Wednesday, July 9, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 340



অটবী সুখ পর্ব-০৯

0

অটবী সুখ

৯.
কারেন্ট নেই। নিকষকৃষ্ণ আঁধারে ঝিমঝিম করছে চারপাশ। অটবী মোমবাতি জ্বালিয়ে সাবধানে বইয়ের কাছে রাখলো। ক্ষীণ হলদেটে আলোয় এখন যা একটু দেখা যাচ্ছে। উঠে দাঁড়িয়ে বিরক্তিকর একটা নিশ্বাস ফেললো। কারেন্ট-টা আর যাওয়ার সময় পায়নি। পৃথা আর নলী এমনিতেই পড়তে চায় না। অনেক কষ্টে বকে বকে পড়তে বসিয়েছিল, ওমনি কারেন্ট ফুরুৎ!
মাথার ওপর মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে। তবুও চাঁদের দ্যুতি ঠিক ধরণীতে পৌঁছাচ্ছে না। উঠোনে পাটি বিছিয়ে পৃথা আর নলী পড়ার ভান করছে। বইয়ের দিকে তাকিয়ে সমানে ফুসুরফাসুর করে যাচ্ছে একে অপরের সাথে। সেদিকে চেয়ে অটবী ভ্রু কুঁচকালো। এই টুনটুনির মতো মেয়েগুলো কি ভেবেছে? সে কিছু বুঝতে পারছে না ওদের চালাকি? থমথমে গলায় অটবী তৎক্ষণাৎ ধমক লাগালো, “পড়ছিস না কেন তোরা? বইয়ের দিকে তাকিয়ে যে নাটক করছিস, ভেবেছিস আমি বুঝতে পারছি না? বেতের বারি খেতে মন চাচ্ছে? দিবো একটা?”

সঙ্গে সঙ্গে কথা থামিয়ে জোরে জোরে মাথা নাড়ালো পৃথা আর নলী। পরমুহুর্তে এমন ভাবে পড়তে লাগলো, যেন এই ইহকালে পড়া ছাড়া তারা আর কিচ্ছু চিনে না। মেয়েদের এমন কান্ড দেখে হাসলেন রেবা বেগম। হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে বললেন, “চা বোধহয় এতক্ষণে হয়ে গেছে অটবী। নিয়ে আয় তো। আমার এখন উঠতে ইচ্ছে করছে না।”
—“আনছি। তুমি ওদের দিকে খেয়াল রাখো। তোমার মেয়েগুলো এত ফাঁকিবাজ হয়েছে!”

অটবী রান্নাঘরে চলে যেতেই নলী আবারও অসমাপ্ত আলোচনাটুকু শেষ করতে উদ্যোগী হলো। রহিমের বখাটে দল অটবীদের বাসার আশেপাশেই আছে। চিৎকার-চেঁচামেচি করে রাখছে না কিছু। ইদানিং ইলিয়ানা আন্টির স্টাইলিশ, উচ্চ শিক্ষিত ছেলে কাদিনও ওদের সঙ্গ দিয়েছে। সারাদিন রহিমের সাথে ঘোরাফেরা করে। নলীও দেখেছে কয়েকবার। কিন্তু পৃথা বিশ্বাস করতে চাইছে না।
নিজেকে সত্য প্রমাণ করতে নলী গলার জোর বাড়িয়ে বললো, “কাদিন ভাইয়া ভালো ছেলে না, পৃথা। আমি নিজের চোখে উনাকে একটা মেয়ের সাথে চিপায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি।”

পৃথার মন খারাপ হলো। কিন্তু সে বুঝতে দিলো না। বইয়ের দিকে দৃষ্টি রেখেই ফিসফিসিয়ে বললো, “তুই হয়তো ভুল দেখেছিস। কাদিন ভাইয়া মোটেও এমন না। আমি উনাকে চিনি।”
নলীও ফিসফিসালো, “কি এমন চিনিস? কয়দিন কথা বলেছিস ওনার সাথে? দূর থেকে দেখেই আপন হয়ে গেল? নাকি তোর রোমিও খারাপ হতেই পারে না! তোদের চোখে তো একমাত্র সরোজ ভাই-ই খারাপ। আর সবাই তো ধোঁয়া তুলশি পাতা।”

পৃথা বই থেকে চোখ তুললো। রেবা বেগমের এদিকে খেয়াল নেই। পাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে তিনি ঝিমুচ্ছেন। কণ্ঠ খাঁদে নামিয়ে পৃথা বললো, “সাবধানে কথা বলবি নলী। কাদিন ভাইয়া আমার রোমিও হতে যাবেন কেন?”
—“রোমিও না হোক, তুই তো উনাকে পছন্দ করিস। তাছাড়া—”

কথা বলতে বলতে হঠাৎ-ই থেমে গেল নলী। রহিমদের গলার আওয়াজ একদম কাছ থেকে শোনা যাচ্ছে। শুধু রহিম না, সরোজ, কাদিন আরও গুটিকয়েক ছেলের কণ্ঠস্বর স্পষ্ট কানে আসছে। নলীর চোখ চিকচিক করে উঠলো। উত্তেজনায় পৃথার বাহু খামছে ধরে বললো, “শুনেছিস? কাদিন ভাইয়ার গলা। আমি বলেছিলাম না উনি রহিম ভাইদের সাথে চলাফেরা করে? তুই তো বিশ্বাসই করতে চাইছিলি না।”
পৃথা থমকালো। একটু না, অনেকখানি। গেটের ওপাশ থেকে কাদিনের বলা কথাগুলো সেও শুনতে পারছে। রহিম ভাই ডেকে ডেকে প্রাণ জান উজাড় করে দিচ্ছে ছেলেটা। অন্যমনস্ক পৃথা বইয়ের একটা লাইন বার বার পড়তে লাগলো। পাশ থেকে নলী অনেক কিছু বলছে। সে শুনছে না। তার ভেতরটা কেমন যেন করছে। অদ্ভুত ভাবে ঢিপঢিপ করে অস্থির করে তুলছে ওকে। আগে তো এমন কখনো হয়নি। কক্ষনো না।

_

অটবীদের রান্নাঘর থেকে সামনের রাস্তা দেখা যায়। চুলার আগুন বন্ধ করে কাপে চা ঢালতে ঢালতে অটবী জালানার বাহিরে তাকালো। ওইতো, রহিম ভাইকে দেখা যাচ্ছে। দলবল নিয়ে গেড়ে বসেছে রাস্তার দূর্বাঘাসের ওপর। কি নিয়ে যেন খুব হাসাহাসি করছে। অটবীর মেজাজ খারাপ হলো। আজকাল রহিমের সাহস অনেক বেশি বেড়ে গেছে। কাউকে পরোয়া করে না। কেউ শাসন করতে চাইলে উল্টো তাকে শাসিয়ে ঘর বন্ধী করে দেয়।
আচমকা টর্চ লাইটের তীক্ষ্ণ আলো মুখের ওপর পরলো তার। অটবী হকচকালো। দীর্ঘক্ষণ পর এমন তেজি আলোর সংস্পর্শে এসে চোখটা জ্বলে উঠলো যেন। অসহ্য ঠেকলো। শুনতে পেল, “কিরে, খুকি না? ওইখানে দাঁড়াই দাঁড়াই কি করো খুকি? আমাদের দেখো?”

রহিমের খসখসে কণ্ঠস্বর। অটবী তখনো তাকাতে পারছে না। লাইটের আলো চোখে সইতে আরও কয়েক সেকেন্ড লাগবে। বেয়াদপ লোকটা এখনো চোখের ওপরই লাইট ধরে আছে।
অটবী চেঁচিয়ে উঠলো, “এগুলো কি ধরণের বেয়াদবি রহিম ভাই? মুখের ওপর লাইট ধরেছেন কেন?”
রহিম খ্যাঁকখ্যাঁ করে হাসলো। যেন কোনো কৌতুক শুনেছে সে। বত্রিশ দাঁত দেখিয়ে বললো, “আশেপাশে অন্ধকার খুকি। অনেকদিন তোমারে দেখিনা। তাই লাইট মাইরা দেখলাম।”

রহিমের বামপাশে সরোজ আর কাদিনকে দেখা যাচ্ছে। অটবী একটা তাচ্ছিল্য দৃষ্টি ছুঁড়ে মারলো ওদের। রাগে তার হাত পা কাঁপছে। এত অসহায় লাগছে নিজেকে! প্রবল অসহায় দৃষ্টিটা ঘুরেফিরে ত্রিস্তানের দিকে স্থির হলো। লোকটা জলন্ত সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে। সবসময়কার উদাসীন দৃষ্টি রাস্তায়। অন্যদের মতো অটবীর হেনেস্তা দেখে মজা নিচ্ছে না, হাসছে না, তাকাচ্ছে না।

ত্রিস্তান সিগারেটে শেষ টান দিয়ে সেটা ফেলে দিলো। অটবী খেয়াল করলো, সে এদিকেই আসছে। অটবীর কাছে। জানালার একেবারে মুখোমুখি হয়ে প্রশ্ন করলো, “কি করছো?”

অসম্ভব স্বাভাবিক কণ্ঠ। যেন এ প্রশ্নটা ত্রিস্তান রোজই তাকে করে। কিন্তু অটবী স্বাভাবিক থাকতে পারলো না। আশ্চর্য হয়ে তাকিয়েই রইলো।
ত্রিস্তান আবার বললো, “এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? কিছু জিজ্ঞেস করেছি তোমাকে। উত্তর দাও।”

অটবী সময় নিলো। হাজারটা বিস্ময়ের সঙ্গে ভেঙ্গে ভেঙ্গে বললো, “চা… চা বানাচ্ছি।”
—“লাল চা? নাকি দুধ চা?”
—“লাল চা।”
—“একদিন তোমায় বাসায় আসবো কেমন? আমি লাল চা খাই না। আমাকে দুধচা খাওয়াবে, ঠিকাছে?”

মনে হলো, ত্রিস্তান হেসে কথাটা বলেছে। কিন্তু তার ঠোঁটে হাসি নেই। চোখদুটো স্থির, শান্ত। খুটখাট শব্দে কি যেন করছে। তার হাত নড়ছে। তবে আসলে ঠিক কি করছে, সেটা বুঝতে পারছে না অটবী।
কপালে ভাঁজ ফেলে বললো, “আমি আপনাকে কেন খাওয়াবো?”
—“বিশেষ কারণ নেই।”
—“আপনি অদ্ভুত আচরণ করছেন।”
—“করছি নাকি?”

বলতে বলতে ত্রিস্তান তাকালো। অটবীর বিস্মিত মুখখানা পরখ করে আলতো হেসে বললো, “তোমাকে রাগলে অনেক সুন্দর লাগে অটবী। তাই আরেকটু রাগাচ্ছি। তুমি রাগ করো না, কেমন?”

কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধান। হঠাৎ-ই সশব্দে জানালা লাগিয়ে দিলো ত্রিস্তান। ‘ধাম’ করে শব্দ হলো। ভয়ংকর শব্দ! অটবীর হাত থেকে চার ছাকনি পরে গেছে। শরীর এখনো কাঁপছে। রেবা বেগম দৌড়ে আসলেন মেয়ের কাছে। উদগ্রীব হয়ে সুধালেন, “কি হয়েছে অটবী? কাঁপছিস কেন? কিসের আওয়াজ ছিল ওটা?”

অটবী জবাব দিতে পারেনি।

__________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
বানান ভুল থাকতে পারে। পরে ঠিক করে দিবো।

অটবী সুখ পর্ব-০৮

0

অটবী সুখ

৮.
গাছের ছায়ার নিচে বসে থাকতে অটবীর মন্দ লাগছে না। আশেপাশে খুব কম মানুষজন। বেশির ভাগই স্টুডেন্ট। অটবীর একটু অস্বস্তি হলো। জোড়সড়ো হয়ে বসলো খানিকটা। সে বাসার জামা পরেই চলে এসেছে। ওড়নার কোণা ছেঁড়া। গম্ভীর ভাবে খেয়াল না করলে বোঝা যায় না। কিন্তু অটবীর অবচেতন মন বলছে, সবাই বুঝি তার ছেঁড়া ওরনা দেখে ফেলেছে? সেটা দেখেই হাসছে?
অটবী জানে এসব তার নিছক কল্পনা। তবুও অস্থিরতা কাটছে না। ত্রিস্তানের সাথে তার এখানে আসাই উচিত হয়নি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুদূরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সে। ত্রিস্তানকে দেখা যাচ্ছে। দোকান থেকে কি কি সব কিনে এদিকেই আসছে সে। হাতে মাঝারি আকারের পলিথিনের ব্যাগ। চোখাচোখি হতেই অটবী দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। এ লোকটার দিকে সে যতবারই তাকায়, চোখাচোখি হবেই!

ত্রিস্তান এসেই ধপ করে বসে পরলো অটবীর পাশে। পলিথিন থেকে পাঁচটা ডেইরি মিল্ক বের করে অটবীর কোলে ছুঁড়ে মারলো। সে জানে, অটবীকে সরাসরি চকলেটগুলো দিলে মেয়েটা নিবে না। পলিথিনের বাকি জিনিসগুলো তনয়াকে দিয়ে বললো, “সবগুলো খাবি না। এখানে দুটো, বাসায় দুটো। কালকে আবার বাকি চারটা। ঠিকাছে?”

তনয়া জোরে জোরে মাথা দুলালো। ইতিমধ্যে পলিথিন থেকে একটা চিপস্ নিয়ে খাওয়া শুরু করে দিয়েছে সে। বড় বড় মায়াবী চোখগুলো খাওয়ার সময়টাতেও চঞ্চলতা ছাড়ছে না। ব্যস্ত হয়ে মাঠের ছেলেপেলের ক্রিকেট খেলা দেখছে। চোখেমুখে কি ভীষণ উৎফুল্লতা!
ত্রিস্তান নজর ফেরালো। অটবীও মাঠের ছেলেগুলোকে দেখছে। একটু গম্ভীর নয়নে। কোলের চকলেটগুলো এখনো সেভাবেই পরে আছে। মেয়েটা ছুঁয়েও দেখেনি। ত্রিস্তান চোখ সরু করলো। প্রশ্ন ছুঁড়লো, “কি হয়েছে? এভাবে ভাঁজ হয়ে বসে আছো কেন?”

অটবী নড়েচড়ে ঠিক হয়ে বসলো। কপাল কুঁচকে এমন একটা ভাব করলো, যেন সে ভীষণ বিরক্ত ত্রিস্তানের ওপর। ভীষণ মানে ভীষণ!
জবাব না পেয়ে ত্রিস্তান আবার বললো, “তোমার দিকে কেউ তাকাচ্ছে না অটবী। এই যে, আমার শার্টের সেলাই খুলে প্রথম দুটো বোতাম পরে গেছে। কেউ কি দেখছে? দেখছে নাতো!”

ভুল কথা। অটবী সেই প্রথম থেকে দেখছে। যদিও সে জানতো না সেলাই খুলে বোতাম পরে যাওয়ার জন্যই ত্রিস্তানের ফর্সা বুকটা দৃশ্যমান হয়ে আছে। সে ভেবেছিল লোকটা স্টাইল করে ইচ্ছাকৃতভাবে বোতাম খুলে রেখেছে। ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে অটবী বললো, “আমি ঠিক আছি। শুধু বাসায় যেতে চাইছি।”
—“আর একটু।”

একথা অটবী অনেক্ষণ ধরে শুনছে। ‘আর একটু’ ‘আর একটু’ বলে ত্রিস্তান আধঘণ্টা পার করে দিয়েছে। নলী আর পৃথার স্কুল ছুটি হবে কিছুক্ষণ পর। সে এতক্ষণ অবশ্যই ত্রিস্তানের সাথে বসে থাকতে পারবে না।
—“তনয়া কবে থেকে অসুস্থ?”

ত্রিস্তান তখন একমনে আকাশ দেখছিল। অটবীর প্রশ্ন শুনে দেখাটা আরেকটু গভীর করলো। ধীরস্থির কণ্ঠে বললো, “দু’বছর আগে থেকে।”
—“ওকে ডাক্তার দেখাচ্ছেন না কেন? নাকি দেখিয়েছেন?”
—“দেখিয়েছিলাম। ট্রিটমেন্টে অনেক টাকা লাগবে। জমাচ্ছি।”

অটবী একপলক তনয়ার দিকে তাকালো। তার প্রচন্ড মায়া হয় মেয়েটার ওপর। হয়তো খুব নরম মনের ছিল মেয়েটা। এত বড় কষ্ট সামলাতে পারেনি। অটবী আজকে দেখেছে, তনয়ার পেটের বিদঘুটে দাগটা। এখনো চোখে ভাসছে। অটবী জানে না দাগটা কিসের। হয়তো খুব খারাপ কিছু হয়েছিল তনয়ার সাথে। হয়তো কষ্টের কিছু। এজন্যই হয়তো তনয়ার স্বামী ওকে ছেড়ে চলে গেছে। সন্তান জন্ম দিতে না পারায়।
আচমকা ত্রিস্তানের প্রতি রাগ হলো অটবীর। রুক্ষ গলায় বললো, “চুরি করে কত টাকা জমিয়েছেন? হারাম টাকা দিয়ে ট্রিটমেন্ট করাবেন বোনের?”

ত্রিস্তান শান্ত, স্বাভাবিক, স্থির। অসম্ভব নির্লিপ্ততা নিয়ে বললো, “আমি চুরি করি না অটবী।”
—“এখন কি মিথ্যে বলা শুরু করে দিয়েছেন?”
ত্রিস্তান আগের মতোই বললো, “নাহ্। আমি ওদেরকে কিভাবে চুরি করতে হবে সেটার প্ল্যান করে দেই। ওরা চুরি করে।”

হাহ! তাতে কি? এটাও তো হারামই! অটবী বললো, “প্রশ্নের উত্তর দিন। কত টাকা জমিয়েছেন?”
—“চুরি করে জমাইনি। আগে পার্টটাইম জব করতাম। পঞ্চাশ হাজারের মতো জমিয়েছিলাম সেখান থেকে।”
—“জব ছেড়েছেন কেন?”
—“ছাড়িনি। কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে।”

ত্রিস্তানের দৃষ্টি আকাশে। বড্ড উদাসীন দৃষ্টি। হতাশাপূর্ণ। মুখটা গুমরে রাখা। একটা চাকরি তার সত্যি খুব প্রয়োজন। অটবী আস্তে করে বললো, “আপনাকে বলেছিলাম আকাশের দিকে না তাকাতে।”

ত্রিস্তান আজও অবাধ্য হলো। দেখেই রইলো আকাশকে। বললো, “দেখতে ভালো লাগে।”

অটবী আরও কিছুক্ষণ বসে থাকলো। এপাশ-ওপাশ চুপচাপ। মাঠের ছেলেগুলো একদফা খেলা শেষে এখন আবার খেলতে নেমেছে। হৈ-হুল্লোড় আওয়াজ কানে লাগছে। নাহ্। আর বসে থাকা যাবে না। ছোট্ট নোকিয়া মোবাইলের স্ক্রীনে চারটা বাজছে। এক্ষুণি রওনা না দিলে ছুটির আগে পৌঁছানো যাবে না। অটবী উঠে দাঁড়ালো। ত্রিস্তানকে কিছু না বললেও তনয়াকে বিদায় জানিয়ে কদম ফেললো যাওয়ার জন্য। ত্রিস্তান সেই কদমের গভীরতা মাপলো। দেখলো, তাকে অগ্রাহ্য করে কি অনায়াসে চলে যাচ্ছে মেয়েটা! অথচ ঠিকই তার দেওয়া চকলেটগুলো যত্ন করে নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। তাহলে এই মিছে অভিনয় কেন? নাকি বুঝতে পারছে না?

চোখ বুজে লম্বা একটা নিশ্বাস নিলো ত্রিস্তান। ক্ষীণ সুরে আওড়ালো, “আমি তারে কই, শুনো হে মানবী, তুমি মোটেও বিশেষ নও। হে কয়, আমি জানি, আমি অন্যরকম। আমি কই, উহু। মিছে কথা। অন্যরকম হইলে আমি তোমারে বুঝি কেমন করে? হে কয়, তুমি তো আমার আপন মানুষ। তুমিই তো আমারে চিনবা। আমি হাসিয়া কই, আমি তোমার আপন মানুষ হইতে পারুম না। আপন হইতে সুখ থাকা লাগে। আমার কাছে সুখ নাই। হে কিছু কয় না। মলিন আঁখি মেলিয়া ধরে।”

_

জায়গাটা অটবীর বাড়ির পেছনে। সরোজ মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক্ষণ হচ্ছে, নলী আসছে না। চিঠিতে বলেছিল, ঠিক বিকাল চারটায় এখানটায় আসবে। এসময় নাকি অটবী পৃথাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবে। পৃথার জ্বর এসেছে হঠাৎ। স্কুলেও যায়নি তাই। এখন সাড়ে চারটা বাজছে। মেয়েটা এখনো আসছে না কেন? দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সরোজের পা ব্যথা করছে। একটা সিগারেট শেষ করে মাত্রই আরেকটা সিগারেট ধরিয়েছিল, নরম পায়ে নলীকে দৌড়ে আসতে দেখে তাড়াতাড়ি ফেলে দিলো। নলী কাছাকাছি আসতেই দাঁত বের করে হেসে বললো, “এত দেড়ি করে আসছিস ক্যান?”

নলী রীতিমতো হাঁপাচ্ছে। আসার আগে মায়ের কাছে প্রায় ধরা পরে যাচ্ছিল। এতক্ষণ বুঝিয়ে সুঝিয়ে এসেছে, সে বান্ধবীর বাসায় যাচ্ছে। নোট আনতে।
বড় বড় নিশ্বাস নিতে নিতে নলী বললো, “মা আসতে দিচ্ছিল না। অনেক কষ্টে এসেছি।”
বলতে বলতে খেয়াল করলো, সরোজ বিশ্রী ভাবে হাসছে। ভ্যাবলাদের মতো। এরকম তো হাসে না! ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো, “কি হইছে? এভাবে হাসছেন কেন?”
—“কিচ্ছু না। কসম!”
নলী নাক কুঁচকে বললো, “আপনার শরীর থেকে এরকম গন্ধ আসছে কেন? কি খেয়েছেন?”

সরোজ হাসি বাড়ালো। খাঁটি অভিনেতার মতো বললো, “মনে হয় সিগারেটের গন্ধ। আমি খাইনাই। রহিম ভাই খাইছে। আমি পাশে ছিলাম। উনার থেকে মনে হয় আমার গায়ে আসছে।”
নলী বোধহয় বিশ্বাস করলো। বললো, “ওদের সাথে মিশেন কেন? পাড়ার সবাই ওদেরকে খারাপ বলে। আপনি ওদের সাথে মিশেন দেখে আপনাকেও খারাপ ভাবে। বুবুও এজন্য আপনাকে পছন্দ করে না।”
—“তোর বুবু যে কেমনে আমারে পছন্দ করবো, সেইটা আমি ভাইবা ফেলছি। আমার মনে হয়, অটবী আপু আর ত্রিস্তান ভাইয়ের ব্যাপারটা কয়দিন পরই রমরমা হইয়া যাইবো। এটাই আমাদের সুযোগ। ত্রিস্তান ভাই আমারে চিনে। আমি কেমন সেটাও জানে। তুই মনে কর, তোর বুবু আর ত্রিস্তান ভাই এক হইলে আমি আর তুইও এক।”

শুনে খুশিতে লাফিয়ে উঠলো নলীর কিশোরী মন। হাসি হাসি মুখ করে বললো, “সত্যি?”
—“হ্যাঁ।”
—“কিন্তু আপনি তো এস.এস.সি. ফেল। এবার ফেল করলে কিন্তু আমি আপনাকে বিয়ে করবো না।”

কেউ সরোজকে ফেল করার কথা বললে সরোজ ভীষণ রেগে যায়। নিজের বাবার সাথেও এজন্য কম রাগারাগি হয়নি। কিন্তু নলীর সাথে তো সে আর রাগ করতে পারবে না, তাই মন খারাপ করে তাকালো। বললো, “এবার ফেল করতাম না। একটা বন্ধু পাইছি। পরীক্ষায় ওর খাতা দেইখা কপি-পেস্ট কইরা দিমু। তাইলেই পাশ!”

নলীও মন খারাপ করলো এবার, “কপি-পেস্ট করতে হবে কেন? একটু পড়ালেখা করলেই তো হয়।”
—“আমার পড়ালেখা করতে ভাল্লাগে নারে। আমার শুধু তোরে ভাল্লাগে।”

প্রেমিকের মুখ থেকে এমন কথা শোনার পর প্রেমিকার আর কি চাই? মন খারাপ-টন খারাপ সব উধাও!

_______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

অটবী সুখ পর্ব-০৭

0

অটবী সুখ

৭.
বিছানার নিচে শত শত কাগজের টুকরো দেখে কপালে দৃঢ় ভাঁজ পরলো ত্রিস্তানের। বিক্ষিপ্ত হলো মন। তনয়া দিনের সারাটা সময় এ রুমেই শুয়ে বসে কাটায়। গোপনে গোপনে কি যেন আঁকিবুঁকি করে। কাজটা নির্ঘাত ওর-ই? চোখ বুজে লম্বা লম্বা তিনটে নিশ্বাস ফেললো ত্রিস্তান। তনয়াকে এতবার বলার পরও একই কাজ পূনরায় করায় খানিকটা রেগে গেল। বাইরে থেকে এসে এখনো একগ্লাস পানিও খাওয়া হয়নি। পরনের শার্ট ঘামে ভিঁজে বিশ্রী অবস্থা। মাথা ব্যথায় টনটন করছে। ঘরে পানি নেই। পানি আনতে হবে। রান্নাঘরে যাওয়ার আগে তনয়ার রুমে একবার উঁকি দিয়ে দেখলো ত্রিস্তান। তনয়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে, কোমড়ে হাত রেখে নানা ভঙ্গমায় হাসছে, লাফাচ্ছে। কাঁধে আলগা ভাবে একটা সুতীর শাড়ি জড়ানো। শাড়িটা মায়ের। তনয়া কোত্থেকে পেল? নিশ্চই ত্রিস্তানের আলমারি থেকে নিয়েছে?

আয়নায় ভাইকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খুশিতে ঝলমল করে উঠলো তনয়া। গায়ের ওপর শাড়িটা আরেকটু ভালো করে জড়িয়ে এগিয়ে এলো ভাইয়ের কাছে। উল্লাসে ভরপুর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “ভাইয়া, আমাকে কেমন লাগছে?”

সুন্দর! মায়ের মতো সুন্দর লাগছে। তনয়ার চেহারা অনেকটা মায়ের ছোঁয়া পেয়েছে বলেই হয়তো। কিন্তু অকপটে প্রশংসা করতে পারলো না ত্রিস্তান। না চাইতেও গম্ভীর গলায় বললো, “আমাকে না বলে মায়ের শাড়ি নিয়েছিস কেন? যেখান থেকে নিয়েছিস সেখানে রেখে আয়, যা!”
তনয়া জোরে জোরে মাথা দুলালো। সে রেখে আসবে না। ত্রিস্তান উচ্চবাক্য করতে পারলো না। বোন তার কিছু থেকে কিছু হলেই নির্দোষ চোখজোড়া তাক করে তাকিয়ে থাকে। কেমন ড্যাবড্যাবিয়ে! সে চাইলেও কিছু বলতে পারে না।
জোড়ালো নিশ্বাস ফেলে ত্রিস্তান অনুমতি দিলো, “খেলা শেষ হলে শাড়ি রেখে আসবি, ঠিকাছে?”

তনয়া আবারও জোরে জোরে মাথা নাড়ালো। এবার না-বোধক নয়, হ্যাঁ-বোধক। ত্রিস্তান তনয়ার হাসোজ্জল মুখটা একটুখানি দেখে চলে যাচ্ছিল, তনয়া আটকে দিয়ে বললো, “ভাইয়া? এই শাড়ি পড়লে কি আমি মায়ের মতো বড় হয়ে যাবো?”
নিষ্পাপ কণ্ঠ। ত্রিস্তান মুচকি হেসে তনয়ার মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিলো, “তুই তো এমনিতে বড়।”
—“নাহ্, আমি মায়ের মতো বড় হতে চাই।”
—“আচ্ছা।”
—“আমি শাড়ি পরবো। আমাকে পরিয়ে দাও না।”

ত্রিস্তান শান্ত চোখে তাকালো। তনয়া আগের মতো ছোট নেই। বিয়ে হয়েছিল, বাচ্চা হওয়ার কথা ছিল, মেয়েটা যথেষ্ট বড়। যতই ভাই হোক, বোনকে শাড়ি পরানোর অধিকার, বিবেক, সামর্থ্য কিছুই ত্রিস্তানের নেই। এটা অসম্ভব।
মৃদু গলায় ত্রিস্তান বললো, “নিজে পরে নেয়।”
—“আমি শাড়ি পরতে পারি না ভাইয়া।”
—“তাহলে পরার দরকার নেই।”
—“কিন্তু আমি পরতে চাই।”
—“পরে পরিস। আমি কাউকে ডেকে আনবো।”
—“না, আমি এখন পরবো। এখন মানে এখন। এখন! এখন! এখন!”

সারাদিনের ক্লান্তি, বিশ্রামহীন ঘুমু চোখ, তিক্ত মেজাজ– সব মিলিয়ে নিজেকে সামলাতে পারলো না ত্রিস্তান। রাগ যেন মুহুর্তেই হানা দিলো সর্বাঙ্গে। অনেকটা উঁচুস্বরেই ধমকে উঠলো, “একবার বলেছি না পরে পরতে? তবুও তর্ক করছিস কেন তনয়া? আর কত জ্বালাবি আমাকে? একটু শান্তি কি আমি পাবো না? সারা জীবন কি তোদের পেছনেই আমাকে দৌঁড়াতে হবে?”

কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে রইলো তনয়া। ভাইয়ের হঠাৎ রাগের কারণ ঠাওর করতে পারলো না। আস্তে আস্তে জলরাশিগুলো ভীর জমালো নেত্রের একদম কোণ ঘেঁষে। বোঝা গেল, তনয়া কাঁদছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। অথচ মুখে স্পষ্ট ভয়, আতঙ্ক! ত্রিস্তান ফিরে চাইলো না। ধুপধাপ পায়ে নিজের রুমে চলে এলো। ওখানে আর এক মুহুর্ত থাকলে হয়তো মেয়েটাকে সে আরও বকতো।

_

রুমে আসার কিছুক্ষণ পরই ত্রিস্তান বুঝলো, তনয়াকে সে অকারণ বকে ফেলেছে। এতটা বকা উচিত হয়নি। বুঝিয়ে বললেই তো হতো! কিন্তু ততক্ষণে দেড়ি হয়ে গেছে। অবুঝ তনয়া বিশাল অভিমান আঁকড়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে। রুমে, বারান্দায়, বাথরুমে- কোথাও নেই। ত্রিস্তান পাগলের মতো শার্ট গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে পরলো তনয়াকে খুঁজতে।

ত্রিস্তান প্রায়ই তনয়াকে বাসায় একা রেখে বাহিরে থাকে। এসময় কোনো দূর্ঘটনা হলে যেন তনয়া নিজ থেকেই ঘর থেকে বেরতে পারে, তাই দরজার ছিটকিনি খোলা শিখিয়েছিল সে নিজেই। এখন আফসোস হচ্ছে, শেখানো উচিত হয়নি। সেই সাথে রাগ হলো এই ভেবে, বাবার কেন এই জঙ্গলের মতো জায়গাতেই বাড়ি বানাতে হলো? তনয়া যদি এখন এই জঙ্গলে হারিয়ে যায়? তখন? সে কিভাবে খুঁজে পাবে বোনকে? উদ্ভ্রান্তের মতো সারা জঙ্গল খুঁজেও তনয়াকে পেল না ত্রিস্তান। ফোনে ততক্ষণে সরোজ, রহিম সবাইকে খোঁজার জন্য তাগাদা দিয়ে ফেলেছে। কেউ পাচ্ছে না। আশ্চর্য! এটুকু সময়ে মেয়েটা গেল কই?

তখন সকাল শেষে দুপুর তিনটে। তনয়াকে না পেয়ে মুখটা শূণ্য হয়ে গেছে ত্রিস্তানের। পরনের জামাকাপড় এলোমেলো, কুঁচকানো, ময়লা। অস্পষ্ট ব্যথায় কাতর হয়ে আছে চেহারা। সে মাথা নুইয়ে ছন্নছাড়া ভাবে হাঁটছে। পুলিশে জিডি করতে হবে। প্রথমেই করা উচিত ছিল। কেন যে করলো না!
হঠাৎ, পেছন থেকে নারী কণ্ঠ ডেকে উঠলো ত্রিস্তানকে। অটবীর কণ্ঠ। হন্তদন্ত পায়ে এগিয়ে এসে ভয়াবহ রাগ নিয়ে বললো, “আপনি এত দায়িত্বহীন কিভাবে হতে পারেন ত্রিস্তান? ওইটুকু একটা মেয়েকে কিভাবে একা ছেড়ে দিতে পারেন? ইলিয়ানা আন্টির বাসার বাগানে লুকিয়ে ছিল মেয়েটা। ভাগ্যিস আমি ওকে দেখেছিলাম! নয়তো কি হতো বুঝতে পারছেন?”
—“তনয়া তোমার কাছে?”

ক্ষীণ কণ্ঠস্বর। গলা ভাঙ্গা। গম্ভীর ব্যক্তিত্বের মানুষটাকে এক মুহুর্তের জন্য চিনতে পারলো না অটবী। এতক্ষণে খেয়ালে এলো, ছেলেটার চোখ মুখ শুকিয়ে কালো দেখাচ্ছে। ঘেমে আছে বাজে ভাবে। চোখ দুটো লাল। গাল অল্প ভেঁজা। ত্রিস্তান কি কাঁদছে? কৌতূহলী অটবী মনের প্রশ্নটাই করলো, “আপনি কাঁদছেন?”
ওপাশ থেকে উত্তর এলো না। ত্রিস্তানের শান্ত দেহে কেমন যেন তাড়াহুড়ো লেগে গেছে। অটবীর হাত শক্ত করে মুঠোয় পুরে নিয়েছে সে।
—“তনয়াকে কোথায় রেখেছ?”
—“আমার বাসায়।”
—“চলো।”

অটবী বিস্ময়ে টু শব্দটিও করতে পারলো না। ত্রিস্তানের শক্তপোক্ত হাতটা বাঘের থাবার মতো ধরে আছে ওকে।

_

‘অরবিন্দ অটবী’-তে ত্রিস্তান ঢুকলো না। গেটের ওপাশে দাঁড়িয়ে থেকেই বললো, “তনয়াকে নিয়ে এসো।”
অটবী মাথা দুলালো মাত্র। বিনাবাক্যে তনয়াকে নিয়ে এলো। মেয়েটা শাড়ি পরেছে। মুখে এখনো কান্নার ছাপ। কিন্তু ঠোঁটে জ্বলজ্বলে হাসি। দীর্ঘ তিন ঘণ্টার খোঁজাখুঁজির পর বোনকে সামনে পেয়ে ত্রিস্তান অনুভূতি হীন হয়ে পরলো। তার ভেতরের খবর হয়তো কেউ জানে না। জানবে না। এতক্ষণ সে কাঁটা মুরগির মতো ঝটপট করেছে। আর এখন বরফের মতো জমে আছে।
অটবী হালকা গলায় বললো, “ও আসলে শাড়ি পরতে চাইছিল বারবার। তাই পরিয়ে দিয়েছি।”
তারপর একটু থেমে বললো, “আপনি কি ওকে মেরেছেন?”

ত্রিস্তান নড়েচড়ে দাঁড়ালো। নিশ্চল চোখে তাকিয়ে অটবীর কথার অর্থ বুঝতে চাইলো। সে তনয়াকে মারবে কেন? শুধু তো বকেছে।
অটবী আবার বললো, “ইলিয়ানা আন্টির বাগানে বসে ও কাঁদছিল। আমি ওর কাছে যেতেই বললো, আপনি নাকি ওকে মেরেছেন। শাড়ি পরতে দেননি।”

সঙ্গে সঙ্গে তনয়ার দিকে তাকালো ত্রিস্তান। মেয়েটা এখনো হাসছে। অবুঝ হাসি। ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললো, “মারিনি। বকেছি শুধু।”
—“বকবেন কেন? ও কি কিছু বুঝে করে?”

একথার জবাব পাওয়া গেল না। ত্রিস্তান এক মনে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। মনে মনে বারবার বলছে, “আর বকবো না তোকে বোন। আর কখনো বকবো না।”
অটবী ভাই বোনের এসময়টুকু মস্তিষ্কে গেঁথে নিলো। কি সুন্দর দৃশ্য! আপনা আপনি মুখে হাসি চলে আসে। আলতো হেসে বললো, “তনয়া আমাকে চিপস্ আনতে বলেছিল ওর জন্য। আমি ভুলে গিয়েছিলাম। যাওয়ার সময় ওর জন্য কিনে নিবেন।”

ত্রিস্তান মাথা দুলালো, “তুমিও চলো।”
—“জি? কোথায় যাবো?”
—“চিপস্ কিনে দিবো। চলো।”
অটবী যেন বুঝলো না। চোখ দুটো সরু করে তাকালো। কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করলো, “চিপস্? কাকে?”
—“তোমাকে।”
—“আমি কি বাচ্চা? আমাকে কেন কিনে দিবেন?”

বিরাম চিহ্নের প্রশ্নবোধক চিহ্নটা মাথায় ঘুরঘুর করছে অটবীর। সেই চিহ্ন চট করে আশ্চর্যবোধকে পালটে হাতটা টেনে ধরলো ত্রিস্তান। ভীষণ নির্দ্বিধায়। নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো, “আমার তোমার সাথে আরেকটু থাকতে ইচ্ছে করছে।”

অটবী থমকালো। থতমত খেয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো, “কি বললেন?”
—“তনয়া তোমার সাথে থাকতে চাইছে।”
—“আপনি এটা বলেননি।”
—“আমি এটাই বলেছি, অটবী।”

অধৈর্য অটবী মানলো না। ঘোর আপত্তি জানিয়ে বললো, “আপনি মিথ্যা বলছেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে…”
কথা বলতে বলতে অটবী থেমে গেল। ত্রিস্তান তাকে পাত্তাই দিচ্ছে না! তনয়ার চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। সে সেগুলোই ঠিক করে দিচ্ছে বারবার। বিশ্রী রকমের বিরক্ত হয়ে অটবী বললো, “আপনি আমার হাত ছাড়ুন তো! যখন তখন হাত নিয়ে টানাটানি করেন কেন?”

অথচ ত্রিস্তান ছাড়লো না। বরং সে যেন আরেকটু শক্ত করেই ধরলো। অটবী টের পেয়েছে। মৃদু গলায় বললো, “তোমাকে চিপস্ কিনে দেওয়া যাবে না। চকলেট কিনে দেবো।”
—“আমি আপনার দেওয়া জিনিস নিবো বলে মনে হয়?”
—“হয়।”
—“আমি জীবনেও নিবো না।”

এতক্ষণ বাদে ত্রিস্তান অটবীর দিকে তাকালো। তবে হাসলো না। গাঢ় গলায় বললো, “আমি জোড় করে দিয়ে দিবো।”

_______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

অটবী সুখ পর্ব-০৬

0

অটবী সুখ

৬.
মাত্র গোসল করে এসেছে ত্রিস্তান। ছোট্ট আধভাঙ্গা আয়নায় তার শুকিয়ে যাওয়া মুখশ্রী ভেসে বেড়াচ্ছে। শ্যাম্পু করায় চুলগুলো ঝরঝরিয়ে পরে আছে কপালে। পরনে শুধু মাত্র ট্রাউজার। খালি বুকটার ডানদিকে লম্বালম্বি কাঁটা দাগ। বুড়ো আঙুল দিয়ে দাগটা হালকা করে ছুঁয়ে দিলো ত্রিস্তান। আঘাতটা তনয়ার দেওয়া। ত্রিস্তানের স্পষ্ট মনে আছে, মা-বাবার রক্তাক্ত লা’শ যখন তাদের সামনে আনা হলো, তনয়া অতি দুঃখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। কথা বলছিল না, কাঁদছিল না, চুপচাপ মা-বাবার শিওরে বসে তাদের নিষ্পলক দেখছিল। কিন্তু যতই সময় যাচ্ছিল, তনয়া কেমন অস্বাভাবিক আচরণ করতে লাগলো। কিছুতেই মা-বাবাকে কবর দিতে দিবে না। সবার পিছু পিছু গোরস্থানেও চলে গিয়েছিল সে। হাতে ছিল ধারালো ছুড়ি—
অতীতের কথাগুলো মনে পরলে আজও গা শিরশির করে ওঠে ত্রিস্তানের। বুকের ক্ষতটা যেন নতুন উদ্যমে জ্বলতে শুরু করে। যন্ত্রণায় কাতর করে তুলে ধুকধুক যন্ত্র। ত্রিস্তান ছটপট শরীরে একটা গেঞ্জি জড়িয়ে নিলো। বাজার থেকে এসেই রান্না সেরে ফেলেছিল বিধায় এখন একটু শান্তি লাগছে। খাবার গুলো এক এক করে টেবিলে সাজাতে সাজাতে সে হাঁক ছাড়লো, “তনয়া? খাবার দিয়েছি। তাড়াতাড়ি আয়।”

তনয়ার খিলখিলানো হাসি শোনা যাচ্ছে। অনেকটা লাফিয়ে লাফিয়ে খাবার ঘরে আসছে মেয়েটা। লাফানোর দরুণ মাথার দু’পাশের বেণীও সমান তালে দুলছে। হাতে বড়োসড়ো একটা টেডিবিয়ার। গোলাপি রঙের। সে এসেই বললো, “আজকে কি রান্না করেছ, ভাইয়া? আমার পছন্দের খাবার না হলে কিন্তু খাবো না। তোমার সাথে কথাও বলবো না। তুমি তখন পঁচা হয়ে যাবে।”

তনয়া স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারে না। কিংবা ভুলে গেছে। কথা বলার সময় কেমন বাচ্চাসুলভ সুর বেড়িয়ে আসে কণ্ঠনালি মাড়িয়ে। শুনতে ভালোই লাগে। ত্রিস্তান চেয়ার টেনে দিয়ে বললো, “বয়।”
তনয়া বসলো না। ভ্রু বাঁকিয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বললো, “একটা চেয়ার টেনেছ কেন? আমার পরী বসবে না? আরেকটা চেয়ার টেনে দাও।”

ত্রিস্তান দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরেকটা চেয়ার টেনে দিলো। তনয়ার টেডিবিয়ারের নাম পরী। পরীকে তনয়া খুব ভালোবাসে। সে যা যা করে, পরীকেও তা তা-ই করায়। প্রতিদিন গোসল করায়, রাত-দুপুরে ঘুম পাড়ায়, নিয়ম মেনে তনয়ার পাশাপাশি ত্রিস্তানকে পরীর জন্যও প্লেটে খাবার বাড়তে হয়। পরে অবশ্য পরীর খাবারটা ত্রিস্তানই খেয়ে হজম করে। তনয়া সেটা জানে না। জানলে হয়তো খুব কাঁদবে। কেঁদে কেঁদে পুরো বাসা মাথায় তুলে বলবে, “পরীর খাবার তুমি কেন খাও ভাইয়া? পরীর ক্ষিধা লাগে না? না খেলে ও মা’রা যাবে না?”

ত্রিস্তান খাবার বেড়ে দিয়ে তার বোনের দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটা উচ্ছ্বল মনে খাবার খাচ্ছে। ঠিক খাচ্ছে না। নষ্ট করছে বেশি। মাঝে মাঝে পরীর সাথে গুপ্ত আলোচনায় ফিসফিস করছে। সেই আলোচনার অল্প অল্প কানে আসছে ত্রিস্তানের। তনয়া আজকে কি কি দুষ্টোমি করবে, তার লিস্ট করছে। মেয়েটা আবার দুষ্টোমি করতে ভারি পটু!
হঠাৎ দরজায় খটখট আওয়াজ হলো। ত্রিস্তান উঠে গিয়ে দরজা খুললো। সরোজ এসেছে। দরজা খোলা মাত্র ছেলেটার দাঁত বের করা হাসি উপচে পরছে। ত্রিস্তান গম্ভীর গলায় বললো, “কেন এসেছিস?”

সরোজ একটা খাম এগিয়ে দিলো, “রহিম ভাই দিসে। আজকের ভাগ।”
খামটা নিলো ত্রিস্তান। একটু ফাঁক করে দেখলো, মোটামোটি ভালোই টাকা। কয়েকদিন ভালো মতো চলা যাবে।
—“দুপুরে খেয়েছিস কিছু? না খেলে ভেতরে আয়।”

সরোজ এবার মাথা নুইয়ে লাজুক হাসলো। বাম হাত দিয়ে মাথার পেছনের চুল চুলকাতে চুলকাতে বললো, “কাজ আছে ভাই। এখন খাইতে পারবো না।”
ত্রিস্তান ভ্রু কুঁচকালো, “কি কাজ?”
—“ওই আরকি, বুঝোই তো। প্রেমিকা অপেক্ষা করতাছে।”

লজ্জার দরুণ লাল হয়ে গেছে সরোজের ফর্সা মুখ। ত্রিস্তানের চোখে চোখ রাখতে পারছে না ছেলেটা। অকারণেই অসংখ্যবার চোখের পলক ফেলছে। ত্রিস্তান আর কিছু বললো না। দরজা লাগিয়ে একবার তনয়াকে দেখে নিলো। মেয়েটা এখনো অর্ধেক ভাতও শেষ করেনি। একটু পর দৌঁড়ে আসবে খাইয়ে দেওয়ার জন্য।
ত্রিস্তান আস্তে আস্তে নিজের রুমে চলে গেল। টাকার খামটা বিছানার ওপর অযত্নে ফেলে বারান্দায় গিয়ে বসলো। ত্রিস্তানের বাসাটা এলাকার একটু ভেতরেই। জঙ্গলের মাঝখানে। তার বাবার আবার পাহাড়, গাছপালা অনেক পছন্দের ছিল। এই বারান্দার এই চেয়ারটাতে বসেই তিনি প্রকৃতি উপভোগ করে বই পড়তেন। ত্রিস্তান তো আর বই পড়ে না! সে অত গাছপালা প্রেমীও না। কিন্তু সময়ে অসময়ে এই বারান্দায় বসে থাকা তার পুরোনো অভ্যাস। এই বারান্দায় এসে ত্রিস্তান আর অভিনয় করতে পারে না। বুক চিড়ে আর্তনাদগুলো এক এক করে বেড়িয়ে এসে বলে, “ওহে সুখনীল ত্রিস্তান, তুমি আজীবন দুঃখীই রয়ে যাবে।”

বিদ্যালয়ের পেছনে একটা পরিত্যক্ত পুকুর আছে। জায়গাটা স্যাঁতস্যাঁতে, পানি নোংরা, কালো। কোথা থেকে একটা বিশ্রী গন্ধ নাকে এসে ঠেকছে। সরোজের বমি পেয়ে যাচ্ছে। গামছা দিয়ে নাক চেপে সে খেঁকিয়ে উঠলো, “প্রেম করার জন্য আর জায়গা পাইলি না? ইছ! কি গন্ধ! এইরম জায়গায় প্রেম করা যায়?”

নলী নিজেও ঠিকমতো নিশ্বাস নিতে পারছে না। কিন্তু এছাড়া আর কোনো জায়গা নেই। পৃথা ইদানিং গোয়েন্দা সেজে আশেপাশে ঘুরছে। সে যেখানে যায় সেখানেই পিছু পিছু হাঁটা ধরে। কোথাও গিয়ে শান্তি নেই।
ভীষণ বিরক্ত হয়ে নলী বললো, “আমিও যেন সখে এসেছি এখানে? বুবু জানলে কি হবে জানেন তো? প্রেম করা একেবারে ঘুচিয়ে দিবে।”

সরোজ চোখ মুখ কুঁচকে তাকালো, “ইছ নীলিমা! ইছ! ইছ! তুই নষ্ট হইয়া গেছিস! আগে তো এমন ভাবে কথা বলতি না!”
—“আগে বলতাম না তো কি হয়েছে? এখন থেকে বলবো। আপনার কোনো সমস্যা আছে?”

ততক্ষণে সরোজ প্রায় বমি করে দিচ্ছিল। নলী চিৎকার দিতেই কোনোমতে সামলে নিলো। রোধ হয়ে আসা কণ্ঠে বললো, “এইখানে থাকা সম্ভব না নীলিমা। তাড়াতাড়ি কথা শেষ কইরতে হবে। চিঠিতে কি জানি বলবি বলছিলি? দ্রুত ক!”
নলী একটু ইতস্তত করলো। কথাটা অটবী সম্পর্কে। সে আসলে বলতে চাইছিল না। কিন্তু চেপেও রাখতে পারছে না। প্রথমে ভেবেছিল পৃথাকে বলবে। কিন্তু ওর ঠিক নেই। পরে নলীকেই ভুল বুঝবে। অনেক ভেবেচিন্তে নলী সিধান্ত নিয়েছে, কথাটা সে সরোজকেই বলবে।

—“আপনি বলেছিলেন না? বুবুর সাথে ত্রিস্তান ভাইয়ের কিছু আছে? আমারও এখন তাই মনে হয়। কালকে রাতে আমি ত্রিস্তান ভাই আর বুবুকে গেটে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখেছি।”

সরোজ একমুহুর্তের জন্য আশেপাশের বাজে পরিবেশ ভুলে গেল। খুশি লাফিয়ে উঠে উচ্চস্বরে বললো, “তোরে বলছিলাম না আমি? দেখছিস? আমার কথাই ঠিক হইছে।”

অটবীর পরীক্ষা শুরু হয়েছে। আজকে প্রথম পরীক্ষা ছিল। কিচ্ছু মন মতো হয়নি। কমন পড়েনি। কিংবা বলা যায়, কমন পরেছে, কিন্তু অটবী পড়েনি বলেই তার জন্য প্রশ্নপত্র এভারেস্ট জয়ের থেকেও কঠিন লেগেছে।
পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে অটবীর মনটা হু হু করে উঠলো। আশেপাশে তার সহপাঠীরা কি আনন্দের সাথে বাড়ি ফিরছে! মুখের বিরাট হাসি যেন আঠার মতো লেগে গেছে ঠোঁটে। কিছুতেই সরছে না। আবার যারা খারাপ করেছে, ওদেরও কোনো না কোনো বান্ধবী আছে। খারাপ করায় সান্ত্বনা দিচ্ছে। অটবীর তো বান্ধবীও নেই। সান্ত্বনা দেওয়ারও কেউ নেই।

রাস্তার মোড়ে সরোজকে দেখতে পেল অটবী। কি অগোছালো হয়ে এসেছে ছেলেটা! পরনে লুঙ্গি, শার্ট। হা করে চারিদিকে চোখ বুলাচ্ছে। ঠিক এই কারণেই অটবীর সরোজকে পছন্দ না। চাল চলনের কোনো ঠিক নেই। একদম না দেখার মতো করে চলে যেতে নিলে সরোজ আচমকা ডেকে উঠলো, “অটবী আপু?”

অটবী দাঁড়ালো। সরোজের দিকে তাকাতেই ছেলেটা মুখে হাসি ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তোমার না পরীক্ষা ছিল আপু? কেমন হয়েছে?”

পরীক্ষা খারাপ হলেও সেটা ঠিক কাউকে বলা যায় না। মনের জ্বালা বাড়ে। সেখান থেকেই ‘মোটামোটি’ শব্দটা বেড়িয়ে আসে মুখ থেকে। অটবীও তাই।
—“তুমি এখানে কি করছো?”

সরোজ কিছু বলতে নিচ্ছিলো। পেছনে ত্রিস্তানকে দেখে থেমে গেল আবার। মুখের হাসি আরও চওড়া করে বললো, “ওইযে, ত্রিস্তান ভাইয়ের সাথে আসছি। উনি উনার মাস্টার্সের সার্টিফিকেট নিতে আসছেন।”
ত্রিস্তান যে অটবীর পেছনে, সেটা সে জানে না। চাপা স্বরে বলতে গিয়েও সে বেশ জোরেই বলে ফেললো, “তোমার ত্রিস্তান ভাই আবার পড়ালেখাও করেছে? বাহ্!”

তাচ্ছিল্য সুর। ত্রিস্তান শুনে হাসলো। ক্ষীণ হাসি তবে দীর্ঘ।
—“কেন? চোররা বুঝি পড়ালেখা করতে পারবে না?”
সাথে সাথে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো অটবী। লজ্জা পেয়েছে বুঝি মেয়েটা? পেয়েছে বোধহয়। গালদুটো আস্তে আস্তে রক্তিম রঙে লেপ্টে যাচ্ছে। হাঁসফাঁস করে বললো, “আমি ওভাবে বলিনি।”
—“তাহলে কিভাবে বলেছ?”

অবস্থা বেগতিক। সরোজ পাশে দাঁড়িয়ে দম ফাঁটানো হাসি চেপে রেখেছে। এদু’জন কি ভুলে গেছে সেও তাদের সাথে আছে? ভুলে গেছে নিশ্চিৎ! ওর দিকে তো তাকাচ্ছেই না।

অটবী কিছু বলছে না দেখে ত্রিস্তান নিজেই আবার কথা শুরু করলো, “তোমার পরীক্ষা কেমন হয়েছে?”
অটবী ছোট্ট নিশ্বাস ফেললো, “ভালো।”
—“মিথ্যা বলছো কেন?”
—“জি?”
—“তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে ভালো হয়নি।”

অটবী আশ্চর্য হয়ে তাকালো এবার। সরাসরি, চোখে চোখ রেখে। ত্রিস্তানের চোখদুটো কি গভীর! স্বচ্ছ!
অটবী আমতা আমতা করে বললো, “তেমন কিছু না। ভালোই হয়েছে।”
—“তোমার একটা ভীষণ খারাপ দিক আছে। তুমি নিজেকে অন্যদের সাথে তুলনা করতে ভালোবাসা। এই তুলনা তোমাকে আরও বেশি দুঃখী করে তোলে। ভাবো, ওর এটা আছে বলেই ও সুখী। তোমার এটা নেই বলেই তুমি দুঃখী।”

কথা সত্য। অথচ অটবী এত সহজে মানতে চাইলো না। পালটা বললো, “আপনি তো তুলনা করেন না। তবে আপনি আমার থেকেও বেশি দুঃখী কেন? সবার দুঃখী হওয়ার আলাদা আলাদা কারণ থাকে ত্রিস্তান।”
—“আমারও আছে। আমার নামই দুঃখ।”

বাতাসে অটবীর মাথার ঘোমটা উড়ছে। ভীষণ অচেনা দৃষ্টিতে ওকে দেখছে মেয়েটা। ত্রিস্তান সত্যিই এ দৃষ্টি চেনে না। তবে, এ দৃষ্টিতে ওর ঘোর লাগছে না। নেশা হচ্ছে না। মাদকতায় মস্তিষ্ক বিগড়ে যাচ্ছে না। অথচ অদ্ভুত কিছু হচ্ছে। অচেনা অদ্ভুত।
অটবী বললো, “সামান্য নাম দিয়েই নিজের জীবনের সুখ,দুঃখ বিবেচনা করে ফেললেন? আপনি তো আমার থেকেও খারাপ।”

শুনে ত্রিস্তান হাসি আটকাতে পারলো না। হেসে ফেললো মাথা নুইয়ে, নিঃশব্দে। চোখের কোণে সুখের জলেরা চিকচিক করে নিজের অস্তিত্ব জানান দিলো। আচমকা অটবীর মাথায় হাত বুলিয়ে সে বললো, “অটবী, আমি চাই তুমি পাগল করা সুখী হও।”

________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
প্রচুর বানান ভুল থাকতে পারে। ভুল-ক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

অটবী সুখ পর্ব-০৫

0

অটবী সুখ

৫.
দিনটা বাদল কন্যাদের দখলে ছলমল করছে। সুদূরে সূর্য রোদ্দুর ছড়ালেও আজ একটু বেশিই মলিন তা। উত্তাপ গা ছুঁচ্ছে না। বরং খোলা জানালা মাড়িয়ে দক্ষিণা হাওয়া সুরসুর করে ভেতরে ঢুকে প্রাণ-জান উজাড় করে দিচ্ছে। চোখ বুজে লম্বা তিনটে শ্বাস ফেললো অটবী। এমনটা সে প্রায়ই করে। ঘুম থেকে ওঠার পর পা দুটো আপনা আপনি চলে যায় জানালার কাছে। ভোরের দুষ্টু-মিষ্টি ঠান্ডা হাওয়া উপভোগ করে পাঁচ থেকে ছয় মিনিট। ছোট্ট একটা মুহুর্ত। অথচ এই ছোট্ট মুহুর্তটাই সারাদিনের ব্যবস্তা ছাপিয়ে তার নিজের। এতে কারো ভাগ নেই। এই কয়েক সেকেন্ড অটবীর একার।
সকালটা একটু ঠান্ডা, ঠান্ডাই বলা যায়। হাত-মুখ ধুঁতে গিয়ে সেটা বেশ ভালো ভাবেই টের পেল অটবী। পানি ছুঁতেই শরীরের লোমকূপ কাঁটা দিয়ে উঠে। অটবী কাঁপতে কাঁপতে গামছা দিয়ে মুখ মুছলো। রান্নাঘরে এগোতেই দেখলো, রেবা বেগম আজও একা একা কাজ করছেন। এতে বড্ড রেগে গেল সে। অসহ্য বিরক্তি নিয়ে বললো, “তুমি একটা কি বলো তো মা? তোমাকে না বলেছি সকালে উঠলে আমাকে ডাকবে? ডাকোনি কেন?”

রেবা বেগম মেয়ের কথায় গ্রাহ্য করলেন না বোধহয়। তার মেয়েটা অতিরিক্ত বদমেজাজি হলেও মাকে ভীষণ ভালোবাসে। এই রাগটা তারই বহিঃপ্রকাশ। মাছে হলুদ, মরিচ, লবণ পরিমাণ মতো দিয়ে তিনি বললেন, “লালশাকগুলো বেছে দেয়, আয়।”

অটবীর বিরক্তি বাড়লো। মায়ের এমন ছন্নছাড়া কাজ তার ভালো লাগছে না। ধুপধাপ পায়ে মোড়া টেনে শাক বাছতে বসে পরলো ও। রেবা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, “তোর বোন দু’টো কি উঠেছে? ওদেরকে উঠাবি কখন? ইস্কুল আছে না?”
—“পৃথাকে ডেকে এসেছি। উঠে যাবে একটুপর।”

কথাগুলো গম্ভীর শোনালো। মেয়েটা কি অভিমান করেছে? রেবা বেগম মিটিমিটি হাসলেন। সাবধানে প্রশ্ন ছুঁড়লেন, “তুই নাকি নলীর সাথে কথা বলছিস না? বিচার দিলো আমাকে।”
অটবী সে কথার উত্তর দিলো না। এড়িয়ে গেল দারুণ কৌশলে, “লালশাকগুলো কিভাবে রাঁধবে? চিংড়ি মাছ দিবে সাথে?”

রেবা বেগম তড়িঘড়ি করলেন। হঠাৎ কিছু মনে পরার মতো করে বললেন,
—“ভালো কথা মনে করেছিস। আমি তোকে বলবো বলবো করে ভুলে গেছি। পাশের বাসায় চিংড়ি মাছ রেখেছিলাম। এক্ষুণি গিয়ে নিয়ে আয়। পরে আর মনে থাকবে না।”

লালশাক বাছা প্রায় শেষের দিকে। হাতদুটো ভালো করে ধুঁয়ে ওড়না গায়ে জড়িয়ে নিলো অটবী। তাদের পাশের বাসায় ইলিয়ানা আন্টিরা থাকেন। ভদ্র মহিলা এমনিতে সবার উপকার করলেও মুখ চলে বেশি। কোথাও স্থির থাকতে পারেন না। এরওর কথা একেওকে বলে বেড়ান। অটবী যতবারই উনার বাসায় গিয়েছে, জোর করে একঘণ্টা নিজের কাছে বসিয়ে হাজারটা গীবত গেয়ে গেছেন। এটা তিনি সবার সাথেই করেন। এজন্য পৃথা আর নলী উনার কাছে আসতে অতটা পছন্দ করে না। বাধ্য হয়ে অটবীকেই আসতে হয়। তাছাড়া ইলিয়ানা নামক মহিলাটির স্বামীর বাজারে বড় মুদির দোকান আছে। পাড়ার সবার থেকে টাকা পয়সাও বেশি। তাই দাপটও বেশি।

দরজায় কড়া নাড়ানোর এক মিনিটের মাথায় দরজা খুলে দিলো এক ছেলে। ঠিক ছেলে না। যুবক। অটবী থেকে বড়ই হয়তো। হয়তো বা সমান বয়সী। দরজা খুলে অটবীর দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে। পরনে কালো গেঞ্জি, কালো হাফ-প্যান্ট।
অটবী ভদ্রভাবে বললো, “ইলিয়ানা আন্টি আছেন? আমি উনার কাছে এসেছি।”

সদ্য ঘুম ভাঙ্গা, খসখসে গলায় ছেলেটা উত্তর দিলো, “আম্মু নেই বাসায়। কি দরকার আমাকে বলেন।”
—“আপনাদের ফ্রিজে মাছ রেখেছিলাম আমরা। ওটা নিতে এসেছি।”

এত বড় ছেলেকে একথাটা বলতে গিয়ে একটু লজ্জাই পেল অটবী। কিন্তু ছেলেটা বিষয়টা স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছে। অনতত তার মুখ তো তা-ই বলছে।
—“কিভাবে দিয়েছেন মাছ? প্যাকেটে নাকি বক্সে?”

ছেলেটার কথার ধরণে মনে হলো, সে একাজে ভীষণ পটু। যেন বহুকাল ধরে একাজই করে আসছে। কিন্তু তবুও খানিকটা অস্বস্তি হলো অটবীর। ইতস্তত কণ্ঠে বললো, “ছোট নুডুলস্-এর প্যাকেটে।”
—“আচ্ছা।”

বলে সাথে সাথে দরজা আটকে দিলো ছেলেটা। ভড়কালো অটবী। এভাবে দরজা আটকানোর মানে কি? সে কি ছেলেটা না আসা অব্দি বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে? কি আশ্চর্য! ছেলেটা এমন বেয়াদব কেন?

পাশের বাসা থেকে অটবী আসতে আসতে পৃথা আর নলীও ঘুম থেকে উঠে গেছে। কালকের মতো আজও কথা বলার সুযোগ খুঁজছে নলী। অটবী পাত্তা দিচ্ছে না। এসেছে থেকে রেবা বেগমের সাথে কথা জুড়ে দিয়েছে। পাশের বাসার ছেলেটা নাকি খুব বেয়াদব। মানুষকে সম্মান করতে জানেনা। নলী অবশ্য ইলিয়ানা আন্টির ছেলেটাকে একবার দেখেছে। সরোজের সাথে প্রায়ই মাঠে ক্রিকেট খেলে। দেখতে তো ভালোই ছেলেটা।

নলী ভয়ে ভয়ে বোনের পাশে গিয়ে বসলো। মৃদু স্বরে ডাকলো, “বুবু?”
অটবী উত্তর দেয়নি। সে আবারও ডাকলো, “ও বুবু, শুনো না!”
—“কি?” কণ্ঠে অল্পসল্প ধমকের রেশ। নলী কিন্তু তবুও দমলো না। সাহস নিয়ে বললো, “আমি আর সরোজ ভাইয়ের সাথে কথা বলবো না বুবু। সত্যি বলছি! তুমি প্লিজ আমার থেকে রাগ ঝেড়ে নাও না বুবু।”

রেবা বেগম একবার অটবীর দিকে আড়চোখে তাকালেন। নাহ্! মেয়ের রাগ গলছে। তিনি দেখেই বুঝতে পারছেন। অনেকটা কৈফিয়তের সুরে তিনিও তাল মেলালেন, “ক্ষমা করে দেয় অটবী। ও আর ওই ছেলের সাথে কথা বলবে না। অনেক রাগ করেছিস। এবার সব ঠিক কর। মেয়েটা তোর জন্য সারাদিন মন খারাপ করে থাকে।”

অটবী এবারও তেমন একটা প্রতিক্রিয়া দেখালো না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার রাগ অনেকটাই কমে গেছে। ছোটবোন দুটোকে জন্ম থেকে আগলে রেখেছে সে। মায়ের মতো না হোক, মায়ের চেয়ে কম ভালোবাসে না। তবে অকপটে শুধু এটুকুই বললো, “ওদেরকে দ্রুত তৈরি হতে বলো মা। স্কুলের দেড়ি হয়ে যাচ্ছে।”

স্কুলে যাওয়ার পথে সরোজের সাথে দেখা হলো নলীর। অটবী পাশেই ছিল। সরোজ নলীর দিকে তাকিয়ে থাকলেও নলী একবারের জন্যও তাকায়নি। বুবু তার অনেক কষ্টে রাগ ভুলেছে, এখন সে আর আগের মতো ছেলেমানুষী করতে পারবে না। যা করতে হবে, সব সাবধানে, লুকিয়ে।
সরোজের জন্য স্কুলে আসার আগে চিঠি লিখে এনেছিল নলী। সেটাই অটবী না দেখে মতো রাস্তায় ফেলে দিয়ে এসেছে। আসার আগে সরোজকে চোখের ইশারায় বুঝিয়েও এসেছে, চিঠিটা যেন সে তুলে।

অটবীদের এলাকার একদম শেষে একটা বাজার পরে। কাঁচা বাজার থেকে শুরু করে শুকনো বাজার সব পাওয়া যায়। কিন্তু ‘অরবিন্দ অটবী’ থেকে বাজারটা বেশ দূরে। নলীদেরকে স্কুলে দিয়ে অটবী বাজারেই গেল। বাজারটা মাছের গন্ধে ভরে গেছে। কিছু ভদ্র লোকদের দেখতে পেল, রুমাল চেপে বাজারে ঘুরঘুর করছে। আবার কেউ কেউ খুব বাজে ভাবে মুখ বিকৃত করে রেখেছে। অটবী বেশ মজাই পেল ওদের দেখে। মনে মনে ভাবলো, সেও যদি এমন আহ্লাদী বাবার সন্তান হতো, তবে কি ওদের মতোই মুখটা এমন করে রাখতো? নিজের চেহারা কল্পনা করে নিজ মনেই খিলখিল করে হেসে ফেললো অটবী। ভাগ্যিস সে আহ্লাদী বাবার মেয়ের হয়নি! তাকে ওভাবে মোটেও সুন্দর লাগতো না। ভীষণ বিশ্রী দেখাতো।

বাজার করা শেষে হুট করে বৃষ্টির আগমন ঘটে গেল। অটবী তখন বাজারের একপাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করছে। তার কাছে ছাতা নেই। পরনে হলুদ রঙের জামা। কাপড়টা খুব পাতলা। এ জামা পরে বৃষ্টিতে ভেঁজা সম্ভব না৷ সে একমনে রাস্তার দিকে চেয়ে ছিল। ফোঁটায় ফোঁটায় রাস্তায় বৃষ্টি পরার দৃশ্যটা দারুণ লাগছে তার।
সরব, ত্রিস্তান এসে পাশে দাঁড়ালো। অটবী প্রথমে খেয়াল করেনি। লোকটা কালো রঙের ছাতা মুখের কাছে ধরতেই চমকে উঠলো। ত্রিস্তান বললো, “ছাতা নিয়ে বাসায় যাও।”

কি নিঃসংকোচ আবদার! অটবী আবদারটা রাখতে পারলো না। কাঠকাঠ গলায় মানা করে দিলো, “আমি কি আপনার কাছে ছাতা চেয়েছি? আমার লাগবে না।”
—“জানি, তবুও নাও।”

অটবী মুখ তুলে সরাসরি তাকালো। লোকটার হাতে বড়সড় বাজারের ব্যাগ শোভা পাচ্ছে। কপাল, চুল, শার্ট ক্ষীণ ভেঁজা। অটবী মুখ ফিরিয়ে নিলো, “অনেক উপকার করেছেন ত্রিস্তান। কিন্তু এ উপকারটা আমার লাগবে না।”

ত্রিস্তান ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললো, “তুমি অনেক বেশি কথা বলো। কান তিতা করে দিচ্ছো। তোমাকে যে চকলেট দিয়েছি, খাওনি?”
—“আপনার দেওয়া জিনিস আমি কেন খাবো?”
—“পঞ্চাশ টাকা দিয়ে কিনেছিলাম অটবী! তুমি এত সহজে ফেলে দিয়েছো?”

কথা শুনে মনে হলো, ত্রিস্তান প্রচন্ড অবাক হয়েছে। কিন্তু তাকে দেখে মোটেও তেমনটা মনে হচ্ছে না। অটবী ক্লান্ত চোখজোড়া কিছুক্ষণ বন্ধ রেখে আবার খুললো। সে ফেলে দেয়নি ত্রিস্তানের চকলেটগুলো। টাকার ব্যাগে এখনো আছে। কিন্তু সেটা ত্রিস্তানকে বললো না। আবার ত্রিস্তানের সঙ্গে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতেও ইচ্ছে করছে না।
ত্রিস্তানের হাত থেকে ছো মেরে ছাতা নিতে নিতে অটবী বললো, “পরে ছাতাটা কিভাবে দেব আপনাকে?”
—“আমি নিজেই নিয়ে নিবো।”

অটবী আর কথা বাড়ালো না। ত্রিস্তানকে পেছনে ফেলে সামনে হাঁটতে লাগলো।
কালো ছাতা হাতে চলে যাওয়া চরম অকৃতজ্ঞ মেয়েটাকে উদাসময় শান্ত দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো ত্রিস্তান। ভিষণ আস্তে বললো, “আকাশের মতো সুন্দর তো তুমি নও। বৃষ্টির মতো মুগ্ধময়ীও নও। অরণ্য, তবে তুমি কি?”

_______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

অটবী সুখ পর্ব-০৪

0

অটবী সুখ

৪.
রাস্তার একপাশে সবুজ দূর্বাঘাসের ওপর বসে আছে অটবী আর ত্রিস্তান। পাশেই তনয়া মহানন্দে কচরমচর শব্দে চিপস খাচ্ছে। মাঝে মাঝে কোমল পানীয়র বোতলে চুমুক দিচ্ছে একটু একটু করে। ত্রিস্তানের দৃষ্টি বোনের পানেই স্থির। নির্মল চোখে বোনের আনন্দ দেখছে সে। তবুও চেহারার কোথাও যেন একটা চাপা অসন্তুষ্টি ভাব। কপালের মাঝখানে গুটিকয়েক সূক্ষ্ণ ভাঁজ। এর কারণ অটবী জানে। টিউশনি থেকে আজই এ মাসের বেতন পেয়েছে সে। হাতে চার হাজারের মতো আছে। ত্রিস্তানের কাছে টাকা নেই শুনে সে অনেকটা জোড় করেই তনয়া যা চায় কিনে দিয়েছে। ত্রিস্তান মানা করেছে অনেকবার। কঠোর চাহনি দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে অটবীর অন্তর। অটবী তবুও শুনেনি। সেই থেকে অটবীর দিকে তাকাচ্ছে না লোকটা।
সরব, ত্রিস্তান মৃদু গলায় বললো, “তোমার টাকা আমি আজকেই দিয়ে দেবো।”

কথাটা গম্ভীর শোনালো। লোকটা কি রেগে আছে? রাগ করতেও জানে নাকি? এ সামান্য বিষয়ে রাগ করার কি আছে? সেদিন রাতে ত্রিস্তানও তো তাকে কতবড় সাহায্য করলো। এবার অটবীর পালা এসেছে। সে কেন পিছিয়ে থাকবে? সমান-সমান করার একটা ব্যাপার আছে না? মনে মনে কয়েকদফা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অটবী বললো, “কিভাবে দেবেন? চুরি করে?”
ত্রিস্তানের সহজ উত্তর, “হ্যাঁ।”
—“পঞ্চাশ টাকার জন্য চুরি করবেন? এমন হলে আমি কোনো চুরির টাকা নিতে পারবো না।”

এ কথার পিঠে ত্রিস্তান আর কিছু বললো না। বোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মুখ উঁচিয়ে তাকালো আকাশের দিকে। হাতদুটো দু’দিকে ছড়িয়ে সবুজ দুর্বাঘাসগুলো মুঠোয় পুরে নিলো। হিমেল হাওয়ায় উঁড়তে রইলো তার কপালের এলোমেলো চুল। চোখদুটো শান্ত, কিন্তু আসলে বড্ড অশান্ত। অটবীর হঠাৎ মনে হলো, ত্রিস্তান নামের দুঃখটি হয়তো তার কল্পনা থেকেও দুঃখী। নয়তো একেবারেই দুঃখী না। লোকটা প্রশান্তি নিয়ে নিশ্বাস ফেললেও মনে হয়, বুকভরা পাথর নিয়ে নিশ্বাস ফেলছে। হাসলে মনে হয়, জোর করে হাসছে। নাকি সবই তার মনের ভুল? হতেও তো পারে।
অটবী আনমনেই জিজ্ঞেস করলো, “আপনার নামের অর্থটা অদ্ভুত। এমন নাম জেনেশুনে আপনার মা-বাবা রেখেছে কেন?”

ত্রিস্তান অবাক হলো না। তার নামের অর্থ জানার পর এ প্রশ্নটা তাকে অনেকেই করে। সে কখনো কাউকে উত্তর দেয়নি। শুধু মুচকি হেসেছে। অটবীর বেলায় মুচকি হাসতে ইচ্ছে করলো না। চোখেরপাতা বুজে লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে বললো, “আমার বাবা একজন বইপোকা মানুষ। আমার বাসায় বাবার অনেক বই আছে। সেসব বইগুলোর মাঝে ‘সোনালী দুঃখ’ নামের একটা বই বাবা খুব যত্ন করে লুকিয়ে রেখেছেন। বইটা তার খুব পছন্দ। সেই বইয়ের নায়ক চরিত্রটা তাকে এতটা প্রভাবিত করেছিল যে, বাবা আমার নাম ত্রিস্তান রেখে দিয়েছিলেন। এতে অবশ্য আমার আম্মু রাজি ছিলেন না। আম্মু আবার অনেক কুসংস্কার মানতেন। ত্রিস্তান অর্থ দুঃখ জেনে অনেকবার আমার নাম পাল্টাতে চেয়েছিলেন। এই নামের জন্য নাকি আমার জীবনে কখনো সুখ আসবে না। রাগারাগিও করেছিলেন বাবার সাথে। কিন্তু বাবা শুনেননি। পরে বাধ্য হয়ে আম্মুও মেনে নেন। কিন্তু পুরোপুরি ভাবে না। আব্বু আমাকে ত্রিস্তান বলে ডাকলেও আম্মু ডাকতেন সুখ বলে। যাতে দুঃখ আমাকে ছুঁলেও সুখও যেন আমাকে ছোঁয়।”

অটবী প্রশ্ন করলো, “আপনার পুরো নাম কি?”
—“সুখনীল ত্রিস্তান।”
—“সুখনীল? আপনি কি খেয়াল করে দেখেছেন, আপনার প্রত্যেকটা নামেই ব্যথার চিহ্ন আছে? নীলকে কিন্তু সবাই বিষাদ বলে।”

ত্রিস্তান সরাসরি অটবীর দিকে তাকালো এবার। বিস্ময়ভরা চাহনি। সে সত্যিই কখনো খেয়াল করেনি। অটবী মুচকি হেসে বললো, “আকাশের দিকে এতবেশি তাকাবেন না। আমাদের মতো মানুষের জন্য আকাশ আনন্দ বয়ে আনেনা।”

তনয়ার দিকে একবার তাকালো অটবী। মেয়েটা হা করে চেয়ে আছে ওর দিকে। কি স্নিগ্ধ চোখদুটো! মুখটা কি আদুরে! অটবী একটু হাসতেই দাঁত বের করে খিলখিলিয়ে হেসে দিলো। ওরাই ভালো। বাস্তবতা চিনে না। নিজের জগতেই থাকে, কল্পনায় সুন্দর একটা জীবন সাজায়।
ব্যাগ কাঁধে নিয়ে অটবী উঠে দাঁড়ালো। মুখের হাসিটা বজায় রেখে বললো, “আসছি। ভালো থাকবেন।”

অটবী চলে যেতেই ত্রিস্তান ঘাসের ওপর শুয়ে পরলো। হাসলো ক্ষীণ। হাসিটা আদৌ কিসের, বোঝা গেল না। অনুভূতিগুলো শূণ্যে ঠেলে চরম অবাধ্য হলো। অটবী মানা করা সত্ত্বেও তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো আকাশকে। দেখেই চললো। অটবী মেয়েটা অবুজ। আকাশ বিষাদ বলেই তো সবার পছন্দ। মেয়েটাও তো আকাশেই আশ্রয় নিয়ে আছে।

আচমকা চিপস খাওয়া বাদ দিয়ে ভাইয়ের কাছে এগিয়ে আসলো তনয়া। বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে চেঁচালো, “ভাইয়া? রক্ত! রক্ত!”
বলতে বলতে নাকের দিকে ইশারা করলো সে। নাক থেকে আবারও রক্ত ঝরছে। ভীষণ বিরক্ত হলো ত্রিস্তান। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুছে নিলো রক্তটুকু।

সরোজ লুকিয়ে লুকিয়ে ‘অরবিন্দ অটবী’-তে এসেছে। অটবীকে ত্রিস্তানের সাথে রেখে সুযোগটা কাজে লাগিয়েছে সে। বাসার পেছনে গিয়ে নলীকে ডাকতেই চমকে উঠলো মেয়েটা। কলপাড়ে কাপড় ধুঁচ্ছিল। সরোজের আওয়াজ শুনে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। টিনের বেড়ার ওপাশ থেকে সরোজ আবার ফিসফিসিয়ে ডাকলো, “ওই ম্যাইয়্য! ওইদিকে না, এইদিকে। টিনের ফুটার দিকে তাকা।”

নলী সাথে সাথে বামপাশে তাকালো। টিনের বেড়ার এদিকটা অনেকটাই ছিদ্র। সরোজের ভ্রু, চোখ দেখা যাচ্ছে। নলী দ্রুত এগিয়ে এসে কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বললো, “তুমি এখানে আসছো কেন সরোজ ভাই? চলে যাও প্লিজ। বুবু দেখলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।”
সরোজ ভরসা দিয়ে বললো, “তোর বুবু এত তাড়াতাড়ি আসবে না। ত্রিস্তান ভাইয়ের সাথে আছে।”
—“বুবু ত্রিস্তান ভাইয়ের সাথে কি করে?”
—“আমার মনে হয়, ভাইয়ের সাথে তোর বুবুর কিছু চলে।”

সরোজ কথাটা খুব গুরুত্ব দিয়ে বললেও নলী বিশ্বাস করলো না, “ধুর! এমন কিছুই না। আমার বুবুকে আমি চিনি।”
সরোজ মুখ বাঁকিয়ে বললো,
—“কচু চিনো তুমি। তোমার মতো বলদ আমি আর একটাও দেখি নাই।”
—“আপনাকে দেখতে বলেছেটাকে?”
—“তুই বলেছিস। এখন এসব কথা বাদ। কাজের কথা বল। অটবী আপু কি তোকে আর মারছে?”

নলী মন খারাপ করে বললো, “উহু, মারেনি। কিন্তু রাগ করে আছে। কালকে থেকে কথা বলছে না।”
নলীর মুখ ফুলানো দেখে সরোজের ইচ্ছে করলো গালদুটো শক্ত করে টেনে দিতে। মুচকি মুচকি হেসে বললো, “ওরে আমার নীলিমা সুন্দরী রে, মন খারাপ করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

নলী কপট রাগ দেখালো, “সরোজ ভাই, আপনাকে না বলেছি আমাকে নীলিমা বলে না ডাকতে? তবুও ডাকেন কেন? আমার সুন্দর একটা নাম আছে। নলী বলে ডাকতে পারেন না?”
—“ইছ! ওইটা কোনো নাম হইলো? নলী! গরুর গোবরের মতো দূর্গন্ধযুক্ত নাম। ওইটা আবার সুন্দর!”

নলী কটমট চোখে চাইলো। ভয়াবহ কিছু মুখ থেকে বের করার আগেই শুনতে পেল, অটবী ফিরে এসেছে। সদর দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকছে দরজা খুলে দেওয়ার জন্য।
সরোজ বিরক্ত হয়ে বললো, “তোর বুবুই হইলো আমাদের প্রেমের ভিলেন, বুঝলি?”
—“আপনি ভিলেন। এখন যান এখান থেকে। আর শুনুন, আমি কোনো প্রেম করিনা আপনার সাথে।”

একথায় সরোজ হাসলো খুব। চলে যেতে যেতে বললো, “অস্বীকার করে লাভ নাই সখী। তোমার আমার প্রেমের খবর পুরো পাড়ায় রটিয়ে দিতে যাচ্ছি।”

লাজুকপাতার ন্যায় রাঙা হয়ে উঠলো নলী। কাপড় ধুঁতে গিয়ে মনোযোগ হারালো। এই সরোজ ভাইটাও না!

রাতে ঘুমানোর সময় পৃথা বারবার খোঁচাচ্ছিল নলীকে। নলী রেগে গিয়ে বললো, “কি সমস্যা? খোঁচাচ্ছিস কেন?”
—“তুই ভালো হবি কবে?”
—“কি আশ্চর্য! মাথা কি গেছে? কি আবলতাবল বকছিস?”
—“আজকে দুপুরে আমি তোর সব কান্ড দেখেছি। কালকে থেকে বুবু তোর সাথে কথা বলেনা, তাও কি তোর শিক্ষা হচ্ছে না? সরোজ ভাই কি বুবুর থেকেও আপন হয়ে গেছে?”

নলী সাথে সাথে পৃথার দিকে মুখ করে শুলো। চেহারা ভয়ে জর্জরিত। পৃথা কি তবে সব দেখে ফেলেছে? মিনমিনিয়ে অনুরোধ করলো, “বুবুকে বলিস না পৃথা। বুবু নয়তো আরও রেগে যাবে।”
—“সেটা তোর সরোজ ভাইয়ের সাথে কথা বলার আগে ভাবা উচিত ছিলো।”
—“পৃথা, তুই কি চাচ্ছিস বুবুর সাথে আমার সম্পর্ক নষ্ট হোক?”
—“তাহলে বল সরোজ ভাইয়ের আর সাথে কথা বলবি না।”

নলী একটু ভেবে বললো, “আচ্ছা, বলবো না।”
পৃথা আশ্বস্ত হতেই নলী একটু নিশ্চিন্ত হলো। যাক! এ যাত্রায় সে বেঁচে গেছে। মনে মনে বললো, “প্রেম করতে গেলে একটু আধটু মিথ্যা বলতেই হয়। আমিও নাহয় বললাম। একটু মিথ্যা বললে কিচ্ছু হবে না।”

রাত তখন সাড়ে বারোটা প্রায়। ঘরের সব কাজ শেষে অটবীর ঘুমাতে গিয়ে মনে পরলো, সে মূল গেটে তালা লাগাতে ভুলে গেছে। শোয়া থেকে উঠে টেবিল থেকে চাবি নিলো সে। ওড়না গায়ে জড়িয়ে গেট লাগাতে চলে গেল।
গেট-টা পুরোনো আমলের। অটবীর বাবা প্রায় গর্ব করে বলতেন, গেট-টা তার বাবার বাবা বানিয়েছেন। খুলতে, লাগাতে গেলেই বিশ্রী একটা আওয়াজ হয়। অটবী সাবধানে দরজা লাগালো। মৃদু শব্দটাও যেন বিরাট হয়ে গেল নিশ্চুপ পরিবেশে। প্রায় তালা লাগিয়ে ফেলেছিল, এসময় দরজার ওপাশ থেকে ভরাট গলা শোনা গেল, “অটবী?”

ত্রিস্তানের গলা না? হ্যাঁ, তারই তো! অটবী তবুও নিশ্চিত হতে প্রশ্ন করলো, “বাহিরে কে? ত্রিস্তান?”
—“হ্যাঁ। দরজা খুলো।”
অটবী খুললো না, “কি দরকার? এভাবে বলুন।”
—“তোমার ঘরে দা-বটি আছে না? আগের মতো নিয়ে আসো। দরজা খোলার পর কিছু করলে ডাইরেক্ট গলায় চালিয়ে দিও।”

অটবী মোটেও অতটা অবিশ্বাস করে না ত্রিস্তানকে। এই সল্প পরিচয়েই যেন অনেকটা চিনে ফেলেছে।
ধীর-স্থির ভাবে দরজা খুলে অটবী তাড়া দিয়ে বললো, “তাড়াতাড়ি বলুন কি বলবেন। মা জেগে গেলে সমস্যা হবে।”

প্রতিবারের মতো গুছানোহীন ত্রিস্তান! কিন্তু এখন একটু বেশিই অগোছালো লাগছে তাকে। বিনাবাক্যে তার দিকে হাত বাড়িয়ে বললো, “নাও।”
—“হু?”

ত্রিস্তানের হাতে একশ টাকার কচকচে নোট। মুঠ করে রেখেছে। অটবী দেখেই বললো, “আমি নিবো বলেছি?”
ত্রিস্তান আবারও বললো, “চুরি করিনি। নাও।”

বলতে বলতে সে নিজেই অটবীর হাত টেনে টাকাটা গুঁজে দিলো। অটবীকে চমকানোর সময়টুকুও দিলো না। অটবী দেখলো, ত্রিস্তান শুধু টাকাই দেয়নি, দুটো চকলেটও দিয়েছে। সাথে সাদা কাগজে ছোট্ট লিখা, “তুমি অনেক তিতা অটবী। তোমার উচিত বেশি বেশি মিষ্টি খাওয়া।”

________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

অটবী সুখ পর্ব-০৩

0

অটবী সুখ

৩.
রাস্তার মাঝখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে অটবী। সিক্ত, মলিন চোখজোড়া একদৃষ্টে চেয়ে চেয়ে দেখছে ত্রিস্তানকে। বড়ো বড়ো পা ফেলে চলে যাচ্ছে ছেলেটা। বড্ড শান্ত একেকটা কদম। কোনো তাড়াহুড়ো নেই। দেখে মনে হয়, ভদ্র ঘরের চাকরি করা সভ্য একটা ছেলে। যে সবসময় ঝামেলা এড়িয়ে চলে। অথচ একটু গভীরভাবে দেখলেই বোঝা যায়, সে আসলে কতটা ছন্নছাড়া, উদাসীন। যেন হাজারটা দুঃখ, কষ্ট আর চিন্তা সে একাই আগলে রেখেছে। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলছে, “অরণ্য, রহস্য লুকানোর বদলে এবার একটু দুঃখ খুঁজে দেখাও তো দেখি!”

বাসায় ফিরে অটবীর আর বিশ্রাম নেওয়া হলো না। এই কাজ, সেই কাজ করতে করতে দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে চললো। কিছুক্ষণ পর নলী আর পৃথার স্কুল ছুটি হবে। হাতে বেশি সময় নেই। আর মাত্র পনেরো মিনিট। কোনোমতে একপ্লেট ভাত খেয়েই অটবী বেরিয়ে পরলো। ভরা পেটে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। সে অন্যান্য সময় যত দ্রুত হাঁটে, এখন তার অর্ধেকও হাঁটতে পারছে না।
ধীরে ধীরে, একটু একটু করে স্কুলের কাছাকাছি আসতেই বোনদের দেখতে পেল অটবী। ঝালমুড়ি দোকানের একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে ওরা। নলী ঠোঁটে জ্বলজ্বলে হাসি এঁটে রাখলেও পৃথা বেজার মুখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। হঠাৎ দুটো ঝালমুড়ি নিয়ে সেখানে হাজির হলো সরোজ। একটা নলীকে দিতেই মেয়েটা খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। কিন্তু পৃথা নিতে চাইছে না। অটবী পায়ের গতি বাড়ালো। ভেতরে ভেতরে মারাত্বক দাবানলে ছটপট করে উঠলো মন। বিষিয়ে গেল। কাদের জন্য সে এতটা কষ্ট করছে? জীবনের সখ-আহ্লাদ ত্যাগ করেছে? এরা তো তাকেই মান্য করে না।

চোয়াল শক্ত করে নলীর মুখোমুখি দাঁড়ালো অটবী। ভীষণ স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লো, “তোদের কাছে তো টাকা নেই। ঝালমুড়ি কোত্থেকে পেলি?”

সহসা চমকে উঠলো নলী। মুখের উজ্বলতা মিইয়ে গিয়ে স্পষ্ট ভয়ের ভাঁজ দেখা দিলো। আমতা আমতা করে বলতে চাইলো, “সরোজ ভাই কিনে দিছে বুবু।”
সেকেন্ডের ব্যবধান। আচমকা রুক্ষ হাতের চড় পরলো নরম গালটায়। নলী গালে হাত দিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলো। অটবী যেন রণমুর্তি ধারন করেছে। ভয়ংকর রাগে শ্যামবর্ণ মুখটাও লাল দেখাচ্ছে। নলীর কান্নার আওয়াজ বাড়লো। গালের ব্যথায় না, বোনের ভয়ে।
সরোজ হাঁসফাঁস করে বললো, “নীলিমার দোষ নাই অটবী আপু। আমিই জোর করছিলাম।”

পৃথা একপাশে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে। মনে মনে খুব চাইছিলো, নলীর এমন একটা শিক্ষা হোক। মেয়েটা বেশ বাড় বেড়েছিল। সে এতবার সাবধান করেছে, তবুও শুনেনি। আরেকটু মজা নেওয়ার জন্য নলীর কানের কাছে গিয়ে পৃথা আস্তে আস্তে বললো, “তোকে আবারও নীলিমা বলে ডাকছে সরোজা ভাই। তুই কিছু বলবিনা?”

অন্যসময় হলে নীলিমা ডাকার অপরাধে সরোজের সাথে বিশাল ঝগড়া বাঁধিয়ে দিতো নলী। নীলিমা নামটা তার একদমই পছন্দ না। কিন্তু সরোজ তাকে এই নামেই ডাকবে! এ নিয়ে কম বাকবিতর্ক হয়নি সরোজের সাথে তার। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি আলাদা। সে তো কেঁদেই কূল পাচ্ছে না। ঝগড়া করার সময় কই?
সরোজ নম্র কণ্ঠে আবার বললো, “ওকে বইকো না, আপু। ওর সত্যিই দোষ নাই। আমিই জোর করে ঝালমুড়ি কিনে দিয়েছি। ও নিতে চায় নাই।”

অটবী নলীর বাহু শক্ত করে ধরে নিজের কাছে নিয়ে এলো। বললো, “আমি ছোট নই সরোজ। তোমার থেকে বয়সে অনেক বড়। জোর করছো কি করছো না সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি। নলীর বয়স কম। সঠিক-ভুল এখনো চিনতে শিখেনি। ভালো হয়, তুমি ওর থেকে দূরে থাকলে। ওর আশেপাশেও যেন তোমাকে না দেখি।”

“তুমি যা ভাবছো, সেসরক কিছুই না আপু।”

“তোমার থেকে আমার জানা লাগবে না সরোজ। পারলে এসব বখাটেপনা ছেড়ে পড়ালেখায় মনোযোগ দাও। তোমাকে নিয়ে তোমার বাবার অনেক স্বপ্ন। সামান্য পিয়নের চাকরি করে পুরো পরিবার চালাচ্ছেন। তাকে আর্থিক দিক দিয়ে সাহায্য করতে না পারো, অনতত দশটা লোকের সামনে মাথা নিচু করতে দিও না।”

নলীকে এক প্রকার টেনে নিয়ে যেতে লাগলো অটবী। নলী কেঁদেই যাচ্ছে। কথা বলতে পারছে না। রাস্তার পথচারীদের অনেকেই চেয়ে চেয়ে দেখছে ওদের। ক্ষণে ক্ষণে অবাক হচ্ছে এই ভেবে, শান্ত মেজাজের হাসিখুশি মেয়েটাকে তারা কখনো এতটা রেগে যেতে দেখেনি।

রেবা বেগম এখন অনেকটাই সুস্থ। সকাল থেকে খুটখাট শব্দে এটা ওটা করছেন। গোছানো জিনিসগুলোও মাঝে মাঝে গুছিয়ে রাখছেন। ঘুম ভাঙ্গার পর মাকে কাজ করতে দেখে রেগে গেল অটবী। রেবা বেগম তখন রুটি ছেঁকছিলেন। ঝটকা মেরে তার থেকে খুন্তি নিয়ে অটবী বললো, “তোমার সমস্যা কি মা? সুস্থ হয়েছ একদিনও হয়নি। তোমাকে রান্না করতে বলেছে কে?”

রেবা বেগম অল্প হাসলেন। অটবী থেকে আবারও খুন্তি নিয়ে বললেন, “এতদিন তো শুয়েই ছিলাম। আর শুয়ে থাকতে ভালো লাগছিল না।— যা, হাতমুখ ধুয়ে খেতে আয়।”

অটবী আর কিছু বললো না। বিরক্ত ভঙ্গিতে কলপাড়ে যেতে যেতে বললো, “কখন উঠেছো ঘুম থেকে? উঠে ডাকতে পারলে না? আর একা একা কাজ করবে না। আমাকে ডাকবে।”

“শুক্রবার দেখে আর ডাকিনি। এমনিতেই তো সকাল সকাল উঠিস।”

হাতমুখ ধুঁয়ে আসতে আসতে নলী আর পৃথাও ঘুম থেকে উঠে গেল। নলীর চোখ দুটো ফুলে একাকার। রাতে বোধহয় কেঁদেছে অনেক। অটবী দেখেও দেখলো না। চুপচাপ নাস্তা খেতে লাগলো। কালকে টিউশন দুটো করাতে পারেনি। নাস্তা খেয়েই এখন বেরিয়ে পরবে।
নলী কয়েকবার অটবীর সাথে কথা বলতে চাইলেও অটবী এড়িয়ে গেছে। সুযোগ দেয়নি। নলীকে এত সহজে ক্ষমা করে দিলে চলবে না। এখন থেকেই শাসনে রাখতে হবে। তারা নিম্নবিত্ত, এমনিতেই সুখ তাদের কাছে ধরা দেয় না। আবেগের বশে ভুল করলে হয়তো জীবনটাই ধ্বংস হয়ে যাবে।

প্রতিবার টিউশনিতে গেলে জড়তায় চুপসে থাকে অটবী। তার পরনের কোনো ভালো জামা নেই। ঘুরেফিরে এক কামিজ পরে আসে। এনিয়ে ছাত্রের মায়েদের চিন্তার শেষ নেই। অটবীকে দেখেই কেমন মুখটা কুঁচকে রাখেন। ভালো করে দুদণ্ড কথাও বলেন না। মাঝে মাঝে অবশ্য না পারতে নাস্তা দেন, পানসে চা আর ঘরের সবচে’ কমদামি বিস্কুট। অটবীর মনে হয়, তারা হয়তো অটবীর জন্যই দোকান থেকে কমদামি বিস্কুটটা কিনে আনেন।
যতটা সময় সে পড়ায়, একটা অন্ধকার খাঁচায় বন্দি থাকার মতো অনুভূতি হয় তার। হাঁসফাঁস করে। বড়লোকদের সাথে এজন্যই মিশতে ভয় হয় তার। বন্ধুবান্ধবও নেই তাই। কারণ অটবী জানে, সে এই মানুষগুলোর সাথে মানিয়ে চলতে পারবে না।

বাসায় আসার পথে সরোজ পিছু নিলো অটবীর। অটবী তা দেখেই দাঁড়িয়ে গেল। শান্ত সুরে বললো, “কি হয়েছে সরোজ? কিছু বলবে?”

কি মিষ্টি করে বললো অটবী! যেন সরোজের প্রতি রাগ-টাগ কিচ্ছু নেই মেয়েটার। সরোজ একদফা ভড়কালো। মৃদু স্বরে বললো, “তুমি কি নলীকে বকছিলা, অটবী আপু?”

অটবী আগের মতোই বললো, “সেটা দিয়ে তুমি কি করবে?”

“ওকে প্লিজ বকিও না আপু। আমি আর ওর সাথে কথা বলবো না।”

“ভালো।” বলতে বলতে সামনে তাকালো অটবী। ত্রিস্তানকে দেখা যাচ্ছে। একটা মেয়ের হাত ধরে টানছে সে। মেয়েটা কিছুতেই যেতে চাইছে না। চিৎকার করে কাঁদছে। রাস্তায় বসে পরেছে। মেয়েটা কে হতে পারে? এভাবে টানছেই-বা কেন?
অটবীর দেখাদেখি সরোজও সেদিকে তাকালো। পরপরই মুখে একটা অকৃত্রিম আফসোস নিয়ে বললো, “আহারে! ত্রিস্তান ভাইয়ের বোনটা! কয়েকদিন আগেও কি ভালো ছিল! এখন নাকি এই মাইয়্যা পাগল। বিশ্বাসই হইতে চায় না।”

“কি বললে?” অবাক চোখে সরোজের দিকে একবার তাকিয়ে আবারও ত্রিস্তানের দিকে তাকালো অটবী। খেয়াল হলো, মেয়েটাকে আসলেই দেখতে সুস্থ লাগছে না। পরনের জামা কাপড় এলোমেলো। চুলে সুন্দর করে বেণী করা থাকলেও মেয়েটা সেই বেণী টেনেটুনে একাকার করে ফেলেছে। তাকে সামলাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে ত্রিস্তানের। চেহারা অসহায়, ক্লান্ত।
সরোজ বললো, “ওই মেয়ে ত্রিস্তান ভাইয়ের বোন, তনয়া। কয়েক বছর আগে বিয়ে হইছিল। বিয়ের পর বাচ্চা হইতে গিয়ে একটা দূর্ঘটনায় বাচ্চা মারা গেল। মা হইতে পারবে না নাকি আর! তাই জামাই ডিভোর্স দিসে। ডিভোর্সের দিনই আবার ত্রিস্তান ভাইয়ের বাপ-মা একলগে মারা গেল। তখন থেকে তনয়া আপু এমন হইয়া গেছে।”

অটবী নিশ্চুপ হয়ে শুনছে। অনড় দৃষ্টি ত্রিস্তানের পানেই। ধৈর্যহারা ত্রিস্তান ততক্ষণে বোনকে কোলে তুলে নিয়েছে। এদিকেই আসছে। তনয়া নামের মেয়েটা এতে আরও উত্তেজিত হয়ে গেল। বড় বড় নখ দিয়ে আঁচড়ে দিচ্ছে ত্রিস্তানের মুখ, গলা, হাত।

কাছাকাছি আসতেই চোখাচোখি হলো ওরা দু’জন। অটবীর মন কেমন যেন করে উঠলো। ভীষণ গোপনে সুধালো, “দুঃখ, তুমি কি আমার থেকেও দুঃখী?”

জবাব পাওয়া গেল না। অটবী তবুও চেয়ে রইলো। ত্রিস্তান চোখ সরিয়ে নিলেও। আচমকা বলে বসলো, “মেয়েটা যা চাইছে ওকে দিচ্ছেন না কেন?”

ত্রিস্তান থমকালো। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো একবার। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, “আমার কাছে টাকা নেই।”

_____________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

অটবী সুখ পর্ব-০২

0

অটবী সুখ
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

২.
কাল সারারাত জেগে থাকায় ক্লান্তিতে শরীর ভেঙ্গে আসছে অটবীর। চিনচিন মাথা ব্যথার পাশাপাশি প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। তাকিয়ে থাকা দায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু এখন মোটেও ঘুমানো যাবে না। তাড়াতাড়ি বাসায় পৌঁছাতে হবে। ঘর পুরো এলোমেলো হয়ে আছে। অনেক কাজ বাকি। রেবা বেগমকে ঔষধ খাওয়াতে হবে, দুপুরের রান্নাবান্না সাড়তে হবে, কলেজে যেতে হবে, বিকালে দুটো টিউশনও করাতে হবে— হাহ! মনে মনে ভীষণ উদাসীন হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো অটবী। ইদানিং সবার জন্য সবটা করতে গিয়ে মনে হয়, সে নিজেই হারিয়ে যাচ্ছে। নিজের জন্য অল্প একটু অবসর পাওয়ারও অবকাশ নেই। বাবা থাকতে যদিও এতসব দায়িত্ব পালন করতে হতো না ওর। দিনগুলো রঙিনই ছিল। তারপর তিনবছর আগে বাবা মারা গেলেন। মা অসুস্থ হয়ে পরলেন। এইতো, জীবনের রঙ ফ্যাকাশে হতে হতে ম’রে যাচ্ছে।
জঙ্গলের রাস্তার কাছাকাছি আসতেই রহিম উচ্চস্বরে অটবীকে ডেকে উঠলো, “কি খুকি? এত তাড়াহুড়োয় কোথায় যাচ্ছো? দুই সুন্দরীকে ইস্কুলে দিয়ে আসছো বুঝি?”

প্রশ্ন শুনে অটবী মা’রাত্বক বিরক্ত হলো। নলী আর পৃথাকে দিয়ে আসার সময় রহিম তাদেরকে দেখেছিল। টাকা গুণতে ব্যস্ত থাকায় কিছু বলেনি। এখন এসেছে খোঁচাতে! বিরক্তিভাব চোখেমুখে ফুটিয়ে অটবী বললো, “কেন? আপনি জাননে না?”
রহিমা হলুদ দাঁতগুলো বের করে হাসতে হাসতে বললো, “জানি তো অনেক কিছুই। তা চাচির কি অবস্থা? ত্রিস্তান ভাই যে এত কষ্ট করে ঔষধপাতি কিন্না দিলো, ধন্যবাদ বলছিলা উনারে? তুমি তো আবার আমাদেরকে পছন্দ-টছন্দ করো না। দেখছো আমরা মানুষরে কত উপকার করি?”

না চাইতেও চেহারা বিকৃত করে ফেললো অটবী। এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রহিমের অকাজের কথাবার্তা শুনতে বিন্দু মাত্র ইচ্ছা নেই তার। বাধ্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নয়তো কথা না বললে পিছু পিছু আসতেও দ্বিধাবোধ করবে না এই ব’খা’টের দল।
অটবী সব প্রশ্নের উত্তর দিলো না। কাঠকাঠ গলায় তাড়া দিয়ে বললো, “মা এখন আগের চেয়ে ভালো আছে, রহিম ভাই। আমার দেড়ি হচ্ছে। আপনার আর কিছু বলার আছে?”
—“ধন্যবাদ যে দিলা না? আচ্ছা থাক, দিতে হবে না। দেড়ি যখন হচ্ছে, যাওগা।”

অটবী দাঁড়ালো না। দ্রুত পা চালিয়ে সামনে এগোতে এগোতে আড়চোখে একবার ওদের সবাইকে দেখে নিলো। সরোজ ওর বয়সী কিছু ছেলে নিয়ে চাদরে বসে তাস খেলছে। কি আনন্দ ছেলেটার চোখেমুখে! পড়া নেই, লেখা নেই সারাদিন বাবার কষ্টের টাকায় ফুর্তি! বাবার হাতে এত মা’র খেয়েছে, তবুও শিক্ষা হয়নি। আচ্ছা, এই ত্রিস্তান ছেলেটা কেমন? সরোজের মতোই? পরিবার ভালো হলেও সঙ্গ দোষে অধঃপতন হয়নি তো? কি জানি! সারাদিন তো এদের সাথেই থাকে। সকালে সিগারেট টানছিল, এখন বাইকে আরাম করে শুয়ে আছে। অটবীর দিকে একবারও তাকায়নি। শূণ্য দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল আকাশপানে। চারিদিকের কোনো ধ্যান, আগ্রহ ছিল না। কি এমন দেখছিল কে জানে! আকাশে দেখার মতো কি আছে? সাদা-নীল রঙ ছাড়া? সাদা শুভ্রতার হলেও, নীল তো বি’ষাদের। বিষা’দই তো বেশি আকাশে। তাকালেই যেন দুনিয়ার চিন্তা, মন খারাপ জেঁকে বসে। এই যেমন ত্রিস্তানের দেখাদেখি অটবী আকাশের দিকে ভুলে তাকিয়ে ছিল। মন ভার হয়ে গেছে। ফিসফিসিয়ে আ’র্তনাদ করছে, “আমি ভালো নেই। আমার একটা ভালো থাকা চাই।”

_____

অটবীর কলেজ সকাল দশটায় শুরু হয়। ঘড়িতে এখন দশটা পঞ্চান্ন মিনিট। প্রায় একঘণ্টা দেড়ি করে ফেলেছে সে। এমনিতেও নানা কাজে কলেজে আসা হয়না। তারওপর যে দুইটা গুরুত্বপূর্ণ ক্লাসের জন্য এসেছিল, তার একটা মিস হয়ে গেছে। অটবীর মন খারাপ হলো খুব। টাকার অভাবে সে কোথাও কোচিং করে না। রেগুলার না বলে বন্ধুবান্ধবও নেই। কার থেকে নোট নেবে এখন?
ক্লাসের একদম শেষের ফাঁকা বেঞ্চটায় গিয়ে বসলো অটবী। দ্বিতীয় ক্লাসের স্যার এখনো আসেনি। টেবিলের ওপর দুহাত রেখে, সেখানে থুতনি ঠেকিয়ে সবাইকে দেখতে লাগলো সে। প্রতিবার ভালো নম্বর পাওয়া ছাত্র-ছাত্রীগুলো প্রথম সারির তিন বেঞ্চ নিয়ে গল্প করছে। সুন্দরী মেয়েদের একটা দল ওয়াইট বোর্ডের সামনে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে কি নিয়ে যেন খুব হাসাহাসি করছে। অটবী ওদেরই দেখতে লাগলো। দেখতে দেখতে আঁখিপল্লব কেমন ভারি হয়ে উঠলো হঠাৎই। সারাদিনের ক্লান্তি, হতাশায় জেগে থাকতে সায় দিলো না আরামপ্রিয় শরীর। তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পরলো।

অটবীর ঘুম ভেঙ্গেছে তীব্র হাসাহাসির শব্দে। অটবী প্রথমে বুঝতে পারেনি। পরে যখন দেখলো, স্যারসহ ক্লাসের বাকি সবাই তার দিকে তাকিয়েই হাসছে, তখন বুঝতে পারলো ওদের সবার হাসির উৎস সে-ই। অটবী লজ্জা পেল। মাথা নিচু করে ফেলতেই স্যার রসিকতার সুরে বললেন, “কি মেয়ে? রাতে কি না ঘুমিয়ে চুরি-টুরি করো নাকি? ক্লাসেও তো রেগুলার না মনেহয়। এতই যখন ঘুমাতে ইচ্ছে করে তাহলে কলেজ আসো কেন?”

বাবার মৃ’ত্যু’র পর অটবীকে কেউ কথায় কথায় কাঁদতে দেখেনি। সে সামান্য কথায় কাঁদে না। কিন্তু সবার এই তাচ্ছিল্য দৃষ্টি, অবজ্ঞা ভেতর থেকে মিইয়ে দিলো অটবীকে। অশ্রুতে টলমল করে উঠলো মায়াবী চোখ। পুরোটা ক্লাস অটবী মাথা নিচু করে রাখলো। কোনোমতে ক্লাসটা করেই বেরিয়ে পরলো কলেজ থেকে। বাসে উঠেও তার মন খারাপ বাড়লো বৈ কমলো না। একটা সীটও খালি নেই। উপরন্তু ভীড়ের মাঝে কে যেন বাজে স্পর্শ করেছে তাকে। ভীষণ বাজে স্পর্শ। অটবী নিজেকে খুব কষ্টে আটকে রেখেছিল। এলাকায় ঢুকতেই হু হু শব্দে কেঁদে ফেললো। সেই কান্না শোনার কেউ নেই, দেখার কেউ নেই। নির্জন রাস্তায় শুধু সে এবং একমাত্র সে-ই।

—“এভাবে কাঁদছো কেন?”
আচমকা ভরাট কণ্ঠে কেউ বলে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে কান্না থামিয়ে চমকে উঠলো অটবী। সামনে ত্রিস্তান দাঁড়িয়ে আছে। হাতে সামনের হোটেল থেকে আনা নাস্তার প্যাকেট। সে আবার বললো, “কি হয়েছে?”
অটবী উত্তর দিলো না। চোখ বড় বড় করে চেয়েই রইলো ত্রিস্তানের দিকে। বিমূঢ় গলায় শুধালো, “আপনার নাক থেকে রক্ত পরছে।”
—“হু?”

অস্ফুট শব্দ করে পরপরই অটবীর দিকে পিঠ দেখিয়ে দাঁড়ালো ত্রিস্তান। ঝটপট নাকে হাত দিয়ে দেখলো, বাম নাক থেকে রক্ত ঝরছে। সে রক্তটা হাত দিয়েই মুছে ফেললো।
অটবী ততক্ষণে কাছে এগিয়ে এসেছে, “আপনার নাক থেকে রক্ত পরছে কেন? আপনি ঠিক আছেন?”
—“আছি।”
—“আপনার ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত।”
—“তেমন সিরিয়াস কিছু না। যেতে হবে না।”

এখন কি বলা উচিত? কোনো কথা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অটবী কয়েক সেকেন্ড ত্রিস্তানের দিকে তাকিয়ে চলে যেতে চাইলো। তার পূর্বেই ত্রিস্তান জিজ্ঞেস করলো, “আমার নাম জানো?”
থতমত খেয়ে অটবীর উত্তর, “হ্যাঁ।”
—“আমার নামের অর্থ জানো?”

অটবী এবার মাথা নাড়ালো। জানে না। ত্রিস্তান হাসলো মৃদু। গাঢ়, দৃঢ় কণ্ঠস্বরে বললো, “দুঃখ। ত্রিস্তান অর্থ দুঃখ।”

অটবী নির্লিপ্ত। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেললো মাত্র। সে এই নামের অর্থ জানে না ঠিক। অন্য কেউ হলে হয়তো অবাক হতো। কিন্তু তার মনে প্রশ্ন জাগছে। নামের এমন অদ্ভুত অর্থ জেনেও এই নাম কেন রেখেছে? ত্রিস্তানই-বা হঠাৎ একথা দিয়ে কি বোঝাতে চাইছে? অটবী বোঝেনি। জিজ্ঞাসু নয়নে চেয়েই আছে। ত্রিস্তান আবারও হাসলো। প্রশস্ত হাসি। ছেলেটাকে হাসলে আরও সুন্দর লাগে। চলে যেতে যেতে বললো, “এভাবে কাঁদবে না কখনো। অরণ্য কাঁদে না, নিজ গভীরতায় হাজারটা রহস্য পৃথিবী থেকে লুকিয়ে রাখে।”

______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

অটবী সুখ পর্ব-০১

0

অটবী সুখ
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
সূচনা পর্ব

—“খুকি, ভয় পাচ্ছো? এত রাতে বাহিরে কি? দেখি, এদিকে আসো।”
হঠাৎ ডাকে অটবী দাঁড়িয়ে গেল। কালো, লম্বা করে লোক। দেখতে অনেকটা ব’খাটে ধরণের। গলায় আর হাতে চ্যান, ব্রেসলেট ঝুলানো। বাইকে পা ছড়িয়ে বসে, সিগারেটের একেকটা সুখটান দিচ্ছে। আশেপাশে আরও তিনটা বাইক, পাঁচছয়জন ছেলেপেলে। অটবী মনে মনে ভয়ে সিটিয়ে গেল। বুকের কাছের ওড়না এক হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে যথেষ্ট ক’ঠি’ন গলায় বললো, “ঔষধ কিনতে বেরিয়েছি।”
—“কেমন ঔষধ খুকি? খারাপ ঔষধ?” বলেই লোকটা হো হো করে হেসে দিলো। বাকি ছেলেরাও তাই। শুধু দুইজন হাসছে না। একজনকে অটবী চেনে। সরোজ নাম। ভালো পরিবারের ছেলে। বয়সের ভুলে এদের সাথে মেলামেশা শুরু করে গোল্লায় চলে যাচ্ছে। অন্যজন এলাকায় নতুন এসেছে বোধহয়। আগে দু’একবার দেখেছে। অন্যান্য বখাটেদের মতো কখনো মেয়েদের বিরক্ত করে না। চুপচাপ বাইকে বসে সিগারেট খায়। এখনও তাই করছে। তবে পার্থক্য শুধু এটুকুই, তার শান্ত চোখজোড়া এমুহুর্তে ঘুরঘুর করে পর্যবেক্ষণ করছে অটবীকে।
অটবী লজ্জা, অস্বস্তি আর রাগে একাকার হয়ে বললো, “বাজে কথা বকবেন না, রহিম ভাই। মা অসুস্থ।”
—“তাই নাকি? কি হইছে চাচির?”

অটবী একটু নমনীয় হলো এবার। আস্তে করে বললো, “জানি নাহ্। সকাল থেকে বমি করছে। প্রেশার লো। একটু আগে মাথা ঘুরে পরে গেছে। বাসায় ঔষুধও নেই। বাধ্য হয়ে এখন বের হয়েছি। ফার্মেসীর দোকান খোলা পাচ্ছি না।”

কণ্ঠ বুঝি একটু কেঁপে কেঁপে উঠলো? মায়ের অবস্থা আসলেই ভালো না। ঘর থেকে বের হওয়ার আগেও দেখেছে, বিছানায় নিথর হয়ে পরেছিল। একূলে মা আর দুইবোন ছাড়া অটবীর কেউ নেই। মায়ের কিছু হয়ে গেলে সে কিভাবে থাকবে? আচমকা এলাকায় নতুন আসা ছেলেটা এগিয়ে আসলো অটবীর দিকে। ভয়ে অটবী দুকদম পেছালো। ছেলেটা বললো, “এত রাতে কোনো ফার্মেসী খোলা পাবে না। কি ঔষুধ আনতে হবে বলো, আমি নিয়ে আসছি।”
পাশ থেকে রহিম বললো, “ত্রিস্তান ভাই, আপনে কষ্ট করবেন ক্যান? অন্য কাউরে পাঠাই?”
ত্রিস্তান নামের ছেলেটা অটবীর দিকে চেয়ে থেকেই বললো, “সমস্যা নেই।”

অটবী প্রথমে এমন প্রস্তাবে রাজী হলো না। কিন্তু অন্য কোনো উপায়ও নেই। ঔষধের টাকাও ছেলেটা নেয়নি। অটবী বাসায় আসতে আসতে একদফা ছেলেটার কথা ভাবলো। রহিমের দলের প্রায় ছেলেপেলেই চরম রকমের বেয়াদব। একটা তো ধ’ র্ষ’ণ করতে গিয়ে ধরা খেয়েছিল। তবে রহিম ভাই একটু ব্যতীক্রম আছেন। অল্পসল্প দয়ামায়া করতে মাঝে মাঝেই দেখা যায় তাকে। তাই বলে কি রহিম ভালো? মোটেও না। ওদের কেউই ভালো না। সরোজও খারাপ হয়ে গেছে। এই ত্রিস্তান ছেলেটাও হয়তো অনেক খারাপ। দেখে বোঝা যায় না শুধু। তাছাড়া ডাকাতরা আর কতই ভালো হবে? দিনে-দুপুরে পকেট মা’রা, মেয়েদের বিরক্ত করা, রাতে মানুষের বাসায় চুরি করা- এটাই তো এদের কাজ।

_____

‘অটবী’ নামটায় রাজকীয় একটা ভাব আছে। নামটা বাবা রেখেছিলেন। তার নামেই বাড়ির নাম রাখা হয়েছে, ‘অরবিন্দ অটবী’। যার অর্থ, পদ্মের অরণ্য। বাড়িটার নাম শুনে হয়তো মনে হচ্ছে, এ বোধহয় কোনো রাজপ্রাসাদ। সেই রাজপ্রাসাদের রাজকন্যা অটবী। কিন্তু মোটেও তা নয়। কল্পনা থেকে বাস্তব ভিন্ন হয়। এখানেও তাই। অটবীরা আদিকাল থেকেই নিম্নবিত্ত। নিম্নবিত্তেরও কয়েকটা ধাপ থাকে। অটবীরা মাঝারি ধাপের। আধভাঙ্গা বাড়ি, তিনটে খুপরির মতো ঘর, মোটামোটি রকমের উঠান আর উঠানে টিনের তৈরি ছোটখাটো রান্নাঘর। ঘরে তেমন আসবাবপত্রও নেই।

অটবী তাড়াতাড়ি করে মায়ের কাছে যেতেই দেখলো, রেবা বেগম বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছেন। চোখ বন্ধ অথচ চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে। মায়ের শিওরে বসে আছে অটবীর পনেরো বছরের দুইবোন। ওরা জমজ। অটবীকে দেখেই একসাথে দৌঁড়ে এসে বললো, “ওষুধ আনছো বুবু? মা অনেক কষ্ট পাইতেছে। তাড়াতাড়ি খাওয়াই দাও।”
অটবী ওদের দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, “দুই ফাজিল এখনো ঘুমাস নাই কেন? রুমে যা। ঘুমা। মায়ের চিন্তা তোদের করতে হবে না।”
—“কিন্তু আমাদের তো ঘুম আসতাছে না বুবু। তুমি কি ওষুধ আনো নাই? মারে খাওয়াইতাছ না কেন?”
—“ঔষধ একজনকে আনতে পাঠিয়েছি। আসতে দেড়ি হবে। তোরা যা, ঘুমা। সকালে স্কুল আছে না?”

বোন দুটো বুঝলো। দৌড়ে পাশের রুমে চলে গেল। অটবী এবার আস্তে আস্তে মায়ের পায়ের কাছে বসলো। শুকিয়ে হাড্ডি গোনা যাবে, এমন অবস্থা হয়েছে রেবা বেগমের। অটবী দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়ের পা দুটো টিপে দিতে দিতে লহু স্বরে বললো, “আর কিছুক্ষণ মা। একটু সহ্য করো।”

বলতে বলতে সে আবারও ভাবনায় পরে গেল। মস্তিষ্ক হঠাৎ বললো, এভাবে একটা ছেলেকে ঔষধ আনতে পাঠানো তার একদমই উচিত হয়নি। যতই বাসা চিনুক। বাসায় ঢোকার তো কখনো সাহস করেনি। কিন্তু এই মাঝরাতে ঔষধ দেওয়ার নাম করে যদি জোর করে ঘরে ঢুকতে চায়? খারাপ কিছু যদি করে তার সাথে? কে বাঁচাবে তখন? অটবী খুব ঘামলো। মাথার ওপরের ফ্যানটা আস্তে আস্তে চলছে। অন্যদিনের মতো গরমও নয় আজকে। কিন্তু এত হাঁসফাঁস লাগছে শরীরটা!

সরব, টিনের গেটে টোকা দেওয়ার শব্দ হলো। অটবী চমকালো। জেগে জেগে উঠলো নেতানো চিন্তা। গেট খোলার আগে পাশের রুমে একবার উঁকি দিয়ে দেখে নিলো। বোন দুটো ঘুমিয়ে আছে। রেবা বেগমও ব্যথা সহ্য করে একটু আগেই ঘুমিয়েছেন। বাড়িতে সে একলা সজাগ! এই ছোট্ট ভাবনাটা ভেবেও যেন অটবীর শরীর ঝিমঝিম করে উঠলো। উহু! সে মোটেও এতটা দূর্বল নয়। এভাবে ভয় পেলে চলবে না। রান্নাঘর থেকে বটি নিয়ে হাত পেছনে রেখে বটিটা আড়াল করে দাঁড়ালো সে। ক্যাচক্যাচ শব্দে আধো গেট খুলে বললো, “কে?”

ওপাশ থেকে ত্রিস্তানের পুরুষালি মোটা গলা, “তোমার ঔষধ এনেছি।”
অটবী আরেকটু গেট খুললো। হাত বাড়িয়ে বললো, “দিন।”

ত্রিস্তান প্রথমেই দিলো না। কয়েক সেকেন্ড ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। মুখটা অস্বাভাবিক স্থির, শান্ত। একটু গম্ভীরও বটে। চেহারা-সুরত খারাপ না। এক দেখায় প্রেমে পরার মতো। পরনের পোশাকও মোটামোটি সভ্য। এত ভালো ভালো ছেলেগুলো যে কেন চু’রিচা’মা’রির মতো বাজে কাজ করে, অটবী বুঝে পায় না।
ত্রিস্তান অটবীর হাতে ছোট্ট একটা ঠোঙ্গা ধরিয়ে নির্বিবাক স্বরে প্রশ্ন করলো, “বটিটা কি আমাকে মা’রার জন্য এনেছো?”

অটবী ভড়কালো খুব। নজর তুলে তাকালো। মোটেও ঠাট্টা করছে না লোকটা। মুখ দেখে অনতত তাই মনে হচ্ছে। সে উত্তর দিতে চাইলো না। এবং তাকে বাঁচিয়ে দিয়ে রহিম সুদূর থেকে ত্রিস্তানকে ডেকে উঠলো, “ত্রিস্তান ভাই? দেড়ি হইতেছে।”

ত্রিস্তান চলে যাচ্ছিল। অটবীর হঠাৎই একটা প্রশ্ন মাথায় আসলো। জিজ্ঞেস না করে সে শান্তি পাবে না।
—“আপনি কি রহিম ভাইয়ের বড়?”
ত্রিস্তান পেছন ফিরে তাকালো। কপালে অল্প ভাঁজ।
—“কেন?”
—“রহিম ভাই তার দলের কাউকে ভাই বলে ডাকে না।”
—“হ্যাঁ, বড়।”

রহিমের থেকেও বয়সে বড়? রহিমের বয়স অনুমানিক ছাব্বিশ হবে। এলাকার চোরদলের সর্দার সে। সাথের ছেলেগুলোর বয়সও কম। আটারো, বিশ হয়তো। সেই রহিম থেকেও বড় লোকটা? কত হবে? ছাব্বিশ নাকি সাতাশ? কিংবা আটাশ? দেখে এত বড় মনে হয় না। তারচেয়েও বড় কথা, রা’জনৈ’তিক নেতা ছাড়া রহিম কাউকেই এত সম্মান দিয়ে কথা বলে না।

পরেরদিন দুইবোনকে বিদ্যালয়ে নেওয়ার পথে আবারও ত্রিস্তানদের সাথে দেখা হলো অটবীর। তাদের বাসা থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব কমপক্ষে পনেরো মিনিট। মাঝখানে একটা পাঁচ মিনিটের সরু জঙ্গল পরে। জঙ্গলের একদম শেষ মাথায় বসেছে তাদের ব’খাটেদের দল। ওদের মাঝে সরোজকে দেখেই অটবীর বোন নলী ক্ষীণ চেঁচিয়ে উঠলো, “বুবু! বুবু! দেখো, সরোজ ভাইয়া।”

অটবী সাথে সাথে সামনে তাকালো। রাস্তার একপাশে চাদর বিছিয়ে গোল হয়ে বসে আছে ওরা। মাঝখানে কি রেখে যেন হিসাব করছে। একটু এগিয়েই বুঝলো, ওগুলো মানিব্যাগ আর অনেকগুলো টাকার নোট। নিশ্চই চুরি করে এনেছে? ত্রিস্তান ওদের সাথে বসেনি। কিন্তু বাইকে হেলান দিয়ে ঠিকই দাঁড়িয়ে আছে। সিগারেটে টান দিতে দিতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে টাকাগুলোর দিকে।
অটবী নলীর হাসিমাখা মুখের পানে চেয়ে ধমকে উঠলো, “সরোজের সাথে তোর অত কি? আমি সেদিনও তোকে ওর সাথে কথা বলতে দেখেছি। মানা করেছি না ওর সাথে মিশতে?”
নলীর জমজ বোন পৃথা বললো, “ওকে আমিও মানা করছি বুবু। নলী শুনে না।”
নলী পৃথাকে চোখ রাঙ্গালো। নির্দোষ গলায় বললো, “পৃথা বেশি বেশি বলতাছে বুবু। আমি সরোজ ভাইয়ের সাথে এতও মিশি না। কিন্তু ভাইয়ের সাথে মিশলে কি হয়? ভাই তো অনেক ভালো।”
—“ভালো কি ভালো না সেটা আমি বুঝব। তুই আর ওর সাথে কথা বলবি না।”

বলে আবারও ত্রিস্তানের দিকে তাকালো অটবী। ত্রিস্তানের তীক্ষ্ণ চোখ এবার আর টাকার ওপর নেই, অটবীর ওপর।

________________

চলবে~

অনুভূতিরা শব্দহীন পর্ব-৬৫ এবং শেষ পর্ব

0

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

অন্তিম পর্ব (প্রথমাংশ)

সারাহ্-কে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। র°ক্তচাপ কমানোর জন্য এতোটা দেরি করলেও এখনো সারাহ্-র অস্থিরতা কমেনি।

সকাল সাতটায় আহনাফ এসেছে, এখন দুপুর সাড়ে বারোটা। দশটার আগেই জাহাঙ্গীর সাহেব ও সামিহা এসে হাজির।

সারাহ্-কে প্রস্তুত করে নিয়ে যাওয়ার সময় সে আরেক গ্যা°ঞ্জা°ম বাধায়, আহনাফকেও সাথে যেতে হবে।

“ঐশী, এমন আচরণ কেন করছো তুমি?”

আহনাফের শান্ত কথায় সারাহ্ কান্না করে দেয়। খেই তুলে বলল,
“আপনাকে ছাড়া আমার ভ°য় লাগছে, আহনাফ। যদি ওখান থেকে বেরিয়ে আপনাকে আর না দেখি।”

আহনাফ ওর কপালে চুম্বন করে, গালে হাত রেখে বলল,
“সব ঠিক থাকবে। বেবিকে আমরা একসাথে ওয়েলকাম করবো।”

সারাহ্ আহনাফের হাত ধরে রাখে। আহনাফ জোরপূর্বক নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। জাহাঙ্গীর সাহেব মেয়েকে আদর করে সান্ত্বনা দিয়ে দেয়।

সারাহ্-কে ভিতরে নিয়ে গেল। আহনাফ ধীরে ধীরে হেঁটে একটু দূরে এসে স্থির হয়। জীবনে যেসব ক্ষেত্রে ও বেশি প্ল্যান করে, সেখানেই কেন যেন বিপত্তি আসে। এখন সে তাই বেশি কিছু ভাবতে চাচ্ছে না।
______________________________________

বাসার সামনের রাস্তায় শাফিনকে মাঝে দাঁড় করিয়ে দিয়ে পিবিআই সদস্যরা ক্র°স°ফা°য়ারের প্রস্তুতি নেয়, তাৎক্ষণিকভাবে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। শাফিনের দুইহাত পিছনে বাঁধা, তার চোখও বেঁধে দিয়েছে।

ইমতিয়াজ ও মৃত্তিকা এসে গেইটের সামনে দাঁড়ায়৷ দুপাশে মানুষের ভীড়। নাহিদ মাইকিং করে সব মানুষকে একদিকে পাঠিয়ে দেয়।

“ইমতিয়াজ, ওরা এতো দেরি কেন করছে?”
ভ°য় জড়ানো কন্ঠে কথাটা বলে মৃত্তিকা।

“সবকিছুর প্রস্তুতি লাগে, মৃত্তিকা।”

মৃত্তিকা ইমতিয়াজের হাত ধরে কাঁধে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে থাকে। একটু অদ্ভুত লাগছে তার, আবার না শাফিন বেরিয়ে যায়।

রিজভি ওদের দুজনের দিকে কয়েকবার তাকায়। গলির মুখে শরীফকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইমতিয়াজ। শরীফ হাতের ইশারায় ওদেরকে চলে যেতে বলে।

ইমতিয়াজের কপাল কুঁচকে যায়। মৃত্তিকাকে বলে,
“তুমি চলে যাও, কিছু গন্ডগোল আছে।”

“কেন?”
অবাক হয় মৃত্তিকা।

ইমতিয়াজ ওকে একটু ধা°ক্কা দিয়ে বলল,
“পরিস্থিতি স্বাভাবিক লাগছে না। চলে যাও।”

আচমকা রিজভি গু°লি চালায় মৃত্তিকার দিকে। ইমতিয়াজ ওকে সরিয়ে দিলেও গু°লিটা ইমতিয়াজের বামহাতে লাগে, কনুইয়ের খুব কাছে লেগে হাত ছুঁয়ে বেরিয়ে গেছে।

উপস্থিত লোকজন চমকে উঠে। চিৎকার, চেঁচামেচিতে একটা হুলস্থুল কান্ড বেঁধে গেল। পায়ের আঘাতে রাস্তায় অবহেলায় পড়ে থাকা ধুলাবালি বাতাসে বিচরণ করতে শুরু করেছে।

ইমতিয়াজ মৃত্তিকাকে নিয়ে ছুটে ভিতরে চলে আসে। এরমধ্যে আরো কয়েকটা গু°লি পর পর চলে। নিশানা ওদের মৃত্তিকাই। বারবার ইমতিয়াজ-মৃত্তিকা নিজেদের জায়গা পরিবর্তন করায় ওদের নিশানা ঠিক থাকে না।

গালিবের উপর গু°লি লেগেছে, এএসপি নাহিদও খারাপভাবে আ°হত হয়েছে।

শরীফের লোকজনও পাল্টা গু°লি চালায়। এলোপাথাড়ি গুলিতে বেশ কয়েকটা লা°শ পড়ে, আ°হতও হয় অনেকে।

শাফিনের চোখ খুলে দেয়া হয়েছে অনেক আগেই, রিজভিই খুলেছে৷ হাত বাঁধা অবস্থায় শাফিনে দৌড়ে চলে গেল, রিজভির গাড়ি প্রস্তুত আছে তাতে করেই পালিয়ে গেল শাফিন।

গ্যারেজে একটা পিলারের পেছনে মৃত্তিকাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে যায় ইমতিয়াজ। ইমতিয়াজের হাত থেকে ক্রমাগত র°ক্ত গড়িয়ে পড়ছে। ইমতিয়াজ বারবার গেইটের দিকে তাকাচ্ছে, হাতের খেয়াল তার নেই। নিজেকে শেষ করে দিয়ে হলেও সে মৃত্তিকাকে বাঁচাবে।

মৃত্তিকা ওর হাতটা ধরে বলল,
“তাহলে কি রিজভিও এদের সাথেই ছিল?”

“এখন তো তাই মনে হচ্ছে, আর নাহয় বিজনেসের কাগজপত্র নাহিদের থেকে নেয়ার পর পাল্টি খেয়েছে।”

মৃত্তিকা ইমতিয়াজের হাতের দিকে তাকিয়ে বলে,
“র°ক্ত পড়ছে ইমতিয়াজ।”

ইমতিয়াজ মৃত্তিকাকে জড়িয়ে ধরে, ওর মাথাটা নিজের বুকে চেপে বলল,
“পড়ুক, (একটু থেমে) ওদের টার্গেট তুমি ছিলে। তুমি ঠিক আছো তাতেই চলবে।”

কিছুক্ষণ পর গোলাগু°লি থেমে যায়। পরিবেশ শান্ত হয়। ধুলায় পুরো জায়গা অন্ধকার হয়ে আছে, যেন মরুর ধূলিঝ°ড় এখানে হয়ে গেছে।

মৃত্তিকাকে ভিতরে রেখে ইমতিয়াজ বেরিয়ে আসে। গালিব আর নাহিদসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে। কেউ যেন নেই যে তাদের সাহায্য করে।

এতোক্ষণ এতো লোক এখানে জড়ো ছিল, এতো মানুষ কি শুধুই তামাশা দেখতে এসেছিল?

উপায় না পেয়ে ইমতিয়াজ নিজেই এম্বুলেন্স কল করে এবং থানায়ও যোগাযোগ করে। মৃত্তিকা গেইটের কাছে এসে বলল,
“ইমতিয়াজ, এভাবে বাইরে থাকবেন না। ওরা আশেপাশেই থাকতে পারে।”

ইমতিয়াজের মন এমনিতেই ছটফট করছে। শাফিন যে আবার পালিয়ে গেল। রাগ হচ্ছে তাফ প্রচুর। বারবার কেন সে পালিয়ে যেতে পারে? এতোগুলো মানুষের মাঝখান থেকে কিভাবে পালিয়ে যেতে পারে?

মৃত্তিকাকে ধ°মক দিয়ে বলে,
“ভিতরে যাও, এখানে তোমার কোনো কাজ নেই।”

মৃত্তিকা কোথাও যায় না। এখানেই থম মে°রে দাঁড়িয়ে থাকে।

ইমতিয়াজের ফোন বেজে উঠে। শরীফের নাম্বার দেখে সে রিসিভও করে।

“আমি শাফিনের পিছনে আছি, ও সম্ভবত ঢাকার বাইরে যাবে, আমি ভুল না করলে খুলনা যেতে পারে। সুযোগ বুঝে ওকে মে°রে দিবো আমি।”

ইমতিয়াজ শুধুই ওর কথা শুনে, কিছুই বলে না। কল কেটে ফোনটা ছুঁড়ে ফেলতে নিয়েও ফেলে না।

কিছুক্ষণ পরই এম্বুলেন্স চলে আসে। সবাইকে হাসপাতালে পাঠানো হলেও ইমতিয়াজ নিজে যায় না। মৃত্তিকার সাথে এটা নিয়ে একদফা কথা কা°টাকা°টিও হয়ে যায়।

ধ°মক দিয়ে মৃত্তিকাকে বাসায় পাঠায় ইমতিয়াজ। মৃত্তিকার জেদ ইমতিয়াজের কাছে হার মানে, নিজের অনিচ্ছায় বাসায় এসেছে সে। দরজা খুলে ভিতরে এসেই কান্নায় ভে°ঙে পড়ে।

দেলোয়ারা রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ওকে দেখে। উনি কি আর বলবেন, উনার স্বামীর জন্যই তো আজ এ অবস্থা। একজন নারীর কাছে নিজের স্বামীর মৃ°ত্যু প্রার্থনা করা কতটা কঠিন তা দেলোয়ারা জানে।
______________________________________

দুশ্চিন্তা, অস্বস্তি সবকিছুর অবসান ঘটে ছোট্ট প্রাণের চিৎকারে। এই এক কান্না যা শুনে মানুষ খুশি হয়। আহনাফ মনের অজান্তে হেসে উঠে।

একদম সুস্থ একটা সন্তান পৃথিবীতে এসেছে, আহনাফের সাদাব এসেছে। আনুষ্ঠানিক ভাবটা শেষ হয়, জাহাঙ্গীর সাহেব নাতির কানে আযান দেন। এরপর তাকে সারাহ্-র কোলে দেয়া হয়।

তানজিম হাসপাতালে এসেছে, সে মৃত্তিকার বাসায় হওয়া ঘটনা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র কিছু জানে না। সামিহার কল পেয়ে এসে এসেছে।

সামিহা তানজিমকে দেখেই দৌড়ে এসে বলল,
“আমি খালামনি হয়ে গেছি, ছেলেবাবু হয়েছে।”

তানজিম হেসে বলল,
“বেচারা বেবি খালাম্মার য°ন্ত্র°ণায় শেষ হবে।”

সামিহা গাল ফুলিয়ে তাকায়। আহনাফকে দেখে তানজিম বলে,
“কনগ্রেচুলেশন ভাইয়া।”

আহনাফ হাসে। বলে,
“থ্যাংকস। আমি একটু আসছি।”

আহনাফ অন্যদিকে চলে যায়। সামিহা আর তানজিম এটা সেটা নিয়ে কথা বলতে থাকে। এরমধ্যে নার্গিস পারভিন এসে সরাসরি তানজিমকে প্রশ্ন করে,
“তুমি শাফিনের ভাগ্নে না?”

তানজিমের হাসিমুখটা চুপসে যায়। সামিহার দিকে একপলক তাকিয়ে হালকা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,
“জি, আন্টি।”

সামিহা বুঝতে পারে মায়ের দৃষ্টি, উনি কিছুটা ঘৃ°ণার চোখে তানজিমকে দেখে। সামিহা বলে,
“আম্মু, ও আমার ফ্রেন্ড।”

নার্গিস পারভিন সামিহার হাত ধরে নিজের কাছে নিয়ে এসে বলল,
“এমন ফ্রেন্ড থাকার চেয়ে একা থাকা ভালো।”

সামিহাকে নিয়ে অন্যদিকে চলে যায় নার্গিস পারভিন। সামিহা ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তানজিমকে দেখে মায়ের সাথে সাথে যেতে থাকে।

তানজিম কষ্ট পায়। বুঝতে পারে এ অনুভূতি নিজের অপমানের জন্য না, সামিহার দূরে যাওয়ার জন্য। নিজেকে সংযত রাখে সে। তারপর ধীরেসুস্থে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যায়।

এদিকে সারাহ্-র কেবিনের সামনে গিয়ে উঁকি দেয় আহনাফ। সারাহ্ ওকে দেখে বলে,
“সাদাবের আব্বু কি তাকে দেখবে না?”

“সাদাবের আব্বুর সাইদা চাই।”
কথাটা বলে আহনাফ ভিতরে আসে।

সারাহ্ মুচকি হাসে। আহনাফ চেয়ারে না বসে সারাহ্-কে ঠেলেঠুলে কোনোমতে বেডের মধ্যেই জায়গা করে নেয়। সাদাব পৃথিবীতে নিজের প্রথম খাবার খেয়ে মায়ের কোল দখল করে ঘুমাচ্ছে।

কিছুক্ষণ ছেলেকে দেখে আহনাফ একহাতে সারাহ্-কে আগলে ধরে কপালে চুম্বন করে। তারপর বলল,
“আজকে যতবার আমাকে আহনাফ আহনাফ বলে ডেকেছো, আমি কি তার প্রতি°শো°ধ নিবো না?”

“কিভাবে নিবেন? আপনি তো এখন আর রাগ করেন না? আমার উপর রাগ মিটান না।”

সারাহ্-র দিকে তাকায় আহনাফ। সারাহ্ চোখ নামিয়ে নেয়। আহনাফ জানে ওর কথার মানে, সারাহ্-র লজ্জায় সে নিজের জানাকে আরো পাকাপোক্ত করে।

নিচু হয়ে সারাহ্-র গলায় মুখ গুঁজে দেয়। শক্ত ভারি ওষ্ঠের স্পর্শ পায় সারাহ্। কাঁপা কন্ঠে বলে,
“ছেলেটাকে একটু শান্তি দেন।”

আহনাফ ফিসফিস করে বলল,
“আমার রাগ হচ্ছে, ঐশী।”

আহনাফের গরম নিশ্বাস অনুভব করে সারাহ্ চোখ বন্ধ করে ফেলে, সমস্ত দেহ তার স্থির হয়ে গেছে। তার মনে হয় এক অদ্ভুত অন্ধকারে আছে সে, অদ্ভুত শান্তি পাচ্ছে। আহনাফ ভালোবাসি না বলেও যে প্রচন্ড ভালোবাসে।
______________________________________

সন্ধ্যা সাতটা বেজেছে, হাসপাতাল থেকে নিজের প্রাথমিক চিকিৎসাটুকু সেরে নিয়েছে ইমতিয়াজ। গু°লিটা বের হয়ে যাওয়ায় র°ক্ত°ক্ষরণ হলেও ভয়াবহ অবস্থা হয়নি।

গালিবের অবস্থা বেশি খারাপ হওয়ায় তাকে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে নেয়া হয়েছে। নাহিদ মোটামুটি ভালো আছে, গু°লি বের হওয়ার পরই সে ফোন যোগে একটা টিমকে শাফিনের পিছু ধরার অর্ডার দিয়ে দিয়েছে।

ইমতিয়াজ নিজেও শরীফের সাথে যোগাযোগ করে শাফিনের পিছু নিয়েছে। শরীফ জানিয়েছে শাফিন খুলনার পথেই যাচ্ছে এবং রিজভি তার সাথেই আছে। খুব সম্ভবত ওরা জমিদার বাড়িতেই যাবে।

আজকে সকালে নাহিদের কাছ থেকে শাফিনের বিজনেসের কাগজপত্র রিজভি নিয়ে নেয়ার কারণ ইমতিয়াজ এখন ভালোই বুঝতে পারছে।

এদিকে মৃত্তিকা চিন্তায় চিন্তায় পাগলপ্রায় হয়ে আছে। একবার ভাবছে সে ইমতিয়াজকে খুঁজতে যাবে, আরেকবার ভাবছে বাসায় দেলোয়ারাকে একা রেখে যাওয়াটা কি ঠিক হবে কিনা।

ইমতিয়াজকে কল করেও উপায় হয় না। ফোন বাজলেও রিসিভ করছে না। অবশেষে সৌভাগ্য হলো, ইমতিয়াজ কলব্যাক করে।

“ইমতিয়াজ, কোথায় আছে? কোথায় আছেন আপনি? ঠিক আছেন? ডাক্তার দেখিয়েছেন? হাসপাতালে গিয়েছিলেন?”
একনাগাড়ে ছটফট করে প্রশ্ন করছে মৃত্তিকা।

ইমতিয়াজের শান্ত জবাব,
“আমি ঠিক আছি, একটু দূরে যাচ্ছি। আশা রাখতে পারো কালকের মধ্যেই ফিরে আসবো।”

“কোথায় যাচ্ছেন? শাফিনের খোঁজে যাচ্ছেন আপনি, তাই না? প্লিজ ফিরে আসুন।”

মৃত্তিকা কান্না করে দেয়। আজ আবারো সে অসহায় হয়ে গেছে।

“আমি যদি ফিরে না-ও আসি, তবুও তুমি নিজের খেয়াল রেখো। আমাদের বেবির খেয়াল রেখো।”

মৃত্তিকা অবাক হয়।
“এভাবে কেন বলছেন?”

“হতে পারে শেষবারের মতো আমার সাথে কথা বলছো, হয়তো আজ রাতেই আমি চলে যাবো ওই ফেরারির কাছে। আর এই কন্ঠস্বরটা আমাকে শেষবারের মতো ডাকছে..”

ইমতিয়াজের কথার মাঝেই মৃত্তিকা কান্নাভরা কন্ঠে বলে,
“ইমতিয়াজ?”

ইমতিয়াজ চুপ, মৃত্তিকাও চুপ। দুজনের ওষ্ঠোধর কাঁপছে, কণ্ঠনালি বারবার ধ্বনি পাঠালেও তা কেউ উচ্চারণ করছে না। হঠাৎ করে কলটা কে°টে যায়।

কান থেকে ফোনটা সরিয়ে মৃত্তিকা নিজে নিজেই ভাবে,
“তাহমিনাকে এতোই ভালোবাসেন যে তার কাছে যাবার জন্য এতো তাড়া আপনার। আমাকে একটু ভালোবাসলে কি হতো?”

ইমতিয়াজ ফোনের স্ক্রিনে মৃত্তিকার ছবিটা দেখে সিটে হেলান দেয়। আকাশে নিভুনিভু তারার দিকে তাকিয়ে বলে,
“শাফিনকে না মা°রলে সে তোমাকে মে°রে ফেলবে মৃত্তিকা। ভুল বুঝো না আমাকে, আর কাউকে আমি হারাতে পারবো না।”

ইমতিয়াজ চোখ বন্ধ করে। মৃত্তিকার লাজুক মুখখানা ভেসে উঠে, সেই হাসি যেন তার একদম সামনে। আবারো তার কাছে আসবে এক আবেদনময়ী হয়ে, আবারো চোখের ভাষায় বলবে, ‘আমাকে পাগল করে দাও’।
______________________________________

মধ্যরাতে খুলনা পৌঁছায় ইমতিয়াজ। বাস থেকে নেমে সিএনজি করে এসে পৌঁছায় জমিদার বাড়িতে৷

বাড়ির আশপাশটা শান্ত, নিরব। গা ছমছমে রহস্যময়তা ভেদ করে ইমতিয়াজ এগিয়ে চলে। বাড়ির পেছনদিকের দরজার কাছে গিয়ে সে কারো কথা বলার শব্দ শুনতে পায়। আবার সাথে দা-ব°টির টুংটাং শব্দ।

“আমার পি°স্তল কোথায়? এগুলো দিয়ে আমি কি করবো?”

কন্ঠটা শাফিনের। ইমতিয়াজ দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকে।

এবারে রিজভির কন্ঠ পাওয়া যায়।
“পি°স্তলের গু°লি শেষ। তাছাড়া তোমাকে পি°স্তল দেয়া হবে না। তুমি বহু কুকীর্তি করেছো, আমি তোমাকে শুধুমাত্র বিজনেসের জন্যই বাঁচিয়েছি। এছাড়া তোমার সাথে আমার কোনো বোঝাপড়া নেই। (একটু থেমে) শরীফের থেকে বাঁচার জন্য আপাতত এই হাতি°য়ারই ব্যবহার করতে হবে।”

কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে শাফিন বলে,
“তবে কি এই বোঝাপড়ার পর আমাকে মে°রে দিবে?”

রিজভি হাসে। বলল,
“তোমার মতো কৃ°তঘ্ন আমি নই। প্রাণে বেঁচে যাবে।”

কিছুক্ষণের জন্য আবারো নিরবতা বিরাজ করে। তারপর শাফিন বলে,
“ঠিক আছে, আমি রাজি। এগুলো এখানে না রেখে অন্দরমহলে রাখো।”

“আমাকে আদেশ করো না শাফিন। নিজে নিয়ে রেখে দাও। আমি অনেক বড় রিস্ক নিয়েছি।”

ইমতিয়াজ হাত দিয়ে দরজায় আলতো করে ধা°ক্কা দিয়ে বুঝতে পারে দরজা বন্ধ। ভিতরে আবারো টুংটাং শব্দ শুরু হয়েছে।

রিজভি বলছে,
“সব শান দেয়া হয়েছে। অনেক ধা°রালো।”

“এটার ধার কম লাগছে, আমি একটু ধার করে আনি।”

“যা করার করো, তবে আগে আমার খাবারের ব্যবস্থা করো।”

শাফিন দরজা খুলে, ইমতিয়াজ দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। শাফিন বের হতেই পেছন থেকে দুহাতে ওর গলা শক্ত করে পেঁ°চিয়ে ধরে ভিতরে ছিটকে ফেলে।

রিজভি চমকে উঠে দরজার দিকে তাকায়। ইমতিয়াজ ভিতরে এসে দেখে বড় বড় রাম°দা আর তার সাথে ত°লো°য়ার থরে থরে সাজানো। তার পাশে কয়েকটা লোহার পাইপ আর পিভিসি ভাঙাচোরা পাইপের সারি।

“তর°বারির যুদ্ধ লাগাবে নাকি?”
হাসতে হাসতে কথাটা বলে ইমতিয়াজ।

রিজভি কাঁপাকাঁপা হাতে তার পি°স্তলটা হাতে নিয়ে বলল,
“দেখো ইমতিয়াজ, বাঁচবে না তুমি। আমার লোকজন কিন্তু চলে আসবে।”

ইমতিয়াজ হাসে। বলে,
“গু°লিতে যে ছেলে ভ°য় পায় না, তাকে গু°লি ছাড়া খেলনাসম পি°স্তল দিয়ে ভ°য় দেখাও। হাউ ফানি।”

ইমতিয়াজ একটা লোহার পাইপ নিয়ে রিজভির হাতে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আ°ঘাত করে। খুব দ্রুত ঘটনা হয়ে যাওয়ায় রিজভি পালানোর সুযোগ পায় না। প্রচন্ড ব্য°থায় চিৎকার করে রিজভি পি°স্তল ফেলে দেয়।

ইমতিয়াজ পাইপটা ছুঁড়ে ফেলে শাফিনের পা নিশানা করে৷ নিশানা লক্ষ্যে গিয়ে পৌঁছায়। শাফিনের পা এখনো ঠিক হয়নি, ক্ষ°তও পুরোপুরি শুকায়। কেবল পঁচন বন্ধ হয়ে শুকাতে শুরু করেছে। এখন এতোবড় একটা আ°ঘাত পেয়ে সে মাটিতে পড়ে যায়, সাথে গো°ঙা°তে থাকে।

ইমতিয়াজ দ্রুত গতিতে ত°লো°য়ার হাতে তুলে নেয়। রিজভি এবারে পালাতে নিলে দৌড়ে গিয়ে ওর ডানহাতে এক কো°প বসায়, একবারই যথেষ্ট হয়েছে ওর হাতের কবজি আলাদা হতে।

রিজভির গগনবিদারী চিৎকার অবহেলা করে ইমতিয়াজ বলে,
“ত°লো°য়ারটা বেশি ধা°রা°লো করে ফেলেছো?”

শাফিন এবারে ভ°য় পেতে শুরু করে৷ তাহমিনাকে খু°নের সময় সে ভ°য় পায়নি, ভ°য় পায়নি একা বাসায় মৃত্তিকার উপর হা°মলা করতে, সে ভ°য় পায়নি ইমতিয়াজকে খু°নের চেষ্টা করতে। তবে আজ পাচ্ছে কেন?

ইমতিয়াজ যে আজ নেকড়ের রূপ ধারণ করেছে। নেকড়ে যেভাবে শি°কারের দিকে ধেয়ে আসে, ইমতিয়াজও খোলা তর°বারি হাতে এগিয়ে আসে। পিছনে চিৎকার করছে রিজভি। তার কা°টা হাত তারই সামনে পড়ে আছে।

শাফিন পায়ের জন্য উঠতেও পারছে না। তারউপর সে বামচোখে দেখে না, ওখানে একটা পট্টি বাঁধা আছে।

শাফিনে গড়িয়ে সরে গিয়ে ইমতিয়াজকে বলে,
“ইমতিয়াজ, তুমি আমাকে খু°ন করে জেলে যাবে, মৃত্তিকার কি হবে ভাবো তো? তোমার সন্তানের কি হবে?”

ইমতিয়াজ মাথা নাড়ে,
“আমি ভাবছি না ওসব নিয়ে।”

শাফিনের ডানহাত টেনে কভার খুলে ফেলে ইমতিয়াজ। ক্ষ°ত জায়গায় তলোয়ার ঢুকিয়ে দেয় সে। শাফিন চিৎকার করে বলে,
“ইমতিয়াজ, মে°রো না আমাকে।”

“ইমতিয়াজ ডাক শোনার খুব শখ হয়েছিল না তোমার?”
ত°লো°য়ারটা ঘুরাতে থাকে ইমতিয়াজ।

“হ্যাঁ হয়েছিল। তাহমিনার চিৎকার আমার ভালো লেগেছিল, তাই তো মৃত্তিকার থেকেও একই চিৎকার শুনতে চেয়েছিলাম।”

ইমতিয়াজ ত°লো°য়ার উঠিয়ে ছুঁড়ে ফেলে শাফিনের নাকেমুখে ঘু°ষি দিতে শুরু করে। শাফিনকে তুলে ওর মাথা নিয়ে দেয়ালের সাথে পর পর কয়েকবার আছড়ে ফেলে সে ক্ষান্ত হয়।

ইমতিয়াজ সরে আসে। এতো অত্যাচারে শাফিন আর চোখ খুলে তাকাতেও পারছে না। পুরোনো ব্য°থার সাথে নতুন করে আরো কিছু যুক্ত হয়েছে।

শাফিন মাটিতে বসে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে বলে,
“বাঁচতে দাও আমাকে।”

“আমার নিষ্পাপ সন্তানটাও এটা বলেছিল, আমার মিনা এটাই বলেছিল।”
ছন্নছাড়া ইমতিয়াজের এগোছালো জবাব।

এমনসময় বাইরে চারটা গু°লির শব্দ হয়। ইমতিয়াজ চমকে দরজা বন্ধ করতে গেলে শরীফ এসে ভিতরে ঢুকে। রিজভির দুজন লোককে মাত্রই গু°লি করে হ°ত্যা করেছে সে।

ভিতরের অবস্থা দেখে শরীফ থমকে যায়।
“এ কি করেছো, ইমতিয়াজ?”

ইমতিয়াজ আবারো গিয়ে ত°লো°য়ারটা তুলে বলল,
“শাফিনকে আমি নিজ হাতে মা°রবো। সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেও আবার পুরোনো সিদ্ধান্তে ফিরে যাচ্ছি।”

“এমন করো না..”

শরীফ কথার মাঝেই ইমতিয়াজ বলে,
“কেন? মৃত্তিকার কথা ভাবছেন? আমিও ওর কথাই ভাবছি, ওর কথা ভেবেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

রিজভি জ্ঞান হারাবে হারাবে ভাব। সে আর স্থির থাকতে পারছে না। চোখ তার নিভুনিভু, হাতের র°ক্তে সে মাখোমাখো হয়ে গেছে।

শরীফ তার কষ্ট আর বাড়ায় না। সোজা গু°লি করে তার বুকে, একটা গু°লিতেই সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।

ইমতিয়াজ একবার তাকায় রিজভির প্রাণহীন দেহের দিকে। বলে,
“এতো সহজভাবে শাফিন ম°রতে পারে না।”

“মৃ°ত্যুতে সহজ বলে কিছু নেই, মৃ°ত্যুর য°ন্ত্রণা কঠিনই হয়।”

ইমতিয়াজ শাফিনকে টে°নে তুলে। তড়িৎগতিতে ইমতিয়াজকে ধা°ক্কা দিয়ে ফেলে ওর হাতের তলোয়ার নিয়ে শাফিনের গলায় ঢুকিয়ে দেয় শরীফ।

গলার মাঝ বরাবর ঢুকে তা পেছন থেকে বেরিয়ে এসেছে। ফি°ন°কি দিয়ে র°ক্ত বেরিয়ে এসে শরীফকে ভিজিয়ে দেয়। তাৎক্ষণিক এমন ঘটনায় ইমতিয়াজ নিজেও হতবাক।

শরীফ ত°লো°য়ারটা ঘুরাতে শুরু করে। একবার ঘুরিয়ে একটা°নে বের করে নিয়ে আসে। শাফিন মাটিতে পড়ে যায়। কিছুক্ষণ শান্ত থেকে আবারো কেঁপে উঠলো, দুইপা একসাথে নড়ে উঠে, দুইহাত নড়তে নিয়ে থেমে যায়। সঙ্গে সঙ্গে র°ক্ত বেরিয়ে আসে গলার ছিদ্রপথে, নাকমুখ দিয়ে। র°ক্তের সাথে ‘কু’ ধরনের চিকন একটা শব্দ বের হয়।

শব্দের বেগ ধীরে ধীরে কমে, শাফিন হাত হয়। হাতপা ছেড়ে দিয়ে মাটিতে পড়ে থাকে। চোখ একটা তো চিরকালের মতো অন্ধ করেছিল আহনাফ, অন্যটা এখনো খোলা রয়েছে।

এতোদিনের ফে°ত°নার মৃ°ত্যু হয়েছে। অবশ্যই মৃ°ত্যু°য°ন্ত্রণা কঠিন, চরম কঠিন।

‘মৃ°ত্যু°য°ন্ত্রণা সত্যই আসবে। এটা হতে তোমরা অব্যাহতি চেয়ে এসেছ।’ (সুরা কাফ, আয়াত : ১৯)

চলবে……

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

অন্তিম পর্ব (শেষাংশ)

ইমতিয়াজ ও শরীফ দুজনকেই গ্রে°ফ°তার করেছে পিবিআই। যদিও গ্রে°ফ°তার কথাটা এখানে ভুল, ওরা নিজে থেকেই ধরা দিয়েছে।

ঢাকায় নিয়ে আসার পর মৃত্তিকা খোঁজ পায় ওদের। সারারাত পাগলের মতো ছটফট করছিল সে, বিশেষ করে ইমতিয়াজকে ফোনে না পেয়ে সে আরো চিন্তিত ছিল। দুপুরে খবরটা পেয়েই ছুটে এসেছে।

ইমতিয়াজ একটু দূর থেকে ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। দুহাতে হাত°কড়া লাগানো অবস্থায় একটা মানুষ কিভাবে হাসতে পারে? শরীফ পাশে নির্বিক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

আশেপাশে ওদেরকে ঘিরে রেখে সাংবাদিক আর টিভি ক্যামেরা, একের পর এক ছবি তুলছে আর ব্রেকিং নিউজ প্রকাশ করছে।

পাশের লা°শবাহী গাড়িতে শাফিন, রিজভিসহ তাদের লোকজনের দেহ। শাফিনের লা°শ যে দেখেছে সেই ভ°য় পেয়েছে।

ভীড় ঠেলে এগিয়ে যায় মৃত্তিকা। পুলিশ সদস্যদের বাধা কা°টিয়ে ইমতিয়াজের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

“আপনি না বলেছিলেন নিজের সন্তানকে খু°নির সন্তান হতে দিবেন না? তবে এটা কেন করলেন ইমতিয়াজ?”

ইমতিয়াজ ওর চোখে চোখ রাখে না। অন্যদিকে তাকিয়ে বেশ শান্তভাবে জবাব দেয়,
“তার মা তাকে ভালো রাখবে।”

মৃত্তিকার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। ঠিক যে কারণে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল, আজ ইমতিয়াজই তাই করে বসেছে।

শরীফের দিকে তাকিয়ে বলে,
“বাবা, আমার সাথে থাকতে তোমার কখনোই ইচ্ছা হয়নি?”

শরীফ উত্তর দেয় না। মৃত্তিকা অস্ফুটস্বরে বলল,
“বাবা?”

আবারো ইমতিয়াজের দিকে তাকায় সে। ইমতিয়াজ সামনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“চলে যাও এখান থেকে। সাংবাদিকদের তো°পে তুমি পড়ো না।”

“আমাকে ভালোবাসলে কি খুব অপ°রাধ হতো ইমতিয়াজ?”

ইমতিয়াজ তাকায় ওর দিকে, এবারে দুজনে চোখে চোখ রাখে। মৃত্তিকার লাল দুইচোখ দেখে ইমতিয়াজের কষ্টের পাল্লা ভারি হয়।

কিছু বলতে নিলে মৃত্তিকা ওকে ঝাপটে ধরে হাউমাউ করে কান্না করে দেয়। ইমতিয়াজ চমকে উঠে, আশেপাশের ক্যামেরায় ছবি তোলার গতি বাড়ে।

দুজন মহিলা কন্সটেবল কাছে আসতে নিলে ইমতিয়াজ বলে,
“প্লিজ, একটু সময় দিন।”

অনুরোধ রাখে, কিন্তু মৃত্তিকাকে সরানো যায় না। ওর চোখের জলে ইমতিয়াজের শার্টের বুকের ডানপাশের অংশটা ভিজে গেছে, বারে বারে হিঁ°চকি দিচ্ছে মৃত্তিকা। ইমতিয়াজ চুপ করে আছে, শান্ত তার দৃষ্টি।

কাঁদতে কাঁদতে একসময় ক্লান্ত মৃত্তিকা জ্ঞান হারায়। ইমতিয়াজের দুহাত সামনের দিকে এনে আটকে রাখা ছিল, সে দুহাত একসাথে মৃত্তিকার মাথা উপর দিয়ে নিয়ে ওর পিঠের দিকে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলল,
“মৃত্তিকা আমার, মৃত্তিকা।”

ওই দুজন কন্সটেবল আসলে ইমতিয়াজ অসহায় কন্ঠে বলল,
“ও প্রেগন্যান্ট, প্লিজ ওকে ডাক্তারের কাছে নেয়ার ব্যবস্থা করুন। প্লিজ।”

আবারো সে মৃত্তিকার দিকে তাকায়। ওর শরীরের সাথে মিশে আছে মেয়েটা। ইমতিয়াজের গালের সাথে ওর কপাল লেগে আছে।

ইমতিয়াজ ওর কপালে চুম্বন করে, একটু নিচু হয়ে ওর ওষ্ঠপুটেও চুম্বন করে। নিজের গাল ওর ঠোঁটে ছুঁইয়ে বলে,
“মৃত্তিকা, কেন এতো করে চাইছো আমাকে? নিজেকে কেন শেষ করছো?”

জোরপূর্বক ইমতিয়াজের থেকে মৃত্তিকাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। ইমতিয়াজের চেহারায় অসহায়ত্ব প্রকাশ পাচ্ছে। এই লোকগুলোর মধ্যে আবারো যদি কোনো পশুর উদয় হয়, কিভাবে মৃত্তিকাকে রক্ষা করবে ইমতিয়াজ?

ভীড়ের মাঝে মৃত্তিকার সাথে একটা পরিচিত চেহারা দেখে ইমতিয়াজ। মানুষটা তানজিম। মৃত্তিকাকে নিয়ে সিএনজিতে উঠে হাত নাড়ে সে।

“অপ°রাধ হতো বলেই হয়তো তুমি আমি এক হইনি।”
ইমতিয়াজের বুক চি°ড়ে দীর্ঘশ্বাসের সাথে কথা বের হয়।
______________________________________

আব্বাস সাহেব ঢাকায় এসেছেন। সাথে এনেছেন নাতির জন্য অনেক রকমের খেলনা। আহনাফ তো একটা দৌড়াদৌড়ির মধ্যে আছে। হাসপাতালের এ কাগজ, ও কাগজ নিয়ে তাড়াহুড়ো করছে সে।

টাকা জমা দিতে গিয়ে পাশে চলতে থাকা টিভিতে সে ইমতিয়াজ-মৃত্তিকাকে দেখে। সাথে চলছে রঙঢঙ মেশানো এক হেডলাইন।

টাকা জমা দিয়ে রিসিট জাহাঙ্গীর সাহেবের হাতে দিয়েই সে ছুটেছে থানার উদ্দেশ্যে৷ কাল থেকে ওর অগোচরে এতো ঘটনা ঘটে গেছে, অথচ সে টেরই পেল না।

থানায় সে কারো সাথে কথা বলতে পারে না। তাই তানজিমের সাথে যোগাযোগ করে মৃত্তিকাকে দেখতে ক্লিনিকে আসে।

মৃত্তিকার জ্ঞান ফিরেছে, তবে চুপচাপ বসে আছে সে। ইমতিয়াজের এমন কান্ড সে এখনো মেনে নিতে পারছে না।

তানজিম আহনাফকে বলে,
“সকালে আমি খবরটা পেয়েছি। শাফিন মা°রা গেছে আর রিজভিও। শরীফ আংকেল বলছে উনিই মে°রেছেন, তবে সহযোগী সন্দেহে ইমতিয়াজ ভাইয়াকে গ্রে°ফ°তার করেছে।”

আহনাফ চুপ করে যায়। মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে দেখে অনুভূতিহীন একটা মানবী নিরবে তাকিয়ে আছে সাদা টাইলসের মেঝেতে।
______________________________________

একদিন, দুইদিন করে সপ্তাহ পার হয়। আজ সাদাবের আকিকা। কুমিল্লায় আহনাফের বাসায় বেশ রমরমা আয়োজন। একমাত্র ছেলের আকিকা উপলক্ষ্যে হাঁটের বড়বড় দুই খাসি কিনে এনেছে আহনাফ।

সামিহা তো সারাদিন সাদাবকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে আছে। সাদাবকে খাওয়ানো ছাড়া সারাহ্-র আর কোনো কাজ নেই, বাকি সব সামিহাই দেখে।

রান্নার দিকটা দেখে আহনাফ রুমে আসে। সারাহ্ শাড়ি পড়ছে। আঁচল বেশি রাখায় তা ফ্লোর স্পর্শ করছে।

আহনাফ কাছে এসে আঁচলটা তুলে হাতে দিয়ে বলল,
“আঁচল তো মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে।”

“আঁচল ধরার মানুষ থাকলে মাঝে মাঝে লুটোপুটি খাওয়া ভালো।”

“কে ধরবে? আমি? অসম্ভব, আমি কোনো নারীর আঁচল ধরতে রাজি নই।”

সারাহ্ হেসে দেয়। গলায় নেকলেস পড়তে শুরু করলে আহনাফ বলে,
“মনে হচ্ছে বিয়ে করবে। অবশ্য আমি রাজি, বাসর করার ফিলিংসও এখনো আছে। প্রথম বাসর তো করা হয়নি, এখন করতেই পারি।”

সারাহ্ ফিরে দাঁড়িয়ে বলে,
“এই আপনার লজ্জা নেই, সভ্য হবেন না কোনোদিন?”

আহনাফ হেসে ওর কাছে এসে বলল,
“এভাবে কথা বলো না, আমার রাগ হয়।”

আহনাফ নিচু হতে নিলে সারাহ্ ওকে বাধা দিয়ে জড়িয়ে ধরে। আহনাফও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“সাদাবকে পেয়ে সাইদার পাপাকে ভুললে চলবে না। আমার কিন্তু সাইদাও চাই।”

সারাহ্ ফিসফিসিয়ে উঠে,
“তবে আরো রাগ করুন, বারেবারে রাগ করতে থাকুন।”

হঠাৎ করেই বাইরে শোরগোল শুরু হয়। দুজনে চমকে দুদিকে সরে যায়। আহনাফ দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এসে দেখে, তানজিমকে আসতে দেখেই নার্গিস পারভিন রেগে গেছেন।

“মা, আমি ওকে ইনভাইট করেছি। তানজিম এসো।”

আহনাফের কথায় নার্গিস পারভিন শান্ত হয়ে যায়। চুপ করে চলে যায় নিজের কাজে। সামিহা সাদাবকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখ দিয়ে টুপটুপ করে জল পড়ছে।

আহনাফ একবার সামিহার দিকে তাকিয়ে আবারো তাকায় তানজিমের দিকে। তানজিম যে জ°ঘ°ন্যরকম অপমানিত হয়েছে তা বোঝাই যাচ্ছে।

“তানজিম, সাদাবকে আজও দেখবে না?”

আহনাফের কথায় তানজিম নির্জীব হয়ে তাকিয়ে বলল,
“থাক ভাইয়া, আজ না। এই খু°নি র°ক্ত ওকে স্পর্শ না করলেই বোধহয় ভালো হবে।”

তানজিম বের হয়ে যায়। সামিহার ইচ্ছে করছিলো ওকে আটকাতে, কিন্তু সে আটকায় না। সে দ্রুত পায়ে সারাহ্-র কোলে সাদাবকে দিয়ে ভিতরে চলে যায়।
______________________________________

মৃত্তিকা নিজের রুমে বসে আছে। এই কয়েকদিন তার খাওয়া দাওয়ার ঠিক নেই, আর না নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি কোনো খেয়াল আছে।

রাইদ এক মাকে হারিয়ে আরেকটা মা পেয়েছিল আর সেও এখন তার থেকে দূরে থাকে। কোনোরকমে ওকে খাইয়ে দিয়ে মৃত্তিকা আবারো দূরে বসে থাকে।

দেলোয়ারা ওর এমন অবস্থা খেয়াল করছে। খাবার নিয়ে মাঝেমধ্যেই জোর করে খাইয়ে দেয়। এছাড়া কোনো উপায় নেই, ওকে শত বললেও ও নিজের থেকে খাবে না।

সময় মৃত্তিকার এভাবেই কাটে, বেশ অনেকদিন পার হয়। সাড়ে পাঁচমাসের অন্তঃসত্ত্বা এখন মৃত্তিকা। ওর মধ্যে সময়ের প্রতিচ্ছবি ভালোই ফুটেছে।

কোর্ট থেকে আজ রায় দেয়ার কথা। সবাই সেটা নিয়েই ব্যস্ত, শুধু ব্যস্ততা নেই মৃত্তিকার মধ্যে। তার ইমতিয়াজ যে তাকে ভালোবাসে না। সে টিভি দেখেনি, খোঁজও পায়নি যে ইমতিয়াজ ছাড়া পেয়েছে।

শরীফের জন্য আবারো শুনানি হবে আর ইমতিয়াজ খা°লাশ পেয়ে গেছে। বিষয়টা এমন হয়েছিল যে নাহিদের টিম সেখানে গিয়ে দুজনকে একসাথে পেলেও শরীফকেই মূলত শাফিনকে মা°রতে দেখেছে। তাছাড়া যেহেতু এর আগে নাহিদের সাথে ইমতিয়াজের যোগাযোগ ছিল, তাই পিবিআইয়ের অনেকেই তার পক্ষে কথা বলেছে। সাক্ষী মজবুত হওয়ায় আর যুক্তিযুক্ত প্রমাণ না পাওয়ায় সে ছাড়া পেয়ে যায়।

আজ আবার এটাও জানিয়েছে আগামীকাল মমতাজ বেগমের ফাঁ°সি হবে। শারমিলির খু°ন ও বাকি তিন খু°নের সাথে সরাসরি যুক্ত থাকায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সুরভির জন্য সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত, সাত বছরের কারাদণ্ড হয়েছে।

সব আনুষ্ঠানিকতা সেরে সন্ধ্যায় ইমতিয়াজ বাসায় পৌঁছায়। দেলোয়ারা দরজা খুলে ওকে দেখে মলিন মুখে হাসে। ইমতিয়াজ উনাকে সালাম দিয়ে বাসায় প্রবেশ করে।

“মৃত্তিকা কোথায়?”

ইমতিয়াজের প্রশ্নে দেলোয়ারা চিন্তিত হয়ে জবাব দেয়,
“সে রুমে, তুমি যাও।”

ইমতিয়াজ ধীর পায়ে রুমে এসে দরজা খুলে। হালকা শব্দ হয়। বিছানায় হেলান দিয়ে মৃত্তিকা বসে আছে। ওকে দেখে হা করে তাকিয়ে আছে। ইমতিয়াজও ওকে দেখে। চোখের নিচে কালি পড়েছে, গালমুখ ফুলে আছে। সাহসী, শান্ত মেয়েটার মন যে বড় ভীতু আর অশান্ত হয়ে উঠেছে।

ইমতিয়াজ দরজা লাগিয়ে ওর সামনে এসে বসে। মৃত্তিকা বলে,
“চলে যাওয়ার জন্য বারবার কেন আসেন?”

“চলে যেতে আমি আসিনি, মৃত্তিকা।”

মৃত্তিকা এগিয়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে। হঠাৎ এমন ধা°ক্কায় ইমতিয়াজ বিছানায় শুয়ে পড়ে। মৃত্তিকা ছাড়ে না, দুহাতে জোর করে ধরে রেখেছে। ইমতিয়াজ ওকে খুব আলতো করে ধরে রাখে৷ থেমে থেমে ফুঁপিয়ে উঠছে মৃত্তিকা।

বামহাতটা মেলে দিয়ে ইমতিয়াজ ওর মাথাটা হাতের উপর রেখে বলল,
“শান্ত হও, আমিই এসেছি।”

মৃত্তিকা ওর গালে হাত দেয়। একটা ঢোক গিলে বলল,
“বাবা কবে আসবে?”

ইমতিয়াজ ওর গালের সাথে নিজের গাল ঘ°ষে বলল,
“আসবে, খুব তাড়াতাড়ি আসবে।”

“মি°থ্যা বলছেন, তাই না? বাবাকে ওরা ছাড়বে না।”

ইমতিয়াজ চেয়ে থাকে। ওর দৃষ্টিতেই মৃত্তিকা বুঝে যায় তার বাবা আসবে না। ইমতিয়াজ চোখ সরিয়ে উঠে যেতে নিলে মৃত্তিকা ওকে কাছে টে°নে আনে।

“চলে যেতে আসেননি তো চলে কেন যাচ্ছেন?”
______________________________________

পরদিন সকালে, মমতাজ বেগমের ফাঁ°সি আজ কার্যকর হয়েছে। উনার লা°শ গ্রহণ করতে এসেছে মৃত্তিকা, ইমতিয়াজ, তানজিম। লুৎফর রহমান আসেননি, উনি আসবেন না।

মমতাজ বেগমের সাথে শেষবার দেখায় শুধু বলেছিলেন,
“শারমিলির প্রতি আমার ভালোবাসা দেখে হিং°সা করেছো, অথচ তোমাকে কত ভালোবেসেছিলাম তা কখনো বুঝোনি। হিং°সা তোমাকে অন্ধ করে দিয়েছে মমতা। তুমি আমাকে বুঝতেই চাওনি।”

লা°শ বের করে আনা হলো। তানজিম সরে যায়, মায়ের লা°শ দেখার ক্ষমতা তার নেই। মৃত্তিকা কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে সে চিৎকার করে কান্না করে দেয়। বড্ড বেশি ভালোবাসতো সে তার বড়মণিকে। বড়মণির এই নি°কৃষ্ট কর্ম আজও তার বিশ্বাসের বাইরে।

ইমতিয়াজ ওকে জড়িয়ে ধরে, তার কান্না থামে না। ইমতিয়াজের বুকে মাথা রেখে ক্রমাগত কাঁদছে মৃত্তিকা।

তানজিম একটু দূরে থম মে°রে দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে তারই মায়ের মৃ°তদেহ। চোখের পানি আজ একফোঁটাও গড়িয়ে পড়ছে না। থেমে থেমে সে ঢোক গিলছে, তার শরীর কেঁপে উঠছে।
______________________________________

চারমাস পর,
“তানজিম যেন এই বাসায় আর না আসে। তোমার আশেপাশেও ওকে আমি দেখতে চাই না।”

সামিহা চুপ করে আছে। আজ ভার্সিটি থেকে ফেরার সময় তানজিম ওকে পৌঁছে দিয়ে গেছে। আর তখনই ওদেরকে একসাথে দেখে নার্গিস পারভিন।

“আম্মু, সবাই একরকম হয় না। তানজিমের মামা আর মা খারাপ ছিল বলে, সেও খারাপ হবে- এটা কেমন যুক্তি?”

নার্গিস পারভিন কিছু না বলে চলে যায়। সামিহা মায়ের দিকে চলে যাওয়া দেখে। তানজিমের জন্য ওর যে অনুভূতিটা আছে তা সে না তানজিমকে বলতে পারছে আর না নিজের মাকে। বলছে না বলে কি কেউ বুঝতেও পারছে না?

সামিহা রুমে এসে সারাহ্-কে কল দেয়। সাদাবকে নিয়ের সমস্তদিন সারাহ্-র ব্যস্ততা। এখনো এই কাজই করছে। সারাদিনে সাদাবের নোংরা করা কাপড় ধুয়ে বারান্দায় ছড়িয়ে দিতে ব্যস্ত সে।

সামিহার নাম্বার দেখে রিসিভ করে,
“হ্যাঁ সামিহা, বল।”

সামিহার কন্ঠ কাঁপছে। ভা°ঙা ভা°ঙা গলায় বলে,
“আপু, তানজিমকে আমি ছাড়তে পারবো না।”

সারাহ্ নিজের কাজকর্ম থামিয়ে দেয়। কপাল কুঁচকে বলে,
“হঠাৎ এই কথা?”
“আম্মু ওকে পছন্দ করে না।”

সারাহ্ চুপ করে থাকে। আহনাফ মাত্রই কলেজ থেকে ফিরেছে। ফ্রেশ হয়ে ছেলের সঙ্গে খেলায় ব্যস্ত সে। সারাহ্ সেদিকে তাকিয়ে “রাখছি” বলে কল কে°টে দেয়।

সারাহ্ মলিন মুখ করে রুমে আসে। ফোন পাশে রেখে চুপচাপ বসে থাকে।

“ঐশী? কি হয়েছে?”

সারাহ্ ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
“আম্মু আবারো তানজিমের বিষয়টা নিয়ে সামিহার সাথে বাড়াবাড়ি করেছে।”

আহনাফ শোয়া থেকে উঠে সোজা হয়ে বসে বলল,
“সামিহা আর তানজিমের সম্পর্ক গভীর হয়েছে, ঐশী। চাইলেই ওদের আলাদা করতে পারবে না।”

“আমি চাইছিও না, কিন্তু আম্মু বারবার কেন শাফিনের কথা বলে তানজিমকে অপমান করছে?”

“শাফিনের সাথে উনার স্মৃতি খারাপ। এরকমটা হওয়া স্বাভাবিক। তবে উনি বুঝদার মানুষ, আমি বুঝিয়ে বলবো সবটা।”

সারাহ্ আলতো করে মাথা নাড়ে। কিছুক্ষণ আহনাফের দিকে তাকিয়ে থেকে ওকে তাড়া দিয়ে বলল,
“খেয়ে নিবেন চলুন।”
______________________________________

আগামীকাল মৃত্তিকার ডেলিভারির তারিখ দিয়েছে আর আজ শরীফের চূড়ান্ত রায় হবে। সকলের চোখে এখন শরীফ খু°নি, শরীফও নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চায়নি।

আজ বাবার সাথে দেখা করতে এসেছে মৃত্তিকা। বাবার কাছে গিয়ে নিরবে দাঁড়ায় মৃত্তিকা। কিছুক্ষণ পরই শরীফকে আদালতে নিয়ে যাওয়া হবে।

লোহার বে°ড়াজালে আঙ্গুল দিয়ে বাবার হাতে স্পর্শ করে মৃত্তিকা।

“বাবা, তোমার মেয়েটাকে ক্ষমা করে দিও। কোনোদিন তোমাকে বুঝিনি আমি।”

সবাই ধরে নিয়েছে শরীফের ফাঁ°সি হবে। সে তো খু°ন কম করেনি, অনেকগুলো মানুষকে সে মে°রেছে। কেন মে°রেছে তা তো বহু কথা, কিন্তু মে°রেছে সেটাই আসল।

শরীফ মেয়ের আঙ্গুলে চুমো দেয়। বলে,
“নাতি-নাতনিকে কোলে নেয়ার সৌভাগ্য এই অভাগার হয়নি রে মা। তোমার জীবনের সুখ শান্তি আমি কে°ড়ে নিয়েছি, ক্ষমা তো তুমি আমাকে করবে।”

“বাবা..”

মৃত্তিকা আর কিছু বলতে পারে না। অনবরত কাঁদতে থাকে। ইমতিয়াজ একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল, সে এগিয়ে আসে।

শরীফ মৃত্তিকাকে নিয়ে যেতে ইশারা করে। ইমতিয়াজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, কি করবে সে? উপায় কি আছে এছাড়া?

হঠাৎ মৃত্তিকা ব্য°থায় চিৎকার করে উঠে। হয়তো সময় হয়ে গেছে। ওকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে।

“ইমতিয়াজ আমাকে ছেড়ে দিয়ে যাবেন না, থাকেন আমার সাথে।”

“কোথাও যাচ্ছি না আমি, আছি তোমার পাশে।”

যাচ্ছি না বলেও লেবাররুমে ওকে রেখেই বাইরে আসতে হয় ইমতিয়াজের। ওর চিৎকার সহ্য করার ক্ষমতা ইমতিয়াজের নেই।

পৃথিবীতে নতুন একটা মুখ আসলো। কাঁদতে কাঁদতে প্রচুর আগ্রহ নিয়ে দেখতে লাগলো পৃথিবীর আলো। কন্যা সন্তান এসেছে, দুজনের এতোদিনের অপেক্ষার সমাপ্তি হয়েছে।

ইমতিয়াজ নিজেই মেয়ের কানে আযান দেয়। মেয়ের কপালে চুমো খায়। মেয়েকে কোলে নিয়ে মৃত্তিকার প্রথম কথা,
“বাবার সাথে ওর দেখা করাতে পারবেন? বাবা ওকে দেখবে।”

মৃত্তিকা সঙ্গে সঙ্গেই কান্না করে দেয়। ইমতিয়াজ ঘড়িতে দেখে সময় দেখে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এখন এমন সদ্য জন্ম নেয়া নবজাতককে নিয়ে বের হওয়াও মুসকিল।

তবুও ইমতিয়াজ ঝুঁ°কি নেয়। মৃত্তিকাকে রেখে যেতে চাইলেও সে রাজি হয় না। ইমতিয়াজের সাথে যাওয়ার জন্য জে°দ ধরে। ওর জে°দের কাছে ইমতিয়াজ বরাবরের মতো এবারেও পরাজিত হয়।

ফোনযোগে জানতে পারে শরীফের ফাঁ°সির রায় হয়নি, যাবজ্জীবন কা°রা°দণ্ড হয়েছে। বিশেষ বিবেচনায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

জেলে এসে শরীফের সাথে দেখা করার সুযোগ হয়। তবে শরীফ নাতনিকে কোলে নিতে পারেনা। দূর থেকে চেয়ে দেখে। এইতো ওই মিউকো, রিপার আদরের মৃত্তিকা।

বিদায়ের সময় শরীফের বলা কথাটায় মৃত্তিকার কান্নার রেশ আবারো আসে,
“আমি তোমার মামের কাছে যেতে চাইছিলাম মিউকো, ক্ষমা চাইতাম তার কাছে। তোমার মাম কি এখনো রেগে আছে আমার উপর? তুমি বলে দিও যেন এই অধমের উপর রেগে না থাকে।”

শরীফের কন্ঠ শুনে মনে হচ্ছে ছোট্ট মৃত্তিকার সাথে কথা বলছে সে। দুর্বল মৃত্তিকা ইমতিয়াজের শরীরের উপর ঢলে পড়ে৷ ঘনঘন নিশ্বাস নিচ্ছে সে।
______________________________________

বিরামহীন সময়ে বিরাম পড়বে না, এটা তো সর্বদাই সত্য। এবারেও তাই হলো, তিনবছর পেরিয়ে গেল।

অবশেষে আহনাফের এতোদিনের চেষ্টায় সামিহা-তানজিমের বিয়েতে রাজি হয়েছে নার্গিস পারভিন। একটা অসম্ভবকে সে সম্ভব করেছে।

পুরো বাড়িতে রমরমা পরিবেশ৷ আত্নীয়স্বজন, প্রতিবেশীতে একদম হইহই করছে। এরমধ্যে সাদাবকে সামলে রাখা বেশ কষ্টের হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আজও তাকে সামিহাই শান্ত করে নিজের পাশে বসিয়ে রেখেছে। পার্লার থেকে সাজগোজ করে এসে সে এখন অপেক্ষা করছে তার তানজিমের জন্য।

সারাহ্ তো সাইদাকে নিয়ে ভারি ব্যস্ত, মেয়েটা কিছুতেই ঘুমাচ্ছে না। বয়স কত হলো মেয়ের? মাত্রই সাতমাসে পড়েছে।

বর্তমানে দেশে থাকায়, জাহাঙ্গীর সাহেবের দাওয়াত রক্ষা করতে ওদের বাসায় এসেছে আফরোজা-জুহাইব, সাথে ওদের ছেলে জাবের আবরারও এসেছে।

বাবার মতো টার্কিশ চেহারা হয়েছে আবরারের। সাদাবের সাথে বনিবনাও ভালো। দুজনে বেশ আনন্দে খেলতে শুরু করে।

বরপক্ষের লোক হিসেবে লোকজন খুবই কম। তানজিমের বাবা লুৎফর রহমান, ওর চাচা আর ইমতিয়াজ, মৃত্তিকা এসেছে।

ইমতিয়াজ, মৃত্তিকার দুই মেয়ে আর রাইদও এসেছে। বড়মেয়ে সৈয়দ মেহরিবা মেহজাবিন আর ছোট মেয়ে সৈয়দ বারাকাহ্ মেহজাবিন, বারাকাহ্ এবারে একমাসে পড়লো।

সাদাব, আবরারের প্রায় সমবয়সী হওয়ায় মেহরিবা ও রাইদ ওদের সাথে মিশে যায়।

কোনোরকম ঝা°মেলা ছাড়াই নিরিবিলিতে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়ে যায়। সামিহা ঘোমটার আড়াল থেকে তানজিমকে ঠিকই দেখে।

তানজিমের কানের কাছে গিয়ে বলল,
“বিয়ের দিন বরকে এমন বেকুব বেকুব লাগে কেন রে?”

তানজিমও ফিসফিস করে বলে,
“বেকুবের বর চালাক হলেও দেখতে বেকুবই লাগে।”

সামিহা মুখ ভেংচায়। সাদাব এসে আবারো ওর কোল দখল করে ফেলে। সাদাবের সাথে মেহরিবা আসে। সামিহা দুজনকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরে আবরার আর রাইদকেও ডাকে।

“বাচ্চারা তোমাকে এতো পছন্দ করে কেন?”
মৃত্তিকা হাসিমুখে কথাটা বলল।

সামিহাও হাসে। বলে,
“ওরা বোধহয় আমাকে ওদের বয়সীই ভাবে।”

তানজিম পাশ থেকে বলে,
“ওদের ভাবনা সঠিক।”
______________________________________

চারদিন পর, মৃত্তিকা-ইমতিয়াজ পরিবারসহ ইতালি যাবে। মৃত্তিকার বিক্রি করে দেয়া রিপা বেগমের সেই বাড়িটি ইমতিয়াজ পুনরায় কিনে নিয়েছে। সেখানে কিছুদিন থাকার জন্যই ইতালি যাবে ওরা।

আজ সামিহার সাথে মৃত্তিকা এসেছে একটা বৃদ্ধাশ্রমে, মেহরিবাও এসেছে ওদের সাথে। এখানে আজ খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করেছে মৃত্তিকা।

মেহরিবা এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যাকে দেখছে তাকেই নানু, দাদু ডাকছে। সামিহা ওকে খুঁজতে খুঁজতে এসে দেখে শতবর্ষী এক বৃদ্ধার কাছে মেহরিবা দাঁড়িয়ে আছে।

“মেহরিবা আসো, মিউকো আপু ডাকছে তোমাকে।”

সামিহার ডাকে মেহরিবা শান্তভাবে বলে,
“থাকি কিছুক্ষণ।”

বৃদ্ধা মহিলাটি চমকে উঠে হাতড়ে হাতড়ে মেহরিবাকে টে°নে ধরে বলল,
“তুমি মেহরিবা, সেই মেহরিবা না তুমি? রাহার মা তুমি?”

মেহরিবা ভয় পেয়ে কান্না করে দেয়। সামিহা এসে ওকে সরিয়ে নিতে চায়। বৃদ্ধা জোর করে ধরে রাখে ওকে। ব্য°থা পাবে ভেবে সামিহা টা°না°টা°নি করে না।

মৃত্তিকা এসে এ অবস্থা দেখে বৃদ্ধাকে বলল,
“দাদুমণি, ও আমার মেয়ে, মেহরিবা। আপনি কার কথা বলছেন?”

বৃদ্ধা হাত আলগা করে বলে,
“সেই মেহরিবা, আমার সন্তানকে বাঁচিয়েছিল যে, আমাকে যে বাঁচিয়েছিল। রাহার মা মেহরিবা।”

বৃদ্ধা কাঁদতে শুরু করে। বৃদ্ধাশ্রমের একজন স্বেচ্ছাসেবী বলে,
“উনি সারাদিন এই দুইটা নামই জপতে থাকেন। মেহরিবা আর রাহা। নিজেকে সবসময় পা°পী জোসনা বলে।”

মৃত্তিকা কপাল কুঁচকে ফেলে। বলে,
“আপনি কে? জোসনা?”

বৃদ্ধা কাঁপা হাতে মৃত্তিকাকে ধরে বলে,
“আমি জোসনা, পা°পী জোসনা।”

মৃত্তিকা বুঝতে পেরেছে কে এই জোসনা। মমতাজ, শাফিনের মা। যাকে মমতাজ বেগম জীবিত অবস্থায় এতো খুঁজেছে, অথচ খুঁজে পায়নি। ভেবেছি মা°রা গেছে, অথচ আল্লাহ্ তার ম°রণ এতো তাড়াতাড়ি রাখেনি।
______________________________________

তাহসিনার কবর জিয়ারত করে আহনাফ। একটু দূরে সারাহ্ও দাঁড়িয়ে আছে। আজ ওরা আবারো কুমিল্লা ফিরে যাবে।

আহনাফ সারাহ্-র আড়ালে চোখের পানি মুছলেও সারাহ্ তা খেয়াল করে, যদিও সে কিছুই বলে না।

বাইরে রাখা গাড়িতে উঠে বসে ওরা। আহনাফ নিজেই গাড়ি কিনেছে, ওর শখ পূরণ করেছে। গাড়ি স্টার্ট করে আহনাফ বলে,
“তুমি কিন্তু এখনো তোমার শেয়ার দাওনি, ঐশী।”

“কিসের?”

“কিসের আবার? যেটাতে চ°ড়ে বেড়াচ্ছো।”

সারাহ্ কপাল কুঁচকে রাগ দেখিয়ে বলে,
“ওহ, কিছুই দেইনি? এই যে সমস্ত দিন আপনার সাদাব-সাইদা মিলে আমাকে ভ°র্তা করছে, তার বেলা?”

সাদাব পিছন থেকে বলে,
“ইয়েস পাপা, তার বেলা?”

আহনাফ সামনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ওরে, ব্যাটা দেখি মায়ের পক্ষে চলে যায়।”

সারাহ্ ভাব নিয়ে বলে,
“মা কে দেখতে হবে তো।”

আহনাফ গাড়ি থামিয়ে দেয়। হঠাৎ করে থামায় সারাহ্ সামনে ঝুঁ°কে পড়ে। আহনাফ সিটবেল্ট খুলে ওর কাছে এসে চেহারার দিকে তাকিয়ে বলল,
“দেখি একটু।”

সারাহ্ ওকে হালকা ধা°ক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়।
“ছেলে এখানে, কি করেন?”

“কি করি, তোমাকে দেখতেছি। দেখতেই তো বললে।”

“দূর, বে°হায়া লোক।”

সাদাব পিছন থেকে সারাহ্-র হাত টে°নে বলল,
“আম্মু, সাইদাকে আমার কাছে বসিয়ে দাও না প্লিজ প্লিজ।”

“না, সাইদা ঘুমাচ্ছে। তুমি উঠিয়ে ফেলবে।”
“প্লিজ।”
“নো।”

আহনাফ আবারো গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলে,
“হ্যাঁ, সাইদাকে সাদাবের কাছেই রেখে দাও। তারপর তো ওদের আবার একটা ভাইবোন আসবে।”

সারাহ্ মুচকি হাসে। লজ্জায় আজও সে লাল হয়ে আসে। তারপর বলে,
“ভাইবোন আসছে ওদের। এবার তো আপনার অ°স্থিরতা কমান।”

আহনাফ চোখ বড়বড় করে বলল,
“কি বললে তুমি?”

সারাহ্ লাজুক হেসে মাথা নাড়ায়। আহনাফ গাড়ি রাস্তার পাশে থামিয়ে বের হয়ে সারাহ্ দিকে এসে দরজা খুলে বলে,
“সত্যি বলছো?”

সারাহ্ মাথানেড়ে বলল,
“হুম।”

আহনাফ দুহাত দুদিকে দিয়ে চিৎকার করে বলল,
“আল্লাহ্, আল্লাহ্, এতো খুশি আমি কোথায় রাখবো?”

“আহনাফ, আস্তে। কি করছেন? লোকজন তাকিয়ে আছে।”

“থাকুক, তাকিয়ে থাকুক।”

সারাহ্ দুগালে হাত দিয়ে কপালে চুম্বন করে আহনাফ। সাদাব বলে,
“পাপা, আমাকেও চুমু দাও।”

আহনাফ ওকেও চুম্বন করে। সারাহ্ হাসতে হাসতে বলে,
“পাপার মতোই হবে। বেহায়া একটা।”
______________________________________

রাতে বাসায় আসার পথে গো°র°স্থানে এসেছে ইমতিয়াজ। এটা আজ নতুন নয়, প্রায় প্রতিদিনই আসা হয়।

তাহমিনার কবরটা পরিষ্কার করে সে। কিছুক্ষণ নিরবে সময় কা°টায়। কতটা বছর চলে গেছে, ছয়বছরের বেশি সময়।

অনেকক্ষণ পর ইমতিয়াজ গো°র°স্থান থেকে বের হয়, বাসায় ফিরে আসে সে। বেল বাজালে মেহরিবা দৌড়ে এসে খুলে দেয়। দরজা খুলেই সে ইমতিয়াজের কোল দখল করে আজকের দিনের গল্প বলতে শুরু করে।

মৃত্তিকা এসে বলে,
“উনি ওই জোসনাই, বড়মণির মা। জমিদার বাড়িতে আমি ছবি দেখেছিলাম, চেনা চেনা লেগেছে।”

ইমতিয়াজ মেহরিবার গালে চুমো দিয়ে ওকে কোল থেকে নামিয়ে বলে,
“এখন কি সিদ্ধান্ত নিয়েছো?”

মৃত্তিকা মাথানিচু করে বলল,
“উনি যেখানে আছে, ওখানেই থাকবে। শুধু আমি খরচ দিবো।”

“বাসায় নিয়ে আসলে কি হবে?”

“চাচ্ছি না আমি।”

মৃত্তিকার বারাকাহ্-র কাছে চলে যায়। সে চাচ্ছে না জোসনাকে বাসায় আনতে। কারণ তো স্পষ্ট, সে জোসনাকে ভালোবাসে না বা ভালোবাসতে চাচ্ছে না।

ইমতিয়াজ গিয়ে মেহরিবাকে দেখে মিউকোর সাথে খেলছে। তারপর ফ্রেশ হয়ে এসে মৃত্তিকার পাশে বসে বলল,
“ঠিক আছে তোমার ইচ্ছাই সই।”

মৃত্তিকা ওর দিকে ফিরে। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,
“ইতালি থেকে এসে আমি আপনার গ্রামে যাবো। নিয়ে যাবেন?”
“ওখানে কেন আবার?”
“বাবা-মায়ের কবর দেখে আসবো।”

ইমতিয়াজ মলিন হেসে বলল,
“আচ্ছা, নিয়ে গেলাম। তারপর কি চাই?”
“কিছু না।”

মৃত্তিকা মাথানিচু করে। ইমতিয়াজের এই দৃষ্টি ওর চেনা। ইমতিয়াজ কাছে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমাকে কিন্তু আবারো অস্ট্রেলিয়া যেতে হবে।”
“কবে?”
“এ বছরের শেষে।”
“বহু দেরি।”

মৃত্তিকা ওর মুখটা নিজের কাছে এনে বলল,
“বুড়ো হয়ে গেছেন, আজ আপনি আটত্রিশে পড়েছেন।”

ইমতিয়াজ হাসে। বলে,
“মনে রেখেছো? আমার তো মনে ছিল না।”
“আর মনে রাখবো না বুড়ো।”
“বুড়ি।”
চট করে কথাটা বলে মৃত্তিকার নাক টে°নে দেয় ইমতিয়াজ।

এটা তো সবে শুরু, যাত্রা এখনো বহুদূর বাকি। ওদেরকে চলতে হবে একসাথে, পায়ে পা মিলাতে হবে। হয়তো আরো কঠিন সময় আসবে, তবে পাশে থাকলে কঠিনকে সহজ করাও সম্ভব হবে।

সমাপ্ত