প্রেমহীন সংসার আহা সোনামুখী সুঁই পর্ব-১৪

0
261

#প্রেমহীন_সংসার_আহা_সোনামুখী_সুঁই (পর্ব ১৪)

১.
সকালে ঘুম ভাঙতেই কুঞ্জলের মনে পড়ে আজ ওর জন্মদিন। আর আজ ওর শেফ কোর্সে প্রথম ক্লাশ। মনটা ভালো হয়ে যায়। আজকের দিনটা শুভ হোক ওর। বিছানা ছেড়ে ও হাত মুখ ধুয়ে রান্নাঘরে যায়। নাস্তা বানাতে হবে। অর্ককে স্কুলে দিয়ে তারপর দুপুরের খাবার করে আবার ওকে স্কুল থেকে নিয়ে আসতে হবে। তারপর পৃথুলের কাছে দিয়ে ও যাবে। উফ, অনেক কাজ।

অভীক সকালেই অফিসে চলে গেছে। না, ওর জন্মদিনের কোনো মেসেজ বা উইশ করে যায়নি। অন্যান্যবার ও ঘুম ভাঙতেই চোখের সামনে একটা না একটা কিছু দেখতে পায়। কখনও ফুল, কখনও হাতঘড়ি। এই ব্যাপারটা এখন থেকে মিস করবে ও। একটা মানুষ বাইরে প্রেম করেও ঘরের মানুষের সাথে এত রোমান্টিক সম্পর্ক রাখত কী করে? কাল রাত থেকে অভীক ভীষণ গম্ভীর। কী হয়েছে আবার কে জানে। সেদিনের পর শেফ কোর্সে ক্লাশ নিয়ে নতুন করে আর ঝগড়া হয়নি। হয়তো মেনে নিয়েছে, ভাবে কুঞ্জল।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও কাজে ঝাপিয়ে পড়ে। কাজে করতে করতে ও একটা সময় ওর কষ্টগুলো ভুলে যায়। সব শেষ করে অর্ককে পৃথুলের বাসায় দিয়ে আসতে আসতে দুপুর দুটো। হাতে একদম সময় নেই। দ্রুত রেডি হয়। সুন্দর একটা ফ্লোরাল জামা পরে আজ। চুলটা সুন্দর করে সেট করে চোখে একটু কাজল দেয়। তারপর হাতব্যাগ গুছিয়ে বাসা থেকে বেরোয়। আর বেরিয়েই একটা কথা মনে হয়, আজ ওর শেফ স্কুলের প্রথম দিন। অংশুলের সাথে একবার দেখা করে যাবে? হাজার হলেও অংশুলের দেওয়া সাহসে ভর করেই ও ভর্তি হয়েছে। একটু ভাবে, তারপর হাতঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলে। দেখা করে যাবে।

অংশুল দুপুরের চা নিয়ে সবে বারান্দায় বসেছিল। ঠিক এমন সময় কেউ একজন কুঞ্জলের আসার খবর জানায়। বুকটা চলকে ওঠে। ঠিক ওর কথাই ভাবছিল এখন। মুখে নরম একটা হাসি ফোটে। লোকটাকে বলে, ‘এখানে নিয়ে আসো। আর সকালে যে কেকটা বানালাম ওটা নিয়ে এসো ফ্রিজ থেকে।’

কুঞ্জল আসতেই অংশুল মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে, তারপর হাসিমুখে বলে, ‘শুভজন্মদিন। জীবন সুন্দর হোক।’

কুঞ্জল অবাক চোখে বলে, ‘আপনি জানলেন কী করে আজ আমার জন্মদিন? আমি তো ফেসবুকে নোটিফিকেশন অফ করে রেখেছি।’

অংশুল ওর মায়াবী চোখের দিকে চেয়ে থাকে। মেয়েটা আজ কাজল দিয়েছে তাতে করে চোখে একটা নরম মায়া। ও মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে। বাদামী চোখের কোণে রোদ পড়েছে। ও হেসে বলে, ‘ভাইভারে নোটিফিকেশন এসেছে। বসুন।’

কুঞ্জল বসতে বসতে বলে, ‘আমার হাতে একদম সময় নেই। আজ আমার প্রথম ক্লাশ, ভাবলাম আপনার আশীর্বাদ নিয়ে যাই। আমি যেন আপনার মতো শেফ হতে পারি।’

অংশুল নরম গলায় বলে, ‘আপনি আমার চেয়েও বড়ো শেফ হবেন, সাত মিশেলিন স্টার পাওয়া শেফ।’

কুঞ্জল আগ্রহ নিয়ে তাকায়, ‘আপনি এমন ভাবেন বুঝি? সত্যিই আমি পারব?’

অংশুল মাথা নাড়ে, ‘হ্যাঁ তো। ঠিক পারবেন।’

কুঞ্জল বুকের ভেতর একটা ভালো লাগা টের পায়। সাইফুল্লাহ স্যারের পর অন্তত আরেকটা মানুষ ওর ভেতরের শক্তিটাকে বিশ্বাস করেছে। এই মানুষটা ওকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে। ও অনুমতি নেবার গলায় বলে, ‘আমি আজ যাই?’

অংশুল উঠে দাঁড়ায়, ‘একটা মিনিট বসুন।’

বলেই ও দ্রুত ভেতরে চলে যায়। তারপর একটু পরে ফিরে আসে। হাতে ছোট্ট একটা কেক আর একটা রঙিন কাগজ মোড়া কিছু।

অংশুল কেকটা ওর সামনে রেখে একটা নাইফ এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘কাটুন। আজ সকালে নোটিফিকেশন পেয়েই বানিয়েছিলাম। আমি জানতাম আপনি আজ ক্লাশে যাবেন। ভেবেছিলাম সন্ধ্যায় যাব আপনার ইন্সটিটিউটে। কিন্তু আপনিই চলে এলেন। নিন, দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

কুঞ্জল অবিশ্বাস নিয়ে কেকটার দিকে তাকিয়ে থাকে, রেড ভেলভেটের কেকের উপর সুন্দর করে লেখা, ‘শুভজীবন, কুঞ্জল।’

ওকে অমন চেয়ে থাকতে দেখে অংশুল বলে, ‘এখন থেকে আপনাকে এটা বলেই উইশ করব, শুভজীবন কুঞ্জল। আপনার জীবনের সব মন্দ কেটে গিয়ে শুভ হোক।’

কুঞ্জলের চোখ ভিজে আসতে চায়, কতদিন একটু মায়া করে কেউ কথা বলেনি ওর সাথে। জীবনে বেঁচে থাকতে খুব বেশি কিছু জিনিসের দরকার হয় না। একটু মায়া পেলেই হয়।

কুঞ্জল কাঁপা হাতে ছুরিটা নেয়, তারপর কেকটা কাটতেই অংশুল বাচ্চাদের মতো হাততালি দিয়ে ওঠে। তারপর সুর করে বলে, ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, হ্যাপি বার্থডে ডিয়ার কুঞ্জল।’

কুঞ্জল সলজ্জ হাসি হাসে। বাদামি মুখটা কেমন লালচে হয়ে যায়। সেই মুখের দিকে তাকিয়ে পুরুষ সারাজীবন মুগ্ধ হয়েছে।

কুঞ্জল সুন্দর করে একটা পিস কেটে ওর দিকে এগিয়ে দেয়। নিজেও একটু নেয়। অংশুলের খুব ইচ্ছে করছে ওকে একটা পিস খাইয়ে দিতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইচ্ছের ঘুড়িতে লাগাম টানে। তারপর কাগজ মোড়ানো গিফটটা ওর হাতে দিয়ে বলে, ‘ছোট্ট একটা গিফট আপনার জন্য।’

কুঞ্জল একটু ইতস্তত করে তারপর জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘কী আছে এটাতে?’

অংশুল রহস্যময় গলায় বলে, ‘খুলে দেখতে পারেন।’

কুঞ্জল বাচ্চা মেয়েদের মতো প্যাকেটটা খুলে ফেলে। তারপর অবাক হয়ে দেখে খুব সুন্দর একটা কাটিং নাইফ।

অংশুল ব্যাখ্যা দেবার ভঙ্গিতে বলে, ‘এটা একটা জাপানি ছুরি, নাম গিউটো ছুরি। প্রতিটি শেফের জন্য এমন একটা ভালো ছুরি থাকা দরকার। আপনি যদি কখনও জাপানি শেফদের ইয়াকিনিকুর রান্না করতে দেখেন দেখবেন ওরা গরুর মাংসের কত পাতলা করে স্ট্রিপ কাটে। এই ছুরি ছাড়া সেটা সম্ভব না। আপনার সংগ্রহে এমন সুন্দর সুন্দর জিনিস থাকুক। কাজে লাগবে।’

কুঞ্জল সত্যিকারের খুশি হয়। একটা আশংকায় মন সংকুচিত ছিল, অংশুল না আবার এমন কিছু দেয় যেটা নিতে ওর সংকোচ হবে। এখন ভালো লাগছে। মানুষটা সর্ব অর্থেই একজন ভদ্রলোক। ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ছুরিটা নেয়। তারপর ঘাড় কাৎ করে বলে,’আমি এবার আসি?’

অংশুল ওর দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে বলে, ‘আচ্ছা, আসুন। শুভজীবন।’

কুঞ্জল এবার হেসে বলে, ‘শুভজীবন।’

কুঞ্জল চলে যায়। অংশুল কেমন আচ্ছন্নের মতো বসে থাকে। ওর প্রেমহীন জীবনে একটু হলেও প্রেম বুঝি ও পেল। চোখ বন্ধ করে ও সোফায় হেলান দিয়ে বসে থাকে। এই মুহুর্তটা শেষ না হোক।

ঠিক এমন সময় রেস্তোরাঁর একজন স্টাফ এসে গলাখাঁকারি দিতেই অংশুল চোখ খুলে। লোকটা জবাবদিহি করার ভঙ্গিতে বলে, ‘স্যার, অভীক নামে একজন লোক আপনার সাথে দেখা করতে এসেছে।’

অংশুল ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘অভীক? উম, চিনতে পারছি না তো। আচ্ছা আমার রুমে বসাও। আমি আসছি।’

লোকটা চলে যেতেই অংশুল একবার ভাবে কুঞ্জল বুঝি এতক্ষণে ওর সেন্টারে পৌঁছে গেছে। ওর ক্লাশ শেষ হবে সন্ধ্যা সাতটায়। একবার যাবে? প্রশ্নটা মনের ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে।

আনমনে রুমের কাছে আসতেই হঠাৎ করেই ওর মনে পড়ে অভীক নামটা খুব চেনা। কুঞ্জল বলেছিল। কুঞ্জলের হাসব্যান্ড এসেছে! বুকটা ধক করে ওঠে। কুঞ্জলকে এখান থেকে বেরোতে দেখেনি তো? সর্বনাশ!

ওর রুমটা গ্লাস দিয়ে ঘেরা যার ভেতর দিয়ে পুরো রান্নাঘরে নজর রাখা যায়। ও দেখতে পায় একটা লোক শরীর কুঁজো করে বসে আছে। অংশুল লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে ভেতরে ঢোকে, তারপর জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘আপনি আমার কাছে এসেছেন?’

অভীক নামের লোকটা ঝট করে ঘুরে তাকায়। অংশুল খেয়াল করে ওর চোখ লাল, চুলগুলো এলোমেলো, ফর্সা মুখটায় না কামানো দাড়ি।

অভীক সামনে দাঁড়ানো শেফ লোকটাকে দেখে। আচ্ছা, এই তাহলে কুঞ্জলের প্রেমিক, অংশুল। একবার নিজের সাথে মিলিয়ে নেয়। এমন আহামরি কোনো সুদর্শন কেউ না। কুঞ্জল এমন একটা বাবুর্চির প্রেমে পড়ল!

গম্ভীরমুখে বলে, ‘আপনি বাবুর্চি অংশুল?’

অংশুল একটা রাগ টের পায়। ওর পেশাকে অসম্মান করতে অনেকেই এমন তাচ্ছিল্য করে বাবুর্চি শব্দটা ব্যবহার করে। না, বাবুর্চি শব্দে ওর আপত্তি নেই। কিন্তু বলার ভঙ্গিতে একটা তাচ্ছিল্য থাকে সেটা নিতে পারে না।

অংশুল শান্ত গলায় বলে, ‘আমি এই রেস্তোরাঁর হেড শেফ। বলুন কেন এসেছেন আমার কাছে?’

অভীক বাঁকা গলায় বলে, ‘আমি একটা শেফ কোর্সে ভর্তি হতে চাই, আপনি কি একটু সাহায্য করবেন?’

অংশুল বুঝতে পারে কথাটা ওকে খোঁচা মেরেই জিজ্ঞেস করল অভীক। ঝগড়া শুরু করবার একটা ছল। ও সাবধানী গলায় বলে, ‘আমি তো কোনো কোর্স করাই না। আপনি আমার কাছে কেন এসেছেন? আর আমি আপনাকে চিনিও না।’

অভীক দুই হাত ছড়িয়ে হতাশ হবার কৃত্রিম ভঙ্গিতে বলে, ‘ওহ, আপনি তো আমাকে চেনেন না। চেনা হলে সাহায্য করবেন বুঝি?’

অংশুল বুঝতে পারে, এই কথার উত্তরে ও হ্যাঁ বললেই এই লোকটা এবার কুঞ্জলের পরিচয় দেবে।

ও সে পথে হাঁটে না। মাথা নেড়ে বলে, ‘আমি পরিচিত বা অপরিচিত কাউকে রান্না শেখাই না।’

অভীক ওর দিকে এগিয়ে এসে ছুঁচালো মুখে বলে, ‘কিন্তু কুঞ্জলকে শিখিয়েছেন। ওকে রান্নার স্কুলে ভর্তি হতে বলেছেন।’

অংশুলের মুখের পেশি শক্ত হয়ে যায়। লোকটা শেষ পর্যন্ত ওকে কুৎসিত এই খেলায় টেনে নামাল। এখন গায়ে পাঁক জড়াতেই হবে। তাতে করে শুধু মালিন্যতায় বাড়বে। এই লোকের সাথে নরম গলায় কথা বলে কোনো লাভ নেই।

অংশুল শক্ত গলায় বলে, ‘আপনি যা বলতে চান তা স্পষ্ট করে বলুন। এমন ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলার কোনো প্রয়োজন দেখি না।’

অভীকের হঠাৎ করেই মাথায় রাগ উঠে যায়। আমার বউয়ের সাথে নষ্টামি করে এখন ভাব নিয়ে কথা বলছে।

ও খেকিয়ে উঠে, ‘হারামজাদা, সোজা করেই বলছি। তুই আমার বউয়ের সাথে প্রেম করিস, রান্না শিখাস। তোর এত প্রেম কেন। তোর বাসায় বউ নাই? তোর বউরে রান্না শিখা।’

অংশুলের কান গরম হয়ে যায়। ও আড়চোখে একবার কাচের ভেতর দিয়ে বাইরে থাকা ওর স্টাফদের দিকে তাকায়। নাহ, শব্দ বাইরে যাবার কথা না। এই খেপাটে লোকটাকে শান্ত করতে হবে।

অংশুল এবার নরম গলায় বলে, ‘দেখুন অভীক, আপনি ভুল বকছেন। আপনার স্ত্রীর সাথে আমার তেমন করে আলাদা কোনো সম্পর্ক নেই। ওনার রান্নার পেজ থেকে পরিচয়। উনি রান্নার উপর কোর্স করতে চেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন। আর আমি ওনাকে শুধু সেই তথ্যটুকুই দিয়েছি।’

অভীকের মাথায় আগুন ধরে যায়। লোকটা এখনও মিথ্যে বলে যাচ্ছে। ও খপ করে ওর কলার চেপে ধরে, দাঁতে দাঁত ঘষে বলে, ‘কুত্তারবাচ্চা, তোর সাথে আলাদা সম্পর্ক নাই, তাই না? তাহলে তুই ওর ম্যারাথনের দিন মোটরসাইকেল নিয়ে গেছিলি ক্যান? পিরিতির ঠেলায় আবার বাসা পর্যন্ত পৌঁছায় দিয়া গেছিস। আর বলিস আলাদা সম্পর্ক নাই। বল, কয়দিন শুইছিস?’

কানে যেন কেউ গরম সীসা ঢেলে দিল। এই লোকটাতে আজ দৈত্য ভর করেছে। সব ধ্বংস করে দেবে৷ অংশুল দুই হাত দিয়ে ওকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে চায়, পারে না। ওর গায়ে যেন অসুরের শক্তি ভর করেছে। গলার কাছে চাপ বাড়ছে, নিশ্বাস নেবার জন্য হাঁসফাঁস করতে থাকে অংশুল।

ঠিক এই সময় ধুপ করে দরজা খোলার শব্দ হয়। অংশুল ওর কাঁধের উপর দিয়ে দেখতে পায় ওর জুনিয়র শেফ, স্টাফরা ভেতরে ঢুকছে। একটা হইহল্লা শুরু হয়। চার পাঁচজন স্টাফ অভীককে দুই হাত দিয়ে টেনে সরাতে চেষ্টা করতেই অভীক হাত চালায়। এবার একটা মারামারি বেঁধে যায়। অভীক পাগলের মতো হাত পা ছুড়তে থাকে। আর এদিকে অন্য স্টাফরাও হাত চালায়।

অংশুল গলা তুলে চিৎকার করে সবাইকে থামতে বলে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। সবাই মিলে অভীককে মারতে মারতে রেস্তোরাঁর বাইরে বার করে দেয়। অভীক চিৎকার করে বলেই যাচ্ছে, ‘আমি এর প্রতিশোধ নেব। অন্যের বউ নিয়ে নষ্টামি, আমি ছুটাই দিব। তোর বাসায় যেয়ে তোর বউরে বলে আসব। শুয়োরের বাচ্চা।’

গালিগুলো বাতাসে ভেসে রেস্তোরাঁর দারুণ পরিপাটি পরিবেশে এসে বেমক্কা ধাক্কা খেয়ে কেমন বেমানান ভঙ্গিতে একটা অনিশ্চয়তা নিয়ে পড়ে থাকে। মানুষের জোর করে সাজিয়ে রাখা পরিপাটি জীবনের উল্টোপিঠের কুৎসিত দিকটা বেরিয়ে আসে।

অংশুল মাথা নিচু করে নিজের চেয়ারে বসে থাকে। আজ ওর সারাজীবনের এত কষ্ট করে অর্জিত সম্মান মাটির সাথে মিশে গেল। কোনো অপরাধ না করেই ও অপরাধী হলো। কিন্তু কুঞ্জল? ও কি জানে অভীক আজ এখানে এমন তান্ডব চালিয়ে গেল? ওকে সাবধান করতে হবে। অভীক আজ পাগলা কুকুর হয়ে গেছে। ওর গায়ে যদি এমন করে হাত তোলে তাহলে কুঞ্জলের সাথে না কী করবে! ভাবতেই শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে। ও দ্রুত ফোন হাতে নেয়।

কুঞ্জলদের আজ প্রথম ক্লাশ। এখানকার পরিচালক খোদ ড্যানিয়েল স্যার ক্লাশ নিচ্ছেন। কুঞ্জল সেই কলেজ জীবনের মতো করে মনোযোগ দিয়ে নোট নিচ্ছে। একটা ভালো লাগা ছুঁয়ে যাচ্ছে। বহুদিন পর আজ আবার সেই ছাত্রজীবনে ফিরে গেল ও।

ভাবনার এই পর্যায়ে ফোনটা কেঁপে ওঠে, ভাইব্রেশনে রাখা ছিল। ও দ্রুত ফোনটা হাতে নিয়ে অফ করতে যেতেই ভ্রু কুঁচকে দেখে অংশুলের ফোন। ফোনটা কেটে দেয়। অংশুল ফোন করেছে? কিন্তু ও তো জানে এখন ওর ক্লাশ চলছে। জরুরি কিছু? ভাবতেই একটা মেসেজ আসে, ‘খুব বিপদ। ক্লাশ থেকে বেরিয়ে ফোনটা ধরো।’

কুঞ্জলের বুক ধক করে ওঠে। কী হলো হঠাৎ করে? বেরোবে ক্লাশ থেকে? একটু ভাবে, অংশুল যখন লিখেছে খুব বিপদ তার মানে ব্যাপারটা জরুরি। ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ক্লাশ থেকে বেরিয়েই ফোন দেয়।

ওপাশ থেকে সাথে সাথে অংশুল ফোন ধরে উত্তেজিত গলায় বলে, ‘কুঞ্জল, সর্বনাশ হয়ে গেছে। আপনি আমার এখান থেকে বেরিয়ে যেতেই অভীক আমার রেস্তোরাঁয় এসেছিল। তারপর আপনাকে আমার সাথে জড়িয়ে যা ইচ্ছে তাই বলে গেল। একটা পর্যায়ে আমার কলার চেপে আমাকে মারতে গেলে আমার লোকজন ওকে আটকানোর চেষ্টা করেছিল। তাতে উলটো ও আমার লোকদের গায়ে হাত তুলতেই ওরা ওকে মেরে বের করে দিয়েছে। আপনি এখুনি ক্লাশ ছেড়ে বেরিয়ে বাসায় চলে যান। না না, আপনার বাসায় না, আপনার মা বাবার কাছে চলে যান। ও পাগল হয়ে গেছে। ও আজ আপনার গায়ে হাত তুলবে।’

কুঞ্জলের মাথাটা ঘোরাচ্ছিল, পা দু’টো কেমন অবশ হয়ে আসছে। ও তোতলানো গলায় বলে, ‘কিন্তু ও আপনার কথা জানল কী করে?’

অংশুল মাথা নাড়ে, ‘আমার কোনো ধারণা নেই এই বিষয়ে। আচ্ছা, ম্যারাথন দৌড়ের দিন আমি যে আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিয়েছিলাম সে কথা ওকে কে জানাল?’

কুঞ্জল এবার নিজেও অবাক হয়। অংশুল যে ম্যারাথন দৌড়ে গিয়েছিল, তারপর ওকে পৌঁছে দিয়েছিল সেটা তো ও অভীককে খুলে বলেনি। এই সত্যটা ও লুকিয়েছিল। আর সেদিনই অভীক ওকে মেরেছিল।

কুঞ্জল পুরো ঘটনা খুলে বলতেই অংশুল আফসোসের গলায় বলে, ‘ইশ, এত কিছু ঘটে গেছে, আমাকে বলবেন না? ও দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়েছে। আর সন্দেহ ওকে এখানে ঠেলে নিয়ে এসেছে৷ তাতে করে আপনি আমি কিছু না করেও অপরাধী। আমার ক্যারিয়ারে একটা বড়ো ক্ষতি ও করে দিয়ে গেল আজ। তাতে আফসোস নেই, কিন্তু ও আজ আপনাকে পেলে মেরেও ফেলতে পারে। প্লিজ, আপনি আপনার বাবা মায়ের কাছে চলে যান। ও আপনার ইন্সটিটিউটেও যেতে পারে। সবার সামনে আপনাকে অপদস্ত করবে। আপনি এখুনি বের হয়ে যান। বাসায় গিয়ে অর্ককে নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন।’

কুঞ্জল লম্বা একটা নিশ্বাস নেয়, তারপর বিষাদ গলায় বলে, ‘আচ্ছা। আপনি ভাববেন না। আমি সত্যিই ভীষণ দুঃখিত, আজ আমার জন্য আপনার বড়ো একটা ক্ষতি হয়ে গেল।’

অংশুল ওপাশ থেকে বিষাদের হাসি হেসে বলে, ‘আমার বড়ো ক্ষতি অনেক আগেই হয়েছে। আজ যেটা হলো সেটা সাময়িক। আপনি শুধু শুধু কষ্ট পাবেন না। এখন আর এক মুহুর্ত দেরি না করে বেরিয়ে পড়ুন।’

কুঞ্জল ফোন রাখে। একটু ভাবে, কী করবে ও? জীবনে প্রথম নিজের পায়ে দাঁড়াতে গিয়ে এত বড়ো হোঁচট খাবে ভাবতেই পারেনি। আজ সকালটাও কী সুন্দর ছিল সব। অংশুলের ওখানে দুপুরটা ছিল স্বপ্নের মতো। এত দ্রুত স্বপ্ন ভঙ্গ হবে ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি ও। অভীক যেহেতু ওর ওখানে মার খেয়েছে সেক্ষেত্রে এখানে এল বলে। ও কি তাহলে পালিয়ে যাবে? এভাবে জীবন থেকে পালাতে পালাতে ও যে একদিন হারিয়েই যাবে।

কুঞ্জল লম্বা একটা নিশ্বাস নেয়। নাহ, ও পালাবে না। ও তো কোনো অপরাধ করেনি। ও কেন পালাবে? আজ যদি অভীক এখানে এসে ওকে অপদস্ত করে তাহলে ও আজই ওকে ছেড়ে চলে যাবে। তাতে করে যত কষ্টই হোক ও মেনে নেবে।

সিদ্ধান্তটা নিতে পেরে ওর কেন যেন খুব ভালো লাগতে থাকে। ও দৃঢ় পদক্ষেপে ক্লাশরুমে ঢোকে।তারপর নিজের সবটুকু মনোযোগ ওর স্বপ্ন পূরণ হবার ক্লাশে ঢেলে দেয়।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে