Thursday, July 10, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 342



অনুভূতিরা শব্দহীন পর্ব-৩৪+৩৫+৩৬

0

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

চতুর্ত্রিংশ পর্ব (৩৪ পর্ব)

জাহাঙ্গীর সাহেব ও নার্গিস পারভিন বাসায় চলে অনেকক্ষণ হলো। আহনাফ এখনো ছাদেই দাঁড়িয়ে আছে। একপাশের দেয়াল ঘেষে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। চিন্তায় এখন শুধুই সারাহ্ আর তার বেবি। ফোন বেজে উঠলো, আহনাফ চমকে উঠে পকেটে হাত দেয়।

ফোন বের করে আননোন নাম্বার দেখে কপাল কুঁচকায়। রিসিভ করতে ভ°য় করছে ওর। সাত পাঁচ ভেবে শেষে রিসিভ করে নেয়,
“আসসালামু..”

সালাম শেষ করার আগেই অপরপাশ থেকে অপরূপা বলে,
“কি ব্যাপার মিস্টার আহনাফ ফয়েজ? সারাহ্-কে কয়দিন লুকিয়ে রাখবেন? বউকে বাঁচাতে গিয়ে বাবাকে হা°রাবেন না তো?”

আহনাফের ভ°য়টা বেড়ে গেল। বাবা তো বাসায় একা। তবুও নিজেকে শক্ত রাখে সে। এভাবে ভে°ঙে পড়লে তো চলবে না।

“কে বলছেন?”

অপরূপা মৃদু হেসে বলল,
“রূপকথার অপরূপা আমি৷ তাহসিনার মৃ°ত্যুর সময় দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখানে, দুচোখ ভরে দেখেছি তার মৃ°ত্যুর কষ্ট।”

আহনাফ জবাব দিতে পারলো না। ওর কানে ওর ভালোবাসার মৃ°ত্যুর বর্ণনা বেজে চলেছে।

“তাহসিনার আপু, আপু বলে চিৎকার আর তাহমিনার ইমতিয়াজ বলা মিলেমিশে গিয়েছিল সেদিন। (একটু থেমে) ইশ, কেন যে ভিডিও করিনি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভিডিও হতো তবে।”

পাশে বসা শাফিনের দিকে তাকায় অপরূপা। আহনাফের ঢাকায় আসার সংবাদ জামিলের মাধ্যমে পেয়েছে ওরা। সেদিন জামিলের সাথে কি আচরণ আহনাফ করেছে তাও জানে। তাই আহনাফকে মানসিকভাবে দুর্বল করতেই এই ব্যবস্থা।

অপরূপা একটু জোরেই বলে,
“আরেকটা কথা, সারাহ্ প্রেগন্যান্ট তো। সামলে রেখো, প্রেগন্যান্ট মেয়েগুলো কিন্তু বেশি সুন্দরী হয়।”
“হেই, কেন বলছেন আমাকে এসব? আপনি..”

আহনাফের কথা শেষ হওয়ার আগেই কল কে°টে দেয় অপরূপা। আহনাফ কলব্যাক করলেও নাম্বার বন্ধ দেখায়।

অপরূপা ফোন রেখে বলে,
“দুলালের কোনো খোঁজখবর নেই কেন?”
“জার্মানি গেছে যতদূর শুনেছি। এখন কোনো খোঁজখবর নেই।”
“জার্মানি গিয়ে ম°রে গেছে নাকি?”

শাফিন হাসলো। ওর অন্ধকার অধ্যায়ের পুরোটা জুড়েই আছে অপরূপার স্থান। তার কু°কর্মের সম্পূর্ণ ভাগিদার এখন অপরূপা৷

এদিকে আহনাফ আব্বাস সাহেবকে কল দেন। আব্বাস সাহেব রিসিভ করলে আহনাফ তাড়াহুড়ো করে বলল,
“কোথায় আছো বাবা?”

আব্বাস সাহেব হাসলেন। বলেন,
“বাড়িতে এসেছি, এখন তোমার বড়কাকার সাথে কথা বলছি। বাসায় একা একা ভালো লাগে না।”

আহনাফ স্বস্থির নিশ্বাস ফেলে। বাবা তার ভালো আছে, একা নেই। আঁধারের রহস্যে ক্রমাগত হাতড়ে যাচ্ছে, কিছু কালো পাখি খবর দিচ্ছে কিন্তু ধরা দিচ্ছে না। এ বিহ্ব°লতার সমাধান পাচ্ছে না, আঁধারের শেষপ্রান্তেও পৌঁছাতে পারছে না।
______________________________________

রাত পৌনে একটা, নিজেদের বাসায় চলে এসেছে ইমতিয়াজ-মৃত্তিকা। বাসায় আসার পর থেকে এখনো ইমতিয়াজ একরুমে বসে আছে। রুমের দরজা বন্ধ, মৃত্তিকা ডাকলেও জবাব দেয় না।

তাহমিনার ওড়না হাতে নিয়ে ফ্লোরে বসে আছে ইমতিয়াজ। এ কেমন যন্ত্রণা সে জানে আর আল্লাহ্ জানে। ওড়নাটা নাকের কাছে নিয়ে তাহমিনার ঘ্রাণ অনুভব করে সে। কানের কাছে বেজে উঠে সেই ডাক,
“আমার তাজ।”
ওর তাজ ওর ডাকে সারা দেয়নি, ওকে বাঁচাতে পারেনি।

ডাইনিং এ বসে মৃত্তিকা একদৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর উঠে গিয়ে আবারো দরজায় নক করতে নিয়ে দেখে দরজা খোলা। মৃত্তিকা দরজা ঠেলে ভিতরে এসে ইমতিয়াজের দিকে তাকালো। ধীরে ধীরে ওর সামনে গিয়ে বসে। হাতের মুঠোয় থাকা ওড়নাটা দেখে।

“তোমাকে দূরে থাকতে বলেছি না?”

ইমতিয়াজের কন্ঠটা অন্যরকম শোনালো। মৃত্তিকা ওর চোখের দিকে তাকায়, অনবরত কেঁদেছে মানুষটা। চোখ লাল হয়ে আছে, যেন এখনই র°ক্ত ঝরবে৷ ওর গালে থাকা অশ্রু মুছতে গেলে ইমতিয়াজ বাধা দিয়ে বলল,
“দূরে থাকতে বলেছি, কেন বারবার কাছে আসছো?”

হঠাৎ করে চেঁচিয়ে উঠে ইমতিয়াজ,
“যাও।”

মৃত্তিকা সরে যায়। একটু দূরে গিয়ে বসে। এরকম অবস্থায় মানুষকে কখনো একা ছেড়ে দিতে হয় না। ছোট বাচ্চাদের মতো আগলে রাখতে হয়।

“মৃত্তিকা?”
বেশ কিছুক্ষণ পর ইমতিয়াজ আলতো সুরে ডাকে ওকে। মৃত্তিকা তাকাতেই বলে,
“মিনা খুব কষ্ট পেয়েছিল, আমাকে ডেকেছিল, আমি যাইনি বলে আরো কষ্ট পেয়েছিল। (একটু থেমে) বেবিটাও ডেকেছিল তাই না?”

মৃত্তিকা দ্রুত ওর কাছে যায়। ইমতিয়াজের কথায় বোঝা যাচ্ছে তার মানসিক অবস্থা খারাপের দিকেই যাচ্ছে। মৃত্তিকা ওর দুগালে ধরে বলল,
“ইমতিয়াজ, আমার দিকে তাকাও। এমন করো না প্লিজ। তুমি তো শক্ত মানুষ, এমন কেন করছো।”

ইমতিয়াজ ওকে সরিয়ে দেয়। মৃত্তিকা সরে না বরং ওকে ধরে টে°নে উঠায়। ইমতিয়াজের শরীর নি°স্তে°জ হয়ে গেছে, মৃত্তিকা ওকে বিছানায় বসিয়ে বলে,
“ইমতিয়াজ, শান্ত হও। একটু ঠান্ডা হয়ে ভাবো, এভাবে হাল ছেড়ে দিলে ওরা পার পেয়ে যাবে।”

ইমতিয়াজ চুপ করে বসে থাকে। আর দশজন মানুষের মতো ভাবনার শক্তি তার নেই। মৃত্তিকা ভাতের প্লেট নিয়ে আসে। ছোট ছোট লোকমা দিয়ে খাইয়ে দেয় নিজ হাতে।
______________________________________

সকাল সকাল তানজিমের সাথে দেখা করতে এসেছে আহনাফ। সামিহাও সাথে এসেছে। একপ্রকার জো°রাজু°রি করেই বেরিয়েছে আহনাফের সাথে। ঢাবির কার্জন হল এরিয়ায় এসেছে ওরা। তানজিম এখানেই আসার কথা। সামিহা জানে না আহনাফ এখানে কেন এসেছে।

তানজিম রিকশা থেকে নেমে ওদের দিকে এগিয়ে আসে। সামিহা ওকে দেখে হাত নেড়ে বলল,
“হাই।”
“হ্যালো।”
তানজিমও হাত নাড়ে।

আহনাফের সাথে সামিহাকে দেখে একটু অবাক হয় তানজিম। আহনাফের বিয়েটা পরিকল্পিত এইটুকু জানলেও আহনাফ কাকে বিয়ে করেছে তা তানজিম জানে না।

তানজিম কাছে আসতেই সামিহা আহনাফকে বলে,
“ওর নাম তানজিম, আমার ফ্রেন্ড।”

তানজিমের দিকে তাকিয়ে বলল,
“উনি হলো আহনাফ, আমার আপুর একমাত্র হাসবেন্ড।”

তানজিম মুচকি হেসে বলল,
“সারাহ্ আপু?”
“হ্যাঁ তো।”
বেশ ঢং করে কথাটা বলে সামিহা।

তানজিম আহনাফের সাথে কোলাকুলি করে বলে,
“কেমন আছো ভাইয়া? তোমার শ্যালিকা আমার ক্লাসমেট। আচ্ছা চলো, যাওয়া যাক।”
“তোমরা একজন আরেকজনকে চেনো?”
ঠোঁট উলটে প্রশ্ন করে সামিহা।

আহনাফ হেসে ওর গাল টে°নে ওর মতো ঢং করে বলে,
“হ্যাঁ তো।”

সামিহা গাল ফুলিয়ে সামনে সামনে হাঁটতে থাকে। আহনাফ একটু নিচুস্বরে তানজিমকে বলে,
“বিয়েটা পরিকল্পিত, কে করেছে এই পরিকল্পনা?”

তানজিম হাঁটার গতি কমিয়ে সামিহার দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
“কোনো সমস্যা হয়েছে?”
“হুম, কালরাতে কোনো এক মেয়ে কল দিয়েছিল। নাম অপরূপা। ও আবার তাহসিনার কথা বলছিল। আবার এই মেয়েটাই সারাহ্-র কিডন্যাপের কথা বলেছে।”

তানজিম রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“আপুকে সাবধানে রাখেন। উনি এমন একজনের নজরে পড়েছে যে নারী°পা°চারের সাথে যুক্ত আর (একটু থেমে) মানসিকভাবেও অসুস্থ বোধহয়।”
“মানে? কে সে?”

সামিহা ফিরে দৌড়ে ওদের কাছে আসে।
“কি কথা বলছো?”

আহনাফ মাথা নেড়ে বলল,
“কিছু না, চলো।”

ওরা দোয়েল চত্বর পর্যন্ত গেল। ওখানে রাস্তার পাশে গড়ে ওরা ছোট ছোট দোকানে সামিহাকে কিছু জিনিসপত্র দেখতে বলে ওরা আবারো একটু দূরে সরে।

“ভাইয়া, উনার নামটা আমি বলতে চাচ্ছি না। আমার জীবনের ইম্পোর্টেন্ট একজন।”
“উনি তোমার বোনদের মে°রেছে।”

তানজিম চুপ করে অন্যদিকে তাকায়। আহনাফ বলে,
“দেখো, তোমার সারাহ্ আপু অসুস্থ। নিজেকে রক্ষা করার মতো শক্তি ওর নেই, এখন সে এক থেকে দুইয়ে আছে। রি°স্ক নিতে চাই না আমি।”

তানজিম তবুও চুপ। আহনাফ চিন্তায় পড়ে, এমন কে হতে পারে ওর জীবনের এতো গুরুত্বপূর্ণ কেউ।

“আচ্ছা চলো।”

ফিরে তাকিয়ে সামিহাকে কোথাও দেখে না। আহনাফ এদিক ওদিক তাকিয়ে তানজিমকে বলে,
“সামিহা কোথায়?”

তানজিম চমকে উঠে আশেপাশে দেখে৷ পাগলের মতো এদিকসেদিক ছোটাছুটি করে সে। ভ°য়ে ওর হৃদপিণ্ডের গতি বেড়েছে। ঘেমে-নেয়ে একসারা হয়ে গেছে। আবার কোনো বি°পদ ওর না হয়ে যায়।

আহনাফের নজর রাস্তার অপরপাশের পুলিশ পোস্টের দিকে যায়৷ সামিহা ওখানে দাঁড়িয়ে ওকে চুপ থাকতে বলে। আহনাফ কপাল কুঁচকায়।

তানজিম ওকে দেখে দৌড়ে রাস্তা পেরিয়ে যায়। আহনাফও যায় ওর পিছুপিছু। তানজিম গিয়েই ওকে জড়িয়ে ধরে, আহনাফ একটু দূরে দাঁড়িয়ে যায়। সামিহা নিজেই বোকাবনে গেছে, এটা সে আশা করেনি। সে তো শুধুই তানজিমের সাথে মজা করতে চেয়েছিল।

তানজিম নিজের মুখটা ওর কানের কাছে এনে বলে,
“কতটা ভ°য় পেয়েছিলাম জানিস?”

সামিহা আলতো করে ওর পিঠে হাত রেখে চোখ বুজে ফেলে, তানজিমের আজকের স্পর্শটা অন্যরকম। তানজিম দূরে সরে যায়। একটু অ°স্বস্তি নিয়েই বলে,
“এগুলো বা°জে ধরনের রসিকতা, সামি।”

ওর ঘা°ব°ড়ে যাওয়া মুখটা দেখে সামিহা হাসে। আহনাফ ফোনে কথা বলার অজুহাতে দূরেই থাকে। তবে চিন্তা হতে থাকে সামিহাকে নিয়ে৷ তানজিমের সাথে তার সম্পর্ক গভীর, কিন্তু তানজিমের যা ফ্যামিলি তাতে কোনো মেয়ে কি আদৌ নিরাপদ?
______________________________________

দুইদিন পর, আজ সোমবার। কলেজে আজ সাইক্রিয়াটিস্ট এসেছে, ছাত্রছাত্রীদের মানসিক অবস্থা উন্নতির জন্য এটা একটা সাধারণ ব্যবস্থা। ডাক্তার আরিফা ইসলাম ছাত্রীদের সাথে কথা বলছে আর ডাক্তার নাইম আহমেদ ছাত্রদের সাথে কথা বলছে।

হলরুমের বাইরে সারাহ্ দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে ছাত্রছাত্রীরা ডাক্তারদের সাথে কথা বলছে। আহনাফ এসে ওর পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“তুমিও ডাক্তার দেখাবে নাকি?”

সারাহ্ কপাল কুঁচকে বলল,
“না, ক্লাস নেই তাই দাঁড়িয়ে আছি।”

বারান্দার দেয়াল ঘে°ষে দাঁড়িয়ে আহনাফ বলে,
“দেখিয়ে নাও, তোমার মানসিক স্বাস্থ্য ভালো না।”

সারাহ্ ওর পিঠে একটা চা°প°ড় দিয়ে বলে,
“ঠিক আছি আমি।”
“স্টুডেন্টরা দেখবে।”

সারাহ্ ভ্রূ উঁচিয়ে বলে,
“স্টুডেন্টদের সামনে যখন হাঁটু গেড়ে বসেছিলেন, তখন দেখেনি?”

আহনাফ মুখ বাঁ°কিয়ে হাসলো। তারপর বলে,
“সকালে ক্লাস ছিল?”
“হ্যাঁ, ছিল।”
“দাঁড়িয়ে ক্লাস করতে অসুবিধা হয়?”

সারাহ্ ব্যা°ঙ্গা°ত্মক ভাষায় বলল,
“আমি কি নয়মাসের প্রেগন্যান্ট?”

আহনাফ ফিক করে হেসে দেয়। বলে,
“আস্তে কথা বলো, মানুষ শুনবে।”

সারাহ্ও হাসে। মাথানিচু করে তাকায় নিজের উদরে, একটা প্রাণ বেড়ে উঠছে এখানে। সে অনুভব করতে পারে আহনাফের সন্তান আর ভালোবাসার নির্দশনকে

হুট করে লজ্জা লাগতে শুরু করে তার। নিরবে হলরুমের ভিতরে চলে যায়। ডাক্তার আরিফার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো সে। আরিফা ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,
“কি অবস্থা সারাহ্ ম্যাম? আপনার মা আর বেবি ভালো আছে?”

সারাহ্ চোখ বড় করে তাকায়। ওর মায়ের কথা এই মহিলা কেন জিজ্ঞাসা করলো আর ওর প্রেগ্ন্যাসির বিষয়ট কিভাবে জানলো।

এই আরিফা ইসলামের কাছেই মমতাজ বেগমের চিকিৎসা করানো হয়েছিল। সে পরোক্ষভাবে শাফিনের সাথে যুক্ত আছে।
______________________________________

ইমতিয়াজ এসেছে উত্তরা, শাফিনের বাসায়। দুইদিন নিজেকে ঘরব°ন্ধী রেখে আজ অনেক ভেবেচিন্তে এখানে চলে এসেছে। বেল বাজাতেই সুরভি এসে দরজা খুলে দেয়। আটমাসের অন্ত:সত্ত্বা সুরভির হাঁটতে চলতেও সমস্যা হচ্ছে।

ইমতিয়াজকে দেখে হাসিমুখে বলল,
“ভাইয়া, কেমন আছেন? ভিতরে আসুন।”

ইমতিয়াজ ধীরপায়ে ভিতরে যায়। বলে,
“মামা আছে?”
“না, আপনি বসুন আমি কল করছি।”

ইমতিয়াজ শব্দ করে দরজাটা বন্ধ করে বলল,
“এখুনি কল দিন।”

সুরভি শাফিনকে কল করে কিন্তু শাফিন ফোন বন্ধ করে রাখায় কল যায় না। সুরভি ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলে,
“বাবার ফোন বন্ধ।”

ইমতিয়াজ সোফায় বসে বেশ শান্ত গলায় বলে,
“ব্যাপার না, আমি অপেক্ষা করছি।”

এদিকে মৃত্তিকা ইমতিয়াজকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। সকালে উঠে হঠাৎ করে তাকে না দেখে মেয়েটা পাগল প্রায় হয়ে গেছে। গো°র°স্থানে গিয়েও খুঁজে এসেছে, পায়নি।

“কোথায় গেলে ইমতিয়াজ?”
বাসায় এসে বেডরুমে দাঁড়িয়ে কথাটা বলে সে।

এমনসময় সদর দরজায় শব্দ হয়। মৃত্তিকা দরজা খুলেই ভিতরে চলে এসেছিল। ইমতিয়াজ এসেছে ভেবে রুমের বাইরে এসে দেখে শাফিন। মৃত্তিকার মাথায় যেন র°ক্ত চড়ে যায়।

শাফিন দরজা লাগিয়ে দিয়ে বলল,
“ঘটনা দেখো দেখি, আহারে মেয়েটা স্বামীকে খুঁজছে। (একটু থেমে) ইমতিয়াজ তোমাকে ভালোবাসে না?”

মৃত্তিকার কাছে আসতে আসতে বলে,
“ভালোবেসে স্পর্শ করেছে কখনো?”

মৃত্তিকা মনের ভ°য় চেহারায় আনার মেয়ে নয়। একজায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে আছে সে। শাফিনের গতি সুবিধার নয় বোঝা যাচ্ছে।

“তোমার মা কিন্তু আমার আপন বোন নয়, চাচাতো বোন। রাহা সুলতানা, নামটা আমার মা পরিবর্তন করে রেখেছে রিপা বেগম।”

মৃত্তিকা কপাল কুঁচকায়,
“চাচাতো বোন মানে?”
“ওর নয়মাস বয়সেই ওর বাবা-মা মারা যায়৷ ওর মা মানে তোমার নানীও কিন্তু মারা যাওয়ার সময় প্রেগন্যান্ট ছিল, তাহমিনার সাথে যা হয়েছে তার সাথেও সেটাই হয়েছিল। (জোরে হাসে) আমার বাবা সেদিন যা করেছে তাহমিনার সাথে তাই করেছি আমি।”

মৃত্তিকা ঘৃ°ণায় মুখ ফিরিয়ে নেয়। হঠাৎ মনে হলো শাফিন জেনেছে দুলালের আ°টকে রাখার কথা। নাহলে নিজে থেকে এতো কথা বলবে কেন?

মৃত্তিকা আন্দাজে একটা ঢি°ল ছুঁড়ে। জিজ্ঞাসা করে ফেলে,
“দুলাল কোথায়?”

শাফিন মাথা নেড়ে বলে,
“গুড কুয়েশ্চন, আমি নিয়ে গেছি। তোমার বাবা তাকে আটকে রাখতে পারেনি।”

শাফিন চেয়ার টে°নে বসে মুখ বাঁকিয়ে ব্য°ঙ্গ করে বলল,
“রিপাকে আমি বিয়ে করতাম, কিন্তু রিপা বিয়ে করে ওই শরীফকে। শরীফ রাগি মানুষ, তার রাগকে কাজে লাগিয়ে রিপার সংসার শেষ করেছি। (একটু থেমে) আজ তার মেয়ের সংসারও শেষ হবে।”

শাফিন উঠে দাঁড়ালে মৃত্তিকা ওর পায়ে লা°থি দেয়। গায়ের ওড়না খুলে শাফিনের গলায় পেঁ°চিয়ে ধরে শক্ত করে। শরীরের পুরো শক্তি দিয়ে টে°নে বলে,
“তুই ম°রে যা, সব ফে°ত°না ম°রে যাবে। অ°মানুষ, রাস্তার কুকুরও তোর চেয়ে ভালো। ম°রে যা, শাফিন ম°রে যা।”

শাফিন আর যাই হোক একজন পুরুষ। মৃত্তিকা তার শক্তির সঙ্গে পেরে উঠা কঠিন। বেশ অনেকক্ষণ দ°স্তাদ°স্তি হলো দুজনের মধ্যে। শাফিন ওড়নার প্যাঁ°চ খুলে মৃত্তিকার গালে চ°ড় বসায়। ক্লান্ত মৃত্তিকা মাটিতে লু°টিয়ে পড়ে, কিন্তু হার মানে না। চেয়ারের কোণায় লেগে কপাল ফুলে উঠে।

মৃত্তিকা উঠে দাঁড়ানোর আগেই শাফিন ওর গলা চেপে ওকে ফ্লোরের সঙ্গে মিশিয়ে বলে,
“নি°স্তার তোমার নেই মিউকো, মায়ের আদরের মৃত্তিকা।”

মৃত্তিকা তাকে ধা°ক্কা দিয়ে সরিয়ে নিজেও সরে যায়। উঠে বেডরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে ফেলে।

“এ শরীরে ইমতিয়াজের ছাড়া অন্যকেউ স্পর্শ না করুক। হে আল্লাহ্, আমাকে আমার স্বামীর জন্য পবিত্র রাখো।”
প্রাণপণে রবকে ডেকে যাচ্ছে মৃত্তিকা। কোনো একটা আলৌকিক ঘটনা ঘটে যাক, মৃত্তিকা নিজের সম্মানটুকু বাঁচাতে চাচ্ছে।

চলবে….

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

পঞ্চত্রিংশ পর্ব (৩৫ পর্ব)

“মিউকো, মিউকো।”

শরীফের কন্ঠ শুনে মনে কোথাও একটা সাহস পায় মৃত্তিকা। প্রথমবার সে তার বাবাকে ভ°য় না পেয়ে আছে। দরজা খুলে দেখে শরীফ দাঁড়িয়ে আছে, শাফিন নেই। ইমতিয়াজ সদর দরজা খুলে দ্রুত বাসায় প্রবেশ করে।

মৃত্তিকার ওড়না ডাইনিং এর ফ্লোরে পড়ে আছে, কপালে কা°টা দাগ, ঠোঁটের কোণায় র°ক্ত জমেছে, কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। ইমতিয়াজ ওর অবস্থা দেখে আরো ঘাবড়ে যায় আর ইমতিয়াজকে দেখে মৃত্তিকার কলিজায় পানি আসে। মৃত্তিকার ওড়নাটা হাতে তুলে নেয় ইমতিয়াজ।

মৃত্তিকা গিয়ে সোজা ওকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। ইমতিয়াজ ভ°য় পেতে থাকে শাফিন খারাপ কিছু না করে ফেলেছে। আবারো হয়তো কেউ ওকে ডেকেছে আর ও সাড়া দেয়নি।

মূলত শাফিনের বাসায় আসা খেয়াল করে মৃত্তিকার দিকে নজর রাখা শরীফের সেই লোক। শরীফ দুলালকে খোঁজায় ব্যস্ত ছিল, দুলালকে ঠিক কখন বা কিভাবে শাফিন নিয়ে গেছে সে জানে না। শরীফ মৃত্তিকার খবর পেয়ে ইমতিয়াজকে জানায় আর নিজেও ছুটে আসে। তবে ওরা আসার আগেই শাফিন বেরিয়ে গেছে। প্রায় দেড়ঘন্টা সময় লেগেছে ওদের আসতে, এতোক্ষণ মৃত্তিকার অবস্থা কি ছিল তা কেবল আল্লাহ্ই জানে।

ইমতিয়াজ ধীরে ধীরে ওর মাথায় হাত বুলায়। বলে,
“মৃত্তিকা।”

ইমতিয়াজের বুকে মাথা ঠেকিয়ে ক্রমাগত কেঁদেই যাচ্ছে মৃত্তিকা। শরীফ ওদের পাশ কা°টিয়ে বেরিয়ে যায়। যেহেতু ইমতিয়াজ চলে এসেছে তাই ওর এখানে আর কোনো দরকার নেই।

ইমতিয়াজের শার্টে বারবার চোখ মুছছে মৃত্তিকা, কিন্তু মাথা তুলে না। ইমতিয়াজ আলতো হাতে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“বলেছিলাম না এসো না এই কাপুরুষের কাছে।”

ইমতিয়াজের পিঠে খা°মচে ধরে মৃত্তিকা। কেন সে বারবার নিজেকে দোষারোপ করে। এসবে ওর কি দোষ?

ইমতিয়াজ চেয়ার টে°নে ওকে বসিয়ে দেয়। তারপর দরজা বন্ধ করে এসে ওর সামনে ফ্লোরে বসে বলল,
“শাফিন এসেছিল?”

মৃত্তিকা ঢোক গিলে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। ওর ওড়না গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বলে,
“কি হয়েছে?”

মৃত্তিকার কান্নার বেগ বেড়ে যায়। ইমতিয়াজ ওকে দ্রুত জড়িয়ে ধরে। হঠাৎ জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে মৃত্তিকা জ্ঞান হারায়। প্রচন্ড ভ°য় আর উ°ত্তে°জনা থেকে এটা হওয়া স্বাভাবিক। ইমতিয়াজ ওকে কোলে তুলে নেয়। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মুখে হালকা পানির ছি°টা দিতেই জ্ঞান ফিরে।

মৃত্তিকা চোখ খুললে ইমতিয়াজ উঠে যেতে নিলে মৃত্তিকা ওর হাত ধরে বলল,
“থাকেন না আমার কাছে কিছুক্ষণ।”

ইমতিয়াজ পাশে বসে। পিঠের দিকে বালিশ দিয়ে বসেছে। মৃত্তিকা এখনো তার হাতটা ধরে রেখেছে। ইমতিয়াজ হাত ছাড়িয়ে ওর ঠোঁটে আঙ্গুলের স্পর্শ করে। র°ক্ত জমে আছে এখানে। মৃত্তিকা মিনমিনে কন্ঠে বলে,
“চ°ড় দিয়েছে।”

ইমতিয়াজ কপালের কোণায় আঙ্গুল ছোঁয়াতেই মৃত্তিকা বলে,
“পড়ে গিয়েছিলাম, চেয়ারে লেগেছে।”

মৃত্তিকা ইমতিয়াজের গা ঘেষে শুয়ে বলল,
“মামের আসল নাম রাহা সুলতানা আর মাম তাদের আপন বোন না, চাচাতো বোন। মামের প্যারেন্টসকে শাফিনের বাবা মে°রেছে আর ওই লোকটাকে আমি এতোদিন নিজের নানা ভাবতাম।”

মৃত্তিকা কান্না করে দেয়। ইমতিয়াজ চেয়ে আছে ওর দিকে। কতটা অসহায়ত্ব কাজ করছে মেয়েটার মধ্যে।

মৃত্তিকা ফুঁপিয়ে উঠে বলে,
“মামের মাকে মা°রার সময় উনি প্রেগন্যান্ট ছিল, আর ওই লোকটা তাকেও তাহমিনার মতো…”

কথা শেষ হওয়ার আগেই ইমতিয়াজ ওর মাথাটা বুকে চেপে ধরে বলল,
“থামো প্লিজ, থামো।”

মৃত্তিকা থামলো। চুপ করে ইমতিয়াজের বুকে পড়ে রইলো। জীবন শেখাচ্ছে কিভাবে কষ্টিপাথরে ঘ°ষে সোনা চিনতে হয়, কিভাবে পু°ড়ে পু°ড়ে সোনা খাঁটি হয়। ইমতিয়াজও চোখ বন্ধ করে। কষ্ট হয়তো মাথায় নিয়েই জন্মেছে সে। জন্মের পর মা আর যৌবনের শুরুতে বাবাকে হারিয়ে জীবনে অনেক ধা°ক্কা খেয়েছে সে। স্ত্রী-সন্তানকে বাঁচাতে না পারার আ°ক্ষে°প যেমন আছে, তেমনি আজকে মৃত্তিকার প্রতিও সে অনুতপ্ত। শরীফ না থাকলে ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে খুব একটা সময় লাগতো না। ইমতিয়াজের হাতের বন্ধন আরো শক্ত হয়।

মৃত্তিকা ধীরে ধীরে উঠে বসে। ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলল,
“প্রয়োজনে এ জীবন দিয়ে দিবো, তবুও তুমি ছাড়া আর কারো স্পর্শ আমার সহ্য হবে না।”

ইমতিয়াজ সোজা হয়ে বসে। ওর শার্টের বুকের কাছের বোতাম খুলে মৃত্তিকা ওর ঘন লোমে আবৃত বুকে হাত দেয়। এলোমেলো চুলের মেয়েটার আবেদনময়ী দৃষ্টি লক্ষ্য করে ইমতিয়াজ। মৃত্তিকার চুলগুলো মুখের উপর থেকে সরিয়ে দেয়। মৃত্তিকার হক আছে ওর উপর, এসব আবেদন সে করতেই পারে। তবে আপাতত ইমতিয়াজ তাতে সারা দিতে চাচ্ছে না।

মৃত্তিকাকে আবারো জড়িয়ে ধরে বলে,
“কিছুদিন সময় দাও, মৃত্তিকা।”

মৃত্তিকা কিছু বলার আগেই কলিং বেল বাজে। দুজনেই চমকে উঠে বসে। ইমতিয়াজ উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখে তানজিম, সাথে সামিহা আর মিউকো। মিউ মিউ করে ভিতরে চলে আসে সে। তানজিমের সাথে কথা বলতে বসে ইমতিয়াজ, বিষয় শাফিন।

সামিহা দৌড়ে মৃত্তিকার কাছে যায়৷ মৃত্তিকার জন্য কিছু উপহার এনেছে সে৷ একটা মাঝারি শপিং ব্যাগ মৃত্তিকার হাতে দিয়ে বলে,
“তোমার বিয়ের গিফট, তখন দিতে পারিনি তাই এখন দিলাম।”

মৃত্তিকা খুলে দেখে ভিতরে কাঁচের চুড়ি, হিজাব আর কয়েকটা ব্রুচ। মুখ টি°পে হাসে মৃত্তিকা। সামিহা ওর হাত ধরে বসে পড়ে।
______________________________________

কলেজ থেকে ফেরার পর সারাহ্ চুপচাপ আছে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, এখনো কোনো কথা নেই। সারাহ্ ভাবছে নিজের মায়ের কথা, মা কি লুকাচ্ছে? কেন লুকাচ্ছে?

ভেবেচিন্তে উপায় না পেয়ে মাকে কল করে সারাহ্। মা রিসিভ করতেই সারাহ্ কোনো সূচনা ছাড়াই বলে,
“মা, তোমাকে এতো মানুষজন কিভাবে চিনে? আর এরা আমার আশেপাশেই কেন ঘুরঘুর করে?”

নার্গিস পারভিনের হাতপা থ°রথ°র করে কাঁপতে লাগলো। মেয়ের কোনো ক্ষতি না হয়ে যায়, এই ভ°য়ে তার মন আনচান করতে শুরু করলো।

সারাহ্ হয়তো মায়ের অবস্থা বুঝেছে। শান্তভাবে বলল,
“কি লুকাচ্ছো আমার থেকে আম্মু?”

নার্গিস পারভিন নিরবে কাঁদলেন। অনেকক্ষণ চুপ থেকে তারপর বলে,
“কিছুই না। ওরা তোমাকে বা সামিহাকে চাইছে না, ওরা আমাকে চায়।”

সারাহ্-র চোখ কো°ট°র থেকে বের হয়ে আসার উপক্রম হয়। ভ°য় জড়ানো কন্ঠে বলে,
“কেন? কি চায় ওরা?”

নার্গিস পারভিন মাথা নেড়ে বলেন,
“তা আমি সঠিক জানি না। তবে রিপাকে যেমন ধোঁকায় ফেলে দেশে এনেছিল আর খু°ন করেছিল, সেভাবে আমাকেও করবে।”
“রিপা?”
“সরি, ভুল নাম বলেছি। ওর নাম রাহা।”

সবকিছু যা একটু গোছানো ছিল তাও পেঁচিয়ে গেল সারাহ্-র। নার্গিস পারভিন মেয়ের অস্থিরতা বুঝলেন।

সারাহ্-র মনে পড়ে আহনাফকে কিছুদিন আগে কোনো এক রাহা কল করেছিল। আহনাফ কি মাকে বলেনি? হয়তো বলেনি। যদি রাহা খু°ন হয়ে থাকে তবে আহনাফকে কে কল দিয়েছিল।

নার্গিস পারভিন আশেপাশে তাকিয়ে রুমের দরজা চাপিয়ে দিয়ে এসে বললেন,
“যা যা এখন বলবো তা মনোযোগ দিয়ে শুনো। কথার মাঝে কথা বলো না আর বেশি মানুষের মাঝে জানাজানি করো না। কারণ তাতে আরো কয়েকটা লা°শ পড়বে।”

সারাহ্ চমকে উঠে। আরো কয়েকটা লা°শ পড়বে মানে কি? এর আগে কার লা°শ পড়েছে?

“রাহা আমার ফ্রেন্ড, ওর নাম রিপা করেছিল ওর চাচি অরফে পালিত মা। ওর বাবা মায়ের কথা ও জেনেছিল, তাদেরকে নির্মমভাবে হ°ত্যা করেছিল তাদেরই ভাই আর ভাবি। যদিও এসব সে অনেক পড়ে জানতে পারে। কলেজ লাইফে আমার অন্য দুই ফ্রেন্ড পর পর দুই সপ্তাহে আ°ত্ম°হ°ত্যা করেছিল, তবে সেটা আ°ত্ম°হ°ত্যা না খু°ন ছিল। খু°নটা করেছিল রিপার ভাই শাফিন। আমার ওই দুজন ফ্রেন্ড তখন প্রেগন্যান্ট ছিল, (একটু থামে) শাফিন প্রেগন্যান্ট মেয়েদের প্রথমে (আবারো থামে) রে°প করে তারপর খু°ন। ইয়াং বয়সে সে এসব করে বেড়াতো। রিপা এসব জেনেছিল, তবে শাফিন আর তার মায়ের ভ°য়ে চুপ ছিল। দশ দশটা বছর পর আমাকে এসব জানিয়েছে। তবে (লম্বা একটা বিরতি নেয়) তবে তার আগে রিপা যখন প্রথমবারের মতো প্রেগন্যান্ট হয় তখন শাফিন ওকে কলেজের রুমে আটকে রেখেছিল। আর ওকেও…”

নার্গিস পারভিন কান্না করে দেন। সারাহ্ নির্বিকার হয়ে জিজ্ঞাসা করে,
“কি হয়েছিল উনার?”

কিছুক্ষণ পর কান্না থামিয়ে শান্তভাবে বলেন,
“সেদিন আমি আর রোমি ওকে বাঁচিয়েছিলাম, তখন থেকেই আমরা শাফিনের নজরে চলে আসি। তোমার নানা এসব জানতে পেরেই দ্রুত আমার বিয়ে দেন। বিয়ের পর শাফিন আর আমাকে খুঁজে পায়নি বা খুঁজতে চায়নি। কিন্তু রিপা আর আমার সম্পর্ক টিকে থাকায় এতো বছর পর সে আমাকে খুঁজে নিয়েছে। কিসমত এতোই খারাপ যে আমার মেয়েদের দিকেই তার নজর গেছে।”

সারাহ্-র হাত থেকে ফোনটা পড়ে যায়। নিজের পেটে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে। জমে থাকা অশ্রুতে সিক্ত হয় ওর কপোল। মায়ের কথাগুলো এখনো তার কানে ক্রমাগত বেজে চলেছে। প্রতি°শো°ধ°পরায়ণ একজন মানুষ প্রতি°শো°ধের স্পৃ°হায় এখন কি ওর সন্তানকেও শেষ করে দিবে?

ফোনের ওপাশে নার্গিস পারভিন বারবার মেয়েকে ডাকছেন,
“সারাহ্, মা আমার। কথা শুনো মা।”

নার্গিস পারভিনের কথা শেষ হয় না, কিন্তু সারাহ্ আর শুনে না। ফোনটাও তুলে না। বিছানা থেকে উঠে গিয়ে দাঁড়ালো আয়নার সামনে। মা ডাকটা শুনতে পারবে তো সে? আধো আধো কন্ঠে কেউ মা ডাকবে, ছোট হাতগুলো ওর আঙ্গুলকে ধরে রাখবে। আসবে তো সেই দিন?

“ঐশী?”

সারাহ্ দ্রুত চোখ মুছে ফেললেও আহনাফ ঠিকই ওর কান্না ভেজা মুখটা দেখে ফেলে। আহনাফ এগিয়ে এসে বলল,
“কাঁদছো কেন? শরীর খারাপ লাগছে?”

সারাহ্ নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে বসে পড়ে। একটু জোরেসোরে বলতে থাকে,
“আমি ম°রে যাবো আহনাফ, আমার বেবিকে মে°রে ফেলবে ওরা।”

আহনাফ ওকে উঠিয়ে বিছানায় বসায়৷ চোখ মুছে দিয়ে বলল,
“হুশ, এসব বলে না। বলে না। কারা মা°রবে? আমি আছি না, ভ°য় নেই।”

আহনাফ ওর ঠোঁটে হালকা চুম্বন করে। সারাহ্-র কান্নার বেগ কমে যায়। একটু শান্ত হয় সে।

“আহনাফ, আমি না থাকলে আপনি কি তাহসিনার মতো আমাকেও ভালোবাসবেন?”

আহনাফের জীবনের সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন বোধহয় এটাই। ‘আমি না থাকলে’ এই একটা কথা ওর বুকে ঘা°য়ে°ল করলো। সেই রিসোর্ট, সেই কান্না, কেউ র°ক্তা°ক্ত নিথর দেহগুলো। একে একে সবগুলো দৃশ্য আবারো জীবন্ত হয়ে উঠে। ভুলতে না পারা অসমাপ্ত গল্পের পুনরাবৃত্তি হলে তা মেনে নেয়া যায় না। আহনাফও পারবে না আর মেনে নিতে।
______________________________________

তিনদিন পর, অফিসে আজ সন্ধ্যায় এক অনুষ্ঠান আছে। ঘটনা খুবই সাধারণ, বায়ারদের সামনে প্রমোশনপ্রাপ্ত কয়েকজনকে সম্মানিত করা আর শ্রমিক অ°সন্তোষ নেই এটাই প্রমাণ করা। এই পরিকল্পনা শরীফের, মৃত্তিকার মত নেই তবে ইমতিয়াজ অনুমতি দিয়ে দিয়েছে।

ইমতিয়াজের ইচ্ছায় তৈরি হচ্ছে মৃত্তিকা। হাফ সিল্কের শাড়ির সাথে হিজাব আর হালকা মেকআপ। সামিহার দেয়া চুড়িগুলো বের করে পড়ছে, এরমধ্যে কয়েকবার ইমতিয়াজ এসে তাড়া দিয়ে গেল। মৃত্তিকা দ্রুত গতিতে তৈরি হয়।

সামিহার দেয়া চুড়িগুলো মৃত্তিকার হাতের তুলনায় বড় হলো। একে তো সিল্কের শাড়ি আবার এতো বড় বড় চুড়ি। এগুলো ঠিক করতে করতে বাইরে এসে ইমতিয়াজকে বলল,
“আমাকে ঠিকঠাক লাগছে?”

ইমতিয়াজ ফোন স্ক্রল করছিল। ফোন থেকে চোখ সরিয়ে মৃত্তিকাকে দেখে থমকে গেল। এ কোন মৃত্তিকাকে দেখছে সে। ইমতিয়াজকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে মৃত্তিকা লজ্জায় পড়ে গেল। ইমতিয়াজের এমন দৃষ্টি ওর অচেনা।

মৃত্তিকা মৃদুস্বরে বলল,
“শুনুন, আমি কি পালটে ফেলবো?”

ইমতিয়াজ ওর দিকে এগিয়ে এলো। হিজাবের ব্রুচটা সোজা করে দিয়ে আবারো তাকালো ওর মুখের দিকে। লাজুকতায় ছেড়ে গেল মৃত্তিকা। কিছু বলতে নিলে ইমতিয়াজ ওর ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে বলল,
“চুপ, সারাদিন এতো বকবক করো কেন?”

মাথানিচু করে ফেলল মৃত্তিকা, আড়চোখে তাকালো বেসিনের উপরে থাকা আয়নার দিকে। ইমতিয়াজের দৃষ্টি এখনো ওর দিকে নিবদ্ধ। ওমা, দেরি হচ্ছে না ওদের?

ইমতিয়াজ ওর যতকাছে আসছে ততই হৃদপিণ্ডের গতি বাড়ছে, ওষ্ঠদ্বয় কেঁপে কেঁপে উঠছে। আবারো সে ইমতিয়াজের ছোঁয়া পেতে উন্মাদ হচ্ছে। চোখ বন্ধ করলো সে।

হুট করে ইমতিয়াজ সরে গেল। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে চোখে পরপর কয়েকবার পলক ফেলে দ্রুত বলল,
“তাড়াতাড়ি চলো, দেরি হচ্ছে তো।”

মৃত্তিকা চোখ খুলে ইমতিয়াজকে আর দেখলো না। সে ততক্ষণে বেরিয়ে গেছে। এতোকাছে এসেও ভালোবাসা না পাওয়ার আ°ক্ষে°পগুলো ওকে প্রতিনিয়ত পো°ড়া°চ্ছে।
______________________________________

“কোথায় যাবে দুলাল?”

দুলাল ফেরদৌসী অফিস পার্টিতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। কারো কথা শুনে পিছনে ফিরে দেখলো শাফিন। দুলাল টাই বেঁধে বলে,
“তোমার তাতে কি?”

দুলাল আর শাফিনের মধ্যে অনেক কথা কা°টাকা°টি হয়েছে। মূলত ইমতিয়াজকে সবটা বলে দেয়াই প্রধান কারণ। শাফিন এসে দুলালের শরীরে পারফিউম দিয়ে বলল,
“রাগ করো না। আমি তোমার জন্য গিফট এনেছি।”

ব্যাগ থেকে একটা কাঁচের বোতল বের করে তার দিকে এগিয়ে দিলো। বোঝা যাচ্ছে এতে পারফিউম আছে। মুখ খুলে পুরো বোতল দুলালের গায়ে ঢেলে দিলো শাফিন। দেরি না করে ঝটপট পকেট থেকে গ্যাস লাইট বের করে শরীরে আ°গু°ন লাগিয়ে দেয়।

তারপর সে দ্রুত ফ্ল্যাট ত্যাগ করে। গ্যাস সিলিন্ডারের মুখটা আগেই শাফিন খুলে ফেলেছে, দুলালের স্ত্রীকে ড্রইংরুমে বেঁধে রেখেছে। কিছুক্ষণ পরই সিলিন্ডার বি°স্ফো°রণ ঘটে, শাফিন শ°য়°তা°নি হাসি দিয়ে স্থান ত্যাগ করে। খবরে হেডলাইন হবে, সিলিন্ডার বি°স্ফো°রণে মা°রা গেছে শিল্পপতি দুলাল ফেরদৌসী ও তার স্ত্রী।

চলবে….

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

ষট্ ত্রিংশ পর্ব (৩৬ পর্ব)

অফিসের পার্টি স্থ°গিত হয়ে গেছে। কারণ সহজ, দুলালের দু°র্ঘ°ট°না। বেঁচে থাকা কঠিন হলেও আল্লাহ্ তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। শরীরের নব্বই শতাংশ অংশ পু°ড়ে গেছে, কন্ঠনালি পু°ড়ে গেছে। তার স্ত্রীর শরীরের সত্তর শতাংশ অংশ পু°ড়েছে। দুজনের অবস্থাই ভয়াবহ, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ণ ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করানো হয়েছে দুজনকে।

অফিসে খবরটা পেয়ে শরীফ ওদেরকে দেখতে আসলেও ইমতিয়াজ আর মৃত্তিকাকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে। এসবের পিছনে যে শাফিন আছে তা বুঝতে খুব একটা বুদ্ধি খাটানোর প্রয়োজন নেই।

বাসায় এসে মৃত্তিকা ব্যাগটা টেবিলে রেখে বলল,
“সবকিছুর একটা লিমিট থাকে, কোথায় থামতে হবে সেটা জানা উচিত। একের পর এক খু°ন করেই যাচ্ছে। আর..”

মৃত্তিকার কথার মাঝেই ইমতিয়াজ বলে,
“আর আমরা হাতপা গু°টিয়ে বসে ভাবছি পরের পালা কার।”

মৃত্তিকা ইমতিয়াজের চোখের দিকে তাকালো। তার দৃষ্টি স্থির। ইমতিয়াজ পলক ফেলে বলল,
“শাফিনের মৃ°ত্যু আমার হাতেই হবে।”

মৃত্তিকা ইমতিয়াজকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,
“কেন তাকে মা°রবেন? তাকে মে°রে নিজে বাঁচতে পারবেন? (একটু থেমে) আপনার কিছু হলে আমি কি করবো?”
“তুমি আমাদের সন্তানকে নিয়ে থাকবে।”

মৃত্তিকা চমকে উঠে। এ কোন কথা বলে দিলো ইমতিয়াজ। মৃত্তিকা রুমে চলে আসে। হিজাবটা খুলে রেখে হাত দিয়ে চুল গোছাচ্ছে। কাঁধ পর্যন্ত এসেছে তার চুলগুলো। ইমতিয়াজ ওর পিছনে এসে দাঁড়িয়ে সেও হাত দিয়েই চুল গোছানো শুরু করে।

মৃত্তিকা আয়নার দিকে তাকিয়েই বলল,
“আমাকে নকল করছেন কেন?”
“কোথায় দেখলে আমি তোমাকে নকল করছি। আমি তো আমার চুল ঠিক করছি।”
ইমতিয়াজ মৃদু হেসে উত্তর দিলো।

মৃত্তিকা নিজের মেকআপ উঠাতে উঠাতে বলল,
“আমি স্পষ্ট দেখছি আপনি আমাকে নকল করছেন।”

ইমতিয়াজ জোরে হেসে দেয়। কিছুক্ষণ দুজনের হাসাহাসি চলে। তারপর বেশ সিরিয়াস হয়েই ইমতিয়াজ জিজ্ঞাসা করে,
“তোমার মনে হয় দুলাল আর তার স্ত্রী বাঁচবে?”

মৃত্তিকা মাথা নাড়িয়ে বলে,
“আল্লাহ্ ভালো জানে, (একটু থেমে) কিন্তু আপনি কেন বলেছেন শাফিনের মৃ°ত্যু আপনার আপনার হাতে?”
“তোমার মনে হয় না তাহমিনার প্রতি°শো°ধ না নিলে তাহমিনার কাছে আমি ক্ষমা পাবো না? সবটা জেনেও আমি চুপ করে আছি, শান্তি কি পাচ্ছি আমি?”

মৃত্তিকা ইমতিয়াজের দিকে ফিরে বলে,
“আর আমি শান্তি পাবো আপনাকে ছাড়া?”

দুজনের দৃষ্টি দুজনের দিকে নিব°দ্ধ হলো। মৃত্তিকা একটা ঢোক দিলে গিলে ইমতিয়াজের কাছে এসে মিনমিনে স্বরে বলল,
“আমি যেরকম বাবা ছাড়া বড় হয়েছে আপনি কি চান আমাদের সন্তানও সেই ভাবেই বড় হবে?”

ইমতিয়াজ উত্তর না দিয়ে চলে গেল। মৃত্তিকা আবারো আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের মুখ পরিষ্কার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মৃত্তিকা জানে ইমতিয়াজের কাছে এ প্রশ্নের কোনো জবাব নেই।

ঘন্টাখানেক দুজনে আর কোনো কথাই বলল না। মৃত্তিকা নিজের মতো রান্না করলো, দুজনে রাতের খাবার খেলো, এশার নামাজ পড়লো। কিন্তু চুপ।

নামাজ শেষে জায়নামাজ গুছিয়ে রাখছে মৃত্তিকা, তখনই ইমতিয়াজ বলে,
“চলো তোমার বড়মণির বাসায়।”
“এখন? মানে এই রাতে?”
“হুম, আমি হসপিটালে যাবো তাই তোমাকে রেখে যাবো।”

ইমতিয়াজ টিশার্ট খুলে শার্ট পড়তে থাকে। মৃত্তিকা বলে,
“কোনো দরকার আছে ওখানে যাওয়ার?”

ইমতিয়াজ ওর সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
“বাটন লাগিয়ে দাও।”

মৃত্তিকা কপাল কুঁচকে মৃদু হেসে শার্টের বোতাম লাগানো শুরু করে। ইমতিয়াজ বলে,
“শত হোক সে আমাদের পার্টনার আর এখানে পুলিশ কে°ইস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সো যেতেই হবে।”
“আমি একা থাকতে পারবো।”

মৃত্তিকার অভিমানী সুরটা ইমতিয়াজ এক তুড়িতে বুঝে গেল। বারবার কাছে এসেও এক না হতে পারার আ°ক্ষে°প তো মৃত্তিকার রয়েছে। ইমতিয়াজ ওর দুইগালে হাত দিয়ে কপালে চুম্বন করে বলল,
“তুমি যেমন আমাকে ছাড়া শান্তি পাবে না, তেমনি আমিও তোমাকে ছাড়তে পারবো না।”

মৃত্তিকা মাথা তুলতে নিলে ইমতিয়াজের ঠোঁটের সাথে ওর চোখের পাপড়ির স্পর্শ হলো। ইমতিয়াজ হেসে দেয়, মৃত্তিকা ওর কলার টে°নে কাছে নিয়ে আসে। এরমাঝেই মিউকোর হানা, মিউমিউ ডাকে ইমতিয়াজের কাছে আসে। মৃত্তিকা সরে যায়। ইমতিয়াজ মিউকোকে কোলে নিয়ে বলল,
“কোনো মিউকোই আমাকে ছাড়ে না, যেতে তো হবে নাকি?”

মৃত্তিকা হিজাব পড়তে শুরু করে। লাজুকতা তার চোখে আর উপচে পড়া হাসিতে।
______________________________________

দুইদিন পর, দুলালের ভাই ও শ্যালক মিলে এই দু°র্ঘট°নায় মামলা করেছে। দুলালের স্ত্রী কিছুটা কথা বলতে পেরেছে, সে পুলিশকে জানিয়েছে কেউ একজন বাসায় এসেছিল এবং ইচ্ছাকৃতভাবেই এ ঘটনা ঘটেছে। ব্যস, সেই একজনকে খোঁজা শুরু। সিসিটিভি ফুটেজে শাফিনকে স্পষ্ট দেখা গেছে। ছবি দেখানোর পর দুলালের স্ত্রী তাকে চিনতেও পেরেছে। দোকান থেকে তাকে গ্রে°ফ°তার করে নিয়ে গেছে পুলিশ। দেশের বড়বড় টিভি চ্যালেনে দেখাচ্ছে এই খবর, শিল্পপতি দুলাল ফেরদৌসীকে হ°ত্যা°চেষ্টার মা°ম°লায় গ্রে°ফ°তার তারই বন্ধু শাফিন।

কলেজের অফ পিরিয়ডে ফোনে স্ক্রল করার সময় নিউজটা চোখে পড়ে আহনাফের। শাফিনের চেহারা সে দেখেই চিনে ফেলে। তাহলে তার আন্দাজ সঠিক, শাফিনই সেই লোক।

আহনাফ আপন মনে ভাবে,
“তবে কি তাহসিনার দু°র্ঘ°টনায় এর হাত আছে?”

আহনাফ ঢাকায় যাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। তবে সারাহ্-কে একা ফেলে যাওয়াটাও ঠিক নয়, আবার ওর এই অবস্থায় সফর করাটাও ঠিক নয়। তবুও একটা রিস্ক সে নিতে চায়। বাবাকে বুঝিয়ে হলেও সারাহ্-কে রেখেই যাবে সে।

আব্বাস সাহেবকে কল করে আহনাফ। বাবাকে বোঝানো খুব একটা কঠিন কাজ নয়। আব্বাস সাহেবকে সবটা বুঝিয়ে বলতেই উনি বুঝলেন। তবে তাহসিনার পরিবারের কথাটা আহনাফ এড়িয়ে গেল, বাবার কাছে এটা বলা লজ্জার।

কলেজ ছুটির সময় সারাহ্-র সাথে দেখা। সে পুকুরের কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। আহনাফ ওর কাছে গিয়ে ওর হাত ধরে বাইরে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
“ঢাকায় যাবো আজকে।”
“কেন? কোনো সমস্যা?”

অটোতে বসে আহনাফ বলল,
“সমস্যা না, আমি গাড়ি দেখতে যাবো, কিনবো আমি। তুমি বাসায় থাকবা।”

সারাহ্ আহনাফের হাত জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমিও যাবো।”
“বাচ্চাদের মতো বিহেভ করো না।”
আহনাফ একটু ধ°মক দেয়। সারাহ্ হাত ছেড়ে সোজা হয়ে বসে।

বাসায় এসে আহনাফ রুমে গেল। প্রতিদিনের মতো আজকেও দুপুরের খাবার গরম করে রেখেছেন আব্বাস সাহেব, রান্না তো সারাহ্ সকালেই করে যায়।

আহনাফ ফ্রেশ হয়ে এসে সারাহ্-কে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে বলল,
“কি গো, চুপ যে?”

সারাহ্ বালিশে হেলান দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলো। আহনাফ এসে ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে বলল,
“মাথা টি°পে দাও, ব্য°থা করতেছে।”

সারাহ্ ওর মাথায় হাত দেয় না। আহনাফ আবারো বলল,
“একটু স্বামী সেবা করো, সওয়াব হবে।”

সারাহ্ অভিমান করে বলে,
“আপনি বউকে ব°কেন, সওয়াব পাবেন।”

আহনাফ জোরে হেসে উঠে বসে। সারাহ্-র গলায় ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়, বরাবরের মতোই সারাহ্-র বাধা উপেক্ষা করে সে। সারাহ্-র মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
“মান করে না ঐশী রানী।”

সারাহ্ অন্যদিকে মুখ ঘুরালে আহনাফ ওর গালে তর্জনী আঙ্গুল স্পর্শ করায়। সারাহ্ চোখ বন্ধ করে বলল,
“শুয়ে পড়ুন, মাথায় হাত বুলিয়ে দেই।”

ওর ঘনঘন নিশ্বাস আহনাফ অনুভব করে। মুচকি হেসে বলল,
“আগে খেয়ে নাও, তারপর স্বামী সেবা করো।”

সারাহ্ দ্রুত উঠে চলে যায়। এই লোকটা একটা ব°জ্জা°তের সেরা। যখন তখন যেরকম উপায়ে হোক ওকে লজ্জা দিতেই হবে। আহনাফ হেসে উঠে ডাইনিং এ আসে।
______________________________________

পরদিন সকালে, হাসপাতাল থেকে থানায় এসেছে ইমতিয়াজ, মৃত্তিকাও সাথে এসেছে। দুলালের দু°র্ঘ°ট°নার পর হাসপাতালে থাকছে ইমতিয়াজ, পুলিশের নানান জিজ্ঞাসার মুখে মৃত্তিকাকে সে ফেলতে চাচ্ছে না। তাই এই দূরত্ব তৈরি।

শাফিনের সাথে কাউকে দেখা করতে দেয়া হচ্ছে না। দূর থেকে তাকে দেখে মৃত্তিকা। শাফিন র°ক্ত°চক্ষু নিক্ষেপ করে মৃত্তিকার দিকে, মৃত্তিকা ওর নজর দেখে। পুলিশের মাঝ থেকেই শাফিন হাত উঁচিয়ে আঙ্গুল উপরে নিচে দিয়ে মৃত্তিকার শরীর ইঙ্গিত করে। ইমতিয়াজ এগিয়ে যেতে নিলে মৃত্তিকা ওকে বাধা দেয়।

ইমতিয়াজের হাত ধরে বলল,
“প্লিজ, ঝা°মেলা কইরেন না। আমার ভ°য় লাগছে তার দৃষ্টিতে।”

ইমতিয়াজ মৃত্তিকাকে নিয়ে বাইরে আসে। আহনাফ এসেছে, ইমতিয়াজ ওর সাথে হ্যান্ডশেক করে। আহনাফ ভ্রূ উঁচিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“অবশেষে সে ধরা পড়লো।”

ইমতিয়াজ বাঁকা হাসে। বলে,
“তোমার মনে হয় লিগ্যাল ওয়েতে ওর কিছু করা যাবে? এতোগুলো খু°ন ঠান্ডা মাথায় করেছে, এখন তাড়াহুড়ায় ধরা পড়েছে। জন্মগত শ°য়°তান সে, ওকে..”

ইমতিয়াজ কিছু বলতে নিলে মৃত্তিকা ওর শার্টের হাতায় মু°ঠ করে ধরে। মৃত্তিকা জানে সুযোগ পেলে ইমতিয়াজ শাফিনকে মে°রে ফেলবে।

ইমতিয়াজ থেমে গিয়ে পিছনে তাকায়। মৃত্তিকা নিচুস্বরে বলে,
“আর কিছু বলিয়েন না।”
ইমতিয়াজ ওর কথা শুনে, আর কিছুই বলে না।
আহনাফ হেসে অন্যদিকে চলে যায়। সাংবাদিকদের ভীড় আছে এখানে। হঠাৎ একটা কথা ছড়িয়ে পড়ে যে দুলাল ফেরদৌসী মা°রা গেছে। ইমতিয়াজ খবরটা শুনেই শরীফকে কল করে সত্যতা জানতে চাইলে উত্তর আসে,
“সবটাই সত্য, এইতো কিছুসময় আগেই সে মা°রা গেছে।”

তাহমিনাকে কিভাবে মা°রা হয়েছিল তা শুধু দুলালই জানতো। মৃত্তিকা ওইটুকু অংশ ভিডিও করেনি। ইমতিয়াজ একটু আশাহত হয়।

“মৃত্তিকা, চলো তোমাকে বাসায় দিয়ে আমি হসপিটালে যাবো।”
“আমিও যাবো।”
“জে°দ করো না।”

মৃত্তিকা ওর হাত ধরে বলে,
“আপনাকে একা ছাড়লে আমার খুব চিন্তা হয়।”

মৃত্তিকার শত অনুরোধ ইমতিয়াজ শুনে না। ওকে বাসায় রেখেই সে হাসপাতালে যায়। দুলাল ফেরদৌসীর ছেলে কলরব এসেছে, বাবার ম°র°দেহ নিয়ে অঝোরে কাঁদছে।

ইমতিয়াজ থমকে যায়, মনে পড়ে নিজের সেই দিনের কথা। কত আর বড় ছিল, কলেজে পড়তো। বাবার লা°শে°র খাটিয়া বয়ে নেয়ার ক্ষমতা তো তখন ছিল না। তবুও নিতে হয়েছিল। ওই গো°র°স্থানের গেইট পর্যন্ত সবাই আদর করেছে, এরপর যেন সবটাই পালটে গেল। সব চিত্র এলোমেলো হলো।

দুলালের পো°ড়া দেহটা দুইদিন হাসপাতালে কুঁ°কড়েছে, নিজের চোখের সামনে যে পা°পগুলো সে করতে দিয়েছিল। তিনজন জলজ্যান্ত মানুষকে অ°মানুষের মতো হ°ত্যা করেছিল, তার প্রতি°শো°ধ প্রকৃতি নিয়েছে৷ এখন সেই হাশরের ময়দানের ফয়সালার অপেক্ষা করবে সে, অপেক্ষা করবে ইসরাফিল (আ.) এর শি°ঙ্গায় ফুৎকারের। তার আগে থাকবে এক জীবন, যার নাম কবর।
______________________________________

বিকালে সুরভি এসেছে বাবাকে দেখতে। শর্ত দেয়া আছে দূর থেকে দেখতে হবে। যেহেতু দুলাল মা°রা গেছে তাই সে এখন খু°নের আসামী। পুলিশ তো আর জানে না যে সে একটা খু°ন করেনি, এর আগেও এসবের অনেক রেকর্ড তার আছে আর সে এসব থেকে বের হয়েও এসেছে। শাফিন বেশ নিশ্চিন্ত আছে, পুলিশ ওর কিছুই করতে পারবে না সে জানে।

নয়মাসে পড়তে আর কিছুদিন বাকি আছে সুরভির। এইতো কিছুদিন পরই সে মা হবে। বাবার হাতে সন্তানকে তুলে দেয়ার খুশি ওর আর নেই। তানজিমের কাছ থেকে তাহমিনার কথা সে শুনেছে। এখনো যে স্থির আছে এটাই বেশি।

শাফিনের থেকে বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়ালো। দুচোখে তার অশ্রুধারা। বাবার গ্রে°ফ°তারের দুঃখ নয় এটা। তাহমিনার জন্য এ কান্না। সে কি তার মেয়ের বয়সী ছিল না? তার কি নিজের স্বপ্ন পূরণের অধিকার ছিল না?

সুরভি একটু এগিয়ে গিয়ে শাফিনকে বলে,
“আমাকে দেখে তোমার লো°ভ হয়নি বাবা?”

কতটা কষ্ট, কতটা অসহায়ত্ব থেকে একটা মেয়ে তার বাবাকে এই কথাটা বলতে পারে তা কেবল আল্লাহ্ই জানেন। সুরভি জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে নিতে বেরিয়ে আসে। দেলোয়ারা থানায় আসেননি। উনি এখনো শাফিনের এসব ঘটনা বিশ্বাস করতে পারছেন না।

চলবে….

অনুভূতিরা শব্দহীন পর্ব-৩১+৩২+৩৩

0

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

একত্রিংশ পর্ব (৩১ পর্ব)

খুব ভোরে সারাহ্-র ঘুম ভা°ঙলো ফুফুর ডাকে। ফোনে সময় দেখে বুঝলো এখনো আযান দেয়নি। এখন কেন ডাকছে উনি, কোনো বি°পদ হলো না তো।

সারাহ্ উঠে গিয়ে দরজা খুলে। ফুফু ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বলল,
“কিছু মনে করো না আমার আবার ভোরে চা খাওয়ার অভ্যাস তো।”

সারাহ্ জোরপূর্বক হেসে বলল,
“আমি বানিয়ে দিচ্ছি।”

চুলগুলো খোঁপা করে ওড়না দিয়ে শরীর ঢেকে সারাহ্ রান্নাঘরে যায়। ফুফুও পিছুপিছু গিয়ে দাঁড়ালো।

“আহনাফের মা নেই, শুনেছি তুমিও নাকি জব করো। সংসার সামলাও কিভাবে?”

সারাহ্ চায়ের পাতিল চুলায় বসিয়ে দিয়ে বলে,
“দুধ চা খাবেন নাকি লেবু চা?”

এক কথায় উনাকে এড়িয়ে গেল সারাহ্। ওর সংসার কিভাবে সামলায় বা কিভাবে সামলাবে তার কৈফিয়ত ও কাউকে দিবে না।

ফুফু গমগমে সুরে “আদা-লেবু চা” বলে চলে গেল। সারাহ্ মুচকি হাসে। চা বসিয়ে দিয়ে রুমে ফিরে আসে। আহনাফ ঘুমাচ্ছে। মাথায় হাত বুলিয়ে ওর মুখের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখে চোখের কোণায় চিকচিক করছে অশ্রুবিন্দু। রুমের লাইট বন্ধ, কিন্তু ডাইনিং এর লাইটের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ওড়নার কোণা দিয়ে চোখ মুছে দেয় সারাহ্।

“কি লুকাচ্ছেন আপনি? আপনাকে আমি এখনো কেন বুঝতে পারছি না?”

আহনাফের কপালে চুম্বন করে। আহনাফ ওকে জড়িয়ে ধরে গা ঘেষে শুয়ে পড়ে।

“তাহসিনার কাছে গিয়েছিলেন, প্রচুর ভালোবাসেন ওকে। ওর জন্যই মন খারাপ আপনার, কাঁদছেন আপনি?”

আহনাফ জেগে গেছে, কিন্তু চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভাণ ধরে রেখেছে। তাহসিনাকে নিয়ে সারাহ্-র মুখোমুখি ও হতে পারবে না। সারাহ্ আর কথা না বলে উঠে যায়। এরমধ্যেই আযানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে।
______________________________________

সকাল পৌনে সাতটা, আজকে মৃত্তিকা নাস্তা বানিয়েছে। অফিসে যেতে হবে তাই তাড়াতাড়ি উঠে রান্না সেরে ফেলে। ইমতিয়াজ ঘুমিয়ে কাঁদা। মৃত্তিকা সুন্দরমতো টেবিলটা সাজায়। বিড়ালটা ওর পায়ে পায়ে ঘুরছে।

“একদম টেবিল খারাপ করবি না। আমার কিন্তু কষ্ট হয়েছে বলে রাখলাম।”

আঙ্গুল তুলে কথাটা বলে রুমের দিকে তাকায় সে। ইমতিয়াজ এখনো উঠেনি। হাঁটু গেড়ে বসে বিড়ালকে বলে,
“ও তোর বাবা হলে আমি তোর মাম। সো, মামের কথা শুনে চলবি।”

মৃত্তিকা বেসিনের আয়নায় নিজেকে ঠিকঠাক মতো দেখে রুমে যায়। শান্ত সুরে ইমতিয়াজকে ডাকে,
“গুড মর্নিং।”

ইমতিয়াজ উঠে না। মৃত্তিকা গিয়ে ওর কানে সুরসুরি দেয়। ইমতিয়াজ নড়ে উঠে, মৃত্তিকা মুখ টিপে মুচকি হাসে। ইমতিয়াজ মৃদুস্বরে বলে,
“এই মিনা।”

মৃত্তিকা সরে যায়। ঘুমের ঘো°রে ইমতিয়াজের মুখে মিনা নামটাই আসে। কিছুক্ষণ বসে থেকে মাথানিচু করে উঠে যাওয়ার সময় ইমতিয়াজ ওকে টেনে নিজের বুকে নিয়ে আসে। দুহাতে শক্ত করে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। প্রথমবারের মতো এতো কাছে দুজনে, ইমতিয়াজের এই স্পর্শটাও নতুন। মৃত্তিকার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, শরীরে এক অন্যরকম শিহরণের সৃষ্টি হয়।

ইমতিয়াজের ফোনে এলার্ম বেজে উঠলো, হাত বাড়িয়ে এলার্ম বন্ধ করে সে। মৃত্তিকা হাত সরানোর পরই তার ঘুম ভেঙেছিল। মিনার নাম মৃত্তিকার সামনে উচ্চারণ করেছে, মেয়েটা কষ্ট পেয়েছে এটাই স্বাভাবিক। তাইতো কাছে টে°নেছে, কষ্টটা কিছু কমে যাক।

“মৃত্তিকা?”
বলে হাতটা আলগা করতেই মৃত্তিকা উঠে যায়। মাথানিচু করে বসে থাকে। লজ্জায় পালাতে তো পারবে না, ইমতিয়াজ যে এখনো হাত ধরে রেখেছে।

আড়চোখে ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলল,
“অফিস যাবেন না? নাস্তা করে নিন।”

ইমতিয়াজ উঠে বসে। বলে,
“ফ্রেশ হয়ে আসি।”

মৃত্তিকার মুখটা কাছে এনে বলল,
“একটু মানিয়ে নিও।”

ইমতিয়াজ উঠে ওয়াশরুমে চলে যায়। শক্ত মেয়েটাও প্রিয় পুরুষের স্পর্শ পেয়ে লজ্জাবতী হয়ে গেছে।

নাস্তা সেরে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয় আটটার কিছু পরে। মৃত্তিকার অফিসটা মিরপুরে৷ মগবাজার থেকে যেতে বেশ খানিকটা সময় লাগলো ওদের।

অফিসে গিয়ে প্রথমেই গেল মৃত্তিকার কেবিনে। দুইকাপ কফি এনে দুজনে মুখোমুখি বসে। মৃত্তিকা বলল,
“কলরবের বাবা, দুলাল ফেরদৌসী, প্রতিদিন অফিসে আসে। ৭৫ শতাংশ শেয়ার হারিয়েছে, পাগল প্রায় উনি। কিন্তু হাল ছাড়েননি।”

ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে চোখে চোখ রেখে বলল,
“সে আবারো ওই চেষ্টা করবে। আর মামার বিষয়টাও আমাকে জানতে হবে।”

ঘাড় ঘুরিয়ে আবারো দরজার দিকে তাকায়। বলে,
“আমার চেয়ে আপনি ওদের কাছে বেশি যেতে পারবেন। (একটু থেমে) আর আপনি এমডির রেজিস্টার এসিস্ট্যান্ট ছিলেন, তাই বিজনেসের পাক ঝোঁ°ক ভালো বোঝার কথা। কি বলেন?”

ইমতিয়াজ মনোযোগ দিয়ে ওর কথা শুনলো। তারপর বলল,
“হয়তো ঠিক বলছেন। কিন্তু যারা এভাবে ঠান্ডা মাথায় কাজ করে, তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ পাওয়া সহজ বলে মনে করেন?”
“সহজ নয় তবে সম্ভব।”

ইমতিয়াজ মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। মৃত্তিকা এবারে স্বাভাবিক সুরে বলল,
“তবে ডিসিশন ফাইনাল, আপনি অফিস সামলাবেন আর আমি বাসা।”

ইমতিয়াজ হেসে উঠে বলে,
“বাসায় সামলানোর কিছু নেই, আপনিও অফিসে থাকবেন।”
“আমি কি করবো?”

কফির কাপে চুমুক দিয়ে ইমতিয়াজ বলে,
“ধরে নেন আমার পার্টনার।”
“পার্টনার?”
“হুম, পার্টনার।”

দরজায় নক করে মৃত্তিকার পিএ শিল্পা ইউনুস প্রবেশ করে। মেয়েটা কম বয়সী, মিষ্টি করে হেসে বলল,
“ম্যাম, ইসরাত জাহান চলে এসেছে।”
“ওকে, আমি আসছি।”

শিল্পা চলে গেলে মৃত্তিকা ইমতিয়াজকে বলল,
“ইসরাত রাতে চলে যাবে, তো এর আগে আমরা ওর সাথে একটু ফ্যাক্টরি দেখে আসি?”
“হুম, চলুন।”
______________________________________

“আজ কলেজ অফ?”

ফুফুর কথায় সারাহ্ মুচকি হেসে জবাব দিলো,
“জি, আজ শনিবার।”
“শনিবার অফ।”
কথাটা উনি কয়েকবার বলেন।

আলেয়া খাতুনের সাথে রান্নার জোগাড়ে ব্যস্ত সারাহ্। ফুফু রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ওদের কাজ দেখছে। সারাহ্-কে জিজ্ঞাসা করে,
“তোমার গ্রামের বাড়ি কোথায়?”
“শরীয়তপুর।”

ফুফু ভ্রূ উঁচিয়ে ঠোঁট উলটে মাথা নেড়ে বলল,
“তো পড়াশুনা কোথায় করেছো? ঢাকায়?”
“জি।”
“অনার্স কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে?”
“ঢাবি, কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট।”
কাজ করতে করতে জবাব দেয় সারাহ্।

“তো ভিক্টোরিয়াতে কেন জব নিলে?”

সারাহ্ নির্বিকার চোখে উনার দিকে তাকায়। তারপর বলল,
“আম্মুর ইচ্ছা ছিল।”
“কারণ?”
“তা জানিনা, আম্মুর ইচ্ছা ছিল এটাই যথেষ্ট।”

সারাহ্ আবারো রান্নায় মন দেয়। খাবারের গন্ধে অস্বস্তি হওয়ায় ওড়নাটা নাকে মুখে বেঁধে কাজ করছে।

“এটা এভাবে বেঁধেছো কেন?”

এই মহিলা প্রচুর কথা বলে। সারাহ্ একটু বি°র°ক্ত হয়৷ এতো প্রশ্ন একটা ছোট বাচ্চাও বোধহয় করবে না।

আহনাফ সারাহ্-কে ডাকে,
“ঐশী? এই ঐশী, (একটু থেমে) ঐশী, রুমে আসো।”
“যাও, ডাকছে। জলদি যাও।”

ওড়না ঠিক করে সারাহ্ নিশব্দে বেরিয়ে যায়। রুমে গিয়ে আহনাফকে ধ°ম°ক দিয়ে বলে,
“কাজ নেই কোনো আপনার? এভাবে বাড়ি মাথায় তুলে ডাকাডাকি করছেন, বাড়িতে আরো মানুষ আছে।”
“বউকেই তো ডাকছি, বাইরের কাউকে তো ডাকিনি। রাগ করো কেন?”

আহনাফ হেসে বলে,
“রান্নাঘরে তোমার কষ্ট হচ্ছিল।”

সারাহ্ বিছানায় বসে বলল,
“একটু একটু হয়েছে।”
“এজন্যই ডেকেছি, রেস্ট নাও।”
“আপনার ফুপ্পি অনেক কথা বলে। কতকত প্রশ্ন?”

আহনাফ হেসে বলে,
“ঠিকই বলেছো, ফুপ্পি কথা প্রচুর বলে। তবে উনার মনটা কিন্তু অনেক সরল।”
“সেটা আমিও বুঝেছি, নাহলে ভোরে এসে কেউ চা চায় এভাবে।”

আহনাফ হো হো করে হেসে উঠে। সারাহ্ও আলতো হেসে উঠে যায়। আবারো সেই রান্নাঘরের কাজে মন দেয়। আহনাফ বই পড়ছে, এরমধ্যে কল আসে সারাহ্-র নাম্বারে।

আহনাফ ফোন হাতে নিয়ে আননোন নাম্বার দেখে রিসিভও করে,
“আসসালামু আলাইকুম।”

অপরপাশের নারী কন্ঠ বলে উঠে,
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম, নার্গিসের মেয়ের নাম্বার এটা?”
“জি, আপনি কে?”
“আসলে আমি নার্গিসের ফ্রেন্ড রাহা। ওর মেয়েকে দিন ফোনটা।”
“আমি ওর হাসবেন্ড, আমাকে বলুন কি বলবেন?”
“নার্গিসের নাম্বারটা দেয়া যাবে?”

সরাসরি এমন প্রশ্নে আহনাফের কপাল কুঁচকে যায়। সারাহ্-র নাম্বার যে যোগাড় করতে পারে সে সারাহ্-র মায়ের নাম্বার যোগাড় করতে পারলো না।

আহনাফ সহজ ভাষায় বলে,
“এমনি ওমনি অপরিচিত কাউকে দেয়া যাবে না।”
“বললাম তো আমি রাহা।”
“কিন্তু আমি আপনাকে চিনি না।”
“তবে এই নাম্বারটা নার্গিসকে দিয়ে বলবেন রাহার নাম্বার।”

কল কে°টে যায়। আহনাফ ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে। কপালের ভাঁজ আরো গভীর হয়।

সুন্দরী এক রমনী ছিল ফোনের ওপাশে, তার দেহের গড়ন যেকোনো পুরুষের নজর কাড়তে বাধ্য। নামটাও তার মতই সুন্দর, অপরূপা।

সে ফোন রেখে শাফিনকে বলে,
“চিন্তা করতে পারো নার্গিসের মেয়েকে বিয়ে করে আহনাফের মতো ছেলের এতো কথা হয়েছে?”

শাফিন মাথা নেড়ে বলল,
“একটা বিষয় কনফার্ম, আহনাফ রাহাকে চেনে না।”

অপরূপাও মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। শাফিন বলে,
“তবে চিন্তার কারণ মৃত্তিকা, ও রাহা সম্পর্কে শুনেছে।”

অপরূপা ধ°ম°ক দিয়ে বলে,
“তোমার কারণেই হয়েছে এটা। আমি কোনো বিপদে পড়তে চাই না।”

শাফিন অপরূপার গাল চে°পে ধরে বলল,
“চুপ, আমার উপরে হুকুম কম চালাও।”

শাফিন আবারো গিয়ে আগের জায়গায় বসে বলে,
“লুৎফরের মনে বোধহয় সন্দেহ জন্মেছে। এর একটা ব্যবস্থা করতে হবে।”
“করে ফেলো। আর দুই মেয়েকে একসাথে হাতে রাখতে পারলে নার্গিস এমনিতেই দুর্বল হবে।”

কথা শেষে অপরূপা জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। তার কল্পনায় তার কাজে কোনো ভুল নেই, সে সঠিক। আত্নীয়স্বজন, মায়া-মহব্বত এসবের স্থান ওর হৃদয়ে নেই। টাকার জন্য সে সব করতে পারে, বাবার বয়সী শাফিনকে বিয়েও করতে পারে। এ বিয়েটা দেলোয়ারার অগোচরে করেছে শাফিন। অপরূপাকে আলাদা বাসায় রেখেছে।

“মৃত্তিকাকে তুমিই শান্ত করো, শাফিন। তোমার ওয়েতে শান্ত করো ওকে। নার্গিসের জন্য তো আরিফা আর আমি যথেষ্ট।”

শাফিন বিছানায় আরাম করে বসে বলল,
“আরিফা সাহায্য করবে?”
“এটাই শেষ সাহায্য। এই মাসেই প্রত্যেকটা প্রমাণ শেষ করে দাও।”
“তাড়াহুড়ো করো না, আগে তানজিম আর সামিহার বিয়েটা দেয়া উচিত।”

অপরূপা কপাল কুঁচকে বলল,
“কেন ওরা মেয়ে দিবে মমতাজের বেকার ছেলেকে?”
“প্রস্তাব নিয়ে যাবো, ভালো করে বুঝিয়ে বলবো এখন বিয়ে হোক আর ওরা পড়াশুনা চালিয়ে যাক। পড়া শেষে সংসার শুরু করবে।”

অপরূপা মুখ বাঁ°কিয়ে মাথা নাড়ে। শাফিন বুদ্ধিমান, তবে মাঝেমাঝে তার বোকামির জন্যই পুরোনো ঘটনা নতুন করে উঠে এসেছে আর ওদের নতুন নতুন খু°ন করে আবারো সেই ঘটনা ধামাচাপা দিতে হচ্ছে।
______________________________________

রবিবার সকালে তাড়াতাড়ি কলেজে আসে সারাহ্ ও আহনাফ। কলেজে কোনো একটা মিটিং থাকায় আহনাফকে তাড়াতাড়ি আসতে হয়েছে আর সারাহ্ও সাথে এসেছে। কলেজে এসে শুনলো মিটিং ক্যান্সেল।

আহনাফকে মাঠে হাঁটতে দেখে সারাহ্ টিচার্স রুম থেকে বেরিয়ে এসে বলল,
“মিটিং?”
“ক্যা°ন্সে°ল হয়েছে।”

সারাহ্ হাসতে হাসতে মাঠে এসে বলে,
“আহারে, সকালে উঠে কি জলদিই না এসেছেন। বেচারা।”

আহনাফ হাত নেড়ে বলল,
“রসমালাই খাবা? আদি মাতৃভান্ডারের রসমালাই।”
“কোথায় এটা?”
“গেলেই বুঝবা।”

দুজনে কলেজের সামনে থেকে অটোরিকশা নিলো। আহনাফ অটোতে বসে চালককে বলল,
“মামা, প°দুয়ার বাজার, মাতৃভান্ডারের সামনে চলেন।”

অটো চলতে শুরু করে। সারাহ্ আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,
“জায়গার নাম কি?”
“প°দুয়ার বাজার।”

সারাহ্ একটু হাসে। প্রায় একবছর হতে চলল সে কুমিল্লা থাকে, কিন্তু এখানের তেমন কোনো জায়গা সে চিনে না।

আহনাফ বলে,
“তুমি গোমতী পাড়ে যেতে চেয়েছিলে না? এই শুক্রবারে নিয়ে যাবো।”

সারাহ্ খুশি হয়ে ওর হাত ধরে কাঁধে মাথা রেখে বলল,
“সত্যি তো? আবার কোনো অজুহাত দিবেন না?”
“একদম সত্যি।”

কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা মাতৃভান্ডারে পৌঁছে যায়৷ ভাগ্য ভালো থাকায় ভিতরে বসার জায়গা পায়।

আহনাফ বলে,
“সকাল বলে ভী°ড় কম, বিকেলে আসলে তো ওই রাস্তা পর্যন্ত লাইন থাকে।”

অল্প করেই রসমালাই কিনলো। আহনাফ সারাহ্-কে খাইয়ে দিয়ে বলে,
“অতিথি আর অতিথির মাকে আপ্যায়ন করতে হবে তো।”
“ব°মি হলে কে সামলাবে?”
“এই বান্দা আছে তো এখনো।”
______________________________________

এক এক করে তিনদিন কেটে যায়। সকাল সাতটা, তানজিম ভার্সিটিতে চলে গেছে। লুৎফর রহমান দোকানে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। মমতাজ বেগম দুধের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলল,
“খেয়ে নাও।”
“রাখো।”

বেডসাইড টেবিলে দুধের গ্লাস রেখে মমতাজ বেগম ডাইনিং এ গিয়ে নিজের গ্লাসে দুধ ঢাললেন। লুৎফর রহমান দুধ অর্ধেকটুকু খেতেই অসুস্থ বোধ করা শুরু করে। গলায় যেন কিছু একটা আটকে গেছে, নি°শ্বাসটা যেন বুকেই থাকতে চাচ্ছে। কয়েকবার জোরে নিশ্বাস নিয়ে স্বাভাবিক হতে চায়।

“মমতা..”

মমতাজ বেগমকে ডাক দেয়ার শক্তিটুকু তার নেই। বিছানায় বসে খেতে খেতে ওখানেই পড়ে গেল। নি°শ্বাসের পরিমাণ ক্রমাগত কমছে।

মমতাজ বেগমেরও একই দশা। চেয়ার থেকে নিচে পড়ে ছ°টফ°ট করতে করতে উঠে টেবিলের উপর থেকে নিজের ফোনটা নেয়। তানজিমের নাম্বারে ডায়াল করে।

তানজিম রিসিভ করে বলে,
“আম্মু, মাত্রই তো আসলাম।”
“তানজিম বাসায় আ.. আসো।”

শীতল কন্ঠে কথাটা বলে শান্ত হয়ে যায় মমতাজ বেগম। তানজিম কয়েকবার “আম্মু, আম্মু” বলে ডাকলেও সারাশব্দ আসে না। ফোন রইলো টেবিলে আর মমতাজ বেগম ফ্লোরে গ°ড়াগ°ড়ি খেতে খেতে শান্ত হয়৷ মুখের কো°ণা দিয়ে সাদা ফেনা জাতীয় কিছু বেরিয়ে আসে।

চলবে…..

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

দ্বাত্রিংশ পর্ব (৩২ পর্ব)

হাসপাতালের চেয়ারে শান্ত হয়ে বসে আছে তানজিম। দুইবোনের পর মা-বাবাও একই পথের যাত্রী হয়েছে, মৃ°ত্যুর সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছে। এই বয়সে ছোট ছেলেটা কিভাবে তা সহ্য করবে? কথায় বলে না, অল্প শো°কে কা°তর আর অধিক শো°কে পাথর। তানজিমের হয়েছে সে অবস্থা।

বাসায় ফিরে মমতাজ বেগম আর লুৎফর রহমানের অবস্থা দেখে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আসে তানজিম। খবর পেয়ে অফিস থেকে ছুটে এসেছে ইমতিয়াজ ও মৃত্তিকা। বড়মণির জন্য মৃত্তিকার সে কি কান্না। ফুঁ°পিয়ে ফুঁ°পিয়ে অনবরত কেঁদেই যাচ্ছে সে। তার মাথায় শান্ত হয়ে হাত বুলাচ্ছে ইমতিয়াজ।

তানজিম শাফিন সাহেবকে খবর দিয়েছে। উনি হাসপাতালে আসতেই মৃত্তিকা ইমতিয়াজের বাধা উপেক্ষা করে গিয়ে উনার কলার টে°নে বলে,
“আমার বড়মণিকে ওই মে°রেছে, ও কেন এসেছে এখানে। বের হও, যাও।”

মৃত্তিকার ধা°ক্কা শাফিন পড়ে গিয়ে আবারো উঠে দাঁড়ায়। ইমতিয়াজ ওকে সরিয়ে নিয়ে আসে। মৃত্তিকা ইমতিয়াজকে বলে,
“উনি বড়মণিকে পয়°জন দিয়েছে।”

ইমতিয়াজ ওর মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বেশ শক্ত করে বলল,
“শান্ত হও, প্রুভ কি উনি পয়°জন দিয়েছে। এভাবে চিৎকার করে কিচ্ছু হবে না।”

মৃত্তিকা জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে কান্না নিয়ন্ত্রণ করে। ইমতিয়াজ ওকে চেয়ারে বসিয়ে বোতল থেকে পানি পান করায়। তারপর সে যায় আইসিইউর সামনে।

দুজনের পাকস্থলী থেকেই বি°ষ অপসারণ হয়েছে, কি বলে একে? ও হ্যাঁ, স্টোমাক ওয়াশ করা হয়েছে। তবুও বি°ষ°ক্রিয়া ভ°য়া°বহ থাকায় উনাদের দুজনের অবস্থাই আ°শং°কাজনক, বিশেষ করে লুৎফর রহমান বেশি ভ°য়া°বহ অবস্থায় আছে।

“ভাইয়া?”

তানজিমের শান্ত ডাকে ইমতিয়াজ তাকায়। তানজিম বলে,
“আপুকে নিয়ে তুমি চলে যাও।”
“প্রয়োজন নেই, মৃত্তিকা থাকুক। মায়ের এই অবস্থায় ওকে নিয়ে গেছে পাগলামি করবে।”
তানজিম আর কিছু বলে না।

অপরূপা হাসপাতালে এসেছে। সাধারণ একজন রোগীর সদস্য সেজে ওদের আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মৃত্তিকার চোখ ঠিকই ওকে দেখে নেয়। তবে তেমন কোনো সন্দেহের কারণ নেই।
______________________________________

ছোট ফুফু আম্বিয়া আর ফুপা জামিল এখনো আহনাফদের বাসায়ই আছে। সারাহ্-র শারিরীক অসুস্থতা দেখে আম্বিয়ার ঠিকই সন্দেহ হতে থাকে।

আজ সারাহ্ কলেজেও যেতে পারেনি। বমি করে করে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। বৃহস্পতিবার হওয়ায় আহনাফও কলেজ গ্যাপ দিতে পেরেছে। সকাল থেকে একটানা ঘুমাচ্ছে সারাহ্। অবশেষে খাবার খাওয়ার জন্য আহনাফ ওকে ডাকে।

“ঐশী, ঐশী (একটু থেমে) ওই সুন্দরী।”

সারাহ্ চোখ না খুলেই আহনাফের কাঁধে চা°পড় দেয়। আহনাফ হেসে ওর কপালে চুম্বন করে বলল,
“উঠো, কিছু খাবে।”
“ভালো লাগছে না।”

নিচুস্বরে কথাটা বলে আহনাফের গা ঘে°ষে শুয়ে পড়ে সারাহ্। আহনাফ ওকে টেনে তুলে বলল,
“খেতে হবে।”

সারাহ্ খোঁপা করতে গেলে আহনাফ বাধা দেয়। নিজে চিরুনি দিয়ে সুন্দর করে আঁচড়ে দিয়ে চুলে ক্লিপ লাগিয়ে দিলো আহনাফ। গ্লাস থেকে পানি ঠেলে নিজের হাত ভিজিয়ে সারাহ্-র মুখ মুছে দিয়ে বলে,
“খাবার আনছি।”

আহনাফ টেবিলের উপর থেকে স্যান্ডউইচের প্লেট আনে। সারাহ্-র সামনে প্লেট দিয়ে বলে,
“আমি বানিয়েছি।”

ঘুম অনেকটাই কে°টেছে তার। স্যান্ডউইচে কামড় দিয়ে বলল,
“বাসার কেউ দেখেনি?”
“দেখেছে, তবে ফুপ্পি মনে হয় কিছু বুঝেছে।”

অর্ধেকটুকু খেয়ে সারাহ্ বলে,
“আর না। ভালো লাগছে না।”

আহনাফ জোর করে না। সারাহ্ শুয়ে পড়লে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। সারাহ্ আহনাফের শার্টের কলার টে°নে কাছে এনে বলে,
“আজ পারফিউম দেননি?”
“না, তোমার অস্বস্তি হবে।”
“চিন্তা তো সব নিজের ছেলে-মেয়েদের জন্য।”
“সব না কিছুটা, সিংহভাগ তো তাদের মায়ের জন্য।”

সারাহ্ মনের অজান্তেই হেসে উঠে। নিজে থেকেই আহনাফকে কাছে নিয়ে আসে৷ আবার নিজেই লজ্জায় কুঁচকে যায়।

দরজা চাপিয়ে রাখা ছিল, পর্দা পুরোপুরি দিয়ে রাখা। পর্দা সরিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মিষ্টি মুহূর্তগুলো দেখে ফুপা জামিল। ফোন কানে নিয়ে বলে,
“সারাহ্ প্রেগন্যান্ট।”
“ঠিক এই ভ°য়টাই পেয়েছিলাম আমি।”
ফোনের ওদিকে থাকা অপরূপা জবাব দেয়।

জামিল পর্দা দিয়ে সরে আসার সময় হাতের ঘড়িটা দরজায় লেগে একটা মৃদু শব্দ হয়। জামিল দ্রুত জায়গা ত্যাগ করে। আহনাফ-সারাহ্ চমকে উঠে।

“কেউ এসেছিল নাকি?”
বলে আহনাফ উঠে যায়। দরজার ওপাশে কাছাকাছি কেউ না থাকলেও সদর দরজা দিয়ে জামিলকে বেরিয়ে যেতে দেখে।

“ফুপা এভাবে নক না করে রুমে এসেছিল?”
খুব ধীরে কথাটা বলে আহনাফ। কপাল তার কুঁচকে আছে।
______________________________________

রাত দশটা বেজে গেছে। হাসপাতালে এখনো বসে আছে মৃত্তিকা, তানজিম। ইমতিয়াজকে অফিসে যেতে হয়েছে। দুলাল ফেরদৌসী অফিসে এসেছেন, খবরটা পেয়েই যেতে হয়েছে। এখনো ফেরেনি।

অপরূপা মৃত্তিকার বিপরীতে একটা চেয়ারে বসে আছে। চোখেমুখে তার বি°ষন্নতা বিরাজ করছে।

শাফিন খাবার এনে তানজিমকে বলে,
“তোমরা খেয়ে নিবে আসো।”
“ক্ষুধা নেই মামা।”
নির্বিকার জবাব দেয় তানজিম।

“মিউকো?”

নামটা উচ্চারণের সাথে সাথেই মৃত্তিকা খাবারগুলো ছু°ড়ে ফেলে বলে,
“তোমার খাবার তুমি খাও, প্রয়োজনে রাস্তার কুকুরের মতো খাও। (একটু থেমে) কুকুরের থেকে কম নও তুমি।”

মৃত্তিকা হনহনিয়ে বেরিয়ে যায়। শাফিন রাগি চোখে কি°ড়মি°ড়িয়ে তাকায় ওর দিকে। তানজিমের চোখে বি°ষ্ময়। মৃত্তিকা বারবার শাফিনকে খুনি প্রমাণ করতে চাইছে কেন এটাই বুঝে উঠছে না তানজিম।

মৃত্তিকা রাস্তার পাশে এসে দাঁড়ায়। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা বার বার ওর দিকে তাকাচ্ছে। মৃত্তিক জানে ওটা ওর বাবারই লোক।

শরীফ এসে মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“জামাই কোথায়?”

মৃত্তিকা ছেলেটার দিকে ইশারা করে বলে,
“আপনার লোক জানায় নাই আপনাকে? (একটু থেমে) আর জামাই কি? ইমতিয়াজ বলেন।”

শরীফ হেসে বলে,
“আমার দোস্ত নাকি যে ইমতিয়াজ বলবো? আমার মেয়ের জামাই। অফিসে গেছে, আমি জানি।”
“মেয়ে আপনাকে মানে না আবার জামাই নিয়ে ডাকাডাকি।”

মৃত্তিকা রাস্তার দিকে নেমে গেলে শরীফ ওকে সরিয়ে এনে বলে,
“মায়ের মতো তুমিও চলে যেও না প্লিজ।”

মৃত্তিকা হাত সরিয়ে তাচ্ছিল্য করে বলল,
“মামকে যখন মা°রতেন, সি°গা°রেট জ্বালিয়ে ছ্যাঁ°কা দিতেন। তখন এই ভালোবাসা কোথায় ছিল? প্রতিরাতে যখন মাম চিৎকার করতো তখন প্রেম কোথায় ছিল?”

মৃত্তিকা ভিতরে যাওয়ার সময় ইমতিয়াজকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে দাঁড়ায়। ইমতিয়াজ শরীফকে লক্ষ্য করে।

“চলো।”
দুজনে ভিতরে চলে যায়। শরীফ বাইরে একা দাঁড়িয়ে থাকে।

সিঁড়ি দিয়ে উপরে যেতে যেতে মৃত্তিকা বলে,
“এবার আমি শিউর এসবে মামার হাত আছে। বড়মণির মতো শান্ত আর ভালো মানুষের সাথে কার শ°ত্রুতা থাকবে বলেন?”

ইমতিয়াজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আমার মনে হচ্ছে এবারে একটা বড় ধরনের অ্যা°ক°শন নেয়া উচিত।”
“তারচেয়ে একরাতে আমার থা°র্ড ডিগ্রিতে এমনিতেই মুখ খুলবে।”
“মৃত্তিকা।”

ইমতিয়াজের কড়া ভাষা শুনে মৃত্তিকা থেমে যায়। ওকে একহাতে আগলে নিয়ে বলল,
“ধৈর্য রাখো, এতো অধৈর্য হলে সমস্যা বাড়বে বৈ কমবে না।”
______________________________________

সকলে রাতের খাবার খেয়ে নিয়েছে। সকল প্লেট-বাসন নিয়ে রান্নাঘরে ধুতে গেছে সারাহ্। আম্বিয়া গিয়ে বলে,
“আমি সাহায্য করি?”

সারাহ্ একটু সরে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি করে নিবো, আপনি চাইলে হেল্প করতে পারেন।”

আম্বিয়া হেসে কাজ করতে করতে বলে,
“প্রে°শার কমে কেন হঠাৎ?”
“জানি না।”
“আহনাফ বলল তো তুমি খাওয়া দাওয়া করো না, ঠিকমতো ঘুমাও না।”

সারাহ্ মুচকি হাসে। আহনাফ রুমে যাওয়ার সময় জামিলকে রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে। আবারো নিজের ফোনে একটা ছবিও তুলে। জামিলের নজরটা খেয়াল করে আহনাফ রেগে যায়।

রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে জোরে চেঁচিয়ে বলল,
“ঐশী, এক্ষন রুমে আসো।”

সারাহ্ চমকে উঠে। আহনাফ এমন রাগ করে কখনো ডাকে না তো। সারাহ্ দ্রুত রুমে আসে।

“কি হয়েছে?”

আহনাফ দরজা লাগিয়ে দিয়ে সারাহ্-কে কাছে টে°নে এনে বলল,
“চুপ, একটা কথাও বলবা না। কাজ খালা এসে করবে, তোমার কিছু করা লাগবে না।”
“আহনা..”

সারাহ্-র ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে চুপ করিয়ে দিয়ে বলে,
“চুপ থাকতে বলেছি কিনা?”
“কেন রাগ হয়?”

আহনাফ দরজাটা একটু খুলে। সারাহ্-কে বলে,
“রুমে থাকবা, দরজার ওপাশে গেছো তো দেখবা কি করি?”

আহনাফ রুম থেকে বেরিয়ে যায়। সারাহ্ বিছানায় গিয়ে বসে। আহনাফের এ ধরনের আচরণ ওকে বারবার অবাক করে।

“ফুপা, বাইরে যাবেন?”

আহনাফের ডাকে আব্বাস সাহেব বললেন,
“কেন আহনাফ? রাতের বেলা বাইরে কি?”
“এমনিই বাবা, একটু হাঁটতে যেতাম আরকি। ভাবলাম ফুপাকে নিয়ে যাই।”

আব্বাস সাহেব হাসলেন। বলেন,
“ওহ, জামিল যাও।”

আহনাফ আগে আগে বেরিয়ে গিয়ে কল দিলো ওর ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ুয়া এক ছাত্রকে। তাকে কয়েকজন এলাকার ছেলে আর ব্যাট নিয়ে এদিকে আসতে বলে আহনাফ ফোন রাখে।

জামিল বেরিয়ে এসে বলল,
“কোথায় যাবে?”

আহনাফ মুখ টি°পে হেসে বলে,
“সামনেই।”

কুমিল্লা শহরে রাতেও লোকজন চলাচল করে। আহনাফ মেইনরাস্তা ছেড়ে খোলা মাঠের দিকে যায়। মাঠে ছেলেগুলো অপেক্ষা করছে। আহনাফকে দেখে হাত নাড়া দেয়।

“ওরা কারা?”
“আমার স্টুডেন্ট।”

আহনাফ গিয়েই এক ছেলের হাত থেকে ব্যাট নিয়ে জামিলের পায়ে বা°রি দিয়ে ফেলে দেয়। বেশ জোরেই দুই তিনটা বা°রি দিয়ে ফেলে।

“এসব কোন ধরনের অ°সভ্যতা আহনাফ?”

আহনাফ আবারো জামিলের পায়ে বা°রি দিয়ে বলল,
“ঐশীর দিকে বারবার তাকানোর সাহস কেন করছো তুমি?”
“বউ প্রেগন্যান্ট বলে এতো কেয়ার?”

আহনাফ বসে তার মুখে কয়েকটা ঘু°ষি দিয়ে দেয়। জামিলের ফোন বেজে উঠে। জামিল ধরার আগেই আহনাফ ছোঁ দিয়ে ফোন নিয়ে ছেলেগুলোকে ইশারা করে ওকে আটকাতে।

অপরূপা নামটা দেখে রিসিভ করলে অপরপাশ থেকে নারী কন্ঠ বলে উঠে,
“ছবিটা ভালো এসেছে। লাস্ট কাজ, সারাহ্-কে উঠিয়ে নিয়ে আসো।”

আহনাফ জামিলের দিকে রাগি চোখে তাকায়। অপরূপা বলে,
“শুনতে কি পারছো না আমি কি বলছি?”
“ঐশীর দিকে নজর দিও না, ফলাফল খারাপ হবে।”

আহনাফ কল কে°টে জামিলকে বলে,
“কে এটা?”

জামিল হেসে বলল,
“জানতে পারবে না, আহনাফ। তোমার স্ত্রী আর বেবিকে বেশিদিন দেখতে পারবে না। তাহসিনার কাছেই পাঠিয়ে দিবো।”

তড়তড় করে রাগটা বেড়ে যায় আহনাফের। জঘন্যভাবে মা°রে জামিলকে। নিজেও হাতে ব্য°থা পায়। জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে নিতে ফিরে আসে।

আবারো ফিরে গিয়ে বলল,
“কেন করছো এসব?”
“তোমার শাশুড়িকে জিজ্ঞাসা করো।”

আহনাফের মনে পড়ে তানজিমের সেই কথা, তোমার বিয়েটাও পরিকল্পিত। সারাহ্-র শোনা সেই কথা আর নার্গিস পারভিনের অস্বাভাবিক আচরণ।

দ্রুত বাসায় আসে আহনাফ। আব্বাস সাহেব ওকে একা দেখে জিজ্ঞাসা করে,
“জামিল কোথায়?”

আহনাফ দুই আঙ্গুল তুলে বলল,
“স্মো°কিং করছে।”

আহনাফ রুমে চলে যায়। সারাহ্ ফোনে কোনো একটা ভিডিও দেখছে। আহনাফ রুমে আসায় ফোন রেখে বলল,
“কোথায় গিয়েছিলেন?”

আহনাফ এসে ওকে জড়িয়ে ধরে। সবকিছু এখনো ওর কাছে অগোছালো। এলোমেলো থাকাটাই স্বাভাবিক।

সারাহ্ বলল,
“কি হয়েছে?”

সারাহ্-র দিকে তাকিয়ে ওর গালে হাত রেখে বলল,
“আমি জানি না কি আমার কি হয়েছে।”
“কোথায় গিয়েছিলেন?”
“মিস করছিলে খুব?”

সারাহ্ ওর বুকে একটা ধা°ক্কা দিয়ে বলে,
“ধুর।”
______________________________________

একসপ্তাহ পেরিয়ে গেল। মমতাজ বেগম আর লুৎফর রহমান সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে এসেছে। মৃত্তিকা উনাদের বাসায়ই আছে। উনাদের সেবাযত্ন করার মতো কেউ তো নেই এখানে। তানজিম যদিও এতে রাজি ছিল না, তবে তেমন একটা বাধাও সে দেয়নি।

রাত সাড়ে আটটা, অফিস শেষে ইমতিয়াজ বাসায় আসে৷ আগের চাকরি ছেড়ে দিয়ে কোম্পানির কাজে পুরোপুরি মনোযোগ দিচ্ছে সে। রমজানের পর ট্রেনিংয়ের জন্য অস্ট্রেলিয়া যাবে সে।

বেল বাজালে তানজিম এসে দরজা খুলে। ইমতিয়াজ ভিতরে যায়। তিনরুমের বাসায় তাহমিনার সাথে ইমতিয়াজ যে রুমে থাকতো সেখানেই দুইদিন ধরে থাকছে মৃত্তিকার সাথে। বিষয়টা স্মৃ°তিতে আ°ঘা°তের মতো হলেও শক্ত মানসিকতার ইমতিয়াজ এসব সহ্য করতে পারে। দিনটুকুই কেবল থাকা হয়, রাতে মৃত্তিকা মমতাজ বেগমের সাথেই সাথে আর লুৎফর রহমান থাকে তানজিমের সাথে।

ইমতিয়াজ ফ্রেশ হয়ে আসে। মৃত্তিকা এসে জিজ্ঞাসা করে,
“দুলাল ফেরদৌসীর কি খবর?”

ইমতিয়াজ শার্ট খুলতে খুলতে বলল,
“কি আর হবে? আমাকে হেয় করার যত প্রকার উপায় আছে সব কাজে লাগাচ্ছে।”

মৃত্তিকা গিয়ে ওর শার্টের বোতামগুলো একে একে খুলে দেয়। শার্টটা হ্যাংগারে ঝু°লিয়ে দিয়ে বলে,
“কি বলে আবার?”
“কি আর? ওই বউয়ের কোম্পানিতে আছো। (একটু থেমে) আই ডোন্ট কেয়ার, যা খুশি বলুক।”

মৃত্তিকা ফিরে তাকিয়ে আলতো হাসলো। বলে,
“হাতমুখ ধুয়েছেন?”
“হুম।”

মৃত্তিকা বেরিয়ে যেতে নিলে ইমতিয়াজ বলল,
“মামা এসেছিল?”
“এসেছিল, দুপুরে একগা°দা গিলে গেছে।”
“কেইসটা ক্লোজ করে দিয়েছে, সমস্যা দুধটা মেয়াদ উত্তীর্ণ ছিল এটা বলেছে।”

মৃত্তিকা এগিয়ে আসে।
“দুধ মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে ছানা কে°টে যায়।”
“সমস্যা তাদের কে বোঝাবে?”

হঠাৎ লোডশেডিং হলো, কিন্তু জেনারেটর চালু হলো না।

“জেনারেটরের আবার কি হলো?”

মৃত্তিকা ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বা°লালো। ইমতিয়াজ ফোনটা খাটে ছু°ড়ে ফেলে মৃত্তিকাকে কাছে টা°নে। দুজনে কাছাকাছি, নিশ্বাসটুকুও মিলেমিশে একাকার। একই চাহিদা, একই আবেগ দুজনের। মৃত্তিকার কেঁপে উঠা ওষ্ঠোধর প্রথমবারের মতো কোনো পুরুষের ওষ্ঠের স্পর্শে সিক্ত হয়। দুরত্বটুকু শেষ করার ইচ্ছায় দুটো মন যখন পাগল হয়ে উঠে তখনই মমতাজ বেগম মৃত্তিকাকে ডেকে বলে,
“মিউকো, লাইট জ্বা°লিয়ে দিয়ে যাও।”

মৃত্তিকা সরে আসতে চাইলে ইমতিয়াজ ওকে আরো কাছে নিয়ে নেয়। আবারো মমতাজ বেগম ডাক দিলে ইমতিয়াজ হাতের বাঁধন হালকা করে, মৃত্তিকা উঠে চলে যায়।

চার্জার লাইট জ্বা°লিয়ে মমতাজ বেগমের রুমে দিয়ে মৃত্তিকা রান্নাঘরে চলে আসে। নিজেকেই যেন লজ্জা লাগছে তার।

চলবে….

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

ত্রয়োত্রিংশ পর্ব (৩৩ পর্ব)

রাতের খাবার টেবিলে সাজাচ্ছে মৃত্তিকা। ইমতিয়াজ এসে চেয়ার টে°নে বসে ওর দিকে না তাকিয়েই বলল,
“পালিয়ে আসলে যে আর গেলে না?”

মৃত্তিকা চমকে উঠে তাকায়। লজ্জায় লাল হয়ে গেছে মেয়েটা। ইমতিয়াজ মুখ টি°পে হাসে। তানজিম এসে বসতে বসতে বলল,
“ক্ষুধা লাগছে। খাবার রেডি?”

মৃত্তিকা কিছু না বলে মমতাজ বেগম আর লুৎফর রহমানের প্লেট সাজিয়ে নিয়ে যায়। শান্ত পরিবেশে খাওয়া দাওয়া শেষ হয়। তানজিম সব থালাবাসন ধুয়ে রেখে মৃত্তিকাকে বলে,
“আপু আমার কিন্তু মিডটার্ম এক্সাম শুরু রবিবার থেকে, সো আমি পড়বো আজকে সারারাত। ফজরের সময় ডেকে দিও।”

মৃত্তিকা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। শিল্পা ইউনুস, মৃত্তিকার পিএ ওকে কল দেয়ায় মৃত্তিকা কথা বলতে গিয়েও থেমে যায়।

“ম্যাম।”
“ইয়েস।”
“ম্যাম, আপনি একবার অফিসে আসলে ভালো হয়।”

মৃত্তিকা অবাক হয়। ইমতিয়াজ যেহেতু যাচ্ছে তাই ওর যাওয়ার কি প্রয়োজন।

“কেন শিল্পা?”
“ম্যাম, দুলাল স্যার আজ চারদিন হলো অফিসে আসে না আর উনার বাসা গিয়েছিলাম আজকে, উনারা জানিয়েছে উনি নাকি অফিসের কাজে জার্মানি গেছেন। কিন্তু এমন কোনো প্রোগ্রাম তো এখন নেই, আবার ইমতিয়াজ স্যার এটা নিয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হয়নি।”

মৃত্তিকা কপাল কুঁচকায়। ইমতিয়াজ একটু আগে ওকে বলেছিল দুলাল ফেরদৌসী অফিসে আসে, তাকে হে°য় করে। তবে শিল্পা কেন বলছে দুলাল অফিসে আসে না?

“আচ্ছা, শিল্পা। আমি আসতে চেষ্টা করবো, না আসলেও অফিসের কাজ যেন বন্ধ না হয়।”
“ওকে ম্যাম।”

মৃত্তিকা রুমে এসে নক করে বলে,
“আসবো?”
“আসো।”

ইমতিয়াজের অনুমতি পেয়ে মৃত্তিকা ভিতরে প্রবেশ করে। ইমতিয়াজ বিছানায় শুয়ে বিড়ালটার সাথে খেলছিল। মৃত্তিকাকে দেখে রেখে উঠে বসে বিড়ালকে নিচে ছেড়ে দেয়।

মৃত্তিকা ওর মুখোমুখি বসে বলল,
“দুলাল ফেরদৌসী অফিসে আসে না কয়দিন?”

ইমতিয়াজ হেয়ালি করে বলে,
“এসেছিল, আর যেতে দেইনি।”
“মানে? আ°টকে রেখে মি°থ্যা ছড়িয়েছেন?”
বি°ভ্রা°ন্তি নিয়ে চোখ ছোট করে মৃত্তিকা।

ইমতিয়াজ হেসে বলে,
“বিশ্বাস রাখো। কথা জানবো যেহেতু বলেছি সো জেনেই ছাড়বো। (একটু থেমে) তোমার ওয়েতেই জানবো, চিন্তা নেই।”
“কোন ওয়ে?”
“থা°র্ড ডিগ্রি।”
বলে ইমতিয়াজ চোখ টিপ দেয়।

মৃত্তিকা চোখ বড় করে তাকিয়ে বলল,
“তারমানে তাকে আপনি মে°রেছেন? কোথায় আছে এখন?”
“শিল্পাকে জিজ্ঞাসা করলে এটার এন্সারও বুঝে যেতে।”
“আহা, ক্লিয়ার করুন।”

মৃত্তিকাকে কাছে নিয়ে আসে ইমতিয়াজ। বলে,
“হুশ, এতো কথা বলতে পারবো না।”

ইমতিয়াজের কথার ভাষায় হঠাৎ বিরাট এক পরিবর্তন। মৃত্তিকাও কথা বলে না, চুপটি করে মাথা নুইয়ে ফেলে।

ডানহাতের তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে মৃত্তিকার ঠোঁটে স্পর্শ করে। ইমতিয়াজের টিশার্ট খা°মচে ধরে চোখে চোখ রাখে মৃত্তিকা, যেন বলতে চাইছে “পাগল করে দাও আমাকে।”

নিরব মৃত্তিকার চোখের ভাষা ইমতিয়াজ বুঝে ফেলে। আবারো এক হয় তাদের ওষ্ঠোধর জোড়া। এবারে ইচ্ছাকৃতভাবে আলো নিভিয়ে দেয় ইমতিয়াজ। অন্ধকারে নিরব কক্ষে দুজন নর-নারীর নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে, ক্রমশ কাছে আসছে দুজন। একই চাওয়া, একই পাওয়া, একই কথা বলার ইচ্ছা। কিন্তু দুজনে চুপ। ইমতিয়াজের হাতের স্পর্শে নিজের হু°শ জ্ঞান হারিয়ে বসেছে মৃত্তিকা। যেন মধ্যিখানের সব দুরত্ব আজকেই শেষ করবে সে।

ইমতিয়াজের ফোন বেজে উঠে। হঠাৎ শব্দে মৃত্তিকা সরে যায়, নিজেকে গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়। শরীফের নাম্বার দেখে ইমতিয়াজ রিসিভ করে।

“জি, বলেন।”
“দুলাল নেই এখানে, সম্ভবত পালিয়েছে।”

ইমতিয়াজ রেগে যায়। তবুও নিজেকে শান্ত রেখে বলে,
“বের হওয়ার উপায় কম, সে রাস্তা খুঁজছে বোধহয়। (একটু থেমে) আচ্ছা, আমি আসছি।”

ইমতিয়াজ ফোন রেখে উঠে শার্ট পড়তে পড়তে বলে,
“আমি একটু বাইরে যাচ্ছি, আসতে দেরি হবে বা রাতে নাও আসতে পারি।”
“যাচ্ছেন কোথায়? কে কিসের রাস্তা খুঁজছে?”
মৃত্তিকার চোখেমুখে কৌতুহল।

“ফিরে এসে বলছি।”
কথাটা বলেই ইমতিয়াজ বেরিয়ে গেল। মৃত্তিকা সদর দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়।

ইমতিয়াজ সোজা ফ্যাক্টরির গোডাউনে এসেছে। শরীফ এখানেই দাঁড়িয়ে আছে। ইমতিয়াজ এসে ধ°মকে উঠে বলল,
“আপনার এতো লোকজন কি শুধু মৃত্তিকার জন্য? একটা মানুষকে দেখে রাখতে পারেন না?”

শরীফ বলে,
“খুঁজে দেখছে ওরা।”

ইমতিয়াজ কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দুলালকে সে আর শরীফ মিলে চারদিন আগেই পা°কড়াও করেছে। বেঁধে রেখেছে ফ্যাক্টরির গোডাউনে, খাবার বলতে শুকনা মুড়ি আর পানি। আর নিয়ম করে তিনবেলা অ°সহ্য মা°র মেরেছে, তবুও সে এখনো মুখ বন্ধ করে রেখেছে।

ঘন্টা খানেক পর দুলালকে খুঁজে পাওয়া যায়। দুর্বল শরীরে বেশিদূর যেতে পারেনি। হাতপা বেঁধে এনে ফেলা হয়।

ইমতিয়াজ ঠোঁট উলটে শরীফকে বলে,
“আপনি ডাক্তার হয়েও মা°স্তা°নিতে সেরা।”
“শিখে না এসব, আমার মেয়েটা ভ°য় পাবে।”

ইমতিয়াজ মুচকি হাসে। একটু আগের মৃত্তিকার মলিন চেহারা মনে পড়ে তার। আবারো সেই লাজুক চোখের কথা ভেবে হাসি পায়।

দুলালের কথায় ঘোর কাটে,
“কতদিন আ°টকে রাখবে? বের কি আমি হবো না নাকি?”

ইমতিয়াজ হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“হ্যাঁ, সাদা কা°ফ°নে মুড়ে বের হলে হতে পারো। তবে যদি মুখ না খুলো তবে তাও পারবে না।”
“মুখ খুললেও মা°রবে?”
“মৃত্তিকাকে কেন মা°রতে চেয়েছিলে?”

দুলাল কঠিন কন্ঠে বলে,
“ভুল এটাই করেছিলাম আমরা। তাহমিনা আর তাহসিনার সাথেই কবরে গেছে সব সত্যটা, মৃত্তিকা তো কিছুই জানেনি। ওকে মা°রতে গিয়েই ভুল করেছি, সব আবারো জানাজানি হয়েছে।”

ইমতিয়াজের দিকে এগিয়ে এসে বলে,
“তাহমিনা কিন্তু মৃত্তিকার থেকে বেশি চতুর ছিল, আর অতি চালাকের গলায় সবসময়…”

দুলালের গালে চ°ড় বসায় ইমতিয়াজ। শরীফকে বলে,
“ওকে পানি, খাবার কিছুই দেওয়া হবে না।”
______________________________________

পরদিন সকাল সকাল ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে আহনাফ ও সারাহ্। সারাহ্-কে একা রেখে আহনাফ আসতে পারবে না। আহনাফ চিন্তিত ওকে নিয়ে।

সারাহ্ ওর কাঁধে মাথা রেখে বলল,
“এতো কি নিয়ে চিন্তা করেন?”

সারাহ্-কে একহাতে জড়িয়ে ধরে আহনাফ বলে,
“কিছু না।”

আহনাফ সামিহাকে কল দেয়। সামিহা রিসিভ করেই বলে,
“ভাইয়া, আপনারা কোথায় আছেন?”
“চান্দিনার কাছে, তুমি কি আজ বাসায় না?”
“হ্যাঁ, ভাইয়া। শুক্রবার কোথায় আর যাবো।”
“গুড, বাসায়ই থাকবা।”

আহনাফ ফোন রাখলে সারাহ্ বলল,
“হঠাৎ ঢাকায় কেন যাচ্ছি আমরা?”
“পড়ে বলবো।”

খুব একটা কষ্ট হয় না ওদের ঢাকায় পৌঁছাতে। মতিঝিল সারাহ্-র বাসায় এসে আহনাফ নার্গিস পারভিনের সাথে কথা বলতে যায়। জাহাঙ্গীর সাহেব বাসায় নেই। দুইবোন নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতায় ব্যস্ত।

নার্গিস পারভিন রান্নাঘরে কাজ করছেন। আহনাফ গিয়ে দরজায় নক করে ডেকে বলল,
“মা, কথা আছে একটু।”

উনি তো চমকে উঠেন। জামাই কিনা শেষে রান্নাঘরে এসে উনাকে ডাকছে।

“আসছি।”

নার্গিস পারভিন চুলা নিভিয়ে ড্রইংরুমে গেল। আহনাফ সোফায় বসেছে, উনিও বসেন। আহনাফ সরাসরি প্রশ্ন করে,
“সারাহ্-কে কেউ কেন কি°ড°ন্যাপ করতে চায়? কি জানেন আপনি?”

নার্গিস পারভিন চমকে উঠেন। উনার মেয়েকে কেউ অ°প°হরণ করতে চায়, এ ধরনের কথা শুনে হতবাক হন।

“জামিল আমাকে বলেছে কারণ আপনি জানেন, কি জানেন আপনি?”

নার্গিস পারভিন বুঝতে পেরেছেন কিছুই আর লুকানোর সময় নেই। পুরোনো ইতিহাসে টা°ন যেহেতু পড়েছে, তাই ইতিহাসের ইতি টা°নতেই হবে। আজ যদি উনি চুপ থাকেন তবে হয়তো উনার মেয়েকে হারাবেন।

আহনাফ নিচুস্বরে বলল,
“ঐশী প্রেগন্যান্ট মা, ও কিন্তু একা হারাবে না।”

নার্গিস পারভিন আরো চমকে উঠেন। খুশির সংবাদ শুনেও হাসবেন নাকি কাঁদবেন বুঝতে পারেন না। শান্তভাবে জবাব দেয়,
“সবটাই বলবো, কিন্তু সমাধান আমার কাছে নেই।”
“আপনি শুধু বলুন মা।”

অসহায় কন্ঠের অনুরোধ আহনাফের। তাহসিনার মতো আরো একটা প্রাণ ঝ°রবে, ওর ভালোবাসা টুপটুপ করে ঝ°রে পড়বে।

জাহাঙ্গীর সাহেব বাসায় আসলেন। আহনাফকে দেখে ওর সাথে কোলাকুলি করেন। নার্গিস পারভিন এখন আর কথাটা বলতে পারে না।
______________________________________

সন্ধ্যায় ইমতিয়াজ আবারো গোডাউনে আসে। এখন সঙ্গে মৃত্তিকাও এসেছে। শরীফ এখানে নেই, তবে তার দুজন লোক এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ইমতিয়াজ ওদেরকে বাইরে যেতে ইশারা করে।

সারাদিন পানি না খেয়ে দুলালের গলা ঠনঠন করছে। ঢোক গিলে বারবার জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিচ্ছে, কিন্তু তার চোখেমুখে অসহায়ত্ব।

মৃত্তিকা একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। ইমতিয়াজ তার সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে বোতল খুলে পানি পান করে বলল,
“পানি খাবে?”
“হ্যাঁ।”
মাথা নেড়ে মলিন সুরে বলল দুলাল।

ইমতিয়াজ বোতলের পানি তার সামনে ঢালতে থাকে। জিভ বের করেও পানি মুখে নিতে পারে না দুলাল। ইমতিয়াজের এমনরূপ মৃত্তিকা আগে দেখেনি। এতোটা ভ°য়ং°করভাবে কাউকে কষ্ট দিচ্ছে সে।

পুরো বোতলের পানি ঠেলে ইমতিয়াজ বলে,
“একটুও ভিতরে যায়নি। আরেক বোতল আছে।”

আরেকটা বোতল এনে একটু দূরে রেখে বলল,
“একটা একটা করে কথা বলবে আর বোতলটা এগুবে। (একটু থেমে) শুরু করো।”

দুলাল মৃত্তিকার দিকে তাকালো। মৃত্তিকা মুখ ফিরিয়ে নেয়। এসব মানুষের কষ্ট প্রাপ্য। কর্মের ফল এগুলো। বিয়ের দিন একটা মেয়ের স্বপ্ন ধ্বং°স করার শা°স্তি এটা, স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখে থাকতে চাওয়া মেয়েটার সুখকে শেষ করার শা°স্তি এটা, একটা মেয়ের থেকে তার প্রাণপ্রিয় মাকে কে°ড়ে নেয়ার শা°স্তি এটা।

“মুখ খুলবে না, তবে এটাও ফেলে দিই।”

ইমতিয়াজ বোতলটা ধরতেই দুলাল বলে,
“বলছি আমি।”
“বলো।”

ইমতিয়াজ দুলালের মুখোমুখি একটু দূরে বোতলটার কাছে বসে পড়ে। দুলাল আড়চোখে মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে বলে,
“ওকে যেতে বলো।”

ইমতিয়াজ বোতলটা হাতে নিয়ে বলে,
“বলো, আমার এতো সময় নেই।”

দুলাল আর কোনো উপায় না পেয়ে বলা শুরু করে। মৃত্তিকাও মোবাইলের ভিডিও চালু করে।

“খু°নের সময় আমি উপস্থিত ছিলাম। এমনকি শাফিনও ছিল। রোড এ°ক্সি°ডেন্ট ছিল না ওটা, আলাদাভাবে খু°ন করে এ°ক্সি°ডেন্টের নাটক বানানো হয়েছে।”

মৃত্তিকা একহাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে। আলাদাভাবে খু°ন হলে কতই না কষ্ট পেয়েছে ওরা। ইমতিয়াজ ঢোক গিলে তাকিয়ে থাকে।

“শাফিন আর আমার একটা বিজনেস আছে। অন্ধকার জগতের বিজনেস সেটা৷
“কি বিজনেস? ড্রা°গস?”

দুলাল ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল,
“তারসাথে আরেকটা ভালো বিজনেস হলো নারী। দামী বস্তুর চেয়েও হাজারগুণ দামী। (ঢোক গিলে) তাহসিনার সাথেও একই কাজ করতে চেয়েছিল শাফিন, তাই ওর বিয়েটা সে মানতে পারেনি। (একটু থামে) বিয়ের দিন তাহসিনাকে উঠিয়ে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ব°দ°নাম দিতে চেয়েছিল। তাহমিনা জেনে গিয়েছিল আমাদের প্ল্যান, তাই এটা নিয়ে ঝা°মেলা করেছিল সে।”

ইমতিয়াজের মনে পড়ে বিয়ের আগের দিন তাহমিনা চিন্তিত ছিল, অন্যদিনের চেয়ে চুপচাপ হয়ে ছিল। ইমতিয়াজ ভেবেছিল বোনের বিয়েই তার কারণ। সে চোখ বন্ধ করে।

দুলাল বলে চলছে,
“তাই দুইবোনকে একজায়গায় শেষ করে দিয়েছে। (একটু থেমে) যা জানতাম সবই বলেছি, এখন একটু পানি দাও।”

মৃত্তিকা ভিডিও সেভ করে ফোন ব্যাগে রাখে। ইমতিয়াজ বোতল খুলে তাকে পানি খাইয়ে দেয়, তবুও হাত খুলে না। পানি পান করে দুইবার কাশি দেয় দুলাল।

ইমতিয়াজ উঠে দাঁড়িয়ে মৃত্তিকাকে বলে,
“চলো, যাই আমরা। বাকিটুকু সে কাল বলবে।”

দুজনে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে, দুলাল আবারো বলে,
“বাকিটুকু হলো তাহমিনাকে মা°রার আগে রে°প করা হয়েছিল। ইমতিয়াজ, ইমতিয়াজ করে চিৎ°কার করেছিল সে। তাহমিনাকে মা°রা লাগেনি, অতিরিক্ত র°ক্ত°ক্ষরণে সে এমনিতেই মা°রা গেছে।”

ইমতিয়াজ থমকে দাঁড়ায়। যেন একমুহূর্তে পুরো পৃথিবী স্থির হয়ে গেছে। মৃত্তিকা চেয়ে রইলো ইমতিয়াজের দিকে। মানুষটা কিভাবে সহ্য করবে এটা?

“রে°পটা কিন্তু শাফিনই করেছে।”

মৃত্তিকা পিছিয়ে গিয়ে একটা কার্টুন বক্সের সাথে ধা°ক্কা খায়। মামা তার খারাপ, তাই বলে এতোটা?

ইমতিয়াজ ফিরে গিয়ে দুলালের নাকে মুখে এলোপাতাড়ি ঘু°ষি দেয়। নাকমুখ দিয়ে সমানে র°ক্ত পড়তে থাকে তার। ইমতিয়াজের মুখে একটাই কথা,
“এসব মি°থ্যা, বল মি°থ্যা এসব।”

শরীফ এসে এ অবস্থা দেখে ইমতিয়াজকে ধরে সরিয়ে আনে। র°ক্তা°ক্ত মুখ নিয়ে দুলাল বলে,
“সবটাই সত্য।”

ইমতিয়াজ শান্ত হয়ে গেছে। তাহমিনা ওকে ডেকেছিল, প্রাণপণে ডেকেছিল অথচ সে সারা দেয়নি।

“মিনার মৃ°ত্যু আমার জন্য হয়েছে।”
আপনমনে বিড়বিড় করে ইমতিয়াজ। তারপর দাঁড়ানো অবস্থা থেকে সোজা বসে পড়ে।

শরীফ ধরার আগেই মৃত্তিকা দৌড়ে গিয়ে ওকে ধরে ফেলে।
“নিজেকে ব্লেইম করবেন না।”
“আমি দোষী, আমাকে মে°রে ফেলো মৃত্তিকা। আমার সন্তান আমাকে ডেকেছে, আমার মিনা আমাকে ডেকেছে, আমি যাইনি তাদের কাছে।”

সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলেছে ইমতিয়াজ। মৃত্তিকা ওর মাথা নিজের বুকে চেপে ধরে। এমন সত্য সহ্য করা কার পক্ষে সম্ভব? মৃত্তিকার দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে।

ইমতিয়াজ মৃত্তিকাকে সরিয়ে উঠে বাইরে চলে আসে। মৃত্তিকা পিছুপিছু আসলে বলল,
“এসো না তুমি, এই কাপুরুষের কাছে এসো না। যে তার স্ত্রী-সন্তানকে রক্ষা করতে পারে না, তার কাছে এসো না।”
একপ্রকার দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলো মৃত্তিকাকে।
______________________________________

“আমার এক ফ্রেন্ড ছিল, রিপা। দেখা হয়েছে বহু আগে। মূলত এসব ঘটনা ওর জীবন থেকে শুরু হয়েছে আর শেষটা হয়েছে কলেজে।”

নার্গিস পারভিন, জাহাঙ্গীর সাহেব আর আহনাফ তিনজনে ছাদে এসেছে কথা বলতে। মূলত আহনাফ সারাহ্-কে কোনো চিন্তায় এখন ফেলতে চায় না বলেই এখানে এনেছে উনাদের। একটু আগের কথাটা নার্গিস পারভিনই বলেছেন।

“কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে অনার্স করেছি আমি। রিপাও ওখানে পড়েছে। রিপার গ্রামের বাড়ি ছিল খুলনায়, কিন্তু পড়াশুনা কুমিল্লায়। (একটু থামে) একসময় ওর পরিবার কুমিল্লা শিফট হয়, ওর ভাই এক চরিত্র°হীন লোক ছিল।”

আড়চোখে জাহাঙ্গীর সাহেবের দিকে তাকায়। নিচুস্বরে বলেন,
“আমার অন্য দুই ফ্রেন্ড শুধু তার খারাপ প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় প্রাণ হারায়। কিন্তু বিষয়টা তখন খু°নের মতো লাগেনি, বরং আ°ত্ম°হ°ত্যা লেগেছে। তার প্রায় দশবছর পর রিপা আমাকে জানায় এসব খু°ন। ও নিজে তার ভাইয়ের থেকে গোপনে শুনেছি আর ওর আসল নাম নাকি রিপা ছিলই না, রাহা সুলতানা ছিল ওর নাম।”

নার্গিস পারভিন দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। মাথা নেড়ে বলেন,
“দুনিয়া গোল রিপা বারবার আমার আর রোমির সাথে দেখা করতো, কয়েকটা প্রমাণও দিয়েছিল রোমিকে। এই যেমন কিছু সন্দেহজনক ফটোগ্রাফ আর ভিডিও, যদিও আমি তা দেখিনি। শেষবার যখন সে ঢাকায় আসে তখন আমাকে বলেছিল ওরা আমাদের কথা জানতে পারলে খারাপ হবে। সাবধানে থাকতে। আমার মনে হয় সারাহ্-র উপর এরই প্রভাব।”

জাহাঙ্গীর সাহেব রেগে গিয়ে বলেন,
“এতোদিন আমাকে জানাও নি কেন?”

আহনাফ শান্তসুরে বলে,
“মা, আপনি হয়তো কোথাও ভুল। এর সাথে সারাহ্-র কি সংযোগ আর আমার কি সংযোগ?”
“সারাহ্ আমাকে একটা কথা জানিয়েছিল একবার, ও এয়ারপোর্টে যা যা শুনেছে তা নিয়ে। তখনও আমার এটাই মনে হয়েছিল।”

জাহাঙ্গীর সাহেবের কপাল কুঁচকে আসলো। বললেন,
“এটা মনে হওয়ার কোনো বিশেষ কারণ?”
“রিপার ভাই হয়তো জানতো রিপা আমাদের সাথে দেখা করে।”

আহনাফ মাথা নেড়ে না বোঝায়। এসব বিষয় আর সারাহ্-র বিষয়টা ওর আলাদা লাগছে। আবারো জিজ্ঞাসা করে,
“জামিলের সাথে রিলেটেড কোনো ঘটনা আছে?”

নার্গিস পারভিন একটু ভেবে বলেন,
“জামিল নামের কাউকে আমি চিনি না, তবে রিপার ভাইয়ের নাম শাফিন ছিল।”
“শাফিন?”
“হ্যাঁ।”

আহনাফ চমকে উঠে। রিপা, শাফিন নামদুটোই তার চেনা। এরা তাহসিনার খালা আর মামা নয়তো? তবে তো তানজিমের কথাই ঠিক, সবকিছুই পরিকল্পিত। তার অর্থ তানজিম আরো অনেক কিছু জানে।

চলবে…..

অনুভূতিরা শব্দহীন পর্ব-২৮+২৯+৩০

0

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

অষ্টাবিংশ পর্ব (২৮ পর্ব)

“রাত কয়টা বাজে দেখেছেন? ১২ টা বেজে গেছে। এখনো এই বই নিয়েই পড়ে আছেন।”

সারাহ্ আপন মনে আহনাফকে বকাবকি করে যাচ্ছে। আহনাফ বইটা বন্ধ করে বলে,
“রেগে আছো নাকি?”
“না, তাতা থৈ থৈ করছি আমি।”
দাঁত খিঁ°চিয়ে বলল সারাহ্।

আহনাফ বইটা রেখে চেয়ারে বসে বলে,
“আপনি এমনি করিয়া দন্ত বাহির করিলে আপনাকে বৃহৎ আকৃতির একখানা প্রানীর মতন দেখায়। তাহার সুবিশাল লে°ঙ্গুর ঝুলিয়া থাকে। অধুনা বিজ্ঞানীরা তাহাকে মনুষ্যকূলের আদিপুরুষ রূপে গণ্য করিয়া থাকে।”

সারাহ্ রেগে গিয়ে বলে,
“আমাকে বানর বললেন?”
“আহা, তাহা আমি কখন বলিয়াছি। আমি তো তাহার দন্তের সঙ্গে আপনার দন্তের বড়ই মিল পাইয়াছি। তাহারা অতি সুখে দন্ত বাহির করে আর আপনি অতি রাগিয়া তাহা প্রকাশ্যে দন্ত বাহির করো। ইহা পার্থক্য নহে, ইহা কালের বিবর্তন।”

সারাহ্ রেগে জোরে জোরে বিছানা ঝাড়তে শুরু করে। আহনাফ এখনো ক্রমাগত হেসে যাচ্ছে। ঝা°ড়ুটা ছু°ড়ে ফেলে সারাহ্ শুয়ে বলে,
“আমার পাশে আর কেউ শুতে আসবে না, এই বলে রাখলাম।”

আহনাফ উঠে এসে খাটে বসতে বসতে বলল,
“ইহা আপনার একান্ত সম্পত্তি নহে। ইহাতে আমার নিজস্ব অংশ খানিক রইয়াছে। আপনি ইহাতে আসিয়াছেন বলিয়া ইহা সম্পূর্ণ রূপে আপনার ব্যক্তিগত হইয়াছে বলিয়া আমি মান্য করিবো না।”
“আপনার সাধু ভাষা…”

সারাহ্ উঠে আহনাফকে ধরে ঠেলতে ঠেলতে বারান্দায় নিয়ে বলে,
“যতক্ষণ সাধু ভাষা জবান থেকে না যাচ্ছে, ততক্ষণ ঘরে আসবেন না।”

আহনাফ বুকে হাত বেঁধে বলে,
“ইহাও আমার অপরাধ নহে। কাল খানিক পূর্বে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস পড়িয়া আমার এরূপ অধঃপতন হইয়াছে। আগামীকল্য হইতে আমি শুধরাইয়া যাইবো।”

“চুপ।”
ধমকে উঠে সারাহ্। আহনাফ হেসে দেয়। সারাহ্-র গাল টে°নে দিয়ে বলে,
“রাগিলে আপনাকে…”

আহনাফের কথার মাঝে ওকে ঝারি দেয় সারাহ্,
“ঘরে যাবেন না আর মুখ বন্ধ রাখবেন।”

সারাহ্ চলে যেতে নিলে আহনাফ ওকে টে°নে কাছে নিয়ে আসে। দুহাত আলতো করে আহনাফের বুকের কাছে রাখে, চঞ্চলতা থেমে গিয়ে দুজনেই শান্ত হয়েছে।

ডানহাতের তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে সারাহ্-র কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দেয়। সারাহ্ চোখ তুলে তাকায়। দুজনের দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো, একই চাওয়া দুজনের অথচ তা প্রকাশ হলো না।

সারাহ্ সরে রুমে চলে আসে, আহনাফ বারান্দায় গ্রিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকায়। চাঁদ যে অর্ধপূর্ণ, মিটিমিটি জ্বলতে থাকা তারাগুলো চাঁদের পূর্ণতার আশায় ছ°টফ°ট করছে। ঠিক যে ছ°টফ°টানি হচ্ছে আহনাফ আর সারাহ্-র মনে।
______________________________________

বিছানায় শুয়েও ঘুম নেই মৃত্তিকার। পাশে সুরভি বেশ আরামেই চোখ বুজেছে সেই কখন। এখন তো নাক ডাকাও শুরু করেছে।

মৃত্তিকা পাশবালিশটা জড়িয়ে ধরে ভাবছে, শুধুই ভাবছে। ভাবনায় ইমতিয়াজ আর ওর বাবার মাঝের ঘটনা নেই। ভাবনায় কেবলই ইমতিয়াজ। ইমতিয়াজের হাতের স্পর্শ আর কথা, দুটোই সে অনুভব করছে। কিন্তু ইমতিয়াজকে বিয়ে করার অর্থ ওকে আবারো বিপদে টেনে ফেলা। লজ্জা, ভয়, সংশ°য়ের বে°ড়াজালে পড়ে আছে সে।

চিন্তা করতে করতে কোনো একসময় সে ঘুমিয়ে পড়ে। ফজরের সময় সুরভির ডাকে ঘুম ভাঙলো।
“মিউকো, উঠো।”
“হুম।”

চোখ কচলে কচলে উঠে বসে মৃত্তিকা। সুরভি তার মায়ের রুমে চলে যায় নামাজের জন্য। মৃত্তিকা এখানেই নামাজ পড়ে নেয়।

নামাজ শেষে মাত্রই জায়নামাজ গুছিয়ে রাখছে তখন শাফিন সাহেব এসে বলে,
“মিউকো, মা মিউকো।”
“জি, মামা। বলেন।”

শাফিন সাহেব ভিতরে এসে চেয়ারে বসতে বসতে বলল,
“আজ অফিসে যাবা?”

মৃত্তিকা জায়নামাজ রেখে বিছানার কোণায় বসে বলে,
“যেতে হবে মামা, ইমার্জেন্সি।”

শাফিন সাহেব মাথা নাড়েন। মৃত্তিকা নিজে থেকেই বলে,
“কোনো সমস্যা?”
“কলরবের বাবার কোম্পানিতেই কেন জয়েন দিতে হলো?”

মৃত্তিকা সামনে ঝুঁ°কে বলে,
“জয়েন দেইনি, শেয়ার কিনেছি।”
“হ্যাঁ, সেটাই। এখানে কেন করতে হলো? ওরা তোমাকে ভালো নজরে দেখে না।”

মৃত্তিকা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
“সেটা তাদের নজরের সমস্যা, আমার নয়।”

শাফিন সাহেব উঠে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,
“ওকে, যা ভালো বুঝো।”

মৃত্তিকা কিছুক্ষণ দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে। এরপর সে বিছানা নিয়ে নেয়। রাতে ভালো ঘুম হয়নি, এখন তো একটু ঘুমানো লাগবেই।
______________________________________

আজ সকালের নাস্তা বানাচ্ছে আহনাফ নিজে। খিচুড়ি আর ঝাল ঝাল গরুর গোশত। সারাহ্ আহনাফের এসব কাজে খুবই বি°র°ক্ত। রান্নাঘর সবসময় গোছানো আর পরিষ্কার রাখতে পছন্দ করে সারাহ্, অথচ আহনাফ এখানে আসা মানেই হলো এর চেহারা পালটে ফেলা।

“অনেক হয়েছে ফয়েজ স্যার, এবারে গিয়ে তৈরি হয়ে নিন।”
সারাহ্ এসে কাজে হাত দিতে দিতে কথাটা বলল।

আহনাফ গেল না। পালটা জবাব দেয়,
“ফয়েজ স্যার বলবা না। সাদাবের আব্বু, সাইদার পাপা বলবা।”

সারাহ্ চোখ কুঁচকে তাকিয়ে ব্য°ঙ্গসুরে বলে,
“কোথায় সেই সাদাব আর সাইদা। একটা রুমে আর একটা পেটে?”

আহনাফ হেসে ওর দিকে এগিয়ে এসে গালে চুম্বন করে বলল,
“রেডি হয়ে নাও, আমার রান্না প্রায় শেষ।”
“এটা দূরে থেকেও বলা যায়।”

আহনাফ গোশত বাটিতে নিতে নিতে বলে,
“এভাবে দূরে থাকলে সাদাব-সাইদা আর আসবে না। পরে আমি বুড়ো হয়ে যাবো।”
“ছি, মুখের কি ছিরি।”

সারাহ্ রুমে চলে গেল। আহনাফ বেশ কিছুক্ষণ আপন মনে খিলখিলিয়ে হাসলো। সারাহ্ আসার পর ওর জীবনের খুব সুন্দর একটা মোড় এসেছে।

খাবার টেবিলে বসে আব্বাস সাহেব আহনাফকে বললেন,
“শুক্রবারে তোমার ছোটফুফু আর ছোটফুপা আসবে।”

আহনাফ মাথানেড়ে বলল,
“তা তো ভালো কথা।”

আব্বাস সাহেব আবারো বলেন,
“উনারা তিন-চার দিন থাকবেন, তাই গেস্টরুমটা পরিষ্কার করে ফেলো।”

সারাহ্ পাশ থেকে বলে,
“বাবা, গেস্টরুম পরিষ্কারই আছে। আমি উইকলি খালাকে দিয়ে পরিষ্কার করাই।”
“ভেরি গুড।”

আব্বাস সাহেব প্রশংসা করলেও আহনাফ খাবার মুখে ঠু°সে গমগমিয়ে বলল,
“বড় বড় গুড়ের বৈয়াম।”

সারাহ্ বুঝতে পারলো ওকে ঠে°স দিয়ে কথাটা বলা হয়েছে। রেগে চোখ ছোট করে তাকালেও আব্বাস সাহেবের সামনে কিছু বলে না।

আব্বাস সাহেব দুজনের দৃষ্টিই খেয়াল করেছেন। উনি না দেখার ভাণ করেই আহনাফকে বলেন,
“তোমার ছোটফুপা কিন্তু তোমার বিয়ের প্রস্তাব এনেছিল, তাই কোনো প্রকার সমালোচনা যেন না হয়।”

আহনাফ হাত নেড়ে বলল,
“আরে, কিসের সমালোচনা? তোমার এমন অতি গুণবতী অলরাউন্ডার পুত্রবধূ থাকতে আবার সমালোচনা কিসের?”

আব্বাস সাহেব ছেলের পরিবর্তন খেয়াল করছেন। যে ছেলে আগে বেছে বেছে কথা বলতো, সেই ছেলেই এখন দশটা উত্তর তৈরি করে কথা শুরু করে।
______________________________________

“তোমার মনে হয় ইমতিয়াজ মৃত্তিকাকে ভালো রাখবে? আবার তোমার মতো হবে না তো?”

পল্লবীর রাগি রাগি কন্ঠে শরীফ প্রতিবাদ করে না। আরাম কেদারায় বসে সি°গা°রেটের ধোঁয়া ছাড়তে থাকে। পল্লবী সি°গা°রেটটা নিয়ে পায়ের নিচে পি°শে ফেলে।

শরীফ ওর দিকে তাকায়। পল্লবী বলে,
“তুমি অন্যের কথায় নিজের সংসারে আ°গু°ন দিয়েছিলে। ভাবিকে তো কষ্ট কম দাওনি, আবার আমাদের সামনে ভাবিকেই ভি°লে°ন করেছিলে। আর এখন যখন ভাবি নেই তখন তুমি বুঝলে যে তুমি ভুল। (একটু থেমে) ওই ইমতিয়াজ ছেলেটা বিবাহিত, এর আগেও তার স্ত্রী ছিল। যদি সে মৃত্তিকাকে ভালোবাসতে না পারে?”

শরীফ নির্বিকার হয়ে জবাব দিলো,
“ইমতিয়াজ কেয়ারিং, মৃত্তিকা ওইখানেই ভালো থাকবে।”
“আমিও জানি সে কেয়ারিং, কিন্তু ভালোবাসা আর কেয়ার এক নয় ভাইয়া।”

শরীফ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি মৃত্তিকাকে দেখতে যাবো কাল, মেয়েকে বউ সাজলে মায়ের মতো লাগে কিনা তা আমাকেও দেখতে হবে।”

পল্লবী মুখ ভেং°চায়।
“আবারো না কোনো গ°ন্ডগোল লাগে।”

শরীফ রুমে চলে যায়। পল্লবী সি°গা°রেটটা ফেলে দিয়ে নিজের এপ্রোন নিয়ে বেরিয়ে পরে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।
______________________________________

সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা, ইসরাতের সাথে আলোচনায় ব্যস্ত মৃত্তিকা। ইসরাত শনিবারে ইতালিতে ফিরে যাবে, ফিওনা চলে গেছে প্রায় দেড়মাস। এর আগে টুকটাক অনেক কিছুই মৃত্তিকাকে শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে ইসরাত।

কথা শেষে যাওয়ার সময় ইসরাত আবারো ফিরে আসে। বলল,
“তুই সত্যি বিয়ে করছিস?”

মৃত্তিকা আলতো করে হেসে বলল,
“কাল বাসায় আসলেই দেখবি দ্বিধার দেয়াল কিভাবে ভে°ঙেছি।”

ইসরাত মুচকি হাসে। বিয়ে নিয়ে মৃত্তিকার মধ্যে চলা বিরতিহীন দ্বিধাকে গুড়িয়ে দিয়েছে সে। এখন শুধুই ওই মুহূর্তের অপেক্ষা।

দুজনে একসাথে অফিস থেকে বের হয়। তারপর দুজনে নিজের গন্তব্যে রওনা দেয়।

বাসায় এসেই মৃত্তিকা নিজের ট্রলি খুলে। মায়ের জিনিসপত্র কিছু বের করাই ওর উদ্দেশ্য। কিন্তু ট্রলি খুলেই সে অবাক, সব যে এলোমেলো। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, কেউ ওর ট্রলিতে কেউ ঘা°টাঘা°টি করেছে।

সন্দেহের তী°রটা সুরভির দিকেই দেয় মৃত্তিকার। এ রুমে তার আনাগোনা বেশি হয়।

সুরভি এসে বলল,
“কালকে কি শাড়ি পড়বে নাকি লেহেঙ্গা?”

মৃত্তিকা শব্দ করে ট্রলিটা বন্ধ করে বলে,
“রুমে কে এসেছিল আপু? আমার ব্যাগ কে ধরেছে?”

সুরভি ব্যাগের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কেউ না তো। রুমে কেউ আসেনি।”

মৃত্তিকা আড়চোখে ওকে শুধু দেখে, কথা না বাড়িয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। ব্যাগে যেহেতু কেউ ধরেছে তার মানে কিছু খুঁজতে এসেছিল। কি হতে পারে? মৃত্তিকা অনবরত ভাবতে থাকে।
______________________________________

ফজরের আযান দিচ্ছে। মৃত্তিকা ফ্রেশ হয়ে এসে নামাজের জন্য তৈরি হয়। সুরভি এখনো ঘুম থেকে উঠেনি। সুরভিকে একটু ডেকেই নামাজে দাঁড়িয়ে যায় মৃত্তিকা।

নামাজ শেষে বেশ লম্বা সময় জায়নামাজে কাটায় সে। আজকের দোয়াও বেশ দীর্ঘ হয়। সবকিছু ঠিক থাকলে আজকে সন্ধ্যায় সে ইমতিয়াজের স্ত্রী হবে। দোয়ায় প্রতিদিনের মতো মাম থাকলেও আজ ইমতিয়াজের নামও উচ্চারণ হয়েছে। সংসারটা যেন সুখের হয়, শরীফের মতো ব°দ°মেজাজি আর অ°ত্যা°চা°রী কেউ যেন জীবনে পদার্পণ না করে। চোখের কোণায় ফোঁটায় ফোঁটায় জল জমতে থাকে।

এদিকে ইমতিয়াজের অবস্থাও একই। আজ তার মোনাজাতে বাবা, মা, তাহমিনার পর মৃত্তিকার নাম এসেছে। যে মানুষটাকে স্বেচ্ছায় সে নিজের জীবনে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। পর্যাপ্ত সম্মান যেন দিতে পারে সেই দোয়া করছে উভয়ে। যেন দুজনের দোয়া একই প্রান্তে মিলে গেছে।
______________________________________

ঘূর্ণনশীল ঘড়িটা ঘুরে চলছে অবিরাম। সকাল পেরিয়ে মধ্যদুপুরে এসেছে সময়টা। আহনাফ কলেজ থেকে বের হয়েছে। উদ্দেশ্য ঢাকায় যাবে, তাই একটু আগে আগেই বের হয়েছে।

গেইটের কাছে সারাহ্ তাড়াহুড়ো করে এসে বলল,
“কেন যাচ্ছেন বলেন নাই তো? আমার চিন্তা হচ্ছে।”

আহনাফ একটু নিচুস্বরে বলে,
“এক বন্ধুর বিয়েতে যাচ্ছে। রাতারাতিই ফিরে আসবো।”
“না থাক, রাত করে আসা লাগবে না।”
“বউটা একা কেমনে থাকবে?”
বলে আহনাফ চোখ টি°পে দেয়। সারাহ্ সরে যায়।

“ঠিক আছে, সাবধানে যাবেন।”

সারাহ্-কে বিদায় জানিয়ে আহনাফ রওনা দেয় ঢাকার উদ্দেশ্যে। ঢাকায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা ছয়টা বেজে গেছে। প্রথমেই যায় কাকরাইলে সেখানে তানজিমের বাসার সবার সাথে দেখা হয়। মমতাজ বেগম আর লুৎফর রহমান ওকে দেখেই খুব খুশি হয়েছে। মূলত মমতাজ বেগমই ওকে দাওয়াত দেয়ার কথা বলেছিল।

তানজিমকে ইমতিয়াজকে কল দেয়। সে বাসায় আছে, এখনো তৈরি হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর ইমতিয়াজ আসে, আহনাফের সাথে কুশল বিনিময় হয় তার। সকলে একসাথে রওনা দেয় উত্তরা মৃত্তিকার মামা শাফিন সাহেবের বাসার উদ্দেশ্যে।

গাড়িতে ইমতিয়াজ একটু শান্তই রইলো। বাসায় আসার আগে সে গিয়েছিল গো°র°স্থানে। তাহমিনার কবরের কাছে কিছুটা সময় কাটিয়েছে।

এদিকে মামের হালকা গোলাপী বেনারসি শাড়িটা পড়েছে মৃত্তিকা। সুরভিকে সন্দেহ হতে থাকলেও আজ সুরভিই তাকে সাজিয়ে দিচ্ছে। শাড়ির সাথে মাথায় আবার হিজাব পড়িয়ে দিয়েছে সে। ইসরাত আসলেও ওকে সাজানোতে হাত দেয়নি সে, এসবে যে বড্ড কাঁচা।

মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে সুরভি বলল,
“দারুন লাগছে।”

মৃত্তিকা উত্তর দেয় না। সুরভি ওর নিরবতাকে লজ্জা বলে ধরে নিলেও একটা আসলে রাগ ছিল। সুরভি রুম থেকে বেরিয়ে গেলে মৃত্তিকা মনে মনে একটা কথাই বলে,
“মুখোশধারী মানুষগুলোর মধ্যে কি তুমিও আছো আপু?”

ইমতিয়াজসহ সকলে চলে এসেছে। ড্রইংরুমে মৃত্তিকা তাদের কথা শুনতে পাচ্ছে, তবে ইমতিয়াজের কোনো কন্ঠস্বর পায়না।

কিছুক্ষণ পর সুরভি আর তানজিম রুমে আসে। তানজিম ওকে দেখে একটা চওড়া হাসি দিয়ে বলল,
“বাহ আপু, তোমাকে আজকে অন্যরকম লাগছে।”

তানজিমের কথায় সুরভি হেসে বলে,
“মিউকো, চলো। তোমার ডাক পড়েছে।”

তানজিম বলে,
“আমি নিয়ে আসছি, তুমি যাও।”

সুরভি কথা না বাড়িয়ে চলে যায়। তানজিম মৃত্তিকার সামনে বসে বলল,
“ছোট ভাই তো আমি তোমার। বে°য়া°দ°বি করেছি, কষ্ট দিয়েছি, ক্ষমা করবে না?”

মৃত্তিকা ওর গোছানো চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলে,
“রাগ নেই আমার। এভাবে মনের কথা বলে দেয়া মানুষগুলো অনেক ভালো। কিন্তু যাদের মুখে মধু আর অন্তরে বি°ষ?”
“তোমার বাবার কথা বলছো?”

মৃত্তিকা কিছু না বলে আয়নার দিকে তাকায়। শুধু কি ওর বাবাই মি°থ্যা চেহারা নিয়েছে? না, আশেপাশে এমন অনেক আছে।

দেলোয়ারা দরজার কাছ থেকে বলল,
“মিউকো।”

তানজিম মৃত্তিকার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
“তাহসিনা আপুকে এভাবে নিতে পারিনি, তোমাকে নিতে তো পারি?”

মৃত্তিকা ওর হাত ধরে। বোনকে নিরাপদে, যত্নে নিয়ে আসে বিবাহস্থলে। ইমতিয়াজের দিকে আড়চোখে তাকালো মৃত্তিকা। কালো পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা, পৃথিবীর সবচেয়ে সাদামাটা একটা সাজ নিয়েছে সে। মৃত্তিকার দিকে একবার তাকায় ইমতিয়াজ। দুচোখে লজ্জা আর ভয়ের সাথে কিছুটা বিব্রত অবস্থাও নজরে পড়ে।

পাশাপাশি বসানো হলো দুজনকে। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলো। কোনোরকম ঝা°মেলা ছাড়াই বিয়ে সমাপ্ত হলো। তবে পুরো সময় জুড়ে মমতাজ বেগম আর সুরভি এখানে উপস্থিত নেই। মৃত্তিকা বিষয়টা লক্ষ্য করেও নিরব থাকে।

তানজিম বলার পর আহনাফ মৃত্তিকাকে চিনতে পেরেছে। সেদিনের ওই ভদ্রমহিলা রিপা বেগমের একমাত্র মেয়ে।

বাসার সদর দরজা খোলা আছে। দরজা ঠেলে ভিতরে আসে মৃত্তিকার বাবা শরীফ। বিবাহ পরবর্তী মোনাজাত চলছে, মৃত্তিকার নজর উনার দিকে পড়তেই দাঁড়িয়ে যায়। ইমতিয়াজ একহাতে ওকে ধরে বসিয়ে দেয়। মৃত্তিকা তাকায় ইমতিয়াজের দিকে, ইমতিয়াজ এখনো নিজের মোনাজাত ভঙ্গির হাতের দিকে তাকিয়ে আছে।

চলবে……

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

ঊনত্রিংশ পর্ব (২৯ পর্ব)

“তোমাদের সম্পর্ক অটুট থাকুক।”

শরীফ কথাটা বলে মৃত্তিকার মাথায় হাত বুলাতে আসলে মৃত্তিকা সরে যায়। ইমতিয়াজের পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।

শরীফ আসার কারণে একটু আগেই বাসায় তুলকালাম করেছে শাফিন সাহেব আর মমতাজ বেগম। ইমতিয়াজ বরাবরের মতো এবারেও চুপ, আহনাফ তো এসব বিষয় সম্পর্কে জানেই না।

মৃত্তিকা ইমতিয়াজের পিছনে দাঁড়িয়ে ওর পাঞ্জাবির হাতা মু°ঠ করে ধরে৷ এমন আচরণে ইমতিয়াজ একটু অবাক হয়।

শরীফ আর কিছু না বলে চলে যায়। মেয়ে এখনো তাকে ভ°য় পায় বা ঘৃ°ণা করে৷ ঠিক যেরকম ছোটবেলায় লুকিয়ে যেতো, তেমনি আজও লুকিয়েছে। তবুও শরীফ এটা ভেবে স্বস্থি পেয়েছে অন্তত মৃত্তিকা লুকানোর মতো কেউ তো আছে।

শরীফকে নিয়েই একের পর এক কথা বলে যাচ্ছে শাফিন সাহেব। তানজিম একপর্যায়ে বলে,
“মামা, এবারে থামেন। যথেষ্ট হয়েছে।”

মমতাজ বেগম ইমতিয়াজকে বলেন,
“গেস্টরুমটা এতোক্ষণ ধরে ঠিক করেছি, তোমাদের আজকে আর বাসায় যাওয়ার দরকার নেই।”

মৃত্তিকা এসে সোফায় গু°ম মে°রে বসে রইলো। ইমতিয়াজ বলল,
“মা, যেতেই হবে। (একটু থেমে) আসলে বাসায় বিড়ালটা একা তো।”

মমতাজ বেগম শাফিন সাহেবের দিকে তাকালো। শাফিন সাহেব মুচকি হেসে বললেন,
“বিদায় তো দিতেই হবে। আজ দেই বা কাল।”

সকলে একসাথে রাতের খাবার খেলো, তারপর বিদায়ের ঘন্টা বেজে উঠে। ইমতিয়াজ, মৃত্তিকা, লুৎফর রহমান ও তানজিম চলে গেলেও মমতাজ বেগম গেলেন না। উনি ভাইয়ের সাথে থাকবেন। আহনাফ ওদের সাথেই নিচে নামলো।

কথাবার্তা শেষে যাওয়ার সময় তানজিম ছুটে এসে আহনাফকে ধরে বলে,
“ভাইয়া, সাবধানে যাবেন। আজ রাতে অনেককিছু হওয়ার সম্ভাবনা আছে।”

আহনাফ চোখ কুঁচকে বলল,
“কি হবে?”

তানজিম পেছন ফিরে বাকিদের চলে যেতে ইশারা করে। ইমতিয়াজকে বলে,
“তোমরা যাও, আমি পড়ে আসবো।”

তারপর আহনাফের দিকে ফিরে ফিসফিস করে বলল,
“যে সত্যের জন্য মুখ খুলে আমার আপুরা মা°রা গিয়েছিল তা আমি জেনেছি। একটা খুনি পরিবারের সন্তান আমি, যারা নিজের মেয়েদেরও হ°ত্যা করতে দুবার ভাবে না।”

এক নিশ্বাসে কথাটা বলে দেয় তানজিম। আহনাফের মাথায় যেন হঠাৎ করে আকাশ ভে°ঙে পড়ে। খু°ন, খু°নি পরিবার সব কথা ছাড়িয়ে তাহসিনার পরিকল্পিত মৃ°ত্যু°র সংবাদ ওকে ভিতর থেকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে। তানজিমের দিকে নিষ্প্রাণ চোখে তাকিয়ে আছে।

নিজের চোখের কোণায় জমা পানিটুকু মুছে তানজিম বলল,
“এই র°ক্তে খু°ন ঘুরছে ভাইয়া। (একটু থেমে) তোমার বিয়েটাও ওদের পরিকল্পনার অংশ।”

আহনাফের অবাকের পাল্লা আবারো ভারি হয়। ও তো নিজের বিয়ের কথা এখানে কাউকে বলেই নি। তবে তানজিম কি করে জানলো? প্রশ্নগুলো মনের মধ্যেই ঘুরতে থাকে, জবান যেন বন্ধ তার।

তানজিম একটা ঢোক গিলে, গলাটা ভা°রি হয়ে গেছে। চুল নেড়েচেড়ে বলল,
“ইমতিয়াজ ভাইয়া হয়তো কিছু জানে আর মিউকো আপুও।”

আহনাফ একটু দূরে চলে যায়। চোখ মুছে নিজেকে শান্ত করে আবারো এগিয়ে আসে। তারপর বলে,
“খু°নি পরিবার মানে কি? কে কে আছে এর পেছনে?”

তানজিম চুপ করে থাকে। যেন কিছুই আর বলতে চায় না।

“তোমার মনে হয়না অ°ন্যায় হয়েছে জেনে চুপ থাকা আরো বড় অ°ন্যায়।”

আহনাফের কথার উত্তরে তানজিম বলে,
“প্রতি°বাদ করেও লাভ হবে না। (একটু থেমে) আর দুই একজনে এতো বড় কাজ করেনি, এখানে আরো অনেকে আছে।”

তানজিম হাত ঘড়িতে সময় দেখে বলে,
“তুমি সাবধানে থেকো, ওরা তোমার জীবনটাও নিয়ন্ত্রণে নেয়ার চেষ্টা করবে।”
তানজিম বাসার ভিতরে চলে যায়।

আহনাফের মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে একটা আওয়াজ বের হয়,
“তাহু।”

সে স্থির হয়ে গেছে। হয় পুরো পৃথিবী থমকে গেছে আর নাহয় পুরো পৃথিবীর মাঝে ও নিজে থমকে গেছে।
______________________________________

কিছুক্ষণ আগেই বাসায় এসে পৌঁছেছে ইমতিয়াজ ও মৃত্তিকা। ঘড়িতে এখন রাত দশটা। ইমতিয়াজ দরজা খুলে ভিতরে গিয়ে বলল,
“বাসায় এমন কেউ নেই যে আপনাকে আদর আপ্যায়ন করে ভিতরে আনবে।”

মৃত্তিকা ভিতরে আসতে পা বাড়ালে ইমতিয়াজ নিজের হাত বাড়িয়ে দেয়। মৃত্তিকা ওর দিকে তাকালে চোখের ইশারায় হাত ধরে ভিতরে আসতে বলে। মৃত্তিকা তাই করলো।

“আপনি কিন্তু মানসিকভাবে বেশ শক্ত একজন মেয়ে, তবুও তখন ভয়ে আমার পিছনে কেন লুকিয়েছেন?”

মৃত্তিকা কিছু বলে না। ইমতিয়াজ কি করে জানবে মৃত্তিকার জীবনে ভরসা করার মতো পুরুষ সে একাই। মৃত্তিকা যতই নিজেকে সামলাতে পারুক না কেন, সেও চায় কেউ তাকে আগলে রাখুক।

মৃত্তিকার হাত ধরে ওকে শোবার রুমে নিয়ে গিয়ে বলল,
“রেস্ট নিন আমি একটু আসছি।”

ইমতিয়াজ বেরিয়ে গেল। ডাইনিং এ মিউ মিউ শব্দ শুনে মৃত্তিকা সেদিকে যায়। বিড়ালটা টেবিলের উপর ঘুরে বেড়াচ্ছে। সদর দরজার দিকে তাকিয়ে বুঝলো ইমতিয়াজ বাইরে থেকে লক করে গেছে।

মৃত্তিকা বিড়ালটার গায়ে আলতো করে হাত বুলায়। একটু আদর করে আবারো রুমে ফিরে আসে।

ঘন কুয়াশায় পথ চলতে যেমন কষ্ট হয়, তেমনি অবস্থা মৃত্তিকার। পথ তো আছে কিন্তু দৃষ্টি সীমানার বহু দূরে মনে হচ্ছে। কে যে নিজের আসল চেহারা দেখাচ্ছে আর কে যে ভ°ন্ড তাই বোঝা মুসকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আয়নার সামনে গিয়ে হিজাব খুলে, শাড়ির আঁচলে দেয়া ভাঁজগুলো খুলে সমস্ত আঁচল মেলে দেয়। ছোট ছোট চুলগুলোতে হাত বুলায় সে। আয়নাতে দেখতে থাকে নিজেকে।

সকলে তো ওকে সুন্দরী বলে। ফর্সা গায়ের রঙ, উঁচু নাক আর হালকা-পাতলা ঠোঁট ওকে সুন্দরী করেছে। অনেকে তো ওকে পাকিস্তানি মেয়ে বলেও সম্মোধন করে।

দরজা খোলার শব্দ হয়। মৃত্তিকা শাড়ির আঁচল তুলে রুমের দরজার দিকে যায়। ইমতিয়াজ এসেছে, হাতে একটা ব্যাগ। যতটুকু বোঝা গেল এটা বিড়ালের খাবার।

মৃত্তিকা ভিতরে চলে আসলো। ইমতিয়াজ ডাইনিং এ বিড়ালকে খাবার দিচ্ছে। রুমের দরজা খোলা থাকায় দৃশ্যটা দেখা যাচ্ছে। মৃত্তিকা বিছানায় বসে চেয়ে রইলো সেদিকে।

ইমতিয়াজ এসে ওর মুখোমুখি বসে। মৃত্তিকা একবার ওর দিকে তাকিয়ে আবারো দৃষ্টি সরায়।

“আপনি কি জানেন আপনাকে কে বা কারা হত্যা করতে চায়?”

ইমতিয়াজের সরাসরি প্রশ্নে মৃত্তিকা চেয়ে থাকে ওর দিকে। ইমতিয়াজ একটু সামনে এগিয়ে বলে,
“আপনার বাবাকে সন্দেহ করেছিলেন কিন্তু উনাকে তো এসবের সাথে যুক্ত বলে মনে হলো না।”

মৃত্তিকা এবারেও চুপ করে আছে। ইমতিয়াজের রাগ হয়৷ একটু ধ°ম°ক দিয়েই বলে,
“কথা কি কানে যাচ্ছে?”

মৃত্তিকা কান্না করে দেয়। মনে হলো অনেকক্ষণ কাঁদবে কিন্তু খুব দ্রুতই সে চোখ মুছে বলে,
“তিনটা খু°ন, আমার প্রথম থেকেই সন্দেহ হচ্ছিল। প্রথমে ভেবেছিলাম সবকিছুর জন্য বাবা দায়ী, কিন্তু আমি ভুল।”

ইমতিয়াজ খুব সিরিয়াস একটা চেহারা করে বসে বলল,
“তবে আপনি সবটাই জানেন?”
“না, সব জানি না। কিছুটা জানি, বাকিটা শুধুই অনুমান।”
“আপনার জানা আর অনুমান সবই বলুন।”

মৃত্তিকা কয়েকবার ঘনঘন ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলা শুরু করে,
“তাহসিনার বিয়ের আগেও আমি আর মাম বহুবার দেশে এসেছিলাম। কখনোই বড়মণি বা মামার বাসায় যাইনি। আমরা রোমি আন্টির বাসায় যেতাম। সেখানে উনারা আমার অগোচরে কোনো কিছু নিয়ে কথা বলতো। প্রচুর আগ্রহ থাকতো আমার তাদের কথায়, আমি লুকিয়ে শুনতে চাইতাম। বেশ কয়েকবার একটা নাম শুনেছি, রাহা সুলতানা।”

ইমতিয়াজ মনোযোগ দেয়। মৃত্তিকা আবারো বলে,
“কলরবের বাসায় গিয়েছিলাম আমি। বিয়ে ঠিক হওয়ার কয়েকদিন পরের ঘটনা এটা। কলরবের বাবা আমাকে দেখিয়ে কলরবের ফুপ্পির সাথে একটা কথা বলেছিল- ও হলো রাহার মেয়ে। কথাটা ফিসফিসিয়ে বলছিলো, যেন আমি না শুনি।”

মৃত্তিকা পাশের টেবিল থেকে পানি নিয়ে পান করে। ইমতিয়াজ বলে,
“এই রাহা সুলতানা কে? রিপা আন্টি?

মৃত্তিকা গ্লাসটা রেখে মাথা নেড়ে বলল,
“জানি না, এটা জানার জন্যই আমি দেশে থেকে যাই। কলরবের বাবাকে লুকিয়ে অনুসরণ করি। সব ক্ষেত্রে নয়, উনার অফিসেই বেশি অনুসরণ করতে পেরেছিলাম। তবে তেমন কিছুই জানতে পারিনি।”

মৃত্তিকা একটু থামে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“মামার বাসায় আমার উপর হা°ম°লা হয়েছিল। স্টোররুমে আমি সামিহা আর সারাহ্-র ফ্যামিলির ছবি দেখেছিলাম, রোমি আন্টির ফ্যামিলি ফটোও ছিল। (একটু থামে) জ্ঞান হারানোর আগে কলরবের বাবাকে আমি দেখেছিলাম, উনিই আমার উপর হামলা করেছিল। এতোটা আমি ভাবতে পারিনি।”

মৃত্তিকা কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিচুস্বরে বলে,
“মামার উপর আমার সন্দেহ তীব্র।”

এবারে ইমতিয়াজ উঠে দূরে গিয়ে উলটো দিকে ফিরে দাঁড়ায়। অনেকক্ষণ রুমে নিরবতা বিরাজ করতে থাকে।

পিনপতন নিরবতা ছি°ন্ন করে মৃত্তিকা বলে,
“সুস্থ হওয়ার পরও আমি এজন্যই মামার বাসায় থেকেছি। মামা কারো সাথে কথা বলার সময় রাহা নামটা উচ্চারণ করেছে। কিন্তু আমার থেকে দূরত্ব রেখে চলেছে। (একটু থেমে) আমার মনে হয় মামের নামই রাহা।”

ইমতিয়াজ অন্যদিকে ফিরেই বলল,
“এখানে তাহমিনার দোষটা কোথায়?”

এই উত্তর মৃত্তিকার জানা নেই। ছাড়া ছাড়া কিছু ঘটনা জানে সে। সম্পূর্ণ ঘটনা জানতে চেয়েও এখনো জানতে পারেনি সে।

ইমতিয়াজ ফিরে তাকিয়ে বলল,
“কি দোষ ছিল আমার মিনার?”
ওর কন্ঠে ভূমি পর্যন্ত কেঁ°পে উঠবে হয়তো।

মৃত্তিকা কাঁ°পা কন্ঠে বলল,
“একটু বসুন, আমার কথা শেষ হয়নি।”

ইমতিয়াজ বসে না, তবে শান্ত থাকে। মৃত্তিকা ডানহাত দিয়ে বামহাত ঘ°ষতে ঘ°ষতে বলল,
“ক°ফি°নের ভিতরে আমার জ্ঞান এসেছিল, সজ্ঞানে ছিলাম অনেকক্ষণ। দুজনে কথা বলার সময় বলেছিল- সেদিন তাহমিনা আর তাহসিনার সাথে মিউকোকেও পাঠানো দরকার ছিল। রিপার মেয়ে রিপার সাথে চলে গেলে আর এতো ঝা°মেলা হতোই না। (একটু থেমে) ওরা প্রমাণ লো°পা°ট করছে, কিন্তু সেটা এই তিন খু°নের নয়। তার আগেও কোনো খু°ন হয়েছে।”

“পুরোনো খু°নের রেশ ধরেই নতুন কোনো খু°ন, সেটা ধামাচাপা দিতে আবারো…”

কথা শেষ না করেই ইমতিয়াজ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজায়। মনের এমন এক উথাল-পাতাল অবস্থা যা কাউকে বোঝানো যাবে না। রাগ, ক্ষো°ভ বেড়ে গেল হঠাৎ। ড্রেসিংটেবিলের উপরে থাকা সুগন্ধির বোতল মাটিতে ছুড়ে ফেলে। কাঁচের বোতল ভে°ঙে একাকার। এমন ঘটনায় মৃত্তিকা ঘা°ব°ড়ে যায়।

একে একে ড্রেসিংটেবিলের সবকিছু ফেলে দেয়। টেবিলের বইগুলোও ছুঁ°ড়ে ফেলে। ইমতিয়াজের এমন আচরণ মৃত্তিকা অচেনা। এতোটাই ঘা°ব°ড়ে গিয়েছে যে ওকে থামানোর মতো চিন্তা মাথায়ই আসছে না।

বি°ধ্ব°স্ত একটা রুমের মাঝে ইমতিয়াজ চেঁচিয়ে উঠে “তাহমিনা” বলে। জানলার গ্রিলসহ কেঁ°পে উঠলো শব্দে।
______________________________________

রাত একটার কাটা ছুঁইছুঁই, তবুও ঘড়িটা থামছে না। চলছে অবিরাম, রাত গভীর হচ্ছে।

আহনাফকে একের পর এক কল করছে সারাহ্। চিন্তায় চিন্তায় তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। ঢাকা থেকে আসবে নাকি থাকবে তা এখনো জানে না। সেই যে ঢাকায় গিয়ে জানিয়েছিল তারপর আর কোনো কথা নেই।

আব্বাস সাহেব বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। আহনাফ চলে আসবে এমন চিন্তা নিয়ে দশটায় উনি রুমে চলে গেছেন।

সারাহ্ কি করবে বুঝতে পারছে না। চিন্তিত সারাহ্ শেষে কান্না শুরু করে দেয়। ফ্লোরে বসে হাঁটুতে দুইহাত দিয়ে মাথা নুইয়ে কাঁদছে সে।

এদিকে আহনাফ কাকরাইল এসেছে। গো°র°স্থানে রাতে লোকে ভ°য় পায়, আসতে চায় না। আহনাফ এসে বসে আছে। এক নিস্তব্ধতার মাঝে আহনাফের নিশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।

তাহসিনার দুর্ঘটনার পর নিজেকে যতটা সামলে নিয়েছিল আজকে তার চেয়ে বেশি এলোমেলো হয়ে গেছে সে। ফোনটা যে অনবরত কাঁ°পতে কাঁ°পতে থেমে গেছে সে খেয়াল ওর নেই।
______________________________________

ঘর পরিষ্কার করেছে মৃত্তিকা। ইমতিয়াজ বিছানায় বসে আছে। হাত কে°টে গেছে, গাল আর গলার দিকেও ক্ষ°ত হয়েছে। মৃত্তিকা বাধা না দিলে হয়তো আরো বড় ধরনের কিছু হতে পারতো।

ইমতিয়াজের হাতে ব্যা°ন্ডে°জ লাগাচ্ছে মৃত্তিকা। এতোক্ষণ সে কাছে ঘেষতে দেয়নি। এখন নিরব। মৃত্তিকা স্যাভলন লাগানো তুলা নিয়ে গালে লাগাতেই ইমতিয়াজ ব্য°থায় একটু নড়ে উঠলো।

“সরি, আস্তে আস্তে দিচ্ছি।”

কথাটা বলে খুব আলতো হাতে স্যাভলন লাগায় মৃত্তিকা। ব্যা°ন্ডে°জ লাগাতে গেলে ইমতিয়াজ বাধা দেয়। মুখে বলে,
“লাগবে না।”

মৃত্তিকা ব্যা°ন্ডে°জ রেখে দিলো। সবকিছু ঠিকঠাক করে রেখে চুপচাপ রুমে একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকে। ইমতিয়াজ ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
“তখন আপনি আরো কিছু বলতে চাচ্ছিলেন।”

মৃত্তিকা বলতে চাচ্ছে, কিন্তু ইমতিয়াজের যা প্রতিক্রিয়া তাতে এখন কথা বলতেই ভ°য় পাচ্ছে সে।

ইমতিয়াজ বুঝতে পারে মৃত্তিকা ওকে ভ°য় পাচ্ছে। ইমতিয়াজ শান্ত গলায় বলল,
“এখানে এসে বসুন।”

মৃত্তিকা এসে ইমতিয়াজের পাশে বসলো। ইমতিয়াজ বলল,
“ইনসাফ বলে একটা কথা ইসলামে আছে৷ জানেন তো বাবা আমাকে সবসময় ইনসাফের কথা বলতো। স্ত্রীদের প্রতিও ইনসাফ আছে। (একটু থামে) ভয় পাবেন না, জা°নো°য়ারের মতো ব্যবহার আপনি পাবেন না। একটু আগের ঘটনা আমার রাগের ফল। আপনি রাগের কারণ নন।”

মৃত্তিকা একটা ঢোক গিলে বলল,
“যদি সত্যি আমার মামা এসবে যুক্ত থাকে?”

মৃত্তিকার চোখে কোণা দিয়ে গড়িয়ে পড়া জলটুকু ইমতিয়াজ মুছে দিলো। মৃত্তিকা চোখ তুলে তাকায় ওর দিকে।

সত্যি তো হলো ইমতিয়াজ মৃত্তিকাকে ভালোবেসেছে, নিজ ইচ্ছায় স্ত্রীরূপে গ্রহণ করেছে। তার অর্থ তো এই নয় যে সে তাহমিনাকে ভুলে গেছে।

একাধিক স্ত্রীর প্রতি কিভাবে ইনসাফ করতে হয় তা নিয়ে অনেক কোরআনের আয়াত ও হাদিস জানা আছে ইমতিয়াজের। কোরআন-হাদিসকে কি কেউ ভুল বা মি°থ্যা বলতে পারবে? জীবন তো কোরআনের আলোতেই সাজাতে হবে।

চলবে…..

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

ত্রিংশ পর্ব (৩০ পর্ব)

ফজরের আযান দিচ্ছে। আহনাফ গো°র°স্থানের পাশের মসজিদে নামাজের জন্য যায়। ওযু করে নামাজ পড়ে আবারো চলে আসে পূর্বের স্থানে।

পুব আকাশে একটু একটু করে উঠে আসছে সূর্য। আকাশ লাল হয়ে উঠেছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো সাদা হয়ে যাবে। আলোতে ভরে যাবে সবকিছু, মানুষের আনাগোনা বাড়বে৷

এদিকে সারাহ্-র অবস্থা যাচ্ছেতাই। জায়নামাজে বসে অসম্ভব কান্না করে যাচ্ছে শেষরাত থেকে। কি যেন এক অজানা ভয় তার। তার আহনাফ হারিয়ে যাবে, চলে যাবে তার জীবন থেকে। আ°শংকা আর আ°ত°ঙ্কে কান্না করছে সে। চোখ পানি শুকিয়ে যাক, তবুও আল্লাহ্ তার দোয়া কবুল করুক।

ফজরের পর আবারো আহনাফের নাম্বারে ডায়াল করে। ফোনের কাঁ°পুনি অনুভব করে আহনাফ। ফোন বের করে সারাহ্-র নাম্বার দেখে কে°টে দেয়। আবারো কল আসে, আহনাফ কে°টে দেয়। কয়েকবার কে°টে দিয়ে পরে বি°র°ক্ত হয়ে ফোনটা ছুঁড়ে ফেলে।

গো°র°স্থানে প্রবেশ করা শরীফের পায়ের কাছে গিয়ে পড়ে ফোনটা। আহনাফ উনার দিকে তাকিয়ে আবারো অন্যদিকে ঘুরে যায়। শরীফ ফোনের উপর দিয়েই হেঁটে আসে। রিপা বেগমের কবর জিয়ারাত করে।

আহনাফকে ঠায় বসে থাকতে দেখে বলল,
“এখানে বসে আছো? তাও এতো ভোরে?”

আহনাফ উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“আপনার কোনো সমস্যা?”

শরীফ মাথা দুলিয়ে বলল,
“না, আমার কি সমস্যা হবে? এমনিতেই জিজ্ঞাসা করলাম।”

তাহসিনার কবরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শরীফ বলে,
“ওই তো রিপার সাথে মা°রা যাওয়া ব্রাইড। তাহসিনা তাবাসসুম।”

আহনাফ মাথা নেড়ে শুধুই সম্মতি জানায়৷ শরীফ বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,
“এখানে এভাবে থাকলে শরীর খারাপ করবে, বাসায় চলে যাও।”

শরীফ তো বেরিয়ে গেল, কিন্তু আহনাফ গেল না। সে দাঁড়িয়ে আছে। তাহসিনাকে কেউ কেন মা°র°বে, তাও তারই পরিবারের কেউ। ঘন মেঘ আহনাফের মনকে ঘিরে ফেলেছে, বারেবারে ব°জ্র°পা°ত হচ্ছে কান ফাটানো তীব্র শব্দে। আহনাফ এখন শুধুই বৃষ্টির অপেক্ষা করছে।
______________________________________

সকাল আটটা, মৃত্তিকা বেশ আরামেই ঘুমাচ্ছে। সারারাত সজাগ থেকে ফজরের নামাজ পড়ে একেবারে ঘুমিয়েছে সে। রুমে এসি চলছে, হালকা বেগুনি রঙের কম্ফোর্টার গায়ে জড়িয়ে রেখেছে। যদিও সে এটা নিজে থেকে দেয়নি, কিছুক্ষণ আগে ইমতিয়াজ দিয়ে দিয়েছে।

ইমতিয়াজ এখন ব্যস্ত সকালের নাস্তা তৈরিতে। রুটি, ডিম আর চা, এরচেয়ে বেশি ঝা°মেলা সে সকালে করতে চায় না। নাস্তা টেবিলে রেখে রুমে উঁকি দিয়ে মৃত্তিকাকে ঘুমাতে দেখে ইমতিয়াজ আর ওকে ডাকাডাকি করে না। নিরবে ওয়াশরুমে চলে যায়।

খানিকক্ষণ পরে মৃত্তিকা আপনা থেকেই জেগে উঠে। চোখ খুলে গায়ে কম্ফোর্টার দেখে। ওয়াশরুমে পানির শব্দে বুঝতে পারে ইমতিয়াজ ওখানে। উঠে ঝিম মে°রে বসে থাকে।

ইমতিয়াজ গোসল সেরে বেরিয়ে ওকে বসে থাকতে দেখে বলল,
“ঘুম হয়েছে?”

মৃত্তিকা মৃদুস্বরে বলল,
“হুম।”
“ফ্রেশ হয়ে নেন, নাস্তা ঠান্ডা হয়ে যাবে।”

মৃত্তিকা হেলেদুলে ওয়াশরুমে যায়। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে দেখে ইমতিয়াজ বিছানা গুছিয়ে ফেলেছে। ডাইনিং এ উঁকি দিয়ে মৃত্তিকা বলে,
“আপনি একা একা সব করেন?”

ইমতিয়াজ আলতো হেসে বলল,
“তো কে আর করবে?”

মৃত্তিকা চেয়ার টেনে বসে বলে,
“আমি করতে পারতাম, আপনার তো হাত কা°টা।”

ইমতিয়াজ কিছু না বলে ওর প্লেটে রুটি-ডিম তুলে দিয়ে নিজেও খেতে বসে। মৃত্তিকা ওর জবাবের আশায় চেয়ে থেকে ব্যর্থ হয়ে খাওয়া শুরু করে।

“আপনি কি আজ অফিস যাবেন?”

ইমতিয়াজের সোজাসাপ্টা প্রশ্নে মৃত্তিকা জবাব দেয়,
“না, আজকে ছুটি। কাল যেতে হবে।”
“ওহ।”

মৃত্তিকা ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনিও যাবেন আমার সাথে।”
“আমার তো ডিউটি আছে।”
“আপনি কাল থেকে অফিসে যাবেন আর আমি বাসায় থাকবো।”

ইমতিয়াজ কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলে,
“ওয়েট, আপনার অফিসে আমি কি করবো? বিজনেসের কিছুই আমি বুঝি না।”

মৃত্তিকা খেতে খেতে বলল,
“ও কি আর একদিনে বুঝে নাকি? ধীরে ধীরে বুঝে যাবেন। (একটু থেমে) আর আমার অফিস মানে কি? আমারটা কি আপনার না?”
“রি°স্ক নিচ্ছেন ম্যাডাম।”
“আমি জানি, আমি কি করছি।”

ইমতিয়াজ হেসে আবারো খেতে শুরু করে৷ খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে মৃত্তিকা ইমতিয়াজকে দেখে। কাল রাতে কি ভ°য়ং°কর রূপই না সে নিয়েছিল, অথচ এখন কতটা হাসিখুশি।

“কোম্পানির বাকি দুটি শেয়ার কে কিনেছে জানেন?”

ইমতিয়াজের কথায় মৃত্তিকা চমকে উঠে। এতোক্ষণ সে একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিল। ঠোঁট উলটে বলে,
“শিউর তো জানি না, তবে একজন ডাক্তার।”

ইমতিয়াজ একটু হেসে বলল,
“আপনার বাবা।”

ইমতিয়াজের টিশার্ট ধরে টে°নে মৃত্তিকা ওকে কাছে এনে বলে,
“ওই লোকের সাথে আপনার এতো ঘনিষ্ঠতা কেন?”

ইমতিয়াজ ওর হাতের দিকে তাকালে মৃত্তিকা টিশার্ট ছেড়ে দেয়। বি°র°ক্তি প্রকাশ করে মৃত্তিকা বলল,
“ওই লোকের হাত থেকে আমি নিস্তার চেয়েও পাচ্ছি না।”
“নিস্তার পাননি বলেই বেঁচে আছেন। নাহলে মৃত্তিকা নামটা নিশ্চিহ্ন হতো।”

মৃত্তিকা জানে ওর বাবা ওকে বাঁচিয়েছে, ইমতিয়াজই চিঠি মাধ্যমে বলেছিল। তবুও সে বাবাকে বিশ্বাস করে না, ভরসা করে না বরং ঘৃ°ণার চোখে দেখে।

খাওয়া শেষে মৃত্তিকা প্লেট, কাপ ধুয়ে রেখে ডাইনিং এ এসে দেখে ইমতিয়াজ বিড়ালকে হারনেস পড়াচ্ছে। বিড়ালটি বারবার নড়াচড়া করছে আর ইমতিয়াজ তাকে বকাবকি করে হারনেস পড়াচ্ছে। মৃত্তিকা এসব দেখে হেসে রুমে আসে।

ইমতিয়াজ বলে উঠে,
“মিউকো, চল ঘুরতে যাই।”

মৃত্তিকা খুশিমনে এসে বলে,
“হ্যাঁ, চলুন।”

ইমতিয়াজ ফিরে তাকিয়ে জোরে হেসে দেয়। কোনোমতে হাসি থামিয়ে বলে,
“আমার বিড়ালের নাম মিউকো আর আপনি মৃত্তিকা।”

মৃত্তিকা লজ্জা পেয়ে ভিতরে চলে আসে। ইমতিয়াজ তার বিড়ালকে ডাকছিল আর মৃত্তিকা ভেবেছে ওকে বলছে। ইমতিয়াজ বের হওয়ার আগে মৃত্তিকা বলে,
“ওই মিউকোর সাথে এই মিউকোকেও একটু বাইরে নিয়ে যাবেন?”

ইমতিয়াজ হেসে বলল,
“চলেন।”
______________________________________

“আহনাফ এখনো বাসায় আসেনি?”

আব্বাস সাহেবের কথায় সারাহ্ মাথানেড়ে বলল,
“না, বাবা।”
“কল দিয়েছিল? কোন কাজে আছে?”
“চলে আসবেন হয়তো।”

আব্বাস সাহেব নিজের রুমে চলে যায়। সারাহ্ রান্নাঘরে যায়। কাজের খালা, আলেয়া খাতুন, এখানে কাজ করছে। আজ মেহমান আসবে, আহনাফের ছোটফুপা আর ফুফু। কাজ তো অনেক, গোছাতে হবে।

সারারাত নির্ঘুম সারাহ্ কাজে মন দিতে পারছে না। আহনাফ যে একটাবারের জন্যও কল দিলো না। ওর ছ°টফ°টানি কে বুঝে?

একের পর এক সবজি কা°টায় ব্যস্ত হয় সে। কিছুক্ষণ পর কলিং বেল বাজলে আলেয়া খাতুন যাওয়ার আগেই সারাহ্ ছুটে যায়। দরজা খুলে আহনাফকে দেখে স্বস্থির নিশ্বাস ফেলে সে। কিন্তু আহনাফের অবস্থা যে এলোমেলো, যেন বিশাল ঝ°ড় গেছে তার উপর দিয়ে।

“কি হয়েছে আপনার?”
চিন্তিত সারাহ্-র প্রশ্নের জবাব আহনাফ দেয় না। শান্ত চাবি দেয়া পুতুলের মতো হেঁটে সে ভিতরে চলে যায়।

রুমে গিয়ে ধুম করে ফ্লোরে বসে পড়ে সে। সারাহ্ এসে আহনাফকে দেখে আরো অ°স্থির হয়ে যায়।

ওর পাশে গিয়ে বসে বলল,
“আপনি ঠিক আছেন? আহনাফ।”

আহনাফ শান্ত চোখে ওর দিকে তাকায়। মেয়েটার চোখেমুখে অ°স্থিরতা, লাল ফুলে উঠা চোখ দুটো সারারাতের কান্নার সাক্ষী হয়ে আছে। ওর গালে আলতো করে হাত দেয়। সারাহ্ ওর গা ঘেষে বসে বলল,
“বলবেন না আমায়? কোনো ভুল করেছি আমি?”

আহনাফ ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে বলে,
“মাথায় হাত বুলিয়ে দাও, আমি ঘুমাবো। চিরনিদ্রায় চলে যাবো আমি।”

“চিরনিদ্রা” কথাটা শুনে সারাহ্ ভ°য় পায়, কাঁ°পা হাতে আহনাফের চুলে বিলি কাটে। আহনাফ আরাম করে শোয়।

“আপনার সাদাব-সাইদাকে না দেখে চিরনিদ্রায় কেন যাবেন?”

আহনাফ মাথাতুলে ওর দিকে তাকায়। কাঁদোকাঁদো মুখেও সারাহ্ জোরপূর্বক হেসে বলে,
“কয়েকদিন ধরে অনুভব হচ্ছিল, কাল জানতে পেরেছি।”
“কি?”
নিষ্প্রাণ হয়ে প্রশ্ন করে আহনাফ।

সারাহ্ একহাতে ওর চুলে বিলি কেটে, অন্যহাত দাঁড়িতে রেখে বলল,
“শীঘ্রই আপনি সাদাবের আব্বু, সাইদার পাপা হবেন ইনশাআল্লাহ ফয়েজ স্যার।”

মন খারাপের মাঝেও এ এক খুশির খবর হয়ে এলো। পরিবার যে দুই থেকে তিনে যাচ্ছে। আহনাফ উঠে বসে সারাহ্-র গালে, কপালে পাগলের মতো চুমো দেয়। লাজুক সারাহ্ সেই আহনাফের বুকেই আশ্রয় পায়। শক্ত করে ওকে জড়িয়ে ধরে আহনাফ।

তাহসিনার মৃ°ত্যু নিয়ে সারাহ্-কে আর কিছুই জানায় না আহনাফ। তবে সারাহ্-কে ও হারাতে দিবে না, আগলে রাখবে শেষ র°ক্ত°বিন্দু পর্যন্ত। তানজিমের কথা অনুযায়ী এ বিয়ে যদি পরিকল্পিত হয়ে থাকে তবে স্বার্থের জন্য সারাহ্-র প্রাণ নিতে এক মুহূর্ত সময়ও তাদের লাগবে না।

“ঐশী আমার, আমার অপ্রকাশিত প্রেমটুকু তোমার জন্য রইলো।”
মনের কথা মনে থাকে, আহনাফ থাকে চুপ।
______________________________________

দুপুর দুইটা, জুম্মার নামাজ পড়ে বাসায় এসেছে ইমতিয়াজ। মৃত্তিকা নামাজ শেষে মিউকোকে নিয়ে বসে আছে।

ইমতিয়াজ এসে বলে,
“চলুন, বাইরে কোথাও লাঞ্চ করে আসি?”

সকালে অনেকক্ষণ ওরা বাইরে ঘুরেছে। গোরস্থানে গিয়ে জিয়ারাত করে বাসায় ফিরতে ফিরতে আযান দিয়ে দিয়েছিল। তাই তাড়াহুড়ো করে আর রান্নার ঝা°মেলা করতে নিষেধ করে ইমতিয়াজ।

মিউকোকে বাসায় রেখে দুজনে বাইরে যাবে। মৃত্তিকা তৈরি হয়ে নেয়। স্কার্ফটা দেয়ার সময় ইমতিয়াজ বলে,
“কাল আপনাকে হিজাবে সুন্দর লাগছিল।”

মৃত্তিকা ফিরে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
“মানে আমি হিজাব পড়বো? কিন্তু ওটা তো সুরভি আপুর ছিল। আমার হিজাব নেই।”

ইমতিয়াজ উঠে গিয়ে আলমারি খুলে একটা হিজাব বের করে ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“এটা পড়ুন।”
“কার এটা? তাহমিনার?”

ইমতিয়াজ উত্তর না দিয়ে মৃত্তিকাকে হিজাব পড়িয়ে দেয়। মৃত্তিকা অনুভব করে ওর প্রতিটা স্পর্শ। হিজাব পড়িয়েই ইমতিয়াজ বাইরে চলে যায়। মৃত্তিকা আয়নার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আজ সৌন্দর্যটা সত্যিই অন্যরকম।”

হ্যাঁ, অন্যরকম, ভীষণ অন্যরকম একটা দিন কাটায় ইমতিয়াজ ও মৃত্তিকা। দুপুরের লাঞ্চ রেস্টুরেন্টে করে বিকাল পর্যন্ত ঘুরে বেড়ায় আশেপাশেই।

বিকালে রমনার দিকে যায়। ভীড় আর মানুষ মৃত্তিকার অপছন্দ। ভীড়মুক্ত স্থান খুঁজে খুঁজে ব্যর্থ হয়ে ইমতিয়াজ যখন বলে,
“হুমেনের ভীড়।”

মৃত্তিকার জবাব ছিল,
“আমরা এলিয়েন।”

হাওয়াই মিঠাই দেখে মৃত্তিকা ইমতিয়াজের হাতে খোঁ°চা দিয়ে বলে,
“কটন ক্যান্ডি খাবেন?”
“হাওয়াই মিঠাই, সংক্ষেপে শুধু মিঠাই।”

দুটো হাওয়াই মিঠাই কেনা হলো। প্যাকেট খুলে মৃত্তিকা বলে,
“চিয়ার্স।”

ইমতিয়াজ “চিয়ার্স” বলে দুজনে মিঠাই ধা°ক্কা দিতেই তা একসাথে লেগে গেল। মৃত্তিকা ঠোঁট উলটে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ ফিক করে হেসে দেয়। ইমতিয়াজ মুগ্ধ হয়। মেয়েটার হাস্যোজ্জ্বল চেহারা যে বড়ই দুর্লভ। মৃত্তিকা খাওয়ার সময় নাকে, গালে মিঠাই লেগে আঠা আঠা অবস্থা।

ইমতিয়াজ টিস্যু এগিয়ে দিলে মৃত্তিকা গালে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“মুছে দেন।”
“পিঁপড়া হওয়া উচিত ছিল আমার।”
ইমতিয়াজের কথার অর্থ বুঝতে চেয়েও বুঝে না মৃত্তিকা।

রাত পর্যন্ত ঘুরাঘুরি করে রাতের খাবার নিয়েই বাসায় ফেরে দুজনে। শরীরটা ক্লান্ত হলেও মনটা বেশ ফুরফুরে। মৃত্তিকার জীবনে এই হাসিটুকুর বড্ড বেশি অভাব ছিল। আজ তা পূর্ণতা পেয়েছে।

মৃত্তিকার চালচলনে বোঝা যাচ্ছে সে খুশি, প্রচন্ডরকম খুশি। এই মন ইমতিয়াজ ভা°ঙবে না, ওর শত কষ্ট হোক ও মৃত্তিকাকে কষ্ট বুঝতে দিবে না। তাহমিনার স্থান হয়তো মৃত্তিকা পাবে না, তবে হৃদস্পন্দের কোনো এক ছন্দে সে থাকবে আজীবন। ইমতিয়াজের ভালোবাসা বড্ড বেশি অপ্রকাশ্য।

প্রকাশ না করলেও কিছু প্রেম হয়৷ ভালোবাসা সৃষ্টিকর্তা থেকে পাওয়া এক নেয়ামত। এর উপর কারো প্রভাব বা নিয়ন্ত্রণ থাকে না। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছানুসারে কারো মনে কারো জন্য প্রেমের শুরু হয়। কঠিন লাগছে কথাটা?

আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত একটা হাদিস বলি,
রাসুল (সা.)-ও আপন স্ত্রীদের পালা বণ্টন করে বলেছেন, ‘হে আল্লাহ, আমার যতটুকু সাধ্য ছিল আমি ইনসাফ করার চেষ্টা করেছি— আর যে বিষয়টি আমার সাধ্যে নেই (অর্থাৎ কোনো স্ত্রীর প্রতি বেশি ভালোবাসা), সে বিষয়ে আমাকে ভ°র্ৎ°স°না করবেন না।’ (সুনানে তিরমিজি, ৩/১৮৫, হাদিস : ১১৪০; মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, হাদিস : ৪/৪১৪)
______________________________________

দুপুরে বাসায় মেহমানরা এসেছে। বাসার কেউ এখনো নতুন অতিথির সুসংবাদ সম্পর্কে জ্ঞাত নয়। আহনাফ কাউকে জানাতে চায় না। সকলের অজানা থাকুক, সারাহ্-কে নিয়ে কোনো প্রকার ঝুঁ°কি সে নিবে না।

আহনাফের ফুপা, ফুফুর সাথে ড্রইংরুমে বসে আলাপ করছে আব্বাস সাহেব। আহনাফ ও সারাহ্ কিছুক্ষণ সেখানে ছিল। কিন্তু সারাহ্-র শরীর খারাপ লাগায় রুমে চলে আসে।

সারাহ্ বিছানায় শুয়ে আছে আহনাফ এসে পাশে শুয়ে বলল,
“আমার সাইদা কি করছে?”

সারাহ্ ওকে একটা চিমটি দিয়ে বলে,
“সাইদা ঘুমাচ্ছে।”

হঠাৎ কিছু মনে পড়ায় সারাহ্ উঠে বসে বলল,
“কাল সারারাত কোথায় ছিলেন?”
“টেনশনে ছিলাম।”

সারাহ্ কপাল কুঁচকায়। আহনাফ হেসে বলল,
“সাদাব বা সাইদা যে আসছে তা আমি জানতাম, এরজন্যই টেনশনে ছিলাম।”

সারাহ্ গাল ফুলিয়ে বসে বলল,
“মি°থ্যা কথা। বাসায় এসেই কেমন যেন ছিলেন আপনি?”

আহনাফ উঠে ওর ঘাড়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,
“চুপ থাকো, এতোকিছু নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। নিজেকে নিয়ে আর বেবিকে নিয়ে ভাবো।”

আহনাফ চায় থাকুক ওর কষ্টগুলো সারাহ্-র অজানা। সত্য যেমনি বের করবে, ঠিক তেমনি সে সারাহ্-কেও র°ক্ষা করবে।

চলবে……

অনুভূতিরা শব্দহীন পর্ব-২৫+২৬+২৭

0

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

পঞ্চবিংশ পর্ব

বিকালে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় আহনাফ ও সারাহ্। মায়ের সাথে একপ্রকার রাগ করেই চলে এসেছে সারাহ্। বাসে উঠে খেয়াল হলো ওর মা ওইসব কথা উঠলেই রেগে যাচ্ছিল, মানে উনি নিশ্চয়ই কিছু তো জানে। তাহলে এখন ঢাকা থেকে চলে গেলে যদি মায়ের কোনো বি°পদ হয়।

“আহনাফ, আমি বাসায় যাবো।”

সারাহ্-র অতিউৎসাহী কথায় আহনাফ সাধারণ হবাব দেয়,
“তাই তো যাচ্ছি।”
“আম্মুর বাসায় যাবো।”
“কাল না চলে আসার জে°দ করলে?”
“এখন তো যেতে চাচ্ছি, চলেন।”

আহনাফ ভ্রূ উঁচিয়ে চোখমুখ কুঁচকে বলল,
“মাইয়া মাইনসের য°ন্ত্র°ণা আর স°হ্য হয় না।”

সারাহ্ ওর মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,
“কয়টা মেয়ের য°ন্ত্র°ণা স°হ্য করছেন, মিস্টার?”

আহনাফ মুখ টিপে হেসে ওর কাছে গিয়ে বলে,
“আমি যাই করি, এখন তুমি কিছু সহ্য করো।”
“এটা বাস, তোমার বাসা না।”
“তুমি বললে বাসরও বানাতে পারি।”
“ছি।”

সারাহ্ ওকে একটু ধা°ক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। আহনাফ হাসতে থাকে।

তারপর সিরিয়াস একটা চেহারা করে বলে,
“কেন বাসায় যেতে চাচ্ছো?”
“মনে হচ্ছে আম্মু কিছু জানে বাট লুকাচ্ছে।”
“অফিসারকে বললে না কেন?”

সারাহ্ একটু চুপ থেকে বলল,
“অফিসার নাইমাকে জানিয়েছি, উনি বলেছেন আম্মুকে নজরে রাখবেন।”
“তবে তো হলোই।”
“যদি আম্মুর কোনো সমস্যা হয়।”

আহনাফ সিটে হেলান দিয়ে সারাহ্-র দিকে তাকিয়ে বলল,
“মেয়েগুলো যা এক°রো°খা, মা নিশ্চয়ই আরো বেশি হবে। নো টেনশন।”
“আমার মা আপনার শাশুড়ী হয়।”
সারাহ্ কি°ড়মি°ড়িয়ে কথাটা বলে।

আহনাফ চোখ বন্ধ করে হাসতে থাকে। সময়ে অসময়ে, কারণে অকারণে সারাহ্-কে রাগাতে তার ভালোই লাগে।
______________________________________

ইমতিয়াজ পুরো রুমটা ঘুরে ঘুরে দেখছে। জানলা দরজা বেশ ভালো মতো সিল করা। খোলার কোনো উপায় নেই আর ওর তো একহাত ভা°ঙা, চেষ্টাও করতে পারছে না। ওয়াশরুমে কোনো জানলা নেই। এক কথায় বাইরের পরিবেশ থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে ওদের।

নীলুফার দুপুরে এসে খাবার দিয়ে গেছে। ইমতিয়াজ একটু চুপচাপ থাকার চেষ্টা করছে, ঠান্ডা মাথায় ভাবছে সবকিছু। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে এতো এতো ঘটনা ঘটেছে যে তা একমুহূর্তে বোঝা সহজ নয়।

নীলুফার দরজায় নক করে বলে,
“আসবো।”

ইমতিয়াজের উত্তরের অপেক্ষা না করে সে ভিতরে আসে। ইমতিয়াজ তার দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমার ফোন কোথায়?”

মৃত্তিকার স্যালাইন খুলতে খুলতে স্বাভাবিক সুরে বলে,
“আমি জানি না, আপনি নিজেকে যে খুঁজে পেয়েছেন এটাই বেশি।”

ইমতিয়াজ কিছু বলে না, শুধু চোখ কুঁচকায়। নীলুফার আবার বলে,
“কবরে পড়ে ছিলেন তাই উপরে একটা লা°শ নিয়ে। জ°ব্ব°র লোক আপনি।”

ইমতিয়াজ একটু চুপ থেকে বলে,
“কার লা°শ ছিলো? (একটু থেমে) আই মিন, পুরুষ নাকি নারী?”

নীলুফার হেসে বলল,
“নারী নিয়ে কবরে যাবেন?”

তারপর হো হো করে কিছুক্ষণ হেসে বলে,
“পুরুষ ছিল। একজন নারী পাশে পড়ে ছিল।”

ইমতিয়াজ বুঝতে পারে এরাই সেই দুজন যারা ওকে মা°রা°র চেষ্টা করেছে। আবারো প্রশ্ন করে,
“ওরা কিভাবে মা°রা গেছে?”

নীলুফার মৃত্তিকার সব ইলেকট্রোড খুলছে। কাজ থামিয়ে বলল,
“একেকজনকে তিনটা করে গু°লি করা..”

নীলুফার কথা শেষ হওয়ার আগেই পেছন থেকে পল্লবী বলল,
“একদম বুকে দুইটা, হৃদ°পিণ্ড ছি°ন্নভি°ন্ন হয়েছে ওদের।”

ইমতিয়াজ চমকে উঠে পিছন ফিরে। পল্লবী আলতো করে হেসে নীলুফারকে বলে,
“ওকে নিয়ে আসো।”

মৃত্তিকার বেডটা নিয়ে যেতে চাইলে ইমতিয়াজ বাধা দেয়।
“কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন ওকে?”
“এম আর আই করাতে হবে।”

পল্লবীর উত্তরটা ইমতিয়াজের পছন্দ হলো না। অপরিচিত দুজন নারী, যতই ওদের বাঁচাক না কেন বিশ্বাস করা সমীচীন নয়। নিরীহ সেজে ধোঁকা দেয়ার লোকের অভাব নেই।

“আমি সাথে যাবো।”

ইমতিয়াজের কথার জবাব দেয়ার আগে সে আবারো বলে,
“যাবো মানে যাবো, কোনো প্রশ্ন নয়।”

পল্লবী মাথা নাড়িয়ে বলল,
“ঠিক আছে।”

মৃত্তিকাকে নিয়ে যাওয়া হলো। ইমতিয়াজও সাথে যাচ্ছে। সাদা রঙের দেয়ালগুলো দেখছে সে, পাশে থাকা চেয়ারগুলো সাদা, জানলা-দরজার গ্রিল ও পর্দাও সাদা। নীলুফার আর পল্লবীর পোশাকও সাদা।

এম আর আই রুমে গিয়ে নীলুফার সব ঠিক করছে। ইমতিয়াজ পল্লবীকে বলে,
“এসব মেশিন চালাতে তো এক্সপার্ট লোক লাগে। এখানে তো আপনারা ছাড়া আর কেউ নেই।”
“এখানেই অনেক মানুষ আছে, তোমার নজরে তুমি দেখতে পাচ্ছো না।”

ইমতিয়াজ কপাল কুঁচকায়। এই মহিলা যথেষ্ট হেয়ালি করে কথা বলে। কোথায় মানুষ? থাকলে সে দেখবে না কেন?

এখানেও সব সাদা। প্রত্যেকটা জিনিস সাদা। এক অদ্ভুত শুভ্রতা সবকিছুতে।

“এখানে সবকিছুই এমন সাদা কেন?”

ইমতিয়াজের প্রশ্নে পল্লবী একটা রহস্যময় হাসি হেসে বলল,
“কা°ফ°নের রঙ তো শুভ্রই হয়। অন্য কোনো রঙ দেখেছো নাকি?”
______________________________________

লুৎফর রহমান ও তানজিম এসেছে রমনা থানায়। ইমতিয়াজ আর মৃত্তিকা নি°খোঁজ, কিন্তু বাসায় ওদের নিয়ে কোনো কথাই হচ্ছে না। সবাই চিন্তিত কিন্তু কেইসের কথা বললেই কেমন যেন গু°ম°রে যায়। অবশেষে আর কোনো উপায় না পেয়ে দুজনে থানায় আসে।

ইন্সপেক্টর রাব্বি উনাদের সব কথা শুনে, উনাদেরকে সাথে নিয়ে ইমতিয়াজের বাসায় আসেন। দরজা খুলেই সবাই অবাক।

বাসা গোছানো, পারফিউম পাওয়া যাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগেই যেন সবকিছু গোছানো হয়েছে। মিউ মিউ করে বিড়ালটা আসলো, সেও একদম ফুরফুরে মেজাজে আছে। তিনচারদিন ধরে ইমতিয়াজ নেই, তার তো না খেয়ে থাকার কথা৷ অথচ সে আরামে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার বাটিতে খাবার-পানি সব আছে।

ইমতিয়াজের শোবার ঘরে গিয়ে আরেকদফা অবাক হতে হলো তাদের। এই রুমটা আরো গোছানো, পরিপাটি। বিছানা একদম টানটান অবস্থায় আছে। রান্নাঘরে গিয়ে বুঝলো চুলা গরম, অর্থাৎ এখানে রান্না হয়েছে। সিংকের পাশে খুয়ে রাখা থালা-কাপ, তারমানে কেউ খেয়েছে।

রাব্বি সব ঘুরে ঘুরে দেখে বলল,
“আপনারা বললেন আজকে নিয়ে চারদিন উনি নি°খোঁজ, অথচ ঘর দেখে মনে হচ্ছে উনি আজকেও বাসায় ছিল। কেন?”

তানজিম কি বলবে বুঝতে পারছে না। ইমতিয়াজ কি তাদের সাথে আর যোগাযোগ রাখতে চাইছে না? এতো লুকোচুরি কেন?

“যা হোক, আপনারা শুধু শুধুই আমাদের সময় নষ্ট করেছেন।”

এবারে তানজিম মুখ খুলে,
“কিন্তু ওই ম্যাসেজ।”
“হয়তো গিয়েছিল আর ফিরেও এসেছে।”
“তবে মিউকো আপু কোথায়?”

তানজিমের কথায় রাব্বি আবারো রান্নাঘরের দিকে তাকায়। তারপর বলে,
“চলে আসবে।”

একজন কন্সটেবল সাথে এসেছিল। তাকে নিয়ে নিরবে বেরিয়ে যায় রাব্বি। ওদের কথার কোনো গুরুত্বই রাব্বি দেয়নি। কোনো কে°ইস নেয়নি। তার ভাবসাবে মনে হয়েছে ইমতিয়াজ একটু আগে উনার সাথেই চা খেয়ে আড্ডা দিয়ে গেছে।
______________________________________

পরদিন সকালে,

বাসায় কোনো এক অতিথি আসবে৷ তাই বেস ভালো করেই যোগাড় করা শুরু করেছেন নার্গিস পারভিন। বাসার কাজের খালাকেও সকাল থেকে ব্যস্ত করে রেখেছেন।

সামিহা নিজকক্ষে আরামে ঘুমাচ্ছিল। শনিবার, ভার্সিটিতে ক্লাস নেই, এই কারণে বেশ আরামেই ঘুমাচ্ছে সে।

নার্গিস পারভিন এসে লাইট জ্বালিয়ে বলেন,
“ঘুম ছাড়াও জীবনে অনেক কিছু থাকে। তোমার তো আর কোনো উদ্দেশ্য নেই। উঠে ফ্রেশ হও, মেহমান আসবে।”

সামিহা মাথাটা একটু তুলে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে,
“কে আসবে?”
“তোমার এক আন্টি।”

সামিহা আবারো শুয়ে বলল,
“আমাকে দেখতে তো আর আসছে না। তবে আমি কেন উঠবো।”

ওর গায়ের কাঁথা সরিয়ে নিয়ে বলেন,
“উঠো, উঠে পড়ো।”

সামিহা চোখ কচলে উঠে ওয়াশরুমে চলে গেল। মায়ের মেজাজের এমন চৌদ্দটা বেজে আছে কেন তা ওর জানা নেই। কোন দেশি মেহমান আসবে তা ও দেখতে চায়।
______________________________________

“মিউকো চেয়েছিল শেয়ার কিনতে, অথচ এখন হুট করে লা°পাত্তা। ফোন ধরছে না, কোনো ম্যাসেজের রিপ্লাই দিচ্ছে না। ঘটনা কি?”

ইসরাত আপন মনে বকবক করছে আর মৃত্তিকাকে ম্যাসেজ করছে। মৃত্তিকা ম্যাসেজ সিন করছে কিন্তু রিপ্লাই দিচ্ছে না। ইসরাত কল দেয়, রিসিভ হয় না।

রাগে ফোন রেখে ইসরাত বসে থাকে। এ কেমন ব্যবহার ওর। শেয়ার কেনার কথা বলে এখন নিজেই চুপ, ও কি সারাবছর দেশে বসে থাকবে।

এদিকে মৃত্তিকা আর ইমতিয়াজের ফোন আছে শরীফের কাছে। টেবিলে থাকা দুজনের ফোন ক্রমাগত হাতে নিয়ে ঘুরাচ্ছে উনি। মৃত্তিকা শেয়ার কেনার জন্য দেশে ছিল, এই কথাটা মাত্রই জেনেছে।

“মিউকো, আমার মেয়ে আমার দিকেই গেছে। কলবরকে নিশ্চয়ই সে চিনেছে। ওই ফ্যামিলিটা ভালোই থাকতো যদি আমাকে ভালো থাকতে দিতো।”

টেবিলের উপর থেকে পেপারওয়েটটা নিয়ে ছুড়ে ফেলে বলল,
“রিপা, শুধু তুমি বুঝোনি। তোমার মেয়েও সত্যটা ধরেছে আর তুমি..”

রাগে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছে শরীফ। বয়সের ভারে এখন চেঁচামেচি তার জন্য বেশ ভারি হয়। কাঁপতে কাঁপতে বলল,
“তুমি যদি আগে বুঝতে তবে অকালে তোমাকে ম°র°তে হতো না।”
______________________________________

বিকাল চারটা ত্রিশ,
মৃত্তিকার বিছানাটার পাশে ফ্লোরে বসে পেছনের ছোট টেবিলটায় হেলান দিয়ে বসে আছে ইমতিয়াজ। শরীর তারও বেশ খারাপ করছে। এই শুভ্র রঙ আর এতো এতো চিন্তায় মস্তিষ্ক কাজ করা থামিয়ে দিচ্ছে বোধহয়।

হাতের আঙ্গুলে এক দুই করে গুণছে আর ভাবছে ইমতিয়াজ।

মৃত্তিকা বলেছিল তিনটা মৃ°ত্যু°র পেছনে তার বাবার হাত থাকতে পারে। ওর বাবার ওর পিছনে স্পা°ই দিয়েছে।

ওর বাবার কাছে পি°স্ত°ল আছে। আবার গো°রস্থানে ওই দুজনকে গু°লি করা হয়েছিল।

মৃত্তিকাকে মারার আগে ওর কাছে চিঠি এসেছিল। “ওই বাসা” মানে ওর মামার বাসা থেকে বের করতে হতো। শাফিন সাহেবের বাসায় কি ভয়?

খুঁড়ে রাখা কবরের সাথে লাগানো পাথরে মৃত্তিকার নাম ছিল। আগেভাগেই কেউ তা তৈরি করে। তবে কি এটা পূর্বপরিকল্পিত খু°ন?

গো°র°স্থানে লোকটা বলেছিল “তাহমিনার হাসবেন্ডই পরবর্তী লোক।” তারমানে কেউ ওকে আগে থেকে পয়েন্টে রেখেছে।

ইমতিয়াজ নিচুস্বরে বলে উঠে,
“তবে কি সত্যিই তিনজনকে খু°ন করা হয়েছিল?”

ইমতিয়াজ লাফিয়ে উঠে বসে। এতদিন পর এমন একটা চরম সত্য উপলব্ধি করে সে স্তম্ভিত। সবকিছুই পূর্বপরিকল্পনায় হয়েছে। ঠান্ডা মাথার কোনো ব্যক্তি এই পরিকল্পনার মূলে আছে।

কে সে? মৃত্তিকার বাবা? ডি°ভো°র্সের এতো বছর পর উনি কেন রিপা বেগমকে খু°ন করবে? তাও দেশে এনে।

দরজা ঠেলে ভিতরে আসে পল্লবী। ইমতিয়াজকে দেখে মুখ টি°পে হেসে বলে,
“মৃত্তিকার রিপোর্ট দেখলাম।”

ইমতিয়াজ হাতে থাকা কাঁ°চি°টা শক্ত করে ধরে বলে,
“কি এসেছে রিপোর্টে?”

রিপোর্টগুলো অপরপাশের টেবিলে রেখে বলে,
“মোটামুটি ভালো। ওর কো°মা নিয়ে ভ°য় পেয়েছিলাম, তবে এমন কোনো সম্ভাবনা আর নেই।”

ইমতিয়াজ উঠে পল্লবীর পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমাদের এখানে আটকে রাখা হয়েছে কেন?”

পল্লবী ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
“আটকে তো রাখিনি। তবে যেতে দেবো না।”

ইমতিয়াজ কাঁ°চিটা উঁচু করতেই পল্লবী ওর হাতে ও কোমড়ে বেশ জোরে ঘু°ষি দেয়। ইমতিয়াজের কোন কোন স্থানে ক্ষ°ত আছে তা সে ভালো করেই জানে।

ইমতিয়াজ সরে যায়, কোমড়ের ক্ষ°তে আর হাতে প্রচন্ড ব্য°থা হচ্ছে। পল্লবী রাগি কন্ঠে বলে,
“গাধা নাকি তুমি? আমাকে কেন আ°ক্র°ম°ণ করেছো?”
“এই জায়গায় আটকে কেন রেখেছেন?”
কি°ড়মি°ড় করে বলে ইমতিয়াজ।

“কাঁ°চি ফেলো, (ধম°কে উঠে) ফেলো।”

ইমতিয়াজ কাঁ°চিটা ফেলে দেয়। পল্লবী কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে মৃত্তিকার কপালে চুমো দিয়ে বলে,
“জলদি ভালো হয়ে উঠো, মা। পৃথিবী তোমার অপেক্ষায়।”

ইমতিয়াজের দিকে রাগি দৃষ্টি দিয়ে পল্লবী বেরিয়ে যায়। সাথে বন্ধ হয় দরজাটা। ইমতিয়াজ ডানহাতে ধরে এসে নিজের বিছানায় বসে।

চলবে…..

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

ষট্ বিংশ পর্ব (২৬ পর্ব)

“বাসায় কে এসেছিল, এশা?”

বাবার প্রশ্নে সামিহা ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলে,
“কোনো এক রোমি আন্টি।”

জাহাঙ্গীর সাহেব ঠোঁট উল্টালেন। স্ত্রীর কোনো বান্ধুবীকে উনি চিনেন না। শব্দহীন হয়ে নিজকক্ষে প্রবেশের সময় নার্গিস পারভিনকে কারো সাথে কথা বলতে শুনেন,
“আমি ভুল না উনি ঢাকায় থাকার কথা না।”

ফোনের অপরপাশ থেকে রোমি বলেন,
“সিআইডির সাহায্য নেয়া উচিত। তোমার জামাই ঠিক কথা বলছে।”

“কি বলবো? আমার জন্মের আগের ঘটনা এটা, তারপর আমার শৈশব কালেও কিছু ঘটনা ঘটেছে। আমার বাড়ি এক জায়গায় আর এটা ঘটেছে আরেক জায়গায়। মানুষ আমাকে সুস্থ ভাববে?”

রোমি খন্দকার নিরব থাকেন। জাহাঙ্গীর সাহেব অপরপাশের কথা না শুনলেও নার্গিস পারভিনের কথা সবই শুনেছে। উনি দরজা ঠেলে ভিতরে আসেন। নার্গিস পারভিন “রাখছি” বলে কল কে°টে দেন।

“কিসব হচ্ছে? কি ঘটনা ঘটেছে?”

নার্গিস পারভিন শান্ত গলায় হেসে বলেন,
“তেমন কিছু না। আমার এক ফ্রেন্ড এসেছিল, ওর কিছু সমস্যা নিয়েই কথা হয়েছে, কিন্তু সমাধান হয়নি।”

জাহাঙ্গীর সাহেব বিষয়টা নিয়ে আর নাড়াচাড়া করেন না। আলতোভাবে মাথা নাড়েন।
______________________________________

পরদিন ভোরে,
স্বাভাবিকভাবেই গতরাতে ঘুমিয়েছিল ইমতিয়াজ। কিন্তু ঘুমটা ভাঙে তার অস্বাভাবিক ভাবে।

ভোর ভোর তানজিম ডাকছে,
“ভাইয়া, এই ভাইয়া।”

ইমতিয়াজ চোখ খুলে আশেপাশে তাকায়। সাধারণ একটা হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে সে। কোথায় গেল ওই শুভ্র রহস্য?

লুৎফর রহমান পাশ থেকে বলল,
“তুমি ঢাকার বাইরে গেলে, ফিরেও এলে, এ°ক্সি°ডে°ন্ট করলে অথচ একবারও আমরা জানলাম না। চিন্তায় চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম।”

ইমতিয়াজ উঠে বসে বলল,
“তেমন কিছু হয়নি আমার, ঠিক আছি।”
“ঠিক নেই তুমি ভাইয়া। আমরা তো পুলিশ কে°ইসও করতে গেছিলাম, ভাগ্যিস করিনি।”

তানজিমের কথায় ইমতিয়াজ মাথা নাড়ে। বলে,
“মৃত্তিকা?”
“আপু বিশেষ কেবিনে, জ্ঞান ফেরেনি।”

ইমতিয়াজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর উঠে বেরিয়ে আসে। ভোররাত এখনো হয়তো ফজরের আযান দেয়নি। তবুও এখানে কত মানুষ। ওই শুভ্র দিনগুলোকে স্বপ্ন ভাবছে ইমতিয়াজ, হয়তো সে ঘুমিয়ে ছিল। কিন্তু তা তো বাস্তব, এক অচেনা বাস্তবে ছিল সে।

পাশ দিয়ে ডা. পল্লবী যায়। ইমতিয়াজকে দেখে আলতো হেসে চুপ থাকতে ইশারা করে চলে যায়।

মৃত্তিকার কেবিনের সামনে মমতাজ বেগম আর শাফিন সাহেব বসে আছে। ইমতিয়াজকে দেখেই মমতাজ বেগম উঠে এসে ওকে ধরে কান্না করে দেয়। শাফিন সাহেব বললেন,
“কেমন আছো?”

ইমতিয়াজ কাঁচের জানলা ছাড়িয়ে ভিতরে মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“মৃত্তিকার চেয়ে অনেক ভালো আছি।”
“এই কয়দিন কোথায় ছিলে?”

ইমতিয়াজ ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে পল্লবীকে দেখে বলে,
“এখানেই ছিলাম।”
“তোমার বাসায় কে ছিল ভাইয়া?”

পাশ থেকে কথাটা বলে তানজিম। ইমতিয়াজ তাকালে তানজিম আবারো বলে,
“আমি তোমার বাসায় গিয়েছিলাম, বাসা একদম সাজানো গোছানো ছিল।”

ইমতিয়াজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে মি°থ্যা একটা কথা বলে দেয়,
“আমার বন্ধু ছিল।”

পুরো সত্য সে নিজেও জানে না৷ এখন সবাইকে বলা মানে মৃত্তিকার জীবনে আরো দুঃখ টে°নে আনা আর রহস্যটা অধরা থেকে যাওয়া। ওই জীবন্ত স°মা°ধী আর শুভ্রতার রহস্য যে তাকে খুঁজতেই হবে।

তানজিম ওকে টে°নে একটু দূরে এনে ম্যাসেজটা দেখিয়ে বলে,
“এটা কে দিয়েছে?”

ইমতিয়াজ কপাল কুঁচকে বলল,
“আমি না, আমার ফোনই তো আমার কাছে নেই।”

তানজিম মামা, মা আর বাবার দিকে তাকায়। এই পরিবারের উপর কার এমন নজর পড়লো।

তানজিম চলে যেতে নিলে ইমতিয়াজ ওকে বলল,
“এখন একটু চুপ থাকো, বিষয়টা কাউকে জানিও না।”
“কোনো সমস্যা ভাইয়া?”

ইমতিয়াজ তানজিমের কানের কাছে গিয়ে বলে,
“চুপ থাকতে বলেছি, চুপ থাকো। সবকিছুর সময় আসছে।”

ইমতিয়াজ চলে যায়। পল্লবীর কেবিনে গিয়ে দরজায় নক করে। পল্লবী বলে,
“আসো, ইমতিয়াজ।”

ইমতিয়াজ ভিতরে গিয়ে বেশ শক্ত কন্ঠে বলল,
“আমাদের ফোন থেকে আপনি সবাইকে ম্যাসেজ করেছেন?”

পল্লবী ড্রয়ার থেকে ফোন বের করে ওর হাতে দিয়ে বলে,
“আপনা থেকে চলে গেছে।”
“হেয়ালি করবেন না।”
“ওকে, আমি দিয়েছি।”

পল্লবী নিজের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বলল,
“ডা. পল্লবী মহৎ মানুষ, এটা সবাই জানে।”

ফজরের আযান শুনে ইমতিয়াজ আর কিছু না বলে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে চলে যায়। এই মহিলা একটা রহস্যের কু°ন্ড°লী, এমনভাবে পাঁ°ক লেগেছে যে খুলে আসা কঠিন।
______________________________________

আজ বেশ তাড়াতাড়ি কলেজে চলে এসেছে আহনাফ ও সারাহ্। প্রায় সাড়ে সাতটায় কলেজে এসে হাজির, কিন্তু ক্লাস শুরু নয়টায়।

কলেজ গেইট ছাড়িয়ে ভিতরে আসতে আসতে সারাহ্ বলে,
“এতো তাড়াতাড়ি আসলে কেন?”

সারাহ্-র প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আহনাফ পালটা প্রশ্ন করে,
“ব্যাটমিন্টন খেলতে পারো?”

সারাহ্ মাঠের দিকে তাকায়, কতগুলো ছেলে মেয়ে ওখানে ব্যাটমিন্টন খেলছে। সে মাথা নাড়ে,
“হ্যাঁ, পারি।”

আহনাফ ঠোঁট বাকিয়ে হেসে বলে,
“ওকে, ব্যাগ রেখে মাঠে আসো।”

সারাহ্ চোখ কুঁচকে বলল,
“কলেজ মাঠে আমি এখন ব্যাটমিন্টন খেলবো?”
“আমি না আমরা, তাড়াতাড়ি যাও।”

আহনাফ নিজের ব্যাগটা এক ছাত্রের হাত দিয়ে টিচার্স রুমে পাঠিয়ে দেয়। শার্টের হাতা গু°টাতে গু°টাতে গিয়ে ব্যাট নিয়ে খেলতে শুরু করে।

সারাহ্ ব্যাগ রেখে এসে কলেজের বারান্দায় দাঁড়ালো। আহনাফ ওর দিকে কর্ক ছুঁড়ে বলে,
“আসো, দেখি তুমি কেমন খেলতে পারো।”

সারাহ্ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে। আহনাফ সবাইকে বলে,
“ম্যাডামকে একটু জায়গা দাও, দেখি শুধু বিক্রিয়াই লিখতে জানে নাকি খেলতেও পারে।”

পাশ থেকে এক ছেলে বলে,
“স্যার, আপনার সাথে পারবে না।”

আহনাফ কলার টে°নেটু°নে বলল,
“সেটা আমি জানি।”
“ভাব কম নেন ফয়েজ স্যার।”
সারাহ্ একটু জোরে কথাটা বলে গিয়ে ব্যাট হাতে নেয়।

দুজনে খেলা শুরু করে। আহনাফ সারাহ্-র থেকে বেশ লম্বা হওয়ায় ওর একেকটা শট ছোটখাটো সারাহ্-র মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে।

সারাহ্ রাগ করে তাকায় ওর দিকে। আহনাফ বাম চোখ টিপে বলে,
“ম্যাডাম, বেশি উঁচু হচ্ছে।”
“এসব ঠিক না, ফয়েজ স্যার।”

আহনাফ হাঁটু গেড়ে দুহাত মেলে বসে বলল,
“এবারে চলবে।”

সারাহ্ লজ্জা পেয়ে যায়। এতোগুলো স্টুডেন্টের সামনে এমন এক ব্যবহার আহনাফ করছে যে কোনো স্ত্রীই লজ্জায় পড়বে। ছেলে মেয়েগুলো বেশ হাসাহাসি করছে। সারাহ্ ব্যাট রেখে চলে গেল। এই লোকই তো বোর্ডের সামান্য কথা লেখায় ওকে বকেছিল।

আহনাফ সবাইকে বলে,
“ম্যাডামের সমস্যা আছে নাকি মাথায়?”

ছাত্রছাত্রীরা আবারো হাসছে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য আহনাফেরও আর খেলা হলো না। সারাহ্-র পর সেও চলে যায়।
______________________________________

দুইদিন পেরিয়ে যায়৷ মৃত্তিকার জ্ঞান ফিরেছে গতরাতে। মমতাজ বেগম কথা বলতে চাইলেও মৃত্তিকা কথা বলেনি, বরং চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল।

দুপুরের পর ইমতিয়াজ মৃত্তিকাকে দেখতে এসেছে। তার ডানহাত এখনো গলায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। চেয়ার টে°নে পাশে বসে সে। মমতাজ বেগম বাইরে গেছেন অনেকক্ষণ হলো।

মৃত্তিকা চোখ খুলে ইমতিয়াজকে দেখে, সে আপন মনে ফোন দেখছে। মৃত্তিকা নিচুস্বরে বলল,
“কেমন আছেন?”

ইমতিয়াজ ওর দিকে তাকায়।
“ভালো।”

হাঁটুতে বামহাতের কনুই দিয়ে ভর রেখে সামনে ঝুঁ°কে ইমতিয়াজ বলে,
“আপনার এই অবস্থা কে করেছে জানেন কিছু?”

মৃত্তিকা সিলিং এর দিকে তাকিয়ে বলে,
“শ°ত্রুদের যদি চিনতে পারতাম, তবে আজকে ভালোই থাকতাম।”

ইমতিয়াজ সোজা হয়ে বসে। মৃত্তিকা ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“মৃ°ত্যু সহজ নয়, এরচেয়েও বেশি কষ্ট আমার মাম পেয়েছে।”

ইমতিয়াজের হৃদপিণ্ডের কাঁ°পুনি বাড়ে। মৃত্তিকার মাম তো একা ছিল না সেদিন। তাহমিনা যে সাথে ছিল।

মৃত্তিকা ক্যা°নো°লা লাগানো হাতটা ইমতিয়াজের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“ওটা দু°র্ঘ°টনা ছিল না, মামকে ইচ্ছা করে মে°রেছে ওরা। ভালো মানুষ থাকায় তাহসিনা আর তাহমিনাকে একই পথের যাত্রী হতে হয়েছে।”

ইমতিয়াজ উঠে যেতে নিলে মৃত্তিকা ওর হাতের উপর হাত রাখে। ইমতিয়াজ থেমে যায়। মৃত্তিকার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে।

“আমি এতোটা ভালো মানুষ নই, (একটু থামে) আর ভালো হতেও পারবো না।”

ইমতিয়াজ ওর হাতের দিকে চেয়ে থেকে বলল,
“হয়তো আপনিও ভালো মানুষ, নাহলে এভাবে কেউ মা°রতে চাইতো না।”

মৃত্তিকা হাতটা সরিয়ে নেয়। ঘাড় না°ড়াতে এখনো কষ্ট হয় তার। তবে নিজের ব্য°থাগুলো থেকে বেশি ব্য°থা মামের জন্য পাচ্ছে সে।

ইমতিয়াজ একটু বসে থেকে উঠে যায়। মৃত্তিকা আবারো চোখ বন্ধ করে। দরজার বাইরে এসে কান্না করে দেয় ইমতিয়াজ। জীবন ওর সাথে এই খেলাটা কেন খেললো?
______________________________________

সাড়ে তিনটায় ডিপার্টমেন্ট থেকে বের হয়েছে তানজিম ও সামিহা। শেষ কয়েকদিন তানজিম খুবই চুপচাপ আছে, জরুরি কথা ছাড়া বাড়তি কোনো কথা নেই। ইমতিয়াজ-মৃত্তিকার হারিয়ে যাওয়ার গল্প সামিহাকে শুনিয়েছে, অসুস্থতার কথাও বলেছে। কিন্তু তার এমন নিরবতায় সামিহা কষ্ট পাচ্ছে।

তানজিম বাসায় যাওয়ার পথ ধরলে সামিহা এসে ওর একহাত জড়িয়ে ধরে বলল,
“তানজিম, চল আজকে মিউকোপুকে দেখতে যাই।”
“আজ না অন্য দিন।”
নির্বিকার হয়ে জবাব দেয় তানজিম।

তানজিমের মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,
“রেগে আছিস?”
“না।”
“তবে চুপ কেন?”

তানজিম থেমে গিয়ে বলল,
“নিজের পরিবারের মানুষগুলোকে বিশ্বাস হচ্ছে না আমার। দুজন মানুষ হুট করে নিখোঁজ আর আমার ফ্যামিলি হাত পা গু°টিয়ে ছিল। (একটু থেমে) বাবা একটু খুঁজেছে তবে মামা তো চেষ্টাও করেনি।”

সামিহা কপাল কুঁচকায়। পারিবারিক অশান্তিতে আছে বেচারা। তানজিম হাঁটতে হাঁটতে বলল,
“মিউকোপু মামার বাসা থেকে গা°য়েব হয়েছিল, কিন্তু মামা বিষয়টা গায়ে মাখেনি।”
“তানজিম, এতো চিন্তা করিস না প্লিজ।”
“চিন্তাই করতে পারছি না আমি।”

উঁচু ফুটপাতের ধারে বসে পড়ে তানজিম। হাত দিয়ে মুখে ঢেকে বসে থাকে। সামিহা পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
“তানজিম, বাচ্চাদের মতো ব্যবহার করিস না। মানুষ দেখছে।”

তানজিম কিছুক্ষণ এভাবে বসে থেকেই বলে,
“তুই চলে যা সামি। আমার সাথে আর মিশবি না।”
“কেন?”

তানজিম ধ°ম°কে উঠে বলে,
“চলে যা বলছি।”

তানজিমের এলোমেলো কথা গুছাতে পারলো না সামিহা। বরং ওর কথার ঢংয়ে কষ্ট পেল। নিরবে চলে গেল সে। তানজিমকে শান্ত করার পরিবর্তে আরো অশান্ত করে দেয় ছোট মেয়েটা।
______________________________________

“ঐশী, আজকে একটু পাস্তা করো তো।”
“যাচ্ছি যাচ্ছি।”

মাগরিবের নামাজ পড়ে বাসায় এসেই কথাটা বলে আহনাফ। সারাহ্ সবে নামাজ সেরেছে। জায়নামাজ রেখে চুল আঁচড়াতে নিলে আহনাফ বলল,
“অনেক সুন্দর লাগছে, এখন তাড়াতাড়ি যাও। আমার ক্ষুধা লাগছে।”
“আহা, ফয়েজ।”

সারাহ্ কোনোমতে চুলগুলো খোঁপা করে রান্নাঘরে এলো। পাস্তা সিদ্ধ বসিয়ে অন্য চুলায় হোয়াইট সস বানাতে শুরু করলো।

আব্বাস সাহেব এসে রান্নাঘরের দরজা দাঁড়ায়। সারাহ্-র কাজের ক্ষি°প্র°তা কিছুটা আহনাফের মায়ের মতো। রান্নাঘর নিজের মতো করে গুছিয়েছে।

সারাহ্ দরজার দিকে না তাকিয়েই বলল,
“ফয়েজ, রান্না চলছে। তুমি একটু ওয়েট কর। সবকিছুতে অতিরিক্ত তাড়াহুড়ো।”

আহনাফ মাত্র ডাইনিং এ এসেছে। আব্বাস সাহেব হেসে বলেন,
“আমি ফয়েজ, তবে আব্বাস ফয়েজ।”

সারাহ্ জিভ কা°ম°ড়ে ধরে চোখ বন্ধ করে। আহনাফ শব্দ করে হেসে দেয়। আব্বাস সাহেব ড্রইংরুমে গিয়ে টিভি ছেড়ে বসেন।

সারাহ্ কপাল চা°প°ড়ে বলে,
“দেখা তো লাগে।”

আহনাফ এসে ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আহারে, বাসার নিরীহ বউটার শশুড়ের সামনে উলটা কথা বেরিয়েছে।”
“সরুন।”

আহনাফ সরে না। সারাহ্-র ঘাড়ের চুলগুলো সরিয়ে চুমো দিয়ে বলে,
“জলদি খাবার দাও।”

সারাহ্ ওকে ধা°ক্কা দিয়ে সরিয়ে বলে,
“আমাকে খেয়ে ফেলেন, রান্না করতে দিচ্ছে না আবার বলে জলদি খাবার দেও।”

আহনাফ হো হো করে হেসে বলল,
“তোমাকে খেলে আমি সারাদিন কাকে বি°র°ক্ত করবো।”

আহনাফ ড্রইংরুমে চলে আসে। কিছুক্ষণ পর নাস্তা সাজিয়ে নিয়ে সারাহ্ও এখানে আসে। আব্বাস সাহেবের হাতে বাটি দিয়ে বলল,
“বাবা, নিন।”

তিনজনে একসাথে খেতে বসে। আব্বাস সাহেব একচামচ খাবার মুখে নিয়ে বলল,
“রোজার রান্নার হাত অনেক ভালো ছিল।”

সারাহ্ উনার দিকে তাকিয়ে বলে,
“রোজা কে?”

আব্বাস সাহেব আলতো হেসে বলেন,
“তোমার শাশুড়ী আম্মা, রোজার নামের সাথে মিলিয়ে আফরোজার নাম রাখা হয়েছে। মেয়েটা পুরো মায়ের মতো। আর তুমিও রোজার মতোই সংসার গুছাতে পেরেছো।”

সারাহ্ মুচকি হাসে। আহনাফ বলে,
“গুছাতে গিয়ে তোমার ছেলেকে পাজেল করে নাজেল বানিয়ে ছেড়েছে।”

সারাহ্ চোখ পাকিয়ে তাকায় ওর দিকে। আহনাফ মনের সুখে খাচ্ছে। আব্বাস সাহেব ওদের অবস্থা দেখে হাসেন।

চলবে…..

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

সপ্তবিংশ পর্ব (২৭ পর্ব)

আজ বেশ কয়েকদিন পর গো°র°স্থানে এসেছে ইমতিয়াজ। ফজরের পর মসজিদ থেকে বেরিয়ে সোজা এখানে চলে এসেছে। রিপা বেগমের কবরের পাশের দুটো কবরের দিকে তাকায় সে।

“এগুলোই কি ওইদিন খু°ন হওয়া দুজনের কবর?”
কথাটা ভেবে এগিয়ে যায় তাহমিনার কবরের কাছে।

আজ সে নিরব, অনুভূতিহীন। কোনো কথা সে বলছে না, বলে চাচ্ছেও না। মেয়েটার কি এমন দোষ ছিলো আর ওই বেবিটার কি দোষ ছিল, যে পৃথিবীর আলোই দেখেনি। কি দোষ থাকতে পারে ওদের? শত্রুতা যদি রিপা বেগম আর তার মেয়ের সাথে থাকে, তবে তাহমিনা আর তাহসিনার এ অবস্থা কেন?

লোহার দরজায় গড়গড় শব্দ করে ভিতরে আসে শরীফ। ইমতিয়াজ একবার তার দিকে তাকায়।

রিপা বেগমের কবরের সামনে এসে দুহাত মেলে দোয়া করে। তারপর ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলল,
“অবাক হচ্ছো কেন? তুমি যেমন তোমার স্ত্রীর কবরে এসেছো, তেমন আমিও এসেছি।”

ইমতিয়াজ মাটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,
“যখন বেঁচে ছিল, তখন স্ত্রীর দাম দেননি। এখন এসব করে কি লাভ?”

শরীফ এসে ওর পাশে বসে বলল,
“মানুষ একটা সময় নিজের ভুল বুঝতে পারে। (একটু থেমে) মিউকো আর তোমাকে কিন্তু আমি সেদিন উ°দ্ধা°র করেছি।”

ইমতিয়াজ বুঝতে পারে লোকটা কথা ঘুরাতে চাচ্ছে। মুখ বাঁ°কিয়ে হেসে বলল,
“আমার সন্দেহ হয়েছিল। (একটু থেমে) পল্লবী কে?”
“আমার বোন, মিউকোর ফুফু।”

ইমতিয়াজ মাথা নাড়ে। শরীফ বলে,
“তোমার হাত ঠিক হতে সময় লাগবে। এই কয়েকদিন অফিসে যাবে?”

ইমতিয়াজ কিছুই বলে না। মুখ ঘুরিয়ে তাহমিনার কবরের দিকে তাকিয়ে থাকে। শরীফের সব কথার উত্তর দেয়ার ইচ্ছা তার নেই।

শরীফ বলে,
“তুমি মিউকোকে বিয়ে করবে? বিষয়টা কি সত্য?”

ইমতিয়াজ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি একবারও বলেছি আপনার মেয়েকে আমি বিয়ে করবো?”

ইমতিয়াজ চলে যেতে নিলে শরীফ পেছন থেকে বলল,
“আমার মেয়ে বলো না, ও রিপার মেয়ে।”

থমকে দাঁড়িয়ে ইমতিয়াজ বলল,
“তবে তার পিছনে স্পা°ই লাগিয়েছেন কেন?”
“না হলে আর এসব খবর আসতো না। আর না তোমাকে চিঠি দিতে পারতাম।”

ইমতিয়াজ আর ফিরে তাকায় না। হনহনিয়ে হেঁটে চলে যায়। শরীফ কিছুক্ষণ একই জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। শুধু শুধুই রাগ হচ্ছে তার। নিজের প্রতি রাগ হচ্ছে তার, আবার নিজের রাগের প্রতিও রাগ হচ্ছে। বাইরে এসে সি°গা°রেট জ্বা°লায় সে। নাকমুখ দিয়ে অনবরত ধোঁ°য়া নির্গত করতে থাকে।
______________________________________

দুইমাস পর,
ক্লাসে এসে সামিহা পুরো রুমে চোখ বুলায়। তানজিম কোথাও নেই, তার অর্থ সে এখনো আসেনি বা আসবে না। আজকাল ক্লাসে খুব একটা তাকে দেখা যায় না, আসলেও পিছনের সারির কোনো একটা বেঞ্চে বসে থাকে।

সামিহা বেঞ্চে বসে এখনো চেয়ে আছে দরজার দিকে। কিন্তু তানজিম আসেনা।

ক্লাস শুরুর দশমিনিট পর তানজিম দৌড়ে এসে ক্লাসে ঢুকে।
“মে আই কাম ইন স্যার?”
“কাম ফাস্ট।”
স্যার ধ°ম°ক দিয়ে কথাটা বলে।

তানজিম এসে সামিহার পাশেই বসে পড়ে। জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে আর মুখ দিয়ে “হু, হু” বলে অদ্ভুত একটা শব্দ করছে। সামিহা ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

তানজিম ফিসফিস করে বলল,
“ক্লাস শেষে বাইরে আসিস, কথা আছে।”

হুট করে যেন তার কথায় বিশাল পরিবর্তন এসেছে। সামিহা খুশি হয়ে যায়। তার চোখেমুখে খুশি উপচে পড়ছে। তানজিম ওর হাতটা ধরে, সামিহা বোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকলেও পড়া আর তার মাথায় ঢুকছে না।

সামিহার আঙ্গুলের ভাঁজে আঙ্গুল দিয়ে শক্ত করে ওর হাত ধরেছে তানজিম। শতশত পারিবারিক অশান্তি আসবে, সহস্র সমস্যা থাকবে, জীবনে হাজারো ঝ°ড় আসবে যাবে, তাই বলে কি প্রিয় মানুষের হাতটা এতো সহজে ছাড়া যাবে।

সামিহাকে নিজের মনের কথা জানিয়ে সারাজীবন সাথে থাকার প্রস্তাব দিবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে তানজিম। বহুবার যা বলতে গিয়েও আটকে গেছে তা আজ বলেই দিবে সে।
______________________________________

শারিরীকভাবে বেশ সুস্থ হয়েছে মৃত্তিকা, তবে মানসিক অবস্থা এখনো ভালো নয়। কলরবের বাবার হঠাৎ ব্যবসা ম°ন্দা ও নানান কারণে কোম্পানির তিনটা শেয়ার বিক্রি করতেই হয়েছে। মৃত্তিকা একটা শেয়ার কিনেছে, বাকি দুটো কে কিনেছে তা ওর জানা নেই। আপাতত তা জানান দরকারও তার নেই।

হঠাৎ করে এমন ব্যবসা ম°ন্দা হওয়া ও মৃত্তিকার শেয়ার কেনা কলরবের কাছে একটা ষ°ড়°যন্ত্র মনে হলেও উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে সে কিছুই করতে পারেনি।

ইসরাতের বাবার কোম্পানি আছে, বাবার সাথে সে নিজেও প্রায় আড়াই বছর কোম্পানির অনেক কাজ শিখছে। এসব কু°ট কা°চা°লি সম্পর্কে ইসরাতের জ্ঞান ভালো। সেই ব্যবসা ম°ন্দা করার মূল নেতা ছিল। না না, নেতা নয় নেত্রী।

সারাদিন মিরপুরের অফিসে কাটিয়ে সন্ধ্যায় বাসায় আসে সে। এখনো সে উত্তরা মামার বাসায় থাকে। এতো বড় ঘটনার পরও সে মামার বাসায়ই থাকার সিদ্ধান্তে অটল।

বাসায় আসতেই দেলোয়ারাকে ব্যস্ত দেখে মৃত্তিকা বলল,
“মামানী, কোনো সমস্যা?”

সুরভি নিজের রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে চকলেট খেতে খেতে বলল,
“ভাবখানা দেখো যেন আমার ডেলিভারি পে°ই°ন উঠেছে।”

মৃত্তিকা জোরে হেসে দেয়। দেলোয়ারা রাগ করে বলল,
“ইমতিয়াজ আসবে, শুনোনি?”

মৃত্তিকা সুরভির দিকে তাকিয়ে নিচুস্বরে বলে,
“উনি আবার কেন আসবে?”
“তোমাকে দেখতে।”

মৃত্তিকা কপাল কুঁচকায়।
“দেখতে? আগে দেখে নাই নাকি?”

মৃত্তিকা রুমে চলে যায়। স্কার্ফ খুলে বাচ্চা ছেলেদের মতো সদ্য গজানো চুল আঁচড়াতে শুরু করে। সুরভি বিছানায় বসে বলে,
“সত্যি, বাবার সাথে বিয়ের কথা বলেছে। আজকে তোমার মত নিতে আসবে।”

মৃত্তিকা ঠোঁট উলটে বলল,
“মত নিতে আসবে, ওকে ফাইন। তো মামানী এমন করছে কেন?”
“জামাই আসবে এজন্য।”

মৃত্তিকা চিরুনি রেখে ওয়াশরুমে চলে যায়। এতো ধরনের সমস্যার মাঝে এরকম ঘটনা অ°প্রত্যাশিত।

সন্ধ্যার পর সময়মতো ইমতিয়াজ আসে। শাফিন সাহেব আর দেলোয়ারার সাথে কথা হয়, তাদের অনুমতি নিয়ে মৃত্তিকার সাথে আলাদা কথা বলার সুযোগ পায় ইমতিয়াজ।

ড্রইংরুমেই কথা বলছে ওরা, বাকিরা নিজেদের রুমে চলে গেছে।

সবাই চলে যেতেই মৃত্তিকা সরাসরি প্রশ্ন করলো,
“হঠাৎ বিয়ের পি°নি°ক উঠছে কেন আপনার?”

ইমতিয়াজ চোখ কুঁচকে বলল,
“ভদ্রভাবে কথা বলুন। এটা কোনো পি°নি°ক না, জাস্ট কাউকে বাঁচাতে চাচ্ছি।”
“আহা, উ°দ্ধা°র করছেন।”
ব্য°ঙ্গ করে কথাটা বলে মৃত্তিকা।

ওইযে বলেছিল মৃত্তিকা, সে চাইলে আবেগ অনুভূতি কবেই মে°রে ফেলতে পারতো। সেটাই করেছে সে। মে°রে ফেলেছে, ইমতিয়াজকে ভুলে যাওয়ার জন্য যা যা করার সব করেছে। ভুলতে না পারলেও অন্তত ওর অবস্থা কেউ বুঝতে পারে না।

“বিয়ে করবো মানে বিয়ে হচ্ছে। আপনি রাজি নন কেন?”

মৃত্তিকা আড়চোখে তাকিয়ে বলে,
“কারণ আমার কারণে একবার জীবিত কবরে গিয়েছেন, নেক্সট হয়তো ম°রে কবরে যাবেন।”

ইমতিয়াজ হেসে বলল,
“আপনি আমাকে মৃ°ত্যুর ভয় দেখাচ্ছেন?”
“ধরে নিতে পারেন।”

দরজার ওপাশে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইমতিয়াজ। সে সোফা থেকে উঠে এসে মৃত্তিকার পাশে বসলো। মৃত্তিকার হাত ধরতেই চমকে উঠে সে। ইমতিয়াজ শুধু হাত ধরেনি, মৃত্তিকার হাতের মুষ্টিতে কোনো একটা কাগজ দিয়েছে।

“মৃ°ত্যু যেখানে চরম সত্য, সেখানে তা স্মরণে রাখাই ভালো আর আপনি তা স্মরণ করাতে পারলে আপনাকে সাথে রাখাও ভালো।”
ইমতিয়াজ হাত ছাড়লে মৃত্তিকা কাগজটা ওড়নার নিচে লুকিয়ে ফেলে।

রাতে খাবার একসাথে করে সবাই, এখানেই বিয়ের জন্য বৃহস্পতিবার রাতের সময়টা নির্ধারিত হয়ে যায়। ইমতিয়াজের বাসায় যেহেতু কেউই নেই তাই মমতাজ বেগম আর লুৎফর রহমানই আসবেন অভিভাবক হয়ে। যদিও এসব শুধুই আনুষ্ঠানিকতা।

রাত সাড়ে নয়টায় ইমতিয়াজ বিদায় নেয়। যাওয়ার আগে মৃত্তিকার কানের কাছে বলে যায়,
“কাগজটা দেখার পর এনিহাউ নষ্ট করে দিয়েন। আর কারো হাতে যেন না পড়ে।”

ড্রেস পালটানোর নাম করে ঘরের দরজা লাগিয়ে কাগজ খুলে মৃত্তিকা। দুইটা কাগজ, একটা বড় আর একটা ছোট। ছোট কাগজে লেখা,
“মৃত্তিকাকে বিয়ে করো বা না করো, ওই বাসা থেকে বের করে আনো। হয়তো আজ রাতটাই হয়তো ওর জীবনের শেষ রাত।”

মৃত্তিকা চমকে উঠে। বড় কাগজের হাতের লেখাগুলো ইমতিয়াজের।

“আমি জানি না বিষয়টা আপনি কিভাবে নিবেন। তবে ছোট কাগজটা আপনাকে যেদিন খুনের চেষ্টা করা হয়েছিল সে রাতে অচেনা কেউ পাঠিয়েছিল। পরে বুঝতে পারি চিঠির মালিক আপনার বাবা, আপনার বাবা আমাকেও বাঁচিয়েছে। বিয়ের বিষয়ে আপনি চিন্তিত আছেন জানি। তবে অমত করবেন না। আপনার বাবা আমাকে জানিয়েছে শুক্রবারে হয়তো আপনাকে গুম করা হবে, তবে তার আগে কোম্পানির শেয়ার নিবে আপনার কাছ থেকে। তো আমার কথাটা মেনে নিন আর কিছু অন্যরকম হোক।”

কাগজটা দু°মড়ে মু°চড়ে ফেলে মৃত্তিকা। বাবা নামক ওই লোকটা আবারো ওর জীবনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে আর ইমতিয়াজ তাকে বিশ্বাস করছে। একটা ভ°য় জেগে উঠে মৃত্তিকার মনে, ইমতিয়াজ আবার শরীফের মতো হবে না তো?
______________________________________

পরদিন সকালে,
প্রথম পিরিয়ডে কোনো ক্লাস না থাকায় কলেজের সামনের রাস্তায় হাঁটছে আহনাফ। বেশ আরামে সকালের রোদে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে।

আহনাফের ফোন বেজে উঠে। পকেট থেকে ফোন বের করে আননোন নাম্বার দেখেও রিসিভ করে।

“আসসালামু আলাইকুম।”

অপরপাশ থেকে তানজিম বলল,
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম ভাইয়া। আমি তানজিম।”

আহনাফ রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে পড়ে। একটু ইতস্তত করে বলল,
“আরে তানজিম, কেমন আছো?”
“ভালো আছি ভাইয়া। তুমি ঢাকায় আসো না?”
“মাস দুয়েক হয়েছে গিয়েছিলাম।”
“ওহ, (একটু থেমে) আসলে ইমতিয়াজ ভাইয়ার বিয়ে, তুমি আসলে ভালো লাগতো।”

আহনাফ কলেজের দিকে যেতে যেতে বলল,
“ইমতিয়াজ ভাইয়া বিয়ে করছে?”
“হুম, মিউকো আপুকে।”

মিউকো নামটার সাথে আহনাফের পরিচিতি নেই। তবুও এ ব্যাপারে প্রশ্ন না করে বলল,
“ভালো সিদ্ধান্ত। বিয়ের তারিখ কবে?”
“এইতো বৃহস্পতিবার। তুমি আসতে পারবে?”
“ওহ, তবে তো পরশুদিন। আমি চেষ্টা করবো, কিন্তু কথা দিতে পারলাম না।”

তানজিমের ক্লাসের সময় হয়ে যাওয়ায় তাড়াহুড়ো করে বলল,
“আচ্ছা ভাইয়া, আমার ক্লাস আছে। পড়ে কথা হবে।”
“ওকে, ভালো থেকো।”

তানজিম ফোন রেখে দৌড়ে ডিপার্টমেন্টে যায়। কাল বলবো বলবো করেও সামিহাকে কিছুই বলা হয়নি, আর এই মেয়েটাও হয়েছে একটা বোকা। কিছুই যেন বুঝে না। তানজিম তো আর জানে না সামিহা সব বুঝেও শুনতে চাচ্ছে।

দিনটুকু পেরিয়ে এখন শেষ দুপুর, কলেজের ক্লাস শেষে আহনাফ বের হয়৷ সারাহ্ এখনো টিচার্স রুমে আছে। হয়তো কোনো ম্যাডামের সাথে গল্পে মজেছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দৌড়ে দৌড়ে এসে আহনাফকে বলে,
“তাড়াতাড়ি চলেন।”
“এতো তাড়া এখন। এতোক্ষণ তো নিজেই ঘুমাচ্ছিলে।”

দুজনে হাঁটতে শুরু করে। সারাহ্ বলল,
“ঘুমাইনি তো, একটা গল্প শুনছিলাম। অনেক রোমাঞ্চকর।”

আহনাফ একটা হাই তুলে বলে,
“মেয়েদের গল্প স্বামী, সন্তান ছাড়া আর কি?
“আরে না, ওসব কিছু না। (একটু থেমে) আমাকে শুক্রবারে গোমতী পাড়ে নিয়ে যাবেন?”
“আমি ঢাকায় যাবো।”

সারাহ্ অবাক হয়ে আহনাফের দিকে তাকায়। অনেকদিন হয়েছে ওই কথোপকথন ছাড়া আর কোনো সমস্যা হয়নি, সিআইডি থেকেও কিছুই জানায়নি। বুকের ভেতর অজানা ভ°য় জেগে উঠে সারাহ্।

“ঢাকায় কেন যাবেন?”
“চিন্তা করো না, তেমন কিছু না।”

সারাহ্-র সামনে তাহসিনা বা তার পরিবারের কথা বলা যে অনুচিত তা আহনাফ বুঝে। তানজিমকে না করলে বিষয়টা যেমন খারাপ দেখাবে, তেমনি সারাহ্-কে বলাও হয়তো ঠিক হবে না। অদৃশ্য টা°না°পো°ড়েনের মাঝে পড়ে থাকে আহনাফ।
______________________________________

মৃত্তিকা অফিসে আছে। নিজের কেবিনে পায়চারি করছিল এতোক্ষণ। এখন সে চেয়ার টেনে বসে। ইমতিয়াজকে বিয়ে করা না করা নিয়ে বেশ সুন্দর একটা সংশয় তার।

চোখ বুঝলে একদিকে যেমন একটা গোছানো সুন্দর সংসার দেখে, তেমনি অন্যদিকে নিজের মায়ের সংসারের কথা মনে পড়ে। সেখানে তো শুধু অ°শান্তিই ছিল।

চেয়ালে হেলান দিয়ে বসে ইমতিয়াজকে কল দেয়।

“আপনি কাল ওসব কি লি…”

মৃত্তিকার কথার মাঝেই ইমতিয়াজ বলে,
“কিছুই বলিনি আপনাকে, শুধু বিয়ে করতে বলেছি। আর কিছু না।”

মৃত্তিকা আশেপাশে তাকায়। ইমতিয়াজ কাগজে সব লিখে দিয়েছে, আবার এখন ওকে বলতে দিচ্ছে না। এর অর্থ একটাই এমন কেউ আছে যে ওদের কথা শুনছে।

মৃত্তিকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আমার মত ছাড়াই তো বিয়ের তারিখ ঠিক হয়ে গেল।”

ইমতিয়াজ একটু চুপ করে থেকে বলে,
“লাল শাড়ি পড়বেন না, এই অনুরোধ রইলো।”

মৃত্তিকা সোজা হয়ে বসে। ইমতিয়াজ কল কেটে দিলো। মৃত্তিকার ঠোঁট কাঁ°পছে, চেহারা একটা লাবন্যতা এসেছে, একটু লাজুকতা ভর করেছে। সামনের গ্লাস থেকে ঢ°কঢ°ক করে পানি পান করে নেয় সে, তারপর নিরবে চোখ বুজে।

চলবে……

অনুভূতিরা শব্দহীন পর্ব-২২+২৩+২৪

0

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

দ্বাবিংশ পর্ব

রবিবার সকাল ১০ টা,

ইমতিয়াজ একটা জরুরি কাজে অফিসের বাইরে গিয়েছিল। ফিরে এসে এমডির কেবিনে ফাইলগুলো জমা দিয়ে নিজের কেবিনে আসে।

কেবিনে এসে তানজিমকে দেখে অবাক হয়। তানজিম স্বাভাবিকভাবে হেসে বলে,
“ভালো আছেন ভাইয়া?”

ইমতিয়াজ মাথা নেড়ে বলল,
“হ্যাঁ, হঠাৎ অফিসে?”

ইমতিয়াজ নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলো। তানজিম বলে,
“আপনি আবারো বিয়ে করবেন ভাইয়া?”

ইমতিয়াজ চমকে উঠে তানজিমের দিকে তাকায়। ভূমিকা ছাড়া হঠাৎ এমন কথায় সে হতভ°ম্ব। গতরাতে ফোনে লুৎফর রহমান ইমতিয়াজকে বিয়ের কথা বললেও ইমতিয়াজ হ্যাঁ বা না কোনো উত্তর দেয়নি। লুৎফর রহমানও জোর করেননি।

তানজিমের কথায় ইমতিয়াজ হেসে বলে,
“কনে, কাজী সব নিয়ে আসছো নাকি?”

দুষ্টুমির ছলে কথাটা বললেও তানজিমের মুখে হাসি এলো না। ইমতিয়াজ সিরিয়াস হয়ে বলল,
“কি সমস্যা তানজিম?”

হঠাৎ তানজিমের কন্ঠ পরিবর্তিত হয়। একটু ক°ড়া ভাষায় বলে, যেন ইমতিয়াজকে হুমকি দিচ্ছে সে।

“মিউকো আপু তোমাকে বিয়ে করতে চায়। বাবা অথবা মামা যদি বিয়ের প্রস্তাব আনে তবে সোজা না করে দিবে।”

ইমতিয়াজ হাত নেড়ে বলল,
“শান্তভাবে কথা বলো, এটা অফিস।”
“সো হোয়াট, মিউকো আপুকে তুমি বিয়ে করতে পারবা না।”

তানজিমের ফোন বেজে উঠে। দুইবার বাজলে ইমতিয়াজ বি°র°ক্ত হয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বলে,
“ফোন বের করো।”

তানজিম ফোন বের করে৷ ইমতিয়াজ কল কে°টে ফোনটা সাইলেন্ট করে তানজিমের সামনে ফেলে বলে,
“এখন বলো সমস্যা কি?”
“বাবা তোমার সাথে কথা বলেছে?”
“হ্যাঁ বলেছে।”
ইমতিয়াজ মাথা নাড়ে।

তানজিম উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“কি বলেছো তুমি? বিয়ে করবে?”
“সিদ্ধান্ত কি তুমি নিবে নাকি আমি?”

তানজিম টেবিলের উপর হাত দিয়ে দুইটা চাপড় দিয়ে বলে,
“ভালো হচ্ছে না, ভাইয়া।”

ইমতিয়াজের রাগ হলেও শান্ত গলায় বলল,
“অফিসে সিনক্রিয়েট করো না। আমার ডিউটি আছে, এখন তুমি যাও।”

তানজিম চেয়ারে একটা লা°থি দিয়ে বলল,
“যা খুশি তাই করো।”

ইমতিয়াজ তাকিয়ে থাকলো তানজিমের দিকে৷ এমন উ°গ্র স্বভাব কবে থেকে আসলো তার মধ্যে। ইমতিয়াজ কম্পিউটার অন করলেও মন বসাতে পারলো না। এই পুরো পরিবার হয়তো পাগল। নাহলে একটা উচ্চশিক্ষিত মেয়েকে কারো দ্বিতীয় স্ত্রী করার প্রস্তাব কিভাবে দেয়।
______________________________________

বাসায় ফেরার পর থেকেই গু°ম°রে আছে সারাহ্। কাল থেকে নিচুস্বরে একটা দুইটা প্রশ্নের জবাব ছাড়া আর কোনো কথাই বলেনি সে। আব্বাস সাহেব ভেবেছেন হয়তো উনার সামনে কথা বলতে অস্বস্তি হচ্ছে ওর, কিন্তু আহনাফ জানে সে ঘরেও কথা বলছে না। আহনাফ যে কথা বলেনি বিষয়টা তা নয়, সারাহ্ জবাব দেয়নি।

কলেজে যাওয়ার পথে আহনাফের সাথে কথা হয়নি সারাহ্-র। এই এলোমেলো ভয় আহনাফকে কিভাবে জানাবে সে। কথা গুছিয়ে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে বেচারী।

প্রথম ক্লাস শেষে বেরিয়ে আহনাফ সারাহ্-কে দেখে টিচার্স রুমের দিকে যেতে। সে এতোটাই অন্যমনস্ক যে নিজের হাতের তিন তিনটা মার্কার যে মাটিতে লু°টোপুটি খাচ্ছে তা দেখেই নি।

আহনাফ মার্কারগুলো কুড়িয়ে সারাহ্-কে ডাকে,
“ঐশী।”

সারাহ্ ভূ°ত দেখার মতো চমকে পিছনে ফিরে,
“জি।”
“এগুলো নাও।”
মার্কার এগিয়ে দেয়।

সারাহ্ এগুলো হাতে নিলে আহনাফ বলল,
“কি হয়েছে তোমার? কিছু নিয়ে চিন্তা করছো?”

সারাহ্ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আহনাফ বলে,
“বই রেখে আসো। আমি গেইটের কাছে অপেক্ষা করছি।”

আহনাফের কথামতো বই রেখে গেইটের কাছে যায় সারাহ্। বড় গেইটটার কাছে একটা বড় পুকুর। তার পাশে সারি সারি গাছ লাগানো। আহনাফ একটা গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

সারাহ্ গিয়ে চুপচাপ মুখোমুখি দাঁড়ায়।
“কি যেন বলতে চেয়েও থেমে যাচ্ছো? সমস্যা কোনো?”

সারাহ্ একহাত দিয়ে অন্যহাতে ঘ°সতে থাকে। আহনাফ ওর হাত ধরে বলে,
“বলো, এতো ফরমালিটির দরকার নেই।”
“আসলে কাল এয়ারপোর্টে দুজন লোক কথা বলছিলো সামিহাকে নিয়ে।”

আহনাফ কপাল কুঁচকায়। সারাহ্ আবারো বলে,
“হয় মানবে আর না হয় ম°রবে, এমন একটা কথা বলেছিল।”
“আর কি বলেছে?”

সারাহ্ পুরো ঘটনা আহনাফকে খুলে বলে। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একদম পাই টু পাই।

আহনাফ একটু উত্তেজিত হয়েই বলে,
“ইয়া আল্লাহ্, তুমি আগে আমাকে বলোনি কেন? কাল তো বলতে পারতে? গাড়ির নাম্বার দেখেছো?”

সারাহ্ ফোন বের করে একটা ছবি দেখায়। গাড়ির জানলা থেকে ছবিটা তুলেছিল সে। আহনাফ ছবিটা দেখে বলে,
“আমি কালকে ঢাকা যাবো। তুমি বাসায় এ ব্যাপারে কিছু বলো না আর বাবাকেও কিছু জানিও না।”
“ঠিক আছে।”

আহনাফ চলে যেতে নিলে সারাহ্ বলে,
“যদি ওদের নজর আপনার উপর হয়?”

আহনাফ ফিরে দাঁড়িয়ে বলল,
“সাধারণ একজন সরকারি টিচারকে হুদাই কেউ সন্দেহ করবে না। চিন্তা করো না। চলো।”
সারাহ্ও আহনাফের পিছুপিছু চলে গেল।
______________________________________

সন্ধ্যা ৬ টা, শাফিন সাহেব ড্রইংরুমে বসে ইমতিয়াজকে কল করে।

নাম্বার দেখে কিছুক্ষণ চুপ থাকে ইমতিয়াজ। রিসিভ করা না করা নিয়ে সে সিদ্ধানহীনতায় আছে। অবশেষে রিসিভ করে নেয়।

“আসসালামু আলাইকুম, মামা।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ, আপনি কেমন আছেন এখন?”
“এইতো ভালোই। (একটু থেমে) একটা জরুরি বিষয়ে কথা বলতে চাইছিলাম।”
“জি, মামা বলেন।”

শাফিন সাহেব বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“ইমতিয়াজ, লুৎফর হয়তো তোমার সাথে কথা বলেছে। তোমারও একটা সংসার হওয়া উচিত, সন্তান থাকা প্রয়োজন। (একটু থেমে) তাই আমরা তোমার বিয়ের কথা ভাবছিলাম।”

ইমতিয়াজ একটু গলা ঝেড়ে বলল,
“মামা, আমার একটু চিন্তাভাবনা করার প্রয়োজন। এটা এমন কোনো সিদ্ধান্ত না, যা আমি হুট করে নিতে পারবো৷ কিছু মনে করবেন না।”
“আরে না না, কিছু মনে করার নেই। তুমি ভেবেচিন্তে জানিও।”

এদিকে সুরভি মৃত্তিকার হাতে কয়েকটা বড় বড় কার্টুন বক্স দিয়ে বলে,
“মিউকো এগুলো একটু স্টোররুমে রেখে আসবা। আমি তো যেতে পারবো না।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপু। আমি রেখে আসছি।”

মৃত্তিকা বক্সগুলো তাকে তাকে সাজিয়ে নিয়ে সুরভিকে বলল,
“স্টোর রুমের চাবি কোথায়?”
“বাবার কাছে।”

শাফিন সাহেব ড্রইংরুমে, সুরভি উনার রুমে গিয়ে চাবি এনে মৃত্তিকাকে দিয়ে দেয়। বক্সগুলো নিয়ে মৃত্তিকা চলে যায়৷

নিচতলায় স্টোররুম, সেখানের দরজা খুলতেই ধুলার কারণে নি°শ্বাস বন্ধ হওয়ার জোগাড়। রুমের লাইট জ্বা°লি°য়ে মৃত্তিকা বক্সগুলো রেখে নিজে নিজেই বলে,
“এরুম কি কেউ কোনোদিন পরিষ্কার করে না?”

খুব বেশি বড় না হলেও রুমের মধ্যে প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় অনেক জিনিসপত্র ঠাসা। মৃত্তিকার চোখ পড়ে একটা বক্সের দিকে। দেখতে খুব সুন্দর কারুকাজের বক্সটার কাছে গিয়েই ভ°য় পায় সে, এ যে ক°ফি°ন। একদম নতুন একটা ক°ফি°ন এটা, যেন মাত্র কিছুক্ষণ আগেই আনা হয়েছে। রুমে আবার কয়েকটা পায়ের ছাপ।

মৃত্তিকা দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে আসে। দরজা লাগিয়ে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়। কথায় বলে বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘে খায়। বেচারির হয়েছে সেই অবস্থা।
______________________________________

রাত প্রায় দুইটা, নির্ঘুম রাত কাটছে সারাহ্-র। আহনাফ অঘোরে ঘুমাচ্ছে। সারাহ্ ওর দিকে ফিরে শুয়ে থাকে। ওর গালে হাত দেয়। সারাহ্ জানে না ওই লোকগুলো কে হতে পারে, তবে সামিহাকে নিয়ে তার প্রচুর চিন্তা হচ্ছে।

আহনাফ ওর হাতের উপর হাত দিয়ে বলে,
“ঐশী, ঘুমাওনি?”

আহনাফ চোখ খুলে, সারাহ্ ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। আহনাফ ওর কাছাকাছি চলে আসে।

“ঘুমাওনি?”
“ঘুম আসছে না।”

কিছুক্ষণ চুপ থেকে সারাহ্ বলল,
“আহনাফ।”
“উম, নাম ধরে ডাকে না।”

সারাহ্ বি°র°ক্ত হয়। বলে,
“আচ্ছা, ডাকলাম না। তবে আমার বারবার মনে হচ্ছে আমাদের দুইবোনকেই কেউ টার্গেটে রেখেছে।”

আহনাফ কপাল কুঁচকে বলল,
“কোনো বিশেষ কারণ?”
“মনে হচ্ছে, নাহলে শুধু শুধু সামিহাকে কেউ কেন মারতে যাবে? ও তো ইনোসেন্ট, কারো ক্ষতি বা লাভের চিন্তায় ও নেই।”

আহনাফ সারাহ্-র নাকে, গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে,
“চিন্তা করো না, সত্যটা জানা যাবে।”
সারাহ্ আহনাফকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখে। হয়তো এবারে ঘুম হবে।

ফজরের নামাজের পরই আহনাফ বেরিয়ে যায়। আব্বাস সাহেবকে জানিয়েছে একটা জরুরি কাজে ঢাকায় যেতে হবে এবং কাজটা কলেজ সংক্রান্ত।

আহনাফকে এগিয়ে দিতে নিচে বাসার সামনে যায় সারাহ্।
“ঐশী, এতো চিন্তা করো না।”

আহনাফের কথায় সারাহ্ নিচুস্বরে বলে,
“নিজের খেয়াল রাখবেন। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না কি এমন হয়েছে সামিহার সাথে।”

আহনাফ সারাহ্-র কপালে চুম্বন করে। ওর গালে হাত দিয়ে বলে,
“আসছি।”
______________________________________

সকাল সাতটায় মৃত্তিকা এসেছে এয়ারপোর্টে। কারণ ওর ফ্রেন্ড ইসরাত ও ফিওনা ইতালি থেকে দেশে আসবে। বড় শালটা মৃত্তিকার গায়ে জড়ানো, চুল খোলা, একটু এলোমেলো অবস্থায় আছে সে।

গতসন্ধ্যার সেই ক°ফি°ন দেখার ঘটনা কারো সাথে শেয়ার করেনি মৃত্তিকা। তবে ওই ঘটনার একটু গভীরে সে যাবে, সবার অগোচরে লুকিয়ে যাবে।

সাড়ে আটটায় ইসরাত ও ফিওনা এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়। কুশল বিনিময় করে ওরা গাড়িতে উঠে বসে। ওদের জার্নি হোটেল অরনেট পর্যন্ত হয়। রাস্তায় এটা সেটা বেশ অনেকক্ষণ কথা বলে ওরা।

হোটেলের রুম আগে থেকেই বুক করা ছিল। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে বসেই কথা বলা শুরু করে ওরা। ওদের আলোচনার মূল বিষয় মৃত্তিকার বিয়ে।

“পুরো ভার্সিটি লাইফ একা থেকে এখন একজন লোকের সেকেন্ড ওয়াইফ হচ্ছিস? এতো আবেগ কবে থেকে আসলো তোর?”

ইসরাতের প্রশ্নটা স্বাভাবিক। মৃত্তিকা হেসে বলল,
“তোর মনে হয় আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না? এসব আবেগ অনুভূতিকে আমি কবেই মে°রে ফেলতাম, কিন্তু রাখতে হবে বলেই রাখলাম।”

ফিওনা বাংলা বলতে পারে না, তবে ওদের সাথে থেকে থেকে বাংলা ভালোই বুঝে। সে যা বলল তার বাংলা করলে বিষয়টা এমন দাঁড়ায়,
“কেন রাখতে হলো? কি এমন বিশেষত্ব আছে তার? কি যেন ছিল নামটা, ইমতিয়াজ।”

মৃত্তিকা হাত তুলে না দেখিয়ে বলল,
“আরে না, তেমন কিছু না। তবে দেশে থাকাটা এখন আমার জন্য জরুরি, তাই বিয়ে করা। আর তাছাড়া (একটু থেমে) ইমতিয়াজ মানুষ ভালো, মানসিক শান্তি পাই উনার কাছে।”

মৃত্তিকা শালটা খুলে চেয়ারে রেখে বলে,
“এসব বাদ দে। বাড়িটা বিক্রি হয়েছে?”

ইতালিতে থাকা মৃত্তিকার বাড়িটা সে বিক্রি করে দিয়েছে। কারণটা হলো একটা বিজনেস শুরু করা।

ইসরাত বিছানায় শুয়ে বলে,
“ব্যাংকে বাড়ি বিক্রির সব টাকা জমা হয়েছে। শেয়ার কেনার এটাই ভালো সুযোগ।”

মৃত্তিকা বুকে হাত বেঁধে বলল,
“শেয়ার নয়, পুরো কোম্পানি আমি কিনতে চাই।”

ফিওনা ফোন থেকে কিছু একটা দেখে বলে,
“কোম্পানির প্রোফিট ভালো, তবে ওরা কেন বিক্রি করবে?”
“বাধ্য করবো।”

মৃত্তিকার কথায় ইসরাত অবাক হয়, ফিওনার অবাকের পাল্লাও ভারি। মেয়েটা এমন ব্যবহার আগে কখনো করেনি। ব্যবসা কিংবা কোম্পানির শেয়ারের জন্য কখনোই আগ্রহ ছিল না, তবে হঠাৎ কেন এমন ইচ্ছা জাগলো?

মৃত্তিকাকে প্রশ্ন করার আগেই সে উত্তর দিলো,
“কোম্পানির ওনার হলো কলরবের ফাদার, চিনেছিস কলরবকে? আমার মামকে নিয়ে খারাপ কথা বলেছিল। আবার পরে মামাকে বলেছিল, এমন ভ°ব°ঘুরে মেয়েকে বিয়ে করা যাবে না। তাই নিজের একটা পরিচয় করবো।”

ইসরাত ঠোঁট উল্টায়। বলে,
“পরিচয় করার উপায়টা দারুণ।”

মৃত্তিকা এসে বিছানায় বসে বলল,
“মামা যখন চাকরি করতো তখন কলরবের বাবাও চাকরি করেছে সেখানে। তারপর মামা চাকরি ছেড়ে ব্যবসায় এলো আর উনি উনার বিশাল কোম্পানিতে বিনিয়োগ শুরু করেছে। কি মনে হয়? সবটা হালাল টাকা?”
“মোটেও না।”

ফিওনা ওদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে৷ কিন্তু বেচারী অর্ধেক কথা বুঝতে পারছে না। সে শুধু এইটুকু বুঝেছে মৃত্তিকা কোম্পানির শেয়ার কিনবে আর সেটা কলরবের বাবার কোম্পানি।

“আমি ইতালি যেতে চেয়েছিলাম, বাট মন বদলে ফেলেছি। এভাবে সব ছেড়েছুড়ে পালাবো না।”

ইসরাত মাথা নেড়ে বলল,
“তা ঠিক, তবে বিয়ের সিদ্ধান্তটা অবাক করছে। কেন তুই এমন বয়স্ক একজনকে বিয়ে করছিস তাই বুঝলাম না।”

মৃত্তিকা উঠে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আনমনে বলল,
“এতো লম্বা কাহিনী একদিনে কিভাবে বলি?”

মৃত্তিকা বুঝতে পারছে না ও ইমতিয়াজকে ভালোবেসেছে কিনা। তবে সুখের জন্য, একটু শান্তির জন্য, ফুরসতের জন্য ওর ইমতিয়াজকেই লাগবে। এ কি ভালোবাসা নাকি স্বা°র্থ°পরতা? যা খুশি হোক, মৃত্তিকার তাতে আশে যায় না।

সমস্তটা দিন মৃত্তিকা হোটেলে কা°টায়। সবকিছু নিয়ে কথাবার্তা বলে সিদ্ধান্ত হয় যা ডলার আছে তাতে পুরো কোম্পানি কেনা না গেলেও একটা শেয়ার কেনা যাবে৷ ইমতিয়াজের কথাই সই, কলরবকে প্রত্যেকটা কথার হিসাব দিবে সে৷ শুধু পদ্ধতিটা ভিন্ন।

চলবে……

(সর্তকতা- আজকের পর্বটি নিজ দায়িত্বে পড়বেন। অস্বাভাবিক কিছু দৃশ্যের বর্ণনা রয়েছে।)

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

ত্রয়োবিংশ পর্ব

রাত আটটায় বাসায় ফিরে ইমতিয়াজ। ঠিক ফ্ল্যাটের দরজার সামনে একটা লাল গোলাপের তোড়া দেখে সে। ফুলের তোড়াটা হাতে নিয়ে তালা খুলে বাসায় ঢুকে।

বিড়ালটাকে কোলে নিয়ে আদর করে। ফ্রেশ হয়ে এসে ফুলগুলো হাতে নেয়। তোড়ার ভিতরের দিকে একটা কাগজ। ইমতিয়াজ কাগজটা বের করে।

“মৃত্তিকাকে বিয়ে করো বা না করো, ওই বাসা থেকে বের করে আনো। হয়তো আজ রাতটাই হয়তো ওর জীবনের শেষ রাত।”

ইমতিয়াজ চোখমুখ কুঁচকে চিরকুটটা পড়লো। এ কেমন কথা? ওই বাসায় কি সমস্যা বা কে এই চিঠি পাঠিয়েছে সবকিছু নিয়ে দোটানায় পড়ে ইমতিয়াজ। প্রশ্নে প্রশ্নে জড়জড়িত মানুষটা চিন্তিত হয়ে সোফায় বসে পড়ে। ঠিক কি হতে পারে আজ রাতে?

ফোন বের করে মৃত্তিকাকে কল দেয়।
“হ্যালো।”

মৃত্তিকার কোমল সুরের জবাব দিলো ইমতিয়াজ।
“আমি ইমতিয়াজ বলছিলাম।”
“জি বলেন।”

ইমতিয়াজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“কোথায় আছেন?”

বিকালের দিকে হোটেল থেকে বাসায় ফিরেছে মৃত্তিকা। স্বাভাবিকভাবেই জবাব দিলো,
“বাসায়।”
“কোথাও বের হবেন?”

মৃত্তিকা হাসলো। বলল,
“না, কেন বলুন তো?”
“এমনিই, সাবধানে থাকবেন।”

ইমতিয়াজ ফোন রেখে দিলো। মৃত্তিকা চোখ কুঁচকায়, এ কেমন আচরণ?

মাথার চুল টেনে ইমতিয়াজ কোনো সুরাহা পাচ্ছে না, আর না নিজেকে শান্ত করতে পারছে। মৃত্তিকার আজ শেষ রাত। কে বলেছে এ কথা? মৃত্তিকার বাবা?
______________________________________

রাত বারোটা ত্রিশ মিনিট, মৃত্তিকা স্টোররুমের চাবিটা নিয়ে চুপিচুপি নিচতলায় আসে। দরজার সামনে এসে তালা খোলা দেখে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে যায়।

ভিতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই। দরজা ঠেলে ভিতরে গিয়ে চোখ বুলায়।

ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে আশেপাশে দেখতে থাকে। পূর্ব দিকের দেয়ালে কয়েকটা ছবি ঝুলিয়ে রাখা আছে। বেশ কয়েকটা ফ্যামিলি ফটো। এখানে চেনা থেকে অচেনা মানুষের সংখ্যাই বেশি।

একবার দরজার দিকে তাকিয়ে একটা অচেনা ফ্যামিলির ছবি হাতে নিলো, এখানের দুইটা মানুষকে ও চিনে। একজন সারাহ্, সাথে সামিহা। ছবিটাতে সারাহ্ আর সামিহার চেহারার গঠনে মনে হচ্ছে ছবিটা আরো দুই তিনবছর আগের।

“ওদের ফ্যামিলির ফটো এখানে কেন?”

আবারো ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকায়। ছবিটা যথাস্থানে রেখে ও আবারো ঘুরে ফিরে জায়গাগুলো দেখতে থাকে।

এই জায়গাটা নিয়ে ওর কৌতুহলের শেষ নেই। আগ্রহ নিয়ে দেখে আবারো যায় সেই কফিনের কাছে। ক°ফি°নের মুখটা খুলে ভিতরে কিছু আছে কিনা দেখে সে। ভেতরে একটা পাথর রাখা আর তাতে কোনো একটা নাম খোদাই করা আছে।

হঠাৎ পেছন থেকে কেউ ওর উপর হা°ম°লা করলে নামটা আর মৃত্তিকার দেখা হয় না। ফোনটা হাত থেকে ক°ফি°নের ভেতর পড়ে যায়। মাথায় প্রচন্ড আ°ঘা°ত পাওয়া মৃত্তিকার মুখ থেকে র°ক্ত বেরিয়ে আসে। মাথার পেছন দিকে হাত দিয়ে মাটিতে পড়ে গেলে ওর গলায় শক্ত কিছুর প্যাঁ°চ অনুভব করে। চিৎকার করার আগেই মৃত্তিকার হাত ও মুখ বাঁ°ধা হলো, গলায় প্যাঁ°চানো মোটা ওড়নাটার বাঁধন আরো শক্ত হলো।

গলা কা°টা মুরগির মতো ছ°টফ°ট করতে থাকে মৃত্তিকা, পা দুটো অসম্ভব দ্রুত গতিতে নাড়ছে সাথে শরীর ঝাঁ°কা°চ্ছে। ধীরে ধীরে ও শান্ত হয়, চোখ বন্ধ হয়। শরীর স্থির হলে মুখ থেকে খানিকটা র°ক্ত গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে ফ্লোরে। নাকে থেকে বের হওয়া র°ক্ত ঠোঁটের আশেপাশে আর গালে গড়াগড়ি খায়।

যে রহস্যের খোঁজে দেশে থেকে যাওয়া তা মৃত্তিকার সাথেই ক°ফি°ন°বন্ধী হয়ে যায়। ক°ফি°নের দরজা বন্ধের আগে কেউ বলল,

“মিউকো, এতোটা সহজ মৃ°ত্যু তোমার কাম্য ছিল না। মায়ের মতো নিরীহ হয়েও বাবার মতো ধূ°র্ত তুমি।”

অন্ধকারের এই বাক্যের সাথে আরেকটা বাক্য যুক্ত হলো,
“মেয়েটা অবশ্যই কিছু সন্দেহ করছে।”
“কিছু না সবটাই বুঝে গেছে সে, প্রমাণ খুঁজতে এসেছে এখানে।”
“তবে এখন?”
“শেষ প্রমাণ লো°পা°ট হবে, নার্গিস পারভিন ও রোমি খন্দকার।”
______________________________________

“ঐশী, আজ রাতটা আমার থাকতেই হবে।”
“কোথায় আছেন?”
“চাচ্চুর বাসায়। কাল সকালে সিআইডি অফিসে আবার যেতে হবে।”
“যাই করেন, নিজের খেয়াল রাখবেন প্লিজ। চিন্তা হচ্ছে আমার।”

আহনাফের সাথে ফোন যোগে কথা বলছে সারাহ্। আজকে সিআইডি অফিসে ওদের এইরকম অদ্ভুত সমস্যার বিষয় নিয়ে কথা বলেছিল আহনাফ। কিন্তু সমস্যাটা এমন যে একটা উড়াল কথার ভিত্তিতে এখান থেকে গভীরে যাওয়া কঠিন এবং যথেষ্ট সময় সাপেক্ষ।

আহনাফ বলল,
“চিন্তা করো না তুমি, তবে আমার মাথায় একটা বিষয় ঢুকছে না৷ (একটু থেমে) তুমি ওখানে গেলে আর ওরা কথা বলল?”

সারাহ্ চমকে উঠে। তারমানে কেউ ওকে শোনানোর জন্য এমন কথা বলেছে।

“সত্যি বলেছেন, এভাবে তো ভাবিনি। তারমানে কেউ আমাকে শোনাতে চাচ্ছিলো?”
“একদম এটাই। ওরা তোমাকে দেখেছে।”

সারাহ্ নিজের মস্তিষ্কের মধ্যে খোঁজা শুরু করে। এমন কোনো শত্রু কি আদৌ ওদের আছে। কই, পরিবার বা বাইরের এমন কারো কথা তো ও জানে না।

“রাতে খেয়েছো?”

আহনাফের কথায় সারাহ্ আকাশকুসুম চিন্তা থেকে বাস্তবে ফিরে,
“জি, আপনি খাওয়া দাওয়া করেছেন?”
“হুম, তারপর বাবার সাথে কথা বললাম। ফ্রি হয়ে আমার বাচ্চার আম্মুটাকে কল দিলাম।”

“বাচ্চার আম্মু” এমন সম্মোধনে লজ্জা পায় সারাহ্। চুপ করে থাকে সে। পাশে থাকা আহনাফের বালিশটা বুকে জড়িয়ে আবেশে চোখ বুজে।

“কি বলো ঐশী? বেবির চিন্তা করবো? তবে একটা সুবিধা হবে। তুমি আমাকে সাদাবের আব্বু, সাইদার আব্বু বলে ডাকতে পারবে।”

সারাহ্ মুচকি হাসছে। বাচ্চার নামও ঠিক করে ফেলেছে লোকটা। কিছু বলার মতো ভাষা সে পাচ্ছে না।

আহনাফ আবারো বলে,
“ইশ, ফোনে এসব কথা বলছি। তোমার সামনে গিয়ে বলতাম। আমার দেখতে ইচ্ছা করছে তুমি কতটা লজ্জা পাচ্ছো।”
“ঘুমান।”
“স্বপ্নেও চলে আসবে। কিভাবে ঘুমাই?”

আহনাফ সামনে নেই তবুও সারাহ্ মুখ ঢেকে ফেলে। আহনাফ শব্দ করে হাসে। তারপর সারাহ্-কে বলে,
“শীতের ছুটিতে এবারে কোথায় যাবে ঘুরতে?”

সারাহ্ উঠে বসে নিজেকে ঠিকঠাক করে বলে,
“কোথাও না, বাবার সাথে গল্প করে আর আশেপাশে ঘুরাঘুরি করে কা°টিয়ে দিবো।”

আহনাফ হেসে বলে,
“ওকে, বাবার নাতি-নাতনি আসার আগেই গল্প সেরে নাও।”
“থামেন এবারে। বাড়াবাড়ি হচ্ছে।”

আহনাফ হাসলো। সারাহ্ নরমসুরে বলল,
“ঘুমান, শুভ রাত্রি।”
“হুম, স্বপ্নে এসো কিন্তু।”
______________________________________

ফজরের পর গো°র°স্থানে এসেছে ইমতিয়াজ। কাল রাতে কি হয়েছে তা এখনো ওর অজানা। ধীর পায়ে গো°রস্থানের লোহার গেইট ঠেলে ভিতরে ঢুকে, মরিচা ধরা লোহার গেইটে একটা কড়কড়ে শব্দ হয়। রিপা বেগমের কবরের পাশে নতুন একটা কবর খনন করা হয়েছে, তারপাশে একটা ক°ফি°ন।

ইমতিয়াজ সেদিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। বেশ যত্ন নিয়ে কবরটা খোঁড়া হয়েছে। তবে নিচে এখনো কাদা আর পানি রয়ে গেছে।

সে তানমিনার কবরের পাশে গিয়ে বসে।
“খুব বড় সিদ্ধান্ত নিতে হবে মনে হচ্ছে। মিনা, কি করবো আমি? আমার পাশে কেউ নেই যে আমাকে একটু পরামর্শ দিবে।”

“আবারো স্ত্রীর কবরের পাশে এসেছো?”

কারো কথায় ঘাড় ঘুরিয়ে ইমতিয়াজ দেখে সেই পৌঢ় নারী। প্রায়ই এই মহিলাকে গো°র°স্থানে দেখে সে।

মহিলাটি নিজের স্বামীর কবরের পাশে গিয়ে মোনাজাত করে। তারপর নতুন খোঁড়া কবরের সামনে গিয়ে বলে,
“আহ কবর, প্রিয়মানুষদের টে°নে টে°নে নিয়ে যায়।”

ইমতিয়াজ স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,
“আপনার পরিচিত কেউ?”

কবরটার উপরে যে পাথরে খোদাই নাম লাগানো হয়েছে মহিলাটি তা পড়ে।
“মৃত্তিকা মেহজাবিন মিউকো, ১৯৯৫ থেকে ২০২৩।”

ইমতিয়াজ উঠে দাঁড়িয়ে যায়, নামটা তার পরিচিত। গতরাতের ওই চিঠি তবে সত্যি। মৃত্তিকার জন্য কালকের রাতটাই শেষ রাত ছিল।

আরো একজন লোক গো°র°স্থানে আসে। মহিলাটি হেসে বলে,
“অনুমান সত্য হয়েছে, তাহমিনার হাসবেন্ডই পরবর্তী লোক।”

ইমতিয়াজ দুজনের দিকে একবার তাকিয়ে তাহসিনার কবরের পাথরটা তুলে ছুড়ে মারে। লোকটা সরে যাওয়ায় গায়ে লাগে না।

রাগে হি°তা°হিত জ্ঞানশূন্য হয়ে মহিলাটিকে ধরতে গেলেই হাতে থাকা স্প্রে বোতল থেকে কোনো একটা তরল ইমতিয়াজের মুখের সামনে নির্গত করে দেয়। নে°শা জাতীয় কিছু আছে এখানে। ইমতিয়াজ টা°ল সামলাতে পারে না, দাঁড়ানো থেকে সোজা সেই খুঁড়ে রাখা কবরে পড়ে যায়। কাদামাটি আর পানি তার শরীরে ছিটকে পড়ে। কিছু পানি বাইরে এসেও মাটিকে ভিজায়। কিছুটা আবার রিপা বেগমের কবরের উপরে পড়ে।

মাটিতে বারবার হাতড়াতে থাকে ইমতিয়াজ। কোনোভাবে উঠার চেষ্টা করতে থাকে। লোকটা কয়েক মুঠো মাটি ওর মুখ আর শরীরের উপর দিয়ে বলে,
“জীবন্ত স°মা°ধী। কবরের খুব ভয় থাকে মানুষের, এখন নিজচোখে দেখো সেটা।”

বারবার মাটিতে মু°ষ্টি শক্ত করতে করতে ইমতিয়াজের চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসে। ওর চোখ বোজার সাথে সাথে একটা পরিবার শেষ হলো। বাবা, মা, স্ত্রী, সন্তানের পর আজ ইমতিয়াজের রওনা দেয়ার পালা। এই যাত্রা সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত চলছে এবং কি°য়া°মাত পর্যন্ত চলবে।

লোকটা বলে,
“আবারো একটা কবর খুঁড়তে হবে?”
“হ্যাঁ, আরো একটা খুঁড়ে মৃত্তিকাকে চা°পা দেও। মামের আদুরিকে মামের পাশে আর থাকা হলো না।”

লোকটি কফিন খুলে চেঁ°চিয়ে উঠে,
“মৃত্তিকার বডি নেই।”
“কিসব বলছো? ডে°ড বডি কোথায় যাবে?”

গেইটের কাছ থেকে একজন মধ্যবয়সী পুরুষ বলে উঠে,
“আমার নিশানা ও অনুমান এখন আর ভুল হয় না।”

পরপর দুটো গু°লির শব্দ হয়। র°ক্ত ছি°টকে গিয়ে পড়ে রিপা বেগমের কবরের উপর, ইমতিয়াজের শরীরটার উপর গিয়ে পড়ে একটা লা°শ।

গেইটের কাছ থেকে সাদা হুডি পড়া মানুষটা এগিয়ে আসে। মুখ তার মাস্কে ঢাকা। হুডির ক্যাপের জন্য চোখদুটোও দেখা যাচ্ছে না।
“মৃত্তিকাকে মে°রে ফেলা এতো সহজ নয়।”

দুজন মানুষের মৃ°ত্যু নিশ্চিত করতে আরো দুবার করে চারবার গু°লি করে। ছয় ছয়টা গু°লি একই জায়গায় শেষ হয়।

ইমতিয়াজের উপরে থাকা সেই লা°শের টাটকা র°ক্তে ইমতিয়াজের শরীরও র°ঞ্জি°ত হয়। মুখটা র°ক্তা°ক্ত হয়ে ভ°য়ং°কর রূপ নিয়েছে, যেন কোনো মানুষ খে°কো ভ্যাম্পায়ার।
______________________________________

“মিউকো বাসায় নেই, বাবা। কোথাও নেই।”

পাগলের মতো মৃত্তিকাকে খুঁজেছে সুরভি, শাফিন ও দেলোয়ারা। ভোর রাত থেকে এ পর্যন্ত না খুঁজে পেয়ে লুৎফর রহমানকে জানানো হয়েছে। হুট করে হদিস পাওয়া যাচ্ছে না, কোথায় গেছে কেউ জানে না, সাথে ফোন অফ।

শাফিন সাহেব মলিন মুখে সিঁড়িতে বসে পড়লেন। এ বয়সে আর কত ধকল নিবে এ শরীরটা। এখনো ঠিকমতো হাঁটতে পারছেন না, অথচ মৃত্তিকাকে খুঁজতে পুরো বাসায় উনি ছোটাছুটি করেছেন।

দরজার কাছে সুরভি দাঁড়িয়ে রইলো। মৃত্তিকার বাবার কাজ নয় তো এটা, এই চিন্তা তার মস্তিষ্কে ঘুরঘুর করছে।

দেলোয়ারা বলেন,
“একবার ইমতিয়াজকে কল দাও। হয়তো কোনো সাহায্য করতে পারে।”

শাফিন সাহেব নিষ্প্রাণ হয়ে আছেন, কথা বলা ভুলে গেছেন যেন। সুরভি উনার ফোন থেকে কল দেয় ইমতিয়াজকে। ফোন বাজছে কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না। একবার, দুবার, তিনবার করে পনেরো-বিশবার নিয়েও সেই এক কথা,
“নো এন্সার।”

সময় গড়ায়, সকাল ৮ টা বেজে যায়। লুৎফর রহমান মমতাজ বেগমকে সাথে নিয়ে এ বাসায় এসেছে। লুৎফর রহমান পুলিশ কে°ই°স করতে চাইলে শাফিন সাহেব বাধা দিয়ে বলে,
“যদি মিউকোর বাবা ওকে নিয়ে যায় তবে পুলিশ কে°ই°সে হিতে বিপরীত হতে পারে। মিউকোর প্রা°ণনা°শের আশংকা আছে।”

মমতাজ বেগম শাফিন সাহেবের কথায় সম্মত হলেন। সুরভি বলে,
“কালকেও মিউকো সারাদিন বাসায় ছিল না। আমাদের একটু অপেক্ষা করা উচিত।”

দেলোয়ারা বলেন,
“কাল তো ফোন উঠিয়েছিল, বাসায় বলে গিয়েছিল। আজ তো ওকে যেতেই দেখিনি।”

কথা যুক্তিযুক্ত, তবুও পরিবারটা নিরুপায়। কিছুক্ষণ অপেক্ষা না করে হুট করে কে°ই_স করাটা বোকামি বই আর কিছু নয়। ওরা তো আর জানে না প্রিয়মানুষগুলোর পরিণতির ব্যাপারে।
______________________________________

যোহরের নামাজের পর কাকরাইল গো°র°স্থানে আসে আহনাফ। আজ নতুন দুইটা কবর পড়েছে। প্রতিদিন নতুন কবর হচ্ছে, এ তো ভিন্ন কিছু নয়। তাই রিপা বেগমের পাশের দুটি কবরের দিকে আলাদা করে নজর যাওয়ার কোনো কারণ নেই।

তাহসিনার কবরের পাথরটা নেই, আহনাফ আশেপাশে তাকিয়ে দূরে ছিন্নভিন্ন পাথরটা দেখলো। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে শ্যাওলা পড়েছে। এখন তো বৃষ্টি নেই, পথের ধূলায় সবুজ শ্যাওলা সাদা হয়ে আছে।

মোনাজাত শেষে আহনাফ দেখে রিপা বেগমের কবরের উপরের মাটি খানিক নেই। মনে হচ্ছে আজই কেউ কোদাল দিয়ে উপরের মাটি সমান করে উঠিয়ে নিয়ে গেছে।

নতুন কবর দিবে বলে পাশের কবরের মাটি কেন সরাবে। বি°র°ক্ত হয় আহনাফ। তারপর বেরিয়ে এসে সিএনজি নেয়, গন্তব্য কমলাপুর।

বাসে করে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় দুই ঘন্টা। সারাহ্-র সাথেও এরমধ্যে কথা হয়েছে।

ক্যান্টনমেন্ট নামতেই দেখে সারাহ্ এসে হাজির, ওর অপেক্ষা করছে। কাঁধের ব্যাগটা একটু উঠিয়ে ওর কাছে যায়।

“একদম আমাকে নিতে চলে এলে?”

সারাহ্ হেসে বলল,
“প্রচুর চিন্তা হচ্ছে। আপনার জন্য, সামিহার জন্য।”

আহনাফ রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে বলে,
“পরশুদিন তোমাকেও যেতে হবে। কি কি কথা শুনেছো প্লাস তোমাদের ফ্যামিলিতে কোনো প্রবলেম আছে কিনা জানবে। তোমার আব্বুকেও যাওয়া লাগতে পারে।”

সারাহ্ ঠোঁট উলটে বলল,
“বাবা বাসায়, যদি এসবে কিছু মনে করে।”
“আরে না, আমি বুঝিয়ে বলবো।”

সারাহ্ মুচকি হাসে। সব ঠিকঠাক থাকুক। আর যা যা এলোমেলো তাও ঠিকঠাক হয়ে যাক। সহ্য শক্তি বোধহয় কমে গেছে ওর।

চলবে…….

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

চতুর্বিংশ পর্ব

দুইদিন পর,

সিআইডি অফিসে এসেছে সারাহ্ ও আহনাফ। সারাহ্-র সকল কথা আবারো মনোযোগ দিয়ে শুনছে অফিসার গালিব ও নাইমা।

তারপর গালিব বলে,
“ম্যাডাম, আপনার কথার ভিত্তিতে আমরা সেদিনের সিসিটিভি ফুটেজ দেখেছি। ওই গাড়িটার নাম্বারও সংগ্রহ করেছি। (একটু থেমে) দুঃখজনক হলেও সত্য এই যে, এরকম নাম্বারের কোনো গাড়ি এ পর্যন্ত দেশে নেই। রেকর্ডে পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ সবটাই নকল। ড্রাইভারের মুখে একটা ফেস মাস্ক ছিল, কোনো একটা কার্টুনের।”

সারাহ্ আহনাফের দিকে তাকায়। আহনাফ বুঝতে পারে বেশ বড়সড় একটা জা°লে ফেঁ°সে°ছে ওরা। যেখানে শুধু সামিহা না সারাহ্-র জীবনও সংশয়ে আছে।

আহনাফ একটা কাশি দিয়ে বলে,
“এখন এই সল্যুশন কি?”
“আমরা আমাদের মতো করে চেষ্টা করবো। ম্যাডামের পুরো পরিবারের ডিটেইলস আমার লাগবে।”

সারাহ্ হালকা মাথা নেড়ে বলল,
“ঠিক আছে, আমি দিয়ে যাবো।”

সকল ফরমালিটি শেষ করে দুজনে বেরিয়ে আসে। কাল আবারো ওদেরকে আসতে হবে এখানে।

আহনাফ ওর অবস্থাটা বুঝেছে। সারাহ্-র একহাত ধরে বলল,
“এতো ভাবছো কেন ঐশী? আল্লাহ্ যা করে ভালোর জন্যই তো করে।”

সারাহ্ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে,
“আমি জানি, হয়তো এতেও আল্লাহ্ কোনো একটা ভালো লিখে রেখেছেন। তাওয়াক্কুল করতে হবে, ধৈর্য রাখতে হবে। তবে মনটা যে অশান্ত আমার।”

আহনাফ রিকশা ডাকে। দুজনে উঠে বসলে আহনাফ দুষ্টুমি করে বলে,
“মনকে শান্ত করার একটা উপায় বলি? তুমি এখন আমাদের বাবুদের কথা চিন্তা করো। সাদাবের আব্বু, সাইদার আব্বু বলে আমাকে ডেকে ডেকে প্র‍্যাকটিস করো।”

সারাহ্ রেগে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমি চিন্তায় চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছি আর আপনি মজা করছেন?”
“আরে না, সিরিয়াস।”

সারাহ্ অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। ওর মন ভালো করার বৃথা চেষ্টা করতে থাকে আহনাফ। একসময় সারাহ্ ওর কাঁধে মাথা রাখে। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো অশ্রু। আহনাফ মুছে দেয়। এ মন সহজে ভালো হবে না।

পরিবারের বড় মেয়েগুলো খুব দায়িত্বশীল হয়। এরা একদিনে হয় পরিবারের জন্য ঢা°লস্বরূপ, অন্যদিকে ওরাই পরিবারের জন্য বেশি স্যাক্রিফাইস করে।
______________________________________

ধীরে ধীরে চোখ খুলে ইমতিয়াজ। আশেপাশে তাকিয়ে বুঝলো সে হাসপাতালে আছে। ডানহাতে স্যালাইন লাগানো, হাত নাড়াতে পারলো না সে। পায়ের নাড়াতে চেষ্টা করে বুঝলো সেখানে ব্যান্ডেজ আছে।

“নড়াচড়া করবেন না। আপনি এখনো অসুস্থ।”

পাশ থেকে কথাটা বলল এক সুকন্ঠী যুবতী। ইমতিয়াজ সেদিকে তাকিয়ে মুখের অক্সিজেন মাস্কটা খুলে বলল,
“কে আপনি?”

মেয়েটি আলতো হেসে বলে,
“আপনার বউ বললে তো আর বিশ্বাস করবেন না। আমি নীলুফার, একজন নার্স।”

নীলুফার ওকে অক্সিজেন মাস্ক পড়াতে চাইলে ইমতিয়াজ বাধা দিয়ে বলে,
“আমাকে এখানে কে এনেছে?”

নীলুফার হাসলো। বলল,
“একজন ডাক্তার।”
“আর কাউকে এনেছে? কোনো মেয়ে?”

নীলুফার ওর অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে দিয়ে বলল,
“আপনার হাত ভেঙ্গেছে। নিজে ম°র°তে গিয়েছিলেন অথচ বউকে ভুলেননি? আজব প্রেম। (একটু থেমে) আপনার স্ত্রীকে খুঁজছেন তো, মিউকো? উনি আইসিইউতে।”

“আমি যাবো।”
ইমতিয়াজ উঠতে চায়। ডানহাতে ভর দিতেই “উহ” বলে আবারো শুয়ে পড়ে। অসহ্য ব্য°থা এখানে।

সোজা দাঁড়ানো থেকে কবরে পড়ে যাওয়া সহজ কথা নয়। ডানহাত দিয়েই সে সবচেয়ে বেশি জোর দিতে চেয়েছিল। এতো বড় শরীরের ভার কি একহাত নিতে পারে?

নীলুফার সাহায্য নিয়ে উঠে বসে ইমতিয়াজ। ডানহাতটা গলার সাথে ঝুলিয়ে দেয়া হয়। হাঁটার সময় পায়ে জো°র দিতেও পারছে না।

কেবিন থেকে বেরিয়ে আরেকদফা অবাক হয় ইমতিয়াজ। শান্ত একটা পরিবেশ এখানে। পুরোটা জায়গায় সাদা রং চকচক করছে। বোঝা যাচ্ছে এখানের রং মাত্র কিছুদিন আগেই করা হয়েছে।

কোনো মানুষ না দেখে ইমতিয়াজ প্রশ্ন করে,
“হাসপাতাল এতো ফাঁকা কেন?”

নীলুফার কেবিনের দরজা লাগিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
“এই বিল্ডিং এখনো ওপেন হয়নি।”
“তবে আমরা এখানে?”

নীলুফার আবারো হাসলো। তারপর সোজা হাঁটা শুরু করে। ইমতিয়াজ খুব ধীরেসুস্থে হাঁটছে৷ মেয়েটার আচরণ অদ্ভুত লাগলো তার। হাসিহাসি চেহারার পিছনে কিছু তো একটা লুকাচ্ছে। হাসপাতালের ফাঁকা বিল্ডিংয়ে ওর চিকিৎসা, সেদিন ওই মহিলার ওকে জীবন্ত কবর দিতে চাওয়া। সব মিলিয়ে ইমতিয়াজ ভাবনা শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।

আইসিইউর সামনে গিয়ে কাচের ওপারে মৃত্তিকাকে দেখে। শান্ত হয়ে শুয়ে আছে বিছানায়। চোখ বন্ধ, হাতে স্যালাইন। পাশের মেশিনটা জানান দিচ্ছে সে জীবিত।

“ভিতরে যেতে পারেন।”

নীলুফার কথায় ইমতিয়াজ মাথা নেড়ে ভিতরে যায়। মৃত্তিকার পুরো মাথায় ব্যা°ন্ডে°জ, বোঝা যাচ্ছে হয়তো চুল সব ফেলে দেয়া হয়েছে। কয়েকটা ইলেকট্রোড লাগানো আছে মাথায়, হাতে ও পায়ে।

নীলুফার এসে স্যালাইনের প্যাকেট দেখে। ইমতিয়াজ নিচুস্বরে বলে,
“কি হয়েছে ওর?”
“মাথার স্পাইনাল কর্ড ইন°জুরি, সারভাইভাল নার্ভ সিস্টেম ক্ষ°তি°গ্র°স্ত হয়েছে।”

ইমতিয়াজ অপলক তাকিয়ে থাকে। ঠোঁট দুটো নিজের অজান্তেই ফাঁক হয়। মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে বলে,
“ও সুস্থ হবে তো?”

নীলুফার মাথা নাড়ে। বলে,
“সম্ভাবনা ফিফটি ফিফটি, হাই সারভাইভাল নার্ভ ইন°জুরিতে সুস্থ হওয়া কঠিন। হলেও বেশ সময় সাপেক্ষ।”

ইমতিয়াজ আর কিছু বলে না, শুধু মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে থাকে। নীলুফার বলল,
“চলুন, আপনার কেবিনে যাই?”

ইমতিয়াজ মাথা উঠিয়ে বলে,
“এই বিল্ডিং পুরো খালি তো?”
“হুম।”
“আমি যেকোনো রুমে থাকতে পারবো?”

নীলুফার হেসে বলে,
“ম°র্গেও থাকতে পারবেন।”
“তবে এখানে থাকতে চাই আমি।”
হাতের ইশারায় মৃত্তিকার পাশের বেডটা দেখায় ইমতিয়াজ।

নীলুফার মুখ টিপে হাসে। মাথা নেড়ে বলে,
“লাকি গার্ল।”
______________________________________

মতিঝিলে নিজের বাসায় এসেছে সারাহ্। কাল বাবার সাথে কথা হয়েছে, আজ মায়ের সাথে অবশ্যই কথা বলতে হবে। ওদের পারিবারিক শত্রু কে হতে পারে।

ফ্রেশ না হয়েই মায়ের রুমে যায় সে।
“আম্মু, আসবো?”
“আসো।”

নার্গিস পারভিন বিছানা ঠিক করছেন। সারাহ্ ভিতরে গিয়ে সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করে,
“কাল বাবার সাথে কথা বলার সময় জবাব দাওনি কেন?”

নার্গিস পারভিন কাজ করতে করতে স্বাভাবিকভাবে বললেন,
“এমনিই।”

সারাহ্ কপাল কুঁচকে বলল,
“কিছু লুকাচ্ছো তুমি আম্মু?”

এবারেও জবাব এলো না। উনার হাতে বিছানা ঝাড়ুটা টে°নে এনে সারাহ্ ফেলে দেয়। তারপর উনাকে বসিয়ে বলে,
“এসব পরেও করা যাবে। আগে বলো কি লুকাচ্ছো?”

উনি মাথা নেড়ে বলেন,
“কিছুই না।”

সারাহ্ জে°দ ছাড়লো না। রাগি কন্ঠে বলে উঠে,
“তোমার মেয়েরা মরে গেলে তারপর বলবে?”

সারাহ্-র রাগে নার্গিস পারভিনও রেগে যান। চেঁচিয়ে বলেন,
“হ্যাঁ, ম°রে যা। সব মায়েরা মেয়েদের তো বাঁচিয়ে রাখে না, কেউ কেউ মে°রেও ফেলে। যা, ম°রেই যা।”

সারাহ্ উঠে দাঁড়ায়। মায়ের এমন তী°ক্ষ্ণ আচরণ তার অপরিচিত। সারাহ্ রুম থেকে বেরিয়ে যায়। নার্গিস পারভিন একইভাবে একইস্থানে চুপচাপ বসে থাকেন।

সারাহ্ রুমে গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নিতে নিতে বলে,
“বাসায় চলেন।”

আহনাফ ফোনের কথা বলছে। সারাহ্-কে হাতের ইশারায় শান্ত থাকতে দেখিয়ে আবারো কথায় মনোযোগ দেয়। সারাহ্ বুঝলো কলেজের কারো সাথে কথা বলছে আহনাফ।

সারাহ্ গিয়ে আহনাফকে জড়িয়ে ধরে। ওর বুকে মাথা রেখে কাঁদতে থাকে। আহনাফ চমকে উঠে তাড়াহুড়ো করে বলল,
“স্যার, একটু পরে কল দিচ্ছি।”

ফোন ছুড়ে বিছানায় ফেলে আহনাফ বলে,
“ঐশী, কি হয়েছে?”

সারাহ্ কিছু বলে না। মাথাও তুলে না। আহনাফ ওর মুখটা জোর করে উঠিয়ে চোখ মুছে দেয়। সারাহ্ বলে,
“বাসায় যাবো আমি।”
“কাল বিকালে যাবো, ঐশী। কাঁদে না প্লিজ।”
______________________________________

বিকাল চারটায় তানজিম বাসায় ফিরেই চেঁচামেচি শুরু করে,
“বিয়ের কথা হয়েছে, বিয়ে হয়ে যায় নাই যে ওরা যেখানে ইচ্ছা চলে যাবে। আর তোমরা এমনভাবে বসে আছো যেন ওরা হানিমুনে গেছে।”

শাফিন সাহেব চিন্তিত মুখে বসে রইলেন। মৃত্তিকা আর ইমতিয়াজের চিন্তায় বাসার সবাই প্রায় অসুস্থ। দুইদিন আগে অর্থাৎ যেদিন ওদের উপর আ°ক্র°ম°ণ হয়েছিল বিকালে ইমতিয়াজের নাম্বার থেকে ম্যাসেজ এসেছে যে, মৃত্তিকাকে নিয়ে সে ঢাকার বাইরে এসেছে। যদিও তারপর থেকে ইমতিয়াজের ফোন অফ।

বাসার সবাই তা বিশ্বাস করে নেয়, কিন্তু তানজিম তা মানতে পারছে না। সেদিন থেকে প্রতিদিন তানজিম যতক্ষণ বাসায় থাকবে চেঁচামেচি লেগেই থাকবে।

শাফিন সাহেব ধমক দিয়ে বলেন,
“চুপ করো তানজিম। এমন উ°গ্র বিহেভ কেন তোমার?”

মমতাজ বেগম আজকাল ভয় পায় ছেলেকে নিয়ে। ছেলের ব্যবহার দিনদিন খারাপ হচ্ছে। লুৎফর রহমানের শাসন নেহাৎ কম নয়। তবুও যেন ছেলে তা মানে না।

“যা খুশি করো।”

লুৎফর রহমান তানজিমের গালে একটা চ°ড় বসায়। ধ°ম°ক দিয়ে বলে,
“নিজের ঘরে যাও। বড়দের মুখে মুখে তর্ক করবে না।”

তানজিম রুমে চলে যায়। লুৎফর রহমান বেরিয়ে যান নিজের দোকানের উদ্দেশ্যে। উনি এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না ইমতিয়াজ মৃত্তিকাকে নিয়ে ঢাকার বাইরে গেছে। কোথাও একটা সন্দেহ উনাকে কু°ড়ে°কু°ড়ে খাচ্ছে।
______________________________________

রাত পেরিয়ে যাচ্ছে নিজের আপন ছন্দে। এক সময় পেরিয়ে যায়৷ ইমতিয়াজ ফজরের নামাজ পড়ে জায়নামাজে বসে আছে।

মনে তার অনেক চিন্তা। কে বা কারা ওকে মা°র°তে চাইলো, আবার মৃত্তিকাকে মা°র‍°তে চাইলো, ওই মহিলা কে যে ওর উপর নজর রেখেছে, কেই না ওদেরকে বাঁচালো।

দরজার শব্দ শুনে ইমতিয়াজ সেদিকে তাকায়। নীলুফার সাথে আরেকজন নারী এসেছে, পোশাক-আশাক দেখে একজন ডাক্তার বলে চিহ্নিত করে ইমতিয়াজ।

“কেমন আছো, বাবা? আমি ডা. পল্লবী ইসলাম।”
খুব মিষ্টি করে ইমতিয়াজকে জিজ্ঞাসা করেন পল্লবী।

ইমতিয়াজ ঘাড় দুলিয়ে বলল,
“ঠিক আছি।”

ইমতিয়াজ উঠে বিছানায় বসে। পল্লবী মৃত্তিকার রিপোর্টগুলো একে একে দেখে বলে,
“ওর অবস্থা খুবই খারাপ।”

ইমতিয়াজ সেদিকে তাকিয়ে থাকে। ডাক্তারি রিপোর্ট সে বুঝে না, বোঝার কথাও না। এতো বড় বড় বিষয়ের রিপোর্ট বড় মানুষরাই বুঝবে।

“মৃত্তিকার কি হয়েছে?”

পল্লবী ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ঘাড়ের দিকটায় আর মাথার পেছনে আ°ঘা°ত পেয়েছিল। অবস্থা ভালো হবার কোনো লক্ষণ নেই।”

ইমতিয়াজ তাকিয়ে থাকে মৃত্তিকার চেহারার দিকে। মেয়েটার চেহারায় একটা পাকিস্তানি ভাব আছে। পাকিস্তানের মেয়েদের মতো লম্বা মুখ, চিকন গাল, হালকা-পাতলা ঠোঁট, মোটা ভ্রূ আর উঁচু নাক।

পল্লবী ইমতিয়াজের দৃষ্টি লক্ষ করে। বলল,
“দেখো, মানুষ তার নিজের ভাগ্য নিজে লিখে না। সৃষ্টিকর্তা যা দিয়ে দিয়েছে তা খ°ন্ডাবে কার সাধ্য।”

ইমতিয়াজ জিজ্ঞাসা করে,
“আমাদেরকে কি আপনি বাঁচিয়েছেন?”
“বাঁচাতে আর পারলাম কই? মৃত্তিকা তো বাঁচেনি, ও হয়তো কো°মায় থাকবে। সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।”

ইমতিয়াজের মনটা ছটফটিয়ে উঠে। পল্লবী এসে ওর পাশে বসে বলল,
“আমি না, আমার ভাই তোমাদের বাঁচিয়েছে। আমি তো তোমাদের অবস্থার কথা ভেবে এখানে শিফট করেছি।”

পল্লবী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“যেভাবে তোমাকে জি°ন্দা কবরস্থ করছিলো, এমন শ°ত্রু আমার শ°ত্রুরও না হোক।”

ইমতিয়াজ কিছুই বলে না, ওই শত্রুকে সে চেনে না। পল্লবী ওর হাতটা দেখে বলে,
“এটা এভাবে ভিজিয়ো না। নামাজ ছাড়া বোধহয় থাকো না। নামাজের সময় তায়াম্মুম করে নিও, আমি মাটি পাঠিয়ে দিবো।”

ইমতিয়াজের সন্দেহ নীলুফার আর পল্লবীর উপরেও হতে থাকে। এতো ভালো আচরণ কেন করছে, উদ্দেশ্য কি আসলেও ভালো নাকি নজর রাখা?

“আমাকে তোমার মায়ের বয়সী বলতে পারবে না। কিন্তু খালা কিংবা ফুপ্পির জায়গা অবশ্যই দিতে পারো। আন্টি ডাকতে পারো।”

পল্লবী চলে যাওয়ার সময় আবারো ফিরে দাঁড়িয়ে বলে,
“নাম ইমতিয়াজ, তাইতো?”

ইমতিয়াজ কপাল কুঁচকে জিজ্ঞাসা করে,
“আমাদেরকে কি আপনি পার্সোনালি চিনেন?”
“না চিনলে কি কাউকে বাঁচানো যায় না?”
উত্তরের অপেক্ষা না করে সে চলে যায়।

ইমতিয়াজ অনুভূতিহীন দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। জীবনে তো কম মানুষের মৃ°ত্যু সে দেখেনি, চলে যাওয়া মানুষের মধ্যে আপনজন তো অনেক। তবে এভাবে জীবন্ত মৃত্তিকার জন্য কেন এতো কষ্ট হচ্ছে।

এই কষ্টের নাম দেয়ার চেষ্টা করতে থাকে ইমতিয়াজ। নিজের য°ন্ত্র°ণাগুলো সে ভুলে গেছে। মনে আছে একটা কথা, ও হয়তো কো°মায় থাকবে। মৃত্তিকা আর ওই বড়বড় চোখ মেলে তাকাবে না। ওর লাজুক ভাবের খেলা ইমতিয়াজ আগেই খেয়াল করেছিল, যা এখন একটা বিছানায় সীমাবদ্ধ। সিল্কি লালচে সোনালী চুলগুলো আর গোছাতে ব্যস্ত হবে না সে।

অবশেষে এই খারাপ লাগার নাম দিয়ে দেয় ইমতিয়াজ। হয়তো এটা ভালোবাসা।

চলবে……

অনুভূতিরা শব্দহীন পর্ব-১৯+২০+২১

0

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

ঊনবিংশ পর্ব

রাত আটটা, শাফিন সাহেব মাত্রই বাসায় এসেছেন। একটা বিষয় নিয়ে উনি খুবই রেগে আছেন আর তা হলো কলরবের সাথে হওয়া উনার কথা কা°টা°কা°টি।

“মিউকো।”

শাফিন সাহেবের ডাকে মৃত্তিকার সাথে সুরভিও বেরিয়ে আসে। মৃত্তিকা একগ্লাস পানি এনে মামার সামনে রেখে বলল,
“জি, মামা।”
“কলরব কি বলেছে তোমাকে?”

মৃত্তিকা মাথানিচু করে দাঁড়ায়। দেলোয়ারা বেরিয়ে আসে। বিচলিত হয়ে বলে,
“কি হয়েছে?”

শাফিন সাহেব মৃত্তিকাকে জিজ্ঞাসা করে,
“কলরবের সাথে তোমার কি কথা হয়েছে?”

মৃত্তিকা নিজেকে যথাসম্ভব শক্ত রাখলো। তারপর একে একে কলরবের সকল আচরণ খুলে বলল মামাকে। কলরবের সাথে যে ওর বাবাও ছিল তাও জানালো।

শাফিন সাহেবের রাগ বাড়লো। চিৎকার দিয়ে উঠলেন,
“সাহস কি করে হলো আমার বোনের নামে এধরনের কথা বলার? ওই ছেলেকে আমি..”

রাগে কি°ড়মি°ড় করছেন উনি। মৃত্তিকা উনাকে ধরে বলে,
“মামা, নিজের শরীর খারাপ করবেন না।”

দেলোয়ারা এসে শাফিন সাহেবকে সান্ত্বনা দিলেন,
“দেখো, যা হয়েছে তা হয়ে গেছে। পরিবর্তন সম্ভব নয়৷ তাও শুকরিয়া করো বিয়ের আগেই এসব হয়েছে না হলে মেয়েটার জীবনের বাকিটাও শেষ হয়ে যেত।”

শাফিন সাহেব সোফায় বসেন। সামনে থাকা গ্লাস থেকে ঢকঢক করে পানি পান করে। তারপর বলেন,
“আমার দোকানে এসেছিল। যা নয় তাই ব্যবহার করেছে। মি°থ্যাবা°দী, প্র°তা°রক এমন কোনো কথা নেই যা বলেনি।”

শাফিন সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থাকেন। মৃত্তিকা সুরভির পাশে গিয়ে বসে। সুরভি ওর হাত ধরে চোখের ইশারায় শান্ত থাকতে বলে।

“ইমতিয়াজ ঠিক বলেছিল মিথ্যা বলাটা ভালো নয় বরং আরো খারাপ হবে। জানাজানি হলে বিষয়টা খারাপের দিকেই এগোবে। এখন তাই হলো।”

শাফিন সাহেবের কথায় মৃত্তিকা বড়বড় চোখে তাকায়। হুট করে ইমতিয়াজের নাম শুনে তার মন আবারো ছটফটিয়ে উঠে।
______________________________________

সারাহ্ বারান্দায় বসে আছে। আহনাফ ওকে যতই বোঝাতে চায় সে বুঝতে চায় না। কিছুটা ইগো দেখিয়েই আছে সে।

টেবিলে বসে আহনাফ কিছু পড়ছে আর বারবার দেখছে বারান্দার দরজার দিকে। একপর্যায়ে ডাক দেয়,
“ঐশী।”

সারাহ্ জবাব দেয় না, উঠেও আসে না। আহনাফ আবারো ডাকে,
“ঐশী, এদিকে এসো।”

তবুও সারাহ্-র কোনো সারাশব্দ না পেয়ে আহনাফ দুষ্টুমি করে ডাকে,
“জান, কলিজা, গু°র্দা, পাকস্থলী এদিকে আসো।”

আহনাফের কথায় সারাহ্-র হাসি পায়। সে নিরবে হাসে, কিন্তু এবারেও জবাব দেয় না। আহনাফ ফোঁ°স করে একটা নিশ্বাস ফেলে উঠে যায়। আহনাফের আসার শব্দে সারাহ্ মলিন মুখে বাইরে তাকিয়ে থাকে।

“ডাকছি যে শুনতে পাচ্ছো না?”
না শুনার ভান করে বসে আছে সারাহ্।

আহনাফ ওকে কোলে তুলে রুমে নিয়ে আসে। বিছানায় বসিয়ে নিজে পাশে বসে বলল,
“অবুঝ বাচ্চাদের মতো আচরণ করো না, ঐশী। তোমাকে মানায় না এসবে। (একটু থামে) তুমি জানো আমার অতীত সম্পর্কে। আমাকে একটু সময় দাও।”

এবারে সারাহ্ কান্না করে দিলো। বেশ কিছুক্ষণ একভাবে কাঁদলো সে, আহনাফ চেয়ে রইলো ওর দিকে।

“সময় লাগলে আগে বলতে পারতেন। কিন্তু না প্রথমদিন থেকে আমার সাথে অদ্ভুত আচরণ করে গেছেন। যেন আমি ঘুড়ি, হাওয়ার দোলায় সুতার সাথে ওড়ছি আর আপনি ইচ্ছামতো সুতা ছাড়ছেন।”

আহনাফ ওর গালে হাত দেয়। সারাহ্ মুখ ঘুরিয়ে নেয়। আহনাফ জোর করে ওর মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
“আমি অপরাধ স্বীকার করছি। কিন্তু প্লিজ চুপ করে এরকম গু°ম°রে থেকো না।”

সারাহ্ ওর দিকে তাকায় না। চোখ নামিয়ে রেখেছে। কপালের দুপাশে কয়েকটা চুল এলোমেলো হয়ে এসে পড়েছে। আহনাফ চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বলে,
“ম্যাডাম তো তোমাকে প্রেগন্যান্ট বলে বেড়াচ্ছে।”

সারাহ্ অ°গ্নিদৃষ্টি দেয় আহনাফের দিকে। আহনাফ দাঁত বের করে হেসে বলল,
“বাংলা সিনেমার মতো মাথা ঘুরে পড়লে আর প্রেগন্যান্ট হয়ে গেলে?”

কথা শেষ করে হো হো করে হেসে উঠে সে। সারাহ্ একটু সরে বসে বলল,
“আগের দুইদিন আমার ব°মি হয়েছিল, আবার পিঠার গন্ধে অস্বস্তি হচ্ছিল৷ আগের দিনও খাবারের গন্ধে গা গু°লি°য়েছে। তাই ম্যাডাম এসব ভেবেছে।”

আহনাফ ভ্রূ উঁচিয়ে তাকায়, মুখে দুষ্ট হাসি। সারাহ্ আড়চোখে ওকে দেখে বলে,
“কিন্তু প্রেগন্যান্সির জন্য না, আমার প্রেশার কম ছিল আর গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা ছিল।”

আহনাফ হেসে ওর কানের কাছে এসে বলল,
“আমি জানি তুমি প্রেগন্যান্ট নও।”

সারাহ্ গালে চুম্বন করে চলে যায় আহনাফ। সারাহ্ রাগে গাল মুছে। আহনাফের এসব আচরণ ওর একদমই সহ্য হয়না।

আহনাফ আবারো ফিরে এসে বলল,
“কাল বিকেলে ঢাকায় যাবো।”

সারাহ্ একইভাবে বসে থেকে বলল,
“কোথাও যাবো না আমি।”

আহনাফ এসে ওর পাশে বসলো। গালে বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে হালকা স্পর্শ করে বলে,
“যেতে তো হবেই তোমার। ইচ্ছা থাকুক বা না থাকুক।”

আহনাফ আবারো সারাহ্-র দিকে এগিয়ে আসলে সারাহ্ আহনাফকে ধা°ক্কা দিয়ে সরে যায়। একটা ঢোক গিলে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে শান্তভাবে বলে,
“যতদিন মেনে নিতে না পারবেন, ততদিন দূরত্ব রেখে চলবেন। যদি তা রাখতে না পারেন, তবে আমি চিরদিনের দূরত্ব তৈরি করতে বাধ্য হবো।”

সারাহ্ একটু থামে। বড়বড় দুটো নিশ্বাস ফেলে বলে,
“বাইরের মেয়েদের সম্মান করতে পারেন, অথচ নিজের তিনকবুলের বিয়ে করা বউকে সম্মান করা যায় না। অধিকার জোর করে পাওয়া যায় না, সম্মান করলে অধিকার আপনা থেকেই আসে।”
______________________________________

রাত ৯ টা বেজে ৪২ মিনিট, মাত্রই অফিস থেকে বাসায় এসেছে ইমতিয়াজ। দরজা খুলতেই বিড়ালটা দৌড়ে ওর কাছে আসে। ইমতিয়াজ তাকে কোলে তুলে আদর করে বলে,
“মিউকো, মিস করছিলি আমাকে?”

অপরপাশের মিউ মিউ শব্দে ইমতিয়াজ হেসে রুমে যায়। শার্ট খুলে বিছানায় ফেলে ড্রেসিংটেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। হাতঘড়ি খুলছে তখনই ফোন বাজে।

পকেট থেকে ফোন বের করে শাফিন সাহেবের নাম্বার দেখে রিসিভ করে।

“আসসালামু আলাইকুম, মামা। কেমন আছেন?”

কিছুক্ষণের নিরবতার পর অপরপাশ থেকে উত্তর আসে,
“মামা ভালো আছে, আমি ভালো নেই।”

মৃত্তিকার কন্ঠে চমকে উঠে ইমতিয়াজ। ফোন রেখে দিতে চেয়েও রাখে না। বলে,
“আপনার ভালো থাকার মেডিসিন আমার কাছে নেই।”
“এক কথায়ই কোনো ডাক্তার ওষুধ দেয় না। ভালো করে বলতে হয়। ডাক্তারেরও শুনতে হয়।”
“ভণিতা না করে কি বলতে চান তাই বলেন।”

মৃত্তিকা আবারো কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“দেখা করতে চাই, কথা আছে। সময় হবে?”
“না, এখন লং টাইম ডিউটি।”

সরাসরি এভাবে না করায় মৃত্তিকার একটু খারাপ লাগলো। তাই সে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর কল কে°টে দেয়।

ইমতিয়াজ আবারো কল করে। রিসিভ হলেও মৃত্তিকা কথা বলে না।

ইমতিয়াজ নিজে থেকেই বলে,
“কাল অফিস টাইমের পর দেখা করতে পারবো, ৭ টার পর। কোথায় থাকবেন?”

মৃত্তিকা একটু খুশি হলেও মুখে হাসলো না। বলল,
“কাল কাকরাইল বড়মণির বাসায় যাবো। তবে আশেপাশে যেকোনো জায়গায় দেখা করতে পারি।”
“ওকে, আমি বাসার কাছেই থাকবো। কল দিলে নিচে আসবেন।”
“ঠিক আছে।”
“নাম্বার কি আগেরটাই আছে?”
“হুম।”
“ওকে, বাই।”

মৃত্তিকা ফোন রেখে হেসে দেয়। এতোদিন পর ইমতিয়াজের সাথে দেখা হবে। হঠাৎ তানজিমের কথাগুলো মনে পড়ে। মুখটা মলিন হয় তার। সবাই শুধু তাদের কথা কেন ভাবে? মৃত্তিকার দিকটা কি কেউ বুঝে না?

মৃত্তিকার ঠোঁট কেঁপে উঠলো। ডানচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো অশ্রু। চোখজোড়া বন্ধ করলো সে।
______________________________________

পরদিন সকালে,
তানজিম এখনো ভার্সিটিতে আসেনি। একের পর কল করছে সামিহা। রিসিভ করার নামগন্ধও নেই। কিছুক্ষণ পর ম্যাসেজ আসে,
“আমি আজ ক্লাস করবো না, নোট দিয়ে দিস।”

সামিহার মনটা একটু খারাপ হলো। কারণ জিজ্ঞাসা করে ম্যাসেজ করলে ফোন অফলাইন দেখালো। নিশ্চয়ই তানজিমের বাসায় কোনো সমস্যা হয়েছে।

এদিকে মৃত্তিকা, শাফিন সাহেব তানজিমের বাসায় এসেছে। লুৎফর রহমানও আজ দোকানে যাননি। ফরচুন শপিংমলে উনার দুটো কাপড়ের দোকান আছে। কর্মচারী থাকায় মাঝে মাঝে দোকানে না গেলেও কাজ চলে যায়।

মূলত বাবার কথায় ভার্সিটিতে যাওয়া বন্ধ করেছে তানজিম। মৃত্তিকার সাথে কথা বলার বা দেখা করার ন্যূনতম রুচি ওর নেই। খালাতো বোনের হাসবেন্ডকে পছন্দ করতে পারে, এরকম মেয়েকে তানজিম সহ্যই করতে পারে না।

লুৎফর সাহেব ইমতিয়াজকে কল করে অফিস ছুটির পর বাসায় আসতে বলেন, ইমতিয়াজও রাজি হয়। বাসার যেকোনো সমস্যা বা সিদ্ধান্তে ইমতিয়াজ উনাদের ভরসার জায়গা।

মৃত্তিকা মমতাজ বেগমের সাথে কথা বলছে। তানজিম এসে মাকে বলল,
“আম্মু, আমার তো এখানে থাকার কোনো দরকার নেই। আমি কি যেতে পারি?”
“না, থাকো। ইমতিয়াজ আসা পর্যন্ত থাকো।”

মৃত্তিকা তানজিমের দিকে একনজর তাকায়। তানজিম বিরক্তি নিয়ে বলে,
“ভাইয়াকে এখানে টা°নার কি দরকার ছিল? যার যার সমস্যা সে সে সমাধান করবে।”
“তানজিম, তোমার বাবা তোমার চেয়ে ভালো বুঝে।”

তানজিম রেগে চলে যায়। মৃত্তিকা বুঝে ওর রাগের কারণ, কিন্তু সে নিরব থাকে। এক্ষেত্রে কথা বলার অর্থ আ°গু°নে ঘি ঢালা।

দুপুরের পর কলরবের ফ্যামিলি বাসায় আসবে। সব বিষয় নিয়ে সরাসরি আলোচনা হবে আজকে।
______________________________________

আজ আহনাফের সাথেই কলেজে এসেছে সারাহ্। তবে একেবারেই চুপচাপ সে। যেন কথা বলাই ভুলে গেছে। আহনাফও আজ চুপ।

প্রথম পিরিয়ডে ক্লাস আছে আহনাফের। ক্লাসে মন বসাতে কষ্ট হলো তার। কারণটা বুঝতে পেরেছে, গতরাতের সারাহ্-র কথা আর ওদের মাঝে অদৃশ্য দেয়ালের যে বিভাজন তৈরি হয়েছে সেটা আহনাফ মানতে পারছে না।

কোনোমতে ক্লাস করে বেরিয়ে আসে। নিজেকে বারবার বোঝাতে থাকে, কিন্তু শান্ত করতে পারে না। অস্থিরতা বিরাজ করছে তার মনে। দুরন্ত ঘোড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে ছোটাছুটি করছে বুকের বামপাশে থাকা সেই য°ন্ত্র।

রুমে এসে বসে মাথানিচু করে থাকে। বারবার নিজেকে একই কথা বোঝাচ্ছে,
“ঐশী কেউ না। ওর কথা ভেবো না, কষ্ট পাবে। সব অনুভূতি মি°থ্যা, এসবের কোনো মূল্য নেই। তাহসিনা ছাড়া আর কেউ তোমাকে ভালোবাসবে না, বুঝবে না। ঐশীর প্রতি থাকা সকল অনুভূতিকে ক°বর দাও, মূল্যহীন ওগুলো।”

নিজেকে বোঝাতে ব্যর্থ হয় আহনাফ৷ এই একটা মেয়ে ওকে সর্বোচ্চ এলোমেলো করেছে। ভদ্র আহনাফকে অভদ্র করেছে, শান্ত আহনাফকে অশান্ত করেছে। মেয়েটার শান্ত চাহনি, কথা কিংবা অনবরত কাঁপতে থাকা সেই ওষ্ঠোধর সবকিছু আহনাফকে পাগল করেছে।

আহনাফের এমন অস্থিরতার ঠিক উলটো চেহারা সারাহ্ ধারণ করেছে। শান্তভাবে নিজের দায়িত্ব পালন করছে। ক্লাসে যাওয়ার সময় টিচার্স রুমে আহনাফকে দেখেছে। আহনাফ যে অন্যমনস্ক হয়ে আছে তা সে খেয়াল করেও নিশ্চুপ।

ওরা দুজন যেন দুটি দ্বীপের বাসিন্দা। একটি দ্বীপের ঢেউ শান্ত, আরেকটি দ্বীপে হচ্ছে সুনামি। আছড়ে পড়ছে বড় বড় ঢেউ আর ভেসে যাচ্ছে সে দ্বীপে থাকা আহনাফ।
______________________________________

সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় মৃত্তিকার নাম্বারে ম্যাসেজ দেয় ইমতিয়াজ,
“আমি অফিস থেকে বেরিয়েছি, বাসার কাছে চলে এসেছি। আপনি রেডি থাকেন। – ইমতিয়াজ।”

ম্যাসেজটা দেখে মৃত্তিকা দ্রুত ডি°লিট করে দেয়। বাসার সবার সামনে বসে আছে সে। দ্রুত চোখে সকলের দিকে তাকায়। কিভাবে বের হবে সে তাই ভাবতে থাকে।

বিকালে কলরবের ফ্যামিলি এসেছিল। মৃত্তিকা নিজেই বিয়ে ভা°ঙার কথা বলেছে আর তা ইতোমধ্যে ভে°ঙেও গেছে। বাবাকে নিয়ে অনেক কথা হলেও মৃত্তিকা সেখানে ছিল না। এখন বাসার সবাই মোটামুটি স্বাভাবিক আছে।

মৃত্তিকা উঠে রুমে গিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে। সাদা সুতির থ্রিপিসের সাথে সোনালী রঙের স্কার্ফ মাথায় পেছিয়ে নেয়। বুকের ভেতর সাহস জুগিয়ে ড্রইংরুমে আসে সে।

শাফিন সাহেবকে বলল,
“মামা?”
“জি, মামা।”

মৃত্তিকা চঞ্চল চোখে এদিকওদিক তাকিয়ে বলে,
“আমি একটু বাইরে যেতে চাই। যেতে পারি?”

শাফিন সাহেব হেসে বলেন,
“সুরভি নেই বলে ভালো লাগছে না? আচ্ছা, যাও। বেশি দূরে যেও না।”
“থ্যাংক ইউ।”

মৃত্তিকা হাসি হাসি মুখে বেরিয়ে যায়। পড়ার টেবিলে বসে মৃত্তিকার কথা শুনেছে তানজিম। কিন্তু ওর আন্দাজে ইমতিয়াজের কথা আসে না।

বাসার বাইরে এসে ইমতিয়াজকে কল দেয়। ইমতিয়াজ রিসিভ না করে ওর দিকে এগিয়ে আসে।

“বাসার কাছে থাকবো বলেছিলাম, সামনে না।”

মৃত্তিকা একপ্রকার লাফিয়ে উঠে বামদিকে ইমতিয়াজকে দেখে স্বস্থির নিশ্বাস ফেলে। মৃত্তিকা পূর্ণদৃষ্টি দেয় ইমতিয়াজের দিকে। গাঢ় খয়েরী শার্ট, সাথে কালো প্যান্ট, শার্টের হাতা কনুই অব্ধি গুটিয়ে রাখা, প্যান্টের কোমড়ের দিকে অফিস আইডি কার্ড ঝুলানো।

ইমতিয়াজ হাত বাড়িয়ে হাঁটতে ইশারা করে। হাঁটতে হাঁটতে মৃত্তিকা আবারো ওর দিকে তাকায়। নিজেই নিজেকে ফিসফিস করে বলল,
“নজর খারাপ হয়ে গেছে, আর দেখিস না।”

একটা ক্যাফেটেরিয়া পর্যন্ত ওদের গন্তব্য হয়। কফি অর্ডার করে মুখোমুখি বসে দুজনে।

“বলুন, কি কথা বলতে চাচ্ছিলেন?”

মৃত্তিকা লজ্জার চাদর ফেলে স্বাভাবিক হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আমার কথা আসলে শোনার মতো কেউ নেই। কারো ধৈর্য নেই, সময় নেই। (একটু থামে) নিজেকে কেমন যেন যাযাবরের মতো মনে হয়। হয় মামার বাসা আর না হয় বড়মণির বাসা। নিজের বলে কিছু নেই আমার এদেশে।”

ওদের কফি চলে আসে। ইমতিয়াজ ওকে খেতে ইশারা করে কাপে চুমুক দেয়।

মৃত্তিকা এক চুমুক কফি পান করে আবারো বলা শুরু করে,
“কলরবের সাথে অনেক ঝা°মেলা হয়েছে, বিয়েও ভে°ঙে দিয়েছি।”
“কিরকম ঝা°মেলা?”

ইমতিয়াজের কথায় কথা থামে মৃত্তিকার। ওর দিকে একবার তাকিয়ে বলে,
“মামকে নিয়ে খারাপ কথা বলেছে। বলেছে আমি নাকি..”

মৃত্তিকা আর বলতে পারে না। ইমতিয়াজ জিজ্ঞাসা করে,
“আপনি কি?”

মৃত্তিকা মাথানিচু করে ভারি কন্ঠে বলল,
“আমি মামের (একটু থামে) মামের না°জায়েজ সন্তান আর আমার (আবারো থামে) শরীরে নাকি অনেক পুরুষের..”

ইমতিয়াজ ওর ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে থামিয়ে দেয়। মৃত্তিকা ছলছল চোখে ওর দিকে তাকায়। ইমতিয়াজ হাত সরিয়ে নেয়। মৃত্তিকার নয়নের ধারা আবারো গড়িয়ে পড়ে।

ইমতিয়াজ টিস্যু এগিয়ে দিয়ে বলে,
“চোখ মুছে নেন।”

মৃত্তিকা চোখ মুছে নাক ঝে°ড়ে নেয়। ইমতিয়াজ বলে,
“এতো কথা বলে কেউ পার পেয়ে গেল?”
“থা°প্প°ড় মে°রেছি।”

চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ইমতিয়াজ বলল,
“একটা মেয়ের থা°প্প°ড়ে কি এমন হয়েছে? প্রত্যেকটা শব্দের জবাব দেয়া উচিত ছিল।”

মৃত্তিকা মাথানিচু করে রইলো। স্কার্ফ পেরিয়ে কপালের দুপাশে চুলগুলো এসে পড়েছে। মৃত্তিকা কানের পিছনে চুল গুজে বলে,
“বাবাকে কি করবো? সারাজীবন মামের নামে এসব বলেই গেল। উনিই তো কলরবকে এসব বলেছে।”

ইমতিয়াজ শান্তভাবে বলে,
“আপনার বাবা কি করে?”
“ডাক্তার।”

ইমতিয়াজ হেসে দেয়৷ বলে,
“ডাক্তার হয়ে মেয়ের পেছনে সারাদিন কিভাবে থাকে?”

মৃত্তিকা একটু ভেবেচিন্তে নিজের মনের সন্দেহের কথা বলেই দেয়।
“উনি সারাদিন থাকে না, মাঝেমধ্যে থাকে। আর (একটু থেমে আশেপাশে তাকায়) উনার স্পা°ই আমার আশেপাশে থাকে।”
“কি?”
মুখ বাকিয়ে কপাল কুঁচকায় ইমতিয়াজ।

মৃত্তিকা মাথা নাড়ে। মুখে বলে,
“এটা আমার সন্দেহ। নাহলে আমার প্রত্যেক পদক্ষেপের খবর উনার কাছে কিভাবে থাকে?”

মৃত্তিকা আবারো আড়চোখে এদিকওদিক তাকায়। বলল,
“বাবার কাছে একটা পি°স্ত°লও আছে। আমি নিজে দেখেছি ওটা। অ°বৈ°ধ নয়, বৈ°ধ।”

ইমতিয়াজ চোখ ছোট করে তাকায়। ওই লোকটা কি আসলেও একজন ডাক্তার নাকি এর আড়ালে অন্যকিছু? প্রশ্নটা মৃত্তিকাকে না করলেও জানার আগ্রহ তীব্র থেকে তীব্র°তর হতে থাকে ইমতিয়াজের।

চলবে…..

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

বিংশ পর্ব

“তোমাদের দেখা হলো কোথায়?”

বাসায় মৃত্তিকা ও ইমতিয়াজ একত্রে আসায় কিছুটা অবাক হয়েই প্রশ্ন করলেন শাফিন সাহেব।

ইমতিয়াজ স্বাভাবিকভাবে জবাব দিলো,
“বাসার কাছেই উনাকে হাঁটতে দেখলাম। তারপর আসা আরকি।”

শাফিন সাহেব হাসলেন। বলেন,
“একা একা ভালো লাগে না ওর। (একটু থেমে) আচ্ছা, তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও।”
“জি।”

ইমতিয়াজ তানজিমের রুমে গেল। পকেট থেকে ফোন বের করে টেবিলের উপর রেখে তানজিমকে বলে,
“কেমন আছো?”
“ভালো।”

তানজিম খাটে বসে বই পড়ছিল। একটু আগে শাফিন সাহেব আর ইমতিয়াজের মধ্যে হওয়া কথাগুলো সে শুনেছে। উঠে এসে বলল,
“মিউকোপুর সাথে তোমার কোথায় দেখা হয়েছে ভাইয়া?”

ইমতিয়াজ চোখ কুঁচকে বলল,
“বাসার কাছে।”
“সত্যি বলছো?”

ইমতিয়াজ জবাব না দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। এখানে থাকলে তানজিম একের পর এক প্রশ্ন করেই যাবে।

কিছুক্ষণ পর শাফিন সাহেব আর লুৎফর রহমানের সাথে কথা বলতে বসে ইমতিয়াজ। এসব কথা বা কাজে তানজিম বেশ বি°র°ক্ত। বিয়ে ভে°ঙেছে এটা নিয়ে এতো আলোচনার কোনো দরকার নেই।

মৃত্তিকা মাথা নুইয়ে রুমে চলে যায়। প্রচন্ডভাবে মাথা য°ন্ত্র°ণা করছে, হয়তো মাই°গ্রে°নের সমস্যা। আপাতত সে নিরবতা চায়।

বারান্দায় গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। যতক্ষণ তুমি চিৎকার করে নিজের মনের কথা বলতে না পারো, ততক্ষণ এক আল্লাহ্ ছাড়া কেউ তোমার অবস্থা বুঝবে না। এটাই বাস্তবতা, যা মৃত্তিকার ক্ষেত্রে হচ্ছে।
______________________________________

রাত ১১ টা, আহনাফ ঢাকা যাবে বলেও যায়নি। এব্যাপারে সারাহ্-র সাথে কোনো কথাও হয়নি। যেহেতু কাল শুক্রবার তাই বেশ আঁট গাঁট বেঁধে সিরিজ দেখতে বসেছে সারাহ্। আজ ঘুমানোর তাড়া নেই।

আহনাফ ওকে এখানে দেখে গেলেও ডাকে না। কালকের কথায় আহনাফ যে বেশ চুপচাপ আছে।

আহনাফ কফি বানাচ্ছে। দুইটা কাপে কফি এনে একটা সারাহ্-র সামনে দিয়ে নিজে পাশে বসে পড়লো। ইউটিউবে কোনো একটা টার্কিশ সিরিজ দেখছে সে। আহনাফ এসব সহজে দেখে না, তবুও পাশে বসে আছে। সোফার সাথে হেলান দিয়ে দুজনেই ফ্লোরে বসেছে। রুমে একটা অল্প আলোর বাতি জ্ব°লজ্ব°ল করছে।

“ঐশী?”

আহনাফের নরম ডাকে সারাহ্ ওর দিকে তাকালো। আহনাফ বলল,
“এতো চুপচাপ আছো, আগের মতো কথা বলো।”

সারাহ্ আবারো টিভির দিকে তাকায়, সাথে কফির কাপে চুমুক দেয়। মুখে বলে,
“কফি ভালো হয়েছে।”

আহনাফ তাকিয়ে আছে ওর চেহারার দিকে। সারাহ্ খেয়াল করেও কিছু বলে না। আহনাফ সারাহ্-র কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিতে দিতে বলে,
“ঐশী, ঢাকায় যেতে চাচ্ছিলাম।”
“তো যেতে পারতেন। আমি তো নিষেধ করিনি।”
“তোমাকে একা রেখে যাবো?”
“আমি বাচ্চা নই।”

আহনাফ হেসে বলল,
“বাচ্চাদের মতোই রাগ করে বসে আছো।”
“অকারণে রাগ করিনি।”
“আমি জানি যথেষ্ট কারণ আছে। কিন্তু…”

আহনাফের কথার মাঝেই সারাহ্ বলল,
“এসব নিয়ে আর কথা না বলি।”

আহনাফ কিছু বলে না। সারাহ্ টিভি বন্ধ করে আহনাফের দিকে ফিরে বলে,
“আপনার সময় লাগবে, সময় নিন। তবে অযথা আমাকে ব্যবহার করবেন না।”
“আমি তোমাকে ব্যবহার করিনি। কখনোই না।”

আহনাফের ফিসফিসানিতে সারাহ্ সরে যেতে নিলে আহনাফ ওকে বাহুডোরে আগলে নিলো। আহনাফের বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে সারাহ্। দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আহনাফকে, কেন যেন এখন রাগ করতে ইচ্ছা করলো না। অদ্ভুত আকর্ষণ আর অ°ব্যক্ত অনুভূতি দুজনের মাঝেই কাজ করছে। দুটো দ্বীপ একই স্থানে চলে এসেছে। ভালোবাসা মিলেমিশে এক হয়ে গেছে।
______________________________________

ফজরের আযান দিচ্ছে। সারাহ্ চোখ খুলে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বুঝলো সে শয়নকক্ষে বিছানার উপর আছে। ড্রইংরুম থেকে এখানে কখন এসেছে তা ওর মনে নেই। আহনাফ পাশেই ঘুমিয়ে আছে, তার একহাত সারাহ্-র উপর। সারাহ্ উঠে বসে ওর দিকে তাকায়।

আহনাফের হাতটা ধরে সে। ঘন লোমের বলিষ্ঠ পুরুষের হাত, বাবার পর প্রথম এই পুরুষের হাতের স্পর্শ পেয়েছিল। সারাহ্ ওর হাতের উলটো পিঠে চুম্বন করে উঠে যায়। যতই দায়িত্ব, কর্তব্য বলুক না কেন আহনাফ এখনো ওকে পুরোপুরি আপন করতে পারেনি।

ঘুমের ঘোরে আহনাফ বুঝতে পারে না কোনো এক রমনী তার শক্ত হাতে নরম ওষ্ঠোধর ছুয়ে গেছে।

ফ্রেশ হয়ে ওযু করে এসে সারাহ্ কর্কশ গলায় আহনাফকে ডাকে,
“প্রতিদিন ডাকাডাকি লাগে কেন? নিজে থেকে উঠতে পারেন না?”

আহনাফ চোখ খুলে কান চুলকে বলল,
“একটু মিষ্টি করেও তো ডাকতে পারো।”

সারাহ্ কিছু না বলে নামাজের হিজাবটা বাঁধতে লাগলো। আহনাফ উঠে বসে বলে,
“তোমাকে যে আমি ড্রইংরুম থেকে কোলে করে নিয়ে এলাম, তখন তো আমি ফেলে দিয়ে আসতে পারতাম।”

সারাহ্ ফিরে এসে বলল,
“আমি আনতে বলেছিলাম?”
“না আনলে বলতে আনিনি কেন?”

সারাহ্ কিছু না বলে হিজাবটা বাঁধতে থাকে। আহনাফ উঠে ওয়াশরুমে যেতে যেতে বলল,
“লোকে ঠিকই বলে মেয়েদের মন বোঝা সহজ নয় আর বউ হলে তো কথাই নেই।”
______________________________________

সকাল এগারোটা, বাসায় চলে এসেছে শাফিন ও মৃত্তিকা। মৃত্তিকাকে বাসায় রেখে বাইরে গেছেন শাফিন সাহেব। নিজের একটা বড় গ্রোসারি শপ আছে উনার। সেখানে এলেন এখন।

দোকানের প্রবেশের গেইট দুটির মধ্যে একটি বন্ধ থাকায় কর্মচারীকে বলেন,
“কি ব্যাপার গেইট বন্ধ কেন?”

কর্মচারী উমার কিছু জিনিসপত্র গোছাচ্ছিল। শাফিন সাহেব রেগে গিয়ে বলেন,
“কথা কি কানে যাচ্ছে না?”
“সব যাচ্ছে, এখন তুমি চুপ করো।”

উমার একটা ছু°ড়ি দিয়ে শাফিন সাহেবের বুকের ডানপাশে ঢু°কিয়ে দিলেন। পেছন থেকে কেউ একজন উনার পায়ে আর কাঁধে ছু°ড়ি চালালেন। শাফিন সাহেব প্র°তি°রো°ধ করতে গিয়েও ব্যর্থ হলেন। ফ্লোরে পড়ে গিয়ে চোখ বন্ধ হওয়ার আগে কেবল উমারের বুকে কাউকে ছু°ড়ি চালাতে দেখলেন।

বেশ খানিকক্ষণ পর সুরভির নাম্বারে কল এলো। কোনো এক ক্রেতা দোকানে এসে এসব দেখে পুলিশকে খবর দেয় আর উনারা সুরভিকে জানায়।

সুরভি বাবার এ অবস্থার কথা শুনে মৃত্তিকাকে নিয়ে ছুটে এলো দোকানে। শাফিন সাহেবকে ততক্ষণে নিয়ে যাওয়া হয়েছে হাসপাতালে।

ওরা আবারো গেল স্থানীয় বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানে শাফিন সাহেবের দেখা পেলেও এখানে উনাকে রাখা হলো না, অবস্থা খারাপ বলে পাঠানো হলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

সুরভির মা দেলোয়ারা কান্না করতে করতে জ্ঞান হারিয়েছেন। শাফিনের মতো মানুষকে কেউ কেন মা°রার চেষ্টা করবে?

খবর পেয়ে লুৎফর রহমান আর ইমতিয়াজ হাসপাতালে ছুটে এসেছে। মমতাজ বেগমকে এখনো এ ব্যাপারে জানানো হয়নি। সুরভি নিজেও ক্রমাগত কান্না করে যাচ্ছে। শাফিন সাহেবকে কিছুক্ষণ আগেই আইসিইউতে পাঠানো হয়েছে।

মৃত্তিকার বারবার মনে হচ্ছে এসবের জন্যও ওর বাবা দায়ী। ওর বাবা বলেছিল ওকে একা করে দিবে। এভাবেই কি একা করবে উনি?

দুপুর গড়িয়ে বিকাল হলো, তারপর হলো সন্ধ্যা। এই পরিবারটুকু সুখের মুখ আর দেখলো না। শাফিন সাহেবের অবস্থা অপরিবর্তিত। উমার মা°রা গেছে, কে বা কারা এ কাজ করেছে তা চেনা যায়নি। সিসিটিভি ক্যামেরা বন্ধ ছিল আর উমার নিজেই তা বন্ধ করেছে।

মাগরিবের নামাজের পর মৃত্তিকা সুরভিকে নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে বের হয়। অসুস্থ সুরভি যেতে না চাইলেও একটু জোর করেই বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় মৃত্তিকা।

সিএনজি নিয়ে চলে আসে বাসায়। সুরভি লিফটে করে আগে আগে উপরে চলে গেল। মৃত্তিকা ভাড়া মিটিয়ে বাসায় ঢুকার সময় শরীফ এসে পেছন থেকে ডাকলো,
“মিউকো, কোথায় গিয়েছিলে?”

মৃত্তিকা কপাল কুঁচকে ফিরে তাকালো। রাগটা আবারো মাথাচা°ড়া দিয়ে উঠলো। শরীফের দিকে এগিয়ে এসে বলল,
“মামাকে আপনি মা°রার চেষ্টা করেছেন কেন? এভাবে একা করবেন আমাকে?”

শরীফ হাসলো। বলল,
“তোমার মামা এমনিতেও তোমাকে একা করতে চাচ্ছে। আমার তাকে মা°রার প্রয়োজন নেই।”

শরীফ চলে যাওয়ার সময় আবারো ফিরে এসে বলে,
“শাফিন কি বাঁচবে নাকি শেষ?”
বলেই বামহাত ডান থেকে বামদিকে নাড়লো।

মৃত্তিকা উত্তর না দিয়ে ভিতরে চলে গেল। ওর জন্যই যদি সবার এ অবস্থা হয় তবে ওর ইতালি গিয়ে একা থাকাই ভালো। যা যা হবে সব একা সহ্য করে নেয়া উচিত। আবেগ-অনুভূতিকে কবরস্থ করে দেয়া দরকার। শাফিন সাহেব সুস্থ হলেই ইতালি চলে যাবে সে, এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়।
______________________________________

সারাহ্ রাতের রান্না করছে। আহনাফ সাহায্য করতে আসলেও সারাহ্ ওকে পাত্তা দেয়নি। পাত্তা না পেয়ে সে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

“ঐশী, রাতে তোমাকে সুন্দর লাগছিল।”

সারাহ্ রাগি চোখ তাকালে আহনাফ ওকে আরো রাগানোর জন্য বলে,
“কিভাবে এসে বুকে পড়েছিলে? তারপর আবার আমাকে বলছিলে আদর করো না ফয়েজ।”

সারাহ্ জোরে খু°ন্তিটা ফেলে বলল,
“মোটেও না। এতোটা অ°সভ্য আমি নই।”
“আরে তারচেয়েও বেশি। ঘুমালে মনে হয় ম°রে পড়ে আছো। এতোগুলো কিস করলাম উঠলেই না।”

আহনাফ এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলে,
“দুই চারটা কা°ম°ড়ও দিয়েছি।”
“ছি, কি ভাষা?”

সারাহ্ নাক ছি°ট°কানি দেয়। আহনাফ হাসতে হাসতে চলে যায়। মাঝে মাঝে মিথ্যা বলে সারাহ্-কে রাগাতে ভালোই লাগে।

আহনাফ আবারো এসে বলে,
“তুমি মেবি নে°শাটে°শা করো, কি নে°শা°ক্ত একটা কন্ঠ ছিল।”
বলেই বামচোখ টিপে চলে যায়।

“ছি।”
সারাহ্ রাগে ধুপধাপ করে কাজ করছে।

আহনাফ তো হেসে কুটিকুটি। শান্ত মেয়েটা ওকে অভদ্র বানিয়েছে। এতোটা ঠোঁট°কা°টা কোনোকালেই সে ছিল না। অথচ এখন লাজ-লজ্জা সব গঙ্গায় ভা°সিয়েছে।

আহনাফ ডাইনিং থেকে চেঁচিয়ে বলল,
“ঐশী, তুমি কিন্তু…”

সারাহ্ ধ°ম°ক দিয়ে বলে,
“আর একটা কথা বললে একদম গরম পানি ঢেলে দিবো।”

আহনাফ হো হো করে হেসে উঠে। সারাহ্ কাজ করতে করতে ভাবে,
“আমি কি সত্যিই এসব করেছি? আমার তো ঘুম এতো গভীর না, তবে ড্রইংরুম থেকে বেডরুমে গেলাম কখন টের পাইনি কেন?”

সারাহ্ শান্তভাবে হেঁটে আসে। আহনাফকে বলে,
“শুনুন।”

আহনাফ ভ্রূ উঁচিয়ে বলে,
“অসমাপ্ত কথাটা শুনতে চাচ্ছো?”
“না।”
সারাহ্ ধ°মক দেয়।

ধীরে ধীরে সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি সত্যি এসব বলেছি?”

আহনাফের হাসির তো°প বাড়লো। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“ভাউ।”
“মজা না সিরিয়াস।”

আহনাফ ওর কাছে যায়। সারাহ্ একটু নিচু হয়। আহনাফ বলল,
“কেমিস্ট্রি ম্যাডাম আমার সাথে উনিশ-বিশ কিছু করে নাই।”
বলে ঠোঁট বাঁ°কিয়ে উড়ন্ত চুম্বন দেখিয়ে রুমে চলে যায়।

সারাহ্ প্রতিদিন এই লোকের পরিবর্তন লক্ষ্য করছে। প্রথমদিনের সাথে পার্থক্য আছে, দিন যত যাচ্ছে আহনাফের মনের কোণে ততবেশি স্থান পাচ্ছে সে।
______________________________________

একমাস পর,
কিছুটা সুস্থ অবস্থায় বাসায় আছেন শাফিন সাহেব। তবে এখনো একা একা ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না। নিজের কাজগুলো করতেও যথেষ্ট সমস্যা হচ্ছে তার। মৃত্তিকা আর দেলোয়ারার সাহায্যে চলাচল করেন উনি।

আজ উনাকে দেখতে বাসায় এসেছে ইমতিয়াজ। উনি অসুস্থ হওয়ার পর প্রায়ই উনাকে দেখতে আসে ইমতিয়াজ।

মৃত্তিকা আর সুরভি দুপুরের রান্না করছে। দেলোয়ারা এসে বললেন,
“মিউকো, ইমতিয়াজকে নাস্তা দিয়ে আসো।”

মৃত্তিকা মাথা নেড়ে বলল,
“ঠিক আছে, মামানী।”

সুরভি ট্রেতে নাস্তা সাজিয়ে দিলো। মৃত্তিকা ট্রে নিয়ে ড্রইংরুমে ইমতিয়াজের সামনে রাখে। একটা চায়ের কাপ তুলে পাশে সোফায় বসা শাফিন সাহেবের হাতে দেয়।

ইমতিয়াজ ওকে জিজ্ঞাসা করে,
“কেমন আছেন মৃত্তিকা?”
“ভালো।”

ছোট করে উত্তর দিয়ে মৃত্তিকা ভিতরে চলে আসে, আড়চোখে একবার ইমতিয়াজকে দেখলেও পূর্ণদৃষ্টি দেয়া হয় না। আবারো গিয়ে রান্নার কাজে হাত লাগায়। দেলোয়ারা ড্রইংরুমে চলে যাওয়ার পর সুরভি বলে,
“ইমতিয়াজ ভাইয়াকে দেখলে তুমি এমন লজ্জা পাও কেন?”

মৃত্তিকা চমকে মাথানিচু করে। সুরভি ওর রকমবহর দুটোই দেখেছে। মৃত্তিকা বলে,
“কই? এমন কিছু না।”
“আমি অন্ধ বা বোকা নই।”

মৃত্তিকা সুরভির দিকে তাকায়। সুরভি বলে,
“ভালো টালো লাগে নাকি ভালোবাসা?”

মৃত্তিকার কাঁধে আলতো ধা°ক্কা দেয় সুরভি, মুখে থাকে মিষ্টি একটা হাসি। মৃত্তিকা হেসে বলে,
“আরে না, ওই এমনিই।”
“আমার সাথে কিসের শরম? বলো না।”
“না আপু, তেমন কিছু না।”

মৃত্তিকা কাজে মন দেয়। সুরভিও আর কথা বাড়ায় না। মৃত্তিকার নজর, ভাব বুঝতে পারে সুরভি।

চলবে……

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

একবিংশ পর্ব

ঢাকায় এসেছে আহনাফ-সারাহ্। বাসায় আসার পর থেকেই সামিহা সারাহ্-র সাথে গল্পে মজেছে। ক্লাসের এটা ওটা সেটা সবই সারাহ্-কে দেখাচ্ছে সে। কোন কোন জায়গায় ঘুরতে গিয়েছিল, কোথায় কি ছবি তুলেছে তাও দেখাচ্ছে।

সারাহ্ বালিশে মাথা রেখে শুয়ে বলে,
“এগুলো তো হোয়াটসঅ্যাপে বহুবার দেখিয়েছিস।”
“আরে এখন দেখো না, লাইভ।”

সারাহ্ ওর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে পাশে রেখে বলল,
“এক্সাম কবে?”
“উহু, উহু, রুটিন দেয় নাই।”
“পড়াশোনা চা°ঙ্গে তুলে বসে থাকো।”

সামিহা হাসতে হাসতে সারাহ্-র পাশে শুয়ে বলে,
“পরীক্ষার আগে নামাই নিবো। (একটু থেমে) আপু চলো না ঘুরতে যাই।”

সারাহ্ উঠে খোঁপা করতে করতে বলল,
“কাল কিন্তু আমরা চলে যাবো। আজ কোথাও যেতে পারবো না।”
“সে তো জানা কথা। শুক্র, শনি বন্ধ আবার রবিবার কিলাস।”
ব্য°ঙ্গ করে কথাটা বলল সামিহা।

আহনাফ এসে দরজায় নক করে।
“আসবো?”
“জি ভাইয়া, আসেন।”

আহনাফ রুমে আসলে সামিহা বেরিয়ে গেল। সারাহ্ ফোনে ক্লাসের নতুন রুটিন দেখে বলল,
“ফার্স্ট ইয়ারে শুধু আপনার ক্লাস কেন? সেকেন্ড ইয়ার কি করছে?

আহনাফ হেসে উঠে বলল,
“ওখানের মেয়েগুলো কিউট হয়। কারো চোখ সুন্দর, কারো ঠোঁট সুন্দর, কারো হাসি সুন্দর, কারো চুল সুন্দর।”

সারাহ্ চশমার উপর দিয়ে আহনাফের দিকে তাকায়। আহনাফ বলে,
“বাট সমস্যা হলো কেমিস্ট্রির সারাহ্ ম্যাম অসম্ভব মায়াবী।”

সারাহ্-র কাছে এসে বলল,
“সরি, মায়ার খাজানা এখানে।”

সারাহ্ হেসে মুখ ঘুরায়। ওদের সম্পর্ক এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। আহনাফের এসব দুষ্টুমিতে সারাহ্ অভ্যস্ত হয়ে গেছে।

এদিকে, সামিহার ফোনে কল দেয় তানজিম। সামিহা রিসিভ করতেই তানজিম বলে,
“তাড়াতাড়ি নিচে আয়, আমি অপেক্ষা করছি।”

সামিহা নিচে নেমে গেল। বাসার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে তানজিম। সামিহা গিয়ে বলল,
“কিরে, এখন এখানে?”
“দুইদিন ভার্সিটিতে যাইনি, তোকে দেখিনি, তাই চলে আসলাম।”

সামিহা ভ্রূ উঁচিয়ে তাকায়। তানজিম হাঁটা শুরু করে, সামিহাও ওর পাশাপাশি হাঁটছে।

তানজিম বলে,
“পরশুদিন মামার বাসায় গিয়েছিলাম।”

শাফিন সাহেবের অবস্থার কথা সামিহা জানে। প্রশ্ন করে,
“কেমন আছেন উনি?”
“আগের চেয়ে ভালো। (একটু থেমে) দুই একদিন পর পর ইমতিয়াজ ভাইয়া ওখানে যান। সেদিন সন্ধ্যাও গিয়েছিলেন।”

সামিহা চুপ করে আছে। তানজিমের এসব কথা সে কেবল শুনে। ভালোমন্দ যাচাই করতে এখনো শেখেনি সে।

“মামাকে না ভাইয়া মিউকোপুর সাথে দেখা করতে যায়।”

তানজিম হাঁটা থামিয়ে বলে,
“আমি আগেও তোকে বলেছি না ভাইয়া আপুকে অন্য নজরে দেখে। আমার বোন বেঁচে থাকলে কি হতো?”

কি হতো তা সামিহা জানে না। কারো মনের খবর ও তো আর বলতে পারবে না। সামিহা এদিক ওদিক তাকিয়ে একটু বি°ব্রতভাবেই বলে,
“তানজিম, তাহমিনা আপু যেহেতু নেই তাই উনাদেরকে উনাদের মতো থাকতে দিলে হয় না? (একটু থেমে) আমরা অন্য বিষয়েও তো কথা বলতে পারি।”

তানজিম একটু গরম সুরে বলে,
“হ্যাঁ, আমার বোন থাকলে এখানে একটা পর°কি°য়ার গল্প রচিত হতো।”

তানজিম হনহনিয়ে চলে যায়। সামিহা একটু হতভ°ম্ব, নিজের মতো একটা কাহিনী রচনা করেছে তানজিম। সবটাই ওর কল্পনা। এতো বড় হয়েও কি বাস্তবতার জ্ঞান হয়নি তার?

আজকাল তানজিমের সাথে অন্য কোনো বিষয় নিয়ে ওর কথাই হয় না। সারাদিন সে তার বোনদের কথা আর মৃত্তিকা-ইমতিয়াজের বদনামে ব্যস্ত থাকে। সামিহা বি°র°ক্ত হয়ে যাচ্ছে ওর এসব আচরণে। তানজিমের এমন ব্যবহার ও আগে কখনোই দেখেনি।
______________________________________

সন্ধ্যা ৭ টা, শাফিন সাহেব নিজকক্ষে শুয়ে কারো সাথে ফোনে কথা বলছেন। সুরভি দরজায় নক করে।

“বাবা।”

শাফিন সাহেব ফোন রেখে উঠে বসে বলেন,
“হ্যাঁ মা, আসো।”

সুরভি রুমে গিয়ে বসে। বাবার হাতে-পায়ে হাত বুলিয়ে দিলো। শাফিন সাহেব হাসলেন। নিজের সেদিনের ছোট্ট মেয়েটা এখন মা হতে চলেছে।

“মিউকো ইতালি চলে যেতে চায়।”
“ইতালি? কেন?”
শাফিন সাহেব অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন।

সুরভি সরাসরি বলে,
“ওর বাবার কারণে আর কেন। ওর নাকি মনে হয় এসবের জন্য ওর বাবা দায়ী।”

শাফিন সাহেবের হাসি উঠে। কিছুক্ষণ হেসে বলে,
“ওখানে একা একা কিভাবে থাকবে? ওর বাবা তো ওকে একাই করতে চায়।”

সুরভি কিছুক্ষণ বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, যেন কিছু বলতে চায়। শাফিন সাহেব মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলে,
“কি বলবে মা?”

সুরভি হাসে। বলে,
“মিউকো হয়তো কাউকে পছন্দ করে।”
“কাকে? ইতালিতে কেউ?”
“না এখানে। (একটু থেমে) ইমতিয়াজ ভাইয়া।”

শাফিন সাহেব চোখ বড় করে তাকালেন। সুরভি দরজার দিকে একবার তাকিয়ে বলে,
“কিছু মনে করবেন না বাবা, মিউকো আমাকে এসব বলেনি, তবে আমার এটা মনে হয়।”

দেলোয়ারা দরজা ঠেলে রুমে আসেন।
“কি কথা হচ্ছে বাপ-বেটির?”

শাফিন সাহেব উনাকে বসতে ইশারা করে আবারো সুরভিকে বলেন,
“ইমতিয়াজের সাথে কথা বলবো নাকি আগে লুৎফরকে জানাবো?”
“আগে ফুপার সাথে কথা বলেন। ভাইয়াকে উনারা ছেলের মতো ভালোবাসেন।”

দেলোয়ারা মাঝ থেকে প্রশ্ন করেন,
“কি হয়েছে?”

শাফিন সাহেব চোখের ইশারায় শান্ত হতে বলেন। সুরভি উঠে নিজের রুমে চলে যায়। মৃত্তিকা সেখানে কোনো একটা বই পড়ায় ব্যস্ত। সুরভি গিয়ে পাশে দাঁড়ায়।

মৃত্তিকা ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি ঠিক বলেছিলে আপু, বাংলা সাহিত্য আসলেও অনেক আনন্দের।”

সুরভি হেসে বইটা নিয়ে শেলফে রেখে বলে,
“আমার প্রশ্নের উত্তর না দেয়া পর্যন্ত আর কোনো বই পাবা না।”

মৃত্তিকা একটু হকচকিয়ে যায়। তারপর হেসে উঠে বলে,
“বলো, কি প্রশ্ন?”
“ইমতিয়াজ ভাইয়াকে ভালোবাসো?”

কথাটা মৃত্তিকার কানে জোড়ে ধা°ক্কা খায়। কন্ঠনালি কেঁপে উঠলেও কথা বলা হয় না। সুরভি ওর সামনে এসে চেয়ার টেনে বসে বলল,
“বাবাকে বলবো বিয়ের কথা বলতে?”

মৃত্তিকা চমকে উঠে, কিছুই বলতে পারছে না। সব কথা ওর স্বরযন্ত্রের কাছে এসে গু°লিয়ে যাচ্ছে।

সুরভি ওর হাত ধরে বলে,
“অস্বস্তি হচ্ছে জানি, কিন্তু আমি সত্য বলতে বা শুনতে পিছুপা হইনা। এসব বোঝার ক্ষমতা আমার আছে।”

তানজিমের কথাগুলো মনে পড়ে মৃত্তিকার। একটা ঢোক গিলে বলল,
“যদি তাহমিনা আপু থাকতো, তবে?”
“তাহমিনা থাকলে কি হতো না হতো ওসব ভুলে যাও, তাহমিনা নেই। ইমতিয়াজ ভাইয়া একা, কোনো মানুষ একা বাঁচতে পারে না। (একটু থেমে) সঙ্গী হিসেবে তুমি খারাপ নও।”

মৃত্তিকার গাল টে°নে দেয় সুরভি। মৃত্তিকা মাথানিচু করে। সুরভি আলতো হেসে বলে,
“কি? বিয়ের কথা হবে নাকি? বউ সাজবে?”

মৃত্তিকা নিচুস্বরে বলল,
“ইমতিয়াজ যদি রাজি থাকে, তবে আমিও রাজি।”

সুরভি ওর গালে চুমো দেয়। বয়সে মৃত্তিকা ওর থেকে ২ বছরের ছোট। তাহমিনা, তাহসিনাও ওর থেকে ছোটই ছিল। বোন তো সবাই, আদরও সকলের জন্যই সমান। চলে যাওয়া মানুষদের স্মৃ°তি যেমন থাকবে, তেমনি যারা বেঁচে আছে তাদের সুখের কথাও চিন্তা করতে হবে। একপাক্ষিক হয়ে জীবন চলে না।
______________________________________

পরদিন অর্থাৎ শনিবার সকাল,
আব্বাস ফয়েজ, আহনাফের বাবা আজ ঢাকায় আসবেন। আহনাফ উনাকে রিসিভ করতে এয়ারপোর্টে এসেছে, সাথে সারাহ্ও আছে। উনাকে নিয়ে সরাসরি কুমিল্লা চলে যাবে ওরা।

দুজনে গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছে। সারাহ্ আপন মনে ফোন দেখছে।

“ঐশী।”

সারাহ্ আহনাফের দিকে তাকায়। আহনাফ বলল,
“ভাবছি একটা কথা?”
“কি?”
“বাবা চলে আসলে আমাদের কি হবে?”

সারাহ্ ফোন রেখে ওর কাছাকাছি এসে বসে বলল,
“খুব ভালো হবে। আপনার মুখের যা অবস্থা হচ্ছে তাতে বাবা আসলেই ঠিক হবে।”

আহনাফ সারাহ্-কে একহাতে আগলে নিয়ে বলল,
“এটা নিয়ে আমিও চিন্তিত।”
“কেন?”
“তোমার সাথে জড়ানোর পরই আমার এ অবস্থা হইছে। (একটু থেমে) জাদু টো°না করছো নাকি?”

সারাহ্ ওর বুকে একটা থা°প্প°ড় দিয়ে বলে,
“ছি, না। আপনি আগে থেকেই এমন ছিলেন।”
“আরে না, তাহুর সাথে এমন কথা কখনোই বলি নাই।”

তাহু, মানে তাহসিনা, হঠাৎ সারাহ্-র সামনে এই নাম উচ্চারিত হওয়ায় সারাহ্ চমকে উঠে। আহনাফের থেকে একটু সরে যায়। আহনাফ অপ্রস্তুত, এ কি কথা বলে ফেলল?

গাড়ি থেকে বেরিয়ে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো আহনাফ। তাহসিনার কথা মনে পড়ার অর্থ সেই রিসোর্ট, সেই সাদা শাড়ি আর অসম্পূর্ণ সেই স্বপ্নগুলোর কথা মনে পড়া। অথচ এখন সে সারাহ্-র সাথে নতুন স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছে।

সারাহ্ জানলা দিয়ে আহনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। এখন আর এই মানুষটাকে তার ভ°য় লাগে না, তবে এই মানুষটার মুখে তাহসিনার নাম শুনলেই ভ°য় পায় সে। এই বুঝি তাকে ছেড়ে চলে যাবে।

“হে আল্লাহ্, এই সম্পর্ককে জান্নাত পর্যন্ত পৌঁছে দিও।”
সারাহ্-র এই একটা দোয়া মহান রব্বুল আলামীন কবুল করুক। তাহাজ্জুদে চাওয়া স্বামীর ভালোবাসা সে পেতে শুরু করেছে, এখন তো কেবলই শুরু।

কিছুক্ষণ পর দুটো আইসক্রিম কিনে নিয়ে আহনাফ এসে আবারো গাড়িতে উঠে বসলো। নভেম্বরের শেষ সময়, মোটামুটি শীত আছে, এসময় আইসক্রিম দেখে সারাহ্-র একটু রাগ হলো।

“কেন খাবেন এসব? ঠান্ডা লাগবে, জ্ব°র আসবে, আমি কারো সেবাযত্ন করতে পারবো না।”

সারাহ্-র কথায় আহনাফ হেসে একটা আইসক্রিম ওর হাতে দিয়ে বলে,
“আমি অসুস্থ হলে তুমি করবা স্বামীসেবা আর তুমি অসুস্থ হলে আমি করবো বউসেবা। ডিল ফাইনাল? এখন খাও।”

সারাহ্ আহনাফের মুখের দিকে তাকায়। একটু আগে অস্বস্তিকে দূরে সরিয়ে সে স্বাভাবিক হতে চাইছে। মনের অজান্তেই হাসে সে।

“এভাবে হাসলে তোমাকে কাঠবিড়ালির মতো লাগে।”
“কি?”
সারাহ্ কপাল কুঁচকায়। আহনাফ জোড়ে শোরে হেসে উঠে।

সারাহ্ আইসক্রিম খেতে খেতে ঘড়িতে দেখে সকাল ১১ টা। তারপর আহনাফকে বলে,
“একটু বাইরে হাঁটি? বসে থেকে থেকে কোমড়ে ব্য°থা করছে।”
“হ্যাঁ, যাও। আমি যাবো না, বাবা কিন্তু চলে আসবে এখুনি।”
“আচ্ছা, আমি আশেপাশেই আছি।”

সারাহ্ গাড়ির বাইরে হাঁটতে লাগলো। একটা গাড়ির সামনে গিয়ে চেনা একটা নাম শুনলো।

“নাম সামিহা, ডাকনাম এশা।”

সারাহ্-র ছোটবোন সামিহা, তারও তো ডাকনাম এশা। গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে যায় সারাহ্।

এবারে অন্য কন্ঠ,
“এ আমাদের কোন কাজের?”

আবারো পুরোনো কন্ঠটা বলে,
“ওকে দিয়েই কাজ আছে, সেদিন ওখানে এই মেয়েটাই ছিল। (একটু থেমে) হয় মানবে আর না হয় ম°রবে।”

সারাহ্ ভয় পেয়ে যায়। সামিহাকে কেউ মারার প্ল্যান করছে। এরমধ্যে আহনাফের ডাক,
“ঐশী, এদিকে আসো।”

লোক দুজনেই সারাহ্-কে দেখে। সারাহ্ দ্রুত সরে পড়ে। হার্টটা প্রচন্ড গতিতে লাফাচ্ছে তার। আহনাফকে বুঝিয়ে বলার মতো অবস্থায় নেই। এমনকি আব্বাস সাহেবকে সালাম দিতেও বেমালুম ভুলে গেছে সে। গাড়িতে বসে জানলা দিয়ে সেই কালো চকচকে মাইক্রোর দিকে তাকায় সারাহ্। হয়তো এখনো ভেতর থেকে দুজোড়া চোখ ওকে দেখছে।

সারাহ্ চলে গেলে গাড়ির ভেতরের একজন বলে,
“সব ঠিকঠাক, সারাহ্ আমাদের কথা শুনে গেছে।”
______________________________________

লুৎফর রহমানকে বাসায় ডেকেছেন শাফিন সাহেব, দুপুরের খাবারের দাওয়াত। ঘটনা মূলত ইমতিয়াজ আর মৃত্তিকাকে নিয়ে কথা বলা।

জুম্মার নামাজের আগে আগেই লুৎফর রহমান, মমতাজ বেগম আর তানজিম তিনজনই এসেছে। নামাজের পর দুপুরের খাবার খেয়ে তারপর উনারা কথা বলতে বসেছেন।

সুরভি ফল কে°টে এনে উনাদের সামনে রাখলো। শাফিন সাহেব সুরভির দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমার মেয়ে ভাগ্যিস আমার মতো হয়নি, সব বুঝে সে।”

মমতাজ বেগম হাসলেন। সুরভিকে উনার পাশে বসিয়ে বলেন,
“ঠিকই বলছো।”

শাফিন সাহেব একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলেন,
“আসল কথায় আসি। আমি মিউকোর বিয়ে নিয়ে ভাবছিলাম।”

লুৎফর রহমান বলেন,
“একবার এতো ঘটনা হওয়ার পরও?”

শাফিন সাহেব মাথা নাড়িয়ে বললেন,
“হ্যাঁ, মিউকোর জন্য উপযুক্ত একজনকে পাওয়া গেছে।”

মমতাজ বেগম খুশি হয়ে বলেন,
“এ তো ভালো কথা।”
“ইমতিয়াজের জন্য আমাদের মিউকো কেমন হবে?”

মৃত্তিকা রুম থেকে উনাদের কথা শুনছেন। সুরভি উঠে ভিতরে যায়।

লুৎফর রহমান একবার মমতাজ বেগমের দিকে তাকিয়ে বলেন,
“ইমতিয়াজ রাজি হবে? আর মিউকো?”
“তোমরা রাজি কিনা তাই বলো।”
“রাজি না হওয়ার কারণ নেই।”

লুৎফর রহমানের কথায় সম্মত হলেন মমতাজ বেগম,
“ইমতিয়াজের অধিকার আছে নিজের জীবনকে সাজানোর। ওর কবরের কাছে ফাতিহা পড়ার মানুষও নেই। ওর পরিবারের দরকার, সন্তানের দরকার।”

শাফিন সাহেব লুৎফর রহমানকে বললেন,
“তুমি ইমতিয়াজের সাথে কথা বলো।”
“আর মিউকো?”
“সেটা আমি বুঝে নিবো।”

তানজিম সব শুনছে, রাগে তার ক°লজে ফেঁ°টে যাচ্ছে। এখন মৃত্তিকাকে খু°ন করতেও হয়তো সে পিছু হটবে না। কিন্তু বড়দের সামনে কিছু বলতেও পারছে না।

লুৎফর রহমান একটু জোর গলায় মৃত্তিকাকে ডাকেন।
“মিউকো?”

মৃত্তিকা বের হয়ে আসে।
“জি, আংকেল।”

মমতাজ বেগম বলেন,
“বসো, এখানে।”

মৃত্তিকা মমতাজ বেগমের পাশে বসে। মৃত্তিকার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন উনি। তানজিম রাগি চোখে তাকিয়ে আছে। মৃত্তিকা তানজিমকে দেখলেও তেমন একটা পাত্তা দেয়নি। যা হওয়ার হবে, তানজিম বাধা দিলেও হবে আর না দিলেও হবে।

চলবে……

অনুভূতিরা শব্দহীন পর্ব-১৬+১৭+১৮

0

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

ষোড়শ পর্ব

অনলাইন ক্লাস শেষে রুমেই বসে আছে আহনাফ। সারাহ্-র সাথে নিজের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টা করে যাচ্ছে সে।

বিয়ে, নিকা, শাদি, বিবাহ- যে নামেই একে ডাকা হোক না কেন মূলত সবটাই এক। দুটো মানুষের মনের মিলন, আ°ত্মার মিলন, ভালোবাসার বন্ধন। পবিত্র এ সম্পর্কের ভালোবাসা নিয়ে কোরআনের অনেক ব্যাখ্যা জানা আছে আহনাফের৷

সারাহ্-র সাথে খারাপ ব্যবহারে সম্পর্ক শুরু করলেও দিনদিন সে একে স্বাভাবিক করে নিয়ে আসতে চেষ্টা চালাচ্ছে।

কিন্তু আজকে সারাহ্-র ঘটানো এমন অপ্রীতিকর ও অপ্রয়োজনীয় ঘটনায় আহনাফ বি°র°ক্ত। প্রচন্ড রেগে আছে সে।

“ঐশী।”
জোর গলায় সারাহ্-কে ডাকে আহনাফ।

রুমে উঁকি দিয়ে সারাহ্ বলে,
“জি।”
“এদিকে এসো।”

সারাহ্ চুপচাপ ভিতরে যায়। আহনাফ নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। সারাহ্ ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“বোর্ডে ওসব কেন লিখেছো?”

সারাহ্ কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব দেখিয়ে বলল,
“দেখুন, জাস্ট একটা কথাই তো লিখেছি আর তো কিছু না আর…”

সারাহ্ কথার মাঝেই ধ°ম°ক দেয় আহনাফ।
“আমি একজন সিনিয়র টিচার সারাহ্। ওরা আমার স্টুডেন্ট, বন্ধু না।”

আহনাফের মুখ থেকে ঐশী নাম শুনেই সারাহ্ অভ্যস্ত। হঠাৎ করে সারাহ্ শুনে থতমত খায়। সে আসলে এমন কি বড় অপরাধ করেছে তা বুঝতে পারেনা। মাথানিচু করে ফেলে সারাহ্। আহনাফ বেরিয়ে যায়।

“এই লোক জীবনেও ভালো হবে না। কেমন খিটখিটে মেজাজের লোক।”

আপন মনে আহনাফকে ব°ক°তে থাকে সারাহ্। মুহূর্তের মধ্যেই হেসে উঠে সে। তবুও যে এই রাগি মানুষটাকেই ভালোবাসে সে।
______________________________________

পরদিন সকাল ৮ টা,
সামিহার জন্মদিন আজ। সামিহার নিজের কাছে দিনটা বেশ স্পেশাল। যদিও এখনো পর্যন্ত বাবা ছাড়া আর কেউ তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায়নি। বিষয়টা বড় কিছু নয়, কারণ কখনোই এসবের জন্য ওর মা ওকে উৎসাহ দেয় না।

কালো আর লালের মিশ্রণের সুতির শাড়ি পড়েছে। ঘন চুলের মোটা বিনুনি একপাশে নিয়ে এসেছে। কালো ও লালের কাচের চুড়ি ডান হাতে পড়েছে আর বাম হাতে পড়েছে কালো ঘড়িটা। চোখের মোটা কাজল, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, যেন কোন বাঙালি বধু সদ্য স্বামীর বাড়ি এসেছে।

“মা, আমি যাচ্ছি।”
নার্গিস পারভিনের থেকে অনুমতি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্য। মেট্রোরেলে করে ভার্সিটিতে যেতে ও খুব একটা সময় লাগে না তার, মতিঝিল থেকে সরাসরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

তানজিমকে ডিপার্টমেন্টের সামনে অপেক্ষা করতে বলে ইতোমধ্যে একটা মেসেজও করে দিয়েছে।

তানজিম ডিপার্টমেন্টের সামনের ফুটপাতে হাঁটছে৷ সামিহা যেহেতু বাইরে থাকতে বলেছে সুতরাং ভিতরে গেলে আজ একটা মা°ই°রও মাটিতে পড়বে না।

আর কারো মনে না থাকলেও তানজিমের ঠিকই ওর জন্মদিনের কথা মনে আছে। একগুচ্ছ লাল গোলাপ নিয়ে অপেক্ষা করছে সামিহার জন্য। সাথে সাথে মনের মধ্যে সাহস যোগাচ্ছে আজ সামিহাকে সে মনের কথা বলবে৷

কিভাবে বলবে তা বারবার অনুশীলন করছে সে। হঠাৎ চোখ পড়ে ওর দিকে হেঁটে আসা সামিহার দিকে। শাড়ির কুঁচি একহাতে একটু উঁচু করে রেখেছে, অন্যহাতে আগলে রেখেছে আঁচলটা।

শাড়ি, চুড়িতে এমন এক অচেনা রূপে সামিহাকে দেখে তানজিমের হৃদপিণ্ড ব°ন্ধ হওয়ার যোগাড়।

সামিহা ওর সামনে এসে বলে,
“চল, চল।”

সামিহা ভিতরে চলে গেল। তানজিম এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। বুকের বামপাশে হাত দিয়ে বলে,
“এখনো থামিসনি তবে, চলতেছিস?”

সামিহা ফিরে দাঁড়িয়ে বলে,
“তানজিম, আয়।”
“আসি।”

তানজিম ওর পাশাপাশি হলে সামিহা বলে,
“ফুল কার জন্য?”
“এক পাগলীর জন্য।”

সামিহা হেসে বলে,
“ইশ, আজ প্রথমবার পাগলী না হওয়ার জন্য আফসোস হচ্ছে।”

সামিহা এগিয়ে গেল। তানজিম নিজে নিজেই বলে,
“ওফ, আমার পাগলী, এই দোকানের ফুল তোমাকে দেয়া যাবে না।”

ফুলগুলো রাস্তায় অবহেলায় ফেলে দিলো তানজিম। সামিহাকে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে আজ নিজেই সারপ্রাইজ পেয়ে গেছে।

সামিহাকে কিভাবে কি বলবে, প্রায় সবই ভুলে গেছে তানজিম। তালগোল পাকিয়ে গেছে সব। ক্লাস শেষে বাইরে এসে রাস্তার মাঝের ব্যবধায়কে থাকা কাঠগোলাপের গাছ থেকে ফুল সংগ্রহ করতে থাকে তানজিম।

সামিহা ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ওকে ডেকে বলে,
“তানজিম, কি করিস?”

তানজিম ফুলগুলো এনে সামিহার বেনিতে গেঁথে দেয়। সামিহা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তানজিম কাজ শেষে বলে,
“তোকে আজ মুগ্ধ হয়ে দেখেছি সামি। পুরো ক্লাস আমি মনোযোগ দিতে পারিনি। তুই বারবার আমাকে কেন এলোমেলো করছিস?”
______________________________________

কাল থেকে সারাহ্-র সাথে কোনো কথা বলেনি আহনাফ। সারাহ্ও এতোটা জোর করেনি। নিজের ভুল বুঝতে পেরে চুপচাপ ছিল সারাক্ষণ। বোর্ডের লেখাটা এভাবে আহনাফের লজ্জার কারণ হবে তা সারাহ্ বুঝেনি।

কলেজে দুজনে একসাথে এসেছে। তবুও পুরো রাস্তা নিরব ছিল। প্রথম পিরিয়ডে আহনাফের যেখানে ক্লাস ছিল আর দ্বিতীয় পিরিয়ডে সারাহ্-র সেখানেই ক্লাস আছে।

ক্লাসের দিকে যাওয়ার সময় আহনাফের সামনে পড়ে সে। মাথানিচু করে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় আহনাফ বলে,
“ঐশী, আজকে বাসায় যেতে দেরি হবে। ক্লাস শেষে মিটিং আছে। তুমি কি অপেক্ষা করবে?”

সারাহ্ ফিরে তাকিয়ে বলে,
“হুম, করবো।”

আহনাফ মুচকি হেসে হাত দিয়ে ওকে হাসতে ইশারা করে চলে যায়। মনের অজান্তেই হেসে দেয় সারাহ্।

ক্লাসে আজ রসায়ন দ্বিতীয় পত্রে ডু°ব দিয়েছে সে। জৈব রসায়নের কঠিন কঠিন বিক্রিয়া তু°ড়ি মে°রে সহজ করে দিলো সারাহ্। কঠিন বিষয় সহজ করে উপস্থাপন করার কারণেই সারাহ্-কে ছাত্রছাত্রীরা বেশিরভাগই খুব পছন্দ করে।

ক্লাস শেষে বের হওয়ার সময় এক মেয়ে ওর দিকে এগিয়ে এসে বলে,
“মিস?”

সারাহ্ একটু হেসে বলল,
“মিস না বলে ম্যাডাম বলো।”

মেয়েটিও হেসে দেয়। ওদের ম্যাডাম যে এখন মিসেস হয়ে গেছে তা ওরাও জানে। সারাহ্ বলল,
“কি বলবে? বলো।”

মেয়েটি হাতের চকলেট সারাহ্-র দিকে এগিয়ে দেয়। মুখে বলে,
“আপনার জন্য ম্যাডাম।”
“থ্যাংক ইউ। (একটু থেমে) নাম কি তোমার?”
“মাহি।”

সারাহ্ মিষ্টি হাসে। মাহির গাল টে°নে দিয়ে চলে যায়।

সবকিছু এখন তুচ্ছ লাগছে আহনাফের সেই হাসি আর ইশারার কাছে। থাকুক তাহসিনা আহনাফের মনে, কিন্তু এককোনায় সারাহ্-র স্থান হোক।

কলেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকায় সে। ধীরে ধীরে মেঘ জমছে, যেকোনো সময় বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে।
______________________________________

দুপুরের পর মৃত্তিকা বাসা থেকে বের হয়েছে৷ কাকরাইলে আসাই তার প্রধান উদ্দেশ্য। মামের কবরের কাছে সময় কা°টাবে। উদ্দেশ্য সফল হলো, মামের কবরটা একবারের মতো দেখা হলো তার।

“মাম, তুমি তো জানো নিজের ইচ্ছার বি°রু°দ্ধে গিয়ে বিয়েটা করছি আমি। ওই লোকটা তোমাকে কষ্ট দিয়েছিল, তোমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছিল আর এখন আমারটাও শেষ করে দিয়েছে।”

গলা কান্নায় ভারি হয়ে আসে। খানিকক্ষণ থেমে আবারো বলল,
“ওই লোকটাকে আমি কখনোই ক্ষমা করতে পারবো না, তাকে কখনো বাবার মর্যাদা বা সম্মান দিতে পারবো না। কিন্তু সত্য হলো উনি আমার বাবা।”

একটু থেমে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৃত্তিকা।
“আরেকজন মানুষ আমাকে প্রতিনিয়ত কষ্ট দিচ্ছে, ইমতিয়াজ। সে আমাকে বিন্দুমাত্র বুঝে না, কিন্তু জানো তো আমার জীবনের অপূর্ণতাগুলো একমাত্র সেই পূরণ করতে পারবে।”

মৃত্তিকা ফোন বের করে কলরবের সিভি বের করে বলে,
“কলরব, যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। (একটু থামে) জানো মাম, ইমতিয়াজ আমার সাথে আর একবারের জন্যও কথা বলেনি। সেদিন শপিংমলে তাকে শেষবারের মতো দেখেছিলাম। সে আমাকে কলও দেয় না আর আমি কল দিলে ফোন বন্ধ পাই।”

“আমার সিম নষ্ট হয়ে গেছে, তাই ফোন বন্ধ পেয়েছেন।”

মৃত্তিকা চমকে উঠে পিছনে ফিরে। ইমতিয়াজ প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে একটু হাসে। তারপর তাহমিনার কবরের কাছে চলে যায়। মৃত্তিকা কান্না ভেজা চোখে অপলক চেয়ে থাকে তার দিকে, যেন কোনো এক নে°শা তাকে পেয়ে বসেছে।

ইমতিয়াজ দোয়া শেষে বেরিয়ে গেল। মৃত্তিকা পিছুপিছু দৌড়ে গিয়ে বলে,
“দাঁড়ান।”

ইমতিয়াজ দাঁড়ায় না, তবে হাঁটার গতি একটু ধীর করে। মৃত্তিকা কাছে এসে বলে,
“অফিস নেই?”
“তাড়াতাড়ি ছুটি হয়েছে।”
“ওহ, সিম নষ্ট বলে হোয়াটসঅ্যাপ বন্ধ কেন?”

ইমতিয়াজ থেমে বলে,
“আপনি আমার সাথে কি এমন জরুরি কথা বলবেন মৃত্তিকা?”

মৃত্তিকা ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আপনি কি কিছুই বুঝতে পারছেন না?”

ইমতিয়াজ মাথা নেড়ে না বোঝায়। মৃত্তিকা চোখ ছোট করে তাকিয়ে বলে,
“বিয়ের ব্যাপারটা বলতাম।”

ইমতিয়াজ ওর কাছে চলে আসে। একদম কাছাকাছি দুজনে। ইমতিয়াজ ভারি কন্ঠে বলল,
“আমাকে বিয়ের কথা বলতে পারছেন না বলে আমি আপনাকে প্রতিনিয়ত কষ্ট দিচ্ছি বুঝি?”

মৃত্তিকা চমকে উঠে দুইপা পিছিয়ে যায়। কতক্ষণ ইমতিয়াজ তার পিছনে কখন থেকে ছিল কে জানে? মৃত্তিকা দ্রুত গতিতে চলে যেতে যেতে একবার পিছনে ফিরে ইমতিয়াজকে দেখে। ইমতিয়াজ এখনো কপাল কুঁচকে চেয়ে আছে ওর দিকে।
______________________________________

মাহির দেয়া চকলেটটা খেতে খেতে কলেজ মাঠের একপাশ ঘেঁষে হাঁটছে সারাহ্, মূলত আহনাফের জন্য অপেক্ষা করছে সে। আকাশটা আরো অন্ধকার হয়ে আসলো। সারাহ্ ঘড়ি দেখলো, তিনটা ত্রিশ বেজে গেছে।

“মানুষটা এখনো আসেনি।”

ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। সারাহ্ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“হে আল্লাহ্, তার মনে একটুখানি জায়গা দিও আমাকে।”

আহনাফ দৌড়ে এসে ওকে বলল,
“জলদি চলো বৃষ্টি নামছে।”

কথা শেষ করার আগেই ঝুম বৃষ্টি নেমে গেল। দুজনে জলদি গিয়ে উঠলো কলেজের বারান্দায়। আহনাফ শার্ট, ব্লেজার ঝারতে ঝারতে বলল,
“দূর, অ°সময়ের বৃষ্টিই ভালো লাগে না।”
“বৃষ্টিকে গা°লি দিতে নেই। এটা রহমত।”

আহনাফ সারাহ্-র দিকে তাকালো। সারাহ্ মুচকি হেসে বলল,
“অ°সময় নয় তো এটা, আমরাই বের হতে দেরি করেছি।”

আহনাফ হাত বাড়িয়ে ওর ঠোঁটের কোণায় লেগে থাকা চকলেট সরিয়ে বলল,
“ম্যাডাম চকলেট খাচ্ছে তাও মুখ ভরিয়ে?”

সারাহ্ খিলখিলিয়ে হেসে দিলো। তারপর আহনাফের হাতে চকলেটটা দিয়ে নিজে চলে গেল মাঠে। দুহাত মেলে বৃষ্টিতে ভিজতে শুরু করলো। খোলা বারান্দার পিলারের সাথে হেলান দিয়ে আহনাফ ওকে দেখছে। থ্রিপিজটা ভিজে শরীরের সাথে লে°প্টে লেগেছে, সারাহ্ খেয়াল করেনি এসব।

আহনাফ এগিয়ে এসে ওকে কোলে তুলে নিয়ে গেল একটা ক্লাসে। উঁচু বেঞ্চে বসিয়ে বলল,
“বাইরে যাবে না।”

হঠাৎ ওর এমন কাজে হতবাক সারাহ্। আহনাফ ব্লেজার খুলে সারাহ্-র উপর দিয়ে দিলো। ওর কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল,
“আবেদনময়ী হয়ে সবার কাছে ধরা দিও না।”

আহনাফ বাইরে গিয়ে দরজা চাপিয়ে দিলো। বাকি স্যারেরা চলে যাচ্ছে। আহনাফকে দেখে বলল,
“স্যার, যাবেন না?”
“যাবো, একজন আসবে তাকে নিয়ে যাবো।”
“আচ্ছা স্যার, আসি।”
“জি।”

স্যাররা আসছে দেখেই সারাহ্কে সকলের আড়ালে এনেছে আহনাফ। সারাহ্ ব্লেজারটা গায়ে দিয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকালো। আহনাফ ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে।

কিছুক্ষণ পর আহনাফ ভিতরে আসলো।
“এখন বাসায় যাবে কিভাবে?”

সারাহ্ কিছু বলতে নিলেই কারেন্ট চলে যায়। দুজনেই চমকে উঠে। আহনাফ ফোনের ফ্লাশলাইট জ্বালিয়ে দেয়। সারাহ্ ওড়না দিয়ে ধীরে ধীরে নিজেকে আবৃত করছে। আহনাফ ফোনটা পাশে রেখে সারাহ্-র হাত সরিয়ে ওড়নাটা নিজেই ওর শরীরে দিয়ে দিলো।

সারাহ্ অপলক তাকিয়ে আছে ওর দিকে। আহনাফও দেখলো ওকে। বলল,
“কি দেখো?”

সারাহ্ চমকে উঠলো। এ কেমন বেরসিক মানুষ। আহনাফ বেঞ্চের দুপাশে হাত দিয়ে দাঁড়ালো। সারাহ্কে যেন মাঝে ব°ন্ধি করেছে।

“ঐশী, তুমি যথেষ্ট ম্যাচিউর বলেই আমি জানি। কিন্তু আমাকে বিয়ে করার সময় তোমার বুদ্ধিটা বোধহয় ঠিকমতো কাজ করেনি।”

সারাহ্ অন্যদিকে তাকালো। আহনাফ ওর মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
“তোমাকে এতোভাবে ইশারা দিলাম কিন্তু তুমি বুঝলে না আমি কি বোঝাতে চেয়েছি।”
“আমি বুঝেছিলাম।”

সারাহ্ নেমে দাঁড়ালো। আহনাফ একটু সরে এসে বলল,
“তবে জীবনটা কেন নষ্ট করেছো?”

সারাহ্ কিছু বলল না। হৃদয়ের গোপন কথা গোপনে রইলো, আহনাফ বুঝলো কিনা জানা নেই। সারাহ্ বেরিয়ে আসতে নিলে আহনাফ ওকে কাছে টে°নে আনলো। শুধু কাছে না, দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ওকে।

বেশ কিছুক্ষণ পর আহনাফ সারাহ্-র মুখটা উপরে তুলে বলল,
“সবকিছু অন্যরকম হতে পারতো আর হয়েছেও তাই।”

ভেজা ঠোঁটে শক্ত পুরুষের ভারী ঠোঁটের স্পর্শ অনুভব করলো সারাহ্। সরে আসতে চেয়েও সরে আসতে পারলো না, আহনাফ যে তাকে একহাতে জড়িয়ে রেখেছে। আহনাফের শার্টের কলার খা°ম°চে ধরেছে, প্রত্যেকটা সেকেন্ডে নিশ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে সারাহ্-র।

চলবে….

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

সপ্তদশ পর্ব

মাগরিবের নামাজের পর সুরভির রুমে যায় মৃত্তিকা। সুরভি চারমাসের অন্তঃসত্ত্বা, ওর স্বামী কাউসার আহমেদ দেশের বাইরে থাকেন। তাই তো এ অবস্থায় সুরভিকে বাসায় নিয়ে এসেছেন শাফিন সাহেব।

“আপু, আসবো?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, আসো।”

মৃত্তিকা ভিতরে গিয়ে বিছানার একপাশে বসে। সুরভি ইন্দুবালা ভাতের হোটেল নামে একটা বই পড়ছিল। বইটা পাশে রেখে মৃত্তিকাকে বলল,
“মামের সাথে কথা বলে এসেছো?”

মৃত্তিকা আলতো হেসে বলে,
“হুম, ওখানে না গেলেও আমি মামের সাথে সবসময় কথা বলি।”

সুরভির কাছ থেকে বইটা নিয়ে পাতা উল্টায় মৃত্তিকা। সুরভি সেদিকে একটু তাকিয়ে বলে,
“বাংলা উপন্যাস পড়েছো কখনো?”

মৃত্তিকা একটু ভেবে বলে,
“চোখের বালি নামে একটা বই ছিল মামের কাছে, ওইটা পড়েছি।”

সুরভি হেসে বলল,
“বাংলা সাহিত্যে শুধু ডু°ব দাও, ভা°সিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব সেই নিবে। (একটু থেমে) চা খাবো, একটু বানিয়ে আনতে পারবা?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই।”

মৃত্তিকা দ্রুত পায়ে উঠে রান্নাঘরে যায়। চা বসিয়ে দিয়ে গুড়াদুধের কন্টেইনারটা হাতে নিয়ে শুনতে পায় একটা কন্ঠ। ভালো করে কান পাতে, কন্ঠটা মমতাজ বেগমের।

সব ছেড়েছুড়ে ড্রইংরুমে এসে দেখে মমতাজ বেগম আর লুৎফর রহমান মাত্রই বাসায় এসেছে। বড়মণিকে দেখেই মৃত্তিকা জড়িয়ে ধরে। কাঁদোকাঁদো মৃত্তিকাকে আদর করেন মমতাজ বেগম, কপালের স্নেহের পরশ এঁকে দেন।

সুরভিও বেরিয়ে আসে।
“সব আদর মিউকোর আর আমি ফ°ক্কা?”

মমতাজ বেগম হেসে ওকেও আদর করে। তানজিমও এসেছে উনাদের পৌঁছে দিতে, সে থাকবে না। তাই একটু তাড়া দিচ্ছে।

মৃত্তিকা তানজিমকে টেনে বাসার বাইরে নিয়ে গেল,
“ইমতিয়াজের নাম্বার আছে তোমার কাছে?”

তানজিম চোখ বড় করে তাকায়। ইমতিয়াজকে সবসময় “তোমার ইমতিয়াজ ভাইয়া” বলে মৃত্তিকা, সেখানে আজ সোজা ইমতিয়াজ। মৃত্তিকার ছটফটানি দেখে তানজিমের মনে হলো ইমতিয়াজের নাম্বারটা এই মুহূর্তে ওর জীবন বাঁচাবে৷

“নাম্বার দেও।”

মৃত্তিকার কথায় তানজিম চো°য়া°ল শক্ত করে বলে,
“আমার কাছে উনার নাম্বার নেই।”

মৃত্তিকা তানজিমের চেহারার দিকে তাকায়। ছেলেটা মৃত্তিকার চেয়ে প্রায় ৪-৫ বছরের ছোট হবে, এই ছেলে মৃত্তিকাকে চোখ রা°ঙাচ্ছে।

তানজিম বলল,
“আমার বোন হয়তো এই পৃথিবীতে নেই, কিন্তু তার শূণ্যস্থান তোমাকে দিয়ে পূরণ হবে না।”
“কিসব বলছো তুমি, তানজিম?”

তানজিমের চোখমুখ, কপাল কুঁচকে আসে।
“বুঝো না তুমি আপু? ইমতিয়াজ ভাইয়াকে তুমি কোন নজরে দেখো তা আর কেউ নোটিশ না করলেও আমি করেছি। যা করছো খারাপ হচ্ছে। তুমি অন্যকারো বাগদত্তা আর ভাইয়া বিবাহিত।”

মৃত্তিকা চুপ থাকে। ওর চঞ্চল চোখের দৃষ্টি যার বোঝার সে না বুঝলেও তানজিম ঠিকই বুঝেছে।

ভিতরে যাওয়ার আগে তানজিম বলে,
“তাহমিনা আপু বেঁচে থাকলেও কি তুমি এমনটাই করতে? লজ্জা হওয়া উচিত তোমার।”

তানজিম ভিতরে চলে গেছে। সত্যি মৃত্তিকার লজ্জা কমে গেছে। শান্ত, ভদ্র মেয়েটা একটা বিবাহিত ছেলের প্রেমে মাতোয়ারা হয়েছে। তানজিম তো ঠিকই বলেছে তাহমিনা থাকলে কি করতো সে? সবটা মেনে নিতো, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতো। কিন্তু তাহমিনা যে নেই আর প্রকৃতি তো শূণ্যস্থান রাখে না।
______________________________________

আহনাফ-সারাহ্ বাসায় এসেছে কিছুক্ষণ আগে। সারাহ্ ফ্রেশ হয়ে এসে প্রতিদিনের মতোই দেখে খাবার তৈরি। আহনাফ ওর অপেক্ষা না করে খাবার গরম করে ফেলে। সারাহ্ ভেজা কাপড় বারান্দায় মেলে দেয়। বাইরে এখনো বৃষ্টি পড়ছে।

আহনাফের দিকে বারবার তাকাচ্ছে আর লজ্জায় কুঁচকে যাচ্ছে সে। আহনাফ বিষয়টা খেয়াল করেনি। সে স্বাভাবিকভাবে ফ্রেশ হয়ে আসে।

“ঐশী, খাবে না? চলো।”

আহনাফের প্রশ্নে সারাহ্ কিছু না বলে রুমে এসে চুল ঝা°ড়তে থাকে। আহনাফ ওকে একটু দেখে ডাইনিং এ চলে যায়।

ডাইনিং এ চেয়ার টেনে বসতেই কল এলো আফরোজার। আহনাফ বি°র°ক্তি নিয়ে রিসিভ করে,
“হুম।”
“কেমন আছিস, আহনাফ?”
“ভালো।”
“সারাহ্ কেমন আছে?”
“ভালো।”
“সারাহ্ কোথায়? কি করে?”
“রুমে।”

আহনাফ একশব্দে ছোট ছোট করে উত্তর দিচ্ছে। আফরোজা বুঝে তার ভাই এখন কোনো কারণে তার উপর রেগে আছে।

একটু খারাপ লাগলেও কন্ঠ নরম করে সে,
“আহনাফ, কি হয়েছে?”

আহনাফ উঠে বাসার বাইরে চলে যায়। সারাহ্ মাত্রই ডাইনিং এ এসে আহনাফকে বাইরে যেতে দেখে ডাক দিতে নিয়েও ডাক দেয় না।

মেইন দরজার বাইরে গিয়ে আহনাফ বলে,
“র°ক্তের সম্পর্কের মানুষগুলো, হ্যাঁ তোমাদের কথাই বলছি। তোমরা এক ছটাক আমাকে বুঝো না আর বাইরের একটা মেয়েকে দিয়ে গেছো আমাকে বোঝার জন্য।”

“বাইরের একটা মেয়ে” কথাটা সারাহ্ বুঝতে পারে। আহনাফ যে ওকেই বোঝাচ্ছে, নাহলে আর কাউকে তো এখানে দিয়ে যায়নি। সারাহ্ দরজার কাছে চলে যায়।

“আহনাফ, তুই কি সারাহ্-র সাথে মিসবিহেভ করিস? কিছু উল্টাপাল্টা বলিস ওকে?”

একটু চুপ থেকে আহনাফ বিপরীত পাশের কথাটা শুনে, আফরোজার কথা সারাহ্ না শুনলেও আহনাফের কথা ঠিকই শুনে।

“না, ওই মেয়েকে আমি কি বলবো? দোষ তো আমার যে এই রাগের মাথায় বিয়েটা করেছি। মেয়েটার জীবনটা জেনেবুঝে নষ্ট করছি। (একটু থামে) সম্পর্ক? তার কাছে এখন আমরা পারফেক্ট হাসবেন্ড-ওয়াইফ। আমি যেভাবে নিজেকে প্রেজেন্ট করবো, মানুষ আমাকে সেভাবেই বুঝবে।”

চমকে উঠলো সারাহ্। আহনাফ নিজের একটা মি°থ্যা রূপ ওকে দেখাচ্ছে। যে রূপে ওর মনে হচ্ছে আহনাফ ওকে ভালোবাসে, প্রচন্ড রকম ভালোবাসে।

সারাহ্ দরজার পাশ থেকে সরে রুমে আসে। আহনাফকে ও এখনো বুঝতে পারেনি। আহনাফ ঠিক বলে ওকে কেউ বুঝে না।

কিছুক্ষণ আগের লজ্জাটা উধাও হলো তার। মেকি মূহুর্তেগুলো মনে রাখতেই চাচ্ছে না সারাহ্। সারাহ্ মজবুত নারীর মতো নিজেকে বোঝাতে থাকে বারবার।

আহনাফ এখনো ফোনে কথা বলছে,
“রাগের মাথায় বিয়ে করি আর যেভাবেই করি না কেন বিয়ে হয়েছে আর এটা আমি অস্বীকার করতে পারবো না। নিজের স্ত্রীকে আগলে রাখতে হয় তা আমি জানি। (একটু থেমে) কিন্তু এই আগলে রাখায় ভালোবাসাও থাকতে হয়।”

আফরোজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“কি কম আছে সারাহ্-র মধ্যে?”

আহনাফ বি°র°ক্ত হয়। বলল,
“কম আছে। সবকিছুতে অতিরিক্ত বুঝে সে, বাড়াবাড়ি করে। যখন আমি যেরকম চাই সেরকম কিছুই হয় না। আবার…”

আহনাফ থেমে যায়। সারাহ্ তাকে প্রতি মূহুর্তে আর্কষণ করে। একটা অব্যক্ত, বেনামি সম্পর্কের টা°নে যেন বারবার সে সারাহ্-র দিকে যায়। একে সে ভালোবাসা বলতে নারাজ।

আফরোজা বলে,
“আবার কি?”
“কিছু না।”

আহনাফ কল কে°টে ফোন সাইলেন্ট করে দেয়। কে দোষী, কে নির্দোষ আর এসব নিয়ে এখন আর ভাবনার সময় নেই।

আহনাফ এসে সারাহ্-কে ডাকে,
“কি হলো? এখনো খেতে আসোনি?”

সারাহ্ চমকে উঠে বলে,
“আসছি।”

খেতে বসে আবারো সে আড়চোখে আহনাফকে দেখে। আহনাফ নিরবে খাচ্ছে। সারাহ্ ঠিকমতো খেতে পারছে না। ওর মনে হচ্ছে আহনাফ ওকে ঠকাচ্ছে, অভিনয় করছে ওর সাথে।

“কি হয়েছে, ঐশী? খাচ্ছো না কেন?”

সারাহ্ মাথানিচু করে খেতে খেতে বলে,
“এইতো শুরু করেছি।”

এইযে মাত্রই সারাহ্ও পেরেছে নিজেকে লুকাতে, নিজের মিথ্যা চেহারা দেখাতে। কিন্তু এই মিথ্যা চেহারা নিয়ে সংসার কিভাবে বাঁচিয়ে রাখবে সারাহ্? চিন্তায় পড়ে সে।
______________________________________

একসপ্তাহ পেরিয়ে গেল। কলরব নিয়ম করে প্রতিদিন মৃত্তিকাকে কল দেয়, এটাসেটা কথা বলে। আজ একদম দেখা করতে চলে এসেছে। এই বিষয়গুলো মৃত্তিকার কাছে একটু অস্বস্থির।

মামী দেলোয়ারার সাথে কথা বলছে কলরব। মৃত্তিকাকে তৈরি হতে বলেছে, দুজনে শপিংয়ে যাবে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে, মনের বিরুদ্ধে গিয়েই তৈরি হলো সে।

ড্রইংরুমে আসতেই দেলোয়ারা আদুরে কন্ঠে বললেন,
“মাশাল্লাহ, মিউকো। কি সুন্দর লাগছে।”

মৃত্তিকা মাথানেড়ে জোরপূর্বক মুচকি হাসে। কলরব ওর দিকে তাকায়। মৃত্তিকা মাথানিচু করে।

সকাল ১০ টায় কলরবের সাথে বের হয় মৃত্তিকা। কলরবের নিজের গাড়ি আছে, সেটাতে করেই যাচ্ছে ওরা। এসি গাড়ি, ঘন্টার পর ঘন্টার জ্যামে যেখানে অস্বস্তি কম হবে। তবুও এসব বিলাসিতা ভালো লাগছে না মৃত্তিকার। ইমতিয়াজের মতো সাদাসিধা জীবন ওর ভালো লাগে। অতিরিক্ত চাওয়া নেই ওর।

শপিংমলে পৌঁছে কলরব ওকে বলে,
“একটু দাঁড়াও, আমি গাড়িটা পার্ক করে আসি।”

সরাসরি তুমি করে ডাকায় মৃত্তিকার অস্বস্তির পরিমাণ বাড়ে। তবুও মাথানেড়ে সম্মতি জানায়।

কলরব গাড়ি রেখে এসে বলে,
“চলো, আগে কোথায় যাবে? শাড়ির দোকানে?”
“চলুন।”

হাঁটতে হাঁটতে কলরব বলল,
“তুমি এতো চুপচাপ কেন? একটু কথা বলে ফ্রি হও।”
“দুনিয়ায় সকল মানুষ একরকম হয় না। ভিন্ন কিছু মানুষ থাকে, সেরকম ভিন্ন মানুষ আমি।”

কলরব শব্দ করে হেসে বলল,
“ইতালিতে এমনভাবেই থাকতে? বয়ফ্রেন্ডের সাথেও এমনই ছিলে?”

মৃত্তিকা চমকে উঠে। ইতালিতে থাকতে হলে কি বয়ফ্রেন্ড থাকাটা বাধ্যতামূলক? একজন শিক্ষিত মানুষ এমন নিচু চিন্তা কিভাবে করতে পারে বুঝতে পারে না মৃত্তিকা।

“আমার বয়ফ্রেন্ড ছিল না।”

কলরব আবারো হাসলো। বলল,
“বিদেশের বয়ফ্রেন্ড বিডিতে আসবে না। সো, নো টেনশন। (একটু থেমে) আমারো গফ ছিল, কয়েকমাস লিভ ইন রিলেশনশিপে ছিলাম। দ্যাটস নরমাল।”

মৃত্তিকা চোখ ছোট করে তাকায়। এমনভাবে কথাটা বলল যেন লিভ ইন রিলেশনশিপ খুবই সহজলভ্য বিষয়। কলরবের আচরণ খারাপ লাগে তার, কেমন যেন প্লে°বয় টাইপ আচরণ। এই ছেলের সাথে সারাজীবন কিভাবে কাটানো যেতে পারে?

ওদের থেকে কিছুদূরে শরীফকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মৃত্তিকা। একবার কলরবের দিকে তাকিয়ে দ্রুত একটা দোকানে চলে যায়। পিছন ফিরে আবারো শরীফকে দেখে একটা ঢোক গিলে।
______________________________________

কলেজে আজ পিঠা উৎসব হচ্ছে। অক্টোবরের এই সময়টা পিঠা উৎসবের জন্য শ্রেষ্ঠ সময়। কলেজের মাঠে প্যান্ডেল করে সারি সারি পিঠার পশরা সাজানো হয়েছে। বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন রকমের পিঠা।

কয়েকদিন ধরেই সারাহ্-র মন মানসিকতা বা শরীর কোনোটাই ভালো নেই। দূর থেকেই এসব দেখছে সে। অতিরিক্ত টেনশনের ফলে তার র°ক্ত°চাপ কমেছে, সাথে বমি বমি ভাব হচ্ছে। পিঠার ঘ্রাণে সারা কলেজ মৌ মৌ করলেও সারাহ্-র বমি পাচ্ছে এসব গ°ন্ধে।

কেমিস্ট্রির একজন সিনিয়র ম্যাডাম এসে বলল,
“আরে সারাহ্, এখানে দাঁড়িয়ে আছো যে। চলো, কোনো একটা পিঠা খাবে।”

সারাহ্ মৃদু হেসে বলল,
“না ম্যাম, আমার ইচ্ছা নেই।”
“ওমা, কতশত পিঠা এখানে, ইচ্ছা নেই কেন?”
“এমনিই।”
“তুমি ইদানীং এমন গু°মো°ট কেন?”
“শরীর ভালো নয়।”
“ওহ।”

ম্যাডাম চলে গেলেন। সারাহ্ খানিক দূরে আহনাফকে এদিকে আসতে দেখে টিচার্স রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যায়। পড়ে যাওয়ায় পায়েও বেশ ভালোই ব্য°থা পেয়েছে।

আহনাফ দৌড়ে এসে ওকে ধরে বলে,
“ঐশী, কি হলো?”

কয়েকজন ম্যাডাম আর স্টুডেন্ট চলে আসায় আহনাফ ওকে কোলে তুলে একটা ক্লাসে নিয়ে যায়। বেঞ্চে শুইয়ে দিয়ে মুখে পানির ছিটা দিতেই সারাহ্-র জ্ঞান ফিরে।

কেমিস্ট্রির সেই ম্যাডাম এসে বলে,
“লাস্ট কয়েকদিন ওর এ অবস্থা ছিল। প্রেগন্যান্ট নাকি?”

“কি?”
আহনাফ একটু জোরেসোরেই কথাটা বলে।

আহনাফ সকলকে বলে,
“ভীড় কমান। সারাহ্ ম্যাডাম ঠিক আছে।”

ধীরে ধীরে ভীড় কমে। সবাই বেরিয়ে গেছে, রুমে আহনাফ আর সারাহ্ ছাড়া আর কেউ নেই।

সারাহ্ ধীরে ধীরে উঠে বসে। আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমি বাসায় যাবো।”
“কি হয়েছে তোমার?”

সারাহ্ হিজাব টে°নে°টু°নে ঠিক করে বলল,
“প্রেশার ডাউন।”

আহনাফ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,
“তোমার আচরণে পরিবর্তন এসেছে, ঐশী। কলেজের ম্যাডামরাও নোটিশ করছে।”

সারাহ্ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“বাসায় গিয়ে আমরা আমাদের পার্সোনাল কথাগুলো বলি? এটা কলেজ।”

আহনাফ মাথা নেড়ে ওর দিকে পানির বোতল এগিয়ে দেয়। সারাহ্ পানি পান করে বেরিয়ে যায়।

আহনাফ একটু চিন্তায় পড়ে। সারাহ্ যে কিছু নিয়ে অনবরত ভাবছে তা সে বুঝেছে। গভীরভাবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে।

চলবে…..

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

অষ্টাদশ পর্ব

বাসায় এসেও সারাহ্ মৌনতাকে বরণ করে রেখেছে। আহনাফ খেয়াল করেছে শেষ কয়েকদিনে ওর আচরণের পরিবর্তন। আহনাফকে একপ্রকার এড়িয়ে চলছে সে। খাওয়াদাওয়া ঠিক মতো করে না, অনেক দেরি করে ঘুমায়।

সারাহ্ বিছানায় শুয়ে পড়ে। আহনাফ এসে আরেকপাশে অর্ধ শুয়ে ওর মাথায় হাত রেখে ডাকে,
“ঐশী।”

সারাহ্ চুপ করে আছে, চোখ বন্ধ। নিজেকে সে যথেষ্ট শান্ত রেখেছে। ঝ°গ°ড়া, চেঁ°চামে°চি সে পছন্দ করে না আর আহনাফকে যদি কোনো প্রশ্ন করে তবে তাই হবে। সম্পর্কের এমন অবনতি সে চায় না।

আহনাফ আবারো ডাকে,
“ঐশী?”

সারাহ্ চোখ বন্ধ রেখেই বলে,
“আমাকে কিছুক্ষণ একা থাকতে দিন।”

আহনাফ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ো, আসো খাবে।”
“হাত সরান, আহনাফ।”

কড়া ভাষায় কথাটা বলে সারাহ্। আহনাফ হাত সরায়। এভাবে কখনো সারাহ্ কথা বলেনি। কি হলো এখন?

আহনাফ উঠে ডাইনিং এ চলে আসে। সারাহ্-র কথায় অপমানবোধ হচ্ছে আহনাফের। তাহসিনার ঘটনা শোনার পরও যে মেয়ে স্বাভাবিক ছিল, সে এমন কোন ঘটনায় বি°গড়ে গেল বুঝতে পারে না আহনাফ।

সময় ওদের এভাবেই কাটে। মাগরিবের পর সারাহ্ রুম গোছাচ্ছে। ঠিক এমনসময় আহনাফ গিয়ে বিছানায় বসে। এ সময় প্রতিদিন আহনাফ বই পড়ে, তবে আজ ব্যতিক্রম।

“ঐশী, রেগে আছো?”

সারাহ্ কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলে,
“না।”

ড্রেসিংটেবিলের উপরে থাকা হিজাব পিনগুলো গোছাতে শুরু করে। আহনাফ পাশাপাশি গিয়ে দাঁড়ালো। হেসে বলল,
“এগুলো আবারো এলোমেলো হবে।”
“হোক।”

সারাহ্ চলে যেতে নিলে আহনাফ ওর হাত ধরে কাছে এনে বলল,
“কি হয়েছে? আমার কোনো ভুল? বলো তো।”

সারাহ্ হাতের দিকে তাকায়। আহনাফ হাত ছেড়ে ওর কোমড় জড়িয়ে কাছে আনে।

“বলো, নইলে ছাড়ছি না।”

সারাহ্ ছাড়াতে চাইছে না। কোনো চেষ্টা নেই, জো°রজবর°দ°স্তি করছে না। শান্ত একটা দৃষ্টিতে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে। আহনাফ বি°ভ্রা°ন্ত হয়, সারাহ্-র থেকে সরে আছে। মেয়েটা শান্ত থেকেও ওকে ঘা°য়েল করার ক্ষমতা রাখে।

সারাহ্ চলে গেল। নিজের ভুল নিজেই খুঁজতে লাগলো আহনাফ।
______________________________________

পরদিন সকাল ৭ টা বেজে ৪৫ মিনিট, ফজরের নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়েছিল মৃত্তিকা। রাতে ভালো ঘুম হয়নি বলে শরীর খারাপ করছিল, ঠিক এ কারণেই এখন ঘুমানো।

ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙে। কেউ ওকে স্বরণ করেছে। হাতে নিয়ে অচেনা একটা নাম্বার দেখে ইমতিয়াজ ভেবে রিসিভ করে।

“জি।”

মৃত্তিকার কথার জবাব এলো,
“কেমন আছো, মা?”

ইমতিয়াজ নয়, ফোনের অপরপাশে ওর বাবা ছিল। মৃত্তিকা হতাশ হয়, সাথে বি°র°ক্ত।

“কেন ফলো করেন আমাকে? আমি আপনার কি এমন কাজে লাগতে পারবো?”
“আমি ভালোবাসি তোমাকে।”

মৃত্তিকা জবাব দিলো না। এসব ভালোবাসাকে ঘৃ°ণা করে সে। যেসব ভালোবাসা পরিবার ভা°ঙে, সন্তানকে বাবার থেকে দূরে রাখে, সকলের কষ্টের কারণ হয়। সেসব কোনো ভালোবাসা হতেই পারে না।

দুদিকে থাকা স°মা°ধী নিরবতা মৃত্তিকা টুকরো করে বলল,
“আমার কল্পনায় সবসময় আমার একজন বাবা ছিল। সে বাবা আমাকে ভালোবাসতো, আমার মাকে ভালোবাসতো। সে বাবা আমার কান্নার সময় চোখ মুছে দিতো, আমাকে গল্প পড়ে শোনাতো, আমাকে নিয়ে ঘুরতে যেতো, আমার সঙ্গে খেলা করতো।”

মৃত্তিকা থামলে আবারো সেই পূর্ব নিরবতা বিরাজ করে। শীতল কণ্ঠে মৃত্তিকা বলে,
“কিন্তু আমার বাস্তবের বাবা আমার শৈশব, কৈশোর, যৌবন সব ধ্বং°স করেছে।”

কল কে°টে যায়। মৃত্তিকা বিছানায় হেলান দিয়ে বসে৷ বাবা শিশুকালের স্বপ্ন যেভাবে শেষ করেছে, ঠিক সেভাবে ওর যৌবনকালের স্বপ্নও শেষ করছে। বাবার জন্যই নিজের ইচ্ছার বি°রু°দ্ধে একটা চরিত্রহীন ছেলেকে বিয়ে করতে হচ্ছে ওর।
______________________________________

নাস্তা তৈরি করে টেবিলে সাজিয়ে রেখে বেরিয়ে গেল সারাহ্। আহনাফ এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত হয়নি।

“ঐশী, নাস্তা রেডি করেছো?”

সারাহ্-র কোনো সারাশব্দ পাওয়া গেল না। কিভাবে পাওয়া যাবে, সে তো বাসায়ই নেই।

“ঐশী, ঐশী।”
কয়েকবার ডেকেও সারাহ্-র কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে আহনাফ রুমের বাইরে এসে দেখে টেবিলে নাস্তা আছে কিন্তু সারাহ্ কোথাও নেই।

সদর দরজার কাছে গিয়ে বুঝলো সারাহ্ বেরিয়ে গেছে, কারণ ওর জুতো জোড়াও নেই এখানে৷ আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে, এভাবে এড়িয়ে চলার মানে কি?

বাসায় তালা ঝুলিয়ে আহনাফও বের হয়। কলেজে পৌঁছে মাঠের আশেপাশেও সারাহ্-কে দেখে না। নিশ্চয়ই টিচার্স রুমে আছে।

আহনাফ সাত পাঁচ ভাবে না। সোজা টিচার্স রুমে চলে যায়। রুমের দরজায় গিয়ে ম্যাডামদের উদ্দেশ্যে একটা লম্বা সালাম দেয়।

“আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।”

দুই একজন ম্যাডাম সালামের জবাব দিলেন। আহনাফ চোখ বুলিয়ে কোথাও সারাহ্-কে না দেখে একজন ম্যাডামকে জিজ্ঞাসা করলো,
“কেমিস্ট্রির সারাহ্ ম্যাডাম আসেনি?”

আহনাফের প্রশ্ন যারা শুনেছে তাদের কয়েকজন হেসে দিলো। ম্যাডাম উত্তর দিলো,
“না, ও কি বাসায় নেই?”

আহনাফ থ°তমত খায়। বলল,
“ওকে, থ্যাংকস।”

ম্যাডামের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আহনাফ দ্রুত বেরিয়ে আসে। টিচার্স রুমে একটু হাসাহাসি এখনো চলছে। হয়তো কেউ কেউ এখন একটা গল্প বানানোর চেষ্টা করবে আহনাফ আর সারাহ্-কে নিয়ে।

মাঠের পাশে এসে দাঁড়ায় আহনাফ। ফোন বের করে সারাহ্-কে কল দেয়। একবার, দুবার, তিনবার রিসিভ হয় না। তরতর করে আহনাফের রাগ বাড়ে।

চোখ যায় কলেজের বড় গেইটের দিকে, সারাহ্ ভিতরে আসছে। আহনাফকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে উলটো পথে হাঁটা লাগালেও খুব একটা ফল হলো না। আহনাফ তাকে পাকড়াও করলো।

“কিসব হচ্ছে এসব ঐশী? কল রিসিভ করছো না কেন?”
“যখন কলের জন্য অপেক্ষা করতাম তখন দেন নাই, তাই এখন রিসিভ করি না।”
“স্কুল-কলেজের বাচ্চাদের মতো বিহেভ করবা না। রাগ উঠতেছে আমার।”

সারাহ্ ওর দিকে তাকিয়ে ব্য°ঙ্গসুরে বলল,
“ও, তাই নাকি? রাগ হচ্ছে? তো আর কি? পুরো কলেজের সামনে আমাকে কিস করেন। এতে তো আপনার রাগ কমে। হিজাবটা খুলবো নাকি?”

আহনাফ আশেপাশে তাকায়। অনেকে ওদেরকে দেখলেও কথা বোধহয় কেউই শুনছে না। মাঠে অনেক কোলাহল আছে।

আহনাফ নিচুস্বরে বলল,
“ঐশী, প্লিজ থামো।”

আহনাফ চলে যায়। সারাহ্-র নিরবতা অথবা তার কথা দুটোই ওকে আ°হ°ত করছে। সারাহ্ কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে সেও চলে যায় টিচার্স রুমে।

নিজের চেয়ারে বসতেই ওর পাশে বসা ম্যাডাম বললেন,
“স্যার তো এসে তোমাকে খুঁজে গেছে।”

সারাহ্ উনার দিকে তাকাতেই উনি বলেন,
“কোথায় ছিলে?”

সারাহ্ অপ্রস্তুত হয়। বলে,
“উনি ভাড়া দিচ্ছিলেন, তখন আমি ভিতরে চলে এসেছিলাম। মাঠের ওদিকে ছিলাম তাই খুঁজে পায়নি।”
“চোখে হারায়।”

ম্যাডামরা মিটিমিটি হাসলেও সারাহ্ নিচুস্বরে বলল,
“ঘেচু হারায়।”
______________________________________

টিএসসিতে এসেছে সামিহা ও তানজিম। মনমরা অবস্থায় বসে আছে তানজিম। সামিহা এটা ওটা বললেও “হু” ছাড়া আর কোনো জবাব দিচ্ছে না সে।

সামিহা তানজিমের হাত ধরে বলে,
“কি রে? কয়েকদিন ধরেই তোকে চুপচাপ দেখছি। কোনো সমস্যা?”

তানজিম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সামিহা আবারো বলল,
“আন্টি ঠিক আছে?”
“আম্মু ভালো আছে। সমস্যা অন্যকিছু নিয়ে।”

সামিহা তানজিমের মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,
“কি?”
“মিউকোপু ইমতিয়াজ ভাইয়াকে পছন্দ করে।”
“আপুর না বিয়ে ঠিক হয়েছে?”
সামিহা কপাল কুঁচকে কথাটা বলল।

তানজিম মাথা নেড়ে বলল,
“হুম, হয়েছে। তবুও আমি খেয়াল করেছি সে ভাইয়ার প্রতি দুর্বল।”

সামিহা ঠোঁট উল্টায়৷ বলে,
“এই ইমতিয়াজ ভাইটা কে?”
“আমার বড় বোন তাহমিনা আপুর হাসবেন্ড।”

সামিহা “অ্যা” নামক একটা অদ্ভুত বিকৃত শব্দ উচ্চারণ করে। তানজিম বলে,
“উনার সাথে এই বিষয় নিয়ে আমার একদফা ঝ°গ°ড়াও হয়েছে। বাট আমার মনে হয়না উনি ভাইয়াকে ভুলে যাবেন।”

সামিহা বলে,
“ভালোবাসা তো ভুলে যাবার মতো কিছু নয় তানজিম। আর তাহমিনা আপু বেঁচে নেই, তাই ভাইয়াও একা। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিয়ে অবশ্যই একটা ভালো অপশন।”

তানজিম সামিহার দিকে তাকালে সামিহা একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
“মানে আমি বলতে চাচ্ছিলাম মানুষ তো আর একা থাকতে পারে না।”

তানজিম একটা গভীর নিশ্বাস ফেলে বলে,
“হয়তো তুই ঠিক বলছিস। কিন্তু ভাইয়া মিউকোপুর সাথে সংসার করবে এটা আমি কোনো এক কারণে মানতে পারছি না।”

সামিহা তানজিমের হাত ধরে৷ আপাতত এই অস্থির মানুষটাকে শান্ত করার প্রয়োজন। বোনের প্রতি ভালোবাসা আছে, তাই বাস্তবতা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে।
______________________________________

বিকাল সাড়ে চারটা, বাসার সামনের রাস্তায় হাঁটছে মৃত্তিকা। চিন্তাহীনভাবে হাঁটছে সে। যার জীবনে কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই, তার আবার কিসের চিন্তা। যেটুকু চাওয়া ছিল, তাও এখন মাটিচাপা পড়ে গেছে।

কলরবের গাড়িটা একটু দূরে দেখতে পেয়ে থেমে যায় মৃত্তিকা। গাড়ির পাশেই কলরব দাঁড়ানো। বিদেশে চাকরি করা কলরব ছুটিতে দেশে এসেছে, তাই তার এখন প্রতিদিনই শুক্রবার।

কলরবের পাশের মানুষটাকে দেখে দুনিয়া এক জায়গায় স্থির হয় তার। এ যে ওর বাবা শরীফ। মৃত্তিকা পিছিয়ে যেতে নিলে কলরব ওকে ডাকে,
“হেই মিউকো, কাম হেয়ার।”

পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করলেও মৃত্তিকা পালায় না। বাবাকে নিয়ে কলরবের মুখোমুখি আজ নাহয় কাল হতেই হতো। মৃত্তিকা এগিয়ে যায়।

কলরব শরীফের দিকে ইশারা করে বলে,
“উনাকে চেনো?”

মৃত্তিকা হ্যাঁ বা না কিছুই বলে না। কেবলই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। শরীফ পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিয়ে বলে,
“আমার মেয়ে আমাকে চিনবে না তা কি করে হয়?”
কথাটা বলেই শরীফ হেঁটে চলে যায়।

মৃত্তিকা একবার সেদিকে তাকিয়ে মাথানিচু করে। কলরব গাল চুলকাতে চুলকাতে বলে,
“মানে এতো বড় মিথ্যা কথা কেন? তুমি মিথ্যা বলেছো, তোমার মামা মিথ্যা বলেছে, তোমার খালু মিথ্যা বলেছে। মানে মিথ্যা আর মিথ্যা। ডিরেক্ট বললেই তো হতো তোমার মা আর বাবার বিয়ের আগেই তুমি হয়েছো।”

মৃত্তিকা চোখ পাকিয়ে চেঁচিয়ে বলে,
“চুপ করেন, আমার মামকে নিয়ে কোনো বাজে কথা বলবেন না।”

কলরব কান চুলকে মাথা ঝে°ড়ে বলল,
“আহা, রেগে যাচ্ছো কেন? এসব নরমাল তো। (একটু ভেবে) কি যেন বলেছিলে তোমার বয়ফ্রেন্ড ছিল না?”

কলরব শব্দ করে হেসে বলল,
“না জানি এ শরীরে কতশত হাত পড়েছে। বাই দা ওয়ে, তোমার মা কি প্র°স্টি°টিউট ছিলো?”

কলরবের ডান গালে একটা চ°ড় পড়ে৷ ওর শেষের কথায় মৃত্তিকার মাথায় র°ক্ত চ°ড়েছে৷ শান্ত মেয়েটা ধীরে ধীরে হিং°স্র হয়ে গেছে। মামের নামে একটু বাজে কথা যে সহ্য করতে পারে না, সে এতো বড় কথা কিভাবে সহ্য করবে।

মাথা তুলার আগেই কলরবের বাম গালে আবারো একটা চ°ড় পড়ে। কিছু বলার আগেই ওকে ধা°ক্কা দিয়ে ফেলে দেয় মৃত্তিকা।

আঙ্গুল উঁচিয়ে চোখ রা°ঙিয়ে বলে,
“সবার জানা উচিত, কোথায় থামতে হয়। না জানলেই বি°পদ।”

কলরব উঠে বসে বলল,
“ঠিক করলে না এসব মিউকো?”
“চুপ, মামকে নিয়ে কথা বলে আপনি ঠিক করেছেন?”

কলরব দাঁড়িয়ে শার্ট ঝা°রতে ঝা°রতে বলল,
“তোমাকে বিয়ে করছি না আমি, এমন মেয়ে আমার যোগ্য নয়।”

মৃত্তিকা ভ্রূ উঁচিয়ে ব্য°ঙ্গ করে বলে,
“ভাবটা এমন যেন আমি বউ সেজে বসে আছি। এমন চরিত্রহীন ছেলের থেকে নি°স্তার পেয়ে শান্তি লাগছে।”

মৃত্তিকা বাসায় চলে আসে। শরীফ রিপা বেগমের নামে উল্টাপাল্টা কথা ছড়ায় এটা মৃত্তিকা আগে থেকেই জানে। শরীফের পরিবার অর্থাৎ মৃত্তিকার দাদাবাড়ির সবার কাছে রিপা বেগমকে খল°নায়িকা বানিয়েছে শরীফ, বাইরের লোকের কাছেও নিজের সন্তানের মায়ের নামে খারাপ কথা বলতে তার ঠোঁটে আটকায় না।

রুমে এসে দরজা লাগিয়ে মৃত্তিকা কান্না করে দেয়। নিজেকে এতোক্ষণ যতই শক্ত রাখুক না কেন বদ্ধ ঘরে, একাকিত্বে ওর কান্নারা এসে জুড়ে বসে। এ কান্না রিপা বেগম দেখলে হয়তো কলরবকে খু°ন করতো।

মৃত্তিকার কাছে আজ এমন কেউ নেই যে ওর চোখের পানি মুছে দিবে, যে ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে নিষেধ করবে। মৃত্তিকার একাকিত্ব ঘু°চবে না।
______________________________________

আহনাফের আগেই বাসায় এসেছে সারাহ্। মিটিং থাকায় আহনাফের বের হতে দেরি হয় আর বেরিয়ে সে সারাহ্-কে দেখে না। বাসায় এসে ব্যাগটা সোফায় ছু°ড়ে ফেলে আহনাফ।

ডাইনিং এ কাজ করছে সারাহ্। আহনাফ গিয়ে একটা চেয়ার টেনে সারাহ্-কে বসিয়ে দিয়ে বলে,
“কি সমস্যা তোমার?”

সারাহ্ কিছুই হয়নি এমন একটা চেহারা করে তাকিয়ে আছে। আহনাফ ওর দিকে ঝুঁ°কে বলল,
“কি হয়েছে?”

সারাহ্-র এমন নরমাল চেহারা দেখে আহনাফের রাগটা বাড়ে। ধ°ম°কের সুরে বলল,
“কথা বলছো না কেন?”

সারাহ্ আহনাফের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়। বলে,
“আমাকে নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছে নাকি চিন্তার অভিনয় করছেন?”

আহনাফ সারাহ্-র থুতনিতে হাত রেখে বলে,
“এসব কেন বলছো?”
“পারফেক্ট হাসবেন্ড হওয়ার অভিনয় করেছেন? ঠকিয়েছেন আমাকে।”

সারাহ্-র দুইগালে হাত দেয় আহনাফ। কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে,
“একটু শান্ত হও। আমি কখনোই পারফেক্ট হাসবেন্ড হতে পারবো না। হ্যাঁ, অভিনয় করেছি, কিন্তু সেটাও তোমার খুশির জন্য।”
“কেন?”

সারাহ্-র প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ওর ডানগালে ঠোঁট ছোঁয়ায় আহনাফ। সারাহ্ উত্তরের আগ্রহ দেখিয়ে বলে,
“কেন অভিনয় করেছেন আহনাফ?”
“কথা বলো না প্লিজ। এতো উত্তর আমি দিতে পারবো না।”

সারাহ্-র নিরবতা আহনাফকে বুঝিয়ে দিয়েছে সারাহ্ ওর জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে উপনীত হয়েছে। এই মানুষকে অনুভূতিটুকু জানিয়ে দিলেই তা পুরোনো হয়ে যাবে। তার জানার আগ্রহ থাকুক আর আহনাফ অনুভূতি গোপন করতে থাকুক।

চলবে……

অনুভূতিরা শব্দহীন পর্ব-১৩+১৪+১৫

0

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

ত্রয়োদশ পর্ব

“এসব কি করেছেন, আহনাফ?”
“ডোন্ট কল মি আহনাফ।”

বাসায় ফিরেই আহনাফকে প্রশ্ন করে সারাহ্। পুরো রাস্তা কথা বলার কোনো সুযোগই দেয়নি। আহনাফের ধ°ম°ক খেয়ে একটু থতমত খেয়ে যায়।

আহনাফ ফ্রেশ হতে চলে গেল। সারাহ্ সোফায় বসে পড়ে। লোকটাকে এখনো সে পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারছে না। এমন অদ্ভুত ব্যবহার কেন করে সে? মানসিক সমস্যা আছে কোনো? নাকি শুধুই ওর সাথে এমনটা করে?

আহনাফ ফিরে এসে সারাহ্-র গা ঘে°ষে বসে। সারাহ্ সরে নিলে ওর কোমড় জড়িয়ে ধরে বলল,
“কি বলছিলে?”

সারাহ্ ভয় পায়। সেই অ°প্রীতিকর ঘটনার পুনরাবৃত্তি সে চায় না। আহনাফ উঠে দাঁড়িয়ে ওর হিজাবটা খুলে নেয়। চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“ছেলেটার প্রতি খুব দরদ হচ্ছে?”

আহনাফ আচরণ ভালো ঠেকলো না। সারাহ্ ঢোক গিলে বলে,
“ওর বাবা-মাকে ডাকবে, খুব খারাপ একটা ব্যাপার হবে না?”
“না।”

আহনাফ চলে যেতে নিলে সারাহ্ একটু জোরেই বলে,
“তাহসিনাকে ভালোবাসেন তো আমাকে নিয়ে এতো ভাবেন কেন?”

আহনাফ হাত মু°ষ্টি°ব°দ্ধ করে নিজের পায়েই দুবার আঘাত করে। তারপর দ্রুত সারাহ্-র কাছে এসে ওকে একহাতে টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে আরেকহাতের আঙ্গুল উঁচিয়ে ক°ড়া ভাষায় বলে,
“চুপ, গলা উঁচিয়ে কথা বলবে না।”

সারাহ্ কন্ঠ নামিয়ে খুব তাড়াহুড়ো করে বলে,
“মিথ্যা তো বলছিনা আমি? তাহসিনা কে বলছেন না, কোথায় আছে তাও বলছেন না। আবার আমার প্রতি পুরো অধিকার কেন খাটাচ্ছেন? আমি কি…”

আহনাফ ওর ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়। সারাহ্-কে ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়িয়ে বলে,
“এসব তুমি বুঝবে না, ঐশী।”

আহনাফ গিয়ে সোফায় বসে। সারাহ্ এখনো একই স্থানে স্থির। আহনাফ ওকে পাশে বসতে ইশারা করে। সারাহ্ তাই করলো।

আহনাফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“আর একটা দিন অপেক্ষা করো, তোমার সব প্রশ্নের জবাব দিবো। (একটু থেমে) কাল বিকেলে ঢাকা যাবো, তৈরি থেকো।”

আহনাফ চলে যেতে নিলে সারাহ্ বলল,
“তাহসিনা কি ঢাকায় থাকে?”

আহনাফ জবাব দিলো না। ফিরেও তাকালো না ওর দিকে। ওর ভাবে মনে হতে পারে সারাহ্-র কথা সে শুনেই নি।

আহনাফ তো জানে তাহসিনা কোথায়। তাহসিনা যে এখন বড্ড একা, আহনাফ এখন সঙ্গী পেতে নিয়েছে। এটা জানলে কি তাহসিনা কষ্ট পাবে না?
______________________________________

বিকাল চারটা, নিজের রুমে অঘোরে ঘুমাচ্ছে মৃত্তিকা। সারাদিন ঘুরাঘুরি করেছে, দুপুরের খাবারও বাইরে খেয়েছে। মমতাজ বেগম আজ বেশ ভালোই কথা বলেছেন৷ হয়তো একটু একটু করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছেন উনি।

এলোমেলো চুলগুলো মৃত্তিকার চোখমুখের উপর পড়ে আছে। পাশবালিশটা জড়িয়ে ধরে খুব আরামের সাথে ঘুমাচ্ছে।

“মৃত্তিকা?”

চেনা একটা কন্ঠ অচেনাভাবে শুনে মৃত্তিকা। এতো নরম সুরে সে কেন ডাকছে তাকে?

আবারো সেই কন্ঠ,
“মৃত্তিকা?”
“আমাকে মিউকো বলেন না কেন?”
“সে যে আমার বিড়াল।”
“আর আমি?”
“তুমি হয়তো অনেককিছু, নয়তো কিছুই নও।”

মৃত্তিকা চোখ খুলে। উঠে বসে আশেপাশে তাকায়, রুমে কেউ নেই। তবে কি সে স্বপ্ন দেখছিলো?

মৃত্তিকা ফিক করে হেসে দেয়। ইমতিয়াজের কন্ঠ শুনতে ওর এতোই সুখ লাগে যে ঘুমের ঘোরেও সেই কন্ঠ শুনছে।

চুলগুলো খোঁপা করে নেয় মৃত্তিকা। আয়নার দিকে চোখ পড়ে। মৃত্তিকা নিজের চেহারা দেখে হেসে বলে,
“এক বিবাহিত পুরুষের প্রেমে পড়েছিস তুই। পাগল হয়ে গেছিস? সে পুরুষের মনের কোণেও স্থান নেই তোর। ভুলে যা।”

নিজেই নিজেকে ব°কছে। হাসি পায় ওর। ঘুম আর হবে না। স্কার্ফটা মাথায় জড়িয়ে বেরিয়ে যায় মৃত্তিকা। যদিও আজকের আকাশটা একটু অন্ধকার, তবুও সে হাঁটতে বের হলো।

কিছুটা রাস্তা পেরিয়ে যায় গো°র°স্থানের কাছে। বাইরে লাগানো বোর্ডটার দিকে একটু তাকিয়ে লোহার গেইট ঠেলে ভিতরে ঢুকে। সকলে নিশ্চুপ নিরব, মৃত্তিকা গিয়ে রিপা বেগমের কবরের কাছে দাঁড়ায়।

“মাম।”
কণ্ঠনালি চি°ড়ে বের হয় এই ডাক।

সূরা ফাতিহা পড়লো, দোয়া করলো মামের জন্য। চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছে। হঠাৎ গুড়িগুড়ি বৃষ্টি ঝরা শুরু হয়। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে৷ তবুও মৃত্তিকা একই স্থানে দাঁড়িয়ে আছে।

ওর মাথার উপর একটা ছাতা আসলো। মৃত্তিকা চমকে উঠে৷ এখন এখানে কে এসে উপস্থিত হলো। পাশে তাকিয়ে বাবাকে দেখে ভয় পেল মৃত্তিকা।

“আপনি এখানে?”

শরীফ মেয়ের গালে হাত দিয়ে স্নেহের পরশ দিতে চাইলেও মৃত্তিকা তা প্র°ত্যা°খ্যা°ন করে। মুখ সরিয়ে নিয়ে বলে,
“এসব আহ্লাদের প্রয়োজন নেই আমার।”

শরীফ বলল,
“বাইরে এসো। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কোনো লাভ নেই। এতো না আগলে রাখতে চেয়েছিল তোমাকে, কোথায় সে?”

মৃত্তিকা কিছু না বলে ঘাড় ঘুরিয়ে নিলো। অ°মানুষের সাথে চিৎকার করে কোনো ফায়দা নেই। এরা পড়াশুনা করে ডাক্তার হয়, কিন্তু নৈতিকতার বড্ড অভাব।

মৃত্তিকা বাইরে চলে আসে। বৃষ্টির আঁচ কিছুটা কমে গেছে। ভিজে ভিজেই হাঁটতে থাকে সে। শরীফ এসে ওর পাশাপাশি হয়ে বলে,
“বাবার সাথে থাকবে এতে কি সমস্যা তোমার?”

মৃত্তিকা দাঁড়িয়ে গিয়ে বলে,
“ওই বাবা কোথায় ছিল আমার ছেলেবেলায়? যখন আমি বাবার স্নেহ খুঁজতাম তখন কোথায় ছিল? আমার শৈশব ধ্বং°স করেও শান্তি হয়নি আপনার?”
“সেসব তোমার মায়ের জন্য হয়েছে।”

শরীফকে ধা°ক্কা দিয়ে সরিয়ে মৃত্তিকা বলে,
“খবরদার আমার মাকে নিয়ে আর একটা শব্দ বলবেন তো আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।”

শরীফ মেয়ের গালে চ°ড় দিয়ে বলে,
“মায়ের মতোই হয়েছো, বে°প°রোয়া। সময় থাকতে বদলে যাও। নাহলে তোমার মায়ের সংসার জুটেনি আর তোমারও জুটবে না। একা থাকবে, ঠিক আমার মতো।”

একটু থেমে শরীফ নরম কন্ঠে বলে,
“মা, আমার সাথে চলো। আমি ভালোবাসি তোমাকে। আমার ভালোবাসা বোঝো না তুমি?”
“এসব আপনার ভালোবাসা? কথা না শুনলেই মা°র°বেন আর অ°ত্যা°চার করেন, এটা ভালোবাসা?”
“তুমি আজও আমাকে বুঝলে না।”

শরীফ চলে গেল। মৃত্তিকা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। কি করবে সে? যাবে কোথায়? কাকে বোঝাবে ওর মনের কথা? কে আছে ওর? উত্তর একটাই, কেউ নেই ওর।
______________________________________

সন্ধ্যা ৭ টা, আহনাফ টেবিলে কিছু একটা পড়ছে। সারাহ্ একবার এসে চা দিয়ে গেল, একবার এসে বিস্কুট দিয়ে গেল। কিন্তু কোনোবারেই আহনাফ কোনো কথা বলল না।

সারাহ্ আরেকবার রুমে উঁকি দিলো। আহনাফকে ব্যস্ত দেখে ও ড্রইংরুমে চলে গেল। কল দিলো সামিহাকে। কাল যে ওরা বাসায় যাবে তা আগেই জানানো হয়েছে। নতুন জামাই বলে কথা, আয়োজন তো হবেই।

“আপু।”
“কি করিস?”
“তেমন কিছু না, আবার অনেক কিছু।”
“মানে?”

সামিহা হেসে বলল,
“পিঠা বানাচ্ছি, মুগপা°ক্কন আর চন্দ্রপুলি। তুমি তো সোয়ামী নিয়ে এসেই খা°লা°শ, য°ন্ত্র°ণা তো সব আমার।”
“ওমা, এসব কেমন কথা? তোর বিয়ের পরও তো এমন হবে।”
“অসম্ভব।”
চেঁচিয়ে বলে সামিহা।

“কেন রে?”
“আমি বিয়ে করে এখান থেকে কোত্থাও যাবো না, দরকার হলে জামাই এখানে থাকবে।”
“দেখা যাবে।”

সারাহ্ হো হো করে হেসে উঠলো। মেয়েরা একটা বয়সে বলে আমি কোথাও যাবো না, বাবা-মায়ের সাথে থাকবো। কিন্তু বাস্তবতা হলো তাদেরকে যেতে হয়, সেদিন আর এসব কথার কোনো মূল্যই থাকে না।

আহনাফ ড্রইংরুমে এসে টিভি ছেড়ে বসে। সারাহ্-র দিকে তাকালে সারাহ্ আর কিছু না বলেই ফোন রেখে দেয়।

“ব্যাগ গুছিয়েছো?”

আহনাফের কথায় সারাহ্ ডানেবামে মাথা নাড়ে। আহনাফ আবারো খেলা দেখতে ব্যস্ত হয়। সারাহ্ টিভির দিকে তাকায়। ক্রিকেট খেলা সে খুব একটা বুঝে না, ফুটবলেই তার যত আগ্রহ।

আহনাফ বলল,
“তুমি ফোনে কথা বলছিলে। বলতে পারো, সমস্যা নেই।”

সারাহ্ জবাব না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করে,
“কাল ক্লাস করবেন না?”
“ক্লাস নেই কালকে।”
“কলেজ যাবেন?”
“হুম, ওই ছেলের বাবা আসবে।”

সারাহ্ এসে ওর পাশে বসে বলল,
“ছোটমানুষ ওই ছেলে, বুঝেনি এতোকিছু হবে। আপনাকেও তো এক মেয়ে প্রপোজ করেছিল, আমি কি এতো কাহিনী করেছি?”

আহনাফ পা গু°টিয়ে বসে বলল,
“আমি আর তুমি কি এক?”
“না, আসলে..”

আহনাফ ধ°ম°ক দিয়ে বলে,
“তবে? আমি কি করবো না করবো তা কি তুমি ঠিক করবে?”

রিমোটটা ছু°ড়ে ফেলে আহনাফ চলে যায়। সারাহ্ কিছুই বলে না। এ সম্পর্ক কি এভাবেই চলবে। ঝগড়া, রাগ আর ভ°য়ের মধ্যে কি কোনো সম্পর্ক স্থায়ী হয়?
______________________________________

সকাল ৮ টা, তানজিমকে কল করে সামিহা জানালো সে ভার্সিটিতে যাবে না। কারণ আজ বাসায় সারাহ্ আসবে। তানজিমকে ভার্সিটিতে যেতেই হবে, কারণ আজ গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস। বাদ দিলে নোটগুলো পাবে না।

তানজিম বের হওয়ার সময় মৃত্তিকাকে তৈরি হতে দেখে বলে,
“আপু কোথাও যাবে?”
“হ্যাঁ, যাবো।”
“কোথায়?”
“এক ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে যাবো।”
“এত সকালে?”

মৃত্তিকা মাথা নেড়ে “হ্যাঁ” বলে বেরিয়ে যায়।

তানজিমও বের হয়। মৃত্তিকা ওকে জিজ্ঞাসা করে,
“তোমার ইমতিয়াজ ভাইয়া কোথায় থাকে?”
“এইতো কাছেই, মগবাজারের দিকে উনার বাসা।”
“ও” বলে মৃত্তিকা রিকশা ডেকে উঠে পড়ে।

তানজিম নিজের রাস্তায় যায়। আজকে ক্লাসটা বোরিং যাবে। সামিহা নেই, মানে ওর গল্প করার আর দুষ্টুমির সঙ্গিনী নেই।

পান্থপথের কাছে বান্ধুবীর বাসায় আসে মৃত্তিকা। বিশেষ কোনো কারণ নেই, শুধুমাত্র বাংলাদেশের চাকরির অবস্থা জানার জন্যই এখানে আসা। ওর যেকোনো একটা চাকরি হলেই হবে, সে হোক বিশ-বাইশ হাজার টাকার। যার ভবিষ্যৎ নেই, তার টাকারও প্রয়োজন নেই।
______________________________________

বিকাল চারটায় ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় আহনাফ-সারাহ্। সারাহ্ নিষেধ করায় ছেলেটি এবারের যাত্রায় ছেড়ে দেয় আহনাফ, তবে সতর্ক করে দেয়।

বাসে বসে আহনাফ জিজ্ঞাসা করলো,
“ব°মির অভ্যাস আছে?”

সারাহ্ মাথা নেড়ে বলে,
“না।”

আহনাফ অন্যদিকে তাকায়। সারাহ্ বলে,
“একটা প্রশ্ন করি? ভ°য় দেখাবেন না।”

আফনাফ ফিক করে হেসে দেয়।
“আমি কি ভূ°ত যে তোমাকে ভ°য় দেখাবো?”
“আপনা..(একটু থেমে) আপনি তাকালেই আমার ভ°য় করে।”

আহনাফ সরাসরি বলল,
“কি প্রশ্ন করবে তাই করো।”
“ব°কা দিয়েন না, ওকে?”
“আচ্ছা বলো।”
একটু বি°র°ক্ত হয়েই বলে আহনাফ।

“আসলে জানতে চাইছিলাম কালকের ওই ঘটনায় আপনার কি জে°লা°স ফিল হয়েছিল?”

আহনাফ মাথা নেড়ে হাসে।
“জে°লা°স? তাও ওইটুকু একটা বাচ্চার সাথে? কম করে হলেও বারো-তেরো বছরের ছোট হবে আমার থেকে। জে°লা°স বলতে যা বোঝো এটা তা নয়। এটাকে প্রতি°রক্ষামূলক হিং°সা বলে। বোঝো এসব?”

এসব বিষয়ে সারাহ্ নিতান্তই কাঁচা। তাই আর কথা বাড়ালো না চুপচাপ জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকলো।

আহনাফ সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। সারাহ্ আবারো ওর দিকে তাকালো। তাহসিনা নামের কেউ আছে যাকে আহনাফ ভালোবাসে, প্রচন্ড ভালোবাসে। এই একটা ভাবনা সারাহ্-কে বড্ড বেশি পী°ড়া দিচ্ছে। তাহসিনা যে ভালোবাসা পাচ্ছে সেটা ও কেন পেতে পারে না?

ঢাকায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয় ওদের। পুরো রাস্তা সারাহ্ নিরব থাকে। আহনাফ যে তাহসিনার সাথে দেখা করাবে ওকে। কিভাবে সহ্য করবে ও?
______________________________________

রাত আটটা, তানজিমদের বাসায় এসেছে মামা শাফিন ও মামী দেলোয়ারা। মৃত্তিকা উনাদেরকে আসতে বলেছে। শরীফের ব্যবহার নিয়ে আবারো সবার সাথে কথা বলছে মৃত্তিকা।

লুৎফর সাহেব ইমতিয়াজকেও খবর দিয়েছেন, যদিও তা মৃত্তিকা জানে না। ইমতিয়াজ মাত্রই এসেছে। মৃত্তিকা ডাইনিং এ বসে কথা বলছিলো ঘরের বড়দের সাথে।

“আসসালামু আলাইকুম।”

ইমতিয়াজ সকলের উদ্দেশ্যে সালাম দেয়, সালামের উত্তর দেন উনারা। মৃত্তিকা আড়চোখে ওর দিকে তাকায়।

দেলোয়ারা বললেন,
“হাতমুখ ধুয়ে আসো বাবা।”
“জি, মামানী।”

পকেট থেকে ফোন আর অফিসের আইডি কার্ড বের করে টি টেবিলের উপর রেখে তানজিমের রুমে চলে যায় ইমতিয়াজ।

ইমতিয়াজ ফ্রেশ হয়ে আসতেই লুৎফর সাহেব ওকে বললেন,
“একটা বড় সমস্যায় আছে মিউকো, সমাধান নেই।”

ইমতিয়াজ সোফায় বসতে বসতে বলল,
“কি হয়েছে আবার বাবা?”

শাফিন সাহেব বললেন,
“মিউকোর বাবা, ওকে প্রতিদিন একই বিষয়ে য°ন্ত্র°ণা দিচ্ছে। গতকালকেও চ°ড় দিয়েছে ওকে, প্রচন্ড খারাপ ব্যবহার করে। এমন অবস্থা চললে কি হয়?”

ইমতিয়াজ তাকালো মৃত্তিকার দিকে, চোখদুটো এখনো ছটফট করছে কান্নার জন্য। মৃত্তিকা ওর দিকে তাকাতেই ও চোখ ফিরিয়ে নিলো।

দেলোয়ারা চায়ের জন্য উঠে গেলেন। মৃত্তিকাও সাথে গেল।

লুৎফর রহমান বলেন,
“এইটুকু বয়সে একটু শান্তিও পাচ্ছে না। কি করা যায়?”

ইমতিয়াজ একটু ভাবে। তারপর বলে,
“ওর বাবার থেকে ওকে দূরে থাকতে হবে। এনি হাউ।”
“এটাই তো সমস্যার, সব জায়গায় হাজির হয়। যদিও মিউকো সাহসী, তবুও কবে কি হয়ে যায় বলা যায় না।”
লুৎফর রহমানের কথায় সবাই সম্মত হলো।

শাফিন সাহেব বলেন,
“মিউকোর বিয়ে দিতে হবে। একমাত্র ওর হাসবেন্ডই পারবে ওকে ওই লোকের কাছ থেকে দূরে রাখতে।”

মৃত্তিকা চা এনে সবাইকে দেয়। ইমতিয়াজের সামনে নিয়ে কাপ রাখতেই ইমতিয়াজ ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
“হ্যাঁ, মৃত্তিকার বিয়েই এটার সমাধান হতে পারে। আপনারা পাত্র দেখেন, আয়োজন দায়িত্ব আমি আর তানজিম নিলাম।”

মৃত্তিকা একটু সরে এসে একটা নিরব দৃষ্টি দেয় ইমতিয়াজের দিকে। চোখদুটো বারবার বলছে,
“আমাকে তোমার করে নাও। আর কাউকে চাই না আমি। আমার জীবনের সেই সৈ°ন্য হয়ে যাও তুমি, যে প্রতিনিয়ত ঢা°ল-ত°লো°য়ার নিয়ে আমাকে রক্ষা করবে।”

ইমতিয়াজ ওর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দেয়। সকলে একমত হলো, মৃত্তিকার বিয়ের প্রয়োজন।

শাফিন সাহেব বললেন,
“মা মিউকো, কিছু মনে করো না। বিষয়গুলো এখন খুবই স্বাভাবিক। কাউকে কি পছন্দ করো বা ইতালিতে কারো সাথে সম্পর্ক ছিল?”

মৃত্তিকা মাথানিচু করে বলে,
“না। আপনারা যা ভালো বুঝেন, তাই করেন।”

মৃত্তিকা বে°প°রো°য়া নয়, যথেষ্ট শান্ত। সে কি করে বলবে আপনাদের বাড়ির জামাইকেই আমি ভালোবেসেছি। তাহমিনার স্বামী ইমতিয়াজ আমার স্বপ্নেও আসে। ছি, এ কথা বলা মানে পরিবারের সামনে ওর মামের সম্মান বিলীন করা। নিজের অনুভূতিকে ঘৃ°ণা করতে থাকে মৃত্তিকা।

চলবে….

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

চতুর্দশ পর্ব

রাতের খাওয়া দাওয়া শেষে বাসার সবাই আবারো কথা বলছে। মৃত্তিকার জন্য কেমন ছেলে চাই সেটাই এখানে মুখ্য বিষয়।

“মিউকো মা একজন এডুকেটেড মেয়ে। পিএইচডি ডিগ্রিও নিবে আশা করি। তো ওর জন্য একজন পারফেক্ট ছেলেই লাগবে। তাড়াহুড়ো করে যার তার হাতে ওকে তুলে দেয়া যাবে না।”

শাফিন সাহেব সত্যই বলেছেন। শিক্ষিত মেয়ের জন্য শিক্ষিত ছেলে না হলে ভবিষ্যতে সমস্যা হতে পারে।

“তুমি ঠিক বলেছো, শাফিন।”

মমতাজ বেগম রুম থেকে বের হতে হতে বললেন। লুৎফর রহমান উনার দিকে ফিরে বললেন,
“তুমি এখানে?”
“কেন? আসতে পারবো না বুঝি?”

অভিমানী সুরটা লুৎফর সাহেব বুঝলেন। ঘরে থেকে থেকে মানুষটা যে হাঁপিয়ে উঠেছেন। মমতাজ বেগম এসে ইমতিয়াজের পাশে বসলেন।

বড়রা সোফায় বসা। তানজিম আর মৃত্তিকা ডাইনিং এ চেয়ারে বসেছে।

দেলোয়ারা বললেন,
“কিন্তু বাবা মায়ের ব্যাপারে জানতে চাইলে কি বলবেন? (একটু থেমে) না মানে, ডি°ভো°র্সের কথা তো বলা যাবে না।”
“না, ডি°ভো°র্স বলা লাগবে না। বাবা-মা নেই, মা°রা গেছে। মামার কাছে থেকেছে। থ্যাটস ইট, আর কিছু বলার দরকার নেই।”

শাফিনের কথায় সবাই সম্মত হলেও ইমতিয়াজ বলে,
“মামা, কিছু মনে করবেন না। একটা কথা বলি।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলো।”

ইমতিয়াজ একবার মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“বাবার কথা না বললে পরে তো ওর বাবার কথা জানতেই পারবে, উনি যেভাবে মৃত্তিকার আশেপাশে থাকে।”

শাফিনের মুখে চিন্তার ভাঁজ পড়লো, ইমতিয়াজের কথা সত্য। মৃত্তিকার দৃষ্টি ইমতিয়াজের দিকে আর ইমতিয়াজ চেয়ে আছে ফ্লোরে অযত্নে পড়ে থাকা কার্পেটের দিকে।

“যদি বলি বাবা না উনি, মিথ্যা বলছে।”

শাফিনের কথায় মাথা নাড়লো ইমতিয়াজ। বলল,
“মামা, জানাজানি হলে উনার অবস্থাও খালামনির মতোই হবে।”

মমতাজ বেগম ঘাবড়ে গেলেন। রিপা বেগমের ঘাড় আর হাত-পায়ের অবস্থা উনি দেখেছিলেন। মমতাজ বেগম ইমতিয়াজের হাত ধরে বলল,
“কি করবো, বাবা?”

মমতাজ উনাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,
“মা, শান্ত হন। আমাদের খুঁজতে হবে, সময় লাগবে। হয়তো এতোটা পারফেক্ট ছেলে পাওয়া যাবে না, তবে অসম্ভব নয় আশা করি। যে বিয়ে করবে, তাকে সবটা বলতেই হবে।”

লুৎফর রহমান সম্মতি জানালেন,
“আমিও ইমতিয়াজের সাথে একমত। সময় লাগবে, তাড়াহুড়ো করা যাবে না।”
“তবে তাই হোক। মৃত্তিকা কি বলো?”

শাফিন সাহেবের প্রশ্নে মৃত্তিকা মাথা হেলিয়ে সম্মতি দিলো। তারপর বলল,
“আমি জব করতে চাচ্ছিলাম।”
“কিছুদিন আপনার বাইরে না যাওয়াই ভালো হবে।”

কেউ কিছু বলার আগেই মাঝ থেকে কথাটা বলে ফেলে ইমতিয়াজ। সবাই ওর দিকে তাকালে বলে,
“ভুল বললাম?”
“না, ঠিকই বলেছো।”

অত:পর সবাই যার‍ যার রুমে যায়। তানজিম এতোক্ষণে হাফ ছেড়ে বাঁচে। বড়দের মাঝে সকলের ওর দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছিল যেন সে কয়েকদিন আগেই কথা বলতে শিখেছে, এখন কেবল মাম্মা, পাপা বলে।

ইমতিয়াজ তানজিমের রুমে গেছে। মৃত্তিকা এসে ইমতিয়াজের আইডি কার্ড দেখে। অফিসে বেশ বড় পদে চাকরি করছে সে, পরিচালন অধিকর্তার নির্বাহী সহকারী। কোথায় সেই অফিস সেটাও দেখে নেয় সে।

টা°ন দিয়ে কার্ডটা নিয়ে নেয় ইমতিয়াজ। মৃত্তিকা একটু চমকে উঠে।

“এসব ভালো নয়, মৃত্তিকা।”

“সরি। (একটু থেমে) আমাকে মিউকো কেন ডাকেন না?”
“মিউকো যে আমার বিড়াল।”

মৃত্তিকা ইমতিয়াজের চেহারার দিকে তাকায়। সে শার্টের হাতা গুটাতে ব্যস্ত। মৃত্তিকার সেই স্বপ্নের জবাব। মৃত্তিকার আগ্রহ বাড়লো।

“আর আমি?”

মৃত্তিকার মিষ্টি প্রশ্নে ইমতিয়াজ কপাল কুঁচকে বলে,
“কি আপনি?”
“কিছু না।”

প্রশ্নটা ভে°ঙে করতে পারলো না মৃত্তিকা। আবারো সেই অনুভূতিরা জাগ্রত হচ্ছে। ইমতিয়াজ মমতাজ বেগমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল। মৃত্তিকার দিকে একবারের জন্যও তাকালো না। অথচ মৃত্তিকা বারবার ওর দৃষ্টির অপেক্ষায় চেয়ে থাকলো।
______________________________________

পরিবারের সবার সাথে রাতের খাবার শেষে ঘরে এসেছে সারাহ্-আহনাফ। এতোদিন পর পরিবারকে কাছে পেয়ে অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করছে সারাহ্-র। তবে উলটো অনুভূতি হলো তাহসিনাকে দেখবে।

আহনাফ বিছানায় শুয়ে পড়েছে। সারাহ্ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ে নিচ্ছে। আহনাফ একবার ওকে দেখে আবারো চোখ বন্ধ করে। বাসায় আসার পর শাড়ি পড়েছে সে৷ একটা অন্যরকম ভালো লাগা আছে সারাহ্-র আশেপাশে।

“ফয়েজ স্যার?”

সারাহ্-র হঠাৎ ডাকে চমকে উঠে আহনাফ৷ চোখ কুঁচকে বলে,
“কি সমস্যা?”
“কোথায় সমস্যা? আমি তো বললাম ফয়েজ স্যার। আপনাকে ডাকছি।”

আহনাফ উঠে বসে,
“ফয়েজ স্যার কেন? নাম ধরে ডাকবে না।”

সারাহ্ ওর দিকে ফিরে ব্য°ঙ্গসুরে বলে,
“কেন? আপনিও কি ওইসব বিশ্বাস করেন যে স্বামীর নাম ধরে ডাকলে অ°মঙ্গল হয়।”

আহনাফ হাসলো। উঠে বালিশ ঝে°ড়ে আবারো শুয়ে পড়ে। সারাহ্ জবাব না পেয়ে বলল,
“বলেন কি ডাকতে আপনাকে? আহনাফ নাকি ফয়েজ স্যার?”
“এগুলো ছাড়া অন্যকিছু।”

সারাহ্ লাইট নিভিয়ে দিয়ে বিছানায় চলে আসে। শুতে শুতে বলে,
“জান, কলিজা, কিডনি ডাকি?”
“কি?”

আহনাফের ধ°ম°ক শুনে সারাহ্ হেসে অন্যদিকে ফিরে যায়। আহনাফ ওর কোমড়ে হাত দিতেই চমকে উঠে। সারাহ্-কে কাছে এনে ওর পিঠে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজে আহনাফ। এদিকে সারাহ্ ভ°য় পাচ্ছে, এবারে সে একে আর ভ°য় বলে সম্মোধন করলো না। এ লজ্জা, ও লজ্জা পায় আহনাফের স্পর্শ।

আহনাফের হাতের উপর হাত রাখতেই আহনাফ বলল,
“হুশ, ঘুমাও।”
“আহনাফ?”

সারাহ্ ঘাড়ের কাছে ঠোঁটের স্পর্শ পেল। হঠাৎ করে উঠে গিয়ে লাইট জ্বা°লালো। আহনাফ অন্যদিকে ফিরে গেছে। সারাহ্ লাইফ নিভিয়ে আবারো এসে শুয়ে পড়লো।

সারাহ্ বলল,
“আপনার সাথে থেকে থেকে আমিও অস্বাভাবিক আচরণ করছি।”

আহনাফ শব্দ করে হেসে ওর কানের কাছে মুখ এনে বলল,
“তুমি যে আগে থেকেই পাগল সেটা জানতে না বুঝি?”
“আমি মোটেও পাগল না।”
“পাগল না, ভুল বলেছি। তুমি আস্ত ছাগল, মাঠে ঘুরেফিরে যে ঘাস খায় ওই ছাগল।”
“খারাপ হবে বলছি, আহনাফ।”
“নাম ধরে ডাকলে তোমার খারাপ হবে।”
“একশবার ডাকবো। আহনাফ, আহনাফ, আহনাফ।”

বারবার “আহনাফ” বলে ডাকতে থাকে সারাহ্ আর সাথে থাকে দুষ্টুমির হাসি।

আহনাফ ওকে কাছে এনে গলায় আবারো চুম্বন করে। এবারে আর সেদিনের কাঠিন্য নেই, যেন কিছু স্নেহ আর অল্প ভালোবাসা মিলেমিশে আছে। আহনাফের চুলগুলোতে হাত রাখে সারাহ্। মেয়েটা যে বড্ড লাজুক, চোখ মেলাতে পারবে তো পরে?
______________________________________

ফজরের নামাজ পড়ে মসজিদেই বসে আছে ইমতিয়াজ। একটা সিদ্ধান্তহীনতা তাকে অসম্ভব পোড়াচ্ছে। শুক্রবার সকাল হওয়ায় আজকে মসজিদে মানুষ কম। যা কয়েকজন ছিল তারাও নামাজ পড়ে চলে গেছে।

ইমতিয়াজ মোনাজাতে ব্যস্ত। নিজের মনের অবস্থা রব ছাড়া আর কাকে বোঝাবে সে। শ°য়°তা°নের প্র°রো°চনা থেকে বাঁচতে হলে তো রবের দিকেই আসতে হয়।

জীবনের এমন এক মুহূর্তে এসে পৌঁছেছে যে না সে একা থাকতে পারছে আর না সে তাহমিনাকে ছাড়া কোনো সঙ্গী কল্পনা করতে পারছে। লোকে তো হাসবে যে স্ত্রীর মৃত্যুর দুইবছর পেরিয়ে গেলেই এখনো সে কেন একা? কিসের খাতিরে?

সাময়িকের জন্য মৃত্তিকাকে ভালো লাগলেও সে এটাকে শ°য়°তা°নের নিছক প্র°রো°চনা বা ন°ফ°সের বি°কৃ°ত চিন্তা মনে করছে। মাথায় ঘুরতে থাকা এসব কথা প্রাণ খুলে রবের দরবারে পেশ করে সে।

এদিকে মৃত্তিকার চিন্তায় মিশে গেছে ইমতিয়াজ। নিজের লজ্জা ভুলে সকলকে সেটা জানাতে চেয়েও জানাতে পারছে না। ইমতিয়াজ তাকে ভালো রাখবে, হয়তো ভালোও বাসবে। এই বিশ্বাস নিয়ে কাকে বলবে সে মনের ভালো লাগার কথা, নিজের স্বপ্নের পুরুষের কথা কাকে শোনাবে সে?

মসজিদ থেকে বেরিয়ে বাসার দিকে যাচ্ছে ইমতিয়াজ। আকাশে আলো ফুটে উঠছে। ফোন বেজে উঠে। পকেট থেকে বের করে মৃত্তিকার নাম্বার দেখে কপাল কুঁচকায়।

কোনো বি°পদের আশঙ্কায় দ্রুত রিসিভ করে,
“জ্বী, মৃত্তিকা।”

মৃত্তিকা কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলে,
“একটা সাহায্য করতে পারবেন?”
“কি?”
“মামাকে জানাবেন আমি কাউকে পছন্দ করি, আমি তাকেই বিয়ে করতে চাই।”

ইমতিয়াজ হাঁটা থামিয়ে দেয়। একমুহূর্তের জন্য ওর মনে হলো মৃত্তিকা ওর কথাই বলছে৷

তবুও দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“উনারা এসবকে খুব স্বাভাবিক মনে করে। আপনি সরাসরি বলুন, না হলে তানজিমকে বলুন।”
“তানজিম আমার ছোট, ওকে কিভাবে?”
“তবে আমি কেন বলবো?”
“কারণ আপনি জানেন সে কে?”

ইমতিয়াজ চুপ থাকে। সে কি আদৌতে জানে। বেশ কিছুক্ষণ নিরব থেকে ইমতিয়াজ বলল,
“আপনি যা বলছেন তা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সরি।”

ইমতিয়াজ কল কে°টে দিলো। রাগটা বাড়তে থাকে। কার উপর রাগ হচ্ছে? নিজের উপর নাকি মৃত্তিকার উপর?
______________________________________

সকাল সাতটায় কাকরাইল গো°র°স্থানে আসে আহনাফ ও সারাহ্। সারাহ্ জানে ওরা তাহসিনার সাথে দেখা করতে এসেছে। গো°র°স্থানে প্রবেশের সময় সারাহ্ আশেপাশে তাকায়। তাহসিনা জীবিত নাকি মৃ°ত এ নিয়ে বি°ভ্রা°ন্তিতে পড়ে সে।

আহনাফ ওর হাত ধরে একটা কবরের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে বলে,
“এখানেই আছে আমার তাহসিনা।”

সারাহ্ চমকে উঠে। তাহসিনা নেই এই পৃথিবীতে, অথচ তার ভালোবাসা নিয়ে কেউ বেঁচে আসে।

সারাহ্ আহনাফের দিকে তাকিয়ে দেখে সে মোনাজাত করছে। সারাহ্-ও সূরা ফাতিহা পাঠ করলো। “আমিন” বলার সময় ওর চোখ থেকে একফোঁটা পানি পড়ে। এ পানির কারণটা সে বুঝতে পারলো না।

আহনাফ বলে,
“বিয়ের দিন। পুরো রিসোর্ট সাজানো, গোছানো। সুন্দর করে লাইট লাগানো হয়েছে, ফুলের সুভাসে ভরে গেছে চারপাশ। নিজের পছন্দের সাদা শাড়ি পড়েছিল সে, জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সাজে সজ্জিত হয়েছিল। (একটু থামে) কিন্তু সে সাজ নিয়ে আমার সামনে যখন এসেছিল, তখন তার নিশ্বাস বন্ধ। চোখ বুজেছিল সে।”

আহনাফের কন্ঠ কেঁপে উঠলো। সারাহ্ ওর দিকে একবার তাকায়, তারপর আবারো তাকায় কবরের দিকে।

“ওর সেই শাড়িটা লাল হয়ে গিয়েছিল। সেই বৃষ্টি ভেজা ভার্সিটির দিনগুলো। ওকে নিয়ে পাহাড়ে যাওয়ার দিনগুলো এখন শুধুই আমার স্মৃতি।”

আহনাফ থামে। সারাহ্ এখনো স্ত°ব্ধ হয়ে আছে। বিয়ের দিন প্রেমিকার মৃ°ত্যু যে এই মানুষটা সহ্য করেছে এই অনেক।

“জন্ম, মৃ°ত্যু আর বিয়ে তো আমাদের হাতে নেই। তাইতো সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় সে চলে গেল আর তুমি এলে। হয়তো আমিও চলে যাবো আর তুমি থাকবে।”

আহনাফ বেরিয়ে যায়। সারাহ্ তাকিয়ে থাকে সমান হয়ে থাকা কবরের মাটির দিকে। এই কবর কাউকে ছাড়বে না। যেদিন আল্লাহ্-র হুকুম হবে, সেদিনটা যত গুরুত্বপূর্ণই হোক না কেন যেতে আমাদের হবেই। স্বয়ং আল্লাহ্ ছাড়া নিয়তি কেউ খ°ন্ডা°তে পারবে না।

সারাহ্ বেরিয়ে আসে। আহনাফ আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। সারাহ্ ওর হাত ধরে।

“দুই দুইটা বছর পেরিয়ে গেছে। অথচ আমার মনে হয় সেদিনও তাকে পাশে পেয়েছিলাম।”

আহনাফের চোখ বেয়ে পানি পড়তে নিলে সারাহ্ মুছে দিলো। আহনাফ ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমার জীবনটা এভাবে ধ্বং°স করার অধিকার আমার নেই, তবুও করেছি।”

সারাহ্ ওর চোখের পানি মুছে দেয়।

“আপনিই তো বলেছেন এই বিয়ে আল্লাহ্-র ইচ্ছায় হয়েছে, তবে এটা ধ্বং°স কেন হবে? হয়তো এটা পরীক্ষা, আমার ধৈর্যের পরীক্ষা।”

কথাগুলো সারাহ্-র মনেই থাকে। আহনাফকে বলে না সে। আহনাফ কিভাবে নিবে বা কি ভাববে?

আহনাফ চুপ করে সারাহ্-র মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। অন্য কেউ হলে প্রতিক্রিয়া কি হতো আহনাফ জানে না তবে সারাহ্ নিরবতাকে বরণ করেছে।

বাসায় ফিরে আসা অব্ধি কোনো কথা বলেনি সারাহ্। আহনাফও কোনো প্রশ্ন করেনি। সারাহ্ নিরব আছে, চুপচাপ, শান্ত।

বাসায় এসে হিজাব খুলছে সারাহ্। আহনাফ পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
“ঐশী, তোমার প্রশ্নের উত্তরগুলো পেয়েছো? কেন তাহসিনাকে ভালোবেসেও তোমাকে বিয়ে করেছি?”
“হুম।”

ওর ছোট জবাবটা আহনাফের ঠিক পছন্দ হলো না। আবারো সুধালো,
“আর কোনো প্রশ্ন আছে?”
“না।”

সারাহ্ চলে গেল। আহনাফ ওর হাত ধরে বলে,
“খারাপ লাগছে তোমার আমি জানি। কিন্তু সত্যটা তো জানানোর প্রয়োজনও ছিল।”

সারাহ্ মুচকি হেসে ওর দিকে এগিয়ে এসে বলল,
“আমি অন্য কারণে নিরব।”
“কি?”
আহনাফ কপাল কুঁচকায়।

সারাহ্ সরে যেতে নিয়েও সরতে পারে না। আহনাফ ওর হাত এখনো ধরে রেখেছে। সারাহ্ প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালে আহনাফ বলে,
“কারণ কি?”

সারাহ্ হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
“তাহসিনা আপুর মতো করে আমি আপনাকে বুঝতে পারবো না, তবে যতটুকু বুঝতে পেরেছি তাতে..”

সারাহ্ থেমে যেতেই আহনাফ চোখ ছোট করে। সারাহ্ মুচকি হেসে চলে যায়। আহনাফ তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। গতরাতের স্পর্শগুলো সজ্ঞানে করেছে আহনাফ, রাগ কিংবা প্রতি°হিং°সা থেকে নয়।

আহনাফ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় ওর দিকে। পাশাপাশি থাকা দুজন নর-নারীর মনে পবিত্র ভালোবাসা সৃষ্টি করুক মহান সৃষ্টিকর্তা। হালাল সম্পর্কগুলো যে একটু বেশিই সুন্দর।

চলবে….

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

পঞ্চদশ পর্ব

দুপুরের খাওয়াদাওয়া হয়েছে বহু আগে। সারাহ্ সামিহাকে সাথে নিয়ে খাবারের এলাহি আয়োজনের এঁ°টো বাসন পরিষ্কার করলো। এক জামাই আর এক মেয়ের জন্য এতো আয়োজন করেছে যেন আজকে আবারো মেয়ের বিয়ে৷

নার্গিস পারভিন এসে ওদেরকে তাড়া দিয়ে বললেন,
“একটু জলদি কর মায়েরা।”

সারাহ্ একটু বি°র°ক্তি নিয়েই বলে,
“আম্মু, এতো আয়োজন করা ঠিক হয়নি।”
“কেন ঠিক হয়নি?”
“অবশিষ্ট খাবারগুলো কি করবে? শুধু শুধু ওয়েস্ট হবে।”

সামিহা পাশ থেকে বলল,
“প্লেটে জমা খাবারগুলো কুকুরকে খাওয়াবো আর বাকিগুলো ফ্রিজে রেখে আমি মাঝরাতে খাবো।”

সারাহ্ চোখ কুঁচকে বলে,
“ওগুলো কুকুরকে না দিয়ে তুই খেয়ে ফেল। মাঝরাতে কেউ এসব খায়? পাগল কোথাকার?”
“তুমি মস্ত বড় ছাগল।”

নার্গিস পারভিন মেয়েদের ঝগড়ায় বি°র°ক্ত হয়ে নিজকক্ষে চলে গেলেন।

সারাহ্ মুচকি হাসলো। প্লেটগুলো গুছিয়ে রেখে দ্রুত প্রস্থান করলো। সামিহা ভ্রূ উঁচিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে অদ্ভুত একটা চেহারা করে বলে,
“কি এমন বললাম যে হাসতে হবে? ছাগল বললে কেউ হাসে?”

সারাহ্ রুমে গিয়ে আহনাফকে তৈরি হতে দেখে বলে,
“কোথাও যাবেন নাকি?”
“হুম।”
“কোথায়?”
“নিউমার্কেট। (একটু থেমে) তোমার কিছু লাগবে?”

সারাহ্ এসে ওর সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
“সবাই আমাকে ছাগল বলে কেন?”

আহনাফ দাঁত বের করে হেসে বলে,
“নি°র্ঘা°ত কোথাও ঘাস খাচ্ছিলে আর অনেকে দেখেছে।”

সারাহ্-র কপাল কুঁচকে গেল। আহনাফ একটু হেসে মুখটাকে আবার গম্ভীর করে বলে,
“ঐশী, তাহসিনার কথা শোনার পর এটা নিয়ে আর কিছুই তো বললে না। বরং অদ্ভুত একটা আচরণ শুরু করেছো।”

সারাহ্ একটু চমকায়। আহনাফ তার আচরণ খেয়াল করছে। সে শুনতে চাচ্ছে তাহসিনাকে নিয়ে সারাহ্ কি ভাবে।

“আর তো কিছু বলার নেই। যা জানার ছিল, জেনে গেছি। ব্যস।”
কথাটা বলে সারাহ্ বিছানায় গিয়ে বসে।

আহনাফ ঠিকঠাক মতো তৈরি হয়ে গলার কাছটায় পারফিউম দিয়ে সারাহ্-র কাছে এসে ওর গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বেরিয়ে গেল। হঠাৎ এমনটা কথায় একটু চমকে উঠে সারাহ্। গালে হাত দিয়ে মাথানিচু করে সে। গতকাল থেকে আহনাফ এমনভাবে আচরণ করছে যেন ওরা শুরু থেকেই একে অপরকে ভালোবাসে।

সামিহা ডাইনিং এ কাজ করছে। আহনাফকে বেরিয়ে যেতে দেখে বলে,
“ভাইয়া কোথাও যাচ্ছেন?”
“হ্যাঁ, একটু কাজ আছে। সন্ধ্যার আগে চলে আসবো।”
“আচ্ছা।”

আহনাফ বেরিয়ে গেল। সামিহা রুমে এসে তানজিমকে কল করে।

“হ্যালো, তানজিম। আমি খুব রেগে আছি।”

তানজিম অবাক হয়।
“কেন রে?”
“তুই আমাকে ভুলে গেছিস। তোর ওই বড় আপু, কি যেন নাম, (একটু ভেবে) ওই মিউকো আসার পর তুই আমাকে ভুলে গেছিস।”

তানজিম শব্দ করে হেসে বলল,
“এখন তোকে মনে করার জন্য আমার কি করতে হবে তাই বল।”
“আজকে আমাকে নিয়ে ঘুরতে যেতে হবে।”

তানজিম পাশে বসা মৃত্তিকার দিকে একবার তাকায়। তারপর বলে,
“আমি এখন মিউকোপুর সাথে একটু বাইরে যাচ্ছি। কাল তোকে নিয়ে..”

তানজিমের কথার মাঝেই সামিহা ধ°ম°ক দিয়ে উঠে,
“দেখেছিস তুই আমাকে ভুলে গেছিস। এখন তো আমি কেউ না, মিউকোপু সব। থাক তুই।”
“তুই হিং°সা করি না সামি।”

সামিহা ভেঙচি কে°টে ফোন রেখে গাল ফুলিয়ে বসে থাকে। কান্না পাচ্ছে তার, কিন্তু ও কাঁদছে দেখলে সারাহ্ একশো চারটা প্রশ্ন করবে।

তানজিম ফোন হাতে নিয়ে মৃত্তিকাকে বলে,
“আপু, তোমার আজকে বাইরে যাওয়াটা কি খুব ইম্পোর্টেন্ট?”

মৃত্তিকা কপাল কুঁচকে বলে,
“কেন? যেতে পারবে না?”
“আসলে সামিহা ঘুরতে যেতে চাইছে।”

মৃত্তিকা মুচকি হেসে বলে,
“যাও তবে। আমি একা একা চলে যাবো। একটু শপিং করতাম আরকি, এইতো ফরচুনে যাবো।”
“কি কিনবে?”
“ট্রলি কিনতাম আর টুকটাক কিছু৷ কাল তো মামার বাসায় চলে যাবো, বড় ট্রলিটা নিতে চাচ্ছি না।”

তানজিম মাথানেড়ে বলে,
“বসুন্ধরায় যাবা?”

মৃত্তিকা একটু ভেবে বলল,
“ওকে, যাওয়া যায়।”
“তবে সামিহাকে ওখানে আসতে বলি। ঘুরাঘুরি আর শপিং সব হবে।”

তানজিম মৃত্তিকার অনুমতির অপেক্ষা না করে কল দিতে নিলে মৃত্তিকা বলল,
“বাজেট কম আমার, দেখিও সামিহা আবার এটাওটা চাইলে কিন্তু কিনা যাবে না।”

তানজিম হেসে বলল,
“ও এমন না, সমস্যা নেই।”
______________________________________

বিকাল সাড়ে চারটা, সামিহা আর সারাহ্ বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সে চলে এসেছে। তানজিম এসে সারাহ্-কে দেখে সামিহাকে বলে,
“এটা কে?”
“আপু।”

সারাহ্ চোখ সরু করে ওদের দিকে তাকায়। তানজিম দাঁত কেলিয়ে বলে,
“আসসালামু আলাইকুম আপু, কেমন আছেন? আপনার হাসবেন্ড কেমন আছে?”

তানজিমের আচরণ আর তাড়াহুড়ায় সারাহ্-র মনে হলো সে একটা মানসিক রোগী। তবুও ভদ্রতা দেখিয়ে বলল,
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। ভালো আছি।”
“সামিহা চল।”

বলেই তানজিম হাঁটতে শুরু করে। সারাহ্ পিছুপিছু যায়। একটু দূরে গিয়ে মৃত্তিকার সাথে একত্র হলো ওরা। মৃত্তিকা কুশল বিনিময় করে। অল্প সময়ের মধ্যেই মৃত্তিকা আর সারাহ্-র গল্প জমে উঠে।

মৃত্তিকা ট্রলি ব্যাগ দেখছে। সারাহ্ আশেপাশে তাকিয়ে সামিহা কিংবা তানজিমকে না দেখে বলে,
“দুজন কোথায়?”

মৃত্তিকা মৃদু হেসে বলে,
“দুজনে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করছে।”
“কি?”

সারাহ্ চোখ কুঁচকালে, মৃত্তিকা হেসে অন্যদিকে যায়। সারাহ্ শপ থেকে বেরিয়ে হাঁটতে থাকে। একটা দোকানে সামিহাকে দেখে ওর দিয়ে এগিয়ে যায়।

মৃত্তিকার পাশে এসে দাঁড়ায় ইমতিয়াজ।
“সকালে কি বলেছিলেন?”

মৃত্তিকা চমকে উঠে পাশে তাকায়। বলে,
“কি?”
“কি বলছিলেন? কাকে পছন্দ?”

মৃত্তিকা মাথানিচু করে সরে যায়। ব্যাগ দেখতে থাকে নিরবে। ইমতিয়াজ একটা ব্যাগ হাতে দিয়ে বলে,
“এটা কিনুন।”

মৃত্তিকা আড়চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
“ফলো করছেন আমাকে?”
“আমি না অন্যকেউ।”
“কে?”

বাবা ছাড়া আর কেউ মৃত্তিকাকে ফলো করে বলে ওর জানা নেই। আশেপাশে তাকাতে নিলে বাধা দেয় ইমতিয়াজ।

“বারবার তাকালে সন্দেহ করবে।”
“কে আছে?”

ইমতিয়াজ ফোন বের করে কিছুক্ষণ আগে ওর তোলা ছবিটা দেখায়। মৃত্তিকার পাশ থেকে যখন সারাহ্ সরে গেল, তখন ওর বাবা ওর কাছে আসতে নিয়েছিল।

মৃত্তিকা ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলল,
“পাবলিক প্লেসে উনি কখনোই আমার সাথে কথা বলেন না।”
“তাই তো পাশে আছি।”

মৃত্তিকা সামনের আয়নার দিকে তাকায়। ইমতিয়াজের প্রতিচ্ছবিটি দেখে বলে,
“এভাবেই সারাজীবন থেকে যান না কেন?”

এতোটাই মৃদুস্বরে কথাটা বলেছে যে ইমতিয়াজ শুনেনি। সারাহ্, তানজিম আর সামিহাকে এদিকে আসতে দেখে ইমতিয়াজ নিরবে সরে যায়। মৃত্তিকা ওর চলন দেখে। ইমতিয়াজ ওকে চায়, হয়তো ওর চেয়েও বেশি করে চায়। কিন্তু তা প্রকাশিত নয়।
______________________________________

এক মাস পর,

আজ মৃত্তিকাকে পাত্রপক্ষ থেকে দেখতে আসবে। উত্তরা মামার বাসায় চলে এসেছে প্রায় ২৫ দিন আগে। মামার অফিসের কোনো এক ব্যক্তির ছেলেই পাত্র। মৃত্তিকা ছেলের ছবি দেখেছে, নাম কলরব।

সন্ধ্যা সাতটায় এসেছে ওরা। মৃত্তিকাকে মোটামুটি একটা সাজ দিয়েছে ওর মামাতো বোন সুরভি। মৃত্তিকা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে নিলো।

“আপু।”
আলতো কন্ঠে সুরভিকে ডাকলো মৃত্তিকা।

“জি, বলো।”

মৃত্তিকা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
“বাবা মায়ের বিষয়ে কি বলেছে?”
“দুজনকেই মৃ°ত বলেছে।”

মৃত্তিকার ভিতরটা মো°চ°ড় দিয়ে উঠলো। সুরভি সোজা কথার মানুষ। যা বলছে ঠা°স ঠা°স করে বলবে। অর্ধেক কথা পেটে আর বাকিটা মুখে রাখবে না। পুরোটাই এক চো°টে বলে দেয়।

মৃত্তিকা আর কিছু বলল না। ওর বাবা জেনে ঠিক কি কি করবে তা ও বুঝতে পারছে না।

পাত্রের সামনে নেয়া হলো। কলরব বেশ সুদর্শন যুবক, প্রথম দেখায় যে কারো পছন্দ হতে বাধ্য৷ বয়সটা প্রায় মৃত্তিকার সমানই হবে। কলরবের সাথে ওর মা, বাবা, ছোট বোন এসেছে

মৃত্তিকাকে দেখে মুচকি হাসলো ওরা। বড়দের কথাবার্তা চলল অনেকক্ষণ।
______________________________________

কয়েকদিন ধরেই আহনাফ কলেজের কোনো একটা বিষয় নিয়ে কাজ করছে, বিজ্ঞান মেলার কোনো এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রতিদিন সন্ধ্যায় অনলাইনে ছাত্রছাত্রীদের সাথে একটা সেশন করে। আজও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না।

স্মার্ট বোর্ডে ক্লাস নিচ্ছে সে। পেইজ পরিবর্তন করে নতুন পেইজ যেতেই দেখে কালো পেইজে লাল, সাদা, নীলে একটা ইংরেজি বাক্য লেখা,
“My handsome Physics sir, Ahnaf Foyez, I’m waiting for your call.”

আহনাফ বাক্যটি দেখে দ্রুত বোর্ড পরিষ্কার করে। এ যে সারাহ্-র কাজ তা সে ভালোই বুঝেছে। দিনদিন মেয়েটার সাহস বাড়ছে। আহনাফকে ভয় পায় না। লজ্জায় নু°ই°য়ে গেলেও ভ°য় তাকে কাবু করে না।

আহনাফ ক্যামেরা থেকে দূরে সরে যায়। সারাহ্ এখানে নেই, হয়তো ড্রইংরুমে টিভি দেখছে। ছাত্রছাত্রীরা সবাই মোটামুটি স্যারকে ডাকাডাকি শুরু করেছে। অনেকে হয়তো স্ক্রিনশট নিয়ে নিয়েছে আর কাল সেটা নিয়ে কলেজে আলোচনা চলবে।

আহনাফ ড্রইংরুমে গিয়ে সারাহ্-কে বলে,
“ক্লাস শেষে তোমার হচ্ছে সারাহ্। ফাজলামো বেশি শুরু করেছো।”
“আমি আবার কি করলাম?”
সারাহ্ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে।

“বোর্ডে ওসব কে লিখেছে?”
ভ্রূ উঁচিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে আহনাফ।

সারাহ্ মুচকি হেসে বলে,
“পরশু লিখেছিলাম, কারণ আপনি আমাকে নিজে থেকে কল করেন না। (একটু থেমে) মাত্র আজকে এটা দেখেছেন?”

আহনাফ দাঁত কি°ড়°মি°ড়িয়ে বলে,
“বাড়াবাড়ি করেছো।”
______________________________________

কলরবের পরিবার মৃত্তিকাকে পছন্দ করেছে। না করার কোনো কারণ নেই। মেয়ে ভালো, শিক্ষিত, সুশীল। ছেলে লন্ডনে পড়াশুনা করেছে, মেয়ে ইতালিতে। ভালো মানাবে ওদের৷ আংটি পড়িয়ে গেল ওরা। প্রায় ১৫ দিন পর বিয়ের তারিখ নির্ধারিত হয়ে গেছে।

মৃত্তিকা বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। রাতের আকাশের কয়েকগুচ্ছ তারার পানে তাকিয়ে আছে সে। চাঁদ যে নেই, মেঘের আড়ালে লুকিয়ে গিয়ে ওর সাথে লুকোচুরি খেলছে৷ ইমতিয়াজের সাথে দেখা হয়নি গত একমাস, ফোনেও কথা হয়নি।

একটা বে°সু°রো বী°ণা বাজতে লাগলো ওর মনে। দীর্ঘশ্বাসগুলো হতে লাগলো সেই সুর। নয়নের অশ্রুধারা বে°ই°মা°নি করলো, গড়িয়ে পড়লো না আজ। হৃদয়ে বাজতে থাকা লাবডাবের মাঝে একটা নাম উচ্চারিত হলো,
“ইমতিয়াজ।”

চলবে….

অনুভূতিরা শব্দহীন পর্ব-১০+১১+১২

0

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

দশম পর্ব

ফজরের নামাজের পর গো°র°স্থানে এসেছে ইমতিয়াজ। ভোরের আলো পুরোপুরি ফুটেনি। গো°র°স্থান জুড়ে নিরবতা। এতো এতো মানুষ এখানে আছে অথচ ইমতিয়াজ ছাড়া আর কেউ নিশ্বাস নিচ্ছে না, কথা বলছে না।

তাহমিনার কবরের পাশে নিরবে বসে আছে সে। মনে তার একটাই কথা,
“আমাকে ক্ষমা করো মিনা, এ মনে তুমি ছাড়া আর কাউকে স্থান দেয়া ভুল। অপরাধ আমার। ক্ষমা করো তোমার সৌরভকে।”

কবরের মাটির উপর হাত বুলায়। চোখের জল গাল বেয়ে গড়িয়ে মাটিতে পড়ে। ইমতিয়াজ চোখ মুছে না।

“কার কবর?”

নিরবতা ছি°ন্ন করে কারো কন্ঠ কানে আসলে ইমতিয়াজ চমকে উঠলো। চোখ মুছে নাক টেনে পাশে তাকিয়ে দেখে একজন মধ্যবয়স্ক নারী দাঁড়িয়ে আছে।

ইমতিয়াজ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমার স্ত্রীর।”

মহিলাটি একটু হাসলেন। কয়েকটা কবর পড়ে গিয়ে একটা কবরের পাশে গিয়ে বললেন,
“এটা আমার মেয়ের কবর। একদিন সকালে উঠে দেখি আমার মেয়ে নেই। রাতে ঘুমের মধ্যেই চিরকালের ঘুমে চলে গেছে সে।”

ইমতিয়াজ চেয়ে রইলো মহিলাটির দিকে। একফোঁটা পানি নেই মহিলাটির চোখে, কেমন যেন শান্ত শীতল দৃষ্টি। মহিলাটি আবার বলল,
“পাশেরটা আমার ছেলে আর তার পাশেরটা আমার স্বামীর কবর। ওইযে বেলী গাছটা দেখছেন, আমি লাগিয়েছিলাম।”

মহিলাটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আমার সাহেব অসাধারণ মানুষ ছিলেন। খুব ভালোবাসতেন। জানো আমার ছেলে মেয়েরা বেঁচে থাকলে তোমার মতোই হতো।”

ইমতিয়াজ চেয়ে রইলো অপলক। এ মহিলা জীবনে কত কষ্ট পেয়েছে। কষ্ট জমে জমে শক্ত পাথর হয়ে গেছে। এই শক্ত মানুষটাকে এখন সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কোনো সৃষ্টির পক্ষে ভা°ঙা সম্ভব নয়।
______________________________________

সকাল সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। নাস্তা সেরে এসে দ্রুত তৈরি হচ্ছে আহনাফ। সারাহ্ রুমে আসলে আহনাফ বলল,
“কলেজে যাবে?”

সারাহ্ ওড়না আটকাতে আটকাতে বলল,
“জব ছেড়ে দিতে বলছেন?”

আহনাফ হাসলো।
“না, সেসব বলছি না। যাবে কিনা জিজ্ঞাসা করছি।”
“হুম।”

আহনাফ আয়নার সামনে থেকে সরে ওকে জায়গা দিলো। সারাহ্ হিজাবটা বাঁধতে বাঁধতে আয়নায় আহনাফকে দেখছে।

কাল সন্ধ্যা থেকে হঠাৎ করেই তার আচরণ বদলে গেল। প্রথমদিনের সেই রূ°ঢ় ভাষা আর অগোছালো আচরণটা নেই। যেন সে নিজের সৌন্দর্য বজায় রাখছে।

“একটা কথা বলি?”

সারাহ্-র কথায় আহনাফ ব্যাগ গুছাতে গুছাতে বলল,
“বলো।”
“সেদিন ওই ছাত্রীকে তো কিছু বললেন না, প্রেম প্রস্তাব দিলো কোনো প্র°তি°বাদ করলেন না। অথচ আমার সাথে..”

আহনাফ ওর দিকে এগিয়ে আসতেই থেমে গেল। আহনাফ বলল,
“হুম, তারপর?”
“ওই..”

সারাহ্ থেমে যায়। সারাহ্ নিজের গলায় হাত দিতেই আহনাফ হেসে ড্রেসিংটেবিল উপর থেকে ফোনটা নিয়ে সরে এসে বলল,
“মেয়েটা ছোট মানুষ, আবেগের বয়সে ঘুরছে, চোখে লাল চশমা। জীবন নিয়ে ধারণা হয়নি তাই বলিনি কিছু।”

ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,
“তুমি তো যথেষ্ট এ°ডা°ল্ট প্লাস ম্যাচিউর। (একটু থেমে) জলদি এসো।”
“হুম।”
বলে সারাহ্ মাথাটা আলতো নাড়ালো।

আহনাফ বেরিয়ে যাওয়ার সময় আফরোজা বলে উঠে,
“বিয়ের একদিন পেরোতে না পেরোতেই কলেজে যাচ্ছিস, মেয়েটাকে নিয়ে একটু ঘুরতে তো যেতে পারিস।”

জুহাইব ওকে সমর্থন করে বলল,
“ঠিক তো আহনাফ, এসব ঠিক নয়।”

সারাহ্ বেরিয়ে আসলো, জাবেরের গাল টে°নে আদর করছে সে। আহনাফ সারাহ্কে বলল,
“ঐশী, বউয়ের হ্যাঁ তে হ্যাঁ বললে বউ কি খুব খুশি হয়?”

সারাহ্ মুখ টি°পে হাসলো। আহনাফ আবারো বলে,
“তবে ঐশীর কথায়ই আমি কলেজে যাচ্ছি, বউ বলে কথা।”

সারাহ্-র হাত ধরে আহনাফ বেরিয়ে এলো। সারাহ্ চেয়ে আছে ওর দিকে। অবলীলায় বউ বলে চলে আসলো। বাসার বাইরে এসে হাত ছেড়ে দিলো আহনাফ।

একটা অটোতে উঠলো ওরা। সারাহ্ আহনাফের ব্যাগটার দিকে ইশারা করে বলল,
“এটাতে কি আছে?”
“ল্যাপটপ আর প্রশ্ন। আজকে পরীক্ষার প্রশ্ন জমা দিতে হবে।”
“ওহ, সিনিয়র টিচারদের কত কি দিতে হয়?”

আহনাফ মুখ বাঁকিয়ে হাসলো। সিটে হেলান দিয়ে বলল,
“ভাবছি একটা গাড়ি কিনবো, শেয়ার নিবে?”
“মানে?”

আহনাফ বুঝিয়ে বলল
“দেখো ফিফটি ফিফটি ভাগ। আমি হাফ টাকা দিবো আর তুমি হাফ। ব্যস, দুজনেই চড়তে পারবো৷”

সারাহ্ মাথা নাড়িয়ে বলল,
“আইডিয়া ভালো, বাট এতো টাকা তো আমার এখন নেই।”
“ধীরে ধীরে দিও।”
“ওকে।”

দুজনে আর কোনো কথা বলল না। কলেজে পৌঁছে দুজনে দুই রাস্তায় চলে গেল। আহনাফ বারান্দায় দাঁড়িয়ে একবার তাকালো সারাহ্-র দিকে। সারাহ্ ততক্ষণে টিচার্স রুমে চলে গেছে।
______________________________________

“ভালোবাসবো তোকে।”

এমন একটা চিরকুট পেয়ে বি°র°ক্ত হয়ে আছে সামিহা। একটা দুইটা না পর পর চারটা। ওকে নিশানা করে কেউ ছুঁ°ড়ে মে°রে°ছে।

তানজিম এসে বসতেই তানজিমকে কাগজগুলো দেখালো সামিহা। তানজিম দেখে বলল,
“ছি, ছি, সামি। তোকে আমি ভালো ফ্রেন্ড ছাড়া আর কিছু ভাবি না।”

সামিহা এমনিতেই রেগে ছিল তানজিমের কথায় আরো রেগে বলে,
“থা°প°ড়াবো তোকে। এগুলো আমাকে কে যেন দিয়েছে।”

তানজিম হো হো করে হেসে উঠে। উঠে দাঁড়িয়ে চেঁ°চিয়ে চেঁ°চিয়ে বলে,
“আমাদের মিস সামিহাকে কেউ প্রেমপত্র দিয়েছে। তোরা কে দেখবি রে, দেখতে আয়।”

চার-পাঁচ জন ছেলে-মেয়ে ঠিকই আসলো। সামিহা মুখের উপর হাত দিয়ে তানজিমকে বলল,
“থাম তুই, তানজিম।”

সবাই একে একে এসে বেশ জোরে জোরে চিঠিগুলো পড়তে থাকে। সামিহা রেগে উঠে বেরিয়ে যায়। তানজিম ওকে ডেকে বলে,
“সামি, দাঁড়া।”

সামিহার পেছন পেছন তানজিমও বেরিয়ে এলো। সামিহা দৌড়ে চলে যেতে নিলে তানজিম ওর হাত টে°নে বলল,
“থাম না, হইছে অনেক। যে দিছে, দিছে। সামনে এসে বলার সাহস নেই তো এমনই করবে। ক্লাসে আয়।”

সামিহা আঙুল তুলে বলল,
“হাসবি আর আমাকে নিয়ে?”
“হাসবো না, সত্যি।”

সামিহা একটু সরে এসে বলে,
“কান ধরে তিন সত্যি বল।”

তানজিম ওর কথা মতো কান ধরে তিন সত্যি বলল। পাশ থেকে যাওয়া দুইজন জুনিয়র মেয়ে ওকে দেখে হেসে দিলো।

সামিহা ওদেরকে ধ°ম°কে বলল,
“ওই ফার্স্টিয়ার, মা°ই°র খাবি।”

মেয়েগুলো চলে যেতেই তানজিমের একহাত জড়িয়ে ধরে ক্লাসে গেল সামিহা। ভালোবাসি যে যতই বলুক, সামিহার ভরসার জায়গা তো এই একটাই।
______________________________________

এক সপ্তাহ পর,
গতকালই আফরোজা, জুহাইবের সাথে আব্বাস সাহেব বাংলাদেশে ছেড়েছেন। আজকে পুরো বাসা ফাঁকা লাগছে সারাহ্-র কাছে। কেমন যেন নি°স্ত°ব্ধ।

মাত্রই কলেজ থেকে বাসায় ফিরেছে, এসেই রান্নাঘরে গেল সারাহ্। খাবার গরম করতে দিয়ে ফ্রেশ হতে গেল। ফিরে এসেই অবাক, আহনাফ ইতোমধ্যে খাবারের টেবিল সাজিয়ে ফেলেছে।

সারাহ্-কে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল,
“খেতে বসো।”

সারাহ্ মাথা নেড়ে টেবিলে বসতে বসতে বলল,
“ম্যাডামরা সবাই বিয়ের ব্যাপারে জেনে গেছে।”

আহনাফের তেমন একটা হেলদুল হলো না। সে নিজের মতো খাবার নিতে নিতে বলল,
“না জানার কথা?”
“সেটা বলছি না, উনারা ভাবছেন (একটু থেমে) লাভ ম্যারেজ।”

আহনাফ মুখের খাবারটুকু গিলে বলল,
“ঐশী, জানো তো এখন ভাইবোন রাস্তায় হাতধরে হাঁটলেও মানুষ ভাবে ওরা প্রেম করছে। মামা অথবা চাচা, আই মিন কোনো মাহরামকে নিয়ে হাঁটলেও, যদি উনার বয়স একটু কম হয় তখনও ভাবে প্রেমিক যুগল। (একটু থেমে) সেখানে আমাদের নিয়ে এসব ভাবাটা অস্বাভাবিক নয়।”

সারাহ্ চুপ করে খেতে লাগলো। আহনাফের কথা যুক্তিযুক্ত। দেশের পরিস্থিতি এমন একটা জায়গায় চলে এসেছে যে এসব ভাবনা সহজেই মানুষের মনে বাসা বাঁধে।

খাওয়া শেষে দুজনে মিলে টেবিল গুছিয়ে ফেলে। তারপর আহনাফ চলে গেল পড়ার টেবিলে। অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার খাতা চেক করছে। সারাহ্ এখন একা একা অনুভব করছে।

কি করবে ভেবে না পেয়ে ড্রইংরুমে বসে ফোন হাতে নিয়ে ফেসবুকে স্ক্রল করতে থাকে। আহনাফ এসে কয়েকটা খাতা ওর সামনে দিয়ে বলে,
“নাম্বার গুণে আমাকে একটু হেল্প করো।”

সারাহ্ সোফায় আরাম করে বসে বলে,
“আমি কেন? আপনার খাতা, আপনি দেখেন। দায়িত্বটা আপনার। এতো কেয়ারলেস কেন?”

আহনাফ ওর দিয়ে ঝুঁ°কে সোফায় হাত দিয়ে বলল,
“যা বলেছি তাই করো। শুধু শুধু রাগাবে না আমাকে। আমার রাগ যে ভালো না তা তুমি জানো।”

সারাহ্ চোখ বড় বড় করে বলে,
“করবো না একবারও বলেছি নাকি? সরুন, গুণে দিচ্ছি।”

আহনাফ রুমে চলে আসলো। খাতা দেখতে বসে সারাহ্-র চেহারাটা মনে করে হাসতে থাকলো। মেয়েটা যে ওকে প্রচন্ড ভয় পায়।

হঠাৎ ওর মুখের হাসিটা উবে গেল। ওর রাগে তাহসিনা কি করতো। তাহসিনার হাসিতেই যে ওর রাগটা শেষ হয়ে যেত। তাহসিনা ওর গাল টেনে দিয়ে মুখটা হাসি হাসি করে দিতো। ওর যে অনুভূতি কেউ বুঝে না সেটা তাহসিনা বুঝতো।

আহনাফ কলম ছুঁ°ড়ে ফেলে চেঁ°চিয়ে উঠে,
“তাহসিনা।”

সারাহ্ চমকে উঠে। মাত্রই সে একটা অচেনা নাম শুনেছি। তড়িঘড়ি করে উঠে রুমে গেল।

আহনাফ সারাহ্-র দিকে একটু তাকিয়ে টেবিলে মাথানিচু করে বসে পড়ে। সারাহ্ এগিয়ে যাওয়ার সাহস পায়না। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে।

আহনাফ জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। বেশ কিছু সময় পর সারাহ্ এগিয়ে যায়। কলমগুলো তুলে টেবিলে রাখে। আহনাফ মাথা তুলে ওর দিকে তাকায়।

সারাহ্ খাতাগুলো গুছিয়ে রেখে বলে,
“এসব পরে দেখবেন, এখন একটু বিশ্রাম নিন।”

আহনাফের হাত ধরে ওকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলে,
“শুয়ে পড়ুন।”

সারাহ্ চলে আসতে নিলে আহনাফ ডাকলো,
“ঐশী।”
“জি।”
সারাহ্ ফিরে তাকায়।

আহনাফ আর কিছু না বলে শুয়ে পড়লো৷ সারাহ্ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রুমের বাইরে চলে আসে। ওর জানা হলো না তাহসিনাকে নিয়ে, তবে নিজের স্বামীর মুখে অন্য মেয়ের নাম শোনাটা সত্যিই কষ্টের। ড্রইংরুমে গিয়ে আবারো আগের জায়গায় বসে পড়লো সে।
______________________________________

টিকেট কিনে বাসায় এসেছে মৃত্তিকা। চাকরি ছেড়ে দিয়েছে, বাসাটাও ভাড়া দিয়ে দিয়েছে। এখন শুধু দেশে ফেরার পালা। মামের স্মৃতি নিয়ে দেশে যাবে। এমনভাবে যেতে হবে যেন তার বাবা টের না পায়। এই লোকের হাত থেকে নি°স্তা°র চায় সে।

ডি°ভো°র্সের সময় সবচেয়ে বেশি ঝা°মেলা হয়েছিল ওকে নিয়েই। ওর বাবা চেয়েছিল ওকে নিজের কাছে রাখতে, রিপা বেগম চাননি। জোর করে নিয়ে এসেছিলেন মেয়েকে। পরে আদালতও একই আদেশ দিলে রাগে রিপা বেগমকে চ°ড় দিয়েছিল এই লোকটা।

ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে মৃত্তিকা তানজিমকে কল করে। কয়েকবার কল বাজলেও রিসিভ হয় না। তারপর সে কল দেয় লুৎফর রহমানকে।

রিসিভ হলো,
“আসসালামু আলাইকুম, আংকেল।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কেমন আছো মা?”
“ভালো আছি, আংকেল। আসলে আংকেল (একটু থেমে) আমি দেশে আসবো। এই দুইদিন পরেই মানে মঙ্গলবার ফ্লাইট।”

লুৎফর সাহেব খুশি হলেন। বললেন,
“খুব ভালো তো। ইমতিয়াজকে বলে দিবো ও তোমাকে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে আসবে।”

মৃত্তিকার হাসিমুখটা চুপসে যায়। একটা ঢোক গিলে বলল,
“আংকেল, উনাকে শুধু শুধু ব্যস্ত করবেন কেন? আপনি যদি আসতেন?”

মৃত্তিকা একটু ইতস্তত বোধ করছে। লুৎফর সাহেব বললেন,
“তোমার বড়মণির সেশন আছে ওই, তাই আমি তো হাসপাতালে থাকবো মা। ইমতিয়াজ যাবে কিনা আমি জিজ্ঞাসা করে জানাচ্ছি তোমাকে।”

মৃত্তিকা আর অমত করলো না। বড়দের মুখে মুখে এতো তর্ক সে করতে পারে না। উনারা ইমতিয়াজকে ভরসা করেন, করাটা স্বাভাবিক। সে ভরসার যোগ্য, কিন্তু মৃত্তিকা যে অন্য কোথাও আটকে যাচ্ছে বারবার।

মৃত্তিকা একটা ঢোক গিলে বলল,
“আংকেল আপনার কি কিছু সময় হবে? (একটু থেমে) কিছু কথা বলতাম।”
“বলো, মা।”

মৃত্তিকা একটু একটু করে ওর বাবার আচরণের পুরোটার জানালো লুৎফর রহমানকে। ওর বাবা ইতালি এসেছে, ওকে কি কি বলেছে এবং কিভাবে বি°র°ক্ত করেছে সব জানায় ও। কথা বলতে বলতে কান্না করে দেয়।
______________________________________

ইমতিয়াজ নতুন বাসায় চলে এসেছে পরশু। এবারে দুই আর ডাইনিং এর বাসা নিয়েছে। একটা রুম সাবলেট দেয়ার চিন্তাভাবনা আছে।

ঘড়িতে সন্ধ্যা ৭ টা, অফিস থেকে ফিরেই বাসা পরিষ্কার করছে সে। এমনসময় মিউ মিউ শব্দ শুনে তা অনুসরণ করে খাটের নিচে এক বিড়াল খুঁজে পায়। বিড়ালটাকে বের করে এনে দেখে পায়ে ক্ষ°ত।

“দেখে তো হাঁটবি নাকি?”

মায়া হলো তার, বিড়ালটাকে নিয়ে ছুটলো ভে°টের কাছে। পায়ে পরীক্ষা করে ওষুধ নিয়ে আসলো।

বাসায় এসে একটা ঝুড়িতে বিড়ালটার থাকার ব্যবস্থা করলো। ফ্রিজ থেকে মাছ নামিয়ে নিয়ে সিদ্ধ দিয়ে আসলো। বিড়ালটা এখনো ওকে একটু ভ°য় করছে বোধহয়।

ইমতিয়াজ পুরোনো কাঁথা দিয়ে গরম জায়গা বানাচ্ছে। এমনসময় ফোন বেজে উঠলো। তানজিমের নাম্বার দেখে রিসিভ করলো।

“হ্যাঁ, তানজিম।”
“ভাইয়া, একটা সমস্যা হয়েছে।”

সমস্যার কথায় ইমতিয়াজ ভয় পেল। বলল,
“কি সমস্যা? মা ঠিক আছে?”

ইমতিয়াজের উ°ত্তে°জনায় তানজিম শান্তভাবে বলল,
“আম্মু, ঠিক আছে। সমস্যাটা মিউকো আপুর।”

ইমতিয়াজের কপাল কুঁচকে গেল। মিউকো মানে মৃত্তিকার সমস্যার সমাধান ওর কাছে কিভাবে থাকবে?

তবুও বলল,
“কি হয়েছে?”
“আপু কল দিয়েছিল, উনার বাবা ইতালিতে গেছে। সেটা নিয়েই বাবার সাথে কান্নাকাটি করলো।”
“এখন আমি কি করতে পারি?”
“আপু মঙ্গলবার দেশে আসবে, তোমাকে শুধু এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে আসতে হবে।”

তানজিমের কাছ থেকে ফোনটা নিলো লুৎফর সাহেব। বলল,
“ইমতিয়াজ বাবা, মেয়েটা তো অনেকদিন হলো দেশে আসে না। তাই চিনে না রাস্তাঘাট। আমিও তো সেদিন তোমার মাকে…”

উনার কথার মাঝেই ইমতিয়াজ জবাব দিলো,
“ঠিক আছে। কয়টায় আসবে জানালেই হবে।”

ইমতিয়াজ ফোন রাখলো। তানজিমের নাম্বার থেকে হোয়াটসঅ্যাপে একটা ম্যাসেজ এসেছে। ম্যাসেজে খুলে দেখলো মৃত্তিকার নাম্বার পাঠিয়েছে। সাথে লেখা,
“ভাইয়া এটা আপুর নাম্বার, আপনি নক দিলেই টাইম জানিয়ে দিবে।”

রিপ্লাই না দিয়ে ফোন রেখে ইমতিয়াজ নিজের কাজে মন দিলো।

চলবে……

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

একাদশ পর্ব

“বকুলের মালা শুকাবে
রেখে দেবো তার সুরভি,
দিন গিয়ে রাতে লুকাবে
মুছো না গো আমারই ছবি,
তুমি ভুলো না আমারই
না….ম।

তুমি চোখের আড়াল হও
কাছে কিবা দূরে রও
মনে রেখো আমিও ছিলাম।

এই মন তোমাকে দিলাম
এই প্রেম তোমাকে দিলাম।”

রান্নাঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মিষ্টি কন্ঠে একটা গান শুনলো সামিহা। দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিলো, মার কন্ঠ। সামিহা মুচকি হাসলো। রাতে খাবার রান্না করছে আর সাথে গান গাইছেন।

কিছুক্ষণ পর জাহাঙ্গীর সাহেবের কন্ঠও শুনলো।
“আরে, এটা কোনো গান না। আমি একটা গান গাই।”

সামিহা দেয়াল ঘেষে দাঁড়ায়। বাবার গান না শুনে যাওয়া যায় নাকি। মায়ের গান কতই শুনেছে, বাবা কি আর সহজে গানে টান দেয়।

জাহাঙ্গীর সাহেব একটা কা°শি দিয়ে গান শুরু করলেন,
“লাল ফিতে, সাদা মোজা, স্কু-স্কুলের এর ইউনিফর্ম
ন’টার সাইরেন সংকেত, সিলেবাসে মনোযোগ কম।
পড়া ফেলে এক ছুট-ছুটে রাস্তার মোড়ে
দেখে সাইরেন মিস করা দোকানিরা দেয় ঘড়িতে দম।
এরপর একরা°শ কালো কালো ধোঁয়া
স্কুল বাসে করে তার দ্রুত চলে যাওয়া
এরপর বি°ষ°ণ্ন দিন, বাজে না মনবীণ
অবসাদে ঘিরে থাকা সে দীর্ঘ দিন, ওহ
হাজার কবিতা, বেকার সবই তা
হাজার কবিতা, বেকার সবই তা
তার কথা কেউ বলে না
সে প্রথম প্রেম আমার নীলাঞ্জনা
সে প্রথম প্রেম আমার নীলাঞ্জনা।”

“দ্যা°ত, কিসব গান গাও তুমি। মেয়ে শুনলে।”

নার্গিস পারভিনের কথায় সামিহা হেসে রুমে চলে গেল। এই মিষ্টি সম্পর্ক একসাথে ৩০ বছর পেরিয়ে এসেছে। উথালপাতাল ঢেউ আসলেও হাত যে একটিবারের জন্যও ছাড়েনি।

বিছানায় শুয়ে সামিহা সারাহ্-র নাম্বারে ভিডিও কল দেয়। সারাহ্ কল কেটে অডিও কল করে।
“আপু, তোমাকে দেখবো।”

সারাহ্ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“পরে দেখিস। (একটু থেমে) কি করিস এখন?”
“কিছু না।”
“পড়াশুনা নেই?”
“আছে তো। মাত্রই তো টিউশন থেকে ফিরলাম, এখনো খাইনি রাতের খাবার।”

“ঐশী।”

আহনাফের ডাক শুনে সারাহ্ বলে,
“এখন রাখছি, বাই।”
“সে তো রাখবাই, সোয়ামী ডাকতেছে।”
“চুপ।”
“রাখো।”
গাল ফুলিয়ে কথাটা বলল সামিহা। বাবার গানের কথা সারাহ্-কে বলা হলো না।

সারাহ্ ফোন রেখে রুমে গেল। আহনাফ টেবিলে বসে আছে এখনো। সেই খাতা দেখায় ব্যস্ত সে। ওকে দেখে বলল,
“এখানে এসো।”

সারাহ্ ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। আহনাফ সারাহ্-র হাতটা নিজের কপালে রেখে বলে,
“চুলগুলো টে°নে দাও, ঘুমাবো।”

সারাহ্ আস্তেধীরে মাথায় হাত বুলায়। আহনাফ বিরক্তি নিয়ে বলে,
“ভালো করে টা°নো একটু।”

জোরে চুল টে°নে দিতেই “এই আস্তে” বলে আহনাফ রেগে সোজা হয়। চোখ পা°কিয়ে তাকাতেই সারাহ্ হো হো করে হেসে উঠে। আহনাফের রাগ চলে যায়। মুখটা মলিন হয়ে উঠে।

“একটা কাজও ঠিকমতো করতে পারো না।”

আহনাফের কথায় সারাহ্ হাসি থামালো। আহনাফ আবারো খাতায় নজর দেয়। সারাহ্ বলল,
“খাবেন না?”
“না।”
“আমি গুণে দিবো, এখন তো খাবেন?”

আহনাফ হাসলো। বলল,
“ঐশী, এসব গুণাগুণি আমি করতে পারি।”
“আমি খাইয়ে দিলে খাবেন?”

আহনাফ ওর দিকে তাকাতেই সারাহ্ মুখে হাত দিয়ে চলে যেতে নিলে আহনাফ ওর হাত ধরে।

“তুমি নাকি কথা কম বলো, তোমার বাবা তো এটাই বলেছিল। তো এখন এতো কথা কোথা থেকে আসছে?”

সারাহ্ চোখ ছোট ছোট করে বলল,
“সরি।”

আহনাফ ওর হাত ছেড়ে দিলো।
“সরিটরিতে কাজ নাই। বৃহস্পতিবারে আমরা ঢাকা যাচ্ছি, ওখানে তোমার বাবার সাথে বোঝাপড়া হবে।”

আহনাফ আবারো খাতা দেখতে থাকে। সারাহ্ নিজেই নিজেকে বলে,
“এই লোকটা নি°র্ঘা°ত মা°রবে আমাকে। মানে যা তা একটা।”

সারাহ্ বেরিয়ে যায়। আহনাফ আপন মনে হেসে উঠে। হাসতে হাসতে একসময় কলমটা রেখে পেছনে ফিরে একবার দরজার দিকে তাকায়। যতটা ম্যাচিউর মেয়েটা হওয়া উচিত ছিল তার চেয়ে একটু কম।
______________________________________

সোমবার পেরিয়ে আজ মঙ্গলবার সকাল। বিকালে ঢাকায় আসবে মৃত্তিকা। ইমতিয়াজের সাথে কোনো কথা হয়নি ওর, ইমতিয়াজও কল দেয়নি।

অফিস থেকে ইমতিয়াজ আজ ছুটি নিয়েছে। বাসা গুছিয়ে ওর কাছে রাখা সেই বিড়ালকে নিয়ে হাঁটতে বের হয়।

ইমতিয়াজকে এখন আর বিড়ালটা ভয় পায় না। কোলে নিলেই গা ঘেষে শুয়ে পড়ে। ইমতিয়াজ ওর তুলতুলে দেহে হাত বুলায়। বিড়ালটা ওর গা চেটে দেয়।

“এখনো তোর একটা নাম রাখতে পারলাম না। কি নাম রাখা যায় বল তো?”

অপরদিক থেকে “মিউ” বলে একটা প্রতিক্রিয়া আসে। ইমতিয়াজ আলতো হাসে। গোরস্থানে গিয়ে তাহমিনার কবর পরিষ্কার করে৷ বিড়ালটাকে ছেড়ে দিয়েছে হাঁটাহাঁটির জন্য।

“মিনা, ওখানে দেখো আমার একাকিত্বের সঙ্গী৷ তুমি আবার ওকে দেখে হিং°সা করো না।”
কথাটা বলেই ও হাসে।

কবরের পাশে বসেই পুরো দিনটা কাটায় সে। দুপুরে বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে নেয়। বিড়ালের খাবার বাটিতে ঢেলে বলে,
“খেয়ে নিবি কিন্তু। আমি সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরবো।”

গতকালও অফিসে যাওয়ার সময় এভাবেই বিকালকে খাবার দিয়ে গিয়েছিল সে। বিড়ালটা একা থাকায় বড্ড অভিজ্ঞ বোধহয়। বাসায় খেলাধুলা আর খেয়েদেয়ে দিব্বি কা°টিয়ে দেয়। বাইরে যায় না, আবার রাতে ঠিকই ইমতিয়াজের গা ঘেষে শুয়ে থাকে।

ইমতিয়াজ রেডি হয়ে নেয়। তারপর বেরিয়ে পড়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। গাড়ি আগে থেকেই ভাড়া করা ছিল তাই বের হতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না।

এয়ারপোর্টের দুই নম্বর গেট দিয়ে মৃত্তিকার বের হওয়ার কথা। কিন্তু চারটার স্থলে পাঁচটা বেজে গেছে, এখনো মৃত্তিকাকে না দেখে ইমতিয়াজ ফোন বের করে মৃত্তিকার নাম্বারে কল দেয়।

এদিকে মৃত্তিকা বাইরে এসে ইমতিয়াজকে দেখছে। লম্বা, সুঠাম দেহী পুরুষটার চেহারায় এখনো বয়সের ছাপ নেই। কালো টি শার্ট, কালো প্যান্ট আর তার সাথে কালো স্ক্যাটসে একদম কালো হীরা লাগছে। যাকে বলে ব্ল্যাক ডায়মন্ড।

ফোনের ভাইব্রেশনে মৃত্তিকা চোখ সরায়। ফোন বের করে ইমতিয়াজের নাম্বার দেখে কল কেটে দেয়। ইমতিয়াজের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,
“হাই।”

মিষ্টি কন্ঠে ইমতিয়াজ চমকে তাকায়। নিজের বি°ভ্রা°ন্ত চেহারা সামলে নিয়ে বলে,
“ওহ, এসে পড়েছেন?”
“জি।”

ইমতিয়াজ হাত দিয়ে ইশারা করে বলে,
“তবে যাওয়া যাক?”
মৃত্তিকা মাথা নাড়ে।

গাড়িতে বসে ইমতিয়াজ সমানে ফোন দেখছে। কোনো একটা গেম সে খুব মনোযোগ দিয়ে খেলছে। সাধারণত সে গেম খেলেনা, তবে এখন মৃত্তিকার সাথে কথা বলতে চাচ্ছেনা বলে এরকম ব্যবস্থা।

মৃত্তিকা বারবার ওর দিকে তাকাচ্ছে। কথা বলার জন্য ছটফট করছে সে, অথচ ইমতিয়াজ একটাবারের জন্য ওর দিকে তাকায় না।

মৃত্তিকা নিজে থেকেই বলে,
“কেমন আছেন?”

ইমতিয়াজ ফোনের দিকে তাকিয়ে ছোট করে জবাব দেয়,
“ভালো।”

ইমতিয়াজের আগ্রহ নেই দেখে মৃত্তিকা আবারো বলে,
“আজ অফিস নেই?”
“আমি ছুটিতে আছি।”
“ছুটির কারণ কি আমি?”

এবারে ইমতিয়াজ ওর দিকে তাকায়। মাথায় পেঁচানো স্কার্ফ পেরিয়ে সামনের কেটে রাখা লালচে সোনালী চুলগুলো মুখে এলোমেলো হয়ে পড়েছে। লম্বা ভ্রমণে ক্লা°ন্তির ছাপ স্পষ্ট। হালকা গোলাপি ঠোঁটের কোনায় ছোট একটা কা°টা দাগ, যেন কেউ অযত্নে কে°টে দিয়েছে। কপালের কোনায় ছোট একটা পো°ড়া ক্ষ°ত।

ইমতিয়াজ প্রশ্ন করে,
“এতো কাঁ°টা ছেঁ°ড়া দাগ কেন? মা°রা°মা°রি করেন নাকি?”

মৃত্তিকা হেসে দিলো। বলল,
“না, মা°রা°মা°রির কারণে এসব হয়নি।”
“তবে?”
ভ্রূ উঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলো ইমতিয়াজ।

মৃত্তিকা জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো, ঢাকা শহরের উঁচু উঁচু বিল্ডিং আর রাস্তার ব্যবচ্ছেদে লাগানো কয়েকটা এলোমেলো গাছ দেখতে লাগলো। সৌন্দর্যহীন এই নগরীকে মুগ্ধ হয়ে দেখছে সে।

ইমতিয়াজ আবারো ফোনে মনোযোগ দিলো। মৃত্তিকা বলে,
“আমাকে নিয়ে ঢাকার মেট্রোরেলে ঘুরাতে পারবেন?”
“তানজিমকে বললেই নিয়ে যাবে। আমার প্রয়োজন নেই।”
আগ্রহহীন ভাবে জবাব দিল ইমতিয়াজ।

“কিন্তু আমার তো আপনার সাথে ঘুরতে ইচ্ছা করে।”
কথাটা বলতে চেয়েও বলা হলো না মৃত্তিকার।

মনের কথা মনে রইলো। আনমনে হাত দিলো কা°টা ঠোঁটে। যে অ°ত্যা°চা°র ওর মাম সহ্য করেছে, তার কাছে এটুকু কিছুই না।

মৃত্তিকার অন্যমনস্ক ভাবটা ইমতিয়াজ খেয়াল করেছে, কিন্তু কিছুই বলেনা।
______________________________________

আহনাফ বাসায় নেই। সারাহ্ আসরের নামাজের পর থেকেই রান্নাঘর গোছাতে ব্যস্ত। সারাদিন সময় পায় না। এখন নিজের মতো করে গুছিয়ে রাখছে সবকিছু। যা যা রান্নাঘরে দরকার তা ওখানে রাখছে আর যা যা ডাইনিং এর দরকার তা ডাইনিং এ রাখছে।

এরমধ্যে আহনাফ বাসায় এসেছে। মেইন দরজা খোলা ছিল। ডোর হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে ভিতরে এসেই দেখে ঘর এলোমেলো।

ড্রইংরুমের সোফার কভার বদলে ফেলা হয়েছে। টেবিলের উপরে ফুলদানিতে থাকা নকল ফুলগুলো বদলে সতেজ ফুল রাখা হয়েছে। ডাইনিং এখনো গোছানোর কাজ চলছে।

সারাহ্ ওকে দেখে বলল,
“এদিকে আসবেন না, আমি কাজ করছি।”

আহনাফ ঠোঁট উলটে ভ্রূ কুঁচকায়। বলে,
“এসব কাজ?”

ডাইনিং টেবিলের উপরের কাপড়টা সরাতে সরাতে সারাহ্ বলল,
“হ্যাঁ, এটা কাজ। নিজের সংসার নিজে গোছানো, কাজ নয়?”

আহনাফ থমকে যায়। সারাহ্-কে দেখে মনোযোগ দিয়ে। রাগের মাথায় বিয়ে করেছে সে, সেই রাগে প্রথমদিনই ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে।

সারাহ্ ওকে স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে,
“কি হলো? এখনো দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”

আহনাফ মাথা নেড়ে বোঝায় কিছু না। প্লেটগুলো রাখতে রাখতে সারাহ্ বলে,
“তাহসিনা কে?”

ব°জ্র°পা°তের মতো কথাটা আছড়ে পড়ে আহনাফের কানে। সারাহ্ কাজ ফেলে এগিয়ে আসে। ভ°য়ং°কর একটা সাহস করেছে সে।

আহনাফ ওর দিকে তাকায়। সারাহ্-র চোখমুখে এখনো জানার আগ্রহ। সারাহ্ ওড়না দিয়ে নিজের হাত মুছতে মুছতে বলে,
“বলতে না চাইলে ঠিক আছে।”

সারাহ্-কে টা°ন দিয়ে চেয়ারে বসিয়ে আহনাফ শান্তভাবে বলে,
“কেন জানতে চাইছো?”

সারাহ্ উঠে যেতে নিলে আহনাফ ওর দিকে ঝুঁকে বলে,
“উত্তর দাও।”
“আপনি ওইদিন এই নাম নিয়ে চিৎ..”

আহনাফ ডানহাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ওই ঠোঁটে স্পর্শ করতেই সারাহ্ থেমে যায়, ভ°য়ে কুঁচকে যায় সে। আহনাফ বলে,
“তাহসিনা এই স্পর্শে লজ্জা পেতো।”

সারাহ্ ওকে ধা°ক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। কপাল কুঁ°চকে গলা ভারি করে বলে,
“ছি, নিজের বউয়ের কাছে এসব কি বলছেন?”

আহনাফ শার্ট ঝেরে আরেকটা চেয়ার টে°নে বসে বলল,
“বউ জানতে চাইলে আমার কি দোষ?”
“একটা ফালতু লোক আপনি। বাইরে একটা মেয়ের অসভ্যতা করেছেন, আবার ঘরে বউ নিয়ে এসেছেন। (একটু থেমে বিড়বিড় করে) না জানি মেয়েটা কেমন ছিল।”

আহনাফ কথাটা শুনেছে, এবারে সে বেশি রেগে যায়। তাহসিনাকে নিয়ে এধরনের মন্তব্য করা যে সারাহ্-র উচিত হয়নি। আহনাফ উঠে সারাহ্-র দিকে অ°গ্নি°দৃ°ষ্টি নিক্ষেপ করে সোজা বেরিয়ে যায়। সারাহ্ কিছু বলতে চেয়েও পারে না। এলোমেলো রুমটা আর গোছানো হলো না। কান্নার ভারি রেশে সে আর স্থির থাকতে পারলো না, ফ্লোরে বসে পড়লো।
______________________________________

সন্ধ্যা সাতটার দিকে তানজিমদের বাসায় আসে ইমতিয়াজ ও মৃত্তিকা। মৃত্তিকা প্রথমেই চলে যায় মমতাজ বেগমের রুমে। ইমতিয়াজ সোফায় বসে।

মমতাজ বেগমের সাথে কথা বলে মৃত্তিকা বেরিয়ে আসে। তারপর ডাইনিং-এ চেয়ার টে°নে বসে সে। লুৎফর সাহেব এসে বলেন,
“মা মিউকো, ফ্রেশ হয়ে আসো।”

মৃত্তিকা উনার দিকে তাকিয়ে বলে,
“আংকেল, বসেন।”

ইমতিয়াজের পাশে তানজিম বসে ছিল। ইমতিয়াজ তানজিমের কানের কাছে গিয়ে বলে,
“তোমার আপুর কপালে কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করো তো।”

তানজিম একটু জোরে বলল,
“মিউকোপু, ইমতিয়াজ ভাইয়া জানতে চাইছে তোমার কপালে কি হইছে?”

মৃত্তিকা চমকে উঠে ইমতিয়াজের দিকে তাকালো। ইমতিয়াজ মাথা নিচু করে ফেলে। কথাটা বলার পর তানজিম বুঝতে পারলো সে ভুল কিছু বলেছে।

লুৎফর সাহেব বলল,
“হ্যাঁ তো মিউকো, কি হইছে?”

মৃত্তিকা কপালে হাত দিয়ে বলে,
“বাবা, গতকাল বাসায় এসেছিল।”

মৃত্তিকা থেমে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
“সি°গা°রে°ট লাগিয়েছে। ধ°ম°ক দেয়ায় চ°ড়ও দিয়েছে। (একটু থেমে) মামের সাথে যে আচরণটা করেছিল সেটাই আমার সাথে পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।”

ইমতিয়াজ চুপ থাকে না। হঠাৎ কি°ড়মি°ড়িয়ে বলে,
“আপনি উলটো একটা চ°ড় দিতে পারেননি?”
“বাবা হয় উনি।”

কথাটা বলে মৃত্তিকা ফুঁপিয়ে উঠে। লুৎফর সাহেব সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা খুঁজছেন। কিন্তু বাবার কাছ থেকে এমন আচরণ পাওয়া মেয়েকে কি বলে সান্ত্বনা দিবেন উনি।

ইমতিয়াজ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মৃত্তিকার দিকে। মেয়েটার চোখেমুখে অসহায়ত্ব। সং°গ্রামের চিহ্ন তার মুখে, কপালে।

কিছুক্ষণ পর মৃত্তিকা থামে। বলে,
“আমার আর সহ্য হচ্ছে না আংকেল। নিজের মৃ°ত্যু কামনা করা পা°প। অথচ আমার এই পা°প করতেই মন চায়।”

সামনে থাকা জগ থেকে পানি ঢেলে মৃত্তিকা একটু পান করে। তারপর বলে,
“মাম তো আরো কষ্ট স°হ্য করেছে। বারবার মনে হয় মামের মৃ°ত্যুর জন্য ওই লোকটাই দায়ী।”

ইমতিয়াজ বড় বড় চোখে মৃত্তিকার দিকে তাকায়। উপস্থিত বাকিরাও অবাক। রিপা বেগম তো একা মা°রা যাননি, সাথে তাহমিনা আর তাহসিনাও ছিল। এই দুর্ঘটনায় অপরপাশের মাইক্রোবাসের চালকও মা°রা যায়। তবে এটা পরিকল্পিত কিভাবে হতে পারে?

ইমতিয়াজের হাত মু°ষ্টি°বদ্ধ হয়। ওই লোকটার উপর রাগ হচ্ছে। যদিও রাগের কারণ নির্ধারিত নয়, মৃত্তিকার উপর অত্যাচার নাকি তাহমিনার মৃ°ত্যুর সন্দেহ?

চলবে……

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

দ্বাদশ পর্ব

রাত প্রায় এগারোটা, আহনাফ মাত্রই বাসায় ফিরেছে। দরজা এখনো খোলা, সে নিবরে ভিতরে আসে।

সারাহ্ সোফায় ঘুমাচ্ছে। পুরো ঘর একদম পরিষ্কার, গোছানো, সাজানো। আহনাফ পুরো বাসা ঘুরে ঘুরে দেখে। যত জায়গায় নকল ফুল ছিল, সেসব জায়গায় এখন তাজা সতেজ ফুল। আহনাফ ফুলদানির ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখে পানি দেয়া। সে হাসে।

ডাইনিং টেবিলের কাপড়টা সরিয়ে পুরো জায়গা মুছে ঝকঝকে করে ফেলেছে। টেবিলের ঠিক মাঝে আরেকটা ফুলদানি। রঙবেরঙের কিছু ফুল রাখা সেখানে। আহনাফ ভুল না করলে এই ফুলগুলোর নাম ক্যালিস্টেফাস।

“এখানে কোথায় পেল এগুলো?”
প্রশ্ন জাগে আহনাফের মনে।

বেডরুমে গিয়ে আরেকদফা অবাক হয় আহনাফ। সেলফ, টেবিল, বিছানা, ড্রেসিংটেবিল সবকিছু গোছানো। রুমে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ। এরকম ঘ্রাণের কোনো পারফিউম ঘরে আছে বলে ওর জানা নেই। এতো কাজ একজন একা হাতে কিভাবে করলো?

আহনাফ তড়িঘড়ি করে এসে ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে গরম বসায়। এতো কাজ করে না খেয়েই ঘুমিয়েছে সারাহ্।

রুটি বানানো ছিল, আহনাফ সেগুলো সেঁ°কে নেয়। টেবিলে খাবার রেখে সারাহ্-র কাছে যায়। ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়েছে, ডাক দিলে খারাপ লাগবে জেনেও আহনাফ ডাকে।

“ঐশী।”
“হুম।”

ঘুমের ঘোরে মিনমিনিয়ে বলে সারাহ্। আহনাফ হাসে। ছোট শিশুর মতো ব্যবহার ওর।

“ঐশী।”

সারাহ্ চোখ খুলে আহনাফকে দেখে লাফিয়ে উঠে। ঘড়িতে দেখে সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে।

“হায় আল্লাহ্, আমি এতোক্ষণ ঘুমিয়েছি?”

আহনাফ শান্তভাবে বলল,
“খাবার রেডি, খাবে আসো।”

সারাহ্ তাকিয়ে আছে আহনাফের দিকে। যে রাগ নিয়ে বিকেলে বেরিয়েছিল সেই রাগটা নেই। সারাহ্ দাঁড়িয়ে আহনাফকে জড়িয়ে ধরে। আচমকা এমন ঘটনায় বি°ব্র°ত হয় আহনাফ। সারাহ্ যে ওর বুকেই মাথা রেখেছে। আহনাফ ওকে স্পর্শ করে না, হাত পিছনে নিয়ে নেয়।

সারাহ্ বলে,
“সরি, তাহসিনাকে নিয়ে এসব বলা আমার ঠিক হয়নি।”
“ঠিক আছে, ছাড়ো।”

সারাহ্ সরে দাঁড়ায়। অতি আবেগে জড়িয়ে ধরেছে ঠিকই কিন্তু এখন আবারো ভ°য় লাগছে তার। দৃষ্টি মেলাতে পারলো না সে। চুপচাপ খেতে বসে পড়লো।
______________________________________

ইমতিয়াজ বাসায় এসেছে। দরজা খুলতেই বিড়ালটা এসে হাজির। পায়ের কাছে ঘুরে ফিরে গা ঘে°ষ°তে থাকে। ইমতিয়াজ তাকে কোলে নেয়।

“কিরে ক্ষুধা লাগেনি? আমি তো খেয়ে আসছি, আয় তোকে খাবার দেই।”

ক্যাটফুড খেতে দিয়ে ইমতিয়াজ বিছানা ঝে°ড়ে ঘুমানোর উপযুক্ত করতে ব্যস্ত হয়। এমনসময় ফোন বেজে উঠলো। মৃত্তিকার নাম্বার দেখে প্রথমদফা রেখে দিলেও দ্বিতীয় দফায় রিসিভ করে।

“জি, মৃত্তিকা।”

মৃত্তিকা একটু চুপ থেকে বলে,
“কি করছেন?”
“ঘুমাবো।”

ধ°ম°কের সুরে ইমতিয়াজের ঠা ঠা কথায় মৃত্তিকা ভ°য় পায় না। উলটো প্রশ্ন করে সে,
“আমাকে নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছিল? এই যে আজকে ক্ষ°তটা নিয়ে বারবার জিজ্ঞাসা করছিলেন?”

ইমতিয়াজ জবাব দেয় না। কলও কাটে না, ফোনটা লাউডস্পিকার চালু করে পাশে দেখে দেয়। নিজের কাজ করতে থাকে সে।

মৃত্তিকা বলে,
“জানেন, কাল বাবা আমাকে কি বলেছে? (একটু থেমে) বলেছে, আমি যদি উনার কাছে না যাই তবে উনি আমাকে উনার মতো একা করে দিবে। আমি তো এমনিতেই একা, আর কত একা করবে?”

ইমতিয়াজ কাজ থামিয়ে এসে ফোন হাতে নিয়ে বলে,
“আপনি কেন বলেছিলেন এ°ক্সি°ডে°ন্টটার পেছনে আপনার বাবার হাত আছে?”
“মনে হয়, তাই বলেছি।”
“কোনো প্রুভ?”

মৃত্তিকা একটু ভেবে বলে,
“না, উনি বারবার আমাকে একা করে দিবে বলে। উনার একাকিত্বটা আমি বুঝি না বলে, তাই মনে হয়েছে।”

ইমতিয়াজ থেমে যায়। যদি সত্যি মৃত্তিকার মায়ের মৃ°ত্যুর জন্য ওর বাবা দায়ী হয়, তবে তো উনি আরো তিনটা মৃ°ত্যুর জন্য দায়ী। তাহসিনা, তাহমিনা আর সেই অনাগত নিষ্পাপ শিশুটার। ইমতিয়াজ চোখ বন্ধ করে ফেলে, আপাতত আর কিছু ভাবার জন্য সে প্রস্তুত নয়।

বিড়ালটা মেও মেও করে ওর কাছে আসে। মৃত্তিকা অপরপাশ থেকে বলল,
“আপনার বাসায় বিড়াল আছে?”

ইমতিয়াজ চোখ খুলে নিজের অবস্থা সামলে নিয়ে বলে,
“হ্যাঁ, আছে।”
“নাম কি?”

ইমতিয়াজ বিড়ালকে কোলে নিয়ে বলে,
“মিউকো, সারাদিন মিউ মিউ করে তো তাই।”

মৃত্তিকা শব্দ করে হেসে দেয়। বলল,
“আমার নামে বিড়াল পুষছেন?”
“সমস্যা কোনো?”
“না তো।”
“হলেও আমার তাতে কিছু আসে-যায় না।”

“আপনার কি করে আসবে-যাবে? আমার মনের খবর কি আর আপনি জানেন? এ হৃদয়ের খবর ওই সর্বশক্তিশালী রব ছাড়া কেউ জানে না।”
মৃত্তিকা মনে মনে ভাবতে থাকে। মুখ ফুটে একথা বলা হয়ে উঠে না।

ইমতিয়াজ বলল,
“রাখছি?”

মৃত্তিকা তাড়াহুড়ো করে বলে,
“একটু শুনুন।”
“জি।”

মৃত্তিকা আর কিছু বলতে পারে না। কলটা কেটে দেয়। ইমতিয়াজের কপাল কুঁচকে যায়। মেয়েটা যে তাকে পছন্দ করতে শুরু করেছে তা সে বুঝতে পারে, কিন্তু সে প্রশ্রয় দিবে না।
______________________________________

পরদিন,
আজ ভার্সিটিতে যাবে না তানজিম আর সামিহা। দুজনে কিছুক্ষণ ঘুরেফিরে আবারো চলে এসেছে তানজিমের বাসায়। সেদিনের পর থেকে একদিন পর পরই তানজিমের বাসায় আসে সামিহা। মমতাজ বেগমও ওকে খুবই পছন্দ করে। ও আসলে অনেক কথা শুনেন উনি, কথাও বলেন।

তানজিম বেল বাজালো। মৃত্তিকা এসে দরজা খুলে দেয়। সামিহাকে দেখে আলতো হেসে বলে,
“ভিতরে আসো।”

সামিহা ভিতরে আসতে আসতে তানজিমকে বলে,
“উনি কে?”
“মিউকোপু।”
“কি পু?”
কপাল কুঁচকে তানজিমকে বলে সামিহা।

মৃত্তিকা কথাটা শুনেছে। শব্দ করে হেসে দেয় সে৷ সামিহা সোফায় বসলে মৃত্তিকা ওর পাশে গিয়ে বসে বলে,
“আমি মৃত্তিকা, তানজিমের কাজিন।”
“ওহ।”

ছোট করে উত্তর দিয়ে সামিহা একটু এলোমেলো করে বলল,
“আগে দেখিনি? কোথা থেকে এসেছেন?”

কথা শেষে বোকাবনে গেল সে। তানজিম জিভে কা°ম°ড় দিয়ে ভিতরে চলে গেছে। এই মেয়ে উল্টাপাল্টা কথা প্রায়ই বলে।

মৃত্তিকা একটু হেসে বলল,
“আমি রোমে ছিলাম, তাই দেখোনি।”

সামিহা ঠোঁট উলটে বলে,
“রুমে থাকতেই পারেন, বারান্দায় থাকবেন নাকি?”

মৃত্তিকা এবারে হো হো করে হেসে উঠে। সামিহা বেশ মজার মানুষ। মৃত্তিকার ভালো লাগে ওকে।

“রুম না রোম, ইতালির রোম।”

মৃত্তিকা কথায় সামিহা দুচোখ খিঁ°চে বন্ধ করে। নিজের বোকামির জন্য রাগ হয় ওর, সাথে লজ্জাও পায়।

“বসো, আমি চা দেই।”
মৃত্তিকা উঠে গিয়ে চা বসায়।

সামিহা নিজের মাথায় নিজেই চ°ড় দিয়ে বলে,
“একটা কথা বুঝে তো বলবি। মেয়ে না তুই, আস্ত ছাগল।”

মৃত্তিকা এখনো হেসে যাচ্ছে। কি কিউট একটা মেয়ে। বাচ্চাবাচ্চা ভাব আর চেহারায় যুবতী বয়সের ছাপ।

তানজিম এসে রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে বলল,
“আপু, আমাকেও চা দিও।”

মৃত্তিকা ওকে ডেকে বলল,
“মেয়েটা কে রে?”
“আমার ক্লাসমেট।”
“সব ক্লাসমেট কে কি বাসায় আনিস?”
“আরে না।”
মুখের সামনে হাত নেড়ে বলল তানজিম।

মৃত্তিকা মুচকি হাসলো।
“আচ্ছা যা, আমি চা আনছি।”

সামিহা ততক্ষণে মমতাজ বেগমের রুমে চলে গেছে। উনার সাথে এটা সেটা নিয়ে কথা বলা শুরু করেছে সামিহা। মৃত্তিকা চা নিয়ে গেল।

সামিহা ওকে দেখে বলল,
“আপু চলো কোথাও হাঁটতে যাই। তোমার সময় হবে?”

মৃত্তিকা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে বলল,
“হ্যাঁ হবে, কোথায় যাবে?”
“এই আশেপাশেই।”

মৃত্তিকা একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল,
“এখানে আশেপাশে তেমন কোনো হাঁটার জায়গা নেই। দুই একটা শপিংমল থাকতে পারে। (একটু ভেবে) আর কাছে মেবি রমনা আছে, তবে ওখানে ভীড় থাকে।”

সামিহা একটু চুপসে গেছে। মৃত্তিকা বলল,
“আমরা হাঁটতে না গিয়ে, মেট্রোরেলে করে কোথাও ঘুরে আসি?”

“সেটা করা যেতে পারে।”

সামিহা খুশি মনে রাজি হলো। মৃত্তিকা বলল, “ঠিক আছে আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি।”

তিনজনের সাথে মমতাজ বেগম বের হলেন। আজ অনেকদিন পর হাসপাতাল ছাড়া অন্যকিছুর উদ্দেশ্যে বের হলেন উনি।

বাইরে এসে ওরা রিকশা নিলো। কাওরানবাজার মেট্রোরেল স্টেশন থেকে ওরা যাত্রা শুরু করবে।

মৃত্তিকা আর মমতাজ বেগম এক রিকশায় উঠলো, তানজিম-সামিহা অন্যটায়।

মমতাজ বেগম বললেন,
“তোমার বাবা জানে তুমি ঢাকায়?”

মৃত্তিকা মাথা নেড়ে বলল,
“না, উনি এমনিতেই আমার জীবনটা ন°র°ক করে দিয়েছেন। এখন আর খারাপ কিছু হোক আমি চাই না।”

মমতাজ বেগম আর কোনো কথা বললেন না। নজর ঘুরিয়ে দ্রুত চলা রিকশার চাকায় চোখ রাখলেন।
______________________________________

ক্লাস শেষ করে আহনাফ টিচার্স রুমে যাচ্ছে। ফার্স্ট ইয়ারের বি সেকশনে ক্লাস নিচ্ছে সারাহ্। শুধু ক্লাস না একপ্রকার চেঁ°চা°মে°চি করছে সে। ক্লাসের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সারাহ্-কে ব°কাব°কি করতে দেখে আহনাফ দাঁড়ায়।

ব°কাব°কির কারণ আবিষ্কার হয় এক ছেলে সারাহ্-র ওড়নায় টা°ন দিয়েছে। আহনাফ ছেলেটাকে একবার দেখে কপাল কুঁচকে প্রস্থান করে।

একটু পরে সারাহ্ও বেরিয়ে আসে। রাগে এখনো শরীর জ্ব°লছে ওর।

“অ°সভ্য ছেলে, টিচারের সাথে কেমন ব্যবহার করতে হয় তা জানে না। থা°ব°ড়া দিয়ে গাল লাল করে ফেলতে ইচ্ছা করে।”

বিড়বিড়িয়ে কথা বলতে বলতে হাঁটতে থাকে সারাহ্। ম্যাডামদের টিচার্স রুমে ঢুকার সময় সারাহ্ দেখে পাশ থেকে শার্টের হাতা গু°টাতে গু°টাতে আহনাফ কোথাও যাচ্ছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে না যে ক্লাসে যাচ্ছে।

“আহনাফ?”

সারাহ্-র ডাকে ওর দিকে র°ক্ত°চ°ক্ষু নিক্ষেপ করে আহনাফ। সারাহ্ একটু ঘা°ব°ড়ে যায়। তবুও সে টিচার্স রুমে চলে যায়।

আহনাফ বি সেকশনে গিয়ে সকলের উদ্দেশ্যে বলে,
“সবাই দাঁড়াও।”

সকলে একটু আতিপাতি করে হলেও দাঁড়ায়। আহনাফ প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে সকলের মুখ দেখতে দেখতে বলে,
“ম্যাডামদের ওড়না টা°ন দিতে ভালো লাগে?”

কয়েকজন মাথানিচু করে ফেলে। প্রথম বেঞ্চ থেকে একটা কলম নিয়ে বলে,
“উত্তর দাও।”

“উনার বউ বলে খুব গায়ে লাগছে?”

দুজন ছেলের ফিসফিসানি আহনাফ শুনে। কলমটা ছেলেটার দিকে ছুঁ°ড়ে ফেলে বলে,
“বের হয়ে এখানে আসো।”

ছেলেটা প্র°তি°বাদ না করে বের হয়ে গিয়ে সামনে দাঁড়ায়। আরেকটা ছেলেকে বলে,
“তোমাদের কেমিস্ট্রির সারাহ্ ম্যাডামকে ডেকে আনো।”

ছেলেটি কথামতো বেরিয়ে যায়। ফিজিক্সের সূত্রের মতো এই স্যারও যে পেঁ°চিয়ে ধরে তা সবাই জানে।

টিচার্স রুমে গিয়ে ছেলেটি বলে,
“সারাহ্ ম্যাম, আপনাকে ফিজিক্স স্যার ডাকছে।”
“আমাকে?”

সারাহ্ একটু বি°ব্র°ত হয়। ফিজিক্স স্যার মানে আহনাফ ডাকছে, তাও একটা ছেলেকে দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছে।

সারাহ্ তড়িঘড়ি করে উঠে যায়। ক্লাসের কাছে গিয়ে থেমে যায় সে। সেকশন দেখে বুঝেছে ক্লাসে ওর সাথে যা হয়েছে তা আহনাফ জানে।

সারাহ্ গিয়ে একবার উঁকি দেয়।
“স্যার?”

আহনাফ ওকে দেখে মাথা নাড়ে। বলে,
“আসেন, ম্যাডাম।”

সারাহ্ ভিতরে এসে আহনাফের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে,
“আহনাফ, কি হচ্ছে এসব?”
“স্যার বলুন।”
“জি।”
সারাহ্ মাথা নাড়ে।

আহনাফ ছেলেটিকে ইশারা করে বলে,
“এই ছেলে?”
“হুম।”
সারাহ্ মাথা নেড়ে জবাব দেয়।

এরমধ্যে বায়োলজির স্যার মেহেদী হাসান ক্লাসে এসে উপস্থিত হয়। আহনাফ উনাকে বলে,
“আসসালামু আলাইকুম স্যার।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম, কি ব্যাপার স্যার?”

মেহেদী পুরো ক্লাসে চোখ বুলায়। আহনাফ বলে,
“সুন্দরী ম্যাডামের উপর ছাত্ররা ক্রা°শ খাচ্ছে। তাই ম্যাডাম বিচার করাতে আনলো আর কি।”

সারাহ্-র কপাল কুঁচকে গেল। ঠিক কখন আহনাফকে ও বিচারের জন্য এনেছে মাথায় আসলো না ওর।

“ওহ, এই ছেলে?”

মেহেদীর ডাকে ছেলেটি আড়চোখে তাকালো। আহনাফ বলে,
“ক্লাস নেন স্যার। আমি ওকে নিয়ে প্রিন্সিপালের কাছে যাচ্ছি। এইটুকু ছেলে এতো সাহস কোথায় পায় আমিও দেখবো।”

ক্লাস থেকে ছেলেটিকে নিয়ে বেরিয়ে আসে আহনাফ, সারাহ্ও পিছনে আসে। আহনাফ সারাহ্-কে বলে,
“আপনি যেতে পারেন।”
“আহনাফ?”
“স্যার।”

সারাহ্ একটু বড় নিশ্বাস ফেলে বলে,
“ওকে স্যার। দেখেন, এসব করে শুধু শুধু ছেলেটার উপর চাপ তৈরি করছেন।”

আহনাফ ভ্রূ উঁচিয়ে তাকায়। সারাহ্ আবারো বলে,
“যা ব°কার আমি ব°কেছি, এখন আর বাড়াবাড়ির প্রয়োজন নেই।”
“আমি কি আপনার কথায় চলবো, মিসেস সারাহ্ আহনাফ ফয়েজ?”

সারাহ্ কপাল কুঁচকে ফেললো। মুখের হাসিটা আসতে নিয়েও বাধা পেল। মিসেস সারাহ্ আহনাফ ফয়েজ, নামটা মন্দ নয়।

আহনাফ ছেলেটিকে নিয়ে চলে গেল। সারাহ্ মুখ টি°পে হেসে নিজে নিজেই বলল,
“ফিজিক্সের ফয়েজ স্যার, আমার মিস্টার।”

চলবে……

অনুভূতিরা শব্দহীন পর্ব-৮+৯

0

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

অষ্টম পর্ব

আজ শুক্রবার, ইংরেজিতে যাকে বলে ফ্রাইডে। মৃত্তিকা নিজের আশেপাশে এই শব্দটা শুনেই অভ্যস্ত। তার মামই তো শুক্রবার বলতো।

অফিসে আজ অর্ধদিবস কাজ করেছে সে। বাসায় চলে এসেছে তাড়াতাড়ি। ইতালির ঘড়িতে দুপুর একটা, গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে গেল মৃত্তিকা।

“শুক্রবারে সময় পেলে বেশি ইবাদত করবে। নফল নামাজ পড়বে, কোরআন পড়বে, দুরুদ পড়বে। এতে শ°য়°তা°ন তোমাকে সহজে কাবু করতে পারবে না।”
মামের কথাগুলো মেনে চলার চেষ্টায় আছে মৃত্তিকা। প্রায়ই শুক্রবারে অর্ধদিবস কাজ করে সে।

বারবার কলিং বেল বাজতে থাকায় বেশ বি°র°ক্ত হয় সে। নামাজের সালাম ফিরিয়েই উঠে যায়। দরজা খুলে অবাক হয় সে, তার বাবা এসেছে।

“কেমন আছো, মিউকো?”

মৃত্তিকা দরজা লাগাতে নিলেও শরীফ দরজা ঠেলে ভিতরে আসে। মৃত্তিকা রেগে একটু দূরে সরে যায়।

“আপনি এখানে কেন এসেছেন?”
“আমার মেয়েকে দেখতে আমি এসেছি।”

মৃত্তিকা কপাল কুঁচকে বলল,
“কে আপনার মেয়ে? আমি আপনার মেয়ে না। বের হন।”

শরীফ গিয়ে সোফায় বসলো,
“আমার পাশে এসে বসো।”

মৃত্তিকা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। শরীফ বলল,
“তুমি আমার সাথে থাকছো না কেন? চলো, দেশে ফিরে যাই।”
“যাবো না আমি কোথাও।”
রাগে কিড়মিড়িয়ে বলে মৃত্তিকা।

শরীফ আলতো হেসে বলে,
“তোমার মা আমাকে একা করে দিয়েছিল আর তুমিও আমাকে একা করে দিলে?”
“এটাই আপনার জন্য উচিত।”

মৃত্তিকার ঝটপট জবাবে শরীফ বেশ মন°ক্ষু°ন্ন হলো। কানের লতি চুলকাতে চুলকাতে বললেন,
“তোমরা মা-মেয়ে একা থাকার কষ্টটা বোঝো না।”

মৃত্তিকা দরজা খুলে দিয়ে বলল,
“এতোদিন যেহেতু মামকে ছাড়া একা থেকেছি তাই একা থাকতে কেমন লাগে আমি জানি। আপনি যেতে পারেন।”

শরীফ বেরিয়ে গেল। মৃত্তিকা মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিলো। তারপর আবারো এসে জায়নামাজে বসে পড়ে। দুচোখের পানি ছেড়ে দিয়েছে।
______________________________________

টিকটিক করতে থাকা ঘড়িটা জানান দিচ্ছে সন্ধ্যা ৭ টা। কিছুক্ষণ আগেই আহনাফের সাথে সারাহ্-র বিয়েটা হয়ে গেছে, আহনাফ কোনো বাধা দেয়নি। সারাহ্ এখন নিজের রুমে এসে বসেছে। মেহমানরা খাওয়া দাওয়া করছে। তারপরই সারাহ্-র বিদায়ের সময় চলে আসবে।

এখনো আহনাফের বলা কথাটার সমীকরণ মেলাতে ব্যস্ত সারাহ্। সামিহা এসে ওর পাশে বসলো।

“কিছু বলবি?”
“আপু, আজকেই তোকে নিয়ে যাবে।”

সারাহ্ একটু হেসে বলল,
“কলেজে ক্লাসের জন্য তো যেতেই হবে।”

সামিহা গালে হাত দিয়ে মাথা বাঁ°কিয়ে বলে,
“মানে ভাইয়াকে তুই আগেই দেখেছিস?”
“হুম। কেন তোরা সিভি দেখিসনি?”

সামিহা উলটো প্রশ্ন করলো,
“পছন্দ ছিল বুঝি?”

সামিহার দুষ্টুমিতে একটু লজ্জায় পড়লো সারাহ্। ছোটবোনকে আর যাই হোক, নিজের প্রথম দেখার প্রেমের কথা বলা যায় না।

“আপু, বলো না। ভাইয়াও তোমাকে পছন্দ করতো?”

এবারে সারাহ্ অন্যকথা ভাবলো। আহনাফ ওর সাথে মজা করেনি তো? এমনও তো হতে পারে ও যেভাবে আহনাফকে ভালোবেসেছে, আহনাফও সেভাবেই ওকে ভালোবাসছে।

সামিহাকে ধ°ম°ক দিয়ে বলল,
“পাকনামি করিস না, ভাগ এখান থেকে।”

একপ্রকার তাড়িয়ে দিলো সামিহাকে। সামিহা রাগ করে হয়ে বেরিয়ে আসলো। মায়ের রুমে গিয়ে তানজিমের নাম্বারে ডায়াল করলো।

“হ্যালো?”
“তানজিম, আন্টি কেমন আছেন এখন?”
“ভালো না রে, কেমন যেন চুপচাপ আর গু°মো°ট ভাবে আছে।”

সামিহা একটু চুপ করে থেকে বলল,
“ডক্টর শেষ পর্যন্ত কি বলেছে।”
“উনার সাথে কথা বলতে বলেছে আর ওষুধ কন্টিনিউ করতে। কিন্তু আম্মু তো কারো কথা শুনেনই না।”
“হয়তো শুনে, আমাকে কালকে তোদের বাসায় নিয়ে যাবি।”
“আচ্ছা।”

তানজিম ফোন রেখে মায়ের দিকে তাকালো। সবকিছু সামলে মায়ের যত্ন সে কিভাবে নিবে?

তানজিমের বাসায় এসেছে ওর মামা শাফিন সাহেব ও মামী দেলোয়ারা। মমতাজ বেগমের অসুস্থতার কারণেই এখানে আসা তাদের। দুইবোনের একমাত্র ভাই শাফিন, যে মমতাজ বেগমের ছোট আর রিপা বেগমের বড় ভাই।

শাফিন সাহেব ডাইনিং এ বসে আছে। লুৎফর রহমান উনার পাশে বসা।

শাফিন সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“ছোটবোনটা চলে গেল আর বড়বোনের এ অবস্থা, কিভাবে ঠিক থাকি বলুন দুলাভাই? মিউকো তো দেশেই আসে না।”

লুৎফর রহমান চুপ করে রইলেন। প্রিয়তমা স্ত্রীকে কোনো ভালোবাসি না বললেও সেই ভালোবাসার পরিমানটা তো কম কিছু নয়। বর্তমান যুগের ঠুনকো প্রেম তো তাদের মাঝে ছিল না।

“মমতাজকে বোঝানোর জন্য কাউকে প্রয়োজন। ইমতিয়াজ, তানজিম চেষ্টা তো করছে কিন্তু ওরা তো আর মেয়ের মতো করে বোঝাতে পারে না। (একটু থেমে) যদি মমতাজ আর ঠিক না হয়?”

লুৎফর রহমানের কথায় ভ°য়টুকুর দেখা গেল। শাফিন সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কিছুই করার নেই যে তার। তানজিম এসে উনাদের পাশে দাঁড়ালো। শাফিন সাহেব ভাগ্নের দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক একটু হাসলেন।

ইমতিয়াজ ডাইনিং এ এসে বলল,
“আসসালামু আলাইকুম, মামা।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম, ইমতিয়াজ। কেমন আছো?”
“এইতো আলহামদুলিল্লাহ।”
“কোথাও যাচ্ছো নাকি?”
“বাসায় যাচ্ছি।”
“আচ্ছা, সাবধানে যেও।”

ইমতিয়াজ সকলের থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল। ওর বাসা খুব একটা দূরে নয়। রিকশা করেই চলে যাওয়া যায়।

বাসায় পৌঁছে দেখে বাসার সামনে বাড়িওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে। ইমতিয়াজ কপাল কুঁচকে বলল,
“কোনো সমস্যা, চাচা?”

ভদ্র ভাষার কথাটা শুনে বাড়িওয়ালা পান চিবুতে চিবুতে বলল,
“না, সমস্যা তেমন কিছু না। তবে তোমাকে বাসা ছাড়ার নোটিশ দিতে আসলাম।”

সিঁড়ির রেলিং-এ হাত রেখে দাঁড়িয়ে ইমতিয়াজ বলল,
“কেন? হঠাৎ বাড়ি ছাড়ার নোটিশ কেন?”
“তুমি তো অন্য বাসার মহিলাকে ডিস্টার্ব করো। কমপেলেন পাইছি।”

ইমতিয়াজ পাশের ফ্ল্যাটের দরজার দিকে তাকালো। ওই বাসার মহিলার স্বামী দেশের বাইরে থাকে, বেশ কিছুদিন হলো ইমতিয়াজকে উনি নিজে এটা সেটা বলেছে। ইমতিয়াজ এসবে বরাবরই প্রশ্রয় দেয় না। অন্যের স্ত্রীর দিকে তাকানো তো বহু পরের বিষয়।

“কে বলেছে এসব আপনাকে?”
“যেই বলুক। তুমি বাসা ছাইড়া দেও।”

ইমতিয়াজ একটু জোরে বলল,
“ছেড়ে দাও বললেই কি ছাড়া যায় নাকি? সময় দিতে হয়।”
“বড়জোর এই মাসটা সময় দিতে পারি, এর বেশি সম্ভব না।”

বাড়িওয়ালা চলে গেল। পাশের বাসার মহিলা এসে দরজা খুললো। ইমতিয়াজ কিছু না বলে নিজের বাসায় চলে গেল।

এই মহিলা ওকে অনেক বি°র°ক্ত করেছে কিন্তু আজকের ঘটনা মাত্রাতিরিক্ত। এভাবে চরিত্রে আঙুল তুলে ইমতিয়াজের রাগটা আরো বাড়িয়েছে।
______________________________________

রাত ১১ টায় কুমিল্লা পৌঁছায় সবাই। সারাহ্কে মিষ্টিমুখ করিয়ে রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। বাসর ঘর সাজানো থাকে, ফুলের সৌরভ থাকে। সারাহ্ তো এতোদিন তাই জেনে এসেছে। কিন্তু এখানে তেমনটা নেই। পুরো বাসায় একটা গুমোট ভাব বিরাজ করছে আর এ রুমটা যেন তারই কেন্দ্রবিন্দু।

হঠাৎ সারাহ্ একটা কন্ঠস্বর শুনলো।

“বিয়ে করেছি। ব্যস, আর কোনো আবদার আমি রাখতে পারবো না। এখন বউকে কিভাবে বোঝাবে বোঝাও।”

আহনাফের কন্ঠস্বর, তারমানে সত্যিই ওর অমতে বিয়ে হয়েছে। সারাহ্ দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।

আফরোজা আহনাফের কাছে এসে নিচুস্বরে বলল,
“মেয়েটা মাত্রই বাসায় এসেছে এভাবে চেঁ°চা°মে°চি করিস না আহনাফ।”

আহনাফ আফরোজার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে চলে গেল। সারাহ্ দরজায় কান পেতেও আর কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। হঠাৎ আহনাফ এসে দরজা খুললে আহনাফের উপর পড়তে পড়তেও সরে এসেছে সে।

ভ°য়ে ভ°য়ে আহনাফের দিকে তাকাতেই আহনাফ বলল,
“বাসায় এসেই আড়িপাতা শুরু হয়ে গেছে? (একটু থেমে) শখের বশে ছোটখাটো কাজ করা ভালো, তবে বিয়ে না।”

সারাহ্ কিছুই বলল না। চুপ করে গিয়ে বসলো বিছানায়। আহনাফ ফ্রেশ হয়ে এসে রুমে একটা এয়ার ফ্রেশনার দিলো। তারপর সারাহ্-র স্বপ্ন, ইচ্ছাকে সমাধী দিয়ে এসে ঘুমাতে শুয়ে পড়লো।

কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে সারাহ্কে ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আহনাফ উঠে বসে। আয়নায় ওর প্রতিবিম্ব দেখে সারাহ্।

আহনাফ দাঁত খিঁ°চি°য়ে বলল,
“ঐশী, আপনাকে সুন্দর লাগছে।”

সারাহ্ ফিরে তাকালো। বাবা-মা তো সারাহ্ বলেই ডাকে, ঐশী নামটা রাখা হলেও সহজে কেউ ডাকে না। আহনাফের থেকে এই নামটা শুনতে সারাহ্-র ভালোই লাগলো।

আহনাফ ঠোঁট বাঁ°কিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
“এটাই তো শুনতে চাচ্ছিলেন? শুনেছেন? এখন ঘুমাতে আসুন আর না ঘুমালেও লাইটটা অফ করুন।”

সারাহ্ ওয়াশরুমে চলে গেল। আহনাফের খোঁটা দেয়া কথাটা ভালোই বুঝেছে সে। একপ্রকার ঘ°ষে ঘ°ষে মুখের মেকআপ তুলতে থাকলো। কান্না চেপে রেখে নাক টে°নে মুখ ধুয়ে বেরিয়ে এলো সে।

আহনাফ বিছানায় শুয়ে ফোন টি°প°ছে৷ সারাহ্ এসে অন্যপাশে বসে পড়লো। আহনাফ ওর দিকে একবার তাকিয়ে বামহাতের কনুইয়ে ভর দিয়ে আধশোয়া হয়ে বলল,
“কিছু বলবেন?”

সারাহ্ মাথা নাড়িয়ে বোঝালো সে কিছুই বলতে চায় না। আহনাফ নিজে থেকেই লাইট অফ করে দিয়ে বলল,
“আমি টায়ার্ড, ঘুমাবো।”
“আপনি কি আমার কথাগুলো একটু শুনবেন?”

আহনাফ সোজা হয়ে শুয়ে বলল,
“এইতো বললেন কিছুই বলবেন না। (একটু থেমে) ওকে, বলেন।”
“অন্য কাউকে ভালোবাসেন তবে আমাকে..”

সারাহ্-র কথার মাঝেই বলল,
“তবে আপনাকে কেন বিয়ে করেছি? এটাই তো বলবেন?”
“হুম।”

আহনাফ সারাহ্-র হাত ধরে টে°নে কাছে নিয়ে আসলো। আচমকা টানে আহনাফের উপরে এসে পড়লো সে, আহনাফের নিশ্বাস পড়লো ওর মুখের উপর। সারাহ্ সরতে চাইলো না, বাধা দিলো না। বরং লজ্জাবতী গাছের মতো নুইয়ে পড়লো।

“আমার ইচ্ছা হয়েছে বিয়ে করেছি, এখন ইচ্ছা হলে আরো অনেক কিছুই হবে। সো, আমার মেজাজ ভালো থাকতে দেন, এতেই আপনার ভালো।”

সারাহ্ কিছুই বলতে পারলো না, স্বরযন্ত্রটা যেন শক্ত হয়ে গেছে। শাড়ির ভাঁজ পেরিয়ে কোমড়ের কাছে আহনাফের হাতের স্পর্শ পেল। হালকা কেঁ°পে উঠতেই আহনাফ ওকে সরিয়ে দিয়ে অন্যদিকে ফিরে গেল। সারাহ্ উঠে বসে, নিশ্বাসের হার বেড়েছে ওর।

আহনাফ চোখ বন্ধ করলো। বাবা আর বোনের কথা ভেবেই বিয়ে করেছে সে, কারণ নিষেধ করেও বিয়ে আটকানো কঠিন ছিল। সারাহ্-কে কখনো ভালোবাসতে পারবে কিনা তা সে জানে না, কিন্তু জেনেবুঝে সারাহ্-র জীবন নিয়ে খেলেছে সে।
______________________________________

ইমতিয়াজ কফি বানিয়ে রুমে গিয়ে বসলো। রাত গভীর হচ্ছে আর ওর একাকিত্ব বাড়ছে। এখন আবার বাসা খোঁজার জঞ্জাল শুরু হয়েছে।

ইমতিয়াজের ফোন বেজে উঠলো। আননোন নাম্বার থেকে হোয়াটসঅ্যাপে কল এসেছে।

ইমতিয়াজ রিসিভ করে।
“হ্যালো, কে বলছেন?”

অপরপাশ থেকে কোনো কথা আসলো না। ইমতিয়াজ বলল,
“কাকে চাচ্ছেন?”

বেশ কিছুক্ষণ পর অপরপাশ থেকে বলল,
“কেমন আছেন?”

সুকন্ঠী নারী কন্ঠে ইমতিয়াজ চমকে উঠে। দ্বিধায় পড়ে বলল,
“ভালো, বাট আপনি কে?”
“মৃ..”

বলতেই কলটা কে°টে গেল। ইমতিয়াজ ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। মৃ থেকে মৃত্তিকা নয় তো? কপাল কুঁ°চকে চেয়ে রইলো সে।

এদিকে মৃত্তিকা ফোন খাটে ছুঁ°ড়ে ফেলে ফ্লোরে বসে পড়ে। আজ, এতোদিন পর কেন ও ইমতিয়াজকে কল করলো। কেন ইমতিয়াজকে ভুলতে পারছে না সে। কারণ জানা নেই ওর।
______________________________________

পরদিন,
ফজরের আযানে ঘুম ভা°ঙলো সারাহ্-র। আড়মোড়া দিতে গিয়েই খেয়াল হলো ঘুমের ঘোরে আহনাফের কাছে চলে এসেছে সে। ওর চোখের পাপড়িতে আহনাফের ঠোঁট ছুঁইয়ে আছে। সারাহ্ ধীরে ধীরে সরে আসলো।

শাড়িটা একটু ঠিকঠাক করে উঠে ফ্রেশ হতে গেল। ওযু করে এসে আহনাফকে ডাকলো।
“নামাজ পড়বেন, উঠেন।”

দুইবারের ডাকে আহনাফ চোখ খুললো। উঠে বসে বলল,
“আযান দিয়েছে?”
“হুম, আমি ওযু করে এসেছি।”

আহনাফ উঠে দাঁড়িয়ে সারাহ্-কে টেনে কাছে এনে ওর গলায় গভীর করে চুম্বন করলো। সারাহ্ অ°স্ফু°ট স্বরে বলল,
“সরুন, আমি নামাজ পড়বো।”

আহনাফ সরলো না। সারাহ্-কে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলল,
“বিয়ের তো খুব শখ ছিল, তো এসবের ধারণা ছিল না?”

সারাহ্-কে ছেড়ে দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল আহনাফ। দরজাটা বেশ জোরে শব্দ করে বন্ধ করলো। সারাহ্ নিজের গলায় হাত দিলো। আহনাফের ছোঁয়ায় ভালোবাসা নয়, একপ্রকার রাগ খুঁজে পেল সে। অন্য একজনকে ভালোবেসেও ওকে কেন বিয়ে করলো, এখনো এই কথাটাই বুঝতে পারছে না সারাহ্। একজন ছেলের এমন কি দায়ভার থাকতে পারে?

চলবে……

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

নবম পর্ব

“আজ তো ক্লাস নেই?”

আফরোজার কথায় সারাহ্ মাথা নাড়িয়ে বলল,
“না।”

আফরোজা ঘড়িতে দেখে সকাল সাড়ে নয়টা। বলল,
“আহনাফ উঠেনি এখনো?”

সারাহ্ মাথানিচু করে হালকা নাড়ালো। হঠাৎ করে হয়ে যাওয়া এ বিয়েতে মত থাকলেও সংকোচ যে সহজে কাটে না। আফরোজা মুচকি হেসে কাজে মন দিলো। মূলত সে নাস্তা সাজাচ্ছে, সারাহ্ও হাতে হাতে একটু সাহায্য করার চেষ্টা করছে।

আব্বাস সাহেব ডাইনিং-এ এসে বললেন,
“আহনাফ কোথায়? খেতে ডাকো।”

আফরোজা সারাহ্কে ইশারায় আহনাফকে নিয়ে আসতে বললে সারাহ্ রুমে চলে গেল। দরজা বুজিয়ে দিয়ে আহনাফের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ডাকতে নিয়েও থেমে গেল সে। ভোরের ঘটনার কথা মনে হয়ে গলায় হাতটা চলে গেল।

একটা ঢোক গিলে ডাকলো,
“খেতে আসুন।”

আহনাফ চোখ বন্ধ করেই বলল,
“খাবার আমার কাছে আসবে না?”

“পাগল নাকি?”

বিড়বিড় করে কথাটা বলে আহনাফকে হালকা ধা°ক্কা দিয়ে বলল,
“আপু ডাকছে।”
“আমাকে পাগল লাগছে তোমার?”

আহনাফ উঠে বসে। চুল ঠিক করতে করতে বলে,
“তোমাকে আমার পাগল মনে হয়। তারচেয়েও বেশি, ভ°য়া°ব°হ রকমের পাগল।”

ওর কথা আগের মতো লাগছে না। সারাহ্ প্র°তি°বাদ না করে চলে যেতে নিলে আহনাফ বলল,
“স্বামী সেবা না করে কোথায় যাচ্ছো?”

সারাহ্ কপাল কুঁচকে তাকালো। বলল,
“কি সেবা?”
“স্বামী সেবা। এদিকে আসো।”
হাতের ইশারায় কাছে ডাকলো।

সারাহ্ কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। আহনাফ উলটো দিকে ঘুরে বসে বলল,
“কাঁধে একটু দ°লা°ই°ম°লাই করে দাও।”
“কি?”
“কানে কম শুনো?”

একটু অস্বাভাবিক লাগছে সারাহ্-র। লোকটার আচরণ এমন কেন?

সারাহ্-র দিকে ফিরে বসে বলল,
“কি? বিয়ের শখ মিটে নি।”
“শখ শখ করছেন কেন বারবার?”
জোর গলায় জবাব দিলো সারাহ্।

আহনাফ ওর ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল,
“আওয়াজ নিচে।”

উঠে ওয়াশরুমে চলে গেল আহনাফ। প্রতিনিয়ত সারাহ্ অবাক হচ্ছে, লোকটাকে তো প্রথম দেখায় ভালো ভেবেছিল। মেয়েদের সম্মান করে ভেবেছিল, অথচ নিজের স্ত্রীর সাথে এমন ব্যবহার কেন?
______________________________________

সামিহা আজকে তানজিমের বাসায় যাবে। সুন্দর মতো তৈরি হয়েছে সে। সুতির নতুন থ্রিপিজটা পড়েছে। কচুপাতা রঙের থ্রিপিজের সাথে হালকা মেকআপ আর ঘন চুলের বিনুনিতে বেশ মানিয়েছে।

বাসায় আগে থেকেই অনুমতি নেয়া ছিল। জাহাঙ্গীর সাহেব অনুমতি দিয়ে দেয়ায় খুব একটা অমত করেননি নার্গিস পারভিন।

সামিহা বেরিয়ে এসে মেইন গেইটের কাছেই তানজিমের দেখা পেলো। ওকে দেখে একটু হেসে বলল,
“এমন পে°ত্নী সেজেছিস কেন রে?”
“হোপ, ভদ্রভাবে কথা বল। আমি জানি আমাকে ভালো লাগছে।”
“কচুশাকের মতো লাগছে। মন চাচ্ছে ভাজি করে খেয়ে ফেলি।”

সামিহা গাল ফুলালে তানজিম হেসে ওর হাত ধরে। একটু এগিয়ে বড়রাস্তায় গিয়ে বাসে উঠে দুজনে। মতিঝিল থেকে কাকরাইল, রাস্তাটা দূর নয় তবে জ্যাম ভালোই পড়ে।

দুজনেই পাশাপাশি সিটে বসলো।
“তানজিম।”
“হুম।”

তানজিম সামিহার দিকে তাকালো। সামিহা হেসে বলল,
“এতো সিরিয়াস চেহারা করেছিস কেন? (একটু থেমে) লাস্ট ক্লাসের থিওরিগুলো একটু বুঝিয়ে দিস।”

তানজিম ভ্রূ উঁচিয়ে সামনে তাকিয়ে বলল,
“ঠিক আছে।”

সামিহা বাইরে তাকায়। তানজিম চেয়ে রইলো ওর চেহারার দিকে। সত্যি আজ ওকে অনেক সুন্দর লাগছে। ওর গালে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছা করছে তানজিমের, কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নেয় সে। নজর ঘুরিয়েও লাভ হয় না, সেই সামিহার চোখের পাপড়ির ছন্দেই হারায় সে।
______________________________________

টেবিলে থাকা পেপারওয়েটটা ঘুরাচ্ছে ইমতিয়াজ। অফিসে কাজ থাকলেও আপাতত কাজে মন নেই ওর। মনের ভেতর তো°লপাড় শুরু হয়েছে, যেন যু°দ্ধ। কারণ বিশ্লেষণ করতে পারলো না সে।

ফোন হাতে নিয়ে গতদিনের নাম্বারটা বের করলো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সাত-পাঁচ না ভেবে ম্যাসেজ করলো, একটা ইমুজি পাঠিয়ে চেক করলো অনলাইনে আছে কিনা। তারপর কল করলো।

বেশ কয়েকবার কল করলেও রিসিভ হলো না। ইমতিয়াজ কপাল কুঁচকে একটু ভেবে আবারো কল দিলো। এবারে রিসিভ হলো, কিন্তু কেউ কথা বলছে না।

ইমতিয়াজ শান্ত গলায় সম্পূর্ণ আন্দাজে বলল,
“মৃত্তিকা?”

মৃত্তিকা একটু চুপ থেকে বলে,
“জি।”
“নাম্বার কোথায় পেয়েছেন?”
“তানজিম দিয়েছে।”

ইমতিয়াজ কোনো জবাব দিলো না। মৃত্তিকা নিজে থেকে বলল,
“আপনি কি সত্যি ভালো আছেন?”

একটু অস্বাভাবিক লাগছে ইমতিয়াজের। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“হুম, ভালো আছি। হঠাৎ কেন কল দিয়েছেন?”
“কোনো কারণ নেই। শুধু…”

বলেই মৃত্তিকা থেমে যায়। ইমতিয়াজ বলল,
“শুধু কি?”

অপরপাশ থেকে মৃত্তিকার ভ°য়া°র্ত কন্ঠ ফেরত আসলো,
“কি করছেন এখানে? চলে যান।”
“মৃত্তিকা?”

ইমতিয়াজের ডাকের কোনো জবাব আসলো না। কিছু একটা পড়ে যাওয়ার শব্দ পাওয়া গেল। ইমতিয়াজ একটু ঘা°ব°ড়ে গেল। আরো কয়েকবার ডাকলো মৃত্তিকাকে, কিন্তু এবারে আর কোনো সাড়াশব্দ পেল না। কলটা কেটে গেলে ইমতিয়াজ আবারো কল করলো এবারে রিসিভ হলো না, বরং নাম্বারটা অফলাইনে চলে গেল।
______________________________________

বাসায় এসে পৌঁছেছে সামিহা ও তানজিম। রাস্তার জ্যামের জন্য প্রায় ১২ টা বেজে গেছে। লুৎফর রহমান বাসায় নেই, শাফিন সাহেবও নেই।

দরজা খুললেন তানজিমের মামী দেলোয়ারা খাতুন। সামিহা মিষ্টি হেসে বলল,
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম।”

তানজিম ভিতরে গিয়ে সামিহাকে বলল,
“আয়, বস। উনি আমার মামী (দেলোয়ারা খাতুনকে বলল) মামানী, ও সামিহা, আমার ফ্রেন্ড।”

দেলোয়ারা খাতুন মুচকি হেসে বললেন,
“কেমন আছো?”
“ভালো আছি, আপনি কেমন আছেন আন্টি?”
“আলহামদুলিল্লাহ।”

তানজিম রুমে চলে গেল। দেলোয়ারা খাতুন রান্নাঘরে গেলেন। সামিহা পুরোরুমে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে। ড্রইং ও ডাইনিং এর জন্য আলাদা কোনো জায়গা নেই। ডাইনিং এর একপাশে জোড়া সোফা রাখা। ভিতরে যা আন্দাজ করলো ছোট ছোট তিনটা রুম থাকতে পারে।

তানজিম এসে বলে,
“চল, আম্মুর সাথে দেখা করবি।”
“হুম, আংকেল কোথায়?”
“দোকানে গেছে বোধহয়।”

সামিহা মাথানেড়ে উঠে তানজিমের পেছন পেছন ভিতরে গেল। মমতাজ বেগম খাটে বসে আছেন। সামিহা বলল,
“আসসালামু আলাইকুম।”

উনি তাকালেন কিন্তু জবাব দিলেন না। সামিহা গিয়ে উনার পাশে বসলো। বলল,
“আন্টি, কেমন আছেন? (একটু থেমে) আপনার ছেলেকে চলে যেতে বলুন না, আমরা একটু একা কথা বলি।”

মমতাজ বেগম ওর দিকে তাকালেন, সামিহা হেসে দিলো। ওর দুগালে হাত দিয়ে কপালে চুমো দিয়ে দিলেন। নিজের মেয়ে তাহসিনার মতোই চঞ্চল এই মেয়েটাকে তার পছন্দ হলো।

তানজিম দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। সামিহার কথায় মায়ের এইটুকু প্রতিক্রিয়াও তার সুখের কারণ।
______________________________________

বিকাল ৫ টা, সকালের খাবার খেয়েই আহনাফ বাইরে গেছে। এখনো ফেরেনি। কল করলেও রিসিভ করেনি।

বিকালে আফরোজা সারাহ্কে সাথে নিয়ে ছাদে এসেছে। সারাদিন সারাহ্কে চুপচাপ থাকতে দেখেছে ও। আফরোজা বলল,
“তুমি কি আমাকে ভ°য় পাও?”

সারাহ্ ওর দিকে তাকিয়ে জো°র°পূর্বক একটু হেসে বলল,
“না।”

আফরোজা হাসলো। বলল,
“বিয়ের প্রথম প্রথম আমারো এমন লাগতো। জুহাইবের মায়ের সাথেও কথা বলতে পারতাম না। উনি খুবই ভালো মানুষ, তবুও আমার সংকোচ কাজ করতো।”

সারাহ্ চেয়ে রইলো আফরোজার দিকে। খাঁটি বাঙালি মেয়ে কিভাবে তুরস্কে বউ হয়ে গেল ঠিক মাথায় আসছে না সারাহ্-র। তবুও প্রশ্নটা করা হলো না তার।

আফরোজা নিজে থেকেই বলল,
“মাত্র ২০ বছর বয়সেই আমি বাংলাদেশ থেকে চলে গিয়েছিলাম। (একটু থেমে) স্কলারশিপ পেয়েছিলাম আমি, আঙ্কারা ইউনিভার্সিটিতে অনার্স করতে চান্স পেয়ে গেলাম। আম্মুর অনেক ইচ্ছা ছিল আমি যেন বাইরে পড়তে যাই।”

তারপর একটু হাসলো, সারাহ্-ও হাসলো। সারাহ্ বলে,
“আপনার আম্মু?”

আফরোজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আম্মু অনেক আগেই চলে গেছে। তখন আহনাফের বয়স ছিল নয় বছর আর আমার এগারো। আম্মু ছোট থেকেই বলতো আমাদের দেশের বাইরে পড়তে পাঠাবে।”

আফরোজা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আহনাফ প্রতিদিন স্কুল থেকে এসেই কান্না করতো, ওর ফ্রেন্ডদের মা নিয়ে যায় ওর মা নেই কেন? আমি বলতাম ওই আকাশ যতদূর আছে, আম্মুও ততদূর তোর সাথে আছে।”

সারাহ্ও আকাশের দিকে তাকালো। বাবা-মা দুজনই ওর জীবিত আছে। অথচ জীবনে কতবার বাবা-মায়ের বি°রু°দ্ধে গিয়ে কথা বলেছে ও, না জানি কতবার বে°য়া°দবি করেছে, কষ্ট দিয়েছে। না থাকলে মূল্য বোঝা যায়, থাকলে তাহা বড়ই দায়।
______________________________________

সন্ধ্যা ৭ টায় ইমতিয়াজ অফিস থেকে বেরিয়েছে। সেই সকাল থেকে এই পর্যন্ত অনবরত মৃত্তিকার নাম্বারে কল করে যাচ্ছে অথচ রিসিভ হচ্ছে না। ইতালিয়ান নাম্বারটাও নেই ওর কাছে।

শেষমেশ কিছু একটা ভেবে তানজিমকে কল করলো। সামিহাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে তানজিম সবে ফিরতি পথ ধরেছে। ফোন সাইলেন্ট অবস্থায় পকেটে পড়ে আছে। ইমতিয়াজের বারবার দেয়া কলগুলো সম্পর্কে সে পুরোপুরি অ°জ্ঞা°ত।

ইমতিয়াজ রাগে রাস্তায় পড়ে থাকা ইটের টুকরায় লা°থি দিলো। মৃত্তিকার সাথে কি হয়েছে? সকালে কে ছিল ওর বাসায়? কিছুই জানে না সে।

বাসায় চলে আসলো ইমতিয়াজ। গোসল করতে চলে গেলে মৃত্তিকার নাম্বার থেকে কল আসে। দুবার বেজে কেটে যায়।

গোসল শেষে রুমে এসে ফোন হাতে নিয়ে কলব্যাক করলো। একবার বাজতেই রিসিভ হলো, যেন মৃত্তিকা ফোন হাতে নিয়ে বসেছিল।

“মৃত্তিকা, কি হয়েছিল সকালে?”

ইমতিয়াজের চিন্তিত কন্ঠ আর উ°ত্তে°জ°নায় মৃত্তিকা হাসলো। বলল,
“বাবা এসেছিল।”
“বাবা?”
“হুম, মনে আছে আমার বাবাকে?”

একটু ভেবে বলল,
“বোধহয়। কি বলেছে? সারাদিনে কোথায় ছিলেন?”

মৃত্তিকা কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলল,
“আমাকে নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছে আপনার?”

ইমতিয়াজ ফোন রেখে দিলো। সত্যিই তো কেন এতো চিন্তা হচ্ছিল ওর। অন্য মেয়ের চিন্তা মনে আনা মানে তাহমিনার সাথে প্র°তা°র°ণা করা, এমনটাই মনে করছে সে। ওর মিনার সাথে ও প্র°তা°রণা করতে পারবে না। মৃত্তিকার নাম্বারটা ব্ল°ক°লিস্টে ফেলে দিলো। ভাববে না ও কাউকে নিয়ে, ভাবতে চায়ও না। রাগে ফোনটা ছুঁ°ড়ে ফেলতে নিয়েও ফেলে না। তার এসব রাগ যে তার মিনা পছন্দ করতো না।

হঠাৎ কল কে°টে যাওয়ায় মৃত্তিকা অবাক হলো না। ফোনটা টেবিলে রেখে আবারো কম্পিউটারে মন দিলো।

ভোরে নামাজের পর যখন ইমতিয়াজ কল দিয়েছিল তখন কথা বলতে বলতে মেইন গেইটের কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল সে। তখন শরীফ এসে হাজির হয় ওর সামনে, আদর করে মেয়েকে ডাকলেও মৃত্তিকা রেগে যায়। লোকটাকে দেখলেই তো ওর রাগ হয়। ফুলের টব ছুঁ°ড়ে ফেলেছিল, আহত হয়েছে। যদিও এতে মৃত্তিকার ভ্রূক্ষেপ নেই।

তারপর অসাবধানতার জন্য ফোনটা হাত থেকে পড়ে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে যায়। এখন মাত্র অন করে ইমতিয়াজের এতোগুলো কল দেখে সে। ইমতিয়াজ তাকে নিয়ে ভাবছে, ইমতিয়াজের ভাবনার ছোট অংশে ওর স্থান আছে।
______________________________________

আহনাফ মাত্রই বাসায় আসলো। সারাহ্ চা বানাচ্ছে, আফরোজা পাশে দাঁড়ানো। আহনাফ এসে রান্নাঘরে উঁকি দিলো।

আফরোজা ওকে দেখে বলে,
“কিরে? কোথায় ছিলি সারা বিকাল?”
“প্রিন্টার কিনতে গিয়েছিলাম।”
“প্রিন্টার?”
“হুম, এটা সেটা প্রিন্ট করে বাইরে যেতে হয়, তাই ভাবলাম ঘরেই নিয়ে আসি।”

ধ°ম°কের সুরে বলল,
“দুপুরে খেতে আসিসনি কেন?”
“খেয়েছি আমি।”

সারাহ্ আড়চোখে একবার আহনাফের দিকে তাকালো। আহনাফ খেয়াল করলো সারাহ্-র দৃষ্টি, কিন্তু কিছুই বলল না। আফরোজা দুজনের দৃষ্টিই দেখেছে।

“চা নিয়ে আসো, আমি নাস্তার ব্যবস্থা করছি।”
সারাহ্ মাথা নাড়তেই আফরোজা বেরিয়ে গেল।

আহনাফ এসে সারাহ্-র পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“সব ছেড়েছুড়ে চলে যেতে ইচ্ছা করছে না?”

সারাহ্ তাকালো ওর দিকে। একেবারে পূর্ণদৃষ্টি, চোখে চোখ রাখলো। আহনাফ একবার দরজার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি বারান্দায় আছি, আমার চা ওখানে এসে দিও।”

সারাহ্ মাথা হেলিয়ে সম্মতি দিলো। আহনাফ বের হয়ে যাওয়ার সময় ফিরে দাঁড়িয়ে আঙুল উঁচিয়ে বলল,
“তুমি নিজে আসবে।”
“আচ্ছা।”

আফরোজা এসে ড্রইংরুমে সবার জন্য চা নিলো আর আহনাফের জন্য চা নিয়ে বারান্দায় গেল সারাহ্। ফ্লোরে আহনাফ বসে আছে। সারাহ্কে দেখে পাশে বসতে ইশারা করলো। সারাহ্ তাই করলো।

চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আহনাফ বলল,
“সমস্তটা দিন কোথায় ছিলাম জানো?”
“প্রিন্টার..”

আহনাফের হাসিতে সারাহ্ থেমে গেল। আহনাফ বলল,
“ও তো আপুকে বলেছি। সবাই জানুক আমি ভালো আছি।”

সারাহ্ চুপ করে রইলো, কথার অর্থ গভীর যা সে বুঝলো না। আহনাফ বলল,
“আমি নিজেকে প্রকাশ করতে পারি না। অন্যরা রেগে গেলে চেঁচায়, ভা°ঙ°চু°র করে। হাসি পেলে হাসে, কান্না পেলে কাঁদে। আমি এসব পারি না। নিজেকে অস্বাভাবিক লাগে।”

সারাহ্ মনোযোগী শ্রোতা। আহনাফ চায়ের কাপে চুমুক দেয়। তারপর বলে,
“আপুর সাথে এবার বাবাও আঙ্কারা যাবে। এবারে আমাকে নিয়ে উনারা চিন্তিত থাকবে না, কারণ তুমি আছো।”
“আমি?”

আহনাফ ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“হুম, (একটু থেমে নরম সুরে) গতরাতের বিহেভিয়ারটা অনেক খারাপ হয়েছে। এভাবে তোমাকে হে°ন°স্তা করা উচিত হয়নি। সকালে যা করেছি তাও অনুচিত ছিল। সরি ফর দ্যাট।”

সারাহ্ কি বলবে আর, এখানে কি বলার থাকতে পারে?

“সারাদিন মসজিদে ছিলাম। একাকিত্বে রবই পথ দেখান। ভেবেছি আমি এসব নিয়ে, নিজেকে যথাসম্ভব বুঝিয়েছি। (একটু থেমে) তোমার সাথে যা করেছি তারজন্য সরি, ঐশী।”

সারাহ্ অন্যদিকে তাকালো। যতটা খারাপ তাকে ভেবেছিল, ততটা খারাপ নয়। তবে ওর আচরণ যে অন্য দশটা পুরুষের থেকে আলাদা তা সারাহ্ বুঝে গেছে।

আহনাফ বলেই যাচ্ছে,
“আমি জানি না তোমাকে কতটুকু বোঝাতে পারছি। আমাকে কেন যেন কেউ বুঝে না, আমিও বোঝাতে পারি না। তবে একজন আমাকে বুঝেছিল।”

সারাহ্ ফিরে তাকাতেই আহনাফ উঠে চলে গেল। ওই একজনের ব্যাপারে জানা হলো না সারাহ্-র।

সারাহ্ উঠে রুমে এলো। আহনাফ ড্রইংরুমে চলে গিয়েছে। পড়ার টেবিলের একটা চকলেট রাখা, সাথে একটা চিরকুট।

“সরি ঐশী, এভাবে রাগ দেখানোটা আমার ভুল ছিল।”

চিরকুট পড়ে সারাহ্ নিজে নিজেই বলল,
“এ কেমন রাগ? হে আল্লাহ্, এ মানুষটাকে একটু বোধবুদ্ধি দিও।”

চলবে…..