Thursday, July 10, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 344



প্রেমহীন সংসার আহা সোনামুখী সুঁই পর্ব-১০

0

#প্রেমহীন_সংসার_আহা_সোনামুখী_সুঁই (পর্ব ১০)

১.
কুঞ্জল ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি সামান্য এই রান্নার ভিডিও ওকে এমন একজন মানুষের সংগে পরিচয় করিয়ে দেবে। অংশুল যে ওর মতোই দুঃখ পাওয়া মানুষ সেটা ও সেদিন দেখা হবার আগ পর্যন্ত জানত না। আর এত সহজে মনের আগল খুলে দেবে এটা ও ভাবতেই পারছে না। একজন নিতান্ত অপরিচিত মানুষ কেমন করে মুহুর্তে এত আপন হয়ে যায় এটা ভেবে ও বিস্মিত হয়ে যাচ্ছে। এমন অভিজ্ঞতা ওর প্রথম। লোকটার সাথে ওর বার বার কথা বলতে ইচ্ছে করছে। ইদানিং সারাদিন টুকটাক করে কথা হয়। নিজেদের দুঃখ নিয়ে, রান্না নিয়ে। তাতে করে ওর মনের চাপটা যেন অনেকটাই কমে। সাইফুল্লাহ স্যারকেও ও অনেক কিছু বলতে পারেনি। কিন্তু অংশুলের সাথে ওর কষ্টের মিল থাকাতে বলতে ইচ্ছে করে। ওর কষ্টটা আরও বড়ো। যে মেয়েটাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল সেই মেয়েটাই বিয়ের পাঁচ ছয় বছরের মাথায় অন্য একটা ছেলের সাথে জড়িয়ে যায়। এবং ভীষণ বাজেভাবেই জড়ায়। অন্তরঙ্গ কিছু মুহুর্তের ছবিও ও দেখেছিল। ভীষণ আঘাত পেয়েছিল অংশুল। বিশ্বাস ভাঙার যন্ত্রণা, ভালোবাসা হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। ওর কষ্টের কথা শুনে কুঞ্জল একটু হলেও নিজের দুঃখ ভুলতে পেরেছে। অভীক হয়তো অতটা জড়ায়নি কারও সাথে।

কথাটা ভাবতেই ও নিজের মনকে প্রশ্ন করে, ও আসলে কতটুকু জানে অভীক সম্পর্কে? দু’দুটো মেয়ের সংগে প্রেম ছিল, সেটা কি অন্তরঙ্গতার সীমা অতিক্রম করেনি? কথাটা ভাবতেই আবার মাথা গরম হয়ে যায়। নাহ, এসব আর ও ভাববে না। নিজেকে ব্যস্ত রাখবে। রান্নার পেজটা দ্রুত পরিচিতি পাচ্ছে। এটাতেই সময় দেবে। আর ইদানিং অর্কের সাথে সকালে দৌড়াতে ভালোই লাগে। আচ্ছা, সেদিন তুহিন যে বলল ম্যারাথনে দৌড়ে নাম লেখাতে, লেখাবে?

একটু ভেবে ও ফোন দেয় তুহিনকে। ওকে ম্যারাথনের কথা বলতেই ও উচ্ছ্বসিত গলায় বলে, ‘আপু, সত্যিই তুমি নাম লেখাবে? দারুণ হবে। আমি তো পৃথুল আপুকে কতবার বলেছি, ও একটা অলস।’

কুঞ্জল হেসে ফেলে, তারপর বলে, ‘কিন্তু ম্যারাথন দৌড় কি আমি দৌড়ুতে পারব?’

তুহিন একটু ভেবে বলে, ‘আপু, প্রথমে অল্প দূরত্বের দৌড়গুলো দৌড়াতে পারো। সামনের ২৬ তারিখে একটা পাঁচ কিলোমিটার রান আছে। আফরোজা আপু, আমি যাব ওটাতে। তুমি আপাতত এগুলোতে দৌড়াও। পরে ধীরে ধীরে দশ, পনের এভাবে বাড়াতে পারো। পরে হাফ ম্যারাথন মানে ২১ কিলোমিটারের ইভেন্টে দৌড়ুতে পারবে।’

কুঞ্জল চোখ কপালে তুলে, ‘হাফ ম্যারাথনই এত! আমি পারব না।’

তুহিন হাসে, ‘আগে শুরু করো, দেখবে তুমি কত কী পারো। আমিও একসময় ভাবতাম এত লম্বা পথ দৌড়ুতে পারব না। কিন্তু এখন দৌড়ুতেই ভালো লাগে।’

কুঞ্জল হাসে, তারপর দৌড়ের আরও খুঁটিনাটি জেনে ফোনটা রাখে। তার আগে ৫ কি.মি. রানের জন্য রেজিষ্ট্রেশন করে ফেলতে বলে। দেখাই যাক, কী হয়।

পরদিন স্কুলে যেতেই পৃথুল হইহই করে ওঠে, ‘এই, তুই নাকি দৌড়াবি? তুহিন কাল রাতে বলল। ইশ, আমি যদি তোর মতো দৌড়ুতে পারতাম!’

কুঞ্জল ওর হাত চেপে ধরে বলে, ‘আমার সাথে তুই চল না, প্লিজ। একা একা খুব অস্বস্তি হচ্ছে।’

পৃথুল ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘একা কই? তুহিন যাবে, আফরোজা আপু আছে। যা, ভালো লাগবে। আমার তো উলটো হিংসে হচ্ছে তোকে।’

সেদিন বহুদিন পর ওরা মন খুলে গল্প করে। অংশুলের কথা বলতেই পৃথুল চোখ টিপে বলে, ‘দেখিস, আবার প্রেমে পড়ে যাস না। লোকটা কিন্তু দারুণ স্মার্ট।’

কুঞ্জল হাসে ওর কথা শুনে। মনের ভেতর একটা অজানা ভয় ওকে একটু হলেও ছুঁয়ে যায়। ও আবার জড়িয়ে পড়ছে না তো? নাহ, নিজেকে একটু সামলাতে হবে। সেদিন ইচ্ছে করেই সারাদিন আর অংশুলকে ও মেসেজ দেয় না।

সন্ধ্যার পর অংশুলের ছোট্ট একটা মেসেজ আসে, ‘আপনি ঠিক আছেন তো?’

মেসেজটা পেয়ে কুঞ্জলের কেন যেন ভালো লাগে। অংশুল ওর মেসেজ না পেয়ে চিন্তা করছে এটা ওকে আনন্দ দেয়। কিন্তু সেইসাথে মনের ভেতর একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খায়, তবে কি ও মনের অজান্তেই অংশুলের মেসেজের জন্য অপেক্ষা করে ছিল?

ও দ্রুত টাইপ করে, ‘হ্যাঁ, ঠিক আছি। একটা লম্বা দৌড়ে নাম দিলাম, তাই নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম।’

ওপাশ থেকে বিস্ময়ের ইমোজি আসতেই কুঞ্জল সব খুলে বলে। পুরোটা শুনে অংশুল অবাক হয়ে লিখে, ‘ইশ, আগে জানলে আমিও আপনার সাথে দৌড়ুতাম। কতদিন দৌড়াই না। নাহ, এখন থেকে আপনার মতো সকালে দৌড়াব। তারপর এমন ইভেন্টগুলোতে যাব। আমাকে নিয়ে যাবেন তো?’

কুঞ্জল হাসির একটা ইমোজি দিয়ে বলে, ‘আগে দৌড়ে দম ঠিক করুন।’

কুঞ্জল টের পায় ওর মন ভালো হয়ে যাচ্ছে। অংশুলের সাথে সব শেয়ার করতে খুব ভালো লাগছে। কিন্তু ব্যাপারটা কি ঠিক হচ্ছে? নাহ, অনেক দিন সাইফুল্লাহ স্যারের সাথে দেখা হয় না। যেতে হবে। মনের ভেতর এই দ্বন্দ্বটা নিয়ে একটু কথা বলতে হবে। দৌড়টা শেষ করেই ও দেখা করতে যাবে। ওনাকে জানিয়েও আসবে ও দৌড়াচ্ছে। নিশ্চয়ই খুশি হবেন।

এর ক’দিন পর স্কুলে যেতেই কুঞ্জলের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। অর্কের স্কুলের ফাইনাল খেলা নাকি ২৬ তারিখেই। কথাটা শোনামাত্র ওর মন খারাপ হয়ে যায়। তাহলে তো ওর দৌড়ানোটা হবে না।

ওর মন খারাপ দেখে পৃথুল আশ্বস্ত করে বলে, ‘আরে, তুই অত ভাবছিস কেন? অর্কের সাথে আমি থাকব। তোর দৌড় তো সকালেই শেষ হয়ে যাবে। আর ওদের খেলা শুরু হতে হতে সকাল দশটা। এর মধ্যে তুই চলে আসতে পারবি। তুই ভাবিস না, আমি বাসায় এসে অর্ককে নিয়ে যাব। আমার ইরাও তো দৌড়ে নাম লিখিয়েছে। ওদের দু’জনকে নিয়ে আমি স্কুলে চলে যাব। তুই সরাসরি স্কুলে চলে আসিস।’

কুঞ্জল হাঁপ ছেড়ে বাঁচে, ‘সত্যিই তুই কত করছিস আমার জন্য। তোর কাছে যে আমার অনেক ঋণ।’

পৃথুল তেড়ে মারতে আসে, ‘তোর জন্য এইটুকু করতে না পারলে কিসের বন্ধু? আচ্ছা, অভীক ভাইয়া আসবে না ওইদিন?’

কুঞ্জল অনিশ্চিতভাবে মাথা নাড়ে যার অর্থ হ্যাঁ বা না হতে পারে। পৃথুল আর কথা বাড়ায় না। ওর কেন যেন মনে হয় কুঞ্জল আর অভীকের সম্পর্কটা ঠিকঠাক যাচ্ছে না।

দেখতে দেখতে পঁচিশ তারিখ এসে যায়। কুঞ্জলের হঠাৎ করেই মনে হয় অভীককে ওর দৌড়ানোর ব্যাপারে এখনও কিছু বলা হয়নি। যদিও বলার কিছু নেই, কিন্তু সকালে পৃথুল যখন অর্ককে নিতে আসবে তখন একটা ঝামেলা হতে পারে।

কুঞ্জল একবার লিভিং রুমের দিকে তাকায়। অভীক টিভি দেখছে। অর্ক পাশেই বসে বাবার সাথে গল্প করছে।

কুঞ্জল পায়ে পায়ে এগিয়ে যায়, তারপর গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, ‘অর্ক তোমার বাবাকে বলো কাল আমার সকালে ম্যারাথন দৌড় আছে। তোমার পৃথুল খালামণি এসে তোমাকে নিয়ে যাবে। আমি সকাল দশটার মধ্যে স্কুলে চলে আসব।’

কুঞ্জল এখনও ওর সাথে সরাসরি কথা বলে না।

অভীক ওর কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকায়, তারপর অবাক গলায় বলে, ‘তোমার ম্যারাথন দৌড় আছে মানে?’

অর্ক পাশ থেকে উৎসাহের সাথে বলে, ‘বাবা, তুমি তো জানোই না কাল আম্মু দৌড়াবে। আমারও কাল স্কুলে ফাইনাল খেলা, আমিও দৌড়াব।’

অভীক কিছুই বুঝতে পারছিল না। ও জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘তুমি কাল সকালে কোথায় যাচ্ছ?’

কুঞ্জল বিরক্ত গলায় বলে, ‘বললাম তো ম্যারাথন দৌড় দৌড়াতে। আমাদের এখান থেকে আফরোজা আপু যাবেন। উনি গাড়ি নিয়ে আসবেন। আর পৃথুলের ছোট ভাই তুহিনও যাবে। ওদের সাথেই ভোরে বেরিয়ে যাব। আমাদের বাসার কাছেই। পৃথুল সকালে এসে অর্ককে নিয়ে যাবে। আমি পরে সরাসরি ওর স্কুলে যাব।’

ব্যাপারটা বুঝতে কিছুক্ষণ সময় লাগে অভীকের। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ‘তুমি ছেলে মানুষের সাথে দৌড়াবে?’

কুঞ্জল সরু চোখে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বলে, ‘তো? ছেলেমানুষের সাথে দৌড়ালে কী হয়? সবাইকে নিজের মতো ভেব না। আর তোমার জানার জন্য বলছি, আমাদের সাথে অনেক মেয়েও দৌড়াবে।’

অভীকের হুট করেই রাগ উঠে যায়, ও কর্কশ গলায় বলে, ‘খুব শখ না, ছেলেদের সাথে শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে দৌড়াবে। অসভ্য মেয়েছেলে কোথাকার।’

অর্ক ভয় নিয়ে আম্মুর মুখের দিকে তাকায়। কুঞ্জল আর নিজেকে সামলাতে পারে না, ‘অসভ্য তো তুমি। ঘরে বউ রেখে বাইরের মেয়েদের সাথে ফূর্তি করে বেড়াও। আমাকে নিয়ে একটা বাজে কথা বললে তোমার খবর আছে। অর্ক, চলো, ঘুমোবে। সকালে উঠতে হবে।’

অর্ক মায়ের সংগে বেডরুমে চলে যায়। অভীক বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কুঞ্জল কবে কবে এতটা বদলে গেল! একবার ওকে জানাবার প্রয়োজন মনে করেনি যে ও ম্যারাথনে দৌড়াবে। অভীক যত বেশি করে কাছে আসার চেষ্টা করছে ও ততোই দূরেই সরে যাচ্ছে।

আর এদিকে কুঞ্জলের তখনও অপমানে গা জ্বালা করছিল। ছেলের সামনে এমন কুৎসিত কথা ও বলতে পারল? চোখ ফেটে কান্না আসে। অর্ক মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আম্মু, তুমি কান্না কোরো না। আমি কাল একা একাই যেতে পারব, আর দৌড়ে ফার্স্ট হব।’

কুঞ্জল ছেলেকে বুকে চেপে ধরে হুহু করে কেঁদে ফেলে। আর কত অপমান ও সইবে?

২.
ভোর ৫.১৫। আফতাবনগরে এই ভোর বেলাতেই লোকে লোকারণ্য। অনেক মেয়েরা এসেছে। এত মেয়ে দেখতে পাবে ভাবেইনি। ওর চেয়ে বয়সে বড়োরা যেমন আছে আবার ছোটরাও আছে। আজ সবাই একই রকমের জার্সি পরা। কুঞ্জলও তাই পরেছে। চারদিকে একটা উৎসব উৎসব ভাব।

ও অবাক গলায় বলে, ‘তুহিন, এত লোক দৌড়ুবে?’

তুহিন হেসে বলে, ‘হ্যাঁ আপু, এরা সবাই দৌড়ুবে। চলো স্টার্টিং মার্কে যাই। তুমি আর আফরোজা আপু তো পাঁচ কিলোমিটার দৌড়ুবে, তাতে এক ঘণ্টার মধ্যেই তোমাদের শেষ হয়ে যাবে। আমারটা ২৫ কিলোমিটার, সময় লাগবে। তুমি আফরোজা আপুর সাথে চলে যেও। তোমাদের সার্টিফিকেট আমি নিয়ে আসব।’

আফরোজা আপু খুব হাসিখুশি একজন মানুষ। কুঞ্জলকে দেখে উনি ভীষণ খুশি হয়েছেন। কুঞ্জলকে একটা পানির বোতল দিয়ে বলেন, ‘অল্প অল্প করে পানি খাবে। খেয়াল রেখো শরীর যেন ঠিকঠাক পানি পায়। না হলে কিন্তু খুব অসুবিধে। আর সবসময় তোমার শরীরের কথা শুনবে। যদি মনে হয় দৌড়ুতে কষ্ট হচ্ছে তাহলে সাথে সাথে থেমে যেও। তুমি তো আজ প্রথম দৌড়ুবে, তাই সমস্যা হতেই পারে। জোর করে দৌড়োনোর দরকার নেই। আর আমি যদি আগে শেষ করে ফেলি তাহলে ওই গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে থাকব। একসাথেই ফিরব।’

কুঞ্জল মাথা নাড়ে। আপুর এই টিপসগুলো ও আগেও পেয়েছে। এখন আরেকবার মনে পড়ল।

ভোর পাঁচটা চল্লিশে দৌড় শুরু হয়। এত মানুষ, একটু হুড়োহুড়ি হয় প্রথমটায়। কুঞ্জল দৌড়ের শুরুতেই আফরোজা আপুকে হারিয়ে ফেলে। ওর কেমন ভয় লাগতে থাকে। ছোট ছোট স্টেপে ও দৌড় শুরু করে। কিছুদূর এগোতেই ভীড়টা কমে। ওকে পাশ কাটিয়ে যাবার সময় অনেকেই উৎসাহ দিয়ে যায়। একজন বয়স্ক মানুষ ওকে পার হয়ে যাবার সময় বলে, ‘মাথা সোজা রাখবেন, নিচের দিকে বার বার তাকাবেন না।’

কুঞ্জল মাথা উঁচু করে সামনের দিকে তাকিয়ে দৌড়াতে থাকে। ও মনে মনে হিসেব করে, প্রতি দশ মিনিটে এক কিলোমিটার পেরোতে হবে। সেদিক দিয়ে হিসেব করলে ও অনেকটাই পিছিয়ে।

তিন কিলোমিটার শেষ করতে ওর পয়ত্রিশ মিনিট লেগে যায়। একটু পিছিয়েই পড়েছে ও। নাহ, এবার স্পীড বাড়াতে হবে। ও এবার একটু জোরে দৌড় শুরু করে। একটা জিনিস টের পায়, এখনও ওর ক্লান্ত লাগছে না। কিন্তু খুব পানি পিপাসা পেয়েছে। ও দৌড়াতে দৌড়াতে ট্রাউজারের পকেটে হাত দেয়। কয়েকবার খোঁজে, পানির বোতলটা নেই! হায় হায়! পানির বোতলটা কি তখন হুড়োহুড়িতে পড়ে গেল? কিন্তু ভীষণ পানি পিপাসা পেয়েছে যে।

কারও কাছে চাইবে তাতে সংকোচ হয়। ও শুকনো মুখে দৌড়ুতে থাকে। কেমন যেন ক্লান্ত লাগছে এখন। ঠিক এই সময় একটা মোটরসাইকেল ওর পাশে এসে চলতে থাকে। কেউ একজন ওর নাম ধরে ডাকে, ‘কুঞ্জল, দারুণ দৌড়ুচ্ছেন।’

কুঞ্জল অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে অংশুল। হঠাৎ ওর মনে পড়ে আজকের দৌড়ের ইভেন্ট নিয়ে অংশুল ক’দিন আগেই জানতে চেয়েছিল।

ও চোখ বড়ো বড়ো করে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ‘আপনি এখানে!’

অংশুল হাসে, তারপর বলে, ‘আপনার কথা বলতে হবে না। তাহলে দৌড়াতে কষ্ট হবে। আমি ভোরেই এসেছি। কিন্তু এত মানুষের ভেতর খুঁজে পাইনি। কয়েকবার করে চক্কর কেটে এই পেলাম। আপনার জন্য স্পেশাল একটা লেমোনেড বানিয়ে নিয়ে এসেছি। এটা দৌড়ুনোর সময় খেলে খুব কাজে লাগে। এই নিন।’

কুঞ্জলের মনে হয় ও যেন হাতে স্বর্গ পেল। বোতলটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে ঢক ঢক করে খেতে থাকে। অংশুল মুগ্ধ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। ঘামে ভেজা মুখটা চিকচিক করছে। নাকের উপর বিন্দু বিন্দু ঘাম। এত সুন্দর লাগছে দেখতে!

কুঞ্জল বোতলটা ফেরত দিয়ে বলে, ‘একটু পানি খাব। পারলে একটু এনে দেবেন?’

অংশুল হাসে, ‘সেটাও এনেছি। এই নিন। আপনি আসতে থাকুন, আমি আপনার আশেপাশেই আছি।’

অংশুল একটু সামনে এগিয়ে যায়। কুঞ্জলের কেন জানি এখন খুব ভালো লাগছে। এতক্ষণ খুব একা একা লাগছিল, ভয় লাগছিল। রাস্তাটার এই অংশে প্রতিযোগী কম।

অংশুল একটু এগিয়ে গিয়ে থামে। কুঞ্জল যখন দৌড়ে কাছাকাছি আসে তখনই আবার ও সামনে এগিয়ে যায়। অংশুলকে আজ খুব সুন্দর লাগছে জিন্স আর সাদা টি-শার্ট তার উপর কালো জ্যাকেটে দারুণ হ্যান্ডসাম লাগছে।

অংশুল উৎসাহ দেবার গলায় বলে, ‘ফাইনাল ল্যাপ। এবার কিন্তু জোরে দৌড়াতে হবে।’

কুঞ্জল হাতঘড়ির দিকে তাকায়। মিনিট পাঁচেকের মতো ও পিছিয়ে আছে। হ্যাঁ, এবার ও সবটুকু দিয়ে দৌড়ুবে। ইচ্ছে করেই প্রথমে আস্তে আস্তে দৌড়িয়েছে।

কুঞ্জল গতি বাড়ায়। একে একে অনেকেই এবার পিছে পড়তে থাকে। শেষ দুইশ মিটার ও দৌড়ুয় একদম পেশাদার দৌড়বিদদের মতো। লম্বা লম্বা স্টেপে হরিণের মতো ছুটতে থাকে। আর অবাক হয়ে খেয়াল করে ওর সামনে দুইজন মাত্র প্রতিযোগী আছে। চারপাশ থেকে সবাই চিৎকার করে উৎসাহ দিচ্ছে। তার মাঝে অংশুলের গলাটাও শুনতে পায়। কুঞ্জল একবার অর্কের মুখ মনে করে, তারপর শরীরের সবটুকু শক্তি এক করে ছোটে।

কুঞ্জলে বুক হাঁপড়ের মতো উঠানামা করছে। UCR এর একজন অফিশিয়াল এসে ওকে অভিনন্দন জানায়, ‘আপনি সেকেন্ড হয়েছেন। আপনি কিন্তু থাকবেন, সবার শেষ হলে আমরা সার্টিফিকেট আর প্রাইজমানি দেব। আপনি একটা ক্রেস্টও পাবেন।’

কুঞ্জল অবিশ্বাস নিয়ে তাকায়। ও সেকেন্ড হয়েছে! এমন সময় অংশুল হইহই করতে করতে এগিয়ে আসে, ‘অসাধারণ পারফরম্যান্স। আপনি তো দেখি মাত করে ফেললেন। কংগ্রাচুলেশনস কুঞ্জল।’

কুঞ্জল কপালের ঘাম মুছে বলে, ‘অনেক ধন্যবাদ।’

কিছুক্ষণ পর আফরোজা আপু হাঁপাতে হাঁপাতে আসেন। চোখ কপালে তুলে বলেন, ‘তুই তো দেখি এসেই বাজিমাত করে দিলি। কংগ্রাচুলেশনস কুঞ্জল। অনেক ভালো লাগা। শোন, আমার যেতে দেরি হবে। তুহিন বলছিল তোর নাকি তাড়া আছে। কিন্তু তুই যাবি কী করে? আর তোর প্রাইজ, সার্টিফিকেট, ট্রফি এগুলো নিবি না?’

কুঞ্জল অসহায় গলায় বলে, ‘আপু, আজ আমার ছেলের স্কুলে ফাইনাল খেলা। আমাকে এখনই যেতে হবে। আপনি যদি কষ্ট করে আমার ট্রফি প্রাইজ মানি নিয়ে আসতেন খুব খুশি হতাম।’

আফরোজা আপু মন খারাপ গলায় বলে, ‘আহারে, এতো ভালো করলি, নিজ হাতে পুরস্কার নিবি না? আচ্ছা, তুই যা আমি নিয়ে আসব তোরটা।’

কুঞ্জল থ্যাংকস জানিয়ে এবার ছোটে। পেছন থেকে অংশুল ওর মোটরসাইকেল চালিয়ে এসে ওর পাশে থামে, ‘আপনি চলে যাচ্ছেন! একবার বিদায় নিলেন না?’

কুঞ্জল লজ্জিত গলায় বলে, ‘সরি। আমার মাথার ঠিক নেই। আমার এখনই বাসায় যেতে হবে। আজ অর্কের স্কুলে ফাইনাল খেলা। আফরোজা আপুর গাড়িতে যাব ভেবেছিলাম। কিন্তু উনি এখন যাবেন না। ভীষণ মুশকিল হয়ে গেল।’

অংশুল ওর দিকে তাকিয়ে গম্ভীরমুখে বলে, ‘আপনি আমার কথা একবারও ভাবলেন না? দেখলেন তো আমি মোটরসাইকেল নিয়ে এসেছি। তাও আমার কাছে লিফট চাইলেন না? আমি কি আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসলে খুব অন্যায় হবে?’

কুঞ্জল থমকে ওর মুখের দিকে তাকায়। ওর গলায় একটা অভিমান টের পায়। কেমন বাচ্চাদের মতো মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছে। যদিও অভিমানটা পাত্তা দেওয়া উচিত না, কিন্তু আগে পৌঁছুতে পারবে এই ভেবে ও রাজি হয়। হাসিমুখে বলে, ‘আপনি পৌঁছে দিয়ে এলে খুব উপকার হয়। আগে যেতে পারব।’

অংশুলের মুখে এবার হাসি দেখা যায়। কুঞ্জল উঠে বসে আলতো করে ওর কাঁধটা ধরে। অংশুল এক্সিলারেটরে চাপ দেয়, মোটরসাইকেল এগিয়ে চলে।

আধা ঘন্টার মধ্যেই ওরা পৌঁছে যায়। কুঞ্জল দ্রুত নেমেই দৌড় দিতে নিয়েও থেমে যায়। তারপর ফিরে এসে হেসে বলে, ‘থ্যাংকিউ সো মাচ। আমার ভীষণ উপকার হলো। এটাই আমার বাসা। আজ উপরে আসতে বলতে পারলাম না। আমি এখুনি ড্রেস চেঞ্জ করে স্কুলে যাব। আরেকদিন অবশ্যই আসবেন।’

অংশুল মাথা নাড়ে, তারপর বলে, ‘সে না হয় আসব। আপনি তো ছেলের স্কুলে যাবার তাড়া আছে, চাইলে আমি অপেক্ষা করি। আপনি নামুন, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসব।’

কুঞ্জল হাসে, তারপর বলে, ‘স্কুলটা কাছেই, অসুবিধা হবে না। আমি যাই।’

কথাটা বলে কুঞ্জল আর দাঁড়ায় না।

অংশুল ওর চলে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে থাকে। তারপর হালকা করে মাথা নেড়ে মোটরসাইকেল ঘুরিয়ে চলে যায়।

কুঞ্জল দ্রুত লিফট থেকে নেমে দরজার চাবি ঘুরিয়ে খুলতেই দেখে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ? ও ভ্রু কুঁচকে তাকায়, অভীক বাসায়?

কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে যায়। ও অবাক হয়ে খেয়াল করে অভীক দাঁড়িয়ে আছে। চোখমুখ থমথমে।

একটা অশ্রাব্য গালি দিয়ে বলে, ‘প্রেমিক পৌঁছে দিল বুঝি? আজ আমি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে আগে না এলে তো দেখতেই পেতাম না। আমাকে খারাপ বলো, আর নিজে তলে তলে এসব করছ। অসভ্য, নষ্টা মেয়ে একটা।’

কথাটা শেষ হতেই সজোরে একটা চড় এসে পড়ে কুঞ্জলের গালে। মাথাটা যেন ঘুরে উঠে। ও গালে হাত চেপে ধরে। বিস্ময়ে বোবা হয়ে ও তাকিয়ে থাকে। অভীক অশ্রাব্য সব গালি দিয়ে যাচ্ছে।

কুঞ্জল চোখের জল মুছে কঠিন গলায় বলে, ‘তুমি আমার গায়ে হাত তুললে? এতটা নীচ। ছিঃ!’

অভীক হিংস্র গলায় বলে, ‘তোর গায়ে হাত তোলাই উচিত।’

কুঞ্জল কেটে কেটে বলে, ‘আরেকবার হাত তুলে দেখো। আমি সোজা যেয়ে থানায় মামলা করব। তখন পুলিশ ঘাড় ধরে থানায় নিয়ে যাবে।’

অভীক থমকায়। ক’দিন আগেই ওর এক কলিগের সাথে এমন হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা খুব কঠিন মামলা, জামিন অযোগ্য। ও গজগজ করতে করতে ভেতরে চলে যায়।

কুঞ্জল নিজের রুমে যেয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। তারপর আয়নার সামনে একবার দাঁড়ায়, গালে আঙুলের ছাপ স্পষ্ট। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, গালটা নোনতা জলের স্পর্শে জ্বলে ওঠে।

কী করবে? ইচ্ছে করছে যেদিক দু’চোখ যায় চলে যায়। অর্কের মুখটা মনে পড়ে। ছেলেটা নিশ্চয়ই বার বার ওর আসবার পথের দিকে তাকিয়ে আছে। আহারে, আমার ছোট্ট অর্ক সোনা। এই প্রেমহীন সংসারের নীল বিষে সব বিষাক্ত। কুঞ্জল সিলিংয়ে ঝোলানো ফ্যানের দিকে তাকায়। বেঁচে থাকতে আর ইচ্ছে করছে না। একটু ভেবে উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে কুঞ্জল।

(চলবে)

প্রেমহীন সংসার আহা সোনামুখী সুঁই পর্ব-০৯

0

#প্রেমহীন_সংসার_আহা_সোনামুখী_সুঁই (পর্ব ৯)

১.
অর্কের আজ ভীষণ আনন্দ। ভোর হতেই ও ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। আম্মু তখনও ঘুমুচ্ছিল। ও ডেকে ডেকে আম্মুকে উঠিয়ে রেডি হয়ে বের হয়েছে। পায়ে কাল বাবার কিনে আনা নতুন জুতো। আম্মুও আজ নতুন জুতো পরেছে।

কুঞ্জলের ভীষণ আলসেমি লাগছিল ঘুম থেকে উঠতে। কাল অনেক রাতে ঘুম এসেছে, আরেকটু ঘুমাতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু অর্কের উত্তেজনা দেখে ওকে আর নিরাশ করেনি। রেডি হয়ে যখন বেরোয়, অভীক তখনও ঘুমুচ্ছিল। আজ অফিস ছুটি। দশটার আগে উঠবে না ও।

ওদের বাসা থেকে একটু এগিয়ে যেতেই ছোট্ট একটা মাঠ। অনেকেই সকালে এখানে দৌড়োয়। ইতোমধ্যে অনেকেই এসেছে, কেউ দৌড়ুচ্ছে, কেউ জোর কদমে হাঁটছে। মাঠে ঢুকেই অর্ক এক দৌড়ে অনেকটা এগিয়ে গিয়ে থামে, তারপর পেছন ফিরে চিৎকার করে বলে, ‘আম্মু, তুমি স্টপ ওয়াচ চালু করো।’

কুঞ্জল হেসে মোবাইলের স্টপ ওয়াচ চালু করে। তারপর ইশারা করতেই অর্ক ছোটা শুরু করে। ওর ছোট ছোট পা দুটো একটা নির্দিষ্ট ছন্দে এগিয়ে চলে। অনেকটা দৌড়ে ও যখন কুঞ্জলের সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন রীতিমতো ও হাঁপাচ্ছিল।

কুঞ্জল স্টপওয়াচ বন্ধ করে, ওর দিকে সস্নেহে তাকিয়ে বলে, ‘১৮ সেকেন্ড। তোমাদের তো একশ মিটার দৌড় হবে। তুমি এক কাজ করো বাবা। এখান থেকে দৌড়ে ওই গাছটা পর্যন্ত যাবে। ওটাই তোমার টার্গেট। আমি ঘড়িতে হিসেব রাখছি।’

অর্ক এবার চোখমুখ সিরিয়াস করে দৌড়ের পজিশন নেয়। কুঞ্জল এবার সুর করে বলে, ‘রেডি, ওয়ান, টু, থ্রিইইই।’

অর্ক তীরের বেগে ছুটে চলে। কুঞ্জল এক বুক মায়া নিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর ছেলেবেলা দেখতে পায়। স্কুলে ও যখন দৌড়ুত তখন এমন করে সকালে উঠে প্রাকটিস করত।

গাছের সামনে পৌঁছুতেই ও ঘড়ি বন্ধ করে। তারপর বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে থাম্পস আপ করে।

অর্ক কাছে এসে আগ্রহের সাথে বলে, ‘কত সেকেন্ড লেগেছে আম্মু।’

কুঞ্জল হাসিমুখে বলে, ‘১৭ সেকেন্ড। অনেক ফাস্ট দৌড়েছ বাবা।’

অর্কের চোখে হাসি দেখা যায়। এবার ও ফার্স্ট হবেই। ও আবার দৌড়ের প্রস্তুতি নিতেই কী মনে করে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, ‘আম্মু, তুমি দৌড়ুবে? দেখি তুমি আমার সাথে পারো কি-না?’

কুঞ্জল হাসে, ‘আমি দৌড়ুব? তোর সাথে পারব না বাবা। সেই কবে দৌড়াতাম, এখন এত দমও নেই।’

অর্ক এবার মাকে পেয়ে বসে, ‘না, না। তোমাকে দৌড়াতে হবে। মোবাইলটা আমার কাছে দাও, আমি স্টপওয়াচ চালু করে দেখব তোমার কত সময় লাগে।’

কুঞ্জল একটু ভাবে। সত্যি বলতে ওর খুব ইচ্ছে করছে দৌড়ুতে। কিন্তু কেমন একটা জড়তা কাজ করছে। অবশ্য ওর মতো কয়েকটা মেয়ে দৌড়ুচ্ছে।

অর্ক আবার আবদারের গলায় বলে, ‘আসো না আম্মু। একবার শুধু।’

কুঞ্জল এবার উড়নাটা কোমরে পেচিয়ে বাঁধে। তারপর মোবাইলটা অর্কের হাতে দিয়ে বলে, ‘আচ্ছা, তুই হিসেব রাখ।’

কুঞ্জলের কেমন একটা উত্তেজনা হচ্ছে। কতদিন পর আজ দৌড়ুবে ও। পেছন থেকে অর্কের কচি গলায় চিৎকার শোনা যায়, ‘আম্মুউউ, রেডি, ওয়ান, টু, থ্রিইইই।’

কুঞ্জল ছোটে। প্রথমে একটু জড়তা নিয়ে, তারপর বেশ সাবলীল ভঙ্গিতে গাছটার কাছে এসে ও দৌড় শেষ করে। জোরে জোরে হাঁপাতে থাকে। হাঁপড়ের মতো বুক উঠানামা করছে। কতদিন অভ্যাস নেই, তাই অল্পতেই দম ফুরিয়ে গেছে। পেছন থেকে অর্কের ছুটে আসা টের পায়। কাছে এসে ও চিৎকার করে বলে, ‘আম্মু তুমি তো প্রো। মাত্র ১৫ সেকেন্ড লেগেছে তোমার। ও আম্মু, তুমি এত ভালো দৌড়াও!!’

কুঞ্জল হাসে। সত্যিই অনেক ভালো লাগছে। দৌড়ানোর সময় মনে হয় ও যেন আকাশে উড়ছে। ছোটবেলায় দৌড়োনোর সময় মনে হতো ও বুঝি পাখির মতো আকাশে উড়ে যাবে।

সেদিনের মতো দৌড় শেষ করে ওরা যখন বের হয়ে আসছিল ঠিক তখন ,পেছন থেকে কেউ ডাকে, ‘আপুউ ! তুমি এত সুন্দর করে দৌড়াতে পারো!’

কুঞ্জল পেছন ঘুরে তাকাতেই দেখে তুহিন, পৃথুলের ছোট ভাই। লজ্জা পেয়ে বলে, ‘আমি কী আর পারি। ওই অর্কের স্কুলে একটা দৌড়ের কমপিটিশন আছে তাই নিয়ে এসেছিলাম। জানিস তো স্কুলে আমি খুব ভালো দৌড়ুতাম। তা তুই দৌড়াস নাকি?’

তুহিনের গায়ে নেভি ব্লু রঙের ট্র‍্যাকস্যুট, পায়ে কেডস। ও কাছে এসে বলে, ‘আপু, আমি তো নিয়মিত দৌড়াই। অনেকগুলো ম্যারাথন দৌড়িয়েছি। আগামী মাসের ছাব্বিশ তারিখেও একটা দশ কিলোমিটারের ম্যারাথন আছে।’

কুঞ্জলের হঠাৎ করেই সাইফুল্লাহ স্যারের কথা মনে পড়ে যায়। উনি বলেছিলেন এমন অনেকে ম্যারাথন দৌড়ুয়। ও আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করে, ‘মেয়েরাও যায়?’

তুহিন চনমনে গলায় বলে, ‘হ্যাঁ তো আপু। আমাদের এখানেই একটা বড়ো আপু আছে, ডাক্তার আফরোজা আপু। উনি তো আমাদের সব দৌড়ে অংশগ্রহণ করেন। তুমি দৌড়ুবে আপু?’

কুঞ্জল অর্কের দিকে তাকায়, অর্ক চিৎকার করে বলে, ‘হ্যাঁ, আম্মু দৌড়ুবে।’

কুঞ্জল হাসে, তারপর তুহিনের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আমি পারব? দমই তো নেই। কতদিন দৌড়াই না।’

তুহিন এবার উৎসাহের সাথে বলে, ‘আপু, তুমি ঠিক পারবে। হাতে তো এখনও মাসখানেক সময় আছে। প্রতিদিন সকালে এসে আধা ঘন্টা করে দৌড়ুলে দেখবে সব ঠিক হয়ে যাচ্ছে। আর আমি কিছু টিপস শিখিয়ে দেব নে।’

কুঞ্জল একটা উত্তেজনা বোধ করে। সত্যিই ও দৌড়ুবে?

সেদিন বাসায় ফিরতেই অর্ক দৌড়ে বাবার রুমে যায়, হড়বড় করে বলে, ‘জানো বাবা, আম্মু অনেক জোরে দৌড়ুতে পারে। আমাকে আজ হারিয়ে দিয়েছে।’

অভীক সবে ঘুম থেকে উঠেছে। কাল অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম আসেনি। কুঞ্জলের সাথে ঝগড়াটা হবার পর থেকেই আর ঘুম আসেনি। ইদানিং কী যে হয়, কুঞ্জল ওর কোনো কিছুতেই স্বাভাবিক আচরণ করে না। আদর করে চুমু খেতে গেল আর তাতে কেমন উলটো কথা বলল। কাল ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠেও কেমন একটা শূন্যতা ঘিরে ধরেছিল। কিন্তু এখন অর্ককে দেখে ভালো লাগছে।

ও বিছানা থেকে উঠে বসে বলে, ‘তোমার জুতো ঠিকঠাক ছিল?’

অর্ক মাথা দোলায়।

অভীক একবার ওর দিকে তাকায়, ‘এই টি-শার্ট পরে দৌড়ুতে গিয়েছিলে? ট্র‍্যাকস্যুট নেই?’

অর্ক মুখ কালো করে মাথা নাড়ে, ‘না তো বাবা।’

অভীক ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘আচ্ছা নাস্তা করে নেই। তারপর চলো মার্কেটে যাব। তোমাকে একটা সুন্দর ট্র‍্যাকস্যুট কিনে দেব।’

রান্নাঘর থেকে কুঞ্জল ওদের কথা শুনছিল। অর্কের জন্য আসলেই একটা ট্র‍্যাকস্যুট কেনা দরকার। সকালে খুব ঠান্ডা পড়ে। জ্যাকেট পরে তো আর দৌড়ুনো যায় না। যাক, ছেলের ব্যাপারে অন্তত খেয়াল আছে। এটুকু থাকলেই হবে।

কুঞ্জল দ্রুত তিনটা রুটি ভেজে ফেলে সাথে ডিম-আলু ভাজি, আর চা। ওদের নাস্তা করতে দিয়ে ও নিজেও আলাদা করে বসে।

ওরা বেরোবার সময় অভীক গম্ভীরমুখে বলে, ‘কিছু আনতে হবে? আমি অর্ককে নিয়ে বাইরে যাচ্ছি। তুমি যাবে?’

কুঞ্জল শুকনো গলায় বলে, ‘না, আমি যাব না। চা, আর গুড়ো দুধ শেষ।’

অভীক ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছাড়ে। তারপর ছেলেকে নিয়ে বেরোয়।

ওরা চলে যেতেই কুঞ্জল দুপুরের রান্না নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আজ বিরিয়ানি রান্না করবে ও। সেইসাথে নতুন একটা ভিডিও করে ফেলা যাবে, ভাবে কুঞ্জল।

দুপুর নাগাদ ওরা যখন ফিরে আসে ততক্ষণে কুঞ্জল রান্না শেষে গোসলের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

অর্ক বাসায়ায় ঢুকেই আনন্দের গলায় বলে, ‘আম্মু, দেখো কত কী এনেছি। এটা আমার ট্র‍্যাকস্যুট। আর এটা তোমার।’

কুঞ্জলের কপালে ভাঁজ পড়ে, অবাক গলায় বলে, ‘আমার ট্র‍্যাকস্যুট মানে?’

অর্ক দুষ্ট হাসি হেসে বলে, ‘বাবাকে বলেছি তুমি ম্যারাথন দৌড়ুবে। বলতেই বাবা এটা কিনে দিয়েছে।’

কুঞ্জল নিচের ঠোঁট কামড়ে একবার আড়চোখে অভীকের মুখের দিকে তাকায়। একটা সময় মানুষটা ওর ছিল, ভালোবাসত এমন করে। অনেক দিন পর একটু হলেও মায়া টের পায়। অভীক কি সত্যি সত্যি ভালো হয়ে গেছে, নাকি সাময়িক?

২.
কুঞ্জল চিন্তিত মুখে গরুর মাংসের ভুনার দিকে তাকিয়ে আছে। রেসিপি দেখে ঠিকঠাকই বানিয়েছে। খেতে ভালোও হয়েছে। কিন্তু একবার খেলে স্বাদ মুখে লেগে থাকার মতো ভালো হয়নি। ওর মনে পড়ে, মাঝে মাঝে এক দুটো দাওয়াতে মুখে লেগে থাকার মতো গরুর মাংসের ভুনা খেয়েছিল। কিন্তু ও কিছুতেই কাঙ্ক্ষিত স্বাদটা আনতে পারছে না। সমস্যাটা কোথায়? মানুষ ওর রান্নার রেসিপি দেখে রান্না করে যদি কাঙ্ক্ষিত স্বাদটা না পায় তাহলে তো ওর পেজটা একটা সময় চলবেই না। এই ক’দিনেই ওর পেজের ফলোয়ার পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। সবাই ওর নতুন নতুন রেসিপি খুব পছন্দ করছে। কিন্তু এই সোজা রান্নাটা কিছুতেই মন মতো হচ্ছে না।

একটু ভাবতেই শেফ অংশুলের কথা মনে পড়ে৷ একবার জিজ্ঞেস করে দেখবে? শেষবার তো ওর রান্নার প্রশংসা করেই কমেন্ট করেছিল। একটু দ্বিধা করে শেষ পর্যন্ত মেসেজ দেয়, “রান্না না জেনেও রান্না করি। তাই একটু সাহায্যের দরকার ছিল। সব ঠিকঠাক দেবার পরও গরুর মাংস ভুনাটা মন মতো হচ্ছে না। একটু কি ঠিকঠাক করে দেবেন ‘রান্না জানা মানুষ’?”

অংশুল একজন ‘কমি শেফ’কে (শিক্ষানবিশ) সবজি কাটার টেকনিক শেখাচ্ছিল। ছেলেটা বরাবরই স্লাইসগুলো মোটা করে করছিল। অংশুল নিখুঁত মাপে কেটে দেখিয়ে দিয়ে বলে, ‘এভাবে কাটবে। আমার প্রতিটা স্লাইস এক মাপের, প্রয়োজনে স্কেল দিয়ে মেপে দেখতে পারো।’

ছেলেটা শ্রদ্ধাবনত চোখে একবার তাকায়। এমন একজন গুণী শেফের কাছে হাতেকলমে রান্না শিখতে পারবে ও ভাবেনি। ছেলেটা এবার আবার চেষ্টা করে।

অংশুল এবার নিজের স্টেশনে ফিরে এসে মোবাইলটা হাতে নেয়। সাইলেন্ট করে রাখা ছিল৷ হাতে নিতেই দেখে কুঞ্জলের মেসেজে। কৌতুহল নিয়ে খুলতেই হেসে ফেলে। নাহ, মেয়েটা এখনও রেগে আছে। শুরুতেই খোঁচা দিয়ে লিখেছে। আবার শেষটাতেও রান্না জানা মানুষ বলে সম্বোধন করেছে।

একটু ভাবে, তারপর লিখে, “হ্যালো, ‘রান্না না জানা মানুষ’, মাংস ভুনা কেন মনমতো হচ্ছে না সেটা তো না খেয়ে বলতে পারব না। একদিন সকালে চলে আসুন না আমার রেস্তোরাঁয়। খেয়ে বলব কী সমস্যা। আর এটা আমার ফোন নম্বর।”

কুঞ্জল রান্নাঘরে হাঁড়িকুঁড়ি গোছাচ্ছিল। আর একটু পর পর মোবাইলের দিকে উৎসুক চোখে তাকাচ্ছিল। ঠিক তখুনি অংশুলের মেসেজ আসে। ও দ্রুত টাওয়ালে হাত মুছে মোবাইল হাতে নেয়, তারপর ফিক করে হেসে ফেলে। লোকটা দুষ্ট আছে তো। ওকে ‘রান্না না জানা মানুষ’ বলে সম্বোধন করেছে। পুরো মেসেজ পড়ে একটু ভাবে, তারপর লিখে, ‘তাহলে কালই আসছি। আজকের রান্না করা মাংসটা ফ্রিজে উঠিয়ে রাখছি। অনেক অনেক ধন্যবাদ আমাকে আপনি সময় দেবেন বলে।’

কুঞ্জল এবার একটা ছোট টিফিন বক্সে মাংসটা বেড়ে ফ্রিজে রাখে। তারপর সব গুছিয়ে যখন গোসল করতে যায় তখন হঠাৎ করেই একটা কথা মনে হয়, আচ্ছা, এই লোকটা ওকে এতটা সময় দিচ্ছে কেন? ওনার মতো ব্যস্ত শেফের এত কী দায় পড়েছে যে ওর রান্না খেয়ে সেটা ঠিক করে দেবে?

পরদিন সকালে অর্কের সাথে দৌড় শেষ করে ও গোসল করে রেডি হয়। অর্ককে স্কুলে দিয়ে তারপর বাসায় এসে মাংসটা নিয়ে বের হয়। আধা ঘন্টা পর ও যখন ইনকা রেস্তোরাঁর সামনে এসে পৌঁছে ততক্ষণে সকাল দশটা বেজে গেছে। আধুনিক, ঝকঝকে একটা রেস্তোরাঁ। খুব সুন্দর আর রুচিশীল সব জিনিসপত্র দিয়ে সাজানো। ভেতরটা এখন খালি। দুপুর থেকে ভীড় বাড়ে আর সেটা রাত বারোটা অব্দি চলবে। কুঞ্জল মোবাইল বের করে ফোন দিতেই ওপাশ থেকে ভরাট একটা গলা ভেসে আসে, ‘আপনি নিশ্চয়ই কুঞ্জল?’

কুঞ্জল একটু অবাক হয়, তারপর বলে, ‘হ্যাঁ। আমি আপনাদের রেস্টুরেন্টের ভেতরে।’

ফোনটা কেটে যায়। কুঞ্জল আবার ফোন করতে যেতেই পেছন থেকে কেউ একজন বলে ওঠে, ‘রান্না না জানা মানুষ।’

কুঞ্জল একটু কেঁপে ওঠে পেছন ফেরে। লম্বা, একহারা গড়নের একজন মানুষ। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা, লম্বাটে মুখ, তীক্ষ্ণ চোখ, চুলগুলো ছোট ছোট করে ছাঁটা। গলার স্বর ভরাট, শুনতে ভালো লাগে। বয়স ওর কাছাকাছিই হবে অথবা কয়েক বছর বড়ো।

ওকে রান্না না জানা মানুষ বলে সম্বোধন করাতে হেসে ফেলে, ‘আপনি নিশ্চয়ই অংশুল?’

অংশুল মাথা নাড়ে, তারপর বলে, ‘চলুন, ওপাশটায় যেয়ে বসা যাক। তার আগে আপনার মাংসের বাক্সটা দিন। আমি কাউকে গরম করে দিতে বলি। আজ না হয় আপনার মনমতো না হওয়া মাংস দিয়েই নাস্তা করি।’

কুঞ্জল হাসে, তারপর টিফিনবক্সটা ওর হাতে দেয়। অংশুল একজনকে ডেকে বুঝিয়ে দেয়। তারপর ওর দিকে ফিরে তাকায়। মিষ্টি চেহারার একটা মেয়ে। মুখটা মায়া মায়া।

এক কোণে বড়ো কাচঘেরা দেয়ালের পাশে একটা টেবিলে ওরা বসে। কাচের ভেতর দিয়ে ওপাশে ছোট একটা সবুজ লন দেখা যাচ্ছে। অংশুল এবার ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আপনি ভালো আছেন তো?’

কুঞ্জল হাসে, মাথা নেড়ে বলে, ‘হ্যাঁ, ভালো আছি।’

অংশুল চেয়ে থাকে, মেয়েটার মুখ হেসেছে, কিন্তু চোখ হাসেনি। কেমন নিষ্প্রাণ। কুঞ্জল এবার নিজেই রান্নার অনেক গল্প জুড়ে দেয়। অনেক কিছুই জানতে চায়৷ অংশুল মৃদু হেসে ওর সব প্রশ্নের একটা একটা করে উত্তর দেয়।

কিছুক্ষণ পর ওর রান্না করে নিয়ে আসা মাংসটা আসে সাথে লাচ্ছা পরোটা। একটা প্লেটে সুন্দর করে কিছু সালাদ। অংশুল ওর প্লেটে বেড়ে দিয়ে নিজে নেয়। তারপর খাওয়া শুরু করতেই কুঞ্জল চিন্তিত মুখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।

অংশুল খেতে খেতে বলে, ‘কী ব্যাপার, আপনি খাচ্ছেন না কেন? আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনার পরীক্ষার রেজাল্ট দেবে। নিন, খান। আমার সময় লাগবে রান্নার সমস্যাটা ধরতে।’

কুঞ্জল মন খারাপ করে খেতে থাকে। এই লোক কী না কী বলবে। ধুর, ঝোঁকের মাথায় এমন করে আসা উচিত হয়নি। ও তো আর শেফ হবে না। একটু না হয় কম মজা হলোই।

খাওয়া শেষে অংশুল চা নিয়ে বলে, ‘আমার মনে হচ্ছে আপনার রান্নায় লবন আর ঝালের পরিমাণটা ঠিক নেই। মাংসগুলো চিবোনোর সময় মনে হচ্ছিল ভেতরে লবন ঢোকেনি। আর মাংস ভুনা একটু ঝাল বেশি হলেই ভালো লাগে। এই দুটো যদি ঠিকঠাক করতে পারেন তাহলেই দেখবেন একদম মনমতো হচ্ছে। আসলে যেকোনো রান্নায় লবন আর ঝালটা খুব খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটু এদিকওদিক হলেই গোলমাল। সংসারে যেমন বিশ্বাস আর মায়া এদিকওদিক হলেই সব গোলমাল, তেমন আর কী।’

কুঞ্জল ভ্রু কুঁচকে তাকায়। এই লোকটা কি ইচ্ছে করেই শেষ কথাটা বলল? কিন্তু উনি তো ওর মনের কথা জানার কথা না।

কুঞ্জলের মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। ও শুকনো গলায় বলে, ‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, আমার মতো সাধারণ একটা মানুষের জন্য এতটা সময় দিলেন।’

অংশুল মেয়েটার বদলে যাওয়া মুখটা খেয়াল করে। মাথা নেড়ে বলে, ‘হ্যাঁ, আপনি ঠিক বলেছেন। আপনাকে এতটা সময় দেবার কথা না। কিন্তু দিলাম। কেন দিলাম, জানেন?’

কুঞ্জল সরু চোখে তাকিয়ে বলে, ‘কেন দিলেন?’

অংশুল ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘আপনি আমার মেসেজের উত্তরে লিখেছিলেন যে আপনি রান্না করেন জাগতিক কষ্ট ভুলে থাকার জন্য। এই মেসজটা পড়ে মনে হয়েছে আপনি আমার খুব আপন কেউ। কারণ, আমিও আপনার মতোই দু:খ, কষ্ট ভুলে থাকার জন্য রান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকি। আমার জীবনে এই প্রথম কাউকে পেলাম যে আমার মতোই কষ্ট থেকে পালিয়ে বেড়াতে রান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তাই সেদিনের পর থেকে আপনি আমার কাছে খুব মূল্যবান একজন মানুষ। আপনার গুরুত্ব আমার কাছে অনেকই বেশি।’

কুঞ্জল স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকে। ওর মতো কষ্ট ভুলতে ইনিও এমন রান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করে! তারমানে উনিও ওর মতোই জীবনে আঘাত পাওয়া একজন মানুষ? ওনার আঘাত কি ওর চেয়েও গভীর?

কুঞ্জল ফিসফিস করে বলে, ‘আপনার কষ্টগুলো কি আমাকে বলবেন?’

অংশুলের বুকের ভেতর কোথায় যেন একটা কিছু হয়ে যায়। আহ, এতদিন পর কেউ এমন করে জানতে চাইল ওর কষ্টের কথা, একাকীত্বের কথা। হ্যাঁ, ও বলবে, সব খুলে বলবে। এই মেয়েটা যে ওর মতোই কষ্ট পাওয়া মানুষ।

ওরা দু’জন সেদিন মনের আগল খুলে সব কষ্টের কথা বলে। বিশ্বাস হারানোর গল্প বলে। ওরা ঠিক বুঝে পায় না কার মনের ক্ষত কতটা বেশি গভীর।

(চলবে)

প্রেমহীন সংসার আহা সোনামুখী সুঁই পর্ব-০৮

0

#প্রেমহীন_সংসার_আহা_সোনামুখী_সুঁই (পর্ব ৮)

১.
অংশুল মনোযোগ দিয়ে এবারের মিশেলিন স্টার গাইডটা দেখছিল। মিশেলিন স্টার হলো শেফদের জন্য অনেকটা অস্কার জেতার মতো। শুধু রান্না ভালো হলেই হবে না, এর পরিবেশন, নতুন নতুন রেসিপি উদ্ভাবন – সব মিলিয়ে যারা অসাধারণ কিছু করে তারাই এই সম্মান পায়। একজন শেফের সারাজীবনের স্বপ্ন, কম করে একটা মিশেলিন স্টার পাওয়া অথবা একটা মিশেলিন স্টার রেস্তোরাঁয় কাজ করা। এই মুহুর্তে উনিশটি মিশেলিন স্টার নিয়ে ‘এলেইন ডুকাস’ তালিকার একদম প্রথমেই আছেন। আর ওর প্রিয় গর্ডন রামসে সাতটা মিশেলিন স্টার নিয়ে আছেন তালিকার মাঝামাঝিতে। ইশ, ওঁদের মতো এমন বিখ্যাত শেফ যদি হতে পারত! তা রান্নাটা ও বেশ মনোযোগ দিয়েই করে। আর তার ফলও হাতে হাতে – শহরের নামী রেস্তোরাঁ বলতে ‘ইনকা’ কে সবাই একনামেই চেনে। এই রেস্তোরাঁয় এক্সিকিউটিভ শেফ অর্থাৎ শেফ দ্য কুইজিন হিসেবে বছর পাঁচেক ধরে কাজ করছে। মালিকপক্ষ অনেকটা তোয়াজ করেই ওকে রাখে। একটাই সমস্যা, ওর রাগটা একটু বেশি।

অংশুল ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে চায়ে চুমুক দেয়। তারপর জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়, শীতের সকাল। একটু একটু করে রোদ বাড়ছে। এসময়টা ওর বরাবরই ভালো লাগে।

এমন সময় মেসেজের ‘টুন’ শব্দে ও ফিরে তাকায়। বিরক্ত হয়ে দেখে মেসেঞ্জারে মেসেজ এসেছে। ও মেসেঞ্জার খুলতেই দেখে একগাদা মেসেজ স্প্যাম ফোল্ডারে জমা হয়েছে। নাহ, এগুলো সব ডিলিট করতে হবে। অংশুল মেসেজগুলো সিলেক্ট করে ডিলিট করতে যেয়ে হঠাৎ একটা মেসেজে চোখ পড়ে, কুঞ্জল নামে একটা মেয়ের মেসেজ। নামটা চেনা লাগছে। পরিচিত কেউ?

কৌতুহল নিয়ে ও মেসেজ বক্স খোলে। মেসেজটা কয়েকদিন আগে এসেছে। কচুবাটা কী করলে গলায় ধরবে না সেটা জানতে চেয়েছে মেয়েটা। এবার মনে পড়ে। আরে, এই মেয়েটা তো সেই মেয়েটা যে নারকোল দিয়ে কচুবাটার একটা ভিডিও ছেড়েছিল। আর লোকজন সমানে প্রশংসা করে যাচ্ছিল। আজকাল সবাই শেফ হতে চায়। রান্নার বেসিক না জেনেই একটা যা তা ভিডিও ছেড়ে দেয় আর লক্ষ লক্ষ লাইক, কমেন্ট পড়ে। এসব অংশুলের ভীষণ বিরক্ত লাগে। সেদিন এই মেয়েটার ভিডিও দেখে আনাড়ি মনে হলেও এর কাজটা পরিপাটি ছিল। কিন্তু রান্নার রেসিপিতে একটু ভুল ছিল। কী মনে হতে অংশুল মেয়েটার প্রশ্নের উত্তর দেয়,

‘আপনি কচুর টুকরোগুলো ব্লেন্ড করার পর সরাসরি না মাখিয়ে আগে কচুর পেস্টটা একটা পাতলা কাপড়ে জড়িয়ে নিয়ে চেপে চেপে সব পানিগুলো বের করে ফেলবেন। অনেকে এটাকে কচুর দুধ বলে। এটাই মূলত গলায় ধরে। সব পানি ঝরিয়ে একদম ঝরঝরে হয়ে গেলে তখন আর গলায় ধরবে না। আর, রান্না না শিখে সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার লোভে রান্নার ভিডিও ছাড়বেন না। আপনার জন্য অনেক শুভকামনা রইল।’

ইচ্ছে করেই একটু রুঢ় করে লিখে অংশুল, যাতে
এরা একটু ঠিক হয়।

কুঞ্জল আজ মেথি দিয়ে হাঁসের রান্না করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। মোবাইলটা রান্নাঘরের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় সেট করে। তারপর একবার ভিডিও অপশনটা চালিয়ে দেখে। নাহ, সব ঠিকঠাক আছে। সন্তুষ্ট মনে আজকের রান্নার নতুন ভিডিওটা শুরু করতে যেতেই মেসেজ আসার একটা শব্দ পায়। নাহ, নেটটা বন্ধ করে নেওয়া উচিত ছিল। ভ্রু কুঁচকে স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে খেয়াল করে সেই বিখ্যাত শেফ লোকটা ওর মেসেজের উত্তর দিয়েছে। বুকটা একটু চলকে ওঠে।

ও ঝট করে মোবাইলটা হাতে নেয়, তারপর দ্রুত মেসজটা খুলতেই হোঁচট খায়। খুব ভালো একটা টিপস দিয়েছেন ভদ্রলোক, কিন্তু এমন রুঢ় করে লিখল? ও সস্তা জনপ্রিয়তা পাবার লোভে ভিডিও বানায়? না হয় উনি মস্ত শেফ, রান্না নিয়ে পড়াশোনা আছে। তাই বলে এমন করে লিখল?

মনটাই খারাপ হয়ে যায়। কেন যেন নতুন রেসিপিটা আজ করতে ইচ্ছে করছে না। এত এত ভালো কমেন্টের ভীড়ে একটা নেগেটিভ কথা কেমন করে সব উৎসাহ নিভিয়ে দেয়।

একটু ভেবে ও লিখে, ‘আপনার মতো মানুষ আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন, অনেক ধন্যবাদ। রান্নার ব্যাপারে আমার প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা নেই, কিন্তু আমি রান্না করতে ভালোবাসি। আপনার এমন হয় কি-না জানি না কিন্তু আমি রান্না করতে গেলে ওই সময়টুকু জাগতিক কষ্ট ভুলে থাকতে পারি। সবাই তো আপনার মতো প্রফেশনাল না, যারা শুধু রান্নার জন্যই রান্না করে।’

মেসেজটা পাঠিয়ে চুপ করে বসে থাকে। সকাল সকাল মনটা খারাপ করে দিল। পৃথুলকে কাল বলেছিল আজ নতুন রান্নার ভিডিও আপলোড করবে। কিন্তু এই লোকটা সব ভেস্তে দিল। কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকে। তারপর গা ঝাড়া দিয়ে উঠে, নাহ, মানুষের কথা শুনে কাজ নেই। এটা ওর বেঁচে থাকার একটা জানালা। দু’একজন এমন নেগেটিভ কথা বলবেই, তাই নিয়ে মন খারাপ করে ও বসে থাকবে না। ও নিজেই নিজেকে বোঝায়। তারপর আবার মোবাইলটা আগের জায়গায় সেট করে। তার আগে মোবাইলটা ফ্লাইট মোডে দিয়ে নেটওয়ার্ক বন্ধ করে নেয়। তারপর সুন্দর করে শুরু করে, ‘প্রিয় দর্শক, শীত মানেই হাঁসের মাংসের ভুনা। আজ আপনাদের আমি মেথি দিয়ে হাঁস রান্না করে দেখাব।’

কুঞ্জল যত্ন করে পুরো রান্নাটা করে। তারপর শেষ হতেই ও পুরো ভিডিওটা একবার দেখে নেয়। কয়েকটা জায়গায় একটু অস্পষ্ট হয়েছে ভিডিওটা, এছাড়া সব ঠিকঠাক। ভালো হতো কেউ যদি মোবাইলটা ধরে রেখে ওর রান্নাটা ভিডিও করে দিত। অর্ক বলেছিল ও ধরে রাখবে। কিন্তু কুঞ্জল দেয়নি। ছেলেটা কষ্ট করে এতক্ষণ রান্নাঘরে থাকবে এটাই মেনে নিতে পারেনি। আজ অর্কের স্কুল নেই। ও বসার ঘরে বসে পড়ছিল।

রান্না শেষ হতে দেখে এগিয়ে আসে, ‘আম্মু, তোমার শেষ? আমি কিন্তু একবারও শব্দ করিনি।’

কুঞ্জল হাসে, ‘লক্ষ্মী ছেলে তুমি। আচ্ছা, তুমি পড়াটা শেষ করো, আমি একটু গুছিয়ে গোসল করে খেতে দেব।’

এদিকে অংশুল ওর সব শেফদের ডেকে আজকের কাজগুলো বুঝিয়ে দিচ্ছিল। সবাই বেশ মনোযোগ দিয়েই ওর কথা শুনছিল। এই লাইনে শেফ দ্য কুইজিনকে সবাই খুব শ্রদ্ধা করে। আর অংশুল স্যারের রান্নার সেন্স অসাধারণ।

সবাইকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে অংশুল এবার ওর স্টেশনে গিয়ে দাঁড়ায় যেখান থেকে সব শেফদের দেখা যায়। রান্নার সময় ও ঘুরে ঘুরে তীক্ষ্ণ নজর রাখে সবার উপর। আজকের রান্না শুরু হয়।

অংশুল একবার মোবাইলে চোখ বোলায়। আর কৌতুহল নিয়ে খেয়াল করে সেই মেয়েটা আবার মেসেজ দিয়েছে। দেখবে না ভেবেও মেসেজটা দেখে। নিস্পলক চোখে চেয়েই থাকে। মোবাইলটা বন্ধ করে ও ‘সু শেফ’ ( রান্নাঘরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ) কে ডেকে বলে, ‘আমি একটু বারান্দায় বসছি। কিছু লাগলে আমাকে ডাকবে।’

এই রেস্তোরাঁর পূব কোণে একটা বড়ো বারান্দা আছে। বারান্দা পেরিয়ে ওপাশে একটা লেক। সকালের রোদ্দুর পড়ে বারান্দাটা এখন আলোকিত। অংশুল বারান্দার এককোণে রাখা বেতের একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে। মাথার লম্বা শেফ হ্যাটটা নামিয়ে রাখে, তারপর আনমনে বাইরে তাকিয়ে থাকে। অনেক দিন পর কেউ একজন ওর পুরনো কষ্টগুলো মনে করিয়ে দিল। ও কুঞ্জলের মেসেজটা আবার পড়ে, বার বার করে পড়ে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে, মেয়েটা একদম ঠিক বলেছে। রান্না ওকে ওর পুরনো দুঃখ, কষ্টগুলো ভুলে থাকতে সাহায্য করে। এটাতে ডুবে থাকতে পারে বলেই তো ও বেঁচে আছে। না হলে কবেই পাগল হয়ে যেত। প্রিয়াঙ্কাকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিল। বিয়ের পাঁচ ছয় বছর পর প্রথম টের পেল ও অন্য কারও সাথে জড়িয়ে গেছে। প্রথমে ব্যাপারগুলো সাধারণ মেসেজ ফোনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এরপর সেটা সীমা ছাড়িয়ে শারীরিক সম্পর্কে গড়াল। অংশুল যেদিন এটা জানতে পেরেছিল ভেবেছিল মরে যাবে। কিন্তু পারেনি, সন্তানের মুখ চেয়ে। প্রিয়াঙ্কা পায়ে পড়ে ক্ষমাও চেয়েছিল। পুরনো ভালোবাসার জেরে ওকে ক্ষমা করে বুকেও টেনে নিয়েছিল। ভেবেছিল সব আগেরমতো ঠিকঠাক হয়ে যাবে, কিন্তু হয়নি। প্রায়ই ঘুম ভেঙে চুপ করে বসে থাকত অংশুল। অসহ্য স্মৃতিগুলো তাড়িয়ে বেড়ায় এখনও। সেদিনের পর থেকে একটা দিন ও ভালো থাকেনি। একটা সময় রান্নায় মনোযোগ দেয়। অবাক হয়ে দেখে কষ্টটা ও ভুলে থাকতে পারছে। আচ্ছা, এই কুঞ্জল মেয়েটাও কি ওর মতোই দুঃখী যে রান্নার ভেতর ডুবে থেকে কষ্ট ভুলতে চায়? কোথায় যেন এই মেয়েটার সাথে ওর একটা মিল খুঁজে পায়। একটা মায়া টের পায় মেয়েটার জন্য।

বিকেলের দিকে কুঞ্জল যখন হাঁস রান্নার ভিডিওটা ছাড়ে সাথে সাথে লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আজকেও ঝড়ের বেগে লাইক কমেন্ট পড়তে থাকে – ‘আহ, শীতের পারফেক্ট রান্না’, ‘দেখেই মনে হচ্ছে হাঁস ভুনাটা মজা হয়েছে’। কমেন্টগুলো পড়ে ওর দিনের শুরুতে যে মন খারাপ হয়েছিল সেটা কেটে যায়। অবশ্য ফাঁকে ফাঁকে দুরুদুরু বুকে ওই লোকটা আজ কিছু লিখল কি-না সেটাও খুঁজে দেখে। নাহ, আজ এখনও কমেন্ট করেনি। কেন যেন লোকটাকে ও ভয় পাচ্ছে। শেফ মানুষ, কী না কী ভুল ধরবে কে জানে।

বিকেলে অর্ককে নাস্তা করে দিয়ে ও যেই মোবাইলটা নিয়ে বসেছে ঠিক তখুনি একটা নতুন কমেন্ট আসে। ও খুলতেই অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে থাকে, সেই লোকটা লিখেছে তো! কমেন্টটা দুইবার পড়ে, তারপর একটা অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে থাকে। লোকটা এত সুন্দর একটা কমেন্ট করেছে?

“আজকের রান্নাটা একদম পারফেক্ট। একটা মিশেলিন স্টার পেতেই পারেন এই রান্নার জন্য।’

কুঞ্জল ভ্রু কুঁচকে তাকায়, এই মিশেলিন স্টার আবার কী? ভালো কিছু সেটা বুঝতে পারছে। দ্রুত গুগলে সার্চ দিতেই ওর চোখ ছানাবড়া। এ তো দেখছি সত্যিই শেফদের একটা অনারারি র‍্যাংক। লোকটা এমন ভালো মন্তব্য করতে পারে? বিশ্বাস হতে চায় না। সকালে যখন লিখল, সস্তা জনপ্রিয়তা পাবার জন্য ও এমন করে, তখন খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন সত্যিকারের মন ভালো হয়ে গেছে। এমন নামকরা একজন শেফের মন্তব্য পেয়ে ওর আত্মবিশ্বাসের পারদ উঁচুতে উঠে। নাহ, ওনাকে সুন্দর করে লিখতেই হয়। কুঞ্জল কমেন্টের উত্তর লিখে –

‘আপনার এমন একটা মন্তব্য বাঁধিয়ে রাখার মতো। অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আমি সত্যিই অনুপ্রাণিত।’

অংশুল কমেন্টের উত্তর পড়ে মৃদু হাসে। যাক, মেয়েটার মন ভালো হয়েছে। সকালে অমন কড়া করে মেসেজ করা ঠিক হয়নি। অবশ্য তাতে একটা জিনিস তো জানতে পারল, ওর মতো কেউ একজন দুঃখ ভুলে থাকতে রান্না করে।

২.
অভীক অফিস শেষে একটা স্পোর্টস এর দোকানে ঢোকে, অর্কের রানিং স্যু কিনতে হবে। ছেলেটা নাকি স্কুলে দৌড়ের হিটে ফার্স্ট হয়েছে। বুকের ভেতর একটা নরম মায়া টের পায়।

দোকানিকে জিজ্ঞেস করতেই বলে, ‘স্যার, একদম অরিজিনাল নাইকি স্যু আছে। নিয়ে যান, মাখনের মতো নরম আর পাতলা জুতা। পঙখীরাজের মতো দৌড়াইব।’

অভীক হাসে। এগুলো কপি নাইকি, আসল না। তবে আসলের মতোই। অভীক হাতে নিয়ে একবার উল্টেপাল্টে দেখে। ভালোই মনে হচ্ছে। অর্ক বলছিল ব্ল্যাক স্যু নিয়ে যেতে। আর এটা তাই। ও দামাদামি করে স্যুটা কিনে ফেলে। তারপর বেরিয়ে আসতে যেতেই পাশের মেয়েদের শোরুমে সুন্দর একটা কার্ডিগানের দিকে চোখ পড়ে। কুঞ্জলের জন্য নেবে? নাহ থাক। দেখা যাবে এই নিয়ে উল্টো অশান্তি হবে। সেদিন শাড়ি নিয়ে যা কান্ড হলো ভাবতেই ও সংকুচিত হয়ে পড়ে। এখন সত্যিটাও কুঞ্জলের কাছে মিছে মনে হয়। আর সেজন্য ও নিজেই দায়ী। কিন্তু এমন করে সংসার হয়? এতটুকু মায়া অবশিষ্ট নেই ওর জন্য। এই যে অফিস থেকে আজ ফিরতে দেরি হচ্ছে সেটা নিয়ে একবারও ফোন আসেনি। আচ্ছা কেন ও বাড়ি ফিরে যায় যেখানে এতটুকু মায়া নিয়ে কেউ অপেক্ষা করে নেই?

মন খারাপ নিয়ে অভীক বাসায় ফেরে। অর্ক নতুন জুতো পেয়ে বাড়ি মাথায় তোলে। সাথে সাথে পায়ে দিয়ে একটু দৌড়ে দেখে। তারপর খুশিতে উচ্ছ্বসিত গলায় বলে, ‘বাবা, এটা একদম পারফেক্ট। দেখো, এবার কেউ আমার সাথে পারবে না। আর আম্মু বলেছে আমাকে কাল সকাল থেকে প্রাকটিস করাবে।’

অভীক একবার আড়চোখে দেখে কুঞ্জল মোবাইলে তাকিয়ে কী যেন দেখছে। হয়তো রান্নার ভিডিও। ইদানীং ও রান্নার ভিডিও দিচ্ছে ফেসবুকে, তাই নিয়ে হয়তো ব্যস্ত। এই যে ও অফিস থেকে ফিরে এল একবার চেয়েও দেখল না। একটা রাগ টের পায় অভীক।

গোসল সেরে এসে দেখে টেবিলে খাবার বেড়ে দেওয়া। একজনের খাবার। তার মানে ওরা খেয়ে নিয়েছে। শেষ কবে একসাথে খেয়েছে ওরা? একটা সময় কুঞ্জল বসে থাকত, ও বাইরে থেকে খেয়ে আসত। কুঞ্জল খুব কষ্ট পেত সে সময়টা। কিন্তু আজ যেন পাশার দান উলটে গেছে। মন খারাপ নিয়ে খেতে বসে। খিচুড়ি, হাঁসের মাংস। খেতে গিয়ে টের পায় রান্নাটা অসাধারণ হয়েছে। তা কুঞ্জলের রান্না হাত খুব ভালো। খেয়ে তৃপ্তি হয়।

কুঞ্জল আড়চোখে খেয়াল করে অভীক দুইবার খিচুড়ি নিল। তার মানে রান্না ভালো হয়েছে। না হলে নাক কুঁচকে কিছু একটা বলতই। বিয়ের প্রথম থেকেই এই রান্না নিয়ে অনেক কথা শুনেছে। মূলত ওর কথার ভয়েই ও রান্নাটা খুব যত্ন নিয়েই করত। এখন সেটা অভ্যেস হয়ে গেছে।

অভীকের খাওয়া শেষ হলে ও সব গুছিয়ে শোয়ার আয়োজন করে। কাল ভোরে উঠতে হবে। অর্ক ধরেছে ও সকালে নাকি নতুন স্যু পরে দৌড়ুবে। কেন যেন কুঞ্জলেরও খুব ইচ্ছে হচ্ছে ছেলের সাথে দৌড়ুয়। বিশেষ করে সেদিন সাইফুল্লাহ স্যার ওকে রানিং স্যুটা গিফট করার পর থেকেই এমন ইচ্ছে হচ্ছে। ও ফেসবুকে দেখেছে সত্যিই ওর মতো অনেক মেয়েই ম্যারাথন দৌড়ুয়। অনেকগুলো সংগঠন আছে যারা এমন দৌড়ের আয়োজন করে।

কুঞ্জল বিছানা ঠিক করতে করতে ভাবে, কাল একবার নতুন স্যু পরে অর্কের সাথে দৌড়ে দেখবে আগের দমটা আছে কি-না।

বিছানা পাতা হতেই অর্ক শুয়ে পড়ে। অন্যদিন ওকে জোর করেও এত দ্রুত বিছানায় পাঠানো যায় না। আজ নিজেই শুয়ে পড়েছে কাল সকালে উঠবে বলে। ওর দিকে তাকিয়ে কুঞ্জল হাসে।
মশারি করে ও এবার ডাইনিংয়ে যায়। এক গ্লাস পানি খেয়ে ফিরে আসতে যেতেই অভীক পেছন থেকে হুট করে ওর হাত টেনে ধরে। কুঞ্জল ভয়ে চাপা চিৎকার করতে যেতেই থেমে যায়। অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর হাত ছাড়িয়ে নিতে যেতেই অভীক মরিয়া গলায় বলে, ‘আর কতদিন রাগ করে থাকবে বলো তো? আমি বলেছি তো আমি আর এমন করব না। প্লিজ, আর রাগ করে থেকো না।’

কুঞ্জল ঠান্ডা গলায় বলে, ‘অভীক, তোমার উপর আমার রাগ নেই। কাছের মানুষের সাথেই রাগ করা যায়, অভিমান করা যায়। তুমি তো আমার কাছের মানুষ নেই। আমি তো বলেছি, তুমি তোমার মতো থাকো, আমার কোনো অভিযোগ নেই।’

অভীক এবার ওকে ঝট করে কাছে টেনে নেয়। তারপর দুই হাতে শক্ত করে ধরে আকুল গলায় বলে, ‘প্লিজ, এমন করো না। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আসো, আজ আমার সাথে শোবে।’

কথাটা শেষ করেই ও কুঞ্জলের মুখটা টেনে নিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে।

কুঞ্জলের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। ওর শুধু একটা কথা মনে হয়, এই ঠোঁট দিয়ে অভীক মেঘাকে চুমু খেয়েছে অথবা পূর্ণকে। কথাটা মনে হতেই কুঞ্জল তীব্র একটা ঘৃণা নিয়ে ছিটকে মুখটা সরিয়ে নেয়। তারপর তীব্র গলায় বলে, ‘তোমার শরীরের এই খিদেটা অন্য কারও সাথে মেটাও, আমার সাথে না।’

অভীক স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকে। কুঞ্জল এই কথা বলতে পারল! মাথায় ক্রোধের আগুন জ্বলে ওঠে। ও হিংস্রভাবে ওর বাহু খামচে ধরে সামনে টেনে নেয়৷ তারপর মুখের কাছে মুখ নিয়ে তীব্র গলায় বলে, ‘তুমি বুঝি অন্য কারও সাথে শরীরের খিদে মেটাচ্ছ, তাই আমার আদর ভালো লাগছে না। অসভ্য, নষ্ট মেয়ে।’

কুঞ্জলের স্তম্ভিত হয়ে তাকায়। একটা অপমানের জ্বালা টের পায়। চোখ ফেটে কান্না আসে। একবার পেছন ঘুরে ভয়ে ভয়ে ছেলের রুমের দিকে তাকায়। নাহ, অর্ক গভীর ঘুমে।

কুঞ্জল চোখ মুছে, তারপর নিচু গলায় বলে, ‘আমাকে একটা বাজে কথা বললে আমি সুইসাইড করব। আর মরার আগে আমি সবাইকে তোমার কথা বলে যাব।’

কথাটায় কাজ হয়। অভীক কুঁকড়ে যায়, ওকে ছেড়ে দিয়ে অসহায় চোখে খানিকক্ষণ চেয়ে থাকে। তারপর মন খারাপ করে নিজের রুমে ফিরে যায়।

কুঞ্জল বিছানায় বসে থাকে। দু’চোখ বেয়ে অবিরল জল ঝরে। এত বাজে একটা কথা অভীক বলতে পারল? কষ্টে বুকের ভেতর দুমড়েমুচড়ে যায়। সংসার এত কষ্টের কেন?

রাত বাড়ে, কিন্তু কুঞ্জলের ঘুম আসে না। একটা চাদর জড়িয়ে বারন্দায় এসে বসে। বাইরে ল্যাম্পপোস্টের আলো ঘিরে ঘন কুয়াশা। সেখান থেকে ক্ষীণ একটা আলো এসে পড়েছে বারান্দায়। চারদিক সুনসান নীরবতা। মাঝে মাঝে বাইরে শীতের কুয়াশা ঝরে পড়ার টুপটাপ শব্দ হচ্ছে। এই শহরের সবাই এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হয়তো সাবাই না, ওর মতো মনের কষ্ট নিয়ে কেউ কেউ জেগে আছে।

নাহ, আজ আর ঘুম আসবে না। কুঞ্জল ভেতর থেকে হেডফোন নিয়ে আসে। গান শুনে আজ রাত পার করে দেবে। একে একে পছন্দের গান বাজতে বাজতে একটা সময় শুভমিতার গলায় প্রেমহীন সংসার গানটা বাজে –

আমি কার কে আমার, কি যে তার আমি হই, কানামাছি কাছাকাছি, দূরে-দূরে আমি রই, প্রেমহীন সংসার, আহা সোনামুখী সুঁই।’

গানটা শুনতেই কুঞ্জল হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। এই পৃথিবীর কোথাও কী কেউ নেই যে ওকে একটু ভালোবাসবে, মায়া করবে?

(চলবে)

প্রেমহীন সংসার আহা সোনামুখী সুঁই পর্ব-০৭

0

#প্রেমহীন_সংসার_আহা_সোনামুখী_সুঁই (পর্ব ৭)

১.
‘প্রিয় দর্শক, কুঞ্জল রসুইঘরে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। আমি কুঞ্জল আজ আপনাদের খুব মজার একটা রেসিপি দেখাব যেটা একবার খেলে বার বার খেতে ইচ্ছে করবে। আর রেসিপিটা হলো নারকোল দিয়ে কচুবাটা।’

এ পর্যন্ত বলে কুঞ্জল থামে। তারপর দৌড়ে এসে মোবাইল স্ট্যান্ডে রাখা মোবাইলের ভিডিও অপশনটা অফ করে। তারপর একবার চালিয়ে ভিডিওটা দেখে। সন্তুষ্ট মনে মাথা নাড়ে, নাহ, একদম ঠিকঠাক। কিছুদিন আগেই পৃথুল ‘কুঞ্জল রসুইঘর’ নামে একটা রান্নার পেজ খুলে দিয়েছিল। এখন পর্যন্ত রান্নার ভিডিও আপলোড করেনি। এটাই প্রথম ভিডিও। তাই ইচ্ছে করেই একটু ভিন্ন রকমের রান্নার রেসিপি ও বেছে নিয়েছে।

কুঞ্জল শাড়িটা ভালো করে কোমরে পেচিয়ে নেয়। এবার আবার শুরু করে, ‘আমি আজ দু’ভাবে মানকচুর এই অমৃত ভর্তাটা করে দেখাব। আগে থেকে কুড়ানো নারকোল, সরিষা দানা, কাঁচা মরিচ… ‘, কুঞ্জল একে একে উপাদানগুলো বলে যায়। তারপর যত্ন নিয়ে নারকোল দিয়ে মানকচু ভর্তাটা করে দেখায়।

ভিডিওটা অফ করে এবার ও একটু ভর্তা মুখে দিয়ে দেখে, বাহ, দারুণ হয়েছে তো। এবার ভিডিওটা আপলোড করতে হবে। তার আগে একটু কেটে ছেঁটে কমানো দরকার। কাজটা করতে গিয়ে কোথা দিয়ে ঘন্টাখানেক সময় পেরিয়ে যায় ও বুঝতেই পারে না। নাহ, হাতে সময় নেই। অর্কের নতুন বছরের ক্লাশ শুরু হয়েছে। ওকে আনতে যেতে হবে।

ভিডিওটা পেজে আপলোড করেই ও বেরিয়ে পড়ে। আল্লাহ ভরসা, এবার আর কয়েক ঘন্টা ও ফেসবুকেই ঢুকবে না। ভিডিওটা আপলোড করে এখন কেমন যেন লজ্জা লাগছে। ওই পাগল মনের ডাক্তারের কথা শোনা উচিত হয়নি। সেদিন অদ্ভুত সব কথা বলছিল। না, কষ্ট কমেনি কিন্তু সেদিনের পর মনের এই কষ্টগুলো সইবার শক্তি বেড়েছে। হ্যাঁ, এখন থেকে নিজের আনন্দগুলো খুঁজে দেখবে তারা ওর মনের কোথায় ঘাপটি মেরে আছে।

কুঞ্জল বেরোয়। স্কুলে আসতেই পৃথুল হইহই করে ওঠে, ‘প্রথম ভিডিওতেই তো ফাটিয়ে দিয়েছিস। কংগ্রাচুলেশনস।’

কুঞ্জল অবাক গলায় বলে, ‘কী ফাটিয়ে দিলাম আবার?’

পৃথুল মুখ ভেঙচে বলে, ‘ন্যাকা। মানকচুর ভর্তাটা তো হিট। ইতোমধ্যেই তিনশ লাইক পড়ে গেছে, আর গোটা পঞ্চাশ কমেন্ট। সবাই কী দারুণ দারুণ কমেন্ট করছে। তুই সবগুলো কমেন্টের আলাদা করে উত্তর দিবি। তুই দেখেছিস তো?

সর্বনাশ! সত্তিই এতগুলো লাইক, কমেন্ট পড়েছে? কুঞ্জল নিরীহ গলায় বলে, ‘না, আমি আপলোড করেই ফেসবুক বন্ধ করে বসে আছি। ভীষণ লজ্জা লাগছিল।’

পৃথুল ওর গালে একটা ঠুনকো দিয়ে বলে, ‘এহ, লজ্জা করে। একবার খুলে দেখ, মন ভালো করা সব কমেন্টস।’

কুঞ্জল এবার ফেসবুক খোলে, আর সাথে সাথে নোটিফিকেশনের মিষ্টি ‘টুন’ ‘টুন’ শব্দে চারপাশ ভরে ওঠে। ও স্ক্রল করে করে নিচে যায়। সবাই দারুণ সব কমেন্ট লিখেছে। কেউ লিখেছে – আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, পুরনো এই রান্নাগুলো ফিরিয়ে আনার জন্য; কেউ লিখেছে – অসাধারণ একটা ভর্তা, মা করতেন; কেউ লিখেছে – নিয়মিত এমন সুন্দর সব রেসিপি দেবেন। আরও কত কত কমেন্ট। পরিচিতদের মাঝে অনেকেই লিখেছে। কিন্তু অপরিচিত মানুষ বেশি। কুঞ্জল ভাবতেই পারে না, ওকে চেনে না জানে না এমন মানুষজন ওর প্রশংসা করছে। হঠাৎ করেই মনটা ভালো হয়ে যায়। পৃথুলের হাত ধরে বলে, ‘সত্যিই তো অনেক লাইক কমেন্ট পড়ছে। আমি তো ভাবলাম এমন সাধারণ ভর্তার রেসিপি কেউ পছন্দই করবে না।’

পৃথুল দুষ্ট হাসি হাসে, ‘আপনার চেহারা মাশাল্লা যা, তাতে করে কচুর লতি রান্না করলেও মানুষজন হামলে পড়বে। তবে শাড়ি পরাটা ছাড়িস না, এটা পরেই রান্না করবি। তাতে কেমন একটা আপন আপন লাগে, আমাদের মায়েদের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়।’

কুঞ্জল হিহি করে হাসে, ‘আমরাই তো এখন মা। তবে ব্যাপারটা এত জমে যাবে এটা ভাবিনি। আচ্ছা চল, অর্কদের ছুটি হলো বলে।’

স্কুল ছুটি হতেই অর্ক বন্ধুদের হাত ধরে বেরিয়ে আসে। মাকে দেখে দৌড়ে কাছে এসে বলে, ‘আম্মু, আমার রানিং স্যু কিনতে হবে। আমি স্কুলের খেলায় দৌড়ে নাম দিয়েছি। আজ হিট হয়েছিল, আমি ফার্স্ট হয়েছি।’

কুঞ্জলের হঠাৎ করেই মনে পড়ে, স্কুলে ও খুব ভালো দৌড়াত। ছেলের চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, ‘তাই! আমার অর্ক বাবা ফার্স্ট হয়েছে? তাহলে তো দৌড়ুনোর জন্য ভালো জুতো কিনতেই হয়। জানো তো, আম্মুও কিন্তু ভালো দৌড়াতে পারে।’

অর্ক অবিশ্বাস নিয়ে বলে, ‘তুমি দৌড়াতে পারো?’

কুঞ্জল মন খারাপ করে ভাবে, আসলেই তো, ও যে দৌড়াতে পারে, ছুটতে পারে সেটা ভুলেই গিয়েছিল। সংসার ওকে জুবুথুবু মানুষ বানিয়েছে। সব দুঃখ, কষ্টকে হারিয়ে দিয়ে ও যে দৌড়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারে সেটা ভুলে গিয়েছিল। এখন থেকে ও খুব দৌড়ুবে, সামনের দিকে।

বিকেল নাগাদ কুঞ্জলের রান্নার ভিডিওতে হাজারখানেক লাইক পড়ে, তিনশ’র উপর কমেন্ট। ওর কেমন দিশেহারা লাগছে। এতদিন জাদুর বাক্স নামের শাড়ির পেজে ও এটা হতে দেখেছে। যদিও সেই ঘটনার পর ওই কাজটা ছেড়ে দিয়েছিল। আজ নিজের পেজে হচ্ছে। ভাবতেই ও একটা অবাক,আর অদ্ভুত আনন্দ নিয়ে বসে থাকে। কী মনে হতে ও মনের ডাক্তার সাইফুল্লাহকে ফোন দেয়, ‘হ্যালো, আপনি ফ্রি আছেন একটু?’

সাইফুল্লাহ মাত্রই একটা সেশন শেষ করে চা নিয়ে বসেছিল, তখনই কুঞ্জলের ফোন আসে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলে, ‘মাত্রই ফ্রি হলাম। আপনি ভালো তো?’

কুঞ্জল কিশোরী মেয়েদের মতো উচ্ছ্বসিত গলায় বলে, ‘হ্যাঁ, ভালো। জানেন, আজ দারুণ একটা ব্যাপার হয়েছে। আপনার কুবুদ্ধিমতো আমি একটা রান্নার ভিডিও করেছিলাম। বলুন তো কী হতে পারে?’

সাইফুল্লাহ গায়ের চাদরটা আরেকটু জড়িয়ে নিয়ে বলে, ‘নিশ্চয়ই সবাই খুব পচা বলছে।’

কুঞ্জল কৃত্রিম রাগের গলায় বলে, ‘এহ, তা বলবে কেন। আমার রান্না বুঝি পচা?’

সাইফুল্লাহ হেসে বলে, ‘আমি তো খাইনি কখনো। না খেয়ে বলি কী করে?’

কুঞ্জল গাঢ় গলায় বলে, ‘আপনাকে খাওয়াব তো। আপনি সত্যিই আমার দিনগুলো ভালো করে দিচ্ছেন। জানেন, আজ আমার প্রথম ভিডিওটাই হাজারখানেকের উপর লাইক পড়ে গেছে। আর সবাই এত ভালো ভালো কমেন্ট করছে যে কী বলব। সবচেয়ে ভালো লাগার জায়গাটা কি জানেন? এরা বেশিরভাগই আমার অপরিচিত। আমি আমার জীবনে কোন কাজ করে এত প্রশংসা পাইনি।’

সাইফুল্লাহ নরম গলায় বলে, ‘আপনি জানতেনই না আপনার এই শক্তিশালী দিকটার কথা। আমার কাজই হলো আপনাকে আপনার মনের সেই শক্তিশালী দিকগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। আপনার পাওনা প্রশংসাগুলো ঠিকঠাক পাওয়া। আর এগুলো হলো মনের খাবার। আচ্ছা শুনুন, আপনার জন্য একটা গিফট আছে। একবার এসে নিয়ে যাবেন খন।’

এবার কুঞ্জল অবাক হয়, ‘সে কী! আমার জন্য গিফট! কেন?’

সাইফুল্লাহ রহস্যের গলায় বলে, ‘সেটা এলেই জানবেন। আমি সকালের দিকে ফ্রি থাকি। আসার আগে জানিয়ে আসবেন কিন্তু।’

ফোন রেখে কুঞ্জল কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। আজ দিনটা এত সুন্দর কেন? সব ভালো লাগার জিনিসগুলো ওর সাথে ঘটছে। একটা মন ভালো করা নিশ্বাস নেয়। নিশ্বাস নিতে গিয়ে টের পায় বুকের কোথাও ব্যথা লাগল না। এমন করেই তো ও বাঁচতে চেয়েছিল। অভীক ওর নিশ্বাসগুলো ব্যথায় ভরিয়ে দিয়েছিল। আর সেটা প্রতিবার নিশ্বাস নেবার সময় ও টের পেত। নাহ, এরপর আর কোনো বেচাল করেনি অভীক। অথবা করলেও ও আর সেটা নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবেনি। অভীক কয়েকবার ক্ষমা চেয়েছে, কুঞ্জল কিছুই বলেনি। আসলে বিশ্বাসটাই টলে গেছে।

রাতে অভীক যখন বাসায় ফেরে ততক্ষণে কুঞ্জলের ভিডিওটা দু’হাজার লাইক পেরিয়ে গেছে। আর সেইসাথে পাল্লা দিয়ে কমেন্টের সংখ্যাও বাড়ছে। ও অর্ককে নিয়ে টিভি দেখছিল আর ফাঁকে ফাঁকে কমেন্টগুলো পড়ছিল। অভীক এসে একবার গম্ভীরমুখে তাকায়, তারপর অর্ককে ডেকে বলে, ‘বাবা, এটা তোমার আম্মুকে দাও।’

কুঞ্জল আড়চোখে একবার দেখে, একটা কাগজের ব্যাগ। অর্ক ওর হাতে দিতেই ভেতর থেকে একটা মভ কালারের শাড়ি বের হয়ে আসে।

কুঞ্জল খুশি হতে যেয়েও মন খারাপ করে ফেলে। সেবারও অভীক ওর জন্য শাড়ি নিয়ে এসেছিল, কিন্তু যে শাড়ির জন্য ও অপেক্ষা করে বসেছিল সেটা না। সেদিন সেই শাড়িটা মেঘাকে দিয়েছিল। আর সেটা ব্যালেন্স করতেই ও বাসায় ওর জন্য জামদানি শাড়ি নিয়ে এসেছিল। সেই স্মৃতিটা মনে পড়তেই হঠাৎ করেই ওর মাথায় আগুন ধরে যায়।

ও ঝট করে মুখ তোলে, তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ‘শাড়ি এনেছ কেন? আজ বুঝি অন্য কাউকে শাড়ি কিনে দিয়েছ, আর সেটা ব্যালেন্স করতে আমার জন্যও একটা নিয়ে এসেছে? এর আগেও তো এমন করেছিলে। এবার মেয়েটা কে?’

হঠাৎ এমন আক্রমণে অভীক প্রথমে হকচকিয়ে যায়। কুঞ্জলের সাথে সম্পর্কটা স্বাভাবিক করতেই শাড়ি আনা। কিন্তু এ তো দেখি হিতে বিপরীত হলো। অভীক চোখমুখ অন্ধকার করে বলে, ‘তোমাকে আর কতবার বললে তুমি বিশ্বাস করবে আমার আর এসব কিছু নেই। কেন এমন উল্টাপাল্টা কথা বলো?’

কুঞ্জল তীক্ষ্ণ গলায় বলে, ‘কারণ তুমি মিথ্যুক, বেইমান। তোমাকে আমি একফোঁটাও বিশ্বাস করি না। তোমার এই শাড়ি যার জন্য কিনেছ তাকে দিয়ে আসো।’

কথাটা বলেই কুঞ্জল শাড়িটা ছুড়ে ফেলে দেয়। অভীকের মাথায় যেন আগুন ধরে যায়। ও শাড়িটা কুড়িয়ে নিয়ে হিংস্র গলায় বলে, ‘ঠিক আছে। তোমার যখন এতই অবিশ্বাস সেটা আমি এখনই মিটিয়ে দেব।’

কথাটা বলে ও শাড়িটা নিয়ে রান্নাঘরে যায়। তারপর খুঁজে খুঁজে একটা দেয়াশলাই বের করে আনে। তারপর হিসহিসিয়ে বলে, ‘সব জ্বালিয়ে দেব। এত অশান্তি আর ভালো লাগে না।’

অর্ক বিছানায় বসে কাঁপছিল, ও ভয়ার্ত গলায় বলে ওঠে, ‘আম্মুউউ।’

কুঞ্জলের এবার হুশ ফেরে। ও লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামে। ঝট করে অভীকের হাত থেকে শাড়িটা ছিনিয়ে নেয়। তারপর দাঁতে দাঁত ঘষে বলে, ‘বাচ্চাটাকে ভয় না দেখালেই না, তাই না? ওর সামনে এমন হিংস্র আচরণ করবে না আর। এমন করলে আমি আমার ছেলেকে নিয়ে চলে যাব।’

শাড়িটা নিয়ে ও অর্ককে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে। ফিসফিস করে বলে, ‘বাবা ভয় পেও না।’

অর্ক মায়ের বুকের ভেতর ঢুকে পড়ে। ও ঠিক বুঝে পায় না আম্মু আর বাবা কেন এত ঝগড়া করে?

অভীক অবসন্ন শরীরে লিভিংয়ের সোফায় বসে পড়ে। মাথাটা কেমন ঘোরাচ্ছে। কুঞ্জল ওকে দোষ দিল। অথচ আজকের ঝগড়াটা ওই শুরু করেছে। কী হতো শাড়িটা নিয়ে নিলে? শাড়িটা নিয়ে অমন একটা খোঁচা দেওয়া কথা বলার কোনো মানে ছিল? যেখানে ও বার বার ক্ষমা চাচ্ছে, ফিরে আসতে চাইছে সেখানে কুঞ্জল বারবারই ওকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। মাঝখান দিয়ে ছেলেটা একটা অসুস্থ পরিবেশে বড়ো হচ্ছে। নাহ, এমন আর করা যাবে না।

অভীক এবার গলা বাড়িয়ে ডাক দেয়, ‘অর্ক, এদিকে শুনে যাও তো বাবা।’

একটু পর অর্ক ছোট ছোট পা ফেলে ওর সামনে এসে দাঁড়ায়। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে অভীকের বুক ভেঙে যায়। ইচ্ছে করছে নিজের গালে চড় মারতে। এত খারাপ বাবা কেন ও?

একটা হাত ধরে ছেলেকে পাশে বসায়, তারপর নিচু গলায় বলে, ‘বাবা, আজ স্কুলে গিয়েছিলে?’

অর্ক মাথা নাড়ে। তারপর ভয়ে ভয়ে বলে, ‘বাবা, আমার একটা রানিং স্যু লাগবে। আমি স্কুলে দৌড়ে নাম দিয়েছি।’

অভীক ছেলেকে কাছে টেনে বলে, ‘তাই! বাহ, খুব ভালো। কাল আমি আসার সময় নিয়ে আসব। কী রঙের জুতো কিনবে? সাদা, না নীল?’

অর্ক মাথা নেড়ে বলে, ‘কালো স্যু বাবা। ভালো করে দেখে এনো কিন্তু। আমি ফার্স্ট হব দৌড়ে।’

অভীক ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘হবে তো। জানো তো, তোমার আম্মুও স্কুলে ফার্স্ট হতো দৌড়ে।’

অর্ক এবার উৎসাহের সাথে বলে, ‘হ্যাঁ বাবা। আম্মু আজ বলেছে আমাকে। আমার ফাইনাল খেলার দিন ছুটি নেবে কিন্তু।’

কুঞ্জল ভেতর থেকে ওদের কথা শুনছিল। এখন নিজের কাছে খারাপ লাগে। ইশ, কেন যে ছেলের সামনে অমন করতে গেল? বার বার ভাবে, ছেলের সামনে এই কুৎসিত ব্যাপার নিয়ে কথা বলবে না। কিন্তু কেন জানি তখন মাথাটা উল্টাপাল্টা হয়ে গেল। নাহ, এটা নিয়ে সাইফুল্লাহ স্যারের সাথে কথা বলতে হবে।

সেদিন রাতে কুঞ্জল মন খারাপ নিয়ে ঘুমিয়ে যাবার আগে অবাক হয়ে দেখে ওর রান্নার ভিডিওটা তিন হাজার লাইক পেরিয়ে গেছে। আরও অনেক নতুন কমেন্ট পড়েছে। স্ক্রল করে ও নতুন কমেন্টগুলো পড়তে থাকে। তাতে করে মন খারাপ ভালো হতে শুরু করে।

ঘুমিয়ে যাবার আগে হঠাৎ করে একটা কমেন্ট দেখে ও থমকে যায়, ‘এভাবে কচু ভর্তা করলে গলায় ধরবে। আপনার ভর্তার রেসিপিতে একটু ভুল আছে।’

কুঞ্জল ভ্রু কুঁচকে কমেন্টটার দিকে তাকিয়ে থাকে। এই প্রথম একটা নেগেটিভ কমেন্ট পড়ল। কিন্তু সত্যি বলেছে। কারণ আজ দুপুরে খাবার পর একটু একটু গলায় ধরেছিল কচুটা। কুঞ্জল আইডিটা খেয়াল করে, ‘অংশুল’ নামে একজন কমেন্ট করেছে। কী মনে হতে ও প্রোফাইলে ঢুকতেই দেখে লেখা, ‘শেফ, ইনকা রেস্তোরাঁ।’

কুঞ্জলের চোখ বড়ো বড়ো হয়ে যায়। ইনকা শহরের নামকরা একটা রেস্টুরেন্ট। আর সেখানকার শেফ ওর রান্নার ভিডিও দেখেছে? মনটা ভালো হয়ে যায়। ও এবার কী মনে হতে অংশুলের ইনবক্সে একটা মেসেজ লিখে, ‘আপনার কথা ঠিক, কচু ভর্তাটা আসলেই গলায় ধরছে। একটু যদি বলতেন ভুলটা কোথায় হলো, তাহলে খুব উপকার হতো। আর আপনার মতো একজন মানুষ আমার ভিডিও দেখে মন্তব্য করেছেন সেজন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।’

মেসেজটা পাঠিয়ে দিয়ে ও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। নাহ, কোনো রিপ্লাই আসে না। বিখ্যাত শেফ, হয়তো মেসেজ দেখবেই না। কুঞ্জল আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, তারপর মোবাইল বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ার আয়োজন করে। অর্ক আগেই ঘুমিয়েছে। অভীক এখনও একাই শোয়। এই জীবনে আর কখনও হয়তো ওরা একসাথে ঘুমাবে না।

২.
আজ কুঞ্জল নিজে একা একাই সাইফুল্লাহ স্যারের বাসা চিনে এসে পড়েছে। গেটের দরজার হাতল ঘোরাতেই খুলে যায়। সকাল দশটা, শীতের সকাল। ভেতরে পা দিতেই একটা মিষ্টি ঘ্রাণ পায়। তাকাতেই দেখে শিউলি ফুল পড়ে আছে মাটিতে।

এমন সময় স্যারের গলা পাওয়া যায়, ‘কুড়োতে পারেন, এখনও টাটকা আছে।’

কুঞ্জল গলার আওয়াজ লক্ষ করে উপরে তাকায়। ছাদে বসে মিটিমিটি হাসছেন। ইশারা করেন, ‘ উপরে উঠে আসেন।’

কুঞ্জল হাতের টিফিন বক্স দেখিয়ে বলে, ‘আপনার জন্য রান্না করে নিয়ে এসেছি। আপনার সেই সহকারী কই?’

সাইফুল্লাহ আশ্বস্ত করে বলে, ‘ও আছে। আপনি ওটা নিচে রেখে উপরে চলে আসেন। শীতের রোদ পোহাই আর আপনার সাথে গল্প করি।’

কুঞ্জল হাসে। তারপর টিফিন বক্সটা বাড়ির ভেতর নামিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে আসে। সিঁড়িটা পুরনো আমলের মোজাইক করা, সেগুন কাঠের হাতল। এমন বাড়িগুলো কেমন নস্টালজিক যেন।

ছাদে আসতেই মন ভালো হয়ে যায়। ফুলে ফুলে চারপাশ ছেয়ে গেছে। গাঁদা ফুল, কসমস ফুল, নানান জাতের গোলাপ। আরও যে কত কত ফুল। ও অবাক গলায় বলে, ‘আপনি আবার ফুলও ফোটান?’

সাইফুল্লাহ হাসে, ‘আপনার মতো আমারও এই একটা গুণ আছে, ফুল ফোটানোর। বসুন আরাম করে। বাচ্চুকে বলা আছে, চা দিয়ে যাবে এখুনি। তারপর আপনার খবর বলেন।’

কুঞ্জল কালকের রাতের কথাটা একবার মনে করে, পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ‘একদম ফার্স্টক্লাস। আমার রান্নার ভিডিও তো মানুষজন খুব পছন্দ করেছে। সত্যিই নতুন করে বাঁচার অনুপ্রেরণা পাচ্ছি। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’

সাইফুল্লাহ হাসে, তারপর বলে, ‘আমি কিছুই করিনি। আপনার মাঝে ছিল, দেখতে পাননি। আচ্ছা, এবার বলেন অভীকের কী খবর।’

কুঞ্জল একটু থমকায়, এমন সরাসরি ওর কথা জিজ্ঞেস করবেন ও আশা করেনি। নিচের ঠোঁট কামড়ে বলে, ‘আছে ঠিকঠাক। আমি আমার মতো, ও ওর মতো। আচ্ছা, আমাকে একটা বুদ্ধি বাতলে দিতে পারবেন?’

সাইফুল্লাহ কৌতুহলী গলায় বলে, ‘কী বুদ্ধি?’

কুঞ্জল দ্বিধান্বিত গলায় বলে, ‘আমি অভীকের ব্যাপারে ভাবতে চাই না। মানে ও কার সাথে প্রেম করল সেটা নিয়ে ভাবতে চাই না। কিন্তু পারি না। সুযোগ পেলেই আমার ভেতরের সন্দেহপ্রবণ মনটা জেগে ওঠে। আর যার ফলাফল কুৎসিত ঝগড়া। কেন এমন হয় বলুন তো? আমি তো ওর কাছে আর কিছুই আশা করি না।’

সাইফুল্লাহ ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘ভুল। আপনি আসলে মনে মনে আশা করেন। অভীকের উপর আপনার একটা অধিকারবোধ আছে যেটা চাইলেও আপনি ঝেড়ে ফেলতে পারবেন না। মানুষ একটা অদ্ভুত প্রাণী, একবার কোনো কিছু নিজের করে পেলে সেটা আর কিছুতেই হারাতে চায় না, সেটা কাজে না লাগুক, তাও। ব্যাপারটা সহজ করে বলি। বাসায় এমন অনেক জিনিস পাবেন যেটা বছরের পর বছর ব্যবহার হয়নি, কিন্তু সেটা ফেলে দিতে ইচ্ছে করে না আবার কাউকে দিতেও ইচ্ছে করে না। এটা একটা অবস্থা। এরপর যখন সত্যিই অধিকারবোধটা ক্ষীণ হয়ে আসে তখন আর অসুবিধে হয় না জিনিসটা ঝেড়ে ফেলতে। আপনি এখনও ওই অবস্থায় যাননি। এখনও কিছু মায়া হয়তো রয়ে গেছে, তাই অমন হয়।’

কুঞ্জল হতাশ গলায় বলে, ‘আপনি বলছেন এত কিছুর পরেও ওর জন্য আমার মনে মায়া রয়ে গেছে?’

সাইফুল্লাহ হেসে বলে, ‘হ্যাঁ রয়ে গেছে, ভাগশেষের মতো। চিন্তা করবেন না, এভাবে চলতে থাকলে একটা সময় ভাগশেষও থাকবে না। আর তখন কষ্টও থাকবে না, আপনি যেটা চান আর কি।’

কথাটা বলে সাইফুল্লাহ তীব্র চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। কুঞ্জলের মুখে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করে। আর সেটা পেয়েও যায়। মেয়েটার মুখে এখন একটা নীল বেদনার রেখা ফুটে উঠেছে। আহারে, মানুষের কত কত কষ্ট! নিজের অচেনা মনের সামনে কত অসহায় মানুষ!

পরিবেশটা হালকা করতে ও বলে, ‘তা আজ কী কী রান্না করে নিয়ে এলেন?’

কুঞ্জল এবার স্বাভাবিক হয়, ‘উম, পাবদা মাছ জলপাইয়ের ঝোল দিয়ে। কুচো চিংড়ি পালং শাক দিয়ে। আর একটু মুরগির মাংস, সাতকড়া দিয়ে। খান তো এগুলো?’

সাইফুল্লাহ চোখ কপালে তোলে, ‘এত কিছু! আর সব পছন্দের পদ নিয়ে এসেছেন। খাবেন তো আমার সাথে?’

কুঞ্জল বাচ্চাদের মতো মাথা নাড়ে, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই খাব। কিন্তু তার আগে বলুন, আমার গিফট কই?’

সাইফুল্লাহ প্রশ্রয়ের ভঙ্গিতে হাসে, তারপর পাশে থাকা একটা ব্যাগ ওর হাতে দিয়ে বলে, ‘খুলে দেখেন।’

কুঞ্জল আগ্রহ নিয়ে ব্যাগটা খোলে, অবাক হয়ে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বলে, ‘কেডস? আমার জন্য?’

সাইফুল্লাহ মাথা নাড়ে, ‘কেডস না, রানিং স্যু। জানেন তো ম্যারাথন দৌড় হয় প্রায়ই। বিভিন্ন সংগঠন আয়োজন করে। ঢাকাতেও অনেকগুলো গ্রুপ আছে। ফেসবুকে দেখবেন UCR নামে একটা গ্রুপ আছে, ওরা হলিডেগুলোতে ম্যারাথন দৌড়ের আয়োজন করে। অনেক মেয়েরাও তাতে অংশগ্রহণ করে। আপনি যেহেতু একসময় দৌড়ুতেন সেজন্যই এটা কেনা। সাইজটা না হলে ওদের শপ থেকে পালটে নিবেন। ওরা বলেছে পালটে দেবে।’

কুঞ্জল আঁতকে ওঠে, ‘এই বয়সে দৌড়ুব?’

সাইফুল্লাহ আশ্বস্ত করে বলে, ‘ইয়াং লেডি, আপনার চেয়ে বিশ বছর বড়ো বয়সের মেয়েরাও দৌড়ুচ্ছে। আপনি ফেসবুকে ঢুকে একবার দেখতে পারেন।’

কুঞ্জলের ভীষণ ইচ্ছে করছে দৌড়াতে। কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব?

দুপুরে ওরা দু’জন যখন খেতে বসে তখন সাইফুল্লাহ প্রশংসার গলায় বলে, ‘বাহ, আপনার হাতের রান্না আসলেই তো খুউব ভালো। মাঝে মাঝে নিয়ে আসবেন তো?’

কুঞ্জল একটা মায়া নিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ আসব। কেন যেন আপনার কাছে আসতে আমার ভালো লাগে।’

সাইফুল্লাহ মৃদু হাসে তারপর বলে, ‘তার কারণ আছে। আপনি আমাকে আপনার কথাগুলো অকপটে বলতে পারেন। নিজের কথাগুলো কাউকে বলার মতো মানুষের খুব অভাব। তাই তো এত এত কষ্ট।’

কুঞ্জল খাওয়া থামিয়ে চেয়ে থাকে ওর মুখের দিকে। কী ভীষণ সত্যি একটা কথা উনি এইমাত্র বললেন। অভীককে যদি ও ওর সব কথা বলতে পারত!

(চলবে)

প্রেমহীন সংসার আহা সোনামুখী সুঁই পর্ব-০৬

0

প্রেমহীন_সংসার_আহা_সোনামুখী_সুঁই (পর্ব ৬)

১.
অভীক সবে ভৈরব পেরিয়েছে ঠিক তখন মেঘার ফোন আসে। ঘণ্টাখানেক আগে মেঘাকে ফোন করেছিল, তখন ধরেনি। সকালে বাসা থেকে বের হয়েই মেসেজ করেছিল আজ সিলেট যাচ্ছে, ফ্রি থাকবে। কিন্তু ও তখন ফোন ধরল না কেন? যাক, এখন ফোন দিয়েছে তো।

ও দ্রুত ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে মেঘার কাঁপা গলা পায়, ‘অভীক, সর্বনাশ হয়ে গেছে। তোমার বউ একটু আগেই আমার অফিসে এসেছিল। আমি বলেছিলাম তোমার সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। কিন্তু ঠিক তখুনি তোমার ফোন আসে। ও দেখে ফেলেছে। তুমি তোমার বউকে সামলাও প্লিজ। ওকে মানসিকভাবে ভীষণ এলোমেলো লেগেছে। আমাকে প্লিজ আর ফোন করো না।’

অভীকের তলপেট খালি হয়ে যেতে থাকে। ভয়ের একটা ঠান্ডা স্রোত ওর পিঠ বেয়ে নেমে যায়। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বাসে বসেও ও ঘামতে থাকে। সর্বনাশ! কুঞ্জল মেঘার অফিসে গিয়েছিল। আর তখুনি ও ফোন দিয়েছিল? হায় হায়। এবার যে কুঞ্জল ওকে আর বিশ্বাসই করবে না। কিন্তু তার চেয়েও ভয়ের ব্যাপার হলো কুঞ্জল যদি রাগের মাথায় সুইসাইড করে ফেলে! কথাটা ভাবতেই বুক কেঁপে ওঠে। কী করবে ও?

সিলেট অভিমুখী বাসটা ভৈরব ব্রিজ পার হয়ে একটা হাইওয়ে রেস্টুরেন্টে থামে। অভীক একবার ভাবে, কুঞ্জলকে ফোন করবে? কথাটা ভাবতেই ও ফোন করে। নম্বরটা বন্ধ। অভীক আবার করে, এবারও বন্ধ পায়। এবার টেনশন হতে থাকে ওর। মেয়েটা যদি কিছু একটা করে ফেলে? কাকে ফোন করবে এখন? একটু ভাবতেই কুঞ্জলের বন্ধু পৃথুলের কথা মনে হতেই ও ফোন দেয়। ওপাশ থেকে পৃথুল অবাক গলায় বলে, ‘ভাইয়া, কোনো সমস্যা?’

অভীক একটু থতমত খেয়ে বলে, ‘কুঞ্জলের ফোন বন্ধ পাচ্ছি। তুমি যেয়ে একটু দেখবে ও বাসায় আছে কি-না? একটু জরুরি দরকার ছিল।’

পৃথুল ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘কুঞ্জল তো একটু মার্কেটে গেছে। যাবার আগে অর্ককে আমার বাসায় রেখে গেছে। আপনি ভাববেন না, ওর মোবাইলে হয়তো চার্জ ফুরিয়ে গেছে। ও এলে আমি বলব আপনাকে ফোন দিতে।’

অভীক ফোন রেখে বিমূঢ় হয়ে বসে থাকে। তার মানে কুঞ্জল এখনও বাসায় ফেরেনি। হয়তো পথে। একটু ভাবে, তারপর দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়। অফিসে ফোন করে জানিয়ে দেয় ও সিলেট যেতে পারছে না, ছেলে হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এই মিথ্যেটা বলতে বুক কাঁপে, কিন্তু তাও বলে। এরপর ও ঢাকার বাস ধরে। কুঞ্জলকে বিশ্বাস নেই, ও রাগের মাথায় যা তা করে ফেলতে পারে।

এদিকে কুঞ্জল একটু আগেই বাসায় এসেছে। ভেবেছিল মাকে সব জানাবে, কিন্তু ইচ্ছে করেনি। মা বাব দু’জনের অবস্থা ওর মতোই, বড়ো ভাইয়ার সংসারে আশ্রিতের মতো। উল্টো বলবে মানিয়ে নিতে।

কুঞ্জল খাটে পা মেলে বসেছিল। অর্ক অবাক চোখে মায়ের পায়ে সাদা প্লাস্টারের দিকে তাকিয়ে আছে। বার বার জিজ্ঞেস করেও ওর কৌতুহল শেষ হয় না। মাকে কখনও এমন অসুখ হতে দেখেনি ও।

অর্ক মন খারাপ গলায় বলে, ‘আম্মু, অনেক ব্যথা করছে তোমার? আমি একটু আদর করে দেই তোমার পায়ে?’

কুঞ্জল বুকের ভেতর একটা নরম মায়া টের পায়। ছেলেটার জন্য বেঁচে থাকা। না হলে এই জীবনের কোনো মানেই নেই। আজকের পর থেকে অভীক ওর জীবন থেকে মৃত। ওকে নিয়ে আর ভাববে না। অভীকের উপর ওর অধিকারটুকু ও ছেড়ে দেবে। পৃথুল আজ হয়তো কিছু সন্দেহ করেছে। একে তো ওর ফোন বন্ধ ছিল, তার মাঝে অভীক ওকে ফোন দিয়ে না পেয়ে পৃথুলকে ফোন দিয়েছিল। পৃথুল তো ওকে দেখে যার পর নাই অবাক। বেচারি আজ দুপুরের রান্না, রাতের রান্না করে দিয়ে গেছে।

আচ্ছা অভীক হঠাৎ করে পৃথুলকে ফোন দিল কেন? ওই মেঘা মেয়েটা কি ওর যাবার কথা জানিয়ে দিয়েছে? আর সেজন্যই বুঝি অভীক ওকে ফোন দিয়েছিল? যা ইচ্ছে করুক, ও আর ভাবতে চায় না।

কষ্ট করে দুপুরের খাবার খেয়ে ও যখন একটু বসেছে ঠিক তখন বাসার কলিং বেল বেজে ওঠে। অর্ক দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলতেই আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, ‘আম্মুউ, বাবা এসেছে। বাবা, আম্মু পায়ে ব্যথা পেয়েছে। দেখে যাও, পায়ে সাদা ব্যান্ডেজ।’

কুঞ্জল বাসায় আছে, একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে অভীক। কিন্তু পায়ে ব্যান্ডেজ মানে?

ও অপরাধীর মতো রুমে ঢুকতেই চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে থাকে, তারপর উদবিগ্ন গলায় বলে, ‘তোমার পায়ে কী হয়েছে? এক্সিডেন্ট করেছ?’

অর্ক চোখে মুখে একটা ভয় ফুটিয়ে বলে, ‘জানো বাবা, একটা পচা রিক্সা আম্মুর পায়ের উপর দিয়ে চলে গেছে। আম্মু অনেক ব্যথা পেয়েছে। এই দ্যাখো হাতও কেটে গেছে।’

অভীক ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে। তারপর অনুযোগের গলায় বলে, ‘এত বড়ো একটা এক্সিডেন্ট হয়ে গেল আমাকে একটা খবর দিলে না?’

কুঞ্জল ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবে একটা মানুষ এতটা নির্লজ্জ হয় কী করে! বার বার মিথ্যে বলে ধরা খাচ্ছে তারপরও কেমন করে ওর সামনে এসে দাঁড়ায়?

কুঞ্জল নিচু কিন্তু তীক্ষ্ণ গলায় বলে, ‘আমার জন্য আর চিন্তা করবে না কখনও। তুমি তোমার মতো থাকবে, আমি আমার মতো। তুমি কার সাথে প্রেম করো না ঘুরে বেড়াও তাতে আমার কিছুই যায় আসে না।’

অভীক হাতজোড় করে বলে, ‘কুঞ্জল, প্লিজ আমাকে শেষবারের মতো ক্ষমা করে দাও। দেখো, আমি তোমাকে আজও অনেক ভালোবাসি। আমি তোমার ফোন বন্ধ পেয়ে আমার সিলেট যাওয়া ক্যানসেল করে চলে এসেছি। এরপরও বলবে তোমার জন্য আমার ভালোবাসা নেই?’

কুঞ্জল এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বিষণ্ণ একটা হাসি হাসে, বলে, ‘না নেই। তুমি কেন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছ সেটা আমি জানি। তুমি ভেবেছ তোমার এই নির্লজ্জ বেহায়াপনা দেখে আমি সুইসাইড করে ফেলব, পুলিশ তখন তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে। আর তোমার মোবাইল একটু ঘাটলেই তো সব কুকীর্তি ফাঁস হয়ে যাবে। আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেবার দায়ে তোমার শাস্তি না হয়ে যায় এই ভয়ে ছুটে এসেছ।’

অভীক আর্তনাদ করে ওঠে, ‘এসব কী বলছ কুঞ্জল! তোমার বেঁচে থাকা আমার কাছে যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।’

কুঞ্জল কেটে কেটে বলে, ‘না, একবিন্দুও গুরুত্ব নেই তোমার কাছে। থাকলে আমাকে মেরে ফেলার সব আয়োজন তুমি করতে না। অভীক, তুমি ভয় পেও না। আমি সুইসাইড করব না। শুধু একটা অনুরোধ, আমাকে নিয়ে ভেব না। আমিও তোমাকে নিয়ে ভাবব না। তুমি আজ থেকে মুক্ত। অর্ক বড়ো হওয়া পর্যন্ত আমি আছি। ও আরেকটু বড়ো হলে আমি তোমার সাথে আর থাকব না। তখন পূর্ণ অথবা মেঘা অথবা অন্য কাউকে বিয়ে করো।’

অভীক মাথা নিচু করে বসে থাকে। নাহ, এখন আর কোনো প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যাবে না। আসলেই ওর উত্তর দেবার মতো কিছু নেইও। অর্ক বড়ো হবে, একদিন সব জানবে। তখন নিশ্চয়ই ও বাবাকে ঘৃণা করবে। কথাটা ভাবতেই ওর মন খারাপ হয়ে যায়।

বিকেলে পৃথুল ওকে দেখতে আসে। কুঞ্জলের খুব ভালো লাগে ও আসাতে। এবার পৃথুল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জিজ্ঞেস করে। কুঞ্জল মেঘার অংশটুকু বাদ দিয়ে ওই সাইফুল্লাহ লোকটার কথা বলে।

পৃথুল শুনতে শুনতে উত্তেজিত গলায় বলে, ‘এ তো দেখি পুরো সিনেমার কাহিনী। নায়িকার পা ভেঙ্গে গেল, নায়ক কোলে তুলে হাসপাতালে দৌড়।’

ওর বলার ভঙ্গিতে কুঞ্জল হেসে ফেলে। হাসতে হাসতে বলে, ‘আরে কম করে পঞ্চাশ-ষাট বছরের বুড়ো। তবে দারুণ পরিপাটি মানুষ।’

পৃথুল সিনেমাটিক গলায় বলে, ‘প্রেম না মানে বয়সের বাধা।’

বলেই ঘর কাঁপিয়ে হাসতে থাকে।

অভীক একবার উঁকি দিয়ে যায়। ওদের দুই বান্ধবীকে হাসতে দেখে একটু যেন নিশ্চিন্ত বোধ করে। ইশ, এমন যদি হাসিখুশি থাকত কুঞ্জল। নাহ, এখন থেকে ও ভালোবাসতে চেষ্টা করবে কুঞ্জলকে। অনেক অপরাধ জমা হয়ে গেছে। অনেক অবিশ্বাস। একটু একটু করে ওকেই সেই পুরনো বিশ্বাস ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে।

পৃথুল বিদায় নেবার সময় কুঞ্জল ওকে পাঁচ হাজার টাকা বের করে দিয়ে বলে, ‘তুই একটু যাবার সময় আমার ফোনে এই টাকাটা বিকাশ করিস তো। ভদ্রলোককে টাকাটা ফেরত দিতে হবে।’

পৃথুল বিরক্ত গলায় বলে, ‘তুই কী রে! এভাবে কেউ উপকারের প্রতিদান দেয়? নিজে যেয়ে ওর টাকাটা ফেরত দিয়ে আয়। সাথে একটা সুন্দর শার্ট বা পাঞ্জাবি কিনে নিয়ে গেলি। তোর কথা শুনে যা বুঝলাম মানুষটা ভীষণ ভালো।’

কুঞ্জল মাথা নাড়ে, ‘আসলেই খুব ভালো মানুষ উনি। না, টাকাটা আজ দিয়ে দেই। পা ভালো হলে একদিন তোকে নিয়ে দেখা করে আসব।’

পৃথুল বলে, ‘না বাবা, আমি কাবাব মে হাড্ডি হতে চাই না।’

বলেই চোখ মারে, তারপর হি হি করে হেসে বিদায় নেয়।

কুঞ্জলের মনটা হালকা হয়। ও একবার অর্ককে ডেকে নাস্তার কথা জিজ্ঞেস করে। অভীক লিভিং থেকে গলা বাড়িয়ে বলে, ‘তুমি উঠো না, আমি বাইরে থেকে নিয়ে আসছি।’

অভীক বাইরে চলে যায়। কুঞ্জল মোবাইলটা হাতে নিতেই বিকাশের টাকাটা আসে। তারপর ও দ্রুত সেন্ড মানি অপশনে যেয়ে সাইফুল্লাহ নামের লোকটার মোবাইল নম্বর লিখে। তারপর একবার মিলিয়ে নিয়ে টাকাটা পাঠিয়ে দেয়।

টাকা পাঠিয়ে এখন খুব শান্তি লাগছে। আচ্ছা লোকটা বলছিল উনি নাকি মনের ডাক্তার। তাই বুঝি চট করে ওর মনের এলোমেলো দিকটা ধরতে পেরেছিলেন?

ঠিক এই সময় মেসেজ আসে, ‘ধন্যবাদ, টাকা পেয়েছি। আপনার পায়ের ব্যথা কমেছে?’

কুঞ্জল কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে দেখে সাইফুল্লাহ সাহেব মেসেজ লিখেছে। লিখবে না ভেবেও ও লিখে, ‘হ্যাঁ, এখন অনেক কম। খোঁজ নেবার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ।’

মেসেজটা পাঠিয়ে কেন জানি ভালো লাগতে থাকতে ওর। এরপর মাঝে মাঝেই মনের অজান্তে ওর চোখ মোবাইলের দিকে চলে যায়। তারপর নিজেই লজ্জা পায়। আচ্ছা ওর মন কি সাইফুল্লাহ সাহেবের মেসেজের আশা করছে? কিন্তু কেন? লোকটা ওর মন খারাপের খবরটা পড়তে পেরেছে, সেজন্য ওকে এত আপন মনে হচ্ছে?

২.
সাইফুল্লাহ মনোযোগ দিয়ে পাবমেডে বাংলাদেশের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে একটা আর্টিকেল পড়ছিল। মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১৮.৭% ছিল যেটা মহামারী পরবর্তী সময়ে বেড়ে গিয়ে ৪৬% পর্যন্ত উঠেছে। আর সরকারের স্বাস্থ্য খাতের মোট বাজেটের মোটে ০.৪৪% টাকা মানসিক স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হয়। কী ভয়াবহ একটা চিত্র! কত মানুষ যে এই মানসিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত। মন খারাপ করে আবার পড়া শুরু করতে যেতেই ফোন বাজে, চেয়ে দেখেন সেই মেয়েটির ফোন। আজ মেয়েটার আসার কথা। ক’দিন আগেই এক বিকেলে ওকে ফোন করেছিল, দেখা করতে চায়। সাইফুল্লাহ সানন্দেই রাজি হয়েছিল। ও যতটুকু বুঝেছে মেয়েটার সাহায্য দরকার।

সাইফুল্লাহ ফোনটা রিসিভ করে, ‘আপনি এসেছেন?’

ওপাশ থেকে কুঞ্জলের গলা পাওয়া যায়, ‘এই তো কাছাকাছি। আপনি কি ওই দোকানটায় আছেন, মানে যেখানে আমার এক্সিডেন্টটা হয়েছিল?’

সাইফুল্লাহ ওকে আশ্বস্ত করে বলে, ‘আপনি আসতে আসতে আমি চলে আসব। আসুন আপনি।’

ফোন রেখে সাইফুল্লাহ দ্রুত রেডি হয়ে বের হয়। একটু হাঁটতেই সেই দোকানের কাছে পৌঁছে যায়। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। কুঞ্জল একটা সিএনজি থেকে নামতেই সাইফুল্লাহ হাত নাড়ে ওকে উদ্দেশ করে। কুঞ্জল একবার তাকিয়ে হাসে।

সাইফুল্লাহর মন ভালো হয়ে যায়। আজ মেয়েটাকে দেখে ভালো লাগছে। লালচে খয়েরী রঙের সুন্দর একটা জামা পরেছে, চুল পরিপাটি করে বাঁধা। মুখে হালকা প্রসাধনী। মন ভালো করা একটা মুখ, ভাবে সাইফুল্লাহ। মেয়েটা হয়তো নিজেকে সামলে নিয়েছে।

কুঞ্জল কাছে আসতেই সাইফুল্লাহ ওর পায়ের দিকে তাকিয়ে উচ্ছ্বসিত গলায় বলে, ‘বাহ, আপনার পা তো একদম ভালো হয়ে গেছে। দৌড়ুতে পারবেন?’

কুঞ্জল হাসে, ‘কেন আপনি বুঝি দৌড়ুবেন আমার সাথে। আমি কিন্তু দৌড়ে বরাবর ফার্স্ট হতাম স্কুলে।’

সাইফুল্লাহ কৃত্রিম অবাক হবার ভান করে, ‘তাই বুঝি? একদিন তাহলে আপনার সাথে দৌড়ে দেখতে হবে। আচ্ছা, কোথায় বসবেন তাই বলুন। এখানে একটা ভালো রেস্টুরেন্ট আছে সেখানে বসতে পারি। আর আমার বাসা কাছেই, ওখানেই রোগী দেখার আলাদা চেম্বার আছে। ইচ্ছে করলে বসতে পারেন।’

কুঞ্জল একটু ভাবে, তারপর বলে, ‘আপনার চেম্বারেই বসি, চলুন।’

সাইফুল্লাহ মাথা নাড়ে। তারপর ওকে পথ দেখিয়ে ওর বাসার কাছে নিয়ে যায়।

কাছাকাছি আসতেই কুঞ্জল অবাক হয়ে খেয়াল করে ঢাকা শহরের এমন ব্যস্ততম জায়গায় একটা ছোট এক তলা বাড়ি। চারপাশে সব উঁচু দালানকোঠা। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে, ‘এটা আমার পৈতৃক ভিটা। কেন জানি উঁচু দালানকোঠা আমার সহ্য হয় না। আমার স্ত্রীও এই একতলা বাসাটা ভালোবাসত। তাই এটা রয়ে গেছে। একমাত্র মেয়ে ইরা গ্লাসগো ইউনিভার্সিটিতে গ্রাজুয়েশন করছে। এখানে আমি একাই থাকি।’

কুঞ্জল ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘আপনার স্ত্রী?’

সাইফুল্লাহ গম্ভীরমুখে বলে, ‘আপনি খেয়াল করেননি আমি কিন্তু বলেছি আমার স্ত্রী এই একতলা বাসাটা ভালোবাসত। মানে, ও এখন আর বেঁচে নেই। ইরার জন্মের দু’বছর বয়সেই মারা যায়। তারপর থেকে এই পৃথিবীতে আমরা দু’জন, আমি আর ইরা। বছরের কয়েকটা মাস ওর কাছে গিয়েই থাকি।’

কুঞ্জলের মন খারাপ হয়ে যায়। এই মানুষটার এত মন খারাপ করা একটা গল্প আছে ও ভাবতেও পারেনি। ও অস্ফুটে বলে, ‘সরি।’

সাইফুল্লাহ মাথা নাড়ে, ‘আপনি তো জানতেন না। মানুষকে বাইরে থেকে পরিপাটি মনে হলেও ভেতরে ভেতরে প্রতিটি মানুষ এমন দুঃখ বয়ে বেড়ায়। একেকজনের দুঃখ একেকরকম, এই যা পার্থক্য। এসব মন খারাপের কথা থাকুক, আপনি চা খাবেন তো?’

কুঞ্জল হ্যাঁ-সূচল মাথা নাড়ে, তারপর ও ব্যাগ থেকে একটা কাগজের ব্যাগ বের করে বলে, ‘দেখুন তো এই ফতুয়াটা আপনার লাগে কি-না?’

সাইফুল্লাহ খুশি খুশি গলায় বলে, ‘বাহ, আমার প্রিয় আকাশি রঙের ফতুয়া এনেছেন। উম, লাগবে এটা। আপনি দেখি এক দেখাতেই আমার ফতুয়ার সাইজ বুঝে ফেলেছেন।’

কুঞ্জল হাসে, তারপর ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আপনিও তো একবার দেখেই আমার মনের গোপন খবর জেনে ফেলেছেন।’

সাইফুল্লাহ মাথা নাড়ে, ‘আসলে যার যা কাজ। আমি তো মনের খবর নিয়েই কাজ করি। আচ্ছা, বসুন আমি চা নাস্তার কথা বলে আসি।’

কুঞ্জল মাথা নাড়ে। সাইফুল্লাহ বেরিয়ে যেতেই ও পুরো রুমটা ঘুরে দেখে। একটা পাশ জুড়ে বই রাখার তাক। বেশিরভাগই ইংরেজি বই। একটা পাশে দুটো গদি ওয়ালা চেয়ার, দেখেই বোঝা যায় চেয়ার দুটো আরামদায়ক, আর দামীও। এককোণে একটা টেবিলে তাজা ফুল রাখা। ঘরের মাঝমাঝি দেয়াল জুড়ে বড়ো জানালা, তার ফাঁক গলে সকালের রোদ্দুর আসছে। কুঞ্জলের মন ভালো হয়ে যায়। ও আরাম করে একটা চেয়ারে বসে।

সাইফুল্লাহ এসে একবার তাকায়, মেয়েটা আজ খুব বেশি স্বাভাবিক আচরণ করছে, জড়তা নেই। কিন্তু কেন?

সাইফুল্লাহ বসতে বসতে বলে, ‘আমার এই রুমটা পছন্দ হয়েছে? আমি সাজিয়ে রাখি প্রতিদিন।’

কুঞ্জল বাচ্চাদের মতো মাথা নাড়ে, ‘হ্যাঁ, খুব সুন্দর, সাজানো গোছানো। আচ্ছা, আপনি তো মনের ডাক্তার। আমার এলোমেলো হয়ে থাকা মনটা কি এমন পরিপাটি করে সাজিয়ে দিতে পারবেন?’

সাইফুল্লাহ চেয়ে থাকে, তারপর ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘মানুষের মন আসলে কেউই ঠিক করে দিতে পারে না। আমি আপনাকে বরং আপনার মনকে চিনতে সাহায্য করতে পারি। আপনার মনের নাজুক দিকগুলোর পাশাপাশি শক্তিশালী দিকগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারি। যাতে করে আপনি প্রতিকূল পরিস্থিতিতে যুদ্ধ করতে পারেন।’

কুঞ্জল গালে হাত দিয়ে সামনে ঝুঁকে বসে বলে, ‘সেটা কেমন?’

সাইফুল্লাহ একটু ভেবে বলে, ‘এই যে আপনি জোরে দৌড়াতে পারেন এটা কিন্তু ভুলেই গিয়েছিলেন। আজ আমার সাথে কথা বলতে গিয়েই আপনার এই কথাটা মনে হলো।’

কুঞ্জল আগ্রহের গলায় বলে, ‘একদম ঠিক বলেছেন। আমি যে আগে এত ভালো দৌড়ুতাম সেটা ভুলেই গিয়েছিলাম। আচ্ছা আর কি কি?’

সাইফুল্লাহ হাসে, মেয়েটা মজা পেয়েছে ওর কথায়। ও চোখ কুঁচকে বলে, ‘কুঞ্জল, আমি কোনো জাদু জানি না যে আপনার মনের খবরগুলো বলতে পারব। আপনি আপনার কথাগুলো আমাকে বলতে পারেন। অবশ্য যতটুকু আপনি বলতে চান। জোর করে কিছু বলতে হবে না।’

কুঞ্জল মাথা নিচু করে বসে থাকে তারপর ধীরে ধীরে প্রথম থেকে সব খুলে বলে। তাতে মাঝে মাঝেই কুঞ্জলের গলার স্বরে উঠানামাটা টের পায় সাইফুল্লাহ।

একটা সময় কথা ফুরোয়। কুঞ্জল মাথা নিচু করে বসে থাকে।

সাইফুল্লাহ উঠে গিয়ে একটা গ্লাসে পানি ভরে ওর দিকে এগিয়ে দেয়, ‘নিন, আপনার পিপাসা পেয়েছে।’

কুঞ্জল হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা নেয়। তারপর ঢকঢক করে পানি খায়, সত্যিই গলা শুকিয়ে গিয়েছিল।

গ্লাসটা রাখতেই সাইফুল্লাহ বলে, ‘খুব সাধারণ সমস্যা আপনার।’

কুঞ্জল চমকে মুখ তুলে তাকায়, মন খারাপ গলায় বলে, ‘সাধারণ সমস্যা! আমার সংসার ভেঙে যাচ্ছে আর আপনি বলছেন সাধারণ সমস্যা?’

সাইফুল্লাহ আশ্বাস্ত করে বলে, ‘বুঝিয়ে বলছি আপনাকে। সৃষ্টির সেই আদিকাল থেকেই এমন হয়ে আসছে৷ মানুষ আসলে পলিগ্যামাস। তাই সুযোগ পেলেই এমন করে। হ্যাঁ, এটা যে করে সে অপরাধী। যে করে সে নিজেও জানে এটা অপরাধ। কিন্তু এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এজন্য যুগ যুগ ধরে মানুষ নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে নানান কিছুর আশ্রয় নিয়েছে। তার মধ্যে ধর্ম একটা। এছাড়া শিক্ষা, বিবেক, সামাজিকতার মতো উপাদানও আছে।’

কুঞ্জল রাগী গলায় বলে, ‘তার মানে আপনি বলছেন অভীককে কিছু বলার নেই?’

সাইফুল্লাহ মাথা নেড়ে বলে, ‘আমি তো বলার কিছু দেখি না। অভীক এই পথ থেকে নিজেকে কিছুতেই ফেরাতে পারছে না। তার শিক্ষা, ধর্ম, পরিবারের প্রতি মায়া – এগুলোর কোনো উপাদানই ঠিকঠাক কাজ করছে না। নিজের মোহের কাছে এগুলো সব পরাস্ত। তবে একটা আশার কথা হলো মানুষ একটা সময় ঠিক ফিরে আসে। মানুষ জন্মগতভাবে ভালো হয়ে থাকতে চায়। সে আশেপাশের মানুষের কাছে ‘ভালো মানুষ’ কথাটা শুনতে চায়। তখন তার শিক্ষা অথবা ধর্ম অথবা বিবেক – যেকোনো একটা উপাদান শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আমার মনে হয় অভীক এবার ফিরবে।’

কুঞ্জল অনেকক্ষণ ওর মুখের দিকে চেয়ে থাকে। তারপর লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘ও ফিরুক বা নাই ফিরুক আমি আর ওর কথা ভাবতে চাই না। আপনি কি আমাকে একটা পথ বাতলে দিতে পারেন যাতে আমি এই ক্ষতগুলো ভুলে থাকতে পারি।’

সাইফুল্লাহ মাথা নাড়ে, ‘এটা খুব সহজ। নিজেকে ব্যস্ত করে ফেলতে পারেন। এমন কোনো একটা কাজ যেটা আপনি করতে ভালোবাসেন। আমি যেমন মন খারাপ হলে ছবি আঁকতে বসি। তাতে মন কেন্দ্রীভূত হয়।’

কুঞ্জল চিন্তিত মুখে বলে, ‘কিন্তু আমি তো এমন কিছু পারি না। শুধু নানা ধরনের রান্না করতে পারি।’

সাইফুল্লাহ সামনে ঝুঁকে এসে বলে, ‘তাই করুন তাহলে। আজকাল তো দেখি অনেকে রান্নার ব্লগ করে, পেজ বানায়। তাতে অনেক অনেক মানুষ ভালো ভালো মন্তব্যও করে। এতে মন ভালো থাকবে।’

কুঞ্জলের হঠাৎ করেই পৃথুলের কথা মনে পড়ে যায়। ও একদিন এমনটা বলেছিল বটে। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে বলে, ‘আর কিছু?’

সাইফুল্লাহ দুই হাত ছড়িয়ে বলে, ‘পুরনো স্কুল বন্ধুদের খুঁজে বার করুন। নিজের জন্য সময় বার করে ঘুরতে চলে যান বন্ধুদের সাথে। অথবা মানুষের উপকার হয় এমন কিছু করতে পারেন। দেখবেন জীবনে বেঁচে থাকার কত কত উপাদান পড়ে আছে। শুধু কুড়িয়ে নিতে জানতে হয়। আর নিজের কষ্টের কথাগুলো শেয়ার করবেন, অবশ্যই ভালো মানুষের সাথে। যে আপনার কথাগুলো মন দিয়ে শুনবে।’

কুঞ্জলের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। তারপর আকুল গলায় বলে, ‘আমার এই কথাগুলো আর কাউকেই বলিনি। আপনাকেই আজ বললাম। আপনার সাথে আমার কথাগুলো শেয়ার করলে আপনি শুনবেন তো?’

সাইফুল্লাহর মুখে মৃদু হাসি ফোটে, ‘হ্যাঁ, আমি আপনার সব কথা শুনব। আপনার যখনই মন খারাপ লাগবে আমাকে বলবেন, নিশ্চিন্ত মনে। আমি আপনাকে আপনার মনের ঠিক পথটা বাতলে দিতে সাহায্য করব।’

কুঞ্জলের কেন যেন আজ নিজেকে ভারমুক্ত মনে হয়। একজন মানুষকে অন্তত ওর কষ্টের কথা বলতে পেরেছে। আর মানুষটা ওর কথাগুলো গুরুত্ব দিয়ে শুনেছে। হয়তো বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টাটা ও এবার করে দেখতে পারবে।

(চলবে)

প্রেমহীন সংসার আহা সোনামুখী সুঁই পর্ব-০৫

0

#প্রেমহীন_সংসার_আহা_সোনামুখী_সুঁই (পর্ব ৫)

১.
মেঘা সকালের চা শেষ করে আজকের কাজগুলো পয়েন্ট করে লিখে ফেলে। কোনো কোনো পয়েন্টে লাল কালি দিয়ে দাগ দেয় যেগুলো করতেই হবে। তার মধ্যে অভীককে ফোন করা একটা। সকালেই ওর মেসেজ এসেছিল আজ সিলেট যাচ্ছে। আজ যেকোনো সময় ওকে নিশ্চিন্তে মেসেজ বা কল দেওয়া যাবে। একটু যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে ও। এই ক’টা মাসের প্রিয় অভ্যাস হুট করে চাইলেও ছেড়ে দেওয়া যায় না। হৃদয়ের দাবিতে এত সহজে যে ছাড় দেওয়া যায় না।

ভাবনার এ পর্যায়ে পিয়ন ছেলেটা জানায় ফাহমিদা নামে একজন ক্লায়েন্ট ওর সাথে দেখা করতে এসেছে। নামটা অপরিচিত, এর সাথে ইন্স্যুরেন্সের ব্যাপারে কখনও কথা হয়েছিল কি?ঠিক মনে করতে পারে না মেঘা।

ও মাথা নেড়ে বলে, ‘আচ্ছা পাঠিয়ে দাও।’

কুঞ্জল কাচের দরজা খুলে ঢুকতেই মেঘা মুখ তুলে তাকায়, মুখটা অচেনা। কেমন এলোমেলো লাগছে মেয়েটাকে।

ও গম্ভীরমুখে বলে, ‘আপনি ফাহমিদা?’

কুঞ্জল অপলক চেয়ে থাকে, এই মেয়েটাই মেঘা? অভীক একেই ভালোবাসে? গায়ের রঙ দুধে আলতা, ধারালো মুখচোখ। পরিপাটি করে শাড়ি পরেছে, হাতে চারকোণ ডায়ালের কালো ফিতের ঘড়ি। বুক চিরে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাসটা লুকায় ও। তারপর চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে, ‘হ্যাঁ, আমি ফাহমিদা।’

ইচ্ছে করেই মিথ্যে বলে। পিয়নটা যখন নাম জিজ্ঞেস করেছিল তখনই এই নামটা বলেছে। কুঞ্জল নামটা হয়তো ওর জানা থাকতে পারে। আর অভীক এর মধ্যে নিশ্চয়ই ওর ব্যাপারে সব বলেছে।

মেঘা তাড়া দিয়ে বলে, ‘বলুন, আপনাকে কেমন করে সাহায্য করতে পারি? ইন্স্যুরেন্স করবেন?’

কুঞ্জলা একটা বিষণ্ণ হাসি হাসে, তারপর ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, সংসার-ইন্স্যুরেন্স করব।’

মেঘা ভ্রু কুঁচকে তাকায়, অবাক গলায় বলে, ‘কী বললেন? সংসার-ইন্স্যুরেন্স? এমন অদ্ভুত ইন্স্যুরেন্সের নাম তো শুনিনি কখনও।’

কুঞ্জল একটু বাঁকা হাসি হাসে, তাতে ওর কষ্ট হয়। তারপর আনমনে বলে, ‘এই যেমন থাকে না, আপনাদের গাড়ির ইন্স্যুরেন্স। কোনো দূর্ঘটনায় ক্ষতি হলে আপনারা মেরামতি করে দেন নয়তো বা নতুন গাড়ি কিনে দেন। তেমন আর কি। কারও সংসার-ইন্স্যুরেন্স থাকলে তার ভেঙে যাওয়া সংসার জুড়ে দেওয়া হবে অথবা নতুন ঝকমকে সংসার গড়ে দেওয়া হবে যেখানে শুধুই মায়া থাকবে। যেমন থাকা উচিত আর কি। আছে আপনাদের এমন সংসার-ইন্স্যুরেন্স?’

মেঘা মনে মনে সতর্ক হয়। কোথাও একটা কিছু ঠিকঠাক নেই। কে এই মেয়ে? ও মুখচোখ শক্ত করে বলে, ‘না, আমাদের এমন কিছু নেই। আপনি আসুন।’

কুঞ্জল এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তারপর হঠাৎ করেই বলে, ‘আচ্ছা আপনি কি বিবাহিত?’

মেঘা এবার ধৈর্য হারায়, ‘আপনি কি চান আসলে বলুন তো? আমি বিবাহিত কি-না তা দিয়ে আপনার কী দরকার?’

কুঞ্জল একটু সামনে ঝুঁকে আসে, তারপর নিচু গলায় বলে, ‘না মানে আমি বুঝতে চেয়েছিলাম আপনি যদি বিবাহিত হন তাহলে কী করে অন্য একটা মানুষের সংসার ভেঙে দেবার আয়োজন করতে পারেন। অবশ্য আপনিই প্রথম না, এর আগেও আরেকজন আমার সংসার ভাঙার পাঁয়তারা করছিল। তাই ভাবছিলাম আপনাদের যদি একটা সংসার-ইন্স্যুরেন্স থাকত তাহলে আমি আমার সর্বস্ব দিয়ে করতাম। প্লিজ আপা, দেখেন না, এমন একটা ইন্স্যুরেন্স আমাকে খুলে দেওয়া যায় কি-না?’

মেঘার তলপেট কেমন খালি হয়ে যেতে থাকে। আড়াচোখে একবার তাকায় কাচের দরজাটা বন্ধ আছে কি-না। অফিসে লোকজনের আনাগোনা বাড়ছে। যে কেউ যেকোনো মুহুর্তে রুমে ঢুকে পড়তে পারে। সামনে বসা এই মেয়েটা অভীকের স্ত্রী কুঞ্জল, এ ব্যাপারে ওর কোনো সন্দেহ নেই। এই ভয়টাই এতদিন ও পেয়ে আসছিল। ইশ, অফিসে জানাজানি হয়ে গেলে ওর যে মান-সম্মান আর কিছুই থাকবে না। অভীক সামলাতে পারল না ব্যাপারটা?

মেঘা নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ‘আপনি কুঞ্জল?’

কুঞ্জলা মাথা নাড়ে। কেমন একটা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তাতে করে মেঘার অস্বস্তি বাড়ে। না, একে রাগানো যাবে না। তার চেয়ে অপরাধ স্বীকার করে ফেলা ভালো।

মেঘা মাথা নিচু করে বলে, ‘আমার ভুল হয়েছে। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দেবেন প্লিজ।’

কুঞ্জল হাসে, ‘জানেন তো সবাই আমার কাছেই ক্ষমা চায়। কিন্তু একই ভুল বার বার করলে ক্ষমা করি কী করে?’

মেঘা নিজের পক্ষে সাফাই দেবার ভঙ্গিতে বলে, ‘কিন্তু এটা আমার প্রথম ভুল। এর আগে কখনও এমন হয়নি।’

মেঘা বুঝদার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে কেমন অদ্ভুত গলায় বলে, ‘সেক্ষেত্রে আপনাকে ক্ষমা করে দেয়াই যেতে পারে। কিন্তু অভীককে নিয়ে কী করি, বলুন তো? আপনার আগে পূর্ণ নামে আরেকটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল। সেটা নিশ্চয়ই জানতেন?’

মেঘার চোখে মুখে কষ্ট পাবার ছাপ স্পষ্ট ফুটে ওঠে। অভীক সবসময় বলত ও ওর প্রথম প্রেম। এর আগে কাউকে ভালোবাসেনি। এত বড়ো মিথ্যেটা ও বলল?

কুঞ্জল কৃত্রিম দুঃখ পাবার গলায় বলে, ‘দেখেছেন, আপনিও সহ্য করতে পারছেন না অভীকের অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্কটা। তাহলে আমি কী করে করি বলুন তো? আমার তো সংসার। না হলে কবে ছেড়েছুড়ে আপনার মতো দিব্যে প্রেম করে সময় পার করতাম।’

শেষ দিকে এসে কুঞ্জলের গলার স্বর উঁচু হয়। মেঘা ভয়ে ভয়ে একবার বাইরে তাকায়। নাহ, এখনও সব স্বাভাবিক আছে।

ও নরম গলায় বলে, ‘এমন ভুল আর হবে না। প্লিজ আপনি শান্ত হন। অভীকের সব নম্বর আমি ব্লক করে দিয়েছি।’

কথাটা শেষ হওয়া মাত্রই মেঘার ফোন বেজে ওঠে। ওরা দু’জনেই স্ক্রিনের দিকে তাকায়। অভীকের নামটা জ্বলজ্বল করে স্ক্রিনে ভেসে উঠছে। এটা যেন নাম না, মেঘার মৃত্যু পরোয়ানা।

কুঞ্জল এবার হিসহিসিয়ে বলে উঠে, ‘অসভ্য, মিথ্যেবাদী মহিলা। অন্যের সংসার ভাঙতে এতটুকু লজ্জা নাই। আমি এখুনি আপনার অফিসের সবাইকে ডেকে ডেকে বলব আপনি কত বাজে একটা মহিলা।’

মেঘার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। মাথাটা কেমন ঘুরছে। ও ঝট করে কুঞ্জলের হাত ধরে ফেলে, কান্না কান্না গলায় বলে, ‘প্লিজ, এখানে কিছু বলবেন না। এই চাকরিতে আমার সংসার চলে। আমার এ জীবনের মতো শিক্ষা হয়ে গেছে। আপনি কোনোদিন আমার দিক থেকে কোনো ঝামেলা পাবেন না। এই যে আমি অভীকের নম্বর মুছে দিচ্ছি। আর ও যদি এরপরেও যোগাযোগ করে আমি আপনাকে জানাব। আমাকে ক্ষমা করে দিন, প্লিজ, প্লিজ।’

কুঞ্জল করুণার চোখে চেয়ে থাকে। মানুষের যখন আসল জায়গায় টান পড়ে তখন মানুষ ঠিক হয়। এর আগে বুঝি হয় না। ভীষণ কষ্ট লাগছে, অভীক এখনও ঠিক হলো না। এখনও এই মেয়েটার সাথে যোগাযোগ রাখছে। নাহ, বাইরের মানুষকে দোষ দিয়ে ও কী করবে, ওর ঘরের মানুষই যে ঠিক নেই। ভীষণ একটা ধিক্কার আসে নিজের উপর। ওর কোনো মূল্যই নেই অভীকের কাছে। ইচ্ছে করছে আজই মরে যেতে। শুধু অর্ক বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলে ও উঠে দাঁড়ায়, তারপর ক্লান্ত গলায় বলে, ‘সংসার-ইন্স্যুরেন্সের কথাটা মাথায় রেখেন। দেখবেন অনেক কাটতি থাকবে এই ইন্স্যুরেন্সের।’

কুঞ্জল চলে যায়। মেঘা স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকে। বুকের ভেতর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। একটা মানুষের জীবন, তার সংসার কী ভীষণ করে এলোমেলো করে দিয়েছে ও। স্বার্থপরের মতো নিজের একটু সুখের জন্য ওই মেয়েটার সব সুখ ও কেড়ে নিল কী করে? একটা অনুতাপ ঘিরে ধরে মেঘাকে। ভীষণ কান্না পাচ্ছে।

২.
সাইফুল্লাহ একটা চায়ের দোকানে বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছিল। আকাশী রঙের একটা ফতুয়া আর সাদা পাজামা পরা, কোথাও একটু ভাঁজ নেই, একদম পরিপাটি। মাথার কাঁচাপাকা চুলগুলো ঝাউ গাছের মতো ঘন কোঁকড়ানো। চোখে গোল ফ্রেমের একটা চশমা। মুখটা ছোটখাটো, নাকটা বেশ তীক্ষ্ণ। চেহারাটা হিন্দি সিনেমার নাসিরুদ্দিন শাহ এর সাথে মিলে যায়। অনেকে ফিরে তাকায়। সেদিকে অবশ্য ওর ভ্রুক্ষেপ নেই। সাইফুল্লাহ মনোযোগ দিয়ে পথ চলতি মানুষ দেখছিল। এটা ওর একটা খেলা। কাকরাইলের এই দিকটা অফিস পাড়া। সারাদিন নানান পদের মানুষ আসে। কেউ দালাল, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ চাকরিজীবি, কেউ ভবঘুরে। সাইফুল্লাহ সবাইকে খেয়াল করে দেখে। তাদের কথা বলার ভঙ্গি, হাঁটার স্টাইল, সব।

এই যে সামনের ফুটপাত ছেড়ে রাস্তা দিয়ে এখন যে মেয়েটা বিপদজনকভাবে হনহন করে হেঁটে চলছে তাকে দেখলে মনে হয় এখুনি বুঝি পৃথিবীর সাথে সব লেনদেন চুকিয়ে দিতে চায়। নাহ, মেয়েটাকে সাবধান করা দরকার। যেকোনো সময় গাড়ি চাপা পড়বে। সেটা না হলেও নিদেনপক্ষে রিক্সার নিচে।

কথাটা ভাবতে ভাবতেই দূর্ঘটনাটা ঘটে। উল্টোপথে একটা রিক্স আচমকা সামনে চলে আসে। শেষ মুহুর্তে ব্রেকও কষে কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। হুড়মুড় করে রিক্সাটা মেয়েটার উপর পড়তেই চিৎকার চেচামেচি শোনা যায়। সাইফুল্লাহ চায়ের কাপ রেখে তড়িৎ গতিতে সামনে এগিয়ে যায়। মেয়েটা ফুটপাত ঘেঁষে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে। ব্যথায় নীল হয়ে গেছে মুখটা, চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। একটা হাত দিয়ে ডান পায়ের নিচের দিকে চেপে ধরে বসে আছে।

সাইফুল্লাহ সংকোচ ঝেড়ে মেয়েটাকে টেনে তোলে। ব্যথায় ককিয়ে ওঠে কুঞ্জল। পায়ে জোর ব্যথা পেয়েছে। ভেঙেছে কি-না কে জানে। মেঘার অফিস থেকে বেরিয়ে ওর কেন যেন মাথা এলোমেলো হয়ে গেল। উদ্দেশ্যবিহীনভাবে হাঁটছিল। কোথা থেকে এই রিক্সাটা চলে এল?

সাইফুল্লাহ জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘আপনি হাঁটতে পারবেন? মনে হচ্ছে পায়ে জোর ব্যথা পেয়েছেন। দেখুন তো পা ফেলতে পারেন কি-না?’

কুঞ্জল নিচের ঠোঁট চেপে ব্যথাটা সামলায়। তারপর লোকটার দিকে তাকায়। বয়স্ক একজন মানুষ, কাঁচাপাকা চুল। দেখে তো ভদ্রলোক মনে হচ্ছে। ও এবার সাবধানে পা ফেলতেই পুরো শরীরে ব্যথাটা বিদ্যুতের মতো একটা শক দেয় যেন। কুঞ্জল লোকটার ধরে থাকা হাত শক্ত করে চেপে ধরে ‘উউউহ’ করে ওঠে।

সাইফুল্লাহ চিন্তিত গলায় বলে, ‘এহ হে, মনে তো হচ্ছে পা মচকে গেছে অথবা হাড় ভেঙে গেছে।’

কুঞ্জল দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘আমাকে একটা সিএনজি ঠিক করে দিন প্লিজ। বাসায় গিয়ে রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে।’

সাইফুল্লাহ হতাশ হয়ে মাথা নাড়ে, তারপর বলে, ‘আপনাকে এখন হাসপাতাল যেতে হবে। আপনি মনে হয় খেয়াল করেননি যে আপনার নিচের দিকে জামা রক্তে ভিজে গেছে। হাতের এদিকটাও কেটে গেছে। কাছেই একটা ক্লিনিক আছে, চলুন আমি নিয়ে যাচ্ছি।’

এরপর লোকটা ওকে আর কথা বলার সুযোগ দেয় না। ভীড় জমে যাওয়া লোকদের মাঝে একজন একটা সিএনজি ঠিক করে দেয়। লোকটার কাঁধ ধরে ও কোনোমতে সিএনজিতে উঠে বসে।

ঘন্টা দুই পর হাসপাতাল থেকে যখন ও ছাড়া পায় ততক্ষণে ডান পায়ে ভারী প্লাস্টার। আর হাতে, পায়ে যেখানে ছড়ে গেছে সেখানেও ব্যান্ড এইড দেওয়া। পায়ের উপরের দিকে একটা ব্যান্ডেজ পড়েছে। সব দেখেশুনে ডাক্তার সাহেব বলেছেন, হাড় ভাঙেনি, মচকে গেছে শুধু।

সাইফুল্লাহ হেসে বলে, ‘বেঁচে গেলেন। না হলে মাস তিনেক পা তুলে বসে থাকতে হতো। আর রাস্তায় অমন আনমনে হয়ে হাঁটবেন না।’

কুঞ্জল এবার খুব লজ্জা পায়। সেই তখন থেকে বয়স্ক মানুষটা ছুটোছুটি করে সব ব্যবস্থা করছে। ওকে চেনে না জানে না তাও কত কী করল। হঠাৎ করে একটা কথা মনে হতেই ও জিভ কাটে। আচ্ছা, এইসব টেস্ট, প্লাস্টার করতে তো অনেক টাকা খরচ হয়ে যাবার কথা। ও দ্বিধান্বিত গলায় বলে, ‘কিছু মনে না করলে যদি বলতেন আপনার কত টাকা খরচ হলো?’

সাইফুল্লাহ ভ্রু কুঁচকে হিসেব করে, ‘তা ধরুন গিয়ে হাজার পাঁচেকের মতো। আমি কার্ড দিয়ে দিয়েছি।’

কুঞ্জল এবার অতলান্তে পড়ে। এত টাকা যে এই মুহুর্তে ওর কাছে নেই। অভীক কয়েকবার ক্রেডিট কার্ড নেবার কথা বলেছিল, কিন্তু নেওয়া হয়নি। নাহ, এখন কী করে?

ও এবার সংকোচের গলায় বলে, ‘যদি কিছু মনে না করেন আপনার মোবাইল নম্বর যেটাতে বিকাশ আছে সেটা দিলে আমি দিয়ে দিতাম।’

সাইফুল্লাহ পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে বলে, ‘এখানে আমার নাম ধাম ঠিকানা লেখা আছে। আর নিচে যে মোবাইল নম্বরটা ওটাতেই টাকা পাঠাতে পারেন। আপনি একা ফিরতে পারবেন তো?’

কুঞ্জল হাত বাড়িয়ে কার্ডটা নিয়ে ব্যাগে রাখে। তারপর মাথা নেড়ে বলে, ‘একটা সিএনজি ঠিক করে দিলে পারব।’

সাইফুল্লাহ ওর বাসার ঠিকানাটা জেনে একটা সিএনজি ঠিক করে দেয়। কুঞ্জল ওর হাত ধরে সিএনজিতে কষ্ট করে উঠে, তারপর কৃতজ্ঞ গলায় বলে, ‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আমার জন্য অনেক কষ্ট করলেন।’

সাইফুল্লাহ মৃদু হাসে, তারপর ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আপনার পা সেরে গেলে একবার জানাবেন। আর মনের যত্ন নেবেন, আপনি কিন্তু মনের দিক থেকে ভালো নেই।। ভালো নেই মানে খুব খারাপ আছেন। অবহেলা করবেন না।’

কুঞ্জল চমকে ওঠে। এই লোক জানল কী করে ওর মন ভালো নেই? নাকি এই বুড়োটাও অন্য সব পুরুষ মানুষের মতো ফ্লার্ট করার চেষ্টা করছে?
ওর চোখমুখ শক্ত হয়ে যায়, ‘আমার মন ভালো আছে, সেটা নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না। আজ বিকেলেই আপনার পাওনা টাকা পেয়ে যাবেন। ধন্যবাদ।’

সাইফুল্লাহ মাথা নাড়ে, ‘না, আপনার মন ভালো নেই। আপনি মিথ্যে বলছেন। আপনি যখন ফুটপাত দিয়ে না হেঁটে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলেন আমি খেয়াল করে দেখছিলাম আপনার দু’ পায়ে দু’রঙের জুতো। মন ভালো থাকলে এমন ভুল করতেন না। তারপর আপনার ব্যাগের চেইনটাও খোলা ছিল। পড়ে যাবার সময় আপনার ব্যক্তিগত কিছু জিনিস পড়ে গিয়েছিল। একটা মেয়ে এত অগোছালো হয়ে বাড়ি থেকে বের হয় না। আপনি হয়তো ভাবছেন আমি এতকিছু খেয়াল করলাম কেন? আমি আসলে একজন কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট। আমার ভিজিটিং কার্ডে লেখা আছে, আপনি খেয়াল করেননি। মানুষ দেখা আমার একটা নেশার মতো। আপনার দু’পায়ে দু’রকম জুতো দেখেই আমি কৌতুহলী হয়ে আপনাকে অনুসরণ করছিলাম।’

কুঞ্জল অবিশ্বাস নিয়ে জুতোর দিকে তাকায়। একটা পাটি খুলে রেখেছে, অন্যটা বা পায়ে পরা। ও অবাক হয়ে খেয়াল করে আসলেই তো, দু’পায়ের জুতো দুই রঙের। তাড়াহুড়ায় সকালে খেয়ালই করেনি। লজ্জা লাগছে এখন।

সাইফুল্লাহ নরম গলায় বলে, ‘বাসায় যান। ডাক্তার যেভাবে লিখেছেন সেভাবে ক’টা দিন বিশ্রাম নিন। ওষুধগুলো ঠিকঠাক খাবেন। আর মনের ভেতর যে জট পাকিয়ে আছে সেটা সারাতে চাইলে আমাকে ফোন করতে পারেন।’

কুঞ্জল নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। হঠাৎ করেই আবার কান্না পাচ্ছে। আজ মেঘাকে অফিসে দেখে মনটা একটু হলেও স্বস্তি পেয়েছিল যে ওই মেয়েটা অভীকের সাথে সিলেট যায়নি। কিন্তু মেঘার মোবাইলে যখন অভীকের ফোন এল তখন ওর পুরো পৃথিবীটা যেন ভেঙেচুরে গিয়েছিল। নিজেকে ভীষণভাবে প্রতারিত মনে হচ্ছিল। এতক্ষণ কষ্টটার কথা মনে ছিল না। কিন্তু এই লোকটা আবার মনে করিয়ে দিল। ও গম্ভীরমুখে বলে, ‘আমার কারও সাহায্য লাগবে না। ধন্যবাদ আপনাকে।’

সিএনজি ছেড়ে দেয়। সাইফুল্লাহ চিন্তিত মুখে মেয়েটার চলে যাবার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই মেয়েটার মধ্যে জীবন নিয়ে একটা চরম উদাসীনতা চলে এসেছে। যতটুকু মনে হচ্ছে হাসব্যান্ডের সাথে ঝামেলা। না হলে এতক্ষণে একবার হলেও হাসব্যান্ড বা বাসার কাউকে দূর্ঘটনার কথা ফোন করে জানাত। এই মেয়েটা দারুণ অভিমানী। বুকে বড়ো কোনো কষ্ট চেপে ঘুরে বেড়াচ্ছে। না হলে এত বড়ো একটা দূর্ঘটনা ঘটে যাবার পরও কাউকেই ফোন দেয়নি। যেকোনো সময় মেয়েটা আত্মহত্যা করে ফেলতে পারে। সাইফুল্লাহ চিন্তিত মুখে বাসার দিকে এগোয়। মেয়েটাকে বাঁচাতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু যে নিজেই বেঁচে থাকতে চায় না তাকে বাঁচিয়ে রাখা কঠিন কাজ। কিন্তু সেই কঠিন কাজটাই এখন করতে ইচ্ছে করছে।

(চলবে)

প্রেমহীন সংসার আহা সোনামুখী সুঁই পর্ব-০৪

0

#প্রেমহীন_সংসার_আহা_সোনামুখী_সুঁই (পর্ব ৪)

১.
মেঘা কিছুতেই বুঝে পারছে না অভীকের কী হয়েছে। আজ দু’দিন ওর কোন পাত্তাই নেই। শুধু ছোট্ট একটা মেসেজ এসেছিল, আপাতত ওকে কোনো মেসেজ না করতে। তা মেঘা আর মেসেজ দেয়ওনি। কিন্তু খুব চিন্তা হচ্ছে, ওর বাসায় কি কোনো ঝামেলা হয়েছে? ওদের সম্পর্কটা কি জেনে ফেলল? এটা ও ভাবতেও চায় না। কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে। মাহমুদ জানলে কী যে হবে! ভাবতেই বুক শিউরে ওঠে ওর। কিন্তু অভীক ছেলেটার জন্য যে মন কেমন করে। পরিচয়ের প্রথম থেকেই ভালো লেগে গেছিল ওকে। এমন মায়া জড়ানো একটা মানুষকে যদি পেত ও। মাহমুদের সংসারে কোনো দায়িত্ব নেই, উলটো ওর পয়সায় নেশা করে। মাঝে মাঝে মেয়ের সামনেই গায়ে হাত তুলত। সংসারটা বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হতো। তাই অভীকের সাথে পরিচয়টা ওকে একটা মুক্তি দিয়েছিল। একটু হলেও জীবনের না পাওয়া মায়া, ভালোবাসা পাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে কী হলো?

এই যখন ভাবছে ঠিক তখনই অভীকের ফোন আসে। মেঘার বুক চলকে ওঠে। তাড়াহুড়ো করে ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে ওর গলা পাওয়া যায়, ‘মেঘা, জরুরি কথা আছে। আজ বিকেলে একটু সেই কফিশপে আসতে পারবে?’

মেঘা আকুল গলায় বলে, ‘আসব। কিন্তু তোমার কী হয়েছে, যোগাযোগই করছ না একদম। অভীক, কোনো সমস্যা?’

অভীক বিমর্ষ গলায় বলে, ‘বিকেলে আসো, সব খুলে বলছি।’

ফোন রেখে দিয়ে অভীক চিন্তিত মুখে সামনে তাকিয়ে থাকে। দু’দিন পর আজ অফিসে এল। সেদিন রাতে কুঞ্জল যখন অমন করে দরজা বন্ধ করে দিল তখন ভয়ে ওর হাত পা অবশ হয়ে গিয়েছিল। বার বার মনে হচ্ছিল দরজা খুললেই কুঞ্জলের দেহটা ফ্যান থেকে ঝুলতে দেখবে। তীব্র আতংক ওকে গ্রাস করেছিল। আর ছোট্ট অর্ক কেমন ভয় পেয়ে কান্না করছিল! এটুকু ভাবতেই অভীকের বুক দুমড়ে মুচড়ে ওঠে। না, কুঞ্জল তার একটু পরে নিজেই দরজা খুলে দিয়েছিল। হয়তো ছেলের কান্নাতেই কাজ হয়েছিল। তা যেটাতেই কাজ হোক তাতে অভীকের মাথাব্যথা নেই। কুঞ্জল যে ঠিকঠাক ছিল সেটাই তখন বড়ো মনে হয়েছে। সেদিন ওর হাত ধরে ক্ষমা চেয়েছে, এমন আর করবে না। কী যে হয় ওর। পূর্ণের পর ভেবেছিল অন্য কোনো মেয়ের সাথে আর জড়াবে না। কিন্তু কেমন করে যেন ঠিক জড়িয়ে যায়। নাহ, মেঘাকে আজ সব খুলে বলতে হবে। এই সম্পর্কটা আর রাখা যাবে না। কুঞ্জল একদম পাগল হয়ে গেছে। কেমন পাগলাটে চোখে তাকিয়ে থাকে। কখন যে একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলে। কথাটা ভাবতেই ওর বুক কেঁপে ওঠে। দ্রুত ছেলের মোবাইলে ফোন দেয়।

ফোন বাজছে। ধরছে না কেন অর্ক? অভীক বুকের ভেতর একটা ধুকপুক টের পায়। একদম শেষ মুহুর্তে ওর গলা পাওয়া যায়, ‘বাবা।’

অভীক আদরের গলায় বলে, ‘নাস্তা করেছ অর্ক?’

অর্ক মাথা নেড়ে বলে, ‘হ্যাঁ বাবা। তুমি?’

অভীক মাথা নেড়ে বলে, ‘হ্যাঁ বাবা করেছি। তোমার আম্মু খেয়েছে? তোমার আম্মু কী করে?’

অর্ক একটু চুপ থাকে, তারপর উত্তর দেয়, ‘আম্মু খেয়েছে। আর এখন আমার নতুন বইয়ের মলাট লাগিয়ে দিচ্ছে।’

অভীক একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। তারপর বলে, ‘আচ্ছা বাবা, আম্মুকে হেল্প করো তুমি। আর আম্মুর দিকে খেয়াল রেখো। আম্মুর শরীর খারাপ লাগলে আমাকে ফোন দিও।’

ফোন রেখে এবার ও চায়ে চুমুক দেয়। পিয়ন ছেলেটা একটু আগেই চা দিয়ে গেছে। কুঞ্জল বইয়ের মলাট লাগাচ্ছে, তার মানে ও এখন স্বাভাবিক। ছেলের মুখ চেয়ে নিশ্চয়ই ও খারাপ কিছু করবে না? এই ভাবনাটুকু স্বস্তি দেয় ওকে। কিন্তু পরক্ষণেই একটা দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরে, কুঞ্জল এখন স্বাভাবিক আছে। কিন্তু আবার যদি মন বিগড়ে যায়? অর্ক স্কুলে চলে যাবার পর বড়ো একটা সময় কুঞ্জল বাসায় একাই থাকে। তখন কোনো অঘটন ঘটে গেলে? ভাবতেই বুক কেঁপে ওঠে ওর। এখন থেকে এই ভয়টা ওকে তাড়া করে বেড়াবে।

বিকেল চারটা। গুলশানের রেট্রো কফিশপে ভীড়টা এখন কম। মেঘা আজ আগেই এসে পৌঁছেছে। মনের ভেতর একটা অস্বস্তি হচ্ছে যেটা অভীকের সাথে কথা না বলা পর্যন্ত কিছুতেই দূর হবে না। কোণের একটা টেবিলে বসতেই ও দরজা ঠেলে অভীককে ঢুকতে দেখে। অভীক পুরো ক্যাফেতে একবার চোখ বুলিয়ে ওর উপর এসে চোখ স্থির হয়। একটু হাসে, হাত নাড়ে। মেঘাও হেসে হাত নাড়ে।

কাছে এসে চেয়ার টেনে বসতে বসতে ও বলে, ‘অনেক আগেই এসে পৌঁছেছ?’

মেঘা না-সূচক মাথা নাড়ে, ‘এই এসে বসলাম মাত্র। তুমি ঠিক আছ তো?’

অভীক নিচের ঠোঁট কামড়ে মাথা নাড়ে। ওর চোখের দিকে তাকায়। মেঘা আজ অরেঞ্জ কালারের একটা জামা পরেছে। এমনিতেই ওর গায়ের রঙটা দুধে আলতা৷ তার উপর এই জামাতে আরও ঝলমলে লাগছে। এত ভালো লাগে মুখটা। মন খারাপ করা সুন্দর, এই মেয়েটা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অভীক। মেঘার সান্নিধ্য ওর ভালো লাগত। অথচ আজ সেই ভালো লাগাটুকুর মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে।

কয়েকটা মোমো আর কফির অর্ডার দিয়ে অভীক মেঘার হাতটা চেপে ধরে, তারপর আবেগের গলায় বলে, ‘মেঘা, বিরাট ঝামেলা হয়ে গেছে। তোমার ব্যাপারে কুঞ্জল সব জেনে ফেলেছে।’

মেঘা আতংকিত চোখে ওর দিকে তাকায়। মনে মনে এটাই আশংকা করছিল ও। চিন্তিত মুখে বলে, ‘কিন্তু কী করে হলো? তুমি বাসায় যাবার পর তো আমি মেসেজ করিনি কোনোদিন।’

অভীক ওর হাত ছেড়ে হতাশ গলায় বলে, ‘সেসব কিছু না। এটাকে বলে দূর্ভাগ্য।’

তারপর ওকে সব খুলে বলতেই ওর মুখ রক্তশূণ্য হয়ে যায়। কাঁপা গলায় বলে, ‘তার মানে তোমার বউয়ের কাছে আমার অফিসের ঠিকানা, আমার ফোন নম্বর সব আছে। সর্বনাশ হয়ে গেল। এখন যদি আমার অফিসে এসে কোনো সিনক্রিয়েট করে?’

শেষ কথাটা বলতে গিয়ে ও সত্যিকার অর্থেই কেঁপে ওঠে। অভীক ওর হাত ধরে, একটু চাপ দিয়ে বলে, ‘এটা করবে না ও। কিন্তু আমাদের আর যোগাযোগ করা যাবে না। অন্তত ক’টা মাস চুপচাপ থাকতে হবে। সব স্বাভাবিক হয়ে গেলে এরপর আমি অনেক সাবধান থাকব।’

মেঘা চেয়ে থাকে, তারপর আকুল গলায় বলে, ‘তার মানে তুমি আমাকে ছেড়ে যাচ্ছ না? সত্যিই আবার আগেরমতো ভালোবাসবে?’

অভীক বুকের ভেতর একটা মায়া টের পায়। ইচ্ছে করছে ওকে বুকের ভেতর টেনে নিতে। আর্দ্র গলায় বলে, ‘মেঘা, আমি তোমাকে সারাজীবন ভালোবেসে যাব। হয়তো আগের মতো হুটহাট করে দেখা হবে না, মেসেজও দিতে পারব না। কিন্তু জেনে রেখো, আমি তোমার পাশে আছি।’

মেঘা মাথা নাড়ে, ‘আমি অপেক্ষা করব অভীক। তুমি ভেব না, আমি আর নিজে থেকে মেসেজ দেব না।’

ওর ফর্সা মুখটা কেমন লালচে এখন। চোখ জলে ভেজা। ইচ্ছে করছে ওর মুখটা বুকে চেপে ধরতে। অভীক ঠিক বুঝতে পারে না এই মায়ার উৎস কোথায়? কুঞ্জল যখন মরে যেতে নিল তখন মনে হয়েছিল পৃথিবীর সবকিছুর বিনিময়ে হলেও ওকে চায়। আবার এখন মেঘাকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে। নাহ, এরপর আর কখনও কারও মায়ায় জড়াবে না। একবার জড়িয়ে গেলে বের হয়ে আসা কষ্টের।

অভীক বিদায় নেয়। মেঘা ঠোঁট কামড়ে কান্না সামলায়। তারপর ও নিজেও বেরিয়ে আসে। বাইরে সন্ধ্যা নেমেছে। মেঘা ক্লান্ত পায়ে বাড়ির পথ ধরে যেখানে একটা বিষাক্ত পরিবেশ ওর জন্য অপেক্ষা করছে। মেয়ের মুখ চেয়েই মাহমুদের সব অত্যাচার সহ্য করে যায় ও। মাহমুদ যদি ওকে অভীকের মতো করে একটু ভালোবাসত, মায়া করত, তাহলে ও বেঁচে যেত। অভীককে আঁকড়ে ধরে একটু বাঁচতে চেয়েছিল। অভীক বলেছে সব স্বাভাবিক হলে আবার ও যোগাযোগ করবে, ভালোবাসবে। কথাটা ওর ছেলেভুলানো কথা মনে হয়েছে, বিশ্বাস হয়নি। কুঞ্জলের জন্য আজ অভীক ওকে ছেড়ে যেতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করল না। ভীষণ হিংসা হয় কুঞ্জলের উপর। কী ভাগ্যবতী মেয়েটা, অভীক ওকে ভালোবাসে। ওর জন্য সব ছেড়ে দিতেও কুন্ঠাবোধ করল না অভীক। অথচ প্রায়ই বলত ওকে কখনও ছেড়ে যাবে না, ভালোবাসবে। কিন্তু ঠিক ছেড়ে গেল। আজ এই পৃথিবীতে শুধু ওকে আলাদা করে ভালোবাসার কেউ রইল না। তীব্র একটা মন খারাপ ঘিরে ধরে মেঘাকে।

২.
আজ অর্কের রেজাল্ট দেবে। সকালেই সবাই চলে এসেছে। বাইরে অভিভাবকেরা চিন্তিত মুখে অপেক্ষা করছে। পৃথুল কুঞ্জলের মুখের দিকে চেয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘কী রে, মুখটা অমন হাড়ির মতো অন্ধকার করে রেখেছিস কেন? অর্কের রেজাল্ট নিয়ে খুব ভাবছিস বুঝি?’

কুঞ্জল মাথা নাড়ে, ‘উহু। এমনিতেই ভালো লাগছে না। আচ্ছা, ওদের আর কতক্ষণ লাগবে, বল তো? এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে না।’

পৃথুল ওর হাত ধরে টান দেয়, ‘রেজাল্ট দিতে দেরি হবে। চল ওদিকে যেয়ে বসি। তোকে একটা জিনিস দেখাব।’

ওরা হেঁটে মাঠের কোণে শান বাঁধানো বড়ো একটা ছাতিম গাছের নিচে গিয়ে বসে। এই জায়গাটা ওদের খুব প্রিয়। এখানে পা ঝুলিয়ে বসলে সেই কলেজে পড়ার সময়টুকু যেন ফিরে আসে। নিশ্চিন্ত, উচ্ছ্বল একটা সময়। কিন্তু সেই সময়টা আসলে ফিরে আসে না।

কুঞ্জল পা ঝুলিয়ে বসে। একটা সুন্দ ঘ্রাণ পায়। নাক টেনে নিশ্বাস নেয়। ছাতিম ফুল ফুটল বুঝি। আচ্ছা, জীবন এত জটিল কেন? ও তো কাউকে কষ্ট দেয়নি কখনও। কেন ও কষ্ট পায়?

পৃথুল মোবাইল বের করে কিছু একটা খোলে। তারপর ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে একটা দুষ্ট হাসি হেসে বলে, ‘দেখ তো এটা কেমন হয়েছে?’

কুঞ্জল চেয়ে দেখতেই চোখ বড়ো হয়ে যায়। গোলাপি রঙের একটা ইনার স্লিপ যেটা থাই পর্যন্ত নেমেছে সেটা পরে মোহময় একটা পোজ দিয়েছে পৃথুল। ও চাপা চিৎকার করে ওঠে, ‘এ কী! এটা তুই কী পরেছিস!’

পৃথুল হেসে গড়িয়ে পড়ে, ‘এহ হে, তুই দেখি লজ্জা পেয়ে চোখমুখ লাল করে ফেলেছিস। ইমন খুঁজে খুঁজে এইসব কিনে নিয়ে আসে। আমার ওয়ারড্রোবের একটা ড্রয়ার পুরোটা জুড়ে এইসব।রাত হলেই পাগলামি বাড়ে। এগুলো পরতে বলে। আর কী কী পাগলামি যে করে।’

কুঞ্জলের কান গরম হয়ে যায়। সেইসাথে তীব্র একটা মন খারাপ ওকে ঘিরে ধরে। একটা হাহাকার টের পায় মনের ভেতর। ওর সাথে অভীকের সম্পর্কটা কবে যে উষ্ণতা হারিয়েছে ঠিকঠাক মনে পড়ে না। ওকে ঘিরে অভীকের পাগলামো নেই, কোনো উচ্ছ্বাস নেই, আবদার নেই।

হঠাৎ করেই মনটা আরও খারাপ হয়ে যায়। শুকনো মুখে বলে, ‘চল, ওদের রেজাল্ট মনে হয়ে গেছে।’

কথাটা বলে ও শান বাঁধানো জায়গাটা থেকে নেমে পড়ে। পৃথুল অবাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। কুঞ্জলের নিশ্চিত অন্য কোনো সমস্যা হয়েছে। কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে ও। ভেবেছিল ওর এই দুষ্ট ছবিটা দেখে হেসে ফেলবে, মজা করবে। কিন্তু কেমন চুপ হয়ে গেল। তাহলে কি অভীক ভাইয়ের সাথে ওর সম্পর্কটা ঠিকঠাক যাচ্ছে না?

অর্ক রেজাল্ট কার্ড হাতে দৌড়ে আসে, ‘আম্মু, আমি সেকেন্ড হয়েছি এবার। এই দ্যাখো।’

অর্কের মুখ ঝলমল করছে আনন্দে। ওর রোল বারো ছিল ক্লাশ ফোরে। কখনও প্রথম দিকে থাকতে পারেনি। এবার এত ভালো রেজাল্ট করল!

কুঞ্জলের সব মন খারাপের মেঘ বিদায় নেয়, আলোকিত হয়ে উঠে চারপাশ। ও রেজাল্ট কার্ড নিয়ে একবার চোখ বোলায়, ‘২য়’।

ছেলেকে এবার জড়িয়ে ধরে, ‘আমার সোনা বাবা। সত্যিই দেখি তুমি সেকেন্ড হয়েছ। উম্মমা।’

সশব্দে কপালে চুমু খায় ও। পেছন থেকে পৃথুল হেসে বলে, ‘এই তো মুখে হাসি ফুটেছে। এবার বুঝলাম, ছেলের জন্যই এতক্ষণ মন খারাপ করে ছিলি।’

কুঞ্জল হাসে, তারপর পৃথুলের পাশে ওর মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘পৃথা মামণি তো এবার ক্লাশ থ্রিতে উঠল।’

পৃথুল হাসে, ‘হ্যাঁ, অর্কের মতো অত ভালো করেনি। শোন, অর্কের নোটগুলি দিস।’

কুঞ্জল মাথা নাড়ে, ‘সে দেব খন। তুই বাসায় আসিস, আড্ডা দেব।’

ওরা বিদায় নেয়।

কুঞ্জলের খুব ইচ্ছে করছে ছেলেকে নিয়ে কোথাও ঘুরে আসে। সারাটা বছর ওরা দু’জন এত পরিশ্রম করেছে যার ফল আজ হাতেনাতে পেল। ছেলেটা একটু ঘুরে এলে মন ভালো লাগত। কিন্তু অভীকের সাথে এখন কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না।

রাতে অভীক ফিরতেই অর্ক ওর রেজাল্ট কার্ড নিয়ে দেখাতেই ও অবাক গলায় বলে, ‘তুমি সেকেন্ড হয়েছ? ওরে আমার লক্ষ্মী বাবাটা আমার। চল, মিষ্টি কিনে নিয়ে আসি।’

অর্ক মায়ের দিকে তাকায়। কুঞ্জল মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। অভীক অফিসের জামা কাপড় না ছেড়েই ছেলেকে নিয়ে বাইরে চলে যায়। কুঞ্জল একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, সংসারে এই ছোট ছোট সুখ, মায়ার বাঁধন ছেড়ে মানুষ কেন অন্য কারও কাছে আলাদা করে মায়া খোঁজে?

রাতে খাওয়া শেষে কুঞ্জল ছেলেকে নিয়ে আলাদা রুমে ঘুমোতে যায়। সেদিনের পর থেকে আলাদাই ঘুমুচ্ছে ও। অর্ক অবশ্য খুব খুশি। আম্মুকে জড়িয়ে ধরে কত কত গল্প চলে ওর।

এমন সময় দরজায় অভীকের ছায়া দেখা যায়। কুঞ্জল অবশ্য তাকায় না। অভীক গলা খাঁকারি দিয়ে বলে, ‘কাল আমি সিলেট যাচ্ছি, অফিসের কাজে। দু’দিন পর ফিরব।’

অর্ক মাথা তুলে বলে, ‘বাবা, আমাদের বেড়াতে নিয়ে যাবে না এবার?’

প্রতি বছর ওরা একবার হলেও কোথাও না কোথাও যায়। কিন্তু এবার যা পরিস্থিতি তাতে অভীকের ঠিক সাহস হয় না বেড়াবার কথা বলবার। ও নিচু গলায় বলে, ‘তোমার আম্মুকে বলো বাবা।’

অভীক আর দাঁড়ায় না। কুঞ্জল ছেলের সামনে কখন কী বলে ফেলে তার কোনো ঠিক নেই।

রাত বাড়ে। অর্ক একটা সময় ঘুমিয়ে পড়ে। কুঞ্জলের ঘুম আসে না। হঠাৎ করেই পৃথুলের কথা মনে পড়ে যায়। মনের অজান্তেই ফিক করে হেসে ফেলে। আচ্ছা, ও কি এখন অমন অদ্ভুত সব জামা পরে ওর বরের সাথে ঢং ঢাং করছে? ভাবতেই মন খারাপ ঘিরে ধরে। নিজেকে ভীষণ বঞ্চিত মনে হয়।

পরদিন সকালে অভীক যখন ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে যায় কুঞ্জল আড়চোখে খেয়াল করে জিন্সের প্যান্ট সাথে সাদা হাফ শার্টে ওকে খুব হ্যান্ডসাম লাগছে। আচ্ছা এই শার্টটা তো আগে দেখেনি ও। এটা কি তবে ওই শয়তান মেঘা মেয়েটা দিল? ভাবতেই মাথা গরম হয়ে যায়। এই মেয়েটা ওর সাথে সিলেট যাচ্ছে না তো?

কুঞ্জলের কেমন পাগল পাগল লাগছে। ফোন করবে ওই মেয়েটাকে? কিন্তু যদি না ধরে? অভীক নিশ্চিত এর মাঝেই ওকে সব জানিয়ে দিয়েছে। ওর নম্বরটাও হয়তো ব্লক করে রেখেছে। আর যদি নাও রাখে, ফোন ধরে যদি মিথ্যা বলে?

কুঞ্জল অস্থির পায়ে পায়চারি করতে করতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। তারপর কী মনে হতে পৃথুলকে ফোন দেয়।

ওপাশ থেকে পৃথুল অবাক গলায় বলে, ‘কী রে, এত সকালে ফোন দিয়েছিস। কোনো সমস্যা?’

কুঞ্জল গম্ভীরমুখে বলে, ‘পৃথুল, অর্ককে তোর বাসায় কিছুক্ষণ রাখতে পারবি? আমি একটু বাজারে যাব, ফিরতে দেরি হবে।’

পৃথুল মনে মনে অবাক হয়। এর আগে কখনও এমন হয়নি। কুঞ্জল তো ছেলেকে নিয়েই বাজার সদাই করে। ওর অস্বস্তিটা বুঝতে না দিয়ে বলে, ‘কোনো সমস্যা নেই। পৃথা খুশি হবে। তুই দিয়ে যা।’

কুঞ্জল দ্রুত অর্ককে নাস্তা করে রেডি করায়। তারপর ঘর তালা দিয়ে বেরোয়। অর্ককে বুঝিয়ে বলে, ‘বাবা, তোমার পৃথুল খালামণির বাসায় সুন্দর করে থেকো। আমি দুপুরের মধ্যেই চলে আসব। দুষ্টুমি কোরো না কিন্তু।’

অর্ক মাথা নাড়ে, মাকে আশ্বস্ত করে বলে, ‘আমি একটুও দুষ্টুমি করব না আম্মু।’

কুঞ্জল অর্ককে দিয়ে পথে নামে। তার আগে ওই মেয়েটার অফিসের ঠিকানাটা একবার দেখে নেয়, কাকরাইল। একটা সিএনজি ঠিক করে উঠে পড়ে।

কুঞ্জলকে নিয়ে এগিয়ে চলে সিএনজিটা। কেন যেন আজকাল নিজের উপর ওর নিয়ন্ত্রণ নেই। যে কাজগুলো করলে ও আরও ছোট হয়ে যাবে সেই কাজগুলোই করতে ইচ্ছে করে। ওই মেঘা মেয়েটার কাছে যেয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, কেন ওর সংসারে হাত বাড়িয়েছে মেয়েটা? আচ্ছা, যদি যেয়ে দেখে মেয়েটা আজ অফিস আসেনি, সত্যিই সিলেট গেছে, তাহলে? কুঞ্জলের চোখমুখ শক্ত হয়ে আসে, প্রয়োজনে আজ ও সিলেট যাবে, সত্যটা ওর জানতেই হবে। অভীককে ও আর বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করে না।

কুঞ্জল যখন মেঘার অফিসের সামনে এসে পৌঁছে ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটা দশটা পেরিয়ে গেছে। এদিকে অফিস পাড়ায় কর্মচঞ্চল মানুষের ভীড় বেড়েছে। কুঞ্জল একবার ঠিকানা মিলিয়ে দেখে। তারপর দৃঢ় পদক্ষেপে মেঘার অফিসের দিকে এগোয়।

(চলবে)

প্রেমহীন সংসার আহা সোনামুখী সুঁই পর্ব-০৩

0

#প্রেমহীন_সংসার_আহা_সোনামুখী_সুঁই (পর্ব ৩)

১.
কুঞ্জল পিঠের নিচে দুটো বালিশ দিয়ে আধাশোয়া হয়ে বসে আছে। আজ সকালে উঠতে দেরি হয়ে গেছে। সকালের নাস্তা বানানো হয়নি আজ। অভীক না খেয়েই অফিসে চলে গেছে। না রাগ করে নয়, বরঞ্চ ওর শরীর খারাপ ভেবে ওই জোর করে সকালে উঠতে দেয়নি। তাতে একটা মায়া ছিল, কিন্তু এই মায়াটা কি সত্যি? যে মানুষ অন্যের জন্য চুপিচুপি শাড়ি কেনে সে ওর এমন অল্প শরীর খারাপ গুরুত্ব দেয় কী করে? ও বিভ্রান্ত হয়ে যায়।

কাল মাথা ঘুরে পড়ে যাবার পর অভীক ঘাবড়ে গিয়েছিল। বার বার জিজ্ঞেস করছিল কী হয়েছে? কুঞ্জল ইচ্ছে করেই কিছু বলেনি কাল রাতে। কেমন করে কিছু না জিজ্ঞেস করে ও থাকতে পারল, তাই ভেবে অবাক হচ্ছে কুঞ্জল।

অর্ক ঘুম থেকে উঠে আজ লক্ষ্মী ছেলের মতো একটা খাতা নিয়ে বসেছে। কুঞ্জল চেয়ে দেখে ও মনোযোগ দিয়ে ছবি আঁকছে। ছোট্ট মানুষেরাও বড়োদের মন খারাপ টের পেয়ে যায়। মা বিরক্ত হতে পারে এমন কিছুই করছে না।

খাট থেকে নেমে ও ছেলের পাশে গিয়ে বসে। মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে বলে, ‘কী আঁকছ বাবা?’

অর্ক মাথা তুলে, তারপর ফিক করে হেসে দেয়ালে ঝোলানো একটা ছবির দিকে ইশারা করে বলে, ‘তোমার আর বাবার ছবি।’

কুঞ্জল ভ্রু কুঁচকে ছবিটার দিকে তাকাতেই ও অবাক হয়ে খেয়াল করে অর্ক ওর আর অভীকের বিয়ের দিনের একটা ছবি আঁকছে যেটা দেয়ালে টাঙানো। এবং ছবিটা হুবহু এঁকেছে। মুহুর্তেই ওর মন ভালো হয়ে যায়। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ইশ! কী সুন্দর এঁকেছে আমার অর্ক বাবা। এত সুন্দর আঁকা কই শিখলে তুমি?’

অর্ক মাথা নেড়ে বলে, ‘আমাদের আর্ট টিচার মানুষ আঁকা শিখিয়েছে।’

কুঞ্জল ছবিটার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। একটা সময় মন খারাপ হয়ে যায়। অভীক ওকে আর আগেরমতো ভালোবাসে না। অন্য কাউকে ভালোবাসে, অন্য কারও জন্য শাড়ি কেনে। কথাটা মনে হতেই ওর হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যায়। ঠোঁট চেপে কান্না সামলায়। হালকা করে চোখ মুছে বলে, ‘ক্ষুধা পায়নি বাবা?’

অর্ক মাথা দোলায়। কুঞ্জল ওকে একটু আদর করে বলে, ‘আমি এখুনি নাস্তা বানিয়ে দিচ্ছি।’

অর্ক চোখ বড়ো বড়ো করে বলে, ‘কিন্তু তুমি যদি আবার মাথা ঘুরে পড়ে যাও?’

কুঞ্জল এবার শক্ত গলায় বলে, ‘না বাবা, আর মাথা ঘুরে পড়ব না।’

মনের ভেতর দূর্বল হয়ে আসা অংশটুকু এবার শক্ত করতে হবে। অভীক যদি এবার উল্টোপাল্টা কিছু করে ও ছাড়বে না।

কুঞ্জল এবার দ্রুত নাস্তা বানিয়ে অর্ককে খাইয়ে নিজেও খায়। এখন একটু ভালো লাগছে। না খেয়ে শরীর দূর্বল হয়ে ছিল। এবার ও এক কাপ চা নিয়ে বসে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে ভাবে, আচ্ছা, অভীক কার জন্য শাড়ি কিনল এটা কী করে জানা যায়? এমন তো হতে পারে ওর অফিসের কোনো ফিমেল কলিগ কেউ ওর ফেসবুক থেকে অর্ডার করে দিতে বলেছে। ও হয়তো মিথ্যে সন্দেহ করছে। নাহ, ব্যাপারটা জানা দরকার। কিন্তু, কী করে?

হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই ওর মুখ উজ্জ্বল হয়ে যায়। দ্রুত মোবাইল খুলে ‘জাদুর বাক্স’ শাড়ির পেজে লগ-ইন করে। তারপর খুঁজে খুঁজে অভীকের মেসেজটায় যায়। কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে মেসেজটার দিকে। তারপর দ্রুত টাইপ করে, ‘স্যার, শাড়িটা নিশ্চয়ই হাতে পেয়েছেন। শাড়িটা কেমন ছিল, ম্যাডামের পছন্দ হলো কি-না জানাবেন।’

মাঝে মাঝে এমন ফিডব্যাক জানার জন্য ওরা কাস্টমারকে মেসেজ করে। অনেকে শাড়ি পরে ছবিও দেয়। সেগুলো মার্কেটিংয়ের অংশ হিসেবে পেজে আপলোড করা হয়।

কুঞ্জল অধীর আগ্রহে বসে থাকে। অভীক এখনও মেসেজটা সিন করেনি। আচ্ছা কী লিখতে পারে অভীক? যদি লিখে ম্যাডাম খুব পছন্দ করেছে, তখন ও কী করবে?

এলোমেলো ভাবনার এই পর্যায়ে ‘টুন’ করে শব্দ হতেই ও ঝট করে তাকায়। অভীক লিখেছে!
‘শাড়িটা ডিফেক্ট ছিল। আপনারা এটা চেঞ্জ করে দিন।’

কুঞ্জল নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। তার মানে শাড়িটা যাকে দিয়েছে সে কমপ্লেইন করেছে। নিজেকে সামলায়। একবার যদি জানা যেত কাকে শাড়ি দিল।

কুঞ্জল দ্রুত টাইপ করে, ‘স্যার, শাড়িটা আমরা সংগ্রহ করে আপনাকে নতুন ভালো দেখে একটা কপি পাঠিয়ে দেব। শাড়িটা কি আপনার অফিসের যে ঠিকানা সেখান থেকেই সংগ্রহ করব? আপনি চাইলে বাসা থেকেও সংগ্রহ করতে পারি।’

শেষ লাইনটা ইচ্ছে করেই বলে।

ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর উত্তর আসে। সেটা ঠিক উত্তর না, যেন একটা ধারালো ছুরি দিয়ে বুক ফালা ফালা করে দেবার মতো কতগুলো শব্দ।

‘ডিফেক্ট শাড়িটা ম্যাডামের অফিসের ঠিকানা থেকে সংগ্রহ করে ওখানেই আবার নতুন শাড়িটা ডেলিভারি করবেন। আর এই হলো ঠিকানা:
মেঘা, ম্যানেজার, আলফা ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড, কাকরাইল, মোবাইল নং: ০১৭১…’

পড়তে পড়তে কুঞ্জলের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। হাতে ধরে থাকা মোবাইল থরথর করে কাঁপতে থাকে। কোনোমতে লিখে, ‘ওকে স্যার।’

তারপর মোবাইল রেখে বিছানায় বসে। চোখ জলে ভিজে যাচ্ছে। প্রাণপণ চেষ্টা করে কান্নাটা থামাতে। এবার আর সফল হয় না। হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। একটা বালিশ বুকে চেপে ধরে। বুকটা যে ভীষণ করে পুড়ে যাচ্ছে, জ্বলে যাচ্ছে। অভীক আবার নতুন কোনো মেয়ের সাথে জড়িয়েছে!

অর্ক বসার ঘর থেকে ছুটে আসে, ভয় পাওয়া গলায় বলে, ‘আম্মুউউ, কী হয়েছে? তুমি কাঁদছ কেন? ব্যথা পেয়েছ?’

কুঞ্জলের বুক ছিড়ে যায়। বলতে ইচ্ছে করে, হ্যাঁ বাবা, ভীষণ ব্যথা পেয়েছি। এ জীবনে এমন করে আর কখনও ব্যথা পাইনি। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে রে বাবা।
ছেলেকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে কুঞ্জল। অর্কের কেন যেন খুব কান্না পাচ্ছে। আম্মু এমন করে কখনও কাঁদেনি। তবে কি আম্মু অনেক ব্যথা পেয়েছে? বাবাকে কি ফোন দেবে ও?

অনেকক্ষণ পর ও শান্ত হয়। তারপর অর্ককে বুঝিয়ে বলে, ‘তোমার বাবাকে কিছু বলো না। আমি একটু ব্যথা পেয়েছিলাম, তাই কান্না করেছি বাবা।’

অর্ক মাথা নেড়ে অদ্ভুত চোখে আম্মুর দিকে তাকিয়ে থাকে। আম্মুর বুঝি অনেক ব্যথা?

এদিকে অভীক অফিসে দুপুরের খাবার শেষ করে চায়ে চুমুক দিতে দিতে মেঘাকে ফোন দেয়, ‘লাঞ্চ করেছ?’

ওপাশ থেকে হ্যাঁ-সূচক উত্তর আসতেই অভীক বলে, ‘শোন, শাড়িটা তোমার অফিস থেকে কালেক্ট করবে ওরা। তারপর আবার নতুন ভালো দেখে একটা দিয়ে যাবে।’

মেঘা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘ভালো করেছ। ইশ, এত দামী আর সুন্দর শাড়িটায় অমন ডিফেক্ট ছিল, ভাবাই যায় না। ভেবেছিলাম এই শাড়িটা পরে তোমার সাথে দেখা করতে আসব।’

অভীক আদরের গলায় বলে, ‘ও রে আমার পাখিটা। লক্ষ্মী একটা মেয়ে তুমি। তুমি শাড়ি পরলে খুব ভালো লাগে।’

মেঘা হাসে, তারপর বলে, ‘ছাড়ছি। মিটিং আছে। পরে কথা হবে।’

অভীক ফোনটা রাখে। তারপর চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে ভাবে বাসায় একটা ফোন করা দরকার। কাল রাতে কুঞ্জল অমন মাথা ঘুরে পড়ে গেল কেন?

প্রথমবার ফোন দিতেই কেউ ধরে না। দ্বিতীয়বারে অর্ক ফোন ধরতেই অভীক জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘তোমার আম্মু কই?’

অর্ক কেমন মনমরা গলায় বলে, ‘আম্মু ঘুমিয়ে আছে।’

অভীক ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘এখন ঘুমুচ্ছে! তোমরা দুপুরের খাবার খাওনি?’

অর্ক মাথা নেড়ে বলে, ‘আমার ক্ষুধা পায়নি বাবা। পরে খাব।’

অভীক এবার আরও অবাক হয়। এখনও ওরা দুপুরের খাবার খায়নি? নাহ, কুঞ্জলের শরীর কি বেশি খারাপ?

অভীক চিন্তিত গলায় বলে, ‘তোমার আম্মু ঘুম থেকে উঠলে আমাকে একটা ফোন দিতে বলো বাবা। এখন রাখছি।’

ফোন রেখে ও কিছুক্ষণ চুপ মেরে বসে থাকে। কাল শাড়ি নিয়ে যাবার পর থেকেই উলটো ঘটনা ঘটছে। কই শাড়ি দেখে খুশি হবে, তা না, মাথা ঘুরে পড়ে গেল? আর আজ তো একবার ফোনও দিল না কুঞ্জল। কাল হঠাৎ মেঘার শাড়িটা যখন এলো তখন হুট করেই একটা অনুশোচনা ঘিরে ধরেছিল। কুঞ্জল মাঝে মাঝে সাদা জামদানি শাড়ির কথা বলত। কেনা হয়নি। কাল মেঘার সাথে দেখা করে যখন শাড়িটা দিল তখনই মনে হয়েছিল। মেঘা খুব খুশি হয়েছিল শাড়িটা পেয়ে। মেয়েটা এত রুচিশীল, আর পরিপাটি যে প্রথম দেখাতেই ও প্রেমে পড়ে যায়। ওদের অফিসের সব ইন্স্যুরেন্সের কাজ মেঘাদের অফিসের সাথে। মাস তিনেক আগে পরিচয়। তারপর একটু একটু করে কখন যে জড়িয়ে গেল ও বুঝতেই পারেনি। পূর্ণের সাথে যোগাযোগটা বন্ধ হয়ে যাবার পর ভীষণ একা লাগত। কোনো কিছুতেই উৎসাহ পেত না, শুন্য শুন্য লাগত সব। সেই সময়টায় কুঞ্জল কেমন দূরে দূরে থাকত।

মেঘা যেন ওর জীবনে সেই শূন্যতাটুকু পূরণ করতেই এসেছে। এখন আর মন খারাপ থাকে না। একটা ভীষণ ভালো লাগা জড়িয়ে থাকে সবসময়। মেঘাকে ভাবলেই বুকের ভেতর একটা আঁকুপাঁকু টের পায়। ইশ, মেঘাকে যদি একদিন নিজের করে পেত!

২.
অভীক আজ সন্ধ্যা নামতেই বাড়ি ফিরে আসে। কুঞ্জল আর ফোন দেয়নি। যতবারই ফোন দিয়েছে, অর্ক ধরেছে। আর সেই একই কথা, আম্মু ঘুমোচ্ছে। নাহ, কোথাও একটা বড়োসড়ো ঝামেলা হয়েছে। মেজাজ খারাপ নিয়ে ও বাসায় ঢোকে। বেডরুম অন্ধকার। অর্ক লিভিংয়ে বসে বসে টিভি দেখছিল। বাবাকে দেখে কাছে আসে, কিন্তু আজ কোনো উচ্ছ্বাস নেই। ও ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘তোমার আম্মু কই, বাবা?’

অর্ক হাত তুলে ইশারা করে বেডরুম দেখায়। অভীক চিন্তিত মুখে বেডরুমে যেয়ে লাইট জ্বালাতেই দেখে কুঞ্জল কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। তাহলে কি ওর শরীর খারাপ?

কাছে যেয়ে ওর গায়ে হাত দিয়ে নরম গলায় বলে, ‘এই কুঞ্জল, কী হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে?’

কুঞ্জল ভেজা চোখ মোছে। বুকের ভেতর একটা ঝড় টের পায়। নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে বসে। তারপর ওর দিকে তাকাতেই অভীক চমকে ওঠে। এ কী হাল হয়েছে ওর! চোখ ফুলে আছে, মনে হয় অনেকক্ষণ কেঁদেছে।

অভীক ভয়ে ভয়ে বলে, ‘কী হয়েছে তোমার, কাঁদছ কেন?’

কুঞ্জল স্থির চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, ‘আচ্ছা, তুমি তিনদিন আগে ‘জাদুর বাক্স’ নামে অনলাইন শাড়ির পেজ থেকে একটা শাড়ি কিনেছিলে?’

অভীক চমকায়। বুকের ভেতর কেমন ফাঁকা হয়ে যেতে থাকে। তোতলানো গলায় বলে, ‘না তো। কেন?’

কুঞ্জল পাগলাটে দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে, তারপর নিচু কিন্তু তীক্ষ্ম গলায় বলে, ‘তোমার নামে, তোমার অফিসের এড্রেসে সাড়ে আট হাজার টাকা দামের একটা আজ্রাখ সিল্ক শাড়ি অর্ডার হয়েছে। শাড়িটা তুমি কার জন্য কিনেছ অভীক?’

অভীক ঢোঁক গিলে। কুঞ্জল জানল কী করে শাড়ির কথা! নাহ, কেউ কি বলে দিল? মাথা গরম করা যাবে না। ঠান্ডা মাথায় সামলাতে হবে।

এবার ও যথাসাধ্য মুখচোখ স্বাভাবিক করে বলে, ‘ওহ, মনে পড়েছে। আমার অফিসের রায়হানা আপা অর্ডার করেছিল আমার ফেসবুক আইডি থেকে। টাকাটা উনিই দিয়েছেন। এখন মনে পড়ল। ওনার ইন্টারনেট কাজ করছিল না, তখন উনি আমার ফেসবুক থেকে শাড়িটা অর্ডার করেছে। কিন্তু তোমাকে এগুলো কে বলল?’

কুঞ্জল চেয়ে থাকে। অবাক হয়ে ভাবে, মানুষ কত অবলীলায় মিথ্যে বলতে পারে।

কুঞ্জল এবার কেটে কেটে বলে, ‘অভীক, তোমার ভুল হচ্ছে কোথাও। শাড়িটা তুমি মেঘা নামের একটা মেয়ের জন্য কিনেছ যে একটা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি করে। তোমার শাড়ির অর্ডারটা আমিই রেখেছিলাম। তুমি তো আমার কোনো খোঁজ খবর রাখো না। জাদুর বাক্স শাড়ির পেজটাতে আমি কয়েকমাস ধরেই কাজ করি। এখন সত্যটা বলো আমাকে। মেঘা তোমার নতুন প্রেমিকা?’

অভীকের মুখ রক্তশূণ্য হয়ে যায়। মেঘা জাদুর বাক্স পেজে কাজ করে??? হায় হায়, সর্বনাশ হয়ে গেছে। এখন কী করে এটা ধামাচাপা দেবে ও?

অভীক ঝট করে কুঞ্জলের হাত চেপে ধরে, তারপর আকুল গলায় বলে, ‘বিশ্বাস করো, মেঘা আমার কেউ না। ওই কাজ করতে যেয়ে পরিচয় হয়েছে। আমাদের অফিস থেকেই ওকে একটা শাড়ি কিনে দিতে বলেছিল তাই দিয়েছি। আমাদের একটা বড়ো ইন্স্যুরেন্স ক্লেইম ছিল সেটা ওই মেঘা পাইয়ে দিয়েছিল। ওর সাথে সত্যিই আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি তোমাকেই ভালোবাসি।’

কুঞ্জলের সারা গায়ে কেউ যেন বিছুটি পাতা ছেড়ে দেয়। ও পাগলের মতো চিৎকার করে ওঠে, ‘মিথ্যুক, শয়তান একটা। তুই আমাকে ভালোবাসিস না। তুই ওই মেঘার সাথে নষ্টামি করিস, ওকে শাড়ি কিনি দিস। আর কত এইসব করবি??? একবার পূর্ণের সাথে, আরেকবার মেঘার সাথে? তুই আমাকে কেন বিয়ে করেছিস তাহলে? আজকেই আমাকে তুই ডিভোর্স দিবি।’

অর্ক টিভি বন্ধ করে ভয়ে ভয়ে আম্মুর রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর ক্ষীণ গলায় বলে, ‘আম্মু!’

অভীক দুই হাতে কুঞ্জলকে জড়িয়ে ধরে নিচু গলায় বলে, ‘প্লিজ, আমাকে যা ইচ্ছা বলো, কিন্তু অর্কের সামনে বোলো না। ছেলেটা ভয় পাচ্ছে।’

কুঞ্জল এক ঝটকায় ওকে সরিয়ে দেয়, তারপর হিসহিসিয়ে বলে, ‘ওর জানা উচিত, ওর বাবা একটা মিথ্যুক, লুচ্চা।’

কুঞ্জল যেন উন্মাদিনী এখন। চুলগুলো এলোমেলো, হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগীদের মতো সারা শরীর কাঁপছে। অর্ক এবার ভয়ে কেঁদেই ফেলে।

অভীক দৌড়ে গিয়ে অর্ককে জড়িয়ে ধরে, ‘বাবা, কিছু হয়নি। তোমার আম্মু ভালো হয়ে যাবে।’

ঠিক এমন সময় সশব্দে বেডরুমের দরজা লাগানোর শব্দ হতেই অভীক ঝট করে ঘুরে তাকায়। ছিটকিনি লাগানোর শব্দ হচ্ছে। অভীকের বুক চলকে ওঠে। কুঞ্জল দরজা বন্ধ করছে কেন?

এক লাফে ও দরজার কাছে চলে এসে জোর একটা ধাক্কা দেয়। ভেতর থেকে বন্ধ! হায় হায়। অভীকের বুকের ভেতর যেন হাতুড়ি পেটার শব্দ হতে থাকে। ও পাগলের মতো ধড়াম ধড়াম শব্দে দরজা ধাক্কাতে থাকে। আর আকুল গলায় ডাকতে থাকে, ‘কুঞ্জল, প্লিজ দরজা খোল। আমাকে মাফ করে দাও। আমি আর এমন করব না। কুঞ্জল, প্লিইইজ।’

আর এদিকে ছোট্ট অর্ক বিস্ফারিত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর ভয়ার্ত গলায় চিৎকার করতে থাকে, ‘আম্মুউউউ। দরজা খোল, আম্মু। আমার ভীষণ ভয় করছে।’

(চলবে)

প্রেমহীন সংসার আহা সোনামুখী সুঁই পর্ব-০২

0

#প্রেমহীন_সংসার_আহা_সোনামুখী_সুঁই (পর্ব ২)

১.
গুলশান পুলিশ প্লাজার দোতলায় একটা ভালো স্পোর্টসের দোকান আছে। অফিস শেষে ফেরার পথে অভীক নামে। সাধারণত বাসায় ফেরার সময় ও কোথাও নামে না। আজ অবশ্য অন্য একটা কারণ আছে। অর্কের পরীক্ষা শেষ, একটা কিছু নিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে ছেলেটার জন্য। ফুটবল খেলতে খুব পছন্দ করে অর্ক। বাসার পাশেই খেলার একটা মাঠ আছে। ছুটির দিনগুলোতে ছেলেটাকে এবার সময় দেওয়া যাবে।

অভীক দোকানের তাকে সাজানো ফুটবলগুলো দেখতে থাকে। এখন কত ধরনের কোম্পানির ফুটবল এসেছে। অথচ ওদের সময় একটাই বল ছিল, সাদা কালো, ডিয়ার। অভীক দোকানির দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, ‘ডিয়ার সাদা কালো বলটা আছে?’

দোকানি হেসে তাকায়, ‘সাদা কালো নাই, তবে নীল সাদা বলটা আছে।’

দোকানি তাক থেকে একটা নীল সাদা ছক কাটা চুপসানো বল বের করে ওর হাতে দিয়ে বলে, ‘অরিজিনাল ৫ নম্বর সাইজের বল। ইচ্ছা করলে মাপ দিয়া নিতে পারেন, পুরা সত্তুর সেন্টিমিটার।’

বলটা নতুন, চকচকে। দেখেই খেলতে ইচ্ছে করছে। স্কুলে পড়ার সময় ওরা চাঁদা তুলে তুলে একটা বল কিনত। কী উত্তেজনা ছিল! দেখা যেত পুরো টাকাটা যোগাড় হয়নি, সবার মন খারাপ। সেসময় একটা বল মানে অনেকগুলো ছোট ছোট বাচ্চার স্বপ্ন। আর এখন!

অভীক দোকানিকে অনুরোধের গলায় বলে, ‘এটা পাম্প করে নেওয়া যাবে?’

লোকটা মাথা নেড়ে বলটা দোকানের ছোট একটা ছেলের হাতে দিয়ে বলে, ‘এইটা পাম্প কর তো। দেখিস বেশি হার্ড করিস না।’

দোকানি ওকে বসতে বলে। অভীক ছোট্ট একটা টুলে বসে তাকিয়ে দেখে। ছেলেটা একটু একটু করে হাওয়া দিচ্ছে আর চুপসে থাকা বলটা কেমন সুন্দর গোল একটা আকৃতি পাচ্ছে। একটু আগেও বলটাকে কেমন মন মরা জুবুথুবু মনে হচ্ছিল। অথচ এখন কেমন তরতাজা। হঠাৎ করেই ওর মনে হয় ওর আর কুঞ্জলের জীবনটাও ওই চুপসে থাকা ফুটবলের মতো জুবুথুবু। কোনো প্রাণ নেই সম্পর্কটায়। হ্যাঁ, ভুলটা ওর ছিল। কিন্তু সেটা নিয়ে কুঞ্জল এত বাড়াবাড়ি করল যে মনটাই বিষিয়ে গেল।

পূর্ণের সাথে বহুদিন পর একটা শপিংমলে দেখা হয়েছিল। ওর প্রথম প্রেম ছিল পূর্ণ, যেমন থাকে আর সবার, আবেগে ভরা একটা সময়। তাই বহুদিন বাদে পূর্ণকে দেখে পুরানো সেই উজ্জ্বল দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। পূর্ণও ভীষণ উচ্ছ্বাস নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। পুরানো মান অভিমান, অভিযোগ পাশে সরিয়ে ওরা একসাথে বসেছিল এক কাপ কফি নিয়ে। পূর্ণের দুই ছেলে, বর ইঞ্জিনিয়ার। বেশ সুখে যে আছে সে কথাই বার বার বলছিল। ওর বউ কি করে সেটা জানতে চাইতেই যখন কুঞ্জলের কথা বলেছিল তখন ও আগ্রহ নিয়ে বউয়ের ছবি দেখতে চাইল। দেখে প্রশংসার গলায় বলল, ‘বাহ, তোর বউ তো দেখতে ভারী মিষ্টি।’

সেদিনই ওর ফেসবুকে রিকুয়েষ্ট পাঠিয়ে আবার নতুন করে বন্ধু হয়। মোবাইল নম্বর দেয় পূর্ণ। পুরনো বন্ধুর মতো যোগাযোগ থাকবে সে কথা জানায়। কিন্তু যোগাযোগটা একটা সময় বন্ধুর পর্যায়ে থাকেনি। অভীক ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছিল পূর্ণ অসুখী। প্রাচুর্য আছে কিন্তু সুখ নেই ওর সংসারে। একদিন ভীষণ অসুস্থ শরীর নিয়ে ফোন দিয়েছিল একজন ডাক্তার দেখাবে বলে। পুরনো প্রেম কিংবা পুরনো বন্ধুর টানেই ও গিয়েছিল। আর সেদিন মনে মনে অবাক হয়েছিল ওর হাসব্যান্ড আসেনি বলে। পরে জেনেছিল ওর ইঞ্জিনিয়ার জামাই ভীষণই ব্যস্ত থাকেন অফিস নিয়ে। তাই আসতে পারেননি। সেদিন অভীক পূর্ণকে নিয়ে অনেক ছুটোছুটি করেছিল। এরপর ও সুস্থ হলে একটা বেলা ওরা বসেছিল, অনেক অনেক কথা বলার পর ওরা দু’জন আবিস্কার করেছিল এখনও ওরা দু’জন দু’জনকে ভুলতে পারেনি। আর বিয়ের এতটা বছর পর ওরা যে মনের দিক থেকে অনেকটাই একা সেটাও বেরিয়ে এসেছে। না, নতুন করে ভালোবাসাবাসির কথা হয়নি, কিন্তু একটু পাশে থাকা, মনের কথাগুলো শেয়ার করার জন্যই ওরা কাছে এসেছিল। প্রায় প্রতিদিনই কথা হতো। তাতে করে ঘনিষ্ঠ কথাও থাকত, শরীরের আকুলতার কথাও থাকত। সম্পর্কের এই পর্যায়ে কুঞ্জল একদিন ওর একটা মেসেজ দেখে ফেলে। অভীক বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করেছিল এটা নেহায়েত ফেসবুক মেসেঞ্জারে কথাবার্তা, বাস্তবে কিছু নেই। কিন্তু কুঞ্জল কেমন পাগলের মতো হয়ে গেল। ও সাথে সাথে ওর মোবাইলের মেসেঞ্জার থেকে ফোন করে যা তা বলল পূর্ণকে। তারপর রাগের চোটে মোবাইলটা মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ভেঙে ফেলেছিল। সেবার এক মাস কোনো কথাই বলেনি কুঞ্জল।

এর মাঝে পূর্ণ নিজেই একবার ওর সাথে দেখা করে বলেছিল, ‘অভীক, আমরা এখন এমন একটা বয়সে আছি যখন সুখের চেয়ে স্বস্তি দরকার, ভালোবাসার চেয়ে ঝামেলাবিহীন ভালো থাকা জরুরি। তুই আর আমাকে ফোন দিস না, আমিও দেব না। তবে কোনোদিন খুব বিপদে পড়ে গেলে হয়তো ডাকব, তখন আসবি তো?’

অভীকের বুকের ভেতর ভেঙেচুরে যাচ্ছিল সেদিন। ও কথা দিয়েছিল আর ফোন দেবে না, দেয়ও নি। তারপর ধীরে ধীরে আবেগটাও কমে এসেছে। ওদিকে কুঞ্জলের রাগ, অভিমানের পারদ নেমে স্বাভাবিক হয়েছিল সম্পর্কটা। স্বাভাবিক মানে পূর্ণের কথা মতো ঝামেলাবিহীন স্বস্তির জীবন ফিরেছিল সংসারে। কিন্তু মায়াটা ছিল না, ভালোবাসা ছিল না।

অভীক ছোট্ট করে একটা নিশ্বাস ফেলে। সেই সাথে বল থেকে পিন বের করার সময় বাতাসের একটা হিসহিস শব্দ বেরিয়ে আসে। ও তাকিয়ে দেখে বলটা এখন বেশ গোলগাল সুখী, সুন্দর। ছেলেটা ওর হাতে দিতেই বলটা ও মাটিতে ক’বার ঠুকে ঠুকে দেখে। মাটিতে পড়া মাত্রই বলটা একদম বুক বরাবর উঠে আসছে। জীবনটাও বুঝি এমন? ঠিকঠাক মায়ার হাওয়া ভরা না থাকলে সেটা আর বুকের কাছে উঠে আসে না, পায়ের কাছেই পড়ে থাকে।

দোকানি বলটা একটা সুতোর জালে জড়িয়ে দিতে দিতে বলে, ‘মাঝে মাঝে হাওয়া ভরে নেবেন। নেতানো অবস্থায় রেখে দেবেন না। বোঝেন তো, হাওয়া ছাড়া ফুটবল অচল। যার যা খাবার, তাই দিতে হয়।’

অভীক মাথা নাড়ে। সেটা ওর চেয়ে আর কে ভালো বোঝে। যার যেটা লাগে তাকে সেটা না দিলে যে সে বেঁচে থাকে না। যেমন ওর সংসারে মায়া নেই, তাই ওটা নেতিয়ে আছে। ঠিকঠাক মায়া পেলে আবার বেঁচে উঠত।

অভীক বলের দাম মিটিয়ে বেরিয়ে পড়ে। নাহ, আজ দেরি হয়ে গেল।

গলির কাছাকাছি আসতেই হাজী বিরিয়ানির দোকানটা চোখে পড়ে। এটা আসল হাজীর বিরিয়ানি না, কিন্তু এটাও খুব স্বাদের। অর্ক বিরিয়ানি খেতে খুব পছন্দ করে, কুঞ্জলও। কথাটা মনে হতেই ও তিন প্যাকেট বিরিয়ানি কেনে। তার আগে কুঞ্জলকে একটা মেসেজে জানিয়ে দেয় আজ রাতে যেন না রান্না করে, হাজীর বিরিয়ানি নিয়ে আসবে।

২.
কুঞ্জল ফ্রিজ থেকে তিন পিস রুই মাছ বের করে। আজ রাতে আর ঝামেলা করবে না। বেশি করে পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে ভেজে দিলে গরম গরম খেতে খুব ভালো লাগবে। অভীক খুব পছন্দ করে এটা। সাথে একটু নতুন ছোট ছোট আলুর ভর্তা করবে শুকনো মরিচ আর পেয়াঁজ পাতা একটু টেলে নিয়ে।

কুঞ্জল মাছের পিসগুলোতে একটু লবন আর হলুদ মাখিয়ে রাখতেই পৃথুলের ফোন আসে, ‘আপু, লেবু ডালটা যেন কেমন করে করে? লেবুর পিসগুলো আগেই দেব?’

পৃথুল মাঝে মাঝেই এমন ফোন দেবে। বেচারা এখনো রান্নাটা আয়ত্বে নিয়ে আসতে পারল না। ও বুঝিয়ে বলে, ‘একদম শেষে দিবি, না হলে তো তিতে হয়ে যাবে। আর নামানোর আগে বাসায় লেবু পাতা থাকলে দুই তিনটা দিস।’

ওপাশ থেকে পৃথুল কৃত্রিম ক্ষোভের গলায় বলে, ‘এই, তুই একটা রান্নার চ্যানেল দিস না কেন বল তো? আমাদের মতো আনাড়ির কত হেল্প হয়। তোর এইসব টোটকা রান্নায় খুব কাজে লাগে। আচ্ছা ছাড়ছি এখন, কাল দেখা হবে।’

ফোনটা রাখতেই কুঞ্জলের হঠাৎ করেই মনে হয় আসলেই তো, একটা রান্নার চ্যানেল ও দিতেই পারে। অনলাইনে প্রতিটি রান্নার চ্যানেল এত জনপ্রিয়। ও মাঝে মাঝেই দেখে। নিজেও একটু আধটু এক্সপেরিমেন্ট করে দেখে। রান্নার একটা চ্যানেল দিলে মন্দ হয় না। ওর তো রান্না করতেই হয়। শুধু মোবাইলের ভিডিও অপশনটা চালু করে রাখলেই হয়। ভাবতেই একটা উত্তেজনা টের পায় কুঞ্জল। এর আগে একবার অনলাইনে শাড়ির পেজ খুলতে চেয়েছিল। কিন্তু ও কাছ থেকে দেখেছে। অনেক ঝক্কির কাজ। শাড়ি কিনে আনা, লাইভ শো করা, তারপর এগুলোর ডেলিভারির ব্যবস্থা করা। কাস্টমাররা অনেক সময় শাড়ি ফেরত দেয়। এসবের পাশেও সবচেয়ে বড়ো সমস্যা এখন এত এত শাড়ির পেজ যে বিক্রি করাই মুশকিল। আর এতে অনেক টাকাও ইনভেস্ট করতে হয়। ওর অত টাকা কোথায়?

মোবাইলটা রেখে রান্নাঘরের দিকে এগোতেই অভীকের মেসেজ আসে। ভ্রু কুঁচকে মেসেজটা পড়তেই ওর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। আর কিছুক্ষণ আগে জানালে কী হতো যে আজ বিরিয়ানি নিয়ে আসবে? ও তো মাছ মসলা দিয়ে মাখিয়ে ফেলেছে। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে, অভীক ইদানীং ফোনটাও ঠিকঠাক করে না। মাছ ভাজতে ভাজতে ও ভাবে শাড়িটা কি ওর জন্যই অর্ডার করেছে?

অভীক বাসায় আসতেই অর্ক এক দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। তারপর উৎসাহের সাথে বলে, ‘বাবা, আমার আজ পরীক্ষা শেষ। এখন শুধু খেলব।’

কথাটা বলতে বলতে ও থমকে বাবার হাতের দিকে তাকাতেই চিৎকার করে ওঠে, ‘ফুটবল!!’

অভীক হাসে, তারপর হাতে থাকা ফুটবলটা সুতোর জাল থেকে বের করে মেঝেতে ঠুক দেয়, বলটা শুন্যে লাফিয়ে উঠতেই অর্ক একটু সামনে ঝুঁকে দু’হাত দিয়ে লুফে নেয়। তারপর বুকের সাথে চেপে ধরে ঘ্রাণ নেয়।

অভীক ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘কি, পছন্দ হয়েছে বাবা?’

অর্ক জোরে মাথা নাড়ে। তারপর এক দৌড়ে রান্নাঘরের দিকে ছুটে যায়। কুঞ্জল রান্নাঘর থেকেই বাপ ছেলের কথা শুনছিল। অর্ক দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই ও হেসে তাকায়।

অর্ক চোখ বড়ো বড়ো করে বলে, ‘আম্মু, দেখো বাবা আমার জন্য ফুটবল নিয়ে এসেছে।’

এমন সময় অভীক হাতের বিরিয়ানি প্যাকেটগুলো ডাইনিং টেবিলের উপরে রাখতে রাখতে বলে, ‘এগুলো তাড়াতাড়ি বেড়ে ফেলো, খেয়ে ফেলি। না হলে ঠান্ডা হয়ে যাবে।’

কথা শেষ করে তাকাতেই দেখে কুঞ্জল গম্ভীরমুখে মাছ ভাজছে, ওর দিকে তাকাচ্ছে না। কী হলো আবার? আজ দুপুরে দু’বার ফোন বিজি পেয়েছিল। তাই বুঝি রাগ করে আছে? পূর্ণের সেই ঘটনার পর থেকে ওর ফোন বিজি পেলেই সন্দেহ করত। কিন্তু সেসব পাট তো অনেক আগেই চুকেছে। তাহলে আজ নতুন করে কী হলো? নাহ, ঘরে ফিরে শান্তি নেই। সবসময় মুখ কালো।

ও আর কথা বাড়ায় না। শার্ট-প্যান্ট ছেড়ে গোসলে ঢোকে।

গোসল সেরে যখন বেরোয় ততক্ষণে কুঞ্জল খাবার বেড়ে ফেলেছে। খেতে বসতে গিয়ে ও থমকে তাকায়, তারপর বলে, ‘কী ব্যাপার, তুমি বিরিয়ানি খাবে না?’

কুঞ্জল শুকনো গলায় বলে, ‘মাছ ভেজেছিলাম। ভাতও রান্না হয়ে গিয়েছে। তুমি বিরিয়ানি নিয়ে আসবে সেটা আগে জানালেই হতো। তোমরা খাও, আমি খাব না। আমি একটু মাছ দিয়ে ভাত খাই।’

অভীক মাথার ভেতর সূক্ষ্ম একটা যন্ত্রণা অনুভব করে। কই ভেবেছিল সবাই আরাম করে বিরিয়ানি খাবে, তা না উলটো ঝামেলা হলো। কুঞ্জল রাগ দেখিয়েই খেল না। কেন যে এত অল্পতেই রেগে যায়, কে জানে।

চুপচাপ খাওয়া শেষ করে ও উঠে পড়ে।

কুঞ্জল সব গুছিয়ে যখন ঘুমোতে আসে ততক্ষণে রাত বারোটা প্রায়। অভীক বিছানায় শুয়ে শুয়েই টিভি দেখছে। কুঞ্জল আড়চোখে একবার তাকায়। মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই ওর মনে কী চলছে। এই যে আজ অনলাইনে শাড়ির অর্ডার দিল সেটা কার জন্য? ওর জন্য নিশ্চয়ই না? নাকি ওকে চমকে দিতেই এটা করেছে? খুব ইচ্ছে করছে শাড়ির কথা জিজ্ঞেস করতে। করবে? নাহ, থাক। আগে শাড়ি ডেলিভারি হোক, সে পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। যদি এরপরও ওকে কিছু না বলে তাহলে বুঝতে হবে অভীক আবার ওই বজ্জাত মেয়েটার সাথে প্রেম করছে। আর এবার যদি এমন কিছু হয় তাহলে ওকে ছেড়ে চলেই যাবে। কথাটা ভাবতেই ও থমকে যায়। কোথায় যাবে ও? কার কাছে? বাবা মায়ের কাছেই ফিরে যেতে হবে। কিন্তু ওরাও যে ওর মতোই ভাই ভাবির সংসারে আশ্রিতের মতোই থাকে। কুঞ্জল আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও চলে যাবার মতো একটা জায়গা খুঁজে পায় না। ভীষণ হতাশ লাগে।

লাইট অফ করে ও শুয়ে পড়ে। অভীকও চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ে, একা, কোলবালিশ জড়িয়ে। একটাবার ওকে ধরে ঘুমায় না। এমনই চলছে অনেকদিন। কুঞ্জলের ভীষণ কষ্ট হতে থাকে। একটু ভালোবাসা পাবার জন্য মন ছটফট করে।

এরপর দুটো দিন দারুণ উৎকন্ঠায় কাটে ওর। বার বার শাড়িটার ডেলিভারি স্ট্যাটাস চেক করে দেখে। তৃতীয় দিন দুপুর বারোটার দিকে শাড়িটা ডেলিভারি হবার খবর পায়। কুঞ্জল সেদিন পুরোটা বেলা উদাস হয়ে বারান্দায় বসে থাকে। খুব বেশি উৎকন্ঠা হতে হতে একটা সময় মানুষ যখন সব আশা ছেড়ে দেয় ঠিক তেমন করে ও বসে থাকে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। মনের ভেতর চাপ বাড়ছে। আচ্ছা, আজ যদি অভীক শাড়িটা না নিয়ে আসে, ও তাহলে কী করবে? জিজ্ঞেস করলে সত্যিই যদি বলে ওই মেয়ের জন্য কিনেছে? তখন ও কী করবে?

রাত আটটার দিকে বাসার কলিং বেল বেজে উঠে। কুঞ্জলের বুক চলকে ওঠে। অর্ক এক দৌড়ে দরজা খোলে, চিৎকার করে বলে, ‘বাবা, এসেছে।’

অভীকের মনটা আজ খুব ভালো। কুঞ্জল আজ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে। ওর পছন্দের একটা শাড়ি নিয়ে এসেছে আজ। ইচ্ছে করেই ওকে বলেনি শাড়ির কথাটা।

কুঞ্জল উন্মুখ হয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে। অভীক ঢুকছে, এক হাতে অফিসের ব্যাগ। আরেক হাতে ওটা কী? বুকের ভেতর ড্রাম পেটানোর শব্দ পাচ্ছে। একটা মোড়ানো প্যাকেট। তবে কি ওর অনুমান মিথ্যা করে অভীক শেষ পর্যন্ত শাড়িটা নিয়ে এল?

অভীক বাসায় ঢুকেই বেশ চনমনে গলায় বলে, ‘দেখো তো শাড়িটা পছন্দ হয় কি না?’

কুঞ্জলের পা কেমন অবশ হয়ে আসছে। ও পায়ে পায়ে কাছে আসতেই দেখে বিছানার উপর একটা শাড়ির ব্যাগ। চেয়ে থাকে কাগজের ব্যাগটার দিকে। চেয়েই থাকে। এটা ওদের শাড়ির পেজের ব্যাগ না।

অভীক উৎসাহের সাথে ব্যাগের ভেতর থেকে একটা সাদার উপর সাদা কাজ করা জামদানী শাড়ি বের করে ওর চোখের সামনে মেলে ধরে। তারপর উৎসাহের সাথে বলে, ‘সাদা জামদানি না কিনতে চেয়েছিলে? নিয়ে এলাম। পছন্দ হয়েছে?’

কুঞ্জল মেলে ধরা সাদা জামদানীর দিকে বিহবল চোখে চেয়ে থাকে। ধীরে ধীরে সাদা জামদানীটা ঝাপসা হয়ে কেমন ধূসর একটা সাদা কুয়াশার চাদর হয়ে ওকে ঘিরে ধরে। মাথার ভেতরটা শুন্য হয়ে যায়। চোখে কেমন অন্ধকার দেখছে এখন। মাথা ঘুরে খাটে পড়ে যাবার আগে ওর একটা কথাই মনে হয় অভীক ওর জন্য ওদের পেজ থেকে অর্ডার করা মোডাল সিল্ক আজ্রাখ শাড়িটা নিয়ে আসেনি। তাহলে ওটা কার জন্য কিনেছে?

(চলবে)

প্রেমহীন সংসার আহা সোনামুখী সুঁই পর্ব-০১

0

#প্রেমহীন_সংসার_আহা_সোনামুখী_সুঁই (পর্ব ১)

১.
কুঞ্জল কড়াইয়ের গরম তেলে সবে জিরের ফোড়ন ছেড়েছে আর ঠিক তখুনি বাইরের রাস্তা থেকে একটা হাঁক ভেসে আসে, ‘অ্যাই, পুরানা ভাঙাচোরা কিছু আছে এ এ..’

কুঞ্জল থমকে যায়। কড়াইয়ে এখন পেয়াঁজ কুচি ছাড়তে হবে, কিন্তু ও সেটা বেমালুম ভুলে কেমন একটা বিহবল দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে থাকে। রান্নাঘরের জানালা পেরিয়ে একটা খালি জমি, তাতে লাল শাকের ছোট ছোট চারা মাথা জাগিয়েছে সবে। জমিটা পেরিয়ে গলি রাস্তা। সেখান থেকেই হাঁকটা আসছে। কুঞ্জল উঁকি মেরে তাকাতেই লোকটাকে দেখতে পায়। পুরনো রঙ চটে যাওয়া নীল একটা শার্ট আর বাদামী লুঙ্গী পরা একটা লোক, ভাঙাচোরা মুখ, কাঁধে একটা বড়োসড়ো সাদা বস্তা। লোকটা কুঞ্জলকে উঁকি দিতে দেখে এবার আবার সুর করে হাঁক দেয়, ‘পুরানা ভাঙাচোরা বিক্রি করবে..এ..এ..ন’

কুঞ্জল এবার গলা বাড়িয়ে উঁচু স্বরে ডাকে, ‘অ্যাই, বাড়ির গেটে এসো।’

লোকটা মুখ তুলে একবার ওর দিকে তাকায়, তারপর মাথা নেড়ে রাস্তা ঘুরে বাড়ির গেটের দিকে আসতে থাকে। কুঞ্জল এবার দ্রুত হাতে পেয়াঁজ কুচি ভেজে নেয়। তারপর তাড়াহুড়ো করে অল্প অল্প মসলা ছেড়ে নাড়তে থাকে। এর মাঝেই গেটের কলিংবেলটা বাজতেই ও দ্রুত হাতে পরনের জামাটা ঠিক করে নেয়। বাসায় এখন কেউ নেই, অর্ক স্কুলে, পরীক্ষা চলছে। ওদের ক্লাশ ফোরের পরীক্ষা শেষ হতে হতে দুপুর দেড়টা। তার আগেই রান্না শেষ করে ওকে আনতে যেতে হবে। কাল বাজার থেকে একটা কচি লাউ কিনে এনেছিল। ফ্রিজে শোল মাছ ছিল, তাই দিয়ে আজ দুপুরের রান্না।

কুঞ্জল এক দৌড়ে গিয়ে গেটটা খুলে, দেখে লোকটা বস্তা নামিয়ে সিঁড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ও অনুনয়ের গলায় বলে, ‘ভাই, একটু বোসো। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আসছি।’

লোকটা মাথা নেড়ে এবার সিঁড়িতে বসে পড়ে।

কুঞ্জল এবার আগে থেকে বের করে রাখা মাছের টুকরোগুলো দ্রুত মসলায় কষিয়ে নেয়। তারপর মাছ উঠিয়ে কিউব করে কাটা লাউয়ের টুকরোগুলো কড়াইয়ের মসলার ভেতর ছাড়ে। হালকা একটু নেড়ে চুলার জ্বাল কমিয়ে একটা ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দেয়। তারপর দ্রুত হাতে কিচেনের ক্যাবিনেট থেকে জমে থাকা পুরনো যত প্লাস্টিকের কৌটা বের করে। এরপর নিচের ক্যাবিনেট থেকে একটা ভাঙা ব্লেন্ডার মেশিন বের করে। ব্লেন্ডার মেশিনটা নামী কোম্পানির ছিল। অনেকদিন ঝামেলা ছাড়াই ও ব্যবহার করেছে। এই মেশিনটা ওর প্রতিদিনের রান্নার সংগী ছিল। আজ বেচে দিতে একটু খারাপই লাগছে।

জিনিসগুলো নিয়ে এবার ও লোকটাকে ডাক দেয়, ‘অ্যাই, দেখো তো এগুলোর কত দাম হবে।’

লোকটা নিরুৎসাহিত চোখে প্লাস্টিকের কৌটাগুলো দেখে। তারপর ব্লেন্ডারে চোখ পড়তেই চোখ চকচক করে ওঠে। দ্রুত খুশির ভাবটা লুকায়। বেজার মুখে বলে, ‘প্লাস্টিকের এইগুলান ত্রিশ টাকা কেজি আর এই মেশিনটা পঞ্চাশ টাকা কেজিতে বেচবার পারবেন।’

কুঞ্জল স্পষ্ট বোঝে লোকটা ওকে ঠকাচ্ছে। অন্যদিন হলে এই নিয়ে দামাদামি করত। কিন্তু কেন জানি আজ ইচ্ছে করছে না। ও মাথা নেড়ে বলে, ‘আচ্ছা মাপ দাও। ‘

লোকটা এবার আর দেরি করে না, দ্রুত বস্তার ভেতর থেকে একটা দাড়িপাল্লা বের করে মাপ দিতে থাকে। কুঞ্জল আনমনে চেয়ে থাকতে থাকতে বলে, ‘এগুলো দিয়ে তোমরা কী করো?’

লোকটা একবার মুখ তুলে, বোঝার চেষ্টা করে প্রশ্নটা। তারপর বোঝানোর ভঙ্গিতে বলে, ‘মনে করেন এই পুরান প্লাস্টিক বেচমু প্লাস্টিকের কারবার করে যারা তাগো কাছে। ওরা এইগুলান ধুইয়া মুইছা আগুনে গলাইয়া আবার নতুন প্লাস্টিক বানায়। তারপর এই লোহাও দেখা যায় কোনো না কোনা কামে লাগায়। আফা, এই মেশিনটার মতো দামী পুরানা ভাঙাচোরা আর কিছু আছে?’

শেষের কথাটা লোকটা বেশ আগ্রহ নিয়েই বলে।

কুঞ্জলের হঠাৎ করেই বলতে ইচ্ছে করে, আছে তো! ওর আর অভীকের সম্পর্কটা। বিয়ের এই বারো বছরে তা আজ জরাজীর্ণ, পুরাতন, অথচ একসময় কী ভীষণ দামী ছিল! অথচ সেই সম্পর্কটার আজ কোনো মূল্য নেই, অন্তত ওর কাছে। কুঞ্জলের খুব জানতে ইচ্ছে করে, এমন কেউ কি আছে যে এই পুরাতন, ক্ষয়ে যাওয়া সম্পর্কটা নিয়ে ঠিকঠাক করে একদম ঝাঁ চকচকে নতুন একটা টাটকা সম্পর্ক বানিয়ে দেবে?

ও মাথা নাড়ে, ‘নাহ, আর কিছু নেই। আবার এসো একদিন, পেলে বলব।’

লোকটা বিগলিত হেসে বলে, ‘আফা, আপনি খুব ভালা মানুষ। সবাই এই ভাঙাচোরা জিনিস বেচার সময় এমন করে যেন যক্ষের ধন। দামাদামি করে হুদাই। অথচ দেখেন, কয় টেকার আর জিনিস। আমরা তাও টেকা দিয়া কিনা নেই। নাইলে তো এই পুরান, ভাঙাচোরা জিনিস দিয়া কী হইত? এইগুলা তো অচল, বাড়িতে কেবলি জঞ্জাল। ফালায় দেওয়া সবচেয়ে ভালো।’

কুঞ্জল ঠোঁট কামড়ে ভাবে, লোকটা না বুঝে কী দামী একটা কথাই না বলল! ভাঙাচোরা জিনিস আসলেই অচল, ফেলে দিতে হয়। অথচ ও গত একটা বছর সেই ভাঙাচোরা সম্পর্কটাই বয়ে চলছে। ইশ, যদি অন্যান্য ভাঙাচোরা জিনিসের মতো সম্পর্কও বেচে দিয়ে জঞ্জালমুক্ত হতে পারত!

লোকটা মুখে মুখে হিসেব আউড়ে ওকে টাকাটা বুঝিয়ে দেয়। তারপর বস্তাটা কাঁধে নিয়ে অমায়িক একটা হাসি দিয়ে বলে, ‘আফা, আবার দুই সপ্তাহ পর আইমু। পুরান কিছু জমলে দিয়েন।’

কুঞ্জল মাথা নেড়ে ওকে বিদায় দেয়। তারপর টাকাটা ডাইনিং টেবিলের এক কোণে গ্লাস চাপা দিয়ে রেখে দ্রুত রান্নাঘরে যায়। ঢাকনা উঠিয়ে একবার দেখে, লাউ প্রায় সিদ্ধ হয়ে এসেছে। এবার মাছটা ছাড়তে হয়। আচ্ছা, অভীক তো আবার লাউয়ের তরকারি খাবে না। ওর মাংস ছাড়া কিছুই পছন্দ না।

কথাটা ভাবতেই ও শোবার ঘরে এসে মোবাইলটা হাতে নেয়। ফোন করতেই নম্বরটা বিজি পায়। মনটা একটু খারাপ হয়ে যায়। ঘড়ির দিকে তাকায়, সাড়ে এগারোটা বাজে। নাহ, হাতে খুব একটা সময় নেই। ফোনটা হাতে নিয়েই ও রান্নাঘরে আসে। তারপর এক হাতে লাউয়ের তরকারিটা একবার নেড়ে দিয়েই আবার ফোন করে। এখনও ব্যস্ত। ভ্রু কুঁচকে ও ফোন রাখতে যেতেই ওপাশ থেকে অভীক ফোন ধরে কর্কশ গলায় বলে, ‘কী সমস্যা, বার বার ফোন দিচ্ছ কেন?’

ইদানীং এমন। অভীক ভালো করে কথাও যেন বলতে চায় না। অথচ রাগ করার কথা কুঞ্জলের। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘দুপুরে লাউ দিয়ে শোল মাছ রান্না করেছি। রাতে আর কিছু লাগবে?’

ওপাশ থেকে অভীক বিরক্তির গলায় বলে, ‘তোমার যা ইচ্ছে রান্না করো। বাসায় বসে কাজ নেই, বার বার ফোন দিয়ে বিরক্ত করা। ফোন রাখো, অফিসে এমনিতেই কাজের চাপে থাকি।’

বলেই খট করে ফোনটা কেটে দেয়। যেন হঠাৎ করেই জমজমাট একটা নাটকের পর্দা পড়ে তেমন। কুঞ্জলের মনটা খারাপ হয়ে যায়। ওর বলতে ইচ্ছে করছিল এতই যদি কাজের প্রেশার তাহলে এতক্ষণ ধরে ফোন বিজি কেন? সেই মেয়েটা না তো?

কথাটা মনে করতে চায় না ও। কিন্তু মনে পড়ে যায়। আর যখন মনে হয় তখন ইচ্ছে করে সব ভেঙেচুরে গুড়িয়ে দেয়। এই যেমন এখন ইচ্ছে করছে গরম এই লাউয়ের তরকারির কড়াইটা এক টানে উলটে ফেলে দিতে। মাথাটা কেমন দপদপ করে ওঠে। ও ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে থাকে কড়াইয়ের দিকে। ‘লাভ ইউ পাখি। বউ বাসায়, পরে ফোন দিচ্ছি’, এই লাইনটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বছরখানেক আগে হুট করেই একদিন ও অভীকের মেসেঞ্জারে মেসেজটা দেখে ফেলেছিল। তারপর থেকে একটা দিনের জন্যও ও ভুলতে পারেনি। একটা রাত শান্তিতে ঘুমোতে পারেনি। আজকেও আবার মনে পড়ে গেল। সেদিন ও পাগলের মতো ওকে খামচে ধরে জিজ্ঞেস করেছিল মেয়েটা কে। অভীক বলেছিল, পুরাতন প্রেমিকা। কুঞ্জল স্তম্ভিত হয়ে ওর মুখের দিকে চেয়েছিল, কী অবলীলায় কথাগুলো বলছে!

অভীক ব্যাখ্যা দেবার ভঙ্গিতে বলেছিল, ‘বোঝই তো, পূর্ণ ছিল আমার প্রথম প্রেম। এতদিন পর খুঁজে পেলাম। তাই একটু আবেগতাড়িত হয়ে গিয়েছিলাম।’

কুঞ্জলের শুধু একটা কথাই মনে হয়েছিল, যেখানে অভীকের লজ্জিত, সংকুচিত হওয়া উচিত ছিল সেখানে ও যুক্তি দেখাচ্ছিল। তাতে করে কুঞ্জলকে যে আরও বেশি করে অপমান করা হয় সেটা ও বুঝতেই পারছিল না। নিজেকে সেদিন ভীষণ প্রতারিত মনে হয়েছিল। হঠাৎ করেই পরাজিত মনে হয়েছে নিজেকে।

টানা একটা মাস ও কথা বলেনি। একটা সময় অভীক ওর কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়েছে, সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেছে। ছেলে অর্কের দিক চেয়ে ও স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করেছে। লুকিয়ে পূর্ণ নামের মেয়েটার প্রোফাইলে চুপিচুপি দেখে এসেছে। ওর চেয়ে তো আহামরি সুন্দর কিছু না। গায়ের রঙটা একটু সাদা এই যা। চোখ দুটো কেমন ছোট ছোট। অথচ কুঞ্জলের চোখ যেই দেখেছে বলত নাটোরের বনলতা সেন। গায়ের রঙটা উজ্জ্বল শ্যামলা, কালো নয় মোটেই। নাকটা আদুরে বোচা। অনেকে বলে নাটকের ‘তিষা’র সাথে খুব মিল। ওর মুখে নাকি একটা মায়া আছে। কিন্তু এতকিছু থেকেও অভীককে ও আটকে রাখতে পারেনি। ওর সব কিছু বুঝি পাওয়া হয়ে গিয়েছে অভীকের?

সেসময় একটা কথাই ওর মনে হয়েছিল, ওর আসলে যাবার কোনো জায়গা নেই। না আছে নিজের মাথা গোঁজার ঠাঁই, না আছে একটা চাকরি। খুব আফসোস হয়েছিল। পড়াশোনা শেষ করে চাকরির চেষ্টা করার আগেই অর্ক পেটে চলে এল। বিয়েটাও তাড়াতাড়িই হয়েছিল। কত হবে তখন ওর বয়স? ২৩-২৪। ভেবেছিল অভীক থাকতে ওর বুঝি নিজের কিছু করার দরকার নেই। কিন্তু গতবছর সেই ঘটনাটা ওর সব ধারণা আমূল পালটে দিয়েছে। চাকরির চেষ্টা করেছে কিন্তু এতটাই দেরি হয়ে গেছে যে এখন আর ব্যাপারটা সহজ নেই। পরে এক বন্ধুর পরামর্শে ‘জাদুর বাক্স’ নামে একটা নামকরা শাড়ির পেজে মডারেটর হিসেবে কাজ করে। শাড়ির অর্ডার রাখে, শাড়ি নিয়ে কেউ কিছু জানতে চাইলে তার উত্তর দেয়। এই কাজটা ওর জন্য খুব সহজ হয়েছে। যদিও খুব বেশি টাকা পাওয়া যায় না, তবুও হাতখরচটা ওঠে। কেন জানি সেদিনের পর থেকে অভীকের কাছ থেকে নিজের জন্য কিছু চাইতে ইচ্ছে করে না। অভীক ওর মন থেকে সেদিনই মুছে গেছে। ওদের যে সম্পর্কটা নতুন থাকবার কথা আজ তা পুরোনো, ভাঙাচোরা যেটা ফেলে দিতে হয়, না হয় সের দরে বেচে দিতে হয়।

কুঞ্জল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কড়াইটা নামাতে গিয়েই ‘উফ’ করে ওঠে। দ্রুত পাশের সিংকের কল ছেড়ে পানিতে হাতের আঙুল ভেজাতে থাকে। অসাবধানে খেয়ালই করেনি খালি হাতে এলুমিনিয়ামের কড়াই নামাতে গিয়েছিল, আর গরম ছ্যাঁকাটা খেল। ইশ, জ্বলছে হাতটা। ঠান্ডা পানিতে জ্বলুনি কমে। আর তখনই আবার সেই মেসেজের লাইনগুলো মনে পড়ে। তাতে করে মনের জ্বলুনিটা বাড়ে। আর সেটা ঠান্ডা করবার কোনো উপায় কুঞ্জলের আজ এখন পর্যন্ত জানা নেই।

২.
অর্কের স্কুলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে পোনে একটা বেজে যায়। হাতে এখনও পয়তাল্লিশ মিনিট সময় আছে। নাহ, আরেকটু পরে এলেও হতো। অর্ককে আনতে যাবার সময় প্রতিবার এমন হয়। কখনও একটু দেরি হয়ে গেলে বুক কাঁপতে থাকে। অর্ক যদি স্কুল থেকে বেরিয়ে ওকে না দেখতে পেয়ে ভয় পেয়ে যায়? এই ভয়টাই ওকে কোথাও চলে যেতে দেয় না। সেবার মনের এমন বিক্ষুব্ধ অবস্থায় একবার মনে হয়েছিল সব ছেড়েছুড়ে চলে যাবে। কিন্তু পরক্ষণেই অর্কের কথা মনে হতেই আর পারেনি।

কুঞ্জল ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে সামনে এগোতেই দেখে পৃথুল পুরো আসর জমিয়ে বসেছে। স্কুলের মাঠের এককোণে ওকে ঘিরে অন্যান্য বাচ্চাদের অভিভাকেরা ঘিরে আছে। পৃথুল খুব দুষ্ট। প্রায়ই দুষ্ট আর হাসির সব ভিডিও খুঁজে খুঁজে বার করে ওদের দেখায়। আর সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ে। আজকেও নিশ্চয়ই এমন কিছুই দেখাচ্ছে। মেয়েটা খুব হাসিখুশি, ওর চেয়ে বয়স কম, কিন্তু বন্ধুর মতো তুই তুই করে বলে।

ও হাসিমুখে কাছে এগিয়ে যেতেই ভীড়ের ভেতর থেকে পারভিন আপা চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘ওই যে কুঞ্জল এসেছে। দেখে যান ভাবি, আজ হাতেনাতে আসামি ধরেছি।’

বলেই পারভিন আপা মুচকি মুচকি হাসতে থাকে। কুঞ্জল ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘কে আসামি? কাকে ধরেছেন আপা?’

পারভিন আপা এবার পৃথুলের থুতনিটা হাত দিয়ে ধরে উঁচু করে ধরেন, তারপর কৃত্রিম রাগের গলায় বলেন, ‘দেখেছিস, কী অবস্থা?’

কুঞ্জল কৌতুহলী চোখে তাকাতেই দেখে পৃথুলের ফর্সা গলায় কালচে লাল দাগ। আদরের দাগ। বিয়ের প্রথম দিকে ওরও হতো। যদিও ওর গলা অত ফর্সা না, কিন্তু ভালোবাসার জোরটা বুঝি তখন বেশিই ছিল। তাই গায়ের রঙ ছাপিয়েও দাগ হয়ে যেত। এখন অবশ্য এমন করে আদর পায় না বহুদিন, ওর ইচ্ছেও নেই। মনটা খারাপ হয়ে যায়।

পারভিন আপা বলে, ‘দেখেছিস, আদরের ঠেলায় গলার কী হাল? আর আমাদের বলে ওসব নাকি আর ভালো লাগে না।’

আপার কথা বলার ধরণ দেখে পৃথুল হেসে গড়িয়ে পড়ে মাটিতে। আশেপাশের অন্য আপারাও হাসতে থাকে। কুঞ্জল জোর করে মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে, তাতে করে হাসিটা আরও বেশি করে করুণ দেখায়।

পরীক্ষা শেষ হবার ঘন্টাটা বাজে। কুঞ্জল হাঁপ ছেড়ে যেন বাঁচে। আড্ডাটা ভেঙে যায়। সবাই তাড়াহুড়ো করে এবার স্কুল গেটের দিকে এগোয়। কুঞ্জল একটু এগোতেই পেছন থেকে পৃথুল জোর পায়ে হেঁটে এসে ওকে ধরে। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলে, ‘কী রে, মন খারাপ?’

কুঞ্জল মাথা নাড়ে, ‘না তো। তোর দেখি খুব ভাব হয়েছে জামাইয়ের সাথে। একদম দাগ করে স্কুলে এসেছিস।’

পৃথুল হাসে, ‘আর বলিস না। কী যে লজ্জা পেয়েছি আজ। বাদ দে। তোদের শাড়ির পেজ থেকে একটা ইক্কাত শাড়ি অর্ডার করেছিলাম। এখনও দেয়নি কেন রে?’

পৃথুলের মনে পড়ে, ও মাথা নেড়ে বলে, ‘ ধূসর সাদার সাথে কালো-হলুদের পাড় দেওয়া শাড়িটা তো? পাবি। একটু রাশ চলছে, তাই দেরি হচ্ছে।’

পৃথুল হেসে বলে, ‘অসুবিধে নেই। আসিফ শাড়ি কেনার টাকা দিয়েছে তো তাই। ও দেখতে চাইছিল।’

কুঞ্জল দীর্ঘশ্বাসটা গোপন করে। অভীক অনেকদিন নিজে থেকে ওকে শাড়ি কিনে দেয়নি কিংবা হাতে টাকাও দেয়নি। ইদানিং এমন হয়। মানুষের ছোট ছোট সুখগুলো ওকে জোর করে মনে করিয়ে দিয়ে যায় যে ও সুখে নেই।

গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই দূর থেকে অর্ককে আসতে দেখে। সাথে সাথে মন খারাপের মেঘ দূর হয়ে যায়। এই একটা মুখের দিকে চেয়ে ও পৃথিবীর সব না পাবার দুঃখ ভুলে থাকতে পারে।

অর্ক কাছে আসতেই কুঞ্জল চিন্তিত গলায় বলে, ‘পরীক্ষা কেমন হয়েছে বাবা?’

অর্ক কল কল করে বলে, ‘ভালো হয়েছে আম্মু। আমি সব প্রশ্ন লিখতে পেরেছি। আর জানো, রনি না একটা প্রশ্ন পারে নাই। পরে আমাকে খালি পেছন থেকে ডাকে।’

কুঞ্জল পৃথুলের দিকে হাত নেড়ে বিদায় জানায়। তারপর অর্কের মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলে, ‘তাই? তুমি সব পেরেছ?’

হাঁটতে হাঁটতে অর্ক বলে, ‘হ্যাঁ আম্মু, আমি সব পেরেছি। আর স্যাররা বলেছে আমরা নাকি এখন ক্লাশ ফাইভে। জানুয়ারি মাসের এক তারিখে নতুন বই নিতে যেতে বলেছে।’

অর্কের চোখেমুখে একটা আনন্দ, নতুন বই পাবার আনন্দ। কুঞ্জল ওকে নিয়ে রিক্সায় ওঠে। তারপর এক হাতে জড়িয়ে ধরে গল্প করতে করতে বাড়ির পথে এগোয়।

বাসায় এসে হাতমুখ ধুয়ে আগে ছেলেকে খাইয়ে নেয় ও। তারপর নিজেও খায়। খুব ক্ষুধা পেয়েছিল। এখন একটু ভালো লাগছে। খাওয়া শেষে ও অর্কের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আমার বাবাটা এখন কী করবে?’

অর্কের মুখটা হাসি হাসি হয়ে যায়। ও আবদারের গলায় বলে, ‘আমি গেমস খেলব আম্মু।’

কুঞ্জল হাসে, পরীক্ষার এই ক’টা দিন বেচারা খেলতে পারেনি। ও ছেলের কপালে একটা চুমো খেয়ে বলে, ‘আচ্ছা বাবা, খেল। আমি একটু কাজ করব এখন।’

রিয়া আপু সকালেই মেসেজ দিয়ে রেখেছিলেন আজ শাড়ির লাইভ করবেন। জাদুর বাক্স পেজটা আপুর। আপুর লাইভ মানে হাজার লোক দেখবে। সবাই যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আর মুহুর্তেই সব শাড়ি বিক্রি হয়ে যায়। মানুষজন কাড়াকাড়ি করে শাড়ি নেয়। সেক্ষেত্রে ওদের উপর চাপটা বেশি থাকে। অর্ডারগুলো ঠিকঠাক নেওয়া, ডেলিভারির ব্যবস্থা করা।

কুঞ্জল দ্রুত সব গুছিয়ে ওর বেডরুমে আরাম করে বসে। রিয়া আপু অলরেডি সবাইকে নক করেছেন, লাইভ শুরু হচ্ছে। আর আজ শাড়ির কোড ১ থেকেই শুরু হবে। লোকজন কোড উল্লেখ করে শাড়ির অর্ডার দেয় এই পেজে।

একটু পরেই লাইভ শুরু হয়ে যায়। আজ রিয়া আপু খুব সুন্দর সুন্দর মোডাল সিল্ক আজ্রাখ শাড়ি দেখাচ্ছেন। একেকটা একেকটার চেয়ে সুন্দর। দামটাও নেহায়েত কম না, সাড়ে আট হাজার করে প্রত্যেকটা। ইনবক্সে দ্রুত অর্ডার পড়ছে। লোকজন কোড নম্বর আর মেইলিং এড্রেস লিখে লিখে পাঠাচ্ছে। কুঞ্জল অর্ডার কনফার্ম করার আগে আইডিগুলো একবার দেখে নেয়। যাতে বুঝতে পারে এরা আসলেই নেবে কি-না। অনেকে রেগুলার কাস্টমার, তাদের ক্ষেত্রে সমস্যা হয় না। এই যেমন এখন দিলারা চৌধুরী ম্যাডাম অর্ডার দিল, কোড ১। উনি মোটামুটি দু’দিন পর পরই শাড়ির অর্ডার দেন। মানুষ এত টাকা যে কোথায় পায়, কে জানে।

কুঞ্জল দ্রুত ওনার অর্ডার কনফার্ম করে। যত বেশি অর্ডার ও কনফার্ম করতে পারে তত বেশি কমিশন। কুঞ্জল আরও দুটো অর্ডার কনফার্ম করে। তারপর অপেক্ষা করে নতুন মেসেজের।

ঠিক এই সময় একটা অর্ডার আসে। এটা নতুন আইডি, মানে এর আগে কখনও নেয়নি। ভালো করে নামটা পড়তেই ও থমকে তাকায়। আরে, এটা তো অভীকের ফেসবুক আইডি। অবিশ্বাস নিয়ে ও মেসেজের দিকে তাকিয়ে থাকে। শাড়ির কোড ৩, নিচে ডেলিভারি এড্রেস লেখা। আর সেটা অভীকের অফিসেরই ঠিকানা। নিশ্চিত হতে ও ফেসবুক আইডিটা খুলে। অভীকের হাসিমাখা একটা মুখ, পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে। বছর দুয়েক আগে ওরা সবাই দার্জিলিংয়ে গিয়েছিল তার ছবি। কাভার পেজে ওদের তিনজনের ছবি। দেখলেই মন জুড়িয়ে যায়। আইডিটা অভীকের। কুঞ্জলের সারা শরীর কেমন অসাড় হয়ে আসে। অভীক শেষ পর্যন্ত ওর জন্য বুঝি শাড়ির অর্ডার করল? মনটা খুশি হতে যেয়েও থমকে যায়। ও যে অনলাইন শাড়ির পেজের মডারেটর সেটা অভীক জানে না। মানে কখনও জিজ্ঞেস করেনি, আর ও নিজেও বলেনি। তাহলে কি শাড়িটা ওর জন্য না? সেই পূর্ণ মেয়েটার জন্য?

(চলবে)