Wednesday, July 9, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 341



অনুভূতিরা শব্দহীন পর্ব-৬৩+৬৪

0

(সতর্কতা- নৃ°শং°স খু°নের বর্ণনা আছে, নিজ দায়িত্বে পড়বেন।)

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

পর্ব ৬৩

নিয়াজী এখন অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছে৷ শরীফের চিকিৎসাতেই সুস্থ হয়েছে। এখন সে বাসায় যাওয়ার জন্য একদম ঠিকঠাক আছে। আর কোনোভাবে সে আহনাফ কিংবা ইমতিয়াজের হাতে পড়তে চায় না।

ঘড়ি দেখাচ্ছে সকাল সাতটা বেজেছে, নিয়াজী হাসপাতালের ছোট বিছানা থেকে উঠে নিজের প্রয়োজনীয় কিছু একটা খুঁজতে, খুব স্বভাবতই তা ফোন। তবে পায় না।

“কিছু খুঁজছো নাকি?”

শরীফ এসে রুমে প্রবেশ করে। নিয়াজী ওকে দেখে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,
“হ্যাঁ, আমি আসলে বাসায় যেতে চাই।”

“আসল ঠিকানায় যাবে? চলো, পৌঁছে দেই।”

নিয়াজী সরতে পারে না, শরীফ ওকে বিছানার সাথে চেপে ধরে বলে,
“রিপাকে মা°রধর করেছি এটাই পৃথিবী দেখেছে, কিন্তু ওকে যে আমি ভালোবেসেছি সেটা কেউ দেখেনি। ওকে মা°রা তোমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।”

নিয়াজী শরীফকে ধা°ক্কা দিয়ে বেরিয়ে যেতে চায়, কিন্তু এবারে সে চির ব্যর্থ হলো। ব্যর্থতাকে আর টপকাতে পারে না।

পি°স্তলে সাইল্যান্সার লাগানো থাকায় শব্দ হয় না, তবে গু°লি চলে। কপাল ভেদ করে চলে যায় গু°লিটি। সাদা বিছানা, সাদা টাইলসের মেঝেতে যেন কেউ আলপনা এঁকেছে। র°ক্তের আলপনা। শেষ নিশ্বাস বের হয়েছে নিয়াজীর।

নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা সেও করেছে। তাহসিনা, তাহমিনা বা রিপা বেগমের মতো সেও বেঁচে থাকার আকুতি ছিল তার চোখেমুখে, কিন্তু বাঁচতে পারেনা।

কপালে একটা গোলাকার গু°লির চিহ্ন, র°ক্তে মাখোমাখো হয়ে আছে। সেই ছিদ্র দিয়ে এখনো বের হচ্ছে টাটকা র°ক্ত।

শরীফ বাইরে এসে ইশারা করলে চারজন লোক নিয়াজীর দেহ নিয়ে ম°র্গে চলে যায়। শরীফ শান্তভাবে হেঁটে নিজের চেম্বারে চলে আসে। চোখের সামনে ভেসে উঠে পুরোনো কথা।

“আমাদের মেয়ের নাম হবে মৃত্তিকা। সুন্দর না নামটা? আমি আগে থেকেই এটা ভেবে রেখেছিলাম।”
মেয়েকে কোলে নিয়ে কথাটা বলে রিপা।

“কি করে বুঝেছিলে মেয়ে হবে?”

“মায়েরা বুঝতে পারে।”

রিপার কথা মনে করে কান্না পায় শরীফের। চোখের পানি বাঁধনহারা হয়ে গড়িয়ে পড়ছে৷ বয়সের এই প্রান্তে এসে ডি°ভোর্স হয়ে যাওয়া স্ত্রীর জন্য কান্না করাটা বেমানান। কিন্তু ভালোবাসা যে বাধা মানে না।
______________________________________

এলার্জি হয়ে মৃত্তিকার হাত-মুখ-গলা লাল হয়ে আছে। আয়নার সামনে নিজের এ অবস্থা দেখে বলে,
“কি হয়েছে দেখেছেন?”

ইমতিয়াজ অফিসে যেতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওর কথায় ভালো করে দেখে বলল,
“আজকে বিকালে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। হঠাৎ এমন হলো কেন?”

“জানি না।”

মৃত্তিকা ছোট করে জবাব দিয়ে নাস্তা তৈরি করতে চলে যায়। টেবিলে নাস্তা রেখে অপরূপার দিকে আড়চোখে কয়েকবার তাকালো।

অপরূপা মৃদু হেসে বলল,
“সকালে অন্য মেয়েদের গায়ে লাভ বাইট থাকে আর তোমার এলার্জি? বাহ, বাহ।”

ঘর থেকে ইমতিয়াজ কথাটা শুনে। সে বেরিয়ে এসে বলল,
“আমার স্ত্রীর লাভ বাইট দেখার শখ তোমার জাগে কেন? এধরনের ফালতু কথা আরেকবার শুনলে খুব খারাপ হবে।”

মৃত্তিকা নাস্তা নিয়ে রুমে চলে যায়। বিছানায় খাবার রেখে গাল ফুলিয়ে বসে থাকে। ইমতিয়াজ ওর মুখোমুখি বসে ওর মুখের সামনে খাবার তুলে বলল,
“খাবে না?”

মৃত্তিকা খাবার মুখে নিয়ে বলে,
“কি করবেন ওকে দিয়ে?”

“অফিসারদের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা করবো।”

“যদি শাফিনের আরো লোক থাকে? আর ওকে আর শাফিনকে বাঁচিয়ে নেয়।”

“সম্ভাবনা কম, শাফিনের অবস্থা এমনিতেই খুব খারাপ। ওর লোকেরা ওর সাহায্য আর করবে বলে মনে হয় না।”

“আপনি যে বলেছিলেন এবারে শাফিনকে অন্য ফাঁ°দে ফেলবেন। ওর এ অবস্থায় কিভাবে সম্ভব?”

ইমতিয়াজ মাথানেড়ে খেতে থাকে। চুপচাপ খাওয়া শেষ করে বলল,
“চাইলে এ অবস্থায়ও সম্ভব। অফিসার গালিব চেষ্টা করছে, অফিসার রিজভি চেষ্টা চালাচ্ছে। সবাই তো আর শাফিনের পক্ষে না। তবে ফাঁ°দে তাকে পড়তেই হবে।”

“ফাঁ°দটা কি?”

ইমতিয়াজ ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“যদি শাফিন এবারেও বেঁচে ফিরে, তবে বুঝতে পারবে।”

মৃত্তিকা উঠে এসে ইমতিয়াজকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“সব ভালো থাকুক। ফে°তনা দূর হোক।”

ইমতিয়াজ ওর গলায় ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বলে,
“অফিস যেতে হবে তো।”

মৃত্তিকা সরে যায়। গত পরশুদিন তানজিম আর সুরভি বাসায় এসে ইমতিয়াজকে দেখে যে ভয়টা পেয়েছে, সেটা ভেবে এখন আবারো মৃত্তিকার হাসি পায়।

“নিজে নিজে হাসছো কেন?”

“এমনিতেই, রেডি হয়ে নিন।”
______________________________________

সুরভি শাফিনের কাছেই আছে। মমতাজের দিকে সে ফিরেও তাকায় না। মমতাজ বেগম উঠতে পারে না, নিজে নিজে খেতে পারে না। সামান্য পানিটুকু চাইলেও সুরভি তা দেয় না। ঘৃ°ণার পরিমান এতো বেশি হয়েছে যে সে ওদেরকে মে°রে ফেলতে পারলে বাঁচে।

অপরূপার উপরেও তার রাগ আছে। অপরূপার সত্যটা জানতে পেরে সুরভি বাবাকে আরো বেশি ঘৃ°ণা করছে। পরশু যখন অপরূপাকে মৃত্তিকার বাসায় দেখেছে, তখন থেকে সে আরো চুপ আছে।

ঝড় আসার আগে প্রকৃতি যেমন শান্তরূপে নিজেকে পরিবেশন করে, সুরভিও তেমনি আছে।

“সুরভি, মা আমার, একটু পানি দাও।”

মমতাজ বেগমের কথা উপেক্ষা করে নিজেকে শান্ত রেখে সে বেরিয়ে আসে। মৃত্তিকার বাসায় চলে এসেছে সে।

সকাল সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। মৃত্তিকা মনোযোগ দিয়ে একটা বই পড়ছে আর মিউকোর গায়ে হাত বুলাচ্ছে। বেল বাজায় চমকে উঠে।

মৃত্তিকা ধীরপায়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। সুরভি ভিতরে এসে মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ইমতিয়াজ বাসায়?”
“না, অফিসে গেছে।”

সুরভি মাথানেড়ে অপরূপার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মৃত্তিকাকে বলে,
“বাবা তোমার সাথে দেখা করতে চাচ্ছে, মিউকো। দেখা করবে?”

নিজের থেকে বানিয়ে মিথ্যা কথা বলে দেয় সুরভি। মৃত্তিকা একটু চমকে উঠে। আবার শাফিনের কুৎসিত অবস্থা নিজের চোখে দেখার ইচ্ছাও জাগে। ইমতিয়াজ জানলে ওকে যেতে দিবে না, তাই না জানিয়েই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে।

“আমি যাবো, আপু।”

“ঠিক আছে, তুমি তৈরি হয়ে বের হও। আমি ওকে পাহারা দিচ্ছি।”

মৃত্তিকা অপরূপার দিকে ইশারা করে বলল,
“ও কিন্তু অনেক বিপজ্জনক।”

“ও কতটা খাতারনাক, আমি তার চেয়ে বেশি খাতারনাক।”

মৃত্তিকা মৃদু হাসে। দ্রুত তৈরি হয়ে সে বেরিয়ে যায় হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। ও চলে গেছে সুরভি অপরূপার কাছে এসে বলে,
“এখন যদি তোমাকে ছেড়ে দিই, কোথায় যাবে?”

অপরূপা মুখ বাঁকিয়ে বলে,
“আগে তোমাকে মা°রবো আর তারপর মৃত্তিকাকে। ইমতিয়াজকে একা করবো আমি।”

“তোমার কি সমস্যা ইমতিয়াজের সাথে?”

“মৃত্তিকাকে এতো ভালোবাসে কেন? এতো আদর কিসের জন্য?”

হিং°সার অনলে জ্ব°লছে অপরূপা। সুরভি সোজা হয়ে বসে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,
“চলো তবে, মা°রবে মৃত্তিকাকে।”

প্রায় আধঘন্টা পর সুরভি অপরূপাকে নিয়ে বের হয়। কোনো জোরাজুরি না করেই অপরূপা ওর সাথে আসছে। সিএনজি করে হাসপাতালে পৌঁছায় ওরা।

এদিকে মৃত্তিকা শাফিনের সাথে দেখার করার অনুমতি পেয়ে ভিতরে এসে শাফিনের অবস্থা দেখে।

পঁ°চা অংশ থেকে গন্ধ ছড়াচ্ছে। সময়মতো পরিষ্কার করা হয়নি বলে এ অবস্থা হয়েছে। মৃত্তিকার গা গু°লিয়ে আসে।

মমতাজ বেগমের কাছে গিয়ে বলল,
“বড়মণি?”

দুবারের ডাকে মমতাজ বেগম চোখ খুলেন। হাত উঠিয়ে বলে,
“এসেছো মা? একটু পানি দিবে।”

দুর্ঘটনায় উনার বুকে ব্য°থা পেয়েছিল। থেকে থেকে সে ব্যথায় কাতরে ওঠে। মৃত্তিকা উনাকে ধরে উঠিয়ে পানি পান করিয়ে দেয়।

মমতাজ বেগম আবারো শুয়ে বলে,
“আমি তোমাকে মা°রার জন্য শাফিনের ঠিকানা বলিনি, তোমাকে আমি এখন আর মা°রতে চাই না মা।”

মৃত্তিকা অপলক তাকিয়ে বলল,
“মাম একটা কথা বলতো, খালা নাকি মায়ের চেয়ে ভালা। আর আমার খালা আমার মাকেই মে°রেছে।”

মৃত্তিকা মুখ ঘুরিয়ে নেয়। চোখের পানি লুকাতে ব্যস্ত হয় সে।

শাফিনের কাছে গিয়ে বলে,
“তোমার মনের মতো তোমার শরীরটাও পঁচতে শুরু করেছে। এই হাত দিয়ে মেয়েগুলোকে স্পর্শ করেছিলে, তাই না? মজলুমের অভিশাপ বিফলে যায় না মামা।”

কঠিন প্রশ্নে চেয়ে থাকে শাফিন। মৃত্তিকা আবারো বলে,
“কেন ডেকেছো তাই বলো? কেন দেখা করতে চেয়েছো?”

শাফিন নিচুস্বরে বলল,
“তোমাকে আমি আসতে বলিনি।”

শাফিনের বামহাতে হাতকড়া লাগানো আছে। লোহার ভারি কড়াটা শব্দ করে নাড়িয়ে বলে,
“এই হাত খোলা থাকলে এখনই তোমাকে মে°রে দিতাম। তোমার জন্য আমি মৃ°ত্যু য°ন্ত্রণা সহ্য করছি।”

“এগুলো কর্মফল।”

শাফিন আবারো চোখ বন্ধ করে ফেলে। ডানহাতের আঙ্গুলগুলো তার নড়ছে। ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে, যেন সে হাত নাড়াতে চাচ্ছে। মৃত্তিকা সেদিকে তাকিয়ে আছে।

কিছুক্ষণ পর অপরূপাকে টে°নে ভিতরে এনে ফেলে সুরভি। মৃত্তিকা চমকে উঠে বাইরে তাকায়। দুজন পুলিশ তাদের জায়গায় নেই। আইসিইউর সামনে পুরো স্থান ফাঁকা।

“আপু?”

মৃত্তিকার ডাকে সুরভি উত্তর দেয়,
“চুপ করো, বাধা দিও না।”

সুরভি শাফিনকে ডেকে বলে,
“বাবা, তোমার সুন্দরী, যুবতী, সুনয়না স্ত্রী দেখা করতে এসেছে। যার রূপে পাগল হয়ে তুমি আমার মায়ের সাথে প্র°তা°রণা করেছো, সেই অপরূপা এসেছে। দেখো তুমি।”

শাফিন ধীরে ধীরে চোখ খুলে। সুরভি অপরূপার চুলের মুঠি ধরে ওকে শাফিনের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলে,
“সবাই সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে, শুধু আমার বাবা আর আমি ছাড়া।”

অপরূপার মাথাটা বিছানায় চেপে ধরে ওড়নার নিচ থেকে বড় ছু°ড়িটা বের করে অপরূপার গলায় গভীর করে চালিয়ে দেয় সুরভি। চিৎকার দেয়ার সময়টুকু অপরূপা পায় না। ছু°ড়ি দিয়ে খুঁচিয়ে র°ক্ত আরো বের করে সুরভি।

মৃত্তিকা ধরতে আসতে নিলে সুরভি ধমক দেয়,
“খবরদার কাছে আসবে না। এখানে তোমার কিছু নেই। চলে যাও।”

সে নিজেও কান্না করে দিয়েছে। র°ক্তে মাখোমাখো হয়েছে তার শরীরের পোশাক। ছটফট করতে থাকা অপরূপাকে ধরে রাখতে রাখতে মুখে-গলায়-হাতে র°ক্ত মেখে ভ°য়ং°কর রূপ এসেছে সুরভির।

“সন্তানের হাতের মৃ°ত্যুর চেয়ে তোমার জন্য কোনো বড় শাস্তি নেই বাবা।”

মমতাজ বেগম এসব দেখে চিৎকারে করে উঠে। শব্দ শুনে কয়েকজন পুলিশ সদস্য ভিতরে চলে আসে।

সুরভি শাফিনের উপর ছু°ড়ি চালাতে নিলে দুজন মহিলা কন্সটেবল জোরপূর্বক সুরভিকে ধরে ফেলে। সরিয়ে আনে শাফিনের কাছ থেকে। তবুও শাফিনের হাতে ছুড়ির আঁ°চড় পড়ে, কে°টে র°ক্ত ঝরা শুরু হয়েছে।

সুরভি এখনো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শাফিনের দিকে। বাবার প্রতি তার চরম ঘৃ°ণা, এতোটাই ঘৃ°ণা যে বাবাকে মে°রে ফেলতেও সে দ্বিধা করবে না।

মৃত্তিকা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। আকস্মিক ঘটনায় মানসিকভাবে বিপ°র্য°স্ত হয়ে পড়েছে সে। এই পরিবারের কেউ আবারো খু°ন করলো। তানজিম ঠিক বলেছিল এ র°ক্তে খু°ন ঘুরছে।
______________________________________

দশদিন পেরিয়ে যায়। দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে সারাহ্ নিজের রুমে শুয়ে আছে। আহনাফ গতকাল আসেনি, সেই যে শুক্রবারে গেল তারপর যেন বাসার পথই ভুলে গেছে। সারাহ্ও অভিমান করেছে, কোনো কল দেয়নি।

কলিং বেল বাজলে সে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখে অপরিচিত কয়েকজন মেয়ে এসেছে, হাতে একটা দানবাক্স।

“আসসালামু আলাইকুম।”

এক মেয়ের সালামের জবাব দেয় সারাহ্।
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। জি বলুন।”

“আমরা একটা বৃদ্ধাশ্রমের জন্য টাকা সংগ্রহ করছি।”

মেয়েগুলোর পিছন থেকে “টুকি” বলে বেরিয়ে আসে সামিহা। তাড়াহুড়ো করে বলে,
“আমি ওদেরকে নিয়ে এসেছি, জলদি জলদি টাকা বের করো।”

সারাহ্ পুরো দরজা আগলিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“এ টাকা কোথায় যাবে?”
“বৃদ্ধাশ্রমে, সত্যি বলছি। আমরা মিথ্যা বলি না, আমি তো না-ই।”

সারাহ্ কপাল কুঁচকে গিয়ে পার্স থেকে দুইশ টাকার নোট দিয়ে বলে,
“যাবো একদিন ওই বৃদ্ধাশ্রমে, দেখবো টাকার কি হচ্ছে।”

মেয়েগুলো চলে যায়। সামিহা ভিতরে এসে হেলেদুলে হেঁটে হেঁটে বলছে,
“আপু, তুমি সোজা হবা কবে?”

“কেন? আমি কি বাঁকা?”

“না, কোমড়ে হাত দিয়ে এমন সাপের মতো হাঁটা থামাবা কবে তাই বলো।”

“তবে রে।”

সারাহ্ ওর দিকে কুশন ছুঁড়ে দিলে সামিহা দৌড়ে পালায়। তারপর আবার রুম থেকে উঁকি দিয়ে বলে,
“আমিও ইমতিয়াজ ভাইয়ার মতো একদিন ম°রার ভাণ ধরে থাকবো। তখন দেখবো তুমি কেমনে কা°ন্দো।”

সারাহ্ কপাল কুঁচকে ফেলে। সামিহা রুমে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। তানজিমের কাছ থেকে ইমতিয়াজের মৃ°ত্যুর অভিনয়ের কথা শুনেছে সামিহা।

সারাহ্ রুমে চলে এসেছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে বলল,
“কোলে কবে আসবি, সোনা? আমার যে আর ধৈর্য থাকছে না।”
______________________________________

সুরভিকে জে°লে নেয়া হয়েছে আজ দশদিন। রাইদ মাকে ছাড়া খুবই কান্নাকাটি করে। সুরভি ছেলেকে দেখে না, দেখা করতে আসলেও কাছে যায় না।

অপরূপার দা°ফনের কাজ অনেক আগেই শেষ হয়েছে৷ নিয়াজীর খু°নের কথাও এখন ওপেন সিক্রেট বলা যায়, তবে শরীফকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

দেলোয়ারা তো আগে থেকেই নিষ্প্রাণ হয়ে আছে। স্বামীর এ অবস্থার পর মেয়ের জেল, উনি যে বেঁচে আছেন সেটাই বেশি।

রাইদকে মৃত্তিকা কোলে নিয়ে শান্ত করতে চেষ্টা করছে। দেলোয়ারা এখন মৃত্তিকার বাসায়, ওর সাথেই আছে।

“বাবা আমার, সোনা আমার, আর কাঁদে না। একটু খাও।”

ফিডার দিয়ে অল্প অল্প করে দুধ খাওয়াচ্ছে ওকে মৃত্তিকা। ছোট মানুষ, মা ছাড়া বুঝেটা কি? বাবা তো মাকে ছেড়েই দিয়েছে।

সমস্তটা দিন মৃত্তিকা ওকে নিয়েই কা°টিয়েছে। রাতে ইমতিয়াজ বাসায় এসে দেখে ক্লান্ত মৃত্তিকা রাইদের পাশে আরামে ঘুমাচ্ছে। ওকে ঠিকঠাক করে শুইয়ে দিয়ে কপালে চুম্বন করে দেয়।

রান্নাঘরে গিয়ে দেখে রাতের খাবার প্রস্তুত।

ইমতিয়াজ নিজে নিজেই বলে,
“গিন্নি তবে পারফেক্ট হচ্ছে।”

পেছন থেকে দেলোয়ারার কন্ঠ পাওয়া যায়।
“আরে ইমতিয়াজ, এসে গেছো। ফ্রেশ হয়ে নাও, আজ আমি রান্না করেছি।”

ইমতিয়াজের মুখটা শুকিয়ে যায়। তবে এসব রান্না দেলোয়ারা করেছে। পরক্ষণেই হাসে সে, সবসময় স্ত্রীরা রান্না করবে কেন? মাঝে মাঝে স্বামী তাকে রেঁধে খাওয়াতে নিষেধ নেই। ওদের সম্পর্ক না হয় উল্টোই হোক।
______________________________________

মধ্যরাতে কাঁপুনি দিয়ে জ্ব°র এসেছে শাফিনের। জ্ব°রে কাঁপছে, ব্য°থায় চিৎকার করছে আর মনে মনে আফসোস করছে সে।

যদি জামিল, দুলাল বেঁচে থাকতো, তবে সে ঠিকই বেঁচে যেতো। আজ তার খারাপ সময়ে বিশ্বস্ত লোকগুলোও যেন পালিয়েছে। কারো কোনো খোঁজখবর নেই।

মমতাজ বেগম অনেকটাই সুস্থ, তবে বয়সের তুলনায় দুর্ঘটনার ভারটা সে নিতে পারছে না। শাফিন জানে মমতাজ পালাবে না, তবে তাকেও যে পালাতে দিবে না।

পা তার সম্পূর্ণ অবশ, হাত একটু নাড়াতে পারে। নাড়ালেই পঁ°চা-গলা মাংস খুলে পড়তে শুরু করেছে। শাফিন চিৎকার করে। একজন কর্তব্যরত ডাক্তার ভিতরে আসলে মমতাজ বলে,

“ওকে দূরে সরাও, না হয় আমাকে সরাও। ওর চিৎকার আমার ভালো লাগে না।”

ডাক্তার শাফিনকে ঘুমের ওষুধ প্রয়োগ করে। এছাড়া কোনো উপায়ও নেই। ক্ষ°ত সারানোর ওষুধ ওর উপর কেন যেন কাজ করছে না। ক্ষ°ত শুকাচ্ছে না, বরং আরো বাড়ছে। ভ°য়ং°কর রকম দূ°র্গন্ধ আসছে তার থেকে।

“আমাকে সুস্থ করো, নাহয় মে°রে ফেলো। সহ্য হচ্ছে না আমার। মিউকো, ছাড়বো না আমি তোমাকে।”

চলবে….

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

চতুঃষষ্টি পর্ব (৬৪ পর্ব)

“হাত-পা কে°টে ফেললে বেঁচে যাবে তুমি।”

ভোর ভোর ডা: মাহিনের কথায় শাফিনের খারাপ মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেল। খিঁ°চিয়ে উঠে বলল,
“কা°টতে হবে কেন? অনেক মানুষের এরকম হয়েছিল, ওরা কি সুস্থ হয়নি?”

মাহিন হেসে স্যালাইন ঠিক করে দিতে দিতে বলল,
“ওরা তো বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করেছে, তুমি তো তা পারবে না।”

শাফিন যেন আশার আলো দেখে।
“আমাকেও বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন প্লিজ। আমার আর সহ্য হচ্ছে না।”

মাহিন স্টেথোস্কোপ হাতে নিয়ে বলল,
“সহ্য তো করতে হবে আর না হয় ম°রতে হবে। (একটু থেমে) মেয়েগুলো যেমন সহ্য করতে না পেরে ম°রে গেছে, ঠিক তেমন।”

মাহিন চলে যেতে নিলে শাফিন বলে,
“ওই ডাক্তার, আমি দোষী হলে মিউকোও দোষী। সে আমার এ হাল করেছে।”

মাহিন ফিরে দাঁড়িয়ে বলে,
“ঠিক করেছে। দেশের আইন যা পারেনি, সে পেরেছে। স্যালুট করা উচিত তাকে।”

মাহিন দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে যায়। সমাজ সংস্কারকের ভূমিকায় যারা আছে তারাই আজ অ°ন্যায়-অবিচারকে প্রশ্রয় দিচ্ছে ক্রমাগত। ফে°ত°নার সৃষ্টি করছে, নিরীহদের হ°ত্যা করছে। এমন মানুষদের সাথে কথা বলার ইচ্ছা মাহিনের নেই, না তাদের চিকিৎসা করার ইচ্ছা আছে।
______________________________________

ফজরের নামাজের পর মৃত্তিকা রাইদের জন্য খাবার বানাতে গেল। সাতমাসের বাচ্চাটা মায়ের দুধ ছাড়া আর কিছু খেতেও তো শিখেনি এখনো।

পানি মিশিয়ে পাতলা করা দুধ গরম করে মৃত্তিকা। ইউটিউব দেখে দেখে সে এ পদ্ধতি ব্যবহার করছে। আবার আজ থেকে একটু একটু সুজি দিবে ভাবছে, তবে তারজন্য ইমতিয়াজের সাহায্য লাগবে।

মসজিদ থেকে বাসায় এসেই ইমতিয়াজ রাইদের কান্না শুনে দ্রুত গিয়ে ওকে কোলে তুলে নেয় সে। মৃত্তিকা ফিডার নিয়ে এসে ওকে খাওয়াতে চেষ্টা করে। গলা ফা°টিয়ে চিৎকার করছে রাইদ।

মৃত্তিকা নরম কন্ঠে বলল,
“বাবা আমার, একটুখানি খেয়ে নাও। জান না আমার।”

দেলোয়ারা কান্না শুনে উঠে এসে দরজায় নক করে। মৃত্তিকা বলে,
“দরজা খোলা মামানী।”

দেলোয়ারা ভিতরে আসে। গত কয়েকদিন রাইদকে নিয়ে মৃত্তিকার বিশ্রামহীন, নিদ্রাহীন রাতগুলোর কথা উনি জানেন।

দেলোয়ারা বি°র°ক্তি নিয়ে বলে,
“বাপ-বেটি খু°ন করে পড়ে আছে, জ্বা°লা সব আমার।”

ইমতিয়াজ উনার দিকে তাকিয়ে বলল,
“মামানী, যে দোষ করেছে সে দোষী, তার পরবর্তী প্রজন্ম না। উত্তর কোরিয়ার নিয়ম এখানে মানলে তো আর হবে না।”

“সে তুমি যাই বলো, এই গুষ্ঠির কেউই ভালো হবে না। এই র°ক্ত যেখানে গেছে, সেখানেই লা°শ পড়েছে।”

মৃত্তিকা ধ°মক দিয়ে উঠে,
“থামো তো মামানী, এই বাচ্চা কি করছে? শুধু শুধু ও কেন কষ্ট পাচ্ছে? সহ্য না হলে তুমি ঘরে যাও।”

দেলোয়ারা কথা বাড়ালেন না, নিজের রুমে চলে গেলেন উনি। উনার কষ্ট উনি জানেন আর জানেন আল্লাহ্।

মৃত্তিকা মিউকোকে এনে রাইদের সামনে বসিয়ে দেয়। মিউকোকে দেখিয়ে দেখিয়ে মৃত্তিকা বলে,
“ওটা কি? ওটা ক্যাট, মোটা বিড়াল। বিড়াল খায়, রাইদও খায়।”

মিউকোর লেজ ধরে বলে,
“এটা লেজ, বিড়ালের লেজ। রাইদ লেজ দেখে খায়।”

মিউকোর নড়াচড়া আর খেলাধুলা দেখিয়ে রাইদের খাওয়া চলতে থাকে। একটুখানি খেয়ে শান্ত হয় সে। একপর্যায়ে মৃত্তিকার কোলে ঘুমিয়ে পড়ে।

মৃত্তিকা ওকে বুকের উপর নিয়ে বিছানায় বসে থাকে। পুরো সময় ইমতিয়াজের দৃষ্টি মৃত্তিকার দিকে ছিল। মাতৃত্ব যেন তার মধ্যে হঠাৎ করে চলে এসেছে। একটা আলাদা চাহনী, আলাদা স্নেহময় কন্ঠ।

ইমতিয়াজ ওর পাশে বসে কিছু বলতে নিলে মৃত্তিকা ওর ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে চুপ করিয়ে না বোধক মাথা নাড়ে। ইমতিয়াজ মুচকি হেসে রাইদের কপালে চুমো দেয়।

মৃত্তিকা ওর মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিজের গাল ইশারা করে। ইমতিয়াজ ওর গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে ধীরে ধীরে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
“লজ্জা বি°স°র্জন দিয়েছো?”

মৃত্তিকা মুচকি হাসে, কিছুই বলে না। রাইদকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে, ইমতিয়াজও মিউকোকে নিয়ে ওর পাশে শোয়। দৃষ্টি দুজনের চোখে দুজনের আবদ্ধ, কিছু বলতে চেয়েও নিশ্চুপ ওরা।
______________________________________

আরেকটা দিন আহনাফের অপেক্ষায় কাটিয়ে দেয় সারাহ্। ওর আর এসব ভালো লাগে না। আহনাফ কেন আসছে না? ফোনে ওইটুকু সময় কথা বলে কি হয়? না ঠিকমতো শোনা হয় আর না দেখা হয়।

অবশেষে আজ সন্ধ্যায় আহনাফ আসে। সারাহ্ অভিমান ধরে রেখেছে, রাখবেই। এতো সহজে ছেড়ে দিলে লোকটা পার পেয়ে যাবে।

নার্গিস পারভিনের সাথে কথা শেষে আহনাফ রুমে আসে। সারাহ্ ওকে দেখেই বারান্দায় চলে গেল। আহনাফ মুচকি হেসে ব্লেজারের গুপ্ত পকেট থেকে গোলাপ বের করে ওর কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।

“গোলাপ লাগবে কারো?”

সারাহ্ ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনি এটা গরুর মতো চিবিয়ে খেয়ে ফেলেন।”

আহনাফ ভ্রূ উঁচিয়ে ঠোঁট উলটে বলল,
“ফাইন, এখানে কার মায়ের নাম নার্গিস?”

“এই একদম আম্মুকে নিয়ে কিছু বলবেন না।”

আহনাফ হেসে বলল,
“নার্গিস হলো একটা ঘূ°র্ণিঝ°ড়ের নাম, তাই তুমি ঝ°ড়ের মেয়ে আরেক ঝ°ড়। না ঝ°ড় না, তুমি সাহারা মরুভূমি।”

সারাহ্ কপাল কুঁচকে তাকালে আহনাফ আবারো বলে,
“হ্যাঁ, তোমাকেই বলেছি, এভাবে তাকানোর কিছু নেই তো।”

“আপনার সাথে কথা বলাই বেকার। এতোদিন পর এসেছেন, আবার ঠিকমতো কথাও বলছেন না।”

আহনাফ ওর কাছে এসে গোলাপ ওর বেনীতে গুঁজে দিয়ে বলল,
“এখন একদম পাক্কা লম্বা লেজের লাফানো প্রাণী লাগছে।”

সারাহ্ তেঁতিয়ে উঠে,
“আপনি আবার আমাকে বানর বললেন?”

“বলেছি বুঝি? কই, এমনকিছু তো মনে পড়ছে না। তো সাহারা মরুভূমি, বলছিলাম কি..”

আহনাফের কথার মাঝেই সারাহ্ বলে,
“কে সাহারা মরুভূমি, আমি সারাহ্, কোনো এক ন্যাকার ঐশী।”

আহনাফ ওকে জড়িয়ে ধরে ন্যাকাসুরে বলল,
“সাইদার আম্মু রাগ করে না। আদর, আদর, অনেক আদর।”

সারাহ্-র কপালে, গালে, থুতনিতে চুম্বন করতে থাকে আহনাফ। সারাহ্ ওকে ধা°ক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলে,
“আর ন্যাকামি লাগবে না।”

“এগুলো তো আমার সাইদা আর সাদাবের জন্য। তোমাকে দিচ্ছি নাকি? এমন ভান যেন উনাকে আমি আদর করছি। ঠে°কা আমার।”

সারাহ্ চলে যেতে নিলে আহনাফ ওকে কাছে এনে ওর ঠোঁটে স্পর্শ করে বলল,
“এখানেরটুকুই আপনার, বাকিটা আমার বেবিদের।”

সারাহ্ মুচকি হেসে মাথা নুইয়ে ফেললে আহনাফ ফিসফিস করে বলে,
“সিংহভাগ তো এখানেই থাকে।”

সারাহ্ এবারে নিজের মুখ আহনাফের বুকেই লুকায়। নিজে নিজেই হাসছে সে।

স্ত্রীর রাগের পাহাড় ডিঙিয়ে প্রেমের প্রান্তে পৌঁছে গেছে আহনাফ। সারাহ্-র মিষ্টি লাজুক হাসি দেখে আহনাফও হাসে।

এই কয়েকদিন ধরে আহনাফ ব্যস্ত ছিল অন্যকাজে। সারাদিন ক্লাস করে রাতে সে জামিলের সাথে সম্পৃক্ত নানা তথ্য খুঁজেছে।

ফুফু আম্বিয়ার কাছ থেকে জানতে পেরেছে ছয়তলায় একটা হলরুম করার উদ্দেশ্যে সেখানে কাজ চলছিলো, কিন্তু মাঝপথে অর্থ সংকটে কাজ থেমে গেছে।

বোঝা যায়, তবে এই সুযোগে অপরূপা সেখানে ঘা°টি বেঁধেছিল।। এছাড়া আর তেমন কিছুই সে পায়নি। নতুন কোনো মানুষের সম্পৃক্ততাও এখানে নেই।
______________________________________

ঘড়িতে রাত বারোটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট, শাফিনের কাছে এএসপি নাহিদ এসেছে। মমতাজ বেগম ঘুমাচ্ছে, শাফিনের ঘুম নেই। য°ন্ত্র°ণায় সে নির্ঘুম রাত্রিযাপন করে।

নাহিদকে দেখে সে অবাক হয়। শাফিন বলে,
“আটকে রেখে কেন দেখতে এসেছো?”

“তোমার ক্রস°ফা°য়ার আমি থামিয়েছি, নাহলে ওইদিনই তুমি শেষ হয়ে যেতে।”

“কারণ? এমন পদে থেকে আমাকে কেন বাঁচিয়েছো?”

নাহিদ একটু হেসে বলে,
“এখনও তোমাকে বাঁচাতে পারি। ইন্ডিয়া নিয়ে যাবো, মুম্বাই না হলে তামিলনাড়ু। অস্ট্রেলিয়া বা সিংগাপুরেও নিয়ে যেতে পারি। যাবে?”

“কেন সাহায্য করছো তাই বলো। উদ্দেশ্য কি?”

নাহিদ ভণিতা করে বলে,
“আহা, উত্তেজিত হয় না। (একটু থেমে) তোমার যতপ্রকার বিজনেস আছে, সব আমার আন্ডারে দিয়ে দাও। ব্যস, তুমি বেঁচে যাবে।”

শাফিন মুখ ভেংচিয়ে বলল,
“ওসব নিয়ে আর কি করবে? লোকজন নেই তো।”

“ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না। তুমি শুধু আমার আন্ডারে করবে, সব ঠিক কোথায় কোথায়, কি কি আছে তা বলবে। তবেই হবে।”

শাফিন কিছুক্ষণ ভাবে, এছাড়া কোনো উপায়ও নেই। বলে,
“ঠিক আছে, দিবো। তবে এখন অর্ধেক দিবো, বাকি অর্ধেক সুস্থ হওয়ার পর।”

“মেন্টালি রেডি হও, তুমি শেষরাতে বের হয়ে যাবে। সব ব্যবস্থা আগে থেকেই করা আছে।”
শক্তকন্ঠে কথাটা বলে নাহিদ।

শাফিন আবারো একটু ভেবে জিজ্ঞাসা করে,
“ইমতিয়াজ কেমন আছে? সত্যিই সে মা°রা গেছে।?”

হুট করে শাফিনের এমন প্রশ্নে নাহিদ অবাক হয়। তারপর বলে,
“সত্য সত্যই মা°রা গেছে।”

শাফিন সত্যটা জানে না। ওকে কেউ জানায়নি, কি করে জানবে। সে মুচকি হাসে, তারপর শব্দ করে হাসে। বলল,
“সে আমাকে মা°রতে চেয়েছিল, নিজেই ম°রে গেছে। মিউকো, একা তুমি, চির একা। আমিই তোমাকে একা করেছি।”

নাহিদ বেরিয়ে আসে। ইমতিয়াজ বাইরে বসে আছে। নাহিদ ওর কাছে এসে বলল,
“কাজ শেষ, যতটুকু দরকার ছিল বলেছি। আশা করি এবারে তাকে শক্তপোক্ত করেই ধরা যাবে।”

ইমতিয়াজ মাথানেড়ে বলল,
“ধন্যবাদ, আপনার মতো মানুষের জন্য আইনের উপর এখনো বিশ্বাস রাখা যায়। (একটু থেমে) ডিআইজি দিলদারের খবর কি? উনিই তো শাফিনের মৃ°ত্যু°দ°ন্ডের আদেশ থামিয়েছে।”

“উনি আমার সিনিয়র, তবে আইন সিনিয়র-জুনিয়র মানে না। জে°লে আছে।”

ইমতিয়াজ আইসিইউর দিকে তাকিয়ে বলল,
“শাফিন কিন্তু ভ°য়ং°কর লোক, সামলাতে পারবেন?”

“ইনশাআল্লাহ, আল্লাহ্ আমাকে সেই শক্তি দান করুক।”

ইমতিয়াজ মাথানেড়ে বলল,
“আমিন।”

দুজনে বাইরে আসতে আসতে ইমতিয়াজ জিজ্ঞাসা করে,
“সুরভি আপুর খবর কি? উনাকে কি রি°মান্ডে নিবে নাকি?”

“না, উনি সব স্বীকার করেছে। বাকিটা কোর্ট যা বলে। শুনানি হবে, মৃত্তিকা ম্যাডামকে আসা লাগতে পারে, যেহেতু উনি প্রত্যক্ষদর্শী।”

ইমতিয়াজ উত্তর দিলো না। রাইদের অবস্থা চোখের সামনে দেখছে সে। মাকে ছাড়া ইমতিয়াজ নিজেও বড় হয়েছে, কষ্ট সে জানে।

মায়ের মৃ°ত্যু হয়েছিল ওর জন্মের কিছুক্ষণ পরই। তারপর ইমতিয়াজের কথা ভেবেই ওর বাবা ওরই খালাকে বিয়ে করে। বয়স যখন তিনবছর তখন তিনিও মা°রা যান। বাবার কাছেই মা ছাড়া বড় হয়েছে সে। ওর তো বাবা ছিল, রাইদের তো কেউ নেই।

পরক্ষণেই ইমতিয়াজ ভাবে,
“না আছে, রাইদের মা যদি মৃত্তিকা হয়, তবে সে বাবা। রাইদের বাবা-মা দুই-ই আছে। তবুও কাউসারের সাথে একবার কথা বলা উচিত।”
______________________________________

নাহিদ কথা রাখে। শেষরাতে কয়েকজন লোক এসে হাজির হয় শাফিনের কাছে। শাফিনের বেডসহ তাকে নিয়ে যেতে নিলে শব্দ শুনে মমতাজ বেগমের ঘুম ভা°ঙে।

“কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন ওকে? আপনারা কারা?”

একজন লোক এসে মমতাজ বেগমকে বলে,
“আপনি ঘুমান, এসব আপনার জানার বিষয় না।”

শাফিন পেছন থেকে জোরে জোরে বলতে থাকে,
“আমি সুস্থ হবো, মিউকোকে মে°রে ফেলবো আমি। তাহমিনার কাছে ইমতিয়াজ গেছে আর ইমতিয়াজের কাছে মৃত্তিকা যাবে।”

মমতাজ বেগম আকুতি করে উঠে,
“মে°রো না ওকে, ওই শিশুগুলোর অভিশাপে তুমি পঁচে যাচ্ছো, আর অভিশাপ নিয়ে যেও না।”

শাফিন হেসে জোর গলায় বলল,
“তুমি মিউকোকে বাঁচাতে চাচ্ছো? সে তোমাকে মা°রবে। বাবা কি বলেছিল মনে নেই? সবসময় নিজের কথা ভাববে, কাউকে নিয়ে ভাবার দরকার নেই।”

মমতাজ বেগম কাঁদতে শুরু করলো। এছাড়া আর করবেনই বা কি। শাফিনকে নিয়ে বেরিয়ে গেল লোকগুলো। সাদা চাদরে ঢেকে লা°শের মতো বের করে নিয়ে এম্বুলেন্সে তুলে দেয়া হলো।

নাহিদ এম্বুলেন্সে বসে আছে, ড্রাইভারের পাশের সিটে ইমতিয়াজ এমনভাবে বসে রইলো যেন শাফিনের চোখে না পড়ে।
______________________________________

দেড়মাস পর, সময়টা হিসাবের ক্ষেত্রে অনেকটা বেশি মনে হলেও আসলে বেশি নয়।

সারাহ্-কে আজকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। আগামীকাল ওর ডেলিভারির তারিখ দিয়েছে। এজন্যই তো আজকে সন্ধ্যায়ই ওকে চেকআপের জন্য নিয়ে আসা হয়েছিল, বাচ্চার পজিশন ঠিকঠাক না থাকায় ভর্তি করাতে বলা হয়েছে।

ভর্তি হওয়ার পর থেকে ভয়ে মেয়েটা কুঁচকে আছে, বারবার দুরুদ পড়ছে। সাহায্য চাচ্ছে আল্লাহ্-র কাছে।

আহনাফ, সামিহা তার পাশেই আছে। নার্গিস পারভিন আজকে ওর সাথে থাকবে। মহিলা ওয়ার্ডে রাতে পুরুষ থাকা নিষেধ। আহনাফকে তাই চলে যেতে হবে।

রাত নয়টা বেজে গেছে, সারাহ্ আহনাফের যাওয়ার কথা শুনে ওর হাত ধরে কান্না করে দেয়,
“থেকে যান আমার কাছে, আমার ভ°য় করে।”

আহনাফ ওর কপালে চুম্বন করে বলে,
“আমার সাইদা-সাদাব আসছে, ভ°য় পেয়ো না।”

সারাহ্ ধ°মক দিয়ে উঠে,
“একটু আগে ডাক্তার কি বলল শুনেননি? বেবির পজিশন ঠিক নেই। (নরমসুরে) আহনাফ, আহনাফ, আমার বেবি ঠিক আছে না?”

“একদম ঠিক আছে। কিচ্ছু হয়নি।”

সারাহ্-র সমস্যা অনেক দেখা দিয়েছে। র°ক্তের সুগার বেড়ে আছে, উচ্চ র°ক্তচাপও দেখা দিয়েছে। এ সময় এমন হওয়া স্বাভাবিক, তবে দু°শ্চিন্তার কারণে শরীর আরো খারাপ হতে পারে।

“আহনাফ, যদি আমাদের আর দেখা না হয়? আহনাফ, আমার ভ°য় করে।”

সারাহ্-র পাগলামিতে আহনাফের কষ্ট বাড়ছে। দেখা না হওয়ার কথা শুনে ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠে তার।

আহনাফ নার্গিস পারভিনের দিকে তাকায়। নার্গিস পারভিন মেয়েকে সান্ত্বনা দিতে শুরু করে।

পাশের বেডের মহিলার মা বলে,
“আরে মেয়ে, এতো ভ°য় পেলে মা হবে কি করে? মায়েরা মজবুত হয় পাহাড়ের মতো, আবার তাদের ভালোবাসা হয় সমুদ্রসম। মাতৃত্ব সহজ নয়, কষ্ট পেতে হবে। এটা তো কেবল শুরু।”

আহনাফের আর সহ্য হয় না, সে বের হয়ে যায়। সে নিজে যে শান্ত আছে তা নয়, তবে শান্ত রাখতে হচ্ছে। ওয়েটিং রুমে গিয়ে বসে থাকে সে। বাসায় যেতে মন মানছে না।

কিছুক্ষণ পর আবারো উঠে এসে সামিহাকে বলে,
“সামিহা, তুমি থাকো, তবে ঐশী ভ°য় কম পাবে।”

সারাহ্ মাথা তুলে বলল,
“খবরদার, এশা যদি এখানে থাকে তবে আমি থাকবো না বললাম।”

সামিহা হাই তুলে বলে,
“আপু, তোমার কি লেবার পে°ইন উঠেছে? এমন লাফালাফি করতেছো কেন?”

“এশা, লা°ত্থি খাবি বললাম।”

“এই পেট নিয়ে লা°থি তুমি দিতে পারবা না। সো, আজকের দিনটাই আমার।”

সারাহ্ নার্গিস পারভিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার আরো দশটা শ°ত্রু বেশি থাকতো, তাও এমন একটা বোন না থাকতো।”

সামিহা উঠে দরজা কাছে এসে আহনাফকে বলে,
“আমি আর জীবনে এখানে আসবো না। এমন অপ°মান মানা যায় না, না না, কিছুতেই না।”

আহনাফ হেসে দেয়। সারাহ্-র দিকে তাকিয়ে দেখে মেয়েটার চোখেমুখে আকুতি। “থেকে যাও আহনাফ” তার চোখদুটো যেন তাই বলছে।

আহনাফ হাত নেড়ে বিদায় জানায়। সারাহ্ কান্না চেপে বিদায় দেয়। একটা ভ°য় তার, সাদাব-সাইদা ঠিকমতো আসবে তো? সন্তানকে কোলে নিয়ে আহনাফকে দেখতে পারবে তো সে?
______________________________________

গতকাল গভীর রাতে শাফিন দেশে ফিরে এসেছে। নাহিদ শাফিনের সকল কিছুর কর্তৃত্ব আজ সকালেই নিজের করে নিয়েছে। শাফিনের এসবের রেকর্ডও রেখেছে সে। শাফিন ফাঁ°দে পড়ে গেছে, এখন শুধুই সফল হওয়ার পালা।

সকাল এগারোটা, কিছু দরকারী জিনিস কিনতে মৃত্তিকা গ্রোসারি সুপারশপে এসেছে।

ওর পিছুপিছু এসে হাজির হয়েছে শাফিন। সকালে নাহিদের থেকে বিদায় নিয়েই সে মৃত্তিকার পিছু নিয়েছে। আর কোনো বাড়তি সময় না নিয়ে সুযোগ বুঝে মৃত্তিকাকে মা°রতে চায় সে।

মৃত্তিকা কেনাকাটা শেষ করে বাড়ির পথে যাওয়া শুরু করে। বাসা বেশি দূরে না হওয়ায় সে হেঁটে হেঁটেই যাচ্ছে।

লিফটে ওর সাথেই উঠে শাফিন। মাস্ক পড়া ও বড় হ্যাট থাকায় শাফিন ভাবে মৃত্তিকা তার চেহারা খেয়াল করেনি, অথচ মৃত্তিকা তাকে ঠিকই দেখেছে।

মৃত্তিকা বাসার দরজা খুলতেই ওকে ধা°ক্কা দিয়ে ভিতরে এসে হাজির হয় শাফিন।

ডানহাতের টোকায় হ্যাট ফেলে অন্যহাতে মাস্ক খুলে মৃত্তিকাকে বলে,
“কি ভেবেছিলে? ম°রে যাবো? শাফিন ম°রে না, বারেবারে ফিরে আসে।”

ডানহাতে তার শক্ত কভার লাগানো, মানে হাত এখনো ঠিক হয়নি। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে, পায়ের অবস্থাও ঠিক নেই। তবুও যেন জোর কমে না।

মৃত্তিকা তার পা থেকে মাথা অব্ধি দেখে চুপ করে আছে। শাফিনকে দেখে সে অবাক হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ফিক করে হেসে দেয়।

ব্যাগটা ফ্লোরে রেখে মৃত্তিকা সোফায় বসে পড়ে। শাফিনের রাগ বাড়ে। দরজা বন্ধ করে দেয় শাফিন।

মৃত্তিকা বলে,
“ঘটনা কি মামা? হাত-পা ঠিক হয়ে গেছে? প্রতিশোধ নিতে এসেছো?”

শাফিন ওর কাছে আসে। বলল,
“প্রশ্নের জবাব দিবো না আমি। ইমতিয়াজ নেই, এভাবে তোমাকে একা পাবো তা কিন্তু ভাবিনি। ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে, তুমিও কি ইমতিয়াজকে ডাকবে?”

মৃত্তিকা ঠোঁট উল্টায়, মুখে তার মুচকি একটা হাসি। শাফিনের হাত টে°নে মৃত্তিকা নিজের ঠোঁটের লিপস্টিক লেপ্টে দেয়, চোখের কাজল হাত দিয়ে নিয়ে শাফিনের সাদা টিশার্টে লাগিয়ে দেয়।

শাফিন চমকে উঠলো, এ কি করছে মেয়েটা। মৃত্তিকা শাফিনের ইন করা টিশার্ট টে°নে তুলে তাকে একপ্রকার এলোমেলো করে দেয়।

“বাঁচাও আমাকে, ঘরে কেউ একজন এসেছে। কে আছো বাঁচাও, আমাকে শেষ করে দিচ্ছে।”

গলা ফা°টিয়ে চিৎকার করতে থাকে মৃত্তিকা। মাঝে মাঝে থেমে গিয়ে একটু হাসে, তারপর আবারো চেঁ°চাতে থাকে। একপর্যায়ে সে ফ্লোরে বসে পড়ে।

শাফিন বুঝতে পারে এখানে কোনো বড়সড় চাল আছে। দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে নিলে সামনে পড়ে নাহিদ।

“সময় শেষ, মামা।”

মাথানেড়ে কথাটা বলল মৃত্তিকা। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“অন্তঃসত্ত্বা নারীকে ধ°র্ষ°ণের চেষ্টার সময় এএসপি নাহিদের হাতে ধরা পড়লো ধ°র্ষ°ক শাফিন, হেডলাইনটা কেমন?”

মৃত্তিকার কথায় সমর্থন জানিয়ে নাহিদ বলে,
“এর আগেও অসংখ্য মেয়ে তার নোং°রা দৃষ্টির শি°কার।”

ইমতিয়াজ শার্টের হাতা গু°টাতে গু°টাতে লিফট থেকে বেরিয়ে শাফিনের টিশার্ট ধরে টে°নে ফ্ল্যাট থেকে বের করে বলল,
“ইমতিয়াজ বলে চিৎকারটা তুমি বারবার শুনবে না।”

শাফিন হা করে তাকিয়ে আছে ইমতিয়াজের দিকে। পুরো একটা সত্য থেকে ওকে এভাবে দূরে রেখে বোকা বানালো, আর ও টেরই পেল না।

ইমতিয়াজ ওর কাছে মুখ এনে বলে,
“সিসিটিভিতে শুধু ভিডিও দেখা যায়, ছবি না। বাজেভাবে ফেঁ°সে গেছো তুমি শাফিন।”

মৃত্তিকা বের হয়ে আসে। ইমতিয়াজ শাফিনকে ছেড়ে দেয়। পাশের ফ্ল্যাটের লোকজন বেরিয়ে আসলে মৃত্তিকা নাকিকান্না করতে করতে ইমতিয়াজকে জড়িয়ে ধরে।

সবাই ধরেই নেয় শাফিন এবারে মৃত্তিকার সাথে খারাপ কিছুই করেছে। ধি°ক্কা°র জানাতে থাকে সবাই। স্যান্ডেল, জুতা ছুঁ°ড়ে ফেলতে থাকে ওর দিকে। ইমতিয়াজ শুধু দেখতে থাকে।

একে একে বেশ কয়েকজন পিবিআইয়ের লোক আসে। অফিসার গালিব ও রিজভিও আছে এখানে। জোরপূর্বক শাফিনকে ধরে গ্যারেজে নিয়ে যায়।

চলবে…..

অনুভূতিরা শব্দহীন পর্ব-৬১+৬২

0

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

একষষ্টি পর্ব (৬১ পর্ব)

ফজরের পর পরই আহনাফ বেরিয়ে যেতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। সারাহ্ নামাজ শেষ করে খুব তাড়াহুড়ো করে বলে,
“এতো ভোরে যাচ্ছেন কোথায়? এখনো তো ঠিক করে সূর্যই উঠলো না।”

আহনাফ শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বলল,
“মেয়ে দেখতে যাচ্ছি।”
“মেয়ে?”
সারাহ্ কপাল কুঁচকায়।

আহনাফ হাসি চেপে বেশ সিরিয়াস ভাব করে বলল,
“হুম, মেয়ে। এক চেহারা দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত, তাই নতুন মুখ দেখতে হবে।”

সারাহ্ এগিয়ে এসে ওর শার্ট খুলে ফ্লোরে ফেলে দেয়। রাগ দেখিয়ে বলে,
“আজকালের বেডা জাত, অ°জাত, কু°জাত, বদ°জাত।”
“গা°লি দেও কেন?”

সারাহ্ শার্ট তুলে ফার্নিচার মুছতে মুছতে বলে,
“না, আপনাকে আমি আদর করবো? অসভ্য লোক, ঘরে প্রেগন্যান্ট বউ রেখে বাইরে যাচ্ছে মেয়ে দেখতে।”

আহনাফ তড়িঘড়ি করে বলল,
“আমার শার্ট?”
“এটা আজকে থেকে তেনা।”

সারাহ্ হিজাব খুলে গিয়ে বসে। এখনো সে রাগে ফোঁ°সফোঁ°স করছে। আহনাফ ওর কোলে শুয়ে বলল,
“ঘরে বউ কোথায় দেখতেছো? (একটু থেমে) হ্যাঁ, মানছি একটা বেডি আছে। সে আমার সাইদার আম্মু, বউ তো না।”

সারাহ্ ওকে ধা°ক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। কপাল কুঁচকে বলল,
“কবুল পড়েন নাই? এখন অস্বীকার করেন কেন?”

আহনাফ মাথার নিচে দুইহাত দিয়ে বলল,
“একদিন এই বাসায় খাইতে আসছিলাম। একবার খাইলাম একটা বেডি দিয়া দিলো। এখন মনে হইতেছে দুইবার খাওয়া দরকার ছিল, দুইটা বেডি পাইতাম।”

সারাহ্ চোখ রাঙিয়ে বলে,
“একদম উল্টাপাল্টা কথা বলবেন না, আহনাফ।”

আহনাফ হাসিমুখে ধমক দেয়,
“ওই, আহনাফ কেন? কল মি সাদাবের পাপা।”
“আহনাফই বলবো, দুই বেডি মানে কি হ্যাঁ? আমার বোনের দিকে নজর? চোখ খুঁ°চিয়ে তুলে দিবো।”

আহনাফ উঠে বসতে বসতে বলল,
“আস্তাগফিরুল্লাহ। আল্লাহ মাফ করুক, এসব চিন্তা আমার নাই।”

সারাহ্ কিছু বলে না। আহনাফ আবারো বলে,
“বেডি দিলেও একটু ভালো একটা দিতো। কি খেঁ°কখেঁ°কানি দিছে একটা।”

“বেডি কি? কল মি সাইদার আম্মু।”
ভাব নিয়ে কথাটা বলে সারাহ্।

আহনাফ উঠে গিয়ে আরেকটা শার্ট বের করে পড়তে শুরু করে। সারাহ্ আবারো এসে বোতামে হাত দিলে আহনাফ বলে,
“ভেরি ব্যাড ঐশী, তুমি আমার লজ্জাহরণ করছো।”

সারাহ্ সরে যায়। আহনাফ মুচকি হেসে ঠিকঠাক হয়ে বের হয়ে যাওয়ার আগে সারাহ্-র কপালে গভীরভাবে চুম্বন করে বলল,
“চিন্তা করো না, তুমি ছাড়া..”

কথার মাঝেই থেমে যায় সে। দ্রুত পায়ে দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবারো বলে,
“বেডি শুধু দেখবো, ঘরে আনবো না।”

সারাহ্ রাগ দেখিয়ে বলে,
“আর ঘরে আসতেও হবে না। ভাগেন।”

সারাহ্ ওকে ধা°ক্কা দিয়ে বের করে দেয়। আহনাফ হাসতে হাসতে চলে যায়। সারাহ্ সেদিকে চেয়ে থেকে মনে মনে একটা অদ্ভুত কথা ভাবছে,
“লোকটা এতো এতো কথা বলে অথচ ওকে ভালোবাসিটা আজও বলে না, কেন? সেই ভালোবাসা কি তাহসিনার জন্য কেবল প্রযোজ্য?”

হঠাৎ করে সারাহ্-র মনে পড়ে আহনাফের কাছে তো ফোন নেই। নিজের ফোন নিয়ে সে দ্রুত গতিতে বেরিয়ে আসে। লিফট থেকে নেমে আহনাফকে গেইটের কাছে দেখে জোরে ডাকে,
“আহনাফ, দাঁড়ান।”

আহনাফ ফিরে আসে। সারাহ্ জোরে জোরে হাঁপাতে থাকে। একটু দ্রুত হাঁটাহাঁটি করায় তার নিশ্বাস ভারি হয়ে এসেছে।

আহনাফ ওকে ধরে বলে,
“কি হলো?”
“ফোন নিয়ে যান।”

আহনাফ ফোনটা পকেটে নিয়ে কঠোরভাবে বলল,
“তোমাকে আমি যত সাবধানে থাকতে বলি, ততই তুমি এসব উল্টাপাল্টা কাজ করে বসো।”
“সরি।”
“বাসায় যাও।”

সারাহ্ যায় না। বলে,
“নাস্তা করে যান, আসেন।”
“বাইরে খেয়ে নিবো, দেরি হচ্ছে।”
______________________________________

“এখন তুমি কি করতে চাও?”

নিয়াজীর কথা ইমতিয়াজ খুব একটা মাথা ঘামায় না। সকালের নাস্তার জন্য রুটি বানাতে বানাতে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“কি করার কথা বলো? শাফিনকে মে°রে দেই আর তার আগে তোমাকে।”

মিউকো মিউ মিউ শব্দে এসে ইমতিয়াজের পায়ের কাছে দাঁড়ালে, ইমতিয়াজ তাকে কোলে তুলে নেয়। নিয়াজী বুঝে এই ছেলেটার অন্তত ওকে নিয়ে খুব একটা মাথাব্য°থা নেই।

“তোমার মনে হচ্ছে না শাফিন ওখান বেরিয়ে এলে তোমার স্ত্রীকে মে°রে ফেলবে?”

“ভ°য় দেখাচ্ছো?”

“তুমি কি ভ°য় পাচ্ছো?”

ইমতিয়াজ একটু হেসে একমুঠো ক্যাটফুড নিয়াজীর উপর ছুঁড়ে ফেলে। মিউকো গিয়ে নিয়াজীর শরীরের উপর-নিচে বেয়ে বেয়ে খেতে লাগলো।

নিয়াজী কিড়মিড়িয়ে বলল,
“তোমার বিড়াল তোমার মতোই নিশ্চিন্ত।”

ইমতিয়াজ আবারো হেসে রুটি নিয়ে রান্নাঘরে চলে যায়। নাস্তা তৈরি করে টেবিলে রেখে এসে মিউকোকে কোলে নেয়।

ইমতিয়াজ বলে,
“তোমাকে মাসের পর মাস পুষে আমার লাভ নেই।”
“ওয়াদা ভঙ্গ করো না, তুমি তো মুসলিম। আমি সত্য বলেছি, তাই আমাকে ছেড়ে দিতে হবে।”
“তুমি যে সত্য বলেছো তা আগে প্রুভ হোক।”

ইমতিয়াজ রুমে চলে যায়। মিউকোকে চেয়ারে বসিয়ে নিজে গিয়ে মৃত্তিকাকে ডাকে। ফজরের পর থেকে মেয়েটা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সারারাত তার দুচোখের পাতা এক হয়নি। কোনো কারণে সে ঘুমাতে পারেনি, কারণ সে নিজেও নির্দিষ্ট করতে পারেনি।

ইমতিয়াজ আধশোয়া হয়ে ওর মাথায় হাত বুলায়।
“মৃত্তিকা?”

মৃত্তিকা ওর গা ঘেষে শুয়ে পড়ে। ইমতিয়াজ ঘড়ি দেখে বলে,
“সাতটা বেজে গেছে, উঠে পড়ো। হাসপাতালে যেতে হবে।”
“উম, উম।”

ঘুমের মধ্যেই মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ বের করছে মৃত্তিকা। ইমতিয়াজ ওকে কপালে চুম্বন করে। মৃত্তিকা ধীরে ধীরে চোখ খুলে বলে,
“ঘুম পাচ্ছে।”
“হাসপাতালে যাবে না?”

মৃত্তিকা চোখ কচলে উঠে বসে। ইমতিয়াজের পায়ের কথা স্মরণে আসলে বলে,
“পায়ের কি অবস্থা দেখি?”

ইমতিয়াজ টাউজার উপরে উঠায়। হাঁটুর নিচ থেকে গোড়ালি পর্যন্ত ক্ষ°তগুলো দেখে মৃত্তিকা বলে,
“এখন আবার ওষুধ লাগাতে হবে তো? আমি লাগিয়ে দিচ্ছি।”
“ওষুধ খেতেও হবে।”
“খাবারের পর।”
“হুম।”

মৃত্তিকা জলদি জলদি ওষুধ এনে পায়ে লাগিয়ে দিতে দিতে বলে,
“তবে আমি নাস্তা বানাতে বানাতে আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন।”
“নাস্তা তৈরি আছে।”

মৃত্তিকা ওষুধ লাগানো থামিয়ে দেয়। ইমতিয়াজ শার্ট সরিয়ে ঘাড়ের কাছে আঁ°চড়ের দাগ দেখিয়ে বলে,
“দুইটা মিউকো ঘরে আছে, দুজনের আর্ট অসাধারণ। এখানেও একটু লাগিয়ে দাও।”

মৃত্তিকা উঠে চলে যায়। কাল ম°র্গে ওর নখ দিয়েই এই দাগের উৎপত্তি হয়েছে। ইমতিয়াজ সামনাসামনি কথাটা বলে ফেলায় বেচারী বেশ লজ্জায়ও পড়ে গেছে।

ইমতিয়াজ হেসে বলল,
“নাস্তা করে বের হতে হবে।”
“আপনিও যাবেন?”

মৃত্তিকা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে শুরু করে। ইমতিয়াজ ওর পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“উহু, আমি বাসায় থাকবো। তুমি শিল্পাকে নিয়ে যাবে, আহনাফ থাকবে।”

“এখনো কেন নিজেকে লুকাচ্ছেন? যেহেতু আপনি শাফিনকে নিজে মা°রবেন না বলেছেন, তবে কেন বাসায় থাকবেন?”

“বিনা প্রয়োজনে নিশ্চয়ই করছি না।”

“হ্যাঁ, তা করছেন না মানলাম। তবে মি°থ্যা বলায় কি গু°নাহ হচ্ছে না?”

ইমতিয়াজ একটু মলিন মুখে বলল,
“হচ্ছে তো অবশ্যই, ক্ষমা করার মালিক আল্লাহ্।”

ইমতিয়াজ আয়নায় মৃত্তিকার প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমাকে আজকের জন্য হলেও লুকাতে হবে।”

মৃত্তিকা ওর দিকে ফিরে বলে,
“কি ভাবছেন আপনি?”

ইমতিয়াজ মাথানেড়ে বলল,
“যা ভাবছি, ভাবতে দাও। কালকের পরিকল্পনা বাদ দিয়েছি বলেই ভাবছি। সময় হলে সব জেনে যাবে। শরীফ সাহেবকে আজকে বাসায় আসতে বলো।”

মৃত্তিকা আর কিছু বলে না। এখন যে জানতে চেয়েও লাভ নেই। মৃত্তিকা ওর শার্ট সরিয়ে আঁ°চড়ের জায়গায় হাত বুলিয়ে দেয়। ইমতিয়াজ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসতে লাগলো।
______________________________________

গালিব শাফিনের শাস্তির জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। ওর বিশ্বস্ততা নিয়ে প্রশ্ন উঠার কারণ একমাত্র এই শাফিনই ছিল। শাফিন ওকে অপমান করেছে, শাফিনকে শাস্তি দেয়ার কারণ হিসেবে তার জন্য এইটুকুই যথেষ্ট।

সকাল দশটা, কাগজপত্র খুঁজে সে পাকাপোক্ত কোনো প্রমাণ পায় না। শেষবার যখন শাফিনের ফাঁ°সির জন্য উকিল এসব নিয়ে গেছিলো, তারপর এগুলোর হদিস আর কারো কাছে আছে কিনা জানা নেই।

বাধ্য হয়ে আহনাফকে কল দেয় গালিব। মৃত্তিকার কাছে বিথী অনেকদিন থাকায় সে মৃত্তিকার সাথে দেখা করতে চায়, যদি বিথীর কোনো কাগজপত্র মৃত্তিকার কাছে থাকে। তবে ইমতিয়াজের মৃ°ত্যুর খবর পেয়ে সরাসরি মৃত্তিকাকে কল দেয়া তার কাছে অদ্ভুত ঠেকলো।

“হ্যালো?”

গালিবের কথায় অপরদিক থেকে অচেনা একটা নারী কন্ঠ বলে,
“জি।”

গালিব মনে করে, এটা হয়তো আহনাফের স্ত্রী। খুব স্বাভাবিক প্রশ্ন করে,
“মিস্টার আহনাফকে দেয়া যাবে? কিছু জরুরি কথা ছিল।”

“আহনাফ? উনি তো এখানে নেই।”

“কখন আসবেন জানেন?”

“উনি আসবে না, আমি যাবো।”

গালিব কপাল কুঁচকে বলল,
“আচ্ছা বুঝলাম, কখন যাবেন?”

“তা তো আমি জানি না। আজও যেতে পারি, আবার চারদিন পর।”

বির°ক্ত হয়ে গালিব ফোন রেখে দেয়। আহনাফের ফোন হাতে নিয়ে হেসে উঠে অপরূপা। কাল যখন আহনাফ হন্যে হয়ে নিয়াজীকে খুঁজছিলো, তখন সে এই ফোনটা নিয়েছে। ঠিক যেভাবে একজন পকেটমা°র পকেট থেকে ফোন নেয়।

ইমতিয়াজের মৃ°ত্যুর খবর সে পেয়েছে, তবে তার পরপরই মৃত্তিকার বাসায় চলে আসাটা ওর সন্দেহের কারণ হয়েছে। তবুও সে চায় সংবাদটা সত্য হোক, ইমতিয়াজ সত্যিই মা°রা যাক।

এবারে সে আহনাফের নাম্বার থেকে মৃত্তিকাকে ম্যাসেজ দেয়,
“ম্যাডাম মিউকো, মমতাজ বেগম আইসিইউতে নেই। উনি পল্টন আছেন, একটা বাসায় অপরূপার সাথে। আপনি জলদি আসুন।”

ম্যাসেজ সেন্ড করে অপরূপা অপেক্ষা করতে থাকে। ওর উপর করা মৃত্তিকার প্রতিটা আঘাতের বদলা সে নিবে।

ফোন কেঁপে উঠলো। মৃত্তিকা ম্যাসেজটা দেখে চোখ কুঁচকে তাকায়। আহনাফ মাত্রই ওর সামনে থেকে গেল। ওরা আছে ঢাকা মেডিকেলে, তবে পল্টন কখন গেল?

“আহনাফ ফয়েজ?”

মৃত্তিকার ডাকে ফিরে দাঁড়ায় আহনাফ। মৃত্তিকা দ্রুত গতিতে এগিয়ে গিয়ে ম্যাসেজটা দেখিয়ে বলে,
“আপনার ফোন খুঁজে পাননি?”
“না তো। আমার কাছে ঐশীর ফোন।”

মৃত্তিকা মাথা নেড়ে বলল,
“চলুন, আগে আপনার ফোনটা নেয়া যাক। আর এই ব্যক্তিকেও।”

মৃত্তিকা কথা শেষ করে আহনাফের ডাক না শুনেই তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে যায় হাসপাতাল থেকে, আইসিইউতে থাকা মমতাজ বেগমের দিকে একবার তাকিয়ে আহনাফও বেরিয়ে যায়। মৃত্তিকা এক কাজে এসে আরেক কাজে কেন যাচ্ছে।

এরমধ্যে আবারো মৃত্তিকার ফোন কেঁপে ওঠে। এবারে তানজিম কল করেছে।

“হ্যাঁ, তানজিম।”
“আপু, কাল থেকে কোথায় আছো তুমি? ঠিক আছো?”

তানজিমের কন্ঠে উৎকন্ঠা বোঝা যাচ্ছে। অনেক ভ°য়ে ঘাবড়ে আছে সে। ইমতিয়াজের মৃ°ত্যুতে যদি শো°কের বশে মৃত্তিকা কিছু করে বসে, বেচারা ভয় পাচ্ছে।

মৃত্তিকা ওর অবস্থা বুঝেও চুপ থাকে। ইমতিয়াজ ওকে এটাই বলেছে, ওর জীবিত থাকার খবর এখনই কাউকে দেয়ার দরকার নেই।

“হাসপাতাল থেকে সব ব্যবস্থা করবে তানজিম। তবে যেহেতু এখানে পুলিশ কে°ইস আছে, তাই আমাদের ইমতিয়াজের কাছে যেতে দিচ্ছে না।”

“এ কেমন কথা? (একটু থেমে) কিন্তু তুমি কোথায়?”

“রাখছি তানজিম, কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।”

ফোন রেখে মৃত্তিকা দেখে আহনাফের নাম্বার থেকে আরো একটা ম্যাসেজ এসেছে। সেখানে একটা বাসার ঠিকানা দেয়া আছে।

আহনাফ বাইরে আসলে মৃত্তিকা ওকে ম্যাসেজটা দেখালে আহনাফ একটু জোর গলায় বলল,
“আপনার মনে হচ্ছে না, আপনি বাঘের গুহায় যেতে চাচ্ছেন? (একটু থেমে) এটা জামিল ফুপার এপার্টমেন্টের ঠিকানা।”

মৃত্তিকাও পালটা জবাব দেয়।
“তো? ওখানে যে আছে, সে শাফিনেরই কেউ আর আমি ভুল না করলে অপরূপা। এই মেয়েটা প্রতি°শোধের আ°গুনে জ্ব°লছে। একটা চড়ের জন্য তানজিমকে কি মা°র মে°রেছিল জানেন?”

আহনাফ নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বলে,
“আপনি বারবার অতিরিক্ত বুঝেন। ইমতিয়াজ আপনাকে এসব কিছুই করতে বলেনি। সো, যা করতে এসেছেন তাই করেন, আপনার বড়মণির সাথে থাকেন। এছাড়া আমি আপনার সাথে কোথাও যাচ্ছি না।”

“আশ্চর্য ব্যবহার তো আপনার।”

আহনাফ ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে হাসপাতালে ফিরে আসে। সুস্মিতার সাথে দেখা করে। মৃত্তিকাও এসেছে।

সুস্মিতা ওদেরকে বসতে ইশারা করে। তারপর শাফিনের ফাইলটা বের করে বলল,
“গতরাতে শাফিনের অবস্থা কিছুটা উন্নতির দিকে মনে হয়েছিল, তবে এখন আবারো ওর অবস্থার অবনতি হয়েছে।”

আহনাফ মাথা নেড়ে বলল,
“বাঁচবে না মনে হচ্ছে?”

“বেঁচে যাবে, তবে সুস্থ হতে সময় লাগবে। ডা: মাহিন আজকে দেখবে, তারপর আরো ভালোভাবে বোঝা যাবে।”

“আচ্ছা, ধন্যবাদ। আর মমতাজ বেগমকে আইসিইউতেই আটকে রাখতে হবে। বাইরের সাথে যোগাযোগ উনার যত কম থাকবে, ততই ভালো।”

“সবটা তো আমার হাতে নেই, পুলিশ যাকে অনুমতি দেয় সেই ভিতরে যায়। উনাকে আমি ঘুমের ওষুধ দিয়ে রাখছি।”

“ঠিক আছে।”

আহনাফ চলে যেতে নিলে সুস্মিতা বলল,
“তবে মমতাজ বেগম প্রায়ই জেগে থাকেন। ঘুমের ওষুধ উনার খুব একটা কাজ করে না।”

মৃত্তিকা মুখ কুঁচকে ফেলে। অনেকদিন উনাকে ঘুমের ওষুধ প্রয়োগ করেছে সে, এজন্য উনার শরীর এটা সয়ে নিয়েছে।

এখন আবারো মৃত্তিকার ফোনে ম্যাসেজ আসে,
“আপনি এখনো আসলেন না যে।”

মৃত্তিকা বারবার ম্যাসেজ দেখেও কোনো রিপ্লাই না দেয়ায় অপরূপা ধরে নেয় মৃত্তিকা ইমতিয়াজের শো°ক পালনে ব্যস্ত। তার মুখের চওড়া হাসি জানান দেয় সে খুব খুশি।

সামনে থাকা দুজনকে বলে,
“শাফিন বের হোক বা না হোক, আমরা আমাদের ইনতেকাম নিবোই নিবো। মৃত্তিকা বাসায় আছে, আমরা ওখানেই যাবো।”
______________________________________

হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আহনাফ সোজা বাসায় এসেছে। সারাহ্-র সাথে দেখা করে আজই কুমিল্লার উদ্দেশ্যে রওনা দিবে। দুদিন ধরে ক্লাস করাতে পারেনি, নিজের দায়িত্বে অবহেলা সে পছন্দ করে না। তবুও এখন নিরুপায়।

সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা বেজেছে বাসায় আসতে আসতে। রাস্তায় বেশ ভালোই জ্যাম ছিল।

বেল বাজালে জাহাঙ্গীর সাহেব দরজা খুলেন। আহনাফ বেশ লম্বা একটা সালাম দিয়ে ভিতরে আসে। জাহাঙ্গীর সাহেব সালামের জবাব দেন।

“বাবা, আসলে আমি চলে যাবো এখন। ক্লাস মিস হচ্ছে।”

নার্গিস পারভিন ভিতরের রুম থেকে এসে বলল,
“এখন যাবে কেন? সকালে যেও। কুমিল্লা যেতে আর কতক্ষণ লাগবে?”

“তবুও যদি এখন যাই..”
ইতস্তত করে কথা থামায় আহনাফ।

জাহাঙ্গীর সাহেব বললেন,
“আচ্ছা, তুমি ফ্রেশ হও। (নার্গিস পারভিনকে বলেন) নাস্তা রেডি করো।”

আহনাফ রুমে আসলে সারাহ্ বলে,
“সকালে গেলে হয় না?”

আহনাফ হেসে বলল,
“কেন? আসতেই তো বারণ করেছিলে।”
“আহা, সকালে গেলেই হবে।”

আহনাফ ওর কাছে এসে বলল,
“বলো যে, আমাকে তোমার জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে ইচ্ছা করে। এটা বললে থাকবো।”

সারাহ্ চোখ পাকিয়ে সরে গেল। এই লোকটার কি লজ্জাশরম বলে কিছুই নাই। বেহায়া-বেশরম লোক।

“তুমি বলতে পারবে না, আমিও থাকতে পারবো না।”

সারাহ্ কোনো প্রতি°বাদ করে না। ইচ্ছা কি শুধু ওর করে, তার কি কোনো ইচ্ছা নেই? সারাহ্-কে আগলে রাখতে ইচ্ছা করে না তার?
______________________________________

মিউকোকে নিয়ে ডাইনিং এ বসে আছে ইমতিয়াজ। সন্ধ্যা থেকে নিয়াজী ইমতিয়াজ আর মিউকোর এসব রঙ-তামাশা দেখে যাচ্ছে। মুখে ক্রচটেপ থাকায় সে কিছুই বলতে পারছে না।

মৃত্তিকা এখনো বাসায় আসেনি। সে কোথায় গেছে তা ইমতিয়াজকে জানায়নি। অপরূপার পাঠানো ঠিকানায় সে চলে গেছে অপরূপারই খোঁজে। একা কাজে ঝুঁকি বেশি, অথচ তার একা কাজই বেশি পছন্দ।

দরজার লকটা ঘুরছে, মানে কেউ ভিতরে আসার চেষ্টা করছে। ইমতিয়াজ সেদিকে তাকিয়ে মিউকোকে ফ্লোর থেকে টেবিলে তুলে দেয়।

অপরূপা ভিতরে আসে। ইমতিয়াজকে দেখে ভূ°ত দেখার মতো চমকে উঠে সে। ইমতিয়াজ এগিয়ে এসে বাইরে আর কাউকে না দেখে শব্দ করে দরজা লাগায়।

অপরূপার দিকে ফিরে বলে,
“সারপ্রাইজ, ভাবোনি কখনো এভাবে মৃ°ত কারো সাথে দেখা হবে? ম°র্গের লা°শ তোমার সামনে স্থির। আমি জানতাম তুমি আসবে।”

চলবে……

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

দ্বিষষ্টি পর্ব (পর্ব ৬২)

জামিলের এপার্টমেন্টে গিয়ে মৃত্তিকা দেখে গ্যারেজে কোনো একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে, মনে হলো গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান।

মৃত্তিকা এখানে দাঁড়িয়ে যায়। ছয়তলায় যাওয়ার কথা ভুলে সে অনুষ্ঠান দেখতে শুরু করে। মেয়েগুলো সব হলুদ, সবুজ শাড়ি পড়েছে। ফুলের সাজে সবাইকে খুব সুন্দর লাগছে। স্টেজে বাসন্তী রঙের শাড়ি পড়া মেয়েটা বউ।

পেছনে লেখা ‘মেহজাবিনের হলুদ সন্ধ্যা’। অজান্তেই হাসতে থাকে মৃত্তিকা। ওর নামও তো মেহজাবিন, মৃত্তিকা মেহজাবিন মিউকো।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে লিফটের দিকে পা বাড়ায়। লিফটেও কিছু মানুষ উপরে উঠছে, সবাই সেজেগুজে আছে।

মৃত্তিকা লিফটে উঠে ছয়তলার সুইচ চাপলে একটা মেয়ে বলল,
“আপনি ছয়তলায় থাকতেন?”

মৃত্তিকা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলে,
“না, একজনের সাথে দেখা করতে এসেছি।”

“কার সাথে দেখা করবেন? ছয়তলার তিনটা ফ্ল্যাটই তো খালি।”

মৃত্তিকা কপাল কুঁচকে ফেললে আরেকটা মেয়ে বলে,
“হ্যাঁ, ওখানে তো অনেকদিন ধরে কিসের যেন কাজ হচ্ছে। সব টাইলস উঠিয়ে ফেলেছে। দিনের বেলা মাঝে মাঝে দুইটা লোক আসে, এখন কেউ আছে কিনা জানা নেই।”

মৃত্তিকা কপালের ভাঁজ গাঢ় করে ছয়তলায় নামে। ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে আশেপাশে দেখতে শুরু করে।

রাত প্রায় আটটা বেজে গেছে, এখন কি আদৌ এখানে কেউ থাকার কথা। আবারো লিফটের সাইরেনের শব্দ হয়৷ মৃত্তিকা বুঝতে পারে এই ফ্লোরে কেউ এসেছে।

একটা ফ্ল্যাটে ঢুকে সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

“কেউ আছেন? মৃত্তিকা, আপনি কি এখানে?”

কন্ঠটা আহনাফের, মৃত্তিকা চিনে যায়। সে বেরিয়ে এসে আহনাফকে মারতে উ°দ্ধত হলে আহনাফ সরে দাঁড়িয়ে ধ°মক দিয়ে বলে,
“আমি না করার পরেও কেন এখানে এসেছেন? ইমতিয়াজ জানলে কি ভাববে?”

মৃত্তিকাও পালটা ধ°মক দেয়,
“আমার ইচ্ছা, আমি এসেছি। আপনার কি সমস্যা?”

“গলা নামিয়ে কথা বলুন, মিউকো ম্যাডাম। আমার কিন্তু রাগ হচ্ছে।”

“রাগ একা আপনার আছে? আমার নেই? বাচ্চা আমি?”

“বাচ্চা হবেন কেন? সবকিছুর জ্ঞান তো টনটনা। এটা বুঝেন না যে, এখানে আপনার কোনো সমস্যা হলে দায়ভার আমার উপরেও যাবে।”

“আপনি কিন্তু আমার বিষয়ে বেশি নাক গলাচ্ছেন?”

“ইমতিয়াজ থাকলে নাক গলাতাম না। যেহেতু সে নেই, তাই গলানো লাগতেছে।”

“এই ফ্ল্যাটের এ অবস্থা কেন, এখানে সকালে কোন লোক আসে, খবর আছে? আমি খবর নিবো।”

“ওরে সাংবাদিক এলেন?”

“আমার ইচ্ছা, আমি যাবো কি থাকবো?”

আহনাফ গিয়ে সিঁড়িতে বসে পড়ে। মৃত্তিকা আবারো আশেপাশে ঘুরাঘুরি করতে থাকে। একটা রুমে গিয়ে সে অবাক হয়। এ রুমে খাট আছে, লাইট-ফ্যান লাগানো, কয়েকটা ব্যাগ রাখা।

“আহনাফ ফয়েজ, এখানে আসবেন একটু প্লিজ।”

আহনাফ বির°ক্তি নিয়ে উঠে এসে বলে,
“জীবনে কতটা দুঃখ থাকলে আরেক লোকের বউ পাহারা দেয়া লাগতেছে।”

আহনাফ রুমে এসেই হা করে তাকিয়ে থাকে। মৃত্তিকা ব্যাগগুলো ঘাটাঘাটি করে মেয়েদের জামাকাপড় পায়। আরেকটা ব্যাগে ছেলেদের পোশাক।

“এখানে ছেলে-মেয়ে উভয়ই থাকে। এই মেয়ে অপরূপা ছাড়া আর কেউ হতেই পারে না।”

আহনাফ ব্য°ঙ্গ করে বলে,
“তা হবে কেমনে? অপরূপা ছাড়া আর কোনো মেয়ে তো দুনিয়ায় নাই।”

মৃত্তিকা ফিরে তাকিয়ে বলল,
“দেখেন, আপনি পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করতেছেন। বাচ্চাদের মতো আচরণ করেন কেন?”

আহনাফ উত্তর না দিয়ে আশেপাশের জিনিসপত্র দেখতে শুরু করে। সি°গা°রেট, ম°দের বোতল, শুকনো কিছু খাবার পায়। কয়েকটা ছেঁড়া কাগজের সাথে আহনাফের ফোনের কাভারটাও পায়।

আহনাফ মৃত্তিকার দিকে তাকালে মৃত্তিকা একটা বি°চ্ছি°রি হাসি দিয়ে বলে,
“আগে এলে ফোনটাও পেয়ে যেতে পারতেন। এখন কোনো ক্রা°ইম করে আপনাকে ফাঁসিয়ে দিলে আপনার আম, ছালা দুটোই যাবে।”
______________________________________

ইমতিয়াজের মুখোমুখি অপরূপা বসে আছে। বাঁধা নয়, একদম স্বাভাবিকভাবে বসে আছে সে। আহনাফের ফোনটা অপরূপার থেকে নিয়ে নিয়েছে ইমতিয়াজ।

ইমতিয়াজ পায়ের ব্য°থায় একটু কষ্ট পাচ্ছে, কিন্তু তবুও সে যথেষ্ট শান্ত আছে। বাইরে শান্ত থাকলেও ভেতরটা তার অস্থির। রাত হয়ে গেল, অথচ মৃত্তিকা আসলো না।

বাসায় নিয়াজীর সাথে মৃত্তিকাকে রেখে যাওয়া কিংবা নিয়াজীকে একা রেখে যাওয়া খুবই অনিরাপদ, আবার মৃত্তিকাকে একা ছেড়েও যেন ভুল করেছে।

“আমার লোকজন নিচে আছে ইমতিয়াজ। মৃত্তিকা আসলেই কিন্তু ধরা পড়বে।”

অপরূপার কথায় ইমতিয়াজ হেসে দেয়। বলে,
“ওই নারীকে নিয়ে আমার চিন্তা নেই। তোমার শাফিনকে যে নারী বিবির বাজার থেকে ঢাকায় আনতে পারে, তার পক্ষে তোমার দুই-চারজন লোক কোনো ব্যাপার না।”

বেল বাজলে ইমতিয়াজ দ্রুত দরজা খুলে দেখে শরীফ এসেছে। ইমতিয়াজকে দেখে ঠেলেঠুলে কোনোমতে ভিতরে এসে বলল,
“তুমি ঠিক আছো? আমি তো অন্য কিছু শুনেছিলাম।”

ইমতিয়াজ মৃদু হেসে বলল,
“কি শুনেছিলেন?”

“বাদ দাও।”

শরীফ নিয়াজীর দিকে তাকিয়ে বলে,
“ও কে?”

“চেনেন না? নিয়াজী।”

শরীফ ইমতিয়াজের দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“ও এখানে কেন?”

“আমি এনেছি। আর উনি (অপরূপাকে দেখিয়ে) নিজে নিজে এসে হাজির হয়েছে।”

শরীফ আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
“মিউকো নেই?”

“চলে আসবে।”

নিয়াজী আর অপরূপার কথা বলতে বলতে সময় পার হয়ে যায়। রাত দশটার দিকে মৃত্তিকা আসে। বাসায় এসে শরীফকে দেখে অবাক না হলেও অপরূপাকে দেখে সে প্রচন্ড অবাক হয়।

ইমতিয়াজ মৃত্তিকাকে বলে,
“খাচ্ছিলো তাঁতি তাঁত বুনে, কাল হলো তার এঁড়ে গরু কিনে। অপরূপাকে তোমাকে মা°রতে এসেছে।”

ইমতিয়াজের কথায় মৃত্তিকা হেসে বলে,
“বাহ, এখন নিজেই ধরা পড়েছে।”

আহনাফের ফোনটা দেখিয়ে ইমতিয়াজ বলে,
“আহনাফ ফয়েজের ফোন। (একটু থেমে) তুমি এতোক্ষণ কোথায় ছিলে?”

“গিয়েছিলাম আহনাফের ফয়েজের নাম্বার থেকে অপরূপার পাঠানো ঠিকানায়।”

ইমতিয়াজ চোখ রা°ঙিয়ে বলে,
“না গেলে হতো না? আমি তোমাকে বারবার নিষেধ করেছি অতিরিক্ত কিছুই করবে না। আমি তো আগেই বুঝেছিলাম ও আসবে।”

মৃত্তিকা রুমে চলে যায়। ইমতিয়াজ শরীফকে বলে,
“এখন আপনি বলেন আপনি আগে আগে সব কিভাবে জেনে যান? মৃত্তিকাকে কে, কবে, কখন মারতে চেয়েছিল। মৃত্তিকার মামা ওকে একা করতে চায় কি চায় না। (একটু থেমে) ইভেন, যে কথা আমি মনে মনে ভাবিনি তাও জেনে গেছে। হাউ?”

“দেখো রিপা মা°রা যাওয়ার পর মিউকো ইতালি চলে গেছিল। এরপরই আমি জানতে পারি এসব কিছু সাজানো ছিল।”

“কিভাবে জেনেছেন? কার মাধ্যমে?”

শরীফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“সেদিন চারটা খু°ন হয়েছিল। একটা ছেলে মা°রা গেছিলো, ওর ফোনে ভিডিও করছিল। ওই ভিডিওতে আমি কলরবের বাবা দুলালকে দেখেছিলাম।”

“ভিডিও কোথায় পেয়েছেন আপনি?”

“ওর ভাইয়ের ফোন আর ওর ফোনের জিমেইল একাউন্ট একটাই ছিল। ভিডিও জিমেইল রিস্টোর করে নেয়। সেখান থেকে পেয়েছি, মানে ওর ভাইয়ের ফোন থেকে।”

“ওর ভাইকে কোথায় পেয়েছেন?”

“বিষয়টা আমি বলবো কাকতালীয়। ওর ভাই ওকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছিল। সেখান থেকে আবার থানায় গিয়ে মা°মলা করেছিল। সেই মা°মলা নিয়ে হাসপাতালে তার বাবার সাথে হওয়া কথোপকথন শুনে আমার সন্দেহ হয়। বিশেষ করে স্থান আর সময় একই হওয়ায় এই সন্দেহের উৎপত্তি। তারপর কথা।”

ইমতিয়াজ ভ্রূ উঁচিয়ে বলে,
“তা আপনার গ্যাং কবে তৈরি করেছেন?”

“এ গ্যাং আরো আগে থেকেই তৈরি হয়েছে। রিপার সাথে ছাড়াছাড়ির পর থেকেই গ্যাং তৈরি করেছি।”

“কি কি করেছে এই গ্যাং?”

“তেমন কিছু না, আগে গ্যাং ছোট ছিল। শক্তিশালী টিম আমি আরো পরে তৈরি করেছি।”

ইমতিয়াজ শরীফের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“করতোটা কি এরা তখন?”

“রিপার উপর নজর রেখেছে। যেভাবে আমি মৃত্তিকার জন্য স্পা°ই রেখেছিলাম সেভাবে রিপার জন্যও ছিল।”

ইমতিয়াজ এবারে জোরে চেঁচিয়ে উঠে,
“তো সেদিন ওই স্পা°ই গুলো কোথায় ছিল? রিপা বেগমকে সেদিন কেন ওরা বাঁচাতে পারেনি?”

শরীফ মাথানিচু করে ঠোঁট চেপে নিজের কান্না লুকিয়ে বলে,
“আমার বিশ্বস্ত তিনজনের লা°শ পেয়েছিলাম আমি, শাফিন হয়তো বুঝে গিয়েছিল ওরা নজর রাখছে।”

ইমতিয়াজ নিয়াজীকে বলে,
“এ কথা তো তুমি বলোনি?”

“আমি জানি না এ ব্যাপারে। শাফিন আর দুলালের কাছে যে ধরনের মানুষ ছিল, তার কাছে শরীফের এদেরকে আমার চুনোপুঁটি লাগে।”

টেবিলের উপর থেকে কাচের জগটা নিয়ে নিয়াজীর মাথায় আ°ছড়ে ফেলে ইমতিয়াজ। জগ ভে°ঙে কাচের টুকরো তার মুখে মাথা লাগে। গলার আশেপাশেও কয়েক টুকরো লেগেছে। র°ক্ত ঝরা শুরু হয়েছে।

মৃত্তিকা দ্রুত গতিতে বেরিয়ে এসে ইমতিয়াজকে টে°নে সরিয়ে নেয়। রাগে এখনো জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে সে।

শরীফ নিয়াজীকে ধরে ইমতিয়াজকে ধমক দেয়,
“কি করছো তুমি এসব? মে°রে ফেলবে নাকি?”

“ম°রে যাক।”

ইমতিয়াজ রুমে চলে যায়। হুটহাট রাগের উপর তার নিয়ন্ত্রণ কম।

শরীফ কাউকে কল করে। কয়েক মিনিট পর দুজন লোক এসে নিয়াজীকে নিয়ে যায়।

মৃত্তিকা রুম থেকে বলে,
“কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ওকে?”

“ইমতিয়াজের হাতে যেন কারো মৃ°ত্যু না হয়, সে ব্যবস্থা করছি। দরজা লাগিয়ে দাও।”

মৃত্তিকা দরজা লাগাতে গেলে অপরূপা ওকে বলে,
“ভাবো নিয়াজী মা°রা গেল আর ইমতিয়াজের ফাঁ°সি হলো বা যাবজ্জীবন সাজা, শাফিনের মতো সে কিন্তু বের হতে পারবে না।”

অপরূপা কথা শেষে হেসে দেয়। মৃত্তিকা জবাব না দিয়ে অপরূপাকে চেয়ারের সাথে বেঁধে রুমে চলে আসে।

ইমতিয়াজের কাছে গিয়ে বসে বলল,
“এই পাগলামিগুলো কেন করেন আপনি?”

ইমতিয়াজের মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে ওর কপালে-গালে চুম্বন করে মৃত্তিকা। ইমতিয়াজ ওকে টে°নে কাছে এনে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।

নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ওকে ঝাপটে ধরে বলল,
“হয়তো আমার রাগের জন্যই আমরা আলাদা হয়ে যাবো।”

“প্লিজ, এভাবে বলো না। আমার সহ্য…”

মৃত্তিকার কথা মাঝপথে থেমে যায়। অপরূপার শ°কুনি দৃষ্টি ওদের রুমের দিকেই। দরজা অর্ধেক খোলা থাকায় এখান দিয়েই সে দেখছে স্বামী-স্ত্রীর একান্ত কাটানো সময়টুকু।

মৃত্তিকা ইমতিয়াজকে সরিয়ে উঠে যায়। অপরূপার দিকে একবার পূর্ণদৃষ্টি দিয়ে সে সশব্দে দরজা বন্ধ করে দেয়।
______________________________________

আহনাফকে আবারো বাসায় আসতে দেখে সারাহ্ মুখ ভেংচিয়ে ব্য°ঙ্গ করে বলে,
“বড়বড় কথা বলে কে যেন বেরিয়ে গেছিলো? কোথায় তাহার বড়বড় কথা?”

আহনাফ উত্তর দেয় না। নার্গিস পারভিনের ডাকে সারা দিয়ে ডাইনিং এ যায়। নিরবে রাতের খাবার খেয়ে রুমে আসতেই আবারো সারাহ্-র ভাষণ শুরু হয়,

“সাইদা মা, তোমার আব্বা কি বলছিলো?”

কথাটা বলে সারাহ্ নিজের পেটে হাত দিয়ে আবারো বলে,
“একদম তাই, আমি চলে যাবো।”

সারাহ্ বিছানায় বসে হাসতে লাগলে আহনাফ বলে,
“হু, একটা গান আছে, কি যেন এখন মনে পড়তেছে না। (একটু ভেবে) হ্যাঁ মনে পড়ছে।
আমার ঘরেরও রমনী
যেন কাল না°গিনী।
একদম তাই, এমন বাচ্চার মায়ের জন্যই বলছিলো।”

সারাহ্ রেগেমেগে উঠে,
“কি? আমি কাল না°গিনী? আমি কাল সা°প, রাসেল ভাই°পার।”

আহনাফ হেসে বিছানায় ওর পাশে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“তোমার জন্য ফিরে আসিনি, আমি আমার সাদাব-সাইদার জন্য আছি।”

সারাহ্ও আহনাফকে জড়িয়ে ধরে,
“আমি জানি, আমার জন্য জীবনেও থাকবেন না।”

“একদম ঠিক। কাল সকালে কিন্তু যেতেই হবে।”
______________________________________

তিনদিন পর, শাফিনের অবস্থা আজ অনেক খারাপ হয়ে গেছে। হাত আর পায়ে যেখানে যেখানে পে°রেক ঠু°কে দেয়া হয়েছিল, সেখানে পঁচন ধরতে শুরু করেছে।

য°ন্ত্র°ণায় থেমে থেমে চিৎকার করে শাফিন। এমনকি ওর অবস্থা দেখে সহজে কোনো নার্সও ওর কাছে ঘেষতে চায় না।

ডা: মাহিন আর সুস্মিতা এসেছে ওকে দেখতে। একজন নার্স ওয়াশ করতে শুরু করলে আবারো সে চিৎকার করতে থাকে,

“বাঁচাও আমাকে, ও আল্লাহ্, ম°রে গেলাম, কি ব্য°থা।”

মুখ দিয়ে যে যে শব্দ বের হচ্ছে, সে তাই উচ্চারণ করছে।

সুস্মিতা ক্ষ°তস্থান দেখে মুখভঙ্গি পালটে ফেলে। এমনিতেই সে শাফিনকে ঘৃ°ণা করে আর ওর এসব ক্ষ°ত দেখে সুস্মিতা বুঝতে পারে প্রকৃতির প্রতি°শোধ বলে আসলেও কিছু আছে।

“আমি কি ভিতরে যেতে পারি?”

বাইরে কেউ অনুমতি চাচ্ছে। সুস্মিতা দরজার কাছে গিয়ে সুরভিকে দেখে। পুলিশরা ওকে অনুমতি দিচ্ছে না।

সুস্মিতা বলে,
“আসতে দিন, শাফিনের মেয়ে।”

সুরভি মাথানিচু করে ভিতরে এসে বলল,
“পরিচয়টা না দিলেও হতো।”

শাফিনের পরিচয় দিতে সুরভির লজ্জা হয়, ঘৃ°ণা হয়। বিতৃষ্ণা চলে এসেছে তার জীবনের প্রতি।

শাফিনের কাছে গিয়ে ওর এ অবস্থা দেখে সুরভির চোখে পানি চলে আসে। যতই হোক সে তার বাবা।

“নিজের এ হাল করে ছেড়েছো তুমি? আরশে গিয়ে যে চিৎকারগুলো ঠেকেছে, আরশের মালিক কি তার বিচার করবে না ভেবেছো? তুমি ওই আল্লাহ্-কে সেদিন ভুলে গেছিলে আর আজ ডাকছো?”

মনের কষ্টে কথাগুলো বলতে থাকে সুরভি। শাফিনের কানে হয়তো সবগুলো কথা পৌঁছায়নি। সে তো পৃথিবীতে ভোগ করছে তার পা°পের এক ক্ষুদ্রাংশের শা°স্তি।

‘নিশ্চয়ই যারা জা°লেম, তাদের জন্যে রয়েছে য°ন্ত্র°ণাদায়ক শা°স্তি।’ (সুরা ইবরাহিম : আয়াত ২২)

চলবে……

(সতর্কতা- নৃ°শং°স খু°নের বর্ণনা আছে, নিজ দায়িত্বে পড়বেন।)

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

পর্ব ৬৩

নিয়াজী এখন অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছে৷ শরীফের চিকিৎসাতেই সুস্থ হয়েছে। এখন সে বাসায় যাওয়ার জন্য একদম ঠিকঠাক আছে। আর কোনোভাবে সে আহনাফ কিংবা ইমতিয়াজের হাতে পড়তে চায় না।

ঘড়ি দেখাচ্ছে সকাল সাতটা বেজেছে, নিয়াজী হাসপাতালের ছোট বিছানা থেকে উঠে নিজের প্রয়োজনীয় কিছু একটা খুঁজতে, খুব স্বভাবতই তা ফোন। তবে পায় না।

“কিছু খুঁজছো নাকি?”

শরীফ এসে রুমে প্রবেশ করে। নিয়াজী ওকে দেখে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,
“হ্যাঁ, আমি আসলে বাসায় যেতে চাই।”

“আসল ঠিকানায় যাবে? চলো, পৌঁছে দেই।”

নিয়াজী সরতে পারে না, শরীফ ওকে বিছানার সাথে চেপে ধরে বলে,
“রিপাকে মা°রধর করেছি এটাই পৃথিবী দেখেছে, কিন্তু ওকে যে আমি ভালোবেসেছি সেটা কেউ দেখেনি। ওকে মা°রা তোমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।”

নিয়াজী শরীফকে ধা°ক্কা দিয়ে বেরিয়ে যেতে চায়, কিন্তু এবারে সে চির ব্যর্থ হলো। ব্যর্থতাকে আর টপকাতে পারে না।

পি°স্তলে সাইল্যান্সার লাগানো থাকায় শব্দ হয় না, তবে গু°লি চলে। কপাল ভেদ করে চলে যায় গু°লিটি। সাদা বিছানা, সাদা টাইলসের মেঝেতে যেন কেউ আলপনা এঁকেছে। র°ক্তের আলপনা। শেষ নিশ্বাস বের হয়েছে নিয়াজীর।

নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা সেও করেছে। তাহসিনা, তাহমিনা বা রিপা বেগমের মতো সেও বেঁচে থাকার আকুতি ছিল তার চোখেমুখে, কিন্তু বাঁচতে পারেনা।

কপালে একটা গোলাকার গু°লির চিহ্ন, র°ক্তে মাখোমাখো হয়ে আছে। সেই ছিদ্র দিয়ে এখনো বের হচ্ছে টাটকা র°ক্ত।

শরীফ বাইরে এসে ইশারা করলে চারজন লোক নিয়াজীর দেহ নিয়ে ম°র্গে চলে যায়। শরীফ শান্তভাবে হেঁটে নিজের চেম্বারে চলে আসে। চোখের সামনে ভেসে উঠে পুরোনো কথা।

“আমাদের মেয়ের নাম হবে মৃত্তিকা। সুন্দর না নামটা? আমি আগে থেকেই এটা ভেবে রেখেছিলাম।”
মেয়েকে কোলে নিয়ে কথাটা বলে রিপা।

“কি করে বুঝেছিলে মেয়ে হবে?”

“মায়েরা বুঝতে পারে।”

রিপার কথা মনে করে কান্না পায় শরীফের। চোখের পানি বাঁধনহারা হয়ে গড়িয়ে পড়ছে৷ বয়সের এই প্রান্তে এসে ডি°ভোর্স হয়ে যাওয়া স্ত্রীর জন্য কান্না করাটা বেমানান। কিন্তু ভালোবাসা যে বাধা মানে না।
______________________________________

এলার্জি হয়ে মৃত্তিকার হাত-মুখ-গলা লাল হয়ে আছে। আয়নার সামনে নিজের এ অবস্থা দেখে বলে,
“কি হয়েছে দেখেছেন?”

ইমতিয়াজ অফিসে যেতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওর কথায় ভালো করে দেখে বলল,
“আজকে বিকালে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। হঠাৎ এমন হলো কেন?”

“জানি না।”

মৃত্তিকা ছোট করে জবাব দিয়ে নাস্তা তৈরি করতে চলে যায়। টেবিলে নাস্তা রেখে অপরূপার দিকে আড়চোখে কয়েকবার তাকালো।

অপরূপা মৃদু হেসে বলল,
“সকালে অন্য মেয়েদের গায়ে লাভ বাইট থাকে আর তোমার এলার্জি? বাহ, বাহ।”

ঘর থেকে ইমতিয়াজ কথাটা শুনে। সে বেরিয়ে এসে বলল,
“আমার স্ত্রীর লাভ বাইট দেখার শখ তোমার জাগে কেন? এধরনের ফালতু কথা আরেকবার শুনলে খুব খারাপ হবে।”

মৃত্তিকা নাস্তা নিয়ে রুমে চলে যায়। বিছানায় খাবার রেখে গাল ফুলিয়ে বসে থাকে। ইমতিয়াজ ওর মুখোমুখি বসে ওর মুখের সামনে খাবার তুলে বলল,
“খাবে না?”

মৃত্তিকা খাবার মুখে নিয়ে বলে,
“কি করবেন ওকে দিয়ে?”

“অফিসারদের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা করবো।”

“যদি শাফিনের আরো লোক থাকে? আর ওকে আর শাফিনকে বাঁচিয়ে নেয়।”

“সম্ভাবনা কম, শাফিনের অবস্থা এমনিতেই খুব খারাপ। ওর লোকেরা ওর সাহায্য আর করবে বলে মনে হয় না।”

“আপনি যে বলেছিলেন এবারে শাফিনকে অন্য ফাঁ°দে ফেলবেন। ওর এ অবস্থায় কিভাবে সম্ভব?”

ইমতিয়াজ মাথানেড়ে খেতে থাকে। চুপচাপ খাওয়া শেষ করে বলল,
“চাইলে এ অবস্থায়ও সম্ভব। অফিসার গালিব চেষ্টা করছে, অফিসার রিজভি চেষ্টা চালাচ্ছে। সবাই তো আর শাফিনের পক্ষে না। তবে ফাঁ°দে তাকে পড়তেই হবে।”

“ফাঁ°দটা কি?”

ইমতিয়াজ ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“যদি শাফিন এবারেও বেঁচে ফিরে, তবে বুঝতে পারবে।”

মৃত্তিকা উঠে এসে ইমতিয়াজকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“সব ভালো থাকুক। ফে°তনা দূর হোক।”

ইমতিয়াজ ওর গলায় ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বলে,
“অফিস যেতে হবে তো।”

মৃত্তিকা সরে যায়। গত পরশুদিন তানজিম আর সুরভি বাসায় এসে ইমতিয়াজকে দেখে যে ভয়টা পেয়েছে, সেটা ভেবে এখন আবারো মৃত্তিকার হাসি পায়।

“নিজে নিজে হাসছো কেন?”

“এমনিতেই, রেডি হয়ে নিন।”
______________________________________

সুরভি শাফিনের কাছেই আছে। মমতাজের দিকে সে ফিরেও তাকায় না। মমতাজ বেগম উঠতে পারে না, নিজে নিজে খেতে পারে না। সামান্য পানিটুকু চাইলেও সুরভি তা দেয় না। ঘৃ°ণার পরিমান এতো বেশি হয়েছে যে সে ওদেরকে মে°রে ফেলতে পারলে বাঁচে।

অপরূপার উপরেও তার রাগ আছে। অপরূপার সত্যটা জানতে পেরে সুরভি বাবাকে আরো বেশি ঘৃ°ণা করছে। পরশু যখন অপরূপাকে মৃত্তিকার বাসায় দেখেছে, তখন থেকে সে আরো চুপ আছে।

ঝড় আসার আগে প্রকৃতি যেমন শান্তরূপে নিজেকে পরিবেশন করে, সুরভিও তেমনি আছে।

“সুরভি, মা আমার, একটু পানি দাও।”

মমতাজ বেগমের কথা উপেক্ষা করে নিজেকে শান্ত রেখে সে বেরিয়ে আসে। মৃত্তিকার বাসায় চলে এসেছে সে।

সকাল সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। মৃত্তিকা মনোযোগ দিয়ে একটা বই পড়ছে আর মিউকোর গায়ে হাত বুলাচ্ছে। বেল বাজায় চমকে উঠে।

মৃত্তিকা ধীরপায়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। সুরভি ভিতরে এসে মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ইমতিয়াজ বাসায়?”
“না, অফিসে গেছে।”

সুরভি মাথানেড়ে অপরূপার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মৃত্তিকাকে বলে,
“বাবা তোমার সাথে দেখা করতে চাচ্ছে, মিউকো। দেখা করবে?”

নিজের থেকে বানিয়ে মিথ্যা কথা বলে দেয় সুরভি। মৃত্তিকা একটু চমকে উঠে। আবার শাফিনের কুৎসিত অবস্থা নিজের চোখে দেখার ইচ্ছাও জাগে। ইমতিয়াজ জানলে ওকে যেতে দিবে না, তাই না জানিয়েই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে।

“আমি যাবো, আপু।”

“ঠিক আছে, তুমি তৈরি হয়ে বের হও। আমি ওকে পাহারা দিচ্ছি।”

মৃত্তিকা অপরূপার দিকে ইশারা করে বলল,
“ও কিন্তু অনেক বিপজ্জনক।”

“ও কতটা খাতারনাক, আমি তার চেয়ে বেশি খাতারনাক।”

মৃত্তিকা মৃদু হাসে। দ্রুত তৈরি হয়ে সে বেরিয়ে যায় হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। ও চলে গেছে সুরভি অপরূপার কাছে এসে বলে,
“এখন যদি তোমাকে ছেড়ে দিই, কোথায় যাবে?”

অপরূপা মুখ বাঁকিয়ে বলে,
“আগে তোমাকে মা°রবো আর তারপর মৃত্তিকাকে। ইমতিয়াজকে একা করবো আমি।”

“তোমার কি সমস্যা ইমতিয়াজের সাথে?”

“মৃত্তিকাকে এতো ভালোবাসে কেন? এতো আদর কিসের জন্য?”

হিং°সার অনলে জ্ব°লছে অপরূপা। সুরভি সোজা হয়ে বসে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,
“চলো তবে, মা°রবে মৃত্তিকাকে।”

প্রায় আধঘন্টা পর সুরভি অপরূপাকে নিয়ে বের হয়। কোনো জোরাজুরি না করেই অপরূপা ওর সাথে আসছে। সিএনজি করে হাসপাতালে পৌঁছায় ওরা।

এদিকে মৃত্তিকা শাফিনের সাথে দেখার করার অনুমতি পেয়ে ভিতরে এসে শাফিনের অবস্থা দেখে।

পঁ°চা অংশ থেকে গন্ধ ছড়াচ্ছে। সময়মতো পরিষ্কার করা হয়নি বলে এ অবস্থা হয়েছে। মৃত্তিকার গা গু°লিয়ে আসে।

মমতাজ বেগমের কাছে গিয়ে বলল,
“বড়মণি?”

দুবারের ডাকে মমতাজ বেগম চোখ খুলেন। হাত উঠিয়ে বলে,
“এসেছো মা? একটু পানি দিবে।”

দুর্ঘটনায় উনার বুকে ব্য°থা পেয়েছিল। থেকে থেকে সে ব্যথায় কাতরে ওঠে। মৃত্তিকা উনাকে ধরে উঠিয়ে পানি পান করিয়ে দেয়।

মমতাজ বেগম আবারো শুয়ে বলে,
“আমি তোমাকে মা°রার জন্য শাফিনের ঠিকানা বলিনি, তোমাকে আমি এখন আর মা°রতে চাই না মা।”

মৃত্তিকা অপলক তাকিয়ে বলল,
“মাম একটা কথা বলতো, খালা নাকি মায়ের চেয়ে ভালা। আর আমার খালা আমার মাকেই মে°রেছে।”

মৃত্তিকা মুখ ঘুরিয়ে নেয়। চোখের পানি লুকাতে ব্যস্ত হয় সে।

শাফিনের কাছে গিয়ে বলে,
“তোমার মনের মতো তোমার শরীরটাও পঁচতে শুরু করেছে। এই হাত দিয়ে মেয়েগুলোকে স্পর্শ করেছিলে, তাই না? মজলুমের অভিশাপ বিফলে যায় না মামা।”

কঠিন প্রশ্নে চেয়ে থাকে শাফিন। মৃত্তিকা আবারো বলে,
“কেন ডেকেছো তাই বলো? কেন দেখা করতে চেয়েছো?”

শাফিন নিচুস্বরে বলল,
“তোমাকে আমি আসতে বলিনি।”

শাফিনের বামহাতে হাতকড়া লাগানো আছে। লোহার ভারি কড়াটা শব্দ করে নাড়িয়ে বলে,
“এই হাত খোলা থাকলে এখনই তোমাকে মে°রে দিতাম। তোমার জন্য আমি মৃ°ত্যু য°ন্ত্রণা সহ্য করছি।”

“এগুলো কর্মফল।”

শাফিন আবারো চোখ বন্ধ করে ফেলে। ডানহাতের আঙ্গুলগুলো তার নড়ছে। ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে, যেন সে হাত নাড়াতে চাচ্ছে। মৃত্তিকা সেদিকে তাকিয়ে আছে।

কিছুক্ষণ পর অপরূপাকে টে°নে ভিতরে এনে ফেলে সুরভি। মৃত্তিকা চমকে উঠে বাইরে তাকায়। দুজন পুলিশ তাদের জায়গায় নেই। আইসিইউর সামনে পুরো স্থান ফাঁকা।

“আপু?”

মৃত্তিকার ডাকে সুরভি উত্তর দেয়,
“চুপ করো, বাধা দিও না।”

সুরভি শাফিনকে ডেকে বলে,
“বাবা, তোমার সুন্দরী, যুবতী, সুনয়না স্ত্রী দেখা করতে এসেছে। যার রূপে পাগল হয়ে তুমি আমার মায়ের সাথে প্র°তা°রণা করেছো, সেই অপরূপা এসেছে। দেখো তুমি।”

শাফিন ধীরে ধীরে চোখ খুলে। সুরভি অপরূপার চুলের মুঠি ধরে ওকে শাফিনের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলে,
“সবাই সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে, শুধু আমার বাবা আর আমি ছাড়া।”

অপরূপার মাথাটা বিছানায় চেপে ধরে ওড়নার নিচ থেকে বড় ছু°ড়িটা বের করে অপরূপার গলায় গভীর করে চালিয়ে দেয় সুরভি। চিৎকার দেয়ার সময়টুকু অপরূপা পায় না। ছু°ড়ি দিয়ে খুঁচিয়ে র°ক্ত আরো বের করে সুরভি।

মৃত্তিকা ধরতে আসতে নিলে সুরভি ধমক দেয়,
“খবরদার কাছে আসবে না। এখানে তোমার কিছু নেই। চলে যাও।”

সে নিজেও কান্না করে দিয়েছে। র°ক্তে মাখোমাখো হয়েছে তার শরীরের পোশাক। ছটফট করতে থাকা অপরূপাকে ধরে রাখতে রাখতে মুখে-গলায়-হাতে র°ক্ত মেখে ভ°য়ং°কর রূপ এসেছে সুরভির।

“সন্তানের হাতের মৃ°ত্যুর চেয়ে তোমার জন্য কোনো বড় শাস্তি নেই বাবা।”

মমতাজ বেগম এসব দেখে চিৎকারে করে উঠে। শব্দ শুনে কয়েকজন পুলিশ সদস্য ভিতরে চলে আসে।

সুরভি শাফিনের উপর ছু°ড়ি চালাতে নিলে দুজন মহিলা কন্সটেবল জোরপূর্বক সুরভিকে ধরে ফেলে। সরিয়ে আনে শাফিনের কাছ থেকে। তবুও শাফিনের হাতে ছুড়ির আঁ°চড় পড়ে, কে°টে র°ক্ত ঝরা শুরু হয়েছে।

সুরভি এখনো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শাফিনের দিকে। বাবার প্রতি তার চরম ঘৃ°ণা, এতোটাই ঘৃ°ণা যে বাবাকে মে°রে ফেলতেও সে দ্বিধা করবে না।

মৃত্তিকা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। আকস্মিক ঘটনায় মানসিকভাবে বিপ°র্য°স্ত হয়ে পড়েছে সে। এই পরিবারের কেউ আবারো খু°ন করলো। তানজিম ঠিক বলেছিল এ র°ক্তে খু°ন ঘুরছে।
______________________________________

দশদিন পেরিয়ে যায়। দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে সারাহ্ নিজের রুমে শুয়ে আছে। আহনাফ গতকাল আসেনি, সেই যে শুক্রবারে গেল তারপর যেন বাসার পথই ভুলে গেছে। সারাহ্ও অভিমান করেছে, কোনো কল দেয়নি।

কলিং বেল বাজলে সে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখে অপরিচিত কয়েকজন মেয়ে এসেছে, হাতে একটা দানবাক্স।

“আসসালামু আলাইকুম।”

এক মেয়ের সালামের জবাব দেয় সারাহ্।
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। জি বলুন।”

“আমরা একটা বৃদ্ধাশ্রমের জন্য টাকা সংগ্রহ করছি।”

মেয়েগুলোর পিছন থেকে “টুকি” বলে বেরিয়ে আসে সামিহা। তাড়াহুড়ো করে বলে,
“আমি ওদেরকে নিয়ে এসেছি, জলদি জলদি টাকা বের করো।”

সারাহ্ পুরো দরজা আগলিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“এ টাকা কোথায় যাবে?”
“বৃদ্ধাশ্রমে, সত্যি বলছি। আমরা মিথ্যা বলি না, আমি তো না-ই।”

সারাহ্ কপাল কুঁচকে গিয়ে পার্স থেকে দুইশ টাকার নোট দিয়ে বলে,
“যাবো একদিন ওই বৃদ্ধাশ্রমে, দেখবো টাকার কি হচ্ছে।”

মেয়েগুলো চলে যায়। সামিহা ভিতরে এসে হেলেদুলে হেঁটে হেঁটে বলছে,
“আপু, তুমি সোজা হবা কবে?”

“কেন? আমি কি বাঁকা?”

“না, কোমড়ে হাত দিয়ে এমন সাপের মতো হাঁটা থামাবা কবে তাই বলো।”

“তবে রে।”

সারাহ্ ওর দিকে কুশন ছুঁড়ে দিলে সামিহা দৌড়ে পালায়। তারপর আবার রুম থেকে উঁকি দিয়ে বলে,
“আমিও ইমতিয়াজ ভাইয়ার মতো একদিন ম°রার ভাণ ধরে থাকবো। তখন দেখবো তুমি কেমনে কা°ন্দো।”

সারাহ্ কপাল কুঁচকে ফেলে। সামিহা রুমে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। তানজিমের কাছ থেকে ইমতিয়াজের মৃ°ত্যুর অভিনয়ের কথা শুনেছে সামিহা।

সারাহ্ রুমে চলে এসেছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে বলল,
“কোলে কবে আসবি, সোনা? আমার যে আর ধৈর্য থাকছে না।”
______________________________________

সুরভিকে জে°লে নেয়া হয়েছে আজ দশদিন। রাইদ মাকে ছাড়া খুবই কান্নাকাটি করে। সুরভি ছেলেকে দেখে না, দেখা করতে আসলেও কাছে যায় না।

অপরূপার দা°ফনের কাজ অনেক আগেই শেষ হয়েছে৷ নিয়াজীর খু°নের কথাও এখন ওপেন সিক্রেট বলা যায়, তবে শরীফকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

দেলোয়ারা তো আগে থেকেই নিষ্প্রাণ হয়ে আছে। স্বামীর এ অবস্থার পর মেয়ের জেল, উনি যে বেঁচে আছেন সেটাই বেশি।

রাইদকে মৃত্তিকা কোলে নিয়ে শান্ত করতে চেষ্টা করছে। দেলোয়ারা এখন মৃত্তিকার বাসায়, ওর সাথেই আছে।

“বাবা আমার, সোনা আমার, আর কাঁদে না। একটু খাও।”

ফিডার দিয়ে অল্প অল্প করে দুধ খাওয়াচ্ছে ওকে মৃত্তিকা। ছোট মানুষ, মা ছাড়া বুঝেটা কি? বাবা তো মাকে ছেড়েই দিয়েছে।

সমস্তটা দিন মৃত্তিকা ওকে নিয়েই কা°টিয়েছে। রাতে ইমতিয়াজ বাসায় এসে দেখে ক্লান্ত মৃত্তিকা রাইদের পাশে আরামে ঘুমাচ্ছে। ওকে ঠিকঠাক করে শুইয়ে দিয়ে কপালে চুম্বন করে দেয়।

রান্নাঘরে গিয়ে দেখে রাতের খাবার প্রস্তুত।

ইমতিয়াজ নিজে নিজেই বলে,
“গিন্নি তবে পারফেক্ট হচ্ছে।”

পেছন থেকে দেলোয়ারার কন্ঠ পাওয়া যায়।
“আরে ইমতিয়াজ, এসে গেছো। ফ্রেশ হয়ে নাও, আজ আমি রান্না করেছি।”

ইমতিয়াজের মুখটা শুকিয়ে যায়। তবে এসব রান্না দেলোয়ারা করেছে। পরক্ষণেই হাসে সে, সবসময় স্ত্রীরা রান্না করবে কেন? মাঝে মাঝে স্বামী তাকে রেঁধে খাওয়াতে নিষেধ নেই। ওদের সম্পর্ক না হয় উল্টোই হোক।
______________________________________

মধ্যরাতে কাঁপুনি দিয়ে জ্ব°র এসেছে শাফিনের। জ্ব°রে কাঁপছে, ব্য°থায় চিৎকার করছে আর মনে মনে আফসোস করছে সে।

যদি জামিল, দুলাল বেঁচে থাকতো, তবে সে ঠিকই বেঁচে যেতো। আজ তার খারাপ সময়ে বিশ্বস্ত লোকগুলোও যেন পালিয়েছে। কারো কোনো খোঁজখবর নেই।

মমতাজ বেগম অনেকটাই সুস্থ, তবে বয়সের তুলনায় দুর্ঘটনার ভারটা সে নিতে পারছে না। শাফিন জানে মমতাজ পালাবে না, তবে তাকেও যে পালাতে দিবে না।

পা তার সম্পূর্ণ অবশ, হাত একটু নাড়াতে পারে। নাড়ালেই পঁ°চা-গলা মাংস খুলে পড়তে শুরু করেছে। শাফিন চিৎকার করে। একজন কর্তব্যরত ডাক্তার ভিতরে আসলে মমতাজ বলে,

“ওকে দূরে সরাও, না হয় আমাকে সরাও। ওর চিৎকার আমার ভালো লাগে না।”

ডাক্তার শাফিনকে ঘুমের ওষুধ প্রয়োগ করে। এছাড়া কোনো উপায়ও নেই। ক্ষ°ত সারানোর ওষুধ ওর উপর কেন যেন কাজ করছে না। ক্ষ°ত শুকাচ্ছে না, বরং আরো বাড়ছে। ভ°য়ং°কর রকম দূ°র্গন্ধ আসছে তার থেকে।

“আমাকে সুস্থ করো, নাহয় মে°রে ফেলো। সহ্য হচ্ছে না আমার। মিউকো, ছাড়বো না আমি তোমাকে।”

চলবে….

অনুভূতিরা শব্দহীন পর্ব-৫৮+৫৯+৬০

0

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

অষ্টপঞ্চাশৎ পর্ব (৫৮ পর্ব)

“জানেন আজ একটা ঘটনা ঘটেছে।”

রাতের খাবার শেষে একটু গল্পগুজব শেষ করে মাত্রই ঘুমাতে এসেছে আহনাফ। বিছানায় শোয়া মাত্রই উপরোক্ত কথাটা বলে সারাহ্।

“কি ঘটেছে?”

সারাহ্ খুব আগ্রহ নিয়ে বিছানায় বসে বলল,
“একটা চেনা কন্ঠ শুনেছি। যে কন্ঠের মালিক আমাকে বাঁচিয়েছে, তাকে দেখেছি।”

এবারে আহনাফ উঠে বসে। কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়েছে। মাথা নেড়ে বলল,
“মানে কি?”

সারাহ্ সকালের পুরো ঘটনা খুলে বলে। আহনাফ আবারো খানিক চিন্তায় পড়ে যায়। এ আবার কেমন সমস্যা আসলো?

আর সময় নষ্ট না করে সে বেরিয়ে যায়, সারাহ্ উঠে দরজা পর্যন্ত আসে। আহনাফের সাথে বের হওয়ার সাহস ওর হয়ে উঠে না।

আহনাফ এসে হাজির হয়েছে পাঁচতলায়। চারটা ফ্ল্যাটের মাঝে কোনটাতে থাকে সে ব্যক্তি, তা নিয়ে বি°ব্রত হলেও সারাহ্-র কথা অনুযায়ী ফ্ল্যাট ফোর-বি তে বেল বাজায়। তবে বেল বাজে না। বাজবে কিভাবে? এখানে তো বেল লাগানোই নেই।

দরজায় নক করে আহনাফ। জোরে জোরে কয়েকবার নক করলে শরীফ ভিতর থেকে বলে,
“কে?”

আহনাফ গলা ঝেরে বলল,
“নিচের ফ্ল্যাট থেকে এসেছি, এখানে শব্দ হচ্ছে তাই।”
“এখন কোনো শব্দ নেই, যেতে পারেন।”

শরীফ দরজা খুলে না। আহনাফ আরেকবার দরজায় নক করে বলে,
“একটু বাইরে আসবেন কথা আছে।”

লুকিং হোলে আহনাফকে দেখে শরীফ আর বের হয় না, ভিতর থেকে বলে,
“যা বলবেন ওখান থেকেই বলুন, আমি জবাব দিবো।”

আহনাফ নিশব্দে চলে যায়। লোকটাকে দেখার অনেক বেশি ইচ্ছে তার, তবে সে ইচ্ছে অপূর্ণ থাকে।

এদিকে মৃত্তিকার ফোনে ইমতিয়াজ অনবরত কল করছে। একই স্থানে স্থির মৃত্তিকা কান্না ভরা চোখে কম্পনরত ফোনের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। ঘূর্ণায়মান পৃথিবী তার জন্য বোধহয় থেমে গেছে। এদিন কাটবে না, এ মাস শেষ হবে না, সুন্দর একটা সকাল হয়তো তার দেখা হবে না। এমনটাই মনে হচ্ছে মৃত্তিকার।

শরীফ এসে তানজিমকে বলল,
“আহনাফ এখানে?”

“হয়তো আপুর সাথে দেখা করতে এসেছে।”

“কোন আপু?”
কপাল কুঁচকায় শরীফ।

“উনার ওয়াইফ, সারাহ্। চারতলায় থাকে।”

শরীফ মাথা নেড়ে ভিতরে যায়। সে জানে সারাহ্ এখানে থাকে, তার সাথে দেখা হয়েছিল তো।

মৃত্তিকা ওকে দেখেও একইভাবে বসে থাকে। শরীফ মৃত্তিকার ফোন হাতে নিয়ে বলে,
“ইমতিয়াজ বারবার কল করছে।”

মৃত্তিকা মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
“অপরূপা ইমতিয়াজের কথা বলেছে, বড়মণি পঞ্চম ব্যক্তিকে চেনে না, শাফিন ও ইমতিয়াজের কথাই বলেছে। এর অর্থ কি দাঁড়ায়?”

শরীফ চুপ করে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মৃত্তিকা আবারো বলে,
“অপরূপা অনেকদিন থেকে আমার কাছে জি°ম্মি। তাই শাফিন আর ওর পরিকল্পনা করার কোনো সুযোগ হয়নি, তবে একই কথা কেন দুজনে বলেছে?”

শরীফ ওর মুখোমুখি বসে।
“দেখো, আমি বুঝতে পারছি, ইমতিয়াজ নামটা শুনে তোমার কেমন লাগছে? তবে একটা বিষয় মাথায় রেখো এই শাফিন তোমার মায়ের নামেও আমার কাছে অনেক কথা বলেছে, পথ°ভ্র°ষ্ট করেছে আমাকে। (একটু থেমে) বুদ্ধিমানের জন্য ইশারা যথেষ্ট।”

হ্যাঁ, মৃত্তিকার জন্য ইশারা যথেষ্ট হলো। সে বুঝতে পারলো এমনও হতে পারে যে শুধুমাত্র ওর সংসার ভা°ঙার জন্য ইমতিয়াজের উপর জোর করে দোষ চাপানো হচ্ছে।

“আমাকে সকালে বাসায় দিয়ে আসবেন?”

মৃত্তিকার কথায় শরীফ চলে যেতে নিয়েও থেমে দাঁড়িয়ে বলে,
“ঠিক আছে, রেডি থেকো।”
______________________________________

সকাল সকাল মৃত্তিকা ঠিকই এসে বাসায় হাজির হয়। কলিং বেল বাজাতে না বাজাতেই ইমতিয়াজ দরজা খোলে। শরীফ উপরে আসেনি, তানজিমকে বাসায় একা রেখে এসেছে বলে দ্রুত চলে যায়।

দরজা খুলে দেয় ইমতিয়াজ ঠিকই, কিন্তু ওকে ভেতরে ঢোকার জায়গা দেয় না। মৃত্তিকা ওকে পাশ কাটিয়ে ঢুকতে নিলে ইমতিয়াজ ওর হাত ধরে বাইরে বের করা দেয়।

“ভিতরে যাই, আমি বলছি সব কথা।”

মৃত্তিকার কথায় ইমতিয়াজ জবাব দেয়,
“তুমি যেটা বলবে মি°থ্যাই বলবে।”

মৃত্তিকার সেই এক মিথ্যার রেশ ধরে, ওকে আর বিশ্বাস করে না ইমতিয়াজ। মৃত্তিকা ওকে ধা°ক্কা দিয়ে ভিতরে চলে আসে।

“বাবার সাথে ছিলাম, এই কথাটা কি বিশ্বাস হচ্ছে না?”

ইমতিয়াজ শব্দ করে দরজা বন্ধ করে বলে,
“তুমি তোমার বাবার সাথে ছিলে, তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তুমি ফোন কেন রিসিভ করোনি? কাল যখন বাসায় আসতে বলেছি তখন কেন আসনি?”

“ইচ্ছে হয়নি, তাই আসিনি।”

“তো এখন কেন এসেছো? রাতে কোন মেয়ে নিয়ে ছিলাম কিনা সেটা দেখতে?”

ইমতিয়াজ শোবার রুমের দরজা খুলে বলে, “দেখো, কে আছে দেখো। ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন, এখানে দেখো।”

মৃত্তিকা রেগেমেগে বলে,
“চিৎকার করবেন না আর ভদ্রতা বজায় রাখুন।”

“এখন আমি চিৎকার করছি? দু দুটো রাত তুমি বাসার বাইরে ছিলে। কোথায় ছিলে, কি করছো, কোনো কিছু জানাওনি। ফোন বন্ধ রেখেছিলে, যাও কল রিসিভ করলে কথা শেষ না করে কে°টে দিলে, তারপর সারাদিনে আর কোনো যোগাযোগ নেই।”

ইমতিয়াজ ওর কাছে এসে বলে,
“তোমার কি মনে হয় আমি তোমার বাবার বাসায় যাইনি? ওখানে তুমি ছিলে না, অপরূপাও ছিল না। হাসপাতালে গিয়েছিলাম, উনি ছিল না। কোথায় ছিলে তোমরা?”

মৃত্তিকা রুমে চলে যায়। হিজাব খুলে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলে,
“আপনি আমাকে সন্দেহ করছেন, তাই না?”

“না, এটা সন্দেহ না, তবে জবাবদিহিতা তোমাকে করতে হবে।”

একটু থেমে ইমতিয়াজ বলে,
“বিবির বাজার কেন গিয়েছিলে তোমরা?”

মৃত্তিকা চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকায়। এমনিতেই মৃত্তিকা ওকে সন্দেহ করে, তার ওপর বিবির বাজার যাওয়ার খবর সে কোথায় পেল? আরো একটা প্রশ্ন এসে দানা বাঁধে মৃত্তিকার মনে।

মৃত্তিকা কিছু বলার আগেই ইমতিয়াজ বলে,
“থাক, তোমাকে আর কোনো কথা বানাতে হবে না। কারণ সত্যটা তুমি আমাকে বলছো না।”
______________________________________

শুক্রবার দিন পুরো পরিবার একসাথে নাস্তা করবে। সামিহা টেবিল সাজাচ্ছে। সারাহ্ বেশ আরাম করে বসে বলে,
“মা, তোমার মেয়ে কিন্তু বেশ কাজের হচ্ছে।”

নার্গিস পারভিন হাসলেন, নিচুস্বরে সারাহ্-কে বলেন,
“আহনাফকে ডেকে আনো।”

সারাহ্ উঠে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আহনাফ সবে মাত্র উঠে ফ্রেশ হয়েছে। সারাহ্ ন্যাকাসুরে ডাকে,
“সোয়ামি।”

আহনাফ যেন ভী°ম°ড়ি খেয়ে উঠে। চোখে চঞ্চলতা রেখে বলে,
“কিসব বলছো?”
“ওমা, কি বললাম? আপনাকে নাম ধরে তো ডাকা যাবেনা, তাই এই পদ্ধতি অবলম্বন করা আরকি। আমি আবার খুব বুদ্ধিমান (একটু থেমে) সরি, বুদ্ধিমতী।”

আহনাফ কিছু বলার আগেই নার্গিস পারভীন ওদেরকে ডেকে বলে,
“এসো তোমরা, সারাহ্ এসো। আহনাফ এসো, বাবা।”

আহনাফ একটু উঁচু গলায় বলে,
“আসছি।”

রাস্তার টেবিলের খাবারের চেয়ে গল্প বেশি জমে উঠে। একপ্রকার হাসি তামাশায় মেতে উঠেছে সবাই। নাস্তা শেষে ড্রয়িং রুমে বসে জাহাঙ্গীর সাহেব ও আহনাফ এটা সেটা নিয়ে কথা বলছে। এর মাঝে সামিহা এসে পুরনো পত্রিকার শেলফটা ঘাটাঘাটি শুরু করেছে।

জাহাঙ্গীর সাহেব বলে,
“কি খুঁজছো?”

“একটা কাগজ, বাবা। এখানে রেখেছিলাম।”

একটা ছবি এসে আহনাফের পায়ের কাছে পড়ে। ছবিটার দিকে তাকিয়ে সে অবাক হয়, এ যে ইমতিয়াজ।

“উনি কে সামিহা?”

আগে পিছে তেমন কিছু না ভেবেই আহনাফ সামিহাকে প্রশ্ন করে বসে।

সামিহা সরল জবাব দেয়,
“মিউকো আপুর হাজব্যান্ড।”
“উনার ছবি তোমার শেলফে কেন?”

সামিহা হেসে বলে,
“শুধু ছবি না সিভিও আছে। আপু যখন মাস্টার্সে, তখন প্রস্তাব এসেছিল বিয়ের।”

আহনাফ আর কিছু না বলে নিরবে উঠে চলে যায়। তার মানে ইমতিয়াজকে উনারা সবাই চেনে। যদিও ঘটনা অনেক আগের তাই এটা নিয়ে আহনাফের কোনো মাথাব্য°থা নেই।

রুমে বসে সে গালিবকে ফোন দেয়। শাফিনের আপডেট জানতে ফোন দিলেও, সে আপডেট পায় ডাক্তার আরিফার। আরিফা হঠাৎ করেই প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে গেছে এবং তাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে, অবস্থা খুবই শোচনীয়।

এদিকে আরিফা হাসপাতালে আসার খবরে শরীফ ঢাকা মেডিকেলে এসেছে। অন্যান্য ডাক্তারদের সাথে সম্পর্ক ভালো থাকায় শরীফ খুব সহজেই আইসিইউতে প্রবেশ করে ফেলে।

আরিফার কাছে গিয়ে একটু ঝুঁকে খুব ধীরে ধীরে বলে,
“কাল রাতে একটা গ্যাস ছড়িয়েছিল নাকি?”

আরিফা চোখ বড় বড় করে তাকায়। সত্যিই কাল সেলের ভিতরে একটা গ্যাস ছড়িয়েছিল এবং এই গ্যাসের জন্য সে অসুস্থ হয়ে পড়ে।

শরীফ আবারো বলে,
“পঞ্চম ব্যক্তি কে? এটা বললেই বেঁচে যাবে।”

আরিফা জোরে শ্বাস টে°নে নেয়। মিনমিনে কন্ঠে বলে,
“ইমতিয়াজ।”

যেন সকলের এই নামটা মুখস্থ করে বসে আছে। যাকে জিজ্ঞাসা করছে, একই নাম জবানে আসছে।

শরীফ আবারো জিজ্ঞাসা করে,
“কোন ইমতিয়াজ? সৌরভ?”

আরিফা ডানে বামে মাথা নেড়ে না বুঝায় অর্থাৎ এই ইমতিয়াজ, সৈয়দ ইমতিয়াজ সৌরভ না।

“তবে কোন ইমতিয়াজ?”

আরিফা আঙ্গুল উঠিয়ে কিছু একটা ইশারা করে। শরীফ কপাল কুঁচকে এদিক ওদিক তাকায়।

ডা. দীপ এসে বলে,
“শরীফ সাহেব বাইরে চলে আসুন। আইসিইউতে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক না।”
“হুম।”
বলে বেরিয়ে আসে শরীফ।

তী°ক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পুরো ফ্লোরে সে তাকাতে থাকে। আরো একজন ইমতিয়াজের খোঁজে ব্যস্ত সে। এই ইমতিয়াজ সৌরভ নয়, এইটুকু কথা ওর স্বস্তির জন্য যথেষ্ট ছিল। এর মধ্যে একটা কথা ছড়িয়ে পড়ে, আরিফা মা°রা গেছে।

শরীফ চমকে উঠে। আরিফার থেকে কথা নেয়ার জন্য, ওকে সেল থেকে বের করা জরুরী ছিল। তাই ওর লোকের মাধ্যমে অল্প কিছু কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস সেখানে দেওয়া হয়, তবে তার মাত্রা এত বেশি ছিল না যে আরিফা মরে যাবে।

শরীফ দ্রুত পায়ে আইসিইউর কাছে এসে দেখে সাদা কাপড়ে ঢেকে আরিফাকে বের করে নিয়ে আসছে। আরিফাকে নিয়ে গেলে শরীফ ভিতরে আসে অক্সিজেন সিলিন্ডারে ফু°টো, এখান থেকে গ্যাস লিক হয়েছে আর অক্সিজেনের অভাবে সে মা°রা গেছে।

কে এই ইমতিয়াজ? প্রশ্নটা রয়ে যায়।
______________________________________

আজকের দিনটুকু পেরিয়ে যায়। রাতে মৃত্তিকা শরীফের থেকে আরিফার ঘটনা শুনে আবারো আত°ঙ্কি°ত হয়ে যায়। আরো একজন মানুষ বাইরে ঘুরঘুর করছে, অথচ কেউ বুঝতেও পারলো না।

ইমতিয়াজ কিছুক্ষণ আগে বাসায় এসেছে। এসেই সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে রাতে সে খাবে না।

শরীফের থেকে সবটা জেনেও মৃত্তিকার নজর ইমতিয়াজের উপর থেকে সরে না। বিশ্বাস নামক শব্দটা এখন শুধুই একটা শব্দ, বাস্তবে তার অস্তিত্ব নেই।

যে মমতাজ বেগম দুই বছরের বেশি সময় মেয়েদের শো°কে মানসিক রোগীর অভিনয় করেছে, সে নাকি তার মেয়েদের খু°নি। যে মামা ভাগ্নির জন্য এত ভালবাসা দেখিয়েছে, সে নাকি তার ভাগ্নিকে নোংরাভাবে ছুঁয়েছে। এত কিছু হওয়ার পর ইমতিয়াজকেও সে বিশ্বাস করতে পারছে না।

মৃত্তিকা শরীফকে বলে,
“শাফিনকে রাতভর পি°টিয়েও কোনো লাভ হবে না। তার যদি বিবেকবোধ থাকতো, তবে সে এসব করতোই না। আর ওদেরকে জানে মে°রে ফেলো না। ওরা ঠিক সেই ভাবে ম°রবে, যেভাবে ওরা মামকে মে°রেছে।”
“তবে তার আগে সেই ইমতিয়াজকে আমি চাই। হাসপাতালে খুঁজলে পেতে পারি।”

কথা শেষে ফোন রেখে মৃত্তিকা ঘরে যায়। ইমতিয়াজ ওর কথা সবই শুনেছে, কিন্তু সে এখন ঘুমের ভান ধরে শুয়ে আছে। মৃত্তিকা ওর গা ঘেষে শুয়ে পড়ে। ইমতিয়াজ বাধা দেয় না, আবার ওকে জড়িয়েও নেয় না।

ইমতিয়াজের পিঠে মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে মৃত্তিকা। দুজনেই কষ্ট পাচ্ছে, ওরা জানে ওরা একে অপরকে কষ্ট দিচ্ছে। ইচ্ছা করে আরো জ°ঘ°ন্য কথা বলে বলে কষ্ট বাড়িয়েছে। কিন্তু কেউই হার মানতে রাজি নয়, আবার দূরে যেতেও রাজি নয়। শারিরীকভাবে একই স্থানে থেকেও মনটা যোজন যোজন দূরে তো কত আগেই চলে গেছে।
______________________________________

শনিবার সকাল, আজও আহনাফ বাসায় থাকবে। তাই সকালেই সামিহা ওর সাথে ঘুরতে বেরিয়েছে। সামিহা একটু আগে আগে হাঁটছে আর আহনাফ একটু পিছনে।

সামনে দিয়ে একটা বড় লা°শবাহী গাড়ি যায়। ফ্রিজিং গাড়ি নয়, খোলা বড় গাড়ি। রাস্তার কুকুরগুলো গাড়িটাকে দেখেই চিৎকার করে ঘেউ ঘেউ করতে শুরু করে। সামিহা দাঁড়িয়ে গাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকে।

আহনাফ ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে বলল,
“কি? ভ°য় পেলে?”
“না, দেখে একটু চমকে গেছি। এতো সকালে লা°শবাহী গাড়ি কেন? তাও এতো বড়।”
“হয়তো কোনো দু°র্ঘ°টনা হয়েছে।”
“হতে পারে।”

এরমধ্যে পর পর চারটা গু°লি চলে। সামিহাকে নিয়ে সরে যায় আহনাফ। সামিহা প্রচুর ভ°য় পেয়েছে। কয়েকজন অচেনা লোক গাড়িটার পিছু করতে করতে গু°লি চালিয়েছে।

একজন বলে,
“সরে যান।”

আহনাফ ওদের কোমড়ে লাগানো আইডি কার্ড দেখে তাদেরকে পুলিশ বলেই শনাক্ত করে। লা°শবাহী গাড়ি থেকে তিনজন লোক নেমে ওদের বাসায়ই ঢুকে যায়।

আহনাফও সামিহাকে নিয়ে দ্রুত বাসায় ঢুকে। লোকগুলো সিঁড়ি দিয়ে উঠেছে আর ওরা উঠে লিফটে। চারতলায় নেমে সামিহাকে ফ্ল্যাটে ঢুকিয়ে আহনাফ দাঁড়িয়ে থাকে।

লোকগুলো চারতলা পেরিয়ে পাঁচতলায় যেতে নিলেই আহনাফ একজনকে টে°নে জোরে দেয়ালের দিকে আছড়ে ফেলে, আরেকজনের গলা হাতের বাঁধনে চেপে ধরে। সামিহা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকেই ভয়ে চেঁচিয়ে উঠে।

উপর থেকে তানজিমও নেমে আসে। সামিহা ওকে দেখে কপাল কুঁচকে বলে,
“তানজিম?”

তৃতীয় জনকে তানজিম ধরে ফেলে। তিনজনই এখানে আটকা পড়ে যায়। লিফট খুলে বেরিয়ে আসে পাঁচ ছয়জন লোক। একজন আইডি কার্ড ফেলে দিয়ে বলে,
“এসবই মি°থ্যা, উনাদের ধরার জন্য থ্যাংকস।”

শরীফ পিছন থেকে এসে তিনজনের উদ্দেশ্যে বলে,
“তোমাদের মধ্যে ইমতিয়াজ কে?”

আহনাফও অবাক হয়। তিনজনের একজনকেও সে চেনে না।

“কতটা নি°র্ল°জ্জ হলে লা°শবাহী গাড়িতে করে পালাতে পারো।”

শরীফের ইশারায় বাকিরা এসে ওদেরকে ধরে ফেলে। আহনাফ জিজ্ঞাসা করে,
“কারা ওরা?”

শরীফ আড়চোখে তিনজনকে দেখে বলে,
“একজন রাঘব বোয়াল এদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে।”

আহনাফ কপাল কুঁচকে তাকালে শরীফ বলে,
“আসো, তোমাকে বলছি।”

আহনাফ গতরাতের কন্ঠ এটাই ছিল বুঝে যায়, সামিহাকে দরজা বন্ধ করার ইশারা করে শরীফের সাথে উপরে আসে।

সামিহার পিছন থেকে উঁকি দিয়ে এতোক্ষণ শরীফকে দেখেছে সারাহ্। এই লোক সবকিছু জেনে যায় কোথা থেকে? সব জায়গায় কিভাবে হাজির হয়? লোকটা ভালো নাকি খারাপ? কোনো হিসাবই সারাহ্-র মিলে না।

চলবে…..

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

ঊনষষ্টি পর্ব (৫৯ পর্ব)

“আরিফার ডে°ডবডি ডিএমসির ম°র্গে রেখেছিল, ওরা তিনজন সেই লা°শ বের করার চেষ্টা করেছে। আজ ভোরে এই কাজ করার সময় আমার কাছে ধরা পড়ে পালিয়ে যায়।”

শরীফ আহনাফ সকল ঘটনাই বলেছে। ইমতিয়াজকে নিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোও বলা হয়েছে। তবে শরীফের কথা আহনাফের পুরোপুরি বিশ্বাস হয় না। যদি ওরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে পালায়, তবে এখানে কেন?

প্রশ্নটা করে বসতেই শরীফ জবাব দেয়,
“হুম, ওরা এখানে কেন এসেছে তা আমিও সঠিক জানি না। তবে গাড়ি নিয়ে ওরা এখানেই এসেছে। সম্ভবত শাফিনকে নিতে।”

আহনাফ চোখ কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“আপনি সবকিছু এমন আগে আগে কিভাবে জেনে যান?”

শরীফ ওর কথায় তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। বেশ স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,
“বুদ্ধি থাকলেই হয়। কাল আরিফা মা°রা যাওয়ার পর, আমি আশপাশ নজরে রেখেছিলাম।”

আহনাফ মাথানেড়ে পাশে বাঁধা অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকা শাফিনের দিকে তাকায়। বলে,
“সারাহ্-র উপরেও নজর ছিল নাকি?”

শরীফ উঠে শাফিনের কাছে গিয়ে বলে,
“না, তবে শাফিনের উপর ছিল। (একটু থেমে) আর নজর ছিল বলেই তোমার সারাহ্ বেঁচে আছে।”

আহনাফ উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“ওহ, আচ্ছা। তবে সেদিন আপনার হাতে পি°স্ত°ল থেকেও এই শাফিন কিভাবে বেঁচে গেল?”

শরীফ অনেকটা রেগে যায়। শাফিনের ডানকাঁধ আহনাফের থেকে ঘুরিয়ে বলে,
“এখানে ক্ষ°তটা দেখছো? আমার গু°লি থেকে এটা হয়েছে।”

আহনাফ দুহাত বুকে বেঁধে বলে,
“ওকে বুঝলাম, কিন্তু কে ওই ইমতিয়াজ তা কিভাবে বের করবেন? এমনও হতে পারে ইমতিয়াজ বলে আসলে কেউ নেই, সেটা একটা ছদ্মনাম।”

শরীফ চিন্তায় পড়ে, আহনাফের কথা অবশ্যই সঠিক হতেই পারে। সেটা একটা ছদ্মনাম তবে কার? ডা. দীপের দিকে সন্দেহের তীর যায়, আবার সামনে বসে থাকা তিন বান্দার দিকেও চোখ পড়ে।

শাফিন ফ্লোরে শুয়ে হাসতে হাসতে বলে,
“ইমতিয়াজদের বের করা তোমার কাজ নয়। যে ইমতিয়াজকে চিনো তাকেই নাহয় পাকড়াও করো।”

আহনাফ প্রথম তার কথা গুরুত্ব না দিলেও পরক্ষণেই মনে হয় ইমতিয়াজদের মানে কি? সে উঠে শাফিনের কাছে গিয়ে বসে বলে,
“ইমতিয়াজ একজন নয়?”

শাফিনের মুখটা চুপসে গেল। বোঝা যাচ্ছে সে ভুলবশত কথাটা বলে ফেলেছে। আহনাফ একটু হেসে বলে,
“মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে? আহারে, বেচারার চেহারাটা দেখার মতো হয়েছে।”

আহনাফ উঠে দাঁড়িয়ে একটু জোরেশোরে বলল,
“একে বাঁচিয়ে রেখে কি করবেন? এমনিতেও সে কিছুই বলবে না, মে°রে ফেলেন।”

শরীফ সোফায় বসে বলে,
“থাকুক কিছুক্ষণ বেঁচে, এতো জলদি ম°রলে হবে। যদি আবার মুখ ফসকায়।”

আহনাফ রাগে গজগজ করতে করতে পা দিয়ে শাফিনের চোখ চেপে ধরে বলে,
“যে মেয়েটা আমার সামনে লজ্জায় নুয়ে পড়ে তার গায়ে হাত দেয়ার চিন্তা কিভাবে করেছো? কিভাবে ওর দিকে দৃষ্টি দিয়েছো?”

শাফিন চিৎকার করতে শুরু করে। পায়ের আঙুল চোখসহ ভিতরে দিয়ে রাগে শরীরের শক্তি সেখানে প্রয়োগ করে আহনাফ। শাফিন পুরো শরীর নাড়াচাড়া শুরু করে। সাথে চলে আ°র্ত°নাদ,
“ছাড়ো আমাকে।”

চোখ থেকে র°ক্ত পড়া শুরু হয়। আহনাফ সরে আসে। মনে হয় না, এ চোখ আর ঠিক হবে। অপরূপা শাফিনের অবস্থা দেখে পিছনে যেতে শুরু করে, ফ্লোরে গড়াগড়ি খেয়ে কোনোরকমে সে সরতে থাকে। এদিকে শাফিন চিৎকার শুরু করেছে।

“আপনি ঠিক কে? তা আমি এখনো বুঝিনি।”
শরীফকে কথাটা বলে আহনাফ দরজা খুলে বেরিয়ে যায়।
______________________________________

ফজরের পর ইমতিয়াজ ও মৃত্তিকা দুজনেই ঘুমিয়ে পড়েছে। দশটা প্রায় বাজতে চলল, অথচ ওদের ঘুম এখনো ভা°ঙলো না।

ঘুমের ঘোরে দুজনে কাছাকাছি চলে এসেছে। মৃত্তিকা সেই ইমতিয়াজের বুকেই মাথা গুজে ঘুমাচ্ছে। মৃত্তিকার উন্মুক্ত উদরে ইমতিয়াজের হাত লাগতেই ওর ঘুম হালকা হয়ে যায়।

চোখ খুলে ইমতিয়াজের এতো কাছে বুঝতে পেরে মাথা তুলে তাকায় সে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ইমতিয়াজের চেহারার দিকে, তারপর তার গালে হাত দিয়ে কপালে, ঠোঁটে চুম্বন করে উঠে যায়।

মৃত্তিকা রুম থেকে বেরিয়ে গেলে ইমতিয়াজ চোখ খুলে। এতোক্ষণ সে জেগেই ছিল। উঠে বসে ঘড়ি দেখে চমকে উঠে। অফিসে তো যাওয়া দরকার ছিল।

মৃত্তিকা আবারো রুমে এসে ওকে দেখেও কথা না বলে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। নিজের মতো ফ্রেশ হয়ে সে নাস্তা তৈরি করে নেয়।

ইমতিয়াজ অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে এসে নাস্তার টেবিলে বসে। মৃত্তিকা চুপচাপ ওকে নাস্তা দিয়ে নিজের খাবার খেতে মনোযোগ দেয়। খাওয়া শেষে ইমতিয়াজ বেরিয়ে যেতে নিয়ে আবারো ফিরে আসে।

মৃত্তিকাকে জোর করেই নিজের দিকে ঘুরিয়ে কাছে আনে। মৃত্তিকা আর কোনো জোরাজুরি করছে না। ইমতিয়াজ ওর কাছে এসেও আবারো চলে যায়। তার মন যে এখনো জমে আছে, কারণটা মৃত্তিকার করা অপমান।
______________________________________

সন্ধ্যা সাতটা, আহনাফের কাল চলে যেতে হবে। আবার শাফিন ওদের উপরের তলায় আছে, এটা জেনে তো যেতেও ইচ্ছা করছে না। কোনোভাবে যদি শাফিন ছাড়া পায় তবে সকালে ওর করা আচরণের বদলা নার্গিস পারভিন অথবা সারাহ্-র উপর দিয়ে যাবে।

সামিহার সাথে রান্নার কাজ করছে সারাহ্। রান্নাঘর থেকেই বেরিয়ে আহনাফকে বাইরে যেতে দেখে সারাহ্ বলে,
“এই সময় কোথায় যাচ্ছেন?”

আহনাফ হাত দিয়ে বাইরের দিকে ইশারা করে বলল,
“এখানেই, চলে আসবো।”

সারাহ্ মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। আহনাফ হেসে বেরিয়ে যায়। সে নিচে না গিয়ে পাঁচতলায় শরীফের ফ্ল্যাটে এসেছে। দরজায় নক করলে শরীফ খুলে দেয়। সকালের পর তানজিম আর বাসায় নেই।

আহনাফ ভিতরে সে সকালের তিনজন ছেলেকে র°ক্তা°ক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে বলে,
“আপনি কি আদৌতে ডাক্তার? আমার তো বিশ্বাস হয় না। কোনো ডাক্তার একজন মানুষকে এভাবে মা°রতে পারে?”

শরীফ সি°গা°রেটে টা°ন দিয়ে বেশ আরামে ধোঁয়া ছেড়ে বলে,
“ডাক্তার তোমার একটা পরিচয়। যখন রিপা ছিল, তখন এটা আমার আসল পরিচয় ছিল। এখন রিপা নেই, তাই এখন আমার আসল পরিচয় একজন মা°ফিয়া লিডার।”

আহনাফ ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
“মা°ফিয়ার লিডার? ভদ্রতা সব ক্ষেত্রে চলে না, মা°ফিয়া ড°ন বলে।”

শাফিনের এক চোখে ভারী ব্যা°ন্ডে°জের পট্টি, করে শুয়ে সে এখনো কিছু ছটফট করছে৷ আহনাফের ক্ষো°ভে ওর অবস্থা ঠিক কতটা খারাপ হয়েছে তা ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে৷

“নাম কি এদের?”

আহনাফের কথায় শরীফ জবাব দেয়।
“তকী, মনসুর আর ইমন।”
“এখানে কেন এসেছিল বলেছে?”

শরীফ একটু হেসে বলে,
“শাফিন এখানে তা জানতো না। তবে আমার বাসায় এসেছিল, আমাকে ধরতে।”

তিনজনের নামগুলো কয়েকবার জপে আহনাফ বলে,
“ইমন, মনসুর আর তকী৷ একটা ক্লু দেন তো।”
“ক্লু? কিসের ক্লু?”

“এদের নাম মিলিয়ে নিলে ইমতি হয়।”
পেছন থেকে কথাটা বলে ইমতিয়াজ নিজেই। দরজা খোলা থাকায় অনুমতি না নিয়ে সে ভিতরে প্রবেশ করেছে।

আহনাফ ওর দিকে ফিরে বলে,
“কারেক্ট, ইমতি।”

শরীফ কপাল কুঁচকে বলল,
“তার মানে ইমতিয়াজ কোনো একজন লোক না, কয়েকজন মিলে।”
“ইয়েস।”

শাফিন চিৎকার করে বলে,
“তোমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইমতিয়াজ। মা°রো এখন।”

কেউ শাফিনের কথায় তেমন কোনো গুরুত্ব দেয় না। ইমতিয়াজ শরীফকে বলে,
“আপনি মৃত্তিকাকে নিয়ে বিবির বাজার গিয়েছিলেন। আমাকে সন্দেহ করেন ভালো কথা, কিন্তু তাই বলে মৃত্তিকাকে নিয়ে এদিক-সেদিক চলে যাবেন, সেটা তো আমি এলাউ করব না।”

শরীফ ওর দিকে এগিয়ে এসে বলে,
“তুমি কি করে জেনেছো আমরা বিবির বাজার গিয়েছিলাম?”
“পেছনে যে একটা অফিসের গাড়ি গেছে তা হয়তো খেয়াল করেননি।”
“তারমানে আমাদের ফলো করেছো?”
“না, করিয়েছি। মৃত্তিকার পিএ শিল্পা গিয়েছিল।”

ওদের কথার মাঝেই দরজায় দুবার নক পড়ে। ইমতিয়াজ জোর গলায় বলে,
“কে?”

আরেকবার ধাক্কা দিয়ে জবাব আসে,
“দরজা খুলেন নাহয় ভে°ঙে প্রবেশ হবে।”

ইমতিয়াজ দরজা খুলে দেয়। গালিব তার পুরো টিম নিয়ে এবং সাথে র‍্যাবের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা নিয়ে বাসায় প্রবেশ করে।

একজন অফিসার বলেন,
“শাফিনকে এখানে আ°টকে রেখেছেন কেন? এই তথ্য লুকানোর জন্য আপনাদের জে°ল জরিমানা হতে পারে, জানেন সেটা?”

আহনাফ মাথা নাড়িয়ে বলল,
“আইন সেটাতে আসবেন না, অফিসার। আইনের জ্ঞান ভালোই আছে। আমাদের অন্তত আছে, আপনার নেই বা আপনাদের নেই। যদি থাকতো, তবে ওই আইনের ফাঁক গলে বারবার এরকম কেউ বাইরে আসতে পারতো না।”

অফিসার উত্তর দেয়,
“শাফিনকে আমাদের হাতে তুলে দিতে হবে, তুলে না দিলেও আমরা নিয়ে যাবো।”
“শাফিনকে ক্র°স°ফায়ারের কথা বলেছিল?”

ইমতিয়াজের কথায় গালিব বলে,
“উপরতলা থেকে আদেশ এসেছে, তাকে জীবিত ধরতে হবে।”

ইমতিয়াজ হাত নেড়ে রাগিস্বরে বলল,
“তবে সে আবারো পালাবে। নিয়ে যান, সে পালাবে, আবারো খু°ন করবে, আবারো কোন নারীর শ্লীলতাহানি হবে।”

ওদের সামনে দিয়ে শাফিনকে নিয়ে যাওয়া হয়। ইমন, মনসুর, তকী- এই তিনজনকেও নিয়ে যায়। ঘর থেকে অপরূপা আর মমতাজ বেগমকেও নিয়ে যায়। শরীফ সকলের পিছু পিছু বের হয়ে যায়।

ইমতিয়াজ বলে,
“আমি বলেছিলাম শাফিনের মৃ°ত্যু আমার হাতে হবে। আমি এতো সহজে কথার খেলাপ করবো না, ও আজ ম°রবে আর না হলে কাল এর বেশি দেরি হবে না।”

রাস্তায় গাড়িতে তোলার সময় ইমন, মনসুর ও তকী- তিনজনকে নিশানা করে মোট ছয়টা গু°লি চালায় শরীফ, তারপর পালিয়ে যায়। ওকে ধরা সহজ নয়, সত্যিই পালিয়ে গেল।

নিচে এসে এই ঘটনা দেখে কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেছে আহনাফ ও ইমতিয়াজ। এতটা ওরা কখনোই আশা করেনি। এখানে, বাসার সামনে, এভাবে শরীফ কাউকে মে°রে দিয়ে চলে যাবে, এটা সত্যিই ওদের কল্পনাতীত।

তবুও ওদের লা°শ নিয়ে যাওয়া হয়। শাফিন, অপরূপা আর মমতাজ বেগমকে দ্রুত গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যায়।

ইমতিয়াজ অফিসের গাড়িতে উঠে আহনাফকে বলে,
“তুমি বাসায় থাকো। বলা যায় না, এখানে আর কখন, কি হয়?”
“হুম, শরীফ সাহেব কি পাগল হয়ে গেলেন?”
“হয়তো।”
ইমতিয়াজ ওদের পিছু নেয়।

আহনাফও এখন এখান থেকে চলে যাওয়াটা নিরাপদ মনে করছে না, তাই সে বাসায় থাকে। শাফিনের আরো লোকজন বাইরে আছে, পাছে কখন হা°মলা হয় তার ভ°য় আছে।

বাসায় আসতেই দেখে সবাই ভী°ত। গু°লির শব্দ ওরা পেয়েছে। আহনাফ সকলকে কোনোমতে বুঝিয়ে তুমি এসে দেখে সারাহ্ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।

বারান্দা থেকে রাস্তার দৃশ্য দেখা যায়, সে সবটাই দেখেছে। আহনাফ রুমে আসতেই দূরে গিয়ে থাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়।

“তুমি না এতো সাহসী মেয়ে, তবে কেন কাঁদছো?”

সারাহ্-র কান্না থামে না। থামার কথাও নয়, চোখের সামনে তিন-তিনজন মানুষ, একই সাথে মৃ°ত লা°শে পরিণত হয়েছে। বিষয়টা চোখে দেখার পর শান্ত থাকা কঠিন।
______________________________________

সকাল আটটা চল্লিশ মিনিট, হাসপাতালে এসে দীপের চেম্বারে যায় শরীফ। চেম্বারে ঢোকার সময় সে শুনতে পায়, দীপ কারো সাথে কথা বলছে,
“শাফিনকে এনি হাও বের করে আনো। শরীফ ওকেও মা°রার চেষ্টা করবে।”

শরীফ দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে বলে,
“আর তোমাকেও।”

চমকে উঠে পিছনে ফিরে দীপ। ফোন লাইনে রেখেই বলে,
“কি বলছেন?”
“যা শুনেছো।”

শরীফ আর সময় নষ্ট করে না। ছু°ড়ি বের করে দীপের গলায় ধরে ফোনে দেখে নিয়াজী নামে কারো সাথে সে কথা বলছিলো।

শরীফ জিজ্ঞাসা করে,
“কে এই নিয়াজী?”
“এডভোকেট বিথীর ভাই।”
“আরিফার অক্সিজেন সিলিন্ডার ফু°টো করেছে কে?”
“সিলিন্ডার ফু°টোই ছিল, গ্যাস বের হতে যা সময় লাগে তাই লেগেছে।”

ব্যস, আর কোনো কথা শুনতে শরীফ প্রস্তুত নয়। ছবিটা বেশ গভীর করে দীপের গলায় চালিয়ে নিয়ে। কা°টা মুরগির মতো ছটফট করে তার চোখদুটো অজানার পানে স্থির হলো।

তারপর ফোন হাতে নিয়ে নিয়াজীর উদ্দেশ্যে বলে,
“শাফিনকে আজ কোর্টে আনবে, চলে এসো।”

আহনাফের মতো সূত্র মিলিয়ে শরীফ বুঝে ফেলে নিয়াজীর নাম থেকেই ‘ইমতিয়াজ’ নামক গুচ্ছ নামটা এসেছে।
______________________________________

“আপনাদের চোখের সামনে দিয়ে শাফিনকে নিয়ে গেল। আপনারা শুধুই কি করলেন? চেয়ে চেয়ে দেখলেন। আমি চেয়েছিলাম, তার সামনে অপরূপাকে মে°রে তারপর তাকে মা°রতে। ঠিক যেভাবে মামকে মেরেছিল, সেভাবে সে ম°রতো।”

মৃত্তিকার কথায় ইমতিয়াজ কোনো জবাব দেয় না। দুজনেই কোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে৷ গতরাতে এই ঘটনা শোনার পর মৃত্তিকা অনবরত একই কথা বলে যাচ্ছে। মৃত্তিকা এখনো ইমতিয়াজের নাম নিয়ে বানানো গুচ্ছের কথা জানে না, তাই সে এখনো একে রহস্যই মনে করছে।

এদিকে বুলেট প্রুফ কালো গাড়িতে করে শাফিন ও মমতাজকে কোর্টে নিয়ে আসা হয়েছে। গাড়ির কাচগুলোও কালো, বাইরে থেকে ভিতরের কিছু দেখার উপায় নেই।

গালিব এসবে আর তুমি রাজি ছিল না। কিন্তু নিজের চাকরির খাতিরে, তাকে রাজি হতে হয়েছে। কিন্তু তার মনে এখনো একটাই প্রশ্ন ঘুরছে, ওর এই চাকরিটা কেন? অপরাধীদের শা°স্তি দেওয়ার জন্যই তো, তবে সে কেন জেনেবুঝে অপ°রাধীদের ছেড়ে দিচ্ছে?

অবশেষে ওরা কোর্টে পৌঁছায়। মৃত্তিকাকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে ইমতিয়াজ হেঁটে একটু দূরে এসে দাঁড়ায়। কালো গাড়িতে শাফিন আছে, এটাই ওর টার্গেট।

শরীফ সকলের মাঝে লুকিয়ে আছে। কালো গাড়িটাকে সেও নিশানাতে রেখেছে।

আহনাফও এখানে এসেছে। গালিবের উপর তার প্রচুর রাগ, সাথে প্রশ্ন জমে আছে। শাফিনের খোঁজ ওরা কি করে পেল? এতোদিন না পেয়ে কাল হঠাৎ কিভাবে?

এরমধ্যে তানজিম এসে হাজির হয়।
“কি অবস্থা ভাইয়া?”

আহনাফ মাথা নাড়ে। মেজাজ যে গরম আছে তা বোঝা যাচ্ছে। আহনাফ বলে,
“কি হলো এতদিন এত কিছু করে? সেই উপরতলার লোকজন শাফিনের সঙ্গই দিচ্ছে।”

“তুমি এ কথা বলছো। তবুও তো শাফিন ধরা পড়েছে। দেশে এমন অনেক কে°ইস আছে, যেখানে আ°সামি কে তাই জানা নেই।”

“গালিব জানলো কি করে শাফিনের খোঁজ?”

তানজিম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“আমার মাধ্যমে জেনেছে। কাল ওরা হাসপাতাল থেকে লোকগুলোকে অনুসরণ করেছে। আর তাতেই ধরে ফেলেছে। (একটু থেমে) আরিফা একজন যাবজ্জীবন দ°ণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছিল। ওর যেহেতু মৃ°ত্যু হয়েছে, তবে ওখানে অনেক পুলিশের লোকজন ছিল। এইটুকু তো বোঝা উচিত ছিল শরীফ আংকেলের।”
“তুমি কেন বলেছো?”

আহনাফের কথায় রাগ স্পষ্ট। তানজিম জবাব দেয়,
“উপায় ছিল না। ধরে নিয়ে গিয়েছিল।”

হঠাৎ করে শোরগোল বেড়ে যায়। শাফিনের গাড়িটা বে°প°রোয়া ভাবে ছুঁটে চলছে। সকলের মাঝ দিয়ে গিয়ে ড্রাইভারকে বাইরে ফেলে গাড়িতে উঠে বসেছে ইমতিয়াজ। দ্রুত গতিতে স্টেয়ারিং ঘুরিয়ে আঁকাবাঁকা পথে সে গাড়ি নিয়ে পালায়।

“তোমাকে বলেছিলাম শাফিন, মৃ°ত্যু তোমার আমার হাতে। মৃত্তিকার ইচ্ছানুযায়ী ওর মামের মতোই ম°রবে তুমি।”

ডানহাতে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ রেখে, বামহাতে ছু°ড়িটা নিয়ে শাফিনের দিকে ছুঁ°ড়ে মা°রে। মমতাজ বেগম চিৎকার করে উঠে, হাত বাঁধা তার, কিছুই করতে পারে না। শাফিনের বুকে ছু°ড়িটা লেগে যায়।

সামনে একটা চৌরাস্তা দেখে ইমতিয়াজ দরজা খুলে চলন্ত গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়ে। পিচঢালা রাস্তায় পড়ে বেশ অনেকটা পথ গড়িয়ে যায় সে। তার র°ক্তে পুরো রাস্তা রঞ্জিত হয়ে পড়ে। দূর থেকে ভেসে আসা সবগুলো চেঁচামেচির মাঝে সে মৃত্তিকাকে খুঁজতে খুঁজতে জ্ঞান হারায়।

গাড়িটা রাস্তার ব্যবধায়ক পেরিয়ে অপরপাশে গিয়ে আ°ছড়ে পড়ে। ধোঁয়া উঠা শুরু হয়েছে। ভিতরে কেউ বেঁচে আছে কিনা বোঝা মুশকিল। তবে ভিতরের দুজনের মধ্যেই প্রাণের অস্তিত্ব খানিকটা এখনো রয়েছে।

চলবে….

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

ষষ্টি পর্ব (৬০ পর্ব)

রাত অনেক হয়েছে। ঘরের সব কাজ সেরে নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ে শারমিলি। ছোট বাচ্চাটা এখনো কাঁদছে। তাকে কোলে তুলে শান্ত করে, শারমিলি তার কপালে চুমো দেয়।

দেড় বছরের মেয়ে তাহমিনা এখনো টিভি দেখছে। বাসায় নতুন রঙিন টিভি এসেছে। এসব তো এখনো বড়লোকদের জিনিসপত্র, কিন্তু লুৎফর তার মেয়ের জন্য নিয়ে এসেছে।

বাচ্চাকে দুগ্ধ পান করানোর জন্য প্রস্তুত হয়ে গলা ছেড়ে বড় মেয়েকে ডাকে শারমিলি,
“তাহমিনা মা, ঘুমাতে এসো।”

ওদিক থেকে কোনো জবাব আসে না। তবে দরজা খুলে ভিতরে আসে মমতাজ বেগম।

তাহসিনাকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে শারমিলি। বেশ আরামেই তাহসিনা মাতৃদুগ্ধ পান করছে।

“আরে, মমতাজ যে। বসো, উনি এখনো আসেনি?”

মমতাজ বেগম মাথা নেড়ে বলল,
“না, লুৎফরের আসতে আজ দেরি হবে।”
“ওহ, জেগে থাকবে তুমি?”
“তুমি যেহেতু শান্তিতে ঘুমাবে, তাই আমাকে জেগে থাকতেই হবে।”

শারমিলি মুচকি হেসে বলে,
“আরে না, আমিও জেগে থাকতে পারবো।”
“কিন্তু আমি তোমাকে জেগে থাকতে দেবো না।”

মমতাজ বেগমের চোখের চাহনি শারমিলির খুব একটা সুবিধাজনক লাগে না। তাহসিনাকে সে আগলে নেয়। সরে যাওয়ার সুযোগ না দিয়েই মমতাজ বালিশ নিয়ে শারমিলির নাকে মুখে চেপে ধরে। দুইহাতে তাহসিনাকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় পা আ°ছড়াতে আ°ছড়াতে শান্ত হয় সে।

বালিশ সরিয়ে খোলা চোখদুটো বন্ধ করে মমতাজ। তাহসিনাকে নিজে নেড়েচেড়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। শারমিলিকে ঠিকঠাক করে শুইয়ে দিয়ে যায়, যেন মনে হয় সে ঘুমাচ্ছে।

নিরবে একটা খু°ন করে মমতাজ বেগম। ভাবখানা এমন যেন কেউ কিছুই দেখেনি, তবে দেখেছে একজন। সেই আল্লাহ্, তিনি সর্ব বিষয়েই অবগত।

কোরআনের আয়াত কি একবারও তার মনে হয়নি?
“তোমরা কি মনে করো যে,
(হিসাব-নিকাশ ছাড়াই) তোমাদেরকে এমনি ছেড়ে দেওয়া হবে?” (সূরা কিয়ামাহ, আয়াত ৩৬)

মমতাজ বেগম চমকে উঠে চোখ খুলেন। নিজেকে তিনি হাসপাতালের বিছানায় আবিষ্কার করেছেন। এতক্ষণ তবে তিনি স্বপ্ন দেখেছেন, নিজের পা°পের স্বপ্ন। কতটা ভ°য়াবহ হতে পারে, যদি আমরা নিজের সামনে নিজের করা পাপগুলোকে দেখতে পাই? এইটুকু চিন্তা করার মত সময় কি হবে?

শাফিন ও মমতাজকে একটা আইসিইউতে রাখা হয়েছে। একটা ক°ড়াকড়ি নিরাপত্তা চাদরে শাফিনকে আবৃত করে রাখা হয়েছে। সে এমন একজন আসামী, যাকে যেকোনো সময় যেকোনো কেউ মে°রে ফেলতে পারে।

ইমতিয়াজকে কেবিনে রেখেছে, অবস্থা গুরুতর নয় আবার খুব একটা ভালোও নয়। কাচের জানলা থেকে মৃত্তিকা ইমতিয়াজকে দেখে। নিজের জীবনের এতোবড় ঝুঁকি সে কেন নিলো? চোখদুটো কেঁপে উঠলো মৃত্তিকার, সেখানের সমুদ্র থেকে কয়েক ফোঁটা গড়িয়ে পড়লো।

নার্স এসে মৃত্তিকাকে বলল,
“আপনার হাসবেন্ড আপনার সাথে দেখা করতে চায়। খুব ধীরে উনার সাথে কথা বলবে।”

ইমতিয়াজের জ্ঞান ফিরেছে, সঙ্গে সঙ্গেই সে মৃত্তিকার সাথে কথা বলতে চেয়েছে। দ্রুত পায়ে ভিতরে আসে মৃত্তিকা।

ইমতিয়াজের কাছে যেতেই ইমতিয়াজ ওকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে। ইমতিয়াজকে একদম স্বাভাবিক লাগছে।

ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞাসা করে,
“শাফিন কি জীবিত?”

মৃত্তিকা প্রশ্নের জবাবে পাল্টা প্রশ্ন করে,
“আপনি ঠিক আছেন?”
“হুম, শাফিনের খবর কি?”
“বেঁচে আছে আর ক°ড়া নিরাপত্তায় আছে।”

ইমতিয়াজ কিড়মিড়িয়ে উঠে,
“ইশ, আবারো বেঁচে বেরিয়ে গেল। একটা কাজ করতে পারবে?”
“কি?”

আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
“সবাইকে বিশ্বাস করিয়ে দাও, আমি মা°রা গেছি।”

মৃত্তিকা অবাক হয়। এতক্ষণ ধরে তবে ইমতিয়াজ অসুস্থতার নাটক করেছে।

“আমি এতটা আহত হইনি যতটা হলে আমাকে আইসিউতে থাকতে হবে।”

মৃত্তিকা ওর গালে হাত দেয়।
“নিজেকে মৃ°ত কেন প্রুভ করতে চাইছেন?”
“কারণ জীবিত কেউ এখন শাফিনকে আর মা°রতে পারবে না, মৃ°ত কেউ পারবে।”

এমন মুহূর্তে ডাক্তার সুস্মিতা ভিতরে আসে, উনার সাথে পল্লবীও আছে। পল্লবী এসেছে ইমতিয়াজকে দেখতে।

“আপনি এখানে কি করছেন?”

মৃত্তিকাকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে সুস্মিতা। ইমতিয়াজ হাতের ইশারায় উনাদেরকে চুপ থাকতে বলে। তারপর নিজের পরিকল্পনা নিয়ে কথা বললে দুজনেই তাতে রাজি হয়।

সুস্মিতার রাজি হওয়ার কারণ একজন জেল পলাতক আ°সামিকে সে কখনোই চিকিৎসা করতে রাজি নয়। শাফিনের নি°কৃষ্টতা সম্পর্কে সে পুরোপুরিভাবে অবগত আছে।

পল্লবী একটু ইতস্তত করেই রাজি হয়। ইমতিয়াজকে ঘুমের ওষুধ প্রয়োগ করে সাদা চাদরে ঢেকে দেয়া হয়।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝড়ের বেগে একটা কথা ছড়িয়ে গেল,
“ইমতিয়াজ মা°রা গেছে।”

শো°কে কাতর হওয়ার নাটকটা মৃত্তিকা ভালোই সামলে নিয়েছে। ইমতিয়াজকে নিয়ে যাওয়া হলো মর্গে। স্থবির হয়ে থাকা মৃত্তিকার পাশে এসে দাঁড়ায় সুরভি।

“একজন লোকের কারণে আর কতজন মা°রা যাবে? আর কতটা মন ভা°ঙবে?”

সুরভির কথায় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৃত্তিকা। তারপর সে বেরিয়ে যায়। এখন ইমতিয়াজের কথা মতো কাজ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তবে ইমতিয়াজকে সেই অন্ধকার লা°শঘরে রাখতেও তার মন মানে না।

আসরের নামাজ পড়ে হাসপাতালে ফিরে এসেই ইমতিয়াজের মৃ°ত্যুর সংবাদ পায় আহনাফ। লুৎফর রহমান, তানজিম এখানে থাকলেও মৃত্তিকা নেই।

আহনাফের কপাল কুঁচকে গেল, স্বামী মা°রা গেছে স্ত্রী কোথায়। আর তাছাড়া ইমতিয়াজের অবস্থা এমন কোনো খারাপ হয়নি যে সে মা°রা যাবে। তবুও যদি ধরে নেয় মা°রা গেছে, তবে এতো দ্রুত কেন ম°র্গে নিয়ে গেল।
______________________________________

শরীফের ধানমন্ডির বাসায় এসেছে মৃত্তিকা। বিথীর কাছ থেকে পাওয়া সকল কাগজপত্র সে ভালো করে দেখছে। ঠিকই এসব ঘেটেঘুটে সে কিছু নাম পেল, সাথে ফোন নাম্বার, ঠিকানা ও ছবি।

জামিল, কবির, দুলাল, হুমায়ুন, ইমন, তকী, মনসুর- এরা সবাই মা°রা গেছে। মৃ°তের তালিকা এতোই বড় যে জীবিত কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে না। অবশেষে পেল ডা: দীপের নাম্বার। কল দিয়ে জানতে পারলো, তাকেও আজ সকালে তারই চেম্বারে কেউ মে°রে ফেলেছে।

অবশেষে পেল আরো একটা নাম্বার নিয়াজী। কল করতে রিসিভ করে এক পুরুষ। মৃত্তিকা গলা ঝেড়ে বলল,
“মিস্টার নিয়াজী সাহেব বলছেন?”
“জি, বলছি।”
“আপনি ফ্রি থাকলে কিছু কথা বলতাম।”
“আমি ব্যস্ত।”

কল কে°টে গেল। মৃত্তিকা ঘেটেঘুটে আর কোনো নাম্বার পেল না। এরমধ্যে ইমতিয়াজ কল দেয়।

“ইমতিয়াজ? আপনি ঠিক আছেন?”
“হ্যাঁ, ঘুম ভাঙলো। পেলে কিছু?”
“হুম।”
“জলদি এসো, এতো এতো লা°শের মাঝে আমার নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে।”

ইমতিয়াজ ফোন রাখার সাথে সাথেই মৃত্তিকা নিয়াজীর তথ্যগুলো সংগ্রহ করে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে নিয়ে অপরূপার সামনে পড়ে, সাথে দুজন অচেনা লোক। এতো লোকের মাঝ থেকে অপরূপার উধাও হওয়াটা কি কেউ খেয়াল করেনি?

দরজা লাগিয়ে ঘুরতেই অপরূপাকে দেখে সে। কোনোরকমে ওদের ধা°ক্কা দিয়ে ফেলে মৃত্তিকা পালিয়ে যায়। দ্রুত বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠে। পেছনে হয়তো অপরূপা আছে।

তবুও সে হাসপাতালে ফিরে আসে। সুস্মিতার সাহায্য নিয়ে ম°র্গে এসে পৌঁছায়। ওকে পৌঁছে দিয়ে সুস্মিতা অন্যদিকে যায়।

দরজা লাগিয়ে ভিতরে এসে এতোগুলো লা°শ দেখে সে ঘাবড়ে যায়। সারি সারি ফ্রিজ আর তার উপর লাগানো নাম্বার আর নাম। সামনে কয়েকটা নতুন লা°শ, এরা হয়তো ফ্রিজে জায়গা হয়নি।

নিচুস্বরে ডাকে,
“ইমতিয়াজ।”

ইমতিয়াজের সারাশব্দ না পেয়ে মৃত্তিকা একে একে লা°শগুলো দেখতে শুরু করে। হঠাৎ হাতে টা°ন পড়ার লাফিয়ে সরে যেতে নিলে ইমতিয়াজ মুখের কাপড় সরিয়ে বলে,
“জোরে ডাকবে তো, ঘুমিয়ে গেছিলাম।”

মৃত্তিকা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
“পাগল আপনি? এভাবে কেউ হাত ধরে?”

ইমতিয়াজ উঠে বসে। বলে,
“বেশ ঠান্ডা লাগছে। (একটু থেমে) কি পেয়েছো তাই বলো।”

কাগজগুলো দিয়ে বলে,
“একজনই জীবিত আছে, নিয়াজী। ডা: দীপও আজ মা°রা গেছে।”
“তোমার বাবাই বোধহয় মে°রেছে, লোকটা পাগল হয়ে গেছে এক কথায়।”

মৃত্তিকা ওর হাত টে°নে বলে,
“বাইরে চলুন, আমার এখানে ভালো লাগছে না।”

ইমতিয়াজ শরীরের উপর থেকে চাদর সরায়। ওর পায়ে ব্যান্ডেজ করা। চলন্ত গাড়ি থেকে পড়ে গড়িয়ে গেছে, পায়ের উপর দিয়েই পুরো ধকল গেছে তার। হাতের অবস্থাও খুব একটা ভালো না।

“আমি হাঁটতে পারবো না, তোমাকে যেতে হবে।”
“এখানে আপনাকে রেখে আমি যাবো না।”
“বোঝার চেষ্টা করো, আমি বের হবো কি করে এখান থেকে?”
“যেভাবে ডেডবডি বের হয়।”

ইমতিয়াজ আবারো ধপাস করে শুয়ে পড়ে। মৃদু হেসে বলল,
“কি দিনকাল পড়লো? আমার বউ নাকি আমাকে কা°ফন পড়াবে?”
“এখনো আপনি মজা করছেন?”

ইমতিয়াজ ওকে টা°ন দিয়ে নিজের উপরে ফেলে বলে,
“একটু মজা করলেও দোষ?”
“এটা ম°র্গ ইমতিয়াজ।”
“আমি জানি।”

মাথা একটু উঁচু করে মৃত্তিকার নরম ঠোঁটে অধিকার বসায় ইমতিয়াজ। শীতল কক্ষে এমন উষ্ণ ছোঁয়ায় মৃত্তিকা বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে। ইমতিয়াজের শরীরে থাকা নরম কাপড়টা খা°মচে ধরে সে, ওর নখের আঁ°চড় ইমতিয়াজের গায়েও খানিক পড়ে।

কিছুক্ষণ পর সুস্মিতা ভিতরে আসে। শব্দ শুনে দুজনে সরে যায়। বিষয়টা বুঝেও সুস্মিতা এড়িয়ে গেল, সবকিছু তো আর পাত্তা দিতে নেই।

সুস্মিতা ইমতিয়াজের সামনে একটা ব্যাগ রেখে বলে,
“তুমি এই পোশাক পড়ে নাও, তারপর বেরিয়ে যাও। মাস্ক দেওয়া থাকলে কেউ সহজে চিনতে পারবে না। আর এটা রেখো, হাঁটতে সুবিধা হবে।”
একটা ক্রাচ ওয়াকিং স্টিক ওকে দিয়ে শেষের কথাটা বলে।

ইমতিয়াজ তৈরি হয়ে নিলো। সাদা এপ্রোন, সার্জিক্যাল মাস্ক- সবকিছু মিলিয়ে তাকে একজন পারফেক্ট ডাক্তারের মত লাগছে। মৃত্তিকা আগে আগে বের হয়ে যায়।

পল্লবী এসে ইমতিয়াজকে বলে,
“বাস্তবতা বোঝার বয়স তোমার হয়েছে, এমন কিছু করো না যাতে সারাজীবন পস্তাতে হয়।”

ইমতিয়াজ মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। পল্লবী আবারো বলে,
“দেখো, শরীফ ভাইয়ের অবস্থা। উনার রাগের বশবর্তী হয়েই আজ তার এ অবস্থা হয়েছে। পাগল প্রায় হয়ে আছে সে। একের পর এক খু°ন করছে, নিজের জীবন ধ্বং°স করছে সে। জেনেবুঝে ধ্বং°স করছে। (একটু থেমে) তুমি এমনটা করো না, মৃত্তিকার জন্য ধৈর্য ধরো। আর তা নাহয়, নিজের সন্তানের জন্য তো করো।”

ইমতিয়াজ শক্ত কন্ঠে বলে,
“আমি জানি, আমি কি করছি। আমাকে বাচ্চা মনে করবেন না। আপনারা সাবধানে থাকবেন।”

ইমতিয়াজ হনহনিয়ে বের হয়ে যায়। চতুর্থ তলায় আহনাফকে দেখে তার সামনে গিয়ে বলে,
“নিচে আসো।”

চট করে কন্ঠটা ধরে ফেলে আহনাফ। এটা ইমতিয়াজ ছাড়া কেউ নয়। কথামতো নিচে চলে যায় সে।

অফিসের গাড়ি তৈরি আছে, আহনাফ আসলে ইমতিয়াজ জানলা থেকে ওকে বলে,
“বসো।”

শিল্পা ইউনুস গাড়ি চালানো শুরু করে। আহনাফ অবাক হয়, ভিতরে সে এক কথা শুনলো আর এখন অন্যকিছু দেখছে।

ইমতিয়াজ তাকে বলে,
“তুমি মৃত্তিকাকে নিয়ে নিয়াজীর এড্রেসে যাবে। নিয়াজী সেখানে আছে কিনা শুধু সেটাই দেখবে। আমি যেতে পারবো না, কারণ সবার চোখে আমি মৃ°ত। নিয়াজী তোমরা তিন জায়গায় খুঁজবে, এক তার বাসা, দুই অফিস আর শিল্পা হাসপাতালে থাকবে।”

আহনাফ কপাল কুঁচকে বলল,
“কিন্তু তোমার মনে হচ্ছে না এটা অসম্ভব একটা কাজ।”
“হতে পারে, তবে আমি একটা পরিকল্পনা করেছি।”
“কি?”

“তোমরা দুজন নিয়াজীর খোঁজ বের করবে, নিয়াজীর থেকেই জানা যাবে এখানে আর কেউ যুক্ত আছে কিনা। না থাকলে ভালো আর থাকলে তাদেরকেও ধরতে হবে। তবে চিন্তার কারণ শাফিন।”

ইমতিয়াজের কথায় আহনাফ একটা মৃত্তিকার দিক তাকিয়ে বলে,
“শাফিনের বুকের ডানপাশে ছু°ড়ি লেগেছে, বামদিকে লাগলে তখনই মা°রা যেতো।”
“সেটাই বলছি, ও যেন কোনোভাবেই বেঁচে না বের হয়।”

মৃত্তিকা ওদের কথা মাঝে বলল,
“অপরূপা তো পালিয়েছে। আমার পিছু পিছু বাসায়ও গিয়েছিল।”
“ওই মেয়ে যেভাবেই হোক পালাবে, এটা জানা ছিল। কিন্তু সে শাফিনের কাছে যাবেই যাবে।”

পরিকল্পনা এবারে কিছুটা পাকাপোক্ত, তবে কতটুকু কাজ করবে সেটাই দেখার পালা।
______________________________________

নিয়াজীর বাসায় সে নেই, তার অফিসেও তাকে পাওয়া যায়নি আর নাম্বারটাও বন্ধ। রাতে হতাশা নিয়েই আহনাফ ও মৃত্তিকা হাসপাতালে আসে। তবে এখানে ওরা নিয়াজীকে খুঁজে পায়।

শাফিনের আইসিইউর সামনে সে দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশের মাঝ থেকে ওকে নেয়া যাবে না। ওরা একটা দূরত্বে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ পরই নিয়াজী ভিতরে যায়। ইমতিয়াজকে কল করে গাড়ি তৈরি রাখতে বলে মৃত্তিকা।

শাফিনকে ঘুমের ওষুধ দেয়া হয়েছে। মমতাজ বেগম নিজের বিছানায় আছে। নিয়াজী তাকে বলে,
“কি হলো আপা? কিছু না। তোমার ভাই এবারে ফেল, কতগুলো বাচ্চার কাছে ফেল। কি ভাবছো? আমি তোমাদের বাঁচাবো? আমার নিজের প্রাণের ভ°য় আছে।”

মমতাজ নিষ্প্রাণ হয়ে তাকিয়ে বলল,
“তোমরা যে স্বার্থপর তা আমি জানি।”
“এতোকিছু কি স্বার্থের জন্য করোনি?”
“আমরা প্রতি°শোধ নিতে চেয়েছি আর তোমরা ধনী হতে চেয়েছো।”

নিয়াজী শাফিনের দিকে তাকিয়ে বলে,
“শাফিনকে কে বাঁচায় তা আমিও দেখবো।”

নিয়াজী বেরিয়ে যায়। হাসপাতাল থেকে বাইরে আসতেই আহনাফ হেসে তার কাঁধে হাত দিয়ে বলল,
“রেগে আছেন আংকেল?”

নিয়াজী ওর হাতের দিকে তাকিয়ে বলে,
“কে আপনি? কি সমস্যা?”
“কোনো সমস্যা না, তবে ভাবছিলাম একটু ফিজিক্স পড়ানো যেতেই পারে।”
“মানে?”
“এই যেমন আপেল কেন মাটিতে পড়ে? কিন্তু চাঁদ কেন পড়ে না?”
“আজাইরা পেঁচাল।”

নিয়াজী চলে যাওয়ার আগেই মৃত্তিকা গাড়ি নিয়ে আসে। দরজা খুললে তাকে জোর করে ভিতরে নিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়া হয়। সুঠাম দেহী আহনাফ আর ইমতিয়াজের মাঝে তাকে বসানো হয়েছে।

নিয়াজীকে ইমতিয়াজের বাসায় আনা হয়েছে। এমনকি শিল্পাকেও বাসায় পাঠানো হয়নি, কাউকে একা ছাড়া যাবে না। বিশ্বাস নেই কারো উপর।

নিয়াজীর চেহারা আর শারিরীক ভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছে ধরা পড়েও কোনো চিন্তা নেই, সে হয়তো ধরেই রেখেছিল সে ধরা পড়বে।

“কি জানতে চাও তোমরা? একে একে অনেককেই তো ধরেছো, সবাই ছাড়া পেয়েছে।”

নিয়াজীর কথায় ইমতিয়াজ হেসে বলল,
“কেউ কেউ চিরস্থায়ী ছাড়া পেয়ে উপরে চলে গেছে। মানুষের জীবনের মূল্য তোমাদের কাছে এতোই কম যে চাইলে কাউকে মে°রে ফেলতে পারো?”

নিয়াজী সকলের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে বলে,
“শরীফও বহু মানুষকে মে°রেছে। মা°স্তানি তো সেও করছে।”

আহনাফ দুই পকেটে হাত দিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে নিয়াজীর পেছনে গিয়ে তার ঘাড়ে পা দিয়ে মাথা নিচু করিয়ে বলল,
“ওসব বাদ দাও, আগে বলো তোমরা ছাড়া আর কে কে এখানে আছে।”
“ইমতিয়াজ আছে আর ইমতিয়াজ।”
“ঠিক ঠিক করে বলো।”

নিয়াজী হেসে বলল,
“ইমন, মনসুরকে মে°রেছে, তকীকেও মে°রেছে। বাকি আছি আমি, আমাকেও মা°রবে। মুখ খুললেও মা°রবে আর না খুললেও।”

ইমতিয়াজ স্বাভাবিকভাবে বলল,
“সত্য বললে কেউ মা°রবে না। প্রাণে বেঁচে যাবে।”

আহনাফ চিৎকার করে আরেকটু জোরে পা দিয়ে চেপে বলল,
“বলো, কে ওই পঞ্চম ব্যক্তি?”

মৃত্তিকা পাশের রুমে চলে যায়। নিরবে সে শিল্পার সাথে বসে থাকে, শরীর এখন আবারো খারাপ লাগছে।

নিয়াজী শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে বলল,
“এখনো বুঝোনি, কে পঞ্চম ব্যক্তি? পঞ্চম বলে কেউ আসলে নেই। আমরা পাঁচজন মিলে ইমতিয়াজ নাম তৈরি করেছি, তাই পঞ্চম বলা হয়।”

ইমতিয়াজ আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“পাঁচজন মানে? আর কে আছে?”
“দীপ।”

নিয়াজীর কথায় আবারো ইমতিয়াজের প্রশ্ন,
“আমার নাম কেন ব্যবহার করা হয়েছে?”
“নামটা মিউকোর বিয়ের পর হয়েছে। শাফিন চেয়েছিল মিউকো তোমাকে মে°রে ফেলুক। এতোদিনে তা হয়েও যেতো যদি শরীফ বাধা না দিতো।”

আহনাফ চোখ ছোট করে বলে,
“ওর কথা বিশ্বাস করবো?”
“পুরোপুরি তো কখনোই না, তবে শোনা যায়।”

নিয়াজী আবারো হেসে উঠে। বলে,
“শরীফকে আগে থামাও, তোমরা না মা°রলেও সে আমাকে মা°রবে।”

আহনাফ পা সরিয়ে নেয়। ইমতিয়াজ দেয়ালের সাথে ধা°ক্কা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যতই সে ভালো থাকার চেষ্টা করুক, সে তো ভালো নেই। শরীরে অসংখ্য স্থান কেটেছে, ধীরে ধীরে য°ন্ত্র°ণা বাড়ছে।

পুরো রুম নিস্তব্ধ হয়ে যায়। পিনপতন নিরবতা ছিন্ন করে নিয়াজী বলল,
“রিপার মৃ°ত্যুর কয়েকদিন পরই শরীফ জানতে পারে রিপা স্বাভাবিকভাবে মা°রা যায়নি, এটা দু°র্ঘ°টনা নয়। সে তখন থেকেই নিজের লোকজন যোগাড় করেছে। একে একে অনেক ছেলেপুলে তার সাথে কাজ শুরু করেছে। সবাই কি ডাকাত, মা°স্তান? না, বেশিরভাগ সাধারণ স্টুডেন্ট।”

দুজনে চোখ কুঁচকে তাকায়। এ কি শুনছে ওরা?

“শরীফ শাফিনকে সন্দেহ করছিল, তাই তো সে মিউকোকে মামার থেকে নিয়ে আসার জন্য চেষ্টা করেছে। যখন মিউকো রাজি হয়নি, তখন সে তোমাকে (ইমতিয়াজকে ইশারা করে বলে) চিঠি দিয়েছিল। সে জেনে গিয়েছিল ওরা মিউকোকে মা°রতে চায়।”

ওদের অবাক মুখে আরেকটা কথা ছুঁ°ড়ে নিয়াজী,
“সারাহ্-র বাসায় ইমতিয়াজের সাথে বিয়ের প্রস্তাব কে নিয়ে গিয়েছিল? আমি নিয়েছিলাম। জাহাঙ্গীর সাহেব রাজি হয়নি, কিন্তু শাফিন চেয়েছিল সারাহ্-র বিয়ে ইমতিয়াজের সাথে হোক। (একটু থেমে) ভেবেছিল, ইমতিয়াজকে অনুরোধ করবে বউ নিয়ে শাফিনের সাথে থাকার জন্য, এতে নার্গিসকে ব°শ করা সহজ হতো।”

ইমতিয়াজ চোখ কুঁচকে বলল,
“উনার সাথে আমার বিয়ের কথা হয়েছিল?”
“হ্যাঁ, তুমি তো মেয়ের ছবিই দেখোনি। সারাহ্ দুইবছর পর তোমাকে দেখেই চিনে নিলো, অবাক হওনি সেদিন বাসে। পরে অবশ্য জামিলের কথায় আহনাফের সাথে বিয়ে হয়, কিন্তু এতে শাফিনের উদ্দেশ্য হাসিল হয় না।”

কুমিল্লা থেকে ঢাকা আসার পথে সারাহ্-র সাথে দেখা হওয়ার খবর নিয়াজী কি করে জানে। সবকিছু খুলতে খুলতেও যেন পেঁচিয়ে যাচ্ছে।

নিয়াজী দাঁত কেলিয়ে বলল,
“বাসের একদম পিছনের সিটে দীপ আর ইমন ছিল। সেদিন সারাহ্-কে কি°ড°ন্যাপ করতে সেখানে ছিল ওরা, তোমার জন্য পারেনি।”

নিয়াজী কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে বলে,
“রোমির মেয়েকে কে মে°রেছে? শাফিন? উহু, দীপ মেরেছে। সম্পর্ক ছিল ওদের, মে°রে সম্পর্ক ভে°ঙেছে। মৃ°ত্যু কঠিন নয়, খুব সহজ।”

ইমতিয়াজ ফ্লোরে বসে পড়ে। এতো এতো ঘটনা ওদের জীবনে মিশেছে, অথচ সে এসব পাত্তাই দেয়নি।

“শাফিনের মৃ°ত্যু তোমাদের সবার মতো আমিও চাই। ওকে আমিই দোকানের কর্মচারী উমারকে দিয়ে হ°ত্যা করতে চেয়েছিলাম, পারিনি।”

আহনাফ ওর কাছে এসে বলল,
“শাফিনকে তুমি কেন মা°রতে চাও?”

নিয়াজী অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
“কারণ শাফিন আমার সাথে বিশ্বাস°ঘা°তকতা করেছে।”
“কিভাবে?”

নিয়াজী জোরে জোরে বলে,
“কিভাবে আবার? আমি ওকে বিথীর খোঁজ দিয়েছিলাম, সব ধরনের সাহায্য করে রিপার করা কে°ইস থেকে বের করে এনেছিলাম আর সে কি করেছে? নিজে বের হয়ে আমাকে ফাঁ°সিয়ে জে°লে দিয়ে দিলো আর প্রাণের ভ°য়ে বিথী, আমার বোন, আমাকে বের করেনি। দুইবছর আমাকে জে°লে থাকতে হয়েছিল।”

ইমতিয়াজ আহনাফকে বলে,
“চিন্তা করো আহনাফ, দুইবছর জে°ল খাটার পরও ওই মানুষটার সাথে গিয়েই মিললো, আবার তিন তিনটা খু°নও করলো।”
“তিনটা না চারটা।”

ইমতিয়াজ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আর কে?”
“একটা ছেলে, যখন ওদেরকে দুলালের রিসোর্টের রুমে নিয়ে যাচ্ছিলাম তখন সে পিছু ধরেছিল।”

দুজনে আবারো চুপ হয়ে যায়। কে জানে ওই ছেলেটা কে ছিল? তার কি বা দোষ ছিল?

“শাফিনের সাথে না মিললে হুমায়ুন, দুলাল আর জামিলের মতো সে আমাকেও মে°রে দিতো। এখন দীপ আবার ওকে বাঁচাতে বলে। পারলে ওকে আইসিইউর ভিতরেই মে°রে দিবো।”
“তবে সেটাই করো, যাও আর ওকে মে°রে দাও।”

ইমতিয়াজের কথায় আহনাফ ওর দিকে তাকায়। ইমতিয়াজ আবারো বলে,
“আমি চাই না, আমার সন্তানকে কেউ খু°নির সন্তান বলুক। যেমনটা এখন সুরভির সাথে হচ্ছে।”

ইমতিয়াজ আস্তেধীরে হেঁটে রুমে চলে যায়। আহনাফ নিয়াজীকে বলে,
“ইমতিয়াজ চাইলেও আমি তা চাই না। তোমাকে ছাড়লে তুমি শাফিনকে বাঁচিয়েও নিতে পারো।”

ইমতিয়াজ মৃত্তিকার কাছে এসে বলে,
“কাল তোমার বাবাকে খবর দাও, উনি সবকিছু এতো আগে আগে কিভাবে জানে তা আমাকে একটু শিখাবে।”

মৃত্তিকা ওর দিকে তাকিয়ে থাকলো। কিছু বলছে না সে। ক্ষ°তবিক্ষ°ত একটা দেহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মানুষটা। এতো কষ্ট কি তার সত্যিই প্রাপ্য ছিল?
______________________________________

রাত সাড়ে বারোটায় বাসায় এসেছে আহনাফ। বারবার ওর ফোনে কল করে ফোন বন্ধ পাওয়া সারাহ্-র মন অস্থির হয়ে আছে। আহনাফ বেল বাজানোর সাথে সাথে সে দরজা খুলে দেয়।

আহনাফকে দেখেই জড়িয়ে ধরে। আহনাফ ওর পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,
“কি হলো? আবার সাইদার আম্মু এমন করছে কেন?”
“সাদাবের আব্বু ফোন বন্ধ রেখেছে তাই।”

সারাহ্ সরে দাঁড়িয়ে ওকে ভিতরে আসতে দেয়। আহনাফ ড্রইংরুমে বসে পকেটে হাত দিয়ে টের পায় ফোন এখানে নেই।

“আমার ফোন কোথায় গেল?”

সারাহ্ এসে বলে,
“কোথায় গেল মানে?”
“নেই। একটু তোমার ফোনটা আনো তো।”
“আনছি।”

সারাহ্ ফোন নিয়ে আসলে আহনাফ বলে,
“ইমতিয়াজ বা মৃত্তিকার নাম্বার আছে তোমার কাছে?”
“মৃত্তিকার আছে।”

আহনাফ মৃত্তিকার নাম্বারে কল দেয়। ফোনের খোঁজ জানতে চাইলে মৃত্তিকা জানায় বাসায় দেখে জানানো হবে। পকেট থেকে এভাবে কেউ ফোন নিয়ে গেল আর ও টের পেল না।

সারাহ্ ওর পাশে বসে বলে,
“কি হয়েছে কো°র্টে আমি টিভিতে দেখেছি। এখন ইমতিয়াজ সাহেব কেমন আছেন?”

আহনাফ ওর দিকে তাকায়। মাথা নেড়ে বলে,
“হাঁটাচলা করতে পারতেছে। বেশি গু°রুতর কিছু না।”
“যাক, ভালোই। শাফিনের?”
“আইসিইউ, ইমতিয়াজ ছু°ড়ি চালিয়েছিল।”
“কই মাছের জান, সহজে ম°রে না।”

সারাহ্ উঠে রুমে চলে আসে। আহনাফ পিছুপিছু এসে বলে,
“তো সাইদার আম্মু সাদাবের আব্বুর জন্য এতো চিন্তা কেন করেছে? আর ঘুমায়নি কেন?”
“ঘুম আসেনা আমার..”

কথার মাঝে হুট করে সারাহ্ থেমে যায়। আহনাফ ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,
“কেন?”

সারাহ্ উত্তর না দিয়ে মিষ্টি করে হেসে বলে,
“খেয়ে নিবেন, আমি খাবার আনছি।”
______________________________________

মৃত্তিকা আহনাফের ফোন খুঁজছে। ডাইনিং-এ থাকা নিয়াজীর আশেপাশে ভালো করে খুঁজে। তারপর যায় গেস্টরুমে, যেখানে শিল্পা আছে। সেখানেও পায় না।

রুমে এসে দেখে ইমতিয়াজ পায়ের ব্যান্ডেজ খুলে কা°টা জায়গায় ওষুধ লাগাচ্ছে। সুস্মিতা ওকে ওষুধ দিয়ে দিয়েছিল।

ক্ষ°তস্থান দেখেই মৃত্তিকার গা গু°লিয়ে উঠে। ইমতিয়াজ ওকে বলে,
“চেয়ে চেয়ে কি দেখো? যা খুঁজতেছো, তাই খুঁজো।”

মৃত্তিকা এসে পাশে বসে। আলতো হাতে তুলা দিয়ে নিজের ক্ষ°তস্থানে ওষুধ লাগিয়ে দেয়। বলে,
“আমি ভেবেছিলাম আপনার পা হয়তো ভে°ঙেছে, যেভাবে বলেছিলেন হাঁটতে পারবেন না।”
“না, ভা°ঙলে হাঁটতে পারতাম না।”

ওষুধ লাগিয়ে মৃত্তিকা সব সরিয়ে রাখে।
“খাবেন কিছু?”
“না, এখন আর ইচ্ছা নেই। তোমার কোনো কাজ না থাকলে শুয়ে পড়ো।”
“আপনি ঘুমাবেন না?”
“না, নিয়াজীকে পাহারা দিতে হবে। আহনাফ হয়তো ঠিক, ও ছাড়া পেলে শাফিনকে বাঁচাতেও পারে।”

মৃত্তিকা আলো নিভিয়ে মিউকোকে নিয়ে অন্যদিক ফিরে শুয়ে পড়ে। ইমতিয়াজ ওর উপর দিয়ে গিয়ে মিউকোকে আদর করে।

মৃত্তিকা বলে,
“অপরূপার কি হবে?”
“শাফিনের ব্যবস্থা হলো, সব ব্যবস্থাই হয়ে যাবে। তবে তুমি নিজের হাত রাঙিয়ে ফেলবে না। বেবির জন্য হলেও খু°ন করবে না তুমি।”

মৃত্তিকা ফিরে ওর দিকে। বাইরে থেকে আসা মৃদু আলোয় ইমতিয়াজকে দেখে সে।

“এতোদিন আমি শাফিনকে মা°রতে চাইলেও আজ সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছি। ওকে আমি নিজ হাতে মা°রবো না। কিন্তু সে ম°রবে।”

কিছুক্ষণ চুপ থেকে ইমতিয়াজ ওর কপালে চুম্বন করে বলল,
“ঘুমাও।”

জানলার পর্দা টেনে ইমতিয়াজ ডাইনিং এ চলে গেল।

চলবে……

অনুভূতিরা শব্দহীন পর্ব-৫৫+৫৬+৫৭

0

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

পঞ্চপঞ্চাশৎ পর্ব (৫৫ পর্ব)

“তাহসিনার সিলেট যাওয়ার আবদারটা মূলত শাফিনের কারণেই হয়েছিল। শাফিন ওকে কিছু ভিডিও দেখায়। তাহসিনা একটু বিলাসিতা পছন্দ করতো, তার ভালো লাগে এসব। তাই একপ্রকার জে°দ ধরেই সে সিলেট যায়।

রিসোর্টে বিয়ের আগের দিন খুব ঝা°মেলা করে তাহমিনা। শাফিনের সাথে দু°র্ব্যবহার করে, আবার ওকে চ°ড় মা°রে। সত্যি বলতে ওদেরকে মা°রার ইচ্ছা তখনও আমার ছিল না। তবে নিজেকে বাঁচাতে আমি শাফিনের প্রস্তাবে রাজি হই।

পার্লার থেকে বের হওয়ার আগে রিপা আমাকে কল দিয়েছিল। বলেছিল, তাহসিনাকে নাকি খুব সুন্দর লাগছে। ওরা খুব আনন্দে আছে, কিছুক্ষণ পরই চলে আসবে।

ওরা যে আসতে পারবে না তা আমি জানতাম। রাস্তা থেকে ওদেরকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়৷ দুইবোনকে মা°রার পরও রিপা অনেকক্ষণ বেঁচে ছিল। শাফিনরা পাঁচজন ছিল। শাফিন, জামিল, দুলাল, কবির, আরেকজন কে ছিল আমি জানি না। রিপা নিজের হাতের বাঁধন খুলে ফেলেছিল, কবিরকে ওখানেই মে°রে ফেলে সে।

তবে তারপর আর রিপা বাঁচে না। তিনজনকে আবারো গাড়িতে তুলে দেয়। কবিরকে উল্টোদিকের গাড়ির ড্রাইভার সাজিয়ে দেয়, একদম পারফেক্ট এ°ক্সি°ডেন্ট লুক আসে৷ কেউ তোমরা বুঝতে পারোনি।”

মৃত্তিকাকে রোমি খন্দকার ও নার্গিস পারভিনের সাথে শাফিনে শ°ত্রু°তা নিয়েও সবটা বলেছে মমতাজ বেগম। তিনটা খু°নের বর্ণনাও করে। মৃত্তিকা শুধু শুনছে আর থেমে থেমে ছোট ছোট প্রশ্ন করছে।

“পঞ্চম মানুষটা কে?”
“জানা নেই আমার।”

মৃত্তিকা আর কিছু জিজ্ঞাসা না করলেও মমতাজ বেগম বলে,
“আমি কখনো চাইনি তাহমিনার ভালো কোথাও বিয়ে হোক। তাইতো ইমতিয়াজের মতো ছেলেকে আমি পছন্দ করেছিলাম। মূলত শাফিন আমাকে ওর খোঁজ দিয়েছিল।”

মৃত্তিকার কপাল কুঁচকে যায়। বলে,
“ইমতিয়াজকে শাফিন আগে থেকে চেনে?”

“হ্যাঁ চেনে। আমি লুৎফরকে রাজি করেছিলাম। ইমতিয়াজের সম্পর্কে অনেক খোঁজখবর নিয়ে যখন দেখলেন ছেলেটা ভালো, তখন উনি তাহমিনা সাথে কথা বলে। তাহমিনারও পছন্দ হয়, তবে ফ্যামিলি না থাকায় তাহমিনা একটু ইতস্তত করে। তবে বিয়ের পর ওদের সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকে।”

মৃত্তিকা ভ°য়ে একটা ঢোক গিলে। ইমতিয়াজ কি শাফিনের সাথে জড়িত? এমন একটা ভ°য়ং°কর প্রশ্ন মৃত্তিকার মনে ঘুরছে।

“তাহমিনার মৃ°ত্যুর পর ইমতিয়াজকে আবারও বিয়ে দিতে চেয়েছিল শাফিন। মেয়েও নাকি দেখেছিল, তবে ইমতিয়াজ রাজি হয়নি। শাফিন কেন এটা চেয়েছিল তা আমাকে জানায়নি।”

মমতাজের কথায় মৃত্তিকা আবারো একটু হকচকিয়ে গেল। নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
“শাফিন এখন কোথায়?”

মমতাজ বেগম একটু হাসলেন, বলেন,
“ওকে তোমরা পাবে না। ওর জে°দের কাছে সবাইকে হার মানতে হবে। ও যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েছে রোমি আর নার্গিসকে মা°রবে, তারমানে ওরা ম°রবেই। তোমাকে শেষ করার কথা তো আরো আগেই বাবাকে দিয়েছিলাম।”

মৃত্তিকা মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“তোমরা জীবনেও শুধরাবে না?”

মমতাজ বেগম মাথা নেড়ে অন্যদিকে তাকায়। তারপর বলে,
“তোমার প্রেগন্যান্সির কথাও জানিয়ে দিয়েছি। তোমার অবস্থাও তাহমিনার মতো হবে।”
“আমি প্রেগন্যান্ট নই বড়মণি, শাফিনকে ধরার এটাই বড় সুযোগ।”

মৃত্তিকা বেরিয়ে যেতে নিলে মমতাজ বেগম আবারো বলেন,
“কেন? ইমতিয়াজ কি ভালোবেসে স্পর্শ করেনি? মিথ্যা কেন বলতে হলো?”

মৃত্তিকা কিছু না বলে বেরিয়ে যায়। ইমতিয়াজ ওকে ভালোবাসুক কিংবা না বাসুক, ও ইমতিয়াজকে ভালোবাসে। কিন্তু শাফিনের সাথে যুক্ত থাকলে, ওকেও শেষ করতে এক মিনিটও ভাববে না সে।
______________________________________

আজ বৃহস্পতিবার হওয়ায় কলেজ তাড়াতাড়ি ছুটি হয়েছে, এখন মাত্র বারোটা বেজেছে।

বাসায় যাওয়ার পথে সারাহ্ বলে,
“আপনি বলেছিলেন আমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবেন, কিন্তু গেলেন না।”

আহনাফ একটু হেসে বলল,
“পরিস্থিতি স্বাভাবিক হোক, আমরা যাবো।”
“জীবনে তো এমন সময় বহু আসবে, তাই বলে কি ঘরব°ন্দী থাকবো নাকি?”
“ঐশী, জে°দ করো না।”

সারাহ্ মুখ ভে°ঙচিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। আহনাফ হেসে বলে,
“আজকের আকাশটা দেখেছো? সুন্দর না?”
“কোথায় সুন্দর?”
ধ°মক দিয়ে বলে সারাহ্।

“আহা, দেখছো না মেঘলা আকাশ, কি রকম কালো কালো মেঘ থরে বিথরে সেজে আছে? আবার কি মৃদুমন্দ একটা বাতাস বইছে? তোমার মনে হচ্ছে না, আজকের দিনটা খিচুড়ি খেয়ে আরামে ঘুমানোর দিন?”
“ওই আপনি দুইটা কাজই পারেন। কাজের মধ্যে দুই, খাই আর শুই।”

আহনাফ হো হো করে হেসে উঠে, তারপর বলে,
“আজকের দিনটা ঘুমানোর দিন, ঘুরাঘুরি নয়। ঘুরাঘুরির জন্য রোদ ঝলমলে দিনের দরকার।”

সারাহ্-র রাগ তবুও ভা°ঙে না। আহনাফ সিএনজি চালককে বলে,
“মামা, একটু রসমালাইয়ের দোকানের সামনে দাঁড় করিয়েন তো।”

চালক ওর কথা মত একটা মিষ্টির দোকানের সামনে সিএনজি থামায়। আহনাফ নেমে দোকানের ভিতরে যায়, উদ্দেশ্য সারাহ্-র পছন্দের কিছু মিষ্টি কেনা। আজকাল সে মিষ্টি খুব খাচ্ছে।

এর মধ্যে বৃষ্টি শুরু হয়, একদম হুট করে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হল। সিএনজির পর্দা নামিয়ে দেয়া হয়। সারাহ্ অপেক্ষা করছে আহনাফের জন্য।

হুট করে একজন মাস্ক পরা লোক এসে সিএনজিতে উঠে বসে। সারাহ্ চমকে উঠে বলে,
“পুরো সিএনজি রিজার্ভ করা, আপনি নেমে যান।”

“নামার জন্য তো আমি আসিনি।”
বলেই সারাহ্-র গলার কাছে পি°স্ত°ল ধরে লোকটি।

চালককে বলে,
“সিএনজি চালাও। না হলে তোমার যাত্রী যাবে আর তুমিও।”

প্রাণের ভয়ে সিএনজি চালানো শুরু করে দেয় চালক। আহনাফ দৌড়ে বেরিয়ে আসলো। পেছন থেকে আহনাফ চেঁচিয়ে বলছে,
“থামাও।”

সিএনজি থামলো না, চলে গেল। আহনাফও অন্য আরেকটি সিএনজি নিয়ে পিছু ধরলো, সাথে গাড়ির নাম্বারটাই দেখে রেখেছে।

বৃষ্টি পড়ছে, কুমিল্লা শহর, জ্যাম থাকাটাই স্বাভাবিক। সব সিএনজিতে পর্দা দেয়া, সবই দেখতে একরকম। খুব স্বাভাবিকভাবে সারাহ্-র সিএনজি কিছুক্ষণ পর আহনাফ আর খুঁজে পেল না। কিন্তু সে হাল ছাড়েনি, এদিকওদিক ঠিকই খুঁজে বেড়াচ্ছে।

এদিকে সারাহ্ স্থির হয়ে বসে আছে, যেন কিছুই হয়নি। ওর পাশে থাকা লোকটি বলে,
“তুমি ভ°য় পাচ্ছ না।”
“না তো, এক আল্লাহ্ ছাড়া আর কাউকে ভ°য় পাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমার জন্য আল্লাহ্ই যথেষ্ট।”

পি°স্ত°ল দিয়ে সারাহ্-র গলায় খোঁ°চা দিয়ে লোকটি বলে,
“খুব তো বড় বড় কথা বলছো। এখন মে°রে এখান থেকে ধা°ক্কা দিয়ে ফেলে দেই, কে বাঁচাবে তোমাকে? তোমার আহনাফ?”

সারাহ্ মুচকি হেসে বলে,
“আমাকে ওই আল্লাহ বাঁচাবে যে ইউসুফ (আঃ)-কে কুয়া থেকে আর ইউনুস (আঃ)-কে মাছের পেট থেকে রক্ষা করেছিল। আমাকে ওই আল্লাহ বাঁচাবে যে ইব্রাহিম (আঃ)-কে অ°গ্নি°কু°ন্ড থেকে আর ইসমাইল (আঃ)-কে ধা°রালো ছু°রি নিচ থেকে রক্ষা করেছিল। আমাকে ওই আল্লাহ বাঁচাবে যে মক্কার কা°ফের মুশ°রিকদের থেকে আমার নবী মুহাম্মদ (সঃ) কে বাঁচিয়েছিল।”

লোকটি ধ°মক দিয়ে উঠে,
“ভ°য় পাও আমাকে, আমি শাফিন।”

সারাহ্ আবারও হাসে। বলে,
“ফে°রা°উন, নম°রুদ অনেক ক্ষমতাধর ছিল, কিন্তু আজ তারা কোথায়? সুতরাং তোমার মত একটা না, হাজার জন শাফিনও যদি আসে, তবেও আমি ভ°য় পাই না।”

শাফিনের রাগ তড়তড় করে বাড়ে। মাস্ক খুলে বাইরে ফেলে দিয়ে চালককে বলে,
“দ্রুত চালাও, সামনে গিয়ে ডানে যাবে।”

সারাহ্ আড়চোখে এদিক-সেদিক দেখতে লাগলো, সে কোথায় আছে আপাতত বুঝতে পারলো না। শাফিন ওর পাশে বসা, ও জানে শাফিন ওকে গু°লি করে কখনোই মা°রবে না।

“কি চাও আমার কাছে, তাই বলো।”

সারাহ্-র শান্ত কথা শুনে শাফিন পি°স্ত°ল দিয়ে আবারো ওর গলায় খোঁ°চা দেয়। তারপর বলে,
“তোমার মাধ্যমে আমি নার্গিস আর আহনাফকে মা°রবো, সাথে পালাবোও। আমি এতোদিন যেহেতু ধরা পড়িনি, তাই আহনাফের মতো কুঁচো চিংড়ির হাতে ধরা দিবো না।”

সারাহ্ আর কোনো জবাব দেয় না। সে ক্রমাগত দুরুদ শরীফ পড়তে থাকে। তার বিশ্বাস আল্লাহ তাকে এতোটা কষ্ট দিবে না, যা সে সহ্য করতে না পারে।
______________________________________

“ভাইয়া, আম্মুকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না।”

তানজিমের ভ°য়ার্ত কণ্ঠ শুনে ইমতিয়াজ চমকে উঠে বলে,
“কোথায় যেতে পারে?”
“কাল রাতেও ছিল না, আজও বাসায় নেই। বাবা খুঁজতে গেছে। আম্মুর সব আত্মীয়-স্বজনের বাসায় ফোনও দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কোথাও নেই।”

ইমতিয়াজ একটু ভেবে বলে,
“মামানিকে কল দিয়েছিলে?”
“দিয়েছিলাম, ওখানেও যায়নি। মিউকোপুকে জানিয়েছে, আপুও তাকে খুঁজছে।”

ইমতিয়াজ জমিদার বাড়ির ওই ঘটনার পর থেকে মমতাজ বেগমকে সন্দেহ চোখে দেখে, আবার মৃত্তিকাও নিজের সন্দেহের কথা ইমতিয়াজকে জানিয়েছিল।

“শাফিনের কাছে যায়নি তো?”

ইমতিয়াজের কথায় তানজিম চুপ হয়ে যায়। ইমতিয়াজ আবারো বলে,
“আমার তো তাই মনে হচ্ছে।”

তানজিম সাতপাঁচ না ভেবে সরাসরি ওর সাথে ওর মায়ের কথোপকথন ও অপরূপার যোগাযোগ সম্পর্কে সব বলে দেয়। সব শুনে ইমতিয়াজ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়,
“তবে উনি শাফিনের কাছেই গেছে, আমি নিশ্চিত।”

ফোন রেখে আবারো অফিসের কাজে মন দেয় ইমতিয়াজ। ঠিক এমনসময় ওর পিএ এসে জানায় কোনো একজন সিআইডি অফিসার ওর সাথে দেখা করতে এসেছে।

অনুমতি নিয়ে ভিতরে আসে অফিসার নাইমা। ইমতিয়াজের মুখোমুখি রাখার চেয়ারে বসে বলল,
“বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। তবে আশা করি আপনি আমাদের সাহায্য করবেন।”

ইমতিয়াজ একটু নড়ে চড়ে বসে বলল,
“আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করব, ইনশাআল্লাহ।”

অফিসের নাইমা ইন্সপেক্টর রাব্বি ও জেলার বিল্লাল হোসেনের গ্রে°ফ°তার হওয়ার কথাটি জানিয়ে বলে,
“ওরা দুজন বলেছে ওরা একটা গ্রুপ হয়ে কাজ করেছে। সেই গ্রুপের সবাই মূলত নিজেদের পজিশন নিচ থেকে উপরের দিকে আনার জন্য শাফিনের সাথে যুক্ত ছিল। দুজনের বক্তব্য ছিল এমন যে, টাকা ছাড়া বাংলাদেশে মেধার কোনো দাম নেই, তাই টাকার জন্য ওরা শাফিনকে সাহায্য করেছে। বিনিময়ে টাকা পেয়েছে এবং নিজেদের অবস্থান উঁচু করেছে।”

ইমতিয়াজ মনোযোগ দিয়ে কথা শুনে আর ঘন ঘন ঘাড় নাড়ায়। নাইমা বলে,
“ওদের মধ্যে একটা বড় ভূমিকা রেখেছিল অ্যাডভোকেট বিথী, যে এখন লা°পাত্তা এবং শেষবার অ্যাডভোকেট বিথীর মোবাইলের অবস্থান ও আপনার মোবাইলের অবস্থান একই ছিল।”

এখানে অ°স্বীকার করার উপায় নেই। ইমতিয়াজ বাম হাতে ভ্রূ চুলকে বলে,
“হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। সে আমার কাছেই আছে। আমি তুলে এনেছি।”

“কেন?”

ইমতিয়াজ উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“কারন আমি ভেবেছিলাম সে জানে শাফিন কোথায়।”

অফিসার নাইমাও উঠে দাঁড়ায়। বলে,
“ঠিক আছে, আমাকে এখন তার কাছে নিয়ে চলুন। আমরা তাকে নিয়ে যাবো এবং আমাদের মতো করে জিজ্ঞাসাবাদ করবো।”

ইমতিয়াজ মাথা নেড়ে বলে,
“অবশ্যই তবে তার আগে আপনাদের আরেকটা কাজ করতে হবে।”
“আপনি আমাদের অর্ডার দিবেন?”
“নো, আমি তো অর্ডার দিচ্ছি না, এডভাইস দিচ্ছি।”

নাইমা কপাল কুঁচকে তাকালে, ইমতিয়াজ হাসি হাসি মুখ করে ফাহাদকে ডাকে। ফাহাদ আসলে নাইমাকে বলে,
“আগে আপনারা যাত্রাবাড়ী যাবেন, সেখানে শাফিনের গোপন ঠিকানা আছে। বাসাটা ফাহাদ আপনাদের চিনিয়ে দেবে।”

নাইমা ফাহাদকে জিজ্ঞাসা করে,
“তুমি কি করে ওই ঠিকানা জানো?”
“অপরূপার পিছুপিছু গিয়েছিলাম।”
“অপরূপা কে?”

পাশ থেকে ইমতিয়াজ বলে উঠে,
“শাফিনের দ্বিতীয় স্ত্রী। এতোদিনে এইটুকুও বের করতে পারেননি?”

নাইমা রাগি চোখে একবার ইমতিয়াজের দিকে তাকায়। তারপর বলে,
“ফাইন, আমাদের একটা টিম ফাহাদের সাথে যাত্রাবাড়ী যাবে আর আমি যাবো এডভোকেট বিথীকে আনতে।”
“ওকে।”
ইমতিয়াজ প্রস্তাবে রাজি হয়।

নাইমা বেরিয়ে যায়। নিজের টিমকে দুই ভাগে ভাগ করে দেয় সে। আর এদিকে ইমতিয়াজ মৃত্তিকাকে ফোন দিয়ে নাইমার বাসায় আসার কথাটা জানিয়ে দেয়।
______________________________________

দুজন পুলিশ সদস্যের সহায়তায় সেই সিএনজিটি খুঁজে পায় আহনাফ। তবে সেখানে কেউ ছিল না, সিএনজির চালকও আশেপাশে নেই। তাই যেখানে এটি পাওয়া গেছে অর্থাৎ পালপাড়ার পুরো অংশ খুঁজে দেখা হচ্ছে। এমনকি পালপাড়া ব্রিজের নিচেও খোঁজা হচ্ছে।

এটা যে শাফিনের কাজ তা তো আর বলার অবকাশ নেই। আহনাফ জানে শাফিন এতদিন অনেক প্রকারে সারাহ্-কে তুলে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, তবে পারেনি। তাই আজ হয়তো নিজে এসেছে।

দুপুর যায়, বিকেল যায়, সন্ধ্যা যায়, তবে সারাহ্-কে খুঁজে পাওয়া যায় না। আব্বাস সাহেব বাসা থেকে চলে এসেছেন। উনিও দুশ্চিন্তায় ক্রমাগত ছটফট করে যাচ্ছেন।

তবে আহনাফ এখনো নিজের ধৈর্য ধরে রেখেছে। আশেপাশের প্রতিটা ঘর খুঁজে দেখছে কয়েকবার করে। এমন কোনো জায়গা বাকি রাখেনি, যেখানে সে দেখেনি।

অবশেষে গ্রামের শেষাংশে সারাহ্-র চশমা খুঁজে পায় আহনাফ। সারাহ্ তো চশমা ছাড়া ঠিকমতো রাস্তা দেখে চলতেও পারে না।

ভ°য় পেলেও একটুখানি আশা খুঁজে পায় আহনাফ। সে আরো ভিতরে যেতে থাকে। গাছপালার আড়ালে থাকা একটা নিচু ঘর দেখে আহনাফ থামে।

দরজা খোলা দেখে ভিতরে যায় আহনাফ। ঘর পুরো অন্ধকার। টর্চ লাইট জ্বালিয়ে আশেপাশে দেখতে দেখতে একজায়গায় একটা লা°শ দেখে সে। হঠাৎ করে চমকে উঠে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে আবারো লাইট ঘুরায়।

ঘরের এক কোণায় সারাহ্-কে উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখে। আহনাফ ছুঁটে গিয়ে ওকে টে°নে নিজের কোলে আনে।

“ঐশী।”

অপরপাশ থেকে কোনো সারাশব্দ আসলো না। সারাহ্-র নাকের কাছে র°ক্ত, ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে মুখ থেকে র°ক্ত বেরিয়ে আসছে।

আহনাফ যেন দেখছে সেদিনের নিস্তব্ধতা, একটা শান্ত মুখ, চিরদিনের মতো চুপ হয়ে যাওয়া একটা মানুষ।

সারাহ্-র গালে হাত দিয়ে কাঁপা কন্ঠে আলতো করে আবারো ডাকে,
“ঐশী?”

সারাহ্-র নাকের কাছে হাত দেয় আহনাফ। চোখ তার বড় হয়ে আসে। মৃ°ত্যু°পুরীর নিস্তব্ধতা ভে°দ করে একটা চিৎকার রুমে প্রতিফলিত হয়,
“ঐশী।”

পেছন থেকে একটা কন্ঠ আসে,
“তবে এসেই পড়েছো, আহনাফ? তাহসিনার পর তোমার ঐশীও আর নেই।”

চলবে…..

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

ষট্ পঞ্চাশৎ পর্ব (৫৬ পর্ব)

পরপর দুইটা গু°লির শব্দ হলো। আহনাফ চমকে উঠে। একটা ধপ করে শব্দ হয়, হয়তো লোকটা পড়ে গেছে।

অনেকগুলো লাইট একসাথে ভিতরে আসে। গালিব আর আব্বাস সাহেব সামনে, পেছনে পুলিশের পোশাকে কিছু লোক।

আব্বাস সাহেব এসে সারাহ্-র অপরদিকে বসে আহনাফকে বলে,
“সারাহ্-র কি হয়েছে?”

আব্বাস সাহেব যেন ভ°য় পাচ্ছেন৷ গালিব আহনাফকে বলে,
“গাড়ি রাস্তায় আছে, উনাকে হসপিটালে নিয়ে চলুন।”

আহনাফ নিষ্প্রাণ চোখে তাকিয়ে বলল,
“ঐশী নিশ্বাস ফেলছে না।”

গালিব শান্ত গলায় জবাব দেয়,
“বেশি ক্রি°টিক্যাল অবস্থায় নিশ্বাস ধীরে পড়ে, বোঝা যায় না। গলার পাশে হাত দিয়ে দেখুন বা পার্লস চেইক করুন।”

চিন্তায় এতোক্ষণ আহনাফের মাথায় এসব আসেনি। পার্লস চেইক করে যখন বুঝতে পারে এ দেহে এখনো প্রাণ আছে, সঙ্গে সঙ্গেই ওকে কোলে তুলে নেয়।

গাড়ি রাস্তায় তৈরিই ছিল, উঁচু রাস্তায় সারাহ্-কে কোলে করে উঠাতেও একটু কষ্ট হয় আহনাফের। অবশেষে সারাহ্-কে সেখানে নিয়ে গাড়িতে তোলা হলো।

ঘরে থাকা সেই লা°শ কিংবা একটু আগের লোকটার চেহারা আহনাফের দেখা হয় না। গাড়ি বসে সারাহ্-র হাত ধরে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো সে, সারাহ্-র মাথা ওর কোলে নিয়ে রেখেছে।

আব্বাস সাহেব পাশেই বসেছেন। উনি পকেট থেকে টিস্যু বের করে সারাহ্-র নাকমুখের র°ক্ত মুছে দেন৷

আহনাফের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে সারাহ্-র হাতের উপর পড়ে। আব্বাস সাহেব ছেলের দিকে তাকায়। তাহসিনার মৃ°ত্যুর পর ওর অবস্থা কতটা খারাপ হয়েছিল উনি দেখেছেন। আজ এতোদিন পর আবারো তার জীবনে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।

“আল্লাহ্, সারাহ্-কে সুস্থ করে দাও, আমার ছেলেটার জীবনের জন্য হলেও সুস্থ করে দাও।”
একটা দোয়াই আছে আব্বাস সাহেবের মনে।

বাকিরাতটুকু ওরা হাসপাতালে কাটায়। ফজরের সময় ডাক্তার এসে সারাহ্-কে দেখে জানালো বেবি সুস্থ আছে, যদিও সাথে কতগুলো টেস্টের লিস্ট ধরিয়ে দিলো। তবুও আহনাফের জান ফিরে এসেছে।

নামাজ পড়ে এসে আহনাফ জানতে পারলো সারাহ্-র জ্ঞান ফিরেছে। নার্স ওকে বলে,
“আপনার স্ত্রী দেখা করতে চাচ্ছে। দেখা করেন, তবে উনার সাথে জোরে কোনো কথা বলবেন না। উনি এখনো একটু ট্র°মায় আছেন, আর শারিরীকভাবে পুরোপুরি ঠিক নেই।”

আহনাফ উনার কথা শুনেনি, তার শোনার প্রয়োজন নেই। তার ঐশীর সাথে সে যেভাবে ইচ্ছা কথা বলবে।

সারাহ্ আশেপাশে তাকিয়ে কোনো চেনা মুখ দেখেনা, একটা চেনা মুখ খুঁজতে খুঁজতে আহনাফ এসে হাজির। সোজা এসে ওকে জড়িয়ে ধরে। সারাহ্ও দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে।

“জানেন ওরা..”

সারাহ্-র কথা আহনাফ শুনেনা, মাঝপথেই তা আটকে যায়। ওর গলায় গভীরভাবে স্পর্শ করে আহনাফ। অনেকক্ষণ পর মাথা তুলে সে, দুজন দুজনকে দেখছে।

সারাহ্ আহনাফের গালে হাত দিয়ে বলে,
“ওরা আমাকে স্পর্শ করতে পারেনি। মে°রে দিয়েছে।”
“রুমে পড়ে থাকা লোকটাকে তুমি মে°রেছো?”

সারাহ্ মাথা নেড়ে বলল,
“না, কেউ একজন গু°লি চালিয়েছিল, জ্ঞান হারানোর আগে একটা কন্ঠ আমি শুনেছিলাম। শাফিন আপনাকেও মে°রে ফেলতে চেয়েছিল, মাকেও।”

সারাহ্ কান্না করে দিলে আহনাফ একটু কড়া গলায় বলে,
“তোমার সামনে জীবিত, আস্ত আহনাফ আছি। তবে কাঁদছো কেন?”

সারাহ্ নাক টা°নলে আহনাফ ওর নাকে নাক ঘ°ষে দিয়ে বলে,
“ওরা নিজেরাই বেঁচে নেই। তবে শাফিনের বিষয়টা শিউর নই।”
“আহনাফ, আম্মুকে কিছু জানিয়েছেন?”
“না।”
“জানানোর দরকার নেই। জানালে এখানে আসতে চাইবে আর ওরা এটাই চেয়েছিল। শাফিন তো ওখান থেকে পালিয়েছিল, গু°লি চলার সাথে সাথেই সে বেরিয়ে গিয়েছিল।”

আহনাফ কপাল কুঁচকায়। গালিবকে কথাটা জানানো দরকার। আহনাফ উঠে বসে ফোন বের করে গালিবকে কল দেয়। গালিব ওর কথা শুনে জানায়, যাকে গু°লি করেছে বা যে রুমে পড়ে ছিল, তাদের কেউই শাফিন না। বোঝা যাচ্ছে শাফিনের অনেক লোকজন এখনো বাইরে ঘুরছে। কিন্তু সারাহ্-কে বাঁচালো কে? তার হদিস পাওয়া গেল না।

“চোখ ধুলা ছিটিয়ে এভাবে পালালো। আমাদেরকে একদিকে ব্যস্ত রেখে সে হাতছাড়া হলো।”
আহনাফ কথাটা বলে ফোন রাখে।

সারাহ্ আশেপাশে তাকিয়ে দেখে রুমে থাকা দুজন নার্স বেরিয়ে গেছে। আহনাফকে বলে,
“আপনার কৃতকর্মে নার্সরাও ছাইড়া দে মা কাইন্দা বাঁচি করে পালিয়েছে।”

আহনাফ আবারো ওর কাছে যায়। তর্জনী আঙুল দিয়ে ওর ঠোঁট ছুঁয়ে বলে,
“ওদেরকে ধরিই নাই, ছাড়ার তো প্রশ্নই উঠে না। যাকে ধরছি সেই..”

কথা শেষ না করেই দুজনের ওষ্টোধর একত্র করে আহনাফ। সারাহ্ চোখ বন্ধ করে আহনাফের শার্ট খা°মচে ধরে। সে আর নিজের ভিতরে নেই। আগের ভী°তি, সংশয় সব যেন দূর হয়ে গেছে।
______________________________________

এডভোকেট বিথীকেই শুধুমাত্র তুলে দিয়েছে মৃত্তিকা। অপরূপাকে সে আগেই সরিয়ে রেখেছে। বিথীকেও সে দিতে চায়নি, ইমতিয়াজের জোরাজুরিতে দিতে হয়েছে।

ফজরের পর ইমতিয়াজ বাসায় এসে আবারো শুয়ে পড়ে। মৃত্তিকা এসে পাশে বসে বলল,
“একটা প্রশ্ন করি?”
“হুম।”

চোখ বন্ধ করে জবাব দেয় ইমতিয়াজ। মৃত্তিকা ঢোক গিলে বলল,
“শাফিনকে আপনি আগে থেকে চেনেন?”

ইমতিয়াজ এবারে ওর দিকে ফিরে তাকায়। বলে,
“আগে থেকে বলতে?”
“তাহমিনার সাথে বিয়ের আগে থেকে।”

ইমতিয়াজ উঠে বসে খুব স্বাভাবিকভাবে বলে,
“হ্যাঁ, চিনতাম। ওর বাসায় ভাড়া থেকেছি।”
“আমার প্রেগন্যান্সির কথাও কি শাফিনই আপনাকে জানিয়েছে?”

ইমতিয়াজ উঠে বসে বলল,
“কিসব বলছো তুমি? শাফিনের সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই।”
“সত্য বলুন ইমতিয়াজ। আমি সরাসরি জিজ্ঞাসা করছি।”
“সত্যই বলছি।”

মৃত্তিকা জোর গলায় বলল,
“মি°থ্যা, সেই পঞ্চম ব্যক্তি আপনি। তাহমিনার জন্য যত অনুভূতি দেখিয়েছেন সব আপনার নাটক। তাহমিনা যখন চিৎকার করেছে তখন আপনি তাহসিনাকে..”

মৃত্তিকার গালে একটা চ°ড় বসায় ইমতিয়াজ, মৃত্তিকা হঠাৎ থেমে যায়।

ইমতিয়াজ রাগ দেখিয়ে বলে,
“যা মুখে আসছে, বলে যাচ্ছো।”

মৃত্তিকা দাঁতে দাঁত ঘ°ষে বলল,
“অপরূপা আমাকে এসব জানিয়েছে।”

সত্যি সত্যিই অপরূপা ওকে এসব বলেছে। যখন অপরূপাকে সরিয়ে ছাদে নিয়ে গেছিলো, তখনই অপরূপাকে সে ইমতিয়াজের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করে। অপরূপা বলে দেয়, ইমতিয়াজ শাফিনের সাথে প্রতিক্ষেত্রেই যুক্ত আছে।

ইমতিয়াজ কপাল কুঁচকায়,
“অপরূপা?”
“হুম।”

ইমতিয়াজ বিছানায় বসে বলে,
“দেখো, অপরূপা মি°থ্যা বলেছে। তুমি আমাকে একটু বিশ্বাস করো।”

মৃত্তিকা আর কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ওর বিশ্বাস আসছে না। ঘোরতর অবিশ্বাসে ডুবেছে সে। দুনিয়ায় সবাইকে সে বিশ্বাস করতে পারছে, কিন্তু ইমতিয়াজকে না।

ইমতিয়াজ পিছুপিছু বেরিয়ে আসে।
“মৃত্তিকা, এমন কেন করছো? একজন কিছু একটা বলে দিবে আর তুমি বিশ্বাস করবে?”

মৃত্তিকা ফিরে ইমতিয়াজকে একটা ধা°ক্কা দিয়ে বলে,
“খবরদার আমাকে মৃত্তিকা ডেকেছেন তো।”

ইমতিয়াজ ওকে জোর করে কাছে নিয়ে আসে। বলে,
“দেখো, মেজাজ দেখাবে না। বেবির কথাটা তানজিম আমাকে বলেছে। শাফিনের বাসায় আমি ভাড়া থাকতাম, এরচেয়ে বেশি কিছু না।”

মৃত্তিকা নিজেকে ওর থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চলে গেল। বি°চ্ছি°রি একটা অনুভূতি নিয়ে সে ছাদের হলরুমে আসে।

অপরূপার মুখের কচটেপ খুলে বলে,
“ইমতিয়াজকে নিয়ে সত্য বলেছো নাকি মিথ্যা?”
“যাকে ভালোবাসো তাকে বিশ্বাস করো না?”

অপরূপা হো হো করে হেসে উঠে। তারপর বলে,
“বিশ্বাস না করলে আর কিসের ভালোবাসা? শেষ, তোমার আর ইমতিয়াজের সম্পর্ক শেষ। এই বাচ্চার কি হবে? তোমার মতো করে বড় হবে।”

অপরূপার হাসিতে মৃত্তিকার রাগ বাড়ে। মৃত্তিকা জিজ্ঞাসা করে,
“মি°থ্যা বলেছো?”

অপরূপা চোখ টি°পে দিয়ে বলে,
“সে তুমি বের করে নাও।”

মৃত্তিকা বের হয়ে যায়। নিজের প্রতি নিজের রাগ হচ্ছে। অপরূপার কথা শুনে কেন সে ইমতিয়াজকে ব্লেইম করলো। আবার মমতাজ বেগমের কথাগুলোর সাথে মিলালে ইমতিয়াজকে পুরোপুরি বিশ্বাসও করতে পারছে না।

বাসায় ঢুকতেই মৃত্তিকার শরীর খারাপ লাগা শুরু হলো। সোফায় বসে পড়ে। ইমতিয়াজ ডাইনিং এ বসে আছে, ওকে দেখেও কিছুই বলে না। শরীফ তো গতকাল থেকে বাসায় নেই।

“ইমতিয়াজ।”

মৃদু ডাকে ইমতিয়াজ তাকায়, কিন্তু জবাব দেয় না। মৃত্তিকা ঢোক গিলে বলে,
“ভ°য়া°নক একটা সময় যাচ্ছে আমাদের, সব কিছু সাজাতে চেয়েও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।”

“তুমি সাজাতে চাচ্ছো, মিউকো?”

মৃত্তিকা উঠে গিয়ে ওর পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
“আমি পাগল হয়ে যাবো, এমন ছিন্নভিন্ন পরিবার আগে কখনো দেখেছেন? এরা নিজেরাই নিজেদের শ°ত্রু।”

ইমতিয়াজ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“তুমি কি করে ভাবতে পারলে তাহমিনাকে আমি ওই লোকগুলোর হাতে ছেড়ে দিয়েছি? কি করে ভাবলে তাহসিনাকে আমি নোংরা হাতে ছুঁয়েছি? তোমার চিন্তাভাবনায় পচন ধরেছে মিউকো।”

ইমতিয়াজ চলে যেতে নিলে মৃত্তিকা ওর হাত টে°নে ধরে। ওর বাহুতে মাথা রেখে বলল,
“একটা সত্যি বললে কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন?”
“কি?”

ইমতিয়াজের সোজা প্রশ্নে মৃত্তিকা ওর দিকে তাকিয়ে দুহাতে বালা খুলে ওর হাতে দিয়ে বলল,
“এগুলো নেয়ার যোগ্যতা আমার নেই। মি°থ্যা বলেছি আমি, শাফিনকে ধরতে এই মি°থ্যা আমাকে সাজাতে হয়েছে।”

ইমতিয়াজ তাকায় ওর দিকে। চোখ ছোট করে তাকায় ওর দিকে। বালা দুটো ছুঁড়ে ফেলে ইমতিয়াজ বেরিয়ে যায়।
______________________________________

রাত আটটা, সব ধরনের চেকআপ শেষে সারাহ্-কে ভর্তি করানো হয়েছে। সম্পূর্ণভাবে শয্যাশায়ী থাকতে হবে তাকে, কমপক্ষে সপ্তাহখানেক ওকে আরাম করতে হবে। তার আগে দুইদিন ওকে ভর্তি থাকতে হবে।

উপুড় হয়ে পড়লেও ও নিজের শরীরের ব্যালেন্স ধরে রেখেছিল, তাইতো নাকমুখ আর পায়ে ব্য°থা পেলেও নিজের সন্তানকে সে ঠিকই ভালো রেখেছে।

আব্বাস সাহেব বাসায় চলে গেছে। আহনাফ ফোন মাধ্যমে ইমতিয়াজকে সব ঘটনা জানায় এবং অপরূপাকে যেকোনো মূল্যে আটকে রাখতে বলে। কারণ আহনাফ নিজেও এখন পিবিআইয়ের উপর ভরসা করছে না।

“সারাহ্-কে বাঁচিয়েছে যে ব্যক্তি সে হয়তো শাফিনের খোঁজ পেতে পারে।”

ইমতিয়াজের কথায় আহনাফ জবাব দেয়,
“হয়তো শাফিনও আহত। র°ক্তের দাগ দেখে অনুসরণ করা হয়েছিল, কিন্তু একটা দূরত্বে গিয়ে দাগ আর পাওয়া যায়নি।”

ইমতিয়াজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“শাফিন কি এখনো কুমিল্লাতে আছে? আমার তো মনে হয় না, সে অবশ্যই পালিয়েছে।”
“হতে পারে, কিন্তু সে পালিয়ে হলেও ঢাকায়ই যাবে।”

এদিকে মৃত্তিকা পাশে বসে ঠিকই ওদের কথোপকথন শুনছে। ইমতিয়াজ মৃত্তিকাকে হ্যাঁ বা না কিছুই বলেনি। বরং নিরবে এড়িয়ে যাচ্ছে ওকে।

কথা শেষে ফোন রাখে আহনাফ। তারপর খাবার নিয়ে কেবিনে এসে দেখে সারাহ্ বিছানায় শুয়ে ফোনে সামিহার সাথে কথা বলছে।

আহনাফ গিয়ে পাশে বসে একটু জোরে বলল,
“ওহো, শ্যালিকা যে, কি অবস্থা?”
“ভালো ভাইয়া।”
অপরপাশ থেকে জবাব দেয় সামিহা।

“দিনকাল যাচ্ছে ভালো?”
“মোটামুটি ভাইয়া, তানজিমের আম্মুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই একটু আপসেট।”

আহনাফ কপাল কুঁচকায়, একটু আগে ইমতিয়াজের সাথে কথা হয়েছে। সে কিছু বলল না কেন?

আহনাফ কথা ঘুরাতে বলল,
“সামিহা, পরে কথা বলো, এখন তোমার আপু খাবে।”

সামিহা আফসোসের রেখা টে°নে বলে,
“আহ, এশা, আহ। আজ একটা জামাই থাকলে তোর কথাও এমনে কেউ ভাবতো। (একটু থেমে) আচ্ছা, ভাইয়া রাখছি।”

সারাহ্ উঠে বসে ওকে ধ°মক দিয়ে কল কেটে দেয়। আহনাফ ওকে খাইয়ে দিতে দিতে বলে,
“এখনো শরীর খারাপ লাগছে?”
“একটু।”

আহনাফ জানে এই একটুর অর্থ আসলে অনেক বেশি।

“কাল বাকি রিপোর্ট আসবে, আশা করি সব ঠিক থাকবে।”
“হুম।”
“ভ°য় পাচ্ছো নাকি?”

সারাহ্ ওর কাঁধে মাথা রেখে বলল,
“আপনি যেহেতু আছেন, তাই ভ°য়ের কিছু নেই।”

আহনাফ ওর কপালে চুম্বন করে বলল,
“খেয়ে নাও।”
______________________________________

সারাদিন মৃত্তিকার শরীর খারাপ লাগছে। শাফিনের ওই ঘটনা শুনে সে স্থিরও থাকতে পারছে না, আবার শরীরে কোনো শক্তিও পাচ্ছে না।

রাতের খাবার টেবিলে সাজিয়ে রুমে এসে ইমতিয়াজকে ডাকে, কিন্তু ইমতিয়াজ সারা দেয় না। আলো নিভিয়ে মিউকোকে কোলে নিয়ে সে ফ্লোরে বসে আছে।

“ইমতিয়াজ, আপনি কি আছেন?”

ইমতিয়াজের শব্দ না পেলেও মিউকোর মিউ মিউ শব্দ মৃত্তিকা পায়। লাইট জ্বা°লিয়ে দেখে ইমতিয়াজ এক কোণায় বসে আছে। কেমন যেন হতাশায় সে ঘিরে গেছে।

মৃত্তিকা নিরবে গিয়ে ওর পাশে বসে। ইমতিয়াজ মুখ ফিরিয়ে নেয়। মৃত্তিকা ওর মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
“খাওয়ার সাথে কি? চলুন না, খেয়ে নিবেন।”

ইমতিয়াজ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“তাহমিনা আমাকে বলেছিল তোমাকে ভালোবাসার আরেকজন আসছে, সে আসেনি। যখন ওই কষ্টটুকু আমি কা°টাতে চাইলাম, তখনই তোমার একটা মি°থ্যা নাটক সাজাতে হলো?”

ইমতিয়াজ বেরিয়ে চলে যায়, একদম বাসা থেকে বেরিয়ে আসে। মৃত্তিকা চুপ থাকে। ওর কষ্টের কারণ নির্দিষ্ট নয়। সে এখনো ইমতিয়াজকে সন্দেহ করছে, ভ°য় পাচ্ছে সে ইমতিয়াজকে হারানোর। আবার নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে এসবে ইমতিয়াজ যুক্ত থাকলে নিজেই তাকে হ°ত্যা করবে।

ব্যস, ইমতিয়াজের সাথে ওর দূরত্ব বেড়ে যায়। একদিন, দুইদিন, তিনদিন করে সাতদিন পার হয়। ওরা নিজেদের বাসায় চলে এসেছে। হাতে গুণে দুই একটা কথা ছাড়া তাদের মধ্যে কোনো কথাই হয় না।

মমতাজ বেগমের সাথে দেখা করতে এসে মৃত্তিকা পল্লবীকে পুরো ঘটনা জানায়। পল্লবী সবকিছু শুনে বলে,
“ইমতিয়াজকে আমার কখনোই খারাপ মনে হয়নি। তুমি যখন অসুস্থ ছিলে, তখন আমি দেখেছিলাম।”

“অপরূপা যে বলল, সে শাফিনের কাছের লোক। আর ইমতিয়াজ নিজে বলেছে শাফিনকে ও আগে থেকে চিনে।”

পল্লবী একটু ভেবে বলল,
“একটা কথা বলি, একটু স্বাভাবিক হও। শাফিন ছাড়া আর কেউ এর উত্তর দিতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে আগেই তুমি সংসার ভে°ঙে ফেলো না।”

হঠাৎ মৃত্তিকার শরীর খারাপ শুরু হলো। জ্ঞান হারিয়ে পল্লবীর উপর পড়ে গেল। পল্লবী ওকে বসিয়ে মুখে একটু পানি দেয়। পল্লবী ফ্যান ছেড়ে এসে মৃত্তিকার হিজাব খুলে ওকে একটু হালকা করে দেয়।

মৃত্তিকা একটু একটু করে চোখ খুলে। মৃদুস্বরে বলল,
“পানি খাবো।”

পল্লবী ওকে পানি দেয়। পানি পান করে মৃত্তিকা বলে,
“কয়েকদিন ধরেই শরীরের অবস্থা খারাপ।”
“প্রেশার লো হয় নাকি?”
“জানি না।”

মৃত্তিকা জানে আসলে কি, যে মি°থ্যা সে ছড়িয়েছিল তা এখন সত্য। ইমতিয়াজের সন্তান ওর গর্ভে একটু একটু করে বড় হচ্ছে।
______________________________________

সারাহ্ কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে নিয়েছে। সারাদিন বাসায় থেকে থেকে সে বি°র°ক্ত হয়ে গেছে। তবুও বের হওয়া নিষেধ। কোনো প্রকারে ওর বাইরে যাওয়া হবে না।

সারাদিন টিভি দেখে, বই পড়ে, রান্না করে, কোরআন পড়েই সে কা°টিয়ে দিচ্ছে। রান্নায় গিয়েও মাঝে মাঝে আহনাফের ব°কা খেতে হয়।

বিকাল পাঁচটা, আরাম করে বসে বসে সে বই পড়ছে। এর মধ্যে ফোন বেজে উঠে। আননোন নাম্বার দেখেও সারাহ্ রিসিভ করে,
“আসসালামু আলাইকুম, কে বলছেন?”

অপরপাশ থেকে জবাব আসে,
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম, আমি মৃত্তিকা। (একটু থেমে) আ, ওই মিউকো। তানজিমের কাজিন।”

সারাহ্ মাথা নেড়ে বলল,
“ওহ, আপনি। কেমন আছেন?”
“জি, আলহামদুলিল্লাহ। আপনার কি অবস্থা?”
“আলহামদুলিল্লাহ।”

মৃত্তিকা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“শাফিনকে আপনি দেখেছিলেন?”
“হুম, দেখেছিলাম।”
“আপনাকে কে বাঁচিয়েছিল সেদিন?”
“জানি না, সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। অন্ধকার থাকায় চেহারা দেখিনি।”
“কন্ঠ শুনেছিলেন?”
“হুম।”
“একটা ভয়েস পাঠাচ্ছি, শুনে বলতে পারবেন উনি কিনা?”
“পারবো, ইনশাআল্লাহ।”

মৃত্তিকা কল কে°টে শরীফের একটা ভয়েস রেকর্ড পাঠায়। সারাহ্ কথা শুনে এক ঝ°ট°কায় চিনে ফেলে। কথার স্টাইল আর সুর একই।

সারাহ্ আবারো মৃত্তিকাকে কল দিয়ে বলল,
“আমার তো মনে হচ্ছে উনিই। কন্ঠ একদম সেম।”

মৃত্তিকা ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলে,
“আমি শিউর।”
“কে উনি?”
“আমার কাছের কেউ, যাকে আমি অনেক ভালোবাসি।”

এমনসময় মৃত্তিকার কাছে আসে ফাহাদ। বলে,
“এডভোকেট বিথীর স্বীকারোক্তি জানা গেছে। সে নিজের বিষয় ছাড়া, এখানে থাকা অপরূপার ব্যাপারে কিছুই বলেনি।”

মৃত্তিকা কল লাইনে রেখেই বলল,
“নিজের ব্যাপারে কি বলেছে?”
“বলেছে সে প্রাণের ভ°য়ে শাফিনের সাথে যুক্ত ছিল। এর আগেও নাকি একজন এডভোকেটকে শাফিন মে°রে ফেলেছিল, শুধুমাত্র তার বিরুদ্ধে কথা বলার অপ°রাধে। তাই বিথী এসব করেছে।”
“ওকে, তুমি যাও।”

ফোনের অপরপাশে থাকা সারাহ্ ওদের কথোপকথন সবই শুনে। বিথীকে সে চেনে না, তবে এটা তো বুঝেছে শাফিনকে যে এডভোকেট বারবার বাঁচিয়েছে সেও ধরা পড়েছে।
______________________________________

তিনমাস পেরিয়ে যায়, একে একে ফাঁ°সি হয়েছে রাব্বি, বিল্লাল, বিথীর। সম্পৃক্ততা থাকার প্রমাণে আরিফাসহ আরো চারপাঁচ জন অফিসারের যাবৎ জীবন কারাদন্ড হয়েছে। এমনকি শাফিনকে গোসল করানো সেই লোকদেরও বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। শাফিনের অনেক লোকজনই এখন জেলে আছে।

তবে শাফিনের খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি। পিবিআই না পেলেও মৃত্তিকা পেয়েছে।

মমতাজ বেগমের মাধ্যমে জেনে নিয়েছে শাফিনের অবস্থান, সে সালদা নদী পেরিয়ে ভারতে চলে গেছিলো। শাফিনকে ফোনযোগে অনেকদিন না পেলেও, হঠাৎ-ই পরশু সে মমতাজ বেগমকে ফোন দেয়।

মমতাজ বেগম খুব স্বাভাবিক কন্ঠে কথা বলে সবটা জেনে নেয়। উনি শাফিনের খোঁজ জানতে নিজে থেকেই মৃত্তিকাকে সাহায্য করেছে। যদিও কারণটা মৃত্তিকার কাছে খুবই সহজ। মমতাজ বেগম চাচ্ছে মৃত্তিকা ম°রে যাক, তাও শাফিনেরই হাতে।

ভারতের ত্রিপুরায় সে এতোদিন অবস্থান করেছিল, এখন সে আবারো বর্ডার পেরিয়ে দেশে এসেছে। বিবির বাজার এলাকায় কোনো এক বাড়িতে সে আছে। সারাহ্-কে যেদিন অপ°হ°রণ করেছিল, সেদিনই শরীফের তাড়া খেয়ে সে পালিয়েছিল আর পরশুদিন ফিরে এসেছে।

সব খোঁজখবর যোগাড় করে মৃত্তিকা হাসপাতালে আসে, শরীফের সাথে দেখা করতে। শরীফ নিজের চেম্বারেই ছিল। মৃত্তিকা এসে কোনো অনুমতি ছাড়াই ভিতরে ঢুকে যায়।

শরীফ ওর দিকে না তাকিয়েই বলল,
“পারমিশন ছাড়া ভিতরে আসলেন কেন?”
“বাবার চেম্বারে মেয়ের আসতে হলে পারমিশন লাগে না।”

শরীফ অবাক চোখে মৃত্তিকার দিকে তাকায়। উঠে ওর কাছে এসে বলে,
“মিউকো?”
“হুম, কথা আছে।”
“বসো।”

মৃত্তিকা এসে শরীফের চেয়ারেই বসে পড়ে। শরীফ হেসে পাশের সোফায় বসে। মৃত্তিকা বলে,
“আমি বিবির বাজার যাবো, শাফিন ওখানেই আছে।”

শরীফ ওর কাছে এসে বলে,
“একা?”
“একা হলে কি আর আপনার কাছে আসতাম? আপনিও যাবেন।”
“ইমতিয়াজ?”
“আপনি জানেন আমি ওকে সন্দেহ করছি, এখনো করি।”

শরীফ মাথা নেড়ে বলল,
“কবে যাবে?”
“আজই, বলা যায় না শাফিন কখন পালায়।”
“ঠিক আছে, বিকেলে রওনা দিবো। প্রস্তুতির প্রয়োজন।”

মৃত্তিকা তাতেই সম্মতি জানিয়ে বেরিয়ে আসার সময় বলে,
“শাফিনকে আমি জি°ন্দা ধরবো। অপরূপাকে আমি ওর সামনে মা°রতে চাই।”
______________________________________

সাড়ে সাতমাসের অন্তঃসত্ত্বা সারাহ্-র এখন সবকিছুতেই অস্বস্তি হচ্ছে। হাঁটা, বসা, শুয়ে থাকা, সবই যেন কষ্টের। কুরবানির ইদ গেল কয়েকদিন আগে, বেচারী তাতেও কোথাও বের হতে পারলো না।

ঢাকায় চলে এসেছে দুইমাস হলো। একদিন পর পর আহনাফ এসে দেখা করে। কিন্তু আহনাফকে দেখার তৃষ্ণা যে তাতে মেটে না, লজ্জায় তাকে বলতেও পারে না।

রুম থেকে বেরিয়ে ড্রইংরুমে এসে টিভি ছাড়ে। মাঝে মাঝে কোমড়ের পিছনে হাত দিয়ে হাঁটে, ব্য°থা হয় বলে এই পদ্ধতি। এখনো সে এমন করেই হাঁটছে, পিছন ফিরে দেখে, সামিহা ওকে অনুকরণ করছে। ও তাকাতেই দৌড়ে পালিয়ে যায়।

সারাহ্ এসে সোফায় বসলে সামিহা আবারো ওকে অনুকরণ করতে থাকে। সারাহ্ রেগেমেগে নার্গিস পারভিনকে ডেকে বলে,
“আম্মু, দেখো তোমার মেয়ে কি করে?”

সামিহা হেসে কু°টিকু°টি। নার্গিস পারভিন এসে সামিহাকে বলে,
“আমি দেখছি কিন্তু এশা। নিজের সময় বুঝবি, এমন ফাজলামি কেউ করে?”

সারাহ্ হেসে উঠে বলে,
“দোয়া করো যেন ওর একসাথে চারটা বেবি হয়। মায়ের দোয়া তাড়াতাড়ি কবুল হয়।”

নার্গিস পারভিন মুচকি হেসে “আমিন” বলে চলে গেলেন। সামিহার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। সারাহ্ এখনো হেসে যাচ্ছে।
______________________________________

বিকেল চারটায়, বিবির বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় মৃত্তিকা ও শরীফ, সাথে আর কাউকে আনেনি ওরা। ইমতিয়াজও জানে না মৃত্তিকা কোথায়। কল দিতে পারে ভেবে মৃত্তিকা ফোন সুইচ অফ করে দিয়েছে।

ঢাকা থেকে কুমিল্লা শহর, সেখান থেকে ব্রাহ্মণপাড়া থানা এবং সেখান থেকে প্রধান গন্তব্য বিবির বাজার চলে আসে। শরীফ নিজের গাড়ি নিয়ে এসেছে। জিপিএস ব্যবহার করে জায়গা খুঁজতে সমস্যা না হলেও সময়টা কম লাগেনি, সব মিলিয়ে পাঁচ ঘন্টা লেগেছে ওদের।

রাত নয়টা বেজে গেছে। দেশের সীমান্তবর্তী এলাকা, অবশ্যই এখানে প্রতি পদক্ষেপে বি°পদ। মৃত্তিকাকে একহাতে শক্ত করে ধরে রেখেছে শরীফ।

“শাফিন, খোলামেলা জায়গায় অবশ্যই থাকবে না।”

শরীফের কথায় মৃত্তিকা জবাব দেয়,
“থাকতেও পারে, এমনও তো হতে পারে যে সে এলাকার কোনো প্রভাবশালীর বাসায় আছে।”

শরীফ চিন্তাভাবনা করে বলে,
“সামনে একটা জায়গা আছে। ওখানে প্রচুর ব্ল্যা°ক মার্কেটিং হয়, শাফিন কি ওখানে থাকতে পারে?”

মৃত্তিকা মাথা নাড়ে। তারপর বলে,
“একসাথে দুজন যাওয়া কি ঠিক হবে?”
“আমি তোমাকে একা ছাড়বো না।”
ধ°মক দিয়ে কথাটা বলে শরীফ।

শরীফের কথা মেনে নেয় মৃত্তিকা। দুজনে যায় সীমান্তের সেই স্থানে। রাতের আঁধারেও সেখানে লোকজন আছে। টর্চলাইট জ্বালিয়ে কাঁ°টা°তারের বেড়া কে°টে ওপার থেকে এপারে আর এপার থেকে ওপারে জিনিসপত্র আনা নেওয়া হচ্ছে।

এরমধ্যে একটা চেনা মুখ চোখে পড়ে। হ্যাঁ, এটা শাফিন। সম্ভবত এখানে সে শ্রমিকের কাজ করছে। কাজ শেষে টাকা নিয়ে সে হাঁটা লাগায়, যেন একপ্রকার অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।

মৃত্তিকা-শরীফ একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে ওকে অনুসরণ করছে। শরীফ একটা লাঠি নিয়ে রাস্তা থেকে নেমে ঝোপের আড়ালে চলে যায়। মৃত্তিকা রাস্তার পাশ দিয়ে দ্রুত হেঁটে শাফিনের সামনে দিয়ে চলে যায়।

বোরকা-নেকাব থাকায় শাফিন ওকে চিনতে পারে না। একটু দূরে গিয়ে মৃত্তিকা বসে যায়। শাফিন ওর কাছে আসলে মৃত্তিকা বলে,
“আমার খুব শরীর খারাপ লাগছে, একটু সাহায্য করবেন। আমি প্রেগন্যান্ট।”

শাফিন যেন অদ্ভুত এক আনন্দ পায়, সে মৃত্তিকার বি°কৃত কন্ঠটা চিনে না। অনেকদিন হলো সেই চিৎকার সে শুনে না। নি°ষি°দ্ধ চাহিদা বেড়ে গেল তার, ঘোরে জড়িয়ে গেল সে।

শরীফ এখনো ঝোপের আড়ালে লুকানো। তার নজর শাফিনের পায়ের দিকে। এক আঘাতে ওকে কাবু করতে হবে।

মৃত্তিকা উঠে দাঁড়িয়ে নেকাব খুলে স্বাভাবিকভাবে বলল,
“বলেছিলাম না মামা, সিংহী শি°কার করবে। দেখো শি°কার করতে চলে এসেছে।”

ওর মুখের দিকে টর্চ দিয়ে চেহারা দেখে শাফিন বলে,
“মিউকো।”

“ইয়া আল্লাহ্।”
বলে পেছন থেকে শাফিনের পায়ে আ°ঘা°ত করে ওকে ফেলে দেয় শরীফ।

শাফিনের হাত থেকে টর্চ নিয়ে শাফিনের মাথায় জোরে আ°ঘা°ত করে মৃত্তিকা। মাটিতে গ°ড়াগ°ড়ি খাওয়ার মূহুর্তটাই সুযোগ। ওর হাতপা, মুখ বেঁধে দেয়।

“এখন ওকে গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে।”

মৃত্তিকা একটু হেসে বলে,
“আশা করি এটাও পারবো।”

চলবে….

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

সপ্তপঞ্চাশৎ পর্ব (৫৭ পর্ব)

গাড়ির পিছনের সিটের নিচের অংশে শাফিনকে বেঁধে ফেলে রেখেছে। শরীফ ড্রাইভ করছে আর মৃত্তিকা পাশে বসা। শাফিনকে এমনভাবে রেখেছে যেন বাইরে থেকে না দেখা যায়। কিছুক্ষণ পর পর শরীফ তার দিকে তাকাচ্ছে।

গাড়িতে উঠে মৃত্তিকার আবারো শরীর খারাপ হওয়া শুরু হলো। প্রচুর বমি হলো, আবার মাই°গ্রে°নের ব্য°থা। সিটে গা এলিয়ে শুয়ে পড়লো। ঘুম আসলেও, সে ঘুমাচ্ছে না। সারারাত জেগে থাকা মেয়েটা এই ভোররাতে আর কিভাবে চোখ খুলে রাখতে পারে? কিন্তু শাফিনের জন্য জেগে থাকতে হবে ওর।

শরীফ ওর দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বলে,
“একটু খাও, মুখেও দিয়ে নাও।”

মৃত্তিকা তাই করলো। শরীফ গাড়ির এসি বন্ধ করে মৃত্তিকাকে বলে,
“জানলা খুলে দাও।”

এরমধ্যে শরীফের ফোন বেজে উঠে। মৃত্তিকা ফোন হাতে নিয়ে ইমতিয়াজের নাম্বার দেখে বলে,
“ফোন অন রাখা জরুরি?”
“হাসপাতাল বা কোম্পানি থেকে কল আসতে পারে।”

বেজে বেজে কল কে°টে গেল। মৃত্তিকা ফোন সাইলেন্ট করে রেখে দেয়। শরীফ এতে কিছুই বলে না। মেয়ে যে তার মতোই, কিছু বললেও শুনবে না।

রাস্তায় কোনো জ্যাম নেই। গাড়ি সাই সাই করে এসে পড়ে ঢাকায়। শাফিনকে শরীফের ধানমন্ডির ফ্ল্যাটে নেয় না, ওকে মতিঝিলের ফ্ল্যাটে নিয়ে আসে।

জাহাঙ্গীর সাহেবের ফ্ল্যাটের একতলা উপরেই সেই ফ্ল্যাট, মানে পাঁচতলায়। এই মাসেই ভাড়াটিয়া চলে যাওয়ায় ফাঁকা পড়ে আছে। বাসায় কোনো ফার্নিচার নেই, শুধু দুইরুমে লাইট লাগানো আছে।

বাসায় এসে শাফিনকে জানলার গ্রিলের সাথে শক্ত করে বেঁধে দেয়। মৃত্তিকা ফ্লোরে বসে পড়ে। হঠাৎ করে এতোটা লম্বা ভ্রমণ করায় সে ক্লান্ত।

শরীফ এসে ওকে বলল,
“ঠিক আছো?”

মৃত্তিকা মাথা নেড়ে বলল,
“যা আছি, ভালো আছি। অপরূপাকে এখানে আনার ব্যবস্থা করুন।”

শরীফ চিন্তায় পড়ে যায়। মৃত্তিকা এখন আর ধানমন্ডি যেতে পারবে না, আবার ওকে এখানে একা রেখে শরীফের যেতেও ইচ্ছা করছে না। শাফিনকে একা রাখাও বি°প°জ্জনক।

মৃত্তিকা বুঝতে পারে শরীফের চিন্তা, আশ্বাস দিয়ে বলে,
“আপনি যেতে পারেন, কোনো সমস্যা নেই।”
“তোমাকে একা রেখে?”
“আমি থাকতে পারবো।”

শরীফ যায় না। ফ্লোরে ওর পাশে বসে কল দেয় তানজিমকে। মতিঝিলের বাসার ঠিকানা আর ফ্ল্যাট নাম্বার দিয়ে, ওকে আসতে বলে। তানজিম দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে। সামিহার বাসায় শরীফ কেন যেতে বলছে?

তবুও সে বের হয়। বলা তো যায় না সামিহার কোনো বিপদ হলো কিনা। মাত্র কিছুক্ষণ আগে ফজরের আযান দিলো, এখনো সূর্য উঠেনি। নামাজ পড়েই বেরিয়ে যায় তানজিম।

এদিকে কাল থেকে মৃত্তিকাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে ইমতিয়াজ। ফোনের পর ফোন দিচ্ছে, কিন্তু বারবার বন্ধ দেখাচ্ছে। মৃত্তিকার ছড়ানো মি°থ্যা যে সত্য হয়েছে, তা ইমতিয়াজ জানে। এখন শাফিন যদি কোনো ক্ষতি করে, এই ভ°য়ে ক্রমাগত তার ভী°তি বাড়ছে।

শরীফ নামাজ পড়ছে। ড্রইংরুমেই একপাশে সে নামাজে দাঁড়িয়েছে। মৃত্তিকা এখনো ফ্লোরে বসা। ফোন অন করে সে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবারো ইমতিয়াজের কল আসে।

কল কা°টতে গিয়ে ভুলবশত রিসিভ করে ফেলে সে। এবারে আর কোনো উপায় না পেয়ে ফোন কানে দেয়।

“কোথায় তুমি, মিউকো?”

ইমতিয়াজের মুখ থেকে বারবার ‘মিউকো’ নাম শোনাটা মৃত্তিকার জন্য কষ্টেরই বটে। হতে পারে সে দোষী, খু°নি, অনেক কিছু। কিন্তু সে তো মৃত্তিকার ভালোবাসা নাম।

“মৃত্তিকা?”

এবারে ইমতিয়াজের কন্ঠে বেশ উৎ°ক°ন্ঠা বোঝা গেল। মৃত্তিকা মৃদুস্বরে বলে,
“হুম।”
“কোথায় আছো?”
“বাবার কাছে।”

মৃত্তিকার দুচোখ বেয়ে পানি পড়ছে, কিন্তু সে একদম স্বাভাবিক কন্ঠে কথা বলছে।

“ফোন বন্ধ ছিল কেন?”

মৃত্তিকা নিশ্চুপ। ইমতিয়াজ আবারো বলে,
“বাসায় আসো।”

মৃত্তিকা কিছু না বলে কল কে°টে দেয়। ফোন দূরে ফেলে কাচুমাচু করে বলে থাকে। শরীফ নামাজ শেষে মৃত্তিকাকে দেখে বলে,
“নামাজ পড়ে নাও।”

শরীফের সাহায্য নিয়ে উঠে মৃত্তিকা ওয়াশরুমে যায়। অযু করে, নামাজ পড়ে নেয়।

শরীফ ওকে পাশের রুমে নিয়ে বলে,
“যা সহ্য করতে পারছো না, তা কেন করছো?”
“ইমতিয়াজ..”

কথা শেষ করতে পারে না মৃত্তিকা, কাঁদতে শুরু করে দেয়। শরীফ ওকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“মা আমার, এভাবে নিজেকে কষ্ট দিও না। ইমতিয়াজ শাফিনকে আগে থেকে চেনে, হতে পারে সে ওই পঞ্চম ব্যক্তি। তাই বলে নিজেকে শেষ করো না।”

মৃত্তিকা মাথা তুলে না। বাবার মিউকো বাবার বুকেই আশ্রয় নেয়। শরীফ ওর মাথায় হাত বুলায়। এমনসময় সদর দরজায় নক পড়ে। কলিং বেল নেই, তাই তানজিম এসে নক করেছে।

শরীফ গিয়ে দরজা খুলে বলল,
“আসো।”

তানজিম ভিতরে এসে শাফিনকে দেখে রেগে যায়। তেড়ে যেতে নিলে শরীফ ওকে থামিয়ে বলে,
“শান্ত হও। আগে পুরো কথা শুনো, তারপর ভেবে দেখো কি করবে।”
“কি কথা?”
“মিউকো।”

মৃত্তিকা বাইরে এসে দাঁড়ায়। তানজিম এখনো বি°ভ্রা°ন্তিতে আছে। শরীফ বলে,
“এখন তুমি তোমার বোনকে পাহারা দাও, আমি অপরূপাকে নিয়ে আসি।”

তানজিম আর কিছু জিজ্ঞাসা করার সুযোগ পায় না। শরীফ বেরিয়ে যায়। মৃত্তিকা শান্ত গলায় বলল,
“তানজিম, বসো।”
______________________________________

সকাল সকাল উঠে সারাহ্ ঘর গুছিয়ে ফেলছে। যেহেতু আজ বৃহস্পতিবার, তাই আহনাফ আজকে আসলে হয়তো দুইদিন থাকবে। সামিহা ভার্সিটিতে গেছে। এজন্য একা একাই সব কাজ সেরে ফেলছে সে।

মাত্রই ড্রইংরুম গুছিয়েছে সারাহ্। নার্গিস পারভিন নাস্তা এনে ওকে দিয়ে বলে,
“এশাটাও হয়েছে, নাস্তা না করেই দৌড় লাগিয়েছে।”

সারাহ্ মাথা নেড়ে বসে বলে,
“দিনে দিনে বয়স বাড়ার থেকে কমতেছে।”
“তাই তো দেখছি। (একটু থেমে) জামাই আজকে আসলে থাকবে তো।”
“জানি না, ওর তো আবার মত বদলাতে সময় লাগে না।”

নার্গিস পারভিন ওর পাশে বসে বলল,
“শাফিনের কোনো খোঁজ এখনো পায়নি। ভয় হচ্ছে আমার।”
“ভ°য় পেয়ে কি হবে মা? যা ভাগ্যে আছে, তা কি আর মুছে ফেলা যাবে।”
“তা ঠিক, কিন্তু…”

দরজার বাইরের একটা শব্দে দুজনের কথা হঠাৎ থেমে যায়।

“ছেড়ে দিন আমাকে।”
বলে জোরে কেউ চিৎকার করলো।

মায়ের বাধা উপেক্ষা করে গিয়ে সারাহ্ দরজা খুলে, লিফট বন্ধ হয়ে গেছে। মানে কেউ লিফটে করে কাউকে জোরপূর্বক নিয়ে যাচ্ছে।

লিফট পাঁচতলায় গিয়ে থেমেছে। শরীফ অপরূপাকে নিয়ে এসেছে। অপরূপা জোরাজুরি করে চারতলায় লিফট থামিয়ে চেঁচিয়েছে, নিজেকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা তার ব্যর্থ।

সারাহ্ও পাঁচতলায় যায়। সব ফ্ল্যাটই স্বাভাবিক লাগছে। সারাহ্ ঘুরে ঘুরে চারটা ফ্ল্যাট দেখে নেমে যেতে নিলে শরীফ বের হয়। আচমকা সামনে চলে আসায় সারাহ্ চমকে উঠে।

“সরি, সরি, ধা°ক্কা লেগেছে নাকি?”

শরীফের কথায় সারাহ্ মাথা নেড়ে বলল,
“না, আমি ঠিক আছে।”

শরীফ লিফট খুলে সারাহ্-র সাথেই নিজে উঠলো। বলে,
“গ্রাউন্ড ফ্লোর?”
“না, থার্ড ফ্লোর।”
“ওকে।”

কন্ঠটা সারাহ্-র চেনা লেগেও অচেনা। তবে ভেবেচিন্তে সে চিনে যায়। এই কয়েক মাসে মৃত্তিকার পাঠানো ওই ভয়েসটা সে এতোবার শুনেছে, এই কন্ঠ ভুলে যাওয়ার নয়।

সারাহ্ বাসায় চলে আসে। নার্গিস পারভিন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সারাহ্ ঠোঁট উলটে বলে,
“সব নরমাল, কিন্তু শব্দ একটা হয়েছে।”
“যাক, তোমার আর বাইরে যেতে হবে না। বাসায় থাকো।”
“হ্যাঁ, আমি তোমাদের একমাত্র বন্দিনী।”

অপরূপার পর এবারে মমতাজ বেগমকে আনতে গেছে শরীফ। তিনজনকে একসাথে করেই কথা বলবে ওরা। শরীফের যে রাগটা শাফিনের উপর জমে আছে তা সে যেকোনো মূল্যে বি°স্ফো°রণ ঘটাবে।

শাফিনের মুখোমুখি অপরূপাকে বেঁধে বসিয়েছে মৃত্তিকা। তানজিমকে এতোক্ষণ সে ভ°য়া°নক পারিবারিক অতীতটা বলেছে। তানজিম পুরো ঘটনা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছে। অতীতে একজনের চেয়ে অন্যজন নি°ষ্ঠুর। সেই নি°ষ্ঠুর°তার শাস্তি ওরা কেন পাচ্ছে? আর ওর বাবা? সন্তানের মুখ দেখেই কেন তার ভালোবাসার পরিবর্তন হলো? যদি তা না হতো তবে তার বোনেরা আজ বেঁচে থাকতো।
______________________________________

বিকালে আহনাফ বাসায় আসে। সামিহা দরজা খুলতেই ওর হাতে মিষ্টির প্যাকেট দিয়ে সে নার্গিস পারভিন ও জাহাঙ্গীর সাহেবের সাথে কুশল বিনিময় করে। তারপর রুমে চলে যায়। কাঁধে ব্যাগ থাকায় বোঝা যাচ্ছে ও আজ রাতটুকু হলেও থাকবে।

সারাহ্ মাত্রই আসরের নামাজ পড়ে উঠেছে। জায়নামাজ রেখে ফিরতে গিয়েই আহনাফের সামনে পড়ে। আহনাফকে দেখে নিজের অজান্তেই হেসে দেয় সারাহ্।

“বাহ, ঘরে আসতেই বাবুর আম্মুর মিষ্টি হাসি৷”

সারাহ্ একটু লজ্জা পেয়ে বসে। আহনাফকে ধা°ক্কা দিয়ে সরিয়ে সে হিজাব খুলে বলে,
“এরপরে শুধু কান্নাকাটি করবো।”

আহনাফ ব্যাগ রেখে শার্টের হাতার বোতাম সবে খুলতে শুরু করেছে, সারাহ্ এসে ওকে জড়িয়ে ধরে। একদম বুকে মাথা রেখে ওর সাথে মিশে গেছে। আহনাফ ওকে বেশ আলতো করে আগলে নেয়।

সারাহ্-র মাথায় চুম্বন করে বলল,
“বাবুটা লজ্জা পাবে মায়ের বেহায়াপনায়।”

সারাহ্ কিছু বলে না। সে নিজেই নিজের এই কাজে লজ্জায় ম°রছে। আহনাফের দিকে তাকানোর সাহসটুকু ওর অবশিষ্ট নেই। বুকের মধ্যিখানের স্থান দখল করেছে সে।
______________________________________

শরীফ হাসপাতালে গেছে, খুব জরুরি দরকার আছে বলেই যেতে হয়েছে। তানজিম এখনো বাসায় মৃত্তিকার কাছেই আছে।

মৃত্তিকা তানজিমকে বলে,
“আমি দশমিনিটের জন্য বাইরে যাবো। ওদের খেয়াল রেখো।”
“জি।”
বলে তানজিম মাথা হেলিয়ে সম্মতি দেয়।

মৃত্তিকা বাইরে গিয়ে কয়েকটা বড় বড় পে°রেক কিনে, সাথে একটা বড় হাতুড়ি নেয়। তারপর সে আবারো বাসায় ফিরে আসে। ড্রয়িং রুমে করা বিছানার উপর এগুলো রাখে। অপরূপা একটা শুকনো ঢোক গিলে।

অপরূপা জানে, এই মেয়ের দ্বারা অসম্ভব কোনো কাজ নেই। যেভাবে ওকে সি°গা°রেট দিয়ে পু°ড়িয়েছিল, গরম শি°কের ঘা দিয়েছিল, ওর মুখে সুই ঢু°কিয়েছিল, ঠোঁট সেলাই করার প্রস্তুতি নিয়েছিল, এমনকি ওর মুখে গরম পানি ঢে°লে ঝ°লছে দিয়েছিল। এই মেয়ে চাইলে, সমস্ত শরীরে পে°রেক ঢুকিয়ে দিতে খুব বেশি সময় নিবে না।

মৃত্তিকা শাফিনকে বলে,
“তুমি, জামিল, দুলাল- এই তিনজন ছাড়া খু°নের সাথে আর কে জড়িত?”

শাফিন একটু হেসে বলে,
“জামিল ম°রেছে, দুলাল ম°রেছে। আর ছিল কবির, যাকে তোমার মা সেদিন মে°রে ফেলেছে। আর আমি তোমার সামনে। কথা দিচ্ছি, তোমাকে না মে°রে এই শাফিন মরবে না।”

মৃত্তিকা বুঝতে পারে, মমতাজ বেগমের কথা সাথে শাফিনের কথার মিল আছে, চতুর্থ ব্যক্তি কবির।

“আর কে কে ছিল?”

শাফিন এবারে জোরে জোরে হেসে ওঠে। ওর হাসি শুনে মৃত্তিকার রাগ বাড়ে। ডান হাতের বাঁধন খুলে তা দেয়ালে চেপে ধরে তানজিমকে বলে,
“একটা পে°রেক দাও।”

মৃত্তিকার কথায় একটা ভ°য়া°নক রাগ আর ক্ষোভ আছে। তানজিম পে°রেক দিলে মৃত্তিকা শাফিনের হাতের উপর তা শক্ত করে চেপে ধরে বলে,
“হাতুড়ি।”

হাতুড়ি পাওয়া মাত্রই পে°রেকে আ°ঘাত করা শুরু করে মৃত্তিকা। হাতের তালু এ°ফোড় ও°ফোড় হয়ে পে°রেক গিয়ে লাগে দেয়ালে। শাফিন চিৎকার করতে নিলে, তানজিম কিছুক্ষণ আগে পে°রেকের সাথে আসা বড় শপিং ব্যাগটা ওর মুখে ঢু°কিয়ে দেয়।

মৃত্তিকা কি°ড়মি°ড় করে বলল,
“মুখ বন্ধ করো না। আমি ওর চিৎকার শুনতে চাই।”

গড় গড় করে র°ক্ত বেয়ে পড়তে লাগলো। সাদা দেয়াল মুহূর্তেই র°ঞ্জিত হয়ে গেল। মৃত্তিকার অ°গ্নিকু°ণ্ডের ন্যায় চোখের দিকে তাকিয়ে শাফিন যেন নিজের মৃ°ত্যু দেখছে।

শপিং ব্যাগটা বের করে মৃত্তিকা জিজ্ঞাসা করে,
“দ্বিতীয়বার সুযোগ দিলাম এবার বলো আর কে কে ছিল?”
“পঞ্চম ব্যক্তি বেঁচে আছে, আমি ম°রে গেলেও সে তোমাকে মা°রবে। তবে আমি চাই তাহমিনার মতো করে তোমাকে মা°রতে।”

হাতে লাগানো পেরেকটা মৃত্তিকা ঘুরাতে শুরু করে। এবারে মুখ খোলা থাকায় শাফিন জোরে চেঁচিয়ে উঠে।

মৃত্তিকা বলে,
“এই হাত দিয়ে স্পর্শ করতে না ওদের? খুব আনন্দ হতো ওদের চিৎকার শুনে? এখন আমি তোমার চিৎকার শুনে, খুব আনন্দ পাচ্ছি, খুব খুশি লাগছে আমার।”

মৃত্তিকা আরেকটা পে°রেক নিয়ে শাফিনের পায়ের পাতায় গেঁথে দেয়। শাফিনের ভ°য়ংকর এক মৃ°ত্যু চিৎকার বারবার প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। কিন্তু তবুও মৃত্তিকা থামে না, জোরে জোরে হাতুড়ি পি°টিয়ে পে°রেক আরও শক্ত করে দেয়। পায়ের পাতা ভেদ করে তা গিয়ে লাগে শক্ত টাইলসের গায়ে। মমতাজ বেগম পাশের রুমে থাকায়, এখানে ঘটনা উনি দেখেন না। তবে শব্দ উনি শুনেছেন।

“আপু, থামো। সে ম°রে যাবে, আর আমি চাই না এতো তাড়াতাড়ি সে ম°রে যাক।”

তানজিমের কথায় মৃত্তিকা সরে আসে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। এর মধ্যেই মনে হয় ইমতিয়াজের কথা। ওকে তো বাসায় যেতে বলেছিল, ও শোনেনি। হয়তো ইমতিয়াজ এখনো ওকে খুঁজছে।
______________________________________

হঠাৎ করে উপরের ফ্ল্যাটে খুব জোরে শব্দ হওয়ায়, সারাহ্ চমকে সরে আসে। আহনাফ হেসে উঠে একটু জোরে বলে,
“বাবুটা আমার, তোমার আম্মাজানের নির্লজ্জতায় লজ্জা পেয়ো না। সে একটু এমনই।”
“আহনাফ।”

সারাহ্-র ডাকে আহনাফ ওর সামনে মুখ দিয়ে বলে,
“আহনাফ বলবে না। হুটহাট নাম ধরে ডাকা আমার পছন্দ না, কেন ভুলে যাও এটা?”

সারাহ্ কোমড়ে হাত দিয়ে বলে,
“ওকে, একটা গল্প বলি। একসময় মানুষ স্বামীর নাম ধরে ডাকাকে খুব বড় অপ°রাধ মনে করতো, গল্পটা ওই সময়ের। এক মহিলা নদী পার হবে, তো তার নৌকা লাগবে। কিন্তু মহিলার কাছে কোনো টাকা নেই, এখন সে তার স্বামীর নাম বলে নদী পার হয়ে যাবে। পরে স্বামী টাকা শোধ করে দিবে। কিন্তু স্বামীর নাম তো সে বলতে পারবে না তাই মাঝিকে বলেছে- চব্বিশ গুণ দুই আর তিন গুণ চার, যোগ করে পেয়ে যাবেন সোয়ামির নাম আমার। তাহলে তার স্বামীর নাম কি?”

আহনাফ হেসে উঠে বলে,
“কি হবে?”
“কি আবার? চব্বিশ গুণ দুই মানে আটচল্লিশ, তিন গুণ চার মানে বারো। যোগ করলে হয় ষাট। মানে তার স্বামীর নাম ষাটেশ্বর।”

আহনাফ দাঁত বের করে হাসে। সারাহ্ বলে,
“উহু, হাসলে হবে না। নিজের নামের এমন সূত্র বের করেন ফিজিক্স স্যার। নাইলে দেখবেন কি করি?”

আহনাফ ওর কাছে এসে বলে,
“কি করবা?”

সারাহ্ ওকে সরিয়ে বলে,
“ফ্রেশ হয়ে নেন। তারপর বলবো।”
______________________________________

রাতে শরীফ বাসায় এসে শাফিনের এ অবস্থা দেখে ওর হাতে আর পায়ে ব্যা°ন্ডে°জ করে দেয়। মৃত্তিকাকে ধ°মকে বলে,
“নিজের এই অবস্থায় তুমি ওকে কেন এভাবে আ°ঘাত করেছো? তুমি জানো এই কাজের প্রভাব তোমার বেবির উপর পড়তে পারে? এত ভারী জিনিস তুমি কেন তুলছো?”

সত্যিই হাতুড়িটা অনেক ভারী ছিল। বড়সড় পে°রেক ঢুকানোর, বড়সড় হাতুড়ি এটা। স্বাভাবিকভাবেই অনেক বেশি ভারী হবে।

মৃত্তিকা কিছু বলে না। নিরবে প্রস্থান করে। বারান্দায় গিয়ে চুপচাপ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে চোখের জল বি°স°র্জন করতে থাকে। রিপার জন্য শরীফের কান্না এক আল্লাহ আর শরীফ ছাড়া আর কেউ যেমন জানেনা, ঠিক তেমনি ইমতিয়াজের জন্য মৃত্তিকার কান্না আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না।

শরীফ শাফিনকে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে মা°রতে শুরু করে। শাফিনের নাক মুখ দিয়ে র°ক্ত ঝরছে, গালে র°ক্ত জমাট বেঁধে কালো বর্ণ ধারণ করেছে।

আবারো একটা গরম শি°ক আনা হয়। তবে সেটা অপরূপার জন্য না, এটা শাফিনের জন্য। শাফিনের গায়ের শার্ট অনেকক্ষণ আগেই শরীফ খুলেছে, বুকে-পেটে বিরতিহীনভাবে আ°ঘাত করেছে সে।

শি°ক এনে শাফিনের বুকের বামপাশে ধরে শরীফ বলে,
“অতিরিক্ত গরমে শিলাও গলে যায়, এখন আমি দেখতে চাই তোমার হৃদপিণ্ড গ°লে কিনা। (একটু থেমে) আর কে কে ছিল? সত্যি করে বলো।”

মৃত্তিকা বেরিয়ে এসে দরজার পাশে দাঁড়ায়, উঁকি মে°রে দেখতে থাকে শরীফের সেই পুরনো ভ°য়ংকর রূপ।

অবশেষে শাফিন চেঁচিয়ে উঠে বলল,
“ইমতিয়াজ ছিল, ইমতিয়াজ।”

পেছনের দেয়ালের সাথে ধা°ক্কা দিয়ে দাঁড়িয়ে যায় মৃত্তিকা। জোরে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল,
“সবকিছুকে গুছিয়ে দাও তুমি, আল্লাহ্। আমার ইমতিয়াজকে এতো নি°কৃষ্ট করো না। আমার এতো বড় পরীক্ষা তুমি নিও না, হে আল্লাহ্।”

চলবে……

অনুভূতিরা শব্দহীন পর্ব-৫২+৫৩+৫৪

0

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

দ্বিপঞ্চাশৎ পর্ব (৫২ পর্ব)

অপরূপা দরজা খুলে থেমে যায়। ইমতিয়াজ দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে। অপরূপা একটু পিছিয়ে আসে। ইমতিয়াজ বাসায় ঢু°কেই দরজা লাগিয়ে দেয়। অপরূপার ডানগালের অবস্থা সে দেখে, সেখানেই একটা চ°ড় বসিয়ে দেয়৷

“আমি শুরুতেই সন্দেহ করেছিলাম মৃত্তিকা কিছু একটা করছে।”

ইমতিয়াজের সাথে অপরূপার পেরে উঠা সহজ কথা নয়। অপরূপার হাত উ°লটে পেছনে এনে টেনে ধরে ইমতিয়াজ। দুহাত দুইদিকে ধরে জোরে টা°ন দেয়।

অপরূপা চেঁ°চিয়ে উঠে, হয়তো হাত মচকে গেছে। প্রচুর ব্য°থা অনুভব হচ্ছে। ডাইনিং এর চেয়ারের সাথে ওকে বেঁধে রেখে ফাহাদকে টেনে তুলে বলে,
“কেমন পুরুষ তুমি? একটা মেয়ের সাথে পারো না?”

ফাহাদের নাকেমুখে পানি দেয় ইমতিয়াজ। কিছুটা ঠিক লাগলে সোফায় বসিয়ে দেয়৷ ফাহাদ নিচুস্বরে বলে,
“ম্যাডাম কিছুক্ষণ পরই চলে আসবে।”
“আসুক।”

ইমতিয়াজ অপরূপার সামনে চেয়ার টে°নে বসে। মৃত্তিকা নিষেধ করার পরেও ওর সকল তথ্য ইমতিয়াজকে দিয়েছে ফাহাদ। গতরাতেই দিয়েছে, তাইতো আজ সকাল সকাল এসে হাজির হয়েছে সে।

ইমতিয়াজ পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে অপরূপাকে বলে,
“শাফিনের সাথে যুক্ত আছো, তবে এটাও জানো শাফিন কোথায় আছে?”

অপরূপা চুপ থাকায় ইমতিয়াজ হেসে বলল,
“দেখো, যে লোক জামিল আর দুলালকে মারতে পারে সে তোমাকেও মারতে পারবে। এটা ওর কাছে কোনো বিষয়ই না।”

কথা বলতে বলতে অপরূপার নাম্বার থেকে মৃত্তিকার নাম্বারে ডায়াল করে, রিং হচ্ছে।

ইমতিয়াজ অপরূপাকে বলে,
“ম্যাডামকে আসতে বলো। আমার কথা জানিও না।”

মৃত্তিকা রিসিভ করে, অপরূপা বলে,
“মৃত্তিকা, বাসায় কেউ একজন এসেছে।”

মৃত্তিকা চমকে উঠে। সে এই বাসায়ই আসছিল। চটপট করে বলে,
“কে এসেছে?”

কল কে°টে যায়। মৃত্তিকা আবারো কলব্যাক করলে ইমতিয়াজ কে°টে দেয়। মৃত্তিকা চিন্তিত হয়। এ আবার কোন নতুন সমস্যা?
______________________________________

“শাফিনকে আমি একসময় পছন্দ করতাম। অন্যরকম সম্পর্ক ছিল আমাদের। নার্গিস, রিপা ওরা জানতো আমাদের কথা। তবে ওই দুইটা খু°নের পর আমি সম্পর্ক শেষ করে দিই। শাফিন মেনে নিতে পারেনি এটা। অনেক ঝা°মেলা করেছে আমার সাথে। মানিনি, নিজের জে°দ নিয়ে বসেছিলাম। তখনও আমি ওর অতীত সম্পর্কে জানতাম না। আমি জানতাম না শাফিন রিপাকে পছন্দ করতো।”

একটু থামেন রোমি খন্দকার। তারপর আবারো বলেন,
“আমরা যখন ফাইনাল ইয়ারে পড়ছি তখন রিপা জেনেছিল শাফিন বিভিন্ন অ°বৈধ ব্যবসার সাথে জড়িত। সে শাফিনকে কয়েকবার সর্তক করলেও শাফিন তা মানে না। বরং রিপা যখন মিউকোকে নিয়ে প্রেগন্যান্ট ছিল, তখন…”

রোমি খন্দকার থেমে গেলে সারাহ্ বলে,
“আমি জানি বাকিটা কি?”

রোমি খন্দকার মাথা নেড়ে বলল,
“সেদিন খুব ভয়ংকরভাবে সে আমাদের উপর ক্ষে°পেছিল। তারপর যদিও নার্গিসের বিয়ে হয়ে যায় আর সে অন্য এলাকায় চলে যায়। তবে আমরা ওর এসব সামনে আনতে ম°রিয়া হয়ে ছিলাম। নার্গিস একটা পরিকল্পনা করে, আর সে অনুযায়ী আমি শাফিনের ব্যবসার একটা ভাগ নিয়ে ওর সাথে যুক্ত হই। খুব কাছ থেকে আমি ওর এসব দেখেছিলাম। যত জায়গায় ডিল করেছে সব কাগজ আমি হাতে পেয়েছিলাম। এই ফাইলে সেগুলোর নকল আছে।”

আহনাফ উনার কথাগুলো সব ভিডিও করছে। সে বলে,
“তা না হয় বুঝলাম, তবে এতো বছর পর কেন সে আপনাদের পিছু লেগেছে?”
“ও লাগেনি আমরা লাগিয়েছি, না চাইতেই লাগিয়েছি।”

সারাহ্ একটু অবাক হয়। বি°পদ কেউ ডেকে আনে নাকি?

“রিপার ডি°ভো°র্সের পরপর শাফিনের নামে একটা কে°ইস করেছিল সে। এতে শাফিনের কিছুই হয়নি, জে°লেও যায়নি, কেউ জানেও নি। শাফিনের নজর তখন রিপার উপর তীব্র, আমার বা নার্গিসের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানেনি তখন। তারপর রিপা ইতালি চলে যায়, প্রায়ই দেশে আসতো তবে শাফিনের গোপনে। একের পর এক কুকর্ম সে চালিয়ে যাচ্ছিল, অথচ পুরো সমাজে তার একটা ভদ্র চেহারা ছিল। কোনো কে°ইস তার কিছু করতে পারেনি, লিগ্যাল রাস্তাগুলো যেন তার জন্য বন্ধ। রিপা অনেকবার দেশে এসেছিল, রিপা আর নার্গিস মিলে অনেক চেষ্টা করেছে। তবে কাজ হয়নি। রিপা সমসময় আমাদেরকে লুকিয়ে রেখে নিজে সামনে থাকতো। (একটু থেমে) শেষবার রিপা দেশে আসে ওর বোনের মেয়ের বিয়েতে।”

আহনাফের দৃষ্টি স্থির হয়। রোমি খন্দকার থামে না,
“বিয়ের কয়েকদিন আগে নার্গিস শাফিনকে মে°রে ফেলার পরিকল্পনা করে, রিপা সম্মত হয়। এছাড়া আর কোনো রাস্তা খোলা ছিল না। কাজটা আমাকে করতে হতো। করতে পারিনি, উলটো নার্গিসের পরিকল্পনা সম্পর্কে সে জেনে যায়। নার্গিসকে সে ভ°য়া°নকভাবে টার্গেট করেছিল। তারপর যতটুকু শুনেছি রিপা…”

আহনাফ মাঝ থেকে বলে উঠে,
“তাহসিনার বিয়েতে রিপা বেগম মা°রা যায়।”

রোমি খন্দকার আহনাফের দিকে তাকায়, সারাহ্ও তাকায়। রোমি খন্দকার মাথা নেড়ে বলেন,
“হ্যাঁ, এর আগের রাতে রিপার সাথে আমার ফোনে কথা হয়েছিল। রিপা বলেছিল ওর বোনের দুজন মেয়েই নাকি মামার কথা জেনে গেছে, তাই ছোট মেয়ে মানে যার বিয়ের কথা ছিল তাকেও নাকি পা°চারের হু°মকি দিয়েছিল। তোমাদেরকে এসবের সাথে আমরা জড়াতেই চাইনি সারাহ্।”

আহনাফ ভিডিও সেভ করে ফোন রেখে বলল,
“সবকিছুর জন্য তবে আপনারাই দায়ী, তবুও এতোদিন আপনারা চুপ ছিলেন। এতোটা বছর গু°ম°রে ছিলেন। আজও আমাদের জানাতে চাচ্ছেন না, আরো কয়জন মানুষ ম°রলে জানাতেন আপনারা?”

রোমি খন্দকার মাথানিচু করে ফেলে। সত্যিই তার নিজেকে ছোট মনে হচ্ছে। আহনাফ বেরিয়ে যায়। সারাহ্ বের হতে নিলে রোমি খন্দকার ওর হাতে ফাইলটা দিয়ে বলে,
“এটা মিউকোকে দিয়ে দিও। রিপার বড়বোন আরো অনেক কিছুই জানে, এখানে অনেক ষড়°যন্ত্র আছে সারাহ্।”

“আপনারাও সেই ষড়°যন্ত্রেরই অংশ হয়েছেন আন্টি। চাইলে আরো আগেই অনেক কিছু করা যেতো। এতোগুলো নিরীহ মানুষকে ম°রতে হতো না।”

সারাহ্ ফাইল নিয়ে বেরিয়ে যায়। মায়ের উপর প্রচন্ডভাবে রেগে আছে সে। সব জেনেও কেন বারবার গোপন করেছে উনি।
______________________________________

ঘন্টাখানেক পর মৃত্তিকা এসে বাসার দরজা খুলতে নিয়ে বুঝতে পারে দরজা ভেতর থেকে আটকানো। ব্যাগ থেকে পি°স্ত°ল বের করে বামহাতে রেখে বেল বাজায় সে৷

ফাহাদ এসে দরজা খুলে। মৃত্তিকা ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলে,
“কে এসেছে বাসায়?”

মৃত্তিকা ভিতরে এসে ইমতিয়াজকে দেখে হাত থেকে পি°স্ত°ল পড়ে যায়। অপরূপাকে বাধা অবস্থায় চেয়ারে বসে থাকতে দেখে।

“ইমতিয়াজ।”

ইমতিয়াজ একটু মাথা নাড়ে। চেয়ার ইশারা করে বলে,
“বসো, তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”

মৃত্তিকা চেয়ারে বসে। ইমতিয়াজ ওর দিকে ঝুঁকে বলল,
“এতো লুকোচুরি কেন আমার সাথে? বিশ্বাস করতে পারো না?”

“ও তোমাকে মোটেও বিশ্বাস করে না, তুমি..”

অপরূপার কথার মাঝেই ইমতিয়াজ ওর গালে ঠা°টিয়ে একটা চ°ড় লাগায়। মৃত্তিকা চমকে উঠে।

ইমতিয়াজ বলে,
“ইনোসেন্ট ভাব নিয়ে কোনো লাভ নেই।”
“ইমতিয়াজ, এটা আমার ফ্যামিলির সমস্যা, তাই আপনাকে জড়াতে চাইনি।”

ইমতিয়াজ রাগে চেঁ°চিয়ে উঠে,
“তোমার ফ্যামিলি কি আমার ফ্যামিলি নয়? তাহমিনা কি আমার কেউ নয়?”

মৃত্তিকা উঠে দাঁড়িয়ে ইমতিয়াজকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“শান্ত হন। আপনার ভ°য়ং°কর চেহারা আমার ভালো লাগে না।”

ইমতিয়াজ শান্ত হয়। ওর রাগ ভ°য়াবহ রকম, সে জানে এটা। তাহমিনাও তার রাগকে ভ°য় পেতো।

সময় গড়ায়, দুপুর ছাড়িয়ে বিকাল আর বিকাল ছাড়িয়ে রাত হয়। এরমধ্যে একটা পরিকল্পনা সাজানো হয় ওদের। নিজেদের ছোট এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলেই শাফিন ধরা পড়ে যাবে। তবে এতে কিছুটা সময় লাগবে।

ইমতিয়াজ আজ এ বাসায়ই থাকবে। অপরূপাকে আর যাই হোক, ফাহাদের কাছে ছাড়া মোটেও ঠিক হবে না। মৃত্তিকা চলে গেছে তানজিমের বাসায়। মমতাজ বেগমকে প্রতিদিন সে নিয়ম করে এককাপ চা খাওয়াচ্ছে, ঘুমের ওষুধ মেশানো চা।
______________________________________

একমাস পর,

কয়েকদিন ধরেই কাগজপত্র অদৃশ্য হচ্ছে এডভোকেট বিথীর। সব নয়, বেছে বেছে কিছু কাগজ পাচ্ছে না। এটা নিয়ে শাফিনের সাথে কথা বলতে বলতে বাসায় ফিরছে। রাত প্রায় দশটা বেজে গেছে। নিজের গাড়িতে করেই ফিরছে সে। ড্রাইভার গাড়িটা বাসার দিকে না নিয়ে অন্যরাস্তায় নিচ্ছে দেখে বিথী ফোন রেখে বলে,
“কোথায় যাচ্ছো তুমি?”
“তা তো আমি জানিনা।”

কন্ঠটা বিথীর ড্রাইভারের মতো লাগেনি। ধ°মক দিয়ে বলে,
“কে আপনি?”
“হয়তো কেউ, যে আপনার পরিচিত নয়। চিৎকার করবেন না, আপনি গান পয়েন্টে আছেন।”

গাড়ি থামে শরীফের বাসার সামনে। দরজা খুলে ড্রাইভারের আসন থেকে ইমতিয়াজ বের হয়। উনাকে হেঁচকা টা°নে বের করে বাসার ভিতরে নিয়ে যায়।

মৃত্তিকা বাসার ভিতরেই ছিল। বিথীকে এনে ড্রইংরুমে বসিয়ে ইমতিয়াজ দরজা লাগায়। তারপর ফাহাদকে কল দিয়ে বলে,
“এখন চালু করো।”
“ওকে।”

এতোক্ষণ বাসার সিসিটিভি ক্যামেরা বন্ধ ছিল। এখনই মাত্র চালু হলো। ইমতিয়াজ বিথীকে চেয়ারের সাথে বেঁধে দেয়। অপরূপা আর বিথী মুখোমুখি।

অপরূপার চেহারা দেখে চেনার উপায় নেই। একমাসে তার চেহারায় কোনো বিলাসিতার ছোঁয়া পড়েনি। উলটো সকাল-সন্ধ্যা মৃত্তিকার অ°ত্যা°চারে সে অ°তিষ্ঠ। দুহাত ভে°ঙে গেছে, ব্যান্ডেজ করা আছে সেখানে। সুন্দর চেহারাটা এখন আর সুন্দর লাগছে না, কেমন যেন অগোছালো হয়ে গেছে।

“একে চেনেন?”

খুব শান্তভাবে বিথীর কানের কাছে কথাটা জিজ্ঞাসা করে ইমতিয়াজ। বিথী চুপ করে আছে। ইমতিয়াজ সোজা হয়ে মৃত্তিকাকে বলে,
“শাফিন নি°র্ঘাত এদেরকে শাটআপ ডো°স দিয়েছে।”

মৃত্তিকা একটু হেসে বলে,
“বকবক ডো°স লাগবে বোধহয়।”

মৃত্তিকা এসে বিথীর গাল চেপে ধরে বলল,
“তোমার কাগজপত্র আমি গা°য়েব করেছি। তোমরা চুপ থেকে কয়দিন বাঁচবে আমিও দেখবো।”

বিথী গাল ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
“আমি যা করেছি নিজের জন্য করেছি, আর কিছু না। আমি উকিল, আমি এমনটা করতেই পারি।”
“ন্যায়-অ°ন্যায় বোধটা তোমার নেই। অথচ তোমরাই মোটা মোটা আইনের বইপুস্তক পড়ো।”

মৃত্তিকা বিথীকে চেয়ার থেকে খুলে ওয়াশরুমে নিয়ে আসে। এক বালতি পানিতে মাথা ঢুকিয়ে দেয়। হাত তার পেছনে বাধা, চাইলেও সে মৃত্তিকাকে সরাতে পারবে না। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তার।

বেশ কিছুক্ষণ পর মৃত্তিকা তার মাথা তুলে বলে,
“এখন তো বলবে?”
“উকিলের কথার প্যাঁ°চ নিতে পারবে না।”
“আর তুমি আমার প্যাঁ°চ নিতে পারবে?”

আবারো একই কাজ করে সে। বারবার করলেও বিথী মুখ খুলে না। রাগে মৃত্তিকার গা রিরি করতে শুরু করেছে। বিথী বুঝতেও পারছে না এতে তার উপর অ°ত্যা°চারের মাত্রা কেবলই বাড়বে।
______________________________________

সারাহ্ আয়নার সামনে দাঁড়ায়। নিজেকে দেখছে সে। স্পষ্ট একটা মাতৃকালীন সৌন্দর্য এসেছে তার মধ্যে।

আহনাফ রুমে এসে ওকে আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল,
“নিজেকে এভাবে মুগ্ধ হয়ে দেখছো?”

সারাহ্ ফিক করে হেসে উঠে বলল,
“না তো।”

আহনাফ ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“তবে যে চেয়ে আছো?”

দুজনেই আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে। সারাহ্-র হাসিটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। আহনাফের হাতের উপর হাত রেখে বলে,
“আমার ভ°য় করছে আহনাফ?”
“কেন? শাফিনের ভ°য় পাচ্ছো?”

আহনাফ ওকে ঠিক বুঝে। সারাহ্ আহনাফের বুকে পিঠ ঠেকিয়ে বলে,
“তাহমিনা আমার মতোই ছিল, তাই না?”

আহনাফ ওকে নিজের দিকে ফিরিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে,
“থামো ঐশী, আমার সহ্য হবে না।”

সারাহ্ ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আহনাফ, এমনও তো হতে পারে আম্মু আর আন্টি আমাদের ভালোর জন্যই এসব লুকিয়েছে।”
“কোনো ভালো তো এতে হয়নি।”
“উনারা তো চেষ্টা করেও কিছুই করতে পারে নি। আন্টি তার মেয়েকে হারিয়েছেন। তাহলে তো আম্মুও তার..”

সারাহ্ নিজে থেকেই থেমে যায়। আহনাফও চুপ থাকে। দুজনই কাঁদছে, কিন্তু কেউ কাউকে দেখছে না।
______________________________________

সূর্য উঠে, সকাল হয়। আজ শরীফ অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে আসবে। মৃত্তিকাকে কথাটা জানায়নি ইমতিয়াজ। ভোরে ফ্লাইট ল্যান্ড করেছে। সকাল সাতটায় বাসায় চলে এসেছে শরীফ।

ইমতিয়াজ আজ অফিসে একটু দেরি করে যাবে। মৃত্তিকা এখনো ঘুমাচ্ছে, কালরাতটা এখানেই কা°টিয়েছে সে। এমনি মিউকোকেও সাথে এনেছে, ওকে নিয়েই আরামে ঘুমাচ্ছে সে। কলিং বেল শুনে তার ঘুম ভা°ঙে।

মিনমিনে স্বরে বলল,
“ইমতিয়াজ, কে এসেছে?”

ইমতিয়াজ পাশে বসে ফোন দেখছিল।
“দেখছি।”
বলে ফোন রেখে সে উঠে যায়।

দরজা খুলে শরীফকে দেখে কোলাকুলি করে সে। ইমতিয়াজ তো জানে শরীফ এখন আসবে। শরীফ ড্রইংরুমে বসে বলল,
“মিউকো কি ঘুমাচ্ছে?”
“হুম।”

ডাইনিং এ বাধা অবস্থায় আছে অপরূপা ও বিথী। দুজনেই মাথা হেলিয়ে রেখে ঘুমাচ্ছে। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ফাহাদ। ইমতিয়াজের থেকে প্রায় সকল কথাই শরীফ জেনেছে আর শরীফের কথামতোই কাল বিথীকে তুলে এনেছে ইমতিয়াজ।

শরীফ ওদেরকে ইশারা করে বলে,
“কান টা°নলে মাথা আসবে। তবে আসল কানটা এখনো বাকি।”
“আসল কান?”

মৃত্তিকা চোখ কচলে উঠে আসে। শরীফকে দেখে চমকে উঠে বলল,
“আজকে আপনার দেশে আসার কথা ছিল নাকি?”

শরীফ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“না, সারপ্রাইজ।”

মৃত্তিকা রান্নাঘরে গিয়ে চা বসায়। ব্য°ঙ্গ করে বলে,
“সারপ্রাইজ? ঢং যতসব।”

সারাদিন শরীফ বাসায় থাকলেও মৃত্তিকা তার সাথে একটা কথাও বলে না। সেই জে°দ, সেই রাগ মৃত্তিকার মধ্যে খুঁজে পায় শরীফ। মায়ের মেয়ে মায়ের মতোই, বাবার মতো হিং°স্র°তা ছাড়া আর কিছুই নেই।

সন্ধ্যার পর শরীফ হাসপাতালে যায়। পল্লবী সবটা সামলে নিলেও নিজেকে তো কিছুটা দেখতেই হবে।

মৃত্তিকা চুল আঁচড়াচ্ছে আর ভাবছে। গভীর ভাবনায় মগ্ন সে। শাফিনকে কিভাবে দ্রুত হাতে আনবে? চিন্তা এই একটাই। হঠাৎ মৃত্তিকার মাথায় সেই পুরোনো শর্টকাট বুদ্ধিটাই আবার খেলে গেল।

শাফিন যেহেতু প্রেগন্যান্ট মেয়েদের দিকে আ°কৃষ্ট হয়, তাই ওর প্রেগন্যান্সিই পারে শাফিনকে দ্রুত সম্মুখে আনতে। তবে কি সে মি°থ্যা খবর ছড়িয়ে দিবে? ইমতিয়াজ জানলে ওকে কি বলবে?

ইমতিয়াজ এমনসময় রুমে আসে।
“মৃত্তিকা, কলরব আজ অফিস জয়েন করেছে।”

মৃত্তিকা পিছন দিকে ফিরে তাকিয়ে মাথানিচু করে ফেলে। ওর চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে লজ্জা পাচ্ছে। ইমতিয়াজ কপাল কুঁচকায়, ওর কথায় লজ্জার কি খুঁজে পেল মৃত্তিকা বুঝে না সে।

ইমতিয়াজ ওর সামনে এসে বলল,
“কি হয়েছে? কোনো সমস্যা?”

মৃত্তিকা ওকে জড়িয়ে ধরে। ওর বুকে মাথা রেখে দুহাতে পিঠের দিকের শার্টের অংশ মুঠোয় ধরে। ইমতিয়াজ ওর মুখটা দেখতে পারে না।

ইমতিয়াজ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“মৃত্তিকা?”

চলবে…..

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

ত্রিপঞ্চাশৎ পর্ব (৫৩ পর্ব)

সকাল দশটা, কলেজে ক্লাস করাচ্ছে আহনাফ। বেশ কয়েকবার কল আসলেও ফোন সাইলেন্ট থাকায় সে দেখেনি। গালিব বারে বারে ওকে কল করছে।

রোমি খন্দকারের থেকে আনা ভিডিওটা গালিবকে পাঠিয়েছিল আহনাফ। আহনাফের সন্দেহের উপর ভিত্তি করে শাফিনের সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগে ইন্সপেক্টর ফজলে রাব্বি, জেলার বিল্লাল হোসেনকে গ্রে°ফ°তার করা হয়েছে। ওরা অপ°রাধ স্বীকার করেছে, ওদের ভাষ্য অনুযায়ী শাফিন এখন কুমিল্লাতে আছে এবং সে নার্গিস পারভিন ও রোমি খন্দকারকে না মে°রে কিছুতেই শান্ত হবে না, আর সাথে মৃত্তিকা তো আছেই।

ক্লাস শেষে বেরিয়ে ফোনে এতোগুলো কল দেখে একটু চিন্তিত হয়ে পড়ে আহনাফ। আবার দুইটা ভয়েস ম্যাসেজও আছে।

আহনাফ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ম্যাসেজ দুটি চালু করে,
“শাফিন কুমিল্লাতে আছে, জেলার বিল্লাল হোসেনকে আজকে ঠাকুরগাঁও থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। দুজন ক°ড়া নজরে আছে, পালানোর কোনো রাস্তা খোলা নেই। আজকে র‍্যাবের দুইটা টিম শাফিনকে খুঁজতে কুমিল্লা যাবে, তবে আপনি আর আপনার ফ্যামিলি একটু সাবধানে থাকবেন। নার্গিস পারভিন ও রোমি খন্দকারের জীবনও ঝুঁকির মধ্যে আছে।”

ম্যাসেজগুলো শুনে আহনাফ একটু থম মে°রে যায়। শাফিন কুমিল্লায় আছে, এইটুকু ওর চিন্তার জন্য যথেষ্ট।

ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস নিচ্ছে সারাহ্। বড় আবায়া পড়ে নিজের শরীর আবৃত করে রেখেছে। আহনাফ এসে ক্লাসরুমের দরজা বরাবর বারান্দার গ্রিলে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।

সারাহ্ ওকে দেখেনি, সে মনোযোগ দিয়ে একটা গাণিতিক সমস্যা সমাধান করছে। ক্লাসের কয়েকজন ছাত্রী ওকে খেয়াল করে৷

একজন সারাহ্-কে ডেকে বলে,
“ম্যাম, স্যার এসেছেন।”

সারাহ্ কপাল কুঁচকে দরজার দিকে তাকালো। তারপর ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলে,
“এখন কি স্যারের ক্লাস?”
“নো ম্যাম।”

সারাহ্ ক্লাস থেকে বেরিয়ে এসে বলল,
“এখানে আসার কি দরকার?”
“আমার সাথে বাসায় যাবে, আগে একদম কলেজ থেকে বের হবে না।”

আহনাফ চলে যেতে নিলে সারাহ্ ওকে ডেকে বলে,
“কেন?”
“যা বলেছি শুনো।”

সারাহ্ ক্লাসে ফিরে আসে। আহনাফের এসব আচরণ ওর একদম অদ্ভুত লাগে। হুট করে একটা কথা বলল আর ওকে তাই করতে হবে।
______________________________________

মমতাজ বেগমের সাথে দেখা করতে এসেছে মৃত্তিকা। মমতাজ বেগম বিছানায় শুয়ে আছে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে উনি অসুস্থ।

“বড়মণি, কি হয়েছে?”

মমতাজ বেগম ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
“ঘুম হচ্ছে না, তাই মাথাব্য°থা করছে অনেক।”

মৃত্তিকা গিয়ে উনার পাশে বসে। একমাসের বেশি সময় ধরে উনাকে প্রতিদিন ঘুমের ওষুধ খাওয়াচ্ছে মৃত্তিকা। একটু একটু করে মাত্রা বাড়িয়েছে, আর এটা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে এখন তা ছাড়া উনার ঘুমই হয় না। দুইরাত না দেয়ার ফলে উনি ঘুমাতে পারেনি।

মৃত্তিকা সহানুভূতির সুরে বলে,
“চা করে দিবো?”
“হ্যাঁ, দাও।”

মৃত্তিকা গিয়ে চা করে আনে। তবে এবারে তাতে আর ঘুমের ওষুধ মেশায়নি। মমতাজ বেগম চা পান করা শুরু করে।

মৃত্তিকা উনার মুখোমুখি বসে বলল,
“বড়মণি, একটা কথা বলি?”
“কি?”

মৃত্তিকা শেষবারের মতো চিন্তা করে, তারপর বলে,
“আমার মনে হচ্ছিলো, তাই কি°ট দিয়ে টেস্ট করেছি। (একটু থেমে) আমি প্রেগন্যান্ট বড়মণি।”

মমতাজ বেগম চা খাওয়া বন্ধ করে দেন। দরজার ওপাশ থেকে তানজিমও কথাটা শুনে। তানজিমের অবাক লাগে বিষয়টা। মমতাজ বেগমকে নিয়ে এতো কথা জেনেও মৃত্তিকা কি করে তাকে এটা বলতে পারলো?

মমতাজ বেগম মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের পলক যেন তার পড়ছে না। তারপর হেসে বলল,
“এ তো খুশির খবর, গো°মড়া মুখে বলছো কেন?”
“ভ°য় হচ্ছে।”
“কেন ভ°য় নেই? এটা স্বাভাবিক। (একটু থেমে) ইমতিয়াজ জানে?”

মৃত্তিকা মাথা নেড়ে বলল,
“না।”
“তবে এখন জানিও না, কিছুদিন পর জানাও।”
“জি।”

তানজিম দ্রুত বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। কিছুদিন পর জানাবে কেন? কি হবে এই কিছুদিনে? তানজিম জানে শাফিন আসবে, পশুর মতো আবারো আ°ক্র°মণ করবে মৃত্তিকার উপর।
______________________________________

তিনদিন পর, শাফিনকে পাওয়া যায়নি, খোঁজাখুঁজি করেও না। তবে দেশের এয়ারপোর্ট ও অন্যান্য পোর্টে ক°ড়া নজরদারি চলছে। গালিব আর কাউকে হাতছাড়া করতে দিবে না। এতে আ°ইনের উপর থেকে ভরসা মানুষের উঠে যাবে।

“মৃত্তিকা প্রেগন্যান্ট।”
“তাতে এখন আমার কিচ্ছু আসে যায় না। এই মেয়েটা আমার লাইফটা শেষ করে দিয়েছে। এই মেয়েটাকে মা°রতে গিয়েই প্রথম আমি সন্দেহের জালে পড়েছি।”
“যা হয়েছে, হয়ে গেছে। রোমির কোনো খবর?”
“না, রোমি বাসায় নেই। কোথায় গেছে তা জানা যায়নি। (একটু থেমে) নার্গিসের বাসার আশেপাশে পাহারা জোরালো করেছে আহনাফ।”
“তারমানে তোমাকে ধরার সকল কাজ করা হয়েছে?”
“হুম।”

মমতাজ বেগম ও শাফিন ফোনে কথা বলছে। শাফিন একপ্রকার ফেঁ°সে গেছে, নিজেকে বাঁচানোর এতোদিনের সকল চেষ্টা তার ব্যর্থ হওয়ার পথে।

“অপরূপা কোথায়?”

মমতাজের কথায় শাফিন জবাব দেয়।
“হয়তো ধরা পড়েছে, জানা নেই। রাব্বি, বিল্লাল সবাইকে ধরে ফেলেছে।”
“আমি এখনো বাইরে আছি। এক কাজ করি, আমরা দুজন বেনাপোল দিয়ে ভারতে চলে যাই। আপাতত এছাড়া কোনো উপায় নেই।”
“বেনাপোল দিয়ে যাওয়া যাবে না, টেকনাফ হয়ে মিয়ানমার যাবো আমরা।”
“আচ্ছা, যেভাবেই যাই, আমাকে জানাও।”
“তুমি বাসা থেকে বের হওয়ার বন্দোবস্ত করো।”

খুব স্বাভাবিক স্বরে কথা বলে মমতাজ বেগম ফোন রাখে, উনার ভাব দেখলে মনে হতে পারে এসব কোনো অন্যায় নয় আর উনি যা করেছে সবই ঠিক।

এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠে। দরজা খুলে দেখে, মৃত্তিকা এসেছে।

মৃত্তিকা সোফায় বসে বলল,
“বড়মণি, কোথাও যাচ্ছিলে নাকি?”

ওর কথায় বড়সড় রকমের ভনিতা দেখা যাচ্ছে। মমতাজ বেগম মাথা নেড়ে বলল,
“না তো।”

মৃত্তিকা ব্যাগ থেকে একটা সিরিঞ্জ বের করে বলে,
“ভেবেছিলাম কা°টা দিয়ে কা°টা তুলবো। এখন দেখলাম কা°টা দিয়ে কখনো কা°টা তোলা যায় না, কা°টা তুলতে অন্য যন্ত্রের দরকার হয়।”

মমতাজ বেগম কপাল কুঁচকে বলল,
“মানে? কি বলছো তুমি এসব? আর এই সিরিঞ্জ দিয়ে কি হবে?”

আর কিছু বলতে পারে না, উনার হাতে মৃত্তিকা সিরিঞ্জ ঢু°কিয়ে দেয়। এখানে শরীর অবশ হওয়ার এনে°স্থি°সিয়া ছিল, মমতাজ বেগম আর নড়াচড়া করতে পারে না।

“ভিতরে এসো।”
মৃত্তিকার কথায় তিনজন মেয়ে ভিতরে আসে। ওরা মমতাজ বেগমকে তুলে নিয়ে যায়।

পল্লবীর বাসায় এনে ফেলে উনাকে। পল্লবী জানে এসব। সে মৃত্তিকাকে ঘুমের ওষুধের নাম বলেছিল এবং আজকের এনে°স্থি°সিয়াটুকু উনি দিয়েছে। তিনজন মেয়ে নার্স, পল্লবীর কথায় এইটুকু সাহায্য করেছে।

“অনেক সুযোগ দিয়েছি আর তুমি ক্রমাগত তার অপব্যবহার করেছো। যাক অবশেষে তো একটু কাজে লাগবে।”

এখন অপেক্ষা চলবে কখন মমতাজ বেগম স্বাভাবিক হয়। কারণ শাফিন আর পরিবারের পূর্ব রহস্য সম্পূর্ণটাই এই একজন জানে।
______________________________________

বিকালে সারাহ্-কে নিয়ে ডাক্তারের কাছে এসেছে আহনাফ, টমছম ব্রিজের কাছে ডি. এইচ হসপিটালে।

ডাক্তারের কথা অনুযায়ী সারাহ্ শারিরীকভাবে একদম ঠিক আছে, তবে ওর মানসিক যত্ন আরও বেশি নিতে হবে।

হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসে সারাহ্ মাস্ক পড়তে পড়তে বলে,
“উনি কিভাবে জানলো, আমার মানসিক যত্নেরও বেশি নিতে হবে?”
“আরে (একটু হাসে) ওনাদের এসবের আন্দাজ আছে।”
“না, আপনি কিছু বলেছেন।”
“আরে না, আমি কিছু বলিনি আমি তো চুপই ছিলাম।”

সারাহ্ আশেপাশে তাকাতে তাকাতে একটু দূরে ডাক্তার আরিফাকে দেখে আহনাফকে টে°নে বলে,
“ওই যে ডাক্তার আরিফা।”

আহনাফ ওদিকে তাকায় না। সারাহ্-কে বলে,
“তাকিয়ে থেকো না।”

আহনাফ সিএনজি আনার অজুহাতে রাস্তা পার হয়ে অপরদিকে যায়। ওকে আসতে দেখে আরিফা জোরে জোরে হাঁটতে শুরু করে, তবে পালাতে পারে না। আহনাফ তাকে ধরে ফেলে।

র‍্যাবের তিনজন কর্মকর্তা সিভিল পোশাকে কাছেই ছিল। আহনাফ কাউকে ধরেছে দেখে উনারা এগিয়ে আসে।

“ডা. আরিফা? নজর রাখছেন আমাদের উপর?”

আরিফা হাত ছাড়িয়ে নিয়েও যেতে পারে না। র‍্যাব সদস্যরা সামনে চলে আসে। আহনাফ বলে,
“উনাকেও নিয়ে যান, শাফিনের আরেকজন যাসুস।”

এখান থেকে র‍্যাব সদস্যরা সোজা আরিফাকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। এই কে°ইসের অপ°রা°ধীর অভাব নেই, এতো মানুষ মিলে কি এমন দরকারে নিরীহ জীবনগুলো শেষ করেছে?

আহনাফ সিএনজি নিয়ে সারাহ্-র কাছে এসে বলে,
“এখানে আর কত কত মানুষ আছে, তা এক আল্লাহ্ই ভালো জানে।”

সারাহ্ আলতো করে মাথা নাড়ে। সিএনজিতে বসে সারাহ্ বলে,
“আপনার মনে হয় শাফিন ধরা পড়বে?”
“অবশ্যই ধরা পড়বে।”
“এসব তো আগেও ট্রাই করেছে।”

আহনাফ ওকে দিকে তাকিয়ে বলল,
“তখন ওই অফিসাররা বাইরে ছিল, আর এখন তাদেরকেই আগে ধরা হয়েছে। (একটু থেমে) আর শাফিনকে পাওয়া মাত্রই ক্র°স ফা°য়ার করা হবে।”

সারাহ্ পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারে না। রোমি খন্দকারের কথাগুলো মিলালে, শাফিনকে আর যাই হোক দেশের আ°ইন আদালত দিয়ে কিছুই করা যাবে না। উনারা চেষ্টা করে দেখেছে, ব্যর্থ হয়েছে এবং এই কারণেই এতোদিন লুকিয়ে রেখেছে।
______________________________________

“তুমি বুঝদার মানুষ, আমার মামের বয়সী। সত্যি বলতে মামের পর তোমাকে আমি তার স্থানই দিয়েছিলাম। তবে তুমি সেটা মর্যাদা রাখোনি বড়মণি।”

মমতাজ বেগম চোখ তুলে মৃত্তিকার দিকে তাকায়। মৃত্তিকা হাতঘড়িতে দেখে রাত আটটা বেজেছে। কপালে চুলগুলো সরিয়ে হিজাব বাঁধতে বাঁধতে বলে,
“বড়জোর আজকের রাতটা সময় দিতে পারি। তুমি চিন্তা করে দেখো।”

একটু নিচু হয়ে মমতাজ বেগমের মুখের সামনে গিয়ে বলে,
“মৃত্তিকার হিং°স্র°তা তুমি দেখো না, প্লিজ। তুমি দশজনকে খু°ন করতে পারো, কিন্তু তোমার একজনকে মা°রতে আমার কলিজা ছিঁ°ড়°তে হবে। তোমাকে খুবই ভালোবাসতাম, এটা তোমার থেকে আশা করিনি আমি। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছে তুমি এসবে ছিলে।”

মমতাজ বেগম এখন একটু ঢুলছে, বোঝা যাচ্ছে এনে°স্থি°সিয়ার প্রভাব এখনো কিছুটা রয়ে গেছে। মৃত্তিকা বুঝতে পারে উনার বয়সের তুলনায় এনে°স্থি°সিয়া বেশি পড়েছে।

মৃত্তিকা খাবারের প্লেট এনে মমতাজ বেগমকে একটু একটু করে খাইয়ে দেয় আর বলে,
“বো°মের পরিবর্তে গ্রে°নেট যেমন মা°রতে পারি, তেমন ফুলও ছুঁ°ড়তে পারি। এতো কিছু না করলে বুঝি হতো না?”

“তাহসিনা-তাহমিনা, ওরা আমার সংসার নষ্ট করেছে।”

মৃত্তিকা প্লেটটা পাশে রেখে বলল,
“ওরা কিভাবে তোমার সংসার নষ্ট করেছে?”

“লুৎফরের সাথে আমি ভালোই ছিলাম। আমাদের সংসারের সব ছিল। একটা জিনিসের কম ছিল, তা হলো সন্তান। আমি অপেক্ষা করতে চেয়েছিলাম, চায়নি লুৎফরের মা। ওকে আরেকটা বিয়ে করিয়ে দিলো।”

একটু ঢুলে পড়তে নিলে মৃত্তিকা মমতাজ বেগমকে ধরে সোজা করে বসিয়ে পানি খাওয়ায়। মুখে পানির ছি°টা দিয়ে বলে,
“তাহমিনা-তাহসিনা তোমার মেয়ে না?”

“সৎ মেয়ে, লুৎফরের দ্বিতীয় বউ শারমিলির ঘরে বছর না ঘুরতেই তাহমিনা আসে, তারপর আসে তাহসিনা। আমি বুঝতে পারছিলাম লুৎফর শারমিলিকে অন্যরকম চোখে দেখছিলো, যেন দুজনের জন্য দুরকম নিয়ত তার। শারমিলিকে চোখের হারাতো, তারপর আমি শারমিলিকেই হা°রিয়ে দেই।”

“মে°রে ফেলেছিলে?”

“হ্যাঁ, যেনোতেনো ভাবে না (দুহাত তুলে বলে) মুখে বালিশ চে°পে। সবাই ভেবেছিলো সে ঘুমের মধ্যে হার্ট অ্যা°টাক করেছে।”

মৃত্তিকার আর সহ্য হয়নি, আর কোনো খুনের কথা সে শুনতে পারছে না। মমতাজের গালে একটা চ°ড় বসিয়ে দিয়ে বলে,
“মেয়েগুলোকে ঐদিনই মে°রে দিতে, এত কষ্ট তবে পেতো না।”

পল্লবী দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সকল কথা শুনে। মৃত্তিকা উঠে আসার সময় পল্লবীকে দেখে বলে,
“ফুপ্পিজান, ইমতিয়াজকে বা তোমার ভাইকে এর কথা জানিও না।”

পল্লবী মাথা নাড়ায় বলে,
“ঠিক আছে জানালাম না। তবে লুকিয়ে কয়দিন লাগবে?”

“আগে আমি শাফিনকে চাইছি। সে শীঘ্রই আসবে আমাকে মা°রতে আর তার বোনকে বাঁচিয়ে নিয়ে যেতে।”

মমতাজ বেগম ফ্লোরে পড়ে গিয়ে বলে,
“তুমিও তাহমিনার মত কাঁদবে, চিৎকার করে কাঁদতে, আর এবার আমি সামনে থাকবো।” একই কথা কয়েকবার বলতে থাকে মমতাজ।

মৃত্তিকা বাইরে আসলে পল্লবী ওর পিছু পিছু এসে বলে,
“মিউকো, প্রেগন্যান্সির মি°থ্যা খবরটা ইমতিয়াজ জানলে কিন্তু…”
কথা শেষ না করেই একটু ইতস্তত বোধ করে হাত নাড়ায় পল্লবী।

“ও জানবে না, মমতাজ এখানে আর শাফিন নিশ্চয়ই ইমতিয়াজকে জানাবে না।”
“সব ভালো থাকলেই ভালো। আমি চাইনা তোমার সংসারে কোনো সমস্যা হোক।”

মৃত্তিকা মুচকি হাসে। “তোমার সংসার” কথাটা খুব সুন্দর লেগেছে।

মৃত্তিকা বাসায় আসার বেশ কিছুক্ষণ পর ইমতিয়াজ আসে। মৃত্তিকা অ্যাডভোকেট বিথীর সাথে কথা বলছে। তার এখন আর কিছু জানার নেই, শাফিন কোথায়, কি করছে, কিছু না। কারণ মৃত্তিকা জানে শাফিন ওর কাছেই আসবে। মৃত্তিকা শুধু জানছে, বিথীর কাছে শাফিনের বি°রুদ্ধে আর কোন কোন প্রমাণপত্র আছে।

ইমতিয়াজ মৃত্তিকার পিছন থেকে চোখ ধরে বলে,
“সারপ্রাইজ আছে।”

মৃত্তিকা হেসে ওঠে,
“কি সারপ্রাইজ শুনি?”
“বললে নষ্ট হয়ে যাবে। আমার সাথে এসো।”

চোখ ধরেই মৃত্তিকাকে রুমে নিয়ে আসে ইমতিয়াজ। ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের এসব দৃশ্য দেখে অপরূপা। ওর জীবনটাও তো মৃত্তিকার মতো সাজানো গোছানো হতে পারতো। তবে কেন হয়নি?

মৃত্তিকাকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে ইমতিয়াজ বলে,
“আমি না বলা পর্যন্ত চোখ খুলবে না।”
“ওকে।”
মৃত্তিকার মুখে এখনো সেই অমায়িক হাসি।

ব্যাগ থেকে একজোড়া স্বর্ণের বালা বের করে ইমতিয়াজ। মৃত্তিকার দুহাতে বালা দুটি পরিয়ে দিয়ে বলে,
“এবারে চোখ খোলো।”

মৃত্তিকা চোখ খুলে অবাক হয়। সাধারণত সে স্বর্ণ পড়ে না। দুইকানে ছোট ছোট ডায়মন্ডের দুটি রিং, এছাড়া তার সমস্ত শরীরে বাঙালি মেয়েদের মতো গয়না নেই। সে এসব পছন্দ করে না। তবে আজকে ইমতিয়াজের এই বালা দুটি তার খুব পছন্দ হয়েছে।

মৃত্তিকা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাত নেড়েচেড়ে নিজেকে দেখছে। ইমতিয়াজ ওর পিছনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“সুখ সংবাদ তুমি শোনালে বেশি খুশি হতাম। এমনিতেও খুশি আমি।”

মৃত্তিকাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“নিজের খেয়াল রেখো আর বেবিরও।”

মৃত্তিকার চুল সরিয়ে ঘাড়ে চুম্বন করে ইমতিয়াজ ফ্রেশ হতে চলে যায়। মৃত্তিকার পুরো পৃথিবী এক জায়গায় থেমে গেছে। ইমতিয়াজ যদি জানতে পারে এসব কিছু মিথ্যা, তখন সে কিভাবে সহ্য করবে? তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, ইমতিয়াজ জানলো কি করে?

মৃত্তিকা চোখ বন্ধ করে। ইমতিয়াজকে হারানোর ভ°য় তার শরীরের প্রত্যেকটা শি°রা উপশি°রায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।

চলবে…..

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

চতুঃপঞ্চাশৎ পর্ব (৫৪ পর্ব)

(আজকের পর্বটি গতানুগতিক পর্ব থেকে একটু ভিন্ন)

“বড়মণি কেমন আছে?”

মৃত্তিকার কথায় পল্লবী ঘাড় নাড়িয়ে বলে,
“এখন ভালোই আছে। তবে কিছুই খায়নি।”
“হুম।”

মৃত্তিকা খাবারের প্লেট নিয়ে ভিতরে আসে। মমতাজ বেগম ওকে দেখে বলে,
“এতো দরদ উ°তলে পড়তেছে কেন?”

মৃত্তিকা সামনে বসে রুটি ছিঁ°ড়ে উনার মুখের সামনে ধরে বলে,
“খাও, কালরাতে অর্ধেক খাইয়ে চলে গেলাম আর তো খাওনি।”
“খাবো না, মেহেরিবার মতো দরদ দেখাচ্ছো।”

মৃত্তিকা কপাল কুঁচকে জোর করে উনার মুখে রুটি দিয়ে বলে,
“তোমাকে আমি মা°রতে পারতাম, অপরূপার মতো হাত ভে°ঙে দিতে পারতাম। কিন্তু পারিনি। আমার দুর্বলতা হয়তো এখানেই, যাকে ভালোবাসি তাকে আ°ঘাত করতে পারি না।”

মমতাজ বেগম আর কথা বাড়ায় না। চুপচাপ খেতে থাকেন। খাওয়া শেষে বলেন,
“তোমার মনে হয় আমি কোনো অপ°রাধ করেছি? আমার তো মনে হয় না। বাবাকে কথা দিয়েছিলাম এই বংশের প্রতিটা র°ক্ত°কণাকে শেষ করে দিবো, তাই রিপাকে মে°রে ফেলেছি। আর শাফিন তো তোমাকেও মা°রবে।”

শান্তভাবে চেয়ে থাকে মৃত্তিকা। এতোটা সহজে সে নিজেকে নির্দোষ বলছে কিভাবে?

“তোমরা কি এ বংশের নও?”

মমতাজ বেগম মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, কিন্তু রিপার বাবা আর আমার বাবা আলাদা।”
“সেটা শাফিন আমাকে বলেছে। তবে মা°রতে কেন চাও? আমার নানুমণির সাথেও তোমার বাবা নি°কৃষ্ট আচরণ করেছিল, কিন্তু এতো রাগ কিসের?”

মমতাজ বেগম বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ উপরে ঘুরতে থাকা ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলা শুরু করে,
“খুলনায় গিয়ে জমিদার বাড়ি দেখেছিলে না? অনেক আগের জমিদারি ছিল আমাদের। ইংরেজ আমলেরও আগের জমিদারি, বুঝতে পারছো? অনেক পুরনো জমিদারি এটা। খুলনার বিশাল অংশ জুড়ে এবং পশ্চিমবঙ্গের কিছু অংশসহ এই জমিদারি ছিল।

আমার দাদিমা বলেছিলেন, উনি যখন বিয়ের পর প্রথম খুলনায় আসেন, তখন জমিদারি দেখে উনি অবাক হয়েছিলেন। হওয়ারই কথা, আটদশ জন দাসী সব সময় তাকে পাহারা দিয়ে রাখতো, কিছু করা লাগতো না। একটা রানী রানী ভাব থাকতো তার মধ্যে। উনার দুই ছেলে ছিল, ইউসুফ আর ইউনুস। পরহেজগার মানুষ ছিলেন, তাই নবীদের নামে ছেলেদের নাম রেখেছিলেন।

এরপর ভারত-পাকিস্তান ভাগ হয়, আমাদের জমিদারিও ভাগ হয়। তবে পাকিস্তান আমলেও জমিদারি শেষ হয়নি, কিছুটা ছোট পরিসরে তখনও চলছিল।

আমার দাদা, জমিদার আকবরের ভয়ে তখনও ওই এলাকার লোকজন কাঁপতো। উনি ছেলেদের অনেক যত্নে বড় করলেও ইউসুফ কোনো ভালোমানুষ হলেন না। সে হলো এক ব°খাটে, কু°ৎ°সিত স্বভাবের মানুষ।

ইউসুফ নবীর নামে নাম হলেও নামের মর্যাদা সে রাখেনি। তার কাছে এলাকার কোনো মেয়ে নিরাপদ ছিল না। আমার দাদি এসবের জন্য অনেক শা°সন করেও কোনো লাভ হয়নি।

তাই তাকে দ্রুত বিয়ে করানো হলো এলাকার এক দরিদ্র পরিবারের মেয়েকে। মেয়ের নাম ছিল জোসনা। রূপে গুণে পরিপূর্ণ মেয়েটার জীবন জেনেবুঝে নষ্ট করা হয়েছিল।”

মমতাজ বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“প্রতিরাতে মেয়েটির চিৎকারে পৈ°শা°চিক আনন্দ পেতো ইউসুফ। পি°শা°চের সন্তান কি আর ভালো হবে? হলো না। দুই সন্তান মমতাজ আর শাফিন, কেউই ভালো মানুষ হলো না। দুজনই খারাপ, জঘন্য হলো।”

মৃত্তিকা হা করে তাকিয়ে আছে। চোখের পলক তার পড়ছে না। কি শুনছে সে?

“তবে শাফিন, মমতাজ কিন্তু একদিনে খারাপ হয়নি। তাদেরকে খারাপ করা হয়েছে।”

মৃত্তিকা নিচুস্বরে জিজ্ঞাসা করে,
“মামের নাম কেন পরিবর্তন করেছিলে?”

মমতাজ বেগম হেসে বলল,
“সম্মান রক্ষার্থে, রিপা যাতে বুঝতে না পারে সে কে? কি তার পরিচয়? কে তার বাবা-মা?”

মৃত্তিকার মনে এখনো হাজার প্রশ্ন, কিন্তু করতে পারছে না সে। গুছিয়ে আনতে কষ্ট হচ্ছে, আবার না জানি কি শুনতে হয়?

মমতাজ বেগম থম মে°রে বসে থেকে বলল,
“রিপার বাবার কথা শুনবে না? কি করেছিল সে?”
“বলো।”

“উনার নাম ছিল ইউনুস। উনি ছিলেন বাবার বিপরীত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। লেখাপড়ায় ছিল তার প্রচুর আগ্রহ। সাথে সাথে অ°স্ত্র চালনাও শিখেছে। পড়াশোনার জন্য লাহোরে থেকেছে বহুদিন, সেখানেই পরিচয় হয় পাকিস্তানি কন্যা মেহরিবার সাথে।

প্রেম আদান প্রদান না হলেও বিয়ে ঠিকই হয়, সাথে হয় ভালোবাসায় পরিপূর্ণ একটা সংসার। পর্দাশীল মেহরিবাকে হুর বলে ডাকতো ইউনুস। তার চক্ষু শীতলকারী স্ত্রী, তার প্রাণে সখায় পরিণত হয়।

স্ত্রী নিয়ে দেশে ফিরলে পিতা আকবর নিজের জমিদারি দুইভাগ না করে পুরো জমিদারি দিয়ে দেয় ইউনুস চাচাকে। শ°ত্রু°তার শুরু হয় তখনই।

১৯৭০ সালে জমিদারি হস্তান্তরের কিছুদিন পরই মারা যায় দাদা আকবর ও দাদিমা। রহস্যজনক মৃ°ত্যু হয় তাদের। কে মে°রেছিল? ইউসুফ আর জোসনা মে°রেছিল, আমার মা-বাবা খু°ন করেছিল।”

মমতাজ বেগম চেঁচিয়ে উঠে,
“আমরা দুজন তখনই দেখেছিলাম দুই দুইটা খু°ন। নিজেদের দাদা-দাদির খু°ন। আমাদেরকে বোঝানো হয় এটাই ঠিক। আমাদের বয়স কত ছিল জানো? আমার বয়স ছিল নয় আর শাফিনের সাত।”

মৃত্তিকা কেঁপে উঠলো। নিজের হাতে নিজের বাবা-মাকে খু°ন করাও সম্ভব? তাও জমিদারির জন্য?

মমতাজ বেগম অনেকক্ষণ চুপ থাকেন। তারপর শান্ত গলায় বলেন,

“দেশে যখন যু°দ্ধাবস্থা, তখন একরাতে জন্ম হয় রাহা সুলতানার। তোমার মা, রাহা। আমরা দেখেছিলাম কি অপরূপ সুন্দরী ছিলো সে। মেহরিবাও সুন্দরী ছিল, তুমিও তার মতোই হয়েছো। (একটু থেমে) তবে জানো তো ওই রাতটা আমাদের জন্য সুখের হয়নি। দাদা-দাদিকে খু°নের জন্য বাবাকে সন্দেহ করে চাচা।

সাক্ষী হিসেবে শাফিনকে যখন জিজ্ঞাসা করেছিল, তখন শাফিন সব স্বীকার করেছিল। ওই রাতেই বাবা-মাকে কা°রা°গারে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। অকথ্য নি°র্যাতন চলেছিল বাবার উপর। মা তখন অন্তঃসত্ত্বা ছিল, তাই মাকে মা°রেনি। তবে মায়ের সামনে বাবাকে পাশবিক নির্যাতন করেছিল চাচা। চাচার এমন ভ°য়ংকর রূপ আগে কখনো দেখিনি।”

মমতাজ বেগম থেকে গেলেও মৃত্তিকার শোনার পিপাসা থামে না। জিজ্ঞাসা করে,
“তোমাদের আর কোনো ভাইবোন আছে?”

মমতাজ বেগম মাথা নেড়ে না বোঝানো। তারপর বলল,
“না, আমার মায়ের ওই সন্তান, পৃথিবীর মুখ দেখেনি। মেহেরিবা চাচি প্রতিদিন উনাকে খাবার দিতে যেতো, কিন্তু মা ঠিকমতো খেতো না। কারণ খাবার শুধু উনার জন্য বরাদ্দ ছিল, আমার বাবার জন্য না। আমার বাবাকে একদিন পর পর খাবার দেওয়া হতো, তাও শুকনো শক্ত রুটি। এটা ছিল আমার চাচার অভিনব শাস্তি। একেবারে না মে°রে, তিলে তিলে মা°রতে চেয়েছিল। এর চেয়ে শি°র°শ্ছেদ বা ফাঁ°সি অনেক ভালো।

মা কাঁদতো এসব দেখে, এসবের জন্যই একদিন মা অসুস্থ হয়ে যায়। আমি দেখেছিলাম সেদিন মাকে।

সেদিন একটা কথা ভালোমতো বুঝেছিলাম, যত স্বা°র্থপর হবে, তত ভালো থাকবে। আর সত্য যত কম বলবে, প্রিয়জন তত কম হারাবে। যার যত টাকা, তার তত ক্ষমতা আর ক্ষমতা বেশি মানেই, তুমি যা চাইবে তাই করবে।

বাবা এই খবরটা পেয়ে সেদিন আমাদের দুজনকে বলেছিল এই পরিবারের একটা সদস্যকেও বাঁচতে দিবেন না উনি। যদি উনি না থাকে তবেও যেন ওরা না বাঁচে। আমার মনে আছে, বাবার কথা।

অনেকদিন বাবা মা আমাদের থেকে দূরে থাকে। চাচি আমাদের খেয়াল রাখলেও, বাবা মায়ের অভাব কি আর উনি দূর করতে পারবে?

প্রায় ছয় সাত মাস পর একদিন বাবা পালিয়ে যায়। বাবাকে খুঁজতে আশেপাশে অনেক লোক লাগানো হয়, ঠিক যেমন এখন শাফিনকে সবাই খুঁজছে।

এরমধ্যে আমরা খবর পাই দেশ স্বাধীন হয়েছে। চারদিকে রমরমা থাকলেও আমাদের জমিদার বাড়ি শুনশান ছিল। চাচা আর চাচি আনন্দ করলেও, আমরা দুই ভাইবোন কিছুই করতে পারিনি। আমার বাবাকে খুঁজে পাচ্ছি না, মা কারাগারে, আমাদের অবস্থাটা কেউ বোঝেনি।”

মমতাজ বেগম চুপ হয়ে যায়। মৃত্তিকা এসে উনার পাশে বসে বলল,
“বড়মণি, তোমার বাবার খোঁজ কিভাবে পেয়েছিলে?”
“খোঁজ পাইনি উনি এসেছিলেন।”

মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে বলেন,
“রাহার বয়স তখন কেবল নয়মাস। প্রতিরাতের মতো একরাতে চাচা ইউনুস ঘরে ফিরে মেহরিবার সাথে গল্পে মশগুল ছিল। মেহরিবা তখন তিনমাসের অন্তঃসত্ত্বা। নিজেদের সুন্দর সময়টাকে কাটাতে ছাদে যায় ওরা। চাঁদনি রাত্র জ্যোৎস্নাবিলাস সুখকর হয় না।

বাবা এসে হাজির হয়, একা নয়। সাথে ছিল বাড়ির সব চাকরবাকর আর পাহারাদাররাও। চাচাকে সেইরাতেই মেহরিবার সামনেই কু°পিয়ে হত্যা করা হয়। আমরা তখন সামনে ছিলাম, রাহা ছিল। আমি নিজে দেখেছিলাম কিভাবে বাবা রাম°দা দিয়ে চাচাকে কু°পিয়েছিল। বড় হা°তুড়ি দিতে থেঁ°তলে দিয়েছিল উনার মাথা।

চাচির চিৎকার আজও আমার কানে বাজে। ইউনুস, ইউনুস করে আকুতিভরা চিৎকার করেছিল। বাবা শুনেনি।

চাচার পর অন্তঃসত্ত্বা মেহরিবার উপর চালানো হয় শারিরীক নি°র্যা°তন। সবসময় পর্দার আড়ালে থাকা মেহরিবাকে সকলের সামনে বস্ত্র°হ°রণ করে হাঁটতে বাধ্য করা হয়। আমার জীবনের নি°কৃষ্টতম দৃশ্য সেদিন দেখেছিলাম। আমার বাবা আমারই চোখের সামনে আমারই চাচিকে রে°প করেছে। শাফিন ছিল সেখানে, চাচির চিৎ°কারে সে হেসেছিল।

বারবার শারিরীক নির্যাতনে র°ক্ত°ক্ষরণে মা°রা যায় চাচি মেহেরিবা। তার খোলা চোখদুটো দেখেছিলাম খুব কাছ থেকে। একটা অধ্যায় যেন মুছে গিয়েছিল। জমিদারিতে একটা কালো দাগ পড়েছিল।”

“থামো, থামো।”
বলে মৃত্তিকা সরে গেল। চিৎকার করে কেঁদে উঠে সে। এতোটা নি°কৃষ্ট কেউ কিভাবে হতে পারে?

অনেকক্ষণ পর মৃত্তিকা শান্ত হয়। মমতাজ বেগম বলেন,
“ঘৃ°ণা হচ্ছে না আমাকে?”

মৃত্তিকা কান্নাভরা কন্ঠে জবাব দেয়,
“এই দৃশ্য দেখেও তুমি কি করে এতোটা নিচে নামতে পারলে?”

মমতাজ বেগম একটু নড়েচড়ে বসে বলল,

“আমার চেয়েও খারাপ শাফিন হয়েছে, সেদিন চাচির চি°ৎ°কারে যেখানে সবাই কাঁদছিলো, সেখানে সে হেসেছিল। সেদিন থেকেই মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। মেয়েদের এই কষ্টের চিৎকারটা সে উপভোগ করতো।”

মৃত্তিকার চোখ দিয়ে এখনো পানি পড়ছে। মমতাজ বেগম বলেন,
“সেদিন এসব দৃশ্য দেখেছিল যেসব চাকররা, তাদেরকেও হ°ত্যা করেছিল বাবা। রাহাকে হ°ত্যা করতে দেয় না আমার মা, বেঁচে যায় রাহা। নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় রিপা। রাহা সুলতানা থেকে রিপা বেগম।

রাতারাতি জমিদারি দখল করে বসে বাবা ইউসুফ। তবে প্রকৃতি বাবাকে এর যোগ্য শা°স্তি দিয়েছিল। ট্রেনে কা°টা পড়ে কিছুদিন পরই মারা যায় সে। আমার মা জোসনা আমাদের সাথে রিপাকেও বড় করতে থাকে। রিপা জানতেও পারে না, তার মা বাবার সাথে কি হয়েছিল। সে জানতো তার বাবা ট্রেনে কা°টা পড়ে মা°রা গেছে।”

মৃত্তিকার চোখের সামনে ঘটনাগুলো ভাসছে। সে দেখছে আকবরের মৃ°ত্যু, ইউসুফের উপর হওয়া নি°র্যা°তন, জোসনার সন্তান হারানোর দুঃখ, ইউনুসের করুন মৃ°ত্যু, মেহেরিবার চি°ৎ°কার, জোসনার মাতৃসুলভ আচরণে রাহার বেঁচে যাওয়া।

সব যেন একই মালার একেকটি মুক্তা, সুতোটায় টা°ন পড়তেই সবগুলো টপটপ করে ঝরে পড়লো।

মমতাজ বেগমের কথায় মৃত্তিকার ঘোর কাটে,

“শাফিন তার বাবার মতোই হলো। তারও প্রতিরাতে মেয়ে চাই, নতুন নতুন মেয়ে। শাফিন মেয়েদের জীবন নিয়ে পুতুল খেলায় মেতে থাকে, সাথে চলে জুয়ার কারবারি। জমিদারি শেষ হতে থাকলো। একপর্যায়ে দেখা যায়, যাও কিছু আছে তা শাফিনের পেছনেই খরচ হচ্ছে।

১৯৮৮ সাল, রিপা তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিবে। যৌবনের রূপ তখন তার সর্বাঙ্গে। মায়ের মতো রূপবতী তরুণী রিপার দিকে নজর যায় শাফিনের। প্রতিটা মুহূর্ত শাফিনের নোং°রা চিন্তায় রিপা।

সবার আগে বিষয়টা মায়ের নজরে পড়ে। মা কখনো চায়নি রিপার ক্ষতি হোক। তখন মায়ের সিদ্ধান্তে ম্যাট্রিকের পর পরই রিপাকে কুমিল্লা পাঠানো হয়।

এই ঘটনায় শাফিন রেগে যায়। রিপাকে নিজের করার বাসনা তার বাড়তে থাকে। এদিকে রিপা তখন ইন্টার পাশ করে অনার্সে পড়াশুনা করছে।

কিছুদিন পর শাফিনকে নিয়ে আমরা ঢাকায় চলে আসি। গ্রামে ওর এতোই বদ°নাম হয়েছিল যে ওখানে থাকাই দুষ্কর ছিল। শাফিন চাকরি নেয়, তারপর ওর বিয়ে হয় দেলোয়ারার সাথে।

তবে গোপনে সে অন্ধকার জগতের বিজনেসের সাথে যুক্ত হয়। হুমায়ুন নামের একজন তখন থেকেই ওর সঙ্গী ছিল, তবে বিজনেস দখলের জন্য সে হুমায়ুনকেও মে°রে ফেলেছিল।”

মমতাজ বেগম একটু বিরতি নিয়ে আবারো বলা শুরু করে,

“রিপা মাঝে মাঝে আমাদের বাসায় বেড়াতে আসতো। শাড়ির ভাঁজে তখনও তার ভরা যৌবনের ছোঁয়া। একবার বাড়িতে আসে তোমার বাবা শরীফের সাথে, দুজনে নাকি বিয়ে করে নিয়েছে। শরীফ তখন ঢাকা মেডিকেলে ইন্টারশীপ করছিল।

শাফিনের জন্য এটা কোনো ভালো খবর হলো না। শরীফ-রিপার সংসার ভা°ঙার জন্য উঠে পড়ে লাগে সে। তবে নিজের স্ত্রীর সামনে একটা মুখোশ পড়ে নেয় সে। ভালো মানুষের মুখোশ। সুরভি আর দেলোয়ারার জন্য যেন তার কত ভালোবাসা।

যখন তোমার জন্ম হয়, তখন রাগে শাফিন আমাদের মাকে মা°র°ধর করে বাড়ি থেকে বের করে দেয়, মাকে আর খুঁজে পাইনি। জানি না বেঁচে আছে নাকি ম°রে গেছে। সব ঘটনা জেনেও আমি চুপ ছিল। অ°ন্যায়কে শুরু থেকে প্রশ্রয় দিয়েছিলাম আমি।

শাফিন অবশেষে সফল হয়। শরীফের রাগকে কাজে লাগিয়ে রিপার ডি°ভো°র্স হয়। তবে রিপা এবারে আর দেশে থাকে না। তোমাকে নিয়ে পাড়ি দেয় ইতালিতে। আর দেশে শাফিন হয় ঢাকার এক বড় অফিসের কর্মকর্তা আর একজন সাধারণ ব্যবসায়ী।”

একটু নিচুস্বরে মমতাজ বেগম বলেন,

“শাফিন কিন্তু এই দিনগুলোতে থেমে থাকেনি, একের পর এক মেয়ের জীবন সে শেষ করেছে। তবে ঢাকায় স্থায়ী হওয়ার পর সে আর এসব করেনি, সে তখন…”

মমতাজ বেগমের কথার মাঝেই মৃত্তিকা বলে,
“অপরূপার মতো মেয়েদের কাছে যেতো, আর অপরূপাকে বিয়ে করে।”
“হুম।”

মৃত্তিকা দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে। লাইটের আলোয় হাতের বালাদুটো চকচক করছে তার। তার বুক চি°ড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়।

মানুষের মধ্যে দুইটা সত্ত্বা থাকে, একটা ভালো আর অন্যটা খারাপ। কিন্তু যখন মানুষটা ভালো সত্ত্বাকে মে°রে ফেলে, তখন খারাপটা তার রক্তনালি দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। কেউ জন্ম থেকে খারাপ নয়, পরিস্থিতি তাকে খারাপ হতে বাধ্য করে। সে হতে পারে অপরূপা, হতে পারে মমতাজ বেগম কিংবা শাফিন।

চলবে…..

অনুভূতিরা শব্দহীন পর্ব-৪৯+৫০+৫১

0

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

ঊনপঞ্চাশৎ পর্ব (৪৯ পর্ব)

রাত নয়টা, রাস্তার জ্যামের কারণে বাসায় পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়ে গেছে মৃত্তিকার । বাসায় এসে দরজা খোলা দেখে বুঝতে পারে ইমতিয়াজ ইতিমধ্যে বাসায় চলে এসেছে। মৃত্তিকা একটা ঢোক গিলে দরজা খুলতে গিয়ে বুঝলো ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগানো।

বাধ্য হয়ে কলিং বেল বাজায় মৃত্তিকা। ইমতিয়াজ বোধহয় দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল, সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলে দেয় সে।

ইমতিয়াজ মাথা হেলিয়ে বলে,
“আসো।”

মৃত্তিকা ধীরে ধীরে ভিতরে আসে। ইমতিয়াজ শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ভিতরে আসে। মৃত্তিকা বেডরুমে যাওয়ার সময় ইমতিয়াজ বলে,
“দাঁড়াও।”

মৃত্তিকা থমকে দাঁড়ায়, তবে ফিরে তাকায় না। ইমতিয়াজ একটু শ°ক্ত ভাষায় বলল,
“কোথায় গিয়েছিলে?”

মৃত্তিকা আবারো ঢোক গিলে। ফিরে দাঁড়িয়ে বলল,
“আশেপাশেই ছিলাম, একটু ঘুরাঘুরি করেছি। একই জায়গায় বসে থেকে আর ভালো লাগছে না।”

ইমতিয়াজ হেসে এগিয়ে আসে। বলে,
“আমাকে বলতে পারতে, ঘুরতে নিয়ে যেতাম।”
“কোথায় নিয়ে যেতেন?”

ইমতিয়াজ ঠোঁট উলটে মাথা নেড়ে বলল,
“চট্টগ্রামে, আমার গ্রামে ঘুরে আসতে।”

মৃত্তিকা এগিয়ে এসে দুই হাতে ইমতিয়াজের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“তবে কি আগামী মাসে যাওয়া হতে পারে?”
“এ মাসে কি সমস্যা?”
“তেমন কিছু না, তবে পরে হলে ভালো হয়।”
“ঠিক আছে।”

ইমতিয়াজ একটু সি°গা°রেটের গন্ধ পায়। মৃত্তিকার হাতটা কাছে আসতে গন্ধটা পেয়েছে সে। নিজের অনুমান যাচাই করার জন্য সে মৃত্তিকার দুহাত টে°নে হাতের তালুতে চুমো দেয়। এ সময় আরো তীব্রভাবে গন্ধ অনুভব করে।

“কি হচ্ছে এসব?”

মৃত্তিকার কথায় ইমতিয়াজ মাথা নেড়ে বোঝায়, কিছু না। মৃত্তিকা ফ্রেশ হতে চলে যায়।

ইমতিয়াজ এখনো স্থির দাঁড়িয়ে আছে। নিজে নিজেই বলে,
“কি করছো তুমি?”

আবারও সে ফাহাদের নাম্বারে ডায়াল করে। সারাদিনে কয়েকবার চেষ্টা করেও ফাহাদের সাথে কোন প্রকার যোগাযোগ করতে পারেনি সে। শুধু আজ নয় গত তিনদিন থেকে ফাহাদ লা°পাত্তা। না ফোন ধরছে, আর না কল ব্যাক করছে।

এবার সে বাধ্য হয়ে কল দেয় শরীফকে। সবটা জানানোর পর শরীফ বলে,
“আচ্ছা আমি ফাহাদের সাথে কথা বলছি।”
“আমার সাথে জলদি দেখা করতে বলুন। আমি চাই না মৃত্তিকা নতুন করে কোনো ভুল করুক।”

কিছুক্ষণ চুপ থেকে শরীফ বলে,
“ওর ভুল আমারও কাম্য নয়।”
______________________________________

আহনাফ কোনো একটা বিষয় নিয়ে ব্যস্ত আছে। কলেজের কয়েকজন স্যার ম্যাডামের সাথে ফোনে কথা বলেছে। সারাহ্ কয়েকবার ওর আশেপাশে ঘুরে গেল, কিন্তু কারণটা বুঝতে পারলো না।

“ঐশী?”

আহনাফের ডাকে সারাহ্ রুমে আসে। বলে,
“কি?”
“তুমি কি কিছু বলবে?”
“না তো।”
সারাহ্ মাথা নেড়ে জবাব দিল।

আহনাফ হেসে হাত দিয়ে ইশারা করে বলল,
“কাছে আসো।”

সারাহ্ সরে দরজার কাছে চলে গেল। বলল,
“কি বলবেন বলেন?”

আহনাফ হো হো করে হেসে উঠে,
“আরে, ভ°য় পাচ্ছ কেন?”
“কারণ আপনি লোক ভালো না।”

আহনাফ উঠে এসে ওকে টে°নে কাছে এনে বলল,
“তোমার ছুটির ব্যবস্থা করছিলাম।”
“ছুটির ব্যবস্থা? আমি বললাম তো এতো তাড়াতাড়ি ছুটি দেওয়া হয় না।”

সারাহ্ চেঁ°চিয়ে উঠলে আহনাফ ওর মুখ চেপে ধরে। আহনাফ বলে,
“চেঁ°চামেচি করবা না।”

সারাহ্ নিচুস্বরে বলল,
“মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাসের হয়, আর এখন আমার মাত্র সাড়ে তিন মাসের কিছু বেশি চলছে। এখন থেকে ছুটি শুরু হলে কতদিন আমার ছুটি শেষ হবে? সে খেয়াল আছে?”

আহনাফ ডানহাতের তর্জনী আঙুল দিয়ে সারাহ্ কপালে গালে স্পর্শ করে বলে,
“খুব খেয়াল আছে। সেটার জন্য কথা বলছিলাম। দ্বিতীয়বারে নেওয়া সম্ভব কিনা? যতটুকু জানা গেছে কিছুদিন বেশি নেওয়া যাবে।”

সারাহ্ ওর আঙুলে কা°ম°ড় দেয়। আহনাফ “এই” বলে আঙুল সরায়। সারাহ্ হেসে বলে,
“কিছুদিন-টিছুদিন আমার হবে না। আমি আরো পরে ছুটি নিবো। (একটু থেমে) প্রয়োজনে আমি চাকরি ছেড়ে দিবো।”

আহনাফ কপাল কুঁচকে তাকালে সারাহ্ বলে,
“মায়েরা সন্তানের জন্য সব করতে পারে। আর আমি তো সামান্য চাকরি ছাড়বো। এটা কোন ব্যাপার না আমার জন্য।”

আহনাফ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সারাহ্-র দিকে। এ এক অচেনা সারাহ্।
______________________________________

সকালে অফিসে না গিয়ে ইমতিয়াজ বাসার কাছেই একটা চায়ের দোকানে বসে থাকে। উদ্দেশ্য মৃত্তিকা কোথায় যায়, কি করে তা দেখা।

মৃত্তিকাকে বাসা থেকে বের হতে দেখে সে বুঝতে পারে তার উদ্দেশ্য সফল হওয়ার পথে। হেঁটে কিছুদূর গিয়ে মৃত্তিকা দোকান থেকে এক প্যাকেট সি°গা°রেট কিনে। ইমতিয়াজ আগ্রহ নিয়ে তাকায়। মৃত্তিকা সি°গা°রেট খায় তা এতদিনে সে টের পায়নি। হঠাৎ করে এ অভ্যাস শুরু হওয়ার কোনো কারণ নেই।

মৃত্তিকা আবারও বাসায় চলে যায়। ইমতিয়াজ শরীফকে কল দেয়।
“ফাহাদের কোনো খোঁজ পাওয়া গেছে?”
“না, আমার কল রিসিভ করেনি।”

ইমতিয়াজ মাথা নেড়ে জিজ্ঞাসা করে,
“মৃত্তিকা সি°গা°রেট খায়?”

ইমতিয়াজের প্রশ্নে শরীফ খুব অবাক হয় এবং অবাক হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। মেয়েকে এতটা খারাপ অভ্যাসের দিকে ছুঁ°ড়ে ফেলার মতো মানুষ তো রিপা বেগম ছিলেন না। তবে মৃত্তিকা এটা কেন করবে?

শরীফ একটু বি°ভ্রা°ন্তি নিয়েই উত্তর দেয়,
“আমার জানামতে তো না।”
“আমি মাত্র ওকে সি°গা°রেট কিনতে দেখেছি।”

শরীফ চুপ থাকে। কিছু বলার মত অবস্থায় সে নেই, এতোটাই অবাক হয়েছে সে। ইমতিয়াজ আবারও জিজ্ঞাসা করে,
“ফাহাদ কি আপনাকে বোকা বানানোর কোনো সম্ভাবনা আছে?”
“সে অনেক বছর ধরে আমার সাথে আছে। এরকম কিছু সে কখনোই করেনি। আমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত মানুষ ফাহাদ। এজন্যই মিউকোর সাথে আমি ওকে পাঠিয়েছি।”
“বুঝেছি, তাহলে এখন যা করার আমাকে করতে হবে।”

ইমতিয়াজ ফোন রাখে। এবারে নিরবে মৃত্তিকার উপর নজর রাখা ছাড়া আর কোনো উপায় সে খুঁজে পায় না। সে তো আর শরীফের মত মা°ফি°য়া নয় যে নিজের লোক লাগিয়ে দিবে। তার হাতে মৃত্তিকার জন্য বিশ্বস্ত লোক একমাত্র সে নিজে।
______________________________________

দুইদিন পার হয়, জামিলকে সিআইডি হেড কোয়ার্টারে না রেখে নিজের বাসায় রেখেছে গালিব। নিয়মিত প্রচন্ড মা°র°ধর আর ক্ষুধার য°ন্ত্র°ণায় শেষ পর্যন্ত সত্য বলতে রাজি হয় জামিল। আহনাফকে এজন্য খবর দেয় গালিব, আহনাফের সামনেই সত্য প্রকাশ পাওয়া উচিত।

সকাল সকাল খবর পেয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় আহনাফ৷ যতদ্রুত সম্ভব ঢাকায় আসা দরকার, অথচ আজই রাজ্যের জ্যাম রাস্তায় পড়েছে। সামান্য দাউদকান্দির অংশ পার হতেই ঘন্টার পর ঘন্টা সময় যাচ্ছে।

বিরক্তির চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে আছে আহনাফ। আর কোনো উপায় না দেখে গালিবকে কল দেয় সে।

“রাস্তায় প্রচুর জ্যাম। মনে হয় না আমি বিকালের আগে ঢাকায় পৌঁছাতে পারবো। এক কাজ করেন আপনি সব কথা জেনে নেন। বলা তো যায় না কখন তার মত পাল্টে যায়।”

আহনাফের প্রস্তাবটা খুব একটা খারাপ নয়। গালিব তাই করবে। ফোন রাখতেই তার বাসার কলিং বেল বেজে ওঠে।

গালিব দরজা খুলে দেখে তার খবর দেওয়া দুজন সহকর্মী চলে এসেছে। একজনের সাথে ক্যামেরা আছে। এমনসময় সামনের বাসায় প্রচন্ড চেঁ°চামে°চি শুরু হয়। তিনজনে বেরিয়ে যায়। গালিব বেশ ভালো করেই দরজায় তালা দিয়ে যায়। একটা নয়, দুটো নয়, তিনটা তালা দিয়েছে। ঘরের বাকি দরজা জানলা আগে থেকেই বন্ধ করা। এক কথায় পুরো বাসা সিল করে দিয়েছে।

সামনের বাসার গ্যারেজে আ°গুন লেগেছে। সেটা নেভানোর জন্যই লোক জড়ো হয়েছে আর শোরগোলের উৎস এটাই। ওরাও আ°গুন না নেভানো পর্যন্ত সেখানে থাকে।

তারপর বাসায় ফিরে এসে ওরা অবাক হয়। তিনটা তালা ভা°ঙা, ভেতরে জামিল নেই। জামিল যতদিন বাসায় ছিল, বাসায় এভাবেই তালা দিয়ে অফিসে যেতো গালিব। কোনোদিন কোন সমস্যা হয়নি। তবে আজ কেন?

গালিবের বুঝতে বাকি থাকে না সামনের ঐ আ°গুন পরিকল্পিত। শুধুমাত্র ওদেরকে বাসা থেকে বের করে নেওয়ার জন্য এটা একটা শান্ত মস্তিষ্কের পরিকল্পনা।

“গালিব, ইউ ফুল।”
রাগে নিজেকেই গা°লাগা°লি করছে সে।

এদিকে জামিলকে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছে শাফিন। জামিল শাফিনকে বলে,
“অনেক ধন্যবাদ। ওরা আমাকে যে পরিমাণ মা°রছিল, তাকে আমি ম°রেই যেতাম।”

নিজের চোখ ইশারা করে জামিল বলে,
“এই যে দেখো আহনাফ কি করেছে? আমার চোখটাকে সারা জীবনের মতো অ°ন্ধ করে দিয়েছে।”

শাফিন শান্তভাবে ওর কথা শুনে বলে,
“কিছু বলে দাও নি ওকে?”
“আরে না, তেমন কিছুই বলিনি।”
হাত নেড়ে জবাব দেয় জামিল।

শাফিন ওকে বলে,
“ঠিক আছে, তবে এখন কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকো।”

জামিল কৃতজ্ঞতা দেখিয়ে শাফিনকে জড়িয়ে ধরে,
“সত্যি তোমার এই ঋণ আমি কোনোদিনও শোধ করতে পারবো না।”

সুযোগটা শাফিন হাতছাড়া করতে চায়নি। ধা°রা°লো ছু°ড়ি জামিলের ঘাড়ে ঢুকিয়ে দেয়, তারপর একই স্থানে ঘুরাতে থাকে। জামিল চিৎকার করে উঠলে, শাফিন তাকে ধা°ক্কা দিয়ে সরিয়ে সেই ছু°ড়িটাই আবার তার গলায় ঢুকিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ ছটফট করে শান্ত হয় জামিল। আবারো নড়ে ওঠে। গলা দিয়ে একটা চিকন শব্দের সাথে কিছু পরিমাণ র°ক্ত মুখ ও কা°টাস্থান দিয়ে বের হয়ে আসে।

শাফিন ছু°ড়িটা ফেলে হেসে বলল,
“নিজেকে বাঁচাতে বন্ধুকে মা°রাও অপরাধ নয়। সুতরাং আমি কোনো অপরাধ করিনি।”
______________________________________

দুপুর তিনটা বাজে গালিবের বাসায় এসে সবকিছু শুনে আহনাফ প্রচন্ড রেগে যায়। বেশ উচ্চস্বরে গালিবকে বলে,
“এতোটা বোকা আর কেয়ারলেস কেন আপনারা? ঠিক যে কারণে আমি ওকে আমার বাসায় রাখিনি, সেই ভুলটাই আপনারা করেছেন। আমি আপনাকে বলেছি ওকে বাঁচাতে কেউ আসতে পারে, আমার কথা কি বুঝেননি?”

নিজের বোকামির জন্য নিজেই অনুতপ্ত গালিব। সে এতটা কখনোই ভাবেনি। প্রতিদিন যে অবস্থায় জামিলকে বাসায় রেখে যায়, সে অবস্থায় রেখেছিল। সে কি করে জানবে সামনের ওই ঘটনা পরিকল্পিত?

“আপনাকে সিআইডি অফিসার বানিয়েছে কে? মাথায় গোবর নিয়ে এত উচ্চপদে কিভাবে এসেছেন? লজ্জা থাকলে পদত্যাগ করা উচিত।”

কথা শেষ করে আহনাফ চুপচাপ বের হয়ে যায়। গালিব সত্যিই অনুতপ্ত, মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে সে পদত্যাগ করবে এবং তারপর জামিলকে খুঁজে বের করবে। সাথে এটাও খুঁজে বের করবে জামিলকে পালাতে সাহায্য করেছে কে কে?

আহনাফ বাইরে এসে ইমতিয়াজকে কল করে সকল ঘটনা জানায়। ঘটনা শুনেই ইমতিয়াজ বেরিয়ে পরে আহনাফের সাথে দেখা করার জন্য। গালিব আর তার সহকর্মীরা এখনো কোনো একটা চিহ্নের আশায় হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। তবে কোনো চিহ্ন শাফিন রেখে যায়নি।
______________________________________

গত দুইদিন মৃত্তিকা বাসা থেকে কোথাও যায়নি, এমনকি অফিসেও না। নিজেকে সে ঘরব°ন্দী করে রেখেছে। কারণ ওর অনুমান যদি ভুল না হয়, তবে ইমতিয়াজ ওকে সন্দেহ করছে।

এ সন্দেহ দূর না হওয়া পর্যন্ত সে কোথাও যাবে না। ফাহাদ ভালো করে অপরূপার উপর নজর রাখছে এ বিষয়ে সে একশ শতাংশ নিশ্চিত। তাই ওদিকে চিন্তা খুব একটা তার নেই। তার সমস্ত চিন্তা ইমতিয়াজকে নিয়ে।

অবশেষে আজ বাসা থেকে বের হয়। ইমতিয়াজ আহনাফের সাথে দেখা করতে গেছে। এরচেয়ে বড় সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। দুপুরের সময় হওয়ায় রাস্তায় খুব একটা জ্যাম ছিল না, খুব সহজেই ধানমন্ডি চলে আসে মৃত্তিকা।

বাসায় এসে অপরূপাকে ফ্লোরে শুয়ে ঘুমাতে দেখে। ওর সামনে বসে ফোনে গেমস খেলছিলো ফাহাদ। মৃত্তিকাকে দেখে ফোন রেখে চটপট উঠে যায় দাঁড়ায় সে।

মৃত্তিকা তাকে বলে,
“অন্য রুমে যাও।”
“জি।”
বলে ফাহাদ চলে যায়।

একমগ পানি এনে অপরূপার মুখে ছুঁড়ে মা°রে মৃত্তিকা। হুড়মুড় করে উঠে বসে অপরূপা।
“কে? কে?”

মৃত্তিকা মগ ফেলে দিয়ে বলে,
“কেন হবে তোমার ভাগ্নি ছাড়া? (ব্য°ঙ্গ করে) মামানি।”

“ডোন্ট কল মামানি।”

অপরূপার কথায় মৃত্তিকা হাসে। বলে,
“বিয়ে করেছে মামাকে, তবে মামানি বলবো না? (একটু থেমে) বাই দ্যা ওয়ে, তুমি কে? তোমার পরিচয় কি?”

অপরূপা মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে থাকে। মৃত্তিকা ওর পরিচয় জানতে চাইছে। ও তো একটা পাখি, সুন্দর পাখি, যে সারাটা জীবন টাকার পেছনেই কা°টিয়ে দিয়েছে। নিজের এই রূপ, এই সৌন্দর্য, সবকিছু টাকার জন্য বিলিয়ে দিয়েছে।

“আমার পরিচয় গোপন রাখতেই আমি পছন্দ করি।”

মৃত্তিকা সি°গা°রেটের প্যাকেটটা বের করে সামনে রেখে বলল,
“দেখো, আমার কাছে কিছুই যে গোপন রাখতে পারবে না তা তুমি ইতিমধ্যে বুঝে গেছো। তবে কেন আবার গোপন করতে চাইছো?”

সি°গা°রেট দেখে শুকনো ঢোক গিলে অপরূপা। মৃত্তিকা আবারো হয়তো এগুলো জ্বা°লিয়ে ঘাড়ে, গলায় বা হাতে য°ন্ত্র°ণা দিবে।

“আমি বলবো। তবে আগে একটু পানি দাও।”

মৃত্তিকা বলে,
“একটু আগেই পানি ছুড়ে মে°রেছিলাম। পারলে ওটাই চেটে চেটে খাও।”
“এত নি°ষ্ঠু°র কেন তুমি?”

মৃত্তিকা ফিক করে হেসে বলে,
“আমি নি°ষ্ঠু°র? আর তোমরা কি করেছ? ব°র্ব°রতার সর্বোচ্চ স্তরে চলে গিয়েছো। তোমাদের জন্য এটা কিছুই না। সুতরাং যা জানতে চাইছি, তা না বললে পানির পরিবর্তে আ°গুন পাবে।”

চলবে…..

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

পঞ্চাশৎ পর্ব (৫০ পর্ব)

“আমি একজন প্র°স্টি°টিউট ছিলাম। আমি ছোট থাকতেই আমার বাবা মায়ের ডি°ভো°র্স হয়ে গিয়েছিল। আমাকে কেউ সাথে নেয়নি। কাকার বাসায় ছিলাম আমি, ভালোই ছিলাম।”

অপরূপা একটু বিরতি নিয়ে আবারো বলা শুরু করে,
“ক্লাস নাইনে যখন প্রথমবার নাসির আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয় তখন আমি রাজি হয়ে যাই। তাকেও যে আমার খুব ভালো লাগতো। আমাদের পাশের বাসার ছেলে ছিল সে। একটু একটু করে আমরা কাছে আসতে থাকি, (একটু থেমে) শারিরীক সম্পর্ক হয়েছে বহুবার। (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) ইন্টার পরীক্ষার পর বিয়ের কথা বলে আমাকে বাসা থেকে বের করে আনে আর আমি তার সাথে এসে আমার জীবনকে শেষ করে দিই।”

মৃত্তিকা মনোযোগ দিয়ে শুনছে অপরূপার জীবনের গল্প। প্রত্যেকের জীবনে নিজস্ব একটা গল্প থাকে। এই গল্পের গভীরতার পরিসর শুধুমাত্র ব্যক্তি নিজেই বলতে পারে।

অপরূপা বলছে,
“সামান্য কিছু টাকার জন্য সে আমাকে বিক্রি করে দেয়। আমি হয়ে যাই একজন স°স্তা…”

কথার মাঝে হুট করে থেমে যায়। অপরূপার গলা চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। কিন্তু তার মায়াবী চোখদুটো স্থির, তাতে কোনো ভাষা নেই, কোনো কান্না নেই, দুঃখ নেই।

“আমার জীবন এভাবেই চলছিলো। ১৮ বছর থেকে ২৪ বছর বয়স পর্যন্ত ওই একটা বদ্ধ জায়গায় আমি কাটিয়েছি। কি বলো তোমরা তাকে? অন্ধ°কার°নগরী? অনেক মানুষ আমার কাছে এসেছে-গিয়েছে। একদিন তোমার মামা, শাফিন এসেছিল। তারপর থেকে সে ব্যতীত আর কেউ আমার কাছে আসেনি। পরিচয়ের কিছুদিন পরই সে আমাকে ওখান থেকে বের করে আনে এবং বিয়ে করে।”

অপরূপা থেমে যায়। মৃত্তিকার দিকে তাকায় সে। মৃত্তিকা এখনো বাকি কথা জানার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে। অপরূপা মুচকি হেসে বলে,
“এবারে কি কিছু পানি দেওয়া যাবে?”

মৃত্তিকা ওর দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়। অপরূপার হাত বাধা, হাতের দিকে ইশারা করলে মৃত্তিকা ওর মুখের সামনে পানি গ্লাস ধরে। মুখে না বললেও কার্যকলাপে বুঝিয়ে দেয় সে এখনো অপরূপাকে বিশ্বাস করে না এবং করবেও না।

পানি পান শেষে অপরূপা আবারও বলতে শুরু করে,
“ভেবেছিলাম হয়তো বন্দি দশা থেকে মুক্তি পাবো, কিন্তু আমি মুক্তি পাইনি। খোলা হাওয়ায় থেকেও আমি বন্দি ছিলাম। ঠিক যেভাবে যেভাবে শাফিন আমাকে চলতে বলেছিল, সেভাবেই চলেছে। কেন জানো? কারণ শাফিনের যে অর্থগুলো, তার লোভে পড়েছিলাম আমি। (একটু থেমে) তবে শাফিন কিন্তু আমাকে কম কিছু দেয়নি, বিলাসী জীবন পেয়েছি। এমন মূল্যবান কিছু নেই, যা আমার জীবনে পাইনি। দেলোয়ারা বা সুরভি এসব পায়নি। এজন্য শাফিনের সব কথা শুনেছি, তার সব কাজে আমি বিশ্বস্ত সহকারি ছিলাম।”

একটু সামনের দিকে ঝুঁকে বলে,
“বুঝে নিয়েছিলাম জীবনে ভালো থাকতে হলে শুধু টাকা লাগে, আর কিছু না।”

মৃত্তিকা বলে,
“একবারও মনে হয়নি ভুল করছো? জীবনে তুমি অনেক কষ্ট পেয়েছো, এটা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু তুমি যা করেছো, তা কি অ°ন্যায় ছিল না?”

অপরূপা ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। বলে,
“আমার জীবনে কোনো ইমতিয়াজ আসেনি।”

মৃত্তিকার মুখটা একটু চুপসে যায়। হ্যাঁ, ইমতিয়াজ এসেছে ওর জীবনে। ওকে অনেকটাই পাল্টে দিয়েছে সে। অগোছালো মৃত্তিকাকে গুছিয়েছে ইমতিয়াজ। অথচ আজ ইমতিয়াজকে লুকিয়েই এসব করছে সে। ভালোবাসার মানুষটার কোনো ক্ষতি যে সে চায় না।

এমন সময় অপরূপার ফোন বেজে উঠে। মৃত্তিকা ফোন হাতে নিয়ে দেখে শাফিনের নাম্বার। অপরূপাকে বলে,
“শাফিনকে বলবে তুমি মৃত্তিকার উপর নজর রাখছো।”

মৃত্তিকা কল রিসিভ করে, ফোনের স্পিকার অন করে দেয়। শাফিন বলে,
“জামিলকে মে°রে ফেলেছি। এখন তুমি কোথায় আছো?”

অপরূপা মৃত্তিকার দিকে তাকায়। মৃত্তিকা কথা বলতে ইশারা করলে, অপরূপা বলে,
“আমি সন্দেহজনক একজনের উপর নজর রাখছি।”
“কে?”
“ইমতিয়াজ।”

মৃত্তিকার হাসিটা বন্ধ হয়েছে। কল কে°টে ফোনটা ছুঁ°ড়ে ফেলে অপরূপার গলা চে°পে ধরে বলে,
“ইমতিয়াজের নাম কেন নিয়েছো?”

অপরূপা হো হো করে হেসে ওঠে বলে,
“এখন শাফিন তোমার ইমতিয়াজের পেছনে যাবে। তুমি ওখানে যাও, পারলে বাঁচাও তোমার ইমতিয়াজকে।”

অপরূপার নাকে মুখে এলোপা°থারি ঘু°ষি দিয়ে ওকে ফেলে দেয় মৃত্তিকা। উঠে দাঁড়িয়ে ফাহাদকে ডেকে বলে,
“আমি না বলা পর্যন্ত একে পানি পর্যন্ত দিবে না। বেশি বিরক্ত করলে গলায় আ°গুন ঢে°লে দিও।”

অপরূপার তাতে তেমন কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। সে শান্তভাবে বলে,
“আমি জীবনে সুখ পাইনি, কাউকে সুখ পেতেও দিবো না।”

মৃত্তিকা আর কিছু না বলে বের হয়ে আসে। রাগে সমস্ত শরীর তার জ্ব°লে পু°ড়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে এখনই অপরূপাকে শেষ করে দিতে। কিন্তু এডভোকেট বিথীর সমস্ত খবরাখবর না পেয়ে অপরূপাকে মেরে ফেলা বিশাল বড় বোকামি হবে, যা মৃত্তিকা চায় না।

নিজের ভিতরের হিং°সা থেকে অপরূপা শাফিনকে সাহায্য করেছে। এ তো এখন দিনের আলোর মতো সত্য। হিং°সা কতটা যে ভয়াবহ তা তো আর বলার দরকার নেই। ওর হিংসার আ°গুনে এ পর্যন্ত বহু মানুষ জ্ব°লেছে আর না জ্ব°লুক।

গাড়িতে বসে মৃত্তিকার মনে একটাই কোরআনের আয়াত ঘুরপাক খাচ্ছে- ‘আর (আমি আশ্রয় চাই) হিং°সু°কের অ°নিষ্ট থেকে, যখন সে হিং°সা করে।’ (সূরা ফালাক-৫)
______________________________________

“ঐশী, আমি রাতারাতই ফিরে আসবো। চিন্তা করো না তুমি।”
“চিন্তা কি আর করতে চাই? এতো তাড়াহুড়োর মধ্যে ঢাকা গেলেন, আবার কিছু বলেও তো গেলেন না। আমি..”

সারাহ্-র কথার মাঝে আহনাফ হেসে উঠে বলে,
“জামিলের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম।”
“কি বলেছে?”
সারাহ্-র কন্ঠ কেঁপে ওঠে।

আহনাফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“দেখা পাইনি, সে পালিয়েছে।”
“পালিয়েছে? কিভাবে পালাতে পারে?”
“দেখো ঐশী, কারণ এখানে অনেক লম্বা। ফোনে বলা যাবে না, আমি বাসায় এসে জানাবো।”

সারাহ্ ঢোক গিলে বলল,
“আচ্ছা, সাবধানে থাকবেন। জামিলের কথা শুনে আমার আরো বেশি চিন্তা হচ্ছে।”
“কিছু না এসব। আমাদের সাদাব-সাইদার কথা ভাবো।”

সারাহ্-র কন্ঠ আরো ক্ষী°ণ হয়,
“প্লিজ, তাড়াতাড়ি আসবেন।”
“আচ্ছা, এখন রাখছি।”

ফোন রেখে আহনাফ ঘড়িতে দেখে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা বেজে গেছে। ইমতিয়াজের সাথে কথা বলতে বলতে সময় কে°টেছে। ওর সমস্ত ঘটনাই বিস্তারিতভাবে ইমতিয়াজকে জানানো হয়েছে। তবে ইমতিয়াজ নিজের সন্দেহ বা মৃত্তিকার অদ্ভুত আচরণ সম্পর্কে কিছুই জানায়নি।

“আমার বাসা খুব কাছেই, বাসায় আসো।”

ইমতিয়াজের কথায় আহনাফ মৃদু হেসে বলে,
“না, এখন বাসায় গেলে দেরি হবে। এমনিতেও ঐশী চিন্তা করছে।”

ইমতিয়াজও হেসে বলে,
“আচ্ছা, ঠিক আছে। সময় করে একদিন বাসায় এসো।”
“ইনশাল্লাহ।”

দুজনের বিদায় পর্ব শেষে চলে আসতে নিলে ইমতিয়াজের পেছন থেকে মৃত্তিকার কন্ঠ পাওয়া যায়,
“ইমতিয়াজ দাঁড়ান।”

চমকে উঠে ফিরে দাঁড়ায় ইমতিয়াজ। মৃত্তিকা দৌড়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে। হঠাৎ এমন ঘটনায় ইমতিয়াজ একটু বি°ব্রত হয়। আহনাফ কারো ডাক শুনে ফিরে দাঁড়ায়। মৃত্তিকাকে দেখে মুচকি হেসে সে আবারো নিজের রাস্তায় রওনা দেয়।

একহাতে মৃত্তিকা কে আগলে নিয়ে ইমতিয়াজ বলল,
“এখানে কি করছো?”

মৃত্তিকা জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। অপরূপার ওই কথাগুলো এখনো তার কানে বাজছে। শাফিন যে ইমতিয়াজের পিছু নেবে।

“মৃত্তিকা, এটা রাস্তা। ছাড়ো, মানুষ আমাদের দেখছে।”

মৃত্তিকা তবুও শোনে না, বরং দুহাতের বাঁধন আরো শক্ত করে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইমতিয়াজ ওকে জোর করেই দূরে সরায়।

রিকশা করে দুজনে বাসায় আসে। বাসায় এনেই মৃত্তিকাকে এক ধ°মক দেয় ইমতিয়াজ,
“বাইরে কি করছিলে তুমি? তুমি কি করো, কোথায় যাও, কিছু তো আমাকে জানাও না, জানানোর প্রয়োজনও মনে করো না।”

মৃত্তিকা মাথায় নিচু করে আড়চোখে ইমতিয়াজের দিকে তাকায়।

“এভাবে তাকিয়ে লাভ নেই তো। (একটু থেমে) তুমি সি°গা°রেট খাও?”

মৃত্তিকা বুঝতে পারে সি°গা°রেট কেনার বিষয়টা ইমতিয়াজ দেখেছে, আর সে কারণে ওকে সন্দেহ করছে। মৃত্তিকা হার মানার পাত্রী না। সে একটা নিরীহ চেহারা করে ইমতিয়াজের দিকে এগিয়ে যায়।

ইমতিয়াজের দুগালে হাত দিয়ে নিজের ওষ্ঠজোড়া ইমতিয়াজের ওষ্ঠে স্পর্শ করিয়ে বলে,
“কোনো গন্ধ আসছে? আসছে না, তবে কেন সি°গা°রেট খাওয়ার কথা বলেছেন? অন্যকারণেও কিনতে পারি।”

ইমতিয়াজ ওকে কোলে তুলে বলল,
“কি এমন কারণ যে সি°গা°রেট কিনতে হবে।”

মৃত্তিকা ওর গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
“যে জিনিস মামকে পু°ড়িয়েছে তা আমি মনের খুশিতে ক্রয় করিনি।”

ইমতিয়াজ ওকে আর তেমন কোনো প্রশ্ন করে না। মৃত্তিকা দুহাতে শক্ত করে ওকে জড়িয়ে ধরে৷ মৃত্তিকা যে কিছু লুকাচ্ছে তা স্পষ্ট। এভাবে প্রশ্ন করে বা ধ°মক দিয়ে ওর থেকে কথা বের করা যাবে না।
______________________________________

সাতদিন পর জামিলের ম°র°দেহ উদ্ধার করে গালিব ও তার টিম। আহনাফের ছোট ফুপ্পি আম্বিয়া আর তার ফুপাতো ভাই দেহ গ্রহণ করেছে।

খুব নি°ষ্ঠু°রভাবে খু°ন করা হয়েছে তাকে। দেহেও তাই প°চন ধরে গেছে, দেহের অনেক অংশ খুইয়ে খুইয়ে পড়ছে। মাংসগুলো কালো হয়ে তী°ব্র গ°ন্ধ বের হচ্ছে। বেঁচে থাকতে যে কু°কর্ম সে করেছে, তার প্রত্যেকটা হিসাব কেয়া°মতে হবে। কিন্তু কিছু শা°স্তি মৃ°ত্যুর সময় সে পেয়ে গেছে।

আহনাফ ঢাকায় আসেনি, তবে খবর সে পেয়েছে। ইমতিয়াজ খবর পেয়ে লা°শ দেখতে গিয়েছিল, তবে ভ°য়া°বহতা বেশি থাকায় সবাইকে দেহের কাছে আসতে দিচ্ছে না।

গালিবকে জবাব দিতে হবে, জবাবদিহিতা না দেওয়া পর্যন্ত ডিপার্টমেন্ট থেকে আর কোন কেস তাকে দেয়া হবে না।

ক্লাস শেষ করে সারাহ্ টিচার্স রুমে চলে এসেছে। সপ্তাহে এখন ওর একটা বা দুইটা ক্লাস থাকে। বেশিরভাগ দিন কলেজে না আসলেও তার চলে, আর আসলেও বসে বসে দিন যায়। এই কাজ আহনাফের, সরকারিভাবে এত তাড়াতাড়ি ছুটি পাবে না বলে প্রিন্সিপালকে অনুরোধ করে ক্লাস রুটিন বদলে দিয়েছে।

আব্বাস সাহেব ওকে কল করে। সারাহ্ রিসিভ করে,
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম, তুমি কি কোন খবর পেয়েছো?”

সারাহ্ কপাল কুঁচকে বলে,
“কি খবর বাবা?”
“জামিল মা°রা গেছে।”

সারাহ্ ভ°য় পেয়ে আশেপাশে তাকায়। নিচুসুরে বলে,
“কিভাবে?”
“কেউ মে°রে ফেলেছে। ভ°য়ং°কর খু°ন, আর বুঝতেই তো পারছ এ কাজ শাফিনের।”
“কথায় বলে না, যার জন্য চু°রি করি সেই বলে চো°র। উনার অবস্থা তাই হয়েছে।”

আব্বাসের মাথা নেড়ে বলল,
“তুমি কি এখন বাসায় আসবে না আহনাফের সাথে একবারে আসবে?”
“কিছুক্ষণ পরে চলে আসবো।”
“একা বের হয়ো না, আমি গিয়ে তোমাকে নিয়ে আসবো।”

সারাহ্ জানে এখানে রাজি না হয়ে আর কোন উপায় নেই। তাই সে রাজি হয়ে যায়।

আব্বাস সাহেব আসলে সারাহ্ কলেজ থেকে বের হওয়ার সময় রাস্তার অপরপাশে ডাক্তার আরিফাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। এই ডাক্তার আরিফার উপর তার প্রচুর সন্দেহ। সেদিন উনি বলেছিলো তোমার মা কেমন আছে, সেদিন থেকেই সন্দেহ। এখন আবারও উনি এখানে দাঁড়িয়ে আছে, তারমানে ওর উপর নজর রাখতে এসেছে।

সারাহ্ দ্রুত অটোতে উঠে পড়ে। অটো চলতে শুরু করলে, আবারো মাথায় হেলিয়ে দেখে ডাক্তার আরিফা ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। একটু ঘাবড়ে গিয়ে ঢোক গিলে। তবে যেকোনো কিছুর জন্য সে নিজেকে প্রস্তুত রেখেছে। যেহেতু জামিলকে মা°রতে পেরেছে, সুতরাং ওদেরকে মা°রা শাফিনের পক্ষে কোনো ব্যাপারে না।
______________________________________

দুপুরের পর আবারো ধানমন্ডিতে আসে মৃত্তিকা। অফিসের জরুরী মিটিং-এ ইমতিয়াজ ব্যস্ত আছে।

গত কয়েকদিন ধরে অপরূপার কাছ থেকে মা°দ°ক এক প্রকার দূরে রেখেছো মৃত্তিকা। ওকে খেতে দিচ্ছে না, কিন্তু ওর সামনে ঝুলিয়ে রেখেছে। মানসিক অত্যাচার যাকে বলে, তাই করছে সে।

কারণ একটাই এডভোকেট বিথীর ঠিকানা জানতে চায়, আবার সাথে ডাক্তার আরিফার সম্পর্কেও জানতে চাচ্ছে।

অপরূপা ক্রমাগত ছটফট করলেও, সে মুখ খুলছে না। অপরূপা পণ করেছে সে মৃত্তিকাকে আর কিছুই বলবে না। মৃত্তিকার একই অ°ত্যা°চার সে সয়ে গেছে।

মৃত্তিকা এসে ওর সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
“আর কত সহ্য করবে এবার তো বলো।”

অপরূপা মাথা নাড়ে আর ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলে বলে,
“আমি কিছুই বলবো না। আমাকে মে°রে ফেললেও না।”

“মে°রে ফেললে কিভাবে বলবে?”
হাঁটুতে হাত দিয়ে নিচু হয়ে ওর দিকে ঝুঁ°কে কথাটা বলে মৃত্তিকা।

“আমি ভয় পাই না তোমাকে। আমি কিছুই বলবো না। তোমার যা করার তুমি করে নিতে পারো।”
চেঁ°চিয়ে চেঁ°চিয়ে কথাগুলো বলে অপরূপা।

“ফাইন।”
ভ্রূ উঁচিয়ে সোজা হয়ে এইটুকু বলে মৃত্তিকা ভিতরে রুমে চলে যায়। অপরূপাকে ভিন্ন কোনো শাস্তি দিতে হবে।

শাফিনের শোবার রুমে থাকা ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে বড় সুই ও মোটাসুতা নিয়ে বাইরে আসে। মৃত্তিকা অপরূপার সামনে বসে সুতা খুলে সুইয়ের মধ্যে গাঁথতে থাকে।

অপরূপা এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মৃত্তিকা ঠিক কি করতে চাইছে তা ও বুঝে উঠছে না।

মৃত্তিকা দাঁত দিয়ে সুতা ছিঁ°ড়ে সুতার রিলটা নিচে ফেলে বলে,
“তুমি যেহেতু কিছু বলবেই না, তবে তোমার মুখটা খোলা রেখে কি লাভ? সেলাই করে দেই। খুব সুন্দর একটা উপায়, তাই না?”

কথাটা বলেই একটা সুন্দর হাসি দেয় মৃত্তিকা। ওর চেহারায় একটা হিং°স্র রূপ চলে এসেছে।

মৃত্তিকা বলে,
“সবাই আমার শান্তর রূপটা দেখেছে, ইনোসেন্ট চেহারাটা দেখেছে। কিন্তু আমার দ্বিতীয় যে রূপটা আছে সেটা হাতেগোনা কয়েকজন দেখেছে, তুমি খুব লাকি।”

চলবে….

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

একপঞ্চাশৎ পর্ব (৫১ পর্ব)

অপরূপার মুখের সামনে সুই সুতা ঝুলিয়ে রেখে মৃত্তিকা বলে,
“জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্ট আজ তুমি পাবে৷ যে রূপের অ°হং°কার তোমার এতোদিন ছিল, তা শেষ করবো আমি।”

বড় সুইটা অপরূপার দুই ঠোঁটে ঢু°কিয়ে দিয়েছে মৃত্তিকা। অপরূপার ঠোঁট ক্রমাগত কাঁপছে, প্রচুর ভ°য় পেয়েছে। ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত পড়া শুরু করেছে। কিছুক্ষণ পর মৃত্তিকা আবারো সুইটা বের করে নেয়। অপরূপা হাফ ছেড়ে বাঁচে।

রান্নাঘর থেকে খুন্তি এনে তা অপরূপার মুখে ঢুকিয়ে জোর করে মুখ হা করায় মৃত্তিকা। তারপর ওর ডান গালে সুই ঢু°কিয়ে দিয়ে বলে,
“এভাবে হা করে থাকবে, মুখ বন্ধ করলে এই সুই তোমার জিহ্বা চি°ড়ে দেবে। না তুমি তোমার মুখ বন্ধ করতে পারবে, আর না তুমি তোমার জিহ্বা নাড়তে পারবে। আপাতত এটাই তোমার শা°স্তি। পরে তোমাকে পাকাপাকি কিছু একটা ভেবে দেখবো।”

অপরূপাকে ভ°য়ং°কর দেখা যাচ্ছে। কপালে ক্ষ°তের চিহ্ন, গালে সুই ঢু°কানো, ঠোঁটে ক্ষ°ত, গলায় পো°ড়া দাগ।

উঠে আসার সময় মৃত্তিকা বলে,
“ডাক্তার আরিফাকে কিভাবে খুঁজে বের করতে হবে তা আমি ভালো করে জানি। সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুলকে একটু বাঁকা করতে হয়।”

মৃত্তিকা বাইরে এসে দোকান থেকে অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ কিনে নেয়। তারপর এগুলো নিয়ে বাসায় চলে আসে।

ইমতিয়াজ এখনো অফিসে আছে। তাই এর মতো সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। মৃত্তিকা সবগুলো ওষুধ খুলে ব্লেন্ডারের গুঁড়ো করার জারে নিয়ে নেয়। সুন্দর মতো গুঁড়ো করে সবগুলোকে একটা বক্সে নেয়।

বক্সটা ব্যাগে ঢুকিয়ে নিজে নিজেই বলে,
“ডাক্তার আরিফা, তৈরি হয়ে যান।”
______________________________________

দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর সারাহ্ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। এখনো সে ডা. আরিফার এই চাহনির কথাই স্ম°রণ করছে। ওর মা ওকে যা যা বলেছে, তার অর্থ করলে এতো বছর পর শাফিন ওর পিছু নেওয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। শ°ত্রু°তার পরিসর আরো অনেক বড়, যা মা ওকে বলেনি নাকি তাহসিনার সাথে আহনাফের সম্পৃক্ততা থেকে সারাহ্-র পিছু করা?

“ঐশী?”

ডাক শুনে পিছন ফিরে আহনাফকে দেখে মুচকি হাসে সারাহ্। তারপর বলে,
“আজ বোধহয় একটু দেরি হয়েছে।”

আহনাফ মাথা নেড়ে বলল,
“হ্যাঁ, একটু দেরি হয়েছে।”

সারাহ্ হুট করে আবারো চুপ হয়ে যায়। আহনাফ বলে,
“তুমি কি কোনো বিষয় চিন্তিত?”

সারাহ্ বোধহয় ওর কথা শুনেনি। সে এক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আহনাফ এসে ওর পাশে দাঁড়ায়। আলতো করে ডাকে,
“ঐশী।”

সারাহ্ চমকে উঠে বলল,
“জি।”
“কি চিন্তা করছো?”

সারাহ্ আবারো আকাশের দিকে তাকিয়ে দুহাতে বারান্দার রেলিং ধরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“মা আমাদের সাথে মিথ্যা বলছে নাকি অন্য কারণে শাফিন আমার পিছু করছে? বুঝতে পারছি না আমি।”

“তুমি কি করে বলছো যে মা মিথ্যা বলেছে?”

“আজ ডাক্তার আরিফাকে দেখেছিলাম। রাস্তায়, এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল।”

আহনাফ কপাল কুঁচকে বলল,
“ডাক্তার আরিফা কে?”

সারাহ্ ওর দিকে তাকায়। একটু অবাক হয়ে বলে,
“আপনি চেনেন না? কলেজে এসেছিল যে সাইক্রিয়াটিস্ট আরিফা।”

আহনাফ একটু ভেবে বলে,
“সে তো অনেক আগে।”
“হ্যাঁ, সেদিন উনি সেশনের মাঝখানে আমাকে বলেছিল আপনার মা কেমন আছেন, আবার উনি আমাদের বেবির কথা জানতেন।”

আহনাফ চিন্তায় পড়ে যায়। এখন তো জামিলও নেই যে জানতে পারবে ডাক্তার আরিফা আসলে কে? নিজের চিন্তা গোপন করে সারাহ্-কে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলে,
“ভ°য় পেয়ো না, আমি আছি তো।”

সারাহ্ ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“এজন্যই তো আমি এখনো নিশ্বাস নিতে পারছি।”

আহনাফও দুহাতে ওকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“ধন্যবাদ, এতোটা বিশ্বাস করার জন্য।”

কিছুক্ষণ চুপ থেকে সারাহ্ বলে,
“আমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাবেন?”
“কোথায়?”
“রোমি আন্টির বাসায়।”
“রোমি আন্টি?”
“হু, ঢাকায় থাকেন। নিয়ে যাবেন?”
“আচ্ছা, কয়েকদিন পর।”
______________________________________

সন্ধ্যায় মৃত্তিকা মমতাজ বেগমের সাথে দেখা করতে তানজিমদের বাসায় এসেছে। তানজিম বা লুৎফর রহমান কেউই বাসায় নেই।

অনেকক্ষণ দুজনে বসে গল্প করে। নানা বিষয় নিয়ে কথাবার্তা হয় দুজনের মাঝে, তবে মৃত্তিকার কথা বেশ ধা°রালো লাগলো মমতাজ বেগমের।

কথার মাঝে মৃত্তিকা হঠাৎ করে বলল,
“চা বানিয়ে আনবো? চা খাবে বড়মণি?”
“হ্যাঁ, আনো।”

মৃত্তিকা উঠে যায়। চটপট দুইকাপ চা বানিয়ে মমতাজ বেগমের কাপে ঘুমের ওষুধের গুড়া মিশিয়ে দিয়ে নিজে নিজেই বলে,
“শুধু কি সাইক্রিয়াটিস্ট হলেই সাইকোলজি সম্পর্কে জ্ঞান থাকে?”

চা নিয়ে মমতাজ বেগমকে দিয়ে বলে,
“বড়মণি, তোমার চা।”

মমতাজ বেগম হাসিমুখে চায়ের কাপ নিয়ে তাতে চুমুক দেয়।
“বেশ ভালো হয়েছে।”

মৃত্তিকা মুচকি হেসে নিজের কাপ নিয়ে বসে। মমতাজ বেগম একটু হায় হু°তাশ করে বলে,
“তাহমিনার সাথে ইমতিয়াজের বিয়ের সময় দেনমোহর নির্ধারণ করেছিল মাত্র এক লক্ষ টাকা আর তোমাকে দিলো চার লক্ষ টাকা। এজন্যই বলে পুরুষ মানুষ রঙ বদলায়।”

মৃত্তিকা আড়চোখে তাকায় উনার দিকে৷ উনি ঠিক কি বোঝালো তা নিয়ে ওর সন্দেহ আছে।

মৃত্তিকা একটা ঢোক গিলে বলে,
“আমি এতো টাকা নেই নাই।”
“সে তোমার ইচ্ছা, কিন্তু নির্ধারণ তো হয়েছে। (একটু থেমে) তবে তাহমিনার সাথে ওর যে সম্পর্ক ছিল সেটা তোমার সাথে হবে না।”

মৃত্তিকা এবারে একটু রেগে যায়। তবুও নিজেকে শান্ত রেখে বলল,
“বড়মণি, সম্পর্ক যা আছে আলহামদুলিল্লাহ।”

মমতাজ বেগম এক ঢোক চা গিলে বলে,
“হ্যাঁ আলহামদুলিল্লাহ তো হবে। তবে ওই বলে না যে প্রথম সে প্রথমেই থাকে, ওই প্রেম আর কারো নয়।”
“মানে?”

মমতাজ বেগম হেসে বলল,
“রিপা থাকলে কথাটা বুঝিয়ে দিতো। আমি তো আর বোঝাতে পারবো না। তবে সত্যি বলতে, রিপা থাকলে ইমতিয়াজের সাথে তোমার বিয়েও হতো না।”
“হ্যাঁ, কারণ তখন তাহমিনা থাকতো।”

মমতাজ বেগম চায়ে চুমুক দিতে নিয়েও দিলেন না। মৃত্তিকার মুখের দিকে তাকালেন উনি। মৃত্তিকা নির্বিকার হয়ে আছে।

মমতাজ বেগম কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারো বলেন,
“তোমার মনে হয় ইমতিয়াজ তোমাকে তাহমিনার স্থান দিবে?”
“চাই না তো ওই স্থান।”

মমতাজ বেগমের কাছে এসে মৃত্তিকা বলে,
“তুমি কি আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) ও খাদিজা (রা.) এর ঘটনা শুনোনি? তারপর হযরত মুহাম্মদ (স.) ও আয়েশা (রা.) এর মিষ্টি সম্পর্কের ব্যাপারে জানো না?”
“সবাই কি মহামানব?”
“না, তবে আমাদের নবীজি (স.) তো আমাদের আদর্শ। আর তাছাড়া এসবের উপরের আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।”

কাপ হাতে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মৃত্তিকা বলে,
“যদিও মনুষ্য সমাজ এটা বুঝে, পশু সমাজ নয়৷ পশুকে তো আর ধর্মের কথা বোঝানো যাবে না। হালাল-হা°রা°মের পার্থক্য কি আর পশু বুঝবে? যেমন দুলাল, শাফিনসহ আরো অনেকে।”

মৃত্তিকা হনহনিয়ে চলে যায়। পরোক্ষভাবে সে মমতাজ বেগমকেও পশু বলে গেছে। চা খাওয়ার পর থেকে ঘনঘন হাই তুলছে মমতাজ বেগম। তবে ওষুধের পরিমান কম থাকায় উনি ঘুমান না। উনি ধরে নেন, সারাদিনের ক্লান্তিতে বোধহয় ঘুম পাচ্ছে।

মৃত্তিকা উনাকে হাই তুলতে দেখে মুখ বাঁ°কিয়ে আলতো হাসে। সবকিছু নিয়ে চিন্তা করতে ওর মস্তিষ্ক বাধ্য নয়। ও বাধ্য করবেও না। চিন্তামুক্ত থাকলেই তো এদেরকে শা°স্তি দিতে পারবে।
______________________________________

দুইদিন পর, সকাল সকাল ঢাকায় এসেছে আহনাফ-সারাহ্। রোমি খন্দকারের সাথে দেখা করতে এসেছে। উনার বাসার ঠিকানা সারাহ্ জানে।

দরজা খুলে রোমি খন্দকার অবাক হন। তবুও মুচকি হেসে বলেন,
“ভিতরে আসো।”

সারাহ্ ভিতরে আসতে আসতে বলে,
“আসসালামু আলাইকুম আন্টি।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কেমন আছো সারাহ্?”
“আলহামদুলিল্লাহ, ভালো।”

সোফার দিকে ইশারা করে বলল,
“বসো তোমরা। (আহনাফকে বলে) তুমি কেমন আছো?”
“জি, ভালো আছি।”

সারাহ্ গলা ঝে°রে বলল,
“আন্টি, আসলে আমরা একটা কথা জানার জন্য এসেছি?”

রোমি খন্দকার কপাল কুঁচকে বলল,
“কি কথা? তাও আমার কাছে?”
“জি, কারণ ঘটনার সাথে আপনি জড়িত।”
“কোন ঘটনা?”

সারাহ্ একবার আহনাফের দিকে তাকায়, তারপর বলে,
“শাফিনকে চেনেন?”

রোমি খন্দকারের মুখের হাসিটা যেন মলিন হয়ে গেল। শাফিনের নাম শুনতেই ওনার চোখ দুটো চঞ্চল হয়। কি যেন এক ভাবনা-চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়েন।

সারাহ্ বুঝতে পারে, ঘটনা এখানে অনেক কিছু আছে। কথায় একটু জোর এনেই বলে,
“আন্টি, চেনেন আপনি শাফিনকে?”

জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে রোমি খন্দকার বলেন,
“সে অনেক আগের ঘটনা। এখন কেন জানতে চাইছো?”
“তারমানে আপনি চেনেন?”
“হ্যাঁ, চিনি।”

আহনাফ হাতের ইশারায় সারাহ্-কে চুপ থাকতে বলে। নিজে উঠে দাঁড়িয়ে দুহাত পিছনে নিয়ে বলে,
“শাফিনের সাথে আপনার আর ঐশীর মায়ের কি শ°ত্রু°তা?”

রোমি খন্দকার জানেন না ওরা কতটুকু জানে। তাই উনি বানিয়ে বানিয়ে মি°থ্যা আগডুম বাগডুম শোনানোর চেষ্টা করে। আহনাফ এতে বেশ অনেকটা রেগে যায়।

বয়সে বড়, প্রায় মায়ের সমবয়সী একজন মানুষ, তাই নিতান্তই ভদ্রতা বজায় রাখতে শান্ত মেজাজে আহনাফ বলে,
“আপনি মিথ্যা বলছেন।”

সারাহ্ পাশ থেকে বলল,
“মা আমাকে দুটো খু°নের কথা বলেছে। শাফিনের একটা বড় প্রবলেম আছে, সে প্রেগন্যান্ট মেয়েদের সাথে কি রকম বিহেভ করে তা আপনি জানেন। এইটুকু পর্যন্ত, শুধুমাত্র এইটুকু পর্যন্তই আমরা জানি। আরেকটা যেটা জানি, তা হলো রাহা সুলতানার ঘটনা। (একটু থেমে) তবে এতো পুরনো ছোট ছোট ঘটনার রেশ ধরে, আজ এত বছর পর আমার আর আমার সিস্টারের উপর কারো নজর পড়তে পারে। এটা আমি বিশ্বাস করতে পারি না।”

সারাহ্ বেশ শান্তভাবে, স্পষ্ট ভাষায় কথা বললেও ওর কথায় বেশ জোর ছিল। রোমি খন্দকার একটু চুপ হয়ে যায়।

কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর রোমি খন্দকার বলেন,
“তুমি ঠিক ধরেছো, সারাহ্। তোমাদের কাছে যেটা এইটুকু ঘটনা, সেটা আমাদের কাছে অনেক বড় কিছু ছিল। তবে এরজন্য শাফিন তোমার পিছু করেনি, কারণ ভিন্ন। ও তোমাদের কাজে লাগিয়ে নার্গিসকে দুর্বল করে নিজের প্রতি°শোধ নিতে চাচ্ছে। (একটু থেমে) আর আমার মেয়েকে তো অনেক আগেই মে°রে ফেলেছে, ছেলেকেও সারাজীবনের মতো প°ঙ্গু করে দিয়েছে। আমার ছেলের একটা পা নেই, শাফিনই এটা করেছে।”

“কিন্তু কেন?”
হুট করে প্রশ্ন করে বসে আহনাফ।

রোমি খন্দকার নিজের চশমা চোখে দিয়ে নিজের শোবার রুমে চলে যায়। আলমারি খুলে একটা ফাইল নিয়ে আসে। ওদের সামনে ফাইলটা রেখে বলে,
“তোমরা ভেবেছো শাফিন আজকাল থেকে এরকম। কিন্তু না, অনেক আগে থেকে ও এরকম কাজ করে আসছে। নিজের কুকর্মের প্রমাণ লো°পাটের জন্য, নিজের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুকে মে°রে ফেলেছিল। ওর অনেক কাজের সাক্ষী আমি আর প্রমাণ এই ফাইলে আছে।”

আহনাফ-সারাহ্ একে অপরের মুখের দিকে তাকায়। আহনাফ বলে,
“প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও চুপ করে বসে আছেন কেন?”

“কারণ মুখ খুলেও কোনো লাভ নেই। তাই বলে খুলিনি ব্যাপারটা তা নয়। শাফিন জে°লেও গিয়েছিল, তবে ছাড়া পেয়ে গেছিলো। (একটু থেমে) কিন্তু শাফিন তো মা°রা গেছে, ফাঁ°সি হয়ে ওর।”
“শাফিন বেঁচে আছে, কবর দেয়ার পরও সে বেঁচে বেরিয়েছে। এসবের কোনো রিপোর্ট হয়নি আর হয়েও কিছুই হবে না।”

দাঁড়ানো থেকে সোজা বসে যায় রোমি খন্দকার। বুকে হাত দিয়ে বলে,
“কবরও তাকে আ°টকাতে পারেনি।”
______________________________________

গত কয়েকদিন ধরেই অপরূপার প্রতি মায়া হচ্ছে ফাহাদের। হওয়াটা স্বাভাবিক, মুখে একটা সুই ঢু°কানো। খাবার খাওয়ানো যাবে না, মৃত্তিকার কড়া হুকুম। ড্রপার দিয়ে অল্প অল্প করে পানি দেয় ফাহাদ। মেয়েটা থেমে থেমে ছটফট করে।

এখন আবারো পানি খাওয়াচ্ছে সে। অপরূপার চোখের দিকে তাকায় সে। একটা আলাদা মায়া আছে, বড়বড় চোখ দুটো হরিণীর মতো। সুন্দর গড়নের শরীর, কালো চোখের মণি পানিতে ঝলমল করছে।

ফাহাদ সুইয়ে হাত দিয়ে আবারো হাত সরিয়ে নেয়। ভ°য় হচ্ছে তার, যদি সুই খুলতে গিয়ে র°ক্ত°পাত শুরু হয়।

অপরূপার ঘন ঘন আন্দোলিত হওয়া চোখের পাপড়ি দেখে ফাহাদের আবারো মায়া বাড়ে। আলতো করে বাম গালে হাত ছোঁয়ায় সে। দুজনের চোখ একে অপরকে দেখছে।

টিস্যু দিয়ে ধরে এক টা°নে সুই খুলে ফেলে ফাহাদ। অপরূপা জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,
“একটু হাত খুলে দাও, আমার প্রচুর য°ন্ত্র°ণা হচ্ছে।”

ওর কথায় ভিন্ন একটা জাদু আছে। নরম কন্ঠ, ঘন নিঃশ্বাস, যেন এক ঘোর লাগা বিষয়। ফাহাদ ওর হাত খুলে দেয়। অপরূপা দুহাত সামনে এনে কয়েকবার মুষ্টিবদ্ধ করে হাতকে স্বাভাবিক করে।

খোলা চুলগুলো খোঁপা করে নিয়ে ধা°ক্কা দেয় ফাহাদকে। ফাহাদ একটু দূরে গিয়ে পড়ে বলে,
“এই কি করছো?”

“যা আমার কাজ।”
অপরূপা উঠে এসে কাঁচের টি টেবিলটা ফাহাদের উপর ফেলে। ফাহাদ গড়িয়ে সরে গেলেও কাঁচের কয়েকটি টুকরা তার পিঠে ঢুকে যায়। ব্য°থায় অ°স্ফুটস্বরে কিছু শব্দ করে সে। তবুও ফাহাদ উঠে দাঁড়ায়।

সোফায় থাকা ড্রা°গের প্যাকেট এনে মুখ দিয়ে ছিঁ°ড়ে অপরূপা। একমুঠো ফাহাদের নাকে মুখে জোর করে ঢুকিয়ে দেয়, নে°শায় একপ্রকার বুদ হয়ে থাকে ফাহাদ। ওর গাল চেটে কিছুটা ড্রা°গ অপরূপা নিজে খায়।

“এবার মৃত্তিকা বুঝবে, এই অপরূপা কি করতে পারে? (একটু থেমে) মৃত্তিকার জা°হা°ন্নাম আমি দেখেছি, এবার আমার জা°হা°ন্নাম মৃত্তিকা দেখবে।”

চলবে…..

অনুভূতিরা শব্দহীন পর্ব-৪৬+৪৭+৪৮

0

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

ষট্ চত্বারিংশ পর্ব (৪৬ পর্ব)

অপরূপার পিছু পিছু যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত আসে মৃত্তিকা। এখানে অপরূপা গাড়ি থেকে নামে, দুজন লোকের সাথে কিছু একটা নিয়ে কথা হয় এবং তাদেরকে একটা ব্যাগ দেয়৷ সবকিছুই ফোনে ভিডিও করে মৃত্তিকা।

এ সুযোগে মৃত্তিকা নেমে ভাড়া মিটিয়ে একটা সিএনজি নিয়ে নেয়। একই গাড়ি বেশিক্ষণ পিছনে দেখলে সন্দেহ হতেই পারে।

অপরূপা এবারে একটা গলির ভিতর যায়। মৃত্তিকাও সিএনজি নিয়ে পিছু নেয়। কিছুক্ষণ পর সিএনজি ছেড়ে দিয়ে হেঁটে পিছু নেয়া শুরু করে। সরু গলি এবং খানাখন্দে ভর্তি রাস্তা হওয়ায় গাড়ি খুব ধীরে চলছে।

মৃত্তিকার পিছু নিতে খুব একটা কষ্ট হলো না। বেশ কিছুক্ষণ হেঁটে গিয়ে একটা বাসার সামনে গাড়িটা থামে। মৃত্তিকা কয়েক বিল্ডিং পরে একটা বাসার গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে দেখে৷

অপরূপা ভিতরে চলে যায় আর ড্রাইভার গাড়িতেই থাকে। তারমানে অপরূপা আবারো বের হবে। আধঘন্টার মতো একই জায়গায় থাকে মৃত্তিকা, কিন্তু অপরূপার দেখা পায় না।

ফোনের কম্পন অনুভব করে চমকে উঠে মৃত্তিকা। ফোন বের করে ইমতিয়াজের নাম্বার দেখেও রিসিভ করে না। বাসায় গিয়েছে কিনা সেটা জানতেই বোধহয় কল করছে৷ একসময় কল কে°টে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই ফোন সুইচ অফ করে দেয় সে।

“চলো, এখন সোজা বাসায় যাবো।”

অপরূপার কন্ঠ শুনে মৃত্তিকা ফোন থেকে চোখ সরিয়ে সেদিকে তাকায়। অপরূপা আবারো গাড়িতে উঠে পড়েছে। সে চলে গেলে মৃত্তিকা ভিতরে যায়।

দোতলা বাড়ির নিচতলা সম্পূর্ণ অন্ধকার। বাড়িটা হয়তো এখনো নির্মাণাধীন, বাইরের ইটের স্তুপ তো সে কথাই জানান দিচ্ছে। অন্ধকারে দেখতে অসুবিধা হওয়ায় ফোন অন করতে বের করার সময় একটা গো°ঙা°নির মতো শব্দ পায়। মৃত্তিকা চমকে উঠে, চোখ বড়বড় করে আশেপাশে তাকায়। এতোক্ষণে ওর চোখ অন্ধকারে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আবছাভাবে একটা দরজা দেখে সে।

সাবধানে হেঁটে দরজার কাছে গিয়ে কান পাতে। কেউ ভিতরে গো°ঙা°চ্ছে। যতটুকু বুঝলো কোনো মেয়ে হবে৷ দরজায় তালা দেয়া আছে। মৃত্তিকার শরীরে লেগে তালা নড়ে শব্দ হয়৷

সিঁড়ির উপর থেকে কেউ বলে উঠে,
“কে?”

পুরুষ কন্ঠ, মৃত্তিকা সরে যায়। বাইরে থেকে নিয়ে আসা ইটটা হাতে শক্ত করে ধরে। কম বয়সী একটা লোক নেমে আসে। লোকটা এসেই লাইট জ্বালায়। মৃত্তিকা ইটটা নিজের পিছনে লুকিয়ে ফেলে।

লোকটা মৃত্তিকার দিকে একটা ক°ড়া বাক্য ছুড়ে বলল,
“কি সমস্যা? কি চাই?”

মৃত্তিকা কিছু বলার আগেই দরজার ওপার থেকে “উম, উম” কিছু শব্দ ভেসে আসে৷ লোকটা ধম°কের সুরে বলল,
“ওই চুপ।”

মৃত্তিকার দিকে ফিরে ওর পা থেকে মাথা অব্দি দেখে বলল,
“ম্যাম বেশ খুশিই হবেন।”

মৃত্তিকাকে ধরতে আসলে ইটটা দিয়ে লোকটার মাথায় আ°ঘাত করে। মাথা কপাল কে°টে ফেঁটে র°ক্ত পড়া শুরু হয়। পকেট হাতড়ে চাবি পায় সে। দরজা খুলেই সে একদফা হতভম্ব হয়ে যায়।

চারজন অল্পবয়সী মেয়ে হাতপা, মুখ বাধা অবস্থায় পড়ে আছে৷ তাদের এলোমেলো অর্ধ পোশাক জানান দিচ্ছে তাদের সাথে কি হয়েছে। গলায়, ঘাড়ে, বাহুতে আঘাতের চিহ্ন। কপাল, ঠোঁট ফুলে লাল হয়ে আছে।

মৃত্তিকা তাড়াতাড়ি করে জানলার পর্দা খুলে এনে মেয়েগুলোকে ঢেকে দেয়। একে একে ওদের হাত-পা, মুখ খুলে।

মেয়েগুলো সদ্য চোখে দেখা বিড়াল ছানার মতো ভ°য়ে কুঁচকে যেতে থাকে। মৃত্তিকা দরজার দিকে তাকিয়ে ওদেরকে জিজ্ঞাসা করে,
“ওই মেয়েটা কে? একটু আগে যে এসেছিল?”

মেয়েগুলো একজন আরেকজনের দিকে তাকায়। একজন মিনমিনে কন্ঠে বলে,
“অপরূপা।”

মৃত্তিকার আর কিছু বোঝার দরকার নেই। অপরূপা এসেছিল, তার মানে এসবের পেছনেও শাফিন আর মমতাজ বেগমেরই হাত আছে। তানজিম তো ওকে অপরূপার নামই বলেছিল।

মৃত্তিকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“অপরূপা আজ আর আসবে?”
“জানা নেই, তবে কাল আসবে।”

মৃত্তিকা রশি নিয়ে বাইরে যায়৷ একটু আগের লোকটা মেঝেতে পড়ে আছে, তার হাতপা বেঁধে রেখে বলে,
“আর কেউ আছে এখানে?”
“আরেকজন থাকতে পারে।”

মৃত্তিকা আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখে না। ভিতরে এসে দেখে মেয়েগুলো এতোক্ষণে আশপাশ থেকে নিজেদের পোশাক নিয়ে পড়ে ফেলেছে।

মৃত্তিকা বলে,
“চলো।”

চারজনকে নিয়েই সে বেরিয়ে আসে। দ্রুত গতিতে হাঁটতে হাঁটতে মৃত্তিকা বলে,
“কোথায় যাবে তোমরা?”

মেয়েগুলোর মধ্যে একজন মাথা নেড়ে বলল,
“বাসায় যাবো।”
“আগে আমার সাথে আসো।”

মৃত্তিকা ওদেরকে নিয়ে শরীফের বাসায় যায়৷ যাত্রাবাড়ী থেকে সিএনজি করেই চলে আসে। স্টোররুমের দরজা খুলে ভিতরে এনে বলল,
“আপাতত একটু এখানে বসো।”

ওদের জন্য হালকা নাস্তার ব্যবস্থা করে সে৷ বিস্কুট, পাউরুটি, কলা আর পানি। ব্যস, এটুকুই গো°গ্রা°সে গিলছে ওরা৷ মৃত্তিকা ওদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ মনে পড়ে ইমতিয়াজ কল করেছিল।

ফোন অন করে কলব্যাক করে সে। সাথে সাথেই রিসিভ হয়। ইমতিয়াজ জোরে ধমক দিয়ে বলে,
“কোথায় আছো তুমি? কান্ডজ্ঞান কি আছে? ফোন অফ কেন?”

মৃত্তিকা একটু নিচুস্বরে বলল,
“সরি, নেটওয়ার্ক ছিল না বোধহয়।”

ইমতিয়াজ একটু শান্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করে,
“কোথায় আছো তুমি?”
“শপিংয়ে এসেছি।”
“ওকে, বাসায় ফিরে জানিয়ো।”
“হুম।”

মৃত্তিকা ফোন রাখে। ইমতিয়াজের ফোনে একটা ম্যাসেজ আসে,
“মিউকো যাত্রাবাড়ী থেকে ধানমন্ডি শরীফ স্যারের বাসায় এসেছে।”

নাম্বারটা শরীফের স্পা°ই ফাহাদের। ইমতিয়াজই তাকে মৃত্তিকার খেয়াল রাখতে বলেছিল। ম্যাসেজটা দেখে ইমতিয়াজ নিজে নিজেই বলে,
“আমাকে লুকিয়ে কি করছো তুমি মৃত্তিকা?”
______________________________________

সন্ধ্যা সাতটা বেজেছে। সারাদিনে আহনাফ একবারের জন্যও বাইরে যায়নি। শুধুমাত্র ওই বন্ধ রুমে গেছে আর বাইরে এসেছে। সকালে জামিল আর আহনাফের মধ্যে হওয়া সব কথাই সারাহ্ শুনেছে। শাফিন ঠিক কতটা জঘন্য কাজ করেছে তা সারাহ্-র ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে। নিজের ভাগ্নির দিকে কেউ কিভাবে কু°দৃষ্টি দেয়?

সকালের পর সারাদিনে তাদেরকে আর কিছুই খেতে দেয়নি আহনাফ। সারাহ্ ওকে ভ°য়ে কিছু জিজ্ঞাসাও করেনি।

চা বানিয়ে এনে আহনাফের সামনে রেখে বলে,
“নাস্তা করে নিন।”

আহনাফ ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি খেয়েছো?”
“এইতো খাবো।”

সারাহ্ও চা এনে ওর সাথে বসে। আহনাফ আজ একটু চুপচাপ আছে। সারাহ্ ওর কাঁধে মাথা রেখে বলল,
“আজ এতো শান্ত কেন?”

আহনাফ একটু হেসে বলল,
“প্রতিদিন তো শান্ত থাকতেই বলো।”

সারাহ্ মাথা তুলে আহনাফের দিকে তাকায়। আহনাফ কেমন যেন অনুভূতিহীন হয়ে চায়ের কাপে চুমুক দেয়। সারাহ্ ওর গালে হাত দিয়ে বলে,
“আপনাকে শান্ত অবস্থায় আমার ভালো লাগে না।”

আহনাফ ওর দিকে তাকিয়ে ওর ওষ্ঠোধরকে আপন করে নিলো। সারাহ্ ওকে সরানোর চেষ্টা না করে বরং আরো কাছে নিয়ে আসে। প্রতি ছোঁয়ায় আহনাফ তাকে ক্রমেই পাগল করছে। সারাহ্-র হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে যায়, মাটির কাপটা শব্দ করে পড়ে ভে°ঙে যায়। দুজনে চমকে সরে আসে।

সারাহ্ ছটফট করে বলে,
“আমি পরিষ্কার করে দিচ্ছি।”

পাশের রুমে শব্দ হওয়ায় সারাহ্ থেমে যায়। আহনাফ উঠে সে রুমে যায়। গিয়েই দরজা বন্ধ করে সে। জামিল দরজায় ধা°ক্কা দিয়েছে বলেই শব্দটা হয়েছিল।

আহনাফ জামিলের বুকে লা°থি দিয়ে ফেলে বলল,
“কি সমস্যা?”

আহনাফ তার মুখের বাঁধন খুলে দেয়। জামিল বলে,
“আমি তো সব বলেছি। আমাকে তবুও কেন আ°টকে রেখেছো?”

আহনাফ ওর সামনে বসে বলল,
“সবটা তো বলোনি, বাবার প্রতি রাগ বুঝলাম। কিন্তু সারাহ্-র মায়ের সাথে কি? পুরোনো খু°নের রেশ? এটা তো হতে পারে না।”
“শাফিন সব করতে পারে।”

জামিলের নাকেমুখে জোরে থা°প্প°ড় দেয় আহনাফ। বলে,
“তোমার তার সাথে কি? তাহসিনার সাথে কি ছিল আর তাহমিনার সাথেই বা কি ছিল? রিপা আন্টি কি করেছিল?”

জামিল মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“শাফিনকেই জিজ্ঞাসা করে নাও।”
“কোথায় থাকে সে?”

জামিল ফিসফিস করে বলে,
“তোমার ঘাড়ের কাছে।”

মরিচের গুড়ার বক্সে এখনো কিছু অবশিষ্ট ছিল। আহনাফ রাগে সেখান থেকে এক খাবলা নিয়ে জামিলের চোখমুখে ছুড়ে ফেলে। জোর করে তার চোখ খুলে ভিতরে ঢু°কিয়ে দেয়৷ “আহ” করে চেঁচিয়ে উঠে সে।

আহনাফ তার মুখ জোর করে বেঁ°ধে দিয়ে বেরিয়ে আসে। আহনাফের হাত জ্বা°লাপো°ড়া করছে। ঠান্ডা পানি দিয়ে হাত ধুয়ে নেয় সে।

সারাহ্ ওর দিকে ভ°য়া°র্ত চোখে তাকিয়ে বলল,
“কি করেছেন ভিতরে?”

আহনাফ উত্তর দেয় না। সে ক্রমাগত হাত ধুয়ে চলেছে। রাগে তার মাথা কাজ করা থামিয়ে দিয়েছে।
______________________________________

রাত আটটায় বাসায় আসে ইমতিয়াজ। সদর দরজার উপরে একটা চিরকুট লাগানো।

“নিজের চাবি দিয়ে দরজা খুলেন, আর লাইট জ্বা°লানো যাবে না।”

ইমতিয়াজ একটু হেসে কাগজটা পকেটে নিয়ে দরজা খুলে। ভিতরে অন্ধকার, দরজা বন্ধ করতেই তা আরো গাঢ় হলো।

মৃত্তিকা টেবিলের উপর রাখা মোমবাতি জ্বা°লিয়ে দেয়। ইমতিয়াজ তাকায় ওর দিকে। বেনারসি শাড়ি পড়েছে, আঁচল দিয়ে ঘোমটা দিয়েছে সে। ঠোঁট গাঢ় লাল লিপস্টিক, চোখে মোটা কাজল। ইমতিয়াজ কাঁধের ব্যাগটা ফ্লোরে ফেলে দেয়। একটা ঢোক গিলে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়।

মৃত্তিকা ওর দিকে এগিয়ে এসে বলে,
“সারপ্রাইজটা কেমন হলো?”

ইমতিয়াজ ভ্রূ উঁচিয়ে জোরপূর্বক হাসে। মৃত্তিকাকে কি কি ব°কা দিবে তা ভাবতে ভাবতেই বাসায় এসেছে সে। অথচ এখন কথাই বলছে না।

মৃত্তিকা ওর গালে হাত দেয়। মৃত্তিকা কাছে এসে ইমতিয়াজের গলায় ঠোঁট ডু°বায়।

মৃত্তিকা ফিসফিস করে বলল,
“এ সাজ আপনার জন্য ইমতিয়াজ। সাজটা নষ্ট করে দিন না আজ?”

অমায়িক আবেদন, আবেদনময়ীর আবেদনে সারা না দিয়ে কি উপায় আছে?
______________________________________

ভোরে নামাজ শেষে আহনাফ কোরআন তেলাওয়াত করছে। সারাহ্ পাশেই শুয়ে আছে৷ ঘুমাবে ঘুমাবে করেও তার ঘুম হচ্ছে না। আহনাফ ওর মাথায় হাত বুলায়।

সারাহ্ নিচুস্বরে বলে,
“একটু জোরে পড়ুন, আমি শুনবো।”

আহনাফ হেসে একটু জোরে জোরে তেলাওয়াত শুরু করে। সারাহ্ মনোযোগ দেয়। কিছুক্ষণ পর আহনাফ কোরআন শরীফ রেখে উঠে যায়। সারাহ্ ঘাড় বাঁকিয়ে তাকিয়ে থাকে।

জামিলের রুমে আসে, সাথে সেই চারটা রুটি। জামিলের অবস্থা ভ°য়া°বহ। চোখে সে কিছুই দেখছে না। রাতে জ্ঞা°ন হারিয়েছিল, তবে পানি দেয়ার পরই জ্ঞা°ন ফিরেছে।

আহনাফ কল করে ডা. সৌহার্দ্যকে। জামিলের কথা জানালে সৌহার্দ্য তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসতে বলে। আহনাফ এখন তার হাতের বাঁ°ধন খুলে জো°র করে রুটি খাইয়ে দেয়। পরিচিত একজনের সিএনজি করে কুমিল্লা মিশন হাসপাতালে নিয়ে আসে।

ডা. সৌহার্দ্য তাকে দেখে। আহনাফ তাকে সত্যটা জানায় না। বলে,
“কোনো এক শ°ত্রু এ কাজ করেছে।”

আহনাফ সর্বক্ষণ সামনে দাঁড়িয়ে থাকায় জামিল কিছুই বলতে পারেনা। চুপচাপ তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তার।

সৌহার্দ্য সব দেখে জানায়,
“ডানচোখ একেবারেই অ°কেজো হয়ে গেছে। শুধু মরিচ দেয়নি, এখানে জোরে প্রেশার দিয়েছে। ভর্তি করাও, দেখি কি করা যায়।”
“ভর্তি ছাড়া আর কোনো উপায়?”
“না, ভর্তি করিয়ে নাও। চিকিৎসা একটু লম্বা হবে এটার।”

আহনাফ জামিলের দিকে তাকায়। মাথানিচু করে জামিলকে বলল,
“শুধু শুধু টাকা খরচের কোনো মানে দেখি না।”
______________________________________

সকাল এগারোটা ত্রিশ মিনিট, আজ থেকে পুরোদমে অফিসের কাজে ব্যস্ত হয়েছে ইমতিয়াজ। মৃত্তিকাকেও নিয়ে এসেছে। তবে মৃত্তিকা কিছুক্ষণ আগেই বেরিয়ে গেছে। ইমতিয়াজ দেখেও চুপ ছিল, ফাহাদকে পিছনে পাঠিয়ে দিয়েছে।

মৃত্তিকার গন্তব্য যাত্রাবাড়ী, দুইঘন্টা পর এসে পৌঁছায়। রাস্তায় মাত্রাতিরিক্ত না হলেও মোটামুটি জ্যাম ছিল। গলির ভেতর প্রবেশ করতেই পেছনে ফাহাদকে খেয়াল করে মৃত্তিকা।

আজ মৃত্তিকা খালি হাতে আসেনি, শরীফের শোবার রুমের আলমারি থেকে পি°স্ত°লটা নিয়ে এসেছে। যদিও তা ওর ব্যাগে। পি°স্ত°ল চালাতে সে জানে না, তবে এটা দেখিয়ে যে ভ°য় দেখানো যাবে তা জানে।

বাসাটা কাছাকাছি এসে ফাহাদের দিকে পি°স্ত°ল তাক করে মৃত্তিকা। বলে,
“পিছু নিচ্ছো কেন?”
“আপনি কোথায় যান তা জানতে স্যার আমাকে পাঠিয়েছে।”

মৃত্তিকা পি°স্ত°লটা ব্যাগে রেখে বলল,
“দেখো তুমি আমার বাবার বেতনভুক্ত একজন কর্মচারী। সারা মাস আমাকে নজরবন্দী রেখে মাস শেষে কত টাকা বেতন পাও? দশ হাজার? বিশ হাজার? চল্লিশ হাজার? এর চেয়ে বেশি তো নয়?”

ফাহাদ ওর কথা ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারে না। তবুও মাথা নাড়লো।

মৃত্তিকা হেসে বলে,
“বেতন দ্বিগুণ হবে। এক মাস আমার কথা মতো চলো, জাস্ট এক মাস। এই এক মাস তুমি তোমার স্যারকে আমার সম্পর্কে কোনো ইনফরমেশন দিতে পারবে না। রাজি?”

মৃত্তিকার অফারটা ভালো। ফাহাদের বেশ পছন্দ হয়। সে রাজি হয়ে যায়। মৃত্তিকা মাথা নেড়ে বলে,
“এখানেই কোথাও লুকিয়ে থাকো আর আমার ইশারার অপেক্ষা করো।”

কথা শেষে মৃত্তিকা বাসার ভিতরে প্রবেশ করে। গতকালকের সেই রুমে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে অপরূপার। সময় গড়ায়, বিকেল চারটা বেজে যায়। কিন্তু অপরূপা আসে না। মৃত্তিকা ধরে নেয় অপরূপা আজ আসবে না।

এমনসময় দরজা খুলে ভেতরে আছে অপরূপা। মেয়েগুলো কেউ নেই, অপরূপা অবাক হয়। চোখ বড়বড় করে তাকায় সামনে বসে থাকা মৃত্তিকার দিকে। মৃত্তিকা শব্দ করে হেসে ওঠে বলে,
“গেম ইজ ওভার।”

চলবে….

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

সপ্তচত্বারিংশ পর্ব (৪৭ পর্ব)

বাসার কলিং বেল বাজলে মমতাজ বেগম দরজা খুলে দেন। সামিহা উনার দিকে এক বিশুদ্ধ হাসি ছুঁড়ে বলে,
“আসসালামু আলাইকুম আন্টি। ভালো আছেন?”

মমতাজ বেগমও হেসে বলেন,
“আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি৷ তুমি কেমন আছো? (একটু থেমে) ভিতরে আসো।”

সামিহা ভিতরে প্রবেশ করতে করতে বলে,
“এইতো আলহামদুলিল্লাহ, আমিও ভালো আছি।”

সামিহা আশেপাশে তাকায়, বুঝতে পারে লুৎফর রহমান বোধহয় বাসায় নেই। সামিহা মুচকি হাসি দিয়ে বলল,
“তানজিম বাসায় আছে?”
“হ্যাঁ, ও ওর রুমে আছে। তুমি যাও।”
হাত দিয়ে তানজিমের রুম দেখায় মমতাজ বেগম।

সামিহা আবারো হেসে তানজিমের রুমে গিয়ে নক করে।

“দরজা খোলা।”
তানজিমের কন্ঠ পেয়ে সামিহা দরজা ঠেলে ভিতরে যায়।

অপ্রস্তুত চোখে সামিহাকে দেখে ভয়ে চমকে ওঠে তানজিম। সামিহা দুহাত দুদিকে দিয়ে সুন্দর একটা হাসি দিয়ে বলল,
“সারপ্রাইজ।”

তানজিম খুশি হয় না বরং ওকে ধ°ম°ক দিয়ে বলে,
“তুই এখানে কি করছিস?”

সামিহা হাত নামিয়ে সোজা হয়ে বলে,
“কি করব? তোকে দেখতে এসেছি।”

সামিহার বিষয়টা একটু খারাপ লাগে। ও সেই মতিঝিল থেকে কাকরাইল এসেছে তানজিমের সাথে দেখা করতে, অথচ তানজিম ওকে দেখে একবার হাসলোও না।

সামিহা বিছানার এককোণায় বসে। তানজিম বই পড়ছিল, বইটা পাশে দেখে উঠে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়।

সামিহা জিজ্ঞাসা করে,
“তোর শরীর কেমন আছে?”

“ভালো।”
ছোট করে খুব দ্রুত জবাব দেয় তানজিম।

সামিহা এবার একটু রাগ দেখিয়ে বলে,
“আমি আসলাম তোকে দেখতে, অথচ তুই আমাকে ন্যূনতম পাত্তা দিচ্ছিস না। কেন?”

তানজিমের কাছে কোনো উত্তর নেই। কিছুক্ষণ চঞ্চলভাবে নিজের চোখ এদিক-ওদিক নাই তারপর একটা মিথ্যা বলে বসে,
“আসলে আম্মু চায় না তুই আমার সাথে দেখা কর বা আমি তোর সাথে দেখা করি। তুই বুঝতে পারছিস?”

সামিহা অপলক তাকিয়ে রইলো। চোখে পানি ছলছল করছে, যেন এখনই কান্না করবে। তানজিম ওর অবস্থা দেখে। একটা কাশি দিয়ে একটু নিচুস্বরে বলে,
“কথাটা বুঝতে চেষ্টা কর। আম্মু আমাদের সম্পর্কটাকে স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছে না। আবার সরাসরি তোকে বলতেও পারছে না (একটু থেমে) কিন্তু আমাকে বলেছে। বুঝেছিস তুই?”

সামিহা আর কোন উত্তর না দিয়ে চুপচাপ বাসা থেকে বের হয়ে যায়। তানজিম তাকিয়ে থাকে ওর চলে যায় পথের দিকে। তানজিম ওকে এভাবে কষ্ট দিতে চায়নি, তবে ওর ভালোর জন্যই দিতে হয়েছে।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বাধা না মানা সামিহার চোখের জল গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। কান্নার মূল কারণ সে সংজ্ঞায়িত করছে না বা করতে চাইছে না।
______________________________________

“তুমি এখানের এড্রেস কোথায় পেয়েছো?”

অপরূপার কথায় মৃত্তিকা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“এতোকিছু বলার সময় আমার নেই।”

অপরূপা হয়তো কাউকে ডাকতে চেয়েছে, তবে ওর গলা দিয়ে শব্দ বের হওয়ার আগেই মৃত্তিকা ওর গালে এক চ°ড় বসায়৷ অপরূপা সোজা হওয়ার আগে মৃত্তিকা ওর ঘাড় চে°পে ধরে মাথা দেয়ালের সাথে বেশ জোরে জোরে কয়েকবার ঠু°কে দেয়। কপাল ফে°টে র°ক্ত পড়া শুরু করে অপরূপার। মৃত্তিকা থামে না, ওর অন্য গালে চ°ড় বসিয়ে গলা চে°পে ওকে দেয়ালের সঙ্গে আটকে রাখে।

অপরুপাও দুহাতে মৃত্তিকার গলা চে°পে ধরতে চায়। তবে মৃত্তিকা ওর দুপায়ের হাটুতে জোরে লা°থি দেওয়ায় নিচে বসে পড়ে। মৃত্তিকা ওর গলা ছেড়ে দেয়।

অপরূপার দুহাত পিছনে নিয়ে টে°নে ধরে বলে,
“শাফিন তোর কি হয়?”

অপরূপা জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে নিতে বলে,
“হাসবেন্ড।”

“কি?”
অবাকের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে বেশ জোরে কথাটা বলে মৃত্তিকা।

অপরূপা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,
“হ্যাঁ, আমি তার দ্বিতীয় স্ত্রী।”

মৃত্তিকা উপরের ঠোঁট উঁচিয়ে বেশ ব্য°ঙ্গ করে বলে,
“এই আকাম কবে করছে আবার? (একটু থেমে) তবে ওর সব কুকর্ম সম্পর্কে তোর ধারণা আছে আশাকরি?”
অপরূপা জবাব দেয় না, মৃত্তিকাও জবাবের অপেক্ষা করে না।

মৃত্তিকা অপরূপার হাত বাধার জন্য আশেপাশে তেমন কিছু পায় না। তাই অপরূপা গায়ের ওড়না দিয়ে ওর হাত বেঁ°ধে দেয়। পা বাঁধার জন্য রুমের পর্দা কে°টে দুই টু°করো করে। শক্ত করে পা বেঁ°ধে বাইরে গিয়ে ফাহাদকে ডাকে।

ফাহাদকে ভিতরে এনে অপরূপার প্রতি ইশারা করে বলে,
“ওকে বাবার বাসা পর্যন্ত নিয়ে যাবে।”

ফাহাদ অবাক হয়। বাবা মেয়ে দুজনে কি মা°ফিয়া নাকি?- এমন একটা সন্দেহ তার জেগে ওঠে।

মৃত্তিকা নিজের হিজাব ঠিক করতে করতে বলে,
“কি বলেছি বুঝেছ?”
“জি।”
“গাড়ি আছে তোমার সাথে?”
“হ্যাঁ, আছে।”

মৃত্তিকা পর্দার বাকি অংশ দিয়ে অপরূপার মুখ শক্ত করে বেঁধে দেয়। ফাহাদকে বলে,
“ওকে গাড়িতে তোলো আমি আসছি।”

ফাহাদের শক্তপোক্ত শরীর। সে খুব সহজেই হ্যাংলা দেহের অপরূপাকে কোলে করে গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যায়। মৃত্তিকা পিছুপিছু সেখানে যায়।

অপরূপাকে গাড়ির সিটে বসাতে নিলে মৃত্তিকা বলে,
“এই কি করো?”

ফাহাদ মৃত্তিকার দিকে তাকায়। মৃত্তিকা গাড়ির ডেকের দিকে আঙুল দিয়ে বলে,
“ওকে ওখানে ঢু°কাও। এটা আমার বসার জায়গা।”
কথা শেষ করে মৃত্তিকা গাড়িতে উঠে যায়।

ফাহাদ মৃত্তিকার কথা মত অপরূপাকে গাড়ির ডেকে ঢুকিয়ে আটকে দেয়। অপরূপার নিরীহ চাহনি এক মুহূর্তের জন্য অপরূপা চোখের দিকে তাকাতে বাধ্য করে ওকে।

“কি হলো? গাড়ি কে চালাবে?”

মৃত্তিকার কথায় ফাহাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“আমিই চালাবো।”
“ওকে চালাও।”

ফাহাদ গাড়িতে বসে গাড়ি স্টার্ট দেয়। উদ্দেশ্য ধানমন্ডিতে শরীফের বাসা।
______________________________________

সৌহার্দ্যের অনেক অনুরোধেও আহনাফ জামিলকে ভর্তি করায়নি। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষেই বাড়িতে নিয়ে চলে এসেছে। পিঠে ওয়াশ করে ওষুধ লাগানো হয়েছে৷ কোন কোন ওষুধ লাগিয়েছে তাও আহনাফ লিখে এনেছে।

কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে চোখ পরিষ্কার করিয়ে এনেছে। ডানচোখে ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। আবার দুইটা ড্রপ দিয়ে দিয়েছে৷

বাড়িতে আনার পর সারাহ্ জামিলের অবস্থা দেখে আ°ৎ°কে উঠে। আহনাফ যত দ্রুত সম্ভব জামিলকে রুমে বন্ধ করে দেয়।

সারাহ্ বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাগানে চলে আসে। তার প্রচন্ড বমি পাচ্ছে, আহনাফ যে এতটা হিং°স্র হতে পারে তা ওর কল্পনার বাইরে ছিল।

আহনাফ ওকে খুঁজতে খুঁজতে বাগানে চলে আসে। ওর পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
“কি হলো তুমি ওরকম করে দৌড়ে বেরিয়ে আসলে কেন?”

সারাহ্ একটু সরে যায়। আহনাফের দিকে না তাকিয়ে বলল,
“আপনি মার°তে পারতেন, তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু এভাবে অ°ত্যা°চার করার মানে কি?”

আহনাফ ভ্রু উঁচিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“মারবো তো বলিনি ট°র্চা°র করব বলেছি। তুমি জানো না কত বড় অ°ন্যায় ওরা করেছে।”

সারাহ্ মাথা ঝাঁ°কিয়ে বলে,
“আমি শুনেছি। দরজার এপাশ থেকে ওপাশের সব কথাই শোনা যায়।”

আহনাফ ওর মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,
“তবে তো হলোই, বুঝতে পেরেছ কেন করেছি।”

সারাহ্ ওর হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলে,
“সকল মানুষ হেদায়েত পাবে না, এটাতো চির সত্য। এই পৃথিবীটা একটা পরীক্ষাক্ষেত্রে। এখানে কেউ হান্ড্রেট মার্কস পাবে, আবার কেউ নব্বই, কেউ বা তেত্রিশ পেয়ে কোনোরকম পাস করবে আর কেউ ফেল। কেউ কেউ শূন্য পাবে, কোনো নাম্বারই তুলতে পারবে না এরা। আপনি কাউকে হেদায়েত দিতে পারবেন না।”

আহনাফ কিছুক্ষণ গাছপালার দিকে তাকিয়ে থাকে তারপর বলে,
“আমি কাউকে হেদায়েত দিতে পারবো না, আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ হেদায়েত দিতেও পারবে না। তবে যে অন্যায় ওরা করেছে তার জন্য এসব কিছুই না।”

সারাহ্ তাকিয়ে থাকে আহনাফের চোখের দিকে। আহনাফ বলে,
“শাফিন ছাড়া পেয়ে গেছে। ফাঁ°সির পরও, কবর দেয়ার পরও বেঁচে গেছে। বুঝতে পারছো কোন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে ওরা।”

সারাহ্ চোখ বড় করে তাকায়, একটা ঢোক গিলে। আহনাফ নিষ্প্রাণ চোখে তাকিয়ে থাকে।

সারাহ্ আহনাফকে জড়িয়ে ধরে, আহনাফও তাকে আগলে নিলো। আহনাফের বুকে মাথা রেখে সারাহ্ বলল,
“মায়ের সাথে কি শ°ত্রুতা ওদের?”
“পুরোনো খু°নের রেশ থেকে শ°ত্রুতা এটা সবাই মানলেও আমি মানতে পারছি না। এখানে আরো অনেক কিছু আছে।”

সারাহ্ একটু চুপ করে থেকে বলে,
“মা কি আমাদের থেকে কিছু লুকাচ্ছে?”
“অবশ্যই লুকাচ্ছে।”
______________________________________

রাতে বাসায় ফিরে ইমতিয়াজ মৃত্তিকাকে সরাসরি প্রশ্ন করে,
“আজ অফিস থেকে কোথায় গিয়েছিলে?”

মৃত্তিকা পড়ার টেবিল গোছাতে গোছাতে মাথা নেড়ে না বুঝিয়ে খুব স্বাভাবিকভাবে বলে,
“কোথাও না, বাসায় এসেছিলাম।”

ইমতিয়াজের সন্দেহ শেষ হয় না। তবে ফাহাদের কাছ থেকে কোনো যুতসই উত্তর না পেয়ে সে মৃত্তিকাকে আর তেমন কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারে না।

মৃত্তিকা একটা বই এনে ইমতিয়াজের সামনে ধরে বলল,
“এ বইটা আপনি পড়েছেন?”
“হ্যাঁ।”
“কেমন লেগেছে?”
“ভালো।”
“আমিও পড়বো।”
“তোমার ইচ্ছা।”

মৃত্তিকা বইটা টেবিলে রেখে বলল,
“কাল সুরভি আপুকে দেখতে যাবো, অনেকদিন হলো রাঈদকে দেখি না।”

ইমতিয়াজ শার্ট খুলতে খুলতে বলল,
“যেও, কিন্তু আমি যেতে পারবো না।”

মৃত্তিকা জেদ করে বলল,
“না, যেতে হবে।”
“জেদ করে না, মৃত্তিকা।”

ইমতিয়াজ একটু থেমে থেকে আন্দাজে একটা ঢিল ছুড়ে বলল,
“কাল যাত্রাবাড়ী গিয়েছিলে কেন?”

মৃত্তিকা চমকে উঠে, ওর চোখমুখ দেখে ইমতিয়াজ কথার সত্যতা নিশ্চিত করে। আর কিছু না বলে ওয়াশরুমে চলে যায় সে। মৃত্তিকা কিছুক্ষণ ভেবে বুঝতে পারে এটা নিশ্চয়ই ওই ফাহাদের কাজ।
______________________________________

ইমতিয়াজ অফিসে গেলে মৃত্তিকা বেরিয়ে যায় ধানমন্ডির উদ্দেশ্যে। বাসায় অপরূপাকে পাহারা দেওয়ার জন্য ফাহাদকে রেখে এসেছিল গতকাল।

আজ বাসায় এসেই মৃত্তিকা বুঝলো ফাহাদকে শরীফ কেন এত বিশ্বাস করে। সে ঠিকই সারারাত ধরে অপরূপার উপর নজর রাখছে। দরজা বাইরে থেকে তালা দেয়া ছিল। ফাহাদ ভিতরে এমনভাবে ছিল যে, ভিতরে কোনো মানুষ আছে কি নেই তা বাইরে থেকে বোঝা মুশকিল।

মৃত্তিকা সোফায় বসে সামনে ফ্লোরে বসা অপরূপার দিকে তাকিয়ে ফাহাদকে বলে,
“বাসায় কোনো স্টোভ আছে?”

ফাহাদ রান্নাঘরের দিকে ইশারা করে বলল,
“রান্নাঘরে একটা আছে। (একটু থেমে) মানে দুই চুলা।”

মৃত্তিকা মাথায় হেলিয়ে বলে,
“সিলিন্ডারসহ নিয়ে এসো।”

ফাহাদ ওর কথা মতো কাজ করে। মৃত্তিকা মৃদু হেসে বলল,
“এখন তুমি ঘুমাতে যাও। সারারাত জেগে ছিলে।”
“জি।”
বাধ্য শি°ষ্যের মতো ফাহাদ মাথা দুলিয়ে চলে গেল।

মৃত্তিকা চুলা চালিয়ে অপরূপাকে বলে,
“কেমন আছো?”
অপরূপা আড়চোখে মৃত্তিকার দিকে তাকায়।

মৃত্তিকা হেসে উঠে দাঁড়ায়। একটা লোহার শি°ক ব্যাগ থেকে বের করে চুলায় সেটা গরম করতে করতে অপরূপাকে জিজ্ঞাসা করে,
“আর কে কে আছে এসবের মধ্যে?”

অপরূপা উত্তর দেয় না। মৃত্তিকা মনোযোগ দিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শি°কটা গরম করছে। লোহা আ°গু°নে পু°ড়ছে, একটু একটু করে লাল হয়ে উঠছে। আশপাশটাও লোহার গরমের সাথে সাথে বেশ গরম হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। অপরূপা একটু ঢোক গিলে শান্ত থাকে।

মৃত্তিকা হাসি হাসি মুখ করে বলে,
“বড়মনি মানে মমতাজ, ওই জেলার, তুমি, দুলাল, আহনাফের ছোট ফুপা আর কে কে আছে?”

অপরূপার উত্তর না পেয়ে মৃত্তিকা রেগে যায়। ধ°ম°ক দিয়ে বলে,
“আর কে আছে নাম বল।”

এবারেও অপরূপা চুপ। মৃত্তিকা শি°কটা এনে অপরূপার গলার কাছে ধরে বলে,
“কথা কি কানে যাচ্ছে না?”
“কানে গেলেও বলব মনে হয়?”

একটা গরম লোহার শি°ক গলার কাছে, অথচ মেয়েটা বিন্দুমাত্র ভয় পাচ্ছে না। কতটা অদ্ভুত একটা বিষয়? ওর ডান বাহুতে ছ্যাঁ°কা লাগিয়ে দেয় মৃত্তিকা অপরুপা চেঁ°চিয়ে উঠে।

মৃত্তিকা কিড়মিড় করে বলে,
“সত্য বলো আর কে ছিল।”

অপরূপা ডানে বামে মাথা নাড়ায়, যার অর্থ সে বলবে না। শি°কটা আরেকটু জোরে চেপে ধরে মৃত্তিকা। ব্য°থায় চেঁচিয়ে উঠলো মুখ খুলে না অপরূপা।
______________________________________

“পরশুদিন কলেজের ছুটি শেষ। কি করবেন?”

সারাহ্-র কথায় স্বাভাবিক সুরে আহনাফ বলল,
“কি করবো? ক্লাস করাবো, ফিজিক্স পড়াবো।”

একটু থেমে আহনাফ দুষ্টুমি করে বলল,
“তুমি না হয় বড় বড় বিক্রিয়া আর জ°টিল জ°টিল পরীক্ষা করিয়ো।”

সারাহ্ ওর সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
“আমি সেটা বলছি না। এই লোকগুলোর কি হবে?”

আহনাফ মাথা নাড়ে। বলে,
“হবে কিছু একটা যখন হবে তখন দেখে নিও।”

সারাহ্ ওর হাত ধরে বলল,
“ওদের বাসায় রাখছেন, তার উপর এমন অ°ত্যা°চার চালাচ্ছেন। যদি কিছু একটা হয়ে যায়, তখন? (একটু থেমে) আমি ওদের চিন্তা করছি না, আমি আপনার চিন্তা করছি। ওদের একজনের কিছু একটা হলে তার পুরো দায়ভার কিন্তু আপনার উপর আসবে।”

আহনাফ শার্টের হাতা গু°টাতে গু°টাতে বলল,
“আমি যা করছি জেনে-বুঝে, স°জ্ঞানে করছি। আমাকে বোকা ভেবো না।”

“আমি তা ভাবছি না। আমি জানি আপনি বুদ্ধিমান। যা করছেন ভেবে করছেন, তবে আমার চিন্তা হচ্ছে।”

আহনাফ ওর দুগালে হাত দিয়ে বলল,
“ঠিক আছে, তোমার এত যখন চিন্তা হচ্ছে, তবে ওদেরকে বাসার বাইরে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। এবারে খুশি তো?”

সারাহ্ ওর হাতের উপর হাত রেখে বলল,
“খুশি।”

চলবে…..

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

অষ্টচত্বারিংশ পর্ব (৪৮ পর্ব)

মৃত্তিকা অনেকক্ষণ ধরে বেশ কয়েকবার গরম শি°কের ছ্যাঁ°কা দেয়ার পরও অপরূপা কিছুই বলে না। মৃত্তিকার রাগ তড়তড় করে বেড়ে গেল। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে যত রাগবে, ততই হার নিশ্চিত হবে।

অপরূপার ব্যাগ ঘে°টেঘু°টে মৃত্তিকা সি°গা°রেট আর একটা ড্রা°গের প্যাকেট পায়। সাদা পাউডারের মতো গুড়া জিনিসের প্যাকেটটা ফাহাদকে দেখিয়ে মৃত্তিকা নিশ্চিত হয় এটা সম্পর্কে। অর্থ যা দাঁড়ালো তা হচ্ছে অপরূপা একইসাথে ধুম°পা°য়ী আর মা°দ°কা°সক্ত।

চট করে একটা বুদ্ধি আসে মৃত্তিকার মাথায়। মা°দ°কাস°ক্ত মানুষকে অতিরিক্ত ড্রা°গ প্রয়োগ করে বা ড্রা°গ একেবারেই না দিয়ে কাবু করা সম্ভব। তবে অতিরিক্ত ড্রা°গে মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকায় মৃত্তিকা তা করবে না। অপরূপা মরে গেলে শাফিন হাতছাড়া হবে।

মৃত্তিকা অপরূপার সামনে গিয়ে সি°গা°রেটের প্যাকেট থেকে একটা একটা করে সি°গা\রেট বের করতে থাকে।

অপরূপা ওকে দেখে বলল,
“তুমিও কি স্মো°ক করো?”

মৃত্তিকা বাঁকা হেসে বলে,
“না করলেও এখন তো করা যাবে? কি বলো?”

মৃত্তিকা মুখ বাঁকিয়ে বেশ ব্য°ঙ্গ করে অপরূপাকে বলে,
“মামানী।”

সবগুলো সি°গা°রেট একসাথে মুঠোবন্দি করে মৃত্তিকা। তারপর আ°গুন জ্বা°লায়। অপরূপা অবাক চোখে মৃত্তিকার কর্মকাণ্ড দেখছে।

সি°গা°রেট সবগুলো একসাথে জ্ব°লে উঠলে মৃত্তিকা ফুঁ দিয়ে আ°গুন নিভায়। অপরূপার হাত টে°নে ধরে তালুতে বসিয়ে দেয়। জ্বলন্ত সি°গা°রেটে ওর চামড়া পু°ড়ে, পো°ড়ার য°ন্ত্র°ণায় চিৎকার করে অপরূপা।

মৃত্তিকা থামেনা, বরঞ্চ সে সি°গা°রেটগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আরো গভীর করে বসাতে থাকে। একসাথে বাধা পা দুটো নাড়তে থাকে অপরূপা। একটু নিস্তার পাওয়ার জন্য ছটফট করেছে

ওর অসহায়ত্ব দেখে মৃত্তিকার মায়া হয় না। আরো ক°ড়া ভাষায় বলে,
“এখন তো বলতেই পারো আর কে ছিল?”
“ডা. আরিফা।”
একপ্রকার অতিষ্ঠ হয়ে আরিফার নামটা বলেই দেয় অপরূপা।

মৃত্তিকা উঠে দাঁড়িয়ে সি°গা°রেটগুলো ফেলে দেয়। মমতাজের চিকিৎসা করেছিল এই আরিফা, একজন সাইক্রিয়াটিস্ট। একজন ডাক্তার এতটা জ°ঘন্য কাজে কিভাবে যুক্ত হতে পারে? ভাবতেই অবাক লাগে ওর। আর মমতাজ বেগম? মেয়েদের মৃ°ত্যুর পর এমন শো°কে চলে যাওয়ার অভিনয় করেছিল, এতটাই গভীর আর নিখুঁত অভিনয় করেছিল যে কেউ বুঝতেই পারেনি সে আসলেই মানসিক সমস্যায় ভুগছিল নাকি না?
______________________________________

তানজিম আজ বেশ কয়েকদিন পর বাসা থেকে বের হয়েছে। এসেছে মতিঝিল সামিহার বাসার কাছে। গতরাত থেকে সামিহাকে একের পর এক মেসেজ দিলেও কোনো উত্তর আসে না। কয়েকবার কল দিলেও সে রিসিভ করেনি।

বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আবারো কল দেয় ওকে, এবারেও কোনো সারা পায়নি। আরেকবার কল দিতেই সামিহা রিসিভ করে। তবে রিসিভ করেই একটা বড় ধ°ম°ক দেয়,
“তুই না আমার সাথে আর কথা বলবি না? তবে কল দিয়েছিস কেন?”

তানজিম ওর রাগের কারণ বুঝতে পারে। তাই বেশ শান্ত গলায় বলে,
“সামি, আমার কথাটা বোঝার চেষ্টা কর…”

তানজিমের কথা শেষ হওয়ার আগেই সামিহা বলে,
“হ্যাঁ, যথেষ্ট বোঝার চেষ্টা করেছি। আর বোঝার চেষ্টা করেছি বলেই তোর সাথে আর কোনো কথা বলছি না।”

“একটু বাইরে আয়, আমি তোর বাসার সামনে।”

এই অসুস্থ শরীরে তানজিম ওর সাথে দেখা করতে এসেছে। সামিহা ফোন না কে°টেই ছুটে বাইরে আসে। তানজিম ওদের বাসা থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়েছিল। সামিহা ধীর পায়ে ওর কাছে যায়।

সরাসরি প্রশ্ন করে,
“হ্যাঁ, বল কি বলবি? আমার হাতে বেশি সময় নেই।”

তানজিম একটু হেসে বলে,
“বেশি সময় চাইছি না, শুধু পাঁচ মিনিট।”

নিজের ফ্যামিলি সম্পর্কে কথা বলতে খুব কষ্ট হয় তানজিমের। তাই পারিবারিক খু°নের কথাটা গোপন থাকে। সামিহাকে এটা বলার মত সাহস কিংবা ইচ্ছা কোনোটাই আসেনা তানজিমের।

সে সত্য ও মিথ্যার মিশ্রণের কিছু কথা সামিহাকে শুনিয়ে দেয়,
“একটা কথা একটু বুঝিস। তুই এডাল্ট, আমিও এডাল্ট। তাই আমরা একসাথে ঘুরাঘুরি করলে, লোকে সম্পর্কটা অন্যভাবে নিবে এবং তা খুবই স্বাভাবিক। আম্মুর ক্ষেত্রেও বিষয়টা তাই হয়েছে। এতে আম্মুর দোষ দেওয়া যাবে না। (একটু থেমে) তবে কালকে ওভাবে আমার বাসায় গিয়েছিস, আবার আমার রুমে গিয়েছিলি। বিষয়টা একটু দৃষ্টিক°টু।”

“আমাদের সম্পর্কটা কি শুধুই বন্ধুত্বের? অন্য কিছুই কি নেই এখানে?”
সামিহার ইচ্ছা করছিল তানজিমকে এটা জিজ্ঞাসা করতে। তবে জিজ্ঞাসা কর হলো না। সে নিরবে তানজিমের প্রতিটা কথা শ্রোতার মতো শ্রবণ করছে।

তানজিম একটু চুপ থেকে আশেপাশে তাকিয়ে বলে,
“বন্ধুত্বটা বাসার বাহিরে পর্যন্তই থাকুক, আমাদের বাসায় এটা না যাক। ভার্সিটিতে একসাথে থাকি, একসাথে ঘুরতে যাই, কোনো সমস্যা নেই। তবে প্লিজ কোনোদিন আমার বাসায় আসিস না। প্রয়োজনে আমাকে কল করিস, আমি চলে আসব।”

“আমার তো সব সময় তোকে প্রয়োজন।”
এই কথাটা সামিহার মনের গহীনে থেকে যায়।

অপ্রকাশিত উপন্যাসের পাতায় যা খুঁজে পাওয়া যায়, তা কখনোই প্রকাশ করতে নেই। অনুভূতি প্রকাশ করলে পুরোনো হওয়ার ভয় পায় সামিহা।

ওকে চুপ থাকতে দেখে তানজিম বলে,
“তুই বুঝেছিস আমার কথা?”

সামিহা উপরে নিচে মাথা নাড়ে, যার অর্থ সে তানজিমের সব কথাই বুঝে নিয়েছে। তানজিম একটা মলিন হাসি দেয়। ওর নিরব আর্তনাদ কেবল ও জানে, আর জানে সৃষ্টিকর্তা।
______________________________________

দুইদিন পেরিয়েছে। জামিলকে সিআইডি অফিসার গালিবের কাছে হস্তান্তর করেছে আহনাফ। এছাড়া আর কোনো বিশ্বস্ত মানুষ সে খুঁজে পায়নি। শাফিন যেভাবে এতজনের মাঝখান থেকে উধাও হতে পেরেছে সেখানে এদের ওপরেও বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবুও বিশ্বাস করতে হয়েছে তাকে।

জামিলের কাছ থেকে শাফিন সম্পর্কে কোন তথ্য আহনাফ পায়নি। অনেক চেষ্টা করেছে সে। তবে এটাও জানতে পারেনি নার্গিস পারভিনের সাথে শাফিনের শ°ত্রুতা ঠিক কোথায় এবং কি নিয়ে।

এখন গালিব পারলে ভালো আর না পারলে সারাহ্-র শত চিন্তার মাঝেও জামিলকে আবারও বাসায় এনেই তুলতে হবে। তবে এখানেও একটা দু°শ্চিন্তা থেকে যায়। যদি জামিলকে বাঁচাতে শাফিন এসে হাজির হয়? তবে এখানেও সারাহ্-র বি°পদ।

ক্লাস শেষে বেরিয়ে আহনাফ গালিবকে কল দেয়। গালিব রিসিভ করে, বেশ কিছুক্ষণ জামিলের ব্যাপারে কথা বলে কল রাখে সে।

তারপর আবারো কল দেয় ইমতিয়াজকে। ইমতিয়াজ অফিসের কাজে ব্যস্ত আজ তাই ফোন সাইলেন্ট মুডে করে রেখেছে। দুই-তিনবার কল আসলেও ইমতিয়াজ তা টের পায় না।

আহনাফ ফোন পকেটে রেখে দেয়। টিচার্স রুমে যাওয়ার সময় সারাহ্ কোথা থেকে যেন ছুটে এসে ওর হাত ধরে বলল,
“লাইব্রেরীতে যাবো, চলেন।”

আহনাফ আশেপাশে তাকায়। তারপর বলে, “এখন লাইব্রেরী?”
“হ্যাঁ, কিছুক্ষণ বই পড়বো। টানা তিনটা ক্লাস নিয়েছি।”
আঙুল উঁচিয়ে তিন দেখায় সারাহ্।

আহনাফ হেসে জিজ্ঞাসা করে,
“খুব টায়ার্ড?”
“অনেক।”
“তবে চলো।”

দুজনে লাইব্রেরীতে যায়। সারাহ্ গল্প উপন্যাসের বই খুঁজে বেড়াচ্ছে। আহনাফ পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
“রসায়নের ম্যাডাম রস না খুঁজে সোজা খেজুর খুঁজতে শুরু করেছে।”

সারাহ্ কপাল কুঁচকে তাকায়। বলে,
“আমার অবস্থা আপনি কিভাবে বুঝবেন? আপনি জানেন আমার দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হয়? এসব তো আপনি বুঝবেন না।”
“না, আমি তো কিছুই বুঝিনা।”

সারাহ্ আবারো বই খুঁজতে শুরু করে। আহনাফ বলে,
“আমি কি তোমার ছুটির ব্যবস্থা করব?”
“কিসের ছুটি?”
“কিসের আবার? মাতৃত্বকালীন ছুটি।”

সারাহ্ অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
“পাগল হয়েছেন? এত তাড়াতাড়ি ছুটি দেয়? লোকে কি বলবে?”
“ওমা, লোকে কি বলবে মানে? লোকের কথা লোকে বলবে তোমার তাতে কি আসবে যাবে?”
“আপনি আস্ত পাগল।”

সারাহ্ চলে যেতে নিলে আহনাফ ওর হাত ধরে বলল,
“হুশ, আর কলেজে এসে কষ্ট করতে হবে না।”

আহনাফ সারাহ্-র কাছে চলে আসলে সারাহ্ বলে,
“দূরে থাকেন, এখানে যেকোনো সময় যেকোনো কেউ আসতে পারে।”
“এখন ক্লাসটাইম, সো কেউ আসবে না।”

আহনাফ আরো কাছে চলে আসে। সারাহ্ ওর বুকে ধা°ক্কা সরিয়ে বলে,
“কেউ দেখলে কে°লে°ঙ্কারি হবে।”

আহনাফ মাথা নুইয়ে ওর কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে,
“কিসের কে°লে°ঙ্কারি? তুমি আমার বাচ্চার মা।”
“বউ নই?”

আহনাফ হেসে উঠে বলল,
“না, বউ না। বউ হলে তো আর কে°লে°ঙ্কারির ভয় থাকতো না।”
“তবে এখানে কেন? কলেজের মাঠে চলেন। লজ্জা শরম তো নিজেরটা খুই°য়েছেন আবার আমারটাও।”

আহনাফ আলতোভাবে ওর কোমড়ে হাত দিয়ে বলে,
“ঐশী, তোমার লজ্জা কবে ছিল গো?”

সারাহ্ ওকে ধা°ক্কা দিয়ে সরিয়ে বেরিয়ে যায়৷ বই পড়ে মাথা ঠান্ডা করা তার আর হয়ে উঠে না। আহনাফ মাথানিচু করে হেসে উঠে৷

ভালোবাসার পুরোনো সংজ্ঞা নতুনরূপে জেনেছে সে। শান্ত, ভদ্র ছেলেটাকে অশান্ত সমুদ্রে পরিণত করার ক্ষমতা কেবল ভালোবাসারই আছে। আবার অশান্ত সমুদ্রের সু°নামিকে শান্ত করতেও ভালোবাসারই প্রয়োজন।

সারাহ্-র চোখে থাকা লজ্জা দেখে সে প্রতিদিন নতুন করে প্রেমে পড়ছে। এ প্রেমের কাব্য কি সারাহ্ জানে? থাকুক না সে কাব্য গোপনে। আহনাফের দেয়া লজ্জায় তার ওষ্ঠদ্বয় কেঁপে উঠুক বারে বারে।

এমন সময় ইমতিয়াজ আহনাফকে কল দেয়। আহনাফ একটু ঘোরের মধ্যে ছিল ফোন বাজায় চমকে উঠে রিসিভ করে।

“কল দিয়েছিলে? সরি, আমি একটু ব্যস্ত ছিলাম।”
“কোনো সমস্যা না। আসলে একটা বিষয় নিয়ে আলাপ করতে চাইছিলাম। সময় হবে?”
“হ্যাঁ, বলো।”

আহনাফ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“আমার ছোট ফুপা, জামিল, উনি শাফিনের সাথে অনেক আগে থেকে ইনভলভ। উনি নিজ মুখেই স্বীকার করেছে তিনটা খু°নের সময় উনি সামনে ছিল। (একটু থেমে) এমনকি তাহসিনাকে (আবারো বিরতি নেয়) তাহুকে পি°টিয়েছিল উনি। তাহুর..”
বাকিটা আহনাফের বলা হয়ে উঠে না। বুকের কোথাও কষ্টগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠে।

ইমতিয়াজ ফোনটা শক্ত করে ধরে বলে,
“উনি কি এখন তোমার কাছে আছে?”
“ছিল কয়েকদিন, ধরেছিলাম, বেশ কয়েকদিন আটকে রেখেছিলাম। বেশ ট°র্চা°রও করেছিলাম। তবে ঐশীর নিরাপত্তার কথা ভেবে উনাকে সিআইডির হাতে তুলে দিয়েছি।”

ইমতিয়াজ মাথা নেড়ে বলে,
“ভুল করেছো, চরম ভুল।”
“এছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।”
“এখন কি সে ঢাকায়?”
“হ্যাঁ ঢাকায়। তোমাদের বাসার কাছাকাছি। সিআইডি হেড কোয়ার্টারে আছে।”

ইমতিয়াজ মাথা নাড়ে। বলে,
“ঠিক আছে। আমি দেখছি।”
“জামিল একা নয় সাথে আরো তিনজন আছে মোট চারজন এসেছিল ঐশীকে তুলে নিয়ে যেতে।”

ইমতিয়াজের পাশে বসে মৃত্তিকা সব কথাই শুনেছে। হালকা করে মাথা নাড়ে সে। জামিলে হাতের কাছে পাওয়া গেছে, এটা একটা বড় সুযোগ।
______________________________________

অপরূপাকে গত দুই দিনে তন্নতন্ন করে খুঁজেছে শাফিন। কিন্তু কোথাও পায়নি। অপরূপা কোথায় গেছে? কি অবস্থায় আছে? তা সে জানে না। জানার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি।

যাত্রাবাড়ী গিয়ে দেখেছিল সেখানে মেয়েগুলো নেই। তার আগের দিন একজনের আহত হওয়ার খবর অপরূপা তাকে দিয়েছিল। তবে কেউ এই ঠিকানা পেয়েছে?

কে হতে পারে? সন্দেহের তী°রটা মৃত্তিকার দিকে যায়। তবে আরো একজন আছে যাকে শাফিন সন্দেহ করতে থাকে, সে হলো ইমতিয়াজ।

আজকের দিনটাও কে°টেছে, বিকাল গিয়ে সন্ধ্যা হলো। অপরূপার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। মৃত্তিকার প্রতি রাগ তার বেড়েই যাচ্ছে।

রুমে বসে সি°গা°রেটের ধোঁয়া ছাড়ছে সে, এমনসময় ফোন বেজে উঠে। অপরূপা কল করেছে। হন্তদন্ত হয়ে রিসিভ করে শাফিন।

“হ্যালো।”
“অপরূপা, কোথায় আছো?”
ধ°ম°ক দিয়ে প্রশ্ন করে সে।

বিপরীত দিকে থেকে অপরূপার স্বাভাবিক কণ্ঠ ফিরে আসে,
“একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জোগাড় করেছি।”
“কি?”
শাফিনের কপাল কুঁচকায়।

“জামিল সিআইডির হাতে ধরা পড়েছে। যে পরিমাণ মা°র পড়ছে, তাতে হয়তো এ থেকে জেড সব বলে দেবে। (একটু থেমে) বিশেষ করে এডভোকেট বিথী যদি ধরা পড়ে, তবে বি°পদ বাড়বে।”

শাফিন মাথা নাড়ে। বলে,
“খবর কোথা থেকে পেয়েছো? সত্য না মিথ্যা?”
“পাকা খবর, আহনাফ তাকে ধরেছিল আর হস্তান্তর করেছে।”
“আহনাফ? তার মানে তুমি ঠিক সন্দেহ করেছিলে?”
“হ্যাঁ।”

শাফিন বেশ অনেকটা সময় নিয়ে ভাবনা চিন্তা করে, কিন্তু যুতসই কোনো বুদ্ধি পায় না। অপরূপা বলে,
“আমার কাছে খুব ভালো একটা প্ল্যান আছে।”
“তাড়াতাড়ি বলো।”
“জামিলকে পৃথিবী থেকে বিদায় দিয়ে দাও। না থাকবে বাঁশ, আর না বাজবে বাঁশি।”

শাফিন ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে মাথা নেড়ে বলল,
“ইউ আর রাইট।”

কল রাখতেই মৃত্তিকা অপরূপার ফোনটা হাতে নেয়। এতক্ষণ মৃত্তিকার শেখানো বুলিগুলো আওড়ে গেছে সে।

ঘাড়ের কাছে চেপে ধরা একগুচ্ছ জ্ব°ল°ন্ত সি°গা°রেটের য°ন্ত্র°ণা থেকে বাঁচার জন্য আর খানিকটা ড্রা°গের আশায় এ কাজ করতে রাজি হয় অপরূপা। দুইদিন ধরে ড্রা°গ না পেয়ে সে অস্থির হয়ে উঠেছে আর সুযোগটা কাজে লাগিয়েছে মৃত্তিকা।

মৃত্তিকা ফোনটা রেখে বলে,
“শাফিনকে আমি সহজে ধরবো না, খেলিয়ে ধরবো। কা°টা দিয়ে কিভাবে কা°টা তুলতে হয় তার শরীফের মেয়ে মিউকো ভালো করেই জানে।”

চলবে….

অনুভূতিরা_শব্দহীন পর্ব-৪৩+৪৪+৪৫

0

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

ত্রয়শ্চত্বারিংশ পর্ব (৪৩ পর্ব)

কোনো বস্তু পড়ার শব্দে ঘুম ভা°ঙে মৃত্তিকার। ইমতিয়াজ আলমারিতে কিছু একটা রাখছে। মৃত্তিকা ফোন হাতে নিয়ে দেখে মাত্র সাড়ে তিনটা বেজেছে৷ ইমতিয়াজ এখনো ওকে খেয়াল করেনি, সে মনোযোগ দিয়ে পড়ে যাওয়া কিছু তুলছে।

“কি করছেন?”

ইমতিয়াজ একপ্রকার চমকে উঠে বলল,
“ডিস্টার্ব হলো?”
“না না, তেমন কিছু না।”

মৃত্তিকা উঠে বসে। অনেকগুলো কাগজ ইমতিয়াজ নিজের ড্রয়ারে রেখে আলমারি বন্ধ করে। তারপর বিছানায় বসে বলে,
“এখনো ফজরের আজান দেয়নি। তুমি ঘুমাও।”

মৃত্তিকা কপালে এলোমেলো হয়ে থাকা চুলগুলো গুছিয়ে বলল,
“আর ঘুমাবো না। এই সময় ঘুম যখন ভে°ঙেছে, তখন তাহাজ্জুদ পড়াই ভালো।”

ইমতিয়াজ আলতো হাসে,
“ওকে, পড়ো তবে।”

মৃত্তিকা কপাল কুঁচকে বলে,
“আপনি পড়বেন না?”
“হ্যাঁ পড়া যায়।”
“তবে আপনি আগে অযু করে আসেন।”

ইমতিয়াজ মাথানেড়ে সম্মতি জানিয়ে উঠে ওয়াশরুমে চলে গেল। মৃত্তিকা দ্রুত উঠে আলমারি খুলে। ড্রয়ার থেকে অনেকগুলো কাগজ পায় সে, একটা ফিতা দিয়ে হালকা করে বাধা আছে৷ ফিতা খুলে কাগজগুলো বের করে মৃত্তিকা একটু অবাক হয়। তাহমিনাকে উদ্দেশ্য করে লেখা একেকটা চিঠি, হাতের লেখা যতদূর বুঝলো ইমতিয়াজের। এ চিঠি কোন অজানায় যাবে তা সেই জানে।

মৃত্তিকা একে একে সবগুলো চিঠি দেখতে লাগলো। কয়েকদিন পর পর হয়তো চিঠি লিখে। আজও একটা চিঠি লিখেছে,
“আজ হয়তো অন্যকারো হাতের পায়েস খেতে হবে। তোমাকে তো প্রতিদিন মিস করছি, আজ বোধহয় বেশি করবো। ইদ মোবারক মিনা, ভালো থেকো তুমি।”

অন্য একটা চিঠিতে লেখা,
“তুমি রাগ করেছো জানি, তবে জেনে রাখো তোমার স্থান কারো নয়। অলিন্দের ছন্দে মিশে গেছো তুমি। অন্যকেউ চাইলেও এ পর্যন্ত আসবে না।”

মৃত্তিকা জানে ইমতিয়াজ তাহমিনাকে আজও ভালোবাসে, তাহমিনার স্মৃ°তি হাতরে বেড়ায় আজও। তবুও মৃত্তিকার হিং°সা হলো। তাহমিনার স্থান সে পাবে না, চায় না সে স্থান। তাই বলে অন্যকারো হাতের পায়েস খেতে হবে, এভাবে তো না বললেও হতো।

মৃত্তিকা দ্রুত কাগজগুলো রেখে আলমারি বন্ধ করে৷ ইমতিয়াজ বেরিয়ে এসে গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলে,
“যাও, অযু করে নাও।”

মৃত্তিকা মাথানিচু করে চলে যায়। কান্না পাচ্ছে তার প্রচুর। সে কেঁদেছে, নামাজে বসেই কেঁদেছে সে। ঠিক যে ভালোবাসা পেতে রিপা বেগম সারাজীবন কেঁদেছিলেন, আজ তার মেয়েও একইভাবে কাঁদছে। কিস°মত বড়ই কঠিন, মা-মেয়েকে একই সুতায় বেঁধে দিয়েছে। মা না জেনে অ°নলে পড়েছিল আর মেয়ে তো জেনেবুঝে পড়েছে৷
______________________________________

ফজরের আযানের আগেই উঠেছে সারাহ্। ড্রিম লাইটের আলোয় আহনাফের উ°ন্মু°ক্ত বুকে মেহেদীর আঁকিবুঁকি দেখে সারাহ্ হেসে উঠে। হাতের মেহেদী কিছু আহনাফের বুকেও লেগে গেছে, আবার তার রঙ হয়েছে।

সারাহ্ আহনাফের বুকে হাত দেয়, মাথানিচু করে চুম্বন দেয়। মাথা ঠেকিয়ে শুয়ে থাকে, একসময় ঘুমিয়ে যায়। আযানের ধ্বনি শুনে আহনাফ উঠতে নিয়ে বুঝে সারাহ্ ওর বুকেই শুয়ে আছে৷

আহনাফ ওর মুখে মাথায় হাত বুলিয়ে জড়িয়ে ধরলো। মুখে ধীরে ধীরে আযানের জবাব দিচ্ছে সে। আযান শেষ হলে সারাহ্-কে ডাকে,
“ঐশী, উঠো।”

সারাহ্ চোখ পিটপিট করে উঠে৷ সরে আসতে চেয়েও আসতে পারলো না। আহনাফ ওর মাথাটা আবারো বুকে রেখে বলে,
“কখন দখল করে নিছো?”

সারাহ্ কিছু বলে না। আহনাফ ওর গাল টে°নে বলল,
“কি হলো? কথা বলো।”
“মেহেদী লেগেছে এখানে।”

আহনাফ মাথা উঠিয়ে দেখে হেসে দিলো। বলল,
“বিয়ের পর এমন একটু আধটু লাগতে পারে৷”

সারাহ্ হেসে উঠে বসে। আহনাফও উঠে বসে সারাহ্-র কাছে এসে বলল,
“তারমানে সারারাত আমাকে জড়িয়ে ধরে ছিলে? একটু সরে টরেও তো থাকা যায়৷ (বড় নিশ্বাস নিয়ে) না, তোমার লজ্জা শরম কিচ্ছু নাই।”

সারাহ্ ওর বুকে ধা°ক্কা দিয়ে উঠে চলে যায়৷ মুখে লাজুক হাসি লেগে থাকে। আহনাফ হেসে নিজের বুকে মেহেদীর রঙ দেখে।
______________________________________

“আমি পাহাড় ভাই°ঙ্গা জাইগ্যা উঠা চান্দেরও বুড়ি
অন্ধকারের মেঘলা মনে জোছনা-পরি।
আমি পাহাড় ভাই°ঙ্গা জাইগ্যা উঠা চান্দেরও বুড়ি
অন্ধকারের মেঘলা মনে জোছনা-পরি।

না বা°ন্ধিলি তুই আমারে মনেরও ঘরে
না ভা°সা°ইলি তুই আমারে প্রেমের জো°য়ারে।

আমি নিশি রাইতের জংলা ফুল
ভা°ঙা নদীর ভাঙা কূল
মইধ্যেখানে জাইগা থাকা চর।”

সকালের নাস্তা সাজাতে সাজাতে গান গাইছে মৃত্তিকা। মনের সুখে না দুঃখে তা তো জানে না, তবে গতকাল থেকেই এই গান তার মনে বেজে যাচ্ছে। মৃত্তিকা তো গান তেমন শুনে না, তবে বাসার পাশে সাউন্ড বক্সে কাল এই গান বেজেছে৷ তার ভালো লেগেছে লিরিক্সটা।

তার জীবনের সাথে সে মিল পেয়েছে। সেও ইমতিয়াজের জীবনে একটা নিশি রাতের জংলা ফুল হয়েই এসেছে আর নাহয় কোনো একটা চর, রাত ফুরিয়ে গেলে ফুল ঝরবে আর জো°য়া°র আসলে চর ডুববে।

ইমতিয়াজ ইদের জামাতে যেতে তৈরি হয়ে এসে চেয়ারে বসতে বসতে বলল,
“কখন করলে এতোকিছু?”

সেমাই, পায়েস, হোয়াইট পাস্তা, ফ্রেঞ্চ টোস্ট আর কফি। বেশ ভারি নাস্তা।

মৃত্তিকা জবাব না দিয়ে সুরভির রুমে নক করে বলল,
“আপু, খেতে আসো। মামানী আসেন।”
“আসছি।”

সুরভির উত্তর পেয়ে মৃত্তিকা নিজে চেয়ার টে°নে বসে পড়ে। ইমতিয়াজের খাবার ওর সামনে সাজিয়ে দেয়, তবে তাকে খাইয়ে দেয় না।

ইমতিয়াজ একচামচ পায়েস নিয়ে ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“খাও।”
“আমার জন্য আছে এখানে।”
“আমি দিচ্ছি তো।”

মৃত্তিকা অল্প একটু মুখে নেয়, ইমতিয়াজ বাকিটুকু খেয়ে ফেলে। মৃত্তিকার চেয়ার টে°নে কাছে এনে বলল,
“এড়িয়ে যাচ্ছো কেন?”

মৃত্তিকা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,
“কোথায়? না তো।”

ইমতিয়াজ ওর গালে হাত দিয়ে বলল,
“আমি তো বুঝি না, তাই মনে করো?”

মৃত্তিকা ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“অন্যকাউকে কেন বুঝতে যাবেন আপনি?”

অভিমানের সুর, প্রচন্ড অভিমান। একগাদা অভিযোগ নেই, তবে অভিমান মেখেঝেখে আছে। ইমতিয়াজ বলে,
“চিঠিগুলো পেয়ে গেছো? (একটু থেমে) আমার পারমিশন ছাড়া ড্রয়ারে হাত দিয়েছো?”

মৃত্তিকা হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ে। ইমতিয়াজ বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে ওর কপালে, গালে স্পর্শ করে বলল,
“অভিমান হয়েছে খুব?”

মৃত্তিকা চোখ নামিয়ে নেয়৷ ইমতিয়াজ বলে,
“অভিমান করো না প্লিজ। সবটা আমার জন্য এতো সহজ নয়।”

মৃত্তিকা একটু এগিয়ে এসে ইমতিয়াজের ঠোঁটে নিজের ঠোঁট স্পর্শ করায়। মৃত্তিকা সরে আসতেই ইমতিয়াজ হেসে মুখ ঘুরিয়ে নেয়৷ বলে,
“নামাজে যাবো আমি, দেরি হচ্ছে।”

সুরভি ও দেলোয়ারা রুম থেকে বেরিয়ে আসে। সকলে একসাথে নাস্তা করে৷ নাস্তা শেষে ইমতিয়াজ উঠে রুমে গিয়ে চুল আঁচড়ে আবারো ঠিক হচ্ছে। মৃত্তিকা পিছুপিছু আসে। আতরের শিশি নিয়ে ওর গলার কাছে, হাতে লাগিয়ে দেয়৷

“এখনো রেগে আছো?”

ইমতিয়াজের কথার জবাব মৃত্তিকা দিলো না। ইমতিয়াজ ওর মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,
“কথা তো বলো।”

মৃত্তিকা ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“তাহমিনার স্থান আমি কোনোদিন চাইনি আর চাইবোও না।”

ওকে পাশ কা°টিয়ে চলে যায়। মৃত্তিকার চোখের পানি সকলের অগোচরে ঝ°রে পড়ে৷ কেন কাঁদছে সে? কার জন্য?
______________________________________

আহনাফ আর আব্বাস সাহেব নামাজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ব্যস্ততা যাচ্ছে সারাহ্-র। আহনাফকে খাইয়ে দিয়েছে, এখন আবার তৈরি হতেও সাহায্য করতে হচ্ছে।

আহনাফ পুরোপুরি তৈরি হয়ে গেলে সারাহ্ ওকে লম্বা করে একটা সালাম দেয়,
“আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।”

আহনাফ হেসে বলল,
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।”

আহনাফের সালাম পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই সারাহ্ হাত বাড়িয়ে বলে,
“সালামি দেন।”

আহনাফ ওয়ালেট বের করতে করতে বলল,
“সালামের জবাব পুরো শুনতে হয়৷ সূরা আন নিসায় বলা আছে, আর যখন তোমাদেরকে অভিবাদন করা হয় (সালাম দেওয়া হয়), তখন তোমরাও তা অপেক্ষা উত্তম অভিবাদন কর অথবা ওরই অনুরূপ কর। (আল-নিসা ৪:৮৬)”

সারাহ্ একটু নিচুস্বরে বলল,
“আচ্ছা, এরপর থেকে খেয়াল রাখবো।”

আহনাফ ওর গাল টেনে দিয়ে হাতে দুইশত টাকার দশটা নোট ধরিয়ে দিলো। এমনভাবে নোটগুলো বের করলো যেন সে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে। সারাহ্ মুচকি হাসে৷

আহনাফ ওকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুম্বন করে বলল,
“ইদ মোবারক, অনেক ভালো দিন কাটুক।”
“আপনাকেও ইদ মোবারক, সাইদার পাপা।”
“সাইদা?”

আহনাফ চমকে উঠে ওর দিকে তাকায়। সারাহ্ হেসে বলল,
“আন্দাজ, সাদাবও আসতে পারে।”
______________________________________

“মৃত্তিকার কাছে ধরা দিও না, ইমতিয়াজও তোমাকে খুঁজছে হয়তো৷ শরীফ অস্ট্রেলিয়া যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করো, খেলা তারপর শুরু হবে।”
“আর কি করবে তুমি? তিন আঙ্গুল দিয়েই মেয়েটা তোমার কপাল ফা°টিয়েছে, সুযোগে ধরলে মে°রে ফেলবে।”
“এই শাফিনকে মা°রা এতো সহজ নয়। আরে আমাকে এখনো খুঁজেই পায়নি।”
“কিন্তু তুমি ধরা পড়েছো। অতিরিক্ত চ°তু°রতা করতে গিয়ে ধরা পড়েছো।”

শাফিন হাসলো। হো হো করে বেশ কিছুক্ষণ হাসার পর শান্ত হলো। মাথার উপরের চুলগুলো সরিয়ে বলল,
“অভিজ্ঞতায় আমি তাদের চারগুণ, অথচ মাথার একটা চুলও পড়েনি। আমাকে গ্রে হেয়ার হ্যান্ডসাম বললেও অবাক হবো না।”
“ভাব কম নেও।”

ধম°ক দিয়েই ফোন রাখে মমতাজ বেগম। ফোনটা খাটে ফেলে রান্নাঘরে যায়৷ সবকিছু গুছিয়ে রেখে এসে রুমে বসে মৃত্তিকাকে কল দেয়।

“আসসালামু আলাইকুম, ইদ মোবারক বড়মণি।”

মৃত্তিকার মিষ্টি কথায় মমতাজ বেগম হেসে বলল,
“ইদ মোবারক৷ আজকে কাকরাইল আসো।”
“ইমতিয়াজ ফিরলে আসবো।”
“হ্যাঁ, আসো। (একটু থেমে) কোথাও যাবে নাকি বেড়াতে?”

মৃত্তিকা একটু ভাবে। কোথায় যাবে ওরা? ইদে তো লোকে গ্রামে যায়। ইমতিয়াজের গ্রামের বাড়িতে কেউ নেই, মৃত্তিকার কেউ থেকেও নেই। মুখ বাঁকিয়ে বলে,
“না, কোথাও যাবো না।”

বেশ কিছুক্ষণ দুজনের কথা হয়। ফোন রাখারা কিছুক্ষণের মধ্যেই শরীফের নাম্বার থেকে কল আসে৷ মৃত্তিকা রিসিভ করে,
“হ্যালো।”

নি°ষ্প্রাণ একটা কন্ঠ পাওয়া গেল,
“ইদ মোবারক মা। কেমন আছো?”
“ভালো।”
“আজকে কি আমরা একসাথে লাঞ্চ করতে পারি?”
“না, দাওয়াত আছে।”

ঠা°স ঠা°স করে জবাব দিচ্ছে মৃত্তিকা। শরীফ একটু মন খারাপ করলো। মেয়ের এমন আচরণ মেনে নেয়া কষ্ট, যদিও দোষটা তো ওরই।

“আগামী সপ্তাহে আমি চলে যাবো, তাই চাচ্ছিলাম…”

কথা শেষ হওয়ার আগেই মৃত্তিকা কল কে°টে দেয়৷ এতো এতো চিন্তায় কেউ ভালো থাকতে পারে না। মৃত্তিকাও ভালো নেই, আবার নতুন চিন্তা সে আনতে চায় না।

ইমতিয়াজ ফিরে এসে জানালো ওরা কাকরাইল যাচ্ছে না, বরং কাকরাইলের সবাই এখানে আসবে। রান্নার জোগাড় শুরু হলো।
______________________________________

বেশ সুন্দর করে সেজেছে সামিহা। খয়েরী গাউন আর হালকা মেকআপে অসাধারণ লাগছে ওকে। তানজিম চোখ ফেরাতে পারবে না, ও তো এতে একদম শিউর।

টিএসসিতে এসেই তানজিমের সঙ্গে দেখা হলো৷ ঘুরতে যাবো দুজনে, তাইতো এখানে এসেছে।

ওর পা থেকে মাথা অব্দি দেখে তানজিম। সামিহা মুচকি হেসে গাউনটা ধরে দুদিকে মেলে দিয়ে বলল,
“কেমন লাগছে আমাকে?”
“ডার্ক ব্রাউন চকলেট কেকের উপর হোয়াইট গার্নিস, ওসাম।”

সামিহা চোখমুখ কুঁচকে ফেলে। বলল,
“এ কেমন প্রশংসা?”
“আমি তো তোর প্রশংসা করিনি।”
“যা, তোর সাথে কোথাও যাচ্ছি না।”

সামিহা চলে যেতে নিলে তানজিম ওর হাত ধরে একটা°নে কাছে নিয়ে আসে। সামিহা চোখ বড় করে একবার তানজিমের দিকে তাকায়, আরেকবার তাকায় হাতের দিকে৷

তানজিম বহুবার ওর হাত ধরেছে, তবে স্পর্শে পার্থক্য করতে সামিহা শিখে গেছে। তানজিম দুচোখ ভরে ওকে দেখে, প্রশংসা বাক্য ছুঁড়ে ফেলতে না পারলেও প্রতি পলকে ভালোবাসা ছুঁড়ে দিলো।

দূর থেকে ওদের দেখে অপরূপা। ডানকানে থাকা ব্লুটুথ নামক ডিভাইসে হাত দিকে বলল,
“তানজিম-সামিহা একত্রেই আছে।”

অপরদিক থেকে মমতাজ বেগম বলেন,
“শুধু নজর রাখো। সামিহাকে শুধু তানজিমের দিকেই ঠে°লে দাও, বাকিটা তানজিম বুঝে নিবে।”

চলবে…..

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

চতুঃচত্বারিংশ পর্ব (৪৪ পর্ব)

লুৎফর রহমান ও মমতাজ বেগম ইমতিয়াজের বাসায় এসেছে, তানজিম আসেনি। এটুকু পর্যন্ত মৃত্তিকা খুশি থাকলেও শরীফ বাসায় আসার সে আর খুশি থাকতে পারলো না।

ড্রইংরুমে সকলের সাথে শরীফ বসেছে। মৃত্তিকা সকলের হাতে শরবত দিয়ে শরীফের গ্লাসটা টেবিলে রেখে চলে আসে।

রুমে এসেই ইমতিয়াজকে বলে,
“এই লোকটাকে খবর না দিলে হতো না?”

ইমতিয়াজ স্বাভাবিকভাবে জবাব দেয়,
“আরে, আজ ঈদের দিন। শশুর উনি, তো দাওয়াত দিতে হবে না?”

মৃত্তিকা কি°ড়মি°ড় করে উঠে,
“আপনার এসব শশুর-জামাই নাটক বন্ধ করেন।”

ইমতিয়াজ শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে বলল,
“কিসের নাটক? আমার কথাবার্তা কাজকর্ম কি তোমার কাছে নাটক মনে হয়?”

“এরচেয়ে কম কি?”
ইমতিয়াজের পা থেকে মাথা অব্দি দেখে বেশ গরম সুরে কথাটা বলে মৃত্তিকা চলে যায়। ইমতিয়াজ বুঝতে পারে চিঠির বিষয়টা নিয়ে মৃত্তিকার আচরণে পরিবর্তন এসেছে।

সুরভির ছেলের নাম রাখা হয়েছে রাইদ। সুরভি ছেলেকে কোলে নিয়ে ড্রইংরুমে আসে। সুরভির থেকে চেয়ে রাইদকে কোলে নেয় শরীফ।

মৃত্তিকা তা দেখে সুরভিকে বলে,
“এই মানুষের কাছ থেকে ছেলেকে দূরে রাখো। না হলে তার মতই হয়ে যাবে।”

শরীফ মৃত্তিকার দিকে তাকায়। মৃত্তিকার তেমন একটা হেলদুল হলো না। সে কথা শেষ করে চুপচাপ চলে গেল। শরীফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
______________________________________

“চল আজ আমাদের বাসায় লাঞ্চ করবি।”

সামিহার কথায় তানজিম অল্প হেসে বলে,
“আজ না, আজ ইমতিয়াজ ভাইয়ার বাসায় যেতে হবে।”

সামিহার একটু মন খারাপ হলো।
“ওহ, কখনো তো আসিস না। ভাবলাম আজ আসবি।”
“আসবো একদিন, তবে আজ না।”
“ওকে, দেখব কবে আসিস।”

সামিহাকে বিদায় জানিয়ে তানজিম ফিরে হাঁটতে শুরু করার সময় রাস্তার অপরপাশে ওর সাথে সাথে হাঁটতে থাকা অপরূপার দিকে নজর যায়। টিএসসি থেকে মেয়েটা তাদেরকে অনুসরণ করছে। তানজিম খেয়াল করেছে, তবে নিশ্চুপ ছিল। তবে এবারে আর সে শান্ত থাকতে পারেনা।

রাস্তা পেরিয়ে অপরপাশে গিয়ে অপরূপা হাত ধরে বলে,
“কি সমস্যা? আপনি কখন থেকে আমাদের অনুসরণ করছেন, আবার আমাদের ছবিও তুলেছেন। কেন?”

তানজিমের গ°মগ°মে সুরের কথা শুনে অপরূপা ঘাবড়ে যায় না, বরং হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বেশ শান্ত সুরে বলল,
“ওমা, আমি কেন আপনাদের ফলো করবো? আমি তো ঘুরতে বেরিয়েছি।”
“তাই বলে আমাদের পিছুপিছু?”

অপরূপা মৃদু হাসে। কপালের চুলগুলো সরিয়ে বেশ ভাব রেখে বলল,
“আমার ঘুরা আমি ঘুরছি। এখন তা যদি আপনার পিছুপিছু হয়ে যায়, তাতে তো আমার কোনো দোষ নেই।”

তানজিম রেগে গিয়ে অপরূপার গালে একটা চ°ড় বসিয়ে দেয়। হাত সরানোর আগে অপরূপা কান থেকে ব্লুটুথ খুলে নিয়ে নেয়। আশেপাশে লোক জড়ো হয়ে গেল। লোকজন দেখেছে একটা ছেলে একটা মেয়েকে মে°রেছে। খুব স্বাভাবিক একটা বিষয় যে সবাই মেয়েটার পক্ষ নিবে। বিষয়টা হলোও তাই।

তানজিম লোকের কথায় খুব একটা মাথা না ঘামিয়ে স্থান ত্যাগ করে। একটু সরে এসে কানে ব্লুটুথটা লাগাতেই অপর পাশের মমতাজ বেগমের কন্ঠ শুনতে পায়। বেশ শান্ত শুনে উনি বলেন,
“তানজিম কি আছে না চলে গেছে? এত শো°রগো°ল কেন? অপরূপা?”

মায়ের কন্ঠ একবারেই বুঝে যায় তানজিম। দাঁতে দাঁত ঘ°ষে নিজেকে শান্ত রাখে। জবাব না পেয়ে মমতাজ বেগম বলেন,
“আমি মৃত্তিকার বাসায় আছি৷ বেশি কথা বলতে পারব না। জলদি বলো তানজিম গিয়েছে কিনা?”

“আমাকে কেন ফলো করছে মেয়েটা? মা, তাও তুমি তা আমাকে জানতে দিতে চাচ্ছো না।”
“তানজিম?”
অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেন মমতাজ বেগম।

তানজিম নির্বিকার ভাবে জবাব দেয়,
“হ্যাঁ, আমি তানজিম।”

একটু দূরে দাঁড়ানো অপরূপা কল কেটে দেয়৷ দৌড়ে এসে তানজিমের কাছ থেকে ব্লুটুথটা নিয়ে বলে,
“মামাকে চিনেছো, মাকে না।”

তানজিম কপাল কুঁচকায়, তবে কি মাও একই কাজে জড়িত। বুকে হাত দেয় তানজিম। অস্ফুট স্বরে বলল,
“মা, এসব সত্যি করো না।”

অপরূপা চলে যেতে নিলে তানজিম তাকে বলে,
“আমাকে কি বলা যাবে পুরো ঘটনা?”

অপরূপা হেসে বলল,
“অবশ্যই, তবে তোমার মা বলবে। আমি শুধু ব্যবস্থা করে দিতে পারি।”
“তবে তাই করুন।”

অপরূপা রহস্যজনকভাবে হাসলো। তারপর বলল,
“এসো।”

তানজিম সরল মনে ভেবেছে অপরূপা সত্যি ব্যবস্থা করবে৷ অথচ বিষয়টি তা হলোই না। অপরূপা তাকে গলির ভিতরে নিয়ে এলো, এরপর নিজের লোকজন দিয়ে তানজিমকে আচমকা মা°রতে শুরু করলো। তানজিম চারজন বিশালদেহী লোকের সাথে পেরে উঠে না, তা সম্ভবও নয়।

আহত তানজিম রাস্তায় মুখ থু°ব°ড়ে পড়লে অপরূপা ওর সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“দোয়া করো তানজিম, দোয়া করো। এমন মা যেন তোমার শত্রুরও না জোটে। (একটু হেসে) তোমার ভালোবাসা কাজে লাগিয়ে সামিহার ক্ষতি করতে চেয়েছিল। মায়ের নিরীহ মুখের আড়ালের শ°য়°তানকে তুমি চেনোই না।”

তানজিম রাগে রাস্তায় হাত দিয়ে দুইটা চা°প°ড় দেয়৷ ধুলো উড়ে, কিন্তু তানজিম উঠতে পারে না। অপরূপা তানজিমের পকেট থেকে ফোন বের করে তানজিমের হাত টেনে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে আনলক করলো। তার কল লাগায় মৃত্তিকাকে৷

মৃত্তিকা রিসিভ করেই ধম°ক দেয়,
“কিরে তানজিম? কই তুই?”

অপরূপা ভ্রূ উঁচিয়ে তানজিমের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সামিহার বাসার কাছে রাস্তায় পড়ে আছে, এসে নিয়ে যাও।”
“তুমি কে?”
মৃত্তিকা ঘাবড়ে গিয়ে প্রশ্ন করলো।

অপরূপা হেসে বলল,
“এক রহস্যে ভরা রূপকথা আমি।”

কল কে°টে ফোন ফেলে দিয়ে অপরূপা উঠে চলে যায়। যেতে যেতে বলে,
“মাকে বলে দিও, অপরূপাকে একটা চ°ড় মা°রায় অপরূপা তোমার এই হাল করেছে।”

তানজিম ধীরে ধীরে এগিয়ে বসতে চেয়ে আবারো পড়ে যায়। পায়ের দিকে আর হাতে বেশি মেরেছে। মনে সাহস এনে আবারো উঠতে চায়, পারে না। উপায় না পেয়ে ফোন বের করে সামিহাকে কল দেয়।

“হ্যালো।”
“সামি, তোদের বাসার পাশে যে ছোট গলিটা ওখানে একটু আয়।”

তানজিমের কন্ঠ শুনেই বোঝা যাচ্ছে সে ভালো নেই। ফোন ফেলে ছুটে যায় সামিহা। গলির ভিতর এসেই তানজিমকে দেখে সে।

“তানজিম, কি হয়েছে তোর?”

ওকে ধরে টেনে তুলে সামিহা। তানজিমের শরীরের ভার নিতে কষ্ট হয় সামিহার৷ তবুও চেষ্টা করে প্রাণপণে।

তানজিমকে নিয়ে বাসার গ্যারেজে বসিয়ে দারোয়ান সজীবকে বলে,
“আংকেল, একটু পানি আনেন প্লিজ।”
“হ্যাঁ মা, আনছি।”

তানজিম সামিহার দিকে তাকায়। সেই ওকে সামিহার সাহায্যেই প্রয়োজন হলো, আর ওকে দিয়েই সামিহার ক্ষতি করাতে চেয়েছে মমতাজ বেগম।
______________________________________

দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর বাইরে বের হয়েছে সারাহ্, আহনাফ ও আব্বাস সাহেব। গন্তব্য খুব একটা দূরে নয়, আহনাফদের গ্রামের বাড়ি। কুমিল্লা শহর থেকে একটু দূরে সাহেবাবাদে৷

সিএনজি একদম বাড়ির উঠান পর্যন্ত গেল। সারাহ্ নেমে দাঁড়িয়ে আশপাশটা দেখে। একটা একতলা ছাদ করা বাড়ি, মোটামুটি পুরোনো বাড়িটা৷ বাড়ি সামনে উঠান আর ডানদিকে ছোট বাগান। পাতা জমে পড়ে আছে একপাশে৷ কাকে দিয়ে যেন আব্বাস সাহেব এটা পরিষ্কার করিয়েছেন।

আব্বাস সাহেব আহনাফকে বলেন,
“তোমার ঝুমা চাচী আছে না? উনাকে বলেছিলাম কাউকে দিয়ে পরিষ্কার করাতে, করিয়ে রেখেছে।”

আহনাফ হাসি হাসি মুখে বলল,
“ভালো হয়েছে। চলো।”

সবাই ভিতরে গেল। আহনাফ ব্যাগগুলো রেখে সারাহ্-কে বলে,
“এইতো বাড়ি, সুন্দর না? এই গ্রামের ফার্স্ট বিল্ডিং তুলেছিলো বাবা। এযুগের নয়।”

সারাহ্ আলতো করে হাসে। আব্বাস সাহেব হাসতে হাসতে অন্যমনস্ক হয়ে যান, উনার মনে পড়ে স্ত্রী রোজার স্মৃ°তি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভিতরে নিজের রুমে চলে যায়। উনার মন খারাপ বা দীর্ঘশ্বাস কেউ খেয়াল করে না, উনি চায় না কেউ দেখুক। উনার রোজাকে উনি মনে করবেন, কষ্ট পাবেন, হাসবেন, স্মৃ°তির পাতায় দৌড়ে বেড়াবেন। এসব উনার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়, কেউ এসব জানবে না।

সারাহ্ ঘুরে ঘুরে প্রতিটা রুম দেখছে৷ আহনাফ ওর কৌতুহলটা দেখে হাসে।

“ঐশী?”
“জি।”

সারাহ্ না তাকিয়েই জবাব দেয়। আহনাফ বলে,
“ছাদে যাবে?”
“হ্যাঁ।”

আহনাফ ওকে সিঁড়ির কাছে নিয়ে যায়। সারাহ্ পা বাড়ালে ওকে পাঁজা কোলে তুলে ছাদে নিয়ে আসে। সারাহ্ চুপটি করে গলা জড়িয়ে থাকে।

ছাদে পুরো ময়লা রয়েছে। আহনাফ আফসোস করে বলে,
“এটা কি কেউ পরিষ্কার করতে পারেনি? ওফ।”
“হইছে।”

সারাহ্ ছাদের একপাশে গিয়ে দাঁড়ালো। অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। আহনাফ ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। সারাহ্-কে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলে সারাহ্ ওর বুকে মাথা রেখে বলে,
“আমরা এখানে কিছুদিন থাকি, কলেজ খুললেও এখানে থাকি প্লিজ৷ এখান থেকে গিয়ে ক্লাস করবেন।”

আহনাফ ওর মাথায় চুম্বন করে বলল,
“আচ্ছা থাকো। তোমার যতদিন ইচ্ছা থাকো।”
______________________________________

তানজিমকে বাসায় নিয়ে এসেছে মৃত্তিকা আর ইমতিয়াজ। এখন তানজিমের একপাশে মৃত্তিকা বসে আছে, অন্যপাশে সামিহা। তানজিম অপরূপার কথাটা দুজনকে জানালেও কৌশলে মায়ের কথাটা এড়িয়ে যায়। একটা মেয়ে তাদের ফলো করেছে এবং কোনো কারণ ছাড়াই তাকে লোক দিয়ে মে°রেছে, ব্যস এটুকুই বলেছে।

মৃত্তিকা একটু চিন্তায় পড়ে। শাফিন এসব করাচ্ছে এতে সে শিউর, তবে এখন তানজিমের পিছু পড়েছে। মৃত্তিকার মনে পড়ে স্টোররুম থেকে পাওয়া সামিহার ফ্যামিলি ফটোর কথা, তবে কি সামিহার জন্য কোনো বিপদ? মৃত্তিকা তাকায় সামিহার দিকে।

সামিহা খুব শান্ত হয়ে তানজিমের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর দৃষ্টি বোঝাচ্ছে এই মানুষটা তানজিমকে কতটা চায়, কতটা ভালোবাসে৷ মৃত্তিকা মুখ টি°পে হাসে, সাথে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এ ভালোবাসাই না সামিহার জীবনের কাল হয়।

“সামিহাকে চলে যেতে বলো আপু। আংকেল চিন্তা করবে।”

মৃত্তিকা ঘড়ি দেখে বলল,
“হ্যাঁ, সামিহা৷ তুমি চলে যাও বরং। ইমতিয়াজ পৌঁছে দিয়ে আসবে।”

সামিহা গাল ফুলিয়ে বলল,
“কারো যাওয়া লাগবে না। যখন প্রয়োজন হয়, তখন (ব্য°ঙ্গ করে) সামি একটু আয়। আর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে ফুড়ুৎ।”

সামিহা হনহনিয়ে চলে যায়। তানজিম হেসে মাথা নাড়ে৷ সামিহার এই বাচ্চামোগুলো তার ভালো লাগে। তবে মায়ের বিষয়টা মনে পড়তেই গম্ভীর হয়ে যায় সে।

দুইদিন পার হয়, তানজিম শারীরিকভাবে কিছুটা ভালো হলেও মানসিক অবস্থা একেবারেই খারাপ। মায়ের সাথে কোনো কথা নেই তার। কেমন যেন গু°মরে আছে।

বাসা থেকে বের হওয়ার সময় মমতাজ বেগম ওকে ডেকে বলে,
“খেয়ে যাও।”

তানজিম কিছু না বলে বেরিয়ে যায়৷ মৃত্তিকার সাথে দেখা করতে এসেছে। অপরূপার সেই কথা মামাকে চিনেছো, মাকে নয়। এর ব্যাখ্যা ওর চাই। ভ°য়ং°কর এক বাক্য।

বেইলি রোডের কাছে এক রেস্টুরেন্টে বসে মৃত্তিকাকে সেদিনের পুরো ঘটনা খুলে বলে তানজিম। সব শুনে মৃত্তিকা বলে,
“অনেক হয়েছে, এবারে আর নয়।”
“করবে কি তুমি?”

মৃত্তিকা তাকায় তানজিমের দিকে৷ তার মনে তো অন্যকিছুই চলছে। শাফিনকে শাফিনের টো°পেই ধরতে হবে৷

মৃত্তিকা হেসে বলল,
“যখন করবো তখন দেখবে৷ বড়মণিকে তুমি চোখে চোখে রাখো আর বেশি কথা বলো না। যে মা মেয়েদের মা°রতে পারে সে ছেলেকেও মা°রতে পারবে।”

এরমাঝেই মৃত্তিকার ফোনে একটা ম্যাসেজ আসে৷ ফোন কেঁপে উঠায় হাতে নিয়ে দেখে বাবার ম্যাসেজ,
“কাল সকালে আমার ফ্লাইট, মিটিং এর সিদ্ধান্ত আগে ভাগেই যেতে হবে। ভালো থেকো মা।”

মৃত্তিকা ম্যাসেজটা দেখে রেখে দেয়। বাবার প্রতি তার বিন্দুমাত্র ভালোবাসা নেই, এসবে তার কিছু যায় আসে না।

সে তানজিমকে জিজ্ঞাসা করে,
“মেয়েটার নাম কি?”
“অপরূপা।”
______________________________________

এখনো গ্রামের বাড়িতেই আছে সারাহ্, আহনাফ আর আব্বাস সাহেব। আনন্দ এখানেই সবচেয়ে বেশি। ভোরে মোরগের ডাকে ঘুম ভা°ঙা, নামাজের পর বাগানে ঘুরে বেড়ানো, পাখি দেখা। রাতে ঝিঁঝি পোকার ডাক আর ব্যাঙের ঘ্যাঙরঘ্যাঙ শব্দ। পুকুরে বর্শি ফেলে মাছ ধরা, কিংবা পুকুর ঘাটে দাঁড়িয়ে হাঁস গোনা। আনন্দ আছে সবকিছুতেই।

সারাহ্ খুশি, সারাদিন সে হাসতে থাকে। আহনাফ দেখে মুগ্ধ হয়ে।

সন্ধ্যায় আহনাফ বেরিয়ে গেছে নাস্তা কিনতে। সারাহ্-র ইচ্ছা হয়েছে বাইরের নাস্তা খাবে৷ আব্বাস সাহেব ঘরে নেই। সারাহ্ টেবিল সাজাচ্ছে।

দরজায় নক হয়। সারাহ্ জোরে বলল,
“খোলা আছে।”
“আমি জানি।”

দরজা ঠেলে ভিতরে আসে জামিল। সারাহ্ কন্ঠ শুনে ফিরে তাকিয়ে জামিলকে দেখে সরে যায়। পরিকল্পিত বিয়ের পিছনে জামিল আছে, শাফিনের সাথে জামিল মিলে ছিল। ছোট ছোট এই কয়েকটা কথা সারাহ্ জানে।

জামিল ভালো উদ্দেশ্যে এখানে আসেনি। মায়ের কথাগুলো মনে পড়ে। শাফিন কেমন মানুষ আর জামিল কেমন মানুষ তা ওর বোঝা হয়েছে। আর কোনো প্রশ্রয় শ°য়°তানকে দিবে না সে।

জামিল কিছু বলার আগেই চিনামাটির ফুলদানিটা নিয়ে তার মাথায় আ°ছ°ড়ে ফেলে সারাহ্। ভে°ঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায় সেটা। জামিল ওকে ধরতে গেলে ধা°ক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দেয়। সারাহ্ জোরে নিশ্বাস ফেলে মাটিতে পড়ে যাওয়া জামিলের গ°লায় নিজের সর্বশক্তি দিয়ে পা ফেলে। জামিলের শ্বাস ব°ন্ধ হওয়ার জোগাড়।

সারাহ্ জোরে চেঁচিয়ে বলে,
“ইয়া আল্লাহ্।”

এমনসময়ই আহনাফ এসে ঘরে ঢুকে। সারাহ্ দৌড়ে এসে আহনাফের পিছনে দাঁড়িয়ে পড়ে। শার্টের হাতা খা°ম°চে ধরে লুকিয়ে যায়৷ এতোক্ষণের সাহসীকতাকে ব°লি দিয়েছে সে, এখন তাকে আহনাফ র°ক্ষা করবে।

আহনাফ ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
“পীপিলিকার পাখা গজায় ম°রি°বার তরে। বাসনা আজ তোমার নয়, আমার পূর্ণ হবে।”
“ওকে শাফিনের কাছেই নিয়ে যেতে এসেছি।”

আহনাফ ফিক করে হাসে। বলে,
“মেয়েটা একা ছিল, তাতেই টাচ অব্দি করতে পারোনি আর এখন তো আমি আছি।”

আহনাফ হুট করে চেঁচিয়ে বলে,
“আসতে বলো তোমার শাফিনকে। আমিও দেখবো সে আমার ঐশীর কি করতে পারে।”

সারাহ্ আহনাফের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। রাগে তার গলার পাশটা ঘনঘন কাঁপছে। সারাহ্ আহনাফের হাতটা জড়িয়ে ধরে। আহনাফ ওর দিকে তাকিয়ে হাত ছাড়িয়ে জামিলের দিকে এগিয়ে যায়।

চলবে…..

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

পঞ্চচত্বারিংশ পর্ব (৪৫ পর্ব)

জামিলকে চেয়ারে বেঁধে বসিয়ে রাখা হয়েছে। আব্বাস সাহেবের জন্য অপেক্ষা করছে আহনাফ৷ সারাহ্ শোবার ঘরের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে, দৃষ্টি তার আহনাফে নিবদ্ধ৷ আহনাফ জামিলের সামনে সমানে পায়চারি করে যাচ্ছে।

প্রশ্ন তার একটাই,
“শাফিন কেন সারাহ্-কে চায়? শুধুই কি নার্গিস পারভিনের সাথে পুরোনো শ°ত্রু°তা?”

জামিল কোনো উত্তর দিচ্ছে না। কথাই বলছে না সে। আহনাফ থেমে থেমে একই প্রশ্ন করে যাচ্ছে।

আব্বাস সাহেবকে খবর দেওয়া হয়েছে। উনি যথাসম্ভব দ্রুত চলে আসেন। ঘরে ঢুকেই আহনাফকে প্রশ্ন করেন,
“কি হয়েছে? সারাহ্ ঠিক আছে?”

আহনাফ একবার সারাহ্-র দিকে তাকায়। তারপর মাথা হেলিয়ে বলে,
“হ্যাঁ, সে ঠিক আছে।”

আব্বাস সাহেব জামিলের সামনে গিয়ে বলেন,
“কি চাও? কেন এত বড় বড় পরিকল্পনা করছো তোমরা?”
জামিল হেসে অন্যদিকে তাকায়।

আহনাফ চেয়ার টে°নে তার মুখোমুখি বসে বলে,
“দেখো যত তাড়াতাড়ি তুমি মুখ খুলবে তত তোমার ভালো, আর যত দেরি করবে (একটু থেমে) ততই খারাপ হবে।”

জামিল এবারে বলে,
“খারাপের কি হবে? কোন পর্যায়ে যাবে? বড়জোর মা°রবে এরচেয়ে বেশি তো কিছু না।”

আহনাফ কপাল কুঁচকায়। “বড়জোর মা°রবে” কথাটা বলতে বুঝায় যে মা°র তার কাছে কোনো ব্যাপারই না।

আহনাফ জামিলের দিকে ঝুঁকে বলল,
“শুধু মা°র নয়, ট°র্চা°র করব। মা°র আর ট°র্চা°রের পার্থক্য বোঝো? না বুঝলে সমস্যা নেই, ফিজিক্সের মতো এই সূত্রটাও আমি ভালোই বুঝাই।”

আহনাফ আব্বাস সাহেবের দিকে তাকালে উনি মাথা নাড়িয়ে ওকে অনুমতি দিলো। মুখে বললো,
“মেইন গেট অফ করে দিও।”

আব্বাস সাহেব রুমে চলে গেলেন। সারাহ্ বাপ-বেটার কথোপকথন বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনলো এবং যা বুঝলো তার অর্থ দাঁড়ায় দুজনেই শান্ত স্বভাবের, কিন্তু হিং°স্র। চুপি চুপি এসে বাঘের মতো ঝাঁ°পিয়ে পড়াই এদের স্বভাব।

জামিলের মুখে মোটা লাল স্কচটেপ লাগিয়ে দিলো আহনাফ। তারপর দুইহাতের বাঁধন হালকা করে চেয়ার থেকে উঠিয়ে আবারো দুইহাত শক্ত করে বেঁধে দিলো।

সারাহ্-কে বলল,
“ঐশী, নিজের রুমে থাকবে।”

জামিলকে টে°নে°হিঁ°চ°ড়ে ডাইনিং এর পাশের খালি রুমে নিয়ে যায় সে। সারাহ্ রুমে যায় না, বরং ধীর পায়ে গিয়ে সে রুমের দরজায় দাঁড়ায়। আহনাফ ওকে পাশ কা°টিয়ে বেরিয়ে এসে বাড়ির সব দরজা-জানলা লাগিয়ে দেয়।

রুমে আবারো প্রবেশের সময় সারাহ্-র দিকে তাকিয়ে বলল,
“রুমে যেতে বলেছি তোমাকে।”
“আমি একটু থাকি?”
“না।”

আহনাফ সারাহ্-কে সরিয়ে দিয়ে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দেয়। পিনপতন নিরবতা চলে এসেছে পুরো ঘরে। সারাহ্ চলে যায় না, দেয়ালে হেলান দিয়ে এখানেই বসে থাকে। একসময় ঘুমিয়ে যায়।

সময় কা°টে, সন্ধ্যারাত পেরিয়ে মধ্যরাতে প্রবেশ করলো পৃথিবীর এ প্রান্তটা। ঘড়িটা জানান দিচ্ছে রাত একটা বেজেছে।

হঠাৎ সারাহ্-র ঘুম ভা°ঙে, কেউ তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে রেখেছে৷ সারাহ্ কোনোমতে মাথা তুলে অন্ধকার রুম দেখে চেঁচিয়ে উঠে,
“এই কে?”

আহনাফ চমকে উঠে ওর মুখ চেপে ধরে বলল,
“কে হবে? আমি। আস্তে চেঁচাও, বাইরে থেকে লোকে শুনলে খারাপ ভাববে।”

সারাহ্-র ঠোঁট কাঁপে, আহনাফ হাত সরায়। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সারাহ্ বলে,
“আমরা কোথায় আছি? রুমে?”
“না, আমরা মঙ্গল গ্রহে যাচ্ছি। স্পেসশিপে আছি।”

সারাহ্ আহনাফের হাতে একটু চিমটি কে°টে বলে,
“ধুর, কি বলেন এসব? (একটু থেমে) ওই লোকটার কি হলো?”
“কিছু না।”
“মে°রেছেন?”

আহনাফ উত্তর দেয় না। রুমের ঘুটঘুটে অন্ধকারে আহনাফের চেহারাও সারাহ্-র দেখা হয় না। সারাহ্ হাত বাড়িয়ে আহনাফের চোখেমুখে হাত দিতেই সে বলে,
“কি হচ্ছে, ঐশী?”

সারাহ্ মুচকি হাসে। সে অনুভব করছে তার আহনাফকে। আহনাফের গালে হাত দিয়ে বলল,
“এতো ঘটা করে রুমে নিয়ে গিয়ে মা°রে°ননি?”

আহনাফ সারাহ্-র আরো কাছে নিয়ে এসে বলল,
“তাকে মে°রেছি কিনা সেটা তার বিষয়, তোমার বিষয় হলো তোমাকে এখন আদর করবো।”
“সরুন।”

সারাহ্ জানে আহনাফ সরবে না আর আহনাফও জানে সারাহ্-র এই সরুন কথার অর্থটা উলটো। ভালোবাসার নৌকার পালে হাওয়া লাগে জোরে, তড়তড় করে নৌকা এগিয়ে যায়। সাথে একটা সুর বেজে উঠে, এ কি ভাটিয়ালি গান?
______________________________________

সকাল সকাল ইমতিয়াজের সাথে এয়ারপোর্টে আসে মৃত্তিকা। ইমতিয়াজ কোনোদিন ভাবেনি বাবাকে বিদায় দিতে মৃত্তিকা আসবে।

শরীফের সাথে দেখা হলো, পল্লবীও সাথে এসেছে। শরীফ ইমতিয়াজের সাথে কুশল বিনিময় শেষে বলল,
“মিউকোর খেয়াল রেখো।”

ইমতিয়াজ মাথা নাড়িয়ে বলল,
“ইনশাআল্লাহ, আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করবো।”

মৃত্তিকা কয়েকবার শরীফের দিকে তাকায়। শরীফ ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,
“ভালো থেকো মিউকো।”

মৃত্তিকা এগিয়ে এসে ইমতিয়াজকে পিছনে সরিয়ে নিজে সামনে এসে শরীফকে বলল,
“আপনার সাথে আমি একটু আলাদা কথা বলতে চাই, পাঁচ মিনিট সময় হবে?”
“অবশ্যই।”

ইমতিয়াজ দুজনকে বলল,
“তবে কথা বলো।”

ইমতিয়াজ সরে যায়। মৃত্তিকা ইমতিয়াজের দিকে একবার তাকিয়ে তারপর শরীফকে বলে,
“আপনার বাসা এখন পুরো খালি?”
“হ্যাঁ।”
“আপনি ফিরে না আসা পর্যন্ত ওখানে আমি (একটু থেমে) মানে আমরা কি থাকতে পারবো?”

শরীফ হেসে মৃত্তিকার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“কেন পারবে না?”

পকেট থেকে চাবি বের করে মৃত্তিকার হাতে দিয়ে বলে,
“এইযে বাসার চাবি।”

মৃত্তিকা বাসার চাবি হাতে নিয়ে বলল,
“আরেকটা জিনিস চাই।”
“কি?”
“স্পা°ইদের সরিয়ে দেন আমার পিছন থেকে।”

শরীফ একটু ভেবে বলল,
“আমি যদি না সরাই তবুও তুমি টের পাবে না।”

শরীফ চলে যেতে নিলে মৃত্তিকা বলে,
“ভুলে যাবেন না আমি আপনারই মেয়ে, আমি ঠিকই বুঝে যাবো।”

শরীফ ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,
“মেয়ে হলে তো আমাকে বাবা বলেই ডাকতে, কই ডাকতে তো শুনিনি।”

মৃত্তিকা আর কিছু না বলে অন্যদিকে চলে যায়৷ শরীফ কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে ব্যাগ নিয়ে ভিতরে চলে যায়।

ইমতিয়াজ পল্লবীর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
“মৃত্তিকা আপনাকে চেনে?”
“এখন চিনবে। আমি তার ফুপ্পি হই।”

ইমতিয়াজ হাসে। বলে,
“শরীফ সাহেবকে শশুর ডাকলে যে মেয়ে রেগে যায়, সে আপনাকে ফুপ্পি ডাকবে?”

পল্লবী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৃত্তিকাকে ডাকে,
“মিউকো?”

মৃত্তিকা পল্লবীর কাছে এগিয়ে আসে। ধীর পায়ে আসতে আসতে ইমতিয়াজের দিকে তাকায়। ইমতিয়াজ ওকে বলে,
“আমার ফুফু শাশুড়ী।”

মৃত্তিকা কপাল কুঁচকে বলল,
“আপনি কে?”
“শরীফের বোন মানে তোমার..”

কথার মাঝেই মৃত্তিকা বলে,
“কেউ না।”

মৃত্তিকা চলে যাওয়ার সময় একটু দূরে অপরূপাকে দেখে। নজর যাওয়ার কারণ বারবার সে মৃত্তিকার দিকে তাকাচ্ছে।

“বাবার নতুন স্পা°ই?”

কথাটা ভেবে পরক্ষণেই মনে হলো,
“না, একে আমি জে°লে দেখেছিলাম।”

মৃত্তিকা আর তাকায় না, সে যে অপরূপাকে দেখেছে তাই বুঝতে দেয় না। ইমতিয়াজ একটু দৌড়ে এসে ওর পাশাপাশি হয়৷

এয়ারপোর্ট থেকে বাসা পর্যন্ত গাড়ি ঠিক করে ইমতিয়াজ। মৃত্তিকাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে বলে,
“আমি একটু ফ্যাক্টরিতে যাবো, আজ জরুরি শিপমেন্ট আছে।”
“আচ্ছা, যান। সাবধানে যাবেন।”
“তুমিও।”

ইমতিয়াজ মৃত্তিকার কপালে চুম্বন করে৷ চলে আসার সময় মৃত্তিকা ওকে কাছে টে°নে এসে সেও ইমতিয়াজের কপালে চুম্বন করে দেয়। ইমতিয়াজ মুচকি হেসে চলে যায়। মৃত্তিকা জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে অপরূপাকে দেখে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকতে। সন্দেহ আরো তীব্র হয় মৃত্তিকার।
______________________________________

সকাল সকাল ঘর থেকে বেরিয়ে উঠানে পা দিতেই কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনে দৌড়ে আবারো ঘরে ফিরে আসে সারাহ্। উঠানে একটা দেশি কুকুর ওকে দেখেই ঘেউ করা শুরু করেছে।

আহনাফ ডাইনিং এ বসে ফোনে কিছু একটা দেখছে আর চা পান করছে। সারাহ্ ওকে ধা°ক্কা দিয়ে বলল,
“দেখেন না আহনাফ, ওখানে একটা কুকুর।”

আহনাফ ওকে টে°নে কোলে বসিয়ে বলে,
“আহনাফ বলে না।”

সারাহ্ রেগে ধম°ক দেয়,
“আমি কুকুরের ভ°য়ে আছি আর আপনি আছেন আহনাফ বলা নিয়ে।”

আহনাফ হাসতে হাসতে বলে,
“জামিলকে ভ°য় পাওনি আর কুকুরকে ভ°য় পাচ্ছো?”

সারাহ্ মাথা নাড়ে। আহনাফ ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,
“ওকে, দেখি কি করা যায়। (একটু থেমে) ওমা ঐশী, তুমি আমার কোলে বসেছো কেন? ভেরি ব্যাড।”

সারাহ্ লাফিয়ে উঠে সরে যায়। আহনাফ হেসে একটা বিস্কুটের প্যাকেট নিয়ে বাইরে আসে৷ সারাহ্ও সাথে সাথে এসে একটু পিছনে দাঁড়ায়। আহনাফকে দেখেই কুকুরটা লেজ নাড়তে নাড়তে এগিয়ে আসে।

“আপনি এটার আমদানি করেছেন?”

আহনাফ কপাল কুঁচকে বলে,
“আমদানি? (একটু থেমে) সেফটির কথা ভেবে এনেছি।”

আহনাফ ওর হাতে বিস্কুট দিয়ে বলল,
“খেতে দাও।”

সারাহ্ কুকুরটার দিকে বিস্কুট ছুড়ে ফেলে সরে যায়। আহনাফ বলে,
“একটু ভদ্রভাবে দাও।”
“পারবো না।”
“ঘরে আসো।”

আহনাফের সাথেই ঘরে আসে সারাহ্। আহনাফ চারটা রুটি আর এক লিটার পানি নিয়ে পাশের রুমে যেতে নিলে সারাহ্ বলে,
“একজন মানুষ চারটা রুটি খাবে, তাও খালি খালি?”

আহনাফ যেতে যেতে বলে,
“একজন না চারজন।”
“চারজন?”

সারাহ্ চমকে উঠে। জামিল ছাড়া আর কে আছে ওখানে?

সারাহ্ দ্রুত ওইরুমে যায়। আহনাফ দরজা লাগিয়ে দিয়েছে, সে ভিতরে যেতে পারে না। তবে কান পাতে, ওইরুমের শব্দ মোটামুটিভাবে বাইরে থেকে শোনা যায়।

চারজন মানুষ রুমে বসে আছে। একজন জামিল আর বাকি তিনজন ওকে সাহায্য করতে এসেছিল। জামিলের দেরি হওয়ায় রাতে এরা বাড়িতে ঢুকলে আহনাফ একে একে তিনজনকেই পা°কড়াও করেছে।

আহনাফ রুটিগুলো সামনে রেখে বলল,
“কাল শুধুই ট্রেইলার দিয়েছি, আজ কিন্তু মেইন মুভি হবে। সো আগে আগে বলে দাও।”

কালরাত থেকে জামিলের সামনে বাকি তিনজনকে বেল্ট দিয়ে পাগলের মতো পিটি°য়েছে আহনাফ। শরীরের এমন কোনো অংশ নেই যেখানে সে মা°রেনি। একপর্যায়ে দেহের সমস্ত পোশাক খুলে পিটিয়েছে সে। একেকজন ব্য°থায় কুঁ°ক°ড়েছে কিন্তু হাতমুখ বাধা থাকায় চিৎকার করতে পারেনি। জামিল এসব দেখেছে, ছটফট করেছে।

চারজনের সামনে ছুড়ে ছুড়ে রুটি ফেলে আহনাফ। মুখে বলে,
“তুলে খাও।”

ওদের মুখ বাধা দেখে হাসে সে। তিনজনের মুখ খুলে দেয়, তবে জামিলের মুখ খুলেনি। তিনজন খুবই ক্লান্ত, সাথে ক্ষুধার্ত থাকায় চার পায়ের প্রাণীর মতোই মুখ দিয়ে খেতে শুরু করে। আহনাফের একটু খারাপ লাগলেও শক্ত থাকে সে। যেমন করেছে, তার চেয়ে কমই তো ফেরত পাচ্ছে।

জামিল “উম, উম” করে শব্দ করে। আহনাফ ওর মুখ খুলে দেয়। জামিল বলে,
“কথা বলতে হলে তো মুখ খুলতে হবে, নাকি?”

আহনাফ চেয়ার টে°নে বসে একটু হেসে বলে,
“হ্যাঁ, বলো।”

জামিল একটা ঢোক গিলে বলল,
“একটু পানি..”

কথা শেষ হওয়ার আগেই আহনাফ চোখ রা°ঙিয়ে বলে,
“বলো।”

“শাফিনের সব কুকর্মে আমার নব্বই শতাংশ অংশ আছে। সে নারী পা°চা°রে যুক্ত, আমি সেখানে শেয়ার রেখেছি৷ সে যখন তাহমিনাকে (একটু থেমে) রে°প করেছিল, আমি দেখেছি। তাহসিনাকে পি°টি°য়ে হাতপা ভে°ঙেছিলাম আমি।”

আহনাফ চোখ বন্ধ করে। তাহসিনাকে কবরে নামানোর সময় কেউ কি বুঝেনি তার হাতপা ভা°ঙা? কষ্ট কি পরিমাণ পেয়েছিল সে?

“রিপার চিৎকার শুনে শাফিনের সাথেই হেসেছিলাম আমি। তাহমিনা মা°রা গেলে তিনজনকে গাড়িতে আ°টকাতে আমি সাহায্য করেছিলাম। রিপা অনুরোধ করছিলো বাচ্চাগুলোকে ছেড়ে দাও। শাফিন আর দুলালের মতো আমিও সেদিন হেসেছিলাম।”

আহনাফ চোখ বন্ধ করেই বলে,
“নব্বই নয়, একশ শতাংশই অংশ রেখেছো।”
“একশ নয়, শাফিনের মতো প্রেগন্যান্ট নারীদের প্রতি আমার লো°ভ হয়না। হলে সারাহ্-কে..”

কথা শেষ করার আগেই জামিলের গলা চে°পে ফ্লোরে ফেলে দেয় আহনাফ। দাঁতে দাঁত ঘ°ষে বলল,
“খু°ন করে ফেলবো, এই ঘরে মে°রে এখানেই পুঁ°তে রেখে দিবো।”

কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে ছেড়ে দিয়ে টে°নে তুলে আহনাফ। তারপর বলে,
“আমার সাথে আর কি সমস্যা হয়েছে তোমার?”

জামিল মাথা নাড়িয়ে হেসে বলে,
“তোমার বাবার সাথে হয়েছিল। তোমার ফুফুর বিয়েতে যা যা দেয়ার কথা ছিল তা তো দেয়নি আবার বারবার অপমান করেছে। আফরোজার বিয়ে আমার পছন্দের ছেলের সাথে করাতে চেয়ে পারিনি। তবে যখন শাফিন নার্গিসের বিষয়টা বলে তখন ভাবলাম এক ঢি°লে দুই পাখি মা°রলে মন্দ হয় না।”

আহনাফ চেয়ার সরিয়ে নিচে জামিলের মুখোমুখি বসে বলল,
“কয়টা পাখি ম°রেছে?”
“একটা, (একটু থেমে) নার্গিস ঘাবড়ে আছে, এটাই কম কি?”

জামিল ঘাড়টা দুদিকে হালকা ঝাঁ°কিয়ে বলল,
“আর শাফিন সারাহ্-কে সহজে ছাড়বে না। তাহমিনার মতো চিৎকার করবে সারাহ্ও, বলবে আহনাফ আ…”

জামিলের নাকেমুখে ঘু°ষি দেয় আহনাফ। তারপর বলে,
“ওহ, এসব তো খুব সাধারণ ব্যাপার।”

আহনাফ উঠে গিয়ে একটা বক্স আনে আর একটা ছু°ড়ি। জামিলের শার্ট খুলে ফ্লোরে ফেলে ছু°ড়ি দিয়ে আঁকিবুঁকি দাগ কা°টে৷ রাগে ক্ষো°ভে দ্রুত হাত চালাচ্ছে আহনাফ। র°ক্ত পড়ছে, ক্ষ°ত হচ্ছে, মাংস বের হয়ে থাকছে। আহনাফ থামে না, জামিল দাঁতে দাঁত চেপে চুপ থাকে।

বাকি তিনজন চেঁ°চানোর আগেই আহনাফ গিয়ে তাদের মুখ আবারো বেঁধে দেয়। জামিলের সামনে এসে বক্সটা খুলে তার মুখের সামনে ধরে বক্সে মরিচের গুড়া দেখে চোখ বড় করে জামিল। কিছু বলতে নিলে মুখে শার্টটা ঠু°সে দেয় আহনাফ। তারপর পিঠে মরিচের গুড়া ঘ°ষে ঘষে লাগায়। ব্য°থায় চিৎকার করতে চেয়েও চিৎকার না করতে পারার য°ন্ত্র°ণায় ছ°টফ°ট করতে থাকে জামিল।

আহনাফ বক্সটা রেখে বলে,
“এটা লেভেল ওয়ান, ওয়েটিং ফর নেক্সট।”
______________________________________

“জামিলের কোনো খোঁজখবর নেই, কালরাতে সারাহ্-কে আনতে গিয়েই লাপাত্তা হয়েছে৷”
“ধরা পড়েছে নাকি?”

অপরূপার কথা হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে শাফিন বলে,
“আরে না।”

অপরূপা কান থেকে ফোন সরিয়ে চুল ঠিক করে আবারো ফোন কানে রেখে বলল,
“শরীফ চলে গেছে। আমি এয়ারপোর্টে এসেছিলাম দেখেছি।”

শাফিন শব্দ করে হেসে বলল,
“খুব ভালো কথা। এখন মৃত্তিকার পালা।”
“তানজিম কিন্তু কোনো দিক দিয়ে কম যায় না। সৎ হলে কি হবে? বোনের দিকেই গেছে।”

শাফিন ব্য°ঙ্গ করে বলে,
“র°ক্ত তো লুৎফরেরই। মা আলাদা হলে কি হবে?”
“তানজিম জানে এসব?”
“না, বোনদের মা ম°রেছে, সব লুকিয়েছে। লুৎফর তো ভাবে তার অন্য স্ত্রীর মেয়েদের মমতাজ নিজের মেয়ের মতো পেলেপু°ষে বড় করেছে। (একটু থেমে) আচ্ছা রাখো এখন।”

অপরূপা ফোন রাখে। একটা মানুষ নি°কৃ°ষ্টতার কোন ধাপে পৌঁছালে হতে পারে তা ভাবা কষ্টকর।

অপরূপা নিজের সাথে আনা কালো গাড়িটাতে উঠে পড়ে। গাড়ি চলতে শুরু করে। পেছনে থাকা ধূসর রঙের গাড়ি থেকে মৃত্তিকা বলে,
“আংকেল, ওই গাড়িটার পিছু পিছু যান।”

চলবে….

অনুভূতিরা শব্দহীন পর্ব-৪০+৪১+৪২

0

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

চত্বারিংশ পর্ব (৪০ পর্ব)

শাফিনের ফাঁ°সির রা°য় কার্যকর হয়েছে। চিন্তিত মানুষগুলো স্বস্থির নিশ্বাস ফেলে। শাফিনের উপর অত°র্কি°ত হা°ম°লার জন্য মৃত্তিকাকে এসপির অফিসে রাখা হয়েছে৷ খবর পেয়ে ইমতিয়াজ ছুটে এসে অফিসারকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে মৃত্তিকাকে নিয়ে আসে।

আহনাফের ফোনে একের পর এক কল করে যাচ্ছে সারাহ্। মধ্যরাত্রী চলছে অথচ আহনাফ বাসায় ফেরেনি, চিন্তা হওয়া তো অস্বাভাবিক নয়। অনেক লোকের ভীড়ে থাকায় ফোনের শব্দ আহনাফ শুনছে না।

ইমতিয়াজ মৃত্তিকাকে নিয়ে বাইরে আসে। আহনাফ ওকে দেখে হাত নাড়ে। ইমতিয়াজ এসে বলল,
“লা°শ বের করেছে?”
“উহু, সেই অপেক্ষাই করছি।”

মৃত্তিকা মাঝ থেকে বলে,
“ব°ডি তো ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাবে। এসপি তো তাই বলছিলো।”
“তবে আমিও সেখানে যাবো।”

ইমতিয়াজের কথায় আহনাফ মাথা নাড়ে। অবশেষে এ°ম্বু°লে°ন্সে করে শাফিনের দেহ বের করে আনা হয়। সুরভি বা দেলোয়ারা কেউই নেই। বাড়ির লোক বলতেই কেউ এখানে নেই। বাড়ির লোকের পরিচয় দিয়ে ইমতিয়াজ-মৃত্তিকা এ°ম্বু°লে°ন্সে উঠে যায়৷ আহনাফ অন্য পথে ঢামেকে পৌঁছায়। সেখানে দেহ গোসল করিয়ে, ক°ফি°নবন্ধী করা হয়। অনেকক্ষণ পর তানজিমের সাথে মমতাজ বেগম আসে আর তারপর লুৎফর রহমান সুরভি ও দেলোয়ারাকে নিয়ে আসে।

ইমতিয়াজের কানের কাছে ফিসফিস করে মৃত্তিকা বলে,
“ফাঁ°সির আ°সা°মীকে এতো সেবা করে বিডিতে?”

উত্তর জানা না থাকলেও ইমতিয়াজ একটা উত্তর দেয়,
“স্পেশাল কতগুলাকে করে বোধহয়।”

শাফিনের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী দা°ফ°ন হবে খুলনায়৷ তার পিতৃ নিবাসে, পিতার কবরের পাশে। ব্যবস্থা করা হলো।

আহনাফ এসে কথাটা শুনে ইমতিয়াজকে বলে,
“আপনি কি যাবেন ভাইয়া?”
“হ্যাঁ।”

আহনাফ ঘড়িতে সময় দেখে বলল,
“আমি তো যেতে পারবো না, আপনি কি আমাকে আপডেটটা জানিয়ে দিতে পারবেন?”
“ওকে, নো প্রবলেম।”
“থ্যাংকস, তবে আমি বাসায় চলে যাই।”
“ওকে।”

দুজনে হ্যান্ডশেক করে। আহনাফ বেরিয়ে পড়ে বাসার উদ্দেশ্যে। মৃত্তিকা মিনমিনে স্বরে ইমতিয়াজকে বলে,
“আমিও (একটু থেমে) কি যেতে পারি?”
“না, যা করেছো তুমি তাই যথেষ্ট।”

মৃত্তিকা ওর হাত জড়িয়ে ধরে বাহুতে পরপর কয়েকটা চুম্বন করে৷ ইমতিয়াজ চমকে আশেপাশে তাকিয়ে হাত সরাতে চাইলে মৃত্তিকা বলে,
“ইজ্জত বাঁচাতে চাইলে সাথে নিয়ে চলেন।”
“আচ্ছা, আচ্ছা, যাবে। এখন ছাড়ো।”

মৃত্তিকা হাত ছেড়ে দেয়। ইমতিয়াজ অন্যদিকে তাকালে মৃত্তিকার চেহারা গম্ভীর হয়ে যায়। মৃত্তিকার মনে পড়ে শাফিনের বলা কথা,
“এখানে আরো অনেক কিছু আছে।”
______________________________________

রাত প্রায় দুইটায় আহনাফ বাসায় ফিরে আসে। শশুড়বাড়ির লোকজন কি ভাববে তার চেয়ে বড় চিন্তা সারাহ্ কেমন আছে। লোকজনের শোরগোল থাকায় জেল থেকে সে কোনো কল দেয়নি বা ফোন ধরে দেখেনি কোনো কল এসেছে কিনা। এখন যখন দেখছে সারাহ্ এতোবার কল দিয়েছে তার মানে মেয়েটা প্রচন্ড রেগে আছে।

বেল না বাজিয়ে সারাহ্-র নাম্বারে কল দেয় আহনাফ। সারাহ্ নামাজ পড়ছিল, সালাম ফিরিয়ে ফোন হাতে নিয়ে আহনাফের নাম্বার দেখে কল কে°টে দেয়। আহনাফ আবারো কল দেয়, সারাহ্ রিসিভ করে না। পরে ম্যাসেজ দেয়,
“ঐশী গো, দরজা খুলো।”

সারাহ্ রুম থেকে বের হয়। এখনো কেউ উঠেনি৷ নার্গিস পারভিন রান্নাঘরে আছেন, হয়তো উনি সেহরি প্রস্তুত করছেন।

সারাহ্ একটু জোরে বলে,
“আম্মু, দরজা খুলে দাও।”
“কেন?”
নার্গিস পারভিন বের হয়ে আসেন।

সারাহ্ মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“তোমার গুণধর জামাই এসেছে।”

নার্গিস পারভিন কপাল কুঁচকে গিয়ে দরজা খুলে। আহনাফ দরজা খোলার শব্দে যতটা স্বাভাবিক হয়েছিল, নার্গিস পারভিনকে দেখে ততটাই অ°প্রস্তুত হয়ে যায়।

গলা ঝেড়ে বলল,
“মা?”
“আসো।”

আহনাফ বাসায় প্রবেশ করে। কেউ যাতে টের না পায় সেজন্য ও সারাহ্-কে ম্যাসেজ করে দরজা খুলতে বলেছিল আর সারাহ্ মাকে জানিয়েই দিয়েছে৷

আহনাফ একটু ইতস্তত করেই বলল,
“মা, আসলে একটা কাজ ছিল তাই দেরি হয়েছে। কিছু মনে করবেন না।”
“না না, সমস্যা নেই। তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও।”

আহনাফ রুমে এসেই সারাহ্-কে বলল,
“মাকে জানানোর খুব প্রয়োজন ছিল?”

সারাহ্ একমনে জিকির করছে, এমন এক ভাব যেন আহনাফের কথা সে শুনতেই পাচ্ছে না। আহনাফ বিছানায় বসে বলল,
“মা কি জানলো? আমি রাতে দেরি করে বাসায় ফিরি, উনি ভাবছে প্রতিদিন আমি এমনই করি।”

সারাহ্ জিকির থামায়। শান্তভাবে জবাব দেয়,
“বাসায় না আসতেন, তবেই হতো।”

আহনাফ ওর থুতনিতে হাত দিয়ে বলল,
“রাগ করেছো?”
“না।”
বলেই সারাহ্ মুখ ফিরিয়ে নেয়।

আহনাফ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে৷ অবশেষে সারাহ্ তাকায় ওর দিকে। বলে,
“কোথায় গিয়েছিলেন?”

আহনাফ এই জবাবটাই দিতে চাচ্ছে না। চুপ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকেই দুজনে ওষ্ঠোধর জোড়া এক করে দিলো। সারাহ্-র বাধা তো সে সবসময়ই উপেক্ষা করে। সারাহ্ একহাতে আহনাফের চুল খা°ম°চে ধরে, অন্যহাতে আহনাফের হাতের মুঠোয় পড়ে রইলো।
______________________________________

সেহরিটা বাইরেই করেছে ইমতিয়াজ ও মৃত্তিকা। ফজরের নামাজটাও রাস্তায় পড়ে নিতে হয়েছে৷ ভোরের আলো ফুটে উঠছে একটু একটু করে। পুব আকাশে লাল সূর্য দেখা যাচ্ছে।

লা°শের গাড়িতে যাচ্ছে ওরা। পেছনে একটা গাড়িতে মমতাজ বেগম, লুৎফর রহমান, তানজিম, সুরভি আর দেলোয়ারা আছে।

মৃত্তিকা বারবার ক°ফি°নটা দিকে তাকাচ্ছে। ফ্রিজিং গাড়ি নয়, সাধারণ একটা এ°ম্বু°লে°ন্স দিয়ে পাঠানো হচ্ছে৷ মৃত্তিকার মনে হচ্ছে লা°শটা উঠে যাবে, শাফিন উঠে দাঁড়াবে আর ওকেও ওর মামের মতোই মে°রে ফেলবে।

সিটে হেলান দিয়ে ইমতিয়াজ ঘুমিয়ে গেছে৷ নিস্তব্ধ পরিবেশ, একটা গু°মোট ভাব। মৃত্তিকা ঢোক গিলে পিছনে ফিরে তাকালো। না, ক°ফি°ন বন্ধই আছে।

“ইমতিয়াজ, ইমতিয়াজ।”

দুবারের ডাকেই ইমতিয়াজ চোখ খুলে। মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে বলে,
“কি?”
“রাস্তা ফুরোয় না কেন?”

ইমতিয়াজ একটু হেসে ওকে একহাতে আগলে নিয়ে বলে,
“ঘুমাও, ফুরিয়ে যাবে।”
“তবে আপনি জেগে থাকুন।”
“হুম, জেগে আছি।”

মৃত্তিকা ওর কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজে। ইমতিয়াজ মৃত্তিকার হিজাবটা ঠিকঠাক করে দিয়ে বলল,
“ওই দুইটা হিজাবই ঘুরে ফিরে পড়তেছো। আলমারিতে তো আরো আছে, পড়তে পারো ওইগুলা।”

মৃত্তিকা ওর দিকে না তাকিয়ে বলে,
“এই দুইটা তাহমিনার তাই পড়ছি।”
“ওইগুলাই তাহমিনারই।”
“আমাকে নিউ কিনে দিয়েন, আর এই দুইটা পড়বো।”

ইমতিয়াজ একটু জোরপূর্বক হাসে৷ মৃত্তিকা বলে,
“আমি যখন তাহমিনার মতো চলে যাবো, তখন এই দুইটা হিজাব একবারে হাতে নিলেই দুজনের স্মৃ°তি পেয়ে যাবেন।”

মৃত্তিকার যুক্তির বহরও আছে। মৃত্তিকা বামহাতের তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে ইমতিয়াজের বুকে হাবিজাবি করে ঘুরাতে থাকে। ইমতিয়াজ ওর হাতে ধরে থামিয়ে দিয়ে বলে,
“ঘুমাও।”
______________________________________

ফজরের পর সারাহ্ ছাদে গিয়ে বসে৷ সারারাত নির্ঘুম মেয়েটার চোখেমুখে দুশ্চিন্তা। মায়ের বলা সেদিনের কথাগুলো নিয়ে ভাবছে সে৷ ও জানে না শাফিন কে? কোথায় আছে? তবে মায়ের একজন পূর্ব শত্রু আছে, যে এখন তাকেও মা°রতে পারে।

আহনাফ এসে ওকে ডাকে,
“ঐশী?”

সারাহ্ ফিরে তাকায় না। কোনো উত্তরও দেয় না। আহনাফ এসে ওর সামনে দাঁড়ায়।

“আজকে বাসায় ফিরে যাবো, এখন তবে একটু ঘুমিয়ে নাও।”
“আমি যাবো না আহনাফ, আপনি চলে যান।”

আহনাফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“যেসব চিন্তা থেকে দূরে রাখতে চাচ্ছি সেসব চিন্তাই তোমার আশেপাশে আসছে বারবার।”

সারাহ্ ফ্লোরে বসে পড়ে। আহনাফ পাশে বসে৷ সারাহ্ বলে,
“সবকিছু থেকে দূরে রাখতে চাচ্ছেন? কিন্তু জানেন তো অনেক ঘটনা আমার আশেপাশে হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। আমি দেখি কিন্তু কথা বলি না।”
“কি হয়েছে?”

সারাহ্ লাল হয়ে থাকা আকাশের দিকে তাকায়। কয়েক মুঠো মেঘে ভেসে বেড়াচ্ছে সেখানে। মেঘেদের সাথে দীর্ঘশ্বাসগুলো উড়িয়ে দিতে ইচ্ছা করছে তার।

বেশ খানিকক্ষণ চুপ থেকে সারাহ্ মায়ের বলা সমস্ত কথা আহনাফকে বলে দেয়। আহনাফ নিরব মনোযোগী শ্রোতার মতো সবকিছু শ্রবণ করে বলে,
“শাফিনের ফাঁ°সি হয়েছে মধ্যরাতে, আমি সেখানেই ছিলাম।”

একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সারাহ্। যেন বিশাল চাপমুক্ত হলো সে।
______________________________________

সকাল নয়টায় খুলনায় নিজের নানাবাড়িতে পৌঁছায় মৃত্তিকা। প্রথমবার এখানে এসেছে সে৷ পুরাতন জমিদার বাড়ি আর গো°র°স্থানের কিছু জায়গা ছাড়া আর কিছুই এখানে অবশিষ্ট নেই।

কবর খোঁড়া হয়েছে। ইমতিয়াজ কবরের কাছে ভিতরে দেখে, একটু গভীর করে কবরটা খোঁড়া হয়েছে৷ আশেপাশের দেয়ালগুলো একদম সোজা। ইমতিয়াজ নামতে নিলে মৃত্তিকা দূর থেকে ডেকে বলে,
“এই নামবেন না।”

মৃত্তিকা দৌড়ে ওর কাছে এসে বলল,
“একদম না। এমন একজন মানুষের কবরে আপনি কেন নামবেন?”

মৃত্তিকার বাধা ইমতিয়াজ মেনে নেয়। সময় গড়ায়, শাফিনের জা°নাযা হলো তারপর দা°ফন। এবারে ফিরে যাওয়ার পালা। মমতাজ বেগমের এক বি°লাপ,
“আমার ভাই নির্দোষ, নিষ্পাপ।”

পুরোনো জমিদার বাড়ির বারান্দায় যোহরের নামাজ পড়ে মৃত্তিকা। ইমতিয়াজ মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে একটু আগেই এসেছে।

পাশের বাড়ি থেকে দিয়ে যাওয়া প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে ইমতিয়াজ আশেপাশে চোখ বুলায়। লতাপাতা জন্মে গেছে বাড়ির দেয়ালে৷ বহুবছর এখানে কেউ আসেনা, থাকেনা। ময়লা, ধুলাবালি আর শুকনা পাতায় ভরে গেছে জায়গাটা।

মৃত্তিকা নামাজ শেষে বলল,
“কখন রওনা দিবো আমরা?”
“একটু পর, মা শান্ত হোক একটু।”

মৃত্তিকা উঠে নিজের হিজাব ঠিক করে। হঠাৎ একটা শব্দ শুনে সে, মনে হলো কোনো বড় কিছু নাড়াচাড়া করা হচ্ছে। তবে শব্দটা খুব মৃদু হওয়ায় সে ভালোমতো কিসের শব্দ বুঝতে পারলো না।

“ইমতিয়াজ, আপনি কোনো শব্দ পেয়েছেন?”

ইমতিয়াজ আশপাশটা দেখতে ব্যস্ত৷ মৃত্তিকার কথায় মাথা নেড়ে বলল,
“না তো।”
“কিন্তু আমি তো কিছু শুনলাম।”

ইমতিয়াজ ভালো করে শুনতে চেষ্টা করে, তবুও কিছুই শুনে না।

“তোমার মনের ভুল, মৃত্তিকা।”
“হতে পারে।”
মৃত্তিকা মাথা নাড়ে৷

তানজিম ওদেরকে ডেকে বলল,
“ভাইয়া, আসো।”

ইমতিয়াজ উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“চলো।”

দুজনে বেরিয়ে আসে৷ ইমতিয়াজ একটু আগে আগে চলে যায়৷ মৃত্তিকা সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় ওর মনে হলো কেউ বাড়ির ভিতরে আছে। মৃত্তিকা ফিরে তাকায়। কোথাও কেউ নেই, কিন্তু ওর মনে হচ্ছে কেউ আছে৷ আবারো সেই শব্দ, কিছু একটা টে°নে নেয়ার শব্দ৷

“ইমতিয়াজ?”

ইমতিয়াজ ফিরে আসে। বলে,
“কি?”
“কেউ আছে ওখানে?”

ইমতিয়াজ তাকায় ভালো করে৷ বলে,
“তুমিই দেখো না কেউ আছে কিনা?”

ইমতিয়াজ ওর হাত ধরে বলল,
“চলো।”

মৃত্তিকা ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে, আবারো পিছনে ফিরে চায়। কেউ নেই, কিন্তু বারবার শোনা সেই শব্দ কি সত্যি?

অপরূপা বাড়ির ভিতর থেকে ওদেরকে দেখে৷ তারপর পিছনে ফিরে ওর লোকদের বলে,
“শাফিনকে দ্রুত আনো।”
“আনছি তো।”

অপরূপা নিজের গোলাপী ঠোঁটগুলো বাঁকিয়ে হেসে আবারো জানলার ফাঁক দিয়ে তাকায়। বলে,
“তোমরা ভেবেছো শাফিন ম°রে গেছে? শাফিন কিভাবে ফিরে আসবে তা তোমরা টেরও পাবে না। হ্যাপি জার্নি।”

চলবে….

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

একচত্বারিংশ পর্ব (৪১ পর্ব)

“আহনাফ, দা°ফ°নের কাজ শেষ হয়েছে। আমি তো ভ°য়ে ছিলাম, কোনো ঝা°মেলা না হয়।”
“যাক, তাও আলহামদুলিল্লাহ।”
“হুম, ক°ফি°নে শাফিনই ছিল। চেহারা আমি নিজে দেখেছি৷ কবরে যখন নামিয়েছে তখনও ছিলাম, কবর দেয়ার পর সরেছি ওখান থেকে।”
“আজকে ফিরে আসবেন?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, এইতো গাড়িতে উঠে যাবো।”
“আচ্ছা, সাবধানে আসেন।”

আহনাফের সাথে ফোনযোগে কথা বলছে ইমতিয়াজ। এখানের সকল ঘটনাই তাকে জানানো হয়েছে। এখনি বের হবে ওরা।

হঠাৎ সুরভি চিৎকার করে উঠে। মৃত্তিকা দৌড়ে গিয়ে ওকে ধরে। মমতাজ বেগম ওর অবস্থা দেখে বলেন,
“লেবার°পে°ইন।”
“সর্ব°না°শ, এখানে কিভাবে কি?”

মৃত্তিকার কথায় তানজিম বলল,
“বাড়ির ভিতরে নিয়ে যাই?”
“হ্যাঁ, তাই করো।”

মমতাজ বেগমের অনুমতি পেয়ে ইমতিয়াজ ও তানজিম মিলে ওকে ভিতরে নিয়ে যায়। গ্রামের একজনকে দিয়ে দাঈ ডেকে আনা হলো আর তারই পরিচিত একজন নার্সকেও আনলো।

মৃত্তিকা জমিদার বাড়ির দরজা খুলে। ভেতরে গন্ধ কম। মৃত্তিকার কপাল কুঁচকে গেল। এতোবছরের পুরোনো বাড়ির ভেতর গন্ধ নেই কেন? এখানে তো গন্ধ, ধুলা সবই থাকার কথা। সুরভির এ অবস্থায় কেউই কথা বলার মতো নেই।

মহিলাদের ভীড় বাড়ে। ইমতিয়াজ, তানজিম, লুৎফর রহমান বাইরে যায়। মৃত্তিকা বাইরে না গেলেও এখানে থাকে না। সে জমিদার বাড়ির ভিতরের রুমগুলো দেখতে বেরিয়ে পড়ে।

সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে সে। একটা রুমের সামনে গিয়ে কাঠের খোদাইকৃত ডিজাইনের চকচকে দরজা দেখে দাঁড়িয়ে যায়। সব দরজা পুরোনো হলেও এটা নতুন কেন? প্রশ্ন জাগে ওর মনে। ক্রমাগত দরজা খোলার চেষ্টা করতে থাকে। ভিতরে কান পেতে শুনতে চেষ্টা করে, কিন্তু ভিতর থেকে কোনো শব্দই আসে না। জোরে জোরে দরজায় ধা°ক্কা দেয় সে। দরজা খুলতে ব্য°র্থ হয়।

অনেকটা সময় পার হয়। একসময় মৃত্তিকাকে ডাকে মমতাজ বেগম। মৃত্তিকা যাওয়ার সময় আবারো দরজার দিকে তাকায়। এখনই কাউকে এর কথা বলা যাবে না, আগে দেখতে হবে এর পেছনে কি আছে।

মৃত্তিকা নিচে যায়, সুরভির বাবুর কান্না শোনা যাচ্ছে। মৃত্তিকা একটা রুমে যায়, সুরভিকে সেখানেই রেখেছে। ছেলেবাবু হয়েছে, সুরভি বাচ্চাকে এখনো দেখেনি। সে দেখবে না, অজানা কারণে নিজের ছেলের উপর রেগে আছে সে। মৃত্তিকা বাবুকে কোলে নেয়। সদ্য জন্ম নেয়া বাবুটা কাঁদছে, তার লাল লাল মুখের দিকে তাকিয়ে আছে মৃত্তিকা।

সুরভির কাছে নিয়ে গিয়ে বলল,
“নিজের ছেলেকে আদর করবে না আপু?”
“আগে ওর কানে আযান দিতে বলো, ভালো করে বুঝিয়ে দাও নানার মতো যেন না হয়।”

মৃত্তিকা ওকে কোলে নিয়ে বাইরে আসে। লুৎফর রহমান এখানে নেই, উনিই তো আযান দিতে পারতো। ইমতিয়াজকে একটু দূরে দেখে ডাকে,
“শুনুন, ইমতিয়াজ।”

ইমতিয়াজ এগিয়ে আসে। বাবুর দিকে তাকালে মৃত্তিকা বলে,
“ওর কানে আযান দেন, নইলে আপু ওকে দেখবেও না।”
“এ কেমন কথা?”
“নিন।”

বাবুকে কোলে নিয়ে তার কানে খুব আস্তেধীরে আযান দেয় ইমতিয়াজ। ওর কানে আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়ে বুঝিয়ে দেয়, এক আল্লাহ্ মহান, তুমি তারই সৃষ্টি। সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ্-র।

আযান দেয়া হলে মৃত্তিকা বাবুকে কোলে নিয়ে বলে,
“নানার মতো হইয়ো না, তোমার মা তবে তোমার সাথে এই আযান দাতাকেও ঝে°রে ফেলবে।”

মৃত্তিকা ভিতরে চলে যায়। ইমতিয়াজ হেসে দেয়। বাচ্চার সাথে এ কেমন বাচ্চামো।
______________________________________

“জামিল ফুপা কি আপনার বন্ধু হয়?”

আহনাফের প্রশ্নে জাহাঙ্গীর সাহেব না বোধক মাথা নেড়ে বলল,
“না।”
“কিন্তু আমাকে তাই বলা হয়েছিল, ফুপার বন্ধু। পরে জানতে পারি এই বিয়ে পরিকল্পিত এবং শাফিন জড়িত ছিল এতে।”

নার্গিস পারভিন ভয় পান। কেউ জেনেশুনে তার মেয়েকে তার থেকে দূরে নিয়ে গেছে। আহনাফ আবারো বলে,
“শাফিনের ফাঁ°সি হয়েছে, দা°ফ°নও শেষ। তবে জামিল ফুপা এখনো বাইরেই ঘুরাঘুরি করছে।”
“তাকে তলব করো।”

জাহাঙ্গীর সাহেবের কথায় আব্বাস ফয়েজ সম্মত হলেন। বলেন,
“হ্যাঁ, তাকে আমাদের বাসায় আসতে বলি আর আপনারাও আসেন। ঘটনা বিস্তারিত জানা যাবে।”

আহনাফ ঠোঁট বাঁ°কিয়ে বলল,
“আপনাদের মনে হয় সে এতো সহজে মুখ খুলবে?”
“কখনোই না।”
আহনাফের প্রশ্নের সাথে সাথেই উত্তর দেয় নার্গিস পারভিন।

আহনাফ উনার দিকে তাকালে বলল,
“তুমি বের করো। আলোচনা আর যার সাথেই হোক তার সাথে নয়।”

আহনাফ মাথা নেড়ে উঠে যায়। নার্গিস পারভিন সবদিক থেকে সঠিক, জামিলের সাথে আলোচনা করে বা কথা বলে লাভ নেই। তাকে বুঝিয়ে কাজ নেই। তার থেকে জোর করে কথা বের করতে হবে।

রুমে বসে সারাহ্ সকল কথাই শুনেছে। নিজের স্বামীর সাথে পরিকল্পিত বিয়ের কথাটা শুধু সারাহ্ কেন যেকোনো মেয়ের জন্যই খুবই অপমানের আর লজ্জার হবে।

“ঐশী?”

আহনাফের ডাকে সারাহ্ একটু চমকে তাকায়। অন্যমনস্ক হয়ে ছিল সে। ওর চোখে পানি দেখে আহনাফ কপাল কুঁচকে বলল,
“কান্না করছো কেন?”

সারাহ্ ছলছল চোখে তাকায়৷ আহনাফ ওর চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বলে,
“জানার ছিল এসব, লুকানো যাবে না।”
“আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন?”

নিষ্প্রাণ প্রশ্ন করে বসে সারাহ্৷ আহনাফ ওর কপালে চুম্বন করে বলল,
“এতোটা সন্দেহ করো না।”

সারাহ্ হয়তো সম্পূর্ণ আশ্বস্থ হয় না। তবুও মাথা ঝাঁ°কিয়ে সম্মতি দেয়।
______________________________________

আজকের মতো ঢাকায় ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা বন্ধ করে সবাই। সুরভির এই অবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়৷ জমিদার বাড়ির চারটা রুম পরিষ্কার করে কোনোমতে থাকার উপযোগী করা হলো। ইফতার বাইরে থেকে কিনে এনে খাওয়া হলো।

ইফতার শেষে মৃত্তিকা সুরভির সাথে বসে আছে৷ মৃত্তিকা বাবুকে কোলে নিয়ে বসে আছে, সুরভি ঘুমিয়ে পড়েছে। মমতাজ বেগম আসলে মৃত্তিকা বাবুকে উনার কাছে রেখে দোতলায় চলে যায়।

সেই দরজার কাছে যেতেই দেখে ইমতিয়াজ সেখানে দাঁড়ানো। ওকে আঙ্গুলের ইশারায় চুপ থাকতে বলে হাত ধরে নিচে নিয়ে আসে। নিজেদের রুমে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে বলে,
“মা, ওই রুমে ছিল। আমাকে দেখে দরজা লাগিয়ে চলে এসেছে। নতুন দরজা কোথা থেকে এলো ওখানে?”

মৃত্তিকার কাছে উত্তর নেই। তবে মমতাজ বেগমকে সন্দেহ করে যাচ্ছে সে। তবে কি এতোগুলো মানুষের মৃ°ত্যুর পিছনে শাফিনের সাথে মমতাজ বেগমও জড়িত?

রাত বাড়ে, পাশের বাড়ির চুলা থেকে সেহরি রান্না করে আনে মৃত্তিকা। এরমধ্যে মমতাজ বেগম আর রুম থেকে বের হননি। সবকিছু সামলে রেখে রুমে আসে। ইমতিয়াজ নামাজ পড়ে এসেই শুয়ে আছে, দুইদিনের ধ°ক°ল গেছে শরীরের উপর দিয়ে।

মৃত্তিকা এসে বালিশ ঝে°ড়ে শুতে নিয়ে বুঝে বালিশ অনেক শক্ত। এগুলোও তো নিজেদের নয়। আশেপাশের পরিচিত কিছু মানুষ দিয়ে গেছে। এরচেয়ে বেশি আর কিই বা আশা করা যায়।

ইমতিয়াজ নিজের একহাত এগিয়ে দিয়ে বলে,
“শুয়ে পড়ো।”

মৃত্তিকা একটু তাকিয়ে থেকে ইমতিয়াজের হাতের উপর শুয়ে পড়ে। ইমতিয়াজ ওকে কাছে নিয়ে আসে। মৃত্তিকা ওর বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।

“ইমতিয়াজ, আমার অদ্ভুত ফিল হচ্ছে৷ সবকিছু অদ্ভুত লাগছে৷ ওই শব্দটা কিসের ছিল?”

ইমতিয়াজ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“বেশি চিন্তা করছো, তাই এমন হচ্ছে।”
“একবার শাফিনের কবরটা চেক করবেন প্লিজ?”
“সকালে।”
“ঠিক আছে।”

মৃত্তিকা ইমতিয়াজকে ভালো করে জড়িয়ে ধরে। ইমতিয়াজও তাকে আগলে নেয়, মিশিয়ে নেয় নিজের বুকে।

রাত পেরিয়ে সকাল হলো, দুজন লোককে সাথে নিয়ে শাফিনের কবরের কাছে গিয়ে দাঁড়ায় ইমতিয়াজ। কবরের আশেপাশে অস্বাভাবিক কিছু নেই। তবুও মন চাইলো তার, শুরু হলো কবর খোঁ°ড়া।

কবর খুঁ°ড়েই অবাক হলো সে। ক°ফি°নের মুখটা খোলা, ভিতরে শাফিনের দেহ নেই। লোক দুজনও ভ°য় পায়। একজন চেঁচিয়ে উঠে৷ চিৎকার শুনে মৃত্তিকা, তানজিম ছুটে আসে। মৃত্তিকা অবস্থা দেখে মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

ইমতিয়াজ কবরের ভিতরে নামে। কবরের একপাশের দেয়াল ভা°ঙা, সেখানে একটা সুরঙ্গ। মৃত্তিকাও ভিতরে নামে। দুজনে সুরঙ্গে প্রবেশ করে। সুরঙ্গটা বেশ বড়, অনেকদূর পর্যন্ত প্রসারিত।

সুরঙ্গের মাথায় মাটির সিঁড়ি কাটা। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে জমিদার বাড়ির একটা রুমে এসে পৌঁছায় ওরা। কারুকার্যে শোভিত বড় একটা কাঠের পালঙ্ক আছে এখানে, বড় বড় দুটো আরাম কেদারাও আছে, বিশাল একটা আয়না আর তারপাশে কিছু তাক। দুজনে ঘুরেফিরে রুমটা দেখে।

ইমতিয়াজ কপাল কুঁচকে রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে বলল,
“নতুন কাঠের দরজা, এটাই কি সেই রুম?”

মৃত্তিকা এবারে নিজের সন্দেহ প্রকাশ করে বলে,
“তবে কি বড়মণি এসবে যুক্ত?”

ইমতিয়াজ চোখ বড় করে তাকায়। মমতাজ বেগম নিজের মেয়েদের খু°নের জন্য দায়ী? ভ°য়ং°কর ব্যাপার এটা।

ইমতিয়াজ কিছু বলার আগেই মৃত্তিকা বলে,
“উনাকে আমার সন্দেহ হচ্ছিল অনেকদিন থেকেই, তবে এখন এটাও শিউর যে শাফিন বেঁচে আছে।”
“নিচ চোখে দেখা মৃত মানুষ জীবিত কিভাবে হয়?”

মৃত্তিকা চিন্তায় পড়ে। আলাদা কোন জিনিসটা সে ভুলে যাচ্ছে? স্মৃ°তির পাতার পৃষ্ঠাগুলো উল্টেপাল্টে দেখে বুঝে শাফিন বলেছিল, ওর অনেককিছু জানার আছে। অবশ্যই জানার আছে, কিন্তু এ জানার অ°ন্ত কোথায়?

রুমে ইমতিয়াজ একটা চিঠি পায়,
“আমি চললাম আমার পথে,
যেখানে জোসনা থাকে অনেক
একটা বেশি দামি।
অনেক অনেক তারার মাঝে
সবচেয়ে উজ্জ্বল আমি।”

ইমতিয়াজ একটু ভেবে বলল,
“ধাঁধা রেখে গেছে। এটা নিশ্চয়ই কোনো ক্লু।”

মৃত্তিকা কাগজটা দেখে। ইমতিয়াজ এটি ভাঁজ করে পকেটে ঢুকায়। কবর থেকে লা°শ উধাও, নাকি লা°শের ভাণ ধরা জীবিত কেউ উধাও? প্রশ্নের সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে ওরা, উত্তরের জন্য অতল গভীরে ডু°ব দিতে হবে।

চলবে….

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

দ্বিচত্বারিংশ পর্ব (৪২ পর্ব)

মৃত্তিকার কাজটুকু ঠিকমতোই করছে সে৷ কাজই হলো মমতাজ বেগমের উপর নজর রাখা৷ সে রাখছে, উনার সব আচরণই স্বাভাবিক। এরমধ্যে শাফিনের কোনো খোঁজ পায়নি ওরা। সবই কেমন যেন শান্ত।

দিন পেরিয়ে যায়, সময়ের নিয়মে রমজানও চলে গেছে৷ শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা গেছে, কাল ইদ।

মৃত্তিকা পায়েস বানাচ্ছে, ইমতিয়াজ এসে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়ায়। সুরভি আর দেলোয়ারা বাসায় থাকলেও মৃত্তিকা তাদেরকে রান্না করতে দিচ্ছে না, দিবে না৷ সে নিজে নিজে একা কাজ করবে।

ইমতিয়াজকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে মৃত্তিকা ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি ভাবছেন আমি এসব বানাতে পারি না?”

ইমতিয়াজ হাসলো। বলে,
“তা কখন বললাম?”
“না, তাকানোটা অদ্ভুত।”

ইমতিয়াজ এসে ওর পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“তোমার চোখ তো সহজে ফসকায় না। তাই তাকানোর স্টাইলটাও দেখেছো।”

মৃত্তিকা একচামচ পায়েস তুলে ফুঁ দিয়ে ইমতিয়াজের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“মিষ্টি ঠিক আছে কিনা দেখেন।”

ইমতিয়াজ একটু খেয়ে বলে,
“একটু কম, বাট চলবে।”

ইমতিয়াজের ঠোঁটের কোণায় একটু পায়েস লেগে আছে৷ মৃত্তিকা আঙ্গুল দিয়ে সেটুকু নিয়ে এসে নিজের খেয়ে ফেলে। ইমতিয়াজ একটু তাকিয়ে থেকে রুমে চলে যায়। এখন মৃত্তিকার মনে হয় সে কি করেছে। লজ্জা পায়, মুখখানা লাল হয়ে গেছে তার। আবারো বুকের বামপাশে তীব্র ধু°কপু°ক।
______________________________________

সারাহ্ আজ খুব ব্যস্ত৷ আহনাফের সাথে তার প্রথম ইদ, অবশ্যই বিশেষ কিছু করা চাই৷ তাজা ফুল এনে পুরোনো ফুলের স্থানে রাখা হয়েছে। বিছানার চাদর, সোফার কভার সব পালটে ফেলেছে। পুরো বাসা ঝকঝকে। নিজের জানা ভালো ভালো রেসিপি করার জন্য সব গোছগাছও চলছে একই তালে।

আহনাফ ইফতার করেই বেরিয়ে গিয়েছিল। এখন বাসায় এসেই ড্রইংরুমে বসে কাউকে ফোন করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আব্বাস সাহেব নিজ রুম থেকে বেরিয়ে আহনাফকে বলল,
“কোথায় গিয়েছিলে আহনাফ?”

আহনাফ ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল,
“ছোট ফুপ্পির বাসায়৷ ফুপা বাসায় নেই। আজ নিয়ে সাতদিন গেলাম আর আসলাম।”
“জামিল বুঝতে পেরেছে তুমি ওর পিছু করছো, এজন্যই গা ঢাকা দিয়েছে।”
“কয়দিন দেয় আমিও দেখবো।”

সারাহ্ রান্নাঘরে পেঁয়াজ কা°টছিল, দুজনের কথা শুনে ছু°ড়ি চালানো থামিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এতোসব সাজ ওর এলোমেলো করতে ইচ্ছা করছে। সব এলোমেলো হয়ে যাক, সব ধ্বং°স হোক।

এতো আয়োজনের মাঝেই আহনাফ ওকে মনে করিয়ে দিয়েছে বিয়েটাই পরিকল্পিত। এ পরিকল্পনা ওরা নয়, একজন লুকায়িত শ°ত্রু করেছে। এই কথা ও বারবার ভুলে যাচ্ছে। একটা বাটারফ্লাই ইফেক্ট হলে সারাহ্ আর আহনাফের হতো না।

ভুলবশত ছু°ড়িটা ও নিজের হাতেই চালিয়ে দেয়৷ কে°টে র°ক্ত পড়ায় টের পায়। “আহ” বলে অস্ফুট স্বরে চেঁচিয়ে উঠে।

আহনাফ ড্রইংরুম থেকে ছুটে এসে ওর হাত ধরে ধ°মক দিয়ে বলে,
“কাজ গুছিয়ে করতে না পারলে করবে না।”

সারাহ্-র কাছে এই ধ°মকটাও খারাপ লাগলো। আহনাফের প্রতি ভুল ভাবনা আসছে তার৷ আহনাফ ওকে ডাইনিং এ এনে বসিয়ে কাটাস্থানে স্যাভলন লাগিয়ে একটা এককালীন ব্যা°ন্ডে°জ দিয়ে দেয়।

আব্বাস সাহেব পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
“একা এতোকিছু কেন করছো, মা?”
“পারবো আমি।”

ছোট করে জবাব দিয়ে সারাহ্ আবারো রান্নাঘরে চলে যায়। আহনাফ ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। সারাহ্-র এমন পরিবর্তন কি শুধুই প্রেগন্যান্সির সময়ের মুড সুইং? সন্দেহ হয় আহনাফের৷ অবশ্যই সারাহ্ বিয়ের বিষয়টা নিয়ে ভাবছে৷
______________________________________

পায়েসটুকু বানিয়ে এসেই মেহেদী দিতে বসে মৃত্তিকা। অনেকদিন পর মেহেদী ধরেছে, তাই হাত কাঁপছে। ইমতিয়াজ বিছানার একপাশে বসে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে, অফিসের কোনো একটা কাজে সে ব্যস্ত।

“শরীফ সাহেব অস্ট্রেলিয়া যাবে।”

ইমতিয়াজের কথায় মৃত্তিকা মুখ ভেংচিয়ে বলে,
“সাহেব? উনাকে এতো ভদ্র করে ডাকার কি দরকার?”
“আমার শশুর তো।”

মৃত্তিকা উঠে এসে একটুখানি মেহেদী লাগানো হাতটা ওর সামনে ধরে বলল,
“কিসের শশুর? আমি যাকে বাবা মানি না আপনি তাকে শশুর ভাবেন কেন?”

ইমতিয়াজ ওকে টে°নে নিজের কোলে বসিয়ে একহাতে কোমড় জড়িয়ে বলল,
“তোমার বাবা, আমার শশুর। তোমার মানা কিংবা না মানার উপর আমার কিচ্ছু আসে যায় না।”

ইমতিয়াজের হাতের বাঁধন হালকা হলে মৃত্তিকা উঠে যায়৷ ঘটনাক্রমে হওয়া নিজের অস্বাভাবিক ভাব মুখে না এনে বলে,
“সুরভি আপুকেও আমার সন্দেহ হয়েছিল, বেশ অনেকদিন তাই নজরব°ন্দি রেখেছি। কিন্তু সব তো স্বাভাবিকই দেখলাম।”

ইমতিয়াজ ল্যাপটপ বন্ধ করে বলে,
“সব আমাদের ভাবনার কয়েক ধাপ উপর দিয়ে হচ্ছে৷ ধাঁধার সমাধান হয়নি। শাফিন নারী পাচারে যুক্ত ছিল, কোথায় সেই স্থান তাও খুঁজে পাইনি। বুঝতে পারছো আমরা পিছিয়ে আছি?”

কথা সত্য, শ°য়°তান এমন সব বুদ্ধি খাটায় যা আমরা ভাবতেও পারি না। ভদ্র সুরতে ক্ষতি করে আমাদের। মৃত্তিকা মাথা নেড়ে বলল,
“তা তো বুঝেছি, তবে শাফিন জীবিত থেকে কবর পর্যন্ত গেলে এখানে বড় বড় লোকের আনাগোনা আছে।”
“প্রথম কথা হলো জে°লারের হাত আছে।”

মৃত্তিকা ওর পাশে এসে বসে বলে,
“হ্যাঁ, তবে জে°লারের থেকে আগে শাফিনকে বের করে আনতে হবে। নিখুঁতভাবে গা ঢাকা দিয়ে আছে সে। ঝ°ড়ের আগে আকাশ এভাবেই শান্ত থাকে।”
“তোমার কি মনে হয় ধাঁধার সমাধানে শাফিনকে পাওয়া যাবে? ওকে খুঁজে পাওয়ার জন্য ধাঁধা দেয়নি।”

মৃত্তিকা মৃদু হেসে বলল,
“তা আমি জানি, এরচেয়ে শর্টকাট পদ্ধতি আছে।”
“কি?”

মৃত্তিকা মুখে হাসি বজায় রেখে মেহেদীর প্যাকেট হাতে নিয়ে উঠে যায়৷ ইমতিয়াজ কপাল কুঁচকে বলল,
“পদ্ধতিটা কি?”

মৃত্তিকা ফিরে তাকিয়ে আবারো হাসলো। ইমতিয়াজ বোকাসোকা চেহারা করে তাকিয়ে থাকে৷ সুরভির রুমে গিয়ে মৃত্তিকা ওর হাতে মেহেদী ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“সুন্দর করে দিয়ে দাও তো।”
______________________________________

গরম গরম স্যুপ খাচ্ছে শাফিন, পাশে অপরূপা আছে। তার গায়ে আকর্ষণীয় পোশাক, আবেদনময়ী হয়ে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে শাফিনের কাছে ধরা দেয় সে। প্রতিদিন এই একই কাজ তার।

সেদিন ফাঁ°সি না দিয়ে ঘুমের ই°ঞ্জে°কশন প্রয়োগ করে ঘুম পাড়ানো হয়েছিল শাফিনকে। তারপর নিজেদের লোক দিয়ে গোসল ও ক°ফি°নব°ন্দি করা হয়। ক°ফি°নে বেশ অনেকগুলো ফুটো ছিল হাওয়া চলাচলের জন্য। কবরের নকশা তো আগেই অপরূপাকে দেয়া হয়েছিল আর এতো পরিকল্পনায় আজ সে মুক্ত বাতাসে বিচরণ করছে।

“ওই নোটটা কেন ছেড়েছিল?”

অপরূপার প্রশ্নে শাফিন হেসে বলে,
“মৃত্তিকা খুঁজবে তার উত্তর, আর খুঁজে জানতে পারবে আমার মায়ের নাম ছিল জোসনা৷ তখন নিজের নানীর নাম তা°লা°শ করবে।”
“ওর নানী?”
“মেহরিবা সুলতানা, আমার চাচী।”
“তাতে আমাদের লাভ?”

শাফিন অপরূপার কোলে মাথা রেখে শুয়ে বলল,
“এতে আমরা পাকাপোক্ত কিছু ভাবতে সময় পাবো, এখন যেমন পাচ্ছি।”

অপরূপা একটু করে মাথা ঝাঁকায়। একজন মানুষ কতটা নি°কৃ°ষ্ট হতে পারে তার উদাহরণ বোধহয় শাফিন। অপরূপা জানে এই লোকটা একটা সা°ই°কো, সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ কখনোই এমন আচরণ করবে না। ডা. আরিফা ওকে একবার বলেছিল, এই মানুষকে হাজার চিকিৎসা করেও সুস্থ করা যাবে না, কারণ সে তো সুস্থ হতেই চায় না।

“মমতাজ জানে আমি এখানে?”

অপরূপা হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ে৷ শাফিন ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল,
“একমাত্র ওকেই কেউ সন্দেহ করে না, ওকে এমনভাবে থাকতে বলো যাতে কেউ টের না পায়৷ আমি সময় করে কথা বলবো।”
“ঠিক আছে।”
______________________________________

আফরোজা বাসার সবার সাথে ভিডিও কলে কথা বলছে। সারাহ্-র সাথে কথা বলার সময় বলে,
“ওমা সারাহ্, মেহেদী দাওনি?”
“না আপু, হাত কে°টে গেছে৷”
“তো কি হয়েছে? বিয়ের পরে প্রথম ইদ, হাত ভরে মেহেদী দিবে। (একটু থেমে) আহনাফকে দাও।”

সারাহ্ আহনাফের দিকে ফোন এগিয়ে দেয়৷ আহনাফ ফোন নিলে আফরোজা বলে,
“কিরে, সারাহ্-র হাত খালি কেন? মেহেদী দিয়ে দিবি।”
“আমি দিতে পারি না।”
“যা পারিস তাই দিবি।”
“আচ্ছা আচ্ছা।”

আহনাফ আব্বাস সাহেবকে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে রুমে আসে। সারাহ্ টেবিলের উপরে থাকা বইগুলো গোছাতে ব্যস্ত।

আহনাফ এসে ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আপু বলেছে তোমাকে মেহেদী দিয়ে দিতে।”
“দিবো না আমি।”

সারাহ্-কে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
“কি হয়েছে?”

সারাহ্ মাথা নেড়ে না বোঝায়। আহনাফ একটু হেসে গিয়ে আলমারি খুলে। একটা শাড়ি বের করে সারাহ্-র হাতে গিয়ে বলল,
“এটা পড়ো, তারপর মেহেদী দেয়ার ব্যবস্থা আমি করছি।”

সারাহ্ শাড়িটা হাতে নেয়। আহনাফ শান্ত কন্ঠে বলে,
“পড়ে নাও, আমি অপেক্ষা করছি।”

আহনাফ বাইরে চলে যায়। কি করবে, পড়বে কি পড়বে না ভেবে ভেবে অবশেষে শাড়িটা পড়েই নেয় সারাহ্। চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে আঁচড়ানোর সময়ই আহনাফ বাইরে থেকে ডেকে বলল,
“ঐশী, আসবো আমি?”
“আসেন।”
মিনমিনে করে জবাব দিলো সারাহ্।

আহনাফ ভিতরে আসে। হঠাৎ সারাহ্-র দিকে তাকাতেই সে থমকে যায়। ছোটবেলায় খেলার ছলে যেমন দাঁড়িয়ে থাকতো বা স্কু°ই°ড গেমে যেমন হঠাৎ থামতে হয়, ঠিক তেমনি আছে আহনাফ।

সারাহ্ একটু লজ্জা পায়। আহনাফ কাছে আসার সাথে সাথে তার লজ্জার পরিসর বাড়ে৷ সারাহ্ চঞ্চল দৃষ্টির চোখদুটো নামিয়ে নেয়। আহনাফ ওর সামনে এসে দাঁড়িয়ে চেয়ে থাকে ওর দিকে৷ নিজের ঐশীর রূপের প্রশংসা সে করে না, অন্যদিনের মতো আজ লজ্জাও দিচ্ছে না কিন্তু সারাহ্ অনবরত লজ্জা পাচ্ছে।

আহনাফ ওর হাতদুটো একহাতে ধরে, অন্যহাতে ওর মুখটা তুলে। দুজনের চোখ দুজনকে দেখে। ঘনঘন ফেলতে থাকা সারাহ্-র চোখের পাপড়ির ছন্দে কোনো এক নৃত্য দেখছে আহনাফ।

আহনাফের কৌতুহলী দৃষ্টি, বড়বড় চোখ, মোটা ঠোঁটজোড়া দেখে দেখে লজ্জা বাড়ে সারাহ্-র৷ কন্ঠ তো সেই কবেই থেমে গেছে, আহনাফ ওর বাধা মানে না।

আহনাফ ওর হাত ধরে এনে বিছনায় বসায়, নিজে বসে মুখোমুখি। ওর হাত টে°নে তালুতে চুম্বন করে, তারপর টেবিল থেকে মেহেদী নিয়ে এসে ডিজাইন করা শুরু করে। ঠিকমতো তো বহু দূর, কোনোমতে মেহেদী লেগেছে। এলোমেলো আর এবড়ো থেবড়ো ডিজাইনে সারাহ্-র হাত লেপ্টে গেছে।

তবে এতে সারাহ্-র সংশয় দূর হয়েছে। আহনাফকে নিয়ে ভুল চিন্তার জন্য নিজেই অনুতপ্ত সে। ভালোবাসি না বললেও এ ভালোবাসা এভাবেই বাড়তে থাকুক।

চলবে…..

অনুভূতিরা শব্দহীন পর্ব-৩৭+৩৮+৩৯

0

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

সপ্তত্রিংশ পর্ব (৩৭ পর্ব)

“অপরূপা নামের কেউ কি এখানে ইনভলভ আছে?”

আহনাফের প্রশ্নে ইন্সপেক্টর রাব্বি বিরক্ত হয়। বেশ কিছুক্ষণ থেকে আহনাফের প্রশ্নের উত্তর একের পর এক দিয়েই যাচ্ছে সে। এবারে বেশ রাগ দেখিয়ে বলল,
“আপনি কি আমাকে রি°মা°ন্ডে বসিয়েছেন?”

ইন্সপেক্টরের কথায় আহনাফের চোখ কুঁচকে যায়৷ একজন অপরাধীর আরো অপরাধ থাকতেই পারে, দায়িত্ব নিয়ে তা খুঁজে বের করা উচিত। কিন্তু রাব্বির মধ্যে এমন কোনো ইচ্ছা আহনাফ দেখলো না। বুকে লাগানো নেমপ্লেটে ‘ফজলে রাব্বি’ নাম দেখে আহনাফ বেরিয়ে আসে। এখন তার মনে হচ্ছে ইমতিয়াজের কথা ঠিক, লি°গ্যাল পথে এরকম মানুষকে শা°স্তি দেয়া যাবে না।

আহনাফের চিন্তাভাবনায় আরো অনেক কিছু আছে। যেমন অপরূপা কি শাফিনের সাথে সত্যিই যুক্ত কিনা, জামিল যুক্ত কিনা নাকি ওর চিন্তাভাবনা ভুল। এতো এতো চিন্তার মাঝে তার ফোন বেজে উঠে।

সারাহ্-র নাম্বার দেখে রিসিভ করে,
“জি, ঐশী।”
“আপনি থানায় কি করছেন?”

আহনাফ চমকে উঠে আশেপাশে তাকায়। কই সারাহ্ তো কোথাও নেই, তবে কিভাবে জানলো সে এখানে।

“আপনি মি°থ্যা বলে ঢাকায় গেছেন, আপনি থানায় গেছেন মানে কোনো সমস্যা আছে। আপনি আমার সাথে লুকোচুরি করছেন আহনাফ।”

আহনাফ গলা ঝে°ড়ে বলল,
“আমাকে একটু কথা বলতে দাও। আমি একটা কাজে…”

আহনাফের কথা শেষ হওয়ার আগেই সারাহ্ উত্তর দেয়,
“হ্যাঁ, কাজে গেছেন, যেতেই পারেন। তাই বলে আমাকে বলতে এতো প্রবলেম?”
“ঐশী রানী, জান আমার। শুনো তো।”

সারাহ্ রাগ করে কল কে°টে দিলো। আহনাফ কলব্যাক করলেও রিসিভ করে না। আহনাফ হতাশ হয়ে ফোন রেখে দেয়

থানা থেকে আহনাফ কাকরাইল গো°র°স্থানে আসে। তাহসিনার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে দোয়া করলো। তারপর হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“তাহু, কি এমন হয়েছিল সেদিন? গল্পটা কি অন্যরকম হতে পারতো না? আমরা নতুন করে লিখতে পারতাম না এটা? এতো রহস্য থাকতো না, শুধুই ভালোবাসা থাকতো।”

আহনাফ থামে, চুপ করে অপেক্ষা করে তার তাহুর জবাবের। কিন্তু তাহু যে তার সাথে মান করেছে, জবাব দিবে না কিছুতেই। হঠাৎ কান্নার শব্দে আহনাফ চমকে উঠে। দূরে একটা মেয়ে কাঁদছে।

আহনাফ উঠে সেদিকে গেল। মেয়েটার মুখ দেখা যাচ্ছে না। ঘোমটার আড়ালে লুকানো মেয়েটাকে প্রশ্ন করে,
“কাঁদছেন কেন আপনি?”

মেয়েটা ফুঁপিয়ে উঠে একটা কবর ইশারা করে বলল,
“ওই কবরে আমার কেউ শুয়ে আছে।”

আহনাফ ঘাড় ঘুরিয়ে কবরটা দেখে বলল,
“কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদতে হয় না।”

আহনাফ বেরিয়ে যেতে নিলে মেয়েটি বলে,
“নার্গিসকে সা°ক্ষী দিতে নিষেধ করো, নাহলে সারাহ্-কে আর খুঁজে পাবে না। ঢাকা থেকে কুমিল্লা কিন্তু দুই ঘন্টার পথ।”

আহনাফ ফিরে মেয়েটিকে ধরতে গেলে অন্য একটা ছেলে ওর সামনে চলে আসে। অত°র্কি°ত আ°ঘা°ত করে আহনাফের উপর, টাল সামলাতে পারে না। পেছন থেকে আরেকটা ছেলে ওকে আ°ঘা°ত করে। মেয়েটা ততক্ষণে সরে গেছে। একটু দূরে গিয়ে ঘোমটা খুলে ফেলে। অপরূপা, এই মেয়েটিই অপরূপা। শাফিনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় সা°ক্ষী ওরা নার্গিস পারভিন ও রোমি খন্দকারকে মনে করছে।

আহনাফ শান্তশিষ্ট ছেলে, মা°রা°মা°রি সে কোনো কালেই করেনি। এসবে বড্ড কাঁচা। তবুও তো পুরুষ। প্রতিরোধের চেষ্টা করে, তবে দুজনের সঙ্গে ঠিক পেরে উঠে না। বেশ করে আ°হত হলে ছেলেদুটো চলে যায়। পায়ে প্রচন্ড ব্য°থা পেয়েছে সে। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে, রাস্তায় লোকজনও বেশ কম।
______________________________________

বাসায় এসে সুরভিকে নিজের শাশুড়ী আর ননদকে দেখে অবাক হয় না। ওর বাবাকে পুলিশ গ্রে°ফ°তার করেছে, সেই সংবাদ শুনেই এসেছেন উনারা।

“আসসালামু আলাইকুম, মা।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম।”
সুরভির শাশুড়ী অনিচ্ছাকৃত জবাব দিলো।

“আপনারা বসুন, আমি নাস্তা নিয়ে আসছি।”

কথাটা বলে সুরভি দ্রুত নাস্তার ব্যবস্থা করতে যেতে নিলে ওর শাশুড়ী বলল,
“লাগবে না। আমরা কথা বলতে এসেছি। (একটু থামে) তুমি আর আমাদের বাসায় ফিরে যেও না।”

সুরভি হা করে তাকিয়ে থাকে শাশুড়ীর দিকে। ওর শাশুড়ী বলতে থাকে,
“তোমার বাবা খু°নের আ°সামী, বলা তো যায় না তুমি কেমন?”

ওর ননদ পাশ থেকে উনাকে খোঁ°চা দিতেই উনি বলেন,
“দেখো, আত্মীয়রা নানা ধরনের কথাবার্তা বলছে। তাই আমরা আর তোমাকে ফিরিয়ে নিতে চাচ্ছি না, তবে (আবারো থামে) তবে বাচ্চার সব দায়িত্ব আমরা নিতে রাজি আছি।”

সুরভির পৃথিবীটা থমকে গেছে। তার বাবার জন্য তার সংসার ভে°ঙে গেল। ওর কি দোষ ছিল? আর লোকে কি বুঝবে?

সুরভির শাশুড়ী আর ননদ বেরিয়ে যায়। সুরভি ওখানেই স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। নিজের সন্তানের জন্য চিন্তা হতে লাগলো তার। একসময় লোকে হয়তো তাকেও খু°নি বলে সন্দেহ করবে।
______________________________________

আহনাফ বাসায় এসেছে রাত আটটায়। নাকমুখ ফুলে আছে, মুখের এখানে সেখানে র°ক্ত জমাট বেঁধেছে। পায়ের ব্য°থায় খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছে সে। আব্বাস সাহেব দরজা খুলে আহনাফের অবস্থা দেখে কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই আহনাফ বলে,
“আমি ঠিক আছি, চিন্তা করো না।”

আহনাফ চলে যেতে নিলে আব্বাস সাহেব বললেন,
“এটা ঠিক থাকা?”

আহনাফ কিছু না বলে রুমে চলে গেল। সারাহ্ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে, আহনাফকে সে খেয়াল করেনি। আহনাফও তাকে ডাকেনা। ফোন আর ওয়ালেট টেবিলে রেখে ওয়াশরুমে চলে যায় সে। ক্ষ°ত°স্থানগুলো নিজে নিজেই ওয়াশ করতে থাকে আহনাফ।

দরজা বন্ধের শব্দ পেয়ে সারাহ্ রুমে আসে। টেবিলে আহনাফের ফোন দেখে সারাহ্ বুঝতে পারে আহনাফ এসেছে। বিকেল থেকেই আহনাফের সাথে রেগে আছে সে। আহনাফ তাকে কেন মি°থ্যা বলেছে।

আহনাফ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ওকে দেখে কাছে টেনে গালে চুম্বন করে বলে,
“রেগে আছো নাকি এখনো?”

সারাহ্ ওর চেহারার দিকে তাকিয়ে চুপসে যায়। আহনাফের মুখে আ°ঘা°তের চিহ্ন। সারাহ্ ওর গালে, ঠোঁটে হাত দিয়ে বলে,
“কি হয়েছে এসব?”

ওর চিন্তিত কন্ঠ আহনাফ চিনে ফেলে। মাথা নেড়ে বলল,
“কিছু না, একটু ব্য°থা পেয়েছি।”

সারাহ্ ওর দুগালে হাত রেখে বলে,
“থানায় ছিলেন? এখন আবার এসব দেখছি? কি হয়েছে বলেন না? আমার..”

ওকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আহনাফ নিজের ওষ্ঠোধর সারাহ্-র ওষ্ঠে স্পর্শ করে দেয়৷ গভীরভাবে স্পর্শ করে আহনাফ সরে যায়।

আহনাফ শার্ট খুলে টিশার্ট পড়তে পড়তে বলল,
“তুমি কি করে জানলে আমি থানায় গেছিলাম?”

সারাহ্ এগিয়ে এসে ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওর পিঠে মাথা ঠেকিয়ে বলে,
“একদম হঠাৎ করেই জেনেছি, টিভিতে একটা নিউজে দেখলাম আপনাকে।”

আহনাফ হেসে উঠে বলল,
“শেষে সাংবাদিক আমার বউয়ের কাছে আমার মিথ্যা ধরিয়ে দিলো?”
“বলুন না কি হয়েছে?”

আহনাফ ফিরে তাকায়। সারাহ্-কে যত এসব থেকে দূরে রাখতে চাইছে, ততই যেন সারাহ্ এসবের কাছে চলে আসছে। আহনাফ ওকে জড়িয়ে ধরে। গো°র°স্থানের মেয়েটি বলেছিল নার্গিস পারভিন সা°ক্ষী দলে সারাহ্-র ক্ষতি হবে৷ আহনাফের হাতের বাঁধন শক্ত হতে থাকে, কোন শত্রুতা ঘিরেছে ওদেরকে?
______________________________________

দুইদিন পর, “রমজান মাসের চাঁদ দেখা গিয়েছে, আগামীকাল থেকে শুরু হচ্ছে পবিত্র মাহে রমজান।”
টিভিতে খবর প্রচারিত হচ্ছে।

তানজিমদের বাসায় আছে মৃত্তিকা। ওই টিভি ছেড়েছে রমজানের খবর শোনার জন্য। হাসিহাসি চেহারা নিয়ে মমতাজ বেগমকে বলে,
“বড়মণি চাঁদ দেখা গেছে।”
“হুম।”

ছোট করে জবাব দিলো মমতাজ বেগম। শাফিনের গ্রে°ফ°তারের পর থেকেই উনি আবারো চুপচাপ আছে। মৃত্তিকা রান্না শেষ করে তানজিমকে বলে,
“সেহরিতে গরম করে নিও। তোমার ভাইয়া আসলে আমি চলে যাবো।”
“প্রথম রোজার দিনটা একসাথে কাটাই?”

মৃত্তিকা মুচকি হেসে বলল,
“অফিস থেকে কালকে এখানে আসবো সোজা। ইফতার একসাথে হবে, ইনশাআল্লাহ।”

ইমতিয়াজ বাসায় এসেই ওদের কথা শুনে বলে,
“ইনশাআল্লাহ।”

মৃত্তিকা পিছনে তাকিয়ে বলল,
“এতো দেরি?”
“অফিসে তো একা সব সামলাতে হচ্ছে।”
“হুম, তো যাওয়া যাক?”
“ওয়েট।”

ইমতিয়াজ ভিতরের রুমে গিয়ে মমতাজ বেগমের সাথে কথা বলে আসে। তারপর দুজনে নিজেদের বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়।

বাসায় এসে মৃত্তিকা আবারো কাজে লেগে গেল। সেহরি তৈরি তো করতে হবে। ইমতিয়াজ ফ্রেশ হয়ে এসে বলল,
“আগে তারাবি পড়ে নিবে চলো।”

মৃত্তিকা চোখের ইশারা পুরো রান্নাঘর দেখিয়ে বলে,
“এতো কাজ?”

পেঁয়াজ কা°টছিল বলে মৃত্তিকার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। ইমতিয়াজ এগিয়ে এসে ওর চোখ মুছে দিয়ে ওর থেকে ছু°ড়ি নিয়ে বলে,
“তুমি অন্য কাজ করো, আমি কে°টে দিচ্ছি।”

দুজনে মিলেমিশে রান্না শেষ করে নেয়। তারপর দুজনে একসাথে তারাবির নামাজ আদায় করে নেয়। এবারের রমজানটা দুজনের জন্যই খুশির হয়ে এসেছে।

নামাজ শেষে মৃত্তিকা জায়নামাজে বসে জিকির করছে। ইমতিয়াজ বলল,
“চলো, ছাদে যাই।”
“কেন?”
মৃত্তিকা জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়।

ইমতিয়াজ ওর হাত ধরে বলল,
“নতুন চাঁদ দেখবো, এসো।”

কোনোরকমে জায়নামাজ রেখে দরজার লকটা দিয়েই ছাদে যায় দুজনে। ওরা চলে গেলে অপরূপা ওদের ফ্ল্যাটে আসে। মৃত্তিকার ফোনটা খুঁজে না পেয়ে রাগ উঠে। তারপর চুলার গ্যাস চালু করে দিয়ে বেরিয়ে যায়। মুখে বলে,
“আ°গুন জ্বা°লা°লেই বুম।”
______________________________________

তারাবি পড়ে বাসায় এসেছে আহনাফ ও আব্বাস সাহেব। সারাহ্ এখনো জায়নামাজে বসে আছে। আহনাফ-সারাহ্ দুজনের মোনাজাতে সন্তানের সুস্থতা।

আহনাফ রুমে আসলে সারাহ্ ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
“নামাজ বাকি আছে?”
“বেতের তাহাজ্জুদের পর।”

সারাহ্ হেসে মোনাজাত সেরে নেয়। তবে জায়নামাজ থেকে উঠার আগেই আহনাফ ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।

“ওমা এসব কি?”

সারাহ্-র প্রশ্ন সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে আহনাফ ওর হাত ধরে নিজের গালে রেখে সূরা আর রহমান তেলাওয়াত করা শুরু করে। সারাহ্ মুচকি হাসে৷ ওর মন প্রশান্ত হয়। চোখ বন্ধ করে সে তেলাওয়াত শুনে। আহনাফের তেলাওয়াত বেশ সুন্দর। সারাহ্ উপলব্ধি করে সূরা আর রহমানের সেই আয়াত,
“আর তোমরা তোমাদের রবের কোন কোন নিয়ামতকে অস্বীকার করবে?”

সত্যিই তো রবের কোনো নেয়ামত অস্বীকার করার সুযোগ নেই। সারাহ্-র জীবনে আহনাফ নেয়ামত হয়েই এসেছে। যার কাছে তার শান্তি মেলে, অন্তর শান্ত হয়।
______________________________________

আকাশে আজ চাঁদ নেই, তারা নেই। কেবলই মেঘে ঢাকা আকাশ। ইমতিয়াজ-মৃত্তিকা হতাশ হলো। মৃত্তিকা ছাদের গালে হাত দিয়ে বসে বলল,
“যাবো না আমি কোথাও।”

ইমতিয়াজ ওর বাচ্চামো দেখে হাসে। মেয়েটা শুধু ওর সামনেই এমন বাচ্চার মতো আচরণ করে। সকলের সামনে শক্ত সাহসী মেয়েটা ওর সামনে ননীর পুতুল হতে চেষ্টা করে।

“আহ্লাদী আমার।”
খুব আস্তেধীরে কথাটা বলে ইমতিয়াজ। মৃত্তিকা শুনে না।

গুড়িগুড়ি বৃষ্টি শুরু হলো। ইমতিয়াজ বলে,
“এই যা, অসময়ের বৃষ্টি। চলো মৃত্তিকা, বৃষ্টি ভিজে না।”

মৃত্তিকার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলে মৃত্তিকা ওর হাত ধরে উঠে দাঁড়ায়। বৃষ্টির বেগ বাড়ে। ইমতিয়াজ চলে যেতে নিলে মৃত্তিকা ওর হাত টেনে ধরে বলল,
“এমন কেন আপনি?”
“কেমন?”
“কিছু না।”

দুজনে ভিজে একাকার। ইমতিয়াজ ওকে পাঁজাকোলে করে নিচে নিয়ে আসে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলে,
“বৃষ্টিতে ভিজলে জ্ব°র হবে।”

বাসায় প্রবেশ করতেই গ্যাসের গন্ধে দুজনে ঘাবড়ে যায়। মৃত্তিকাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে ইমতিয়াজ ভিতরে গেলেও মৃত্তিকা ওর পিছুপিছু ভিতরে যায়। রান্নাঘরের চু°লা বন্ধ করে ইমতিয়াজ জানলা খুলে দেয়৷

পেছনে মৃত্তিকাকে দেখে প্রশ্ন করে,
“চু°লা অফ করোনি?”
“করেছিলাম তো।”
“তবে অন কেন? কেউ..”

ইমতিয়াজ ধীরে ধীরে দরজার কাছে যায়। কেউ নেই এখানে। মৃত্তিকা রান্নাঘরে ভালো করে দেখে। কেউ আসার কোনো চিহ্ন নেই। কিন্তু যখন ওরা শোবার রুমে যায়, তখন বুঝে কেউ এসেছিল। পুরো রুম এলোমেলো।

“কেউ এসেছিল, কিছু খুঁজেছে।”

মৃত্তিকার কথায় ইমতিয়াজ সম্মত। কেউ অবশ্যই কিছু খুঁজেছে। নাহলে রুম এলোমেলো হবে কেন?

“শাফিন কি ছাড়া পেয়ে গেল?”

মৃত্তিকার কথায় ইমতিয়াজ ফ্যা°লফ্যা°ল করে তাকায় ওর দিকে। ওর কথা তো সঠিক হতে পারে, ছাড়া পেতেই পারে সে।

মৃত্তিকা আলমারি খুলে বলে,
“আলমারি খুলেনি, তবে রুমে ঘাটাঘাটি করেছে।”
“এমন কিছু খুঁজেছে যা রুমে পাবে আলমারিতে না।”

চলবে…..

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

অষ্টাত্রিংশ পর্ব (৩৮ পর্ব)

মৃত্তিকা শুকনো কাপড় ইমতিয়াজের হাতে দিয়ে বলল,
“আপনি ভেজা কাপড় পালটে নিন, আমি রুমটা গুছিয়ে নিই।”

ইমতিয়াজ এখনো আশেপাশে তাকাচ্ছে। মৃত্তিকা ওর মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,
“যে এসেছিল, চলে গেছে। চিন্তা কম করেন, জানা যাবে সবটা। (একটু থেমে) এসব তো আর নতুন কিছু নয়।”
“তবুও বিষয়টা জরুরি, কেউ আমাদের মা°রতে চেয়েছিল।”
“জানি আমি, বুঝি তো। শাফিন-দুলাল একা এতো বড় ষ°ড়°যন্ত্র করেনি। আরো লোক আছে।”
“শাফিন ছাড়া পেয়ে যাবে মৃত্তিকা। তুমি মিলিয়ে নিও আমার কথা।”

মৃত্তিকা জানে ইমতিয়াজের কথা ঠিক। তবে আগে আগে এতো চিন্তা করার কিছুই নেই, যা হবে দেখা যাবে।

সে কাপড়গুলো বিছানার কোনায় রাখে৷ ড্রেসিং টেবিলের উপরের জিনিসগুলো দেখছে ইমতিয়াজ। মৃত্তিকা এসে পাশে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো। ইমতিয়াজ ভ্রূ চুলকালে, মৃত্তিকাও চুলকায়। ইমতিয়াজ চুলে হাত রাখলে মৃত্তিকাও রাখে। এবারে ইমতিয়াজ খেয়াল করে মৃত্তিকা তাকে নকল করছে। মৃত্তিকার দিকে চোখ কুঁচকে তাকালে সে হেসে চোখ কুঁচকায়।

“নকল করছো আমাকে?”

মৃত্তিকা জবাব না দিয়ে একই কথা পুনরাবৃত্তি করে,
“নকল করছো আমাকে?”
“এসব ঠিক নয় মৃত্তিকা।”
“এসব ঠিক নয় মৃত্তিকা।”

ইমতিয়াজ হেসে বারান্দার দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে শার্ট খুলে ফ্লোরে ফেলে বলে,
“আরো করো নকল।”

মৃত্তিকা দুহাতে মুখ ঢেকে ফেলে, আবার আঙ্গুলের ফাঁ°ক দিয়ে ইমতিয়াজের দিকে তাকায়। ইমতিয়াজ এগিয়ে এসে ওর হাত সরিয়ে ওর থুতনিতে হাত দিয়ে মুখটা উপরে তুলে। মৃত্তিকা তাকায় না ওর দিকে, চোখ নামিয়ে রেখেছে। কিন্তু মুখে বলে,
“রি°ভে°ঞ্জ নিলাম, সেদিন যেমন আমাকে নকল করেছিলেন।”

মৃত্তিকার কোমড়ে আলতো করে হাত দেয় ইমতিয়াজ, কাছে নিয়ে আসে ওকে। লজ্জায় কুঁ°কড়ে আসে সে। ইমতিয়াজের সাথে যেন মিশে যেতে চাইছে। কিছু বলতে চেয়েও আটকে যাচ্ছে বারবার। ওষ্ঠদ্বয় অনবরত কাঁপছে, তা শান্ত হয় ইমতিয়াজের ওষ্ঠের ছোঁয়ায়। মৃত্তিকাকে কোলে তুলে নিলো। বিছানায় বসিয়ে ইমতিয়াজ পাশে বসে, মৃত্তিকা লজ্জায় লাল হয়ে গেছে।

ইমতিয়াজ আলতোভাবে ওর হাত ধরে, মৃত্তিকা ওর বুকে হাত দিয়ে সরাতে চাইলে ইমতিয়াজ ওকে আরো কাছে নিয়ে আসে। মৃত্তিকার গালে হাত দিলে মৃত্তিকা চোখ বন্ধ করে বলল,
“ইমতিয়াজ, শুনুন তো…”

ওর ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে চুপ করিয়ে দেয় ইমতিয়াজ। শব্দহীন অনুভূতিগুলো আর ভাষায় আনা হলো না। চোখের পলকে ভালোবাসা ছড়িয়ে গেল, ঠোঁটের উষ্ণ পরশে ভালোবাসা প্রকাশ পেল। কিন্তু ধ্বনিতে তা উচ্চারিত হলো না।

বাইরে বিদ্যুতের ঝল°কা°নি আর ঝুম বৃষ্টি থেকে দূরে গেল ওরা। লজ্জার পর্দা আজ পড়ে গেল। ভালোবাসার উষ্ণ ছোঁয়ায় কাছে আসে দুজনে।
______________________________________

সেহরির সময় হয়েছে, সারাহ্ খাবার টেবিলে সাজিয়ে রেখে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তে যায়। আহনাফ ঘুম থেকে উঠলেও বিছানায় বসে ঝিমাচ্ছে।

“ফয়েজ স্যার উঠুন, নামাজ পড়ে নেন।”
“হুম।”

সারাহ্ হিজাব বাঁধতে বাঁধতে বলে,
“আমি কিন্তু আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।”
“তাহলে দ্রুত আসছি।”

আহনাফ লাফিয়ে উঠে সারাহ্-র গালে চুম্বন করে ওয়াশরুমে চলে যায়। সারাহ্ হেসে জায়নামাজ বিছিয়ে অপেক্ষা করে আহনাফের জন্য। কিছুক্ষণের মধ্যে আহনাফ চলেও আসে। দুজনে একসাথে নামাজ পড়ে নেয়। তারপর আব্বাস সাহেবের সাথে দুজনে একসাথে সেহরি সেরে নেয়।

ফজরের পর সারাহ্ কোরআন তেলাওয়াত করতে বসে। আহনাফ এসে পাশে বসে বলল,
“ঐশী, তুমি অপরূপা নামের কাউকে চেনো?”

সারাহ্ কোরআন শরীফ বন্ধ করে বলে,
“না তো, কেন?”
“এমনিই।”
“ভোর বেলা এখন আবার মেয়েদের কথা মনে পড়ে কেন?”
“তওবা আস্তাগফিরুল্লাহ, আস্তাগফিরুল্লাহ।”
বলতে বলতে আহনাফ উঠে বারান্দায় যায়। সারাহ্ মুচকি হেসে আবারো তেলাওয়াত করা শুরু করে।

কিছুক্ষণ পর সারাহ্ কোরআন গুছিয়ে রেখে বারান্দায় গেল। আহনাফকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“সেদিন ঢাকা থেকে ওভাবে আসলেন কেন? কোথায় ব্য°থা পেয়েছিলেন?”
“সেটা দূরে থেকেও বলতে পারো তো, আমার রোজা হালকা করো কেন?”

সারাহ্ হুট করে সরে গেল। এই লোকটা আজন্মকাল অ°সভ্যই থাকবে, জীবনেও ভালো হবে না। আহনাফ ফিরে তাকিয়ে মুচকি হাসে।

সারাহ্ মিনমিনে স্বরে বলল,
“অ°সভ্য।”

আহনাফ ওর মুখের সামনে এসে নিজের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“গা°লা°গাল দিয়ে লাভ নেই, তুমি ইচ্ছা করে আমার রোজা হালকা করতে এসেছো।”
“সরেন।”

সারাহ্ ওকে ধা°ক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়৷ আহনাফ হাসতেই থাকে, সারাহ্ রাগ করে রুমে চলে যায়। সে চলে যেতেই আহনাফের হাসি থামে। সেদিনের একটা ঘটনা বলতে গেলেই বাকি ঘটনাও সারাহ্ জানতে চাইবে, তারপর শুরু করবে দু°শ্চিন্তা। আহনাফ চায় না এসব।
______________________________________

শাফিনকে তিনদিনের রি°মা°ন্ডে নেয়ার আদেশ দেয়া হয়েছে। আজকেই নিয়ে যাবে৷ খবর পেয়ে দুপুরের পর ইমতিয়াজ তার সাথে দেখা করতে এসেছে। অফিস থেকে সরাসরি চলে এসেছে যেন মৃত্তিকা না জানে।

সময় নির্দিষ্ট, এর মধ্যেই কথা বলতে হবে তার সাথে। ইমতিয়াজকে দেখেই শাফিন হাসে, তাচ্ছিল্যের সেই হাসি। ইমতিয়াজ চোখ ছোট করে তাকাতেই শাফিন বলে,
“আহারে, কষ্ট হয় তাহমিনার জন্য। যে মেয়েটা তোমার নাম জ°পতে জ°পতে ম°রে গেল তাকে ভুলে তুমি কিনা আরেকটা সংসার করছো?”

ন্যূনতম অনুশোচনা শাফিনের নেই। ইমতিয়াজ কিড়মিড়িয়ে বলে,
“তাহমিনার জন্য কোনো শেয়াল কুকুরের কষ্ট পাওয়ার দরকার নেই।”
“আর মৃত্তিকা? তার জন্য পেতে পারি?”

ইমতিয়াজ উত্তর দেয়ার আগে আবারো বলে,
“চেয়েছিলা বউকে মা°রার জন্য আমাকে তুমি মা°রবে, কিন্তু পেরেছো? পারোনি।”
“এখান থেকে বেঁচে বের হতে পারবে না, আর যদি বের হও তবে আমার হাতে ম°রবে।”
আঙ্গুল উঁচিয়ে কথাটা বলে ইমতিয়াজ।

শাফিন লোহার বেড়াজালের কাছে এসে বলল,
“ম°রার আগে মৃত্তিকাকে মা°রবো, তাহমিনার মতো করে মা°রবো। সেও চেঁ°চা°বে ইমতিয়াজ বলে।”

ইমতিয়াজ তাকে ধরতে গিয়েও পারে না, লোহার ছোট ছোট ফাঁক দিয়ে ওর হাত ভিতরে যায় না। শাফিন দাঁত বের করে হাসে।

ইমতিয়াজকে আরো রাগানোর জন্য বলে,
“আমি বের হওয়ার আগে মৃত্তিকা প্রেগন্যান্ট হলে ভালো হবে। একই কষ্ট, একই চিৎকার, শুধু মানুষটা ভিন্ন।”
“খবরদার মৃত্তিকার দিকে তাকিয়েছো তো।”
“সে তাকানো আমার শেষ, শুধু ছুঁয়ে দেখা বাকি।”

ইমতিয়াজ র°ক্ত°চক্ষু নিক্ষেপ তাকায়। শাফিনকে এখনই খু°ন করতে ইচ্ছা করছে ইমতিয়াজের। তবুও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে সে বেরিয়ে আসে, সময় যে শেষের পথে৷

ইমতিয়াজ বের হওয়ার কিছুক্ষণ পর অপরূপা ভিতরে প্রবেশ করে৷ তার আর অনুমতি লাগে না। ইন্সপেক্টর রাব্বিসহ উপরতলার বড়বড় মানুষের সাথে যোগাযোগ থাকায় অপরূপা সেলের ভিতরে গিয়েই শাফিনের সাথে কথা বলতে পারে।

“যা বুঝেছি সবাই মিলে তোমাকে ফাঁ°সি°তে ঝু°লানোর বন্দোবস্ত করে ফেলেছে।”

অপরূপার কথায় মাথা দুলায় শাফিন। বেশ শান্তভাবে বলে,
“ইমতিয়াজ হু°ম°কি দিয়েছে জীবন্ত বের হলে সে আমাকে খু°ন করবে।”
“ব্যাপারটা জলে কুমির ডাঙায় বাঘের মতো হলো না।”

অপরূপা ঘাবড়ে গেলেও শাফিন মোটেও ঘাবড়ায় না। বলে,
“নার্গিসের কি খবর?”
“আহনাফকে হুমকি দিয়েছি, নার্গিস মুখ খুললে সারাহ্ ম°রবে।”
“জামিলের কথায় আহনাফের সাথে সারাহ্-র বিয়ে দেয়াটাই ভুল হয়েছে।”

অপরূপা শাফিনের দিকে তাকালে শাফিন ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল,
“জীবিত না বের হতে পারি, ম°রে তো বের হতে পারবো? আমার লা°শই বের হবে এখান থেকে।”
“মানে?”
“কবরটা খুলনায় হবে, বাবার কবরের পাশে। ঠিক যেভাবে খুঁড়তে বলবো সেভাবে খুঁড়াও। আর আমার ফাঁ°সির বন্দোবস্ত করো।”

অপরূপা ভ°য়া°র্ত মুখে কিছু বলতে নিলে শাফিন আবারো বলে,
“যারা কবর খুঁড়বে তাদেরও শেষ করে দিবে।”

হাতের মুঠোয় থাকা ছোট কাগজটা অপরূপাকে দিয়ে বলে,
“আমার স°মা°ধীর মানচিত্র।”
______________________________________

সারাদিন ডিউটিতে ছিল মৃত্তিকা। ইমতিয়াজ দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত অফিসে না থাকলেও বাকি সময়টুকু ছিল। এখন দুজনেই চলে এসেছে তানজিমের বাসায়। মৃত্তিকা ভিতরে চলে গেছে আর ইমতিয়াজ গেছে গো°র°স্থানে।

মৃত্তিকা ভিতরে এসে তানজিমের সাথে ইফতার বানানোতে হাত লাগায়। দুই ভাইবোন বেশ আনন্দেই কাজ করছে। সব পেঁয়াজ তানজিম আগেই কে°টে রেখেছে। মৃত্তিকা বলে,
“এতো পেঁয়াজ কা°টা কেন?”
“ভাইয়া বলেছে কে°টে রাখতে, তুমি কা°টলে নাকি কান্নাকাটি করো।”

মৃত্তিকা মুচকি হাসে। মানুষটা চুপচাপ থাকলেও খেয়ালটুকু রাখতে ভুলে না। কোথায় ওর আনন্দ আর কোথায় ওর কষ্ট ঠিক বুঝে নিতে পারে।

তানজিম আবারো বলে উঠে,
“আপু, জানো আম্মু আজকে কি বলেছে?”
“কি?”
মৃত্তিকা কাজ করতে করতে জবাব দেয়।

তানজিম ধোয়া প্লেটগুলো রেখে বলল,
“বলেছে ম°রে গেল গেল আবার আমার ভাইকেও নিয়ে গেল।”

মৃত্তিকা অবাক চোখে তাকিয়ে বলে,
“উনি কি তাহমিনার কথা জানে না?”
“উহু, বলিনি। সিনক্রিয়েট করতে পারে।”
“এজন্যই নিজের ভাইকে সাধু ভাবছে।”

তানজিম শরবত বানানো শুরু করেছিল। কাজ থামিয়ে বলে,
“নিজেই কি এমন সাধু যে ভাইকে ভাববে।”

মৃত্তিকা তাকাতেই তানজিম চলে গেল। মৃত্তিকা তাকিয়ে তার চলে যাওয়ার পথের দিকে। কেন যেন মমতাজ বেগমকেও সন্দেহ হচ্ছে তার। পরক্ষণেই নিজেকে বুঝায়,
“নিজের মেয়েদের কেউ মা°রে না মিউকো, এসব ভুল চিন্তা তোর।”
______________________________________

কলেজ বন্ধ, সমস্তটা দিনই বাসায় কাটিয়েছে সারাহ্। আহনাফও বাসার ভিতরেই ঘুরঘুর করেছে, এখনো তাই করছে। তবে রোজা বলে আজ তার মুখে বেশ লাগাম লেগেছে, তবে ওই বলে না কয়লা ধুইলে ময়লা যায় না।

ইফতার বানাচ্ছে সারাহ্। হেল্প করার নামে আহনাফও এখানে দাঁড়িয়ে আছে। যদিও এসব কেবল নামমাত্রই, সে বিশেষ কোনো কাজে লাগছে না।

“ঐশী, একদিন বাবা-মাকে ইফতারের দাওয়াত দিই। কি বলো?”
“কাকে?”
“আরে, আমার গুণধর বউকে যে জন্ম দিছে ওই কাপলের কথা বলতেছি।”

সারাহ্ দাঁত খিঁ°চি°য়ে বলল,
“ভালো করে বললেই তো হয়।”
“ভালো করেই তো বললাম বাবা মা, তুমিই তো বুঝলে না। আমার কি মা আছে? আমি তো একজনকেই মা বলি।”

সারাহ্ তাকিয়ে আছে আহনাফের দিকে। ‘আমার কি মা আছে?’ কথাটা বলা কত কঠিন।

আহনাফ এগিয়ে এসে ওর থেকে খুন্তি নিয়ে বেগুনীগুলো উলটে দিতে দিতে বলে,
“পু°ড়ে যাবে তো।”

সারাহ্ আবারো ভাজাভাজি শুরু করে। বলল,
“দেন, আপনার ইচ্ছা।”
“এখন আমি রোজা, তুমি চাইলে তোমাকে চুমু দিতে পারবো না।”

সারাহ্ কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
“দাওয়াত দিতে বলেছি।”
“ওকে, তোমাকে সহস্র চুমোর দাওয়াত ইফতারের পর।”

কথাটা বলেই আহনাফ হেসে দেয়৷ সারাহ্ ওর পিঠে ধু°ম করে একটা কি°ল দিয়ে দরজার দিকে ইশারা করে বলে,
“বের হন।”

আহনাফ যেতে যেতে বলে,
“স্বামীকে মা°র°ধর করা ভালো না।”

সারাহ্ কথায় ন্যাকামো সংযুক্ত করে বলল,
“ওগো সোয়ামি, আপনার পাকনা কথায় আপনাকে কি°ঞ্চি°ৎ আ°ঘা°ত করার জন্য আমি অতি দুঃখ প্রকাশ করতেছি।”
“থাক থাক, যতসব গরু মে°রে জুতা দান।”

সারাহ্ হেসে আবারো কাজে মন দেয়। ইফতারের সময় যে হয়ে আসছে।
______________________________________

অপরূপা খুলনা যাচ্ছে। সাথে দুজন লোক আছে, এরা শাফিনের জন্য কবর খুঁড়বে।

উকিলকে কল করে সে,
“হ্যালো, এডভোকেট বীথি বলছেন?”
“জি, আপনি অপরূপা?”
“ইয়েস, আ’ম অপরূপা।”

বীথি একটা কাশি দিয়ে বলল,
“আপনারা কেইসটা হা°রতে চাচ্ছেন কেন? তাও এমন ইচ্ছা করে?”
“সেসব জানার বয়স কি আপনার হয়েছে?”
“শাফিনকে বহুবার আমিই বাঁচিয়েছি মনে রাখবেন। তার বহু কুকীর্তি আমি জানি।”

অপরূপা নিচের ঠোঁট কা°মড়ে বলল,
“শাফিন বেঁচে থাকবে, তবে ফাঁ°সি°তে ঝু°লেই বের হবে।”
“মানে?”
বীথি চোখমুখ কুঁচকে ফেলে।

অপরূপা হেসে বলে,
“মানে পুরো দেশ, মিডিয়া জানবে শাফিন মা°রা গেছে। সবাই জানবে ওর স°মাধী হয়ে গেছে। কিন্তু সে জীবিত হয়ে ফিরবে৷ তাই ওর ফাঁ°সির জন্য কেইসটা হা°রতে হবে। (একটু থেমে) তারপরের কাজ শাফিন করে নিবে।”
“আর ইউ শিউর?”
“ইয়াহ।”

অপরূপার কথায় বোঝা যাচ্ছে সে শতভাগ নিশ্চিত যে শাফিন বেঁচে যাবে। কিন্তু বীথি এসবে অনেক বি°ভ্রা°ন্তিতে পড়ে। ফাঁ°সি হলে কেউ কিভাবে বাঁচবে, কবর হলে কেউ কিভাবে ফিরবে?

চলবে…..

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

ঊনচত্বারিংশ পর্ব (৩৯ পর্ব)

এক দুই তিন করে পনেরো দিন পার হয়৷ দুলাল ফেরদৌসী হ°ত্যা মাম°লা°র চূড়ান্ত রায় আজ। প্রত্যেকটা টিভি চ্যালেনে লাইভ হচ্ছে। কি হবে, কি হবে করছে শুধু।

নার্গিস পারভিন খুব একটা টিভি দেখেন না। জাহাঙ্গীর সাহেব খবর দেখার সময় নিউজটা চোখে পড়ে তার৷ বিশেষভাবে আটকানোর কারণ না থাকলেও শাফিনের চেহারা দেখে থমকে যায় নার্গিস পারভিন। এ চেহারা সে ভুলবে না। ভ°য়ং°কর দ°স্যুর চেহারা। চোখেমুখে অদ্ভুত এক বিষ্ময় চলে এসেছে নার্গিস পারভিনের।

“কি হয়েছে, নার্গিস?”

জাহাঙ্গীর সাহেবের কথায় চমকে উঠে নার্গিস পারভিন বলেন,
“কিছু না।”

উনি উঠে তাড়াহুড়ো করে সামিহার রুমে চলে যায়। সামিহা বই পড়ায় ব্যস্ত ছিল। মাকে আসতে দেখে বলল,
“আম্মু?”

নার্গিস পারভিন থম মে°রে বসে রইলেন। শাফিন কি এতো সহজে মা°রা যাবে। যদি যায় তবে তো আলহামদুলিল্লাহ, কিন্তু যদি না যায়? তবে তো সারাহ্-র ঘোর বিপদ।

সামিহা মায়ের পাশে বসে বলল,
“আম্মু, কি চিন্তা করছো তুমি?”
“কিছু না, তুমি তোমার কাজ করো।”
সামিহা বিষয়টা নিয়ে আর ঘাটাঘাটি করলো না। সে চুপচাপ নিজের পড়া শুরু করলো। সে এখনো জানে না তানজিমের মামা খু°নের মামলায় গ্রে°ফ°তার হয়েছে।

অন্যদিকে আহনাফ ফোন ঘেটে যাচ্ছে কোথাও থেকে একটা সংবাদ আসুক শাফিন মা°রা গেছে বা তার মৃ°ত্যু°দন্ড দেয়া হয়েছে। যদিও এখনো পর্যন্ত কোনো পজিটিভ বা নেগেটিভ সংবাদ আসেনি।

কলরব আদালতে আছে। সেও জানতে চাচ্ছে তার বাবার খু°নির কি শাস্তি হবে। রি°মা°ন্ডে শাফিন সবকিছু স্বীকার করে নেয়ায় পুলিশ এসব নিয়ে আর তেমন কোনো তদন্ত করে না। যদিও উপরতলার হস্তক্ষেপ থাকায় তদন্ত হতোই না।

ইমতিয়াজ অফিসে আছে। সেখান থেকেই শাফিনের মৃ°ত্যু°দন্ডের খবর শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। মৃত্তিকারও একই অবস্থা। সবার একই দোয়া শাফিন যেন জীবিত বের না হয়।

শুধু একজন ভিন্ন রকম একটা দোয়া করছে। তার দোয়া,
“যে করেই হোক শাফিন সুস্থভাবে বের হয়ে আসুক।”
এ মানুষটি মমতাজ বেগম। তার ভাই কি জঘন্য অপরাধ করেছে তা মানতে সে নারাজ। তার ভাই ভালো থাকুক এটাই চান উনি।

সংখ্যাগরিষ্ঠের দোয়া কবুল হয়। শাফিনের ফাঁ°সি°র রায় হয়ে যায়। একাধিক মানুষ একত্রে বলে,
“আলহামদুলিল্লাহ।”
______________________________________

ইফতারের পর ইমতিয়াজ মিউকোকে খাবার খাওয়াচ্ছে। মৃত্তিকা এসে বিছানায় বসে বলল,
“শাফিন যদি তবুও ছাড়া পায়?”
“ওর লা°শ নিজ চোখে না দেখা পর্যন্ত ওকে আমি একবিন্দুও বিশ্বাস করি না। ভ°য়ং°কর এক অভিনেতা সে, নিখুঁত অভিনয়।”

মৃত্তিকা মাথা দুলিয়ে বলে,
“তা বুঝলাম, কিন্তু তাকে কে মা°রার চেষ্টা করেছিল?”
“তোমার বাবা, আর কে?”

ইমতিয়াজ স্বাভাবিকভাবে কথাটা বললে মৃত্তিকা চট করে বলে,
“উনি না।”

মৃত্তিকার কথায় ইমতিয়াজ তাকায় ওর দিকে। মৃত্তিকা মাথা নেড়ে বুঝায় সে ঠিক বলছে। ইমতিয়াজ ফ্লোরে বসে আছে, মৃত্তিকা বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে থেকে ওর দিকে ঝুঁকে বলে,
“উনি না, অন্যকেউ?”

ইমতিয়াজ ওর কাছে এসে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বলল,
“সন্দেহ আছে কারো প্রতি?”

মৃত্তিকা ঠোঁট উলটে একটু ভেবে বলল,
“দুলাল হতে পারে, আবার অন্যকেউও হতে পারে। যাদেরকে আমরা চিনি না।”
“হতে পারে।”

কথা শেষে মৃত্তিকার মুখে হালকা ফুঁ দেয় ইমতিয়াজ। মৃত্তিকা চমকে উঠে সরে যায়। ইমতিয়াজ হেসে উঠে। মেয়েটা এখনো প্রচুর সংকোচে আছে, লজ্জা পায় বারে বারে।

কিছুক্ষণ পর মৃত্তিকা বলে,
“ইদের পর আপনি অস্ট্রেলিয়া যাবেন?”
“যাবো না।”
“কেন? কেন?”

ইমতিয়াজ উত্তর না দিয়ে মিউকোকে আদর করতে থাকে। মৃত্তিকা এসে ইমতিয়াজের পাশে বসে মিউকোকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে বলে,
“যা ভাগ, সারাদিন শুধু বাবার কোল দখল করে বসে থাকা। বাবার কাছে মাম না আসলে ভাইবোন কপালে জুটবে না, ভাগ এখন।”

ইমতিয়াজ মুখ টিপে হাসছে। মৃত্তিকা ওর দিকে তাকিয়ে জিভে কা°ম°ড় দেয়। ইমতিয়াজ ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাছে এনে বলে,
“বাবার কাছে মাম চলে এসেছে।”

মৃত্তিকা ওর কাঁধে মাথা রেখে বলল,
“অস্ট্রেলিয়া যাবেন না কেন? ট্রেনিং নিতে হবে না?”
“অস্ট্রেলিয়া গেলে মিউকোর ভাইবোন কিভাবে আসবে?”

মৃত্তিকা মাথা তুলে ওর দিকে তাকায়। ইমতিয়াজ অন্যদিকে তাকিয়ে হাসছে। মৃত্তিকা ওর মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
“ফাজলামো না, সিরিয়াস।”

ইমতিয়াজ এখন বেশ গম্ভীর চেহারা করে বলল,
“শাফিন যতদিন বেঁচে আছে, ততদিন আমি তোমাকে একা রাখতে পারবো না।”

মৃত্তিকা হেসে দুহাতে ইমতিয়াজকে জড়িয়ে ধরে। মিউকো এসে আবারো ইমতিয়াজের গা ঘেষে শুয়ে পড়ে। ইমতিয়াজ একহাতে মৃত্তিকাকে জড়িয়ে ধরে, আরেকহাতে মিউকোকে আদর করে দেয়। মৃত্তিকা বেশ আরাম করে আধশোয়া হয়ে থাকতে থাকতে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে। ইমতিয়াজ ওকে নিজের কোলে শুইয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। মৃত্তিকার চেহারার দিকে তাকায় সে। ছোটবেলা থেকে যু°দ্ধ করে বড় হওয়া মেয়েটার বাহিরটা শক্ত হলেও ভেতরে একদম ছোট বাচ্চার মতো।

“যতন করে সাজিয়ে রাখতে ইচ্ছা করে, পুতুল আমার।”

মৃত্তিকা জেগে থাকলে এ কথা কখনোই ইমতিয়াজ বলতে পারতো না। তবে এখন বলছে। মৃত্তিকার আড়ালে প্রকাশ করছে নিজের অনুভূতি।
______________________________________

দিন আগায়, এক সপ্তাহ পেরিয়ে যায়। আজ রাতেই শাফিনের ফাঁ°সি হবে। তাই আজ পরিবারের মানুষজন তার সাথে দেখা করতে আসতে পারবে। দেলোয়ারা আজ প্রথমবারের মতো শাফিনের সাথে দেখা করতে এসেছে। সুরভিও সাথে এসেছে।

সুরভিকে দেখে এগিয়ে আসে শাফিন। সুরভি বলে,
“পরশুদিন আমার ডেলিভারির ডেইট দিয়েছে বাবা। তাহমিনা থাকতে পারতো আমার সাথে, তাহসিনাও থাকতো। রিপা আন্টি থাকতো, কিন্তু তুমি তা হতে দাওনি।”

সুরভির চোখ বেয়ে পানি পড়ে। ডানহাতের উলটো পিঠ দিয়ে মুছে নাক টে°নে বলল,
“আমার বাবুটাকে তার বাবা দেখবে আর শুধুই খরচ দিবে। কোলে নিবে না। (একটু থামে) তোমার কোলে প্রথম তুলে দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু তুমি তা হতে দিলে না।”

সুরভি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। শাফিন অনুভূতিহীন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এসবে তার আদৌ কি কিছু আসে যায়?

“আমার সংসার আর স্বপ্নগুলো ধ্বং°স করেছো তুমি বাবা।”

সুরভি কথা বললেও দেলোয়ারা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে কোনো ভাষা নেই। এক নিরব, নির্জনতা ভর করেছে তার উপর। এতোবছর যার সাথে সংসার করেছে সে একটা অ°মানুষ। দেলোয়ারা বিশ্বাস করতে পারছে না। নিজের স্বামীকে অনেক ভালোবাসতেন উনি, যা এখন কেবলই ঘৃ°ণা।

“তুমি কিছু বলবে না, দেলোয়ারা?”

শাফিনের প্রশ্নে ঘৃ°ণায় চোখ সরায় দেলোয়ারা। সুরভির থেকে সে সবটাই জেনেছে। ঠিক কেমন আচরণ তাহমিনার সাথে করেছে তাও জানে। যদিও এখনো পুরোটা সে বিশ্বাস করেনি।

নিচুস্বরে একটা কথাই দেলোয়ারা বলে,
“আপনার ম°রা মুখটাও আমি দেখতে চাই না।”
______________________________________

সারাহ্ ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে। আহনাফের সাথে সকালেই ঢাকায় এসেছে সে। আব্বাস সাহেবও এসেছেন। মূলত জাহাঙ্গীর সাহেবের দাওয়াত রক্ষায় এসেছে সবাই।

আহনাফ এসে ওর পেছনে দাঁড়িয়ে শার্টের কলার ঠিক করছে। বোঝা যাচ্ছে সে বাইরে যাবে। সারাহ্ আয়নার দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে বলল,
“কোথায় যাবেন?
“যাবো কোথাও।”

সারাহ্ ওর দিকে ফিরে বলল,
“এখন কেন, মাত্রই তো ইফতার করলেন।”

আহনাফ হেসে ওর দুগালে চুম্বন করে বলে,
“সমস্যা নাই, চলে আসবো।”
“কখন আসবেন?”
“সেহরির আগেই।”

সারাহ্ কপাল কুঁচকায়।
“সেহরির আগে মানে সারারাত বাইরে থাকবেন?”

আহনাফ হেসে পারফিউম দিয়ে বলল,
“চিন্তা করো না, মেয়ে নিয়ে থাকবো না।”

সারাহ্ ওর বুকে একটা হালকা ধা°ক্কা দেয়, আবার নিজেই শার্ট খা°ম°চে কাছে নিয়ে আসে। বলে,
“না গেলে হয় না?”

আহনাফ মুচকি হেসে হাঁটু গেড়ে বসে সারাহ্-র পেটে হাত রেখে বলল,
“বাবা আমার, আম্মুকে সামলে রেখো। তোমার আম্মু কিন্তু অনেক ভীতু। সে বাবাকে মিস করে সারাদিন। গল্প করো আম্মুর সাথে।”

সারাহ্ ওর কান্ডকারখানা দেখে হাসে। আহনাফ মাথা উঠিয়ে সারাহ্-কে দেখে বলল,
“তোমার আম্মুর লজ্জাও কমে যাচ্ছে, দিনদিন বে°হা°য়া হচ্ছে আর আমাকেও তাই বানিয়ে দিলো।”
“ইশ, লজ্জাশীল ব্যক্তি আমার।”

আহনাফ ওর পেটে চুম্বন করে, সারাহ্ লাফিয়ে উঠে বলল,
“সরুন, কি করছেন?”

আহনাফ উঠে দাঁড়িয়ে হেসে বেরিয়ে যায়। সারাহ্ আয়নার দিকে ফিরে নিজের পেটে হাত রেখে বলে,
“বাবাটা বেশি দুষ্ট হয়েছে, একদম লাগাম ছাড়া।”
______________________________________

আহনাফ জেলে এসেছে। শাফিনের সাথে দেখা করাই উদ্দেশ্য। সুরভি আর দেলোয়ারা বের হলেই আহনাফ দেখা করতে যায়। ওকে দেখে শাফিন বাঁকা হেসে বলে,
“সারাহ্ ভালো আছে?”

উত্তর না দিয়ে আহনাফ পালটা প্রশ্ন করে,
“অপরূপা কে? আর জামিলের সাথে আপনার কি সম্পর্ক?”

শাফিনে হেসে বলল,
“অপরূপা মানে যে প্রচুর সুন্দরী, রূপবতী। একদম রূপকথার গল্পের রাজকুমারীর মতো। (নিচুস্বরে) তাহসিনার মতো।”

আহনাফ বুঝতে পারে অপরূপাকে শাফিন চেনে আর এখন শাফিনের মূল উদ্দেশ্য ওকে রাগানো। আহনাফ শান্ত মেজাজে বলল,
“আর জামিল?”
“বন্ধু, তোমার আর সারাহ্-র বিয়ের প্ল্যানটা ওই গাধাই দিয়েছিল। এতে সারাহ্ হাতে না থেকে হাতছাড়া হয়ে গেছে।”

আহনাফ চোখ বুলিয়ে শাফিনকে ভালো করে দেখে। তার মধ্যে মৃ°ত্যুর ভয় নেই, চিন্তা নেই। কেমন যেন অদ্ভুত এক চেহারা। আহনাফ আর কিছু না বলে বেরিয়ে যায়।

শাফিন পেছন থেকে চেঁ°চিয়ে উঠে বলে,
“সারাহ্ মানে তোমার আদরের ঐশীকে সামলে রেখো।”

আহনাফ পাত্তা না দিয়ে বাইরে চলে আসে।বাইরে তানজিম আর ইমতিয়াজের সাথে দেখা হয়। দুজনে একই উদ্দেশ্যে এসেছে। আহনাফ তানজিমকে বলে,
“তুমি ঠিক বলেছিলে বিয়েটা পরিকল্পিত। জামিল ফুপা এক সাথে জড়িত আছে।”

তানজিম মাথা নেড়ে বলল,
“হুম, আমার সন্দেহ হয়েছিল। তবে এখনো আমি কারণটা নিয়ে কনফিউজড।”

তানজিম বি°ভ্রা°ন্ত হলেও আহনাফ মোটেও নয়। নার্গিস পারভিনকে দুর্বল করার জন্যই সারাহ্-কে ব্যবহার করতে চেয়েছিল ওরা। কিন্তু এখন ওরা ব্যর্থ।

“ভাইয়া, মিউকোপু কোথায়?”

তানজিমের কথায় ইমতিয়াজ আশেপাশে তাকায়। মৃত্তিকা ওর পাশেই ছিল কিন্তু এখন নেই। ইমতিয়াজ অন্য দিকে দেখতে থাকে। অবশেষে মৃত্তিকাকে ভিতরে যেতে দেখে ইমতিয়াজও যায়।

শাফিনের কাছে গিয়ে মৃত্তিকা বলে,
“মিজানের পা°ল্লার কথা ভেবেও তো তোমার শুধরে যাওয়া উচিত ছিল। কিভাবে দাঁড়াবে আল্লাহ্-র সামনে? কবরের আ°যা°ব কিভাবে সহ্য করবে?”
কথা বলতে বলতে মৃত্তিকার কন্ঠ কেঁপে উঠছে।

হিসাবের খাতা নিয়ে একবার বসে দেখো আমাদের পা°পের বোঝা ঠিক কতটা। যেন মনে হয় সমস্তটা জীবন পা°প করেই কাটিয়ে দিয়েছি। গুনাহ করতে করতে এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছি যে এখন গুনাহ করলেও তা নিয়ে ভাবনার সময় আমাদের নেই।

ইমতিয়াজ চলে আসায় শাফিন বলে,
“তোমার বউ স্বেচ্ছায় আমার কাছে এসেছে।”

মৃত্তিকা পিছনে তাকায়। ইমতিয়াজ ওর হাত ধরে শাফিনের দিকে তাকিয়ে মৃত্তিকাকে বলল,
“চলো।”

শাফিন হেসে বলল,
“দুলালের যে ভিডিওটা করেছিলে সেটা আদালতে দেখাও নি কেন?”
“সেটা আদালতের জন্য না, সেটা শুধুমাত্র তোমার জন্য।”

ইমতিয়াজ মৃত্তিকাকে নিয়ে বাইরে চলে আসে। প্রচুর মানুষের ভীড় এখানে। মৃত্তিকার হাত বেশ শক্ত করে ধরে হাঁটছে। মৃত্তিকা ঘাড় ঘুরিয়ে বারবার শাফিনের দিকে তাকাচ্ছে। শাফিনের আচরণ আর কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছে সে তার বের হওয়ার সব বন্দোবস্ত করে ফেলেছে।

বাইরে এসে ইমতিয়াজ তানজিমকে বলল,
“মৃত্তিকাকে নিয়ে বাসায় যাও, তানজিম।”
“আর আপনি?”
“ওর ফাঁ°সির পর আসবো।”
“আমি আপনাকে ছাড়া যাবো না।”

ইমতিয়াজ আড়চোখে একবার তানজিমের দিকে তাকায়। তারপর বলে,
“মৃত্তিকা, যা বলছি করো। এখানের পরিস্থিতি যেকোনো সময় যা খুশি হতে পারে।”
“আপনি থাকলে আমিও থাকবো।”

“যাও।”
ইমতিয়াজ এবারে ধ°ম°ক দেয়৷ ধ°ম°কে কাজ হয়, মৃত্তিকা চলে যেতে রাজি হয়।

উবার কল করে মৃত্তিকা আর তানজিমকে বাসায় পাঠিয়ে দেয় ইমতিয়াজ। কিছুদূর গিয়েই মৃত্তিকা গাড়ি থেকে নেমে তানজিমকে বলে,
“ইমতিয়াজকে জানাবে না আমি নেমে গেছি, বাসায় যাও।”
“কিন্তু আপু..”

ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই মৃত্তিকা ধ°ম°ক দেয়,
“যা বলছি তাই, বাসায় যাও। বড়মণি আর খালু একা ওখানে।”

মৃত্তিকা হাঁটা শুরু করে। তানজিম ড্রাইভারকে বলে,
“ভাইয়া চলুন।”

গাড়ি চলতে শুরু করলে তানজিম ইমতিয়াজকে কল দেয়।
“ভাইয়া, আপু নেমে গেছে গাড়ি থেকে।”
“এই মেয়েটা? আচ্ছা, তুমি বাসায় যাও, আমি দেখছি।”

ইমতিয়াজ ফোন রেখে আহনাফকে বলল,
“একটু অপেক্ষা করো, আমি আসছি।”
ইমতিয়াজ মৃত্তিকাকে খুঁজতে যায়৷

এদিকে মৃত্তিকা ফেরার পথে কারাগারের সামনের সড়কে অপরূপাকে দেখে। কালো চাদর গায়ে জড়ানো মেয়েটাকে আলাদা করে চেনার কারণ এই চাদরটাই। এখন বেশ গরম পড়েছে, চাদর দেয়ার অবশ্যই বিশেষ কোনো কারণ আছে।

মৃত্তিকাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অপরূপা বলে,
“কি দেখো?”
“কিছু না।”

অপরূপা রহস্যময় একটা হাসি দিয়ে বলল,
“চাদর দিয়েছি তাই দেখছো?”
“হুম।”
মৃত্তিকা জোরপূর্বক হাসে।

অপরূপা চাদর খুলে গুছিয়ে ডানহাতে ঝুলিয়ে নিয়ে বলে,
“মাঝেমাঝে নিজেকে লুকাতে হয়, আবার মাঝেমাঝে প্রকাশ্যে আনতে হয়।”

অপরূপা অন্যদিকে চলে যায়। মৃত্তিকা কয়েক মুহূর্ত ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে আবারো নিজের পথে হাঁটে৷

ইমতিয়াজের কাছে এখন ধরা না দিয়ে শাফিনের সাথে দেখা করে। শাফিন ওকে দেখে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল,
“কি ব্যাপার? আবার আসলে যে?”

মৃত্তিকা আশেপাশে তাকিয়ে তাড়াহুড়া করে বলে,
“তাহমিনার সাথে ওরকম আচরণ কেন করেছো? শুধুই কি সত্য জানার জন্য নাকি আরো কোনো কারণ আছে?”

শাফিন এগিয়ে এসে লোহার বেড়াজালে হাত রেখে বলল,
“তোমার মায়ের দুই ফ্রেন্ডের সাথেও এই আচরণ করেছিলাম, (ফিসফিসিয়ে বলে) তুমি গ°র্ভে থাকতে তোমার মায়ের সাথেও একই কাজ করতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছিলাম।”

মৃত্তিকা রাগে গ°জ°গ°জ করতে করতে বলল,
“এখানে তাহমিনার সাথে কি সম্পর্ক? শুধু অন্তঃসত্ত্বা ছিল বলে?”

শাফিন মাথানিচু করে হালকা মাথা ঝাকিয়ে মুখে “চু, চু” মতো একটা আওয়াজ করে। তারপর হাসিহাসি মুখে বলে,
“অনেক কিছু এখনো তোমার জানা বাকি। যা দুলাল জানতোই না। বেচারা শুধু ব্যবসা বাঁচানোর জন্য আমার সাথে ছিল।”

মৃত্তিকা কপাল কুঁচকে চোখ ছোট করে। শাফিন বলে,
“নিজেকে সামলে রেখো, আর মনে রেখো যে শাফিনকে এতোবছরে কেউ শা°স্তি দিতে পারেনি তাকে সামান্য ফাঁ°সির দড়ি কিছুই করতে পারবে না।”

মৃত্তিকার মাথায় খু°ন চেপে বসে। লোহার ছোট ফাঁক দিয়ে ডানহাতের তিন আঙ্গুল ভিতরে ঢুকিয়ে শাফিনের ফতুয়া ধরে হেঁচকা টা°ন দেয়। হঠাৎ করে টা°ন পড়ায় শাফিনের মাথা লোহায় বা°রি খায়। পরপর দুবার টা°ন দিতেই দুজন মহিলা কন্সটেবল এসে মৃত্তিকাকে সরিয়ে নেয়।

শাফিনের কপালের মাঝ বরাবর কে°টে গেছে, র°ক্ত ঝরছে সেখান থেকে। মৃত্তিকা এখনো রাগে ফোঁ°সফোঁ°স করছে।

মৃত্তিকা জোর গলায় বলে,
“মনে রেখো শাফিন, সিংহী কিন্তু শি°কার করে সিংহ নয়।”

চলবে….