Tuesday, July 29, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 402



মনেরও গোপনে পর্ব-১২+১৩

0

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_১২
( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)

রুদ্র গাড়ি থেকে নেমে মিহিকে নামানোর জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। মিহি রুদ্রর হাত না ধরে একা একা নামলো।
” ধন্যবাদ ডাক্তার সাহেব।”
” স্বাগত মিহির দানা। ”
” আবারও! ”
” ভুল হয়ে গেছে মিহির দানা। ”
রুদ্রর দাঁত বের করা হাসি দেখে মিহির গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে একেবারে। শরীফ গেট পেরিয়ে বাসার দরজার তালা খুলে এরমধ্যেই ভিতরে প্রবেশ করেছে। রুদ্র মুখ টিপে মিটিমিটি হাসতে হাসতে দরজার দিকে এগোচ্ছে আর মিহি তার পিছু পিছু হাঁটছে।

নিজের ঘরে মনমরা হয়ে বসে আছেন মিহির মা। বাসার সবাই রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ করেছে শুধু মাত্র রিনা বেগমই অভুক্ত রয়েছেন।
” মা ভিতরে আসবো?”
রাহি দরজার বাইরে হাতে খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়ের কথা ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে ছিলেন রিনা। রাহির কথায় ভাবনার ছেদ ঘটলো।
” হ্যাঁ এসো।”
রাহি খাটের পাশের টেবিলের উপর ভাতের প্লেট রেখে বিছানায় শ্বাশুড়ির পাশে বসলো।
” মা আপনি না খেয়ে থাকলে আপনার শরীর খারাপ হয়ে যাবে। তাছাড়া মিহি যদি জানতে পারে আপনি এরকম করছেন তাহলে কি ও ওই বাড়িতে ভালো থাকতে পারবে?”
” আমার খেতে ইচ্ছে করছে না রাহি। তুমি মিহিকে কিছু জানিও না। ”
” আচ্ছা মা আপনি, আমি সবাই তো বাবার বাড়ি ছেড়ে এসেছি তাই না? এটাই তো প্রাকৃতিক নিয়ম, মেয়েরা বিয়ে করে শ্বশুর বাড়ি গিয়ে নিজের সংসার গুছিয়ে নিবে। তাছাড়া মিহির শ্বশুর বাড়ি তো কাছেই।”
” তা ঠিক বলেছো। তুমি খাবার রেখে যাও,আমি অল্প খেয়ে নিবো। তোমার শ্বশুর কি খেয়েছেন?”
” হ্যাঁ তিনি খাবার খেয়ে ঔষধ খেয়ে নিয়েছেন। টিভিতে খবর দেখছেন দেখে এলাম।”
” তাহলে তুমিও গিয়ে শুয়ে পড়ো।”
” ঠিক আছে মা, খেয়ে নিবেন কিন্তু। ”
রিনা বেগম মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন তিনি। রাহি শ্বাশুড়ির ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়েই মিহিকে কল দিলো। দু’টো রিং হতেই ওপাশ থেকে কল রিসিভ করলো।
” ভাবি আমি এখন এমনিতেই কল দিতাম,সবাই কেমন আছেন? ”
” হ্যাঁ ভালো আছেন। তুমি খেয়েছো রাতে? ”
” না রান্না শেষ হলো মাত্র। তুমি খেয়েছো?”
” হ্যাঁ কিন্তু রান্না কি তুমি করলে?”
রাহির কন্ঠে বিস্ময় সেটা বুঝেই হাসলো মিহি।
” আরে না, চাচা আছেন উনি করেছেন।”
” তাই বলো। তা তোমার বর কোথায়? ”
” ডাইনিং রুমে গেলো মনে হয়। লোকটা ভীষণ বজ্জাত। ”
” তাই না-কি! তা এখনো তো বিছানায় গেলেই না তার আগেই কী আদর শুরু করেছে? ”
রাহি দুষ্টমি করে বললো। মিহি লজ্জা পেলো কিছুটা।
” ধ্যাৎ! কীসব বলো না তুমি। এমনিতে খুব ক্ষ্যাপায় আমাকে। কতবার বলেছি আমার নাম মিহি কিন্তু বজ্জাত লোকটা বারবার মিহির দানা বলেই ডাকছে!”
” রসিক মানুষ মজা করে একটু তাতে রাগের কী আছে ননদী? ”
” মজা না ছাই!”
” হাহা! আচ্ছা রাখছি এখন রাতের জন্য শুভকামনা রইলো।”
” ভাবি!”
রাহি ফোন কেটে পিছন ফিরে তাকাতেই চমকালো। আদ্রিয়ান দাঁড়িয়ে আছে পিছনে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিলো না-কি!
” তুমি এখানে? ”
” তুমি কোথাও খুঁজতে গিয়ে এখানে গলার আওয়াজ পেলাম।”
” আচ্ছা চলো ঘরে যাই।”
আদ্রিয়ান রাহির পেছন পেছন ঘরে এসেছে। কিন্তু বিছানার দিকে তাকাতেই রাহির চোখ ছানাবড়া! পুরো বিছানায় বইয়ের ছড়াছড়ি। আদ্রিয়ান বইপ্রেমি মানুষ কিন্তু সমস্যা হলো বই পড়ে সব বিছানায় এলোমেলো করে রাখে। রাহি আদ্রিয়ানের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালো একবার। আদ্রিয়ান সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে দরজা আঁটকে দিলো। রাহি বিছানা গুছিয়ে বইগুলো সব শেলফে রেখে দিলো।
” এবার শুয়ে উদ্ধার করো আমাকে, বাতি নিভিয়ে এসো।”
রাহি শুয়ে পড়েছে এরমধ্যেই। আদ্রিয়ান রুমের বাতি নিভিয়ে বাধ্য ছেলের মতো রাহির পাশে শুয়েছে।
” রাহি!”
” হ্যাঁ বলো।”
” আমার শাস্তি কি শেষ হবে একজীবনে? ”
” জানি না আমি। তুমি যতবার আমার কাছাকাছি আসার চেষ্টা করো ততবারই তোশার বলা কথাগুলো মনে পড়ে যায়। ”
” বিশ্বাস করো তোশার সাথে কোনো খারাপ সম্পর্কে লিপ্ত হইনি আমি। আর না তো খারাপভাবে স্পর্শ করেছি।”
” স্পর্শ তো করেছো!”
রাহির এই কথার উত্তরে বলার মতো কোনো যুক্তি নেই আদ্রিয়ানের কাছে। রাহি ফিরে এসেছে মাসখানেক হলেও এখনো আদ্রিয়ানকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। তোশা আদতে না থাকলেও তোশার বলা প্রতিটি কথা আদ্রিয়ান ও রাহির মধ্যে অদৃশ্য দেয়াল হয়ে জুড়ে আছে।

রাতের খাবার রান্না করা শেষে রহমান চাচা ও রুদ্র মিলে টেবিলে পরিবেশন করেছে। তারপর মিহিকে ডেকে নিয়ে এসেছে রুদ্র। বিয়ের ভারী গয়নাগাটি ও পোশাক পাল্টে মিহি হালকা গোলাপি রঙের একটা থ্রিপিস পরেছে। রুদ্রও পাঞ্জাবি পাল্টে টি-শার্ট আর লুঙ্গি পরেছে। ডাইনিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে মিহি। রুদ্র বসে গেছে আগেই, রহমান চাচা প্লেটে খাবার দিচ্ছে।
” কি হলো দাঁড়িয়ে রইলে কেনো? খেতে বসো।”
” হ্যাঁ বসছি,চাচা খাবেন না?”
রহমান চাচা মুচকি হেসে বললেন,
” আমি বাসায় গিয়ে তোমার চাচির সাথে খাবো মা। তোমরা শুরু করো। এই বয়সেও স্ত্রী’র প্রতি অগাধ ভালোবাসা দেখে সত্যি অবাক হয়েছে মিহি। এই যুগে একজন মানুষে আজীবন আসক্ত থাকা আগুনে পা দিয়ে হাঁটার সমান। মিহি রুদ্রর পাশের চেয়ারে বসে খেতে শুরু করলো। কিন্তু লজ্জার কারণে বেশি খেতে পারলোনা। কয়েক লোকমা ভাত মুখে দিয়েই প্লেটে হাত ধুয়ে বসে রইলো। রুদ্র তখনও খাচ্ছে, কিন্তু মিহির বিষয়টা দেখেছে ঠিকই।
” চাচা ফ্রিজে আইসক্রিম আছে না?”
রহমান চাচা তখন রান্নাঘরে গ্যাসের চুলো পরিষ্কার করছিলো। রুদ্রর কথায় ফ্রিজ খুলে দেখে বললো,
” হ্যাঁ আছে তো,নিয়ে আসবো না-কি? ”
” হ্যাঁ এসো।”
লোকটা কী ভাতের সাথে আইসক্রিম খাবে না-কি! মনে মনে ভাবলো মিহি। রহমান চাচা আইসক্রিম নিয়ে এসে টেবিলে রাখলো।
” মিহির দানা খাবে না-কি আইসক্রিম? ”
মিহি চুপ করে আছে। এভাবে খাবো কি-না জিজ্ঞেস করলে কী বলা যায় খাবো? জোর করে খেতে বলতে পারেনা লোকটা?
” এই মিহির দানা! ”
” না না আমি খাবো না আপনি বরং ভাতের সঙ্গে খান।”
” কী বললে? ভাতের সাথে আইসক্রিম! এটা তোমার জন্য আনতে বলেছি বোকা মেয়ে। ”
” আমি মোটেও বোকা নই।”
” ঠিক আছে বুদ্ধিমতী তরুণী। ভাত তো খেলে না আইসক্রিম অন্তত খেয়ে নাও। মেয়েরা তো ফুচকা, আইসক্রিম, ভেলপুরি, চকলেট এসব পছন্দ করে। ”
” হ্যাঁ আমিও করি। আপনি তো মনে হয় মেয়েদের উপর পিএইচডি করেছেন। ”
” তা করিনি কিন্তু জানি আরকি। তুমি কি জানো তুমি আমার চেয়ে কত বছরের ছোটো? ”
মিহি চোখ বড়ো বড়ো করে শুধালো,
” কত? ”
” বেশি না ছয় বছরের বড়ো। ”
” ছয় বছরের বড়ো!”
” হ্যাঁ তাতে ওমন করে বলার কী হয়েছে মিহির দানা? ”
” কিছু না। ”
রুদ্র খাওয়া শেষে আইসক্রিমের বাটিটা নিজের দিকে নিলো। মিহি আড়চোখে তাকিয়ে আছে সেদিকে।
” তুমি তো মনে হয় খাবে না তাহলে আমিই খাই।”
রুদ্র চামচ দিয়ে নাড়াচাড়া করছে হাতে মিহির খুব ইচ্ছে করছে খেতে কিন্তু লজ্জায় বলতে পারছেনা সেটা। এমনিতেই আইসক্রিম খুব প্রিয় মিহির। এতোটাই প্রিয় যে শীতের মৌসুমেও আইসক্রিম খেতে দুবার ভাবে না। মিহির ভাবসাব দেখে রুদ্র বুঝতে পেরেছে এই মেয়ে লজ্জায় মুখ ফুটে খাওয়ার কথা বলতে পারবেনা। তাই নিজে থেকেই আবারও সাধলো।
” আচ্ছা বেশি খেতে হবে না অল্প একটু খাও।”
রুদ্র আইসক্রিমের বাটি মিহির দিকে এগিয়ে দিলো কিছুটা। মিহি ইতস্ততভাবে চামচটা হাতে নিলো এবার।
” আহা খাও তো। খাবার খেতে এত লজ্জা করলে চলে? দেখে তো মনে হয় না এমনিতে এত লজ্জাবতী তুমি। ”
রুদ্রর শেষ কথাটায় মিহি ক্ষ্যেপে গেলো কিছুটা। এক চামচ আইসক্রিম মুখে দিয়ে রুদ্রকে কিছু বলতেই যাবে এমন সময় রহমান চাচা বলে উঠলো,
” আমি যাচ্ছি তাহলে রুদ্র বাবা,মিহি মা গেলাম।”

” জি চাচা, সাবধানে যাবেন।”
” চাচা খাবার প্যাকেট করে নিয়েছেন তো? ”
” হ্যাঁ রুদ্র বাবা নিয়েছি।”
” ঠিক আছে। ”
চলবে,

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_১৩
( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)

“জি চাচা, সাবধানে যাবেন।”
” চাচা খাবার প্যাকেট করে নিয়েছেন তো? ”
” হ্যাঁ রুদ্র বাবা নিয়েছি।”
” ঠিক আছে। ”
রহমান চাচা চলে যেতেই রুদ্র আইসক্রিমের বাটিটা হুট করে নিজের দিকে টেনে নিয়ে এক চামচ আইসক্রিম মুখে দিয়ে বললো,
” তখন ক্ষ্যেপে গিয়ে কী জানি বলতে চেয়েছিলে মিহির দানা? ”
” আপনি আসলে খুব বজ্জাত লোক। আমি রুমে গেলাম। ”
মিহি রাগে কটমট করতে করতে সিড়ি দিয়ে দোতলায় চলে গেলো। রুদ্র এখনও ডাইনিং টেবিলে বসে আইসক্রিম মুখে হাসছে। নবনীও ঠিক এরকমই রাগী ছিল। কথায় কথায় রেগে চোখের পানি নাকের পানি এক করে ফেলতো। স্মৃতি মনে পড়তেই মুখটা কেমন মলিন হয়ে গেলো রুদ্রর।

ঘরে এসে বিছানায় ধপ করে বসে পড়েছে মিহি। একদিনের সংসারেই রুদ্র এত খুনসুটি করছে ভাবতেই মিহির মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এতটা গায়ে পড়া পুরুষ মানুষ মোটেই ভালো লাগে না তার। তুই পুরুষ মানুষ কোথায় চোখমুখ গম্ভীর করে রাখবি তা না সব সময় টম এ্যান্ড জেরীর মতো করবি কেনো?
” কী হয়েছে দানাপানি এমন রেগে বসে আছে কেনো?”
মিহি ভাবনার অতলে ডুবে ছিল বিধায় রুদ্রর আগমন টের পায়নি। তাই কিছুটা নড়েচড়ে বসলো সে। রুদ্র দরজা আঁটকে আলমারি থেকে একটা সাদা পাঞ্জাবি বের করে রাখলো টেবিলের উপর।
” হোয়াট দ্য! মিহির দানা অবধি একরকম ছিল কিন্তু দানাপানি? ”
কপট রাগ দেখিয়ে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো মিহি। রুদ্র ভাবলেশহীনভাবে মিহির পাশে বসলো।
” একেই বলে মেয়ে মানুষ! যখন মিহির দানা ডাকি তখন তো বলো, আমি কোনো দানাপানি নই। তাই ভাবলাম মিহির দানার চেয়ে দানাপানি ডাকলে বেশি খুশি হবে। ”
” শুনুন ডাক্তার রুদ্র চৌধুরী, আমার নাম মিহি শুধু মিহি। আন্ডারস্ট্যান্ড? ”
” ওকে মিহির দানা। ”
মিহির চোখমুখ এখন দেখার মতো হয়েছে। ফর্সা গালদুটোর চামড়ায় রাগের কারণে লাল আভা ফুটে উঠেছে। রুদ্র সেসব দেখেও না দেখার ভান করে মিহিকে পাশ কাটিয়ে অন্য পাশে শুয়ে ফোন হাতে নিয়ে সেদিকে মনোযোগ দিলো। মিহির মাথা দিয়ে মনে হচ্ছে আগুন বের হচ্ছে। এই লোক কোন পাগলাগারদ থেকে এলো? কোনো ডাক্তার এরকম আধ-পাগলা হয় বলে জানা ছিল না তার।
ঘুম ভাঙলো এলার্ম ঘড়ির আওয়াজে। চোখ মেলে তাকাতেই কেমন ভারী ভারী অনুভব হলো মিহির। বিষয়টা আঁচ করতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো। পরক্ষণেই একপ্রকার বিছানা থেকে লাফিয়ে ফ্লোরে পড়লো। আর তারপরেই মুখ থেকে অস্ফুটে স্বরে আওয়াজ বেরিয়ে এলো মিহির। হুট করে বিছানা থেকে ফ্লোরে পড়ার কারণে কোমরে একটু ব্যথা পেয়েছে। ঘটনার আকস্মিকতায় রুদ্রও ঘুম থেকে উঠে চোখ বড়সড় করে ফ্লোরে তাকিয়ে আছে।
” অসভ্য লোক ওরকম ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে আবার। ”
” আমি কী করলাম! তুমি ওরকম ফ্লোরে বসে চিৎকার করলে কেনো?”
” আপনিই তো আমার পিঠে নিজের হাত রেখেছিলেন। পাশে শুয়েছি বলে সুযোগ নিবেন এভাবে? উঁহু কোমরে লেগেছে ভালোই। ”
রুদ্র বিছানার সবখানে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। তারপর বিছানা থেকে নেমে মিহির হাত ধরে দাঁড় করাতে চাইলো কিন্তু মিহি হাত না ধরে নিজেই দাঁড়াতে চাইলো কিন্তু পারলো না দাঁড়াতে।
” ব্যাথা ভালোই লেগেছে কোমরে। তবে মিহির দানা বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখো,আমার হাত তোমার শরীরের উপর ছিল না। ওটা অবলা কোলবালিশ আমার, ভুলে তোমার পিঠের ওপর চলে গেছিলো।”
রুদ্রর কথায় ঠিক বিশ্বাস হলোনা মিহির। তাই সন্দিহান দৃষ্টিতে একবার বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখলো। আসলেই খাটের মাঝ বরাবর কোলবালিশ রাখা আছে এখনো! নিজের ভুল বুঝতে পেরে কিছুটা লজ্জা পেলো মিহি। কিন্তু নিজ থেকে রুদ্রর সাহায্য চাওয়া কী ঠিক হবে?
” আসলে আমি বুঝতে পারিনি,সরি।”
” এবার কি উঠবে না-কি এভাবেই বসে থাকবে বলো?”
মিহি লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে। রুদ্র নিজে থেকেই মিহির হাত ধরে বিছানায় উঠিয়ে বসালো। তারপর ড্রয়ার থেকে ফাস্ট এইড বক্স বের করে একটা মলম এগিয়ে দিলো মিহির দিকে।
” ঔষধ লাগবে না এমনি ঠিক হয়ে যাবে। ”
” ডাক্তার কি আমি না তুমি? ”
” আপনি হার্ট স্পেশালিষ্ট হৃদপিণ্ড নিয়ে থাকুন। ”
” পাকনামি কম করো বুঝলে এটা লাগাও। আশেপাশ থেকে লোকজন আসতে পারে আবার না-ও পারে কিন্তু তোমার বাসা থেকে নিশ্চয়ই কেউ আসবেন। ”
মিহি রুদ্রর হাত থেকে মলমটা নিলো কিন্তু রুদ্রর কথার আগামাথা কিচ্ছু বুঝলো না।
” হ্যাঁ তা তো আসতেই পারে তাতে কী? ”
” তুমি কি আসলেই মাস্টার্সে পড়ো?”
” হ্যাঁ কোনো সন্দেহ আছে? ”
” অবশ্যই আছে। বিয়ের পরের দিন নতুন বউ কোমরের ব্যথায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটলে সবাই কী ভাববে জানো না? মনে মনে তো সবাই আমাকেই দোষারোপ করবে।”
মিহির কিয়ৎক্ষণ লাগলো রুদ্রর কথার মানে বুঝতে। কিন্তু না বুঝলেই হয়তো ভালো হতো। এই লোকটা আসলে কী! লজ্জায়, রাগে মিহির চোখমুখ আবারও লাল হয়ে গেছে। রুদ্র আর কিছু বললো না। শুধু মুচকি হেসে বাথরুমে ফ্রেশ হতে চলে গেলো।
সকাল হতেই আদ্রিয়ান ও রাহিকে হসপিটালের করিডরে ছুটে আসতে হয়েছে। রিনা বেগমও আসতেন কিন্তু মিহির বাবার শরীরটা হঠাৎ করে খারাপ হয়ে যাওয়ায় আসতে পারেননি। সেদিন তোশা বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পরে আদ্রিয়ানের বাসার কেউ ভাবতেও পারেনি মেয়েটা এরকম একটা কাজ করতে পারে। আদ্রিয়ানের চাচা শাহআলম নিজাম এরমধ্যেই আদ্রিয়ানকে একদফা কথা শুনিয়েছেন। উনার ভাষ্যমতে আদ্রিয়ানের জন্যই তোশা শেষমেশ আত্মহ*ত্যার মতো একটা সিন্ধান্ত নিয়েছে। রাহি রাস্তায় থাকাকালীন সময়েই আদ্রিয়ানকে বারবার বারণ করে দিয়েছে যাতে কারো সাথে কোনো প্রকার কথা কাটাকাটি না করে। সে কারণে চাচার সব কথা মুখ বুঝে সহ্য করছে সে। আগে তোশা সুস্থ হোক তারপর কথা বলা যাবে।
” ডাক্তার সাহেব কেমন আছে আমার মেয়ে? ”
ডাক্তারকে ও.টি থেকে বের হতে দেখা মাত্রই তোশার মা ফাতিমা তেড়ে এসে প্রশ্ন করলেন। ডাক্তার তানজিম খান গম্ভীর স্বরে বললেন,
” আপাতত ঠিক আছে। আরেকটু দেরি হয়ে গেলে শরীর থেকে বিষ বের করা যেতোনা। ”
” যাক আলহামদুলিল্লাহ। আমরা কী দেখতে পারবো এখন?”
” না মি.শাহআলম, এখনই আমরা কাউকে এ্যালাউ করবো না,কেবিনে নেওয়া হবে এখন। দুপুরে দেখা করতে পারবেন শিউড়লি। ”
” ঠিক আছে ডক্টর, থ্যাংক ইউ। ”
” নো নিড ইটস মাই ডিউটি। ”
ডাক্তার সাহেব নিজের রুমের দিকে চলে গেছেন। আদ্রিয়ান চুপ করে আছে সাথে রাহিও। ফাতিমা আদ্রিয়ানের দিকে কিছুটা এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,
” তোরা বাসায় চলে যা। আমি জানি দোষ আমার মেয়ের তাই অহেতুক তোকে দোষারোপ করছি না আদ্রিয়ান। ”
” চাচি তুমি একটু চাচাকে বোঝাও। আমরা থাকি,তোশার সাথে দেখা করেই না হয় ফিরবো।”
” না তার কোনো দরকার নেই। তোকে দেখলে ওর পাগলামি বাড়বে। আমরা ওকে এটুকুও বলবো না যে তুমি এখানে এসেছিলে।”
” আপনি যেটা ভালো মনে করেন চাচি তাই করুন। আমি আর আদ্রিয়ান তাহলে আসছি,তোশার দিকে খেয়াল রাখবেন। ”
” ঠিক আছে। ”
দূরে দাঁড়িয়ে বিরক্ত হচ্ছেন শাহআলম নিজাম। স্ত্রী’র এরকম উদারতা মোটেও ভালো লাগে না উনার। কপাল ভালো যে মেয়েটা মায়ের মতো হয়নি বলে মনে মনে শুকরিয়া আদায় করেন তিনি।
সকালের নাস্তা শেষে রুদ্রর সাহায্যে নিজের রুমে এসে বসেছে মিহি। রহমান চাচা খুব সকালে এসে নাস্তা তৈরি করে রেখেছিলেন। মলম দেওয়ার জন্য কোমরের ব্যথাটা একটু কমেছে। কিন্তু এতবেলা হয়ে গেলো তবুও বাবার বাড়ি থেকে কেউ একবার কল পর্যন্ত দিলো না ভেবে কিছুটা মন খারাপ লাগছে মিহির। তাছাড়া রুদ্রর এত জ্বালাতনও বিরক্ত লাগছে। লোকটার হসপিটাল কতদিন বন্ধ কে জানে? রিংটোনের আওয়াজে বিছানায় তাকাতেই ফোনের স্ক্রিনে মায়ের নম্বর ভেসে উঠতে দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠেছে মিহির। কালক্ষেপণ না করে দ্রুত কল রিসিভ করে কানে ধরলো।
” হ্যালো মা কেমন আছো তোমরা? ”
” হ্যাঁ ভালো আছি। তোরা কেমন আছিস?”
” ভালো কিন্তু তোমার গলাটা এমন লাগছে কেনো? কিছু হয়েছে মা?”
” তোশা সুইসা*ইড করতে গেছিলো, আল্লাহ সহায় ছিলেন বলে বেঁচে গেছে। ”
” কী! বদমাশ মেয়ে একটা। দূরে গিয়েও আমার ভাই আর ভাবিকে অশান্তিতে রাখার বুদ্ধি। ”
” থাক এসব বিকেলে তোর ভাবি যাবে তোকে দেখতে। তোর বাবার শরীর একটু খারাপ নইলে আমরাও যেতাম। ”
” বাবার কী হয়েছে? বাড়াবাড়ি কিছু হয়নি তো!”
” আরে না, তুই চিন্তা করিস না। একটু প্রেশার বেড়ে গেছিলো। নিজের খেয়াল রাখিস রাখছি।”
” বাবার খেয়াল রেখো আর নিজেরও টাটা।”

চলবে,

মনেরও গোপনে পর্ব-১০+১১

0

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_১০
(মুক্তমানদের জন্য উন্মুক্ত)

” ঠিক আছে তাহলে বাবাকে গিয়ে বলুন আমরা রাজি। বিয়ে যখন করতেই হবে তখন না বলে লাভ নেই। আপনাকে না হলেও অন্য কাউকে করতেই হবে, তারচে আপনার একাকীত্বের বন্ধু হবো না হয়।”
” আচ্ছা মিহির দানা। ”
” আমি মিহি,শুধু মিহি। কোনো দানাপানি নয়।”
মিহি মুখ ভেংচি কেটে বললো রুদ্রকে। বিনিময়ে রুদ্রও এক টুকরো মিষ্টি হাসি উপহার দিলো।

দু’জন কথাবার্তা শেষে সালমান খুরশিদকে তাদের মতামত জানিয়েছে। মিহি দাঁড়িয়ে আছে একপাশে আর রুদ্র সালমান খুরশিদের পাশের সোফায় বসেছে। রিনা বেগম স্বামীর আদেশে মিষ্টি আনতে রান্নাঘরে গিয়েছেন।
” তাহলে তোমার কোনো আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে এসো, আনুষ্ঠানিকভাবে দিন-তারিখ ঠিক করবো।”
” আসলে আমার তেমন কোনো আত্মীয় নেই আঙ্কেল। আপনারা আমার বাসাতেই না হয় সবাইকে নিয়ে গেলেন তারপর কথাবার্তা বলবেন। ”
” ঠিক আছে বাবা।”
” আজকে আসছি আঙ্কেল। মিহির কাছে ফোন নম্বর দিয়ে গিয়েছি আপনি সুবিধামতো কল করে নিবেন।”
” সাবধানে যেও। ”
রুদ্র সালমান খুরশিদকে সালাম দিয়ে বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে। কেনো জানি লোকটার প্রতি কেমন মায়া কাজ করছে মিহির। হয়তো পৃথিবীতে তার কেউ নেই বলেই এই মায়া!

গভীর রাত। ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে রাত ঠিক কতটা গভীর হয়েছে সেটা বুঝতে চেষ্টা করলো রাহি। তিনটে বিশ বেজেছে, কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না। ইদানীং মনটা কোনো কথা শুনতে চায় না। আদ্রিয়ানকে দেখলে খুব কষ্ট হয়। হবেই না কেনো? আদ্রিয়ানের মতো তো রাহি নয়। রাহির প্রথম ও শেষ ভালোবাসা আদ্রিয়ান। গতকাল রাহির দুলাভাই পারভেজ রাহিকে আদ্রিয়ানের কাছে থেকে ডিভোর্স পেপার চাইতে বলেছেন। এভাবে অহেতুক সম্পর্ক ঝুলিয়ে রাখার কোনো মানে হয় না তার মতে। কিন্তু রাহি কিছু বলেনি তখন। মনটা বড্ড ছটফট করছে। বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর বদলে শুধু এপাশ-ওপাশ করছে । ভাবনারা যেনো কিছুতেই শেষ হবার নয়। কিছুক্ষণ পরে শোয়া থেকে উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো রাহি। ঠান্ডা বাতাস বইছে বাইরে। বিছানার পাশ থেকে চাদরটা গায়ে জড়িয়ে ফের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো রাহি। নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেছে পুরো শহর। কোথাও কেউ নেই। মাঝে মধ্যে নেড়ি কুকুরের আওয়াজ ভেসে আসছে দূরে কোথাও থেকে। হঠাৎ কারো গলার স্বরে কেঁপে উঠলো রাহি। কেউ চাপা স্বরে গান গাইছে। সামনের রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে আছে এক ছায়ামানব। কিন্তু তার গলার স্বর চিরপরিচিত রাহির। কান খাঁড়া করে ছায়ামানবের কন্ঠস্বর আরো ভালো করে বুঝতে চেষ্টা করলো সে।

পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়।

ও সেই চোখে দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়।

আয় আর একটিবার আয় রে সখা, প্রাণের মাঝে আয়।

মোরা সুখের দুখের কথা কব, প্রাণ জুড়াবে তায়।

মোরা ভোরের বেলা ফুল তুলেছি, দুলেছি দোলায়

বাজিয়ে বাঁশি গান গেয়েছি বকুলের তলায়।

হায় মাঝে হল ছাড়াছাড়ি, গেলেম কে কোথায়

আবার দেখা যদি হল, সখা, প্রাণের মাঝে আয়।

গান থেমেছে, ল্যাম্পপোস্টের নিচ থেকেও যে ছায়ামানব রাহির দিকে দৃষ্টিপাত করেছে সেটা রাহির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে জানান দিচ্ছে। আদ্রিয়ান! এই শীতের রাতে রাস্তায় কেনো বসে আছে সে? তা-ও আবার রাহির বাসার সামনে! অনুভূতি এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে রাহির। এই মুহুর্তে সব প্রতিজ্ঞা, সব অবহেলা, সকল অভিমান যেনো ভুলতে বসেছে সে। ইচ্ছে করছে দৌড়ে গিয়ে একবার বক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়ে সবকিছু ভুলে নতুন করে শুরু করতে। দোটানায় পড়ে বেশ কিছুটা সময় পেরিয়ে গেলো। রাহি আলমারি থেকে পুরনো সিম বের করে ফোনে ঢুকিয়ে আদ্রিয়ানের নম্বরে কল দিলো। রিং হতেই আদ্রিয়ান রিসিভ করেছে।
” হ্যালো রাহি!”
কতদিন পরে! রাহি ফোনটা বুকে আঁকড়ে নিঃশব্দে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। অন্যদিকে আদ্রিয়ান পাগলের মতো হ্যালো হ্যালো করে যাচ্ছে । কিয়ৎক্ষণ বাদেই রাহি নিজেকে সামলে নিয়ে পুনরায় ফোন কানে ধরলো।
” এত রাতে বাড়ির সামনে কেনো এসেছো তুমি? ”
” কেমন আছো রাহি?”
” প্রশ্নের জবাবে পাল্টা প্রশ্ন পছন্দ না। ”
” বদলে গেছো অনেক। ”
” বদলে দিয়েছো নিজেই।”
” ক্ষমা করা যায় না একবার? ”
” বিশ্বাসঘাতকতার কোনো ক্ষমা হয় না। ”
আদ্রিয়ান চুপ করে গেলো। কী করবে সে? বোনকে যে কথা দিয়েছে তার বিয়েতে ভাবিকে উপস্থিত করবেই।
” একবার বাইরে আসবে প্লিজ! ”
” না।”
” কথা দিচ্ছি আর কখনো এভাবে এসে বিব্রত করবোনা তোমাকে। ”
” ঠিক আছে, আসছি।”
আদ্রিয়ান খুশিতে গদগদ হয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো রাহির জন্য। ঠিক পাঁচ মিনিট পরে রাহি এসে দাঁড়ালো আদ্রিয়ানের সামনে। অথচ বাসা থেকে এখানে আসতে নয় – দশ মিনিট সময় লাগার কথা! আদ্রিয়ান মুগ্ধ নয়নে কিছু সময় দেখে নিলো রাহিকে। রাহিও নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনে থাকা মানুষের দিকে। কিন্তু রাহি কিছু বুঝে উঠার আগেই আদ্রিয়ান হুট করে বক্ষে জড়িয়ে নিলো তাকে। রাহি তড়িৎ গতিতে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করলো একবার। কিন্তু আদ্রিয়ানের বাহুডোর থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হলো না। আদ্রিয়ান রাহির মাথায় হাত বুলিয়ে কানে কানে ফিসফিস করে বললো,
” আগে বলো ক্ষমা করেছো নয়তো শেষ নিঃশ্বাস অবধি এমন করে জড়িয়ে রাখবো।”
রাহি কিছু বললো না, কেবল হুহু করে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। এতদিনের রাগ,অভিমান, সব যেনো মিইয়ে গেলো ভালোবাসার মানুষের স্পর্শে। অবশ্য আদ্রিয়ানকে কম অবহেলা করেনি এতদিন। আদ্রিয়ানও বারবার অবহেলিত হয়ে বুঝতে পেরেছে প্রিয় মানুষের নিকট থেকে অবহেলা পেলে ঠিক কতটা পুড়ে যায় হৃদয়। রাহির আশকারা পেয়ে আদ্রিয়ান তার ললাট মাঝে ওষ্ঠদ্বয় ছুঁইয়ে দিলো। মাথায় হাত বুলানো অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। এতক্ষণে রাহির কান্নার বেগ কমেছে। আদ্রিয়ান আঁখি যুগল মুছে দিলো তার। ল্যাম্পপোস্টের বাতির আলোতে দু’জন দু’জনার মুখাবয়ব দেখছে।
” তুমি খুব খারাপ লোক একটা। তুমি খুব খারাপ আদ্রিয়ান। ”
” আর একটা সুযোগ দিয়ে দেখো এই খারাপ মানুষটা আর কখনো তোমাকে কষ্ট দিবে না। ”
” আমি একা পারবোনা সেটা আদ্রিয়ান। বাসায় এসে কথা বলে দেখো, উনারা যদি তোমাকে ক্ষমা করেন তাহলে আমি যাবো।”
” বেশ তাহলে কালকেই আমি আসবো। আব্বুও আসবেন, তোমার চিন্তায় উনি অসুস্থ হয়ে গেছেন।”
” আমার কিছু করার ছিল না, তুমি বাধ্য করেছিলে আমাকে। মিহির না-কি বিয়ের কথা চলছে? ”
” হ্যাঁ আজকেই ঠিক হলো। আগের সম্মন্ধ বাতিল,আব্বুর পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে হবে। ”
” বাহ। ”
” মিহির বিয়ের আগেই তোমাকে বাসায় নিয়ে যাবো।”
” দেখা যাক।”
আদ্রিয়ান মুচকি হেসে রাহিকে বিদায় জানিয়ে বাসায় গেলো।
পরেরদিন সকালে যথারীতি সালমান খুরশিদকে নিয়ে আদ্রিয়ান রাহিদের বাসায় উপস্থিত হয়েছে। রাহির বাবা-মা প্রথম প্রথম দ্বিমত পোষণ করলেও শেষমেশ রাহিকে ফিরিয়ে দেয় আদ্রিয়ান ও সালমান খুরশিদের সাথে। দেড় বছর পর রাহি নিজের সংসারে পা রেখেছে আজ। রিনা বেগম ছেলের এরকম কর্মকাণ্ডে বিশেষ খুশি হননি। অবশ্য শ্বাশুড়ি যে তাকে দেখে খুশি হবেন না এটা আগেই থেকে জানতো রাহি। কিন্তু মিহি রাহির আসার অপেক্ষায় ছিল এতক্ষণ। দরজার কলিংবেলের শব্দ পেতেই নিজের রুম থেকে বেরিয়ে বসার ঘরে এসেছে মিহি।
” কি খবর মিহি কেমন আছো? অনেক দিন পর দেখলাম তোমাকে। ”
” আলহামদুলিল্লাহ ভাবি। কালকে সন্ধ্যায় যখন কল দিয়েছিলে তখনই ভেবেছিলাম এরকম কিছু হবে। আমি খুব খুব খুশি হয়েছি ভাবি। ”
” আমিও খুশি হয়েছি তোমার বিয়ের খবরটা শুনে।”
” হ্যাঁ এবার কোমর বেঁধে বিয়ের কাজ শুরু করো।”

মিহি হেসে বললো রাহিকে সাথে রাহি ও আদ্রিয়ানও হাসলো। সালমান খুরশিদ বেশিক্ষণ বাইরে থাকতে পারেননা তাই বাসায় ফেরা মাত্রই নিজের রুমে চলে গেছেন। রিনা বেগম রান্নাঘরে কাজ করছেন, সকালের নাস্তা তৈরি হয়নি এখনো।
” বাহ আমাকে রেখেই সব আনন্দ করছো আদ্রিয়ান?”
দরজা খোলা ছিল, হঠাৎ তোশার আগমনে কিঞ্চিৎ অবাক হলো সবাই। মিহির তো রাগ হতে শুরু করেছে। সম্পর্কে চাচাতো বোন হলেও মিহি তোশাকে সহ্য করতে পারে না একদম। মেয়েটা বরাবরই তার কাছে কেমন গায়েপড়া স্বভাবের। রাহির ভিতরে কী যেনো হলো হঠাৎ। বাসায় আসা মাত্রই এরকম কিছু ঘটবে আশা করেনি মেয়েটা। তোশার গলা শুনতেই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন রিনা বেগম। আদ্রিয়ান রেগে দাঁত খিঁচিয়ে বললো,
” তুই! তুই সকাল সকাল এখানে কী করতে এসেছিস?”
” আমি বলেছি ওকে আসতে। ”
রিনা বেগম ভাবলেশহীনভাবে বললেন কথাটা। আদ্রিয়ান অবাক হয়েছে মায়ের আচরণে। আসলেই কী উনি আদ্রিয়ানের আপন কেউ! রাহি মোটেও অবাক হয়নি কিন্তু খারাপ লাগছে।
” মা তুমি? কিন্তু কেনো! তোমার কাছে আমার সুখ বড়ো না-কি তোশার খামখেয়ালি? ”
চলবে,

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_১১

(মুক্তমানদের জন্য উন্মুক্ত)
আদ্রিয়ান অবাক হয়েছে মায়ের আচরণে। আসলেই কী উনি আদ্রিয়ানের আপন কেউ! রাহি মোটেও অবাক হয়নি কিন্তু খারাপ লাগছে।
” মা তুমি? কিন্তু কেনো! তোমার কাছে আমার সুখ বড়ো না-কি তোশার খামখেয়ালি? ”
” অবশ্যই তোর সুখ আগে। কিন্তু তুই নিজের ভালো নিজে বুঝিস? ”
” মা প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো আমি রাহির সাথে থাকতে চাই। মানছি মাঝখানে আমি ভুল করেছিলাম। কিন্তু সবারই তো ভুল হয় তাই না?”
” আদ্রিয়ান আমার সাথে সম্পর্ক থাকাটা এখন ভুল হয়ে গেছে? ”
” তুই চুপ কর তোশা,আমি মায়ের সাথে কথা বলছি।”
এতক্ষণে কথা কাটাকাটির আওয়াজে সালমান খুরশিদ আবারও বসার ঘরে এসে উপস্থিত হয়েছেন। তোশাকে দেখেই ঝামেলার কেন্দ্রবিন্দু আঁচ করতে পেরেছেন তিনি। আর স্ত্রী’র আচরণও তার অজানা নয়। গম্ভীর মুখে স্ত্রী’র সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন সালমান খুরশিদ। রাহির খুব খারাপ লাগছে এসব। অশান্তি যেনো তার জীবন থেকে সরছে না কিছুতেই!
” রিনা তোমাকে স্পষ্ট একটা কথা জানিয়ে দিচ্ছি আজ,আমার কাছে আমার ছেলেমেয়েদের সুখ আগে তারপর তুমি। তাই সেই সুখের পথে যদি তুমি কোনো প্রকার বাঁধা সৃষ্টি করো তাহলে তোমাকে ছাড় দিবো না আমি। শেষ বয়সে এসে বিচ্ছেদ সহ্য হবে তো তোমার?”
মিহির বাবার কথায় সবাই অবাক হয়েছে। বিশেষ করে রিনা বেগম। এতো কঠিন একটা কথা তিনি বলবেন কেউ ভাবেননি। তোশা মনে মনে বেশ রেগে গেছে। রিনা বেগম ভয়ে চুপসে গেছেন ইতিমধ্যেই। স্বামীকে হারানোর কথা ভাবতেও পারেননা তিনি।

” চাচা আমি কী তোমার কাছে কেউ না? আমার কথা একটুও ভাববে না!”
মেকি কান্নায় মন ভোলাতে চাইলো তোশা। সালমান খুরশিদ এমনিতেও যথেষ্ট স্নেহ করেন তোশাকে। তাই সেই সুযোগ নেওয়ার পূর্ণ চেষ্টা চালাচ্ছে তোশা। সালমান খুরশিদ মুচকি হেসে তোশার মাথায় একবার হাত বুলিয়ে দিলেন। তোশার ঠোঁটের কোণে শয়তানি হাসি ফুটে উঠেছে। সম্ভাব্য বিজয়ের আভাস মিলেছে ভেবে আনন্দে মন উড়ু উড়ু করছে তার।
” শোন তোশা,তোকে এতটা স্নেহ করি বলেই এতদিন কিছু বলিনি। কিন্তু এখন যদি না বলি ওই মেয়েটার প্রতি অবিচার করা হবে। এবার তোর বাবা-মাকে বলবো একটা ভালো পাত্র দেখে তোকে বিয়ে দিয়ে দিতে। আশা করি আমাকে কঠিন হতে বাধ্য করবি না। এখন চলে যা,পরের বার জামাই নিয়ে আসিস।”
নিজের চাচার কাছ থেকে এসব কথা মোটেও আশা করেনি তোশা। ফলে রাগে কটমট করতে করতে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো।
” ভাবি এবার রুমে যাও তোমরা। আপদ বিদায় হলো অবশেষে। আর মা তুমিও এবার বোঝো কোনটা আসল হিরা আর কোনটা নকল।”
মিহি মায়ের উপর বেশ রেগে গেছে। তাই কথা শেষ করেই নিজের রুমে হনহনিয়ে চলে গেলো। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন আদ্রিয়ানের মা। আদ্রিয়ান রাহির হাত ধরে রুমের দিকে গেলো। বসার ঘরে এখন শুধু আদ্রিয়ানের বাবা-মা দাঁড়িয়ে আছেন।
” দাঁড়িয়ে না থেকে নাস্তা দাও টেবিলে। বেলা তো কম হলো না! দুপুর থেকে তো রাহি রান্না করবে তোমার ছুটি। ”
রিনা বেগম মুচকি হাসলেন স্বামীর কথায়। আসলেই তো এই মেয়েটা না থাকলে সব কাজ তাকেই করতে হতো। মিহি অবশ্য মাঝে মধ্যে সাহায্য করতো কিন্তু সেটা রাহির শূণ্যতা পূর্ণ করতে পারতোনা। ডাইনিং টেবিলে নাস্তা পরিবেশন করেছেন রিনা বেগম। সালমান খুরশিদ এরমধ্যেই খেতে বসে গেছেন। মিহিকে রিনা বেগম খেতে ডাকলেও আসেনি খেতে। মায়ের উপর বড্ড রাগ করেছে মেয়েটা। আদ্রিয়ান অবশ্য রাহিকে নিয়ে এসেছে। শ্বাশুড়িকে খেতে বসিয়ে দিয়ে নিজে সবাইকে নাস্তা দিচ্ছে রাহি। রিনা বেগম চোখ বন্ধ করে একটা নিঃশ্বাস নিলেন। সব কুটিলতা বাদ দিয়ে সবাইকে আঁকড়ে ভালো থাকার চেষ্টা করবেন ভেবে মনে মনে প্রতিজ্ঞ হন তিনি।
” রাহি!”
” হ্যাঁ মা বলুন,কিছু লাগবে? ”
” না, আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমার কারণেই হয়তো আদ্রিয়ান তোমার প্রতি অবিচার করার সাহস পেয়েছিল। আমি তো প্রথম থেকেই তোমাকে অপছন্দ করতাম। ”
” এখন কী পছন্দ করেন তাহলে?”
রাহি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হেসে বললো। রিনা বেগমও হাসলেন।
” একেবারে পছন্দ না করলেও এখন থেকে আর তোমাকে কষ্ট দিবো না। ”
” যাক আলহামদুলিল্লাহ। ”

দেখতে দেখতে মিহির বিয়ের দিন চলে এসেছে। এরমধ্যে রুদ্রর বাসায় গিয়ে আংটি বদল সেরেছে মিহির পরিবার। ওখানেই ছোটোখাটো একটা অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলো রুদ্র। আজ মিহি ও রুদ্রর বিয়ে। বেশ ধুমধামে বিয়ের অনুষ্ঠান করতে চেয়েছিলেন সালমান খুরশিদ কিন্তু মেয়ের কথায় ঘরোয়া ভাবেই বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। মিহি অযথা টাকাপয়সা খরচ করা মোটেও পছন্দ করে না। তার মতে যে টাকাপয়সা বিয়েতে খরচা হবে সেগুলো ভবিষ্যতের জন্য জমা করে রাখলে ভালো হবে। তাই সেটাই করেছেন সালমান খুরশিদ।
রাত আটটা বাজতে বাকি বিশ মিনিট। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ফুল দিয়ে সাজানো সুন্দর চার চাকার গাড়ি। গাড়ির ড্রাইভারের সিটে বসে আছে শরীফ। শরীফ শুধু রুদ্রর চেম্বারের কাজ করে না সাথে ড্রাইভারের কাজটাও করে। রুদ্র গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। মিহি রাহিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে অবিরত। রিনা বেগম বসার ঘরে সোফায় বসে কাঁদছেন। মেয়ের সামনে ছিলেন এতক্ষণ কিন্তু মাত্রাধিক কান্নাকাটির জন্য ভিতরে দিয়ে এসেছে আদ্রিয়ান। সালমান খুরশিদ দাঁড়িয়ে আছেন রুদ্রর পাশেই।
” বাবা একটি মেয়ে আমার, দেখেশুনে রেখো। কোনো ভুলত্রুটি করলে আমাকে জানিও।”
” আপনি কোনো চিন্তা করবেন না আঙেল। আমি আগলে রাখবো আপনার রাজকন্যাকে।”
রুদ্র সালমান খুরশিদের হাতে হাত রেখে আশ্বস্ত করলো।
” এভাবে কাঁদে না মিহি। দেখো আমিও তো বাবার বাড়ি ছেড়ে তোমাদের সাথে থাকছি,এটাই নিয়ম। তাছাড়া তোমার বাসায় তো তুমি আর তোমার বর শুধু। ইচ্ছে করলেই চলে আসতে পারবে।”
মিহি নিশ্চুপ চোখের পানি ফেললো আরো কিছুক্ষণ। তারপর রুদ্রর সাথে গাড়িতে বসে নতুন জীবনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। পেছনে ফেলে এলো চিরচেনা জায়গা,মানুষজন সাথে কতশত স্মৃতি!
গাড়ি চলছে তার আপন গতিতে। এমনিতে রুদ্র বাসা কাছেই তবে রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম থাকলে একটু বেশি সময় লাগে। তবে আজ রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা। মিহি জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। রুদ্র মাঝে মধ্যে ফোনের স্ক্রিন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মিহিকে পর্যবেক্ষণ করছে। মেয়েটা কী এখনও কাঁদছে!
” এই যে মিহির দানা! তুমি কি এখনও কাঁদছো? ”
আকস্মিক রুদ্রর এরকম প্রশ্নে বিরক্ত হলো মিহি। চোখমুখ কুঁচকে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে বললো,
” মিহির দানাপানি নই আমি শুধু মিহি। আর কাঁদবো কেনো আমি? ”
” এমা! কিছুক্ষণ আগেই তো ভেউভেউ করে কাঁদলে সবার সামনে। ”
রুদ্র মজা করছে মিহির সাথে যাতে কিছুটা হলেও মনটা ভালো হয়ে যায় তার। কিন্তু মিহি যথেষ্ট সিরিয়াস হয়ে আছে। এমনিতেই বাসার সবার জন্য মন কেমন করছে।
” আপনি তো মহা বজ্জাত লোক! আপনাকে তো অন্য রকম ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি… ”
” এখন দেখছে খুব খারাপ লোক তাই না? ”
হঠাৎ কিছু একটা ভাবতেই মিহির চোখগুলো বড়ো বড়ো হয়ে গেলো।
” ওয়েট ওয়েট আপনি না একটু আগে পর্যন্ত আমাকে আপনি বলে সম্মোধন করেছিলেন? তাহলে এখন হঠাৎ তুমি করে বলছেন কেনো!”
” এখন তো তুমি আমার স্ত্রী, আর এমনিতেই তুমি বয়সেও যথেষ্ট ছোটো। তাই আর আপনি করে ডাকবো না।”
মিহি হুট করে একেবারে জানালার পাশে চেপে বসলো যাতে রুদ্রর শরীরের সাথে একটুও ছোঁয়া না লাগে। বিষয়টা বুঝতে পেরে রুদ্র মুখ টিপে মিটিমিটি হাসছে।
” শুনুন আপনার কিন্তু বলেছিলেন আপনার একটা অতীত আছে এবং তাকেই ভালোবাসেন আপনার, এখন যদি আমাকে পেয়ে সেসব ভুলে উল্টোপাল্টা কিছু ভেবে থাকেন মোটেও ভালো হবে না। ”
” তা কী হবে শুনি?”
” গাড়ি থেকে ঝাঁপিয়ে প্রাণ দিয়ে দিবো আমি। ”
রুদ্র মিহির হাতটা শক্ত করে ধরে বললো,
” এখন পারলে ঝাঁপিয়ে দেখাও। আর হ্যাঁ গাড়ি থেকে বাইরে পড়লে মরবে বলে মনে হয় না। তারচেয়ে বাসায় চলো তারপর অন্য কোনো উপায় দেখা যাবে। তবে তোমার প্রতি শুধু বন্ধু হিসেবে খেয়াল রাখছি অন্য কিছু না হুহ্। ”
মিহি কিছু বলার আগেই রুদ্র মিহির হাত ছেড়ে গাড়ির দরজা লক করে দিলো। রুদ্রর শেষ কথাটায় কিছুটা ভরসা পেয়েছে সে। রুদ্র হয়তো সত্যি বন্ধুর মতোই আচরণ করছে কিন্তু মিহির মন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে বলে সব অন্যরকম লাগছে। ভাই আর ভাবির কথোপকথন শুনে এতক্ষণ নিঃশব্দে হাসছিলো শরীফ। বাসার সামনে এসে গাড়ি দাঁড় করিয়ে শরীফ হেসে বললো,
” বাকি কথা বাসায় গিয়ে বলবেন ভাবি,আমরা এসে গেছি।”
” ওহ এসে গেছি! এতটুকু সময়ে নিজের বাড়ির রাস্তা ভুলে গেছি কিছুদিন এই মেয়ের সাথে থাকলে তো পাগল হয়ে যাবো।”
মিহি চোখ পাকিয়ে তাকালো রুদ্রর দিকে। রুদ্র হাসছে তখনও। শরীফ গাড়ি থেকে নেমে দুপাশের দরজা খুলে দিয়েছে। রুদ্র গাড়ি থেকে নেমে মিহিকে নামানোর জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। মিহি রুদ্রর হাত না ধরে একা একা নামলো।
” ধন্যবাদ ডাক্তার সাহেব।”
” স্বাগত মিহির দানা। ”
” আবারও! ”
চলবে,

মনেরও গোপনে পর্ব-৮+৯

0

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_৮
(মুক্তমানদের জন্য উন্মুক্ত)

এতক্ষণে রহমান চাচার দিকে খেয়াল করেছে রুদ্র।
” উনাদের সামনে আগ বাড়িয়ে বিয়ের কথা বললেন কেনো আপনি? আপনার যদি আরেকটা বিয়ে করার ইচ্ছে থাকে তো বলুন চাচীকে গিয়ে বলে আসছি।”
“এসব কী বলছো তুমি? তোমার চাচি ভুলেও এসব শুনলে আমার গর্দান নিবে।”
কিছুটা হতাশ কন্ঠে বললেন রহিম চাচা। সারাদিন রুদ্র চেম্বারে যখন থাকে রহিম চাচাও বাড়িতে থাকে। রুদ্রর বাসা থেকে কয়েক মিনিটের পথ উনার বাসা। নিঃসন্তান দম্পতি উনারা,কিন্তু ভালোবাসার কমতি নেই। রুদ্র তো দুপুরে বাসায় ফেরে না তাই একেবারে সন্ধ্যায় আসেন রহমান চাচা। তারপর রান্নাবান্না শুরু করেন,মাঝে মধ্যে রাতে রুদ্রর সাথেই থাকে। রুদ্র অবশ্য কয়েকবার বলেছিল স্ত্রী’সহ তার বাসায় থাকতে কিন্তু রহমান চাচা গরীব হলেও আত্মসম্মান প্রচুর।
” আহারে! তারমানে চাচী কিছু না বললে আপনি ঠিক আরেকটা বিয়ে করতে রাজি ছিলেন?”
” তা ঠিক আরকি, না মানে না।”
রহমান চাচার মুখখানা দেখে রুদ্র আর নিজের হাসি চেপে রাখতে পারলোনা। রুদ্রকে এরকম হাসতে দেখে রহমান চাচা আরকিছু বললো না। রাতের খাবার রান্না করার জন্য রান্নাঘরে গিয়ে তরকারি কাটতে শুরু করেছেন তিনি। আজকের খাদ্য তালিকায় আছে পুটিমাছ আর বাঁধাকপি।

রাতের আকাশে একফালি চাঁদ কেমন আলো ছড়িয়ে আছে। চারপাশে তার কতশত তারাদের ভীড়! উত্তরের ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করেছে আজকাল। এই যে এখনও ঠান্ডা বাতাস বইছে। মিহি বরাবরের মতোই চাঁদ দেখার জন্য ছাঁদে এসে উপস্থিত হয়েছে। চাঁদের সৌন্দর্য দেখে বিমোহিত হয়ে গেছে মেয়েটা। মাঝে মধ্যে কয়েক টুকরো কালো মেঘেরা ঢেকে দিচ্ছে চাঁদকে। মেঘের আড়ালে চাঁদ! হঠাৎ করে রাহির কথা খুব মনে পড়ছে মিহির। মানুষ দূরে চলে যায় কিন্তু তার স্মৃতিগুলো রেখে যায় খুব কাছে।
” এত রাতে ছাঁদে কী করছিস তুই? ”
হঠাৎ ভাইয়ের আগমনে কিছুটা হকচকিয়ে গেলো মিহি। এমন সময় কখনো সে ব্যাতিত অন্য কেউ ছাঁদে আসেনা।
” আমি প্রতিদিন এমন সময় এখানে আসি। তুমি এলে কেনো?”
” ভালো লাগছিল না ঘরে, এজন্য ভাবলাম একটু খোলা আকাশের নিচ থেকে ঘুরে আসি।”
” ভালো করেছো। তোশা আপুর সাথে না-কি মা তোমার বিয়ে দিতে চান?”
” আর বলিস না! জীবনে আমার মাঝে মধ্যে এমন ভুল করে বসি পরে আর সেই ভুল শোধরাবার কোনো পথ খোলা থাকে না। ”
” কথায় আছে না কর্মফল? এসবকিছু তোমার কর্মফল। ভাবির মতো স্ত্রী পেয়েও হেলায় হারালে। ”
আদ্রিয়ান বোনের কথায় কিছু বলার মতো কথা পেলো না। আজ খুব কষ্ট হচ্ছে তার। বুকটা কেমন খাঁ খাঁ করছে। মনে হচ্ছে একবুক তৃষ্ণা জমেছে হৃদয়ে। এ তৃষ্ণা রাহির ভালোবাসা পাবার তৃষ্ণা! ভাইয়ের নিরবতা দেখে নিজে থেকেই আবারও কথার খেই ধরলো মিহি।
” আমি তো বেশি দিন থাকবো না বাসায় তুমি বরং ভাবিকে ফেরানোর চেষ্টা করো তার আগেই। বাবা-মা উঠেপড়ে লেগেছেন আমাকে পরের ঘরে পাঠানোর জন্য। ”
বোনের কন্ঠে স্পষ্ট অভিমানী সুর খেয়াল করলো আদ্রিয়ান।
” বোকা মেয়ে বিয়ে তো করতেই হবে তাই না? আজকেও গিয়েছিলাম রাহির অফিসের গেটের সামনে। ও দেখেও আমার জন্য একটু দাঁড়ালো না মিহি।”
কথাগুলো বলার সময় আদ্রিয়ানের গলা কেমন ভারী হয়ে এসেছে। মিহি এবার বেশ আগ্রহের সহিত ভাইয়ের দিকে আরো মনোযোগ দিলো। পূর্ণ দৃষ্টিতে একবার আদ্রিয়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলো নোনাজলে চিকচিক করছে গাল। ভাগ্যিস জোছনার আলো খুব প্রখর নয়তো ভাবির জন্য ভাইয়ের অশ্রু বিসর্জন দেওয়ার বিষয়টা দেখতো না সে। মিহি ভাইয়ের দু’হাত ধরলো।
” ভাইয়া তুমি যতই অপরাধ করো না কেনো আমি তোমার কষ্ট সহ্য করতে পারছি না। চোখের পানি মুছে ফেলো। ”
আদ্রিয়ান নিঃশব্দে নিজের চোখের পানি মুছে ফের বোনের হাতে হাত রাখলো। বোন হলো মায়ের মতো, তারকাছে সবকিছু নিরদ্বিধায় বলা যায়।
” আমি চেষ্টা করবো মিহি। যতটা অন্যায় করেছি রাহির সাথে তার জন্য প্রায়শ্চিত্ত করবো। কিন্তু তোশার থেকে রেহাই চাই আমি। ঝোঁকের বশে তোশাকে লাই দিয়ে মাথায় তুলে যে কতটা ভুল করেছি সেটা এখন হাড়েহাড়ে বুঝতে পারছি। ”
” কিন্তু ভাইয়া তোশা আপু একা তো নয় সাথেও মা-ও আছে। মা’কে কীভাবে বোঝাবো বলো তো? ”
” সবকিছু আমার জন্য। আমার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই বোন। আজ বেঁচে থেকেও আমি প্রতি দিন, প্রতি মুহুর্তে ম*রে যাচ্ছি। ”
” এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। কীভাবে ভাবির মন জয় করবে সেটা ভাবো বুঝলে? একবার ভাবি চলে এলে তোশা এমনি আউট হয়ে যাবে। ”
” ঠিক আছে মিহি। ধন্যবাদ বোন,একটু হালকা লাগছে এখন। ”
” ধন্যবাদ লাগবে না, পকেট থেকে পাঁচশো টাকার একটা নোট বের করো। কাল আইসক্রিম আর চকলেট খাবো তারপর তোমার জন্য দোয়া করে দিবো ওকে।”
মিহির কথা শেষ হতেই দু’ভাই বোন একসাথে হেসে উঠে। আদ্রিয়ান মিহিকে টাকা দিয়ে দেয়। আসলে ছোটো থেকেই মিহি আদ্রিয়ানের কাছে এরকম চকলেট আর আইসক্রিম কেনার টাকা চেয়ে নিতো। কিন্তু বড়ো হওয়ার পর আজ আবারও টাকা চাওয়াতে দুজনেই শৈশবের সুখকর স্মৃতি রোমন্থন করলো।

দেখতে দেখতে কয়েকদিন পেরিয়ে গেছে। এরমধ্যে রিনা বেগম তার নিজের পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করেছে মিহির। ছেলে ব্যবসায়ী, বাবামায়ের একমাত্র সন্তান। টাকাপয়সার কোনো অভাব নেই তাদের। একবার নিজের পছন্দের ছেলের কাছে গিয়ে খালি হাতে ফিরেছেন বলে সালমান খুরশিদ নিজের স্ত্রীকেই মেয়ের জন্য ছেলে দেখতে বলেছিলেন। তাই তিনিও সেই মতো কাজ করেছেন। মিহিকে একবার ছবি দেখাতে গিয়েছিলেন রিনা বেগম কিন্তু মিহি ছবি না দেখেই হ্যাঁ বলে দিয়েছে। আদ্রিয়ান বেশ বুঝতে পারছে মিহির মন অন্য কোথাও আছে। তাই মনে মনে ভেবেছে মিহির সাথে সরাসরি কথা বলবে। কিন্তু সেটা একান্ত নিরিবিলিতে।

ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে ঘাসের উপর বসে আছে মিহি,অহনা। এরমধ্যে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে মিহি। অহনার সাথে সবকিছুই শেয়ার করে মিহি। বিয়ের কথা শুনে অহনা চুপ করে আছে। ঠিক কী বলবে বুঝতে পারছে না। যদি কোনো ছেলের সাথে সম্পর্ক থাকতো কিংবা সেই ছেলেটাকে যদি চোখেও দেখতো তবুও না হয় তার কথা বলা যেতো বাসায়। কিন্তু এরকম পাগলামির কথা কে শুনবে? আর যার কোনো খোঁজ নেই তার জন্য অপেক্ষা করা তো আসলেই বোকামি ছাড়া কিছু না। কিন্তু মনটা এমন কেনো? কারো সামান্য স্পর্শ কিংবা সাহায্যেও তার প্রতি ভালোলাগা সৃষ্টি হতে হবে!
” মিহি তুই যা ঠিক করেছিস তাই কর। তবে হ্যাঁ মনের মধ্যে অন্য কাউকে আগলে রেখে আরেকটা লোকের সাথে কীভাবে সংসার করবি!”
” তবুও সংসার করতে হবে অহনা। সংসার করবো,তার শয্যাসঙ্গী হবো,তার বাচ্চার মা-ও হবো অথচ আমার মনটা থাকবে অন্য কোথাও। ”
” এরকম করে বলিস না। বড্ড খারাপ লাগছে।”
” আরে বাদ দে,তা তোর খবর বল। আসমান ভাই দেশে ফিরবে কবে?”
” সামনের বছর ফেরার কথা বলেছে। তারপর বিয়ের কথা বলবে বাসায়। ”
” দোয়া করি আল্লাহ তোর মনের মানুষের সাথে মিল করে দিক।”
” আমিও দোয়া করি সব পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো ধৈর্য যেনো তোর হয়।”

দুই বান্ধবীর কথা শেষ হওয়ার আগেই হুট করেই বৃষ্টি শুরু হলো। নভেম্বর রেইন! অসময়ে সবকিছুই খারাপ লাগে অহনার। তাই দৌড়ে ভার্সিটির ভিতরে ঢুকলো অহনা। কিন্তু মিহি কেবল উঠে দাঁড়ালো কিন্তু কোথাও গেলো না। অহনা ইশারায় বারকয়েক ডাকলো তাকে। কিন্তু মিহি সেদিকে খেয়াল করলো না। বৃষ্টির মধ্যে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। গুনগুনিয়ে গান ধরলো মিহি,
আজকেও বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফিরবে বলে সিন্ধান্ত নিয়েছে মিহি। ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে অটোতে চড়ে বসলো। সেদিনের মতোই অর্ধেক গিয়ে গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করলো মিহি। সেদিনের ঘটনাটা কী আরেকবার পুনরাবৃত্তি হতে পারে না? কিন্তু না তেমন কিছু ঘটলো না সারা রাস্তায়। ভিজতে ভিজতে বাসায় গিয়ে পৌঁছুলো মিহি। দরজা খুলে মিহিকে ভেজা দেখে বেশ চটে গেলেন রিনা বেগম।
” তোকে কতবার বলেছি অসময়ে যখন তখন বৃষ্টি হচ্ছে ছাতা নিয়ে বের হ। কিন্তু না আমার কথাই কানে যায় না তোর। ”
মিহি মায়ের কথায় কোনো জবাব দিলো না শুধু পাশ কাটিয়ে বাসার ভিতরে প্রবেশ করলো। তারপর সোজা নিজের রুমে গিয়ে দরজা আঁটকে দিলো। রিনা বেগম আরো কিছু সময় একা একাই বকাবকি করলেন। যার সারমর্ম ছিল সামনে বিয়ে এখন অসুস্থ হয়ে চেহারা নষ্ট করলে কী ভালো দেখায়?

জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে হাত গলিয়ে বৃষ্টি ছুঁয়ে শহরের ব্যস্ত সড়কের দিকে তাকিয়ে আছে রুদ্র। বৃষ্টি হলে না ছুঁয়ে পারে না সে। মনে হয় কোনো সম্মোহনী শক্তি তাকে বৃষ্টির দিকে অনবরত টানে। আজকে বৃষ্টির কারণে রোগী কম এসেছে অন্য দিনের তুলনায়। তাছাড়া দুপুর হয়ে গেছে এখন খাওয়ার সময় বটে। শরীফ এরমধ্যেই দুজনের খাবার নিয়ে চেম্বারে এসেছে।
” ভাইয়া আসেন খেয়ে নিন।”
” তুমি খাও আমি একটু পর খাবো। ”
” ভাইয়া আপনি কী কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করছেন? ”
শরীফ রুদ্রর সাথে থাকতে থাকতে ভালোই বুঝতে পারে তাকে। রুদ্রকে ভাইয়ের মতো ভালোবাসে তাই কখনোই কোনো কিছু লুকায় না রুদ্র। জানালা পাশ থেকে সরে এসে নিজের চেয়ারে বসে টিস্যু দিয়ে হাত মুছে শরীফের দিকে মনোযোগ দিলো রুদ্র। শরীফও রুদ্রর দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
” আসলে শরীফ গত মাসে যে একজন ভদ্রলোক এসেছিলেন না? সালমান খুরশিদ নামে,সাথে উনার ছেলে ছিলো?”
শরীফ কিয়ৎক্ষণ ভেবে মনে পড়ার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললো,
” হ্যাঁ মনে পড়েছে। ভদ্রলোক খুব ভালো, দেখেই বোঝা যায়। ”
” হ্যাঁ উনি দিন পনেরো আগে হঠাৎ একদিন রাতে আমার বাসায় একটা অদ্ভুত প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন।”
” আমার কাছ থেকেই তো বাসার ঠিকানা নিয়েছিলেন উনার ছেলে। তারপর বলো ভাইয়া।”
” সাথে উনার স্ত্রীও ছিলেন বুঝলে। উনি উনার একমাত্র মেয়েকে আমার হাতে তুলে দিতে চাচ্ছিলেন। আমি সেখানেই কৌশলে না বলে দিয়েছিলাম।”
” তাহলে কী হয়েছে আবার? ”
” উনি আমার অসম্মতির কথা শুনে সেখানে বসেই একটু অসুস্থ ফিল করেছিলেন। বুঝতে পারছিস কতটা আশাবাদী ছিলেন?”
” আসলেই খারাপ লাগছে। কিন্তু এরকম হুটহাট কী বিয়ে ঠিক হয়!”
” সেটাই তো। তাছাড়া তুমি তো জানোই বিয়ে নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই। ”
” জানি বলেই বলছি মানুষ একা বাঁচতে পারে না। শেষ বয়সে পাশে থাকার জন্য হলেও একজন সঙ্গীর প্রয়োজন ভাইয়া। ”
” কিন্তু আমি তো অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারবোনা শরীফ।”
” সংসার করতে গেলে ভালোবাসা আপনাআপনি চলে আসবে। ভালোবেসে বিয়ে করা জরুরি নয়,বিয়ের পরও ভালোবাসা যায়। ”
” ও আচ্ছা! তা তোমার কী বিয়ের শখ হলো না-কি? ”
” কী যে বলো ভাইয়া! বড়ো ভাই এখনও বিয়ে করেনি,আমি কীভাবে করবো।”
” আচ্ছা ভদ্রলোকের নাম আর ফোন নম্বর আছে না?”
” হ্যাঁ সব রোগীদের থাকে, উনারও আছে। খুঁজে বের করবো?”
” হ্যাঁ দেখো তো একবার। ভাবছি সন্ধ্যায় উনার বাসায় যাবো। ভদ্রলোক যদি এখনো রাজি থাকেন তাহলে উনার মেয়েকে মেয়েকে জানাবো, আমি তাকে বিয়ে করলেও তাকে ভালোবাসতে পারবোনা। এসব শুনেও যদি সে রাজি হয় তাহলে বিয়ে করবো তাকে। ”
এরমধ্যে শরীফ রোগীদের তথ্যের খাতা থেকে খুঁজে সালমান খুরশিদের ফোন নম্বর বের করেছেন। ভালো কথা হচ্ছে সাথে উনার বাড়ির ঠিকানাও আছে!
চলবে,

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_৯
(মুক্তমানদের জন্য উন্মুক্ত)
এরমধ্যে শরীফ রোগীদের তথ্যের খাতা থেকে খুঁজে সালমান খুরশিদের ফোন নম্বর বের করেছেন। ভালো কথা হচ্ছে সাথে উনার বাড়ির ঠিকানাও আছে!
” ফোন নম্বর আছে সাথে ঠিকানাও। কিন্তু বিয়ে করবে কিন্তু ভালোবাসতে পারবেনা এটা কী ধরনের কথা ভাইয়া?”
শরীফ খাতাটা রুদ্রর সামনে দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো। রুদ্র ততক্ষণে একবার সালমান খুরশিদের ঠিকানাটায় চোখ বুলিয়ে নিয়েছে।
” তুমি ভালো করেই জানো শরীফ আমি নবনী ছাড়া আর কাউকে এ জীবনে ভালোবাসতে পারবোনা। ”
” তাহলে অন্য একটা মেয়েকে অহেতুক নিজের সঙ্গে জড়ানোর দরকার কী! সে তো বাবার কাছে না খেয়ে নেই যার জন্য আপনার সাথে বিয়ে করবে! বিয়ের পর একটা মেয়ে তার স্বামীর কাছে ভালোবাসা ছাড়া আর কী-বা চাইতে পারে? ”
” আমি আমার কোনো দায়িত্ব অপূর্ণ রাখবো না শরীফ। স্বামীর সব দায়িত্ব পালন করবো কেবল মনটা দিতে পারবো না। ”
” তোমার যা ভালো মনে হয় করো। মনে হয় না কোনো মেয়ে এরকম প্রস্তাবে রাজি হবে! ”
” না হলে ভালোই। আসলে ভদ্রলোকের চেহারাটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। কোথাও যেনো নানুর চেহারার সাথে একটু মিল আছে। ”
নানার কথা মনে পড়তেই বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো রুদ্রর। শরীফ আর কিছু বললো না আর।
ইদানীং প্রতিদিন আদ্রিয়ান রাহির জন্য অফিসের বাইরে অপেক্ষা করে। প্রথম প্রথম রাহির সাথে কথা বলার চেষ্টা করলেও আজকাল আর সেই চেষ্টা করে না আদ্রিয়ান। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রাহির গমনের পথে চেয়ে থাকে অপলক দৃষ্টিতে। রাহিও প্রতিদিন গাড়ির সাইডে থাকা আয়নার দিকে তাকিয়ে একপলক দেখে নেয় আদ্রিয়ানকে। কিন্তু যখনই এটা অনুভব করে আদ্রিয়ানের কাছে সে কেবল প্রয়োজন ছিল প্রিয়জন নয় তখনই এক নিমিষে মনকে শক্ত করে ফেলে। অবশ্য এ জগতে সবাই প্রয়োজনেই প্রিয়জন বানায়।
ভরসন্ধ্যা, বসার ঘরে সোফায় বসে টিভি দেখছেন সালমান খুরশিদ। রিনা বেগম পাশে বসে আছেন ঠিকই কিন্তু তার মনোযোগ অন্য দিকে। আদ্রিয়ানের চেহারার দিকে তাকানো যায় না ইদানীং। একেবারে শুকিয়ে গেছে ছেলেটা। তোশার সাথে বিয়ের কথা বলতে গেলেই এড়িয়ে যায় সে। তাছাড়া সামনে মিহির বিয়ে এসব নিয়ে ভাবুক হয়েছেন রিনা বেগম। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে নড়েচড়ে উঠলেন তিনি। সালমান খুরশিদও স্ত্রী’র দিকে তাকালেন একবার। রিনা বেগম গিয়ে দরজা খুলতেই চমকালেন। ডাক্তার রুদ্র চৌধুরী!
” আপনি? ”
কন্ঠে আকাশসম বিস্ময় নিয়ে শুধালেন রিনা বেগম। এরমধ্যে সালমান খুরশিদও দরজার কাছে উঠে এসেছেন। রুদ্র স্বভাবসুলভ মিষ্টি হেসে বললো,
” জি আন্টি,কেমন আছেন আপনারা?”
” আরে বাবা তুমি! এসো এসো ভিতরে এসে বসো।”
স্বামীর কথায় রিনা বেগমও যেনো হুঁশ ফিরে পেলেন। এতক্ষণ দাঁড় করিয়ে কথা বলা ঠিক হয়নি বুঝতে পেরে বললেন,
” দেখেছেন দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখলাম! আমি খুব লজ্জিত, ভিতরে চলুন।”
” সমস্যা নেই। আর আপনিও আমাকে তুমি বলেই সম্মোধন করুন,খুশি হবো।”
রুদ্র বাসার ভিতরে প্রবেশ করেছে। সালমান খুরশিদ নিজে সোফায় বসে রুদ্রকেও বসতে বললেন। রিনা বেগম রান্নাঘরে গিয়ে চায়ের সাথে কিছু বিস্কুট নিয়ে এলেন। আগে থেকেই চা তৈরি করা ছিল বলে আপাতত এগুলো দিলো। তারপর নিজেও বসলেন সেখানে। রুদ্র ভীষণ চা পছন্দ করে তাই নিরদ্বিধায় চায়ের কাপে চুমুক দিতে শুরু করলো।
” তা বাবা হঠাৎ আমার বাসায় আগমন? আর ঠিকানা কোথায় পেলে তুমি? ”
” ঠিকানা পাওয়া বিষয় নয় আঙ্কেল, আসলে সেদিন আপনি যে প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন আমি সেই বিষয় কথা বলতে এসেছি। ”
” মিহির বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ”
মাঝখান থেকে রিনা বেগম বলে উঠলেন। সালমান খুরশিদ একটু দোটানায় পড়ে গেলেন। এরমধ্যে মিহি দৌড়ে বসার ঘরে এসে উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু বাবা-মা ব্যাতিত তৃতীয় কারো উপস্থিতিতে লজ্জা পেলো সে। এরকম দৌড়ে না আসলেও বোধহয় হতো। রুদ্র মুচকি হেসে বললো,
” ইটস ওকে মিহির দানা। আপনার লজ্জা পেতে হবে না। ”
রুদ্রর এরকম অদ্ভুত কথায় ভড়কে গেলো মিহি। লোকটা এরকম কেনো? প্রথম দেখায় কেউ এরকম ভুলভাল নামে সম্মোধন করে!
” এক্সকিউজ মি,আমার নাম তানজিনা ইসলাম মিহি নট মিহির দানা। গট ইট ওকে?”
” ওকে ম্যাম।”
” আচ্ছা বাবা শোনো ভাবি কল করেছিলো আমাকে। এত দিন পর কল পেয়ে একটু এক্সাইটেড হয়ে গেছিলাম। বাই দ্য ওয়ে উনি কে বাবা?”
” তুমি রাজি থাকলে উনার সাথে তোমার বিয়ে হবে মিহি।”
সালমান খুরশিদের কথায় রিনা বেগম, মিহি ও রুদ্র তিনজনই চমকে উঠেছে। যেখানে মেয়ের বিয়ে অন্যত্র ঠিক হয়ে গেছে সেখানে এসব বললেন কেনো ভদ্রলোক! রিনা বেগম ইশারায় সালমান খুরশিদকে চুপ করতে বললেন কিন্তু তিনি মোটেও সেসব গ্রাহ্য করলেন না। রুদ্র ও মিহি নির্বাক হয়ে দু’জন দু’জনার দিকে তাকিয়ে আছে।
” রুদ্র তুমি বরং মিহির সাথে একটু আলাদা কথা বলে নাও। তোমাদের যদি দু’জন দুজনকে ভালো লাগে তাহলে আমি তোমাদের বিয়ে দিতে রাজি। বিয়ের কথা আগে তোমার সাথে হয়েছিল তাই তুমি আগে অগ্রাধিকার পাবে অবশ্যই। ”
স্বামীর কথায় ক্ষেপে উঠলেন রিনা বেগম কিন্তু রুদ্র সামনে থাকায় দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে রইলেন। বাবার কথার আগামাথা কিছুই বুঝলোনা মিহি। তবে অন্য কাউকে বিয়ে করাও যা আর লোককে বিয়ে করাও মিহির জন্য সমান। তাই বাবার কথামতো ইশারায় রুদ্রকে নিজের সাথে যেতে বললো মিহি। রুদ্রও মনে মনে যেনো এ সুযোগ খুঁজছিলো। মিহিকে একা পেলে সবকিছু বলা যাবে। তাই মিহির পিছুপিছু রুদ্র ছাঁদে গেলো। রুমের সাথে কোনো বারান্দা না থাকায় ছাদ ছাড়া অন্য কোথায় বসে কথা বলার জায়গা খুঁজে পেলো না মিহি। অচেনা একজন লোকের সাথে রুমে ঢুকে কথা বলা কেমন বেমানান লাগবে বলে মনে হচ্ছিল মিহির। ছাঁদের দক্ষিণ দিকে কার্ণিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে মিহি,সামনে রুদ্র দাঁড়িয়ে। আশেপাশের বিল্ডিং- গুলোতে বাতি জ্বলছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ রইলো দু’জন তারপর সময় অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে রুদ্র নিজেই কথা শুরু করলো।
” আপনার কোনো পছন্দের মানুষ আছে? ”
হঠাৎ রুদ্রর এই কথায় কাটা গায়ে কেমন নুনের ছিটা লাগার মতো অনুভূতি হচ্ছে মিহির। অবশ্য রুদ্র একটা স্বাভাবিক প্রশ্নই করেছে।
” না তেমন কেউ নেই। আপনার আছে না-কি? অবশ্য থাকলে তো নিজে থেকে বিয়ের কথা বলতে আসতেন না।”
” ব্রিলিয়ান্ট গার্ল। ঠিক ধরেছো,কেউ নেই কিন্তু অতীতে ছিল। আমি আজও তাকেই ভালোবাসি মিহির দানা। তাই আপনাকে বিয়ে করতে পারবো কিন্তু মন থেকে ভালোবাসতে পারবোনা কখনো। কিন্তু বিশ্বাস করুন স্বামী হিসেবে সকল দায়িত্ব পালন করবো অবশ্যই। ”
রুদ্রর কথা শুনে বেশ ভালো লাগলো মিহির। মোটেও খারাপ লাগলো না তার। কারণ মিহি নিজেও তার স্বামীকে কখনো মন দিতে পারবেনা।
” আমার কোনো সমস্যা নেই তাতে। কিন্তু কথা হলো যদি ভালোবাসতে না পারেন তাহলে বিয়ে কেনো?”
” আপনার বাবা খুব ভালো মানুষ। উনি একবার আমার বাড়ি গিয়েছিলেন আপনার কথা বলতে। আমি তখন অতীতের জন্য তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু পরে বারবার উনার মুখখানা ভেসে উঠছিল চোখের সামনে। আর মেইন কথা হচ্ছে উনার সাথে আমার নানুর চেহারার বেশ মিল আছে। নানু ছিলেন এ পৃথিবীতে আমার একমাত্র আপনজন। ”
” তারমানে আপনার কেউ নেই? ”
” নাহ! আমি একাই থাকি একটা বাড়িতে, রাতে শুধু একজন চাচা আছেন উনি রান্নাবান্না করেন।”
মিহি চুপ রইলো আবারও কিছু সময়। তারপর কিছুটা হেসে বললো,
” ঠিক আছে তাহলে বাবাকে গিয়ে বলুন আমরা রাজি। বিয়ে যখন করতেই হবে তখন না বলে লাভ নেই। আপনাকে না হলেও অন্য কাউকে করতেই হবে, তারচে আপনার একাকীত্বের বন্ধু হবো না হয়।”
চলবে,

মনেরও গোপনে পর্ব-০৭

0

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_৭
(মুক্তমানদের জন্য উন্মুক্ত)
তাহলে বিয়ে না করে কার জন্য অপেক্ষা করবে সে? তাছাড়া লোকটা তো বিবাহিত হতে পারে! বয়সের কথা না হয় না-ই ভাবলো কিন্তু বউ,বাচ্চা নেই তার গ্যারান্টি কী? চোখ বন্ধ করে একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো মিহি। মনেরও গোপনে পুষে রাখা সুপ্ত ভালোবাসা আজীবন গোপন রেখেই অন্যের সংসার করবে বলে সিন্ধান্ত নিলো মিহি। বাস্তবতা কঠিন আর সেই কঠিন বাস্তব জীবনে কাল্পনিক ভালোবাসার কোনো অস্তিত্ব নেই।

” মা আমি বিয়ে করতে রাজি,তোমরা তোমাদের পছন্দমতো ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করতে পারো।”
মিহি আবারও বসার ঘরে ফিরে এসে বাবামায়ের উদ্দেশ্য বললো। আকস্মিক মিহির এরকম কথায় রিনা বেগম ও সালমান খুরশিদ দুজনেই চমকালেন।
” তুই ঠিক বলছিস তো?”
রিনা বেগম মেয়ের দিকে তাকিয়ে সন্দিহান দৃষ্টিতে প্রশ্ন করলো।
” হ্যাঁ। আমার কাছে বাবার শরীর আগে তারপর পড়ালেখা। ”
মিহির কথা শুনে মুচকি হাসলেন সালমান খুরশিদ। মনে মনে ভিন্ন কিছু চিন্তা করতেই ঠোঁটের কোণের হাসি আরো কিছুটা প্রসস্থ হলো।

দুপুরের কড়া রোদের মধ্যে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিয়ান। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নির্দিষ্ট সময় হলো কি-না সেটা পরখ করে নিলো বারকয়েক। সামনে অফিসের গেটের দিকে তাকাতেই বুকের ভেতর কেমন ছলাৎ করে উঠলো আদ্রিয়ানের। সেই পরিচিত চেহারা! বছরখানেকের বেশি হয়েছে মুখখানা দেখেনি সে। তবে বদলেছে তার পোশাকআশাক। শাড়িতে যাকে সংসারের সব কাজকর্ম করতে দেখতো এখন সে সুট বুট পরে অফিসে যাওয়া আসা করে। কতক্ষণ তাকিয়ে ছিল খেয়াল করেনি আদ্রিয়ান কিন্তু গাড়ির আওয়াজে ঘোর কাটলো তার। ততক্ষণে রাহি নিজের গাড়িতে উঠে বসেছে। আদ্রিয়ান আর কালক্ষেপণ না করে দ্রুত গাড়ির কাছে দৌড়ে গেলো। গাড়ির জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কয়েকবার দম নিয়ে নিলো আদ্রিয়ান। এতক্ষণে রাহির দৃষ্টিগোচর হয়েছে বিষয়টা। তাই ড্রাইভারকে দ্রুত গাড়ি চালাতে বললো সে।
” রাহুল দাদা গাড়ি স্টার্ট করুন, কারো জন্য দাঁড়ানোর দরকার নেই। ”
” রাহি প্লিজ! একবার শোনো যেও না। রাহি! রাহি!”
আদ্রিয়ান গাড়ির পিছনে ছুটলো মিনিটখানেক কিন্তু একটা সময় হাল ছেড়ে দাঁড়াতে হয়েছে তাকে। রাহির কথামতো ড্রাইভার তখনই গাড়ি চালাতে শুরু করেছিলেন। গাড়ির পাশের আয়নায় কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল রাহি। চেহারায় কেমন রোগা হয়ে গেছে লোকটার। মনে হয় ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করে না! আপন মনে বিরবির করছে রাহি। যতই শক্ত হোক সময় চলে যাক মনের গোপনে যে ভালোবাসা রয়েছে সেটুকু অস্বীকার করার কিছু নেই।
” রাহি আপু কিছু বলছেন? ”
ড্রাইভার রাহুলের কথায় ভাবনার ছেদ ঘটলো রাহির। আস্তে আস্তে কথা বললেও লোকটা শুনে ফেলেছে নিশ্চিত।
” না দাদা,একা একাই হিসাব মিলানোর চেষ্টা করছিলাম।”
” আচ্ছা। ”

রাস্তায় হাঁটু গেড়ে বসে আছে আদ্রিয়ান। দু-চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে তার। এতটা পরিবর্তন কীভাবে হলো মেয়েটা? অবশ্য পরিবর্তন তো আগেই হয়েছিল তবে তখন সেটা অগ্রাহ্য করেছিল তখন। সেদিন যদি রাহির অভিমান ভাঙাতো আদ্রিয়ান তাহলে আজ এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতোনা। বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো আদ্রিয়ানের। আসলেই সময় গেলে সাধন হয় না!

সালমান খুরশিদ যেদিন প্রথম রুদ্র চৌধুরীকে দেখেছিলেন সেদিনই মনে মনে মেয়ের জামাই করবেন বলে ভেবেছিলেন। সেই আরজি নিয়ে আজ রুদ্রর বাসায় এসে উপস্থিত হয়েছেন তিনি,সাথে রিনা বেগমও আছেন। সময়টা রাত আটটা এখন। রুদ্র একটু আগেই বাসায় ফিরেছে মাত্র। এসেই এই দম্পতিকে দেখে খুব চিন্তায় নিমজ্জিত হয়ে ছিল সে। চিকিৎসা করানোর জন্য নিশ্চয়ই একেবারে বাড়িতে এসে উপস্থিত হননি তারা! রিনা বেগম অবশ্য স্বামীর এরকম পাগলামিতে বিশেষ খুশি নন। দেশে তো ডাক্তার ছেলের অভাব নেই যে বলেকয়ে এই ছেলেকেই মেয়ের জামাই করতে হবে। রহমান চাচা এরমধ্যেই দু’জনকে চায়ের সাথে হালকা নাস্তা পরিবেশন করেছেন। সেগুলো অবশ্য এখনও সামনে রাখা টি-টেবিলের ওপর রাখাই আছে কোনো খাবারে হাত দেননি দুজনের কেউ। জামাকাপড় পাল্টে ফ্রেশ হয়ে এতক্ষণে মুখোমুখি সোফায় বসলো রুদ্র।
” তা কেমন আছেন আপনারা? আঙ্কেলের শরীর কেমন এখন?”
হাসি মুখে প্রশ্ন করলো রুদ্র। মিহির বাবা সন্তুষ্ট চিত্তে বললেন,
” আলহামদুলিল্লাহ বাবা, আমরা ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? ”
” এইতো ভালো। চা তো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, শরবত হয়ে গেলে মোটেও ভালো লাগবে না খেতে। চা খেতে খেতে বরং কথা বলুন আপনারা।”
রুদ্রর কথামতো দুজনেই চায়ের কাপে চুমুক দিলেন।
” আসলে বাবা আমরা একটা বিশেষ প্রয়োজনে তোমার কাছে এসেছি। এ-র আগে তোমার হসপিটালে গিয়ে তোমার ঠিকানা সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছে আমার ছেলে।”
” হ্যাঁ সেটা তো বুঝতে পেরেছি আঙ্কেল। নিশ্চিত কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কথা বলতে এসেছেন। কিন্তু চিকিৎসা ব্যতীত আমার সাথে কী গুরুত্বপূর্ণ কথা থাকতে পারে সেটাই বোধগম্য হচ্ছে না আমার। আর চিকিৎসার ব্যাপার হলে নিশ্চয়ই বাসায় আসতেন না!”
” বুদ্ধিমান তুমি। আসলে অন্য বিষয় কথা বলতে এসেছি আমরা। কিন্তু কথাগুলো তুমি কীভাবে নিবে সেটাই বুঝতে পারছি না। ”
সালমান খুরশিদ বেশ ইতস্ততভাবে বললেন কথাগুলো। রিনা বেগম ভাবলেশহীনভাবে চায়ের দিকেই মনোযোগ দিয়ে আছেন। রুদ্র মিহির বাবার অস্বস্তি কাটাতে হাসলো একটু।
” সমস্যা নেই আঙ্কেল, আপনি নিশ্চিতে বলতে পারেন।”
” বাবা আমি তোমাকে আমার ছেলে হিসেবে পেতে চাই,আমার একমাত্র মেয়ে মিহির স্বামী হিসাবে। ”
এরমধ্যে রহমান চাচা রুদ্রর পাশে এসে দাঁড়িয়ে উনাদের কথোপকথন শুনছিলেন। হঠাৎ ভদ্রলোকের এরকম প্রস্তাবে খুশিতে দু-চোখ চকচক করে উঠেছে তার। রুদ্র বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছে। সালমান খুরশিদের থেকে এরকম একটা প্রস্তাব কল্পনাতীত ছিল তার। তাই ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গেছে রুদ্র। রুদ্র চুপ করে আছে, সালমান খুরশিদ রুদ্রর চেহারার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ করেই পুরো রুম জুড়ে পিনপতন নীরবতায় ছেয়ে গেছে। রিনা বেগম রুদ্রর হাবভাব দেখে স্বামীকে ফিসফিসিয়ে বললেন,
” মনে হয় উনার অন্য কোথাও সম্পর্ক আছে কিংবা তোমার থেকে এরকম প্রস্তাব আশা করেনি।”
” চুপ করো, দেখি কী বলে ছেলেটা। ”
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে রহমান চাচা নিজে থেকেই বলে উঠলেন,
” বাহ এটা তো খুব ভালো প্রস্তাব। এমনিতেই রুদ্র বাবার বিয়ের জন্য যথেষ্ট বয়স হয়েছে ”
রহমান চাচার কথায় রুদ্র চমকালো। লোকটা কী বলছে উনাদেরকে! রুদ্র মোটেই বিয়েসাদী করতে চায় না। সে হোক এখন কিংবা পরে। কিন্তু ভদ্রলোক যথেষ্ট ভালো মনে হচ্ছে কীভাবে মুখের উপর না বলবে রুদ্র?
” চাচা আপনি থামুন। আঙ্কেল আসলে এখনই বিয়ে করার কথা ভাবছি না আমি। ”
রুদ্রর কথায় সালমান খুরশিদ যেনো খুব কষ্ট পেলেন। হঠাৎ বুকের বামপাশে হাত দিয়ে কেমন কেঁপে উঠলো তার শরীর। রুদ্র তৎক্ষনাৎ সালমান খুরশিদের বুকে হাত দিয়ে একটু নাড়াচাড়া করলো।
” ঠিক আছি আমি বাবা। আসলে খুব আশা নিয়ে এসেছিলাম তো কেমন যেনো কষ্ট লাগলো। দুঃখিত এরকম অন্যায় আবদার নিয়ে তোমার কাছে আসার জন্য। ”
রিনা বেগম যথেষ্ট রেগে গেছেন কিন্তু সেটা রুদ্রর সামনে খুব কষ্ট করে চেপে যাচ্ছেন।
” এখন বাসায় ফিরে চলো। অযথা উনাকে বিব্রত করলে আর নিজেও অসুস্থ শরীর নিয়ে এলে।”
রিনা বেগম কিছুটা রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বললেন স্বামীকে। রুদ্রর বেশ খারাপ লাগছে বটে। ভদ্রলোক আসলেই বেশ দুঃখ পেলেন। কিন্তু এতে রুদ্রর কী করবার আছে? হঠাৎ করে এরকম অদ্ভুত আবদার করলে সেটা তো মানা যায় না। তাছাড়া বিয়ে কোনো ছেলেখেলা নয়।
” ক্ষমা করবেন আঙ্কেল। আপনি নিজের শরীরের খেয়াল রাখবেন। আর দরকার হলে অবশ্যই চেম্বারে আসবেন। ”
” ঠিক আছে বাবা। আমরা আসছি।”
রিনা বেগম ও সালমান খুরশিদ ধীরে ধীরে বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে গেলেন। রুদ্র ঠায় দাঁড়িয়ে আছে বসার ঘরে। রহমান চাচা নাস্তাগুলো নিয়ে রান্নাঘরে রেখে এসেছে। এতক্ষণে রহমান চাচার দিকে খেয়াল করেছে রুদ্র।
” উনাদের সামনে আগ বাড়িয়ে বিয়ের কথা বললেন কেনো আপনি? আপনার যদি আরেকটা বিয়ে করার ইচ্ছে থাকে তো বলুন চাচীকে গিয়ে বলে আসছি।”
চলবে,

মনেরও গোপনে পর্ব-০৬

0

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_৬
(মুক্তমানদের জন্য উন্মুক্ত)

রাহিকে যে কারণে অসহ্য লাগতো তোশার সাথে মেশার পরে বুঝেছে তোশা তারচে বেশি অসহ্য। আসলে মানুষ চাইলেও সুখী হতে পারে না, যদি না সৃষ্টিকর্তা চান। আদ্রিয়ানের বেলায় ও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে রিনা বেগম রাহি চলে যাওয়াতে খুশি না হলেও অখুশি হননি। সালমান খুরশিদ সে হিসেবে খুব কষ্ট পেয়েছেন। মেয়েটা একেবারে মায়ের মতো করে দাঁড়িয়ে থেকে খাওয়াতো,খুব খেয়াল রাখতো।

বাবার বাড়ি এসে নানান প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল রাহিকে। অবশ্য সবটা বুঝিয়ে বলার পরে তেমন কোনো সমস্যা পোহাতে হয়নি তাকে। শুধু বড়ো ভাইয়ের থেকে ভালোবেসে বিয়ে করার পরিণাম সম্পর্কে কিছু কথা শুনতে হয়েছিল। বাড়ির ছোটো মেয়ে রাহি,সবার বড়ো ভাই তারপরে আরেক বোনের পরে রাহি। মোট তিন ভাইবোন তারা। রাহির মা মুখে কিছু না বললেও মেয়ের জীবনের এরকম পরিণতিতে বেশ চিন্তিত থাকেন সব সময়। তিনি খুব ভালো করে জানেন আদ্রিয়ানকে কতটা ভালোবাসতো মেয়েটা।
তপ্ত দুপুর,জানালার গ্রিলে হাত দিয়ে দূরের আকাশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাঁড়িয়ে আছে রাহি। জীবনের হিসাব মিলেনি তার,কত বছরের ভালোবাসার কী পরিণতি হলো সেই নিয়ে ভাবতে ভাবতে বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস।
” ভরদুপুরে উদাসী হয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন রাহি?”
নির্জন ঘরে হঠাৎ বোনের কন্ঠে কিছুটা নড়েচড়ে উঠলো রাহি। সমস্ত ভাবনা মস্তিষ্কের একপাশে রেখে ঠোঁটের কোণে মেকি হাসি ফুটিয়ে বোনের দিকে ফিরে তাকালো সে। রাহির আসার কথা শুনেই মিথিলা এসেছে বাবার বাড়ি।
” কই! এমনি আকাশ দেখছিলাম। দুলাভাইকে সাথে নিয়ে আসলে না কেনো আপু?”
মিথিলা রাহির পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে এরমধ্যেই। সামনাসামনি দাঁড়িয়ে এখন দুই বোন। মিথিলা কিছু সময় চুপ রইলো। রাহির চোখের দিকে তাকিয়ে কী যেনো বুঝতে চেষ্টা করলো হয়তো।
” পারভেজ অফিসের কাজে ব্যস্ত খুব। রাহি এত কষ্ট পেয়ে কী হবে বোন? যে মানুষটা তোর মূল্য বোঝেনি তার জন্য নিজেকে কষ্টের অনলে জ্বালানো কি বোকামি নয়?”
” আসলে কি আপু আমরা অনেক সময় বুঝি ভুল করছি তবুও নিজেকে সেই ভুল থেকে সরাতে পারিনা। আমি জানি আদ্রিয়ান আমাকে কখনো ভালোবাসেনি,ভালোবাসা এতটা ঠুনকো হতে পারে না। মিহি আমাকে আগেই বুঝিয়েছে এসব। একটু সময় লাগবে শুধু আরকিছুই না। ”
” সময় নে সমস্যা নেই। আদ্রিয়ানকে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দেওয়ার কথা ছিল না? ”
” হ্যাঁ কালকেই কুরিয়ার করে দিয়েছি। আশা করি দু-একদিনে পৌঁছে যাবে। ”
কথাগুলো বলার সময় আঁখি যুগল ছলছল করছিলো রাহির। মিথিলা বুঝেও কিছু বললো না। আসলেই সময় দরকার, সময় সবকিছু তার আপন গতিতে ঠিক করে দিবে। আর এটা হবেই, আজ যে কারণে খুব কষ্ট হচ্ছে একটা সময় সেই কথা ভেবেই হাসি পাবে।

দেখতে এক বছর পেরিয়ে গেছে। আদ্রিয়ান আর রাহির ডিভোর্স হয়নি কারণ আদ্রিয়ান শেষমেশ ডিভোর্স পেপারে সাইন করেনি। এরমধ্যে তোশা আদ্রিয়ানের জীবন নরক করে তুলেছে। এমনকি রাহির বাড়িতে গিয়ে তার আর আদ্রিয়ানের সম্পর্কের ব্যাপারে সবকিছু বলে এসেছে। তাতে অবশ্য রাহির একটু কষ্ট হলেও সুবিধা হয়েছে। মানুষ না বুঝে ভুল করলে ক্ষমা করা যায় কিন্তু জেনেশুনে যে বেইমানি করে তার কোনো ক্ষমা নেই। রাহিও ক্ষমা করেনি আদ্রিয়ানকে। গত এক বছরে আদ্রিয়ান তিনবার গিয়েছিল রাহিকে ফিরিয়ে আনতে কিন্তু প্রতিবারই রাহি ফিরিয়ে দিয়েছে তাকে। এমনকি আদ্রিয়ানের দৃষ্টি সীমানার মধ্যেও আসেনি সে। না ঘৃণা করে না আদ্রিয়ানকে কারণ যাকে ভালোবাসা যায় না তাকে ঘৃণা করাও বেমানান। ওই মানুষটা ঘৃণারও অযোগ্য রাহির কাছে। তোশার বলে যাওয়া প্রতিটি কথা দিনে দিনে রাহিকে আরো শক্ত করে তুলেছিলো। আর আদ্রিয়ানকে বারবার ফিরিয়ে দেওয়া তারই জলজ্যান্ত প্রমাণ। রাহি ইতিমধ্যে পারভেজের অফিসে একটা চাকরি করতে শুরু করেছে। বাড়িতে বসে থাকলে মন মানসিকতা খারাপ লাগবে বলে মিথিলাই রাহিকে চাকরিতে জয়েন করতে বলেছিল। আদ্রিয়ান তোশাকে এখন আর সহ্য করতে না পারলেও রিনা বেগম এতদিনে তোশাকে ছেলের বউ হিসেবে পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে গেছেন। মিহির সাথে রিনা বেগমের এ নিয়ে প্রায় কথা কাটাকাটি হয়। এরমধ্যে মিহির গ্রাজুয়েট শেষ হয়ে গেছে। ফলে রিনা বেগম একপ্রকার কোমর বেঁধে নেমেছেন মেয়ের বিয়ে দিবে বলে। অবশ্য এর পিছনে কারণ রয়েছে। এরমধ্যে কয়েকজন পাত্রের ছবি দেখিয়েছে মিহিকে কিন্তু মিহি কারো ছবি না দেখেই বিয়ের জন্য না করে দিয়েছে।
খাবার টেবিলে বসে আছে আদ্রিয়ান। ইদানীং খাওয়াদাওয়া করতেও অনীহা লাগে তার। মিহি খাবার আদ্রিয়ানকে খেতে দিয়ে নিজেও খেতে বসলো। রিনা বেগম আর সালমান খুরশিদ খেয়েদেয়ে এরমধ্যেই ঘুমানোর উদ্দেশ্যে ঘরে গিয়েছেন। দুই ভাইবোন একসাথে বসে খাচ্ছে অথচ কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। মাঝে মধ্যে পরিস্থিতি এতটা জটিল রূপ ধারণ করে মানুষ পাশাপাশি বসে থেকেও কথা বলতে দ্বিধায় পড়ে যায়।
” মিহি।”
নীরবতা ভেঙে আদ্রিয়ান ডাকলো মিহিকে। মিহি প্লেটের দিকে তাকিয়েই উত্তর দিলো।
” হুম বলো।”
” তোর ভাবির মানে রাহির সাথে কথা হয় তোর?”
” নাহ,প্রথম প্রথম কথা হলেও অনেক মাস হলো কথা হয়নি। কোন মুখে নিজে থেকে কল দিবো বলো তো!”
বোনের প্রশ্নের উত্তরে কিছু বলার মতো উত্তর আসলেই নেই আদ্রিয়ানের কাছে। মিহি খাবার শেষ না করেই নিজের রুমে চলে গেলো। এরমধ্যেই আদ্রিয়ানের ফোনের স্ক্রিনে তোশার নাম ভেসে উঠেছে। আদ্রিয়ান কয়েকবার কল কেটে দিলেও রিসিভ না করে পারলোনা। কারণ তোশা সব সময় আত্ম**হত্যা করার কথা বলে ব্লাকমেইল করে।
” কী হয়েছে? বুঝতে পারছিস না আমি বিজি।”
কল রিসিভ করেই রাগী স্বরে বললো আদ্রিয়ান।
” হ্যাঁ সবকিছুই বুঝি রাহির মতো এখন আমাকেও অসহ্য লাগে তোমার। ”
” আজাইরা কথা বলবি না তোশা। তোকে কখনোই আহামরি ভালোবাসতাম না আমি। তুই প্লিজ আমাকে ছেড়ে দে।”
” আমাকে কী তোমার রাহি মনে হয়? আমি আর কয়েকদিন দেখবো। এরমধ্যে যদি কাকির কথামতো আমাকে বিয়ে না করো তাহলে তোমার বাসায় গিয়ে বি*ষ পান করবো।”
আদ্রিয়ানের খুব অসহায় লাগছে। তোশা একা হলে আলাদা বিষয় ছিল কিন্তু সাথে তার মা-ও আছে। মিহিকে বিয়ে দিয়ে বাড়ি থেকে সরিয়ে তোশাকে ছেলের বউ করে ঘরে তোলাই উনার উদ্দেশ্য। আদ্রিয়ান আরকিছুই বলার সুযোগ দিলো না তোশাকে। কল কেটে দিয়ে প্লেটে হাত ধুয়ে নিজের রুমে গেলো। এই ঘরে এলেও অস্থির লাগে আদ্রিয়ানের। কতশত স্মৃতি দুজনের!

ইদানীং বাবার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। মুখে না বললেও রাহি চলে যাওয়াতে বড়সড় একটা মানসিক আঘাত পেয়েছেন তিনি। তাই আদ্রিয়ান আগামীকাল ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাবে সালমান খুরশিদকে।

ইসিজি রুমে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে রুদ্র চৌধুরী। বেশ কিছুক্ষণ ধরে পরীক্ষা চললো। তারপর চেম্বারে রোগীসহ নিজেও গিয়ে বসলো। ডাক্তারের চেয়ারে বসে আছে রুদ্র আর তার সামনে রোগীদের জন্য বরাদ্দ করা চেয়ারে বসে আছে আদ্রিয়ান ও তার বাবা। ইসিজি রিপোর্ট নিয়ে চেম্বারে ঢুকলো শরীফ। সবাই চুপ করে আছে। রুদ্র রিপোর্ট দেখলো খানিক সময়।
” কী দেখছেন ডক্টর? বাবার শরীর ঠিক আছে তো?”
” এই বয়সে যেমন থাকার কথা তার থেকে ভালোই আছেন। তবে অতিরিক্ত চিন্তা করেন উনি,যেটা উনার হার্টের জন্য মোটেও সুখকর নয়।”
” চিন্তা কী এমনি করি বাবা! সরি বাবা বলে ফেললাম, কিছু মনে করবেন না। ”
সালমান খুরশিদ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেছেন। কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে রুদ্র মিষ্টি করে হেসে বললো,
” আরে না সরি কেনো! আপনি আমার বাবার বয়সী আপনি বরং তুমি করে বলুন আমাকে। আর হ্যাঁ চিন্তা একটু কম করুন। ”
” চেষ্টা করবো বাবা। তোমার সাথে কথা বলে ভালো লাগলো।”
” সেইম টু ইউ আঙ্কেল। ”
” তাহলে আমরা আসছি ডক্টর।”
” হ্যাঁ দু’টো ঔষধ লিখে দিয়েছি সেগুলো নিয়মিত খাওয়াবেন। ”
আদ্রিয়ান বাবাকে নিয়ে চেম্বার থেকে বেরিয়ে এসেছে। নিজেকে নরকের কীটের থেকেও জঘন্য মনে হচ্ছে আদ্রিয়ানের। আজ তার জন্য বাবা এত চিন্তা করেন। কত সুখেই তো ছিল দু’জন! মানুষের কিছু কিছু ভুলের মাশুল সারাজীবন দিতে হয়।

” তাহলে তুই বিয়ে করবি না?”
বসার ঘরে বসে আছেন সালমান খুরশিদ ও রিনা বেগম। মিহি দাঁড়িয়ে আছে একপাশে। এতদিন ধরে বিয়ের কথা বলেও কোনো লাভ হয়নি। তাই রিনা বেগম আজ বেশ ক্ষেপে গেছেন।
” নাহ মা। আগে মাস্টার্স শেষ হোক তারপর। ”
” ততদিনে যদি তোর বাবার কিংবা আমার কিছু হয়ে যায়? আমাদের কী মরার পরেও চিন্তায় রাখবি!”
” মা! এসব কেনো বলছো।”
” তোর বাবাকে ডাক্তার কী বলেছে আদ্রিয়ানের কাছে শুনিসনি? টেনশন কম করতে বলেছেন। আশা করি বাবার কথা ভেবে তোর মতামত বদলাবে।”
বাবার শরীরের কথা শুনে নিশ্চুপ হয়ে গেছে মিহি। সত্যি তো উনার শরীরের জন্য চিন্তা করা খুব খারাপ প্রভাব ফেলে। মিহি তৎক্ষনাৎ কিছু বললো না। নিঃশব্দে নিজের রুমে চলে গেলো। অস্থির লাগছে খুব, রুমে ঢুকে দরজা আঁটকে বিছানায় বসলো মিহি। মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবতে শুরু করলো। সে যা করছে সেটা কী ঠিক? অচেনা কোনো এক পুরুষের জন্য নিজের বাবা-মা’কে কষ্ট দেওয়া কী শোভা পায়? নাহ,বাব-মা’র চেয়ে সেই ব্যক্তি মিহির কাছে বেশি নয়। তাছাড়া সারাজীবন খুঁজলেও তাকে পাওয়া অসম্ভব। তাহলে বিয়ে না করে কার জন্য অপেক্ষা করবে সে? তাছাড়া লোকটা তো বিবাহিত হতে পারে! বয়সের কথা না হয় না-ই ভাবলো কিন্তু বউ,বাচ্চা নেই তার গ্যারান্টি কী?
চলবে,

মনেরও গোপনে পর্ব-০৫

0

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_৫
(মুক্তমানদের জন্য উন্মুক্ত)

ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে রাহিকে ফোনে কথা বলতে দেখলো আদ্রিয়ান। কিন্তু সেদিকে বিশেষ খেয়াল না করে ডাইনিং টেবিলে খাওয়ার উদ্দেশ্য এগোলো। অদ্ভুত বিষয় রাহি তবুও ফোনে কথা বলেই যাচ্ছে, মোটেই আদ্রিয়ানের সাথে গেলো না! আদ্রিয়ান একবার ভাবলো রাহিকে জিজ্ঞেস করবে কী হয়েছে? কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলো অযথা কথা বলার দরকার নেই। এমনিতেই ঘাড় থেকে নামলে বাঁচি!
আদ্রিয়ান রুম থেকে বের হতেই ফাঁকে মিহি এসে ঢুকলো রাহির ঘরে।
” ভাবি কিছু বললো ভাইয়া?”
রাহি এতক্ষণ বিছানায় বসে উসখুস করছিল। মিহিকে দেখে একটু স্বস্তি পেয়েছে।
” নাহ কিছু বলেনি কিন্তু কিঞ্চিৎ অবাক হয়েছে বটে, ওর চেহারার হাবভাবে বোঝা যাচ্ছিল সেটা। ”
” এক কাজ করো, আমি একটা ফেইক আইডি খুলেছি ফেইসবুকে। তুমি মেসেঞ্জারে আমার সাথে কথা বলবে বারোটা পর্যন্ত। ভাইয়া যদি উঁকিঝুঁকি দেয় তাহলে যেন বোঝে কোনো ছেলে বন্ধুর সাথে কথা বলছো।”
” কিন্তু ও যদি ভুল বোঝে? ”
” সঠিকটা বোঝাতে যদি এইটুকু ভুল বোঝে তাহলে বুঝতে দাও। এরকম এক সপ্তাহ চালিয়ে তারপর বাবার বাড়ি চলে যাবা। ”
” ঠিক আছে মিহি,তোমার ভাই তুমি যাও এখন এসে পড়বে এখুনি। ”
” ওকে ভাবি কথা হবে রাতে। ”
মিহি হেসে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। কিন্তু যাওয়ার সময় করিডোরের মাঝখানে আদ্রিয়ানের সাথে দেখা হলো।
” কি খবর তোর? লেখাপড়া চলে তো ঠিকঠাক? ”
” হ্যাঁ ভাইয়া। তুমি একা খেয়ে এলে! ভাবি খেয়েছে? ”
” প্রতিদিন তো অপেক্ষা করে, আজকে তো দেখলাম ঘরে বসে আছে। কিছু বললো না তো।”
” ও ভাবি তো খেয়েছে একটু আগে। আমার খেয়াল ছিল না। আচ্ছা ভাইয়া শুভ রাত্রি। ”
” হুম। ”
মিহি নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আঁটকে দিলো। আদ্রিয়ান এখনও করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে।

দেখতে দেখতে পাঁচ দিন কেটে গেলো এরকম করেই। রাহি এখন আদ্রিয়ানের কাছে সম্পূর্ণ আলাদা এক রাহি। হুট করে যে এতটা বদল কীভাবে ঘটলো মাঝে মধ্যে ভাবে আদ্রিয়ান। কিন্তু পরক্ষণেই আবার এটা ভেবে খুশি হয়ে যায় মেয়েটা আগের মতো পাগলামি করে না। ডিভোর্সের কথাটা এখন বলাই ভালো। যেই ভাবা সেই কাজ! এরমধ্যেই ডিভোর্স পেপার তৈরি করতে দিয়েছিল আদ্রিয়ান। আজকে দুপুরে সেটা নিয়ে বাসায় ফিরলো। রাহি প্রতিদিনের মতো সালমান খুরশিদকে খাবার পরিবেশন করে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। আদ্রিয়ান একবার সেদিকে তাকিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। এখন আর আদ্রিয়ান বাসায় লাঞ্চ করে না দুপুরে। সকালে বেরোয় আবার দেরি করে রাতে ফেরে। রাহি কিছু না বলাতে আদ্রিয়ান আরো লাগামছাড়া হয়ে গেছে। মাঝে মধ্যে তোশা আসে অফিসে তবে সেটা দুপুরের খাওয়ার সময়। প্রথম প্রথম আদ্রিয়ান তোশাকে এড়িয়ে চললেও এখন স্বাভাবিক কথাবার্তা বলে। তোশা যে আদ্রিয়ানকে নিজের করে পাওয়ার জন্য কতটা উদগ্রীব হয়ে আছে সেটা ভালোই বুঝতে পারে আদ্রিয়ান। স্ত্রী’র সাথে দূরত্ব গড়েছে অনেক মাস। তোশার সাথে কথাবার্তা বলার সময় মাঝে মধ্যে দূর্বল হয়ে যায় আদ্রিয়ান। কিন্তু বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে লিপ্ত হওয়ার মতো সাহসও হয় না ঠিক। আজকে হঠাৎ দুপুরে আদ্রিয়ানের বাসায় ফেরার পিছনে যে নিশ্চয়ই কোনো কারণ রয়েছে সেটা খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছে রাহি। তাই শ্বশুরের খাওয়া শেষে তড়িঘড়ি করে নিজের রুমে গেলো রাহি। কিন্তু রুমে ঢুকে দেখলো আদ্রিয়ান ঘরে নেই। নিসন্দেহে ওয়াশরুমে গেছে। রাহি বিছানায় বসে সামনের টেবিলের উপর আদ্রিয়ানের ফোন রাখা দেখতে পেলো। আগে প্রায় ফোন চেক করতো রাহি ভাবতেই হাসি পেলো তার। মিথ্যা মিথ্যা দূরত্ব গড়তে গিয়ে আজকাল সত্যি দূরে সরে গেছে মেয়েটা। আদ্রিয়ানের অবহেলা আগের মতো আর কষ্ট দেয় না তাঁকে। তবুও কী ভেবে রাহি বসা থেকে উঠে ওয়াশরুমের দিকে এগোতে চাইলেই তার নজর আঁটকে গেলো ফোনের নিচে রাখা একটা কাগজের দিকে। রাহির মনে খচখচ করছে, ফোনের নিচে কীসের কাগজ! আদ্রিয়ানের অনুপস্থিতিতেই ফোনের নিচে রাখা কাগজটা খুলে দেখতে লাগলো রাহি। প্রথমে একটা ধাক্কা লাগলো বুকে কিন্তু তারপর মনকে বুঝালো রাহি। ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটালেও চোখের কোণে টলমল করছে জল। অবশেষে বিচ্ছেদ! মিহি তো বলেছিল আদ্রিয়ান তার মূল্য বুঝবে,কিন্তু তা আর হলো কই! দরজার শব্দে চোখের জল লুকিয়ে ফেললো রাহি। আদ্রিয়ানকে কিছুতেই বুঝতে দিবে না তার সাথে বিচ্ছেদ হবে ভেবে কষ্ট হচ্ছে রাহির। তড়িৎ গতিতে রাহি মেইন দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করার ভান করলো। যেনো মাত্র ঘরে ঢুকেছে সে। রাহিকে দেখে আদ্রিয়ান নিজে থেকেই কথা বলতে শুরু করলো,
” ভালো হয়েছে তুমি এসেছো। একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার জন্য বাসায় এসেছি। ”
“হ্যাঁ বলো।”
আদ্রিয়ান ফোনের নিচ থেকে ডিভোর্স পেপারটা বের করে রাহির হাতে দিয়ে বললো,
” আমাদের ডিভোর্স পেপার। আশা করি কোনো ঝামেলা ছাড়া সবকিছু মিটে যাবে। ”
রাহি ভাবলেশহীনভাবে বললো,
” ভালোই করছো আমিও কাল বিকেলে বাবার বাড়ি চলে যাচ্ছি। সবকিছু চুকিয়ে গেলে আমারও ভালো হয়।”
কাঙ্খিত জিনিস পাবে শুনেও ভেতর ভেতর কেমন জানি খুশি হতে পারলো না আদ্রিয়ান। রাহিও ডিভোর্স চাচ্ছিলো!
” ওহ আচ্ছা। ঠিক আছে ভালো থেকো তাহলে। সাইন করে পাঠিয়ে দিও না হয়।”
” হ্যাঁ বাসায় গিয়ে সাইন করবো,বাবা-মায়ের সামনে। নইলে উনারা বিশ্বাস করবেন না আমি আর তোমার সাথে সত্যি থাকতে চাই না। ”
আদ্রিয়ানের ফের অস্বস্তি হচ্ছে। রাহি তাকে ডিভোর্স দিতে চাচ্ছিলো! আদ্রিয়ান তো নিজেই ডিভোর্স দিবে বলে ভেবেছিলো।
” ঠিক আছে। খেয়েছো না হলে এসো শেষ বারের মতো একসাথে খাবো।”
” ধন্যবাদ আদ্রিয়ান। সেটার দরকার নেই আমি ইতিমধ্যে খেয়ে নিয়েছি। তুমি বরং খেয়ে নাও, খাবার ঢেকে রাখা আছে। ”
আদ্রিয়ান মাথা নেড়ে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। রাহি ফ্লোরে বসে পড়েছে। অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব হচ্ছে বুকের ভেতর। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কান্না করতে।
ভোরের আলো ফুটেছে। হেমন্তে বিদায় নেয়নি এখনও তবুও প্রকৃতিতে এরমধ্যেই হালকা শীতের আমেজ এসে গেছে। গ্রামাঞ্চলে মোটামুটি ভালোই ঠান্ডা লাগে। বিশেষ করে উত্তর অঞ্চলে। কিন্তু ঢাকা শহরে কোনো পরিবর্তন নেই। মজার কথা শীতের সময়ও ঢাকায় তেমন শীত পড়ে না। কিন্তু তবুও রহিম চাচা খুব স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ। এখনই তিনি চাদর, টুপি ও মোজা ব্যবহার করেন। তবে বিষয়টা শুধু নিজে পরা নিয়ে নয়, তিনি রুদ্রকেও শীতের পোশাক পরার জন্য বলেন। তাতেই বাঁধে যত বিপত্তি। রুদ্র মোটেই এসব ভারী পোশাক পরতে পছন্দ করে না।
” চাচা কতবার বলবো আপনার মতো ঠান্ডা আমার লাগে না। আর এখনও শীতের পোশাক পরার মতো ঠান্ডা আসেনি।”
ডাইনিং টেবিলে বসে খেতে খেতে বললো রুদ্র। পরনে তার কালো শার্ট। বারবার চুল কাটাতে অসহ্য লাগে বলে চুলগুলো যতটা সম্ভব ছোটো করে ছেঁটেছে গতকাল। রহিম চাচা নিজের চিন্তা ভাবনা সঠিক প্রমাণ করার জন্য বললো,
” তোমারে কে কইছে ঠান্ডা পড়েনাই? পাশের বাসার সাদাতও তো জ্যাকেট পরে ঘোরে। ”
” সাদাত পরে কারণ ওর শীত লাগে বলে আমার তো লাগে না চাচা! আমার সময় নেই তর্ক করার আসছি আমি। ”
রুদ্র অর্ধেক খাবার ফেলে রেখেই হসপিটালের দিকে ছুটলো।

রাহি বাবার বাড়ি চলে গেছে সপ্তাখানেক হবে। মিহির এজন্য খুব মন খারাপ লাগে। যদিও ফোনে প্রায় কথাবার্তা হয় তবুও মিস করে। আদ্রিয়ানের দিনকাল ভালো কাটার কথা থাকলেও যেমনটা চেয়েছিল তেমন ভালো কাটছে না। তোশার সাথে এরমধ্যে একবার ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেছিল কিন্তু দরজা বন্ধ করতেই কেনো জানি রাহির হাসি হাসি মুখের অবয়ব ভেসে উঠেছিল তার চোখের সামনে। ব্যাস সেখান থেকে বেরিয়ে যায় আদ্রিয়ান। ফলে তোশা আদ্রিয়ানের উপর আরো রেগে গেছে। রাহিকে যে কারণে অসহ্য লাগতো তোশার সাথে মেশার পরে বুঝেছে তোশা তারচে বেশি অসহ্য। আসলে মানুষ চাইলেও সুখী হতে পারে না যদি না সৃষ্টিকর্তা চান।

চলবে,

মনেরও গোপনে পর্ব-০৪

0

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_৪

(মুক্তমানদের জন্য উন্মুক্ত)
” আসলে অতিরিক্ত ভালোবাসে ভাবি তোমাকে। হয়তো তোমার দিক থেকেও কিছু খামতি আছে। নয়তো অহেতুক সন্দেহ কেনো করবে বলো? আর কাজিনের সাথে দেখা করাই দোষ কোথায়!”

” আমার কী খামতি আছে রাহাত? আর তোশাকে ঠিক পছন্দ করে না রাহি। কারণ তোশা আমাকে পছন্দ করে কলেজ লাইফ থেকেই। ”
” আদ্রিয়ান তুমি যথেষ্ট বুঝো। নারী তার পছন্দের পুরুষকে কারো সাথে ভাগ করতে পারে না। হ্যাঁ তুমি বলবে তোশা তো তোমাকে নিয়ে যায়নি কিংবা তুমিও তোশার সাথে থাকোনি,কিন্তু যে নারী তার স্বামীকে পেতে চায় সেই নারীর উপস্থিতি অবশ্যই একজন স্ত্রীর কাছে অপছন্দের বিষয়। এসব তুমি ফিল করতে পারছো না এটাই তোমার খামতি।”
রাহাতের কথাবার্তা বিরক্ত লাগছে আদ্রিয়ানের। এতটুকু বুঝে গেছে রাহাত আগাগোড়াই বউ পাগলা হয়ে গেছে। তাই কথা আর বাড়াবে না বলে প্রসঙ্গ বদলাতে চেষ্টা করলো। কী কথা বলা যায় ভাবতেই দুপুরের খাবারের কথা মনে পড়লো।
” আচ্ছা এসব পরে আলোচনা করা যাবে, চলো খেয়ে আসি। ”
” তুমি যাও, আমি তো অলরেডি খেয়েছি বললাম না? ”
” ঠিক আছে থাকো তুমি, আমি আসছি।”
আদ্রিয়ান রুম থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেলো সাথে রাহাতও। মুখে না বললেও আদ্রিয়ান যে রাহাতের কথোপকথনে বিরক্ত হচ্ছিল সেটা বেশ বুঝতে পেরেছে রাহাত।

” আদ্রিয়ান কী আজ বাসায় খাবে না রাহি? বেলা তো অনেক হলো এখনো তো ফিরলো না।”
সালমান খুরশিদ দুপুরের খাবার খেতে খেতে রাহিকে প্রশ্ন করলেন। রাহি টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল কিছু প্রয়োজন হলে দিবে বলে।
” আমি তো জানি না বাবা। কল দিয়ে কিছু জানায়নি আমি দিলে কেটে দিচ্ছে। ”
“ছেলেটা কেমন হয়ে যাচ্ছে আজকাল। সবকিছুই কপাল।”
রিনা বেগম উপরোক্ত কথাটি বলে চেয়ারে বসলেন। মিহিও বাসায় ফিরে গোসল সেরে খেতে বসেছে। সত্যি বলতে ভাইয়ের পরিবর্তন তার চোখেও পড়েছে। শুধু কী এসব? রাহির সাথে করা খারাপ আচরণগুলোও মিহির চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। আর মায়ের শেষ কথাটাও যে কাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন সেটাও অজানা নয় মিহির।
” মা সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। ভাবি তুমিও একসাথে খেতে বসে যাও, ভাইয়া হয়তো আজ আসবে না দুপুরে। ”
রাহি মিহির কথায় মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। সবাই খাওয়াদাওয়ায় ব্যস্ত আপাতত। রাহি শুধু প্লেটের মধ্যে আঙুল ঘুরিয়ে যাচ্ছে। রাহি না চাইতেও দু-চোখ কেমন ঝাপসা হয়ে গেছে। মিহি একবার তাকালো রাহির দিকে। তারপর আবারও খাবারের দিকে মনোযোগ দিলো। একমাত্র বিকেলবেলা কোনো কাজ থাকে না রাহির। রাতে আবার রান্না করতে হয়। তাই দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পরে মিহি এসেছে রাহির ঘরে। পাশাপাশি ঘর হওয়ায় রিনা বেগমের চোখের আড়ালেই সব আলোচনা করা যাবে বলে মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলো মিহি। বিছানায় মুখোমুখি বসে আছে মিহি আর রাহি। বয়সে রাহির থেকে তিন-চার বছরের ছোটো মিহি। কিন্তু তবুও তুমি করেই সম্মোধন করে রাহিকে।
” ভাবি আসলে আমি প্রতিদিন রাতে শুনি তোমাদের ঝামেলা হয়। জানি এসব তোমাদের একান্ত নিজস্ব ব্যাপার তবুও কেনো জানি মনে হচ্ছে এটা নিছক মান-অভিমান কিংবা রাগ নয়,ঝামেলা তারচে বেশি।”
মিহির কথায় একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো রাহির। ঠোঁটের কোণে ম্লান হাসির রেখা ফুটিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে রাহি বললো,
” আসলে তোমার ভাইয়ের মন মানসিকতা ইদানীং খারাপ থাকে। হয়তো অফিসে কোনো ঝামেলা হচ্ছে আজকাল এজন্যই। ”
” আসলেই কী তাই ভাবি?”
এবার আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলোনা রাহি। বাচ্চাদের মতো হুহু করে কেঁদে উঠলো মিহিকে জড়িয়ে ধরে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেছে মিহি। বুকের ভেতর কতটা কষ্ট লুকিয়ে রাখতে পারে এই মেয়েটা সেটা তার কান্না দেখেই বুঝলো মিহি। কিছুক্ষণ কাঁদার পরে নিজেকে সামলে নিলো রাহি। অনেক দিনের কষ্ট কিছুটা হলেও নোনাজলের মধ্যে দিয়ে হালকা হবে বলেই মিহিও চুপ করে ছিল এতক্ষণ।
” কয়েকমাস ধরে তোমার ভাইকে ভালো কিংবা খারাপ যে প্রশ্নই করি তাতেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে। যার ফলে আমার মনেও সন্দেহ দানা বেঁধে গিয়েছিল। তাই আমি ফেইসবুক থেকে শুরু করে মেসেঞ্জার,হোয়াটসঅ্যাপ সবকিছুর উপর নজর রাখতাম। বাসায় ফিরলেও মাঝে মধ্যে সন্দেহবশত প্রশ্ন করে ফেলি। তা নিয়ে আদ্রিয়ান আরো রাগ করে। ও যদি আমাকে বুঝিয়ে বলে তবে কিন্তু আমি মনকে সান্ত্বনা দিতে পারতাম বলো?”
মিহি ভালো শ্রোতার মতো নিঃশব্দে সবকিছু শুনে যাচ্ছে। রাহি আবারও নিজের কথার খেই ধরলো।
” শুধু রাগ করলে একটা বিষয় কিন্তু… ”
” কিন্তু কী ভাবি?”
” আগে প্রতিদিন জড়িয়ে ঘুমাতাম কিন্তু ইদানীং গায়ে হাত লাগলেও ফুঁসে ওঠে। অন্য কিছু তো বাদ।”
রাহি বেশ ইতস্ততভাবে বললো। মিহি বুঝলো ভাবির কথার গভীরতা। আদ্রিয়ান রাহিকে শরীর ও মন সবদিক থেকেই দূরে সরিয়ে দিয়েছে।
” ভাবি ধৈর্য ধরো আগে। আমার নিজের ভালোবাসার কিংবা প্রেমের অভিজ্ঞতা না থাকলেও একটা জিনিস খুব ভালো করে জানি।”
” কী?”
রাহি মিহিকে বিস্ময় ভরা চোখে প্রশ্ন করে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মিহি আস্তে আস্তে বললো,
” শোনো ভাবি, মানুষের স্বভাব হচ্ছে খুব সহজে কিছু পেয়ে গেলে সেটার যথাযথ মূল্য সে দিতে পারে না কিংবা দেয় না। এমনকি সেটা হিরা কিংবা সোনা হলেও কয়লা ভাবে। সব সম্পর্কেই আসলে নির্দিষ্ট একটা স্পেস রাখা দরকার। কিন্তু আমরা সেটা পারি না। ভালোবাসলে একেবারে মনপ্রাণ দিয়ে বেহিসাবি ভালোবাসি। ফলে বিপরীত পাশের মানুষটা একেবারে গ্রান্টেড ধরে নেয়। সে বুঝে ফেলে এই মানুষটাকে যতই অবহেলা করি না কেন, আমাকে কখনোই ছেড়ে যাবে না। তাই ভালোবাসার ক্ষেত্রেও টেইক এন্ড গিভ পলিসি নীতি দরকার। সে যতটা ভালোবাসা দিচ্ছে ঠিক ততটুকুই দিতে হবে।”

মিহির কথাগুলো খুব মন দিয়ে শুনলো রাহি। কথা সে ভুল বলেনি। একটা সময় ছিল যখন আদ্রিয়ান রাহিকে পাগলের মতোই ভালোবাসতো। কিন্তু তখন রাহি এখনকার মতো এতটা ভালোবাসতো না আদ্রিয়ানকে। কিন্তু যখনই রাহি আদ্রিয়ানের প্রতি অধিক দূর্বল হয়ে গেলো তখনই আদ্রিয়ান এরকম শুরু করলো।
” কিন্তু মিহি আমি তো তোমার ভাইয়ের স্ত্রী, প্রেমিকা তো নই। ”
” এটা বউ কিংবা প্রেমিকার বিষয় না। নিজের ব্যক্তিত্ব এবং আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে কখনো কাউকে ভালোবাসতে নেই। তবে সে যদি তোমাকে যথাযথ ভালোবাসে তাহলে কখনোই তোমাকে নিজের স্বত্বা ত্যাগ করতে দিবে না। তুমি ভাইয়াকে একেবারে নিজের মতো করে ছেড়ে দাও। এমন ভাব দেখাও যাতে মনে হয় ওর অবহেলা কিংবা রাগে তোমার কিছু যায় আসে না। ”
” আমি পারবো মিহি?”
” অবশ্যই পারবে। সবচেয়ে ভালো হয় যদি বাবার বাড়ি চলে যাও। চোখের আড়ালে গেলে তোমার শূণ্যতা ফিল করবে। ”
” তাহলে কাল চলে যাবো ও বাড়ি।”
” না ভাবি। চার-পাঁচ দিন পর যাবে তবে এই ক’দিন একেবারে ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখাবা। তুমি তোমার মতো সময় কাটাবে। ওর সাথে নিজে থেকে অপ্রয়োজনীয় কোনো কথা বলবে না বুঝেছো?”
” হ্যাঁ বুঝেছি। মিহি তুমি আমার বড়ো বোনের মতো উপদেশ দিলে,তোমার কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই বোন।”
রাহি মিহির দু-হাত ধরে আবেগে আপ্লূত হয়ে বললো। মিহি হেসে বললো,
” বড়ো বোন না হলেও ছোটো বোন তো বটেই তাই না?”
এবার রাহিও মিহির সাথে হাসলো আর মনে মনে আসন্ন পরীক্ষার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করবে বলে সিন্ধান্ত নিলো। আদ্রিয়ানের থেকে দূরে থাকা রাহির জন্য পরীক্ষাই বটে!

সারাদিনের কর্মব্যস্ততা শেষে নিজের বাসায় ফিরেছে রুদ্র চৌধুরী। কিন্তু রাতেও বাসায় ফিরতে বিশেষ ভালো লাগে না তার। কারণ বাড়িতে সে, রহমান চাচা ছাড়া আর কোনো তৃতীয় মানুষ নেই। রহমান চাচাকে রান্নাবান্না করার জন্য গত দু’বছর আগে রেখেছিলো রুদ্র। অবশ্য রহমান চাচা প্রায় বিয়ের কথা বলেন আজকাল। কিন্তু রুদ্রর তেমন টনক নড়ে না সে কথায়। বিয়ে নিয়ে এ জীবনে কোনো চিন্তা ভাবনা নেই তার।
” চাচা বাড়ি এরকম অন্ধকার কেনো? আপনি কোথায়!”
বাড়িতে ঢুকেই সবকিছু অন্ধকার দেখে কিছুটা বিস্ময় নিয়ে নিজের রুমে গিয়েছিল। ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বেলে জামাকাপড় পরিবর্তন করে বসার ঘরে এসে রহমান চাচাকে ডাকছে এখন। রহমান চাচা রান্নাঘর থেকে একটা মোমবাতি নিয়ে বসার ঘরে এসে দাঁড়িয়ে হতাশ কন্ঠে বললো,
” আর বইলো না রুদ্র বাবা,কারেন্টে যে কী এক লোডশেডিং লাগাইয়া রাখছে আইজকাল। ”
রহমান চাচার কথায় মুচকি হাসলো রুদ্র। বেচারা রহমান চাচার অন্ধকারে রান্না করতে বেশ ঝামেলা হয়েছে। কপাল ভালো সিলেন্ডার গ্যাস সরবরাহ আছে বাসায়। লাইনের গ্যাসের আগুনের তো ভরসা নেই ঢাকা শহরের।
” বুঝতে পেরেছি চাচা। চলুন আমি আপনাকে রান্নায় সাহায্য করছি।”
” হ চলো তাইলে মোমবাতিটা উঁচু করে ধরবে আরকি। কত কইরা বলি তোমাকে একটা বিয়ে করো এখন, তুমি তো কথাই শোনো না আমার। ”
রুদ্র নিঃশব্দে হেসে জবাবে বলে,
” এখন একটা বিয়ে করবো চাচা? তারমানে পরে কি আরো কয়েকটা বিয়ে করতে পারবো? ”
রুদ্রর এহেন কথাবার্তার দরুন রহমান চাচা সশব্দে হেসে উঠলেন। রান্নাঘরের দিকে এগোতে এগোতে বললেন,
” তুমি আর বদলাবে না। ”
রুদ্রও রহমান চাচাকে অনুসরণ করে রান্নাঘরে পৌছুলো। মোমবাতির বদলে ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বেলে চাচার দিকে ধরলো। হঠাৎ চোখমুখ বদলে গেছে রুদ্রর। মলিনতাহীন চেহারা নিয়ে জোর করে হাসার চেষ্টা করে বললো,
” আমি বদলাতে চাই না চাচা। কারণ মানুষ মারা গেলে সহ্য করা যায় কিন্তু বদলে গেলে ভীষণ কষ্ট হয়। ”
মুহুর্তেই দুজনের মধ্যে পিনপতন নীরবতা ছেয়ে গেলো। রহমান চাচা নিজের মতো করে তরকারি কেটেকুটে রাঁধছেন আর রুদ্র আলো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। রহমান চাচা এ বাড়িতে দু’বছর হলো এসেছেন ঠিক তবুও রুদ্রর জীবনের কোনো কথাই অজানা নয় তার। না চাইতেও পুরনো ঘায়ে খোঁচা দিয়ে দিলেন রহমান চাচা। ভাবতেই ভদ্রলোক আরো নিশ্চুপ হয়ে কাজ করতে লাগলেন।

ইদানীং আদ্রিয়ান একটু রাতে করে বাসায় ফেরে। সবার খাওয়াদাওয়া হয়ে গেলেও আদ্রিয়ানের জন্য রাহি না খেয়ে অপেক্ষা করতো। কিন্তু আজ বাসায় ঢুকে রাহিকে ডাইনিং টেবিলে বসে থাকতে না দেখে একটু অবাক হলো আদ্রিয়ান। ভাবলো অসুস্থ হলো না তো মেয়েটা? এসব ভাবতে ভাবতে নিজের ঘরে গেলো সে। কিন্তু ঘরে গিয়ে দেখলো রাহি দিব্যি ফোন নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে ব্যস্ত। যাক তাহলে ঠিক আছে সব! আলমারি থেকে টি-শার্ট আর লুঙ্গি বের করে ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে চলে গেলো তারপর আদ্রিয়ান। কিন্তু রাহি কেনো আজ জামাকাপড়গুলো বের করে এগিয়ে দিলো না বুঝতে পারছে না।
” ওহ আচ্ছা। তা কবে দেখা করবি বল।”

ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে রাহিকে ফোনে কথা বলতে দেখলো আদ্রিয়ান। কিন্তু সেদিকে বিশেষ খেয়াল না করে ডাইনিং টেবিলে খাওয়ার উদ্দেশ্য এগোলো। অদ্ভুত বিষয় রাহি তবুও ফোনে কথা বলেই যাচ্ছে, মোটেই আদ্রিয়ানের সাথে গেলো না!

চলবে,

মনেরও গোপনে পর্ব-০৩

0

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_৩
(মুক্তমানদের জন্য উন্মুক্ত)

অতটুকু সময়ে কারো স্পর্শ আদৌও অনুভব করা যায় বলে ভাবতেও অদ্ভুত শোনাবে। তবুও এটা সত্যি মিহির কাছে। মানুষটাকে কী কখনো খুঁজে পাবে? নাহ সেটার সম্ভাবনা একেবারে শূন্য। একটা ছাতার সাহায্যে ঢাকা শহরে কাউকে খুঁজে পাওয়া খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজার মতোই।

ভোরের আলো ফুটেছে। ফোনের এলার্মের আওয়াজে ঘুম ভেঙেছে মিহির। যেদিন যেদিন সকালে ক্লাস থাকে সেদিন ফোনে এলার্ম সেট করে রাখে। মিহি ঘুম ঘুম চোখে ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে দেখলো এরমধ্যেই ন’টা বেজেছে। তারমানে অনেকক্ষণ ধরে এলার্ম বেজে যাচ্ছিল। কিন্তু ঘুমের জন্য সেটা টের পায়নি মিহি। ভাবতেই বিছানা ছেড়ে তড়িঘড়ি করে উঠলো সে। খুব দ্রুত চোখমুখে পানির ছিটিয়ে রেডি হয়ে নিলো। আজকে একেবারে কালো একটা থ্রি-পিস পরেছে মিহি। সাথে কানে ছোটো ঝুমকো, চোখে কাজল, কপালে ছোট্ট কালো টিপ সাথে খোলা চুল। কোনো প্রকার সাজগোছ একেবারে অপছন্দ মিহির। সাজগোজের মধ্যে কাজল আর টিপ, মুখে কোনো প্রকার মেকআপ করে না। । আর বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানে গেলে তখন হালকা লিপস্টিক ব্যবহার করে।
” মিহি তোর না আজ ক্লাস আছে! বের হবি কখন? ”
ডাইনিং রুম থেকে মায়ের গলার আওয়াজে কিছুটা ব্যস্ত হয়ে নিজের রুম থেকে বেরুলো মিহি। ডাইনিং টেবিলে বসে আছে আদ্রিয়ান ও সালমান খুরশিদ। রিনা বেগম দাঁড়িয়ে রাহিকে কী জানি বলছেন। মিহির এখন অতকিছু খেয়াল করার সময় নেই। তাই তাড়াহুড়ো করে নাস্তা না করেই বেরোনোর সিন্ধান্ত নিলো।
” মিহি খেয়ে যাও।”
” ভাবি সময় নেই এখন,ক্যান্টিনে গিয়ে খেয়ে নিবো।”
মিহি বেরিয়ে গেলো কিন্তু রিনা বেগম সেদিকে খেয়াল করলেন না কারণ তিনি যথেষ্ট বিরক্ত হয়ে গেছেন। রাহির সাথে নাতি-নাতনীর বিষয় প্রায় কথা বলেন তিনি। একটু আগেও জিজ্ঞেস করেছিলেন কোনো খবর আছে কি-না। কিন্তু রাহি বরাবরের মতোই বলেছে, ‘না’। ব্যাস তাতেই বিরক্ত হলেন রিনা বেগম। আসলে আদ্রিয়ানকে বেশ কয়েকবার বলেছিলো রাহি কিন্তু আদ্রিয়ান বলেছে আরো পরে। কিন্তু সেই কথা শ্বাশুড়িকে বললেও তিনি তবুও রাহিকেই কথা শোনান। অদ্ভুত দুনিয়া! ছেলের না বলাতেও পুত্রবধূর কথা শুনতে হয়।

হসপিটালের করিডরে বসে অপেক্ষা করছেন আতিক রহমান। ডক্টরের চেম্বারে ঢুকেছে তার ছোটো ছেলে নয়ন। বয়স মাত্র আঠারো তার। কিন্তু এরমধ্যেই হৃদপিণ্ডে তার বেঁধেছে অসুখ। স্বাস্থ্য ভালো হওয়ার কারণে বোধহয় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছে ছেলেটা। ডক্টরের চেম্বারের দিকে তাকিয়ে অস্থির হয়ে আছেন আতিক রহমান। এখনো কেনো ছেলেটা বেরুলো না ভাবতে ভাবতে চোখ গেলো দরজার উপর ডাক্তারের নেমপ্লেটের ছবির দিকে। বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা ” ডাক্তার রুদ্র চৌধুরী “। বিরক্ত লাগলো আতিকের, নামটার দিক থেকে নজর সরিয়ে আবারও করিডোরে হাঁটতে শুরু করলো। ডাক্তারের চেম্বারে রোগী ছাড়া আর কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না এখানে। অবশ্য রোগী যদি খুব অসুস্থ থাকে সেক্ষেত্রে আলাদা বিষয়।
” আপনি নয়নের বাবা? ”
হঠাৎ কারো কথায় পায়চারি থামিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে সামনে এগোলেন আতিক রহমান। ডাক্তারের সহকারী শরীফ ডেকেছেন তাকে।
” হ্যাঁ। ঠিক আছে নয়ন?”
” হ্যাঁ। আপনি ভেতরে আসুন, স্যার আপনার সাথে কথা বলবেন। ”
আতিক আর কথা না বাড়িয়ে শরীফের সাথে ডাক্তারের চেম্বারে প্রবেশ করলেন। নয়ন এখন বসে আছে ডাক্তার রুদ্র চৌধুরীর সামনের চেয়ারে। ডাক্তার রুদ্র দাঁড়িয়ে একটা ইসিজির রিপোর্ট দেখতে ব্যস্ত তখনও। নয়নের বাবাকে দেখে ইসিজির রিপোর্ট টেবিলে রেখে নিজের চেয়ারে বসলো রুদ্র। সাদা রঙের শার্টের সাথে জিন্সের প্যান্ট পরনে তার,চোখে একটা চশমা।
” নয়নের পাশের চেয়ারে বসুন।”
আতিক রহমান নিঃশব্দে ছেলের পাশে বসে হাতে হাত রেখে কিছুটা ভরসা দিলো। নয়নের চোখমুখ শুকনো হয়ে গেছে। চিন্তার ভাজ পড়েছে কপালের রেখায়। বয়স মাত্র আঠারো এখুনি খারাপ কিছু ঘটে যাবে কি-না এ কথা ভাবতেই আঁতকে ওঠে নয়ন। সবাই এ পৃথিবীতে বাঁচতে চায়। যে মানুষটা নিজের দুঃখকষ্ট সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার মতো কঠিন কাজ করতে যায়, সেই মানুষটাও কিন্তু দম বন্ধ হওয়ার আগে বাঁচার আকুতি জানায়।

” জি ডক্টর রুদ্র বলুন,নয়নের এখন কী অবস্থা? কোনো বড়সড় কিছু হয়নি তো?”
” গত সপ্তাহে তো পইপই করে বলে দিয়েছিলাম আপনাকে কোনো ধরনের মশলাযুক্ত খাবার নয়নকে খেতে দিবেন না। কিন্তু রিপোর্ট দেখে মনে হচ্ছে কোনো বিধিনিষেধ মেনে চলেনি ও।”
রুদ্রর কথা শুনে বাপ-বেটা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো একবার। নয়ন বাবার চোখের দিকে আর তাকালো না। আসলে নয়ন বাড়িতে এ ধরনের কোনো খাবার খায়নি কিন্তু বাইরে বন্ধুদের সাথে বারকয়েক খেয়ছিল। নয়নের মাথা নত থাকতে দেখে আতিক রহমান বেশ বুঝলেন ছেলের মনের কথা।
” ডক্টর ও ছেলেমানুষ, হয়তো বাইরে গিয়ে খেয়েছে মশলাযুক্ত খাবার-দাবার। প্লিজ আপনি কিছু করুন!”
রুদ্র একটু নড়েচড়ে বসলো তারপর গম্ভীর স্বরে বললো,
” আমি হার্ট স্পেশালিষ্ট এটা ঠিক কিন্তু নিয়ম না মেনে কেউ মৃত্যুর পথে ধাবিত হলেও যে তাকে বাঁচিয়ে ফেলবো এই শক্তি আমার নেই। আশা করি ভবিষ্যতে সকল নিয়মকানুন মেনে চলবে আপনার ছেলে। নিয়মমাফিক জীবনযাপন করলে ইনশাআল্লাহ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে।”
” স্যার আমি এরপর সব নিয়ম মেনেই চলবো সাথে নিয়মিত ঔষধ খাবো।”
” দ্যাটস লাইক এ গুড বয়। আচ্ছা আসুন তাহলে মি.আতিক।”
” থ্যাংকস ডক্টর রুদ্র। ”
” ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম। ”
আতিক রহমান নিজের ছেলেকে নিয়ে চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেলেন। শরীফ রুদ্রর একপাশে প্রভুভক্ত পোষা প্রাণীর মতো দাঁড়িয়ে আছে। আসলে শরীফের পারিবারিক অবস্থা খুব খারাপ। সাহায্য করার জন্যই নিজের চেম্বারে সাথে থাকার চাকরিটা দিয়েছিল রুদ্র।
” ভাইয়া দু’টো তো বেজে গেলো, খাবার কি নিয়ে আসবো? না-কি ক্যানটিনে গিয়ে খাবেন? ”
” নিয়ে আসো একসাথে খাবো এখানে বসেই।”
শরীফ গেলো রুদ্র ও নিজের জন্য খাবার আনতে। রুদ্র এমনিতে কিছুটা রাগী হলেও সব সময় হাসিখুশি থাকতে পছন্দ করে। তবে সহজে রাগে না সে,কিন্তু রাগলে সামাল দেওয়া মুশকিল। শরীফ রুদ্রকে ভাইয়া বলেই সম্বোধন করে। রুদ্র কখনো তার সাথে কর্মচারীর মতো আচরণ করেনা।

ক্লাস শেষে কয়েকজন বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে ক্যাম্পাসের মধ্যে বসে আছে মিহি। ক্লাস শেষে সব সময়ই এরকম আড্ডা চলে কিছুক্ষণ। আড্ডার টপিক থাকে কার ব্রেকআপ হলো কিংবা কে নতুন প্রেমে পড়লো আবার কোন কোন কোন বান্ধবীর বিয়ে করে জীবন অতিষ্ঠ হলো!
” তোদের কি খেয়েদেয়ে আর কোনো কাজ নেই? সব সময় প্রেম-বিয়ে নিয়ে কথা বলিস। যেনো পৃথিবীতে আর কিছু নেই।”
কিছুটা মুখ ঝামটি দিয়ে বললো মিহি। কিন্তু মিহির কথায় সবাই সশব্দে হেসে উঠলো। এতে মিহি আরো কিছুটা ক্ষেপে গেলো বটে। কিন্তু কিচ্ছুটি বললো না।
” তো কী নিয়ে আড্ডা দিতে চাস তুই? সবাই কি তোমরা মতো প্রেম-বিয়ে না করে সন্ন্যাসী হবে! ”
অনিক হাসতে হাসতে বললো মিহিকে। মিহি চুপ করে রইলো। পাশ থেকে এই ফাঁকে সুনয়না বলে উঠে,
” আহা সন্ন্যাসী হবে কেনো? আমাদের মিহিও একদিন প্রেমে পড়বে দেখিস। ”
” না রে আমার প্রেম পিরীতি করার ইচ্ছে নেই। লেখাপড়া শেষ করে একটা চাকরি করবো এতটুকুই।”
” হয়েছে হয়েছে। এখন চল বাসায় ফিরতে হবে তো!”
অহনা মিহির হাত ধরে নাড়া দিয়ে বললো। মিহিও এতক্ষণে ফোনের স্ক্রিনে তাকালো সময় দেখার জন্য। আসলেই দেরি হয়ে গেছে। মিহি আর অহনা আড্ডা থেকে বিদায় নিয়ে বাসার উদ্দেশ্য রওনা দিলো।
এদিকে সকালের কথাবার্তার পরে রাহির শ্বাশুড়ি আরো কোনো কথা বলেনি রাহির সাথে। মনে হচ্ছে রাহি বড়সড় কোনো অপরাধ করে ফেলেছে। দুপুরের রান্নাবান্না শেষে সব কাজ গুছিয়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা আঁটকে বসে আছে রাহি। কেনো জানি সবকিছু কেমন বিষাক্ত লাগছে। একদিকে আদ্রিয়ানের অবহেলা অন্য দিকে রিনা বেগমের ওরকম ব্যবহার। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বসা থেকে উঠে গোসল করতে গেলো রাহি,গোসল করলে কিছুটা হলেও ফ্রেশ লাগবে এই আশায়। কিন্তু সত্যি কথা হলো যতক্ষণ চেতনা থাকে ততক্ষণই দুশ্চিন্তা ঘিরে থাকে রাহিকে। বাবা-মা’র কাছে কিছু বলা সম্ভব নয় আর বলেও বা কী হবে? রাহি কিছুতেই আদ্রিয়ানকে ছেড়ে থাকতে পারবে না। মানুষ যখন নিজের চেয়েও অন্য কাউকে বেশি ভালোবেসে ফেলে তখন নিজের অস্তিত্ব ত্যাগ করে হলেও তার সাথে থাকতে চায়। তখন আর কোনো আত্মসম্মান পর্যন্ত কাজ করে না।

” কী হলো? আজ বাসায় ফিরবে না আদ্রিয়ান! ”
অফিসে নিজের রুমেই বসে ছিল। এমন সময় আদ্রিয়ানের সহকর্মী রাহাত উপস্থিত হলো সেখানে। তাই রাহাতকে দেখে কিছুটা নড়েচড়ে উঠলো সে। অফিসে কয়েকজনের সাথে আদ্রিয়ানের খুব ভালো সম্পর্ক। রাহাতও তাদের মধ্যে থেকে একজন।
” না আসলে বাইরে খেয়ে নিবো ভাবছি। তুমি? ”
” আমি বাসা থেকে খাবার নিয়ে এসেছিলাম।খেয়ে বাইরে বেরুলাম তখনই তোমার ছায়া দেখলাম বাইরে থেকে। ”
” বসো তাহলে। ”
” না তুমি বরং খেয়ে আসো। আর হ্যাঁ তোমার চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে কিছু নিয়ে চিন্তা করছো!”
” তুমি তো জানোই ইদানীং রাহিকে অসহ্য লাগে খুব। ডিভোর্সের কথা মুখ ফুটে বলতেই পারছিনা।”
” এসব কী বলছো? সংসারে ঝামেলা হয়, অশান্তি হয়। তাই বলে ডিভোর্স! শোনো সব ক্ষেত্রেই ভালো-খারাপ দুটোই থাকে। দরকার হলে কয়েকদিন দূরে থাকো। ভাবিকে বরং তার বাবার বাড়ি পাঠাও। কয়েকদিন পরে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। ”
” না রাহাত, বিষয়টা তেমন নয়। ওর অতিরিক্ত সন্দেহে অতিষ্ট আমি। আমার জাস্ট কিছু ভাবতেই ইচ্ছে করে না শুধু ওর থেকে মুক্তি চাই।”
রাহাত বুঝলো আদ্রিয়ানের মনে রাহির প্রতি চরম বিরক্তি এসেছে।
” ভাবি যেসব বিষয় নিয়ে সন্দেহ করে সেসব বিষয় বুঝিয়ে বলেছো কখনো? ”
” কী বোঝাবো বলো? আমি ওর জন্য ফেইসবুকে কারো পোস্টে কমেন্ট করতে পর্যন্ত পারি না। ওর কাছে কিন্তু পাসওয়ার্ড পর্যন্ত আছে তবু। শুনলে মনে হয় নিব্বা নিব্বির প্রেমের কথা। সেদিন তোশার সাথে মানে আমার কাজিনের সাথে দেখা করতে গেলাম পরে বাসায় যেতেই শুধালো লেডিস পারফিউমের সুভাস কেনো আসে? রাহি ঝামেলা করবে বলে তোশার সাথে দেখা করার বিষয়টা পর্যন্ত এড়িয়ে গেছিলাম। এরকম কত কথা আছে তার হিসাব নাই। বলতেও ইচ্ছে করে না ভাই। ”

” আসলে অতিরিক্ত ভালোবাসে ভাবি তোমাকে। হয়তো তোমার দিক থেকেও কিছু খামতি আছে। নয়তো অহেতুক সন্দেহ কেনো করবে বলো? আর কাজিনের সাথে দেখা করাই দোষ কোথায়!”

চলবে,

মনেরও গোপনে পর্ব-০২

0

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_২
(মুক্তমানদের জন্য উন্মুক্ত)

” ওকে। তাহলে রুদ্র গান ধর এবার। মেরে ম্যাহেবুব গানটা দিয়ে শুরু কর। ”
সাইকির পাশ থেকে সালান বলে উঠলো রুদ্রকে উদ্দেশ্য করে। রুদ্র হাসলো স্মিত,গানটা পছন্দের তার। একটা সময় ইউনিভার্সিটিতে এই ছয়জন সব সময় একত্রে চলাফেরা করতো। কিন্তু লেখাপড়া শেষে সে যার জীবনে কর্মব্যস্ততায় ডুবে গেছে। এখন আর বছরেও দেখা হয় না তবে কথা হয় মাঝে মধ্যে। তাই অবশেষে সবাই পরিকল্পনা করে সকল ব্যস্ততা পাশে রেখে আজ অয়নদের বাসায় উপস্থিত হয়েছে। অয়ন পেশায় ডাক্তার, ব্যাচেলর। ছোটো বোন আর মা’কে নিয়ে সংসার। রুদ্র গিটারে সুর তুললো। বাকিরা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রুদ্রর দিকে। গান ধরলো রুদ্র এবার।

শুধু মেহবুব কেয়ামত হোগী

আজ রুসওয়া তেরি গালিওঁ মে মহব্বত হোগি

মেরি নাজরীন তো গিলা করতি হ্যায়

তেরে দিল কো ভি সনম তুজসে শিখায়ত হোগি

মেরে মেহবুব…

তেরি গালি ম্যায় আতা সনম

নাগমা ওয়াফা কা গাতা সনম

তুঝসে সুনা না জাতা সনম

ফির আজ ইধার আয়া হুঁ মাগার ইয়ে কেহনে ম্যায় দিওয়ানা

খতম বাস আজ ইয়ে ভেহশত হোগি

আজ রুসওয়া তেরি গালিওঁ মে মহব্বত হোগি

মেরে মেহবুব…

মেরি তারাহ তু আহেন ভরে

তু ভি কিসিসে প্যায়ার করে

অউর রাহে ভো তুজসে পারে

তুনে ও সনম ধায় হ্যায় সিতাম তো ইয়ে তু ভুল না জানা

কি না তুঝপে ভি ইনায়েত হোগি

আজ রুসওয়া তেরি গালিওঁ মে মহব্বত হোগি

মেরে মেহবুব…..

গান শেষে এক ধরনের হৈ-হুল্লোড় লেগে গেলো নিজেদের মধ্যে। আসলে রুদ্র খুব ভালো গান করে। তাই আরেকটা গান গাওয়ার জন্য জোড়াজুড়ি করছে সবাই। শুধু সাইকি একাই তার ব্যতিক্রম। আসলে সাইকি বেশ চুপচাপ স্বভাবের। যদিও আগে এরকম ছিল না। জীবনের কঠিন চপেটাঘাতে চুপ করে গেছে হাসিখুশি মেয়েটা। আসলে আমাদের সবার জীবনেই একটা গল্প থাকে। কারো গল্প বেশি দুঃখজনক আর কারো গল্প তুলনামূলক কম দুঃখজনক।
” এত ঢং করিস না তো রুদ্র, আরেকটা গান দর ব্যাটা।”
রুদ্রের পাশ থেকে অয়ন খোঁটা দিয়ে বললো। সাথে তাল মেলালো নীলা, সালান, রনি, আবির।
” শোন গান হলো মনের ভালো লাগায় গাওয়ার জিনিস। কিন্তু আমার এখন আর গাইতে ইচ্ছে করছে না। চল তারচেয়ে বরং গল্পগুজব করি নয়তো তোরা কেউ গান গাইতে পারিস। ”
রুদ্র বরাবর জেদি স্বভাবের। তাই আর কেউ জোরাজুরি করলোনা রুদ্রকে। কিন্তু বাকিরা সবাই একসাথে সমস্বরে গান গাইতে শুরু করলো। রুদ্র শুধু গিটার বাজাচ্ছে। ত্রিশ বছর বয়সী রুদ্র পেশায় ডাক্তার। ঢাকা শহরে একাই থাকে সে। কারণ পরিবার বলতে আপন কেউ নেই তার। ছোটো থেকে দাদার কাছে মানুষ হয়েছে। কিন্তু তিনিও গত হয়েছেন বছর চারেক আগেই। নীলা বিয়ে করে সুখে সংসার করছে, সালান বাবার টাকায় আয়েশ করছে এখনও। রনি আর আবির দুজনেই প্রাইভেট কোম্পানিতে কর্মরত আছে। তবে আবির বিবাহিত রনি এখনো বিয়ে করেনি কিন্তু সামনেই বিয়ে। আর সাইকি আপাতত কিছু করছে না। বড়ো বোনের বাসায় এসেছে সময় কাটাতে। কিছুদিন আগে অবধি একটা ব্যাংকের ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ছিল সে। অয়নদের ছাদে আজ হয়তো সারারাত চলবে তাদের গান আর আড্ডাবাজি।

” রাহি তোমাকে দুপুরেই একবার ওয়ার্নিং দিলাম তারপরও আবার এক বিষয় ঘ্যানঘ্যান করছো?”

রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে দু’জনেই ঘুমানোর জন্য বিছানায় শুয়ে ছিল। কিন্তু রাহি কিছুতেই নিজের মনের খচখচানিটা দূর করতে পারছিলো না বলেই সরাসরি প্রশ্ন করেছিলো আদ্রিয়ানকে,লেডিস পারফিউমের সুভাস কেনো এসেছিলো! আর সেই প্রশ্নেই আবারও চটে গেলো আদ্রিয়ান।
” তুমি রাগ না করে উত্তরটা সরাসরি বলতে পারছো না? ”
” সামান্য পারফিউমের সুভাস নিয়ে এত সন্দেহ তোমার! রাস্তায় কতশত মহিলা চলাফেরা করে। আমি তো আকাশ দিয়ে চলাফেরায় করি না যে সেখানে কোনো মহিলা থাকবে না। ”
” না মানে প্রতিদিনই তো বাইরে যাও তখন তো…”
” রাহি! রাহি প্লিজ একটু স্বাভাবিক হও। এত সন্দেহ ভালো না। আমার অসহ্য লাগে তোমাকে ইদানীং, তুমি কী সেটা বুঝতে পারো না?”
আদ্রিয়ান বরাবর স্পষ্টভাষী, কখনো মন রক্ষার্থেও মিথ্যা কথা বলে না। কিন্তু তোশার কথাটা ইচ্ছে করেই এড়িয়ে যাচ্ছে সে। কারণ তোশা যে আদ্রিয়ানের জন্য কতটা পাগল সেটা রাহিও জানে। তাই তোশার সাথে কফিশপে গেছিলো জানলে সমস্যা আরো বাড়বে। তোশা প্রায় আদ্রিয়ানকে এখানে সেখানে ডেকে পাঠায় কিন্তু আদ্রিয়ান যায় না। কিন্তু আজ মনটা ভীষণ অস্থির থাকায় কি ভেবে যেনো কফিশপে গিয়েছিল সে।
” তুমি কি আমাকে আর ভালোবাসো না?”
নিজের ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে অসহ্য লাগে কথাটা শুনলে যেকোনো মানুষই কষ্ট পাবে। রাহিও তেমনই কষ্ট পাচ্ছে এখন। ছলছল নয়নে শুধালো রাহি। রাহির সব কথাই কেমন বাড়াবাড়ি মনে হয় আজকাল। তাই শান্ত হয়ে কথা না বলে বরং আরো রেগে গেলো আদ্রিয়ান।
” কী করলে মনে হবে আমি তোমাকে ভালোবাসি? সারাদিন ভালোবাসি ভালোবাসি বললেই কী ভালোবাসা হয়!”
” কিছু করতে হবে না, ঘুমাও তুমি সরি।”
” আর কখনো ভালোবাসার কথা বলবে না আমার সাথে। আর এরকম অহেতুক সন্দেহ করে আজাইরা প্রশ্নও করবা না। ”
রাহি মুখে কিছু বললো না আর মাথা নাড়ালো কেবল। আদ্রিয়ান অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পাশে থাকা বাতিটা নিভিয়ে দিলো। রাহি সিলিং এর দিকে তাকিয়ে সোজা হয়ে শুয়ে আছে। নিঃশব্দে আঁখি যুগল বেয়ে ঝরে পড়ছে অশ্রু। পাশে শুয়ে একটা মানুষ কাঁদছে অথচ টের অবধি পাচ্ছে না আদ্রিয়ান। অথচ একটা সময় কোনো দিন চোখে পানি আসতে দিবে না বলে কথা দিয়েছিল লোকটা। ভাবতেই কান্নার বেগ বেড়ে গেলো।

এতক্ষণে ওইঘর থেকে কথা কাটাকাটির আওয়াজ স্তব্ধ হয়েছে। ঘুমানোর চেষ্টা করলেও ঠিক ঘুমোতে পারছিল না এতক্ষণ মিহি। ভাবিকে খুব ভালোবাসে মিহি আর ভাইকেও। দু’জন দু’জনাকে যথেষ্ট ভালোবাসে তবুও সময়ের আবর্তনে সম্পর্কে মরিচা ধরে গেছে। আসলেই কি সময়ের সাথে সাথে সম্পর্কের রসায়ন বদলে যায়? কি জানি উত্তর খুঁজে পায় না মিহি। এরমধ্যে ফোনে একটা এসএমএস এলো। ফোনের নোটিফিকেশনের শব্দে স্ক্রিনে তাকালো মিহি। আগামীকাল ক্লাস আছে ইউনিভার্সিটিতে সেটাই টেক্সট করে জানালো অহনা। অহনা মিহির ক্লাসমেট সাথে বন্ধুও বটে। মিহির মনটা অস্থির হয়ে গেছে আদ্রিয়ান আর রাহির ঝগড়ার কারণে। কিছু একটা করতে হবে বলে মনে মনে দৃঢ় সংকল্প করলো মিহি। কিন্তু নিজের জন্য কী করবে ভেবে উঠতে পারলোনা। এভাবেও মানুষ কাউকে ভালোবাসতে পারে? শুধু একটু স্পর্শ আর একটা ছাতা ব্যস এতটুকুই! ফোন বালিশের পাশে রেখে বাতি নিভিয়ে চোখ মুদলো মিহি। সহসাই চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেদিনের বৃষ্টি ভেজা দুপুরের এক শিহরণ জাগানো ঘটনার কথা।
ভরা আষাঢ় মাস। শহর-গ্রাম সব জায়গায় বৃষ্টির পানিতে থৈথৈ জল। মিহি তখন অনার্স প্রথম বর্ষের বার্ষিক পরীক্ষা দিচ্ছিলো। পরীক্ষা শেষে বাসায় ফিরছিলো মিহি। অটোতে করেই বেশিরভাগ সময় চলাফেরা করে মিহি। সেদিনও অটোতে ছিল, হঠাৎ অটো থেমে গেলো মাঝপথে। ট্রাফিক জ্যামের কারণে অনেকগুলো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে সামনে। সেইজন্যই অটো থামতে বাধ্য হয়েছে সেটুকু বুঝলো মিহি। কিন্তু অত সময় বসে থাকতেও ইচ্ছে করছিলো না। হুট করেই মাথায় এলো একটা দুষ্ট বুদ্ধি। আজ খালি পায়ে হেঁটে বৃষ্টিতে ভিজে বাসায় ফিরবে। যেই ভাবা সেই কাজ। অটোর ভাড়া মিটিয়ে ফোন ব্যাগে ঢুকিয়ে ভালো করে আঁটকে অটো থেকে নেমে গেলো মিহি। গাড়িগুলো তখনও দাঁড়িয়ে। কিছুটা পথ হাঁটতেই গাড়ি চলা শুরু করলো। অবশ্য সেদিকে বিশেষ খেয়াল করলো না মিহি। কিন্তু বৃষ্টির পানিতে বারবার চোখের পাপড়ি ঝাপসা হয়ে আসছিলো বলে হাত উঁচু করে বারবার চোখ মুছে নিচ্ছিল। এমন সময় হঠাৎ কারো হাতের স্পর্শে চমকে উঠলো মিহি। কিন্তু সেদিকে তাকিয়ে কিছু বোঝার আগেই ঘটনা যা ঘটার ঘটে গেলো। পাশে তাকিয়ে কেবল গাড়ির জানালার বাইরে নীল রঙের শার্ট পরিহিত একজন লোকের হাত দেখলো। জ্যামে গাড়ি আঁটকে ছিলো এতক্ষণ নিশ্চিত লোকটার। মিহিকে ভিজতে দেখে জানালা দিয়ে চোখের পলকে হাতে ছাতা ধরিয়ে দিয়ে গেলো। বিষয়টা একেবারে অবাকই হওয়ার মতো। মিহিও অবাক হলো সাথে বিস্ময়। পরিচিত কেউ ছিল কি গাড়িতে? না-কি অচেনা কেউ!

অতীতের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে টের পায়নি মিহি। ছাতাটা এখনো খুব যত্ন করে রাখা আছে। কী কারণে, কেনো লোকটার স্পর্শ এখনও অনুভব করে মিহি জানে না। অতটুকু সময়ে কারো স্পর্শ আদৌও অনুভব করা যায় বলে ভাবতেও অদ্ভুত শোনাবে। তবুও এটা সত্যি মিহির কাছে।

চলবে,

মনেরও গোপনে পর্ব-০১

0

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_১

” তুমি কি ঠিক করেই নিয়েছো রাহিকে সত্যি ডিভোর্স দিবে?”
আদ্রিয়ানের দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো তোশা। যে মেয়ের জন্য তাকে এত বছর দূরে সরিয়ে রেখেছে আজ হঠাৎ করে তাকে ডিভোর্স দেওয়ার কথা কীভাবে বললো আদ্রিয়ান!
” ডিভোর্স মিথ্যে মিথ্যে দেওয়া যায় না তোশা।”
মুখে গাম্ভীর্যের সঙ্গে কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললো আদ্রিয়ান। একটা কফিশপে সামনাসামনি বসে আছে তোশা ও আদ্রিয়ান। তোশা সম্পর্কে আদ্রিয়ানের চাচাতো বোন, প্রায় সমবয়সী দুজনেই। কলেজ জীবন থেকেই আদ্রিয়ানকে পছন্দ করতো তোশা। কিন্তু আদ্রিয়ান জুনিয়র রাহির প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলো ততদিনে। অবশেষে প্রেমের সম্পর্কে প্রণয় এসেছিলো দুই পরিবারের সম্মতিতেই।
” ঠিক আছে তাহলে তোমার যা ইচ্ছে সেটাই করো। দেখো কাকি যেনো আবার আমাকে দোষারোপ না করেন।”
তোশার মনে মনে যে কী পরিমাণ আনন্দ হচ্ছে সেটা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। কিন্তু সেসব আড়াল করে আদ্রিয়ানের সামনে এমন ভাবসাব দেখাচ্ছে যেনো এ বিষয় একেবারে কোনো আগ্রহ নেই তার। আদ্রিয়ান কফি শেষ করলো। তারপর ফোনের স্ক্রিনে তাকালো সময় দেখার জন্য। উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
” তোকে এতকিছু ভাবতে হবে না তোশা। আমি যাচ্ছি, এরপর আর যখন-তখন ডেকে পাঠাবি না আমাকে।”
আদ্রিয়ান মুখের বাক্য শেষ করেই হনহনিয়ে স্থান ত্যাগ করলো। তোশা কিচ্ছু বললো না শুধু তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠেছে তৃপ্তির হাসি। রাহি সরে গেলেই তোশার রাস্তা পরিষ্কার!

দুপুরের কড়া রোদের কারণে জনজীবন অতিষ্ঠ।জোহরের আজান হলো মাত্রই। রাহি প্রেশারকুকারের ঢাকনাটা খুলে একবার পরখ করে নিলো মাংস সেদ্ধ হলো কি-না। আজকে মিহির সাথে গল্পগুজব করতে গিয়ে রান্নায় কিছুটা দেরি হয়ে গেছে তার। মিহি রাহির একমাত্র ননদ। রান্না দেরি হওয়াতে না জানি কখন আবার শ্বাশুড়ি রিনা বেগম এসে বকাঝকা শুরু করেন!
” রাহি! রান্না কতদূর হলো? তোমার শ্বশুরকে খেতে হবে সময়মত মনে নেই না-কি! ”
” হ্যাঁ মা হয়ে গেছে। ”
মনে মনে যার ভয় পাচ্ছিলো এতক্ষণ সেটাই হবে এখন। রাহি তাড়াহুড়ো করে রান্নাঘরের সবকিছু গোছগাছ করে খাবারগুলো দ্রুত ডাইনিং টেবিলে পরিবেশন করার জন্য উদ্ধত হলো। রাহির শ্বশুর সালমান খুরশিদ ডায়াবেটিসের রোগী। খাওয়াদাওয়া সব নিয়মমাফিক করেন। এরমধ্যেই সালমান খুরশিদ ডাইনিং টেবিলে এসে খেতে বসেছেন। এমনিতে রিনা বেগম ভালোই কিন্তু মাঝে মধ্যে কেমন রুক্ষমূর্তি ধারণ করেন। রাহি এ বাড়িতে এসেছে প্রায় পাঁচ বছর হলো তবুও শ্বাশুড়িকে ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি।
” বাবা আপনার কি আর কিছু লাগবে? ”
” না ঠিক আছে। তুমি তোমার কাজে যাও, খাওয়া শেষ হলে সব গুছিয়ে রেখো।”
” জি।”
সালমান খুরশিদ শান্ত স্বভাবের মানুষ। আদ্রিয়ান হয়েছে একেবারে তার বিপরীত। সব সময় মেজাজ চটেই থাকে তার। তবে ইদানীং একটু বেশিই খিটখিটে হয়ে গেছে আদ্রিয়ান। ভাবতেই ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো রাহির। আদ্রিয়ানের কথা মাথা থেকে বের করে ডাইনিং টেবিল পেরিয়ে বসার ঘরে গেলো মিহিকে ডাকতে। মিহি সোফায় বসে ফোন ঘাঁটছে। মিহি অনার্স তৃতীয় বর্ষে লেখাপড়া করে। তবে এরমধ্যেই বাসায় প্রায় বিয়ে-শাদির কথা হয়। অবশ্য মিহি মোটেও বিয়ে করে সংসার করতে ইচ্ছুক নয় এখনই।
” মিহি তোমার কাছে শ্যাম্পু আছে? আমার শ্যাম্পু শেষ হয়ে গেছে, তোমার ভাইকে বললাম কিন্তু ওর মনেই থাকে না। ”
” হ্যাঁ ভাবি আছে। তুমি আমার রুমে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপর তাকালেই পেয়ে যাবে। ”
” ওকে মিহি।”
রাহি দোতলায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই কলিংবেল বেজে উঠলো। মিহির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাহি সে ফোনের স্ক্রিনে তাকাতে ব্যস্ত। তাই নিজেই গেলো দরজা খুলতে। আদ্রিয়ান ফিরেছে, কিন্তু আদ্রিয়ানের শরীর থেকে লেডিস পারফিউমের সুভাস এসে নাকে ঠেকলো রাহির। মুহুর্তেই রাহির মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু মিহির সামনে সেসব প্রকাশ করলোনা মোটেও। আদ্রিয়ান কোনো কথা না বলে সোজা নিজের রুমে চলে গেলো। রাহি সালমান খুরশিদের খাওয়া শেষে এঁটো থালাগুলো জড়ো করে রেখে নিজের রুমে গেলো। আদ্রিয়ান তখন চক্ষু মুদে বিছানায় শরীর এলিয়ে ছিলো। এখনও বাইরের পোশাক পরিহিত সে। রুমে ঢুকে সশব্দে দরজা আঁটকে দিলো রাহি। আদ্রিয়ান সম্ভবত অন্য কোনো চিন্তায় নিমজ্জিত ছিল তাই বোধকরি টের পায়নি।
” এখন বুঝলাম ইদানীং কেনো আমার ধারেকাছেও আসো না।”
হঠাৎ রাহির ত্যাড়া কথায় চোখ মেলে তাকালো আদ্রিয়ান। চেহারায় একরাশ বিরক্তি নিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো।
” রাহি সব সময় এধরণের কথাবার্তা ভালো লাগে না। ”
” এখন তো আমাকে ভালো লাগবেই না,পুরনো হয়ে গেছি। এজন্য অন্য কারো সাথে লটরপটর করে এসেছো।”
” চুপ করো,মুখের ভাষা ঠিক করো।।”
মুহুর্তেই রেগে হুংকার দিয়ে উঠলো আদ্রিয়ান। তড়িৎ গতিতে রাহির কাঁধ ঝাঁকিয়ে ফের বললো,
” সমস্যা কী তোমার? শরীরে জ্বালা হয়েছে? কাছে যাই না বলে আজাইরা কথা বলতেছো?”
রাহি চোখের জল ফেলে চুপ করে থাকার মেয়ে নয়। বরং উল্টো তেজ দেখিয়ে বললো,
” জ্বালা শরীরে যতটা তার তিনগুণ বেশি অন্তরে। তুমি সেটা বুঝবে না এখন।”
আদ্রিয়ান রাহিকে ছেড়ে দিয়ে দেয়ালে সজোরে একটা ঘুষি মারলো। ফলস্বরূপ ব্যথা পেলো সে। রাহি দ্রুত গিয়ে আদ্রিয়ানের হাতটা ধরতে চাইলে আদ্রিয়ান রাহিকে সরিয়ে দিলো।
” অতিরিক্ত ভালোবাসা তোমাকে ঈর্ষান্বিত ও সন্দেহপ্রবন করে তুলেছে রাহি। এখুনি এসব বন্ধ না করলে চিরতরে হারাবে আমাকে,মাইন্ড ইট।”
কথা শেষ করেই ওয়াশরুমের ভেতর চলে গেলো আদ্রিয়ান। আসলেই কি মিছে সন্দেহ করছে রাহি? না-কি নিজের দোষ লুকাতে উল্টো রাহিকে কথা শুনিয়ে গেলো!
শহরের বুকে রাত নেমেছে অনেকক্ষণ। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে একবার সময় দেখে নিলো মিহি, রাত এগোরাটা বেজেছে। আকাশের দিকে তাকাতেই মিহির ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠেছে। পূর্নিমার আলোয় অপার্থিব সুন্দর লাগছে সবকিছুই। মিহি চাঁদ দেখতে ভীষণ পছন্দ করে। তাই মাঝে মধ্যে ছাদে একা আসে চাঁদের আলো গায়ে মাখতে। আজও তেমনই এসেছে চাঁদ দেখতে। মিহির মনটা আজ বিশেষ ভালো না। হেতু ভাই-ভাবীর মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটছে সেটা ভালোই বুঝতে পেরেছে মিহি। আসলে মিহির পাশের রুমটাই আদ্রিয়ান ও রাহির। তাই না চাইতেও মাঝে মধ্যে ঝগড়াঝাটির আওয়াজ শুনতে পায় সে। এসব নিয়ে ভাবনায় ডুবে ছিলো মিহি। কিন্তু আশেপাশ থেকে হঠাৎ গানের সুর ভেসে এলো মিহির কর্ণকুহরে। ভাবনার ছেদ ঘটলো মিহির। কান খাঁড়া করে শুনলো…

এই রাত তোমার আমার
ওই চাঁদ তোমার আমার
শুধু দুজনের,
এই রাত শুধু যে গানের
এই ক্ষণ এ দুটি প্রাণের
কুহু কূজনের,
এই রাত তোমার আমার….

মিহি চারদিকে তাকিয়ে গানের উৎস খোঁজার চেষ্টা করছে। এদিক-সেদিক তাকাতে তাকাত হঠাৎ চোখ গেলো দক্ষিণ দিকের একটা বাড়ির ছাদে। একদল ছেলেমেয়ে আগুন জ্বেলে গোল হয়ে বসে গান গাইছে। যদিও তেমন ঠান্ডা পড়েনি ঢাকা শহরে কিন্তু এঁরা সম্ভবত সময় উপভোগ করার জন্যই এমনটা করেছে। কিন্তু এপাশ থেকে যে একটা মেয়ে তাদের গান শুনে তাকিয়ে আছে সেটা কী আদৌও ভাবতে পারবে তারা? না সেটা সম্ভব না। মিহি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ছাদ থেকে নেমে নিজের রুমে গেলো। এই শহরে রাতের আঁধারে কতশত মানুষ স্মৃতি পোড়ায়, সাথে পুড়ে যায় হৃদপিণ্ড। রাতের আঁধারে শক্তপোক্ত মানুষটাও নিজেকে ভেঙেচুরে আবারও জোড়ায়।

” এখন কিন্তু এরকম পুরনো আমলের গান চলবে না সাইকি।”
আগুনের পাশে গোল হয়ে বসা ছেলেমেয়েদের মধ্যে থেকে সবচেয়ে সুদর্শন ছেলেটা সামনে থাকা ছোটো চুলের শ্যামবতী মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বললো। সাইকি হাসলো কিছুটা। মোট ছয়জন বসে আছে, চারজন ছেলে আর দু’জন মেয়ে।
” ঠিক আছে। তোদের তো হিন্দি গানই বেশি পছন্দ তাই সেটাই কর তাহলে। আমি আছি সাথে। ”
” ওকে। তাহলে রুদ্র গান ধর এবার। মেরে ম্যাহেবুব গানটা দিয়ে শুরু কর। ”
সাইকির পাশ থেকে সালান বলে উঠলো রুদ্রকে উদ্দেশ্য করে। ”

চলবে,