Tuesday, July 29, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 403



মুঠোবন্দী লাজুকলতা পর্ব-৩৭ এবং শেষ পর্ব

0

সম্পূর্ণ প্রাপ্তমনস্ক এবং প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য)
#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#অন্তিম_পর্ব
🍁
খট করে শব্দ তুলে বন্ধ হলো সদর দরজা, খাদিজা বেগমের চোখের আড়াল হলো রাইফ এবং মীরা। মধ্যরাত্রে মেয়ে এবং মেয়ে জামাতার গমন পথ অনুসরণ করে বদ্ধ দরজাতেই চেয়ে আছেন তিনি। হঠাৎ পেছন থেকে কারো স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলেন খাদিজা বেগম। এক কদম সরে গিয়ে পিছু ফিরে দেখলেন স্বামী শওকত রহমান দাঁড়িয়ে। সদ্য ঘুম থেকে জাগ্রত হয়েছেন বলে চোখ কঁচলে যাচ্ছেন বারংবার। লম্বা একটা হাই তুলে ঘুমের রেশ কাটিয়ে খাদিজা বেগম শুধালেন,

-‘এখানে কি করছেন? ভয় পাইছি অনেক। যান ঘুমান।’

-‘কে আসছে?’

-‘রাইফ। চলেও গেছে। মীরাকে নিতে আসছিলো।’

উৎকন্ঠিত হলো শওকত রহমান। শুধালেন,

-‘এতো রাতে! কি হলো আবার?’

-‘কিছু হয় নি। রাইফ আমাকে ঘুমাতে বলছে, আপনি ঘুমান। চলেন।’

কথা সমাপ্ত করেই নিজস্ব রুমের দিকে হাঁটা ধরলেন খাদিজা বেগম। রাইফের পাগলামি তিনি ঠিকি বুঝতে পেরেছেন। মিটিমিটি হাসছেন, মেয়েকে যে সুপাত্রের হাতে দিতে পেরেছেন সেটা ভেবে খুশিও হলেন। স্ত্রীর কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে না পেরে ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছেন শওকত রহমান। স্বামীর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে পিছু ফিরলেন খাদিজা বেগম, কন্ঠ উঁচু করে তাগদা দিয়ে বললেন,

-‘কি হলো, দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? আসেন। শুধু শুধু চিন্তা করছেন, কিছু হয় নি।’

______________

নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে মোজাইক করা সিঁড়ির ধাপ গুলো একের পর এক ক্রমান্বয়ে গুটি গুটি পায়ে রাইফের পেছন পেছন অতিক্রম করছে মীরা। কিছুক্ষণ আগে ঘুম থেকে ওঠার ফলে মাথা কিছুটা ভার হয়ে আছে তার। টালমাটাল ঘুম কাতুরে মীরা রাইফের সাথে পা মেলাতে সক্ষম হচ্ছে না, তাই পিছিয়ে গেলো খানিকটা। অধৈর্য রাইফ এর পছন্দ হলো না মীরার ধীর গতিতে হাঁটা। নিজের পা দুটো থামালো, ঘাড় ঘুড়িয়ে পিছু ফিরলো। হঠাৎ রাইফের পা স্থির হওয়াতে নিচের দিকে তাকিয়ে সাবধানতা অবলম্বন করে হাঁটতে থাকা মীরা মাথা উঁচু করে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো রাইফের দিকে। লোকটির চোখ দূটো অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ বেশ লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। চৌকস চেহারাটা তেও ক্লান্তির ছাপ। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে জার্নি এবং রাত জাগার ফল এটা। আচ্ছা, এটা মীরা বিহীন থাকার ফল বললে কি ভুল হবে? ভুল হলেও কিছুটা সঠিক তো হবে। এই যে, রাইফের আগামীকাল ফেরার কথা থাকলেও, আজকেই ফিরলো, কারণ তো মীরাই। আবার ঘুমানোর জন্য বারবার চেষ্টারত রাইফ মধ্যরাত অব্দি নির্ঘুম কাটালো, সেটা তো মীরার জন্যই। তবে?

হাত বাড়িয়ে মীরার কোমল একটা হাত মুঠোয় নিলো রাইফ। নিজের সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে এই পন্থায় উত্তম মনে হলো। অস্থির চিত্তে দ্রুতপদে হাঁটতে থাকা মানবটির সাথে মীরা তাল মেলাতে পারলো না তবুও, পেছনেই পরে রইলো। ধপাধপ বড় বড় কদমে হাঁটতে থাকা রাইফ মীরার হাত ধরে এক প্রকার টেনে নিয়ে যাচ্ছে। মাত্র শুকিয়ে আসতে শুরু করা হাতের ক্ষততে চাপ লাগায় মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো মীরা। দাঁড়ালো, মিনমিন করে বলল,

-‘আস্তে হাঁটুন না। হাতে ব্যাথা পাচ্ছি তো।’

রাইফ থামলো, মীরার হাতের কথা তো একদম ই ভুলে গিয়েছিলো সে। সাথে সাথেই ছেড়ে দিলো কোমল হাতটা। সরু দৃষ্টিতে সামনের রমনীকে এক নজর দেখে তিন সিঁড়ি পিছিয়ে গেলো মীরাকে অতিক্রম করে। এতোক্ষণ যাবত সামনে থাকা সুঠাম দেহি মানুষটা এখন ঠিক মীরার পেছনে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে। মীরার হাতের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় শুধালো রাইফ,

-‘বেশি ব্যাথা পাইছো?’

-‘উহু। কিছুটা।’

মীরার উত্তর দিতে দেড়ি রাইফের মীরাকে কোলে নিতে দেড়ি হলো না। মীরা কিছু বোঝার আগেই আকস্মিক পাঁজকোলা করে ছোট্ট দেহটাকে শূন্যে তুলে নিয়েছে সে। রাইফের হঠাৎ এমন কার্যে মীরার ছোট্ট হৃদয় কেঁপে উঠলো। হতভম্ব হলো, পরে যাওয়ার ভয়ে দু হাতে রাইফের গলা আঁকড়ে ধরলো। ভয় তো কা’টলো কিন্তু লজ্জার চাদর মারাত্মক ভাবে জড়িয়ে নিলো মীরাকে। সবুজ শাড়ি পরিহিত মীরার ঘুম কাতুরে ফর্সা মুখাবয়বে ফুটে ওঠলো লজ্জা মিশ্রিত মুচকি হাসি। মুখ লুকালো রাইফের থেকে। সুপুরুষ টির গলার কাছে থাকা মীরার লাজুক মুখশ্রী নত হলো, থুতনি ঠেকল নিজ বুকে। রাইফকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে থাকা মীরা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে নিচু আওয়াজে শুধালো,

-‘কি করছেন?’

-‘কি করছি?’

ঠোঁট ফুলিয়ে আদুরে কন্ঠে বলল মীরা,

-‘এভাবে কেউ কোলে নেয়? কেউ দেখে ফেললে কি হবে?’

-‘কি আর হবে, যে দেখবে তার হিংসে হবে। খাওয়া দাওয়া করো না ঠিক মতো? এতো পাতলা কেনো তুমি? ৩০ কেজিও মনে হচ্ছে না।

গাল ফুলালো মীরা। সবসময় উনার বাঁকা বাঁকা কথা। কোথায় পঞ্চাশ কেজি আর কোথায় ত্রিশ! গুনে গুনে বিশ কেজি ডিফারেন্স। লোকটার সব কিছু ভালো হলেও আইডিয়া ভালো না। পাঁচ কেজি ডিফারেন্স হলে মানা যেতো, তাই বলে এতো?
দ্রুত পায়ে হাঁটতে থাকা রাইফের দু পা শ্লথ হলো পাঁচতলার দরজার সামনে এসে। কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছে মীরা রাইফের কোল হতে নামার জন্য একটু ছটফট করতেই রাইফ শক্ত করে চেপে নিলো বুকের সাথে। চোখ রাঙ্গালো, উসখুস করতে থাকা মীরা মূহুর্তেই দমে গেলো। চুপটি করে রয়ে গেলো ওভাবেই। নিজের বাসার দরজা খুলতে গিয়েও কি মনে করে আর খুললো না রাইফ। পা বাড়ালো ছাদের দিকে। রাইফের দিক পরিবর্তন মীরার চোখে পরলো, রাইফের ভুল হচ্ছে ভেবে তড়িঘড়ি করে বলল,

-‘বাসার দরজায় আমরা। পাঁচ তলায়। উপরে যাচ্ছেন কেনো?’

মীরার প্রশ্ন শুনে রাইফ রহস্যময় একটা হাসি ঠোঁটের কোণে ফুটিয়ে বলল,

-‘তোমাকে মে/রে ফেলতে।’

-‘সত্যি?’

মীরার কন্ঠে বিস্ময়ের ছাপ। এতোক্ষণ ব্যাস্ত পায়ে হাঁটতে থাকা রাইফ ধীর পায়ে হাঁটছে। একটু আগেও তার মাঝে যে পরিমাণ ব্যাস্ততা ছিলো তার এক বিন্দু ছিটেফোঁটাও নেই এখন। এই পথ পাড়ি দেওয়ার নেই কোনো তাড়াহুড়োও। ধীরে ধীরে রাইফ এর হাসি দীর্ঘ হলো। তবুও আগের ন্যায় ই রহস্যময় ভাবেই বলল,

-‘সত্যি না হলে কি এমনি এমনি এতো রাতে তোমাকে তুলে আনি। ভাবো মীরা ভাবো। চিৎকার চেঁচামেচিও করতে পারো।’

বুদ্ধিমতী মীরা ঘাবড়ালো না। রাইফের রহস্যময় হাসিটাই অনুকরণ করে নিজের মুখে ফুটে তুলল, কন্ঠ স্বাভাবিক রেখে আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,

-‘আচ্ছা। আপনি তাহলে পৃথিবীর প্রথম মানুষ যে কাওকে খুন করতে তাকেই কোলে করে নিয়ে যাচ্ছেন যেনো হাতে ব্যাথা না পায়। ব্যাপারটা ঘেটে গেলো না.?

সিঁড়ির একেকটা ধাপ অতিক্রম করা রাইফ মীরার বুদ্ধিদীপ্ত জবাবে পুনরায় মুচকি হাসলো। মিটিমিটি হাসি ঠোঁটের কোণায় ফূটিয়ে বলল,

-‘প্রেমের ম/রাই মা/রবো তোমায়। আমার স্পর্শে অথবা গাঢ় চুম্বনে। কাওকে মা/রার পূর্বে যেমন ছু’ড়িতে শা/ন দেওয়া দরকারী, বউকে প্রেমাসিক্ত করতে কোলে নেওয়া জরুরি। বলতে পারো প্রথম ধাপ এটা। যেটাতে আমি পাস করেছি অলরেডি।’

রাইফের কথা শুনে বিস্ফোরিত নেত্রে এক ধ্যানে তাকিয়ে মীরা। হৃদ স্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে কেনো এভাবে? বলে কি এই লোক? এই ছিলো তাহলে উনার মনে? অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া মীরা যেনো পলক ফেলতেও ভুলে গেলো। এক ধ্যানে একই রকম ভাবে তাকিয়ে আছে সে। সম্মুখে তাকিয়ে থাকা রাইফ আঁড় দৃষ্টিতে দেখলো মীরার বিস্মিত মুখশ্রী। মেয়েটাকে লজ্জায় ফেলতে চায় নি সে। ভালো মানুষ সে কিন্তু একমাত্র মীরাকে কাছে পেলেই কেমন খারাপ মানুষ হয়ে যায়। না না, এটাকে কি খারাপ বলা যায়? প্রেমিক পুরুষ শব্দটা বেশ মানায়।
মীরার দিকে তাকালো রাইফ, এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকা মেয়েটার ধ্যান ভাঙ্গাতে দুই ঠোঁট কিঞ্চিৎ ফাঁকা করে ফু দিলো মীরার গৌড় বর্ণের মুখ টাতে। কেঁপে উঠলো মীরা, ধ্যান ভা’ঙ্গলো, সাথে সাথে আঁখিপল্লব বদ্ধ হলো। রাইফের গলা হালকা করে ধরে রাখা মীরার দু হাত আঁকড়ে ধরলো শক্ত করে। একটা টু শব্দ করার সাহস পেলো না আর।

ছাদের দরজা খোলা। প্যান্টের পকেট হতে চাবিটা আর বের করতে হলো না রাইফের। পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ক্যাচক্যাচ আওয়াজ তুলে স্টিলের দরজাটা খুলল সে। ডান পা ভেতরে রেখে প্রবেশ করল খোলা ছাদে। বিশাল আকাশের নিচে থাকা এক জোড়া কপোত-কপোতী কে মুক্ত হাওয়া এসে আলিঙ্গন করলো সাথে সাথেই। সামনে হাঁটতে থাকা রাইফ কি মনে করে পিছু ঘুরলো, পুনরায় দরজার কাছে এসে আদেশের স্বরে বলল,

-‘সিটনিকি টা লিগিয়ে দাও তো মীরা।’

-‘হুম?’

-‘সিটনিকিটা লাগাও। হুটহাট কেউ এসে ডিস্টার্ব করুক সেটা আমার পছন্দ না। লাগাও।’

শেষ কথাটা কিছুটা জোর দিয়ে ধমকের সুরেই বলল সে। রাইফের মৃদু ধমকেই দ্বিতীয় প্রশ্ন করার সুযোগ পেলো না মীরা। গলা থেকে হাত নামিয়ে রাইফের কথা মতো দরজার সিটনিকি লাগিয়ে দিলো। রাইফ আর দেড়ি করলো না, পুনরায় ঘুরে রেলিং এর কাছে এসে দাঁড়ালো। কোলে থাকা মীরাকে পা ঝুলিয়ে বসিয়ে দিলো ইট সিমেন্ট এর তৈরি সরু রেলিং এর উপর। পরে যেনো না যায় সে জন্য পুরুষালি দু হাত আঁকড়ে ধরে রাখলো মীরার ফিনফিনে কোমড়।

শীতল হাওয়া বইছে প্রকৃতিতে। আকাশে আজ আর রুটির ন্যায় জ্বলজ্বলে গোলাকৃতির চাঁদটা নেই। নক্ষত্ররাজিতে ভরে আছে সমগ্র আকাশ। সোনালী আলোয় ঝিলমিল করছে। আজ অনেক দিন পর আসমান ভরা নক্ষত্রপুঞ্জের মেলা দেখে বিমোহিত হলো মীরা। রাইফের দুহাতে আঁকড়ে থাকা মীরা ব্যাস্ত চাঁদহীন তারায় ভরা আকাশ দেখতে, আর সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা মানব ব্যাস্ত নিজের জীবন রাঙ্গিয়ে দেওয়া রমনীকে দেখতে। রাতের নিকষ কালো আঁধার আর আঁধার নেই। চারিপাশের কৃত্রিম আলোতে মীরার মুখ রাইফের কাছে স্পষ্ট দৃশ্যমান। আবছায়া আলোয় একরাশ মুগ্ধতা ছেয়ে গেছে মীরার সমগ্র আদল জুড়ে। বিমোহিত রাইফ আরো এক ধাপ এগিয়ে গেলো। কোমড় থেকে এক হাত সরিয়ে মীরার খোঁপা করা চুলের পেছনে হাত রাখলো। খোঁপায় গুঁজে দেওয়া সরু কাঠিটা আলতো করে টান দিতেই ঝরঝরে দীঘল কালো চুল গুলো পিঠ ময় ছড়িয়ে কোমড়ের নিচে দুলতে লাগল। আকাশ দেখতে থাকা মীরা রাইফের এমন কার্যে উর্ধ্ব হতে নজর সরিয়ে নিলো, দৃষ্টি নিবদ্ধ করল রাইফের মুখে।
না আছে চাঁদের আলো, আর না আছে ঝলমলে সূর্যের আলো। আশেপাশের ওই কৃত্রিম আলোর ছিটেফোঁটাও মীরার মুখে খুব বেশি পরে নি। তবুও রাইফ মুগ্ধ নজরে দেখেই যাচ্ছে সামনে খোলা চুলে বসা রমনী কে। পলক পরছে না রাইফের, গম্ভীর মুখাবয়বে নেই সচারাচর ফুটে থাকা মুচকি হাসিটাও। সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা সুপুরুষ টির শান্ত আচরণ মীরাকে সংকোচিত করলো বেশ। আবারও, হ্যাঁ আবারও রাইফের এমন চাহনি তে মীরার বুক ধ্বক করে উঠলো। এই মুগ্ধ নজর, এই থমথমে গাম্ভীর্যপূর্ণ
মুখ খুব সচারাচর দেখা যায় না লোকটির। আর যখন দেখা যায় তখন মীরাকে নিজের করে নিতে এক পা পিছু হয় না যা মীরা এতো দিনে প্রমাণ পেয়েছে বেশ কয়েক বার। অপলপক দৃষ্টি ভ’স্ম হওয়া মীরা কাচুমাচু ভঙ্গিতে বলল,

-‘কি দেখছেন?’

শান্ত গম্ভীর পুরুষটার শীতল কন্ঠের জবাব,

-‘তোমাকে।’

-‘আমাকে তো রোজ দেখেন। এভাবে দেখার কি আছে।’

গাম্ভীর্য পূর্ণ রাইফের ঠোঁটের কোনায় ঈষৎ হাসি ফুটলো যা মীরার দৃষ্টিগোচর হলো না। শীতলতর হলো রাইফের কন্ঠ। বলল,

-‘তুমি আমার এমন এক চাওয়া-পাওয়া, যার শেষ নেই, যার সমাপ্তি বলতে কিছু নেই। তোমাকে আমি যতবার দেখি, প্রতিবার নবরূপে আবিস্কার করি। একবার দেখি, বার বার দেখি, হাজারবার দেখি, দেখতেই থাকি। এতোবার দেখি তবুও মুগ্ধতা শেষ হয় না। তোমাকে দেখার সাধ যে আমার কিছুতেই মিটে না।’

থামল রাইফ। কিঞ্চিৎ মাথা ঝুকে রাইফের বুকের উপর দৃষ্টি রেখে একেকটা উচ্চারিত বাক্যের নিগুঢ় অর্থ অনুধাবন করছে মীরা। কোমড় থেকে হাত সরিয়ে এবার মীরার গালে হাত রাখলো রাইফ। মীরার কান, গলা উভয়ই স্পর্শ করেছে রাইফের আংগুল গুলো। মীরার নরম গালের উপর রাখা বৃদ্ধাংগুল আলতো ভাবে ঘষে দিলো বেশ কয়েকবার। চল্লিশ সেকেন্ড সময়ের ব্যাবধানে নিরবতা ছেদ করে রাইফ পুনরায় বলল,

-‘তুমি আমার রোজকার নে/শা হয়ে যাচ্ছো মীরা। তোমাকে দেখার নে/শা, কাছে পাওয়ার তীব্র নে/শা দিনকে দিন ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বুঝলে মীরা, তোমার এই লজ্জাতুর মুখটা আমাকে খুব টানে। টানছে। বেহায়া মন প্রচন্ডভাবে বেহায়া হচ্ছে।’

অর্থপূর্ণ কথা গুলো উপলব্ধি করলো মীরা। মুখ ফুটে দুই একটা শব্দ উচ্চারণ করতে চেয়েও ব্যার্থ হলো। একেকটা কথা আর ক্রমাগত রাইফের বৃদ্ধাংগুলির স্পর্শ নাজেহাল করে তুলছে মীরাকে। শক্তিহীন হচ্ছে পুরো দেহ। দুজনের মাঝের ফাঁকা জায়গা টুকুর ব্যাবধান কমালো রাইফ, এগিয়ে এলো মীরার দিকে। লজ্জায় নুইয়ে যাওয়া মীরার গোলাপি আভা ফুটে ওঠা মুখটার থুতনিতে হাত রাখলো, ধীরে ধীরে উর্ধ্বে
তুলে ডেকে উঠলো,

-মীরা?

নুইয়ে রাখা মুখতো মীরার উপরে উঠেছে, কিন্তু ঝুঁকে রাখা দৃষ্টি রাইফের চোখে চোখ রাখতে পারলো না। এ কেমন অনুভূতির জালে ফেঁ/সে গেলো মীরা! রাইফের ডাকে জবাব টুকু পর্যন্ত দিতে পারছে না। রাইফ জানে মীরা পুরোপুরি ঘায়েল হয়েছে, দ্বিতীয় ধাপ ও তার আওতাধীনে। তবুও শেষ সময়ে স্বামীর দ্বায়িত্ব থেকে ফিসফিস করে শুধালো,

-‘আজ আমার হবা মীরা? পুরোপুরি আমার।’

রাইফের মৃদু আওয়াজে বলা কথাটা কর্নকুহরে প্রবেশ করতেই বদ্ধ চোখ আরো খিঁচে ভেতরে নিলো মীরা। শুষ্ক অধর ভেজালো জ্বিহবার সাহায্যে। শুকনো ঢোক গিলে গলা ভেজানোর বৃথা চেষ্টা করলো মাত্র। রাইফের হাতের সাহায্যে উপরে তুলে রাখা মুখশ্রী নুইয়ে নিলো এক লহমায়। আজ সত্যি এক লোকটা মীরাকে মে/রে ফেলার পায়তারা করেছে। মৌন মীরার আর কষ্ট করে জবাব দিতে হলো না, তার আগেই নীরবতা সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে মাঝের দূরত্বটুকু পুরোপুরি ঘোচালো রাইফ। ব্যাক্তিগত ভাবে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলো। নিম্ন মুখটা উপরে তুলে অধর ছোঁয়ালো কপালে, কপাল হতে বদ্ধ নয়নে, নাকের ডগায়, তিরতির করে কাঁপতে থাকা গোলাপি অধর অতিক্রম করে থুতনি, গাল, কানের লতি হতে গলা। ভারী হতে থাকলো মীরার শ্বাস-প্রশ্বাস। সময়ের ব্যাবধানে ধীরে ধীরে গাঢ় হতে শুরু করলো রাইফের একেকটা স্পর্শ। পুরুষালী বুকে আবদ্ধ মীরা ছটফটাতে থাকলো এমন গভীর সংস্পর্শে। কোমল হাতে বাঁধা দিতে থাকলো, রাইফের গাঢ় চুম্বন পুরো শরীর জুড়ে শিহরণ তুলল। ভারী ত’প্ত নিশ্বাস ক্রমাগত ভারী হতে থাকলো। কোনরকমে রাইফকে বাঁধা দিয়ে বলল,

-‘পাগল হলেন নাকি, এটা ছাদ।’

মীরার গলায় মুখ ডুবিয়ে রাখা রাইফ থামলো। মুখ তুলে আশে পাশে তাকালো যতদূর চোখ যায়। না, কোনো কাক পক্ষীও নায়। মীরার অগোছালো চুল গুছিয়ে দিলো নিজ হাতে। রেলিং থেকে নামিয়ে নিলো মীরার ছোট্ট দেহটা কে। মীরার গোলগাল মুখটার দুপাশে হাত রাখলো, লজ্জায় আড়ষ্ট মীরা আঁখিপল্লব একত্রিত করলো। কন্ঠ খাঁদে নামিয়ে ফিসফিস আওয়াজে বলল রাইফ,

-‘লাজুকলতা, তুমি আমার এক গুচ্ছ লাজুকলতা। আমার মুঠোয়বন্দী লাজুকলতা। আমার তরফ হতে তোমাকে সীমাহীন ভালোবাসা।’

দুজোড়া অধর একত্রিত হলো, মিষ্টি ছোঁয়া মীরাকে এবার সত্যি সত্যি মে/রে ফেলল। গা ছেড়ে দিলো রাইফের আচমকা স্পর্শে। মীরাকে দ্রুত হস্তে ধরে ফেলল রাইফ। পাঁজা কোলে তুলে ব্যাস্ত পায়ে ছোট্ট আদরে সিক্ত করতে করতে ব্যাস্ত পায়ে ছুটলো বাসার উদ্দেশ্যে। পূর্ণতা পেলো, অবশেষে। লাজুকলতা সম্বোধন করা মীরা সত্যি সত্যি লজ্জাবতী লতার ন্যায় চুপসে গেছে রাইফের বুকে। লাল টুকটুকে মুখটা লজ্জায় আরো লাল হয়েছে। রাইফের ভালোবাসা আজ চূড়ান্ত সীমা অতিক্রম করেছে। নিজে ম*রে/ছে, মীরাকে মে/রে/ছে, ভালোবাসার আলিঙ্গনে একান্তভাবে জড়িয়ে নিয়েছে।

সমাপ্ত।

মুঠোবন্দী লাজুকলতা পর্ব-৩৫+৩৬

0

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_৩৫

নৈশভোজের জন্য রান্নাবান্নার কাজে শাশুড়ীকে সাহায্য করে নিজ রুমে প্রবেশ করতেই বিছানার উপর রাইফের ভাঁজকরা কাপড় চোপড় গুলো দেখে ক্ষানিক অবাকই হলো মীরা। অফিস হতে এই তো এলেন একটু আগে। এখনি আবার এসব বের করছেন কেনো? হাতে ধরে রাখা সাদা রংয়ের কফি মগটা নিয়ে ছোট ছোট কদমে আলমারি থেকে শার্ট-প্যান্ট বের করতে থাকা রাইফের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। গলা খাঁকারি দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টাও করল সে। সক্ষম হলো, মীরার অস্তিত্ব বুঝতে পেরে পিছু ফিরে তাকালো রাইফ। মীরা কফি মগটা রাইফের দিকে এগিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক স্বরে শুধালো,

-‘কোথাও যাবেন?’

মীরার হাতে ধরে রাখা কফিপূর্ণ মগটা রাইফ হাতে নিয়ে বিছানায় বসল। মীরার প্রশ্ন শুনেও আমলে নিলো না সে। কফির কাপে ছোট্ট চুমুক দিয়ে তৃপ্তিদায়ক অনুভূতি মুখে ফুটিয়ে বলল,

-‘দশে দশ।’

-‘কি?’

-‘কফি।’

-‘ভালো লেগেছে?’

-‘নাহ।’

পূর্ণ রেটিং পেয়ে খুশি হওয়া মীরার রাইফের মুখে ‘না’ বাচক উত্তর শুনে আগডুম বাগডুম করা মন টা ফুটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো। কন্ঠ কিঞ্চিৎ উঁচু করে শুধালো,

-‘তাহলে দশে দশ হয় কি ভাবে?’

তৃপ্তি সহকারে কফির পরিপূর্ণ স্বাদ গ্রহণ করা রাইফের ঝটপট জবাব,

-‘তুমি লজ্জা পাও যে ভাবে।’

লজ্জাজনক কোনো কাজ না করেই শুধুমাত্র কথার জালে ফাঁসিয়ে মীরাকে ফের লজ্জায় ফেলল রাইফ। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলতে থাকা মীরা ঘুড়ে দাঁড়ালো রাইফের থেকে। ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠা মৃদু হাসি লুকাতে এগিয়ে গেলো আলমারির সামনে। শুধু শুধু এটা সেটা নাড়াচাড়া করে কন্ঠে কিঞ্চিৎ রাগ মিশিয়ে শুধালো,

-‘আপনি কি কোনো দিনও সোজা কথা বলবেন না?’

বিছানায় বসে থাকা রাইফ উঁচু করে রাখা বালিশে হেলান দিলো আরামের খোঁজে। কন্ঠে জোর দিয়ে বলল,

-‘অবশ্যই বলবো। এখনি শুনতে চাও নাকি পরে?’

মীরা মনে মনে আগ্রহ প্রকাশ করল। এই ক’দিনে তো খুব বেশি একটা সোজা কথা বলেননি, আজ যখন বলতে চাচ্ছে তখন শুনতে আর দেড়ি কিসের। ঝটপট জবাব দিলো সে,

-‘এখনি।’

মীরার স্পষ্ট জবাব শুনেও রাইফ আরেকবার নিশ্চিত হতে প্রশ্ন করলো,

-‘এখনি?’

-‘হ্যাঁ এখনি।’

রাইফ উপর নিচ ঘাড় নাড়িয়ে পাশের জায়গাটুকু ইশারা করে বলল,

-‘এদিকে আসো। দূর থেকে ভুলভাল শুনে ফের দোষ দিবা আমার।’

আলমারির কপাট বন্ধ করে ছোট্ট ছোট্ট পা ফেলে রাইফের সামনে এসে দাঁড়ালো মীরা। মীরার আগাগোড়া পরখ করে রাইফ কিছু বলল না, শান্ত চোখে তাকিয়েই রইলো শুধু। মীরা যেনো বুঝতে পারল রাইফের তীক্ষ্ণ নজরে ধমকে বলা উহ্য কথাটুকু। রাইফের বাম দিকে ফাঁকা জায়গাটুকু তে বসে নিরবে নিজের অবস্থান জানান দিলো। ডান হাতে মগ ধরে রাখা রাইফ পিঠ টানটান করে সোজা হয়ে বসল। কাছাকাছি এসে দুজনের মাঝের দূরত্বটুকু ঘুচিয়ে দিলো মুহুর্তের মাঝে। পেশিবহুল বাম হাতটা দিয়ে জড়িয়ে নিলো সহধর্মিণীকে। ঘাড় ঘুরিয়ে মীরার মায়াবী মুখশ্রীতে গভীরভাবে তাকালো। এই মেয়েটার মায়া ভরা মুখটাতে রাইফ যতোবার তাকায় ততবারই তার বক্ষ পিঞ্জর ছলাৎ করে ওঠে।
এই তো গুনে গুনে দশদিন আগে মীরাকে ঘরে তুলে এনেছে সে নতুন পরিচয়ে। চাইলে প্রথম দিন-ই স্বামীর অধিকারটুকু আদায় করে নিতে পারত রাইফ। কিন্তু সুখকর মুহূর্ত গুলোর এক তরফা অনুভূতি নিতে ইচ্ছুক নয় সে। এতো তাড়াহুড়ো নেই রাইফের মাঝে। জীবনের উনত্রিশ টা বসন্ত যেখানে মীরাহীন ছিলো সেখানে আর কয়েকটা দিন সময় দিলে মন্দ কি?
এই কয় দিনে না হয় ভাব জমুক দুজনের, প্রেম হোক, প্রেমালিঙ্গণ হোক। মীরার প্রতি যেমন রাইফের টান, তার প্রতিও মীরার টান তৈরি করা আবশ্যক লেগেছে রাইফের। অবশ্য যাথেষ্ট সফল ও হয়েছে সে। গতকাল অর্থাৎ দূর্ঘটনার সময় মীরার মুখশ্রী হতে কণ্ঠনালীতে নিজের জন্য যে আতংকিত রুপ দেখেছে সে, তাতেই প্রকাশ পায় মীরার অস্তিত্ব জুড়ে এখন শুধুই রাইফের বসবাস। রাইফের প্রতি ভালোবাসা কিংবা ভালোলাগা সমূহ ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবের মেয়েটা সহজে প্রকাশ করতে পারে না শুধু। এই যে এক বাহুতে আবদ্ধ হয়ে আছে মেয়েটা, চাইলে রাইফ এক লহমায় পুরোপুরি নিজের করে নিতে সক্ষম। কিন্তু মীরার অনুভূতি গুলো এতে ফিকে হতে পারে কিছুটা। এক বিন্দুও ফিকে হতে দিতে ইচ্ছুক নয় সে। সঠিক ক্ষণ যে খুব নিকটে তা রাইফ জানে। এতো দিন যখন অপেক্ষা করতে পেরেছে সেখানে অসুস্থ মীরার সুস্থ হয়ে ওঠা পর্যন্ত আরেকটু অপেক্ষা করায় যায়। সে পর্যন্ত না হয় চুটিয়ে প্রেম ই করুক দুজন।
পেছন দিয়ে আগলে রাখা রাইফের হাত টা মীরার পিঠের ক্ষততে হালকা করে ছুঁয়ে দিলো। শান্ত স্বরে মোলায়েম কন্ঠে শুধালো,

-‘ব্যাথা আছে?’

মীরা উপর নিচ মাথা নাড়লো শুধু। রাইফের এই সামান্য স্পর্শও মীরার শিরা উপশিরায় শিহরণ জাগায়। কেঁপে তুলে ক্ষণে ক্ষণে। রাইফ হাতের কফি মগটা পাশের টেবিলে রাখলো। পুরুষালী ভরাট কন্ঠটা শীতল কন্ঠে শুধালো,

-‘মীরা, একা থাকতে পারবা না?’

হঠাৎ রাইফের এমন প্রশ্নে বিস্ময় প্রকাশ করলো মীরা। প্রশ্নের জবাব না দিয়েই উদ্দিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলো,

-‘কেনো, একা কেনো থাকবো?’

-‘ইমার্জেন্সি অফিসিয়াল কাজ পরে গেছে মীরা। চার দিনের জন্য ঢাকা যেতে হবে। খুব ইম্পোর্টেন্ট। জরুরি না হলে এই অবস্থায় তোমাকে এভাবে রেখে যেতাম না।’

উত্তর শুনে মীরা রাইফের এতো ক্ষণ ধরে আলমারি থেকে কাপড় চোপড় বের করার ব্যাপারটা বুঝলো সাথে একা থাকতে বলা কথাটাও। শরীর যেমন মীরার খারাপ, তেমন রাইফেরও তো খারাপ। লোকটির মাথার পেছনে পাওয়া আঘাতটা যে অনেকাংশে ফুলে জখম হয়েছে, নীলচে বর্ণ ধারণ করেছে পুরোটাই। মীরা মিনমিন করে প্রশ্ন সূচকে বলল,

-‘শুধু আমার কথা চিন্তা করছেন, আপনার কথা ভাবছেন না কেনো? আপনার শরীরটা ও তো ভালো না। এই অবস্থায় আপনার যাওয়াটা উচিত হবে না।’

মীরার কথায় স্পষ্টরূপে রাইফের জন্য উৎকন্ঠা প্রকাশ পাচ্ছে। ক্ষণিকের মাঝেই ভালো লাগার আবেশ ছড়িয়ে গেলো রাইফের হৃদয় জুড়ে। ঠোঁটের কোণায় মুচকি হাসি ফুটিয়ে শুধালো,

-‘চিন্তা হচ্ছে?’

সাথে সাথেই মীরার নিঃসংকোচ দ্বিধাহীন জবাব,

-‘হুম।’

অর্ধাঙ্গিনীর এই ছোট্ট জবাবে রাইফের মুখের মুচকি হাসি বিস্তৃত হলো। জড়িয়ে ধরে রাখা হাতটা দিয়ে নিজের কাছে আরেকটু চেপে নিলো। দীঘল কালো কেশরাশি গুলো লম্বা বেণী করে রাখা মীরার মাথায় ছোট্ট করে চুমু এঁকে দিলো রাইফ। গাঢ় কন্ঠে বলল,

-‘ভালো লাগছে, সত্যি ভীষণ ভালো লাগছে। আমার জন্য চিন্তা করার মানুষ বেড়েছে, এক থেকে আজ দুই হয়েছে।’

___________________

দশটার বাস। নৈশভোজ সেরে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছে রাইফ। কালো রংয়ের টিশার্ট এর সাথে জিন্স পরেছে লম্বাচওড়া পুরুষটি। শেষ সময়ে নিত্য দিনের ব্যাবহৃত পারফিউম টা দিয়ে নিলো।
পানি ভর্তি ছোট্ট মাম পটটা এনে রাইফের ব্যাগে দিয়ে দিলো মীরা। রাইফ এগিয়ে এলো তার দিকে। কেনো যেনো আজ মীরাকে রেখে যেতে ইচ্ছা করছে না রাইফের। কলিগরা সাথে না থাকলে নিশ্চিত সাথে করেই নিয়ে যেতো। পিছু ফিরে রাইফ কে দেখে বলল মীরা,

-‘চার্জার আর পাওয়ার ব্যাংক এই সাইডে, মেডিসিন এখানে। পানির মামপট এখানে আর…’

-‘আর তুমি কোথায়?’

রাইফের মুখে হুটহাট অন্য দিকে মোড় ঘুরিয়ে বলা কথাটা শুনে মীরা স্তব্ধ হয়ে গেলো, তবে ঘাবড়ালো না। এতোক্ষণ বসে থাকা মীরা উঠে দাঁড়ালো। এতো দিনের গুটিয়ে থাকা মীরা সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে এক পা এগিয়ে গিয়ে সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা রাইফের বুকের বা পাশে কোমল হাতটা রাখল। রাইফের তীক্ষ্ণ চোখে চোখ রাখতে চেয়েও পারল না। খুব নিকটে দাঁড়িয়ে থাকা সুপুরুষটির গলায় দৃষ্টি আবদ্ধ করে নিচু আওয়াজে বলল,

-‘এখানে। আমি আছি ঠিক এখানে, খুব যতনে। সাবধানে যাবেন। এখানে রাখা আমি টাকে যেভাবে পাঠাচ্ছি সেভাবেই ফেরত আনবেন।’

রাইফ অবাক হলো অনেক। ভেবেছিলো হয়তো এবারও তার থেকে পালাতে চাইবে মীরা। কিন্তু ভুল প্রমানিত করে কি দারুণ কয়েকটা বাক্য উচ্চারিত করল। রাইফ বুকে রাখা মীরার ক্ষত হাতটা আলতো করে নিজের হাতে নিলো সতর্কতার সহিত। ছোট করে অধরের পরশ দিতে ভুলল না। উহু, একবার দিয়ে কেনো যেনো মনটা ভরলো না রাইফের। পুনরায় অধর ছুঁয়ে চুম্বন এঁকে দিলো মীরার হাতের উল্টো পিঠে। নিচু করে রাখা মীরার মুখ আরো নিচু হয়েছে রাইফের ক্ষুদ্র সংস্পর্শে। অপর ব্যাক্তিটির উপর শুধু নিজের অবস্থান দৃঢ় করলে তো হবে না, নিজের উপর অপর ব্যাক্তিটির অবস্থান ও দৃঢ় করার সুযোগ দিতে হবে। রাইফ ও ঠিক তাই করলো। একত্রিত করা দুজনের হাত দুটোর মধ্যে উপরে রয়েছে মূলত মীরার হাত।সুকৌশলে ধরে রাখা মীরার হাত হালকা ঘুরিয়ে রাইফ নিজের হাতের উল্টো পিঠ উপরে আনলো। শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মীরার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য। ফ্লোরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা মীরা তড়িৎগতিতে সচকিত দৃষ্টিতে তাকালো রাইফের পানে। সেকেন্ডের ব্যাবধানে নজর সরিয়েও নিলো সে। রাইফের এমন কাজের অর্থ বুঝতে সময় লাগলো না বুদ্ধিমতী মীরার। পরবর্তী সময়ের কথা চিন্তা করেই ঘামতে শুরু করলো, হৃদ স্পন্দন স্বাভাবিক থেকে ক্রমশ অস্বাভাবিক হতে শুরু করল। সময় গড়ালো মিনিট খানেক, রাইফ একই ভাবে নিজের হাতের উল্টো পিঠ উপরে রেখে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে। রাইফের সাড়াশব্দ আশা করেছিলো মীরা, কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ধীরে ধীরে মুখাবয়ব উপরে তুললো। সম্পূর্ণ দৃষ্টি দিলো অনড়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা রাইফের উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের মুখাবয়বে। এক নিমিষেই বুঝতে পারলো, আজ আর কোনো ভাবেই রক্ষা নেই লোকটির থেকে। রাইফ যতোটা স্বাভাবিক মীরা তার সম্পূর্ণ বিপরীত। এক আকাশ পরিমাণ লজ্জা আষ্টেপৃষ্টে ঘিরে ধরেছে তাকে। রাইফের ঘায়েল করা চাহনি ভেদ করে কিছুতেই আগাতে পারছে না পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য। শুষ্ক ওষ্ঠজোড়া জিহ্বার ডগার সাহায্যে ভিজিয়ে বাম হাতটা উর্ধ্বে তুলল সে। ধীরে ধীরে কোমল হাতটা রাইফের চক্ষুদ্বয় এর উপর রাখল, নিজেকে আড়াল করলো রাইফের নিষ্পলক চাহনি হতে। রাইফের হাতে আবদ্ধ হওয়া ডান হাতটা টেনে আনলো নিজের কাছে, কাঁপা কাঁপা গোলাপি অধর ছুঁয়ে দিলো পুরুষালি হাতের উল্টো পিঠে। তাৎক্ষণিক এক প্রস্থ হাসি ফুটলো রাইফের ঠোঁটে। লজ্জায় পালিয়ে যাবে মীরা এমন সময় তাড়াহুড়ো করে বলে উঠলো সে,

-‘আরেক বার। মীরা, আরেক বার প্লিজ। শুধু একটা বার।’

বুকের ভেতর ডামাডোল বাজতে থাকা মীরা থমকে গেলো। রাইফের এমন আকুতিভরা কন্ঠে পিঠের শিরদাঁড়ায় শীতল স্রোত বয়ে গেলো। এবার আর ঠোঁট কাঁপছে না মীরার, রাইফের চোখের উপর ধরে রাখা হাত থেকে শুরু করে পুরো শরীর কাঁপছে। এমন অনুভূতি যেনো আজ মীরাকে অবশ করে তুলেছে। এর থেকে যত দ্রুত সম্ভব রেহাই পাওয়া উচিত। দেড়ি করলো না মীরা, রাইফের হাতে পুনরায় অধর ছোঁয়াতে মুখ এগিয়ে আনবে এমন সময় উচ্চস্বরে রাইফকে ডেকে ওঠা রাজিয়া বেগমের কন্ঠস্বর ভেসে আসলো। চমকে উঠলো মীরা, দ্রুততার সহিত হাত ছাড়িয়ে নিয়ে পিছু ফিরে বদ্ধ দরজার দিকে তাকালো। রাইফের হাস্যজ্বল মুখ হতে হাসি উড়ে গেলো মায়ের আচমকা ডাকে। হতাশ গলায় দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল,

-‘ডাকার আর সময় পাইলা না আম্মা! এমনিতেই লেট লতিফ হয়ে পরে আছি। তোমার পুত্রবধুর কাছ থেকে একটু তো আদর-যত্ন নিতে দাও।’

এতোক্ষণের লজ্জা মিশ্রিত অনুভূতি পূর্ণ মীরা শব্দ করে হেসে দিলো রাইফের মৃদু আওয়াজে বলা কথা শুনে। ধীরে ধীরে সেই হাসি বিস্তর হলো। নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করার পরেও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না বাঁধভাঙা হাসিটুকু। রাইফ শান্ত এবং স্থির। বিছানায় রাখা ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে চলে যাওয়ার আগ মূহুর্তে মীরার হাস্যজ্বল মুখে টুপ করে অধর ছোঁয়ালো আচমকা। মিষ্টি চুম্বনে সিক্ত করলো মীরার গোলাপি আভাযুক্ত ফর্সা গাল।

চলবে……

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_৩৬

পর পর কেটে গেছে তিন দিন। দুই দিন হলো স্বামী এবং শাশুড়ীর অনুমতিতে আপন নীড়ে ফিরে এসেছে মীরা। অনেক দিন পর মেয়েকে কাছে পেয়ে শওকত রহমান যেনো একটুকরো চাঁদ হাতে পেয়েছেন। চোখের আড়াল হতে দিচ্ছেন না কিছুতেই। একটু এদিক সেদিক গেলেই রাশভারি বয়োজ্যেষ্ঠ লোকটা ‘আম্মাজান, আম্মাজান। কই গেলো আমার আম্মাজান?’ বলে ডেকে ওঠেন। এই তো কিছুক্ষণ আগে শাশুড়ীকে এক পলক দেখতে পাঁচতলায় গিয়েছিলো মীরা, তার অনুপস্থিতিতে পুরো বাসা সুদ্ধ খুঁজে বেরিয়েছেন তিনি। স্বামীর এমন কার্যকলাপে বিরক্ত হয়ে খাদিজা বেগম যখন বললেন, মীরা উপরে গেছে তখনি ক্ষান্ত হয়েছেন।

মসজিদ হতে মাগরিবের সালাত আদায় করে বাসায় ফিরেই শওকত রহমান উঁকি দিলেন মেয়ের রুমে। দরজা খোলা তাই আর নক করার প্রয়োজন বোধ মনে করলেন না। বিছানার মাঝ বরাবর বসে আছে মীরা। তার চারিপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেক গুলো শাড়ি। সুতী, জামদানী, টাংগাইল শাড়ী বেশি। বেশির ভাগ শাড়ির রং সাদা, সবুজ কিংবা ঘি’য়ে।
মেয়েকে এক পলক দেখে শওকত রহমান গলা খাঁকারি দিয়ে রুমে প্রবেশ করলেন। পিতার পরিচিত কন্ঠস্বর কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই নুইয়ে রাখা মাথাটা তুলে মীরা সামনে তাকালো, চোখে চোখ পরতেই মিষ্টি একটা হাসি ছুড়ে দিলো প্রাণপ্রিয় আব্বাজানের জন্য। সালাম বিনিময় করে বাবাকে বসার ব্যাবস্থা করে দিতে বিছানা হতে কিছু শাড়ি সরিয়ে একপাশে রাখলো মীরা। রাশভারী প্রবীণ জ্ঞানসম্পন্ন মানুষটি মেয়ের কাছাকাছি এসে বসলেন। গাম্ভীর্য পূর্ণ চেহারায় সুন্দর একটা হাসি ফুটিয়ে বললেন,

-‘কি করছে আমার আম্মাজান?’

-‘দাদীজানের শাড়িগুলো গোচাচ্ছি আব্বাজান। অনেক দিন তোলা ছিলো, আজ রোদে দিয়েছিলাম। ভাঁজ করা শেষ হলেই আলমারিতে রাখবো।’

-‘রেখে আর কি হবে? আম্মাজানের অনুপস্থিতিতে এগুলো সব তো আপনারই। সাথে নিয়ে যাবেন, মাঝে মাঝে পরবেন।’

মীরার মুখে মিঠে হাসিটা ফুটে উঠল আবারও। শুধু শাড়ি কেনো, বেঁচে থাকা কালীন পুরো মানুষটাই যে তার ছিলো। হাসির আড়ালে চাপা দীর্ঘশ্বাস টা বুকের মাঝেই চাপা রেখে হালকা বেগুনি রংয়ের একটা শাড়ি নাকের কাছে নিয়ে আঁখি পল্লব বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস গ্রহণ করল মীরা। রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করলো নূর জাহান বেগমের শরীরের মমতাময়ী ঘ্রাণ। শাড়িটা শওকত রহমানের হাতে দিয়ে হাসি-হাসি মুখে বলল মীরা,

-‘দাদীজান আমাদের সাথেই আছে তাই না আব্বাজান। এই যে দেখেন, কতো গভীর ঘ্রাণ। এখনও ঠিক আগের মতোই।’

শওকত রহমানের আদলখানি মলিন হলো কিছুটা। নিজের মেয়ের মাঝে মায়ের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলেও মায়ের শূন্য স্থান যে কখনোই পূরণ হবার নয়। সময়ের তালে তালে বয়স বাড়লেও মাতৃস্নেহের জন্য তার মন কাঁদে মাঝে মাঝেই। ভেতরের হাহাকার টা আড়াল করলেন মীরার থেকে। শাড়িটা আলতো হাতে ছুঁয়ে বুকে চেপে ধরলেন। মায়ের স্নেহময় কোলটাকে অনুভব করলেন সংগোপনে। অনেক গুলো ভাঁজ করা শাড়ি থেকে গাঢ়
সবুজ-কালো রংয়ের সংমিশ্রণে সুতোর বুননে কারুকার্যখচিত জামদানী শাড়িটা হাতে নিলেন। মীরার ন্যায় তিনিও নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রাণ নিলেন। আগের থেকে কমে গেলেও, মায়ের সেই পরিচিত ঘ্রাণ ঠিকি বুঝতে সক্ষম হলেন তিনি।

-‘আম্মাজান?’

শাড়ি ভাঁজ করতে থাকা মীরার ব্যাস্ত হাত থেমে গেলো বাবার ডাকে। শাড়িতে নিবদ্ধ থাকা নজর ও ঘুড়ে গেলো আব্বাজানের দিকে। চোখে চোখ পরতেই শওকত রহমান এক গাল হেসে বললেন,

-‘নেন, এই শাড়িটা আলাদা করে রাখেন। সময় করে একদিন পরবেন। ভালো লাগবে।’

মীরা হাসি মুখে বাবার হাত থেকে শাড়িটা নিলো। শওকত রহমান আরো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে তবেই প্রস্থান করলেন রুম হতে।

_____________

মধ্যরাত্রি। পিনপিতন নিরবতা চারিদিক। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মীরার ঘুম ভাঙ্গল আকস্মিক কলিং বেলের উচ্চশব্দে। একবার, হ্যাঁ একবার ই বেজেছে। কে আসলো এতো রাতে? গভীর ঘুম ভাঙ্গার ফলে বিরক্তির সহিত চিন্তার সুক্ষ্ণ ভাঁজও ফুটে ওঠেছে কপালে। কান খাড়া করে আরেক বার কলিং বেলের শব্দের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলো মীরা। না, আর বাজছে না। বুক অব্দি জড়িয়ে রাখা কাঁথাটা মাথা অব্দি টেনে চোখ মুখ ঢেকে নিলো। নয়ন জোড়া বন্ধ করে যখনি ঘুমের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে তখনি পুনরায় উচ্চ আওয়াজে কলিং বেল বেজে উঠলো পর পর দুই বার। ধরফর করে উঠে বসল মীরা। পাশ হতে মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো রাত একটা বাজতে মাত্র মাঁচ মিনিট বাকি। আম্মা কিংবা আব্বাজান কে ডেকে তুলে দেখা উচিত কে এসেছে। চোখ কচলে ঠান্ডা ফ্লোরে পা রাখলো গমনের উদ্দেশ্যে।

তিন তলার সদর দরজার সামনে অস্থির ভাবে পায়চারী করছে রাইফ। শুধু বাহির টাই তার অস্থির না, সেই সাথে ভেতরটাও তুফানের ন্যায় অস্থির। অফিসিয়াল কাজে চারদিনের জন্য ঢাকা গেলেও আগে ভাগে কাজ শেষ হওয়াতে তিন দিনের মাথাতেই বাসায় ব্যাক করেছে সে। অনেক রাতে ফিরেছে বলে আর ফোন করে জানায়নি মীরাকে। জার্নি করে এসেছে, একেবারে সকালেই না হয় দেখা করবে। কিন্তু বিপত্তি ঘটেছিলো ঘুমাতে গিয়ে। এপাশ ওপাশ করেও রাইফ ঘুমাতে পারছিলো না কিছুতেই। মীরাকে স্মরণ হচ্ছিলো বার বার। ঘড়িতে ঘন্টার কাটা তখন বারোটার ঘরে আর মিনিটের কাটা পয়তাল্লিশে। রাত্রি বারোটা বেজে পপয়তাল্লিশ মিনিট। এখন মীরাকে আনতে যাওয়ার উপযুক্ত সময় না। সাত-পাঁচ ভেবে বেপরোয়া মনটাকে যা খুশি তাই বোঝ দিয়ে নাকে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা রত রাইফ পুনরায় ব্যার্থ হলো। নাহ, থাকা যাচ্ছে না নিদ্রাহীন ভাবে শুয়ে থাকতে। পিঠ টা টনটনে ব্যাথা করছে তার। সোজা উঠে বসলো সে। এভাবে নিজেকে শাস্তি দেওয়ার কোনো মানেই দেখছে না রাইফ। নিজের বউ, নিজের শশুড় বাড়ি। রাত আর বিরাত আছে নাকি? যখন মন চাই তখনি যেতে পারবে। সেই মূহুর্তে কি হলো কে জানে! আগা মাথা আর কিছুই তখন ভাবে নি রাইফ। ফটাফট উঠে লম্বা-লম্বি চেক চেক সাদা কালো টিশার্ট গায়ে জড়িয়েই ছুটে এসেছে শশুড় বাড়ির তিন তলার সদর দরজায়। এখানে আসার পর পর ই মনে হয়েছিলো বিশাল একটা ভুল কাজ করে ফেলেছে সে। ফোনটা সাথে আনা উচিত ছিলো। ফোনটা সাথে থাকলে এভাবে আর ঘর সুদ্ধ মানুষকে কলিং বেল চেপে জাগাতে হতো না। একটা কল করেই মীরাকে ফুরুৎ করে বেরিয়ে আনা যেতো। থাক ওসব, এসে যখন পড়েছে তখন আর ফিরে যাবে না সে। বউ কে সাথে নিয়েই যাবে। একবার কলিং বেল চেপে দাঁড়িয়ে থাকা রাইফ অধৈর্য হয়েছিলো কারো সাড়াশব্দ না পেয়ে। কতো ঘুম ঘুমায় রে বাবা! তিনজন মানুষের একজনও সজাগ পাচ্ছে না। ধৈর্য আর বাঁধ মানেনি তার। পর পর দু বার কলিং বেলের সুইচ চেপেই ক্ষান্ত হলো সে। সেকেন্ড দশেকের মাঝে অবশেষে রাইফের ধৈর্যের কঠিন পরীক্ষা নিয়ে দরজা খুললেন খাদিজা বেগম। ঘুম কাতুরে মধ্য বয়সী মহিলার চোখে মুখে বিস্ময়ের ছাপ। রাইফ কে দেখে মুখে জোর পূর্বক হাসি টেনে দরজা থেকে সরে গিয়ে বললেন,

-‘এতো রাতে রাইফ? আসো ভেতরে আসো। কোনো অসুবিধা হয়নি তো?’

অসুবিধা তো হয়েছে। অবশ্যই হয়েছে। কেনো হবে না? নতুন বউ ছাড়া এই রাইফের অসুবিধা তো হবেই। এটাই স্বাভাবিক। উল্টো অসুবিধা না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। রাইফ অগ্রসর হলো, প্রবেশ করলো বাসার ভেতর। মীরার রুমের দিকে তাকিয়ে বলল,

-‘হ্যাঁ আম্মা। অসুবিধা একটু হয়েছে। মীরা কই?’

প্রশ্নটা করে বুঝতে পারলো প্রশ্নটা করা উচিত হয়নি। মীরা এতো রাতে কোথায় আর থাকবে? স্বামীকে আ’ঙ্গার করে, দু চোখের ঘুম কেড়ে নিয়ে নিজে আরামে ঘুমাচ্ছে নিশ্চয়ই। ছটফট করতে থাকা রাইফের মতিগতি বোঝার চেষ্টা করছেন খাদিজা বেগম। এতো দিন হলো জামাতা হয়েছে, ছেলেটার এমন আচরণ যে আজকেই প্রথম। কেমন যেনো অদ্ভুত আচরণ।

-‘দাঁড়িয়ে কেনো? বসো। কখন আসছো ঢাকা থেকে?’

-‘এইতো একটু আগে।’

কথাটা বলেই উচ্চস্বরে ‘মীরা’ নাম ধরে ডেকে উঠলো রাইফ। তার ধৈর্য আর কুলালো না সত্যি। এতোক্ষণে তো চলে আসার কথা। মীরা ঘুম কাতুরে ঠিক আছে। তাই বলে এতোটা? রাইফের ডাক কি তার কানে যাচ্ছে না? আজব ব্যাপার স্যাপার! খাদিজা বেগম রাইফের এমন আচরণের কূল কিনারা পাচ্ছেন না কিছুতেই। অস্বস্তি মূলক ভঙ্গিতে শুধালেন,

-‘রাইফ বাবা, এতো রাতে কোনো কিছুর কি দরকার?’

-‘হ্যাঁ দরকার তো আম্মা। মীরাকে দরকার। একটু ডেকে দেন না প্লিজ। এতো লেট করছে কেনো আসতে!’

পরপর কয়েক বার কলিং বেলের শব্দ এবং শেষে নিজের নাম রাইফের কন্ঠে শুনতেই মাত্র ফ্লোরে পা রাখা মীরা কোনো রকমে লাইট জ্বা/লিয়ে ধরফর করে দৌড়ে নিজ রুম হতে বাহিরে এসেছে। কিন্তু রাইফের মুখে ‘মীরাকে দরকার’ কথাটা শুনে চলমান পদক্রম শ্লথ হলো। এভাবে কেউ শাশুড়ীকে বলে নাকি যে তার মেয়েকে দরকার! দিন দিন লোকটা কেমন লাগামহীন হয়ে যাচ্ছে। মায়ের সামনে রাইফের মুখে এমন কথায় লজ্জা পেলো খানিক। স্বামীর ডাকে যতটা উৎসাহের সহিত ছুটে এসেছিলো, ততটাই নিভে গেলো রাইফের শেষ কথাটুকু শুনে। পায়ের আওয়াজে মীরার দিকে তাকালো রাইফ। পরিচিত সেই হাসিটা দিয়েই তাকিয়েছে সে। কিন্তু মীরার এমন রূপ তার জান ক/বজ করে নিলো যেনো। মোচড় দিলো ছোট্ট বক্ষপিঞ্জর। চক্ষুদ্বয় কোটর ছেড়ে বাহিরে আসবে যে কোনো সময়। অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে ঠোঁট জোড়াও ফাঁক হয়েছে কিঞ্চিৎ। সবুজ রঙের শাড়িতে মীরাকে সবুজ শ্যামল প্রকৃতির থেকেও যেনো সুন্দর লাগছে রাইফের কাছে। ঘুম থেকে ওঠা মীরার ফোলা ফোলা তৈলাক্ত চোখ মুখ সদ্য বৃষ্টিতে ভেজে দূর্বাঘাসের মতোই স্নিগ্ধ লাগছে। রাইফের নে/শা/লো দৃষ্টি মীরাকে আড়ষ্ট করলো বেশ। লোকটি কি ভুলে গেলো নাকি এখানে তার শাশুড়ীও আছে। মীরা নিজেই এগিয়ে এলো, অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পরে নজর এদিক সেদিক ঘুরিয়ে শুধালো,

-‘কখন এসেছেন?’

মীরার রূপের মোহে আচ্ছন্ন হওয়া রাইফ যন্ত্রের ন্যায় জবাব দিলো,

-‘অনেক ক্ষণ’

মীরা রাইফের এমন জবাবে এবার সত্যি বিপাকে পরলো। ধ্যান ভাঙ্গাতে এসে নিজেই রাইফের এমন নে/শা/ময় চাহনিতে কাবু হচ্ছে। খাদিজা বেগম মীরার দিকে তাকিয়ে রাইফকে ঘরে নিয়ে যেতে আদেশ করলেন। ব্যাস, ধ্যান ভাঙ্গলো রাইফের। ঝটপট উঠে দাঁড়ালো সে। মীরার হাতটা খপ করে ধরে খাদিজা বেগমের দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে বলল,

-‘মীরাকে নিতে আসছিলাম। নিয়ে যাচ্ছি। চিন্তা করবেন না। এখন সব ঠিকঠাক আম্মা। ঘুমান।’

কথাটা বলে মীরার দিকে তাকালো রাইফ। কন্ঠস্বর কিছুটা চেপে মৃদ্যু আওয়াজে বলল,

-‘কি দেখছো? আসো। কি করবো বলো? তোমাকে ছাড়া ঘুম আসছিলো না তো। দিন দিন কেমন বাজে অভ্যাসে পরিনত হচ্ছো। ভালো ভালো। এভাবেই থেকো, পরিবর্তন করার প্রয়োজন নেই একটুও।’

চলবে……

মুঠোবন্দী লাজুকলতা পর্ব-৩৪

0

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_৩৪

দিনের মধ্যভাগ। সূর্যরশ্মি লম্বালম্বি ভাবে প্রখর তাপ দিচ্ছে ধরণীতে। আজ একটু দেড়ি করেই ঘুম থেকে ওঠে শাশুড়ীর সাথে নাস্তা করে রাইফ অফিসে চলে যেতেই পুনরায় ঘুমিয়ে পরেছে মীরা। রাইফ যেনো আজ অফিস না যায় সে জন্য অনেক বার বারণ করেছিলো সে। কিন্তু জরুরি অফিসিয়াল কাজ থাকায় ছুটি নেওয়ার সুযোগ হয় নি রাইফের৷ রাতে পেইন কিলার খাওয়ার জন্য অবশ্য রাইফের মাথার পেছনে পাওয়া আঘাত অনেকটায় সেরে উঠেছে, ব্যাথাও কমে গেছে বেশ। জ্বরাক্রান্ত মীরার ও জ্বর কমে গেছে অনেকটা, কিন্তু শরীরে প্রফুল্লতা পাচ্ছে তেমন। ঝিমানো শরীরটা বার বার বিছানা টানছিলো শুধু। সেই যে সকালের নাস্তা শেষে বাবা মায়ের সাথে এক ফোঁকর দেখা করে এসেই ঘুমিয়েছিলো, সজাগ পেলো ভর দুপুরে বিছানার উপর অবহেলায় পরে থাকা মুঠোফোনের কর্কশ আওয়াজ এবং কম্পনে। ঘুমুঘুম চোখ জোড়া দুহাতের উল্টো পিঠের সাহায্যে ডলে ওঠে বসল। মুঠোফোনটা হাতে নিতেই দেখল ঝকঝকে স্কিনে জ্ব’লজ্ব’ল করে ভাসছে ‘Golar Mala’ লেখাটা। উর্মি কল করেছে। সকালেও দিয়েছিলো বেশ কয়েক বার। সে সময় কিছুটা ব্যাস্ত থাকার কারণে রেস্পন্স করা সম্ভব হয়নি মীরার। ফ্রি হয়ে যখন কল দিতে চেয়েছিলো তখন ই রাজ্যের ঘুম নেমেছিলো মীরার চোখে। কল ব্যাক করা সম্ভব হয় নি আর। মুখাবয়বের দুপাশ বেয়ে বুকের উপর ছড়িয়ে থাকা এলোমেলো চুল গুলো কানের পিঠে গুঁজে নিয়ে বৃদ্ধাংগুলির সাহায্যে মীরা কল রিসিভ করতে দেড়ি, অপর প্রান্ত হতে হুরমুর করে উর্মির ঝাঁঝালো কন্ঠ ভেসে আসতে দেড়ি হয় নি। ক্ষোভ মিশ্রিত কন্ঠে চেঁচিয়ে বলছে,

-‘দুই সপ্তাহ হয় নি বিয়ে হইছে তাতেই বড়লোক হয়ে গেছিস তাই না? এতো বার করে কল দেই, রিসিভ করিস না।’

-‘ব্যাস্ত ছিলাম রে। যখন ফ্রি হলাম তখন আবারও ঘুমাই গেছিলাম।’

মীরার কথার সূত্র ধরেই উর্মির প্রশ্ন,

-‘কেন? রাতে ঘুমাস নি? গরু চুরি করছিস নাকি জামাই আদর খাইছিস?’

উর্মির ঠেস দিয়ে বলা প্রশ্নতে মীরার শরীর শিরশির করে উঠলো। সয়ংক্রিয় ভাবে তার বাম হাত টা ঘাড়ে চলে গেলো। দু ঠোঁটের মাধ্যমে লোকটা যে গতরাতে বেশ জ্বালিয়েছিলো তাকে, আধিপত্য বিস্তার করেছিলো সমগ্র ঘাড় জুড়ে। রাইফের এমন কার্যকলাপ মনসপটে ভেসে উঠতেই মীরার ঠোঁট জোড়া কিঞ্চিৎ প্রসস্থ হলো, লজ্জা মিশ্রিত মুচকি হাসি ফুটে ওঠল ঘুম কাতুরে মায়াবী মুখশ্রী তে। আন্দাজে ঢিল মারা প্রশ্ন যে জায়গা মতো পরেছে সেটা উর্মি নিজে না জানলেও মীরা ঠিক ই জানে। বুদ্ধিদীপ্ত মীরা কিছুটা কৌশলের সহিত এমন ভাবে উত্তর দিলো ‘জামাই এর আদর।’ যে উর্মি সত্য কিনা মিথ্যা ধরতে পারল না। শুধু আফসোসের কন্ঠে বলল,

-‘তোর ই সময় মীরু, এসব আর বলিস না। না না, ভুলেও না। জামাই পাইছস, আদর ও পাইছস। আমার আর কে আছে বল?’

-‘ তোর জন্য দারোয়ান ব্যাটা আছে তো।’

চেতে গেলো উর্মি। যাকে সে যমের মতো ভয় পায় তার কথা বলেই খোঁচা দিচ্ছে। পাইছে টা কি মীরা? ঈষৎ রাগ প্রকাশ করে ধমকের স্বরে বলল উর্মি,

-‘ফালতু কথা বলবি না মীরু। রাইফ ভাই এর সাথে থাকতে থাকতে আজকাল তুই ও কেমন উল্টা পাল্টা বলিস। আমার জন মনে হয় সুইজারল্যান্ড আছে বুঝছিস। হেঁটে হেঁটে আসতেছে তাই সময় লাগছে।’

উর্মির অযৌক্তিক কথা শুনে ফিক করে হেসে দিলো মীরা। জামাই তার সুইজারল্যান্ড থাকে, কিন্তু আসছে হেঁটে হেঁটে! বাহ! কি মারাত্নক যুক্তি! না না, অসম্ভব। এটা যুক্তি হতেই পারে না। বলা যায় কি সুন্দর অযুক্তি।
তবে যুক্তিতর্ক আর করলো না মীরা, তাল মেলালো উর্মির কথায়। মিটিমিটি হাস্যজ্বল মুখে জিজ্ঞাসা করল,

-‘আকাশ দিয়ে হেঁটে আসছে নাকি পাতাল দিয়ে?’

-‘যেদিক দিয়েই আসুক, আসতেছে তো মেহেদী পায়ে দিয়ে কচ্ছপের গতীতে। আমার কি! আমার লাভ ও নাই, লস ও নাই। সে নিজেই এসে বউ টাকে বুড়ি অবস্থায় পাবে। ঠকবে তো ব্যাটা নিজেই।’

-‘হুম ভালোই হবে। এসেই লাঠিতে ভর দিয়ে চলা উর্মির গলার মালা হয়ে ঝুলে পরবে। তাই না গলা, উপস সরি, উর্মিমালা?

নাম নিয়ে মীরার সুক্ষ্ণ খোঁচা উর্মির বুঝতে সময় লাগলো না। এতো বছর এক সাথে ছোট থেকে বড় হয়েছে কিন্তু সুযোগ পেলেই মীরা গলার মালা ডাকতে ভুলে না তাকে। উর্মির সাথে না হয় মালা মিলিয়ে উর্মিমালা ডাকা যায়, কিন্তু গলার মালা না ছালা এসব আবার কি! যদিও সে জানে মীরা তাকে আদর করে সবসময় না ডাকলেও জমজমাট কথোপকথনে ‘গলার মালা’ বলে সম্বোধন করে তবুও মুখ কিছুটা গোমড়া করে থাকলো সে। কথায় বলবে না আজ। নিরবতা ভেঙ্গে ডেকে উঠলো মীরা,

-‘কিরে? রেগে গেলি?’

-‘হ্যাঁ।’

-‘আরেকটু রাগাই।’

-‘রাগা।’

-‘তোর বর খুঁজতে আজ আমিও সুইজারল্যান্ড এর উদ্দেশ্যে বের হবো বুঝছিস। কচ্ছপের গতীতে না রে, যাবো তো আমি খরগোশের গতিতে।’

কথা চলমান অবস্থাতেই বড় একটা হাই উঠলো মীরার। মুখের উপর বা হাতের উল্টো পিঠ রেখে হাই তোলা অবস্থাতেই বলল,

-‘মাঝ রস্তায় ঘুমিয়ে গেলে ডেকে তুলিস। ঠিক আছে?’

-‘না ঠিক নাই। ভাল্লাগে না। তুই এখনি ঘুমা।’

-‘আচ্ছা।’

নিরব হলো দুজন ই। কারো মুখ থেকেই কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। মূলত মীরার খোঁজ নিতেই কল করেছিলো উর্মি। কিন্তু এক কথা, দু কথা থেকে কতো কথা হয়ে গেলো, অথচ আসল কথা জিজ্ঞাসা করতেই ভুলে গিয়েছে সে। মোলায়েম কন্ঠে উর্মি শুধালো,

-‘এখন তোর শরীর কেমন মীরু? মামির কাছে শুনেছি রাতের ঘটনা। আল্লাহ, আমি শুনেই খুব ভয় পাইছি।’

-‘আলহামদুলিল্লাহ। ভালো আছি। আল্লাহ বাঁচাইছে রে। এমন ভাবে ট্রাকটা আমাদের দিকে আসতেছিলো, ত্রিশ সেকেন্ড দেড়ি হলেই আজ হয়তো আমাদের লা/শ পরে থাকতো। উনি যদি আমাকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে না পরতো, এতোক্ষণে হয়তো.. ‘

কন্ঠ কেঁপে উঠলো, গলা ধরে গেলো মীরার। বাকি টুকু বলতে চেয়েও আর বলতে পারলো না। দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার মতো চিরন্তন সত্য আমরা জানলেও এই দুই দিনের দুনিয়ার মায়া কেউ ই কাটাতে পারি না সহজে। মীরাও তার ব্যাতিক্রম নয়। নিজের মৃত্যুর সাথে সঙ্গীর মৃ/ত্যুর ভয় সেই যে কোমল হৃদ যন্ত্রটাতে জেঁকে বসেছে, এখনও পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারে নি সে।

_________________

পড়ন্ত বিকেল। রাজিয়া বেগমের নরম বিছানায় বসে শুকনো কাপড় চোপড় সাবধানতা অবলম্বন করে ক্ষত হাতেই ধীরে ধীরে ভাঁজ করছে মীরা। পাশেই রাজিয়া বেগম খোশগল্প জুড়ে দিয়েছেন পুত্রবধূর সহিত। কতো রকমের গল্প যে উনি করছেন তার হদিস নেই। কখনও উনার বিয়ের গল্প তো কখনও ছেলের জন্মের গল্প। কখনও নিজের শৈশবের গল্প তো কখনও কৈশরের। এই তো কিছুক্ষণ আগেই নিজের সুন্দর সংসারের মিষ্টি মিষ্টি ঘটনা গুলো হাসি মুখে শুরু করলেও শেষ টা এখন বিষাদের দিকে গড়াচ্ছে। স্বামীর সুমধুর স্মৃতিচারণ যে ধীরে ধীরে স্বামীর শূন্যতা গ্রাস করবে উনাকে, বেদনাদায়ক করে তুলবে তার ভেতরটা বুঝতেই পারছেন না তিনি। মীরা আজ আর নিরব শ্রোতা নয়। সে নিজেও ভীষণ আগ্রহের সহিত নিজে থেকে দুই একটা প্রশ্ন করছে। জানার আগ্রহ বাড়ছে রাইফের শৈশব থেকে শুরু করে শশুড়ের অন্তিম বিদায়ের কাহিনীও।
সদর দরজায় পরপর দুবার টোকা পরতেই অগ্যাত মীরা পিছু ফিরল। কাপড় গুলো এক দিকে সরিয়ে রেখেই ছুটলো দোর খোলার উদ্দেশ্য। দ্রুতপদে ছুটে যাওয়া মীরার কপালে কিছুটা চিন্তার সুক্ষ্ণ ভাঁজ লক্ষনীয়। সবে তিনটা পঞ্চাশ বাজে, এতো দ্রুত তো উনার আসার কথা নয়। তবে? এ’কদিনের মাঝেই মীরা দরজার উপর টোকা দেওয়ার ধরণ শুনেই বুঝে যায় রাইফের আগমন। লোকটা সবসময় পরপর দুবার কিছুটা তাল মিলিয়ে টোকা দেয় যা সবার থেকে কিছুটা ইউনিক হয়, অন্যদের থেকে সহজেই আলাদা করা যায়। চিহ্নিত করা যায় রাইফের আগমন।
নব ঘুরিয়ে দরজা খুলতেই দেখতে পেলো চৌকস চেহারার অধিকারী সেই পরিচিত মুখ। ক্লান্তিপূর্ণ মুখটাতে মীরাকে দেখা মাত্রই ফুটে তুলেছে মুচকি হাসি। রাইফের হাসিতে মীরা নিজেও ফেরত দিলো সুন্দর মিষ্টি হাসি। সামনে থেকে সরে গিয়ে স্বামীকে ভেতরে আসার জায়গা করে দিলো মীরা। রাইফ জুতা খুলে প্রবেশ করতে করতেই মীরার শরীর এবং মায়ের খোঁজটুকু জেনে নিলো। দরজা লাগিয়ে রাইফের পিছু পিছু হাঁটতে থাকা মীরার মনে খচখচ করা প্রশ্নটা করেই বসল সে। ধীর কন্ঠে শুধালো,

-‘আজ এতো দ্রুত আসলেন?’

চলমান রাইফ পিছু ফিরে এক পলক তাকালো মীরার দিকে। রুমে ঢুকে ফোন, ওয়ালেট এবং বাইকের চাবিটা ছোট টেবিলটাতে রেখেই বিছানায় বসল। গায়ে আঁটসাঁট ভাবে জড়িয়ে থাকা ধূসর রংয়ের শার্টটার উপরের দু বোতাম খুলে দিয়ে পরখ করল মীরাকে। আসল কথা বলতে গিয়েও সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মীরার উৎসুক মুখটা দেখে আর সোজা-সাপটা কথাটা বলা হলো না রাইফের। দুষ্টুমি মাখা স্বরে বাঁকা কথাটা বলেই ফেললো,

-‘বউ ছাড়া মন টিকে না।’

আহাম্মক বনে গেলো মীরা। সে তো ভুলেই গিয়েছিলো রাইফের উল্টো জবাব দেওয়ার অভ্যাসটা। তবে আজ আর তাল মিলালো না। উত্তরটা জানার উদ্দেশ্য শান্ত কন্ঠেই বলল,

-‘ঠাড্ডা করবেন না তো। এতো দ্রুত কেনো আসলেন সেটা বলেন?’

-‘বাসায় আসবো না?’

-‘আসবেন। কিন্তু,’

-‘কিন্তুটা তুমি মীরাবতী। বাড়িতে বউ রেখে অফিসে মন টেকানো মেরে লিয়ে না মুমকিন হ্যাঁ। সামঝি?’

বুঝেও মীরার অবুঝ উত্তর,

-‘নেহি, মুঝে সামাঝ নেহি আয়া।’

রাইফের মৃদ্যু হাসিটা মীরার উত্তর শুনে প্রসস্থ হলো বেশ এবং ধীরে ধীরে অট্টহাসিতে রূপ নিলো। নিজেই হিন্দিতে উত্তর দিয়ে আবার বলছে সামাঝ নেহি আয়া। স্মার্ট, ভেরি স্মার্ট।কোনো রকমে হাসি থামিয়ে ফ্যানের সুইচ অন করতে বিপরীত পাশে চলে যাওয়া মীরাকে উদ্দেশ্য করে বলল রাইফ,

-‘বোঝো নি যখন তখন সামনে আসো, কাছে বসো। দুই একটা চুমুটুমু খাই। আঘাত পেয়ে হ্যাং হয়ে যাওয়া মাথাটা আমার ও খুলে যাক, তোমার ও ব্যাথা কমুক।’

রাইফের এমন খোলামেলা কথায় ফ্যানের সুইচ অন করতে থাকা মীরার হাত থেমে গেলো, কান গরম হলো অস্বাভাবিক ভাবে। এই লোক শোধরানোর না। এখন কথা বাড়ানো মানেই রাইফের ইঙ্গিত পূর্ণ কথাতে আরো লজ্জাকর পরিস্থিতিতে পরা। দ্রুত সুইট টা অন করেই নিজেকে আড়াল করতে দ্রুতপদে ছুটলো রুম হতে চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু রাইফ এবারও রেহাই দিলো না তার লাজুকলতাকে। কন্ঠটা কিঞ্চিৎ উঁচু করে গমগম আওয়াজ তুলে বলল,

-‘এভাবে লজ্জা পেয়ো না লাজুকলতা। মারাত্নক সুন্দর লাগে, ভীষণ মিষ্টি লাগে। আহ্ হা! মনটা শুধু বউ বউ করে। না জানি হুট করে কেউ ভরা মজলিসে বউ পা’গলা ডেকে বসে।’

চলবে…..

মুঠোবন্দী লাজুকলতা পর্ব-৩৩

0

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_৩৩

বাসার সামনের সরু গলিটা দিয়ে ব্যাস্ত ভাবে পায়চারী করছেন শওকত রহমান। রাশভারি মুখটাতে তার চিন্তার ছাপ স্পষ্ট, মনটাও সন্তান এবং জামাতার জন্য ভীষণ রকমের উৎকন্ঠিত। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় যে উনার দেহ হতে কুলকুল করে ঘাম ঝরছে তা গায়ের সাতবে লেপ্টে থাকা ভেজা সাদা পাঞ্জাবি টাতে বাহ্যিক দিক থেকেই স্পষ্ট। রাতের আঁধারে নিরিবিলি গলি, হুটহাট দুই একটা মানুষের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। রাস্তার ধারে বন্ধ টং দোকানের ব্রেঞ্চটাতে বসলেন শওকত রহমান। পাঞ্জাবীর পকেট থেকে মুঠোফোন বের করে সময় দেখলেন বারোটা বাজতে আর মাত্র পাঁচ মিনিটের ঘাটতি। লাস্ট এক ঘন্টায় তিনি সময় দেখেছেন কম করে হলেও বিশ বার। এই এক ঘন্টা তার কাছে মনে হচ্ছে উনার জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘতম ঘন্টা। ষাট মিনিটে এক ঘন্টা হলেও, আজ তার কাছে এক ঘন্টাকে এক দিনের সমপরিমাণ মনে হচ্ছে, প্রয়োজনে তার থকেও বেশি। অপেক্ষারত শওকত রহমান উঠে দাঁড়ানোর আগে সময়টা আরেক বার দেখলেন, রাত্রী বারোটা বেজে এক মিনিট। নতুন তারিখের সূচনা, কিন্তু তার অপেক্ষার পালা শেষ হচ্ছে না কিছুতেই।
অবশেষে অপেক্ষার অবসান হলো শওকত রহমানের। দূর হতে বাইকের হেডলাইটের আলো দেখে অশান্ত মনটা আরো বেশি ছটফট করে উঠল উনার।
রাইফ এক টানে বাইক নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে শশুড়ের সামনে। শওকত রহমান দ্রুত ছুটে এলেন, শারিরীক দিক থেকে দুজনকে স্বাভাবিক দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেললেন। আব্বাজানের দেখা পেয়ে মীরার ভ’ঙ্গুর মন মোচড় দিয়ে উঠল, ঝড়ো বর্ষণ নামার পূর্ব প্রস্তুতি দেখা দিলো ভাসা ভাসা মায়াবী চোখ জোড়ায়। ঢোক গিলে নয়নজোড়া বন্ধ করে ঠিকরে বেরিয়ে আসা নোনাজল ভেতরেই চাপা দিলো মীরা, ছিলে যাওয়া হাতের ক্ষত আড়াল করল ওড়নার ভেতর। নিজেকে শক্ত করল, বাবার সামনে নিজের ব্যাথাতুর মুখটায় মৃদু হাসি ফুটালো। রাইফ এবং মীরার নিকট দূর্ঘটনার বিস্তারিত শুনে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করলেন। এমন পরিস্থিতে মাথার পেছনে আঘাত প্রাপ্ত রাইফ নিজেই ড্রাইভ করে আসার জন্য একচোট বকাও খেলো শশুড় মহাশয় এর থেকে। রাইফ জানালো, সে বেশি রাস্তা ড্রাইফ করে নি। সিএনজি তে করে এসেছে পুরো রাস্তা। চেয়ারম্যানের ঠিক করে দেওয়া বিশ বাইশ বছরের ছেলেটা বাইক নিয়ে এসেছে তাদের পিছু পিছু। অনেক রাত হয়ে গেছে জন্য রাইফ আর তাদের আগাতে দেয় নি। বাকি পথ নিজেই যেতে পারবে জানিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বিদায় নিয়েছে তাদের থেকে। শওকত রহমান দুজনকে সাথে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলেন। তিন তলায় সদর দরজায় দুজনেই অপেক্ষারত মা এবং শাশুড়ী কে দেখল কান্নারত চেহারায়। চাপা কান্না বাঁধ মানলো না খাফিজা বেগম এবং রাজিয়া বেগমের। নিজ নিজ সন্তান কে বুকে আগলে নিয়েই হু হু করে কেঁদে উঠলেন দুজনে।

_______________

মধ্যরাত্রি। ঘড়ির কাটা দেড়টা ছুঁই ছুঁই। রাইফ মাথার পেছনে আ’ঘাত পাওয়াতে অপেক্ষা না করে আজ দ্রুত শুয়ে পরেছে মীরার আগেই। কোনো রকম ফ্রেশ হয়ে, দু লুকমা খাবার খেয়ে, সালাত আদায় করেই মীরাও শুয়ে পরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বারান্দার লাইট জ্বালিয়ে রুমের আলো নিভিয়ে গুটিগুটি পায়ে নীরবে বিছানায় এসে বসল সে। বালিশের পাশ হতে মুঠোফোন টা হাতে নিলো ফজরের সালাত আদায় এর উদ্দেশ্যে এলার্ম সেট করার জন্য। সাধারণত বহুদিনের অভ্যাসরত মীরা এলার্ম বিহীন ফজরের ওয়াক্তে সজাগ পায়, কিন্তু আজকের কথা ভিন্ন। দূর্ঘটনার ধকল শেষে এমনিতেই আজ ঘুমাতে বেশ দেড়ি, তার উপর দেহের আ’ঘাত প্রাপ্ত স্থানের ব্যাথা কমানোর জন্য হাই পাওয়ার পেইন কিলার খেয়েছে দুজন ই। আজ ভোরে ঘুম থেকে উঠার জন্য এলার্ম এর সাহায্য নেওয়া মীরার জন্য সত্যি জরুরি। এলার্ম সেট করে মীরা পুনরায় বালিশের পাশে রেখে দিলো ফোনটা। যেহেতু বারান্দার লাইট অন, সেহেতু বাহিরের সেই আলো ঘরে প্রবেশ করে পুরো রুম আলোকিত করেছে বেশ। মীরা এক পলক তাকালো রাইফের দিকে। চিৎ হয়ে চোখের উপর হাত রেখে শুয়ে আছে রাইফ। ঘুমিয়ে গেছে নাকি সজাগ, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। নিচে ঝুলিয়ে রাখা পা দুটো তুলে ভাঁজ করে বিছানার উপরে বসল মীরা। ঢিলে হয়ে আসা হাত খোঁপাটা খুলে দিলো, কোমড় সমান চুল গুলো আলগোছে জায়গা করে নিলো পুরো পিঠ সমেত। খোলা চুলে ঘুমানো মীরার ছোট বেলার অভ্যাস। শুয়ে থাকা রাইফের যেনো ঘুমে বিঘ্ন না ঘটে তাই চুপি চুপি বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই আচমকা চোখ মুখ খিঁচিয়ে চাপা আর্তনাদ করে উঠল মীরা। যেভাবে শুয়েছিলো সেভাবেই সে তড়িৎগতিতে উঠে বসতেই নিদ্রায় মাত্র চোখ লেগে আসা রাইফও ধপ করে উঠে বসল। মীরার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল, চোখ খিঁচে ঠোঁট কামড়ে রেখেছে মেয়েটা। ঘাড়ের উপর দিয়ে ক্ষত হাতটা পেছনে নিয়ে পিঠে চেপে রেখেছে। রাইফ দ্রুত মীরার কাছে এলো, উৎকন্ঠিত স্বরে শুধালো,

-‘কি হয়েছে মীরা? দেখি, দেখাও আমাকে।’

ব্যাথায় জর্জরিত মীরা ছটফটিয়ে উঠলো। ব্যাস্ত কন্ঠে বলল,

-‘পিঠে কি যেনো খুব বিঁধছে। ব্যাথা লাগছে প্রচন্ড।’

-‘দেখি, ওদিকে ঘোরো।’

ব্যাথাতুর মীরা দু দিকে ঘাড় নাড়িয়ে নিষেধ করল। দূর্ঘটনার পর সংকোচ ভুলে যাওয়া মীরাকে আবারও আষ্টেপৃষ্টে সংকোচ জেঁকে বসেছে। পিঠে চিনচিনে ব্যাথাতুর যায়গা রাইফে দেখাতে ভীষণ লজ্জায় ভুগছে। রাইফের দিকে না তাকিয়েই মীরা মৃদু আওয়াজে বলল সে পারবে। আজ ধৈর্যশীল রাইফের কি হলো জানে না, মীরার কথায় রাগ দপাদপ মাথায় উঠলো। সবসময় এতো বেশি বুঝতে হবে কেনো এই মেয়েটার? এতোই যদি পারত তবে এখনও পারছে না কেনো? এখনও কেনো ব্যাথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে? ক্ষত হাত টাতে এতো প্রেশারই বা দিচ্ছে কেনো?
মীরার ঘাড় নাড়ানো না বোধক জবাবে একটা শব্দও উচ্চারণ করল না রাইফ। চোয়াল শক্ত করে কড়া চোখে গম্ভীর মুখে শুধু তাকিয়ে রইল মীরার দিকে। সুক্ষ্ণ চিনচিনে ব্যাথা সয়ে যাওয়া মীরা রাইফের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে নিম্নে রাখা মুখটা উপরে তুলল। এক পলক রাইফকে দেখেই মীরার মুখ থম মে/রে গেলো। রাইফের এমন কাঠিন্য গম্ভীর চেহারা যে এর আগে দেখেনি সে। রাইফের এমন তীক্ষ্ণ চাহনী, শক্ত চোয়াল আর নীরাবতা মীরার ভীত কাঁপিয়ে তুলল। সম্মোহনের ন্যায় ধীরে ধীরে রাইফের দিকে পিঠ দিয়ে ঘুরে বসল মীরা।
চিনচিনে ব্যাথাযুক্ত জায়গাটা থেকে হাত সরিয়ে নিলো সে। রাগান্বিত রাইফ মীরার পিঠ ময় ছড়িয়ে থাকা চুল গুলো বা হাতের আংগুলে সরিয়ে এক পাশে সামনে ঠেলে দিলো। রাইফের
আংগুলের স্পর্শ মীরার ঘাড় ছুঁইয়ে দিয়েছে বিড়বিড় করে। রাইফের আংগুলের হালকা স্পর্শে মীরা আড়ষ্ঠ হলো, রাইফের থেকে সামনের দিকে নুইয়ে গেলো অনেকটা এবং সাথে সাথেই রাইফের কড়া চাহনি মনে পড়লো তার। ভুল করে ফেলল সে। জিভ কে’টে রাগান্বিত রাইফের এক কড়া ধমকের অপেক্ষায় থাকা মীরা রাইফের আবারও কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে চোরা চোখে পেছন ঘুরে তাকিয়ে দেখলো এখনও আগের ন্যায় কঠিন মুখশ্রী রাইফের। ধীরে ধীরে পিঠ সোজা করে আবারও রাইফের সামনে টানটান হয়ে বসলো মীরা। ফিটিং জামা পরিহিত মীরার ডান কাঁধের কিছুটা নিচে পিঠের উপরিভাগ এ আলতো করে হাত বুলালো। তীক্ষ্ণ ধারালো কিছু একটা বিঁধে আছে মীরার পিঠে। রাইফ অনুমান করল কাঁচ জাতীয় কিছু একটা হবে। আবছায়া আলোয় মীরার গোলাপি রংয়ের জামাটার কিছু অংশ ভিজিয়ে দেওয়া তরল র/ক্তও টের পেলো রাইফ। ক্ষত স্থানে রাইফের হাতের আলতো স্পর্শেও মীরা আর্তনাদ করে উঠল। ব্যাতি ব্যাস্ত স্বরে বলল,

-‘আহ! ব্যাথা পাচ্ছি। হাত সরিয়ে নিন প্লিজ, হাত সরিয়ে নিন।’

রাইফ দ্রুত হাত সরিয়ে নিলো। মীরা আঁটসাঁট জামা পরিধান করায় বিঁধে যাওয়া বস্তু রাইফের পক্ষে বের করা সম্ভব নয়। বিছানা হতে নেমে ঝটপট উঠে দাঁড়ালো রাইফ। কাঠের আলমারি খুলে হ্যাংগারে ঝুলানো ফ্রেশ ছাই রংয়ের শার্ট টা এনে মীরার দিকে এগিয়ে দিলো। তীক্ষ্ণ ব্যাথা সয়ে যাওয়া মীরা একবার শার্ট তো আরেকবার রাইফের দিকে হতভম্ব চেহারা নিয়ে তাকিয়ে রইল ফেলফেল চোখে। রাইফ শার্ট ধরে রাখা হাত টা ঝাঁকিয়ে নেওয়ার জন্য তাগদা দিলো মীরাকে। গম্ভীর মুখটা আরো গম্ভীর করে আদেশ সূচকে বলল,

-‘এক মিনিটের মধ্যে চেঞ্জ করে আসবা। এক সেকেন্ড বেশি হলে আজ কিন্তু কিছু একটা করেই ছাড়বো মীরা। মাইন্ড ইট।’

ব্যাস, রাইফের ছোট্ট একটা মিষ্টি হুমকি কাজে লাগলো। রাইফের হাত থেকে শার্ট টা এক প্রকার ছিনিয়ে নিয়েই মীরা দ্রুত পায়ে ছুটল ওয়াশরুমে। নির্দিষ্ট করে সময় দেওয়া সত্বেও চেঞ্জ করে আসতে মীরার এক মিনিট তো দূরের কথা, তিন মিনিট লেগেছে। লম্বা চওড়া দেহের অধিকারী রাইফের শার্ট মীরার দেহের অনেকটা অংশ ঢেকে রেখেছে। খয়েরী রংয়ের সুতি ওড়নাটা গলায় দু প্যাচ দিয়ে আঁটসাঁট ভাবে রাইফের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। রাইফ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তে মীরার আপাদমস্তক পরখ করতে ভুলল না। ঢিলেঢালা ছাই রংয়ের শার্ট আর গাঢ় খয়েরী রংয়ের ওড়ানা টাতে মীরাকে মানিয়েছে বেশ। শার্টের সমস্ত বোতাম লাগিয়ে টপ বোতাম ও এমন ভাবে লাগিয়েছে যে শার্টের কলার মীরার গলায় চিপকে আছে। রাইফের সূক্ষ্ণতীসুক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আরো আড়ষ্ট হলো মীরা। কি আশ্চর্য! এভাবে তাকিয়ে দেখার কি আছে? এখন কি এভাবে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখার সময়? যখনি সময় পায় তখনি দেখে যায়!
মীরা কিছু বলার আগেই রাইফ নিজেই মীরাকে হাত ধরে কাছে টানল। বারান্দার দরজা খুলে দিয়েছে একটু আগেই। রুম সম্পূর্ণ আলোকিত না হলেও রাইফ মীরাকে যেখানে বসিয়েছে সেখানে এখন বারান্দার আলোয় পুরোপুরি আলোকিত বলা চলে। হাতে ফার্স্টএইড বক্স নিয়ে মীরার পেছনে বসল রাইফ। মীরা স্পষ্ট ধারণা করছে সামনে কি হতে যাচ্ছে। পিঠের অনেকটা অংশ যে রাইফের সামনে আজ উন্মোচন হবে তার তার মস্তিষ্ক জানান দিয়েছে প্রথমেই। যা বিঁধেছে বিঁধেছেই, আচ্ছা, ঠিক আছে। মীরাকে ব্যাথা দিতে হবে তো, আচ্ছা দে। কিন্তু বেছে বেছে পিঠেই কেনো? হাত, পা, মুখ ও তো ছিলো? দেহের এসব অংশ কি চোখে দেখেনি বস্তুটা?
পেছনে বসা রাইফের পরবর্তী কাজ কি হতে পারে সেটা ভেবেই শিউরে উঠল মীরা। মাথা ঝুঁকিয়ে উশখুশ করতে লাগল যা রাইফের কাছে স্পষ্ট প্রতীয়মান। নিশুতিরাতের হৈ হুল্লোড় বিহীন নগরে এক জোড়া কপোত-কপোতীর নিরব রুমটাতে নিরবতা ভেঙ্গে কথা বলে উঠল রাইফ। স্বাভাবিক কন্ঠে নাম ধরে ডেকে উঠলো,

-‘মীরা?’

-‘হুম।’

-‘আমি কে?’

সেই কখন থেকে চিনচিনে ব্যাথা সহ্য করে যাওয়া মীরা বিরক্ত হলো রাইফের এমন প্রশ্নে। এটা কোনো প্রশ্ন হলো? এমন সময় এরকম প্রশ্ন করা কি খুব জরুরি? বিরক্তির আভাস মাখা মুখটায় গাল ফুলিয়ে উল্টো প্রশ্ন করলো মীরা,

-‘আপনি কে?’

রাইফ কন্ঠে কিঞ্চিৎ রাগ মিশিয়ে ধমকে উঠলো,

-‘প্রশ্নর পৃষ্টে প্রশ্ন করবা না মীরা। যা প্রশ্ন করবো সরাসরি জবাব দিবা।’

মীরার ছোট্ট জবাব, ‘হুম’।

রয়েসয়ে রাইফ পুনরায় শুধালো,

-‘আমি কে?’

-‘আপনি মানুষ।’

মীরার উত্তরে রাইফের গম্ভীর মুখটায় হাসি ফুটল। মেয়েটা বেশ দুষ্ট, কিন্তু প্রকাশ করে না। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে আবারও শুধালো,

-‘কেমন মানুষ?’

প্রশ্নত্তর পর্ব দ্রুত শেষ করার জন্য মীরার ফটাফট জবাব,

-‘লাজ লজ্জাহীন ভালো মানুষ।’

মুচকি হাসি ধীরে ধীরে প্রসস্থ হচ্ছে রাইফের ঠোঁটে। হাসি মাখা বদনে ভরাট গলায় পুনরায় শুধালো,

-‘লাজ লজ্জাহীন ভালো মানুষটা সম্পর্কে তোমার কি হয়?’

ছোট্ট একটা ঢোক গিলে মীরা কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে মৃদু স্বরে জবাব দিলো,

-‘স্বামী।’

-‘আমি স্বামী হলে আমার অর্ধাঙ্গিনী তুমি। তোমার প্রতি আমার অধিকার গুলো কি পয়েন্ট আকারে বলতে হবে মীরা?’

এবার আর ফটাফট জবাব দিতে পারলো না মীরা। সুকৌশলে রাইফ যে মীরাকে তার অবস্থান সুস্পষ্ট করে বুঝিয়ে সহজ করে তুলছে তা বুঝতে পুরোপুরি সক্ষম না হলেও কিছুটা হলো। শুধু ডানে বায়ে মাথা নাড়িয়ে মীরা বুঝিয়ে দিলো তার প্রতি রাইফের অধিকার সমূহ বলার প্রয়োজন নেই। নীরব মীরার মাথা নাড়ানো দেখে মৌখিক উত্তরের জন্য অপেক্ষা করল না রাইফ। অনেক ক্ষণ যাবত সয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। আর কষ্ট দেওয়া উচিত হবে না। ছাই রংয়ের শার্ট টা নিচের দিক থেকে উপরে তুলে উন্মুক্ত করল মীরার মেদহীন ফিনফিনে কোমড় হতে পিঠের অনেকটা অংশ৷ ছোট্ট একটা ভাঙ্গা কাঁচ বিঁধে এতো ক্ষণে র/ক্তজমাট করে ফেলেছে ক্ষতস্থানে। লম্বালম্বি ভাবে আঁচড় ও লেগে কে/টে অনেকটা। রাইফ বুঝতে পারল এটা সেই ট্রাকের ই ভাঙ্গা গ্লাসের টুকরো। ব/জ্জাত কাঁচ এখানেও পিছু ছাড়েনি।
দ্রুত হস্তে কাঁচ টা টেনে বের করতেই ছটফটিয়ে আর্তনাদ করে উঠল মীরা। ফার্স্টএইড বক্স হতে সরঞ্জামদী বের করে পরিষ্কার করে দিলো ক্ষত স্থান টুকু। সামান্য নরম তুলার ছোঁয়াতেও ব্যাথায় বার বার কুঁকড়ে যাচ্ছে মীরা। থেমে থেমে আর্তনাদ করে উঠছে মৃদু স্বরে। পুরোপুরি পরিষ্কার শেষে এক হাতে ধরে রাখা শার্ট টা ছেড়ে দিলো রাইফ, ঢেকে দিলো মীরার ফর্সা পিঠ। মীরাকে আরামদায়ক অনুভব করাতে তার গলার কাছে লাগানো বোতামটাও খুলে দিলো নিজ হাতে। সামনে এক পাশ করে রাখা চুল গুলো পিঠে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই রাইফের চক্ষু আঁটকে গেলো গৌর বর্নের ঘাড়ে কৃষ্ণবর্ণের ক্ষুদ্র তিলটায়।

চলবে।

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_৩৩ ( এর বর্ধিতাংশ)

মধ্য রাত্রি। ঘড়ির কাটা টিকটিক করে সেকেন্ডের পর সেকেন্ড থেকে শুরু করে ঘন্টা অতিক্রম করে দুইটা বেজে গেছে। এতো রাতেও ঘুম আসছে না শওকত রহমানের। এপাশ ওপাশ করে ছটফট করছেন, তবুও ঘুমাতে পারছেন না। পাশেই শুয়ে থাকা খাদিজা বেগমের তন্দ্রাচ্ছন্ন ঘুমে ব্যাঘাত হলো স্বামীর বার বার নড়াচড়ার জন্য। চোখ মেলে তাকালেন তিনি। রুমের ক্ষীণ আলোয় এক পলক দেখে শওকত রহমানকে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললেন,

-‘এমন ছটফট করছেন কেনো? ঘুমান।’

সহধর্মিণীর কন্ঠ শুনে চকিত দৃষ্টিতে তাকালেন শওকত রহমান। খাদিজা বেগমের প্রশ্নকে অগ্রাহ্য করে নিজেই প্রশ্ন করলেন,

-‘খাদিজা, জেগে আছো?

-‘না। মাত্র চোখ লেগেছিলো তখনি আপনার নড়াচড়ায় ঘুম টা ভেঙ্গে গেলো।’

-‘শোনো খাদিজা। মেয়েটার জন্য মনটা ছটফট করছে বুঝছো। এতো করে আজ রাতটা এখানে থাকতে বললাম, রাইফ শুনলো না। সাথেই নিয়ে গেলো। আমার মনে হচ্ছে মীরার শরীর টা ভালো না। একটা কল দাও তো।’

-‘এতো রাতে? অসুস্থ মেয়েটার কাঁচা ঘুমটা যদি ভেঙ্গে যায়?

-‘আহা, বুঝতেছো না। ওর খোঁজটা নেওয়া জরুরি।’

খাদিজা বেগম স্বামীর চিন্তা স্পষ্ট বুঝতে পারলেন। মেয়ে যে উনার চোখের মণি। যেখানে মীরার দেহে একটু আঁচড় সহ্য করতে পারেন না সেখানে মেয়ের ক্ষত হাত উনার ভেতর বাহির দুটোই অস্থির করে তুলেছে। চিন্তা তো তার নিজের ও হচ্ছে, সেটা আর প্রকাশ করলেন না স্বামীর সামনে। ভরসা দেওয়ার উদ্দেশে আস্বস্ত স্বরে বললেন,

-‘চিন্তা করবেন না, রাইফ আছে তো। দেখলেন না, মীরাকে চোখে হারায় জন্য আপনি এতো করে বলার পরও রেখে গেলো না। ওর আম্মার কথা পর্যন্ত শুনলো না। সাথে করে নিয়েই গেলো। রাইফ থাকতে মীরার কিছু হবে না। শুধু শুধু চিন্তা করছেন, ঘুমান আপনি। শরীর খারাপ করবে, প্রেশার হাই হবে। কাল সকালে গিয়ে দুজন দেখে আসবো নে। হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে আপনার, দেখি কাঁথাটা টেনে নেন।’

খাদিজা বেগমের কথায় অস্থিরতা কিছুটা কমলো রাশভারী মানুষটার। খাদিজা ঠিকই বলেছে। রাইফ যে মীরাকে কতোটা আগলে রাখে তা উনার দৃষ্টিগোচর হয়েছে ভালোভাবেই। ছেলেটা ভরসার যোগ্য। স্বামী হিসেবে দ্বায়িত্ব পালনে হের ফের করতে দেখেন নি তিনি।

______________

গৌরবর্নের ঘাড়ে কৃষ্ণবর্নের ক্ষুদ্রাকায় তিল দেখিয়ে রাইফের ঘুম হারাম করে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে মীরা। সজাগ রাইফ বেশ কয়েক বার ঘুমানোর জন্য আঁখি পল্লব একত্রিত করেছিলো, কিন্তু অনেক আগেই রাতের ঘুম যে ফুরফুর করে ফাঁকি দিয়েছে দু চোখ হতে। জেগে থেকে আর কতোক্ষন ই চোখ বন্ধ করে থাকা যায়। তাই আবছায়া আলো আঁধারিতেই মীরার দিকেই নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে ছিলো রাইফ। মুখোমুখি দুজন। বুক অব্দি কাঁথা টেনে মীরা ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়েছে ঘন্টা খানেক হলো। এই মেয়েটার সব কিছুই কেমন মায়ায় ভরা। চাল চলন, কথা বার্তা, থেকে থেকে তার নিরবতাও রাইফের মনে ভালোবাসার ঘন্টা বাজায়।
এই যে একটু আগে দৃষ্টিগোচর হলো, এ আর এমন কি জিনিস! বিন্দু সমতুল্য তিল মাত্র। তবুও কেমন টেনে নিচ্ছে রাইফকে। প্রথমে কৃষ্ণবর্নের তিলটা দেখা মাত্রই থমকে গিয়েছিলো তার মস্তিস্ক। ছুঁয়ে দেওয়ার লোভ সে সময় দমন করতে পারে নি তখন। মীরার অজান্তেই তিলটার উপর বৃদ্ধাংগুল এর হালকা স্পর্শ দিতে ভুলেনি সে।

এক হাত দূরত্বে থাকা নিদ্রারত মীরার ক্ষত হাতটা টেনে নিলো রাইফ। কি আর করার, বর্তমানে মীরার হাতটাই যে তার সম্বল। এই হাতেই সে মীরাকে নিঃসংকোচে রেখে পুরোদস্তুর আধিপত্য বিস্তার করতে পারে, যখন তখন ছুঁয়ে দিতে পারে অধর জোড়াও। রাইফের খসখসে হাতটা মীরার কোমল হাত স্পর্শ করতেই তড়িৎগতিতে মস্তিস্ক সচকিত হলো তার। মীরার হাত ভীষণ গরম। দ্রুত হাত ছেড়ে অর্ধাঙ্গিনীর কপাল, গাল এবং গলায় হাত রাখল রাইফ। হ্যাঁ, অস্বাভাবিক তাপমাত্রা মীরার দেহে। জ্বর জেঁকে বসেছে কঠিন রূপে।
মীরা উষ্ণ গলায় রাইফের শীতল হাতের সংস্পর্শে নড়েচড়ে উঠলো। ঘুমের ঘোরে অন্যদিকে পাশ ফিরে বুক অব্দি গায়ে জড়ানো কাঁথাটা গলা অব্দি টানলো। ঘুম ঘুম কন্ঠে বিরবির করে বলল,

-‘শীত লাগছে খুব। ইস! আপনার হাত টা এতো ঠান্ডা।’

ঘুমের মাঝে কথাটুকু বলেই আবারও ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলো মীরা। রাইফ এর কপালে চিন্তার সুক্ষ্ণ ভাঁজ দৃশ্যমান। আজকের দূর্ঘটনায় সব থেকে এই মেয়েটাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাতে ক্ষত, পিঠে ক্ষত, শরীরের ব্যাথা আর বুক ভরা আতংক তো আছেই। সব মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত জ্বরটাও পিছু ছাড়েনি, জেঁকে বসেছে ঘুমন্ত মীরাকে। আচ্ছা, এতো কিছু যখন আঁকড়ে ধরেছে তখন রাইফ কেনো বাদ যাবে? মীরার উপর যেখানে রাইফের সব থেকে বেশি ঘনিষ্ঠ থাকার কথা সেখানে এই ঝঞ্জাট গুলোই উল্টো মাথা উঁচিয়ে অধিকার ফলাচ্ছে। কেউ হাতে, কেউ পিঠে তো কেউ পুরো অঙ্গ জুড়ে। আর তিল, সে তো আ’ঙ্গার করে দিচ্ছে রাইফের হৃদয়।
রাইফ মীরার কাছে এলো সামান্য দূরত্ব বজায় রেখে। মীরার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে ডেকে উঠলো নাম ধরে৷ বেশ কয়েক বার ডাকার পর মীরা জবাব দিলো হ্যাঁ বোধকে। রাইফ শান্ত কন্ঠে বলল,

-‘মীরা, উঠো একটু। মেডিসিন খাবে উঠো।’

-‘খেয়েছি তো।’

-‘জ্বরের মেডিসিন খাবা। জ্বর আসছে তোমার।’

-‘নাপা খেয়েছি আমি।’

কথাটা বলেই কাঁথাটা মাথা অব্দি টেনে নিবে এমন সময় মীরার স্নায়ু পুরোপুরি কাজ করল। অবাক কন্ঠে শুধালো,

-‘আমার জ্বর এসেছে?’

রাইফ আহাম্মক হলো সাথে কিছুটা কনফিউজড ও বটে। বলে কি এই মেয়ে? নিজের জ্বর কি নিজে টের পাচ্ছে না? নাকি রাইফের ই ভুল। সন্দেহ দূর করতে মীরার উতপ্ত গালে হাত রাখতেই ছ্যাত করে উঠল। ঘুম কাতুরে মীরা চেতে গিয়ে বলল,

-‘সাপের গায়ের মতো ঠান্ডা কেনো আপনার হাত? হাত গরম করেন আগে, ঠান্ডা লাগছে আমার।’

-‘আমার হাত ঠিক আছে মীরা, তোমার শরীর ঠিক নায়। জ্বর আসছে। উঠো।’

মীরার ঘুম ছুটে গেলো। সত্যি ভীষণ রকম জ্বর এসেছে তার। এজন্যই ঘুমের মাঝে বার বার কেঁপে কেঁপে উঠছিলো সে। কি একটা আগডুম বাগডুম স্বপ্নের জন্য জ্বর অনুভব করতে পারে নি। মৃদ্যু শীত লাগাটাকেও স্বপ্নের ই অংশ মনে করেছিলো এতোক্ষণ। হুস ফিরতেই ধরাম করে উঠে বসল, নিজের হাত দিয়েই নিজের কপাল-গলায় হাত ছোঁয়ালো। শরীর গরম। আসলেই জ্বর আসছে কিনা নিশ্চিত হতে নিজের শরীরের তাপমাত্রা আর রাইফের শরীরের তাপমাত্রার পার্থক্য নির্নয় করতে মীরা সামনেই এক হাতের উপর ভর দিয়ে কাত হয়ে শুয়ে থাকা শ্যাম বর্ণের সুপুরুষ টার কপালে হাত রাখলো আচমকা। মীরার এমন আচরণে কিছুটা কনফিউজড রাইফ পুরোপুরি কনফিউজড হলো। এমন অদ্ভুত কর্মকান্ডে তার হাসিও পেলো বেশ। জ্বরাক্রান্ত মীরা রাইফের হাসি দেখে থতমত খেলো, রাইফের গলায় হাত রাখতে যাবে এমন সময় দ্রুত হাত সরিয়ে নিলো। মীরার থতমত চাহনি রাইফের মুখে এক প্রস্থ হাসি ফুটিয়েছে। ধীরে সুস্থে নিজেও ওঠে বসল মীরার মুখোমুখি। পর পর প্রশ্ন করলো কয়েকটা,

-‘কি বুঝলা? শরীর কি গরম আমার? জ্বর আছে?’

-‘না।’

রাইফ মীরার একটা হাত টেনে নিজের কপাল ছোঁয়ালো। সময় নিয়ে কপাল থেকে গালে এবং ধীরে ধীরে গলায়। দু দিকে মাথা নাড়ালো রাইফ, মীরাকে বুঝিয়ে দিলো আসলেই তার জ্বর আসে নি। এবার গলা থেকে কিছুটা নিম্নে এনে হাত থামালো রাইফের বলিষ্ঠ বুকের বা পাশে। মীরার হাতটা বুকে চেপে ধরে ভরাট গলায় নিরব রুমে গমগমে আওয়াজ তুলে বলল,

-‘এসেছে। এদিকটায় পুড়ছে। আ/গ্নেয়গিরির লাভার ন্যায় পুড়ছে। ছাই হয়ে উড়ে যাওয়ার আগে তোমার তপ্ত দেহটার সান্নিধ্য পেতে চাই মীরা। তোমার জ্বরাক্রান্ত দেহটাই পারবে আমার দ/গ্ধ হয়ে যাওয়া বা পাশটাকে শীতল করতে। আমাকে সুখানুভূতি দিতে।’

মীরা নির্বাক শ্রোতার ন্যায় ধ্যান মে/রে শুনে যাচ্ছে রাইফের কথা। স্বামীর মুখে উচ্চারিত একেকটা শব্দের মর্ম অনুধাবন করছে গভীর ভাবে। রাইফের গাঢ় স্বরের আকুল আবেদন মীরার ভেতর বাহির উথাল-পাতাল করে তুলছে। তবুও মৌন মীরা মৌন থেকে গেলো সেকেন্ডের পর সেকেন্ড। রাইফ হতাশ হয়ে চাপা দীর্ঘশ্বাস টা আড়াল করে শুয়ে পরল আগের ন্যায়। তার শান্ত মুখশ্রী এক পলক দেখতে ভুলল না মীরা। না রাগ না অভিমান, কিছুই ফুটে ওঠেনি রাইফের চৌকস চেহারায়। লাজুক মীরা আজ সাহস পেলো যেনো। হয়তো জ্বরাক্রান্ত দেহটাও রাইফের সান্নিধ্য পেতে মরিয়া হয়ে ওঠেছে। জ্বরের তোপে শীত শীত অনুভব করা মীরার দেহ রাইফের বুকের উষ্ণতা লুটে নিতে চাচ্ছে। নাকি রাইফের মাদ/কতা মেশানো আকুল আবেদন কে অগ্রাহ্য করতে পারছে না মীরা? কে জানে? এতো কারণ ই বা দর্শাতে হবে কেনো? দূরত্ব ঘোচাতে এতো কারণ খোঁজার কি আছে? এলোমেলো খোলা চুলগুলো ঘাড় থেকে সরিয়ে বা পাশে টেনে সামনে নিলো সে।
রাইফ মীরার সব কিছুই অনুধাবন করেছে এতোক্ষণ। এই মেয়েটাকে চেনে সে। কোনো কিছু করার আগে যে সে দীর্ঘ ভাবনায় পতিত হয় সেটাও তার অজানা নয়। ইচ্ছাকৃত ভাবে এগিয়ে যেতে নারাজ সে। আবার বিপরীত পক্ষ থেকে একটু ইশারা পেলেই ঝটপট কাজে লেগে যায়। রাইফ মীরার জড়তা দূর করতে একটু সাহায্য করলো। চিত হয়ে শুয়ে থাকা রাইফ কাত ঘুরলো। পেশিবহুল বাম হাতটা মেলে দিলো পাশে। কাচুমাচু করতে থাকা মীরা রাইফের এক ধাপ এগিয়ে আসাতে স্বস্তি পেলো। সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে রাইফের দিকে পিঠ দিয়ে শুয়ে পরলো। বালিশের উপর রাখা পেশিবহুল বা হাতের উপর মাথাটা রাখতেই মীরার পেটের উপর রাইফের শক্তপোক্ত ডান হাতটা আঁকড়ে ধরে টেনে নিলো, দুজনের মাঝের দূরত্ব ঘুচিয়ে দিলো পুরোটায়। কাঙ্ক্ষিত নারীকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলো, বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করল নিবিড়ভাবে। একে অপরের সাথে মিশে গেলো, সজ্ঞানে মীরা নতুন অনুভূতির সাক্ষী হলো। রাইফের বুকের উষ্ণতা কুড়িয়ে নিলো, ইচ্ছাকৃত ভাবে আজ নিজেই রাইফের হাতের উপর হাত রাখল। রাইফের হাতের উল্টো পিঠের উপর দিয়েই আঙুল এ আংগুল গুঁজল। কাঠকাঠ হয়ে পরে রইলো রাইফের দু বাহুর বন্ধনে।
.
কখনও মীরার মেয়েলি সুবাস টেনে নিচ্ছে রাইফ , কখনও বা মুখ ডুবিয়ে লাজুকলতার চুলের ঘ্রাণ।
সময়ের পর সময় অতিবাহিত হচ্ছে। বুকের সাথে জড়িয়ে রাখে মীরা থেকে শুরু করে এ শহরের কাক পক্ষীরাও ঘুমিয়ে গেছে অথচ রাইফের ঘুম নেই এখনও। নাহ, এভাবে আর থাকতে পারছে না রাইফ। তার বেহায়া মনটা আরো বেশি বেহায়া হলো, অবাধ্যতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেলো যেনো। মীরার ঘাড়ে পরে থাকা চুল গুলো সরিয়ে দিলো সতর্কতার সহিত। বাহির থেকে ঘরে প্রবেশ করা আলোতেই মনোযোগ দিয়ে দেখল সেই ক্ষুদ্র তিলটা। বৃদ্ধাংগুলি দিয়ে হালকা করে ঘষে দিলো করেক বার। মাথা কিঞ্চিৎ উঁচু করে মীরার উষ্ণ ঘাড়ে রাইফের শীতল ঠোঁট জোড়া ছুঁয়ে দিলো ছোট্ট করে। আচমকা স্পর্শে বাহুবন্ধনে পরে থাকা মীরা ঈষৎ কেঁপে উঠলো। মৃদু কম্পনও স্পষ্ট অনুভব করল রাইফ। এতোক্ষণ কাঠকাঠ হয়ে পরে থাকা মীরা যে তার ন্যায় সজাগ বুঝতে সময় লাগলো না। ভালোই হলো, সুখানুভব তবে দুজনের ই হোক। রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করুক সঙ্গীনীর অধরের মিষ্টি ছোঁয়া।
রাইফ মীরার কানের কাছে মুখ আনলো, দু ঠোঁট হালকা করে ছুঁইয়েও দিলো নরম লতিতেও। কন্ঠ যথেষ্ট খাদে নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

-‘ভয় পেয়ো না, বেশি না জাস্ট পাঁচটা মিনিট। আজ অন্য কোথাও না, তোমার ঘাড়েই শুধু আমার দখলস্বত বসাবো। আমার গাঢ় স্পর্শ শুধু তোমার ক্ষুদ্র তিলটা টাতেই ছড়াবো।’

চলবে……

মুঠোবন্দী লাজুকলতা পর্ব-৩২

0

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_৩২

রাজিয়া বেগম এশার সালাত আদায় করেছেন কিছুক্ষণ হলো। বেশ কিছুক্ষণ জায়নামাজে বসে থাকার পর উঠেই মুঠোফোন টা হাতে নিয়ে বিছানায় বসেছেন ছেলে আর পুত্রবধুর খোঁজ নিতে। রাইফ সেই যে সন্ধ্যায় কলে জানিয়েছিলো তাদের ফিরতে দেড়ি হবে, রাত্রী প্রায় সাড়ে নয়টা বেজে যাচ্ছে এখনও ফেরার নাম নিচ্ছে না। ছেলে রাত বিরাতে বাসায় দেড়িতে ফিরলেও মীরাকে নিয়ে বেশি ক্ষণ যেনো বাহিরে না থাকে তা পই পই করে বলে দিয়েছিলেন তিনি। এতো দেড়ি তো হওয়ার কথা না!সন্তানের কথা ভেবে কিঞ্চিৎ চিন্তার ভাঁজ ফুটে উঠেছে তার মুখাবয়বে। রাইফের নাম্বারে কল দিয়ে লাউড স্পিকার অন করলেন, পর পর রিং হয়ে কল এর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলো। আবারও কল দিলেন এবং পূর্বের ন্যায় এবারও কোনো সাড়া পেলেন না অপর প্রান্ত থেকে। ছেলেকে না পেয়ে তিনি একমাত্র পুত্রবধু মীরার নাম্বারে কল দিলেন, কিন্তু এবারও হতাশ হলেন। দুজনের একজন ও কল রিসিভ করলো না। মনের মাঝে উঁকি দেওয়া ঈষৎ চিন্তা এবার গাঢ় হতে শুরু করল রাজিয়া বেগমের। পরক্ষণেই কল দিলেন নতুন সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়া বেয়াইন খাদিজা বেগম কে। কয়েক সেকেন্ডের ব্যাবধানেই সাড়া দিলেন, খাদিজা বেগম কল রিসিভ করলেন হাসি মুখে। খোশ মেজাজে কুশলাদি বিনিময়ের মাধ্যমে কথোপকথন শুরু হলেও শেষ হলো দুজনের দুরুদুরু বুকে কপালে চিন্তার রেখা ফুটিয়ে। দু প্রান্তের দুই মা’য়ের মনেই এখন সন্তানের
বি/পদের আশংকা জেঁকে বসেছে, ছটফট করছে ছেলে মেয়েকে কাছে পেতে। আকুল নিবেদনে সন্তানের মঙ্গল কামনা করছেন মহান আল্লাহর দরবারে। সহি সালামতে কোলের সন্তানকে ঘরে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা দুজনের মাঝে।

____________

কিয়ৎক্ষণ পূর্বে গগণ বিদারী চিৎকারে ভারী হওয়া রাতের আকাশ-বাতাস এখন শান্ত, নিরবতায় আচ্ছন্ন, থম
মে/রে আছে যেনো। বেপরোয়া গতিতে দ্বিকবিদিক ভুলে রাইফ-মীরার দিকে ছুটে আসা মালবাহী ট্রাক ব্রিজের রেলিং ভে’ঙ্গে দুমড়ে মুচড়ে ছিটকে গিয়ে বিশাল গর্জন তুলে নদীর টুইটুম্বুর জলে পতিত হয়েছে, সাথে সাথেই নদীর শান্ত জল কে করেছে অশান্ত। বড় বড় ঢেউ আছড়ে পরেছে তার দুই কূলে। ট্রাকের ভা’ঙ্গাচুরা কিছু ধ্বং/সাবশেষ ভাসছে পানির উপরে। নদীর অতল গহব্বরে ডু’বে যাওয়া ট্রাকের ভেতর থেকে কোনো রকমে জান টা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এসেছে ড্রাইভার এবং হেলপার দুজনেই। নদীর টুইটুম্বুর জলে হাঁপাতে হাঁপাতে সাঁতরে এসেছে পাড়ে।

রাস্তার মাঝে পরে আছে একটা মুঠোফোন, উপরের গ্লাস ফেঁটে তার চুরমার অবস্থা। অদূরে পরে থাকা ফোনটায় একটানা রিং হচ্ছে উচ্চ শব্দে, ডিসপ্লে তে জ্বল জ্বল করে শো করছে “আম্মা” লেখাটি। কালো রংয়ের ছোট হ্যান্ড ব্যাগ এবং এক জোড়া জুতাও এলোমেলো হয়ে পরে আছে অবহেলায়। ইট-সিমেন্টে তৈরি রেলিং এর সাথে ধাক্কা লেগে গাড়ির সামনের গ্লাস ভেঙ্গে চুর্ণ বিচূর্ণ কাঁচ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ব্রিজের মাঝের অনেকটা অংশ জুড়েই। ভয়ে গুটিয়ে নিজেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা শেষে এক লহমায় কি হতে কি হয়ে গেলো বুঝতে পারছে না রাস্তায় পরে থাকা এক জোড়া কপোত-কপোতী। শুধু নিথর দেহ পরে আছে পাশাপাশি, আঁকড়ে ধরে আছে একে অপরের হাত।
বেগতিক ভাবে ছুটে আসা ট্রাক আর অর্ধাঙ্গিনীর আঁকড়ে জড়িয়ে ধরা দু হাত বলছিলো এখান থেকে সরে যেতে হবে যে করেই হোক। মস্তিষ্কের নিউরন সেকেন্ড এর মাঝে রাইফকে জানান দিয়েছিলো, তীক্ষ্ণ ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলো বাঁচতে হবে দুজনকে। এই সুন্দর ধরনীতে হাতে হাত রেখে পথচলা তাদের এখনও বাকি, সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে জীবনকে উপভোগ করার ইচ্ছেটাকে এতো দ্রুত দেওয়া যায় না ফাঁকি! এতো তাড়াতাড়ি প্রেয়সীর হাতে হাত রেখে বৃদ্ধ হওয়ার ইচ্ছে নিঃশেষ হতে পারে না রাইফের। না না, কিছুতেই না।
তুমুলবেগে ধেয়ে আসা ট্রাক দেখার সাথে সাথেই রাইফের বলিষ্ঠ পুরুষালী বাহু দুটো মীরাকে শক্ত করে জড়িয়ে বক্ষে আবদ্ধ করেছিলো, ইট সিমেন্ট এর ব্রিজ থেকে তার লাজুকলতার ছোট্ট দেহটাকে শূন্যে তুলে নিয়েছিলো তাৎক্ষণিক। বড় বড় পা ফেলে এক প্রকার ছিটকে সরে গিয়েছিলো উচ্চ আওয়াজে হর্ণ বেজে বেপরোয়া গতিতে আসা ট্রাকের সামন হতে। তাড়াহুড়ায় সরে আসাতে রেলিং এর নিচে সিঁড়ির মতো উঁচু করে বাঁধায় করা জায়গাটাতে পা বেজে হোঁচট খেয়ে ছিটকে নিচে পরে গিয়েছিলো মধ্য সড়কে। আল্লাহ সহায় ছিলো তাদের উপর। গ্রাম্য রাস্তায় যানবাহনের চলাচল খুবই কম, শহুড়ে ব্যাস্ত রাস্তা হলে এতো ক্ষণে হয়ত দুটো দেহ পিষ্ট হতো গাড়ির চাকায়।
.

মাথার পেছন দিকে চরম ভাবে আঘাত প্রাপ্ত রাইফ মৃদু শব্দ করে ডেকে উঠলো মীরার নাম ধরে। পাশেই পরে থাকা মীরা রাইফের ডাকে সাথে সাথেই সাড়া দিতে পারল না। রাইফের হাতে রাখা হাত টা ঈষৎ নাড়িয়ে চিনচিনে ব্যাথায় শুধু হালকা আর্তনাদ করে উঠলো সে। রাইফের টনক নড়ল মীরার আর্তনাদে। পাশেই চিৎ হয়ে পরে থাকা দেহটার দিকে পাশ ফিরে তাকাতেই বুকের বা পাশটা মোচড় দিয়ে উঠল তার। দ্রুত উঠতে গিয়ে শরীরের তীক্ষ্ণ ব্যাথায় মুখ কুঁচকে চোখ খিঁচল, হজম করে নিলো মুখ ফুটে বেরিয়ে আসা ‘আহ্’ শব্দটুকু। এক হাত দূরত্বে পরে থাকা মীরার ব্যাথাতুর চেহারা রাইফের ভীত কাঁপিয়ে দিলো, নড়বড়ে করল, বিপদের আশংকা জেঁকে বসলো মনে। দ্রুত কাছে এলো মীরার, শিয়রে বসে রাস্তায় পরে থাকা মীরার মাথাটা কোলে তুলে নিলো আলতো হাতে। এতোক্ষনের বদ্ধ চোখ জোড়া পিটপিট করে খুলল মীরা। ভয় মিশ্রিত ব্যাথাতুর মুখটায় চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে পরা ভেজা পল্লব খুলল, ঝাপসা দৃষ্টিতে রাইফকে দেখে বেদনা ভরা মুখশ্রী তে মৃদু হাসি ফুটলো মীরার সরু গোলাপি ঠোঁটের কোণে। পিচ ঢালা সড়কের মাঝে ছিটকে পরে গিয়ে ছিলে যাওয়া কোমল হাত টা উর্ধ্বে তুলে ছুঁইয়ে দিলো রাইফের গাল। শুষ্ক গলাটা ছোট্ট ঢোক গিলে ভিজিয়ে নেওয়ার বৃথা চেষ্টা করে মীরা ধীর কন্ঠে নিস্তেজ গলায় শুধালো,

-‘ঠিক আছেন তো আপনি? কিছু হয় নি তো আপনার?’

রাইফ জবাব দিতে পারল না, কোন শব্দ কন্ঠ গহ্বর থেকে উচ্চারিত হতে পারল না। যেনো কঠিন ধারা জারি করা হয়েছে রাইফের কণ্ঠনালীতে। কন্ঠস্বর এ যেনো কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে উচ্চারিত না হওয়ার।
মীরার এই একটা কথায় কি ছিলো
জানে না রাইফ, শুধু জানে তার মতো এই নারীটাকেও সঙ্গী হারানোর ভয় মুষড়ে দিয়েছে, চুরমার করে দিয়েছে বুকের বা দিকে থাকা ছোট্ট হৃদ পিন্ডটাকে।
মীরার নিস্তেজ দেহটাকে টেনে তুলে কোলের উপর বসালো রাইফ। দুজনের মাঝে থাকা দূরত্ব টুকু ঘুচিয়ে নিলো, মীরার নরম দেহটাকে নিজের শক্ত দেহের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলো ব্যাক্তিগত ভাবে। এই সংকট ময় সময়ে নতুন জীবন পাওয়া দম্পতির মেলবন্ধনের সাক্ষী হলো মাথার উপর থাকা গোলাকৃতির চাঁদ, উঁকি দিয়ে দেখতে ভুলল না জ্ব’লজ্ব’ল করা ছোট্ট ছোট্ট নক্ষত্ররাজিরাও।
রাইফের থেকে সবসময় সংকোচ হোক কিংবা লজ্জায় পালিয়ে থাকা মীরা সব ভুলে গেলো। তার ছিলে যাওয়া ক্ষ’ত বিক্ষ’ত র/ক্তিম দু হাত রাইফের পুরুষালী পিঠ জড়িয়ে নিলো, খাঁমচে ধরল রাইফের সাদা রংয়ের শার্ট। শক্ত বুকটায় মুখ গুঁজে দিলো মীরা। এতোক্ষণ স্বামীকে হারানোর চেপে রাখা ভয় টুকু অশ্রু হয়ে ঝড়ে পরল, নিরবে ভিজিয়ে দিলো রাইফের বুক। নিরব কান্না বেগতিক হারে বাড়তে শুরু করেছে স্বামীর সংস্পর্শে, কেঁপে কেঁপে উঠছে রাইফের দু হাতের মাঝে আব’দ্ধ থাকা মীরার কোমল দেহটা। রাইফের হাত আলতো করে বুলিয়ে দিচ্ছে মীরার ফিনফিনে পিঠ। এই মুহূর্তে ভীতসন্ত্রস্ত আদুরে বউটাকে শান্ত করার জন্য এই পদ্ধতি তার কাছে সঠিক মনে হলো। হুম, সঠিক ই হলো। ক্রন্দনরত মীরার কান্নার বেগ কমলো, কেঁপে কেঁপে ওঠা দেহ টা স্থির হয়ে পরে রইল রাইফের বলিষ্ঠ বুকে। মীরাকে আরেকটু চেপে ধরল নিজের দেহের সাথে, কন্ঠনালীর সাথে যু/দ্ধ করে জয়ী হয়ে ভরাট কন্ঠে থেমে থেমে কয়েকটি শব্দ উচ্চারিত করল রাইফ,

-‘ভয় নেই, এইতো আমি। আছি, তোমার সাথেই আছি। খুবই নিকটে, এই আমি পুরোটাই তোমার হয়ে।’

….

মূহুর্তেই লোক জন ভীর করে জটলা পাকলো দুজন কে ঘিরে। জাপটে ধরে থাকা মীরাকে সরিয়ে নিলো রাইফ। লোকজন ও ব্যাস্ত হলো তাদের কে নিয়ে, সাহায্যের হাত এগিয়ে দিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করতে তাদের নিয়ে ছুটল নিকটস্থ কোনো ফার্মেসী তে। এলাকার চেয়ারম্যান ও চলে এসেছে ঘটনা পর্যবেক্ষণ করতে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ট্রাকের হেল্পার কে পেলেও পেলো না ড্রাইভার কে। নে/শাগ্রস্ত ধুরন্ধর ড্রাইভার পালিয়ে গিয়েছে জন সমাগম হওয়ার আগেই।
চিকিৎসার সহিত রাইফ-মীরাকে বাসায় ফেরার ব্যাবস্থা করলেন চেয়ারম্যান নিজেই। এই পরিস্থিতে তিনি নিজের বাসাতেই দুজন কে থেকে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু রাইফ সম্মতি দেয় নি মায়ের কথা ভেবে। অশান্ত মনটাকে স্থির করতে এখন আপন নীড়ে ফেরা তার জন্য খুবই জরুরি।

চলবে……

মুঠোবন্দী লাজুকলতা পর্ব-৩০+৩১

0

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_৩০

🍁
জায়নামাজে বসে অঝরে অশ্রু বর্ষণ করছে মীরা। মিনিটের পর মিনিট অতিবাহিত হচ্ছে, এক ভাবেই বসে আছে সে। আজ তার কোমল হৃদয়টা বিষন্নতায় ছেঁয়ে গেছে। বিষাদের আনাগোনা তার মনিকোঠায়। দেখতে দেখতে গত হলো চারটি বছর, মীরাকে একা করে নূর জাহান বেগমের গত হওয়ার চার চারটি বছর। নিঃসঙ্গ মীরার সঙ্গী হয়েছে এখন কিন্তু দুচোখ ভরে যার দেখার কথা ছিলো সেই নেই।
মীরার কান্নায় ফুলে ফেঁপে ওঠা র’ক্তিম লাল চোখ দুটো স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে জায়নামাজের উপর। নিরবে অশ্রুপাত করার আকুল চেষ্টা করছে মীরা, কিন্তু বারবার ঝড়ের বেগে দলা পাকিয়ে চিৎকার করে বেরিয়ে আসছে কান্না গুলো। অবাধ্য কান্নাকে দমন করার ব্যার্থ প্রচেষ্টা রত মীরার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে, গুঙিয়ে কেঁদে উঠছে মাঝে মাঝেই।
আজকের দিনে ভঙ্গুর হৃদয়ের মীরার খুব ইচ্ছে করছে দাদীজানের সান্দিধ্য পেতে। তাকে না ছুঁতে পেলো, তাকে জড়িয়ে রাখা সোদা মাটির ঘ্রাণ নিতে হৃদয়টা ভীষণ রকমের ব্যাকুল হয়ে আছে তার। চোখ মুছে পাশের টেবিল থেকে মুঠোফোন টা হাতে নিলো মীরা। কল লিস্টের দ্বিতীয় নাম্বার টাতে ডায়াল করলো সে। পরপর তিনবার রিং হতেই রিসিভ হলো। রাইফের কন্ঠস্বর শোনা গেলো কানে ধরে রাখা মুঠোফোন টায়। উৎকন্ঠিত কন্ঠে রাইফ বলছে,

-‘কি ব্যাপার আজ! আমার মহারানীর তলব পরেছে যে? কোনো সমস্যা মীরা?’

ছোট একটা ঢোক গিলে ভেজা গলায় বলল মীরা,

-‘না, সমস্যা না। আমি একটু বাহিরে যাবো। দাদীজানকে মনে পরছে খুব। যাই?’

-‘একা যাবা? আমি আসি?’

-‘না না। আপনার কষ্ট করে আসতে হবে না। উর্মিকে সাথে নিয়ে যাবো আমি।’

রাইফ হাত ঘড়িতে চোখ বুলাল। সময় দুইটা বেজে পঞ্চান্ন মিনিট। সূর্য এখনও প্রখর তাপ দিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীতে। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে মীরাকে উদ্দেশ্য করে বলল রাইফ,

-‘একটু পর বের হও মীরা। এখন বাহিরে অনেক রোদ। চারটা বা সাড়ে চারটা নাগাদ বের হবা কেমন? আর শোনো, আমি আসবো তোমাকে নিতে। ফোন কাছেই রেখো।’

-‘ঠিক আছে।’

মীরা ছোট্ট জবাবের পর ই নিরব হলো ফোনের দুই প্রান্তের মানুষ দুটো। কোনো সাড়াশব্দ নেই দুজনের মুখেই। রাইফ ইচ্ছা করেই কথা বলছে না এখন। সারাদিন তো নিজেই বকবক করে, এবার তার মহারানীর মুখ থেকে কিছু শুনতে ইচ্ছা করছে। মীরার ধারণা ছিলো রাইফ ই কিছু বলবে এখন। কিন্তু যখন তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো, তখন নীরবতা ভাঙ্গলো সে নিজেই।

-‘শুনছেন?’

-‘বলেন, শোনার জন্যই বসে আছি।’

রাইফের গলায় ঠাড্ডার সুর। মীরা ছোট করে প্রশ্ন করল,

-‘খেয়েছেন?’

-‘হুম।’

মীরার কিঞ্চিৎ রাগ হলো রাইফের জবাবে। সবসময় তো কথার ফুলঝুরি নিয়ে বসে থাকে, আর আজ হু হা বলে কে’টে পরছে। কথায় বলছে না। এমনি তেই মীরার মন খারাপ, তার উপর হু হা। ভালো লাগে না, এভাবে কি এক তরফা কথা বলা যায় নাকি? ধৈর্য হারা হয়ে মীরা নিজেই শুধালো,

-‘আপনি কি ব্যাস্ত?’

পিঠ টান টান করে বসে একটানা কাজ করা রাইফ আরাম করে হেলান দিলো চেয়ারে। লম্বা একটা হাই তুলে বলল,

-‘ব্যাস্ত হতে চাচ্ছিলাম। আমার মহারানীর কথা শুনে ব্যাস্ত হওয়ার শখ জেগেছিল খুব কিন্তু সে আর হলো না। আম্মা কি করে?

-‘ঘুমাচ্ছে।’

-‘তুমিও বিশ্রাম নাও একটু। সাবধানে এসো।’

-‘ঠিক আছে। রাখি?’

-‘রাখো।’

_____________

পড়ন্ত বিকেলে আসরের সালাত আদায় করেই বেড়িয়ে পরেছে মীরা এবং উর্মি। রিক্সা দিয়ে এসে মূল গন্তব্যের একটু আগেই নেমে পরেছে দুজন। ব্যাস্ততম শহরে দুজন পায়ে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটতে চায় কিছুক্ষণ। পাঁচমিনিটের পথ অতিক্রম করে কবর স্থানের মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করল দুজন। দুরন্ত স্বভাবের উর্মিও আজ ঝিমিয়ে গেছে, মীরার মতো নেতিয়ে পরেছে মন। মীরার হাত টা ধরে ইট বাঁধা সরু পথটা দিয়ে সামনে এগিয়ে ডান দিকে বাঁধায় করা তিনটা কবরের পরের কবরেই এসে পা থামলো দুজনের। দাদীজানের মাথার কাছেই চুপটি করে দাঁড়ালো মীরা। কোনো রা নেই দুজনের মুখে। নিরবে টুপটুপ করে কয়েক ফোঁটা অশ্রু বর্ষণ করছে মীরা, থেমে থেমে ফুঁপিয়ে উঠলো উর্মি। কি নিদারুণ যন্ত্রণা, কি নিষ্ঠুর বেদনাদায়ক অনুভূতি!
পাতলা ঠোঁট নাড়িয়ে বিরবির করে সূরা তেলওয়াত করছে মীরা। ভেজা নয়নে সময় অতিবাহিত হলো অনেক ক্ষণ। সবুজ ঘাসে বসে আছে উর্মি কিন্তু মীরা ঠাঁই দাঁড়িয়ে।

পেছন থেকে রাইফের আওয়াজ শোনা মাত্র চমকিত হলো মীরা। চকিত দৃষ্টিতে ঘুরে তাকালো তৎক্ষনাৎ। সাদা ফরমাল শার্ট, কালো প্যান্ট এর পরিপাটি বেশভূষা রাইফের যে কারো নজর কাড়তে সক্ষম।
স্বামীর পানে ভেজা নয়নে এক পলক তাকিয়ে মুখটা আড়াল করে নিলো মীরা। চুপিসারে চোখের জল মুছে ফেলল, দু ঠোঁট হালকা গোলাকৃতি করে ছেড়ে দিলো ভেতরে জমে থাকা হাহাকার ভর্তি চাপা দীর্ঘশ্বাস।
উর্মি উঠে দাঁড়ালো রাইফ কে দেখে। রাইফের চোখে চোখ পরতেই বেদনা ভরা মুখটাতে ফুটিয়ে তুলল কিঞ্চিৎ হাসি। চোখে চোখে কথা হলো উর্মি এবং রাইফের। উর্মির কাছ থেকে রাইফ যা জানতে পারলো তার সারমর্ম ‘মীরার অবস্থা ভালো না। সরানো যাচ্ছে না এখান থেকে। কেঁদে কুঁদে একাকার অবস্থা। এবার আপনি সামলান।’
রাইফ মীরাকে ঘুরিয়ে নিলো নিজের দিকে। চোখের কোল বেয়ে পরা অশ্রুটুকু স্বান্তনা দেওয়া হাতের অভাবে শুকিয়ে গেছে, দাগ হয়ে আছে ফর্সা গালে। মীরার লালচে হয়ে আসা গাল দুটোই হাত রাখল রাইফ। শুকনো দাগ টাতেই বৃদ্ধাংগুল ছোঁয়ালো, আলতো করে মুছে দিলো অশ্রুপাতের শেষ চিহ্ন টুকু।
রাইফের ভরসার হাত টা মীরার হাত টেনে নিলো নিজের দিকে। সামনে পা আগাতে আগাতে মীরাকে ইশারা করলো তার সাথে পা মেলানোর। বোনের ভরসার হাতটা টেনে নিলো উর্মিকে। তিন জোড়া পা চলল একই পদক্রমে। দুজনের মনে নানী এবং দাদীজানকে হারানোর শোক তো অপর জনের মনে শুকরিয়া। মীরাকে নিজের করে পাওয়ার শুকরিয়া। এক সাথে চলা তিন জোড়া পায়ের এক জোড়া পা হঠাৎ কিছুটা ধীর হলো। এপর্যায়ে এসে বাম দিকের কোণায় সাদা রঙের কবরটাতে নজর রাখল রাইফ। পিতার শূন্যতা অনুভব হলো, চাপা কষ্টে র/ক্তক্ষ/রণ হলো শক্তপোক্ত বুকের বা পাশটাতে।

____________

রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে মীরা, উর্মি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না পায়ের ব্যাথায়। হেলান দিয়েছে স্ট্যান্ড করে রাখা রাইফের বাইকে।
সামনের দোকান থেকে ফার্স্টফুড পার্সেল করা প্যাকেট টা হাতে নিয়ে বড় বড় পা ফেলে মীরাদের কাছে এসে দাঁড়ালো রাইফ। পার্সেল টা উর্মির হাতে দিয়েই হাঁক ছাড়ল রিক্সার জন্য। হাত উঁচিয়ে ডাকলো একজন অর্ধবয়স্ক ব্যাক্তিকে যিনি পরিবারের মুখে হাসি ফোঁটাতে ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে রিক্সার প্যাডেল ঘোরান জীবীকার তাগিদে৷
অর্ধবয়স্ক লোকটি কাছে আসলে বাসার এড্রেস বলল রাইফ। রিক্সাওয়ালা ব্যাক্তিটি এক গাল হেসে দিলেন, বললেন সেদিকে যেতে ইচ্ছুক তিনি।
ধৈর্য হারা উর্মি পায়ের ব্যাথায় আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। তড়িঘড়ি করে এক প্রকার লাফ দিয়েই রিক্সায় উঠে গেলো, বসে পরলো এক পাশে মীরার জন্য জায়গা রেখে। রাইফের পাশেই এক হাত পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মীরা স্বভাব বশত মাথায় পেঁচানো ওড়নাটা শুধু শুধু টানলো একটু। রিক্সায় ওঠার জন্য দু কদম এগিয়ে গিয়ে রাইফ কে অতিক্রম করবে এমন সময় মীরার হাত রাইফের হাতে ব’ন্দী হলো, টান পরলো কোমল হাতে। প্রশ্নত্নাক দৃষ্টিতে পিছু ফিরল মীরা। রাইফ মীরাকে এক পলক দেখে সামনে চোখ রাখল। উর্মিকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-‘আমাদের ফিরতে দেড়ি হবে শালিকা। তোমার বোনটাকে নিয়ে একটু ঘুরবো। তুমি পৌঁছে একট কল দিবা ঠিক আছে? যাও।’

পা ব্যাথায় জর্জরিত উর্মির মুখে ফুটল দুষ্ট হাসি। রাইফ আজ উর্মিকে শালিকা সম্বোধন করছে। যেখানে ছেলে মেয়ে সমান অধিকার, সেখানে উর্মি কেনো পিছিয়ে থাকবে! ঠোঁট চেপে মুচকি হেসে বলল উর্মি,

-‘আপনাদের ই সময় দুলাভাই। কাবাবের হাড্ডি হাড্ডি ফিল নিতে চাচ্ছি না আজ। দোয়া করিস মীরু, বাসায় পৌঁছানোর আগেই যেনো একটা আশিক মিলে যায়, দেওয়ানা হয়ে যায় আমার প্রেমে।’

🔳

গোধূলি লগ্ন। পশ্চিমাকাশে ঢলে পরা গোলাকার র’ক্তি’ম সূর্য টার তেজ এখন নেই বললেই চলে। শহর কৃত্রিম আলোয় আলোকিত হতে শুরু করেছে।
মীরার ধরে রাখা হাত টা টেনে বাইকের সামনে এনে দাঁড় করালো রাইফ। এতো ক্ষণ মনের মাঝে চেপে রাখা প্রশ্নটা করেই ফেলল মীরা,

-‘কোথাও যাবেন?’

-‘হুম, ঘুরে আসি চলো। ভালো লাগবে তোমার। আচ্ছা প্রিয় কোনো জায়গা আছে তোমার? কোথায় যেতে চাও বলো?’

পর পর প্রশ্ন করা রাইফের প্রস্তাব মীরার ভালো লাগলো। বিষন্ন মনটা যদি একটু ভালো হয় এই সুযোগে। এই শহরের কোলাহল থেকে দূর থেকে দূরান্তর যেতে চায় মীরা। ধীর কন্ঠে স্পষ্ট ভাষায় জবাব দিলো সে,

-‘যে দিকে চোখ যায়।’

রাইফ এর স্বাভাবিক চেহারায় ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। ব্যাস্ত নগরীর ব্যাস্ত সব কিছু। কেও ই দেখার জন্য কিংবা তাদের আলাপচারিতা শোনার জন্য থেমে নেই। তারপরেও পুরুষালী কন্ঠটা যতো টুকু সম্ভব খাঁদে নামালো রাইফ। ভরাট কন্ঠে শান্ত ভঙ্গিতে বলে উঠল,

-‘আমার মন তো শুধু তোমাকেই চায়। আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়াতে চায়, দু চোখ ভরে দেখতে চায়।’

চলবে…

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_৩১

উর্মি বাসায় পৌঁছেছে মিনিট পাঁচেক আগে। কোনো রকমে ফ্রেশ হয়েই রাইফের দেওয়া খাবারের পার্সেল নিয়ে বসেছে বিছানার ঠিক মাঝ বরাবর। এক হাতে তার বার্গার তো অন্য হাতে পিজ্জার টুকরো। দুটোতেই সমান তালে কামড় বসিয়ে দন্তপাটি তে পিষ্ট করে গলাধঃকরণ করছে সে, মাঝে মাঝেই অমৃত স্বাদ নিচ্ছে চোখ বন্ধ করে। খাবারের স্বাদ কে আরো দ্বিগুণ করে তুলতে দু হাতের কব্জির সাহায্যে কোল্ড ড্রিংকস এর ক্যান তুলে চুমুক দিচ্ছে থেমে থেমে।
বার্গারে মাত্র বড়সড় আরেকটা কামড় বসানোর জন্য মুখ হা করতেই মায়ের উচ্চ আওয়াজের ডাক কানে আসলো উর্মির, বিরক্তির ভাঁজ ফুটে ওঠলো কপালে। এমনিতেই তার মন মেজাজ খারাপ, তার উপর মায়ের ডাকা ডাকি। শান্তি নেই একটুও।
অবশ্য মেজাজ খারাপের ও যথেষ্ট কারণ আছে তার কাছে। বাসায় ফেরার সময় উর্মি আজ আশেপাশে নজর রেখেই আসতেছিলো এই ভেবে যে, যদি কেউ তার দিকে প্রেমের ইশারা টিশারা দেয়। কিন্তু আশায় গুড়ে বালি দিয়ে কোথায় থেকে যেনো হুট করে আগমন হলো তার শ্রদ্ধেয় পিতার। রিক্সা থামিয়ে দুই দুইটা বাজারের ব্যাগ রিক্সায় দিয়ে বলেছিলো বাসায় নিয়ে যেতে, তার দেড়ি হবে ফিরতে। দুঃখে, কষ্টে মাঝ রাস্তায় অল্পের জন্য কেঁদে দেয় নি উর্মি। থুতনির নিচে আঁটকে রাখা মাক্সটা দিয়ে দ্রুত মুখ ঢেকেছিলো সে লোকলজ্জায় ভয়ে। এভাবে পরিচিত কেউ দেখলে নিশ্চিত ঠাড্ডা করতে ভুলবে না। এমনিতেই শখের পুরুষের দেখা পাচ্ছে না সে, তার উপর বাজারের ব্যাগ! এই বুঝি মান ইজ্জত ধূলিসাৎ হয়ে গেলো তার। তাকাবে না, কেউ তাকাবে না আজ তার দিকে। প্রশ্নই উঠে না তাকানোর? ড্যাশিং, হ্যান্ডসাম, সুদর্শন যুবক যখন দেখবে দুই দুইটা বাজারের ব্যাগ নিয়ে যাচ্ছে সে, কেউ কি ফিরে তাকাবে? হতাশ মনে বিড়বিড় করে তখন বলেছিলো উর্মি, ‘আমার ভবিষ্যতের জান, প্রাণ, আত্না। আমি বুড়ি হলে দেখা দিয়েন বুঝছেন। নাকি মায়ের কোল থেকে হাঁটাই শুরু করেনি কে জানে! ভাল্লাগে না। দ্রুত আসতে কি হয় অসভ্য লোকটার।’

___________________________

পশ্চিমাকাশে ঢলে পরা অস্তমিত প্রায় সূর্যটা টুকটুকে লাল রং ধারণ করেছে নীল আকাশের বুকে, যে কোনো সময় হারিয়ে যাবে দূর ওই আকাশ হতে।
পিচ ঢালা সরু রাস্তায় পশ্চিম দিকে ছুটে চলছে বাইক।
বিশাল আকাশে ধূসর রংয়ের তুলোর মতো থোকায় থোকায় ভেসে থাকা মেঘ গুলোর মাঝে তেজহীন রক্তিম সূর্যটা দেখতে অপরুপ লাগছে মীরার। এরিমধ্যে শহরের কোলাহল থেকে দুজন চলে এসেছে গ্রামের দিকে। পিচ ঢালা রাস্তার দুপাশে যতদূর চোখ যায় ধূ ধূ করে বিরাণ ভূমি। অনেক ক্ষণ পর পর দুই একটা বাড়ির দেখা পাওয়া যাচ্ছে। লোকালয় থেকে লোকালয় ছেড়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে বাইকের উপর বসে থাকা দুজন। শিরশিরে হাওয়া ছুঁইয়ে দিচ্ছে রাইফ-মীরাকে।
মীরার নরম কোমল হাতটা রাইফের কাঁধে। এই হাতটা যখন রাইফের শক্ত পোক্ত কাঁধ ছুঁয়েছিলো, কোমল হাতের মেয়েটার কেঁপে উঠেছিলো তনুমন। কাঁধে ছোঁয়া পাওয়া পুরুষটার মন হয়ে উঠেছিলো উৎফুল্ল।

বাবার কাছ থেকে কিনে নেওয়া শখের ‘ইয়ামাহা আর ওয়ান ফাইভ’ এ চার বছর ধরে রাইড করেছে রাইফ। কিন্তু আজকের মতো অনুভূতি তার হয় নি কখনও। শখের নারীর পরশে কালো রংয়ের শখের বাইক টাকে রকেটের ন্যায় ছুটাতে ইচ্ছা করছে তার। কিন্তু পেছনে বসা রমনী টা যে তার খুবই নাজুক, সাথে ভীষণ আদুরেও বটে। এইতো মিনিট বিশেক আগের কথা, যাত্রা শুরুর পূর্বে যখন হ্যালমেট টা মীরাকে নিজ হাতে পরিয়ে দিচ্ছিলো রাইফ, লজ্জাবতী পাতার ন্যায় নুইয়ে পরেছিলো মীরার ঘন আঁখি পল্লব। রাইফের তখন খুব করে ইচ্ছে করছিলো মীরার নুইয়ে পরা আঁখি পল্লবের উপর আধর ছোঁয়াতে, রক্তিম লাল সূর্যের ন্যায় ছোট ছোট চুম্বন এঁকে সৌন্দর্য বর্ধন করতে মীরার লাজুক মুখশ্রীতে।

🔸
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছে, চোখে মুখে সেই মুগ্ধতা স্পষ্ট দৃশ্যমাণ মীরার। দু চোখ ভরে অবলোকন করছে দু পাশের গ্রাম্য দৃশ্য, বিশুদ্ধ শ্বাস নিচ্ছে বুক ভরে। বাইক চালিয়ে মাইলের পর মাইল পথ অতিক্রম করতে থাকা রাইফকে মৃদ্যু আওয়াজে ‘শোনেন’ বলে ডেকে উঠলো মীরা। শো শো বাতাসের শব্দ আর হ্যালমেট পরা থাকায় শুনতে পেলো না রাইফ। রাইফের কাঁধে রাখা হাত টা হালকা চাপ দিয়ে গলার স্বর কিঞ্চিৎ উঁচু করে চেঁচিয়ে ডাকলো মীরা,

-‘শুনুন?’

কান খাঁড়া করলো রাইফ। তৎক্ষনাৎ অর্ধাঙ্গিনীর ডাকে সাড়া দিলো তার কন্ঠ অনুকরণ করেই,

-‘হ্যাঁ বলুন।’

-‘হ্যালমেট টা খুলি?’

-‘অসুবিধা হচ্ছে?’

-‘না। বাতাস টা পুরোপুরি নিতে ইচ্ছা করছে।’

-‘দাঁড়াবো?’

-‘না। আমি পারবো।’

মীরা পারবে বলার পরেও রাইফ বাইক থামালো। মীরার কার্য সম্পন্ন হলে যাত্রা শুরু হলো আবারও। বেশ কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর রাইফ নিজেই ডেকে উঠলো মীরাকে,

-‘মীরা?’

-‘জ্বী।’

-‘একটা কথা।’

রাইফের সাথে থাকতে থাকতে স্বামীর বিদ্যা এ কদিনের বেশ আয়ত্ত করেছে ফেলেছে মীরা। রাইফের বিদ্যা কাজে লাগিয়ে ত্যাড়া ভাবে বলল সে,

-‘একটা কেনো? দুইটা বলুন।’

মীরার জবাবে ঠোঁট বিস্তৃত করে প্রসস্থ হাসি ফুটল রাইফের। স্ত্রী তার বেশ ভালো দীক্ষায় দীক্ষিত হয়েছে দেখা যাচ্ছে। ঘাড় ঘুড়িয়ে একটু দেখার চেষ্টা করল মীরাকে। শুধালো,

-‘তুমি বিয়েতে কেনো রাজি হইছিলা মীরা? এতো পাষাণ তুমি! আমার কথা একটুও ভাবলা না?’

কি ওলট পালট কথা বলছে লোকটা! নিজেই বিয়ের সমন্ধ পাঠিয়ে, বিয়ের জন্য উতলা হয়ে এখন নিজেই বলছে তার কথা নাকি ভাবে নি। মাথায় আজ উনার অবরোধ চলছে নাকি? কেমন গন্ডগোল মার্কা কথা বার্তা! হালকা চেঁচিয়ে জবাব দিলো মীরা,

-‘আপনার কথা ভেবেছি বলেই তো রাজি হয়েছি।’

-‘আরেহ বোকা মেয়ে! তোমার দাদীজান, আমার নুরজাহান ডার্লিং বেঁচে থাকা অবস্থায় যে বিয়েটা ঠিক হয়েছিলো, সেটাতে কেনো মত দিছিলা?’

মীরার বোধগম্য হলো এবার। দাদীর কথা মনে পড়ার সাথে সাথে ক্ষানিক মন খারাপও হলো। চুপ করে রইলো সে। রাইফ চেঁচিয়ে আবারও ডাকলো মীরাকে। মীরা ছোট আওয়াজে সাড়া দিতেই শুধালো রাইফ,

-‘মন খারাপ হলো বিয়ে ভেঙ্গেছিলো বলে?’

-‘না। দাদীজানের পছন্দ ছিলো তাই রাজী হয়েছিলাম।’

-‘ভাগ্যিস বিয়েটা ক্যান্সেল হইছে। তোমার যদি বিয়েটা হয়েই যেতো?’

মীরা মন ম/রা বিবশ কন্ঠে জবাব দিলো,

-‘হতো না বিয়েটা। ক্যান্সেল হতো যেভাবেই হোক। আপনার সাথেই যে আমার রিজিক জুড়ে আছে। শুধু বিয়ে ভাঙ্গার অছিলাটা দাদীজান না হলেও পারতো। আগে হোক বা পরে, আমি তো আপনার ই হতাম।’

-‘পুরোপুরি হতে আর কতো দিন লাগবে মীরা। দেড়ি তো সহে না, মনে তো মানে না।’

মীরা বললো কি আর রাইফের জবাব কি? এই লোকটার সাথে মীরা আর পারছে না। সব সময় ইনিয়ে বিনিয়ে ইঙ্গিত পূর্ণ কথা বলবেই বলবে। রাইফের কথা শুনে কান গরম হয়ে মাথা শূন্য লাগছে মীরার। কোনো রকমে একটা প্রবাদ ছুড়ে দিলো রাইফের উদ্দেশ্যে,

-‘সবুরে মেওয়া ফলে। অপেক্ষা করেন।’

-‘মেওয়ার মিঠে স্বাদ নিতে মরিয়া হয়ে আছি। আমার আশার ষোলকলার পূর্ণতা কিন্তু চাই ই চাই।’

রাইফের আবারও ইঙ্গিত দেওয়া অর্থপূর্ণ কথাতে কিছুটা লজ্জা পাওয়া মীরা কপট রাগ দেখালো। রাইফকে চুপ থাকতে বলে শাসালো ক্ষানিক।
মীরার শাসন গায়ে লাগলো না রাইফের, উল্টো হো হো করে হেসে দিলো। হাসির চোটে শরীর মৃদু দুলছে তার। মীরা রাগান্বিত স্বরে মৃদ্যু আওয়াজে ধমকে উঠলো আবারও। রাইফ লুকিং গ্লাসে তাকালো, মীরার নজরে নজর আবদ্ধ হতেই দৃষ্টি সরিয়ে নিলো মীরা। আকাশী রংয়ের মাক্সে ঢাকা মুখাবয়বে মীরার ছোট ছোট দৃশ্যমান চোখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে হাসছে সে। রাইফ জোর গলায় বলে উঠল,

-‘তোমার কন্ঠে আদুরে ধমক টা এতো মিষ্টি, না জানি ভালোবাসার কথায় কতো নতুন অনুভূতির সৃষ্টি। শোনো আমার লজ্জাবতী, তোমার কড়া ধমকের আড়ালে চোখে ফুটে ওঠা গোপন হাসি এই হৃদয় ছেদন করল, এই রাইফ আজ ম/রতে ম/রতেও অমর হলো।’

______________

বুড়িগঙ্গা নদের উপর সুবিশাল ব্রিজের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে দুজন। আজ ভরা পূর্নিমা। সম্মুখে সুদূরে অবস্থিত পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের দা/নবীয় পাহাড়টার কোল বেয়ে আসা নদীর টলমল জল স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে চাঁদের আলোয়। জোনাকিপোকা জ্ব/লছে ঝোপে ঝাড়ে, ঝি ঝি পোকার ডাকও শোনা যাচ্ছে আশে পাশে। গ্রাম্য এলাকা বলে খুব একটা আনাগোনা নেই মানুষজনের। দুই একটা গাড়ির যাতায়াত দেখা যাচ্ছে মাঝে মধ্যে। ব্রিজের মাঝ বরাবর এক পাশে দাঁড়িয়ে এক জোড়া কপোত-কপোতী। সুউচ্চ ব্রিজে শীতল বাতাস মন প্রাণ জুড়িয়ে দিচ্ছে দুজন এর।
ব্রিজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মীরার হালকা গা ঘেষে পেছন দিকে পাশে এসে দাঁড়ালো রাইফ। ডান বাহু দিয়ে মীরার ডান পাশের রেলিং টা ধরে ফেলল। এক দিকে রাইফের সুঠাম দেহ, অন্যদিকে বলিষ্ঠ বাহু দিয়ে ঘিরে বুকের খুব নিকটে আবদ্ধ করেছে মীরাকে। এমন ভাবে আবদ্ধ করেছে যে শরীরের সাথে শরীর স্পর্শ হবে হবে ভাব আবার হচ্ছেও না। রাইফ কাছাকাছি আসতে রেলিং থেকে হাত নামালো, আড়ষ্ট থেকে আরো আড়ষ্টতর হলো মীরা। ছটফট করে উঠলো তার বক্ষ পিঞ্জর। রাইফের মুখের কাছে ওড়না দিয়ে আচ্ছাদিত মীরার মাথাটায় চুমুর পরশ এঁকে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলো না। মীরার অজান্তেই অধর ছোঁয়ালো ছোট্ট করে। দিন শেষে এতো টুকুতেই ভীষণ রকমের শান্তি অনুভব করলো সে। আরেকটু শান্তি পেতে মরিয়া হয়ে উঠলো পুরুষালী হৃদয়। রেলিং থেকে হাত সরিয়ে মীরার হাতের উপর হাত রাখলো, মীরার ছোট্ট দেহটাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো পেছন থেকে। পুরো শরীর জুড়ে শীতল স্রোত বয়ে যাওয়া মীরার বক্ষ পিঞ্জর এর অবস্থা এখন টালমাটাল। শিরা-উপশিরায় শিহরণ বয়ে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে। নিজেকে এরকম পরিস্থিতিতে সামলাবে এমন সময় দশ সেকেন্ড এর ব্যাবধানে বেপরোয়া ভাবে ক্ষিপ্র গতীতে ছুটে আসা মালবাহী ট্রাক দিক ভুল করল, উচ্চ আওয়াজে হর্ণ বাজিয়ে ধেয়ে আসলো তাদের দিকে। রাইফের দিকে সেকেন্ডের ব্যাবধানে ঘুরে দাঁড়ালো মীরা, ভয়ে দুহাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল রাইফের কোমড়। মূহুর্তেই গগণ বিদারী চিৎকার এ ভরে উঠলো রাতের আকাশ।

চলবে…….

মুঠোবন্দী লাজুকলতা পর্ব-২৮+২৯

0

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_২৮

🍁
নতুন জামাতার আগমনের খবর শুনেই ভাইয়ের বাসায় ছুটে এসেছেন সানজিদা বেগম। একমাত্র ভাতিজিকেও দেখতে তার মন আকুপাকু করছিলো সকাল থেকেই। এসেই খাদিজা বেগমের সাথে লেগে পরেছেন রান্না বান্নায়। শওকত রহমান বাজার করে এনেছেন ব্যাগ ভরে। আপাতত গরুর গোস্ত আর কাবাবের লোভনীয় সুস্বাদু ঘ্রাণ মৌ মৌ করছে পুরো বাসায়।

নিজ রুমে বসে থাকা শওকত রহমান হাঁক ছুটালেন উচ্চ আওয়াজে, ডেকে উঠলেন প্রিয় সহধর্মিণীকে। খাদিজা বেগম আসলেন, ঘর্মাক্ত মুখ শাড়ির আঁচলে মুছে তাগদা দিলেন কি জন্য ডেকেছে সেটা বলতে।
শওকত রহমান পাশে বসালেন, ফোনটা হাতে নিয়ে বাড়িয়ে দিলেন স্ত্রীর দিকে। বললেন,

-‘রাইফের আম্মাকে ফোন দিয়ে আসতে বলো। সবাই আছে, উনিও আসুক। একা একা কি করবে বাসায়।’

-‘হ্যাঁ হ্যাঁ। দেন, তাড়াতাড়ি কল দেন। কথা বলছি।’

কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানেই কল রিসিভ হলো। রাজিয়া বেগমের সহিত খাদিজা বেগম কুশলাদি বিনিময় করলেন খোশ মেজাজে। অনুরোধের সুরে বাসায় আসার আমন্ত্রণ জানালেন, কিন্তু রাজিয়া বেগমের ইচ্ছা থাকা স্বতেও আসতে পারবেন না বলে জানিয়ে দিলেন। হাঁটুর ব্যাথা চরম আকারে বৃদ্ধি পেয়েছে তার৷ রেস্ট করছেন শুয়ে শুয়ে। না আসতে পারার জন্য ক্ষমাও চেয়ে নিলেন বিনীতস্বরে।

🔹

মীরার হাতের চা খাওয়ার সৌভাগ্য আর হয় নি রাইফের। হবে কি করে? নববধূ মীরাকে যে ভাবে কথার জালে জব্দ করে যাচ্ছে একের পর এক, সামনে মুখ দেখানোর মতো আর সাহস পায় নি মীরা। প্রখর জ্ঞানসম্পন্ন রাইফও জানে মীরা আর আসবে না। লজ্জাবতী লাতার ন্যায় চুপসে যাওয়া মীরার ছোট্ট কোমল হৃদয়ে যে এখন তুখোড় গতিতে ডামাডোল বাজছে তা সে খুব ভালো করেই জানে। রাইফ ফ্রেশ হয়ে গা এলিয়ে দিয়েছে বিছানায়। তার ক্লান্ত দেহ মীরার নরম বিছানা পেয়ে প্রশান্তিতে চোখ বুজে নিলো। খুব বেশি সময় লাগলো না, মূহুর্তেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো রাইফ।

একটু আগে রাইফের কথার বাণে বি’দ্ধ হওয়া মীরা ঘুরঘুর করছে কিচেনে, খাদিজা বেগমের আশেপাশে। কাজ না থাকা স্বতেও একবার এটা ধরছে তো আরেকবার ওটা। ব্যাস্ত হাতে কাজ করা খাদিজা বেগমের চার পাশে ঘুরঘুর করাতে তার মাথা ঘুরছে। বিরক্তি ভরা চোখে তাকালেন তিনি, মীরাকে ধমকে উঠলেন কিঞ্চিৎ। মেয়েকে স্থির থাকতে বলে রুমে গিয়ে রাইফের কি লাগে দেখতে বললেন। মীরা তো যাবে না কিছুতেই, এমন পরিস্থিতির পর কিভাবে যাবে মীরা রাইফের সামনে? রাইফের কাছ থেকে গা ঢাকা দিতেই তো এখানে ঘুরঘুর করছে আর উনি কিনা বলে রাইফের কাছে যেতে। অসম্ভব, এখন যাওয়া মানেই আরেক বার উনার বেফাঁস কথায় কান গরম হওয়া। মীরা আমতা আমতা করল, মিনমিন করে বলল,

-‘উনার মনে হয় কিছু লাগবে না আম্মা।’

-‘লাগবে না মানে কি? চা নিয়ে যা।’

মীরা মাথা চুলকালো। ইনিয়ে বিনিয়ে বলল,

-‘চা খাবে না।’

-‘কি খাবে?’

-‘কিছুই খাবে না।’

-‘এসব কি ধরণের কথা বার্তা মীরা। নতুন জামাই, না দিলে খাবে কি করে। এই নে ট্রে, যা নিয়ে যা।’

মীরা যে আজ কঠিন বি’পদে পরেছে তা একদম হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। রাইফ এর বলা একেকটা কথা যে তার ভেতর কম্পন সৃষ্টি করে তা তো আর কেউ জানে না। মীরার মনে হচ্ছে এভাবে চলতে থাকলে সে আর বেশি দিন বাঁচবে না। এমন দুরুদুরু বুকে ভয়ে ভয়ে আর কতো দিন ই বা থাকা যায় দুনিয়ায়। রাইফের হুট হাট কাজে মীরার হৃদ স্পন্দন থেমে যায় তো কখনও বেগতিক ভাবে চলে। কথাতেই এমন, কাজে কর্মে না জানি কেমন হবে এটা ভেবেই দিশেহারা সে। কঠিন শঙ্কায় মীরা, কবে জানি হার্ট এট্যাক করে বসে রাইফের এমন আচরণে। এলোমেলো চিন্তা মনের মাঝেই চাপা দিয়ে দুরুদুরু বুকে নিজ রুমে উঁকি দিলো মীরা। ওই তো বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে রাইফ। মীরার কপালে খানিক চিন্তার ভাঁজ পরল। এই কয় দিনে রাইফকে সন্ধ্যার পর কখনও ঘুমাতে দেখেনি সে। শরীর খারাপ করে নি তো? ট্রে টা টি টেবিলের উপর শব্দহীন ভাবে রেখেই মৃদু আওয়াজে ডেকে উঠলো মীরা,

-‘শুনছেন?’

মীরার মিহি ডাকে ঘুমন্ত রাইফের ঘুম পাতলা হলো, কিন্তু জবাব দিলো না। ওভাবেই পরে রইলো বিছানায়। জড়তার সাথে কথা বলা মীরা আরেকটু এগিয়ে এলো। কন্ঠে উৎকন্ঠা মিশিয়ে ডেকে উঠল পুনরায়,

-‘এই যে শুনছেন? আপনার কি শরীর খারাপ?’

রাইফ যেনো এটার ই অপেক্ষায় ছিলো। ঘুম ভে/ঙ্গে গেলো পুরোপুরি, বালিশে গুঁজে দেওয়া মুখটায় ফুটে ওঠলো দুষ্ট বাঁকা হাসি। নড়াচড়া না করে ওভাবেই ঘুম জড়ানো কন্ঠে জবাব দিলো রাইফ,

-‘হুম। ব্যাথা, বুকের বা পাশে ব্যাথা, তোমায় কাছে না পাওয়ার প্রচন্ড ব্যাথা।’

রাইফের নিচু স্বরে বলা কথার শেষ অংশ টুকু শুনতে পেলো না মীরা। যতোটুকু শুনল তাতে ব্যাথা শব্দটা শুনে ধরে নিলো রাইফের সত্যি সত্যি শরীর খারাপ। মীরা উৎকন্ঠিত হলো, ব্যাতিব্যাস্ত কন্ঠে শুধালো,

-‘কোথায় ব্যাথা? মেডিসিন দিবো? দেই একটা?’

তড়িৎগতিতে মাথা উঁচু করে তাকাল রাইফ। মুখে তার বিস্তর হাসি। কপালে পরে থাকা এলোমেলো চুল গুলো এক হাতের সাহায্যে গুছিয়ে নিয়ে উঠে বসল ধীরে সুস্থে। মীরার মুখ বরাবর মুখ এনে চাপা আওয়াজে বলল,

-‘মেডিসিন লাগবে না মীরা। বুকে আসো, বিশ্বাস করো কোনো ব্যাথা থাকবে না। একটুও না। এন্টিবায়োটিক তুমি, ভিটামিন, ব্যাথানাশক সব তুমি।’

মীরার তনুমনে শিহরণ বয়ে গেলো। শীতল স্রোত বয়ে গেলো শিড়দাড়া দিয়ে। শেষের কথাতে মীরার অবশ্য হাসিও পেলো বেশ। এই লোক সভ্য হবে না কখনও। সিরিয়াস সময়েও কেমন অসিরিয়াস কথাবার্তা! হাতাশার শ্বাস ফেলে রাইফের সামনে চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে দিতে বলল,

-‘আপনার সাথে কথা বলাই বৃথা। সব সময় কথা উল্টান। সোজা কথা কবে বলবেন?’

রাইফের এবার পুরো মুখ জুড়ে হাসি ফুটালো। আরাম করে বসে মীরার গোলগাল মুখটায় নজর বুলিয়ে ভ্রু জোড়া কিছুটা উপরে তুলে বলল,

-‘সোজাসাপটা কথা হজম করতে পারবা তো মীরা? তাহলে বলি শোনো, তোমার ওই গোলাপি ঠোঁট টার জন্যও….

মীরা বিস্ফোরিত নেত্রে তাকিয়ে, চোখ কোটর ছেড়ে বেড়িয়ে আসার জোগার। কি বলছে এসব? সর্বনাশ! পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে উপস্থিত বুদ্ধি মাথায় যা আসলো তাই করলো। হাতে থাকা চায়ের গরম কাপ টা রাইফের বকবক করে বলতে থাকা ঠোঁটে ছোঁয়ালো। রাখঢাক না রেখে বেঁফাস কথা বলা রাইফের জবান বন্ধ হলো চায়ের কাপের গরম ছ্যাঁ/কে। মৃদু আর্তনাদ করে উঠল রাইফ, ঠোঁটে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,

-‘কাপ না ছুঁইয়ে তোমার গোলাপি ঠোঁট দুটোই ছুঁইয়ে দিতা। তিল তিল করে না পু’ড়ে একেবারেই না হয় পু’ড়ে যেতাম। বুকের ব্যাথা তো কমে যেতো।’

🔹

ভাতিজি জামাই এর সাথে গল্প জুড়েছেন সানজিদা বেগম। আলাপ আলোচনায় বিভিন্ন প্রশ্ন করছেন তিনি। রাইফ ও সুন্দর ভাবে একেকটার জবাব দিয়েই যাচ্ছে। উর্মি হুটহাট আসে, আবার হুটহাট চলে যায়। এই তো একটু আগে এসে যখন রাইফ আর সানজিদা বেগমের আলাপচারিতায় বাগরা দিয়ে তার বিয়ের কথা বলে আফসোস করতে থাকল, সানজিদা বেগম নিজের জেগে ওটা রাগ কোনো রকমে চেপে গেছেন সামনে বসে থাকা রাইফের জন্য। রাইফ না থাকলে এই মেয়েকে আজ উনি কিছু একটা করতেন ই করতেন। এতো ধিঙ্গিপণা মেয়েকে নিয়ে তিনি খুব বিপাকে পরেন আজকাল। এবার মনে হচ্ছে নিজের মেয়ের বিয়ের কথা ভাবতে হবে অচিরেই। তবু যদি একটু শুধরানো যায়।

_____________

সবাই নৈশভোজ সেরেছে কিছুক্ষণ হলো। রাইফ তখনি জানিয়ে দিয়েছে সে আজ থাকতে পারবে না। শওকত রহমান এবং খাদিজা বেগম অনেক জোরাজুরি করেছেন, কিন্তু রাইফ অনুরোধ করেছে না থাকার জন্য। অন্য দিন অবশ্যই থাকবে। মীরার মনটা পরিবার কে পেয়ে প্রফুল্ল হয়েছে। রাইফ থাকলে মেয়েটার একটু হলেও অস্বস্তি হবে। থাকুক সে, পরিবারের সাথে একান্ত সময় কাটাক। তার উপর মায়ের অসুস্থতার কারণেও বাসায় যেতে ইচ্ছুক সে।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাইফ, চলে যাবে এখনি। উর্মিকে দিয়ে মীরাকে ডেকে পাঠিয়েছে কয়েক বার। আহম্মকি কাজ করায় মীরার খুব সংকোচ হচ্ছে রাইফের সামনে আসতে। কেনো যে তখন কাপ টা রাইফের ঠোঁটে লাগালো। ছিহ্, নিজের উপর ই তার বিরক্ত লাগছে তখন থেকে। ছোট ছোট কদমে জড়সড় হয়ে রাইফের সামনে এসে দাঁড়ালো মীরা। এই লোকটার সামনে আসতে তার অন্তর কাঁপে, ভীত নড়বড়ে হয়। আলোছায়ায় ঘেরা বারান্দায় রাইফ গম্ভীর মুখে তাকিয়ে দেখছে মীরাকে। মীরা পিটাপিট করে তাকাচ্ছে এদিক সেদিক। ঘন পাপড়ির ওঠানামা রাইফের হৃদয়ে ব্যাকুলতা সৃষ্টি করছে। ডাগর ডাগর চাওনি দেওয়া চোখটাতে আলতো করে অধর ছোঁয়ার তীব্র বাসনা চেপে বসেছে মনের মধ্যিখানে। মীরার একটা হাত টা টেনে নিলো রাইফ, দুহাতের মুঠোয় চেপে গাঢ় স্বরে বলল,

-‘ধীরে ধীরে সংকোচ দূর করো মীরা। তোমাকে মা ডাক শোনানোর তীব্র বাসনা জেগেছে আমার মনে।
ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। তোমার এই ছোট্ট দেহ টাকে বুকে আগলে নিতে দিনকে দিন সত্যি বেহায়া হচ্ছে আমার মন।’

চলবে………

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_২৯

🍁
রাতের আঁধার দূরীভূত করে ধরণীর বুকে সবেমাত্র সূর্যের কিরণ ছড়িয়ে পরতে শুরু করেছে। এতো সকালেই রাজিয়া বেগমের পুরো কিচেন খাবারের ঝাঁঝালো ঘ্রাণে ভরে গেছে। দুই চুলায় ঝমঝম আওয়াজ তুলে পুরোদস্তুর রান্না করছে মীরা। পাশেই উঁচু মোড়ায় বসে আছেন রাজিয়া বেগম।
ফজরের সালাত আদায় করেই মীরা চলে এসেছিলো পাঁচ তলায়। শাশুড়ীর অসুস্থতার খবর শুনে গতরাতেই একবার দেখতে আসতে চেয়েছিলো মীরা, কিন্তু রাইফের বারণে আসতে পারেনি। ভোরেই ঘুম থেকে উঠে ফজরের সালাত আদায় করেই সোজা উপরে চলে এসেছে সে।

মীরার কঠোর বারণ রাজিয়া বেগমের প্রতি। কোনো ভাবেই যেনো উনি রান্না-বান্নার কাজে হাত না লাগায়। রাজিয়া বেগম বেশ কয়েক বার বাঁধা দিয়েছেন মীরা যেনো রান্না না করে৷ কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় নি। গতরাতে রাইফ চলে আসার সময় রাজিয়া বেগমের জন্য খাবার প্যাক করে পাঠিয়েছিলেন মীরার মা। সেই খাবার থেকে অল্প একটু খেয়েছেন তিনি৷ সেটা দিয়েই চালাতে চেয়েছিলেন আজকের সকালের খাওয়া-দাওয়া পর্ব। সেই সকাল থেকে বলেই যাচ্ছে মীরা যেনো খাবার রান্না না করে, কিন্তু মীরা মানতে নারাজ। শাশুড়ীর কি খেতে ইচ্ছা করছে তা পেট থেকে বের করেই ছেড়েছে। বিয়ের দিন থেকে গোস্ত, পোলাও, কোরমা খেতে খেতে মুখের রুচি কমে গেছে রাজিয়া বেগমের। তাই মীরাকে বলেছে অল্প কিছু ভর্তা করার জন্য।
মীরা আলু ভর্তা, ডাল ভর্তা, তিল ভর্তা শেষে এখন ইলিশ মাছ ভাজছে আর অন্য চুলায় ওদের বাড়ি থেকে পাঠানো খাবার টুকু গরম করছে। মীরা ফল কে/টে হাতে ধরিয়ে দিয়েছে শাশুড়ী আম্মাকে এবং একটু পর পর ই তাগদা দিচ্ছে খাওয়ার জন্য। রাজিয়া বেগম এক টুকরো খাচ্ছেন তো দুই টুকরো মীরার মুখেই তুলে দিচ্ছেন। মীরা না করলেও শুনছেন না তিনি। শাশুড়ী-পুত্রবধু যেনো একে অপরকে খাওয়ানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে আজ সাত-সকালে।
______________

মীরা পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। বদ্ধ রুমের দরজা খানিক খুলে উঁকি দিলো রুমে। রাইফ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। শব্দ বিহীন পায়ে রুমে প্রবেশ করল সে। ওয়াশ রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রাইফের পাশেই বসে আধোশোয়া হয়ে হেলান দিলো বিছানায়। মোবাইলে চোখ বুলাল, সময় সাতটা বেজে পঞ্চাশ মিনিট। ডেকে তোলা প্রয়োজন রাইফকে। অফিসের সময় হয়ে এলো, কিন্তু মীরার ডাকতে ইচ্ছা করছে না একটুও। কি সুন্দর ভাবে ঘুমাচ্ছে রাইফ, শ্যমবর্ণের মুখটায় মায়া ছড়িয়ে পরেছে সর্বত্র। লাজুক মীরার খুব করে ইচ্ছা করছে রাইফের এলোমেলো চুলগুলো ছুঁয়ে দিতে, আংগুলের সাহায্যে অগোছালো চুল গুলোকে আরেকটু এলোমেলো করতে।
গত তিনদিনেই মীরার অভ্যাস টাও কেমন পালটে গেছে হুট করে। রাইফের আংগুলে আংগুল রেখে রাত্রিযাপন করা মীরার গতরাতের ঘুমে বার বার খুঁজছিলো রাইফের শক্তপোক্ত হাতটা। লোকটা ভালো, ভীষণ রকমের ভালো। কিন্তু মীরার অস্বস্তি ওই এক যায়গাতেই। হুটহাট কথা বলে লজ্জায় ফেলে দেয় সুযোগ পেলেই।

সময় পেরোলো মিনিট দশেক। মীরার মনে রাইফকে ঘিরে হাজারও ভাবনা প্রজাপতির ন্যায় ডানা ঝাপ্টাচ্ছে এমন সময় পাশে রাখা মুঠোফোনটায় কর্কশভাবে বেজে উঠলো এলার্ম ধ্বনি। মীরা বতিব্যাস্ত হলো এলার্ম অফ করার জন্য। বালিশের পাশে পরে থাকা মুঠোফোনটায় হাত দিতেই রাইফের হাতটাও মীরার হাতের উপর স্পর্শ করল। আচানাক কারো হাতের সংস্পর্শে রাইফ ভ্রু কুঁচকালো এবং সেকেন্ড পাঁচেক পার হতেই কুঁচকানো ভ্রু সোজা হলো। বদ্ধ চোখের মুখটাতে ফুটে উঠল মুচকি হাসি। শক্ত করে আবদ্ধ করে নিলো মীরার হাত। উপুর হয়ে শুয়ে থাকা রাইফ পাশ ফিরলো মীরার দিকে। চোখ খুলল, সকাল বেলায় অপ্রত্যাশিত ভাবে কাঙ্ক্ষিত নারীর মুখটা দেখে প্রশান্তি ছেয়ে গেলো তার হৃদয় জুড়ে। মীরা রাইফের চাওনিতে ফেরত দিলো মুচকি হাসি। টিকটিক করে বেজে যাওয়া এলার্ম টা অফ করার জন্য হাত ছেড়ে নিতে চাইল মীরা। রাইফ বাঁধা দিলো,হাত ছাড়ল না। উপায়ন্তর না পেয়ে মীরা বা হাতের সাহায্যে এলার্ম অফ করে চাইল রাইফের পানে। সাধারণত স্বাভাবিক সময়ে মীরা নিঃসংকোচে তাকায় রাইফের পানে, চোখে চোখ রেখে কথা বলে কোনো অস্বস্তি বিহীন। কিন্তু রাইফের কিছু দৃষ্টি আছে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, গভীর থেকে গভীরতর দৃষ্টি। সেই দৃষ্টিতে শুধুই মুগ্ধতার ছড়াছড়ি। সেই গাম্ভীর্যপূর্ণ দৃষ্টিতেই মীরা নজর রাখতে পারে না। দৃষ্টি রাখবে কি করে? রাইফের এই দৃষ্টিতে যে এক আকাশ সম প্রেম স্পষ্ট দেখতে পায় মীরা, অনুভব করে শিরা উপশিরায়।

রাইফ ইশারা দিলো মীরাকে পাশে পুরোপুরি ভাবে শোয়ার জন্য। কিন্তু মীরা ইশারার সঙ্গ দিলো না। বুঝেও না বোঝার ভান ধরল তৎক্ষনাৎ। ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্নাত্মক ইশারায় জিজ্ঞাসা করল “কি?”
রাইফ আবারও ইশারায় বলল শুয়ে পরার জন্য। কিন্তু লাভের লাভ কিছু হলো না তার। মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি খেলে যাওয়া মীরা আবারও না বোঝার ভান ধরল, আবারও ইশারায় বোঝালো রাইফের ইশারা বোঝেনি সে। প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন রাইফ ধরে ফেলল মীরার চালাকি। রাইফ পুনরায় ইশারা দিলো মীরাকে যার অর্থ “আমার ইশারা কি বোঝো নি?”
মীরা ইশারাতেই বলল বোঝে নি সে। রাইফ বিস্তৃত হাসল। ঠোঁট চেপে মিটিমিটি হাসছে মীরাও। লাজুকলতার মিঠে মুচকি হাসি রাইফের মন শীতল করে তুলল। এই মেয়েটা জানেই না হাসলে কতো সুন্দর লাগে তাকে। রাইফের সঙ্গ পেয়ে মীরাও যে দুষ্টুমি আয়ত্ত করে ফেলছে সেটাও ধরে ফেলল সে।
এ পর্যায়ে এসে শেষ টোপ টা ফেলতে চায় রাইফ। ওস্তাদের সাথে পাঙ্গা নিয়েছে, খেল তো জমাতেই হবে। কেননা না, লাটাই তো তার ই হাতে। আংগুলে আংগুল রাখা মীরার হাতটা আরো শক্ত করে ধরল। ধারালো চোখে তীক্ষ্ণ এক ইশারা দিলো যার অর্থ এবার পাল্টে গেছে। এবার আর পাশে শুতে বলে নি রাইফ, এবার সোজা তার বুকে মাথা রাখতে বলেছে মীরাকে। এবং পরক্ষণেই এটাও ইশারা করেছে, এর ব্যত্যয় ঘটলে তার মুঠোয় আবদ্ধ হওয়া হাতটা টেনে কাছে টানবে মীরাকে।
রাইফের শেষ ইশারায় মীরার হাসিহাসি মুখটা থেকে ফুরুৎ করে উড়ে গেলো মুচকি হাসিটুকু। কিছুটা লজ্জায় গোমড়া হলো চেহারা। রাইফের বুকে যাওয়ার ভয়ে ফটাফট আগের ইশারা মতো শুয়ে পরল দ্রুত। এই লোকের এক বিন্দুও গ্যারান্টি নায়। কখন যে হেঁচকা টানে কাছে নিবে বলা যায় না। মীরার এমন আচরণে রাইফের পেট ফেটে হাসি পেলো, এতোক্ষণের চেপে চেপে মুচকি হাসি শব্দ হয়ে বেরিয়ে এলো। রাইফের খলখল হাসির শব্দে ভরে গেলো পুরো রুম। মীরার কিঞ্চিৎ রাগ হলো। এভাবে হাসার কি আছে? আজ তাকে আলাভোলা পেয়ে এভাবে হাসছে তো, সেও একদিন দেখে নিবে। হুহ!
বদ্ধ রুমে রাইফের হাসি প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছে। মীরা ধ্যান দিলো রাইফের হাস্যজ্বল মুখাবয়বে। শ্যাম সুন্দর পুরুষটার এমন হাসি দেখেনি সে আগে। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে সঙ্গ দিলো রাইফের, শেষ পর্যন্ত হেসে উঠল মীরা নিজেও।

রাইফের হাসি থামল, এগিয়ে এলো মীরার দিকে। চিত হয়ে শুয়ে থাকা মীরার মুখ থেকে হাসি উবে গেলো রাইফের হঠাৎ কাছে আসাতে। পর্দার ফাঁক দিয়ে আসা সূর্যের সোনালী ঝলমলে রোদ্দুর্র মীরার মুখে পরেছে তীর্যক ভাবে। মীরার ফর্সা মুখে লেপ্টে যাওয়া সোনালী আভা এ মূহুর্তে যে কারো বক্ষ পিঞ্জরে মুগ্ধতা ছড়ানোর জন্য যথেষ্ট। রাইফের হাসি হাসি মুখটা ধীরে ধীরে গম্ভীর হলো। হালকা করে মাথায় পেঁচানো ওড়না টার ফাঁক দিয়ে কিছু চুল পরে আছে মীরার গোলাপী আভা যুক্ত গালে। শান্ত স্থির মুখাবয়বে রাইফ মীরার মুখে সম্পুর্ন দৃষ্টি নিবদ্ধ করে তাকিয়ে আছে উপুড় হয়ে বুকে ভর দিয়ে। মীরার একটা হাত এখনও মুঠোয় তার। অন্য হাতে গালে পরে থাকা চুল গুলো সরিয়ে দিলো আলতো করে। নরম গালে রাইফের হাতের স্পর্শ পেয়ে মীরা হৃদয় থমকে গেলো, চোখ বুঝে গেলো সয়ংক্রিয় ভাবে। মীরা অশান্ত মন বলছে রাইফ আজ কিছু করবেই করবে। আচ্ছা এতো যে ধ্যান মে/রে তাকিয়ে আছে তার মুখে, সেই মুখটাতেই অধিকার ফলাবে না তো! অধিকার ফলালে ফলাবে, এতে মীরার আপত্তি নেয় একটুও। রাইফ তার স্বামী, সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে মীরার প্রতি। রাইফকে বাঁধা দেওয়া অনুচিত তবুও নতুন জন্ম নেওয়া গোলমালে অনুভূতি গুলোই বার বার মীরাকে আরষ্ঠ করে তুলছে। রাইফ মীরার ছোট গোলগাল মুখটায় হাত রাখল। নরম গাল টা ঘষে দিলো আলতো করে। মীরার নিশ্বাস ক্রমশ ভারী হতে থাকলো রাইফের স্পর্শে, চোখ বুজেই বিছানায় পরে রইলো শক্ত হয়ে। বালিশের উপর মীরার মুঠোবন্দী হাতটা টেনে তুলল রাইফ। মেহেদীর রঙ এখনও শোভা পাচ্ছে মীরার হাতে। মেহেদীর গাঁঢ় খয়েরী রংটা একদিনে এখন হালকা লালে পরিণত হয়েছে। মীরার হাতের উল্টো পাশটায় রাইফ খুব যত্ন করে বৃদ্ধাংগুল ঘষলো বার কয়েক। মীরার বদ্ধ চোখে আরেকবার নজর বুলাল। ছোট একটা ঢোক গিলে মুঠোয় রাখা মীরার হাতের উলটো পাশে অধর ছোঁয়ালো ছোট্ট করে। মীরার অন্তরাত্মা ধরাম করে উঠল, বদ্ধ নয়ন কুঁচকে আরো ভেতরে গেলো। হৃদ স্পন্দন এক সেকেন্ডের জন্য থেমে গিয়ে বেগতিক হাড়ে ছুটতে শুরু করলো। রাইফের অধরের ছোঁয়ায় মুঠোয় পরে থাকা হাতটা দিয়ে রাইফের হাত শক্ত করে চেপে ধরল মীরা। রাইফের মন অশান্ত হলো। এতো ছোট চুম্বনে মনটা কিছুতেই শান্ত করা সম্ভব না, কিছুতেই না। বুকের ভেতর যে ঝড় উঠেছে সেটা থামানো প্রয়োজন, খুবই প্রয়োজন। বেশি সময় নিলো না, সাত-পাঁচ ভাবার সময় নেই তার এখন। সম্মুখে ধরে রাখা হাত টাতে পুনরায় অধর ছোঁয়ালো। এক বার, দু বার, তিন বার এবং পর পর অনেক বার৷ অজস্র চুমুতে ভরিয়ে তুলল মীরার মেহেদী রাঙা হাত। কখন বা স্বশব্দে কখনও বা শব্দ বিহীন।

চলবে……..

মুঠোবন্দী লাজুকলতা পর্ব-২৬+২৭

0

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_২৬

🍁
নিশুতি রাত, শান্ত শীতল পৃথিবী। হৈ হুল্লোড় নেই কোথাও। হঠাৎ দুই একটা গাড়ির হর্ণ বাজছে, আবার কখনও বা শোনা যাচ্ছে ডানা ঝাপটে উড়ে যাওয়া পাখির কিচিরমিচির ডাক।
পাঁচ তলায় অবস্থিত এক ব’দ্ধ রুমের নিকষ কালো আঁধারে দুটো চোখ তাকিয়ে আছে সম্মুখে। বিশাল আকাশে জ্ব/লজ্ব/ল করে জ্ব/লতে থাকা থালার মতো মস্ত বড় চাঁদের কিঞ্চিৎ আলো খোলা জানালা ভেদ করে পর্দার ফাঁক ফোঁকর দিয়ে ঢুকে মীরার কপাল থেকে থুতনিতে তীর্যক ভাবে লেপ্টে আছে৷ সদ্য নববধূ তার গালের নিচে মেহেদী রাঙা হাত রেখে বিভর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। মাথায় পেঁচানো শাড়ির আঁচল টা সরে গিয়ে বালিশের উপর পরে আছে। খোঁপা করে রাখা চুল বাঁধন ছেড়ে চোখ স্পর্শ করে গালের উপর লেপ্টে আছে। মাথার উপর ভনভন করে চলা ফ্যানের বাতাসে মৃদু উড়ছে সেগুলো। গায়ের উপর পাতলা কাঁথা জড়িয়ে আরাম করেই ঘুম দিয়েছে মীরা। এই শহরের সবাই হয়তো মীরার মতোই গভীর নিদ্রায় কিন্তু নিদ্রাবিহীন শুধু তার পাশে শুয়ে থাকা পুরুষটি। চোখ সয়ে যাওয়া অন্ধকার রুমে কাত হয়ে এক হাতের উপর ভর দিয়ে মুগ্ধ নয়নে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাইফ। পলক ফেলছে অনেক ক্ষণ পর পর। মীরার শরীর থেকে আসা বেলীফুলের মেয়েলি সুবাস নিঃশ্বাসের সাথে সুগভীর ভাবে গ্রহণ করছে সে।

রাইফের সাথে ঘুমানোর আগে মীরার মাঝে ভীষণ সংকোচ কাজ করছিলো। মীরার আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া অবস্থা দেখে রাইফ আর তাকে খুব একটা ঘাটে নি তখন। নাজুক মীরাকে তার ব্যাক্তিগত বিছানা ছেড়ে দিয়ে ঘুমাতে বলে কাজের বাহানা দিয়ে চলে গিয়েছিল বাহিরে। মীরা দুরুদুরু মনে খাটের এক কোণায় শুয়ে পড়েছিলো রাইফের কথা মতো। সারাদিনের ধকল শেষে ক্লান্ত মীরা গা এলিয়ে দিয়েছিলো রাইফের নরম বিছানায়। শোয়ার সাথে সাথেই সেই পরিচিত ঘ্রাণ হালকা হালকা অনুভব করছিলো মীরা। পাবেই বা না কেনো? যেখানে সেই ঘ্রাণের ব্যাক্তিটির ই বসবাস, সেখানে ঘ্রাণের ছোঁয়া থাকাটাই তো স্বাভাবিক। অতিরিক্ত কান্নার ফলে ফোলা ফোলা চোখ দুটো জ্ব/লছিলো মীরার। ক্লান্তিকর চোখ বুজে জেগে থাকা মীরা ঘুমের দেশে যে কখন পাড়ি জমিয়েছিলো বুঝতেই পারেনি। রাইফ পাঁচ-সাত মিনিট পরেই যখন উঁকি দিয়েছিলো রুমে, মীরাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে অবাক হয়েছিলো বেশ। এতো অল্প সময়েই কেউ গভীর নিদ্রায় কিভাবে যেতে পারে? তাও আবার বাসর রাতে?
বিছানার কাছাকাছি এসে একটা বালিশ দূরত্ব রেখে মীরার পাশে রাখা দেখে মুচকি হেসেছিলো রাইফ। অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করেছিলো তখন। মীরা যে রাইফের জন্য বিছানায় জায়গা রেখে ঘুমিয়েছে তা বুঝতে বাকি রইলো না তার। ফুটফুটে মেয়েটার ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখাবয়ব অনেক ক্ষণ দেখার ইচ্ছা থাকলেও লাইট টা অফ করে দিয়েছিলো যেনো মীরার ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে।

টিকটিক করে চলা দেয়াল ঘড়িটা শব্দ করে জানান দিলো এখন রাত্রী তিনটা। মৃদু শব্দ কানে যেতেই মীরা নড়েচড়ে উঠলো কিছুটা। রাইফের ধ্যান ভা/ঙলো। অন্ধকারেই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবলো অনেক রাত হয়েছে, এবার ঘুমানো উচিত তার। মীরা এখন তার অর্ধাঙ্গিনী, জীবনসঙ্গী। রাইফের জীবনের সাথে ওৎপৎ ভাবে জড়িয়ে গেছে সে। সারাটা জীবন এভাবেই পাশাপাশি থাকবে তারা। কাল দিনের আলোয় দেখা যাবে ভেবে দুচোখের পাতা এক করলো ঘুমানোর উদ্দেশ্য। নাহ, কিছুতেই ঘুম আসছে না রাইফের। বালিশ টা মীরার দিকে আরেকটু এগিয়ে নিয়ে সে নিজেও সামনে আগালো, মীরার কাছাকাছি এলো কিছুটা। রাইফের শ/ক্তপো/ক্ত হাতটা চুপিসারে মীরার মেহেদী রাঙা কোমল হাত টেনে নিলো নিজের দিকে। ছোট্ট হাত টা রাইফের হাতের তালুতে আব/দ্ধ করে বুকের কাছে টেনে নিলো। নির্ঘুম দু চোখ কে রেহাই দিয়ে চোখ বুজলো রাইফ। মীরার দেখা পাওয়ার পর থেকেই শান্তির ঘুম উড়ে গিয়েছিলো তার চোখ হতে। চোখ বুজলেই মীরার প্রথম দিনের হতভম্ব চেহারা অকপটে ভেসে উঠতো তার। আজ আর তেমন হচ্ছে না রাইফের। এই তো পাশেই সে। মীরার নরম হাতটা রাইফের মুঠোব’ন্দী। মুঠোব’ন্দী তার লাজুকলতা।

তিন রাস্তার মোড়ে অবস্থিত মসজিদ থেকে ফজরের আজান ভেসে আসছে। নিত্যদিনের অভ্যাসরত মীরা আজানের ধ্বনিতে নড়েচড়ে উঠলো। হালকা হলো তার গভীর নিদ্রা। অন্য দিকে পাশ ফেরার জন্য কাত ঘুরতেই টান লাগলো হাতে। ভ্রু কুঞ্চিত করে অন্ধকারেই চোখ মেলল, শ’ক্ত করে ধরে রাখা হাত টা ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। অন্য হাতে বালিশের নিচে রাখা ফোনটা বের করে ফ্ল্যাশলাইট অন করল। কাছাকাছি পাশে শুয়ে থাকা রাইফ কে ঘুমন্ত অবস্থায় পেলো সে। বলিষ্ঠ হাত দুটো বুকের কাছে জড়িয়ে রেখেছে মীরার হাত। মীরা কি যেনো ভেবে ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসলো। বেখেয়ালি ভাবে ফোনের আলো রাইফের মুখে পরতেই রাইফ চোখ কুঁচকালো। মীরা দ্রুত ফোন সরিয়ে অন্য দিক করে রাখল। হালকা উঁচু করে রাখা মাথাটা আবারও বালিশে রাখল সে। মুখের পাশ দিয়ে বির/ক্ত করা এলোমেলো চুল গুলো কানে গুঁজে রাইফের দিকে দৃষ্টি দিলো। বাহিরে এখনও অন্ধকার ভাব কাটেনি। ফ্লাশ লাইট এর আলোয় রাইফের অবয়ব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মীরা। এই সেই পুরুষ, যার উপস্থিতি মীরার তনুমন উচাটন করে তোলে, যার স্পর্শে মীরার হৃদ স্পন্দন বেগতিক হারে বাড়ে। যার ঠোঁট কা/টা স্বভাব মীরাকে লজ্জায় ফেলে, যার তীক্ষ্ণ নজর মীরাকে আড়ষ্ট করে তোলে।
এই প্রথম মীরা সম্পূর্ণরূপে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো রাইফের মুখে। চৌকস চেহারার অধিকারী লোকটার খোঁচা খোঁচা দাড়ি, সরু নাক, ব’দ্ধ চোখ এ নজর বুলালো। আগে অনেক বার সাক্ষাৎ হলেও এতো কাছাকাছি থেকে গভীর দৃষ্টিতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কখনও দেখেনি মীরা। সুগভীর ভাবে পরখ করে উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের রাইফকে সুপুরুষ থেকে কম মনে হলো না মীরার। সময়ে কে/টে গেলো বেশ। ফর্সা হতে শুরু করেছে ধরণী। মীরা রাইফের মুঠোয় পরে থাকা হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। উহু, পেশিবহুল হাতটা দিয়ে এমন ভাবে ধরে রেখেছে, ছাড়ানো যাচ্ছে না। উপায়ন্তর না পেয়ে মীরা একটু জোর প্রয়োগ করে হাত টা আরেকবার ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই আরো শ/ক্ত করে ধরে ফেলল রাইফ। ভ্রু কুঁচকে ঘুম জড়ানো কন্ঠে আদেশ সূচকে বলল,

-‘আহ! নড়াচড়া করো না তো মীরা। আমাকে একটু ঘুমাতে দাও। ঘুমাতে পারি নি আমি।’

হুট করে রাইফের কন্ঠস্বর শুনে মীরা চমকে উঠল, কপালে ভাঁজ পরলো দু একটা। নড়াচড়াই বা সে করলো কখন? হাত টা ছাড়ানোর চেষ্টা করেছে মাত্র। এটা কে কি নড়াচড়া বলে? মীরা নোয়ানো গলায় বলল,

-‘হাত টা ছাড়ুন, দেড়ি হয়ে যাচ্ছে আমার। নামাজ পড়বো।’

মীরা অপেক্ষা করলো, কিন্তু রাইফ ছাড়লো না। এভাবে আর কতোক্ষণ থাকবে সে। হতাশ হয়ে আবারও মীরাই বলে উঠলো,

-‘ছাড়ুন না। সত্যি দেড়ি হয়ে গেছে। আর আপনি ঘুমাতে পারেননি কেনো?’

মীরার করা প্রশ্ন কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসি ফুটে তুলল রাইফ। মীরার দৃষ্টিগোচর হলো সেই হাসি। রাইফের এই হাসি তার চেনা, ভীষণ চেনা। এই হাসির অর্থ সে বুঝে গেছে এ ক’দিনে। এখনি কিছু বলে ফেলবে এই লোক তা সে হাড়ে হাড়ে জানে। মীরা এই সাত সকালে আর লজ্জায় পরতে চায় না। তাই তো দ্রুত এক ঝাটকায় হাত ছাড়িয়ে উঠে বসল। পা দুটো ফ্লোরে রেখে উঠে দাঁড়াতেই শাড়ির আঁচলে টান লাগলো। অগ্রসর হওয়া পা থেমে গেল, চোখ বুজে ফেলল মীরা। শেষ রক্ষা তার হলো না আজকেও। রাইফ হাতে শাড়ির আঁচল কিছুটা পেঁচিয়ে মীরাকে কাছে টানল। ঘুমুঘুমু চোখ মেলে মীরাকে বলল,

-‘সদ্য প্রস্ফুটিত একটা ফুল যদি পাশে থাকে, কি করে ঘুমাই বলো? তোমার মতো নি’ষ্ঠুর তো আমি নই যে বাসর রাতে ঘুমিয়ে যাবো।’

কথাটা বলে ইউঠে বসে রাইফ মীরাকে ঘুরিয়ে নিলো তার দিকে। হাতটা টেনে নিয়ে পুরুষালী কন্ঠটা আরো খাঁদে নামিয়ে আনলো রাইফ। মীরার হাত টা নেড়েচেড়ে স্মিত স্বরে বলল,

-‘তুমি আমার হৃদয়হ’রণ করেছো মীরা। অ|প|রা|ধ করে ফেলেছো, কঠিন অ|পরা|ধ। তোমাকে যাবত জীবন কা/রাদ/ন্ডে দ/ন্ডিত করা হলো আজ থেকে।’

রাইফ প্রেয়সীর হাতটা উপরে তুলে ধরলো। মীরার এদিক সেদিক তাকানো দৃষ্টি থেমে গেলো হাতে জ্ব/লজ্ব/ল করা হীরার ছোট্ট আংটিটাতে এসে। ভুল দেখছে না সে। রাইফ মাত্র পরিয়ে দিয়েছে তাকে। মীরার তনুমন আবারও কেঁপে উঠল। পিটপিট করে চোখ তুলে তাকাতেই দেখল কাঁথা মুড়ি দিয়ে মাথা ঢেকে শুয়ে পরেছে রাইফ।

চলবে….

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_২৭

ঘড়ির কাটা নয়টা বেজে পয়ত্রিশ মিনিট। রৌদ্রজ্বল সকাল। মীরা মায়ের কোলে মাথা রেখে জাপটে ধরে আছে খাদিজা বেগমকে। কিছুক্ষণ আগে এসেছে নিজ নীড়ে।
বিয়ের পর গুনে গুনে তিন দিন অতিবাহিত হয়েছে। বৌভাতের দিন নিজ পরিবারের সাথে দেখা হলেও আত্নতুষ্টি মিলেনি মীরার। এ ক’দিন রাইফের দুষ্ট মিষ্ট সঙ্গ পেয়ে সময় কাটলেও পরিবাবের কথা ভেবে ঠিকই বুক টা হা হা করে উঠেছিলো তার। আজ সকালে হুট করে ড্রয়িং রুমে যখন শওকত রহমানের উপস্থিতি দেখছিলো রাইফের সাথে, শশুড় বাড়ির কথা সাত পাঁচ না ভেবেই দৌড়ে এসে আব্বাজান কে জাপটে ধরেছিলো মীরা। বাঁধাভাঙ্গা চাপাকান্না হু হু করে নিরবে অশ্রুপাত করেছিলো বাবার বুকের মাঝে মাথা রেখে। শওকত রহমান বাবার স্নেহে সামলে নিয়েছিলেন মেয়েকে। রাজিয়া বেগম বুঝেছিলেন এই কান্নার মানে। মীরার কান্নারত মুখটা দেখে নিজেও আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছিলেন। নতুন পরিবেশে যতই আদর যত্নে রাখা হোক না কেনো, মনটা যে আপন নীড়েই পরে থাকে তা তিনি জানেন। উপলব্ধি করেছিলেন, মনের কোণে ভেসে উঠেছিলো আরো বছর ত্রিশেক আগের স্মৃতি। সপ্তদশী কন্যা রাজিয়া যখন নতুন বউ হয়ে শশুড় বাড়িতে পা রেখেছিলেন, আদর যত্নের কোনো কমতি রাখেন নি রাইফের দাদা দাদী। তার উপর তো রাইফের বাবার সঙ্গতো ছিলোই। তারপরেও সপ্তদশী কন্যার পরিবারের সখ্যতা লাভের জন্য তনুমন প্রতিনিয়ত হাহাকার করে উঠত।
মীরাকে আর বাঁধা দেন নি তিনি। নিজ থেকেই মীরাকে বাসায় যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন শওকত রহমান প্রস্তাব দেওয়ার আগেই।

শওকত রহমান এর হাত ধরেই সকাল সকাল চলে এসেছে মীরা। চুপটি করে কোল থেকে মাথা তুলে খাদিজা বেগমের বুকে মাথা রেখে জড়িয়ে আছে মিনিট পাঁচেক হল। মায়ের বুকের শান্তি টুকু কুড়িয়ে নিচ্ছে আপনমনে। খাদিজা বেগম মাথাটা তুললেন মেয়ের। বাবার সাথে কান্না করে ক্ষান্ত হয়নি, মাকে দেখেও হেঁচকি তুলে নাক টেনে টেনে কান্না করেছিলো অনেক ক্ষণ। যার ফলে মীরার ফর্সা আদল খানি লাল টুকটুকে হয়ে গেছে। খাদিজা বেগম মেয়ের মুখটা আলতো হাতে ছুঁইয়ে দিলেন। থুতনিতে হাত রেখে আদর মাখা কন্ঠে বললেন,

-‘এতো যখন মনে পড়েছিলো আমাদের কথা, রাইফ কে বললেই তো দেখা করাতে নিয়ে আসতো। পাঁচ তলা থেকে তিন তলায় আসতে কি এমন ব্যাপার?’

মীরা ভেজা নয়নে মায়ের পানে তাকালো। থমথমে মুখটা আরো থমথমে করে বলল,

-‘তুমি তো জানোই আম্মা, আমি কেমন। অনেক চেষ্টা করেছি বলার কিন্তু আমি বলতে পারিনি। যদি উনারা ভুল বুঝে মানা করে দেয়?’

খাদিজা বেগম উঠে দাঁড়ালেন। মেয়ের এতো কান্না দেখে মনের মাঝে ঠিকই অনেক ক্ষণ থেকে ঘুরঘুর করছে এক প্রশ্ন। মায়ের দ্বায়িত্ব বোধ থেকে প্রশ্নটা করেই বসলেন,

-‘কেমন মনে হলো তোর শাশুড়ী কে? যতো দূর মনে হয় উনি অনেক ভালো। তার পরেও আমাকে বল, কোনো অসুবিধা হয়েছে কি?’

-‘না না, উনি অনেক ভালো আম্মা। কোনো অসুবিধা হয় নি। চিন্তা করো না।’

‘আর রাইফ ভাই? সে কেমন হ্যাঁ? আদর যত্ন ঠিক মতো করেছে তো আমাদের মীরারানীর?’
মীরা এবং খাদিজা বেগম চকিত দৃষ্টিতে দরজার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। উর্মি দরজায় দাঁড়িয়ে। মুখে তার ব্যাঙ্গাত্মক হাসি। প্রশ্নটা করে খাদিজা বেগমের সামনেই মীরাকে জ্বব্দে ফেলেছে সে। বাঁকা হেসে ভ্রু নাচিয়ে মীরাকে ইশারায় জব্দ করেই যাচ্ছে।
শওকত রহমান রাতেই উর্মিদের জানিয়েছিলেন আজ সকালে মীরাকে আনতে যাবেন। মীরাদের বাসায় চলে আসার জন্য উর্মি এলার্ম দিয়ে রেখেছিলো সকাল সাতটা থেকে আটাটার।
দশ মিনিট পর পর তুমুল বেগে চলা এলার্মের শব্দও ঘুমকাতুরে উর্মিকে তুলতে সক্ষম হয়নি। শেষ মেশ সানজিদা বেগমের হাঁক ডাকে উঠতে উঠতে নয়টা বেজে গিয়েছিলো তার। কোনো রকমে ফ্রেশ হয়েই দৌড় লাগিয়েছিলো এখানে আসার উদ্দেশ্যে। বাসার মেইন দরজার সামনে এসে কলিং বেল চাপতে গিয়েও নব মোচড় দিতেই যখন খুলে গেলো তখন চুপি সারে এসে দাঁড়িয়েছে মীরার রুমের সামনে। মা মেয়ের কথোপকথনে শেষ কথা টুকু কানে আসতেই খাদিজা বেগমকে দ্বিতীয় প্রশ্ন করার সময় না দিয়ে বু/লেটের গতিতে গলা উঁচিয়ে প্রশ্নটা করেই ফেলেছে সে।
মীরা চোখ পাকিয়ে আছে উর্মির দিকে। খাদিজা বেগম গোপনে মুচকি হাসলেন। এখানে আর থাকা উচিত হবে না তার। দুজনের জন্য খাবার রেডি করার বাহানা দিয়ে কেটে পরলেন রুম থেকে।
উর্মি দ্রুত পায়ে মীরার কাছে এসে জাপটে ধরল। হঠাৎ আসায় তাল সামলাতে পারল না মীরা, পিছিয়ে গেলো কিছুটা৷ উর্মি ছাড়ল,উৎসুক কন্ঠে বলল,

-‘কি হলো বললি না যে, উত্তর দে?’

-‘কি?’

-‘কি মানে? আমি এক কথা দুবার বলতে পছন্দ করি না। বল কেমন আদর যত্ন করলো?’

মীরা হঁচকালো না। উর্মির সাথেই তাল মেলাল। গদগদ কন্ঠে উর্মির সুর অনুকরণ করে বলল,

-‘স্বামী-স্ত্রীর ব্যাক্তিগত আদর যত্নের কথাও আমি তৃতীয় জনকে বলতে পছন্দ করি না গলার মালা।’

উর্মি মুখ গোমরা করল, সরু ঠোঁটদুটো ফুলিয়ে অভিমানের স্বরে বলল,

-‘আমাকেও বলবি না? বিয়ে হওয়ার সাথে সাথেই আমাকে এভাবে পর করে দিলি মীরু। জানতাম তুই এমন করবি, তাই বলে এতো দ্রুত।’

মীরা হেসে দিলো শব্দ করে। উর্মির নাদুস নুদুস গালটা দু আঙ্গুলের সাহায্যে টেনে দিয়ে বলল,

-‘তোর রাইফ ভাই ভীষণ দুষ্ট, কথার জালে ফাঁ/সাতে সে ভীষণ পটু।’

উর্মি মীরার কথার পরিপ্রেক্ষিতে মুখ খুলে বলবে
” আর আদর যত্নে কেমন পটু?”
তা আর বলতে দিলো না মীরা। হাত ধরে টেনে তুলল উর্মিকে। তাগদা দিলো সাথে আসার জন্য, আজ মায়ের হাতের সুস্বাদু খাবার খাবে পেট ভরে।

____________

সন্ধ্যা নেমেছে পৃথিবীতে। পড়ার টেবিলে বইয়ে মুখ গুঁজে পড়ছে মীরা। উর্মি অলস ভাবে বিছানায় শুয়ে ফোন ঘাটছে। এমন সময় কলিং বেল বাজলো পর পর দুবার। তৃতীয় বার কলিং বেল বাজতেই মীরা বিরক্তি ভরা চোখে উর্মির দিকে তাকালো। শুয়ে আছে, তবুও উঠছে না উর্মি। মীরা তাগদা দিলো দরজা খোলার জন্য। উর্মি হেলে দুলে উঠে বসেছে তখনই বাহিরে খাদিজা বেগমের কন্ঠস্বর শুনে মনের বিপরীতে ওঠে বসা উর্মি আবারও ধপ করে শুয়ে পরলো। মামি উঠে গেছে মানে উনি দরজা খুলবে, তার আর যাওয়ার প্রয়োজন নেয়। মীরা আবারও ধ্যান দিলো পড়ায়।

বই পড়ুয়া মীরার পড়া থেমে গেলো রাইফের কন্ঠস্বর কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই। বাহির থেকে স্পষ্ট ভেসে আসছে রাইফের কন্ঠস্বর। রাইফ যে হেসে হেসে কথা বলছে তা মীরা না দেখেই বুঝতে পারছে। মীরা দ্রুত পিছু ফিরে তাকাল। ওমা, যে উর্মি এতোক্ষণ বিছানা থেকে উঠতে নারাজ সেই উর্মি উঠে গিয়ে উঁকি দিচ্ছে দরজার বাহিরে। এক পলক বাহিরে উঁকি দিয়েই মীরার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো উর্মি,

-‘তাকিয়ে দেখলে হবে নাকি আসতে হবে। আয় আয়, দ্রুত আয়। তোর আশিক এসেছে।’

বলেই ফিক করে হেসে দিলো সে। মীরা আহম্মক বনে গেলো। একদিকে রাইফ তো আরেক দিকে উর্মি, যে যখন পাচ্ছে তখনি মীরাকে কোনো না কোনো ভাবে খোঁচা দিয়েই যাচ্ছে তাকে। মাঝে মাঝে উর্মি তাও ছাড় দেয়, কিন্তু রাইফ সুযোগ পেলেই হলো। কথার পিঠে কথা বলে লজ্জা নামক মিঠে অস্বস্তিতে ফেলতে দুবারও ভাবে না।

___________

এতোক্ষণ শাশুড়ী এবং শালিকার সাথে হেসে হেসে কথা বলা রাইফের জবান থেমে গেলো মীরার মিহি কন্ঠে রাইফের উদ্দেশ্যে দেওয়ার সালাম শুনে। তড়িৎগতিতে রাইফ তাকালো মীরার দিকে। এই প্রথম মীরা তাকে সালাম দিয়েছে। স্বামীর সম্মান যেন স্পষ্ট উপলব্ধি করছে রাইফ। রাইফের সারাদিনের ক্লান্তি মীরার মিহি স্বরের সালাম পেয়েই দূরীভূত হলো, প্রশান্তিতে ভরে উঠল মন। আওয়াজ করেই লম্বা সুরে সালাম ফিরালো রাইফ,
‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ’
গুটি গুটি পায়ে মীরা মায়ের কাছে এসে দাঁড়ালো। রাইফের সালামের ধরণ দেখে মিটিমিটি হাসছে উর্মি। খাদিজা বেগম মেয়েকে তাড়া দিলেন রাইফকে রুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সারাদিন অফিস শেষে ক্লান্ত হয়ে আছে। রাইফকে ফ্রেশ হতে বলে উর্মিকে নিয়ে খাদিজা বেগম চলে গেলেন কিচেনে। নতুন জামাই এসেছে বাড়িতে, আপ্যায়ন এ কোনো কমতি রাখবেন না তিনি।

▫️

মীরার পিছু পিছু রাইফ ঢুকেছে মীরার রুমে। ঘাড় ঘুরিয়ে মীরার পুরো রুমে চোখ বুলাল। আজকেই প্রথম মীরার রুমে এসেছে রাইফ। বেশ পরিপাটি গুছানো রুম। শৌখিন জিনিসপত্র গুছিয়ে রেখেছে পুরো রুম জুড়েই। শার্টের উপরে দুই বোতাম খুলে নেভি ব্লু শার্টের স্লিভ গুটিয়ে বিছানায় বসল সে। মীরা সুইচ টিপে ফ্যান অন করে বেরিয়ে যাবে তখনি রাইফ ডেকে উঠল মীরার নাম ধরে৷ মীরা থামল, ঘাড় ঘুরিয়ে প্রশ্নত্নক দৃষ্টিতে চাইলো। রাইফ ইশারায় কাছে ডাকল। মীরা ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে এলো রাইফের দিকে, মিনমিন করে ছোট্ট আওয়াজে বলল,

-‘চা আনি আপনার জন্য?’

-‘পরে, এদিকে আসো। কাছে আসো, দূরে দাঁড়িয়ে কেনো। আসো, বসো।’

মীরা খানিক দূরত্ব রেখেই বসল রাইফের পাশে। রাইফ এর তর সইলো না। সারাদিন অফিসের ধকল শেষে বিয়ে করা বউ যদি দূরে গিয়ে বসে, সারাদিনের ক্লান্তি দূর হবে কি ভাবে? দূরত্ব ঘুচালো, মীরার বাহুর সহিত রাইফের বাহু ছুঁই ছুঁই অবস্থা এমন ভাবে বসলো। কোলের উপর রাখা মীরার মুঠো করে রাখে হাতটা টেনে নিজের কাছে নিলো। খানিক নেড়েচেড়ে প্যান্টের পকেট থেকে বেলি ফুলের মালা বের করে পরিয়ে দিলো মীরার হাতে। সাদা বেলির মাঝে লাল গোলাপ ভীষণ সুন্দর লাগছে দেখতে। মীরার ভালোলাগা কাজ করলো, মুচকি হাসি স্থান করে নিলো ঠোঁটের কোণে। রাইফের হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে নাকের কাছে হাত নিয়ে সুবাস নিলো গভীর শ্বাস গ্রহন করে। গোলাপ-বেলির মিঠে সুবাসে মন প্রাণ তাজা হলো মীরার। রাইফ অনিমেষ দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে মীরাকে। পিটপিট চোখে মীরা রাইফের দিকে তাকালো,

-‘ঘ্রাণ টা অনেক সুন্দর।’

তৃপ্তির হাসি ফুটলো রাইফের মুখে। সহজ হতে শুরু করেছে মীরা। মীরার বলা কথায় রাইফের ভরাট কন্ঠের ঝটপট জবাব,

-‘আমার ফুলটাও অনেক সুন্দর, তার ঘ্রাণ এর থেকেও হাজার গুন বেশি প্রখর। রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে নে/শা সৃষ্টি করে, মা/দ/কতায় ছড়িয়ে যায় আমার ভেতর বাহির। ছুঁয়ে দেওয়ার ইচ্ছে গুলো হামলে পরে, শক্ত করে বক্ষ পিঞ্জরে আব’দ্ধ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে।’

মীরা দৃষ্টি নুইয়ে ফেলল। রাইফের ইশারা যে তার দিকেই স্পষ্ট বুঝতে পারছে সে। শব্দ বিহীন উঠে দাঁড়ালো। গুটি গুটি পায়ে রাইফ কে অতিক্রম করে দরজার কাছে এলো। মাথায় দেওয়া ওড়না টা সরিয়ে হাতের বেলি ফুলের মালাটা খোঁপায় পেঁচিয়ে মাথায় ওড়না টেনে ছুটলো কিচেনে। এখানে যতোক্ষণ থাকবে ততক্ষণই রাইফ যে তাকে ছাড়বে না তা মীরার ঢের জানা। কিন্তু আসলেই কি লুকাতে পারবে? পবিত্র সম্পর্ক যেখানে বন্ধন সৃষ্টি করেছে সেখানে পূর্ণতা না পেলে যে বেমানান। চোখে লাগার মতোই বেমানান।

চলবে…..

মুঠোবন্দী লাজুকলতা পর্ব-২৪+২৫

0

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_২৪

🍁
পরপর কে/টে গেছে এক সপ্তাহ। রাইফ এই ক দিন মীরার সাথে ফোনে যোগাযোগ করেছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় নি। মীরার মুখ থেকে হু হা ব্যাতীত কিছুই বের করতে পারে নি সে। দেখা করতে চাইলেও মীরা নাকচ করেছে ইনিয়ে বিনিয়ে।
অবশেষে ধৈর্য হারা হলো রাইফ, এভাবে মীরাকে না দেখে থাকতে পারছে না মোটেও। মেয়েটা যে কেনো বোঝে না ওর অবস্থাটা? একটু দেখতেই তো চায় শুধু, কাছে তো এখনি টেনে নিচ্ছে না। এতো সংকোচের কি আছে? আজব!
রাইফ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই রাজিয়া বেগম কে জানিয়েছে আজ অফিস যাবে না। মীরাদের বাসায় যাবে বিয়ের ডেট ফিক্সড করতে। কালকের মাঝেই মীরাকে তাদের বাসায় চায় তার।
রাজিয়া বেগম রাইফের কথাতে মুখের উপর কাঠকাঠ ভাবে অসম্মতি জানালেন। সামনে মীরার ফাইনাল পরীক্ষা। বিয়েটা তিনি পরীক্ষার পর ই করতে বললেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা, রাইফ এর এক কথা, এখনি বিয়ে করবে সে। পরীক্ষা তো আর আঁটকে রাখছে না সে। পরীক্ষার সময় পরীক্ষা দিবে৷ না করেছে কে? রাজিয়া বেগম রেগে গেলেন কিঞ্চিৎ, শক্ত কন্ঠে বললেন,

-‘সমস্যা কি তোর রাইফ? এখনি বিয়ে করতে হবে কেনো? মেয়েটার সামনে পরীক্ষা। এখন বিয়েটা হলে ওর পরীক্ষা খারাপ হতে পারে। আর একটা প্রস্তুতি আছে না? হুট করে বিয়ে করানো যায়? মীরাকে রাজ রানী করে ঘরে তুলবো আমি।’

রাইফ ছটফট করে পায়চারি করছে। একবার বসছে তো একবার হাঁটছে। অস্থিরতা স্পষ্ট ফুটে ওঠেছে তার ভাব ভঙ্গিমায়। কি করে বলবে তার সমস্যা কি। মাকে কি এখন বলা যায় যে মীরাকে না দেখলে তার ভালোলাগে না, ঘুম হয় না রাতে। অফিস করেও শান্তি পায় না। এসব মুখ ফুটেই বলতে হবে কেনো? বুঝে নিতে কি অসুবিধা? ছোট্ট শ্বাস ফেলে রাজিয়া বেগমের কাছে এসে বসলো রাইফ।
মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

-‘যে আগে থেকেই রানী, সে সাজলেও রানী, না সাজলেও রানী। নতুন করে বানাতে হবে না আম্মা।’

রাজিয়া বেগম দমলেন না। মেজাজ খারাপ হচ্ছে তার। সে নাহয় কোনো রকমে আনলো কিন্তু মীরাদের পরিবার এর কথাও তো ভাবতে হবে। নিজেকে শান্ত করে রাইফ কে মানাতে কোমল স্বরে বললেন,

-‘উনারা কি ভাববে আব্বা? উনাদেরও তো একটা প্রিপারেশন আছে তাই না?’

মায়ের কথা রাইফের মনঃপুত হলো না। এটা কোনো কারণ হলো? অদ্ভুত কারণ দিয়ে যাচ্ছে কখন থেকে।
ভ্রুকুঞ্চন করে অশান্ত ভঙ্গিতে বলল রাইফ,

-‘কিসের প্রিপারেশন আম্মা? তিন তলায় থেকে পাঁচ তলায় মেয়েকে পাঠাতে কিসের প্রিপারেশন? আনতে ঘোড়াও লাগবে না, হাতিও লাগবে না। কোলে করেই আনতে পারবো।’

-‘মুখে লাগাম দে বে/য়া/দব কোথাকার।’

রাইফ মায়ের ধমকে হাসি দিলো। দুহাতে জাপটে ধরে আবদারের স্বরে বলল,

-‘আম্মা, তুমি যাও প্লিজ। কথাতো বলে দেখো।’

-‘বুঝিস না কেনো?’

-‘কি বুঝবো আম্মা? তোমার কি একটু মায়া দয়া হয় না। উপযুক্ত ছেলেটা মুখ ফুটে বিয়ের কথা বলছে। বাবা থাকলে এরকম কখন ও হতো না। আমি বলার আগেই ব্যাবস্থা করে দিতো।’

জায়গা মতো কো/প দিয়ে রাইফ মন খারাপের ভাব ধরে চুপ করে রইলো। রাজিয়া বেগম স্বামীর কথা মনে হতেই আবেগাপ্লুত হলেন। স্মৃতি চারণ এ ব্যাস্ত হলেন। ছেলের বিয়ে নিয়ে কতোই না শখ ছিলো উনার। মন গলল রাজিয়া বেগমের। রাইফ আঁড়চোখে একবার দেখলো মাকে। চেহারা পাল্টে গেছে, ইতিবাচক সিদ্ধান্ত মনে করে বিস্তর হাসি ফুটল তার মুখে।

_____________

ড্রয়িং রুমে রাজিয়া বেগম এর সাথে খাদিজা বেগম খোশ মেজাজে গল্প করছেন। শওকত রহমান ও ছিলেন এই আড্ডায়। আসরের সালাত আদায় করতে মসজিদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গিয়েছেন কিছুক্ষণ আগে।

মীরার পরিবার রাজিয়া বেগমের আকস্মিক আগমকে স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছিলেন। একটা সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছে তারা, আসবেন তো অবশ্যই। কিন্তু রাজিয়া বেগম ভণিতা ছাড়াই শওকত রহমান এবং খাদিজা বেগমকে জানিয়েছেন কালকের মাঝেই মীরাকে তার পুত্রবধূ করতে ইচ্ছুক। রাইফের কথা চিন্তা করে শওকত রহমান কে মিনতিও করেছেন রাজি হওয়ার জন্য।
শওকত রহমান দোটানায় ভুগছিলেন অনেক ক্ষণ। একটা মাত্র মেয়ে তার। বিয়েটা তিনি ধুমধাম করেই দিতে চান। কিন্তু এতো দ্রুত কিভাবে সব কিছুর আয়োজন করবেন তিনি? রাজিয়া বেগম ও ছাড়ছেন না কিছুতেই। কিছু বুঝে ওঠতে না পেরে ফোন করলেন বোন সানজিদা বেগম এবং মীরার বড় মামাকে। শলা পরামর্শ করে শওকত রহমান এক দিনের সময় চেয়ে নিলেন রাজিয়া বেগমের থেকে। বিবাহের দিন ধার্য করলেন এক দিন পর। রাজিয়া বেগমও খুশি হলেন, উনারও তো সময় দরকার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য। সম্মতি জানালেন শওকত রহমান কে। বিয়ের তারিখ ধার্য হলো অবশেষে।
শওকত রহমান মসজিদ থেকে ফেরার সময় রাইফের সাথে দেখা হলো রাস্তার মোড়ে। কুশলাদি বিনিময় করে তিনি জোর করে বাসায় এনেছেন হবু জামাতা কে। রাইফের ও অবশ্য ইচ্ছে ছিলো, অনেক দিন হলো মীরাকে দেখে না। এই সুযোগে এক নজর দেখা হলে মন্দ হয় না।

দুপুরের খাওয়া শেষে সেই যে ঘুম দিয়েছিলো মীরা, একেবারে বিকেল পাঁচটায় সজাগ পেয়েছে। হাই তুলে চোখ মুখ ডলে উঠে বসল। বেড সাইডে সুইচ টিপে অন্ধকার রুমটা কৃত্রিম আলোয় আলোকিত।
বালিশের পাশে রাখা সুতি ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো। আসরের সালাত আদায় করবে ভেবে অজু করতে যেতে চেয়েও ও দিকে আর পা বাঁড়ালো না মীরা। অনেক ক্ষণ ঘুমানোর ফলে মাথাটা ভার ভার হয়েছে। ঘুম ঘুম ভাব কাটানো দরকার। কড়া লিকারের এক কাপ রঙ চা ই পারে মাথাটা সতেজ করে তুলতে। সিদ্ধান্ত নিলো চা বানানোর জন্য চুলায় পানি দিয়েই বরং সে নামাজ পড়বে। নামাজ ও হলো, চা ও হলো। সময়টাও বেঁচে গেলো।
রুমের দরজা খুলে লম্বা একটা হাই তুলল মীরা। কোমড় ছাপানো খোলা চুল গুলো দু হাতের সহিত খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে আনমনে হাঁটা ধরলো কিচেনে।
দু হাতের কার সাজিতে চুল গুলো পেঁচিয়ে গুজে দিলেই খোঁপা বাধা শেষ হবে এমন মুহূর্তে হাত আঁটকে গেলো, ছোট্ট ছোট্ট পায়ের কদম থেমে গেলো সোফায় বসে থাকা রাইফ কে দেখে। মীরা আ/তং/কিত হলো, বিস্ময় ভরা চেহারায় তাকিয়ে রইলো। অসম্ভব, উনি এখানে কেনো থাকবেন? দেখার ভুল ভেবে বিরক্তিতে অন্য দিকে তাকাতেই গলা খাঁকারির শব্দ শুনে চমকে উঠলো, কেঁপে উঠলো জোরেসোরেই। হাতে ধরে রাখা খোঁপার বাঁধন আগলা হলো কয়েক হাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা রাইফ কে দেখে। ধীরে ধীরে কোমড় ছাপানো দীঘল কালো চুল গুলো জায়গা করে নিলো পুরো পিঠ সমেত। দু গালের পাশ দিয়েও জায়গা করে নিলো ঘাড় সমান ছোট চুলগুলো।
সেই সুপরিচিত ঘ্রাণ পাচ্ছে মীরা। তড়িৎগতিতে মস্তিস্ক জানান দিলো এটা তার দেখার ভুল নয়, এটা সত্যি। হুলুস্থুল করে ওড়না টেনে মাথায় জড়ালো।
রাইফ তাকিয়েই আছে এক দৃষ্টিতে। মীরার কাঁধ বেয়ে কোমড় ছুঁয়ে দেওয়া চুল দেখে বিমোহিত হয়েছে সে। মীরার এমন রূপ যে তার অজানা। এই ঘুম কাতুরে ফোলা ফোলা স্নিগ্ধ মুখটাও তার অদেখা।
মীরা খুব করে চেষ্টা করছে কিছু বলতে কিন্তু রাইফের হঠাৎ সাক্ষাতে সব কিছুই গুলিয়ে যাচ্ছে। রাইফ ই প্রথম কথা বলল। ওড়না ভেদ করে কোমড়ের দিকে বেরিয়ে আসা চুল গুলো আরেকবার দেখে মীরার নজরে নজর আব/দ্ধ করলো। গম্ভীর গলায় নিবিড় কন্ঠে বলল,

-‘তোমার এই মোহনীয় রূপ টা আমার ভেতরটায় কাল বৈশাখী ঝ/ড় তুলেছে মীরা। বিশ্বাস করো, অবাধ্য ইচ্ছে গুলো হামলে পরেছে। গগণ বিদারী চি/ৎকার করে বলছে চুল গুলো ছুঁয়ে দিতে। ফোলা ফোলা চোখ দুটোয় ওষ্ঠ ছোঁয়ার প্রচন্ড লো’ভ হচ্ছে আজ।

রাইফের চাপা স্বরে বলা কথা গুলো মীরার হৃদয় নাড়িয়ে দিলো। ভয়ে আড়ষ্ঠ হলো। লোকটা কি বলছে এসব? ভয় ভয় চেহারা লুকিয়ে চেহারায় স্বাভাবিকতা ফুটিয়ে মাথা নাড়ালো, যার অর্থ এমন কাজ করবেন না, ভুলেও না।
রাইফ জ্বল জ্বলে হাসি দিলো মীরার এমন চেহারায়। দীর্ঘদেহী পুরুষটা কিঞ্চিৎ ঝুঁকলো মীরার দিকে। চাপা স্বরে ফিসফিসিয়ে বলল,

-‘আর দুটো দিন, রেডি থেকো মীরা। আমি ছাড়বো না তোমাকে, সত্যি ছাড়বো না।’

চলবে…..

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_২৫

🍁
বাসা ভর্তি মেহমান গিজ গিজ করছে। হৈ হুল্লোড় এ মেতে উঠেছে সবাই। খুশির ঝিলিক চোখে মুখে উপচে পরছে বর পক্ষ এবং কনে পক্ষের সকলের মুখেই। কেউ খোশ গল্পে মেতে ওঠেছে তো কেউ কেউ ব্যাস্ত তার নিজ কর্মে।
কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে নিজের রুমে খুবই সাধারণ ভাবে বধু সেজে বসে আছে মীরা। লাল রঙের জমিনের উপর সোনালী রংয়ের কারুকার্য করা বেনারসি টা মীরার অঙ্গ জুড়ে জড়িয়ে আছে, অপরূপ সৌন্দর্য্য ফুটিয়ে তুলেছে। চোখ ধাঁধানো, মন মাতানো রূপ ঠিকরে পরছে মাথায় দেওয়া ছোট্ট ঘোমটার মাঝে ফর্সা আদল টুকুতে। টানা টানা চোখ দুটোই হালকা করে দেওয়া কাজল লেপ্টে আছে। গোলাপি সরু অধরে হালকা কৃত্রিম গোলাপি আভা লাগিয়ে মীরার সৌন্দর্য আরো দ্বীগুণ করে তুলেছে।
টকটকে লাল মেহেদী দেওয়া হাত টা কোলের উপর রেখে কঁচলে যাচ্ছে অনেক ক্ষণ। সকাল থেকেই কয়েক চোট কান্না করে লাল করে ফেলেছে দু চোখ। ফোলা ফোলা চোখ দুটোই কাজল দেওয়াতে মীরার চেহারায় অন্য রকম মায়া সৃষ্টি হয়েছে আজ।
উর্মি আজ ভীষণ খুশি। সুন্দর একটা ড্রেস পরে মীরার আশে পাশেই ঘুরপাক খাচ্ছে। রাজিয়া বেগম মীরার এমন রূপ দেখে অনেক ক্ষন ধ্যান মে/রে তাকিয়ে ছিলেন। ছেলে যে তার এমনি এমনি পাগল হয় নি তার আজ খুব করেই টের পাচ্ছেন। মেয়েটা গুণেও যেমন গুণবতী, রূপেও তেমন রূপবতী। কোনো অংশই যেনো কমতী নেই মীরার মাঝে।
শওকত রহমান গলা খাঁকারি দিয়ে প্রবেশ করলেন মীরার রুমে। বিয়ে পড়ানোর আগে তিনি একান্ত সময় কাটাতে চান মীরার সাথে। প্রাণের আম্মাজান কে কাছে টেনে শেষ মুহুর্তে আরেকটু আপন করে নিতে চান তিনি। মীরা বাদে রুমের সবাই চলে গেলো বাহিরে।
মীরার বউ সাজার মুখটা দেখে শওকত রহমান যেমন খুশি হলেন তেমনি ভাবে বুকটাও হু হু করে উঠলো। একমাত্র কন্যাকে আজ অন্য ঠিকানায় পাঠাবেন তিনি। এতো দিনের আগলে রাখা মেয়েটাকে অন্য কোথাও পাঠাতে হবে ভেবে ভেতর টা মোচড় দিয়ে উঠল তার। মেয়েকে বুঝতে দিলেন না, প্রকাশ করলেন না কিঞ্চিৎ পরিমাণও। মীরা তার আব্বাজানের আগমনেও আজ নীচু করেই রেখেছে মুখটা। আব্বাজানের সাথে চোখে চোখ মেলাতে পারবে না কিছুতেই। কঠোর ভাবে অশ্রু গুলোকে ব/ন্দী করে রেখেছে আঁখি কোঠরে। আব্বাজানের পানে তাকালেই যেনো অশ্রু গুলো মুক্তি পাবে, চোখের কোণ দিয়ে ঝর ঝর করে বর্ষণ ধারা ঝরে যাবে কপোল ছুঁয়ে।

শওকত রহমান ভ’ঙ্গুর হৃদয়ে মীরার পাশে বসে ফাঁকা জায়গাটুকু দখল করে নিলেন। মীরার মাথায় হাত রাখতেই কান্না গুলো দলা পাকিয়ে গলায় আঁটকে গেলো শওকত রহমানের। নীজের ভেতরের ব্যাথাতুর অনুভূতি গুলোকে সন্তর্পণে লুকিয়ে ফেললেন ছোট এক শ্বাস ছেড়ে। মীরা পিতার কাঁধে মাথাটা হেলান দিলো। আব্বাজানের খসখসে হাতটা টেনে নিলো, নিজের দু হাতের মুঠোয় পুরে তাকিয়ে রইল সম্মুখে। নীরব দুজনেই। টিক টিক করে সময় কে/টে গেলো মিনিটের পর মিনিট। শওকত রহমান ছোট্ট করে চুমু খেলেন মীরার মাথায়। নিরবতা ভেঙ্গে মোলায়েম স্বরে বললেন,

-‘ইমাম সাহেব আসছেন আম্মাজান। ওদিকের কাজ শেষ। অপেক্ষা করছেন আপনার জন্য। ডাকবো উনাকে?’

মীরা বাবার প্রশ্নে উত্তর দিলো না। মৃদু ভাবে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো শুধু।
শওকত রহমান গলা উঁচু করে ডেকে ইমাম সাহেব কে রুমে আসতে বললেন। ইমাম সাহেবই প্রথম প্রবেশ করলেন। তার পেছন পেছন এক এক করে মীরার মা, ফুপু-ফুপা, রাজিয়া বেগম, উর্মি এবং রাইফের বড় চাচা-চাচি সহ বয়োজ্যেষ্ঠ সম্মানিত ব্যাক্তিগণও প্রবেশ করলেন। পিতার কাঁধ থেকে মাথা তুলে সোজা হয়ে বসলো মীরা। বুকের বা পাশে ধুকপুকুনি বেড়ে গেছে হাজার গুন। কেঁপে কেঁপে উঠছে বার বার৷ শরীর টাও কেমন ঝিমিয়ে গেছে যেনো। এই বোধ হয়ে নেতিয়ে পরবে শরীর টা। বয়োবৃদ্ধ ইমাম ইসলামি ধর্ম মোতাবেক বিয়ে পড়ানো শুরু করেছেন। শেষ সময়ে এসে যখন মীরাকে বলতে বললেন কবুল, মীরা দুচোখ বন্ধ করে কেঁপে উঠল। শওকত রহমান ঠাহর করলেন পাশে বসে থাকা আদুরে কন্যার অবস্থা। বরাবরের ন্যায় শওকত রহমানের ভরসার হাত টা মীরাকে পেছন থেকে জাপটে নিলো তৎক্ষনাৎ। কোমল কন্ঠে নিচু আওয়াজে মীরাকে বললেন,

-‘আমার সাহসী আম্মাজান, ভয় নেই। আপনার আব্বাজান সব সময় আপনার পাশে ছিলো, আছে এবং থাকবে।’

মীরা ছলছল নয়নে মুখ তুলে শওকত রহমানের পানে তাকাল। যতই চেষ্টা করুক অশ্রু লুকানোর, কিন্তু ভেজা নয়ন স্পষ্ট বলছে মীরা কেঁদেছে যার ছোঁয়া এখনও আঁখি পল্লবে লেগে আছে। শওকত রহমান মেয়ের মুখের পানে তাকালো। মুখে মুচকি হাসি লেপ্টে ঘাড় নাড়িয়ে চোখের পাতা এক বার বন্ধ করে আবারও খুলল। পিতার নিকট থেকে সাহস পেলো মীরা। কিন্তু ধুকপুকানি কমছে না কিছুতেই। খাদিজা বেগম মেয়ের একটা হাত মুঠোয় নিলেন। মায়ের সংস্পর্শে মীরা এবার আর নিজের সংযত করতে পারল না। গুঙিয়ে কেঁদে উঠলো, হুরমুর করে ধেয়ে আসা অশ্রু গুলো চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পরল। কান্নারত মীরা কাঁপা কাঁপা স্বরে জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠে মৃদ্যু আওয়াজে বলল ‘কবুল।’
আলহামদুলিল্লাহ জয়ধ্বনীতে শুকরিয়া আদায় করলো সবাই। হাসি ফুটলো সকলের মুখে। উর্মির হাতে রাখা মোবাইল টাতে ফোনকলে বর বেশে থাকা সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত সুপুরুষটির মুখেও বিস্তর হাসি ফুটল তৎক্ষনাৎ। স্বস্তি পেল, শুকরিয়াও আদায় করলো। বুকের ভেতর পাথরের মতো বোঝা সৃষ্টি করে জমে থাকা কয়েক দিনের দীর্ঘশ্বাস টাও দুঠোঁটে ফাঁক দিয়ে ছেড়ে দিলো চোখ বন্ধ করে।

খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করে চলে এসেছে বিদায় মুহুর্ত। মীরা ছোট বাচ্চার ন্যায় অনবরত কান্না করেই চলেছে শওকত রহমানের বুকে মাথা গুঁজে। একবার তো বলেই ফেলেছে সে যাবে না এখান থেকে। শওকত রহমান সহ সবাই সবার মতো বুঝিয়েই যাচ্ছে কিন্তু কিছুতেই মীরাকে সামলানো যাচ্ছে না। নীরবে অশ্রুপাত করে পিতার বুক ভিজিয়ে ফেলেছে। শওকত রহমান আর নিজেকে খোলসে আবৃত করে রাখতে পারেননি, পারেননি পরিবারের কেউ ই। বিদায় বেলায় হু হু করে কেঁদেছেন সকলে।

_________________

রাইফের খোলা বারান্দায় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে মীরা। আকাশে আজ মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে। জ্ব/লজ্ব/ল করে আলো ছড়িয়ে রাতের নিকষ কালো অন্ধকার দূর করেছে ধরণী থেকে। মীরার মুখটাও উজ্জ্বল হয়েছে জ্যোৎস্নার রুপালি আলোয়। শিরশিরে হাওয়া এসে শরীর-মন দুটোই জুড়িয়ে দিচ্ছে মীরার।
হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি পরিহিত মীরার রাইফের সাথে প্রথম দেখা হওয়া থেকে শুরু করে বর্তমান, সব কিছুই তার অকপটে ভেসে আসছে মনে।
নিয়তি আজ ঠিক সেখানেই দাঁড় করিয়েছে মীরাকে যেখানে সে রাইফকে স্নিগ্ধ ভোরে দেখেছিলো একদিন। ভাবুক মীরা ভাবছে আরো অনেক কিছুই। এই তো ঘন্টা খানেক আগেই যখন মীরা বধু বেশে সিঁড়ি দিয়ে পাশাপাশি হেঁটে উপরে উঠছিলো রাজিয়া বেগমের সাথে, হুট করেই রাইফ এসে মীরার বাম দিকটা দখল করেছিলো সর্তপনে। মীরার সহিত পায়ে পা মিলিয়ে সামনে দৃষ্টি রেখে হাঁটছিলো রাইফ। কান্না করার ফলে মীরার ফর্সা মুখ এবং চোখ দুটো লাল বর্ণের তখন।
মীরার নিজ পরিবার ছেড়ে নতুন ঠিকানায় যেতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো, নরম হৃদয়টা ছে/দন হচ্ছিলো মারাত্নক ভাবে। অসাড় হয়ে আসা টালমাটাল পা দুটো যখন কোনো রকমে এগিয়ে যাচ্ছিলো তখনি রাইফের আগমন আরো বেশি ধরাক করে তুলেছিলো মীরার কোমল হৃদয়। র*ক্তিম হয়ে আসা চোখ দুটি তুলে আড় দৃষ্টিতে একটু রাইফ কে দেখে আবারও সামনে দৃষ্টি দিয়েছিলো সে। রাইফ দাম্ভিকতার সহিত হেঁটে যাচ্ছে পাশে, কোনো হেলদোল নেই তার। ধ্যান জ্ঞান পুরোটুকুই সামনের দিকে। খুব একটা মাথা ঘামায় নি মীরা। স্বাভাবিক ভাবে ছোট ছোট পা ফেলে চুপটি করে হেঁটে যাওয়া মীরা আচানাক তার কনিষ্ঠ আঙুলে কারো স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠেছিলো। পাশে ফিরে তাকাতেই রাইফের তী/ক্ষ্ণ নজর ভ্রু উঁচিয়ে সামনে তাকাতে হুকুম করেছিলো সাথে সাথেই। মীরা শুষ্ক অধরে দাঁত কা/মড়ে মাথাটা নুইয়ে নিয়েছিলো তখনি। প্রচন্ড ভাবে কাঁপছিলো মীরার হাত। টালমাটাল পা দুটো থেমে যাবে যেকোনো সময়। রাইফ বুঝেছিলো মীরার কাঁপুনি। রাইফ তার খসখসে কনিষ্ঠ আংগুল দিয়ে আঁকড়ে ধরা মীরার কোমল কনিষ্ঠ আংগুল টা ছেড়ে দিয়েছিলো তক্ষুনি। মীরা হাফ ছেড়ে বাঁচলো এবার। চোখ বন্ধ করে স্বস্তির শ্বাস ফেলবে তক্ষুনি মীরার কোমল হাতটা শ’ক্তপোক্ত হাতে ব/ন্দি হয়েছিলো। মীরার ছোট ছোট আংগুলে রাইফ আংগুল গুঁজে দিয়েছিলো মূহুর্তেই। মীরার বন্ধ আঁখিদুটি আরো খিঁচে কুঁচকে গিয়েছিলো ভেতরের দিকে, পা দুটো থেমে গিয়েছিলো সাথে সাথেই। মীরার এমন অবস্থা দেখে রাইফের বৃদ্ধাঙুল মীরার হাতের উল্টো পাশে এদিক ওদিক বুলিয়ে দিচ্ছিলো। সহজ করে তুলতে চেষ্টা করছিলো সে। মীরার নরম হাতে শ/ক্ত একটা চা/প প্রয়োগ করেছিলো মীরার ধমকে যাওয়া পা দুটোকে আবারও সচল করার উদ্দেশ্যে।

মৃদুমন্দ বাতাসে সামনের ছোট চুল গুলো মীরার মুখে এদিক ওদিক খেলা করছে। গোলাকৃতির চাঁদের দিকে তাকিয়ে গভীর ভাবনায় আচ্ছন্ন হওয়া মীরা কপালের কাছে কারো স্পর্শ পেয়ে শিউরে উঠল। তড়িৎগতিতে পাশে তাকাতেই রাইফ কে দেখে বুকে জমা রুদ্ধশ্বাস ছেড়ে দিলো। মীরার উড়ন্ত খোলা চুল গুলো কানের পিঠে গুঁজে দিলো রাইফ। শ্যমবর্ণের মুখটা মীরার কানের কাছে এনে ঠোঁটের কোণে অমায়িক হাসি ফুটিয়ে ভরাট গলায় বলল,

-‘জানো মীরা, তুমি আমাকে ওই চাঁদের আলোর মতোই আলোকিত করেছো। আমি আজ পূর্ন মীরা, আমার লাজুকলতা কে পেয়ে আজ আমি সম্পূর্ণ।’

চলবে…..

মুঠোবন্দী লাজুকলতা পর্ব-২২+২৩

0

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_২২

সকালের মিঠে রোদ ঝলমলে করে তুলেছে ধরনীর বুক। আধোখোলা জানালার গ্রিল ভেদ করে সূর্য রশ্মি উঁকি দিয়ে সাদরে জায়গা করে নিয়েছে মীরার মুখাবয়বে। গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন সে। ডান হাত টা চোখের উপর রেখেছে সূর্যের আলোয় যেনো ঘুমের ব্যাঘাত না হয় তার। পাশেই উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে উর্মি। সাধারণত মীরা নিয়ম মাফিক দশটা-সাড়ে দশটার মাঝেই ঘুমিয়ে যায়। কিন্তু কাল ঘুমাতে ঘুমাতে মধ্যরাত হয়ে গিয়েছে। এতো দেড়িতে ঘুমানোর কারণ ও আছে বৈকি।
ফাইনাল পরীক্ষার জন্য ফর্ম ফিলাপের ডেট দিয়েছিলো রাজিয়া বেগম রা দেখে যাওয়ার পরের দিন ই। তাই সেদিন ই ঢাকা চলে গিয়েছিলো। চার দিন ছিলো হলে। গতকাল রাত্রে ফিরেছে মীরা। গাজীপুর চৌরাস্তার অসহ্যকর জ্যাম এর জন্য ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিলো। তার উপর অনেক ক্ষণ গল্পগুজব করে সবার সাথে কা’টিয়েছে সময়। উর্মিও চলে এসেছে, তাই আড্ডাটা আরো বেশি জমে উঠেছিলো।
দেড়ি করে ঘুমানোর ফলে কোনো রকমে চোখ কচলে ফজরের সালাত আদায় করে আবার শুয়ে পরেছে মীরা। খাদিজা বেগম এসেছিলেন কয়েক বার ডেকে তুলতে। গভীর নিদ্রায় দুজনকে দেখে ডেকেও আর ডাকতে পারেননি।
বালিশের নিচে রাখা সেলফোন টাতে এলার্ম বেজে চলেছে। এই বার নিয়ে তিন বার হয়ে গেলো। মীরা পিটপিট করে কোনো রকমে চোখ খুলে মোবাইল হাতরে কর্কশভাবে বেজে ওঠা এলার্ম অফ করে দিলো। আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বসলো। দুপাশে হাত টা/না দিয়ে আবারো হেলান দিয়ে আধো শোয়া হলো। শরীর টা আজ বড্ড বিছানা টা/নছে মীরার। আলসেমি যেনো ছাড়ছেই না। এদিকে ক্ষুধাও লেগেছে অনেক। এক দিকে পেট ভর্তি ক্ষুধা, অন্য দিকে চোখ ভর্তি ঘুম। সময় নিলো বিছানা ছাড়তে।
খোলা চুল গুলো হাত খোঁপা বেঁধে ধীরে পায়ে হেঁটে এসে দাঁড়ালো বারান্দায়। মীরার লাগানো শখের পাতা বাহার গাছ গুলো কেমন নেতিয়ে গেছে এই কদিনে। শুকিয়েও গেছে অনেক পাতা। শুকনো পাতা গুলো আলতো হাতে সরিয়ে দিতে গিয়ে খেয়াল হলো হাত দুটো ফাঁকা ওর। ঢাকায় গিয়েছিলো বলে খুলে রেখেছিলো রাজিয়া বেগমের দেওয়া সরু বালা দুটো। রাইফের কথাও মনে পড়ে গেলো মনিকোঠায়। খাদিজা বেগমের ডাক কানে আসাতে আর ভাবতে পারলো না বেশিক্ষণ। উর্মিকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে দ্রুতপদে মায়ের কাছে ছুটলো সে।

খাদিজা বেগম ড্রয়িং রুমে কুশিকাটার কাজ নিয়ে বসেছেন সকাল সকাল। মীরাকে দেখে সুতা গুলো এক পাশে রেখে দিলেন। এক চিলতে হাসি দিয়ে বললেন,

-‘পরোটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, কখন খাবি? উর্মি উঠেছে?’

মীরা মায়ের পাশে গিয়ে বসলো। জড়িয়ে ধরে ধাতস্থ গলায় বলল,

-‘উঠছে আম্মা। ফ্রেশ হতে গেছে।’

-‘আচ্ছা, তাহলে বস। ও চলেই আসবে, তুই খাওয়া শুরু কর। আমি দিচ্ছি ডাইনিং এ।’

-‘আম্মা, এভাবেই বসে থাকো কিছুক্ষণ। তোমাকে এভাবে ধরে থাকি একটু। ভালো লাগছে খুব।’

খাদিজা বেগম মেয়ের আচরণে খুব খুশি হলেন। মনটা ভরে উঠলো পরম মমতায়। মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলেন, কাছে টেনে নিলেন আরেকটু।
উর্মি এসে বসলো মীরার পাশে। ফ্রেশ হয়ে এলেও এখনও ঘুম ঘুম ভাব পুরোপুরি কাটেনি তার। হাই তুলে ঘুমজড়ানো কন্ঠে বলল,

-‘মীরু, এবার ছাড়। প্রচন্ড ক্ষুধা লাগছে আমার।’

খাদিজা বেগম উর্মির দিকে তাকিয়ে কপট রাগ দেখালেন। কন্ঠে কিঞ্চিৎ রাগ মিশিয়ে বললেন,

-‘সকাল দশটা পর্যন্ত ঘুমালে তো ক্ষুধা লাগবেই। আরেকটু ঘুমিয়ে একেবারে দুপুরে উঠতি দুজন।’

রাগ দেখিয়েছেন ঠিকই কিন্তু সাথে তাড়াহুড়োও দেখা যাচ্ছে তার আচরণে। উঠতে যাবেন তখনি মীরা টে’নে ধরলো। সে নিজে উঠে বলল,

-‘আমি আনছি আম্মা, তুমি বসো।’

উর্মি খাদিজা বেগমের কথা শুনে বলল,

-‘বকো না মামি, রাতে ঘুম হয়নি তো। এই দেখো, না ঘুমানোর জন্য চোখের নিচে কালি পরে গেছে।’

মীরা কিচেন থেকে হাতে দুইটা প্লেট নিয়ে আসতে আসতে কন্ঠ সামান্য উঁচু করে বলল,

-‘ফজরের নামাজ টাও পরে নি আম্মা। আমার থেকে বেশি ঘুমিয়েছিস তুই। আমার কালি পরলো না, আর তোর পরে গেলো? মিথ্যা কথা বলার আর জায়গা পেলি না উর্মিমালা!’

-‘কাজা নামাজ পরে নিবো। আর শোন, তোর স্কিন টোন আর আমার টোন এক না। আমার টোন টা কালি কালি বুঝছিস। এজন্য ঘুমাতে হয় একটু বেশি বেশি।’

উর্মির কথার পরিপ্রেক্ষিতে মীরা আর খাদিজা বেগম হেসে দিলো এক সাথে। উর্মির পাশে বসে রুটির প্লেট টা ওর হাতে দিলো মীরা। ডাইনিং আর বসবে না, এখানেই বসে খাবে। পরোটার ছোট্ট এক টুকরোর সাথে ডিম নিয়ে মুখে দিলো। চিবুতে চিবুতে বলল,

-‘আরো বেশি বেশি ঘুমা, বেশি বেশি কালি কালি হবি।’

-‘উল্টা বলিস কেনো?’

-‘উল্টা বললাম কোথায়! তুই দেখ। আমি কম ঘুমিয়ে যদি স্কিন টোন ভালো হয়, তাহলে বেশি ঘুমিয়ে স্কিন টোন কালি।’

উর্মি ক্ষে/পে গেলো মীরার উপর। বোঝায় একটা আর বোঝে আরেকটা। বলেছে তো ওর স্কিন ভালো না। তারপরেও কথা প্যাচাচ্ছে! খাজিদা বেগম দুজনের তর্ক দেখে থামাতে লাগলেন। মীরা আলাভোলা মুখ করে কথার জালে ক্ষে/পিয়ে দিচ্ছে উর্মিকে। জমে উঠেছে রাতের ন্যায় আরেক দফা আড্ডার পসরা।

___________

আকাশি রংয়ের শার্ট পরিহিত সুঠাম দেহের অধিকারী রাইফ অফিসিয়াল কাজ করছে নিজের ডেস্কে। চোখ তার সামনে রাখা কম্পিউটারের স্কিনে। কাজের ফাঁকে ধোঁয়া উড়ানো কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে ছোট্ট করে। এর মধ্যে মুঠোফোন টা বেজে উঠলো। ধ্যানমগ্ন রাইফের ধ্যান ভাঙলো তৎক্ষনাৎ।
ফোনটা প্যান্টের বা দিকের পকেট থেকে বের করে হেলান দিলো, গা ছেড়ে আরাম করে বসলো।
ফাহাদের নাম্বার ভাসছে স্কিনে। বৃদ্ধ আংগুলের সাহায্যে সোয়াইপ করে কানে নিলো। স্বাভাবিক গলায় বলল,

-‘বল।’

-‘যাবি নাকি আজ রাইডে? দূরে যাওয়ার প্লান আছে আজ।’

-‘আজ সম্ভব না। হাতে কাজ আছে একটা।’

রাইফের হাতে আজ কাজ নেই, তবুও অজ্ঞাত মিথ্যে কথাটা বলতেই হলো। ফাহাদ স্বাভাবিক ভাবেই নিলো রাইফের বিষয়টি। আরো কিছুক্ষণ টুকিটাকি কথা বার্তা বলে ফোন রাখল। রাইফ কালো হাত ঘড়িতেটাতে চোখ বুলিয়ে আশে পাশে তাকালো। ছুটির সময় চলে এসেছে, শেষ সময়ের কাজ টুকু সম্পূর্ণ করার জন্য আবারও হাত দিলো কম্পিউটারের মাউস এ।

____________

পড়ন্ত বিকেলে অলসতা কা’টাতে মীরা চা বানাচ্ছে কিচেনে। উর্মি ডেকে চলেছে রুম থেকে। চুলার আঁ/চ কমিয়ে ছুটলো রুমের দিকে। মীরা গলার স্বর কিঞ্চিৎ উঁচু করে বলল,

-‘কি হয়ছে, গন্ডারের মতো ডাকছিস কেনো?’

-‘তোর কল আসছে। তিনবার বাজলো।’

মীরা ফোন হাতে নিতে নিতে জিজ্ঞাসা করল,

-‘কে?’

-‘আননোন নাম্বার।’

-‘তাহলে থাক। কে না কে। দরকার হলে আবার করবে।’

-‘তিন বার করেছে মীরু। প্রয়োজনেই করেছে।’

মীরা মাথা নেড়ে বলল,

-হ্যাঁ, সেটাও ঠিক বলছিস।

কথাটা বলেও কল দিচ্ছে না মীরা। কেনো যেনো ইচ্ছে করছে না কল দিতে। এমনিতেই ফোনে কথা বলতে ভালো লাগে না, তার উপর আননোন নাম্বার। যার দরকার সে আবার কল দিবে বলে উঠে দাঁড়াতেই ভোঁ ভোঁ করে ভাইব্রেট হয়ে রিংটোন বেজে উঠলো। এগারো ডিজিটের শেষ দুই ডিজিট নয়-দুই। উর্মির দিকে তাকাতেই দেখলো উর্মিও তাকিয়ে মীরার দিকে। ইশারায় দ্রুত রিসিভ করতে বলল সে। কল কে’টে যাবে সে মূহুর্তে দ্রুত রিসিভ করল। কানে নিয়ে ধরে থাকলো অপর প্রান্তের কথা শোনার জন্য। কি ব্যাপার, কিছু বলছে না কেনো? মীরার রাগ হলো, স্বাদের মালাই চা বানানো বাদ দিয়ে এখানে কে না কে কল করেছে, তার তামশা দেখবে নাকি এভাবে। বিরক্ত হয়ে কান থেকে ফোন সরানোর জন্য উদ্যত হতেই কর্ণকুহরে প্রবেশ করলো ভরাট গলার আদেশ করা কন্ঠস্বর,

-‘মীরা, ছাদে আসো একটু। বেশি না, পাঁচ মিনিটের জন্য। অপেক্ষা করছি আমি।

টুট টুট শব্দ করে বিচ্ছিন্ন হলো সংযোগ। মীরার মুখাবয়বে স্পষ্ট বিস্ময় ভাব ফুটে উঠেছে। উর্মির দৃষ্টি গোচর হলো সেটা। তড়িৎগতিতে মীরার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলো, কি হয়েছে? মীরা চেহারা স্বাভাবিক করে বলল,

-‘আমি পারবো না যেতে।’

-‘কোথায় যাবি?’

-‘ছাদে।”

মুচকি মুচকি হেসে আহ্লাদে আট খানা হয়ে উর্মি বলল,

-‘রাইফ ভাই?’

মীরা কোনো জবাব দিলো না। হনহন করে হাঁটা ধরলো কিচেনে। বললেই হলো নাকি? কেনো যাবে সে? যাবে না।
উর্মি ছুটলো মীরার পেছন পেছন। কমিয়ে দেওয়া চুলার আঁচ টা মিডিয়াম করে দিলো মীরা। উর্মি তার কাছে এসে বলল,

-‘এখানে এলি যে, যাবি না?’

-‘না।’

মীরার স্পষ্ট জবাব। উর্মি বিস্ময় কন্ঠে বলল,

-‘আল্লাহ মীরু! আজ বাদে কাল উনি তোর হাসব্যান্ড হবে। আর তুই তার কথা শুনছিস না!’

-‘যেদিন হবে সেদিন শুনবো। আমি পারবো না যেতে। তুই জানিস লোকটা কেমন অস/ভ্য!’

-‘কেমন অস/ভ্য? কি করেছে?’

উর্মি কথায় বিস্ময়? মীরা মুখ ফসকে হাতে চুমু দেওয়ার কথা বলতে গিয়েও সামলে নিলো।
আমতা আমতা করে বলল,

-‘উল্টা পাল্টা কথাতে লজ্জায় ফেলে আমাকে।’

মীরার এহেন কথাতে উর্মির বিস্ময় ভরা মুখটাতে দু’ষ্টমির হাসি ফুটে উঠলো। কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বলল,

-‘ওহহোওওও, শুরু হয়েছে তবে।’

মীরা ভ্রু কুচকে ঠোঁট ফুলিয়ে চোখ রাঙ্গালো। চারটা কাপ নিয়ে চা ঢালবে সে মূহুর্তে উর্মি একটা সরিয়ে ফেলল। মীরা তাকাতেই বলল,

-‘তুই তো ছাদে যাবি। চা খেলে দেড়ি হবে। তুই যা আমি চা নিয়ে যাচ্ছি মামু মামির কাছে।’

মীরা যাবে না বলে আবারও টে’নে নিলো কাপ। উর্মি মৃদুস্বরে ধমকে উঠলো। বলল,

-‘যাবি না কেনো আশ্চর্য! দুই দিন পর যখন বিয়ে হবে তখন লুকাবি কিভাবে? তুই না গেলে রাইফ ভাই যে রকম মানুষ, বাসায় চলে আসবে। বুঝিস তখন।’

মীরা উর্মির কথাতে একটু দমল। হ্যাঁ, উনার কাজ কর্মের কোনো নিশ্চয়তা নেই। হুটহাট কি করে বসে বলা যায় না। যদি বাসায় এসে বলে বসে মীরাকে দরকার, তখন কি করবে সে। লজ্জায় পরে যাবে বাবা মার সামনে। ছিহ ছিহ, এমন টা না হোক। মীরা আরেকটা কাপ সরিয়ে দুইটা কাপে চা ঢাললো। মীরার হাতে দিয়ে বলল,

-‘আব্বাজান আর আম্মাকে দিয়ে আয় দ্রুত।’

-‘আমার চা? শুনে রাখ মীরু, আমি চা খাই। শুধু খাই বললে ভুল হবে, নে*শা উঠলে বালতিতে করে খাই৷ আর তুই কি না আমাকে চা দিচ্ছিস না!’

-‘ছাদ থেকে এসে খাবি। আয় দ্রুত। আমার সাথে যাবি তুই।’

উর্মি আশ্চর্য হলো আরেক দফা। কথা বলার জন্য ঠোঁট দুটো ফাঁক করবে তখনি হনহন করে পাশ কেটে চলে গেলো। যেতে যেতে বলল,

-‘তুই না গেলে আমিও যাবো না ফাইনাল।’

চলবে…..

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_২৩

🍁
গুটি গুটি পায়ে সিঁড়ি বেয়ে ঊর্ধ মুখে এগিয়ে যাচ্ছে মীরা এবং উর্মি। পাশাপাশি হাঁটছে দুজন। ছাদের কাছাকাছি আসতেই ধীর হলো মীরার হাঁটার গতি। কিছুটা পিছিয়ে গেলো উর্মির থেকে। পা ফেলছে কোনোরকমে, অবশ অবশ লাগছে মীরার। উর্মির জোর করে পরিয়ে দেওয়া লাল ওড়নাটা টেনে মাথাটা পুরোপুরি ঢেকে নিলো। ঢিপঢিপ করে কাঁপছে হৃদয়।
রাইফের সামনা সামনি হতে মীরার এখন সংকোচ হয় অনেক। যে লোকটাকে সে জেগে জেগে স্বপ্ন দেখতে বলেছিলো, সে সত্যি সত্যি স্বপ্ন টাকে বাস্তব করে দিচ্ছে কয়েক দিনের ব্যাবধানে।
ছাদের এক কোণায় দাঁড়িয়ে গেটের দিকেই তাকিয়ে রাইফ। তার গভীর চোখ দুটো প্রেয়সীর অপেক্ষায়। পায়ের আওয়াজ শুনে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রাইফ সোজা হয়ে দাঁড়ালো। হাতে রাখা মুঠোফোন পকেটে গুজলো।
ছাদের দরজা দিয়ে উর্মি ঢুকল প্রথমে। তাকে দেখা মাত্র রাইফের মুখটা ভারাক্রান্ত হলো। আসতে বলল মীরাকে আর এলো কে? এই মেয়েটা এবার সত্যি সত্যি ওর ঘরে আনতে হবে। সময় দিচ্ছে তো, গায়ে লাগছে না ওর। রাগ হলো খানিক, বিরক্তও হলো সাথে। ভ্রু জোড়া কুঁচকে উর্মির পেছন তাকাতেই ছলাৎ করে উঠলো বুকের বা পাশটা। ওইতো কাংখিত নারী, পরনে সাদা সালোয়ার-কামিজের সাথে মাথায় লাল ওড়না। কি স্নিগ্ধ সুন্দর লাগছে। ধবধবে সাদা মেঘের মাঝে যেনো মীরার লাল ওড়না পেঁচানো আদলটুকু রক্তিম সূর্য ন্যায় দীপ্তি ছড়াচ্ছে চতুর্দিক।
সাদা পোশাকে পবিত্র লাগছে ভীষণ। লালের মাঝে ফর্সা মুখাবয়ব টা ফুটে উঠেছে বেশ।
নীচু দৃষ্টিতে এগিয়ে আসা মীরা আকাশি রঙের শার্ট পরিহিত রাইফকে এক পলক দেখেছে। নজর নিম্নে আবদ্ধ করেই উর্মির পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। রাইফ এর সাথে বেশ ব্যাবধান নিয়েই দাঁড়িয়েছে সে।
হাসি মুখে উর্মির সাথে কুশল বিনিময় করে রাইফ এর চোখ ঘুরে ফিরে মীরার দিকেই ছুটে যাচ্ছে। মন ভরে দেখার জন্য ছটফট করছে চোখের কালো মনিটা।
কিন্তু একটা সুক্ষ্ণ বিপত্তি দেখা দিলো। মাঝে উর্মি দাঁড়ানোতে ঠিক মতো দেখতেও পাচ্ছে না রাইফ। গুনে গুনে পাঁচ দিন পর দেখা, আর এই মেয়ে কিনা এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে, রাইফের উঁকি মেরে দেখা লাগছে। হাসি হাসি মুখটা চুপসে গেলো। রাগ হলো সাথে বিরক্তও। জোরপূর্বক মুখে বোকাসোকা একটা হাসি ঝুলিয়ে ভণিতা না করে সরাসরি রাইফ উর্মিকে বলে উঠলো,

-‘এখানে কেনো আসছো উর্মি? কাবাব মে হাড্ডি হতে?’

-‘আমি হাড্ডি হতে চাই নি রাইফ ভাই। আমাকে জোর করে বানানো হইছে।’

মীরা মাথা নিচু করেই গাল ফুলালো কিন্তু কিছু বলল না। রাইফ পুনরায় উর্মিকে বলল,

-‘তাহলে তোমার ইচ্ছা নেই কাবাবের হাড্ডি হওয়ার?’

কন্ঠে জোর দিয়ে জবাব দিলো উর্মি,

-‘মোটেও না। আমি ওতোটাও মীর জাফর না যে আপনাদের মাঝে এসে দাঁড়াবো।’

তাৎক্ষণিক বা ভ্রুটা উঁচু করে রাইফের সহজ সরল জবাব,

-‘দাঁড়িয়েই তো আছো।’

উর্মি দ্রুত দুজনের মাঝ হতে সরে আসলো। সত্যি সত্যি সে যে বেখেয়ালি তে দাঁড়িয়ে আছে দুজনের মাঝে বুঝতেই পারে নি। লজ্জা পেলো কিন্তু প্রকাশ করলো না। মীরার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে বলল,

-‘মীরা পেছনে আসছে জন্য পেছনে পরছে৷ দোষ ওর।’

মীরা চোখ বড়সড় করে উর্মির দিকে তাকালো। রাইফ কথা বাড়ালো না। সময় নষ্ট হচ্ছে, এখন কথার প্রেক্ষিতে কথা বাড়ালে ওর নিজের ই লস। তাই সুক্ষ্ণ কৌশলের সহিত বলল,

-“দোষ আমার, আমার ই উচিত ছিলো ওপাশে গিয়ে দাঁড়ানো। এবার তাহলে কি করা উচিত তোমার বলো তো?

উর্মি রাইফের কথার ধরণে হেসে দিলো। মীরা বারংবার উর্মিকে মাথা নেড়ে না করছে। অনুরোধের সুরে বলল ,

-‘উর্মি, এটা করিস না। যাবি না, প্লিজ যাস না।’

উর্মি কপালে বিরক্তির ভাঁজ ফেলে বলল,

-‘পেয়েছিস কি দুজন। একজন নিচে ঠেলে তো আরেক জন উপরে। এ ভাই, তোরাই নিচে যা। আমি এখানে থাকি।’

মীরা এগিয়ে গেলো উর্মির দিকে। আবারো অনুরোধ করছে যেনো চলে না যায়। কিন্তু উর্মির চেহারা বলছে সে মীরার মতামত কে গ্রাহ্য করছে না একটুও। রাইফ সুক্ষ্ণ ইশারা দিলো উর্মিকে যার অর্থ
‘ভালো মেয়ের মতো এবার ফটাফট একটা দৌড় দাও তো বাসার দিকে।’
বুদ্ধিদীপ্ত উর্মি ইশারার মানে ধরে ফেলল সহজেই।
মূহুর্তেই দ্রুত পায়ে মীরাকে পাশ কেটে চলে গেলো, মীরা বাঁধা দেওয়ার সময় টুকু পর্যন্ত পেলো না। তাজ্জব বনে গেলো উর্মির কান্ডকারখানা দেখে। ভয় মিশ্রিত চেহারা নিয়ে তাকিয়ে থাকলো সিঁড়ির দরজার দিকে। কি হবে এখন? উর্মি বাসায় গেলে আব্বাজান যদি জিজ্ঞাস করে মীরার কথা তখন কি ও বলে দিবে রাইফের সাথে ছাদে থাকার কথা! ছিহ ছিহ! এ কেমন পরিস্থিতিতে পরলো ও। চোখ নামিয়ে নিতেই হুট করে উর্মি আবারও দৌড়ে প্রবেশ করলো ধপাধপ শব্দ করে। মীরার সম্মুখে এসে বলল,

-‘টেনশন করিস না। আমি সিঁড়িতেই বসে আছি তোর জন্য।’

কথাটুকু বলেই উর্মি যেভাবে তড়িৎগতিতে এসেছিলো সেভাবেই প্রস্থান করলো সেখান থেকে৷ মীরা স্বস্তি পেলো, কিন্তু রাইফের কথা ভেবে অস্থির মনটাকে স্থির করতে পারলো না পুরোপুরি। সময় কে/টে গেলো কিছুক্ষণ ওভাবেই। রাইফ রেলিং এ হেলান দিয়ে
নিরবতা বিচ্ছিন্ন করে ডেকে উঠলো,

-‘মীরা?’

রাইফের দিকে তাকালো না মীরা। দৃষ্টি নিচে রেখেই কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জবাব দিলো,

-‘জ্বী’

-‘ভ/য় পাচ্ছো?’

মীরা অকপটে স্বীকার করলো। ছোট্ট করে জবাব দিলো,

-‘কিছুটা’

-‘কিছুটা না, অনেকটায় মনে হচ্ছে। দেখি, এদিকে আসো।’

রাইফের ইশারায় নির্দেশ করা জায়গায় দূরত্ব বজায় রেখে চুপটি করে দাঁড়ালো মীরা।
রাইফ মুচকি হাসলো। কৌতূহল সুরে শুধালো,

-‘আমাকে ভয় পাচ্ছো?’

মীরা নিশ্চুপ। এখানে আর কে আছে যে উনাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করবে! রাইফ জানে ওর প্রশ্নের উত্তর মীরা দিবে না। মীরার দুরুদুরু মনটা হালকা করতে প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল,

-‘ফর্ম ফিলাপ কমপ্লিট?’

-‘জ্বী।’

-‘কখন আসছো বাসায়?’

-‘রাতে।’

-‘এক্সাম কবে হওয়ার সম্ভাবনা?’

-‘এক দু মাস পরেই।’

রাইফের মুখাবয়ব ভাবুক হলো। কিছু ভেবে ভরাট গলায় শীতল কন্ঠে পুনরায় ডেকে উঠলো,

-‘মীরা?’

মীরা কেঁপে উঠলো। সবাই তো ওকে মীরা বলেই ডাকে। কিন্তু রাইফের গলায় মীরা ডাকটা তাকে শিরশিরে অনুভূতি দেয়। কেঁপে তুলে শিরা উপশিরা। ছোট্ট একটা ঢোক গিলে জবাব দিলো সে,

-‘জ্বী’

রাইফের পুরুষালি কন্ঠস্বর আদেশ সূচকে বলল,

-‘আমার দিকে ঘুড়ে দাঁড়াও।’

মীরার কি হলো জানে না। ননীর পুতুলের ন্যায় ঘুরে রাইফের সামনাসামনি হয়ে দাঁড়ালো।
রাইফ এক কদম এগিয়ে এলো মীরার দিকে। আপাদমস্তক পরখ করলো মীরার। ওড়নার একটা সুতা কখন থেকে টেনেই যাচ্ছে সে। রাইফ নম্র গলায় বলল,

-‘সুতাটাকে রেহাই দিয়ে একটু আমার দিকে তাকাবা?’

মীরা সুতা ছেড়ে দিলো সাথে সাথেই। রেহাই তো দিলো ঠিকি কিন্তু রাইফের দিকে তাকাতে পারলো না। রাইফ কন্ঠ খাঁদে নামিয়ে আরো শীতল কন্ঠে বলল,

-‘আজ আর তোমাকে লজ্জায় ফেলবো না মীরা। শুধুই দেখবো। একটু দেখি তোমাকে?

রাইফের কন্ঠ থেকে শুরু করে চোখে মুখে আকুল আবেদন ঠিকরে পরছে মীরাকে দেখার। তীব্র মনোবাসনা বেঁধেছে বুকের ভেতর। আরো এক কদম এগিয়ে নম্র কন্ঠে শান্ত ভঙ্গিতে পুনরায় বলল,

-‘মাথাটা তোলো প্লিজ, তাকাও আমার দিকে।’

মূহুর্তেই বশবর্তী হলো রাইফের ঠন্ডা কন্ঠের আকুল আহ্বানে। মিশমিশে কালো পল্লবের আঁখিদ্বয় মেলে তাকালো রাইফের পানে। নজর আবদ্ধ হলো রাইফের শান্ত স্থির চোখ দুটিতে। অনিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে রাইফ। মুখে তার অনিন্দ্য সুন্দর মুচকি হাসি লেপ্টে আছে। দুষ্ট মিষ্ট চাহনি নেই আজ। খোঁচা খোঁচা চাপ দাঁড়ি, পরিপাটি চুল। আকাশি রংয়ের শার্ট আঁটসাঁট ভাবে লেগে আছে বলিষ্ঠ দেহে। উপরের দু বোতাম খোলা। হাত দুটো কালো প্যান্টের পকেটে গুজে দাম্ভিকতার সাথে দাঁড়িয়ে আছে সে। মীরার ডাগর ডাগর চাহনিতে মুচকি হাসি প্রসস্থ হলো রাইফের। মীরা দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। রাইফের আজকের চেহারা এবং চোখদুটোতে ভালোলাগা ফুটে ওঠেছে, প্রেয়সীর নজরে নজর রেখে আচ্ছন্ন হয়েছে ভালোবাসায়। প্রকৃতিতে শিরশিরে হাওয়া বইছে। তুলোর মতো পুঞ্জ পুঞ্জ সাদা মেঘ উড়ে যাচ্ছে। নীলাভ বিশাল আকাশের নীচে ছাদে দাঁড়িয়ে দুজন। একজন লজ্জায় টুইটুম্বুর হয়ে নজর ফিরিয়ে নতমুখে দাঁড়িয়ে তো অন্যজন অপলক নয়নে মন জুড়িয়ে নিচ্ছে। আসলেই কি জুড়িয়ে যাচ্ছে? যদি জুড়িয়েই যেতো তবে কেন একের পর এক অবাধ্য ইচ্ছে গুলো হানা দিচ্ছে তার হৃদয় কুঠরে! মাঝের সামান্য ব্যাবধান টুকু ঘুচিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা ক্রমশ বাড়ছে কেনো তবে? পারছে না আলতো হাতে ছুঁয়ে দিতে, পাচ্ছে না ওড়নার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসা চুল গুলো কানে গুজে দিতে। এই যে দেখছে, দেখেই যাচ্ছে তবুও মন ভরছে না কিছুতেই। রাইফের মনে হচ্ছে তু/লে বাসায় নিয়ে রেখে দিতে। আরাম করে বসে দেখা যাবে। চুপটি মেরে বসে থাকা মীরাকে রাতদিন ভর দেখবে সে।
সময়ের পর সময় চলে যাচ্ছে, রাইফ এর নজর সরছেই না মীরার থেকে। কখনও নাকে, গালে, চোখে তো কখনও মীরার সরু পাতলা গোলাপি অধরে।
রাইফের অনিমেষ চাহনিতে মীরার সংকোচ বাড়তে থাকল। কাঁচুমাচু করে রাইফের দিকে তাকিয়ে অনুমতি নেওয়ার স্বরে বলল,

-‘এবার যাই?’

রাইফ দুদিকে মাথা নাড়ালো। তার অর্থ ‘না’। মীরা বাধ্যগত মেয়ের মতো আবারও নিরব হলো। রাইফ পকেট থেকে হাত বের করে বলল,

-‘আমার নাম্বারটা সেভ করে নিও। রাতে কল দিব।’

মীরা মাথা তুলে তাকালো। চোখে চোখ রেখে ধীর আওয়াজে বলল,

-‘আপনি আমার নাম্বার কবে নিলেন, কার কাছ থেকে নিলেন?’

রাইফ জবাব দিলো না। রহস্য ময় বাঁকা হাসি ফুটিয়ে তুললো শুধু। মীরার মনে জাগা একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় থেকেই। রাইফের জবাব না পেয়ে মীরা পুনরায় শুধালো,

-‘আমিতো তখন কথা বলি নি, কি করে বুঝলেন কলে আমি ছিলাম?’

রাইফ বুকের উপর দুহাত ভাঁজ করল। মাথাটা মীরার দিকে ঝুঁকে উল্টো প্রশ্ন করল,

-‘আমার লাজুকলতা ব্যাতীত তোমাদের বাসায় কল রিসিভ করে নিরব থাকার মতো কি কেউ আছে মীরাবতী?’

রাইফের মুখে উচ্চারিত ‘লাজুকলতা এবং মীরাবতী’ সম্বোধন শুনে মীরা লজ্জায় দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। নিচের ঠোঁট কামড়ে চোখ খিঁচে ফেলল তৎক্ষনাৎ। এখানে আর কোনো ভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না সে। কোনো রকমে মিন মিন করে বলল,

-‘আসছি।’

রাইফের জবাবের অপেক্ষা না করেই মীরা ঘুরে হাঁটা শুরু করলো। মীরার লজুক মুখ দেখে রাইফের মুখে অমায়িক হাসি ফুটলো। দুষ্টমি খেলা করলো মস্তিস্কে। কন্ঠ উঁচু করে ডেকে উঠল,

-‘মীরা?’

প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছু ফিরে তাকাল মীরা।
রাইফ ডান হাত টা বুকের বা পাশে নিলো। ইশারায় বুকের বা পাশটা দেখিয়ে দুষ্টমি মাখা কন্ঠে বলে উঠলো,

-“দেড়ি কিসের তবে, দ্রুত এসো। বুকের বা পাশ টা শুধুই তোমার জন্য বরাদ্দ। অপেক্ষায় তোমার জন্য।’

চলবে……