Wednesday, July 9, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 338



প্রিয়তার প্রহর ২ পর্ব-০৬

0

#প্রিয়তার_প্রহর
পর্ব ( ৬ )

প্রিয়তার পরিকল্পনা পূর্ণ হয়নি। ভেবেছিল দুপুর অবধি ঘুমিয়ে তারপর রান্না করবে। কিন্তু রান্নার চিন্তায় বেশিক্ষণ ঘুমোতে পারেনি প্রিয়তা। সাড়ে ন”টার দিকে ঘুম ভাঙে তার। আরহাম তখন টিভির দিকে তাকিয়ে আছে। পাশেই বিস্কিটের বয়াম। পানি দিয়ে বিস্কিট ভিজিয়ে মুখে পুরছে ছেলেটা। টিভিতে ছবি চলছে। প্রিয়তা হাই তুলে টিভির দিকে তাকাল। আজ ছেলেটা কার্টুন দেখছে না। মুভি চলছে সেথায়। বাংলায় ডাবিং করা তামিল মুভি দেখছে এক ধ্যানে। আরহামের পরণে শুধু ঢিলেঢালা হাফ প্যান্ট। উন্মুক্ত চিকন শরীরটা বেশ ফর্সা। চিকন হাত-পায়ে কোমল ভাব। দেখে মনে হবে ছেলেটা সামনেই ছয় বছরে পা রাখবে?

প্রিয়তা ব্রাশ করে তরকারি কুটতে বসল মেঝেতে। বেগুন আর আলু দিয়ে গুঁড়ো মাছ রান্না করবে। সে অনুযায়ী তরকারি কুটতে কুটতে টিভির দিকে তাকাচ্ছে সে। মুভিটা দেখতে ভালোই লাগছে তার। আরহাম এক পলক বোনের দিকে চেয়ে বয়াম টা রেখে দিল খাটের নিচে। হাত ঝেরে নিল প্যান্টে। বললো,

” আজকেও কাগজ পেয়েছি দরজার নিচ থেকে।

প্রিয়তা বিরক্ত হয় না। অবাক ও হয় না। নিয়ম মাফিক প্রত্যেকদিন চিঠি আসে তার নামে। প্রিয়তা এখন আর চিঠি পড়ে দেখে না। ফেলে দেয়। এ আর নতুন কি? বললো,

” ফেলে দিয়েছো?

” হুমম।

প্রিয়তা কাজে মনোযোগ দেয়। টিভিতে মারামারি চলছে। দুই বন্ধুর মাঝে মারামারি চলছে একটি মেয়েকে নিয়ে। অথচ কিছুদিন আগে বন্ধু দুটোর মাঝে বেশ ভাব ছিল। একে অন্যকে ছাড়া এক মুহুর্ত ভাবতে পারতো না। মেয়েটি কার কাছে যাবে বুঝতে পারছে না। একাধারে কেঁদে চলেছে পাশে দাঁড়িয়ে। মারামারির এক পর্যায়ে আরহাম হুট করেই চিল্লিয়ে উঠল। টিভির দিকে চেয়ে বলল,

” মার। মার শা*লার পো শা*লারে।

হতবিহ্বল চোখে তড়িৎ বেগে আরহামের দিকে তাকায় প্রিয়তা। চোখ ছোট ছোট করে ফেলে। ছেলেটা এই সব শব্দ কেন বললো? এমন গালি দিল কোন সাহসে? শব্দ করে বটি মেঝেতে রেখে খাটে বসে প্রিয়তা। রিমোর্ট চেপে অফ করে দেয় টিভি। কালো হয়ে যায় পর্দা। আরহাম ও অবাক হয় বোনের এহেন কাণ্ডে। রাগে ফুঁসে প্রিয়তা। ধমকে উঠে। হিংস্র সিংহীর ন্যায় গর্জে বলে উঠে,

” এইসব কি ধরনের ভাষা আরহাম? কার কাছে শিখেছো এসব? ছিঃ।

আরহাম বোঝেনি। জিজ্ঞেস করলো,

” কি বলো আপু? কি করেছি?

” শা*লা কোন ধরনের ভাষা জানো? না জেনে শব্দ উচ্চারণ করো কেন? এটা একটা গালি। আমি তোমাকে বলেছি না গালি-গালাজ না করতে? আমার সামনে তুমি বাজে কথা বলো? কত্ত বড় সাহস তোমার।

” আমি বুঝিনি আপু। এটা গালি বুঝিনি। এটা খারাপ জানি না তো।

” কোথা থেকে শুনেছো এটা তুমি? বলো আমায়?

” আমাদের ক্লাসের রোহান আছে না?

প্রিয়তা চিনে ছেলেটাকে। বলতে গেলে আরহামের স্কুলের সব টিচার আর স্টুডেন্টকেই চিনে প্রিয়তা। নামটা শুনেই সে বলে ওঠে,
” হুহ। তারপর কি বলো? রোহান বলেছে?

” রোহান আমাকে সেদিন বললো,- “ওই শা*লার পো শা*লা, এদিকে আয়”। আমি বুঝিনি ওটা গালি। আমি ভাবলাম বন্ধুদেরকে এই নামে ডাকে।

“না জেনে শব্দ ব্যবহার করো কেন? মুখের ভাষা এত খারাপ হবে কেন? আজ তোমার সকালের খাওয়া-দাওয়া বন্ধ। যাও রান্নাঘরে গিয়ে কান ধরে দাঁড়াও। দুপুর অবধি কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে।

আরহামের চেহারা মলিন হয়। অশ্রুতে টইটম্বুর হয় আঁখি। ঠোঁট উল্টে ফেলে ছেলেটা। শাস্তির ভয় হৃদয়ে ঝেঁকে বসে। ভেজা, গোলাপি ঠোঁটের আদলে বলে ওঠে,
” আর হবে না আপু।

” এটা তোমার শাস্তি আরহাম। যাও কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকো। কান ছেড়ে দিলেই কঞ্চির মাইর পরবে পিঠে। যাও। নইলে মাইর দিবো। আমার মেজাজ খারাপ করো না।

আরহাম উঠে দাঁড়ায়। একটু সামনে এগিয়ে দু কান ধরে দাঁড়ায়। অশ্রু ঝরে চোখ বেয়ে। অভিমান জমে বোনের প্রতি। আরহাম খুব ভালো করেই জানে প্রিয়তার শাস্তি থেকে সহজে নিস্তার পাওয়া যায় না। চুপ থাকে। অসহায় ভঙ্গিতে তাকায় বোনের পানে। প্রিয়তা গলে না। নরম হয় না হৃদয়। গম্ভীর হয়ে কাজে মন দেয়। খেয়াল রাখে আরহাম কান ছেড়ে দেয় কিনা। মাঝে মাঝে গর্জন করে উঠে। কঞ্চি ধরে রাতে হাতে।

সকালে রান্না হবার পর ও প্রিয়তা খেল না। আরহামকে খেতে দেয়নি। সে খাবে কি করে? ভাইকে ছাড়া একা একা খেতে পারবে? আরহাম এখনো শাস্তি ভোগ করছে। আরহামের সামনে গম্ভীর ভাবে বসে রইল প্রিয়তা। বললো,

” কাল তোমার পরিক্ষার রেজাল্ট দিবে না?

দু কান ধরে মাথা উপর নিচ করে হ্যাঁ বোধক উত্তর দিল আরহাম। প্রিয়তা বললো,

” কাল তোমার স্কুলে যাবো। রেজাল্ট ভালো হলে ফ্রিজে ওইদিন যে হাঁসের মাংস রেখেছিলাম না? মাংসটুকু বের করে রেঁধে খাওয়াবো।

আরহাম ভয় পেল না। সে জানে পরিক্ষা ভালো হয়েছে। প্রিয়তা তাকে যেগুলো পড়িয়েছিল, তার সবই এসেছিল পরিক্ষায়। তবুও জিজ্ঞেস করলো,

” আর রেজাল্ট ভালো না হলে?

” তাহলে আর কি করার? রান্না করবো না মাংস। যা যা লিখতে পারোনি সেগুলোই পড়াবো। বুঝবো আমিই ব্যর্থ। তোমাকে পড়াতে পারিনি। ভালোভাবে পড়া বুঝিয়ে দিতে পারিনি। বুঝে নিবো আমি লুজার, দায়িত্ব পালন করতে পারি না।

_____

বিশাল বড় তৃণভূমি। বেঞ্চের পর বেঞ্চ সারি সারি করে ফেলে রাখা রয়েছে। কৃষ্ণচূড়া গাছের মেলা বসেছে। কিচিরমিচির শব্দ করে ডেকে উঠছে পাখি। আশপাশে কপোত-কপতি বসে আছে। খাবারের দোকান রয়েছে অনেকগুলো। তানিয়ার এখানে বসে থাকতে অসস্তি হচ্ছে। তবুও বসে আছে নির্বিকার চিত্তে। বসে থাকা বেঞ্চের মাঝে পিজ্জার প্লেট। ইহান সেখান থেকে এক টুকরো পিজ্জার অংশ তুলে কামড় দিল। চিজ লেগে গেল ঠোঁটে। ঠোঁট দ্বারা মুছে নিল সেটুকু। তানিয়ার মনে দ্বিধা। দোটানায় যা তা অবস্থা। উত্তেজিত হয়ে সে বলে উঠল,

” বাবা গতকাল বিকেল থেকে এ অবধি কিচ্ছু খায়নি। আন্টিও না খেয়ে বসে আছে। বলছে আপনাকে বিয়ে না করলে পানিটাও ছুঁয়ে দেখবে না। হঠাৎ এমন করার কি মানে বলুন?

ইহান এবার খাওয়া বন্ধ রাখল। পানি খেল ঢকঢক করে। সামনে থাকা রমনীর পানে তাকাল আড়চোখে। শাড়িতে তানিয়াকে বড্ড মায়াবি লাগছে। কাজল দেওয়া আঁখির দিকে তাকালে কেমন নেশা লেগে যায়। ওষ্ঠ জোড়া চেপে দিতে ইচ্ছে হয় চোখের পাতায়। তানিয়ার সবুজ পাড়ের সাদা শাড়িটি আকর্ষণীয়। তানিয়ার গায়ে শাড়িটা মানিয়েছে বেশ। চশমা ছাড়া তানিয়াকে কেমন লাগবে ভাবতে বসল ইহান। উঁহু! মানাবে না একদম। তানিয়াকে চাশমিশ হিসেবেই ভালো লাগে। চশমা না পরলে মেয়েটাকে অদ্ভত লাগবে। গাঢ় চোখে তাকিয়ে চোখ বুজে নেয় ইহান। বলে,

” আম্মাও আমার সাথে কথা বলছে না। এসব আন্টি আর আম্মার প্রি-প্ল্যানড।

” কি করবো বলুন তো?

” আমি আমার আম্মাকে কষ্ট দিতে পারবো না। এমনিতেই আম্মা কয়েকদিন আগে বড়সড় একটা ধাক্কা খেয়েছে। তার শোক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। আমি বিয়েতে সায় জানিয়েছি। বাকিটা তোমার ইচ্ছা।

” আপনার সাথে আমার বিয়ে?

বিস্ময়ে ফেটে পরে তানিয়া। চোখের চাহনি অন্যরকম হলো। শিরশির করে ওঠে দেহ। বুক ওঠানামা করে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকে। ছটফট করে ওঠে হৃদয়। এটা কিভাবে সম্ভব? লোকটার কি কোনো হেলদোল নেই? এইসব নিয়ে মাথা ব্যথা নেই?

ইহান স্বাভাবিক। পরিকল্পনাটি দারুন লেগেছে তার। বলে উঠল,

“কেন? আমি কি তোমার যোগ্য নই? নাকি আমাকে তোমার পছন্দ নয়?

এমন প্রশ্নের উত্তরে কি বলা যায় ভেবে পায় না তানিয়া। দাঁত দ্বারা চেপে ধরে ওষ্ঠাধর। চিন্তিত দেখায় তাকে। ঢোক গিলে স্বাভাবিক হয়ে বলে,

” আপনার সাথে আমার ম্যাচ হবে? মানে আপনি এত গম্ভীর, রাগী, বদমেজাজি, সাহসী অপরদিকে আমি অতটা শান্ত নই, বেশি কথা বলি, ভিতুও বটে। আপনার সাথে কিভাবে থাকবো আমি? এটা সম্ভব নাকি?

” এটা তোমার ব্যাপার তানিয়া। আম্মার কথা রাখার জন্য আমি সবই করতে পারি। আমি বিয়েতে রাজি। আশা করি আম্মার ইচ্ছাকে তুমিও প্রাধান্য দিবে।

” কিন্তু?

” ভেবে দেখো।

উঠে গেল ইহান। শাড়ির আঁচল দ্বারা নাকের ডগায় জমে থাকা স্বেদজল মুছে নিল তানিয়া। সন্দেহ হলো ইহানের প্রস্তাব নিয়ে। ইহান সবটা ভেবে বলছে তো? ইলমা বেগমের মুখের দিকে চেয়ে এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার মানুষ তো ইহান নয়। ধৈর্যবান লোকটা মাত্র একদিনেই অধৈর্য হয়ে বিয়ে করতে সম্মতি জানাল? তাও আবার তানিয়াকে? ঝামেলা অবশ্যই আছে। হুট করে নিজের জীবন নিয়ে এমন ভাবনা মাথায় আনবে না ইহান। বিয়ে করতে চাইছে তানিয়াকে, এটা কি বিশ্বাস যোগ্য?

_______

ইলমা বেগম ছেলের ঘরে ঢুকলেন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। ইহান তখন ফাইল পত্র গোছাতে ব্যস্ত। প্রহর চলে যাওয়ার পর দায়িত্ব আরো বেড়ে গিয়েছে ইহানের। দু চোখের পাতা এক করার সময় নেই। এখানে ওখানে যেতে হচ্ছে যখন তখন।

ইলমা বেগম এসে বিছানায় বসলেন। ইহানকে ইশারা দিয়ে কোলে শুয়ে থাকতে বললেন। ইহান অমান্য করল না সে কথা। কাজ বাদ দিয়ে আম্মার কোলে শান্তিতে শুয়ে রইল খানিকক্ষণ। ইলমা বেগম ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। চুলগুলো টেনে দিলেন। একটু সময় নিয়ে বললেন,

” তানিয়ার সাথে আলাদাভাবে কথা বলেছিলি?

” বলেছিলাম।

” কি বললো?

‘ বলেনি কিছুই।

” তানিয়া বিয়েতে রাজি হয়েছে। জানিস?

চট করে উঠে পরল ইহান। অবিশ্বাস্য চোখে তাকাল আম্মার দিকে। ইলমা বেগম হেসে উঠলেন ছেলেকে এহেন হকচকিয়ে উঠতে দেখে। ইহান না বুঝে বললো,

” কি বললে? তানিয়া রাজি হয়েছে?

” হ্যাঁ।

” সত্যি বলছো?

” তোর সাথে কি আমি ঠাট্টা করছি? মেয়েটার মত বদলানোর আগেই আমি তোদের বিয়ে দিতে চাইছি। থানা থেকে কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে নে।

” তানিয়া বোধহয় ওর পরিবারের কথা রাখতেই..

” সে যাই হোক। বিয়েটা হোক তবু। বিয়ের পর মেয়েটার মন জয় করে নিস আব্বা। তানিয়া কিন্তু বিয়েতে একটা শর্ত দিয়েছে।

” শর্ত? সেটা কি আম্মা?

” বিয়ে নাকি শুধু কাজী ডেকে রেজিস্ট্রি করিয়ে হবে। প্রহর এলে তখন ধুমধাম করে বিয়ে দিলে তানিয়ার আপত্তি নেই। এখন শুধু কাজী ডেকে আইনী ভাবে বিয়ের ব্যবস্থা করতে বলছে। প্রহর নাকি ঢাকায় হাওয়া পরিবর্তন করতে গিয়েছে? তানিয়া চাইছে না বিয়ের কথা শুনে প্রহর এখন চলে আসুক।

ইহান বুঝল তানিয়ার ভাবনা। ইহানের মনের কোণে অজানা এক অনুভূতি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল। তানিয়ার চিরচেনা অবয়ব ভেসে উঠল চোখের পাতায়। শিরশির করে উঠল দেহ। তার শখের নারী শেষমেশ তার হবে? নাকি সবটাই ভ্রম? যদি সত্যই হয়, তাহলে কেন এত হাহাকার? কেন এত দ্বন্দ্ব?

______

সকাল সকাল নিজেকে লম্বা ফ্রকে আবৃত করল প্রিয়তা। কালো রঙের হিজাব বেঁধে নিল মাথায়। সাথে ম্যাচিং করে মাস্ক পরে নিল। প্রিয়তার চিন্তা হচ্ছে। চিন্তায় হাত-পা রীতিমতো শিতল হচ্ছে। আরহামের পরিক্ষার ফলাফল কেমন হবে এই ভেবে রাতে ভালো মতো ঘুমই হয়নি প্রিয়তার। ভাইটা এই প্রথম স্কুলের বেঞ্চে বসে পরিক্ষা দিয়েছে, ভাবতেই উত্তেজিত হচ্ছে হৃদয়।

আরহামের স্কুলের ইউনিফর্ম নেভি ব্লু আর সাদা। সাদা রঙের শার্ট, সাদা রঙের বুট জুতো। প্যান্ট আর টাইটা নেভি ব্লু রঙের। প্রিয়তা আরহামকে শার্ট-প্যান্ট পরিয়ে নিজে তৈরী হয়েছে। স্কুলের ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে প্রিয়তা আর আরহাম বেরিয়ে পরল রাস্তায়। বাড়ি থেকে আরহামের স্কুলে হেঁটে যেতে প্রায় পনেরো মিনিট লাগে। রিকশা ভাড়া বাচানোর উদ্দেশ্যে প্রিয়তা রিকশা নিল না। আরহামের সাথে গল্প করতে করতে হেঁটেই স্কুলে পৌঁছাল। আরহামের স্কুলটি প্রাইমারি স্কুল। এ স্কুলটির চারপাশে ইটের দেয়াল দিয়ে ঘেরা দেওয়া। সুন্দর, সুন্দর পেইন্টিং করা দেয়ালে। কার্টুনের পোর্ট্রেট সহ উপদেশমূলক বাণী লেখা। স্কুলের সামনে একটা গেইট আছে এবং পেছনেও একটি গেইট রয়েছে। এলাকায় এ স্কুলের যেমন নাম-ডাক রয়েছে, তেমনই স্কুলে পড়ানোর নিয়মকানুন সুন্দর। এছাড়া স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাগন বেশ আন্তরিক। যেজন্য প্রিয়তা কাছের এই স্কুলে আরহামকে ভর্তি করিয়েছে। স্কুলের বা পাশে গার্ডিয়ান প্লেস নামে ছাউনি দ্বারা আবৃত খোলামেলা কক্ষ রয়েছে। সেখানে অনেকগুলো বেঞ্চ পেতে রাখা থাকে। গার্ডিয়ানরা সেখানে বাচ্চাদের জন্য অপেক্ষা করে। গার্ডিয়ান মিটিং হলে এখানেই মিটিংটা হয়।

প্রিয়তা আর আরহাম গিয়ে গার্ডিয়ান হলে বসল। স্কুলের সব বাচ্চার মা অথবা বাবা এসেছে বাচ্চাদের সাথে। আরহাম সেদিকে তাকিয়ে রয়। মহিলাদের পানে বারংবার তাকায়। মাথা উচিয়ে বোনকে প্রশ্ন করে,

” আম্মু কেন আসে না বনু? দেখো ওদিকে। সবার আম্মু-আব্বু আসে, সবাইকৈ আদর করে। আমার আম্মু-আব্বু পচা। ওরা আসে না আমার কাছে। আমার তুমি ছাড়া কেউ নেই। জানো আমার বন্ধুরা আমাকে কি জিজ্ঞেস করে? জিজ্ঞেস করে কেন আমি বাবা-মাকে নিয়ে আসি না? কেন তাদের নিয়ে কথা বলি না?

প্রিয়তা থমকায় না। দুঃখ পায় না। কণ্ঠে জড়তা চেপে ধরে না। এখন সেসব বাদ দিয়েছে সে। অতিত মুছে ফেলার তাগিদে লেগে পরেছে। আরহামের মাথায় সযত্নে হাত বুলিয়ে সে বললো,

” ওইযে তুমি বললে, আমি ছাড়া তোমার কেউ নেই। এই কথাটা প্রতিনিয়ত ভাববে। আমি ছাড়া আসলেই তোমার কেউ নেই। আর বন্ধুদের বলবে তোমার মা-বাবা আছেন। কিন্তু তারা বিজি থাকেন বলে আসতে পারেন না। তাই আপু আসে। বুঝলে?

আরহাম মাথা নাড়ায়। স্কুল ইউনিফর্মে ছেলেটাকে দারুন লাগে। মলিন হলে ছেলেটার মুখটা আরো ফ্যাকাশে লাগে। সময় গড়ায়। গার্ডিয়ানদের একেক করে ডাক পরে। আরহামের ভর্তির রোল আঠাশ। আঠাশ রোল ডাকার সাথে সাথে স্কুলের অফিস রুমে প্রবেশ করে প্রিয়তা। আরহামের আঙ্গুল হাতের মুঠোয় রাখে। অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করেন অফিস রুমে। স্কুলের হেড ম্যাম প্রিয়তাকে বসতে বলেন চেয়ারে। আরহামকে কোলে নিয়ে চেয়ারটিতে বসে প্রিয়তা। বলে,

” আসসালামু আলাইকুম ম্যাম।

” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। ভালো আছো?

‘ আলহামদুলিল্লাহ্ ম্যাম। আপনি কেমন আছেন?

” ভালো আছি। আরহাম তো খুবই ট্যালেন্টেড। পড়াশোনার বিষয় না হয় বাদ দিলাম, অন্যান্য দিক থেকেও হি ইজ সো ক্লেইম অ্যান্ড কিউট।

হাসে প্রিয়তা। ভাইয়ের জন্য গর্বে বুক ফুলে ফেপে উঠে। প্রশান্তি ছেয়ে যায় হৃদয়ে। উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,

” পরিক্ষায় কেমন নম্বর পেয়েছে ও?

” তোমার ভাই দুটো বিষয় বাদে বাদবাকি বিষয়ে একশোতে একশো পেয়েছে। ও দুটোয় আটানব্বই পেয়েছে। আ’ম ইমপ্রেসড। আরহামের হাতের লেখাও দারুন। চুপচাপ থাকে সবসময়।

প্রিয়তা খুশি হয়। আরহামের দিকে নজর বুলায়। রেজাল্ট শীট হাতে নেওয়ার পূর্বে হেড মিস বলে উঠেন,

” আরহামের বাবা-মা নেই এটা তুমি আমাকে জানিয়েছিলে। আমি সবার সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি ব্রাইট স্টুডেন্ট যাদের বাবা-মা নেই, তাদের জন্য আমরা ছাড় দিবো। আরহামের পরিক্ষা আর স্কুলের ফি এবার থেকে অর্ধেক দিও।

প্রিয়তার ভঙ্গি বদলে যায়। মুচকি হেসে বলে,

” আরহাম সবে শিশু শ্রেণীতে পড়ে। ওর এখনো অনেক শ্রেনী উত্তীর্ণ হওয়া বাকি। এখনই যদি আমি আমার ভাইয়ের দায়িত্ব কমিয়ে ফেলতে চাই তা কি করে হয় ম্যাম? ওর পড়ালেখার খরচ চালানোর সামার্থ্য আপাততো আমার আছে। যদি কখনো মনে হয় আমি আর পারছি না, তাহলে আপনাদের জানাবো। ভাইয়ের স্বার্থের জন্যে হলেও আপনাদের কাছে সাহায্য চাইবো।

ফেরার পথে আরহাম মনে করিয়ে দিল রোহানের কথা। হাতের ইশারায় রোহান নামের ছেলেটিকে দেখাল। রোহান ছেলেটা আরহামের মতোই ফর্সা। আরহামের চেয়ে খানিক লম্বা, বয়সেও হয়তো বড় হতে পারে। প্রিয়তা এগিয়ে গেল। রোহানের সাথে রোহানের আম্মুও দাঁড়িয়ে আছে। অন্যান্য গার্ডিয়ানদের সাথে বাচ্চার রেজাল্ট নিয়ে কথা বলছে। প্রিয়তা এগিয়ে এলো। জিজ্ঞেস করল,

” রোহান কেমন রেজাল্ট করেছে আপু?

রোহান হাসে। রোহানের আম্মু বলেন,

” সব বিষয়ে সত্তরের উপরে মার্ক পেয়েছে আমার ছেলে।

প্রিয়তা হাসে। রোহানের মুখে হাত বুলিয়ে বলে ওঠে,

” ভালো করে পড়াশোনা করবে। শুনেছি তুমি অনেক গালিগালাজ করো। এটা কি ঠিক? গালি দেওয়া ভালো নয়। জানো না? এটা পাপ।

রোহানের আম্মু বলে ওঠে,

” ও কাকে গালি দিয়েছে।

প্রিয়তা বলে,
“আমার ভাইকে। বাজে সম্বোধন করে ডাকে আরহামকে। রোহানকে গালিগালাজ না করতে বলবেন। ওর থেকেই সবাই এসব ভাষা শিখছে। এই বয়সটা থেকেই বাচ্চারা শিখে। এখনই এভাবে গালি দিলে সামনে আরো তো দিন পরেই আছে। ওকে ভালো বন্ধুদের সাথে মিশতে দিবেন। ক্লাসে মনোযোগী হতে বলবেন। আমার ভাই কিন্তু ক্লাসে ফার্স্ট হয়েছে। সবেতেই নাইন্টি ফাইভ পার্সেন্টের বেশি মার্কস পেয়েছে।

বলেই প্রিয়তা একটা ডেইরি মিল্ক বের করে রোহানের হাতে দিল। চুলে হাত বুলিয়ে বলে,
” আর কখনো কারো সাথে গালিগালাজ করবে না। আমি তোমার আপু লাগি। আর যদি এসব শুনি আমি কিন্তু বকবো তোমায়।

______

প্রিয়তা আজ খুব খুশি। আনন্দে আত্মহারা সে। আরহাম এত ভালো রেজাল্ট করবে ভাবেনি সে। প্রত্যাশার চেয়ে বেশি কিছু পেয়ে প্রিয়তার হৃদয়ে আনন্দের জোয়ার বইছে। আরহামের মুখে অজস্র চুমু এঁকে দিল প্রিয়তা। ছোট্ট হাতের উল্টোপিঠে সশব্দে চুমু খেয়ে জিজ্ঞেস করল,

” তোমার কি চাই ভাই? আজ তোমার একটি ইচ্ছে পূরণ করবো। বলো কি চাও?

আরহাম গালে হাত দিয়ে ভাবতে সল। প্রিয়তা হেসে বললো,
” এমন কিছু চাইবে যা দেওয়ার সামর্থ্য আপাতত আমার আছে।

ভেবেচিন্তে আরহাম উত্তর দিল,
” প্রহর ভাইয়ার সাথে দেখা করতে চাই আপু। ভাইয়া বলেছিল রেজাল্ট ভালো হলে আমাকে অনেক চকলেট দিবে। ভাইয়ার সাথে দেখাও হবে, চকলেট ও পাব।

প্রিয়তা দমে গেল। মুখটা থমথমে হয়ে গেল। তবুও চাইল আরহামের কথা রাখতে। অটো ধরে খানিকক্ষণ পরে থানায় পৌঁছাল। থানার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কনস্টেবলকে প্রিয়তা জিজ্ঞেস করল,

” প্রহর স্যার থানায় আছে?

লোকগুলো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল । প্রিয়তার প্রশ্নে খানিক মন খারাপ করে বলে উঠল,

” স্যার আজ রিজাইন দিয়ে চলে গিয়েছেন। সকালে এলেও উনাকে পেতেন।

চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

প্রিয়তার প্রহর ২ পর্ব-০৫

0

#প্রিয়তার_প্রহর
পর্ব সংখ্যা ( ৫ )

গত রাতে তুমুল বর্ষণ নেমেছিল ধরণীতে। সেই রেশ এখনো প্রকৃতিতে বিদ্যমান। ভিজে একাকার রাস্তাঘাট। গাছের পাতা বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির কণা ঝরে পরছে। গরমের উত্তাপ কমিয়ে কিছুটা শীতল হয়েছে পৃথিবী। এলাকার প্রায় অনেক রাস্তা-ই এবড়োখেবড়ো। পানি জমাট বেঁধে রয়েছে সর্বত্র। সেথায় পা ফেললে সপসপ শব্দ হয়। ভোট নেওয়ার সময় এলাকার নেতারা এসে বাড়িতে বাড়িতে ভিড় জমায়। জনগনের পাশে থাকার প্রতিজ্ঞা করেন। অথচ ভোট শেষ হলেই সেইসব নেতা/নেত্রীদের খুঁজে পাওয়া যায় না। জনগনের সেবা করার কথা তারা ভুলেই যান। প্রত্যেকবার রাস্তা মেরামত করার ওয়াদা করেন তারা। কিন্তু কই সেসব? এলাকার রাস্তার অবস্থা বাজে। হাঁটু সমান পানিতে পা ভিজিয়ে যাতায়াত করতে হয়।রিকশা একবার গেঁথে গেলে দু-তিনজন শক্তি সামর্থ্যবান লোক ব্যতিত রিকশা উঠতে পারে না গর্ত থেকে। কাঁদায় রাস্তাঘাটে পা ফেলা যায় না। জামাকাপড়ের বেহাল দশা হয়।

আরহামকে স্কুলে পৌছে দিয়ে বাড়িতে ফিরেছে প্রিয়তা। ব্যাগে নিজের বই খাতা গুছিয়ে নিচ্ছে। ভার্সিটিতে যেতে হবে আজ। ইমপর্ট্যান্ট ক্লাস আছে। প্রিয়তা তৈরী হলো। সকালে খেতে ইচ্ছে করে না তার। ভোরে আরহামের জন্য পাউরুটি আর ডিম ভেজেছিল। আরহামের টিফিনে আজ সেই পাউরুটিই দিয়েছে। ললাট অবধি পুরু ওরনা দ্বারা মাথা ঢেকে ঘরে তালা মারল প্রিয়তা। বাড়িওয়ালীর আগমন সেসময় বিরক্ত লাগল প্রিয়তার নিকট। সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন তিনি। চোখ মুখ অগোচরে কুঁচকে ফেলল প্রিয়তা। মহিলার পরণে সবুজ শাড়ি। গলায় চিকন সোনার চেইন। কানে সোনার ঝুমকা। নাকে বড়সড় নাকফুলের রঙটা কেমন কালো হয়ে গিয়েছে। মহিলার ঠোঁটে গা জ্বালানো হাসি। প্রিয়তাকে দেখে এগিয়ে এসে তিনি বললেন,

” পড়তে যাও নাকি?

প্রিয়তা সম্মতি দিল। মাথা নাড়িয়ে ভদ্রতাসূচক হেসে বলল,

” জি আন্টি। কিছু বলবেন?

” কালকে ম্যালায় গেছিলা?

” গিয়েছিলাম তো।

” একটা পোলারে দেখলাম লগে। তোমার ভাই হ্যার কোলে ছিল। ছ্যাড়াডা তুমার কি হয়?

” হ্যাঁ গিয়েছিলাম। উনি আমার বন্ধু হয়।

পুনরায় চলে যাবার পূর্বে প্রিয়তা বলে উঠল, খবরদার আন্টি! উনার নামে আজেবাজে কিছু বলবেন না। উনি কিন্তু পুলিশ। উল্টা পাল্টা কথা বললে কোন কেসে যে আপনাকে ফাঁসিয়ে দিবে ধরতেই পারবেন না।

মুখটা শুকনো হয়ে গেল মহিলার। তেজ ফুটে উঠল চোখেমুখে। এইটুকু মেয়ের মন বেলেল্লাপনা কথায় রেগে গেল। বললো,

” আমারে ভয় দেখাও? হ্যায় যে পুলিশ তার প্রমাণ কি?

” আপনার ফোন আছে?

” হ আই ফোন। আমার পোলায় পাঠাইছে।

” ওই আইফোনের গুগোল অ্যাপসে গিয়ে ইনসপেক্টর আজওয়াদ ইশতিয়াক লিখে সার্চ দিবেন। ছবি দেখে মিলিয়ে দেখবেন কালকের লোকটাই গুগোলের ছবির লোকটা কিনা? কেমন? এরপর আমাকে জানাবেন।আজ আসি আন্টি। দেরি হচ্ছে।

প্রিয়তা দ্রুত গতিতে পা ফেলল। ঠান্ডা পানিতে সালোয়ারের নিচের অংশ খানিক ভিজে গেল। কাঁদা লেগে গেল। বিরক্ত হলো প্রিয়তা। ঝটপট পা চালিয়ে অটো ধরল। সস্তির শ্বাস ফেলে ওড়নার অংশ টেনে ললাটে এনে রাখল। বাবা-মায়ের ঝামেলা ব্যতিত অন্যকোনো খুঁত নেই প্রিয়তার। গোলগাল, নমনীয় মেয়েটার চেহারা। চিবুকে স্পষ্ট টোল রয়েছে। হাসলে ফুটন্ত ফুলের ন্যায় মন কাড়ে। মাঝারি আকারের ঘন পাপড়িযুক্ত চোখের মায়ায় মজতে বাধ্য পুরুষগন। স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি সবখানেই শ-খানেক মানুষের নজর কেড়েছে প্রিয়তা। বিশেষ করে গত দু-মাসে সৌন্দর্যের ধারাই বদলে ফেলেছে সে। প্রিয়তার কেশ এখন আর গোলাপি রঙের নেই। কুচকুচে কালো দীঘল কেশ কোমর ছাড়িয়ে আরো খানিক নিচে ঝুঁকে গিয়েছে। সেই চুলের আগা মাঝে মাঝেই আঁচরানোর ঝামেলায় কেঁটে ফেলে প্রিয়তা। আর অবাক করার বিষয় খুব জলদিই চুল বেড়ে ওঠে প্রিয়তার। তার শরীরে কিছুটা গুলুমুলু ভাব এসেছে বটে। মাঝে মাঝে নিজের সৌন্দর্যে নিজেই বিমোহিত হয় প্রিয়তা। চেয়ে থাকে অপলক।

ভার্সিটিতে পৌঁছানোর পূর্বেই অটো থামল মাঝ রাস্তায়। ফোনে থেকে চোখ উঠিয়ে বাইরে তাকাল প্রিয়তা। ললাটে গাঢ় ভাঁজ পরল। জ্যাম তো নেই? সামনে বাইক দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়তা মাথা বের করে বাইকে বসে থাকা লোকটাকে দেখল। মুখ দিয়ে বিরক্তিসূচক শব্দ বের করে অটোওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে নেমে পরল। মুঠোফোন ব্যাগের চেইন খুলে রেখে দিল। বাইকের নিকট এসে দৃঢ়, ঝাঁঝ মেশানো স্বরে বাইকের মালিকের উদ্দেশে বললো,

” অপরাধীদের ধরা বাদ দিয়ে একটি মেয়েকে দেখার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন। আজওয়াদ ইশতিয়াক এমনটা করতে পারে? লোকে কি বলবে? এ তো অকল্পনীয় ব্যাপার।

হাসল প্রহর। ছেলেটার পরণে ধুসর রঙের শার্ট আর কালো প্যান্ট। হাতে সোনালী রঙের দামী ঘড়ি। চুলগুলো গোছানো। মিষ্টি হেসে প্রিয়তার মন জয় করল ছেলেটা। বললো,

” আপনি এটা ভাবেন? আমিও ভাবি। একটা দিক কিন্তু ভালো হয়েছে। শহরে যতগুলো প্রেমিক আছে তারা সবাই আমার থেকে শিখবে কিভাবে প্রেমিকার পিছনে লেগে থাকতে হয়? কিভাবে ভালোবাসার জন্য ভুলে যেতে হয় জগতের নিয়মকানুন? ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কিভাবে ব্যক্তিত্ব ত্যাগ করতে হয় তা জানবে। জানবে কিভাবে কাছাকাছি আসতে হয় আরো।

” কিন্তু আমি তো আপনার প্রেমিকা নই। আর আপনিও আমার প্রেমিক নন।

” প্রেমিকা হতে হবে না। সেই সুযোগ দিবো না। বউ হলেই চলবে।

” দেখুন,

” দেখাও।

” আমি আপনাকে সাফ সাফ জানিয়ে দিচ্ছি। আপনার সাথে কোনোরুপ সম্পর্কে জড়াতে ইচ্ছুক নই আমি। আপনি একজন সৎ পুলিশ অফিসার। আপনাকে আমি সম্মান করি। আপনার পেশাকেও আমি শ্রদ্ধা জানাই। কিন্তু এই পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তির সাথে আমি সম্পর্ক রাখতে চাই না। আপনি অপরাধীদের ধরবেন, শাস্তি দিবেন। গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মুখোশ উন্মোচন করবেন। তারা আপনার উপর অসন্তুষ্ট হবে। অতঃপর আপনাকে শাস্তি দিবে আমাদের কষ্ট দিয়ে। তাদের আপনার উপর থাকা ক্রোধ, ক্ষোভ আমাদের জীবনকে জাহান্নাম বানিয়ে ছাড়বে। আমি নিজের জন্য ভাবি না। নিজের জীবন নিয়ে কোনো সংশয় নেই আমার। আমার চিন্তা শুধু আরহামের জন্য। আরহামকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। আরহামের জীবন নিয়ে আমি বিন্দুমাত্র ঝুঁকি নিতে পারবো না। বর্তমানে ভালো মানুষের ভাত নেই একথা আপনি জানেন। আর আপনার এই সততা আপনাকে নিঃশেষ করে দিবে। তখন? তখন আমি কিভাবে বাঁচবো? আপনার কিছু হয়ে গেলে আমার কি হবে ভেবেছেন একবারো? আমার কিছু হলে আরহাম কিভাবে বাঁচবে সেটা বলুন?

প্রিয়তার বাক্যগুলো বিষাক্ত তীরের ন্যায় তড়িৎ গতিতে বুকে লাগল প্রহরের। থমকে গেল সে। চেহারা ফ্যাকাশে হলো মুহূর্তেই। বাদামি রঙের চোখের মণি তীর্যক হয়ে খেয়াল রাখল প্রিয়তার। প্রহর থামে, ভড়কায়। তটস্থ হয় প্রিয়তার ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে। জড়তা কাজ করে কণ্ঠে। দৃঢ় কণ্ঠে বলে ওঠে,

” পুলিশের ইউনিফর্মকে আমি ভালোবাসি। অপরদিকে আপনাকেও ভালোবাসি। আপনি যা চাইছেন তাই হোক। আপনার ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিচ্ছি প্রিয়।

প্রহর বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে গেল দ্রুত। পেছন ফিরে তাকাল না আর। প্রিয়তার ভয় বাড়ে। চোখের কার্ণিশে জমে যায় অশ্রুকণা। এসব কথা বলার কারণে প্রহর হয়তো তাকে ঘৃণা করবে। ভাববে সে যাকে ভালোবাসে সে অসৎ, স্বার্থপর। প্রিয়তা শুধু নিজেদের কথা ভাবে। সমাজে অন্যায়ের শিকার হওয়া মানুষ গুলোর প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতি নেই প্রিয়তার। সৎ থাকার কারণে প্রহরের ভালোবাসার মানুষ প্রহরকে গ্রহণ করছে না। ছিঃ,কতটা স্বার্থপর প্রিয়তা!

প্রহরের এই পেশা নিয়ে প্রহর কতটা সন্তুষ্ট তা প্রিয়তা জানে। প্রহর ভালোবাসে এই পেশাকে। সবসময় এই পেশা নিয়ে গর্ব করে লোকটা। সিলেটের সবাই তার কথা জানে, ছোটখাটো কেস হলেও প্রহরের শরণাপন্ন হয় তারা। বুঝে এই পুলিশের কাছে এলে টাকা লাগে না, ক্ষমতা থাকা লাগে না, তোষামোদ করতে হয় না, পিছু পিছু ঘুরতে হয় না। সন্দেহ হয় না তদন্ত নিয়ে।

প্রিয়তা ভার্সিটি যায় না। আরেকটা অটো ধরে ভার্সিটির উল্টোদিকে যায়। আধঘন্টা পরে একটি বড়সড় বাড়িতে পৌঁছায় প্রিয়তা। বাড়ির সামনে অনেকগুলো মেয়ে। অনেকেই প্রিয়তার সমবয়সী। আবার অনেকেই প্রিয়তার বড়। ছোট মেয়েদের সংখ্যা কম। প্রিয়তাকে দেখে হাসল সকলে। কয়েকজন এগিয়ে আসল সামনে। সেখানকার একটি মেয়ে বলে উঠল,

” আমরা তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তৈরী হয়ে নাও দ্রুত। ফাদার তোমার উপর একটু রেগে আছেন। গত সপ্তাহে তুমি আসোনি কেন?

প্রিয়তা বলে না কিছু। বাড়িটা পর্যবেক্ষণ করে। বিশাল বড় বাড়িটির গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বারান্দা। বারান্দায় ছোট ছোট সবুজ ঘাসের সমাগম। বাড়ির বাইরেও বড় বড় মেহগনি গাছ। সাদা রঙের বাড়িটির আশপাশে ফুলের সমাহার। রেডিওতে একটি গান বাজছে। কয়েকটি আসন পেতে রাখা হয়েছে বারান্দায়। কয়েকজন মেয়ে বসে আছে চোখ বন্ধ করে। প্রিয়তা এগিয়ে আসে। বড় করে সাইনবোর্ডে লেখা দেখতে পায় ” জুলফার মাশাল আর্ট”। নিচে ছোট ছোট করে লেখা “সেইভ ইউ অ্যান্ড আদার্স”।

________

রন্ধনশিল্প নিয়ে আলোচনা চলছে তাসলিমা খাতুন আর ইলমা বেগমের মধ্যে। একে অপরকে রান্নার রেসিপি বলে দিচ্ছেন তারা। ইলমা বেগমের গায়ে সুতির শাড়ি। তাসলিমা খাতুনের পরণে সালোয়ার কামিজ। মাথায় চওড়া ওড়না। চায়ে চুমুক দিতে দিতে তিনি বললেন,

” মেয়েটা এত ব্যস্ত থাকে যে কি বলবো। বাড়ি ফিরেও কত কাজ।

ইলমা বেগম হাসলেন। তানিয়ার দায়িত্বের প্রতি গভীর মনোযোগ দেখে মুগ্ধ হলেন। বললেন,

” আপনার মেয়েটা সত্যিই চমৎকার।

” মেয়েটাকে বিয়ে দিতে চাইছি। গতকাল ছেলে দেখতে এলো। মেয়েকে সাজিয়ে বসালাম ছেলে পক্ষের সামনে। যিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি বলেছিলেন ছেলের বয়স কম। অতীব যুবক। মিথ্যে! ছেলের বয়স তেত্রিশ। ব্যাংকের ম্যানেজার। ব্যাংক ব্যবসায় আবার তানিয়ার পছন্দ নয়। এটা নাকি সুদের কারবার। তাই আজ ছেলেকে না করে দিলাম। মেয়েটা কি আমার কম সুন্দর? কম প্রতিভাবান? কুড়িতেই নাকি মেয়েরা বুড়ি হয়ে যায়। এ কথা আমি মানি না। কুড়িতেই একটি মেয়ে নারী সত্তার আসল মানে বুঝতে পারে। পরিপূর্ণ ভাবে নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখে। কুড়ি বছরের মেয়েদের আমি মেয়ে মনে করি। এর নিচে সব মেয়েই বাচ্চা।

মুগ্ধ হয় ইলমা বেগম। সৎ মেয়ের প্রতি মহিলার এই গভীর অনুরাগ বিস্মিত করে তাকে। খানিকক্ষণ বাদে বলে ওঠে,

– আপনার কাছে একটা মূল্যবান জিনিস চাইতে এসেছি আপা। দিবেন?

চিন্তিত হয় তাসলিমা। হাসি কমে। কৌতূহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,

– কি আপা?

– আপনার মেয়েকে আমার ছেলের বউ হিসেবে চাই। না করবেন না আপা। আমার ছেলেটা লুকিয়ে লুকিয়ে আপনার মেয়েকে ভালোবাসে। অনেকদিন ধরে এই কথা পেটে আটকে রেখেছিল। আমি জেনে গিয়েছি। দরেই করিনি আর।

– ইহান? অবাক হন তাসলিমা খাতুন।

– তানিয়া এ কথা জানে না আপা। ইহানের মতে তানিয়া এসব জানলে সরাসরি না করে দিবে। বন্ধুত্ব ভেঙে দিবে।

‘ ইহানকে আমি চিনি। ইহানের মাধ্যমেই আমি তানিয়ার সাথে পরিচিত হয়েছি। আপনার ছেলে বুঝদার, ব্যক্তিত্ববান। কাজে কর্মে এবং রুপের দিক থেকে অতুলনীয়। ব্যক্তিগত ভাবে আমি ইহানকে খুবই পছন্দ করি। এমন একটা ছেলের সাথেই তানিয়াকে মানায়। আমার এ বিষয়ে আপত্তি নেই। তবে মেয়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারবো না আমি। ওর বাবাকে জানাই, ওকেও বলে দেখি। এরপর না হয় উত্তর দিবো। ও তো এডাল্ট। কোনো কিছুই চাপিয়ে দিতে পারি না আমি।

– তানিয়াকে একটু বুঝাবেন আপা। বন্ধুত্বে ফাটল ধরবে এটাই ভাববে মেয়েটা। আমার ছেলেটার সুখ আমি দেখতে চাই।

” আমার দিক থেকে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো আপা। আপনার প্রস্তাবে আমি খুশি।

________

“তোমার জন্য ছেলে-মেয়েকে ছাড়লাম। আরহামকে রাখতে চাইলাম, সেটাতেও তোমার আপত্তি। আমার সন্তান প্রয়োজন। বুড়ো হয়ে যাচ্ছি।

নেইলপলিশ নখে নিয়ে ফু দিল দীপা। বিরক্ত হলো স্বামীর এহেন কথায়। ঠোঁট ভেংচি দিয়ে বলল,
” বিয়ে হয়েছে মাত্র ছ মাস। এখনই বাচ্চা বাচ্চা করে ঘ্যান ঘ্যান করো না তো।

” আমি আমার অর্থ সম্পদের কিছুটা আরহাম আর প্রিয়তার নামে লিখে দিতে চাই। ওদের বাবা আমি। ভরণপোষণের দায়িত্ব আমি ছাড়া কে নিবে?

‘ দেখো গিয়ে তোমার মেয়ে এতদিনে কত ছেলে ধরেছে। একা একা দুই ভাইবোন টিকে থাকতে পারবে? তুমি বললেই হলো? ওদের কাছে টাকা-পয়সা আছে নাকি? তোমার মেয়ের যা রুপ তাতে কত ছেলেকে পটিয়ে টাকা আদায় করেছে দেখো গিয়ে। সবই জানি।

আরিফ হোসাইন রেগে গেল। দীপাকে আজকাল অসহ্য ঠেকটে তার। টাকা-পয়সা কেমন শাই শাই করে উড়ে যাচ্ছে। কোনো কিছুর হিসেব করতে পারছে না সে। আজকাল বুকে কেমন চিনচিন ব্যথা করে আরিফের। দুর্বল লাগে নিজেকে। স্ত্রীর নিকট এ কথা জানালে আমলে নেয় না দীপা। গ্যাস্টিকের ট্যাবলেট ধরিয়ে দেয় হাতে। সংসারে সুখ নেই। কোথাও একটা শূন্যতা রয়েছে। প্রিয়তার মুখ আজকাল খুব বেশিই মনে পরে। আরহামের অ্যাক্সিডেন্টের খরবটা প্রিয়তা দিয়েছিল। ছুটে গিয়েছিল হাসপাতালে। এক মিনিটের জন্য আরহামকে দেখতে দিয়েছিল প্রিয়তা। অতঃপর অপমান করে বের করে দিয়েছিল। আরিফ হোসাইন অবাক হয়েছিল ভিষণ। এই প্রিয়তাকে সে চিনে না। সে তার মেয়েকে কাঁদতে দেখেছে, তাচ্ছিল্যের স্বরে হাসতে দেখেছে, কিন্তু এমন তেজস্বী রুপ দেখেনি।

আরিফ হোসাইন সেসব এড়িয়ে বলল,,

” খাবার দাও।

” আগে বিকাশে টাকা পাঠাও তো। মা অসুস্থ দেখতে যাবো।

” এত টাকা দিতে পারবো না আমি। রোজ তোমার আত্মীয়স্বজন অসুস্থ হয় তাইনা?

” বাজে কথা বলবে না।

” তালাক দেবো আমি তোমায়।

” দাও। কোটি টাকার কাবিন করেছি। হাতে দাও সে টাকা। চলে যাবো।

_______

ঘুমানোর পূর্বে বিছানা গুছিয়ে নিল প্রিয়তা। আরহাম ঘুমিয়েছে। প্রিয়তার ও ঘুম পাচ্ছে ভিষণ। ক্লান্ত লাগছে বরাবরের মতো। কাল শুক্রবার। ভার্সিটি কিংবা টিউশন কোনোটাই নেই। প্রিয়তা ভাবল সকালে রান্না করবে না। দুপুর অবধি ঘুমিয়ে পরে রান্না করবে। ঘুমটা তার সত্যিই প্রয়োজন। বালিশে মাথা রাখার সাথেই সাথেই পুরোনো কথাগুলো মনে পরল বারবার। সিলেট থেকে চলে আসার সময়কার কথা মনে পরল।

উদ্যানে দাঁড়িয়ে ছিল প্রিয়তা। হাতে সাইলেন্সার লাগানো রিভলবার। অজানা ভয়ে গুটিয়ে নেয়ার প্রবল চেষ্টা চালাচ্ছিল সে। কিছু সময় চলে যাওয়ার পর ব্যথা না পেয়ে চোখ মেলে প্রহর। পিছনে আর্তনাদ আর গোঙানির শব্দ শুনে পিছু ফিরে সে। এক সুদর্শন, বলিষ্ঠ দেহের পুরুষকে লুটিয়ে থাকতে দেখে। বিস্ময় চেপে ধরে তাকে। দ্রুত লোকটার সামনে এগিয়ে আসে প্রহর। পায়ের মাঝে গুলি লেগেছে। বিষাক্ত বেদনায় ছটফট করছে লোকটা। প্রহর এক ঝলক প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে পুনরায় প্রিয়তার দিকে তাকালে প্রিয়তা ভয় পায়। ঘন ঘন শ্বাস ফেলে। রিভলবার ফেলে দৌড়ে চলে আসে উদ্যান থেকে। লোকটার পাশেই বোমা দেখতে পায় প্রহর। বুঝতে পারে তাকে মেরে ফেলার জন্যই লোকটা এসেছিল। আর প্রিয়তা তার মত বদলে লোকটাকে শ্যুট করেছে। ভাবতেই মৃদ্যু হাসে।

আরহাম যে হাসপাতালে এডমিট হয়েছে, লোকটাকে সেই হাসপাতালে ভর্তি করে প্রহর। জানতে চায় তাকে মারতে চাওয়ার কারণ। কিন্তু লোকটা বলে না। স্বীকার করে না কিছুই। তাকে টাকা দেওয়া হয়েছিল প্রহরকে মারার জন্য। যে টাকা দিয়েছে তাকে এই লোকটা চিনে না। দেখেওনি কোনোদিন। টাকা দেওয়া ব্যক্তির একজন চামচা এসে টাকাগুলো দিয়ে গিয়েছিল লোকটাকে। এর বেশি আর কিচ্ছু নাকি জানে না আহত লোকটা। প্রহরের সবকিছু অগোছালো লাগে। সেসময় ইনভেস্টিগেশন করার অবস্থায় সে নেই। আরহামের জন্য মানসিক ভাবে ভেঙে গিয়েছিল প্রহর। সব কিছুর জন্য নিজেকে দায়ী করছিল বারংবার। প্রিয়তাকে হাসপাতালে সেসময় দেখতে পায়নি প্রহর। করিডোরে মেয়েটার জন্য অপেক্ষা করছিল। সান্ত্বনার বাণী ছুড়তে চেয়েছিল প্রিয়তার দিকে। এদিকে অপারেশনের অনেকগুলো জন্য টাকা লাগবে। সেই টাকার খোঁজ করতে গিয়েছিল প্রিয়তা। টাকার চিন্তায় ভুলে গিয়েছিল পাপ-পূণ্য। কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। মাথায় চাপল সেসময় দুষ্টু বুদ্ধি। বাড়িতে ফিরল প্রিয়তা। সবসময় বহন করা ছোট পার্সটার চেইন খুললো। আরিফ আর প্রীতিলতা সকালে অফিসে যেতো। বাড়িতে থাকতো প্রিয়তা আর আরহাম। আরহামের দেখভাল করা মহিলাকে ছাড়িয়ে দিয়েছিল সে। রান্না করার মহিলা সকালে এসে রান্না করেই চলে যেতো। সেসময় প্রিয়তার পার্সে বাড়ির একটি চাবি থাকতো। কখনো কখনো প্রয়োজন হতো চাবিটির। প্রিয়তা তো চাবিটা ফেলে আসেনি। কোনো মতো শুধু টাকা পার্সে ভরেই চলে এসেছিল বাড়ি ছেড়ে। প্রিয়তা বুদ্ধি আটল। কল করল আরিফকে। আরহামের অ্যাক্সিডেন্টের কথা জানাল। প্রিয়তা জানতো আরিফ তার স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতালে আসবেই। আরহামের প্রতি সহানুভূতি কিংবা দায়িত্ববোধের কারণে হলেও আসবে। ঠিক তাই হলো। প্রিয়তা নিজের বাড়িতে গিয়ে কাউকেই পেল না। তালা খুলে ঘরে প্রবেশ করল। আরিফ হোসাইন সব চাবি নিয়ে ঘুরে বেড়ায় না। চাবি রাখার গোপন জায়গা আছে তার। প্রিয়তা চাবি চুরি করে আলমিরা খুলে দীপার একটি ডায়মন্ডের ব্রেসলেট আর আরহামের আংটি চুরি করল। প্রতিজ্ঞা করল জীবনে কখনো বড়সড় মাপের টাকা ইনকাম করতে পারলে এই ব্রেসলেটের সমপরিমাণ টাকা ছুড়ে মারবে দীপার মুখে। অতঃপর সেই টাকা দিয়েই আরহামের অপারেশন হলো। কিন্তু আরহামের জ্ঞান ফেরার নামগন্ধ নেই। প্রহর অভিমানের বশে কথা বলছিল না প্রিয়তার সাথে। প্রিয়তার ও এসব ভাবার সময় ছিল না। আরহামকে এক মিনিটের জন্য দেখতে দিয়ে আরিফ হোসাইনকে অপমান করে বের করে দিয়েছিল হাসপাতাল থেকে।

এরপর আরহাম বেঁচে গেল। হাসপাতালে রইল তিনদিন। এর মধ্যে কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিল প্রিয়তা। চুরি করার অপবাদ নিয়েও ভয়ে ছিল তার মনে। বাড়িতে ফিরে মিসেস নাবিলার সাথে দেখা করল। বলল,
” আমরা এ শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি আন্টি। আপনাকে বলে যাচ্ছি। প্রহর এ কথা জানে না। উনাকে আমি জানাতেও চাই না। সিম বন্ধ করে ফেলবো আমি। আপনার ছেলের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখবো না।

এরপর ব্যাগ থেকে একটি কাগজ বের করে মিসেস নাবিলার হাতে দিয়ে বললো,

” এই কাগজটা উনাকে দিবেন। চাইলে আপনি পড়েও দেখতে পারেন। এতে আমাদের ঠিকানা লেখা নেই। ভালো থাকবেন আন্টি। আপনাকে মনে রাখবো।

এটুকু বলেই হাসপাতাল থেকে আরহামকে নিয়ে শহর ছেড়েছিল প্রিয়তা। প্রহর তখন থানায় তিনদিনের চাপ সামলাতে ব্যস্ত। প্রিয়তা তন্ময়ের থেকে কিছু টাকা যোগাড় করেছিল। টিউশনির কিছু টাকা নিয়ে নতুন পরিবেশে প্রিয়তা যেদিন পা রাখল বুঝতে পারল সংগ্রাম এখনো অনেকটা বাকি। কিংবা এখান থেকেই শুরু সব। ঢাকা শহরের অলিগলিতে টিকে থাকতে হলে পয়সা থাকতে হয়। নইলে বেদনা নিয়ে ত্যাগ করতে হয় শ্বাস।

আর ভাবতে পারল না প্রিয়তা। বিষাদে ছেয়ে গেল হৃদয়। ঘুমের অতল গভীরে তলিয়ে যাওয়ার আগে ছোট্ট শরীরটাকে বক্ষস্থলে জড়িয়ে নিল। চুমু খেল ছেলেটার নাকের ডগায়। চিকন অশ্রু গড়াল চোখ বেয়ে।

___

ঘুমোনোর আগমুহুর্তে প্রহর বেলকনিতে এসে দাঁড়াল। মিসেস নাবিলার সাথে মনোমালিন্য চলছে প্রহরের। নাড়ির টান কেই বা অমান্য করতে পারে? প্রহর ও পারে না। প্রহর ভালোবাসে তার মা কে। মাঝে মাঝে ফোন দিয়ে কথা বলে। কেমন আছে, কি করছে এটুকুই জিজ্ঞেস করে। আর কি কথা বলবে ভেবে পায় না প্রহর। প্রিয়তা চলে আসার পরেও মিসেস নাবিলা প্রিয়তার বদনাম করেছে প্রহরের সামনে। প্রিয়তার পরিবারের মানুষজন নেই, সহায়-সম্পদ কিংবা বংশ পরিচয় নেই বললেই চলে। এমন মেয়ের সাথে নিজের ছেলের বিয়ে দিতে পিয়াসের মতো মিসেস নাবিলাও নারাজ ছিলেন। প্রিয়তা চলে যাবার সময় তিনি প্রিয়তাকে আটকাননি। বরং চলে যেতে বাধ্য করেছেন একপ্রকার। খুশি হয়েছেন প্রিয়তার চলে যাওয়ায়। প্রিয়তার পরিবার নেই এটাই যেন প্রিয়তার সবচেয়ে বড় খুঁত বলে ধরে নিয়েছেন তিনি। প্রহর যেন প্রিয়তাকে ভুলে যায় সেজন্য অনেক চেষ্টা করেছেন। এমনিতেই প্রিয়তা চলে গিয়েছে বলে প্রহর সেসময় হতাশায় ভুগছিল, সেই মুহুর্তে মিসেস নাবিলার প্রিয়তার এত খুঁত তুলে ধরার বিষয়টি ভালো লাগেনি প্রহরের। যেজন্য বাড়ি ছেড়েছিল সে। মাকে বোঝাতে চেয়েছিল আপন মানুষ, ভালোবাসার মানুষ দূরে সরে গেলে কেমন লাগে।

মায়ের নম্বরে কল করল প্রহর। ফোন ধরলেন মিসেস নাবিলা। প্রহর গাঢ় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,

” কেমন আছো মা।

অত্নরাত্মা কেঁপে ওঠে মিসেস নাবিলার। ছেলের এহেন নরম কণ্ঠ শুনে ভালো বোধ করে। ছেলেটা কতদিন ধরে হাসিমুখে কথা বলে না তার সাথে। ভাবতেই এক রাশ অনুতপ্ততা ঘিরে ধরে তাকে। প্রিয়তা চলে যাওয়ার পর ছেলেটা কেমন ছন্নছাড়া, অশান্ত, অস্থির হয়ে গিয়েছিল। বারংবার প্রিয়তাকে খুঁজতো আশেপাশে। সবটাই দেখেছেন তিনি। তবুও পরিবারহীন মেয়ের সাথে ছেলের সম্পর্ক মানতে পারেননি। ছেলের ভালো চাইতে গিয়ে খারাপ করে ফেলেছিলেন। নরম কণ্ঠে তিনি বলেন,

” ভালো আছি বাবা। তুমি কেমন আছো?

” ভালো আছি।

” খেয়েছো।

” হ্যাঁ। তুমি?

” খেয়েছি।

” তোমাকে একটা কথা বলার আছে।

” হুম বলো না।

” প্রিয়তাকে খুঁজে পেয়েছি।

মিসেস নাবিলা প্রচণ্ড খুশি হলেন। উত্তেজিত হলেন ভিষণ। ততক্ষণাৎ জিজ্ঞেস করলেন,

” প্রিয়তা, প্রিয়তা কেমন আছে? কোথায় আছে? আরহাম কেমন আছে? প্রিয়তার সাথে দেখা করেছো? বলেছো আমার কথা?

” তোমার সাথে কথা বলিয়ে দিবো। ও ভালো আছে। আমার থানা থেকে কিছুটা দুরত্বেই ওরা ভাড়া থাকে।

” তুমি ওকে নিয়ে এসো। আমি দেখতে চাই ওকে। আমার মন মানছে না। ওকে বিয়ে করে নিয়ে এসো এখানে। তোমার বাবা প্রিয়তাকে মেনে নিয়েছে। চলে এসো। আমরা একসাথে থাকবো।

” খুব শীঘ্রই আসবো। তুমি চিন্তা করো না। অস্থির হয়ো না। আমরা একসাথেই থাকবো।

মিসেস নাবিলা খুশি হন। ততক্ষণাৎ ফোন করেন প্রবাসী স্বামীকে। বলেন,
” শুনছো, প্রিয়তাকে খুঁজে পাওয়া গেছে। ছেলেটা আবার আগের মতো হয়ে যাবে দেখে নিও। তুমি ছুটি নিয়ে আসবে তো বিয়েতে?

চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

প্রিয়তার প্রহর ২ পর্ব-০৪

0

#প্রিয়তার_প্রহর
পর্ব সংখ্যা (৪)

সন্ধ্যার মাঝামাঝি। কুচকুচে অন্ধকার আশপাশে। বাড়ির ভেতর থাকা সব বাল্প নেভানো। আরহামের চোখেমুখে বিস্ময়। সে স্বপ্ন দেখছে মনে হচ্ছে। ছোট্ট হাত দ্বারা চোখ ডলে আবারো সামনে তাকাল সে। গোলাকার চোখ উজ্জল হলো মুহুর্তেই। ঝাঁপিয়ে পরল সামনে থাকা মানুষটার বক্ষস্থলে। আঁকড়ে ধরল মানুষটার শার্টের অংশ। পেশিবহুল বুকের আচ্ছাদনে মিইয়ে রইল। অভিমানে নত হলো আরহামের মুখশ্রী। বলে উঠল,

” তুমি এতদিন আসো নি কেন? আমি তোমাকে মিস করেছি।

প্রহরের মুখে স্লান হাসি। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল আরহামের মোলায়েম শরীরটাকে। চোখ চিকচিক করে উঠল প্রহরের। এতদিন পর বাচ্চাটাকে কাছে পেয়ে আবেগাপ্লুত হলো। বক্ষস্থলের উন্মাদনা টের পেল। চোখ পরল সদর দরজার দিকে। প্রিয়তার অস্তিত্ব টের পেল না সেথায়। আরহামের ললাটে গাঢ়ভাবে চুম্বন করল সে। গালে গাল ঘসে বলে উঠল,

” তুমিও তো আমার খোঁজ নাও নি। আমি তো তবুও এলাম।

” তোমার ফোন নম্বর আপুর ফোনে নেই। কিভাবে ফোন দিবো বলো? আপুকে বারবার বলেছি তোমার সাথে কথা বলতে চাই। শোনেইনি। আপু এখন সারাদিন আমায় বকে জানো? সবসময় রেগে থাকে।

” তোমার আপু বড্ড পাষাণ, নির্দয়া। প্রেমের উত্তাপে আমাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভষ্ম করার পরিকল্পনা করেছে সে। আমাকে রক্তাক্ত, জখম, ছন্নছাড়া করার প্রক্রিয়া চালাচ্ছে।

আরহাম পিটপিট করে তাকিয়ে রইল। প্রহরের গায়ে শুভ্র শার্ট আর কালো প্যান্ট। গলায় ঝুলিয়ে রেখেছে কালো টাই। চুলগুলো এলোমেলো। জোড়া ভ্রুদ্বয় যেন আর্ট করা। স্নিগ্ধ হাসি প্রহরের মুখে। সতেজ লাগছে খুব। আরহাম বলে উঠল,
” তুমি আমায় মিস করেছো?

– খুব করেছি।

প্রিয়তা বেরিয়ে এসেছে সদর দরজার সামনে। আরহামকে প্রহরের কোলে দেখে হাসল সে। এগিয়ে এলো প্রহরের অতি নিকটে। প্রিয়তার গায়ে হলদে রঙের জামা। বড় ওড়না দ্বারা শরীরের অর্ধেকাংশ ঢেকে রাখা। চুলগুলো আলতো করে খোঁপা করে রেখেছে। অন্ধকারে আচ্ছন্ন এই এলাকাটিতে রঙ না থাকলেও প্রিয়তার ওষ্ঠাদ্বয়ে লেগে থাকা গোলাপি রঙের লিপবাম চিকচিক করছে। প্রহর দৃষ্টি মেলল অসাবধানতায়। প্রহরের এমন সম্মোহনী দৃষ্টি নজর এড়াল না প্রিয়তার। সেসব এড়িয়ে প্রশ্ন করলো,

” এখানে হঠাৎ কি করতে এসেছেন ইন্সপেক্টর?

আরহামকে কোলে রেখেই প্রিয়তার উদ্দেশ্যে বাঁকা হেসে প্রহর বলে উঠল,

” এখানে আসার প্রথম রিজন আপনারা। আপনাদের দেখতে এসেছি। অ্যান্ড সেকেন্ড রিজন হলো মেলায় আসা। সামনে যে মেলা বসেছে সেই মেলার আয়োজনের সব দায়িত্বে রয়েছে শফিক শাহ্। উনার জমিতেই মেলাটা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি উনি। মেলায় যেন গোলমাল, হানাহানি, চুরি-ডাকাতি, গ্যাঞ্জাম না হয় এজন্যে আমাদের ফোর্সকে টহল দিতে বলেছে। আমি টিমকে সবটা বুঝিয়ে দিতে যাচ্ছি।

” আপনি বললে আমরাই যেতাম থানায়। এই সন্ধ্যায় এখানে এসেছেন কেন? বাড়িওয়ালী জানলে ভিষণ রাগারাগি করবেন। তিল কে তাল করে ফেলবেন। কতশত কুৎসিত বাক্য ছুড়বে আমার অগোচরে জানেন?

” সেসব আমি দেখে নিবো। আমি আপনাকে নিতে এসেছি প্রিয়।

” কোথায়।

” মেলায়।

অধরযুগলে দাঁত চেপে হাসল প্রিয়তা। বলল,
” আপনি এমন ভাবে বললেন যেন আমি আপনার বিয়ে করা বউ। রাগ করে চলে এসেছি বলে আপনার ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছেন।

” আপনি চাইলে সেটাও করতে পারি।

‘ থাক, আরহাম মেলায় যেতে চেয়েছিল। ওকে নিয়ে যান তবে।

” আপনি যাবেন না?

” আমি কেন যাবো?

” চলুন প্রিয়তা। কতদিন আমাদের ভালো করে কথা হয় না। চলুন আমাদের সাথে। আরহামের ভালো লাগবে।

প্রিয়তা থামে। মিইয়ে যায়। কণ্ঠরোধ হয়। অজানা ভালো লাগায় আপ্লুত হয় মন। নির্নিমেষ তাকিয়ে রয় সম্মুখে। জড়তা চেপে ধরে বক্ষস্থলে। অস্থিরতা চলমান রয়ে যায়। আরহামের মলিন মুখ নজরে পরল প্রিয়তার। আরহাম ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বললো,

” চলো না আপু। আমি কিচ্ছু খাবো না। কিনবোও না। শুধু দেখবো।

প্রিয়তা ঘরে ফিরে আসে। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে ঘরে থেকে লোহার ছোট্ট তালা বের করে দরজা বন্ধ রেখে তালা দেয়। ওড়নার কোণা থেকে বের করে কয়েকটা খুচরো নোট। হাতের মুঠোয় পুড়ে এগিয়ে আসে প্রহরের সামনে। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে মাথা নত করে বলে ওঠে, ” চলুন”।

আরহাম খিলখিলিয়ে হাসে। হাত তালি দেয় শব্দ করে। প্রহরের হাসি গাঢ় হয়। প্রশান্তিতে ছেয়ে যায় হৃদয়। সাহসটা বেড়ে যায় যেন। আচমকা তড়িৎ বেগে আলতো করে ধরে প্রিয়তার কব্জি। অতি নিকটে এসে ধরা দেয় প্রিয়তা। অক্ষিযুগল ধারাল হয়। বিস্ময়ে বিমূঢ় হয় প্রিয়তা। লজ্জায় মূর্চ্ছা যায়। তবুও তেজ কমে না। ঝাঁঝ আর তেজ দেখিয়ে সে বলে উঠে,

” কি করছেন? হাত ছাড়ুন।

” ছাড়বো না। আজীবন ধরে রাখার যেই শপথ আমি করেছি সেই শপথ ভাঙার প্রশ্নই ওঠে না।

” লোকে দেখে ফেলবে প্রহর। আমি কিন্তু যাবো না এমন করলে। মাত্রা ছাড়াবেন না।

প্রহর ছেড়ে দিল। আরহামকে ভালো করে কোলে নিল। নিস্তব্ধ রজনীতে দুরত্ব বজায় রেখে হাঁটল দুজন। শনশন বাতাসে দুলে উঠল প্রিয়তার চোখের সামনের চুলগুলো। ঘাড় বাঁকিয়ে লম্বাটে, বলিষ্ঠ দেহের লোকটার পানে নজর আটকাল। কিছুটা ভয় হলো প্রিয়তার। তটস্থ চিত্তে দমিয়ে রাখল নিজেকে। একটা দিনই তো। এরপর না হয় লোকটাকে জীবন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করবে।

___________

থানায় পৌঁছানোর পর ইহানকে কোথাও দেখতে পেল না তানিয়া। কনস্টেবলকে জিজ্ঞেস করলে উত্তর আসে ” ইহান স্যার তো আজ থানায় আসেনি”। তানিয়া হতবাক। এ দুদিন থানায় আসতে না পারার জন্য ইহান ছটফট করছিল। আজ যখন সিলেটেই আছে তখন থানায় আসল না কেন? প্রশ্ন জাগে তানিয়ার মনে। তৎক্ষণাৎ প্যান্টের পকেটে রাখা মুঠোফোন বের করে আঙ্গুল চালিয়ে ইহানের নম্বরে ডায়াল করে। ফোনের ওপাশ থেকে নারীকণ্ঠে কেউ বলে উঠে,

Sorry, The number you have dialed is currently unreachable. Please call later or leave a massage..

তানিয়া এইবার একটু বেশিই চমকাল। ইহান স্যারের ফোন অফ থাকে না কখনো। হঠাৎ ফোন বন্ধ করে থানায় না আসার কারণটা ধরতে পারল না তানিয়া। মাথার ক্যাপটা খুলে শার্টের কলার ঠিক করতে করতে অটো ধরল সে। দ্রুত পৌঁছাল ইহানের বাড়ি। ইহান স্যার না থাকলেও উনার আম্মা তো থাকবে। এইভেবে বাড়িতে পা রাখল তানিয়া। ড্রইংরুমের মেঝেতে ইলমা বেগম কে বসে থাকতে দেখল। ইলমা বেগম কাঁথা সেলাই করছেন। চোখে চারকোণার চশমা। সুচ ফুটিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে কাজটি করছেন তিনি। তানিয়া এগিয়ে গিয়ে বসল সোফায়। জিজ্ঞেস করল,

” এত ছোট কাঁথা কার জন্য আন্টি?

ইলমা বেগম হাসলেন। বললেন,

” আমার ভবিষ্যত নাতি-নাতনির জন্যে। তুমি কেমন আছো মা?

” ভালো আছি আন্টি। আপনার শরীর ঠিক আছে? ইহান স্যার কোথায়?

” আমি ভালো আছি। ইহান তো ঘুমোচ্ছে।

” ঘুমোচ্ছে?

” আর বলো না, ছেলেটা এত চিন্তায় থাকে যে ভালোমতো ঘুমোতেই পারে না। এজন্যে সকাল সকাল ওর ফোন অফ করে রেখেছি আমি। এলার্ম বাজেনি তাই ঘুম থেকেও ওঠেনি। আমিও ডাকতে যাইনি।

” উনাকে তো আজকে একটু থানায় যেতে হতো আন্টি। আমি আজ থানায় থাকবো না বেশিক্ষণ।

” ওহ। অনেক বেলা হয়েছে। যাও এখন ওকে ডাকো গিয়ে। এখন যেতে পারে।

তানিয়া ধীর পায়ে নির্দিষ্ট কক্ষে এলো। ইহানের ঘরটা বরাবরের মতোই গোছানো, পরিপাটি। ঘরের দেয়ালে সুন্দর সুন্দর পেইন্টিং। উদাম গায়ে সফেদ বিছানায় শুয়ে আছে ইহান। কোকড়া চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। রোমশপূর্ণ বুকটা দেখে থতমত খেল তানিয়া। ইহানের বুক অবধি কাঁথা দিয়ে ঢেকে রাখা। এসি চলছে ঘরে। এভাবে ইহানকে দেখে একটু ভড়কাল তানিয়া। নিঃশব্দে এগিয়ে এলো বিছানার দিকে। ডেকে উঠল নরম স্বরে। উঠল না ইহান। পুনরায় ডেকেও লাভ হলো না। তানিয়া এইবার একটু জোরেই ডেকে উঠল।

” ইহান স্যারররররর।

ধরফরিয়ে উঠে বসল ইহান। ড্যাবড্যাব করে তাকাল তানিয়ার পানে। হুট করে জেগে ওঠায় মাথায় একটা চিনচিন ব্যথার উৎপত্তি হলো। খানিক বিরক্ত হলো ইহান। চোখ ছোট ছোট করে ফেলল। ললাটে ভাঁজ দেখা দিল। পাশে থাকা ছাই রঙা শার্ট জড়িয়ে নিল শরীরে। বললো,

” এভাবে চিৎকার করছো কেন তানিয়া? উফফ মাথা ধরিয়ে দিলে।

” ক’টা বাজে সে খেয়াল আছে? থানায় যাবেন না?

” কটা বাজে? আমি তো এলার্ম দিয়ে রেখেছিলাম।

” আনফরচুনেটলি আন্টি আপনার ফোন অফ করে রেখেছে যাতে আপনি অনেকক্ষণ ঘুমোতে পারেন। এখন বাজে এগারোটা। উঠুন জলদি।

ইহান উঠে দাঁড়াল। আম্মার উপর ভিষণ রাগ হলো তার। এমনিতেই দুদিন গ্যাপ দিয়েছে। উপর মহল থেকে চাপ দিচ্ছে। এখন এভাবে লেইট করে থানায় যাওয়া বেমানান। ইহান ব্রাশ মুখে গিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকল। পাঁচ মিনিটের মাথায় পুলিশ ইউনিফর্ম গায়ে জড়িয়ে বের হলো সে। রিভলবার কোমড়ে গুঁজে নিয়ে পা বাড়াল বাইরে। ইলমা বেগম টিফিন দিলেন হাতে। তা নিয়েই বেরিয়ে পরল ইহান আর তানিয়া। ইহানের গাড়ি চলতে লাগল স্বাভাবিক গতিতে। দু মাস আগে মাইক্রোটা কিনেছে ইহান। ড্রাইভার ও রেখেছে। ইহান আর তানিয়া পেছনে বসেছে। তানিয়া ইহানের ভাবভঙ্গি বুঝে বলল,

” আমি দুপুর পর্যন্ত থানায় থাকবো। দুপুরের দিকে বাড়ি ফিরতে হবে আমাকে।

” কেন?

” আজ ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে আমায়। আন্টি বলেছে তাড়াতাড়ি ফিরতে।

” ও।

” আপনি কবে বিয়ে করবেন স্যার? আন্টিকে দেখলাম নাতি-নাতনির জন্য কাঁথা সেলাই করছেন। অথচ আপনার বিয়ের কোনো নামগন্ধই নেই। বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন তো।

শেষের কথাটা তানিয়া খুব ভয়ে ভয়েই বলে উঠল। ইহান নামক মানুষটা রাগী, বদমেজাজি। কখন, কোন কথা বলে কাকে কষ্ট দিবে তা সে নিজেই জানে না। থানার লোকজন খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা না হলে ইহানকে সে কথা বলতে আসে না। তানিয়ার মাধ্যমেই সব কথা ইহানের নিকট পৌঁছায়। ইহানকে এরূপ কথা বলার সাথে সাথেই ধুকবুক করে উঠল তানিয়ার বুক। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে রইল ইহানের পানে। এই বুঝি ইহান তেতে উঠে দু কথা শুনিয়ে দিল, ধমক দিল। তানিয়া অপেক্ষা করলো বিস্ফোরন সামলাবার জন্য। ভীত হলো মুখশ্রী। চক্ষুদ্বয় বুজে নিল ভয়ে। কিন্তু ঝাঁঝালো স্বর শুনলো না। আড়চোখে তানিয়ার দিকে তাকিয়ে ইহান বলে উঠল,

“সত্যিই বুড়ো হয়ে যাচ্ছি?

তানিয়া যেন প্রাণ ফিরে পেল। বোকা হাসল সে। উক্ত কথায় সাহস পেল কিছুটা। দ্বিধা আর জড়তা নিয়ে বললো,

” হ্যাঁ। বিয়ের বয়স তো পেরিয়ে যাচ্ছে আপনার। আমার ও বয়স পেরিয়ে গিয়েছে। এজন্য আন্টি জোড়াজুড়ি করছেন বিয়ের জন্য।

ইহান চুপ রইল। গ্লাসের বাইরে থাকা পরিবেশ দেখতে লাগল। ততক্ষণাৎ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সত্যিই তো। বয়স তো পেরিয়ে যাচ্ছে। জীবন সঙ্গী নির্বাচন করা আসলেই প্রয়োজন। ইলমা বেগমের নাতি-নাতনি নিয়ে খেলার অধিকার আছে। বিয়ে না করলে সে ইচ্ছে পূরণ হবে কিভাবে আম্মার? ভাবতে বসল ইহান। তানিয়ার দিকে তাকাল কয়েক পল। তানিয়ার বুদ্ধিমত্তা প্রখর। তবু কেন মেয়েটা ইহানের অনুভূতি বুঝতে পারে না? নাকি বুঝে? বুঝে না বোঝার ভান করে?

______

স্কুল থেকে ফিরে আরহাম টিভি দেখছে। সাথে খেলনা খাটে বিছিয়ে রেখেছে। মটু পাতলু কার্টুনটা তার প্রিয়। দেখতে বসলে হাসতে হাসতে পেটে খিল লেগে যায় ছেলেটার। প্রিয়তার আজ দুটো টিউশনি ছিল। সেগুলো শেষ করে বাসায় ফিরল বাজার নিয়ে। কলমি শাক আর বেগুন ভাজা করবে ভেবেছে প্রিয়তা। বেগুন ভেজে চটকে ভাত মাখালে আরহাম খুব ভালো খায়। গত রাতে মেলায় গিয়ে জিলাপি, খুরমা কিনেছিল প্রিয়তা। কেনার পর বয়ামে আটকে রেখেছে। ভাত না থাকলে আরহামকে খেতে বলেছে ওগুলো। মেলায় প্রহরের সাথে আরহাম অনেকক্ষণ ঘুরেছে। নাগরদোলায় চড়ছে, ট্রেইনে চড়েছে, আচার আর জুস খেয়েছি। এদিক ওদিক ঘুড়ে বেরিয়েছে। বাধ্য হয়ে প্রিয়তাও ওদের পিছু পিছু হেঁটেছে। প্রহর কয়েক মিনিট পর পর এটা ওটা প্রিয়তাকে কিনে দিতে চেয়েছে। প্রিয়তা নেয়নি সেসব। চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে ছিল শুধু। চিল্লাচিল্লি করেছে অনেকবার। আরহামের জন্য খেলনা কিনে দিয়েছে প্রহর। সেসব পেয়ে আরহাম খুব খুশি।

বাজারের ব্যাগটা রেখে প্রিয়তা জিজ্ঞেস করলো,

” খেয়েছো?

” ভাইয়া বলেছে দুপুরে খেতে না। আমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবে। ভাইয়ার সাথে খাবো।

” কোথায় যাবে তুমি?

” জানি না।

” দ্রুত ফিরবে। আমি যেন বাসায় এসে তোমাকে পাই।

” আচ্ছা।

বলতে না বলতেই বাইকের শব্দ শোনা গেল। আরহাম তড়িৎ গতিতে খাট থেকে লাফিয়ে সদর দরজার কাছে গেল। প্রিয়তাও পিছু ছুটল। আরহামকে নিয়ে কোথায় যাবে তা তার জানা প্রয়োজন। বাইরে এসে প্রহরের মুখটা দেখতে পেল প্রিয়তা। প্রহরের গায়ে নীল রঙের শার্ট।শার্টের দুটো বোতাম খোলা। হাতা ফোল্ড করে রাখা। ঠোঁটে নিদারুণ হাসি। প্রহরের নজরকাড়া রুপে যে কোন মেয়েই ঘায়েল হতে বাধ্য। সবাই বলে ভালোবাসা রুপ দেখে হয় না। এটা মিথ্যে। প্রিয়তা যেমন প্রহরের ব্যক্তিত্বে মজেছে, ঠিক তেমনি প্রহরের সৌন্দর্যে ঘায়েল হয়েছে। মাঝে মাঝে প্রিয়তার খুব করে বলতে ইচ্ছে হয়,

” আপনি সুন্দর বলে আপনাকে ভালোবাসি না ইন্সপেক্টর সাহেব। আপনাকে ভালোবাসি বলেই পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ আপনাকেই লাগে।

প্রহর হুট করেই বাইক থেকে নেমে দাঁড়াল। শার্টের কলার ঝাঁকিয়ে আচমকা প্রিয়তার অতি নিকটে এসে দাঁড়াল। প্রিয়তার বক্ষপিঞ্জর কেঁপে উঠল। অস্থির হয়ে উঠল মুহুর্তেই। ঘন ঘন শ্বাস ফেলল। আশপাশে তাকিয়ে লোকজনের উপস্থিতির দিকে খেয়াল রাখল। প্রহর ঝুঁকে এলো প্রিয়তার কপোলের দিকে। তাকিয়ে রইল কয়েক পল। প্রিয়তার বাহুতে পেশিবহুল হাতের চাপ প্রয়োগ করল। বাকরুদ্ধ প্রিয়তা। শ্বেতজ্বল গড়াল ললাট বেয়ে। নাসিকারন্ধ্রে পারফিউমের কড়া সুগন্ধ পেল। তীক্ষ্ম, তুখোড় চোখ দ্বারা আশপাশ পর্যবেক্ষণ করে প্রহর ওষ্ঠাধর কিঞ্চিৎ ফাঁক করে একজোড়া শুষ্ক, শীতল ওষ্ঠাদ্বয় দ্বারা সশব্দে, সজোরে চুমু খেল প্রিয়তার ললাটের মধ্যিখানে। বলে উঠল,

” আপনাকে আমার করে নিলাম প্রিয়। সিল মেরে দিলাম। এটা ট্রেইলার ছিল। পিকচার আভি বাকি হ্যায় মেরা জান।

শিরশির করে উঠল প্রিয়তার শরীর। কম্পিত হলো হৃদয়। ইষৎ কেঁপে উঠল। হৃদস্পন্দন থেমে গেল যেন। বরফের ন্যায় জমে গেল খানিকক্ষণের জন্য। দূরে সরে গেল ততক্ষণাৎ। ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইল। মস্তিষ্ক কাজ করল না প্রিয়তার। কাঠের মতো জড় বস্তুর ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল। কথা আটকে গেল গলায়। একটু আগে কি হলো তা ভেবে কান্না পেল প্রিয়তার। নোনাজল গড়াল চোখ বেয়ে। নাকের পাটা ফুলে উঠল। রাগ হলো অনেকটা। চোখ পাকিয়ে তাকাল। ধমক দেবার আগেই আরহামকে কোলে নিয়ে বাইক স্টার্ট দিলো প্রহর। শো শো করে ছুটে গেল বাইক। নিমিষেই উধাও হলো দুজন। ধুলোবালি উড়ল প্রিয়তার সম্মুখে। দেখা গেল না প্রহরের অবয়ব।

_______

রাত নয়টার দিকে বাড়ি ফিরল ইহান। ঘর্মাক্ত শরীরে ঘরে ঢুকল সে। ঘুম পাচ্ছে খুব। অলসতা ঝেঁকে বসেছে। বাড়িতে ফিরেই গোসল করে নিল ইহান। টাওয়াল দিয়ে সিল্কি চুলগুলো মুছতে মুছতে ওয়াশরুম হতে বের হলো। বিছানায় সালোয়ার কামিজ পরে বসে আছেন ইলমা বেগম। ছেলেকে দেখে টেবিল থেকে পোলাও আর মাংসের বাটিটা বিছানায় রাখলেন তিনি। বললেন,

” তাড়াতাড়ি খাবি আয়।

ইহান হাসল। ভালো লাগায় ছেয়ে গেল হৃদয়। কোনোরকমে মাথা মুছে বিছানায় বসল পা ভাঁজ করে। মাংসের বাটি থেকে খানিক মাংস আর ঝোল পোলাওয়ের বাটিতে ঢেলে নিল। হাত দ্বারা নেড়েচেড়ে মুখে নিল খাবারটুকু। হেসে বলে উঠল,

” আম্মা।

” কি?

” তোমার হাতের রান্না বেস্ট। খুবই সুস্বাদু।

” ভালো করে খা।

ইহান খেতে লাগল। ইলমা বেগম খানিক সময় নিয়ে বললেন,

” বিয়ে কবে করবি আব্বা?

হাত থেমে গেল ইহানের। মাথা উঁচু করে চাইল আম্মার পানে। পুনরায় খেতে আরম্ভ করল। একটু চুপ থেকে বলল,

” করবো আম্মা।

” কবে করবি? তানিয়ার বিয়ে হয়ে গেলে?

দ্রুত মাথা উঁচিয়ে বিস্ময় নিয়ে আম্মার পানে তাকাল ইহান। থতমত খেল একটু। পানি ঢকঢক করে গলায় ঢেলে নিল। এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে উঠল,

” কি বলছো আম্মা?

ইলমা বেগম টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটি বই বের করলেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের “প্রথম আলো” বইটা ইহানের সামনে রাখলেন তিনি। হকচকিয়ে গেল ইহান। এই বইটা তার ঘরের বুকশেল্ফে থাকে। অনেকদিন ধরে ধরা হয়নি বইটা। ইলমা বেগম যে বেছে বেছে এই বইটাই পড়ার জন্য নিবেন তা ভাবেনি ইহান। ইলমা বেগম ছেলের এহেন হকচকিয়ে ওঠাটা ভিষণ উপভোগ করলেন। বললেন,

” কি ভেবেছিস? আমি কিছুই বুঝবো না? বইয়ের ভাঁজে চিঠি দেখেই আমি পড়তে শুরু করলাম। প্রথমে পড়তে চাইনি বিশ্বাস কর। পরে ভাবলাম ছেলের প্রতি মায়ের অধিকার সবচেয়ে বেশি। মায়ের কাছে ছেলের পার্সোনাল জিনিস আবার কি? জানার অধিকার তো আমার আছে।

” আচ্ছা। কি বুঝলে পড়ে?

” তানিয়াকে ভালোবাসিস। মেয়েটার উদ্দেশ্যে চিঠি লিখেছিস। কিন্তু সে চিঠি পাঠাসনি তানিয়ার কাছে। কেন?

” আমার ভালোবাসাটা একতরফা আম্মা। এমন শত শত চিঠি আমি লিখেছি তানিয়ার নামে। সেসব চিঠি প্রেরণ করা হয়নি। ইউনিফর্ম গায়ে দিলে আমি তানিয়ার স্যার হই। আর নরমাল ড্রেসআপে আমি শুধু মাত্র ওর বন্ধু। এর বেশি ও আমাকে কিছু ভাবে না।

” ওকে বলেছিস তোর ভালোবাসার কথা? মেয়েটাকে আমার ও খুব পছন্দ রে। কি সুন্দর ওই দুদিন আমার খেয়াল রাখল। ব্যবহার ও অনেক ভালো। ছেলের বউ হিসেবে তানিয়াকে মেনে নিতে আমার কোনো আপত্তি নেই।

” ভালোবাসার কথা বলা হয়নি। বন্ধুত্ব ভাঙতে চাইনি আমি। নিজের অনুভূতির কথা জানালে তানিয়া হয়তো আমার সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথাই বলতে পারবে না।

” তাহলে কি অবিবাহিত থাকবি সারাজীবন? বিয়ের বয়স তো পেরিয়ে গেছে।

” জানি না আম্মা।

ইলমা বেগম চলে গেলেন ঘরে। বেলকনি বেয়ে ঠান্ডা,শীতল বাতাস ঘরে প্রবেশ করল। ইহানের আর খাওয়া হলো না। হাত ধুয়ে ল্যাপটপ অন করল। কিছু টাইপ করার পর তানিয়ার উজ্জ্বল মুখশ্রী ভেসে উঠল। প্রশান্তি অনুভব করল ইহান। তাকিয়ে রইল দীর্ঘসময় ধরে।

চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

বিঃদ্রঃ রি-চেইক দেওয়া হয়নি।

প্রিয়তার প্রহর ২ পর্ব-০৩

0

#প্রিয়তার_প্রহর (২য় পরিচ্ছেদ)

৩.
ভোর চারটা বেজে পনেরো মিনিট। অন্ধকারে নিমজ্জিত লোকালয়। ভয়ঙ্কর, নিস্তব্ধ পরিবেশ। অতিতের রেশ কাটেনা বোধহয় কখনো। সর্বদা সেসব তাড়া করে বেড়ায়। ক্ষণে ক্ষণে যন্ত্রণা দিয়ে নিঃশেষ করে। প্রহরের কথা মস্তিষ্কে প্রহার হলো প্রিয়তার। হৃদয়ের অন্তঃস্থলে ভূকম্পনের ন্যায় তীব্র কাঁপুনি অনুভব করল। প্রহরকে নিয়ে ভাবতে বসলেই এই দশা হয়।
গরমে হাঁসফাঁস করছে প্রিয়তা। হাত পাখা দিয়ে ধীরে ধীরে হাওয়া দিচ্ছে প্রাণপ্রিয় ভাইকে। হাত ব্যথা করছে কিছুটা। পাখা কয়েক মিনিট ঘুরিয়ে কয়েক সেকেন্ডের জন্য হাত থামিয়ে দিচ্ছে প্রিয়তা। পুনরায় পাখা ঘুরিয়ে যাচ্ছে। কারেন্ট আসার নামগন্ধ নেই। রাত বারো টার দিকে সেই যে গেল এখনো আসেনি। প্রিয়তা আরহামের দিকে তাকিয়ে রইল। ছেলেটা তাকে জড়িয়ে ধরে নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে। মাঝে মাঝে মুখ নাড়িয়ে যাচ্ছে। প্রিয়তা হাসল একটু। সময় গড়াল। আরহাম মাথায় হাত রেখে চোখমুখ কুঁচকে পিটপিট করে চাইল। জিজ্ঞেস করল,

” নড়ছো কেন?

” মাথায় ব্যথা আপু। যন্ত্রণা হচ্ছে।

” বড়দের কথা না শুনলে কি হয় দেখলে? সেদিন বারবার বলেছিলাম দোকানে যেও না। অ্যাক্সিডেন্ট করে মাথা ফাটালে। তোমার কিছু হলে আমার কি হতো?

” এখন তো সব কথা শুনি।

” উঠছো কেন?

” কারেন্ট আসেনি?

” না। বাতাস তো দিচ্ছি।

” লাগবে না। তুমিও ঘুমাও। তোমার ঘুম পায় না?

” তুমি ঘুমাও।

আরহামের সজল চাহনি। প্রগাঢ় ভাবে জড়িয়ে রাখে মায়ায়। অন্ধকারেও উজ্জল দেখায় আরহামের গোলাকার চোখ। শব্দের দারিদ্রতায় মিইয়ে যায় প্রিয়তা। সদা কাঠকাঠ স্পষ্ট বাচনভঙ্গি, অকপটে জবাব হারিয়ে যায়। ফিসফিস করে আরহামের প্রশ্নের জবাব দেয়।

” একটু পরই রান্না করতে উঠতে হবে। এখন ঘুমাবো না। আটটায় তোমার ক্লাস। ঘুমাও। ক্লাসে গিয়ে নইলে ঝিমিয়ে থাকবে।

” রান্না করো না। আমরা বাইরে খাবো।

ঘুমুঘুমু কণ্ঠে কথাটা বললো আরহাম। হাসল প্রিয়তা। মুগ্ধ দৃষ্টি মেলে ধরল। আরহামের চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিল। বোনের এহেন আদরে নবজাতক শিশুদের ন্যায় উৎফুল্ল হলো আরহাম। আরহামের এই প্রগাঢ় উচ্ছলতাকে বাড়িয়ে দিতে ইচ্ছে হলো প্রিয়তার। চুপ করে রইল খানিকক্ষণ। আরহামের ঘন ঘন শ্বাস ফেলার শব্দ ভেসে আসল কানে। নির্জীব আঁখির আভরণে বাঁকা হাসল প্রিয়তা। কন্ঠ খাদে নামিয়ে বললো,

” প্রহরের সাথে গতকাল আমার দেখা হয়েছে আরহাম।

এক সেকেন্ড, দু সেকেন্ড করে কয়েক সেকেন্ড পার হতেই আরহাম সজাগ হলো। শুয়ে থাকা অবস্থা থেকে তড়িঘড়ি করে বসে পরল। এই অন্ধকারেও প্রিয়তা স্পষ্ট আরহামের অভিব্যক্তি বুঝতে পারল। আরহামের উত্তেজনা উপলব্ধি করতে পারল। ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রয়েসয়ে আরহাম জিজ্ঞেস করলো,

” ভাইয়া? এখানে? কেমন আছে ভাইয়া? আমার সাথে দেখা হলো না কেন? আমার কথা প্রহর ভাইয়া জিজ্ঞেস করেনি তোমাকে?

” করেছে।

‘ কি বলেছে?

আরহামের কণ্ঠ গাঢ় হচ্ছে। অর্থাৎ ছেলেটার উত্তেজনা মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। নিজেকে সামলাতে পারছে না আরহাম। পরিচিত, প্রিয় মানুষের খবর পেয়ে আনন্দে গদগদ হয়ে আছে। প্রিয়তা সে ভাষা বুঝল। বললো,

” তুমি কেমন আছো জিজ্ঞেস করলো। বললো তোমার সাথে দেখা করতে চায়।

” আমিও তো চাই। কবে দেখা করবে?

” সেসব কিছু বলেনি।

” তুমি ভাইয়ার সাথে কথা বললে?

” বললাম তো।

” তাহলে এতদিন কেন আমায় কষ্ট দিলে? কেন যোগাযোগ করতে দিলে না ভাইয়ার সাথে?

প্রিয়তা আর কথা বললো না। চুপ করে শুয়ে রইল। প্রহরের কথাগুলো ভাবতে লাগল। ভাবতে লাগল চার মাস আগের কথা। আরহাম তখন হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে। ডাক্তাররা কোনো প্রকার আশা দিতে পারছিল না। ভেঙে পরেছিল প্রিয়তা। নিরাশ হয়েছিল। হাউমাউ করে কেঁদেছিল। রাগে দিক্বিদিক হারিয়েছিল প্রিয়তা। সব কিছুর জন্য প্রহরকে দায়ী মনে হয়েছিল। অমন একটা পরিস্থিতিতে প্রিয়তা বেরিয়ে এসেছিল হাসপাতাল থেকে। উদ্দেশ্য ছিল প্রহরকে শেষ করে দেওয়া, আরহামের ক্ষতি যার জন্য হয়েছিল তাকে চিরতরে শেষ করে দেওয়া। প্রহর যেই স্থানে ছিল সেখানেই ছুটে গিয়েছিল প্রিয়তা। কৌশলে প্রহরের কোমর থেকে রিভলবার বের করে এনেছিল। হাতের মুঠোয় রিভলবার চেপে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। কিন্তু গুলিটা ছোঁড়ার আগ মুহূর্তে জ্ঞান ফিরে প্রিয়তার। নিজের ভুল বুঝতে পারে। কত বড় পাপ করতে বসেছিল বুঝতে পেরে অনুতপ্ততা গ্রাস করে তাকে। চঞ্চলা হৃদয় মুহূর্তেই ছেয়ে যায় মলিনতায়। আশপাশে নজর বুলায় প্রিয়তা। ঠিক তখনই প্রহরের পেছনে একজনকে দেখতে পায় সে। ললাটে ভাঁজ পরে। লোকটাকে চিনে না প্রিয়তা। ইনফ্যাক্ট লোকটা কে ছিল তা এখনো জানে না সে। দেয়ালের আড়াল থেকে প্রহরকে দেখছিল লোকটা। লোকটার বয়স কম। সুদর্শন, বলিষ্ঠ গায়ের গড়ন। তীক্ষ্ম, ধারালো চোখ। কপোলে ক্ষুদ্র দাগ। লোকটার হাতে বোমা জাতীয় বস্তু দেখতে পেয়েছিল প্রিয়তা। ঘাবড়ে গিয়েছিল প্রচন্ড। প্রিয় মানুষকে হারিয়ে ফেলার ভয় তাড়া করেছিল। প্রহর তখন চোখ বুজে রেখেছে। প্রহর বুঝে নিয়েছিল আজ প্রিয়তার হাতেই তার মৃত্যু হবে। তাই তো চুপচাপ চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করছিল। লোকটা যেই না দেয়ালের আড়াল থেকে একটু বেরিয়ে এসে বোমা ছোঁড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, ঠিক তখনই প্রিয়তার হাতে থাকা রিভলবার নিশানা পরিবর্তন করে প্রহরের পরিবর্তে অচেনা লোকটার পায়ে গুলি করে। সাইলেন্সার লাগানো রিভলবার থেকে শক্ত গুলি ছুঁড়ে আঘাত করে লোকটাকে। মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে লোকটা। রিভলবার থেকে উত্তপ্ত ধোঁয়া বের হয়। খানিক সময় নিয়ে চোখ খুলে প্রহর। নিজের কিছু হয়নি দেখে আশপাশে তাকিয়ে লোকটাকে ধরে ফেলে। প্রিয়তা ততক্ষণে রিভলবার রেখেই পালিয়েছে।

________

রান্না শেষ হয়েছে মাত্র। গরমের কারণে রান্নাঘরে পা ফেলতে ইচ্ছে হয় না প্রিয়তার। অলসতা লাগে খুব। মন চায় বাহির থেকে খাবার এনে খেতে। কিন্তু টাকার অংকটা পরিমাপ করলে সে ইচ্ছে গায়েব হয়ে যায়। প্রিয়তার বয়স বিশ। এই বিশ বছরের জীবনে সে কি কি পেয়েছে আর কি কি পায়নি তার ছক কষতে গেলে ভালোবাসার অভাবটা বোধহয় সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হবে। এই বয়সটা ঘুড়ে বেড়ানোর, চঞ্চলা কিশোরী হৃদয়ে উড়ে বেড়ানোর, বন্ধুবান্ধবের সাথে আড্ডা দিয়ে সময় কাটানোর। কিন্তু সেসব মোটেও হচ্ছে না। দিনের পর দিন একই নিয়মে চলছে সে। জীবনটা একদম একঘেয়ে লাগছে। তিক্ততা, বিষাদে তেতো হয়ে গিয়েছে অন্তঃস্থল। দায়িত্বের ভাড়ে নিজেকে বড় হচ্ছে না মনে হচ্ছে।

প্রিয়তা ঘন ঘন শ্বাস ফেলল। আরহামকে উঠিয়ে খাইয়ে দিল। শার্ট আর প্যান্ট পড়িয়ে চুল আচরে দিল অতি যত্নে। আরহামের মুখে হাসি হাসি ভাব। প্রহরের খবর পেয়ে ছেলেটা অনেক কিছু পেয়ে গেছে মনে হচ্ছে। প্রিয়তা হাসল। ছোট্ট ব্যাগটাতে বই খাতা গুছিয়ে রেখে আরহামের কাঁধে চাপিয়ে দিল। দরজায় খটখট শব্দ পরায় প্রিয়তা টিফিনটা দ্রুত আরহামের ব্যাগে রেখে দরজা খুলল। দরজার অপ্রান্তে থাকা ব্যক্তিকে দেখে গম্ভীর হলো প্রিয়তা। বললো,

” এত সকালে আজ?

মহিলার নাম মনোয়ারা। স্বামী গত হয়েছেন বছর দুয়েক আগে। এক ছেলে আর এক মেয়ে উনার। বড় ছেলেটা সৌদিতে থাকে। ছোট মেয়েটার বিয়ে হয়েছে। ছেলের বউ আর নাতনি নিয়ে মহিলার সংসার। প্রিয়তা যেই বাড়িতে থাকে সে বাড়ির প্রত্যেকটা দেয়াল সিমেন্ট আর ইটের হলেও উপরের ছাদটা টিনের। সম্প্রতি ভবনের বাড়িটির খানিক অংশ দু ভবন বিশিষ্ট বাড়িতে তৈরী করা হয়েছে। উপরের ঘরগুলোতে বাড়িওয়ালি তার ছেলের বউকে নিয়ে থাকে। নিচের ঘরগুলোতে ভাড়াটিয়াদের বাস। মাস শুরু হতে না হতেই মহিলা প্রত্যেকটা ঘরে গিয়ে ঘরভাড়া চাইতে ভুলেন না। আজ মাসের সাত তারিখ। ভাড়া চাইতে এসেছেন উনি। প্রিয়তার প্রশ্নে বলে উঠলেন,

” সকাল বেলায় একটু হাঁটতে বের হই। সবার একটু খোঁজ-খবর নেই এই।

” আমাদের খোঁজ নিতে এসেছেন বলে তো মনে হচ্ছে না আন্টি। টাকা চাই তাই তো?

” তুমি এমন ব্যবহার করো ক্যান সবসময়? ভালো কইরা কথা কইতে পারো না? আমি তোমার ছোট নাকি? সম্মান দিয়া কথা কইতে পারো না?

” আপনি আমার ঘরে আসুন। আমার কেমন ব্যবহার করা উচিত আপনি বুঝে যাবেন। আসুন একটু চা খেয়ে যান। দুটো গল্প করি বসে। ভাড়াটা দিচ্ছি। আসুন।

মহিলার ললাটে ভাঁজ পরল। রাগান্বিত হলো চেহারা। ত্যাছড়া হেসে প্রিয়তার ঘরে ঢুকলেন তিনি। প্রিয়তা চেয়ার টেনে বসতে দিল মনোয়ারে খানমকে। আরহামকে বিস্কিট বের করে দিতে বললো। অতঃপর হাসিমুখে বললো,
” ভাড়াটা এখনই নিবেন?

” এখন দিলে তো ভালোই হয়। আমাগো আমার খুব সমস্যা হইতাছে। পোলায় টাকা পাঠায় না।

” টাকাটা যে দিবো, ঘরের অবস্থা দেখেছেন? বৃষ্টি পরলে ঘর ভেসে যায়। তোষক থেকে ভেজা ভোটকা গন্ধ বের হয়। যেখানে যেখানে টিনে ফুঁটো, সেখানে হাঁড়ি-পাতিল রেখে দিতে হয়। সারা রাত আমরা ভাই-বোন এক কোণায় গুটিশুটি হয়ে শুয়ে থাকি। আমি ভাড়া দিবো না তা নয়। অবশ্যই ভাড়া দিবো। কিন্তু আমি আটশো টাকা কম দিবো। পুরোটা দিবো না।

‘ কি কউ? আমি তো কইছি আমার পোলা আসলে টিন বদলাই দিবো।

” ততদিন আমি ভাড়াটাও কম দিবো। এইভাবে কি থাকা যায়? মাসের ভাড়া আমি মাসেই দিই। সবার মতো বাকি রাখি না। এত কষ্ট করে থাকবো কেন?

” ভাড়া আমি কমই রাহি।

” এর চেয়েও কম দিবো। ঘর ভাড়া আগামীকাল পেয়ে যাবেন। এবার আপনি আসুন আন্টি। আমি আরহামকে স্কুলে দিতে যাবো।

মহিলা চোখ পাকিয়ে অহংকারি, দাম্ভিক ভঙ্গিতে জুতোর খটখট শব্দ করে চলে গেলেন। প্রিয়তা হাসল খানিক। মনোয়ারা খানমের স্বভাব ভালো নয়। একজনের কথা আরেকজনের কানে লাগায়। তিলকে মুহুর্তেই তাল বানিয়ে ফেলে। কোন বাড়ির ছেলে-মেয়ে কি করল এসব নিয়ে গবেষণা করেন। যত রকম কূটকচালি করা যায় সবেতেই তিনি আছেন। প্রিয়তার সামনে প্রিয়তার গুণগান গেয়ে বেড়ান। অথচ অন্যদের কাছে প্রিয়তাকে নিয়ে নিন্দে করেন। সবই প্রিয়তার কানে আসে। কিচ্ছু বলে না সে। চুপ থাকে। নাগালে পেলে কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে হলেও নিজেকে সামলে নেয়। নিজের বদনাম শুনে প্রিয়তা রাগ করে না। তাকে নিয়ে অন্যরা ভাবছে এটা ভাবতেই ভালো লাগে।

প্রিয়তা নিজেও তৈরী হয়ে আরহামকে নিয়ে বের হলো। আরহামকে স্কুলে রেখে টিউশনিতে যাবে সে। প্রিয়তার কপালে আজ ছোট্ট কালো টিপ। কালো রঙের কামিজের সাথে ম্যাচিং সালোয়ার আর ওড়না। কানে ক্ষুদ্র দুল। নাকে থাকা নোস পিন রোদে জ্বলজ্বল করছে। নিজের সৌন্দর্যে আজকাল গর্ববোধ করে প্রিয়তা। সৃষ্টিকর্তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানায়।

_______

গুণী মানুষজন ঠিকই বলেন। পৃথিবী থেকে একজন হারিয়ে গেলে সেই মৃত লোকটির জন্য মানুষ একদিন কাঁদে, দু-দিন কাঁদে অতঃপর তিনদিনের দিন মৃত ব্যক্তির আপনজন নিজেদের শক্ত করে ফেলেন।
জীবনের পথে ধীরে ধীরে চলতে আরম্ভ করেন। কান্নাকাটি বন্ধ করে নৈমিত্তিক কাজকর্মে মনোনিবেশ করেন। সামলে নেয় নিজেদের। ইহানের আব্বার মৃত্যুর দুটো দিন পেরিয়ে গিয়েছে খুব নিখুঁত ভাবে। ইহানদের বাড়িটির নাম সবাই দিয়েছে “মরা বাড়ি”, “মৃত মহল”। লোকে এসে এসে দেখে যাচ্ছে ইলমা বেগমকে। হা-হুতাশ করে যাচ্ছে। ইহান নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছে। ইহানের সিলেটে ফেরার সময় হয়েছে। এখানে তার আর থাকা সম্ভব নয়। তানিয়াও এ দুদিন থানায় যায়নি। ইহানের সাথে গাজিপুরেই থেকেছে। ইহানের আম্মার দেখভাল করেছে তানিয়া। রান্নাবান্না করে খাইয়েছে সবাইকে। ইলমা বেগমের কাছাকাছি থেকেছে সবটা সময়।

ইহান তার আম্মাকে ছেড়ে সিলেটে যাবে না। ইলমা বেগমকে সে নিজের সাথেই নিয়ে যাবে বলে ঠিক করেছে। কিন্তু ইলমা বেগম এতে নারাজ। কোনোমতেই ঘর-বাড়ি আর স্বামীর শেষ আশ্রয় টুকু ছেড়ে যাবেন না তিনি। এই নিয়ে নানারকম কথাবার্তা চলছে। আলাপ আলোচনা বিভ্রান্তি হচ্ছে। মা ছেলের এই দ্বন্দ্বের মাঝে না চেয়েও ঢুকে পরল তানিয়া। বললো,

” ইহান স্যার তো ওখানে একা থাকে আন্টি। আপনি গেলে উনার ভালো লাগবে। আর আপনারও তো হাওয়া পরিবর্তন করা দরকার। সিলেট থেকে ঘুরে আসুন। মাসে না হয় দু-বার এখানে এসে আঙ্কেলের কবর দেখে যাবেন।

ইলমা বেগমের করুণ মুখ। আঁচল দ্বারা মুখ ঢাকলেন তিনি। নিঃশব্দে অশ্রু বিসর্জন দিলেন। বললেন,

” ও এখানে শুয়ে থাকবে। আমি এত দূরে যাই কিভাবে?

তানিয়া এগিয়ে এলো। ইলমা বেগমের কাঁধে হাত রাখল। তানিয়ার খারাপ লাগছে। প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রণা সে বোঝে। মৃত বাড়িতে থাকতে চাওয়ার মন-মানসিকতা কেমন হয় সেসব সে জানে। ক্লান্ত চোখে তানিয়া বললো,

” মৃত মানুষ কখনো ফিরে আসে না আন্টি। মৃত মানুষের সাথে সুখ-দুঃখের আলাপ করা যায় না, কষ্ট ভাগাভাগি করা যায় না। আবার মৃত মানুষের পাশে পাশে থেকে তার মুহুর্ত গুলোকেও আনন্দদায়ক করা যায় না। কিন্তু জীবিত ব্যক্তিদের সাথে থাকা যায়, দুঃখ-কষ্ট ভাগ করা যায়, খেয়াল রাখা যায়। আপনার উচিত যে বেঁচে আছে তাকে সময় দেওয়া, তার খেয়াল রাখা। কিছু স্মরণীয় মুহুর্ত বন্দী করে রাখা। ইহানে স্যারের সাথে আপনার থাকা উচিত।

” ওখানে গিয়ে আমি কিভাবে থাকি বলো?

” প্রথম প্রথম কষ্ট হবে। কিন্তু আমরা তো মানুষ আন্টি। মানিয়ে নেওয়াই আমাদের ধর্ম। ছেলের সাথে থাকলে কষ্ট আপনার কমই হবে। ইহান স্যার নিজে বাড়ির কাজ করেন, বাইরের কাজ করেন। সবটা সামলাতে হিমশিম খান। আপনি উনার সাথে থাকলে উনি দিন শেষে বাড়ি ফিরে শান্তিতে ঘরে বসতে পারবেন। আপনার পাশে বসে সারাদিনে ঘটে যাওয়া ঘটনা ভাগাভাগি করতে পারবেন। এর চেয়ে সুখের মুহুর্ত আর কি হতে পারে বলুন?

ইলমা বেগম তাকিয়ে রইলেন তানিয়ার দিকে। তানিয়ার মাথায় হাত রাখলেন। সবটা শুনে রয়েসয়ে চেয়ার থেকে উঠলেন। নিজের ঘরে গিয়ে লাগেজ বের করলেন। আস্তে আস্তে আলমারির দিকে এগিয়ে এসে স্বামীর আর নিজের জামাকাপড় ঠাসাঠাসি করে ভরলেন ব্যাগে। স্বামীর ছবি বুকে আঁকড়ে ধরে বসে রইলেন খানিকক্ষণ। আশপাশে চুখ বুলালেন সময় নিয়ে। ঘরের বাইরে বুকে দু হাত গুঁজে সবটাই দেখল ইহান। কোথাও একটা শূন্যতা অনুভব করছিল সে। আজ বোধহয় শূন্যতা হারাবে। আম্মাজানকে নিয়ে এক সাথে থাকবে ভেবেই আনন্দ হচ্ছে ইহানের। এই দুটো দিন কেমন অদ্ভুত লেগেছে। আনন্দ নেই, কাজের প্রতি দায়বোধ নেই, কোথাও ফেরার তাড়া নেই। আপন জন হারানোর নিষ্ঠর ব্যথাই শুধু বক্ষস্থলে ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে। হাহাকারে ভঙ্গ হচ্ছে হৃৎপিণ্ড।

তানিয়া ইহানের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বুঝতে চাইছে ইহানের অভিব্যক্তি। ইহান তানিয়ার দিকে চেয়ে রইল। তানিয়ার চোখে ইহানের আম্মার জন্য গভীর ভালোবাসা দেখতে পেল সে। বরাবরই ইহান ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবের। খুব ছোট বেলা থেকেই সে চুপচাপ থাকতে পছন্দ করে। দশ কথা বললে এক কথার উত্তর দেওয়ার মতো মানুষ ইহান। পড়াশোনাতে সবসময় এগিয়ে থাকতো ইহান। কলেজ আর ভার্সিটি লাইফে হাতে গোনা কয়েকজন বন্ধুবান্ধব ছিল। সময়ের রেশ ধরে এখন কারোই সাথেই তেমন পরিচয় নেই। একেকজন একেক দিকে হারিয়েছে। কারো সাথে অতিরিক্ত কথাও হয় না ইহানের। প্রয়োজনের খাতিরে যেটুকু দরকার সেটুকু বলতে পারলেই বেঁচে যায়। অস্বাভাবিক রকমের রাগের কারণে অনেকেই আড়ালে ইহানের নামে বদনাম রটায়। আবার অনেকে ইহানকে প্রচণ্ড বুঝদার, নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ বলেই জানে। ইহানের ভার্সিটির সব বন্ধুবান্ধব বিয়ে করে বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে ঘুরছে। এদিকে ইহানের এসব নিয়ে ভাবনাই নেই। সব ভাবনাতে কেউ একন জল ঢেলে দিয়েছে বোধহয়। তানিয়ার দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতাসূচক মুচকি হাসল ইহান। বলল,

” তোমাকে ধন্যবাদ তানিয়া।

তানিয়ার আঁখি অশ্রুতে টইটম্বুর। মোহনীয় ফর্সা মুখের আদল। হাসলে তানিয়ার চোখ ও হেসে উঠে। মুক্তোর ন্যায় দাঁত গুলো ঝিলিক দিয়ে উঠে। তানিয়া মৃদু হাসল। বলল,
” আপনি তো খুব একটা কথা বলার ঝামেলা নিতে চান না। তাই আপনার হয়ে কথা বলার দায়িত্ব আমাকেই নিতে হচ্ছে। সবাইকে আপনার হয়ে সামলাতে হচ্ছে। কিন্তু এসব তো আপনার করার কথা ইহান। আর কবে মন খুলে কথা বলতে শিখবেন? কবে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে শিখবেন?

ইহানের কণ্ঠ জোরাল। শ্যামলা গরণের অবয়বে মাধুর্যতা। গম্ভীরতা বিদ্যমান ছেলেটার শিরায় শিরায়। অন্তরে অগ্নিশিখা জ্বললেও বাহিরের আবরণ গোছালো। নাকের পাটা ফুলিয়ে সে বলে উঠল,
” আমি এমনই। আমার মনে হয় যে বোঝার সে এমনিতেই বুঝবে। আমার কাজে, আমার আচরণেই বুঝবে। আমাকে মুখ ফুটে বলতে হবে কেন আমি তাকে আমার কাছে কাছে চাই। কেন বলতে হবে তার প্রতি আমার অনুভূতিটা ভালোবাসার, বিশ্বাসের, মর্যাদার?

” বলতে হয় ইহান। সবাই সব কথা বুঝে না। তাদেরকে বুঝিয়ে বলতে হয়। দেখুন কোনোদিন এমন না হয়, আপনার এই অতিরিক্ত ইন্ট্রোভার্ট হওয়ার কারণে আপনার প্রিয় মানুষজন আপনার থেকে হারিয়ে যায়। দূরে সরে যায়। আপনি একাকীত্বে ভুগেন।

ইহান শুনল। ঘরে ফিরে শার্ট বদলে নিল। ফোনে থানার লোকদের সাথে কিছু জরুরী কথা বলে নিল। অতঃপর তানিয়াকে ফেরার জন্য তাড়া দিল। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে ইহান ফোন বের করল। প্রহরের নম্বল ডায়াল করল। ওপাশ থেকে ফোন তুললো প্রহর। ইহান কিছুটা ঘাবড়াল। কপাল চুলকে বললো,

” কি করছিস?

” বসে আছি। তুই?

” কিছু করছি না। এখন ফ্রি আছিস?

” হ্যাঁ বল না। কেমন চলছে দিনকাল?

” আমি আর তানিয়া গাজিপুরে এসেছি?

প্রহর অবাক হয়। বসা থেকে বোধহয় উঠে দাঁড়ায়। বলে,

” পরিবারের কাছে এসেছিস? এখানে আয়। বেশি দূর না তো। দেখা করে যা।

সময় নেয় ইহান। গাঢ় শ্বাস ফেলে। বলে,
” আব্বা দুদিন হলো মারা গিয়েছে। আব্বাকে কবর দিয়ে আম্মাকে নিয়ে সিলেটে ফিরছি প্রহর। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে তোর সাথে দেখা করতাম।

মূর্তির ন্যায় জমে যায় প্রহর। শোকাহত হলো খুব। খারাপ লাগল ভিষণ। ইহান ভালো ছেলে। কষ্ট সবসময় চেপে রাখতে ভালো বাসে। ছেলেটাকে দেখে বোঝা যাবে না এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে তার জীবনে। প্রহর কি বলবে বুঝতে পারে না। বলে,

” আমাকে একবার ও জানানোর প্রয়োজন বোধ করলি না? এতটাই পর হয়ে গিয়েছি আমি? আঙ্কেলকে শেষবারের মতো দেখতেও দিলি না আমাকে? বললে কি হতো হ্যাঁ?

হাঁসফাঁস করে ইহান। সামনাসামনি থাকলে প্রহর হয়তো ইহানের অভিব্যক্তি দেখে তার মনের কথা বুঝতে পারতো। এখন কিভাবে ছেলেটাকে বোঝাবে পরিস্থিতি? ভেবে পায় না ইহান। দমে যায়। তানিয়ার নিকট চলে আসে হন্তদন্ত হয়ে। তানিয়া তখন ইলমা বেগমের শাড়ি ভাঁজ করতে ব্যস্ত। ইহানকে এভাবে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে ভ্রু কুচকে ফেলে তানিয়া। কিছু বোঝার আগেই ইহান ফোনটা তানিয়ার কানে মেলে ধরে। স্ক্রিনে থাকা নাম দেখে কথা বলতে আরম্ভ করে তানিয়া।

” আসসালামু ওয়ালাইকুম স্যার।

” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। এসব কি শুনছি আমি তানিয়া? আঙ্কেল মারা গেছে তোমরা একবার ও আমাকে জানাওনি? ইহান না হয় জানাতে ভুলে গিয়েছিল। পরিস্থিতি অন্যরকম ছিল বলে বলার সুযোগ পায়নি। তুমি কেন জানালে না?

তানিয়া এইবার বুঝল আসল বিষয়। বলল,
‘ কাকে রেখে কাকে সামলাবো সেটাই বুঝতে পারিনি স্যার। আপনি চিন্তা করবেন, কষ্ট পাবেন, ছুটে আসবেন ভেবে আপনাকে বলিনি। আজই জানাতাম আমি। আঙ্কেল মারা গিয়েছেন সকালে। আমরা পৌছেছি রাতে। মৃত মানুষের শরীর দেখার মতো ভয়ঙ্কর অনুভূতি আপনি অনেক পেয়েছেন স্যার। চাইনি পরিচিত মানুষের এমন অচেতন রুপ আপনি দেখুন। আমাকে ক্ষমা করবেন স্যার। আপনাকে জানিয়ে কষ্ট দিতে চাইনি। আমরা এদিকটা সামলে নিয়েছি। দু দিন থানায় যাইনি। আজ ফিরতেই হবে। নইলে আপনার ওখানে যেতাম।

” বেশ। যাও তবে। আঙ্কেলের জন্য আমার দোয়া রইল। ইহানকে সামলে রেখো। কি থেকে কি করবে ঠিক নেই।

” আমি আছি স্যার।

ইহানের দিকে তাকিয়ে কথাটুকু বলে ফোন কেটে দিল তানিয়া। ফোনটা ছো মেরে কেড়ে নিয়ে ঘর ছাড়ল ইহান।

________

সন্ধ্যা হয়েছে। আকাশে উজ্জল তারা গুলো জ্বলজ্বল করছে। গাছের পাতা দুলে উঠছে বারংবার। প্রিয়তাদের বাড়ির পাশেই বিশালাকার কয়েকটি মাঠ। মাঠের সাথেই একটি স্কুল। স্কুলের শিক্ষার্থীরা বিকেল হলেই খেলতে আসে মাঠে। হৈ হুল্লোরে কান ধাঁধিয়ে যায়। ক্রিকেট, ফুটবল, দৌঁড়াদৌড়ি চলতেই থাকে মাঠটিতে। এ বাড়ি ও বাড়ির বয়স্ক মানুষজন বিকেল হলে মাঠে এসে বসে গালগল্প করেন। সন্ধ্যায় বিদ্যুত চলে গেলে পাটি, মাদুর বিছিয়ে অনেকেই শুয়ে থাকেন মাঠে। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা যায় মাঠের আশপাশ। পেয়ারা গাছে কিছু ছেলেপিলে উঠে বসে থাকে। আরহামকে নিয়ে মাঝেসাঝেই মাঠে চলে যায় প্রিয়তা। প্রকৃতির মৃদু হাওয়া গায়ে লাগায়। মুহূর্তটা উপভোগ করে দু ভাইবোন। অতিতের গল্প গুলো পুনরায় বলে চলে। আরহাম পিটপিট করে তাক্য় বোনের পানে। আম্মুর জন্য আরহামের বুক পুড়ে। আব্বুর সুশীতল বুকে মুখ গুঁজে বসে থাকতে ইচ্ছে হয়। নিজেদের বাড়িতে ফিরে যেতে ইচ্ছে হয় আরহামের। বুঝতে পারে সেই বাড়ি আর তাদের বাড়ি নেই। সে বাড়িতে অন্যদের বসবাস। বিন্দুমাত্র ভালোবাসার ছিটেফোঁটা ও বাড়িতে নেই।

পাউরুটি মুখে তুলে নিল আরহাম। পাউরুটির প্যাকেটে থাকা জেলি ছোট্ট আঙ্গুলের মাথায় নিয়ে রুটিতে মাখিয়ে আয়েশী ভঙ্গিতে কামড় দিল সে। ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা জেলিটুকু জিভ দ্বারা চেটে নিয়ে বোনের পানে তাকাল। প্রিয়তা খাতা দেখতে ব্যস্ত তখন। স্টুডেন্টদের খাতা দেখতে দেখতে আড়চোখে দেখছে ভাইকে। প্রিয়তা যে দোকানে কাজ করে সেই দোকানের নাম “বিউটি শপ”। দোকানের মালিকের কিছু ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে আজকে পুরো দোকানটাই সন্ধ্যের মধ্যে বন্ধ করে দিয়েছে। আগামীকাল একই সময়ে দোকান চলবে বলে নোটিশ দিয়েছেন মালিক কর্তৃপক্ষ। প্রিয়তার খুশি আর ধরে না। রোজ রাত করে বাড়ি ফিরতে ভালো লাগে না মোটেই। আরহামকেও সময় দেওয়া হয় না। আজ সময় পেয়ে বাচ্চাদের পরিক্ষা নিয়েছে। সেই খাতাই সময় নিয়ে দেখতে বসেছে। আরহাম খেয়ে হাত ধুয়ে প্রিয়তার গা ঘেঁষে বসল। বললো,

” গলির মাঠে না মেলা বসেছে। জানো?

প্রিয়তার ললাটে ভাঁজ পরল। চোখে বাঁকিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকাল। পুনরায় খাতা দেখায় মন দিয়ে বললো,

” জানি না। কখন বসেছে?

” সকালে। আসার পথে দেখোনি?

” অন্য রাস্তা দিয়ে এসেছি। দেখিনি।

‘ যাবে না?

” ক-দিন থাকবে?

” শুধু আজই থাকবে। আর বসবে না।

” যেতে হবে না। গেলেই খুব খরচ।

” চলো না আপু যাই। আমি শুধু ঘুরে ঘুরে দেখবো। কিচ্ছু চাইবো না।

প্রিয়তা নিষ্পলক চোখে আরহামকে পর্যবেক্ষণ করল। প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে খাতা দেখায় ব্যস্ত হলো। আরহাম আরো ঘেঁষে বসল। প্রিয়তার সান্নিধ্যে এসে মলিন মুখে বসে রইল। ফোনের রিংটোন বাজল। প্রিয়তা ফোনের দিকে আড়চোখে তাকাল। নম্বরটা ভিষণ চেনা প্রিয়তার। সিমের মালিকের মুখটা ভেসে উঠল চোখের পাতায়। প্রিয়তা ফোন ধরে বলে উঠল,

” আসসালামু ওয়া আলাইকুম।

ওপাশের ব্যক্তিটি সালামের উত্তর নিল বোধহয়। পরক্ষণে কিছু একটা বলে উঠল। সেসব স্পষ্ট শুনতে পেল না আরহাম। শুধু চেয়ে রইল প্রিয়তার দিকে। আরো দু কথা বলে ফোন রাখল প্রিয়তা। অতঃপর হাসল আরহামের দিকে তাকিয়ে। খাতা কলম সরিয়ে আরহামকে কোলে নিল সন্তপর্ণে। আগলে নিল বক্ষপিঞ্জরে। আরহামের গায়ে আলাদা এক ঘ্রাণ মিশে আছে। সেই ঘ্রাণ প্রিয়তার নাসিকারন্ধ্রে প্রবেশ করল। মৃদু হেসে আরহামের মুখটা চেপে ধরল খুবই আলতো ভাবে। চোখের পাতায় সশব্দে চুমু খেয়ে বললো,

” মেইন গেটে কেউ একজন এসেছে। দেখে এসো তো। দেখো তো চিনতে পারো কি না।

” কে এসেছে আপু? আরহামের কৌতুহলী চোখে উজ্জলতা। গোলাকার দুটি চোখে উপচে পরা বিস্ময়।

গত চারমাসে কেউ প্রিয়তাদের বাড়ি আসেনি। এত রাতে দেখা করতে আসার মতো তেমন কেউই নেই তাদের। সন্ধ্যে হলে আরহামকে একা একা কোথাও যেতে দেয় না প্রিয়তা। আজ নিজে থেকে বাইরে যেতে বলছে? বিষয়টা অদ্ভুত ঠেকল আরহামের নিকট। চোখ ছোট ছোট করে ফেলল সে। প্রিয়তা ছেলেটার নাক টেনে বলল,

” দেখেই আসো না। হয়তো বাইরে কোনো সারপ্রাইজ আছে। যাও যাও।

____

খেতে বসেছে আরিফ। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে দীপা। মুখে তার এক চিলতে হাসি। স্লিভলেস ব্লাউজের সাথে মিষ্টি রঙের ফিনফিনে জর্জেট শাড়িতে দীপাকে আবেদনময়ী লাগছে। ভারী মেকআপে রাঙিয়ে রেখেছে নিজেকে। গরুর মাংসের কালা ভুনা রেঁধেছে সে। মাংসের কয়েক টুকরো তুলে দিল স্বামীর প্লেটে। হাসিমুখে বললো,

” খেয়ে দেখো তো কেমন হয়েছে রান্নাটা?

আরিফ হেসে ভাতের সাথে তরকারিটুকু নেড়ে মুখে নিল। বলল,

” বাহ্। ভালো হয়েছে তো। এত ভালো রান্না কিভাবে করলে? তুমি তো রাঁধতে পারো না।

” মন দিয়ে করেছি। ভালো হবে না? খাও খাও।

আবার ও ভাত নেড়ে খাবার মুখে তুলতে তুলতে আরিফ বলল,
” প্রিয়তা গরুর কালা ভুনা খেতে খুব ভালোবাসতো। প্রীতি রান্না করলে মেয়েটা ঝাঁপিয়ে পরতো। পুরো এক বাটি রেখে দিতে হতো প্রিয়তার জন্য। চেটেপুটে খেতো একদম। প্রায় এই ডিশ রান্না হতো বাড়িতে। সে কি আয়োজন আর আনন্দ।

সলজ্জ চোখে কথাটুকু বলে থমকে গেল আরিফ। ভাতের অংশ আটকে গেল গলায়। প্রিয়তার আর আরহামের কথা মনে পরল কেন? প্রিয়তা কেমন আছে এখন? খেতে পাচ্ছে এমন খাবার? হুট করে প্রিয়তার নামটা কেমন বেরিয়ে এলো মুখ থেকে। হয়তো চায়নি কথাটা বের হোক। তবুও বেরিয়েই এলো। মন খারাপ হলো।

দীপা রেগে গেল প্রিয়তার নাম শুনে। এই নামটা সহ্য হয় না তার। চেঁচিয়ে বলে উঠল,
” ওদের নাম মুখে আনতে না করেছি না? মুখ থেকে বেরিয়ে যায় তাইনা? খাও সব। ছেলে-মেয়েকে দিয়ে খাওয়াও। যত্তসব ন্যাকামি।

কথাটুকু বলে হনহন করে ঘরে গিয়ে ঘরের দরজা শব্দ করে আটকে দিল দীপা। আরিফ তাকিয়ে রইল তরকারির দিকে। চোখ ছলছল করে উঠল।

চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

প্রিয়তার প্রহর ২ পর্ব-০২

0

#প্রিয়তার_প্রহর_(২য়_পরিচ্ছেদ)
পর্ব সংখ্যা (২)

প্রিয়তার নত মুখশ্রী। দুরু দুরু করছে বুক। তৃষ্ণা পাচ্ছে ভিষণ। অভিযোগ ও অহমিকায় তেতে উঠছে সর্বাঙ্গ। ওষ্ঠদ্বয় শুষ্ক হয়ে আসছে। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল প্রিয়তা। বলল,

” ইনসপেক্টর গতকাল দুপুরে একটি ছেলেকে ধরে এনেছেন আপনারা। উনার নামে আমি জিডি করতে এসেছি। আমিই রাস্তায় উনাকে ধরিয়ে দিয়েছিলাম।

প্রহর কলমের ঝুড়ি থেকে কলম বের করল।ডেস্কে রাখা খাতার ভালো পৃষ্ঠা বের করে কিছু লিখল। পুনরায় লেখার ভঙ্গি করে প্রিয়তার পানে তাকিয়ে বললো,

” আপনার নাম?

” প্রিয়তা।

” আইডি কার্ডের নাম অনুযায়ী পুরোটাই বলুন।

” প্রিয়তা হোসাইন।

” ঠিকানা?

” সাভার, বিশমাইল।

” বয়স?

” বিশ।

” ম্যারিটাল স্ট্যাটাস?

” আনম্যারিড।

” ফোন নম্বর?

” এটা দিতেই হবে?

” জিডি করতে হলে অবশ্যই দিতে হবে।

” ০১৯********

” ল্যাপটপে টেক্সট করতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত ল্যাপটপ কাজ করছে না। ঠিক করতে একটু সময় লাগবে। আপনাকে একটু বসতে হবে। বাইরে গিয়ে বসুন।

প্রিয়তা উঠে দাঁড়াল। সালাম দিয়ে পা বাড়াল। মস্তিষ্ক বলে উঠল ” চলে যা প্রিয়তা, পুরোনো ক্ষত আর তাজা করিস না। শুকিয়ে যাওয়া ক্ষত খুঁচিয়ে রক্ত বের করিস না”। অপর দিকে মন বললো,- “থেকে যা এখানে। জিডি শেষ হলেই যাস। জেনে যা প্রহর কেমন আছে, সংসার-ই বা কেমন চলছে তার”?

প্রিয়তা বেঞ্চে বসে রইল। মনে উত্তেজনার উপস্থিতি টের পেল। চঞ্চলতা বৃদ্ধি পেল যেন। ছটফট করতে লাগল শরীর। খানিক সময় যেতেই প্রহর বেরিয়ে এলো পুলিশের পোশাক ছেড়ে। প্রিয়তা অবাক হলো ভিষণ। ডিউটিতে থাকাকালীন লোকটা ইউনিফর্ম খুললো কেন? প্রহর সম্মুখে এসে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়াল প্রিয়তা। দুরত্ব কমিয়ে প্রহর ফিসফিস করে বলে উঠল,

” আমার সাথে চলুন প্রিয়তা।

প্রিয়তার কণ্ঠ কাঁপছে। তেজ আর রাগ বেড়ে যাচ্ছে। হু হু করে শীতল প্রবাহ বইছে হৃদয়ে। লোকটার কণ্ঠ এত সুন্দর কেন? প্রিয়তার কঠিন চাহনি, দৃঢ় অবয়ব। অকপটে সে বলে উঠল,

” আমি আপনার সাথে কেন যাবো? কোথায়ই বা যাবো? আশ্চর্য! আমি কোথাও যাবো না।

” আপনি আমার সাথে যাবেন।

প্রহরের কঠিন চাহনি। ধারালো, উজ্জল চোখ। কণ্ঠে উত্তেজনা। রাগান্বিত মুখশ্রী। ললাটের রগ ফুলে উঠেছে। থুতনির নিচের টোলটাকে সুন্দর লাগছে। ভয়ঙ্কর এই প্রহরকে ভয় লাগছে না প্রিয়তার। সে বলে উঠল,

” আমি কোথাও যাবো না।

” সেদিন আপনি যে কাজটা করতে পারেননি সেই কাজটা আমি করতে বাধ্য হবো প্রিয়। চলুন আমার সাথে।

প্রিয়তা ভীতিগ্রস্থ চোখে তাকাল। লোকটা কি সেই ঘটনা এবার নিজের হাতে ঘটাতে চাইছে? তিক্ত ঘটনার সম্মুখীন করতে চাইছে তাকৈ? বিভীষিকার অন্তজ্বালে পুড়িয়ে ফেলতে চাইছে? নাকি অনুতপ্তে দগ্ধ করতে চাইছে? প্রহর এগিয়ে গেল সামনের দিকে, থানার বাইরে। প্রিয়তার বক্ষপিঞ্জরে ক্রমান্বয়ে ধকধক করে উঠল। প্রহর তাকে কি বলবে? কোথায়-ই বা যেতে বলছে এখন? কিচ্ছু জানে না প্রিয়তা। জানতে চায় ও না। কিন্তু কি করবে? কিভাবে প্রহরকে এড়িয়ে চলে যাবে? প্রিয়তা পেছনেই হাঁটতে লাগল। প্রহরের গাড়ি দাঁড় করানো রাস্তায়। প্রিয়তাকে বসতে বললো ফ্রন্ট সিটে। প্রিয়তা তাতে নারাজ। শুনতে চাইছে না কোনো বাক্য। পাড়ার সকলে বলে প্রিয়তা খিটখিটে স্বভাবের মেয়ে। পাশাপাশি পরিপক্ক, বুঝদার, পরিশ্রমী, ধৈর্যশীল, দায়িত্বশীল আর ভিষণ চটপটে। এইসব গুণ প্রহর সামনে আসায় কেমন মিলিয়ে যাচ্ছে। প্রিয়তার কেমন ভয় লাগছে। কথা বলতে পারছে না। বিষয়টাতে প্রচন্ড বিরক্ত বোধ করল প্রিয়তা। নিজের উপর রাগ হলো ভিষণ। প্রিয়তার নড়চড় না দেখে প্রহর চোখ পাকিয়ে বললো,

” রাস্তায় সিনক্রিয়েট করবেন না প্রিয়তা। আমার আপনার সাথে অনেক কথা আছে। আপনি না গেলে আমি তাই করবো যা আপনি চার মাস আগে করার চেষ্টা করেছিলে। আই সয়্যার। দু বার ভাববো না আমি।

প্রিয়তা দমে গেল। স্বাভাবিক ভাবে উঠে বসল গাড়ির ফ্রন্ট সিটে। শো শো করে ব্যস্ত শহর দিয়ে গাড়িটি চলতে লাগল। এতদিন পর প্রিয় মানুষের পাশে বসে থাকার অনুভূতি কেমন হওয়া উচিত? নিজেকে প্রশ্ন করল প্রিয়তা। মন কোনো উত্তর দিল না। মস্তিষ্ক কোনো জবাব দিল না।

__________

প্রহর আর প্রিয়তা একটি বাড়ির সামনে এসে থেমেছে। দ্রুত গাড়ি থেকে নামল প্রিয়তা। আশপাশ পর্যবেক্ষণ করল। প্রহর গাড়িটি লক করে বাড়িটিতে প্রবেশ করল। পিছু পিছু প্রিয়তা ঢুকল বাড়িটাতে। বাড়িটির রং ধবধবে সাদা। তিনটে রুম, ওয়াশরুম আর ছাদ ছাড়া বাকি তেমন কিছুই নেই। বাড়িটি পরিপাটি করে সাজানো। পারফিউমের ঘ্রাণ ছড়িয়ে আছে সর্বত্রে। প্রিয়তাকে বসতে বলল প্রহর। ঘড়িতে সময় দেখে প্রিয়তার মুখোমুখি সোফাতে বসল। নরম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,

” আরহাম কেমন আছে প্রিয়তা?

প্রিয়তা মাথা উঁচু করে চাইল। প্রহরের চোখে আরহামের প্রতি ভালোবাসা লক্ষ্য করল প্রিয়তা। অন্তঃস্থলে ঝড়ের মাত্রা বৃদ্ধি পেল। সাবলীল কণ্ঠে বললো,

” ভালো আছে।

” আরহাম আমার কথা জিজ্ঞেস করে না ?

” করে তো। আমি তো জানতাম না আপনি এখানে এসেছেন। নইলে নিয়ে আসতাম।

” আমি এখানে আছি জানলে আপনি এ শহর ছেড়েই চলে যেতেন। আরহামকে এখানে আনা তো অনেক দূরের কথা।

” তেমনটা নয়।

” তেমনটাই।

” আপনি আমার দেওয়া কথাটা রাখেননি। আমি বলেছিলাম আমাকে না খুঁজতে। কিন্তু আপনি ঠিকই খুঁজতে খুঁজতে এখানে, এই এলাকায় চলে এসেছেন।

” আমাকে আর কত ছোট করবেন প্রিয়তা? কত অপমান করবেন? আমি আপনাদের খুঁজতে খুঁজতে এখানে আসিনি। আপনারা চলে আসার পর ও বাড়িতে আমি থাকতে পারিনি। সর্বক্ষণ আপনাদের স্মৃতি ভেসে উঠতো। আপনাদের সাথে কাটানো মুহুর্ত ক্রমাগত আঘাত করতো। আমার সবকিছু বিষাক্ত লাগতে শুরু করেছিল সেসময়। তাই ইহানের পরিবর্তে কাজের সূত্রে আমি এখানে ট্রান্সফার হয়ে এসেছি। এখানে এসেছি শুধু কাজের জন্যেই। আমার ভাবনাতেই ছিল না আপনি এত দূর আসবেন। আর আপনাকে আমি খুঁজে পাবো।

” আচ্ছা বেশ। আমাকে এখানে কেন এনেছেন?

” আপনাকে জানতে। আমার অনেক প্রশ্ন, অনেক কথা জমে আছে প্রিয়তা। কেন সেদিন চলে এসেছিলেন আমায় না বলে? মা কে বলে এলেন, অথচ আমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করলেন না। আর চিঠিতে কি লিখেছিলেন? লিখেছিলেন আমাদের সাথে আর যোগাযোগ রাখতে চান না। আমি যেন আরহামের কেসটা নিয়ে তদন্ত না করি, না ভাবি। সবকিছু যেন ভুলে যাই। আপনি জানেন আমি এখনও ওই শত্রুকে ধরতে পারিনি। আপনার দেয়া কথার খেলাপ করতে পারিনি। কেন এমনটা করলেন প্রিয়?

শেষেল কথাটুকু বড্ড নরম শোনাল।
প্রিয়তা উঠে দাঁড়াল। থাই গ্লাস সরিয়ে দিল। আকাশ হলুদাভ বর্ণে ধারণ করেছে। সূর্য উত্তাপ ছড়াচ্ছে। প্রিয়তা সেদিকে তাকিয়ে বলে উঠল,

” ওখানে আমাদের শত্রুর অভাব নেই। সহজ-সরল আর নিরাপদ জীবন পেতেই আমরা ওখান থেকে চলে এসেছি। আপনার শত্রুরা আমাদের ক্ষতি করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। এছাড়া তিক্ত ঘটনা গুলো এমন ভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল সে বাঁচার উপায় ছিল না। জীবনের কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে আমি বিপর্যস্ত। অপমানে শরীর বিষিয়ে গিয়েছে আমার। একটু সুখের আশায় ছটফট করেছি অনবরত। দেখুন ওখান থেকে চলে এসে আমরা ভালো আছি। খুব ভালো আছি। এখানে ক্ষণে ক্ষণে আক্রমণের শিকার হবার ভয় নেই। পিছুটান নেই।

প্রহরের বুকে তোলপাড়। ফ্যাকাশে মুখ করে বলে ওঠে,
” একবার ও ভাবলেন না আরহামকে এভাবে লুকিয়ে নিয়ে গেলে আমার কেমন লাগবে? আমি যে ওকে ভালোবাসি প্রিয়। আমার ও কষ্ট হয়।

” জানি। কিছুই করার ছিল না। সেসব বাদ দিন। লিরা আপু কোথায়? দেখতে পাচ্ছি না কেন?

” লিরার কি এখানে থাকার কথা ছিল? (গম্ভীর হলো প্রহর)।

” আপনাদের বিয়ে হয়নি? আপু কি ইংল্যান্ডে চলে গিয়েছে?

হাসে প্রহর। হাসি পায় ভিষণ। জ্বলে ওঠে শরীর। দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্যান্টের পকেটে দু হাত গুঁজে বলে,
” আপনি বড্ড বোকা প্রিয়তা, খুব বোকা। আপনি সব-ই বোঝেন, অথচ মন বোঝেন না। মায়ের কথা শুনে আপনি ভেবে নিলেন আমার আর লিরার বিয়ে হবে। কিন্তু একবার ও জানতে চাইলেন না আমি এতে রাজি আছি কিনা, কিংবা লিরা এ বিষয়ে রাজি কি না? সবটা নিজেই বুঝে নিলেন। নিজেই কষ্ট পেলেন। আরেহ্ লিরা বাংলাদেশের কালচারে একদম অভ্যস্থ নয়। লিরা মেয়েটা ভ্রমণপ্রেমী। ইউরোপ, আমেরিকা, ইউ এস, ইংল্যান্ড, মালয়েশিয়া, নিউজিল্যান্ড সব জায়গায় ঘুরে বেড়ায় ও। আব্বুর কথা শুনে লিরা বাংলাদেশে ঘুরতে এসেছিল। এখানকার সুন্দর সুন্দর জায়গার ছবি তোলার জন্য এসেছিল। প্রিয়তা লিরা ফ্রান্সের একটি ছেলের সাথে লিভ ইন এ আছে। সব ঠিকঠাক থাকলে ওই ছেলেটাকেই ও বিয়ে করবে। ওর বাবা-মা আর আমার বাবা-মা বিয়ে নিয়ে আলোচনায় বসেছিল। লিরা এতে সাফ সাফ না জানিয়ে দিয়েছে। বাঙালি ছেলে ওর পছন্দ নয় তেমন। আমিও মানতে পারিনি এই বিয়ের ব্যাপারটা। আমিও রাজি হইনি। সব ছেড়ে এখানে চলে এসেছি।

” তার মানে আপনি বিয়ে করেননি? প্রিয়তার
কণ্ঠে বিস্ময়।

” নাহ্। করিনি। আমার মা আপনাকে অনেক কথা শুনিয়েছে তাইনা? আমার এখানে চলে আসার অন্যতম কারণ ও এটা। মায়ের সাথে আমার মনোমালিন্য চলছে। মা যা করেছে তারপর আমি ওখানে থাকতে চাইছি না।

” দেখুন আমি আর ভাবতে চাই না সেসব। আমার কোনো পিছুটান নেই। কারো প্রতি রাগ নেই, অভিযোগ, অভিমান কিচ্ছু নেই। আপনিও আর ভাববেন না ওসব নেই। সবটা ভুলে ভালো থাকুন। আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে। যেতে দিন।

” আরহামকে একটাবার আমার সাথে দেখা করতে দিবেন প্রিয়তা? ওর রক্ত মাখা মুখটা দেখার পর ওর সুস্থ শরীরটা আমি আর দেখতে পাইনি। আমায় ওকে দেখতে দেবেন?

প্রহরের কণ্ঠে কেমন আকুতি। বুঝতে পারে প্রিয়তা। বলে,
” সারাদিন ও বাসায় একা থাকে। যাবেন সময় করে। আসছি।

প্রিয়তা পা বাড়ায়। পিছু থেকে প্রহর বলে ওঠে,
” আমি জানি আপনি আমায় ভালোবাসেন প্রিয়তা। তাহলে চারটা মাস কিভাবে আমার থেকে দূরে থাকলেন?

” জানি না আমি। সত্যিই জানি না।

” আমাদের মাঝে থাকা দুরত্বই আমাদের আরো কাছে এনে দিয়েছে প্রিয়তা। আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি আমি আপনাকে ভালোবাসি। বিরহের অনলে আমিও কষ্ট পাচ্ছি। প্রেমের উত্তাপে আমিও প্রতিনিয়ত জ্বলে পুড়ে ছারখার হচ্ছি। আপনি বুঝতে পারছেন না? নাকি বুঝতে চাইছেন না?

” আমি আপনাকে খু’ন করতে গিয়েছিলাম। এসব জেনে বুঝেও কেন? পিছু ফিরে প্রিয়তা। প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা করে।

প্রহর বলে ওঠে,
” সেই পরিস্থিতিতে আমি থাকলে আমিও তাই করতাম। শুধুমাত্র আমার জন্যই আরহামের অমন একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল। আমার জন্য প্রতিনিয়ত আপনারা বিপদে পরেছেন। আরহাম মৃত্যুর সাথে লড়াই করছিল আমার জন্যই। ছেলেটার বাঁচার কোনো নিশ্চয়তাই ছিল না। আপনি আপনার ভাইকে খুব ভালোবাসেন প্রিয়তা। আরহামের জন্য সব করতে পারেন। সেসময় আপনি বুঝতে পারেননি আপনার কি করা উচিত। মাথা ঠিক ছিল না আপনার। তাই তো আমায় মারতে এসেছিলেন। যার জন্য আপনার ভাই এত কষ্ট পাচ্ছে তাকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেননি। আপনি আমার পিছনে থাকা আমার শত্রুকে শ্যুট করেছিলেন। আমি ভেবেছিলাম সেদিনটাই আমার বেঁচে থাকার শেষ দিন হবে। কিন্তু আপনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছিলেন। পারেন নি আমাকে মেরে ফেলতে। আমাকে শ্যুট করেননি আপনি, করেছিলেন অন্যকাউকে। ভালোবাসার মানুষকে মেরে ফেলার ক্ষমতা আমার প্রিয়র নেই।

_______

তানিয়া অটোতে বসেছে। তার কোলে ল্যাপটপ। দ্রুত গতিতে চলছে অটো। তানিয়ার চুলগুলো উড়ছে। তার গায়ে হালকা গোলাপী রঙের সুতির শাড়ি। শাড়িটাকেই আজকাল প্রধান পোশাক হিসেবে পরিধান করে তানিয়া। ভালো লাগে গায়ে শাড়ি জড়াতে। আঁচলটা টেনে তানিয়া বসে রইল অটোতে। খানিকক্ষণ বাদে মুঠোফোন বেজে উঠল। Ehan Sir লেখাটি দেখে ফোনটা ধরল তানিয়া। ফোনটা কানে ধরতেই ওপাশ থেকে ইহান শান্ত কণ্ঠে বলে উঠল,

” বাড়িতে আসতে হবে না তানিয়া। আমি বাড়িতে থাকবো না।

” মানে কি? কোথায় আপনি? থাকবেন না কেন বাড়িতে?

” আমি গাজিপুর যাচ্ছি। বের হচ্ছি।

” হঠাৎ? আন্টি আঙ্কেল ঠিক আছে?

” আব্বা মারা গিয়েছে তানিয়া। একটু আগে খবর পেয়েছি।

উক্ত কথাটুকু বলতে বোধহয় কণ্ঠ কাঁপল ইহানের। তানিয়া আৎকে উঠল। এই মুহুর্তে এমন শোক সংবাদ শোনার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না সে। ইহান তার আব্বাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। ছোটবেলা থেকেই বাবার ন্যাওটা ইহান। সবসময় থানার মজলিশে আব্বার গল্প করে ইহান। সেই আব্বার মৃত্যু হয়েছে? এমন মুহুর্তে ইহানকে কি বলে সান্ত্বনা দিবে বুঝল না তানিয়া। মলিন মুখে বললো,

” আপনি বাড়ির সামনেই দাঁড়ান। আমি আসছি। আপনার সাথে যাবো।

” তানিয়া, থাকো।

” প্লিজ না করবেন না। আমি আসছি। এজ আ ফ্রেন্ড আমি আপনার সাথে থাকতে চাই। প্লিজ।

ফোন কাটল ইহান। তানিয়া পৌঁছাল পনেরো মিনিট বাদে। অটো ভাড়া দিয়ে শাড়ির কুঁচি ধরে দৌঁড় লাগাল। হন্তদন্ত হয়ে ইহানের বাড়ির সদর দরজা পার হলো। ইহানকে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সস্তি পেল তানিয়া। দ্রুত বেগে ইহানের সম্মুখ এসে দাঁড়াল। ইহান স্থির, সাবলিল। কাঠিন্যতা নেই চোখেমুখে। উদাস মনোভাব। তানিয়াকে দেখে সামনের দিকে পা বাড়াল সে। তানিয়া তাল মিলিয়ে হাঁটল ইহানের সাথে। কোনরুপ বাক্য ব্যয় করার মতো সুযোগ পেল না। সুযোগ বুঝে ল্যাপটপটা জানালা দিয়ে রাখল টেবিলে।

বাসে উঠে তানিয়া পুনরায় ইহানের দিকে তাকাল। পলকহীন ভাবেই তাকিয়ে থাকল। পাশাপাশি বসেছে তারা। ইহানের অভিব্যক্তি ধরতে পারল না তানিয়া। লোকটা এমন স্থির কেন? ভাবতে বসল দীর্ঘক্ষণ। বারবার তানিয়ার এইরুপ দৃষ্টি, মলিন চেহারা দেখে ইহান বিরক্ত হলো। ললাটে ভাঁজ দেখা দিল তার। বিরক্তির সহিত বলে উঠল,

” এভাবে তাকাচ্ছো কেন?

তানিয়া চুপ করে বসে রইল পাশে। বলতে পারল না মনের কথা। ইহানকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে ” আপনি কিভাবে এমন শান্ত আছেন ইহান? আপনার কষ্ট হচ্ছে না”? বলা হলো না সে কথা। টানা ছয় ঘন্টার বাস জার্নি করে গাজিপুর পৌঁছাল ইহান আর তানিয়া। ইহানদের বাড়িটা খোলামেলা। অনেকগুলো রুম এ বাড়িতে। এক তলার এই বাড়িটা অনেক পুরোনো বোধহয়। রঙ গুলো কেমন উঠে গিয়েছে। বাড়ির ভেতর থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে উঠছে। গা ছমছম করছে তানিয়ার। আত্মা কেঁপে উঠছে। একটা মানুষ পৃথিবী থেকে এইভাবে হারিয়ে গেল। না জানি তার আপনজনদের কি অবস্থা? তানিয়ার কান্না পাচ্ছে। কয়েক মাস আগেই ইহানের বাবার সহিত কথা বলেছিল তানিয়া। কেমন আছেন? কি করছেন? এ পর্যন্তই কথা সীমাবদ্ধ ছিল। আজ মানুষটা এভাবে চলে গেল ভাবতেই মন খারাপ হচ্ছে তার।

তানিয়া আর ইহান একটি ঘরে ঢুকল। ঘরটা থেকে কান্নাকাটি আর আহাজারি করার শব্দ আসছে। ইহান ধীর পায়ে এগিয়ে গেল ঘরে। দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। ইহানের আম্মা কান্নাকাটি করছেন লাশের পাশে বসে। ইহানের বাবার সাদা কাপড়ে মোড়ানো দেহটা ঢেকে রাখা। তানিয়া এমন অবস্থা দেখেই ইহানের হাত ধরল। ইহান একবার লাশের দিকে আরেকবার আম্মার দিকে তাকিয়ে রইল। টলতে থাকল ইহানের পা। দরজার হাতল ধরে নিজেকে সামলালো। চক্ষুদ্বয় লাল হচ্ছে ইহানের। কান্না করতে চেয়েও কান্না করতে না পারার দরুন এমন হচ্ছে। নাকের পাটা কাঁপছে থরথর করে। শ্যামলা মুখশ্রী রক্তিম রঙ ধারন করেছে। ইহানের আম্মা ছেলেকে দেখতে পেলেন। উঠে আসার সময় শাড়িতে পা পেঁচিয়ে পরে যেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলেন। ইহানের বুকে এসে ঠাই হলো উনার। ইচ্ছেমতো কিল দিলেন ইহানের বুকে। কান্না করতে করতে মহিলার গলার স্বর ভেঙে গেছে। মুখ ভিজে একাকার। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে তিনি বললেন,

” তোর আব্বার বারোমাসের শীত। প্রত্যেকদিন কম্বল নিয়ে ঘুমায়। আজ সকালে উঠে দেখি কম্বল নিচে পরে আছে। গায়ে দিতে গিয়ে দেখি শরীর ঠান্ডা। শ্বাস নেয় না। এত ডাকি উঠে না। ও আমাকে ছেড়ে গেল। আমি কি ভুল করেছি হ্যাঁ? কেন ছেড়ে গেল? এখন আমি কিভাবে একা থাকবো?

ইহান চোখ বুজল। আঁকড়ে ধরল আম্মার পিঠ। ছেলেটা এখনো কিভাবে শান্ত আছে বুঝতে পারছে না তানিয়া। ইতিমধ্যে ইহানের আম্মার কান্নাকাটি দেখে কান্না করতে করতে সর্দি জমিয়ে ফেলেছে তানিয়া। শাড়ির আঁচল দিয়ে বারবার নাক, মুখ মুছে যাচ্ছে। ফুঁপিয়ে উঠছে অনবরত। বিলাপ শুনে প্রচন্ড অসহায় লাগছে তানিয়ার। কান্নারত কণ্ঠে তানিয়া বলে উঠল,

” আন্টি এভাবে কাঁদবেন না। আল্লাহ্ যেন আঙ্কেলকে পরপারে সুখী রাখে এই দোয়া করুন। এভাবে কান্নাকাটি করলে আপনি অসুস্থ হয়ে পরবেন আন্টি। আপনার শরীর ভালো নয়।

ইহান ধীর পায়ে এগিয়ে এলো ইলমা বেগমকে( ইহানের আম্মা) আঁকড়ে ধরে। সোফায় নিয়ে বসাল। আম্মার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল ইহান। চোখেমুখে এখনো কাঠিন্যতা বজায় রেখেছে সে। কিছুই যেন হয়নি এমন ব্যবহার করছে। তানিয়ার বুঝ এলো না ইহান কি করে পারছে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে? কীভাবে পারছে কান্নাকাটি না করে থাকতে? এত ধৈর্য কেন লোকটার? সহ্য ক্ষমতা এত বেশি কেন? আজকের দিনেও লোকটা কাঁদবে না? কষ্ট পেয়েছে বোঝাবে না কাউকে? ইহান আটকে যাওয়া কণ্ঠে বলে উঠল,

” কেঁদো না আম্মা। আব্বা ভালো মানুষ ছিলেন। আল্লাহ্ তায়ালা উনাকে নিয়ে গেছেন। হায়াতের মালিক তো আল্লাহ্। উনি যা ভালো বুঝেছেন করেছেন। এতে আমাদের হাত নেই। তোমাকে তো বাঁচতে হবে। এভাবে কান্নাকাটি করলে অসুস্থ হয়ে পরবে। আব্বা তোমাকে কখনোই এভাবে দেখতে চাননি।

ইহানের আম্মার বিলাপ কমল না। তিনি হাত-পা ছোড়াছুড়ি করে কান্নাকাটি করতে লাগলেন। আশেপাশের প্রতিবেশীরাও আহত কণ্ঠে বিলাপ করলেন। বাড়িটাতে ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে। আশপাশ থেকে সকলে লাশ দেখতে আসছে। দু একবার অজ্ঞান হলেন ইহানের আম্মা। ইহান নির্বাক, নিশ্চুপ। ঠান্ডা মস্তিষ্কের আদলে বসে আছে। কারো সাথে কথা নেই, বিলাপ নেই। কঠিন চাহনি নিক্ষেপ করে লাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ক্ষণে ক্ষণে চোখের পলক ফেলছে। রক্তিম নাক ডলে যাচ্ছে।

সকালে লাশের কবর দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ইহানের ইচ্ছেতে প্রায় গভীর রাতেই বাড়ির সাথের ছোট্ট জমিতে কবর খোঁড়া হলো। কবর দেওয়ার সময় তানিয়া একচোট কান্না করল ইহানের আম্মার সাথে। “মৃত্যু” শব্দটা সত্যিই ভয়ঙ্কর। একদিন সবাইকে এর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। লাশ দেখলে কেন জানি বেশি ভয় হয় তানিয়ার। আপন মানুষ হারানোর যন্ত্রণা জড়িয়ে ধরে। ইহানের আম্মা এখন নিশ্চুপ। চুপচাপ বসে আছেন। চোখ এখন শুষ্ক। এক প্রকার মেঝেতে গড়িয়ে পরে আছে। যে যার ঘরে ঢুকে গেল কবর দেওয়া শেষে। মহিলার অবস্থা রুগ্ন, এলোমেলো শরীর। পাড়ার মানুষজন নিজেদের বাড়ি ফিরে গেল। কারোই আজ রাতে ঘুম হবে না। তানিয়া খুব চেষ্টা করল ইহান আর তার আম্মাকে খাওয়ানোর জন্য। কেউই রাতে খাওয়া-দাওয়া করল না। তানিয়া নিঃশব্দে ইহানের ঘরে ঢুকল। ইহান বিছানার কোণার চাদর হাত দিয়ে মুচরে ধরে বসে আছে। মাথা নত ছেলেটার। তানিয়া পাশে এসে বসল। কিছুক্ষণ চুপ করেই বসে রইল। মাঝে মাঝে হেচকি তুলে নিজের উপস্থিতির জানান দিল। ইহান এক পলক চেয়ে আবার ও মুখ নত করল। তানিয়া বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে চাইল। ইহানের হাতের উপর আলতো করে হাত রেখে বললো,

” কোনো মানুষই সারাজীবন বেঁচে থাকে না ইহান। আমাদের জীবনে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত আসে। আপনজনদের মৃত্যু আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় আঘাত। এই আঘাতটাকে মেনে নিতে হয়। দেখুন শুধুমাত্র এর বিরুদ্ধেই আমরা কোনো পদক্ষেপ নিতে পারি না।

চুপ থেকে পুনরায় বললো,
এভাবে বসে আছেন কেন? কান্না করুন। কথা বলুন। এইভাবে চুপচাপ বসে থাকবেন না। কান্না না করার কারণে আপনার চোখ-মুখ ফ্যাকাশে লাগছে। অস্থির লাগছে আপনাকে। কান্না করে নিজেকে একটু হালকা করুন। মনে খুলে কান্না করুন, যতক্ষণ না হালকা লাগে। কেন ইমোশন আটকে রাখছেন ইহান?

ইহান তানিয়ার দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল। বললো,

” আব্বার সাথে আমার সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না প্রথমে। আব্বা কখনোই চাননি আমি পুলিশে জয়েন করি। আমাকে ঝামেলা, ঝঞ্ঝাট থেকে দূরে থাকতে বলতেন সবসময়। কিন্তু পুলিশের পেশাটাকে আমি ভালোবাসি খুব। মানিনি উনার কথা। পুলিশে জয়েন করার পর আব্বা আমার সাথে তেমন ভাবে কথা বলতেন না। সিলেটের থানায় ট্রান্সফার হয়েছি শুনে আব্বা খুব কান্না করেছিলেন। ছেলেকে এত দূরে রাখতে তিনি চাননি। আবার জায়গা-জমি, বাড়ি-ঘর, চাকরি ছেড়ে ওখানেও যেতে চাননি। বারবার বলেও আমি আব্বাকে সিলেটে যাওয়ার জন্য রাজি করাতে পারিনি। আর আম্মাও ইচ্ছে পোষণ করেনি। শেষমেশ মনোমালিন্য হলো আমাদের মধ্যে। আমি আব্বার বিরুদ্ধে গিয়েই চলে গেলাম সিলেটে। এইতো কয়েক মাস ধরে আব্বা একটু ভালো করে কথা বলছিলেন আমার সাথে। জাফরের দুর্নীতি প্রকাশ পাওয়ায় টিভিতে আমার ছবি দেখে আব্বা খুব খুশি হয়েছিলেন। আমাকে নিয়ে গর্ব বোধ করেছিলেন।

এইভাবে উনি চলে যাবেন ভাবতে পারছি না আমি। মনে হচ্ছে এই বুঝি আব্বা বাইরে থেকে আসবেন। আমাকে দেখে হাসিমুখে বলবেন “এতদিন পর এলি? আব্বাকে মনে পরে না তোর? এত দেরি করিস কেন আসতে “? তানিয়া! তানিয়া আমার মনে হচ্ছে আমি কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছি। ঘুম ভাঙলেই সবটা ঠিক হয়ে যাবে। তুমি আমায় চিমটি কাটো তো। এটা কোনো দুঃস্বপ্নই হবে। আব্বা এভাবে চলে যেতে পারেন না। আমাদের সম্পর্কটা তো এখনো পুরোপুরি ভালো হয়নি।

তানিয়ার ঠোঁট ভেঙে এলো। চোখে বেয়ে তপ্ত, নোনা পানি গড়াল। এমন পরিস্থিতি কিভাবে সামাল দিবে সে? ইহানের মন এমন পাথর হলো কেন? লোকটা তো অসুস্থ হয়ে পরবে। তানিয়া ইহানের শক্তপোক্ত শরীর ধরে ঝাঁকিয়ে দিল। চোখ গরম করে উচ্চস্বরে বলে উঠল,

” ইহান এটা বাস্তব। আঙ্কেল আর নেই। আপনি সজাগ হন। কেঁদে নিজেকে হালকা করুন। এত শক্ত থাকতে হবে না। নিজের কষ্টটা বের করুন।

ইহান শুনল খানিকক্ষণ পর। মুহুর্তেই অশ্রুসিক্ত হলো ইহানের আঁখি। ঝরঝর করে মুখে হাত দিয়ে কেঁদে ফেলল ইহান। হাহাকার করে উঠল ইহানের বুকে। মাটিতে লুটিয়ে পরল ছেলেটা। চিৎকার করে উঠল। ফুপিয়ে উঠল ততক্ষণাৎ। নিজের হাত নিজে কামড়ে ধরল ইহান। হাতে কামরের অজস্র দাগ বসিয়ে ফেলল নিজের। শব্দ যেন বাইরে না যায় সেজন্য হাত দিয়ে মুখ ঢাকল। নিজের চুল নিজেই টেনে ছিঁড়তে লাগল ইহান। মেঝেতে হাত দিয়ে থাপড়ে ঝংকারের শব্দ তুললো। বিড়বিড় করে অশ্রুসিক্ত নয়নে বলে উঠল,

” আব্বা আর নেই। আব্বা কোথাও নেই। আমার আব্বা নেই। আমি আব্বার বাধ্য ছেলে নই। আব্বা আমাকে ক্ষমা করবেন না।

তানিয়া নিজেও কাঁদল। বক্ষপিঞ্জর কেঁপে উঠল। এভাবে ইহানকে কখনো কাঁদতে দেখেনি সে। এভাবে কি? কখনো কাঁদতেই দেখেনি ইহানকে। গুলি খেয়ে, ব্যথা পেয়েও এভাবে কষ্ট পায়নি লোকটা। এইভাবে বিলাপ করা তো অনেক দূরের কথা। দ্রুত নিজেও মাটিতে বসল তানিয়া। হাত ধরল ইহানের। ইহান আড়চোখে তাকাল। ইহানের রক্তিম চোখ দেখে ভয় পেল তানিয়া। এক ঝটকায় তানিয়াকে জড়িয়ে ধরল ইহান। আঁকড়ে নিল সন্তর্পণে। পিঠে জোর দিয়ে ধরে রাখল। তানিয়া হতবাক, ওষ্ঠাধর কেঁপে উঠছে। বাকশক্তি হারিয়েছে সে। পরিস্থিতি এতটা জটিল হবে ভাবেনি তানিয়া। বন্ধুত্বটাকে প্রাধান্য দিয়ে নিজেও আলতো হাতে জড়িয়ে ধরল ইহানকে। অদ্ভুত ভাবে শকড পেল। এভাবে ইহানকে কখনো দেখবে ভেবেছিল সে? বললো,

” আমি আপনার সাথে আছি ইহান। বন্ধু হয়ে সবসময় আপনার পাশে আছি। কাঁদবেন তো? কাঁদুন, খুব করে কান্না করুন। আজ কেউ আপনাকে আটকাবে না। প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রণা আমি বুঝি। আপনার কষ্ট আমি উপলব্ধি করতে পারছি।

ইহান ঝরঝর করে কাঁদল। প্রিয় মানুষকে বক্ষস্থলে পেয়ে কান্না করার আনন্দ বুঝতে পারল। বিড়বিড় করল বারবার। নিস্তব্ধ এই রজনীতে এক ঘরে দুজন মানব-মানবী একজন আরেকজনকে অনুভব করলো দু ভাবে। কেউ বন্ধু ভেবে আর কেউ ভালবাসার মানুষ ভেবে।

চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

প্রিয়তার প্রহর ২ পর্ব-০১

0

#প্রিয়তার_প্রহর (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ
[ অন্যত্র কপি কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। চাইলে শেয়ার করতে পারেন]

শালা শুয়োরের বাচ্চা, মেয়ে দেখলেই গো’পন অঙ্গ দেখাস। লজ্জা করে না? এখন আবার পালাচ্ছিস? দাঁড়া। আজ তোর একদিন কি আমার একদিন। জা*নোয়ার কোথাকার। ভয় পাচ্ছিস কেন?

মাঝ রাস্তায় একটি ছেলের পিছনে ছুটতে ছুটতে রাগান্বিত কণ্ঠে বাক্যটি আওড়াল একটি মেয়ে।

একাধারে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে হাপিয়ে উঠল মেয়েটি। প্রচন্ত পিপাসা পেল। তৃষ্ণায় তৃষ্ণার্ত হলো মুহুর্তেই। থামল না মেয়েটি। যত জোর আছে সবটা দিয়ে ছুট লাগাল ছেলেটির পেছন পেছন। বাজার, অফিস পেরিয়ে, কোলাহল পেরিয়ে পাকা রাস্তায় অবস্থান করল তারা। ছেলেটি ছুটে চলেছে। মনে অজানা ভয়। আতঙ্কে বারংবার পিছু ফিরে মেয়েটিকে দেখছে। মনে মনে চাইছে মেয়েটি লুটিয়ে পড়ুক রাস্তায়, আর দৌঁড়ানোর শক্তি না পাক। কিন্তু মেয়েটি দৌঁড়াতেই থাকল পিছু পিছু। বেশ কিছুক্ষণ দৌঁড়ে ছেলেটি হাপিয়ে উঠল। টলতে থাকল ছেলেটির পা। ইটের অহর্নিশ চাপে পা মচকে গেল। মুহুর্তেই ছিটকে রাস্তায় পরে গেল ছেলেটা। ব্যথায় মৃদু আর্তনাদ করে উঠল। আবার ও উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই খপ করে ছেলেটির কলার ধরে টেনে দাঁড় করাল এতক্ষণ পিছনে দৌঁড়াতে মেয়েটি। মেয়েটির পরণে ছাই রঙের ঢিলেঢালা থ্রিপিস। কোমর ছারিয়ে গিয়েছে বেনুনী। নাকে নোস রিং, হাতে চকচকে কালো ঘড়ি। মেয়েটির কপাল বেয়ে শ্বেতজল গড়াচ্ছে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে। ছেলেটির ভ্রূক্ষেপ নেই। পালানোর পন্থা অবলম্বন করতে চাইল সে। মেয়েটি সেই সুযোগ দিল না মোটেই। ঠাস করে কষে চড় মারল ছেলেটির বা গালে। তড়িৎ বেগে মাথা হেলে পরল ছেলেটির। চুল এলোমেলো হলো। বয়স কত ছেলেটার ? পঁচিশ কি ছাব্বিশ। ফিনফিনে রোগা চেহারা। চোখ লাল। পরণে আকাশি টি শার্ট আর কালো প্যান্ট। কোকড়া চুল। গায়ের রং শ্যামলা। নেশা জাতীয় দ্রব্যের জঘন্য গন্ধ বের হচ্ছে গা থেকে। মেয়েটি সমস্ত বল প্রয়োগ করেই বোধহয় চড়টা মেরেছে। ছেলেটির গালে দাগ বসে গিয়েছে। ঠোঁটের কোণে কেটে গিয়েছে। মেয়েটি নাকের ডগায় জমে থাকা স্বেদতজল ওড়না দ্বারা মুছে নিয়ে দু হাতে ছেলেটির কলার ধরে ঝাঁকাল। তেজী, দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠল,

” মেয়ে মানুষ দেখলে ক্ষুধার্ত হয়ে পরিস কেন রে? এত যৌ”বন জ্বালা তোর? পতিতালয়ে যা জা*নোয়ার, কু’ত্তা।

ছেলেটি আশপাশে তাকাচ্ছে। মেয়েটি চিৎকার করে উঠল পুনরায়। রাগে ফেটে পরছে মেয়েটি। কণ্ঠে ভারী রাগ। ক্ষণে ক্ষণে দাঁতে দাঁত চেপে রাগ নিবারণ করার চেষ্টা করছে। ছেলেটি বলে উঠল,

” আমি কিছু করি নাই।

” কিচ্ছু করিসনি? আমাকে দেখে শিস বাজালি কেন? জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজালি কেন? আর প্যান্টের ওই গোপন স্থানে হাত দিলি কেন কু’ত্তা? মেয়ে দেখলে হুশ থাকে না তাইনা? বাসায় মা বোন নাই তোর? শু’য়োর কোথাকার।

মেয়েটির এমন চিৎকারে মানুষজন জড় হয়ে গিয়েছে। সকলেই গোল করে দাঁড়িয়েছে মাঝ রাস্তায়। ঘটনাটা আগ্রহ নিয়ে দেখতে এসেছে সবাই। গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে জ্যাম বেঁধে গেল। দর্শকে ভরে উঠল জায়গাটা। সকলের মাঝে আলোচনা চলছে। মেয়েটির এখনো রাগ কমেনি। বল প্রয়োগ করে ছেলেটির চুল সজোরে টেনে দিল সে। ব্যথায় কুকিয়ে উঠল ছেলেটি। সবার উদ্দেশ্যে মেয়েটি বলে উঠল,

‘ একে চিনে রাখুন। এই লোকটা আমাকে কু প্রস্তাব দিয়েছে। খারাপ অঙ্গভঙ্গি দেখিয়েছে। একে কি করা উচিত আপনারাই বলুন? রাস্তাঘাটে আমরা মেয়েরা আজ নিরাপদ নই শুধু মাত্র এদের কারণেই। বাবা-মা এজন্যই আমাদের মেয়েদের একা বের হতে দিতে চায় না। এদের জন্যই ভয়ে ভয়ে চলতে হয় আমাদের। কেন? আমরা এমন লুকিয়ে চলবো কেন? এদেরকেই সমাজ থেকে তাড়ানো হোক। মেয়েরা নিরাপদে চলাচল করতে পারুক এবার।

ঘটনাটি সত্যিই চমৎকার। শ্লী’লতাহানির চেষ্টা করতে চাওয়া একটি ছেলেকে মাঝ রাস্তায় এভাবে গালিগালাজ আর মারধোর করছে একটি সাধারণ মেয়ে। মেয়েটির চোখে-মুখে কাঠিন্যতা, প্রতিবাদ করার মানসিকতা। সকলেই মুগ্ধ হচ্ছে ব্যাপারটাতে। সবাই মেয়েটির কথা শুনে ছেলেটির দিকে তাকাচ্ছে। রাগে গজগজ করতে লাগল প্রায় সবাই। একজন মহিলা বলে উঠল,

” এরে এখনই পুলিশে দেওয়া দরকার।

মেয়েটি নিঃশব্দে হাসল। ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের ক্রূর হাসি তার। সকলের দিকে চেয়ে বললো,

” এই লোকটা কি এমন ভুল করেছে বলুন তো আন্টি? কাউকে খুন করেনি, চুরি-ডাকাতি করেনি, গায়ে হাত ও দেয়নি। এর শাস্তি পুলিশ কি দিবে? দু দিন জেলে আটকে রাখবে, অতঃপর লোকটার পরিবার এসে অফিসারকে দু হাজার টাকা দিয়ে একে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে। ব্যস! কেশ ডিশমিশ। পুনরায় এই লোকটা একই কাজ করে যাবে।

” তাহলে কি করবা এরে? ছাইড়া তো দেওয়া যাইবোই না।

মেয়েটি এক হাত পায়ের কাছে এনে শক্ত জুতোটা পা থেকে খুলে ফেলল। ছেলেটির চোখেমুখে এক রাশ ভয় প্রতীয়মান দেখা দিল। পালানোর সুযোগ নেই। সকলেই ঘিরে ধরেছে ওদের। সবাইকে ধাক্কা দিয়ে পালানোর বৃথা চেষ্টা করল না ছেলেটি। হাত জোর করে ক্ষমা চাইল। মেয়েটি কি সে কথা শুনল? উঁহু! গায়ের সমস্ত বল প্রয়োগ করে ইচ্ছেমতো জুতো পেটা করতে লাগল। ছেলেটির পুরো শরীরে একের পর এক প্রহার করল। অনেকে মেয়েটির এই দুর্দান্ত কাজটি লাইভে দেখাল, কেউ বা পোস্ট করলো সোশাল মিডিয়ায়। মেয়েটির রাগ না কমা অব্দি প্রহার করতে থাকল। পাশ থেকে আরেকটি মেয়ে বলে উঠল,

” এই লোকটা আমাকে দেখেও এমন করে। আমি না দেখার ভান করে চলে যাই।

প্রহার থামিয়ে মেয়েটি ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। বলে উঠল,

” আমি না দেখার ভান করে থাকতে পারি না গো।

জ্যাম জনযাটে পুলিশের জিপও আটকে গিয়েছে। একটি জায়গায় গোলাকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বহু সংখ্যক মানুষ। অর্ধবয়স্ক পুলিশ এগিয়ে এলেন ঘটনাস্থলে। লোকজন সরিয়ে মেয়েটির সম্মুখে আসল। একটি ছেলেকে রাস্তায় কাত হয়ে শুয়ে থাকতে দেখল পুলিশ। ব্যথায় ছটফট করছে ছেলেটি। নেতিয়ে গিয়েছে একদম। গায়ে ক্ষতের দাগ স্পষ্ট। পুলিশটি সবার দিকে চেয়ে বললেন,

” কি হয়েছে এখানে?

একটু আগে রেগে থাকা মেয়েটি এখন নির্মল, শান্ত। পুলিশের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল সে। পুলিশকেই খুঁজছিল মেয়েটা। মেয়েটার হাসিতে ছিল প্রাপ্তি। সালাম দিয়ে সে বলে উঠল,

” এই লোকটা রাস্তায় মেয়ে দেখলেই নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দেখায়, শিষ বাজায়, বাজে ভাবে টিজ করে। আমাকে ও করেছিল। তাই মেরেছি। না মারলে এতক্ষণে পালিয়ে যেতো।

” পুলিশকে ডাকলেই তো হতো। এইভাবে রাস্তায় সিনেমা দেখানোর কি প্রয়োজন? ভিড় বাড়িয়েছেন কেন সবাই? যে যার কাজে যান

” প্রয়োজন নেই বলছেন? আমার রাগটা ওর উপর ঝেরেছি। এখন আপনাদের হাতে তুলে দিচ্ছি। নিয়ে যান ওকে।

সকলের সমর্থন ছিল মেয়েটির কথায়। তারাও পুলিশকে উদ্দেশ্যে করে বিচার চাইল। দু একজন বিচার দিল ছেলেটার বিরুদ্ধে। বয়স্ক পুলিশ ছেলেটাকে উঠিয়ে জিপে বসাল। জিপ স্টার্ট করার পূর্বে মেয়েটি বলে উঠল,

‘ আমি রোজ থানায় গিয়ে লোকটাকে দেখে আসবো। জিডি করতেও যাবো। একে তো আমি দেখে নিবো।

______________
দুপুরের তীব্র রোদ। গরমে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। গলা শুকিয়ে আসছে বারবার। কয়েকদিন আগেই শীত কমেছে, তবুও গরম প্রচুর। মেয়েটি বাড়ি পৌঁছে নির্দিষ্ট ঘরের দরজায় টোকা দিল। ওরনা দিয়ে পুনরায় ললাট মুছে নিল। হাতে তার বাজারের ব্যাগ। হাত ব্যথা করছে ব্যাগ ধরে রাখায়। মৃদ্যু স্বরে ডেকে উঠল সে,

” আরহাম, দরজা খোলো।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দরজা খুলল আরহাম। ছেলেটার মুখে প্রাণবন্ত হাসি। গোলাকার বড় বড় চোখ ও যেন হেসে উঠল। পলক ঝাপটাল বারবার। প্রিয়তাকে দেখে তার হাত থেকে বাজারের একটা ব্যাগ নিজের দু হাতে নিল আরহাম। প্রিয়তা ঘরে ঢুকে ফ্যানের নিচে বসল। ওড়না সরিয়ে পাশে রাখল। আরহাম বোনের এহেন অবস্থা দেখে পাশেই বসে রইল। এগিয়ে এসে বললো,

” আন্টি ঘর ভাড়া দিতে বলেছে।

প্রিয়তা থমকাল। আজ মাসের পাঁচ তারিখ। এত দ্রুত ঘর ভাড়া কে চায়? স্টুডেন্টদের বাবা-মা রা চাকরি করে। বেতন পায় সাত তারিখে। প্রিয়তার হাতে সেই টাকা পৌঁছাতে আট তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। অনেক গার্ডিয়ান আরো দেরিতে বেতন পায়। প্রিয়তা বাড়ি নেই এই সুযোগে মহিলা আরহামকে এসে টাকা চাই বলে কথা শুনিয়েছে। প্রিয়তা ফোস করে শ্বাস টানল। আরহামের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,

” দিয়ে দেবো।

” ডিশ বিল নিতেও এসেছিল। আমি বলেছি আপু দিবে।

” বেতন পেলেই দিয়ে দিবো। এক দিন টিভিতে ডিশ থাকলে দু দিন ডিশ থাকে না। দু দিন আবার ঝিরঝির করে। আসুক ওই ব্যাটা। আগে কয়েক কথা শুনিয়ে দেবো, তারপর টাকা দিবো। আর বাড়িওয়ালি যে টাকা চায়, কোন মুখে চায়? ঘরের টিন তো ছিদ্র। বৃষ্টি আসলে হুরহুর করে পানি পরে। হাঁড়ি-পাতিল মেলে ধরতে হয়। তোষক ভিজে যায়। জুবুথুবু হয়ে বসে থাকতে হয় সারা রাত।

আরহাম কিছুই বললো না। তাকিয়ে রইল ক্লান্ত বোনের মুখের দিকে। প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকাল। আরহাম আজকাল পিটপিট করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। কিছু একটা ভাবে। প্রিয়তা ব্যাগ হাতরে দশ টাকার ডেইরি মিল্ক বের করল। আরহামের হাতে গুঁজে দিল চকলেটটা। আরহামের চোখ-মুখ উজ্জল হলো। প্রিয়তা বললো,

” একটু পানি আনো তো। পিপাসা পেয়েছে।

” লেবুর শরবত বানিয়ে দেই?

” তুমি পারবে বানাতে? থাক, লেবু কাটতে গিয়ে হাত কেটে ফেলবে। দরকার নেই। পানি আনো শুধু।

” আমি পারবো আপু। দাঁড়াও তোমার সামনেই বানিয়ে দেখাই।

আরহাম ঘরের কোণে গেল। একটি গ্লাস এনে রাখল প্রিয়তার কাছে। খাটের নিচ থেকে একটা লেবু বের করে বটিও বের করল। মেঝেতে পা মোছার ন্যাকড়া রাখল। প্রিয়তা হাসল মনে মনে। সে নিজেই বলেছিল লেবু কাটতে হলে নিচে কিছু একটা দিয়ে রাখবে। নইলে মেঝে সাদা হয়ে যাবে। আরহাম সেই কথা মনে রেখেছে। ধীরে ধীরে ছেলেটা অতি উৎসাহের সাথে লেবু কাটল। বোনকে দেখাতে চাইল সে পারে এটা, সে আর ছোট নেই। লেবু চিপে রস বের করল আরহাম। জগ থেকে পানি ঢেলে তাতে লবণ দিল। সবটা প্রিয়তা পর্যবেক্ষণ করল সূক্ষ্ম চোখে। ছেলেটাকে আজকাল বড় বড় লাগে। এখন আর তেমন একটা বায়না করে না, প্রিয়তাকে কাজেকর্মে সাহায্য করতে চায়। আরহাম ডাম থেকে বয়াম বের করল। বয়ামে চিনি নেই। প্রিয়তার দিকে তাকাল সে। মুখটা মলিন করে বললো,

” চিনি তো নাই আপু।

” লেবু আর লবণ দিয়েই দাও।

আরহাম গ্লাসটা এগিয়ে দিল। প্রিয়তা গাল টেনে দিল আরহামের। ঢকঢক করে শরবত পান করল। তৃপ্তিতে মুখে হাসি ফুটল প্রিয়তার। ভাইয়ের এহেন যত্নে নিজেকে পরিপূর্ণ মনে করল।

শরবতটুকু খাওয়া শেষ হলে আরহাম গ্লাসটা নিচে রেখে বললো,

” আপু জানো কি হয়েছে?

” কি হয়েছে?

” তিহা আপু নাকি বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়ে গেছে।

” সে কি? এসব কে বললো তোমায়?

” তিহা আপুকে পাওয়া যাচ্ছে না। খালা কান্নাকাটি করছিল। আমি গিয়ে দেখলাম সবাই কি সব বলছে। বাড়িওয়ালী আন্টি বললো যে তিহা আপু নাকি বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়ে গেছে। একটা ছেলে নাকি বাড়ির সামনে এসে ঘুরঘুর করতো। তিহা আপু নাকি কথা বলতো।

অবাক হলো প্রিয়তা। না জেনে এসব কথা রটার জন্য দুঃখ ও পেল। বলল,
” এসব কথা কাউকে বলার দরকার নেই। তিহা ভালো মেয়ে। ওর সম্পর্কে এসব বলবে না।

” বয়ফ্রেন্ডের সাথে চলে যাওয়া কি খারাপ আপু? দেখিও, আমিও একদিন গালফ্রেন্ডের সাথে চলে যাবো।

প্রিয়তা হকচকিয়ে গেল। হাসি পেল খুব। এই ছেলেটা বলে কি? ওর বয়স তো মাত্র পাঁচ। এখনই গালফ্রেন্ডের সাথে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে আরহাম? ততক্ষণাৎ প্রশ্ন করলো প্রিয়তা,

” বয়ফ্রেন্ড, গালফ্রেন্ড মানে তুমি বোঝো?

” বুঝি তো। বয় মানে বালক আর ফ্রেন্ড মানে বন্ধু। দুটো মিলিয়ে হলো ছেলে বন্ধু। আর গালফ্রেন্ড মানে বালিকা বন্ধু।

” আচ্ছা জানো দেখছি। তা তুমি পালাবে কেন?

” তুমি তো আমাকে সময়ই দাও না। সারাদিন একা একা ভালো লাগে না বাড়িতে। তাই তো বন্ধুর সাথে ঘুরতে যাবো। আবার ফিরেও আসবো।

” এসব কথা আর যেন না শুনি।

” তোমার ও তো বয়ফ্রেন্ড আছে।

” মানে? কে?

‘ তন্ময় ভাইয়া আর..

” আর?

” প্রহর ভাইয়াও তো তোমার বালক বন্ধু। নত মুখে কথাটা বললো আরহাম।

প্রিয়তা থমকাল কিছু সময়ের জন্য। হৃদয়ে তোলপাড় শুরু হলো। প্রহর! প্রিয়তার প্রহর। কতদিন এই নামের মানুষটার থেকে দূরে আছে প্রিয়তা। প্রহরের খবর টাও নেয়না সে। কোথায় আছে প্রহর? কেমন-ই বা আছে? কি করছে এখন? আচ্ছা প্রহরের কি মনে পরে প্রিয়তার কথা? অস্থির অস্থির লাগে? প্রিয়তার জন্য পরান পুড়ে না প্রহরের? যন্ত্রণা হয় না বুকে? নাকি বিয়ে করে ছেলেটা সুখেই আছে? ভুলে গিয়েছে তথাকথিত বন্ধুকে? এইযে প্রিয়তার মনে যে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে, প্রতিক্ষণ যে দহনে জ্বলে একাকার হয়ে যায় প্রিয়তা, এটা কি প্রহরের সাথেও হয়? জানতে ইচ্ছে হয় প্রিয়তার। দেখতে ইচ্ছে হয় পুলিশম্যানকে। কিন্তু উপায় নেই। দুরত্ব এখন মাইল মাইল। সিলেট শহর ছেড়ে এখন ঢাকায় এসেছে তারা। সিলেটের মানুষ বলতে শুধু তন্ময়ের সাথেই যোগাযোগ আছে প্রিয়তার। নিজের সিমটাও সে বদলে ফেলেছে। অতিত মুছে ফেলতে চেয়েছে অনবরত। কিন্তু পেরেছে কি? সেই তিন ভবন বিশিষ্ট বাড়ি, বাড়ির সাথের মাঠ, খোলামেলা পরিষ্কার ছাদ, আর সেই বাড়ির বাড়িওয়ালার ছেলে। এদের কি ভুলতে পারবে প্রিয়তা? কখনোই না।

___

তানিয়ার ঘুম ভেঙেছে নয়টায়। গতকাল থানায় ছোটখাটো একটা কেস এসেছে। সেই বিষয়টা নিয়েই ঘাঁটাঘাঁটি করছে তানিয়া। ল্যাপটপ টা বিরক্তির সাথে খুললো সে। ভিক্টিমের ডিটেইলস সব রেখেছিল ল্যাপটপে। সেসব যাচাই-বাছাই করতে হবে। তানিয়া চশমা আটকে নিল চোখে। পুনরায় হাই তুললো। গতকাল রাতে ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে ইনফরমেশন গুলো কালেক্ট করেছিল তানিয়া। ল্যাপটপ অন করে কোনো ডিটেইলস দেখতে না পেয়ে ললাটে ভাঁজ পরল। বিস্ময়ে হা হয়ে গেল তানিয়ার মুখ। দ্রুত খটখট শব্দে টাইপিং করে তথ্য খোঁজার চেষ্টা করল। কোথাও তথ্যগুলো নেই। তানিয়ার ভারী মন খারাপ হলো। রাত জেগে সবটা কালেক্ট করল, আর এখন সেসব নেই? তানিয়া সেভ করেছিল তো? কনফিউসড হলো তানিয়া। এসময় ইহানের কথাটা সর্বপ্রথম মনে পরল তার। বালিশের নিচ থেকে মুঠো ফোন হাতে নিল তানিয়া। নির্দিষ্ট নম্বরে ডায়াল করল। দু বার রিং বাজার পরই কল ধরল ইহান। তানিয়া সালাম জানাল। জিজ্ঞেস করল,

“কি করছেন আপনি?

ইহান হাঁচি দিল। তার এক হাতে ময়দা লেগে আছে। অপর হাতে থুনতি ধরে আছে। ঘাড় বাঁকিয়ে ফোনটা কাঁধে রেখে কানে চেপে ধরল ইহান। পুনরায় হাঁচি দিল। রক্তিম নাক ডলে দিল। বললো,

” রান্না করছি। রুটি আর ডিম ভাঁজা।

” আপনার সর্দি লেগেছে নাকি?

” হ্যাঁ একটু লেগেছে।

” একটু তো মনে হচ্ছে না। নাকে পলিথিন বেঁধে রাখুন।

” ইয়াক, এসব কি কথা তানিয়া? ফোন রাখো। ফাজিল মেয়ে। আজেবাজে কথা।

” আরেহ্ শুনুন। মজা করেছি। সর্দি তো মনে হচ্ছে ভালোই লেগেছে। ঔষধ খেয়েছেন?

” হ্যাঁ একটু বেশিই। ওয়েদার চেঞ্জ হয়েছে সেজন্য। রান্না হলেই খেয়ে নিবো।

” আপনি ফ্রি আছেন? মানে কথা বলতে সমস্যা নেই তো?

” এই রান্নাটা হলেই ফ্রি আছি।

” দেখা করতে পারবেন একটু?

ইহান ভড়কাল। এই মেয়েটার থেকে যতই দূরে থাকতে চায় মেয়েটা ততই কাছে আসার বায়না ধরে। অপ্রস্তুত করে ইহানকে। মেয়েটা রোজ ফোন করে খবর নিচ্ছে। হুটহাট বাড়ি চলে আসে সমস্যা সমাধান করতে। বন্ধুত্বটা বলতে গেলে তানিয়াই টিকিয়ে রেখেছে। শুষ্ক ওষ্ঠদ্বয় জিভ দ্বারা ভিজিয়ে নিয়ে ইহান বললো,

” কেন?

” আমার ল্যাপটপের কিছু ইনফরমেশন রিকভার করতে হবে। কি করে ডিলিট হলো বুঝতে পারছি না।

” আশেপাশে টেকনোলজি সার্ভিসের তো অভাব নেই। আমাকে বলছো কেন? পুলিশ স্টেশনেও তো এসবের জন্য দক্ষ অফিসার আছ।

” আপনার কি আমার সাথে দেখা করতে সমস্যা আছে?

” ধুরর। তা নয়।

” আমি এই কেসটা নিয়ে কারো সাথে আলোচনা করিনি। আপনি তো সব দায় আমাকে দিয়ে রেখেছেন। আপনাকেই রিকভার করতে হবে।

” বাড়িতে আছি।

” আমি আসছি তাহলে। আপনি বাড়িতেই থাকুন।

” আচ্ছা।

_________

প্রহর থানায় বসে আছে নির্বিকার চিত্তে। ফাইলগুলো উল্টেপাল্টে দেখছে। ইহান অন্য থানাতে ট্রান্সফার হতে চেয়েছিল। অফার পেয়েছিল বড় অফিসারের কাছ থেকে। কিন্তু ইহানকে অনেক জোর জবরদস্তি করে সিলেটের থানায় রেখে এখানে ট্রান্সফার হয়েছে প্রহর। ইহানের পরিবর্তে প্রহর নিজে চলে এসেছে ঢাকায়। তানিয়া আর ইহান আছে সিলেটে। তানিয়া আর ইহানের সাথে প্রায়ই যোগাযোগ হয় প্রহরের। দু-তিন মাস পর আবার সিলেটে ফিরবে প্রহর। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এসেছিল এখানে। প্রহর ফিরতে চায়নি, ইহান আর তানিয়া অনুরোধ করেছে অনেকবার। প্রিয়তা চলে যাওয়ার পর ওরাই প্রহরের পাশে ছিল। তাই ওদের অনুরোধ রাখতে হবে। একই থানায় থাকতে চাইছে তিনজন। অগত্যা রাজি হয়ে দু-তিন মাস পরে ফিরবে বলে কথা দিয়েছে প্রহর। এজন্য দরখাস্ত জমা দিয়েছে উপরমহলের অফিসারের কাছে।

প্রহর ফোন বের করল। প্রিয়তার নম্বরে ডায়াল করল। প্রত্যেকবারের মতো এবার ও সিম বন্ধ দেখাল। ওপাশ থেকে নারী কণ্ঠে কেউ বলে উঠল, “এই মুহুর্তে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে”। হতাশায় ভুগল প্রহর। গত চার মাসে একই নম্বরে লাগাতার কল দিয়ে যাচ্ছে সে। একটা দিন ও সিমটা অন পায়নি। প্রিয়তা যে প্রহরের জন্যই সিম কার্ড খুলে রেখেছে, এটা প্রহর বুঝে। তবুও রোজ কয়েকবার করে কল করে নম্বরে। যদি প্রিয়তা সিম অন করে? ফোন ধরে?মেয়েটাকে বড্ড মিস করে প্রহর। খুঁজে বের করার উপায় নেই। যাওয়ার আগে মেয়েটা একটা চিঠি লিখে সেথায় বলেছিল ” আমাকে খুঁজবেন না প্লিজ। আমার কসম। আমাকে দূরে থাকতে দিন। আমরা হারাইনি। সেচ্ছায় চলে যাচ্ছি। তাই খুঁজবেন না আমায়”। আরো অনেক কথাই বলেছিল। সেসব মনে করতে চায় না প্রহর। ভাবতে চায় না।

ঢাকার একটি বড় কসমেটিক্স-এর দোকানে সেলসম্যানের কাজ করে প্রিয়তা। দুপুর তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত সেখানেই কাজ করে। সকাল নটা থেকে দুপুর বারোটা পর্যন্ত ভার্সিটিতে থাকে প্রিয়তা। এরপর দুইটা পর্যন্ত টিউশন করায়। আটটায় ফিরে নয়টা থেকে পাড়ার কয়েকটা বাচ্চাকে পড়ায়। ব্যস্ততায় কাটে সারাদিন। আরহামকে সময় দিতে পারে না বলে প্রায়সই অভিমান করে বসে থাকে আরহাম। আবার মাঝে মাঝে ছেলেটা বুঝতে পারে এত পরিশ্রমের কারণ। এখানকার একটা ভার্সিটিতে নতুন বছরে ভর্তি হয়েছে প্রিয়তা। দু দিন পর পর ভার্সিটিতে যায়। আরহামকেও শিশু শ্রেনীতে ভর্তি করেছে। রাতে বাড়ি ফিরে দুই-ভাই বোন খেয়ে পড়তে বসে। এটাই মূলত প্রিয়তার রুটিং। রোজ একই নিয়মে চলছে সে। আজ দুপুরে দোকান থেকে ফেরার পথে প্রিয়তা থানার পথটা ধরল। জিডি করা দরকার দ্রুত। থানায় একবার না গেলেই নয়।

প্রিয়তা ভিন্ন পথ ধরল। কিছুটা সময় নিয়ে থানায় পৌঁছাল। থানার সামনে দুজন কনস্টেবল দাঁড়ানো। প্রিয়তা তাদের সালাম গিয়ে ভিতরে ঢুকল। অফিসার নাকি মাত্র লাঞ্চ করতে বসেছে। আধ ঘন্টা বসতে হবে। প্রিয়তা বসল বাইরের একটা বেঞ্চে। সকালে রান্নাবান্না করে দোকানে যেতে হয় বলে ঘুম তেমন হয় না প্রিয়তার। ভেবেছিল বাড়ি গিয়ে আজ একটু ঘুমোবে। কিন্তু অফিসার ব্যস্ত জেনে রাগ হলো খানিক। বসে রইল সেখানেই। ঘড়িতে তখন বারোটা বেজে পয়ত্রিশ মিনিট। প্রিয়তা ভাবল ঘুমোবে। কিন্তু তা আর হলো না। থানায় কেউ এসেছে জেনে অফিসার নাকি লাঞ্চ শেষ করে ফেলেছে দ্রুত। প্রিয়তার রাগ গায়েব হলো। পুলিশটার বিবেক আছে বুঝতে পেরে ভালো লাগল। পা বাড়িয়ে অফিসারের ডেস্কে পৌঁছাল প্রিয়তা। ভিতরে ঢোকার অনুমতি চাইল,

” স্যার আসতে পারি?

গম্ভীর পুরুষালি কণ্ঠে ভেতর থেকে উত্তর এলো,

” আসুন।

প্রিয়তা কেবিনে প্রবেশ করল। মাথা উঁচু করল। অফিসারের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে বিমূঢ় হলো প্রিয়তা। ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইল কয়েক পল। ব্লু রঙের শার্ট পরিহিত লোকটা। গায়ের রঙ উজ্জ্বল। সেই একই রকম সৌন্দর্য। নেইমপ্লেটে দেওয়া পরিচিত নাম। আজ কতগুলো দিন পর মানুষটাকে সামনাসামনি দেখল প্রিয়তা? অনেকদিন। পরিচিত কণ্ঠ শুনতে পেল বহুদিন পর। প্রিয়তার চোখের কার্ণিশ অশ্রুতে ভরে গেল। ওষ্ঠদ্বয় কাঁপতে লাগল। জোয়ার বইল হৃদয়ে। পা দুটো টলতে লাগল। অস্থির ঠেকল প্রিয়তার। প্রিয় মানুষের সামনে আসায় ছটফটানি শুরু হলো। ঘন ঘন শ্বাস ফেলে প্রিয়তা এগিয়ে এলো। প্রহর নির্বিকার। গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,

” বসুন।

প্রিয়তা চেয়ারটা টেনে বসল। কণ্ঠে তার জড়তা। সম্মুখে বসে থাকা মানুষটাকে দেখে অন্তরাত্মা জুড়াল প্রিয়তার। বলতে পারল না সেসব। প্রহর তাকিয়ে রইল প্রিয়তার দিকে। প্রহরের এমন একটা মুহুর্ত নেই যে মুহুর্তে প্রিয়তার কথা মনে পরেনি। প্রিয়তাকে দেখে হৃদয় কাননে পুষ্প সতেজ হলো প্রহরের। প্রেমের উত্তাপে জ্বলে যাওয়া বুক শীতল হলো খানিক। তীক্ষ্ম চোখ দ্বারা পর্যবেক্ষণ করল প্রিয়তাকে। প্রিয়তার পরণে কালো রঙের কামিজ। চুল এখন পিঠ ছাড়িয়ে কোমড় ছড়িয়ে পরেছে। প্রিয়তার আদল বদলেছে। খানিক ওজন এসেছে শরীরে। গুলুগুলু লাগছে মেয়েটাকে। মায়া মায়া নজরে এপাশ ওপাশ তাকালে বুকটা ধক করে উঠছে প্রহরের। পুলিশ ইউনিফর্মের নিকট এ অনুভূতি অগোচরেই রইল। জিজ্ঞেস করলো,

” আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?

চলবে?

প্রিয়তার প্রহর সিজন-০১ পড়তে লেখাটি উপর ক্লিক করুন।

অটবী সুখ পর্ব-৩৩ এবং শেষ পর্ব

0

অটবী সুখ

শেষ পর্ব.
বিশ্বে এমন কিছু মানুষও আছেন, যারা মানুষের রক্ত পান করতে ভালোবাসেন। তাদের দাবি, রক্ত পানের মাধ্যমে তাদের মাথাব্যথা, পেটের জ্বালাপোড়া, ক্লান্তি ভাব দূর হয়। তারা এও বিশ্বাস করেন, রক্ত পান তাদের দৈহিক ও মানসিক শক্তি জোগায়। নাহ্! এটা কোনো ড্রাকুলা কিংবা ভ্যাম্পায়ার ঘটিত কাল্পনিকতা নয়। মানুষের এই রক্ত পান করাটা আসলে এক ধরণের রোগ। আমার মা, সিন্ড্রেলা স্টিফেনও এরোগে আক্রান্ত ছিলেন।

বাবা এ কথা জানতেন না। পড়ালেখার সূত্রে বিদেশে যাওয়ার পরই মায়ের সঙ্গে তার দেখা, প্রণয়, প্রেম। পাঁচ বছর জমিয়ে প্রেম করার পর তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, বিয়ে করবেন। নানাবাড়ির সবাই মেনে নিলেও আপত্তি জানালেন দাদাবাড়ির মানুষ। আমার দাদা উচ্চবংশের জমিদার। বিশাল ফ্যাক্টরির মালিক। তাদের একটা সুনাম আছে, নামডাক আছে। একে তো বিদেশিনী, তারওপর বিধর্মী! এমন মেয়েকে তারা কিভাবে নিজের বড় ছেলের বউ হিসেবে মেনে নেবেন? তারা মানলেন না। বাবা শত চেষ্টা করার পরও দাদার মন গলেনি। বাবা ভাবলেন, হয়তো বিয়ে করে ফেললে দাদার এই মান অভিমান, অভিযোগ নিঃশেষ হবে। কিন্তু কই? পরিস্থিতি যেন তখন আরও খারাপের দিকে ধাপিত হলো, আরেকধাপ খাদে নামলো। অনেকটা অপরিকল্পিত ভাবেই বাবাকে তেজ্যপুত্র ঘোষণা করলেন দাদা।

বাবা তখন মোটামোটি স্ট্যাবলিশ। বিদেশ থেকে মাত্র পড়ালেখা শেষ করে দেশে ফিরেছেন। ব্যাগ ভর্তি তাজা সার্টিফিকেট। টাকাও ছিল চলার মতো। মাকে নিয়ে বাবা নতুন জীবন শুরু করলেন। বাসা ভাড়া নিলেন। চাকরী শুরু করলেন। আস্তে আস্তে তাদের ছোট্ট সংসারটা একটু জমিয়ে, একটু হিসেবি হয়ে বড় হতে লাগলো। আমার মায়ের অতশত চাওয়া পাওয়া ছিল না। একটুতেই তাকে খুশিতে আত্মহারা হতে দেখছি আমি। দেখেছি, বাবার প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা, শ্রদ্ধা। বাবাকে ভালোবাসেন বলেই হয়তো তাকে হারানোর ভয়ে কখনো নিজের অসুস্থতার কথা বাবার সামনে প্রকাশ করেননি তিনি। কাউকে করতেও দেননি। শুরু থেকেই বিষয়টা চেপে গেছেন। প্রেমের সম্পর্কে থাকাকালীন লুকিয়েচুকিয়ে রক্ত পান করলেও বিয়ের পর রক্তপান প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন মা। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো তখন… যখন আমি আসলাম আমার মায়ের গর্ভে।

শুনেছি, গর্ভবর্তী মায়েদের অনেক কিছু খেতে ইচ্ছে করে। টক, ঝাল, মিষ্টি! কিন্তু আমার মায়ের ইচ্ছে করতো, মানুষের তাজা রক্ত পান করতে। আমার বাবা কাজ পাগল মানুষ। প্রায়ই বাসার বাহিরে থাকতেন। আমার অসুস্থ মা তখন সারাবেলা বিছানায় শুয়ে শুয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা করতেন, অনেক কিছু ভাবতেন। তার মনের দৃঢ় বিশ্বাসটা তখন আবারও জাগ্রহ হতে লাগলো, রক্ত পান করলে বোধহয় তার মানসিক, দৈহিক শক্তিটা ফিরে আসবে। তাকে এভাবে বিছানায় আর শুয়ে বসে থাকতে হবে না। তিনি আবারও হাসি খুশি হয়ে যাবেন।

সারাদিন বিশাল বড় ফ্ল্যাটে একা থাকা আমার মা এসব চিন্তায় যত না অসুস্থ ছিলেন, তারচেয়ে বেশি অসুস্থ হয়ে পরছিলেন। একটুখানি রক্তের তৃষ্ণায় তার বুকটা হাহাকার করে উঠছিল। বুক থেকে গলা অব্দি চৌচির হয়ে গিয়েছিল নিঃশব্দ কান্নায়, চিৎকারে। এজন্যই হয়তো বাবাকে বলেই ফেলেছিলেন, তাকে যেন একটু রক্ত এনে দেওয়া হয়… তিনি যন্ত্রণায় মরে যাচ্ছেন।

মায়ের বর্ণনাগুলো আমার স্পষ্ট মনে আছে। বিছানায় অসুস্থতায় কাতরাতে কাতরাতে তিনি তখনো বাবার প্রশংসা করে যাচ্ছিলেন। এত মায়া তার পুরো মুখশ্রীতে! কিন্তু কথাগুলো তো মধুর ছিল না। আমার, সুখনীল ত্রিস্তানের নামের মতোই তার মা বাবার জীবনটাও ত্রিস্তান সাগরের স্রোতে ডুবছিল। আমি তাদের জীবনে আসার পর থেকেই তাদের সুখ সুখ সংসারে ফাটল ধরে। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, আমিই দায়ি। আমিই সব করেছি। সব দোষ একান্তই আমার।

মা বাবার কাছে রক্ত চাওয়ার পর বাবা কি করেছিলেন আমি জানি না। মা সেসব বলেননি। তাদের প্রেমের কোনো কিছুই আমার আর জানা নেই। তবে বাবাকে ছোটবেলায় দেখেছি, মায়ের অনেক যত্ন নিতে। মা প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। ঘরের কাজ, রান্নাবান্না, তনয়া আর আমাকে সামলানো প্রায় সব কাজই বাবা একা হাতে সামলাতেন। মাঝে মাঝে দেখতাম, কোথা থেকে লাল রঙের পলিথিন ভর্তি কি যেন ফ্রিজে রাখছেন। কৌতূহল বশত আমি খেয়েও ফেলেছিলাম ওগুলো। বাবার তখন সে কি রাগ! মায়ের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া করে বাসা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। কোথায় গিয়েছিলেন, কি করেছিলেন, জানি না। সম্ভবত আমাদের জঙ্গলের বাড়িটায় দু’রাত কাটিয়ে এসেছিলেন। তারপর… তারপর সব শান্ত! বাবা ফিরে এলেন। সব আগের নিয়মে চলছিল। মায়ের নিয়ম করে অসুস্থ হওয়াটা বেড়ে গিয়েছিল অবশ্য। আমিও বড় হলাম। সবে কলেজে উঠেছি। বাবার সঙ্গে সঙ্গে ঘর সামলাচ্ছি, তনয়ার খেয়াল রাখছি। তখন বোধহয় প্রতিবেশী সবাই আমার মাকে ‘সুখী নারী’ বলে হিংসে করতো। আমাদের দেখলে বলতো, “অ্যা হেপি ফ্যামিলি”

আসলেই কি হ্যাপি ফ্যামিলি? যারা আমাদের হ্যাপি ফ্যামিলি বলতো তারাই তো আমাদের পরিবার ধ্বংস করে দিয়েছে। মায়ের অসুখ… আরো কি কি বিশ্রী কথা রটিয়ে খবরে ছাপিয়ে দিলো, “বাংলাদেশে মিলল বাস্তবিক ভ্যাম্পায়ার! মানুষ হয়েও ভ্যাম্পায়ারের মতো রক্ত পান করেন যারা”
সাথে মায়ের শাড়ি পরা হাস্যোজ্জ্বল ছবি! আমার দাদাবাড়ির মানুষ তখন সবে আমাদের মেনে নিতে শুরু করেছিলেন। এরমধ্যে… এই খবর… এসব… সব তছনছ করে দিলো! দিনে দিনে এই একটা খবর সব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পরলো। লাখ লাখ লাইক, কমেন্ট, ভিউ-র মাঝে কিভাবে যেন আমাদের পারিবারিক একটা ছবিও ভাইরাল হয়ে গেল। ছবিটা পুরোনো বলে আমি আর তনয়া মোটামোটি বেঁচেই গিয়েছিলাম। কিন্তু বাবা বাঁচতে পারেননি। তিনি গুণী বলে তাকে চাকরি থেকে বিদায় না করলেও বুলিং জিনিসটা কম হয়নি। পাঁচ দিনের ভেতর আমাদের এলাকা ছাড়তে নোটিশও দেওয়া হলো। কিন্তু আমরা কোথায় যাবো? অনেক সখ করে বাবা ফ্ল্যাট কিনেছেন। এ ফ্ল্যাট ছাড়া যদিও আমাদের অন্য একটা বাড়ি আছে। কিন্তু ওটা জঙ্গলে। ওখানে গেলে আমরা খাবো কি? তাছাড়া অন্য কোথাও যে বাসা ভাড়া নেব, তারও উপায় নেই। পুরো দেশ যে আমার মাকে চেনে! আমাদের চেনে!

বাবা সেই ফ্ল্যাটে, সেই এলাকায়, সেই চাকরি নিয়েই রয়ে গেলেন। আস্তে আস্তে আনন্দ ফুর্তি করা আমার বাবাটা কেমন যেন পালটে গেল। আমাদের কারো সঙ্গেই তেমন কথা বলতেন না। বললেই রেগে যেতেন। মায়ের সঙ্গে তার ঝগড়া হতে লাগলো প্রচুর! মা কাঁদতেন, আমি দেখতাম। কেন যেন আমারও তখন মন মেজাজ ভালো ছিল না। এসবের জন্য মাকেই দোষী করতাম কতশত বার! স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েগুলো আমাকে আর তনয়াকে চিনে ফেলেছিল। বেশি বুদ্ধীমান কিনা! সবাই যা-তা ব্যবহার করতো। স্যার-ম্যাডাম পর্যন্ত! কলেজে যেতে ইচ্ছে করতো না। এদিকে কলেজে না গেলে সারাদিন মায়ের কান্না দেখতে হতো। আমার ভালো লাগতো না। অসহ্য লাগতো।

ভালো ছেলেমেয়েগুলো আমার সঙ্গে না মিশলেও খারাপ ছেলেরা আমার সঙ্গে ভাব জমাতে চাইতো খুব। কারণটা আমার জানা নেই। কখনো জানতে চাইনি। ওরা কি কি যেন খেত। সিগারেট, আফিম আরও কত কি! আমাকেও জোড় করতো। খেতে না চাইলে বন্ধুত্ব ভেঙ্গে দিবে বলে হুমকি দিতো। আমার তখন কথা বলার কোনো মানুষ ছিল না। ওদের সাথে কথা বললে আমার একটু হালকা লাগতো। বন্ধুত্ব নষ্ট হওয়ার ভয়েই আমি ওগুলো খেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, আর কেউ না থাকলেও ওরা আমার সঙ্গে সবসময় থাকবে। কি বোকা আমি!

আমি মাদকাসক্ত হয়ে পরলাম। ড্রাগস ছাড়া আমার চলতো না। সারাদিন বাসায় শুয়ে বসে সিগারেট ফুঁকতাম। ড্রাগস নিতাম। বাহিরে গেলেও তাই! এসবের মাঝে আমার যে একটা বোন আছে, আমি সেটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। বাবা তো সেই কবেই আমাদের দায়িত্ব নেওয়া ভুলে গেছেন। বোনটা আমার সারাদিন একা একা থাকতো। বাসা থেকে কলেজ! আবার কলেজ থেকে বাসা……. ওর তো কোনো দোষ ছিল না! সব দোষ আমার, আমার মায়ের, আমার বাবার। তাহলে ওকে কেন শাস্তি পেতে হলো? নিষ্পাপ মেয়েটা কেন শাস্তি পেল?

আমার বোন, তনয়া সিন্ড্রেলা সুখনীল! আমার কারণেই আমার বন্ধুদের হাতে ধর্ষিত হয়েছিল। আমার অসুস্থতার কথা বলে কলেজ থেকে আসার পথে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল আমার বোনকে। দুদিন আমার বোন বাসায় ফিরেনি। বাবা পাগলের মতো পুলিশের দাঁড়ে দাঁড়ে ঘুরিছিলেন শুধু। কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি। এরপর… এরপর আবারও খবরের নিউজ! আবারও বিশ্রী এক শিরোনাম! বিভৎস লাগছিল টিভিতে আমার বোনকে। জানোয়ারগুলো এমন ভাবে আমার বোনকে আঘাত করেছিল যে ওর চেহারা পর্যন্ত চেনা যাচ্ছিল না। বোন আমার তখন আধা পাগল। আমি সারাক্ষণ নেশায় বুদ! বাবার ঝগড়া করাটা যেন হাজারগুণ বেড়ে গেলে। এত বাড়লো যে, একদিন ঝগড়ার মাঝে রাগের মাথায় মাকে ধাক্কা দিয়ে বসলেন তিনি। বোধহয় একটু বেশি জোড়েই। দূর্বল মা আমার ধাক্কা সামলাতে পারলেন না। কাঁচের টেবিলের উপর পরে গেলেন। কাঁচ বিঁধলো, মায়ের গলায়! শরীরে! মাথায়! মরে গেছে জেনেও বাবা ছুটলেন হস্পিটালে। বেপরোয়া ভাবে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। আমি তো তখনো নেশায় বুদ ছিলাম, যতটুকু শুনেছি, রং রোডে গাড়ি চালানোতে এক্সিডেন্ট হয়েছে।

বলা হয়নি, তনয়া তখন ছয় মাসের প্রেগন্যান্ট। ঝগড়া করে বাবা যখন আমার মাকে মেরে ফেললো, ও আমাকে ডাকতে এসেছিল। আমি নিজের মাঝে ছিলাম না। ঘুমাচ্ছিলাম। ওর ডাকে উঠিনি। বাবার এক্সিডেন্টের খবর শুনে ও যখন আবারও আমাকে ডাকতে এলো, আমি তখনো ঘুমাচ্ছিলাম। এরপর যখন চোখের পাতা মেলি, অঘোষিত উৎফুল্ল তন্দ্রা ঘোর যখন কাটে, ততক্ষণে সব শেষ হয়ে গেছে। আমি হারিয়ে ফেলেছি আমার জীবনের মূল্যবান দুটি মানুষ। আর তনয়া… আমার কারণে, আমার জন্যই ওর পেটের সন্তানটা হারিয়ে ফেলেছিল ও। সিঁড়ি দিয়ে তাড়াহুড়োয় নামতে গিয়ে।
সেই থেকেই বোধহয় তনয়ার কিছু মনে নেই। বাচ্চাদের মতো আচরণ করে। ঠিক ছোটবেলার আমার সেই ছোট্ট পুতুলটার মতো! মাঝে মাঝে বলে, ওর নাকি বিয়ে হয়েছিল, বাচ্চা ছিল! আসলেই কি তাই? আচ্ছা! এমনও তো হতে পারতো। হলো না কেন?
১২ই মার্চ।

আমি এই ডায়েরীটা কেন লিখেছি কিংবা লিখছি, আমি জানি না। আমার ডায়েরী লেখার অভ্যেস কোনো কালেই ছিল না। ইদানিং সবকিছু ভুলে যাচ্ছি বলেই হয়তো। এত এত মানসিক চাপ আমি নিতে পারছি না। মাদক, বিড়ি, সিগারেট— এসব ছাড়তে চাচ্ছি। কিন্তু হচ্ছেই না! একা একা এসব ছাড়া সম্ভব নয়। পাশে কাউকে দরকার হয়। কিন্তু আমার তো কেউ নেই। নানাদের আমি কখনো দেখিনি। দাদা সেই যে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন! বাবা মারা যাওয়ার পরও তাকে একবার দেখতে আসেননি। আমি যদি আমার চিকিৎসা করাতে কোথাও চলে যাই, তাহলে আমার বোনকে কে দেখবে? ভাবছি, জঙ্গলের বাড়িটায় চলে যাবো। এখানে থাকা আর সম্ভব না। প্রতিবেশীরা এখন ঘর অব্দি চলে আসতে শুরু করেছে। ওদের কাছে যেগুলো আশ্বস্ততা, আমাদের কাছে সেগুলো তিক্ততা। ওরা সেটা কেন বোঝে না?
৩০শে মার্চ

আমার ভুলে যাওয়ার রোগ বেড়েছে। বাবা মা ঘটিত অনেক কিছুই মনে পরে না। মাঝে মাঝে তনয়াকে দেখে চমকে উঠি। ওকে চিনতে পারি না। ও যখন আমার সাথে ভাব জমাতে আসে, খেলতে চায়, আমার তখন এত বিরক্ত লাগে! আমি বুঝতে পারছি, আমার অসুস্থতা কোনো স্বাভাবিক অসুস্থতা না। অতি রঞ্জিত ভয়াবহ কিছু। আমি অবশ্য ভালো কিছু আশাও করি না। আমার জীবনটাই যেখানে দুঃক্ষের সাথে ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িত, আমি সুখ খুঁজে পাবো কোত্থেকে?
২৫শে এপ্রিল

আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার মা মরে নি। আমার সাথেই আছেন। হাসছেন, কথা বলছেন! আমার তখন এত ভালো লাগে! মাকে ইচ্ছে করে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে। তারপর হঠাৎ করেই মা উধাও! বুকটা খালি হয়ে যায়। আফসোস হয়, যদি আগের সময়গুলোতে ফেরা যেত! এইতো! এইতো সেদিনই তো মায়ের হাতে ভাত খেয়েছিলাম। বোনের বেণুনী টেনে মজা নিচ্ছিলাম। এখন হাত বাড়ালেই সব শূণ্য কেন? চোখ মেললেই সব ঘুটঘুটে অন্ধকার কেন?
৩০ এপ্রিল

আমি বিরল রোগে আক্রান্ত। পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার। রোগটার নাম শুনলে আগে হাসি পেত। এমনও রোগ হয় নাকি? একই মানুষ কিন্তু দুইটা চরিত্র! কি হাবিজাবি কথা! অথচ সেই রোগটাই আমার সঙ্গে বন্ধুত্বের জন্য হাত বাড়িয়েছে। আমি সেই হাতটা ধরেছিও! ফ্রিজে হঠাৎ রক্তের ব্যাগ আসার কারণটাও আমার কাছে এখন স্পষ্ট। এই রক্তের ব্যাগ কোথা থেকে এসেছে আমার জানা নেই। তবে ডাক্তারদের ধারণা, আমি আমার মায়ের চরিত্রটাকে নিজের মাঝে ধারণ করে ফেলেছি। যা নেই, আমি তাও বাস্তব ভেবে জীবনযাপন করতে শুরু করেছি। রোগটা নাম… ঠিক মনে পরছে না। তবে ভালোই হয়েছে। আমি সব ভুলে গেলেই ভালো। এসব মানসিক চিন্তা থেকে তো অনতত মুক্তি পাবো!
৩ জুন

তনয়ার মতো এখন আমারও মনে হয়, ওর বিয়ে হয়েছিল। আমি জানি এটা সত্য নয়। তবুও কেন যেন আমার ভেতর সত্ত্বা কথাটা মানতে চায় না। লোকেদের আমি এটাই বলে বেড়াই। যারা আমাকে চেনে, তারা হাসে, বাজে বাজে মন্তব্য করে। আমি অবুজ হয়ে তাকিয়ে রই। কিছুই করতে পারি না। আমি এত ব্যর্থ সন্তান! ব্যর্থ ভাই!
সেদিন ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। তনয়ার ব্যাপারে কথা বলতে। ও ঠিক হবে কি-না জানতে। ডাক্তার বলেছেন, ঠিক হওয়ার চান্স ফিফটি-ফিফটি। আমি শুনেছি, সায় দিয়েছি, এরপর চলে এসেছি রিপোর্ট সমেত। সেই হাসপাতালে আর যাইনি। অন্য কোনো হাসপাতালেও না। এই ফ্ল্যাট বেচে হলেও আমি তনয়ার চিকিৎসা করাতে পারবো, এ ক্ষমতা আমার আছে। কিন্তু তনয়া যদি ঠিক হয়ে যায়? আমার কর্মের জন্য আমায় যদি ঘৃণা করে? আমি তা মেনে নিতে পারবো না। আপন মানুষ বলতে ওই-তো আছে আমার জীবনে। ও চলে গেলে আমি একা হয়ে যাবো না?
আবিষ্কার করলাম, আমি আসলে স্বার্থপরও!
২৫ জুন

আমি আমার আর তনয়ার চিকিৎসা আর করাই নি। শহর থেকে বহুদূরে, মফস্বল এলাকার বাড়িটাতে চলে এসেছি। ছোটবেলায় একবার এসেছিলাম এখানে। অনেক রহস্য লুকিয়েচুকিয়ে বানানো জঙ্গলের এই বাড়িটা। বাবার অনেক সখের। নিচে একটা পাতাল ঘরও আছে। আমার কেন যেন মনে হয়, ওখানে মা আছেন। আমাকে ডাকছেন। আমি সেখানে লুকিয়ে রেখেছি তাকে। লোকচক্ষুর আড়ালে। যেন আবারও সেই কালো অতীতটা ফিরে না আসে। লোকে যেন মায়ের ব্যাপারে জেনে না যায়…..
আশেপাশের মানুষদের কত কি যে বানিয়ে বানিয়ে বলি! ওরা বোকার মতো বিশ্বাস করে। আমাদের চেনে না বলেই হয়তো। কিন্তু এই মিথ্যেগুলো আজকাল সত্য মনে হয়। সত্য মিথ্যার পার্থক্যটা আমি ঠিক ধরতে পারছি না। কোনটা সত্য? আমার মা বেঁচে নেই? নাকি আমার মা আছেন? ওই পাতাল ঘরটায়?
১৬ জুলাই

ডায়েরীর বাকি পাতাগুলো খালি। শেষের এক পৃষ্ঠার মধ্যখানে অবশ্য ছোট্ট করে লিখা, এ ডায়েরীটা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। ত্রিস্তান হয়তো এটার কথা ভুলেই গিয়েছিল। এজন্য হয়তো পুড়ে ফেলাও হয়ে ওঠেনি।

অটবীর জট পাকানো প্রশ্নগুলোর ঘুরপাক থেমে গেল। সব এবার স্পষ্ট হতে লাগলো একটু একটু করে। পাতালঘরে আসলে কখনোই কেউ ছিল না। ওসব ত্রিস্তানের কাল্পনিকতা। ত্রিস্তান যখন নিজের সত্ত্বায় থাকে, তখন তার মস্তিষ্ক তাকে এ বলে দাবিয়ে রাখে, ওখানে তার মা আছেন। সে তাকে সেখানে আটকে রেখেছে। সেই ভাবনা থেকেই ত্রিস্তান যখন যখন তার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে পাতালঘরে যায়, তার চরিত্র পালটে যায়। ওখানে সে কি করে, না করে কিছুই তার মনে থাকে না। সে নিজেই নিজের মায়ের সত্ত্বা ধারণ করে, কাঁদে, হাসে, কথা বলে। ঠিক যেমনটা তার মা করতো? গায়ে শতশত আঁচর দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে নিজ শরীর। তার পরপরই যখন কাল্পনিক রাজ্যের ঘোর ভাঙ্গে, ত্রিস্তানের মস্তিষ্ক তাকে শিখিয়ে দেয়, ওটা আসলে ওর মায়ের দেওয়া আঘাত। ওর কর্মের ফল। নিজ মনেই মায়ের সঙ্গে এক কাল্পনিক সাক্ষাৎ সাজিয়ে নেয় ত্রিস্তান। একা একা কষ্ট পায়, দুশ্চিন্তায় ভোগে, বিষণ্ণ হয়! এমনি এতকাল সে মানুষদের তার সম্পর্কে যা যা বলেছে, যা যা করেছে সবটাই কাল্পনিক রাজ্যে বসবাস করা মস্তিষ্কের জোড় থেকেই। ওটা আসল ত্রিস্তান না। আসল ত্রিস্তানটা বোধহয় সমাজের কুৎসিত আচরণের কবলে মরে গেছে। আর ফিরেনি….

রয়েসয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো অটবী। হাতে তখনো ত্রিস্তানের ডায়েরী, তনয়া আর তার মেডিকেল রিপোর্টস্! সযত্নে সেগুলো আবারও তোশকের নিচে রেখে ত্রিস্তানের পানে তাকালো সে। লোকটা গভীর তন্দ্রায় আচ্ছন্ন। ঘণ্টা দুয়েক ঘুমাবে। এখন উঠবে না। ঘড়িতে ন’টা বাজছে প্রায়। রাতের রান্না করতে হবে। ভেবে ভেবে ত্রিস্তানের মুখপানে আরেকদফা তাকালো অটবী। হাত বাড়িয়ে চুলের গভীরে, কপালে, চোখে, ঠোঁটে একে একে আঙুলের আলতো স্পর্শ একে দিতে লাগলো। অল্প ঝুঁকে কপালের একেবারে মধ্যিখানে অধর ছুঁইয়ে দিতেই ক্ষীণ নড়েচড়ে উঠলো ত্রিস্তান। অটবী আর অপেক্ষা করলো না। সাবধানে উঠে দাঁড়ালো। লোকটার শরীরে কম্বল জড়িয়ে দিলো।

ত্রিস্তান তার জন্য ঠিকই আইসক্রিম এনেছিল। সবুজ পলিথিনে মোড়ানো দু’তিনটে চকবার সেই বহু আগে থেকেই মেঝেতে পরে আছে। এতক্ষণে হয়তো গলেও গেছে। মেঝে থেকে পলিথিনটা উঠিয়ে নেওয়ার মাঝেই শুনতে পেল, দরজার ওপাশ থেকে সরোজের তুমুল কণ্ঠস্বর। মৃদু চাপা কণ্ঠে একাধারে ভাবি ভাবি ডেকে চলেছে সে। দরজা খুলতেই একবার ঘরের ভেতর উঁকি মেরে উৎসুক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “কি হইছে ভাবি? ভাই কি কিছু কইছে? বুইঝা ফেলছে নাকি সব? তুমি কি কিছু খুঁইজা পাইছো?”

অটবী ক্লান্ত নয়নে তাকালো, “একসাথে এতগুলো প্রশ্ন করলে কিভাবে উত্তর দেব, সরোজ?”
—“এক এক কইরাই দাও। আমি আর অপেক্ষা করতে পারতেসি না, ভাবি।”

বলতে বলতে আবারো ঘরের ভেতর উঁকিঝুঁকি মারলো সরোজ। ত্রিস্তানকে ওভাবে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে বললো, “ত্রিস্তান ভাই ওইভাবে ঘুমায় ক্যান? তোমাগো মাঝে ঝগড়া টগড়া কিছু অয় নাই?”
—“তুমি কি আমাদের ঝগড়া জন্য অপেক্ষা করছিলে?”

এপর্যায়ে ভীষণ বিরক্ত হলো সরোজ, “মজা নিও না তো, ভাবি! আমি এহন এমনেতেও সিরিয়াস। যা কাম হওনের কতা আছিল, তা ওই রহিম বাটপার আইজকা করবো না। ভাই এদিকে আইসক্রিম কিন্নাই বাসায় চইলা আইবো। অনেক কষ্টে তারে দোকানে পাঁচ দশ মিনিট আটকাই রাখছিলাম। সে আর থাকবোই না! ঘরে আইসে, তোমারে ডাইকাও পায় নাই। হে তো বুইঝা গেসে কিছু একটা গন্ডগোল। ধইরা বাইনধাও আটকাইবার পারি নাই। সোজা রুমে ঢুইকা দরজা আটকাই দিসে।”
একটু থেমে বললো, “তুমি কি কোনো ইম্পোর্টেন্ট কিছু পাইছিলা? ওই মহিলারে খুঁইজা পাইছো?”

অটবীর চাপা নিশ্বাস। প্রথমেই কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। গলে যাওয়া আইসক্রিমগুলো ফ্রিজে রেখে দেবার জন্য রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো সে। বিড়াল ছানার ন্যায় তার পিছু নিলো সরোজও।
—“আমি আর তনয়া ছাড়া এখানে কোনো মেয়ে থাকে না, সরোজ।”
—“তাইলে আমি কার চিৎকার শুনছি?”

সরোজের চোখে মুখে কৌতূহল। ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত। যেন আজ সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেই ছাড়বে সে। তার এহেন নাছোরবান্দা স্বভাব দেখে অল্পসল্প হতাশ হলো অটবী। বললো, “ঠিক কেমন আওয়াজ শুনেছো, সেটা তো বলতে পারছি না। তবে ত্রিস্তানের মোবাইলে তার মায়ের একটা ভিডিও আছে। সেখানে তিনি কাঁদছিলেন। চিৎকার করে।”

আগামাথা হীন কথা! সরোজ সহজেই বুঝতে পারলো না। কিংবা বুঝলোই না। সেকেন্ড কয়েক বোঝার চেষ্টা করেও যখন কথাগুলো মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল, অবুঝ কণ্ঠে সে সুধালো, “আমি কিছু বুঝবার পারতেছি না, ভাবি। সহজ কইরা কও।”

কেবিনেট থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো একে একে নামিয়ে রাখতে লাগলো অটবী। চুলার পাশ থেকে চপিং বোর্ড নিয়ে পিয়াজ কাঁটতে লাগলো। রয়েসয়ে বললো, “ত্রিস্তান অসুস্থ, সরোজ। তিনি যা করেছেন, করছেন সবটাই কাল্পনিক। রক্ত দিয়েও তিনি কি করেন, আমি জানি না। হয়তো ফেলে দেন, নয়তো…”
বলতে বলতে থমকালো অটবী। অনুভূত হলো, কথাটা সরোজকে বলা ঠিক হবে না। কাউকেই বলা ঠিক হবে না। ত্রিস্তানের মায়ের সঙ্গে যা হয়েছিল, তা যদি ত্রিস্তানের সঙ্গে হয়? সরোজকে সে চেনে। মরে গেলেও ভাই সমতুল্য ত্রিস্তানের নামে একটা বদনামও সে রটাবে না। তবুও কোথা থেকে এক তীক্ষ্ণ সুর বাকি কথাগুলো বলতে বিচ্ছিরি বাঁধা দিচ্ছে অটবীকে।

পাশ হতে সরোজের লাগাতার প্রশ্ন, “এত ট্যেকা দিয়া রক্ত কিন্না ভাই রক্ত ফালাই দেয়? এইডা কেমন কতা, ভাবি? তুমি কি ভালো কইরা খোঁজ নিছিলা?”
—“একবার বলেছি তো, সরোজ! ত্রিস্তান অসুস্থ! একজন অসুস্থ মানুষ থেকে কিই-বা আশা করছো তুমি? কি শুনতে চাচ্ছো?”

সরোজের নমনীয় কণ্ঠস্বর, একরাশ বিশাল অনুরাগ, “আমি বুঝবার পারছি, ত্রিস্তান ভাইয়ের কোনো অসুখ হইছে। এইডাও বুঝবার পারতেছি, তুমি আমার কাছ থেইকা কিছু লুকাইতেছো। কিন্তু এইডা ঠিক না, ভাবি। আমি ভাইরে আমার আপন মানুষ থেইকা কম কিছু মনে করি না। হে আমার বড় ভাই। হের কিছু হইলে হেইডা আমার জানবার অধিকার আছে। তার কষ্ট একেবারে মাইরা ফেলতে না পারি, ভাগাভাগি তো কইরা নিতে পারুম?”
গাঢ়, দৃঢ় কথাগুলোর মাঝে কি যেন ছিল। কাজ করতে থাকা অটবীর হাত দুটো আচমকাই থেমে গেল। সরোজের শান্ত কণ্ঠে বলা একেকটা কথা শুনে মনে হলো, সে আর ছোট নেই। অনেক বড় হয়ে গেছে।

বলবে না বলবে না করেও সবটা বলে ফেললো অটবী। একেবারে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সবটুকু! ভেবেছিল, সত্য শুনে সরোজ চমকাবে, বিরূপ ভঙ্গিমায় মুখ বাঁকাবে। কিন্তু নাহ্! সরোজ অতশত চমকালো না। শুধু প্রশ্ন ছুঁড়লো, “এহন কি করবা, ভাবি? ভাইরে ডাক্তার দেইখাইবা না?”

ভাবুক অটবী চুলার ফুটন্ত তরকারির দিকে তাকিয়ে আছে। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। রয়েসয়ে, সময় লাগিয়ে বহুক্ষণ পর সে ধীর কণ্ঠে উত্তর দিলো, “আমি আসলে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছি, সরোজ। লোকটার তার অতীতের প্রায় অনেক কিছুই মনে নেই। বিশেষ করে তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশটা, অধপতনটা। ত্রিস্তান তনয়ার চিকিৎসাও করায়নি এই ভেবে, তার বোন হয়তো তাকে ঘৃণা করবে। ছেড়ে চলে যাবে। এমনকি নিজের অসুস্থতার কথা জেনেও সে চুপ ছিল। নিরবে কষ্ট পেয়েছে, কষ্টে কাতরেছে। সব কিছু ভুলে যাওয়াটা তার কাছে আনন্দের। সেখানে আমি কিভাবে তাকে আবার অন্ধকারে ঠেলে দেই? কোন অধিকারে?”

সরোজের কণ্ঠস্বর ক্ষীণ কাঁপলো যেন। সামান্য প্রতিবাদ করতে চাইলো, “এইভাবে তো ভাই আরও অসুস্থ হইয়া পরবো, ভাবি। তারওপর ভাইয়ের নাক দিয়া হঠাৎ হঠাৎ রক্ত পরে।”

এ কথার জবাব পাওয়া গেল না৷ জবাব দিতে অটবীর ইচ্ছে করলো না। তরকারিতে ধনেপাতা ছড়িয়ে দিয়ে বললো, “তনয়া কি এখনো ঘুমাচ্ছে, সরোজ? ওকে একটু ডেকে আসো। দুপুর থেকে ঘুমাচ্ছে মেয়েটা।”

সরোজ তনয়াকে ডাকতে গেল ঠিকই, কিন্তু যাওয়ার পূর্বে ভীষণ অর্থপূর্ণ কণ্ঠে বলে গেল, “তুমি যা-ই করো না ক্যান ভাবি; তা যদি ভাইয়ের ভালার লাইগা হয়, আমারে সবসময় তোমার পাশে পাইবা।”
নাহ্! ছেলেটা সত্যিই হুট করে বড় হয়ে গেছে।

বিশাল আকাশ কোণে তপ্ত সূর্যের উত্তপ্ততা আজ একটু কম। মৃদুমন্দ বাতাসে গাছপালা অল্পসল্প দুলছে, খেলছে। সুদুর কোথা থেকে কাকের কা কা ডাক শোনা যাচ্ছে। জানালা গলিয়ে বাহিরে তাকাতেই দেখা মিললো, দূর গাছের ডালে বসে থাকা কাকটির। আপাতত কয়েকধাপ ডাকাডাকি শেষে সে একটু বিশ্রাম নিচ্ছে। চোখ বুজে ঝিমাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে!
অটবী তখন বিকালের নাস্তা বানানো শেষে মাত্রই সোফায় এসে বসেছে। পাশে খাতায় কি যেন আঁকিবুঁকি করে ভরিয়ে ফেলছে তনয়া। ঠোঁটে তৃপ্ত হাসি তার। চারপাশে রঙপেন্সিল ছড়িয়ে-ছিটানো। দৈবাৎ, কলিংবেলের শব্দ হলো। একবার, দুইবার, তিনবার! অটবী উঠতেই নিচ্ছিলো, এরমাঝে কোত্থেকে হন্তদন্ত পায়ে দৌড়ে এলো সরোজ। অটবীকে দেখে সামান্য ভড়কালো। সদর দরজা খুলতে খুলতে বোকা হেসে বললো, “ন-নলী মনে হয় আইসা পরছে, ভাবি। হেহ্ হেহ্।”

অথচ অটবীর মুখমন্ডল দৃঢ়, হাসিহীন। চোখ ছোট ছোট করে সরোজকে আগাগোড়া পরখ করছে সে। যেন রক্তগরম দৃষ্টি দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে, আমার বোন থেকে দূরে থাকো!

সরোজ আর সেখানে দাঁড়ালো না। একপলক প্রাণপ্রিয় প্রিয়তমাকে পরাণ ভরে দেখে পকেট থেকে ফোন বের করলো। মিছেমিছি অভিনয় করতে লাগলো, “ওহ্হো! আমারে তো ত্রিস্তান ভাই ফোন দিছিলো! কি করুম কন তো, ভাবি? ভাইয়ের আমারে ছাড়া চলেই না! এসএমএস কইরাও কইতেছে, তার নাকি আমারে দরকার। আমি আরও নলী…. না মানে আপনাগো লগে থাকতে চাইছিলাম। কিন্তু কি আর করার! ভাইয়ের আমারে দরকার।”
পরপরই এক প্রকার চোরের মতো করেই পালিয়ে গেল সেখান থেকে।

—“সরোজ ভাই এভাবে পালিয়ে গেলো কেন, আপা? তুমি কি আবারও তারে ভয় দেখাইছো?”
প্রশ্নটা নলীর। সোফায় বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলো সে।
অটবী সে কথার উত্তর দিলো না। প্রসঙ্গ পাল্টে বললো, “আম্মা নাকি আচার পাঠিয়েছে? কই? আনিস নি সাথে?”
—“এনেছি। ব্যাগে আছে।”

বলতে বলতে কাঁধ ব্যাগ থেকে দুটো আচারের বোয়ম বের করলো নলী। একটা বড় বক্সও আছে সাথে। প্রশ্ন ছুঁড়লো, “ত্রিস্তান ভাইয়া কই? আম্মা ভাইয়ার জন্য পিঠাও পাঠিয়েছে।”
—“বাহিরে গেছে একটু আগে। এখনই চলে আসবে। তুই বল, আম্মা আর পৃথা কেমন আছে? পৃথাকে আনিস নি কেন সাথে?”

পৃথার কথা জিজ্ঞেস করায় একটু বরং বিরক্তই হলো নলী৷ সেই বিরক্তিটুকুর পরিমাপটা তার কণ্ঠেই বোঝা গেল, “ওর কথা জিজ্ঞেস কইরো না তো, আপা! ওই ছেমড়ি ভালোই আছে। এখনো তোমার ফোন দিয়ে কাদিনের সাথে প্রেম করে। ওই ছেলে যখন ওরে ছ্যাঁকা দিবে, তখন বুঝবে মজা!”
অটবী শুনলো, বুঝলো। নরম কণ্ঠে বললো, “তুইও সাবধানে থাকিস, নলী। ভুল কিছু করিস না।”
—“আমি আবার কি ভুল করবো? সরোজকে তো তুমি চিনোই, আপা।”

হাত বাড়িয়ে আমের আচারটা খুললো অটবী। তনয়া মুখিয়ে আছে একটুখানি আচার চেখে দেখবার জন্য। লোভনীয় দৃষ্টি সেই বহু আগে থেকেই আচারগুলোর পানে সীমাবদ্ধ। অটবী তাকে একটুখানি আচার খাইয়ে দিতেই উৎফুল্ল হয়ে উঠলো তনয়া। খিলখিল করে হাসলো। হাসলো অটবীও। লহু হাসি, দুই তিন সেকেন্ডের জন্য। পরপরই নলীর চোখে চোখ রেখে কেমন কাঠিন্যতা নিয়ে বললো, “আমি তোদের ক্ষেত্রে ত্রিস্তানকেও বিশ্বাস করবো না, নলী।”

সময় গড়িয়েছে। বিশাল বারান্দার মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে পশ্চিম আকাশের ডুবি ডুবি সূর্যটাকে দেখছে অটবী। অপেক্ষা করছে প্রাণ পুরুষের, তার দুঃখ মানবের। এমনটা সে প্রায়ই করে। একটু অবসরে, একটু অলসতা নিয়ে নিজেকে এই একান্ত সময় দেওয়াটা ভীষণ প্রিয় অটবীর। সারাদিনে সে কি করলো, পরবর্তীতে তার কি করা উচিত, কি করা উচিত না— এসব ভাবনাতে সূর্যের মতোই অল্প অল্প করে ডুবে যায় অটবী। কিন্তু ভাবনাগুলো তার শেষ হয় না। মাঠ, ঘাট, দিগন্ত, প্রান্ত ছাপিয়ে শূন্যে ভাসে। চাপা দীর্ঘশ্বাসগুলো আবারও জড়ো হয়ে আন্দোলন চালায়। এত করুণ আন্দোলন!

হঠাৎ, পেছন থেকে দুটো হাত অটবীর কোমড় জড়িয়ে ধরলো। অটবী চমকাল ক্ষীণ। ভাবনা গুড়িয়ে ভঙ্গুর হলো। জিজ্ঞেস করলো, “কখন এসেছেন?”

ত্রিস্তান তখন অটবীর মাঝে মগ্ন। অটবীর নিজস্ব ঘ্রাণে সিক্ত। ছোট্ট করে উত্তর দিলো, “এখনই।”
—“নলী এসেছিল। আপনার সাথে দেখা করবে বলে অনেক্ষণ অপেক্ষাও করেছিল মেয়েটা। আপনি আসতে এত দেড়ি করলেন যে? এতক্ষণ বাহিরে কি করছিলেন?”
ত্রিস্তান আগের মতোই উত্তর দিলো, “একটু কাজ ছিল। বন্ধুদের সাথে ছিলাম।”

সঙ্গে সঙ্গে ত্রিস্তানের দিকে ফিরলো অটবী। মুখোমুখি হলো। কপালে হাজারটা ভাঁজ ফেলে গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “আপনি আবারও রহিমদের ওখানে গেছেন, তাই না? আপনাকে কতবার বলেছি ওদের সাথে না মিশতে? কথা কেন শুনছেন না, ত্রিস্তান? দুটো টিউশন তো করছেনই! এখনো ওদের সঙ্গে মেশার কি দরকার….”

অটবীর কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই ডান গালে চট করে একটা চুমু এঁকে দিলো ত্রিস্তান। অটবী গরম চোখে তাকালো। আবারও কিছু বলতে নিলেই তার বাম গালে আরও একবার চুমু খেলো ত্রিস্তান। মুচকি হেসে সুধালো, “তুমি রাগলে আমার এত ভালো লাগে কেন, অরণ্য?”

অটবী জবাব দিলো না। মুখ ফুলিয়ে রাখলো। তা দেখে আরেকদফা হাসলো ত্রিস্তান। দীর্ঘ, লম্বা হাসি! অটবীকে শক্ত করে বাহুডোরে জড়িয়ে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো, “বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম, অটবী। রহিমদের সাথে না।”
—“হু? আপনার আবার কোন বন্ধু….” বলতে বলতে থমকালো অটবী। কিছু একটা মনে পরতেই আবার জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা, আমাদের বিয়েতে আপনার কিছু বন্ধু এসেছিল না? সাক্ষী দিতে? ওদের সাথেই কি দেখা করতে গিয়েছিলেন?”
—“ওদের কথা তোমার এখনো মনে আছে?”
—“আছে।”

অটবী দু মিনিট চুপ থাকলো৷ কি যেন ভাবলো। এরপর সাবধানে জিজ্ঞেস করলো, “ওরা কে, ত্রিস্তান? ওদের সাথে আপনার কিভাবে দেখা হয়েছে? না মানে… আমি তো শুনেছিলাম আপনার তেমন একটা বন্ধুবান্ধব নেই।”
—“পাঁচ মাস আগে শহর থেকে কিছু স্টুডেন্ট এসেছিল, ঘুরতে। ওরা বিপদে পরায় আমি সাহায্য করেছিলাম।”
—“তারপর থেকে ওরা আপনার বন্ধু?”
—“হ্যাঁ।”

স্পর্শের গভীরতা বেড়েছে। বেড়েছে তীব্র বাতাসের আনাগোনা, অন্ধকার নিকষকৃষ্ণের ঘনত্ব। বুকের বা’পাশের যন্ত্রটার ধুকবুক নিয়ন্ত্রণ হারা হতেই অটবী আটকালো, “আপনি মাত্র বাহির থেকে ফিরেছেন, ত্রিস্তান! ফ্রেশ হবেন না?”
ত্রিস্তানের ব্যস্ত উত্তর, “পরে।”
বলতে বলতে অটবীর অধরে অধর ছুঁইয়ে দিতে চাইলো সে। অটবী দিলো না। আবারও আটকালো। চোখে চোখ রেখে আস্তে করে বললো, “কালকে কিন্তু আমাদের ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।”

চোখের পলক পরলো। বেশ কয়েকবার। প্রশ্ন করলো, “ডাক্তারের কাছে কেন? মাকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাবে?”

অটবী হাসলো মাত্র। অদ্ভুত লুকোচুরি মাখা হাসি! পায়ের পাতার ওপর ভর দিয়ে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো ত্রিস্তানের গলা। ত্রিস্তান চমকালো। টাল সামলাতে সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকলো সে নিজেও। বলতে চাইলো, “কি হয়েছে, অরণ্য?”

অথচ অটবী তার ওষ্ঠধর ছুঁয়ে দিতেই সব কথা থেমে গেল! উড়ে গেল! বলা হলো না, অটবীর জন্য সে একটা উপহার এনেছে। সদর দরজায় লাগাবার জন্য ছোট্ট একটা নেমপ্লেট। যেখানে খুব সুন্দর কারুকাজে লিখা আছে, ‘অটবী সুখ’

_________________

সমাপ্ত~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

অটবী সুখ পর্ব-৩২

0

অটবী সুখ

৩২.
জানালার শুভ্র পর্দা নড়ছে। সূক্ষ্ণ রোদ্দুরের আলোটুকু কাঠের মেঝে রাঙিয়ে দিচ্ছে অনায়াসে। ফ্যান চালু নেই। বিদ্যুৎ নেই হয়তো। তবুও গরম লাগছে না। ভোর রাতের দুষ্টুমিষ্টি, স্নিগ্ধ বৃষ্টির দরুণ আবহাওয়া সেই তখন থেকেই ঠান্ডা ঠান্ডা। গায়ে মোটা কম্বল জড়ানো। অটবীর লতাপাতার মতো বাঁকানো ছোট্ট শরীরটা পুরো ঢেকে আছে ওতে। অল্পসল্প মুখাবয়ব দেখা যাচ্ছে। ত্রিস্তান একটু নড়তে চাইলো। খেয়াল হলো, তার বাম হাতটা অটবীর দখলে। হাতটাকে বালিশ বানিয়ে বুকের সঙ্গে সুখ সুখ অনুভূতি নিয়ে লেপ্টে আছে মেয়েটা। তার নড়াতে বরং অটবীর অসুবিধে হচ্ছে। ফোলা ঠোঁটটাকে আরেকটু ফুলিয়ে ফেলেছে সে। বাচ্চাদের মতো! ত্রিস্তান ক্ষীণ হাসলো। চোখের ঘুম নিমিষে উবে গেল। আলতো হাতে প্রেয়সীর এলোমেলো চুলগুলো কানে গুঁজে অল্প ঝুঁকলো সে। কপালের মধ্যিখানে অধর ছোয়ালো। গভীর ভাবে, দৃঢ়তার সঙ্গে। পরপরই লহু কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “প্রিয় অরণ্য, তুমি আরও আগে এলে না কেন?”

প্রশ্নটা অবান্তর। ত্রিস্তান নিজেই অটবীকে তার জীবনে আরও আগে আসতে দেয়নি। এখন যখন আসতে দিলো! কোনো মতেই আর ছাড়তে চাইছে না। আষ্টেপৃষ্টে যদি মেয়েটা বুকপাজরে বেঁধে রাখা যেত! ত্রিস্তান জানে, সে অসুস্থ। খুব গুরুতর কিছু হয়েছে তার। কিন্তু সেই রোগটা কি… তার মনে নেই। মনে করার চেষ্টাটুকু করতেও এত এত আলসেমী কাজ করে! মাঝে মাঝে অবশ্য আকাশচুম্বী কিছু ভয় হুরহুর করে হানা দেয়, ডাকে। বলে, “শোন গো সুখনীল ত্রিস্তান, তোর যে কিচ্ছু হবে না৷ তুই যে একা মরবি!”

ভয়ে ত্রিস্তানে গলা শুকিয়ে যায়। হাঁসফাঁস করে। প্রতিবার অটবীর দিকে তাকালেই মনে হয়, মেয়েটা তাকে ছেড়ে চলে যাবে। তার অজান্তে করা ভুলে তাকে ঘৃণা করবে। ত্রিস্তান মনের এই ভাবনাগুলোকে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। ভয়ানক সব ইচ্ছে জাগে তার। কখনো কখনো ভাবে, রান্নাঘরের নিচের তাকে থাকা মোটা লম্বা দড়ি দিয়ে অটবীকে বেঁধে রাখবে, ঘরে আটকে রাখবে। কোথাও যেতে দেবে না। তবে যদি তার ভয়টা একটু কমে! পরক্ষণেই মনে হয়, এমন করলে যদি তার অটবী কষ্ট পায়? তাকে যদি আরও ঘৃণা করে? বিরূপ চিন্তায় পাগল হয়ে যায় ত্রিস্তান। দিশেহারা বোধ করে। এখনো! এখনো তার অটবীকে বেঁধে রাখতে ইচ্ছে করছে। সবসময় করে। অটবী তার এত কাছে! বুকের মধ্যখানে ওর মাথা। ওর এক হাত ত্রিস্তানকে জড়িয়ে আছে। তবুও উড়ন্ত দ্বিধার এতখানি বিষাক্ত ছোঁয়া! বুকে চাপা ব্যথা! ত্রিস্তান বুঝে পায় না। মারাত্বক উন্মাদনায় অটবীকে নিজের সাথে আরও শক্ত করে জড়িয়ে নেয়। বিড়বিড় করে আওড়ায়, “আমি প্রচন্ড ভীতু, অটবী। তুমি আমার ভয় কাটিয়ে দাও। কালো অন্ধকারগুলো দূরে সরিয়ে দাও। আমার হাত-টা শক্ত করে ধরো, অটবী।”

পুনঃপুন করে জ্বলতে থাকা চুলার কড়াইয়ে আলু ভাঁজি হচ্ছে। আধসিদ্ধ এখনো। হতে আরও দশ-বারো মিনিটের মতো লাগবে। রুটি বেলতে বেলতে ঘড়ির দিকে একবার তাকালো অটবী। সকাল দশটা বেজে দু’মিনিট। ত্রিস্তান এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। কালরাত্রি বেলা ভীষণ জ্বরে কাতরাচ্ছিল লোকটা। ‘মা’ ‘মা’ বলে করুণ সুরে বুলি আওড়াচ্ছিল। অটবী সস্নেহে চুলে হাত বোলানো মাত্রই সে শান্ত, নিশ্চুপ! বন্ধ চোখের কোণে অঘোষিত দু’ফোঁটা জলের বিষাদময় অস্তিত্ব!
ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো অটবী। ঢাকনা তুলে আলু ভাঁজিটা একটু নেড়েচেড়ে দিলো। পেছন হতে সরোজের গলা শোনা গেল, “কি ভাবি? কি রাঁনধেন?”

নাহ্! সম্মোধনটা অটবীর ভালো লাগলো না। কপাল কুঁচকে ঘাড় ঘুরিতে তাকালো সে। সরোজ তখন ফ্রিজ খুলে ঠান্ডা পানির বোতল বের করছে। জিজ্ঞেস করলো, “তুমি আমাকে ভাবি কবে থেকে ডাকতে শুরু করলে, সরোজ? নতুন কি ফন্দি আঁটছো?”
সরোজ সময় নিলো। সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিতে পারলো না। পানির বোতল থেকে ঢকঢক করে পানি পান করে পরপরই চোখ মুখ দারুণ ভাবে কুঁচকে বললো, “ছি! ছি! ছিহ্… তুমি আমারে এমন ভাবো, ভাবি? আমি তোমারে নিয়া ফন্দি আটুম? বড় ভাইয়ের বউরে লইয়া? নাউজুবিল্লাহ, নাউজুবিল্লাহ! এমন বিচ্ছিরি সন্দেহ কইরো না গো। তুমি ত্রিস্তান ভাইয়ের বউ দেইখাই তোমারে ভাবি ডাকনের প্রেকটিস শুরু করছি৷ আর তুমি আমারে এমন ভাবে সন্দেহ করতাছো? এইডা ঠিক না ভাবি, এইডা ঠিক না।”

সরোজের কণ্ঠে অতিরিক্ত রংঢং, মন খারাপের কৃত্রিম রেশ। অটবী শুনলো মাত্র। জবাব দিলো না। নিজের কাজে মন লাগালো। এখনো অনেক কাজ বাকি পরে আছে। চা বানাতে হবে। ত্রিস্তানকে ডাকতে হবে। লোকটার জ্বর সেরেছে কি-না তাও তো একবার দেখা হয়নি।
চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাসগুলো আরেকদফা ধূলিসাৎ হলো, ভাঙলো, জোড়া লাগলো, এরপর আবার ভাঙলো! এক এক করে ভেঁজে রাখা রুটিগুলো প্লেটে সাজিয়ে রাখলো অটবী। দৃঢ় কণ্ঠে প্রশ্ন করলো, “নলীর সাথে কি কালকে তোমার দেখা হয়েছিল, সরোজ?”

সরোজ হকচকালো খুব। ভীষণ তোতলিয়ে বললো, “ন-নলী মানে? ও-ওর সাথে আমার দেখা হইবো ক্যান?”
—“নাটক করা এবার থামাও, সরোজ। তোমরা যে আমি মানা করার পরও দেখা করো, সেটা আমি জানি। ওর সামনে পরীক্ষা। দয়া করে ওকে যে ফোনটা দিয়েছো, ওটা নিয়ে নেবে। পড়ালেখা বাদ দিয়ে ও শুধু ফোন নিয়ে বাথরুমে, উঠোনের ঝোপঝাড়ে পরে থাকে। নিজে তো পড়ালেখা করো না, এবার কি ওকেও পড়ালেখা করতে দেবে না?”
হতবিহ্বল সরোজ জোড়ে জোড়ে মাথা নাড়ালো। একবার, দু’বার, লাগাতার! অর্থাৎ, সে দেবে। অবশ্যই নলীকে পড়তে দেবে। পরক্ষণেই প্রসঙ্গ পাল্টাতে সরোজ নড়বড়ে কণ্ঠে বললো, “আইজকা তো ত্রিস্তান ভাই মনে হয় বিকালের দিকে বাইর হইবো। রহিম ভাইগো লগে কি যেন বোঝাপড়া করতে হইবো। আমি যামু লগে। এই-ই সুযোগ ভাবি। আপনে ত্রিস্তান ভাইয়ের ঘরে একবার চেক মাইরেন।”

তরকারি নাড়াতে থাকা হাতটা আচমকাই থমকে গেল। চোখের পলক আস্তে ধীরে ফেলে অটবী বললো, “ত্রিস্তানের অনেক জ্বর, সরোজ। উনি কিভাবে বের হবেন?”
—“হেইডা বিকাল হইলেই দেখবেন। ভাই কাজের সময় হেলাফেলা করে না। হে কইছে বিকালে বাইর হইবো, মানে বি-কা-লেই বাইর হইবো! কেউ তারে আটকাইতে পারতো না। জ্বর-টর মনে কইরবেন তহন নাই! গায়েব!”

অথচ অটবী মানতে চাইলো না। ভেতরকার অশান্তি এক ফোঁটাও কমলো না। বরং তা সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে। প্রত্যেকবারই তীব্র দ্বিধাদ্বন্দে আটকে দিচ্ছে, “তুমি কি সত্যিই ত্রিস্তানের ঘরে মেয়েলি চিৎকার শুনেছো, সরোজ?”
সরোজ মাথা নাড়ালো। হ্যাঁ, সে শুনেছে।

অটবী আবার বললো, “কিন্তু আমি তো এই ছয়দিনে কোনো চিৎকার শুনিনি।”
—“আমি এত কিছু ডিটেইলে জানি না, ভাবি। মাগার, ত্রিস্তান ভাই আপনি আহনের পর এহন আর ফ্রিজে রক্তও রাহে না। আপনারে বুইঝা শুইনা সবকিছু করতে হইবো।”

অটবী আর কোনো প্রশ্ন করলো না। কৌতূহলী ভাবচিত্র প্রকাশে আনলো না। নিশ্চুপভাবে চুলায় চায়ের পানি বসিয়ে ধীর কণ্ঠে বললো, “আরেকটু পর নাস্তা হয়ে যাবে, সরোজ। তুমি গিয়ে তনয়াকে ডাকো। আমি ত্রিস্তানকে ডাকছি।”

বাস্তবিকই বিকাল হতে হতে শরীরের উত্তাপ প্রায় কমে এলো ত্রিস্তানের। জ্বরের অস্তিত্ব ক্ষীণ বিলিন হয়ে চোখের লালচে ভাবটাও মিলিয়ে গেল যেন। লোকটা আপাতত ফিটফাট হয়ে তৈরি হয়ে আছে বাহিরে যাবার জন্য। চোখমুখ মলিন, তবুও উজ্জ্বল রঙের শার্ট-টাতে তাকে এত মানিয়েছে! এত সুদর্শন লাগছে! অটবী চোখ ফেরাতে পারলো না। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ভাবুক নয়নে চেয়ে রইলো দুঃখ মানবের পানে।
সরব, আগোছালো চুলে অটবীর দিকে এগিয়ে এলো ত্রিস্তান। হাঁটু গেঁড়ে বসলো। সামান্য ঝুঁকে, মাথাটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “চুল আঁচড়ে দাও, অটবী।”

বিয়ের পর থেকেই ত্রিস্তান বড্ড আলসে হয়ে গেছে। নিজের কোনো কাজই তার করতে ভালো লাগে না, ইচ্ছে হয় না। সময়ে সময়ে অটবীকে আবদার করে বলে, “কোন শার্টটা পড়বো, অটবী? কোনোটাই তো ভালো লাগছে না। এদিকে আসো। একটা শার্ট খুঁজে দিয়ে যাও।” কিংবা “অটবী, আজকাল নিজ হাতে খাবার খেতে একদমই ভালো লাগে না। তুমি খাইয়ে দাও তো!”

অটবীর অবশ্য এসব ছোটখাটো আবদার খুব একটা খারাপ লাগে না। বরং ত্রিস্তানের একেকটা আবদার সাচ্ছন্দ্যে পূরণ করবার চেষ্টা করে সে, করছে।
—“দেখি, আমার দিকে তাকান। এভাবে ঝুঁকে থাকলে চুল আঁচড়াবো কিভাবে?”

ত্রিস্তান তাকালো। চোখে চোখ রেখে। কেমন কেমন করে যেন পরখ করতে লাগলো অটবীকে। চোখের দৃষ্টি গভীর, সূক্ষ্ণ, তেজিয়ান! অটবীর অস্বস্তি হলো। কোনোমতে ঝটপট চুল আঁচড়ে দিয়ে বললো, “এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”
ত্রিস্তানের এক বাক্যে উত্তর, “তুমি তাকাতে বলেছো।”
—“কিন্তু আমি তো এমন এমন ভাবে তাকাতে বলিনি।”
—“তাহলে কেমন কেমন ভাবে তাকাতে বলেছ?”
অটবী জবাব দিতে সময় লাগালো। উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত হলো। এরমাঝে ত্রিস্তান আবারও প্রশ্ন ছুঁড়লো, “কথা বলছো না কেন, অটবী? তোমার দিকে আমার কিভাবে তাকানো উচিত, শেখাবে না?”

চোখে মুখে দারুণ দুষ্টুমি নিয়ে তাকিয়ে আছে ত্রিস্তান। ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিৎ হাসির রেশ। সেই হাসিটুকু একবার দেখে অটবী ঝটপট উত্তর দিলো, “ভদ্র ভাবে তাকাবেন।”
—“আমি ভদ্র ভাবে তাকালে অভদ্র ভাবে কে তাকাবে, অটবী? তোমার লজ্জারা যদি একটু অবসর নিতো, তবে আমি ভেবে দেখতাম।”

কপালের মধ্যিখানে ওষ্ঠধরের গাঢ় স্পর্শ এঁকে উঠে দাঁড়ালো ত্রিস্তান। ভাঁজ করা শার্টের হাতায় আরেকটা ভাঁজ ফেলে সুধালো, “তোমার জন্য আসার সময় কি আনবো? কিছু খেতে ইচ্ছে করছে?”
অটবী মাথা নাড়ালো। তার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।
—“তবে আইসক্রিম নিয়ে আসি? চকবার? ওটা তো খাবে?”

ত্রিস্তান আর সরোজ চলে যেতেই সদর দরজাটা নিঃশব্দে আটকালো অটবী। ত্রিস্তানের ঘরে যাওয়ার পূর্বে একবার তনয়ার ঘরে উঁকি দিলো। নাহ্! তনয়া ঘুমাচ্ছে। দুপুরে যে ঘুমিয়েছিল, এখনো ওঠেনি। তপ্ত নিশ্বাস ফেলে কদমে কদমে বা’দিকের ঘরটায় ঢুকলো সে। দরজা ভেড়াল। পরিচিত ঘর! আনাচে-কানাচে চেনা। অথচ কোথা থেকে কি খোঁজা শুরু করবে, তা ঠাওরে এলো না তার। ত্রিস্তান তার বুকসেল্ফটা কাউকে অত একটা ধরতে দেয় না। তাকে, সরোজকে, তনয়াকে— কাউকে না। প্রথমে এখান থেকেই খোঁজা শুরু করলে কেমন হয়? যেই ভাবা সেই কাজ! এগিয়ে গিয়ে বুকসেল্ফটার সামনে দাঁড়ালো অটবী। পাঁচটা তাকের প্রত্যেকটা বই এক এক করে খুঁজতে লাগলো। প্রথম তাক! দ্বিতীয় তাক! তৃতীয় তাক! চতুর্থ তাকের সাত নম্বর বইটা টান দিতেই হঠাৎ বিকট শব্দে নড়েচড়ে উঠলো বুকফেল্ফ। বা’দিকের খালি জায়গাটায় সরে গেল। দৃশ্যমান হলো, কালো কাঠের অতি পুরোনো দরজা। তালা কিংবা অন্য কোনো যন্ত্রপাতি দিয়ে বন্ধ নয়। সামান্য ছিটকিনির মাধ্যমেই দরজাটা খুলে গেছে। কিন্তু দরজার ওপাশটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঘরের আলো থেকে যতটুকু বোঝা যায়, ওপাশে সিঁড়ি আছে। সিঁড়ি বেড়ে নিচে নামতে হবে। স্তব্ধ অটবী এদিক-ওদিক তাকালো। টেবিলের ওপর থেকে টর্চ লাইটটা নিয়ে সুইচ চাপলো। তবুও যেন নিকষকৃষ্ণ আঁধারে অতটুকু আলো যথেষ্ট নয়। আলো চারিদিকে ছড়াচ্ছে না। কি অদ্ভুত! রয়েসয়ে ঢোক গিললো অটবী। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলো। ঠিক যেন কোনো আলাদিনের চেরাগ খুঁজতে অন্ধকার গুহায় হেঁটে চলেছে সে। সোনা রুপার কথা জানা নেই, কিন্তু যতই সে এগোচ্ছে একটা বিদঘুটে গন্ধ নাকে এসে ঠেকছে তার। এত বিশ্রী! এত দমবন্ধকর! অটবীর নাসিকারন্ধ্র রোধ হয়ে এলো যেন। নাকে ওড়না চেপে টর্চ লাইট-টা এদিক ওদিক ঘোরালো। সামনে আর সিঁড়ি নেই। দেওয়ালের একপাশে সুইচ জাতীয় কি যেন দেখা যাচ্ছে। সেটা চাপতেই হঠাৎ আলোকিত হয়ে গেল চারিপাশ। প্রথম প্রথম অটবী চোখ মেলতে পারলো না। তীব্র আলোয় অস্পষ্ট দেখলো সব। তারপর যখন আস্তে আস্তে আলো চোখে সয়ে এলো? আশপাশ, পুরো ঘর স্পষ্ট হলো? চমকের দরুণ শরীরের নিয়ন্ত্রণ হারালো অটবী। বিস্ময়ে স্থবির হলো, হকচকালো, ভড়কালো, নিশ্বাসগুলো আটকে আটকে এলো খুব।

পাতালঘরের মতো ছোট্ট একটা ঘর। মাথার ওপর জ্বলতে থাকা বাতি ছাড়া আর কোনো আসবাবের দেখা নেই। প্রত্যেকটা দেওয়ালে লাল বর্ণের কি যেন অস্বাভাবিক ভাবে লেপ্টে আছে। অটবীর ধারণা, এগুলো রক্ত। মেঝের একপাশে একটা স্টিলের বাটি আর দুটো শেকলের মাঝেও রক্তের অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে। শুকিয়ে-টুকিয়ে বিদঘুটে অবস্থা! অটবী তার আঁখিজোড়া আবারও সচল করলো। প্রত্যেকটা আনাচে কানাচে ভালো করে পরখ করতে লাগলো। নাহ্! কেউ নেই। এই পুরো ঘরে সে ছাড়া একটা মশা পর্যন্ত নেই। তবে… তবে ত্রিস্তান কি লুকাতে চেয়েছিল এখানে? কি লুকিয়েছিল? মস্তিষ্কে হিসাব কষতে কষতে সব দলাপাকালো। দুর্বিষহ ঠেকলো। এমনিতেও বাজে গন্ধে এই ঘরটাতে টেকা যাচ্ছে না৷ তারওপর এখন মাথা ব্যথাটাও চড়া দিয়ে ওঠেছে। সুদূর থেকে শুনতে পাচ্ছে, সরোজের উচ্চ কণ্ঠস্বর! ত্রিস্তান কি তবে চলে এসেছে? এত তাড়াতাড়ি? হাঁসফাঁস ভাবটা কমে এলো। আগের সেই আতঙ্ক অনুভব করলো না অটবী। আস্তে ধীরে পাতালঘরের বাতি নিভিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো।

বাহির থেকে আকাশের গর্জন শোনা যাচ্ছে। গুরুম, গুরুম! তীব্র বাতাসে খোলা জানালা গলিয়ে লতাপাতা ঢুকছে। ক্ষীণ বৃষ্টির ছিঁটায় মেঝে পিচ্ছিল। দরজা আটকানো। ওপাশ থেকে একটু আগেও সরোজের হাঁক শোনা গেলেও এখন তা পুরোদমে নিস্তব্ধ।
বিছানার একপাশে ত্রিস্তানকে বসে থাকতে দেখা গেল। বিকালের সেই ফিটফাট রুপটা নেই। বড্ড অগোছালো, উদ্ভ্রান্ত। একাধারে নিচের দিকে চেয়ে মাথার চুলগুলো দুহাতে খামছে আছে লোকটা। ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলছে। বুকের উঠানামা অস্থির, অশান্ত। অটবী ধীর পায়ে পাশে গিয়ে বসতেই ক্ষীণ ভাঙ্গা গলায় জিজ্ঞেস করলো, “তুমি সব জেনে গেছ, তাই না?”

অটবী জবাব দিলো না। ত্রিস্তান উত্তরের অপেক্ষাতেও নেই, “তুমি কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে, অটবী? যেও না। আমি তোমাকে ছাড়া কিভাবে থাকবো? তুমি না থাকলে আমার সময় কাটবে কিভাবে?”

ভীষণ মিনতিপূর্ণ অনুরোধ। কণ্ঠে হাজারটা হাহাকার। কথাটা বলার সময় অটবীর দিকে তাকালো ত্রিস্তান। সমুদ্রের ন্যায় গভীর চোখ দুটোয় কি অসীম ভালোবাসার দুর্গম ভয় দেখা দিলো? তাকে হারানোর ভয়? দিলো বোধহয়।
মুচকি হেসে অটবী বললো, “আপনি বলেছিলেন, আমাকে হারানোর ভয় আপনার নেই। আপনি জানেন আমি কখনো আপনাকে ছেড়ে চলে যাবো না। তবে এখন ভয় পাচ্ছেন কেন?”

ত্রিস্তান অটবীর হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় পুরলো। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিঁজিয়ে বললো, “মিথ্যে বলেছিলাম।”
—“আপনি এত মিথ্যে বলতে পারেন ত্রিস্তান! আমাকে আজ পর্যন্ত কতগুলো মিথ্যে বলে বোকা বানিয়েছেন, বলুন তো!”

উন্মাদনা আরেকধাপ বাড়লো। ত্রিস্তান দ্রুত উত্তর দিলো, “আর বলবো না, অটবী। তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না তো?”
—“যাবো না। তবে আপনাকে আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।”
—“কি প্রশ্ন?”

অটবী একটু সময় নিলো। নমনীয় গলায় জিজ্ঞেস করলো, “নিচের ওই ঘরে কে থাকে, ত্রিস্তান?”
—“মা।”
—“নিজ মাকে ওখানে কেন রেখেছেন? ওভাবে?”
—“তনয়া মাকে দেখে ভয় পাবে। তুমি, সরোজ সবাই ভয় পাবে। তাই… আমি আসলে মাকে লুকিয়ে রাখতে চাইনি।”

অটবী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সুদীর্ঘ লম্বা নিশ্বাস! ত্রিস্তান যে অসুস্থ, বিরল রোগে আক্রান্ত, সে তা বহু আগেই জেনেছে। কিন্তু এখন, এই মুহুর্তে ত্রিস্তানের কথাগুলো, কথা বলার ভঙ্গিমা— সবকিছু ভীষণ দুমড়েমুচড়ে দিচ্ছে ভেতরটা। অসহনীয় করে তুলছে বারংবার।

—“আমি আপনাকে ছেড়ে সত্যিই কোথাও যাবো না, ত্রিস্তান। সুখনীল ছাড়া অরণ্য যাবেই-বা কোথায়?”

সময় গড়িয়েছে। সন্ধ্যা শেষে রাতের আগমন ঘটছে আস্তে আস্তে। অটবী তখনো সেই বিছানাতেই বসে। তার কোলের ওপর ত্রিস্তানের মাথা। শরীরটাকে গুটিয়ে ভীষণ তন্দ্রায় তলিয়ে আছে লোকটা। তার ঝাকড়া চুলগুলোর ভেতর অটবীর হাত ঘুরঘুর করছে। দু’মিনিট যেতেই হাতটা সরিয়ে নিলো অটবী। অল্পসল্প পাশে ঝুঁকে বিছানার তোষক উল্টালো। কিছু কাগজপত্র আর একটা ডায়েরী পরে আছে। ডায়েরীটা ত্রিস্তানের। মোলাটে সুন্দর করে ছয় বছর আগের সালটা খোদাই করা। কাগজপত্রগুলো অবশ্য তেমন পুরোনো নয়৷ তিন বছর আগের। কাগজ আর ডায়েরীটা অটবী সেই প্রথম দিনই খুঁজে পেয়েছিল। ওইযে? সরোজ তাকে কিছু বই এনে দিয়েছিল না পড়তে? সেখানে ডায়েরী আর কাগজগুলোও ছিল। ত্রিস্তান হয়তো তা জানতো না। নয়তো এত সহজে কি অটবীকে নিজের অতীত নিজেই জানতে দিতো?

ডায়েরীটা রেখে প্রথম কাগজটা হাতে নিলো অটবী। খুললো। কোনো এক হাসপাতালের মেডিকেল রিপোর্ট। রোগীর নামের জায়গায় ‘Sukhneel Tristan’ নামটা সুন্দর করে লিখা। এর বেশ নিচে গাঢ় কালির দাগে রোগটার সন্ধানও পাওয়া গেল, ” Parsonality disorder”.

_______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

অটবী সুখ পর্ব-৩০+৩১

0

অটবী সুখ

৩০.
—“ছেলেটার পেশা আমার ভালো লাগছে না, অটবী। তুই এটা কি করলি?”

পূব আকাশে সূর্য সবে মাথার ওপর উঠতে শুরু করেছে। ঘুম হয়নি রাতে। সারারাত রেবা বেগমের অজ্ঞাত অভিব্যক্তি জানবার উত্তেজনায় নির্ঘুম ছিল দু’চোখ। ফজরের নামায শেষেই দৌঁড় লাগিয়েছে রেবা বেগমের ঘরে। কিন্তু তিনি সেখানে ছিলেন না। উঠোনে তার হার হামেশা পাতিয়ে রাখা চতুর্ভুজ পাটিতে পানের খিলি নিয়ে বসেছিলেন। অটবী সেখানে গেল নিরবে। মায়ের পাশে গিয়ে বসলো। কিন্তু দু’জনের কেউ-ই কারো সঙ্গে কথা বলছে না, তাকাচ্ছে না! সর্বশেষে অটবীই ভীতু কণ্ঠে ডাকলো, “আম্মা?”

সঙ্গে সঙ্গে নিজের অসন্তোষ জানেলন তিনি, “ছেলেটার পেশা আমার ভালো লাগছে না, অটবী। তুই এটা কি করলি?”
অটবী সময় নিলো। মনে মনে কথা সাজিয়ে ত্রিস্তানের পক্ষে কিছু বলতে নেওয়ার আগেই রেবা বেগম সুদীর্ঘ হতাশা নিয়ে বললেন, “তোর আব্বার সাথে আমার যখন বিয়ে হয়েছিল আমি তখন ষোলো। কেলাশ আইটে পড়তাম। বিয়ের পর পড়াটড়া সব গোল্লায় গেছে। তোর আব্বার আমাকে পড়ানোর অনেক ইচ্ছা থাকলেও টাকা ছিল না। আমি মানুষের বাসায় টুকটাক কাজ করতাম আর তোর আব্বা ট্রাক চালাতো। সয়সম্পত্তি বলতে এই বাড়ি ছিল বলে সহায়! যখন তুই আমাদের কোল জুড়ে আসলি, তোর আব্বা মনে মনে প্রার্থনা করছিল, তোকে যেমনে পারুক পড়াবে! আমরা যেমন মূর্খ দেখে কষ্ট করছি, তোকে তেমন কষ্ট করতে দিবে না। পড়াইছেও! ভাবছিলাম… তোর একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ হবে। উচ্চবংশে তোর বিয়ে দিবো। কিন্তু তোর কপাল সেই আমাদের কাছে এসেই ঠেকেছে! বিয়েটাও এমন ভাবে ভেঙ্গে গেল!”

বুকে চাপা দীর্ঘশ্বাসটা আরেকদফা বেড়িয়ে এলো। রোধ হয়ে আসা কণ্ঠস্বরে আরেকটু শক্তিসামর্থ্য নিয়ে বললেন, “আমি কাল সারারাত অনেক ভেবেছি, বোঝার চেষ্টা করেছি। ত্রিস্তান ছেলেটার আচার ভালো। কথায় মানুষকে ভোলাতে ভালো পারে। তুই কেন ছেলেটাকে বিয়ে করেছিস, আস্তে আস্তে বুঝতে শুরু করেছি। কিন্তু আমাকে না বলে নিজে নিজে বিয়ে করে ফেলাটা আমাকে কষ্ট দিয়েছে। ছেলেটা বেকার। জঙ্গলের একটা ভুতুড়ে বাড়িতে থাকে। বোন প্রতিবন্ধী। সারাটা দিন শুধু রহিমদের সাথে ঘুরে বেড়ায়। পাশের বাসার রাহেলা থেকে শুনেছি, ওদের সাথে মিলে চুরি ডাকাতিও করে নাকি! কি খায়, কিভাবে চলে, কেউ কিচ্ছু জানে না। এমন ছেলের সাথে আমি তোকে কিভাবে মেনে নেই অটবী? তুই-ই বল?”

মায়ের কষ্ট-টা অটবী বুঝে। সেদিন বিয়ে করার পর কোথাও যেন একটু খারাপও লেগেছিল তার। মনে হয়েছিল, আম্মাকে না বলে বিয়ে করাটা উচিত হয়নি। এত তাড়াহুড়ো না করলেও চলতো। কিন্তু সে এ-ও জানে, সেদিন বিয়ে না করলে অটবী হয়তো ত্রিস্তানকে আর কখনো পেত না। হারিয়ে ফেলতো। সে ভয় থেকেই অটবী একটু স্বার্থপর হয়েছে। শুধুমাত্র নিজের চিন্তা করেছে। নিজের ভালোর জন্য, সামান্য সুখের জন্য স্বার্থপর হওয়া কি পাপ?

চোখে ছলছল করা পানিটুকু বহুকষ্টে দমালো অটবী। কেমন করে যেন বললো, “আমি শুধু একটু ভালো থাকতে চেয়েছিলাম, আম্মা। ত্রিস্তানের কাছে আমি সেই ভালো থাকার ভরসা পাই।”
রেবা বেগম যেন একটু চমকালেন। মেয়ের মাসুম চেহারার দিকে চেয়ে রইলেন অনেক্ষণ! এমনিতেও তাকে থাপ্পড় মেরে অপরাধ বোধে ভুগছিলেন তিনি। বাপ মারা যাওয়ার পর মেয়েটা তো তার কম কষ্ট করেনি। বরং তিনিই বেশি অধিকার দেখিয়ে ফেলেছিলেন। মেয়ে বড় হয়েছে, তার নিজস্ব মত আছে, জীবন আছে! তবুও কোথাও যেন সল্প অভিমান আর দুঃখের জট রয়েই যায়।

পানের জিনিসপাতিগুলো একে একে গুছিয়ে উঠে দাঁড়ালেন রেবা বেগম। রান্নাঘরে অনেক কাজ পরে আছে। নাস্তা বানাতে হবে। চলে যেতে যেতে তিনি আবারও বললেন, “ছেলেটাকে একবার আসতে বলিস। বিয়ে যেহেতু হয়ে গেছে, তোকে আর এখানে রাখা উচিত হবে না।”

অটবী থমকালো, ভড়কালো। ভেবে পেল না, তার কি এখন খুশি হওয়া উচিত? প্রচন্ড খুশিতে লাফানো উচিত? কিন্তু সে তো তা পারছে না। ডের বুঝতে পারছে, রেবা বেগম এখনো কষ্টে আছেন, অভিমান করেছেন। মায়ের এহেন বিষাক্ত অভিমানে অটবী কি করে খুশি হবে? আনন্দ করবে? সে তপ্ত নিশ্বাস ফেললো। পাটি মুড়িয়ে গুছিয়ে রাখলো। অন্যমনস্ক হলো। তার জীবনে আনন্দ বলতে কিছু নেই। যা আছে সব কালো কালো ধোঁয়া, স্পষ্ট অন্ধকার!

বাবা মারা যাওয়ার পর কখনো বিশেষ কোনো স্বপ্ন দেখা হয়নি অটবীর। কিন্তু ত্রিস্তান যখন তার জীবনে এলো? ভুলেভালে একটা অবাস্তব স্বপ্ন দেখে ফেলেছিল সে। ভয় পেয়েছিল, তা কখনো সত্য হবে না। অথচ এখন যখন স্বপ্ন পূরণ হলো? এখনো অটবী ভয় পাচ্ছে। প্রচন্ড ভয়ে সিটিয়ে যাচ্ছে। কি ভীষণ বিচ্ছিরি ব্যাপার!

ঘড়িতে তখন সকাল এগারোটা বেজে পনেরো মিনিট। সোফায় বসে ত্রিস্তানকে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে অটবী। মেঝেতে এলোমেলো হয়ে পরে আছে বাজারের ব্যাগ। ত্রিস্তান সেটা আরও এলেমেলো করে দিচ্ছে। সবকিছু ঘাটাঘুটি করা শেষে ত্রিস্তানের ছোট্ট প্রশ্ন, “কি খাবে? কি বানাবো?”
—“আপনি এখব রান্না করবেন?”

ত্রিস্তান হঠাৎ একটু এগিয়ে এলো। গালে লেগে থাকা হালকা অশ্রুর দাগ বুড়ো আঙুলের চাপে মুছতে চাইলো যেন। পরপরই আচমকা গালে ঠোঁটের স্পর্শ এঁকে সরে দাঁড়ালো সে। তড়িৎ স্পর্শ! অথচ স্পর্শের রেশ দীর্ঘ। হতভম্ব অটবী অবাক নয়নে ঝটপট তাকালো। অথচ ত্রিস্তান তখনো নির্বিকার, নির্লিপ্ত!

—“যে এনার্জি নিয়ে কাঁদছিলে! এতক্ষণে তো ক্ষুধা লেগে যাওয়ার কথা। ক্ষুধা লাগেনি?”
বলতে বলতে বাজারের ব্যাগ থেকে ডিমগুলো আলাদা করে রাখতে লাগলো ত্রিস্তান। আবারও বললো, “এভাবে কাঁদছিলে কেন, অটবী? মনে তো হচ্ছিল গলা ফাঁটিয়ে এক্ষুণি বলবে, আমাকে দিয়ে আসুন তো ত্রিস্তান! বিয়ে-টিয়ে বাদ। আমি আপনার সাথে থাকতে পারবো না।”

চুমুর রেশটুকু কাটাতে অল্প সময় নিলো অটবী। ধাতস্থ হলো। ত্রিস্তানের বলার ঢং দেখে ভ্রু কুঁচকে সুধালো, “বিদায়ের বেলাতে সব মেয়েরাই কাঁদে। সেটা এভাবে বলার কি আছে?”
—“বিদায়ের বেলাতে মেয়েরা মা-বাবা, ভাই-বোন যত গুষ্টির মানুষ আছে ওদের ধরে ধরে কাঁদে। তোমার মা বোনের সামনে তো তোমার চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানি বেরোলো না! পুরো রাস্তাতেও চুপচাপ ছিলে। কেঁদেছ এই জঙ্গলে, আমার বুক ভাসিয়ে। নতুন ইস্ত্রি করা শার্ট অটবী! কি করলে বলো তো?”

অটবী আশ্চর্য হলো। বড়োবড়ো চোখে চেয়ে অভিযোগ জানালো, “আপনি তখনো শার্ট নিয়ে আমাকে একশটা কথা শুনিয়েছিলেন! এখনো আপনি সেই শার্ট নিয়েই পরে আছেন? সমস্যা কি ত্রিস্তান? শার্টটা কিন্তু আমি একদম ছিঁড়ে ফেলব!”
—“No Your Highness, you’ll be in big trouble if you tear up my shirt when I’m still wearing it.”

মাছি তাড়ানোর মতো করে চলে গেল ত্রিস্তান, রান্নাঘরে। কি বানাবে কে জানে! কয়েকটা ডিম আর ডাল নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেছে। পাঁচ মিনিট গড়ালো, দশ মিনিট গড়ালো! লোকটার আর দেখা পাওয়া গেল না। বসে বসে অলস সময়টাতে আরেকদফা ঘরের আনাচে কানাচে দেখতে লাগলো অটবী। একটু দূরে তার জামাকাপড়ের ব্যাগ পরে আছে। এগুলো সে কোথায় রাখবে? ত্রিস্তানকে জিজ্ঞেস করা দরকার।

দৈবাৎ, সরোজের কণ্ঠ শোনা গেল, “আরেহ্! অটবী আপু যে? এক্কেবারে চইলা আসছেন নাকি?”
অটবী নজর ফেরালো। ত্রিস্তানের ঘর থেকে মাত্র ঘুম শেষে উঠে এসেছে সরোজ। চোখে মুখে এখনো তন্দ্রা স্পষ্ট! পরনে ঢিলাঢালা প্যান্ট, গেঞ্জি। সরোজকে দেখেই অটবী একটু বিরক্ত হলো, “ক’টা বাজে, সরোজ? এত বেলা পর্যন্ত কেউ ঘুমায়?”

সরোজ মাথা চুলকালো, “তনয়া আপুও তো ঘুমায়।”
—“ও ঘুমাতেই পারে। ওর কি তোমার মতো পড়ালেখা আছে?”
আরেকদফা মাথা চুলকালো সরোজ। বোকা হেসে আবারও একই প্রশ্ন ছুঁড়লো, “এক্কেবারে চইলা আসছেন আপু? সাথে কাউরে আনেন নাই?”
—“কাকে আনবো? তুমি কি নলীকে এক্সপেক্ট করছিলে?” প্রশ্নটা একটু গাঢ় কণ্ঠে শুধাতেই মাথা নাড়ালো সরোজ। এদিক-ওদিক, লাগাতার! দাঁত দিয়ে ভিজ কামড়ে দৃঢ়তা নিয়ে বললো, “না, না! তা করমু ক্যান? এমনিই কইতেছিলাম, যদি কাউরে আনেন। হে হে।”

সরোজ আর দাঁড়ালো না। ছুট লাগালো সেই রান্নাঘরেই।

ঘণ্টাখানেক যেতে না যেতেই খিচুরি নিয়ে হাজির হলো ত্রিস্তান। এটুকু সময়ে অটবী বসে বসে গল্পের বই পড়ছিল। সরোজ দিয়ে গেছে। খাবার আসতেই খিচুরির মন ভোলানো ঘ্রাণে মনটা আনন্দে ভরে উঠলো অটবীর। বই রেখে ডাইনিং টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। খিচুড়ির সাথে ডিম ভাঁজা, বেগুন ভাঁজা আর আচারও আছে। সরোজ তখন তনয়াকে ঘুম থেকে ডাকতে চলে গেছে। অটবী বললো, “সব কাজ কি আপনারা ছেলেরাই করবেন? আমাকেও কিছু করতে দিন। আমার এভাবে বসে থাকতে ভালো লাগছে না।”

ত্রিস্তান সবার প্লেটে খিচুড়ি বেড়ে দিচ্ছিল। অটবীর কথায় একপলক তাকালো। হেসে বললো, “তোমার এখন কাজও করতে ইচ্ছে হয়?”
—“আমি মজা করছি না, ত্রিস্তান!”
—“আচ্ছা! লেবু নিয়ে আসো তবে। রান্নাঘরে ভুলে রেখে এসেছি।”

অটবী দেড়ি করলো না। একছুট লাগালো রান্নাঘরে। ফ্রিজ খুলতে খুলতে শুনতে পেল, ডাইনিং থেকে ত্রিস্তান বলছে, “লেবু কিন্তু চুলার পাশে রাখা আছে, অটবী।”

ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে। অটবী ফ্রিজ খুলে ফেলেছে, থমকেছে। চোখের একদম সামনাসামনি দুটো লাল তরলের ব্যাগ! দৃশ্যমান। অটবী যেন ক্ষীণ কেঁপে উঠলো। জাদুজালে আটক রমণীর ন্যায় ওগুলো ছুঁতে চাইলো। ওমনি ত্রিস্তানের হাঁক, “কই অটবী? পাওনি?”

সঙ্গে সঙ্গে আবারও হাত গুটিয়ে নিলো অটবী। একপলক তরল রক্তগুলোকে দেখে নিঃশব্দে ফ্রিজ বন্ধ করলো। ঢোক গিলে কোনোমতে উত্তর দিলো, “পেয়েছি। আনছি।”

______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

অটবী সুখ

৩১.
ডাইনিং টেবিলের পরিবেশ কিঞ্চিৎ অস্থির, কোলাহলপূর্ণ। বামপাশে থাকা বৈদ্যুতিক বাতিটা নিভছে-জ্বলছে। চোখে লাগছে খুব। আবার বাতিটা বন্ধ করে দিলে আলো-আঁধারে ছেয়ে যাচ্ছে ঘর। বাধ্য হয়ে খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ত্রিস্তান। কোথা থেকে নতুন, ফকফকা সাদা লাইট এনে লাগাতে ব্যস্ত হলো। অটবী তখনো রক্তের বিষয়টা নিয়ে স্বাভাবিক হতে পারছিল না। হাজারো প্রশ্নে মিইয়ে যাচ্ছিল বারবার। ভেতরে ভেতরে তার অন্তর আত্মা শুকিয়ে চৌচির, ভঙ্গুর, ভীতু। অথচ মুখ গলিয়ে কথা বেরুচ্ছে না। খুব জানতে ইচ্ছে করছে, এমন কঠিন জিনিস ত্রিস্তানের কাছে কেন? তাও আবার ফ্রিজে?
ভাবনাগুলো মস্তিষ্কে জট পাকালো। শরীরের কাঁপন নিয়ন্ত্রণে রেখে ত্রিস্তানকে একাধারে দেখে চললো অটবী। আমচকা শুনতে, সরোজ ঠাট্টার সুরে বলছে, “কি অটবী আপু? ভাইরে এত কি দেখ?”

পাশে বসে থাকা তনয়া খাওয়া থামালো। সরোজের দিকে বড় বড় চোখে চেয়ে অবাক কণ্ঠে বললো, “ওমা! তুমি জানো না কেন তাকায়?”
প্রশ্নের ঢংয়ে মজা পেল সরোজ। জিজ্ঞেস করলো, “কেন তাকায়?”
—“বউ তো তার বরের দিকে তাকাবেই। ওদের নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে। ওদের প্রেম প্রেম পায় না?”

কথাটা শোনা মাত্র হু হা করে হেসে ফেললো সরোজ। গা কাঁপিয়ে, অনেক্ষণ! হাসতে হাসতেই আবার প্রশ্ন ছুঁড়লো, “তুমি তো দেহি অনেক প্রেমের ব্যাপারে জানো! তা কয়টা প্রেম করছিলা?”
—“আমি তো প্রেম করিনি। বিয়ে করেছি। কেন? তুমি জানো না? ভাইয়া তোমাকে বিয়েতে দাওয়াত দেয়নি?”

পুতুল নিয়ে খেলতে খেলতে নিষ্পাপ কণ্ঠের বলা কথাটা শুনে থমকালো প্রত্যেকেই। হাসির তোড় বন্ধ হলো। খুকখুক করে কাশলো সরোজ। হাঁসফাঁস করলো। তনয়া যে এমন একটা কথা বলে ফেলবে, ভাবেনি।
ততক্ষণে ত্রিস্তানের বাতি লাগানোও শেষ। বেসিনে হাত ধুয়ে চেয়ার টেনে বসতে বসতে সে গাঢ় গলায় ধমক লাগালো, “খাওয়ার সময় এত কথা বলিস কেন, সরোজ? চুপ থাকতে পারিস না?”
অপরাধীর ন্যায় মাথা ঝুঁকিয়ে সরোজ শুধু এটুকুই বললো, “সরি ভাই। আর কথা কইতাম না।”

আনন্দ ঘন মূহুর্তটা ঘন কালো আঁধারে ডুবে গেল যেন। পিনপতন নিরবতায় তনয়ার বকবক ছাড়া অন্য কিছু শোনা যাচ্ছে না। তাকে ত্রিস্তান খাইয়ে দিচ্ছে। খাওয়ানোর মাঝে আড়চোখে দেখছে অটবীকে। অটবী না তাকিয়েও সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি অনুমান করছে, জড়োসড়ো হচ্ছে। এবং সেই দৃষ্টির জাল থেকে বাঁচতেই মাথা নুইয়ে একের পর এক লোকমা গিলে চলেছে সে।

অটবীর খাওয়ায় মন নেই। সুস্বাদু খাবারটুকু প্রত্যেকবারই বিষাদ হয়ে গলা বেয়ে নামছে। চোখে অস্পষ্ট ভাবে ভাসছে, থকথকে, গাঢ় লাল বর্ণের প্যাকেট দুটি। জঘন্য অনুভূতি! এহেন জঘন্য অনুভূতি নিয়ে কি আদৌ মানুষ খাবার খেতে পারে? আদৌ সম্ভব? সেই অসম্ভব কাজটিকে আরও একধাপ অসম্ভব করে দিয়ে তনয়া হঠাৎ বিচিত্র কণ্ঠে বলে বসলো, “তোমরা কি জানো, আমার মা কে? আমার মা রুপকথার রাক্ষস। রাক্ষসদের মতোই রক্ত খায়।”

—“তুমি যে আমার কত বড় একখান অপকার করছ, সেইটা জানো অটবী আপু?”

খাওয়ার পর ত্রিস্তান যেন কোথায় গেছে। পুরো বাড়িতে তনয়া, সরোজ আর অটবী। ড্রইংরুমে অভ্যাসমত ছবি এঁকে চলেছে তনয়া। এতক্ষণ তার দিকেই অটবীর দৃষ্টি ছিল। সরোজের কথায় ফিরে তাকালো। সোফায় ঠিক হয়ে বসে, ভ্রু কুঁচকালো, “আমি আবার কি করেছি?”

সরোজ যেন অভিযোগের লিস্ট নিয়ে বসলো এবার। দারুণ দৃঢ়তা নিয়ে বলতে শুরু করলো, “কি কি করো নাই হেইডা জিগাও। প্রত্থমে তো পড়ালেহা নিয়া সারাটা দিন চেইতা থাকতা। আগে কালেভাদ্রে দেখা হইলে বকতা। এহন তো আল্লাহর দিন্না চব্বিশটা ঘন্টা বকতে থাকবা। তারওপর কয়েকদিন ধইরা ত্রিস্তান ভাইয়ের মনে দয়ামায়া জাগছিল। আমারে তার রুমে ঘুমাইতে দিতো। এহন তুমি আহনে আবার এইহানে, এই ছোট্ট সোফাডায় ঘুমাইতে হইবো। আহহারে! আমার জীবন! আমারই আমার জীবনডার লাইগা মায়া লাগে রেহ্..”

কপালের ভাঁজগুলো আরও খানিকটা গাঢ় হলো। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে অটবী প্রশ্ন ছুঁড়লো, “নিজের বাসায় গেলেও তো পারো। এত কষ্ট করে এখানে থাকার দরকার কি?”
সরোজ হাসলো। ভীষণ অর্থপূর্ণ হাসি। গায়ে গামছা এঁটে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বললো, “তা তুমি বুঝতা না। বুঝবার পারলে তো হইতোই।”

সরোজ চলে গেল। এক মিনিট, দু’মিনিট, তিন মিনিট! তার আর দেখা নেই। ওপাশ থেকে পানির তীব্র শব্দ শোনা যাচ্ছে। গোসল করছে নাকি? দ্বিধাদ্বন্দে অটবী উঠে দাঁড়ালো। একপলক তয়নাকে দেখে আস্তে আস্তে ডাইনিং টেবিলের সামনের দেওয়ালে থাকা ত্রিস্তানদের ফ্যামিলি ফটোটার দিকে আগালো। কাছাকাছি হতেই কদম থামালো সে। ফ্রিজে রক্ত দেখার পর থেকেই এই ফ্রেমটা নিয়ে বড় সন্দেহে আছে অটবী। সেদিন এই ফ্রেমের ভেতরে একটা চাবি খুঁজে পেয়েছিল। চাবিটা কি এখনো আছে? সে ভালো করে দেখেনি। তারচেয়ে বড় প্রশ্ন, চাবিটা কিসের?

দুরুদুরু বুকে সেদিনের মতো আবারও ছবির সেই জায়গায় হাত ছোঁয়ালো অটবী। নাহ্! কিছু হচ্ছে না! অস্থির চিত্তে সে আরেকবার চেষ্টা করতেই হঠাৎ বিকট শব্দে সরে গেল ছবিটা। কালো মতো গুহার সিন্দুকটা আবারও বেড়িয়ে এলো। কিন্তু আফসোস! ভেতরে কিছু নেই। নিঃসন্দেহে সবটা ফাঁকা, খালি! একপাশে অল্প ধুলোবালি জমে আছে মাত্র।

—“তুমি এইহানে কি করতাছো, আপু?”
সরোজের কণ্ঠ!
মুহুর্তেই অজানা আতঙ্কে শিরা-উপশিরায় বিদ্যুৎ খেলে গেল অটবীর। কাঁপলো ক্ষীণ। দ্রুত পেছনে ফিরলো। সরোজ তার ঠিক দু’হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে। চুল ভেঁজা নেই। আগের কাপড় পরনে। তারমানে সে গোসল করতে যায়নি? হতাশায় চাপা তপ্ত নিশ্বাস ঘুরপাক খেল। উদাস হলো এই ভেবে, সে এত বোকা কেন? পরপরই সামান্য হেসে বলতে চাইলো, “ছবি, ছবি দেখছিলাম। হা-হাত লেগে কিভাবে যেন কি হয়ে গেল। কি অদ্ভুত, না?”

অথচ ওপাশ থেকে উত্তর নেই। সরোজ কেমন করে যেন ওকে দেখছে। অনাকাঙ্ক্ষিত লুকোচুরি খেলতে গিয়েও থমকাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। চোখ তার বড্ড শান্ত, নিরব, নিশ্চুপ!

ঘড়িতে তখন কতই-বা বাজে? রাতের সাত কি আট? ত্রিস্তান বেড়িয়েছিল দুপুর দুটোয়। এইমাত্র এলো। এসেই বিরাট এক সাদা খাম অটবীকে ধরিয়ে দিয়ে বললো, “নাও, তোমার জন্য।”

অটবী তখন বিছানায় বসে বসে গল্পের বই পড়ছিল। একেবারে কাঁথা কম্বল মুড়ি দিয়ে। ত্রিস্তানের এত এত বই! কোনটা রেখে কোনটা পড়বে সেই দ্বিধাতেই তার নাস্তানাবুদ অবস্থা। এরমাঝে ত্রিস্তানের হঠাৎ আগমন তাকে একটু চমকেই দিলো বটে। খামটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসু কণ্ঠে সুধালো, “কি এটা?”
ত্রিস্তানের নির্লিপ্ত কণ্ঠস্বর, “সেলারি।”
—“সেলারি? কিসের সেলারি?” বলতে বলতে অল্পসল্প ভাবুক হলো সে। এরপর কিছু একটা মনে পরতেই সূক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “আপনি আবারও রহিমদের সাথে মিলে চুরি করেছেন, ত্রিস্তান?”
—“আমি কখনোই চুরি করিনি।”
—“মাস্টারমাইন্ড তো আপনিই ছিলেন। চুরি করা আর চুরির বুদ্ধি দেওয়া একই ব্যাপার।”

বুকশেলফের নিচের ড্রয়ার গুলোর একটাতে কি যেন খুঁজছে ত্রিস্তান। খুটখুট শব্দে। পেয়ে যেতেই গাঢ় কণ্ঠে বললো, “ওসব ছেড়ে দিয়েছি। টিউশন নিয়েছি দুটো। এক মাস হলো।”

আশ্চর্য অটবী আরেকদফা আশ্চর্য হলো। তড়িৎ গতিতে খাম খুললো। ভেতরে একহাজার টাকার আট-টে নোট। সে টাকাগুলো বের করলো না। রেখে দিলো। আগের সেই বাঘিনী রুপটায় শত শত পানি ঢেলে বললো, “টিউশন কেন? চাকরির জন্য চেষ্টা করছেন না কেন?”
—“কারো গোলামি করতে আমার ভালো লাগে না।”

অটবী হতবাক হলো, “চাকরি করা গোলামি? তাহলে টিউশন কি?”
—“টিউশন ইজ নট সো লাইক গোলামি। যখন ইচ্ছে ছেড়ে দিতে পারবো। ফর এক্সেমপল, টাকা পেয়ে এখন আর আমার টিউশন দুটো করাতে ইচ্ছে করছে না। কালকে থেকে আর যাবো না আমি।”
এবার যেন বিমূঢ়তার শেষ সীমানা অতিক্রম হলো। কণ্ঠস্বর গলিয়ে কিয়ৎক্ষণ কথাই বলতে পারলো না অটবী। অথচ ওপাশের লোকটা তখনো নির্বিকার, নির্লিপ্ত, নিজের কাজে ব্যস্ত!

ড্রইংরুম থেকে অটবীর কাপড়ের ব্যাগটা নিয়ে এসেছে ত্রিস্তান। নিজেই এক এক করে আলমারিতে গুছিয়ে রাখছে সেগুলো। অটবী মানা করেছিল, লোকটা শোনেনি। অটবীকে বিছানা থেকেই নামতে দিচ্ছে না সে! পরাজিত অটবী তখন চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিল ত্রিস্তানকে। আনমনে, কিঞ্চিৎ মন খারাপ নিয়ে। এইযে, লোকটা? সুখনীল ত্রিস্তান? আজন্মকাল তাকে বলে বেড়ালো, সে অরণ্য। তার মাঝে শত শত রহস্য লুকানো। কিন্তু কই? সে তো নিজের মাঝে কোনো রহস্য খুঁজে পায়নি। বরং উদ্ভট গোলকধাঁধায় লোকটায় নিজেই আটক। নিঃশব্দ হাহাকারে সেই ধাঁধা থেকে বেরতে চায়, মুক্তি চায়। একেকটা চিৎকারে কাঁপিয়ে তোলে তার নিজস্ব কাল্পনিক পৃথিবী। কিন্তু কারো সঙ্গে ভাগাভাগি করে না। অটবী সেই হাহাকার বুঝতে পারে বলেই এখনো সাথে আছে, চুপ আছে। এত কিছু বুঝে, শুনে, দেখেও ধৈর্য হারা হচ্ছে না।

যন্ত্রণাময় দীর্ঘ নিশ্বাসটুকু আস্তে আস্তে বেড়িয়ে এলো। ঢোক গিলে অটবী উঁচু কণ্ঠে ডাকলো, “আপনাকে এসব করতে মানা করেছি, ত্রিস্তান! আপনি এদিকে আসুন।”

অদ্ভুত ভাবে ত্রিস্তান এবার আর ত্যাড়ামো করলো না। দিরুক্তিহীন কাছে আসলো। অটবীর পাশে এসে বসলো। অতএব অটবীর আরেকদফা আদেশ, “চোখ বন্ধ করুন।”
কপালে গুটিকয়েক বলিরেখা দেখা দিলো। কয়েক পলক অটবীকে আগাগোড়া পরখ করে চোখ বুঝলো ত্রিস্তান। বলতে চাইলো, “তুমি কি করতে চাইছো, অটবী?”

কণ্ঠস্বর শব্দ হারালো তক্ষুণি, যখন অটবীর কোমল হাতের স্পর্শ নিজের গালে অনুভব করলো সে। ভেবে রাখা প্রশ্নটাও থেমে গেল কণ্ঠনালিতেই। অটবী তার সারা মুখ ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে। ভ্রু যুগল, চোখ, চোখের পাতা, পাঁপড়ি! এই মেয়েটার হলো কি হঠাৎ?

—“আমি সবসময় আপনার পাশে থাকবো, ত্রিস্তান। আপনি ভয় পাবেন না।”
ত্রিস্তান চোখ খুললো না। নড়লো না। অটবীর স্পর্শ ডোরে আটকে থেকেই বললো, “আমি কেন ভয় পাবো? তুমি সবসময় আমার পাশে থাকবে, আমি জানি।”
—“আপনি ভয় পান, ত্রিস্তান। আপনিও মানুষ। রোবট নন। কেন বুঝেন না?”

কথার তোড়ে ত্রিস্তান তাকাতে চাইলো, কিন্তু অটবী দিলো না। বাঁধা দিয়ে বললো, “চোখ খুলছেন কেন? আমি চোখ খুলতে বলেছি?”

ত্রিস্তান শুনলো। অবাধ্য হলো না। ঢিমে যাওয়া কণ্ঠে কেমন করে যেন বললো, “আমি তোমাকে মানা করেছিলাম অটবী, আমার সঙ্গে না জড়াতে।”
—“আমি কখনো আপনার মানা শুনিনি।”

গালের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির শেষ প্রান্তে এসে হাত থমকালো অটবী। চাপা নিশ্বাসগুলো তখনো ঘুরঘুর করছে, দুজনেরই। আমচকাই তা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। অধরে অধর ছুঁয়ে গেল। সময় গড়ালো। কারো খেয়াল থাকলো না, সে সর্বপ্রথম এগিয়ে এসেছিল?

________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

অটবী সুখ পর্ব-২৮+২৯

0

অটবী সুখ

২৮.
শেষ রাতের বৃষ্টির রেশ এখনো রয়ে গেছে। মাথার ওপর চলন্ত বৈদ্যুতিক পাখার গতি তীব্র। শীত লাগছে। কিন্তু ফ্যান কমানোর কিংবা বন্ধ করার বিন্দু মাত্র প্রয়াস নেই। ওড়নাটা শরীরের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে অটবী শুধু ঘরের এক প্রান্ত থেকে অন্ত প্রান্ত পায়চারি করছে। চিন্তায় মনে হচ্ছে, মাথায় হাজারটা পাথরের বোঝা। ঠোঁটের পাতাগুলো রুক্ষ হয়ে আছে। জিভ দিয়ে তা ভিঁজিয়ে ঘড়ির দিকে তাকালো অটবী। এগারোটা বেজে বারো মিনিট। ত্রিস্তান এসেছে দশটায়, হুট করেই। কাল সন্ধ্যায় লোকটা বলেছিল, সে অটবীকে আজকে নিতে আসবে। অটবী বিশ্বাস করেনি। একদম পাত্তাই দেয়নি। ভেবেছিল, লোকটা মিথ্যে বলছে, তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। সত্যি সত্যি হয়তো আসবে না। কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে ত্রিস্তান এসেছে। বসার ঘরে বসে মায়ের সঙ্গে কথা বলছে। এক ঘন্টা হয়ে গেল, তাদের কথা শেষই হচ্ছে না!
এমনিতেও রেবা বেগম রহিমদের কাউকে পছন্দ করেন না। সে হিসেবে ত্রিস্তানকেও তার পছন্দ হবার কথা নয়। তারওপর বিয়ের মতো বড় একটা ব্যাপার ঘটে গেছে। ত্রিস্তানকে দেখা মাত্রই উনার উচিত ছিল চিৎকার-চেঁচামেচি করে পুরো এলাকা উল্টে ফেলা। পুলিশ-টলিশ ডেকে এলাহি কান্ড ঘটানো। কিন্তু তা না করে এরা দুজন এত শান্ত, স্থবির পরিবেশে এতক্ষণ কি কথা বলছে তা কিছুতেই ঠাওর করতে পারছে না অটবী। ওপাশ থেকে চিৎকার-চেঁচামেচি তো দূর, কথার আওয়াজও ভেসে আসছে না। তার মনের হাঁসফাঁস বাড়ছে। ভয় বাড়ছে। বিছানায় একটু শান্তিতে বসতেও পারছে না সে। এই নলীটাও যে কোথায় গেল! কাজের সময় একদম পাওয়া যায় না।

ভাবনা অকূল পাথারেই খট করে খুলে গেল দরজা। নলী এলো হাঁপাতে হাঁপাতে। তাড়াহুড়ো কণ্ঠে বললো, “কাহিনী তো ঘটে গেছে আপা।”

অটবীর ভয় সীমা ছাড়ালো যেন, “ক-কি হয়েছে? আম্মা কিছু বলেছে ত্রিস্তানকে? গালিটালি দেয়নি তো?”
ঝুঁকে থাকা নলী সোজা হয়ে দাঁড়ালো। পানির তেষ্টা পাচ্ছে। ঢোক গিলে বললো, “সেটাই তো সমস্যা! গালিটালি কিচ্ছু দেয় নাই। বকেও নাই। চুপ ছিল।”
অটবী ভ্রু বাঁকালো। প্রশ্ন করলো, “তাহলে?”
—“ত্রিস্তান ভাইয়া জম্বেশ একটা ভাষণ দিছে। ওমনি আম্মা শান্ত! কি ভাষণ দিছে, শুনবা?”

অটবী উৎসুক জনগণের ন্যায় তাকালো। তাতে যেন আরও উৎসাহ পেল নলী। কণ্ঠকে জোড়পূর্বক পুরুষালি করে ত্রিস্তানের মতো গম্ভীরমুখো হয়ে বললো, “আমি জানি আপনি কষ্ট পেয়েছেন। কষ্ট পাওয়াটা স্বাভাবিক। বিয়ে কোনো ছেলে খেলা না। আমাদের অবশ্যই উচিত ছিল আপনার মত নিয়ে বিয়ে করা। কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূলে ছিল না। আপনাদের আর্থিক অবস্থা, হঠাৎ বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়া– সব মিলিয়ে অটবী আপনাকে আর দুশ্চিন্তায় ফেলতে চায়নি। এখন আপনি বলতে পারেন, আমরাই হয়তো বিয়ে ভেঙ্গেছি বা এমন কিছু। কিন্তু আমরা আমাদের অনেক আগে থেকে পছন্দ করলেও আমাদের মাঝে সম্পর্কের উৎপত্তি ঘটেছে ওর বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার পর। একমাস আগে।”

নলী থামলো। বোঝা গেল, ত্রিস্তানের মতো কথা বলতে তার খুব বেগ পেতে হচ্ছে। বারবার তাল হারিয়ে ফেলছে। জোড়ে জোড়ে দুটো নিশ্বাস নিয়ে আবার বলতে শুরু করলো, “অটবী আপনাকে খুব সম্মান করে, ভালোবাসে। আপনি ওর মা। ওকে মারতেই পারেন। কিন্তু যে নিজেই ভুল পথে হাঁটছে, তার কথা বিশ্বাস করে; পুরোটা না জেনেই ওকে মারা উচিত হয়নি। একটু নিজের মেয়ের কাছে গিয়ে বসুন। ওর পুরো কথা শুনুন। আগে আমি কেমন তা জানুন। তারপর নাহয় সিদ্ধান্ত নেবেন। আপনার নিশ্চই আপনার মেয়ের ওপর বিশ্বাস আছে? ও আপনার মতামতের বিরুদ্ধে একপাও আগাবে না। আর না আমি ওর মতের বিরুদ্ধে যাবো।”

সত্য মিথ্যা মিলিয়ে বিশাল বক্তব্য। তবে মিথ্যের চেয়ে সত্যই বেশি বলেছে লোকটা। অটবী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “আম্মা আর কিছু বলে নি?”
—“নাহ্, বলে নাই।”

বলতে বলতে পড়ার টেবিল থেকে প্লাস্টিকের বড় বোতল উঠালো নলী। কয়েক ঢোক পানি গিলে গলা ভেঁজালো। এরপর আবার বললো, “তোমাকে ত্রিস্তান ভাইয়া বলছিল উঠানে যাইতে। কি যেন বলবে বললো।”
—“উঠানে? উনি এখনো যাননি?”

প্রশ্ন ছুড়ে, এবড়োথেবড়ো ওড়নাটা সুন্দর করে মাথায় জড়ালো অটবী। বসার ঘরে একবার উঁকি দিয়ে সাবধানী গলায় শুধালো, “আম্মা কোথায়? বাইরে যেতে পারবো?”
—“রুমে আছে। পৃথাও মনে হয় রুমে। আল্লাহ জানে আম্মার কানে কি আকাম-কুকাম ঢালতাছে! তুমি আপা তাড়াতাড়ি যাও তো!”

অটবী আর দেড়ি করলো না। ছুটন্ত পায়ে বেড়িয়ে গেল ঘর থেকে। ত্রিস্তান কি এখনো অপেক্ষা করছে? নাকি চলে গেছে? অস্থির লাগছে তার। ভীষণ অস্থিরতা কাজ করছে।

উঠানের দিকটায় ত্রিস্তানকে পাওয়া গেল না। আড়ষ্ট অটবীকে আরও অশান্তিতে ফেলে সে বিন্দাস গেটের বাহিরে সিগারেট ফুঁকছে। মুখ দেখা যাচ্ছে না। উলটো দিক ফিরে আছে। ঝাকড়া চুলের মাথার ওপর দিয়ে অবিরাম ধোঁয়ার সারি উড়ে বেড়াচ্ছে। যেন ভেতরকার সব গ্লানি নিজের কাছে টেনে নিচ্ছে আকাশ! ত্রিস্তানও-বা কম কিসের? চোখের লুকোচুরিতে আকাশের সঙ্গে গোপন আলাপনে মত্ত হয়েছে সে। কেমন একটা রাজকীয় ভাবসাব! কিন্তু কোথাকার রাজা সুখনীল ত্রিস্তান? অটবীর বক্ষে লুকানো ওই গোপন যন্ত্রের? নাকি এই বিশাল আকাশের? যাকে সে তার মনের সব কথা বলে।

ক্যাচক্যাচ শব্দে গেট খোলার আওয়াজ হতেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো ত্রিস্তান। অটবীকে দেখে অল্প হাসলো। স্নিগ্ধ হাসি! মনোমুগ্ধকর! অটবীর রাগ-টাগ চট করে উবে গেল। কি মুশকিল! সে কি আদৌ কখনো এ লোকের ওপর রাগ করতে পারবে না?
কৃত্রিম গম্ভীরতা নিয়ে অটবী মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি এখানে দাঁড়িয়েছেন কেন? আমি আপনাকে খুঁজছিলাম।”

ত্রিস্তান উত্তর দিলো না। হাতের সিগারেট-টা ফেলে পা দিয়ে পিঁষে ফেললো। আচমকা ঝুঁকে বললো, “দেখো তো, সিগারেটের গন্ধ পাচ্ছো?”

লোকটা কাছে চলে এসেছে। একটু বেশিই কাছে। কানের জায়গাটুকু গরম নিশ্বাসেরা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে। অদ্ভুত অনুভূতি! অটবী ভড়কে এক কদম পেছালো। কাঁধে আলতো ধাক্কা দিয়ে ত্রিস্তানকে দূরে সরিয়ে দিলো। অন্যদিকে চেয়ে বললো, “কিজন্য ডেকেছেন?”
—“ঘুরতে যাবো।”
—“হু? কি?”

অটবীর আশ্চর্য দৃষ্টি। পরনে মোটামোটি ধরণের সালোয়ার। চুলগুলো কাকের বাসা হয়ে আছে। এ অবস্থায় ঘুরতে যাওয়া? তারওপর রেবা বেগমের হাবভাবও সুবিধার নয়। কাল রাত্রির রাগ নিশ্চই এত তাড়াতাড়ি কমে যায়নি?
অটবী দিরুক্তি জানালো, “মাথা খারাপ হয়েছে আপনার? এমতাবস্থায় আপনি ঘুরতে যাওয়ার কথা বলেন কিভাবে?”

ত্রিস্তান আগের মতোই উত্তর দিলো, “কিছু হবে না, চলো।”
অটবীর হাত ধরে ক্ষীণ টানলো সে। অথচ অটবী শক্ত হয়ে আছে। নড়ছে না।

—“আপনি বাচ্চামো করছেন, ত্রিস্তান! এমনিতেও আম্মা রেগে আছেন। তাকে আর রাগানো ঠিক হবে না।”
—“তিনি রেগে নেই।” ত্রিস্তানের নির্লিপ্ত কণ্ঠ। অটবী ভ্রু কুঁচকালো, “মানে?”
—“তোমার আম্মা মনে মনে রাজিই আছেন। শুধু প্রকাশ করছেন না।”
—“আমাকে কাল থাপ্পড় মেরে আম্মা এখন রাজি আছেন? আপনি আমাকে সেটা বিশ্বাস করতে বলছেন?”
—“কাল হয়তো ছিলেন না, এখন আছেন। তুমি উনাকে পটাতে পারোনি। এটা তোমার দোষ।”

হাহ! এখন সব দোষ তার? দিরুক্তি করে কিছু বলবে, তার পূর্বেই অটবীর হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিলো ত্রিস্তান। কোত্থেকে হাজারটা গাম্ভীর্য নিয়ে বললো, “আর কথা বলো না তো, অটবী। তুমি আমাকে খুব বিরক্ত করছো।”

কথাটা কি ত্রিস্তান তাকে ভয় পাওয়াতে বললো? কিন্তু অটবী তো মোটেও ভয় পায়নি। উলটো চরম বাধ্য হয়ে বললো, “সবাই দেখবে, ত্রিস্তান! আপনি এমন বাচ্চামো কেন করছেন? অনতত হাতটা তো ছাড়ুন!”
তৎক্ষণাৎ ত্রিস্তানের একরোখা উত্তর, “তো? দেখলে দেখুক। তুমি আমার প্রেমিকা নও।”
তবে সে কে? অটবীর খুব ইচ্ছে হলো, প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করতে। কিন্তু সে জানে, জিজ্ঞেস করলেও ত্রিস্তান উত্তর দেবে না। চুপ থাকবে।

জঙ্গলের কাঁদায় মাখো মাখো রাস্তা পেরিয়ে ত্রিস্তানের বড়োসড়ো বাড়িটায় পৌঁছাতেই ত্রিস্তান হাত ছেড়ে দিলো। দরজা খুললো। ভেতরে ঢুকতে ইশারা করে বললো, “তোমাকে একেবারে নিয়ে আসবো বলেছিলাম। কথা রাখতে পারছি না বলে দুঃখীত, অটবী। তবে এখন, এই মুহুর্তে আরেকটা কথা দিচ্ছি। এখন থেকে বিকাল অব্দি এটা তোমার। এখানের সবকিছু তোমার। যা ইচ্ছা করো, যত ইচ্ছা জ্বালাও। কেউ কিছু বলবে না।”

______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

অটবী সুখ

২৯.
দূর থেকে পাখির কুহুকুহু ডাক শোনা যাচ্ছে। ঘরে ফ্যান চালানো নেই। বাহির থেকে মৃদুমন্দ বাতাসে ফ্যানের কথা মনেই আসছে না। জঙ্গল তো! আশপাশে প্রচুর গাছ। রোদের আলো ঠিকঠাক আসে না। গাছেরা সারাদিন দুলতে থাকে আনন্দে। গরম লাগবে কোত্থেকে? কোলে মাথা এলিয়ে শুয়ে থাকা ত্রিস্তানের চুলে অল্প হাত বুলালো অটবী। লোকটার চোখের পাতা বন্ধ। একটু আগে সেগুলো পিটপিট করলেও এখন সেটাও নিস্তেজ হয়ে গেছে। নড়ছে না। ঘনঘন নিশ্বাস একেকটা। তাকে এ রাজ্যের রাণী বানিয়ে ত্রিস্তান কি ঘুমিয়ে গেছে? এত তাড়াতাড়ি? অথচ একটু আগেও তাকে ধরে বেঁধে বিছানায় বসিয়ে বিরাট হাই তুলে বলেছিল, “হামি দিচ্ছি বলে ভেব না, ঘুমাবো। শুধু একটু কোলে মাথা রাখতে চাচ্ছি। বউয়ের কোলে নাকি মায়ের মতো আরাম আছে! আছে নাকি? তুমি কিছু জানো?”

বলতে বলতে অটবীর কোলে মাথা রাখলো ত্রিস্তান। পরপরই চোখ-মুখ কুঁচকে নিজেই আবার আশ্চর্য হয়ে বললো, “আরেহ্! তুমি জানবে কিভাবে? তোমার তো আবার বউ নেই।”
অল্প হেসে উঠলো অটবী। তার সত্যিই কোনো বউ নেই। কিন্তু একটা গম্ভীর প্রকৃতির ফাজিল বর আছে। যে আর কিছু পারুক আর না পারুক, অটবীকে জ্বালাতে খুব পারে!

—“ত্রিস্তান? উঠবেন না?”
মিহি কণ্ঠের ডাক। ত্রিস্তান নিশ্চুপ, স্থির। নিশ্বাসের গতি আস্তে আস্তে গভীর হচ্ছে। চোখে-মুখে অকৃত্রিম বিষাদ, তবু কোথাও যেন ক্ষণিকের প্রশান্তির ছায়া। একটু কি শুকিয়েছে লোকটা? হ্যাঁ, আগের চেয়ে স্বাস্থ্য কম কম লাগছে। ঠোঁট শুষ্ক, চুল রুক্ষ, চোখের নিচে বিশ্রী কালো কালির ছড়াছড়ি। বড়োবড়ো ঘন পাঁপড়ির আড়ালে থাকা কালো দাগটুকু আলতো আঙুলে স্পর্শ করলো অটবী। ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখলো লোকটার সারা মুখ। কপাল থেকে নাক, নাক থেকে ঠোঁট, ঠোঁট থেকে আবার কপাল! ত্রিস্তান যেন একটু বিরক্তই হলো এতে। এতক্ষণ পর সামান্য নড়েচড়ে উঠলো। ভীষণ বিরক্তি নিয়ে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে আওড়ালো, “জ্বালিও না, অরণ্য। আমি একটা তুমি তুমি স্বপ্ন দেখছি।”

চোখের সামনে খুলে রাখা জানালা। গাছের পাতার দুলোদুলি ক্ষীণ কমেছে। সময় গড়াচ্ছে। নিস্তব্ধ পরিবেশে ঘড়ির টিকটক শব্দের যে কি তীব্রতা! অটবী একপলক ত্রিস্তানকে দেখলো। লোকটা তার কোমড় জড়িয়ে মুখ লুকিয়ে আছে। সরবার কিংবা নড়বার জোটুকুও নেই। পাশের টেবিলে কিছু কেক আর বিস্কুট পরে আছে। একটু আগে যদিও ত্রিস্তানের হাতে সে ভাত খেয়েছিল। কিন্তু এখন আবার ক্ষুধারা ঝগড়ায় মেতেছে। কিছু না খেলে চলবে না। অল্প ঝুঁকে কেক নিতে গিয়ে অটবীর হঠাৎ খেয়াল হলো, টেবিলের একদম শেষ প্রান্তে তিনটে বই সোজাসোজি করে রাখা। অটবী কেক মুখে পুরলো। খেতে খেতে বইগুলো হাতে নিলো। তিনটের মধ্যে দুটো বাংলা বই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর শরৎচন্দ্রের। তৃতীয় নম্বরটা কোনো বই না, ডায়েরী। কাঠের কভারে খাঁদ কেটে ইংরেজীতে লিখা ‘Shukhneel Tristan’।
মনে মনে কৌতূহলের দানা জট পাকালো। ডায়েরীর ভেতরের রহস্য জানতে বড় সাধ জাগলো অটবীর। দ্বিধাদ্বন্দে ডায়েরী খুললোও। পৃষ্ঠা উল্টালো। পৃষ্ঠাগুলোও কেমন যেন। কুঁচকানো, ভাঁজ ফেলা। কিছু কিছু লেখা ঝাপসা। যেন পানি লেগে কুঁচকে গেছে, লেখা মুছে গেছে। কোনো কোনো জায়গায় আবার রক্তের ফোঁটা ফোঁটা দাগ। অটবীর বুঝতে অসুবিধে হলো না, রক্তগুলো ত্রিস্তানের। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে লেখাগুলোয় চোখ বুলালো,

‘আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি কিছু ভুলে যাচ্ছি। খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু। নিজের নামটাও আজকাল মনে থাকে না। ভুলে যাই। রাতে ঘুমাতেও খুব অসুবিধে হয়। বিশ্রী বিশ্রী স্বপ্ন আসে। মাকে নিয়ে, বাবাকে নিয়ে, তনয়াকে নিয়ে! বাবা-মা মারা যাওয়ার পর থেকেই এমন হচ্ছে। আমার মনে হয়, আমি খুব খারাপ কিছু করেছি। নয়তো তারা মারা যাওয়ার পরই এমন বাজে স্বপ্ন দেখছি কেন?
স্বপ্নের ওই সুখনীল ত্রিস্তান আমি নই। আমি ওরকম খারাপ হতেই পারি না। আমি তো আমার মায়ের রাজপুত্র, বাবার গর্ব, বোনের ভরসা। তাহলে স্বপ্নে ওমন দেখায় কেন? ডাক্তারও আজেবাজে কথা বলছেন। আমি নাকি নাটক করছি! আশ্চর্য! আমি কি অভিনেতা? আমি কেন নাটক করবো? আমার সত্যি কিছু মনে নেই। মাঝে মাঝে যা মনে আসে, সব ঝাপসা, ঘুটঘুটে অন্ধকার। শুধু মায়ের অশ্রুসিক্ত মুখটা দেখতে পাই। মা-টা আমার এত হাহাকার করে কাঁদছিল!

মাথা ব্যথাটাও আজকাল বেড়েছে। কিচ্ছু সহ্য করতে পারিনা। তনয়া আশেপাশে সারাদিন ঘুরঘুর করে, বিরক্ত করে। আমার তখন ইচ্ছে করে ওকে…..’

অটবী থামলো। এরপরের লাইন দুটোয় অনেক কাটাছেঁড়া। চেষ্টা করেও পড়া যাচ্ছে না। হাতের তিনটে আঙুল ফাঁক রেখে গুটিগুটি অক্ষরে ত্রিস্তান আবার লেখেছে,

“আমার নাক দিয়ে সময়ে অসময়ে রক্ত ঝরা শুরু হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন, এটা কোনো ব্যাপার না। আমার অতিরিক্ত চিন্তা আর অসুস্থতার কারণেই এমন হচ্ছে। চিকিৎসা করালে ঠিক হয়ে যাবে। ভুলে যাওয়া অতীতগুলো হয়তো ফিরে আসবে একে একে। কিন্তু আমি সেটা চাই না। আমি জানি, আমি খুব খারাপ কিছু করেছি। এই জানাজানিটা এটুকুতেই থাক। আমি এতেই ভালো আছি। সারাজীবন এই রোগ বয়ে বেড়াতেও আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি শুধু ভালো থাকতে চাই। একটুখানি শান্তি চাই। আমার কেন যেন মনে হয়, অতীত জেনে গেলে আমার আর ভালো থাকা হয়ে উঠবে না। আমি মরে যাবো। শেষ হয়ে যবো।”

সম্পূর্ণ ডায়েরীটা ফাঁকা। আর কিছু লেখা নেই। স্তব্ধ অটবী ডায়েরী রেখে দিলো। আগে যেমনটা রাখা ছিল? তেমন ভাবেই। সদর দরজায় কারাঘাত শোনা যাচ্ছে। অটবীর মনে পরলো, সে আসবে বলে সরোজ আর তনয়াকে আগেই বাহিরে পাঠিয়ে দিয়েছিল ত্রিস্তান। তারা বোধহয় এসে গেছে। ঘড়িতে একবার সময় দেখে নিলো সে। রোধ হওয়া কণ্ঠে জোড় লাগালো, “ত্রিস্তান? উঠুন। আমাকে এখন চলে যেতে হবে।”

বাসায় আসা মাত্রই রেবা বেগমের মুখোমুখি হলো অটবী। থমকালো। ভেবেছিল, তিনি আরও একবার চিৎকার চেঁচামেচি করবেন, মারবেন! কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে তিনি কিছুই বললেন না। চুপচাপ রান্নাঘরে চলে গেলেন। ক্লান্ত অটবী নিজেও বাম পাশের রুমটায় চলে গেল। পৃথা তখন ওঘরেই ছিল। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফোনে ভিডিও দেখছিল আর খিলখিল করে হাসছিল। অটবীকে দেখা মাত্রই হাসি থেমে গেল। মুখটা এমন ভাবে বিকৃত করলো যেন অটবীকে নয়, ভীষণ বিরক্তিকর কিছু দেখে ফেলেছে সে। তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে চলে যেতে নিলেই অটবী ডেকে উঠলো, “পৃথা, দাঁড়া।”

পৃথা দাঁড়ালো। প্রচন্ড অনিচ্ছায়। অটবী আবার বললো, “এদিকে ফির। তোর সাথে কথা আছে।”
—“কি বলবা এভাবে বলো। আমি শুনছি।”

পৃথার হাতে দামি অ্যান্ড্রয়েড ফোন। আলমারিতে সামলে রাখা মুশফিকের সেই ফোনটা! যেটা অটবী কয়েকদিন আগেও খুঁজে পাচ্ছিল না। এটা তবে পৃথার কাছে ছিল!

—“তুই আমাকে না বলে ফোনটা নিয়েছিস কেন, পৃথা?”
পৃথার দায়সারা উত্তর, “আমার লাগবে এজন্য নিয়েছি। এখন কি তোমাকে কৈফিয়ত দিতে হবে নাকি?”
—“অবশ্যই দিতে হবে। জিনিসটা আমার, পৃথা। যেখানে আমি ফোনটা কখনো ধরে দেখেনি সেখানে তুই ধরেছিস কোন সাহসে?”
—“প্রেম করার জন্য নিয়েছি। হয়েছে তোমার?”

অটবীর ইচ্ছে হলো, খুব করে পৃথার গালে একটা চড় লাগিয়ে দিতে। ইচ্ছেটা বহুকষ্টে দমিয়ে নমনীয় হতে চাইলো, “দেখ পৃথা, বোঝার চেষ্টা কর। কাদিন ছেলেটা ভালো না।”
—“সেটা তোমার চিন্তা না করলেও চলবে। নিজের চরকায় গিয়ে তেল দাও।”

পৃথা ধুপধাপ পায়ে চলে গেল। সম্ভবত মায়ের ঘরে। নলী কটমট দৃষ্টে তা দেখলো মাত্র। এ মেয়ে অনেক বাড় বেড়েছে। আগে সরোজের জন্য তাকে কত কিছু বলতো। আর এখন দেখ! নিজে হয়েছে হার বেয়াদব! অসভ্য!
পড়ার টেবিল থেকে উঠে অটবীকে জড়িয়ে ধরলো নলী। কোমল গলায় বললো, “তুমি ওর কথায় কষ্ট পেও না, আপা। ও বখে গেছে। শিক্ষা পেলেই ঠিক হয়ে যাবে। দেখ না, আমি ওর সাথে কথা বলছি না? তুমিও বলো না।”

অটবী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বুকে চাপা তীব্র বেদনার দীর্ঘশ্বাস! ঢিমানো কণ্ঠে বললো, “তোরা কেউই তো আমার কথা শুনিস না, নলী।”
নলী যেন বুঝলো না। অবুঝ গলায় শুধালো, “আমি আবার কোন কথা শুনিনি?”
—“সরোজ থেকে দূরে থাকতে বলেছিলাম। শুনেছিস?”

হাতের বাঁধন ঢিলে হলো। এক কদম সরে দাঁড়ালো নলী। অবাক হলো, “তুমি জানতে?”

অটবী জবাব দিলো না। চুপচাপ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরলো। আশপাশে এত রহস্য! উদাসীনতা! মন খারাপ! কোথাও অল্প সুখের রেশ নেই।

_____________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা