মনেরও গোপনে পর্ব-১০+১১

0
298

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_১০
(মুক্তমানদের জন্য উন্মুক্ত)

” ঠিক আছে তাহলে বাবাকে গিয়ে বলুন আমরা রাজি। বিয়ে যখন করতেই হবে তখন না বলে লাভ নেই। আপনাকে না হলেও অন্য কাউকে করতেই হবে, তারচে আপনার একাকীত্বের বন্ধু হবো না হয়।”
” আচ্ছা মিহির দানা। ”
” আমি মিহি,শুধু মিহি। কোনো দানাপানি নয়।”
মিহি মুখ ভেংচি কেটে বললো রুদ্রকে। বিনিময়ে রুদ্রও এক টুকরো মিষ্টি হাসি উপহার দিলো।

দু’জন কথাবার্তা শেষে সালমান খুরশিদকে তাদের মতামত জানিয়েছে। মিহি দাঁড়িয়ে আছে একপাশে আর রুদ্র সালমান খুরশিদের পাশের সোফায় বসেছে। রিনা বেগম স্বামীর আদেশে মিষ্টি আনতে রান্নাঘরে গিয়েছেন।
” তাহলে তোমার কোনো আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে এসো, আনুষ্ঠানিকভাবে দিন-তারিখ ঠিক করবো।”
” আসলে আমার তেমন কোনো আত্মীয় নেই আঙ্কেল। আপনারা আমার বাসাতেই না হয় সবাইকে নিয়ে গেলেন তারপর কথাবার্তা বলবেন। ”
” ঠিক আছে বাবা।”
” আজকে আসছি আঙ্কেল। মিহির কাছে ফোন নম্বর দিয়ে গিয়েছি আপনি সুবিধামতো কল করে নিবেন।”
” সাবধানে যেও। ”
রুদ্র সালমান খুরশিদকে সালাম দিয়ে বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে। কেনো জানি লোকটার প্রতি কেমন মায়া কাজ করছে মিহির। হয়তো পৃথিবীতে তার কেউ নেই বলেই এই মায়া!

গভীর রাত। ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে রাত ঠিক কতটা গভীর হয়েছে সেটা বুঝতে চেষ্টা করলো রাহি। তিনটে বিশ বেজেছে, কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না। ইদানীং মনটা কোনো কথা শুনতে চায় না। আদ্রিয়ানকে দেখলে খুব কষ্ট হয়। হবেই না কেনো? আদ্রিয়ানের মতো তো রাহি নয়। রাহির প্রথম ও শেষ ভালোবাসা আদ্রিয়ান। গতকাল রাহির দুলাভাই পারভেজ রাহিকে আদ্রিয়ানের কাছে থেকে ডিভোর্স পেপার চাইতে বলেছেন। এভাবে অহেতুক সম্পর্ক ঝুলিয়ে রাখার কোনো মানে হয় না তার মতে। কিন্তু রাহি কিছু বলেনি তখন। মনটা বড্ড ছটফট করছে। বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর বদলে শুধু এপাশ-ওপাশ করছে । ভাবনারা যেনো কিছুতেই শেষ হবার নয়। কিছুক্ষণ পরে শোয়া থেকে উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো রাহি। ঠান্ডা বাতাস বইছে বাইরে। বিছানার পাশ থেকে চাদরটা গায়ে জড়িয়ে ফের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো রাহি। নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেছে পুরো শহর। কোথাও কেউ নেই। মাঝে মধ্যে নেড়ি কুকুরের আওয়াজ ভেসে আসছে দূরে কোথাও থেকে। হঠাৎ কারো গলার স্বরে কেঁপে উঠলো রাহি। কেউ চাপা স্বরে গান গাইছে। সামনের রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে আছে এক ছায়ামানব। কিন্তু তার গলার স্বর চিরপরিচিত রাহির। কান খাঁড়া করে ছায়ামানবের কন্ঠস্বর আরো ভালো করে বুঝতে চেষ্টা করলো সে।

পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়।

ও সেই চোখে দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়।

আয় আর একটিবার আয় রে সখা, প্রাণের মাঝে আয়।

মোরা সুখের দুখের কথা কব, প্রাণ জুড়াবে তায়।

মোরা ভোরের বেলা ফুল তুলেছি, দুলেছি দোলায়

বাজিয়ে বাঁশি গান গেয়েছি বকুলের তলায়।

হায় মাঝে হল ছাড়াছাড়ি, গেলেম কে কোথায়

আবার দেখা যদি হল, সখা, প্রাণের মাঝে আয়।

গান থেমেছে, ল্যাম্পপোস্টের নিচ থেকেও যে ছায়ামানব রাহির দিকে দৃষ্টিপাত করেছে সেটা রাহির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে জানান দিচ্ছে। আদ্রিয়ান! এই শীতের রাতে রাস্তায় কেনো বসে আছে সে? তা-ও আবার রাহির বাসার সামনে! অনুভূতি এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে রাহির। এই মুহুর্তে সব প্রতিজ্ঞা, সব অবহেলা, সকল অভিমান যেনো ভুলতে বসেছে সে। ইচ্ছে করছে দৌড়ে গিয়ে একবার বক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়ে সবকিছু ভুলে নতুন করে শুরু করতে। দোটানায় পড়ে বেশ কিছুটা সময় পেরিয়ে গেলো। রাহি আলমারি থেকে পুরনো সিম বের করে ফোনে ঢুকিয়ে আদ্রিয়ানের নম্বরে কল দিলো। রিং হতেই আদ্রিয়ান রিসিভ করেছে।
” হ্যালো রাহি!”
কতদিন পরে! রাহি ফোনটা বুকে আঁকড়ে নিঃশব্দে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। অন্যদিকে আদ্রিয়ান পাগলের মতো হ্যালো হ্যালো করে যাচ্ছে । কিয়ৎক্ষণ বাদেই রাহি নিজেকে সামলে নিয়ে পুনরায় ফোন কানে ধরলো।
” এত রাতে বাড়ির সামনে কেনো এসেছো তুমি? ”
” কেমন আছো রাহি?”
” প্রশ্নের জবাবে পাল্টা প্রশ্ন পছন্দ না। ”
” বদলে গেছো অনেক। ”
” বদলে দিয়েছো নিজেই।”
” ক্ষমা করা যায় না একবার? ”
” বিশ্বাসঘাতকতার কোনো ক্ষমা হয় না। ”
আদ্রিয়ান চুপ করে গেলো। কী করবে সে? বোনকে যে কথা দিয়েছে তার বিয়েতে ভাবিকে উপস্থিত করবেই।
” একবার বাইরে আসবে প্লিজ! ”
” না।”
” কথা দিচ্ছি আর কখনো এভাবে এসে বিব্রত করবোনা তোমাকে। ”
” ঠিক আছে, আসছি।”
আদ্রিয়ান খুশিতে গদগদ হয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো রাহির জন্য। ঠিক পাঁচ মিনিট পরে রাহি এসে দাঁড়ালো আদ্রিয়ানের সামনে। অথচ বাসা থেকে এখানে আসতে নয় – দশ মিনিট সময় লাগার কথা! আদ্রিয়ান মুগ্ধ নয়নে কিছু সময় দেখে নিলো রাহিকে। রাহিও নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনে থাকা মানুষের দিকে। কিন্তু রাহি কিছু বুঝে উঠার আগেই আদ্রিয়ান হুট করে বক্ষে জড়িয়ে নিলো তাকে। রাহি তড়িৎ গতিতে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করলো একবার। কিন্তু আদ্রিয়ানের বাহুডোর থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হলো না। আদ্রিয়ান রাহির মাথায় হাত বুলিয়ে কানে কানে ফিসফিস করে বললো,
” আগে বলো ক্ষমা করেছো নয়তো শেষ নিঃশ্বাস অবধি এমন করে জড়িয়ে রাখবো।”
রাহি কিছু বললো না, কেবল হুহু করে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। এতদিনের রাগ,অভিমান, সব যেনো মিইয়ে গেলো ভালোবাসার মানুষের স্পর্শে। অবশ্য আদ্রিয়ানকে কম অবহেলা করেনি এতদিন। আদ্রিয়ানও বারবার অবহেলিত হয়ে বুঝতে পেরেছে প্রিয় মানুষের নিকট থেকে অবহেলা পেলে ঠিক কতটা পুড়ে যায় হৃদয়। রাহির আশকারা পেয়ে আদ্রিয়ান তার ললাট মাঝে ওষ্ঠদ্বয় ছুঁইয়ে দিলো। মাথায় হাত বুলানো অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। এতক্ষণে রাহির কান্নার বেগ কমেছে। আদ্রিয়ান আঁখি যুগল মুছে দিলো তার। ল্যাম্পপোস্টের বাতির আলোতে দু’জন দু’জনার মুখাবয়ব দেখছে।
” তুমি খুব খারাপ লোক একটা। তুমি খুব খারাপ আদ্রিয়ান। ”
” আর একটা সুযোগ দিয়ে দেখো এই খারাপ মানুষটা আর কখনো তোমাকে কষ্ট দিবে না। ”
” আমি একা পারবোনা সেটা আদ্রিয়ান। বাসায় এসে কথা বলে দেখো, উনারা যদি তোমাকে ক্ষমা করেন তাহলে আমি যাবো।”
” বেশ তাহলে কালকেই আমি আসবো। আব্বুও আসবেন, তোমার চিন্তায় উনি অসুস্থ হয়ে গেছেন।”
” আমার কিছু করার ছিল না, তুমি বাধ্য করেছিলে আমাকে। মিহির না-কি বিয়ের কথা চলছে? ”
” হ্যাঁ আজকেই ঠিক হলো। আগের সম্মন্ধ বাতিল,আব্বুর পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে হবে। ”
” বাহ। ”
” মিহির বিয়ের আগেই তোমাকে বাসায় নিয়ে যাবো।”
” দেখা যাক।”
আদ্রিয়ান মুচকি হেসে রাহিকে বিদায় জানিয়ে বাসায় গেলো।
পরেরদিন সকালে যথারীতি সালমান খুরশিদকে নিয়ে আদ্রিয়ান রাহিদের বাসায় উপস্থিত হয়েছে। রাহির বাবা-মা প্রথম প্রথম দ্বিমত পোষণ করলেও শেষমেশ রাহিকে ফিরিয়ে দেয় আদ্রিয়ান ও সালমান খুরশিদের সাথে। দেড় বছর পর রাহি নিজের সংসারে পা রেখেছে আজ। রিনা বেগম ছেলের এরকম কর্মকাণ্ডে বিশেষ খুশি হননি। অবশ্য শ্বাশুড়ি যে তাকে দেখে খুশি হবেন না এটা আগেই থেকে জানতো রাহি। কিন্তু মিহি রাহির আসার অপেক্ষায় ছিল এতক্ষণ। দরজার কলিংবেলের শব্দ পেতেই নিজের রুম থেকে বেরিয়ে বসার ঘরে এসেছে মিহি।
” কি খবর মিহি কেমন আছো? অনেক দিন পর দেখলাম তোমাকে। ”
” আলহামদুলিল্লাহ ভাবি। কালকে সন্ধ্যায় যখন কল দিয়েছিলে তখনই ভেবেছিলাম এরকম কিছু হবে। আমি খুব খুব খুশি হয়েছি ভাবি। ”
” আমিও খুশি হয়েছি তোমার বিয়ের খবরটা শুনে।”
” হ্যাঁ এবার কোমর বেঁধে বিয়ের কাজ শুরু করো।”

মিহি হেসে বললো রাহিকে সাথে রাহি ও আদ্রিয়ানও হাসলো। সালমান খুরশিদ বেশিক্ষণ বাইরে থাকতে পারেননা তাই বাসায় ফেরা মাত্রই নিজের রুমে চলে গেছেন। রিনা বেগম রান্নাঘরে কাজ করছেন, সকালের নাস্তা তৈরি হয়নি এখনো।
” বাহ আমাকে রেখেই সব আনন্দ করছো আদ্রিয়ান?”
দরজা খোলা ছিল, হঠাৎ তোশার আগমনে কিঞ্চিৎ অবাক হলো সবাই। মিহির তো রাগ হতে শুরু করেছে। সম্পর্কে চাচাতো বোন হলেও মিহি তোশাকে সহ্য করতে পারে না একদম। মেয়েটা বরাবরই তার কাছে কেমন গায়েপড়া স্বভাবের। রাহির ভিতরে কী যেনো হলো হঠাৎ। বাসায় আসা মাত্রই এরকম কিছু ঘটবে আশা করেনি মেয়েটা। তোশার গলা শুনতেই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন রিনা বেগম। আদ্রিয়ান রেগে দাঁত খিঁচিয়ে বললো,
” তুই! তুই সকাল সকাল এখানে কী করতে এসেছিস?”
” আমি বলেছি ওকে আসতে। ”
রিনা বেগম ভাবলেশহীনভাবে বললেন কথাটা। আদ্রিয়ান অবাক হয়েছে মায়ের আচরণে। আসলেই কী উনি আদ্রিয়ানের আপন কেউ! রাহি মোটেও অবাক হয়নি কিন্তু খারাপ লাগছে।
” মা তুমি? কিন্তু কেনো! তোমার কাছে আমার সুখ বড়ো না-কি তোশার খামখেয়ালি? ”
চলবে,

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_১১

(মুক্তমানদের জন্য উন্মুক্ত)
আদ্রিয়ান অবাক হয়েছে মায়ের আচরণে। আসলেই কী উনি আদ্রিয়ানের আপন কেউ! রাহি মোটেও অবাক হয়নি কিন্তু খারাপ লাগছে।
” মা তুমি? কিন্তু কেনো! তোমার কাছে আমার সুখ বড়ো না-কি তোশার খামখেয়ালি? ”
” অবশ্যই তোর সুখ আগে। কিন্তু তুই নিজের ভালো নিজে বুঝিস? ”
” মা প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো আমি রাহির সাথে থাকতে চাই। মানছি মাঝখানে আমি ভুল করেছিলাম। কিন্তু সবারই তো ভুল হয় তাই না?”
” আদ্রিয়ান আমার সাথে সম্পর্ক থাকাটা এখন ভুল হয়ে গেছে? ”
” তুই চুপ কর তোশা,আমি মায়ের সাথে কথা বলছি।”
এতক্ষণে কথা কাটাকাটির আওয়াজে সালমান খুরশিদ আবারও বসার ঘরে এসে উপস্থিত হয়েছেন। তোশাকে দেখেই ঝামেলার কেন্দ্রবিন্দু আঁচ করতে পেরেছেন তিনি। আর স্ত্রী’র আচরণও তার অজানা নয়। গম্ভীর মুখে স্ত্রী’র সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন সালমান খুরশিদ। রাহির খুব খারাপ লাগছে এসব। অশান্তি যেনো তার জীবন থেকে সরছে না কিছুতেই!
” রিনা তোমাকে স্পষ্ট একটা কথা জানিয়ে দিচ্ছি আজ,আমার কাছে আমার ছেলেমেয়েদের সুখ আগে তারপর তুমি। তাই সেই সুখের পথে যদি তুমি কোনো প্রকার বাঁধা সৃষ্টি করো তাহলে তোমাকে ছাড় দিবো না আমি। শেষ বয়সে এসে বিচ্ছেদ সহ্য হবে তো তোমার?”
মিহির বাবার কথায় সবাই অবাক হয়েছে। বিশেষ করে রিনা বেগম। এতো কঠিন একটা কথা তিনি বলবেন কেউ ভাবেননি। তোশা মনে মনে বেশ রেগে গেছে। রিনা বেগম ভয়ে চুপসে গেছেন ইতিমধ্যেই। স্বামীকে হারানোর কথা ভাবতেও পারেননা তিনি।

” চাচা আমি কী তোমার কাছে কেউ না? আমার কথা একটুও ভাববে না!”
মেকি কান্নায় মন ভোলাতে চাইলো তোশা। সালমান খুরশিদ এমনিতেও যথেষ্ট স্নেহ করেন তোশাকে। তাই সেই সুযোগ নেওয়ার পূর্ণ চেষ্টা চালাচ্ছে তোশা। সালমান খুরশিদ মুচকি হেসে তোশার মাথায় একবার হাত বুলিয়ে দিলেন। তোশার ঠোঁটের কোণে শয়তানি হাসি ফুটে উঠেছে। সম্ভাব্য বিজয়ের আভাস মিলেছে ভেবে আনন্দে মন উড়ু উড়ু করছে তার।
” শোন তোশা,তোকে এতটা স্নেহ করি বলেই এতদিন কিছু বলিনি। কিন্তু এখন যদি না বলি ওই মেয়েটার প্রতি অবিচার করা হবে। এবার তোর বাবা-মাকে বলবো একটা ভালো পাত্র দেখে তোকে বিয়ে দিয়ে দিতে। আশা করি আমাকে কঠিন হতে বাধ্য করবি না। এখন চলে যা,পরের বার জামাই নিয়ে আসিস।”
নিজের চাচার কাছ থেকে এসব কথা মোটেও আশা করেনি তোশা। ফলে রাগে কটমট করতে করতে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো।
” ভাবি এবার রুমে যাও তোমরা। আপদ বিদায় হলো অবশেষে। আর মা তুমিও এবার বোঝো কোনটা আসল হিরা আর কোনটা নকল।”
মিহি মায়ের উপর বেশ রেগে গেছে। তাই কথা শেষ করেই নিজের রুমে হনহনিয়ে চলে গেলো। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন আদ্রিয়ানের মা। আদ্রিয়ান রাহির হাত ধরে রুমের দিকে গেলো। বসার ঘরে এখন শুধু আদ্রিয়ানের বাবা-মা দাঁড়িয়ে আছেন।
” দাঁড়িয়ে না থেকে নাস্তা দাও টেবিলে। বেলা তো কম হলো না! দুপুর থেকে তো রাহি রান্না করবে তোমার ছুটি। ”
রিনা বেগম মুচকি হাসলেন স্বামীর কথায়। আসলেই তো এই মেয়েটা না থাকলে সব কাজ তাকেই করতে হতো। মিহি অবশ্য মাঝে মধ্যে সাহায্য করতো কিন্তু সেটা রাহির শূণ্যতা পূর্ণ করতে পারতোনা। ডাইনিং টেবিলে নাস্তা পরিবেশন করেছেন রিনা বেগম। সালমান খুরশিদ এরমধ্যেই খেতে বসে গেছেন। মিহিকে রিনা বেগম খেতে ডাকলেও আসেনি খেতে। মায়ের উপর বড্ড রাগ করেছে মেয়েটা। আদ্রিয়ান অবশ্য রাহিকে নিয়ে এসেছে। শ্বাশুড়িকে খেতে বসিয়ে দিয়ে নিজে সবাইকে নাস্তা দিচ্ছে রাহি। রিনা বেগম চোখ বন্ধ করে একটা নিঃশ্বাস নিলেন। সব কুটিলতা বাদ দিয়ে সবাইকে আঁকড়ে ভালো থাকার চেষ্টা করবেন ভেবে মনে মনে প্রতিজ্ঞ হন তিনি।
” রাহি!”
” হ্যাঁ মা বলুন,কিছু লাগবে? ”
” না, আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমার কারণেই হয়তো আদ্রিয়ান তোমার প্রতি অবিচার করার সাহস পেয়েছিল। আমি তো প্রথম থেকেই তোমাকে অপছন্দ করতাম। ”
” এখন কী পছন্দ করেন তাহলে?”
রাহি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হেসে বললো। রিনা বেগমও হাসলেন।
” একেবারে পছন্দ না করলেও এখন থেকে আর তোমাকে কষ্ট দিবো না। ”
” যাক আলহামদুলিল্লাহ। ”

দেখতে দেখতে মিহির বিয়ের দিন চলে এসেছে। এরমধ্যে রুদ্রর বাসায় গিয়ে আংটি বদল সেরেছে মিহির পরিবার। ওখানেই ছোটোখাটো একটা অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলো রুদ্র। আজ মিহি ও রুদ্রর বিয়ে। বেশ ধুমধামে বিয়ের অনুষ্ঠান করতে চেয়েছিলেন সালমান খুরশিদ কিন্তু মেয়ের কথায় ঘরোয়া ভাবেই বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। মিহি অযথা টাকাপয়সা খরচ করা মোটেও পছন্দ করে না। তার মতে যে টাকাপয়সা বিয়েতে খরচা হবে সেগুলো ভবিষ্যতের জন্য জমা করে রাখলে ভালো হবে। তাই সেটাই করেছেন সালমান খুরশিদ।
রাত আটটা বাজতে বাকি বিশ মিনিট। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ফুল দিয়ে সাজানো সুন্দর চার চাকার গাড়ি। গাড়ির ড্রাইভারের সিটে বসে আছে শরীফ। শরীফ শুধু রুদ্রর চেম্বারের কাজ করে না সাথে ড্রাইভারের কাজটাও করে। রুদ্র গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। মিহি রাহিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে অবিরত। রিনা বেগম বসার ঘরে সোফায় বসে কাঁদছেন। মেয়ের সামনে ছিলেন এতক্ষণ কিন্তু মাত্রাধিক কান্নাকাটির জন্য ভিতরে দিয়ে এসেছে আদ্রিয়ান। সালমান খুরশিদ দাঁড়িয়ে আছেন রুদ্রর পাশেই।
” বাবা একটি মেয়ে আমার, দেখেশুনে রেখো। কোনো ভুলত্রুটি করলে আমাকে জানিও।”
” আপনি কোনো চিন্তা করবেন না আঙেল। আমি আগলে রাখবো আপনার রাজকন্যাকে।”
রুদ্র সালমান খুরশিদের হাতে হাত রেখে আশ্বস্ত করলো।
” এভাবে কাঁদে না মিহি। দেখো আমিও তো বাবার বাড়ি ছেড়ে তোমাদের সাথে থাকছি,এটাই নিয়ম। তাছাড়া তোমার বাসায় তো তুমি আর তোমার বর শুধু। ইচ্ছে করলেই চলে আসতে পারবে।”
মিহি নিশ্চুপ চোখের পানি ফেললো আরো কিছুক্ষণ। তারপর রুদ্রর সাথে গাড়িতে বসে নতুন জীবনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। পেছনে ফেলে এলো চিরচেনা জায়গা,মানুষজন সাথে কতশত স্মৃতি!
গাড়ি চলছে তার আপন গতিতে। এমনিতে রুদ্র বাসা কাছেই তবে রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম থাকলে একটু বেশি সময় লাগে। তবে আজ রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা। মিহি জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। রুদ্র মাঝে মধ্যে ফোনের স্ক্রিন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মিহিকে পর্যবেক্ষণ করছে। মেয়েটা কী এখনও কাঁদছে!
” এই যে মিহির দানা! তুমি কি এখনও কাঁদছো? ”
আকস্মিক রুদ্রর এরকম প্রশ্নে বিরক্ত হলো মিহি। চোখমুখ কুঁচকে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে বললো,
” মিহির দানাপানি নই আমি শুধু মিহি। আর কাঁদবো কেনো আমি? ”
” এমা! কিছুক্ষণ আগেই তো ভেউভেউ করে কাঁদলে সবার সামনে। ”
রুদ্র মজা করছে মিহির সাথে যাতে কিছুটা হলেও মনটা ভালো হয়ে যায় তার। কিন্তু মিহি যথেষ্ট সিরিয়াস হয়ে আছে। এমনিতেই বাসার সবার জন্য মন কেমন করছে।
” আপনি তো মহা বজ্জাত লোক! আপনাকে তো অন্য রকম ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি… ”
” এখন দেখছে খুব খারাপ লোক তাই না? ”
হঠাৎ কিছু একটা ভাবতেই মিহির চোখগুলো বড়ো বড়ো হয়ে গেলো।
” ওয়েট ওয়েট আপনি না একটু আগে পর্যন্ত আমাকে আপনি বলে সম্মোধন করেছিলেন? তাহলে এখন হঠাৎ তুমি করে বলছেন কেনো!”
” এখন তো তুমি আমার স্ত্রী, আর এমনিতেই তুমি বয়সেও যথেষ্ট ছোটো। তাই আর আপনি করে ডাকবো না।”
মিহি হুট করে একেবারে জানালার পাশে চেপে বসলো যাতে রুদ্রর শরীরের সাথে একটুও ছোঁয়া না লাগে। বিষয়টা বুঝতে পেরে রুদ্র মুখ টিপে মিটিমিটি হাসছে।
” শুনুন আপনার কিন্তু বলেছিলেন আপনার একটা অতীত আছে এবং তাকেই ভালোবাসেন আপনার, এখন যদি আমাকে পেয়ে সেসব ভুলে উল্টোপাল্টা কিছু ভেবে থাকেন মোটেও ভালো হবে না। ”
” তা কী হবে শুনি?”
” গাড়ি থেকে ঝাঁপিয়ে প্রাণ দিয়ে দিবো আমি। ”
রুদ্র মিহির হাতটা শক্ত করে ধরে বললো,
” এখন পারলে ঝাঁপিয়ে দেখাও। আর হ্যাঁ গাড়ি থেকে বাইরে পড়লে মরবে বলে মনে হয় না। তারচেয়ে বাসায় চলো তারপর অন্য কোনো উপায় দেখা যাবে। তবে তোমার প্রতি শুধু বন্ধু হিসেবে খেয়াল রাখছি অন্য কিছু না হুহ্। ”
মিহি কিছু বলার আগেই রুদ্র মিহির হাত ছেড়ে গাড়ির দরজা লক করে দিলো। রুদ্রর শেষ কথাটায় কিছুটা ভরসা পেয়েছে সে। রুদ্র হয়তো সত্যি বন্ধুর মতোই আচরণ করছে কিন্তু মিহির মন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে বলে সব অন্যরকম লাগছে। ভাই আর ভাবির কথোপকথন শুনে এতক্ষণ নিঃশব্দে হাসছিলো শরীফ। বাসার সামনে এসে গাড়ি দাঁড় করিয়ে শরীফ হেসে বললো,
” বাকি কথা বাসায় গিয়ে বলবেন ভাবি,আমরা এসে গেছি।”
” ওহ এসে গেছি! এতটুকু সময়ে নিজের বাড়ির রাস্তা ভুলে গেছি কিছুদিন এই মেয়ের সাথে থাকলে তো পাগল হয়ে যাবো।”
মিহি চোখ পাকিয়ে তাকালো রুদ্রর দিকে। রুদ্র হাসছে তখনও। শরীফ গাড়ি থেকে নেমে দুপাশের দরজা খুলে দিয়েছে। রুদ্র গাড়ি থেকে নেমে মিহিকে নামানোর জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। মিহি রুদ্রর হাত না ধরে একা একা নামলো।
” ধন্যবাদ ডাক্তার সাহেব।”
” স্বাগত মিহির দানা। ”
” আবারও! ”
চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে