Thursday, July 10, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 343



অনুভূতিরা শব্দহীন পর্ব-৬+৭

0

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

ষষ্ঠ পর্ব

সামিহার ক্লাস শেষ হয়েছে বহু আগে। এখন সে শ°হী°দ মিনারের সামনের সিঁড়িতে বসে, এক সিঁড়ি উপরে বসে আছে তারই বেস্টফ্রেন্ড তানজিম। আজ দুজনের তুমুল ঝগড়া হয়েছে, সে রাগ ভা°ঙাতেই পিছুপিছু এসেছে তানজিম।

“সামি, দেখ এসব নরমাল। লামিনা তো..”

তানজিমের নরম কথায় সামিহা একটা মুখ ঝামটা দিয়ে বলে,
“একদম ওই মেয়ের নাম মুখে আনবি না। গলা চি°পে ধরবো।”

দুহাত বাড়িয়ে বলা শেষের কথায় তানজিম একটু সরে যায়। বলল,
“দেখ, লামিনা আমার পাশে বসেছে, হাত ধরেছে। ওই ধরেছে, আমি তো কিছু করিনি।”

সামিহা ভেং°চি কেটে বলল,
“আহাগো, সাধু আমার, তুইও তো বারবার মেয়েটার দিকে তাকাচ্ছিলি। আমি কি দেখিনি ভেবেছিস?”

ঘটনাটা হলো এই যে প্রতিদিনের মতো আজ ক্লাসে তানজিমের পাশে জায়গা পায়নি সামিহা। অন্য একটা মেয়ে, লামিনা ওর পাশে বসেছিলো আর ওর হাতও ধরেছিলো। ব্যস, এইটাকে পুঁজি করে ঝ°গড়া শুরু করে সামিহা। যদিও হাতটা ইচ্ছাকৃত ধরেনি, ক্লাস থেকে বের হওয়ার সময় পড়ে যেতে নিয়ে হঠাৎ ধরে ফেলে।

তানজিম এসে সামিহার পাশে বসে একহাত ধরে বলল,
“আমার বউ তো তোর জ্বা°লা°য় সংসারই করতে পারবে না।”
“থা°প্প°ড় দিবো। বাচ্চা ছেলে, সারাদিন বউ বউ করে শুধু।”
“কিসের বাচ্চা? পুরো ২২ বছর আমার।”

সামিহা চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলল,
“এমন কি কিছু বেশি হয়েছে?”

তানজিম হেসে উঠে গেল। একটু দূরে বসে ফুল বিক্রি করতে থাকা ছোট মেয়েটার কাছ থেকে শিউলি ফুলের মালা নিয়ে আসে। সামিহার ডানহাতে মালা পেঁ°চি°য়ে দিতে থাকে সে। সামিহা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে তানজিমের দিকে। ওর হাতের দিকে তাকিয়ে তানজিমের ঠোঁটের হাসিটা দেখে হঠাৎ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো সে।

তানজিম বলল,
“লামিনাকে মালা কিনে দিয়েছি? নিজে থেকে হাত ধরেছি? তবে রাগ করিস কেন?”

সামিহা কিছুক্ষণ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখে। তারপর বলে,
“অন্য কারো সাথে মিশলে বেস্টফ্রেন্ডের খারাপ লাগতেই পারে।”
“আচ্ছা, আর মিশবো না।”
“গুড বয়।”
তানজিমের গাল টে°নে দিলো সামিহা।

ভার্সিটির প্রথমদিনই দুজনের আলাপ হয়। মনস্তাত্ত্বিক মিল থাকায় ধীরে ধীরে তা বন্ধুত্বে পরিণত হয়। বন্ধু থেকে সেরা বন্ধু হয়ে উঠে দুজনে। একে অন্যকে চোখে হারায় অবস্থা। যদিও ওদের সম্পর্ককে অনেকে অন্য নামে ডাকে, তবে ওরা সম্পর্কের বিশেষ নাম দিতে নারাজ।
______________________________________

লাঞ্চ টাইমে অফিস থেকে বেরিয়ে গেছে ইমতিয়াজ। অর্ধদিবস ছুটি নিয়ে কাকরাইল গো°র°স্থানে এসেছে তাহমিনার কবর যিয়ারাত করতে। কবরের সামনে দাঁড়িয়ে সূরা ফাতিহা পাঠ করে দোয়া করলো। আজও তার চোখের কোণে জল জমে, কন্ঠ ভারী হয়, নিশ্বাস থেমে আসে। তার মিনা আর সন্তান কি করে আছে ওই অন্ধকারে।

কবর পরিচর্চার লোক থাকলেও তাহমিনার কবরটা নিজেই পরিষ্কার করলো। সাথে করে নিয়ে আসা বেলী আর গোলাপের চারা লাগিয়ে দিলো। বোতল থেকে পানি ঢেলে ভিজিয়ে দিলো গাছের গোড়া।

“মিনা, অন্ধকারে ভয় করে তোমার? আমাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করে না? আমার যে খুব করে ইচ্ছা করে তোমাকে দেখতে, তোমার কন্ঠ শুনতে, তোমার ব°কা শুনতে।”

কথাগুলো বলতে বলতে হুট করে কেঁদে দেয় ইমতিয়াজ। অনেকটা সময় বসে থাকে সে। উঠতে চেয়েও উঠতে পারে না। অদৃশ্য আকর্ষণে আটকে আছে সে।

“মিনা, ফিরে এসো।”

অসম্ভব এই কথা খানা বারবার বলতে থাকে ইমতিয়াজ। ভালোবাসায় পিপাসায় তৃষ্ণার্ত এই মানুষটা বারে বারে তার মিনাকে ফিরে পেতে চায়।

“তুমি আসবে না, মিনা। আমাকে তবে তোমার কাছে নিয়ে নাও।”
______________________________________

সন্ধ্যা ৭ টায় আফরোজাকে নিয়ে শপিং এ এসেছে আহনাফ। কলেজে একটা কাজে আটকে পড়ায় তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরা হয়নি তার। তাইতো সন্ধ্যা করে বের হওয়া হয়েছে।

আফরোজা শাড়ি দেখছে, আহনাফ পাশে বসে আছে। আফরোজা একটা শাড়ি দেখিয়ে বলল,
“এই শাড়িটা কেমন?”

আহনাফ একবার শাড়িটা দেখল। তারপর বলল,
“চলে।”

ওর কথায় বোঝা গেল এসবের ওর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। আফরোজা ফের শাড়ি দেখায় মন দিলো। গাড় নীল ও সোনালী রঙের বেনারসি শাড়ি দেখিয়ে বলল,
“এটা?”

আহনাফের এবার বি°র°ক্ত লাগলো। বলল,
“যা নিবে নাও তো আপু।”

আফরোজা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আর কিছুই বলে না। আহনাফ হালকা গোলাপী রঙের একটা শাড়ি দেখিয়ে বলে,
“এটাতে তোমাকে ভালো মানাবে।”

আহনাফ জানে ওর বিয়ের জন্যই শাড়ি কেনা হচ্ছে। তবুও এভাবে কথাটা বলে উঠে চলে যায়। আফরোজা আলতো হেসে বলল,
“এটা প্যাক করুন।”

শাড়ির পর কিছু কসমেটিকস কেনা হলো, সাথে একটা ফোনও কিনলো। আহনাফ বুঝে গেছে যেকোনো মূল্যে ওকে বিয়ে করাবে সবাই। ও রাজি না থাকলে জোর করবে, পাত্রী পছন্দ না হলেও বিয়ে করাবে।

ওরা এবারে ব্যাগের দোকানে এসেছে। ওরা বললে ভুল হবে কারণ স্বেচ্ছায় এসেছে আফরোজা আর একপ্রকার মনের বিরুদ্ধে জোর করে এসেছে আহনাফ। অকারণে মার্কেটে ঘুরে বেড়াতে ওর মোটেও ভালো লাগছে না।

আফরোজা বেশ মনোযোগ দিয়ে ব্যাগ দেখছে। আহনাফ বলল,
“আপু, মনে একটা প্রশ্ন ঘুরছে।”
“হ্যাঁ, বলে ফেল।”
“যদি পাত্রী পছন্দ না হয়?”
“তবে চলে আসব।”
ঝটপট জবাব দেয় আফরোজা।

আহনাফ অন্যদিকে তাকিয়ে আলতো হাসে। দোকানের আয়নায় ওর প্রতিবিম্ব টা দেখে আফরোজা। পাত্রী পছন্দ হলেও বিয়ে যে আহনাফ করতে চাইবে না তা আফরোজা অন্তত ভালো করে বুঝেছে।
______________________________________

ইতালির ঘড়িতে দুপুর আড়াইটা। অফিসের কাজে ব্যস্ত মৃত্তিকা। এমন সময় তানজিমের নাম্বার থেকে কল আসে। ফোনের ভাইব্রেশন চালু ছিল, অনবরত ফোন কাঁ°পছে। মৃত্তিকা ফোনের দিকে তাকিয়ে আবারো কম্পিউটারের স্ক্রিনে মনোযোগ দেয়।

বেশ কয়েকবার কল আসায় অবশেষে রিসিভ করে সে।
“আসসালামু আলাইকুম।”

মৃত্তিকার নরম কন্ঠের সালামের জবাব দেয় ইমতিয়াজ,
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম।”

হুট করে এতদিন পর এই কণ্ঠ শুনে ফোনটা কান থেকে দূরে সরায় মৃত্তিকা। সেই পুরোনো অনুভূতিগুলো জেগে উঠার ভ°য়ে ভী°তু হয় সে।

খানিক বাদে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
“কে বলছেন?”
“আমি ইমতিয়াজ। আসলে মা আপনার সাথে কথা বলতে চাইছে, তাই..”

ইমতিয়াজ থেমে যেতেই মৃত্তিকা অস্থির হয়ে বলল,
“বড়মনিকে ফোন দিন।”

মমতাজ বেগমের হাতে ফোন দেয় ইমতিয়াজ। মুখে বলে,
“মা, মিউকো কলে আছে।”

ফোন নিয়ে মমতাজ বেগম বলে,
“মিউকো, কেমন আছো মা?”
“ভালো আছি বড়মনি। আপনারা কেমন আছেন?”
“আমরাও ভালো আছি। তা রিপার কি খবর?”

মৃত্তিকার কণ্ঠনালী পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। অনবরত কাঁপতে থাকা কন্ঠে বলে,
“মাম ভালো আছে।”
কথাটা বলে দু চোখের জলের ফোয়ারা ছেড়ে দেয়।

আর কথা বলতে পারে না মৃত্তিকা। কোনরকমে বলে,
“বড়মনি, আমি অফিসে আছি। বাসায় গিয়ে কথা হবে।”
“তখন রিপাকে দিও। রিপা তো নিশ্চয়ই আমার সাথে রাগ করে আছে।”
“মাম রেগে নেই বড়মনি। রাখছি।”

কল কা°টার আগেই ইমতিয়াজের কন্ঠ শুনে মৃত্তিকা। মমতাজ বেগমকে বলছে,
“মা, এখন আপনি রেস্ট নিন।”

মৃত্তিকা ফোন রেখে দিলো। যে অনুভূতিকে ও আরো আগেই ত্যাগ করেছে, তা নতুন করে জেগে উঠুক তা সে চায় না। যোজন যোজন দূরে সেই বাংলাদেশে ফেলে আসা ওই লোকটার সামনে আর যেতে চায় না। থাকুক সবাই নিজের মতো ভালো অথবা খারাপ।
______________________________________

পরদিন,
ফজরের পরই জাবেরকে নিয়ে দুষ্টুমিতে মজেছে আহনাফ। ছোট জাবের এখনো কথা বলা শিখেনি। হু, হা করে আর আধো আধো বুলিতে মা বলতে পারে। সেও আহনাফের সাথে খিলখিল হাসিতে মজেছে।

দুজনের একজনেরও ঘুম নেই। আফরোজা প্রচন্ড বি°র°ক্ত আহনাফের উপর আর ওকে ইচ্ছা করে আরো বি°র°ক্ত করাচ্ছে আহনাফ।

“আপু, কাল তো ঢাকায় যাবি?”
“হুম।”
আফরোজা গমগমে সুরে বলল।

“আপু, পাত্রীর কোনো ছবি নেই?”
“কেন?”
“মানে টাকা খরচ করে ঢাকা যাওয়ার থেকে এখানে দেখে নিলেই ভালো হতো না?”

আফরোজা তেতিয়ে উঠে,
“না, তুই কেন এমন করছিস আহনাফ?”

আফরোজা ড্রইংরুমে এসে আহনাফের সামনে বসে বলল,
“বিয়ে করা তো সুন্নত। তবে তোর এতো সমস্যা কেন?”
“আর স্ত্রীকে মর্যাদা দিতে হবে না? সম্মান দিতে হবে না? ভালোবাসতে হবে না? শুধু বিয়ে করলেই কি সব খতম?”

আহনাফের কথায় আফরোজা চুপ করে। আহনাফ আবারো বলল,
“একটা মেয়ে নিজের পরিবার, বাবা-মা সব ছেড়ে আমার কাছে আসবে আর আমি তাকে ভালোবাসতে পারবো না, এতে কি সে সুখী হবে আপু?”

ভাইয়ের দুইগালে হাত দেয় আফরোজা। শান্ত গলায় বলে,
“যে ছেলের এই বোধবুদ্ধি আছে সে সুখী রাখতে না পারলেও খারাপ রাখবে না। (একটু থেমে) বাসায় একজন নারীর পদচারণ দরকার। সংসার সাজানোর জন্য, আগলে রাখার জন্য কাউকে দরকার।”

আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারো জাবেরের দিক মন দেয়। ওর গালে চুমো খায়। আফরোজা বলল,
“তোর সন্তান লাগবে না? তোর সন্তানের জন্য, এ বংশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য তোর বিয়ে করা দরকার।”

আহনাফ হুট থেকে থমকে গেল। একটু অপ্রস্তুত সে। আফরোজা যেন আগে থেকেই সব যুক্তি সাজিয়ে রেখেছে।

আফরোজা উঠে জাবেরকে নিয়ে চলে গেল। আহনাফ সোফায় হেলান দিয়ে বসে ভাবতে লাগলো। আফরোজার কথাগুলো নিয়ে ও ভাবছে না, ও ভাবছে তাহসিনাকে নিয়ে। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেল আহনাফ।

আব্বাস সাহেবের ডাকে ঘুম ভা°ঙে৷
“আহনাফ, কলেজ যাবে না?”

চোখ কচলে উঠে বসে। অসময়ের ঘুম সহজে কা°টতে চায় না। আহনাফ উঠে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিলো।

তারপর এসে নাস্তার টেবিলে বসলো। জুহাইব বলল,
“এবারে কিন্তু ছুটি কম, শালাবাবু। মাত্র দুসপ্তাহ।”
“শালাবাবু বইলেন না তো ভাইয়া। অদ্ভুত শোনায়।”
“শুধু শালা বললে তো গা°লি গা°লি লাগে।”

জুহাইবের কথায় উপস্থিত সবাই হেসে দিলো। আহনাফ কোনোমতে হাসি থামিয়ে বলল,
“ভাইয়া, এই গা°লি কোথায় শুনেছেন?”
“আমার এক বাঙালি কলিগ যাকে তাকে রেগে গেলেই শালা ডাকতো। তার থেকেই একদিন জেনেছি এটা গা°লি।”

আহনাফ ঠোঁট টি°পে হেসে বলল,
“নির্ঘাত চাঁটগাইয়া।”

আবারো হাসির রোল পড়লো। সকলের হাসির মাঝে আফরোজার হাসিটা ফিকে লাগছে। আহনাফ দেখলো বোনের অবস্থা, বুঝতেও পারলো কিন্তু কিছু বলল না।

নাস্তা শেষে আহনাফ রেডি হয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। পরপর দুটো ক্লাস থাকায় আজ বেশ ব্যস্ত সময় কাটবে তার।

কলেজের সামনে সারাহ্ রিকশা থেকে নেমে উপর পাশে আহনাফকে দেখলো। ওকে দেখেই মুচকি হাসলো সারাহ্। ভিতরে আসার সময় আবারো ফিরে তাকালো আহনাফের দিকে। হালকা নীল শার্ট আর ধূসর রঙের ফর্মাল প্যান্টে বেশ সুদর্শন লাগছে তাকে।

সারাহ্ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিজেকে বলে,
“এসব ঠিক হচ্ছে না, সারাহ্। এই লোকে আসক্ত হোস না।”

আহনাফ ক্লাসে গেল। সকাল নয়টা থেকে নয়টা পঞ্চাশ প্রথম ক্লাস এবং দশটা থেকে দশটা পঞ্চাশ দ্বিতীয় ক্লাস নিয়েছে সে। ক্লাস থেকে বেরিয়ে বারান্দায় আসতেই পেছন থেকে একজন মেয়ে ডাক দিলো,
“স্যার?”

আহনাফ ফিরে তাকালো।
“ইয়েস, এনি প্রবলেম?”

মেয়েটি এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
“মেনি প্রবলেম স্যার।”
“কি হয়েছে?”
“আপনি সেই প্রবলেম স্যার।”

আহনাফ ভ্রূ কুঁচকায়। বি°ভ্রা°ন্তি নিয়ে বলে,
“আমি.. কিভাবে?”

মেয়েটি আরেকটু কাছে আসতে নিলে আহনাফ বলল,
“কিপ ডিসটেন্স।”
“ওকে।”

মেয়েটি দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল,
“স্যার, আমি ফিদা। (একটু থেমে) আপনার উপর ফিদা।”

আহনাফ রেগে গেছে। তবুও চুপ করে আছে। মেয়েটি দুহাত একবার উপরে একবার নিচে নিয়ে বলল,
“আপনার এটিটিউটে আমি পুরোই..”

কথা শেষ করার আগেই মেয়েটির গালে একটা চ°ড় পড়ে। আহনাফ নিজেও চমকে উঠে। চ°ড়টা তো আহনাফ দেয়নি, দিয়েছে পাশ দিয়ে যাওয়া সারাহ্।

ক্লাসে যাচ্ছিল সে, মেয়েটির কথা শুনে রেগে গিয়ে চ°ড় বসিয়ে দেয়।

“একজন স্যারের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানো না? বে°য়া°দ°ব।”
“সরি ম্যাম।”
“ক্লাসে যাও।”

সারাহ্-র ক°র্ক°শ কন্ঠের ঝা°রি খেয়ে মেয়েটি ক্লাসে চলে গেল। সারাহ্ আহনাফের দিকে ফিরে বলল,
“স্টুডেন্টদের মাথায় তুলবেন না। পরে আপনার মাথায়ই কাঁঠাল ভে°ঙে খাবে।”

আহনাফ বুকের হাত বেঁধে ভ্রূ উঁচিয়ে মাথা নাড়ালো। সারাহ্ হেলেদুলে ক্লাসে চলে গেল। এই মানুষটার উপর একটা অধিকার অনুভব করছে সে। খুব করে চাচ্ছে, এ অধিকার বৈ°ধ হয়ে আসুক ওর কাছে। ক্লাসে যাওয়ার আগে আবারো পিছনে ফিরে আহনাফের দিকে তাকায় সে। আহনাফ টিচার্স রুমের দিকে যাচ্ছে। সারাহ্ মাথানেড়ে হেসে ক্লাসে যায়।

চলবে…..

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

সপ্তম পর্ব

ঘড়িতে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা, ঢাকার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে সারাহ্। শা°স°ন°গাছায় কোনো এসি বাস পায়নি, তাই স্টেশন রোড বিআরটিসি কাউন্টারে চলে এসেছে সে। টিকেট কিনে ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করতে লাগলো।

ফোন বের করে কল করলো বাবাকে।
“আসসালামু আলাইকুম, বাবা।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। গাড়িতে উঠছো?”
“না, বাবা। টিকেট কিনেছি।”
“আচ্ছা, গাড়িতে উঠে জানিও। আমি বাজারে আছি, পরে কথা বলবো।”
“আচ্ছা বাবা।”

জাহাঙ্গীর সাহেব ফোন রাখলেন। কাল মেয়েকে দেখতে আসবে সেসবের জন্য বাজার আর সবকিছু গোছানো উনার একার জন্য একটু কষ্টসাধ্যই বটে। তবুও নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন উনি।

সারাহ্ জানলা দিয়ে বাইরে তাকালো। উঁচুনিচু রাস্তার অপরপাশের দোকানগুলোতে হঠাৎ করে দেখলো এক লোককে। চেনা লাগলো সারাহ্-র, কিন্তু ঠিক চিনতে পারলো না। ভালো করে দেখার জন্য ব্যাগটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল।

এরমধ্যে বাস চলে আসায় লোকটাকে আর দেখা হলো না সারাহ্-র। বাসে উঠে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে লোকটাকে আর দেখলো না সারাহ্, লোকটা নেই ওখানে। কপাল কুঁচকে মস্তিষ্কের মধ্যে আ°তি°পা°তি করে খুঁজতে লাগলো সে, যদি মনে পড়ে লোকটাকে কোথায় দেখেছে।

“এক্সকিউজ মি, আপনার ব্যাগটা একটু সরান।”

পাশে দাঁড়ানো লোকটার কথায় চমকে উঠে সারাহ্ দ্রুত ব্যাগটা সরিয়ে ফেলে। তাকিয়ে দেখে এই তো সেই লোকটা। এবারে মনে পড়ে সারাহ্-র। এই মানুষটাই তো তাকে দু°র্ঘ°ট°নার হাত থেকে বাঁচিয়েছিল।

ইমতিয়াজ সিটে বসে ঘড়িতে সময় দেখলো। হঠাৎ সারাহ্-র দিকে চোখ পড়ায় দেখে সারাহ্ ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। ইমতিয়াজ কপাল কুঁ°চকে বলল,
“কিছু বলবেন?”
“আপনাকে আমি চিনি বোধহয়।”

ইমতিয়াজ একটু হাসলো। বলল,
“কি বলছেন আপনি এসব?”
“আপনি একবার রাস্তায় আমাকে সাক্ষাৎ মৃ°ত্যু থেকে বাঁচিয়েছিলেন। মনে আছে, ঢাবিতে? শ°হী°দ মিনারের সামনে?”

ইমতিয়াজ একটু অন্যমনস্ক হয়ে বলে,
“যদি এভাবে তাকেও বাঁচাতে পারতাম।”
“কাকে?”

ইমতিয়াজ চুপ করে অন্যদিকে তাকালো। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলল,
“আমার স্ত্রীকে।”

সারাহ্ বুঝতে পারছে ইমতিয়াজের স্ত্রী হয়তো এই পৃথিবীতে নেই আর থাকলেও হয়তো অসুস্থ হয়ে আছে। বিষয়টা নিয়ে জানার আগ্রহ থাকলেও কিছু জিজ্ঞাসা করে না সে।

ইমতিয়াজ সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। সারাহ্ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“আপনার নামটা জানা হয়নি।”

ইমতিয়াজ চোখ খুলে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“সৈয়দ ইমতিয়াজ সৌরভ।”
“আমি সারাহ্ তাসনিম ঐশী।”

ইমতিয়াজ নিজে থেকেই বলল,
“কুমিল্লায় থাকেন?”
“হ্যাঁ, ভিক্টোরিয়া কলেজের কেমিস্ট্রি টিচার।”

ইমতিয়াজ ঠোঁট উলটে মাথা নাড়ায়। সারাহ্ বলল,
“আপনার বাসা কুমিল্লায় নাকি ঢাকায়?”
“ঢাকায় থাকি, এখানে গ্রামে এসেছিলাম।”
“ওহ, আন্টি-আংকেল গ্রামে থাকে?”
“আমার বাবা-মা কেউ নেই।”

ইমতিয়াজের কথায় থমকে যায় সারাহ্। এভাবে প্রশ্নটা করা যে ওর উচিত হয়নি তা ভালো করেই বুঝতে পেরেছে। একটু অনুতপ্ততা নিয়ে বলল,
“সরি, আসলে..”

ওর কথার মাঝেই ইমতিয়াজ বলে,
“ইটস ওকে।”

ইমতিয়াজ আবারো চুপ করে। গ্রামে চাচার বাড়িতে গিয়েছিল সে। চাচা অসুস্থ, চাচী কল করে যেতে বলায় যেতেই হয়েছে ওকে। ওর বাবার মৃ°ত্যুর পর এই চাচাই ওর আর দেখাশোনা করেনি। ১৭ বছর, অনেক বেশি, নিজের পথ নিজে দেখ বলে দূরে পাঠিয়ে দিয়েছে। অর্থ না হোক, সাহস দেয়ার জন্যও কাউকে প্রয়োজন হয়। ইমতিয়াজ এমন কাউকেও পায়নি। অথচ আজ চাচার কথা শুনে না এসে পারেনি সে।
______________________________________

ব্যাগপত্র গোছাচ্ছে আফরোজা। আহনাফ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ওকে দেখছে। আফরোজা ওকে দেখে বলল,
“কিছু বলবি?”
“না, কিছু বললেও তো তুমি শুনবে না।”

আফরোজা ধুম করে ট্রলি ব্যাগটা বন্ধ করে বলল,
“কি শুনবো বল তো? বিয়ে করবি না, তাইতো?”

আহনাফ চুপ করে রইলো। আফরোজা নরম কন্ঠে বলল,
“আমি জানি তুই তাহসিনাকে ভুলতে পারিস নি, সহজে ভুলতে পারবিও না। কিন্তু একা কেউ বাঁচতে পারে না আহনাফ। সাথে কাউকে তো চাই।”

আহনাফ মাথানিচু করে চলে গেল। আফরোজার কোনো কথার জবাব দেয়ার ইচ্ছা ওর নেই।

রুমে এসে বিছানায় বসে পড়লো। এ কেমন পরীক্ষায় পড়লো সে? অন্য একজন নারীর বিচরণ হবে ওর জীবনে। কল্পনায় আনতেও কষ্ট হচ্ছে তার।
______________________________________

ইমতিয়াজ ঘুমিয়ে পড়েছিল, সারাহ্-র ডাকে ঘুম ভা°ঙলো। চমকে উঠে বলল,
“মিনা।”

সারাহ্-ও একটু ভ°য় পেয়ে গেল। ইমতিয়াজ ওর দিকে তাকিয়ে থেমে গেল, মিনা যে আসেনি।

সারাহ্ নিচুস্বরে বলল,
“টিকেট চেক করতে এসেছিল, আপনি ঘুমিয়ে ছিলেন।”
“ওহ।”

ইমতিয়াজ কন্ডাক্টরকে ডেকে টিকেট দেখালো। সারাহ্ বলে,
“মিনা কি আপনার স্ত্রীর নাম?”

ইমতিয়াজ নিজের হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, তাহমিনা রহমান।”
“ওহ, কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করতে পারি?”
“জি, বলুন।”
“কি হয়েছিল উনার?”

ইমতিয়াজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“রোড এ°ক্সি°ডে°ন্ট, মাঝ সড়কে আমার অনাগত সন্তানকে নিয়ে তার মা চলে গেল। একবার হাসপাতালে নেয়ার সময়টুকুও দেয়নি।”

সারাহ্ চেয়ে রইলো ইমতিয়াজের দিকে। বাইরের আলোকে দেখলো তার চোখদুটো চিকচিক করছে, নিশ্চয়ই পানি জমেছে। সারাহ্ বলল,
“সরি।”
“ব্যাপার না।”

ইমতিয়াজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“ঢাকায় কি কোনো বিশেষ কাজে যাচ্ছেন? (একটু থেমে) মানে রাত করে যাচ্ছেন তাই জিজ্ঞাসা করলাম।”
“আসলে ক্লাস ছিলো বলে সকালে যাওয়া হয়নি।”
“ওহ।”

ইমতিয়াজের কল আসায় ফোন বের করে দ্রুত রিসিভ করে,
“হ্যাঁ, তানজিম।”
“ভাইয়া, আম্মু কেমন যেন করছে? আপুদেরকে খুঁজছে আর প্রচন্ড কান্নাকাটি করছে।”

ইমতিয়াজ ভ°য় পেয়ে যায়।
“কি বলছো তুমি? এখন কোথায় আছে?”
“বাসায়ই আছে, কিন্তু আমরা কেউ সামলাতে পারছি না। আপনি তাড়াতাড়ি আসেন।”
“আমি তো বাসে, কুমিল্লা থেকে আসছি। (একটু থেমে) আমি ডক্টর আরিফাকে জানাচ্ছি।”

ইমতিয়াজ কল কে°টে আরিফার নাম্বারে ডায়াল করে। কয়েকবার কল হলেও রিসিভ হয় না। চিন্তায় পড়ে যায় ইমতিয়াজ। গত দুইবছর ধরে আরিফার কাছের চিকিৎসারত আছেন মমতাজ বেগম। অবশেষে আরিফা রিসিভ করে আর ইমতিয়াজ উনাকে পুরো ঘটনা বুঝিয়ে বলে উনাকে তানজিমদের বাসায় যাওয়ার অনুরোধ করে।
______________________________________

পরদিন,
ভোর ভোর ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় আহনাফ ও তার পরিবারের সবাই। পরিবার বলতে তো আব্বাস সাহেব, আফরোজা, জুহাইব আর জাবের। মতিঝিলের কাছে সারাহ্দের বর্তমান বাসা। ওরা আগে মতিঝিলে ওর চাচার বাসায় যাবে, সেখান বিকালে থেকে সারাহ্-র বাসায় যাবে।

এদিকে সারাহ্-র বাসায় চলছে মহা আয়োজন। সামিহা ঘর গুছিয়ে রেখে তানজিমকে কল করে,
“তানজিম, আজকে আসবি না?”

তানজিম কান্না করছিল, নাক টে°নে বলল,
“আম্মু অসুস্থ সামি, আমরা হাসপাতালে।”

আচমকা উ°ত্তে°জ°নায় সামিহার ঠোঁটদ্বয় ফাঁক হয়ে গেল। সারাহ্-র দিকে একবার তাকিয়ে বারান্দায় চলে গেল। মমতাজ বেগমের অসুস্থতার ব্যাপারে সে জানে, যদিও পুরো কারণ জানে না।

“কোন হাসপাতালে আছিস? আমি আসবো।”
“না, আপুর আজ বিয়ে আর তুই আসবি।”
“বিয়ে না, দেখতে আসবে। পছন্দ হলে বিয়ে হবে। বাবা সামলে নিবে, আমি আসবো, আসবোই।”

তানজিমের নিষেধ শুনতে রাজি নয় সামিহা। তানজিম ওকে ঠিকানা বলতে বাধ্য হলো। আটটার দিকে জাহাঙ্গীর সাহেবের অনুমতি নিয়ে বেরিয়ে গেল সামিহা।

এনআইএমএইচের কাছে এসে তানজিমকে কল করে। তানজিম এসে ওকে নিয়ে উপরে যায়। চারতলায় মমতাজ বেগমের সেশন চলছে। বাইরে অপেক্ষারত আছে তানজিম, ইমতিয়াজ ও লুৎফর রহমান। সামিহা উনাদেরকে সালাম দিয়ে তানজিমের কাছেই বসে রইলো।

“আন্টির এ অবস্থা কেন হয়েছে তানজিম?”

তানজিম দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বলল,
“আপুদের কথা মনে করে কালকে অনেকক্ষণ চেঁচামেচি করেছে। তারপর হঠাৎ করেই জ্ঞান হারায়। (একটু থেমে) ডক্টর আরিফা বাসায় এসে মাকে দেখলেও সকালে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ায় এখানে নিয়ে আসা হয়। এখন সিনিয়র ডক্টর রিজভী উনার সেশন নিচ্ছে।”

সামিহা তানজিমের হাত ধরে বলল,
“চিন্তা করিস না সুস্থ হয়ে যাবে।”
“হুম।”
বলে তানজিম হালকা মাথা নাড়ালো।
______________________________________

দুপুরে আহনাফ কাকরাইল এসেছে। তাহসিনার কবরের কাছে কিছুক্ষণ কাটালো। তারপর তানজিমদের বাসায় গেল। বেল বাজাতেই ইমতিয়াজ এসে দরজা খুললো। মমতাজ বেগমকে নিয়ে কিছুক্ষণ আগেই বাসায় এসেছে ওরা।

আহনাফকে দেখে ইমতিয়াজ একটু অবাক হলো। বলল,
“আরে আহনাফ, কেমন আছো?”
“এইতো মোটামুটি আছি। আন্টি কেমন আছেন?”
“ভিতরে এসো।”

আহনাফ ভিতরে গেল। সোফায় বসতেই তানজিম আসলো।
“আহনাফ ভাইয়া, ঢাকায় হঠাৎ?”

ইমতিয়াজ ভিতরে চলে গেল। আহনাফ একটু ইতস্ততভাবে বলল,
“চাচার বাসায় এসেছি।”

বিয়ের কথাটা বলা হলো না আহনাফের। তানজিম জানলে হয়তো কষ্ট পাবে। ওর নিজেরও খারাপ লাগবে এতে। এমনিতেও উনাদের মানসিক অবস্থা ভালো নেই।

“আম্মু ভিতরে আছে, চলেন দেখা করবেন।”

মমতাজ বেগমের সাথে দেখা করলো, কথা হলো না। উনি শান্ত হয়ে গেছেন। এতোদিন পর উনার মনে হচ্ছে উনার মেয়েরা নেই, চলে গেছে। উনি বুঝতে পেরেছেন উনার ছোটবোন নেই, যে বোনের সাথে সুন্দর সময়গুলো কাটানো হয়েছিল সেই বোন। থেমে থেমে ঠোঁট কেঁপে উঠে উনার, কাঁদতে থাকেন। আবারো থামেন, কিছু ভাবেন। জীবন চলছে না উনার, যেন মৃ°ত্যু°র দিনক্ষণ গুণছেন।
______________________________________

বিকালের আগেই সারাহ্-কে সাজানো হলো। রোজ গোল্ড রঙের জামদানি শাড়ির সাথে স্বর্ণের ছোট ছোট গহনাগুলো বেশ ভালো মানিয়ে নিলো। মুখের হালকা মেকাপ আর চোখের গাঢ় কাজল যেকারো নজর কাড়তে বাধ্য হবে৷ হালকা গোলাপী রঙের হিজাব পড়ে নিলো সে।

সামিহা ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
“বাহ, কি সুন্দর লাগছে আমার আপুকে। এতোদিন এমন রা°ক্ষু°সির মতো লাগতো কেন?”
“কি?”

সারাহ্-র রাগ করা কথায় হেসে দিলো সামিহা। সারাহ্ আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে বলল,
“সকালে কোথায় গিয়েছিলি?”
“হাসপাতালে, তানজিমের মা অসুস্থ।”
“ওহ, কি হয়েছে আন্টির?”
“উনি মানসিকভাবে একটু অসুস্থ।”

সারাহ্ আয়না দিয়েই সামিহার চেহারার দিকে তাকালো। আশেপাশে এতো মানুষ আছে, অথচ একেকজনের একেক সমস্যা। না কেউ কারো সমস্যা বুঝে আর না কেউ কারো সমস্যার সমাধান করতে পারে।

সময় পেরিয়ে বিকাল সাড়ে চারটা বাজলো। আহনাফরা চলে এসেছে। ড্রইংরুমে কথা বলছেন সবাই। সারাহ্ রুমে বসে আ°ইঠা°ই করছে ওকে দেখার পর আহনাফের কি প্রতিক্রিয়া হয় তা দেখার জন্য।

অবশেষে সেই মহেন্দ্রক্ষণ আসলো। সারাহ্কে নিয়ে ড্রইংরুমে গেল জাহাঙ্গীর সাহেব। আহনাফ ওকে দেখে আবারো মাথানিচু করলো, তেমন বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না।

সারাহ্ আড়চোখে তাকালো ওর দিকে। সাদা শার্ট, কালো ফর্মাল প্যান্ট, বামহাতের ঘড়ি আর শার্টের গোটানো হাতার কাছে থাকা চকচকে কালো তিল। সবকিছু মিলিয়ে এই সুদর্শন পুরুষকে মিস্টার পারফেক্ট লাগছে। সারাহ্ লাজুক হেসে মাথানিচু করলো।

আফরোজা সারাহ্-র সাথে এটাসেটা নিয়ে কথা বলল। আহনাফ বলল,
“আংকেল, কিছু মনে না করলে আমি উনার সাথে একটু আলাদা কথা বলতে চাই।”
“হ্যাঁ, অবশ্যই। (সারাহ্কে বলল) সামিহার রুমে যাও।”

সারাহ্ একটু মাথা নাড়লো। সামিহার রুমে দুজনের কথা বলার ব্যবস্থা হলো। চেয়ার টেনে বসলো আহনাফ আর সারাহ্ বসলো খাটের একপাশে। সারাহ্-র বুকের ভিতর ডিপডিপ করতে লাগলো। কঠিন এক অনুভূতিতে আছে সে।

“আপনাকে আমার ছবি দেখানো হয়েছিল?”

আহনাফের সরাসরি প্রশ্নে সারাহ্ মাথানেড়ে বলল,
“জি।”
“আপনি আমাকে চিনতে পেরেছিলেন, তবে বলেননি কেন?”

সারাহ্ আহনাফের দিকে তাকালো। এ কেমন প্রশ্ন? চিনলেও কি বলবে সে? এইযে শুনছেন আপনার সাথে আমার বিয়ে হওয়ার কথা। তবে বাসায় না গিয়ে এখানেই দেখে ফেলুন। এসব তো আর বলা যায় না, তবে?

সারাহ্-র নিরবতায় আহনাফ বি°র°ক্ত হয়ে বলে,
“আপনার ইচ্ছায় বিয়ে হচ্ছে নাকি অনিচ্ছায়? (একটু থেমে) মানে মত আছে?”
“মত না থাকলে কুমিল্লা থেকে ঢাকা আসতাম না।”
নিচুস্বরে জবাব দেয় সারাহ্।

আহনাফ জোরে নিশ্বাস নিয়ে বলল,
“আমার মা নেই, বাসায় কোনো মেয়েই থাকে না। সবটা সামলে নিতে পারবেন?”
“আশা করি পারবো।”
“বিয়ের পর যদি বলি চাকরি করতে পারবেন না?”

সারাহ্ চঞ্চল চোখে ফ্লোরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
“ছেড়ে দিবো।”
“যদি বলি অন্য কাউকে ভালোবাসি। আপনাকে ভালোবাসতে পারবো না। তবে?”

আহনাফের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক হয়ে বলল,
“তবে তাকেই বিয়ে করুন।”

আহনাফ একবার ওর আপাত মস্তক দেখে উঠে বেরিয়ে গেল। ওর শেষের কথাটা নিয়ে ভাবছে সারাহ্। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। যদি সত্যি ও আহনাফের মনে জায়গা না পায়? আহনাফকে নিয়ে যে স্বপ্ন ও দেখতে শুরু করেছে তা কি সত্যি করতে পারবে না? হৃদয় গহীনে গড়ে তোলা ভালোবাসার তাজমহল কি শাহজাহান নিজ হাতে ভে°ঙে দিতে পারে?

প্রশ্নগুলো মনের মধ্যে আটকে রেখে আবারো ড্রইংরুমে যায় সে, বাবা যে তাকে ডাকছে। আহনাফ ওর দিকে তাকায়, দুজনের দৃষ্টি এক হয়। কিন্তু সারাহ্-র ডাগর চোখের ভাবের খেলা আহনাফ বুঝে না বা বুঝতে চায় না।

চলবে…..

(আহনাফ-সারাহ্ চলবে?)

অনুভূতিরা শব্দহীন পর্ব-৪+৫

0

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

চতুর্থ পর্ব

বাসায় এসে বেল বাজালো সারাহ্। সামিহা দরজা খুলে দিয়ে বলল,
“কিরে আপু, তোমার গালে কি হয়েছে?”

সারাহ্ উত্তর দিলো না। ভিতরে ঢুকে সোফায় বইগুলো রাখলো।

সামিহার দিকে তাকিয়ে মাথার হিজাবটা খুলতে খুলতে বলল,
“রাস্তায় পড়ে গেছিলাম।”

নার্গিস পারভিন বেরিয়ে এসে সারাহ্-র এ অবস্থা দেখে বলল,
“কি করেছো এসব?”
“তেমন কিছু না, আম্মু।”

সারাহ্ ডাইনিং এ গিয়ে বেসিনের উপরে লাগানো আয়নায় নিজের গালটা দেখছে। চামড়ার আ°স্ত°রণ উঠে গিয়ে জায়গাটা গোলাপী বর্ণ ধারণ করেছে। একটু স্পর্শ করতেই জ্বা°লা করতে শুরু করলো। চোখ মুখ কুঁ°চকে গেল সারাহ্-র।

এমনসময় সারাহ্-র মনে হলো ফুটপাতে পড়ে যাওয়ার সময় ওর গালের কাছে ইমতিয়াজের হাতটা ছিল।

“তবে তো ওই লোকটার হাতেও ব্য°থা পেয়েছে, কে°টে গেছে বোধহয়।”
আনমনেই বলে উঠে সারাহ্।

“কোন লোকটা আপু?”

সামিহার কথায় চমকে উঠে সারাহ্ বলল,
“কই কেউ না।”

আর কিছু না বলে সারাহ্ নিজের রুমে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে, জামা-কাপড় পাল্টে নিলো সে। কোমরে, হাতে, পায়ে বেশ ভালই ব্য°থা আছে। আজকে একটু জন্য বড়সড় দু°র্ঘ°ট°নার হাত থেকে বেঁচেছে।

সামিহা রুমের একপাশে দাঁড়িয়ে এক পলকে সারাহ্-র দিকে তাকিয়ে আছে। সারাহ্ বেশ কয়েকবার ওকে দেখলেও তেমন পাত্তা দিলো না।

সামিয়া নিজ থেকেই বলল,
“কোন লোকটার কথা বলছিল আপু।”
“বললাম তো কেউ না।”
ধ°ম°ক দিয়ে বলল সারাহ্।

সামিহা মানলো না। আবার বলল,
“আরে তুমি কি শুধু শুধু বলছো নাকি? আমি স্পষ্ট শুনেছি তুমি কোনো লোকের কথা বলেছো। বলো কে?”

নাছোড়বান্দা মেয়ে সামিহা। শেষ পর্যন্ত সারাহ্ বলতে বাধ্য হলো, এ°ক্সি°ডে°ন্ট করতে করতে কিভাবে বেঁচে গেছে সে আর একটা লোক কিভাবে বাঁচিয়েছে ওকে।

আয়নার সামনে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে সারাহ্ বলল,
“আল্লাহ্ সময়মত উনাকে পাঠিয়েছিল, না হলে কি যে হতো।”
“তুমি কি ওই লোকটাকে ভালো টালো বেসে ফেলেছো?”
“আরে না।”
হেলার সুরে বলে উঠে সারাহ্।

সামিহা হেলেদুলে বলে,
“নিজের ব্য°থা ভুলে কারো ব্য°থার চিন্তা করছো কেন তবে?”

সামিহার কথায় কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো সারাহ্। তারপর বলল,
“জীবন বাঁচিয়েছে, কৃতজ্ঞ আছি। তবে মাত্র এইটুকু সময়ে কাউকে ভালোবাসা যায় না। ভালোবাসার যে অনুভূতি তা হুট করে অনুভব করা যায় না, (একটু থেমে) অনুভব করলেও তা সবার জন্য সবসময় হয় না।”

সামিহা ঠোঁট উলটে বলল,
“কৃতজ্ঞতা থেকে কি ভালোবাসা আসতে পারে না?”

সারাহ্ হাসলো। বলল,
“কৃতজ্ঞতা আর ভালবাসার মধ্যে পার্থক্য আছে। আমরা এই পার্থক্য টুকু বুঝিনা, তাই ভালোবাসা শব্দটাকে খুব মূল্যহীন করে ফেলেছি। এখানে ওখানে, যাকে তাকে ভালোবাসি বলি আমরা।”
“এত কঠিন কথা বলো না তো আপু। ভালো লাগে না।”
সামিহা কিছু গাল ফুলিয়ে চলে যেতেই সারাহ্ মুচকি হাসলো।
______________________________________

তানজিমকে নিয়ে বাসায় ফিরেছে ইমতিয়াজ। মৃত্তিকা দরজা খুলে তানজিমকে বলল,
“কাগজপত্র সব ঠিকঠাক মতো জমা দিয়েছো?”

ভিতরে আসতে আসতে তানজিম বলল,
“জি আপু।”
“আর কিছু কি লাগবে?”

একটু ভেবে বলল,
“আ…আপাতত এরকম কিছু বলেনি।”
“ফ্রেশ হয়ে নাও।”

তানজিম রুমের দিকে যাওয়ার সময় মৃত্তিকার কথা শুনলো,
“আপনার হাতে কি হয়েছে?”

ইমতিয়াজ কিছু বলার আগেই তানজিম বলে উঠে,
“মহামানব হতে গিয়েছিল, নিজে ম°রে আরেকজনকে বাঁচাতে গেছিল।”
“তানজিম, চুপ কর।”

ইমতিয়াজের ক°ড়া ভাষায় বলা কথাটাতে তানজিম আরো কিছু বলতে গিয়েও বলে না, চুপচাপ নিজে রুমে চলে যায়।

হাফ হাতা শার্ট থাকায় ইমতিয়াজের কনুই আর হাতের উল্টো পাশের ক্ষ°ত°স্থানটা মৃত্তিকা ঠিকঠাক মতোই দেখতে পায়, ঘন দাঁড়ির আড়ালে গালে সৃষ্টি হওয়া ছোট ক্ষ°তটাও দেখে। কিছু বলতে নিয়েও বলতে পারে না, কারণ ইমতিয়াজ রুমে চলে গেল।

মৃত্তিকা তাড়াতাড়ি করে স্যাভলন আর তুলা নিয়ে ইমতিয়াজের রুমে নক করলো।

“দরজা খোলা।”

মৃত্তিকা মাথার ওড়নাটা একটু টে°নে নিয়ে ভিতরে গেল। ইমতিয়াজ কপাল কুঁ°চকে বলল,
“আপনি?”

স্যাভলন আর তুলাগুলো রিডিং টেবিলে রেখে মৃত্তিকা বলল,
“ক্ষ°ত জায়গাগুলো ওয়াশ করে নিবেন।”

ইমতিয়াজ কোন জবাব দিলো না। মৃত্তিকা চলে আসার সময় বলল,
“বড়মনি আগামীকালকে বাসায় আসবে।”
“কল দিয়েছিল?”
“জি, (একটু থেমে) আপনাকে গিয়ে নিয়ে আসতে বলেছে।”

ইমতিয়াজ মাথা নাড়লো। মৃত্তিকা বের হয়ে গেলে ইমতিয়াজ দরজা লাগিয়ে দিলো। স্যাভলন-তুলা টেবিলে পড়ে রইলো। ইমতিয়াজ এগুলো ছুঁয়েও দেখলো না। সে সোজা ওয়াশরুমে চলে গেল।

কিছুক্ষণ পর মৃত্তিকা চুপিচুপি দরজা খুলে ভিতরে আসলো। লোকটা যে ক্ষ°ত জায়গাগুলো যত্ন নিবে না তা সে জানে। যত্ন নেয়ার মতো অবস্থায় সে নেই আর না তার যত্ন নেয়ার কেউ আছে।

ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে মৃত্তিকাকে দেখে একপ্রকার ধ°ম°ক দেয় ইমতিয়াজ।
“আবার কি করছেন এখানে?”

ভ°য়ে কেঁ°পে ওঠে মৃত্তিকা। ইমতিয়াজ এগিয়ে আসে। মৃত্তিকা বড়বড় চোখ করে বলল,
“আ… আপনার..”

মৃত্তিকা থেমে যায়। ইমতিয়াজ বিছানায় বসে বলে,
“চলে যান।”

একটু বেশি সাহস দেখায় মৃত্তিকা। ইমতিয়াজের হাত টেনে নিয়ে স্যাভলন লাগিয়ে দেয়। এককালীন ছোট একটা ব্যা°ন্ডে°জও দিয়ে দেয়। তুলা নিয়ে গালে লাগাতে নিয়েই ইমতিয়াজের চেহারা দিকে নজর পড়ে মৃত্তিকার। রাগী চোখ তাকিয়ে সে। মৃত্তিকা হাতটা ছেড়ে দিলো।

“আপনাকে আমি চলে যেতে বলেছি কিনা?”

মৃত্তিকা মাথানিচু করে উঠে দাঁড়ায়। ইমতিয়াজ ব্যা°ন্ডে°জ খুলে ছুঁ°ড়ে ফেলে। স্যাভলনের বোতলটাও ছুঁ°ড়ে ফেলে দিলো। কাচের বোতলটা ভে°ঙে গুড়িয়ে গেল। মৃত্তিকা একটু কেঁ°পে উঠে সরে গেল।

রাগে সারা শরীর রি রি করছে ইমতিয়াজের। বলল,
“বের হন আমার রুম থেকে আর আমার সামনে আসবেন না।”

মৃত্তিকা বেরিয়ে গেল। হঠাৎ করে নিজের করা এমন কাজে নিজেই কিছু হতবাক সে। কিন্তু অজানা কারণে ইমতিয়াজের ব°কাটাতে ও কষ্ট পাচ্ছে। রুমের দরজা লাগিয়ে অঝোরে কাঁদছে মৃত্তিকা।

বাবার আদর না পাওয়া মেয়েটা কোনো পুরুষকে বিশ্বাস করতে পারেনি কখনো, কাছে যাওয়ার চিন্তাও মাথায় আনেনি। ইতালির বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠীরা যখন প্রেমে মগ্ন ছিল, তখন সে পড়ায় মগ্ন ছিল। আজ কেন ইমতিয়াজে আ°স°ক্ত হলো সে? উত্তর সে নিজেও জানে না।

খেই তুলে মৃত্তিকা বলে উঠে,
“মাম, তুমি কোথায়?”

এদিকে ইমতিয়াজ নিজের চুল টে°নে ধরে বিছানার কোণায় বসে পড়লো। নিজে নিজেই বলল,
“কোনো নারী আমার কাছে আসাটা পছন্দ করতে না তুমি মিনা। তুমি থাকো বা না থাকো, আমার কাছে আর কেউ আসবে না।”
চোখের কোণে জমা পানিটা গড়িয়ে পড়লো।
______________________________________

সন্ধ্যার পর আহনাফ বেশ সুস্থ বোধ করছে। জ্ব°রটাও এখন নেই আর ক্লান্তিও কম। আফরোজা ওর বিছানা গুছিয়ে দিচ্ছে আর ও রিডিং টেবিলে বসে কোনো একটা নোট তৈরি করছে।

“এখন এসব পড়াশুনা না করলে হচ্ছে না?”

আফরোজা কথায় খুব একটা ভাবাবেগ হলো না। আহনাফ মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। আফরোজা ওর পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“কি খাবি এখন?”
“একটু পায়েস করতে পারবা?”
“কেন পারবো না?”

ভাইয়ের আবদার ফেলেনি আফরোজা। দ্রুতই রান্নাঘরে চলে যায়। দুধের বোতল ফ্রিজ থেকে বের করে ভিজিয়ে রেখে চাল ধুয়ে নেয়। রান্নার সময়ই জুহাইব এসে পাশে দাঁড়ায়।

আফরোজা একবার ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
“কি হলো?”
“আমাকে ভুলে গেছো তুমি।”

আফরোজা প্রথমে কপাল কুঁ°চকে ফেললেও পরক্ষণেই হেসে বলল,
“হঠাৎ এমন কেন মনে হলো?”
“এই যে আমাকে আর সময় দেও না।”

চুলোয় বসানো পায়েসটা নেড়ে দিয়ে আফরোজা জুহাইবকে কাছে টে°নে বলল,
“ওতো পাত্তা আমি দিতে পারি না, এতোটুকুই পারবো।”
“এইটুকুই যথেষ্ট।”

“আফরোজা?”

আব্বাস সাহেবের ডাকে দুজনে সরে যায়। ড্রইংরুম থেকে ডাকছেন উনি। আফরোজা একটু জোরে বলল,
“জি, বাবা।”
“এখন রান্নাঘরে কি করো?”
“আহনাফ পায়েস খেতে চেয়েছে, সেটাই বানাচ্ছি।”

আব্বাস সাহেব আর কিছু বললেন না। ছেলের ইচ্ছার উপর কোনোকালেই জোর°জবর°দস্তি করেননি উনি। এখন তো সামান্য পায়েসের ব্যাপার।

আফরোজার গালে ব°লি°ষ্ঠ পুরুষের ভারী ঠোঁটের স্পর্শ পেল, ধীরে ধীরে গভীরতর হয়ে হঠাৎ দূরে সরে গেল। আফরোজা হেসে মাথানিচু করলো, জুহাইব বেরিয়ে গেল।

পায়েস তৈরি হলো। সুন্দর দুইটা বাটিতে পরিবেশন করে জুহাইব ও আব্বাস সাহেবকে দিয়ে আসলো আফরোজা। আরেকটা বাটিতে করে নিয়ে আসে আহনাফের রুমে।

ছোট বাচ্চাদের সুজি খাওয়ানোর আগে যেভাবে নেড়ে ঠান্ডা করে ঠিক সেভাবে আহনাফের পাশে দাঁড়িয়ে পায়েস ঠান্ডা করছে আফরোজা।

একচামচ আহনাফের মুখে তুলে দিয়ে বলল,
“কেমন হয়েছে?”
“ভালো।”

ছোট করে জবাব দিয়েই আহনাফ পালটা প্রশ্ন করলো,
“ভাইয়ার ছুটি তো একমাসের ছিল?”
“হ্যাঁ, এজন্যই তো আগামী সপ্তাহে চলে যাবে।”
“তুমিও যাবা?”
“না, আরো পড়ে যাবো।”

আহনাফ কিছুক্ষণ আবারো চুপ করে শান্ত ছেলের মতো পায়েসটা খেয়ে নিলো। তারপর বলল,
“কাল ঢাকায় যাবো।”

ভূ°ত দেখার মতো চমকে উঠলো আফরোজা।
“হঠাৎ ঢাকায় কেন?”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আহনাফ বলল,
“আন্টি অসুস্থ, দেখতে যাবো।”

আফরোজা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।
“তানজিম কল করেছিল, ওই বলল আন্টি অসুস্থ। যাবে আমার সাথে আপু?”
“ঠিক আছে, যাবো।”

আহনাফ আফরোজাকে জড়িয়ে ধরে। মাত্র ৯ বছর বয়সে মা হা°রানো ছেলেটা মায়ের জায়গায় বোনকে বসিয়ে নিয়েছে। আদরে আদরে বড় করেছে যে এই বোনটাই।
______________________________________

রাতে ইমতিয়াজ খেতে আসলো না। মৃত্তিকাও ডাইনিং এ আসেনি। তানজিম দুজনকে ডেকে ডেকে অবশেষে ১১ টা বাজে নিজেই খেয়ে নিলো। কাল বাবা-মা বাসায় আসবে, সন্ধ্যা থেকে তাদের রুম গুছিয়েছে সে।

রাত ১২ টায় পুরো ফ্ল্যাটটাতে ভূ°তু°ড়ে আঁধার নেমে এলো। মৃত্তিকা চুপিচুপি রুম থেকে বেরিয়ে এলো। কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। তানজিমের কথায় নিদ্রা কাটলেও সারা দেয়নি।

ডাইনিং এ বসে পানি খেয়ে চেয়ে রইলো ইমতিয়াজের রুমের দিকে। সম্পর্কে তো লোকটা ওর বড়বোনের স্বামী হয়, যদিও তাহসিনার বিয়েতে আসার আগে কখনোই সে ইমতিয়াজকে দেখেনি। নিজের অনুভূতিগুলো বুঝতে পারছে সে। রাগ হয় নিজের প্রতি, হাতের গ্লাসটা শব্দ করে টেবিলে রাখে।

“কেমন মেয়ে আমি, মামের শো°ক না কাটিয়েই একটা লোকের জন্য অনুভূতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছি। মাম আমাকে কখনো ক্ষমা করবে না।”
কথাটা মনে মনে ভেবেই কেঁদে দেয় মৃত্তিকা।

অনুভূতিকে প্রশ্রয় দিতে না চেয়েও দিয়ে দেয় সে। উঠে গিয়ে নিশব্দে ইমতিয়াজের রুমের দরজাটা একটু ফাঁক করে। ইমতিয়াজের পায়ের দিকটা দেখা যাচ্ছে। রুমের ফ্লোর পরিষ্কার মানে ভা°ঙা কাঁচের টুকরোগুলো সরিয়েছে সে।

“তানজিম?”

ইমতিয়াজের কন্ঠে ভ°য় পেয়ে যায় মৃত্তিকা। ও ভেবেছিল লোকটা হয়তো ঘুমিয়েছে।

“কিছু বলবে?”

মৃত্তিকা কোনো উত্তর না দিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। ভ°য়ে শরীরে কাঁ°পুনি হচ্ছে। চুলগুলো গুছিয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি করে শুয়ে পড়ে সে।

ইমতিয়াজ উঠে এসে দরজা খুলে কাউকেই দেখে না। ডাইনিং এর লাইট জ্বালায়, কেউ নেই। তানজিমের রুমে গিয়ে বুঝতে পারে সেও ঘুমাচ্ছে।

ইমতিয়াজ বেরিয়ে আসে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে মৃত্তিকার কক্ষের দিকে। তারপর আবারো নিজের হাতের দিকে তাকায়।

“ব্যবহারটুকু পাওনা ছিল আপনার, মিউকো।”
কথাটা ভেবে আবারো নিজের রুমে পাড়ি জমায় সে।
______________________________________

ফজরের নামাজ পড়েই ঢাকা যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নেয় আহনাফ৷ আফরোজা, জুহাইবও যাবে ওর সাথে।

সাদা শার্ট, কালো ফর্মাল প্যান্ট পড়েছে আহনাফ। শার্টের পকেটে নেয়া লাল গোলাপটা যেকারো নজর কাড়তে বাধ্য। তাহসিনার দেয়া কালো ঘড়িটাও বামহাতে শোভা পাচ্ছে।

আফরোজা বুঝতে পেরেছে আহনাফ তাহসিনার মাকে না তাহসিনার কবরটুকু দেখতে যাচ্ছে। আফরোজার দীর্ঘশ্বাসের পাল্লাটা ভারী হলো, তার ভাইয়ের জীবন কি শুধু স্মৃ°তি নিয়ে কাটবে।

কুমিল্লা থেকে ঢাকা চলে আসলো মাত্র ৩ ঘন্টায়। রাস্তায় তেমন জ্যাম নেই বললেই চলে। কাকরাইলের কাছাকাছি থাকা গো°র°স্তা°নের কাছে এসে আহনাফ গাড়ি থামাতে বলল।

আহনাফ নেমে গেল, আফরোজা আর জুহাইব গাড়িতেই বসে রইলো। ওকে কিছুক্ষণ একা থাকতে দেয়া উচিত।

আহনাফ তাহসিনার স°মা°ধীস্থলে গিয়ে বসে পড়লো। পকেট থেকে ফুলটা বের করে সামনের গাছে রেখে বলল,
“মনে আছে এখান ওখান থেকে ফুল এনে তুমি এভাবে গাছে ঝুলাতে পছন্দ করতে।”

নিজে নিজেই হাসলো আহনাফ। চোখের কোণের পানিটুকু সরিয়ে বলল,
“তোমার পছন্দে সাদা শার্ট পড়েছি, কেমন লাগছে আমাকে? (একটু থেমে) কি আর বলবে? বলবে ভালো লাগছে, কিন্তু কালো প্যান্ট পড়েছো কেন?”

আহনাফ আপন মনে হেসে বলল,
“তোমাকে আর দেখবো না, এটা ভাবলেই বুকের বামপাশে ব্য°থা হয় তাহু। কেন হলো এমনটা আমাদের সাথে?”

আহনাফ বুকে হাত দিয়ে বসে রইলো। এ ব্য°থা আর কেউ অনুভব করবে না, ও কাউকে বোঝাতেও পারবে না।

চলবে…….

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

পঞ্চম পর্ব

দুই বছর পর,

বিরামহীন এই সময়কে বিরাম দিবে কার সাধ্য। সময় চলে যায়, মানুষ চলে যায়, শুধু থাকে স্মৃ°তি আর ভালোবাসা।

আহনাফ ক্লাস করাচ্ছে। ঘন্টা যে পড়েছে সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই, টপিক শেষ না করে সে যাবে না। রসায়নের ম্যাডাম সারাহ্ এসে দরজার কাছে অপেক্ষা করছে। যেহেতু সারাহ্ একজন গেস্ট টিচার, তাই সিনিয়র একজন টিচারকে ও কিছু বলতেও পারছে না। এদিকে বি°র°ক্ত হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে।

অতঃপর আহনাফ ক্লাস শেষ করে যাওয়ার সময় সারাহ্-র দিকে না তাকিয়েই চলে গেল, সরি বলারও প্রয়োজন বোধ করলো না। এমন ব্যবহারে সারাহ্ একটু বি°র°ক্ত হলো। তারপর ক্লাসে ঢুকে পড়ানো শুরু করলো।

আর কোনো ক্লাস না থাকায় আহনাফ বের হয়ে যাচ্ছে৷ কারণটা আবার বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আফরোজা আর জুহাইব তাদের একমাত্র পুত্রকে নিয়ে দেশে ফিরছে। সকালে ঢাকায় এসেছিল আর এখন কুমিল্লা এসেছে।

বাসায় ফিরে আফরোজাকে দেখে হাসিমুখে জড়িয়ে ধরে। একমাত্র ভাগ্নে জাবেরকে কোলে নিয়ে আদর করে।

“কেমন আছিস, আহনাফ? আজকাল ফোন তো দিসই না।”

আফরোজার কথায় আহনাফ ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভালো আছি। সময় পাই না কল দেয়ার।”

জুহাইব বলল,
“জাবের আসার পর থেকে তোমার বোন আমাকে ভুলেই গেছে।”

আহনাফ হাসলো। বলল,
“না, ভুলে নাই। ভাগিদার আসলে ভাগ তো কিছু কমবেই।”

আব্বাস সাহেব নাতিকে কোলে তুলে আদর করলেন। তারপর আফরোজাকে বললেন,
“ফ্রেশ হয়ে নে তোরা। আর কত এই এক ড্রেসে থাকবি?”
“হুম যাচ্ছি।”

আফরোজা আহনাফকে ভালো করে খেয়াল করলো। হাসি হাসি ভাবটা থাকলেও তার ভাই যে ভালো নেই তা সে তো বুঝে।
______________________________________

অফিসে কাজ করছে ইমতিয়াজ। এরমধ্যে কল করে তাহমিনার বাবা লুৎফর রহমান। উনাদের ছেড়ে একা থাকা শুরু করে ইমতিয়াজ, যা উনারা চাননি। এরজন্য প্রায়ই কল করেন। এটা সেটার জন্য উনাদের বাসায় গেলেও থাকা হয় না।

“বাবা?”

ইমতিয়াজের ডাকে লুৎফর রহমান ভা°ঙা ভা°ঙা গলায় বলেন,
“আজ কি একটু আসতে পারবে?”
“অফিস শেষে আসবো। আপনাদের কিছু লাগবে?”
“তোমাকে দেখবো আর কিছু না।”

ইমতিয়াজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ঠিক আছে বাবা, এখন রাখছি।”
বলে নিজেই কে°টে দিলো। পুরো পৃথিবীকে এড়িয়ে যাচ্ছে সে একমাত্র এই মানুষগুলোকে ছাড়া।

জীবন ওর কিভাবে যাচ্ছে তা কেবল সেই জানে। তাহমিনা আর তাদের অনাগত সন্তানের জন্য আজও সে ফুঁপিয়ে কাঁদে। একা, সঙ্গীহীন জীবনে সে তাহমিনাকে আজও ফিরে পেতে চায়। অসম্ভব জেনেও চায় তাহমিনা ফিরে আসুক।
______________________________________

ঘড়িতে রাত ৯ টা, সারাহ্ বাসায় রান্না করছে আর ভিডিও কলে বাসায় কথা বলছে। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে চাকরি নেয়ায় ঢাকা থেকে চলে এসে এখানে একা একা থাকতে শুরু করেছে৷ যা নিয়ে পরিবারে একটু মনোমালিন্য হয়েছিল, তবে এখন তা নেই।

“আপু, জানো। আমিও এখন স্টুডেন্ট পড়াই, পুরো তিনটা।”

সামিহার কথায় হাসে সারাহ্। তারপর বলে,
“ক্লাস করিস ঠিকমতো?”
“হ্যাঁ, প্রতিদিন যাই। ক্লাস না থাকলেও যাই।”
“না থাকলে কি করতে যাস?”
“ডান্স।”

নার্গিস পারভিন ফোন নিয়ে বলে,
“বাদ দাও ওর কথা। সারাহ্, তুমি শুক্রবারের আগে ঢাকায় আসো।”
“কোনো জরুরি কাজ আছে নাকি আম্মু?”
“হ্যাঁ, তোমার ফোনে একটা ফাইল গেছে, চেক করো তো।”

ভাতের মাড় ফেলে পাতিলটা চুলায় বসিয়ে দিয়ে বলল,
“কিসের ফাইল?”
“একটা ছেলে দেখেছে তোমার বাবা, তোমার জন্যই। তারই সিভি। উনারা শুক্রবারে কথা বলতে আসবেন।”

আজ মঙ্গলবার, শুক্রবার তো আর বেশি দূরে না। সারাহ্ ক্যামেরা থেকে একটু আড়ালে চলে গেল। হুট করে মায়ের কাছ থেকে এমন কথা শুনে লজ্জায় পড়েছে সে।

ওর মা বলল,
“ছেলের ফ্যামিলি চাকরি নিয়েও কোনো সমস্যা নেই বলেছে। তোমার বাবার বন্ধু প্রস্তাবটা দিলো।”

সামিহা ফোন টে°নে নিয়ে বলল,
“আপু, আপু, তুমি আসার সময় হবু দুলাভাইয়ের জন্য গিফট নিয়ে আইসো। গিফট কি আনবে সেটা আমার থেকে আইডিয়া নিতে পারো। দিবো?”

সারাহ্ তাড়াহুড়ো করে বলল,
“আম্মু, আমি পরে কথা বলবো। এখন রাখছি।”
বলে কল কে°টে পিডিএফ ফাইলে প্রবেশ করলো।

আহনাফ ফয়েজ, নামটা দেখলো আর তারপর ছবিটা দেখে চমকে গেল। এ তো কলেজের সেই সিনিয়র স্যার, যে আজকে ওর ক্লাসের টাইম নষ্ট করেছে। হঠাৎ সারাহ্-র লজ্জার পরিমানটা বেড়ে গেল, কাল আবারো লোকটার সাথে দেখা হবে যে।

“লেকচারার সাহেবের সিভি শেষ পর্যন্ত আমার বাসায়?”
মনে মনে কথাটা ভেবেই হেসে উঠে সে।
_____________________________________

রাতের খাবার শেষে আহনাফ সোফায় বসে ভাগ্নে জাবেরের সাথে দুষ্টুমি করছে। আফরোজা, জুহাইব আর আব্বাস সাহেব কোনো জরুরি বিষয় নিয়ে পরামর্শ করছেন। তারপর তিনজনই এসে সোফার রুমে বসলো।

জাবেরকে আফরোজা কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াতে চলে যায়। যাওয়ার সময় আব্বাস সাহেবকে ইশারায় কিছু একটা বুঝিয়ে দেয়, যা আহনাফের দৃষ্টি এড়ায় না।

আব্বাস সাহেব কিছু বলবে বলবে করেও বলছে না দেখে আহনাফ নিজে থেকেই বলল,
“বাবা, কিছু বলবেন?”

আব্বাস সাহেব নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন,
“আফরোজা তো কয়দিন পরেই চলে যাবে।”
“হ্যাঁ, খুব স্বাভাবিক বিষয়।”
“ঘরে তো কোনো নারী আর থাকবে না। তাই বলছিলাম…”

একমুহূর্তের জন্য আহনাফের মনে হলো ওর বাবা চাইছে ও বিয়ে করুক। ওর ভাবনা সত্য হলো।

জুহাইব বলল,
“আহনাফ, আংকেল বলতে চাচ্ছে তুমি বিয়ে করে ফেলো।”

বিয়ের কথা শুনেই ওর মনে পড়লো সাজানো রিসোর্ট, তিনটা লা°শ আর মাঝে শুয়ে থাকা ওর ভালোবাসা। কা°ফ°নে বাধা তাহসিনাকে ভুলবে কিভাবে আহনাফ। কবরের মাটিটা তো এতোদিনে সমান হয়ে গেছে। ভেতরে থাকা তাহসিনার দে°হটাও আর নেই। কিন্তু আহনাফের মনে তাকে কি করে দা°ফ°ন করবে?

আব্বাস সাহেব ওর পাশে এসে বসে বলল,
“আহনাফ, জীবন থেমে থাকে না। কারো জন্য থামবে না, এ তো চলতে থাকবে। (একটু থেমে) আমি তোমার ছোটফুপার এক বন্ধুর মেয়েকে দেখেছি।”

আহনাফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“বাবা, আমি কি বিয়ে করলেই হবে? বিয়ে মানে তো একজনের দায়িত্ব নিয়ে নেয়া। আমি কি পারবো দায়িত্বটা নিতে?”

জুহাইব আহনাফের অন্যপাশে এসে বসে বলল,
“কেন পারবে না? অবশ্যই পারবে। (একটু থেমে) তুমি চাও তো শুক্রবারে আমরা উনাদের বাসায় যেতে পারি৷ কোনো অনুষ্ঠান না, পছন্দ হলে ওখানেই বিয়ে।”

আহনাফ হ্যাঁ বা না কিছুই বলল না, উঠে রুমে চলে গেল। দরজা লাগিয়ে দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা কেউ করবে না এটাই স্বাভাবিক, কারণ ও যে অতীত আঁ°ক°ড়ে পড়ে আছে৷ কিন্তু তাহসিনার জায়গাটা অন্যকাউকে দেয়া কি সম্ভব?
_____________________________________

ইমতিয়াজ বেল বাজালো, তানজিম দরজা খুলে বলল,
“আরে, ইমতিয়াজ ভাই যে, কেমন আছেন?”
“এইতো ভালো।”

কোলাকুলি করলো দুজনে। ইমতিয়াজ ভিতরে গেল। লুৎফর রহমান ও মমতাজ বেগম নিজেদের রুমে ছিল, ইমতিয়াজের কন্ঠস্বর শুনে উনারা বেরিয়ে এলেন।

মমতাজ বেগম ইমতিয়াজকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলেন। ইমতিয়াজও দীর্ঘশ্বাস ফেলল৷ মা কি কখনো মেয়েদের ভুলতে পারে? মমতাজ বেগমও পারেননি।

রাতের খাবার ইমতিয়াজ উনাদের সাথেই করলেন। মমতাজ বেগম এতোদিন পর ইমতিয়াজকে পেয়ে কথার ভান্ডার খুলেছেনে। মানসিক অবস্থা উনার খুব একটা ভালো না৷ হুটহাট করে প্রায়শই আবোল তাবোল কথা বলেন।

“কালকে তাহসিনা তাহমিনার সবুজ শাড়িটা পড়ে আমাকে দেখাচ্ছিল, সেটা দেখে তাহমিনার কি রাগ?”

বলে কিছুক্ষণ হাসলেন। তারপর আবারো বললেন,
“তানজিম তো আমার সাথে কোনো কথাই বলে না। তাহসিনা তো কিছু বলে আর তাহমিনা তো সেই নিজের বাচ্চাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে। বাচ্চাকে তো আমার কোলে দেয়ই না, নিজেও দুধ খাওয়ায় না। সারাদিন কাঁদে আমার নাতি, তুমি আচ্ছা করে ব°কে দিবে কিন্তু।”

কথা শেষ করে আবারো কাঁদছেন উনি। উনার কল্পনায় এখনো তাহসিনা-তাহমিনা জীবিত। উনার এই হঠাৎ হাসা আর হঠাৎ কান্নায় ইমতিয়াজের বুকটা ফেটে যাচ্ছে। অথচ ঠান্ডা মেজাজে বসে উনার সব কথা শুনছে সে।

তানজিম পাশে এসে বসে ইমতিয়াজের দিকে তাকায়। ইমতিয়াজ ওকে ইশারায় শান্ত থাকতে বলে।
______________________________________

খুব সকালে কলেজে যেতে তৈরি হচ্ছে সারাহ্। আজ সে সুন্দর করে সেজেগুজে কলেজে যাবে। সাদা-বেগুনী সুতির শাড়ি পড়লো, লম্বা চুলগুলো বেঁধে বেগুনী শিফনের হিজাবটা সুন্দর করে পড়ে নিলো, ঠোঁটের হালকা গোলাপী লিপস্টিকটা ওর ফর্সা মুখে দারুণ মানিয়েছে৷ মুখের লাজুক ভাবটা ব্লাশ দিয়ে আরেকটু বাড়িয়ে নিলো।

আয়নায় শেষ বারের মতো নিজেকে দেখে বেরিয়ে গেল কলেজের উদ্দেশ্যে। অটো ডেকে উঠে পড়লো।

আটটার দিকে কলেজ পৌঁছে গেল। ফোনের স্ক্রিনে নিজেকে শেষবারের মতো দেখে ভিতরে চলে গেল সারাহ্।

টিচার্স রুমে যেতেই একজন ম্যাডাম বলে উঠলো,
“মাশাল্লাহ, সারাহ্। আজ তো খুব সুন্দর লাগছে, কোনো স্পেশাল দিন নাকি?”

সারাহ্ মুচকি হেসে বলল,
“না, তেমন কিছু না। এমনিতেই ইচ্ছা হলো আরকি।”

আরো বেশ কয়েকজন ওর প্রশংসা করলো। করবে না কেন? অন্যদিনের চেয়ে আজ তো ওকে বেশ পরিপাটি আর সুন্দর লাগছে।

ক্লাস শুরু হয়েছে। আহনাফ কোথায় ক্লাস নিবে ও জানে না। তাই সেটা দেখার উদ্দেশ্যে প্রথম পিরিয়ডে ক্লাস না থাকলেও নোট বুকটা নিয়ে সারাহ্ কলেজের বারান্দায় একটু ঘুরে আসলো। সেকেন্ড ইয়ারের এ সেকশনে আহনাফকে ক্লাস নিতে দেখে আবারো টিচার্স রুমে চলে আসলো।

নিজের চেয়ারে বসে নিজের প্রতিই হাসি আসলো তার। মাত্র কালই তো বিয়ের কথা জানলো ও, এখনো তো কিছুই নিশ্চিত নয় অথচ ও আহনাফকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিলো।

ও আজ আহনাফের জন্য সেজেছে এটা ভেবে নিজেই নিজেকে বলল,
“ভেরি ব্যা°ড, সারাহ্।”

দ্বিতীয় পিরিয়ডে ওর ক্লাস আছে। তড়িঘড়ি করে যাওয়ার সময় না চাইতেই আহনাফের সামনে পড়ে গেছে। ও ডানপাশে সরে জায়গা দেয়ার সময় আহনাফও ডানদিকেই সরতে চেয়েছে। দুজনের অজান্তেই এমন মুহূর্তের সৃষ্টি হলো।

আহনাফ একপাশে দাঁড়িয়ে গিয়ে ওকে জায়গা দিয়ে বলল,
“এখন যান।”

সারাহ্ মাথা নেড়ে চলে গেল। বুকের ভেতরটা অসম্ভব ধুকধুক করছে। একবার পেছন ফিরে আহনাফকে দেখলো। অবাক হলো সে, এতোক্ষণ পুরোপুরি মাথানিচু করে রেখেছিল আহনাফ। একবারের জন্যও ওর দিকে তাকায়নি।

সারাহ্ ক্লাসে যেতে যেতে আপন মনে বলল,
“মেয়েদের ষোল আনা সম্মান দিতে জানে। জীবনে তো এমন পুরুষই চাই। আমি অবশ্যই শুক্রবারের আগে ঢাকা যাবো।”
সারাহ্ ক্লাসে চলে আসলো।

আহনাফ টিচার্স রুমে গিয়ে বসলো। ফোন কাঁপছে, পকেট থেকে বের করে আফরোজার নাম্বার দেখে বারান্দায় গিয়ে রিসিভ করলো।

“জি, আপু।”
“তুই আজকেও একটু তাড়াতাড়ি আসিস।”
“কেন?”
“ক্যান্টনমেন্ট যাবো, শপিং করতে। আ…. ওই ছোটখাটো কিছু কেনাকাটা আরকি, জুহাইব যাবে না তাই বললাম।”
“ঠিক আছে আপু, আমি তাড়াতাড়ি আসবো।”
______________________________________

এলার্মঘড়ি বন্ধ করে চোখ খুলল মৃত্তিকা। মামের মৃ°ত্যুর একমাস পর সে আবারো ইতালি চলে এসেছে৷ মামের স্মৃ°তিটুকু নিয়ে পরে রইলো এই বাসায়।

উঠে চোখ কচলে ঘড়িতে দেখলো ভোর পাঁচটা। বাংলাদেশ থেকে ৫ ঘন্টা ধীরে চলা ইতালিতে এখনো সূর্যোদয় হয়নি। ফ্রেশ হয়ে ওযু করে নামাজ পড়ে নিলো। এখন সে একা একা সকালে উঠে নামাজ পড়তে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।

নামাজ শেষে জগিং করতে গেল। বাসার আশেপাশের রাস্তায় জগিং করার সময় দেখা হলো ওর অফিস কলিগ ফিওনার সাথে৷ ফিওনার বাসা ওর বাসার খুব কাছে।

“হাই মিউকো, গুড মর্নিং।”
ফিওনা হাত নেড়ে বলল।

মৃত্তিকাও হাত নাড়লো।
“মর্নিং।”

দুজনে কিছুক্ষণ একসাথে ব্যায়াম করে বাসায় চলে আসলো। বাসার সামনে থাকা ফুলগাছ গুলোতে পানি দেয় সে।

এরপর গোসল করে ফ্রেশ হয়ে, নাস্তা বানাতে রান্নাঘরে গেল। ফ্রেন্স টোস্ট আর কফি খেয়ে রেডি হয়ে নিলো অফিসে যাওয়ার জন্য।

এরমধ্যে ফিওনা এসে ওকে ডাকলো,
“হেই মিউকো, কাম ফাস্ট।”
“জাস্ট আ মিনিট।”

ব্যাগ নিয়ে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেল। দুজনে প্রতিদিন একত্রে অফিসে যায়। মৃত্তিকার নিরবতার জন্য অফিসের অনেকেই ওর সাথে সহজে কথা বলে না। যদিও এতে মৃত্তিকার খুব একটা হেলদুল নেই। কাজের মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রেখে নিজের অনুভূতিগুলো লুকানোর চেষ্টায় থাকে সে, এগুলো যে ব°ড্ড পী°ড়া°দা°য়ক।

চলবে…..

অনুভূতিরা শব্দহীন পর্ব-২+৩

0

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

দ্বিতীয় পর্ব

ক্লাস শেষে বের হলো আহনাফ৷ কলেজ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালো। কুমিল্লার আকাশটা আজ বড্ড কালো হয়ে আছে, ঝিরঝির করে বৃষ্টিও পড়তে শুরু করেছে।

আহনাফের মনে পড়লো ভার্সিটি লাইফের কথা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কাটাপাহাড় রোডে বৃষ্টির দিনেই দেখা হয়েছিল তাহসিনার সাথে। বাদলার দিনে ভিজা শরীরে জোঁ°কের কবলে পড়েছিল সে।

আহনাফ কাছে গিয়ে বলেছিল,
“হেল্প লাগবে ম্যাডাম।”

তাহসিনা ওর দিকে সন্দেহের চোখে চেয়ে বলেছিল,
“নো।”

আহনাফ হেসে হাঁটু গেড়ে বসে জোঁ°ক তুলে দিয়ে বলেছিল,
“বৃষ্টির দিন এভাবে রাস্তায় কি করছেন? স্টুডেন্ট নাকি ঘুরতে আসছেন?”
“স্টুডেন্ট।”
“তবে হলে চলে যান, সা°পে ধরবে।”

আহনাফ চলে আসার সময় তাহসিনা পেছন থেকে চেঁ°চিয়ে বলে উঠেছিল,
“চবিতে কি শুধু সা°পই থাকে, মানুষ থাকে না? ভর্তির পর থেকে শুধু এই কথাই শুনছি।”

আহনাফ ফিরে হেসে দেয়।
“ফার্স্ট ইয়ার?”
“হুম।”

দুজনে সেদিন পরিচিত হয়েছিল। আহনাফ তখন সেকেন্ড ইয়ারে ছিল আর তাহসিনা ফার্স্ট ইয়ারে। পুরো ভার্সিটি লাইফ দাঁ°পিয়ে প্রেমে মজেছিল দুজনে।

“বেস্ট কাপল, মেইড ফর ইচ আদার” এমন অনেক কথা বলতো তাদের বন্ধুরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাহাড়গুলোতে প্রায়ই ঘুরতে যেতো, শাটলে করে শহরে আসতো। কত সকাল শাটলে ঘুরেছে, কত দুপুর ষোলশহরের তপ্ত রোদে ঘুরে বেড়িয়েছে।

শুধু প্রেম না, পড়াশুনা আর চাকরির প্রস্তুতিতেও পাল্লা চলতো ওদের৷ একে অন্যের পড়া ধরা, ব°কা দেওয়া সব চলতো। প্রচন্ড মেধাবী এই দুজনের বেবি নাকি বাংলার আইনস্টাইন বা নিউটন হবে, এই বলে ভবিষ্যতবানী করেছিল অনেকে। তবে মাত্র কয়েকটা মুহুর্তে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল।

হঠাৎ ব°জ্রপাতের তীব্র শব্দে বাস্তবে ফিরে আসলো আহনাফ৷ গতসপ্তাহের শনিবারটা যে তাকে বড্ড পো°ড়াচ্ছে।

বিয়ের আগের দিন রাতে অর্থাৎ শুক্রবার দিবাগত রাতে ফোনে তাহসিনার বলা একটা কথা তো আজও তার কানে বাজছে,
“দূরত্ব মিটে গেছে আহনাফ, আর মাত্র কয়েক ঘন্টা।”

দূরত্ব মিটেনি, ঘন্টার ব্যবধানে বেড়েছে এবং বেড়েই চলেছে। এতোটাই বেড়েছে যে এখন অসীম দূরত্বে আছে দুজনে।

বাতাসের ঝাপটায় বৃষ্টির পানি এসে আহনাফের মুখে পড়ছে, ওর শার্ট ভিজে গেছে, দাঁড়ি বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে গলা থেকে বুকে। সেদিকে ওর খেয়াল নেই, মন যে এখনো ভাবছে সেই চলে যাওয়া পাখিটিকে।

জীবনের প্রথম বিসিএস পরীক্ষায় শিক্ষা ক্যাডারে চান্স পেয়ে গিয়েছে আহনাফ। মানুষ বছরের পর বছর পরীক্ষা দেয় আর সে একবারেই উত্তীর্ণ হয়ে গেল। সেদিন তাহসিনা বোধহয় সবচেয়ে খুশি ছিল।

দুজনে রেস্টুরেন্টে গিয়েছিল সেলিব্রেশনের জন্য। তাহসিনার বলা প্রথম কথা ছিল,
“বিয়েতে আমি সাদা শাড়ি পড়বো আহনাফ, আই লাভ হোয়াট।”

সূচনা ছাড়া এমন কথায় আহনাফ অবাক হয়েছিল।
“লাল বধূ চাই আমার।”
“বাট আমার সাদা রং প্রিয়।”

তাহসিনার কথা ফেলতে পারেনি। তার ইচ্ছা মেনে নেয়ায় মেয়েটার খুশির অন্ত ছিল না। বড় বড় চোখগুলো সেদিন খুশিতে থৈথৈ করে নেচে উঠেছিল।

সেই চোখগুলো আহনাফ আর দেখতে পারবে না, এই একটা কথাই মানতে পারছে না সে।

“স্যার, আপনি তো পুরো ভিজে গেছেন।”

এক ছাত্রের ডাকে ফিরে তাকিয়ে আহনাফ অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
“ইটস ওকে, তুমি ক্লাসে যাও। এখানে কি করো?”
“সরি স্যার।”
“যাও।”

ধ°ম°ক খেয়ে ছেলেটা ক্লাসে চলে গেল। আহনাফ একটা বড় নিশ্বাস ফেলল, যেন কষ্টগুলোকে বিদায় করার একটা উপায় এটা। ওই অন্ধকার আকাশ আর এই জমিনের মাঝে অসহায় হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে সে। না আকাশের বুকে মিশতে পারছে আর না জমিনে লুকাতে পারছে।
______________________________________

দুপুরের রান্নাটা আজ সারাহ্ একা হাতে করছে, কিন্তু সব কাজে বাধা দিচ্ছে সামিহা। সাহায্যের নামে কাজ বাড়ানোই যেন তার উদ্দেশ্য। রেগে গেলেও নিজেকে শান্ত রেখে সামিহাকে সহ্য করছে সারাহ্।

মাত্রই ভাতটুকু ফুটতে শুরু করেছে। চুলা কমিয়ে সারাহ্ বেগুন ভাজতে শুরু করেছে। সামিহা এসে বলল,
“আপু, বেগুন তো পু°ড়ে যাচ্ছে।”
“পু°ড়ুক।”
“কি পু°ড়ুক? (একটু থেমে) আজকে খিচুড়ি রান্না করলে ভালো হতো।”
“এতো পারবো না, আগে বলতে পারিস নি।”
“ব°কা দেও কেন?”

একটু পরে সামিহা ন্যাকাসুরে বলল,
“আপু, আজকে একটু বাইরে যাবো।”
“কোথায়?”
রান্না করতে করতেই সারাহ্ বলে।

সামিহা হেলেদুলে বলল,
“চলো, আজকে রাতের খাবার‍টা বাইরে কোথাও খাই।”

সারাহ্ একটু ভেবে বলল,
“আইডিয়া খারাপ না, কোথায় যাবি?”
“যেখানে নিয়ে যাবা, সেখানেই যাবো। আব্বুকে আমি রাজি করিয়ে ফেলেছি, আম্মুকে তুমি করো।”

সারাহ্ হাসলো, যদিও ওর হাসি সামিহা দেখেনি। তার আগেই হেলেদুলে নিজের রুমে চলে গেছে সে। মাথানেড়ে আবারো সে রান্নায় মন দিলো। কিছুক্ষণ যেতেই যে সামিহা এসে আবার হাজির হবে তা সে জানে।

সারাহ্-র ভাবনা সত্যি হলো, একটু পরেই সামিহা এসে হাজির হলো। হাতে একটা নিউজপেপার।

সারাহ্ ওর দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
“কি রে? আবার কি দেখাতে এসেছিস?”

সামিহা বলল,
“দেশে কত কত দু°র্ঘ°ট°না ঘটে যাচ্ছে গো আপু।”
“কেন? আবার কি হলো?”

সামিহা নিউজপেপার এগিয়ে দিয়ে বলল,
“দেখো না, সড়ক দু°র্ঘ°ট°নায় কনেসহ তিনজনের মৃ°ত্যু।”

সারাহ্ নিউজপেপারের তারিখ দেখে বলল,
“দেখ, একসপ্তাহ আগের নিউজ।”
“বাদ দাও না তারিখ, দেখো এখানে কি লিখছে। এক পরিবারের দুই মেয়ে মা°রা গেছে। বাবা-মায়ের কি অবস্থা গো?”

সামিহার কথায় সারাহ্ হঠাৎ চুপ করে গেল। নিজের বাবা-মায়ের কথা মনে পড়লো৷ ওরা দুইবোন ছাড়া আর কেউ তো নেই তাদের। পরক্ষণেই সারাহ্ ভাবলো,
“আল্লাহ্ যা করবেন ভালোর জন্যই করবে, সবার জীবন তো আর একরকম হবে না।”

কিন্তু মানুষের মন তো খারাপটাই ভাবে বেশি। সারাহ্ আর বেশি কথা বলতে পারলো না।

একটা কথাই সামিহাকে বলল,
“মানুষের জীবনে কত কষ্ট দেখেছিস। আমরা ভালো আছি, সুখে আছি, এজন্য শুকরিয়া না করে উলটো আফসোস করি এটা নেই ওটা নেই করে।”

দুপুর দেড়টা,

নামাজ পড়া শেষ করেও জায়নামাজে বসে আছে মৃত্তিকা। মামের জন্য দোয়া করছে। তার মাম বলেছিল,
“নেককার সন্তানদের দোয়া মৃ°ত্যুর পরেও সুখের কারণ হয়।”

দোয়া করলে মামের সুখ হবে, একটুকু ভেবেই দোয়া করছে সে। ঠোঁট নড়ছে না, কিছু মুহূর্ত পর পর শুধু কেঁপে উঠছে আর চোখ দিয়ে নিরবিচ্ছিন্নভাবে অশ্রু ঝরছে। ঝরুক অশ্রু, তবুও রব তার দোয়া কবুল করুক।

চোখ মুছে জায়নামাজ গুছিয়ে রেখে ডাইনিং এ গেল। ইমতিয়াজকে খাবার দেয়ার কথা বলে গিয়েছিল তানজিম। ও প্রায় ভুলেই গিয়েছিল বাসায় ও ছাড়াও আরো কেউ আছে।

রান্নাঘর থেকে ডাইনিং টেবিলে খাবার নিয়ে এলো মৃত্তিকা। ইমতিয়াজ কি রুমে আছে নাকি বাইরে তা ও জানে না। কিভাবে ডাকবে?

ইমতিয়াজের রুমের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো মৃত্তিকা।

এদিকে ইমতিয়াজ ফ্লোরে বসে আছে, দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে তাকিয়ে আছে উপরে ঘুরতে থাকা ফ্যানটার দিকে। ওর ইচ্ছা করছে চিৎকার করতে অথচ ও নিরবে বসে আছে। যোহরের নামাজটাও এখনো পড়া হয়নি তার। কয়টা বাজে তাও জানে না।

হঠাৎ দরজায় নক পড়ায় চমকে উঠলো।
“কে?”

ওপাশ থেকে মৃত্তিকা বলল,
“খেতে আসুন।”

ইমতিয়াজ গলা ঝে°ড়ে বলল,
“খাবো না।”
“হাসপাতালে কখন যাবেন?”

ইমতিয়াজ ফোন হাতে নিয়ে সময় দেখে বলল,
“তিনটায় বের হবো।”

আর কোনো সারাশব্দ পাওয়া গেল না। মৃত্তিকা নিজের রুমে চলে গেছে। ইমতিয়াজ উঠে ওযু করে এসে নামাজ পড়ে নিলো। তাহমিনা থাকলে জামায়াত ছাড়া নামাজ পড়তেই পারতো না ইমতিয়াজ, ঠিক সময়ে ঠে°লে°ঠু°লে মসজিদে পাঠাতো ওকে। এমনকি অফিসে থাকলেও বারবার ফোন করে নামাজের কথা মনে করিয়ে দিতো। অফিসেও যাচ্ছে না সে, চাকরিটা আছে কিনা তাও জানে না। এসব জানার ইচ্ছা ওর নেই, কার জন্য আর চাকরি করবে আর টাকা আয় করবে? নেই তো ওর কেউ।

নামাজ শেষে রুম থেকে বের হয়ে দেখে মৃত্তিকা খাচ্ছে। ইমতিয়াজকে আসতে দেখে মৃত্তিকা একটা প্লেট এগিয়ে রেখে নিজের প্লেট নিয়ে রুমে চলে গেল। খাওয়ার ন্যূনতম ইচ্ছা নেই ইমতিয়াজের। তাই আবারো রুমে চলে গেল। আজকাল একবেলা খাবার খেয়ে আরেকবেলা উপোস থাকা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে তার।

তিনটার দিকে বেরিয়ে গেল দুজনে। কাকরাইল থেকে স্কয়ার হাসপাতাল খুব একটা দূরে না হলেও পাবলিক বাহনে যাওয়া একটু কষ্টেরই বটে।

বাসে উঠে মৃত্তিকা বসার জায়গা পেলেও ইমতিয়াজ দাঁড়িয়ে রইলো। আরেকজন পুরুষ মৃত্তিকার কাছে এসে দাঁড়ালে ইমতিয়াজ সামনে একহাত দিয়ে রাখলো। হুট করে সামনে একটা হাত আসায় মৃত্তিকা চমকে উঠে তাকালো ইমতিয়াজের মুখের দিকে। মৃত্তিকার দিকে তাকায়নি সে, সামনের দিকে তাকিয়ে আছে অপলক।

মৃত্তিকা জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালো। বাবা তার মামকে প্রতিদিন কিভাবে মা°রধর করতো তা মৃত্তিকা দেখেছে, হয়তো ছোট ছিল কিন্তু প্রত্যেকটা ঝ°গড়া ওর সামনে হতো। রিপা বেগম যতই মেয়েকে দূরে রাখুক, ওর বাবা এসবের পরোয়া কখনো করে নি। এই নি°কৃ°ষ্ট মানুষটা নাকি আবার ডাক্তার ছিল, ভাবতেই অবাক হয় ও।

তার মামের শরীরের ক্ষ°ত°স্থান আর পো°ড়া জায়গাগুলো সে দেখেছে। সি°গা°রেট জ্বালিয়ে গলার কাছে, হাতে, পায়ে চে°পে ধরতো আর রিপা বেগম কিভাবে চিৎকার করতো তা ও জানে। ওই আ°র্ত°নাদ° ভুলতে পারবে না এই মৃত্তিকা। আবারো কান্না পাচ্ছে ওর, গাল বেয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়তেই মুছে ফেললো।

স্কয়ার হাসপাতাল থেকে একটু দূরে নেমে গেল ওরা। ৫-৬ মিনিটের রাস্তা হেঁটে যেতে হবে। ইমতিয়াজ একটু আগে আগে হাঁটছে আর মৃত্তিকা পিছনে।
_____________________________________

সন্ধ্যা ৭ টায় বাবা-মায়ের সাথে সারাহ্, সামিহা বেরিয়েছে। সামিহার ইচ্ছা অনুযায়ীই রাতের খাবারটা বাইরে কোনো রেস্টুরেন্টে খাবে সবাই।

যমুনা ফিউচার পার্কে গেল সবাই। টুকটাক শপিং এর এটা ওটা দেখছে সামিহা আর কিছুক্ষণ পর পর সারাহ্কে বলছে,
“আপু, এটা সুন্দর না?”

সারাহ্-র উত্তর “সুন্দর” হলেই বলে,
“কিনে দাও।”

সারাহ্ ধমকের মাঝেও কয়েকটা কসমেটিকস কিনেছে সে। জাহাঙ্গীর সাহেব কিংবা নার্গিস পারভিন তেমন ব°কা দেননা মেয়েদের। দুজনের খুনশুটি ভালোই উপভোগ করছেন উনারা।

বড় বড় আয়নাগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে বেশ কয়েকটা মিরর সেলফিও তুলেছে ওরা৷ সামিহা যতটা নাচানাচি করে খেতে এসেছিল, তার একভাগও খেতে পারেনি। মেয়েটার চঞ্চলতা দিন দিন বাড়ছে। বড় হয়েছে সে, এইটুকু বোধ এখনো তার পুরোপুরি হয়নি।
_____________________________________

“মা আমার, আর ইতালিতে ফিরে যেও না। আমাদের সাথেই থাকো।”

লুৎফর সাহেবের অনুরোধে মৃত্তিকা মাথানিচু করে ফেলল। একটু চুপ থেকে বলল,
“মামের স্মৃ°তিটুকু ইতালিতেই আছে। এখানে আমি ভালো থাকতে পারবো না।”

হাসপাতালে মমতাজ বেগমের কেবিনে বসে কথা বলছে উনারা। তানজিম পাশেই বসে আছে, ইমতিয়াজ বাইরে আছে। মমতাজ বেগমকে ঘু°মের ওষুধ দেয়া হয়েছে, মেয়েদের চলে যাওয়া সহ্য করার ক্ষমতা উনার এখনো হয়নি।

“আপু, ওখানে গিয়েও আপু ভালো থাকবে না।”

মৃত্তিকা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বাইরে চলে এলো। একটু দূরে ইমতিয়াজ দাঁড়িয়ে আছে, ফোনের স্ক্রিনে তার চোখদুটো নি°ব°দ্ধ।

“আরে মিউকো যে, মায়ের মৃত্তিকা।”

ব্য°ঙ্গসুরে বলা কারো কথায় ফিরে তাকালো মৃত্তিকা। কপাল কুঁচকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো সামনের লোকটির দিকে। চেনাচেনা ঠে°কলেও হুট করে চিনলো না।

অবশেষে চিনতে পারলো, এ যে ওরই বাবা, শরীফ আহমেদ। কপালের ভাঁজগুলো গভীর হলো।

“আমাকে কি করে চিনলেন?”

মৃত্তিকার কথায় শরীফ হাসলো। মাথা ঝাঁ°কিয়ে কুঁকড়ানো চুলগুলো নেড়েচেড়ে বলল,
“তোমার মা আমার থেকে তোমাকে দূরে রাখতে চাইলেও আমি কিন্তু দূরে থাকিনি, তাই চিনি। (একটু থেমে) শুনলাম সে ম°রে°ছে।”

মৃত্তিকা রেগে গিয়ে বলল,
“ভদ্র ভাষায় কথা বলুন।”
“হুশ।”
শরীফ মুখে আঙ্গুল দিয়ে বলল।

ঝা°মেলা কিছু হয়েছে ভেবে ইমতিয়াজ এগিয়ে এলো। শরীফ ইমতিয়াজকে দেখে বলল,
“এখানে দেখার কিছু নেই, যেতে পারেন।”

ইমতিয়াজ মৃত্তিকাকে বলল,
“এনি প্রবলেম?”

মৃত্তিকা তার বাবার দিকে শুধু ইশারা করলো। শরীফ আবারো বলল,
“কে হয় এই মেয়ে আপনার? এতো ইন্টারেস্ট কেন?”
“বোন হয়, কোনো সমস্যা? বি°র°ক্ত করছেন কেন?”

ইমতিয়াজ স্বাভাবিক কথায় শরীফ হেসে উঠে বলল,
“বোন? (একটু হেসে মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে) তোর মায়ের আরো কোনো চ°ক্ক°র ছিল নাকি?”

মৃত্তিকা কিছু বলার আগেই শরীফের গালে একটা থা°প্প°ড় বসায় ইমতিয়াজ। মৃ°ত একজন মানুষের প্রতি এমন ভাষা ওর সহ্য হয়নি।

শরীফ সরে গিয়ে বলল,
“বড়দের সাথে এমন বিহেভ কেন? মা-বাবা কিছু শেখায়নি?”
“সে কৈফিয়ত আপনাকে না দিলেও হবে।”

ইমতিয়াজ আর কিছুই বলে না, চলে যায় এখান থেকে। জন্মের পরে মাকে আর ১৭ বছর বয়সে বাবাকে হা°রিয়ে একা বড় হওয়া ছেলেটা এই ৩২ বছর বয়সে এসে বাবা-মাকে নিয়ে অচেনা কাউকে কিছু বলতে চায় না।

মৃত্তিকা আবারো কেবিনের ভিতরে চলে গেল। শরীফ ওকে ফলো করছে, শুধু এখন না আরো আগে থেকে করছে। এটা মৃত্তিকা হা°ড়ে হা°ড়ে টের পাচ্ছে। ওর মামের মৃ°ত্যুর পিছনে আবার এর হাত নেই তো? হঠাৎ অজানা একটা ভ°য়ে ঘা°ব°ড়ে যায় মৃত্তিকা।

চলবে……

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

তৃতীয় পর্ব

রাত সাড়ে ১০ টার কিছুক্ষণ পর বাসায় এসে পৌঁছায় মৃত্তিকা, তানজিম আর ইমতিয়াজ। তানজিম সোজা নিজের রুমে চলে যায়। বোনদের চলে যাওয়া আর মায়ের অসুস্থতা এই বাচ্চা ছেলেটাকেও অসুস্থ করে দিচ্ছে। বয়স আর কত হবে? মাত্রই তো ১৯ ছেড়ে ২০ এ গেল। ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে, এ সময়টা অন্যদের মতো হাসি-আনন্দে যাচ্ছে না ওর।

ইমতিয়াজ রুমে যাওয়ার সময় আবারো ফিরে আসে। মৃত্তিকাকে বলল,
“লোকটা কে ছিল?”

মৃত্তিকা প্লেট ধুয়ে এনে টেবিলে রাখছিলো। ইমতিয়াজের কথায় থমকে যায়। মৃত্তিকার নিরবতায় ইমতিয়াজের কৌতুহল বাড়ে।

“আমার বাবা উনি।”

কথাটা শুনে ইমতিয়াজ ছোটখাটো ধা°ক্কা খায়। বাবা হয়ে মেয়ের সাথে এমন ব্যবহার কিভাবে সম্ভব।

“আপনার বাবা?”
“দেখুন, উনাকে নিয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাইছি না।”

ইমতিয়াজ চলে যেতে নিলে মৃত্তিকা পিছু ডেকে বলল,
“আপনি তো দুপুরেও খাননি, এখন খেয়ে নিন। আমি ডিম ভেজে আনছি।”

ইমতিয়াজ কিছু বলে না, রুমে চলে যায়। তাহমিনা প্রতিরাতে ওকে খাইয়ে দিতো। ক্লান্ত হয়ে অফিসে থেকে ফিরে দেখতো তাহমিনা খাবার সাজিয়ে রেখেছে। একপ্লেটে দুজনে খেতে বসতো। গত দেড়বছরে এটা ওর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

বিছানায় শুয়ে পড়লো ইমতিয়াজ। একটা হাত মেলে দিয়েছে। এই হাতের উপর তাহমিনা শুয়ে পড়তো। তারপর ধীরে ধীরে কাছে চলে আসতো দুজনে। ওর বুকে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকতো ওর মিনা, ওর দুষ্টুমির স্পর্শগুলোতে লজ্জায় মুখ লুকাতো।

ও অনুভব করছে তাহমিনা এসে ওর হাতের উপর শুয়েছে।
“আমার তাজ, খাবে না? আমিও তো খাইনি।”

“মিনা।”
লাফ দিয়ে উঠে বসে ইমতিয়াজ। তাহমিনার ডাকা “আমার তাজ” কথাটা যে শুনেছে ও।

“ভাইয়া, কি হয়েছে?”

জোরে চিৎকার করায় তানজিম এসে হাজির হয়েছে। ইমতিয়াজ স্বাভাবিক ভাবে বলল,
“কিছু না।”
“ভাইয়া, খেতে আসুন।”

শেষ পর্যন্ত খেতে যায় ইমতিয়াজ। তার মিনা যে তাকে খেতে বলেছে। মনের ভুলটাকে জোরপূর্বক সত্য বলে ধরে নিলো।

খাবার টেবিলে বসে তানজিম বলল,
“আপু, কালকে একটু আমার সাথে ভার্সিটিতে যেতে পারবে? আমার এইচএসসির মার্কশীট জমা দেয়া হয় নাই।”
“কালই?”
“হুম, না দিলে ভর্তি বাতিল হয়ে যাবে।”

মৃত্তিকা আর কিছু বলার আগেই ইমতিয়াজ বলল,
“আমি নিয়ে যাবো।”
______________________________________

“জুহাইব আজকে টিকেট নিয়ে এসেছে, বাবা। আগামী সপ্তাহে আমরা চলে যাবো।”

আফরোজার কথায় আব্বাস সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“চলে তো যেতেই হয়। এই পৃথিবীর নিয়মই তো এটা।”

আফরোজা এসে বাবার কাছে বসে বলল,
“বাবা প্লিজ, এভাবে হায়°হু°তাশ করো না। আমার কষ্ট হয়।”

আব্বাস সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলালেন। এই মেয়েটাই তাকে প্রথম বাবা ডাক শুনিয়েছিল, আধো আধো বুলির সেই ডাক আব্বাস সাহেব ভুলেননি। এখন মেয়ে বড় হয়েছে তাই নিজের সংসারে যেতেই হবে।

আফরোজার কপালে চুমো দিয়ে বলল,
“আহনাফের অবস্থাটা দেখেছিস? ওকে কিভাবে সামলে রাখবো আমি?”
“চিন্তা করো না তুমি। আহনাফ নিজেই সামলে থাকবে।”

আফরোজা কিছুক্ষণ আহনাফের ঘরের দরজার দিকে চেয়ে থেকে বলল,
“যে ছেলেটা দায়িত্বের খাতিরে এরকম মানসিক অবস্থায় কলেজে যেতে পারে, সে ভুল সিদ্ধান্ত নিবে না।”
“হুম, তাই যেন হয়।”

আহনাফ নিজের ঘরেই আছে। কলেজ থেকে এসে এখানে পড়েছে তো পড়েছেই। মানসিক অবস্থার সাথে শারিরীক অবস্থাও খারাপ, হুট করে ঠান্ডা লেগে গেছে, হালকা জ্ব°রও আছে বোধহয়।

আফরোজা ওর ঘরে আসলো। এতোক্ষণ চোখ খুলে রাখলেও শব্দ শুনে চোখ বন্ধ করলো আহনাফ। কপালে হাত দিয়ে জ্ব°র বুঝতে পারলো আফরোজা। জল প°ট্টি দিলো, শরীর মুছে দিলো, কিন্তু আহনাফ উঠলো না। ঘুমন্ত মানুষকে জাগানো যায়, জেগে থাকা মানুষকে তো আর জাগানো যায় না।

কপালে ভেজা রুমালটা দিয়ে আফরোজা নিজের রুমে চলে আসলো। প্রচন্ড খারাপ লাগছে ভাইয়ের জন্য, কান্নাও পাচ্ছে। বাবা-ভাইকে এ অবস্থায় ফেলে দূর ইউরোপে থাকতে পারবে ও? দম ব°ন্ধ হয়ে যাবে তো।

জুহাইব ল্যাপটপ নিয়ে বসে ছিল। আফরোজাকে দেখে ল্যাপটপ রেখে দিলো। আফরোজা ওর পাশে বসতেই বলল,
“আশকিম (আমার ভালোবাসা)?”

আফরোজা অসহায় চোখে তাকালো। জুহাইব ওর গালে হাত দিয়ে বলল,
“কি হয়েছে?”

আফরোজা জুহাইবের বুকে মাথা রেখে বলল,
“আমি দেশে থাকি? তুমি বরং চলে যাও। বাবা আর আহনাফকে এভাবে রেখে যেতে ইচ্ছা করছে না।”

এক নিশ্বাসে কথাটা বলে ফেলে সে। জুহাইব ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ওর অবস্থাটা বুঝতে পারছে। মেয়েটা যে কাঁদছে সে অনুভূতিটাও হলো তার।

আফরোজারা মাথা তুলে ওর কপালে চুম্বন করে বলল,
“ঠিক আছে, তুমি থাকো। (একটু থেমে) একা একা ফিরতে পারবে তো?”
“খুব পারবো।”

কান্না ভেজা চোখে খুশির ঝিলিক দেখা দিলো। জুহাইব ওর চোখ মুছে দিয়ে বলল,
“পরে আমার জন্য কাঁদলে কিন্তু আসতে পারবো না। যা আদর আছে এখনি করে দাও।”

জুহাইবের কথায় হেসে ওর বুকে একটা মা°ই°র দিলো আফরোজা। এই লোকও পারে, শুধু অসময়ে প্রেম জেগে উঠে। আফরোজা উঠে যেতে নিলে জুহাইব ওকে টেনে কাছে নিয়ে আসে, আফরোজাও এতে সম্মত হয়।

ভোর ৫ টা,

নামাজ শেষে কোরআন তেলাওয়াত করছে সারাহ্। হঠাৎ একটা বি°ক°ট শব্দে চমকে উঠে। কালরাত থেকে বেশ কয়েকবার এমন শব্দ হয়েছে। সামিহা সবেমাত্র বিছানা নিয়েছিল, লাফিয়ে উঠে বসে সেও।

“পুরো রাত ঘুম হয়নি এই শব্দে, এখন আবার কেন?”

সারাহ্ কোরআন বন্ধ করে রেখে বি°র°ক্তি নিয়ে বেরিয়ে যায়। জাহাঙ্গীর সাহেবের রুমের সামনে গিয়ে বলল,
“বাবা।”

এক ডাকেই জাহাঙ্গীর সাহেব বেরিয়ে এলেন। হয়তো বের হওয়ার জন্যই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। নার্গিস পারভিনও বেরিয়ে এলেন। সারাহ্ বলল,
“উপরের তলায় রাত থেকে এতো সাউন্ড হচ্ছে কেন? বাড়িঘর ভে°ঙ্গে ফেলবে নাকি?”
“দেখছি আমি।”

জাহাঙ্গীর সাহেব বেরিয়ে গেলেন। সারাহ্ সদর দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। জাহাঙ্গীর সাহেব প্রথমে দারোয়ানকে বিষয়টা জানালেন। তারপর উপরের তলায় ওদের ফ্ল্যাটের বরাবর ফ্ল্যাটে গেলেন।

বেশ কয়েকবার কলিং বেল বাজানোর পর মধ্যবয়সী এক লোক এসে দরজা খুলল। ক°র্ক°শ কন্ঠে বলল,
“কি চাই?”

জাহাঙ্গীর সাহেব কিছু বলার আগেই দারোয়ান বলল,
“শরীফ সাহেব, আপনার বাসায় নাকি শব্দ হচ্ছে?”

শরীফ চেঁচিয়ে উঠে,
“তো হচ্ছে, আমার বাসায় হচ্ছে। উনার সমস্যা কি?”
“নিচের ফ্ল্যাটে শব্দ যাচ্ছে, আমাদের অসুবিধা হয়।”

জাহাঙ্গীর সাহেবের কথায় শরীফ সোজা জবাব দিলো,
“তো বাসা ছেড়ে দেন। চলে যান অন্য কোথাও।”

মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিলো। জাহাঙ্গীর সাহেব প্রচন্ড বি°র°ক্ত হলেন। ন্যূনতম ভদ্রতা নেই লোকটার।

শরীফ কাল বাসায় এসেই রাগে জিনিসপত্র ভা°ঙ°চু°র করছে। কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে কথা বলে, হঠাৎ করে চেঁ°চামেচি করে আর অতিরিক্ত রাগটুকু ফার্নিচার আর ঘরের ছোটখাটো জিনিসপত্রের উপর ঝাড়তেছে। রাগটা কি মৃত্তিকার উপর নাকি ইমতিয়াজের উপর তা সে নিজেও জানে না।

জাহাঙ্গীর সাহেব বাসায় এসে বললেন,
“ফালতু এক লোক থাকে।”

সারাহ্ উৎ°ক°ন্ঠা নিয়ে বলল,
“কি বলেছে বাবা?”
“বলেছে ডিস্টার্ব হলে বাসা ছেড়ে চলে যাও।”
“কি? এভাবেও কেউ বলে?”

নার্গিস পারভিন বললেন,
“বাদ দাও, যা খুশি হোক। একটু রয়েসয়ে যাবো, তাও এই অসভ্য মানুষটার সাথে আর দেখা করারই দরকার নেই।”
“হ্যাঁ, আম্মু ঠিক বলেছে।”
মাকে সমর্থন করে বলল সারাহ্।
______________________________________

ফজরের নামাজটা মসজিদে পড়ে ফাঁকা রাস্তায় একা একা হাঁটছে ইমতিয়াজ। কতবার ভোরে তাহমিনাকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে, অথচ আজ এমন একা হয়ে গেছে সে।

ওদের বিয়েটাতেও একটা নাটকীয়তা ছিল। ব্যাচেলার বাসার এতিম ছেলেটা তো জানে বাবা-মায়েরা মেয়ের জন্য সবসময় পারফেক্ট একজন ছেলে চায়, যা ইমতিয়াজ নয়। এজন্য বিয়ে নিয়ে ভাবতেই চায়নি সে, কখনো কাউকে পছন্দ হলেও অনুভূতিকে পাত্তা দেয়নি।

ইমতিয়াজের এক বন্ধুর বাবার সাথে লুৎফর রহমান মেয়ের সাথে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে নিজে এসেছিলেন। অবাকের পাল্লা ভারী হয়েছিল ইমতিয়াজের। বাবা-মা ছাড়া টিউশন আর পার্ট টাইম জব করে নিজের অনার্সটুকু শেষ করেছিল সে। মাস্টার্স করার ইচ্ছা থাকলেও করা হয়নি। ছোটখাটো চাকরি করা ইমতিয়াজ যেদিন তাহমিনাকে বিয়ে করে সেদিন লুৎফর সাহেবের অনুরোধে তাদের সাথেই থাকতে শুরু করে সে।

লুৎফর সাহেব মেয়ের জন্য সাধারণ একটা ছেলে চেয়েছিলেন, কেন এমন ইচ্ছা ছিল তা আজও জানা হয়নি ইমতিয়াজের।

ধীরে ধীরে মেয়ের জামাই থেকে বাড়ির ছেলে হয়ে উঠে সে, বড় ছেলে। ঘটনা তো বেশিদিন আগের নয়, ১৮ কি ১৯ মাস হবে।

প্রথম যখন তাহমিনা নিজের মধ্যে আরেকটা নতুন অস্তিত্ব খুঁজে পায় তখন সর্বপ্রথম ইমতিয়াজকেই জানায়। সেদিনের মুহূর্তগুলো ভুলে যাওয়ার নয়।

ইমতিয়াজের হাতটা নিজের উদরে রেখে তাহমিনা বলেছিল,
“তোমার জন্য আরেকটা ভালোবাসা আসছে।”
“পুরো পৃথিবীকে জানিয়ে দাও মিনা।”
“আমার তাজ, সবাই জানবে।”

ছি°ন্ন°বিচ্ছি°ন্ন কথাগুলো ভাবতে ভাবতে রাস্তায় পড়ে থাকা ইটের টুকরায় লা°থি দিয়ে ইমতিয়াজ। টুকরাটা কিছুদূর গড়িয়ে গড়িয়ে গিয়ে থেমে যায়। বড় একটা নিশ্বাস ফেলে সে আবারো হাঁটতে থাকে।
______________________________________

সকাল দশটায় ঘুম ভাঙে আহনাফের। জ্ব°রের তীব্রতা বেড়েছে, শরীরে কাঁ°পুনি হচ্ছে৷ ফোন হাতে নিয়ে সময় দেখে উঠার ইচ্ছা হলেও শরীরটা সায় দিলো না।

আফরোজা ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এসেছে।

“আপু, এখন..”

আহনাফের কথা শেষ হওয়ার আগেই আফরোজা রেগে বলে,
“১০৪ ডিগ্রি জ্ব°র নিয়ে পড়ে আছো আর আমি এখানে কেন সেটা জানতে চাচ্ছো?”

আহনাফ চুপ করে। আজকের ক্লাস মিস হয়েছে, কিছুদিন পর ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের টেস্ট এক্সাম শুরু হবে আর ও এখন ক্লাসে যেতে পারলো না।

আফরোজা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“একটু বাঁকা হয়ে শুয়ে পড়, মাথায় পানি দিয়ে দিই।”

আহনাফ প্রতিবাদ করে না। বিছানায় আড় হয়ে শুয়ে পড়ে। আফরোজা ওর মাথায় পানি ঢালছে।

ভার্সিটিতে থাকতে একবার এমন জ্ব°র হয়েছিল আহনাফের৷ তাহসিনার কি ব°কাটাই না খেয়েছিল সেদিন। তারপর তাহসিনা ওর রুমে এসে ওকে খাইয়ে দিলো, মাথায় পানি দিয়ে গা মুছে দিলো।

ঘটনাগুলো আজও পুরোনো মনে হয় না। এইতো সেদিনের ঘটনা যেন সব। আহনাফ চোখ বন্ধ করে, ওই মানুষটা আর আসবে না এটা ভাবতেই পারছে না সে। ভুলে যাওয়া কি এতো সহজ?

“তুই কাঁদছিস?”

আফরোজার কথায় চমকে উঠে আহনাফ। কখন ওর চোখ দিয়ে পানি বেরিয়েছে তা ও নিজেই জানে না।

আফরোজা কিছু না বলে বেরিয়ে চলে যায়। কান্না যে তারও পাচ্ছে, কিন্তু ভাইয়ের সামনে কাঁদবে না সে। জুহাইব রুম থেকে বের হয়ে ড্রইংরুমে আফরোজাকে কাঁদতে দেখে এগিয়ে যায়। জুহাইবকে দেখে কান্নার রে°শটা বাড়ে আফরোজার।
_____________________________________

কিছু বই কিনতে নীলক্ষেত এসেছে সারাহ্। সকাল সকাল এসেছে যেন জ্যাম না পড়ে, তবুও ঢাকা বলে কথা। জ্যামে, গরমে অ°স্থির হয়ে উঠেছে।

কয়েক দোকান খুঁজে ওর পছন্দমতো কিছু বই পেল। মূলত চাকরির প্রস্তুতির বই কিনতে এসেছে সে। বইগুলো নিয়ে কা°টাবন রোড ধরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েও আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে যায় একটু একা ঘুরাঘুরি করবে বলে।

রিকশা নিয়ে চলে গেল দোয়েল চত্বর। সেখানে রিকশা থেকে নেমে ফুটপাত ধরে হাঁটছে। সামিহার ডিপার্টমেন্টটাও এখানে, গণিত বিভাগে ভর্তি হয়েছে সে।

কেন্দ্রীয় শ°হী°দ মিনারের কাছে এসে রাস্তা পার হওয়ার সময় রাস্তার মাঝেই ব্যাগ ছিঁ°ড়ে বইগুলো মাটিতে পড়ে যায়। সারাহ্ হাঁটু গেড়ে বসে তাড়াহুড়ো করে বইগুলো তুলতে লাগলো। মাঝরাস্তায় এমন ঘটনায় রেগে গেছে সে। আশেপাশে এতো এতো মানুষ ওকে দেখছে।

হঠাৎ মানুষের চেঁ°চামেচি অনুসরণ করে তাকিয়ে মাত্রই বাঁক নেয়া মাইক্রোবাসটা ওর দিকেই আসছে। উঠে দাঁড়াতেই তড়িৎ গতিতে কেউ এসে ওকে ছি°টকে নিয়ে ফেললো একপাশে। শক্ত কং°ক্রি°টের ফুটপাতে বেশ ভালোই ব্য°থা পেয়েছে সারাহ্, সাথের লোকটাও বোধহয় আরো ব্য°থা পেয়েছে।

সারাহ্ উঠে বসলো, চশমাটা খুলে কোথায় পড়েছে খুঁজে পাচ্ছে না। অনবরত হাতড়াচ্ছে সে, লোকটা ওর হাতে চশমাটা দিয়ে ধ°ম°কের সুরে বলল,
“চশমা পড়েও চোখে দেখেন না?”

মাইক্রোবাসটাও থেমেছে। ড্রাইভার নেমে এসে ওকে বলল,
“এখানে গাড়ি মোড় নেয় জানেন না? এমনে রাস্তায় কেউ বসে থাকে?”

ইমতিয়াজ দাঁড়িয়ে জামা কাপড় ঝাড়তে থাকে। সারাহ্-কে বাঁচানো এই লোকটা ইমতিয়াজই। তানজিমকে নিয়ে ভার্সিটিতে এসেছে, ডিপার্টমেন্টের বাইরে এসে সারাহ্-কে এ অবস্থায় দেখে বাঁচানোর জন্য ম°রিয়া হয়ে উঠে সে। না জানি কোথায় কার মেয়ে, কার স্ত্রী বা কার বোন চলে যায়।

সারাহ্ উঠে দাঁড়ায়। তাৎক্ষণিক এক ঘটনায় সে বেশ লজ্জা পেল। আশেপাশে লোক জড়ো হয়েছে। ইমতিয়াজ সারাহ্-র বইগুলো তুলে এনে ওর সামনে রেখে বলল,
“এই কয়টা বইয়ের জন্য জীবন দিয়েন না। বেঁচে থাকলে বই জীবনে বহুত পড়তে পারবেন।”

ইমতিয়াজ চলে গেল। ধীরে ধীরে ভীড়টাও কমতে থাকলো। সারাহ্ বইগুলো তুলতে তুলতে আবারো তাকালো অচেনা লোকটির দিকে। ওকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন ঝুঁ°কিতে ফেলে দিলো কেউ একজন অথচ ও থ্যাংকস জানানোর সময়টুকুও পেল না।

বইগুলো কোনোরকম নিয়ে দৌড়ে ইমতিয়াজের পিছুপিছু গেল সারাহ্।

“শুনুন, এক্সকিউজ মি, এইযে হিরো। (একটু থেমে) এই যে একটু আগে ফুটপাতে পড়ে গেছিলেন ওর ভাইয়া।”

ইমতিয়াজ ফিরে তাকালো। চোখ মুখ কুঁচকে বলল,
“জি, আমাকে কিছু বলছেন?”

সারাহ্ হাঁ°পাতে হাঁ°পাতে বলল,
“হ্যাঁ, কখন থেকে ডাকছি।”
“কেন?”
“থ্যাংক ইউ, আমাকে বাঁচানোর জন্য। আজকাল কারো জন্য কেউ এমন করে না।”

ইমতিয়াজ আলতো হাসলো। বলল,
“যখন তার কেউ থাকে না, ভালোবাসাগুলো মাঝরাস্তায় বিলীন হয় তখন হয়তো মানুষ এমনই করে।”

সারাহ্ অবাক হয় ইমতিয়াজের কথায়। মাথামু°ণ্ডু খুঁজে পায়না, অর্থটাও বুঝতে পারে না। ইমতিয়াজ চলে গেল, সারাহ্ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

চলবে……

অনুভূতিরা শব্দহীন পর্ব-০১

0

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
প্রথম পর্ব

লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

বিয়ে বাড়িটা মুহূর্তের মধ্যেই শো°কে স্ত°দ্ধ হলো কনের মৃ°ত্যুতে। পার্লার থেকে সাজ শেষে ফেরার পথেই সড়ক দু°র্ঘ°টনার কবলে প্রাণ হা°রায় তাহসিনা, যার আজকে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল।

তাহসিনার সাথে তার বড়বোন তাহমিনা আর ছোটখালা রিপাও পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। তাহসিনার ছোট ভাই তানজিম আর ওর মা-বাবা পাগল প্রায় হয়ে গেছে। এ কেমন মৃ°ত্যু আসলো তাহসিনার জীবনে?

সদ্য মাস্টার্স শেষ করা মেয়েটি নিজের প্রথম প্রেমকে আজ নিজের করে নিতো। কিন্তু বিধাতা হয়তো তা চায়নি, তাইতো তাকে তুলে নিয়েছে।

তাহমিনার স্বামী, ইমতিয়াজ তাহমিনার হাত ধরে নিরবে কাঁদছে। মেয়েটা যে অন্তসত্ত্বা ছিল, নিজের ঘরটা সাজিয়েছিল অনাগত সন্তানের জন্য।

“কেন চলে গেলে? বেবিকে নিয়ে আমরা কি একসাথে থাকতে পারতাম না। ও আমার মিনা, কথা তো বলে।”

একটু থেমে আবারো বলে,
“মিনা, আমাকে কেন নিলে না তোমার সাথে?”
ইমতিয়াজের কথা কি তার মিনা আর শুনবে?

তাহসিনার খালা রিপার মেয়ে মৃত্তিকা মায়ের প্রাণ°হীন দেহের পাশে বসে আছে, ওকে দেখলে জীবন্ত লা°শ মনে হবে। বিদেশে বড় হওয়া মৃত্তিকাকে মা ছাড়া বাকি সবাই মিউকো বলে ডাকতো৷ এখন ওকে মৃত্তিকা বলবে কে? মায়ের মৃ°ত্যু কিভাবে সইবে সে। তার যে আর কেউ নেই। বাবা তো ওর চার বছর বয়সেই মাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে গেছে।

মৃত্তিকার মুখ দিয়ে অ°স্ফুট স্বরে বের হয়,
“মাম, আমার মাম।”

কিছুক্ষণ পরই বর আহনাফের গাড়ি প্রবেশ করলো। দূর থেকে সাজানো এই রিসোর্ট দেখে পুলকিত হচ্ছিল সে, অথচ কাছে আসতেই একটা অদ্ভুত অনুভূতি হলো। শব্দ নেই, গান-বাজনা নেই, হৈ-হুল্লোড় নেই। বিয়ে বাড়িতে এসব তো থাকার কথা।

আহনাফ গাড়ি থেকে নেমে রিসোর্টের ভিতরে চলে গেল। ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখলো পরপর রাখা তিনটা লা°শ। হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো সে, মাঝের মানুষটা যে তার বড্ড চেনা।

তাহসিনার মায়ের চিৎকার ওর কানে আসছে না, তানজিমের ডাকও সে উপেক্ষা করলো। সোজা গিয়ে তাহসিনার মাথার কাছে বসে পড়লো। মাথায় হাত রেখে চেয়ে রইলো চেহারাটার দিকে। এই মানুষটা ওকে দেখলেই লজ্জায় লুটিয়ে পড়তো।

ও যে প্রতিনিয়ত তাহসিনার কাজল কালো বড়বড় হরিণী চোখের প্রশংসা করতো, আজ চোখজোড়া বন্ধ কেন? আজ সে বর সেজেছে, তাহসিনা তো দেখতে চেয়েছিল। তবে দেখছে না কেন?

ছেলেরা তো মনের বি°লাপ মুখে আনতে পারে না, তাই ওর মনের অবস্থাটা কেউই বুঝছে না।

তাহসিনার খুব ইচ্ছা ছিল বিয়েতে সাদা-গোলাপী শাড়ি পড়বে আর আহনাফ চেয়েছিল লাল বধূ। সাদা শাড়ি তো আজ ঠিকই পড়েছিল, কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে তা এখন লালে র°ঞ্জি°ত।

আহনাফ চিৎকার করতে পারছে না, কাঁদতে পারছে না। সকলে কাঁদছে, এখানে উপস্থিত সবার চোখে জল। অথচ ওর চোখও আজ বে°ই°মা°নি করছে।

বরাবরের মতোই নিজেকে প্রকাশে অপারগ আহনাফ। শান্ত ছেলেটা মেঝেতে বসে রইলো। তার বড় বোন আফরোজা এসে ওর পাশে বসলো, ওর পিঠে হাত রাখলো যেন ওকে সান্ত্বনা দিতে চাইছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই, শুধু চোখে জল আর বি°লাপের শব্দ।

ঘন্টাখানেক পর লা°শ°বাহী ফ্রিজিং গাড়ি আসলো। তাহসিনার ইচ্ছায় সিলেটের এই রিসোর্টে বিয়ের আয়োজন করা হয়েছিল৷ এখন আবারো ফিরে যাবে ঢাকায়, দেহগুলোকে কবর দিতে। ইচ্ছেটা যে চির অপূর্ণ রয়ে গেল।

লা°শ গাড়িতে তোলা হচ্ছে, আহনাফের চোখজোড়া স্থির হয়ে রইলো তাহসিনার চেহারার দিকে। এখনো এই ধা°ক্কাটা মেনে নিতে পারছে না সে৷ স্বপ্ন তো সাজানো হয়েছিল বহু আগে, তবে আজ কেন ভে°ঙ্গে গেল?

রাতেই ঢাকায় ফিরলো সবাই। সকাল ১০ টায় জানাজা হলো আর তারপর শেষবারের মতো তাহসিনার মুখটা দেখলো আহনাফ৷ সাদা কাফনে মাটির নিচে চলে গেল তাহসিনা। শুভ্র রঙ তার খুব প্রিয় ছিল, এজন্যই বুঝি?

কবরের পাশে বসে থাকলো আহনাফ। এখনো পড়নে বরের শেরওয়ানি। আফরোজা এসে বলল,
“আহনাফ, ফ্রেশ হয়ে নিবি আয়। কাল থেকে তো কিছুই খাসনি।”

সামনের ছোট গাছটায় হাত মু°ষ্ঠিবদ্ধ করে আহনাফ বসে রইলো, কোনো জবাব দিলো না। আফরোজার কথা ওর কানে যাচ্ছে কিনা আল্লাহই ভালো জানে। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে আফরোজা দূরে চলে গেল।

ইমতিয়াজ একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ছোট থেকে এ°তিম ছেলেটার তাহমিনা আর তার পরিবারই ছিল একমাত্র ভালোবাসার স্থান, তাদের সাথেই তো সে ভালোবাসার রংমহল গড়েছিল। বিয়ের পর থেকে তাদের সাথেই থাকতো ইমতিয়াজ, ঘরের জামাই কম আর ছেলে বেশি সে।

আজ তার সেই ভালোবাসা চোখ বুজলো। ছেলেরা কাঁদলে নাকি বেমানান দেখায়, নিয়মের তোয়াক্কা না করেই কাঁদছে ইমতিয়াজ।

আফরোজা এখনো আহনাফের আশায় রইলো, হয়তো সে উঠবে৷ কিন্তু উঠছে না, কাঁদছে না, ডাগর চোখে একইভাবে চেয়ে রয়েছে।

“শুনছেন আপু?”

আফরোজা পিছু ফিরে মৃত্তিকাকে দেখে বলে,
“জি।”

মৃত্তিকা পিটপিট করে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে। সারারাতের নির্ঘুম কান্নায় চোখমুখ ফুলে আছে তার। আফরোজা যত্ন করে ওর চোখ মুছে দিয়ে বলল,
“বলো।”

মৃত্তিকা কান্না চেপে বলল,
“ওখানে কেউ একজন আপনাকে ডাকছে, ফরেইনার মনে হলো।”

একটু থেমে দূরে থাকা গাড়ির দিকে ইশারা করে বলল,
“ওখানে?”

আফরোজা ওদিকে চেয়ে বলে,
“মাই হাসবেন্ড, জুহাইব।”
“ওহ।”

আহনাফকে নিয়ে যাওয়ার জন্যই গাড়ি এসেছে। আফরোজা গিয়ে জুহাইবকে বলল,
“আফনাফকে জোর করে হলেও নিয়ে আসো, ওর অবস্থা আমার ঠিক লাগছে না।”

আফরোজার গলা কেঁপে উঠলো,
“ম°রে যাবে আমার ভাইটা।”

জুহাইব একটু ভেবে বলল,
“হুম, যাচ্ছি।”

বিদেশি সাদা চামড়ার জুহাইব আফরোজাকে বিয়ে করেছে। বিয়ের পর আফরোজা জুহাইবের সাথে তার দেশ তুরস্কতে থাকতে শুরু করেছে। বছরে একবার দেশে আসা হয়, এবার এসেছে আহনাফের বিয়ে উপলক্ষ্যে। দুজনেই পরস্পরের ভাষা আয়ত্ত করে ফেলেছে।

একপ্রকার টে°নে হিঁ°চড়ে আহনাফকে নিয়ে আসা হলো। তানজিম ছাড়া তাহসিনার পরিবারের আর কারো সাথেই দেখা হলো না, তাহসিনার মা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আহনাফকে নিয়ে ওরা কুমিল্লায় নিজেদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।

বাড়িতে ফিরেই আহনাফ নিজের রুমে চলে গেল। সারাটা রাস্তা বিড়বিড় করে একটা কথাই বলতে থাকে,
“তাহু, ফিরে এসো প্লিজ।”

আফরোজা চিন্তিত ভাইয়ের এ পরিণতি নিয়ে। তাহসিনার বাসার পরিস্থিতিও ঠিক নেই, না থাকারই কথা। এমন মৃ°ত্যু মেনে নেয়াটা কষ্টের।
___________________________________

আজ অনার্স ফাইনালের রেজাল্ট বেরিয়েছে সারাহ্-র। আনন্দ যে তার আর ধরে না, সিজিপিএ ৩.৮০ পেয়েছে বলে কথা। খুশিতে সারাদিন ডগমগ করেছে সে আর অপেক্ষা করেছে কখন বাবা বাসায় ফিরবে।

সারাহ্-র বাবা আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর সাহেব মাত্রই অফিস থেকে ফিরেছেন। সারাহ্ উনার পাশে গিয়ে বসে বলল,
“বাবা?”

উনি পায়ের মোজা খুলতে খুলতে বললেন,
“জি আম্মুটা, বলেন।”
“আজকে রেজাল্ট দিয়েছে।”

জাহাঙ্গীর সাহেব মুচকি হেসে বললেন,
“জানি তো আমি আমার মেয়েটা ভালো সিজিপিএ নিয়ে এসেছে।”
“কিভাবে জানো?”
“আপনার আম্মুজান বলেছে।”

সারাহ্ রাগী চোখে মায়ের দিকে তাকালো। ওর মা নার্গিস পারভিন মুচকি হাসলেন।

জাহাঙ্গীর সাহেব মেয়ের অবস্থাটা বুঝলো, উনাকে সারপ্রাইজ দেয়া হলো না বলে মেয়ে যে রাগ করেছে তাও বুঝলো। সারাহ্-র মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“আম্মু, খুব খুশি হয়েছি তোমার রেজাল্টে৷ এখন সামনের পরিকল্পনা কি?”

সারাহ্ একটু চুপ থেকে বলল,
“বাবা আমি মাস্টার্স করতে চাচ্ছি আর তারপর জব নিয়ে ভাববো।”
“ভালো কথা, তা সরকারি চাকরির জন্য তো আগে থেকে পড়তে হবে। পড়ছো তো তুমি?”
“জি, বাবা। আমি তো অনার্সের শুরু থেকেই একটু একটু করে পড়ছি।”
“এইতো আমার গুড আম্মুটা।”

জাহাঙ্গীর সাহেব মেয়ের কপালে চুম্বন করলেন।

“দেও দেও, সব ভালোবাসা ওই একজনকেই দাও। এদিকে আমি যে ঢাবিতে ভর্তি হলাম, সেটার কি হবে?”

সামিহার কথায় জাহাঙ্গীর সাহেব হাসলেন, সাথে সারাহ্ও হাসলো।

সারাহ্ সামিহাকে বলল,
“ঢাবিতে ভর্তি হওয়ার আদর তোকে বহুবার করেছে, এখনের আদর শুধু আমার।”

দুইমেয়েকে দুইদিকে বসিয়ে দুজনকেই আদর করলো জাহাঙ্গীর সাহেব৷ সামিহা বলল,
“বাবা, ক্লাস শুরু হতে দেরি আছে। এর আগে আমি একটু ট্যুরে যেতে চাই।”
“হুম, অবশ্যই যাবে।”
“ইয়ে..”
চেঁচিয়ে উঠলো সামিহা।

সারাহ্-র ছোট বোন সামিহা। সারাহ্ বুঝদার, শান্ত হলেও সামিহা ওর উলটো। চঞ্চল স্বভাবের মেয়েটা সারাদিন বাসাটাকে মাথায় করে রাখে। জাহাঙ্গীর সাহেব খুব খুশি তার দুই জান্নাতকে নিয়ে, যা আল্লাহ তাকে দান করেছে।

এক সপ্তাহ পর,

আহনাফের ছুটি শেষ হয়েছে আজ। এতোদিন কলেজে না গেলেও আজ তো যেতেই হবে। ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও রেডি হয়ে নেয় সে৷ দায়িত্বশীল এই লোকটি নিজের কষ্টের জন্য নিজের স্টুডেন্টদের ভোগান্তিতে ফেলতে পারবে না।

টানা সাতদিন নিজেকে ঘরবন্দী রাখা আহনাফ বের হয়ে যাচ্ছে, আবার ফর্মাল ড্রেসআপ। আফরোজা নাস্তা সাজাচ্ছিল, ওকে দেখে বলল,
“আহনাফ, তুই কলেজে যাচ্ছিস?”
“হুম।”

আহনাফের বাবা, আব্বাস ফয়েজ এসে নাস্তার টেবিলে যোগ দিলেন। উনি বললেন,
“আহনাফ, নাস্তা করবে না?”

আহনাফ একটু চুপ থেকে নিচুস্বরে বলল,
“বাবা, আমার লেট হচ্ছে।”

চলে যেতে নিলে আব্বাস সাহেব ওর হাত ধরে এনে নিজের পাশে বসিয়ে বলল,
“খেয়ে নেও।”

আহনাফ খেলো না, বসে রইলো চুপ করে। কোনোমতে একটু খাবার খেয়ে আহনাফ বলল,
“বাবা, আমি আসছি।”

ঘড়ি দেখে কথাটা বলেই আহনাফ হনহনিয়ে চলে গেল। বেশি কথা বলার ইচ্ছেটা ওর নেই। আফরোজা চেয়ে থাকলো ভাইয়ের দিকে।

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের লেকচারার আহনাফ। সে জানে ক্লাসে তার মন বসবে না, কিন্তু মনকে পাথর করে যাত্রা করলো কলেজ পথে।

কলেজে পৌঁছে রিকশা ভাড়া দেয়ার সময় ওয়ালেটের ছোট্ট পকেটে মায়ের ছবিটা চোখে পড়লো। ভাড়া মিটিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভিতরে গেল সে, ২০ বছর হতে চলল মাকে ছাড়া। অন্ধকার কবর ভালোবাসার মানুষগুলোকে তাড়াতাড়ি নিয়ে নেয় কেন, উত্তরটা জানা নেই আহনাফের।
___________________________________

মৃত্তিকা এখনো তাহসিনাদের বাসায়ই আছে৷ যাওয়ার আর জায়গা কোথায় তার ওই ইতালির বাসা ছাড়া?

জানলার পাশে বসে আছে সে। চোখের নিচের কালো জায়গাটা নির্দেশ করছে মেয়েটা ভালো নেই।

“মাম, ও মাম, সারাজীবন আমাকে দিয়ে গেলে আর আমি কিছুই দিতে পারলাম না। তার আগেই চলে গেলে তুমি।”

বাবা নামক বে°ই°মা°ন মানুষটা চলে যাওয়ার পর মৃত্তিকাকে আদরে আদরে বড় করেছে রিপা৷ তখন দেশ ছেড়ে ইতালিতে গিয়ে মৃত্তিকাকে নিয়ে রিপা ঠিক কতটা যু°দ্ধ করেছে তা মৃত্তিকা জানে। রিপা পিএইচডি করেছে, সাথে মৃত্তিকার দেখাশোনাও। সবাই ভেবেছে হয়তো প্রচুর টাকা থাকে রিপার হাতে। অথচ মাস গেলে মেয়ের শখগুলো আর পূরণ করতে পারতো না রিপা বেগম। রিপা বেগম যখন চাকরি পেল তখন মেয়ের জন্য একটা বাড়িও কিনেছে ইতালিতে।

সেই মৃত্তিকা বড় হয়েছে, পড়াশুনা শেষ করে সদ্যই চাকরিতে যোগ দিয়েছে আর তার মাম চলে গেল।

বাবার প্রতি তার অগাদ ঘৃ°ণা৷ শৈশবকাল যে ধ্বং°স করেছে তার বাবা, তেমনি গড়ে দিয়েছে তার মাম।

মৃত্তিকা চোখ বন্ধ করে৷ মামের হাতের স্পর্শ অনুভব করার চেষ্টা করে। এভাবে আর কে তাকে আপন করবে?

“আপু আসবো?”

তানজিমের কন্ঠে চমকে উঠে সে। ঢোক গিলে বলল,
“তানজিম, আসো।”

তানজিম ভিতরে আসলো না। দরজাটা একটু খুলে বলল,
“আব্বু হাসপাতালে গেছে, তাই তোমাকে বলেছে ইমতিয়াজ ভাইয়াকে দুপুরের খাবার দিতে৷ আমিও এখন একটু হাসপাতালে যাচ্ছি।”

মৃত্তিকা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। তানজিম বেরিয়ে গেল। বোনদের চলে যাওয়ার পর ওর মা আজ চারদিন হলো হাসপাতালে ভর্তি। ওর জানা নেই ওর মা ঠিক কবে সুস্থ হবে বা আদৌ সুস্থ হবে কিনা।

মৃত্তিকা কিছুক্ষণ নিজঘরে থেকে তারপর বেরিয়ে রান্নাঘরে গেল। চাল ধুয়ে ভাত বসিয়ে দিলো। মামের কাছ থেকে ছোটখাটো রান্না ও ভালোই আয়ত্ত করেছে৷

ডিম আনতে ডাইনিং এ যাওয়ার সময় হঠাৎ ইমতিয়াজ এসে রান্নাঘরে ঢুকায় চমকে উঠে মৃত্তিকা। অপ্রীতিকর মুহূর্ত এড়াতে ইমতিয়াজ “সরি” বলে বেরিয়ে যায়।

মৃত্তিকা বাইরে এসে দেখে ইমতিয়াজ ডাইনিং এ বসে আছে। অফিসে যাচ্ছে না, কেমন যেন ছ°ন্ন°ছা°ড়া ভবঘুরে হয়ে গেছে।

ফ্রিজ থেকে ডিম নামাতে নামাতে মৃত্তিকা বলল,
“আজ কি বড়মণিকে দেখতে হাসপাতালে যাবেন?”
তাহসিনার মা মৃত্তিকার বড়খালা, তাইতো তাকে বড়মণি বলে।

ইমতিয়াজ ওর দিকে না তাকিয়েই বলে,
“হুম।”
“তবে আমাকেও নিয়ে যাবেন। বড়মণিকে দেখে আসবো।”
“হুম।”

হুম ছাড়া আর কোনো জবাব ইমতিয়াজ দিলো না। মৃত্তিকাও আর কিছু না বলে রান্নাঘরে চলে গেল। ভাতের পাতিলে উঠা বুদবুদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আবারো চোখজোড়া জলে ভরে উঠলো।

চলবে……..

প্রেমহীন সংসার আহা সোনামুখী সুঁই পর্ব-১৬ এবং শেষ পর্ব

0

#প্রেমহীন_সংসার_আহা_সোনামুখী_সুঁই (পর্ব ১৬) -শেষ পর্ব

১.
অক্টোবর মাসের শেষে বাতাসে একটা হালকা শীতের ছোঁয়া টের পাওয়া যায়। প্রকৃতি এ সময়টায় সবচেয়ে সহনীয় থাকে। ভোর পাঁচটা বাজে। কুঞ্জল, পৃথুলের ছোট ভাই তুহিন, আফরোজা আপু সহ ম্যারাথন দৌড়ের স্টার্টিং মার্কে দাঁড়িয়ে আছে। আজ দশ মাইলের লম্বা দৌড়ে নাম লিখিয়েছে কুঞ্জল। এর জন্য শেষ একটা মাস ও নিয়মিত সকালে অনুশীলনও করেছে। না লিখিয়ে উপায়ও ছিল না। আর ক’টা দিন পরেই রান্নার কোর্সের তৃতীয় কিস্তির টাকা জমা দিতে হবে। কিন্তু হাতে জমানো টাকা খুব সামান্যই আছে। সেদিন হঠাৎই তুহিন বলছিল, আপু এবার দশ মাইলের দৌড়ে নাম লিখাও। প্রথম হলে পঁচিশ হাজার টাকার পুরস্কার আছে। সেদিনই সিদ্ধান্ত নেয়, ও দৌড়ুবে। মেয়েদের ক্যাটাগরিতে একটু চেষ্টা করলেই ও ফার্স্ট হতে পারে। তা ও জোর প্রস্তুতিও নিয়েছিল। কিন্তু গত ক’দিন ধরে শরীরটা খারাপ যাচ্ছে, ঠান্ডা-জ্বরের মতো। কুঞ্জল নাক টানে। অভীক আসতে চেয়েও শেষ পর্যন্ত আসেনি। আসার পর থেকে তিন চার বার ফোন দিয়েছে অভীক। ও বলেওছিল এখন আর ফোন না দিতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। ওর সন্দেহ যায় না।

কুঞ্জল কান খাড়া করে অপেক্ষা করে রেস শুরু হবার, হুইশেল বাজার। তীক্ষ্ণ শব্দে হুইশেল বাজতেই একটা হুড়োহুড়ি লাগে। কুঞ্জল ধীরে সুস্থে দৌড় শুরু করে। আজ মনে করে ও পানির বোতল নিয়ে এসেছে। প্রথমবারের মতো ভুল করেনি। হঠাৎ করেই অংশুলের কথা মনে পড়ে যায়। সেবার অংশুল পানির বোতল এনে দিয়েছিল, সাথে ওর জন্য একটা লেমোনেডও বানিয়ে এনেছিল। মনটা বিষণ্ণ হয়ে যায় কুঞ্জলের। জীবন চলার পথে এমন ছোট ছোট মায়ার দেখা ও আর পাবে না যেটা বেঁচে থাকার জন্য খুব দরকার ছিল। না, অংশুল আর কোনো মেসেজ দেয়নি। হয়তো নিজের ক্যারিয়ারের কথা ভেবেই। আর সেটা ভাবাই উচিত। কুঞ্জল নিজেও ব্যাপারটা বোঝে।

অর্ধেক পথ পেরোতেই কুঞ্জল টের পায় ওর খারাপ লাগছে। কেমন যেন শক্তি ফুরিয়ে আসছে। দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সাহস দেয়। ওর যে আজ ফার্স্ট হতেই হবে। কিন্তু আজ এখনও ওর সামনে অনেক প্রতিযোগী। কুঞ্জল মরিয়া হয়ে দৌড়ুতে থাকে। শেষের দিকে এসে ও চোখে যেন অন্ধকার দেখে। কিছুতেই শক্তি পাচ্ছে না। ইচ্ছে করছে সব ফেলে এখানেই শুয়ে পড়তে। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। ও যখন ফিনিশিং লাইন ছোঁয় তখন মাথা ঘুরে পড়ে যায়। জ্ঞান হারানোর আগে ও কিছু মানুষের আফসোসের গলা শুনতে পায়।

মুখে ঠান্ডা পানির স্পর্শে কুঞ্জলের জ্ঞান ফেরে৷ চেয়ে দেখে তুহিন, আফরোজা আপু ওর মুখের উপর ঝুঁকে তাকিয়ে আছে। ওকে চোখ মেলতে দেখে ওরা একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।

আফরোজা আপু ওর কপালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, ‘তোর শরীর এতটা খারাপ বলবি না? অমন জোর করে দৌড়ানো যায়? নিজের ক্ষতি করে ফেলবি তো পাগলি।’

কুঞ্জল একটু হাসার চেষ্টা করে, তারপর দূর্বল গলায় বলে, ‘আপু, আমি দৌড়ে কততম হয়েছি?’

আফরোজা নরম গলায় বলে, ‘তুই এই শরীর নিয়ে দৌড়েও সপ্তম হয়েছিস। ইশ, তুই ভালো থাকলে ঠিক ফার্স্ট হতিস।’

কুঞ্জলের বুক ফেটে কান্না আসে। ও পারল না? এখন কী হবে। ও হেরে গেল এমন করে? তাহলে কি ওর রান্নার কোর্সটার এখানেই সমাপ্তি টানতে হবে? চেয়েছিল নিজের টাকায় কোর্সটা শেষ করবে। কিন্তু টাকা উপার্জন আসলেই ভীষণ কঠিন, অন্তত এই বয়সে এসে। বিষণ্ণ মনে ও ভাবতে থাকে জীবনের সব দৌড়েই আজ ও পরাজিত।

বাসায় যখন ফেরে শরীর অবসন্ন, ক্লান্ত। মনে হচ্ছে জ্বর আসবে। তুহিন এসেছে ওকে এগিয়ে দিতে।

অভীক দরজা খুলেই কর্কশ গলায় বলে, ‘তোমার ফোন বন্ধ কেন? সেই কখন থেকে ফোন দিচ্ছি।’

কুঞ্জল একবার তুহিনের দিকে তাকায়, তারপর বলে, ‘দৌড়ানোর সময় ফোন বন্ধ করে রেখেছিলাম, আর খুলতে মনে নেই।’

পাশ থেকে তুহিন এবার উদ্বিগ্ন গলায় বলে, ‘ভাইয়া, আপু ভীষণ অসুস্থ। মনে হচ্ছে দৌড়ে খুব ক্লান্ত হয়ে গেছে। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। আপুর বিশ্রাম দরকার।’

অভীক রাগের গলায় বলে, ‘কেন দৌড়াতে যাও? আর তুহিন, তোমরা আর তোমার আপুকে নিয়ে যেও না। সবার সব কাজ না।’

কুঞ্জল কোনোমতে ভেতরে ঢুকে বিছানায় শুয়ে পড়ে৷ অর্ক কাছে এসে মায়ের কপালে হাত রাখে, ‘আম্মু, তুমি অসুখ? আজ দৌড়ে ফার্স্ট হয়েছ?’

কুঞ্জল চোখ বন্ধ করেই ক্লান্ত গলায় বলে, ‘আব্বু, একটু পানি দাও। আর দেখো তো বাবার কাছে প্যারাসিটামল আছে কি-না।’

সেদিন অভীক একটু পর পরই কুঞ্জলের কাছে এসে বসে খোঁজ নেয়, জ্বর মেপে দেখে। রাতে কুঞ্জলের জ্বর বাড়ে। জ্বরের ঘোরে ও দেখতে পায় দশ মাইলের দৌড়ে ও প্রথম হয়েছে। কেউ একজন ওকে মেডেল পরিয়ে দিচ্ছে। কোথা থেকে অভীক এসে ওর গলা থেকে মেডেলটা ছুড়ে ফেলে দেয়। স্বপ্নের ভেতরই কুঞ্জল ভয়ে কেঁপে ওঠে।

তিনদিন লেগে যায় কুঞ্জলের সুস্থ হতে। অভীক আজ অফিসে গেছে। এই ক’টা দিন অভীকের যত্নটুকু ভালো লেগেছে। সাইফুল্লাহ স্যারের কথা মনে পড়ে যায়। উনি কি এই মায়ার কথাই বলেছিলেন?

ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে ও রেডি হয়। অর্ককে আনতে যেতে হবে। আয়নার সামনে চুলে চিরুনি বোলাতে বোলাতে ওর হঠাৎ মনে পড়ে রান্নার স্কুলে কোর্স ফি দিতে হবে। চিন্তিত মুখে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে থাকে। গলার দিকে নজর পড়তেই ও ভ্রু কুঁচকে একটু ভাবে। তারপর গলার স্বর্নের চেইনটা হাত দিয়ে ধরে। গত বছর বিবাহবার্ষিকীতে অভীক কিনে দিয়েছিল। বারো আনার মধ্যে সুন্দর একটা চেইন। আচ্ছা এটা বিক্রি করলেই তো ওর টাকার ব্যবস্থা হয়ে যায়। ভাবতেই একটা উত্তেজনা বোধ করে কুঞ্জল। কিন্তু কাজটা করা কি ঠিক হবে? একটু ভাবে ও৷ তারপর সব দ্বিধা ঝেড়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, চেইনটা বিক্রি করে ও পুরো কোর্স ফি টা দিয়ে দেবে।

কুঞ্জল আলমারি থেকে খুঁজে খুঁজে চেইন কেনার রশিদ বের করে। তারপর চেইনটা খুলে একটা ছোট বক্সে ভরে হাতব্যাগে নিয়ে নেয়। অর্ককে স্কুল থেকে নিয়েই আজ চলে যাবে।

স্কুল থেকে অর্ককে নিয়ে ও যখন সেই জুয়েলারির দোকানে আসে ততক্ষনে দুপুর দুটো বেজে গেছে। অর্ক শুকনো মুখে বলে, ‘আম্মু, আমার ক্ষুধা পেয়েছে।’

কুঞ্জল ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘একটু দাঁড়াও বাবা। আমি ওই দোকনটা থেকে এখনই আসছি।’

অর্ক স্কুল ব্যাগ নিয়ে বাইরে দাঁড়ায়। চেয়ে দেখে আম্মু সামনের দোকানের ভেতরে ঢুকে গেল। কাচের দরজা দিয়ে আম্মুকে দেখা যাচ্ছে।

দোকানি তাকাতেই কুঞ্জল সংকুচিত গলায় বলে, ‘আমার একটা গলার চেইন বিক্রি করব। আপনাদের এখান থেকেই নিয়েছিলাম। এই যে এটা।’

লোকটা কেমন যেন সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে। কুঞ্জলের ভীষণ লজ্জা লাগছে। একটা সংকোচ ওকে ঘিরে ধরে। লোকটা বলে, ‘রিসিট আনছেন?’

কুঞ্জল এবার ব্যাগ হাতড়ে রশিদটা দিতেই লোকটা কী যেন দেখে। তারপর জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘কিন্তু এখানে তো অভীক নামে একজনের নাম লেখা। উনি আপনার কে হয়?’

কুঞ্জল মনে মনে প্রমাদ গোনে। স্বর্ন বিক্রি করতে এসে এখন না ও বেইজ্জতি হয়। ও গম্ভীরমুখে বলে, ‘আমার হাসব্যান্ড উনি। কেন বলুন তো?’

লোকটা এবার নরম গলায় বলে, ‘আসলে অনেকে এমন বিক্রি করতে আসে। পরে আবার হাসব্যান্ড এসে ঝামেলা করে। তাই আর কি। আপনি বসুন ম্যাডাম, আমি ওজন দিয়ে দেখছি।’

কুঞ্জল বসে না। ও কাচের দরজা দিয়ে বাইরে তাকায়, অর্ক ওর দিকেই উম্মুখ হয়ে তাকিয়ে আছে।

স্বর্নের দোকানি যখন ওর হাতে পয়ষট্টি হাজার টাকা তুলে দেয় তখন কুঞ্জল যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। ভেবেছিল এরা ঠকাবে। নাহ, ভালো দামই দিয়েছে। কুঞ্জল টাকাটা ব্যাগে ভরে।

বাইরে বেরোতেই অর্কের মুখে হাসি ফোটে। অর্ককে নিয়ে প্রথমে একটা ফাস্ট ফুডের দোকানে ঢোকে। তারপর অর্কের প্রিয় চিজ বার্গার অর্ডার করে৷ নিজেও একটা নেয়। অর্ক বেশ মজা করে খেতে থাকে। দু’জনে দুটো কোক নেয়। অর্ক কোকে চুমুক দিতে দিতে বলে, ‘আম্মু, বার্গারটা খুব মজা ছিল। মাঝে মাঝে আমরা এখানে এসে খাব।’

কুঞ্জল ছেলের উজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে হাসে। খাওয়া শেষে অর্কের জন্য টুকিটাকি কিছু কেনে – একটা প্যান্ট, পোলো শার্ট। নিজের জন্যও একজোড়া জুতো কেনে। কেন যেন খুব ভালো লাগছে। হঠাৎ করেই ওর মনে হয় অর্থনৈতিক স্বাধীনতা একটা বড়ো স্বাধীনতা।

সেদিন কুঞ্জল ওর পুরো কোর্স ফি জমা দিয়ে বাসায় ফিরে। আর কোনো বাধা রইল না। এবার একটু মাথা ঠান্ডা করে ক্লাশগুলো করতে পারবে। ও গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে রাতের রান্নার যোগাড়যন্ত্র শুরু করে।

রাতে অভীক যখন বাসায় ফেরে কুঞ্জল খেয়াল করে ওর মুখ গম্ভীর। কপালে একটা চিন্তার ভাঁজ পড়ে। কী হলো আবার?

রাতে খাওয়া শেষে অভীক কুঞ্জলকে ডাকে, ‘একটু রুমে আসো, কথা আছে।’

কুঞ্জল ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকায়। আবার অংশুলকে নিয়ে কথা শোনাবে? আজ যদি একটা বাজে কথা বলে ও ছেড়ে দেবে না।

কুঞ্জল গম্ভীরমুখে রুমে ঢোকে, চোখমুখ শক্ত করে বলে, ‘বলো, কী বলবে?’

অভীক পকেট থেকে ছোট্ট একটা বক্স বের করে ওর হাতে দেয়। কুঞ্জল চোখ কুঁচকে বলে, ‘কী এটা?’

অভীক উদাস গলায় বলে, ‘খুলে দেখো।’

কুঞ্জল কপাল কুঁচকে বক্সটা খোলে। ভেতরে তাকাতেই একটা সোনালি আলো ঝিকমিক করে ওঠে। স্তম্ভিত হয়ে ও তাকিয়ে দেখে এটা সেই স্বর্নের চেইন যেটা ও আজ দুপুরেই বিক্রি করে এসেছে। পুরো শরীর কেঁপে ওঠে ওর। তোতলানো গলায় বলে, ‘এটা কোথায় পেলে?’

অভীক ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে, তারপর বলে, ‘তুমি যখন ওই দোকানে এটা বিক্রি করতে যাও, ওরা আমাকে ফোন দিয়েছিল। তুমি হয়তো খেয়াল করোনি রশিদে আমার নাম, মোবাইল নম্বর লেখা ছিল। ওরা শুধু নিশ্চিত হতে চেয়েছিল চেইনটা বিক্রি হচ্ছে আমি জানি কি-না। পুরোটা শুনে বললাম টাকাটা তোমাকে দিয়ে দিতে। তারপর আমি যেয়ে আবার ওটা কিনে এনেছি – তোমাকে যে দামে দিয়েছে তার চেয়ে একটু বেশি দামে। কুঞ্জল, কী সমস্যা বলো তো? তোমার টাকার দরকার আমাকে বলোনি কেন? না বলে চেইন বিক্রি করতে গেলে!’

কুঞ্জল মাথা নিচু করে থাকে। কেন যেন খুব লজ্জা লাগছে এখন। নিজেকে চোর চোর মনে হচ্ছে। নিচের ঠোঁট কামড়ে বলে, ‘আমার রান্নার কোর্সে টাকা বাকি ছিল। সেজন্য বাধ্য হয়েই এটা বিক্রি করতে গিয়েছিলাম।’

অভীক সামনে ঝুঁকে অবাক গলায় বলে, ‘কিহ!? সেই কোর্সের টাকার জন্য তুমি আমার দেওয়া বিয়ে বার্ষিকীর উপহারটা বেচে দিলে? আমার কাছে টাকা চাইলে কি আমি না করতাম? এতটা দূরে সরে গেছ তুমি কুঞ্জল!’

শেষ লাইনটায় আক্ষেপ ঝরে পড়ে অভীকের।

কুঞ্জলের চোখে জল চলে আসে৷ ও দুটো ঠোঁট চেপে কান্না সামলায়, তারপর বলে, ‘তুমিই তো দূরে ঠেলে দিয়েছ। একের পর সম্পর্কে জড়িয়েছ। কখনও আমার ছোট ছোট ভালো লাগাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোননি। রান্না শিখতে আমার ভালো লাগে, নিজে একজন নামকরা শেফ হবার স্বপ্নও দেখি। প্রতিটি মানুষ তার নিজের কাছে অন্তত বড়ো হতে চায়। কিছু ব্যক্তিগত অর্জন থাকতে হয় মানুষের। না হলে পারস্পরিক শ্রদ্ধাটা আসে না। যেটা আসে সেটা করুণা। আমার তো তেমন কিছুই ছিল না। তাই এটা আঁকড়ে নিজের আত্মবিশ্বাসটা ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি ভুল বুঝলে। আরও দূরে ঠেলে দিলে, নিজেও দূরে সরে গেলে। তুমি কি সত্যিই আমার আছ এখনও?’

অভীক সামনে এসে ওর দুই বাহু চেপে ধরে, আবেগ নিয়ে বলে, ‘কুঞ্জল, শেষ পর্যন্ত আমি তোমার কাছেই ফিরে এসেছি। আমি বার বার ভুল করেছি, উচিত হয়নি। মোহে পড়ে গিয়েছিলাম। আমার নিজের মানসিক দূর্বলতা আছে, কখনও লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করিনি। কিন্তু একটা সময় আমি ফিরে আসার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তুমি আমাকে ক্ষমা করোনি, বিশ্বাস করোনি। চেয়ে দেখো আমি তোমারই আছি।’

কুঞ্জল আর পারে না, অভীকের বুকের ভেতর ঢুকে যায়। মনের সব কষ্ট জল হয়ে চোখ ভিজিয়ে দিয়ে যায়। অভীক শক্ত করে ওকে বুকের ভেতর ধরে রাখে।

সেদিন বহুদিন পর ওদের গুমোট সংসারে সুখের সুবাতাস বইতে থাকে। অর্ক অবাক হয়ে দেখে আম্মু বাবার সাথে হাসছে। ওর ছোট্ট মনের ভেতর এতদিনের চেপে থাকা একটা ভয় যেন নিমিষেই মিলিয়ে যায়। আম্মু ওদের ছেড়ে কোথাও চলে যাবে না। বাবা আর আম্মুকে বকবে না, আম্মু কাঁদবে না।

২.
কুঞ্জল ব্যস্ততার সাথে রান্না করছিল। অভীক কাল বাজার থেকে বড়ো শোল মাছ এনেছে, সাথে কচি একটা লাউ। লাউটা চুলোয় দিয়ে মসলা দিয়ে মেখে ঢেকে দেয়। সিদ্ধ হোক। এই ফাঁকে অন্য কাজগুলো সেরে ফেলতে হবে। ঘড়ির দিকে তাকায়, অর্কের স্কুল ছুটি হতে এখনও অনেকটা সময় বাকি আছে।

কুঞ্জল ফ্রিজের দরজা খুলতে যেতেই বাসার কলিং বেল বেজে ওঠে। কে এল আবার এই সময়। হাত মুছে ও দরজা খুলেই দেখে সেই পুরনো ভাঙাচোরা জিনিসপত্র কেনে যে লোকটা সে। ভাঙাচোরা মুখ, পিঠে সাদা একটা বড়ো বস্তা। ওকে দেখেই এক গাল হেসে বলে, ‘আপা, অনেকদিন পরে আইলাম। এই কয়দিনে নতুন কইরা ভাঙাচোরা কিছু জমে নাই?’

কুঞ্জল আজ প্রাণখোলা হাসি হাসে, ‘না ভাই, এই ক’দিনে ভাঙাচোরা যা ছিল তা জোড়া লেগেছে। তোমাকে দেবার মতো কিছু নেই।’

লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে কেমন আধ্যাত্মিক গলায় বলে, ‘ভাঙাচোরা জিনিস কি আর জোড়া লাগে আপা? একটু জোরে চাপ পড়লেই আবার ভাইংগা যায়।’

কুঞ্জল থমকে তাকায়। এমন করে এই লোকটার কাছ থেকে সত্যটা শুনবে ও ভাবেনি। সেই সোনার চেইন ফিরিয়ে দেবার দিন থেকে প্রথম একটা মাস দারুণ সময় কেটেছে। অভীক যেন সেই পুরনো অভীক হয়ে গিয়েছিল। বিয়ের পর পর যেমন হয়। তারপর একদিন হুট করেই ওর মনের ভেতর চেপে থাকা নোংরা ভাবনাটা বেরিয়ে আসে। সেদিন কুঞ্জলের রান্নার স্কুলের সবাই মিলে বিখ্যাত এক শেফের রেস্তোরাঁয় গিয়েছিল হাতে কলমে শিখতে। তা সেদিন ওর ফিরতে রাত দশটার মতো বেজে যায়। ওর ক্লাশের সুশীল নামে একটা ছেলে সেদিন ওকে বাসায় পৌঁছে দিয়েছিল। সেদিনও কেমন করে যেন সেটা অভীকের চোখে পড়ে যায়। আর সাথে সাথে ওর ভেতরে লুকিয়ে থাকা নোংরা মানুষটা বেরিয়ে আসে। কুৎসিত ভঙ্গিতে বলেছিল, ‘কী, এখন আবার নতুন প্রেমিক ধরেছ?’

কুঞ্জল সেদিনই বুঝে গিয়েছিল অভীক শোধরাবার না। মন খারাপ করে ক’দিন কথা বন্ধ ছিল ওদের। শেষমেষ আবার ক্ষমা চেয়ে মিল করে। কিন্তু কুঞ্জলের মনটা আর ঠিক হয়নি। ইদানিং ও আগের মতোই দেরি করে বাড়ি ফেরে। প্রায়ই ফোন বিজি পাওয়া যায়। তাতে ওর মনেও সন্দেহ জাগে, অভীক আবার পুরনো পথে পা বাড়ায়নি তো? পুরনো সেই দুঃসহ স্মৃতিগুলো প্রায়ই হানা দিয়ে যায় – ‘বউ বাসায় আছে সোনা, পরে ফোন দেই’, অথবা শাড়ির অর্ডার নেবার দিনের কথা। মাঝে মাঝেই এই দুঃসহ স্মৃতিগুলো চোরাগোপ্তা হামলা করে, মনের স্বস্তির ঘরটুকু টুকরো টুকরো করে ভেঙে দিয়ে যায়। ও আবার জোড়া লাগায়, আবার ভেঙে যায়৷

ভাঙাচোরা জিনিসপত্র কিনতে আসা এই সামান্য লোকটা ওকে কত দামি একটা কথা বলে গেল আজ!

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লোকটাকে বিদায় দেয়। তারপর দ্রুত রান্না শেষ করে ও অর্কের স্কুলে যায়। ওর ক্লাশ সিক্সের পরীক্ষা চলছে। আর ক’দিন পরেই ক্লাশ সেভেনে উঠবে ও। ছেলেটা বড়ো হয়ে যাচ্ছে। ও বড়ো হলেই ওর মুক্তি, ভাবে কুঞ্জল।

স্কুল থেকে ফেরার পথে কুঞ্জল ছেলের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলে, ‘বাবা, তুমি তো বড়ো হয়ে যাচ্ছ। এখন থেকে একা একা স্কুল যেতে পারবে না?’

অর্ক মাথা দুলিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ তো আম্মু। আমাদের অনেকেই একা একা আসে। আমি ক্লাশ সেভেনে একা একাই আসতে পারব। এখন থেকে তুমি রান্নার স্কুলে গেলে আর পৃথুল আন্টির বাসায় আমাকে রেখে আসতে হবে না।’

কুঞ্জল থমকে ছেলের মুখের দিকে তাকায়। অর্ক ঠিক ওর মনের কথা বুঝতে পেরেছে। ওর জন্যই এতটা দিন কিছু করতে পারেনি। আর ক’টা মাস পর ওর কোর্স শেষ হলে তখন ও ভালো কোথাও শেফের চাকরির চেষ্টা করবে। আর চাকরি যদি হয়েই যায় তাহলে অর্ককে তখন একাই স্কুলে যেতে হবে। অনেকটা সময় অর্ককে বাসায় একা থাকতে হবে। তাতে করে ওর যদি কোনো ক্ষতি হয়ে যায়? হতাশ লাগে ওর। অর্ক ক্লাশ নাইন বা টেনে না ওঠা পর্যন্ত যে ওর মুক্তি নেই। কিন্তু তখনও কি ও মুক্তির পথ খুঁজে পেতে সাহস করে বেরিয়ে পড়তে পারবে?

রাতে অভীক বাসায় ফেরে। সাদামাটা কথা হয়। বাজার সদাই আছে কি-না, ঘরের চাদর পুরনো হয়েছে, দেয়ালটা পেইন্ট করাতে হবে, ইলেক্ট্রিসিটির বিল বাকি সেটা দিতে হবে।

এক ফাঁকে অর্ক বাবার কাছে বাইরে কোথাও ঘুরতে যাবার আবদার করে। অভীক কথাও দেয়, ওদের নিয়ে এবার ঘুরতে যাবে। তারপর খাওয়া শেষে অভীক টিভির সামনে বসে মনোযোগ দিয়ে খবর দেখতে থাকে। কুঞ্জল রান্নাঘরের সবকিছু গুছিয়ে ছেলেকে পরীক্ষার পড়া পড়াতে বসে। পড়া শেষে বিছানা করে ওকে ঘুম পাড়িয়ে অভীকের রুমে আসে। ওরা এখন আগের মতো একসাথেই ঘুমোয়।

বাসার সব আলো নিভিয়ে দেওয়াতে কেমন একটা অন্ধকার চারপাশ। অভীক একটা সময় কুঞ্জলকে নিয়মমাফিক কাছে টানে। বেডরুমে কাঠের খাটটা পুরনো হয়েছে। অল্পতেই বড্ড বেশি শব্দ হয়। গভীর রাতে সেখান থেকে একটা নিয়মিত ছন্দে শব্দ আসতে থাকে। একটা সময় শব্দটা দ্রুত হতে থাকে। তারপর পুরুষের ঘন শ্বাসের শব্দের সাথে একটা তৃপ্তির শব্দ ভেসে আসে।

কিছুক্ষণ পর বারান্দা থেকে সিগারেটের গন্ধ পাওয়া যায়। আদর শেষে সিগারেট খাওয়া অভীকের বহুদিনের অভ্যেস। অভীক সিগারেটে একটা সুখটান দিয়ে ভাবে, কুঞ্জলকে ও আবার নিজের করে পেয়েছে। মাঝখানে কুঞ্জল ওর ছিল না, কেমন দূরে সরে গিয়েছিল। যে কুঞ্জলকে ও হারিয়ে ফেলেছিল আজ সেই কুঞ্জলকে বুঝি নিজের করে ফিরে পেল।

কুঞ্জল গায়ে একটা চাদর জড়ায়। কেন যেন শীত শীত লাগছে। অভীক ঘুমিয়ে পড়েছে, মৃদু নাকও ডাকছে। মুখটা কেমন সুখী সুখী। ওর শরীরের অধিকার ফিরে পাবার আনন্দ ওর চোখেমুখে লেপটে আছে। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে ও পাশ ফিরে ঘুমোনোর চেষ্টা করে কিন্তু ঘুম আসে না। না, অভীককে ও মন থেকে ক্ষমা করতে পারেনি। মনের ভেতর যে অবিশ্বাসের ক্ষতটা রয়ে গেছে সেটা যে আর কিছুতেই সারবার নয়। আজ সেই ভাঙাচোরা পুরনো জিনিস কিনতে আসা নিতান্ত সাধারণ লোকটা ওকে আরেকবার সেই কথাটাই মনে করিয়ে দিয়ে গেছে। বাকি জীবনটা হয়তো এমন প্রেমহীন সংসার করেই কাটিয়ে যেতে হবে।

(সমাপ্ত)

প্রেমহীন সংসার আহা সোনামুখী সুঁই পর্ব-১৫

0

#প্রেমহীন_সংসার_আহা_সোনামুখী_সুঁই (পর্ব ১৫)

১.
গ্রীষ্মের শুরুতেই এবার অনেক গরম পড়েছে। রাত আটটা বাজে তবুও গরম কমেনি। একটু হাঁটলেই ঘাম হচ্ছে৷ কুঞ্জল হাতের উলটো পিঠ দিয়ে মুখটা মোছে, তারপর অর্কের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘বাবা, পৃথুল আন্টির বাসায় দুষ্টুমি করোনি তো?’

অর্ক দু’পাশে মাথা নাড়ে, তারপর বলে, ‘না আম্মু। আমি আর পৃথা অনেক খেলেছি। আন্টি আমাদের এগ টোস্ট ভেজে দিয়েছিল। কিন্তু তোমার এত্ত দেরি হলো কেন আম্মু?’

কুঞ্জল ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘মন খারাপ হয়েছে?’

অর্ক আহ্লাদী গলায় বলে, ‘হ্যাঁ আম্মু, তুমি না থাকলে একদমই ভালো লাগে না।’

কুঞ্জলের বুকের ভেতর নরম হয়ে আসে। এটুকু মায়ার জন্যই তো মুখ বুজে সব সহ্য করা। আজ বাসায় ফেরার পর অভীক যে কী করবে ভাবতেই মাথাটা দপদপ করছে। এতদিন তো ওকে বলার মতো কিছু পায়নি, কিন্তু আজ অংশুলকে জড়িয়ে বলার মতো কিছু পেয়েছে। অভীক নিশ্চয়ই এই সুযোগটা ছাড়বে না। কিন্তু একটা জায়গায় স্বস্তি যে অভীক আজ ওর রান্নার স্কুলে যায়নি। এতটা নিচে ও নামেনি। মনে মনে একটু কৃতজ্ঞ বোধ করে।

বাসায় পৌঁছে কলিংবেল চাপতেই দরজা খুলে যায়। অভীক যেন ওর অপেক্ষাতেই ছিল। কুঞ্জল ওর দিকে তাকিয়ে একটু চমকে ওঠে। মুখে কয়েকটা ব্যান্ড এইড, ডান হাতের কব্জিতে প্লাস্টার, হাতটা একটা আর্ম স্লিংয়ে ঝোলানো। ইশ, কী করেছে ওরা। এমন করে মেরেছে! এবার সত্যিই রাগ হয় অংশুলের স্টাফদের উপর।

অর্ক ভয় পাওয়া গলায় বলে, ‘বাবা! কী হয়েছে তোমার? ব্যথা পেয়েছ?’

অভীক ছেলের দিকে একবার তাকায়, তারপর চোখ কুঁচকে কুঞ্জলের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কুঞ্জল উদবিগ্ন গলায় বলে, ‘ইশ! এমন করে ব্যথা পেয়েছ? ডাক্তার দেখিয়েছ তো?’

অভীক কর্কশ গলায় বলে, ‘তোমার প্রেমিক তো গুন্ডা পোষে।’

কুঞ্জল ঝট করে তাকায়, কড়া গলায় বলে, ‘খবরদার! ছেলের সামনে একটা বাজে কথা যদি বলেছ আমি এক মুহুর্ত থাকব না বাসায়। যা বলার আমাকে আলাদা বলো।’

অভীক বাঁকা হাসে, তারপর বলে, ‘আমার সময় একথা মনে ছিল না? আমাকে তো ঠিকই ছেলের সামনে লুচ্চা বলেছিলে, আমাকে ছোট করেছ। ওর জানা উচিত ওর মা ভালো না। আরেক লোকের সাথে মোটরসাইকেলে ঘুরে বেড়ায়। না জানি আর কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায়।’

কুঞ্জল তীক্ষ্ণ গলায় চিৎকার করে ওঠে, ‘অভীক! এত নোংরা আর বাজে কথা বলতে বাঁধছে না তোমার? অর্ক, তুমি ওই ঘরে যাও তো।’

তারপর ও অভীকের দিকে ফিরে বলে, ‘এই রুমে আসো। যা বলার আমাকে বলো। ছেলের সামনে মিথ্যে বলে আমাকে ছোট করো না।’

অভীক মুখ ভেঙচে বলে, ‘মিথ্যে বলেছি আমি? তুমি সেদিন ওই বদমাশটার সাথে মোটরসাইকেলে আসোনি?’

কুঞ্জল এবার সামনে এসে ওর বাম হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে রুমের দিকে নিয়ে যায়। তারপর দরজা বন্ধ করে ওর বাহু খামচে ধরে তীব্র গলায় বলে, ‘এবার বলো, যা খুশি। আমি তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দেব।’

অভীক মুখ থমথমে করে বলে, ‘ওই লোকের সাথে তুমি কতদূর এগিয়েছ? তোমরা কি বেডেও গেছ?’

কুঞ্জলের মনে হয় এত কুৎসিত কথা ও এই জীবনে শোনেনি। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে থাকে। নাহ, আর এক মুহুর্ত এই সংসারে থাকবে না। কুঞ্জল ওর দিকে তাকিয়ে ঘৃণার স্বরে বলে, ‘তোমার মুখ নর্দমা হয়ে গেছে। আমি তোমার সাথে সংসার করব না। আজই আমি চলে যাচ্ছি। তুমি তোমার মেঘা, পূর্ণকে নিয়ে সুখে থাকো।’

কুঞ্জল পেছন ঘুরে দরজার লক খুলতে যেতেই পেছন থেকে অভীক ওর হাত টেনে ধরে৷ তারপর হিংস্র গলায় বলে, ‘আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যেখানে খুশি চলে যাও।’

কুঞ্জল ঘুরে ওর দিকে তাকায়। তারপর লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে শক্ত গলায় বলে, ‘সবাইকে নিজের মতো ভাবো কেন? এই নাও আমার মোবাইল। অংশুলের সাথে আমার কী কী কথা হয় সেটা দেখো। কোনো লুকোছাপা নেই। আমার রান্নার পেজ থেকে পরিচয়। সেদিন আমার ম্যারাথন দৌড়ের দিন উনি গিয়েছিল এটা সত্য। কিন্তু সেটা আমি জানতাম না। আর আমার বাসায় ফেরার কথা ছিল আফরোজা আপার সাথে। কিন্তু উনি আসতে দেরি করবেন তাই আমি তাড়াহুড়ো করে অর্কের স্কুলে পৌঁছাতে চাচ্ছিলাম। কোনো কিছু না পেয়ে ওনার মোটরসাইকেলে এসেছিলাম, শুধুমাত্র তাড়াতাড়ি আসার জন্য।’.

অভীক এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর গম্ভীরমুখে বলে, ‘তাহলে সেদিন মিথ্যে বলেছিলে কেন যে তুমি ‘পাঠাও’য়ে এসেছ?’

কুঞ্জল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ‘ওটাই ভুল হয়েছে। তোমাকে সত্যটা বলা উচিত ছিল। আমি সেজন্য ক্ষমা চাইছি। কিন্তু এর বাইরে একটা বাজে কথা বললে আমি মেনে নেব না।’

অভীক ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, বিশ্বাস করার মতো কিছু একটা খোঁজে। কুঞ্জল কখনও ওর সংগে মিথ্যে বলেনি। ওর মতো নিতান্ত গৃহিণী একটা মানুষ এমন করেছে ও ভাবতেই পারেনি। এতদিন বাসা আর স্কুল, এই পর্যন্ত ছিল ওর গন্ডী। এখন ম্যারাথন দৌড়ুচ্ছে, রান্না শিখতে যাচ্ছে। সেখানেও তো কত মানুষের সাথে পরিচয় হবে। ও কি কুঞ্জলকে আটকে রাখতে পারবে?

অভীক গম্ভীরমুখে বলে, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমি সব বিশ্বাস করলাম। কিন্তু কাল থেকে তুমি আর রান্নার স্কুলে যাবে না। লাগলে অনলাইনে শিখে নাও। আর তোমার হাতের রান্না তো এমনিতেই অনেক ভালো। কী দরকার ওসব শিখে?’

কুঞ্জল বিষণ্ণ একটা হাসি হেসে বলে, ‘তুমি ভুল বুঝছ। আমি বাসায় রান্নার জন্য শিখছি না। আমি এই লাইনে ক্যারিয়ার করব।’

অভীকের হঠাৎ করেই শেফ অংশুলের কথা মনে পড়ে যায়। ও বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে বলে, ‘তার মানে তুমি ওই অংশুল হারামজাদার মতো বাবুর্চি হবে?’
কুঞ্জল উত্তপ্ত গলায় বলে, ‘উল্টোপাল্টা কথা বলবে না। আমি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য শেফ হচ্ছি।’

অভীক তেড়ছা গলায় বলে, ‘তা এতদিন পর বুঝি মনে হলো নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কথা?’

কুঞ্জল ম্লান হাসে, তারপর বলে, ‘হ্যাঁ বড্ড দেরি হয়ে গেল। তোমাকে একদিক থেকে ধন্যবাদ দেবার আছে। সত্যি কথা বলতে তুমিই আমার চোখ খুলে দিয়েছ যে আমার নিজের পায়ে দাঁড়ানো দরকার।’

অভীক ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘আমি!? সেটা কী করে?’

কুঞ্জল ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘যেদিন জানলাম তুমি অন্য কারও সাথে জড়িয়ে পড়ছ সেদিন ধাক্কা খেলাম। এরপর আবার। দেখলাম, তুমি শুধরাবে না। আমার তখন মনে হয়েছিল এই সংসার ছেড়ে চলে যাই। কিন্তু পারিনি। তার জন্য নিজের পায়ে দাঁড়ানোর দরকার।’

অভীক জীবনে এত অবাক হয়নি। ও কখনও ভাবেনি কুঞ্জল ওকে ছেড়ে চলে যেতে পারে।

অভীক অবাক গলায় বলে, ‘তারমানে তুমি নিজের পায়ে দাঁড়ালে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?’

কুঞ্জল ওর অবাক হওয়া মুখটা দেখে। কোনোদিন এমন ধাক্কা আসতে পারে অভীক হয়তো ভাবেনি। সবকিছু নিঃশর্ত সমর্পণ বলে ধরে নিয়েছিল। জানত, ওর যাবার জায়গা নেই। তাই বুঝি আজ এমন অবাক হয়েছে। কুঞ্জলের খুব মজা লাগে, ও কপাল কুঁচকে বলে, ‘তোমার কি মনে হয় না তোমাকে ছেড়ে যাওয়া উচিত? আচ্ছা, আমি রান্না চড়াই, অর্ক না খেয়ে আছে।’

অভীক ফ্যালফ্যাল করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই কুঞ্জলকে ও চেনে না। ওর চোখেমুখে একটা দৃঢ়তা যা ভয় পাইয়ে দেবার মতো।

দরজা খুলতেই অর্ককে দেখতে পায়। মুখটা ভয়ে শুকিয়ে গেছে। মাকে দেখে এক দৌড়ে কাছে আসে, তারপর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে, ‘আম্মু!’

বুকের ভেতর কষ্টের ঠোকাঠুকি টের পায়। আহারে আমার সোনা বাচ্চা। আমরা বড়োরা কেন এত জটিল? আমাদের জটিলতায় বাচ্চারা কেন কষ্ট পাবে? অর্ক কি কোনোদিন ওর বাবা মাকে মন থেকে সম্মান করবে? ভবিষ্যতে কোনো সম্পর্কে কি ও সুখী হতে পারবে?

কুঞ্জল ওর কপালে চুমু খেয়ে বলে, ‘কিচ্ছু হয়নি বাবা। তোমার বাবা হাতে ব্যথা পেয়েছে তো তাই ঠিক করে দিলাম। যাও, বাবার কাছে গিয়ে বসো। আমি রান্না করব।’

কুঞ্জল দ্রুত ফ্রিজ থেকে মাছের একটা বক্স বের করে পানিতে ডুবিয়ে রাখে। মাছ ছাড়তে সময় লাগবে। এই ফাঁকে ও পেয়াঁজ কেটে নেয়। পেয়াঁজের ঝাঁঝে চোখ জ্বালা করে ওঠে, জলে ভরে ওঠে চোখ। তারপর জল গড়াতেই থাকে সেটা শুধু পেঁয়াজের ঝাঁঝের জন্য নাকি সংসারের ঝাঁঝের জন্য সেটা ঠিক বোঝা যায় না।

কুঞ্জল পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে মাছগুলো ভেজে গরম গরম ভাত বেড়ে ওদের ডাক দেয়। অর্ক বাবাকে হাত ধরে নিয়ে এসে বসে। কুঞ্জল ওদের ভাত বেড়ে দেয়।

অর্ক চিন্তিত গলায় বলে, ‘আম্মু, বাবা খাবে কী করে? বাবার হাতে তো ব্যথা।’

কুঞ্জল আড়চোখে একবার তাকায়, তারপর একটা টেবলচামচ আর কাঁটাচামচ দেয়। অর্ক আগ্রহের সাথে দেখতে থাকে বাবা কেমন করে খায়।

অভীক বাম হাতে চামচ নিয়ে অসহায় ভঙ্গিতে বসে থাকে। চামচ দিয়ে এক হাতে মাছ খাবে কী করে? ও রাগের সাথে বলে, ‘আমি মাছ খাব না। একটু ডাল দাও।’

কুঞ্জল একটু ভাবে, তারপর বলে, ‘আচ্ছা, চামচটা দাও। আমি খাইয়ে দিচ্ছি।’

অর্ক চোখ বড়ো বড়ো করে বলে, ‘আম্মু, তুমি বাবাকে খাইয়ে দেবে! আমাকেও খাইয়ে দিতে হবে।’

অভীক অবিশ্বাস নিয়ে কুঞ্জলের দিকে তাকিয়ে থাকে। কেন যেন মনে হচ্ছে কুঞ্জল ওকে ছেড়ে কখনোই চলে যাবে না।

সেদিন রাতে কুঞ্জল ঘুমিয়ে পড়ার আগে ভাবে, কী করবে ও এখন? ভেবেছিল চুপচাপ ক’টা বছর পার করে দেবে। কোর্সটা শেষ করে কোথাও চাকরি পেয়ে থিতু হলে তখন না হয় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। অংশুল ভরসা দিয়েছিল পাশে থাকবে। কিন্তু এখন আর সে পরিস্থিতি রইল না। অংশুল নিশ্চয় এখন নিজের ক্যারিয়ার বাঁচাতে ওকে ভুলে যাবে। তাহলে ও কি রান্নার কোর্সটা শেষ করতে পারবে না? আরও দুটো কিস্তি বাকি আছে। এই টাকাটা ও অভীকের কাছ থেকে কিছুতেই নেবে না। কিন্তু এত টাকা ও কোথায় পাবে? ইশ, এত বাধা কেন আসে? আসলে জীবনে একবার পিছিয়ে পড়লে কিছুতেই আর এগিয়ে যাওয়া যায় না।

কথাগুলো ভাবতে ভাবতে মনটা অস্থির হয়ে যায়। বহুদিন সাইফুল্লাহ স্যারের সাথে দেখা হয় না। কাল ওনার সাথে দেখা করতে যাবে। কেন যেন ওনার সাথে কথা বললে মন ভালো হয়ে যায়। জীবনের ঠিকঠাক পথটা ও খুঁজে পায়।

২.
আজ কুঞ্জল ফোন করেই এসেছে। সাধারণত সকালে ওনাকে পাওয়া যায়ই। তারপরও আজ কোনো ঝুঁকি নেয়নি কুঞ্জল। আজ যে পেতেই হবে ওনাকে। সদর দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই ও থমকে যায়। সাইফুল্লাহ স্যারকে দেখা যাচ্ছে। ঠিক দেখা যাওয়া যাকে বলে তা না। ওনার কাঁধের একপাশ, হাত। বাকিটা দেখা যাচ্ছে না। কারণ একটা মেয়ে পেছন থেকে স্যারের মাথায় চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। কুঞ্জল ইতস্তত করে, ও কি ভুল সময়ে চলে এল? চলে যাবে?

চলে যেতে পা বাড়াতেই মেয়েটা ঘুরে তাকায়, তারপর শুদ্ধ উচ্চারণে ওর নাম ধরে ডাকে, ‘কুঞ্জল আপু।’

কুঞ্জলের পা থেমে যায়, বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে। কম বয়েসী একটা মেয়ে, সাদা একটা টপস, আর জিন্স পরা। কে এই মেয়েটা যে ওর নাম জানে? আর মেয়েটা স্যারের মাথায় বিলি কাটছে, কাছের কেউ?

এবার সাইফুল্লাহ ঘুরে তাকিয়ে বলে, ‘কুঞ্জল এসেছ। আসো আসো। তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে। বলো তো ও কে?’

কুঞ্জল কাছে এসে মেয়েটার দিকে তাকাতেই বুঝে ফেলে এটা স্যারের মেয়ে। চেহারায় মিল আছে। ও বিস্মিত গলায় বলে, ‘আপনার মেয়ে এসেছে বিদেশ থেকে, বলেননি তো।’

এবার মেয়েটা ওর সামনে এসে হাত ধরে, ‘আপু আমি সারাহ, ইউএসএ তেই গ্রাজুয়েশন করছি কম্পিউটার সাইন্সে। বাবা বলছিল আপনি আসবেন। আপনার হাতের রান্না নাকি মায়ের মতো। একদিন আমাকে খাওয়াবেন?’

কুঞ্জল বুকের ভেতর মায়া টের পায়। এক হাতে ওকে জড়িয়ে ধরে নরম গলায় বলে, ‘তুমি যা যা খেতে চাও আমাকে আজই বলে দেবে। আমি আরেকদিন রান্না করে নিয়ে আসব। আজও এনেছিলাম। তুমি এসেছ জানলে অনেক বেশি কিছু করে নিয়ে আসতাম।’

সারাহর দু’চোখ ভিজে আসে, ‘আপনি আমাকে কখনও দেখেননি, অথচ এক মুহুর্তেই কত আপন করে নিলেন। আপনার নামটাও মায়ের সাথে মিলে যায়। কুঞ্জল নামের মানুষ বুঝি মায়াময় হয়?’

কুঞ্জল টের পায় ওর মন ভালো হতে শুরু করছে। সেইসাথে আফসোস হয়, ওর জীবন এমন মায়াময় হলো না কেন?

ওরা তিনজন বসতেই রান্নার লোকটা চা দেয়। কুঞ্জল ওকে খাবারগুলো বুঝিয়ে দিয়ে সাইফুল্লাহর দিকে ঘুরে বলে, ‘আজ ছুরি শুটকির ভর্তা, চিংড়ির পাতুরী নিয়ে এসেছি। আপনি কাল বললেন না কেন সারাহ এসেছে। তাহলে আরও কিছু করে নিয়ে আসতাম।’

সাইফুল্লাহ মিটিমিটি হাসে, হালকা গলায় বলে, ‘ভাবলাম আপনাকে একটা সারপ্রাইজ দেই।’

এরপর ও সারাহর সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে। তারপর একটা পর্যায়ে সারাহ বলে, ‘আপনি বাবার সাথে কথা শেষ করে নিন। তারপর দুপুরে একসাথে খাব।’

কুঞ্জল হাসে, ‘হ্যাঁ, তোমার বাবার সংগে কথা শেষ করে নেই।’

সারাহ ভেতরে চলে যেতেই সাইফুল্লাহ ওর দিকে নরম চোখে তাকিয়ে বলে, ‘কী খবর তোমার?’

কুঞ্জল দু’হাতে মুখ রেখে বলে, ‘একটা ভালো খবর আছে একটা খারাপ খবর আছে আপনার জন্য।’

সাইফুল্লাহ আগ্রহ নিয়ে বলে, ‘আগে ভালো খবরটা শুনি। তাতে করে খারাপ খবর হজম করতে সহজ হবে।’

কুঞ্জল হাসে, তারপর উৎসাহের সাথে বলে, ‘আমি ইন্টারন্যাশনাল কালিনারি ইন্সটিটিউটে এক বছরের একটা কোর্সে ভর্তি হয়েছি। যেহেতু রান্না ভালোবাসি তাই ভাবলাম শেফ হব। ক্লাশ শুরু করেছি কয়েকদিন হলো।’

সাইফুল্লাহ টেবিল চাপড়ে বলে, ‘বাহ, এটা তো দারুণ খবর। আমি জানতাম তোমার ভেতর আগুন আছে। একটু জ্বালিয়ে দিলে সেটা আলো দেবে।’

কুঞ্জল বিষণ্ণ হাসে, তারপর বলে, ‘আবার পুড়িয়েও দিতে পারে৷ অভীক গত সপ্তাহে ভীষণ বাড়াবাড়ি করেছে।’

সাইফুল্লাহ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘কী করেছে আবার?’

কুঞ্জল ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘অংশুলের কথা তো আপনাকে বলেছিলাম। ওর সাথে আমার ভালো একটা বন্ধুত্ব হয়েছিল। সত্যি বলতে ও আমাকে রান্নার কোর্সে ভর্তি হতে বলল। যাতে ভালো কিছু একটা করতে পারি। আর এতে বিপদ যা হবার হলো। অভীক ভাবল আমি অংশুলের সাথে প্রেম করছি। তাই নিয়ে ও তুলকালাম কান্ড করেছে। অংশুলের রেস্তোরাঁয় মারামারি করে হাত ভেঙে এসেছে। আমাকে যা তা বলেছে এই নিয়ে। আচ্ছা বলেন তো, ও কেন এমন করল?’

সাইফুল্লাহর চোখে কৌতুক খেলা করে। ও মৃদু হেসে বলে, ‘যতদূর মনে পড়ে আপনিও একই কাজ করেছিলেন। অভীকের বান্ধবীর অফিসে যেয়ে কথা শুনিয়ে এসেছিলেন। কেন করেছিলেন?’

কুঞ্জল মাথা নিচু করে বলে, ‘আমি আসলে দেখতে চেয়েছিলাম ও কেন আমাকে ছেড়ে ওই মেয়ের প্রেমে পড়ল।’

সাইফুল্লাহ মাথা নাড়ে, ‘উহু, শুধু সেজন্য যাননি। আপনার একটা অধিকারবোধ ছিল। আপনি অভীককে কারও সাথে ভাগ করে নিতে চান না। কেউই চায় না। অভীকও আপনাকে অন্য কারও সাথে ভাগ করে নিতে চায়নি। তাই ও এমন করেছে। তার মানে হলো, আপনারা দু’জন এখনও দু’জনকে কারও সাথে ভাগ করে নিতে পারছেন না। সেজন্যই অন্য কেউ কাছাকাছি এলেই ঈর্ষা হচ্ছে। যেদিন এটা হবে না সেদিন বুঝবেন সম্পর্কটা মরে গেছে। আপনাদের সম্পর্কটা দারুণভাবে বেঁচে আছে। অভীক যে এই বয়সেও আপনার জন্য মারামারি করে এসেছে এটা শুনে আমার খুব ভালো লাগছে।’

কুঞ্জলের চোয়াল ঝুলে যায়, অবাক গলায় বলে, ‘আপনার ভালো লাগছে? সামান্য ব্যাপার নিয়ে এমন তুলকালাম কান্ড কেউ করে?’

সাইফুল্লাহ কৃত্রিম গম্ভীরমুখে বলে, ‘আমি হলে এর চেয়ে বেশি করতাম। আপনার মতো এমন মিষ্টি একটা মুখের জন্য যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেওয়া যায়।’

কুঞ্জল ফিক করে হেসে ফেলে। এই লোকটা জাদু জানে। কেমন মন খারাপের গল্পের মাঝেও
ওর মনটা ভালো করে দিল। অভীকের সত্যিই ওর জন্য এখনও এত টান আছে? বিশ্বাস হয় না। টান থাকলে অমন কুৎসিত কথা কেউ বলতে পারে?

কুঞ্জল আনমনে বলে, ‘আচ্ছা, মানুষের কাছে শরীর বড়ো না মন বড়ো?’

সাইফুল্লাহ নির্দ্বিধায় বলে, ‘মানুষের কাছে শরীর বড়ো। আপনি খেয়াল করলে দেখবেন আপনি কাউকে মনের সবটুকু দিয়ে ভালোবাসেন তাতে এই পৃথিবীর কেউ আপনাকে দোষ দেবে না কিংবা কোনো কাঠগড়ায় তুলবে না। কিন্তু শরীর দিয়ে ফেললেই সবাই আপনাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে।’

কুঞ্জল মাথা নিচু করে। ওর উত্তর পেয়েছে। অভীক গত এক সপ্তাহে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বার বার যেকথাটা জানতে চেয়েছে সেটা হলো ও শারীরিকভাবে জড়িয়েছে কি-না। মানুষ কী আজব একটা প্রাণি। মন দিয়ে ফেললে কোনো পাপ নেই। শরীর দিলেই যত পাপ।

ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘আগে আমি ওকে বিশ্বাস করতাম না। এখন ও আমাকে বিশ্বাস করে না। বলতে পারেন আমরা দু’জন কী করে একসাথে থাকি?’

সাইফুল্লাহ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘এটা খুব শক্ত। বিশ্বাসটা না থাকলে অযথা ভুল বোঝাবুঝি হবে। আর সেটা থেকে তীব্র সন্দেহ, ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকবে। এটা একটা সময় পর্যন্ত হতে থাকবে। বিশ্রী কিছু ঘটনা ঘটবে। তারপর সময়ের সাথে সাথে ঠিক হয়ে যাবে।’

কুঞ্জল বিরক্তি নিয়ে বলে, ‘কী করে ঠিক হবে? যেখানে বিশ্বাসটাই নড়বড়ে। আমার প্রতি ওর বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধ নেই।’

সাইফুল্লাহ ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘যদি আপনারা সত্যিই আর এমন কিছুতে না জড়ান, তাহলে একটা সময় পর আবার নতুন করে বিশ্বাস ফিরে আসবে। সেজন্য সময় দিতে হবে।’

কুঞ্জল মুখ শক্ত করে বলে, ‘আমি অবিশ্বাসের কিছু করিনি।’

সাইফুল্লাহ মাথা নাড়ে, ‘তা হয়তো করেননি। কিন্তু অংশুল আপনার জন্য বিপদজনক পথ ছিল। আপনি তো জানতেন এখানে ভুল বোঝাবুঝি হতেই পারে। অংশুল মনের দিক থেকে এগোচ্ছিল, আপনি বাধা দেননি। জীবন চলার পথে এমন অনেক খানাখন্দ থাকে। সচেতনভাবে সেই পথ এড়িয়ে যেতে হয়। না হলে যেকোনো সময় তাতে পড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে।’

কুঞ্জল এবার মাথা নিচু করে। হ্যাঁ, অংশুল ওর দিকে ঝুঁকছিল। আর তাতে ওরও ভালো লাগছিল। একটা অনুচ্চারিত সম্পর্ক হয়তো ছিল। কিন্তু ও তো কোনো সীমারেখা অতিক্রম করেনি। একটা মানুষের ব্যক্তিত্ব, মায়া ভালো লাগতেই পারে। তাতে কি অপরাধ হয়?

কুঞ্জল মুখ তুলে বলে, ‘আপনার কথা হয়তো ঠিক। কিন্তু যে বিশ্বাস একবার ভেঙে গেছে তা আর জুড়বার নয়। এই প্রেমহীন সংসারে আমার দম আটকে আসছে।’

সাইফুল্লাহ হাসে, তারপর বলে, ‘সংসার কিন্তু এমনই। এর শুরু হয় দারুণ প্রেম দিয়ে। একটা সময় সেই প্রেম থিতু হয়ে বাস্তবতা সামনে আসে।জীবন নানান চাহিদা নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায় – তাতে টানাপোড়েন এর সৃষ্টি হয়। সম্পর্ক তেতো হতে থাকে। আবার মাঝে মাঝে এমন দু’একটা মায়ার দেখা পাবেন যেটা আপনি সংসার ছাড়া অন্য কোথাও পাবেন না। এই একটা দুটো স্বর্গীয় মায়ার জন্য মানুষ সংসারে আটকে থাকে, অনেকটা চুক্তিবদ্ধ মানুষের মতো।’
কুঞ্জল চেয়ে থাকে। ও যখন আট মাসের প্রেগন্যান্ট তখন এত গরম লাগত যে ঘুমোতে পারত না। ভাদ্র মাস ছিল, প্রায়ই বিদ্যুৎ থাকত না। আর্থিক অবস্থা এমন ছিল যে বাসায় একটা আইপিএস পর্যন্ত ছিল না। তখন অভীক সার রাত হাত পাখা ঘুরিয়ে বাতাস করত। বেচারা এক ফোঁটা ঘুমোতে পারত না। পরদিন ঘুম ঘুম চোখে অফিস যেত। সেই মানুষটা কি করে পালটে গেল? তাহলে ওরও কিছু অবহেলা ছিল? নিজের খামতিগুলো নিয়ে ও কখনই খতিয়ে দেখেনি।

সাইফুল্লাহ নরম গলায় বলে, ‘আপনি যেমন আমার কাউন্সেলিং নিচ্ছেন ঠিক তেমনি অভীকেরও কাউন্সেলিং প্রয়োজন। ওর বিক্ষিপ্ত মনটার মেরামতি দরকার।’

কুঞ্জল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘মেরামতি করা মন দিয়ে কি সংসার হয়?’

সাইফুল্লাহ ব্যথিত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর আশ্বস্ত করে বলে, ‘শরীরের অসুখ করলে যেমন চিকিৎসা নিতে হয়, মানুষ সুস্থ হয়ে ওঠে, তেমনি মনেরও চিকিৎসা নিলে অনেকটাই ঠিক হয়ে যায়।’

কুঞ্জল কথাটা বিশ্বাস করতে চায়, অভীক ভালো হয়ে যাবে। ওদের অর্কসোনা আর কোনোদিন ভয়ে কুঁকড়ে থাকবে না। ও প্রাণভরে জীবনের সুবাতাস নিতে পারবে।

(চলবে)

প্রেমহীন সংসার আহা সোনামুখী সুঁই পর্ব-১৪

0

#প্রেমহীন_সংসার_আহা_সোনামুখী_সুঁই (পর্ব ১৪)

১.
সকালে ঘুম ভাঙতেই কুঞ্জলের মনে পড়ে আজ ওর জন্মদিন। আর আজ ওর শেফ কোর্সে প্রথম ক্লাশ। মনটা ভালো হয়ে যায়। আজকের দিনটা শুভ হোক ওর। বিছানা ছেড়ে ও হাত মুখ ধুয়ে রান্নাঘরে যায়। নাস্তা বানাতে হবে। অর্ককে স্কুলে দিয়ে তারপর দুপুরের খাবার করে আবার ওকে স্কুল থেকে নিয়ে আসতে হবে। তারপর পৃথুলের কাছে দিয়ে ও যাবে। উফ, অনেক কাজ।

অভীক সকালেই অফিসে চলে গেছে। না, ওর জন্মদিনের কোনো মেসেজ বা উইশ করে যায়নি। অন্যান্যবার ও ঘুম ভাঙতেই চোখের সামনে একটা না একটা কিছু দেখতে পায়। কখনও ফুল, কখনও হাতঘড়ি। এই ব্যাপারটা এখন থেকে মিস করবে ও। একটা মানুষ বাইরে প্রেম করেও ঘরের মানুষের সাথে এত রোমান্টিক সম্পর্ক রাখত কী করে? কাল রাত থেকে অভীক ভীষণ গম্ভীর। কী হয়েছে আবার কে জানে। সেদিনের পর শেফ কোর্সে ক্লাশ নিয়ে নতুন করে আর ঝগড়া হয়নি। হয়তো মেনে নিয়েছে, ভাবে কুঞ্জল।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও কাজে ঝাপিয়ে পড়ে। কাজে করতে করতে ও একটা সময় ওর কষ্টগুলো ভুলে যায়। সব শেষ করে অর্ককে পৃথুলের বাসায় দিয়ে আসতে আসতে দুপুর দুটো। হাতে একদম সময় নেই। দ্রুত রেডি হয়। সুন্দর একটা ফ্লোরাল জামা পরে আজ। চুলটা সুন্দর করে সেট করে চোখে একটু কাজল দেয়। তারপর হাতব্যাগ গুছিয়ে বাসা থেকে বেরোয়। আর বেরিয়েই একটা কথা মনে হয়, আজ ওর শেফ স্কুলের প্রথম দিন। অংশুলের সাথে একবার দেখা করে যাবে? হাজার হলেও অংশুলের দেওয়া সাহসে ভর করেই ও ভর্তি হয়েছে। একটু ভাবে, তারপর হাতঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলে। দেখা করে যাবে।

অংশুল দুপুরের চা নিয়ে সবে বারান্দায় বসেছিল। ঠিক এমন সময় কেউ একজন কুঞ্জলের আসার খবর জানায়। বুকটা চলকে ওঠে। ঠিক ওর কথাই ভাবছিল এখন। মুখে নরম একটা হাসি ফোটে। লোকটাকে বলে, ‘এখানে নিয়ে আসো। আর সকালে যে কেকটা বানালাম ওটা নিয়ে এসো ফ্রিজ থেকে।’

কুঞ্জল আসতেই অংশুল মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে, তারপর হাসিমুখে বলে, ‘শুভজন্মদিন। জীবন সুন্দর হোক।’

কুঞ্জল অবাক চোখে বলে, ‘আপনি জানলেন কী করে আজ আমার জন্মদিন? আমি তো ফেসবুকে নোটিফিকেশন অফ করে রেখেছি।’

অংশুল ওর মায়াবী চোখের দিকে চেয়ে থাকে। মেয়েটা আজ কাজল দিয়েছে তাতে করে চোখে একটা নরম মায়া। ও মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে। বাদামী চোখের কোণে রোদ পড়েছে। ও হেসে বলে, ‘ভাইভারে নোটিফিকেশন এসেছে। বসুন।’

কুঞ্জল বসতে বসতে বলে, ‘আমার হাতে একদম সময় নেই। আজ আমার প্রথম ক্লাশ, ভাবলাম আপনার আশীর্বাদ নিয়ে যাই। আমি যেন আপনার মতো শেফ হতে পারি।’

অংশুল নরম গলায় বলে, ‘আপনি আমার চেয়েও বড়ো শেফ হবেন, সাত মিশেলিন স্টার পাওয়া শেফ।’

কুঞ্জল আগ্রহ নিয়ে তাকায়, ‘আপনি এমন ভাবেন বুঝি? সত্যিই আমি পারব?’

অংশুল মাথা নাড়ে, ‘হ্যাঁ তো। ঠিক পারবেন।’

কুঞ্জল বুকের ভেতর একটা ভালো লাগা টের পায়। সাইফুল্লাহ স্যারের পর অন্তত আরেকটা মানুষ ওর ভেতরের শক্তিটাকে বিশ্বাস করেছে। এই মানুষটা ওকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে। ও অনুমতি নেবার গলায় বলে, ‘আমি আজ যাই?’

অংশুল উঠে দাঁড়ায়, ‘একটা মিনিট বসুন।’

বলেই ও দ্রুত ভেতরে চলে যায়। তারপর একটু পরে ফিরে আসে। হাতে ছোট্ট একটা কেক আর একটা রঙিন কাগজ মোড়া কিছু।

অংশুল কেকটা ওর সামনে রেখে একটা নাইফ এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘কাটুন। আজ সকালে নোটিফিকেশন পেয়েই বানিয়েছিলাম। আমি জানতাম আপনি আজ ক্লাশে যাবেন। ভেবেছিলাম সন্ধ্যায় যাব আপনার ইন্সটিটিউটে। কিন্তু আপনিই চলে এলেন। নিন, দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

কুঞ্জল অবিশ্বাস নিয়ে কেকটার দিকে তাকিয়ে থাকে, রেড ভেলভেটের কেকের উপর সুন্দর করে লেখা, ‘শুভজীবন, কুঞ্জল।’

ওকে অমন চেয়ে থাকতে দেখে অংশুল বলে, ‘এখন থেকে আপনাকে এটা বলেই উইশ করব, শুভজীবন কুঞ্জল। আপনার জীবনের সব মন্দ কেটে গিয়ে শুভ হোক।’

কুঞ্জলের চোখ ভিজে আসতে চায়, কতদিন একটু মায়া করে কেউ কথা বলেনি ওর সাথে। জীবনে বেঁচে থাকতে খুব বেশি কিছু জিনিসের দরকার হয় না। একটু মায়া পেলেই হয়।

কুঞ্জল কাঁপা হাতে ছুরিটা নেয়, তারপর কেকটা কাটতেই অংশুল বাচ্চাদের মতো হাততালি দিয়ে ওঠে। তারপর সুর করে বলে, ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, হ্যাপি বার্থডে ডিয়ার কুঞ্জল।’

কুঞ্জল সলজ্জ হাসি হাসে। বাদামি মুখটা কেমন লালচে হয়ে যায়। সেই মুখের দিকে তাকিয়ে পুরুষ সারাজীবন মুগ্ধ হয়েছে।

কুঞ্জল সুন্দর করে একটা পিস কেটে ওর দিকে এগিয়ে দেয়। নিজেও একটু নেয়। অংশুলের খুব ইচ্ছে করছে ওকে একটা পিস খাইয়ে দিতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইচ্ছের ঘুড়িতে লাগাম টানে। তারপর কাগজ মোড়ানো গিফটটা ওর হাতে দিয়ে বলে, ‘ছোট্ট একটা গিফট আপনার জন্য।’

কুঞ্জল একটু ইতস্তত করে তারপর জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘কী আছে এটাতে?’

অংশুল রহস্যময় গলায় বলে, ‘খুলে দেখতে পারেন।’

কুঞ্জল বাচ্চা মেয়েদের মতো প্যাকেটটা খুলে ফেলে। তারপর অবাক হয়ে দেখে খুব সুন্দর একটা কাটিং নাইফ।

অংশুল ব্যাখ্যা দেবার ভঙ্গিতে বলে, ‘এটা একটা জাপানি ছুরি, নাম গিউটো ছুরি। প্রতিটি শেফের জন্য এমন একটা ভালো ছুরি থাকা দরকার। আপনি যদি কখনও জাপানি শেফদের ইয়াকিনিকুর রান্না করতে দেখেন দেখবেন ওরা গরুর মাংসের কত পাতলা করে স্ট্রিপ কাটে। এই ছুরি ছাড়া সেটা সম্ভব না। আপনার সংগ্রহে এমন সুন্দর সুন্দর জিনিস থাকুক। কাজে লাগবে।’

কুঞ্জল সত্যিকারের খুশি হয়। একটা আশংকায় মন সংকুচিত ছিল, অংশুল না আবার এমন কিছু দেয় যেটা নিতে ওর সংকোচ হবে। এখন ভালো লাগছে। মানুষটা সর্ব অর্থেই একজন ভদ্রলোক। ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ছুরিটা নেয়। তারপর ঘাড় কাৎ করে বলে,’আমি এবার আসি?’

অংশুল ওর দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে বলে, ‘আচ্ছা, আসুন। শুভজীবন।’

কুঞ্জল এবার হেসে বলে, ‘শুভজীবন।’

কুঞ্জল চলে যায়। অংশুল কেমন আচ্ছন্নের মতো বসে থাকে। ওর প্রেমহীন জীবনে একটু হলেও প্রেম বুঝি ও পেল। চোখ বন্ধ করে ও সোফায় হেলান দিয়ে বসে থাকে। এই মুহুর্তটা শেষ না হোক।

ঠিক এমন সময় রেস্তোরাঁর একজন স্টাফ এসে গলাখাঁকারি দিতেই অংশুল চোখ খুলে। লোকটা জবাবদিহি করার ভঙ্গিতে বলে, ‘স্যার, অভীক নামে একজন লোক আপনার সাথে দেখা করতে এসেছে।’

অংশুল ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘অভীক? উম, চিনতে পারছি না তো। আচ্ছা আমার রুমে বসাও। আমি আসছি।’

লোকটা চলে যেতেই অংশুল একবার ভাবে কুঞ্জল বুঝি এতক্ষণে ওর সেন্টারে পৌঁছে গেছে। ওর ক্লাশ শেষ হবে সন্ধ্যা সাতটায়। একবার যাবে? প্রশ্নটা মনের ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে।

আনমনে রুমের কাছে আসতেই হঠাৎ করেই ওর মনে পড়ে অভীক নামটা খুব চেনা। কুঞ্জল বলেছিল। কুঞ্জলের হাসব্যান্ড এসেছে! বুকটা ধক করে ওঠে। কুঞ্জলকে এখান থেকে বেরোতে দেখেনি তো? সর্বনাশ!

ওর রুমটা গ্লাস দিয়ে ঘেরা যার ভেতর দিয়ে পুরো রান্নাঘরে নজর রাখা যায়। ও দেখতে পায় একটা লোক শরীর কুঁজো করে বসে আছে। অংশুল লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে ভেতরে ঢোকে, তারপর জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘আপনি আমার কাছে এসেছেন?’

অভীক নামের লোকটা ঝট করে ঘুরে তাকায়। অংশুল খেয়াল করে ওর চোখ লাল, চুলগুলো এলোমেলো, ফর্সা মুখটায় না কামানো দাড়ি।

অভীক সামনে দাঁড়ানো শেফ লোকটাকে দেখে। আচ্ছা, এই তাহলে কুঞ্জলের প্রেমিক, অংশুল। একবার নিজের সাথে মিলিয়ে নেয়। এমন আহামরি কোনো সুদর্শন কেউ না। কুঞ্জল এমন একটা বাবুর্চির প্রেমে পড়ল!

গম্ভীরমুখে বলে, ‘আপনি বাবুর্চি অংশুল?’

অংশুল একটা রাগ টের পায়। ওর পেশাকে অসম্মান করতে অনেকেই এমন তাচ্ছিল্য করে বাবুর্চি শব্দটা ব্যবহার করে। না, বাবুর্চি শব্দে ওর আপত্তি নেই। কিন্তু বলার ভঙ্গিতে একটা তাচ্ছিল্য থাকে সেটা নিতে পারে না।

অংশুল শান্ত গলায় বলে, ‘আমি এই রেস্তোরাঁর হেড শেফ। বলুন কেন এসেছেন আমার কাছে?’

অভীক বাঁকা গলায় বলে, ‘আমি একটা শেফ কোর্সে ভর্তি হতে চাই, আপনি কি একটু সাহায্য করবেন?’

অংশুল বুঝতে পারে কথাটা ওকে খোঁচা মেরেই জিজ্ঞেস করল অভীক। ঝগড়া শুরু করবার একটা ছল। ও সাবধানী গলায় বলে, ‘আমি তো কোনো কোর্স করাই না। আপনি আমার কাছে কেন এসেছেন? আর আমি আপনাকে চিনিও না।’

অভীক দুই হাত ছড়িয়ে হতাশ হবার কৃত্রিম ভঙ্গিতে বলে, ‘ওহ, আপনি তো আমাকে চেনেন না। চেনা হলে সাহায্য করবেন বুঝি?’

অংশুল বুঝতে পারে, এই কথার উত্তরে ও হ্যাঁ বললেই এই লোকটা এবার কুঞ্জলের পরিচয় দেবে।

ও সে পথে হাঁটে না। মাথা নেড়ে বলে, ‘আমি পরিচিত বা অপরিচিত কাউকে রান্না শেখাই না।’

অভীক ওর দিকে এগিয়ে এসে ছুঁচালো মুখে বলে, ‘কিন্তু কুঞ্জলকে শিখিয়েছেন। ওকে রান্নার স্কুলে ভর্তি হতে বলেছেন।’

অংশুলের মুখের পেশি শক্ত হয়ে যায়। লোকটা শেষ পর্যন্ত ওকে কুৎসিত এই খেলায় টেনে নামাল। এখন গায়ে পাঁক জড়াতেই হবে। তাতে করে শুধু মালিন্যতায় বাড়বে। এই লোকের সাথে নরম গলায় কথা বলে কোনো লাভ নেই।

অংশুল শক্ত গলায় বলে, ‘আপনি যা বলতে চান তা স্পষ্ট করে বলুন। এমন ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলার কোনো প্রয়োজন দেখি না।’

অভীকের হঠাৎ করেই মাথায় রাগ উঠে যায়। আমার বউয়ের সাথে নষ্টামি করে এখন ভাব নিয়ে কথা বলছে।

ও খেকিয়ে উঠে, ‘হারামজাদা, সোজা করেই বলছি। তুই আমার বউয়ের সাথে প্রেম করিস, রান্না শিখাস। তোর এত প্রেম কেন। তোর বাসায় বউ নাই? তোর বউরে রান্না শিখা।’

অংশুলের কান গরম হয়ে যায়। ও আড়চোখে একবার কাচের ভেতর দিয়ে বাইরে থাকা ওর স্টাফদের দিকে তাকায়। নাহ, শব্দ বাইরে যাবার কথা না। এই খেপাটে লোকটাকে শান্ত করতে হবে।

অংশুল এবার নরম গলায় বলে, ‘দেখুন অভীক, আপনি ভুল বকছেন। আপনার স্ত্রীর সাথে আমার তেমন করে আলাদা কোনো সম্পর্ক নেই। ওনার রান্নার পেজ থেকে পরিচয়। উনি রান্নার উপর কোর্স করতে চেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন। আর আমি ওনাকে শুধু সেই তথ্যটুকুই দিয়েছি।’

অভীকের মাথায় আগুন ধরে যায়। লোকটা এখনও মিথ্যে বলে যাচ্ছে। ও খপ করে ওর কলার চেপে ধরে, দাঁতে দাঁত ঘষে বলে, ‘কুত্তারবাচ্চা, তোর সাথে আলাদা সম্পর্ক নাই, তাই না? তাহলে তুই ওর ম্যারাথনের দিন মোটরসাইকেল নিয়ে গেছিলি ক্যান? পিরিতির ঠেলায় আবার বাসা পর্যন্ত পৌঁছায় দিয়া গেছিস। আর বলিস আলাদা সম্পর্ক নাই। বল, কয়দিন শুইছিস?’

কানে যেন কেউ গরম সীসা ঢেলে দিল। এই লোকটাতে আজ দৈত্য ভর করেছে। সব ধ্বংস করে দেবে৷ অংশুল দুই হাত দিয়ে ওকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে চায়, পারে না। ওর গায়ে যেন অসুরের শক্তি ভর করেছে। গলার কাছে চাপ বাড়ছে, নিশ্বাস নেবার জন্য হাঁসফাঁস করতে থাকে অংশুল।

ঠিক এই সময় ধুপ করে দরজা খোলার শব্দ হয়। অংশুল ওর কাঁধের উপর দিয়ে দেখতে পায় ওর জুনিয়র শেফ, স্টাফরা ভেতরে ঢুকছে। একটা হইহল্লা শুরু হয়। চার পাঁচজন স্টাফ অভীককে দুই হাত দিয়ে টেনে সরাতে চেষ্টা করতেই অভীক হাত চালায়। এবার একটা মারামারি বেঁধে যায়। অভীক পাগলের মতো হাত পা ছুড়তে থাকে। আর এদিকে অন্য স্টাফরাও হাত চালায়।

অংশুল গলা তুলে চিৎকার করে সবাইকে থামতে বলে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। সবাই মিলে অভীককে মারতে মারতে রেস্তোরাঁর বাইরে বার করে দেয়। অভীক চিৎকার করে বলেই যাচ্ছে, ‘আমি এর প্রতিশোধ নেব। অন্যের বউ নিয়ে নষ্টামি, আমি ছুটাই দিব। তোর বাসায় যেয়ে তোর বউরে বলে আসব। শুয়োরের বাচ্চা।’

গালিগুলো বাতাসে ভেসে রেস্তোরাঁর দারুণ পরিপাটি পরিবেশে এসে বেমক্কা ধাক্কা খেয়ে কেমন বেমানান ভঙ্গিতে একটা অনিশ্চয়তা নিয়ে পড়ে থাকে। মানুষের জোর করে সাজিয়ে রাখা পরিপাটি জীবনের উল্টোপিঠের কুৎসিত দিকটা বেরিয়ে আসে।

অংশুল মাথা নিচু করে নিজের চেয়ারে বসে থাকে। আজ ওর সারাজীবনের এত কষ্ট করে অর্জিত সম্মান মাটির সাথে মিশে গেল। কোনো অপরাধ না করেই ও অপরাধী হলো। কিন্তু কুঞ্জল? ও কি জানে অভীক আজ এখানে এমন তান্ডব চালিয়ে গেল? ওকে সাবধান করতে হবে। অভীক আজ পাগলা কুকুর হয়ে গেছে। ওর গায়ে যদি এমন করে হাত তোলে তাহলে কুঞ্জলের সাথে না কী করবে! ভাবতেই শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে। ও দ্রুত ফোন হাতে নেয়।

কুঞ্জলদের আজ প্রথম ক্লাশ। এখানকার পরিচালক খোদ ড্যানিয়েল স্যার ক্লাশ নিচ্ছেন। কুঞ্জল সেই কলেজ জীবনের মতো করে মনোযোগ দিয়ে নোট নিচ্ছে। একটা ভালো লাগা ছুঁয়ে যাচ্ছে। বহুদিন পর আজ আবার সেই ছাত্রজীবনে ফিরে গেল ও।

ভাবনার এই পর্যায়ে ফোনটা কেঁপে ওঠে, ভাইব্রেশনে রাখা ছিল। ও দ্রুত ফোনটা হাতে নিয়ে অফ করতে যেতেই ভ্রু কুঁচকে দেখে অংশুলের ফোন। ফোনটা কেটে দেয়। অংশুল ফোন করেছে? কিন্তু ও তো জানে এখন ওর ক্লাশ চলছে। জরুরি কিছু? ভাবতেই একটা মেসেজ আসে, ‘খুব বিপদ। ক্লাশ থেকে বেরিয়ে ফোনটা ধরো।’

কুঞ্জলের বুক ধক করে ওঠে। কী হলো হঠাৎ করে? বেরোবে ক্লাশ থেকে? একটু ভাবে, অংশুল যখন লিখেছে খুব বিপদ তার মানে ব্যাপারটা জরুরি। ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ক্লাশ থেকে বেরিয়েই ফোন দেয়।

ওপাশ থেকে সাথে সাথে অংশুল ফোন ধরে উত্তেজিত গলায় বলে, ‘কুঞ্জল, সর্বনাশ হয়ে গেছে। আপনি আমার এখান থেকে বেরিয়ে যেতেই অভীক আমার রেস্তোরাঁয় এসেছিল। তারপর আপনাকে আমার সাথে জড়িয়ে যা ইচ্ছে তাই বলে গেল। একটা পর্যায়ে আমার কলার চেপে আমাকে মারতে গেলে আমার লোকজন ওকে আটকানোর চেষ্টা করেছিল। তাতে উলটো ও আমার লোকদের গায়ে হাত তুলতেই ওরা ওকে মেরে বের করে দিয়েছে। আপনি এখুনি ক্লাশ ছেড়ে বেরিয়ে বাসায় চলে যান। না না, আপনার বাসায় না, আপনার মা বাবার কাছে চলে যান। ও পাগল হয়ে গেছে। ও আজ আপনার গায়ে হাত তুলবে।’

কুঞ্জলের মাথাটা ঘোরাচ্ছিল, পা দু’টো কেমন অবশ হয়ে আসছে। ও তোতলানো গলায় বলে, ‘কিন্তু ও আপনার কথা জানল কী করে?’

অংশুল মাথা নাড়ে, ‘আমার কোনো ধারণা নেই এই বিষয়ে। আচ্ছা, ম্যারাথন দৌড়ের দিন আমি যে আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিয়েছিলাম সে কথা ওকে কে জানাল?’

কুঞ্জল এবার নিজেও অবাক হয়। অংশুল যে ম্যারাথন দৌড়ে গিয়েছিল, তারপর ওকে পৌঁছে দিয়েছিল সেটা তো ও অভীককে খুলে বলেনি। এই সত্যটা ও লুকিয়েছিল। আর সেদিনই অভীক ওকে মেরেছিল।

কুঞ্জল পুরো ঘটনা খুলে বলতেই অংশুল আফসোসের গলায় বলে, ‘ইশ, এত কিছু ঘটে গেছে, আমাকে বলবেন না? ও দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়েছে। আর সন্দেহ ওকে এখানে ঠেলে নিয়ে এসেছে৷ তাতে করে আপনি আমি কিছু না করেও অপরাধী। আমার ক্যারিয়ারে একটা বড়ো ক্ষতি ও করে দিয়ে গেল আজ। তাতে আফসোস নেই, কিন্তু ও আজ আপনাকে পেলে মেরেও ফেলতে পারে। প্লিজ, আপনি আপনার বাবা মায়ের কাছে চলে যান। ও আপনার ইন্সটিটিউটেও যেতে পারে। সবার সামনে আপনাকে অপদস্ত করবে। আপনি এখুনি বের হয়ে যান। বাসায় গিয়ে অর্ককে নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন।’

কুঞ্জল লম্বা একটা নিশ্বাস নেয়, তারপর বিষাদ গলায় বলে, ‘আচ্ছা। আপনি ভাববেন না। আমি সত্যিই ভীষণ দুঃখিত, আজ আমার জন্য আপনার বড়ো একটা ক্ষতি হয়ে গেল।’

অংশুল ওপাশ থেকে বিষাদের হাসি হেসে বলে, ‘আমার বড়ো ক্ষতি অনেক আগেই হয়েছে। আজ যেটা হলো সেটা সাময়িক। আপনি শুধু শুধু কষ্ট পাবেন না। এখন আর এক মুহুর্ত দেরি না করে বেরিয়ে পড়ুন।’

কুঞ্জল ফোন রাখে। একটু ভাবে, কী করবে ও? জীবনে প্রথম নিজের পায়ে দাঁড়াতে গিয়ে এত বড়ো হোঁচট খাবে ভাবতেই পারেনি। আজ সকালটাও কী সুন্দর ছিল সব। অংশুলের ওখানে দুপুরটা ছিল স্বপ্নের মতো। এত দ্রুত স্বপ্ন ভঙ্গ হবে ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি ও। অভীক যেহেতু ওর ওখানে মার খেয়েছে সেক্ষেত্রে এখানে এল বলে। ও কি তাহলে পালিয়ে যাবে? এভাবে জীবন থেকে পালাতে পালাতে ও যে একদিন হারিয়েই যাবে।

কুঞ্জল লম্বা একটা নিশ্বাস নেয়। নাহ, ও পালাবে না। ও তো কোনো অপরাধ করেনি। ও কেন পালাবে? আজ যদি অভীক এখানে এসে ওকে অপদস্ত করে তাহলে ও আজই ওকে ছেড়ে চলে যাবে। তাতে করে যত কষ্টই হোক ও মেনে নেবে।

সিদ্ধান্তটা নিতে পেরে ওর কেন যেন খুব ভালো লাগতে থাকে। ও দৃঢ় পদক্ষেপে ক্লাশরুমে ঢোকে।তারপর নিজের সবটুকু মনোযোগ ওর স্বপ্ন পূরণ হবার ক্লাশে ঢেলে দেয়।

(চলবে)

প্রেমহীন সংসার আহা সোনামুখী সুঁই পর্ব-১৩

0

#প্রেমহীন_সংসার_আহা_সোনামুখী_সুঁই (পর্ব ১৩)

১.
দুপুরের খাবার শেষে কেমন একটা ঝিমুনি আসে অভীকের। চাকরিতে ঢোকার আগ পর্যন্ত প্রতিদিন দুপুরে ভাত খেয়ে একটা ভাতঘুমের অভ্যেস ছিল। ওর মনে পড়ে যায়, সেই ছোটবেলায় মা দুপুরের খাওয়া শেষে ওদের দুই ভাইবোনকে নিয়ে বিকেল অব্দি ঘুমোত। বাবা আসত সন্ধ্যে বেলা। ছোট একটা চাকরি করত। এসেই খেয়েদেয়ে ওদের নিয়ে পড়তে বসত। রাত দশটার মধ্যে সবাই বিছানায়। ওর কোনোদিন মনে পড়ে না মা বাবার মাঝে এমন তৃতীয় পক্ষের সংগে অবৈধ সম্পর্ক নিয়ে কখনও ঝামেলা হতে দেখেছে। ওর আশেপাশের বন্ধুদের বাবা মায়ের ক্ষেত্রেও এমন শুনেনি। কিন্তু ওর বেলায় এমন হলো কেন? যুগ পালটে গেছে, তাই? ইন্টারনেটের যুগে মানুষের যোগাযোগ বুঝি খুব বেশি সহজ হয়ে গেছে। তাই সুযোগ পেলেই অমন জড়িয়ে পড়ছে। আচ্ছা, ওর বাবা মায়েরা কি সুযোগের অভাবে সৎ ছিলেন? নাহ, কীসব পাপ ভাবনা ভাবছে। মনটাই পচে গলে গেছে। মন শোধরাবার যন্ত্র কোথায় পায়?

এমন সময় অফিস কলিগ পাশা ওর কাঁধে হালকা করে ধাক্কা দেয়। ঘুমের ঝিমোনি কেটে যায়, ও চোখ খুলে তাকাতেই পাশা দুষ্ট গলায় বলে, ‘কী বন্ধু, রাতে মনে হয় কাজকাম বেশি হইছে? ঘুমাচ্ছিস যে।’

অভীক ম্লান হাসে। কাজকাম মানে বউকে আদর করার কথা বলছে পাশা। ও মাঝে মাঝেই এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে চায়। অভীক এড়িয়ে যায়। কতদিন ওর কুঞ্জলের সাথে কিছুই হয় না? সম্পর্কের ভিতে শরীরের একটা ব্যাপার হয়তো থাকে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘নাহ, রাতে আসলে ঘুম হয়নি। তোর কী খবর তাই বল?’

পাশা ওর পাশে বসতে বসতে বলে, ‘আমার খবর ভালো। তোর কাছে একটা কাজে এলাম। সামনের সপ্তাহেই তো পহেলা বৈশাখ। আমাকে একটা সুন্দর দেখে পহেলা বৈশাখের শাড়ি কিনে দে। তুই তো মাঝে মাঝে অনলাইনে শাড়ি কিনতি। সেখান থেকে একটা অর্ডার কর।’

অভীক চমকে ওঠে। মেঘার কথা মনে পড়ে যায়। এই শাড়ি কেনা নিয়েই অশান্তির শুরু। এত আগ্রহ করে কেনা শাড়ি যে একসময় গলার ফাঁস হবে তা ভাবেনি কখনও। পাশাকে সতর্ক করতে হবে। ও কার জন্য শাড়ি কিনছে?

অভীক গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, ‘দোস্ত, কার জন্য শাড়ি কিনছিস?’

পাশা ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘কার জন্য মানে? তোর ভাবির জন্য। এখন তোর সেই শাড়ির পেজটা খোল, আর তাড়াতাড়ি অর্ডার কর।’

অভীক থতমত খেয়ে যায়, আসলেই ওর মনটা নষ্ট হয়ে গেছে। তাই সবাইকে ওর মতোই ভাবে। ও এবার দ্রুত ফেসবুক ব্রাউজ করে কয়েকটা শাড়ির পেজ থেকে ওকে লাল সাদা শাড়ি দেখায়। প্রতিটি পেজে এখন নববর্ষের শাড়ির অফার।

পাশা একটা লালের উপর গোল্ডেন কাজের পাড় শাড়ি পছন্দ করে। দামটাও বেশ কম। অভীক অর্ডার কনফার্ম করতেই পাশা অবাক গলায় বলে, ‘হয়ে গেল? এত সহজ? এই অভীক, তোর ভাবি তো একটু স্বাস্থ্যবান, শাড়িটা হবে তো? মানে এক্সএল শাড়ি অর্ডার করেছিস তো?’

অভীক হো হো করে হেসে ফেলে, ‘এই গাঁড়ল, শাড়ির আবার সাইজ হয় নাকি। তুই বুঝি জীবনেও শাড়ি কিনিসনি?’

পাশা একটা বোকা হাসি হাসে, ‘আমার এই কেনাকাটা করতে গেলেই গোলমাল লাগে। এটা ওর ডিপার্টমেন্ট। কিন্তু এবার মনে হলো ওকে চমকে দেই। আমি ভাবছি শাড়ি পেলে ওর মুখের অবস্থা কেমন হবে। এই প্রথম আমি নিজে শাড়ি কিনছি ওর জন্য।’

অভীক ওর সারা মুখে একটা দাম্পত্য সুখের ছায়া দেখতে পায়। পাশা চলে যায়, আর অভীক ওর জীবনের গভীর দাম্পত্য অসুখ নিয়ে ভাবতে থাকে। তারপর কী মনে হতে বিকেলের দিকে একটা সবুজ জমিনের সাথে লালচে গোলাপি পাড়ের শাড়ি অর্ডার করে। যদিও এর আগেরবার শাড়ি নিয়ে যাওয়াতে উলটো ফল হয়েছিল। কিন্তু এতদিনে নিশ্চয়ই সেই রাগটা আর নেই। শাড়িটা অর্ডার করে অভীকের মনটা ভালো হয়ে যায়। এবারের নববর্ষে ও নতুন করে জীবন শুরু করবে। কুঞ্জলকে আর অমন দূরে দূরে থাকতে দেবে না।

অভীক শাড়িটা হাতে পায় পহেলা বৈশাখের ঠিক আগেরদিন। এই ক’টা দিন একটা উদ্বেগ ছিল শাড়িটা আদৌও পহেলা বৈশাখের আগে পাবে কি-না। শেষ পর্যন্ত হাতে পেয়ে মন শান্ত হয়।

অভীক সেদিন অফিস থেকে আগেই বের হয়। বসন্তের শেষ দিন আজ। যদিও গরম পড়ে গেছে অনেক আগেই, তবুও আজ রাস্তায় পা দিয়েই মন ভালো হয়ে যায়। একটা মাতাল হাওয়া শরীরে লাগে। ঘর ফেরতা মানুষের দিকে তাকিয়ে দেখে একটা সুখ আজ তাদের চোখেমুখে। অভীক নিজেকে সুখী ভাববার চেষ্টা করে।

মাগরিবের আজান যখন পড়ে তখন অভীক বাসায় এসে পৌঁছে। কলিং বেল বাজিয়ে অপেক্ষা করে কিছুক্ষণ। কেউ ওপাশ থেকে দরজা খোলে না। ও অধৈর্য হয়ে বার বার কলিংবেল বাজায়, কিন্তু তারপরও দরজাটা বন্ধই থাকে। মেজাজ চড়ে যাচ্ছে, টের পায় অভীক। বিরক্তি নিয়ে ব্যাগ থেকে চাবি বের করে লক খোলে। দরজার হাতল ঘোরাতেই ও অবাক হয়ে দেখে পুরো বাসা অন্ধকার। বুকটা কেঁপে ওঠে অভীকের। ওরা কই? হাতড়ে হাতড়ে ও লিভিং এর বাতি জ্বালে। তারপর মরিয়া গলায় ডাকে, ‘অর্ক, কোথায় তোমরা।’

কারও সাড়া আসে না। ও দ্রুত রুমগুলো, বাথরুম, রান্নাঘর – সব খুঁজে দেখে। নেই, কোথাও ওরা নেই। তারমানে ওরা বাইরে কোথাও গেছে? ওকে তো কিছু বলেনি, অন্তত একটা মেসেজ দেয়নি। কুঞ্জল ফোন না দিলেও অন্তত মেসেজ তো দেয়।

শাড়ির প্যাকেট রেখে ও ফোন বের করে। বার বার নিজেকে বোঝায়, মাথা ঠান্ডা রাখবে। ফোনটা কয়েকবার বেজে থেমে যায়। আবার ফোন দেয়, এবারও কুঞ্জল ধরে না। রাগটা টের পায় অভীক। মুখ গম্ভীর করে ও সোফায় বসে। নাহ, আজকে এই ঝামেলার একটা বিহিত করে ফেলতে হবে। অনেক সহ্য করেছে।

কুঞ্জলের মনটা আজ খুব ভালো লাগছে। শেষ পর্যন্ত ও সাহস করে ইন্টারন্যাশনাল কালিনারি ইন্সটিটিউট এ ভর্তি হয়েছিল। আজ ছিল তার প্রথম দিন। সবার সাথে পরিচিতি, এখানে পড়ার উদ্দেশ – এসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হলো আজ। বিশেষ করে ওর কোর্সের চীফ ইন্সট্রাকটর মাস্টার শেফ ড্যানিয়েল স্যারের দুটো কথা ওর ভীষণ ভালো লেগেছে। রান্নার প্রতি তীব্র আগ্রহ সেই সাথে কঠোর পরিশ্রম একজন শেফের সাফল্যের চাবিকাঠি। তা পরিশ্রম করতে ওর দ্বিধা নেই। এখন আফসোস হয় কেন আগেই নিজের জীবন নিয়ে ভাবেনি ও।

অর্ক মায়ের হাত ধরে টান দেয়, ‘আম্মু, আমরা চলে এসেছি তো।’

কুঞ্জলের ভাবনায় ছেদ পড়ে। ও তাকিয়ে দেখে বাসার কাছের গলিতে চলে এসেছে। আজ প্রথম দিন, তাই অর্ককে সাথেই নিয়ে গিয়েছিল। অভীককে এখনও বলা হয়নি। আজ বলতে হবে, মানে জানিয়ে রাখা আর কি। সপ্তাহে মোটে দুটো দিন, তার একটা আবার ছুটির দিনে। সেদিন অভীক একটু অর্ককে দেখে রাখবে। আর বাকি দিনটা পৃথুলের কাছে রেখে আসবে।

লিফট বেয়ে উঠতেই ও অবাক হয়ে খেয়াল করে দরজা হালকা করে খোলা। বুকটা ধক করে ওঠে, চোর ঢুকল না তো!

ওদের পায়ের আওয়াজ পেয়ে অভীক গম্ভীরমুখে দরজা খুলে দাঁড়ায়, চোখে রাগী দৃষ্টি। কুঞ্জল একটু থতমত খেয়ে যায়, অস্ফুটে বলে, ‘তুমি কখন এসেছ?’

কথাটা বলেই হঠাৎ ওর মনে পড়ে যে ও তো অভীকের সাথে কথা বলে না।

অর্ক বাবার মুখ দেখে সংকুচিত হয়ে যায়, ক্ষীণ গলায় বলে, ‘বাবা, আমরা আম্মুর স্কুলে গিয়েছিলাম।’

ওরা ভেতরে ঢুকতেই অভীক ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘আম্মুর স্কুল মানে? তোমরা যে বাইরে যাচ্ছ, আমাকে একবার বলবে না?’

কুঞ্জল হাতের ব্যাগ নামিয়ে রাখতে যেতেই শাড়ির প্যাকেটের দিকে নজর যায়। অভীক শাড়ি এনেছে ওর জন্য?

ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে ও বলে, ‘অর্ক, তুমি হাতমুখ ধুয়ে ফেল। আমি নাস্তা বানাচ্ছি, বাবার সাথে খাবে।’

অভীকের মাথায় রাগটা বাড়ছিল। ও চাপা গলায় বলে, ‘আমি জিজ্ঞেস করেছি তোমরা কোথায় গিয়েছিলে, উত্তর দিচ্ছ না যে?’

অভীকের কর্তৃত্বের গলায় এমন জিজ্ঞাসা করাটা কুঞ্জলের মাথায় আগুন ধরিয়ে দেয়। ও কঠিন মুখে বলে, ‘তোমাকে সব বলে যেতে হবে?’

অভীক মুখচোখ শক্ত করে বলে, ‘অবশ্যই আমাকে বলে যেতে হবে।’

কুঞ্জল স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে, তারপর বলে, ‘তুমি ভুল ভাবনায় আছ। তোমাকে জানিয়ে যাবার দিন ফুরিয়েছে। তারপরও যেহেতু জানতে চেয়েছে বলছি। আমি একটা কালিনারি ইন্সটিটিউটে শেফ কোর্সে ভর্তি হয়েছি। এক বছরের কোর্স। সপ্তাহে দু’দিন। বিকেল তিনটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত। শুক্রবার আর মঙ্গলবার। শুক্রবার দিন বাবু তোমার কাছে থাকবে আর মঙ্গলবার আমি পৃথুলের কাছে রেখে যাব।’

কোথাও একটা ভূমিকম্প হলেও অভীক বুঝি এত অবাক হতো না। ও অবিশ্বাস নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর চোখমুখ কুঁচকে বলে, ‘কিসে ভর্তি হয়েছ? বাবুর্চি হবার জন্য? মানে ওই ছেলেমানুষদের সাথে হোটেলে রান্না করবে? নষ্টামি করতে সুবিধা হয়, তাই না?’

কুঞ্জলের গায়ে যেন কেউ বিছুটি পোকা ছেড়ে দেয়। নিজেকে আর সামলাতে পারে না, চিৎকার করে বলে, ‘একটা বাজে কথা বলবা না। নিজে নষ্ট মানুষ তাই সবাইকে নষ্ট মনে করো। আমি রান্না ভালোবাসি, তাই সেটা ভালো করে শিখতেই গিয়েছি। এতে অন্যায়টা কী?’

অভীক সত্যিই কোনো কারণ খুঁজে পায় না। তবুও ও গোঁয়ারের মতো বলে, ‘এইসব শেখার কী দরকার? তুমি কি হোটেলের শেফের চাকরি করবে?’

কুঞ্জল লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, আমি এই কোর্স শেষ করে সুযোগ পেলে তাই করব। শেফ পেশায় আমার ক্যারিয়ার করব।’

অভীক মুখ ভেংচে বলে, ‘ভদ্র বাড়ির মেয়েরা এমন হোটেলের বাবুর্চি হয় না।’

কুঞ্জল তীক্ষ্ণ গলায় বলে, ‘আর ভদ্র বাড়ির ছেলেরাও বউ রেখে পরনারীদের সংগে প্রেম করে না।’

অভীক রাগে দাঁত কিড়মিড় করে বলে, ‘কথা অন্য দিকে নিয়ে যাবে না। ঐটা আমার অতীত৷ আমি এখন ভালো হয়ে গেছি। তাই তুমি এসব কাজ করতে পারবে না।’

কুঞ্জল এক পা সামনে এগোয়, ‘আমি করবই, পারলে তুমি ঠেকিও।’

অভীক আগুন চোখে তাকিয়ে থাকে। কুঞ্জল ঘুরে রান্নাঘরের দিকে এগোয়। শব্দ করে হাড়িপাতিল বের করে। তারপর নুডলস বের করে। গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে হাড়িতে পানি গরম দেয়। এক দৃষ্টিতে ও দাউ দাউ করে জ্বলা আগুনের শিখার দিকে তাকিয়ে থাকে। ইচ্ছে করছে সব পুড়িয়ে দিতে।

অর্ক চুপ করে ওর রুমে বই খুলে বসে আছে৷ যদিও ওর এখন তেমন পড়ার চাপ নেই। কিন্তু ও বইয়ের পাতার দিকে তাকিয়ে থাকে। বাবা কেন আম্মুকে এত বকাঝকা করে? আম্মু স্কুলে পড়লে কী হয়? ওর ছোট্ট মনে এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পায় না। তবে একটা জিনিস বোঝে বাবা আর আম্মুর মাঝে অনেক ঝগড়া। যদি ও হ্যারি পটারের মতো জাদু জানত, তাহলে এক লহমায় সব ঝগড়া ঠিক করে দিত।

সে রাতে আরেকটা রাত আসে প্রেমহীন সংসারে। একই ছাদের নিচে দুটো আলাদা ঘরে দুটো মানুষ একসাথে না হতে পারার যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে। আর লিভিংরুমে সবুজের উপর লালচে গোলাপি পাড়ের নববর্ষের শাড়িটা অনাদরে, অবহেলায় পড়ে থাকে। ওদের জীবনে নতুন ঝলমলে নববর্ষ কি আর আসবে?

২.
অভীক আজ ক’দিন ধরেই একটা কথা ভাবছে। কুঞ্জল ইদানিং এমন এমন সব কাজ করছে যা আগে কখনও করত না। এই যে ম্যারাথন দৌড়োনোর ব্যাপারটা। এটা ও আগে কখনও করেনি। ওর মতো একজন হাউসওয়াইফ যে এটা করতে পারে সেটা মাথায়ই আসেনি। সেটা না হয় ওই তুহিন ছেলেটার পাল্লায় পড়ে দৌড়ুল। কিন্তু এই যে এখন বাবুর্চি হতে চাচ্ছে সেটা কার বুদ্ধিতে? তাও একেবারে একবছরের কোর্সে ভর্তি হয়েছে? আর এসব কোর্সে তো অনেক টাকা লাগে। এত টাকা ও কই পেল? ওর কাছেও তো চায়নি। ওর মা বাবা দিয়েছে? কিন্তু ওনাদের অবস্থা তো ভালো না, ছেলের সংগে থাকেন। বিয়ের পর ওদের বাড়ি থেকে ইদ ছাড়া তেমন কিছু কখনোই দেয়নি। ওরা টাকা দেবার কথা না। তাহলে?

হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই অভীক থমকে যায়। আচ্ছা, কুঞ্জল কারও সাথে প্রেম করছে না তো? সেই হয়তো ওকে উস্কাচ্ছে ঘর ছাড়তে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে। কথাটা মনে হতেই একটা রাগ টের পায় অভীক। সেইসাথে একটা হীনমন্যতা। ওর কুঞ্জল অন্য কাউকে পছন্দ করে এই ভাবনাটা ও নিতেই পারছে না।

সন্দেহটা ধীরে ধীরে দানা বাঁধতে থাকে। যদি কেউ থেকেই থাকে তবে তার সাথে বেশিদিন পরিচয় না। কী মনে হতে ও কুঞ্জলের ফেসবুক পেজে ঢোকে। আচ্ছা দেখা যাক ওর নতুন বন্ধু কারা। ফ্রেন্ড লিস্ট ক্লিক করতেই দেখে সেটা লক করা। ভ্রু কুঁচকে একটু ভাবে। তারপর ওর ফেসবুকের নতুন পোস্টগুলো একটা একটা করে দেখে। কারা লাইক দিয়েছে, কারা কমেন্ট করেছে তাদের সবার প্রোফাইল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। বেশিরভাগই অর্কের বন্ধুদের মায়েরা অথবা ওর স্কুল ফ্রেন্ড যাদের ও চেনে। অপরিচিত অনেকে আছে, কিন্তু তাদের মধ্যে সন্দেহ করার মতো তেমন কিছু খুঁজে পায় না।

দেখতে দেখতে ও কুঞ্জলের ম্যারাথন দৌড়ে ট্রফি হাতে ছবিটায় আসে। এটাতে আরও কয়েকটা ছবি আছে, ও আর অর্কের মেডেল পরা ছবি। কুঞ্জল দৌড়াচ্ছে তার ছবি। এটাতে সবচেয়ে বেশি লাইক, কমেন্ট পড়েছে। অভীক এবার সময় নিয়ে প্রতিটা কমেন্ট পড়ে। যাদের চেনে না তাদের প্রোফাইল খুলে খুলে দেখে। এমনই একটা অপরিচিত প্রোফাইলে ক্লিক করতেই ও থমকে যায়। বিড়বিড় করে পড়ে, অংশুল, হেড শেফ, ইনকা রেস্তোরাঁ। ভ্রু কুঁচকে ও কিছুক্ষণ প্রোফাইলটার দিকে তাকিয়ে থাকে। এখন পর্যন্ত কুঞ্জলের বন্ধু লিস্টে শেফ কেউ ছিল না। এটাই প্রথম। আচ্ছা এই লোকটা ওকে রান্নার ইন্সটিটিউটে ভর্তি হতে উৎসাহ জোগায়নি তো?

কথাটা মনে হতেই ও লোকটার প্রোফাইল স্ক্রল করতে থাকে। একটা ছবিতে লোকটার মাথায় শেফের সেই বিখ্যাত টুপিটা নেই। এই ছবিটার দিকে ও অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। এই মুখটা ও কোথাও দেখেছে। কিন্তু এই মুহুর্তে ঠিক মনে পড়ছে না। তবে দেখেছে এটা নিশ্চিত।

অভীক চিন্তিত মুখে স্ক্রল করতে থাকে। বেশিরভাগ পোস্টই রান্না সংক্রান্ত। লোকটার অনেক ফ্যান ফলোয়ার, বোঝায় যাচ্ছে নাম করা শেফ। আর ইনকা রেস্তোরাঁতে ও নিজেও অনেকবার খেয়েছে। মেঘাকে নিয়েও এক দু’বার যাওয়া হয়েছে।

ও স্ক্রল করে আরেকটু নিচে নামতেই হঠাৎ একটা পোস্টে ওর চোখ আটকে যায়। একটা ম্যারাথন দৌড়ের পোস্ট। একসাথে অনেকজন প্রতিযোগীদের ছবি। ও চোখ কুঁচকে পোস্টটা জুম করে, সবার গায়ে একই গেঞ্জি। গেঞ্জির উপর বড়ো করে লেখা ‘গ্রিণ ঢাকা ম্যারাথন’।

অভীক একটু ভাবতেই বিদ্যুৎ চমকের মতো ওর একটা কথা মনে হয়। তারপর দ্রুত ও কুঞ্জলের ফেসবুক প্রোফাইলে ঢোকে। দ্রুত স্ক্রল করে ওর সেই দৌড়ের পোস্টে যায়। হ্যাঁ, একদম যা ভেবেছিল তাই। কুঞ্জলও সেদিন এই গেঞ্জিটাই পরে দৌড়েছিল। ওর গেঞ্জিতেও ‘গ্রিণ ঢাকা ম্যারাথন’ লেখা। পোস্ট দুটো একই তারিখে করা। পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে এই শেফ অংশুল ওইদিন ম্যারাথনে উপস্থিত ছিল! তারমানে এই লোকের সাথে কুঞ্জলের আগে থেকেই ঠিক করা ছিল ম্যারাথনে দেখা করার?

কথাটা ভাবতেই ওর মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে। ও দ্রুত লোকটার আরও কিছু ছবি বের করে দেখে। একটা ছবি দেখে ওর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার মতো অবস্থা হয়। লোকটা একটা মোটরসাইকেলে বসে আছে, তার ছবি। এবার লোকটাকে ও চিনতে পারে। সেদিন কুঞ্জল একজনের মোটরসাইকেলে করে ফিরেছিল। ও জানালা দিয়ে লোকটার মুখ স্পষ্ট দেখেছিল। ওরা কেমন হাসিমুখে কথা বলছিল সেদিন। অথচ কুঞ্জল বলেছিল পাঠাও কোম্পানির মোটরসাইকেলে করে ও বাড়ি ফিরেছিল। কুঞ্জল মিথ্যে বলেছে ওর সাথে!? ওর সাথে প্রতারণা করেছে? ওই অংশুল লোকটার সাথে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করছে? আর লোকটার বুদ্ধিতেই বুঝি শেফ কোর্সে ভর্তি হয়েছে। এবার ও একে একে সব মেলাতে পারছে। কেন কুঞ্জল হঠাৎ করেই শেফ কোর্সে ভর্তি হলো। নিজের ছেলেকে অন্যের বাসায় রেখে ক্লাশ করতে যাচ্ছে। ও কঠিনভাবে নিষেধ করা সত্বেও সেটা করেই যাচ্ছে। সব ওই লোকটার জন্য। তাহলে শেষ পর্যন্ত ওর সন্দেহটাই ঠিক। কুঞ্জল অন্য কাউকে ভালোবাসে। এজন্যই তো এতবার ক্ষমা চাইবার পরেও ওর মন গলেনি। ওর সাথে ঘুমায় না, আদর করে না। আচ্ছা কুঞ্জল কি ওই লোকের সাথে……..। নাহ, এত নিচে ও নামবে না নিশ্চয়ই।

অভীক বুকের ভেতর কেমন একটা হাহাকার টের পায়। পা দূর্বল হয়ে আসে। ও নিজে ভুল করেছে, সেজন্য নিজের কাছেই লজ্জিত। কিন্তু কুঞ্জল যে কখনও এমন কিছু করতে পারে এটা ওর ধারণাতেই ছিল না। বিশ্বাস ভাঙার একটা তীব্র কষ্ট ও টের পায়। এতদিন এই কষ্টের সাথে ওর পরিচয় ছিল না। আজ মনে হচ্ছে এই পৃথিবীতে ও শুন্য। ওর কেউ নেই।

অভীক মন শক্ত করে। ও কিছুতেই ছেড়ে দেবে না। কুঞ্জল ওর বেলায় যা করেছে ও তাই করবে। এই বদমাশ লোকের রেস্তোরাঁয় যেয়ে ওর গলা চেপে ধরবে কেন ওর কুঞ্জলের সাথে ও প্রেম প্রেম খেলা খেলছে। বেটাকে কঠিন একটা শিক্ষা দিতে হবে যাতে আর কোনোদিন কুঞ্জলের পেছন না ঘোরে। প্রয়োজনে এই লোকটার বাসায়ও জানাবে ও। আগুন যখন লেগেছে তখন ভালো করেই লাগুক। সব পুড়ে ছাই হয়ে যাক।

(চলবে)

প্রেমহীন সংসার আহা সোনামুখী সুঁই পর্ব-১২

0

#প্রেমহীন_সংসার_আহা_সোনামুখী_সুঁই (১২)

১.
কুঞ্জল অর্কের একটা বাংলা রুল টানা খাতায় হিসেব লিখছিল –

দু’রুমের একটা বাসা – পনের হাজার টাকা
খাওয়া খরচ (২জন) – সাত হাজার টাকা
স্কুল টিউশন – পনেরশ টাকা
জামা কাপড় – দু’হাজার টাকা
যাতায়াত – তিন হাজার টাকা
অন্যান্য – দুই হাজার টাকা

মোট – ত্রিশ হাজার পাঁচশ টাকা।

লেখাটার দিকে ও তাকিয়ে থাকে। ও যদি অর্ককে নিয়ে আলাদা বাসা নেয় তাহলে খরচের অংকটা যে এত বেশি হবে ও ভাবতেই পারেনি। একটা অবিশ্বাস নিয়ে যোগ করার পর মোট টাকার ঘরটায় স্থির চোখে তাকায়। তারপর হঠাৎ করেই মনে হয় এটা আরও বাড়বে। যদি ও বা অর্ক কেউ অসুস্থ হয়? অর্কের যদি প্রাইভেট পড়তে হয়? যত উঁচু ক্লাশে উঠবে ততই তো খরচ। তখন? কথাটা ভাবতেই ও দিশেহারা বোধ করে। এই ক’টা দিন ও আশেপাশের কয়েকটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে কথা বলেছে। দশ থেকে পনের হাজারের বেশি বেতন দেয় না এরা। আর এই বয়সে হুট করেই কোথাও চাকরি হবার না। ও তো সাধারণ বিষয়ে মাস্টার্স করা। এতে কোথাও চাকরি হবার না। আর অনলাইনে রান্নার অর্ডার নিয়ে, তারপর বাজার করে সেগুলো রেডি করা ওর একার পক্ষে সম্ভব না। আর যদি কষ্ট করে করেও কিন্তু অর্ডার যে পাবে তার খুব একটা নিশ্চয়তা নেই। কত কত রান্নার পেজ যে আছে, তার ভীড়ে ও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে কী করে?

আরেকটা ব্যাপার মনে হতেই ও আরও পিছিয়ে যায়। ও যদি চাকরি করে তাহলে অর্ককে কে দেখবে?

পুরো ব্যপারটার একটা সমাধান অবশ্য আছে। ও যদি বাবা মায়ের ওখানে যেয়ে থাকে তাহলে ওর বাসা ভাড়া বাবদ মোটা অংকের টাকা লাগবে না, আবার অর্ককে দেখে রাখার বিষয়টাও সমাধান হবে। বাসায় এখনও অভীকের সাথে ওর টানাপোড়েনের কথা জানায়নি। এবার যে জানাতেই হয়। দেয়ালে ওর পিঠ ঠেকে গেছে। অভীক সেদিন গায়ে হাত তোলার পর যদিও অনেকবার ক্ষমা চেয়েছে কিন্তু অভীকের ভয়টা ভেঙে গেছে। এখন ছুতো পেলেই গায়ে হাত তুলবে, আর পরে ক্ষমা চেয়ে নেবে। এভাবে যে চলতে দিতে পারে না ও। আজই মায়ের বাসায় যাবে। এবার সব খুলে বলার সময় হয়েছে।

সেদিন অর্ক স্কুল থেকে ফিরতেই ও ব্যাগ গুছিয়ে ফেলে। অর্ক যখন শোনে ও নানুর বাড়ি যাবে তখন ও আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, ‘ইশ, কতদিন নানুর কাছে যাই না। আম্মু, আজই যাব?’

কুঞ্জল একটু হেসে বলে, ‘হ্যাঁ বাবা। আজ রাতটা ওখানে থাকব।’

অর্কের মন খারাপ হয়ে যায়, ‘মোটে এক রাত?’

কুঞ্জল থমকে তাকায়, তারপর বলে, ‘যদি সবসময় থাকি আমরা, তখন থাকবি?’

অর্ক চোখ বড়ো বড়ো করে বলে, ‘সত্যিই আম্মু? তাহলে তো খুব মজা হবে।’

কুঞ্জল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে, বাচ্চাদের পৃথিবীটা কত সুন্দর, নির্ঝঞ্ঝাট। ওর ছোট্ট মনে একবারও নানুর বাড়ি সবসময় থাকার ব্যাপারটা নিয়ে খটকা লাগেনি।

কুঞ্জল এবার দ্রুত হাতে রাতের রান্না করে। রান্না শেষে অর্ককে নিয়ে খেতে বসে। তারপর রাতের খাবারগুলো ফ্রিজে ঢোকায়। আর অভীককে একটা মেসেজ লিখে, ‘আমরা অর্কের নানু বাড়ি গেলাম। কাল আসব।’

মেসেজ পাঠানোর এক মিনিটের মাথায় অভীকের ফোন আসে। ধরবে না ভেবেও ফোনটা ধরে। ওপাশ থেকে অভীকের অধৈর্য গলা শোনা যায়, ‘তুমি হঠাৎ করে মায়ের বাড়ি যাচ্ছ, কেন?’

কুঞ্জল গম্ভীরমুখে বলে, ‘কেন, যেতে মানা আছে নাকি? আমি কাল সকালে আসব।’

বলেই ফোনটা রেখে দেয়। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আরও ক’বার ফোন আসে, ও ধরে না। অযথা কথা বলা।

অর্কের নানু বাড়িটা কাছেই। সিএনজি করে যেতে খুব একটা সময় লাগে না। এত কাছে বাসা তাও মাসে একবার আসা হয় না। তার পেছনে অবশ্য কারণও আছে। মা বাবা বড়ো ভাই সেলিমের সাথে থাকে। আর মায়ের সাথে ভাবির প্রায়ই ঝগড়া হয়। কুঞ্জল মাঝে ভাবিকে এক দু’বার বলতে গিয়ে উল্টো কথা শুনেছে। তাই যতটা কম পারা যায় এখানে আসে।

সুলতানা আসরের নামাজ পড়ে সবে সালাম ফিরিয়েছেন। এমন সময় কলিংবেল বেজে ওঠে। তুতুলকে ডাকতে যেয়ে হঠাৎ করেই মনে হয় তুতুল তো বাবা মায়ের সাথে কোথায় যেন দাওয়াত খেতে গেছে। বউটা এমন নচ্ছার হয়েছে যে কিছু বলে যাবার প্রয়োজনবোধ করে না। আর সেলিমও হয়েছে একেবারে বউ ন্যাওটা। বউ উঠতে বসলে উঠবে, বসতে বললে বসবে। একমাত্র নাতনি তুতুলটা ভালো হয়েছে। যাবার সময় ওর গলা ধরে আদর করে গেল, আর ফিসফিস করে বলে গেছে ওরা আসলে দাওয়াত না শপিংয়ে যাচ্ছে। ক’দিন পর কক্সবাজার নাকি ঘুরতে যাবে তার জন্য কেনাকাটা করতে। তা যাক, কিন্তু ওকে সেটা না বলার কী আছে?

ভাবতে ভাবতে এবার গলা বাড়িয়ে বলেন, ‘এই তুমি কই, দরজাটা খোল। দেখো তো কে আসল?’

বাথরুম থেকে হাজী মোহাম্মদ মোস্তাফিজের একটা গলাখাঁকারির আওয়াজ পাওয়া যায়।

তারপর ক্ষীণ গলায় বলে, ‘আমি বাথরুমে।’

সুলতানা গজগজ করে ওঠেন, ‘একটু পর পর বাথরুমে যেতে হয়। ডায়াবেটিস পরীক্ষা করতে বলি, তা করবে না।’

সুলতানা গায়ের চাদরটা জড়িয়ে নিয়ে দরজার কাছে যায়। খুলতে যেয়ে থমকে যান। বউমা পইপই করে সাবধান করেছে কি-হোল দিয়ে না দেখে দরজা যেন না খোলে। সুলতানা কি-হোলে চোখ রাখেন। খালি চোখে অতটা পরিস্কার বোঝা যায় না। কিন্তু একটা সময় চেহারার অবয়ব একটু পরিস্কার হতেই বুক ধক করে উঠে, কুঞ্জল!

দ্রুত হাতে দরজার ছিটকিনি খুলে অবাক গলায় বলেন, ‘তুই! আরে আমার অর্ক সোনাও এসেছে।’

অর্ক চিৎকার করে বলে, ‘নানুউ!’

সুলতানা এগিয়ে গিয়ে অর্কের হাত ধরেন। তারপর টেনে ভেতরে নিয়ে যান।

কুঞ্জল ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে, ‘তোমরা তো একটা খবর নাও না, বেঁচে আছি না মরে গেছি।’

সুলতানা মনে মনে শংকিত হয়, মেয়ের মেজাজ ঠিক নেই। জামাইয়ের সাথে কিছু হলো?

ব্যাপারটা বুঝতে হালকা গলায় জিজ্ঞেস করেন, ‘তুইও তো ফোন দিস না। খুব ভালো করেছিস এসে। তা অভীক বুঝি রাতে আসবে তোদের নিতে?’

কুঞ্জল সোফায় বসতে বসতে বলে, ‘কেন? তোমার এখানে বুঝি একটা রাত থাকা যাবে না? আমি বুঝি না, এটা তো বাবার নিজের পয়সায় কেনা বাসা। কিন্তু তোমাদের দেখলে মনে হয় তুমি তোমার ছেলের বাসায় ভাড়া থাকো।’

ঠিক এসময় মোস্তাফিজ ড্রয়িংরুমে ঢোকেন। আনন্দিত গলায় বলেন, ‘কুঞ্জল মা এসেছিস। আমার নানাভাই এসেছে। ও নাকি এবার দৌড়ে ফার্স্ট হয়েছে?’

অর্ক উৎসাহের গলায় বলে, ‘নানা, আম্মুও দৌড়ে সেকেন্ড হয়েছে।’

মোস্তাফিজ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই কুঞ্জল চোখ পাকিয়ে অর্ককে থামায়। তারপর হাসিমুখে বলে, ‘বাবা, তোমার শরীর ভালো তো? ডায়াবেটিসটা চেক করাও তো নিয়মিত?’

সুলতানা ফোড়ন কাটে, ‘সেটা করাবে না, উলটো চুপিচুপি মিষ্টি খাবে। আচ্ছা তোরা বোস, আমি নানুভাইকে নাস্তা দেই। ওরা সবাই বাইরে গেছে, ফিরতে রাত হবে।’

কুঞ্জল মায়ের পেছন পেছন যায়। তারপর নিজেই ফ্রিজ খুলে দেখে কি কি আছে। একটা মিষ্টির প্যাকেট থেকে মিষ্টি মুখে পুরে অস্পষ্ট গলায় বলে, ‘মা, তোমার সাথে আমার কথা আছে। ভালো হয়েছে যে ভাইয়া ভাবি বাসায় নেই।’

সুলতানা মনে মনে প্রমাদ গোনেন। লক্ষণ সুবিধার মনে হচ্ছে না। দ্রুত কয়েকটা মিষ্টি আর কেক বের করে অর্ককে খেতে দেন। তার আগে অবশ্য কটমট করে মোস্তাফিজের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘তুমি কিন্তু একটা মিষ্টিও খাবে না।’

তারপর বেডরুমে আসতেই দেখেন কুঞ্জল জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। পায়ে পায়ে মেয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ান। আলতো করে কাঁধে হাত রাখতেই ও চমকে ওঠে, ফিরে তাকিয়ে বলে, ‘মা, এই বাসা তো এখনও বাবার নামে। তোমাদের চারটা রুমের মধ্যে একটা রুমে আমাকে থাকতে দেবে?’

সুলতানা ভ্রু কুঁচকে বলেন, ‘এটা কেমন কথা। তুই বেড়াতে এসেছিস, তোর মতো আরাম করে থাকবি। কে কি বলবে তোকে।’

কুঞ্জল অস্ফুটে বলে, ‘বেড়াতে না, আমি সারাজীবনের জন্য থাকতে চাই মা। অভীকের সাথে আমার সম্পর্কটা ঠিকঠাক যাচ্ছে না। ওর কিছু ব্যাপার আমি তোমাদের বলিনি। কিন্তু আমি আর পারছি না মা। দেবে আমাকে থাকতে?’

সুলতানার বুক কেঁপে ওঠে। নিজের সন্তান, একদিন এই বাসাতেই কত আদরে মানুষ হয়েছে আজ সেই বাসার একটা রুমে থাকার জন্য কী আকুল করে হাত পেতেছে! কষ্টে বুকের ভেতর দুমড়েমুচড়ে যায়। সন্তানের এমন অসহায় বাড়ানো হাত যে ভীষণ কষ্টের।

এক লহমায় মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন, আকুল গলায় বলেন, ‘কী হয়েছে মা? অমন করে কেন বলছিস?’

কুঞ্জল কাঁদে। আজ বহুদিন পর একটা আশ্রয় খুঁজে পেয়ে ও অনেক কাঁদে। জমাট বেঁধে থাকা সব কষ্টরা আজ বরফ গলা নদীর মতো মুক্তির পথ খুঁজে পায়।

সুলতানা মেয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন, ‘আমাকে সব খুলে বল।’

কুঞ্জল সব খুলে বলে। সুলতানা শোনেন, নির্বাক তাকিয়ে থাকেন। তারপর একটা সময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘তুই ফিরে যা। ছেলেমানুষের এমন একটু আধটু দোষ থাকে। ও তো আরেকটা বিয়ে করে ফেলেনি বা করতেও চায়নি। ছেলেদের এটুকু দোষ থাকে সেটা শক্ত হাতে তোকে ঠিক করে নিতে হবে। তুই চোখে চোখে রাখবি ওকে। আর নিজেও একটু সেজেগুজে থাকবি। মা রে, মেয়েদের এমন কত কিছু করে সংসার টিকিয়ে রাখতে হয়।’

মায়ের কথা শুনে কুঞ্জলের মাথায় আগুন ধরে যায়, অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, ‘তা তুমি কি কি করেছ এমন? নিজেকে তো কখনও এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি তাই অমন বলছ। আমার মতো এমন পরিস্থিতিতে পড়লে বুঝতে কত অপমান এই বেঁচে থাকাতে।’

সুলতানা বিষণ্ণ হাসি হাসেন, তারপর বলেন, ‘সন্তানকে তার পিতার সম্পর্কে খারাপ কিছু বলতে নেই, লুকিয়ে রাখতে হয়। এটুকুই শুধু বললাম।’

কুঞ্জল হতভম্ব হয়ে চেয়ে থাকে। তার মানে বাবাও মাকে কষ্ট দিয়েছে! কথাটা বিশ্বাস হতে চায় না।

সুলতানা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, ‘আমি জানি এই অপমানের কষ্টটা। কিন্তু কী করবি বল? আমরা বুড়ো হয়েছি, তোর ভাইয়ের সংসারে থাকি। তোর বাবার জমানো সব টাকা গেছে এই বাড়ি করতে। এখন ছেলে না দেখলে যে না খেয়ে মরতে হবে। তাই এই বাসায় তোকে রাখার অধিকার কিংবা সামর্থ্য কোনোটাই নেই আমাদের।’

সত্যটা নিদারুণ। চোখ জ্বালা করে উঠে কুঞ্জলের। কোথাও এতটুকু ভরসার জায়গা নেই। নিজের বেড়ে উঠা বাড়িটাতে আজ ও অনাহুত। এই পৃথিবী বুঝি ওকে হারিয়ে দেবার সব ষড়যন্ত্র করে বসে আছে।

২.
অংশুল নিপুণ নামের নতুন কমি শেফের দিকে তাকিয়ে আছে। নিপুণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে, চোখে জল নিয়ে বলছে চাকরি ছেড়ে দেবে। মেয়েটা খুব বেশিদিন হয়নি চাকরিতে যোগ দিয়েছে। এরই মধ্যে খুব ভালোও করেছে। ও খেয়াল করে দেখেছে মেয়েরা রান্নার সেন্সটা বেশ ভালো বুঝতে পারে। কিন্তু একটাই সমস্যা, এরা এই পেশায় খুব বেশিদিন ক্যারিয়ার ধরে রাখতে পারে না। হয় স্বামী না হয় সন্তানের জন্য একটা সময় ছেড়ে দিতেই হয়। আর সামাজিক মর্যাদাও একটা বড়ো ব্যাপার। অথচ পাশ্চাত্যে একজন ভালো শেফ একজন সেলিব্রেটির মতোই।

অংশুল আফসোসের গলায় বলে, ‘তুমি তো খুব ভালো করছিলে। একটা বছর কষ্ট করে কাজটা করলে অনেক কিছু শিখতে। এই লাইনে অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারতে।’

নিপুণ ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে, ‘স্যার, আমার বাসা থেকে এই কাজটা করতে দিতে চাচ্ছে না। কিন্তু আমি সত্যিই একজন মাস্টার শেফ হতে চেয়েছিলাম।’

অংশুলের মন খারাপ হয়ে যায়। আশ্বস্ত করে বলে, ‘তুমি মন খারাপ কোরো না। আপাতত বাসায় যাও। কিছুদিন সময় নাও। তোমার ইচ্ছের কথাটা বুঝিয়ে বলো। হয়তো ওনারা রাজি হতেও পারে। আর না হলেও কিছু যায় আসে না। তুমি অনলাইনেও শিখতে পারো। এখন অনলাইনেও অনেক কোর্স করা যায়।’

নিপুণ ঠোঁট কামড়ে কান্না সামলায়, তারপর আশা নিয়ে বলে, ‘আমি যদি বাসায় রাজি করাতে পারি তবে আপনি আমাকে আবার সুযোগ দেবেন?’

অংশুল মাথা নেড়ে বলে, ‘অবশ্যই। তুমি একটুও ভেব না।’

এবার নিপুণের মুখে হাসি ফোটে। ও ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নেয়।

অংশুল ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াতেই ফোন আসে। স্ক্রিনে ভেসে উঠা নামটা দেখেই মন ভালো হয়ে যায়, ‘কুঞ্জল, আপনি? এতদিন কোন খোঁজ নেই?’

কুঞ্জল একটু লজ্জাই পায়। সেদিনের পর ইচ্ছে করেই যোগাযোগ কমিয়েছিল। আজ দরকারেই ফোন দিয়েছে।

কুঞ্জল কৈফিয়ত দেবার গলায় বলে, ‘একটু ব্যস্ত ছিলাম। আপনি আজ আছেন? একটু আসতাম অথবা কোথাও একটু বসতাম।’

অংশুলের বুকের ভেতর একটা কিছু হয়। মনে চঞ্চলতা টের পায়। ও দ্রুত বলে, ‘এখানেই চলে আসুন, সমস্যা নেই। আজ আমার হাতে কাজ কম আছে।’

কুঞ্জল খুশি হয়। অংশুল যে আলাদা কোথাও বসতে চায়নি তাতে ওর প্রতি বিশ্বাসটা বাড়ে। যাক, অংশুল ওকে নিয়ে উল্টোপাল্টা ভাবছে না।

আধা ঘন্টা লাগে কুঞ্জলের। শীত শেষে গরম পড়তে শুরু করেছে। এটুকু পথ আসতে গিয়েই ও ঘেমে গেছে। ইনকা রেস্তোরাঁর ভেতর ঢুকতেই অবশ্য এসির ঠান্ডা বাতাসে শরীর জুড়িয়ে যায়। মানুষের মনের জ্বালা জুড়োনোর এমন কোনো যন্ত্র থাকত, তবে খুব ভালো হতো, ভাবে কুঞ্জল।

ওকে দেখে হাসিমুখে অংশুল এগিয়ে আসে। হাতে সুদৃশ্য দুটো বাহারি কাচের গ্লাসে হালকা সবুজ রঙের ড্রিংক্স, তাতে লেবুর পাতলা স্লাইস ভাসছে। দেখেই পিপাসা বাড়ে।

‘আগে এটা খেয়ে নিন, তারপর কথা শুনব’, অংশুল একটা গ্লাস বাড়িয়ে দেয়।

কুঞ্জল চুমুক দিতে দিতে বলে, ‘আপনি ভালো আছেন তো?’

অংশুল মাথা নাড়ে, ‘আছি, আমার মতো করে। আপনার কী খবর? অনেকদিন রান্নার ভিডিও দেননি যে।’

কুঞ্জল বিষণ্ণ হাসে, তারপর বলে, ‘আসলে একটু ঝামেলায় ছিলাম।’

অংশুল কিছু বোঝার চেষ্টা করে। কুঞ্জল ভালো নেই, নিশ্চয়ই কোনো বিপদে পড়েই ওর কাছে এসেছে। নাহ, মেয়েটাকে সময় দিতে হবে। নিশ্চয়ই নিজে থেকেই বলবে।

খাওয়া শেষে গ্লাস নামিয়ে রেখে টিস্যুতে মুখ মোছে, তারপর আচমকা জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা, আপনাদের এখানে শেফদের বেতন কেমন? পার্টটাইম কাজ করলে? মানে বিকেল তিনটে থেকে রাত দশটা?’

অংশুল ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘কেন বলুন তো? কার জন্য? আপনার পরিচিত কেউ?’

কুঞ্জল মাথা নিচু করে বলে, ‘আমার জন্য।’

অংশুল একটু চমকে ওঠে। কী অসহায় দেখাচ্ছে মুখটা। ও উদবিগ্ন গলায় বলে, ‘আপনার হাসব্যান্ডের কিছু হয়েছে? মানে ওনার চাকরির সমস্যা?’

কুঞ্জল ম্লান হাসে, ‘না, সেসব কিছু না। আমি নিজে কিছু একটা করব, তাই ভাবছিলাম। তেমন কিছু তো পারি না, রান্নাটা একটু বুঝি। তাই ভাবলাম আপনি যদি একটা সুযোগ করে দেন, তাহলে হয়তো নিজের পায়ে একটু দাঁড়াতে পারতাম।’

অংশুল চেয়ে থাকে, কোথাও একটা বেদনার সুর টের পায়। সুরটা ভীষণ চেনা। কুঞ্জলের ব্যক্তিগত সমস্যাটা হয়তো আরও বেড়েছে। তাই বুঝি মুক্তির পথ খুঁজে পেতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাচ্ছে।

ও সামনের দিকে ঝুঁকে বলে, ‘হ্যাঁ, তেমন একটা চাকরি আপনি পেতেই পারেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে খুব বেশিদূর আপনি এগোতে পারবেন না। বেতনও খুব একটা বেশি হবে না। কম করে হলেও একটা একাডেমিক ডিপ্লোমা ডিগ্রি লাগে। আমি বলি কি আপনি ডিপ্লোমা ইন গ্লোবাল কালিনারি আর্টসের উপর একটা বছর পড়াশোনা করুন। তাতে করে ভালো স্যালারিতে জয়েন করতে পারবেন। আপনার কি খুব বেশি তাড়া আছে?’

কুঞ্জল একটু ভাবে, অংশুল ঠিক বলেছে। একটা ডিগ্রি না থাকলে ও খুব বেশি এগোতে পারবে না। ও জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘এক বছরে হবে? কখন ক্লাশ হয়?’

অংশুল আশ্বাস দিয়ে বলে, ‘আপনার সমস্যা হবে না। তিনটা শিফট আছে, সকাল ৭-১০ টা, অথবা ১১-৩টা, অথবা ৩-৭টা। অর্কের স্কুলের পরে এসে যদি করতে চান তাহলে আমি মনে করি ৩-৭ টা পর্যন্ত করতে পারেন। আর এটা সপ্তাহে মাত্র দু’দিন করতে হবে।’

কুঞ্জল আশান্বিত গলায় বলে, ‘তাই? তাহলে তো খুব সহজে আমি করতে পারব। কত টাকা লাগতে পারে?’

অংশুল একটু মনে করে বলে, ‘খুব বেশি না, দেড় লাখ টাকার মতো। কিন্তু এটার সার্টিফিকেটের ভ্যালু আছে। এই কোর্সের ক্রেডিট আপনি অস্ট্রেলিয়াতেও ট্রান্সফার করতে পারেন।’

কুঞ্জল ঢোঁক গিলে, ‘এত টাকা!’

অংশুল থমকায়। ও যতটুকু দেখেছে ওরা স্বচ্ছল। এই টাকাটুকু খুব বেশি হবার না। কিন্তু কুঞ্জলের গলা বলে দেয় টাকাটা অনেক। ও আশ্বস্ত করে বল, ‘একবারে দিতে হবে না। চার কিস্তিতে দেওয়া যাবে।’

কুঞ্জল মাথা নাড়ে, চার কিস্তি তো ব্যাপার না। কিন্তু টাকাটা পাবে কোথায় ও? ওর কাছে সব মিলিয়ে হাজার পঞ্চাশেক টাকা আছে। অভীকের কাছে চাইলে পাওয়া যাবে। কিন্তু ও কিছুতেই ওর কাছ থেকে টাকা নেবে না। তাহলে?

ভাবনাটা ভাবতেই ও হতাশ গলায় বলে, ‘আচ্ছা, আমি একটু ভেবে দেখি।’

অংশুল ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। কুঞ্জল টাকার কথা শুনে পিছিয়ে গেল? তার মানে ও হাসব্যান্ডের টাকা নিতে চায় না। ওদের স্বামী স্ত্রীর টানাপোড়েন বুঝি আরও বেড়েছে? নাহ, মেয়েটাকে সাহায্য করা উচিত। ও গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, ‘কুঞ্জল, আমি ঠিক বুঝতে পারছি আপনি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাচ্ছেন। আমি কি আপনার পাশে দাঁড়াতে পারি?’

কুঞ্জল স্থির চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘কেন আমি আপনার সাহায্য নেব?’

অংশুল একটু ভেবে বলে, ‘জীবনে এগিয়ে যেতে কারও না কারও সাহায্য নিতে হয়। আমি যে আজ এই পর্যায়ে এসেছি তার পেছনে অনেক শুভাকাঙ্খীর অবদান আছে। ধরে নিন আমি আপনার একজন শুভাকাঙ্খী।’

কুঞ্জল ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সেখানে সত্যিকারের একটা মায়ার ছায়া দেখতে পায়। এই মায়া ফিরিয়ে দেবার শক্তি নেই ওর। কিন্তু একটাই ভয়, মানুষকে সবকিছুর শোধ দিতে হয়। আর মায়ার ঋণ মায়া দিয়েই যে শোধ দিতে হয়।

(চলবে)

প্রেমহীন সংসার আহা সোনামুখী সুঁই পর্ব-১১

0

#প্রেমহীন_সংসার_আহা_সোনামুখী_সুঁই (১১)

১.
‘শুচিশুদ্ধ’ স্কুলের ফাইনাল খেলা চলছে। এখনই ক্লাশ ফোর আর ফাইভের বাচ্চাদের একশ মিটার দৌড় শুরু হবে। সবাইকে স্টার্টিং মার্কে সার বেঁধে দাঁড়াতে বলে। অর্ক একবার দর্শক সারির দিকে তাকায়। নাহ, আম্মু এখনও আসেনি। ওর ছোট্ট মুখটা মলিন হয়ে যায়। তারপর হাঁটু গেড়ে পজিশন নেয়। একজন শিক্ষক গলা ফুলিয়ে চিৎকার করেন, ‘রেডিইই, ওয়ান..’

অর্ক লম্বা করে একটা নিশ্বাস নেয়। আম্মু এটা শিখিয়েছিল। একবার ও আড়চোখে তাকায়। আর তখনই আম্মুকে দেখতে পায়। মুহুর্তেই ওর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আর ঠিক তখনই দৌড় শুরু করবার বাঁশি বেজে ওঠে।

অর্কের একটু দেরি হয় শুরু করতে, কিন্তু তারপর ও ছোটে, প্রাণপণে ছোটে। আম্মু এসেছে, আম্মু ওকে দেখছে দৌড়ুতে। একটা দুর্নিবার আনন্দে ও হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে দৌড়ুতে থাকে।
কুঞ্জল উত্তেজনায় ওর চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। হাতের মুঠো শক্ত হয়ে আছে। বুকের ভেতর নিশ্বাস চেপে ও ফিনিশিং লাইনের দিকে তাকিয়ে আছে। দেখতে পায় সাদা গেঞ্জি পরা, এক মাথা কালো চুল ছেলেটা সবার আগে ফিনিশিং লাইন পেরোল। কুঞ্জল স্থান-কাল ভুলে চিৎকার করে ওঠে, ‘অর্ক!’

পাশ থেকে অভীক ওর বাহু ধরে আনন্দের গলায় বলে, ‘হ্যাঁ, আমাদের অর্ক ফার্স্ট হয়েছে।’

কুঞ্জল হাতটা ছাড়িয়ে নেয়। তারপর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই পৃথুল অবাক হয়ে বলে, ‘তুই কখন এলি? অর্ক ফার্স্ট হয়েছে দেখেছিস!’

কুঞ্জল চোখের জল মোছে, তারপর ধরা গলায় বলে, ‘হ্যাঁ দেখেছি। তুই অনেক কষ্ট করলি।’

পৃথুল মুখ ভেংচে বলে, ‘আহা, কী কষ্টই না করলাম! আচ্ছা তোর দৌড় কেমন হলো? এমন সেজেগুজে দৌড়ুতে গেছিলি? মুখে এত মেকআপ দিয়েছিস কেন?’

কুঞ্জল বিষণ্ণ হাসি হাসে। আসার সময় ইচ্ছে করেই বেশি করে মুখে ফাউন্ডেশন দিয়েছে যাতে করে ওর মুখে চড়ের দাগটা দেখা না যায়। আর সেটা যে ও ভালোভাবেই লুকোতে পেরেছে তা পৃথুলকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ওর গালে চড়ের দাগটা টের পায়নি। ও দরজা বন্ধ করে রেডি হচ্ছিল দেখে অভীক ভয় পেয়ে দরজায় সে কী ধাক্কাধাক্কি। ভেঙেই ফেলে আর কী। ভয় পেয়েছিল, সুইসাইড করে ফেলে কি-না। না, কুঞ্জল মরবে না। ও আজ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, এই প্রেমহীন সংসার থেকে ও বেরিয়ে যাবে। অর্ককে নিয়েই ও বেঁচে থাকবে।

ভাবনার এই সময় অর্ক ছুটে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে, ‘আম্মুউউউ। আমি ফার্স্ট হয়েছি।’

কুঞ্জল শক্ত করে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে৷ পরম মমতায় ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়, চুলের ঘ্রাণ নেয়। জীবনে বেঁচে থাকার একমাত্র আনন্দ।

অভীক অপরাধীর মতো মুখ করে পাশে এসে দাঁড়াতেই অর্ক অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে, তারপর চিৎকার করে বলে, ‘বাবা, তুমিও এসেছ? আমার দৌড় দেখেছ বাবা?’

অর্ক গভীর আগ্রহ নিয়ে অভীকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। অভীক এবার কাছে এসে ছেলের হাত ধরে, ‘হ্যাঁ বাবা, দেখেছি তো। একদম উসাইন বোল্টের মতো দৌড়েছ। আজকে থেকে তোমার নাম অর্ক বোল্ট।’

অর্ক শুদ্ধ হাসি হাসে। ওর খুব ভয় করছিল। কাল বাবা আম্মুকে অনেক বকা দিয়েছিল। ভেবেছিল বাবা বুঝি আসবেই না। কিন্তু এখন সেই ভয়টা আর নেই। বাবা এসেছে, আম্মুও এসেছে। ওর নিজেকে এখন রাজা মনে হয়। অর্ক এবার এক হাতে মাকে ধরে। তারপর ওর ছোট দুইটা হাত দিয়ে বড়ো বড়ো দুইজন মানুষকে শক্ত করে ধরে থাকে।

অভীকের মন অনুতাপের আগুনে পুড়ে যাচ্ছে। এই যে সুখের সংসার, আজ শুধু ওর জন্যই ভাঙতে বসেছে। নিজের কুৎসিত চিন্তা কুঞ্জলের মতো মানুষকে সন্দেহ করতে বাধ্য করেছে। অথচ বেচারি অর্কের স্কুলে একটু আগে পৌঁছানোর জন্যই ‘পাঠাও’ এর মোটরসাইকেলে করে এসেছিল। কেন ও এমন করল? নিজের হাত কেটে ফেলতে ইচ্ছে করছে।

সেদিন অর্ক গলায় মেডেল পরে বাসায় ফেরে। কত কত কথা যে বলে আজ ছেলেটা। ওর খুশি দেখে কুঞ্জল সব কষ্ট ভুলে যায়। আহা, এত মায়া কেন সংসারে? আজ সকালেই যে সংসারকে বিষাক্ত মনে হয়েছিল এখন সেটাই এত মমতা নিয়ে হাজির হলো!

বাসায় ফিরে মনে পড়তেই অর্ক দৌড়ে মায়ের কাছে এসে বলে, ‘আম্মু, তুমি দৌড়ে কী হয়েছ, বললে না তো?’

কুঞ্জল কৃত্রিম মন খারাপ গলায় বলে, ‘আমি তোমার মতো ফার্স্ট হতে পারিনি বাবা। সেকেন্ড হয়েছি।’

অর্ক কাছে এসে ওর হাত ধরে সান্ত্বনার গলায় বলে, ‘মন খারাপ করো না আম্মু। তুমি এরপর আমার মতো প্রতিদিন দুটো করে ডিম খাবে। তাহলে তোমার অনেক শক্তি হবে। আর ফার্স্ট হবে। তুমি তো ডিমই খাও না।’

কুঞ্জলের বুকটা মুচড়ে ওঠে। আমার ছোট্ট অর্ক সোনা ঠিক খেয়াল করেছে ও যে ডিম খায় না। ওকে কাছে টেনে বলে, ‘আচ্ছা, আজ থেকে ঠিক খাব।’

অভীক চুপ করে বসে বসে সব শুনছিল। কুঞ্জল নিজের খাওয়া নিয়ে খুব অবহেলা করে। সংসারের সবার খাওয়া ঠিকঠাক রেখে ও নিজেরটাই ভুলে যায়। নাহ, এখন থেকে ও নিজে একটু খেয়াল রাখবে।

সেদিন বিকেলে আফরোজ আপু, তুহিন হইহই করতে করতে বাসায় ঢোকে। হাতে ফুল, মিষ্টি। তুহিন চিৎকার করে বলে, ‘আপু, প্রথমবারই তুমি সেকেন্ড হয়ে গেলে! কনগ্রাচুলেশনস। এই তোমার ট্রফি, সার্টিফিকেট আর তিন হাজার টাকার একটা প্রাইজমানি।’

অর্ক অবাক চোখে দেখে আম্মুর হাতে একটা ট্রফি। অভীক পায়ে পায়ে এগিয়ে আসতেই তুহিন প্রাঞ্জল গলায় বলে, ‘ভাইয়া, আপু তো ফাটিয়ে দিয়েছে। আপু যে এত ভালো দৌড়ুয়, জানতামই না। আপনি এরপর আপুর সাথে আসবেন। আপুকে আজ একা একা যেতে হলো।’

আফরোজা আপু এবার গম্ভীরমুখে বলেন, ‘হ্যাঁ ভাই, আপনি না গেলে বেচারি উৎসাহ পাবে কোথা থেকে। আমার হাসব্যান্ড তো প্রায়ই যায়।’

অভীক একটা বিব্রত হাসি হাসে, তারপর জড়তা কাটিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ যাব তো। এরপর প্রতিটি দৌড়েই যাব। আর ও তো আসলেই খুব ভালো দৌড়োয়। আমাদের ছেলে অর্কও আজ স্কুলে ফার্স্ট হয়েছে দৌড়ে।’

তুহিন অবাক গলায় বলে, ‘কী রে, তুইও ফার্স্ট হয়েছিস! তোরা মা ছেলে মিলে তো সব পুরস্কার নিয়ে যাবি।’

ওর কথা বলার ভঙ্গিতে সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। কুঞ্জল ওদের সবাইকে মিষ্টি, নাস্তা খেতে দেয়। অনেক গল্প হয়। তারপর যাবার সময় ট্রফি হাতে ওদের সাথে ছবি তোলে।

ওরা বিদায় নিতেই অভীক কাছে এসে আন্তরিক গলায় বলে, ‘কনগ্রাচ্যুলেশনস।’

কুঞ্জল মাথা নাড়ে। কিছু বলে না। অর্ক ট্রফিটা হাতে নিয়ে বলে, ‘আম্মু, আমার একটা ছবি তুলে দাও।’

অভীক এবার মোবাইল বের করে বলে, ‘তোমার আম্মুর পাশে দাঁড়াও, আমি তুলে দিচ্ছি।’

অর্ক উৎসাহের সাথে মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।কুঞ্জল অর্কের হাত ধরে গম্ভীরমুখে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। অভীক চার-পাঁচটা ছবি তোলে।

ছবি তোলা শেষ হতেই অর্ক আবদারের গলায় বলে, ‘বাবা, তুমি আর আম্মু একসাথে দাঁড়াও। আমি তুলে দেই।’

অভীক আগ্রহের সাথে সামনে আসতেই কুঞ্জল বিরক্ত গলায় বলে, ‘অর্ক, ছবি তুলতে হবে না। আমার রান্না আছে।’

অর্ক জোরে মাথা নাড়ে, ‘আম্মু একটা ছবি তুলব।’

কুঞ্জল লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলে দাঁড়ায়। অভীক ওর পাশে এসে দাঁড়াতেই ও সংকুচিত হয়ে যায়। অর্ক হাসি হাসি মুখে বলে, ‘স্মাইল আম্মু।’

কুঞ্জল হাসার চেষ্টা করে, কিন্তু সেটা ঠিকঠাক হাসি না হয়ে কেমন একটা কান্নার মতো হয়।

রাতে ঘুমাতে যাবার আগে অংশুলের মেসেজ আসে, ‘ছেলের দৌড় কেমন হলো? ঠিক সময়ে যেতে পেরেছিলেন তো? সারাদিন আর কিছু জানালেন না তো?’

কুঞ্জল চেয়ে থাকে মেসেজটার দিকে। উত্তর দেবে? অংশুলের সাথে কথা বলা কি ঠিক হবে? ভাবতেই ওর মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, অভীকের ভয়ে ও অংশুলের সাথে কথা বলা বন্ধ করবে না। বরং ওর সামনেই দেখিয়ে দেখিয়ে কথা বলবে। ও তো আর অংশুলের সাথে প্রেম করছে না।

কথাটা ভাবতেই ও স্বস্তি পায়, তারপর লিখে, ‘সরি, ব্যস্ত ছিলাম। হ্যাঁ, আমি সময়মতোই পৌঁছাতে পেরেছিলাম। আর অর্ক দৌড়ে ফার্স্ট হয়েছে।’

ওপাশ থেকে উচ্ছাসের সাথে অংশুল লিখে, ‘আনন্দের খবর। একদিন ছেলেকে নিয়ে আসুন, কেক কেটে সেলিব্রেট করি। আমি নিজে কেক বানাব আপনাদের জন্য।’

কুঞ্জল একটা হাসির ইমোজি দিয়ে বলে, ‘অবশ্যই আসব।’

অংশুল একটা লাইক সাইন দিয়ে লিখে, ‘আচ্ছা, আপনার কি মন খারাপ?’

কুঞ্জল ভ্রু কুঁচকে তাকায়, এই লোকটা বুঝল কী করে ওর যে মন খারাপ। নাহ, ব্যাপারটা বাড়তে দেওয়া যাবে না। ও লিখে, ‘না, মন ঠিক আছে। ঘুম পাচ্ছে খুব। সারাদিন অনেক খাটুনি গেল।’

ওপাশ থেকে অংশুল তাড়াহুড়ো করে লিখে, ‘আচ্ছা, ঘুমান। তার আগে আপনার কয়েকটা ছবি দেখে ঘুমান। আপনার অনুমতি না নিয়েই তুলেছিলাম। অপরাধ মার্জনীয়।’

কুঞ্জলের চোখ বড়ো হয়ে যায়, ওর ছবি তুলেছে? কখন?

ছবিগুলো আসতেই ও অবাক হয়ে খেয়াল করে ভোরে ও যে দৌড়ুচ্ছিল তার কিছু ছবি। আর ছবিগুলো এত সুন্দর এসেছে যে ও বিশ্বাসই করতে পারছিল না এগুলো ওর ছবি। ইশ, এগুলো এখনই ফেসবুকে পোস্ট করতে ইচ্ছে করছে। ও এবার অনেক ধন্যবাদ জানায় ছবিগুলো তোলার জন্য।

ওপাশ থেকে অংশুল হাসির একটা ইমোজি দিয়ে বলে, ‘আমি খুব চিন্তায় ছিলাম, আপনি না আবার রাগ করেন।’

কুঞ্জল লিখে, ‘না তো। কেউ তো আমার এমন দৌড়োনোর সময়কার ছবি তুলেনি। আপনি আজ এসেছিলেন বলেই না এমন হলো। আবারও অনেক ধন্যবাদ আসার জন্য।’

কথাটা লিখেই অভীকের চড় দেবার কথা মনে হয়। একটু কুঁকড়ে যায়। তারপর হুট করেই ‘শুভরাত্রি’ বলে বিদায় নেয় ও। কেন জানি এখন কষ্ট লাগছে। সেইসাথে একটা অপরাধবোধও। অভীক সকালে নিজে থেকেই যখন বলল, তুমি ‘পাঠাও’ এর মোটরসাইকেলে এসেছ? তখন ও মাথা নেড়ে শুধু ‘হু’ বলেছিল। কেন সত্যিটা বলল না? বলতে তো পারত আমার বন্ধু অংশুল পৌঁছে দিয়ে গেছে। কেন এটা বলতে পারল না ও? তাহলে কি ও অংশুলের কথাটা লুকোতে চায়?

২.
সাইফুল্লাহ আগ্রহ নিয়ে বাসার সামনের বড়ো রাস্তাটার পাশে একটা গাছের নিচে বসে বসে ওর প্রিয় কাজটা করছিল, মানুষ দেখা। ঠিক মানুষ দেখছিল না, মানুষের রাস্তা পার হওয়া দেখছিল। পাশেই ইয়াসিনের বাহারি টি স্টল। সুন্দর করে সাজানো কাচের চায়ের কাপ। একটা কাচের গ্লাসে তুলসী পাতা, আরেকটাতে মালটা কেটে রাখা, আরেকটা পাত্রে আদা কুচি করে রাখা, আরেকটায় লেবুর টুকরো। যে যেমন চায় ও বানিয়ে দেয়। ওর চায়ের হাত ভালো। সাইফুল্লাহ একটা তুলসি চা নিয়ে আরাম করে চুমুক দিচ্ছে, আর মানুষের রাস্তা পার হওয়া দেখছে। একটা মজার জিনিস ও আবিষ্কার করেছে। যখনই একটা ছেলে আর একটা মেয়ে রাস্তা পার হচ্ছে তখনই ছেলেটা অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করছে। যেপাশ দিয়ে গাড়ি আসে নিজে সেই পাশে আর মেয়েটাকে অন্যপাশে দিয়ে একটা হাত ট্রাফিকের মতো উঁচু করে রাস্তা পার হচ্ছে। সংগে থাকা মেয়েটা কোনো দিক না তাকিয়ে নিশ্চিন্ত মনে রাস্তা পেরোয়। এভাবে তিনটে জুটি রাস্তা পেরোল। প্রত্যেকে একইভাবে। আচ্ছা, মেয়েরা যখন একা রাস্তা পার হয় তখন কিন্তু সে নিজেই ভালো করে দেখে পার হয়। অথচ এই মেয়েটাই যখন আরেকটা ছেলের সাথে রাস্তা পার হয় তখন সে ধরেই নেয় ছেলেটা খেয়াল রাখবে। এটা স্বাভাবিক প্রত্যাশা। সাইফুল্লাহ আগ্রহ নিয়ে বসে থাকে, এর উল্টোটা কেউ করে কি-না।

ঠিক এমন সময় রস্তার উল্টোপাশ থেকে শাড়ি পরা একটা মেয়েকে রাস্তা পেরোতে দেখে। এই মেয়েটা এক দু’বার দেখেই রাস্তায় নামে। তারপর দ্রুত পায়ে রাস্তা পেরোতেই সাইফুল্লাহ অবাক হয়ে দেখে মেয়েটাকে উনি চেনেন, কুঞ্জল! ওর কাছে এসেছে?

সাইফুল্লাহ হাত নাড়ে, কিন্তু মেয়েটা বুঝি খেয়াল করেনি ও এখানে বসে আছে। এবার ও গলা বাড়িয়ে ডাক দেয়, ‘কুঞ্জল।’

কুঞ্জল থমকে যায়, এদিক ওদিক তাকিয়ে খোঁজে, কে ডাকল। একটু তাকাতেই দেখে একটা কাঠের বেঞ্চিতে বসে চা খাচ্ছে সাইফুল্লাহ স্যার। এবার ওর মুখে হাসি ফোটে।

কাছে এসে বলে, ‘আপনি এখানে? আমি আপনার বাসায় যাচ্ছিলাম।’

সাইফুল্লাহ মুচকি হাসে, ‘আমাকে তো নাও পেতে পারতেন? বসুন এখানে। চা খাবেন তো?’

কুঞ্জল বেঞ্চে একটা ফু দিয়ে বসে পড়ে, তারপর মাথা নেড়ে বলে, ‘হ্যাঁ, খাব। মালটা চা।’

সাইফুল্লাহ এবার গলা তুলে ইয়াসিনকে এক কাপ মালটা চা দিতে বলে। তারপর মিটিমিটি হেসে বলে, ‘আপনার অনেকদিন কোনো খবর নেই। সব ভালো তো?’

কুঞ্জল হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ে। তারপর ব্যাগ থেকে একটা কাগজে মোড়ানো জিনিস বের করে ওর হাতে দিয়ে বলে , ‘এটা আপনার।’

সাইফুল্লাহ আগ্রহ নিয়ে মোড়কটা খোলে, তারপর অবাক বিস্ময়ে বলে, ‘ট্রফি? আপনি কি সত্যি সত্যি দৌড়েছেন?’

কুঞ্জল বাচ্চাদের মতো মাথা দোলায়, তারপর আগ্রহ নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আপনি খুশি হয়েছেন?’

সাইফুল্লাহ মায়া নিয়ে ওর দিকে তাকায়, ‘খুব খুশি হয়েছি। এই তো, এভাবেই জীবনের সব কষ্টকে দৌড়ে পেছন ফেলে দিতে হবে। চলুন, বাসায় যেয়ে বসি। আপনার গল্প শুনব।’

চা শেষে ওরা হাঁটতে হাঁটতে বাসার দিকে এগোয়। সাইফুল্লাহ আড়চোখে ওকে খেয়াল করে, মেয়েটার মন খারাপ? কেমন মাথা নিচু করে হাঁটছে।

আজ আর ছাদে বসে না। রুমের ভেতর সেই গদিওয়ালা চেয়ারে আরাম করে বসে। তারপর অনুযোগের গলায় বলে, ‘আপনি নিজ থেকে আমার খবর নেন না কেন?’

সাইফুল্লাহ মিটিমিটি হেসে বলে, ‘আমি জানি আপনি ভালো আছেন। আর এও জানি, খারাপ থাকলে ঠিক আমার কাছে চলে আসবেন, এই যেমন আজ এসেছেন।’

কুঞ্জল আনমনে তাকিয়ে থাকে, তারপর বলে, ‘হ্যাঁ, আপনি ঠিক বলেছেন। আমি আর পারছি না, সম্পর্কটা দিন দিন বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে।’

সাইফুল্লাহ ওর দিকে ঝুঁকে এসে বলে, ‘বেরিয়ে যান তাহলে। কি, সাহস হচ্ছে না বেরোতে?’

কুঞ্জল একটু চমকে ওঠে, উনি এত সহজে ওকে বেরিয়ে যেতে বলছে? ও ঠোঁট কামড়ে বলে, ‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন, সাহস হচ্ছে না। ছেলের কথা ভাবি, নিজের কোনো উপার্জন নেই সেটাও একটা বড়ো বাধা। তাই মার খেয়ে অপমান হজম করে সংসার করি।’

সাইফুল্লাহ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘গায়ে হাত তুলেছে! কী বলছেন? কেন?’

কুঞ্জল লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলে সংক্ষেপে সব খুলে বলে। তারপর ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ও কেন এমন করল বলতে পারেন?’

সাইফুল্লাহ মন খারাপ গলায় বলে, ‘দুইজন পার্টনারের মাঝে একজন যদি অপরাধ করে আর সেটা ধরা পড়ে তখন সে হীনমন্যতায় ভুগতে থাকে। সে তখন সুযোগ খুঁজতে থাকে পার্টানারের এমন কোনো অপরাধ বা ভুল ধরতে পারে কি-না। অভীক আপনাকে ওর মতো অপরাধী প্রমাণ করতেই এমন করেছে। যাতে ওর অপরাধ জায়েজ হয়। আপনিও যদি ওর মতো অন্য আরেকজনের সাথে প্রেম করে ধরা পড়েন তাতে ওর খুব সুবিধা হয়। ওর হীনমন্যতাটা কমে। মানুষ কখনও নিজের কাছে কিংবা অন্যের চোখে নিজেকে মন্দ মানুষ হিসেবে দেখতে চায় না। কিন্তু যেহেতু অভীক আপনার চোখে মন্দ হিসেবে ধরা পড়েছে, এখন আপনি যদি সামান্য ভুলও করেন সেটা ও অনেক বড়ো করে উপস্থাপন করবে।’

কুঞ্জল মাথা নাড়ে। কথাটা ঠিক বলেছেন উনি। তারপর ও একটু ভেবে বলে, ‘আচ্ছা, আমি যে ওই শেফ অংশুল ছেলেটার সাথে আমার কষ্টগুলো শেয়ার করার জন্য কথা বলছি, এটা কি ঠিক হচ্ছে?’

সাইফুল্লাহর চোখে হাসি খেলা করে। ও চোখ কুঁচকে বলে, ‘আচ্ছা, আপনি যে আমার সাথে কষ্টের কথা শেয়ার করতে আমার বাসা পর্যন্ত আসছেন তাতে কি আপনার মনে কোনো প্রশ্ন জাগে? মানে এটা ঠিক না বেঠিক এমন প্রশ্ন?’

কুঞ্জল এর উত্তর দিতে দেরি করে না, নির্দ্বিধায় বলে, ‘না তো। এমন প্রশ্ন মাথায়ই আসে না।’

সাইফুল্লাহ হেসে বলে, ‘কিন্তু অংশুল ছেলেটার ক্ষেত্রে আসছে। তার মানে আপনি নিজেই দ্বিধান্বিত। কাজটা তখনই অন্যায় হবে যখন আপনি নিজে ভাববেন কাজটা অন্যায়। আপনি যেহেতু এটা নিয়ে দ্বিধান্বিত সেক্ষেত্রে আপনার মনে কোথাও এটা নিয়ে অপরাধবোধ আছে। সম্পর্কটা আমার সংগে যেমন সহজ, তেমন হলে প্রশ্নটা আসত না।’

কুঞ্জল চেয়ে থাকে। এই লোকটা এত সুন্দর করে ব্যাপারটা পরিস্কার করে দিল! আসলেই তো, অংশুলকে নিয়ে ওর একটু হলেও অস্বস্তি আছে। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘অভীক এটাকে ইস্যু করে আরও খারাপ ব্যবহার করবে। আমি অবশ্য সেটা ভাবছি না। ও যেহেতু আমার গায়ে হাত তুলেছে, আমি আর ওর সাথে থাকব না। কিন্তু এত সাহস ও কোথা থেকে পায়?’

সাইফুল্লাহ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘কারণ ও জানে আপনার যাবার জায়গা নেই। আপনি স্বাবলম্বী হলে এটা করত না হয়তো।’

একটা অক্ষম রাগ টের পায় কুঞ্জল। কেন যে বিয়ের পর সব ছেড়ে দিল। হতাশ চোখে তাকিয়ে বলে, ‘আমি তো এখন এই বয়সে চাকরিও খুঁজে পাব না।’

সাইফুল্লাহ আশ্বস্ত করে বলে, ‘এখন মানুষ অনেক কিছুই করছে। আপনি এত সুন্দর রাঁধেন, অনলাইন রেস্টুরেন্ট বিজনেস করতে পারেন। মানে, খাবারের অর্ডার নিলেন, বানিয়ে দিলেন। সেক্ষেত্রে আমি এক নম্বর কাস্টমার হব আপনার।’

কুঞ্জল একটু হাসে, ‘সে আপনাকে আমি এমনি রেঁধে খাওয়াব। আপনি ফ্রি ফ্রি আমাকে সময় দিচ্ছেন।’

সাইফুল্লাহ হাত নাড়ে। তারপর ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘জীবনের একটা সহজ সাধারণ নিয়ম থাকে। আপনি এত ভাববেন না। আপনি শুধু যেখানে পৌঁছাতে চাচ্ছেন সেখানে যাবার জন্য যা করার তাই করুন। জীবন আপনাকে হতাশ করবে না। আমি আপনাকে শুধু এক জোড়া জুতো দিয়েছিলাম। আর আপনি দৌড়ে ঠিক একটা ট্রফি জিতে নিয়ে এলেন। অথচ এর আগে কোনোদিন দৌড়ানোর কথা ভাবেননি। আজ আমি আপনাকে আরেকটা জিনিস দেব, দেখেন কতদূর যেতে পারেন।’

কুঞ্জল কৌতুহলী চোখে ওর দিকে তাকায়। সাইফুল্লাহ উঠে ভেতরে যায়। একটু পরেই হাতে পুরনো একটা ডায়েরি নিয়ে আসে। ওর হাতে দিয়ে বলে, ‘আমার স্ত্রী আপনার মতো রাঁধতে পছন্দ করত। সেদিন আপনি যে জলপাই দিয়ে পাবদার ঝোল করে খাওয়ালেন আমার তখন ওর কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। ও আপনার মতো এমন পুরোনো দিনের সব মজার রান্না করত। এটাতে ওর নিজস্ব কিছু রেসিপি আছে, যদি কাজে লেগে যায় আপনার। দেখা গেল এটা দিয়েই আপনি দেশ সেরা রাঁধুনি হয়ে গেলেন।’

কুঞ্জল পরম মায়ায় ডায়েরিটা হাতে নেয়। তারপর যত্নের সাথে খুলে – কুমড়োর ছক্কা, বাদাম ভর্তা, আমের টকে পঞ্চপদী ডাল। গোটা গোটা অক্ষরে সুন্দর হাতের লেখা। চোখ জুড়িয়ে যায়। বোঝা যায় মানুষটা পরিপাটি ছিলেন।

কুঞ্জল নরম গলায় বলে, ‘এত মূল্যবান একটা জিনিস আমাকে দিয়ে দিলেন?’

সাইফুল্লাহর মুখে একটা আলো খেলা করে, ও সস্নেহে বলে, ‘আমি চাই আপনি এগিয়ে যান। আপনার ভেতরের শক্তিগুলো কাজে লাগান। আর নিজের উপর বিশ্বাস রাখবেন। আপনি ঠিক লক্ষে পৌঁছে যাবেন।’

কুঞ্জল উজ্জ্বল চোখে ওর দিকে তাকায়, তারপর এক বুক আশা নিয়ে বলে, ‘সত্যিই আমি পারব?’

সাইফুল্লাহ হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ে, তারপর গম্ভীর গলায় বলে, ‘অবশ্যই।’

কুঞ্জলের মনের ভেতর অস্থিরতাটা কমে। মনটা শান্ত হয়ে আসে। ও পারবে, নিশ্চয়ই মুক্তির পথ খুঁজে পাবে। একটা কৃতজ্ঞতা ওকে ঘিরে ধরে। এই মানুষটা বার বার ওর অস্থির মন শান্ত করে দিয়েছে।

ও কৌতুহলী গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা, আপনি আমার জন্য এত করছেন কেন? আমি তো আপনাকে আপনার প্রাপ্য কিছুই দেই না। মানুষ এমনি এমনি কারও জন্য কখনও কিছু করে না।’

সাইফুল্লাহ কিছুক্ষণ ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, তারপর উঠে যেয়ে ভেতরের ঘর থেকে একটা ছবি নিয়ে আসে। ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘ওই যে আপনাকে ডায়েরিটা দিলাম এটা ইনি মানে আমার স্ত্রীর ছবি। ওনার জন্যই করি। কাকতালীয়ভাবে ওর নামও ছিল কুঞ্জল। আমি কোকিল বলে ডাকতাম। যেদিন আপনি পা মচকে হাসপাতালে আপনার নাম কুঞ্জল লিখলেন সেদিন চমকে উঠেছিলাম। সচারাচর এমন নাম কম শুনি। তাই একটা মায়া পড়ে গেছে আপনার উপর।’

কুঞ্জল মায়া নিয়ে সাইফুল্লাহর দিকে তাকিয়ে থাকে। মানুষ কত বিচিত্র হয়। একজন এখনও তার মৃত স্ত্রীর স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন। তার সাথে সামান্য নামের মিলের জন্যও কত কিছু করছেন। আর অভীক? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কুঞ্জল বিদায় নেয়। কথা দেয়, ও হেরে যাবে না, ওর ভেতরের শক্তিগুলো খুঁজে দেখবে।

(চলবে)