মনেরও গোপনে পর্ব-০৩

0
259

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_৩
(মুক্তমানদের জন্য উন্মুক্ত)

অতটুকু সময়ে কারো স্পর্শ আদৌও অনুভব করা যায় বলে ভাবতেও অদ্ভুত শোনাবে। তবুও এটা সত্যি মিহির কাছে। মানুষটাকে কী কখনো খুঁজে পাবে? নাহ সেটার সম্ভাবনা একেবারে শূন্য। একটা ছাতার সাহায্যে ঢাকা শহরে কাউকে খুঁজে পাওয়া খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজার মতোই।

ভোরের আলো ফুটেছে। ফোনের এলার্মের আওয়াজে ঘুম ভেঙেছে মিহির। যেদিন যেদিন সকালে ক্লাস থাকে সেদিন ফোনে এলার্ম সেট করে রাখে। মিহি ঘুম ঘুম চোখে ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে দেখলো এরমধ্যেই ন’টা বেজেছে। তারমানে অনেকক্ষণ ধরে এলার্ম বেজে যাচ্ছিল। কিন্তু ঘুমের জন্য সেটা টের পায়নি মিহি। ভাবতেই বিছানা ছেড়ে তড়িঘড়ি করে উঠলো সে। খুব দ্রুত চোখমুখে পানির ছিটিয়ে রেডি হয়ে নিলো। আজকে একেবারে কালো একটা থ্রি-পিস পরেছে মিহি। সাথে কানে ছোটো ঝুমকো, চোখে কাজল, কপালে ছোট্ট কালো টিপ সাথে খোলা চুল। কোনো প্রকার সাজগোছ একেবারে অপছন্দ মিহির। সাজগোজের মধ্যে কাজল আর টিপ, মুখে কোনো প্রকার মেকআপ করে না। । আর বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানে গেলে তখন হালকা লিপস্টিক ব্যবহার করে।
” মিহি তোর না আজ ক্লাস আছে! বের হবি কখন? ”
ডাইনিং রুম থেকে মায়ের গলার আওয়াজে কিছুটা ব্যস্ত হয়ে নিজের রুম থেকে বেরুলো মিহি। ডাইনিং টেবিলে বসে আছে আদ্রিয়ান ও সালমান খুরশিদ। রিনা বেগম দাঁড়িয়ে রাহিকে কী জানি বলছেন। মিহির এখন অতকিছু খেয়াল করার সময় নেই। তাই তাড়াহুড়ো করে নাস্তা না করেই বেরোনোর সিন্ধান্ত নিলো।
” মিহি খেয়ে যাও।”
” ভাবি সময় নেই এখন,ক্যান্টিনে গিয়ে খেয়ে নিবো।”
মিহি বেরিয়ে গেলো কিন্তু রিনা বেগম সেদিকে খেয়াল করলেন না কারণ তিনি যথেষ্ট বিরক্ত হয়ে গেছেন। রাহির সাথে নাতি-নাতনীর বিষয় প্রায় কথা বলেন তিনি। একটু আগেও জিজ্ঞেস করেছিলেন কোনো খবর আছে কি-না। কিন্তু রাহি বরাবরের মতোই বলেছে, ‘না’। ব্যাস তাতেই বিরক্ত হলেন রিনা বেগম। আসলে আদ্রিয়ানকে বেশ কয়েকবার বলেছিলো রাহি কিন্তু আদ্রিয়ান বলেছে আরো পরে। কিন্তু সেই কথা শ্বাশুড়িকে বললেও তিনি তবুও রাহিকেই কথা শোনান। অদ্ভুত দুনিয়া! ছেলের না বলাতেও পুত্রবধূর কথা শুনতে হয়।

হসপিটালের করিডরে বসে অপেক্ষা করছেন আতিক রহমান। ডক্টরের চেম্বারে ঢুকেছে তার ছোটো ছেলে নয়ন। বয়স মাত্র আঠারো তার। কিন্তু এরমধ্যেই হৃদপিণ্ডে তার বেঁধেছে অসুখ। স্বাস্থ্য ভালো হওয়ার কারণে বোধহয় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছে ছেলেটা। ডক্টরের চেম্বারের দিকে তাকিয়ে অস্থির হয়ে আছেন আতিক রহমান। এখনো কেনো ছেলেটা বেরুলো না ভাবতে ভাবতে চোখ গেলো দরজার উপর ডাক্তারের নেমপ্লেটের ছবির দিকে। বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা ” ডাক্তার রুদ্র চৌধুরী “। বিরক্ত লাগলো আতিকের, নামটার দিক থেকে নজর সরিয়ে আবারও করিডোরে হাঁটতে শুরু করলো। ডাক্তারের চেম্বারে রোগী ছাড়া আর কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না এখানে। অবশ্য রোগী যদি খুব অসুস্থ থাকে সেক্ষেত্রে আলাদা বিষয়।
” আপনি নয়নের বাবা? ”
হঠাৎ কারো কথায় পায়চারি থামিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে সামনে এগোলেন আতিক রহমান। ডাক্তারের সহকারী শরীফ ডেকেছেন তাকে।
” হ্যাঁ। ঠিক আছে নয়ন?”
” হ্যাঁ। আপনি ভেতরে আসুন, স্যার আপনার সাথে কথা বলবেন। ”
আতিক আর কথা না বাড়িয়ে শরীফের সাথে ডাক্তারের চেম্বারে প্রবেশ করলেন। নয়ন এখন বসে আছে ডাক্তার রুদ্র চৌধুরীর সামনের চেয়ারে। ডাক্তার রুদ্র দাঁড়িয়ে একটা ইসিজির রিপোর্ট দেখতে ব্যস্ত তখনও। নয়নের বাবাকে দেখে ইসিজির রিপোর্ট টেবিলে রেখে নিজের চেয়ারে বসলো রুদ্র। সাদা রঙের শার্টের সাথে জিন্সের প্যান্ট পরনে তার,চোখে একটা চশমা।
” নয়নের পাশের চেয়ারে বসুন।”
আতিক রহমান নিঃশব্দে ছেলের পাশে বসে হাতে হাত রেখে কিছুটা ভরসা দিলো। নয়নের চোখমুখ শুকনো হয়ে গেছে। চিন্তার ভাজ পড়েছে কপালের রেখায়। বয়স মাত্র আঠারো এখুনি খারাপ কিছু ঘটে যাবে কি-না এ কথা ভাবতেই আঁতকে ওঠে নয়ন। সবাই এ পৃথিবীতে বাঁচতে চায়। যে মানুষটা নিজের দুঃখকষ্ট সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার মতো কঠিন কাজ করতে যায়, সেই মানুষটাও কিন্তু দম বন্ধ হওয়ার আগে বাঁচার আকুতি জানায়।

” জি ডক্টর রুদ্র বলুন,নয়নের এখন কী অবস্থা? কোনো বড়সড় কিছু হয়নি তো?”
” গত সপ্তাহে তো পইপই করে বলে দিয়েছিলাম আপনাকে কোনো ধরনের মশলাযুক্ত খাবার নয়নকে খেতে দিবেন না। কিন্তু রিপোর্ট দেখে মনে হচ্ছে কোনো বিধিনিষেধ মেনে চলেনি ও।”
রুদ্রর কথা শুনে বাপ-বেটা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো একবার। নয়ন বাবার চোখের দিকে আর তাকালো না। আসলে নয়ন বাড়িতে এ ধরনের কোনো খাবার খায়নি কিন্তু বাইরে বন্ধুদের সাথে বারকয়েক খেয়ছিল। নয়নের মাথা নত থাকতে দেখে আতিক রহমান বেশ বুঝলেন ছেলের মনের কথা।
” ডক্টর ও ছেলেমানুষ, হয়তো বাইরে গিয়ে খেয়েছে মশলাযুক্ত খাবার-দাবার। প্লিজ আপনি কিছু করুন!”
রুদ্র একটু নড়েচড়ে বসলো তারপর গম্ভীর স্বরে বললো,
” আমি হার্ট স্পেশালিষ্ট এটা ঠিক কিন্তু নিয়ম না মেনে কেউ মৃত্যুর পথে ধাবিত হলেও যে তাকে বাঁচিয়ে ফেলবো এই শক্তি আমার নেই। আশা করি ভবিষ্যতে সকল নিয়মকানুন মেনে চলবে আপনার ছেলে। নিয়মমাফিক জীবনযাপন করলে ইনশাআল্লাহ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে।”
” স্যার আমি এরপর সব নিয়ম মেনেই চলবো সাথে নিয়মিত ঔষধ খাবো।”
” দ্যাটস লাইক এ গুড বয়। আচ্ছা আসুন তাহলে মি.আতিক।”
” থ্যাংকস ডক্টর রুদ্র। ”
” ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম। ”
আতিক রহমান নিজের ছেলেকে নিয়ে চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেলেন। শরীফ রুদ্রর একপাশে প্রভুভক্ত পোষা প্রাণীর মতো দাঁড়িয়ে আছে। আসলে শরীফের পারিবারিক অবস্থা খুব খারাপ। সাহায্য করার জন্যই নিজের চেম্বারে সাথে থাকার চাকরিটা দিয়েছিল রুদ্র।
” ভাইয়া দু’টো তো বেজে গেলো, খাবার কি নিয়ে আসবো? না-কি ক্যানটিনে গিয়ে খাবেন? ”
” নিয়ে আসো একসাথে খাবো এখানে বসেই।”
শরীফ গেলো রুদ্র ও নিজের জন্য খাবার আনতে। রুদ্র এমনিতে কিছুটা রাগী হলেও সব সময় হাসিখুশি থাকতে পছন্দ করে। তবে সহজে রাগে না সে,কিন্তু রাগলে সামাল দেওয়া মুশকিল। শরীফ রুদ্রকে ভাইয়া বলেই সম্বোধন করে। রুদ্র কখনো তার সাথে কর্মচারীর মতো আচরণ করেনা।

ক্লাস শেষে কয়েকজন বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে ক্যাম্পাসের মধ্যে বসে আছে মিহি। ক্লাস শেষে সব সময়ই এরকম আড্ডা চলে কিছুক্ষণ। আড্ডার টপিক থাকে কার ব্রেকআপ হলো কিংবা কে নতুন প্রেমে পড়লো আবার কোন কোন কোন বান্ধবীর বিয়ে করে জীবন অতিষ্ঠ হলো!
” তোদের কি খেয়েদেয়ে আর কোনো কাজ নেই? সব সময় প্রেম-বিয়ে নিয়ে কথা বলিস। যেনো পৃথিবীতে আর কিছু নেই।”
কিছুটা মুখ ঝামটি দিয়ে বললো মিহি। কিন্তু মিহির কথায় সবাই সশব্দে হেসে উঠলো। এতে মিহি আরো কিছুটা ক্ষেপে গেলো বটে। কিন্তু কিচ্ছুটি বললো না।
” তো কী নিয়ে আড্ডা দিতে চাস তুই? সবাই কি তোমরা মতো প্রেম-বিয়ে না করে সন্ন্যাসী হবে! ”
অনিক হাসতে হাসতে বললো মিহিকে। মিহি চুপ করে রইলো। পাশ থেকে এই ফাঁকে সুনয়না বলে উঠে,
” আহা সন্ন্যাসী হবে কেনো? আমাদের মিহিও একদিন প্রেমে পড়বে দেখিস। ”
” না রে আমার প্রেম পিরীতি করার ইচ্ছে নেই। লেখাপড়া শেষ করে একটা চাকরি করবো এতটুকুই।”
” হয়েছে হয়েছে। এখন চল বাসায় ফিরতে হবে তো!”
অহনা মিহির হাত ধরে নাড়া দিয়ে বললো। মিহিও এতক্ষণে ফোনের স্ক্রিনে তাকালো সময় দেখার জন্য। আসলেই দেরি হয়ে গেছে। মিহি আর অহনা আড্ডা থেকে বিদায় নিয়ে বাসার উদ্দেশ্য রওনা দিলো।
এদিকে সকালের কথাবার্তার পরে রাহির শ্বাশুড়ি আরো কোনো কথা বলেনি রাহির সাথে। মনে হচ্ছে রাহি বড়সড় কোনো অপরাধ করে ফেলেছে। দুপুরের রান্নাবান্না শেষে সব কাজ গুছিয়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা আঁটকে বসে আছে রাহি। কেনো জানি সবকিছু কেমন বিষাক্ত লাগছে। একদিকে আদ্রিয়ানের অবহেলা অন্য দিকে রিনা বেগমের ওরকম ব্যবহার। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বসা থেকে উঠে গোসল করতে গেলো রাহি,গোসল করলে কিছুটা হলেও ফ্রেশ লাগবে এই আশায়। কিন্তু সত্যি কথা হলো যতক্ষণ চেতনা থাকে ততক্ষণই দুশ্চিন্তা ঘিরে থাকে রাহিকে। বাবা-মা’র কাছে কিছু বলা সম্ভব নয় আর বলেও বা কী হবে? রাহি কিছুতেই আদ্রিয়ানকে ছেড়ে থাকতে পারবে না। মানুষ যখন নিজের চেয়েও অন্য কাউকে বেশি ভালোবেসে ফেলে তখন নিজের অস্তিত্ব ত্যাগ করে হলেও তার সাথে থাকতে চায়। তখন আর কোনো আত্মসম্মান পর্যন্ত কাজ করে না।

” কী হলো? আজ বাসায় ফিরবে না আদ্রিয়ান! ”
অফিসে নিজের রুমেই বসে ছিল। এমন সময় আদ্রিয়ানের সহকর্মী রাহাত উপস্থিত হলো সেখানে। তাই রাহাতকে দেখে কিছুটা নড়েচড়ে উঠলো সে। অফিসে কয়েকজনের সাথে আদ্রিয়ানের খুব ভালো সম্পর্ক। রাহাতও তাদের মধ্যে থেকে একজন।
” না আসলে বাইরে খেয়ে নিবো ভাবছি। তুমি? ”
” আমি বাসা থেকে খাবার নিয়ে এসেছিলাম।খেয়ে বাইরে বেরুলাম তখনই তোমার ছায়া দেখলাম বাইরে থেকে। ”
” বসো তাহলে। ”
” না তুমি বরং খেয়ে আসো। আর হ্যাঁ তোমার চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে কিছু নিয়ে চিন্তা করছো!”
” তুমি তো জানোই ইদানীং রাহিকে অসহ্য লাগে খুব। ডিভোর্সের কথা মুখ ফুটে বলতেই পারছিনা।”
” এসব কী বলছো? সংসারে ঝামেলা হয়, অশান্তি হয়। তাই বলে ডিভোর্স! শোনো সব ক্ষেত্রেই ভালো-খারাপ দুটোই থাকে। দরকার হলে কয়েকদিন দূরে থাকো। ভাবিকে বরং তার বাবার বাড়ি পাঠাও। কয়েকদিন পরে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। ”
” না রাহাত, বিষয়টা তেমন নয়। ওর অতিরিক্ত সন্দেহে অতিষ্ট আমি। আমার জাস্ট কিছু ভাবতেই ইচ্ছে করে না শুধু ওর থেকে মুক্তি চাই।”
রাহাত বুঝলো আদ্রিয়ানের মনে রাহির প্রতি চরম বিরক্তি এসেছে।
” ভাবি যেসব বিষয় নিয়ে সন্দেহ করে সেসব বিষয় বুঝিয়ে বলেছো কখনো? ”
” কী বোঝাবো বলো? আমি ওর জন্য ফেইসবুকে কারো পোস্টে কমেন্ট করতে পর্যন্ত পারি না। ওর কাছে কিন্তু পাসওয়ার্ড পর্যন্ত আছে তবু। শুনলে মনে হয় নিব্বা নিব্বির প্রেমের কথা। সেদিন তোশার সাথে মানে আমার কাজিনের সাথে দেখা করতে গেলাম পরে বাসায় যেতেই শুধালো লেডিস পারফিউমের সুভাস কেনো আসে? রাহি ঝামেলা করবে বলে তোশার সাথে দেখা করার বিষয়টা পর্যন্ত এড়িয়ে গেছিলাম। এরকম কত কথা আছে তার হিসাব নাই। বলতেও ইচ্ছে করে না ভাই। ”

” আসলে অতিরিক্ত ভালোবাসে ভাবি তোমাকে। হয়তো তোমার দিক থেকেও কিছু খামতি আছে। নয়তো অহেতুক সন্দেহ কেনো করবে বলো? আর কাজিনের সাথে দেখা করাই দোষ কোথায়!”

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে