Wednesday, July 9, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 339



অটবী সুখ পর্ব-২৬+২৭

0

অটবী সুখ

২৬.
বাহিরে তখন রাত বেশ। ঘড়ির কাটা টিকটিক করে বারোটার ঘর পেরিয়েছে। চারপাশে সুনসান নিরবতা। জানালা দিয়ে যতদূর চোখ যায়, সবটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। ত্রিস্তান ইচ্ছে করেই বাড়ির পেছনে কোনো বাতি লাগায়নি। কেন যেন এই অন্ধকারটুকু তার ভালো লাগে। মনে হয়, প্রতিনিয়ত এই আঁধারই তাকে তার অস্তিত্বের সাথে বেঁধে রাখছে। তার জীবনের কালো অধ্যায়গুলো মনে করিয়ে দিচ্ছে।
বারান্দার একপাশে খাতা, কলম দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো ত্রিস্তান। কারেন্ট থাকা সত্ত্বেও দুটো মোম জ্বালালো দু’পাশে। আধো আলোয় খাতার মাঝখান থেকে একটা পৃষ্ঠা বের করে ইংরেজি অক্ষরে দাগ কাটতে শুরু করলো, “Things are getting more difficult. I messed up everything. I can’t let go and I also can’t hold on. Why the hell this things are so complicated? My intention was to leave that girl after spending some time with her. But why can’t I leave now? Why can’t I step back from my unknown feelings? It seems like everything is out of reach.
I feel bored. I feel like I’m lying in a dark grave, badly waiting for the death. I think, It would be better if I died. Otherwise I will not be able to leave her, whom I guess I give my everything. Maybe my heart also?”

বাকিটুকু আর লিখা হলো না। দরজায় খটখট শব্দ হচ্ছে। ত্রিস্তান দরজা না খুলেই বুঝে গেল, এটা সরোজ। নয়তো এত রাতে কেই-ইবা আসবে এখানে?
দরজা খুলে সরোজের দিকে শান্ত চোখে তাকালো ত্রিস্তান। জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে?”

সরোজ ততক্ষণে অন্ধকার ঘরে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। কিন্তু তেমন সুবিধা করতে পারছে না। এত বিশ্রী রকমের কালো ভেতরটা! বারান্দা দিয়ে যদিও হলদেটে আলো আসছে! তবুও মাথায় ‘ভূতুড়ে ঘর’ ছাড়া আর কোনো শব্দ এলো না সরোজের। কপাল কুঁচকে বললো, “কারেন্ট তো আছে! তারপরও এমন ভূতের মতোন কইরা রাখছো ক্যান ঘরডা?”

ত্রিস্তান অন্যদিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেললো। বললো, “মাথা ব্যথা করছিল… কি জন্য এসেছিস সেটা বল।”
সরোজ কথা বাড়ালো না। হাতের বাটি-টা ত্রিস্তানের দিকে এগিয়ে দিলো চুপচাপ। নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো, “ভাত খাইছিলা?”
—“পরে খাবো।”
সরোজ চলে যাওয়ার পূর্বে আবারও একই ভাবে বললো, “তুমি কিন্তু রাতে ভাত খাইতেছো না ইদানিং। খাওয়া লইও ভাই। ভাতডা খালি ফ্রিজে রাখছি। গরম কইরা লইও।”

সরোজ চলে গেছে অনেক্ষণ। ত্রিস্তান দরজা আটকে নিরব বসে আছে বারান্দায়। জ্বলন্ত মোম দুটো এখন বন্ধ। বাতাস প্রচন্ড রকমের আনাগোনা শুরু করেছে। ওতেই বোধহয় বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ ত্রিস্তানের এসবে খেয়াল নেই। রক্তের বাটি-টা ওইযে, ডানপাশের খালি জায়গায় ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়েছে সে। কিছু ভাল্লাগছে না তার। আজকাল পাতালঘরেও যেতে ইচ্ছে করে না। ব্যক্তিটির ঘৃণ্য সৃষ্টি এত পোড়ায়! এত অসহ্য লাগে! অসহ্য দমবন্ধকর অনুভূতি বারংবার করে মনে করিয়ে দেয়, সে একা। খুব, খুব, খুব একা।

আলতো দীর্ঘশ্বাসগুলো যখন মিলেমিশে ক্লান্ত, ঘুমে যখন চোখ অবাধ্য, যখন পুরো শরীরটা দেওয়ালের সঙ্গে ঠেকে একাকার, তখন চোখ বোজা মাত্রই একটা নাম মস্তিষ্কে হানা দিয়ে উঠলো ত্রিস্তানের। ঢিমে যাওয়া কণ্ঠে খুব অস্পষ্ট ভাবে উচ্চারণ করলো, “অটবী…”

শনিবার। দুপুর তিনটে।
গরমে ঘেমে একাকার হয়ে বাজার নিয়ে বাসায় ফিরছে অটবী। পা যেন আর চলছে না। কপালের ঘামগুলো গলা ছুঁচ্ছে। হঠাৎ মনে হলো, সে পৃথাকে দেখেছে। প্রথমে মনের ভুল ভাবলেও সন্দেহ মেটাতে একটু আশেপাশে তাকাতেই সন্দেহটা আরও প্রবল হলো তার। একটু এগোতেই বুঝতে পারলো, ওটা আসলে পৃথাই। সকালে এভাবেই সাদা ফিতা দিয়ে দু’বেণী করে দিয়েছিল বোনকে। হাতে সেই একই কালো ব্রেসলেট, স্কুল ড্রেস! অটবীর বুকটা ধুপধাপ করে কাঁপলো। পৃথার সাথে ওই ছেলেটাকে? এত ঘনিষ্ট হয়ে কি করছে ওরা? একে অপরকে চুমু দিচ্ছে? অটবী দ্রুত পা চালালো। বাজারের ব্যাগটা যে তার হাত থেকে পরে গেছে, সে খেয়াল আপাতত নেই। পৃথার কাছাকাছি এসেই সর্বপ্রথমে একটা মারাত্বক চড় লাগালো অটবী। কণ্ঠ চিড়ে ধমকালো, “স্কুল বাদ দিয়ে এখানে কি করছিস পৃথা? এজন্য তোকে স্কুলে পাঠাই আমি।”

বলতে বলতে ছেলেটার দিকে তাকালো অটবী। হাহ! যা ভেবেছিল তাই! এলাকার গুণধর কাদিন দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। চোখে মুখে কি ভীষণ বিরক্তি!
অটবী রাগে কাঁপতে লাগলো, “আমার বোনের সাথে এসব করার সাহস পাও কোথায় তুমি? তোমার মাকে আমি এক্ষুণি গিয়ে বলব। অনেক বেড়ে গেছো তুমি!”

কাদিন যেন একটুও পাত্তা দিলো না অটবীকে। দায়সারা ভাবে বললো, “আমার মাকে বলার আগে নিজের বোনকে সামলান। আপনার বোনই আগে এসেছিল আমার কাছে, আমি না।”

অটবী বড় বড় চোখে পৃথার দিকে তাকালো এবার। পৃথা কাঁদছে কম, রাগে ফুঁসছে বেশি। আশেপাশে এত মানুষ! তার বোনের কি একটুও জ্ঞান বুদ্ধি নেই? মানুষ প্রেম করতেই পারে। তাই বলে এত চিল্লাবে?

—“কাদিন কি সত্যি বলছে, পৃথা?”
পৃথা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো যেন, “সত্যি বললে কি? মারবা আমাকে?”

অটবী থমকালো, চমকালো। ভীষণ অবাক হলো পৃথার আচরণে। পৃথা থেকে সে এমন জবাব আশা করেনি। তারচেয়েও বেশি অপমান লাগলো, যখন কাদিন তাকে উদ্দেশ্য করে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাসলো! অটবী আর দেড়ি করলো না। পৃথার হাত টেনে নিয়ে যেতে লাগলো বাসায়। পুরো রাস্তায় পৃথা অনেকবার হাত ছাড়াবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু অটবী ছাড়েনি। বাসায় আসা মাত্র রেবা বেগমও পৃথাকে এভাবে টানার কারণ জিজ্ঞেস করেছিলেন। অটবী তারও উত্তর দেয়নি। পৃথাকে টেনে রুমে নিয়ে গিয়ে দরজা আটকে দিয়েছে।

নলী তখন ঘুমাচ্ছিল। তার গায়ে ১০১ জ্বর। স্কুলে যায়নি আজকে। ভেবেছিল আরাম করে আজকে সারাদিন ঘুমাবে। কিন্তু বিধিবাম! জোড়ে দরজা লাগানোর শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল তার। রাগান্বিত অটবীকে দেখে একটু ভ্রু কুঁচকে তাকালেও, পৃথাকে কাঁদতে দেখে চটজলদি উঠে বসলো সে। অবাক হয়ে সুধালো, “কি হয়েছে, বুবু?”

অটবী এবারও নিরুত্তর। পৃথার দিকে তাকালেই তার রাগটা আরও বেড়ে যাচ্ছে। চোখ বুজে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো সে। স্বাভাবিক হতে চাইলো, “এমন কেন করলি পৃথা? তোকে আমি বুদ্ধীমান ভাবতাম! অথচ… এত অশ্লীলতা! তোকে এসব শিখিয়েছি আমি?”

পৃথা রাগে ফোঁসফোঁস করে উঠলো আবার। ভীষণ জোড়ে চেঁচিয়ে উঠলো, “করেছি তো কি হয়েছে? তুমি করোনা? আর অশ্লীল কাকে বলছো? চুমু খেলেই অশ্লীল হয়ে গেল? তুমি কাও নি যেন? তোমার ত্রিস্তানের সাথে কত কি করেছো আমি জিজ্ঞেস করেছি ক…”

পূর্বেই আরেকটা চড় মারলো অটবী। তবে এবার খানিকটা জোড়ে।
কণ্ঠ রোধ হয়ে আছে তার। মাথার যন্ত্রণায় সবটা আবছা লাগছে। অটবী এই পৃথাকে চেনে না। তার সহজ-সরল, একটুখানি বুদ্ধিমতি বোনটা কোথায়? কোথায় চলে গেল? মাথা ঘুরে পরে যেতে নিলেই নলী দৌঁড়ে এসে ধরলো বোনকে। বিছানায় বসালো। পৃথা ততক্ষণে দরজা খুলে চলে গেছে। একবারও বোনের দিকে চোখ ফিরিয়ে তাকায়নি। ব্যাপারটায় ভীষণ ধাক্কা খেল অটবী। নলীর দিকে তাকিয়ে আস্তে করে সুধালো, “পৃথা কখন এমন হয়ে গেছে, নলী?”

নলী জবাব দিতে পারলো না। সে কি বলবে? তার নিজেরই পৃথাকে দেখে অবাক লাগছে।

পৃথার সঙ্গে বাকবিতর্কতার পরপরই ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পরেছিল অটবী। হঠাৎ শক্ত করে কেউ হাত টেনে উঠে বসাতেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখদুটো আধো আধো করে মেলার আগেই গাল ব্যাথায় টনটন করে উঠলো যেন। কানে কিচ্ছুক্ষণ কিচ্ছু শুনতে পেল না অটবী। এরপর সম্বিৎ ফিরতেই বুঝতে পেল, রেবা বেগম খুব গালাগালি করছেন তাকে। খুবই বিশ্রী গালি। ক্রোধে অন্ধ হয়ে চেঁচাচ্ছেন, “কাকে জিজ্ঞেস করে তুই একা একা বিয়ে করেছিস? এত সাহস কোথায় পেয়েছিস তুই?”

___________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

অটবী সুখ

২৭.
আজকের সকালটা মোটেও সুন্দর ছিল না। বিকাল হতে হতে তা একেবারে বিদঘুটে হয়ে গেছে। বাহিরে প্রচন্ড বৃষ্টি। ঠা ঠা শব্দে বিদ্যুৎ চমকানোর আওয়াজ। একটুখানি শীতলতা শরীরের আশপাশ দিয়ে ঘুরঘুর করছে। অথচ এই বৃষ্টির কোথাও একটু ভালো লাগা নেই। নেই একটু শান্তির সন্ধান। ত্রিস্তান আস্তে করে রান্নাঘরের জালানা লাগিয়ে দিলো। ফ্রিজ খুলে সরোজের আনা রক্তের প্যাকেট দুটি রাখতে গিয়ে ‘থ’ হয়ে রইলো কিছুক্ষণ। একাধারে ওই থকথকে, লাল তরলটার দিকে কেমন ঘোরগ্রস্তের মতো চেয়ে রইলো। চোখের পাতা ক্ষীণ কাঁপলো, হাতের বুড়ো আঙুলে সূক্ষ্ণ ব্যথা হলো। মনে পরে গেল, পুরো দিনগুলোর কথা। তার নিজের ছেলেবেলার কথা।

ত্রিস্তানের বয়স তখন কতই বা হবে? ত্যারো কি চৌদ্দ? খুব একটা বোঝার বয়স না। হাসি খুশি পরিবারের সে ছিল মধ্যমণি। সারা ঘর টইটই করে বেড়াতো। প্রায়ই দেখতো, তার বাবা অফিস থেকে এসে কি যেন লুকিয়ে লুকিয়ে ফ্রিজে রাখছেন। সাদা ঝকঝকে কাঁচের বোতলে টকটকে লাল রঙের তরল পানীয়র মতো কিছু। ত্রিস্তানের ছোট বয়স। বুক ভরা হাজারটা আগ্রহ আর কৌতূহল। তার বাবা তাকে না জানিয়ে কি এমন মজার জিনিস তার থেকে লুকিয়ে রাখছেন, সে কিছুতেই তা ঠাওর করতে পারতো না। বাবাকে জিজ্ঞেস করলেও ঠিকঠাক উত্তর পাওয়া যেত না। তিনি শুধু বলতেন, “ওগুলো বড়দের জিনিস। ছোটদের দেওয়া যাবে না।”

অথচ ত্রিস্তানের ভেতরকার কৌতূহল তখনো দমবার নয়। এক দানব কণ্ঠ যেন তাকে বারবার বলছিল, “নাহ্! ওটা কি আমাকে জানতেই হবে!”
সেই মনোবল থেকেই একদিন রাত্রিবেলা লুকিয়েচুরিয়ে সেই লাল টকটকে তরল খেয়ে ফেলেছিল ত্রিস্তান। রক্তের স্বাদ…. মানুষের রক্তের কি-না জানা নেই, তবে স্বাদটা এখনো স্পষ্ট মনে আছে ত্রিস্তানের। একটু নোনতা, প্রচুর পানসে, ভীষণ বিশ্রী খেতে।

আচমকা সরোজের ডাকে সম্বিৎ ফিরলো ত্রিস্তানের। সরোজ উদ্বীগ্ন কণ্ঠে ডাকছে। ডাকতে ডাকতে রান্নাঘরে পা রাখার আগেই ফ্রিজের দরজা বন্ধ করে দিলো ত্রিস্তান। কপাল কুঁচকে সামনে তাকাতেই সরোজ বলে উঠলো, “কাহিনি তো ঘইট্টা গেছে ত্রিস্তান ভাই।”

রান্নাঘরের চুলার দিকটা অগোছালো। চিনির পট, লবণ-মরিচের পট এলোমেলো করে রাখা। সেগুলো গোছাতে গোছাতেই ত্রিস্তান জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে?”
—“তোমার শ্বাশুড়ি, মানে হইলো গিয়া অটবী আপুর মা… হে তো বিয়ার খবর সব জাইনা গেছে।”

ত্রিস্তানের হাত থমকালো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য। পরপরই আগের মতোই আবার বললো, “তুই কিভাবে জানিস এতকিছু? তোকে তো আজকে সারাদিন ঘর থেকে বের হতে দেখিনি।”
—“ওইযে? নলীরে কয়েকদিন আগে একখান মোবাইল কিন্না দিলাম না? একটু আগে ফোন কইরাই সব ঘটনা কইলো।”
এরপর একটু থেমে আবার বললো, “এহন কি করবা, ভাই? আন্টি নাকি অটবী আপুরে অনেক বকছে। মারছেও নাকি!”

ত্রিস্তান এবার আর জবাব দিলো না। ভেতরকার ভারী নিশ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে চাইলো। শান্ত রাখতে চাইলো। কিন্তু নাহ্! সবকিছু ঘুরে ফিরে ওই অশান্তি, অস্বাভাবিকের মাঝে গিয়েই ঠেকছে। এত অসহ্য লাগছে সব! এত বিশ্রী ঠেকছে! আর বুঝি সে অটবী নামক দূর্বলতা থেকে ছুটতে পারলো না? একেবারে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধেই গেল?

তখন মাত্র সন্ধ্যা নামো নামো ভাব। বৃষ্টি শেষে পশ্চিম আকাশে মনোমুগ্ধকর কমলাটে রঙ। সূর্যকে দেখা যাচ্ছে না বললেই চলে। ওদিকে আবার নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে চাঁদমামা উঁকিঝুঁকি মারছে। কখন সূর্য পুরোপুরি উবে যাবে! কখন সে দৃশ্যমান হবে!
অটবী তখন জানালার ধারে বসে চাঁদ-সূর্যের লুকোচুরি দেখছিল। মুখ তার মলিন, চোখের শিরা-উপশিরা কান্নার দরুণ ক্ষীণ লাল। শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুর লম্বাটে দাগ স্পষ্ট গালে গেঁথে আছে। বাহ্যিক দিক থেকে তাকে শান্ত দেখালেও ভেতরটা তার অস্থির। বুকটা ভীষণ যন্ত্রণায় কেমন কেমন যে করছে! ফেঁটে যাচ্ছে একদম! দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরের দরজার দিকে আরেকবার তাকালো অটবী। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। সে নিজেই বন্ধ করে রেখেছে। একটু একা থাকতে চাওয়ার জন্য। কিন্তু পরিস্থিতি তাকে একা থাকতে দিচ্ছে না। কোলাহলে, কলরবে মনে হচ্ছে, যেন সে একটা বিস্তর যানজটপূর্ণ রোডে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির জানালা গলিয়ে একজন ড্রাইভার একজন রিকশাচালককে খুব গালাগাল করছে। ঠিক যেমনটা রেবা বেগম এখন করছেন অটবীকে। সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে, দরজার ওপাশ থেকে অবিরাম বকাবকি করছেন তিনি। দু’চারটে হৃদয়বিদারক কথার বাণী ছুঁড়ে দিচ্ছেন অনায়াসে! অথচ এদিকে যে অটবীর প্রাণটা ছিঁড়ে যাচ্ছে, এর খেয়াল আছে কারো? নেই… অটবী একবার পুরো ঘরে চোখ বুলিয়ে দেখলো। আসলেই কেউ নেই।

অটবী সবে মাত্র জানালার সঙ্গে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করেছিল। সরব, কপালে উষ্ণ এক ছোঁয়া পেতেই চট করে চোখ মেললো। নজর সামনে তুলতেই দেখলো, ত্রিস্তান! তার সামনে ত্রিস্তান দাঁড়িয়ে আছে…
অটবীর ঘরের অবস্থান বাড়ির দক্ষিণ দিকে। এদিকটা সচরাচর নির্জন, নিস্তব্ধ। মানুষের আনাগোনা নেই। খানিকটা জঙ্গলের মতো। ত্রিস্তানের এদিকে আসতে পারার কথা না। সে আসলো কিভাবে?
কণ্ঠে বিহ্বলতা নিয়ে অল্পসল্প ভাঙ্গা স্বরে অটবী সুধালো, “আপনি এখানে কিভাবে? কিভাবে এসেছেন?”
—“নলী হেল্প করেছে।”
—“নলীকে কোথায় পেলেন?”
—“কোথায় পাবো?”

বলতে বলতে ত্রিস্তানের শক্ত বাম হাতটা অটবীর নরম গালে কোমলভাবে স্পর্শ করলো।

—“কেন এসেছেন, ত্রিস্তান? কেউ দেখে ফেললে?”
—“কেউ দেখেনি।” ত্রিস্তান অদ্ভুত আচরণ করছে। তার বুড়ো আঙুল অপরিচিত ভাবে স্পর্শ করছে তাকে। গালের রক্তজমাট বাঁধা জায়গা থেকে শুরু করে চোখের পাতার নিচ অব্দি যত্নের সঙ্গে আঙুল বোলাচ্ছে ত্রিস্তান। চোখদুটোর দৃষ্টি অন্যরকম। ভীষণ অন্যরকম। এমন ত্রিস্তানকে অটবী আগে কখনো দেখেনি। এত গভীর নয়নে ত্রিস্তান কখনো অটবীকে পরখ করেনি।

—“অটবী… এত কেঁদেছ কেন?”
এবার ফোলা চোখের পাতায় আঙুল চালালো ত্রিস্তান। আলতো স্পর্শে কাহিল করে দিলো অটবীকে। অটবীর বুকের ভেতরটা নড়েচড়ে উঠলো। হঠাৎ করে তার একলা সময়ে কাউকে কাছে পেয়ে চোখ বেয়ে অজান্তেই দু’ফোটা অশ্রু গড়ালো। সাথে সাথে সেই জল মুছে নিলো ত্রিস্তান। ঢিমে স্বরে বললো, “এত কাঁদছো কেন? বেশি ব্যথা পেয়েছ?”

কথাটা গালের লাল অংশে আঙুল বুলিয়ে বললো ত্রিস্তান। এর অর্থ হয়তো এটাই, চড়টা বেশি জোড়ে লেগেছে কি-না। কিন্তু অটবীর তো শুধু গালে ব্যথা লাগেনি। তার মনটাও ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। মায়ের রুঢ় আচরণ, বোনের হঠাৎ পরিবর্তন— সব কিছু তার হৃদয়ে আঁচড় কেটেছে। দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছে তাকে।
ত্রিস্তানের প্রশ্নের উত্তরে অটবী জোড়েজোড়ে মাথা দুলালো। হ্যাঁ, তার ব্যথা লেগেছে। অনেক! অনেক! অনেক!

ত্রিস্তান আলতো তপ্ত নিশ্বাস ফেললো। লবণ পানিতে প্রেয়সীর গাল আবারও ভিঁজে আসতেই কাছাকাছি হলো সে। চুমু খেল দু’গালে, দু’চোখে, নাকে আর কপালে! এরপর একটু থামলো ত্রিস্তান। যত্ন করে অটবীর কপালের চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিলো। আরেকদফা তপ্ত নিশ্বাস নস্যি করে উঁড়িয়ে দিলো বুকের মধ্যখান থেকে। অল্পক্ষণ অটবীর রক্তিম ঠোঁটটাকে দেখে হঠাৎ করেই অধরে-অধর মেলালো সে। এত আদুরে ভাবে! এত অধৈর্য হয়ে! অটবী ভয়ানক অনুভূতিতে পিসে যাচ্ছিল। তার দু’হাত কখন যে ত্রিস্তানের কলার জড়িয়ে ধরেছে, খেয়াল নেই। ত্রিস্তান সাবধানে অটবীর গালের দু’পাশ ধরে আছে। ওভাবেই কাছে টানলো ওকে। অটবী স্পষ্ট টের পেল, একটা মিষ্টি সুবাস তার ঘ্রাণশক্তি রোধ করে দিচ্ছে। মস্তিষ্ক ফাঁকা করে তুলছে। কিসের সুবাসটা ওটা? তাদের একটু দূরে থাকা বেলী গাছগুলোর? হতে পারে!

তারা ওভাবে কতক্ষণ ছিল, অটবীর জানা নেই। তবে আকাশের কমলাটে রঙ এখন একেবারে ধুলিসাৎ হয়ে গেছে। সন্ধ্যার অন্ধকারে ছেয়ে গেছে চারিপাশ। ঘরের বাতি জালানো নেই বিধায় অটবী ত্রিস্তানকে তেমন করে দেখতে পারছে না। শুধু অনুভব করতে পারছে, লোকটা ঠিক তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। ত্রিস্তান থেকে জানালার উচ্চতা বেশি নয়। বরং ত্রিস্তানকেই লম্বা লাগছে। জানালাটা তার বুক অব্দি আসে।

—“কোথায় যাচ্ছো?” ত্রিস্তান বললো, শীতল কণ্ঠস্বরে।
অটবী ঘরের বাতি জ্বালাতে উঠতে গিয়েও উঠলো না। “লাইট জ্বালাতে চেয়েছিলাম।”
—“প্রয়োজন নেই।”

ত্রিস্তানের অদ্ভুত আচরণের পালা তখনো শেষ হয়নি। তার হাতের আঙুলের ভাঁজে ভাঁজে তখনো অটবীর একেকটা হাতের আঙুল।

—“তোমার চোখে আমি কতটুকু ভালো, অটবী? কতটুকু ভালো মনে করো আমায়?”
—“হু?” অটবী যেন বুঝলো না, “আপনি হঠাৎ এমন সব প্রশ্ন করছেন কেন?”

ত্রিস্তান সে কথার উত্তর দিলো না। আস্তে করে বললো, “আমি যদি কালকে তোমাকে আমার সাথে নিয়ে যাই, সমস্যা হবে অটবী?”
অটবী বার কয়েক পলক ফেললো, “ক-কোথায় নিয়ে যাবেন?”

—“আমার কাছে। একেবারের জন্য।”

কথাটা শোনা মাত্রই ত্রিস্তানের হাতদুটো শক্ত করে ধরলো অটবী।

_____________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

অটবী সুখ

২৭.
আজকের সকালটা মোটেও সুন্দর ছিল না। বিকাল হতে হতে তা একেবারে বিদঘুটে হয়ে গেছে। বাহিরে প্রচন্ড বৃষ্টি। ঠা ঠা শব্দে বিদ্যুৎ চমকানোর আওয়াজ। একটুখানি শীতলতা শরীরের আশপাশ দিয়ে ঘুরঘুর করছে। অথচ এই বৃষ্টির কোথাও একটু ভালো লাগা নেই। নেই একটু শান্তির সন্ধান। ত্রিস্তান আস্তে করে রান্নাঘরের জালানা লাগিয়ে দিলো। ফ্রিজ খুলে সরোজের আনা রক্তের প্যাকেট দুটি রাখতে গিয়ে ‘থ’ হয়ে রইলো কিছুক্ষণ। একাধারে ওই থকথকে, লাল তরলটার দিকে কেমন ঘোরগ্রস্তের মতো চেয়ে রইলো। চোখের পাতা ক্ষীণ কাঁপলো, হাতের বুড়ো আঙুলে সূক্ষ্ণ ব্যথা হলো। মনে পরে গেল, পুরো দিনগুলোর কথা। তার নিজের ছেলেবেলার কথা।

ত্রিস্তানের বয়স তখন কতই বা হবে? ত্যারো কি চৌদ্দ? খুব একটা বোঝার বয়স না। হাসি খুশি পরিবারের সে ছিল মধ্যমণি। সারা ঘর টইটই করে বেড়াতো। প্রায়ই দেখতো, তার বাবা অফিস থেকে এসে কি যেন লুকিয়ে লুকিয়ে ফ্রিজে রাখছেন। সাদা ঝকঝকে কাঁচের বোতলে টকটকে লাল রঙের তরল পানীয়র মতো কিছু। ত্রিস্তানের ছোট বয়স। বুক ভরা হাজারটা আগ্রহ আর কৌতূহল। তার বাবা তাকে না জানিয়ে কি এমন মজার জিনিস তার থেকে লুকিয়ে রাখছেন, সে কিছুতেই তা ঠাওর করতে পারতো না। বাবাকে জিজ্ঞেস করলেও ঠিকঠাক উত্তর পাওয়া যেত না। তিনি শুধু বলতেন, “ওগুলো বড়দের জিনিস। ছোটদের দেওয়া যাবে না।”

অথচ ত্রিস্তানের ভেতরকার কৌতূহল তখনো দমবার নয়। এক দানব কণ্ঠ যেন তাকে বারবার বলছিল, “নাহ্! ওটা কি আমাকে জানতেই হবে!”
সেই মনোবল থেকেই একদিন রাত্রিবেলা লুকিয়েচুরিয়ে সেই লাল টকটকে তরল খেয়ে ফেলেছিল ত্রিস্তান। রক্তের স্বাদ…. মানুষের রক্তের কি-না জানা নেই, তবে স্বাদটা এখনো স্পষ্ট মনে আছে ত্রিস্তানের। একটু নোনতা, প্রচুর পানসে, ভীষণ বিশ্রী খেতে।

আচমকা সরোজের ডাকে সম্বিৎ ফিরলো ত্রিস্তানের। সরোজ উদ্বীগ্ন কণ্ঠে ডাকছে। ডাকতে ডাকতে রান্নাঘরে পা রাখার আগেই ফ্রিজের দরজা বন্ধ করে দিলো ত্রিস্তান। কপাল কুঁচকে সামনে তাকাতেই সরোজ বলে উঠলো, “কাহিনি তো ঘইট্টা গেছে ত্রিস্তান ভাই।”

রান্নাঘরের চুলার দিকটা অগোছালো। চিনির পট, লবণ-মরিচের পট এলোমেলো করে রাখা। সেগুলো গোছাতে গোছাতেই ত্রিস্তান জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে?”
—“তোমার শ্বাশুড়ি, মানে হইলো গিয়া অটবী আপুর মা… হে তো বিয়ার খবর সব জাইনা গেছে।”

ত্রিস্তানের হাত থমকালো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য। পরপরই আগের মতোই আবার বললো, “তুই কিভাবে জানিস এতকিছু? তোকে তো আজকে সারাদিন ঘর থেকে বের হতে দেখিনি।”
—“ওইযে? নলীরে কয়েকদিন আগে একখান মোবাইল কিন্না দিলাম না? একটু আগে ফোন কইরাই সব ঘটনা কইলো।”
এরপর একটু থেমে আবার বললো, “এহন কি করবা, ভাই? আন্টি নাকি অটবী আপুরে অনেক বকছে। মারছেও নাকি!”

ত্রিস্তান এবার আর জবাব দিলো না। ভেতরকার ভারী নিশ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে চাইলো। শান্ত রাখতে চাইলো। কিন্তু নাহ্! সবকিছু ঘুরে ফিরে ওই অশান্তি, অস্বাভাবিকের মাঝে গিয়েই ঠেকছে। এত অসহ্য লাগছে সব! এত বিশ্রী ঠেকছে! আর বুঝি সে অটবী নামক দূর্বলতা থেকে ছুটতে পারলো না? একেবারে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধেই গেল?

তখন মাত্র সন্ধ্যা নামো নামো ভাব। বৃষ্টি শেষে পশ্চিম আকাশে মনোমুগ্ধকর কমলাটে রঙ। সূর্যকে দেখা যাচ্ছে না বললেই চলে। ওদিকে আবার নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে চাঁদমামা উঁকিঝুঁকি মারছে। কখন সূর্য পুরোপুরি উবে যাবে! কখন সে দৃশ্যমান হবে!
অটবী তখন জানালার ধারে বসে চাঁদ-সূর্যের লুকোচুরি দেখছিল। মুখ তার মলিন, চোখের শিরা-উপশিরা কান্নার দরুণ ক্ষীণ লাল। শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুর লম্বাটে দাগ স্পষ্ট গালে গেঁথে আছে। বাহ্যিক দিক থেকে তাকে শান্ত দেখালেও ভেতরটা তার অস্থির। বুকটা ভীষণ যন্ত্রণায় কেমন কেমন যে করছে! ফেঁটে যাচ্ছে একদম! দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরের দরজার দিকে আরেকবার তাকালো অটবী। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। সে নিজেই বন্ধ করে রেখেছে। একটু একা থাকতে চাওয়ার জন্য। কিন্তু পরিস্থিতি তাকে একা থাকতে দিচ্ছে না। কোলাহলে, কলরবে মনে হচ্ছে, যেন সে একটা বিস্তর যানজটপূর্ণ রোডে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির জানালা গলিয়ে একজন ড্রাইভার একজন রিকশাচালককে খুব গালাগাল করছে। ঠিক যেমনটা রেবা বেগম এখন করছেন অটবীকে। সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে, দরজার ওপাশ থেকে অবিরাম বকাবকি করছেন তিনি। দু’চারটে হৃদয়বিদারক কথার বাণী ছুঁড়ে দিচ্ছেন অনায়াসে! অথচ এদিকে যে অটবীর প্রাণটা ছিঁড়ে যাচ্ছে, এর খেয়াল আছে কারো? নেই… অটবী একবার পুরো ঘরে চোখ বুলিয়ে দেখলো। আসলেই কেউ নেই।

অটবী সবে মাত্র জানালার সঙ্গে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করেছিল। সরব, কপালে উষ্ণ এক ছোঁয়া পেতেই চট করে চোখ মেললো। নজর সামনে তুলতেই দেখলো, ত্রিস্তান! তার সামনে ত্রিস্তান দাঁড়িয়ে আছে…
অটবীর ঘরের অবস্থান বাড়ির দক্ষিণ দিকে। এদিকটা সচরাচর নির্জন, নিস্তব্ধ। মানুষের আনাগোনা নেই। খানিকটা জঙ্গলের মতো। ত্রিস্তানের এদিকে আসতে পারার কথা না। সে আসলো কিভাবে?
কণ্ঠে বিহ্বলতা নিয়ে অল্পসল্প ভাঙ্গা স্বরে অটবী সুধালো, “আপনি এখানে কিভাবে? কিভাবে এসেছেন?”
—“নলী হেল্প করেছে।”
—“নলীকে কোথায় পেলেন?”
—“কোথায় পাবো?”

বলতে বলতে ত্রিস্তানের শক্ত বাম হাতটা অটবীর নরম গালে কোমলভাবে স্পর্শ করলো।

—“কেন এসেছেন, ত্রিস্তান? কেউ দেখে ফেললে?”
—“কেউ দেখেনি।” ত্রিস্তান অদ্ভুত আচরণ করছে। তার বুড়ো আঙুল অপরিচিত ভাবে স্পর্শ করছে তাকে। গালের রক্তজমাট বাঁধা জায়গা থেকে শুরু করে চোখের পাতার নিচ অব্দি যত্নের সঙ্গে আঙুল বোলাচ্ছে ত্রিস্তান। চোখদুটোর দৃষ্টি অন্যরকম। ভীষণ অন্যরকম। এমন ত্রিস্তানকে অটবী আগে কখনো দেখেনি। এত গভীর নয়নে ত্রিস্তান কখনো অটবীকে পরখ করেনি।

—“অটবী… এত কেঁদেছ কেন?”
এবার ফোলা চোখের পাতায় আঙুল চালালো ত্রিস্তান। আলতো স্পর্শে কাহিল করে দিলো অটবীকে। অটবীর বুকের ভেতরটা নড়েচড়ে উঠলো। হঠাৎ করে তার একলা সময়ে কাউকে কাছে পেয়ে চোখ বেয়ে অজান্তেই দু’ফোটা অশ্রু গড়ালো। সাথে সাথে সেই জল মুছে নিলো ত্রিস্তান। ঢিমে স্বরে বললো, “এত কাঁদছো কেন? বেশি ব্যথা পেয়েছ?”

কথাটা গালের লাল অংশে আঙুল বুলিয়ে বললো ত্রিস্তান। এর অর্থ হয়তো এটাই, চড়টা বেশি জোড়ে লেগেছে কি-না। কিন্তু অটবীর তো শুধু গালে ব্যথা লাগেনি। তার মনটাও ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। মায়ের রুঢ় আচরণ, বোনের হঠাৎ পরিবর্তন— সব কিছু তার হৃদয়ে আঁচড় কেটেছে। দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছে তাকে।
ত্রিস্তানের প্রশ্নের উত্তরে অটবী জোড়েজোড়ে মাথা দুলালো। হ্যাঁ, তার ব্যথা লেগেছে। অনেক! অনেক! অনেক!

ত্রিস্তান আলতো তপ্ত নিশ্বাস ফেললো। লবণ পানিতে প্রেয়সীর গাল আবারও ভিঁজে আসতেই কাছাকাছি হলো সে। চুমু খেল দু’গালে, দু’চোখে, নাকে আর কপালে! এরপর একটু থামলো ত্রিস্তান। যত্ন করে অটবীর কপালের চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিলো। আরেকদফা তপ্ত নিশ্বাস নস্যি করে উঁড়িয়ে দিলো বুকের মধ্যখান থেকে। অল্পক্ষণ অটবীর রক্তিম ঠোঁটটাকে দেখে হঠাৎ করেই অধরে-অধর মেলালো সে। এত আদুরে ভাবে! এত অধৈর্য হয়ে! অটবী ভয়ানক অনুভূতিতে পিসে যাচ্ছিল। তার দু’হাত কখন যে ত্রিস্তানের কলার জড়িয়ে ধরেছে, খেয়াল নেই। ত্রিস্তান সাবধানে অটবীর গালের দু’পাশ ধরে আছে। ওভাবেই কাছে টানলো ওকে। অটবী স্পষ্ট টের পেল, একটা মিষ্টি সুবাস তার ঘ্রাণশক্তি রোধ করে দিচ্ছে। মস্তিষ্ক ফাঁকা করে তুলছে। কিসের সুবাসটা ওটা? তাদের একটু দূরে থাকা বেলী গাছগুলোর? হতে পারে!

তারা ওভাবে কতক্ষণ ছিল, অটবীর জানা নেই। তবে আকাশের কমলাটে রঙ এখন একেবারে ধুলিসাৎ হয়ে গেছে। সন্ধ্যার অন্ধকারে ছেয়ে গেছে চারিপাশ। ঘরের বাতি জালানো নেই বিধায় অটবী ত্রিস্তানকে তেমন করে দেখতে পারছে না। শুধু অনুভব করতে পারছে, লোকটা ঠিক তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। ত্রিস্তান থেকে জানালার উচ্চতা বেশি নয়। বরং ত্রিস্তানকেই লম্বা লাগছে। জানালাটা তার বুক অব্দি আসে।

—“কোথায় যাচ্ছো?” ত্রিস্তান বললো, শীতল কণ্ঠস্বরে।
অটবী ঘরের বাতি জ্বালাতে উঠতে গিয়েও উঠলো না। “লাইট জ্বালাতে চেয়েছিলাম।”
—“প্রয়োজন নেই।”

ত্রিস্তানের অদ্ভুত আচরণের পালা তখনো শেষ হয়নি। তার হাতের আঙুলের ভাঁজে ভাঁজে তখনো অটবীর একেকটা হাতের আঙুল।

—“তোমার চোখে আমি কতটুকু ভালো, অটবী? কতটুকু ভালো মনে করো আমায়?”
—“হু?” অটবী যেন বুঝলো না, “আপনি হঠাৎ এমন সব প্রশ্ন করছেন কেন?”

ত্রিস্তান সে কথার উত্তর দিলো না। আস্তে করে বললো, “আমি যদি কালকে তোমাকে আমার সাথে নিয়ে যাই, সমস্যা হবে অটবী?”
অটবী বার কয়েক পলক ফেললো, “ক-কোথায় নিয়ে যাবেন?”

—“আমার কাছে। একেবারের জন্য।”

কথাটা শোনা মাত্রই ত্রিস্তানের হাতদুটো শক্ত করে ধরলো অটবী।

_____________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

অটবী সুখ পর্ব-২৪+২৫

0

অটবী সুখ

২৪.
রাত ঠিক কত হবে? অটবীর জানা নেই। ঘড়ি দেখা হয়নি। বাসায় এতক্ষণে নিশিরাতের গভীর ঘুমে সবাই। তার বড়োলোকি আত্নীয়দের কেউই তাদের এই ভাঙ্গা বাসায় থাকতে আগ্রহী নয়। বিয়ে ভাঙ্গা পরপরই একরাশ উত্তাপে ভরা সমালোচনার পর যার যার বাসায় চলে গেছে। পরিবেশটা তখন থেকেই গুমোট, নিস্তব্ধ। অটবী পায়ে পায়ে পেছনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলো। আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে মুখস্ত শিক্ষার্থীর মতো চলে গেল নিজ রুমে। নলী আর পৃথা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ঘোর তন্দ্রায় বিভোর হয়ে আছে। ঘুমানোর ধরনটা এলোমেলো। নিশ্চিৎ এতক্ষণ তার জন্য অপেক্ষা করছিল! ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে ওদের দিকে এগিয়ে গেল অটবী। সুন্দর করে শুইয়ে দিয়ে কাথা টেনে দিলো। এ মেয়ে দুটোর ঘুম আবার ভীষণ ভালো। একবার ঘুমালে প্রচন্ড শব্দেও সহজে ঘুম ছেড়ে উঠে না।

ফোনে তখন অত চার্জ নেই। কোনোমতে লম্বালম্বি বক্সে একদাগ অবশিষ্ট আছে। নষ্ট ফোনে এইটুকু চার্জ পাঁচ মিনিটও ঠিকবে না। কিন্তু ত্রিস্তান বলেছিল, বাসায় ফিরে একটা মেসেজ দিতে। দিবে কি? লোকটা যদি অপেক্ষায় থাকে?
নলীদের পাশের অল্প জায়গায় রয়েসয়ে গা এলালো অটবী। ফোনের কন্টাক্ট লিস্টের টি(T) অক্ষরের ত্রিস্তান নামটি খুঁজে বের করলো চটজলদি। বার্তা পাঠালো, “বাসায় পৌঁছেছেন?”

সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এলো না। সময় নিলো। অটবীর অধীর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ফোনে জ্বলজ্বল করলো তিনটি অক্ষরের শব্দ, “এসেছি।”
তারপর আবার টুং করে শব্দ হলো, “এখন কি করছো? বাসার কেউ কিছু বলেছে?”

অটবী দ্রুত টাইপ করলো, “না। সবাই ঘুম।”
—“আচ্ছা।”

এরপর আর কোনো বার্তা এলো না। অটবী অক্লান্ত চোখে পিটপিট করে চেয়ে দেখলো আলো আঁধারিয়া আকাশটাকে। চোখে ঘুম নেই। ফোনটাও ততক্ষণে চার্জের অভাবে প্রাণহীন হয়ে পরে আছে, বদ্ধ হাতের মুঠোয়। অথচ মস্তিষ্কে এক নিদারুণ অলসতা অনুভব করছে সে। কিছু ভাববার অলসতা। ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিকল্পনার অলসতা। সে কি সত্যি ত্রিস্তানের হয়ে গেছে? ত্রিস্তান কি এখন তার? সব এত জলদি জলদি হয়ে গেছে যে অটবীর মনে হচ্ছে, সে বুঝি কোনো কাল্পনিক গল্পের সুখী চরিত্র! চরিত্রটা যদিও খারাপ নয়। অটবী বোধহয় ছোট থেকে এমনই এক সুখ সুখ চরিত্রের সন্ধানে ছিল। সন্ধ্যান পেয়ে যেতেই নিজেকে এখন কেমন নির্ভার, চিন্তামুক্ত লাগছে!

সকাল থেকে রেবা বেগম খুব কম কথা বলছেন। প্রয়োজন ছাড়া তার কণ্ঠনালি গলিয়ে একটা টু শব্দও বেরুচ্ছে না। অটবীর তাই অল্পসল্প মন খারাপ। সকালে সে মুশফিক ছেলেটাকে কল করার চেষ্টা করেছিল। প্রত্যেকবারই ফোন বন্ধ বলছে। মুশফিকের কাছে অটবী যেমন কৃতজ্ঞ, তেমনি ছেলেটার জন্য একটা সুক্ষ্ণ অপরাধবোধও ভেতরে ভেতরে কাজ করছে। পাশাপাশি এ-ও জানতে ইচ্ছে করছে, শেষ মুহুর্তে ছেলেটা এমন বিয়ে ছেড়ে পালিয়ে গেল কেন? ঠিক কি কারণে? অটবীর ওপর প্রবল ঘৃণায়? হতে পারে। অটবী কাজটাই করেছে এমন।

নলী আর পৃথাকে বিদ্যালয়ে দিয়ে আসার পথে ত্রিস্তানের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল অটবীর। লোকটা মাত্রই জঙ্গলের পথ শেষ করে মেইনরাস্তায় পা দিয়েছে। ভ্রু দুটো কুঁচকানো। খুব বিরক্ত হয়ে ফোনে কি যেন টাইপ করছে। তাকে দেখেই থমকে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “কেঁদেছো?”

হকচকিয়ে অটবী উত্তর দিলো, “কই, নাতো!”
—“চোখ ফোলা তোমার।”
—“রাতে ঘুমাইনি। এজন্যই বোধহয়।” বলতে বলতে দু’চোখে একবার হাত ছোঁয়ালো অটবী। আসলেই চোখদুটো ফুলে আছে। হাত দিয়ে স্পর্শ করে মনে হচ্ছে, সে কোনো পানির বল ধরছে। এত ফুললো কখন?

ফোনটা প্যান্টের পকেটে পুরে ত্রিস্তান আবার বললো, “আর কোনো কাজ আছে তোমার? টিউশন বা অন্য কিছু?”
—“মায়ের কথায় টিউশন ছেড়ে দিয়েছিলাম। ওদের সাথে আর যোগাযোগ করা হয়নি।”
—“অন্য কোনো কাজ নেই বলছো?”
—“নেই।”

ত্রিস্তান এবার কাছাকাছি হলো। নির্বিকার ভঙ্গিতে অটবীর হাত ধরে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো, “তোমার কিছু গলার, হাতের কিসব রেখে গেছো বাসায়। নূপুরও দেখলাম। কালকে কি আমাকে বিয়ে করতে এসেছিলে নাকি যুদ্ধ করতে? ওগুলো খুলে রাখলে কখন? খুললে যখন আবার নিয়ে গেলে না কেন?”

অটবী সরু চোখে তাকালো। লোকটা এভাবে কথা বলছে কেন? গতকাল কান্নাকাটির এক পর্যায়ে সে ত্রিস্তানের গায়ে তার চুড়ি খুলে ছুড়ে মেরেছিল। গলার গহনা আর নুপুর তো লোকটার সামনেই খুলেছিল কাজী অফিস যাওয়ার পূর্বে। তাহলে? ‘কখন খুললো’– এসব জিজ্ঞেস করার মানে কি?
অটবী সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিলো, “আপনার সামনেই তো খুলেছিলাম ওগুলো। চোখ কি তখন আকাশে রেখে এসেছিলেন?”

ত্রিস্তান ততক্ষণে অটবীর হাতে হাত রেখে জঙ্গলের পথে পারি জমিয়েছে। এবারও তার নির্লিপ্ত জবাব, “নাওনি কেন আর?”
—“নেওয়ার সুযোগ ছিল? বিয়ের পর তো বাসাতেই চলে গিয়েছিলাম।”

ত্রিস্তান অটবীর দিকে না তাকিয়েই ভারী নিশ্বাস ফেললো, “ওহ! তাইতো!”

অটবী আশ্চর্য হলো। চূড়ান্ত পর্যায়ের আশ্চর্য, হতবাক, বিমূঢ়! লোকটার আসলে সমস্যা কি? কি চায়? অটবীকে বিরক্ত করতে এত মজা লাগে কেন তার? অটবীর তো মোটেও মজা লাগে না। বরং ত্রিস্তানের জায়গা অন্য কেউ এমন না বুঝে ঝগড়া করলে সে নিশ্চিৎ ওই ব্যক্তিকে দু’গালে দুটো চড় লাগিয়ে দিতো। একেবারে শক্ত হাতের কড়া চড়! ত্রিস্তান বলে বেঁচে গেছে।

সরোজ কিংবা তনয়া কাউকেই পাওয়া গেল না। তারা নাকি ঘুরতে বের হয়েছে। ত্রিস্তান অটবীকে সোফায় বসতে বলে রান্নাঘরে এগোতে এগোতে সুধালো, “কি খাবে?”

অটবী বসলো না। ত্রিস্তানের পিছু পিছু রান্নাঘরে ঢুকলো। পরিপাটি রান্নাঘর। এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে উত্তর দিলো, “কিছু খাবো না। খেয়ে বের হয়েছি।”
তারপর একটু থেমে আবার বললো, “আপনি সরোজকে আর কতদিন এখানে এভাবে রাখবেন? ওকে ওর বাসায় পাঠাচ্ছেন না কেন?”

ত্রিস্তান চপারবোর্ড আর ছুড়ি নিয়ে কি যেন খুটখাট করে কাটছে। উত্তরে আস্তে করে বললো, “ও যেতে না চাইলে আমি কি করতে পারি?”
—“ওর যে পড়ালেখার ক্ষতি হচ্ছে, সেটা বুঝতে পারছেন? এমনিতেই পড়তে চায় না।”
—“আমি পড়াচ্ছি ওকে।”

অটবী অবাক হলো খুব।
—“বই-খাতা, এসব কোথায় পেয়েছেন?”
—“চাচা দিয়ে গেছে কয়েকদিন আগে।”
এপর্যায়ে ধীর অথচ বিশাল বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো অটবী। চাচাকেও এরা হাত করে নিয়েছে। এখন তো তার আর কিছু বলার নেই। সরোজ যদি এখানে থেকে হলেও একটু পড়ালেখা করে, তাও-বা কম কিসের?

ত্রিস্তান এক এক করে পেয়াজ, ধনেপাতা, আলু, চপারবোর্ডে চপচপ করে কাটছে। খুবই দক্ষ হাতে। তার পুরুষালী হাতগুলো এত দ্রুত নড়ছে যে অটবী মনোযোগ সহকারে তাকিয়েও কুলকিনারা খুঁজে পাচ্ছে না। অথচ প্রত্যেকটার সাইজ এত পার্ফেক্ট! এত নিঁখুত!

ভাবনার অকূল পাথারেই ত্রিস্তান বললো, “অটবী? আমাকে একটু ওখান থেকে দুটো ডিম দাও তো।”

অটবী সাথে সাথে বাম পাশে তাকালো। মাঝারি আকারের একটা ফ্রিজ রাখা। আলতো পায়ে এগিয়ে সে ফ্রিজটা খুলতেই নিচ্ছিল, হঠাৎ তড়িৎ গতিতে আধখোলা ফ্রিজটা সশব্দে বন্ধ করে দিলো ত্রিস্তান।
অটবী ভয় পেল। চমকিত হয়ে দূরে সরে গেল কয়েক কদম। বিস্মিত নয়নে ত্রিস্তানের দিকে তাকাতেই দেখলো, লোকটা ভীষণ ঠান্ডা চাহনিতে চেয়ে আছে ওরদিকে। শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন করলো, “ফ্রিজ খুলছিলে কেন?”

অটবী দু’বার চোখের পলক ফেললো, “আপনি… ডিম দিতে বলেছিলেন।”
—“ফ্রিজে ডিম নেই।”
বলতে বলতে ফ্রিজের পাশের ঝুড়ি থেকে দুটো ডিম নিজেই নিলো ত্রিস্তান। অটবী কেমন দৃঢ় চোখে তাকিয়ে বললো, “ফ্রিজে এমন কি আছে? এমন কেন করলেন আপনি?”

ত্রিস্তান সরে এলো ওখান থেকে। একহাতে পরপর দুটো ডিম ভাঙ্গলো চুলার গরম পাত্রে।
—“কিছু নেই।”
—“আপনি ঘামছেন কেন?”
—“কই ঘামছি?”

অজান্তেই নিজের কপালে হাত ছোয়ালো ত্রিস্তান। নাহ্। লবণাক্ততার ছিঁটেফোঁটাও নেই। অটবী তখন দূর থেকে ত্রিস্তানকে পরখ করছিল। যত কঠিন পরিস্থিতিই হোক না কেন, ত্রিস্তান সবসময় তার মুখটাকে এত নির্লিপ্ত করে রাখে! এবারও করে রেখেছিল। কিন্তু ইদানিং কেন যেন ওই অতি স্বাভাবিক মুখটার ভীষণ গভীরে লুকিয়ে থাকা আতঙ্কগুলো অটবী ধরতে পারে। ওই রহস্যময় প্রাচীন গন্ধটা নাকে বার বার বারি খায়। মস্তিষ্কে জট পাকায়। অথচ…. ত্রিস্তান বলেছিল অরণ্যর ভেতর নাকি বেশি রহস্য থাকে? কই? সে তো কষ্টকে দেখছে, হাজারটা রহস্যে মোড়ানো, আষ্টেপৃষ্টে বন্ধী।

—“আমি একটু পর নাস্তা নিয়ে আসছি, অটবী। তুমি ড্রইংরুমে গিয়ে বসো। এখানে গরম।”
—“আমি কিছু খাবো না বলেছি।”
—“তোমার কথা শুনছে কে?”

আবারও! অটবীর দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে আবারও সেই শান্ত দৃষ্টিটা ছুঁড়ে দিচ্ছে ত্রিস্তান। দৃষ্টিটা অটবীর পছন্দ নয়। এই দৃষ্টির কারণেই ত্রিস্তানকে অচেনা লাগে। সমুদ্র সমতুল্য রহস্যময় মনে হয়।

কাল রাত্রির নির্ঘুম, ক্লান্ত, অবসর প্রিয় চোখদুটো ত্রিস্তানের অপেক্ষায় অপেক্ষায় কখন যে সোফাতেই নিস্তেজ হয়ে গেল! অটবীর খেয়াল নেই। ঘুম ভাঙ্গলো এর ঘন্টাখানেক পরই। চোখে মেলে নিজেকে আর সোফাতে পেল না সে। নরম বিছানায় কারো বাহুবন্ধনে আবিষ্কার করলো। তার গলায় লোকটা মাথা গুঁজে আছে। অটবীর নিজের হাত দুটোও লোকটার গলা জড়িয়ে, চুলের গভীরে। চুলগুলো এত ঘনকালো! পরনের কুঁচকানো শার্ট, পুরুষালী গঠন দেখে যদিও বোঝা যায়, এটা ত্রিস্তান। কিন্তু অটবী জানে, ত্রিস্তান ছাড়া তাকে এভাবে জড়িয়ে ধরবে কে?

অটবী আস্তে করে ডাকলো, “ত্রিস্তান? আপনি কি ঘুমাচ্ছেন? ছাড়ুন আমাকে!”

ওপাশ থেকে জবাব নেই। অটবী মাথা উঁচিয়ে একবার ত্রিস্তানকে দেখে নিলো। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন! সে আবার ডাকলো, “ত্রিস্তান! উঠুন!”

ত্রিস্তান নড়লো ক্ষীণ। অস্পষ্ট কণ্ঠে আওড়ালো, “জ্বালাচ্ছো কেন?”
—“আমি জ্বালাচ্ছি?”
—“জ্বালাচ্ছোওই তো, অরণ্য। জ্বালিয়ে আমার বুক ব্যথা করে দিচ্ছো।”

______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

অটবী সুখ

২৫.
ত্রিস্তানের ঢিলে হাতদুটো নড়েচড়ে এবার শক্ত করে জড়িয়ে নিয়েছে অটবীকে। সে ঘুমের মাঝে কথা বলছিল। প্রয়োজন মাফিক কথাটুকু বলেই আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। অটবী দু’তিনবার ডাকলেও আর সারাশব্দ পাওয়া যায়নি। বরং ত্রিস্তানের ওই পুরুষালি কঠিন মুখটার নমনীয় হয়ে পরে থাকাটা বেশ লাগছে তার। এত স্নিগ্ধ! এত আদুরে! চোখের পাপড়িগুলোও কি লম্বা! একবার ছুঁয়ে দেখবে কি? অটবী প্রথমে নিজের চোখের পাপড়ি ছুঁয়ে দেখলো। এরপর কাঁপা হাতে ত্রিস্তানের। পরিমাপ করে দেখলো, নাহ্! ত্রিস্তানের পাপড়িগুলো তার চেয়েও একটু বেশি লম্বা। ঘনও বটে।
কাঁপা আঙুলদুটো আস্তে আস্তে গাল ছুলো। এরপর নাক, চিবুক! ঠোঁটের আশপাশে যাওয়ার সাহস হলো না। দ্রুত হাতটা সরিয়ে নিলো অটবী। একটু চেষ্টা করতেই ত্রিস্তানের বাঁধন থেকেও ছাড়া পেয়ে গেল। এবার সে কি করবে? চলে যাবে? ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো, মাত্র দুপুর তিনটে বেজে এক মিনিট। সে ঘুমিয়েছিল একটার আশপাশে। বেশি ঘুমোয়নি তবে। নলী আর পৃথার স্কুল ছুটি হতেও আরো একঘণ্টার মতো বাকি। তাহলে তো একটু থাকাই যায়।

সরোজ তনয়াকে জোড় করে নলীদের স্কুলের ওখানে নিয়ে গেছে। তনয়া যেতে চাইছিলো না। বার বার জিজ্ঞেস করছিল, “তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো, সরোজ ভাইয়া?”

সরোজ ক্ষীণ বিরক্ত হয়ে বললো, “আমি তোমার ভাইয়া হই না, আপু। কতবার কমু?”
—“যারা বড়, তাদেরকে তো ভাইয়াই ডাকতে হবে। ত্রিস্তান ভাইয়া বলেছে। তাছাড়া তুমি আমার থেকে কত লম্বা দেখেছো?”

টিফিন ছুটি দিয়েছে মাত্র। শিক্ষার্থীরা এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করছে। নলী তো বলেছিল, টিভিন ছুটি হলেই দৌঁড়ে আসবে। তাহলে? এখনো আসছে না কেন? তাকে কি খুঁজে পাচ্ছে না? সে কি একটু গাছের আড়াল থেকে বের হয়ে দাঁড়াবে?
যথারীতি গাছের আড়াল থেকে একটি দূরে সরে দাঁড়ালো সরোজ। তনয়ার অধৈর্য চাহনি একবার লক্ষ করে উত্তর দিলো, “হেইডা তো বয়সে বড় হইলে কইতে কইছে। আমি তোমার থেইকা লম্বা হইলেও বয়সে তুমি বড়। ধরো, তুমি আইফেল টাওয়ার হইলে আমি হইলাম গিয়া পুদিনা পাতা।”

তনয়া চোখ পিটপিট করে বারকয়েক পলক ফেললো। অবুজ কণ্ঠে সুধালো, “আইফেল পাওয়া, সেটা কি ভাইয়া?”

সরোজ যেন বুঝতে পারলো না। কান খাঁড়া করে, ভ্রু দুটো কুঁচকে বললো, “কি, কি? কি বললা?”
—“আইফেল পাওয়ার, এইটা কি?”

ঠোঁট দুটোর মধ্যিখানে বিস্তর ফাঁক দেখা দিলো। কিচ্ছুক্ষণ নিরবে তনয়ার দিকে চেয়ে থেকে বিশাল লম্বা শ্বাস ফেললো সরোজ। বেদনা ভরা কণ্ঠে বললো, “কিচ্ছু না আপু। ওইটা কিচ্ছু না।”

দেখা গেল, একটু পরই নলীর দেখা মিলেছে। ওইতো! স্কুল ড্রেস পরা, পিচ্চি পিচ্চি ভাব নিয়ে এগিয়ে আসছে মেয়েটা। এসেই চঞ্চল, তাড়া লাগানো গলায় বলে উঠলো, “বেশি কিন্তু সময় নেই। কি জরুরি কথা বলবেন বলেছিলেন? বলে ফেলুন।”

সরোজ মন খারাপ হলো। খুব! খুব! খুব!
—“আমি কি খালি জরুরি কথা কইবার আহি? প্রেম প্রেম কথা কইবার আইতে পারি না? এমন আছরণ ক্যান করতাছিস নীলিমা? তুই মেলা পাল্টাই যাইতেছিস।”

সরোজের কথায় তেমন একটা পাত্তা দিতে দেখা দিলো না নলীকে। বরং তনয়ার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো সে। জিজ্ঞেস করলো, “কেমন আছো আপু? কি হালচাল?”

তনয়া হেসে মাথা দুলালো মাত্র। যার অর্থ, সে ভালো আছে।
পাশ হতে সরোজ আবারও বললো, “তোরে কিছু কইছি নীলিমা। উত্তর দেস না ক্যালা?”
—“কি উত্তর দিবো? এখন থেকে এসবের অভ্যাস করুন। নরম মন পেয়ে অনেক জ্বালিয়েছেন।”

সরোজ অধৈর্য হলো, “আমি জ্বালাইছি? কখন? কোন সময়? তুই এ-না জ্বালাইতেছিস আমারে। আমার পরাণডা দেখছিস? তোর দহনে পুইড়া যাইতেছে রে…!”

নলী সরাসরি তাকালো এবার। চোখে চোখ রাখলো। ভীষণ গম্ভীর কণ্ঠে বললো, “আপনি আমাকে বিয়ে করতে চান?”

সরোজের তৎক্ষণাৎ উত্তর, “হ, চাই।”
—“তাহলে এসব বাজে ঘোরাঘোরি বন্ধ করে পড়ালেখায় মন দিন। নয়তো আমি একদম ভেগে যাবো। আপনাকে মোটেও বিয়ে করবো না।”

সরোজের দু’চোখ বড় বড়। প্রবল আতঙ্ক নিয়ে দাঁত দিয়ে জিভ কেটে বললো, “তওবা তওবা, আস্তাগফিরুল্লাহ্! এইরম কথা কইবার পারলি নলী? তুই ছাড়া আমার জীবন কেমনে ধ্বংস হইবো হেইডা জানোস তুই? হেইডা জাইনাও এইরম কথা কইবার পারলি? বুক কাঁপলো না তোর? জিহ্বায় আটকাইলো না?”

নলী এইবারও পাত্তাহীন। তবে ক্ষীণ বিরক্ত হতে দেখা গেল। ডান হাতের ঘড়িটির দিকে একবার তাকিয়ে যেনতেন ভাবে বললো, “সময় নেই আমার। আর কথা বলতে পারবো।”
সরোজ আবারও চমকালো, “তুই তো আইলিই মাত্র।”

নলীর দায়সারা চেহারার দিকে একবার তাকিয়ে আবার বললো, “এমন করতাছিস কেন, নলী? তুই এহন আমারে একদমই সময় দিবার চাস না।”
—“দিবো। আগে ঠিকঠাক পড়ালেখা করুন।”

নলী চলে গেল। পেছনে ব্যর্থ প্রেমিকের মতো পরে থাকা সরোজ উত্তপ্ত দাবানলের মতো ফুসে উঠলো যেন। সে যদি পারতো, এই পড়ালেখা আবিষ্কার করা লোকটিকে কবর থেকে উঠিয়ে ঠাস ঠাস করে কয়েকটা গুলি মেরে দিতো! ফাজিল লোক! দুনিয়াতে আজব জিনিসের অভাব ছিল? এর এই পড়ালেখাই আবিষ্কার করতে হবে? আশ্চর্য!

কচ্ছপের গতিতে চলতে থাকা সময়টাতে বড্ড আলসেমি লাগছে অটবীর। ত্রিস্তানের ঘরে নতুন করে কিছু ঘুরে দেখার নেই। তবে বুকসেল্ফের বইগুলো থেকে একটা বই নিয়ে সময় কাটানো যায় অবশ্য। কিন্তু ত্রিস্তান আগেরবার যা কান্ড ঘটিয়েছিল, তা থেকে ওই ইচ্ছেটাও শক্ত করে জন্মাচ্ছে না।
ঘুমন্ত ত্রিস্তানকে আরও একবার দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে পরলো অটবী। পুরাতন হলেও বাড়িটাতে একটা রাজকীয় ভাবসাব আছে। একেকটা জিনিস এত মানানসই! যেন এই বাড়িটাকে উদ্দেশ্য করেই বানানো হয়েছে সব। অটবী ধীর পায়ে টেবিলের ওপাশে টাঙানো ত্রিস্তানের পারিবারিক ফ্রেমটার দিকে এগোলো। প্রথমেই দৃষ্টি ছুটলো, ত্রিস্তানের মায়ের পানে। তাকে কাছ থেকে আরও বেশি সুন্দর দেখায়। গায়ের ফর্সা রঙটা সাদা বাতির মতো জ্বলজ্বলে। নীল চোখের মণিটা যেন ফ্রেম থেকে বেরিয়ে এসে দেখছে অটবীকে। এত নিখুঁত, স্পষ্ট! ত্রিস্তানের বাবাও যদিও কম নন। অটবী হলফ করে বলতে পারে, ওইসময়কার শত রমণীর রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়া স্বপ্নপুরুষ তিনি। মা-বাবা এত সুন্দর বিধায় তনয়া আর ত্রিস্তানও তাই বোধহয় এমন সৌন্দর্যের পুজারি হয়েছে। দুজন যেন চাঁদের দুটো টুকরো।

কোমল গোলাপের মতো ফুটে থাকা ত্রিস্তানের মুখখানা একটু করে ছুয়ে দেখলো অটবী। আলতো করেই। কিন্তু আকস্মাৎ কি যে হলো! ছবির ফ্রেমটা কেমন কেঁপে উঠলো। একেবারে আলাদিনের চেরাগের মতো ডানপাশে সরে ছোট্ট লকারের মতো কি যেন বেরিয়ে এলো। পুরানো দিনের লকার। তালা নেই। অনেকটা কৌতূহল নিয়েই লকারটা খুললো অটবী। সোনালী রঙের রিংবক্স মধ্যিখানে পরে আছে। বক্সের ঢাকনা নেই। ময়লা ট্যিসুর ওপর একটা ঝকঝকে চাবি শোয়ানো। অটবী চাবিটা ধরতে নিবে, পূর্বেই সদর দরজা খোলার আওয়াজ হলো হঠাৎ। সঙ্গে সঙ্গে ভূমিকম্পের মতো কেঁপে উঠলো অটবী। দিকবেদিক শূণ্য হয়ে ধাম শব্দে লকার লাগালো। ছবির ফ্রেমটা টেনে ওপাশে নিতে নিতেই সরোজের কণ্ঠ শোনা গেল, “আরে… অটবী আপু যে? কখন আসলা? ওখানে ফ্রেম ধইরা কি করতাছো?”

ততক্ষণে ফ্রেম ছেড়ে সরে দাঁড়িয়েছে অটবী। ইতোমধ্যে কপালে ঘাম ছেড়ে দিয়েছে। শুষ্ক ঢোক গিলে সে উত্তর দিলো, “দে–দেখছিলাম, ছবিটা।”

সরোজ দাঁত বের করে হাসলো। হি হি শব্দ হলো ওতে। বললো, “তুমি এইহানে আইলেই ছবিটার দিকে তাকায় থাকো। এতো ভাল্লাগে তোমার ছবিটা? ত্রিস্তান ভাইরে কও, তোমারে ছবিটা যেন দিয়া দেয়।”
একটু থেমে রান্নাঘরে একপলক উঁকি দিলো সরোজ। এরপর আবার সুধালো, “ভাই কই?”

অটবীর দৃষ্টি এলোমেলো, “ঘু–ঘুমাচ্ছে।”

তনয়া দৌঁড়ে আসলো তক্ষুণি। অটবীকে এতদিন পর দেখে তার খুশির অন্ত নেই। অটবীর হাত দুটো মুঠোয় পুরে, দুলিয়ে দুলিয়ে আবদার করলো, “অটবী আপু, আমার সাথে খেলবে?”

তনয়ার মিষ্টি মুখপানে চেয়ে অটবী হাসলো ঠিক, কিন্তু তার ভেতরকার পরিস্থিতি এখনো সেই ছবির ফ্রেমের ভেতরেই আটকে আছে। অজানা চাবিটা নিয়েও খুব চাপাচাপি করছে মস্তিষ্ক। আর কত… আর কত রহস্য লুকিয়ে আছে এই বাড়িটায়? কেমন রহস্য লুকিয়ে আছে? বাজে? নাকি খুব বাজে?

ত্রিস্তানের ঘুম ভাঙলো একটু পরই। ঘুম ভাঙ্গার সঙ্গে সঙ্গে সে এসে হাজির হলো তনয়ার ঘরে। অটবী তখন তনয়ার সাথেই খেলছিল। তনয়ার ছবি আঁকার হাত মারাত্বক! এত সুন্দর আঁকে মেয়েটা! সে বসে বসে একেকটা ছবি মুগ্ধ নয়নে দেখছিল। ত্রিস্তান এসে পাশে দাঁড়াতেই মুখ উঁচিয়ে তাকালো।

মাত্র ঘুম থেকে ওঠা মুখ! ক্ষীণ তৈলাক্ত ভাবটুকু বাতির আলোয় চিকচিক করছে। চোখ আর ঠোঁট কিঞ্চিৎ ফোলা। ঝাকড়া চুলগুলো এলোমেলো। কপাল ঢেকে রেখেছে। পরনের শার্টটাও বাজেভাবে কুঁচকানো।
অটবী ত্রিস্তানের সরু চোখের দিকে চেয়েই জিজ্ঞেস করলো, “মাত্র উঠেছেন?”

ত্রিস্তানের একবাক্যে উত্তর, “হ্যাঁ।”

অটবী উঠে দাঁড়ালো এবার। তনয়ার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বললো, “আমি আজকে আসি তাহলে? পরে তোমার সাথে খেলবো?”

—“আমি সাথে যাচ্ছি। চলো।” পাশ থেকে বলে উঠলো ত্রিস্তান। কিন্তু অটবী রাজী হলো না, “যেতে পারব আমি। শুধু শুধু কষ্ট করতে হবে না।”

—“আমি বলেছি কষ্ট হবে?” ত্রিস্তানের দৃঢ় কণ্ঠস্বর।
—“আমি যখন যেতে পারবো তখন আপনার শুধু শুধু যাওয়ার দরকার কি?”
—“আমি তোমাকে একা ছাড়বো কেন?”

অটবী থমকালো। চোখ ঝাপটালো বার কয়েক। কথাটা হজম করতে মিনিটখানেক সময় নিয়ে বললো, “আমি বাসায় যাবো না এখন। স্কুলে যাবো। একটু পর নলীদের স্কুল ছুটি হবে।”
—“তো?”
—“তো মানে? স্কুলে আপনার কাজ কি?”

বলতে বলতে ত্রিস্তানের দিকে তাকালো অটবী। লোকটা ভ্রু কুঁচকে রেখেছে। চোখে-মুখে নিখাঁদ বিরক্তি! অটবী বুঝে পাচ্ছে না, লোকটার আজ হলো কি? কথায় কথায় এত তর্ক করছে কেন?

ত্রিস্তান সেই নিঁখাদ বিরক্তি নিয়েই প্রশ্ন ছুঁড়লো, “তুমি আমার সাথে যাবে না?”
—“না।”
—“সত্যি যাবে না?”
—“না বলেছি তো।”

ত্রিস্তান তপ্ত একটা নিশ্বাস ফেললো। মেঝের দিকে একবার চেয়ে অটবীর দিকে তাকালো আবার। কেমন কেমন করে যেন বললো, “তুমি কিন্তু তোমার বরের অবাধ্য হচ্ছো, অটবী!”
হকচকালো অটবী, “কিহ্?”
—“তোমাকে কিন্তু আমি সবসময় শাড়ি পরিয়ে রাখবো।”
—“কি আবলতাবল বকছেন?”
—“তোমাকে কিন্তু আমি বেঁধে রাখবো, অটবী।”
—“আশ্চর্য ত্রিস্তান! তনয়াকে দেখছেন না আপনি?”

তনয়ার দিকে তাকিয়ে কথাটা বললো অটবী। সে হা করে তার ভাইকে একবার, তারপর অটবীকে একবার দেখছে। অথচ ত্রিস্তানের সেদিকে খেয়াল, ধ্যান কিচ্ছু নেই। সে নির্বিকার কণ্ঠে আবারও সুধালো, “তুমি আমার সাথে যাবে না?”
—“না।”
—“আমি কিন্তু তোমাকে এখন কোলে নিবো, অটবী।”
—“ত্রিস্তান!”
—“তোমাকে কিন্তু…”

অটবী আর বলতে দিলো না। হাত টেনে ঘরের বাহিরে যাওয়ার সময় খেয়াল হলো, দরজায় হেলান দিয়ে সরোজ নিঃশব্দে পেট জড়িয়ে হাসছে। ব্যাপারটায় খুব লজ্জা পেল অটবী। নিচু গলায় ত্রিস্তানকে বকলোও, “এমন করলেন কেন আপনি? লজ্জা নেই?”

ত্রিস্তান কি একটু হাসলো? অটবী দেখতে পেলো না।

________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

অটবী সুখ পর্ব-২২+২৩

0

অটবী সুখ

২২.
বিষণ্ণ ক্ষণ। বিষণ্ণ আকাশ। বিষণ্ণ সন্ধ্যে। বিষণ্ণ অটবীর চাপা মনটাও। বিয়ের দিন-তারিখ সব ঠিক হওয়ার পর থেকে তার সুশ্রী মুখটা মলিন রঙে ঢেকে গেছে। ভেতরটা নিদারুণ উদাসীনতায় জড়োসড়ো, আতঙ্কিত। অটবী বসে আছে ঠিক জানালার মাঝখানটায়। নির্জীব দৃষ্টি দূর গহীনে। হাতে ফোন। ফোনের স্ক্রীনে মুশফিকের নামটা গোটা গোটা অক্ষরে জ্বলজ্বল করছে। বিয়ের কথাবার্তা আগানো মাত্রই মুশফিক ছেলেটা কেমন যেন অদৃশ্য অধিকার দেখাচ্ছে অটবীর ওপর। এটা করো না, ওটা করো না, ফোন দিলে সাথে সাথে ধরবে– ইত্যাদি! ইত্যাদি! অটবীর ব্যাপারটা ভালো লাগছে না। বিরক্ত অনুভূত হচ্ছে। কিন্তু তাতেই-বা কার কি? কে তার মনের অবস্থাটুকু শুনবে? মায়ের তো ওই এক কথা! এখানেই বিয়ে করতে হবে। নয়তো আবার সেই জেদি অভিমান!
নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অটবী কলটা ধরলো। সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন কণ্ঠ, “ফোন কই থাকে তোমার? এতক্ষণ লাগে কল ধরতে?”

সম্পর্কটা আপনি থেকে তুমিতে বদলেছে। অটবীর ক্ষেত্রে না, মুশফিকের দিক থেকে। আর এই বিষয়টাই অটবীকে ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে দিচ্ছে। বিষাদগ্রস্ত করে তুলছে।
সে ধীর গলায় জবাব দিলো, “ওয়াশরুমে ছিলাম।”

ওপাশ থেকে একটা ছোট্ট নিশ্বাসের শব্দ পাওয়া গেল। পরপরই অনেকটা প্রেমে মাখোমাখো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “এখন কি করছো? নাস্তা করেছো?”
অটবীর ছোট্ট উত্তর, “হু।”
—“আমি খেয়েছি কি-না জিজ্ঞেস করবে না?”
—“আপনি খেয়েছেন?”
প্রশ্নের ধরণটা অনেকটা দায়সারা, নির্জীব। ফোনের অপর পাশের ব্যক্তিটা সম্ভবত বুঝতে পারলো। একটু চুপ থেকে কিঞ্চিৎ মন খারাপ নিয়ে বললো, “তুমি কি এ বিয়েতে রাজি না, অটবী? তোমার আচরণ, কথার ধরণ, বিয়ের প্রতি কোনো আগ্রহই নেই তোমার! বিয়ের সপিংটা পর্যন্ত আমার সাথে করতে গেলে না। এমন কেন করছো?”

অটবী এমন কেন করছে? প্রশ্নের উত্তরটা তারও জানা নেই। দুই-তিন দিন ধরে সে এই একটা প্রশ্নের উত্তরই খুঁজে চলেছে। কিন্তু প্রশ্নটা বড্ড কঠিন, খুঁজে পাওয়া মুশকিল। শুধু এটুকু জানে, এই বিয়ে সে করতে চায় না। এই এলাকা ছেড়ে সে চলে যেতে চায় না। মুশফিককে চায় না। মাকে, নলীকে, পৃথাকে! কাউকে ছেড়ে যেতে চায় না। আর ত্রিস্তান? তাকে নিয়ে অটবীর চিন্তা ঝাপসা, অস্পষ্ট। শুধু একটুখানি অনুভূতি থেকে উপলব্ধি করে সে তার নাম দিয়েছে, “হৃদয় কামড়ানো নীল ব্যথা!”

রান্নাঘর থেকে রেবা বেগম হাঁক ছাড়ছেন। চা, পরোটা বানানো হয়ে গেছে। সবাইকে খেতে ডাকছেন। ফোনের ওপাশ থেকে মুশফিক ডাকটা শুনলো। অটবীকে কিছু বলতে না দেখে নিজেই কথা আগালো, “উত্তর দিবে না? আবারও বাহানা করে কথা কাটিয়ে দিবে?”

অটবী ম্লান হাসলো। দু’এক সেকেন্ডের জন্য। এরপর আস্তে করে বললো, “রাখছি।”

কল কেটে মোবাইলটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে রাখলো অটবী। চেয়ার থেকে ওড়না নিলো। গায়ে জড়ালো। ঘর থেকে বের হয়ে দেখলো, তার দুই বোন, দুই পন্ডিত আগে থেকেই খাবার টেবিলে বসে ওর জন্যে অপেক্ষা করছে। মন তাদেরও খারাপ। বোনের বিয়ে এখনই হোক, সেটা তারাও চায়নি।
অটবী নিঃশব্দে ওদের পাশের চেয়ারটাতে বসলো। ভ্রু কুঁচকে বললো, “খাচ্ছিস না কেন? খাওয়া শুরু কর।”

নলী ঠোঁটে ঠোঁট চেপে করুণ গলায় বললো, “আর মাত্র দুইদিন আপা।”
—“কিসের দুইদিন?”
প্লাস্টিকের একটা বৈয়ম থেকে বিস্কুত নিয়ে কামড় বসালো অটবী। নলী আবারও বললো, “তারপর আর তোমাকে যখন তখন জড়িয়ে ধরতে পারবো না।”

বিস্কুটের অবশিষ্ট অংশটুকু গলায় আটকে আটকে নামলো যেন। খুব রয়েসয়ে। চোখের পাতা ক্ষীণ কাঁপলো। নিশ্বাস থমকালো। অটবীর কি বুক চিঁড়ে কান্না আসছে? কারো কি বুক চিঁড়ে কান্না আসে কখনো? তাহলে তার এমন লাগছে কেন? জগ থেকে পানি নিয়ে ঢকঢক করে গিললো অটবী। কৃত্রিম ধমকের সুরে বললো, “এসব কি কথা? এমন কথা তোদের মাথায় ঢুকিয়েছে কে?”

নলী, পৃথা কিছু বললো না। কাঁদলো মাত্র। তাদের মিষ্টি চেহারায় এই বিষাদ কান্না বেমানান। বিশ্রী রকমের নিষ্ঠুর। কিন্তু অটবী তাদের কাঁদতে মানা করলো না। জোরপূর্বক চুপচাপ বিস্কুট চিবুতে লাগলো। ততক্ষণে রেবা বেগম রান্নাঘর থেকে চা নিয়ে এসেছেন। মেয়েদের এমন কান্না দেখে কয়েক মুহুর্তের জন্য ভড়কে গেলেও পরক্ষণেই ধমকে উঠলেন, “কিরে? তোরা এভাবে মরা কান্না কাঁদছিস কেন? অটবীর সুখ কি তোদের সহ্য হয় না? মেয়েটা কি সারাজীবন তোদের জন্য ঘরে বসে থাকবে?”

তিক করে মেজাজটা চড়ে উঠলো। চাপা রাগটা সীমা অতিক্রম করতেই না চাইতেও অনেকটা উঁচু গলায় বলে ফেললো অটবী, “আশ্চর্য! ওদের বকছো কেন?”

রেবা বেগম শক্ত চোখে তাকালেন। শাসনের সুরে বললেন, “তো বকবো না? বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকে তুই একদম চুপচাপ হয়ে গেছিস। এখন আবার এদের কান্না! এই বিয়েতে তোদের এত সমস্যা কেন, বলতো? মুশফিক ছেলেটা কোন দিক দিয়ে খারাপ?”
—“কোনো দিক দিয়েও না। সে ভালো। কিন্তু আমি তার জন্য পার্ফেক্ট না। আমার এখন বিয়ে করারও ইচ্ছে নেই। তুমি জোর করছো, না খেয়ে থাকছো, কথা বলা বন্ধ করে দিচ্ছো! এগুলা কি মানসিক অশান্তি না?”
—“আমি এসব তোর ভালোর জন্য করছি, অটবী।”

হাহ! ভালোর জন্য! মুখে একটা তাচ্ছিল্যের রেশ ফুঁটে উঠলো অটবীর। খাওয়ার ইচ্ছে পুরোপুরি মরে গেল। চেয়ার ছেড়ে ঘরে যেতে নিলেই রেবা বেগম আবার ডেকে উঠলেন, “কোথায় যাচ্ছিস অটবী? খেয়ে যা!”

অটবী শোনে নি। দাঁড়ায়নি। চোখের পলকে ঘরে চলে গেছে। রেবা বেগম তার ছোট মেয়ে দুটোর দিকে তাকালেন এবার। ওদের মুখশ্রীতেও স্পষ্ট অসন্তুষ্টি। অথচ মেয়েগুলো বুঝতে পারছে না কেন? মা কি কখনো সন্তানের খারাপ চায়? মেয়ের বয়স হয়েছে। আর কত নিজের প্রয়োজনে, নিজের স্বার্থে মেয়েকে ঘরে বসিয়ে রাখবেন? পাড়া প্রতিবেশীরাও কম কথা শোনাচ্ছে না। মুশফিক ছেলেটা ভালো। টাকাপয়সা মোটামোটি আছে। অটবী সুখে থাকবে। তাহলে কেন তিনি এই বিয়ে চাইবেন না?

রাত তখন বারোটা। নলী, পৃথা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে গেছে বহু আগে। অটবীর চোখে ঘুম নেই। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে একাধারে দেখছে নিশ্চল, নিস্তব্ধ রাতটাকে। রাত যত বাড়ছে মনের শঙ্কা, ভয় ততই বেড়ে চলেছে তার। কাল বাদে পরশু বিয়ে। ছোটখাটো, ঘরোয়া অনুষ্ঠান। শুধুমাত্র পাত্রপক্ষদের কয়েকজন আত্মীয় আর রেবা বেগমের পরিচিত কিছু প্রতিবেশী থাকবেন। বিয়ে পরানোর পরপরই অটবীকে নিয়ে যাওয়া হবে অচেনা, অজানা জায়গায়।

মুশফিক দু’দিন আগে বিয়ের যাবতীয় গহনা, শাড়ি নিয়ে এসেছিল। আলমারিতে সেগুলো সে থেকেই পরে আছে। অটবী ছুঁয়ে দেখেনি। তার আগ্রহই জাগে নি কখনো। আজকাল সব আগ্রহ মিছে হয়ে যাচ্ছে। ধূলিসাৎ হয়ে কোথায় যে উড়ে যাচ্ছে! সরব, ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে দরজা খুলে গেল। রেবা বেগম এসেছেন। অটবী সেদিকে একবার তাকালো মাত্র। এর পরপরই নজর ফিরিয়ে নিলো।
রেবা বেগম কাঠকাঠ গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লেন, “রাত ক’টা বাজে, অটবী? এখনো ঘুমাস নি কেন?”

অটবী উত্তর দিলো না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। তিনি এবার গলার জোর আরেকটু বাড়ালেন, “কি বলেছি তোকে? ঘুমাতে যাচ্ছিস না কেন?”

বোধহয় কাজ হলো। অটবী চুপচাপ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরলো। নলীর পাশে। টু শব্দটিও করলো না। রেবা বেগম এগিয়ে এসে মেয়ের মাথার কাছে বসলেন। আলতো হাতে চুলে হাত বুলিয়ে দিলেন দু’চার মিনিট। সস্নেহে, অতি আদরে। তারপর শান্ত গলায় সুধালেন, “ঘুমিয়ে গেছিস, অটবী?”

অটবী এবারও জবাব দিলো না। রেবা বেগম একটা সুদীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলেন, “অটবী… তুই আমাদের জন্য অনেক কষ্ট করেছিস। অনেক! তোর বাবা দেখলে হয়তো বলতো, ‘আমার মেয়েটা বড় হয়ে গেছে!’ অবশ্য সে জীবিত থাকলে তোকে এতো কষ্টও করতে হতো না। শুন মা, আমি তোর ভালো চাই। তোকে প্রতিদিন ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরতে দেখলে কষ্ট পাই। তুই যখন রাতে দেড়ি করে ফিরিস, ভয়ে আমার বুক শুকিয়ে যায়। আমি চাই না আমাদের জন্য তোর জীবনটা এমন পরিশ্রমে পরিশ্রমে শেষ হয়ে যাক। তোর বিয়ের বয়স হয়েছে। তোর বাবা থাকলে হয়তো এতদিনে বিয়েটাও হয়ে যেত।”

একটু থেমে আরও একবার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি, “মুশফিক ছেলেটা ভালো। ব্যবহার সুন্দর। আশেপাশের মানুষ থেকেও খারাপ কিছু শুনিনি। সবচে’ বড় কথা, ছেলেটা তোকে নিয়ে অনেক ভাবে। নিজ থেকেই নলী আর পৃথার দায়িত্বও নিবে বলেছে। তুই তো এমন কিছুই চেয়েছিলি। তাহলে এই বিয়ে নিয়ে এত রাগ, নিষেধাজ্ঞা কেন? বিয়েটা খুশি মনে করে নে মা। তুই, আমি, আমরা সবাই ভালো থাকবো।”

অটবীর অনুভূত হলো, রেবা বেগম কাঁদছেন। লহমায় এ-ও বুঝতে পারলো, তার বন্ধ চোখ দিয়ে একটু একটু করে অশ্রু কণা বালিশ ভিঁজিয়ে দিচ্ছে। শুধু কি বালিশ? স্রোতের মতো তার জীবনটাকেও উলটপালট করে দিয়েছে।

গুমোট পরিবেশে একরাশ আচ্ছন্নতা হয়ে বারি খাচ্ছে তরঙ্গের মতো ভেসে বেড়ানো গানগুলি। হিন্দি গান, বাংলা গান, কত যে গান! কিছু কিছু গান অটবী কস্মিনকালেও শোনেনি। তার শোনার, জানার ইচ্ছেও নেই। সে আপাতত একদৃষ্টে আয়নার প্রতিবিম্বটির দিকে তাকিয়ে আছে। হলুদ বর্ণ গায়ে লাল শাড়িটা মানিয়েছে খুব। মুশফিক কোত্থেকে যেন পার্লারের মেয়ে পাঠিয়েছে। সে অতশত সাজেনি। কিন্তু তাতেও দেখতে খারাপ লাগছে না। কৃত্রিম স্বর্ণের মতো চিকচিক গহনায় বরং অপ্সরীর সঙ্গে তুলনা করা যাবে। মাথায় বড়সড় আঁচলের ঘোমটা। তাকে কি আজকে একটু বেশিই সুন্দর লাগছে? অথচ সে চেয়েছিল তাকে যেন আজকে খুব বাজে লাগে। খুব!

তখন বাজে দুপুর দুটো। বিকেল তিনটে বা চারটের দিকে বিয়ে পরানো শুরু হবে। অটবী এখন থেকেই আশেপাশের মানুষের হৈ-হুল্লোড় শুনতে পাচ্ছে। আহা! কি আনন্দ তাদের! কি উল্লাস! অটবী এত আনন্দিত হতে পারছে না কেন? তার ভেতরে তো কোনো আনন্দই কাজ করছে না।

—“আপু? তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।”
খানিকটা ভয় ভয় কণ্ঠ। অটবী পাশ ফিরে নলীর দিকে তাকালো। মেয়েটার কপাল অস্বাভাবিক ভাবে ঘেমে আছে। ক্ষীণ তোতলাচ্ছে, দ্বিধায় ভুগছে। অটবী ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো, “কি হয়েছে?”
—“তুমি ত্রিস্তান ভাইয়াকে ভালোবাসো, তাই না? ভাইয়াকে ভালোবাসলে এই বিয়ে করছো কেন?”

আচমকা এহেন কথায় হতবাক হলো অটবী। তৎক্ষণাৎ পুরো রুমে একবার করে চোখ বুলালো। নাহ্! আশেপাশে কেউ নেই।
—“তুই ইদানিং এমন অদ্ভুত কথা কোত্থেকে খুঁজে আনছিস, নলী? আমি তোর ত্রিস্তান ভাইকে কেন ভালোবাসতে যাবো?”
—“মিথ্যে বলছো কেন? আমি জানি তুমি ত্রিস্তান ভাইয়াকে ভালোবাসো। সেও তোমাকে ভালোবাসে।”
—“সে আমাকে ভালোবাসে না, নলী। আমিও বাসি না।”

নলীকে অধৈর্য দেখালো। মুখের রঙ পালটে, প্রচন্ড উৎকন্ঠা হয়ে বললো, “তুমি মায়ের মতো জেদ করছো আপা! এইসময় জেদ খাটে না। তোমার কাছে মাত্র আর কয়েক ঘণ্টা আছে। এখন যদি তুমি এমন বাচ্চাদের মতো করো, তাহলে কিভাবে কি হবে? বিষয়টা বুঝতে পারছো না কেন?”

অটবীর অনুভূতি শূণ্য চোখজোড়া শান্ত হয়ে গেল হঠাৎ, “তুই বড়দের মতো কথা বলছিস।”
—“কারণ তুমি বাচ্চাদের মতো করছো। ভালোবাসা ছাড়া কি জীবন চলে আপা? মুশফিক লোকটার সাথে কি ভালোবাসা ছাড়া সারাজীবন থাকতে পারবা? তোমার মনে তো শুধু ত্রিস্তান ভাইয়া।”
—“তুই এত কিছু জানিস কিভাবে?”
—“জানি এক ভাবে। তুমি দ্রুত সিধান্ত নাও। আমাদের হাতে বেশি সময় নেই।”

দু’হাতে দশটা, দশটা করে বিশটা কাঁচের চুড়ি অটবীর। লাল রঙের। একটু ধারালো। হাতে খোঁচা লাগছে। চুড়িগুলো কোনোমতে সামলে অটবী ধীর গলায় উত্তর দিলো, “এখন অনেক দেড়ি হয়ে গেছে, নলী। আমি চাইলেও কিছু হবে না।”
—“কে বলেছে হবে না? সরোজ ভাই পেছনের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। মা, পৃথা, বাকি সবাই সামনের উঠোনে। কেউ কিচ্ছু জানবে না আপা। তুমি পালিয়ে যাও।”

অটবী তৎক্ষণাৎ তাকালো। চোখে বিস্ময় নিয়ে শুধালো, “সরোজ এলো কোত্থেকে? নলী! তুই বারণ করার পরও সরোজের সাথে কথা বলেছিস?”
এপর্যায়ে নিজের বোনের প্রতি প্রচন্ড বিরক্ত হলো নলী। কিসব খেজুরে আলাপ লাগিয়ে দিয়েছে! ওইদিকে মায়ের আসতে দেড়ি নেই। এক্ষুণি এসে পরবেন।
চট করে অটবীর বাম হাত টেনে দাঁড় করালো নলী। টেনে নিয়ে পেছনের দরজার দিকে আগাতে নিলেই অটবী বাঁধা দিতে চাইলো, “আমি কোথাও যাবো না নলী। এটা হয় না। মা অনেক কষ্ট পাবে। তাছাড়া… ত্রিস্তান… সে আমাকে চায় না।”
বিরক্ত সূচক শব্দ করলো নলী,
—“কে বলছে চায় না? তোমারে এমন ওকালতি করতে কে বলছে? ত্রিস্তান ভাইয়া যে তোমার বিয়ের কথা শুনে ঘরবন্দি হয়ে আছে, সেকথা জানো?”

অটবী জানে না। জানতেও চায় না। এত কষ্ট করে নিজের মনকে বুঝিয়েছিল, নলী এসে এমন ঝড় তুলছে কেন? সে পরে নিজেকে সানলাবে কিভাবে?
—“নলী, হাত ছাড়! আমি কোথাও যাবো না। আর দু’ঘণ্টা পর বিয়ে। এখন… তুই হাত ছাড়!”

নলী ছাড়তে চাইলো না। কিন্তু অটবীর ধমকের পিঠে বেশি জোড় খাটাতেও পারলো না। মনে মনে ভীষণ কষ্টে মরে যেতে ইচ্ছে করলো ওর। তার বোন এমন কেন? সবার সুখের হিসেব রাখতে গিয়ে নিজের সুখের হিসেবটা এমন গোলমেলে করে ফেলছে কেন?
নলী থেকে হাত ছাড়িয়ে অটবী সোজা নিজের রুমে চলে গেল। আয়নায় তাকিয়ে দেখলো, তাকে দেখতে অদ্ভুত লাগছে। আগেও বিষণ্ণ লাগছিল। কিন্তু এখন কেমন যেন না পাওয়া কষ্টে, আফসোসে মৃত মানুষের মতো লাগছে। মৃত মানুষ! অটবীর ভেতরটা হঠাৎ করেই চমকে উঠলো। আধভাঙ্গা ড্রেসিংটেবিলের ওপর তার ফোনটা রাখা। মেসেজ আসায় স্ক্রীন জ্বলজ্বল করছে। ওতে লেখা, “অটবী, তোমার বউ সাজের একটা ছবি দেবে? আমি আসলে এতক্ষণ অপেক্ষা করতে পারছি না। রাস্তায় এত জ্যাম!”

মেসেজটা মুশফিকের।

_________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

অটবী সুখ

২৩.
যেন এক অসহায়, জীবনশূণ্য মানুষের মতো সমুদ্রের অতলে তলিয়ে যাচ্ছিলো অটবী। বাঁচার কোনো আশা নেই, চেষ্টা নেই, মায়া নেই! তারপর হঠাৎ করেই এক বিন্দু আলো সুদুর থেকে উঁকি দিতেই মনটা ঝটপটে হয়ে উঠলো। নির্জীব হাত-পা জোড়া হলো চঞ্চল। এদিক ওদিক শূণ্যে নাড়িয়ে, সাঁতরে উপরে উঠতে চাইলো যেন! তবুও মনে বিস্তর সংশয়, আঁতঙ্ক! সমুদ্রের তীরে কাঙ্ক্ষিত মানুষটা তার জন্য অপেক্ষা করবে তো? নাকি প্রতিবারের মতো ঠুনকো করে দূরে সরিয়ে দিবে?
প্রচন্ড ঝংকার তুলে ফোনটা বিশ্রী সুরে বেজে উঠলো। অটবী তখন দ্বিধাদ্বন্দে মিইয়ে বিছানার এককোণে বসে আছে। ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো, মুশফিক কল করেছে। অতিশয় দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেললো সে। ভেঙ্গেচুরে নিসাড় হওয়া নিজেকে স্বাভাবিক করে ফোন তুললো, “হ্যালো?”

ওপাশ থেকে হিন্দি গানের তীব্র শব্দ, হৈচৈ। কথা খানিকটা অস্পষ্ট শোনাচ্ছে। মুশফিক বলছে, “অটবী, কি করছো?”

অটবী সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো না। রয়েসয়ে উত্তর দিলো, “বসে আছি।”
—“তোমার সাথে কে আছে?”
—“কেউ নেই।”
—“তুমি একা একা বসে আছো? আচ্ছা, ভালো! খেয়েছ কিছু?”
—“হু।”

অটবীর কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছে না। প্রচন্ড হিংস্র কান্না বুকের ভেতর দলা পাকিয়ে গুমরে আছে। কি ভীষণ যন্ত্রণা! কথা বলতে গিয়েও কণ্ঠ কেমন কেঁপে কেঁপে অস্থির। মুশফিক হয়তো সেই কাঁপনটুকু অনুভব করতে পারলো। মুহুর্তেই কণ্ঠস্বর নরম করে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কি কাঁদছো অটবী? কি হয়েছে? আরে বাবা সব মেয়েকেই বিয়ে করতে হয়, পরিবার ছাড়তে হয়। তাই বলে এভাবে কাঁদবে? আমি কি তোমাকে খারাপ রাখবো নাকি?”

ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলো অটবী। তবুও হলো না। বাজে একটা করুণ সুর গলায় রয়েই গেল।
—“আপনাদের আসতে আর কতক্ষণ লাগবে?”
—“বেশি না। বিশ-পঁচিশ মিনিট। আরও আগে পৌঁছাতাম। কিন্তু রাস্তায় প্রচুর জ্যাম। তারওপর বাবা মিষ্টির দোকান থেকে কি কি যেন কিনছেন। এখনো দোকানের সামনেই বসে আছি।”

অটবী পুরো কথা শুনলো। খুব মনোযোগ দিয়ে। আস্তে করে বললো, “আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল। বলি?”
ওপাশ থেকে মুশফিকের আহ্লাদী কণ্ঠ, “জিজ্ঞেস করতে হচ্ছে কেন? বলে ফেলো।”

জানালার বাহিরে ঝলমলে আকাশ দেখা যাচ্ছে। একটুখানি রোদ্দুরে মাখো মাখো সাদা মেঘমালা। অটবী একপলক সেই আকাশটা দেখে নিলো। নাসিকাগ্রন্থে সতেজ নিশ্বাসটুকু টেনে নিয়ে চোখ বুজলো শক্ত করে। একদমে বললো, “ধরুন, আপনি কাউকে অনেক ভালোবাসেন। সেও আপনাকে ভালোবাসে। কিন্তু কিছু কারণে আপনাকে মেনে নিতে পারছে না। সেসময় আবার আপনার জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসে। আপনি অনেকটা জেদের বশে কিংবা নিজ মায়ের জোড়াজোড়িতেই বিয়েতে রাজী হন। বিয়ের একদম শেষ মুহুর্তে, আর দু’এক ঘণ্টা বাকি; আপনি জানতে পারেন আপনার ভালোবাসার মানুষটা আপনার বিয়ের সংবাদ পেয়ে ঘর বন্দি হয়ে আছে। আপনার এখন একদমই এই বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে না। সব জেদ, অভিমান ধুলোয় মিশিয়ে সেই মানুষটার কাছে ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে। এখন আপনি কি করবেন? বিয়েটা করে নিবেন?”

অটবী থামলো। উত্তরের অপেক্ষা করলো। এক সেকেন্ড, দু সেকেন্ড, এক মিনিট! কিন্তু মুশফিক কিছু বলছে না। ঘন ঘন নিশ্বাসের তেজি শব্দে কানে ঝং ধরিয়ে দিচ্ছে। অটবী এবার ডাকলো, “মুশফিক? শুনছেন আমার কথা?”

একটা তীব্র হাহাকারে ভরা নিশ্বাস! হতাশা! ফোনের ভেতর থেকেও মুশফিক ছেলেটার বিকৃত মুখটা চোখে ভেসে উঠলো অটবীর। শান্ত অথচ গনগনে গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লো, “মানুষটা তুমি, তাই না? তুমি এখন বিয়ে ছেড়ে পালাতে চাইছো?”
অটবীর কণ্ঠ ধরে এলো, “ন-নাহ্! আমি শুধু বলছি, আপনি কি করতেন?”
—“বিয়েটা করে নিতাম।”

চোখ বেয়ে একফোঁটা অশ্রু ঝরলো। শুনতে পেল, গাড়ির দরজা খোলার ক্ষীণ শব্দ। লহমায় আবার প্রচন্ড রূঢ় শব্দে দরজাটা আটকে পায়ের ধুপধাপ হাঁটার আওয়াজ। অটবীর ভয় বাড়লো। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলতে চাইলো, “আপনি একপাক্ষিক ভাবছেন।”
মুশফিক আক্রোশে ফেঁটে উঠলো, “তাহলে এখন কি চাইছো? এইমুহুর্তে বিয়েটা ভেঙ্গে দেই? আদৌ সম্ভব? তোমাকে আমি আগে জিজ্ঞেস করিনি? রাজী আছো কি নও কতবার জিজ্ঞেস করেছি? তখন তো চুপ ছিলে। এখন আবার কি প্রেম, ভালোবাসা; আশ্চর্য!”

নিচের ঠোঁটের পাতা কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলেছে অটবী। সে জানে সে ভুল। এমনটা.. এসময়ে.. এখন.. মোটেও বলা উচিত হয়নি। কেন যে বললো! মুখ দিয়ে কিছু উচ্চারণ করবে, তার পূর্বেই মুশফিক রাগে মিইয়ে কেমন শীতল অনুরোধ জারি করলো, “তুমি বরং পালিয়ে যাও, অটবী। তোমাকে আমার সহ্য হচ্ছে না।”

কিন্তু অটবী পালালো না। হু হু বুকের বিষক্ষয় নিয়ে চুপটি করে নিয়তির অপেক্ষায় রইলো। কাঁদলোও আবার। একটু একটু করে চোখের জলে সাজ-সজ্জা সব মলিন করে তুললো।
প্রাণ যখন একদম ফুরিয়ে আসছিল, বিয়ে করা ছাড়া আর কোনো উপায় চোখের সামনে ভাসছিল না, এমন সময় উঠোন থেকে হুলুস্থুল চিৎকার, চেঁচামেচি চারিদিকে তরঙ্গ ছড়ালো, “জামাই নাই! জামাই নাই! কই গেলা সবাই? জামাই তো পালাইছে।”

গুণে গুণে তিনটে ঘুমের ঔষধ খেয়ে ভোরবেলায় বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিল ত্রিস্তান। ঘড়িতে এখন রাত দশটা। কে যেন প্রচন্ড শক্তি নিয়ে সদর দরজায় কারাঘাত করছে। আশ্চর্য! দরজা ভেঙ্গে ফেলবে নাকি? ঘুমের মাঝেই চোখ, কপাল দারুণ চিত্তে কুঁচকে ফেললো ত্রিস্তান। ঘুম ভাঙ্গতেই লম্বা একটা নিশ্বাস নিলো। চোখে এখনো তন্দ্রা লেগে আছে। ঔষধের প্রভাব কাটেনি বোধহয়। এখন চোখটা বন্ধ করলেই অনায়াসে আরও দু’তিন ঘণ্টা আরামে ঘুমিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু এসময় তাকে বিরক্ত করতে দরজায় বারি দিচ্ছে কে? সরোজটাও-বা কোথায়? দরজা থাক্কানোর শব্দ কি সে শুনতে পাচ্ছে না?
দু’আঙুলে কপাল ঘঁষে মাথার টনটনে বিশ্রী ব্যথাটা আয়ত্বে আনার চেষ্টা চালালো ত্রিস্তান। আরও তিন-চার সেকেন্ড শুয়ে থেকে তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো। দরজার ওপাশে থাকা ব্যক্তিটি তখনো কারাঘাত থামায়নি। বরং থেমে থেমে, একটু পরপর তীব্র টোকার শব্দে নিস্তব্ধ পরিবেশটা গরম করে দিচ্ছে। ত্রিস্তানও অত একটা তাড়া দেখালো না। রয়েসয়ে একবার তনয়ার ঘরের ভেতরটা দেখে নিলো। তনয়া, সরোজ দুজনেই ঘুমাচ্ছন্ন। সরোজ মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে আর তনয়া বিছানায় রঙ পেন্সিল নিয়ে। আরেকদফা বহমান বাতাসের একটুখানি নিজের ভেতর টেনে আবার ছাড়লো ত্রিস্তান। পা বাড়ালো সদর দরজার উদ্দেশ্যে।

বাহিরে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। থেকে থেকে মেঘ ডাকছে। দরজা খুলতেই ভেতরের কৃত্রিম বৈদ্যুতিক আলো উঠোনে ছড়িয়ে পরলো তরতরিয়ে। দেখতে পেল, তার সামনে চিরচেনা, অপ্রত্যাশিত সেই মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। ত্রিস্তান কিঞ্চিৎ চিন্তায় মগ্ন হলো। ঘুমের ঔষধের প্রভাবটা কি এখনো যায়নি? স্বপ্নেতেও ত্রিস্তান অটবীকে এমন বউ সাজেই দেখেছিল। এখন আবার সামনে থেকে, একদম কাছ থেকে দেখছে! বুঝতে পারছে না, এটা তার কল্পনা নাকি বাস্তব? কল্পনাই হবে। নয়তো অটবী এখানে আসবে কোত্থেকে?

ভাবনা অকূল পাথারেই অটবী থমথমে গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লো, “এখন কি ভেতরেও ঢুকতে দেবেন না? এভাবে সামনে সং সেজে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”

নাহ্! স্বপ্নের অটবী মিষ্টি করে কথা বলছিল। এ মেয়ে স্বপ্ন হতেই পারে না! তবে কি বাস্তব? ত্রিস্তান আস্তে করে পলক ফেললো।
—“তুমি সত্যি?”

জবাব পাওয়া গেল না। অটবী কেমন কঠিন করে চেয়ে আছে, “এখনো সরছেন না কেন? ঢুকতে দেবেন না তাহলে?”
লহমায় ত্রিস্তান সরে দাঁড়ালো। তার মনে হচ্ছে, তার মাথায় গুটিকয়েক গাজুরিয়া মাইর পরেছে। কি তীব্র ব্যথা! সব কি ভীষণ উলোটপালোট!

অটবী গিয়ে সোফায় দ্বিধাহীন ভাবে বসলো। পরনের শাড়ি একটু ভিঁজেছে। নিচের পাড়টায় অল্প বালি ভাব জমিয়েছে। সেই জমানো বালিটা হাত দিয়ে একটু ঝেরে নিলো সে। ততক্ষণে ত্রিস্তান গ্লাস ভর্তি পানি এনে এগিয়ে দিয়েছে অটবীর পানে। অটবী নিলো গ্লাসটা। তার কাঠকাঠ হয়ে থাকা গলা ভেঁজাতে এই পানির খুব প্রয়োজন ছিল।

—“তুমি এখানে কেন এসেছো, অটবী?”
পানিটুকু পান করে সশব্দে গ্লাসটা টেবিলে রাখলো অটবী। গম্ভীর কণ্ঠে বললো, “আমার বিয়ে ভেঙ্গে গেছে।”

ত্রিস্তান সামনাসামনি সোফায় বসেছে। দুজনের চোখ দুজনের মধ্যিখানে। অটবী স্পষ্ট দেখলো, ত্রিস্তান বাম চোখটা খুব সামান্য লাফিয়েছে। অথচ চেহারা ভাবাবেগ শূন্য! লোকটা কি বিশ্বাস করেনি?
—“আপনি কিছু বলবেন না?”
—“কি বলবো?”

নির্লিপ্ত কণ্ঠ। অটবীর সহ্য হলো না, “আমার বিয়ে ভেঙ্গে গেছে ত্রিস্তান! আপনার কিছুই বলার নেই?”
ত্রিস্তানের দৃষ্টি অটবী থেকে সরে এখন পানির গ্লাসে। ঠিক যেখানটা অটবী ঠোঁট ছুঁয়েছিল? সেখানে লিপস্টিকে স্পষ্ট দাগ! ঠোঁটের নিঁখুত ভাঁজ! নাহ্, গ্লাসটা ধোঁয়া যাবে না। কোথাও গোপন করে লুকিয়ে রাখতে হবে।
গ্লাসের দিকে নজর রেখেই ত্রিস্তান বললো, “তোমার এখানে আসা উচিত হয়নি, অটবী। চলো, বাসায় পৌঁছে দিচ্ছি। আর এমন পাগলামি করবে না।”

যেন একটুখানি হাওয়া বইছিল। হঠাৎ করেই ঝড় শুরু হলো। সেই ঝড়ে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললো অটবী। ঠোঁট কাঁপলো! চোখের পাতা পলক ফেললো! নিমিষেই উঁচু গলায় চেঁচিয়ে উঠলো সে, “আমি পাগলামি করছি? তাহলে আপনি কি করছেন? ঘুমের ঔষধ খেয়েছেন না, ত্রিস্তান? কেন খেয়েছেন? বিন্দাস একটা লাইভ লিড করছেন! যাকে তাকে ভালোবাসার বুলি বলে কয়ে হারিয়ে যাচ্ছে! আপনার তো কষ্ট থাকার কথা না। তাহলে কার কষ্টে ঘরবন্দি ছিলেন? আমার? কই! আপনি তো আমাকে খেলনা ভাবেন। যেমন ইচ্ছে ব্যবহার করে ফেলে দিয়েছেন। তাহলে? খেলনার জন্য কষ্ট লাগছে?”

এক ধরণের অদ্ভুত গাম্ভীর্য নিয়ে অটবীকে কিছুক্ষণ একাধারে দেখলো ত্রিস্তান। নয়নে গভীরতা লুকোচুরি করে অশান্ত গলায় বললো, “বুঝিনি অটবী, তোমাকে ভুলে ভালোবেসে ফেলবো।”

অটবীর উগ্র ভাবটা কোথায় যেন হারালো। আর ফিরে এলো না। এতে বেশ বিরক্তই হলো সে। লোকটা তাকে এত জ্বালিয়েছে, অথচ সে একটু উঁচু গলায় কথা বলতে পারছে না? কেন?
ঠোঁট কিঞ্চিৎ ফাঁক করে ক্লান্ত নিশ্বাস ছাঁড়লো অটবী। দৃঢ় কণ্ঠে বললো, “চলুন, বিয়ে করবো।”

ত্রিস্তান ভ্রু কুঁচকালো। চমকটা একটু জোরেসরেই লেগেছে। অবাক কণ্ঠে সুধালো, “কি বললে?”
—“বিয়ে করবো। এক্ষুণি।”
—“সম্ভব না, অটবী।”
—“কেন সম্ভব না? এত… এত পাষাণ কেন আপনি?”
কান্নাটা আটকানো গেল না। বহু কষ্টে চেপে রাখা অশ্রুকণা বেরিয়ে এলো নিঃশব্দে। আর কত নিচে নামবে অটবী? আর কত বেহায়া হবে? কিসের এত বাঁধা? ত্রিস্তান কেন তাকে একটু কাছে টানছে না? অথচ উত্তরটা বরাবরের মতোই সাদা কালিতে অদৃশ্য।

ত্রিস্তানের মনে হলো, সে ক্রমশই দূর্বল হয়ে উঠছে। ভেতরে কি একটা যেন বাজেভাবে ছিঁড়ে যাচ্ছে। দমবন্ধ লাগছে। এই মেয়েটা… এই মেয়েটা তার প্রাণ। ইচ্ছে করছে এক্ষুণি শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকের সাথে পিষে ফেলতে। অথচ অদৃশ্য বাঁধায় শিকল বন্ধী। ত্রিস্তান শিকলটা শক্ত করে ধরলো। শেষ চেষ্টা করে বললো, “তুমি আমার সঙ্গে কখনো ভালো থাকবে না, অটবী। আমি অনেক খারাপ।”
—“আমার সমস্যা নেই।”
—“তুমি আবেগে ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছো।”

অটবী রাগলো এবার। লোকটা এখনো তাকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। তার আবেগের বয়স আছে এখনো?
ক্ষিপ্ত গলায় বললো, “আপনাকে কে বলেছে এটা আবেগ? আমার অনুভূতি আপনি আমার থেকে বেশি জানেন?”

শক্ত টানে শিকলটা ছিঁড়ে গেল। তৃষ্ণা, ধৈর্য সব ফুরালো। ত্রিস্তান মাথা ঝুঁকিয়ে হাসলো ক্ষীণ। মুচকি হাসি। এগিয়ে এসে অটবীর হাত ধরে, অটবীকে অবাক করে দিয়ে বললো, “চলো, বিয়ে করবো।”

বিয়েটা হয়ে গেল তক্ষুণি। এই মাখো মাখো প্রেম সুর নিয়ে আসা শ্রাবণ ক্ষণেই। তখন বোধহয় এগারোটা পেরিয়েছে। দোকানপাট সব বন্ধ হওয়ার জোগাড়। আধঘণ্টা তল্লাশি চালিয়ে শহরের মাথায় একটা কাজী অফিস খোলা পাওয়া গেল। কাজীর তখন ঘুমের সময়। তবুও টাকার চাকচিক্য ঝলকে সে রাজী না হয়ে পারে নি। স্বাক্ষী হিসেবে ত্রিস্তানের দুজন বন্ধুও এলো। বেশভূষায় আধুনিক, রুচিশীল। ত্রিস্তানের এমন বন্ধুও আছে? কই, আগে তো কখনো দেখেনি।

বৃষ্টি তখন নেই। অটবী রাস্তার পাশের ভেঁজা বেঞ্চে চুপচাপ বসে আছে। দৃষ্টি, দূরের ত্রিস্তানের পানে। লোকটা তার বন্ধুদের বিদায় জানিয়ে এদিকেই আসছে। ক্রমশই এত কাছে চলে আসছে! মনে হচ্ছে তাদের মাঝের যোজন যোজন দূরত্বটা কমে ছোট হয়ে গেছে। একদম ছোট!
ত্রিস্তান ধপ করে অটবীর পাশে এসে বসলো। আকাশের দিকে মুখ উঁচিয়ে, দারুণ নিশ্বাস ফেলে বললো, “তুমি কিন্তু আর আফসোস করতে পারবে না, অটবী।”
অটবীর ধীর উত্তর, “আচ্ছা।”
—“তুমি এখন সোজা বাসায় যাবে। আমি পৌঁছে দেব।”
—“ঠিকাছে।”
—“বাসায় কেউ জানে তুমি আমার কাছে এসেছো?”
—“নলী আর পৃথা জানে। ওরা ওদিকটা সামলাবে।”

ত্রিস্তান একটু থামলো। একটু একটু করে ঝুঁকে পরলো অটবীর দিকে। ছোট্ট, নরম কাঁধে মাথা রাখলো। ফিসফিসিয়ে বললো, “আমি শুধু ভুল করেই যাচ্ছি, অটবী।”

পরপরই অটবী অনুভব করলো, তার গলার মধ্যিখানে এক অধৈর্য ঠোঁটের শক্ত চুমু।

_________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

অটবী সুখ পর্ব-২০+২১

0

অটবী সুখ

২০.
“My lady, If I could, I would hold you so tightly that you would never let go of me.”

ঘুম থেকে উঠে অটবীকে আশেপাশে পায়নি ত্রিস্তান। বাহিরে তখন সন্ধ্যা শেষে আঁধার। ঘুটঘুটে অন্ধকার। এতক্ষণ অবশ্য থাকার কথাও না। শরীরের পাতলা কাঁথাটা সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো ত্রিস্তান। টি-টেবিল থেকে পানির জগ নিয়ে ঢকঢক করে পানি গিললো। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। চোখে সূক্ষ্ণ জ্বালাতন। বুক ভারী। মেয়েটা কি সত্যিই চলে গেছে? ভাবতেই ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস সুরসুর করে বেড়িয়ে এলো। সরোজ তখনো রান্নাঘরে কি যেন করছে। একটু পর পর খুটখাট শব্দে মেতে উঠছে নিস্তব্ধ পরিবেশ। অটবী তার বানানো নুডুলস্ খেয়ে যায়নি। তাই তার একটু মন খারাপ। কাঁচের প্লেটে নিজের বানানো নুডুলস্ নিজেই চামচের আঘাতে টুংটাং শব্দে খাচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে মন খারাপ করছে।
সরোজের কাছে যাওয়ার পূর্বে তনয়ার রুমে একবার তাকালো ত্রিস্তান। দরজা ভেড়ানো। বোধহয় ঘুমাচ্ছে। সরোজকে বললো, “অটবী কখন গেছে?”

সরোজ চমকালো, ভড়কালো। হঠাৎ ত্রিস্তানকে দেখে ভয় পেল ক্ষীণ। বুকে লাগাতার কয়েকবার ফুঁ দিয়ে চোখ বড় বড় করে অভিযোগ জানালো, “এমন ভূতের মতো হঠাৎ কথা কও ক্যান? কথা কওনের আগে কাঁশি-টাঁশি দিতে পারো না?”

ত্রিস্তান সে কথার ধার ধারলো না। ভ্রু কিঞ্চিৎ বাঁকিয়ে রান্নাঘরের বামপাশটায় এগোলো। ক্ষুধায় পেটে হরতাল লেগে যাচ্ছে। ছোট একটা বাটিতে নুডুলস্ নিতে নিতে আবারও একই প্রশ্ন ছুঁড়লো, “অটবী কখন গেছে?”
—“বেশিক্ষণ হয় নাই। এই আযানের একটু আগে।”

কথাটা বলে একটু থামলো সরোজ। আড়চোখে ত্রিস্তানকে একবার দেখে নিলো। গম্ভীর মুর্তে নুডুলস্ গিলছে সে। চাবাচ্ছে কি-না তাতেও সন্দেহ! আমতা আমতা করে সরোজ বলতে চাইলো, “তোমগো মাঝে কি ঝগড়া হইছিল, ভাই? অটবী আপুরে দেখলাম কানতেছিল।”

তৎক্ষণাৎ খাওয়া থামলো। মুখে তখন মাত্র এক চামচ নুডুলস্ পুরেছে ত্রিস্তান। সেটা কোনোমতে গিলে অবাক কণ্ঠে সুধালো, “কাঁদছিল মানে?”
—“ওইতো, যখন এন থেইকা যাইতেছিল গা তখন চোখ মুখ লাল, পানি। কান্নার লাইগা কথাও কইতে পারতেছিল না।”

ত্রিস্তান শুনলো। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে সশব্দে রেখে দিলো বাটি-টা। পেটে ক্ষুধা থাকলেও এখন আর খেতে ইচ্ছে করছে না। রুচি চলে গেছে। গলা দিয়ে আর খাবার নামবে না।
—“সরোজ, তোকে যেটা আনতে বলেছিলাম, এনেছিস?”
—“হ। আনছি।”

বলতে বলতে শেষ নুডুলস্-টুকু ঝটপট চিবিয়ে ফ্রিজ খুললো সরোজ। গোল প্লেট সুদ্ধ একটা লাল প্যাকেট বের করলো। গাঢ় লাল রক্তের প্যাকেট। উদ্ভট গন্ধ। ত্রিস্তানের দিকে এগিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলো, “আজইকাও কি এক্সপেরিমেন্ট করবা, ভাই?”

ত্রিস্তান প্লেট-টা নিলো। সরোজের দিকে না তাকিয়েই গম্ভীর গলায় উত্তর দিলো, “হু।”
—“তোমারে একখান কথা কই, ভাই?”
ত্রিস্তানের আবারও ছোট্ট উত্তর, “হু।”
—“তুমি আমারে যত বোকা ভাবো আমি কিন্তু ততটা বোকা না। কিছু কিছু জিনিস আমিও বুঝি।”

এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড! দারুণ চমকে সরোজের মুখপানে তাকালো ত্রিস্তান। পরমুহুর্তেই আবারও শান্ত হয়ে ছেলেটার চোখে চোখ রাখলো। নিষ্পাপ চোখদুটোয় তখন হাজারো প্রশ্ন, কৌতূহল ভীড় জমাচ্ছে। সেই ভীড়ের মাঝে হঠাৎ করেই চমৎকার এক দ্যুতি উঁকি দিলো। যেন এতকাল খুঁজতে থাকা প্রশ্নের কিছু উত্তর সরোজ জেনে গেছে, যা জানা তার একদমই উচিত হয়নি।

ঢোক গিলে গলাটা একটু ভিঁজিয়ে নেওয়ার প্রয়াস চালালো ত্রিস্তান। নিস্তেজ কণ্ঠস্বরকে যথাসম্ভব কঠোর করে বললো, “আমার রুমে ঢুকতে মানা করেছিলাম, সরোজ। আর ঢুকবি না।”

সরোজ এমন সরাসরি প্রশ্নটা করতে চায়নি। কিন্তু রোজ রাতে ত্রিস্তানের ঘর থেকে আসা নারী কণ্ঠের চিৎকার, কান্নার করুণ সুর সে উপেক্ষা করতে পারছে না। না চাইতেও বিশ্রী সন্দেহ জমাট বাঁধছে। আস্তে আস্তে মাথা তুলে দেখলো, ত্রিস্তান চলে যাচ্ছে। বড় বড় কদম ফেলে। যেন পালাতে চাইছে এখান থেকে। সরোজ এই লোকটাকে বড় ভাই মানে। বড় ভাইয়ের থেকেও বেশি। এলাকার সবাই যখন সরোজকে খারাপ বলে তিরস্কার করতো, একমাত্র ত্রিস্তানই তাকে কাছে টেনে ভালো-মন্দ বুঝিয়েছিল। এই মানুষটা থেকে সে দূরে সরে যায় কেমন করে?

ত্রিস্তান রুমে ঢুকতেই নিচ্ছিল, সরোজ তড়িৎ কণ্ঠে তৎক্ষণাৎ কেমন প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলে, “ভাই, তুমি যা-ই করো, আমি তোমার সাথে আছি। হোক সেটা খারাপ। আমারে সবসময় পাশে পাইবা।”

সশব্দে দরজাটা লাগিয়ে দিয়েছে ত্রিস্তান। দরজার সঙ্গে গা ঘেঁষে বসে পরেছে মেঝেতে। ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলছে। এ সত্য সে কতদিন চেপে রাখবে? কতদিন চেপে রাখা যাবে? অটবী! সরোজ! তনয়া! নলী! সবাই ভুল বুঝবে তাকে। ঘৃণা করবে! বাবা-মায়ের মতো কেউ ভালোবাসবে না। কেউ না। শরীরের শিরা-উপশিরায় ভীষণ একটা যন্ত্রণা অনুভব হলো। হাতে থাকা রক্তের থলি, প্লেট ছুঁড়ে ফেললো সুদূর মেঝেতে। রক্তের থলি ছিঁড়লো না ঠিক, কিন্তু কাঁচের প্লেট-টা ভেঙ্গে গেল। ত্রিস্তান সেদিকে চেয়ে চেয়ে দেখলো, কাঁচের টুকরোগুলো তাকে তাচ্ছিল্য করে বলছে, “ওহে সুখনীল ত্রিস্তান! দুঃখ তোর পিছু ছাড়বে নারে অভাগা!”

নিশ্বাসটা ভারী হলো। কষ্ট দিলো। নিজের ওপর বড্ড করুণা হলো তার। মস্তিষ্ক শুধু এখন একটা নামই জপছে। অটবী! অরবিন্দ অটবীতে বসবাসরত তারই মতো সুখ খোঁজি একটি মেয়ে!

মাথার ওপর কড়া উত্তাপ। ঝলমলে রোদ্দুর। তীব্র তাপে শরীর ঘেমে একাকার। স্কুল শেষে হাতে হাত ধরে বাসায় ফিরছিল দু’বোন, নলী আর পৃথা। হাতে দশ টাকার বাদামের ঠোঙা। ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় নিজেদের ব্যস্ত করে রেখেছে ওরা। আশেপাশের খেয়াল নেই। আলোচনার মূল বিষয় এই, আজকে অটবীকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। রেবা বেগম তাই মেয়েকে ঘর থেকে বের হতে কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। পাত্রপক্ষ দেখতে আসায় কেন ঘর থেকে বেরোনো যাবে না- তা তাদের ছোট্ট মস্তিষ্কে ঢুকছে না। পাশাপাশি তারা এ নিয়েও চিন্তিত, তাদের ভবিষ্যৎ বোনজামাই ঠিক কেমন হবে? ভালো হবে তো? দেখতে শুনতে ভালো না হলে বাদ। চরিত্রও ভালো হতে হবে। নয়তো তাদের ফুলের মতো বোনকে তারা কিছুতেই বিয়ে দিবে না। একদমই না।

রাস্তার মোড়ে রহিম, কাদিন সঙ্গে আরও কিছু ছেলেপেলে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। কথার মাঝে কাদিনের দিকে দৃষ্টি চলে যায় পৃথার। কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে সেদিকে চেয়ে থেকে আফসোসের সুরে বলে, “কাদিন ছেলেটাকে আমি ভালো ভেবেছিলাম।”

নলীও একবার কাদিনের দিকে তাকালো। অতঃপর চোখ-মুখ বিকৃত করে বললো, “কি দেখে ভালো মনে হইছিল? আমার তো প্রথম থেকেই ভাল্লাগে না। বান্দরের মতো চেহারা। শরীর একটা কাঠি। ফুঁক মারলেই বাতাসে ভাসাভাসি শুরু করে…”

কথাটা শেষ হতে পারলো না। পৃথা চোখ রাঙিয়ে চেয়ে আছে। নির্ঘাত নলীকে মেরে কুচিকুচি করার পরিকল্পনা আঁটছে মনে মনে। নলী কাদিনের বদনাম আর গাইলো না। অভিযোগের সুরে বললো, “তোরা যে সরোজকে নিয়ে বলতিস? আমার খারাপ লাগতো না? এবার বুঝ! পছন্দের মানুষকে গালাগাল করলে কেমন লাগে!”
—“সরোজ ভালো ছেলে না।”

পৃথার গম্ভীর কণ্ঠ। নলী ঢং করে বললো, “কাদিন যেন অনেক ভালো?”
—“কাদিনও ভালো না।”

ততক্ষণে ওরা রহিমের কাছাকাছি চলে এসেছে। রহিমের বাজে হাসিটা তখন টাটকা, তাজা। দাঁত কেলিয়ে ওদের উদ্দেশ্যেই প্রশ্ন ছুঁড়লো, “কি ময়না পাখিরা? স্কুল শেষ? বাসায় যাচ্ছো?”

নলী সাথে সাথে বিরক্তি প্রকাশ করলো। পৃথার হাত টেনে দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে বিড়বিড়ালো, “তো আর কোথায় যাবো রে লুচ্চা?”

অটবীকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসার সংবাদটা ত্রিস্তান পেল রাত্রিবেলা। ঘড়িতে তখন ন’টা বেজে পঞ্চান্ন মিনিট। ত্রিস্তান টং দোকানে বসে চা-সিগারেট ফুঁকছিল। কোত্থেকে দৌঁড়ে এসে সংবাদটা জানালো সরোজ। সরোজের সাথে যদিও ইদানিং তার কথাবার্তা হচ্ছে অল্পসল্প। দূরত্বটা ত্রিস্তানই তৈরি করেছে। কিন্তু সরোজ তার দিক থেকে সচল, চঞ্চল। ত্রিস্তান না জানতে চাইলেও অটবীর প্রত্যেকটা পদক্ষেপ সম্পর্কে মিনিটে মিনিটে অবগত করছে। ত্রিস্তান সব কিছু পাত্তা দেয় না। না শোনার ভান ধরে রয়। এই যে! এখনো ধরছে। ধরার চেষ্টা করে নিজেকে বলছে, সে শোনেনি। কিচ্ছু শোনেনি।
কিন্তু ভেতরকার হৃদযন্ত্র সেকথা মানতে নারাজ। তাকে ভুল প্রমাণ করতে উঠেপরে লাগছে। অধৈর্য করছে। এরপর… এরপর দশমিনিটের মাথায় ত্রিস্তান অটবীদের বাসার সামনে! ঠিক রান্নাঘরটার সম্মুখে, যেখানে আপাতত অটবী চুলায় খাবার গরম করতে ব্যস্ত।

মেয়েটার মুখশ্রী মলিন। চোখ ফোলা। সে কি কেঁদেছে? তিক্ত নিশ্বাস ফেলে ত্রিস্তান আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। ভেবেছিল, অটবীকে একটু দেখেই চলে যাবে। তবে তা আর হলো না। চলে যাওয়ার পূর্বেই অটবীর নজরে পরে গেল সে। এখন কি করবে? সে কি একটু হাসবে? কিছু বলা উচিত কি?
ভাবনার অকূল পাথারে অটবীই সর্বপ্রথম জিজ্ঞেস করলো, “কেন এসেছেন?”

দূরত্ব বেশি নয়। তিন-চার হাত। একটু জোরে কথা বললেই সব শোনা যায়। কিন্তু অটবী আস্তে কথা বলছে। কথাটা শুনতে ক্ষীণ বেগ পেতে হলো ত্রিস্তানের। এরপর সে নিজেও ওভাবে উত্তর দিলো, “তোমার নাকি বিয়ে হয়ে যাচ্ছে? তাই দেখতে এলাম।”

অটবী মনে মনে হাসলো। লোকটার কাছে দেখি তার সব খোঁজখবরই আছে! তাহলে এই মিছে অভিনয়, দূরে সরে যাওয়া কেন? অটবীর খুব বলতে ইচ্ছে হলো, “দেখেছেন ত্রিস্তান? এবারও আপনি আমার কাছে এসেছেন। আমাকে দূর্বল করতে। অথচ আপনি নাকি আমাকে নিজের করে চান না!”
কিন্তু মুখে বললো, “বিয়ে এখন হচ্ছে না। যখন হবে, তখন আসবেন। সবার সাথে।”

ত্রিস্তান মুচকি হাসলো। আরও কিছুক্ষণ অটবীকে মন ভরে দেখে, সুপ্ত বেদনাটা লুকিয়ে রাখলো। কেমন করে যেন বললো, “বিয়ে করে নিও অটবী। ছেলে শুনলাম… ভালো?”
—“এখন কি আপনার কথা মতো চলতে হবে?”

ত্রিস্তানের হাসির আওয়াজ বৃদ্ধি পেল। কৃত্রিম, দীর্ঘ হাসি। সেই হাসি অটবীকে তৃপ্ত করতে পারলো না। বিষিয়ে দিলো। চাপা বিশ্রী রাগটাকে হঠাৎ করেই বাড়িয়ে দিলো সুরসুর করে। পাষাণ লোকটার চোখে চোখ রেখে মারাত্বক ঘৃণা নিয়ে বললো, “আপনার মতো জঘণ্য লোক আর কেউ হতে পারে না, ত্রিস্তান।”

পরপরই তাদের মধ্যিখানে দেওয়াল হয়ে দাঁড়ালো বন্ধ বিস্তর জানালা! ত্রিস্তান দৃষ্টি সরালো না। বন্ধ জানালাটার দিকে চেয়েই থাকলো। যেন সে এখনো দেখছে, অটবী দাঁড়িয়ে আছে ওই তো, অদূরে। রাগী নয়নে ভস্ম করে দিচ্ছে তাকে। মেয়েটা এত রাগতে পারে! ত্রিস্তান আরও একবার মলিন হাসলো। কে বলে সে হাসে না? এইযে, ক্ষণে ক্ষণে হাসছে!
চোখ দুটো বুজে, আকাশ পানে মুখ করে, ত্রিস্তান দীর্ঘশ্বাস ফেললো, “আমার প্রাণ। প্রাণের অটবী। তোমাকে পাওয়ার যদি একটা সুযোগ পাওয়া যেত।”

______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

অটবী সুখ

২১.
পাতাল ঘরটায় ডুবো ডুবো অন্ধকার। বাজে, বিশ্রী গন্ধে এক তেঁতো ঝাঁঝ গলায় এসে উপচে আসতে চাইছে। বাতাসে ভ্যাপসা গরম, দমবন্ধ অনুভূতি। বাতি জ্বালাতেই দেখা গেল, নোংরা কাপড়ে ব্যক্তিটি দেওয়াল ঘেঁষে বসে আছে। পাশে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কাপড়গুলি রাখা। ছুঁয়েও দেখেনি হয়তো।
ত্রিস্তান দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নিঃশব্দে ম্যালামাইনের সাদা বাটি-টা মেঝেতে রাখলো। এরপর ক্লান্ত গলায় বললো, “বলেছিলাম কাপড় চেঞ্জ করে নিতে। করোনি কেন?”

সাদা বাটিতে টকটকে গোলাপের মতো রক্তগুলো দেখে মনে আলতো আনন্দের বাতাস দোলা দিয়ে উঠলো ব্যক্তিটির। তবে তা তক্ষুণি প্রকাশ করলো না। ভীষণ অভিযোগের সুরে বললো, “আমার এখানে ভালো লাগে না। আর কতদিন আমাকে বন্দী করে রাখবি? আমি বাহিরে যাবো।”

বাহিরে? এ অবস্থায়? মোটেও সম্ভব না। তাছাড়া বাসায় সরোজ আছে। তনয়া ড্রইংরুমে খেলছে।
—“পরে নিয়ে যাবো। এখন এটা খেয়ে নাও।”
—“সত্যি নিয়ে যাবি?”

ত্রিস্তান জবাব দিলো না। মেঝেতে পা মুড়িয়ে বসলো। তার তুখোড় দৃষ্টি ব্যক্তিটির পানে বিদ্যমান। সে একবার ত্রিস্তানের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বাটি-টির দিকে এগিয়ে গেল। লোভাতুর নয়নে প্রাণভরে রক্তগুলো পরখ করে ঝাপিয়ে পরলো খেতে। ঢকঢক শব্দে রক্ত পানের সময় ঠোঁট বেয়ে এক সূক্ষ্ণ রেখা গড়িয়ে পরলো একটু একটু করে। ত্রিস্তান সবটা দেখলো। নিজেকে বড্ড ক্লান্ত লাগলো ওর। আর কত? আর কতদিন? ক্লান্ত নিশ্বাস ফেলে বললো, “কালকে থেকে আর প্রতিদিন রক্ত পাবে না। ভাত খেতে হবে।”

সঙ্গে সঙ্গে চট করে তাকালো ব্যক্তিটি। খাওয়া থামালো। আশ্চর্য রকমের বিরক্তি নিয়ে বললো, “ভাত কেন খাবো? আমি ভাত খেতে পারবো না।”
ব্যক্তিটি রেগে গেছে। বিকৃত মুখশ্রীতে হাজারো অসন্তোষের ভীড়। তবে সেই অসন্তোষে পূর্ণ রাগ তাকে দমাতে পারলো না। শান্ত সুরে বললো, “তোমার মতো মানুষেরা খাবার খেতে পারে। তুমিও খেয়েছো, ভবিষ্যতেও খেতে পারবে।”
—“আমার ভাত ভালো লাগে না। আমার রক্ত ছাড়া কিচ্ছু ভালো লাগে না।”
—“শুধু রক্ত খেতে থাকলে একদিন মরে যাবে।”
—“আমি মরতেই চাই।”

ঘাড় ব্যথা করছে। হাত-পায়ে চিনচিনে যন্ত্রণা। আজকে জঙ্গল দিয়ে আসার সময় পায়ে কিসের যেন কাঁটা বিঁধে গেছে। বিরাট আঁচড়। একটু কেটেও গেছে। ঔষধ লাগানো হয়নি। রক্ত শুকিয়ে লেপ্টানো। ত্রিস্তান পায়ের ক্ষতটা একবার দেখে নিলো। তেমন বিশেষ না। এরচেয়েও বড় আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে সে। তবুও এই সামান্য কাঁটাছেঁড়ায় এত কষ্ট হচ্ছে কেন? সে কোথায় যেন শুনেছিল, “ক্ষুদ্র ব্যথায় বেদনা বেশি।”
আসলেই কি তাই?

তিক্ত মেজাজটা মাথার ডান পাশে তিক করে উঠলো। বুড়ো আঙুল আর শাহাদাত আঙুলের সাহায্যে কপাল বার কয়েক ঘঁষে নিলো ত্রিস্তান। বললো, “তাড়াতাড়ি খাবার শেষ করো। আমার কাজ আছে।”
—“কিসের কাজ? করিস তো চুরি। অবশ্য তোর দ্বারা এর চেয়ে বেশি কিছু হবেও না।”

স্পষ্ট অপমানটা ত্রিস্তান গিলে নিলো। কিছু বললো না। কিন্তু ওপাশের ব্যক্তিটি তখনো থেমে নেই।
—“তনয়াকে আমার কাছে আর আনিস না কেন? কত দিন দেখা হয় না!”
—“কেন আনবো? আগের বার মেরে ফেলতে পারো নি বলে এবার যেন মেরে ফেলতে পারো, তার জন্য?”

না চাইতেও সেদিনের ঘটনা মনে পরে গেল ত্রিস্তানের। রক্ত খেতে না দেওয়ায় এই যে, সামনে বসে থাকা তার ভীষণ আপন মানুষটা উম্মাদ হয়ে গিয়েছিল প্রায়। ত্রিস্তানেরও যে কি হয়েছিল! পাতাল ঘরের দরজাটা আটকাতে মনে নেই। সেই সুযোগে রান্নাঘর থেকে ছুঁড়ি নিয়ে ঘুমন্ত তনয়াকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল ব্যক্তিটি। ত্রিস্তানের ভাবতেও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে, সে যদি সেদিন সময়মতো না আসতো! তাহলে হয়তো ভীষণ বাজে রকমের অঘটন ঘটে যেত। ভীষণ বিশ্রী অঘটন!

অথচ সামনের মানুষটির চেহারায় অপরাধ বোধের ছিঁটেফোঁটাও নেই। সে খুব আরামে বাটির অবশিষ্ট তরল বিন্দুটুকু শেষ করলো। যেন এমন অমৃত সে কখনো খায়নি। রয়েসয়ে উত্তর দিলো, “তুই না খাইয়ে রেখেছিলি কেন? তাছাড়া ওই পাগল মরে গেলেই ভালো।”

চোয়াল শক্ত হলো। কপালের রগ সূক্ষ্ণ ভাবে ফুঁটে উঠলো। বলতে ইচ্ছে করলো, “তুমিও তো পাগল। তনয়ার চেয়েও বড় পাগল।”
কিন্তু তা আর ভেতর গলিয়ে বাহির হলো না। গম্ভীরমুখে উঠে দাঁড়িয়ে, সে কঠিন গলায় বললো, “কালকে থেকে তোমার এসব খাওয়া বন্ধ। ভাত পাবে শুধু। খেতে পারলে খাবে, নয়তো না খেয়ে থাকবে।”
চোখে মুখে আতঙ্ক বাসা বাঁধলো। কেঁপে কেঁপে, থেমে থেমে বলতে চাইলো, “সুখনীল! তুই জানিস… রক্ত খেতে না পেলে আমার কষ্ট হয়।”
—“আমারও হয়। যখন সময়ের কাটা প্রত্যেকটা সেকেন্ড মনে করিয়ে দেয়, আমার কেউ নেই।”

সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার সময় ত্রিস্তান শুনলো, পেছন থেকে অবিরাম ব্যক্তিটি চিৎকার করছে। চিৎকার করে বলা কথাগুলো কানে বিঁধছে খুব। অশান্তি লাগছে। দূর থেকে দীর্ঘশ্বাসেরা একপলক আকাশ দেখে করুণ সুরে অভিযোগ করছে, “আর কত? এবার থামো!”

_

অটবীকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিল ঠিক রবিবার বিকেলে। সোমবার বিকেল হতে না হতেই সেই বিয়ের গুঞ্জন ধামাচাপা হয়ে যায়। পাত্রের পরিবার রাজী থাকলেও অটবী মানা করে দিয়েছে। তার অসুস্থ মা আছে। ছোট দুটো বোন আছে। সে বিয়ে করে চলে গেলে তাদের দেখবে কে? এই যুক্তি দিয়ে পাত্রপক্ষকে মানা করা গেলেও রেবা বেগম বেঁকে বসলেন। এত ভালো সম্বন্ধ! অথচ মেয়েটা কি না কি নিয়ে বসে আছে। তাদের দেখাশোনা করতে হবে বলে আজীবন বিয়ে না করে থাকবে? এ কেমন যুক্তি? এমন সম্বন্ধ কি বারবার আসে? রেগেমেগে অটবীর সঙ্গে কথা বলছেন না পুরো একদিন। অটবী প্রথম প্রথম যদিও রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করেছিল। এখন থেমে গেছে। তার মা অভিমানীর সঙ্গে জেদিও। তার এই অভিমান বিয়েতে রাজী না হওয়া অব্দি শান্ত হবে না। আর অটবী এই বিয়ে করবে না।

তখন ঘড়িতে দুপুর তিনটে। মাথার ওপর উত্তপ্ত সূর্য। তেজটা আগের চেয়ে একটু বেশিই বোধহয়। সূর্যিমামা কি তবে আজ রেগে আছেন? রেগে আছেন হয়তো। ব্যাগ থেকে রুমাল বের করতে গিয়ে অটবী খেয়াল করলো, ফোনের নোটিফিকেশনে অপরিচিত নম্বর থেকে পাঁচটা মিসড্ কল দেখাচ্ছে। অটবী জানে নম্বরটা কার। ওইযে? তাকে যারা পরশুর আগেরদিন দেখতে এলো? সেই ছেলে। তার নাকি অটবীকে খুব পছন্দ হয়েছে। বিয়েতে মানা করার পরও অটবীর পিছু ছাড়ছে না। কল করে বিরক্ত করছে খুব। ফোন সাইলেন্ট করেও শান্তি নেই। সে কল ধরছে না, তবুও বেহায়ার মতো করেই যাচ্ছে!

অটবী বিরক্ত প্রকাশের অবকাশ পেল না। ষষ্ঠবারের মতো আবারও ছেলেটা কল করছে। হাহ! এমন মানুষও পৃথিবীতে হয়? অটবীর মাঝে কি এমন পেল এই ছেলে?
মোবাইলটা ঠেলেঠুলে ব্যাগের ভেতর আরও গুঁজে রাখলো অটবী। রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলো। গরমে গলা শুকিয়ে গেছে। তৃষ্ণায় মন আকুপাকু করছে। ব্যাগ হতে পানির বোতল বের করবে, ওমনি কে যেন পাশে এসে হাঁটতে লাগলো, “আপনি আমার কল ধরছেন না কেন?”

অটবী চমকালো, থমকালো। চট করে পাশ ফিরে তাকালো। সেই দেখতে আসা ছেলেটা! এই ছেলে ভূতের মতো হঠাৎ এলো কোত্থেকে? তাকে ফলো করছে নাকি? কপাল কুঁচকে ভীষণ আশ্চর্য হয়ে বললো, “আপনি এখানে কিভাবে?”

ছেলেটা লাজুক হাসলো। নিশ্চিন্ত হয়ে বললো, “চিনেছেন তাহলে!” এরপর আবার বললো, “একটু কাজে এসেছিলাম আসলে। যাওয়ার সময় আপনাকে দেখে কথা বলতে এলাম।”

মিথ্যে কথা। এই ছেলে বিদেশে থাকে। তিন বছর ধরে সেখানেই ছোটখাটো কাজ করছে। কয়েকদিন হলো বিয়ের জন্য দেশে এসেছে। এর বাসাও অটবীদের চার এলাকা পরে। এই ছেলের কস্মিনকালেও এখানে কোনো কাজ থাকতে পারে না। থাকলেও সেটা অটবী জড়িত। অটবীর পিছু পিছু হ্যাংলার মতো দৌঁড়ানো।
অটবী যথাসম্ভব মিথ্যেটা হজম করে নিলো। পাশ থেকে ছেলেটা আবার জিজ্ঞেস করলো, “উত্তর দিলেন না যে? আপনি আমার কল ধরছিলেন না কেন?”

বিরক্তির মাত্রা বাড়লো। অল্পসল্প দমাতে চেষ্টা করে বললো, “ফোন সাইলেন্ট ছিল। দেখিনি।”
—“আমার তো মনে হচ্ছে আপনি মিথ্যে বলছেন। একটু আগেও দেখলাম আপনি ফোন হাতে নিয়েছেন।”

অটবী নিত্যান্তই ভদ্র, শান্ত মেজাজি। এমন ছেলেদের পাত্তা না দিলেও সোজা-সাপটা কিছু বলতে পারে না। তবুও একটু তাচ্ছিল্য করে হেসেই প্রশ্ন করলো, “জানেন যেহেতু জিজ্ঞেস করছেন কেন?”
কিঞ্চিৎ থতমত খেলো ছেলেটা। তবে দমলো না। সময় নিলো। ধাতস্ত হতেই ট্রেনের গতিতে ছুটলো, “আমার নাম মুসফিক। জানেন নিশ্চই? আপনার নাম অটবী, তাই না? অনেক সুন্দর একটা নাম। আপনার মতো।”
অটবী এবার কথা বাড়ানোর অবশিষ্ট আগ্রহটুকুও হারিয়ে ফেললো। সবকিছু অসহ্য লাগছে তার। জঘন্য রকমের অসহ্য। তার জীবনে কি কষ্টের অভাব ছিল? এই বার্তি ঝামেলার উড়ে এসে জুড়ে বসবার প্রয়োজন কি ছিল?

দুপুর হলেও রহিমের দল ঠিকই মোড়ের টং দোকানে আয়েশ করে চা খাচ্ছে। সাথে ত্রিস্তান, সরোজও আছে। ত্রিস্তান সবসময়কার মতোই এক হাত দিয়ে সিগারেটে একটু পরপর টান দিয়ে অন্য হাতে চা ধরে আছে। পাশের এলাকায় বিদেশ ফেরত এক লোক এসেছে। টাকা পয়সার অভাব নেই। পাঁচ ভোরিস্বর্ণ, গয়না, গোটা পঞ্চাশ হাজার টাকা! তাজা খবরটা রাকিব এক্ষুণি এনেছে। নিজের চোখে সবকিছু দেখে এসেছে সে। এই নিয়েই আজকের মূল আলোচনা। টং দোকানাদার যেন তাদের আলোচনার আগাগোড়া কিচ্ছু শুনতে না পায়, তাই তারা বেশ ফিসফিসিয়েই কথা চালিয়ে যাচ্ছে। দোকানদারও কান খাঁড়া করে আছে। কিন্তু লাভের লাভ কিছু হচ্ছে না। এত আস্তে কেউ কথা বলে? এই ব্যাটাছেলেগুলো কি একটু মজাও নিতে দিবে না?

ত্রিস্তান এসবের ভেতর কখনোই থাকে না। সবকিছু ঠিক হওয়ার পর সে শুধু প্লেন বানিয়ে দেয়। তার আপাতত এখানে কোনো কাজ নেই। ওদের থেকে বেশ দূরে দাঁড়িয়ে একেকটা সুখটান বাতাসে মিলিয়ে দিচ্ছে সে। আর যেখানে ত্রিস্তান, সেখানেই সরোজ। পাশে দাঁড়িয়ে সরোজও ড্যাবড্যাব করে আশপাশ দেখছে। হঠাৎ অটবীকে চোখে পরলো ওর। তৎক্ষণাৎ ত্রিস্তানের বাহু গুঁতিয়ে জোরেসোরে বললো, “ভাই? ওইডা অটবী আপু না? লগে ওই ব্যাডা কে?”

ত্রিস্তান সঙ্গে সঙ্গে বামদিকের রাস্তায় তাকালো। অটবী তাড়াহুড়োয় কোথায় যেন যাচ্ছে। পাশে মোটামোটি ধাঁচের একটা ছেলে। হেসে হেসে কথা বলছে। অজান্তেই ঈগল চোখদুটো তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো। দৃঢ়, গাঢ় নয়নে ওদেরকে সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে দেখলো ত্রিস্তান। বুক ভারী হওয়ার পূর্বে সরোজকে বলতে শুনলো, “এই ব্যাডা তো মনে হয় ওই বিয়ের ছেলে। অটবী আপু না বিয়ে ভাইঙ্গা দিসে? এ ব্যাডা এনে কি করে?”

হাতের সিগারেটটা শেষ হয়ে গেছে। দূরের দূর্বাঘাসে সেটি ছুঁড়ে ফেলে আরেকটা সিগারেট ধরালো ত্রিস্তান। অটবী সেই ছেলেটার সাথে এতই ব্যস্ত যে, পেছনে ফেলে আসা ত্রিস্তানকে সে একবারও খেয়াল করেনি। ভালো! সে তো এটাই চেয়েছিল। প্রথম থেকে। কিন্তু তবুও বুকটা এমন নীল নীল ব্যথায় কাতরে উঠছে কেন? নীলেরা এত নিষ্ঠুর হয় কেন? মুক্ত বাতাসের অভাবে তার দমবন্ধ হয়ে আসছে।

প্রাণের অরণ্য,
আমি দুটো তুমি দেখেছি। চোখ বুজে রাখলে আমার একদম কাছের তোমাকে আর চোখ মেললেই বহুদূর হারিয়ে যাওয়া তুমিকে।

আকাশে কালো মেঘের ছড়াছড়ি। মেঘের তড়িৎ গর্জনে ভেতরটা নড়ে উঠছে। সেই দু’ঘণ্টা আগ থেকে বৃষ্টি আসবে আসবে বলেও আসছে না। ভয় লাগাচ্ছে শুধু। তনয়া বায়না ধরেছে, সে বৃষ্টি দেখে ভাত খাবে। কিন্তু কই? এত অপেক্ষা করেও তো বৃষ্টির দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। শেষমেষ অনেকটা জোড় করেই তনয়াকে ভাত খাইয়ে দিতে লাগলো ত্রিস্তান। তনয়া গাল, নাক ফুলিয়ে রেখেছে। বৃষ্টির ওপর তার ভীষণ রাগ। পঁচা, দুষ্টু বৃষ্টি।
ভাতে আজ বিশেষ কিছু নেই। আলু ভর্তা, ডাল। তনয়ার আবার এইসব ভর্তা বেশ পছন্দ। ভাতের একেকটা লোকমা সে প্রচন্ড আনন্দ নিয়ে চিবুচ্ছে। খেতে খেতে কেঁশে উঠতেই পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো ত্রিস্তান। নরম কণ্ঠে বললো, “আস্তে খা।”

বলতে বলতে পাশের চেয়ারে শোকের ছায়া এঁটে রাখা সরোজকে একবার আড়নয়নে দেখলো সে। এক লোকমা ভাত তনয়ার মুখে পুরে দিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “কি হয়েছে? মুখ অন্ধকার করে রেখেছিস কেন?”

সরোজ বেজায় মন খারাপ নিয়ে বললো, “তুমি খবর শুনো নাই?”
—“কেমন খবর?”
সরোজ আগের মতোই ম্লান কণ্ঠে বললো, “অটবী আপু বিয়ে করতে রাজী হয়ে গেছে। সামনের শুক্রবার বিয়ে।”

তারপর মুহুর্তেই ত্রিস্তানের দিকে তাকিয়ে উৎকণ্ঠা হয়ে বললো, “তুমি কিছু করবা না ভাই? আপুরে এমনে এমনে বিয়ে করতে দিবা?”

ততক্ষণে চঞ্চল হাতজোড়া থেমে গেছে। স্তব্ধ হয়েছে শরীর, ফাঁকা হয়েছে মস্তিষ্ক! শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। নিশ্বাসগুলো এমন আটকে আটকে আসছে কেন? তনয়া ভাতের জন্য তাগাদা দিতেই সম্বিৎ ফিরলো ত্রিস্তানের। আস্তে করে উত্তর দিলো, “আমি কি করবো?”
—“কি করবা মানে? বিয়ে আটকাবা না? তুমি না আপুরে ভালোবাসো?”

‘তুমি না আপুরে ভালোবাসো?’— কথাটা যেন কেমন। মাথায় পাহাড়সম চাপ সৃষ্টি করে। মনে হয়, তার মতো অসহায় আর দুটো নেই। সে কিছু পারে না। কাউকে আগলে রাখার নূন্যতম ক্ষমতাও তার নেই।
পুরোটা সময় সরোজ ত্রিস্তানের উত্তরের অপেক্ষায় বসে ছিল। ত্রিস্তান উত্তর দেয় নি। তনয়াকে ভাত খাইয়ে চুপচাপ চলে গেছে নিজ রুমে। বিছানার পাশের ছোট্ট টি-টেবিলের দ্বিতীয় ড্রয়ারে কয়েকটা ঘুমের ঔষধ গুছিয়ে রাখা আছে। সেখান থেকে তিনটে ঔষধ নিয়ে ত্রিস্তান পানি দিয়ে গিললো তা। বিছানায় গা এলালো। ফোনের গ্যালারির প্রথর সারির একটা ভিডিও ওপেন করবো। এটা তার মায়ের ভিডিও। তার মা গান গাইতে খুব ভালোবাসতেন। ছোটবেলায় তাকে কোলে নিয়ে এভাবেই গান গেয়ে ভিডিও করে রাখতেন তিনি। ওইযে? ভিডিও-তে দেখা যাচ্ছে তার মাকে। শাড়ি পরে, বাঙালিয়ানা সাজ সেজে ছোট্ট ত্রিস্তানকে কোলে নিয়ে বসে আছেন। বাংলা গান তো আর তেমন ভালো পারেন না। ইংরেজি কি যেন একটা গান গাইছেন। ভিডিও করছেন তার বাবা। যে কেউ দেখলে বলবে, “অ্যা ফরএভার হ্যাপি ফ্যামিলি!”

ভিডিওটা ত্রিস্তান বারবার টেনে দেখলো, শুনলো। দেখতে-দেখতে শুনতে-শুনতে তন্দ্রায় দূর্বল হয়ে পরলো সে। চোখের তীব্র জ্বালায় কপাল কুঁচকালো। হাহ! তার না পাওয়ার ঝুলিতে আরেকটা না পাওয়া যোগ হয়ে গেল। তার এত না পাওয়া!

________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

অটবী সুখ পর্ব-১৮+১৯

0

অটবী সুখ

১৮.
চারিদিকে বৃষ্টির মাতাল ঘ্রাণ। শূণ্য, ফাঁকা রাস্তা। বর্ষণের ঝরঝর গানের মাঝে গরম নিশ্বাসের তীব্র শব্দ কানে ঠিকই পৌঁছাচ্ছে। মনহরিণ দুঃখ বালকটা অটবীর একদম গা ঘেঁষে এঁটে আছে। জ্বরে শরীর উত্তপ্ত, কাঁপছে ক্ষীণ। অটবী পূর্ণদৃষ্টিতে ত্রিস্তানের দিকে চেয়ে রইলো। লোকটার শারীরিক দূর্বলতা সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। ফর্সা ত্বকের জায়গায় জায়গায় ছোপ ছোপ লাল আবরণ। ফিসফিসিয়ে কি যেন বলছে বারবার। অটবী বুঝতে পারছে না। তিক্ত একটা স্বাদ গলায় ঠেকে আছে। চিন্তা হচ্ছে, রাগ লাগছে। এই বৃষ্টির দিনে লোকটার বের হওয়ার দরকার কি ছিল?
ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে ত্রিস্তানকে ডাকার চেষ্টা করলো অটবী, “ত্রিস্তান? শুনছেন? উঠুন! আপনার ফোন কোথায়? পকেটে?”

ত্রিস্তান জবাব তো দিলোই না, উলটো অটবীর শরীরের সঙ্গে আরও লেগে বসলো যেন। হাতের বাহুতে নাক ঘঁষে আবারও কি যেন বিড়বিড়ালো।
অটবী হাল ছেড়ে দিলো। নিজেই ত্রিস্তানের ফোন খুঁজতে লাগলো। প্রথমে শার্টের পকেট, এরপর প্যান্টের পকেট! বাম পাশের পকেটটায় পাওয়া গেল ফোনটা! ত্রিস্তানের ফোন দিয়ে আগেও একবার সরোজকে কল করেছিল অটবী। ওইযে? যেদিন লোকটা অসুস্থ হয়ে পরেছিল রাস্তায়? তাই একটু চিন্তা মুক্তই হলো সে। অনতত বিপদের সময় ফোনের লক-টক খোলার তো কোনো ঝামেলা নেই। নয়তো লোকটার যা অবস্থা! মনে তো হয় না ভূমিকম্পে চাপা পরলেও ঘুম ছেড়ে উঠবে।
ত্রিস্তানকে একপলক দেখে ফোনের পাওয়ার বাটনে চাপ লাগালো অটবী। সঙ্গে সঙ্গেই যেন একটা প্রবল ঝটকা তিরতির করে শিরাউপশিরায় উপচে উঠলো। নিশ্বাস থমকালো, চোখের পাতা মিলেমিশে একাকার হতে ভুলে গেল, মন হতবিহ্বল হয়ে নিজেকে শুধালো, “এসব কি?”

ফোনের ওয়ালপেপারে অটবীর নিজের ছবি। বাজারে সবজি কিনছে সে। কোনো কারণে দোকানির সাথে বিশাল বাকবিতর্ক হওয়ায় ভীষণ বিরক্ত নিয়ে চেয়ে আছে। হাতে আরও কিছু সবজি-মাছ-মাংসের পলিথিন। অটবীর নিশ্বাস থেমে থেমে আবার আটকালো। তার মনে পরলো, ছবিটা বেশিদিন আগের না। কালকে এই ছাই রঙা জামাটা পরেই বাজারে গিয়েছিল সে। পণ্যের দাম বেশি চাওয়ায় বিক্রেতার সঙ্গে চরম ঝগড়াও করেছিল। কই? ত্রিস্তানকে তো তখন আশেপাশে দেখেনি!

মনের সন্দেহের দানাটা বিপুল হতেই কি মনে করে গ্যালারিতে ঢুকলো অটবী। সেখানে আলাদা কোনো ছবির ফোল্ডার নেই, ছবি নেই, ভিডিও নেই— শুধু মাত্র পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন ছবি ছাড়া। পাঁচটি ছবিই তার। একটাতে সে হাসছে, একটাতে নলীকে বকছে, একটাতে শাড়ি পরে আনমনা হয়ে নিচের দিকে চেয়ে আছে! প্রত্যেকটা ছবিই ভীষণ সাবধানে তোলা। অটবী কখনো ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি ত্রিস্তানের এমন রুপও থাকতে পারে!
মস্তিষ্কের নিউরনগুলো হঠাৎই চঞ্চল হয়ে এক এক করে দেখিয়ে দিলো, ত্রিস্তানের করা প্রত্যেকটা কাজ, কথা বলার ধরণ, যত্ন! চুপিচুপি বললো, ছেলেটা তোকে পছন্দ করে বোকা মেয়ে। নয়তো এসবের মানে কি?

দমবন্ধকর অনুভূতি নিয়ে ফোন থেকে দৃষ্টি সরালো অটবী। নিশ্চল চোখে ত্রিস্তানের ফ্যাকাশে মুখপানে তাকিয়ে রইলো বহুক্ষণ। আটকে আসা কণ্ঠে বলতে চাইলো, “ত্রিস্তান, আপনি কখন…এতটা…”

গলা দিয়ে কথা বেরোলো না। ত্রিস্তান নড়ছে। চোখ পিটপিট করে আবারও ঘুমের অতলে নিজেকে ডুবিয়ে দিচ্ছে। দিশেহারা অটবী ত্রিস্তানকে কিচ্ছুটি বলতে পারলো না। অদ্ভুত দ্বিধাদ্বন্দে শিউরে উঠলো।

চারদিন একাধারে বৃষ্টির পর আজকের দিনটা রোদ্দুরে ঝলমল। বৃষ্টির কারণে অনেকটাই রাজনৈতিক ঝগড়া মিটে গেছে। অল্পতে ঝামেলা শেষ করতে রাজি হয়েছে দু’পক্ষ। নয়তো আজ বাদে কালও গোলাগুলির ভয়ংকর শব্দে গোটা এলাকা আঁতঙ্কে থতমত হয়েছিল।
অটবীর মন বলছে, সেদিন ত্রিস্তান তার জন্যই বৃষ্টি মাথায় করে এসেছিল। তাকে আটকাতে। সফলও হয়েছিল বটে! সরোজকে কল করার পর সে একবাক্যে মানা করে দেয়, এখন এলাকায় ঢোকা যাবে না। পরিস্থিতি শিথিল হলে সে নিজেই তাদের নিতে আসবে। গুণে গুণে তিন ঘণ্টা ত্রিস্তানকে নিয়ে সেই নির্জন আঁধারিয়া জায়গায় জড় বস্তুর মতো বসে থাকতে হয়েছিল অটবীকে। ত্রিস্তান তখনো জ্বরে কাতর। আধবেহুশ। কিছুক্ষণ পর পর কিসব হাবিজাবি কথা বলে পাগল করে দিচ্ছিল। আচ্ছা, লোকটা এখন কেমন আছে? এতদিনে তো সুস্থ হয়ে যাওয়া কথা। সুস্থ হয়েছে কি? কিজানি! ওইদিনের পর তো আর দেখাই হলো না!

ঘড়িতে সকাল ন’টা বেজে সাত। টিউশনে বেরিয়েছে অটবী। সাধারণত এত সকাল সকাল সে কোথাও বের হয়না। টিউশনগুলোও বিকালে অথবা রাতের মধ্যে শেষ করার চেষ্টা করে। কিন্তু রেবা বেগমের স্পষ্ট মানা, সন্ধ্যার পর বাসার বাহিরে থাকা যাবে না। কারণটা অবশ্য সেদিনের ঘটনাই। মেয়েকে রাতে বাসায় ফিরতে না দেখে প্রেসার বাড়িয়ে, কেঁদেকেটে একাকার করে ফেলেছিলেন তিনি। তারপর যখন অটবী বাসায় ফিরলো, তখন শরীরের সর্ব শক্তি দিয়ে নিজের বুকের ভেতর গুঁজে রেখেছিলেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আসলে মায়ের মন তো! মায়েরা আবার মেয়েদের প্রতি একটু বেশিই ব্যাকুল থাকেন।

সরব, কে যেন ডেকে উঠলো অটবীকে। ডাকটা সামনে থেকে আসছে। সামনের মুদির দোকান থেকে।
—“অটবী আপু? কেমন আছো?”

অটবী রয়েসয়ে নজর তুললো। তনয়া দৌঁড়ে আসছে। হাতে চিপস, কোক। দ্রুত কাছে এসে আবারও ছটপটে কণ্ঠে বললো, “কত্তদিন পর দেখা আপু! জানো, আমি তোমাকে অনেক মিস করেছি। ভাইয়াকেও বলেছিলাম তোমার কাছে নিয়ে যেতে। কিন্তু ও পঁচা। তোমার কাছে নিয়ে যায় না।”

অটবী একটু অপ্রস্তুত হলো। সস্নেহে হাত রাখলো তনয়ার চুলের ভাঁজে। আলতো হেসে বললো, “কেমন আছো?”
—“ফাঁটাফাঁটি।”
—“তোমার ভাইয়া কেমন আছেন? উনার জ্বর ঠিক হয়েছে?”

অটবী কি কোনো কৌতূক বললো? হয়তো। তার কথা শুনে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো তনয়া। প্রচন্ড গর্ব নিয়ে বললো, “বুঝলা? আমার ভাইয়াকে জ্বরও ভয় পায়। একদিনও টিকতে পারে নি। ভাইয়া একটা ধমক দিয়েছে, আর ও গায়েব!”

অটবী আবারও হাসার চেষ্টা করলো। মুদির দোকানে একটু করে তাকিয়ে দেখলো, সরোজকে দেখা যাচ্ছে। চিপস্, কোকের দাম মেটাচ্ছে সে। সাথে নিজেও কি যেন কিনছে। অটবী সেদিকে চেয়ে থেকেই কোনোরূপ ভণিতা ছাড়া বললো, “তুমি আমার একটা কাজ করতে পারবে তনয়া?”
—“কি কাজ?”

অটবী জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেঁজালো,”বেশি কিছু না। তোমাদের বাসাটা অনেক সুন্দর। আমার ওখানে যেতে ইচ্ছে করছে। তুমি কি আমাকে ওখানে নিয়ে যাবে? আমি তোমার সাথে সময়ও কাটাতে পারবো। একসাথে খেলতেও পারবো।”

তনয়া অবুঝ চোখে চেয়ে অটবীর কথা বোঝার চেষ্টা করলো। পিটপিট করে চোখের পাতা ফেলে বললো, “আমি কিভাবে নিয়ে যাবো? আমি তো বাসার রাস্তা চিনি না।”
—“তোমাকে নিতে হবে না। সরোজ নিয়ে যাবে। তুমি শুধু সরোজকে বলবে, তুমি চাও আমি যেন তোমাদের সাথে তোমার বাড়ি যাই। বলতে পারবে না?”
তনয়া দাঁত বের করে হাসলো। মাথা দুলালো, “পারব।”
—“কাউকে বলবে না আমি তোমাকে এটা শিখিয়ে দিয়েছি, ঠিকাছে? তোমার ভাইয়াকেও না।”
—“আচ্ছা।”

অটবী যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল! সে এমনটা কেন করছে, তা তার নিজেরও জানা নেই। শুধু মনে হচ্ছে, অনেক কিছু আছে যা সে জানে না। কিন্তু তাকে জানতে হবে। জানতেই হবে!

অটবীকে ত্রিস্তানের বাড়িতে আনতে পেরে সরোজও অনেক খুশি। তার কেন যেন মনে হয়, ত্রিস্তান আর অটবীর মাঝে কিছু একটা চলছে। সবার অগোচরে তারা মারাত্বক প্রেম করে বেড়াচ্ছে। এও মনে হয়, শীগ্রই সে একটা বিয়ে খাবে। অটবী আর ত্রিস্তানের। এরপর তার আর নলীর মাঝে বাঁধাধরা থাকবে না। ত্রিস্তান ভাই তো তাকে চেনে। তার নিশ্চই তাদের সম্পর্কে আপত্তি নেই। ত্রিস্তান অটবীকে শতভাগ রাজি করাতে পারবে। দরকার হলে সরোজ তার পায়ে পরবে, কান্নাকাটি করবে। আর অটবী তো ত্রিস্তানের কথা ফেলতেই পারবে না!

আগাম পরিকল্পনার কথা ভেবেই আনন্দে, উল্লাসে বাক-বাকুম পায়রা হয়ে গেল সরোজ। অটবীকে ড্রইংরুমের সোফায় বসিয়ে শ্রদ্ধার সহিত জিজ্ঞেস করলো, “কি খাইবা আপু? তোমার লাইগা কি বানামু কও? তুমি খালি মুখ থেইকা বাইর করবা, আমি এক্ষুণি হাজির করতাছি।”

অটবী তখন ডাইনিং টেবিলের সামনে ত্রিস্তানের ফ্যামিলি ফটোটা দেখছিল। সরোজের প্রশ্নে ওর দিকে তাকালো, “আমি এখানে খেতে আসিনি… ত্রিস্তান আছে বাসায়?”

সরোজ চোখ বড় বড় করলো। ঠোঁটে বিরাট দুষ্টু হাসি এঁটে বললো, “ভাই তো নাই। আইয়া যাইবো। তুমি চিন্তা কইরো না। বেশি অপেক্ষা করতে হইবো না।”
তারপর একটু থেমে আবার বললো, “নুডুলস্ বানাই তোমার লাইগা? কিছু না খাইয়া তো এন থেইকা যাইতে পারবা না।”

অটবীর হতাশ চোখের দৃষ্টি, “নিজের বাসায় যাচ্ছো না কেন, সরোজ? চাচা তোমার জন্য কত চিন্তায় আছেন, জানো কিছু?”
সরোজ যেন গায়ে মাখলো না। আনন্দে আটখানা হয়ে রান্নাঘরে যেতে যেতে বললো, “থাকতে দাও। একটু চিন্তা করলে বুইড়ার কিচ্ছু হইতো না।”

সময় গড়ালো। ঘড়িতে দশটা বাজছে। সরোজ রান্নাঘরে রান্নায় ব্যস্ত। তনয়া অটবীর পাশে বসে রঙ নিয়ে কি কি যেন আঁকাবুকি করছে। তাদের ডান পাশে দুটো রুম। প্রথমটার দরজা বন্ধ। ওটা ত্রিস্তানের। পাশেরটা তনয়ার। দরজার ফাঁক দিয়ে বিভিন্ন পুতুল, ড্রেসিংটেবিলে সাজগোজের জিনিস দেখা যাচ্ছে।
অটবী আস্তে করে উঠে দাঁড়ালো। প্রশ্ন ছুঁড়লো, “সরোজ, ওয়াসরুমটা কোথায়?”
—“ত্রিস্তান ভাইয়ের রুমে একটা। তনয়া আপুর রুমে একটা। তোমার যেডায় মন চায় চাও। ত্রিস্তান ভাইয়ের রুম কিন্তু পয়লাডা!”

কথাগুলো সরোজ উলটাপালটা মতলবে বললেও অটবী ভেতরে ভেতরে ভীষণ দূর্বল, অনিশ্চিৎ, ভীতু। ক্রমশই হাত পায়ের শীতলতা টের পাচ্ছে সে। সে যা করছে তা কি ঠিক? হয়তো না। একদমই ঠিক না। কিন্তু এছাড়া যে আর কোনো পথ নেই। সামনের বিরাট সাইনবোর্ডে লিখা, “ফিরে যাওয়া নিষেধ।” তবে? অটবী ফিরবে কেমন করে? সব যে বন্ধ! তালা দেওয়া!
তেঁতো নিশ্বাস ফেলে তনয়ার দিকে একবার তাকালো সে। নাহ্! এদিকে বিন্দু মাত্র খেয়াল নেই। সে নিজের কাজেই ব্যস্ত। পাথর সম পাদুটো নিয়ে অটবী এবার সামনে এগোলো। নিঃশব্দে ঢুকলো ত্রিস্তানের ঘরে। সাদামাটা একটা ঘর! তবে দৈর্ঘ-প্রস্থ অনেকটাই বড়। আগাগোড়া পরিচ্ছন্ন, গোছানো! আসবাবপত্র তেমন একটা নেই। শুধু বুকসেলফ, চেয়ার-টেবিল, খাট, আলমারি। এজন্যই হয়তো আকারে বড় লাগছে ঘরটা। অটবী চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলো। পা বাড়িয়ে বুকসেলফের কাছাকাছি হলো। উপরের তিনটে তাকেই বই। বাকি তাকগুলো কাঁচের ভেতর তালামারা। খোলার উপায় নেই। তৃতীয় তাকে বইয়ের পাশাপাশি কিছু ফাইলও আছে। অটবী সেগুলোতেই হাত বাড়ালো। ভেবেছিল, কিছু একটা পাবে। কিন্তু না। ফাইলগুলোতে কিসব হিসাব প্রিন্ট করা। কাজের কিছু নেই। আশাহত হয়ে অটবী বইগুলো দেখতে লাগলো এবার। এক এক করে সবকটা। তার মন টানছে না। সে কিছু একটা চায়। কোনো একটা রহস্যের সমাধান! যেকোনো একটা!
উপরের তাকের বইগুলোতে হাত বাড়াতেই নিচ্ছিল, এসময় হঠাৎ বাহুতে টান পরে। চোখ তুলে দেখে, ত্রিস্তান দাঁড়িয়ে আছে। হাতে বাজারের ব্যাগ। মুখ ঘর্মাক্ত। চোয়ালে কাঠিন্যতা স্পষ্ট। বাহির থেকে এসেই হয়তো এ ঘরে ঢুকেছে।

—“এখানে কি করছিলে, অটবী?”

অটবীর গলা দিয়ে যেন কথা বেরোলো না। বাজেরকমের আন্দোলনে আহত হলো। থেকে থেকে বলতে চাইলো, “আমি… ওয়াসরুম…”
ত্রিস্তান থামিয়ে দিলো, “ওয়াসরুম ওদিকে। এখানে কি করছো?”
—“বই দে-দেখছিলাম।”

সশব্দে একটা নিশ্বাস ফেললো ত্রিস্তান। ধপ করে বাজারের ব্যাগটা ফেলে দিলো মেঝেতে। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো, “এরপর থেকে তনয়ার রুমে যা দরকার করবে। এ রুমে আসবে না।”

অটবীর বলতে ইচ্ছে হলো, “এঘরেই তো তার যত সব দরকার। তাহলে কেন আসবে না?”
কিন্তু বলা হলো না। ততক্ষণে ত্রিস্তান চোখের ইশারায় তাকে বিছানায় বসার নিমন্ত্রণ জানাচ্ছে। সেও বাধ্য মেয়ের মতো চুপচাপ একপাশে বসলো। ত্রিস্তানের মুখোমুখি। আস্তে করে বললো, “আমার কিছু প্রশ্ন আছে।”

ত্রিস্তানের গলার সুর শীতল, অস্বাভাবিক শান্ত। সে প্রায় তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলো, “সেদিনের কথা ভুলে যাও, অটবী। আমি যা বলেছি সব ভুল। কিচ্ছু সত্য না।”

অটবী দমলো না। গলার জোর বাড়ালো, “আপনার বাবা-মার এক্সিডেন্টের পর কি হয়েছিল, ত্রিস্তান? আমি জানতে চাই।”
—“তোমাকে সব ভুলে যেতে বলেছি।”
—“ভুলে যাওয়ার মতো কিচ্ছু বলেননি। যা বলেছেন তা আমার কৌতূহল বাড়িয়েছে মাত্র! কোনো রহস্য উদঘাটন হয়নি।”

অটবী থামলো। তারপর কেমন করে হাসলো যেন, “আপনি অনেক চতুর, ত্রিস্তান। জ্বরের ঘোরেও সত্য বলেননি। পুরোটা চেপে গেছেন। আপনি আমাকে পছন্দ করেন, সেটাও কখনো বুঝতে দেননি। কেন?”

কণ্ঠ কাঁপছে তার। চোখ জলে টলমল। পাষাণ ত্রিস্তান কঠিন হৃদয়ে পুরোটা দেখলো শুধু। কিচ্ছুটি বললো না। দেখে মনে হচ্ছে, সব স্বাভাবিক। আগের মতো।
তার এমন নির্বিকার আচরণ অটবীর পছন্দ হলো না। ভেতরটা বিষিয়ে দিলো। চোখের পানিগুলো অনাদরে ফেলে দুর্বিষহ কণ্ঠে হাহাকার তুললো, “আপনি আমাকে নিজের প্রতি দূর্বল করে এভাবে মাঝপথে ছেড়ে যেতে পারেন না, ত্রিস্তান! নিজের বাবা থেকে আপনি কম কিসের?”

ত্রিস্তান কি একটু চমকালো? মনে হলো না। চেয়ার ছেড়ে উঠে লোকটা ভীষণ নির্লিপ্তভাবে এগিয়ে এলো কাছে। অটবীর কান্না ভেঁজা গালদুটো মুছে দিলো মোলায়েম স্পর্শে। মেয়েটাকে কাঁদলে এত মানায়!
ধীর কণ্ঠে বললো, “আস্তে কথা বলো। সরোজ, তনয়া শুনতে পাবে।”

কথাটা কি তাকে তাচ্ছিল্য করে বললো লোকটা? মুহুর্তেই রুঢ় ভাবে তাকালো অটবী। ত্রিস্তানের গভীর চোখদুটো নিজের দাবানলে আসক্ত চাহনির পিঠে ঝাঝরা করে দিলো। কাঠকাঠ গলায় বললো, “এ ঘরে কাকে লুকিয়ে রেখেছেন, ত্রিস্তান?”

চোখের পাতা যেন একটু কাঁপলো। অটবীর রক্তিম গালদুটো আলতো করে নিজের হাতের ভাঁজে নিয়ে নিলো সে। কপালে কপাল ঠেকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “একটা মিথ্যে বলি অটবী? শুনবে?”

অটবীর উত্তর নেই। ত্রিস্তান উত্তরের অপেক্ষাতেও নেই। সে নিজের মতোই সর্বশ্রেষ্ঠ মিথ্যেটা বলে উঠলো, “আমি তোমাকে ভালোবাসি না বলেই তোমার সব কিছু জানা অধিকার আছে, অটবী।”

তবে? এই মিথ্যের সত্য কি? আমি তোমাকে ভালোবাসি বলেই তোমার সবকিছু জানার অধিকার নেই? কেন নেই?

_____________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

অটবী সুখ

১৯.
নিস্তব্ধ ঘরটাতে হৃদযন্ত্রের ধুকধুক ধ্বনি স্পষ্ট। আলাদা কোনো শব্দ নেই, কথা নেই। ত্রিস্তান তখনো চোখ বুজে রেখেছে। অটবীর গাল ধরে রাখা তার হাত দু’টো স্থির নেই। অসম্ভব কাঁপছে। ধীরে ধীরে চোখ মেলে অটবী দেখলো, ত্রিস্তান তার অতি নিকটে। রুঢ়ভাবে কপাল কুঁচকে আকাশের মতো বিষাদ নিয়ে লেপ্টে আছে। না পাওয়ার এক সূক্ষ্ণ যন্ত্রণা চারিদিকে মৌ মৌ করে ছড়িয়ে যাচ্ছে যেন। এত বিষাদে ভরা কেন লোকটা? একটু মন খুলে কি হাসতে পারেনা? এত কষ্ট কিসের?
কর্মহীন পরে থাকা হাতটা ত্রিস্তানের হাতের পিঠে আলতো করে রাখলো অটবী। আটকে আসা কণ্ঠে ডাকলো, “ত্রিস্তান?”

ত্রিস্তান শুনলো। শেষ বারের মতো প্রিয়তমাকে অতি নিকট থেকে ছুঁয়ে, দেখে সরে দাঁড়ালো আস্তে আস্তে। বেদনায় নিমজ্জিত মুখটা মুহুর্তেই কঠিন করে অটবীর দিকে দৃষ্টি ফেলতেই খেয়াল করলো, মেয়েটা আশ্চর্য চোখে চেয়ে আছে ওর দিকে। চোখে ভয়। মনে আতঙ্ক। ঠোঁট কাঁপছে কিছু বলার জন্য। ত্রিস্তানের ভ্রু কুঁচকে গেল হঠাৎ করেই। গম্ভীর গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লো, “কি হয়েছে?”

ভারী আওয়াজে একটু চমকালো অটবী। দমবন্ধকর গলায় শুধালো, “আপনার কি হয়েছে ত্রিস্তান? আপনি কি সত্যিই অসুস্থ?”

ভ্রুটা যেন আরেকটু বেঁকে গেল। অটবীকে গভীর চোখে দেখতে গিয়ে জিভে এক বিশ্রী নোনতা স্বাদ উপলব্ধি করলো ত্রিস্তান। চট করে নাকের কাছে হাত ছোঁয়ালো। রক্ত! নাক থেকে আবারও রক্ত ঝরছে! হাহ্! বিরক্তিকর এক নিশ্বাস ফেলে টেবিল থেকে রুমাল নিলো ত্রিস্তান। যেমন তেমন করে রক্ত মুছতে মুছতে আদেশের সুরে বললো, “এখান থেকে যাও অটবী। আর কখনো এঘরে আসবে না।”

অটবী চরম অবাধ্য হলো। নিজ জায়গা থেকে এক পাও নড়লো না। জোর গলায় বললো, “উত্তর দিন আগে। আপনি কি অসুস্থ?”
—“হলে? চিকিৎসা খরচ দিয়ে উদ্ধার করবে আমায়?”

নিশ্বাসের গতি কমে নেই হয়ে গেছে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বিশ্রীরকমের অনুভূতি লুকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে অটবী। কিন্তু হচ্ছে না। উদাস এক ব্যর্থতা দুমড়েমুচড়ে নস্যি করে দিচ্ছে প্রতিবার। অটবী কখনো কারো সামনে কাঁদে না। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে বুঝতে শিখেছে, নিজের দূর্বলতা কাউকে দেখাতে নেই। এই কঠিন নীতি মেনে চলা মেয়েটা সর্বদাই জয়ী, সফল। তবে আজ কি হলো? কান্না কিছুতেই থামাতে পারছে না কেন? চোখের কোণ ঘেঁষে একের পর এক অশ্রুকণা গালের শেষ সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। অথচ নিজের নিষ্ঠুরতার প্রমাণ দিয়ে ত্রিস্তান একবারও তাকে চেয়ে দেখছে না। কেন দেখছে না?

ত্রিস্তানের কাছে এক পা এগিয়ে লোকটার সামনাসামনি দাঁড়ালো অটবী। চোখে চোখ রেখে দৃঢ় গলায় বললো, “আমি আপনার থেকে দূরে দূরেই ছিলাম ত্রিস্তান। আপনি কাছে এসেছেন। আমাকে দূর্বল করেছেন। এখন এর দায়ভার নিতে ভয় পাচ্ছেন কেন? আগে মনে ছিল না? কষ্ট কি শুধুই আপনার হয়? আমার নেই?”

ত্রিস্তান দৃষ্টি সরালো না। গভীর চোখে চেয়েই রইলো। ক্ষীণ গলায় উত্তর দিলো, “আমার কষ্ট সহ্য করার অভ্যেস আছে, অটবী। তোমার নেই।”
—“আমি অভ্যেস করে নেব। আপনি শুধু আমাকে সত্যটা বলুন।”
—“তুমি আমাকে ঘৃণা করবে, অটবী। এর চেয়ে আমি তোমাকে নাই-ই পেলাম।”

অটবীর গাল গড়ানো জলগুলো মুছে দেওয়ার বড্ড স্বাদ জাগলো তার। হাত বাড়াতে গিয়েও কি মনে করে আবার গুটিয়ে নিলো। টেবিলের পাশে ডাস্টবিন আছে। সেখানে রক্তে রঞ্জিত টিস্যুটা ফেলে আস্তে করে বললো, “আমার ঘুম পাচ্ছে অটবী। ঘুমাবো। তুমি এখন যাও।”

অটবী গেল না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। মনে হলো, ত্রিস্তানের হাঁটু কাঁপছে। সে ধপ করে বসে পরলো বিছানায়। মুহুর্তেই পাশ ড্রয়ার থেকে কি যেন হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগলো। দেখা গেল, ছোট্ট একটা কৌটা থেকে কিসের যেন তিনটে ঔষধ নিচ্ছে সে। পানির গ্লাসটা ওঠাতে গেলেই মেঝেতে পরে গেল সেটা। ত্রিস্তান অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে। অথচ মুখটা তখনো কঠিন, রুক্ষ।

অটবী দেড়ি করলো না। ছুটে গিয়ে ত্রিস্তানের পাশে বসলো। কাঁধে হাত রেখে উদগ্রীব কণ্ঠে একাধারে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “এমন করছেন কেন ত্রিস্তান? বেশি খারাপ লাগছে? ডাক্তার ডাকি? শুনুন না! ত্রিস্তান?”

ত্রিস্তান জবাব দিচ্ছে না। একটা হাত কপালে চেপে ঝুঁকে আছে। অটবীর ভয় বাড়ল। দিকবেদিক শূণ্য হয়ে সরোজকে ডাকতে নিলেই থামিয়ে দিলো ত্রিস্তান।
—“পানি খাবো।”

মেঝেতে পরা গ্লাসটা কাঁচের হলেও ভাঙ্গেনি। অটবী সেটা উঠিয়ে আবার পূণরায় পানি ঢাললো। ঔষধ সহ ত্রিস্তান সেটা গিললো মাত্র। কিন্তু তবুও শান্তি মিলছে না। বুক জ্বলছে, চোখ জ্বলছে। বুকের ব্যথাটাই বরং বেশি।

ত্রিস্তানকে কোনোমতে শুইয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো অটবী। লোকটা কিছুতেই শুতে চাইছিল না। ত্যাড়া আচরণ করছিল। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বললো, “এখন কেমন লাগছে? ঠিক আছেন এখন?”

ত্রিস্তান সে উত্তর দিলো না। অতি গোপনে অটবীর একটা হাত শক্ত করে মুঠোয় পুরে নিলো। ঘুমের অতলে তলিয়ে যেতে যেতে কেমন করে যেন বললো, “এই অটবী! আমার কিন্তু তুমি ছাড়া কেউ নেই।”

লোকটা ঘুমিয়ে গেছে। তখনো গভীর করে ধরে রেখেছে তার হাত। অটবীও ছাড়লো না। ধরে রইলো। এরমাঝে অবশ্য সরোজ আর তনয়াও একবার এসেছিল, আওয়াজ শুনে। কিন্তু তাদের এভাবে দেখে তনয়াকে জোড় করে টেনে নিয়ে গেছে সরোজ। আর আসতে দেয়নি।

ঘড়িতে একটা বেজে সাত। এ বাড়ির আশেপাশে মসজিদ না থাকলেও সুদূর থেকে আযানের ক্ষীণ সুর কানে ভেসে আসছে। খোলা জানালার বামদিকে দুটো চড়ুই বসে ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে। মাথা এদিক-ওদিক করে গভীর পর্যবেক্ষণ করছে যেন। অটবী সেখান থেকে দৃষ্টি সরালো। দুঃখ মানব গভীর তন্দ্রায় বিভোর। নিশ্বাসের আনাগোনা প্রচন্ড ধীর, ক্ষীণ। হাতের বাঁধনও আলগা হয়ে গেছে। খুব ক্লান্ত কি? হওয়ারই কথা।

ত্রিস্তানের প্রতি অটবী ঠিক কখন দূর্বল হয়ে পরেছিল, এ প্রশ্নের উত্তর আদৌ তার জানা নেই। হয়তো দূরে দূরে থাকতে গিয়েই ক্রমশ অধঃপতনের দিকে পা বাড়াচ্ছিল। পা বাড়াতে বাড়াতে এখন অনেকটা পথ পেরিয়ে গেছে। ফিরে যাওয়াটা এখন ভীষণ কষ্টকর, প্রায় অসম্ভব। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ত্রিস্তানের গাল আলতো করে ছুঁয়ে দেখলো অটবী। ঠান্ডা হয়ে আছে। আঙুলের ছোঁয়াটা গালের সবটুকু জায়গায় ঘোরালো। লোকটার অতীত সম্পর্কে সে অত শত জানে না। যেটুকু জানে, সেটুকু তার বিশ্বাস করতে খুব অবাক লাগে। এ জানার মাঝেও অনেক কিছু লুকানো আছে, আড়ালে আছে। ত্রিস্তান জ্বরের ঘোরেও সেসব কথা মুখে আনেনি।

অটবীর চোখে ভাসে, সেদিন বৃষ্টির রাতে ত্রিস্তানের অবুঝপনা। একদম নিষ্পাপ শিশুটি হয়ে যাওয়া। ত্রিস্তান যেন তখন অন্য মানুষ। কৃত্রিমতার ছিঁটেফোঁটাও নেই। উদাস এক ব্যক্তি হয়ে একমনে চেয়ে ছিল অটবীর মুখপানে। মাদকতা নিয়ে বলেছিল, “তোমাকে আমার বুকে গুঁজে রাখতে ইচ্ছে হয়, অটবী। বুকে আসবে?”

অটবী তখন কিছু বলতে পারেনি। চুপ করে ছিল। এই চুপ করে থাকার সময়টাতেই ত্রিস্তান কতকিছু যে বলেছে! ও-কে নিয়ে, ওর মাকে নিয়ে, ওর বাবাকে নিয়ে। এইযে! এই সুন্দর ছেলেটা আগে প্রচন্ড রকমের খারাপ ছিল। পুরো দিন-রাত নেশায় বুদ হয়ে থাকা ছিল তার একমাত্র কাজ। ঠিকঠাক ভাবে খেতো না, ঘুমাতো না। পড়ালেখা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল। ড্রাগস্-এর নেশায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিল ত্রিস্তান। ত্রিস্তানের বাবা তাই ছেলের এ অবস্থা দেখতে পারছিলেন না। তার এত স্বাদের ছেলে! সুস্থ ছেলে! এমন হয়ে গেল কিভাবে? ছেলেকে নিয়ে প্রতিনিয়ত ত্রিস্তানের বাবা-মায়ের মাঝে ঝগড়া হতো। দুজনেই দুজনকে দোষারোপ করছে, আঙুল তুলে দেখিয়ে দিচ্ছে, “তুমি ভুল!”
ঝগড়ার একপর্যায়ে ভালোবাসাটা যেন কোথাও লুকিয়ে গেল। দূরত্ব বাড়লো। অভিমান বাড়লো। ত্রিস্তানের বাবা আলাদা রুমে শুতে লাগলেন। কিন্তু তখনো ত্রিস্তান তার মতো। নির্বিকার। চোখের সামনে বাবা-মায়ের ঝগড়াটাও যেন তার বিবেক নাড়াতে পারছিল না।

ত্রিস্তানের মা, ডায়না আলবার্ট। বিয়ের পর হলেন ডালিয়া হোসাইন। ভীষণ দূর্বল, প্রিয়জন প্রিয় মানুষ। সম্পর্কের এই তিক্ততা, জটিলতা মেনে নিতে পারেননি। এক মধ্যরাত্রিতে ঝগড়ার মাঝখানে হাতের রগ কেটে ফেলেছিলেন। ভালোবাসায় যেন তখনই টান অনুভব হলো। ত্রিস্তানের বাবার সম্বিৎ ফিরলো। স্ত্রীকে নিয়ে ছুটলেন হাসপাতালে। কিন্তু তারপর… তারপর পরিস্থিতি পুরো পালটে গেল। কার এক্সিডেন্টে আহত-নিহত হলেন ত্রিস্তানের বাবা-মা। ত্রিস্তান যখন এ খবর শুনেছে, তখন রাত পেরিয়ে সকাল। নেশায় বুদ হয়ে পরেছিল বিছানার একপাশে। তনয়া আট মাসের ভরা পেট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ডাকছিল ভাইকে। ত্রিস্তান উঠছিল না। তার চোখে যে তখন কি ঘুম! এত ঘুম পাচ্ছিল কেন? রাতে বেশি নেশা করে ফেলেছিল বলে?

ত্রিস্তানের চোখের কালো দাগে হাত বুলালো অটবী। পরক্ষণেই কি মনে করে দ্রুত ড্রয়ারটা টান দিয়ে খুললো। ত্রিস্তান যে ঔষধগুলো খেয়েছিল তার কৌটা সাদা রঙের। সামনে-পেছনে-উপরে-নিচে কোথাও সামান্য লেখা নেই। সম্পূর্ণ ফাঁকা। ড্রয়ারে যদি কিছু থাকে! তবে আফসোস! তন্য তন্য করে খুঁজেও তেমনে কিছু পেল না অটবী। শুধু এক ডায়েরি ছাড়া। ডায়েরির আগাগোড়ায় কয়েকটা কবিতা লেখা। কবিতার একদম শেষে অচেনা নামও উল্লেখ করা। ‘সৈয়দ শাহ্জাহান!’ এটা কে হতে পারে? অটবী অতসবে গেল না। এক এক করে সব পৃষ্ঠা দেখতে লাগলো। সর্বশেষ পৃষ্ঠাটায় গুটিগুটি করে লিখা,
“প্রিয় অরণ্য, আমার কেন যেন মনে হয়, তুমি সুখী হবে। কোনো এক সুখী মানুষের সাথে ঘর বাঁধবে। সেই ঘরের নাম দেবে ‘অটবী সুখ’। সেই ঘরের কোথাও আমি থাকবো না। আমার অস্তিত্ব থাকবে না। অথচ তোমাকে চোখের আড়ালও হতে দেবো না। তুমি যখন ফুটপাত দিয়ে প্রিয় মানুষটার হাত ধরে হাঁটবে, আমি দূরে দাঁড়িয়ে তোমায় দেখবো। তোমার হাসিটুকু দেখে নিজেও হাসবো…
এই অটবী! এই মানুষটা অন্যের জেনেও তাকে ভালোবাসা কি পাপ হবে? আমি কি আজীবন পাপী হয়ে থাকবো?”

স্তব্ধ অটবী খামচে ধরলো ডায়েরিটা। হাত, পা কাঁপছে। ভেতরটা নিদারুণ নিষ্ঠুরতায় তিরতির করছে। টলমলে চোখদুটো ত্রিস্তানের পানে স্থির হতেই মস্তিষ্কে টান লাগলো, ত্রিস্তান বলছে, “আমি আমার বাবা-মায়ের মতো হতে চাইনি, অটবী। আমি তাকে রুমে আটকে রাখতে চাইনি।”

সেদিনের মতো। সেদিনের সেই বৃষ্টির রাতের মতো ত্রিস্তান আবারও একই কথা বলছে।

_______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

অটবী সুখ পর্ব-১৬+১৭

0

অটবী সুখ

১৬.
আকাশে গুটিকয়েক তারা বাসা বেঁধেছে। সবচেয়ে বড় তারাটা সবার উপরে মিটিমিটি হাসছে। চাঁদের আলো মোটামোটি। জঙ্গলের আশপাশটা ভালোই দেখা যাচ্ছে। তবুও অটবীর ভেতরটা স্বস্তি পাচ্ছে না। সে অন্ধকার ভয় পায়। ছোট থেকেই। দুঃখ-যন্ত্রণা সয়ে সয়ে সেই ভয়টা ক্ষীণ কমে গেলেও একেবারে নিঃশেষ হয়নি। এই যে, ইয়া লম্বা লম্বা গাছগুলো বামে-ডানে দাঁড়িয়ে লোভাতুর দৃষ্টে চেয়ে আছে ওর দিকে। বুকটা কাঁপছে। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে ক্রমশই। সে একা হলে হয়তো এতক্ষণে জ্ঞান হারিয়ে কোনো একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলত। কিন্তু পাশে ত্রিস্তান আছে। লোকটার সামনে সে তার দূর্বলতা প্রকাশ করতে চায় না। যথাসম্ভব শক্ত খোলস আঁকড়ে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে। কেউ দেখলে হয়তো কখনোই বুঝবে না, অটবীর অন্ধকারে ভীষণ ভয়।
জঙ্গলের পথ প্রায় শেষ। রাস্তার শুরুতে একটা ল্যাম্পপোস্ট আছে। সেটার আলো দশ-বারো হাত দূর থেকেও স্পষ্ট দেখা যায়। বাসার পথটাও অতটা নির্জন-আঁধারী না। সে নির্ভরে যেতে পারবে। অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে অটবী বললো, “আপনাকে আর যেতে হবে না। বাকিটা আমি পারব।”

সম্পূর্ণটা পথ ত্রিস্তান নিশ্চুপ ছিল। আপন খেয়ালে মগ্ন হয়ে অটবীর পায়ের সঙ্গে পা মেলাচ্ছিল শুধু। সবসময়কার মতো আড়চোখে তাকায়নি পর্যন্ত। অটবী ভেবেছিল, এখনও বুঝি মৌন সম্মতি দিয়ে চলে যাবে সে। কিন্তু ত্রিস্তান গেল না। অনেক্ষণ বাদে নির্বিকার কণ্ঠে বললো, “তোমার বাসার ওদিকে আমার কাজ আছে।”

কথাটা অটবীকে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার সূক্ষ্ণ প্রস্তাব। কিন্তু আসলেই কি তার ওখানে কাজ আছে? অটবী বিশ্বাস করতে পারলো না। সরু চোখে তাকালো, “মিথ্যে বলছেন কেন?”
“আমি হতে পারি শ্রেষ্ঠ মিথ্যুক। কিন্তু এখন সত্য বলছি।”
“কি কাজ ওখানে?”
“এখানে ভালো সিগারেট পাওয়া যায় না। তাই ওখান থেকে কিনব।”

আশ্চর্য অটবী হতবিহ্বল হলো। ত্রিস্তানকে দেখে মোটেও মনে হচ্ছে না সে ঠাট্টা করছে। চোখে-মুখে এত গম্ভীরতা! ব্যস্ততা! যেন এদিকটায় সত্যিই ভালো সিগারেট পাওয়া যায় না। ভালো সিগারেটের অভাবে ত্রিস্তান শুকিয়ে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। এইতো, আর চার-পাঁচ মিনিট। ভালো, মধুময়, অতি সুস্বাদু সিগারেট খেতে না পেয়ে ত্রিস্তানের বেদনাদায়ক মৃ’ত্যু ঘটবে।
অটবী জোরেসোরে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। হতাশ গলায় বললো, “আপনি ক্লান্ত হন না?”

ত্রিস্তান উত্তর দেয়নি। খুব ধীরে সুস্থে সামনের দিকে একেকটা কদম ফেলছে। অটবী বিরক্ত হলেও কিছু বললো না। এতদিনের সাক্ষাতের পরও ত্রিস্তানকে সে ভরসা করতে পারেনি। কেমন যেন একটা জড়তা কাজ করে। লোকটা তুখোড় বুদ্ধিমান, চরম চতুর– সে জানে। অদ্ভুত আচরণ দিয়ে ক্ষণে ক্ষণে বোঝাতে চায়, সে খুবই ভয়ংকর একটা মানুষ। গহীনের মতো বিশাল রহস্য লুকিয়ে রাখতে রাখতে বড্ড ক্লান্ত। কিন্তু সেই রহস্যটা কি? অটবীর মাঝে মাঝে খুব কৌতূহল হয়। প্রশ্ন জাগে, বাউন্ডুলে, চোরেদের চুরি করার জন্য অদ্ভুত অদ্ভুত সব বুদ্ধি দেওয়া ছন্নছাড়া ছেলেটা হঠাৎ এত রহস্যময় হয়ে গেল কিভাবে? আগের অপরিচিত ত্রিস্তানটাই বোধহয় ভালো ছিল। পরিচিত হওয়ার পর সেটা গলার কাঁটার মতো ঠেকে আছে।

“আপনার মা কি বিদেশি?”

তার প্রশ্ন শুনে ত্রিস্তান কি হাসলো? চট করে পাশ ফিরলো অটবী। নাহ্! লোকটা আগের মতোই নির্লিপ্ত হাঁটছে। দৃষ্টি, রাস্তার ইট-পাথরের দিকে। অটবী নজর ফিরিয়ে আবারও সামনে তাকালো। একটা সিএনজি বেকায়দায় এদিকেই আসছে। গতি নিয়ন্ত্রণে নেই। নেশাটেশা করে গাড়ি চালাচ্ছে নাকি? ভ্রু কুঁচকে মনে মনে কয়েকটা পাপী শব্দ উচ্চারণ করে ফেললো সে। ত্রিস্তানকে বললো, “আরেকটু কাছে আসুন। রাস্তার ওদিকে হাঁটছেন কেন?”

রাস্তার দুপাশে হাঁটার অত জায়গা নেই। ত্রিস্তান অটবীর দিকে চাপতেই না চাইতেও অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছে ওরা। অটবী অস্বস্তি হচ্ছে।
“আমার মা বিদেশি।”

অটবী বার কয়েক পলক ফেললো। জিজ্ঞাসু কণ্ঠে বললো, “জি?”

ত্রিস্তান আবার বললো, “আমার বাবা পড়ালেখা করতে আমেরিকা গিয়েছিলেন। সেখানেই মায়ের সাথে পরিচয়, প্রেম তারপর বিয়ে।”

অটবী মন দিয়ে শুনলো। বাতাসে উড়তে থাকা চুলগুলো কানে গুজলো। মায়াবী চোখ দুটো থেকে এখনো প্রশ্ন সরছে না। চাহনিতে প্রবল সন্দেহের দানা বুনে বললো, “আপনাকে তো বড়লোক মনে হচ্ছে। সত্যি করে বলুন তো, আপনি কি কোনো খারাপ কাজ করে এই এলাকায় লুকাতে এসেছেন? এমন গরিবের বেশ ধরে থাকেন কেন?”

এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড, তিন সেকেন্ড! আচমকাই ত্রিস্তান হু হা করে হাসতে লাগলো। অটবী কখনো ত্রিস্তানকে এভাবে হাসতে দেখেনি। চোখ বুজে, নিচের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে অবিরাম হাসছে লোকটা। হাসতে হাসতে যেন কেঁদেই ফেলবে। অটবীর রাগ হলো। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো, “এভাবে পাগলের মতো হাসছেন কেন? আমি এমন কি বলেছি?”

নিষ্প্রাণ গাছে কে যেন পানি ঢেলেছে। মুক্ত, বাঁধাহীন হাসিতে ত্রিস্তানকে কিশোর থেকে কম লাগছে না। ছোট্ট একটা কম বয়সী ছেলে। যেন মাত্রই হাসা শিখেছে৷ আনন্দ কি জিনিস– তা উপলব্ধি করতে জেনেছে।
ত্রিস্তান হাসি থামালো। বলে চললো, “আমার মা খুব চঞ্চল ধরণের। ছোট থেকে ছোট বিষয় নিয়েই হাসিখুশি থাকতেন। বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকাগুলো তার খুব ভালো লাগতো। বাবা তাই তাদের সেকেন্ড অ্যানিভারসেরিতে এখানে ঘুরতে আসেন। কাছের রিসোর্ট-টায়। ঘুরতে এসে খোঁজ পেলেন, জঙ্গলের মাঝখানে একটা বাড়ি আছে। বাড়ির মালিক বাড়িটা বিক্রি করতে চায়। মায়ের খুব পছন্দ হয়ে গেল বাড়িটা। বাবাও কিনে ফেললেন।”
অটবী কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে দারুণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললো, “এখন তো আমি আরও নিশ্চিৎ, আপনি বড়োলোক।”

অটবীর অবুজপনায় ত্রিস্তান মুচকি হাসলো। মেয়েটার আজ হয়েছে কি? কাঠখোট্টা হওয়ার অভিনয় বুঝি আর করতে পারছে না?
রয়েসয়ে বললো, “বাবা মারা যাওয়ার পর চাচারা সব সম্পত্তি নিজের নামে করে ফেলেন। এই বাড়িটা আমার নামে থাকায় তেমন সুবিধা করতে পারেননি। তাই এই বাড়িটা ছাড়া আমার আর কিছুই নেই। আর আমিও তোমার ধারণাকৃত তথাকথিত বড়োলোক নই।”

অটবী থামলো না। আবারও প্রশ্ন করলো, “আপনাকে আমি কখনো এ এলাকায় দেখিনি কেন?”
“কারণ আমি শহরে বড় হয়েছি। মাঝে মাঝে এখানে আসতাম। বাসাতেই থাকতাম বেশি। আর আমি তোমাকে দেখেছি। তুমি হয়তো খেয়াল করোনি।”

কথায় কথায় কখন যে তারা ‘অরবিন্দ অটবী’-তে পৌঁছে গেছে, অটবী খেয়াল করেনি। খেয়াল হয়েছে তখন, যখন চুপি চুপি তার হাতে একটা-দুটো চকলেট গুঁজে দিলো ত্রিস্তান। সেই তখনকার চকলেট। যেটা অটবী নিতে চায়নি। ফিসফিসিয়ে বললো, “আমি একবার দেওয়া জিনিস ফেরত নেইনা, অরণ্য। রাত হয়েছে, বাসায় গিয়ে চকলেট খেয়ে ঘুমিয়ে পরো। তুমি এখনো তেতো রয়ে গেছো।”

আকাশে ঘন কালো মেঘেরা ছোটাছোটি করছে। এসময় আবহাওয়ায় একটা মিষ্টি ঘ্রাণ ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু এই পুরোনো, অব্যবহৃত পুকুরটা সেটা হতে দিচ্ছে না। নাকের আশেপাশে শুধু বিশ্রী দুর্গন্ধই ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাতে ঘুম হয়নি সরোজের। তন্দ্রার অভাবে চোখের শিরা-উপশিরা রক্তিম হয়ে আছে। চোখের পাতা ফুলে একাকার। ফর্সা ত্বক লাল টকটকে। কোনোমতে রুমাল দিয়ে নাক চেপে আছে সে।
নলী এসেই সরোজকে এভাবে দেখে চমকে উঠলো। উৎকণ্ঠা হয়ে বললো, “আল্লাহ্! এই কি অবস্থা আপনার? রাতে ঘুমান নাই?”

গলায় জোড় পাওয়া যাচ্ছে না। তবুও লহু স্বরে সরোজ উত্তর দিলো, “না।”
–“কেন?”

এই ‘কেন’-র উত্তরে সরোজের কি বলা উচিত? কাল রাতের কথা ভাবতেও তো তার শরীর শিউরে উঠছে। রাত তিনটের সময় ঘুম থেকে উঠিয়ে জঙ্গলের ভয়াবহ আঁধারের মাঝে ঠান্ডা জমজমে পুকুরের পানিতে গোসল করা কোনো চারটি খানি কথা না। তবে সেটাকে গোসল বলা চলে না। গুণেগুণে পঁচিশটা ডুব দিতে হয়েছিল তাকে। আল্লাহ মাবুদ জানে, পুকুরের ভেতর কি না কি! এমনিতে পিচ্ছিল সিঁড়ি, তারওপর পায়ের সাথে কি কি যেন বারি খাচ্ছিল বারবার। সরোজ তো ভেবেই নিয়েছিল, এটাই আর জীবনের শেষ সময়। এইতো! এখনই পানির নিচ থেকে একটা রাক্ষসী এসে ওর পা টেনে ধরবে!

অসহনীয় সেই ভয়ের কথা ভেবে সরোজের যেন শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেল। রুমালের ওপাশে জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিয়ে তাড়াহুড়ো গলায় বললো, “আজকের পর থেইকা এই পুকুরে আর দেখা করতে পারুম না। পুকুর দেখলেই আমার গা জ্বলে। শা’লার অজাতি-কুজাতি পুকুর! একটুর জন্য মাইরাই লাইতো।”

নলী কপাল কুঁচকে তাকালো। ইদানিং পৃথা বেশিই সিআইডি গিরি করছে। আঠার মতো চিপকে থাকে। অনেক কষ্টে সরোজের সাথে দেখা করতে এসেছে সে। অথচ ছেলেটা কাজের কথা না বলে সেই কখন থেকে আবলতাবল বকেই যাচ্ছে!
বিরক্ত হয়ে নলী বললো, “আমার হাতে সময় নেই। তাড়াতাড়ি যেতে হবে। পৃথা থেকে নজর বাঁচিয়ে এসেছি। উলটাপালটা কথা না বলে ভালো কিছু বলুন।”

ওমনি, সরোজ তেঁতে উঠলো, “ভালো কিছু আর কি কইতাম? আমার মুখ দেখছিস? সর্দি-কাশিতে মইরা যাইতেছি। আদর-যত্ন না কইরা চেতস ক্যান?”
“আশ্চর্য! আপনি আমাকে ধমক দিচ্ছেন কেন?”
নিমিষেই সরোজ বড় বড় চোখে তাকালো। সে ধমক দিলো কখন? তড়িৎ গলায় বললো, “আমি কহন ধমক দিছি? তুই কি এহন অসুস্থ প্রেমিকের লগেও ঝগড়া করবি?”

নলী শুনলো না। ঠোঁট চেপে কাঁদো কাঁদো নয়নে তাকালো, “আপনি অন্যের রাগ আমার ওপর দেখাচ্ছেন, তাই না? ভালো! যত দেখানোর দেখান! এটাই আমাদের শেষ দেখা।”

নলী দৌঁড়ে চলে গেল। সরোজ বলতে চাইলো, “নলী, আমার কথাটা তো শোন।”
কিন্তু কথার মাঝখানেই ডাকাতের মতো ভয়াবহ বাজে হাঁচি-কাশিটা চলে এলো বাঁধা দিতে। কি বিশ্রী ব্যাপার-স্যাপার! আজকাল সর্দি-কাশিও এমন চরম মুহুর্তে এসে হাজির হয় নাকি?

অটবী কাদিনকে পড়াচ্ছে আজ নিয়ে পাঁচদিন। প্রচুর ফাঁকিবাজ ছেলে। একদিনও পড়া ঠিক মতো দিবে না। অংক করে রাখতে বললে কিচ্ছু করবে না। এসে থেকে ছুটি ছুটি বলে পাগল বানিয়ে ফেলবে। বয়সে ছোট হলেও কাদিন অটবী থেকে প্রায় দুই-তিন ইঞ্চি লম্বা। এত বড় একটা ছেলেকে মারতে-বকতে দ্বিধা হয় অটবীর। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা ভিন্ন। তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। কালকে এত করে বলে গেছে, অংকগুলো করে রাখতে। অথচ কাদিন ছুঁয়েও দেখেনি। কয়টা অংক দিয়েছিল সে? ছোট ছোট মাত্র চারটা! আর কোনো পড়াও ছিল না।

অটবী বড় বড় নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। থমথমে গলায় বললো, “খাতা বের করো। এক্ষুণি আমার সামনে অংকগুলো করবে। দ্রুত!”

কাদিন নিজ জায়গা থেকে নড়লো না। ঠায় বসে রইলো। দায়সারা কণ্ঠে বললো, “আমি আজকে পড়বো না। ছুটি দিন।”
“কি বললে তুমি?”
“আমার ছুটি…”

কথাটা শেষ হওয়ার আগেই স্কেলের আঘাতে কাদিনের শ্যামবর্ণ হাতের পিঠ ব্যথায় জর্জরিত করে দিলো অটবী। কাদিন তৎক্ষণাৎ শক্ত হয়ে গেল। অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো অটবীর দিকে। অটবীর মুখশ্রী কঠোর, রাগে লাল। টেবিল থেকে ব্যাগটা কাঁধে এঁটে চলে যেতে যেতে বললো, “তোমার আম্মুকে বলে দেবে, আমি আর তোমাকে পড়াচ্ছি না।”

ঘড়িতে তখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা। অপমানে চৌচির হয়ে ইলিয়ানা আন্টির বাসা ত্যাগ করার পূর্বে অটবী খেয়াল করলো, ড্রইংরুমের দামি সোফার মাঝখানে অবাক হয়ে বসে আছে ত্রিস্তান। তাকে দেখছে। তার রাগান্বিত নিশ্বাসের উত্তাপ পরিমাপ করার চেষ্টা চালাচ্ছে।

______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

অটবী সুখ

১৭.
আষাঢ়ের ঘর বাঁধার সময় হয়েছে। পথ-ঘাট বৃষ্টির পানিতে পিচ্ছিল। আকাশ মেঘলা। গাছের ডালপালা, পাতা সতেজতায় মোড়ানো। এসময় কড়া একটা ঘুম দিতে পারলেই জীবনটা ধন্য! অথচ অটবীর সেই সুযোগ নেই। বিকেল চারটার মধ্যে তৈরি হয়ে ছুটতে হচ্ছে টিউশনে। হাতে ছোটখাটো ছাতা। কালো রঙের। বাহিরে বৃষ্টি তেমন না হলেও গুড়িগুড়ি ভাব। অটবীর আবার সমস্যা আছে। বৃষ্টিতে ভিঁজতে পারে না। বৃষ্টির পানি শরীরে একটু লাগতেই জ্বর-কাশি শুরু হয়ে যায়।
সাবধানে কদম ফেলে চলতে চলতে অটবী খেয়াল করলো, মোড়ের রাস্তায় ভয়ানক জটলা বেঁধে আছে। অসংখ্য মানুষ, তুমুল ঝগড়ার চিৎকার-চেঁচামেচি! একটু দূরেই ত্রিস্তান, কাদিন আর সরোজ দাঁড়িয়ে আছে। ত্রিস্তান ঠিক দাঁড়িয়ে নেই, সবসময়কার মতো বাইকে রাজকীয় ভাবে বসে সিগারেটে একেকটা সুখটান দিচ্ছে। ঝগড়ার ওদিকে বিন্দু মাত্র মন নেই। ভাবখানা এমন, এসব অহেতুক জিনিসের প্রতি আগ্রহ দেখালেই তার মহা মূল্যবান সময় গণহারে পাচার হয়ে যাবে। দেশের অসহায় মানুষ সেই পাচার সইতে না পেরে দুর্ভিক্ষে শহিদ হবে। ত্রিস্তান তো আবার মহা দয়ালু! সে তো আর এ অন্যায়টা করতে পারে না! কিছুতেই না।
কিন্তু পাশের দুটো ছেলে আবার অন্যরকম। কাদিন আর সরোজ ভীষণ উৎসুক দৃষ্টে ঘটনাস্থলে তাকিয়ে আছে। কৌতূহলের চটে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলেছে একেবারে। অটবী ওদেরকে কিছুক্ষণ দেখে সামনে পা বাড়ালো। কাছাকাছি আসতেই সরোজ তাড়াহুড়ো গলায় বললো, “তুমি ওই দিকে কই যাইতেছ, অটবী আপু?”

অটবী দাঁড়ালো। আস্তে করে বললো, “পড়াতে যাচ্ছি।”
“আজকে আর যাইও না। এই ঝগড়া বড় হইবো। পুরা এলাকায়ও ছইড়া যাইতে পারে। ওইযে? রাজু আছে না? ওর লগে বিরাট ঝামেলা হইছে। রাজনৈতিক ব্যাপার-স্যাপার! আইজকা ঘর থেইকা বাইর না হওয়াই ভালো। তুমিও বাসায় চইলা যাও।”

অটবী এসব কখনই পাত্তা দেয় না। এবারও দিলো না। তাছাড়া ছাত্রের কালকে পরীক্ষা। আজকে না গিয়ে উপায় নেই। যেতেই হবে।
সামনে পা বাড়াতে নিলেই কাদিন এবার বিরক্ত হয়ে বললো, “আরে আশ্চর্য! আপনাকে না ওখানে যেতে মানা করলো? তারপরও যাচ্ছেন কেন?”

এই কাদিন ছেলেটাকে অটবীর একদম পছন্দ না। সরোজ থেকেও চার ডবল বেয়াদব। আজ নিয়ে একমাস হচ্ছে সে কাদিনকে আর পড়ায় না। ইলিয়ানা আন্টি যদিও অনেকবার বলেছিলেন, কিন্তু সে যায়নি। তবুও দেখো! একটুও অপরাধবোধ নেই ছেলেটার মাঝে। কেমন নির্লজ্জের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। অটবী তুচ্ছ শ্বাস ফেললো। একদম না শোনার ভান করে চলে গেল মোড়ের রাস্তার ওপাশে।
সরোজের চিন্তা কমলো না। অন্যমনস্ক ত্রিস্তানকে জিজ্ঞেস করলো, “ভাই, ভাবী যে চইলা গেল? এখন যদি কোনো বিপদ হয়?”

সিগারেট-টা রাস্তায় ফেলে পা দিয়ে পিসে ফেললো ত্রিস্তান। নির্লিপ্ত গলায় বললো, “বিপদ হলে আর কি… কালকে চকলেট নিয়ে তোর ভাবীকে হাসপাতালে সমবেদনা জানাতে চলে যাস।”

কাদিন বোকার মতো প্রশ্ন করলো, “কি চকলেট নিবো? দামি চকলেট নিতে পারবো না। এক টাকার চকলেট পাঁচটা নিলে হবে না?”

সরোজ চটলো খুব। এ নাকি ক্লাসের ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট! জেনেরাল নলেজটুকুও নেই! গোবর ভরা মাথা! ক্ষেপে গিয়ে বললো, “অ্যাঁই! তোর এখানে কি? রহিমের পিছে পিছে এ-না লেগে থাকবি! এনে কি? মধু বিলাইতেছি আমরা? যা তো এন থেইকা!”
কাদিন চোয়াল শক্ত করে তাকালো। ত্রিস্তানকে অভিযোগের সুরে বললো, “ওরে কিছু বলো ত্রিস্তান ভাইয়া। দেখো কিভাবে কথা বলছে! সবসময় এমন করে।”
—“ওই! বিচার দেস কারে? ত্রিস্তান ভাই কি তোর মা লাগে? ‘ওরে কিছু বলো ত্রিস্তান ভাইয়া!’ হুহ্! ঢং!”

কাদিন বেজার মুখে চেয়ে রইলো ত্রিস্তানের পানে। কিন্তু আশানুরূপ প্রতিক্রিয়া না পেয়ে হতাশ হলো খুব। নিঃশব্দে কেটে পরলো ওখান থেকে। সরোজ সময় নিলো না। নির্জন একটু ফাঁকফোঁকর পেতেই আবারও অসমাপ্ত কথাটা শেষ করতে চাইলো, “ভাই! তোমার কিন্তু উচিত ছিল ভাবীরে আটকানো।”
—“তোদের ভাবীকে আটকিয়ে আমার কি লাভ?”
—“কারণ, ভাবী তোমার ভবিষ্যৎ বউ।”

ত্রিস্তান কিভাবে যেন হাসলো। তাচ্ছিল্য, অনীহার রেশ স্পষ্ট। ঠাট্টার সুরে বললো, “আমার বউ না, সে অন্যকারো বউ।”
“ধুর! মনে মনে প্রেম করো, অথচ মুখে শিকার করতে চাও না। এই আবার কেমন প্রেম?”

কপালে গুটিকয়েক বলিরেখা দৃশ্যমান হলো। কণ্ঠে বিস্ময়ের মিছেমিছি রেশ এঁকে ত্রিস্তান সুধালো, “এসব আজগুবি খবর কোথা থেকে শুনে এসেছিস? আমি মনে মনে প্রেম করতে যাবো কেন?”
—“অন্যখান থেইকা শুনতে হইবো ক্যান? আমার কি চোখ নাই? চোখ দিয়া দেখছি।”

ত্রিস্তান প্রথমেই উত্তর দিলো না। মিনিট খানেক নিচের ঠোঁট দাঁত দিয়ে কামড়ে কিসের যেন হিসেব মেলালো। লুকোচুরি খেলতে আর ভালো লাগছে না। এই শীতল আবহাওয়াও ভ্যাপসা ঠেকছে। হাঁসফাঁস লাগছে। ভেতর থেকে একটা ছোট্ট শ্বাস ঠেলে আসলো। ত্রিস্তান ভীষণ ঠান্ডা গলায় বললো, “মনে মনে প্রেম, ভালোবাসার কিচ্ছু হয়নি, সরোজ। যেটা আছে, সেটাকে টাইমপাস বলতে পারিস।”

“কি কইলা?” সরোজের যেন বিশ্বাস হলো না। তার এত বছরের চতুর চোখ! ভুল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাছাড়া অটবীর জন্য ত্রিস্তানের তাকানোর ধরণ তো সে কথা বলে না! একদমই না! এনিয়ে প্রশ্ন করতে গিয়েও থেমে গেল সরোজ। ত্রিস্তান চলে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে, জানা নেই। তাকে যে সাথে নিবে না, তা সরোজ ভালো করেই জানে। আপাতত জরুরি যেটা, সেটা হচ্ছে অটবীর নিরাপত্তা।

সরোজ একরোখা কণ্ঠে তৎক্ষণাৎ বললো, “তুমি এভাবে যাইতে পারো না, ত্রিস্তান ভাই। অটবী আপুরে অনতত বাঁচাও।”

বাইকটা স্টার্ট দিয়ে সরোজের চিন্তিত মুখটা একবার দেখে নিলো ত্রিস্তান। অনেকটা অতৃপ্ত গলায় বললো, “তোর এত চিন্তা হলে তুই যা, ওকে বাঁচা। তারওপরও যদি বাঁচাতে না পারিস আমি আসবো কালকে, হাসপাতালে? তোরা কি চকলেট খাবি, আমাকে এসএমএস করে দিস।”

রাস্তায় বিশ্রী জ্যাম এঁটে আছে। জ্যামের ভেতর খুঁজে খুঁজেও একটা খালি রিকশা পাওয়া যাচ্ছে না৷ তুমুল বর্ষণে শহরের অবস্থা জুবুথুবু। কারেন্ট আসছে-যাচ্ছে। রাত ক’টা বাজে, অটবীর জানা নেই। হাতঘড়ি পানি লেগে নষ্ট হয়ে গেছে। ফোনে চার্জ নেই। তবুও কয়েকবার পাওয়ার বাটন চেপে দেখলো সে। নাহ্! চালু হচ্ছে না। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে চারপাশটায় নজর বুলালো অটবী। সে আপাতত কোনো এক দোকানের ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় একঘণ্টা যাবত। ছাত্রের বাসা থেকে বেরোনোর আগে শেষ সময় দেখেছিল। দেওয়াল ঘড়িতে ন’টা বাজছিল তখন। এখন নিশ্চই আরও রাত হয়েছে? মা বোধহয় এতক্ষণে চিন্তা করে করে প্রেসার হাই করে ফেলেছেন। মায়ের কথা মাথায় আসতেই বৃষ্টিকে আর পরোয়া করতে মন চাইলো না অটবীর। অনেক হয়েছে। আর কত? আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে?

দৈবাৎ, বামদিক থেকে কে যেন ছুটে এলো অটবীর কাছে। লম্বা, সুঠাম ধরণের লোক। পরনের কালো শার্ট কনুই অব্দি গোটানো। হাঁটুর ওপর দু’হাত ভর দিয়ে একাধারে নিশ্বাস ফেলছে, নিচ্ছে। নিশ্বাসের আওয়াজ সুস্পষ্ট। গুটি কয়েক চুল ঢেকে রেখেছে সমস্ত কপাল।
অটবী আড়চোখে একবার তাকালো। সঙ্গে সঙ্গেই আঁতকে উঠলো সে। বিমূঢ়তা সামলাতে না পেরে অজান্তেই বললো, “ত্রিস্তান?”

বুকের ভেতরটা বিষাদ যন্ত্রণায় নিমজ্জিত। সারা রাস্তা হন্নের মতো দৌঁড়ে আসায় শরীর ক্লান্ত, মন বেজার। বার কয়েক জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়ালো ত্রিস্তান। ঠিক অটবীর পাশে।

—“আপনি এখানে কি করছেন?” প্রশ্নটা অটবীর। সে করতে চায়নি। কিন্তু না করেও শান্তি পাচ্ছিল না। সে যেখানে যায় ঠিক সেখানেই লোকটা এসে হাজির হয়। প্রতিবার তো বিষয়টা কাকতালীয় হবার নয়।
ত্রিস্তান সময় নিলো না। ত্যাড়া কণ্ঠে উত্তর দিলো, “খেতে এসেছি।”
—“কি?”
—“তোমাকে। অনেকদিন মানুষ খাওয়া হয় না।”

ত্রিস্তান যতটা নির্বিকার হয়ে বললো, ততটা সহজ ভাবে নিতে পারলো না অটবী। তৎক্ষণাৎ চোখ দুটো বড় বড় করে তাকালো। আশ্চর্য কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “আপনার দ্বারা কি একটুও স্বাভাবিক আচরণ হয় না?”
ত্রিস্তান নজর ফেরালো। চোখেচোখ রাখলো। হীম শীতল চাহনি। নিগূঢ় কণ্ঠ, “হয়, অটবী।”

কথাটায় কি যেন ছিল। অটবী আর একটা কথাও বলতে পারলো না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। এক মিনিট, দুই মিনিট, এক ঘণ্টা! মিনিটের কাঁটা ঘুরে ঘণ্টায় ঠেকে গেছে। বৃষ্টি তখনো কমেনি। দোকানপাট বন্ধ করে অনেকেই এই বৃষ্টির ভেতর ভিঁজে ভিঁজে চলে গেছে। মানুষহীন, যানবাহন ছাড়া রাস্তা। বৃষ্টির তীব্র ঝরঝরে শব্দ ছাড়া কানে আর কিচ্ছু আসছে না। পা দুটো দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ব্যথায় টনটন করে উঠছে। যেন বলছে, “মাফ চাই, ভাই। আর কতক্ষণ আমাকে এভাবে কষ্ট দিবি? একটু তো কোথাও গিয়ে বয়? এই অসহায়ের ওপর দয়া কর?”

নাহ্! সত্যিই আর দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না। অটবীর শেষ ধৈর্যটুকুও নিঃশেষ হয়ে গেছে। আর কতক্ষণ? এ বৃষ্টি আজ আর থামবে না। থামার হলে আগেই থামতো। অটবী মনে মনে ভেবে নিলো, এই বৃষ্টির মাঝেই সে বাড়ি ফিরবে। পরে যা হওয়ার হবে। ভিঁজলে ভিঁজবে। জ্বর হলে হবে। এসব পরোয়া করার সময় তার আর নেই।
পলিথিনে মোড়ানো ছাতা বের করে অটবী যেই না এক পা বাড়াবে! ওমনি ওর হাত খপ করে ধরে ফেললো ত্রিস্তান। গাঢ় গলায় বললো, “কোথায় যাচ্ছো?”

অটবী হাতের বাঁধনের দিকে একপলক তাকালো, “বাসায় যাচ্ছি। আর কতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকবো?”
—“এখন যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আরেকটু অপেক্ষা করো। বৃষ্টি কমে যাবে।”

মিথ্যে কথা। বৃষ্টির যে তীব্রতা, তিন ঘণ্টার আগে এই বৃষ্টি কমবে কি-না সন্দেহ। শুধু শুধু আশায় বসে থাকার কোনো মানে আছে?
ত্রিস্তান থেকে হাত ছাড়িয়ে অটবী বললো, “কমলে কমবে। আমার পক্ষে আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব না।”
—“তাহলে বসে থাকো। ক্ষুধা লাগলে বলো, কিছু আনার ব্যবস্থা করছি৷ কিন্তু তুমি এখান থেকে যেতে পারবে না।”

বলতে বলতে ত্রিস্তান আবারও অটবীর হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিয়েছে। চোখের দৃঢ়তা স্পষ্ট বলছে, সে কিছুতেই অটবীকে এখান থেকে যেতে দিবে না।
সহসা, অটবী তিক্ত নিশ্বাস ফেললো। কণ্ঠ নমনীয় করে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি চাইছেনটা কি?”
—“বেশি কিছু না। একটু সাথে থাকো।”

ত্রিস্তানের কি দৃষ্টি বদলেছে? চোখের চাহনি? কই? নাতো! সবসময়কার মতো অদৃশ্য কঠিনতাই তো দেখতে পাচ্ছে অটবী। তাহলে হঠাৎ এভাবে কথা বলছে কেন? এখনকার ত্রিস্তানকে বড্ড অপরিচির মনে হলো তার। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলো, দোকানের সামনে একটা পুরাতন বেঞ্চ পরে আছে। ছোটখাটো। ভেঁজা। ভেঁজা দেখে এতক্ষণ সে সেখানে বসেনি। কিন্তু ত্রিস্তান খুব অনায়াসে সেখানে পা ছড়িয়ে বসে পরলো। অটবীকে ডাকলো, “তোমার না পা ব্যথা করছে? এটা চোখে দেখোনি? এখানে এসে বসো। আসো!”
অটবী কথা শুনলো। অবাধ্য হলো না। ত্রিস্তানের পাশে চুপটি করে বসলো। তার পা ব্যথায় অবশ হয়ে গেছে। তার ২৩ বছরের জীবনে সে কখনো এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেনি।

ত্রিস্তান অটবীর দিকে একটা কিটক্যাট এগিয়ে দিয়ে বললো, “খাও।”
সে নিলো। মানা করলো না। ত্রিস্তান যেন অবাকই হলো। মেয়েটা জেদি স্বভাবের। সবকিছুতেই আগে ‘না’ শব্দটা উচ্চারণ করে। আজকে হঠাৎ এত ভালো হয়ে গেল কিভাবে? কপাল কুঁচকে একটু করে দেখে নিলো অটবীকে। আদুরে লাগছে। মাথায় ওড়না নেই। সরে গেছে। জামার একপাশ ভেঁজা৷ ঠান্ডা হয়তো একেবারেই সহ্য করতে পারেনা। ঠোট আদ্র, নাক লাল টকটকে!
ত্রিস্তান আস্তে করে শুধালো, “পানি আনবো? পানি খাবে অটবী?”
—“এসময় পানি পাবেন কোথায়? দোকান তো সব বন্ধ।”
—“বৃষ্টির পানি আছে না? দু’হাত ভরে এনে দেবো। তুমি সেখান থেকে খেতে পারবে না?”

কথাটা বলে ত্রিস্তান হাসলো। নিঃশব্দ হাসি। মাথাটা ঝিমঝিম করছে তার। শীত লাগছে। ভেঁজা শরীরে থাকার কারণে কি? হয়তো! সেও ঠান্ডা সহ্য করতে পারে না। আবার হয়তো পারেও। এইযে, এখন যেমন ঠায় বসে আছে। ভদ্র ছেলের মতো। কিন্তু আসলে সে ঠিক নেই। গায়ে উত্তাপ ওঠা জ্বর। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা। অথচ পাশের মানুষটা সেটা বুঝতেই পারছে না!
ঠোঁটের প্রস্থ বাড়িয়ে ত্রিস্তান আচমকা বললো, “তুমি ভয়ানক সুন্দর, অটবী।”

অটবী যেন বুঝলো না। অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “জি?”
অটবীর দিকে শাহাদাত আঙুল তাক করলো ত্রিস্তান। কিঞ্চিৎ ঘাড় বাঁকিয়ে হেসে হেসেই আবার বললো, “তুমি, তুমি মেয়েটা এত সুন্দর কেন?”

বাতাসে বাতাসে ত্রিস্তানের শার্ট, প্যান্ট, চুল শুকিয়ে গেছে। চোখের সাদা অংশ ক্রমশ রক্তে ভরে যাচ্ছে। মুখ লাল। মুখাবয়ব অসন্ন কিছুর ইঙ্গিত বরাবরই দিচ্ছে। অটবী কি মনে করে ত্রিস্তানের কপালে হাত রাখলো। সঙ্গে সঙ্গে আঁতকে উঠলো ভীষণ, “আপনার শরীর তো জ্বরে পুরে যাচ্ছে। এই জ্বর নিয়ে বসে আছেন কিভাবে? ত্রিস্তান?”

ত্রিস্তান চুপ। কপাল থেকে হাতটা খুব আস্তে করে নিজের কাছে নিয়ে অবাঞ্ছিত এক চুমু এঁকে দিলো। এতেও যেন মন ভরলো না। কাছে এগিয়ে অটবীর কপালেও অধর ছুঁইয়ে দিলো অতি অধৈর্য ভঙ্গিতে। অটবী চমকালো, থমকালো। এক মুহুর্তের জন্য রাগলো খুব। ছিটকে সরে গিয়ে বললো, “সমস্যা কি আপনার? এটা কি করলেন এই মাত্র?”

ত্রিস্তান জবাব দিলো না। একটু আগের তার সেই দীর্ঘ হাসিটাও হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেছে। তৃষ্ণায় কাতর দেখাচ্ছে মুখটা। অটবী দূরে সরে গেলেও সে আবারও কাছাকাছি এগোলো। সন্তপর্ণে কপাল ঠেকালো অটবীর কাঁধে। লহু স্বরে আহাজারি করলো, “তোমাকে আমার ছাড়তে ইচ্ছে করছে না, অটবী। তোমাকে যদি সারাজীবন কাছে রাখতে পারতাম!”

________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

অটবী সুখ পর্ব-১৪+১৫

0

অটবী সুখ

১৪.
আজকাল রেডিও-র অতশত চল নেই। কাশেম আলী সৌখিন মানুষ। টং দোকানে বহু আমলের পুরাতন সামলে রাখা রেডিও ধুঁয়ে-মুছে সাজিয়ে রেখেছেন। আশ্চর্যের বিষয়, ভুচুংভাচুং শব্দে গানও বাজে ওটা থেকে। এই যেমন এখন কাশেম আলী কাপে চা ঢালতে ঢালতে রেডিও-র গানের সাথে তাল মেলাচ্ছেন,
“তুমি বন্ধু কালা পাখি,
আমি যেন কি?
বসন্ত কালে তোমায় বলতে পারিনি।
সাদা সাদা কালা কালা
রঙ জমেছে সাদা কালা।”

শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে গানটা গাইছেন তিনি। কণ্ঠস্বর নেহায়েত খারাপ না। শুনতে ভালো লাগছে। আগের দিনের একটা চঞ্চল সুবাসে টগবগ করছে শরীর। ত্রিস্তান চায়ের কাপে চুমুক দিলো। সরোজের দিকে নজর ফেলতেই দেখলো, ছেলেটা কেমন চোখ-নাক কুঁচকে চেয়ে আছে ওর দিকে। কৌতূহলে নিশপিশ করছে সারা মুখ।
ত্রিস্তান ভ্রু বাঁকিয়ে প্রশ্ন করলো, “কি হয়েছে? এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?”

সরোজের অভিব্যক্তি পাল্টালো না। ভীষণ আগ্রহ নিয়ে বললো, “ভাই, একটা প্রশ্ন ছিল।”
“কি?”
“তোমার হাতে, গালে এরকম আঁচড় ক্যান? ব্যাথা পাইছো কেমনে?”

প্রশ্ন করতে না করতেই কচকচ শব্দে একটা বেলা বিস্কুট অনায়াসে চিবিয়ে ফেললো সরোজ। ভেতরের আগ্রহ কিছুতেই শান্তি দিচ্ছে না। এক্সট্রা এক্সাইটমেন্ট ধরে বেঁধে রেখেছে। কাল রাতে যখন ত্রিস্তানের বাসায় আশ্রয় নিতে গেল, তখন রাত বাজে দু’টা। নিস্তব্ধ পরিবেশে দরজায় খটখট শব্দ তৈরি করার কিছুক্ষণের মাঝেই সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল ত্রিস্তান। টকটকে তাজা ক্ষতগুলো তখন স্পষ্ট, রক্তে ভেঁজা। সরোজ তক্ষুণি আঘাতের কারণ জানতে চেয়েছিল। কিন্তু ত্রিস্তানের ক্লান্ত, রুক্ষ, রুঢ় চাহনিটা তাকে থামিয়ে দেয়।
রয়েসয়ে একটা তিক্ত নিশ্বাস ছাড়লো সরোজ। ত্রিস্তান প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে না। দিবেও না। কচকচ শব্দে আরেকটা বিস্কুট চিবুতে চিবুতে এক্সাইটমেন্ট নামক বিশ্রী অনুভূতিটা দমিয়ে রাখার চেষ্টা চালালো সে। চারপাশে নজর বুলালো। টং দোকানের সাত-আঁট হাত দূরে অটবীকে দেখা যাচ্ছে। নলী আর পৃথাকে সম্ভবত স্কুলে নিয়ে যাচ্ছে। তারা একা নয়। জোয়ান, মোটামোটি দেখতে একটা যুবক আর নলীর বয়সী একটা ছেলেও আছে সাথে। অটবী খুব হেসে হেসে কথা বলছে যুবকটির সাথে। সরোজ একবার বাঁকা চোখে ত্রিস্তানকে দেখলো। ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসিটা এঁটে কিটকিটিয়ে বললো, “আল্লাহ্! ত্রিস্তান ভাই! তুমি এহন কি করবা? ভাবীরে তো অন্য পোলায় নিয়া যাইতেছে গা রে! আহহারে! পুওর সুখনীল ত্রিস্তান! উহু! দেবদাস সুখনীল ত্রিস্তান।”

ত্রিস্তান সাথে সাথে উত্তর দিলো না। একটু সময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “ভাবী কে?”
“আর কেডা? অটবী আপু। তোমার প্রেমিকা লাগে না? আমি বুঝি ভাই। সামনে তাকাও, দেখবার পারবা। তোমার পাখিরে তো অন্য ব্যাডায় নিয়া যাইতেছে গা।”

সরোজের ইশারাকৃত স্থানে একবার তাকালো ত্রিস্তান। কিছুই দেখেনি– এমন ভাব করে খালি চায়ের কাপটা বেঞ্চের একপাশে রাখলো। মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করতে করতে জোরেসোরে নিশ্বাস ফেলে বললো, “তোর পাখির দিকে তাকা ব্যাটা। লাল বাতি জ্বলজ্বল করছে।”

“মানে?”

চট করে আবারো অটবীদের পানে দৃষ্টি মেললো সরোজ। এটা কি? তার প্রাণপ্রিয় প্রেমিকা দেখি পুচকে ছেলেপেলের সাথে হাসির ঠেলায় কথাই বলতে পারছে না। আহ্লাদে মাখোমাখো হয়ে একে অন্যের গায়ের ওপর ঢলে পরছে একদম! কি ভাই? প্রতিবন্ধী নাকি? মা-বাবা হাঁটা শেখায়নি? পরকীয়ার সূক্ষ্ণ গন্ধটা নাকে বারি খেতেই তেঁতে উঠলো সরোজ। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো, “এইডা আমি কি দেখতাছি? এইডা দেখবার আগে আমি অন্ধ হইয়া গেলাম না ক্যান? আমার লগে অন্যায় হইতাছে। আমি ঠইকা গেছি। আমারে এহন বাঁচাইবো কেডা?”

পাশ থেকে ত্রিস্তান সবিনয়ে জিজ্ঞেস করলো, “বিশ লাগবে, ছোটভাই?”
চোখে পানি নেই। তবুও চোখের পানি মোছার ভান করলো সরোজ। কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, “আমার বুক জ্বলতাছে, ভাই।”
“মরে যা। জ্বলা বন্ধ হয়ে যাবে।”
“আমি সত্যি কইতাছি।”
“ঢং করবি না সরোজ। তাড়াতাড়ি খাবার শেষ কর। তনয়া বাসায় একা।”

সরোজ ঠোঁটের পাতা দুটো চেপে অসহায় চোখে তাকালো নলীর দিকে। নলীও তাকিয়েছে। টং দোকান পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় ইশারায় হেসে হেসে কি যেন বলেছেও। হু! ঢং! অন্য ব্যাটাছেলের সাথে হাইসা-টাইসা তাকে দাঁত দেখানো হচ্ছে! ক্ষিপ্ত মেজাজটা হুরহুর করে বেড়ে গেল সরোজের। কিন্তু পরমুহুর্তে কিছু একটা মনে পরতেই শান্ত হয়ে গেল সে। ত্রিস্তানের দিকে চোরা দৃষ্টে তাকালো। আমতা আমতা স্বরে বললো, “ভাই… তুমি কেমনে জানো নীলিমা… মানে নলীর লগে আমার কিছু চলে?”

চা-বিস্কুটের দাম এসেছে ত্রিশ টাকা। ত্রিস্তানের কাছে ভাংটি নেই। এক’শ টাকার একটা নোট দিয়ে তনয়ার জন্য দু’টা চিপস আর কয়েকটা কেক কিনছিল সে। সরোজের কথা শুনে ঠাট্টার সুরে বললো, “যারা সারা বছর পরীক্ষায় ফেল করে চোরের মতো রাস্তায় ঘুর ঘুর করে, তাদের চোখ দেখলেই ভালো-মন্দ জানা যায়।”

সরোজ যেন এবার সত্যি সত্যি কেঁদে দিবে। আজকের দিনটাই খারাপ! ঘুম থেকে উঠে কার মুখ যে দেখেছিল! নিজের মুখটাই তো! প্রতিদিন তো আয়নায় নিজের মুখটাই সবার আগে দেখে।

সারা এলাকা জুড়ে কারেন্টের অভাব। রাস্তায় দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোস্টগুলোও নিস্তেজ। কোথাও এক রশ্মি আলো নেই। চাঁদের দ্যুতিও দূর্বল চিত্তে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে, সে অসুস্থ। পথচারীদের রাস্তা দেখাবার শক্তি তার নেই। সূর্য আড়ি কেটেছে। পর্যাপ্ত আলো তাকে ধার দেয়নি। ঘুটঘুটে অন্ধকারে অটবী অনেকটা মুখস্ত পরীক্ষার্থীর মতো ফার্মেসীর দিকে হেঁটে চললো। এখন রাত বাজে বারোটা। টিউশন শেষ করে আট’টার দিকে ইলিয়ানা আন্টির বাড়িতে গিয়েছিল সে। কাদিন এবার ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষে উঠেছে। ছাত্র ভালো হলেও একটু তদারকির প্রয়োজন। তাই কাদিনকে পড়ানোর দায়িত্ব পরেছে অটবীর ওপর। সে বিষয়ে কথা বলতেই গিয়েছিল অটবী। এই বিষয়, সেই বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনায় ব্যস্ত ইলিয়ানা আন্টি তাকে কিছুতেই বাড়ি যেতে দিচ্ছিলেন না। ভাগ্যিস কারেন্ট-টা গিয়েছিল! নয়তো এখনো তাকে ওইসব হাবিজাবি কথা শুনতে হতো। ওদিকে আবার রেবা বেগমের শরীরটাও মন্দ যাচ্ছে। ঔষধও ফুরিয়ে যাবে যাবে ভান ধরেছে। ব্যাগে পাঁচশত টাকার পুরাতন নোট। ঔষধগুলো এক্ষুণি কিনতে হবে। নয়তো কালকে আবার সকালের ঔষধ বাদ পরে যাবে।

ঔষধ কিনতে কিনতে বার্তি দশ মিনিট গেলে যায় অটবীর। অন্ধকার এবার অনেকটা সয়ে গেছে। অল্পসল্প স্পষ্ট আশপাশ। সে এখন জসিমুল্লাহ সাহেবের বাসার সামনে দিয়ে যাচ্ছে। ভাঙ্গাচোরা রাস্তা। রাস্তার দুপাশে বিশ্রী ভাবে তাকিয়ে আছে কালো কালো ঝোপঝাড়। হঠাৎ তাকালে মনে হয় পাড়ার কিশোরগুলো ক্ষিপ্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অটবী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মনে মনে পণ করলো, বেতনের টাকাটা পেলেই এবার নতুন একটা ফোনের ব্যাটারী কিনবে। তার বর্তমানে যেটা আছে সেটা নষ্ট। ফুলচার্জ করলে এক ঘণ্টাও টিকে না।
আচমকা, কিসের যেন শব্দ শুনলো অটবী। পাতার কচরমচর শব্দ, নড়েচড়ে ওঠার শব্দ, তেজি নিশ্বাসের শব্দ, ক্ষীণ হিসহিস শব্দ! ভয়ে ভেতরটা খিঁচে উঠলেও অটবী ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। দমবন্ধকর গলায় আস্তে করে বললো, “কে ওখানে?”

সারাশব্দ নেই। অটবী ঠিক করলো, সে ওদিকে যাবে। উঁকি দিয়ে দেখবে। মারাত্বক বেয়াদব কৌতূহলটাকে শান্ত করবে। আর যদি খারাপ কিছু হয়, ডানে-বামে দেখার কোনো দরকার নেই। এক ছুটে সোজা বাসা! যদিও জায়গাটা অতটা নির্জন না। চিৎকার দিলে নিশ্চই আশেপাশের সবাই ছুটে আসবে? মনে মনে মিথ্যা সান্ত্বনা নিয়ে আলতো পায়ে এগিয়ে গেল অটবী। পাতার কচরমচর শব্দ আবারো হচ্ছে। কেউ নড়ে উঠছে। ঐতো! লম্বা মতো কে যেন বসে আছে গাছের সাথে হেলান দিয়ে। কে এ লোক? আরেকটু ভালো করে দেখার চেষ্টা করলো সে।

“অটবী?”
কণ্ঠস্বর ভীষণ পরিচিত। এটা ত্রিস্তান। অটবী শতভাগ নিশ্চিৎ!

ভর-ডর নিমিষেই কোথায় যেন উঁড়ে গেল। অটবী এগোলো দূরন্ত পায়ে। কাছাকাছি হতেই ত্রিস্তান আবার বললো, “তুমি, অটবী?”

অন্ধকারে ত্রিস্তানকে ভালো ভাবে দেখা যাচ্ছে না। অটবী শুধু এটুকুই বুঝলো, লোকটা হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছে। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। দূরত্ব রেখে সেও বসলো পাশে। ঝটপট জিজ্ঞেস করলো, “ভূতের মতো একা একা আপনি এখানে বসে আছেন কেন? আবারও অসুস্থ হয়ে পরেছেন? আপনার ফোনে লাইট নেই? দেখি, জ্বালান তো একটু।”

ত্রিস্তান শীতল নয়নে অটবীর দিকে চেয়ে আছে। আবছা চোখেও অটবীকে অপরূপ লাগছে। মেয়েটা সুন্দর– এ কথা সে অস্বীকার করতে পারবে না। এক দেখায় যে কারো পছন্দ হয়ে যাবে।
ত্রিস্তান ক্ষীণ স্বরে বললো, “আস্তে কথা বলো, অটবী। তুমি পুরো এলাকাকে আমার এখানে থাকার কথা জানিয়ে দিচ্ছো।”

অটবী গুটিকয়েক ছোট ছোট নিশ্বাস ফেললো। কণ্ঠ খাঁদে নামিয়ে বললো, “আপনি এখানে কি করছেন? তনয়া কোথায়?”
—“সরোজ আছে তনয়ার সাথে।”

অটবী ভ্রু কুঁচকালো, “মানে? ও তনয়ার সাথে কি করছে?”
“চাচা ওকে বের করে দেওয়ার পর আমার বাসায় থাকছে এখন।”

অটবী হতাশ হলো। এক রহিম কি কম ছিল? এখন ত্রিস্তানও জুটেছে ছেলেটার সুন্দর ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে। কাঁধের ব্যাগটা মাটি থেকে উঠিয়ে সে চলে যেতে চাইলো। তাকে থামিয়ে দিলো ত্রিস্তান, “আরেকটু বসবে, অটবী?”

নিঃসঙ্কোচ আবদার। অটবীর কেন যেন মানা করতে ইচ্ছে করলো না। ব্যাগটা আবারও মাটিতে রেখে বসে পরলো। স্বাভাবিক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি এখনো উত্তর দেননি, ত্রিস্তান। এত জায়গা থাকতে এই ঝোপঝাড়ের ভেতর কি করছেন?”

“এটা আমার প্রিয় জায়গা।”

“এই ঝোপঝাড়?”

ত্রিস্তান মৃদু হাসলো। হাতের সিগারেট-টা সেই অনেক আগে ফেলে দিয়েছে। চোখ বুজে, ঢিমানো কণ্ঠে বললো, “ঝোপঝাড় দেখেই পছন্দ। একেবারে নির্জন! কেউ দেখার নেই, শোনার নেই। কাউকে মেরে ফেললেও কেউ কিচ্ছু জানবে না।”

ত্রিস্তানের ঠোঁটের কোণের ওই সুন্দর হাসিটা অস্বাভাবিক। অটবী বিমূঢ় নয়নে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো। হালকা স্বরে বললো, “আপনাকে অসুস্থ লাগছে। আপনার এখন বাসায় চলে যাওয়া উচিত।”
“ওই বাসাটায় ভয় লাগে অটবী৷ ওখানে যেতে ইচ্ছে করে না।”

আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। হঠাৎ হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে ক্লান্ত ত্রিস্তানকে দেখা যাচ্ছে। আবার আলো নিভে যেতেই বাজে রকমের আঁধার। একটু আগের চাঁদের দ্যুতিটুকুও নেই। অটবী সেই অল্প আলোতেই অবাক হয়ে দেখলো, ত্রিস্তান ভয়ংকর মানুষের মতো হাসছে। চোখের গভীরে অদ্ভুত উদাসীনতা, দুঃখ, যন্ত্রণা একই সাথে ক্ষুধার্ত বাঘের হিংস্রতা। অটবী ভয় পেল। কিন্তু অতটা না, যতটা পেলে মানুষ দৌঁড়ে পালায়। সে খুব শান্ত হয়ে বসে আছে। এই ত্রিস্তানকে সে চেনে না। কিন্তু চিনতে চাইছে। আস্তে করে ডাকলো, “ত্রিস্তান?”

সাথে সাথে একটু ঝুঁকে আসলো ত্রিস্তান। চোখে চোখ রাখলো। অটবী নড়লো না। স্থির চেয়ে রইলো।

“তোমার চোখে আমি নিজেকে এত ওপরে দেখতে পাই কেন, অটবী? আমার নিজেকে অনেক ছোট মনে হয়।”

ঝড় বইছে। বৃষ্টি পরবে। ত্রিস্তান উঠে দাঁড়ালো। বড় বড় পায়ে চলে যাচ্ছে সে। একবারও অটবীর দিকে তাকায়নি।

_______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

অটবী সুখ

১৫.
বাতাসে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ ঘুরে বেড়াচ্ছে। মা চুলায় হালুয়া রাঁধছেন। ঘি-য়ের মনোরম ঘ্রাণে জিভের পানি আটকানো যাচ্ছে না। রান্নাঘরের আশপাশটায় চাতক পাখির মতো ঘুর ঘুর করছে পৃথা আর নলী। কখন হালুয়া হবে, ওমনি তারা ঝাপিয়ে পরবে খেতে! অটবী জানালার বাহিরে উঁকি দিয়ে ওদের একবার দেখে নিলো। এদু’জনকে সে সকালে বলেছিল ঘরটা গুছিয়ে রাখতে। গোছায়নি। বরং পড়ার ছুতোয় উঠোনে পাটি গেড়ে হালুয়া খাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। ভেতর থেকে একটা সূক্ষ্ম দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। কোমড়ে ওড়না বেঁধে প্রথমে বিছানা ঝাড়লো অটবী। বিছানার নিচে নলীর ব্যাগ অনাদরে পরে আছে। ব্যাগের চেন খোলা। বইপত্র মেঝে ছুঁচ্ছে! মেয়েটা এতো অগোছালো! বেশ খানিকটা বিরক্তই হলো অটবী। ব্যাগ গুছিয়ে রাখতে রাখতে হঠাৎ খেয়াল হলো, নলীর ব্যাকরণ বইয়ের ভেতর থেকে একটা লাল রঙের কাগজ বেরিয়ে এসেছে। বইটা পৃথার হলে অটবী হয়তো বিষয়টা অত আমলে নিতো না। কিন্তু একবার যখন বিশ্বাস ভেঙ্গেছে, নলীর কোনো কিছুই সে সহজে নিতে পারে না।
অনেকটা সন্দেহের বশেই লাল রঙা কাগজটা খুললো সে। যা ভেবেছিল তা-ই! এটা প্রেমপত্র। মধুর, রসালো প্রেমপত্র! নয়-দশ লাইনের। পড়তে পড়তে অটবীর ভ্রুদ্বয় কঠিন ভাবে বেঁকে গেছে। রাগটা প্রকাশ করতে না চাইলেও দমাতে পারলো না অটবী। উচ্চস্বরে ডেকে উঠলো, “নলী? এক্ষুণি রুমে আয়! এক মিনিটও দেড়ি করবি না।”

নিজ খেয়ালে মশগুল নলী জোরেসোরে চমকে উঠলো। পৃথার দিকে একবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টে তাকিয়ে ছুট লাগালো রুমের দিকে। অটবী তখন হাতের কাগজটা টেবিলের ওপর মেলে রেখেছে। নলী আসতেই ওর দিকে বাড়িয়ে দিলো। থমথমে গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লো, “এটা কি? কে দিয়েছে?”

কাগজটা কাল স্কুলে যাওয়ার পথে সরোজ দিয়েছিল। নলী খুলে দেখেনি। তার তো মনেই ছিল না। কাগজ হাতে এক ঝলক লেখাগুলোয় চোখ বুলিয়ে নিলো সে। নাহ্! সূচনা-উপসংহার কোথাও সরোজের নাম নেই। মনে মনে বড্ড খুশিই হলো নলী। চেহারায় দারুণ আতঙ্ক ঝুলিয়ে নির্দোষ কণ্ঠে বললো, “এইটা আমি নিতে চাই নাই বুবু। আমার কোনো দোষ নাই। ইস্কুলে একটা ছেলে আমাকে খুব বিরক্ত করে। ও-ই জোড় করে কাগজটা আমার ব্যাগে ঢুকিয়ে দিছে।”
“কাগজটা এখনো তোর ব্যাগে কি করে? ফেলে দিস নি কেন এটা?”

এপর্যায়ে নলী একটু তোতলালো, “মনে…মনে ছিল না বুবু।”
অটবীর তীক্ষ্ণ চোখজোড়া নলীকে আগাগোড়া পর্যবেক্ষণ করছে। যদিও তার মস্তিষ্ক বলছে, নলী যা বলছে সব মিথ্যা। কিন্তু তবুও সে মস্তিষ্কের কথা শুনলো না। বিশ্বাস করে নিলো। ডাস্টবিনে কাগজটা ফেলে দিয়ে বললো, “আর এসব কাগজ-টাগজ নিবি না। বেশি বিরক্ত করলে বলবি, বিষয়টা আমি দেখবো।”

নলী কথা বাড়ালো না। মাথা কাত করে সায় দিলো শুধু। এবার থেকে আরও সাবধান হতে হবে। এইসব চিঠি-কাগজ বাদ! এগুলোতে রিক্স অনেক।

রোদ্দুরের উত্তাপ দৃঢ়, রুক্ষ। ফ্যাকাশে একটা রঙ ধারণ করেছে সবুজ সতেজতা। ভ্যাপসা, মৃদুমন্দ বাতাস। অটবী তিনটার দিকে টিউশনে বেড়িয়েছিল। একটা পড়িয়েছে। বাকিগুলো পড়াতে ইচ্ছে করছে না। ঘুম পাচ্ছে খুব। বাসায় গিয়ে একটা মারাত্বক ঘুম দেওয়া দরকার। খুব দরকার। মোড়ের রাস্তার পাশে ছোট্ট একটা দোকান বসে। ঝালমুড়ি, চটপটি, ফুচকা— এসবের। সেদিক দিয়ে যাওয়ার সময় অটবীর কেন যেন প্রচন্ড ইচ্ছে করলো একটু ঝালমুড়ির স্বাদ নেওয়ার। ব্যাগে পর্যাপ্ত টাকা আছে। একদিন একটু পাঁচ টাকার ঝালমুড়ি খেলে মাসিক খরচে টানাপোড়ন লাগবে না নিশ্চই?

অনেকটা উৎফুল্ল মনেই ঝালমুড়ি নিয়ে বাসার পথে পা বাড়ালো অটবী। ঝালমুড়ি মুঠোয় পুরে খেতেই নিচ্ছিল, হঠাৎ কোত্থেকে আগমন ঘটলো তনয়ার। মেয়েটার ফর্সা মুখটা রক্তিম। স্পষ্ট কাঁদছে। কাজল রাঙা আঁখিদ্বয় লেপ্টানো। ভীতু সাব্যস্ত হৃদযন্ত্র অটবীকে দেখে যেন কিঞ্চিৎ শান্ত হয়েছে। আশেপাশে ত্রিস্তান, সরোজ কাউকে দেখা যাচ্ছে না। মেয়েটা কি আবারও বাসায় না জানিয়ে এতটুকু পথ এসেছে? আবার হারিয়ে গেছে? তপ্ত নিশ্বাস ফেলে তনয়ার চোখের অশ্রুগুলো হাত দিয়ে মুছে দিলো অটবী। আদুরে গলায় জিজ্ঞেদ করলো, “তোমার ভাইয়া কোথায়, তনয়া? আবারও কাউকে না বলে বাসা থেকে বেড়িয়েছ?”

তনয়া অপরাধীর ন্যায় মাথা নুয়ালো। মিনমিনিয়ে বললো, “আমি হারিয়ে গেছি।”
“তোমার ভাইয়া এমন কেয়ারলেস কেন? তুমি যখন বেড়িয়েছিলে, কেউ দেখেনি?”
“সরোজ ভাইয়া ঘুমায়।”
“আর ত্রিস্তান?”

তনয়া চোখ পিটপিট করে তাকালো, “ভাইয়া বাহিরে। কাজ করে।”

ভেতরকার দীর্ঘনিশ্বাসটা রয়েসয়ে ফেললো অটবী। খেয়াল করলো, তনয়া অনেক্ষণ ধরে তার হাতের ঝালমুড়ির দিকে চেয়ে আছে। চাপা হতাশা আটকে ঝালমুড়িটা তনয়া দিকে বাড়িয়ে দিলো সে। বললো, “নাও, এটা খাও।”

ত্রিস্তানের বাসা ঠিক কোথায়, তা জানা নেই অটবীর। শুধু জানে, জঙ্গলের ভেতরের ছোট্ট আঁকাবাঁকা রাস্তা পেরিয়ে একটা মাঝারি আধভাঙা রাজপ্রাসাদ আছে। ওটাই ত্রিস্তানের বাড়ি। কিন্তু সে শতভাগ নিশ্চিত না। নলী বলতে শুনেছিল। এই শোনা ওপর নির্ভর করে সম্পূর্ণ অচেনা জায়গায় পা বাড়াতে ইচ্ছে করছে না। কপালে চিন্তার বলিরেখা এঁটে তনয়ার দিকে তাকালো। মেয়েটা ওর দিকে চেয়ে ছিল। ছটপটে কণ্ঠে বললো, “আমি এখান থেকে বাসায় যেতে পারবো, আপু।”
—“তোমাদের বাসা এই জঙ্গলের ভেতরেই? তুমি রাস্তা চেনো?”

তনয়া বেশ কয়েকবার মাথা দুলালো। হ্যাঁ, সে চেনে। কিন্তু তবুও তাকে একা ছাড়লো না অটবী। ছোট্ট রাস্তাটার ভেতর দু’জনেই পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। তনয়ার ঝালমুড়ি খাওয়া শেষ। সে আপাতত শক্ত করে অটবীর হাত ধরে আছে। মেয়েটা অটবী থেকে এক-দু’ বছরের ছোট হবে। তবে উচ্চতায় সমান সমান। এত বড় একটা মেয়েকে শাসন করতে একটু অস্বস্তি লাগছে তার। এই মেয়েটা যদি সুস্থ থাকতো, তবে নিশ্চই তাকে অন্যের ওপর নির্ভর থাকতে হতো না। হয়তো মেয়েটা এতদিনে নিজের মতো করে একটা সুন্দর জীবন গড়ে তুলতো।

জঙ্গল থেকে ত্রিস্তানের বাড়ি অত দূরে না। দশ মিনিটের পথ। কোনো ধরণের গেট নেই। হয়তো ছিল, কিন্তু এখন এর অস্তিত্ব সম্পূর্ণ বিলীন। দু’পাশে শুধু দু’টা পিলার গেঁথে আছে। বাড়ির সুরক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা দেওয়াগুলোও ভেঙ্গে একাকার। অটবী পিলার দুটো পাশ কাটিয়ে সামনে এগোলো। সদর দরজা সম্পূর্ণ খোলা। বসার ঘরে হাত পা ছড়িয়ে হা করে ঘুমাচ্ছে সরোজ। দুটো ঠোঁটের পাতার মাঝখানে বিস্তর ফাঁকা। কি আরামের ঘুম তার!
তয়না দৌড়ে সরোজের কাছে গেল। কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে চেয়ে, টেবিলে থাকা জগের পানিগুলো চট করে ঢেলে দিলো সরোজের মুখে। সরোজের ঘুম ভাঙ্গলো। ভয়ানক চিৎকার দিয়ে ভূত, ভূত বলে লাফিয়ে উঠলো সে। পরক্ষণেই তনয়াকে চোখের সামনে পেয়ে চড়া গলায় বললো, “তোমার সমস্যা কি, তনয়া আপু? আমার ঘুমের সাথেই তোমার এত শত্রুতা কেন?”

সরোজের উত্তপ্ত রাগটা কেউই আমলে নিলো না। তনয়া লুকালো নিজেকে অটবীর পেছনে আড়াল করে। অটবী এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে বললো, “রাতে কি ঘুমাও না, সরোজ? পড়ালেখাও তো করো না। সারাদিন এদিক-ওদিক ছুটতে থাকো। আসলে করোটা কি তুমি? এত ঘুম কেন আসে? মেয়েটা যে একা একা মোড়ের রাস্তায় চলে গিয়েছিল, সেই খেয়াল আছে?”

সরোজ চমকালো খুব। একবার অটবীকে দেখে আরেকবার লুকিয়ে থাকা তনয়াকে দেখার চেষ্টা করলো। বাম হাত দিয়ে ঘাড় চুলকালো কয়েক সেকেন্ড। ভ্রু বাঁকিয়ে, ভীষণ আশ্চর্য কণ্ঠে সুধালো, “সত্যি বলতাছো? আমি এত বিশ্রী ঘুমাই?”
শুনে তনয়া খিলখিলিয়ে হাসলো। থম মেরে থাকা সরোজকে দেখে তার খুব হাসি পাচ্ছে। মজাও লাগছে ভীষণ। ঠোঁটের হাসিটা দৃঢ় করে অটবীর একটা হাত জড়িয়ে ধরলো সে। আবদারের সুরে বললো, “আজকে আমার সাথে এখানে থাকবা, আপু?”

নিষ্পাপ শিশুর ন্যায় চোখের সচ্ছ মায়া অটবীকে গলাতে পারলো না। আস্তে আস্তে ধরণীতে সন্ধ্যা নামছে। এক্ষুণি বাসায় না ফিরলে অনেক দেড়ি হয়ে যাবে।
পাশ হতে সরোজ গলা মেলালো, “তনয়া আপু ঠিক বলতাছে। এখন যাওয়া ঠিক হবে না। এই রাস্তা ভালো না। শিয়ালে দল বাঁইধা বইসা থাকে। তুমি ত্রিস্তান ভাই আসার পরে যাইও আপু। ত্রিস্তান ভাই এইতো, আইসা পরবে। অনেক্ষণ হইছে বাইরে গেছে।”

অটবী একদমই চাইছিল না থাকতে। কিন্তু দুইজন মানুষের পিড়াপিড়িতে সে একা টিকতে পারেনি। ডাইনিংটেবিলের চেয়ারে গম্ভীর মুখে বসে আছে। পাশে তনয়া তার প্রিয় টেডিবিয়ার নিয়ে খেলছে। মাঝে মাঝে অটবীকে কি কি যেন জিজ্ঞেস করছে, বলছে। অটবীর উত্তর হু, হা-তেই সীমাবদ্ধ। তার আসলে বিরক্ত লাগছে সবকিছু। মনে হচ্ছে, উপকার করাটাই উচিত হয়নি।

ত্রিস্তান আসলো মিনিট খানেক বাদে। সরোজ তখন রান্নাঘর থেকে হাঁক ছাড়ছে। সে নতুন নতুন চা বানানো শিখেছে। লাল চা, দুধ চা– দুটোই। অটবী কোনটা খাবে, সেটা জানার জন্যই তার এত হাঁক-ডাক। অটবী বাঁকা চোখে একবার ত্রিস্তানকে দেখলো। লোকটার হাত ভর্তি বাজারের ব্যাগ। অটবীর দিকে একবার স্বাভাবিক দৃষ্টে তাকিয়ে সে নিজেই প্রশ্নের উত্তর দিলো, “সবার জন্য দুধ চা বানা, সরোজ।”

“অটবী আপু কি দুধ চা খাইবো?”

“হ্যাঁ।”

তনয়ার জন্য আনা চকলেটগুলো তনয়াকে দিয়ে ত্রিস্তান নিজেও চলে গেল রান্নাঘরে। অটবী চোখ-মুখ খিঁচে শক্ত হয়ে বসে রইলো। দারুণ অস্বস্তিতে হাত পা কাঁপছে তার। যাওয়ার আগে লোকটা তার হাতেও চকলেট গুঁজে দিয়ে গেছে। কাজটা এত দ্রুত করেছে যে, সে মানা করার সুযোগও পায়নি।

অটবী ভেবেছিল, ত্রিস্তান এসেই তাকে এখানে দেখে চমকে যাবে। নানান প্রশ্ন করবে। কিন্তু সেসব নিছক কল্পনা। ত্রিস্তান এতটাই স্বাভাবিক আচরণ করছে যে অটবী নিজেই ক্ষণে ক্ষণে হতবাক হচ্ছে, চমকাচ্ছে। লোকটার সফটওয়্যার গুলো কি ভালোমতো কাজ করে না? একটু তো অবাক হওয়া উচিত ছিল।

ডাইনিংটেবিলের একদম সামনের দেওয়ালটাতে বাঁধাই করা একটা ছবি আছে। সুখী পরিবারের। লম্বা, সুদর্শন মতো একজন লোক। স্যুটপ্যান্ট পরে আছেন। তার কোলে আট-নয় বছরের একটা ভীষণ সুন্দর ছেলে। দাঁত বের করে চোখ বুজে হাসছে। সুদর্শন লোকটার পাশে শাড়ি পরা একজন অত্যাধিক সুন্দরী নারী দাঁড়িয়ে আছেন। দেখতে মোটেও এদেশের মতো না। বিদেশিনী। একটু খেয়াল করলে বোঝা যায়, চুলগুলো ভীষণ লাল। আমেরিকান মুখাবয়ব। ফর্সা টকটকে ত্বকে ঘিয়া রঙা শাড়ি ফুঁটে আছে। তার কোলে তোয়ালে পেঁচানো নবজাতক শিশু। ছবির এই চারজনই এত স্নিগ্ধ হাসছে! অটবী চোখ সরাতে পারলো না। মুগ্ধ হয়ে চেয়েই রইলো। সরোজ তার মুগ্ধতা দেখে চায়ের ট্রে-টা টেবিলে রাখতে রাখতে উচ্ছাস নিয়ে বললো, “এইটা ত্রিস্তান ভাইয়ের বাপ-মা। পোলাটা ত্রিস্তান ভাই, আর বাচ্চাটা তনয়া আপু। সুন্দর না ছবিটা?”

অটবী মন্ত্রমুগ্ধের মতো মাথা নাড়ালো। ত্রিস্তান এসে পাশে বসেছে। ট্রে থেকে একটা চায়ের কাপ, এক প্লেট বিস্কুট অটবীর সামনে রেখে বললো, “খাও।”

অটবী খাবারের দিকে তাকালো না। সরাসরি বললো, “আমি বাসায় যাবো। আপনি শুধু জঙ্গলটা পার করে দিন। বাকিটা আমি পারব।”
—“দিবো। আগে খেয়ে নাও।”

বিরক্ত হয়ে কপাল কুঁচকালো অটবী। লোকটা এত অসহ্য কেন? চিবিয়ে চিবিয়ে বিস্কুট খেতে খেতে হাতের মুঠোয় থাকা চকলেটটা ত্রিস্তানের কোলে ছুঁড়ে মারলো সে। অথচ ত্রিস্তান কিছুই বললো না। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে প্রশ্ন করলো, “তুমি এখানে কেন এসেছো?”

এতক্ষণ! এতক্ষণ পর জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন বোধ করলেন জনাব! অটবী বলতেই নিচ্ছিল, সরোজ তাড়াহুড়ো করে বাঁধা দিলো, “ওইতো, তনয়া… মানে তনয়াকে ইয়ে করেছিল…”
মাঝপথে থামিয়ে তনয়া নিজেই বললো, “সরোজ ভাইয়া অনেক কাজ চোর হয়ে গেছে ভাইয়া। আমাকে পাহারা না দিয়ে নাকে তেল লাগিয়ে ঘুমাচ্ছিল। এই সুযোগে আমি বাসা থেকে পালিয়ে গেছি। দরজা খোলার সময় এত শব্দ করেছি, তবুও ঘুম থেকে উঠেনি। তোমার কিছু করা উচিত। সরোজ ভাইয়া খুব বাজে ভাবে নাক ডেকে ডেকে ঘুমায়।”

আধখাওয়া বিস্কুট-টা হাত থেকে পরে গেছে। গলা দিয়ে খাবার নামছে না। অগ্রিম ভয়ে হার্ডফেল করে যেন মারা যাবে সরোজ। সে এখনই তার ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে। এই ঘন আঁধারে, বটগাছের সাথে বাঁধা অবস্থায় চিৎকার করে ‘মাগো মা’ চিলাচ্ছে সে।

______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

অটবী সুখ পর্ব-১২+১৩

0

অটবী সুখ

১২.
একফালি রোদ্দুর চোখে এসে পরছে। সারা মাথায় টনটনে ব্যথা। চোখদুটো মেলতে গিয়ে বুঝতে পারলো, আঁখিপল্লব ভারী হয়ে আছে। সরাসরি তাকাতে পারছে না। আশপাশ ভীষণ অস্পষ্ট। নিজেকে সামলাতে ক্ষীণ সময় নিলো ত্রিস্তান। কালরাতে অনেক দেড়ি করে রুমে এসেছিল। ততক্ষণে তনয়া গভীর ঘুমে মশগুল। সরোজও বাসায় ফিরেনি। ড্রইংরুমের সোফায় এখনো হয়তো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমিয়ে আছে। ছেলেটা অনেক সরল-সোজা। ত্রিস্তান কি করে না করে, সেসব না জেনেই তাকে সাহায্য করছে। অবশ্য, জানলে হয়তো কখনো ত্রিস্তান মুখো হতো না।

“ভাইয়া, তোমার চোখ এত লাল কেন?”

ত্রিস্তান চমকালো। থমকানো দৃষ্টে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো, তনয়া মেঝেতে বসে আছে। দুটো হাত, থুতনি রয়েসয়ে বিছানার ওপর ঠেকানো। মায়াবী একজোড়া নয়ন ড্যাবড্যাবিয়ে ওকে দেখছে। ত্রিস্তান বার কয়েক পলক ফেলে চোখের দূর্বলতা ঢাকতে চাইলো। কপাল কুঁচকে ভরাট গলায় বললো, “তুই এত সকালে আমার রুমে কি করছিস?”
“তুমি কোন দুনিয়ায় আছো? সকাল তো সেই কবেএএ শেষ! আমার ক্ষুধা লেগেছে। পেটের ইঁদুরগুলো একটু পর আমার পেট ফুঁটা করে দিবে। তুমি নাস্তা বানাবা কখন?”

ত্রিস্তান সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালো। নগ্ন পেটানো শরীরে জড়িয়ে নিলো কালো রঙা টি-শার্ট। কপালের চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে বললো, “তোর সরোজ ভাইয়া কোথায়? চলে গেছে?”
“নাহ্। সোফায়। ঘুমায়। অনেক্ষণ ধরে ডাকছি, উঠে না।”
“জগে পানি আছে না? ওর মুখে ঢেলে দে। উঠে যাবে।”
“সত্যি মুখে ঢালবো?” তনয়া অবুজ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো।
মায়ের মতো দেখতে মেয়েটার দিকে তাকালেই বুকের ভেতরটা শীতলতায় মিইয়ে যায় ত্রিস্তানের। রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ানোর আগে সে মৃদু গলায় অনুমতির সুরে বলে, “চাইলে লাথিও মারতে পারিস।”

রান্নাঘরের অবস্থা নাজেহাল। চায়ের কৌটা উদলা হয়ে পরে আছে। চুলার ওপর এঠো কেতলি, চামচ। ঢাকনাটাতেও ময়লা লেগে আছে। ত্রিস্তান তিক্ত নিশ্বাস ফেললো। নিশ্চিৎ সরোজের কাজ এটা। রাতে চা বানাতে গিয়ে এমন অবস্থা করেছে। সে এঠো জিনিসগুলো দক্ষ হাতে ধুঁয়ে নিলো। ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছে বেশির ভাগ সময় রান্নাঘরের দিকটা বাবা সামলাতেন। ত্রিস্তানও টুকিটাকি সাহায্য করতো। মা অসুস্থ থাকতেন সারাবছর। সে সুবাধে স্কুলে পড়ুয়া অবস্থাতেই রান্নাবান্নায় ভীষণ পটু হয়ে গেছে ত্রিস্তান।

হঠাৎ! সূক্ষ্ণ একটা চিৎকার এসে বারি খেল দেওয়ালে। সরোজের চিৎকার। ত্রিস্তানের নাস্তা বানানো ততক্ষণে শেষ। কাপে চা ঢেলে আস্তে ধীরে ডাইনিংটেবিলের ওপর খাবার রাখলো সে। চেয়ার টেনে বসলো। সরোজ ভিঁজে একাকার হয়ে আছে। পরনে ভেঁজা প্যান্ট আর গায়ে পাতলা গামছা জড়িয়ে কাতর দৃষ্টে চেয়ে আছে তার দিকেই। ত্রিস্তান তাকাতেই প্রায় কেঁদে ফেলার মতো করে বললো, “ভাই! ও ভাই! সক্কাল সক্কাল তোমার বোন কামডা কি করছে দেখছো? ঘুমাইতে ছিলাম, মুখের উপর পানি ঢাইলা দিলো! তুমি এর একটা বিচার করো।”

ত্রিস্তান প্রথমেই কিছু বললো না। নির্বিকার ভঙ্গিতে চায়ের কাপে চুমুক দিলো। অনেকদিন চুল কাটা হয়না। মাথার একগুচ্ছ চুল বারবার চোখ ঢেকে ফেলছে।

“আমি তো তনয়াকে আরও একঘণ্টা আগে পানি ঢালতে বলেছিলাম। তোর ভাগ্য ভালো, ও আরেকটু ঘুমাতে দিয়েছে তোকে।”

“ভাই! তুমি এমনটা করতে পারলা?”
“পারছি। এখন বেশি কথা না বলে খেতে আয়।” সরোজ চেহারা কুঁচকে ত্রিস্তানের মুখোমুখি চেয়ারে বসলো। আবহাওয়া অতটা ঠান্ডা না। কিন্তু তবুও তার শীত শীত লাগছে। ঝটপট গরম গরম চায়ের কাপে হামলে পরতে পারলেই বাঁচে!
ত্রিস্তান সময় নিয়ে প্রশ্ন করে, “তনয়া কই? ওকে দেখছি না কেন?”

সরোজ হাভাতের মতো পরোটা দিয়ে চা খাচ্ছে। অনেকটা সেভাবেই বললো, “তোমার বোন যে বিটকেল! পানি ছুঁইড়াই দৌঁড়! বকারও সুযোগ দে নাই।”

অর্ধেক পরোটা রয়ে গেছে। আর খেতে ইচ্ছে করছে না। ত্রিস্তান তনয়ার জন্য দুটো পরোটা প্লেটে আলাদা করে রাখলো। থমথমে গলায় বললো, “খাওয়া শেষে চলে যাবি। আঙ্কেল ফোন করেছিল। তোর নাকি দুপুরে কোচিং আছে?”
“তোমার মনে হয় আমি কোচিং-এ যামু?”
“তুই কয়বার ম্যাট্রিক ফেল করেছিস যেন?”

সরোজ মিনমিনিয়ে বললো, “একবারই তো ফেল করছি। এমন করো ক্যান?”
“এবারও ফেল করবি। তোর কপালে লেখা আছে।”

সরোজ সে কথায় কান দিলো না। আয়েশ করে পরোটার টুকরা চায়ে ভিঁজিয়ে মুখে পুরে নিলো। সুধালো, “ভাই, তুমি রক্ত দিয়া কি করো?”
ত্রিস্তান চমকে তাকালো ঠিক কিন্তু পরমুহুর্তেই নিজেকে সামলে নিলো। হিম শীতল গলায় বললো, “খাই।”
অথচ সত্যটা সরোজ একেবারেই বিশ্বাস করলো না, “ধুর! রক্ত আবার খাওয়া যায় নাকি? কি করো আসলে কও তো। ওই দোকানের ব্যাটাও দেখলাম তোমার কথা শুইনা কেমন ভয় পাইয়া গেল।”

দোকানি ত্রিস্তানকে দু’কারণে ভয় পায়। এক. ইভটিজিং করায় একবার রাস্তায় পিটিয়েছিল বলে। আর দ্বিতীয় কারণটা অবচেতন মনের ভয়।
ত্রিস্তান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “বিশেষ কিছু না। এক্সপেরিমেন্ট করি।”
“কি এক্সপেরিমেন্ট?”
“আরেকটু বড় হ, তারপর বলবো।”

সরোজের আগ্রহী মন দমলো না। খেতে খেতে সে জোরে জোরে মাথা নাড়ালো। সে অপেক্ষা করবে। সামনে বসে থাকা ত্রিস্তান দমবন্ধ করে চেয়ে রইলো শুধু। মনে মনে হাসলো খুব। সরোজের ওপর না। নিজের ওপর। ভাবলো, বোকা মানুষগুলো তার পাল্লাতেই পরে কেন? সে চূড়ান্ত পর্যায়ের বিশ্বাসঘাতক, খারাপ, মিথ্যুক। ভাবুক হওয়ার ভান ধরে থাকে। এসব মানুষগুলো যখন তার আসল সত্য জানবে, তখন কি করবে এরা? ত্রিস্তান চায় না ওরা কিছু জানুক। একদমই চায় না। যাদের চোখে সে নিজের জন্য ভালোবাসা দেখতে পায়, তাদের চোখের ঘৃণা কিভাবে সহ্য করবে? আদৌ পারবে সহ্য করতে? ত্রিস্তান জানে, সে পারবে না।

গুটিকয়েক চড়ুই তারে বসে আছে। বাতাসে উত্তাপ নেই। তবুও হাঁসফাঁস লাগছে। কাঁধের ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে সময়টা দেখে নিলো অটবী। পাঁচটা দশ বাজছে। আজকে একটা টিউশন করাতে পারেনি। ছাত্র বেড়াতে গেছে। অথচ অটবীকে একবার জানানোর প্রয়োজন বোধও করেনি। অতদূর হেঁটে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছানোর পর দেখে দরজায় তালা ঝুলানো।
অটবীর বুকের ভেতরটা গুমট অনুভূতিতে চুপসে আছে। ক্লান্ত শরীর ঘেমে একাকার। ওইতো, রাস্তার একপাশে ত্রিস্তানকে দেখা যাচ্ছে। ভাবলেশহীন লোকটা এখনো নির্লিপ্ত। অনায়াসে হাত পা ছড়িয়ে ফুটপাতের দূর্বাঘসে শুয়ে আছে। অটবী কিছুক্ষণ সেদিকে চেয়ে রইলো। শক্ত হাতে কাঁধের ব্যাগ সামলে গটগট পায়ে এগলো। নিঃশব্দে বসলো ত্রিস্তানের পাশে। ত্রিস্তান ওকে দেখে হাসলো অল্প। একদম ক্ষীণ। উঠে বসতে বসতে বললো, “অভাগার দুয়ারে এসেছ যে? তোমাকে দেওয়ার মতো কিছু আমার কাছে নেই।”
“আমি আপনার কাছে এসেছি, কে বললো?”

মেয়েটার চোখের তীক্ষ্ণটা সরাসরি বুকে বিঁধছে। ত্রিস্তান অকারণেই আবার হাসলো। বললো, “তাহলে আমার পাশে বসেছ কেন?”
অটবী আনমনা হলো। সুবজ ঘাসের মাঝে একদুটা হলুদ ঘাসেরা উঁকি দিচ্ছে। একটা একটা করে হলুদ ঘাসগুলো ছিঁড়ে সে মৃদু স্বরে বললো, “দেখছিলাম, এত দায়িত্বের ভারেও আপনি কেন নুইয়ে পরছেন না। হাসছেন, ঘুরছেন, ফুর্তি করছেন। হয়তো লোকদেখানো। কিন্তু তবুও… আমি কেন পারি না?”

ত্রিস্তান আজ বড্ড বেশিই হাসছে। সচরাচর তাকে হাসতে দেখা যায় না। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ মুখশ্রীতে সর্বদাই শীতলতা লুকোচুরি খেলে। বাদামী চোখদুটো কালো অধ্যায় যেন। অঘোষিত আইনের এলোমেলো চুলগুলোর ফাঁকে ফাঁকে থাকা নোনতা পানিগুলো ক্লান্তির সূক্ষ্ণ প্রকাশ। ত্রিস্তান চোখেচোখ রাখলো। অন্যরকম দৃষ্টি। চঞ্চল। প্রশ্ন করলো, “শিখতে চাও?”

অটবী চোখ সরালো না। ত্রিস্তানের মতো করে জানতে চাইলো, “কি?”
“কিভাবে ভালো থাকতে হয়।”
অটবীও হাসলো এবার, “চাই।”
“কিন্তু তার বিনিময়ে আমাকে কিছু দিতে হবে।”
“কি দিতে হবে?”

অটবীর চাহনি পাল্টালো। কঠোরতায় ডুবুডুবু হতেই ওর দিকে ঝুকলো ত্রিস্তান। চট করে একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চুমু খেলো পিঠে। ফিসফিসিয়ে বললো, “Your Highness, can I buy some of your time until you get tired?”

________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

অটবী সুখ

১৩.
“Your Highness, can I buy some of your time until you get tired?”
স্নিগ্ধ একটা পরশ আশপাশে ঘুরঘুর করছে। ত্রিস্তানকে পুরোনো দিনের সুদর্শন, সুশৃঙ্খল ‘ডিউক’ কিংবা ‘নোবেল’ থেকে কম লাগছে না। একহাতে অটবীর হাত ধরে অন্যহাতটা পেছনের দিকে মুড়িয়ে রেখেছে সে। দূর্বাঘাসের ওপর হাঁটু গেড়ে বসে আছে। চোখ বুজে হাতের পিঠে দীর্ঘ চুমুর মুহুর্তটা বোধহয় বর্ণনা করা যাবে না। শুধু অভাব একটা রাজকীয় পোশাকের। তাহলেই হয়তো ত্রিস্তান নামক আজীবন দুঃখী ছেলেটা কোনো এক রাজ্যের সুখী রাজকুমার হয়ে যেত।
অটবী হালকা করে নিশ্বাস ফেললো। ত্রিস্তান থেকে হাতটা টেনে ছাড়িয়ে শান্ত গলায় বললো, “আমার উত্তরটা আপনার জানা, ত্রিস্তান।”
“উত্তরটা কি পাল্টাবে না বলছো?”
“হ্যাঁ।”

ত্রিস্তান আবারও পা ছড়িয়ে বসলো। স্বভাবহীন হাসিটা হাসলো আরও একবার। ঠাট্টার সুরে বললো, “সমস্যা নেই, অটবী। আমি তবুও তোমার শিক্ষক হতে রাজী আছি। আমি বুকভরা আবার দয়ামায়া! সামলে রাখতে পারিনা। অকৃতজ্ঞদের সাথেও ভুলেভালে কৃতজ্ঞতা দেখিয়ে ফেলি।”

অটবী চোখ-মুখ কঠিন করে বললো, “দরকার নেই এমন শিক্ষকের। আমি আপনার থেকে কিচ্ছু শিখতে চাই না।”
“একটু আগেই না বললে ভালো থাকার উপায় শিখতে চাও?”
“একটু আগে চেয়েছিলাম। এখন চাই না।”

ত্রিস্তান ঘাসের ওপর শুয়ে পরেছে। শুয়ে শুয়ে হাত পা ছড়িয়ে একমনে দেখছে অটবীকে। রুঢ় মেয়েটা ওর দিকে তাকাচ্ছে না। সামনের রাস্তায় কি যেন নিখুঁত ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। কালো লম্বা চুলে মোটা বেণুনী। গোলগাল হলদেটে চেহারায় মানিয়েছে খুব। ভীষণ সাদামাটা পোশাক। এটাকেই থ্রি-পিস বলে বোধহয়। ত্রিস্তান আকাশ পানে মুখ উচিয়ে ঘন ঘন নিশ্বাস নিলো। ঠোঁটের সূক্ষ্ণ হাসিটা ধরে রেখে বললো, “তোমরা কি বলো তো অটবী! আমার কাছে আসতে সময় নাও, অথচ দূরে যেতে একদম সময় নাও না।”

ত্রিস্তান জবাবের অপেক্ষা করলো। এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড, তিন সেকেন্ড— এক মিনিট! অটবীর জবাব পাওয়া গেল না। মেয়েটা এত নিষ্ঠুর! অনুভব করতে পারলো, ভেতরটায় একটা বিশ্রী, তেঁতো যন্ত্রণা আন্দোলন করছে। চারিদিকের মৃদুমন্দ বাতাস, হৈ-হুল্লোড়, যানবাহনের হর্ণ— প্রত্যেকটা জিনিস এত বিষাদ ঠেকছে! শরীরের শক্তি যেন নাই হয়ে গেছে। ত্রিস্তান ঘুরেফিরে আবারও অটবীর দিকে তাকালো। দৃষ্টি আবছা, ঘোলা। ঠোঁট নাড়িয়ে হালকা কণ্ঠে পৃথিবীর সবচে’ আশ্চর্যজনক প্রশ্নটা করলো, “অটবী… মৃ’ত্যু কি খুব কষ্টের? সেখানেও কি একা থাকা লাগে?”

প্রশ্নটা বুঝতে অনেক্ষণ সময় লাগলো তার। পরক্ষণেই অর্থ উদ্ধার করতেই চট করে ফিরে তাকালো। লোকটাকে স্বাভাবিক লাগছে না। একটু আগেও ভালো ছিল। অথচ এখন ঘেমেনেয়ে একাকার! কপাল বেয়ে বেয়ে ঝরছে লবণাক্ত জলকণা। বুকের উঠানামা তীব্র। নিশ্বাসের শব্দ কান ঝাঁঝিয়ে দিচ্ছে। হতবাক অটবীর দুশ্চিন্তায় গলা শুকিয়ে এলো। ত্রিস্তানের দিকে বড় বড় চোখে চেয়ে আতঙ্কিত গলায় আর্তনাদ করলো, “ত্রিস্তান? এমন করছেন কেন? শুনছেন আপনি? কি হয়েছে?”

ত্রিস্তান কিছু একটা বললো। অস্পষ্ট। বোঝার জন্য তার দিকে বেশ খানিকটা ঝুঁকলো অটবী।
“বাম দিকে ফোন… সরোজকে কল দাও।”

সঙ্গে সঙ্গে বাম দিকে তাকালো অটবী। এক প্যাকেট সিগারেট, লাইটার, মোবাইল ফোন, ওয়ালেট! বড্ড অবহেলায় পরে আছে সেগুলো। অটবী ঝটপট মোবাইল হাতে নিলো। কোনো ধরণের লক নেই বিধায় সহজেই ডায়াল লিস্টে গিয়ে কল লাগালো সরোজকে। সরোজ আশেপাশেই আছে। এখান থেকে সাত-আট মিনিটের রাস্তা।

“কল করেছি। এক্ষুণি চলে আসবে।”
“তুমি চলে যাও অটবী।”
“জি?” চমকিত হয়ে ত্রিস্তানের দিকে তাকালো সে। লোকটার অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। শুধু অস্থিরতা কমে নির্জীব হয়ে গেছে। ব্যাপারটা পূর্বের থেকেও বেশি ভয়াবহ।

“আমাকে কি অমানুষ বলে মনে হয় আপনার? আপনাকে একা রেখে কেন যাবো?”
“আমি অমানুষ, অটবী।”

ত্রিস্তান অসুস্থ! ত্রিস্তান পাগল! ত্রিস্তান আবোলতাবোল বকছে! এ তিনটা বাক্য ছাড়া আর কোনো কিছু মাথায় ঢুকছে না অটবীর। সে শক্ত হয়ে বসে আছে। যাবে না এখান থেকে। কিছুতেই না। অথচ ত্রিস্তানও নাছোড়বান্দা। পাষাণের মতো এত জোড়ে ধমকে উঠল তার ওপর! অটবীর রাগ করার কথা। নিস্তেজ ত্রিস্তানকে সেখানে একা ফেলে আসার পর সারা রাস্তা সে রেগে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু পারেনি। এটা কি ধরণের যন্ত্রণা? এত অসহ্য!

বাসা থেকে তুমুল ঝগড়া করে এসেছে সরোজ। আজকে কোচিংয়ে পরীক্ষা ছিল। সে যায়নি। ফলসরূপ জসিম আখতার ভীষণ রেগে ওকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছেন। থাপ্পড়ও মেরেছেন বোধহয়। বাম গালটা টকটকে লাল হয়ে আছে। নলী সরোজের গোমড়া মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। বাদাম খেতে খেতে বললো, “আঙ্কেল ঠিকই করেছে। আরও মারা উচিত ছিল।”

সরোজ কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, “তিনটা থাপ্পড় মারছে! তোর কাছে কি কম লাগে? কই একটু আদর-টাদর করবি! আইছোস শ্বশুড়ের পিছ ধরতে!”
“বাজে কথা বলবেন নাতো। পড়ালেখা করতে হবে। ভালো চাকরি না পেলে বুবু জীবনেও আপনাকে মেনে নিবে না।”

সরোজ পাত্তা দিলো না। ভবিষ্যতেরটা ভবিষ্যতে। এসব নিয়ে এখন প্যারা নিয়ে লাভ নেই। পৃথা আজকে স্কুলে আসেনি। ধরা পরার তাই ভয় নেই। নলীকে জোড় করে অনেক কষ্টে নদীর পাড়ে নিয়ে এসেছে। টিফিন টাইম শেষ হতে দেড়ি নেই। এই অল্পটুকু সময়ে প্রেমালাপ না করে এসব ফালতু আলোচনার কোনো মানে হয়?
তৎক্ষণাৎ মুখে জ্বলজ্বলে হাসি ফুঁটালো সরোজ। নলীর বাহুতে আলতো গুটা মেরে বললো, “এইসব বাদ দে নীলিমা। ভালা কথা ক। কত্তদিন পর এমন সুন্দর জায়গায় প্রেম করার সুযোগ পাইছি! বড় রোমান্টিক রোমান্টিক ফিল আসতাছে রে!”

নলী কোণা চোখে তাকালো একবার। কটমট গলায় বললো, “আপনি ভালো হবেন না, তাই না? আপনার বাবা আপনাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। মনে হয় না দুইতিন দিনে ঢুকতে দিবে। একয়দিন কোথায় থাকবেন, কি খাবেন! এসব চিন্তায় আমারই তো মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। অথচ আপনাকে দেখুন! কোথাকার কোন নবাবজাদা! যেন পাঁচ-ছয়টা বাড়ির মালিক। একটা থেকে বের করে দিলে অন্যটায় গিয়ে উঠবে।”

সরোজ দাঁত কেলিয়ে হাসলো।
“ঠিক বলছিস। নিজের বাড়ি না থাকলেও থাকার অভাব নাই। ত্রিস্তান ভাইয়ের বাসায় বিন্দাস থাকমু। কার বাপের কি?”
“ত্রিস্তান ভাইয়া না হাসপাতালে? এখন কেমন আছেন ভাইয়া?”
“হাসপাতালে আর থাকছে কই? জ্ঞান ফিরার পরই বাসায় যাওনের লাইগা যে কি অবস্থা করছে! তয়, করা স্বাভাবিক। তনয়া বাসায় একা না?”
“কি হইছিল ভাইয়ার?”
“জানি না। ডাক্তাররে কইতে শুনছিলাম প্রেসার লো।”

নদীর পাড়ে পা ভিঁজিয়ে বসে ছিল ওরা দুজন। নলী উঠে দাঁড়ালো। হাতের অবশিষ্ট বাদামগুলো সরোজকে দিয়ে বললো, “বাকিটা আপনি খান। আমি যাই। টিফিন টাইম শেষ হতে বেশি দেড়ি নেই।”

সরোজ মন খারাপ করলো খুব। মুখে এখনো বাদাম রয়ে গেছে। সেগুলো চিবুতে চিবুতে অসম্ভব করুণ গলায় বললো, “এখনই চইলা যাবি? প্রেম তো শুরুই করলাম না।”

নলী পেছনে ফিরে বললো, “এখন প্রেম করতে হবে না। বিয়ের পরে কইরেন।”

রাত ক’টা বাজে জানা নেই। হাতে খাবারের মস্ত বড় প্লেট নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামছে ত্রিস্তান। নিচ থেকে আওয়াজ আসছে। ধাপধুপ ধুপধাপ! বাতি জ্বালাতেই অন্ধকার রুমটা স্পষ্ট হয়ে এলো। রুক্ষ-সূক্ষ্ম, জীর্ণ শরীরের ব্যক্তিটি মাঝ বরাবর বসে হাত পায়ের শিকল খোলার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ত্রিস্তানকে দেখা মাত্রই চেঁচিয়ে উঠলো, “খাবার আনতে এত সময় লাগে? আমারে মেরে ফেলতে চাইছিস তুই? এত সহজ আমাকে মা’রা?”

ত্রিস্তান ক্লান্ত গলায় উত্তর দিলো, “ঘুমিয়ে পরেছিলাম।”

বলতে বলতে খাবারের প্লেট-টা সামনে রাখলো সে। প্লেটে বড় বড় দুটো মাছ ভাঁজা, ভাত, আলু তরকারি।
খাবারগুলো দেখা মাত্রই ঘৃণায় নজর সরিয়ে ফেললো ব্যক্তিটি। দাঁত কিড়মিড় করে বললো, “এইগুলা কি আনছিস? রক্ত কই? রক্ত খাবো।”
“রক্ত নেই।”
“রক্ত নেই মানে? তুই ইচ্ছা করে দিচ্ছিস না। আমি জানি না মনে করেছিস? খাবো না এগুলা। নিয়ে যা এখান থেকে।”
“এগুলোই খেতে হবে।” ত্রিস্তানের চোয়াল শক্ত। চোখে মুখে দারুণ কাঠিন্যতা। বোঝা গেল, আজকে সে কিছুতেই রক্ত খেতে দিবে না। মুহুর্তেই ব্যক্তিটি অধৈর্য হয়ে গেল। মেঝে থেকে খাবারের প্লেট উঠিয়ে ছুঁড়ে মারলো ত্রিস্তানের বুকে। কিন্তু এতেও যেন তৃপ্তি মেলেনি। তেঁড়ে এসে ক্ষত-বিক্ষত করে দিতে লাগলো ত্রিস্তানের গাল, হাতের চামড়া। অনবরত পাগলের ন্যায় চিৎকার করতে লাগলো, “তুই ইচ্ছা করে আমাকে কষ্ট দিচ্ছি। তুইও আমাকে মেরে ফেলতে চাস। আমাকে শান্তিতে বাঁচতে দিবি না তোরা। অভিশাপ তুই! আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ!”

নখের ধারালো আঁচড়ে বিষাক্ত যন্ত্রণা অনুভব করলেও মনের ব্যথা থেকে এই ক্ষত যেন খুবই নগণ্য। ত্রিস্তান শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। টু শব্দটিও করলো না। নিশ্চল চোখজোড়া স্থির চেয়ে রইলো সামনের মানুষটার পানে।

_____________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

অটবী সুখ পর্ব-১১

0

অটবী সুখ

১১.
শান্ত মেজাজের ত্রিস্তান যে কতটা ত্যাড়া, তা এই মুহুর্তে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে অটবী। এখনো ঠায় গাছের সাথে লেগে দাঁড়িয়ে আছে। নড়ছে না। অটবী এতগুলো প্রশ্ন করলো, তারও উত্তর নেই। মুঠোয় পুরে রেখেছে রক্তে ভেঁজা রুমাল।
প্লেটের অবশিষ্ট বিরিয়ানিটুকু গলা দিয়ে আর নামতে চাইলো না অটবীর। শক্ত হাতে প্লেট-টা ধরে রাখলো। জিজ্ঞেস করলো, “আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন না কেন?”
“কোন প্রশ্ন?” ত্রিস্তানের সঙ্গে এতদিন মেলামেশার পর অটবী একটা বিষয় খুব করে লক্ষ্য করেছে। লোকটা অনুভূতি লুকাতে ভীষণ পটু। আমরা যেমন মন খারাপ হলে মন খারাপের রেশ ধরে কথা বলি, আনন্দিত হলে উল্লাস নিয়ে কথা বলি, ত্রিস্তান তেমনটা করে না। সুখ, দুঃখ, কষ্ট, হতাশা- সবেতেই তার বাচনভঙ্গি থাকে এক রকম। শান্ত, স্থবির, নিশ্চল।

“আমি তো অনেকগুলো প্রশ্ন করেছি। আপনি একটারও জবাব দেননি।”
“আবার করো। এবার জবাব দিবো।”

অটবী ছোট্ট নিশ্বাস ফেললো। ধীরস্থির ভাবে বললো, “আপনি এখানে শুধু শুধু কেন দাঁড়িয়ে আছেন? খেতে যাচ্ছেন না কেন? আপনি কি অসুস্থ? আর সর্বশেষ, আমার রুমাল দিয়ে আপনার কি কাজ?”

জবাবগুলো যেন আগে থেকেই সাজিয়ে রেখেছিল ত্রিস্তান। অটবীর কথা শেষ হওয়া মাত্রই একাধারে বলে চললো, “ক্ষুধা নেই। তাই খেতে যাচ্ছিনা। কাজ নেই, তাই এখানে দাঁড়িয়ে আছি। কাজ নেই বলেই তোমার রুমালটা কুকাজে লাগানোর জন্য নিয়ে যাচ্ছি। চুরি-ডাকাতিতে রিস্ক থাকলে ওন দ্যা স্পট তোমার রুমাল ফেলে আসবো। আমার বদলে তুমি জেল খাটবে। আর সর্বশেষ, আমি সুস্থ। ঠিক আছি।”

অটবীর চোখজোড়া গভীর গম্ভীর অরণ্যের মতো। টলটলে মিঠা নদীর গহীন। আর ত্রিস্তান! সে তো বাজপাখি। শিকারের আগেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টে ঝাঝরা করে ফেলে শিকারকে। অটবী সেই দৃষ্টির ধারে কাছে গেল না। কোত্থেকে যেন রবীন্দ্রসংগীত ভেসে আসছে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে সে গানের উৎস খুঁজতে লাগলো। মৃদু হেসে বললো, “আমি কিন্তু মানুষের মিথ্যে ধরতে পারি ত্রিস্তান। তাছাড়া আপনার এই মিথ্যে কেউ বিশ্বাস করবে না।”
“কই? আমি তো জানি সবাই বিশ্বাস করে।”
“আমি তো করি না।”
“স্বাভাবিক। তোমার নামেই একটা রহস্য রহস্য ভাব আছে। তুমি তো রহস্য খুঁজবেই।”

অটবী না চাইতেও ত্রিস্তানের দিকে তাকালো। বাজপাখির চোখে মিঠা পানির ঘোল মিশিয়ে অন্ধ করে দিলো তাকে। ভালো লাগার প্রাপ্তি অনুভব করার আগেই আবার দূরে ছিঁটকে ফেললো, “আমি আজীবন দুঃখী একটা মেয়ে, ত্রিস্তান। দুঃখ-দুঃখী মিলে সুখ হবে কি-না জানি না, কিন্তু পৃথিবী ধসে পরবে। আমি এমন রহস্য খুঁজতে চাই না। এই অরণ্য কৌতূহলী নয়, ভীষণ ভীতু।”

অদ্ভুত, ত্রিস্তান হাসছে। অটবী অবাক হলো এইভেবে, এতগুলো সাক্ষাতের পর এই প্রথম ত্রিস্তান অকৃত্রিম হাসছে। যেখানে কোনো পর্দা নেই। খোলা জানালার মতো ভেতর-বাহির দারুণ স্পষ্ট। কিন্তু এহেন কথায় হঠাৎ হাসার মানে কি? ত্রিস্তান তো এমন না। হাসিটা এত অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে কেন?

নিঃশব্দ অথচ শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাওয়া হাসিটা থামলো অল্পক্ষণ পর। অটবী খেয়াল করলো, হাতের মুঠোয় থাকা রুমালটা গায়ের সব শক্তি দিয়ে চেপে ধরেছে ত্রিস্তান। বাতাসের তালে তালে ফিসফিসিয়ে বলছে, “ভয় নেই ভীতু অরণ্য, আমি আমার নামের শেষ দুটো শব্দ তোমাকে কখনোই দিবো না।”

সরোজ ফাঁকফোকর খুঁজছে নলীর সাথে কথা বলার জন্য। কিন্তু সুযোগ পাচ্ছে না। অটবী সারাক্ষণ বোনদের সামনে শক্ত দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সরোজ একটু বিরক্তই হলো। এত পাহারা দেওয়ার কি আছে? সে কি নলীকে খেয়ে ফেলবে নাকি? আশ্চর্য!
অনুষ্ঠান প্রায় শেষের দিকে। অটবী বোনদের নিয়ে চলে যাচ্ছে। সরোজ সেদিকে চেয়ে আছে। মনটা তার একটু বেশিই খারাপ। প্রেমিকা এত সুন্দর করে সেজেগুজে আসলো, অথচ সে একটু ছুঁয়ে দেখতে পারলো না। হাহ্! দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিগারেট ধরানোর পূর্বে সরোজ গুনগুনিয়ে ‘এই মেঘলা, দিনে একলা’ গানটার রফাদফা করে দিলো, “এই রোদেলা, দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন। কাছে যাবো, কবে পাবো ওগো দোকলা হওয়ার নিমন্ত্রণ।”

ত্রিস্তান যে কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সরোজ খেয়াল করেনি। ত্রিস্তানের ভ্রু কুঁচকানো দৃষ্টির সম্মুখীন হতেই ভ্যাবলা হাসলো। সিগারেট আর ধরালো না। পকেটে পুরে রাখলো। কণ্ঠে একরাশ মধু ঢেলে বললো, “একটু ক্রিয়েটিভ হওয়ার চেষ্টা করলাম ভাই। কতকাল আর এক লিরিক্স গাইতে থাকমু?”

পাশ হতে মুখভর্তি বিরিয়ানি নিয়ে কাদিন বললো, “তোর এই ক্রিয়েটিভিটি হেমন্ত কুমার মুখোপাধ্যায় দেখলে তোরে জেলের ভাত খাওয়াইতো।”

“তুই আগে তোর মুখের ভাত শেষ কর ব্যাটা।” কাদিনকে সরোজ অত বেশি পছন্দ করে না। ছেলেটা কথায় কথায় দোষ ধরে। সারাদিন মুখে ইংরেজি ফুঁটিয়ে রাখবে। এমন একটা ভাব, যেন সে ছাড়া আর কেউ ইংরেজি বলতে পারে না, জানে না। কোত্থেকে যে এগুলো আসে! সরোজ একটা তাচ্ছিল্য দৃষ্টি ছুঁড়ে মারলো কাদিনের দিকে। প্রচন্ড অনিহা নিয়ে বললো, “রহিম ভাই তোরে ডাকে। তুই যা তো এনথেইকা।”

কাদিন বেজার মুখে চলে গেল। ত্রিস্তান তখন তনয়ার ঠোঁটের আশেপাশে লেগে থাকা খাবার টিস্যু দিয়ে মুছে দিচ্ছে। সরোজ সাবধানে জিজ্ঞেস করলো, “এখন কি বাসায় চইলা যাইবা গা ভাই?”
—“তুইও যাচ্ছিস আমার সাথে।”

বলে একটু থামলো ত্রিস্তান। অস্বাভাবিক শান্ত চোখে চেয়ে বললো, “যা আনতে বলেছিলাম, এনেছিস?”
প্রশ্নটা শুনে সরোজের মুখভঙ্গিও একটু পালটে গেল যেন। আশেপাশে একবার নজর বুলিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো, “আনছি ভাই।”

“কোথায় পেলি? দাম কত নিয়েছে?”

“তোমার দেওয়া দামই নিছে। কুড়ি টাকা বাইঁচা গেছে শুধু। প্রথমে দিতে চায় নাই। লোভ দেখানোর পর রাজী হইছে। ওইযে, হাশেম আলী আছে না? ওইটার পরের দোকান।”

ত্রিস্তান চোয়াল শক্ত করে বললো, “বাকি টাকা তুই রেখে দিস। এখন বাসায় চল।”

জঙ্গলের ঠিক মাঝখানটায় ত্রিস্তানের বাড়ি। দীর্ঘদিন যাবত মেরামতের অভাবে খানিকটা কুড়েঘর মনে হয়। আসলে কিন্তু ছোটোখাটো রাজপ্রাসাদ। বাহিরটা যতটা ভাঙ্গাচোরা, ভেতরটা ততটাই রুচিশীল, গোছানো। একতলা বাড়ি হলেও মাটির নিচে আরেকটা গুপ্ত পথ আছে। ত্রিস্তান ছাড়া সেটা কেউ জানে না। বাবা অবশ্য জানতেন। তার ডিজাইন করা বাড়ি বলেই হয়তো। কিন্তু তিনিও এখন বেঁচে নেই।

সরোজকে তনয়ার কাছে রেখে ত্রিস্তান অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে লাগলো। ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিচ্ছু স্পষ্ট নয়। আঁধারে ধরে আসছে চোখদুটো। কিন্তু ত্রিস্তান স্বাভাবিক ভাবেই নিচে নামছে। অভ্যস্ত বলে কথা! এ কাজটা সে নতুন করছে না।
কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছাতেই বাতি জ্বালিয়ে দিলো ত্রিস্তান। মাঝারি আকারের ঘর। দেওয়ালগুলোর একেকটায় কালচে আবরণ, খামচির দাগ, রক্তের দাগ! এককোণে জোড়োসড়ো হয়ে বসে আছে একজন ব্যক্তি। গায়ে জড়ানো পরিষ্কার কাপড়। ডান পায়ে শেকল বাঁধা। কিন্তু মুখ দেখা যাচ্ছে না।
ত্রিস্তান নিষ্প্রাণ গলায় বললো, “খাবার এনেছি।”

ব্যক্তিটি আলো জ্বালানোতে এমনিতেই রেগে ছিল। ত্রিস্তান কথা বলতেই খেঁকিয়ে উঠলো, “ওই বাজে খাবার আমি খাবো না। নিয়ে যা এখান থেকে।”

“ওসব আনিনি। তুমি যেটা পছন্দ করো, সেটাই এনেছি।”

সাথে সাথে তাকালো ব্যক্তিটি। বাদামি চোখের মণি জ্বলজ্বল করছে। ত্রিস্তান হাতের বাটি-টা সামনে রাখতেই ছুটে আসলো বাটি-টার কাছে। কালো দাঁতগুলো বের করে উচ্ছলতার সঙ্গে হাসলো। বাচ্চাদের মতো মাথা দুলিয়ে বেশ কয়েকবার একই কথা বললো, “আমি খুশি হয়েছি।” “আমি খুশি হয়েছি।”

ত্রিস্তানের পা দুটো দুলছে। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। আজ অনেকদিন পর প্রিয় মুখটা দেখেছে সে। আগের সেই স্নিগ্ধতা কোথাও নেই। খামছে, আঁচড়ে ক্ষ’ত-বিক্ষ’ত করে ফেলেছে। ত্রিস্তান কাঁপা পায়ে দেওয়াল ঘেঁষে বসলো। ব্যক্তিটি অনেক্ষণ লোভাতুর চোখে বাটি-টির দিকে চেয়ে থেকে প্রশ্ন করলো, “তুইও কি একটু খাবি আমার সাথে?”
“না।”
“তাইলে কি খাবি? ওইযে, সাদা সাদা লবণের মতো কি জানি খাইতিস, ওগুলো?”
“ছেড়ে দিয়েছি।”
“ওহ্!”

ত্রিস্তান চোখের পলক ফেললো না। বুকে পাথর বেঁধে ব্যক্তিটির রক্ত খাওয়ার দৃশ্য একাধারে দেখে গেল। ঠোঁটের কোণে তাজা রক্ত নিয়ে তার দিকে তাকিয়েই হাসছে সে। দাঁতেও রক্ত লেগে আছে। ভয়ংকর হাসি। ভয়ংকর তৃপ্ত চোখ। ত্রিস্তান সঙ্গে সঙ্গে চোখের পাতা বুজে নিলো। দেওয়ালে ঠেকিয়ে রাখলো মাথা। একটা কাঁটাময় শুকনো ঢোক গিলতেই কে যেন কানের কাছে এসে বললো, “অপ্রিয় দুঃখ, তুই কারো প্রিয় সুখ হতে পারবি না।”

______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

অটবী সুখ পর্ব-১০

0

অটবী সুখ

১০.
এলাকার বড় মাঠ-টায় বড়সড় আয়োজন করা হয়েছে। আশেপাশে এত মানুষ! এত ব্যস্ততা! অটবী শাড়ি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। একেতো সে সচরাচর শাড়ি পরে না, আবার শাড়ি তেমন সামলাতেও পারে না। কেন যে মায়ের কথা শুনে শাড়ি পরতে গেল! বড্ড আফসোস হচ্ছে অটবীর। তার হাত দুটো নলী আর পৃথাকে শক্ত করে ধরে আছে। চোখ দুটো ব্যস্ত হয়ে খুঁজছে, কোনো একটা নির্জন স্থান। যেখানে একটু শান্তিতে দাঁড়ানো যাবে। কিন্তু এমন লোকসমাগমে নির্জন জায়গা পাওয়া আসলেই কঠিন। হাল ছেড়ে অটবী নলী আর পৃথার দিকে তাকালো। হতাশ সুরে বললো, “বাসায় যাবি? চল, চলে যাই।”

নলী জোরে জোরে মাথা নাড়ালো। সে কিছুতেই যাবে না। তাড়াহুড়ো করে বললো, “আমরা না মাত্র আসলাম? কনেও তো আসলো না এখনো। কনে না দেখেই চলে যাবো?”
পৃথাও সহমত জানিয়ে বললো, “নলী ঠিক বলেছে বুবু। তাছাড়া আমরা অনেক কষ্ট করে সেজে এসেছি। এখনই চলে গেলে ঘণ্টাখানেক ধরে সেজে লাভ কি হলো?”

অটবীর দৃষ্টি সন্তুষ্ট নয়। তবুও সে কিছু বললো না। খুঁজে খুঁজে মানুষ তুলনামূলক কম, এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো। এই এলাকার সুনামধন্য মুন্সি চাচার মেয়ের বিয়ে আজকে। ছোট থেকে বুড়ো সবাইকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। অটবী যদিও দাওয়াতে আসতে চায়নি কিন্তু মুন্সি চাচা বারবার অনুরোধ করছিলেন ওকে আসতে। উনার মেয়েকে দু’বছর টিউশন পড়িয়েছে বলেই হয়তো এত আহ্লাদ-আদর। অটবীর ভেতর থেকে একটা গুমরে ওঠা নিশ্বাস বেরিয়ে এলো। গরিব বলে পাড়ার সব মেয়েদেরকেই আঠারো পেরোনোর আগে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। মুন্সি চাচার মেয়ের বয়সও আঠারো হয়নি। এবার নিউ টেনে উঠতো। চোখ ভরা কত স্বপ্ন ছিল মেয়েটার! প্রত্যেক ক্লাসে রোল ১ হতো। প্রায়ই বলতো, অনেক বেশি বেশি পড়ে একদিন ডাক্তার হবে। অনেক টাকা কামাবে। পাশের বড়লোকি এলাকায় নিজস্ব একটা ফ্ল্যাট কিনে বাবা-মার সাথে থাকবে। কই? কিচ্ছু তো হলো না।
নাহ্! সবই হলো। সবার সব ইচ্ছে পূরণ হলো। মাঝখান দিয়ে মেয়েটার আকাশচুম্বী স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে।

ভাবনার অকূল পাথারেই কোত্থেকে তনয়া দৌঁড়ে এলো অটবীর কাছে। পেছনে ত্রিস্তানও আসছে। ঝটপট গলায় বললো, “ভালো আপু, ভালো আছো?”
তনয়া আজকে লাল টুকটুকে ফ্রক পরেছে। আদুরে চেহারার মেয়েটাকে সদ্য ফোটা নিষ্পাপ ফুলের মতো লাগছে। অটবী ক্ষীণ হাসলো। সস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, “ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?”
—“ভালো নেই।”
—“কেন?”

তনয়া আড়চোখে একবার পাশে দাঁড়ানো ত্রিস্তানকে দেখে নিলো। গাল দুটো বেলুনের মতো ফুলিয়ে অভিমানে টইটম্বুর হয়ে বললো, “ভাইয়া পঁচা। শুধু বকা দেয়।”

ত্রিস্তান অটবীর ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অগোছালো স্বভাবটা আজ একটু কম। চুল জেল দিয়ে পরিপাটি করে সাজানো, শার্ট ইন করা। গাল ভর্তি দাঁড়ি গুলো একটু কম কম লাগছে না? হ্যাঁ, ঠিক। দাঁড়িও ছেটেছে বোধহয়। বেশভূষা বড় সাহেবের মতো। সচ্ছ চোখটা যেন অটবীকে অনেক কিছু বলছে। অটবী ধরতে পারেনি। সরু চোখে চেয়ে প্রশ্ন করে, “আপনি ওকে আবার বকেছেন?”
ত্রিস্তানের ছোট্ট উত্তর, “আগে আগে হাঁটছিল।”
—“তো কি হয়েছে? আগে আগে হাঁটা কি অপরাধ নাকি? আমার সাথে ওর যখনই দেখা হয় তখনই দেখি আপনি ওকে বকছেন! সমস্যা কি আপনার?”

কপালের ভাঁজগুলো স্পষ্ট হলো। গাঢ় দৃষ্টে কয়েক পল অটবীর দিকে তাকিয়ে রইলো ত্রিস্তান। ধীর কণ্ঠে বললো, “তনয়াকে আর ভালো লাগছে না আমার। তুমি ওকে নিয়ে যাও।”

কথাটা বুঝে উঠতে পারলো না অটবী। চোখ পিটপিট করে বোকা বোকা কণ্ঠে সুধালো, “জি? কি নিবো?”
ত্রিস্তনকে দেখে মোটেও মনে হচ্ছে না সে মজা করছে। বরং আগের মতোই নির্বিকার গলায় বললো, “তনয়াকে নিয়ে যেতে বলেছি।”
—“আশ্চর্য! আপনি কয়েকদিন ধরে এমন অদ্ভুত আচরণ করছেন কেন আমার সাথে?”

ওপাশ থেকে জবাব এলো না। অবাক অটবী হতবাক হয়ে দেখলো, ত্রিস্তান তাকে কি ভীষণ স্বাভাবিক ভাবে অগ্রাহ্য করে নলী আর পৃথার সাথে কথা বলছে। পাজি দুটোও কম না। তনয়াকে নিয়ে তাদের এতক্ষণের জমানো প্রশ্ন এক এক করে জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে ত্রিস্তানকে। লোকটাও জবাব দিচ্ছে। যেন অটবী নামক কেউ তাদের মাঝে কস্মিনকালেও ছিল না। কি আশ্চর্য! কি আশ্চর্য!

কনে আর বরকে একসাথে বসানো হয়েছে। একদল মানুষ তাদের দেখতে ব্যস্ত থাকলেও অন্যদল খেতে ব্যস্ত। মাঠে আলাদা করে খাওয়ার জায়গা করা হয়নি। যারা চেয়ারে বসেছে তাদের সেখানেই বিরিয়ানির প্লেট ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে আর যারা বসার জায়গা পায়নি তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাচ্ছে।
ত্রিস্তান কোত্থেকে যেন তিনটা চেয়ার জোগার করে নিয়ে এলো। পৃথা, নলী আর তনয়াকে সেখানে বসিয়ে বললো, “চেয়ার আর পাইনি। তুমি কি দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে?”
অটবী আস্তে করে বললো, “সমস্যা নেই।”

সরোজ আর কাদিন দূর থেকে ছুটে আসছে। দু’হাতে দুটো করে বিরিয়ানির প্লেট। সরোজ তাড়াহুড়ো করে এসে একটা প্লেট অটবীর দিকে এগিয়ে দিলো। মুখের সবকটি দাঁত বের করে বললো, “অটবী আপু, স্পেশাল তোমার জন্য।”

অটবী প্লেট নিতেই কাদিনের আগে আগে সরোজ আবার ছুটে গেল নলীর কাছে। প্লেট দেওয়ার বাহানায় ছুঁয়ে দিলো নলীর হাত। নলী বড় বড় চোখে তাকালো। ছেলেটা পাগল নাকি? অটবী সামনে দাঁড়িয়ে!
সরোজ নলীর ভয়ের ধার ধারলো না। ঠোঁটে লাজুক হাসি ফুঁটিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো, “তোরে খুব সুন্দর লাগতাছে ডার্লিং। আমার বুক তো নাচা বন্ধ করতাছে না রে!”
নলী লজ্জায় লাজুক পাতার ন্যায় মিইয়ে গেল। সরোজের পানে আর একবারও মাথা তুলে তাকালো না। তার কিশোরী মনে ঝড় বইছে। তীব্র ঝড়। ঝড়টা কি তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে? মনে মনে ভীষণ উত্তেজনা অনুভব করলো নলী। ভাবলো, প্রেম এত রঙিন কেন? এত সুন্দর কেন?

বিরাট গাছের ছায়াতলে দাঁড়িয়ে আছে ত্রিস্তান আর অটবী। ত্রিস্তান এক প্রকার জোড় করেই নিয়ে এসে এসেছে ওকে। অটবী টিয়াপাখির মতো একটু একটু করে খাচ্ছে। চোখ জোড়া স্থির পাজি দুটোর দিকে। পৃথাকে স্বাভাবিক লাগছে না। একটু আগের উৎফুল্লতা হারিয়ে কেমন মন মরা হয়ে আছে। অটবী খেয়াল করেছে, কাদিনকে দেখার পর থেকেই ওর এমন পরিবর্তন।

অটবী অনেক কিছু বুঝেও না বুঝার ভান ধরলো। পাশে থাকা ত্রিস্তান ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। নিজের জন্য খাবার আনেনি। আনতে যাচ্ছেও না। অটবী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “আপনি খেতে না গিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”
—“পরে খাবো।”
—“আমি আপনাকে বুঝে উঠতে পারছি না।”

ত্রিস্তান কপালের চুলগুলো পেছনে ঠেলে বললো, “আমি নিজেও আজকাল নিজেকে চিনতে পারছি না।”
—“আপনি– আমার মনে হয় আমাদের এত বেশি মেলামেশা উচিত হচ্ছে না। আপনার উচিত আমাকে এড়িয়ে চলা।”
ত্রিস্তানের ঢিমানো কণ্ঠস্বর, “চেষ্টা করছি।”

অটবী সময় নিলো। বলতে চাইলো, “চেষ্টা না, আপনার করতেই হবে।” কথাটা বলতে গিয়ে ত্রিস্তানের দিকে তাকালো সে। কিন্তু বলতে পারলো না। হাতের প্লাস্টিকের প্লেট-টা শক্ত করে ধরলো। কণ্ঠ-টা অল্পসল্প কাঁপলো যেন। আঁতকে উঠলো, “আপনার নাক থেকে আবারও রক্ত ঝরছে ত্রিস্তান!”

সাথে সাথে ত্রিস্তানও তাকালো। অটবী দিশেহারা হলো খুব। হাতের প্লেট-টা ত্রিস্তানকে দিয়ে ঝটপট সাইড ব্যাগ থেকে রুমাল বের করলো। চোখ-মুখ কুঁচকে নড়বড়ে গলায় বললো, “আপনার আসলে কি হয়েছে বলবেন প্লিজ?”

ত্রিস্তান উত্তর দিলো না। ত্যাড়া স্বভাবটা খুব দৃঢ় ভাবে ধরে রাখলো। রুমাল দিয়ে নাক মুছে রুমালটা বেশ সাচ্ছন্দ্যে প্যান্টের পকেটে পুরে গাঢ় গলায় বললো, “আমি, সুখনীল ত্রিস্তান, তোমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি অটবী। রুমালটা তুমি আর পাচ্ছো না।”

____________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা