অনুভূতিরা শব্দহীন পর্ব-৩১+৩২+৩৩

0
285

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

একত্রিংশ পর্ব (৩১ পর্ব)

খুব ভোরে সারাহ্-র ঘুম ভা°ঙলো ফুফুর ডাকে। ফোনে সময় দেখে বুঝলো এখনো আযান দেয়নি। এখন কেন ডাকছে উনি, কোনো বি°পদ হলো না তো।

সারাহ্ উঠে গিয়ে দরজা খুলে। ফুফু ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বলল,
“কিছু মনে করো না আমার আবার ভোরে চা খাওয়ার অভ্যাস তো।”

সারাহ্ জোরপূর্বক হেসে বলল,
“আমি বানিয়ে দিচ্ছি।”

চুলগুলো খোঁপা করে ওড়না দিয়ে শরীর ঢেকে সারাহ্ রান্নাঘরে যায়। ফুফুও পিছুপিছু গিয়ে দাঁড়ালো।

“আহনাফের মা নেই, শুনেছি তুমিও নাকি জব করো। সংসার সামলাও কিভাবে?”

সারাহ্ চায়ের পাতিল চুলায় বসিয়ে দিয়ে বলে,
“দুধ চা খাবেন নাকি লেবু চা?”

এক কথায় উনাকে এড়িয়ে গেল সারাহ্। ওর সংসার কিভাবে সামলায় বা কিভাবে সামলাবে তার কৈফিয়ত ও কাউকে দিবে না।

ফুফু গমগমে সুরে “আদা-লেবু চা” বলে চলে গেল। সারাহ্ মুচকি হাসে। চা বসিয়ে দিয়ে রুমে ফিরে আসে। আহনাফ ঘুমাচ্ছে। মাথায় হাত বুলিয়ে ওর মুখের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখে চোখের কোণায় চিকচিক করছে অশ্রুবিন্দু। রুমের লাইট বন্ধ, কিন্তু ডাইনিং এর লাইটের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ওড়নার কোণা দিয়ে চোখ মুছে দেয় সারাহ্।

“কি লুকাচ্ছেন আপনি? আপনাকে আমি এখনো কেন বুঝতে পারছি না?”

আহনাফের কপালে চুম্বন করে। আহনাফ ওকে জড়িয়ে ধরে গা ঘেষে শুয়ে পড়ে।

“তাহসিনার কাছে গিয়েছিলেন, প্রচুর ভালোবাসেন ওকে। ওর জন্যই মন খারাপ আপনার, কাঁদছেন আপনি?”

আহনাফ জেগে গেছে, কিন্তু চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভাণ ধরে রেখেছে। তাহসিনাকে নিয়ে সারাহ্-র মুখোমুখি ও হতে পারবে না। সারাহ্ আর কথা না বলে উঠে যায়। এরমধ্যেই আযানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে।
______________________________________

সকাল পৌনে সাতটা, আজকে মৃত্তিকা নাস্তা বানিয়েছে। অফিসে যেতে হবে তাই তাড়াতাড়ি উঠে রান্না সেরে ফেলে। ইমতিয়াজ ঘুমিয়ে কাঁদা। মৃত্তিকা সুন্দরমতো টেবিলটা সাজায়। বিড়ালটা ওর পায়ে পায়ে ঘুরছে।

“একদম টেবিল খারাপ করবি না। আমার কিন্তু কষ্ট হয়েছে বলে রাখলাম।”

আঙ্গুল তুলে কথাটা বলে রুমের দিকে তাকায় সে। ইমতিয়াজ এখনো উঠেনি। হাঁটু গেড়ে বসে বিড়ালকে বলে,
“ও তোর বাবা হলে আমি তোর মাম। সো, মামের কথা শুনে চলবি।”

মৃত্তিকা বেসিনের আয়নায় নিজেকে ঠিকঠাক মতো দেখে রুমে যায়। শান্ত সুরে ইমতিয়াজকে ডাকে,
“গুড মর্নিং।”

ইমতিয়াজ উঠে না। মৃত্তিকা গিয়ে ওর কানে সুরসুরি দেয়। ইমতিয়াজ নড়ে উঠে, মৃত্তিকা মুখ টিপে মুচকি হাসে। ইমতিয়াজ মৃদুস্বরে বলে,
“এই মিনা।”

মৃত্তিকা সরে যায়। ঘুমের ঘো°রে ইমতিয়াজের মুখে মিনা নামটাই আসে। কিছুক্ষণ বসে থেকে মাথানিচু করে উঠে যাওয়ার সময় ইমতিয়াজ ওকে টেনে নিজের বুকে নিয়ে আসে। দুহাতে শক্ত করে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। প্রথমবারের মতো এতো কাছে দুজনে, ইমতিয়াজের এই স্পর্শটাও নতুন। মৃত্তিকার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, শরীরে এক অন্যরকম শিহরণের সৃষ্টি হয়।

ইমতিয়াজের ফোনে এলার্ম বেজে উঠলো, হাত বাড়িয়ে এলার্ম বন্ধ করে সে। মৃত্তিকা হাত সরানোর পরই তার ঘুম ভেঙেছিল। মিনার নাম মৃত্তিকার সামনে উচ্চারণ করেছে, মেয়েটা কষ্ট পেয়েছে এটাই স্বাভাবিক। তাইতো কাছে টে°নেছে, কষ্টটা কিছু কমে যাক।

“মৃত্তিকা?”
বলে হাতটা আলগা করতেই মৃত্তিকা উঠে যায়। মাথানিচু করে বসে থাকে। লজ্জায় পালাতে তো পারবে না, ইমতিয়াজ যে এখনো হাত ধরে রেখেছে।

আড়চোখে ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলল,
“অফিস যাবেন না? নাস্তা করে নিন।”

ইমতিয়াজ উঠে বসে। বলে,
“ফ্রেশ হয়ে আসি।”

মৃত্তিকার মুখটা কাছে এনে বলল,
“একটু মানিয়ে নিও।”

ইমতিয়াজ উঠে ওয়াশরুমে চলে যায়। শক্ত মেয়েটাও প্রিয় পুরুষের স্পর্শ পেয়ে লজ্জাবতী হয়ে গেছে।

নাস্তা সেরে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয় আটটার কিছু পরে। মৃত্তিকার অফিসটা মিরপুরে৷ মগবাজার থেকে যেতে বেশ খানিকটা সময় লাগলো ওদের।

অফিসে গিয়ে প্রথমেই গেল মৃত্তিকার কেবিনে। দুইকাপ কফি এনে দুজনে মুখোমুখি বসে। মৃত্তিকা বলল,
“কলরবের বাবা, দুলাল ফেরদৌসী, প্রতিদিন অফিসে আসে। ৭৫ শতাংশ শেয়ার হারিয়েছে, পাগল প্রায় উনি। কিন্তু হাল ছাড়েননি।”

ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে চোখে চোখ রেখে বলল,
“সে আবারো ওই চেষ্টা করবে। আর মামার বিষয়টাও আমাকে জানতে হবে।”

ঘাড় ঘুরিয়ে আবারো দরজার দিকে তাকায়। বলে,
“আমার চেয়ে আপনি ওদের কাছে বেশি যেতে পারবেন। (একটু থেমে) আর আপনি এমডির রেজিস্টার এসিস্ট্যান্ট ছিলেন, তাই বিজনেসের পাক ঝোঁ°ক ভালো বোঝার কথা। কি বলেন?”

ইমতিয়াজ মনোযোগ দিয়ে ওর কথা শুনলো। তারপর বলল,
“হয়তো ঠিক বলছেন। কিন্তু যারা এভাবে ঠান্ডা মাথায় কাজ করে, তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ পাওয়া সহজ বলে মনে করেন?”
“সহজ নয় তবে সম্ভব।”

ইমতিয়াজ মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। মৃত্তিকা এবারে স্বাভাবিক সুরে বলল,
“তবে ডিসিশন ফাইনাল, আপনি অফিস সামলাবেন আর আমি বাসা।”

ইমতিয়াজ হেসে উঠে বলে,
“বাসায় সামলানোর কিছু নেই, আপনিও অফিসে থাকবেন।”
“আমি কি করবো?”

কফির কাপে চুমুক দিয়ে ইমতিয়াজ বলে,
“ধরে নেন আমার পার্টনার।”
“পার্টনার?”
“হুম, পার্টনার।”

দরজায় নক করে মৃত্তিকার পিএ শিল্পা ইউনুস প্রবেশ করে। মেয়েটা কম বয়সী, মিষ্টি করে হেসে বলল,
“ম্যাম, ইসরাত জাহান চলে এসেছে।”
“ওকে, আমি আসছি।”

শিল্পা চলে গেলে মৃত্তিকা ইমতিয়াজকে বলল,
“ইসরাত রাতে চলে যাবে, তো এর আগে আমরা ওর সাথে একটু ফ্যাক্টরি দেখে আসি?”
“হুম, চলুন।”
______________________________________

“আজ কলেজ অফ?”

ফুফুর কথায় সারাহ্ মুচকি হেসে জবাব দিলো,
“জি, আজ শনিবার।”
“শনিবার অফ।”
কথাটা উনি কয়েকবার বলেন।

আলেয়া খাতুনের সাথে রান্নার জোগাড়ে ব্যস্ত সারাহ্। ফুফু রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ওদের কাজ দেখছে। সারাহ্-কে জিজ্ঞাসা করে,
“তোমার গ্রামের বাড়ি কোথায়?”
“শরীয়তপুর।”

ফুফু ভ্রূ উঁচিয়ে ঠোঁট উলটে মাথা নেড়ে বলল,
“তো পড়াশুনা কোথায় করেছো? ঢাকায়?”
“জি।”
“অনার্স কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে?”
“ঢাবি, কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট।”
কাজ করতে করতে জবাব দেয় সারাহ্।

“তো ভিক্টোরিয়াতে কেন জব নিলে?”

সারাহ্ নির্বিকার চোখে উনার দিকে তাকায়। তারপর বলল,
“আম্মুর ইচ্ছা ছিল।”
“কারণ?”
“তা জানিনা, আম্মুর ইচ্ছা ছিল এটাই যথেষ্ট।”

সারাহ্ আবারো রান্নায় মন দেয়। খাবারের গন্ধে অস্বস্তি হওয়ায় ওড়নাটা নাকে মুখে বেঁধে কাজ করছে।

“এটা এভাবে বেঁধেছো কেন?”

এই মহিলা প্রচুর কথা বলে। সারাহ্ একটু বি°র°ক্ত হয়৷ এতো প্রশ্ন একটা ছোট বাচ্চাও বোধহয় করবে না।

আহনাফ সারাহ্-কে ডাকে,
“ঐশী? এই ঐশী, (একটু থেমে) ঐশী, রুমে আসো।”
“যাও, ডাকছে। জলদি যাও।”

ওড়না ঠিক করে সারাহ্ নিশব্দে বেরিয়ে যায়। রুমে গিয়ে আহনাফকে ধ°ম°ক দিয়ে বলে,
“কাজ নেই কোনো আপনার? এভাবে বাড়ি মাথায় তুলে ডাকাডাকি করছেন, বাড়িতে আরো মানুষ আছে।”
“বউকেই তো ডাকছি, বাইরের কাউকে তো ডাকিনি। রাগ করো কেন?”

আহনাফ হেসে বলে,
“রান্নাঘরে তোমার কষ্ট হচ্ছিল।”

সারাহ্ বিছানায় বসে বলল,
“একটু একটু হয়েছে।”
“এজন্যই ডেকেছি, রেস্ট নাও।”
“আপনার ফুপ্পি অনেক কথা বলে। কতকত প্রশ্ন?”

আহনাফ হেসে বলে,
“ঠিকই বলেছো, ফুপ্পি কথা প্রচুর বলে। তবে উনার মনটা কিন্তু অনেক সরল।”
“সেটা আমিও বুঝেছি, নাহলে ভোরে এসে কেউ চা চায় এভাবে।”

আহনাফ হো হো করে হেসে উঠে। সারাহ্ও আলতো হেসে উঠে যায়। আবারো সেই রান্নাঘরের কাজে মন দেয়। আহনাফ বই পড়ছে, এরমধ্যে কল আসে সারাহ্-র নাম্বারে।

আহনাফ ফোন হাতে নিয়ে আননোন নাম্বার দেখে রিসিভও করে,
“আসসালামু আলাইকুম।”

অপরপাশের নারী কন্ঠ বলে উঠে,
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম, নার্গিসের মেয়ের নাম্বার এটা?”
“জি, আপনি কে?”
“আসলে আমি নার্গিসের ফ্রেন্ড রাহা। ওর মেয়েকে দিন ফোনটা।”
“আমি ওর হাসবেন্ড, আমাকে বলুন কি বলবেন?”
“নার্গিসের নাম্বারটা দেয়া যাবে?”

সরাসরি এমন প্রশ্নে আহনাফের কপাল কুঁচকে যায়। সারাহ্-র নাম্বার যে যোগাড় করতে পারে সে সারাহ্-র মায়ের নাম্বার যোগাড় করতে পারলো না।

আহনাফ সহজ ভাষায় বলে,
“এমনি ওমনি অপরিচিত কাউকে দেয়া যাবে না।”
“বললাম তো আমি রাহা।”
“কিন্তু আমি আপনাকে চিনি না।”
“তবে এই নাম্বারটা নার্গিসকে দিয়ে বলবেন রাহার নাম্বার।”

কল কে°টে যায়। আহনাফ ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে। কপালের ভাঁজ আরো গভীর হয়।

সুন্দরী এক রমনী ছিল ফোনের ওপাশে, তার দেহের গড়ন যেকোনো পুরুষের নজর কাড়তে বাধ্য। নামটাও তার মতই সুন্দর, অপরূপা।

সে ফোন রেখে শাফিনকে বলে,
“চিন্তা করতে পারো নার্গিসের মেয়েকে বিয়ে করে আহনাফের মতো ছেলের এতো কথা হয়েছে?”

শাফিন মাথা নেড়ে বলল,
“একটা বিষয় কনফার্ম, আহনাফ রাহাকে চেনে না।”

অপরূপাও মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। শাফিন বলে,
“তবে চিন্তার কারণ মৃত্তিকা, ও রাহা সম্পর্কে শুনেছে।”

অপরূপা ধ°ম°ক দিয়ে বলে,
“তোমার কারণেই হয়েছে এটা। আমি কোনো বিপদে পড়তে চাই না।”

শাফিন অপরূপার গাল চে°পে ধরে বলল,
“চুপ, আমার উপরে হুকুম কম চালাও।”

শাফিন আবারো গিয়ে আগের জায়গায় বসে বলে,
“লুৎফরের মনে বোধহয় সন্দেহ জন্মেছে। এর একটা ব্যবস্থা করতে হবে।”
“করে ফেলো। আর দুই মেয়েকে একসাথে হাতে রাখতে পারলে নার্গিস এমনিতেই দুর্বল হবে।”

কথা শেষে অপরূপা জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। তার কল্পনায় তার কাজে কোনো ভুল নেই, সে সঠিক। আত্নীয়স্বজন, মায়া-মহব্বত এসবের স্থান ওর হৃদয়ে নেই। টাকার জন্য সে সব করতে পারে, বাবার বয়সী শাফিনকে বিয়েও করতে পারে। এ বিয়েটা দেলোয়ারার অগোচরে করেছে শাফিন। অপরূপাকে আলাদা বাসায় রেখেছে।

“মৃত্তিকাকে তুমিই শান্ত করো, শাফিন। তোমার ওয়েতে শান্ত করো ওকে। নার্গিসের জন্য তো আরিফা আর আমি যথেষ্ট।”

শাফিন বিছানায় আরাম করে বসে বলল,
“আরিফা সাহায্য করবে?”
“এটাই শেষ সাহায্য। এই মাসেই প্রত্যেকটা প্রমাণ শেষ করে দাও।”
“তাড়াহুড়ো করো না, আগে তানজিম আর সামিহার বিয়েটা দেয়া উচিত।”

অপরূপা কপাল কুঁচকে বলল,
“কেন ওরা মেয়ে দিবে মমতাজের বেকার ছেলেকে?”
“প্রস্তাব নিয়ে যাবো, ভালো করে বুঝিয়ে বলবো এখন বিয়ে হোক আর ওরা পড়াশুনা চালিয়ে যাক। পড়া শেষে সংসার শুরু করবে।”

অপরূপা মুখ বাঁ°কিয়ে মাথা নাড়ে। শাফিন বুদ্ধিমান, তবে মাঝেমাঝে তার বোকামির জন্যই পুরোনো ঘটনা নতুন করে উঠে এসেছে আর ওদের নতুন নতুন খু°ন করে আবারো সেই ঘটনা ধামাচাপা দিতে হচ্ছে।
______________________________________

রবিবার সকালে তাড়াতাড়ি কলেজে আসে সারাহ্ ও আহনাফ। কলেজে কোনো একটা মিটিং থাকায় আহনাফকে তাড়াতাড়ি আসতে হয়েছে আর সারাহ্ও সাথে এসেছে। কলেজে এসে শুনলো মিটিং ক্যান্সেল।

আহনাফকে মাঠে হাঁটতে দেখে সারাহ্ টিচার্স রুম থেকে বেরিয়ে এসে বলল,
“মিটিং?”
“ক্যা°ন্সে°ল হয়েছে।”

সারাহ্ হাসতে হাসতে মাঠে এসে বলে,
“আহারে, সকালে উঠে কি জলদিই না এসেছেন। বেচারা।”

আহনাফ হাত নেড়ে বলল,
“রসমালাই খাবা? আদি মাতৃভান্ডারের রসমালাই।”
“কোথায় এটা?”
“গেলেই বুঝবা।”

দুজনে কলেজের সামনে থেকে অটোরিকশা নিলো। আহনাফ অটোতে বসে চালককে বলল,
“মামা, প°দুয়ার বাজার, মাতৃভান্ডারের সামনে চলেন।”

অটো চলতে শুরু করে। সারাহ্ আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,
“জায়গার নাম কি?”
“প°দুয়ার বাজার।”

সারাহ্ একটু হাসে। প্রায় একবছর হতে চলল সে কুমিল্লা থাকে, কিন্তু এখানের তেমন কোনো জায়গা সে চিনে না।

আহনাফ বলে,
“তুমি গোমতী পাড়ে যেতে চেয়েছিলে না? এই শুক্রবারে নিয়ে যাবো।”

সারাহ্ খুশি হয়ে ওর হাত ধরে কাঁধে মাথা রেখে বলল,
“সত্যি তো? আবার কোনো অজুহাত দিবেন না?”
“একদম সত্যি।”

কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা মাতৃভান্ডারে পৌঁছে যায়৷ ভাগ্য ভালো থাকায় ভিতরে বসার জায়গা পায়।

আহনাফ বলে,
“সকাল বলে ভী°ড় কম, বিকেলে আসলে তো ওই রাস্তা পর্যন্ত লাইন থাকে।”

অল্প করেই রসমালাই কিনলো। আহনাফ সারাহ্-কে খাইয়ে দিয়ে বলে,
“অতিথি আর অতিথির মাকে আপ্যায়ন করতে হবে তো।”
“ব°মি হলে কে সামলাবে?”
“এই বান্দা আছে তো এখনো।”
______________________________________

এক এক করে তিনদিন কেটে যায়। সকাল সাতটা, তানজিম ভার্সিটিতে চলে গেছে। লুৎফর রহমান দোকানে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। মমতাজ বেগম দুধের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলল,
“খেয়ে নাও।”
“রাখো।”

বেডসাইড টেবিলে দুধের গ্লাস রেখে মমতাজ বেগম ডাইনিং এ গিয়ে নিজের গ্লাসে দুধ ঢাললেন। লুৎফর রহমান দুধ অর্ধেকটুকু খেতেই অসুস্থ বোধ করা শুরু করে। গলায় যেন কিছু একটা আটকে গেছে, নি°শ্বাসটা যেন বুকেই থাকতে চাচ্ছে। কয়েকবার জোরে নিশ্বাস নিয়ে স্বাভাবিক হতে চায়।

“মমতা..”

মমতাজ বেগমকে ডাক দেয়ার শক্তিটুকু তার নেই। বিছানায় বসে খেতে খেতে ওখানেই পড়ে গেল। নি°শ্বাসের পরিমাণ ক্রমাগত কমছে।

মমতাজ বেগমেরও একই দশা। চেয়ার থেকে নিচে পড়ে ছ°টফ°ট করতে করতে উঠে টেবিলের উপর থেকে নিজের ফোনটা নেয়। তানজিমের নাম্বারে ডায়াল করে।

তানজিম রিসিভ করে বলে,
“আম্মু, মাত্রই তো আসলাম।”
“তানজিম বাসায় আ.. আসো।”

শীতল কন্ঠে কথাটা বলে শান্ত হয়ে যায় মমতাজ বেগম। তানজিম কয়েকবার “আম্মু, আম্মু” বলে ডাকলেও সারাশব্দ আসে না। ফোন রইলো টেবিলে আর মমতাজ বেগম ফ্লোরে গ°ড়াগ°ড়ি খেতে খেতে শান্ত হয়৷ মুখের কো°ণা দিয়ে সাদা ফেনা জাতীয় কিছু বেরিয়ে আসে।

চলবে…..

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

দ্বাত্রিংশ পর্ব (৩২ পর্ব)

হাসপাতালের চেয়ারে শান্ত হয়ে বসে আছে তানজিম। দুইবোনের পর মা-বাবাও একই পথের যাত্রী হয়েছে, মৃ°ত্যুর সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছে। এই বয়সে ছোট ছেলেটা কিভাবে তা সহ্য করবে? কথায় বলে না, অল্প শো°কে কা°তর আর অধিক শো°কে পাথর। তানজিমের হয়েছে সে অবস্থা।

বাসায় ফিরে মমতাজ বেগম আর লুৎফর রহমানের অবস্থা দেখে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আসে তানজিম। খবর পেয়ে অফিস থেকে ছুটে এসেছে ইমতিয়াজ ও মৃত্তিকা। বড়মণির জন্য মৃত্তিকার সে কি কান্না। ফুঁ°পিয়ে ফুঁ°পিয়ে অনবরত কেঁদেই যাচ্ছে সে। তার মাথায় শান্ত হয়ে হাত বুলাচ্ছে ইমতিয়াজ।

তানজিম শাফিন সাহেবকে খবর দিয়েছে। উনি হাসপাতালে আসতেই মৃত্তিকা ইমতিয়াজের বাধা উপেক্ষা করে গিয়ে উনার কলার টে°নে বলে,
“আমার বড়মণিকে ওই মে°রেছে, ও কেন এসেছে এখানে। বের হও, যাও।”

মৃত্তিকার ধা°ক্কা শাফিন পড়ে গিয়ে আবারো উঠে দাঁড়ায়। ইমতিয়াজ ওকে সরিয়ে নিয়ে আসে। মৃত্তিকা ইমতিয়াজকে বলে,
“উনি বড়মণিকে পয়°জন দিয়েছে।”

ইমতিয়াজ ওর মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বেশ শক্ত করে বলল,
“শান্ত হও, প্রুভ কি উনি পয়°জন দিয়েছে। এভাবে চিৎকার করে কিচ্ছু হবে না।”

মৃত্তিকা জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে কান্না নিয়ন্ত্রণ করে। ইমতিয়াজ ওকে চেয়ারে বসিয়ে বোতল থেকে পানি পান করায়। তারপর সে যায় আইসিইউর সামনে।

দুজনের পাকস্থলী থেকেই বি°ষ অপসারণ হয়েছে, কি বলে একে? ও হ্যাঁ, স্টোমাক ওয়াশ করা হয়েছে। তবুও বি°ষ°ক্রিয়া ভ°য়া°বহ থাকায় উনাদের দুজনের অবস্থাই আ°শং°কাজনক, বিশেষ করে লুৎফর রহমান বেশি ভ°য়া°বহ অবস্থায় আছে।

“ভাইয়া?”

তানজিমের শান্ত ডাকে ইমতিয়াজ তাকায়। তানজিম বলে,
“আপুকে নিয়ে তুমি চলে যাও।”
“প্রয়োজন নেই, মৃত্তিকা থাকুক। মায়ের এই অবস্থায় ওকে নিয়ে গেছে পাগলামি করবে।”
তানজিম আর কিছু বলে না।

অপরূপা হাসপাতালে এসেছে। সাধারণ একজন রোগীর সদস্য সেজে ওদের আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মৃত্তিকার চোখ ঠিকই ওকে দেখে নেয়। তবে তেমন কোনো সন্দেহের কারণ নেই।
______________________________________

ছোট ফুফু আম্বিয়া আর ফুপা জামিল এখনো আহনাফদের বাসায়ই আছে। সারাহ্-র শারিরীক অসুস্থতা দেখে আম্বিয়ার ঠিকই সন্দেহ হতে থাকে।

আজ সারাহ্ কলেজেও যেতে পারেনি। বমি করে করে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। বৃহস্পতিবার হওয়ায় আহনাফও কলেজ গ্যাপ দিতে পেরেছে। সকাল থেকে একটানা ঘুমাচ্ছে সারাহ্। অবশেষে খাবার খাওয়ার জন্য আহনাফ ওকে ডাকে।

“ঐশী, ঐশী (একটু থেমে) ওই সুন্দরী।”

সারাহ্ চোখ না খুলেই আহনাফের কাঁধে চা°পড় দেয়। আহনাফ হেসে ওর কপালে চুম্বন করে বলল,
“উঠো, কিছু খাবে।”
“ভালো লাগছে না।”

নিচুস্বরে কথাটা বলে আহনাফের গা ঘে°ষে শুয়ে পড়ে সারাহ্। আহনাফ ওকে টেনে তুলে বলল,
“খেতে হবে।”

সারাহ্ খোঁপা করতে গেলে আহনাফ বাধা দেয়। নিজে চিরুনি দিয়ে সুন্দর করে আঁচড়ে দিয়ে চুলে ক্লিপ লাগিয়ে দিলো আহনাফ। গ্লাস থেকে পানি ঠেলে নিজের হাত ভিজিয়ে সারাহ্-র মুখ মুছে দিয়ে বলে,
“খাবার আনছি।”

আহনাফ টেবিলের উপর থেকে স্যান্ডউইচের প্লেট আনে। সারাহ্-র সামনে প্লেট দিয়ে বলে,
“আমি বানিয়েছি।”

ঘুম অনেকটাই কে°টেছে তার। স্যান্ডউইচে কামড় দিয়ে বলল,
“বাসার কেউ দেখেনি?”
“দেখেছে, তবে ফুপ্পি মনে হয় কিছু বুঝেছে।”

অর্ধেকটুকু খেয়ে সারাহ্ বলে,
“আর না। ভালো লাগছে না।”

আহনাফ জোর করে না। সারাহ্ শুয়ে পড়লে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। সারাহ্ আহনাফের শার্টের কলার টে°নে কাছে এনে বলে,
“আজ পারফিউম দেননি?”
“না, তোমার অস্বস্তি হবে।”
“চিন্তা তো সব নিজের ছেলে-মেয়েদের জন্য।”
“সব না কিছুটা, সিংহভাগ তো তাদের মায়ের জন্য।”

সারাহ্ মনের অজান্তেই হেসে উঠে। নিজে থেকেই আহনাফকে কাছে নিয়ে আসে৷ আবার নিজেই লজ্জায় কুঁচকে যায়।

দরজা চাপিয়ে রাখা ছিল, পর্দা পুরোপুরি দিয়ে রাখা। পর্দা সরিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মিষ্টি মুহূর্তগুলো দেখে ফুপা জামিল। ফোন কানে নিয়ে বলে,
“সারাহ্ প্রেগন্যান্ট।”
“ঠিক এই ভ°য়টাই পেয়েছিলাম আমি।”
ফোনের ওদিকে থাকা অপরূপা জবাব দেয়।

জামিল পর্দা দিয়ে সরে আসার সময় হাতের ঘড়িটা দরজায় লেগে একটা মৃদু শব্দ হয়। জামিল দ্রুত জায়গা ত্যাগ করে। আহনাফ-সারাহ্ চমকে উঠে।

“কেউ এসেছিল নাকি?”
বলে আহনাফ উঠে যায়। দরজার ওপাশে কাছাকাছি কেউ না থাকলেও সদর দরজা দিয়ে জামিলকে বেরিয়ে যেতে দেখে।

“ফুপা এভাবে নক না করে রুমে এসেছিল?”
খুব ধীরে কথাটা বলে আহনাফ। কপাল তার কুঁচকে আছে।
______________________________________

রাত দশটা বেজে গেছে। হাসপাতালে এখনো বসে আছে মৃত্তিকা, তানজিম। ইমতিয়াজকে অফিসে যেতে হয়েছে। দুলাল ফেরদৌসী অফিসে এসেছেন, খবরটা পেয়েই যেতে হয়েছে। এখনো ফেরেনি।

অপরূপা মৃত্তিকার বিপরীতে একটা চেয়ারে বসে আছে। চোখেমুখে তার বি°ষন্নতা বিরাজ করছে।

শাফিন খাবার এনে তানজিমকে বলে,
“তোমরা খেয়ে নিবে আসো।”
“ক্ষুধা নেই মামা।”
নির্বিকার জবাব দেয় তানজিম।

“মিউকো?”

নামটা উচ্চারণের সাথে সাথেই মৃত্তিকা খাবারগুলো ছু°ড়ে ফেলে বলে,
“তোমার খাবার তুমি খাও, প্রয়োজনে রাস্তার কুকুরের মতো খাও। (একটু থেমে) কুকুরের থেকে কম নও তুমি।”

মৃত্তিকা হনহনিয়ে বেরিয়ে যায়। শাফিন রাগি চোখে কি°ড়মি°ড়িয়ে তাকায় ওর দিকে। তানজিমের চোখে বি°ষ্ময়। মৃত্তিকা বারবার শাফিনকে খুনি প্রমাণ করতে চাইছে কেন এটাই বুঝে উঠছে না তানজিম।

মৃত্তিকা রাস্তার পাশে এসে দাঁড়ায়। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা বার বার ওর দিকে তাকাচ্ছে। মৃত্তিক জানে ওটা ওর বাবারই লোক।

শরীফ এসে মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“জামাই কোথায়?”

মৃত্তিকা ছেলেটার দিকে ইশারা করে বলে,
“আপনার লোক জানায় নাই আপনাকে? (একটু থেমে) আর জামাই কি? ইমতিয়াজ বলেন।”

শরীফ হেসে বলে,
“আমার দোস্ত নাকি যে ইমতিয়াজ বলবো? আমার মেয়ের জামাই। অফিসে গেছে, আমি জানি।”
“মেয়ে আপনাকে মানে না আবার জামাই নিয়ে ডাকাডাকি।”

মৃত্তিকা রাস্তার দিকে নেমে গেলে শরীফ ওকে সরিয়ে এনে বলে,
“মায়ের মতো তুমিও চলে যেও না প্লিজ।”

মৃত্তিকা হাত সরিয়ে তাচ্ছিল্য করে বলল,
“মামকে যখন মা°রতেন, সি°গা°রেট জ্বালিয়ে ছ্যাঁ°কা দিতেন। তখন এই ভালোবাসা কোথায় ছিল? প্রতিরাতে যখন মাম চিৎকার করতো তখন প্রেম কোথায় ছিল?”

মৃত্তিকা ভিতরে যাওয়ার সময় ইমতিয়াজকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে দাঁড়ায়। ইমতিয়াজ শরীফকে লক্ষ্য করে।

“চলো।”
দুজনে ভিতরে চলে যায়। শরীফ বাইরে একা দাঁড়িয়ে থাকে।

সিঁড়ি দিয়ে উপরে যেতে যেতে মৃত্তিকা বলে,
“এবার আমি শিউর এসবে মামার হাত আছে। বড়মণির মতো শান্ত আর ভালো মানুষের সাথে কার শ°ত্রুতা থাকবে বলেন?”

ইমতিয়াজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আমার মনে হচ্ছে এবারে একটা বড় ধরনের অ্যা°ক°শন নেয়া উচিত।”
“তারচেয়ে একরাতে আমার থা°র্ড ডিগ্রিতে এমনিতেই মুখ খুলবে।”
“মৃত্তিকা।”

ইমতিয়াজের কড়া ভাষা শুনে মৃত্তিকা থেমে যায়। ওকে একহাতে আগলে নিয়ে বলল,
“ধৈর্য রাখো, এতো অধৈর্য হলে সমস্যা বাড়বে বৈ কমবে না।”
______________________________________

সকলে রাতের খাবার খেয়ে নিয়েছে। সকল প্লেট-বাসন নিয়ে রান্নাঘরে ধুতে গেছে সারাহ্। আম্বিয়া গিয়ে বলে,
“আমি সাহায্য করি?”

সারাহ্ একটু সরে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি করে নিবো, আপনি চাইলে হেল্প করতে পারেন।”

আম্বিয়া হেসে কাজ করতে করতে বলে,
“প্রে°শার কমে কেন হঠাৎ?”
“জানি না।”
“আহনাফ বলল তো তুমি খাওয়া দাওয়া করো না, ঠিকমতো ঘুমাও না।”

সারাহ্ মুচকি হাসে। আহনাফ রুমে যাওয়ার সময় জামিলকে রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে। আবারো নিজের ফোনে একটা ছবিও তুলে। জামিলের নজরটা খেয়াল করে আহনাফ রেগে যায়।

রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে জোরে চেঁচিয়ে বলল,
“ঐশী, এক্ষন রুমে আসো।”

সারাহ্ চমকে উঠে। আহনাফ এমন রাগ করে কখনো ডাকে না তো। সারাহ্ দ্রুত রুমে আসে।

“কি হয়েছে?”

আহনাফ দরজা লাগিয়ে দিয়ে সারাহ্-কে কাছে টে°নে এনে বলল,
“চুপ, একটা কথাও বলবা না। কাজ খালা এসে করবে, তোমার কিছু করা লাগবে না।”
“আহনা..”

সারাহ্-র ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে চুপ করিয়ে দিয়ে বলে,
“চুপ থাকতে বলেছি কিনা?”
“কেন রাগ হয়?”

আহনাফ দরজাটা একটু খুলে। সারাহ্-কে বলে,
“রুমে থাকবা, দরজার ওপাশে গেছো তো দেখবা কি করি?”

আহনাফ রুম থেকে বেরিয়ে যায়। সারাহ্ বিছানায় গিয়ে বসে। আহনাফের এ ধরনের আচরণ ওকে বারবার অবাক করে।

“ফুপা, বাইরে যাবেন?”

আহনাফের ডাকে আব্বাস সাহেব বললেন,
“কেন আহনাফ? রাতের বেলা বাইরে কি?”
“এমনিই বাবা, একটু হাঁটতে যেতাম আরকি। ভাবলাম ফুপাকে নিয়ে যাই।”

আব্বাস সাহেব হাসলেন। বলেন,
“ওহ, জামিল যাও।”

আহনাফ আগে আগে বেরিয়ে গিয়ে কল দিলো ওর ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ুয়া এক ছাত্রকে। তাকে কয়েকজন এলাকার ছেলে আর ব্যাট নিয়ে এদিকে আসতে বলে আহনাফ ফোন রাখে।

জামিল বেরিয়ে এসে বলল,
“কোথায় যাবে?”

আহনাফ মুখ টি°পে হেসে বলে,
“সামনেই।”

কুমিল্লা শহরে রাতেও লোকজন চলাচল করে। আহনাফ মেইনরাস্তা ছেড়ে খোলা মাঠের দিকে যায়। মাঠে ছেলেগুলো অপেক্ষা করছে। আহনাফকে দেখে হাত নাড়া দেয়।

“ওরা কারা?”
“আমার স্টুডেন্ট।”

আহনাফ গিয়েই এক ছেলের হাত থেকে ব্যাট নিয়ে জামিলের পায়ে বা°রি দিয়ে ফেলে দেয়। বেশ জোরেই দুই তিনটা বা°রি দিয়ে ফেলে।

“এসব কোন ধরনের অ°সভ্যতা আহনাফ?”

আহনাফ আবারো জামিলের পায়ে বা°রি দিয়ে বলল,
“ঐশীর দিকে বারবার তাকানোর সাহস কেন করছো তুমি?”
“বউ প্রেগন্যান্ট বলে এতো কেয়ার?”

আহনাফ বসে তার মুখে কয়েকটা ঘু°ষি দিয়ে দেয়। জামিলের ফোন বেজে উঠে। জামিল ধরার আগেই আহনাফ ছোঁ দিয়ে ফোন নিয়ে ছেলেগুলোকে ইশারা করে ওকে আটকাতে।

অপরূপা নামটা দেখে রিসিভ করলে অপরপাশ থেকে নারী কন্ঠ বলে উঠে,
“ছবিটা ভালো এসেছে। লাস্ট কাজ, সারাহ্-কে উঠিয়ে নিয়ে আসো।”

আহনাফ জামিলের দিকে রাগি চোখে তাকায়। অপরূপা বলে,
“শুনতে কি পারছো না আমি কি বলছি?”
“ঐশীর দিকে নজর দিও না, ফলাফল খারাপ হবে।”

আহনাফ কল কে°টে জামিলকে বলে,
“কে এটা?”

জামিল হেসে বলল,
“জানতে পারবে না, আহনাফ। তোমার স্ত্রী আর বেবিকে বেশিদিন দেখতে পারবে না। তাহসিনার কাছেই পাঠিয়ে দিবো।”

তড়তড় করে রাগটা বেড়ে যায় আহনাফের। জঘন্যভাবে মা°রে জামিলকে। নিজেও হাতে ব্য°থা পায়। জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে নিতে ফিরে আসে।

আবারো ফিরে গিয়ে বলল,
“কেন করছো এসব?”
“তোমার শাশুড়িকে জিজ্ঞাসা করো।”

আহনাফের মনে পড়ে তানজিমের সেই কথা, তোমার বিয়েটাও পরিকল্পিত। সারাহ্-র শোনা সেই কথা আর নার্গিস পারভিনের অস্বাভাবিক আচরণ।

দ্রুত বাসায় আসে আহনাফ। আব্বাস সাহেব ওকে একা দেখে জিজ্ঞাসা করে,
“জামিল কোথায়?”

আহনাফ দুই আঙ্গুল তুলে বলল,
“স্মো°কিং করছে।”

আহনাফ রুমে চলে যায়। সারাহ্ ফোনে কোনো একটা ভিডিও দেখছে। আহনাফ রুমে আসায় ফোন রেখে বলল,
“কোথায় গিয়েছিলেন?”

আহনাফ এসে ওকে জড়িয়ে ধরে। সবকিছু এখনো ওর কাছে অগোছালো। এলোমেলো থাকাটাই স্বাভাবিক।

সারাহ্ বলল,
“কি হয়েছে?”

সারাহ্-র দিকে তাকিয়ে ওর গালে হাত রেখে বলল,
“আমি জানি না কি আমার কি হয়েছে।”
“কোথায় গিয়েছিলেন?”
“মিস করছিলে খুব?”

সারাহ্ ওর বুকে একটা ধা°ক্কা দিয়ে বলে,
“ধুর।”
______________________________________

একসপ্তাহ পেরিয়ে গেল। মমতাজ বেগম আর লুৎফর রহমান সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে এসেছে। মৃত্তিকা উনাদের বাসায়ই আছে। উনাদের সেবাযত্ন করার মতো কেউ তো নেই এখানে। তানজিম যদিও এতে রাজি ছিল না, তবে তেমন একটা বাধাও সে দেয়নি।

রাত সাড়ে আটটা, অফিস শেষে ইমতিয়াজ বাসায় আসে৷ আগের চাকরি ছেড়ে দিয়ে কোম্পানির কাজে পুরোপুরি মনোযোগ দিচ্ছে সে। রমজানের পর ট্রেনিংয়ের জন্য অস্ট্রেলিয়া যাবে সে।

বেল বাজালে তানজিম এসে দরজা খুলে। ইমতিয়াজ ভিতরে যায়। তিনরুমের বাসায় তাহমিনার সাথে ইমতিয়াজ যে রুমে থাকতো সেখানেই দুইদিন ধরে থাকছে মৃত্তিকার সাথে। বিষয়টা স্মৃ°তিতে আ°ঘা°তের মতো হলেও শক্ত মানসিকতার ইমতিয়াজ এসব সহ্য করতে পারে। দিনটুকুই কেবল থাকা হয়, রাতে মৃত্তিকা মমতাজ বেগমের সাথেই সাথে আর লুৎফর রহমান থাকে তানজিমের সাথে।

ইমতিয়াজ ফ্রেশ হয়ে আসে। মৃত্তিকা এসে জিজ্ঞাসা করে,
“দুলাল ফেরদৌসীর কি খবর?”

ইমতিয়াজ শার্ট খুলতে খুলতে বলল,
“কি আর হবে? আমাকে হেয় করার যত প্রকার উপায় আছে সব কাজে লাগাচ্ছে।”

মৃত্তিকা গিয়ে ওর শার্টের বোতামগুলো একে একে খুলে দেয়। শার্টটা হ্যাংগারে ঝু°লিয়ে দিয়ে বলে,
“কি বলে আবার?”
“কি আর? ওই বউয়ের কোম্পানিতে আছো। (একটু থেমে) আই ডোন্ট কেয়ার, যা খুশি বলুক।”

মৃত্তিকা ফিরে তাকিয়ে আলতো হাসলো। বলে,
“হাতমুখ ধুয়েছেন?”
“হুম।”

মৃত্তিকা বেরিয়ে যেতে নিলে ইমতিয়াজ বলল,
“মামা এসেছিল?”
“এসেছিল, দুপুরে একগা°দা গিলে গেছে।”
“কেইসটা ক্লোজ করে দিয়েছে, সমস্যা দুধটা মেয়াদ উত্তীর্ণ ছিল এটা বলেছে।”

মৃত্তিকা এগিয়ে আসে।
“দুধ মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে ছানা কে°টে যায়।”
“সমস্যা তাদের কে বোঝাবে?”

হঠাৎ লোডশেডিং হলো, কিন্তু জেনারেটর চালু হলো না।

“জেনারেটরের আবার কি হলো?”

মৃত্তিকা ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বা°লালো। ইমতিয়াজ ফোনটা খাটে ছু°ড়ে ফেলে মৃত্তিকাকে কাছে টা°নে। দুজনে কাছাকাছি, নিশ্বাসটুকুও মিলেমিশে একাকার। একই চাহিদা, একই আবেগ দুজনের। মৃত্তিকার কেঁপে উঠা ওষ্ঠোধর প্রথমবারের মতো কোনো পুরুষের ওষ্ঠের স্পর্শে সিক্ত হয়। দুরত্বটুকু শেষ করার ইচ্ছায় দুটো মন যখন পাগল হয়ে উঠে তখনই মমতাজ বেগম মৃত্তিকাকে ডেকে বলে,
“মিউকো, লাইট জ্বা°লিয়ে দিয়ে যাও।”

মৃত্তিকা সরে আসতে চাইলে ইমতিয়াজ ওকে আরো কাছে নিয়ে নেয়। আবারো মমতাজ বেগম ডাক দিলে ইমতিয়াজ হাতের বাঁধন হালকা করে, মৃত্তিকা উঠে চলে যায়।

চার্জার লাইট জ্বা°লিয়ে মমতাজ বেগমের রুমে দিয়ে মৃত্তিকা রান্নাঘরে চলে আসে। নিজেকেই যেন লজ্জা লাগছে তার।

চলবে….

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

ত্রয়োত্রিংশ পর্ব (৩৩ পর্ব)

রাতের খাবার টেবিলে সাজাচ্ছে মৃত্তিকা। ইমতিয়াজ এসে চেয়ার টে°নে বসে ওর দিকে না তাকিয়েই বলল,
“পালিয়ে আসলে যে আর গেলে না?”

মৃত্তিকা চমকে উঠে তাকায়। লজ্জায় লাল হয়ে গেছে মেয়েটা। ইমতিয়াজ মুখ টি°পে হাসে। তানজিম এসে বসতে বসতে বলল,
“ক্ষুধা লাগছে। খাবার রেডি?”

মৃত্তিকা কিছু না বলে মমতাজ বেগম আর লুৎফর রহমানের প্লেট সাজিয়ে নিয়ে যায়। শান্ত পরিবেশে খাওয়া দাওয়া শেষ হয়। তানজিম সব থালাবাসন ধুয়ে রেখে মৃত্তিকাকে বলে,
“আপু আমার কিন্তু মিডটার্ম এক্সাম শুরু রবিবার থেকে, সো আমি পড়বো আজকে সারারাত। ফজরের সময় ডেকে দিও।”

মৃত্তিকা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। শিল্পা ইউনুস, মৃত্তিকার পিএ ওকে কল দেয়ায় মৃত্তিকা কথা বলতে গিয়েও থেমে যায়।

“ম্যাম।”
“ইয়েস।”
“ম্যাম, আপনি একবার অফিসে আসলে ভালো হয়।”

মৃত্তিকা অবাক হয়। ইমতিয়াজ যেহেতু যাচ্ছে তাই ওর যাওয়ার কি প্রয়োজন।

“কেন শিল্পা?”
“ম্যাম, দুলাল স্যার আজ চারদিন হলো অফিসে আসে না আর উনার বাসা গিয়েছিলাম আজকে, উনারা জানিয়েছে উনি নাকি অফিসের কাজে জার্মানি গেছেন। কিন্তু এমন কোনো প্রোগ্রাম তো এখন নেই, আবার ইমতিয়াজ স্যার এটা নিয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হয়নি।”

মৃত্তিকা কপাল কুঁচকায়। ইমতিয়াজ একটু আগে ওকে বলেছিল দুলাল ফেরদৌসী অফিসে আসে, তাকে হে°য় করে। তবে শিল্পা কেন বলছে দুলাল অফিসে আসে না?

“আচ্ছা, শিল্পা। আমি আসতে চেষ্টা করবো, না আসলেও অফিসের কাজ যেন বন্ধ না হয়।”
“ওকে ম্যাম।”

মৃত্তিকা রুমে এসে নক করে বলে,
“আসবো?”
“আসো।”

ইমতিয়াজের অনুমতি পেয়ে মৃত্তিকা ভিতরে প্রবেশ করে। ইমতিয়াজ বিছানায় শুয়ে বিড়ালটার সাথে খেলছিল। মৃত্তিকাকে দেখে রেখে উঠে বসে বিড়ালকে নিচে ছেড়ে দেয়।

মৃত্তিকা ওর মুখোমুখি বসে বলল,
“দুলাল ফেরদৌসী অফিসে আসে না কয়দিন?”

ইমতিয়াজ হেয়ালি করে বলে,
“এসেছিল, আর যেতে দেইনি।”
“মানে? আ°টকে রেখে মি°থ্যা ছড়িয়েছেন?”
বি°ভ্রা°ন্তি নিয়ে চোখ ছোট করে মৃত্তিকা।

ইমতিয়াজ হেসে বলে,
“বিশ্বাস রাখো। কথা জানবো যেহেতু বলেছি সো জেনেই ছাড়বো। (একটু থেমে) তোমার ওয়েতেই জানবো, চিন্তা নেই।”
“কোন ওয়ে?”
“থা°র্ড ডিগ্রি।”
বলে ইমতিয়াজ চোখ টিপ দেয়।

মৃত্তিকা চোখ বড় করে তাকিয়ে বলল,
“তারমানে তাকে আপনি মে°রেছেন? কোথায় আছে এখন?”
“শিল্পাকে জিজ্ঞাসা করলে এটার এন্সারও বুঝে যেতে।”
“আহা, ক্লিয়ার করুন।”

মৃত্তিকাকে কাছে নিয়ে আসে ইমতিয়াজ। বলে,
“হুশ, এতো কথা বলতে পারবো না।”

ইমতিয়াজের কথার ভাষায় হঠাৎ বিরাট এক পরিবর্তন। মৃত্তিকাও কথা বলে না, চুপটি করে মাথা নুইয়ে ফেলে।

ডানহাতের তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে মৃত্তিকার ঠোঁটে স্পর্শ করে। ইমতিয়াজের টিশার্ট খা°মচে ধরে চোখে চোখ রাখে মৃত্তিকা, যেন বলতে চাইছে “পাগল করে দাও আমাকে।”

নিরব মৃত্তিকার চোখের ভাষা ইমতিয়াজ বুঝে ফেলে। আবারো এক হয় তাদের ওষ্ঠোধর জোড়া। এবারে ইচ্ছাকৃতভাবে আলো নিভিয়ে দেয় ইমতিয়াজ। অন্ধকারে নিরব কক্ষে দুজন নর-নারীর নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে, ক্রমশ কাছে আসছে দুজন। একই চাওয়া, একই পাওয়া, একই কথা বলার ইচ্ছা। কিন্তু দুজনে চুপ। ইমতিয়াজের হাতের স্পর্শে নিজের হু°শ জ্ঞান হারিয়ে বসেছে মৃত্তিকা। যেন মধ্যিখানের সব দুরত্ব আজকেই শেষ করবে সে।

ইমতিয়াজের ফোন বেজে উঠে। হঠাৎ শব্দে মৃত্তিকা সরে যায়, নিজেকে গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়। শরীফের নাম্বার দেখে ইমতিয়াজ রিসিভ করে।

“জি, বলেন।”
“দুলাল নেই এখানে, সম্ভবত পালিয়েছে।”

ইমতিয়াজ রেগে যায়। তবুও নিজেকে শান্ত রেখে বলে,
“বের হওয়ার উপায় কম, সে রাস্তা খুঁজছে বোধহয়। (একটু থেমে) আচ্ছা, আমি আসছি।”

ইমতিয়াজ ফোন রেখে উঠে শার্ট পড়তে পড়তে বলে,
“আমি একটু বাইরে যাচ্ছি, আসতে দেরি হবে বা রাতে নাও আসতে পারি।”
“যাচ্ছেন কোথায়? কে কিসের রাস্তা খুঁজছে?”
মৃত্তিকার চোখেমুখে কৌতুহল।

“ফিরে এসে বলছি।”
কথাটা বলেই ইমতিয়াজ বেরিয়ে গেল। মৃত্তিকা সদর দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়।

ইমতিয়াজ সোজা ফ্যাক্টরির গোডাউনে এসেছে। শরীফ এখানেই দাঁড়িয়ে আছে। ইমতিয়াজ এসে ধ°মকে উঠে বলল,
“আপনার এতো লোকজন কি শুধু মৃত্তিকার জন্য? একটা মানুষকে দেখে রাখতে পারেন না?”

শরীফ বলে,
“খুঁজে দেখছে ওরা।”

ইমতিয়াজ কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দুলালকে সে আর শরীফ মিলে চারদিন আগেই পা°কড়াও করেছে। বেঁধে রেখেছে ফ্যাক্টরির গোডাউনে, খাবার বলতে শুকনা মুড়ি আর পানি। আর নিয়ম করে তিনবেলা অ°সহ্য মা°র মেরেছে, তবুও সে এখনো মুখ বন্ধ করে রেখেছে।

ঘন্টা খানেক পর দুলালকে খুঁজে পাওয়া যায়। দুর্বল শরীরে বেশিদূর যেতে পারেনি। হাতপা বেঁধে এনে ফেলা হয়।

ইমতিয়াজ ঠোঁট উলটে শরীফকে বলে,
“আপনি ডাক্তার হয়েও মা°স্তা°নিতে সেরা।”
“শিখে না এসব, আমার মেয়েটা ভ°য় পাবে।”

ইমতিয়াজ মুচকি হাসে। একটু আগের মৃত্তিকার মলিন চেহারা মনে পড়ে তার। আবারো সেই লাজুক চোখের কথা ভেবে হাসি পায়।

দুলালের কথায় ঘোর কাটে,
“কতদিন আ°টকে রাখবে? বের কি আমি হবো না নাকি?”

ইমতিয়াজ হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“হ্যাঁ, সাদা কা°ফ°নে মুড়ে বের হলে হতে পারো। তবে যদি মুখ না খুলো তবে তাও পারবে না।”
“মুখ খুললেও মা°রবে?”
“মৃত্তিকাকে কেন মা°রতে চেয়েছিলে?”

দুলাল কঠিন কন্ঠে বলে,
“ভুল এটাই করেছিলাম আমরা। তাহমিনা আর তাহসিনার সাথেই কবরে গেছে সব সত্যটা, মৃত্তিকা তো কিছুই জানেনি। ওকে মা°রতে গিয়েই ভুল করেছি, সব আবারো জানাজানি হয়েছে।”

ইমতিয়াজের দিকে এগিয়ে এসে বলে,
“তাহমিনা কিন্তু মৃত্তিকার থেকে বেশি চতুর ছিল, আর অতি চালাকের গলায় সবসময়…”

দুলালের গালে চ°ড় বসায় ইমতিয়াজ। শরীফকে বলে,
“ওকে পানি, খাবার কিছুই দেওয়া হবে না।”
______________________________________

পরদিন সকাল সকাল ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে আহনাফ ও সারাহ্। সারাহ্-কে একা রেখে আহনাফ আসতে পারবে না। আহনাফ চিন্তিত ওকে নিয়ে।

সারাহ্ ওর কাঁধে মাথা রেখে বলল,
“এতো কি নিয়ে চিন্তা করেন?”

সারাহ্-কে একহাতে জড়িয়ে ধরে আহনাফ বলে,
“কিছু না।”

আহনাফ সামিহাকে কল দেয়। সামিহা রিসিভ করেই বলে,
“ভাইয়া, আপনারা কোথায় আছেন?”
“চান্দিনার কাছে, তুমি কি আজ বাসায় না?”
“হ্যাঁ, ভাইয়া। শুক্রবার কোথায় আর যাবো।”
“গুড, বাসায়ই থাকবা।”

আহনাফ ফোন রাখলে সারাহ্ বলল,
“হঠাৎ ঢাকায় কেন যাচ্ছি আমরা?”
“পড়ে বলবো।”

খুব একটা কষ্ট হয় না ওদের ঢাকায় পৌঁছাতে। মতিঝিল সারাহ্-র বাসায় এসে আহনাফ নার্গিস পারভিনের সাথে কথা বলতে যায়। জাহাঙ্গীর সাহেব বাসায় নেই। দুইবোন নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতায় ব্যস্ত।

নার্গিস পারভিন রান্নাঘরে কাজ করছেন। আহনাফ গিয়ে দরজায় নক করে ডেকে বলল,
“মা, কথা আছে একটু।”

উনি তো চমকে উঠেন। জামাই কিনা শেষে রান্নাঘরে এসে উনাকে ডাকছে।

“আসছি।”

নার্গিস পারভিন চুলা নিভিয়ে ড্রইংরুমে গেল। আহনাফ সোফায় বসেছে, উনিও বসেন। আহনাফ সরাসরি প্রশ্ন করে,
“সারাহ্-কে কেউ কেন কি°ড°ন্যাপ করতে চায়? কি জানেন আপনি?”

নার্গিস পারভিন চমকে উঠেন। উনার মেয়েকে কেউ অ°প°হরণ করতে চায়, এ ধরনের কথা শুনে হতবাক হন।

“জামিল আমাকে বলেছে কারণ আপনি জানেন, কি জানেন আপনি?”

নার্গিস পারভিন বুঝতে পেরেছেন কিছুই আর লুকানোর সময় নেই। পুরোনো ইতিহাসে টা°ন যেহেতু পড়েছে, তাই ইতিহাসের ইতি টা°নতেই হবে। আজ যদি উনি চুপ থাকেন তবে হয়তো উনার মেয়েকে হারাবেন।

আহনাফ নিচুস্বরে বলল,
“ঐশী প্রেগন্যান্ট মা, ও কিন্তু একা হারাবে না।”

নার্গিস পারভিন আরো চমকে উঠেন। খুশির সংবাদ শুনেও হাসবেন নাকি কাঁদবেন বুঝতে পারেন না। শান্তভাবে জবাব দেয়,
“সবটাই বলবো, কিন্তু সমাধান আমার কাছে নেই।”
“আপনি শুধু বলুন মা।”

অসহায় কন্ঠের অনুরোধ আহনাফের। তাহসিনার মতো আরো একটা প্রাণ ঝ°রবে, ওর ভালোবাসা টুপটুপ করে ঝ°রে পড়বে।

জাহাঙ্গীর সাহেব বাসায় আসলেন। আহনাফকে দেখে ওর সাথে কোলাকুলি করেন। নার্গিস পারভিন এখন আর কথাটা বলতে পারে না।
______________________________________

সন্ধ্যায় ইমতিয়াজ আবারো গোডাউনে আসে। এখন সঙ্গে মৃত্তিকাও এসেছে। শরীফ এখানে নেই, তবে তার দুজন লোক এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ইমতিয়াজ ওদেরকে বাইরে যেতে ইশারা করে।

সারাদিন পানি না খেয়ে দুলালের গলা ঠনঠন করছে। ঢোক গিলে বারবার জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিচ্ছে, কিন্তু তার চোখেমুখে অসহায়ত্ব।

মৃত্তিকা একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। ইমতিয়াজ তার সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে বোতল খুলে পানি পান করে বলল,
“পানি খাবে?”
“হ্যাঁ।”
মাথা নেড়ে মলিন সুরে বলল দুলাল।

ইমতিয়াজ বোতলের পানি তার সামনে ঢালতে থাকে। জিভ বের করেও পানি মুখে নিতে পারে না দুলাল। ইমতিয়াজের এমনরূপ মৃত্তিকা আগে দেখেনি। এতোটা ভ°য়ং°করভাবে কাউকে কষ্ট দিচ্ছে সে।

পুরো বোতলের পানি ঠেলে ইমতিয়াজ বলে,
“একটুও ভিতরে যায়নি। আরেক বোতল আছে।”

আরেকটা বোতল এনে একটু দূরে রেখে বলল,
“একটা একটা করে কথা বলবে আর বোতলটা এগুবে। (একটু থেমে) শুরু করো।”

দুলাল মৃত্তিকার দিকে তাকালো। মৃত্তিকা মুখ ফিরিয়ে নেয়। এসব মানুষের কষ্ট প্রাপ্য। কর্মের ফল এগুলো। বিয়ের দিন একটা মেয়ের স্বপ্ন ধ্বং°স করার শা°স্তি এটা, স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখে থাকতে চাওয়া মেয়েটার সুখকে শেষ করার শা°স্তি এটা, একটা মেয়ের থেকে তার প্রাণপ্রিয় মাকে কে°ড়ে নেয়ার শা°স্তি এটা।

“মুখ খুলবে না, তবে এটাও ফেলে দিই।”

ইমতিয়াজ বোতলটা ধরতেই দুলাল বলে,
“বলছি আমি।”
“বলো।”

ইমতিয়াজ দুলালের মুখোমুখি একটু দূরে বোতলটার কাছে বসে পড়ে। দুলাল আড়চোখে মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে বলে,
“ওকে যেতে বলো।”

ইমতিয়াজ বোতলটা হাতে নিয়ে বলে,
“বলো, আমার এতো সময় নেই।”

দুলাল আর কোনো উপায় না পেয়ে বলা শুরু করে। মৃত্তিকাও মোবাইলের ভিডিও চালু করে।

“খু°নের সময় আমি উপস্থিত ছিলাম। এমনকি শাফিনও ছিল। রোড এ°ক্সি°ডেন্ট ছিল না ওটা, আলাদাভাবে খু°ন করে এ°ক্সি°ডেন্টের নাটক বানানো হয়েছে।”

মৃত্তিকা একহাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে। আলাদাভাবে খু°ন হলে কতই না কষ্ট পেয়েছে ওরা। ইমতিয়াজ ঢোক গিলে তাকিয়ে থাকে।

“শাফিন আর আমার একটা বিজনেস আছে। অন্ধকার জগতের বিজনেস সেটা৷
“কি বিজনেস? ড্রা°গস?”

দুলাল ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল,
“তারসাথে আরেকটা ভালো বিজনেস হলো নারী। দামী বস্তুর চেয়েও হাজারগুণ দামী। (ঢোক গিলে) তাহসিনার সাথেও একই কাজ করতে চেয়েছিল শাফিন, তাই ওর বিয়েটা সে মানতে পারেনি। (একটু থামে) বিয়ের দিন তাহসিনাকে উঠিয়ে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ব°দ°নাম দিতে চেয়েছিল। তাহমিনা জেনে গিয়েছিল আমাদের প্ল্যান, তাই এটা নিয়ে ঝা°মেলা করেছিল সে।”

ইমতিয়াজের মনে পড়ে বিয়ের আগের দিন তাহমিনা চিন্তিত ছিল, অন্যদিনের চেয়ে চুপচাপ হয়ে ছিল। ইমতিয়াজ ভেবেছিল বোনের বিয়েই তার কারণ। সে চোখ বন্ধ করে।

দুলাল বলে চলছে,
“তাই দুইবোনকে একজায়গায় শেষ করে দিয়েছে। (একটু থেমে) যা জানতাম সবই বলেছি, এখন একটু পানি দাও।”

মৃত্তিকা ভিডিও সেভ করে ফোন ব্যাগে রাখে। ইমতিয়াজ বোতল খুলে তাকে পানি খাইয়ে দেয়, তবুও হাত খুলে না। পানি পান করে দুইবার কাশি দেয় দুলাল।

ইমতিয়াজ উঠে দাঁড়িয়ে মৃত্তিকাকে বলে,
“চলো, যাই আমরা। বাকিটুকু সে কাল বলবে।”

দুজনে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে, দুলাল আবারো বলে,
“বাকিটুকু হলো তাহমিনাকে মা°রার আগে রে°প করা হয়েছিল। ইমতিয়াজ, ইমতিয়াজ করে চিৎ°কার করেছিল সে। তাহমিনাকে মা°রা লাগেনি, অতিরিক্ত র°ক্ত°ক্ষরণে সে এমনিতেই মা°রা গেছে।”

ইমতিয়াজ থমকে দাঁড়ায়। যেন একমুহূর্তে পুরো পৃথিবী স্থির হয়ে গেছে। মৃত্তিকা চেয়ে রইলো ইমতিয়াজের দিকে। মানুষটা কিভাবে সহ্য করবে এটা?

“রে°পটা কিন্তু শাফিনই করেছে।”

মৃত্তিকা পিছিয়ে গিয়ে একটা কার্টুন বক্সের সাথে ধা°ক্কা খায়। মামা তার খারাপ, তাই বলে এতোটা?

ইমতিয়াজ ফিরে গিয়ে দুলালের নাকে মুখে এলোপাতাড়ি ঘু°ষি দেয়। নাকমুখ দিয়ে সমানে র°ক্ত পড়তে থাকে তার। ইমতিয়াজের মুখে একটাই কথা,
“এসব মি°থ্যা, বল মি°থ্যা এসব।”

শরীফ এসে এ অবস্থা দেখে ইমতিয়াজকে ধরে সরিয়ে আনে। র°ক্তা°ক্ত মুখ নিয়ে দুলাল বলে,
“সবটাই সত্য।”

ইমতিয়াজ শান্ত হয়ে গেছে। তাহমিনা ওকে ডেকেছিল, প্রাণপণে ডেকেছিল অথচ সে সারা দেয়নি।

“মিনার মৃ°ত্যু আমার জন্য হয়েছে।”
আপনমনে বিড়বিড় করে ইমতিয়াজ। তারপর দাঁড়ানো অবস্থা থেকে সোজা বসে পড়ে।

শরীফ ধরার আগেই মৃত্তিকা দৌড়ে গিয়ে ওকে ধরে ফেলে।
“নিজেকে ব্লেইম করবেন না।”
“আমি দোষী, আমাকে মে°রে ফেলো মৃত্তিকা। আমার সন্তান আমাকে ডেকেছে, আমার মিনা আমাকে ডেকেছে, আমি যাইনি তাদের কাছে।”

সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলেছে ইমতিয়াজ। মৃত্তিকা ওর মাথা নিজের বুকে চেপে ধরে। এমন সত্য সহ্য করা কার পক্ষে সম্ভব? মৃত্তিকার দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে।

ইমতিয়াজ মৃত্তিকাকে সরিয়ে উঠে বাইরে চলে আসে। মৃত্তিকা পিছুপিছু আসলে বলল,
“এসো না তুমি, এই কাপুরুষের কাছে এসো না। যে তার স্ত্রী-সন্তানকে রক্ষা করতে পারে না, তার কাছে এসো না।”
একপ্রকার দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলো মৃত্তিকাকে।
______________________________________

“আমার এক ফ্রেন্ড ছিল, রিপা। দেখা হয়েছে বহু আগে। মূলত এসব ঘটনা ওর জীবন থেকে শুরু হয়েছে আর শেষটা হয়েছে কলেজে।”

নার্গিস পারভিন, জাহাঙ্গীর সাহেব আর আহনাফ তিনজনে ছাদে এসেছে কথা বলতে। মূলত আহনাফ সারাহ্-কে কোনো চিন্তায় এখন ফেলতে চায় না বলেই এখানে এনেছে উনাদের। একটু আগের কথাটা নার্গিস পারভিনই বলেছেন।

“কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে অনার্স করেছি আমি। রিপাও ওখানে পড়েছে। রিপার গ্রামের বাড়ি ছিল খুলনায়, কিন্তু পড়াশুনা কুমিল্লায়। (একটু থামে) একসময় ওর পরিবার কুমিল্লা শিফট হয়, ওর ভাই এক চরিত্র°হীন লোক ছিল।”

আড়চোখে জাহাঙ্গীর সাহেবের দিকে তাকায়। নিচুস্বরে বলেন,
“আমার অন্য দুই ফ্রেন্ড শুধু তার খারাপ প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় প্রাণ হারায়। কিন্তু বিষয়টা তখন খু°নের মতো লাগেনি, বরং আ°ত্ম°হ°ত্যা লেগেছে। তার প্রায় দশবছর পর রিপা আমাকে জানায় এসব খু°ন। ও নিজে তার ভাইয়ের থেকে গোপনে শুনেছি আর ওর আসল নাম নাকি রিপা ছিলই না, রাহা সুলতানা ছিল ওর নাম।”

নার্গিস পারভিন দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। মাথা নেড়ে বলেন,
“দুনিয়া গোল রিপা বারবার আমার আর রোমির সাথে দেখা করতো, কয়েকটা প্রমাণও দিয়েছিল রোমিকে। এই যেমন কিছু সন্দেহজনক ফটোগ্রাফ আর ভিডিও, যদিও আমি তা দেখিনি। শেষবার যখন সে ঢাকায় আসে তখন আমাকে বলেছিল ওরা আমাদের কথা জানতে পারলে খারাপ হবে। সাবধানে থাকতে। আমার মনে হয় সারাহ্-র উপর এরই প্রভাব।”

জাহাঙ্গীর সাহেব রেগে গিয়ে বলেন,
“এতোদিন আমাকে জানাও নি কেন?”

আহনাফ শান্তসুরে বলে,
“মা, আপনি হয়তো কোথাও ভুল। এর সাথে সারাহ্-র কি সংযোগ আর আমার কি সংযোগ?”
“সারাহ্ আমাকে একটা কথা জানিয়েছিল একবার, ও এয়ারপোর্টে যা যা শুনেছে তা নিয়ে। তখনও আমার এটাই মনে হয়েছিল।”

জাহাঙ্গীর সাহেবের কপাল কুঁচকে আসলো। বললেন,
“এটা মনে হওয়ার কোনো বিশেষ কারণ?”
“রিপার ভাই হয়তো জানতো রিপা আমাদের সাথে দেখা করে।”

আহনাফ মাথা নেড়ে না বোঝায়। এসব বিষয় আর সারাহ্-র বিষয়টা ওর আলাদা লাগছে। আবারো জিজ্ঞাসা করে,
“জামিলের সাথে রিলেটেড কোনো ঘটনা আছে?”

নার্গিস পারভিন একটু ভেবে বলেন,
“জামিল নামের কাউকে আমি চিনি না, তবে রিপার ভাইয়ের নাম শাফিন ছিল।”
“শাফিন?”
“হ্যাঁ।”

আহনাফ চমকে উঠে। রিপা, শাফিন নামদুটোই তার চেনা। এরা তাহসিনার খালা আর মামা নয়তো? তবে তো তানজিমের কথাই ঠিক, সবকিছুই পরিকল্পিত। তার অর্থ তানজিম আরো অনেক কিছু জানে।

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে