Tuesday, July 8, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 337



প্রিয়তার প্রহর ২ পর্ব-১৯ এবং শেষ পর্ব

0

#প্রিয়তার_প্রহর (২য় পরিচ্ছেদ)
( সমাপ্তি পর্ব )
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

“আব্বু যে মারা গিয়েছে আপনি তা জানেন?

ছোট্ট একটি প্রশ্ন। জানা – না জানার প্রশ্ন। উত্তর হ্যাঁ কিংবা না তেই দেওয়া যায়। তবুও এই ছোট্ট প্রশ্নটি শুনে নিষ্প্রাণ দেখাল প্রীতিকে। মুখটা মলিন হলো ভিষণ। সংকোচ দেখা দিল চোখমুখে। নতজানু হলো ততক্ষণাৎ। সময় নিয়ে মাথা নাড়িয়ে বলল,

” জানি।

প্রিয়তা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে,

” আব্বু কিভাবে মারা গেছে জানেন?

চোখ তুলে প্রীতি। স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে,

” স্ট্রোক..

বাকি কথা কেড়ে নিল প্রিয়তা। উচ্চস্বরে বলল,

” আব্বুকে মেরে ফেলা হয়েছে। কে মেরেছে জানেন? দীপা খন্দকার। যার আসল নাম মিথিলা দেওয়ান। ওই মহিলা ধনী পুরুষদের পটিয়ে বিয়ে করেন এবং ব্ল্যাকমেইল করে সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়। আব্বু মারা যাবার আগে আরহামকে কিছু সম্পত্তি লিখে দিয়েছিল। ওই মহিলার তা সহ্য হয়নি। আরহামের পরিবর্তে সম্পত্তি দেখাশোনার দায়িত্ব আমায় দিয়েছিল বলে দুদিন আগে আমাকে মেরে ফেলার জন্য লোক পাঠিয়েছিল ওই মহিলা। আরহামের ক্ষতি করার ও চেষ্টা করেছে। সব আপনার জন্য। সব দোষ আপনার। আপনি যদি পরকিয়ায় জড়িয়ে আব্বুকে দূরে ঠেলে না দিতেন তবে আব্বু একাকীত্বে ভুগে দীপার মতো মহিলার দিকে ঝুঁকে পড়তো না। এত সুন্দর একটা সংসার ও ভেঙে যেত না। সর্বোপরি আমরা সবাই সুখে থাকতাম। এক হয়ে থাকতাম।।

ঢুকরে কাঁদে প্রীতি। কষ্ট হয় খুব। পেটে যন্ত্রণা হয়। কোমর ভারী লাগে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,

” আমার ভুল হয়ে গেছে রে। খুব বড় ভুল করে ফেলেছি।

” ভুল নয়। এটাকে ভুল বলে না। আপনি অন্যায় করেছেন।

” আমাকে ক্ষমা করে দে প্রিয়তা।

প্রিয়তা হাসে। তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসি। প্রিয়তার চোখ জোড়া আরহামকে খুঁজে। এদিক ওদিক তাকিয়ে আরহামকে দেখতে পায় সে। ছেলেটা দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। উঁকি দিয়ে দেখছে সবটা। প্রিয়তাকে তাকাতে দেখে আরহাম ও তাকাল বোনের দিকে। প্রিয়তা ডাকল ছেলেটাকে। ছুটে এসে আরহাম দাঁড়াল প্রিয়তার কাছে। গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল বোনের সাথে। প্রিয়তা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে আরহামের উদ্দেশ্যে বলল,

” চিনতে পারছো?

মাথা নাড়ায় আরহাম। নিষ্পাপ দেখায় ছেলেটাকে। ফর্সা গাল দুটোকে টেনে দিতে ইচ্ছে হয় প্রিয়তার। আরহাম উত্তর দেয়। বলে,

” আম্মু।

” যাবে উনার কাছে?

এবারেও হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ে আরহাম। প্রীতি ছেলের পানে একধ্যানে তাকিয়ে থাকে। হু হু করে উঠে তার বক্ষস্থল। আরহাম বোনের অনুমতির অপেক্ষায় থাকে। প্রিয়তা বাঁধা দেয় না। নিষ্প্রাণ, নির্জীব চোখে বলে,

” যাও।

সময় ব্যয় করে না আরহাম। ছুটে যায় মায়ের কোলে। প্রীতি জড়িয়ে ধরে আরহামকে। চুমু খায় এলোপাথাড়ি ভাবে। শক্ত করে জড়িয়ে রাখে আরহামকে। বলে,

” কেমন আছিস আরহাম।

প্রিয়তা ধীর পায়ে শাশুড়ির দিকে এগিয়ে আসে। মিসেস নাবিলার পাশে দাঁড়িয়ে নতজানু হয়ে বলে,

” আম্মুকে এই ফ্ল্যাটে রাখি আন্টি? আপনার কি অসুবিধে হবে? আমি থাকতে পারবো না উনার সাথে। মাস শেষে আম্মুর জন্য আমি খরচ পাঠাবো।

মিসেস নাবিলা হাসেন। প্রিয়তার হাত ধরে বলেন ,

” এমন করে বলছো কেন প্রিয়তা? এত বড় ফ্ল্যাটটায় কেবল আমি আর নিধি থাকি। নিধি তো সেইভাবে বাড়িতে থাকেই না। সারাক্ষণ একা লাগে নিজেকে। তোমার আম্মু থাকলে আমার ভালোই লাগবে। গল্প করার একটা সঙ্গী পাবো। তোমায় এভাবে বলতে হবে না। উনি যতদিন ইচ্ছা ততদিন এখানে থাকতে পারেন। কোনো সমস্যা হবে না আমার।

প্রিয়তার ভালো লাগে কথাগুলো। অশ্রু জমে চোখে। বিদায় নিতে চায় সবার থেকে। লাগেজ টেনে দরজার সম্মুখে রাখে। অতঃপর প্রীতির দিকে তাকায় প্রিয়তা। প্রীতি ছেলেকে পেয়ে এখন হাসছে। প্রাণবন্ত দেখাচ্ছে তাকে। প্রিয়তা আরহামকে জিজ্ঞেস করে,

” তুমি যাবে আমার আর প্রহরের সাথে? নাকি তোমার আম্মুর সাথে থাকবে।

আরহাম বোনের দিকে তাকায়। উত্তর কি দিবে বুঝতে পারে না। প্রীতির মুখটা শুকনো হয়ে আসে। বলে,

” কোথায় যাবি তুই?

” উনি ঢাকায় চাকরি করেন। ওখানেই থাকবো আমরা। আপনি এখানে থাকবেন আন্টির সাথে। আর আরহাম যেখানে থাকতে চায় সেখানেই থাকবে। আমি এখানে আপনার সাথে থাকবো না।

আরহাম বসেই থাকে। কি বলবে ভেবে পায় না। প্রীতি পুনরায় অজস্রবার চুমু আঁকে আরহামের মুখে। আরহামকে কোল থেকে নামিয়ে বলে,

” আরহামকে তুই যতটা ভালোবাসিস তার এক রত্তি ও বোধহয় আমি বাসতে পারিনি। আমার অনুপস্থিতিতে তুই ওর সব দায়িত্ব পালন করেছিস। বাবার মতো শাসন করেছিস, মায়ের মতো আগলে রেখেছিস, বোনের মতো পাশে থেকেছিস। আমার চেয়ে ওর উপর তোর অধিকার অনেক বেশি। আমি ওকে রাখবো না। ওকে তুই নিয়ে যা। তোর কাছেই আরহাম সবচে খুশি থাকবে।

আরহাম চলে আসে বোনের নিকট। প্রিয়তা চলে যেতে উদ্যত হয়। এক মুহুর্ত এখানে থাকলে দম আটকে মরে যাবে সে। নয়তো ভেঙে চুড়মার হয়ে যাবে। দরজা ছেড়ে বাইরে পা দিতেই পেছন থেকে প্রীতি প্রিয়তার উদ্দেশ্যে বলে,

” তোর আব্বু মরে গিয়ে বেঁচে গিয়েছে প্রিয়তা। তুই ওর প্রতি সহানুভূতি দেখাচ্ছিস। আর আমি? আমি চিরকাল বেঁচে থাকবো তোর ঘৃণা নিয়ে। তোর চোখে আমি আমার প্রতি সারাজীবন রাগ আর ক্ষোভই দেখে যাবো। তুই আমার চোখের সামনে থাকবি না, আমায় এড়িয়ে চলবে, আমাকে অপরাধী ভেবে যাবি সারাজীবন। এর চেয়ে বড় শাস্তি আর কি হতে পারে বল? আমি উন্মাদের মতো ছটফট করবো তোদের দেখার জন্য, তোর ক্ষমা পাওয়ার জন্য, তোর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য, আম্মু ডাকটৃ শোনার জন্য। কিন্তু তুই আমাকে ক্ষমা করবি না, ডাকবি না আম্মু বলে। এর চেয়ে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি আমার জন্য আর কি হতে পারে?

_____

জানালার পাশে বসেছে প্রিয়তা। কোলে বসেছে আরহাম। আরহামের জন্য আরো একটি সিট বুক করেছিল প্রহর। কিন্তু প্রিয়তা ভাইকে নিজের কোলেই রেখেছে। ছেড়ে দিলেই মনে হচ্ছে হারিয়ে যায় আরহাম। প্রিয়তা তো সইতে পারবে না ভাইয়ের নিখোঁজ সংবাদ।

প্রহর চিপস ধরিয়ে দিয়েছে আরহামকে। মন খারাপ ভুলে আরহাম চিপস চিবুচ্ছে। প্রিয়তা ঘর থেকে বের হবার মুহুর্তের সব কথাই বলেছে প্রহরকে। প্রহর সান্ত্বনা দেয় নি। একজন মানুষকে আর কত সান্ত্বনা দেওয়া যায়? প্রিয়তা পরিপক্ক। পরিস্থিতি বোঝার মতো জ্ঞানবুদ্ধি আছে মেয়েটার। প্রিয়তার জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তটি প্রিয়তা কারো পরামর্শ ছাড়াই নিয়েছিল। সবচেয়ে বড় পদক্ষেপটি প্রিয়তা নিয়েছিল কারো সাহায্য ছাড়াই। নিজের জীবনের কঠিন সিদ্ধান্ত গুলো যে সবসময় নিজেকেই নিতে হবে তা বুঝিয়ে দিচ্ছে প্রহর। মেয়েটা এভাবেই একা সিদ্ধান্ত নিক।

বাস ছেড়ে দেয়। চলতে থাকে বাসটি। পিছনের সব গাছপালা ফেলে ছুটতে থাকে। প্রিয়তা জানালা দিয়ে মাথা বের করে। পিছু তাকায়। শহর ছেড়ে যেতে কষ্ট হয় খুব। মনে মনে বুলি আওড়ায় প্রিয়তা। বলে,

” আমি প্রিয়তা। জন্মেছি সিলেটে। সিলেট শহরটার নাম শুনলেই একটা আলাদা প্রশান্তি অনুভূত হয়। সিলেট শহরটার নাম শুনলেই মানসপটে ভেসে ওঠে টিয়ে আর সবুজের মিশেলে সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা চা পাতা। অদ্ভুত , উদ্ভট সুন্দর ভাষা। প্রকৃতির সব সৌন্দর্যই যেন সিলেটকে ঘিরে। অথচ আমার নির্মম ভাগ্য। এই শহরটাই আমার থেকে সব কেড়ে নিয়েছে। একরাশ দুঃখ দিয়েছে। কাছের মানুষ কেড়ে নিয়েছে। প্রতি পদে পদে মানুষের অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। আচ্ছা এই শহরটা তার সবই কি কেড়েই নিয়েছে? কিচ্ছু দেয়নি? প্রিয়তার বিবেক করে ওঠে প্রশ্নটি। পুনরায় নিজেই উত্তর দেয়, প্রহরের মতো মানুষটাকে তুই এই সিলেট শহরটাতেই পেয়েছিলি প্রিয়তা। প্রহরের পরিবারটাকে পেয়েছিলি এই সিলেটেই। পরিক্ষায় সবসময় ভালো নম্বর পেয়েছিস সিলেটে থেকেই। ষোলটি বছর আনন্দে, খুশিতে কাটিয়েছিস। এই শহর যেমন নিয়েছে, তেমনি তোকে দিয়েছেও।

প্রিয়তা বুঝতে পারে। চোখের কার্নিশে জমে অশ্রুকণা। বিড়বিড়িয়ে প্রিয়তা বলে ওঠে,

” শোনো শহর, তোমাকে আমি ঘৃণা করতে পারি না। আবার জাঁকজমক ভাবে ভালোও বাসতে পারি না।

____

ঢাকায় আসার পর ছয়টা দিন কেটে গেল খুব দ্রুত। এই ছ’দিনে প্রিয়তা নিজেকে গুছিয়েছে। প্রহরের বাড়িতে গিয়েই উঠেছে তারা। ছ’টা দিন প্রিয়তা ঘর সাজাতেই ব্যয় করেছে। আগে এ বাড়িতে শুধু প্রহর থাকতো। এখন দুজন মানুষ এড হয়েছে। মেয়েলি জিনিসপত্র কিনতে কিনতেই প্রিয়তার বেহাল দশা। আগে প্রহরের ঘরে ছোট একটা সুকেস ছিল। এখন সেটা রেখে আরো বড় একটি সুকেস কেনা হয়েছে। আয়নাটাও ছিল মাঝারি আকারের। প্রিয়তা আসার পর খুব সুন্দর আর ডিজাইন করা ড্রেসিং টেবিল কেনা হয়েছে। আরহাম আবার এখানকার স্কুলে যাচ্ছে। সব চলছে নিয়ম মাফিক। শুক্রবারের দিনটায় ছুটি পেল প্রহর। সকালের নাস্তা সেরে প্রিয়তা বলে উঠল,

” বাড়িওয়ালা আন্টিকে ঘর ভাড়া দেওয়া হয়নি। চলুন না ও বাড়ি যাই। আসবাবপত্র সব আনতে হবে এখানে। ওখানে রেখে কি লাভ বলুন তো।

আলসেমি লাগে প্রহরের। আলস্য ভঙিতে বলে,

” ওই আসবাবপত্র দিয়ে কি করবেন? এইযে এত আসবাব পত্র কিনলেন। ওগুলোই তো রাখার জায়গা হচ্ছে না ঘরে।

নাক ফুলায় প্রিয়তা। কিল বসায় প্রহরের পেশিতে। বলে,

” কষ্ট করে কিনেছি ওগুলো। ফেলে দিবো নাকি। এনে রাখি। তারপর যা হবে দেখা যাবে। চলুন প্লিজ।

প্রহর ফোন ট্রাউজারের পকেটে রাখে। প্রিয়তা তৈরী হয়ে নেয়। আরহামকে রেখে রওনা দেয় তারা।

______

প্রহরকে বাইরে রেখে প্রিয়তা বাড়িওয়ালার ফ্ল্যাটে ওঠে। কলিংবেল চাপে। দু’বারের মাথায় মনোয়ারা খানমের পরিবর্তে দরজা খুলে মনোয়ারা খানমের ছেলের বউ আলিয়া। আলিয়ার কোলে ছোট্ট একটি বাচ্চা। প্রিয়তাকে দেখে হাসল আলিয়া। বলল,

” এসেছো বাড়ি থেকে? কখন ফিরলে?

প্রিয়তা বাচ্চার গাল টানে। হাসিমুখেই বলে,
” ঢাকায় এসেছি ছ দিন হলো আপা। এখানে এলাম মাত্র। আন্টি কোথায়? ভাড়া দিতে এলাম।

আলিয়ার মুখটা মলিন হলো। হাসি মিলিয়ে গেল মুখ থেকে। বলল,

” আম্মা গেছে তিহাদের বাড়ি। তিহার লা”শ দেখতে।

প্রিয়তা অবাক। তিহা নামটা তার চেনা। খুবই চেনা। মেয়েটাকে প্রিয়তা যথেষ্ট ভালবাসে। আরহামের মুখে কয়েকদিন আগে শুনেছিল তিহাকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই নিয়ে প্রিয়তা পূর্বে ভেবেছিল। কিন্তু সিলেট যাওয়ার পর আর তিহার বিষয়টা মাথায় আসেনি প্রিয়তার। অবিশ্বাসী কণ্ঠে প্রিয়তা বলল,

” লা’শ?

” হ্যাঁ। তিহা তো মারা গেছে। ওর লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। বাড়িতে এনে দিয়েছে। আম্মা ছুটলেন লা”শ দেখতে।

তিহার মাথা ঘুড়ে। প্রচণ্ড চমকায় সে। কণ্ঠরোধ হয় প্রিয়তার। ঘর ভাড়াটা দিয়ে বেরিয়ে আসে বাড়ি থেকে। হন্তদন্ত হয়ে প্রহরের নিকট এসে থামে প্রিয়তা। প্রিয়তাকে বিচলিত দেখে চিন্তিত হয় প্রহর। বলে,

” কি হয়েছে? আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?

প্রিয়তার কান্না পায়। কণ্ঠ কেঁপে উঠে। জড়তা কাজ করে কণ্ঠে। তবুও কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে প্রিয়তা বলে,
” আমার চেনা এক ছোট আপু আছে এখানে। ও নাকি মারা গিয়েছে। আমাকে যেতে হবে।

প্রহর বলে,
” আমিও যাচ্ছি চলুন।

প্রিয়তা জোর কদমে হাঁটে। মাথা ঘুরে তার। সবকিছু এলোমেলো লাগে। তিহার মৃত্যু মানতে পারবে না প্রিয়তা। প্রিয়তার মনে পরে চার মাস আগের কথা। তখন প্রথম এ এলাকায় প্রবেশ করেছিল প্রিয়তা। কি করবে না করবে ভেবে পাচ্ছিল না। এলাকায় নতুন একটি মেয়েকে উঠতে দেখে তিহা একদিন আসে প্রিয়তার কাছে। এসে গল্প করে, আরহামের সাথে খেলে, আড্ডা দেয়। প্রিয়তা তিহাকে ছোট বোনের মতো ভালোবাসতে আরম্ভ করেছিল। ওরা একসাথে যাতায়াত করতো, একে অপরের বাড়ি গিয়ে খোঁজ-খবর নিতো। মেয়েটা প্রিয়তার দুরবস্থা দেখে দু তিনটে টিউশনি খুঁজে দিয়েছিল। সেই টিউশনির টাকা দিয়েই প্রিয়তা ঘর ভাড়া দিয়েছে, ভালো মতো খেয়েছে। কিন্তু এ দু-তিনটে টিউশনিতে চলছিল না প্রিয়তার। তিহা দায়িত্ব নিয়ে দোকানে সেলসম্যানের চাকরি খুঁজে দেয় প্রিয়তাকে। তিহার বাবা ধনী লোক ছিলেন। সিঙ্গাপুরে থাকেন উনি। মাকে নিয়ে এখানে থাকতো তিহা। তিহা তার বাবাকে বলে প্রিয়তাকে চাকরি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। সবসময় প্রিয়তার সাদে সাথে থাকতো মেয়েটা। আরহামের দেখভাল করতো আপন বোনের মতো। এই তিহা মেয়েটা না থাকলে কি হতো প্রিয়তার? ভেবেই চোখে পানি জমে প্রিয়তার। দুমড়েমুচড়ে ওঠে শরীর। তিহার মিষ্টি, হাসিখুশি মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। এত ভালো মেয়েটা কিভাবে চলে যেতে পারে?

প্রিয়তা পৌঁছায় তিহাদের বাড়িতে। বাড়ির বারান্দায় মানুষজনের ভীড়। সকলেই তিহার মৃ”ত লাশ দেখতে এসেছে। প্রিয়তা এগুতে পারে না। বরফের ন্যায় জমে যায় পা। তাল হারিয়ে ফেলে। সবাইকে ঠেলেঠুলে কোনোমতে এগিয়ে আসে বারান্দায়। সাদা কাপড়ে মোড়ানো তিহার শরীরটা দেখে মুখে হাত দিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে প্রিয়তা। শেষবারের মতো মেয়েটার মুখ দেখতে ইচ্ছে হয়। তিহার মা মাটিতে গড়িয়ে কাঁদছেন। উনাকে জড়িয়ে রেখেছে পাড়ার মহিলারা। মনোয়ারা খানম ও সেখানে আছেন। প্রিয়তা এগিয়ে আসে তিহার মায়ের কাছে। ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলে,

” কিভাবে হলো আন্টি? কিভাবে?

তিহার মা প্রিয়তাকে দেখে আরো কাঁদলেন। মেয়ের বান্ধবী হিসেবে প্রিয়তাকে তিনি বেশ পছন্দ করতেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বললেন,

” তুমি তো জানো আমার মেয়ে কত ভালো ছিল। সবার সাথেই ভাব ছিল। কে করল এই রকম কাজ? কে করল? আল্লাহ্ গো।

মনোয়ারা খানম বললেন,
” একদম ঠিক দিনে আইছো। শেষবারের মতো বান্ধবীরে দেইখা নাও প্রিয়তা। মাইয়াডা তোমারি খুব ভালোবাসতো।

আরেকজন মহিলা বলে ওঠল,
” মুখ তো দেখার মতো অবস্থায় নাই। পুরা শরীরটারে টুকরা টুকরা করছে। দেখলেই ভয় পাইবো প্রিয়তা।

প্রিয়তা শিউরে উঠল মহিলার কথা শুনে। চোখে ফুটে উঠল ভয়। বলল,

” টুকরো টুকরো করেছে? কি বলছেন? কিভাবে কি হলো আল্লাহ্? কে করল এমন?

প্রিয়তা বসে পড়ল মাটিতে। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে তার। মেয়েটা এভাবে চলে যাবে ভাবেনি সে। একটু এগিয়ে সাদা কাপড় তুলে প্রিয়তা। মুহুর্তেই বাকশক্তি হারায়। দ্রুত কাপড়টা নামিয়ে সরে আসে সেখান থেকে। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে প্রিয়তা। গা গুলিয়ে আসে লা’শের বি’শ্রী গন্ধে। তিহার লা’শটা দেখতে বিভ’ৎস লাগছে। মাথার মাঝখানটা দু ভাগ হয়ে আছে। মুখে কা’মড় আর খা’মচির দাগ। কান কেটে ফেলে হয়েছে। চোখজোড়া উপড়ে ফেলা হয়েছে। লা’শের দুর্গন্ধে বমি পায় প্রিয়তার। মাটিতে বসে রইল সে। দিকদশা যেন হারিয়ে গেল প্রিয়তার। অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগল। প্রহর এগিয়ে আসে প্রিয়তার কাছে। প্রিয়তার বাহু ধরে ঠেনে উঠায়। প্রিয়তা দুর্বল হয়ে পড়েছে। শরীরে বল নেই মেয়েটার। প্রিয়তার গাল মুছিয়ে দিয়ে প্রহর বলে,

‘ যে খুনটা করেছে সে হয়তো সাইকো, নয়তো মাতাল ছিল। কিংবা প্রতিশোধ আর ঘৃণার কারণে করেছে খু’নটা।

প্রিয়তার প্রচণ্ড যন্ত্রণা হয় বুকে। হাহাকার করে উঠে হৃদয়। মেয়েটার এমন করুণ পরিণতি মানতে পারছে না সে। আচ্ছা যে বা যারা তিহাকে মেরেছে তাদের কি তিহার প্রতি মায়া হয়নি? এত সুন্দর, ভালো একটা মেয়েকে নৃ’শংস ভাবে হত্যা করতে বিবেকে বাঁধেনি? হাত কাঁপেনি? কিভাবে এত যন্ত্রণা দিয়ে মেয়েটাকে মারল? বুঝে উঠতে পারে না প্রিয়তা। বুক জ্বলে ওঠে। মনোয়ারা খানম প্রহরকে দেখে উঠে আসে। বলে,

” এই যে এত বড় মাপের পুলিশ থাকতে আমরা ভাবতাছি কেডা এই কেস নিবো। পুলিশ তো এইহানেই আছে।

প্রিয়তা অবাক পানে তাকায়। জিজ্ঞেস করে,
” মানে?

” তিহা হারাই গেছিল এক মাস হইয়া গেছে। কুনু পুলিশ তিহার খোঁজ দিতে পারে নাই। মরা লাশ এইখানে আইনা দিয়াই হ্যারা দায় কমাইছে। এই পুলিশ তো তোমার ভালো বন্ধু। এত বড় পুলিশ। তুমি কইলে এই পুলিশই খু’নিরে খুঁইজা বাইর কইরা দিবো। কি পারবো না?

তিহার মা এগিয়ে আসে। প্রিয়তার হাত জড়িয়ে ধরে। বলে,

” তোমার বন্ধুকে একটু বলো না আমার মেয়ের খু’নিকে বের করে দিতে। উনাকে আমি প্রথমে দেখেই চিনেছি। উনার মতো পুলিশই পারবে আমার মেয়ের হত্যাকারীকে খুঁজে বের করতে। দয়া করো প্রিয়তা। একমাস ধরে মেয়ের খোঁজ জানতে থানায় থানায় ঘুরেছি, টাকা খাইয়েছি, ঘন্টার পর ঘন্টা মেয়ের ছবি ডিটেইলস নিয়ে বসে থেকেছি। কেউ মেয়েটার খোঁজ দিতে পারেনি। একের পর এক ডেট দিয়ে বলেছে আমরা দেখছি। অথচ তদন্ত করার প্রমাণ ও দিতে পারেনি

তিহার মা প্রহরের নিকট এগিয়ে আসে। প্রহরের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে। থতমত খায় প্রহর। মহিলাকে টেনে তোলে। তিহার মা অত্যাধিক ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলে,

” স্যার দয়া করে আমার মেয়ের খুনীকে খুঁজে বের করুন। আপনার অনেক প্রশংসা শুনেছি। জানতাম না আপনি এখানে আছেন। নইলে আপনার কাছেই যেতাম। প্লিজ এই কেসটা নিয়ে আপনি একটু তদন্ত করুন।

অসহায় চোখে প্রহর তাকায় প্রিয়তার পানে। অতঃপর মহিলার দিকে তাকিয়ে বলে,

” এক মাস ধরে উনি নিখোঁজ ছিলেন? কোন থানায় গিয়েছিলেন আপনি? আমি তো সাভারের থানাতেই ছিলাম।

” আশুলিয়া থানায় গিয়েছিলাম। যদি জানতাম সাভার থানায় আপনি থাকবেন তবে এতদিন ঘুরতে হতো না এখানে ওখানে। আপনি বের করবেন তো খু’নিকে? প্লিজ স্যার। আপনার পায়ে পড়ি।

প্রহর কি বলবে বুঝতে পারে না। চাকরিটা সে ছেড়ে দিয়েছে এটা বলতেও কেমন সংকোচ হচ্ছে তার। কি করে বলবে সে আর পুলিশে নেই। সাধারণ জনগণ সে। কিছুই করার নেই প্রহরের। প্রিয়তাকে নিজের বাহুবন্ধনে আটকে বলে,

” আমি অফিসারদের সাথে কথা বলবো।

প্রিয়তা দম আটকে দাঁড়িয়ে থাকে। কোথাও এক শূন্যতা অনুভব করে। বুঝতে পারে কোথাও ভুল হচ্ছে। বড় একটা ভুল হচ্ছে তার। প্রহর প্রিয়তাকে টেনে বাইকে বসায়। লুকিং গ্লাসে চেয়ে মেয়েটাকে পর্যবেক্ষণ করে প্রহর। নিরব নির্জন জায়গা খুঁজে সে। প্রিয়তাকে নিয়ে একটি পুকুরের সামনে আসে। প্রিয়তার হাত ধরে পুকুরের পাড়ে বসে। প্রিয়তা নিশ্চুপ। নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে টলমলে পানির দিকে। প্রহর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে আরম্ভ করল,

” আমি ছোটবেলায় কোনোদিন পুলিশ হতে চাইনি। পুলিশের পেশাটাকে আমি ঘৃণা করতাম জানেন প্রিয়? পুলিশ মানেই আমার কাছে ছিল আতংঙ্ক। এলাকায় কোনো পুলিশ দেখলে আমি ভয়ে দৌড় দিতাম। মনে হতো ওরা আমাকে ধরে নিয়ে যাবে, সবাইকে মারবে। কিন্তু বড় হতে হতে আমি বুঝতে শিখলাম এই পেশাটায় কতটা মর্যাদা রয়েছে, কতটা দায়িত্ব, কতটা নীতি জড়িয়ে আছে। দিনের পর দিন এই দেশে অন্যায়-অবিচার বেড়ে চলেছে। খু’ন, চু’রি-ছিন’তাই, ডাকা’তি, ধ’র্ষণ, শ্লী’লতাহানির চেষ্টা এসব যেন খুবই কমন একটা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিউজ চ্যানেলে চোখ পড়তেই দেখতে পাই অন্যায়ের অসংখ্য উদাহরণ। খবরের কাগজে চোখ পড়তেই অপমৃ’ত্যুর ঘটনা দেখতে পাই। এসব কেন হয়? প্রশ্ন আসতো আমার মনে। এগুলো নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে আমি জানতে পারি লোভ, প্রতিহিংসা, স্বার্থ, আত্মসাৎ করার মনোভাব, কামনা, অধিক প্রত্যাশা এসব কারণই হলো অন্যায়-অপরাধের মূল কেন্দ্রবিন্দু। ভাবলাম সমাজ থেকে এসব দূর করবো আমি। কিন্তু আমি একা কতজনকে আটকাবো? কত মানুষকে ভালো করতে পারবো? খুব ভেবেছি আমি। পরবর্তীতে ভাবলাম আমি এমন পুলিশ হবো যে আমাকে দেখে মানুষ অন্যায় করতে ভুলে যাবে, ভয় পাবে অন্যায় করতে। সবার মনে হবে অন্যায়-অপরাধ করা যাবে না। অন্যায় করলেই ধরা পড়তে হবে প্রহরের কাছে। যেই এলাকায় পা রাখবো সেই এলাকার মানুষ সব খারাপ পরিস্থিতিতে আমাকে চাইবে, আমার খোঁজ করবে। এখন দেখুন প্রিয়, সিলেট শহরটায় আমার যশ-খ্যাতি হয়েছে। সকলেই জানে প্রহরের কাছে গেলে ন্যায় বিচার পাওয়া যাবেই। প্রহর মানেই সঠিক তদন্ত, ন্যায় মনোভাব।

প্রিয়তার মুখটা মলিন দেখায়। চোখের পাপড়ি এখনো ভেজা মেয়েটার। প্রহরের সব কথা প্রিয়তা মন দিয়ে শোনে। তাকিয়ে থাকে স্বামীর পানে পলকহীন চোখে। প্রিয়তাকে দেখে আদুরে বাচ্চার মতো লাগে। প্রহর হাসে। প্রিয়তার কপোলে মুখ ডুবিয়ে চুমু আঁকে শব্দ করে। প্রিয়তা নির্লিপ্ত ভঙিতে প্রহরের কথা শোনার অপেক্ষায় থাকে। প্রহর প্রিয়তাকে কাছে টানে। জড়িয়ে নেয় আদুরে দেহটাকে। পুনরায় বলে,

” আপনাকে পাওয়ার জন্য আমি চাকরি ছেড়েছি। ইহান যখন জেনেছে আমি চাকরি ছেড়েছি ছেলেটা কতটা কষ্ট পেয়েছে তা আমি আঁচ করতে পেরেছি। তানিয়া তো কেঁদেই দিয়েছে। আপনি জানেন না প্রিয়তা, চাকরি ছাড়ার পর যখন সিলেটের থানায় গেলাম সবাই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। সেই আগের মতো সম্মান জানিয়েছে, আগের মতো ভালোবাসা দিয়েছে। এই সম্মানটা আমি এমনি এমনি পাইনি প্রিয়। অর্জন করেছি। আপনার ভয় ছিল আমার চাকরির কারণে আরহামের ক্ষতি হতে পারে। কারণ আমার চাকরিটাই এমন। যখন তখন বড়, গণ্যমান্য ব্যক্তির যশ-খ্যাতি আমি নিচে নামিয়ে দিতে পারি, অনেকের স্বার্থে আঘাত করতে পারি। সবকিছুর প্রভাব আমার আপনজনদের উপর পড়তে পারে। আপনার এই ভাবনা ভুল নয়। কিন্তু একবার ভাবুন প্রিয়, আমি আরহামের ক্ষতি হতে দিবো? এত সহজ? আপনাদের সবার দায়িত্ব আমার। আমি আপনাদের ক্ষতি হতে দিবো না। সবসময় আপনাদের আগলে রাখার চেষ্টা করবো। ঢাকায় এসেছিলাম এখানকার পুলিশদের জ্ঞান দিতে, উপদেশ দিতে, পরামর্শ দিতে। এখানকার মানুষগুলোকে আপন করে নিতে। আপনি আপন হলেন ঠিকই। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে এসেছিলাম সে উদ্দেশ্য পূরণ হলো না। আজ তিহা মা’রা গিয়েছে। সামনে আরো মানুষ মারা যাবে, নিখোঁজ হবে। এদের অনেকের দেহটাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। কেন জানেন? পুলিশের কাজের প্রতি অলসতা, অপারগতা, দায়িত্ববোধের অভাবে। আমি হয়তো অপরাধ করা আটকাতে পারবো না, কিন্তু অপরাধীকে শাস্তি দিয়ে অপরাধ করতে উদ্যত হওয়া ব্যক্তিদের মনে ভয় ঢুকাতে পারবো।

প্রিয়তা হুট করে উঠে দাঁড়ায়। গম্ভীর হয়ে পেছনে থাকা প্রহরের বাইকে গিয়ে বসে। প্রহর প্রশ্ন করে না। বাইক স্টার্ট দেয়। বাড়িতে আসে দুজন। আরহাম তখন টিভি দেখছিল। প্রিয়তা দ্রুত নিজের ঘরে আসে। ওয়ারড্রবে থাকা প্রহরের ইউনিফর্ম বের করে। সেগুলোকে যত্নের সাথে হাতে নেয় প্রিয়তা। বুকে জড়িয়ে ধরে পোশাকটাকে। অতঃপর প্রহরের নিকট এসে বাড়িয়ে দেয় পোশাকটি। অবাক হয় প্রহর। তাকিয়ে থাকে নির্নিমেষ। প্রিয়তা হাসে। প্যান্টটা প্রহরের হাতে দিয়ে বলে,

” পড়ে আসুন।

প্রহর কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ওয়াশরুমে ঢুকে। প্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি পড়ে বেরিয়ে আসে ঘরে। প্রিয়তা নিজ হাতে শার্টটা পড়িয়ে দেয় প্রহরকে। শার্টের বোতাম গুলো যত্নের সাথে লাগিয়ে রিভলবার গুঁজে দেয় প্যান্টের পকেটে। লাঠি তুলে দেয় হাতে। অবশেষে প্রহরের চুলগুলোকে আঁচড়ে পুলিশের ক্যাপটি পড়িয়ে দেয়। স্বামীর স্নিগ্ধ, সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে প্রিয়তা। মুগ্ধ হয়। ভালো লাগায় ছেয়ে থায় হৃদয়। গর্বে ফুলে উঠে বুক। মুচকি হেসে বলে,

” আমার পুলিশ স্বামী। আমার পুলিশম্যান।

~ সমাপ্ত।

প্রিয়তার প্রহর ২ পর্ব-১৭+১৮

0

#প্রিয়তার_প্রহর (২য় পরিচ্ছেদ)
পর্ব সংখ্যা (১৭)

পাখির কিচিরমিচির শব্দে কান ঝাঁঝিয়ে আসছে প্রিয়তার। রোদের এক ফালি অংশ জানালার ফাঁক ফোকর দিয়ে ঘরে ঢুকেছে। একে অপরের শরীরের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে ওরা। কিঞ্চিত দুরত্বও নেই ওদের মাঝে। সুখ নিদ্রায় তলিয়ে আছে প্রহর। প্রিয়তার ঘুম ভেঙেছে। প্রিয়তার উন্মুক্ত দেহের ভাঁজে ভাঁজে প্রহরের দেহের স্পর্শ এখনো অনুভব করছে প্রিয়তা। শ্বাস নেওয়ার কারণে বুক উঠানামা করছে প্রহরের। রোমশপূর্ণ বলিষ্ঠ বুকে জায়গা করে নিয়েছে প্রিয়তা। ঘুমু ঘুমু চোখে প্রহরের পানে নরম ভাবে তাকায় সে। প্রহরের গালে বিচরণ করে প্রিয়তার নরম, মোলায়েম হাত। অতি সুদর্শন লাগে প্রহরকে ঘুমন্ত অবস্থায়। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। স্নিগ্ধ, মুগ্ধকর মুখে অজানা সুখ খুঁজে পায়।

অতি সাবধানে প্রিয়তার স্পর্শে ঘুম ভাঙে প্রহরের। মুচকি হেসে প্রিয়তার স্পর্শকাতর স্থানে হাত বুলায়। চুমু খায় নাকের ডগায়। জড়িয়ে নেয় আরো নিবিড়ভাবে। নেশালো কণ্ঠে বলে,

” ঘুমান।

প্রিয়তা আঁকড়ে ধরে প্রহরের পিঠ। লজ্জায় বশীভূত হয়। বলে ,

” এবার উঠতে হবে। ছাড়ুন।

হাসে প্রহর। ছেড়ে দেয় প্রিয়তাকে। প্রিয়তার অবস্থা নাজুক। শরীরের ভাঁজে ভাঁজে ব্যথা। শিরশির করছে গা। প্রহর মানুষটা গম্ভীর, সহজ আর প্রাণবন্ত হলেও স্ত্রীর নিকট এলে মানুষটা কেমন অন্যরকম হয়ে যায়। অস্থির, উত্তেজিত দেখায় প্রহরকে। প্রিয়তা গতকাল এক অন্য প্রহরকে দেখেছে। এই প্রহরকে আগে দেখেনি সে। যার মনে-প্রাণে, মস্তিষ্কে প্রিয়তা ব্যতিত অন্য কোনো চিন্তা ছিল না। প্রহরের ভালোবাসার প্রগাঢ়তা প্রিয়তা সহ্য করে নিয়েছে। উপভোগ করেছে ভালোবাসার স্পর্শ গুলো। কালসিটে দাগ পড়েছে প্রিয়তার ঘাড়ে। হাত রাখতেই ব্যথায় টনটন করে উঠল সেথায়। চোখে খিঁচে বন্ধ করে নেয় প্রিয়তা। “উফফ” জাতীয় শব্দ করে। চমকায় প্রহর। চিন্তিত ভঙিতে ভালো করে চোখ মেলে। বলে,

” কি হয়েছে প্রিয়?

প্রিয়তার চোখে অশ্রু। দুঃখের অশ্রু শুকিয়ে গেছে। সুখের অশ্রু গড়াচ্ছে চোখ বেয়ে। প্রহরের চিন্তিত স্বর মোহনীয় লাগে। মুচকি হেসে প্রিয়তা বলে,

” ব্যথা।

প্রহর উঠে বসে। চিন্তিত দেখায় তাকে। প্রেয়সীর আর্তনাদে বক্ষে উন্মাদনা টের পায় প্রহর। জিজ্ঞেস করে,

” শরীর ব্যথা করছে?

” ঘাড়ে বেশি।

প্রহর এগিয়ে আসে প্রিয়তার নিকটে। ঘাড়ে হাত বুলায়। কামড়ের দাগ পড়ে গিয়েছে। কালচে রঙ দেখা গিয়েছে। প্রহর অধরজোড়া চেপে ধরে ঘাড়ে। কেঁপে ওঠে প্রিয়তা। প্রহর বারংবার অধর চেপে ব্যথিত কণ্ঠে বলে,

” সরি প্রিয়, আমি এক্ষুণি মেডিসিন নিয়ে আসছি।

প্রিয়তা থামায় প্রহরকে। বলে,
” লাগবে না।

প্রহর শোনে না। দ্রুত বিছানা ছাড়ে সে। গোসল ছেড়ে বের হয়। গায়ে নীল রঙের শার্ট জড়াতে জড়াতে প্রিয়তার কাছে আসে। অতি চমৎকার কণ্ঠে প্রিয়তার কানে ফিসফিসিয়ে বলে,

” আপনার মলিনতার সুর,
আমার কাঁপিয়ে তোলে বুক।

_______

ব্যথাতুর স্থানে মলমের প্রলেপ পরতেই হৃদস্পন্দন থামে প্রিয়তার। শাড়ির অর্ধেকাংশ মেঝেতে লুটিয়ে আছে। পিঠের নিচ অংশের শাড়ি সরে গিয়ে উন্মুক্ত হয়ে আছে কোমর। প্রিয়তার ভ্রূক্ষেপ নেই। শাওয়ার নিয়ে আরহামের সাথে সময় কাটিয়ে ঘরে ফিরে শুতেই চোখটা কেমন লেগে গিয়েছিল। গতরাতের অন্তরঙ্গ মুহুর্তের দৃশ্য চোখের পাতায় আটকে ছিল। প্রহরের শ্বাসরুদ্ধকর উপস্থিতি, হাতের বিচরণ, অধরের ঝড় সবই যেন এক স্বপ্ন। ঘুমের মাঝেই ঘাড়ে শীতল পদার্থের ছোঁয়া পেয়ে অবাক হয় না প্রিয়তা। গা দুলিয়ে হাসে। বলে,

” ব্যথা দেওয়ার সময় মনে ছিল না?

” আপনিও তো আমাকে ব্যথা দিয়েছন প্রিয়তা। পিঠে আঁচড়ে, কামড়ে ক্ষত-বিক্ষত করেছেন। দীর্ঘ দিন দূরে থেকে আমাকে যন্ত্রণা বাড়িয়েছেন। অভিযোগ এবার আমি করি?

প্রিয়তা কথা বলে না। প্রহর সময় নিয়ে প্রিয়তার ঘাড়ে মাসাজ করে। ঔষধের প্যাকেট থেকে ঔষধ বের করে প্রিয়তার হাতে গুঁজে দিয়ে পানির গ্লাসটাও এগিয়ে দেয় প্রিয়তার সম্মুখে। প্রিয়তা ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
” এত ঔষধ কিসের?

” ভিটামিন, পেইন কিলার, স্পট রিমুভাল মেডিসিন।

প্রহরের কল আসে। কলটা জরুরী হওয়ায় সে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। কানে ফোন চেপে চোখের ইশারায় প্রিয়তাকে খেতে বলে ঔষধগুলো। প্রিয়তা গা ব্যথার ঔষধ চিনে। ঔষধ খেতে বরাবরই অসহ্য লাগে তার। সে তো দুর্বল নয় যে ভিটামিন লাগবে। দাগে মলম দেওয়া হয়েছে, ওই ঔষধেরও প্রয়োজন পরবে না। কেবল ব্যথার ঔষধ খেয়ে বাকিগুলো জানালা দিয়ে ফেলে দিল প্রিয়তা। এত ঔষধ মানুষ কিভাবে খায়?

_____

ইহান ল্যাপটপে মেইল চেইক করছে। তানিয়া বিছানার এক প্রান্তে বসে খাবার খাচ্ছে। আজ রান্না তানিয়া নিজে করেছে। তবে তরকারিতে ঝালের মাত্রা অতিরিক্ত হয়ে গিয়েছে। তানিয়ার নিজেরই খেতে গিয়ে জিভ, ঠোঁট পুড়ছে। বাকিরা কিভাবে খাবে ভেবে মন খারাপ হলো তানিয়ার। ভাতের লোকমা মুখে তুলতেই ঝালে ঠোঁটে জ্বলন শুরু হলো। ইহানের সামনে খেতে বসেছে। খাবার কোনোভাবেই ফেলা যাবে না। খাবার অপচয় করা পছন্দ করে না ইহান। অপরদিকে তানিয়া খেতেও পারছে না খাবারটুকু। ঝালে চোখ-মুখ লাল হয়ে আসছে তার। বুক পুড়ছে। ইহান আড়চোখে তাকায় তানিয়ার পানে। তানিয়া বুঝতে পারে। দাঁত কেলিয়ে বোকা হাসে সে। ললাটে ভাঁজ পড়ে ইহানের। বলে,

” হাসো কেন?

থতমত খায় তানিয়া। বলে,

” কই হাসছি?

“এতক্ষণ লাগে খেতে? কখন বসেছো হিসেব আছে? জলদি খেয়ে আমার জন্য খাবার আনো।

তানিয়ার ভয় হয়। এই তরকারি দিয়ে কিভাবে খেতে দিবে ইহানকে। বকে ত্যানাত্যানা করে ফেলবে তাকে। মুখ নত করে তানিয়া বলে,

” খেতে ইচ্ছে করছে না।

” আমাকে খাইয়ে দাও তবে।

হতবাক চোখে তাকায় তানিয়া। বিস্ময় আকাশ ছোঁয়। রক্তিম ঠোঁট ফুলিয়ে বলে,

” আমার এঁটো খাবার খাবেন?

ইহান তানিয়ার দিকে তাকিয়ে দ্রুত নজর সরায়। বলে,
” এক কথা বারবার বলাও কেন?

অগত্যা বাধ্য হয়ে তানিয়া বিছানার মাঝ বরাবর আসে। চশমা ঠিক করে ভাতের লোকমা তুলে দেয় ইহানের মুখে। ভয়ে থিতিয়ে যায় তানিয়ার চোখ। ইহান ঝাল খায় না, খেতে পারে না। ঠোঁটের জ্বলনে দিক্বিদিক হারায় তানিয়া। ভাবে ইহান ধমকাবে, খেতে গিয়ে ঝালে কাহিল হয়ে পড়বে। কিন্তু না! ইহান খাবার চিবিয়ে কোনো অভিব্যক্তি দেখায় না। অবাক হয় তানিয়া। ইহানের অভিব্যক্তি জানতে চায়। নিজ মুখে স্বীকার করে,

” রান্না আমি করেছিলাম। খুব ঝাল হয়েছে। আমিই তো খেতে পারছি না। আপনি..

ইহান ছোট হা করে। তানিয়া বুঝতে পারে আবার ও খাবারটুকু খেতে চাইছে ইহান। তানিয়া সময় ব্যয় করে না পুনরায় তুলে দেয় ভাতের লোকমা। ইহান চিবোয়। কোনোরুপ বাক্য বিনিময় করে না। পরপর কয়েকবার খাবার খেয়ে ঢকঢক করে পানি খায় ইহান। তানিয়া প্লেট নিয়ে বেরিয়ে যায়। ইহানের থানায় যাওয়ার সময় আসে। ইউনিফর্ম গায়ে জড়িয়ে তৈরী হয় ইহান। রিভলবার পকেটে গুঁজে তানিয়াকে ডাক দেয়। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে তানিয়া। ইহানকে পর্যবেক্ষণ করে। ইহানের ঠোঁট ও লালচে হয়ে গেছে। চোখের শিরা গুলো রক্তিম হয়ে আছে। তানিয়ার মায়া হয়। জিজ্ঞেস করে,

” ডাকছেন?

ইহান পিছু ফিরে। অফিস সরঞ্জাম ফাইলে ভরে তানিয়ার নিকটে এসে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে ওঠে,

” চুমু দাও, ফাস্ট।

তানিয়া ভড়কায়। বিচলিত নয়নে তাকায় ইহানের পানে। কাঁপা কণ্ঠে বলে,

” আমি? আপনাকে?

ইহানের গাম্ভীর্যপূর্ণ চাহনি তানিয়ার দিকে মেলে। বলে,

” তো অন্য কাউকে দিতে চাও নাকি? চালু করো। সময় নেই।

তানিয়া বাইরে নজর ফেলে। ইলমা বেগম দেখে ফেললে? চশমা ঠিক করে ইহানের নিকটে আসে তানিয়া। চোখ বুজে ঘন ঘন শ্বাস ফেলে ইহানের গালে চুমু দিতে উদ্যত হলে ইহান বলে ওঠে,
” ঠোঁটে দাও।

অবাক চোখে তাকায় তানিয়া। সুযোগটা ফেলতে চায় না। তানিয়া দু হাত উঠিয়ে ইহানের গালে হাত রাখে। পা উঁচিয়ে ইহানের পায়ে রাখে। ভেজা অধর আলতো করে স্পর্শ করে ইহানের অধরে। ছোট্ট একটি চুমু দিয়ে সরে আসার পূর্বে ইহানের শক্তপোক্ত হাত তানিয়ার পিঠে চাপ প্রয়োগ করে। তানিয়া ঝুঁকে আসে ইহানের দিকে। ইহান অপর হাত রাখে তানিয়ার কানের নিচে। অধরজোড়া পুনরায় চেপে ধরে তানিয়ার অধরে। সময় গড়ায়। চঞ্চল হয় তানিয়া। সরে আসার চেষ্টা করেও পারে না। হাল ছাড়ে। জড়িয়ে নেয় ইহানকে। লজ্জায় চোখ বুজে নেয় অজান্তে।

______

তানিয়া আর ইহান বসে আছে অফিসরুমে। তানিয়ার নত মুখের দিকে তাকিয়ে নিরবে, নিঃশব্দে হাসে ইহান। মেয়েটা কেমন লজ্জায় বুদ হয়ে আছে। কোনো কথাই বলছে না আজ। ইহান তানিয়ার লজ্জাকে বাড়িয়ে দিতে বলল;

” এত লজ্জা পাওয়ার কি আছে? চুমুই তো।

তানিয়া তড়িৎ বেগে মাথা তুলে। আশপাশে মানুষ আছে কিনা দেখে নেয়। ঠোঁটে আঙুল চেপে বলে,

” চুপ। কেউ শুনে ফেলবে।

” শুনুক।

” লজ্জা, সংকোচ কি সব চলে গেছে?

” চলে গেলেই বোধহয় ভালো হতো।

হাসে তানিয়া। কাজে মনোনিবেশ করে। খানিকক্ষণ বাদে প্রহর আসে থানায়। প্রহরকে দেখে উঠে দাঁড়ায় ইহান আর তানিয়া। প্রহরের পাশে প্রিয়তা দেখে খুশি হয় ওরা। মিষ্টি হাসে। সলজ্জ চোখে তানিয়া প্রশ্ন করে,

” কেমন আছেন স্যার? প্রিয়তা, কেমন আছো?

প্রহর হাসে। তানিয়াকে বসতে বলে। চেয়ার ঠিক করে দেয় তানিয়া। প্রিয়তাকে বসতে দেয়। কফি আনতে বলে ওদের জন্য। প্রহর বসতে বসতে তীক্ষ্ম চোখে বলে,

” আমরা ভালো আছি। তোমাদের কি খবর?

ইহান বলে,
” ভালো আছি। মিথিলা দেওয়ানকে আনতে পাঠিয়েছি। বোস। চলে আসবে।

অপেক্ষা করে প্রহর। টুকটাক আলোচনা হয় তাদের মাঝে। প্রিয়তা গল্প শুরু করে তানিয়ার সাথে। হাসি মজা করে। প্রিয়তাকে আনা হয়েছে সত্য জানার জন্য। প্রহর চায় প্রিয়তা সব জানুক। সময় গড়ায়। ফোর্স আসে দীপা খন্দকারকে নিয়ে। লেডি কনস্টেবল টেনে আনে দীপাকে। প্রহর আর প্রিয়তাকে দেখে ক্ষেপে যায় দীপা। খেঁকিয়ে ওঠে। বলে,

” আমাকে এখানে এনেছো কেন? তোমাদের সাহস দেখে অবাক হচ্ছি।

হাসে প্রহর। ভ্রূ চুলকায়। বলে,
” সাহস দেখানো তো সবে শুরু ম্যাম। চুপচাপ এখানে বসুন আর প্রশ্নের উত্তর দিন। নইলে পুলিশ কি করতে পারে তা আপনি হারে হারে টের পাবেন।

প্রিয়তা অবাক হয় দীপাকে এখানে দেখে। প্রশ্ন করতে উদ্যত হতেই তানিয়া থামায়। ইশারায় সবটা শুনতে বলে। দীপা চুপ করে বসে থাকে। চোখ পাকায়। ক্ষোভে ফুঁসে। প্রহর নির্বিকার চিত্তে তাকায়। কথাগুলো নিজ মনে সাজায় এলোমেলো বাক্যগুলো। অতঃপর গম্ভীর কণ্ঠে বলে,

” মিসেস দীপা খন্দকার, উপসস সরি। মিথিলা দেওয়ান। আরিফ হোসাইন আপনার কত নম্বর স্বামী বলুন তো?

দীপা হতবাক চোখে তাকায়। থতমত খায়। প্রিয়তার মনেও প্রশ্ন জাগে। প্রহর হাসে। বলে,

” থাক, আপনাকে বলতে হবে না। আমিই বলছি। আরিফ হোসাইন আপনার তিন নম্বর স্বামী। আপনি প্রথম বিয়ে করেছিলেন দু হাজার বারোতে। আপনার প্রথম স্বামী ছিলেন জমির দালাল। জমিজমা নিয়ে ব্যবসা করতেন। টাকা আয় করতেন ভালোই। কিন্তু টাকা জমাতে পারতেন না। সব টাকা বোনদের জন্য ব্যয় করতেন। আপনাকে সেভাবে টাকাপয়সা দিতে পারতেন না বলে আপনি রমিজ আকবরের সাথে সম্পর্ক রাখতে চাননি। দীর্ঘ পাঁচ বছর সংসার করার পর আপনার মনে হয়েছে রমিজের সংসারে থেকে আপনার কোনো উন্নতি হচ্ছে না। টাকা-পয়সা কিছুই জমাতে পারছেন না। সব অর্থ ননদদের সংসারে ব্যয় হচ্ছে। খোলাখুলি আলাপ করার পর বুঝতে পারলেন রমিজ আপনাকে নিয়ে চিন্তা করেন না, আপনার ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা নেই লোকটার। তাই আপনি মিউচুয়াল ডিভোর্স চাইলেন। কাবিনের টাকা দিতে নাকোচ করলেন রমিজ। তাই আপনি নারী নির্যাতনের মামলা দেওয়ার ভয় দেখিয়ে কাবিনের পুরো টাকা আদায় করলেন। এরপর সেই টাকা নিয়ে আনন্দে কাটালেন অনেকগুলো দিন। কি তাইতো?

বিস্ফোরিত চোখে তাকায় দীপা। প্রহর আবার বলে,

” দ্বিতীয় বিয়ে করলেন সতেরো সালের শেষের দিকে। স্বামী সামিন রহমানের ব্যবসা ছিল। বিয়ে করে দু বছর সংসার করার পর তার সাথেও একই ঘটনা ঘটালেন। শুধু কি তাই? লোকটার সম্পত্তির অর্ধেকাংশ লিখিয়ে নিলেন নিজের নামে। আইন নারীদের ক্ষেত্রে একটু সেনসিটিভ। নারীদের অধিকারের ক্ষেত্রে আইন প্রচণ্ড সহানুভূতিশীল। পুরুষের কথার চেয়ে নারীর কথাকে বেশি প্রায়োরিটি দেয় আইন। এই সুযোগটাই আপনি নিলেন। সম্পত্তি হাতিয়ে চাঁদপুর ছেড়ে ইন্ডিয়ায় গেলেন। ওখানে থাকাকালীন অনেক পুরুষের সাথেই সম্পর্ক ছিল আপনার। আরিফ হোসাইন মানে প্রিয়তার বাবাকে অনলাইনে পেলেন আপনি। সেসময় প্রিয়তার বাবা একটু ডিপ্রেসড ছিলেন। স্ত্রী পরকিয়ায় জড়িয়ে গিয়েছে বলে প্রিয়তার বাবা হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আপনি তাই বন্ধুর ন্যায় আচরণ করলেন আরিফ আঙ্কেলের সাথে। প্রেমের সম্পর্ক গড়লেন। আরিফ আঙ্কেলের সাথে যখন সম্পর্ক ছিল তখনও আপনি আরো কয়েকজনের সাথে সম্পর্ক রেখেছিলেন। সব শেষে বিয়ে বসলেন আরিফ আঙ্কেলের সাথেই।

এতটকু বলে থামল প্রহর। প্রিয়তার চোখে পানি। তার বাবাকে ঠকিয়েছে সবাই। ঠকিয়ে নিজেদের মতো চালিয়ে গেছে। দীপার বায়োডাটা শুনে ধিক্কার জানাতে ইচ্ছে করছে প্রিয়তার। দীপা ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে। আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে,

” ভুল বলছো তোমরা। পারিবারিক শত্রুতা এখানে টেনে আনছো।

ইহান বলে,
” সব প্রমাণ আছে আমাদের কাছে। আপনার নামে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট এসেছিল অনেক আগে। আপনাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি কারণ আপনি দেশের বাইরে ছিলেন। প্রমাণ হাতে নিয়েই আপনাকে ধরতে গিয়েছি।

প্রহর এবার আসল কথা টানে। দৃঢ় চোখে তাকিয়ে বলে,

” আঙ্কেলকে আপনি খু”ন করেছেন। ইনজেকশন পুশ করে। এর শাস্তি তো আপনাকে পেতেই হবে।

কেঁপে ওঠে প্রিয়তা। উঠে দাঁড়ায় চেয়ার ছেড়ে। প্রহরের কাছে এসে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে,
” আব্বু তো স্ট্রোক করে মারা গিয়েছে। আমরা তো আব্বুকে হসপিটালে দেখলাম। আপনি কি বলছেন?

প্রহর প্রিয়তার মাথায় হাত রাখে। প্রিয়তার উত্তেজিত কণ্ঠ প্রহরের নিকট অত্যন্ত ব্যথিত ঠেকে। প্রিয়তার জীবন নিয়ে ভাবতে গেলেই মায়া হয় মেয়েটার প্রতি। খারাপ লাগে খুব। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে প্রহর বলে ওঠে,
” আপনার আব্বু খুন হয়েছে প্রিয়তা। উনি স্ট্রোক করেছিলেন ঠিকই, স্ট্রোক করার পর বেঁচেও গিয়েছিলেন। আপনার সৎ মা উনাকে বাঁচতে দেননি। আমি সেদিন আপনার আব্বুকে দেখতে চেয়েছিলাম মনে আছে? দীপা আন্টি আমাকে মৃত দেহ দেখতে দেননি। তবুও আমি দেখে ফেলেছিলাম। আপনার আব্বুর ঘাড়ে তিল আছে। সেই ঘাড়ের তিলের মাঝখানটা নীলাভ রঙ ধারণ করেছিল। তিল নীলাভ রঙের হতেই পারে তবুও আমার একটা খটকা লেগৈছিল। ইহানকে বলেছিলাম লাশ দাফন না করতে। আপনার আব্বুকে দাফন করা হয়নি সেদিন। ফরেন্সিক ল্যাবে পাঠানো হয়েছিল উনাকে। আপনি যদি জানতে পারতেন আপনার আব্বুকে দুদিন বরফে রেখে টেস্ট করা হয়েছে, কবর দেওয়া হয়নি, তাহলে আপনি খুব কষ্ট পেতেন। এজন্য আপনাকে বলিনি। আপনার আব্বু আপনাকে শেষ সময়ে এসে খুব মিস করেছেন প্রিয়তা। হসপিটালের বেডে বারবার আপনার নাম জপেছেন। সেজন্য দীপা আন্টি না পেরে বাধ্য হয়ে আমাদের ফোন করে যেতে বলেছিলেন। মারা যাওয়ার পর আমরা যাতে উনাকে সন্দেহ না করি সেজন্য ফোন করে মৃত সংবাদ টাও জানিয়েছিলেন। কিন্তু লাভ নেই। উনি ধরা পড়ে গিয়েছেন। বিষের প্রতিক্রিয়ায় মারা গেছেন। আঙ্কেল প্রমাণ আছে আমাদের হাতে।

প্রিয়তার চোখে পানি। বরফের ন্যায় জমে গিয়েছে সে। নিশ্বাস নিতে যেন কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার। সত্য জানতে পেরে মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। মাথা ভনভন করছে। হাত পা ছড়িয়ে কান্না করতে ইচ্ছে করছে প্রিয়তার। শেষ করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে নিজেকে। নিজেকে সংযত করতে পারে না প্রিয়তা। কেঁদে ফেলে শব্দ করে। উন্মাদের ন্যায় ঝাঁপিয়ে পড়ে দীপার গায়ে। দীপার হাতে চাপ প্রয়োগ করে শক্ত কণ্ঠে বলে,

” আপনি, খারাপ, মনুষ্যত্বহীন, নিচ। আপনি আমার আব্বুকে খুন করেছেন। আমাকে এতিম করেছেন। তোকে আমি মেরেই ফেলবো। মেরে জেলে যাবো। লোভী কোথাকার।

প্রিয়তা পরপর ঠাস ঠাস করে থাপ্পড় দেয় দীপার গালে। দাগ বসে দীপার ফর্সা গালে। দীপাও খেঁকিয়ে ওঠে। প্রিয়তার গায়ে হাত তুলতে উদ্যত হতেই লেডি কনস্টেবল আটকায়। প্রহর আটকায় প্রিয়তাকে। নিজের কাছে টানে। বলে,

” আইন নিজের হাতে তুলতে হবে না আপনাকে। উনার ফাঁ”সিই হবে। একটি খুন, দুজনকে ব্ল্যাকমেইল করে সম্পত্তি আদায়, আমাদের মেরে ফেলার চেষ্টা করা। সব মিলিয়ে উনি আজন্ম থেকে যাবেন জেলে। নয়তো ফাঁ”সি।

ইহান হকচকিয়ে বলে ওঠে,
” তোদের মে”রে ফেলার চেষ্টা করেছে ও?

প্রহর থেমে বলে,
” হ্যাঁ। আরহামের অ্যাক্সি”ডেন্ট উনিই করিয়েছিলেন। আসলে আঙ্কেল অনেক আগে থেকেই চাইছিলেন আরহামকে কিছু সম্পত্তি লিখে দিতে। দীপা আন্টি এটা মানতে পারেননি। আরহামকে সম্পত্তি গ্রহণে অক্ষম বানাতে চেয়েছিলেন। উনি আমাদের খোঁজ খবর রাখতেন। উনিও জাফরের মতো ভেবেছিলেন প্রিয়তার সাথে আমার সম্পর্ক আছে। তাই আমাদের সম্পর্ক ভা”ঙা আর আরহামের ক্ষতি দুটোই একসাথে করতে চেয়েছিলেন উনি। লোক দিয়ে প্রিয়তাকে কল করে বলেছিলেন আমার শত্রুরাই আরহামের অ্যাক্সি”ডেন্টের কারণ। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কেউটে বেরিয়ে এসেছে। আগের ঘটনাগুলোর সত্যতা জানতে পেরেছি এখন।

প্রিয়তার নিজেকে বড্ড অসহায় লাগে। আব্বুর জন্য পড়ান পুড়ে প্রিয়তার। জ্বলে ওঠে বক্ষস্থল। ক্ষত-বিক্ষত হয় হৃদয়। সে তো আরিফের ক্ষতি চায়নি। চায়নি এভাবে উনি মারা যান। তবে কেন প্রিয়তার সাথেই এমন হয়? কেন সুখ এত দ্রুত ফুরিয়ে যায়?

চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

#প্রিয়তার_প্রহর (২য় পরিচ্ছেদ)
পর্ব সংখ্যা (১৮ )

আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে প্রিয়তা। আকাশের তারা গুলো একটু বেশিই জ্বলজ্বল করছে। শীতল বাতাস ছুঁয়ে দিচ্ছে প্রিয়তাকে।প্রিয়তার কোলে ঘুমিয়ে আছে আরহাম। বোনের সাথে গল্প করতে করতে কখন যে ছেলেটার চোখ লেগে গিয়েছে বুঝতেই পারেনি সে। কথা বলার এক পর্যায়ে প্রিয়তা ঘাড় বাঁকিয়ে দেখে তার ভাই ঘুমে ঢুলছে। চোখ ছোট ছোট হয়ে এসেছে ছেলেটার। প্রিয়তা ভাইয়ের ছোট্ট মাথাটা নিজের কোলে নিয়ে নেয়। বসে থাকে দীর্ঘসময় ধরে। হাত বুলিয়ে দেয় আরহামের মাথায়। চুমু খায় খানিক ক্ষণ পর পর। বেলকনি থেকে বাইরের পরিবেশ দেখতে বেশ ভালোই লাগছে প্রিয়তার। আরহামকে বিছানায় ঠিকঠাক ভাবে শুইয়ে দিয়ে পুনরায় বেলকনিতে ফিরে সে। হাতে তার কাচে বন্দী ছবি। ছবিটিতে আরিফ হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে গোলাপী রঙের টাওয়ালে পেঁচানো আরহামকেও দেখা যাচ্ছে। আরিফের পাশে দাঁড়িয়ে ক্যামেরার দিকে তাকিয়েছে প্রিয়তা। ছবিটা তুলে দিয়েছিল প্রীতিলতা। পোজ দিতে গিয়ে অনেক মজা হয়েছিল সেদিন। ভাবতেই চোখ ভিজে আসে প্রিয়তার। কতই না সুখী ছিল তারা। কোনো কিছুর অভাব ছিল না তাদের। আনন্দে কেটে যেত সব দিন। খুনশুটিতে মেতে থাকতো প্রিয়তা। স্কুল থেকে ফিরেই আম্মুর পাশে বসে আড্ডা দিতো সে। কাজ থেকে ফিরে আরিফ সিঙারা, ভেলপুরি, চটপটি নিয়ে আসতো। একসাথে খেতো বাড়ির সবাই। আর আজ? আজ কে কোথায় গিয়ে আস্তানা গড়েছে সে খবর ও কেউ রাখে না। কেমন চলছে সবার জীবন?

প্রিয়তার কণ্ঠ কাঁপে। ছবিটিতে হাত বুলায় সে। নোনা পানির কণা ছবিটিতে পড়ে। ঝাপসা হয় প্রিয়তার চোখ। আব্বুর ছবিতে চুমু আঁকে সে। গভীর কণ্ঠে বলে,

” আব্বু, ও আব্বু। ফিরে আসো না। আমি তো তোমাকে সেই কবেই মাফ করে দিয়েছি। তুমি বোঝোনি? ফিরে আসো না। ওই মহিলা তোমাকে মেরে ফেলেছে না? ও খুব শাস্তি পাবে দেখে নিও। ও সুখে থাকবে না। তুমি ফিরে এসো প্লিজ। আমি তোমার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করেছি তাইনা? আর কখনো করবো না। তুমি আমাকে প্লিজ ক্ষমা করে দিও। তোমার ক্ষতি আমি কোনোদিন চাইনি, কোনদিন না।

কাঁদে প্রিয়তা। ছবিটা বুকে জড়িয়ে রাখে। এলোমেলো লাগে সবকিছু। জীবনটাকে বৃথা মনে হয়। তছনছ করে দিতে ইচ্ছে হয় সব। কাঁদতে কাঁদতে হেচকি ওঠে প্রিয়তার। পুনরায় ছবিটির দিকে তাকিয়ে বলে,

” আমার এত দুঃখ কেন আব্বু? আমার এত যন্ত্রণা কেন?

নিদারুণ যন্ত্রণায় হাঁসফাঁস করে প্রিয়তা। গলা শুষ্ক হয়ে আসে। মাথা ব্যথায় কুঁচকে আসে মুখ। জ্বালা হয় বুকে। অন্তস্থলে দহন জ্বলে। প্রহর বাড়ি ফিরে। ডাকে প্রিয়তাকে। প্রিয়তা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ছবিটি রেখে ঘরে প্রবেশ করে। প্রহরকে ক্লান্ত দেখায়। প্রিয়তার দিকে না তাকিয়ে ঘড়ি টেবিলে রাখতে রাখতে বলে,

” আরহাম ঘুমিয়েছে কখন? আমি যে চিকেন ফ্রাই আনলাম ওর জন্য। না খেয়েই ঘুমাল?

প্রিয়তা চোখ মুছে। মলিন হাসে। বলে,
” পড়াশোনা নেই। শুধু ঘুমায়।

প্রিয়তার কণ্ঠ ভেঙে গেছে। প্রহর বুঝতে পারে প্রিয়তার অবস্থা। হাত পা ধুয়ে প্রিয়তাকে টেনে বেলকনিতে নিয়ে আসে। মৃদ্যু হাওয়ায় প্রিয়তার দীর্ঘ লম্বা চুল দুলে ওঠে। প্রহর অবাধ্য চুলগুলোকে প্রিয়তার কানে গুঁজে মোলায়েম কণ্ঠে বলে,

” খুব কষ্ট হচ্ছে আমার প্রিয়র?

প্রিয়তা নাক টানে। ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলে,
” কষ্ট ছাড়া কিচ্ছু তো নেই জীবনে।

প্রহর প্রিয়তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে নেয়। ঘাড়ে চুমু আঁকে আলতো ভাবে। প্রিয়তার ঘাড়ে চিবুক রেখে তর্জনী আকাশের দিকে তুলে প্রিয়তার উদ্দেশ্যে বলে,

” যে তারাটি আজ সবচেয়ে বেশি জ্বলজ্বল করছে, ওটাই আপনার আব্বু। দেখুন প্রিয়।

প্রিয়তা অবাক চোখে তাকায় তারাগুলোর পানে। আকাশে থাকা অনেকগুলো তারার ভিড়ে একটি তারা সবচেয়ে বেশি জ্বলজ্বল করছে। আশপাশের এতগুলো তারার ভিড়ে এই একটি তারা-ই নজর কাড়ছে। প্রিয়তা নিজেও তর্জনি ওঠায়। বলে,

” ওইটা?

মাথা নাড়ে প্রহর। বলে,
” বাবা যেমনই হোক। মেয়ের সুখে বাবা খুশি হতে বাধ্য। আপনাকে আমার নিকট সুখী দেখে আপনার আব্বু হাসছে। তাই তো এত আলো ছড়াচ্ছে। দেখুন।

এই মুহুর্তে প্রিয়তা অবুঝ, নাদান ইমম্যাচিওর হয়ে গেল যেন। প্রহরের কথাটুকু খুব সহজেই বিশ্বাস করে নিল প্রিয়তা। মুখে হাসি ফুটল। উজ্জল চোখে বলল,

” ওইযে, আব্বু। ওই তারাটার দিকে তাকিয়ে আব্বুকে স্মরণ করলে আব্বুর মুখ ভেসে উঠছে। ওটাই আব্বু। হ্যাঁ ওটাই।

প্রহর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মেয়েটার দুঃখ গুলো এত গভীর যে কেউ শুনলেও দুঃখ পাবে। প্রিয়তাকে সময় দেয় প্রহর। বলে,

” আপনি আপনার আব্বুর সাথে কথা বলুন প্রিয়। আমি আরহামকে ডাকি।

প্রহর চলে যেতেই প্রিয়তা বেলকনির গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। মন খারাপ হয় খুব। আশপাশে তাকিয়ে খানিক উচ্চস্বরে বলে ওঠে,

” জেনে রাখো প্রকৃতি। তুমি ভুল মানুষের উপর প্রতিশোধ নিয়েছো। আব্বুর প্রতি আমার কখনো ঘৃণা জন্মায়নি, বিতৃষ্ণা জন্মায়নি। অভিযোগ করার দায়ভার এত কষ্টের হবে জানলে আমি বোবা হয়ে থাকতাম। মনে মনেও আব্বুর প্রতি অভিযোগ করতাম না।

প্রহর চলে আসে ঘরে। আরহাম ঠোঁট ফুলিয়ে ঘুমোচ্ছে। পাতলা চুলগুলো উড়ছে। আরহামের ঘন, বড় চোখের পাপড়িগুলো দেখতেও ভালো লাগে। প্রহর খুব ধীর করে কণ্ঠে ডাকে আরহামকে।

” আরহাম। ওঠো।

আরহাম উঠে না। একদম বোনের মতো হয়েছে ছেলেটা। প্রথম ডাকে উঠতে চায় না একদম। প্রহর আরহামের পাশে বসে। কণ্ঠ একটু উঁচু করে বলে,

” আরহাম। উঠো। খাবে না?

আরহাম চোখ মেলে। আশপাশে তাকিয়ে সকাল হয়েছে কিনা দেখে। ঘুমুঘুমু কণ্ঠে বলে,

” ডাকো কেন ভাইয়া?

” তুমি বলেছিলে চিকেন ফ্রাই খাবে। আমি কিনে আনলাম। এসে দেখি তুমি ঘুমাচ্ছো। এখন ঘুমানোর সময়? উঠো। খেয়ে আবার ঘুমোবে।

আরহাম পিটপিট করে তাকায়। হাত দিয়ে নাক ঘঁষে। অলস ভঙিতে বলে,
” খুব ঘুম পাচ্ছে ভাইয়া। পরে খাবো।

এইবার প্রহর ধমক দেয়। ছেলেটা না খেয়ে ঘুমোবে এটা হয়? আরহামকে ছাড়া সবাই বাইরের খাবার খাবে? অন্যায় হবে খুব। একটু ধমকে প্রহর বলে উঠে,

” ভাইয়া কিন্তু আর কথা বলবো না। না খেয়ে ঘুমোতে হবে না। খেয়ে আবার ঘুমোবে। এখন ওঠো। নিধি অপেক্ষা করছে। ফ্রাইটা খুব মজা হয়েছে। খেতে আসো।

আরহাম উঠতে চেয়েও উঠে না। প্রহর জগে থাকা পানি হাতের তালুতে নিয়ে আরহামের মুখে ছিটিয়ে দেয়। আরহামের মুখ মুছিয়ে দেয় পানি দ্বারা। অতঃপর কোলে করে নিয়ে যায় ডাইনিং টেবিলে।

_______

তানিয়া একটা ভুল করে ফেলেছে। ভুলটা বড়সড় না হলেও ভয় লাগছে তানিয়ার। ইহান রাগী মানুষ। জানতে পারলে একদম মেরে ফেলবে তাকে? মেরে ফেলবে? নিজ মনে আওড়ায় তানিয়া। না না। পুলিশ হয়ে খুন করবে? সামান্য একটা পারফিউমের জন্য নিজের স্ত্রী কে খুন করবে না ইহান। উঁহু গায়েও হাত তুলবে না। কিন্তু বকবে, হ্যাঁ খুব বকবে তানিয়াকে। ঝড় হবে বাড়িটাতে।

ইহান থানা থেকে ফিরে। তানিয়ার জন্য গোলাপ ফুলের তোড়া এনেছে সে। গোলাপ গুলো তানিয়াকে দিবে কি দিবে না এই নিয়ে দ্বিধায় আছে ইহান। গোলাপগুলো তানিয়ার হাতে দিয়েই বা কি বলবে সে? কেন এনেছে জানতে চাইলে কি উত্তর দিবে? ভাবতে পারে না ইহান। গোলাপগুলো রেখে দেয় ওয়ারড্রবের উপরে। তানিয়া ঘরে এলেই দেখতে পাবে ফুলগুলো। পুলিশের ইউনিফর্ম ছেড়ে টি শার্ট পড়ে তানিয়ার জন্য অপেক্ষা করে ইহান। ঘর জুড়ে কমলার ঘ্রাণ ভাসছে। নাক উঁচু করে ঘ্রাণ শুকে ইহান। তানিয়াকে ডাকে ততক্ষণাৎ। ভীত ভঙ্গিতে ঘরে আসে তানিয়া। চশমা ঠেলে তটস্থ হয়ে তাকায় ইহানের পানে। বলে,

” ডাকছেন কেন?

ইহান পুনরায় ঘ্রাণ শুকে বলে,
” ঘরে এয়ার ফ্রেশনার দিয়েছো কেন? এই ঘ্রাণটা আমার পছন্দ না। আম্মা কিনে এনে রেখেছে স্প্রে টা। আমি ব্যবহার করিনি কখনো। ঘ্রাণটা বিশ্রী। ঘরে স্প্রে করেছো কেন হঠাৎ?

তানিয়া চমকায়। ইহানের নিকট একটি দামী, ব্র্যান্ডের পারফিউম ছিল। দুবাই থেকে এক বন্ধু ইহানকে পারফিউমটা পাঠিয়েছিল মাস তিনেক আগে। মাঝারি কাচের বোতলে থাকায় অনেকদিন ব্যবহার করা গিয়েছে পারফিউমটা। ড্রেসিং টেবিল পরিষ্কার করতে গিয়ে হাতে লেগে পারফিউমের কাচের বোতলটি মেঝেতে পড়ে ভেঙে গিয়েছে। যতটুকু পারফিউম ছিল পুরোটাই মেঝেতে পড়ে গেছে। কাচ গুলোও ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল মেঝেতে। ভয় পেয়ে যায় তানিয়া। দ্রুত কাচ তুলে মেঝেটা ন্যাকড়া দিয়ে মুছে ফেলে। কিন্তু পারফিউমের কড়া, সুন্দর ঘ্রাণ পুরো ঘরে বিরাজমান ছিল। কোনোভাবেই যাচ্ছিল না সুন্দর ঘ্রাণটা। ইহান ঘরে ঢুকলেই বুঝতে পারবে তার শখের পারফিউমটা পুরো ঘরে স্প্রে করা হয়েছে। তাই তানিয়া কমলার সুঘ্রাণ দেওয়া এয়ার ফ্রেশনার ঘরে স্প্রে করে দিয়েছে। পারফিউমের ঘ্রাণটা লুকাতে এই ব্যবস্থা করার পর বিপদ বাড়ল যেন। এয়ার ফ্রেশনারের ঘ্রাণটা ইহানের পছন্দ নয়। তানিয়া থতমত খেয়ে বলল,

” ওয়ারড্রবের পিছনে ইঁদুর মরে পড়ে ছিল। অনেকদিন ধরে মরা ইঁদুর পড়ে ছিল বলে পচে দুর্গন্ধ বেরিয়েছিল ঘরে। তাই তো এয়ার ফ্রেশনার দিলাম।

ভ্রূ কুঁচকাল ইহান। বললো,

” কই আমি তো দুর্গন্ধ পাইনি এতদিন। আমার ঘরে ইঁদুর ও তো ছিল না।

সন্দিহান চোখে তাকায় ইহান। তানিয়া ঠোঁট কামড়ে ধরে। কি বলবে ভেবে পায় না। তবুও বলে,

” ছিল আপনি খেয়াল করেননি।

ইহান বোধহয় বিশ্বাস করল। ড্রেসিং টেবিলে নজর ফেলল। সেথায় তানিয়ার লোশন, শ্যাম্পু, তেল, পাউডার সবকিছু গুছিয়ে রাখা। আগে এসব ছিল না। কেবল ইহানের ব্যবহৃত সামগ্রীই ছিল। তানিয়া ঘর পরিষ্কার করেছে তা বুঝেছে ইহান। ঘরটাকে দেখতে ভালো লাগছে। খানিক হেসে ইহান বলে ওঠে,

‘ তুমি তো খুব কাজের হয়ে গেছো তানু। আই লাইক ইট।

মুখ ফুলায় তানিয়া। প্রশংসা শুনে ভালো লাগার কথা ছিল তানিয়ার, কিন্তু তানিয়া খুশি হতে পারল না। তেজস্বী কণ্ঠে বলল,
” আপনি তো মনে করেন আমি কোনো কাজই পারি না।

ইহান হাসে। তানিয়া নিজের ভুল স্বীকার করতে উদ্যত হয়। স্বামীর সাথে এত লুকোচুরি করতে বিবেকে বাঁধে। ইহানের কাছে এসে মাথি নত করে তানিয়া বলে,

” আপনার প্রিয় সুগন্ধিটা আমি ভেঙে ফেলেছি।

ইহান তানিয়ার দিকে তাকায় স্বাভাবিক ভঙিতে। তানিয়া পুনরায় কিছু বলতে নিলেই ইহান থামায়। বলে,

” আমি জানি।

অবাক হয় তানিয়া। ইহানের পাশে বসে পড়ে ধপ করে। বলে,

” আপনি কিভাবে জানেন?

” হুট করে আজ ঘরে এয়ার ফ্রেশনার দিয়েছো, ড্রেসিং টেবিলে সব থাকলেও শুধু পারফিউমটা নেই, তোমাকেও ভীত দেখাচ্ছে। বুঝবো না কেন?

” আপনি তো আমাকে বকলেন না? আপনার প্রিয় ছিল ওটা।

ইহান চমৎকার হাসে। তানিয়াকে তড়িৎ গতিতে কাছে টেনে আনে। কোলে বসায় নিজের। তানিয়ার ঘাড়ে চিবুক রেখে ভরাট পুরুষালি কণ্ঠে বলে,

” ভালোবাসার মানুষের এমন ছোটখাটো ভুল-ত্রুটি মাফ করাই যায়।

কেঁপে ওঠে তানিয়া। ঘাড়ে উষ্ণ অধরের ছোঁয়া পায়। ইহানের এহেন মোলায়েম কণ্ঠ ভারী মধুর লাগে। বারংবার শুনতে ইচ্ছে করে ইহানির কণ্ঠ। নিজেকে দমায় তানিয়া। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলে,

” আপনি কি ইনডিরেক্টলি আমাকে ভালোবাসার মানুষ হিসেবে সম্বোধন করছেন?

তানিয়ার পেটে হাত রাখে ইহান। চুমু আঁকে তানিয়ার কপোলে। বলে,

” ডিরেক্টলিই বলছি।

তানিয়া চুপ থাকে। নিজেকে খুব বিশেষ মনে হয় তানিয়ার। ইহান পুনরায় ডাকে।

” তানু,

থমকে থাকে তানিয়া। শব্দ বেরোয় না কণ্ঠনালী থেকে। ইহানের ডাকে মনে হয় মাদক মেশানো। সম্মোহনী কণ্ঠে তানিয়া উত্তর দেয়,

” হুহ্?

ইহান চুপ থেকে ফিসফিস করে বলে,
” ভালোবাসি।

_______

প্রিয়তা বালিশ জড়িয়ে শুয়ে আছে বিছানার অপর প্রান্তে। প্রহর ঘরে ঢুকে প্রিয়তাকে পর্যবেক্ষণ করে। বাল্ব নিভিয়ে প্রিয়তার পাশে এসে শোয়। শক্তপোক্ত হাত দ্বারা পেটে চাপ প্রয়োগ করে প্রিয়তাকে নিজের কাছে আনে। মেয়েটার শরীর নরম। কাছে এলেই কেমন নেশা ধরে যায়। প্রিয়তার গায়ে ওড়না নেই। বক্ষ উন্মুক্ত। বক্ষবিভাজনের নরম মাংসপিণ্ডের ভাঁজ চোখে লাগে প্রহরের। সেদিক থেকে চোখ সরায়। প্রিয়তা জড়িয়ে ধরে প্রহরকে। বলে,

” আরহাম ঘুমিয়েছে?

প্রহর আরহামকে ঘুম পাড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছিল। কারন প্রহর নিজেই ছেলেটার কাচা ঘুম ভেঙে দিয়েছে। প্রিয়তা তাই বলেছিল আরহাম না ঘুমোলে প্রহরকে আজ খুব বকবে সে। অগত্যা বাধ্য হয়ে আরহামের সাথে এত রাত অবধি খেলাধুলা করে ঘরে ফিরল প্রহর। লোকটা আরো ঘনিষ্টভাবে আঁকড়ে ধরে প্রিয়তার কোমর। বলে,

” ঘুমিয়েছে।

প্রিয়তা মুখ গুঁজে প্রহরের বলিষ্ঠ, সুঠামদেহী বুকে। নাক ঘষে সেথায়। প্রহর হাসে। প্রিয়তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,

” কাল ভোরে আমরা ঢাকায় ফিরবো প্রিয়।

” কাল? এত তাড়াতাড়ি?

” আপনার ইউনিভার্সিটি, আমার চাকরি, আরহামের স্কুল সবই তো ওখানে। আমার ছুটির মেয়াদ শেষ। আরো গ্যাপ দিলে বস অফিস থেকে বের করে দিবে। তখন আপনার স্বামী
যে বেকার হয়ে যাবে প্রিয়।

” কাল না গেলে হয় না?

” উঁহু হয় না। মাকে সব বুঝিয়ে বলেছি। টিকিট কেটেছি। আবার আসবো প্রিয়। কাল যেতেই হবে।

প্রিয়তা মানে। প্রহরের গভীর, অন্তর্ভেদী চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে খানিকক্ষণ। হেসে বলে,

” নিভৃতে যেইজন রয়ে যায়,
সে-ই তো প্রিয়জন।❤

_______

বেশ সকাল সকাল ঘুম ভেঙে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রার জন্য তৈরী হলো প্রিয়তা আর আরহাম। আরহামের ভিষণ মন খারাপ হয়। এখানে থাকতেই বেশি ভালো লাগে আরহামের। তবুও প্রহরের কথা শুনে ঢাকায় যেতে আপত্তি নেই আরহামের। ভালো শার্ট প্যান্ট পড়ে আরহাম এসে দাঁড়াল দরজার সম্মুখে। প্রিয়তা একে একে বিদায় জানাল সবাইকে। এখান থেকে যেতে তার ও খারাপ লাগছে। সবার থেকে বিদায় নিয়ে প্রিয়তা লাগেজ টেনে দরজার সম্মুখে আসতেই চির চেনা মুখের এক মহিলাকে দেখতে পায়। বিস্ময়ে বিমূঢ় হয় প্রিয়তা। প্রীতিলতাকে এতদিন পর সামনাসামনি দেখে কেমন অভিব্যক্তি দেখানো উচিত বুঝতে পারে না সে। প্রীতিলতার শরীর রুগ্ন, বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। চোখের নিচে কালি পড়েছে। কেমন বিমর্ষ হয়ে তাকিয়ে আছে প্রিয়তার পানে। প্রীতিলতার চোখে পানি চিকচিক করছে। মনে হচ্ছে শ্বাস নিচ্ছে খুব কষ্ট করে। প্রিয়তা মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে। সম্মুখে দাঁড়ানো মানুষটার প্রতি রাগ, ক্ষোভ কোনোটাই দেখায় না প্রিয়তা। কি বলা বা করা উচিত ভেবে পায় না। নিজেকে বড্ড অসহায় লাগে প্রিয়তার। আবেগ ঠেলে বেরিয়ে আসে। প্রীতিলতা এগিয়ে আসে ধীর পায়ে। শ্বাসরুদ্ধকর কণ্ঠে ডাকে,

” প্রিয়তা।

প্রিয়তাও ধীর পায়ে এগোয়। আম্মুকে এসময় এখানে দেখে অবাক হওয়ার পাশাপাশি কষ্ট জমে প্রিয়তার হৃদয়ে। দম নিতে কষ্ট হয়। চোখের কার্ণিশে পানি জমে। ঢোক গিলে বলে,

” আম্মু, তু..তুমি। এখানে?

প্রীতিলতা এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে প্রিয়তাকে। প্রিয়তার মাথা নিজের ঘাড়ে আঁকড়ে ধরে। হু হু করে কেঁদে ফেলে মহিলা। ঢুকরে ওঠে। ফর্সা মুখখানি লাল হয় প্রীতিলতার। অগোছালো চুলগুলো পানিতে ভিজে মুখে এঁটে থাকে। কান্না একটু কমিয়ে প্রীতি বলে,

” কেমন আছিস মা?

মায়ের কণ্ঠস্বরে প্রিয়তার শরীর কেঁপে ওঠে। ভালো লাগায় ছেয়ে যায় হৃদয়। এ ডাক শোনার আশায় যেন মুখিয়ে ছিল প্রিয়তা। প্রিয়তার হুঁশ ফিরে। বুঝতে পারে ভুল হচ্ছে। ততক্ষণাৎ ছেড়ে দেয় প্রীতিলতার বুক। মনে পড়ে প্রীতিলতার বিশ্বাসঘাতকতার কথা, পরকিয়ায় জড়িয়ে আরহাম আর তাকে বের করে দেওয়ার কথা, আরিফের মৃত্যুর কারণটাও মনে পড়ে প্রিয়তার। চোখ মুছে সে। দৃঢ় হয় চোখ। কাঠ কাঠ কণ্ঠে বলে ওঠে,

” কি চাই আপনার? কেন এসেছেন?

প্রীতিলতা মুখে হাত চেপে কাঁদতে থাকে। মিসেস নাবিলা প্রিয়তা আর প্রীতিলতার কথোপকথন শুনে প্রীতিলতাকে চিনতে পারে। মহিলাকে কাঁদতে দেখে মায়া হয় উনার। প্রীতিলতাকে নিয়ে গিয়ে বসায় সোফায়। কাচের গ্লাসে পানি এনে দেয়। প্রিয়তা গম্ভীর থাকে। প্রতিক্রিয়া দেখায় না। বিরক্ত ঠেকে সবকিছু। পুনরায় কণ্ঠে জোর এনে বলে,

” প্রশ্নের উত্তর দিন। আবার কি কেড়ে নিতে এসেছেন আপনি? আর কি চাই আপনার?

প্রীতি ফোলা চোখ দুটো মুছে উঠে দাঁড়ায়। অসহায় কণ্ঠে বলে,
” আমি খুব অসুস্থ প্রিয়তা। আমি আশ্রয় চাইতে এসেছি।

ভ্রু কুঁচকায় প্রিয়তা। প্রহর গিয়েছে কিছু কেনাকাটা করতে। এসময় লোকটা থাকলে পরিস্থিতি খুব সহজেই সামলাতে পারতো। কোন সময় কোন অভিব্যক্তি দেখানো উচিত তা প্রহর বেশ ভালোই জানে। এই মুহুর্তে প্রহরকে খুব চাইল প্রিয়তা। মিসেস নাবিলা জিজ্ঞেস করলেন,

” আপা, কি হয়েছে আপনার?

” আমার গর্ভপাত হয়েছে আপা। আমি গর্ভবতী ছিলাম। আমার বর্তমান স্বামী খুব খুশী ছিল সে বাবা হবে বলে। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল ? সব শেষ হয়ে গেল। তিন দিন আগে কিছুটা ব্লাড বেরোয়, সেই রাতে প্রচুর ব্লিডিং হয়। ডক্টর জানায় আমার বাচ্চা পেটেই নষ্ট হয়ে গেছে। গোপনাঙ্গে সিস্ট ধরা পড়েছে। যোনিতে টিউমার হয়েছে। অপারেশন করেছে সেই রাতে। ডাক্তার জানিয়েছে আমি আর মা হতে পারবো না। কোনোদিন না। সেই ক্ষমতা হারিয়েছি আমি।

বলার সাথে সাথেই কেঁদে দিল প্রীতিলতা। কেঁদে কেঁদেই বলল,
” হাসপাতালে ছিলাম দুদিন। আমার শাশুড়ি কিংবা স্বামী কেউই আমাকে এ দুদিন দেখতে আসেনি। অপারেশনের বিল ও দেয়নি। আজ বাড়ি ফিরে গিয়েছিলাম। ওরা আমাকে দেখেই দরজা বন্ধ করে দিল। সন্তান জন্মদানে অক্ষম কোনো মেয়েকে ছেলের বউ হিসেবে মানতে পারছে না আমার শাশুড়ি। আমার স্বামী আজিজ আমাকেমুখে মুখেই তিন তালাক দিয়ে বের করে দিয়েছে বাড়ি থেকে। তার সন্তান চাই। কিন্তু আমার তো সন্তান দেওয়ার ক্ষমতা নেই। আমি এখন কোথায় যাবো বলেন? চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি কিছুদিন আগে। সবে অপারেশন হয়েছে। হাঁটতেও পারছি না, পেটে ব্যথা হচ্ছে। কি করবো বলেন? এখন তো কাজ করা সম্ভব না। কোথায় যাবো আমি?

প্রিয়তা সবটা শুনে। হু হু করে ওঠে তার বুক। এতকিছু হয়ে গেল অথচ সে কিছুই জানে না। জেনেই বা কি করতো সে? এই মহিলার জন্যই তো তার আব্বু মরেছে। কি করে প্রিয়তা ভুলবে সে কথা? প্রীতি এগিয়ে আসে প্রিয়তার নিকটে। প্রিয়তার হাত ধরে বলে,

” আমাকে ক্ষমা করে দে প্রিয়তা।

প্রিয়তার খানিক মায়া হয়। সামনে দাঁড়ানো মানুষটা তার মা। সে যতই স্বার্থপর, নিষ্ঠুর, খারাপ হোক না কেন সে তো প্রিয়তার মা-ই। এই মানুষটা প্রিয়তাকে জন্ম দিয়েছে, পেটে রেখেছে দশ মাস। উনিশটা বছর প্রিয়তার সব দায়িত্ব পালন করেছে প্রীতিলতা। স্থান দিয়েছে নিজের গৃহে। ষোলটি বছর অতি যত্নে লালন-পালন করেছে। সন্তান হিসেবে মায়ের পাশে থাকাটা প্রিয়তার দায়িত্ব। এ দায়িত্ব কিভাবে এড়িয়ে যাবে সে? কিভাবে মুখ ফিরিয়ে নিবে? উক্ত অনুরোধে প্রিয়তা মলিন হাসে। বলে,

” আপনাকে ক্ষমা করতে না পারার জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন। আপনার প্রতি আমার দায়িত্ব আছে। তা আমি এড়িয়ে যাবো না। আর না অতিত ভুলে যাবো।

চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

প্রিয়তার প্রহর ২ পর্ব-১৫+১৬

0

#প্রিয়তার_প্রহর (২য় পরিচ্ছেদ)
পর্ব সংখ্যা (১৫)

রাত বারোটা বেজে পাঁচ মিনিট। প্রিয়তা বসে আছে বিছানার মাঝ বরাবর। প্রহর এখনো ঘরে আসেনি। ঘড়ির কাটা টিকটিক শব্দ করে সময় জানান দিচ্ছে। প্রিয়তার অগোছালো লাগে নিজেকে। হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে থাকে বিছানায়। বারোটা দশে ঘরে ফিরে প্রহর। ছেলেটার গায়ে পাঞ্জাবি। চুলগুলো গোছালো প্রিয়তাকে এখনো জেগে থাকতে দেখবে আশা করেনি প্রহর। প্রিয়তাকে বসে থাকতে দেখে খানিক অবাক হলো সে। ভেবেছিল প্রিয়তা এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু না, প্রিয়তা তার স্বামীর জন্য অপেক্ষা করছে অধীর চিত্তে। প্রহরকে দেখেই কেমন হেলেদুলে উঠল প্রিয়তা। লজ্জায় নত হলত মুখ।

প্রহর প্রিয়তার সম্মুখে এগিয়ে আসে। প্রিয়তা তন্ত্র পায়ে নামে বিছানা থেকে। খানিক ঝুঁকে ডান হাত দিয়ে প্রহরের দু পা ছুঁয়ে সালাম করে। বিষয়টা ভালো লাগে না প্রহরের। স্ত্রীর নত মুখের চিবুক দু আঙুল দ্বারা সোজা করে। স্ত্রীর পানে তাকিয়ে থাকে অপলক। প্রিয়তার চোখ জোড়া ফোলা ফোলা। কেঁদে চোখ-মুখ লাল করে ফেলেছে মেয়েটা। প্রিয়তার ডাগর ডাগর চোখে কষ্টের রেশ। ধক করে ওঠে প্রহরের বুক। প্রসাধনী ব্যবহার ব্যতিত অগোছালো স্ত্রী কে বড্ড নিষ্পাপ লাগছে প্রহরের নিকট। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে সে বলে,
” পায়ে হাত দিয়ে সালাম করবেননা। মুখে মুখেই সালাম দিবেন। মনে থাকবে?

প্রিয়তা মাথা নাড়ে। প্রিয়তার মাথা থেকে আঁচল সরে যায়। খানিক হেসে যত্নের সাথে আঁচলটা ঠিক করে দেয় প্রহর। প্রিয়তাকে বিছানায় বসিয়ে পাঞ্জাবির উপরের একটি বোতাম খুলতে থাকে। প্রিয়তা তাকিয়ে থাকে স্বামীর পানে। প্রশ্ন করে,

” এত দেরি হলো যে, কোথায় ছিলেন?

প্রহরের হাত থামে। ভড়কায় না ছেলেটা। মেকি হেসে বলে,
” কেন? আপনি কি আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন?

প্রিয়তা থমকায়। পিটপিট করে তাকিয়ে থাকে। প্রহর বুঝে যায় প্রিয়তার মনের কথা। প্রহরের জন্য অপেক্ষা করছিল মেয়েটা। বলতে পারছে না সংকোচে, লজ্জায় পাঞ্জাবিটা পাল্টে ডেনিম শার্ট গায়ে জড়ায় প্রহর। প্রিয়তার উদ্দেশ্যে বলে,

” শাড়িটা বেশ ভারী আর ঝকমকে। ঘুমোতে পারবেন না। চেঞ্জ করে আসুন।

প্রিয়তা লাগেজে থাকা প্লাজু আর ঢিলেঢালা লেডিস ডেনিম শার্ট নিয়ে ওয়াশরুমে ছোটে। মুখ আর হাত পা ধুয়ে প্লাজু আর শার্ট পরেই বের হয় প্রিয়তা। গলায় জড়ায় সিল্কের ওড়না। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে প্রিয়তা থমকে যায়। এতক্ষণ জ্বলে থাকা বাল্বটা এখন নেভানো। পুরো ঘরটা অন্ধকার। গুমোট অন্ধকারে সামনে পা ফেলতেও ভয় লাগে প্রিয়তার। চঞ্চল হয় প্রিয়তার কায়া। এদিক ওদিক তাকিয়ে উপায়ান্তর না পেয়ে প্রহরকে ডাকে,

” প্রহর, কোথায় আপনি? এত অন্ধকার কেন?

প্রহরের উত্তর আসে না। হঠাৎই শীতল এক শক্তপোক্ত হাত প্রিয়তার পেটে বিচরণ করতে থাকে। প্রিয়তার গলায় আর পেটে দু হাত দিয়ে জড়িয়ে সান্নিধ্যে আগলে রাখে অবয়বের প্রশস্ত বুকের সাথে। প্রথমে ভয় পেলেও খানিকক্ষণ দম নিয়ে বড় বড় শ্বাস ফেলে প্রিয়তা। পারফিউমের ঘ্রাণটা ভিষণ চেনা চেনা লাগে। গভীর স্পর্শ আঁকা মানুষটাকে চিনতে অসুবিধে হয় না প্রিয়তার। ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটে অনায়াসে। হাত দুটোর উপর প্রিয়তা তার নরম হাত চেপে ধরে। প্রশান্তিতে চোখে বুজে বলে,

” ভয় পেয়েছিলাম তো।

প্রহর মুখ গুঁজে প্রিয়তার ঘাড়ে। ওষ্ঠ ছোঁয়ায় নিবিড় ভাবে। কেঁপে উঠে প্রিয়তা। ছটফট করে বাহুবন্ধন থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য। অস্থির লাগে প্রিয়তার। হৃদস্পন্দন থামে। স্বেদজল গড়ায় ললাট বেয়ে। প্রহর হাতের বন্ধন ছিন্ন করে পিছন থেকে পুনরায় জড়িয়ে ধরে প্রিয়তাকে। প্রিয়তার ঘাড়ে মাথা রেখে ফিসফিসিয়ে বলে,

” আমি ছাড়া আপনাকে ছোঁয়ার সাধ্যি কার?

প্রিয়তার ভালো লাগে এই গভীর আলিঙ্গন। কিন্তু এ আলিঙ্গনের সময়সীমা দীর্ঘ হয় না। প্রিয়তাকে ধীরে সুস্থে বিছানায় বসায় প্রহর। রঙ বেরঙের মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখে ঘরের সর্বত্রে। অতঃপর প্রিয়তার পিঠের দিকে এসে শুয়ে পরে নির্বিকার চিত্তে। প্রিয়তাকেও ইশারায় শুতে বলে পাশে। প্রিয়তা বাধ্য মেয়ের মতো প্রহরের পাশে শোয়। প্রহর কাছে টানে প্রিয়তাকে। স্ত্রীর মাথায় হাত বুলায়। শক্তপোক্ত এক হাত রাখে প্রিয়তার নরম গালে। দীর্ঘ সময় ধরে চুমু খায় ললাটের মাঝখানে। জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে খানিকক্ষণ। প্রিয়তার কান্না পায়। চোখের পাপড়ি ভিজে আসে। আব্বুর মৃত্যুর বিষয়টা তাকে ভেঙে দিয়েছে। আনন্দ উল্লাস সব যেন কেড়ে নিয়েছে। প্রহরের চোখ জোড়া বন্ধ। নিঃশব্দে কাঁদে প্রিয়তা। শব্দ করে না কোনো। মোমবাতি গলে নিভে গিয়েছে মাত্র। পুরো ঘরটা আবারও অন্ধকার হয়েছে। এই অন্ধকারে প্রিয়তা মন ভরে কাঁদে। শ্বাস ফেলে ঘর ঘন। প্রিয়তার পেটে শক্ত হাতের বিচরণ গাঢ় হলো হঠাৎ। প্রিয়তা হকচকিয়ে তাকায় প্রহরের পানে। প্রহর চোখ বুজেই বলে ওঠে,

” আর কাঁদবেন না প্রিয়তা। অনেক তো হলো।

প্রিয়তার হাত পৌছায় প্রহরের পিঠে। প্রহর চোখ খুলে প্রিয়তার দিকে সম্মোহনী দৃষ্টি ফেলে। প্রিয়তার নাকে নাক ঘঁষে। লজ্জায় জুবুথুবু হয় প্রিয়তা। নিচু কণ্ঠে বলে,

” আপনি কি করে বুঝলেন আমি কাঁদছি?

” আমি বুঝি আপনাকে প্রিয়তা।

প্রিয়তার চোখ পুনরায় অশ্রুসিক্ত হয়। বলে,
” আব্বু কেন চলে গেল বলুন তো? আব্বু হয়তো আমার উপর রাগ করে আছে। ভাবছে আমি তার মৃত্যুতে শোকাহত নই। স্বামী, সংসার নিয়ে আনন্দে আছি খুব।

” এমনটা ভাববেন না প্রিয়তা। ঘুমান। অনেক রাত হয়েছে। অসুস্থ হয়ে পরবেন। বি স্ট্রং প্রিয়তা। এখনো অনেক কিছু জানা আপনার বাকি। ঘুমোন

” ঘুম আসছে না তো।

” আসবে। আমি আদর দিই?

প্রিয়তা দ্রুত প্রহরের বুকে মুখ লুকায়। লাজে রাঙা হয় প্রিয়তার মুখশ্রী। চোখ বুজে ততক্ষণাৎ। বলে,

” ঘুমোচ্ছি, ঘুমোচ্ছি।

_______

সকাল সকাল ব্যাগ ভরতি বাজার এনেছে আজিজ। বাড়িতে বেশ হৈ চৈ হচ্ছে। আজিজ তার সন্তানের আগমনে বেশ আনন্দিত। কোনো কাজই বাদ রাখছে না সে। খাইরুন নাহার এর ব্যবহার বদলেছে। প্রীতির সাথে সর্বক্ষণ ভালো আচরণ করেন মহিলা। প্রীতিকে কোন কাজই করতে দিতে চান না। বাড়ির সব কাজ নিজের হাতেই করেন। প্রীতি চাকরি ছেড়েছে গতকাল। শরীর আজকাল ভালো যায় না তার। অফিসে তার অনুপস্থিতির পরিমাণ বেড়েছে। অফিসে কাজ করতে গিয়েও ঝামেলা হয় বেশ। এদিক ওদিক একটু হাঁটাহাটি করলেই যেন দম বেরিয়ে আসে। অফিসের সব কলিগ গত কয়েকদিন ধরে বলছিল চাকরি ছেড়ে বাড়িতে বসতে। আর গত দুদিন ধরে আজিজ আর খাইরুন নাহার ও জোড়াজুড়ি করছিলেন চাকরি ছাড়ার জন্য। শেষমেশ সন্তান আর নিজের অসুস্থতার কথা মাথায় রেখে গতকাল চাকরিটা ছেড়েছে প্রীতি। বাড়িতে আরাম করছে। খাইরুন নাহারের নাতি-নাতনির প্রতি ভালোবাসার কারণে আগলে নিয়েছেন প্রীতিকেও। সর্বদা প্রীতির খেয়াল রাখছেন তিনি। আজিজ সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে স্ত্রীকে খুশি রাখার। প্রীতির আজকাল নিজেকে সুখী সুখী লাগে। অনাগত সন্তানের প্রতি ভালোবাসা যদিও বাড়েনি, তবুও সবার ভালো ব্যবহারের আশায় প্রীতি সন্তানকে নিয়ে ভাবছে আজকাল। তবে নতুনত্ব খুঁজে পাচ্ছে না, এটা যেন হবারই ছিল। প্রিয়তার সাথে দেখা করার ইচ্ছেটাও ঝেঁকে বসেছে প্রীতির। আরহাম কেমন আছে? কতটুকু লম্বা হয়েছে ছেলেটা? প্রিয়তার জীবন কেমন চলছে? জানতে ইচ্ছে হয় প্রীতির। সময় হয় না দেখতে যাওয়ার। শুনেছে প্রিয়তা ফিরেছে। এখানেই আছে মেয়েটা। আরিফের মৃত্যুর সংবাদ শুনেছে প্রীতি। কেঁদেছে খানিক। মন খারাপ হয়েছে প্রচণ্ড। তবে লাশ দেখতে যেতে পারেনি সংসার হারানোর ভয়ে। আজিজ যদি জানতে পারে প্রাক্তন স্বামীর লাশ দেখতে অতদূর ছুটে গিয়েছে প্রীতি, তবে যাচ্ছে তাই বলে গালমন্দ করবে।

আজিজের ডাকে ধ্যান ভাঙে প্রীতির। হাত মুখ ধুয়ে বাইরে আসে। বাজার-সদাই রান্নাঘরে রাখছেন খাইরুন নাহার। প্রীতি বাইরে আসায় আজিজ বলল,

” কি কি রান্না হবে চটপট মাকে বলো। তোমার মনের মতো সব রান্না হবে। আমার বাচ্চা তৃপ্তি করে খাবে।

হাসে প্রীতি। এগিয়ে এসে বলে,
” তোমার বাচ্চার কি আমার পছন্দের খাবার ভালো লাগবে?

এহেন কথায় রুষ্ট হয় আজিজ। খেঁকিয়ে বলে,
” পছন্দ হবে না কেন? তোমারই তো গর্ভে আছে সে। তুমি যা খাবে তাই তো ওর পেটে যাবে নাকি। মায়ের পছন্দ-ই তো অনাগত সন্তানের পছন্দ।

প্রীতি কয়েক পদ খাবারের নাম বলে। খাইরুন নাহারের হাতে হাতে কাজ করতে প্রীতি এগিয়ে যায় রান্নাঘরে। খাইরুন নাহার সব সবজি গুছিয়ে কিচেন ড্রয়ারে রাখছিলেন। প্রীতিকে এগিয়ে আসতে দেখে বললেন,

” তুমি আবার আইতে গেলা ক্যান কউ তো? আমি কি সব করবার পারি না? আগে একাই একশো জনের লাইগা রান্দন করছি।

প্রীতি শসায় কামড় বসিয়ে বলে,
” আপনি তো আগে বলতেন আপনার শরীর ভালো যায় না। এজন্যে এলাম।

হাসেন খাইরুন। বলেন,
” আমার নাতি আইবো শুইনাই আমার রোগব্যাধি চইলা গেছে। কোনো রোগবালাই নাই এহন।

প্রীতি হাসে। গা ম্যাজ ম্যাজ করছে খুব। বেরিয়ে আসে রান্নাঘর থেকে। লজ্জাস্থানে কিছুটা ভেজা ভেজা অনুভব করে। দ্রুত ওয়াশরুমে ছোটে প্রীতি। লজ্জাস্থান থেকে বের হওয়া তরল রক্তে একটুখানি ভিজে যায় শাড়ির নিচে থাকা বস্ত্র। অবাক হয় সে। প্রেগন্যান্সির সময় পিরিয়ড হবার তো কথা নয়। আগে এমনটা হলে স্বাভাবিক ভাবেই নিতো বিষয়টা। কিন্তু এখন এমন তরল দেখে ভয় পেল প্রীতি। চিন্তিত হলো বেশ।

_____

প্রিয়তা যে এ বাড়ির নতুন বউ তা সে অনুভব করতে পারছে না। মনে হচ্ছে এ যেন নিজেরই বাড়ি। চোখ মেলে সর্ব প্রথম প্রিয় পুরুষের দিকে নজর যায় প্রিয়তার। প্রহর তাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। চুলগুলো ছেলেটার অগোছালো হয়ে চোখে এসে পড়েছে। ঘুমন্ত মুখখানা ভারী সুন্দর লাগছে। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয় স্বামীর পানে। প্রিয়তা নজর ফেরায় না। তাকিয়ে থাকে সময় নিয়ে। খানিকক্ষণ পর উঠতে নিলেই পেটে প্রহরের হাতের বন্ধন গাঢ়ভাবে দমবন্ধ হয় প্রিয়তার। ভ্রূ কুঁচকায় ফেলে। মিছে বিরক্তি নিয়ে বলে,

” আপনি তাহলে ঘুমোননি? অভিনয় করছিলেন?

চোখ বুজেই হাসে প্রহর। প্রিয়তার বিরক্তি ভাব কাটে। অপলক চেয়ে থাকে প্রহরের হাসির পানে। লোকটা এত সুন্দর কেন? কেন এত মাদকতা এই মানুষটা ঘিরে? প্রহর বলে ওঠে,

” ঘুমোলে কি জানতে পারতাম আমার স্ত্রী আমাকে এত ভালোবাসে? এত চোখে হারায় আমাকে।

হেচকা টানে প্রিয়তাকে নিজের বুকের উপরে তুলে প্রিয়তার বক্ষদেশে চুমু আঁকে প্রহর। প্রিয়তা লজ্জায় মূর্ছা যায়। সরে আসে ততক্ষণাৎ। মেঝেতে দাঁড়িয়ে বলে,

” বাজে বকবেন না। ফ্রেশ হবেন। উঠুন জলদি।

প্রিয়তা শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে দৌঁড়ায়। পনেরো মিনিট বাদে ফিরে আসে ঘরে। প্রহর তখনো শুয়ে আছে। বিরক্ত হয় প্রিয়তা। ব্লাউজের উপরে বড়সড় ওড়না জড়িয়ে বলে,

” বের হন ঘর থেকে। শাড়ি পড়বো।

প্রহর ওঠে বিছানা ছেড়ে। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। বলে,

” আমি যে আপনার স্বামী তা কি ভুলে যাচ্ছেন?স্বামীর সম্মুখে কিসের এত লাজ?

রাগে চোখ পাকায় প্রিয়তা। প্রহর উঠে বাইরে চলে যায়। প্রিয়তার হাসি পায় ভিষণ। আজ তাদের ঘুরতে যাবার প্ল্যান আছে। তাইতো ইউটিউব দেখে শাড়িটা পড়তে চাইছে সে।

______

বারবার ঘড়ি দেখছে ইহান। তানিয়া ঘুমোচ্ছে। বেশ সকাল সকাল তানিয়ার বাড়িতে এসেছে ইহান। তানিয়ার ঘুম ভাঙতে চায়নি সে। তাই বসে আছে বিছানার পাশের চেয়ারে। তানিয়ার চোখে চশমা নেই। বদ্ধ চোখ জোড়ার মণি নড়চড় করছে। ইহান পুনরায় ঘড়িতে সময় দেখে। ইহানের পরণে ট্রাউজার আর টি শার্ট। তানিয়ার ঘুম থেকে ওঠার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ইহানের ও ঘুম পায়। বুকে দু হাত গুঁজে বসে থাকে।

সময় গড়ায়। দুপুরের দিক ঘুম থেকে উঠে তানিয়া। বিছানায় বসে বড়সড় হাই তোলে। হাত পা এদিক ওদিক মেলে অলসতা কাঁটায়। ঘোলাটে চোখের কারণে দেখতে পায় না ইহানকে। পুনরায় ঘুমোতে যাবার প্রস্তুতি নিতে নিলেই ধমকে ওঠে ইহান। চেঁচিয়ে বলে,

” ফারদার আর ঘুমোবে না। কটা বাজে ইডিয়ট। কোনো ডিসিপ্লিন নেই তোমার।

হঠাৎ ইহানের এমন কঠিন বাক্যে ভয় পায় তানিয়া। হকচকিয়ে যায়। দ্রুত চশমা চোখে এঁটে ইহানের দিকে তাকিয়ে ভড়কায় তানিয়া। হন্তদন্ত হয়ে পরণে থাকা প্লাজু পায়ের কব্জিতে টেনে আনে। বলে,

” আপনি এখানে? আমি কি স্বপ্নটপ্ন দেখছি নাকি?

ইহান বিরক্ত হয় তানিয়ার এমন অহেতুক কথাবার্তায়। বলে,

” মাথাটা কি গেছে নাকি? এত এত কথা বলো তোমার গলা ব্যথা করে না? কিভাবে পারো?

” আপনি কিভাবে পারেন এত রাগারাগি করতে? এত চেঁচাতে? আপনার মাথা কি কোনোদিন ঠান্ডা থাকে না?

কথা বাড়ায় না ইহান। তানিয়ার সাথে কথা বলার মানে ঝগড়াঝাঁটি করা। এটা আপাতত চাইছে না ইহান। রাগ কমিয়ে গাম্ভীর্য বজায় রেখে ইহান বলে,

” বাড়ি চলো।

হাসে তানিয়া। খানিক ভাব নিয়ে বলে,
” নিতে এসেছেন আমায়? এত প্রেম?

” আম্মা তোমাকে মিস করছে। সেজন্য নিতে এসেছি। আমার কি অত ঠ্যাকা?

” সে যাই হোক, কোলে তুলে নিয়ে যেতে হবে। নইলে যাবো না।

চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ
#প্রিয়তার_প্রহর (২য় পরিচ্ছেদ)
পর্ব সংখ্যা (১৬)

[ প্রাপ্তমনস্কদের জন্য উন্মুক্ত। বাকিরা স্কিপ করতে পারেন ]

ইহানের বিরক্তি আকাশসম। কথা বলতেও কেমন বিরক্তি ঠেকছে তার। সামনে থাকা মেয়েটা তার শখের নারী। ইহান ভালোবাসে এই মেয়েটাকে। সেই প্রথম থেকে। কিন্তু ভালোবাসা প্রকাশে ইহান সর্বদাই কুণ্ঠিত বোধ করে। তানিয়াকে সে ভালোবাসে। কিন্তু ভালোবাসি কথাটি তানিয়ার সম্মুখে বলতে চায় না ইহান। বাড়িতে তানিয়ার মা এবং বাবা দুজনেই আছেন। তাদের সামনে কিভাবে তানিয়াকে কোলে তুলে নিবে সে? নির্লজ্জের মতো তানিয়াকে কোলে তুলতে সংকোচ হচ্ছে ইহানের। তানিয়ার এহেন জেদে রুষ্ট হলো সে। বলল,

” তোমার কি পা নেই? কোলে তুলতে হবে কেন?

তানিয়া উঠে দাঁড়ায়। এখনো ব্রাশ করা হয়নি তার। ক্লোজআপের পেস্ট ব্রাশে লাগিয়ে দাঁত ব্রাশ করতে করতে তানিয়া বলে,

” পা আছে বলে কি কোলে নেয়া যাবে না?

ব্রাশ করা অবস্থায় তানিয়ার কথা বলা পছন্দ নয় ইহানের। তানিয়ার কথা বলাটা ভালো লাগল না ইহানের। চেঁচিয়ে বলে উঠল,
” অ্যাই ফাজিল। আগে ব্রাশ করো দ্যান কথা বলো।

তানিয়া ভেংচি কাটে। বাথরুমে গিয়ে ব্রাশ করে ফিরে আসে ঘরে। ইহান তাড়া দেয়। বলে,

” চলো এবার। আম্মাকে কথা দিয়েছি তোমায় নিয়ে যাবো।

দুষ্টু হাসে তানিয়া বলে,
” কোলে না নিলে যাবো না।

ইহান কি করবে ভেবে পায় না। বলে,
” বেশ কোলে নিবো। একটি শর্ত আছে। বাইরে গিয়ে সবাইকে বলবে বাথরুমে পড়ে গিয়েছিলে, পায়ে ব্যথা পেয়েছো সেজন্য আমি তোমায় কোলে নিয়েছি। ঠিক আছে?

ভড়কায় তানিয়া। রাগ হয় খানিক। বলে,
” মিথ্যে বলবো কেন? আমার পা ঠিক আছে। আপনি বলবেন তানিয়া যেতে চাইছে না। তাই জোর করে নিয়ে যাচ্ছি।

হতাশ হয় ইহান। তানিয়া এতটা জেদি ছিল না। এতটা বাচ্চামোও করতো না। সবসময় ভয় পেত তাকে। সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতো। বিয়ের পর মেয়েটা পাল্টে গেছে। জেদি, একগুঁয়ে স্বভাবের হয়েছে। ইহানকে এখন আর ভয় পায় না তানিয়া। স্বামীর মতো ট্রিট করে। অথচ ইহান ভেবেছিল তানিয়া তার সাথে কখনো ফ্রি হতে পারবে না। মানতে পারবে না তাকে স্বামী হিসেবে। কিন্তু ইহানের থেকে তানিয়াই দ্রুত কদমে এগোচ্ছে। সম্পর্কটা নিয়ে ইহানের চেয়ে তানিয়াই বেশি ভাবছে, গুরুত্ব দিচ্ছে। তানিয়ার নিকট এগিয়ে আসে ইহান। স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে,
” তুমি তো আগে এত জেদি ছিলে না তানিয়া। আমাকে ভয় পেতে।

ইহানের চোখে চোখ রাখে তানিয়া। বলে,

” আগে আপনি স্যার ছিলেন। ঘরে-বাইরে সব ক্ষেত্রে স্যার ছিলেন। কিন্তু এখন সম্পর্কে ভিন্নতা এসেছে। এখন আপনি আমার স্বামী।

শেষ কথাটুকু বলাস লজ্জা পেল তানিয়া। নতজানু হলো। পুনরায় বলে উঠল,

” বিয়েটায় আমার অমত ছিল। রাজি হতে চাইনি আমি। বাবা আর আন্টির কথায় রাজি হয়েছি বিয়েতে। তাই বলে যে আপনাকে অবজ্ঞা করবো, আপনাকে অপমান, অবহেলা করবো এমন মেয়ে আমি নই। সবচেয়ে বড় কথা বিয়েটা হয়ে গিয়েছে। এখন আমাদের উচিত সম্পর্কটাকে গাঢ় করা, টিকিয়ে রাখা। একে অপরকে সময় দেওয়া, একে অপরকে স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করা। কি তাই নয় কি? আপনার আম্মা আমাকে বলেছে আপনি আমাকে ভালোবাসেন। কবে থেকে ভালোবাসেন তাও জানতে পেরেছি। অবাক হয়েছিলাম খুব। বছর খানেক ধরে একজনের প্রতি আসক্ত থাকা মানুষকে কিভাবে মন থেকে সরিয়ে দিই বলুন। কিভাবে দুরে রাখি? আপনি যতই বদ,রাগী, ঝগড়ুটে হন না কেন আমা তো জানি আপনি কেমন। কতটা দায়িত্ববান।

হাসে ইহান। প্রগাঢ় হাসি। তানিয়ার গালে হাত বুলায়। চুমু খায় সশব্দে। ললাটের মধ্যিখানে কম্পিত ওষ্ঠজোড়া রাখে। চোখ বুজে নেয় তানিয়া। রাঙা হয় মুখ। শিরা উপশিরা বেয়ে শীতল স্রোত বয়। সরে আসে ইহান। হুট করে এমন কাজ বোধহয় করতে চায়নি সে। থতমত খেয়ে পরিস্থিতি এড়াতে বলে,

“চলো। বাড়ি ফিরতে হবে।

তানিয়া চটপট আয়নায় নিজেকে দেখে নেয়। অতঃপর ইহানের নিকট এসে বাচ্চা কণ্ঠে বলে,

” নিন কোলে নিন।

হাসে ইহান। তানিয়ার বাচ্চামো উপভোগ করে। পেটে দৃঢ় চাপ প্রয়োগ করে পাজোকোলে তুলে নেয়। তানিয়া ততক্ষণাৎ জড়িয়ে ধরে ইহানের কাঁধ। বাইরে গিয়ে তানিয়ার বলা কথাটাই জানায় ইহান। খানিক লজ্জা পেলেও পরে সামলে নেয় নিজেকে। প্রেয়সীর জন্য একটু নির্লজ্জ হওয়াই যায়।

______

নিধি আর আরহাম বেরিয়েছে দুপুরে। নিধির কলেজে প্রোগ্রাম আছে। আরহামকে নিয়ে সেখানেই গিয়েছে। সেজেগুজে একদম নতুন বেশে আরহাম বেরিয়েছে। ছেলেটার সময় বদলেছে। নতুনত্ব এসেছে জীবনে। হাসিখুশি থাকে আরহাম। প্রিয়তার ভালো লাগে ভাইকে এমন সুখে থাকতে দেখে। প্রহর হাঁটছে পাশেই। প্রিয়তার গায়ে হালকা গোলাপী রঙের শাড়ি। প্রহরের পরণে ম্যাচিং শার্ট। হাঁটতে হাঁটতে প্রেয়সীর পানে তাকিয়ে পুনরায় সামনে তাকায় প্রহর। আইসক্রিমের দোকানে ছুটে যায় প্রিয়তা। দুটো আইসক্রিম কিনে। বিল পরিশোধ করে প্রহর।

ভালোবাসা এক তৃপ্ত বাসনা। সবাই ভালোবেসে প্রিয় মানুষকে নিজের করতে পারে না। যারা পারে তাদের অনেকেই আবার সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পারে না। প্রিয়তা আর প্রহর, এরা দুজনের কেউই কাউকে সেভাবে ভালোবাসার সুযোগ পায়নি। দুরত্ব তাদের বুঝিয়েছে ভালোবাসা আসলে কি? ভালোবাসা প্রয়োজন কেন?

হাঁটতে হাঁটতে প্রিয়তা মুচকি হেসে বলে,
“ভাবিনি আপনার সাথে আবার দেখা হবে, ভাবিনি এক হবো আমরা।

প্রহর নিজেও হাসে। বলে,
” আমিও ভাবিনি।

এলাকার রাস্তাঘাট উন্নত হয়েছে। পাকা রাস্তায় দুজন মানব-মানবী হেঁটে চলেছে। প্রিয়তাকে মিষ্টি লাগছে ভিষণ। গোলগাল চেহারায় খুশি খুশি ভাব। ফুচকার গাড়ি দেখে আবার ওবায়না ধরে প্রিয়তা। বলে,

” চলুন ফুচকা খাই।

মুখ কুঁচকে ফেলে প্রহর। বলে,
” একদম না। রেস্টুরেন্টে গিয়ে কিছু খাওয়া যাবে। ফুচকা খেয়ে পেট খারাপ করতে হবে না।

মন খারাপ হয় প্রিয়তার। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে থাকে অন্যদিকে। হঠাৎ একটি বড়সড় লাঠি এসে প্রিয়তার পায়ের কাছে লুটায়। অবাক হয় প্রিয়তা। আতঙ্কে আর শব্দে লাফিয়ে ওঠে। মোটাসোটা লাঠিটা আরেকটু হলেই তার পিঠে লাগতো। লাঠিটার মতো প্রিয়তা লুটিয়ে পড়তো রাস্তায়। চিৎকার করে উঠতো। কিংবা লাঠিটা প্রহরের মাথায় লাগতে পারতো। ভয়ে ঘন শ্বাস ফেলে প্রিয়তা। প্রহরের দিকে তাকায় বড় বড় চোখ করে। প্রহরের তীক্ষ্ম চোখ তখন সামনে। আট-ন জন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ একত্রে এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। চোখে অসম্ভব আক্রোশ। হাতে লাঠি, বাঁশ, কাঠের টুকরো। অনেকটা দূর থেকেই এরা লাঠিটা ছুড়েছে তাদের দিকে। প্রহর প্রিয়তার হাত ধরে। প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে,

” বিপদ এগিয়ে আসছে প্রিয়তা। পালাতে হবে।

প্রিয়তার চোখে অনেক প্রশ্ন। পরিস্থিতিটা বুঝে উঠতে পারল না। প্রহর বুঝল প্রিয়তার অভিব্যক্তি। কঠিন স্বরে বলল,
” আপনার প্রশ্নের উত্তর পরে দিচ্ছি। দৌঁড়ান।

শাড়ি পড়ে হাঁটতেই অসুবিধে হয় প্রিয়তার। দৌড়ানো তার জন্য অসম্ভব একটি কাজ। তবুও প্রহরের কথার পরিপ্রেক্ষিতে ছুট লাগাল সম্মুখে। হাত ধরে প্রিয়তা আর প্রহর ছুটতে লাগল ফুটপাত দিয়ে। প্রিয়তার পা শাড়িতে পেঁচিয়ে আসে বারবার। নিজেকে সামলে প্রহরের সাথে সাথে দৌড়ানোর চেষ্টা চালায় প্রিয়তা। প্রহরের সাথে তবুও পেরে ওঠে না। কোনরকমে ছুটে চলে মৃত্যুর ভয়ে। স্বেদজল গড়ায় গা বেয়ে। দৌড়াতে গিয়ে বারংবার থেমে যায়। হাঁপিয়ে ওঠে খুব। পুনরায় ছুটে প্রহরের হাত ধরে। ছুটতে ছুটতে বিরক্তি নিয়ে প্রিয়তা বলে,
” পালাচ্ছি কেন? আমরা কি কোনো অন্যায় করেছি?

প্রহর এক পলক প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে প্রিয়তার সামনের রাস্তায় পরে থাকা ইটের টুকরো পা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলে,
” অন্যের স্বার্থে আঘাত করেছি। এতটুকুই জানুন। কথা বলবেন না। সময় নেই।

প্রিয়তা পিছু ফিরে। লোকগুলো তখন ও দৌড়ে আসছে তাদের দিকে। প্রিয়তা চোখ বুজে নেয়। না আর পারবে না সে। আর পালাতে পারবে না। এত ভয় নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে না সে। দোষ করেনি সে, কেন লোকগুলো তাদের মারতে আসবে? কেন তারা পালাবে? প্রিয়তা থেমে যায় ততক্ষণাৎ। ঘন ঘন শ্বাস ফেলে বলে,
” আমি আর দৌড়াতে পারবো না।

প্রহর ও থামে। চোখেমুখে ফুটে ওঠে হতাশা। নিজের অপারগতা মেনে নিতে কষ্ট হয়। বলে,

” এতগুলো মানুষের সাথে আমি একা লড়াই করতে পারবো না প্রিয়তা। আমি বুঝতে পারছি আপনার কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু দৌড়ানো ছাড়া এখন আর উপায় নেই। ওরা সংখ্যায় বেশি। হাতে অস্ত্র ও আছে। আপনাকে নিয়ে আমি কোনো রিস্ক নিতে চাই না প্রিয়তা।

প্রিয়তা হাসে এত এত লোকের ভিড়ে রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরে প্রহরের বাহু। ওরা এগিয়ে আসছে নিকটে। প্রিয়তা দ্রুত বলে ওঠে,
” আপনি একা কেন হতে যাবেন? আমি আছি তো। মার্শাল আর্ট জানি আমি। ওদের সাথে লড়তে পারবো।

আর কথা বলার সময় পায় না প্রিয়তা। দলবল এগিয়ে আসে। শক্ত মোটা কাঠ দ্বারা আঘাত করতে চায় প্রহরকে। প্রহর ট্রেনিং নিয়েছে। মোকাবিলা করার শক্তি আছে তার। প্রহর আঘাত পাওয়ার আগেই লোকটার হাত ধরে মুচরে দেয়। প্রিয়তা থেমে থাকে না। ঢাকায় ফেরার দুদিন পর প্রিয়তা বাসে করে ফিরছিল বাড়িতে। সন্ধ্যের মাঝামাঝি তখন। প্রিয়তার তখন ভয়-ডর অনেক। জীবনে নতুন যাত্রা শুরু করেছে সবে। বাসের সিটে বসে থাকাকালীন প্রিয়তা খেয়াল করে সিট না পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাপ্তবয়স্ক যুবকটি টাল সামলাতে না পেরে বারবার পড়ে যাচ্ছে। কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে অপরাধীদের ন্যায় আশপাশে তাকাচ্ছে। চেষ্টা করেও নিজেকে ঠিকমতো গাইড করতে পারছে না। সন্দেহ হয় প্রিয়তার। কিছু না ভেবেই জিজ্ঞেস করে,

” আপনি আগে কখনো বাসে উঠেননি?

লম্বায় ছেলেটি পাঁচ ফুট পাঁচের উপরে। বয়স আঠারো কি উনিশ। অতি সুদর্শন না হলেও ছেলেটার চেহারা মায়াবি। অতিরিক্ত ফর্সা গায়ের রঙ। চোখের মণি বিড়ালের ন্যায়। প্রিয়তার এহেন কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খায় ছেলেটি। বোকা হেসে বলে,

” এবারই প্রথম। আমার একটু জ্বর আসছে তো। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।

প্রিয়তার মায়া হয় ভিষণ। ছেলেটাকে নিজের সিটে বসিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই বাড়িতে ফিরে বাকিটা রাস্তা। নামার সময় প্রিয়তা দেখে ছেলেটা তাদেরই এলাকার। ধন্যবাদ জানাতে আসে ছেলেটি। অতঃপর কথাবার্তা বলে জানতে পারে ছেলেটি খ্রিষ্টান। নাম জুনিভো। বাবা-মা মারা গেছে ছোটবেলায়। দাদু জুলফিকার-এর কাছেই মানুষ হয়েছে জুনিভো। আগে ইন্ডিয়ায় থাকতো ওরা। দু বছর আগে বাংলাদেশে এসেছে। এখানে জুনিভোর দাদুর একটি মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে। প্রিয়তা শোনার পর খুব অবাক হয়েছিল। মার্শাল আর্টের একাডেমি এদিকে তেমন নেই। ছোটবেলা থেকেই মার্শাল আর্ট শেখার ইচ্ছে ছিল প্রিয়তার। মার্শাল আর্ট শেখার ইচ্ছে পোষণ করার পর জুনিভো প্রিয়তাকে নিয়ে গিয়েছিল তার দাদুর মার্শাল আর্ট একাডেমিতে। চার মাস ওখানেই মার্শাল আর্ট শিখেছে প্রিয়তা। জুলফিকার দাদু প্রচণ্ড ভালো মানুষ ছিলেন। প্রিয়তার সম্পর্কে সবই জানেন তিনি। প্রিয়তাকে তিনি নাতনির মতো ভালোবাসতেন। প্রিয়তা যখনই সময় পেয়েছে তখনই মার্শাল আর্ট শিখতে গিয়েছে ওখানে। পরিশ্রমী প্রিয়তা কঠোর মনোবল নিয়ে খুব শীঘ্রই কৌশল গুলো আয়ত্বে আনতে পেরেছে। ছোট ছোট কিন্তু প্রয়োজনীয় রণ কৌশলগুলোই শিখেছে সে। জুলফিকার বেশ ভালো ভাবেই প্রিয়তাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। আজ সেই শিক্ষার যথাযথ প্রয়োগ করল প্রিয়তা। পা দিয়ে সজোরে লাথি দিল অচেনা ছেলেটিকে। গলায় চাপ দিয়ে মাথাটা ঘুরিয়ে ঘুষি দিল মেরুদণ্ড বরাবর। লুটিয়ে পরল ছেলেটি। প্রহর একের পর এক আঘাত করল ছেলেগুলোকে। দুজনে খুব কম সময়ে লড়াই করে নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে জয়ী হলো। প্রহর ইহানকে ফোন দিয়ে ততক্ষণাৎ জানাল ফোর্স নিয়ে আসতে। প্রিয়তা দম নিল। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল হাসি। বাইরে মোটামুটি মারামারি করেছে সে। তবে এমন যুদ্ধ এই প্রথম করল প্রিয়তা। প্রহর মুগ্ধ হলো প্রিয়তার লড়াইয়ে। পুলিশ ফোর্স এলো খুব শীঘ্রই। ধরা হলো সকলকে। প্রিয়তার ভয় বাড়ে। আজ এই কৌশলগুলো না জানলে ক্ষতি হতে পারতো তাদের। প্রহর পুলিশ হলেও মানুষ। হঠাৎ এতজন মানুষের আক্রমণের সাথে পেরে উঠতো না ছেলেটা।

____

ইহানের থানার সামনে দাঁড়িয়ে প্রহর। প্রিয়তাকে বাড়িতে রেখে এখানে এসেছে সে। ইহানের সাথে কিছু আলাপ আছে প্রহরের। সবকিছু খোলাসা করতেই তার এখানে আসা। থানার দারোয়ান প্রহরকে দেখেই হাসল দাঁত কেলিয়ে। শব্দ করে পা নাড়িয়ে ললাটে হাত রেখে সালাম জানাল। হাসল প্রহর। লোকটার এই এক অভ্যেস। তাকে দেখলেই এমনভাবে বিনয়ের সাথে সালাম দেয়। প্রহর সালামের উত্তর দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল। থানাটা আগের মতোই আছে। কোনো পরিবর্তন হয়নি। আগের মতোই গোছালো, একই রঙ করা দেয়াল। প্রহর আজ এসেছে সাধারণ মানুষ হিসেবে। তবুও থানার সব কনস্টেবল আর প্রহরের চেয়ে জুনিয়র অফিসাররা প্রহরকে দেখে এগিয়ে এলো। সকলের চোখেমুখে প্রশান্তি। প্রহরের রিজাইন দেওয়ার খবরটা জানে তারা। খুব দুঃখ পেয়েছে প্রহরের নেওয়া সিদ্ধান্তে। প্রহরকে দেখে একে একে সকলে দু পাশে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াল। সালাম জানাল বিনয়ের সাথে। প্রহরের সাথে কুশল বিনিময় করল। একজন অফিসার বলল,

” আপনি কেন চলে গেলেন স্যার? আপনাকে ছাড়া থানাটা কেমন শান্ত শান্ত লাগে। কোনো আনন্দই নেই এখানে। ইহান স্যার তো এখন আর আমাদের সাথে আড্ডাই দেন না।

প্রহরের কণ্ঠে জড়তা কাজ করে।কাজের জায়গাটা তার প্রিয়। এখানকার মানুষগুলোকেও আপন করে নিয়েছে সে। সকলেই বেশ ভালোবাসে তাকে। অথচ সে সবার ভালোবাসার কথা ভাবেনি। নিজেকে ঠিক করে প্রহর বলল,
” জীবনে এমন এমন সব পরিস্থিতি আসে যে সে পরিস্থিতি আমরা চাইলেও মোকাবিলা করতে পারি না। তোমরা চিন্তা করো না। ভাগ্যে যদি পুলিশের চাকরি লেখা থাকে তো আবার জয়েন করবো। আবার তোমাদের সাথেই কাজ করবো।

প্রহর সকলকে রেখে ইহানের ডেস্কে গিয়ে বসে। বন্ধুর আগমনে খুশি হয় ইহান। তানিয়া গিয়েছে অন্য থানায়। কিছু ফাইল ট্রান্সফার করতে। ইহান হেসে বলে,

” কেমন আছিস? বিয়ের পরদিনই থানায়?

হাসে প্রহর। বলে,
” বিয়ের দিন তো তুইও থানায় এসেছিলি তানিয়াকে ফেলে।

থতমত খায় ইহান। বিয়ের কথাটা প্রহরকে এখনো জানানো হয়নি। তবে কি তানিয়া বিয়ের বিষয়টা জানিয়ে দিয়েছে প্রহরকে? অবাক কণ্ঠে ইহান প্রশ্ন করে,

” তুই জানিস?

হাসে প্রহর। বলে,
‘ ঢাকায় বসেও এখানকার সব খবর রেখেছি। কটা কেস সলভড করেছিস? কজনকে এরেস্ট করেছিস? সব জানি।

মাথা চুলকায় ইহান। কথা এড়াতে প্রশ্ন করে,
” ওই লোকগুলোকে পিটিয়েছি। তুই যেটা ভেবেছিলি তাই ঠিক। মেইন কালপ্রিট ওই দীপা খন্দকার। আর ওর আসল নাম কিন্তু দীপা নয়। মিথিলা। এর আগেও এই মহিলার নামে কেস করা হয়েছিল।

বাকি কথা টুকু বলার আগেই প্রহরের ফোন বেজে ওঠে। ফোনের স্ক্রিণে বয়স্ক এ সি পি এর নম্বর ভেসে ওঠে। প্রহরের চোখ উজ্জল হয়। ফোনটা ধরে বলে,

” হ্যালো স্যার।

ওপাশ থেকে অফিসার বলে ওঠে,
” হাই। তোমার খবর কি প্রহর? কোনো খোঁজ নেই।

” ঠিক আছি স্যার।

” কবে জয়েন করবে?

” সময় আসুক।

” সময়টা কবে আসবে প্রহর? সবাই তোমাকে চাইছে, সবাই চাইছে তুমি আবার জয়েন করো। তোমার মতো দায়িত্ববোধসম্পন্ন অফিসার আমি আর কোথায় পাবো? ভুলে যেও না তুমি শুধু একজন অফিসার নও। সততা ও ন্যায়ের প্রতীক। তোমাকে দেখে বর্তমানে সকল পুলিশ ন্যায় শিখছে। দেশের জন্য কাজ করছে। তুমি যদি এভাবে চলে যাও..

প্রহর স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই সব কথা শোনে। এ কথা সে প্রায়ই শুনে উপরমহলের লোকেদের মুখে। দৃঢ় কণ্ঠে বলে,

” আমি ব্রেক নিয়েছি, হারাইনি। ফিরতে আমাকে হবেই স্যার। আজ হোক বা কাল।

_____

আরহাম পড়তে বসেছে নিধির ঘরে। অ্যাপেল, বল, ক্যাট এগুলো ইংলিশে লিখছে খাতায়। প্রিয়তা বারবার মোবাইল চেইক দিচ্ছে। অনেক প্রশ্ন জমে আছে প্রিয়তার মস্তিষ্কে। প্রহরকে এখন দরকার প্রিয়তার। সব প্রশ্নের উত্তর জানা প্রয়োজন। রাত ও হয়েছে। প্রহরের না ফেরার কারণে চিন্তা হচ্ছে প্রিয়তার।

প্রহর ফিরে অনেকক্ষণ পর। প্রিয়তা নিচে প্রহরের কণ্ঠ শুনে দ্রুত দৌড়ে বের হয় ঘর থেকে। দুপুরে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা কাউকে বলেনি প্রিয়তা। বললেই সকলেই চিন্তা করবে। প্রহরকে দেখে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয় প্রিয়তার। মাথা রাখতে ইচ্ছে হয় প্রহরের প্রশস্ত ব্যায়ামপুষ্ট বুকে। সকলের সামনে নিজেকে সামলে নেয় প্রিয়তা। প্রহর ঘরে ফেরার সাথে সাথে প্রহরের বুকে হামলে পরে প্রিয়তা। শব্দ করে কেঁদে ফেলে। ভিজিয়ে দেয় প্রহরের শার্ট। প্রিয়তার মাথায় হাত বুলায় প্রহর। বলে,

” কাঁদছেন কেন?

প্রিয়তা চোখ উঁচিয়ে তাকায় প্রহরের পানে। বলে,
” ফোন দেননি কেন? সেই দুপুরে বেরিয়েছেন। এখন কটা বাজে খেয়াল আছে?

প্রিয়তার নরম গালে হাত বুলায় প্রহর। নাকে নাক ঘষে। চুমু খায় ঘাড়ে। জড়িয়ে ধরে প্রিয়তার মেদহীন কোমড়। কাছে টানে নিবিড়ভাবে। কানের লতিতে চুমু খায় বারংবার। প্রহরের গা থেকে মাদকীয় সুঘ্রাণ প্রিয়তার নাসারন্ধ্রে পৌঁছায়। অন্তঃস্থলে ভূকম্পন সৃষ্টি হয়। হীম শীতল হয়ে আসে গা। শিরশির কর উঠে শরীর। খাঁমচে ধরে প্রহরের কাঁধ। হাসে প্রহর। দুজনের ওষ্ঠাদ্বয় মিলিত হয়। স্ত্রীর ওষ্ঠের অমৃতসুধা পান করে প্রহর। আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়। হুট করে প্রহর ছেড়ে দেয় প্রিয়তাকে। থতমত খায় প্রিয়তা। লজ্জিত হয় বেশ। প্রহর দুর্বোধ্য হাসে। প্রিয়তার কপালে কপাল রেখে ঘনঘন শ্বাস ফেলে বলে,

” প্রিয়, আমার প্রিয়।

প্রিয়তা হাসে। এতক্ষণ ওষ্ঠে হওয়া ঝড়ে নেতিয়ে পরে। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে,

” প্রিয় হলে কাছে টানছেন না কেন? হুহ্?

প্রহরের ঠোঁটে দুষ্টু হাসি প্রতীয়মান হয়। বলে,
” কাছে টানছি তো, আপনিই লজ্জা পাচ্ছেন।

” উঁহু এভাবে নয়।

” কিভাবে?

নত মুখ সোজা করে প্রিয়তা। প্রহরের রসিকতা ধরতে পেরে চোখ পাকায়। অভিমানী স্বরে বলে,

” মজা করছেন আমার সাথে?

প্রহরের হাসি গাঢ় হয়। চিকচিক করে ওঠে দন্ত। ফিসফিস করে বলে,

” মজা? না তো।

” বদ লোক কোথাকার। অসভ্য!

” এখনো তো অসভ্যতামো করলামই না ।

প্রিয়তা চলে যেতে চায়। দরজা অবধি পৌঁছাতেই হাত টেনে ধরে প্রহর। দরজা লাগিয়ে দেয়। প্রিয়তাকে এক হাতে আগলে নেয় বুকে। বক্ষস্থলে পীড়া অনুভব করে প্রিয়তা। গুঙিয়ে ওঠে। প্রহরের শক্তপোক্ত হাত প্রিয়তার শরীরের সর্বত্রে বিচরণ করে। নতজানু হয় প্রিয়তা। লাজে নুইয়ে যায়। ঘাড়ে মুখ ডোবায় প্রহর। কামড়ে ক্ষত সৃষ্টি করে সেথায়। “আহ্” জাতীয় শব্দ করে প্রিয়তা। চোখ বেয়ে চিকন নোনা পানি গড়ায়। প্রহরের মায়া হয়। ছেড়ে দিতে উদ্যত হলে বাঁধা দেয় প্রিয়তা। লজ্জিত কণ্ঠে বলে,

” উঁহু, যা..যাবেন না।

চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি _শেখ

প্রিয়তার প্রহর ২ পর্ব-১৩+১৪

0

#প্রিয়তার_প্রহর (২য় পরিচ্ছেদ )
পর্ব সংখ্যা (১৩)

রাত্রির মাঝ ভাগ। ঘড়ির কাঁটা চলছে নিজের খেয়ালে। আশপাশের কোনো বাড়িতেই আলো নেই। অদূরে রাস্তায় থাকা ল্যামপোস্টের ক্ষীণ আলো জ্বলছে। অপার সৌন্দর্যের এই শহরটাকে নিস্তব্ধ দেখাচ্ছে। প্রিয়তার চোখ যায় আকাশের দিকে। তাকিয়ে থাকে খানিকক্ষণ। নেত্রপল্লব ভিজে একাকার হয়। আলগোছে মুছে নেয় নোনা জল। প্রহরের হাতের মুঠোয় হাত চেপে ধরে ছাদের কোণে বসে আছে প্রিয়তা। মাঝে মাঝে নাক টানছে। হেচকি উঠছে অনবরত। নাক লাল করে ফেলেছে মেয়েটা। অন্ধকারে ও চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। প্রহর ফোনের বাটন চেপে সময়টা দেখে নেয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে। প্রিয়তার হাতের পিঠে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে বলে,

” আর কাঁদে না। মাথা ব্যথা করবে।

প্রিয়তা শোনে না। ঠোঁট কামড়ে ধরে দাঁত দিয়ে। মোলায়েম কণ্ঠে বলে,

” থামাতে পারছি না। কষ্ট হচ্ছে খুব।

” অনেক রাত হয়েছে প্রিয়তা। ঘুমোবেন চলুন। অনেকটা জার্নি করেছেন। অসুস্থ হয়ে পড়বেন এবার।

প্রিয়তা ঘাড় বাঁকায়। ঘুম আসছে না তার। প্রহরের দিকে না তাকিয়ে বলে,
” আব্বু আমাকে ভালোবাসে না। একটুও না। আব্বু আমাকে আরো কয়েকবার কাছে ডাকতে পারতো, আরো কয়েকবার আমার কাছে ক্ষমা চাইতে পারতো। কই, করলো না তো। সম্পত্তি নিয়ে কথা বলে গেল শুধু। আমার সম্পত্তির ভাগ চাই না। বিশ্বাস করুন আব্বুর টাকা-পয়সার প্রতি লোভ নেই আমার। কিন্তু আব্বু যদি একবার তার সম্পত্তির কিয়দংশ অংশ আমাকে দিতে চাইতো, একবার যদি বলতো প্রিয়তার দায়িত্ব আমি নিবো, তাতেই আমি খুশি হয়ে যেতাম। মনে করতাম আব্বু আমাকেও নিজের উত্তরাধিকারী ভাবছে। কোনো কিছুই চাইতাম না আমি। শুধু মুখ থেকে একবার শুনতাম। কিন্তু সেটা তো হলো না। আব্বুর চিন্তা শুধু আরহামকে ঘিরে। ওর ভবিষ্যত নিয়ে আব্বু ভাবছে। আমার নিজের দায় নিজেকেই নিতে হবে।

প্রহর কি বলবে ভেবে পায় না। বাবা-মেয়ের এই দ্বন্দ্বে জড়াতে চায় না সে। প্রিয়তাকে সান্ত্বনা দিতে বলে,

” দিলেও আপনি নিতেন না। হয়তো এটা ভেবেই দেয়নি। কিন্তু আপনার দিক থেকে আপনি ঠিক। উনি আপনাকে মানানোর চেষ্টা করতে পারতেন।

” আমি কি ভুল করেছি প্রহর? কেন আমার সাথেই এমন হয়?

” ভুলটা আপনার নয় প্রিয়তা, ভুল আমাদের এই সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে। আপনার আব্বু ঘরে অমন সুন্দরী স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও অন্য নারীতে বিমোহিত হয়েছেন। আপনার আম্মু এমন সুদর্শন, ধনী স্বামী থাকা সত্ত্বেও পরপুরষের সাথে অবৈধ সম্পর্ক গড়েছেন। আপনাদের কথা উনাদের মাথায় আসেনি তখন। উনাদের এই অবৈধ সম্পর্কের মাঝে আপনাকে আর আরহামকে এমন ভাবে পিষে দেওয়া হয়েছে যে আপনারা চাইলেও মাঝ থেকে বের হতে পারছেন না। আপনি হয়তো ভাবছেন আপনার আব্বু-আম্মু অন্য সংসারে গিয়ে বেশ সুখে আছেন। কিন্তু আপনি জানেন কি, কারো সুখ কেড়ে নিয়ে কেউ সুখী হয় না, হতে পারে না। আপনার আম্মু, আব্বুর মাঝে এক ফোঁটা কষ্ট হলেও আছে। এতদিনে হয়তো উনারা দুজনই আপনার ভালোবাসা অনুভব করতে পারছেন। উনারা একটা সময় ঠিকই নিজেদের কর্মফল পাবেন। আপনাকে অভিশাপ ও দিতে হবে না। প্রকৃতি নিজেই প্রতিশোধ নিবে।

প্রিয়তা গা এলিয়ে দেয়। মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগে তার। ঘাড়ে প্রিয়তার চুলের ছোঁয়া পায় প্রহর। মুচকি হাসে। প্রিয়তা প্রশান্তিতে চোখ বুজে নেয়। ঘোর লাগা কণ্ঠে বলে,

” আপনার ঘাড়ে মাথা রাখলে এত শান্তি লাগে কেন প্রহর?

নিঃশব্দে হাসে প্রহর। প্রিয়তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

” বুকে মাথা রাখুন প্রিয়, আরো সুখ পাবেন।

সময় গড়ায়। প্রহর তাড়া দেয় ঘরে ফেরার জন্য। এগারোটার দিকে প্রহর নিজের বাড়িতে প্রিয়তাকে নিয়ে ফিরেছে। প্রিয়তাকে দেখা মাত্র নাবিলা উত্তেজিত হয়ে চুমু খেয়েছেন প্রিয়তার ললাটে। আরহামকে উনি নিজের কাছে রেখেছেন। রান্না করেছিলেন কয়েক পদ। প্রিয়তাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিয়েছেন। সবাইকে ঘুমোতে বলে নিজেও ঘুমিয়েছেন। কিন্তু প্রিয়তার আব্বুর চিন্তায় ঘুম আসে না। ছাদে আসে। ডেকে নেয় প্রহরকেও। দুজনে একসাথে আকাশ দেখে। এত রাত হওয়ায় প্রহর পাঠিয়ে দেয় প্রিয়তাকে। কাঁথা টেনে দেয় শরীরে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

” ধৈর্য ধরুন প্রিয়তা। সুখ আসবেই। কান্নাকাটি করবেন না। ঘুমোনোর চেষ্টা করুন। আপনাকে এভাবে ভেঙে যাওয়া মানায় না। আপনাকে শক্ত হতে হবে। এ প্রিয়তাকে আমি ভালোবাসিনি। আমি ভালোবেসেছি এমন একটি মেয়েকে যে সংগ্রাম করতে জানে। আপনি এক উত্তপ্ত হরিদ্রাভ অনল প্রিয়তা। কখনো আলো দেন, উষ্ণতা দেন, কখনো জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভষ্ম করেন সর্বাঙ্গ।

________

প্রিয়তার ঘুম ভাঙে বেশ বেলা করে। রাতে মাথা ব্যথায় এপাশ ওপাশ করে আরো পরে ঘুম ধরেছিল প্রিয়তার। সকালের সতেজ রোদ মুখে পড়ায় ঘুম ছুটে যায় তার। মিষ্টি হেসে বিছানা ছাড়ে। জানালার সম্মুখে দেওয়া পর্দা ভালো করে সরিয়ে দেয়। বাড়িটা আজ অন্যরকম লাগছে প্রিয়তার নিকট। আগে এ ফ্ল্যাটে ঢুকতে ভয় পেত প্রিয়তা। আর এখন? এখন এ ফ্ল্যাটের হাওয়াটাও দারুন লাগে। মাংসের গন্ধে বাড়িটা ম ম করছে। ওড়না জড়িয়ে বের হতেই দরজার আড়াল থেকে ভো জাতীয় শব্দ করল আরহাম। প্রিয়তাকে ভয় দেখানোর চেষ্টায় সফল হলো। আচমকা সামনে এসে শব্দ করায় ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল প্রিয়তা। ঘটনা বুঝতে পেরে রাগমিশ্রিত কণ্ঠে বলে উঠল,

” এইসব কি ধরনের ফাইজলামো আরহাম? ভয় পেয়েছি না?

আরহাম খুশি হয় বোনকে ভয় দেখাতে পেরে। জোরে হাত তালি দিয়ে বলে,
” প্রহর ভাইয়া বলেছে তুমি নাকি ভয় পাও না। তাই টেস্ট করছি। আমার কোনো দোষ নেই।

প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকায়। বলে,
” উনার কথা শুনো কেন? উনি এইসব বাজে বকেই। মানুষ মাত্রই ভয়। প্রত্যেকটা মানুষ ভীতু। নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে আমরা সবাই ভিতু। কেউ পশুপাখিকে ভয় পায়, কেউ শব্দতে ভয় পায়, মানুষে ভয় পায়, আবার কিছু মানুষ ভালোবাসায় ও ভয় পায়। ভয় পাই না এটা যে বলে সে মিথ্যে বলে। ভয় সবার মাঝেই আছে। বুঝেছো?

আরহাম পুরোটা না বুঝেও মাথা নাড়ে। প্রিয়তা ড্রইংরুমে আসে। সেখানে কেউ নেই। ডাইনিংরুমে প্রবেশ করে প্রিয়তা। বড়সড় টেবিলটায় বসে আছে নিধি। এটা ওটা ঠিকঠাক করছে মিসেস নাবিলা। প্রিয়তাকে দেখে প্রফুল্ল হলো নিধি। দাঁত বের করে হাসল। এগিয়ে এসে প্রিয়তাকে চেয়ারে বসাল। বলল,

” দেখো তোমার জন্য আজ কত আয়োজন। বসো বসো। আমি যে কতটা খুশি হয়েছি তুমি আসবে জেনে, বলে বোঝাতে পারবো না।

প্রিয়তা চারপাশ অবলোকন করে টেবিলে বসল। মিসেস নাবিলা প্রিয়তাকে দেখে হাসলেন। বললেন,

” তোমাকে আরো আগে ডাকতে চাইলাম। সক্কাল সক্কাল উঠে আমি রান্নাবান্না করে রেখেছি। ডাকতে যাবো অমনি প্রহর বললো তুমি অনেক রাত করে ঘুমিয়েছো। এখনই যেন না ডাকি। তাই চলে এলাম। ডাকলাম না।

প্রিয়তার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়। টলমল করে ওঠে চোখের কার্ণিশ। নাকের ডগা রক্তিম রঙ ধারণ করে। মিসেস নাবিলা হাত ধুয়ে বিরিয়ানির প্লেট থেকে খাবার তুলে দেয় প্রিয়তার মুখে। মনে মনে প্রিয়তা বলে,

” এত সুখ আমার সইবে আদৌ?

প্রহর আসে টেবিলে। প্রহরের পরণে ছাই রঙা শার্ট। শার্টের হাতা ফোল্ড করা। অগোছালো চুলগুলো চোখের সামনে এসে হানা দিচ্ছে। প্রিয়তাকে দেখে গাঢ় হাসল প্রহর। প্লেটে খাবার বাড়তে বাড়তে বলে,

” শুভ সকাল।

প্রিয়তা হেসে ফেলে ফিক করে। ঝলমলিয়ে ওঠে মুখশ্রী। বলে,

” এখনো সকাল? দেখুন দুপুর হয়ে গেছে।

নিধি হেসে ফেলে প্রিয়তার কথায়। বলে,

” ভাইয়া দেখি দিন-দুনিয়া ভুলে গিয়েছে। সকালে উঠে আবার গিয়েছিল ঘুমোতে। আপুর চিন্তায় আজকাল রাতে ঘুম হচ্ছে না ভাইয়ার। কি ঠিক বলছি তো?

প্রহর হাসে। উত্তর দেয়,
” রাতে ঘুম আসেনি। ফোন চেপেছি। সকালের দিকে একটু ঘুম হলো। তবে তোর কথা পুরোটা মিথ্যে নয়।

প্রহর আড়চোখে প্রিয়তার দিকে চায়। নজর সরে না প্রিয়তার থেকে। প্রিয়তা বুঝতে পারে প্রিয় পুরুষের গভীর চাহনি। অসস্তিতে আটশাট হয়ে বসে থাকে। নিধি খেতে খেতে প্রিয়তাকে বলে,

” আমার ভাইয়াকে কবে বিয়ে করবে প্রিয়া আপু?

প্রিয়তা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়। এক ঝলক প্রহরের দিকে তাকিয়ে চোখ সরায়। বুকের ভিতরটা ধক করে উঠে। বিয়ে শব্দটা শুনে কম্পিত হয় প্রিয়তার বেখেয়ালি মন। চিবুকে মাথা ঠেকে। নিধি হেসে ফেলে প্রিয়তাকে লজ্জা পেতে দেখে। প্রহর খাবার চিবুতে চিবোতে বলে,

” উনাকে রাজি কর। আজই বিয়ে করবো।

প্রিয়তা দ্রুত মাথা উঁচু করে। বিস্ময় চেপে ধরে চোখেমুখে। শৈথিল্যময় কণ্ঠে বলে,

” বিয়ে করবো বললেই কি বিয়ে করা যায়?

ব্যস। খাওয়া বন্ধ হলো প্রহরের। হাসিখুশি মুখটা নিমেষেই অন্ধকারে ছেয়ে গেল ছেলেটার। গম্ভীর হলো মুহুর্তেই। কণ্ঠ ধারাল হলো বেশ। মিসেস নাবিলার উদ্দেশ্যে বলল,

” আমি আজ রাতেই বিয়ে করবো মা। আয়োজনের কোনো দরকার নেই। এই মেয়ের ডিসিশন একটু পর পর বদলায়। আমি রিস্ক নিব না।

পুনরায় নিধির উদ্দেশ্যে বলল,
” তুই শপিং শুরু করে দে বোনু। আজ এই বাড়িতে আমার আর প্রিয়তার বিয়ে হবে ইন শা আল্লাহ্।

চলে যায় প্রহর। প্রিয়তা হকচকিয়ে ওঠে। বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। বলে,

” কিন্তু এখনই কিভাবে?

মিসেস নাবিলা খুশিমনে বলেন,
” তুমি শুধু সেজেগুজে কবুল বলবে। বাকিটা আমরা দেখে নিবো। আমার ছেলের সংসার আজ আমি সাজিয়ে দিবো।

______

গাড়ির ফ্রন্ট সিটে প্রহরের পাশেই প্রিয়তা বসে আছে। পরণে মিষ্টি রঙের থ্রিপিস আর মাথায় হিজাব। লিপবামের কারণে তৈলাক্ত লাগছে ঠোঁট। আরহাম আসাতে চেয়েছিল। মিসেস নাবিলা ছেলেটাকে আসতে দিলেন না। বিকেলে নাকি আলাদা করে আরহামকে নিয়ে মার্কেটে যাবেন উনি। প্রহর আর কথা বলেনি প্রিয়তার সাথে। মিসেস নাবিলা দুজনকে পাঠিয়েছেন বিয়ের কেনাকাটা করতে। শপিং করেই ইহানের বাসায় যাওয়ার প্ল্যান আছে প্রহরের। পাশে বসে থাকা নির্বাক, নিশ্চুপ রমণীর প্রতি অভিমান জমেছে বেশ। কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করে না প্রহর। প্রিয়তার প্রিয় পুরুষের কণ্ঠস্বর শুনতে ইচ্ছে হয়। হাঁসফাঁস করে কিছুক্ষণ। কাছু বলতে চেয়েও চুপ থাকে। নিচু কন্ঠে প্রশ্ন করে,

” আপনার কোন রঙ পছন্দ?

প্রহর ড্রাইভিং করতে করতে প্রিয়তার দিকে তাকায় গভীর ভাবে। নজর সরে গেলেও মুখ থেকে কথা বের হয় না। প্রিয়তা পড়ে বেকায়দায়। সহ্য হয় না প্রহরের এমন অভিমানী মুখ। পুনরায় বলে ওঠে,

” কোন মার্কেটে যাচ্ছি আমরা?

প্রত্যুত্তর করে না প্রহর। নিরাশ হয় প্রিয়তা। মন খারাপ হয় প্রচণ্ড। বড় বাজারে আসে তারা। নেমে পরে প্রহর। সম্মুখে এগিয়ে যায় দ্রুত গতিতে। প্রিয়তাও পিছু হাঁটে। নত মুখে প্রহরের পা অনুসরণ করে শুধু। কিছুক্ষণ বাদে পা থামায় প্রহর। প্রিয়তার গতি কমে না ঠিক সময়ে। ততক্ষণাৎ ধাক্কা খায় প্রহরের পিঠের সাথে। প্রিয়তার নাক বরাবর মেরুদণ্ড ঠেকে প্রহরের। ব্যথা পায় প্রিয়তা। নাক ডলে। প্রহর কতটকু লম্বা? ধারণা করে প্রিয়তা। সে পাঁচ ফুট সাড়ে তিন ইঞ্চি। প্রহর তার থেকে কম করে ছয়- সাত ইঞ্চি লম্বা। স্বাস্থ্যবান, প্রশস্ত শরীরের অতি নিকটে এলে প্রহরের চিবুক নজরে আসে প্রিয়তার। প্রহর প্রিয়তার দিকে ফিরে। ভ্রু বাঁকায়। গম্ভীর স্বরে বলে,

” কিভাবে হাঁটছেন? ধাক্কা খান কিভাবে?

প্রিয়তা মিইয়ে যায়। লোকটা এমন কেন? একটু ভালো করে কথা বললে কি হয়? মিনমিনে স্বরে সে বলে,

” আপনাকে অনুসরণ করেই চলছি। আপনিই বা মাঝ পথে থেমে গেলেন কেন?

প্রহর বড় শ্বাস ফেলে। সংগ্রামী, পরিপক্ক,কঠোর মেয়েটা তার নিকটে এলেই কেমন বাচ্চা হয়ে যায়। হারিয়ে ফেলে ইগো। প্রিয় পুরুষের সান্নিধ্য পেতে নত করে মাথা। ভালো লাগে প্রহরের। মনে মনে হাসে সে। কণ্ঠ দমে। স্বাভাবিক স্বরে বলে,

” ব্যথা পেয়েছেন?

প্রিয়তা পিটপিট করে তাকায় প্রহরের দিকে। ঠোঁট ফুলিয়ে বলে,

” পেয়েছি। এমন স্থানে ব্যথা পেয়েছি যে চাইলেও আপনাকে দেখাতে পারবো না।

প্রহরের ললাটে ভাঁজ পড়ে। চিন্তা বাড়ে। গাম্ভীর্য তলিয়ে যায় যত্নের কাছে। প্রিয়তার এক বাহু ধরে প্রহর। চিন্তিত স্বরে বলে,

” কোথায় ব্যথা পেয়েছেন? আমায় দেখাবেন না কেন? বেশ, ঠিক আছে। আমাকে বলতে হবে না। সামনের হসপিটালে মহিলা ডক্টর আছে। চলুন এক্ষুণি।

প্রিয়তা হেসে ফেলে শব্দ করে। হাসতে হাসতে পানি জমে চোখে। প্রহর ছোট ছোট করে ফেলে চোখ। প্রিয়তার হাসি থামে। দম নিয়ে বলে,

” সবসময় উল্টো বুঝেন কেন? আপনি কথা বলছেন না আমার সাথে তাইতো আমার বুকে ব্যথা হচ্ছে। বুকের ব্যথা কি দেখানো যায়? এই ব্যথা সেই ব্যথা না।

ব্যস রাগ কমে প্রহরের। আলতো চড় মারে প্রিয়তার মাথায়। হাতে হাত গুঁজে সামনে এগোয়। অনেকগুলো দোকান ঘুরে লেহেঙ্গা দেখে প্রিয়তা। পছন্দ হয় না কোনোটাই। শেষে শাড়ি কিনতে ইচ্ছে হয় প্রিয়তার। জ্ঞান হবার পর থেকে এ পর্যন্ত কখনো শাড়ি পড়েনি সে। ওয়েস্টার্ন পোশাক পড়তো আগে। বাড়ি ছেড়ে আসার পর ওয়েস্টার্ন শব্দটি উচ্চারণও করে না সে। প্রহর একটি গাঢ় খয়েরি রঙের শাড়ি বেছে দিল। সাথে ম্যাচিং করে লিপস্টিক থেকে শুরু করে সবই কিনল। বাড়ি ফেরার পথে ফোন এলো প্রহরের। ফোনের স্ক্রিনে দীপার নম্বর ভেসে ওঠায় চমকাল প্রহর। ধীরেসুস্থে ধরল কলটা। বলল,

” হ্যালো।

ওপাশ থেকে দীপা কিছু বলে ওঠে। কয়েক সেকেন্ড বাদে কল কাটে প্রহর। থমকে যায় চলাফেরা। প্রিয়তা জিজ্ঞেস করে,

” কে ফোন দিয়েছিল?

প্রহর সময় নিয়ে বলে,
” দীপা খন্দকার। আপনার সৎ মা।

প্রিয়তা অবাক হয়। আব্বুকে নিয়ে চিন্তাও হয় খানিক। বলে,
” কি বললেন উনি?

” আপনার আব্বু মারা গেছেন প্রিয়তা।

প্রিয়তা থমকায়। থমকে যায় প্রিয়তার জগত। যন্ত্রণা শুরু হয় বুকে। হৃদস্পন্দন থামে। কম্পিত হয় মোলায়েম দেহ। চোখের পাতা এক হয় না প্রিয়তার। বাকরুদ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে। চোখে পানি জমে। জড়তা কাজ করে কণ্ঠে। কণ্ঠ পেঁচিয়ে আসে। নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকে প্রহরের দিকে। সময় নিয়ে কম্পিত স্বরে থেমে থেমে বলে,

” আব্বু নেই?

চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

#প্রিয়তার_প্রহর (২য় পরিচ্ছেদ)
পর্ব সংখ্যা (১৪ )

“মৃত্যু” এমন একটি শব্দ যা এক লহমায় বদলে দিতে পারে জীবনের বাঁক। আরিফ হোসাইনের মৃত্যুতে প্রিয়তার জীবনের বাঁক ওলটপালট হয়নি। কারন প্রিয়তা নিজের জীবনের সকল পথ নিজেই বেছে নিয়েছিল। তাই বুঝি হাউমাউ করে কাঁদছে না মেয়েটা। বাবার মৃত্যুতে কি শোকাহত হয়নি প্রিয়তা? জানতে চায় আশপাশের লোকজন। সে যে শোকে পাথর হয়েছে এ কথা কাকে বোঝাবে?

হাসপাতাল থেকে লাশ আনা হয়েছে আরিফের বাড়িতে। বাড়ির বাইরের বারান্দায় নামানো হয়েছে লাশ। জনসমাগমে ভরতি এই স্থানে প্রিয়তা এক জড় বস্তুর ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে অদূরে। কপোল বেয়ে রয়েছে নোনা পানির চিহ্ন। চোখের কাজল লেপ্টে গিয়েছে প্রিয়তার। মাথা ব্যথায় উশখুশ করছে সে। দীপা কেঁদে চলেছে স্বামীর পাশে বসে। হাউমাউ করে কান্না করছে মহিলা। প্রিয়তাকে এভাবে কাঁদতে না দেখে কিছু মানুষ গুঞ্জন তুলছে। মেয়ে কি তবে বাবাকে ভালোবাসে না? বাবা যতই খারাপ হোক, মেয়ের তো উচিত বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করা। প্রিয়তা করছে না কেন? প্রিয়তা সব শোনে। তবুও মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে। আরহাম মৃত্যু শব্দটা বুঝে। প্রচণ্ড কাঁদছে ছেলেটা। মিসেস নাবিলা বারংবার চেষ্টা করেও আরহামকে থামাতে পারছেন না। প্রিয়তাও ভাইয়ের কাছে ঘেঁষছে না। কাঁদুক ছেলেটা। বাবার মৃত্যুতে কাঁদুক। প্রহর আশপাশে কোনো কারণ ছাড়াই নজর বুলায়। এগিয়ে আসে লাশের দিকে। সাদা কাফনে জড়িয়ে রাখা লাশটা কেমন ভয়ঙ্কর লাগছে। প্রহরের ভয় নেই। লাশ দেখার ইচ্ছে জাগে তার। নরম স্বরে বলে,

” আমি শেষবার আঙ্কেলকে দেখতে চাই।

দীপার কান্না থামে। ঘনঘন পলক ফেলে মহিলা। চাহনি দৃঢ় হয় তার। চোখ ফিরিয়ে বলে,

” মৃত মানুষকে আর কি দেখবে? কবরের ব্যবস্থা করো গিয়ে। কোনো দায়িত্ববোধ নেই দেখছি। সরো সরো।

প্রহর সরে না। বসে পরে লাশের পাশে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। হঠাৎই হাতের আঙুল দ্বারা সরিয়ে দেয় সাদা কাপড়। কয়েক সেকেণ্ড যেতে না যেতেই দীপা রেগে আবারো মুখ ঢেকে দেয় আরিফের। রাগী স্বরে বলে,
” বললাম না কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করতে? কতক্ষণ লাশ এখানে থাকবে? যাও এখান থেকে। তোমাদের ডাকাই আমার ভুল হয়েছে।

প্রহর উঠে দাঁড়ায়। প্রিয়তার পাশে এসে দাঁড়ায়। প্রিয়তাকে লাশের কাছে আসতে না দেখে সুযোগ পেয়ে যায় দীপা। চেঁচিয়ে বলে ওঠে,
” বাপ মরে গেছে খুশি হয়েছো তো? খুব খুশি তাই না? সম্পত্তি সব পেয়ে গেছো। বাপকে আর কি দরকার?

প্রিয়তা এসব কথায় পাত্তা দেয় না। কিছুটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর ধীরে ধীরে এগোয় বাবার লাশের সামনে। প্রিয়তার চোখের পানি ঘাসে পরে। শুষ্ক লাগে চেহারা প্রিয়তার চেহারা। এলোমেলো অগছালো মেয়েটা বাবার লাশের পাশে বসে। চেঁচামেচি করে না প্রিয়তা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আরিফের মুখে হাত বুলায়। নির্মল, শান্ত অথচ গভীর কণ্ঠে বলে,

” তুমি উঠবে না আব্বু? আমি তোমাকে ক্ষমা করেছি। এবার প্লিজ উঠো। আমি চাইতাম তুমি অনুতপ্ত হও, নিজের ভুল বুঝতে পারো। বিশ্বাস করো কখনোই চাইনি তুমি এভাবে চলে যাও। কখনোই চাইনি তোমার কষ্ট হোক। এতদিন তবুও মনকে এই বলে সান্ত্বনা দিতাম যে তোমরা আছো, পৃথিবীর কোনো এক প্রান্তে বেশ সুখেই আছো। কিন্তু এখন? এখন নিজেকে কি বলে বোঝাবো? উঠো না।

উঠে না আরিফ, নড়েচড়ে না। শ্বাস না নেওয়া আরিফ মেঝেতে লুটিয়েই থাকে। প্রিয়তার হুঁশ ফিরে। বাবাকে উঠতে না দেখে উত্তেজিত হয় তার কায়া। বেশ সজোরে ঝাঁকায় মৃত শরীরটাকে। উত্তেজিত কণ্ঠে বলে,

” এই আব্বু। উঠো। বলেছি তো আর কখনো খারাপ ব্যবহার করবো না। আমি কান ধরছি। উঠো তুমি। আল্লাহ্, এমন মজা করে না আব্বু। দেখো সবাই কষ্ট পাচ্ছে।

প্রিয়তার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়। কপোল বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরে। রক্তিম হয় চোখ আর নাক। নাক টানে প্রিয়তা। হু হু করে কেঁদে উঠে। বাবার শীতল শরীরটাকে জড়িয়ে ধরে। কান্না করে খুব। বিরামহীন অশ্রুতে টইটম্বুর হয় চোখ। ফুঁপিয়ে ওঠে প্রিয়তা। ভুলে যায় দিক্বিদিক। চেঁচিয়ে দীপার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,

” আব্বু আপনাকে বিয়ে করেছিল সুখে থাকার আশায়। কেমন সুখ দিলেন আপনি? পাশে থাকতে পারেন নি? এত টেনশন করতে দিলেন কেন? কেন আব্বুকে প্রাণ হারাতে হলো হ্যাঁ?

দীপাও চেঁচিয়ে উঠে সমান তালে। বলে,
” বাপ তো মানো না ওরে। তোমার কথার ঝাঁঝেই মানুষটা চলে গেছে। বাবার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় তাও তো জানো না। কোনোদিন খোঁজ ও তো নাও নাই। এখন আব্বু আব্বু কইরা ঢং দেখাও? দেখাও যে বাপরে ভালোবাসো?

প্রিয়তা অধিক শোকে পাথর হয়। কাঁদতে কাঁদতে ফুলিয়ে ফেলে চোখ। মাথা ব্যথায় কুঁচকে উঠে ললাট। ভেতরের যন্ত্রণা কাবু করে প্রিয়তাকে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। যন্ত্রণায় হাঁসফাঁস করে প্রিয়তা। ছটফট করে। প্রহর এগিয়ে আসে নিকটে। প্রিয়তাকে আগলে ধরে। ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে,

” কষ্ট হচ্ছে প্রিয়তা? থামুন এবার।

প্রিয়তা থামে না। কেঁদে চলে। মস্তিষ্ক অগোছালো হয় প্রিয়তার। তাল হারিয়ে ফেলে। সবকিছু ঘোলাটে লাগে। পড়ে যেতে নেয় প্রিয়তা। চোখ বুজে আসে। ক্লান্ত স্বরে বলে,
” আমার শ্বা..শ্বাস নিতে ক..কষ্ট হচ্ছে প্রহর। দম বে..বেরিয়ে যাচ্ছে। বাঁচবো না বোধহয়। বাঁচবো না।

জ্ঞান হারায় প্রিয়তা। প্রহরের বুকে মাথা রেখে ঢলে পরে। আগলে নেয় প্রহর। নরম শরীরটাকে চেপে ধরে বক্ষে। ইহানকে কল করে। রাতে ঘুমোনোর পূর্বে এখানে আসার খবরটা ইহানকে জানিয়েছিল প্রহর। বলেছিল শপিং করেই ইহানের বাসায় যাবে। কিন্তু এখন যাওয়ার উপায় নেই। ফোন দিয়ে প্রহর বলল, ” প্রিয়তার আব্বু মারা গেছেন। প্রিয়তা অসুস্থ হয়ে পরেছেন। বিয়ে ক্যানসেল। এখানে গণ্ডগোল আছে বুঝলি? লাশ ভালো মতো দেখে নিবি। আমার সব ঠিকঠাক লাগছে না। প্রিয়তাদের বাড়িতে আয়। আমি প্রিয়তাকে নিয়ে আমার বাড়ি ফিরছি।

_______

সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর তানিয়াকে বিছানায় পায়নি ইহান। সারা বাড়ি খুঁজেও তানিয়ার অস্তিত্ব মেলেনি। ইলমা বেগম ঘুম থেকে দেরি করে উঠেছেন। তানিয়া কোথায় গেছে তা তিনি জানেন না। ইহান নিজ ঘরেই তানিয়ার বস্ত্র খোঁজে। সবই ঠিক আছে। এর মানে পোশাকাসাক নেয়নি। ইহান পুরো ঘরে নজর বুলায়। টেবিলের উপরে সাদা রঙের কাগজ পায়। সেখানে লেখা ছিল,

অপ্রিয় স্বামী,

বাবার কাছে ফিরে যাচ্ছি। আপনার মতো গোমড়ামুখো, অতি গম্ভীর, জেদি মানুষের সাথে সংসার করা আর পুতুলের সাথে খেলা করা একই কথা। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে আপনার ওই কোঁকড়ানো চুলগুলো ধরে নায়কদের মতো দশ ফিট দূরে ফেলে দিতে। অনুভূতিহীন মানুষের সাথে কি আর সংসার করা যায়? বাসায় এসে জোর করে কোলে তুলে না নিয়ে গেলে আর কখনোই ও বাড়ি ফিরবো না।

ইতি,
আপনার অবাধ্যগত বউ।

সকালের ঘটনা ভেবেই গম্ভীর হয় ইহান। প্রিয়তাদের বাড়ি যাবে এখন। সাথে মেয়েটা গেলে ভালো হয়। গণ্ডগোল থাকলে সাথে একজন দক্ষ লেডি পুলিশ নিলে কাজ সহজ হয়। ফোন করবে কি করবে না ভাবে ইহান। ইগোটাকে সরিয়ে কল করতে খুব মানে লাগে ইহানের। তবুও কাজের স্বার্থে ফোন করে ইহান। ফোন খানিকক্ষণ বাদে উঠায় তানিয়া। গম্ভীর স্বরে বলে,

” হ্যালো।

ইহানের মাঝে জড়তা কাজ করে। সর্বদা গম্ভীর থাকে সে। অনুভূতি প্রকাশ করতে দ্বিধায় পরে সবসময়। তানিয়াকে আসতে বলতে ভিষণ অসস্তি লাগে ইহানের। বললে নিশ্চয়ই তানিয়া হাসবে। কৌতুক স্বরে বলবে , ” কি? আমাকে ছেড়ে থাকতে পারলেন না তাই তো? তাহলে বলুন আমাকে ভালোবাসেন”।

গাম্ভীর্য বজায় রেখে ইহান বলে,
” প্রিয়তাদের বাসায় যেতে হবে। রেডি হয়ে তাড়াতাড়ি এসো।

” কেন? প্রিয়তার বাসায় কি কাজ?

” প্রহর আর প্রিয়তা এখানে ফিরেছে। আজ ওদের বিয়েও হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দুপুরেই প্রিয়তার বাবা মারা গেছে। প্রহর বললো ওখানে কিছু গণ্ডগোল আছে। মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়। তাই যেতে হবে।

তানিয়ার যেতে ইচ্ছে হয়। প্রিয়তা আর প্রহরকে একত্রে দেখার ইচ্ছে জাগে। অভিমান ভুলে শান্ত কণ্ঠে বলে,

” প্রিয়তার বাসায় দেখা হবে। আসছি।

_______

প্রিয়তার জ্ঞান ফিরেছে। আধশোয়া অবস্থায় বসেছে বিছানায়। মাথাটায় কেমন যন্ত্রণা হচ্ছে প্রিয়তার। সময়টা জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। পাশ ফিরে তাকিয়ে সময়টা দেখে নেয় সে। সন্ধ্যে হয়েছে। ঘড়ির কাঁটায় ছ টা উনত্রিশ বাজে। একটু শীত শীত লাগছে প্রিয়তার। ললাটে ভেজা কাপড়ের অস্তিত্ব টের পায়। জ্বর এসেছে তার? জলপট্টি দিয়েছে কেউ। চঞ্চল চোখে এদিক ওদিক তাকায় প্রিয়তা। মনে পরে মাঝ দুপুরের ঘটনা। সাথে সাথেই প্রিয়তা শব্দ করে কেঁদে ওঠে। শব্দের দাপটে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ফিরে প্রহর। প্রিয়তার পাশে এসে বসে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় সযত্নে। প্রিয়তার কান্নাকাটিতে বিচলিত না প্রহর। এটা যেন হবারই ছিল। শান্ত কণ্ঠে বলে,
” আবার কাঁদছেন?

প্রিয়তা ফুঁপিয়ে ওঠে। যন্ত্রণায় কাবু হয়ে থাকে। ঘনঘন শ্বাস ফেলে প্রিয়তা। আকাশ সম ব্যথায় নেতিয়ে থাকে। কম্পিত কণ্ঠে বলে,

” আমার জীবনে কান্না ব্যতিত আর কি আছে হুহ? ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কান্না করা ছাড়া আর কি পারি আমি? আমার কারণেই আব্বু চলে গেছে। আমি একটু বেশিই রিয়্যাক্ট করে ফেলেছি। একটু ভালো ব্যবহার চেয়েছিল আব্বু। আমি দিতে পারিনি।

” আপনি দোষী নন প্রিয়তা। আপনি আপনার দিক থেকে ঠিক। উনি দোষ করেছেন, যার ফলস্বরূপ আপনি দুরত্ব বাড়িয়েছেন। আপনি তো কখনো চাননি আঙ্কেল চলে যাক দুনিয়া ছেড়ে। কখনো অভিশাপ দেননি। এটা উনার ভাগ্যে ছিল প্রিয়তা। আল্লাহ্ ব্যতিত কেউ ভাগ্য বদলাতে পারে না। তাই এত অনুশোচনা করবেন না।

” আব্বু কি আমাকে ক্ষমা করবে?

প্রহর কিছু বলে না। চুপ থাকে। পাশে বসে প্রিয়তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। সময় গড়ায়। সন্ধ্যে সাতটা বাজে। প্রিয়তার কান্নার পরিমাণ কমে। চুপ হয়ে যায়। নির্বাক দৃষ্টিতে কেবল তাকিয়ে থাকে। প্রহরের দিকে তাকিয়ে প্রাণহীন কণ্ঠে বলে,

” লাশ কোথায়?

” উনার দাফন শেষ হয়েছে। আপনি ঘুমোচ্ছিলেন। দীপা আন্টি দেরি করতে চাননি।

আবার ও নিস্তব্ধ হয় ঘরটি। ছুটে আসে আরহাম। প্রিয়তাকে জড়িয়ে ধরে ছোট্ট বুকে। ছেলেটার চোখে পানি। প্রিয়তাকে জেগে উঠতে দেখে চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে,

” আপু তোমার খুব জ্বর। কত্তক্ষণ ঘুমোলে তুমি। আব্বুকে শুইয়ে দেওয়া হলো তুমি দেখলে না।

গভীর নয়নে ভাইয়ের দিকে তাকায় প্রিয়তা। আরহামের জীবনে ওর বাবা-মায়ের ভূমিকা এত ঠুনকো কেন? আরিফ হোসাইন চলে গেল। রেখে গেল নিষ্পাপ এক ছেলেকে। এই ছেলেটার বাবার নামের পাশে মরহুম শব্দটি উচ্চারিত হবে। এতিম বলে সম্বোধন করবে ছেলেটাকে। না মেনে নিতে পারে না প্রিয়তা। চেষ্টা করবে ভাইকে সর্বোচ্চ সুখী রাখার। জড়িয়ে নেয় আরহামকে। বলে,

” তুমি তো দেখেছো।

” হ্যাঁ। আব্বুকে সাদা কাপড়ে জড়িয়ে মাটিতে পুঁতে রাখা হলো জানো? আব্বু শব্দ করলো না। আব্বু তো মরে গেছে তাইনা?

কেঁদে ফেলে আরহাম। প্রিয়তা বলে,

” নিধি আপুর কাছে যাও আরহাম। তোমার প্রহর ভাইয়ার সাথে আমার কিছু কথা আছে।

চোখ মুছে চলে যায় আরহাম। প্রিয়তা উঠে বসে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখে প্রহরকে। ঠোঁটের কোণে মৃদ্যু হাসি ফোঁটে। স্বাভাবিক স্বরে বলে,

” আজ আমাদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। তাইনা?

প্রহর মুচকি হাসে। বলে,

” হুহ্। ছিলো।

প্রিয়তা চুপ থাকে। লজ্জায় মাথা নত করে বলে,

” আমি চাই আজই বিয়েটা হোক।

” আপনি আগে সুস্থ হন প্রিয়তা। এসব পরে ভাবা যাবে।

” উঁহু। আজই বিয়ে হবে। আমি ঠিক আছি।

অবাক হয় প্রহর। প্রিয়তার এহেন কথায় বিস্ময় চেপে ধরে তাকে। অবিশ্বাসের সাথে অস্ফুটে বলে,

” প্রিয়তা।

সম্মোহনী চোখে তাকায় প্রিয়তা। লজ্জায় রক্তিম হয় মুখ। হৃদস্পন্দন থামে। নত মুখে বলে,
” আপনাকে ভিষণ প্রয়োজন আমার প্রহর। আপনার বুকে মাথা রেখে নির্ঘুম রাত্রি পাড়ি দিতে চাই। আপনার দেহে আবৃত থাকতে চাই বৈধ ভাবে। চুমু খেতে চাই আপনার প্রশস্ত বুকে। আমার সুখ চাই প্রহর। এই দুঃখের সাগরে আপনিই একমাত্র সুখের দিশা। আপনি কাছে থাকলে আমার সুখ সুখ লাগে। পুরো পৃথিবীকে অনবদ্য লাগে।

প্রহর খুশিতে আত্মহারা হয়। বোঝাতে পারে না অনুভূতি। গাঢ় হাসি ফুটে উঠে চোখে। দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে হয় প্রহরের। রম্যতার কণ্ঠে বলে,

” আপনি খুব দুষ্টু হয়ে গিয়েছেন প্রিয়তা। এত দুষ্টু না হলেও চলতো।

একই ভাবে হাসে প্রিয়তা। ফিসফিস করে বলে,

” শারিরীক নয়, মানসিক সুখের জন্য হলেও আপনাকে আমার চাই। ভিষণ ভাবে চাই।

________

রাত হয়েছে। মেঘের আড়ালে লুকিয়েছে চাঁদ। ইহান, তানিয়া, প্রহরের বাড়ির মানুষ জন, প্রিয়তা আর আরহাম ব্যতিত বাড়িটায় আর কেউ নেই। কাজী এসেছে মাত্র। বয়স্ক লোকটার পরণে ধবধবে সাদা পায়জামা আর পাঞ্জাবি। বড় বড় দাঁড়ি রেখেছেন। মাথায় টুপি পড়ে বসে আছেন বারান্দায়। বিদ্যুত চমকাচ্ছে। অন্ধকার আকাশে বাজ পড়ার কারণে ঝলমল আকাশ করে উঠছে মাঝে মাঝে। কাজী তাড়া দিলেন। প্রিয়তাকে সাজিয়ে আনা হলো বারান্দায়। মেয়েটার পরণে গাঢ় খয়েরি রঙের শাড়ি। কোনোরকম প্রসাধনী নেই মুখে। গলায় সোনার চেইন আর কানে দুল। চোখের নিচে গাঢ় কাজল দিয়েছে প্রিয়তা। চুলের খোঁপা আগলা রয়েছে। ফোলা ফোলা চোখমুখে বারান্দায় আসে প্রিয়তা। মাথার ঘোমটা টেনে আনে ললাটে। নত মুখে বসে সোফায়। খানিকক্ষণ বাদে প্রহরকে আনা হয় বারান্দায়। প্রিয়তা তাকায় না সেদিকে। প্রহরের নজর পরে প্রিয়তার নত মুখে। মুচকি হাসে ছেলেটা। প্রিয়তমা স্ত্রীকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর নারী হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রহর। প্রশান্তিতে ছেয়ে যায় হৃদয়। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে প্রিয়তার পানে। নজর সরে না এক রত্তি। কাজী দোয়া-দুরূদ পড়েন। খানিকক্ষণ বাদে কবুল বলার জন্য অনুরোধ করেন। প্রহর সময় নেয় না। পরপর তিনবার কবুল বলে সাইন করে কাগজে। প্রিয়তাকে কবুল বলতে বলায় কাঁপে না প্রিয়তার কণ্ঠ। বেশি সময় নেয় না। কবুল বলে বেশ অনায়াসে। সাইন করে কাগজে। সকলেই উচ্চস্বরে “আলহামদুলিল্লাহ্” বলে চেঁচিয়ে ওঠে। কাজী যেতেই প্রহর দ্রুত পাশে এসে বসে প্রিয়তার। প্রিয়তার কানের কাছে মুখ রেখে নিচু কণ্ঠে বলে,
” প্রিয়তমা, আমার সব সুখ আপনার হোক। আপনার জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত হোক প্রহরময়।

প্রিয়তা লাজুক হাসে। নত মুখ আরো নত হয়ে আসে। লজ্জায় মূর্ছা যায় মেয়েটা। হাঁসফাঁস করে। ইশশ প্রিয় মানুষের কণ্ঠে এত মাদকতা কেন?

_____

বৃষ্টি পড়ছে। ঝমঝম বর্ষণের শব্দ ঝংকার তুলছে। প্রহরদের বাড়ি থেকে ফেরার সময় এসেছে। খেয়েদেয়ে মিষ্টি মুখ করে বাইরে বেরিয়েছে ইহান আর তানিয়া। একই সময়ে বেরিয়েছে বলে বিরক্ত হলো তানিয়া। ঘড়িতে সময়টা দেখে নিল। এগারোটা বেজে সতেরো মিনিট। গাড়িঘোড়া নেই তেমন। ছাতার নিচে থেকেও ভিজে যাচ্ছে তানিয়া। পায়ের নিচের শাড়ির অংশ ভিজে একাকার। বৃষ্টি থামার নামগন্ধ নেই। ইহান গাড়িতে ওঠে। গাড়ি স্টার্ট দেয় না। বসেই থাকে গম্ভীর ভাবে। বেশিক্ষণ থাকতে পারে না চুপচাপ। উচ্চস্বরে বলে,

” উঠে বসো তানিয়া।

তানিয়া ছাতা সহ এগিয়ে আসে গাড়ির জানালার কাছে। গাড়ির ভিতরে থাকা মানুষটার উদ্দেশ্যে বলে,

” আপনার সাথে যাবো না। ফ্লার্ট করতে চাইছেন? আমি কিন্তু বিবাহিত।

ঠোঁট বাঁকিয়ে কথাটুকু বলে তানিয়া। তানিয়ার এমন অহেতুক কথাবার্তায় বিরক্ত হয় ইহান। ললাটে ভাঁজ পরে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

” বাজে বকো না। উঠে বসো। বাড়ি চলো। আম্মা তোমার অপেক্ষায় আছে।

” আন্টিকে বলে দিবেন, তার অমন জেদি ছেলের সাথে আমি সংসার করতে পারবো না।

” আমার জেদ তুমি দেখোইনি তানি। রাগ বাড়িয়ো না।

তানিয়া শোনে না। এক হাতে ছাতা ধরে অপর হাতে শাড়ির কুঁচি গুলো উঁচু করে ধরে। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় সম্মুখে। বৃষ্টির বেগ বাড়ে। ইহান নামে গাড়ি থেকে। ছাতা নিয়ে হেঁটে চলে তানিয়ার পিছু পিছু। তানিয়া তা দেখে হাসে। হাঁটার গতি বদলে দৌড়ায় তানিয়া। রাস্তায় জমে থাকা পানির তোয়াক্কা করে না। ছুটে চলে নিজের মতো। ছাতাটাও ছুঁড়ে মারে। তানিয়ার দৌড় দেখে ইহান ও দৌড়ায়। ফাঁকা পাকা রাস্তায় দুজন মানব মানবী দৌড়াতে থাকে নিজের খেয়ালে। সপসপ শব্দ করে পানি ছিটে যায় সবখানে। ধরা পরে তানিয়া। তানিয়ার শাড়ির আঁচল টেনে ধরে ইহান। থামে তানিয়া। ইহানের নিকটে আসে। ইহানের হাতে থাকা বন্ধ ছাতাটা ফেলে দেয়। বাতাসে বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে পরে ছাতা। খিলখিলিয়ে হাসে তানিয়া। বলে,

” আপনাকে এভাবে দৌড়াতে দেখতে দারুন লেগেছে। পুরোই সিনেমা।

ইহানের রাগ বাড়ে। শাড়ির আঁচল টেনে ধরে শক্তি দিয়ে। গাড়ির দিকে ফিরে যেতে চায়। রাগী কণ্ঠে বলে,

” খুব অবাধ্য হচ্ছো তানিয়া। এত অহেতুক বকবক করা আমার পছন্দ নয়।

” আমাকে তো পছন্দ।

থতমত খায় ইহান। চোখ নামায়। দুজনেই ভিজে গেছে। কাপড় থেকে পানি পরছে এক নাগাড়ে। ইহানের কোঁকড়া চুল ভিজে একাকার। তানিয়ার চুল থেকে পানি পড়ছে। তানিয়া ইহানের পাশে পাশে হাঁটে। পুনরায় বলে,
” বলুন। আমাকে পছন্দ নয়?

” তোমাকে আমি ঠিক কতটা পছন্দ করি তা তুমি কখনো বুঝতে পারবে না। অপ্রকাশিত ভালোবাসা সবচেয়ে সুন্দর।

” কিন্তু আপনাকে প্রকাশ করতে হবে। নইলে আমি ফিরবো না।

একটি অটো আসে। ততক্ষণাৎ অটোটাকে থামায় তানিয়া। উঠে বসে অটোতে। চলতে থাকে অটো। ইহান দাঁড়িয়ে থাকে রাস্তায়। তানিয়া অটো উধাও হবার পৃর্বে চেঁচিয়ে বলে,

” চিঠিতে যা লেখা ছিল তা না করলে কখনোই আপনার বাড়িতে ফিরবো না। আপনি যদি জেদি হন তো আমিও আপনার বউ। সবসময় এক কাঠি উপরে।

চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

প্রিয়তার প্রহর ২ পর্ব-১২

0

#প্রিয়তার_প্রহর (২য় পরিচ্ছেদ)
পর্ব সংখ্যা (১২ )

রাত নয়টা বেজে আঠারো মিনিট। অন্ধকারে নিমজ্জিত শহর। শাই শাই করে ছুটে চলেছে বাস। বাসের একদম সামনে এলইডি টিভি লাগানো। বাংলা ছবি চলছে সেখানে। প্রিয়তার সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। বাসের জানালা দিয়ে ব্যস্ত নগরী দেখতে ভালো লাগছে তার। মন খারাপের এই সময়ে অন্ধকার শহর দেখতে জমকালো লাগছে। প্রিয়তার কোলে বসে আছে আরহাম। ঘুমোচ্ছে ছেলেটা। বাসে উঠলেই ছেলেটার নাকি ঘুম পায়। ফোস ফোস করে শ্বাস ছাড়ছে সে। প্রিয়তার ডান পাশে বসে আছে প্রহর। আঁখি যুগল প্রিয়তাতে নিবদ্ধ। প্রিয়তা মেয়েটার চোখেমুখে একরাশ মায়া। তাকালেই কেমন ঘোর লেগে যায়। অনন্তকাল তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয় মেয়েটার দিকে। অত্যন্ত সুন্দর এই পুষ্পের মন খারাপ আজ। বাবার এহেন অসুস্থতায় মেয়েটা মিইয়ে গেছে। বুঝতে দিতে চাইছে না মন খারাপের দিক। কিন্তু প্রহর কি অবুঝ? সে খুব ভালোভাবেই বুঝে প্রিয়তার ভালো লাগা, খারাপ লাগা। আরহামের মাথায় হাত বুলিয়ে প্রহর প্রিয়তার উদ্দেশ্যে বলে,

” কিছু খাবেন?

প্রিয়তা এক পলক তাকায় প্রহরের পানে। ছেলেটার চিন্তিত কণ্ঠস্বর সে স্পষ্ট বুঝতে পারে। বলে,

‘ উঁহু। খাবো না কিছু।

” শরীর খারাপ লাগছে? লেবু পাতা আর আচার এনেছি কিন্তু।

” লাগবে না।

প্রহর আরহামকে প্রিয়তার কোল থেকে নিয়ে নিজের কোলে বসায়। প্রিয়তার দু হাত নিজের হাতের মুঠোয় জড়িয়ে নেয়। প্রিয়তা আবেগাপ্লুত হয়। কণ্ঠ জোরাল হয় মেয়েটার। কাঁপা কাপা কণ্ঠে বলে ওঠে,
” আব্বু সুস্থ হয়ে উঠবে তো?

” আগে আমরা ওখানে যাই। গিয়ে দেখি উনি কেমন আছেন। দেখলে বুঝতে পারবো উনি সুস্থ হবেন কিনা। আপনাকে আমি কোনোরুপ মিথ্যে সান্ত্বনা দিতে চাই না প্রিয়তা।

____

না বলেকয়ে ইহানের আগেই থানা থেকে ফিরেছে তানিয়া। বাড়ি ফিরে চুপচাপ শুয়ে আছে সে। ইহানের ঘরে নয় বরং শাশুড়ির ঘরে শুয়ে আছে মুখ ফুলিয়ে। ইলমা বেগম তানিয়ার পাশে বসে তাসবিহ্ পাঠ করছেন। বেশ ভালোমতোই জ্বর এসেছে উনার। চোখের পাতা খুলে রাখতে পারছেন না। তবুও আড়চোখে তাকাচ্ছেন তানিয়ার দিকে। ছেলের বউয়ের এমন মলিনতা মেনে নিতে পারলেন না তিনি। এমন চুপচাপ থাকার স্বভাব যে তানিয়ার নেই তা তিনি ইতিমধ্যে বুঝে গিয়েছেন। বন্ধুসূলভ ভঙ্গিতে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,

” ইহান বকেছে?

তানিয়া পাশ ফিরে তাকায় শাশুড়ির দিকে। মুখ ফিরিয়ে পুনরায় শুয়ে থাকে। একটু সময় নিয়ে বলে ওঠে,

” উনার বকাবকির ধার ধারি আমি?

” তাহলে মুখ ফুলিয়ে আছো কেন? এভাবে কিন্তু তোমাকে মানাচ্ছে না।

” উনি খুব বদমাইশ। আমাকে শুধু শুধু ধমকায়। আমি উনার সাথে কথা বলবো না আর।

হাসেন ইলমা বেগম। ইহানের কণ্ঠস্বর শুনতে পান। বেরিয়ে আসেন বাইরে। ইহানের ঘর্মাক্ত শরীর দেখে বলেন,

” এসি বা ফ্যান ছেড়ে ঘরে বোস।

ইহান আশপাশে চোখ বুলায়। মাথার ক্যাপ খুলে বলে,

” ক্ষুধা লেগেছে আম্মা। লাঞ্চে কিছু খাইনি।

” আমি খাবার দিচ্ছি।

ইহান বিরোধিতা করে। বলে,
” তানিয়াকে পাঠাও আম্মা। তুমি শুয়ে থাকো। তোমার শরীর ভালো নেই। রেস্ট করো।

ইহান ঘরে পৌঁছায়। হাত ঘড়ি খুলে রাখে ড্রেসিংটেবিলে। ইউনিফর্ম খুলে ঢিলেঢালা গেঞ্জি পরে নেয়। দরজার দিকে পুনরায় দৃষ্টি ফেলে। হাঁক ছাড়ে ইহান। তানিয়া ট্রে নিয়ে ঘরে আসে। মেয়েটার মুখ মলিন। অভিমানে জুবুথুবু হয়ে আছে। প্রাপ্তবয়স্ক মনে নানা রকমের দ্বন্দ্ব। ট্রে তে থাকা খাবারটা বিছানায় রেখেই ঘর থেকে চলে আসতে চায় তানিয়া । বাঁধা দেয় ইহান। বলে,

” খাবার দিয়ে চলে যাওয়া কোন ধরনের অভদ্রতা তানিয়া? যতক্ষণ না খাওয়া হচ্ছে ততক্ষণ পাশে বসে থাকবে। কখন কি লাগবে জানতে চাইবে। এখন এটাও বলে দিতে হবে তোমাকে?

তানিয়ার নত মুখ উঁচু হয়। অপমানে থমথম হয় মুখমণ্ডল। কারো সামনে খাবার দিয়ে চলে যাওয়া উচিত নয়। এটা তানিয়ার মা ও বলতেন। উনি বলতেন “কাউকে খাবার দিয়ে কখনো দূরে চলে যাবি না। তাহলে খাবার দেওয়া ব্যক্তিকে অসম্মান করা হবে। সম্ভবত কুকুরকে খাবার দেওয়ার পর কোনো মানুষই কুকুরের সম্মুখে বসে থাকে না। আমরা মানুষরা কুকুরকে কোনরকমে খাবার দিয়েই সেখান থেকে চলে আসি। তাই কারো সামনে খাবার দিয়ে চলে গেলে সে নিজেকে কুকুরের ন্যায় মনে করে”। অভিমানে নত হওয়া তানিয়ার এ কথা মাথায় আসেনি। রাগের বশে ইহানের থেকে দূরে দূরে থাকার পণ করেছে সে। মনে থাকলে কখনোই এমনটা করতো না তানিয়া। ইহানের এমন আচরণে ভেঙে খান খান হলো মেয়েটার নরম সত্তা। শব্দ করলো না কোনো। বসে রইল খাটের এক কোণে। ইহান খেতে বসল। আড়চোখে তাকাল তানিয়ার দিকে। বলল,

” মুখ এমন করে রেখেছো কেন?

তানিয়ার উত্তর দিতে ইচ্ছে হয় না। মলিন মুখেই বলে ওঠে,

” আমার মুখটাই অমন। কোনো সমস্যা?

শেষের বাক্যটুকু বলতে গিয়ে তানিয়ার রাগের পরিমাণ বাড়ল। কণ্ঠে রাগ প্রকাশ পেল তার। ইহান বুঝল বিষয়টা। বলল,

” আবিরের সাথে দেখা করতে দিইনি বলে এত রাগ?

তানিয়া জবাব দেয় না। তানিয়ার এমন ফ্যাকাশে মুখশ্রী সহ্য হয় না ইহানের। বিরক্ত হয় খানিক। খাবার খাওয়ার ইচ্ছে মরে যায়। ভাতে পানি ঢেলে দেয় ইহান। তানিয়ার চাহনি গাঢ় হয়। ভ্রু কুঁচকে ফেলে সে। বিস্ময়ে ফেটে পড়ে। বলে,

” পানি ঢাললেন কেন? খাবেন না?

ইহান ঢকঢক করে পানি পান করে। খালি গ্লাসটা রেখে বলে,

” না। ইচ্ছে নেই।

” তো আন্টিকে বললেন কেন ক্ষুধা লেগেছে?

ইহান হাত বাড়িয়ে তানিয়াকে কাছে টানে। ভড়কে যায় তানিয়া। হতবাক চোখে তাকায় স্বামীর পানে। সলজ্জ চোখে অভিমান কেটে লজ্জার রেশ দেখা দেয়। ইহান ক্রূর হাসে। বলে,

” আবিরকে আমার সহ্য হয় না তানিয়া। তাই দেখা করতে দিইনি।

তানিয়া বাঁকা হাসে। ঘাড় ফেরায় সে। তাকায় না ইহানের দিকে। আবিরের সাথে দেখা করার ইচ্ছে তানিয়ার ছিল না। এমনকি দেখা করতে পারেনি বলে তানিয়া বেশ খুশি হয়েছে। কিন্তু তবুও ইহানের দিকে অভিমানী চোখে তাকাতে ইচ্ছে হচ্ছে তানিয়ার। কেন যেন ইহানের সামনে অভিমানে করতে বেশ ভালোও লাগছে। মন চাইছে ইহান তাকে প্রাধান্য দিক। তার মন খারাপ দূর করার চেষ্টা করুক। অন্যদিকে ঘুরে উঠে দাঁড়াল তানিয়া। ড্রেসিংটেবিলের সামনে এসে আয়নায় ইহানকে দেখল সে। ঠোঁট চেপে ধরে বলে,

” যদি বলি দেখা করতে দেননি বলে আপনার উপর রাগ করিনি? তাহলে?

” তাহলে রাগ করার কারণ বলবে।

” আমায় মিথ্যে বলেছেন সেজন্য রাগ করেছি। আমার সাথে লুকোচুরি খেলেছেন তাই রাগ করেছি, আমার থেকে সত্য আড়াল করেছেন তাই রাগ করেছি। এখন? আর কিছু শুনতে চান?

” মিথ্যে বলেছি আমি?

” হ্যাঁ বলেছেন। গত এক বছর ধরেই বলে চলেছেন। আর কত অভিনয় করবেন ইহান?

ইহান থমকায়। তানিয়া কিসের কথা বলছে বুঝতে পারছে না সে। তানিয়ার কণ্ঠে ক্রোধ। কেমন অদ্ভুত হিংস্র চাহনির সম্মুখে পড়ে নাজেহাল হয় ইহান। জিভ দ্বারা ওষ্ঠাদ্বয় ভিজিয়ে বলে,

” অভিনয়?

” পুলিশের ট্রেনিং নেওয়ার সময় থেকে আপনি আমাকে ভালোবাসেন। অথচ আমাকে এসব ঘুণাক্ষরেও টের পেতে দেননি। আমায় জানাননি। কেন? আমি ভেবেছিলাম আমাদের বিয়েটা হয়েছিল অনাকাঙ্খিত ভাবে। আপনি আমি দুজনেই ছিলাম পরিস্থিতির শিকার। কিন্তু না। এর পেছনে তো ছিলেন আপনি। আপনি আমাকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করে বিয়েতে রাজি করিয়েছেন। নিজেও রাজি ছিলেন। সবাইকে রাজি করিয়েছেন আপনি।

ইহান স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই শোনে তানিয়ার সব কথা। বলে,

” কে বলেছে তোমাকে?

” আমাকে আপনার অবুঝ বলে মনে হয় ইহান? আপনি অতটাও অসহায় মানুষ নন যে আন্টির চাপে পড়ে আপনি বিয়েতে অনিচ্ছা থাকা সত্বেও রাজি হবেন। আন্টি সবটা বলেছে আমাকে, আবিরও বলেছে। আর কিছুটা আমি আন্দাজ করেছিলাম। আপনার উপর খুব রাগ ছিল আমার। ভেবেছিলাম আপনার পছন্দের শার্ট প্যান্ট কেটে কুচি কুচি করে ফেলবো। প্যান্ট হাতে নিলাম। পকেট থেকে খচখচ আওয়াজ হলো। বের করে দেখলাম আমার পুরোনো ছবি। সাথে আমাকে নিয়ে লেখা চিঠি। এত কিছুর পর আপনি অস্বীকার করছেন যে আপনি মিথ্যে বলেননি? সারা রাত জেগে আমাকে দেখেন, আমার মাথায় হাত বুলান, হাতে চুমু খান। কি ভাবেন এসব আমি উপলব্ধি করতে পারিনি?

ইহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মেয়েটা খুব চতুর। মাত্র কয়েকদিন এ ঘরে থেকেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তার অজানা তথ্য বের করে ফেলেছে। এতগুলো কথার পরিপ্রেক্ষিতে কি বলা উচিত ভেবে পায় না ইহান। বলে,

” ভালোবাসা প্রচণ্ড যন্ত্রণার হয়, জানো তানিয়া? এই যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে গিয়ে আমি বহুবার নিজেকে নিজে শাসিয়েছি। আঘাত করেছি নিজেকে। যখন তুমি ট্রেনিংয়ে ছিলে তখন তোমার চাকরি নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। টিকতে পারোনি প্রথমবার। মিইয়ে গিয়েছিলে তাই। বন্দি হয়ে গিয়েছিলে ঘরে। কান্নাকাটি করে গুটিয়ে নিয়েছিলে নিজেকে। সেসময় এসব বলার মতো পরিস্থিতি ছিল না। চুপ করে ছিলাম। তুমি চাকরি পাওয়ার পর ভেবেছিলাম তোমাকে সবটা জানাবো। কিন্তু বলবো বলবো করেও বলা হয়নি। তুমি আমাকে চেনো তানিয়া। অনুভূতি প্রকাশে আমি অক্ষম। কেমন অদ্ভুত লাগছিল নিজেকে। কিভাবে কি বলবো বুঝতে পারিনি। কি বলতে কি বলে ফেলবো এ ভয়ে বলাই হয়নি। এরপর যখন বলার সময় এলো, তুমি তখন সবটা গুছিয়ে নিলে, দেখতে পেলাম তোমার পাশে অন্য একটি মুখ। অন্য কারো বউ হবার ইচ্ছে তোমার চোখমুখে। ফিরে এসেছি। দমিয়েছি নিজেকে।

তানিয়ার বিস্ময় আকাশ ছোঁয়। ইহানের মতো মানুষ ভালোবাসতে পারে? অনুভূতি নামক বিষয়টি তার মধ্যে আছে? একজন নারীকে নিয়ে একান্তভাবে ভাবতে পারে ইহান? কই, কখনো তো বুঝতে দেয়নি তাকে। এমন ব্যবহার ও করেনি যাতে তানিয়া ধরে ফেলে। সবসময় রোবটের মতো থেকেছে লোকটা। ধমকে ধামকে রেখেছে তাকে। অথচ মনে মনে এসব বয়ে বেড়াতো ইহান? তানিয়ার হুট করেই রাগ বেড়ে যায়। জামাকাপড় বের করে আলমিরা থেকে। তেজী স্বরে বলে,

” চলে যাচ্ছি বাবার বাড়ি।

ইহান মুচকি হাসে। বলে না কিছু। তানিয়া পিছু ফিরে তাকায়। ইহানের মুখ থেকে কিছু শুনতে চায়। ইহান বুঝতে পেরে বলে,

” সকালে যেও।

” আর কখখনো ফিরবো না এ বাড়িতে। একেবারের জন্য চলে যাবো। কথাটুকু বলেই তানিয়া লাগেজ খুলে বসে। রাগ দেখিয়ে ভাঁজ করে ছুঁড়ে ফেলে শাড়িসমূহ।

” আম্মা জানে?

” জানেন।

” আচ্ছা।

তানিয়া ঘাড় বাঁকায়। ইহানের হেলদোল না দেখে অবাক হয়। এই লোকটা তাকে ভালোবাসে? কই কথাবার্তায় তো বোঝা যায় না। এইযে সে চলে যেতে চাইছে, আটকানোর চেষ্টাও তো করতে পারতো ইহান। করলো না তো। তানিয়ার রাগ বাড়ে। ক্রোধে ফেটে পড়ে। ঝাঝাল স্বরে বলে,

” জিজ্ঞেস করবেন না কেন চলে যাচ্ছি?

” ইচ্ছে হয়েছে তাই যাচ্ছো। প্রশ্ন করবো কেন?

” আটকাবেন না?

” না।

তানিয়া ফোঁস করে শ্বাস ফেলে। তার রাগ দেখানোই বৃথা। হুট করে এমন করার কারণ নিজেও ধরতে পারল না তানিয়া। ক্রোধে চোখ থেকে চশমাটা মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে তানিয়া। ইহান অবাক হয়। এগিয়ে আসে সম্মুখে। প্রশ্ন করে,
” চশমা ভাঙলে কেন?

তানিয়া উত্তর দেয় না। সামনের প্রতিবিম্ব ঘোলাটে লাগে। দেখতে পায় না কিচ্ছু। হাতরে ইহানকে পায় কাছে। জড়িয়ে ধরে ইহানের বাহু। বলে,

” ইচ্ছে হয়েছে, তাই ভেঙেছি।

” অদ্ভুত ইচ্ছে।

তানিয়া দূরে সরে। এগুতে পারে না। মেঝেতে থাকা টুলের সাথে ধাক্কা খেয়ে আছড়ে পরে মেঝেতে। মাথা ঠুকে মেঝেতে। ধপাস শব্দ হয় ঘরটায়। ব্যথায় কুকিয়ে উঠে তানিয়া। আহ্ জাতীয় শব্দ বেরোয় মুখ থেকে। ইহান ব্যতিব্যস্ত হয়। দ্রুত তানিয়ার হাত ধরে। বিচলিত ছেলেটার চিন্তা হয় ভিষণ। ভয়ার্ত হয় চেহারা। প্রিয় মানুষের আর্তনাদে বুকে হাতুরি পেটানোর ন্যায় বিস্ফোরণ হয়। তানিয়ার কোমরে হাত রাখে। চিন্তিত কণ্ঠে বলে,

” তানু! সাবধানে হাঁটতে পারো না? ইশশ।

তানিয়া গুঙিয়ে ওঠে। ললাটের কোণা ফুলে ওঠে। ওঠার চেষ্টা করে নিজের বলে। ইহানের শীতল হাত কোমরে পড়তেই চেঁচিয়ে ওঠে তানিয়া। রাগী স্বরে বলে,

“ধরবেন না আমায়। ছাড়ুন।

ইহান ছাড়ে না। হাতের বল প্রবল হয়। পাঁজোকোলে তুলে নেয় তানিয়াকে। ধীরে সুস্থে নামিয়ে দেয় বিছানায়। ললাটের ব্যথা বুঝতে পারে। তানিয়ার চোখ ঘোলাটে হয়। প্রচণ্ড আফসোসের সুরে বলে,

” চশমা না পড়লে কিচ্ছু দেখতে পারি না। ধ্যাত।

” আর কোথায় আঘাত পেয়েছো? দেখাও আমায়।

পিঠের মাঝ বরাবর ব্যথা পেয়েছে তানিয়া। কি করে বলবে ইহানকে? ইলমা বেগম ঘুমিয়েছেন। এখন কে মালিশ করে দিবে তাকে? ইহান যদি মালিশ করতে চায়? উঁহু। এত লজ্জা তানিয়া নিতে পারবে না। মাথায় হাত রেখে তানিয়া বলে,

” আর কোথাও না। কোথাও না।

ইহান হাসে। মলম লাগিয়ে দেয় কপালে। চুমু খায় মেয়েটার কানের লতিতে। শিরশির করে ওঠে তানিয়ার দেহ। লজ্জায় রাঙা হয় মুহূর্তেই। শিরা উপশিরা বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়। চেপে ধরে ইহানের হাত। রাগ দেখিয়েও দেখাতে পারে না। বৈধ সম্পর্কের টানে বোধহয় জড়তাও হারায়।

_______

রাত সাড়ে দশটার দিকে নিজ শহরে ফিরে প্রিয়তারা। নিজ এলাকায় এসে প্রিয়তা আনন্দিত হয়। মুক্ত বাতাসে ঘন ঘন শ্বাস নেয়। আরহামের ঘুম উড়ে গেছে। নিজ শহরে ফিরে ছেলেটার খুশি উপচে পড়ছে। প্রহর আরহামের হাত ধরে এগোয় হাসপাতালের দিকে। সদরের বড় হাসপাতাল এটা। হাসপাতালের চারদিকে সাদা ইউনিফর্ম পরে নার্স আর ডক্টররা ঘুরাঘুরি করছে। মানুষজনে ভরতি এই হাসপাতালে কোথাও একটা শূন্যতা। প্রিয়তার মন খারাপ হয়। নির্দিষ্ট কক্ষে পৌঁছে প্রিয়তা এগুতে পারে না। থমকে যায় সে। প্রহর আশস্ত করে তাকে। আরহামের হাত মুঠোয় নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে প্রিয়তা। ফিনাইলের গন্ধে গা গুলিয়ে আসে তার। প্রহর বাইরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। কক্ষের সাদা বিছানায় শুয়ে আছে মধ্য বয়স্ক লোক। অক্সিজেন মাক্স দিয়ে মুখের অর্ধাংশ ঢাকা। প্রিয়তার বাবার মুখ চিনতে অসুবিধে হয় না। পাশেই চেয়ারে বসে থাকা মহিলাকে দেখে জ্বলে ওঠে তার গা। সর্বাঙ্গে ভয়াবহ রাগ ঝেঁকে বসে। পাত্তা না দিয়ে এগিয়ে আসে ছোট বিছানার সামনে। আরহাম উত্তেজিত কণ্ঠে ডেকে ফেলে।

” আব্বু।

আরিফ ততক্ষণাৎ চোখ মেলে। পাশেই নিজের ছেলেকে দেখে উত্তেজিত হয় আরিফ। অক্সিজেন মাক্স খুলে ফেলে দ্রুত। আরহামকে কাছে ডাকে। মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে,

” কেমন আছো বাবা?

প্রিয়তা আরিফের চোখের কোণে জমা অশ্রুধারা খেয়াল করে। খানিক ভালো লাগে বিষয়টা। আরহাম বাবার প্রশ্নের উত্তর দেয়,

” ভালো আছি আব্বু।

প্রিয়তার দিকে তাকায় আরিফ। এতদিন পর সন্তানদের মুখ দেখে হুহু করে কেঁদে উঠে সে। প্রিয়তাকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকে। প্রিয়তা কাছে আসে না। দূর থেকেই স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞেস করে,
” এখন ঠিক আছেন?

প্রশ্নটুকু করতে কণ্ঠ কাঁপল প্রিয়তার। আব্বুকে সে এখনো ভালোবাসে। এভাবে লোকটাকে শুয়ে থাকতে দেখে প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে প্রিয়তার। দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে বুক। কলিজা ফেটে আর্তনাদ আসছে। প্রিয়তার জ্বলন টের পায় না কেউ। ঠোঁট চেপে ধরে রাখে প্রিয়তা। আরিফ উত্তর দেয়,

” এখন তোমাদের দেখে ভালো লাগছে মা।

মা শব্দটা শুনে প্রিয়তা কেঁপে উঠে। জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয় বাবার বুক। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হয় প্রিয়তার। ঘন ঘন শ্বাস ফেলে সে। শক্ত কণ্ঠে বলে,

” ভালো আছেন শুনে ভালো লাগল। আমাকে দয়া করে মা সম্বোধন করবেন না। ক্যামেরার সামনের শুটিং টা ঠিক ভালো লাগে না। অভিনয় বুঝতে পারি আমি।

আরিফের হাসি থেমে গেল। নিভে গেল হাস্যজ্জল মুখ। থমথমে হলো চেহারা। প্রিয়তা হাসল মিটিমিটি। মজা পেল কিছুটা। দীপা উঠে এলো বসা থেকে। ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,

” এখন আসার সময় হলো তোমাদের? বাপ মরলে কি বাঁচলেই বা কি তাইনা? মরে গেলেই বুঝি খুশি হও।

প্রিয়তা রাগতে চায় না। কথা এড়িয়ে যায়। বলে,
” হঠাৎ স্ট্রোক করল কিভাবে?

” চাকরিতে অনেক ঝামেলা চলছে। সেসব নিয়ে টেনশন করতে করতেই তো স্ট্রোক করল।

” আপনি থাকতে উনার এত চিন্তা কিসের? এত সুন্দরী বউ আপনি। মনের মতো স্ত্রী পেয়েছেন উনি, সংসার করছেন স্বাধীন ভাবে। চাকরি নিয়ে এত চিন্তা করার কোনো মানে হয়? যা টাকা পয়সা আছে তাতে তো চলে যাওয়ার কথা।

আরিফ থামতে বলে দীপাকে। প্রিয়তাকে ডাকে। অনিচ্ছায় বাবার কিছুটা কাছে আসে প্রিয়তা। আরিফ থেমে থেমে বলে,

” আমি তোমাদের সাথে খুব অন্যায় করেছি। তুমি হয়তো কখনোই আমাকে মাফ করতে পারবে না। কিন্তু আমি আমার কাজে অনুতপ্ত। তোমাদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার ভাষা আমার নেই। পাপ করার ফল আমি প্রতিনিয়ত পাচ্ছি। রোগ বাসা বেঁধেছে শরীরে। হয়তো বাচবো না বেশিদিন। আরহামের ভবিষ্যত নিয়ে আমি ভেবেছি প্রিয়তা। ছেলেটার একটা সুখের জীবন হোক আমি তাই চাই। আমি তোমাকে চিনি। তুমি কোনদিন আমার সহায়-সম্পত্তি নিবে না। তোমাকে বারবার বলেও আমি আমার কাছে নত করতে পারবো না। কিন্তু আরহাম? আরহাম ছোট। ওর জীবনের কঠিন ধাপগুলোতে ও এখনো পৌঁছাতে পারেনি। কোথায় গিয়ে থামবে ও? আমি কি আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবো না? আমি আমার অর্জিত সম্পদের কিছু অংশ আরহামের নামে লিখে দিয়েছি। দয়া করে সেগুলো নাও প্রিয়তা। আমাকে ক্ষমা করো।আমার ছেলেকে আমার সম্পদ ভোগ করতে দাও। ছেলেটাকে ভালো রাখার জন্য এতটা কঠোর হয়ো না প্রিয়তা।

হু হু করে পুনরায় কেঁদে ফেলল আরিফ। চোখের পানিতে ভিজে গেল কপোল। নিস্তেজ হতে লাগল সে। প্রিয়তার হাত জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইল। প্রিয়তার মন গলে। সরাসরি দেখায় না ভঙ্গুর হৃদয়ে জমা কষ্টের রেশ। কিছু বলতে পারে না প্রিয়তা। আরিফ পুনরায় বলে,

” আমার বিশ্বস্ত উকিলের কাছে সব কাগজপত্র রেখেছি। তুমি আরহামের হাতে দিয়ে দিও। যতদিন না ও প্রাপ্তবয়স্কে উপনীত হয় ততদিন সবকিছুর খেয়াল রেখো।

” আরহামের কিচ্ছু চাই না। এসব ভুলে আপনি নিজের চিকিৎসা করান।

” আমি চাই প্রিয়তা। দয়া কর। আরহামকে ওর অধিকার বুঝে নিতে দাও।

প্রহর এগিয়ে আসে এইবার। আরিফের দিকে তাকায়। আরিফের প্রশ্নবিদ্ধ চোখ দেখে প্রহর বলে,
” আমি আপনার মেয়ের হবু জামাই। আপনার সব কথাই শুনেছি বাইরে থেকে। প্রিয়তা আমার বাড়িতে এক কাপড়ে আসবে। আপনার সহানুভূতির পরোয়া আমার হবু বউ করবে না। প্রেমিকা যে সন্তানদের চেয়ে বড় হয় এটা আমি আগে কখনো দেখিনি। শুনেছি পৃথিবীর কোথাও নাকি খারাপ বাবা নেই। কিন্তু আপনি? আপনি প্রিয়তাকে দুনিয়াতে এমন সব তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করেছেন যে প্রিয়তা পাথর হয়েছে। আঘাতে আঘাতে ক্ষয়ে গেছে মেয়েটা। এখন সম্পত্তি দিয়ে দায় কমাচ্ছেন? ফিরিয়ে দিতে পারবেন প্রিয়তার পাঁচ বছরের আনন্দ? ফিরিয়ে দিতে পারবেন প্রিয়তার কিশোরী বয়সের সময়টা? পারবেন ওর চোখের পানির মূল্য দিতে?

আরিফ কিছু বলতে পারে না। দীপার মুখের দিকে তাকায় প্রিয়তা। মহিলার চোখে অজস্র রাগ দেখতে পায় প্রিয়তার প্রতি। এতক্ষণে চেতে উঠে মহিলা। রাগী কণ্ঠে বলে,

” সব সম্পত্তি ওদের দিলে আমার কি হবে? আমার কথা ভাববে না তুমি? এই ছেলেমেয়ের দরদ এতদিন কোথায় ছিল হ্যাঁ? কাবিনের সব টাকা দেবে আমায়। নইলে পা কেটে ঘরে বসিয়ে রাখবো। তখন টাকা কিভাবে ওদের পিছনে ওড়াও আমিও দেখবো।

চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

প্রিয়তার প্রহর ২ পর্ব-১১

0

#প্রিয়তার_প্রহর (২য় পরিচ্ছেদ )
পর্ব সংখ্যা ( ১১)

তানিয়ার ঘুম ভেঙেছে সকালে। ইলমা বেগমের সাথে রান্নাবান্না করেছে। যদিও তিনি তানিয়াকে কিছুই করতে দেননি। কেবল হাতে হাতে এটা ওটা এগিয়ে দিয়েছে তানিয়া। ইহান ঘুমোচ্ছে। ডাকতে হবে তাকে। তানিয়ার অসস্তি লাগে কিছুটা। ইহানের ঘুমোতে ঘুমোতে রাত বারোটার বেশি বেজে যায়। এত সকালে উঠতে কি লোকটার আলসেমি লাগে না? ভাবে তানিয়া। ঘরে ঢুকে। ইহানের গায়ে আজ শার্ট আছে। গায়ে কাঁথা নেই। দু হাঁটু ভাঁজ করে শুয়ে আছে। তানিয়া ইহানকে ডাকতে ভয় পায়। অন্যভাবে জাগিয়ে তোলার উপায় খোঁজে। ফোনটা বের করে হাই ভলিউমে গান ছেড়ে দেয়। গানটা ভালোমতো বেজে ওঠার সাথে সাথেই নড়েচড়ে উঠে ইহান। কপাল কুঁচকে ফেলে। চোখ না মেলেই বলে,
” এত সকালে কে আউলফাউল গান বাজাচ্ছে? ধ্যাত।

তানিয়া মজা পায়। মিটিমিটি হাসে। ওয়াশরুমে গিয়ে ইউনিফর্ম পরে বেরিয়ে আসে। পুনরায় গান বাজায়। ইহান বিরক্ত হয়ে চোখ খুলে। তানিয়ার হাতে ফোন দেখে রাগী কণ্ঠে বলে,

‘ কাজ নেই তোমার? এত ভলিউম দিয়ে গান শুনছো।

তানিয়া চুল আচরাতে আচরাতে উত্তর দেয়,
” আপনার কাজ নেই? ঘুমোচ্ছেন তো নাক ডেকে। থানায় যাবেন না?

ঘুম ততক্ষণাৎ ভেঙে যায় ইহানের। উঠে বসে। ওয়াশরুমে যায় তড়িঘড়ি করে। ইউনিফর্ম জড়িয়ে দিয়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়। তানিয়া তখনও আয়নার সামনে। ইহান তাড়া দেয়। বলে,

” এখন ও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছো। সরো। রেডি হতে দাও আমায়।

ভেংচি কাটে তানিয়া। এক চুল ও নড়ে না। চিরুনি দিয়ে লম্বা চুলগুলোকে পরিপাটি করতে করতে বলে,

” সময় লাগবে আমার। আপনি যেমন কাজে যাচ্ছেন, আমিও কাজে যাচ্ছি। ভাব নিবেন না একদম।

ইহান হতবাক। মেয়েটা আজকাল একটু বেশিই পাকনামো করছে, বেশি কথা বলছে। হুটহাট অসস্তিতে ফেলছে ইহানকে। ইহানের রাগ হয়। ক্রোধটুকু গিলে ফেলে সে। নম্র কণ্ঠে বলে,

” সরে দাঁড়াও। তাড়া আছে আমার।

তানিয়া ইহানের দিকে ফিরে। চুলগুলো খোঁপা বেঁধে নিয়ে বলে,

” আপনাকে যেতে দিবো। কিন্তু আমাকে একটা হেল্প করতে হবে।

” কি?

” আবিরের সাথে দেখা করতে যাবো। আপনিও আমার সাথে যাবেন।

ইহান থমকায়। আবির নামটা মারাত্মক ভাবে জ্বালায় তাকে। তানিয়ার সাথে কোনো ছেলেকে ভাবতে পারে না ইহান। কেমন শ্বাসরোধ হয়ে আসে। অথচ ইহান আর তানিয়ার সম্পর্ক আর পাঁচটা স্বামী-স্ত্রীর মতো নয়। তবুও হালাল সম্পর্কের প্রতি একটা টান বোধহয় তানিয়াও অনুভব করে। বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকায় ইহান। বোঝার চেষ্টা করে তানিয়ার আবিরের প্রতি কোনো সফট কর্ণার রয়েছে কিনা। না, বুঝতে পারে না ইহান। তানিয়াকে সরিয়ে আয়না দখল করে সে। শার্টের কলার ঠিক করতে করতে বলে ওঠে,
” তোমার সাথে দেখা করতে চেয়েছে। যাও তুমি। আমাকে টানতে চাইলে আমি তোমায় সাথে নিবো না।

” আপনি একা দেখা করবেন ? কিন্তু আবির আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছে।

” তুমি আর আমি কি আলাদা তানিয়া?

মনোযোগী চোখে তাকিয়ে কথাটুকু বলে ইহান। ইহানের অদ্ভুত চাহনিতে অসস্তি হয় না তানিয়ার। গাঢ় হাসে সে। মজা করে বলে,

” না। আমি তো আপনার অর্ধাঙ্গীনী।

” উহু! সম্পূর্ণাঙ্গীনী।

সম্মোহনী চোখে তাকায় ইহান। গাঢ়ভাবে হাসে। তানিয়াও হাসে। মন্ত্র মুগ্ধের ন্যায় তাকায় দুজন দুজনের দিকে। সময় গড়ায়। ঘড়ির কাটা টিকটিক করে সময় জানান দেয়। ইহান তাড়াহুড়ো করে বের হয়। পিছু বের হয় তানিয়া। মেসেজ করে আবিরকে। বলে,

” Coffee Shop – a aschi. Stay There at 2 PM!

___

প্রহরের কাজ পরেছে। প্রিয়তাও অনুরোধ করেছিল হুট করে সিলেট না যাওয়ার জন্য। এখানে আরহামের স্কুল আছে। ট্রান্সফার সার্কিফিকেট নিতে হবে, সাধারণ গোছগাছ ও আছে। সবটা ভেবে প্রিয়তা আজ সিলেটে যেতে রাজি নয়। এদিকে প্রহরের নতুন চাকরি। এখন চলে যাওয়া মানে কথা দিয়ে কথা না রাখা। প্রহর যে কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছে সে কোম্পানির ওউনার প্রহরকে প্রথম দেখায় চিনে ফেলেছে। ইন্টারভিউ ছাড়াই প্রহরকে উঁচু পদে চাকরি দিতে চেয়েছে। প্রহর মানেনি। বলেছে ইন্টারভিউ নিয়ে যাচাই-বাছাই করে তবেই তাকে চাকরি দিতে। ইন্টারভিউ দিয়েছে প্রহর। প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে নিখুঁত ভাবে। চাকরিটাও পেয়ে গেছে অনায়াসে। বলেছিল পরেরদিন থেকে আসবে। দু দিন কাজে যাওয়ার পর হুট করে সিলেটে চলে যাওয়ার ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু দেখায়। তবুও রাগ করে কাল সে বলেছিল সিলেটে চলে যাবে, বিয়ে করবে প্রিয়তাকে। কিন্তু পরবর্তীতে প্রিয়তার না করায় দমে গিয়েছে প্রহর। সামলে নিয়েছে সব দিক ভেবে।

সোহেলের সাথে প্রিয়তার দেখা হলো আরহামের স্কুলে। বিশাল বড় মাঠটার আনাচে কানাচে মানুষ রয়েছে। কৃষ্ণচূড়া গাছের ফুলগুলো পরে আছে ঘাসের উপরিভাগে। সোহেল দাঁড়িয়ে আছে সম্মুখে। ছেলেটার দৃষ্টি নত। প্রিয়তা স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বলে ওঠে,

” বলুন, চুপ করে আছেন কেন?

সোহেল মাথা উঁচু করে। আশপাশে নজর বুলায়। মার্জিত ভঙ্গিতে বলে,
” তুমি আমার লেখা চিঠি পড়তে না?

” প্রথম কয়েকদিন পড়েছি।

” স্যার তোমাকে অফার করেছে? নাকি তুমি?

স্থির দৃষ্টিতে তাকায় প্রিয়তা। ছেলেটার মনোভাব ধরতে পারে সে। সোহেল ছেলেটার লেখার হাত ছিল দারুন। বাচনভঙ্গি ছিল চমৎকার। সোহেলের এমন চমৎকার চিঠি পড়লে যে কেউ সেই লেখার প্রেমে পড়বে। প্রেমে পরবে সোহেলেরও। এমন চিঠি বোধহয় প্রত্যেকটা মেয়েই চায়। কিন্তু প্রিয়তার মন তো গলেনি। সোহেলের এহেন প্রশ্নে প্রিয়তা কিছু ভাবে। বলে,

” আজওয়াদ ইশতিয়াক, এই নামটা সর্বপ্রথম দেখার পর আগ্রহ জ্বন্মেছিল খুব। আমি নিউজ দেখি না। আর উনিও সেই সময় এত ফেইমাস পুলিশ অফিসার ছিলেন না। তাই উনাকে চিনতাম না। প্রথম দেখায় উনি আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন। হ্যাঁ আমার ক্ষতি করার জন্যই উনি আমাকে সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু আমার সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার করেননি উনি। ক্ষতি করেননি আমার। আপনি তো জানেন, আমার জীবনটা অন্যান্য মেয়েদের মতো সহজ-সরল নয়। আমি সংগ্রাম করার জন্য জন্মেছি। নিজের বাড়ি ছেড়ে চলে আসার পর আমি কারো সাহায্য পাইনি। উনিই একমাত্র ব্যক্তি যাকে আমি ভরসা করেছি। তখন আমার জীবনে প্রেম-ভালোবাসা বলে কিছু আসুক আমি তা চাইনি। আপনার প্রেমপত্র পড়তে আমার ভালো লাগতো। কিন্তু প্রেমে পড়িনি আমি। তখন আমার ভাবনা ছিল শুধু আমার ভাইকে নিয়ে। কিভাবে এ সমাজে দুজন টিকে থাকবো সেই চিন্তা ছিল মাথায়। কোন কাজ করবো, কিভাবে সবটা সামলাবো এসব নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। আপনার লেখা আমার মন গলাতে পারেনি। হঠাৎই আমি থমকে গিয়েছিলাম প্রহরের ব্যক্তিত্বে। এই মানুষটার সৌন্দর্য, ব্যক্তিত্ব, তীক্ষ্ম-ধারালো চোখ, মার্জিত দৃষ্টিভঙ্গি সবটাই আমার হৃদয় কেড়েছে। কিন্তু প্রকাশ করার মুরোদ আমার ছিল না। সরে আসতে চেয়েছি, ভুলে যেতে চেয়েছি উনাকে। পরিশেষে সফল না হওয়ায় চলে এসেছি ঢাকায়। এখানে আসার পূর্বে উনাকে ওয়াদা করিয়েছিলাম উনি যেন আমাকে না খুঁজে। যেজন্য আপনি আমাকে খুঁজে পেলেও উনি আমাকে খুঁজে পাননি। আসলে খুঁজতে পারেইনি। অবশেষে জানতে পারলাম এখানে চলে আসায় উনি আমার শূন্যতা বুঝতে পেরেছে। আমাকে যে উনি ভালোবাসেন তা উনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন। আর সব বাঁধা আস্তে আস্তে উধাও হয়ে দিয়েছেন উনি। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি বাঁচবো। কোনো একজনের ভালোবাসা আঁকড়ে ধরে বাঁচবো। কোনো একজনের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সুখের নিদ্রায় আচ্ছাদিত হবো। একাকীত্বে ভুগবো না কখনো।

সোহেলের চোখের কার্ণিশে অশ্রুকণা জমেছে। ছেলেটা আড়াল করতে চাইল সেই অশ্রু। প্রিয়তার নজর এড়ায় না। মুচকি হেসে সে বলে,
” আমরা যা চাই সবসময় আমরা তা পাই না। পৃথিবীর নিয়মটাই এমন ভাইয়া। আপনি যাকে ভালোবাসবেন সে অন্যকে ভালবাসবে। আবার আপনার ভালোবাসার মানুষ যাকে ভালোবাসে সে আবার অন্য কাউকে চাইবে। এমনটাই হয় প্রায় ক্ষেত্রে। জীবনে সবকিছু পেয়ে গেলে চাওয়ার মতো কিছু থাকবে না। আপনি আমাকে ভালোবাসেন, কিন্তু আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি। একটু বেশিই ভালোবাসি। উনাকে কোনোভাবেই ছাড়তে পারবো না আমি। আপনাই ভুল মানুষকে ভালোবেসেছেন।

সোহেল মুচকি হাসে। বলে,
” তোমার জন্য অনেক অনেক শুভ কামনা প্রিয়তা। জীবনের পরবর্তী সময় গুলো তুমি আনন্দে কাটাও এটাই চাইবো।

সোহেল চলে যায়। প্রিয়তার খারাপ লাগে ছেলেটার জন্য। ফোনটা বেজে ওঠে প্রিয়তার। প্রহরের কল। কলটা ধরে দ্রুত। প্রহরের কণ্ঠস্বর অন্যরকম শোনাচ্ছে। চিন্তিত কণ্ঠে ছেলেটা ওপাশ থেকে বলে উঠল,

” আপনি কোথায় প্রিয়তা?

” আরহামের স্কুলে। ওকে নিতে এসেছি। কেন?

” আমাদের সিলেটে ফিরতেই হবে প্রিয়তা। আমি বসের থেকে ছুটি নিয়েছি।

” এ নিয়ে কথা তো হয়ে গিয়েছে আমাদের। কয়েকদিন পর তো যাবো বলেছি।

” আপনি আরহামকে নিয়ে স্কুলেই অপেক্ষা করুন। আমি আসছি। জরুরী কথা আছে।

কল কেটে দেয় প্রহর। প্রিয়তার চিন্তা হয়। কি হলো আবার? সকালেই তো ঠিক হলো সিলেটে ফিরবে কিছুদিন পর। এখন হঠাৎ ছেলেটা মত বদলে ফেলল কেন? আরহাম ক্লাস থেকে বেরিয়ে বোনের সম্মুখে এসে দাঁড়াল। মাঠে ঝালমুড়ি ওয়ালা বসেছে। আরহাম ঝালমুড়ি খাওয়ার বায়না ধরল। দশ টাকার ঝালমুড়ি নিয়ে বেঞ্চে বসে রইল আরহাম আর প্রিয়তা। কয়েকমিনিট বাদে স্কুলে উপস্থিত হলো প্রহর। ছেলেটাকে এলোমেলো লাগছে। প্রিয়তা বসে থাকা অবস্থায় জিজ্ঞেস করে,
” এখানে এলেন কেন আবার?

প্রহর বসে আরহামের পাশে। কোলে নেয় আরহামকে। চুমু খায় ছেলেটার ললাটে। প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে নরম কণ্ঠে বলে,

” আপনাকে আজ সিলেটে ফিরতে হবে প্রিয়তা।

” কেন?

” আপনার আব্বু সম্ভবত স্ট্রোক করেছেন।

হতভম্ব হয়ে তাকায় প্রিয়তা। বুকের পাশটায় চিনচিন ব্যথা অনুভব করে। অক্ষিযুগল মোলায়েম হয় প্রিয়তার। পুরোনো স্মৃতিগুলো ভেসে ওঠে মানসপটে। আরহামের দিকে তাকায় সে। চোয়াল শক্ত হয় তার। জিজ্ঞেস করে,

” আপনি কি করে জানলেন?

” আপনার সৎ মা আমাকে কল করেছিল।

” উনি? আপনাকে কিভাবে কল করল?

” সেসব পরে জানবেন। আগে যেতে হবে আমাদের।

” আমি যাবো না কোথাও ।

প্রহর প্রিয়তাকে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। তিনজন হাঁটতে থাকে একসাথে। প্রিয়তার হৃদয়ে ঝড় উঠে। আব্বুর জন্য পরান পুড়ে প্রিয়তার। আরিফ যতই প্রিয়তাকে তাড়িয়ে দিক, প্রিয়তা তো ভালোবাসে তার আব্বুকে। অভিমান-অভিযোগ যতই থাকুক, বাবার অসুস্থতা মানতে কষ্ট হয় প্রিয়তার। শক্তপোক্ত খোলস বেরিয়ে আসতে চায় সে। টলমল করে ওঠে চোখ। বেহায়া মন ছুটে যেতে চায় প্রিয় শহরে। প্রহর বুঝতে পারে। হাতে হাত রাখে প্রিয়তার। বলে,

” আপনাকে যেতে হবে প্রিয়তা। এতটা কঠোর আপনি নন। আরহামের অ্যাক্সিডেন্টের সময় উনি এসেছিলেন। অন্তত কৃতজ্ঞতা দেখিয়ে আপনার ওখানে যাওয়া উচিত। আপনি যে উনাদের ভালোবাসেন প্রিয়তা। না গেলে এখানে বসেই আপনি দুশ্চিন্তা করবেন। আপনার কষ্ট হবে। কাঁদবেন আপনি। আমি সহ্য করতে পারবো না প্রিয়তা।

“হ্যাঁ কষ্ট হবে। কষ্ট হবে আমার। কি করবো? ওখানে ফিরে যাবো? আব্বুকে অসুস্থ অবস্থায় দেখলে আমি ভেঙে পরবো। নরম হবো। আমি চাই না এটা প্রহর। চাই না।

” আপনাকে যেতেই হবে প্রিয়তা। আমি আপনাকে নিয়ে যাবো। কথা দিচ্ছি প্রিয়তা, আপনাকে সামলে নিবো আমি। টালমাটাল হতে দিবো না, এত সহজে নরম হতে দিবো না। এত এত অপমানের জবাব আপনি দিবেন। আর কষ্ট পেতে দিবো না আপনাকে।

প্রিয়তা আরহামের দিকে তাকায়। ছেলেটাকে বেশ শান্ত লাগছে। প্রিয়তা আর প্রহরের সব কথাই শুনেছে সে। বাবার অসুস্থতার কথা শুনে আরহাম পিটপিট করে করে তাকায় প্রিয়তার পানে। প্রহর কোলে নেয় ছেলেটাকে। আদুরে স্বরে বলে,

” তুমি তোমার আব্বুর কাছে যাবে না আরহাম?

আরহাম বারংবার মাথা নাড়ে। জড়িয়ে ধরে প্রহরের কাঁধ। আকুল কণ্ঠে বলে,

” আমি যাবো। আব্বুকে দেখবো।

____

দুপুর দুটো বাজতে কয়েক মিনিট বাকি। থানার ডেস্কে বসে আছে ইহান আর তানিয়া। তাদের বিয়ের খবরটা কেউ জানে না। জানলে অনেকজন অনেক কথাই তুলবে। সে প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার মতো মনোবল তানিয়ার নেই। তাই কাউকে এ বিষয়ে জানাতে না করেছে সে। ইহান বসে আছে তারই সম্মুখে। তানিয়া আড়চোখে তাকায় ইহানের পানে। টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে বলে,

” ছুটি দিন না।

ইহান রাগী দৃষ্টিতে তাকায়। অনেকক্ষণ করে এক কথা বলে চলেছে মেয়েটা। পাত্তা দেয় না সে। ফাইলে মনোনিবেশ করে। খুঁতখুঁত করে তানিয়া। করুণ চোখে পুনরায় তাকায় ইহানের দিকে। ইহান বিরক্ত হয়। তেজী কণ্ঠে বলে,

” দু-দিন ছুটি নিয়েছো। আজ আবার কিসের ছুটি?

” ঘন্টাখানেক পরই চলে আসবো। প্রমিস।

” উঁহু। এখানেই থাকবে তুমি। আমি একটা কাজে বাইরে যাবো। থানায় যখন তখন উপর মহলের লোক আসবে। দুজনকেই না পেলে ঝামেলা হবে।

” কিন্তু আমি তো কথা দিয়েছিলাম উনাকে।

” সব কথা রাখতে নেই। আমার স্ত্রী তুমি। আমার কথা শুনবে নাকি বাইরের ছেলেটার কথা?

তানিয়া চুপসে যায়। অভিমান হয় খানিক। ঘাড় ঘুরিয়ে বসে থাকে। কথা বলে না আর। ইহান বেরিয়ে যায় থানা থেকে। থানা থেকে আধঘন্টা গেলেই পুরোনো একটা কফিশপ। এখানেই আবিরকে থাকতে বলেছে তানিয়া। ইহান তানিয়াকে আসতে দেয়নি। তানিয়াকে না জানিয়ে নিজেই এসেছে। ঘড়ির কাটায় সই দুটো বেজেছে। ইহান থাই গ্লাস টেনে শপের ভিতরে ঢুকে। আবির দেখতে পায় ইহানকে। দু মিনিট আগেই এখানে এসেছে সে। তানিয়ার অপেক্ষায় আছে। ইহানকে ঢুকতে দেখে ঘাবড়ায় আবির। ইহান ছেলেটাকে তার মারাত্মক সুন্দর লাগে। ইহানের পরনে নেভি ব্লু রঙের পুলিশ ইউনিফর্ম। নেমপ্লেইটে মাঝারি অক্ষরে লেখা “Ehan Talukder”। ছেলেটার চাহনি গম্ভীর। পকেটে গুঁজে রেখেছে রিভলবার। শ্যামলাটে মুখশ্রীতে অজানা জাদু আছে বোধহয়। তাই তো সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেলেটার এমন ফটো দেখে ফলোয়ার বেড়েছে প্রচুর। ইহান আবিরের নিকটে আসে। আলতো হাসে ছেলেটা। চেয়ার টেনে বসে। চুলগুলোকে পেছনে ঠেলে দিয়ে বলে,

” কি খবর?

আবির ছোট ছোট চোখ করে তাকায়। এ প্রশ্নের উত্তর দেয় না সে। উল্টো প্রশ্ন করে,

” তানিয়ার আসার কথা ছিল। আপনি কেন?

‘ তানিয়া আর আমি কি আলাদা? আমরা স্বামী স্ত্রী। দুজন-দুজনের পরিপূরক। তানিয়া আমাকে পাঠিয়েছে।

তীর্যক দৃষ্টি মেলে কথাটুকু বলে ইহান। চোখ দ্বারা ক্রোধ চেপে রাখে। আবিরের ললাটে স্বেদজল জমে। বলে,

” আপনার সাথে আমার কোনো কথা নাই।

” কিন্তু আমার আপনার সাথে কথা আছে। মিস্টার আবির চৌধুরী, আপনি কোন সাহসে আমার স্ত্রীকে মিট করতে বলেন এখানে? কোন সাহসে আমার স্ত্রীর সাথে যোগাযোগ রাখতে চান? আমার স্ত্রীর দিকে চোখ তুলে তাকালে আমি কি করতে পারি তা আপনার ধারণারও বাইরে। জ্বালিয়ে দিবো সব। শেষ করে দিবো আপনাকে। আপনার কি মনে হয় ইহান তালুকদার তার স্ত্রীকে এত সহজে তার প্রাক্তনের সম্মুখে আসতে দিবে? এত সহজ? আমি আপনাকে ওয়ার্নিং দিচ্ছি, তানিয়ার সাথে কনট্যাক্ট করার চেষ্টাও করবেন না। করলে আমি আপনাকে আইনের জ্বালে ফাঁসিয়ে একদম জেলে ভরে দিবো। প্রয়োজন হলে খুন করবো আপনাকে। আমার স্ত্রীর থেকে দূরে থাকবেন। বুঝেছেন?

ইহান জোরেই কথাগুলো বলে ওঠে। আবির থমকায়। পুলিশের সাথে লড়াই করার মতো দুঃসাহস হয় না তার। ইহানের এই থানায় বেশ নামডাক আছে। সততার সাথে জনগণকে সেবা দেয় ওরা। ইহানের সাথে তর্কে জড়ানো মানে নিজের বিপদ ডেকে আনা। কথা বলে না আবির। রাগে প্রচন্ড। ক্রোধ টুকু চেপে রেখে হনহন করে বেরিয়ে যায়।

চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

প্রিয়তার প্রহর ২ পর্ব-১০

0

#প্রিয়তার_প্রহর (২য় পরিচ্ছেদ)
পর্ব সংখ্যা (১০)

দরজার অপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাকে প্রিয়তা চেনে না। আগে কখনো দেখেছে বলে মনেও হয় না। কিন্তু মহিলার আচরণ অন্যরকম। হাসি হাসি মুখে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। অপেক্ষায় আছেন প্রিয়তার ঘরে ঢুকতে বলার আহ্বানের। প্রিয়তা বুঝতে পারে। দরজার কাছ থেকে সরে গিয়ে বলে,

” ভিতরে আসুন। ঘরে বসে কথা বলি।

মহিলা সময় ব্যয় করলেন না। জুতো খুলে প্রবেশ করলেন ঘরে। আশপাশে নজর বুলালেন। প্রিয়তা উনাকে বসতে দিল খাটে। পা ঝুলিয়ে খাটে বসলেন মহিলা। বললেন,

” তোমার কাছে আসবো আসবো করে আসাই হচ্ছিল না। আজ দুপুরের বাসে তাই চলে এলাম।

প্রিয়তা দু হাত বুকের কিঞ্চিত নিচের অংশে ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকে। ইশারায় আরহামকে কাছে ডাকে। আরহাম খাট থেকে নেমে প্রিয়তার কাছে আসে। প্রিয়তা কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলে,
” সেদিন যে চানাচুর এনেছিলাম। সব খেয়েছো?

আরহাম হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ে। প্রিয়তা বিরক্ত হয় খানিক। পুনরায় জিজ্ঞেস করে,
” বিস্কিট আছে তো? প্লেটে করে কয়েকটা বিস্কিট নিয়ে এসো।

আরহাম নীল রঙের কিচেন র‌্যাক থেকে বিস্কিট এনে সম্মুখে রাখে মহিলার। মহিলা আরহামের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
” তোমার ছবি আমি দেখেছি। তাই তোমাকে চিনতেও অসুবিধে হয়নি।

প্রিয়তা বুঝতে পারে মহিলার কথার মানে। আসল কথায় আসে বলে,
” আপনি যেহেতু বলেছেন আমাকে যিনি চিঠি লিখেন তারই মা আপনি, সেহেতু আপনি জানেন আপনার ছেলে আমাকে চিঠি দেন। কেন উনি আমাকে চিঠি দেন সে প্রশ্ন আমি করবো না। কারণ আমি প্রাপ্তবয়স্ক। উনার এইসব লেখার মানে আমি বুঝি। প্রশ্ন একটাই, আপনি আপনার ছেলেকে এসব লিখতে নিষেধ করেননি কেন?

মহিলা হাসেন। বলেন,
” আমার ছেলেটা তোমাকে পছন্দ করে।

পরবর্তী কথাটুকু বলতে দেয় না প্রিয়তা। বলে,
” আপনি সরাসরি বলতে পারেন আন্টি। আপনার ছেলে আমাকে শুধু পছন্দ করেন না, ভালোও বাসেন। রাস্তায় তো অনেক সুন্দর সুন্দর মেয়ে দেখা যায়। সবাইকেই তো দেখতে ভালো লাগে কিংবা অনেককেই দেখে পছন্দ হয়ে যায়। তাই বলে কি তাদের সবাইকে চিঠি লিখা যায়? না তো? আপনার ছেলের লেখা অনুযায়ী বুঝেছি আমাকে উনি বিয়েও করতে চান। এ ধরনের কথা লেখা কি আদৌ যৌক্তিক?

মহিলা ততক্ষণাৎ বলে ওঠেন,
” আমি তোমাদের বিয়ের কথাই বলতে এসেছি। ওর মুখে শুনেছি তোমার বাবা-মা থেকেও নেই। তুমি নিজেই তোমার গার্ডিয়ান। তাই তোমার কাছে এসেছি। তুমি আমার ছেলেকে চিনবে। রাজি হবে আশা করি।

” সিলেটে থাকাকালীন সময়ে চিঠি পেতাম। এখানে আসার পর ও চিঠি পেয়ে আমি বুঝেছিলাম উনি আমার পিছু এত সহজে ছাড়বেন না। চেষ্টা করলেই হয়তো চিঠি প্রেরণকারীকে আমি ধরতে পারতাম। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল চিঠির উত্তর না দিলে প্রেরণকারী আর চিঠি লিখবেন না একসময়।

মহিলা প্রিয়তার কাঠকাঠ কণ্ঠ শোনেন মনোযোগ দিয়ে। অতঃপর দরজার বাইরে তাকান। খোঁজেন কাউকে। প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বলেন,

” আমার ছেলে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। তুমি অনুমতি দিলে ভিতরে আসবে।

প্রিয়তা থমকায়। মহিলার মার্জিত দৃষ্টিভঙ্গি ভালো লাগে তার। দরজার সম্মুখে এসে হাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,

” আসুন।

সাথে সাথেই একজন সুঠাম দেহের ছেলে বিনীত ভঙ্গিতে দরজার অপর প্রান্তে এসে দাঁড়াল। ছেলেটার পরণে লাল-কালো শার্ট। আগোছালো কোকড়া চুল। প্রিয়তা তীক্ষ্ম চোখে লোকটার পানে তাকায়। কেমন চেনা চেনা লাগে ছেলেটাকে। ঘরে ঢোকার আহ্বান জানায় প্রিয়তা। মায়ের পাশে গিয়ে বসে ছেলেটা। প্রিয়তা একটু ভেবে বলে,

” আপনাকে আমি পুলিশ ইউনিফর্মে দেখেছি। কখন, কোথায় দেখেছি ঠিক মনে করতে পারছি না।

ছেলেটা প্রিয়তার দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকায়। একটু হেসে বলে,
‘ তোমার স্মৃতিশক্তি বেশ ধারালো। তোমার সাথে আমার মাত্র একবারই দেখা হয়েছে। প্রহর স্যারের বাড়ির মাঠে ব্যাটমিন্টন খেলার সময় তোমার সাথে কথা হয়েছিল। মনে আছে আমি কথা বলতে এসেছিলাম তোমার সাথে? তোমার সব তথ্য আমিই যোগাড় করে স্যারকে দিয়েছিলাম।

প্রিয়তার মনে পরে। এই ছেলেটাই কয়েক মাস আগে রাতে ব্যাটমিন্টন খেলতে এসেছিল প্রহরের বাসায়। আরহামকে ডাকতে প্রিয়তা গিয়েছিল খেলার স্থানে। ছেলেটা তখন যেচে কথা বলতে এসেছিল। পরিচয় দিয়েছিল। কি যেন নাম বলেছিল নিজের? ভাবল প্রিয়তা। মনে পরল একটু পর। সন্দিহান চোখে জিজ্ঞেস করল,

” আপনি সোহেল?

” হ্যাঁ। চিনেছো তবে।

প্রিয়তা কি বলবে ভেবে পায় না। সোহেলের মা বলে ওঠেন,

” আমি তোমাকে আমার ছেলের বউ বানাতে চাই। তুমি যদি রাজি থাকো..

প্রিয়তা ততক্ষণাৎ উত্তর দেয়,
” দুঃখিত আন্টি। আমায় ক্ষমা করবেন। আমি একজনকে ভালোবাসি। এ মাসের মধ্যে আমরা দুজন বিয়ে করবো। আপনার প্রস্তাব আমি গ্রহণ করতে পারবো না।

মহিলা অবাক হন। পাশ ফিরে তাকান ছেলের দিকে। গম্ভীর কণ্ঠে বলেন,
” তুমি তো বলেছিলে ওর কোনো সম্পর্ক নেই।

সোহেল ছেলেটা হকচকিয়ে তাকায় প্রিয়তার পানে। প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বলে,
” তুমি তো রিলেশনশীপে ছিলে না।

প্রিয়তা মাথা নত করে বলে,
” কিছুদিন আগেই আমি আমার জীবন সঙ্গী নির্বাচন করেছি। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছি উনার সাথে। কোনোভাবেই এই সম্পর্ক আমি ঘুঁচিয়ে ফেলতে পারবো না।

” কে সে? কার সাথে..

” আজওয়াদ ইশতিয়াক প্রহর।

” প্রহর স্যার? অবাক কণ্ঠে বলে উঠে সোহেল।

” জি

সোহেল উঠে দাঁড়ায়। প্রিয়তার সাথে অনেক কথা থাকলেও মায়ের সম্মুখে বলতে পারে না সে কথা। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

” এ ব্যাপারে আমি ওর সাথে পরে একসময় কথা বলে নিবো আম্মু। আজ চলে যাই।

মহিলা আরহামের দিকে তাকিয়ে হাসেন। ঘুরে চলে যাবার পূর্বে সোহেল বলে ওঠে,

” আর কয়েকদিন আগে তোমার সামনে আসলে হয়তো তুমি আমারই হতে।

ছেলেটার করুণ কণ্ঠে প্রিয়তা হকচকিয়ে ওঠে। ভারী বিচলিত হয়। কথা কাটাতে মহিলার উদ্দেশ্যে বলে,

” আজই সিলেটে চলে যাবেন?

মহিলার ফ্যাকাশে মুখশ্রী দেখে ভাঙে প্রিয়তা। ভদ্রতাসূচক এটুকু বলে ইচ্ছে করেই। মহিলা চাপা স্বরে বলেন,
” সোহেলের এক বন্ধু থাকে এখানে। ওর বাসায় উঠবো। সকালে চলে যাবো।

” বিস্কিট খেলেন না?

” দশটা বেজে গেলে ওর বন্ধুর বাড়িতে তালা মেরে দেওয়া হয়। আমাদের আগেই পৌঁছাতে হবে।

” উনি উনার বন্ধুর বাড়ি যাক। আপনার কোনো সমস্যা না হলে আপনি আমাদের সাথে থাকতে পারেন। আমরা দু ভাই-বোনই শুধু এখানে থাকি।

মহিলা ছেলের দিকে তাকান। সোহেলের বন্ধু থাকে ব্যাচেলর হিহেবে। বন্ধু আর বন্ধুর মাকে রাখতে ছেলেটার অসুবিধা হতে পারে। খানিক ভেবে মহিলা বলে ওঠেন,

” ঠিক আছে। আজ রাতটা আমি এখানেই থাকবো।

_________

রাত দশটা নাগাদ ইহান থানা থেকে বের হয়। কাজের চাপ কমেছে কিছুটা। সবটা গুছিয়ে ফিরতে রাত হলো একটু। থানা থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে ইহান। ফোন চেইক দেয়। মেসেঞ্জারে মেসেজের টুং শব্দ বেজে ওঠে। ইহান মেসেঞ্জারে ঢুকে তানিয়ার মেসেজ পায়। তানিয়া লিখেছে,

” আন্টি আজ মাথায় তেল দিতে চাইল, তেল তো নেই। আপনি কি মাথায় তেলটেল কিছু দেন না? আদা বাটা তো কই? ফ্রিজে তো নেই। রাঁধবো কিভাবে? মেয়েদের শ্যাম্পুও তো নাই ঘরে। বাড়িতে দুটো মেয়ে মানুষ আসছে আপনার চোখে পরে না? আসার সময় মনে করে এগুলো আনবেন। নিচে লিস্ট দেওয়া হলো,

১| তেল
২| শ্যাম্পু
৩| আদা
৪| আইসক্রিম।

ইহান ভ্রু কুঁচকে ফেলে। তানিয়ার এমন মেসেজে বিস্ময় ধরে রাখতে পারে না। রিপ্লাই করে,

” সব ঠিক আছে। এই রাতে আইসক্রিম কেন? আমি পারবো না আজগুবি আবদার মেটাতে।

তানিয়া অনলাইনেই ছিল। মেসেজটা দেখার সাথে সাথে সেও রিপ্লাই করে,

” আগের দিন চটপটি এনেছিলেন, দোকানদার টকজল দিয়েছিল একটুখানি। খেতে ভালো লাগেনি। আজ আইসক্রিম আনবেন। দরজা টোকা দিলে আমি দরজার ফুঁটো দিয়ে আইসক্রিম দেখে তবেই দরজা খুলবো। নইলে আজকে বাড়িতে ঢুকতে দিবো না আপনাকে। ঘাড়ত্যাড়ামি করবেন না খবরদার।

ইহান হেসে ফেলে তানিয়ার এমন মেসেজ দেখে। হাসে একটু। গাড়ি দাঁড় করিয়ে লিস্ট দেখে সবকিছু কিনে। সকালের রাগটা এই রাতে এসে উধাও হয়ে যায় ইহানের।

____

সিলিন্ডারের গ্যাসে রান্না করছে প্রিয়তা। পাশে বসে আরহাম আর সোহেলের মা রাবেয়া খানম গল্প করছেন। আরহাম মুগ্ধ হয়ে গল্প শুনছে। মাঝেমাঝে এটা ওটা প্রশ্ন করছে। প্রিয়তার ফোন বেজে ওঠে। প্রহরের ফটো স্ক্রিনে ভেসে ওঠে। প্রিয়তা কিঞ্চিত অসস্তি নিয়ে কলটা ধরে। বলে,

” হু বলুন।

প্রহর গিয়েছিল রিজাইন দেওয়ার কিছু ফর্মালিটিস পূরণ করতে। ফিরেই প্রিয়তার খোঁজ নিতে ইচ্ছে হয়েছে তার। তাইতো এত রাতেও ফোন দিল প্রিয়তাকে। প্রিয়তার উক্ত কথায় সে বলে ওঠে,
” কি করছেন ম্যাডাম? মিস করেননি আমাকে?

প্রিয়তা হেসে ফেলে এমন সম্বোধনে। বলে,
” দুপুরেই তো দেখা হলো। মিস করবো কেন?

‘ আমি চাই আপনি আমাকে প্রতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে মিস করুন।

” বুঝেছি বুঝেছি। ফোন রাখুন এখন।

” কেন?

” কাজ করছি।

” এত রাতে?কি কাজ?

” রান্না করছি। মেহমান এসেছেন। ভালোমন্দ রান্না না করলে চলে?

” মেহমান? কে? বিচলিত কণ্ঠে বলে প্রহর।

প্রিয়তা তরকারিতে ঝোল দিয়ে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দেয়। আরহামদের থেকে দূরে সরে আসে। প্রহরকে হঠাৎই জ্বালাতে ইচ্ছে হয় প্রিয়তার। মুচকি হেসে লাজুক ভঙ্গীতে বলে,

” আমার না হওয়া হবু শাশুড়ি এসেছেন।

প্রহরের ললাটে ভাঁজ পরে। ওষ্ঠাদ্বয় চেপে ধরে দাঁত দ্বারা। চোয়াল শক্ত করে বলে,

” হবু শাশুড়ি? কি বলছেন?

” একটা আন্টি এসেছেন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। উনার ছেলের বউ হিসেবে আমাকে চাইছেন। এত রাতে নাকি আবার সিলেটে ফিরে যাবেন। এটা কেমন বেমানান দেখায় তাইনা বলুন? এজন্যই তো আমি বললাম আজ রাতটা আমাদের ঘরে থেকে যেতে।

প্রহর বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে জড় বস্তুর মতো। প্রিয় মানুষের এহেন কথায় বিচলিত হয় ছেলেটা। বলে,
” আপনি বলেননি আপনার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে?

প্রিয়তা উত্তর দেয় না। প্রহর উত্তেজিত হয়। কণ্ঠে দৃঢ়তা আসে। বলে,

” আমরা আগামীকাল বিয়ে করবো প্রিয়তা। তৈরী হয়ে থাকবেন।

প্রিয়তা চমকে উঠে। ততক্ষণাৎ বলে,
“আরেহ্! আমি বলেছি আপনার কথা। চিন্তা করবেন না।

” আমি কোনো কথাই শুনবো না। এমন দুষ্টুমি করার জন্য আপনাকে আদুরে শাস্তি দিতে চাই। রাখছি। টা টা।

কল কাটে প্রহর। হতভম্ব চোখে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকে প্রিয়তা। আরহাম ডাকে। ছুটে আসে ঘরে। প্রহরের কথাগুলো কানে বাজতে থাকে। লজ্জা পায় প্রিয়তা। নত হয় মুখশ্রী। রক্তিম হয় নাকের মাথা। চোখ বন্ধ করে শ্বাস নেয় ঘনঘন। চোখের পাতায় ভেসে ওঠে প্রহরের মুখটা। লাজুক হাসে প্রিয়তা।

____

সকাল সকাল রাবেয়া খানম বাসে উঠলেন। সোহেল ছেলেটা তার মাকে বাসে উঠিয়ে দিল দায়িত্বের সাথে। সোহেল এখান থেকে যাবে না হয়তো। বুঝতে পেরে খানিক বিরক্ত হলো প্রিয়তা। স্টেশনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তারা। মেহমান বাড়ি থেকে চলে গেলে তাকে এগিয়ে দিয়ে আসতে হয়। ভদ্রতাসূচক সেটুকু করতে স্টেশনে এসেছে প্রিয়তা। গতরাতে মাছ রান্না করে খাইয়েছিল রাবেয়া খানমকে। মহিলা যথেষ্ট বিনীত এবং মার্জিত আচরণ করেছেন প্রিয়তার সাথে। আরহামের সাথেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন কয়েক ঘন্টায়। আরহামকে যারা ভালোবাসে প্রিয়তাও তাদের ভালোবাসে। তাদের প্রতি কোনো রাগ থাকে না প্রিয়তার।

জানালার পাশের সিটে বসেছেন রাবেয়া খানম। মাথা বের করে প্রিয়তাকে ডাকলেন তিনি। প্রিয়তা এগিয়ে গেল। বাসের জানালার দিকে তাকিয়ে রইল। মহিলা হাসি মুখে বললেন,

” তোমার সম্পর্কে সব শুনেছি। আমার ছেলের ভাগ্যে হয়তো তুমি নেই। আমার ধারণা তুমি যার জীবনে যাবে তার জীবনকে আনন্দময় করে তুলতে পারবে।

প্রিয়তা হাসে। মাথা নত করে। বলে,
” উনাকে আপনার সাথে নিলেন না?

” ওর তোমার সাথে নাকি কথা আছে। সে কথা হয়ে গেলেই ও চলে যাবে। আমি কথা দিচ্ছি ও তোমাকে বিরক্ত করবে না।

প্রিয়তা মানে। বাস ছেড়ে দেয়। আরহামকে নিয়ে বাড়ির দিকে ফিরে প্রিয়তা। সোহেল পিছু পিছু হাঁটে। প্রিয়তার অসস্তি হয়। কাঠকাঠ কণ্ঠে সে বলে ওঠে,

” আপনি আমার আশেপাশে না থাকলে আমি খুশি হবো। আপনি আমার সাথে কিছু কথা বলতে চান তাইতো? আরহামের সামনে আমি এসব বিষয়ে আলোচনা করতে চাই না। একটা সময় নির্ধারণ করুন।

সোহেলের পা থামে। লজ্জিত হয় ছেলেটা। বলে,
” আমি তোমাকে সময়টা জানিয়ে দিবো।

” ঠিক আছে।

________

প্রীতিলতা রান্না-বান্না করে ঘরে ঢুকেছে মাত্র।আজিজ ঘুমে এখন। ডাকতে হবে তাকে। প্রীতি স্বামীর পাশে গিয়ে বসে। নম্র কণ্ঠে ডাকে,

” শুনছো? ওঠো। অফিসে যাবে না?

আজিজ উঠে বসে খানিক সময় নিয়ে। প্রীতির হুট করেই গা গুলিয়ে ওঠে। বমি-বমি ভাবটা আবার ও জেগে ওঠে। তন্ত্র পায়ে ওয়াশরুমে গিয়ে বমি করে দেয় প্রীতি। শরীরে ক্লান্তি ছেয়ে যায়। ঘরে ফিরে উবু হয়ে শুয়ে পরে বিছানার মাঝ বরাবর। চিন্তিত হয় আজিজ। স্ত্রীর কাছে এসে জিজ্ঞেস করে,

” গ্যাস হয়েছে নাকি?

প্রীতি অশ্রুসজল চোখে স্বামীর পানে চায়। ধীরে ধীরে উঠে বসে। ওয়ারড্রবের সম্মুখে এগিয়ে যায়। ড্রয়ার খুলে একটি কাগজে পেঁচানো বস্ত এগিয়ে দেয় আজিজের দিকে। আজিজ দ্রুত খুলে দেখে বস্তুটা। প্রেগনেন্সি কিট দেখে কিছুটা চমকে ওঠে। লাল দুটো দাগ দেখে বিমূঢ় নয়নে তাকায় স্ত্রীর পানে। বলে,

” তুমি প্রেগন্যান্ট?

প্রীতির চোখেমুখে খুশির চিহ্ন নেই। কেমন মলিন দেখাচ্ছে তাকে। স্বামীর এহেন প্রশ্নে বিরক্ত হয় সে। বলে,

“দেখতেই তো পাচ্ছো।

আজিজ দ্রুত প্রীতির নিকটে এসে চুমু খায় প্রীতির গালে। জড়িয়ে ধরে। খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয় আজিজের হৃদয়। বলে,

” কবে জানতে পেরেছো? আমায় বলোনি কেন?

প্রীতির ভাবভঙ্গি বুঝতে পারে না আজিজ। এত খুশির একটা খবর দেওয়ার সময় প্রীতির মুখটা এমন ফ্যাকাশে করে রাখার কারণ কি? ততক্ষণাৎ বাইরে গিয়ে মাকে ডেকে আনে আজিজ। প্রীতির শাশুড়ি ছুটে এসে আনন্দের সাথে বলে,

” তুমি আমারে আগে কইবা না আমার নাতি-নাতনি আইবো? আমার নাতি-নাতনির লগে আমি খেলমু। আমার অনেক দিনের স্বাধ। বহো বহো। আজ থাইকা কোনো কাম করা লাগবো না তোমার।

প্রীতির চোখ ভরে ওঠে নোনাজলে। মা হবার অনুভূতি তার কাছে নতুন নয়। এর আগেও সে গর্ভে প্রিয়তা আর আরহামকে ধারণ করেছিল। তাদের প্রতি যে ভালোবাসা ছিল সেসময়, এই সন্তানের প্রতি সেই ভালোবাসা জাগছে না প্রীতির। প্রিয়তা আর আরহাম আসার সংবাদ পেয়ে যতটা খুশি হয়েছিল, তার বিন্দু পরিমাণ আনন্দ ও এখন হচ্ছে না। প্রীতির শাশুড়ি দ্রুত যান আচার আনতে। আজিজ প্রীতির চোখের পানি খেয়াল করে। রাগে হয় তার। ক্ষুদ্ধ কণ্ঠে বলে,

” অন্যের বাচ্চা পেটে রাখতে খুব ভালো লাগে তাইনা? আমার বাচ্চা তোমার পেটে আইছে তাই ভালো লাগতেছে না। আনন্দ নাই। আরিফের বাচ্চা পেটে রাখতে খুব ভালো লাগছে। এতই যখন আগের সন্তানদের প্রতি দরদ, তাইলে আসলি কেন আমার কাছে? ঢং করস তুই। মা*গী

ধপ করে বিছানায় শুয়ে পরে প্রীতি। ফুঁপিয়ে উঠে নিঃশব্দে। এত কষ্ট কেন হচ্ছে তার? নবজাতকের প্রতি ভালবাসা দেখাতে কেন পারছে না সে? কেন আনন্দ হচ্ছে না?

চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

[ রি-চেইক দিই নাই ]

প্রিয়তার প্রহর ২ পর্ব-০৯

0

#প্রিয়তার_প্রহর (২য় পরিচ্ছেদ )
পর্ব সংখ্যা ( ৯ )

ভোর হয়েছে। আলো ফুটছে একটু আধটু। অন্ধকার কেটে সূর্যের রশ্মি কিরণ দিচ্ছে। পুরো ঘরটা অন্ধকার। আলোর রেশ নেই। জানালার সামনে পর্দা মেলে দেওয়া। আলো আসার উপায় নেই ঘরে। ইহান টেবিল থেকে পানি পান করল। গলা ভিজিয়ে বালিশে এক হাত দিয়ে তার উপর মাথা ঠেকিয়ে শুয়ে রইল। সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তানিয়া ঘুমিয়েছে অনেক রাত করে। নতুন ঘর, নতুন বিছানা, পাশে অনাকাঙ্খিত একজন বলিষ্ঠ দেহের পুরুষ। ঘুমোবে কি করে? মাঝরাতে চোখের পাতা এক করেছে সে। ইহান সবটাই বুঝেছে। তানিয়া চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল অনেক রাত অবধি। ঘুমোতে পারেনি। হয়তো বা অসস্তি হচ্ছিল মেয়েটার।

ঘাড় ঘুরিয়ে তানিয়ার দিকে তাকায় ইহান। এখন ঘুমে কাদা হয়ে আছে মেয়েটা। খোঁপা বেঁধেছিল ঘুমোনোর আগে। এলোমেলো হয়ে গেছে এখন চুলগুলো। নীল রঙের শাড়ির ভাঁজে মেদহীন পেট উন্মুক্ত হয়ে আছে তানিয়ার। চিকচিক করছে মুখের আশপাশ। তানিয়ার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসল ইহান। পুরুষত্ব জেগে উঠল বোধহয়। পাশে অমায়িক সৌন্দর্য বহন করা এক রমণী। ইহানের নিজস্ব, ব্যক্তিগত মানুষ। ছুঁয়ে দেখার লোভ জাগল মুহূর্তেই। কম্পিত শীতল ডান হাত উঁচিয়ে ধীর গতিতে হাত রাখল তানিয়ার পেটে। আচানক শিরশির করে উঠল ইহানের দেহ। বুকের পাশটা ধক করে উঠল। ঘুমের মাঝেই তানিয়া কেঁপে উঠল। একটু নড়ে আবার ও ঘুমে আচ্ছন্ন হলো। ইহান হাত সরায়। গলা শুষ্ক হয়ে আসে তার। জিভ দ্বারা ঠোঁট ভেজায়। উঠে বসে বিছানায়। এলোমেলো লাগে নিজেকে। শ্বাস ফেলে ঘনঘন। টেবিল থেকে পুনরায় পানি নিতে গিয়ে ইহান খেয়াল করে তার হাত অসাড়, অবশ হয়ে আসছে। গ্লাসটা ধরতে পারল না ইহান। মেঝেতে পরে গেল পানিভর্তি গ্লাসটা। ঝনঝন শব্দ বেজে উঠল ঘরটাতে। তানিয়ার ললাটে ভাঁজ প্রতীয়মান হলো। চোখ কচলে শাড়ি ঠিক করে উঠে বসল ততক্ষণাৎ। ইহানকে এভাবে বসে থাকতে দেখে ঘুমু ঘুমু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,

” কিসের শব্দ হলো?

ইহানের ভয় হয়। তানিয়া কি দেখে ফেলেছে ইহানের অভিব্যক্তি? বুঝতে পেরে গেছে অনাকাঙ্খিত স্পর্শটি ইহানের ছিল? ইহান বোকা হাসে। দু পাশে মাথা নাড়িয়ে বাচ্চাদের মতো বলে ওঠে,

” কিচ্ছু হয়নি। গ্লাসটা পরে গেছে।

তানিয়ার সন্দেহ কমে না। গাঢ় দৃষ্টি মেলে তাকায় ইহানের পানে। লোকটাকে কেমন অস্থির লাগছে। এসির শীতলতা থাকা সত্তেও ইহান তিরতির করে ঘামছে। তানিয়ার ভালো লাগল না বিষয়টা। সাবধানে হাত রাখল ইহানের ঘাড়ে। বলল,

” কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছেন?

” উঁহু!

তানিয়া কি বলবে ভেবে পায় না। ইহান ঘামছে প্রচণ্ড। লালচে হয়ে গিয়েছে চোখ। কেমন এলোমেলো লাগছে ইহানকে। তানিয়ার চিন্তা বাড়ে। পুনরায় প্রশ্ন করে,

” রাতে ঘুমোননি? চোখ লাল হয়ে গিয়েছে।

ইহান নিজেকে স্বাভাবিক করে তোলে। তানিয়ার দিকে তাকায় ভালোভাবে। সদ্য ঘুম থেকে ওঠা মেয়েটাকে বড্ড অন্যরকম লাগছে। নিষ্পাপ লাগছে তানিয়াকে। ইহান কি করে বলবে তার মনের কথা? পুরো রাতটাই তো তানিয়াকে দেখে দেখে পাড় করেছে সে। কি করে বলবে এ কথা? ইহান কথা বাড়ায় না। নেমে যায় বিছানা থেকে। জানালার পর্দা সরিয়ে দেয়। আলোর তীর্যক রশ্মি ঘরটিতে প্রবেশ করে। বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। অতঃপর তানিয়ার উদ্দেশ্যে বলে,

” তুমি কি আবিরকে ভালোবাসো তানিয়া? ডু ইউ লাভ হিম?

তানিয়া হতবাক। হঠাৎ এ প্রশ্ন তাকে কেন করা বুঝতে পারল না। বিরক্ত হলো সে। ঘুম থেকে উঠে এমন অদ্ভুত প্রশ্ন করছে কেন ইহান? মাথাটা কি গেছে? বিছানা থেকে নামতে নামতে তানিয়া উত্তর দিল,

” এ কথা কেন বলছেন?

” আবির রাত বারোটায় তোমাকে কল করেছিল।

” ধরেছিলেন কল?

” না।

” কেন? এত রাতে ফোন দিল। হয়তো কোনো ইমার্জেন্সি।

ইহান পেছন ফিরে তাকায়। ললাটের রগ ফুলেফেঁপে ওঠে। তীর্যক চোখটা ভয়ঙ্কর লাগে তানিয়ার নিকট। ইহান আলমিরা থেকে শার্ট বের করে বাথরুমে যেতে যেতে তানিয়ার উদ্দেশ্যে বলে,
” তুমি কলটা ধরলেই বোধহয় আবির বেশি খুশি হবে। তাই ধরিনি।

ততক্ষণাৎ জবাব দেয় তানিয়া,
” এমন কেন মনে হলো আপনার?

ইহান কথা বাড়ায় না। গোসল করে ইউনিফর্ম গায়ে জড়িয়ে বের হয় থানার উদ্দেশ্যে। আজ একটু দ্রুতই থানার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। পিছু ডাকে না তানিয়া। এমন অদ্ভুত আচরণ করার মানে কি? আর আবির-ই বা এত রাতে কল করতে গেল কেন?

______

প্রিয়তার দেহ উষ্ণ। জ্বর আসছে বোধহয়। মাথা ব্যথা করছে কিছুটা। পাত্তা দেয় না প্রিয়তা। আরহামকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে টিউশনিতে যায়। প্রিয়তার বাড়ি থেকে পনেরো মিনিট হেঁটে গেলেই জয়নাল হাকিম নামক লোকের বাড়ি। লোকটির বয়স ষাটের অধিক। স্ত্রী, ছেলে, ছেলের বউ আর নাতিন নিয়ে বড় একটি বাড়িতে থাকেন জয়নাল সাহেব। অত্র এলাকার মেম্বার তিনি। এলাকার সবাইকে দাবিয়ে রাখে কথার ঝাঁঝে। রেগে গেলে গোঁফে হাত বুলিয়ে চেঁচামেচি করাই লোকটার স্বভাব। সাভারে উনার আরো একটি বাড়ি রয়েছে। বাড়িটি ভাড়া দিয়েছেন তিনি। বর্তমানে ছেলের সাথে এখানেই বসবাস করেন। এ এলাকায় তেমন পড়াকু ছেলেমেয়ে নেই। থাকলেও তাদের বয়স নিতান্তই কম। টিউশনি করানোর মতো অভিজ্ঞতা নেই তাদের। অগত্যা প্রিয়তাকে তিনি ডেকে আনলেন বাড়ি। নাতিনকে পড়ানোর জন্য অনুরোধ করলেন। প্রিয়তা অকপটে না করতে পারে না। এলাকায় লোকটার দুর্নাম খুব। ব্যবহার ভালো নয়। এজন্যে প্রিয়তা প্রথমে রাজি হয়নি লোকটার নাতিনকে পড়াতে। কিন্তু টাকার পরিমাণটা মনমতো হওয়ায় রাজি হয় প্রিয়তা। পড়াতে আসে গত একমাস ধরে।

জয়নাল হাকিমের বাড়ির সামনে বিশাল বড় দরজা। দারোয়ানকে দেখেই প্রিয়তা সালাম দিল। প্রতিত্যুরে সালামের জবাব নিল দারোয়ান লোকটা। প্রত্যেকদিনের মতো এগিয়ে গেল চঞ্চলের ঘরে। অত্যন্ত চঞ্চল হওয়ায় জয়নাল হাকিম নাতিনের নাম রেখেছেন চঞ্চল। ছেলেটা যে কতটা চঞ্চল আর দুষ্টু তা এতদিনে বেশ ভালোই বুঝেছে প্রিয়তা। ঘরে ঢুকে টেবিলে বসল প্রিয়তা। ছুটে এলো চঞ্চল। পরণে তার হলদে গেঞ্জি। হাতে থাকা ঘড়িটিতে লাল-নীল আলো জ্বলছে। প্রিয়তাকে পড়ানোর জন্য আসতে দেখে বিরক্ত হয় ছেলেটা। চোখমুখ কুঁচকে বলে ওঠে,

” আজ আমি পড়বো না। বাড়ি যাও।

প্রিয়তা হাসে। রোজই ছেলেটা এমন করে। পড়তে চায় না একদম। মাঝে মাঝে প্রিয়তাকে যা তা বলে বের করতে চায়। এখন ও স্কুলে ভর্তি হয়নি চঞ্চল। ভর্তি করানোর পূর্বে সাধারণ জ্ঞানগুলো আয়ত্বে রাখার জন্যই চঞ্চলকে প্রাইভেট পড়ানো হচ্ছে। কতই বা বয়স হবে ছেলেটার? পাঁচ কি ছয়? প্রিয়তার এমন হাসি দেখে রেগে যায় চঞ্চল। ফর্সা মুখটা লাল হয় মুহুর্তেই। বলে,

” হাসবি না। কাজ নেই তোর? আমি পড়বো না মানে পড়বো না। চলে যা।

প্রিয়তা রাগে না। আদর করে কাছে টেনে নেয় ছেলেটাকে। বলে,
” না পড়লে সবাই তোমাকে পচা ছেলে বলবে। পড়ালেখা না করলে বড় হবে কি করে?

বিরক্তি নিয়েই চঞ্চল বসে পরল প্রিয়তার সামনের চেয়ারটিতে। না পড়লে তার আম্মু ভিষণ বকে। সেজন্য বাধ্য হয়েই রোজ প্রিয়তার সামনে বসে থাকে চঞ্চল। আজ ও বসে রইল। প্রিয়তা গতকাল স্বরবর্ণ পড়িয়েছে। খাতার প্রথম রেখায় বড় বড় করে স্বরবর্ণের কয়েকটা বর্ণ লিখে দিয়েছে। নিচে নিচে সেগুলো লিখে যাওয়াই চঞ্চলের বাড়ির কাজ। প্রিয়তা জিজ্ঞেস করল,

” বাড়ির কাজ করেছো? লিখতে দিয়েছিলাম যে?

না বোধক মাথা নাড়ে ছেলেটা। পাশে পরে থাকা স্মার্টফোন হাতে তুলে নেয়। টকিং টম গেইমস বের করে খেলতে শুরু করে। প্রিয়তার রাগ হয়। একমাস ধরে পড়াচ্ছে এই ছেলেটাকে। এখনও অবধি ব্যঞ্জনবর্ণ, স্বরবর্ণ শেখাতে পারেনি। এভাবে রোজ পড়ায় হেলাফেলা করলে চলবে? প্রিয়তাকে কি এমনি এমনি টাকা দিবে এ বাড়ির লোক? প্রিয়তা কি এমনি এমনি টাকাগুলো নিবে? প্রিয়তা রাগ দেখাল। গম্ভীর করল চোখমুখ। কলম হাতে তুলে নিয়ে বলল,

” হাত বাড়াও।

ড্যাবড্যাব করে তাকাল চঞ্চল। বুঝতে পারল মিস তাকে মারবে। ভয় পেল না চঞ্চল। হাত বাড়াল ধীর গতিতে। প্রিয়তা কলম দিয়ে চঞ্চলের হাতের তালুতে প্রহার করল। ব্যথা পাওয়ার মতো অতটা জোর দেয়নি যদিও, তবুও কেঁদে দিল চঞ্চল। ভ্যাবাচ্যাকা খেল প্রিয়তা। এতটুকু আঘাতে কেঁদে ফেলে কেউ? থামানোর চেষ্টা করল সে। প্রিয়তার হাতে থাপ্পড় মারল চঞ্চল। প্রিয়তা ধমক দিল। ঠিক সেই মুহুর্তেই চঞ্চলের দাদা জয়নাল হাকিম উপস্থিত হলেন ঘরে। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে তিনি হাঁক ছাড়লেন। বললেন,

” ভাই কইরে?

চঞ্চল দৌঁড়ে দাদার কোলে উঠল। ঝিমিয়ে রইল দাদুর বুকে। কেঁদে উঠল ফুঁপিয়ে। নাতিনের চোখে পানি দেখে ক্ষুদ্ধ হলেন জয়নাল। চিন্তিত হলেন বেশ। চঞ্চলের গালে চুমু খেয়ে বললেন,

” আমার ভাই কান্দে কেনরে?

চঞ্চল আহ্লাদে গলে পরে। বিচার দেয় দাদুকে। বলে,

” দাদু মিস আমাকে খুব মেরেছে। খুব বকেছে। আমি পড়বো না এই মিসের কাছে। খুব খারাপ এই মিস।

প্রিয়তা ভড়কায়। সে তো ব্যথা পাওয়ার মতো করে মারেইনি। আজ খানিকটা বিরক্ত হয়েই চঞ্চলকে ভয় দেখাতে এটুকু করেছে সে। চঞ্চল এতটা ভয় পাবে বুঝতে পারেনি প্রিয়তা। জয়নাল হাকিম নাতিনের কথা শুনে ক্রোধে ফেটে পরলেন। ততক্ষণাৎ প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

” তুমি আমার ভাইরে মারো কোন সাহসে? ও ছোট মানুষ। পড়া না পারলে বুঝাইবা। একশো বার না বুঝলে একশোবারই বুঝাইবা। কোন সাহসে তুমি আমার নাতিনের গায়ে হাত দাও?

প্রিয়তার ভয় হয় না। সে কোনো ভুল করেনি এমন মাথা নত করে থাকার কোনো মানে হয়? দৃঢ় হয় প্রিয়তার কণ্ঠ। বলে ওঠে,

” চঞ্চল একদমই পড়তে চায় না চাচা। খুব কষ্ট করে পড়াতে হয়। পড়া দিলে পড়ে না, লেখা দিলে লিখে না। ওকে ভয় দেখাতে আজ কলম দিয়ে হাতে আলতো করে মেরেছি। হাতে দাগ ও হয়নি। দেখুন আপনি।

হুংকার ছেড়ে জয়নাল বলে ওঠেন,
“আমার ভাই মিথ্যা কথা কয় না।

প্রিয়তার তর্কে জড়াতে ইচ্ছে হয় না। আরো কিছুক্ষণ উপদেশ দিয়ে জয়নাল বলেন,
” আমার ভাইরে মারবা না। ওর গায়ে ফুলের টোকাও যেন না পরে কইয়া দিলাম। শুধু পড়াইবা চইলা যাবা। নাতিন যদি আর বিচার দেয়..। আমি কোনোদিন আমার ভাইয়ের সাথে জোরে কথা কই না। আর তুমি গায়ে হাত তুলো।

প্রিয়তার খারাপ লাগে। বলে,
” আপনি তাহলে অন্য টিচার খুঁজে নিবেন চাচা। চঞ্চলকে পড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বাচ্চাদের শুধু আহ্লাদ দিলেই চলে না। সময় মতো ধমক ও দিতে হয়। আমার সাথে ও তুই-তুকারি করে। মাঝে মাঝে লাথিও দেয়। আমি বুঝিয়ে বলতে বলতে ক্লান্ত। মিনিমাম ভদ্রতা টুকু আপনার নাতিনের মাঝে নেই। কখনো সালাম তো দেয়ইনি বরং এতদিন দুর্ব্যবহার করে গেছে। এগুলো তো আমার শেখানোর কথা নয়। বাচ্চাদের প্রথম শিক্ষা আসে তার পরিবার থেকে। আপনারা ওকে শেখাননি কাকে কিভাবে ট্রিট করতে হয়। আপনারা ওকে এতটাই আদর-আহ্লাদ দিয়েছেন যে ও কোনো কিছুকে পরোয়া করে না। ভয় পায় না। আপনি এলাকার মেম্বার বলে ও ভাবে সবাই ওর কথামতো চলবে। কিন্তু এটা তো ওর ভুল ধারণা। বড়দের সম্মান করার বিষয়টা আপনাদের ওকে শেখানো উচিত ছিল।

থামে প্রিয়তা। পুনরায় বলে,
” আপনি ওর জন্য অন্য টিচার খুঁজে নিবেন। আমি ব্যর্থ। আজ আসছি। আসসালামু আলাইকুম।

চলে আসে প্রিয়তা। যেখানে সম্মান নেই সেখানে সে থাকবে না। অপমান মুখ বুজে সহ্য করবে না আর। অনেক হয়েছে। অনেক।

______

মন খারাপ করে রাস্তায় পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে প্রিয়তা। মাথা ব্যথা করছে। শরীরের উষ্ণতা বেড়েছে। বাড়ি গিয়েই নাপা খেতে হবে। ভাবতে ভাবতে রাস্তা পাড় হতে চায় প্রিয়তা। যানবাহন অন্যদিনের তুলনায় বেশি। পাড় হতে বেশ ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে প্রিয়তার। একের পর এক যানবাহন চলছেই। থামার নামগন্ধ নেই। প্রিয়তা থামে। দাঁড়িয়ে থাকে। আচমকা কব্জিতে শক্তপোক্ত হাতের গাঢ় ছোঁয়া পায় প্রিয়তা। পাশ ফিরে তাকানোর পূর্বেই পুরুষ অবয়ব রাস্তার দিকে এগোয়। হাত দিয়ে যানবাহন গুলোকে একের পর এক থামিয়ে ওপার থেকে এপারে টেনে আনে প্রিয়তাকে। থমকায় প্রিয়তা। হতবিহ্বল হয়ে তাকায়। প্রহরকে দেখে সস্তি মেলে। লোকটা হুটহাট এমন সব কাজ করে যে প্রিয়তা ভয়ে গুটিয়ে যায়। প্রহর অভ্যেসবশত মুচকি হাসে। কাছে টানে মেয়েটাকে। বলে,

” এত কি ভাবছেন প্রিয়তা? আমি আসছি দেখতে পেলেন না।

প্রিয়তা আড়চোখে তাকায়। মনটা সত্যিই খারাপ হয়ে গেছে তার। এত ভালো একটা টিউশনি চলে গিয়েছে ভাবতেই বিষাদে ছেয়ে যাচ্ছে হৃদয়। ফ্যাকাশে মুখে প্রিয়তা বলে ওঠে,

” ভালো লাগছে না।

প্রহরের ললাটে ভাঁজ দেখা দেয়। বিচলিত হয় প্রিয়তার এহেন অভিব্যক্তিতে। চিন্তিত ভঙ্গিতে প্রিয়তার ললাটে হাতের এপাশ ওপাশ ছোঁয়ায়। প্রিয়তার শরীরের উষ্ণতা বুঝতে পেরে চিন্তায় জমে যায় প্রহর। প্রিয়তাল নরম গালে হাত বুলিয়ে বলে,

” জ্বর এসেছে আপনার। ইশশ! এই অবস্থায় বেরিয়েছেন কেন?

প্রিয়তা কথা বলে না। প্রহরের চিন্তা বাড়ে। উত্তেজিত হয় ছেলেটা। প্রিয়তা হেঁটে চলে সামনের দিকে। পিছু হাঁটে প্রহর। রাগ হয় খানিক। পুনরায় জিজ্ঞেস করে,

” আপনি নিজের যত্ন নেন না কেন প্রিয়তা। আমাকে কষ্ট দেন কেন?

প্রিয়তা পিছু ফেরে। মায়া হয় প্রহরের এহেন সম্মোহনী বাক্য শুনে। নির্দ্বিধায় হাত ধরে প্রহরের। ধীর পায়ে চলতে চলতে বলে,

” একটা টিউশনি চলে গেল। ভালো স্যালারি দিতো। টিউশনি তো গেলই। সাথে অপমান..

” আপনাকে অপমান করেছে? কেন?

প্রিয়তা ফ্যাকাশে মুখে বলে সব কথা। প্রহরের রাগ হয়। কাঠ কাঠ কণ্ঠে বলে ওঠে,

” আপনাকে আর টিউশনি করতে হবে না। এই শরীর নিয়ে বের হবার সাহস করলেন কি করে? আল্লাহ্! আমার একটা কথা যদি এই মেয়ে শোনে।

” স্ট্রাগল করেছি এতদিন। হুট করে সবকিছু ছেড়ে দেওয়া যায়?

প্রহর বড় বড় শ্বাস ফেলে। বুঝতে পারে প্রিয়তাকে। প্রিয়তার আঙ্গুলের ভাঁজে আঙ্গুল ডুবায়। কাছের ফার্মেসিতে গিয়ে জ্বর পরিমাপ করায় প্রিয়তার। ফিরে আসার পথে অটো ধরে প্রহর আর প্রিয়তা। প্রিয়তার ভালো লাগে প্রহরের সান্নিধ্য। অগোছালো অনুভূতি দলা পাকিয়ে আটকে থাকে গহ্বরে। প্রিয়তা একটু হেসে মাথা এলিয়ে দেয় প্রহরের ঘাড়ে। প্রশান্তির হাসি হাসে প্রহর। হাত বুলায় প্রিয়তার চুলে। প্রিয়তা প্রশ্ন করে,
” আপনি এদিকে কি করছিলেন?

” ইন্টারভিউ দিয়ে আসছিলাম। মাঝপথে আপনার সাথে দেখা।

প্রিয়তা পর্যবেক্ষণ করে আটশাট হয়ে সান্নিধ্যে বসে থাকা লোকটাকে। প্রহরের গলায় নীল রঙের টাই। সাদা শার্টের সাথে নীল রঙের প্যান্ট পরিহিত ছেলেটা। পায়ে বুট জুতো। হাতে নীল ফিতে ওয়ালা চকচকে ঘড়ি। চুলগুলো বাতাসের ঝাপটায় এলোমেলো হয়ে এসেছে। লোকটার এমন সৌন্দর্যে মোহিত হয় প্রিয়তা। ফিক করে হেসে ওঠে। ভ্রু কুঁচকে ফেলে প্রহর। প্রিয়তা এড়িয়ে যায় হাসার কারণ। বলে,

” ইন্টারভিউ কেমন হয়েছে?

” চাকরি হয়ে গেছে। আজ থেকেই জয়েন করতে বলেছিল। চলে এসেছি। কাল যাবো।

” হুহ্!

” এরপর আপনাকে নিয়ে সিলেট যাবো। মা আপনাকে দেখার জন্য পথ চেয়ে বসে আছে।

________

আবির নামক লোকটার সাথে তানিয়ার সম্পর্ক সেদিনই শেষ হয়ে গিয়েছিল। আজ হঠাৎ আবিরের কল করার কারণ জানতে কল ব্যাক করল তানিয়া। তার সারাদিন কেটেছে হাসিমজায়। শাশুড়ির সাথে তানিয়ার ভাব আগে থেকেই বেশ ভালো ছিল। এ বাড়িতে বউ হয়ে আসার পর ইলমা বেগম তানিয়াকে মাথায় তুলে রাখেন। রান্নাবান্নায় আজ ইলমা বেগমকে সাহায্য করেছে তানিয়া। কাল থেকেই তাকে থানায় কাটাতে হবে সারাটাদিন। তাই আজকের দিনটা কোনোভাবেই ঝেরে ফেলতে চায়নি তানিয়া। সন্ধ্যে নামার পরপর ঘরে ফিরে আবিরকে কল করে সে। কল কেটে দেয় আবির। নিজেই কল ব্যাক করে আবির। তানিয়া কল ধরা মাত্রই ছেলেটা বলে ওঠে,

” কেমন আছো তানিয়া?

তানিয়া বিচলিত হয়। এই লোকটার সাথে তানিয়ার বিয়ে হবার কথা ছিল। আজ দুরত্ব মাইল ছাড়িয়েছে। এ মুহূর্তে কিভাবে কথা বলা উচিত লোকটার সাথে? বুঝতে পারল না তানিয়া। বিয়ে ভাঙার কারণে প্রতিবেশীরা কম কথা রটায়নি তার নামে। নিয়াজের মুখটাও ছোট হয়ে গিয়েছিল। নিজেকে দোষী ভেবে কতদিন মুখ গুঁজে বসে ছিলেন ঘরে। সে কথা ভেবে তানিয়া গম্ভীর হয়। কণ্ঠ স্বাভাবিক করে বলে,

” বেশ ভালো আছি। আপনি?

” আমি ভালো নেই।

তানিয়ার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো না ভালো না থাকার কারণ। তবুও ভদ্রতাসূচক জিজ্ঞেস করল,

” ভালো নেই কেন?

” তুমি কি করে বিয়ে করে ফেললে তানিয়া? আমি অভিমান করে দূরে সরে গিয়েছিলাম। তাই বলে তুমি আমাকে ফেরাবে না? মান ভাঙাবে না আমার?

তানিয়া হাসে। বলে,
” আপনার আর আমার চিন্তাধারা ভিন্ন। আল্লাহ্ চায়নি বলেই আমরা এক হইনি।

” তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। দেখা করবে প্লিজ? খুব জরুরী কথা।

তানিয়ার অসস্তি হয়। বলে,
” এখানেই বলুন আবির। আমি আলাদা ভাবে দেখা করতে পারবো না।

আকুতি-মিনতি করে আবির। মন নরম হয় তানিয়ার। অধিক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে মনে হয়। থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। অতঃপর বলে,

“আচ্ছা। আপনি লোকেশনটা জানাবেন।

_____

রাত বাজে নয়টা। ভার্সিটির সব পড়াশোনা শেষ করে জামাকাপড় ভাঁজ করছে প্রিয়তা। আরহাম খেয়েছে খানিকক্ষণ আগে। পড়তে বসেছে এখন। এ, বি , সি, ডি লিখছে খাতায়। প্রিয়তা চুল আঁচরে নেয়। আরহামের দিকে তাকিয়ে বলে,

” ঔষধ খাবে না? রাতে ব্যথা বাড়বে কিন্তু আরহাম।

আরহাম মাথা দুলায়। ঠোঁট ফুলিয়ে ফেলে। লিখতে লিখতে বলে ওঠে,

” প্রতিদিন ওষুধ খেতে ভালো লাগে না আপু। তেতো ওষুধ।

প্রিয়তার চোখের কার্ণিশে পানি জমে। অগোচরে মুছে ফেলে অশ্রুকণা। ভাইয়ের গায়ে হাত বুলায়। বই খাতা গুছিয়ে ব্যাগে ভরে দেয়। ঔষুধের পাতা থেকে ঔষধ বের করে ভাইয়ের হাতে গুঁজে দেয়। পানি দিয়ে বলে,

” ঔষধ না খেলে মাথার যন্ত্রণাও কমবে না। এত ব্যথা সহ্য করতে পারবে না ভাই। খেয়ে নাও। সোনা আমার।

আরহাম বাধ্য ছেলের মতো খেয়ে ফেলে ঔষধ। আবার ও লিখতে বসে। ঘুমোতে যাবার আগমুহুর্তে দরজায় টোকা পরে। এতরাতে কে আসবে? চিন্তিত হয় প্রিয়তা। হাঁক ছাড়ে। বলে,

” কে?

নারী কণ্ঠ ভেসে আছে দরজার ওপাশ থেকে। বলে,

” আমায় তুমি চিনবে না মা। আমি তোমাকে চিনি। তোমাকে দেখতে এসেছি। দরজা খোলো।

প্রিয়তা ভাবে। ওড়না ভালোমতো গায়ে জড়িয়ে নেয়। পরবর্তীতে দ্বিধা নিয়ে দরজা খোলে। দরজার ওপাশে শাড়ি পরিহিত এক মধ্যবয়সী নারীকে দেখে ভ্রু দ্বয়ের মাঝে ভাঁজ পরে প্রিয়তার। মহিলা হাসে। বলে,

” তুমিই প্রিয়তা?

প্রিয়তা মাথা নাড়ায়। ওরনা ভালো মতো টেনে নেয় মাথায়। বলে,

” জি আমি। আপনি কে?

” এক ছেলের মা। আমার ছেলের জন্য তোমাকে নিতে এসেছি। যেই ছেলেটা রোজ তোমায় চিঠি লিখে। আমি তারই মা।

চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ

প্রিয়তার প্রহর ২ পর্ব-০৮

0

#প্রিয়তার_প্রহর(২য় পরিচ্ছেদ)
পর্ব সংখ্যা (৮)

দুপুরের শেষ সময়। রোদটা একটু কমেছে। আরহাম ঘুমিয়েছে। রোজ দুপুরে এই সময় ঘুমায় ছেলেটা। প্রিয়তার ঘুম পেলেও সময় হয় না ঘুমোনোর। শপে যাওয়ার জন্য তৈরী হয় প্রিয়তা। গোসল করে হালকা মিষ্টি রঙের সুতির কামিজ জড়িয়ে নেয় গায়ে। ভেজা চুল গুলো ছেড়ে চওড়া ওড়না নিয়ে ঢেকে রাখে। চোখের নিচে কাজল দিয়ে আরহামের কপালে চুমু খায়। পার্স হাতে নিয়ে বের হয় ঘরের বাইরে। শপে হেঁটে যেতে প্রিয়তার আধঘন্টার বেশি সময় লাগে। প্রথম প্রথম আরো বেশি সময় লাগতো। ঘন্টা দেড়েক সময় চলে যেতো। এখন হাঁটার অভ্যেসটা ভালো মতো হয়েছে। পয়তাল্লিশ মিনিটের মাথায় পৌঁছে যায়। মাসের শেষের দিকে যখন টাকা হাতে কম থাকে, তখনই হেঁটে ফিরে প্রিয়তা। বাকি দিনগুলোয় বাসে যাতায়াত করে।

স্টেশনের আশপাশে মানুষজন ভরতি। আজকে বাস কম আসছে। মানুষজন দাঁড়িয়ে আছে বাসের অপেক্ষায়। প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েদের হাতে ফোন। সময় কাটানোর জন্য ফোনটাকে ব্যবহার করছে তারা। বাস এলেই তারা ফোনটা রেখে তড়িঘড়ি করে বাসে উঠতে চাইবে। প্রিয়তার এসব মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। এসব সে দেখে আসছে অনেকদিন ধরে। এই সময়টায় যারা যাতায়াত করে তাদের প্রায় সকলের সাথেই প্রিয়তার ভালো পরিচয় আছে। মাঝে মাঝেই কথা হয়।

ভাবনা চিন্তার মাঝেই প্রিয়তার অতি নিকটে এসে থামে সাদা-কালো বাইক। রোদের ক্ষীণ আলোয় চিকচিক করছে বাইকটা। প্রিয়তা বিচলিত হয় প্রথমে। ভয় পেয়ে যায় আচমকা এমন আগমনে। হেলমেট খুলে প্রহর। প্রহরকে দেখে সস্তি মেলে প্রিয়তার। শ্বাস ফেলে। প্রহর হাসে প্রিয়তার এহেন অভিব্যক্তি দেখে। বলে,

” আপনি ভয় ও পান? বাব্বাহ্! ইটস মিরাকেল।

প্রিয়তা চোখ ছোট ছোট করে ফেলে। অন্যসময় হলে লোকটাকে তাড়িয়ে দিত প্রিয়তা, হেলাফেলা করতো। কিন্তু গতকাল থেকে লোকটা তার মনের মাঝে এমন ভাবে গেঁথে নিয়েছে নিজেকে যে প্রিয়তা মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারেনি। দমে গিয়েছে সে। লোকটার প্রেমে পড়েছে। প্রহরের এহেন বাক্যে রাগ দেখানোর মিছে অভিনয় করল প্রিয়তা। অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল,

” তো ভয় পাবো না? ভূতের মতো শব্দ করে ধুরুম করে সামনে এসে পরলে যে কেউই ভয় পাবে। আমি কি রোবট? যে ভয় পাবো না?

প্রহর পুনরায় হাসে। হয়েছে কি ছেলেটার? আজ একটু বেশিই হাসছে না? একটু বেশিই প্রফুল্ল লাগছে না ছেলেটাকে? প্রিয়তার এমন মিছে অভিনয় দক্ষতার কাছে ধরে ফেলে প্রহর। বলে,

” আপনি রোবট নন। পাথর। আর এই পাথরে ফুল ফুটিয়েছে প্রহর।

প্রিয়তা মুচকি হাসে। আলতো করে কিল বসায় প্রহরের বাহুতে। প্রহর বলে ওঠে,

” চলুন তবে।

অন্য দিন হলে প্রিয়তা যেত না। কিন্তু আজকের দিনটাই বোধহয় অন্যরকম। কোনোরুপ ভনিতা না করে প্রিয়তা উঠে বসে বাইকে। ওড়নার অংশ কোলে রাখে। দুরত্ব বজায় রেখে বসে। হেলমেট মাথায় বেঁধে নেয়। প্রহরের কাঁধে হাত রাখে আলতো ভাবে। বাইকের গ্লাসে প্রিয়তাকে দেখে নিয়ে বাইক স্টার্ট দেয় প্রহর। দ্রুত গতিতে বাইক চালায়। পাকা রাস্তায় সর্বোচ্চ গতিতে শাই শাই করে চলে দুজন মানব-মানবী। প্রিয়তা চোখ ছোট ছোট করে ফেলে। কাঁধে রাখা আলতো হাতের স্পর্শ গাঢ় হয় তার। কাঁধে চাপ প্রয়োগ করে প্রিয়তা। বলে ওঠে,

” আরেহ্! ধীরে, ধীরে চালান। পরে যাবো। আল্লাহ্!

প্রহর হাসে শব্দ করে। বাইকের গতি কমায় না। উচ্চস্বরে বলে ওঠে,

” আমাকে জড়িয়ে ধরে বসুন প্রিয়তা। নইলে সত্যি সত্যি আপনাকে ফেলে দিবো।

” আপনি আমাকে ফেলে দিতে পারবেন? সন্দিহান চোখে তাকায় প্রিয়তা।

” কেন পারবো না? কষ্ট দিবো, ব্যথা দিবো। আবার নিজেই যত্নআত্তি করে সুস্থ করে তুলবো। মাঝে মাঝে একটু আদর..

” আহ্ প্রহর। বাজে কথা বলবেন না। স্পিড কমান। ভয় লাগছে আমার।

” আমাকে জড়িয়ে ধরুন। কথা দিচ্ছি বাইকের গতি কমিয়ে ফেলবো।

প্রিয়তা শোনে। ধীরে ধীরে কাঁধে থাকা হাতটা নামিয়ে ফেলে। প্রহরের পিঠ জড়িয়ে ধরে এক হাতে। লজ্জায় আড়ষ্ট হয় প্রিয়তা। মুখ চিবুকে গিয়ে ঠেকে। মূর্ছা যায় প্রিয়তা। শরীর কেঁপে ওঠে। হৃদপিণ্ডে অযাচিত আওয়াজ ঝংকার তোলে। হাসে প্রহর। প্রিয়তার কোমল, রক্তিম মুখের আদলে মোহিত হয়। এক হাত দিয়ে প্রিয়তার অপর হাতে হাত রাখে। প্রিয়তা মিইয়ে যায়। লজ্জা কাটাতে বলে,

” আপনি কি করে জানলেন আমি এসময় বের হবো?

” আপনার অন্তস্থলের ধকধক আওয়াজ ও আমি শুনতে পাই প্রিয়তা। আপনার মুভমেন্ট জানবো না?

প্রিয়তা চুপ থাকে। লোকটা যে এতটা অসভ্য তা তো জানতো না প্রিয়তা। আগে তো কখনো লোকটাকে এমন মনে হয়নি। দায়িত্ববান, ব্যক্তিত্ববান, সুদর্শন পুলিশ হিসেবেই প্রিয়তা লোকটাকে চিনতো। এখন লোকটা অভদ্র হয়েছে। উন্মাদ প্রেমিক হয়ে গিয়েছে। আচ্ছা প্রথম প্রেম বুঝি এমন হয়? এমন লজ্জা লাগে? প্রথম প্রেমের অনুভূতিতে এত ঝাঁঝ কেন? এত আনন্দ কেন হয়? জানে না প্রিয়তা। ভালো লাগায় ছেয়ে যায় হৃদয়। আশপাশে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে ফেলে প্রিয়তা। এটা তো শপে যাওয়ার রাস্তা নয়। প্রহর তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? প্রিয়তা উত্তেজিত কণ্ঠে বলে ওঠে,

” অ্যাই, আপনি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? উল্টোদিকে যাচ্ছেন কেন?

” আমাদের প্রেমটাকে মাখো মাখো করতে যাচ্ছি।

” আশ্চর্য!

” শপে আর যেতে হবে না আপনাকে। টিউশন করবেন শুধু। আমার বউকে আমি এত মানুষের সাথে হেসে হেসে কথা বলতে দিবো না। আমার হিংসে হয়।

” আমি চাকরি টা করবো না? টিউশন দিয়ে চলবে আমার? টিউশনিতে কয় টাকা পাই?

বাইক থামায় প্রহর। নেমে যায়। হেলমেট খুলে প্রিয়তাও নেমে দাঁড়ায়। আশপাশে মানুষ তেমন নেই। রাস্তায় সারি সারি দোকান। খোলামেলা পরিবেশ। শাই শাই করে চলছে ভিন্ন ভিন্ন যানবাহন। চুল উড়ছে প্রিয়তার। প্রহর প্রিয়তাকে নামিয়ে দোকান থেকে দুটো লাচ্চি কিনে আনে। প্রিয়তার হাতে একটি দিয়ে অপরটি নিজের কাছে রাখে। বোতলের ছিপি খুলে চুমুক দিয়ে প্রহর বলে ওঠে,

” আপনি নিজের যোগ্যতায় উপার্জন করেন। এতে আমার বিধিনিষেধ নেই। কিন্তু আমি চাই না আপনি শপে কাজ করুন। যতটা সময় আপনি শপে দেন ততটুকু সময় আপনি বাড়িতে পড়াশোনা করবেন। আরহামকে সময় দিবেন। বাকি সময়টুকু টিউশনি করবেন। আমরা কিছুদিন বাদেই বিয়ে করবো প্রিয়তা। আপনার সকল দায়িত্ব আমার। আরহামের দায়িত্ব ও আমি নিচ্ছি। আপনার স্বাধীনতা আমি কেড়ে নিচ্ছি না। আপনি চাকরি করবেন, নিজের পায়ে দাঁড়াবেন, প্রতিষ্ঠিত হবেন। কিন্তু তার আগে পড়াশোনা শেষ করতে হবে। মন দিতে হবে পড়াশোনায়। এরপর না হয় অন্য চাকরিতে জয়েন করবেন। আগে বড় হন প্রিয়তা। এপর চাকরির কথা ভাবুন।

প্রিয়তা রাগে। ঠোঁট ফুলায়। কিছু একটা ভাবে। পরবর্তীতে আর কথা বাড়ায় না। প্রহর নিজেও তো প্রিয়তার জন্য অনেক কিছু স্যাক্রিফাইস করেছে। প্রিয়তা পারবে না? পারবে না লোকটার কথা রাখতে? নিজেকে সপে দিতে পারবে না প্রহরের নিকট? হেলমেট পরে আবার ও বাইকে ওঠে প্রিয়তা। হাসি হাসি মুখে বলে ওঠে,

” চলুন। বসের সাথে কথা বলে আসি।

প্রহর আপত্তি জানায়। প্রিয়তার বসে থাকা বাইকের অংশের দু পাশে হাত রেখে ঝুঁকে দাঁড়ায়। ঠোঁট গোল করে ফু দেয় প্রিয়তার ললাটে। ললাটে পরে থাকা এলোমেলো চুলগুলো উড়িয়ে দেয়। দুষ্টু হেসে বলে,

” জি না ম্যাম। আমরা এখন ঘুরতে যাবো। পুরো এলাকা ঘুরবো। আর আপনি আমাকে জড়িয়ে রাখবেন। যতবার কোমর থেকে হাত সরবে ততবার চুমু খাবো। অনেক জ্বালিয়েছেন। আর সে সুযোগ দিবো না।

প্রিয়তা নুইয়ে পরে। লজ্জায় নত হয় আবার। শিরা উপশিরায় শীতল স্রোত বয়ে যায়। নাকের ডগা রক্তিম হয়ে ওঠে। বিড়বিড় করে বলে,

” অসভ্য পুলিশম্যান।

________

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। অন্ধকার হচ্ছে চারপাশ। সূর্য ডুবে গেছে খানিকক্ষণ আগে। শীতল বাতাসে দুলে উঠছে সর্বাঙ্গ। শিরা-উপশিরায় নতুনত্বের ছোঁয়া গাঢ় হচ্ছে। এ বাড়িতে এসে তানিয়ার মোটেই অসস্তি হচ্ছে না। মনে হচ্ছে এ যেন তার নিজেরই বাড়ি। গত চারমাসে এই বাড়িটায় অনেকবার এসেছে তানিয়া। প্রত্যেকবার ইহানের কলিগ হিসেবে এলেও এইবার ইহানের স্ত্রী রুপে এ বাড়িতে এসেছে তানিয়া। এই অনুভূতিটা ভিন্ন। কেমন নতুন! তানিয়ার এখন কষ্ট হচ্ছে না। মনে হচ্ছে এই তো তাদের বাসা। অটো ধরলে আধঘন্টা লাগবে যেতে। তানিয়ার খানিক লজ্জাও লাগছে। নতুন বউ হিসেবে তার এ বাড়িতে কেমন ভাবে চলা উচিত? কেমন আচরণ করা উচিত?

তানিয়া বসে আছে ইলমা বেগমের পাশে। ইলমা বেগম মুখে শাড়ির আঁচল চেপে কেঁদে যাচ্ছেন। তানিয়া চেষ্টা করেছে কান্না থামানোর। কিন্তু ইলমা বেগম থামছেন না। কান্নাকাটি করে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছেন। তানিয়ার অদ্ভুত লাগছে। আজ তো তার কান্নাকাটি করার কথা। কিন্তু করছেন ইলমা বেগম। ইলমা বেগম কান্না করছেন তার স্বামীর জন্য। চোখ মুছে তিনি তানিয়ার উদ্দেশ্যে বললেন,

” আজ ও থাকলে কতই না খুশি হতো। ছেলের বিয়ে নিয়ে অনেক উত্তেজিত ছিল লোকটা। ছেলের বউয়ের জন্য গয়না বানিয়ে রেখেছে দু বছর আগে। ও তোমাকে ছেলের বউ হিসেবে দেখে যেতে পারল না। ছেলের বিয়েটা দেখতে পারল না।

তানিয়ার মন খারাপ হলো। ইহানের আব্বা ভিষণ ভালো মানুষ ছিলেন। তানিয়াকে মেয়ের মতো দেখতেন। আজ এই বিয়েটায় উনি থাকলে বেশ আনন্দিত হতেন। তানিয়াকে মাথায় তুলে রাখতেন বোধহয়। তানিয়া ইহানের ঘরে ফিরে। ফোন তুলে নেয় হাতে। বিয়ের পরই ইহান চলে গিয়েছে। থানায় নতুন কেস এসেছে। বসে থাকার উপায় নেই। বিয়ের কার্য সম্পাদন হবার সাথে সাথেই ইউনিফর্ম পরে চলে গিয়েছে থানায়।

ইহানের নম্বরে ডায়াল করল তানিয়া। একটু সময় নিয়েই ফোন ধরল ইহান। আজকে ইহানের কণ্ঠ কেমন অন্যরকম লাগল তানিয়ার নিকট। সেসব নিয়ে মাথা ঘামাল না সে। একটু চিন্তিত ভঙ্গিতে বউসুলভ আচরণের সাথে বলে উঠল,

” কোথায় আপনি?

তানিয়ার এমন কথায় অপ্রস্তুত হলো ইহান। নিঃশব্দে হাসল। সে হাসি স্থায়ী হলো না বেশিক্ষণ। গাম্ভীর্য টেনে নিল। ভ্রু দ্বয়ের পাশে চুলকে নিয়ে বলে উঠল,

” কেন বলো তো? বের হচ্ছি থানা থেকে।

” তাড়াতাড়ি আসুন। আন্টি কান্না করছে।

” আম্মা কাঁদছে?

” হ্যাঁ। আঙ্কেলের কথা মনে পরছে উনার। জলদি আসুন। আসার পথে আন্টির জন্য ফুচকা, আইসক্রিম আনবেন।

” আজ তো বাড়িতে ঢের রান্না হয়েছে। এসব কেন?

” মেয়েদের এসব বাইরের খাবার খুব ভালো লাগে বুঝলেন। ফুচকা, চটপটি, আইসক্রিম এসব তো আমাদের প্রিয় খাবার। আপনি আনবেন মনে করে।

” আসছি।

” হুহ সাবধানে।

ফোন রাখে তানিয়া। শরীরে থাকা অলঙ্কার খুলে ফেলল। বেগুনি রঙের ঝকমকে শাড়ি বদলে সুতির শাড়ি গায়ে জড়িয়ে পুনরায় ইলমা বেগমের পাশে বসে রইল। আধঘন্টার মাথায় ইহান ফিরল বাড়ি। হাতে কয়েকটা পলিথিন। ডাইনিং টেবিলে পলিথিন গুলো রেখে ইলমা বেগমের ঘরে ঢুকল ইহান। তানিয়া সরে দাঁড়াল। এখনও ইলমা বেগম কাঁদছেন। ইহান আম্মার পিঠে মাথা ঠেকায়। ক্লান্ত কণ্ঠে বলে,

‘ কাঁদছো কেন আম্মা? মাথা ব্যথা করবে তো।

ইলমা বেগম ঢলে পরেন ছেলের বলিষ্ঠ বুকের মাঝে। শব্দ করে কাঁদেন। ছেলের মুখে চুমু দেন। বলেন,

” তোরা আব্বা আজকে তোদের একসাথে দেখলে খুব খুশি হতো তাই না রে? তোর বিয়ে দেখার কত স্বাধ ছিল ওর। ও কি দেখতে পাচ্ছে আমাদের? বল না। দেখতে পাচ্ছে? খুশি হয়েছে তো? ও তোকে বিয়ে দেয়ার কত চেষ্টা করছিল। দ্যাখ আজ ও নেই। আমাকে একা করে দিয়ে চলে গেছে। ছেলের বিয়েটা দেখে যেতে পারল না।

ইহানের চোখ অশ্রুসজল হয়। চিকচিক করে ওঠে চোখের কার্ণিশ। বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে আম্মার চোখের পানি মুছে দেয় ইহান। বলে,

” আব্বা আছেন। আমাদের মনের মাঝে আছেন। তুমি কাঁদবে না একদম। আব্বা কষ্ট পাবেন।

” কষ্ট পাবে?
সন্দেহ নিয়ে কথাটুকু বলেন ইলমা বেগম। উক্ত কথার পরিপ্রেক্ষিতে তানিয়া এগিয়ে আসে। বলে,

” আঙ্কেল খুব কষ্ট পাবে আন্টি। আপনি, আমরা হাসিখুশি থাকলে আঙ্কেলও খুশি হবে। আপনি আর কাঁদবেন না প্লিজ।

ইহান উঠে বসে। শরীরটা বেশ ক্লান্ত লাগছে। দৌঁড়ঝাপ বেশ ভালোই হয়েছে আজ। ডায়মন্ড শপ থেকে দুটো হীরের আংটি আর একটি নেকলেস চুরি হয়েছে। প্রথমে দোকানী চুরির বিষয়টা বুঝতে পারেনি। যখন বুঝেছে তখন চোর গায়েব। সিসি ক্যামেরায় ধরা পরেছে কিনা সেটাও জানে না দোকানী। সব দায়িত্ব দিয়েছে পুলিশকে। তানিয়ার ল্যাপটপের সাথে সেই ক্যামেরার অনেকটা অংশ কানেক্ট করে দিয়েছে ইহান। সিসি টিভি ক্যামেরার সব ফুটেজ তানিয়ার ল্যাপটপে রয়েছে। তানিয়াকে খাবারগুলোর কথা বলে ঘরে গেল ইহান। তানিয়া খাবারগুলো প্লেটে ঢেলে শাশুড়ির সম্মুখে দিল। তানিয়াকে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইলমা বেগম বললেন,

” তুমি এখন ঘরে যাও।

তানিয়া নারাজ। একজনকে খেতে গিয়ে এভাবে চলে যাওয়া যায়? তানিয়ার জন্যেও খাবার এনেছে ইহান। এখন সে খাবে না। ফ্রিজে রেখে দিয়েছে কিছু অংশ। বাকিটা ইলমা বেগমকে দিয়েছেন। উনার খাওয়া শেষ না হওয়া অব্দি কাছ থেকে চলে যাওয়াটা বেমানান। হাসি মুখে তানিয়া বলে উঠল,

” আপনি খান আন্টি। আমি এখানেই থাকি। সমস্যা নেই তো।

” আমার ছেলের কাছে যাও। দেখো গিয়ে কি কি লাগে। এখন তো তোমাকেই এসব দেখতে হবে। স্বামীর সাথে বন্ধুত্ব সুলভ আচরণ করতে হবে তাইনা?

অবাক হয় তানিয়া। বলে,
” উনি তো আমার বন্ধুই। উনাকে তো আমি বন্ধুর মতোই ট্রিট করি।

” তুমি তোমার স্যারকে বন্ধু ভাবো। স্বামীকে তো এবার বন্ধু ভাবতে হবে নাকি? ওর খেয়াল তো এখন তোমাকে রাখতে হবে। অনেক অজানা আলাপ করতে হবে।

তানিয়া মেনে নেয়। ধীর গতিতে ইহানের রুমে পা ফেলে। ইহান সবে গোসল করেছে। উন্মুক্ত রোমশপূর্ণ বুক। কোমরে সাদা টাওয়াল পেঁচিয়ে রেখেছে। চুল বেয়ে মুক্তোর ন্যায় পানির কণা ঝরছে। অপূর্ব লাগছে ছেলেটাকে।

ইহান ওয়ারড্রবের তাকে শার্ট খুঁজছে। ইহানকে এমন অবস্থায় দেখে বিব্রত হয় তানিয়া। উচ্চস্বরে পেছন থেকে শব্দ করে বলে ওঠে,

” আল্লাহ্!

চোখ বন্ধ করে পেছনে ঘুরে যায় তানিয়া। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়। উদাম গায়ে ইহানকে এর আগেও সে দেখেছে। কিন্তু উন্মুক্ত শরীর আর টাওয়াল পেঁচানো অবস্থায় এই প্রথম লোকটাকে দেখে লজ্জায় মরিমরি অবস্থা তানিয়ার। ইহান তানিয়ার এমন উচ্চস্বর শুনে পিছনে ফিরে। বুঝতে পারে তানিয়ার এমন অভিব্যক্তি দেওয়ার কারণ। ভ্রু কুঁচকে ফেলে ইহান। বিরক্ত হয় খানিক। বলে,

” কী? চিৎকার করছো কেন?

” আপনি জামাকাপড় পড়ুন। ছিঃ!

চোখ ছোটছোট করে ফেলে ইহান। বিরক্ত হয়ে বলে,
” এমনভাবে বলছো যেন আমি কিছুই পড়ে নেই।

” হ্যাঁ কিছুই তো নেই শরীরে। টাওয়াল ছাড়া। অকপটে বলে তানিয়া।

ইহান কথা বাড়ায় না। এখন তর্ক করতে বালো লাগছে না তার। ইহান শার্ট আর প্যান্ট পরে নেয় ওয়াশরুমে গিয়ে। ফিরে আসে চুল মুছতে মুছতে। তানিয়া তখনও সেখানে দাঁড়িয়ে। ইহানকে দেখে বলে,

” আজকের দিনটা থানায় না গেলে মহাভারত অশুদ্ধ হতো নাকি? আন্টি মন খারাপ করেছিল দুপুরে।

” অবশ্যই মহাভারত অশুদ্ধ হতো। তোমার মতো তো কুঁড়ে নই আমি।

” এত বড় কথা? আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন। আমি অলস নই।

” তুমি যা তাই বলেছি। ডায়মন্ড শপে চুরি হয়েছে। সিসি ক্যামেরার সব ফুটেজ তোমার ল্যাপটপে। চেইক করো। সন্দেহজনক কিছু পেলে বলবে।

তানিয়া বিরক্ত হয়। ইলমা বেগমের সাথে একটু পর লুডু খেলার প্রতিযোগিতা আছে তার। এখন কি এসব কাজ করার সময়? দুদিন ছুটি নিয়ে তাহলে লাভ কি হলো? যদি বাসায় বসেই কাজ করতে হয়। ভেংচি কেটে তানিয়া বলে উঠল,

” পারবো না। আমার অনেক কাজ আছে। আপনার কাজ আপনি করুন। আমাকে খাটাচ্ছেন কেন?

” তানিয়া, কথা বাড়িও না। যা বললাম করো। কেসটা যত দ্রুত সলভড করতে পারবো ততই ভালো।

” আমি আপনার আন্ডারে এখন কাজ করছি না, আর আপনি এখন আমার স্যার ও নন। তাই এই ধমক-টমক চলবে না।

” বেশ! তো এখন আমি তোমার কি হই? বলো!

অপ্রস্তুত হয় তানিয়া। কণ্ঠে জড়তা কাজ করে। বলে,

” স্বা..স্বামী।

” তো এখন তোমার সাথে স্বামীসুলভ আচরণ করতে হবে তাই তো? ওকে! কাম। আমার বিবি, আসুন আপনাকে স্ত্রী হিসেবে ট্রিট করি।

তানিয়া ঘাবড়ায়। বিড়বিড় করে বলে,

” অসহ্য লোক কোথাকার।

শুনতে পায় ইহান। বাঁকা হেসে বলে,

” সেইম টু ইউ।

তানিয়া বিছানায় উঠে বসে। ল্যাপটপ অন করে। বিড়বিড় করে বকে যায় ইহানকে। পাত্তা দেয় না ইহান। আম্মার কাছে চলে যায়। মেয়েটার আশেপাশে থাকতে ভিষণ ভয় হয় ইহানের। কখন না জানি বুঝে যায় তার অনুভূতি।

______

ফিরতে ফিরতে বেশ খানিকটা লেইট হলো প্রহর আর প্রিয়তার। জ্যামের কারণে রাস্তায় যাতায়াত করা কষ্টকর। পুরো এলাকা টহল দিয়েছে তারা। ফুটপাতের খাবার খেয়েছে, আনন্দ করেছে। এমন দিন প্রিয়তার কাছে যেন নতুন। এভাবে কোনো পুরুষের সাথে ঘুরাঘুরি করেনি প্রিয়তা। তন্ময়ের সাথেই ভাব ছিল প্রিয়তার। কিন্তু সে তো প্রেমিক ছিল না প্রিয়তার। ছোটবেলায় আব্বু-আম্মুর সাথে প্রিয়তা অনেক ঘুরেছে। ভারতেও গিয়েছিল দু বার। সিলেটের কত সুন্দর সুন্দর জায়গায় যে ঘুরেছে তার হিসেব নেই। আরহাম ভূমিষ্ঠ হবার পর আরিফ বেশ খুশি ছিলেন। বিরাট আয়োজন করেছিলেন বাড়িতে। পুরো এলাকার মানুষ ডেকে খাইয়েছিলেন। সেইসব দিনগুলো আজ অতিত। সেসবের সাথে বর্তমানের কোনো মিলই নেই।

কিছুদূর গেলেই বাড়িতে পৌঁছাবে প্রিয়তা। কিন্তু রাস্তায় ছোটখাটো জ্যাম বেঁধেছে। প্রিয়তা অবাক হয় খানিক। এ রাস্তায় সহজে জ্যাম লাগে না। আগে কখনো দেখেনি সে। আজকের দিনেই এমন হতে হলো? সন্ধ্যে ঘনিয়েছে তো।

বাইকে বসে থাকতে গিয়ে প্রহর ও বিরক্ত হলো। নেমে পরল বাইক থেকে। দেখতে চাইল জ্যাম লাগার কারণ। সামনে এগিয়ে প্রহর দেখতে পেল দুজন ট্রাফিক পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। হাতে লোহার লাঠি। পুলিশের পা ধরে কাঁদছেন একজন মধ্যবয়স্ক লোক। প্রহরের বাবার বয়সী হবে লোকটা। চুল আর দাড়িতে পাঁক ধরেছে। নির্জীব চেহারা লোকটার। প্রহরের দেখাদেখি এগিয়ে এলো প্রিয়তা। বুঝতে পারল জ্যাম বাঁধার আসল কারণ। বয়স্ক লোকটি তার অটো মেইন রাস্তায় উঠিয়েছে। যা আইনের ভাষায় অন্যায়। তাই পুলিশ এই লোকটার অটো লক করে দিয়েছে। তাদের সাথে নিয়ে যাচ্ছে অটোটা। বয়স্ক লোকটি তার অটো না নিয়ে যাওয়ার জন্য পুলিশের পা ধরে অনুনয়-বিনয় করেছেন। পুলিশ লোকটা তাই লোহার হাতল দিয়ে প্রহার করল লোকটার পায়ে। কুঁকড়ে উঠলেন বয়স্ক লোকটি। প্রহর নিশ্চুপ থাকতে পারল না। সে ট্রাফিক পুলিশ নয়। তবে রাস্তায় কখনো কোনো সমস্যা হলে প্রহর দায়িত্বের সাথে সে সমস্যার সমাধান করে এসেছে। এজন্য উপরমহলের বস রা বেশ খুশি। আজকাল যেখানে পুলিশরা চেয়ারে বসে বসে ঝিমোয় সেখানে প্রহর ট্রাফিক পুলিশের কাজ গুলোও করছে অলসতা ছাড়াই।

প্রহর এগিয়ে আসে। পুলিশের উদ্দেশ্যে বলে,

” লোকটাকে এভাবে মারছেন কেন? জরিমানা নিয়ে ছেড়ে দিন। অটো নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?

পুলিশ লোকটা বিরক্ত হলো। প্রহরের দিকে তাকিয়ে লোহার হাতলটি চওড়া করে বাঁধা দিল প্রহরকে। বলল,

” সামনে আসবেন না। কাজ চলছে। সরুন।

” আপনি তো ঠিক করছেন না এটা। দৃঢ় কণ্ঠ প্রহরের।

বেজায় রেগে গেল লোকটা। বলল,

” তুই পুলিশ নাকি আমি পুলিশ? আমারে ঠিক ভুল বুঝাইতে আসস? থানায় টানতে টানতে নিয়া লকাপে ভরে দিমু একদম। সর।

প্রহর রেগে যায় খানিক। ক্রোধটুকু গিলে ফেলে। নিজেকে সংযত রেখে বলে,

” যতদূর জানি আইনে এমন নিয়ম নেই যে অটো থানায় নিয়ে যেতে হবে। জরিমানা নেওয়াই এনাফ।

বয়স্ক লোকটি বলে উঠল,
” গাড়ি নিয়া যাইক সমেস্যা নাই। কিন্তু নিয়া গেলে আর তো আর গাড়ি পামু না। আমার নতুন গাড়ি।

প্রহর বলে উঠল,

” জরিমানা নিয়ে ছেড়ে দিন। আর কখনো এই ভুল উনি করবেন না। মেইন রাস্তায় উঠবেন না।

পুলিশ লোকটা ততক্ষণাৎ বাজে ভাষায় গালি ছুঁড়ে দিল প্রহরকে উদ্দেশ্যে করে। প্রহর থমথম চোখে তাকায়। জ্বরে ওঠে সর্বাঙ্গ। প্রিয়তা এগিয়ে এলো। পুলিশের এমন ভাষা শুনে গা গুলিয়ে উঠল তার। গাঢ় কণ্ঠে গর্বের সাথে বলে ওঠল,

” আপনি জানেন উনি কে? কার সাথে কথা বলছেন আপনি? আপনার চেয়ে আইনটা উনি বেশ ভালোই বুঝেন।

চিৎকার করে পুলিশ লোকটা বলে উঠল,
” কে ও? কি করবো ও আমার? বা*ল ছিড়বো?

প্রিয়তা তেজী কণ্ঠে বলে উঠল,
” আজওয়াদ ইশতিয়াক। নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই? তার সামনে দাঁড়িয়ে অন্যায় করছেন আবার তাকে গালিও দিচ্ছেন?

চোখ বড় বড় হয়ে গেল লোকটার। নামটা শুনে ভয়ে কাবু হল খানিক। তবুও উচ্চস্বরে বলল,

” উনি সিলেটের থানার বড় অফিসার। এইখানে উনার নাম চলবো না।

প্রিয়তা হাসে। বলে,
” সরি টু সে, আপনি হয়তো জানেন না উনি এখন সাভারের থানায় ট্রান্সফার হয়েছেন।

পুলিশ লোকটা ততক্ষণাৎ অটোতে চাবি ঘুরিয়ে অটো আনলক করল। একটি কাগজে কিছু লিখে এগিয়ে দিল বয়স্ক লোকটার দিকে। বলল,

” আপনার জরিমানা হয়েছে পাঁচশ টাকা। টাকা দিয়ে অটো নিয়ে যান।

বয়স্ক লোকটা সময় ব্যয় করল না। টাকাটা দিয়ে অটো নিয়ে দ্রুত চলে গেলেন। পিছু ফিরে তাকালেন না একদম। পুলিশ লোকটা মাথা নত করে বলল,

” সরি স্যার। আর হবে না।

প্রহর কথা বাড়ায় না। গাড়িগুলোকে ঠিকঠাক মতো সরিয়ে রাস্তা ক্লিয়ার করে বাইকে বসে। প্রিয়তাও নত মুখে পেছনে বসে। মনে মনে হাসে প্রহর। বলে,

” এটা তো কেবল শুরু প্রিয়তা। আপনি নিজেই আমাকে চাকরিতে জয়েন হতে বলবেন। সমাজের অন্যায় গুলো কেবল আপনার চোখে পরুক। আপনি মানতে পারবেন না সেসব। আমায় ফিরতে বলবেন। আমি অপেক্ষায় রইলাম।

প্রিয়তা মাথা নত করে মলিন মুখে বলে ওঠে,
” আইনে যখন এমনটা নেই তাহলে উনারা কেন অটো নিয়ে যাচ্ছে?

” অটোগুলো নিয়ে ওরা নিলামে তুলবে। মানে বিক্রি করবে। টাকা পাবে। এজন্যই। এটাকে বলে বিজনেস।

চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ।

প্রিয়তার প্রহর ২ পর্ব-০৭

0

#প্রিয়তার_প্রহর (২য় পরিচ্ছেদ)
পর্ব সংখ্যা (৭ )

প্রিয়তার শরীর ভার ভার লাগে। অবচেতন হয় মন। কনস্টেবল লোকটার বলা কথা বারংবার মানসপটে ভেসে ওঠে। প্রহর রিজাইন দিয়েছে? কেন? এই চাকরিটা তো প্রহরের স্বপ্ন ছিল। পুলিশ হবার জন্য কতই না কষ্ট করেছে লোকটা। তবে কেন রিজাইন দিল চাকরি থেকে? প্রশ্ন জাগল মনে। প্রিয়তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিল এসব তার জন্যই। শেষবার প্রহরের সাথে সাক্ষাতের সময় প্রিয়তা বলেছিল প্রহরের এই পেশাটা তার পছন্দ নয়। অনিশ্চয়তার জীবনটাকে সে কখনোই বেছে নেবে না। তবে কি সে জন্যই প্রহর চাকরি ছেড়েছে? প্রিয়তাকে চায় বলে শখের চাকরির মায়া বিসর্জন দিয়েছে প্রহর?

প্রিয়তা দ্রুত বাড়ি ফিরে। আরহামের মন খারাপ হয়। প্রিয়তা প্রতিজ্ঞা করে প্রহর নামক লোকটার সাথে আরহামের একটি সুন্দর সাক্ষাত্কার করাবে সে। আরহাম মানে। বাড়ি ফিরে দুজন। আরহামকে বাড়িতে রেখে পুনরায় বেরিয়ে আসে প্রিয়তা। অটো ধরার আগমুহুর্তে ফোন করে নির্দিষ্ট নম্বরে। ওপাশ থেকে প্রহর কল ধরে সময় নিয়ে। প্রিয়তার গাম্ভীর্য প্রকাশ পায় কথোপকথনে। বলে,

” হ্যালো। কোথায় আপনি?

প্রহর বোধহয় বিস্মিত। প্রহরের সাথে এখানে দেখা হবার পর প্রিয়তা এই অবধি প্রহরকে নিজ থেকে কল করেনি। প্রহর কল দিলে তবেই কথা বলেছে। আজ মেয়েটা ফোন করেছে? বিষয়টা আসলেই অদ্ভুত। প্রহর বলে উঠল,

” বলুন।

” কোথায় আপনি?

অপ্রস্তুত হয় প্রহর। বলে,
” বাড়িতে। কেন?

” ওখানেই থাকুন। আমি আসছি।

কল কেটে দেয় প্রিয়তা। পার্সের ভেতরে থাকা খুচরো টাকা খুঁজে হাতে নেয়। অটো ধরে লোকেশন অনুযায়ী পৌঁছায় প্রহরের বাড়িতে। প্রহর বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। হয়তো প্রিয়তার অপেক্ষা করছিল। প্রিয়তা হন্তদন্ত পায়ে প্রহরের নিকটে আসে। শব্দ কেমন গুলিয়ে যায় তার। তীক্ষ্ম চোখে চেয়ে থেকে দৃঢ় কণ্ঠে বলে ওঠে,

” আপনি রিজাইন দিয়েছেন?

প্রহর বুঝে নিল প্রিয়তার এখানে আসার আসল কারণ। বিচলিত হলো না সে। অকপটে স্বীকার করল।

” হ্যাঁ। আজই।

প্রিয়তার সন্দিহান মন এতক্ষণ অব্দি বিশ্বাস করতে পারেনি। পুরোপুরি নিশ্চিত হবার পর বিস্ময়ে বিমূঢ় হলো প্রিয়তা। ধারালো স্বরে উত্তেজিত হয়ে বলল,

” কেন দিয়েছেন? কেন করেছেন এমন? এই প্রফেশনটা আপনার কতটা প্রিয় সেসব আমি জানি। কতশত ট্রেইনিং নিতে হয়েছে আপনাকে সে গল্প ও শুনেছি। এত দূর অব্দি এগিয়ে এসে এখন একটা তুচ্ছ কারণে রিজাইন দিলেন? হাউ কুড ইউ ডু দ্যাট?

‘তুচ্ছ’ শব্দটা কর্নকুহরে পৌঁছানো মাত্র প্রহরের গাম্ভীর্যতা রাগে পরিবর্তিত হলো। একটু এগিয়ে এলো প্রিয়তার দিকে। বললো,

” আপনি মোটেই আমার নিকট তুচ্ছ নন। আপনি আমার প্রফেশনটা পছন্দ করেন না। এর নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। আপনাকে তো আমি চাই প্রিয়তা। কিছু পেতে হলে কিছু হারাতে হয় তাইনা? চাকরি টা হারানোর বিনিময়ে আপনাকে পাচ্ছি। এই বা কম কিসে?

প্রিয়তা থমকায়। বাকরুদ্ধ হয়। প্রহরের মুখে এমন কথা মানাচ্ছে না মোটেই। প্রিয়তার মনে হচ্ছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা প্রহর নয়। প্রহর এ কথা বলতেই পারে না। চাকরিটা নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল প্রহরের। প্রিয়তার জন্য সেসব স্বপ্ন ভেঙে যাবে? এটা তো প্রিয়তা হতে দিতে পারে না। প্রহরের প্রতি ভিষণ রাগ হয় প্রিয়তার। ঝাঁঝাল স্বরে বলে ওঠে,
” চাকরি ছেড়েছেন তো কি? আপনার বাবা-মা আমাকে কখনোই মানবে না। যেই মেয়ের বাবা-মায়ের খোঁজ নেই, বিষয়সম্পত্তির ছিটেফোঁটা নেই সেই মেয়েকে কেন মানবেন উনারা? কেন ছেলের বউ হিসেবে মানবে? উনাদের কথা ভাববেন না আপনি? অবাধ্য হবেন সবার?

প্রহর কথা বাড়ায় না। ফোন তুলে নেয় হাতে। মিসেস নাবিলার নম্বরে ফোন করে। ওপাশ থেকে সময় নিয়ে ফোন ধরে মিসেস নাবিলা। প্রহর বাক্যব্যয় না করে বলে,

” হ্যালো মা।

” বলো বাবা।

” প্রিয়তা আমার সামনে। আমাদের বিয়ের ব্যাপারে তুমি ওকে কিছু বলতে চাও?

মিসেস নাবিলা উত্তেজিত হন প্রিয়তার নাম শুনে। ততক্ষণাৎ উত্তর দেন,

” দাও ওকে দাও।

প্রহর ফোনটা বাড়িয়ে দেয় প্রিয়তার নিকট। প্রিয়তার ফোন হাতে নিতে ভয় হয়। মিসেস নাবিলা হয়তো প্রিয়তাকে কথা শোনাবেন। বলবেন ” এত দ্রুত তোমার খোঁজ ও কিভাবে পেল? কিভাবে হারালে তুমি? ঠিকই তো আমার ছেলেটার সামনে পরে গেলে। ছেলেকে কিভাবে সামলাবো এখন?
প্রিয়তা শক্ত করে নিজেকে। ফোনটা হাতে তুলে কানে চেপে ধরে। বলে,

” হ্যালো আন্টি।

মিসেস নাবিলার দু চোখ ভরে ওঠে নোনাজলে। মেয়েটাকে কত ভাবেই না হেয় করেছে সে। ভাবতেই অনুতপ্ত বোধ হয়। নরম কণ্ঠে বলে,

” কেমন আছো প্রিয়তা।

” ভালো আছি আন্টি। আপনি কেমন আছেন?

” ওই আছি আরকি। আরহাম কেমন আছে? তুমি আমার উপর তুমি রাগ করে আছো তাইনা? খুব রেগে আছো?

প্রিয়তা মুচকি হাসে। বলে,

” আপনার উপর আমার রাগ কিংবা অভিযোগ কোনোটাই নেই আন্টি। আপনার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে সেও এটাই করতো। আপনার ছেলেকে আপনি জন্ম দিয়েছেন, লালন-পালন করেছেন। আপনার অধিকার আছে ছেলের জন্য নিজের প্রছন্দ অনুযায়ী পাত্রী নির্বাচন করার, খুঁতহীন মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে দেওয়ার। আপনি যা করেছেন তা উনার ভালোর জন্যই করেছেন। আমি রাগ করবো কেন?

” ওইদিন আমি তোমাকে চলে যেতে সাহায্য করেছিলাম। বাধ্য করেছিলাম চলে যাবার জন্য। কত কথাই না শুনিয়েছি সেদিন।

‘ ওসব কথা থাক আন্টি। আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ। আপনি না থাকলে হয়তো জীবনের এই পথে হাঁটতে গিয়ে বারবার হোঁচট খেতাম আমি। মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতাম। আপনার উপস্থিতি আমার জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ওসব নিয়ে একদম ভাববেন না প্লিজ। এভাবে বলবেন না।

” আমি অনুতপ্ত প্রিয়তা।

” বাদ দিন আন্টি। ওসব আমি ভুলে গিয়েছি। আপনি জানেন উনি চাকরি থেকে রিজাইন দিয়েছেন? বলেছে সে কথা?

মিসেস নাবিলা বোধহয় জানতেন না বিষয়টা। থতমত খেলেন তিনি। তবুও দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,

” আমার ছেলেকে আমি চিনি প্রিয়তা। কোনো কিছু না ভেবে, যাচাই-বাছাই না করে প্রহর কোনো ছোটখাটো সিদ্ধান্তও নেয় না। আর এটা তো ওর ক্যারিয়ারের প্রশ্ন, এই চাকরি তো ওর স্বপ্ন। চাকরিটা যখন ও করবে না ভেবেছে তখন এর পেছনে বড়সড় কারণ রয়েছে। প্রহর হয়তো ভেবেচিন্তেই রিজাইন দিয়েছে।

” আপনি উনাকে বাঁধা দিবেন না? উনি অনেকদূর এগিয়ে গেছেন এই পেশায়। এখন এভাবে চাকরিটা..

মিসেস নাবিলা প্রিয়তাকে বলতে দিলেন না পুরো কথা। বলে উঠলেন,

” ছেলে বড় হয়েছে। যোগ্য পুলিশ অফিসার হয়েছে। ওর মতো দক্ষ অফিসার না ভেবে কিছু করবে না। প্রহরের উপর আমার বিশ্বাস আছে প্রিয়তা। ওর উপর বিশ্বাস রাখো। তুমি দয়া করে ফিরে এসো। ছেলেটাকে আবার আগের মতো করে দাও। ওর যন্ত্রণা আমি আর সহ্য করতে পারছি না। ছেলেটা তোমাকে না পেলে অন্য কাউকে বিয়েই করবে না। পাগল হয়ে যাবে। প্রহর আমাকে বলেছে, বলেছে তুমি ওকে ভালোবাসো। তাহলে কেন অভিমান নিয়ে থাকবে?

প্রিয়তা হতবাক। মিসেস নাবিলার এইরূপ ব্যবহার সহ্য হচ্ছে না যেন। আড়চোখে প্রিয়তা তাকায় প্রহরের পানে। বুকটা ধরফর করে ওঠে। প্রহরের চোখে আকাশ সমান ভালোবাসা দেখতে পায় নিজের প্রতি। টুপ করে তপ্ত নোনা পানি গড়ায় গাল বেয়ে। চোখ বুজে নেয় প্রিয়তা। বলে,

” আপনি সত্যিই চাইছেন?

” খুব চাইছি। ফিরে এসো মা। আমি তোমাদের অপেক্ষায় আছি। তুমি আমার ছেলেটার সাথে সাথে থাকো এটাই আমি চাই।

প্রিয়তা প্রহরের চোখের দিকে তাকায় পুনরায়। কম্পিত হয় দেহখান। জিভ অসাড় হয়ে আসে। আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে হয় প্রহরের বলিষ্ঠ দেহ। শক্তপোক্ত খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে প্রিয়তা। মস্তিষ্কের বার্তা এড়িয়ে মনের কথা শোনে। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলে ওঠে,

” আমি আসবো আন্টি। উনার সাথে আপনার নিকট ফিরবো।

ফোন কাটে প্রিয়তা। প্রহর সময় ব্যয় করে না। দ্রুত গতিতে প্রিয়তার অতি নিকটে এসে আঁকড়ে ধরে প্রিয়তার পিঠ। অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। জড়িয়ে নেয় শক্ত হাত দ্বারা। বুকের মাঝে পিষে নেয় প্রিয়তার শরীরটাকে। চুমু খায় চুলের ভাঁজে। প্রিয়তার কান্না পায়। ধীর গতিতে প্রহরের পিঠে হাত রাখে। মাথা গুঁজে রাখে বক্ষস্থলে। ভিজিয়ে দেয় শুভ্র শার্টের অংশ। প্রহরের স্বর অন্যরকম হয়। ঠোঁট ছোঁয়ায় হাতের প্রিয়তার উল্টোপিঠে। নেশালো স্বরে বলে,

” প্রিয়, আমার প্রিয়।

______

আকাশে মেঘ ডাকছে। বৃষ্টি পড়বে বোধহয়। রাতের আঁধারে মেঘ বোঝা যাচ্ছে না। চাঁদ, তারা লুকিয়েছে মেঘের পেছনে। ইহান ছুটি নিয়েছে দুদিন। আগামীকাল তানিয়ার সাথে তার বিয়ে। ইহানের অনুভূতি অন্যরকম হতো যদি তানিয়া তাকে ভালোবেসে বিয়েতে রাজি হতো। কিন্তু তানিয়া তো তা করছে না। বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে বিয়েতে রাজি হয়েছে মেয়েটা। ইহানের প্রতি বিন্দুমাত্র ভালোবাসা তানিয়ার মাঝে নেই। আচ্ছা ইহান কি জোর করে ভালোবাসা আদায়ের চেষ্টা করছে?

ইহানের ফোন বেজে ওঠে। মেসেঞ্জার গ্রুপে ভিডিও কল করেছে প্রহর। তানিয়াও জয়েন হয়েছে কলে। ইহান চটজলদি কল রিসিভ করল। ভেসে উঠল তানিয়া আর প্রহরের মুখ। তানিয়া বসে আছে বিছানায়। প্রহর বেলকনিতে দাঁড়িয়ে। ইহান কল রিসিভ করতেই তানিয়া ঠিকঠাক করে বসল। লজ্জিত হলো বেশ, নত হরো মুখ। বস আগামীকাল স্বামী হবে ভেবেই রক্তিম হচ্ছে গাল। প্রহর বলে ওঠল,

” কেমন আছিস ইহান? তানিয়া, কেমন আছো?

তানিয়া উত্তর দেয়,
” ভালো আছি স্যার।

ইহানও মুচকি হেসে উত্তর দেয়,
” ভালো আছি। প্রিয়তা আর আরহামের কি খবর? ভালো আছে ওরা? প্রেম কেমন চলছে তোর?

প্রহর মাথা চুলকে হেসে ফেলে। মনে পরে দুপুরের কথা। প্রিয়তাকে জড়িয়ে ধরার মুহুর্ত ভেসে ওঠে চোখের পাতায়? ইশশ, সেই সময়টা যদি থমকে যেত? কিংবা আবার ও ফিরে পাওয়া যেতো মুহুর্ত টুকু। কতই না ভালো হতো সময়টাকে ফিরে পেলে। চওড়া হেসে প্রহর বলে উঠল,

” ওরা ভালো আছে। ভালোবাসা জমজমাট।

তানিয়া বলে উঠল,
” প্রিয়তাকে পেয়েছেন, ট্রিট দিতে হবে স্যার।

ইহান হেসে বলে,
” তোমার এ নিয়ে ভাবতে হবে না। আমার বন্ধুর উদার মন। পেট পুড়ে খাওয়াবে।

প্রহর হাসে একটু। মুহুর্তেই থেমে যায় সে হাসি। শান্ত ভাবে বলে ওঠে,
” আমি আজ থানায় গিয়ে রিজাইন দিয়ে এসেছি। আমি আর পুলিশ-টুলিশ নই। স্যার ডেকে লজ্জা দিও না তানিয়া।

বিস্ময়ে বিমূঢ় হয় তানিয়া। থেমে যায় হাসি। ললাটে ভাঁজ পরে। ইহানের অভিব্যক্তি পাল্টে যায়। প্রহর কি বলছে এসব? বলে,

” মজা করছিস?

” মোটেই না

তানিয়া বলে,
” কেন রিজাইন দিয়েছেন স্যার? কি বলছেন এসব? আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।

প্রহর হাসে। সবটা খুলে বলে। প্রিয়তার ভাবনাচিন্তা জানায় বন্ধুদের। সবটা শুনে থমকে যায় ইহান আর তানিয়া। তানিয়ার মনটা নরম। এত প্রিয় একজন স্যার চাকরি ছেড়ে দিয়েছে ভাবতেই কান্না পায় মেয়েটার। প্রহর আর ইহান তার অনুপ্রেরণা। ওদের থেকেই তানিয়া কাজটা রপ্ত করতে শিখেছে। এদের একজন যদি চাকরি ছাড়ে তবে তা তানিয়ার জন্য অত্যন্ত দুঃখের হবে। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে তানিয়া। ফুঁপিয়ে উঠে। প্রহরের মনটাও বিষিয়ে যায় । বিষয়টা বুঝে তানিয়াকে ধমক দেয় ইহান। বলে,

” কাঁদছো কেন? এখন কাঁদার সময়? স্টপ ক্রাইং তানিয়া! কান্ট্রোল ইউর সেল্ফ।

তানিয়া ভয় পেয়ে থামে। চুপটি করে থাকে। প্রহর বলে,
” কেঁদো না তানিয়া। কিছু পেলে কিছু হারাতে হয় এ কথা আমি মানি না। প্রিয়তাকে যেমন আমি নিজের দখলে রাখবো, তেমনি চাকরিটাও করবো।

ইহান বলে,
” কি করে? প্রিয়তা তো মানবে না। ওর এসব ভাবা তো যৌক্তিক প্রহর। ও চায়না আরহামকে নিয়ে রিস্ক নিতে।

” ভাবিস না। কাজ থেকে একটু ব্রেক নিয়েছি। আবার ফিরবো আমি। প্রিয়তা নিজে আমাকে পুলিশে জয়েন হতে বলবে, নিজে বলবে তদন্ত করতে। আর সেই দিনটা খুব শীঘ্রই আসবে। প্রিয়তার ইচ্ছেতেই আমি চাকরি করবো। দেখে নিস।

আরো কিছুক্ষণ কথা বলে কল কাটে ইহান। ল্যাপটপ অন করে। ঘরে প্রবেশ করেন ইলমা বেগম। ছেলের পাশে বসেন উজ্জল চোখে। হাতে উনার শপিং পেপার। ইহানের পাশে বসে হাসি হাসি কণ্ঠে শপিং ব্যাগ থেকে লাল রঙের জামদানি শাড়ি বের করেন। ইহানের হাতে শাড়িটা তুলে দিয়ে বলেন,

” আজ গিয়ে শাড়িটা কিনে আনলাম। তোর তো সময়ই নেই। দেখ তো কেমন হয়েছে? তানিয়াকে ভালো লাগবে তাইনা?

ইহান ভ্রু কুঁচকে ফেলে। ল্যাপটপ হাত থেকে নামিয়ে শাড়িটাতে নজর বুলায়। শাড়িটার রঙ টকটকে লাল। পুরো শাড়িটাতে সোনালী রঙের কারুকাজ করা, পাথর বসানো। পাথরে চকচক করছে শাড়িটা। তবুও ইহানের পছন্দ হলো না যেন। শাড়িটা বিছানায় নামিয়ে বলল,

” তানিয়াকে পার্পল রঙের শাড়িতে ভালো লাগবে আম্মা।

ইলমা বেগম অবাক হলেন। বললেন,
” বিয়েতে লাল শাড়ি পড়বে না?

” তোমার ইচ্ছে। তবে এই রঙটাতে তানিয়াকে খুব মানাবে।

হাসে ইলমা বেগম ছেলের মাথায় হাত বুলায়। প্রেমে পরে ছেলেটা একদম বেকায়দায় পরেছে। বলে,

” আচ্ছা। বিয়ে তো দুপুরের দিকে। সকালে গিয়ে তোর পছন্দ অনুযায়ী তানিয়ার জন্য বিয়ের শাড়ি কিনে আনবি। আমার আব্বা যেমনটা চাইবে তেমনটাই হবে। সবাই তো বিয়েতে লাল পরে। তানিয়া না হয় বেগুনী রঙ গায়ে জড়াবে।

____

আরহামের পা ব্যথা করছে। গতকাল সকালে ঘন্টাখানেক কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকার কারণেই এই সমস্যা হয়েছে। মাথাও ঝিমঝিম করছে কেমন। আজ স্কুলে যেতেও ইচ্ছে করছে না আরহামের। প্রিয়তা শার্ট আর প্যান্ট এগিয়ে দিল ভাইয়ের দিকে। বলল,

” স্কুলে গিয়ে সামনের বেঞ্চে বসবে। পড়ায় মনোযোগ দিবে। দুষ্টুমি একদম নয়।

প্রিয়তার বাকি কথা বলতে দিল না আরহাম। বোনকে নকল করে গম্ভীর স্বরে বলল,

” সবার সাথে মিশবে না। ম্যামদের সাথে দুষ্টুমি করবে না। পড়া না বুঝলে বারবার জিজ্ঞেস করবে। বাইরের খাবার খাবে না। মারামারি করবে না কারো সাথে। একা একা ফিরবে না। আমি নিজে গিয়ে নিয়ে আসবো।

কথাটুকু বলার সাথে সাথে ফিক করে হেসে ফেলল আরহাম। প্রিয়তা নিজেও হেসে ফেলল ভাইয়ের এমন রসিকতায়। গাল টেনে দিল ছেলেটার। বলল,

” আপুর সাথে মজা করছো?

” তুমি রোজ এ কথা বলো আপু। তাই তো মুখস্থ হয়ে গেছে।

” মনে রাখবে কথাগুলো।

আরহাম আমতা আমতা করল। খানিক সময় নিয়ে বোনের গা ঘেসে দাঁড়াল। বলল,

” আজ স্কুলে না যাই আপু? মাথাটা খুব ব্যথা করছে।

প্রিয়তা চিন্তায় পরে। বক্ষস্থল উথাল-পাথাল করে ওঠে। চিকচিক করে ওঠে চোখের কার্ণিশ। ভাইটা তার কতই না ব্যথা সহ্য করছে। ওই অ্যাক্সিডেন্টটার পর মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছিল আরহাম। সেই আঘাতের যন্ত্রণা এখনো কমেনি। রোজ ঔষধ খেতে হচ্ছে ছেলেটাকে। চিন্তিত ভঙ্গিতে ভাইয়ের মাথায় হাত রাখে প্রিয়তা। মাথার এপাশ ওপাশে হাত বুলায়। বলে,

” খুব ব্যথা করছে? চলো ডাক্তারের কাছে যাই।

” না আপু। এত ব্যথা না। একটু ব্যথা। আজ বাসায় থাকি? শুয়ে থাকি।

প্রিয়তা রাজি হয়। আজকে টিউশনিতে তাড়াতাড়ি গিয়ে তাড়াতাড়ি আসার সিদ্ধান্ত নেয়।

_______

দুপুরের তপ্ত রোদে খা খা করছে শহর। গরমে হাঁসফাঁস করছে মানুষজন। রবিবারের দিনটা ভিষণ চমৎকার। তাসলিমা খাতুন সকাল থেকে রান্নাবান্নায় ব্যস্ত। অনেকক্ষণ আগে ইলমা বেগম নিজে এসে তানিয়ার শাড়ি দিয়ে গেছেন। তানিয়ার লজ্জা লাগে এসবে। কেমন অসস্থি লাগে। স্যার ভেবে আসা মানুষটাকে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে জড়িয়ে নিতে হবে সে কি জানতো? জানলে না হয় বন্ধুত্বটাকে প্রাধান্য না দিয়ে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে তুলতো।

তানিয়াকে পড়ানো হয়েছে হালকা বেগুনী রঙের শাড়ি। গলায় সোনার চিকন নেকলেস। হাতে মোটা মোটা এক জোড়া চুড়ি। কানেও সোনার ঝুমকো। নাকে ডায়মন্ডের চকচকে সাদা নোস পিন জ্বলজ্বল করছে। চশমা ঠেলে তানিয়া আয়নায় নিজেকে দেখল। লজ্জায় রাঙা হলো মুখ। ইহান আর ইলমা বেগম নিচে বসে আছেন কাজী নিয়ে। তানিয়া মাথায় ঘোমটা দিল। বুকটা ধুকধুক করছে তার। শিরা-উপশিরায় শীতল স্রোত বইছে। নিজেকে কেমন অচেনা লাগছে তানিয়ার। এভাবে সেজেগুজে ইহানের সামনে যেতে লজ্জা লাগছে। ইহান তো কারো পরোয়া করে না। তানিয়াকে এভাবে সেজে থাকতে দেখে যদি সবার সামনে কিছু বলে বসে? যদি বলে ” এত সাজগোজ করার কি প্রয়োজন তানিয়া? এত মেকআপ করেছো কেন? বিশ্রী লাগছে দেখতে। যাও মুছে ফেল সব। আসল মুখ দেখাও। তুমি তো রীতিমতো আমাকে ঠকাতে চাইছো”। তখন তানিয়া কি করবে? জুবুথুবু হয়ে মাথা নিচু করে ফেলবে? আজকের দিনটায় একটু সাজবে না?

ইলমা বেগম নিজে এসে তানিয়াকে ধরে ড্রইংরুমে আনলেন। তানিয়ার এক খালা আর খালু এসেছেন বিয়েতে। বাকি সব ঘরের মানুষ। কাউকে নিমন্ত্রণ করা হয়নি। ইহান তার আম্মার সাথে বসে আছে সোফায়। ইহানের পরণে তানিয়ার সাথে ম্যাচিং করে আনা হালকা বেগুনী রঙের পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা। চোখের নিচে সুরমা নিয়েছে ইহান। চুলগুলোকে পরিপাটি করে পিছনে ঠেলে দিয়েছে। আড়চোখে ইহানকে দেখল তানিয়া। লোকটাকে ভারী সুন্দর লাগছে আজ। শ্যামলা মুখটা আজ উজ্জল দেখাচ্ছে। ছোট ছোট চোখ গুলোকে চমৎকার লাগছে। তানিয়াকে বসানো হলো ইহানের পাশে। তানিয়া আটশাট হয়ে বসল পাশে। তানিয়ার দিকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য তাকাল ইহান। চোখ ফিরিয়ে নিল। অস্ফুট স্বরে বিড়বিড় করে বলল,

” মাশা আল্লাহ্।

পুনরায় তানিয়ার দিকে তাকাতে গিয়ে ইহান বেকায়দায় পরল। তানিয়াও তার দিকে তাকিয়ে আছে। থতমত খেল ছেলেটা। লজ্জিত হলো খানিক। অসস্তি কাটাতে দক্ষতার সাথে গম্ভীর হয়ে ফিসফিস করে তানিয়ার কানে কানে বললো,

” এত সেজেছো কেন? মেক আপের কারণে মুখই বোঝা যাচ্ছে না। তুমি সত্যিই তানিয়া তো? নাকি তানিয়া সেজে আমাকে বিয়ে করতে এসেছো? গোপন শত্রু হুহ?

কথাটা শোনামাত্র বড় বড় চোখ করে তাকায় তানিয়া। লজ্জা পায় ভিষণ। অসস্তি হয়। লোকটা কি শোধরাবে না কখনো? এভাবেই তানিয়াকে ধমকে যাবে? তানিয়ার মানে লাগল। ততক্ষণাৎ উত্তর দিল,

” বিয়েটা করার জন্য আমি লাফাইনি স্যার। আপনিই জোর করেছেন। আমি ন্যাচরালি সুন্দর। মেকআপ ছাড়াও আমাকে ভালো লাগে। আপনার ভাগ্য ভালো আপনি আমার মতো এত কিউট একটা মেয়েকে পাচ্ছেন। আপনার যা রাগ, কোনো মেয়েই আপনাকে বিয়ে করতে চাইবে না হুহু।

মুখ ভেংচি দেয় তানিয়া। আর তাকায় না ইহানের দিকে। ইহান মিটিমিটি হাসে। মজা পায় তানিয়ার এমন কথায়। বারংবার আড়চোখে তাকায় তানিয়ার দিকে।

সময় গড়ায়। কাজী সাহেব দোয়া পড়েন। কবুল বলার সময় আসে। ইহান কিছু সেকেন্ড সময় নিয়ে “আলহামদুলিল্লাহ্ কবুল” বলে তিনবার। তানিয়া কেঁপে ওঠে। হৃদস্পন্দন থেমে যায় যেন। আশপাশে তাকায়। সকলের দিকে তাকিয়ে থাকে মোলায়েম দৃষ্টিতে। কবুল বলতে সময় নেয় তানিয়া। কেঁদে ফেলে ঝরঝর করে। ইহানের বুকটা ধক করে ওঠে। তানিয়া তো এই প্রথম কাঁদছে না তার সামনে। তাহলে কেন এত কষ্ট হচ্ছে এখন? কেন মেয়েটাকে জড়িয়ে নিতে ইচ্ছে করছে? কেন বুকটা ফেটে যাচ্ছে তানিয়ার কান্নায়? ইহান নিঃশ্বাস আটকে বসে রইল। তানিয়া জড়িয়ে ধরল তাসলিমাকে। তাসলিমা খাতুন কাঁদলেন মেয়েকে ধরে। নিয়াজ থম মেরে রইলেন। মেয়ের বিয়েটাতে খুশি হলেও মেয়ে আজ থেকে এ বাড়িতে থাকবে না ভাবতেই মন খারাপ হচ্ছে। তানিয়া চুপটি করে রইল কিছুক্ষণ। সবাই তাড়া দিল কবুল বলার জন্য। তানিয়া টু শব্দটিও করল না। নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিল। একটা সময় বিরক্ত হলো ইহান। তানিয়া কেন বুঝতে পারছে না কবুল শব্দটা তানিয়ার মুখে শোনার জন্য ইহান মুখিয়ে আছে। নতুন সম্পর্কে জড়াতে ইহান যে বেশ আগ্রহী তা কেন বুঝছে না? কেন এত সময় নিচ্ছে? ইহানের আর তর সয় না। তানিয়াকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,

” তুমি ম্যাচিওর তানিয়া। এভাবে কান্নাকাটি করা তোমাকে মানায় না। তুমি নিজেও জানো তুমি তোমার বাবা-মায়ের থেকে আলাদা হচ্ছো না। তবে কান্নাকাটি করছো কেন? কবুল বলো। লেইট হচ্ছে আমার। থানায় যেতে হবে। কাজ পরেছে।

তানিয়া নাক টানে। শাড়ির আঁচল আঙ্গুল দ্বারা পেঁচিয়ে নেয়। সবার জোড়াজুড়িতে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলে,

” আলহামদুলিল্লাহ্, কবুল।

সবার মুখে হাসে ফুটে। পুনরায় কবুল বলতে বলা হয়। তানিয়া চোখ বুজে নেয়। ঠোঁট কামড়ে ধরে। ফুঁপিয়ে উঠে দ্রুত গতিতে বলে,

” আলহামদুলিল্লাহ্ কবুল, আলহামদুলিল্লাহ্ কবুল।

সাথে সাথে ইহান চোখ বুজে। চক্ষু টলমল করে ওঠে আনন্দে। তানিয়াকে পাওয়ার খুশিতে উজ্জ্বল হয় চেহারা। মুচকি হেসে মাথা নিচু করে বলে ওঠে,

” আলহামদুলিল্লাহ্। পেয়েছি! পেয়েছি তাকে।

চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ