অনুভূতিরা শব্দহীন পর্ব-৩৭+৩৮+৩৯

0
259

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

সপ্তত্রিংশ পর্ব (৩৭ পর্ব)

“অপরূপা নামের কেউ কি এখানে ইনভলভ আছে?”

আহনাফের প্রশ্নে ইন্সপেক্টর রাব্বি বিরক্ত হয়। বেশ কিছুক্ষণ থেকে আহনাফের প্রশ্নের উত্তর একের পর এক দিয়েই যাচ্ছে সে। এবারে বেশ রাগ দেখিয়ে বলল,
“আপনি কি আমাকে রি°মা°ন্ডে বসিয়েছেন?”

ইন্সপেক্টরের কথায় আহনাফের চোখ কুঁচকে যায়৷ একজন অপরাধীর আরো অপরাধ থাকতেই পারে, দায়িত্ব নিয়ে তা খুঁজে বের করা উচিত। কিন্তু রাব্বির মধ্যে এমন কোনো ইচ্ছা আহনাফ দেখলো না। বুকে লাগানো নেমপ্লেটে ‘ফজলে রাব্বি’ নাম দেখে আহনাফ বেরিয়ে আসে। এখন তার মনে হচ্ছে ইমতিয়াজের কথা ঠিক, লি°গ্যাল পথে এরকম মানুষকে শা°স্তি দেয়া যাবে না।

আহনাফের চিন্তাভাবনায় আরো অনেক কিছু আছে। যেমন অপরূপা কি শাফিনের সাথে সত্যিই যুক্ত কিনা, জামিল যুক্ত কিনা নাকি ওর চিন্তাভাবনা ভুল। এতো এতো চিন্তার মাঝে তার ফোন বেজে উঠে।

সারাহ্-র নাম্বার দেখে রিসিভ করে,
“জি, ঐশী।”
“আপনি থানায় কি করছেন?”

আহনাফ চমকে উঠে আশেপাশে তাকায়। কই সারাহ্ তো কোথাও নেই, তবে কিভাবে জানলো সে এখানে।

“আপনি মি°থ্যা বলে ঢাকায় গেছেন, আপনি থানায় গেছেন মানে কোনো সমস্যা আছে। আপনি আমার সাথে লুকোচুরি করছেন আহনাফ।”

আহনাফ গলা ঝে°ড়ে বলল,
“আমাকে একটু কথা বলতে দাও। আমি একটা কাজে…”

আহনাফের কথা শেষ হওয়ার আগেই সারাহ্ উত্তর দেয়,
“হ্যাঁ, কাজে গেছেন, যেতেই পারেন। তাই বলে আমাকে বলতে এতো প্রবলেম?”
“ঐশী রানী, জান আমার। শুনো তো।”

সারাহ্ রাগ করে কল কে°টে দিলো। আহনাফ কলব্যাক করলেও রিসিভ করে না। আহনাফ হতাশ হয়ে ফোন রেখে দেয়

থানা থেকে আহনাফ কাকরাইল গো°র°স্থানে আসে। তাহসিনার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে দোয়া করলো। তারপর হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“তাহু, কি এমন হয়েছিল সেদিন? গল্পটা কি অন্যরকম হতে পারতো না? আমরা নতুন করে লিখতে পারতাম না এটা? এতো রহস্য থাকতো না, শুধুই ভালোবাসা থাকতো।”

আহনাফ থামে, চুপ করে অপেক্ষা করে তার তাহুর জবাবের। কিন্তু তাহু যে তার সাথে মান করেছে, জবাব দিবে না কিছুতেই। হঠাৎ কান্নার শব্দে আহনাফ চমকে উঠে। দূরে একটা মেয়ে কাঁদছে।

আহনাফ উঠে সেদিকে গেল। মেয়েটার মুখ দেখা যাচ্ছে না। ঘোমটার আড়ালে লুকানো মেয়েটাকে প্রশ্ন করে,
“কাঁদছেন কেন আপনি?”

মেয়েটা ফুঁপিয়ে উঠে একটা কবর ইশারা করে বলল,
“ওই কবরে আমার কেউ শুয়ে আছে।”

আহনাফ ঘাড় ঘুরিয়ে কবরটা দেখে বলল,
“কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদতে হয় না।”

আহনাফ বেরিয়ে যেতে নিলে মেয়েটি বলে,
“নার্গিসকে সা°ক্ষী দিতে নিষেধ করো, নাহলে সারাহ্-কে আর খুঁজে পাবে না। ঢাকা থেকে কুমিল্লা কিন্তু দুই ঘন্টার পথ।”

আহনাফ ফিরে মেয়েটিকে ধরতে গেলে অন্য একটা ছেলে ওর সামনে চলে আসে। অত°র্কি°ত আ°ঘা°ত করে আহনাফের উপর, টাল সামলাতে পারে না। পেছন থেকে আরেকটা ছেলে ওকে আ°ঘা°ত করে। মেয়েটা ততক্ষণে সরে গেছে। একটু দূরে গিয়ে ঘোমটা খুলে ফেলে। অপরূপা, এই মেয়েটিই অপরূপা। শাফিনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় সা°ক্ষী ওরা নার্গিস পারভিন ও রোমি খন্দকারকে মনে করছে।

আহনাফ শান্তশিষ্ট ছেলে, মা°রা°মা°রি সে কোনো কালেই করেনি। এসবে বড্ড কাঁচা। তবুও তো পুরুষ। প্রতিরোধের চেষ্টা করে, তবে দুজনের সঙ্গে ঠিক পেরে উঠে না। বেশ করে আ°হত হলে ছেলেদুটো চলে যায়। পায়ে প্রচন্ড ব্য°থা পেয়েছে সে। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে, রাস্তায় লোকজনও বেশ কম।
______________________________________

বাসায় এসে সুরভিকে নিজের শাশুড়ী আর ননদকে দেখে অবাক হয় না। ওর বাবাকে পুলিশ গ্রে°ফ°তার করেছে, সেই সংবাদ শুনেই এসেছেন উনারা।

“আসসালামু আলাইকুম, মা।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম।”
সুরভির শাশুড়ী অনিচ্ছাকৃত জবাব দিলো।

“আপনারা বসুন, আমি নাস্তা নিয়ে আসছি।”

কথাটা বলে সুরভি দ্রুত নাস্তার ব্যবস্থা করতে যেতে নিলে ওর শাশুড়ী বলল,
“লাগবে না। আমরা কথা বলতে এসেছি। (একটু থামে) তুমি আর আমাদের বাসায় ফিরে যেও না।”

সুরভি হা করে তাকিয়ে থাকে শাশুড়ীর দিকে। ওর শাশুড়ী বলতে থাকে,
“তোমার বাবা খু°নের আ°সামী, বলা তো যায় না তুমি কেমন?”

ওর ননদ পাশ থেকে উনাকে খোঁ°চা দিতেই উনি বলেন,
“দেখো, আত্মীয়রা নানা ধরনের কথাবার্তা বলছে। তাই আমরা আর তোমাকে ফিরিয়ে নিতে চাচ্ছি না, তবে (আবারো থামে) তবে বাচ্চার সব দায়িত্ব আমরা নিতে রাজি আছি।”

সুরভির পৃথিবীটা থমকে গেছে। তার বাবার জন্য তার সংসার ভে°ঙে গেল। ওর কি দোষ ছিল? আর লোকে কি বুঝবে?

সুরভির শাশুড়ী আর ননদ বেরিয়ে যায়। সুরভি ওখানেই স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। নিজের সন্তানের জন্য চিন্তা হতে লাগলো তার। একসময় লোকে হয়তো তাকেও খু°নি বলে সন্দেহ করবে।
______________________________________

আহনাফ বাসায় এসেছে রাত আটটায়। নাকমুখ ফুলে আছে, মুখের এখানে সেখানে র°ক্ত জমাট বেঁধেছে। পায়ের ব্য°থায় খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছে সে। আব্বাস সাহেব দরজা খুলে আহনাফের অবস্থা দেখে কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই আহনাফ বলে,
“আমি ঠিক আছি, চিন্তা করো না।”

আহনাফ চলে যেতে নিলে আব্বাস সাহেব বললেন,
“এটা ঠিক থাকা?”

আহনাফ কিছু না বলে রুমে চলে গেল। সারাহ্ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে, আহনাফকে সে খেয়াল করেনি। আহনাফও তাকে ডাকেনা। ফোন আর ওয়ালেট টেবিলে রেখে ওয়াশরুমে চলে যায় সে। ক্ষ°ত°স্থানগুলো নিজে নিজেই ওয়াশ করতে থাকে আহনাফ।

দরজা বন্ধের শব্দ পেয়ে সারাহ্ রুমে আসে। টেবিলে আহনাফের ফোন দেখে সারাহ্ বুঝতে পারে আহনাফ এসেছে। বিকেল থেকেই আহনাফের সাথে রেগে আছে সে। আহনাফ তাকে কেন মি°থ্যা বলেছে।

আহনাফ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ওকে দেখে কাছে টেনে গালে চুম্বন করে বলে,
“রেগে আছো নাকি এখনো?”

সারাহ্ ওর চেহারার দিকে তাকিয়ে চুপসে যায়। আহনাফের মুখে আ°ঘা°তের চিহ্ন। সারাহ্ ওর গালে, ঠোঁটে হাত দিয়ে বলে,
“কি হয়েছে এসব?”

ওর চিন্তিত কন্ঠ আহনাফ চিনে ফেলে। মাথা নেড়ে বলল,
“কিছু না, একটু ব্য°থা পেয়েছি।”

সারাহ্ ওর দুগালে হাত রেখে বলে,
“থানায় ছিলেন? এখন আবার এসব দেখছি? কি হয়েছে বলেন না? আমার..”

ওকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আহনাফ নিজের ওষ্ঠোধর সারাহ্-র ওষ্ঠে স্পর্শ করে দেয়৷ গভীরভাবে স্পর্শ করে আহনাফ সরে যায়।

আহনাফ শার্ট খুলে টিশার্ট পড়তে পড়তে বলল,
“তুমি কি করে জানলে আমি থানায় গেছিলাম?”

সারাহ্ এগিয়ে এসে ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওর পিঠে মাথা ঠেকিয়ে বলে,
“একদম হঠাৎ করেই জেনেছি, টিভিতে একটা নিউজে দেখলাম আপনাকে।”

আহনাফ হেসে উঠে বলল,
“শেষে সাংবাদিক আমার বউয়ের কাছে আমার মিথ্যা ধরিয়ে দিলো?”
“বলুন না কি হয়েছে?”

আহনাফ ফিরে তাকায়। সারাহ্-কে যত এসব থেকে দূরে রাখতে চাইছে, ততই যেন সারাহ্ এসবের কাছে চলে আসছে। আহনাফ ওকে জড়িয়ে ধরে। গো°র°স্থানের মেয়েটি বলেছিল নার্গিস পারভিন সা°ক্ষী দলে সারাহ্-র ক্ষতি হবে৷ আহনাফের হাতের বাঁধন শক্ত হতে থাকে, কোন শত্রুতা ঘিরেছে ওদেরকে?
______________________________________

দুইদিন পর, “রমজান মাসের চাঁদ দেখা গিয়েছে, আগামীকাল থেকে শুরু হচ্ছে পবিত্র মাহে রমজান।”
টিভিতে খবর প্রচারিত হচ্ছে।

তানজিমদের বাসায় আছে মৃত্তিকা। ওই টিভি ছেড়েছে রমজানের খবর শোনার জন্য। হাসিহাসি চেহারা নিয়ে মমতাজ বেগমকে বলে,
“বড়মণি চাঁদ দেখা গেছে।”
“হুম।”

ছোট করে জবাব দিলো মমতাজ বেগম। শাফিনের গ্রে°ফ°তারের পর থেকেই উনি আবারো চুপচাপ আছে। মৃত্তিকা রান্না শেষ করে তানজিমকে বলে,
“সেহরিতে গরম করে নিও। তোমার ভাইয়া আসলে আমি চলে যাবো।”
“প্রথম রোজার দিনটা একসাথে কাটাই?”

মৃত্তিকা মুচকি হেসে বলল,
“অফিস থেকে কালকে এখানে আসবো সোজা। ইফতার একসাথে হবে, ইনশাআল্লাহ।”

ইমতিয়াজ বাসায় এসেই ওদের কথা শুনে বলে,
“ইনশাআল্লাহ।”

মৃত্তিকা পিছনে তাকিয়ে বলল,
“এতো দেরি?”
“অফিসে তো একা সব সামলাতে হচ্ছে।”
“হুম, তো যাওয়া যাক?”
“ওয়েট।”

ইমতিয়াজ ভিতরের রুমে গিয়ে মমতাজ বেগমের সাথে কথা বলে আসে। তারপর দুজনে নিজেদের বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়।

বাসায় এসে মৃত্তিকা আবারো কাজে লেগে গেল। সেহরি তৈরি তো করতে হবে। ইমতিয়াজ ফ্রেশ হয়ে এসে বলল,
“আগে তারাবি পড়ে নিবে চলো।”

মৃত্তিকা চোখের ইশারা পুরো রান্নাঘর দেখিয়ে বলে,
“এতো কাজ?”

পেঁয়াজ কা°টছিল বলে মৃত্তিকার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। ইমতিয়াজ এগিয়ে এসে ওর চোখ মুছে দিয়ে ওর থেকে ছু°ড়ি নিয়ে বলে,
“তুমি অন্য কাজ করো, আমি কে°টে দিচ্ছি।”

দুজনে মিলেমিশে রান্না শেষ করে নেয়। তারপর দুজনে একসাথে তারাবির নামাজ আদায় করে নেয়। এবারের রমজানটা দুজনের জন্যই খুশির হয়ে এসেছে।

নামাজ শেষে মৃত্তিকা জায়নামাজে বসে জিকির করছে। ইমতিয়াজ বলল,
“চলো, ছাদে যাই।”
“কেন?”
মৃত্তিকা জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়।

ইমতিয়াজ ওর হাত ধরে বলল,
“নতুন চাঁদ দেখবো, এসো।”

কোনোরকমে জায়নামাজ রেখে দরজার লকটা দিয়েই ছাদে যায় দুজনে। ওরা চলে গেলে অপরূপা ওদের ফ্ল্যাটে আসে। মৃত্তিকার ফোনটা খুঁজে না পেয়ে রাগ উঠে। তারপর চুলার গ্যাস চালু করে দিয়ে বেরিয়ে যায়। মুখে বলে,
“আ°গুন জ্বা°লা°লেই বুম।”
______________________________________

তারাবি পড়ে বাসায় এসেছে আহনাফ ও আব্বাস সাহেব। সারাহ্ এখনো জায়নামাজে বসে আছে। আহনাফ-সারাহ্ দুজনের মোনাজাতে সন্তানের সুস্থতা।

আহনাফ রুমে আসলে সারাহ্ ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
“নামাজ বাকি আছে?”
“বেতের তাহাজ্জুদের পর।”

সারাহ্ হেসে মোনাজাত সেরে নেয়। তবে জায়নামাজ থেকে উঠার আগেই আহনাফ ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।

“ওমা এসব কি?”

সারাহ্-র প্রশ্ন সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে আহনাফ ওর হাত ধরে নিজের গালে রেখে সূরা আর রহমান তেলাওয়াত করা শুরু করে। সারাহ্ মুচকি হাসে৷ ওর মন প্রশান্ত হয়। চোখ বন্ধ করে সে তেলাওয়াত শুনে। আহনাফের তেলাওয়াত বেশ সুন্দর। সারাহ্ উপলব্ধি করে সূরা আর রহমানের সেই আয়াত,
“আর তোমরা তোমাদের রবের কোন কোন নিয়ামতকে অস্বীকার করবে?”

সত্যিই তো রবের কোনো নেয়ামত অস্বীকার করার সুযোগ নেই। সারাহ্-র জীবনে আহনাফ নেয়ামত হয়েই এসেছে। যার কাছে তার শান্তি মেলে, অন্তর শান্ত হয়।
______________________________________

আকাশে আজ চাঁদ নেই, তারা নেই। কেবলই মেঘে ঢাকা আকাশ। ইমতিয়াজ-মৃত্তিকা হতাশ হলো। মৃত্তিকা ছাদের গালে হাত দিয়ে বসে বলল,
“যাবো না আমি কোথাও।”

ইমতিয়াজ ওর বাচ্চামো দেখে হাসে। মেয়েটা শুধু ওর সামনেই এমন বাচ্চার মতো আচরণ করে। সকলের সামনে শক্ত সাহসী মেয়েটা ওর সামনে ননীর পুতুল হতে চেষ্টা করে।

“আহ্লাদী আমার।”
খুব আস্তেধীরে কথাটা বলে ইমতিয়াজ। মৃত্তিকা শুনে না।

গুড়িগুড়ি বৃষ্টি শুরু হলো। ইমতিয়াজ বলে,
“এই যা, অসময়ের বৃষ্টি। চলো মৃত্তিকা, বৃষ্টি ভিজে না।”

মৃত্তিকার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলে মৃত্তিকা ওর হাত ধরে উঠে দাঁড়ায়। বৃষ্টির বেগ বাড়ে। ইমতিয়াজ চলে যেতে নিলে মৃত্তিকা ওর হাত টেনে ধরে বলল,
“এমন কেন আপনি?”
“কেমন?”
“কিছু না।”

দুজনে ভিজে একাকার। ইমতিয়াজ ওকে পাঁজাকোলে করে নিচে নিয়ে আসে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলে,
“বৃষ্টিতে ভিজলে জ্ব°র হবে।”

বাসায় প্রবেশ করতেই গ্যাসের গন্ধে দুজনে ঘাবড়ে যায়। মৃত্তিকাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে ইমতিয়াজ ভিতরে গেলেও মৃত্তিকা ওর পিছুপিছু ভিতরে যায়। রান্নাঘরের চু°লা বন্ধ করে ইমতিয়াজ জানলা খুলে দেয়৷

পেছনে মৃত্তিকাকে দেখে প্রশ্ন করে,
“চু°লা অফ করোনি?”
“করেছিলাম তো।”
“তবে অন কেন? কেউ..”

ইমতিয়াজ ধীরে ধীরে দরজার কাছে যায়। কেউ নেই এখানে। মৃত্তিকা রান্নাঘরে ভালো করে দেখে। কেউ আসার কোনো চিহ্ন নেই। কিন্তু যখন ওরা শোবার রুমে যায়, তখন বুঝে কেউ এসেছিল। পুরো রুম এলোমেলো।

“কেউ এসেছিল, কিছু খুঁজেছে।”

মৃত্তিকার কথায় ইমতিয়াজ সম্মত। কেউ অবশ্যই কিছু খুঁজেছে। নাহলে রুম এলোমেলো হবে কেন?

“শাফিন কি ছাড়া পেয়ে গেল?”

মৃত্তিকার কথায় ইমতিয়াজ ফ্যা°লফ্যা°ল করে তাকায় ওর দিকে। ওর কথা তো সঠিক হতে পারে, ছাড়া পেতেই পারে সে।

মৃত্তিকা আলমারি খুলে বলে,
“আলমারি খুলেনি, তবে রুমে ঘাটাঘাটি করেছে।”
“এমন কিছু খুঁজেছে যা রুমে পাবে আলমারিতে না।”

চলবে…..

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

অষ্টাত্রিংশ পর্ব (৩৮ পর্ব)

মৃত্তিকা শুকনো কাপড় ইমতিয়াজের হাতে দিয়ে বলল,
“আপনি ভেজা কাপড় পালটে নিন, আমি রুমটা গুছিয়ে নিই।”

ইমতিয়াজ এখনো আশেপাশে তাকাচ্ছে। মৃত্তিকা ওর মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,
“যে এসেছিল, চলে গেছে। চিন্তা কম করেন, জানা যাবে সবটা। (একটু থেমে) এসব তো আর নতুন কিছু নয়।”
“তবুও বিষয়টা জরুরি, কেউ আমাদের মা°রতে চেয়েছিল।”
“জানি আমি, বুঝি তো। শাফিন-দুলাল একা এতো বড় ষ°ড়°যন্ত্র করেনি। আরো লোক আছে।”
“শাফিন ছাড়া পেয়ে যাবে মৃত্তিকা। তুমি মিলিয়ে নিও আমার কথা।”

মৃত্তিকা জানে ইমতিয়াজের কথা ঠিক। তবে আগে আগে এতো চিন্তা করার কিছুই নেই, যা হবে দেখা যাবে।

সে কাপড়গুলো বিছানার কোনায় রাখে৷ ড্রেসিং টেবিলের উপরের জিনিসগুলো দেখছে ইমতিয়াজ। মৃত্তিকা এসে পাশে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো। ইমতিয়াজ ভ্রূ চুলকালে, মৃত্তিকাও চুলকায়। ইমতিয়াজ চুলে হাত রাখলে মৃত্তিকাও রাখে। এবারে ইমতিয়াজ খেয়াল করে মৃত্তিকা তাকে নকল করছে। মৃত্তিকার দিকে চোখ কুঁচকে তাকালে সে হেসে চোখ কুঁচকায়।

“নকল করছো আমাকে?”

মৃত্তিকা জবাব না দিয়ে একই কথা পুনরাবৃত্তি করে,
“নকল করছো আমাকে?”
“এসব ঠিক নয় মৃত্তিকা।”
“এসব ঠিক নয় মৃত্তিকা।”

ইমতিয়াজ হেসে বারান্দার দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে শার্ট খুলে ফ্লোরে ফেলে বলে,
“আরো করো নকল।”

মৃত্তিকা দুহাতে মুখ ঢেকে ফেলে, আবার আঙ্গুলের ফাঁ°ক দিয়ে ইমতিয়াজের দিকে তাকায়। ইমতিয়াজ এগিয়ে এসে ওর হাত সরিয়ে ওর থুতনিতে হাত দিয়ে মুখটা উপরে তুলে। মৃত্তিকা তাকায় না ওর দিকে, চোখ নামিয়ে রেখেছে। কিন্তু মুখে বলে,
“রি°ভে°ঞ্জ নিলাম, সেদিন যেমন আমাকে নকল করেছিলেন।”

মৃত্তিকার কোমড়ে আলতো করে হাত দেয় ইমতিয়াজ, কাছে নিয়ে আসে ওকে। লজ্জায় কুঁ°কড়ে আসে সে। ইমতিয়াজের সাথে যেন মিশে যেতে চাইছে। কিছু বলতে চেয়েও আটকে যাচ্ছে বারবার। ওষ্ঠদ্বয় অনবরত কাঁপছে, তা শান্ত হয় ইমতিয়াজের ওষ্ঠের ছোঁয়ায়। মৃত্তিকাকে কোলে তুলে নিলো। বিছানায় বসিয়ে ইমতিয়াজ পাশে বসে, মৃত্তিকা লজ্জায় লাল হয়ে গেছে।

ইমতিয়াজ আলতোভাবে ওর হাত ধরে, মৃত্তিকা ওর বুকে হাত দিয়ে সরাতে চাইলে ইমতিয়াজ ওকে আরো কাছে নিয়ে আসে। মৃত্তিকার গালে হাত দিলে মৃত্তিকা চোখ বন্ধ করে বলল,
“ইমতিয়াজ, শুনুন তো…”

ওর ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে চুপ করিয়ে দেয় ইমতিয়াজ। শব্দহীন অনুভূতিগুলো আর ভাষায় আনা হলো না। চোখের পলকে ভালোবাসা ছড়িয়ে গেল, ঠোঁটের উষ্ণ পরশে ভালোবাসা প্রকাশ পেল। কিন্তু ধ্বনিতে তা উচ্চারিত হলো না।

বাইরে বিদ্যুতের ঝল°কা°নি আর ঝুম বৃষ্টি থেকে দূরে গেল ওরা। লজ্জার পর্দা আজ পড়ে গেল। ভালোবাসার উষ্ণ ছোঁয়ায় কাছে আসে দুজনে।
______________________________________

সেহরির সময় হয়েছে, সারাহ্ খাবার টেবিলে সাজিয়ে রেখে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তে যায়। আহনাফ ঘুম থেকে উঠলেও বিছানায় বসে ঝিমাচ্ছে।

“ফয়েজ স্যার উঠুন, নামাজ পড়ে নেন।”
“হুম।”

সারাহ্ হিজাব বাঁধতে বাঁধতে বলে,
“আমি কিন্তু আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।”
“তাহলে দ্রুত আসছি।”

আহনাফ লাফিয়ে উঠে সারাহ্-র গালে চুম্বন করে ওয়াশরুমে চলে যায়। সারাহ্ হেসে জায়নামাজ বিছিয়ে অপেক্ষা করে আহনাফের জন্য। কিছুক্ষণের মধ্যে আহনাফ চলেও আসে। দুজনে একসাথে নামাজ পড়ে নেয়। তারপর আব্বাস সাহেবের সাথে দুজনে একসাথে সেহরি সেরে নেয়।

ফজরের পর সারাহ্ কোরআন তেলাওয়াত করতে বসে। আহনাফ এসে পাশে বসে বলল,
“ঐশী, তুমি অপরূপা নামের কাউকে চেনো?”

সারাহ্ কোরআন শরীফ বন্ধ করে বলে,
“না তো, কেন?”
“এমনিই।”
“ভোর বেলা এখন আবার মেয়েদের কথা মনে পড়ে কেন?”
“তওবা আস্তাগফিরুল্লাহ, আস্তাগফিরুল্লাহ।”
বলতে বলতে আহনাফ উঠে বারান্দায় যায়। সারাহ্ মুচকি হেসে আবারো তেলাওয়াত করা শুরু করে।

কিছুক্ষণ পর সারাহ্ কোরআন গুছিয়ে রেখে বারান্দায় গেল। আহনাফকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“সেদিন ঢাকা থেকে ওভাবে আসলেন কেন? কোথায় ব্য°থা পেয়েছিলেন?”
“সেটা দূরে থেকেও বলতে পারো তো, আমার রোজা হালকা করো কেন?”

সারাহ্ হুট করে সরে গেল। এই লোকটা আজন্মকাল অ°সভ্যই থাকবে, জীবনেও ভালো হবে না। আহনাফ ফিরে তাকিয়ে মুচকি হাসে।

সারাহ্ মিনমিনে স্বরে বলল,
“অ°সভ্য।”

আহনাফ ওর মুখের সামনে এসে নিজের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“গা°লা°গাল দিয়ে লাভ নেই, তুমি ইচ্ছা করে আমার রোজা হালকা করতে এসেছো।”
“সরেন।”

সারাহ্ ওকে ধা°ক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়৷ আহনাফ হাসতেই থাকে, সারাহ্ রাগ করে রুমে চলে যায়। সে চলে যেতেই আহনাফের হাসি থামে। সেদিনের একটা ঘটনা বলতে গেলেই বাকি ঘটনাও সারাহ্ জানতে চাইবে, তারপর শুরু করবে দু°শ্চিন্তা। আহনাফ চায় না এসব।
______________________________________

শাফিনকে তিনদিনের রি°মা°ন্ডে নেয়ার আদেশ দেয়া হয়েছে। আজকেই নিয়ে যাবে৷ খবর পেয়ে দুপুরের পর ইমতিয়াজ তার সাথে দেখা করতে এসেছে। অফিস থেকে সরাসরি চলে এসেছে যেন মৃত্তিকা না জানে।

সময় নির্দিষ্ট, এর মধ্যেই কথা বলতে হবে তার সাথে। ইমতিয়াজকে দেখেই শাফিন হাসে, তাচ্ছিল্যের সেই হাসি। ইমতিয়াজ চোখ ছোট করে তাকাতেই শাফিন বলে,
“আহারে, কষ্ট হয় তাহমিনার জন্য। যে মেয়েটা তোমার নাম জ°পতে জ°পতে ম°রে গেল তাকে ভুলে তুমি কিনা আরেকটা সংসার করছো?”

ন্যূনতম অনুশোচনা শাফিনের নেই। ইমতিয়াজ কিড়মিড়িয়ে বলে,
“তাহমিনার জন্য কোনো শেয়াল কুকুরের কষ্ট পাওয়ার দরকার নেই।”
“আর মৃত্তিকা? তার জন্য পেতে পারি?”

ইমতিয়াজ উত্তর দেয়ার আগে আবারো বলে,
“চেয়েছিলা বউকে মা°রার জন্য আমাকে তুমি মা°রবে, কিন্তু পেরেছো? পারোনি।”
“এখান থেকে বেঁচে বের হতে পারবে না, আর যদি বের হও তবে আমার হাতে ম°রবে।”
আঙ্গুল উঁচিয়ে কথাটা বলে ইমতিয়াজ।

শাফিন লোহার বেড়াজালের কাছে এসে বলল,
“ম°রার আগে মৃত্তিকাকে মা°রবো, তাহমিনার মতো করে মা°রবো। সেও চেঁ°চা°বে ইমতিয়াজ বলে।”

ইমতিয়াজ তাকে ধরতে গিয়েও পারে না, লোহার ছোট ছোট ফাঁক দিয়ে ওর হাত ভিতরে যায় না। শাফিন দাঁত বের করে হাসে।

ইমতিয়াজকে আরো রাগানোর জন্য বলে,
“আমি বের হওয়ার আগে মৃত্তিকা প্রেগন্যান্ট হলে ভালো হবে। একই কষ্ট, একই চিৎকার, শুধু মানুষটা ভিন্ন।”
“খবরদার মৃত্তিকার দিকে তাকিয়েছো তো।”
“সে তাকানো আমার শেষ, শুধু ছুঁয়ে দেখা বাকি।”

ইমতিয়াজ র°ক্ত°চক্ষু নিক্ষেপ তাকায়। শাফিনকে এখনই খু°ন করতে ইচ্ছা করছে ইমতিয়াজের। তবুও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে সে বেরিয়ে আসে, সময় যে শেষের পথে৷

ইমতিয়াজ বের হওয়ার কিছুক্ষণ পর অপরূপা ভিতরে প্রবেশ করে৷ তার আর অনুমতি লাগে না। ইন্সপেক্টর রাব্বিসহ উপরতলার বড়বড় মানুষের সাথে যোগাযোগ থাকায় অপরূপা সেলের ভিতরে গিয়েই শাফিনের সাথে কথা বলতে পারে।

“যা বুঝেছি সবাই মিলে তোমাকে ফাঁ°সি°তে ঝু°লানোর বন্দোবস্ত করে ফেলেছে।”

অপরূপার কথায় মাথা দুলায় শাফিন। বেশ শান্তভাবে বলে,
“ইমতিয়াজ হু°ম°কি দিয়েছে জীবন্ত বের হলে সে আমাকে খু°ন করবে।”
“ব্যাপারটা জলে কুমির ডাঙায় বাঘের মতো হলো না।”

অপরূপা ঘাবড়ে গেলেও শাফিন মোটেও ঘাবড়ায় না। বলে,
“নার্গিসের কি খবর?”
“আহনাফকে হুমকি দিয়েছি, নার্গিস মুখ খুললে সারাহ্ ম°রবে।”
“জামিলের কথায় আহনাফের সাথে সারাহ্-র বিয়ে দেয়াটাই ভুল হয়েছে।”

অপরূপা শাফিনের দিকে তাকালে শাফিন ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল,
“জীবিত না বের হতে পারি, ম°রে তো বের হতে পারবো? আমার লা°শই বের হবে এখান থেকে।”
“মানে?”
“কবরটা খুলনায় হবে, বাবার কবরের পাশে। ঠিক যেভাবে খুঁড়তে বলবো সেভাবে খুঁড়াও। আর আমার ফাঁ°সির বন্দোবস্ত করো।”

অপরূপা ভ°য়া°র্ত মুখে কিছু বলতে নিলে শাফিন আবারো বলে,
“যারা কবর খুঁড়বে তাদেরও শেষ করে দিবে।”

হাতের মুঠোয় থাকা ছোট কাগজটা অপরূপাকে দিয়ে বলে,
“আমার স°মা°ধীর মানচিত্র।”
______________________________________

সারাদিন ডিউটিতে ছিল মৃত্তিকা। ইমতিয়াজ দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত অফিসে না থাকলেও বাকি সময়টুকু ছিল। এখন দুজনেই চলে এসেছে তানজিমের বাসায়। মৃত্তিকা ভিতরে চলে গেছে আর ইমতিয়াজ গেছে গো°র°স্থানে।

মৃত্তিকা ভিতরে এসে তানজিমের সাথে ইফতার বানানোতে হাত লাগায়। দুই ভাইবোন বেশ আনন্দেই কাজ করছে। সব পেঁয়াজ তানজিম আগেই কে°টে রেখেছে। মৃত্তিকা বলে,
“এতো পেঁয়াজ কা°টা কেন?”
“ভাইয়া বলেছে কে°টে রাখতে, তুমি কা°টলে নাকি কান্নাকাটি করো।”

মৃত্তিকা মুচকি হাসে। মানুষটা চুপচাপ থাকলেও খেয়ালটুকু রাখতে ভুলে না। কোথায় ওর আনন্দ আর কোথায় ওর কষ্ট ঠিক বুঝে নিতে পারে।

তানজিম আবারো বলে উঠে,
“আপু, জানো আম্মু আজকে কি বলেছে?”
“কি?”
মৃত্তিকা কাজ করতে করতে জবাব দেয়।

তানজিম ধোয়া প্লেটগুলো রেখে বলল,
“বলেছে ম°রে গেল গেল আবার আমার ভাইকেও নিয়ে গেল।”

মৃত্তিকা অবাক চোখে তাকিয়ে বলে,
“উনি কি তাহমিনার কথা জানে না?”
“উহু, বলিনি। সিনক্রিয়েট করতে পারে।”
“এজন্যই নিজের ভাইকে সাধু ভাবছে।”

তানজিম শরবত বানানো শুরু করেছিল। কাজ থামিয়ে বলে,
“নিজেই কি এমন সাধু যে ভাইকে ভাববে।”

মৃত্তিকা তাকাতেই তানজিম চলে গেল। মৃত্তিকা তাকিয়ে তার চলে যাওয়ার পথের দিকে। কেন যেন মমতাজ বেগমকেও সন্দেহ হচ্ছে তার। পরক্ষণেই নিজেকে বুঝায়,
“নিজের মেয়েদের কেউ মা°রে না মিউকো, এসব ভুল চিন্তা তোর।”
______________________________________

কলেজ বন্ধ, সমস্তটা দিনই বাসায় কাটিয়েছে সারাহ্। আহনাফও বাসার ভিতরেই ঘুরঘুর করেছে, এখনো তাই করছে। তবে রোজা বলে আজ তার মুখে বেশ লাগাম লেগেছে, তবে ওই বলে না কয়লা ধুইলে ময়লা যায় না।

ইফতার বানাচ্ছে সারাহ্। হেল্প করার নামে আহনাফও এখানে দাঁড়িয়ে আছে। যদিও এসব কেবল নামমাত্রই, সে বিশেষ কোনো কাজে লাগছে না।

“ঐশী, একদিন বাবা-মাকে ইফতারের দাওয়াত দিই। কি বলো?”
“কাকে?”
“আরে, আমার গুণধর বউকে যে জন্ম দিছে ওই কাপলের কথা বলতেছি।”

সারাহ্ দাঁত খিঁ°চি°য়ে বলল,
“ভালো করে বললেই তো হয়।”
“ভালো করেই তো বললাম বাবা মা, তুমিই তো বুঝলে না। আমার কি মা আছে? আমি তো একজনকেই মা বলি।”

সারাহ্ তাকিয়ে আছে আহনাফের দিকে। ‘আমার কি মা আছে?’ কথাটা বলা কত কঠিন।

আহনাফ এগিয়ে এসে ওর থেকে খুন্তি নিয়ে বেগুনীগুলো উলটে দিতে দিতে বলে,
“পু°ড়ে যাবে তো।”

সারাহ্ আবারো ভাজাভাজি শুরু করে। বলল,
“দেন, আপনার ইচ্ছা।”
“এখন আমি রোজা, তুমি চাইলে তোমাকে চুমু দিতে পারবো না।”

সারাহ্ কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
“দাওয়াত দিতে বলেছি।”
“ওকে, তোমাকে সহস্র চুমোর দাওয়াত ইফতারের পর।”

কথাটা বলেই আহনাফ হেসে দেয়৷ সারাহ্ ওর পিঠে ধু°ম করে একটা কি°ল দিয়ে দরজার দিকে ইশারা করে বলে,
“বের হন।”

আহনাফ যেতে যেতে বলে,
“স্বামীকে মা°র°ধর করা ভালো না।”

সারাহ্ কথায় ন্যাকামো সংযুক্ত করে বলল,
“ওগো সোয়ামি, আপনার পাকনা কথায় আপনাকে কি°ঞ্চি°ৎ আ°ঘা°ত করার জন্য আমি অতি দুঃখ প্রকাশ করতেছি।”
“থাক থাক, যতসব গরু মে°রে জুতা দান।”

সারাহ্ হেসে আবারো কাজে মন দেয়। ইফতারের সময় যে হয়ে আসছে।
______________________________________

অপরূপা খুলনা যাচ্ছে। সাথে দুজন লোক আছে, এরা শাফিনের জন্য কবর খুঁড়বে।

উকিলকে কল করে সে,
“হ্যালো, এডভোকেট বীথি বলছেন?”
“জি, আপনি অপরূপা?”
“ইয়েস, আ’ম অপরূপা।”

বীথি একটা কাশি দিয়ে বলল,
“আপনারা কেইসটা হা°রতে চাচ্ছেন কেন? তাও এমন ইচ্ছা করে?”
“সেসব জানার বয়স কি আপনার হয়েছে?”
“শাফিনকে বহুবার আমিই বাঁচিয়েছি মনে রাখবেন। তার বহু কুকীর্তি আমি জানি।”

অপরূপা নিচের ঠোঁট কা°মড়ে বলল,
“শাফিন বেঁচে থাকবে, তবে ফাঁ°সি°তে ঝু°লেই বের হবে।”
“মানে?”
বীথি চোখমুখ কুঁচকে ফেলে।

অপরূপা হেসে বলে,
“মানে পুরো দেশ, মিডিয়া জানবে শাফিন মা°রা গেছে। সবাই জানবে ওর স°মাধী হয়ে গেছে। কিন্তু সে জীবিত হয়ে ফিরবে৷ তাই ওর ফাঁ°সির জন্য কেইসটা হা°রতে হবে। (একটু থেমে) তারপরের কাজ শাফিন করে নিবে।”
“আর ইউ শিউর?”
“ইয়াহ।”

অপরূপার কথায় বোঝা যাচ্ছে সে শতভাগ নিশ্চিত যে শাফিন বেঁচে যাবে। কিন্তু বীথি এসবে অনেক বি°ভ্রা°ন্তিতে পড়ে। ফাঁ°সি হলে কেউ কিভাবে বাঁচবে, কবর হলে কেউ কিভাবে ফিরবে?

চলবে…..

#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

ঊনচত্বারিংশ পর্ব (৩৯ পর্ব)

এক দুই তিন করে পনেরো দিন পার হয়৷ দুলাল ফেরদৌসী হ°ত্যা মাম°লা°র চূড়ান্ত রায় আজ। প্রত্যেকটা টিভি চ্যালেনে লাইভ হচ্ছে। কি হবে, কি হবে করছে শুধু।

নার্গিস পারভিন খুব একটা টিভি দেখেন না। জাহাঙ্গীর সাহেব খবর দেখার সময় নিউজটা চোখে পড়ে তার৷ বিশেষভাবে আটকানোর কারণ না থাকলেও শাফিনের চেহারা দেখে থমকে যায় নার্গিস পারভিন। এ চেহারা সে ভুলবে না। ভ°য়ং°কর দ°স্যুর চেহারা। চোখেমুখে অদ্ভুত এক বিষ্ময় চলে এসেছে নার্গিস পারভিনের।

“কি হয়েছে, নার্গিস?”

জাহাঙ্গীর সাহেবের কথায় চমকে উঠে নার্গিস পারভিন বলেন,
“কিছু না।”

উনি উঠে তাড়াহুড়ো করে সামিহার রুমে চলে যায়। সামিহা বই পড়ায় ব্যস্ত ছিল। মাকে আসতে দেখে বলল,
“আম্মু?”

নার্গিস পারভিন থম মে°রে বসে রইলেন। শাফিন কি এতো সহজে মা°রা যাবে। যদি যায় তবে তো আলহামদুলিল্লাহ, কিন্তু যদি না যায়? তবে তো সারাহ্-র ঘোর বিপদ।

সামিহা মায়ের পাশে বসে বলল,
“আম্মু, কি চিন্তা করছো তুমি?”
“কিছু না, তুমি তোমার কাজ করো।”
সামিহা বিষয়টা নিয়ে আর ঘাটাঘাটি করলো না। সে চুপচাপ নিজের পড়া শুরু করলো। সে এখনো জানে না তানজিমের মামা খু°নের মামলায় গ্রে°ফ°তার হয়েছে।

অন্যদিকে আহনাফ ফোন ঘেটে যাচ্ছে কোথাও থেকে একটা সংবাদ আসুক শাফিন মা°রা গেছে বা তার মৃ°ত্যু°দন্ড দেয়া হয়েছে। যদিও এখনো পর্যন্ত কোনো পজিটিভ বা নেগেটিভ সংবাদ আসেনি।

কলরব আদালতে আছে। সেও জানতে চাচ্ছে তার বাবার খু°নির কি শাস্তি হবে। রি°মা°ন্ডে শাফিন সবকিছু স্বীকার করে নেয়ায় পুলিশ এসব নিয়ে আর তেমন কোনো তদন্ত করে না। যদিও উপরতলার হস্তক্ষেপ থাকায় তদন্ত হতোই না।

ইমতিয়াজ অফিসে আছে। সেখান থেকেই শাফিনের মৃ°ত্যু°দন্ডের খবর শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। মৃত্তিকারও একই অবস্থা। সবার একই দোয়া শাফিন যেন জীবিত বের না হয়।

শুধু একজন ভিন্ন রকম একটা দোয়া করছে। তার দোয়া,
“যে করেই হোক শাফিন সুস্থভাবে বের হয়ে আসুক।”
এ মানুষটি মমতাজ বেগম। তার ভাই কি জঘন্য অপরাধ করেছে তা মানতে সে নারাজ। তার ভাই ভালো থাকুক এটাই চান উনি।

সংখ্যাগরিষ্ঠের দোয়া কবুল হয়। শাফিনের ফাঁ°সি°র রায় হয়ে যায়। একাধিক মানুষ একত্রে বলে,
“আলহামদুলিল্লাহ।”
______________________________________

ইফতারের পর ইমতিয়াজ মিউকোকে খাবার খাওয়াচ্ছে। মৃত্তিকা এসে বিছানায় বসে বলল,
“শাফিন যদি তবুও ছাড়া পায়?”
“ওর লা°শ নিজ চোখে না দেখা পর্যন্ত ওকে আমি একবিন্দুও বিশ্বাস করি না। ভ°য়ং°কর এক অভিনেতা সে, নিখুঁত অভিনয়।”

মৃত্তিকা মাথা দুলিয়ে বলে,
“তা বুঝলাম, কিন্তু তাকে কে মা°রার চেষ্টা করেছিল?”
“তোমার বাবা, আর কে?”

ইমতিয়াজ স্বাভাবিকভাবে কথাটা বললে মৃত্তিকা চট করে বলে,
“উনি না।”

মৃত্তিকার কথায় ইমতিয়াজ তাকায় ওর দিকে। মৃত্তিকা মাথা নেড়ে বুঝায় সে ঠিক বলছে। ইমতিয়াজ ফ্লোরে বসে আছে, মৃত্তিকা বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে থেকে ওর দিকে ঝুঁকে বলে,
“উনি না, অন্যকেউ?”

ইমতিয়াজ ওর কাছে এসে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বলল,
“সন্দেহ আছে কারো প্রতি?”

মৃত্তিকা ঠোঁট উলটে একটু ভেবে বলল,
“দুলাল হতে পারে, আবার অন্যকেউও হতে পারে। যাদেরকে আমরা চিনি না।”
“হতে পারে।”

কথা শেষে মৃত্তিকার মুখে হালকা ফুঁ দেয় ইমতিয়াজ। মৃত্তিকা চমকে উঠে সরে যায়। ইমতিয়াজ হেসে উঠে। মেয়েটা এখনো প্রচুর সংকোচে আছে, লজ্জা পায় বারে বারে।

কিছুক্ষণ পর মৃত্তিকা বলে,
“ইদের পর আপনি অস্ট্রেলিয়া যাবেন?”
“যাবো না।”
“কেন? কেন?”

ইমতিয়াজ উত্তর না দিয়ে মিউকোকে আদর করতে থাকে। মৃত্তিকা এসে ইমতিয়াজের পাশে বসে মিউকোকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে বলে,
“যা ভাগ, সারাদিন শুধু বাবার কোল দখল করে বসে থাকা। বাবার কাছে মাম না আসলে ভাইবোন কপালে জুটবে না, ভাগ এখন।”

ইমতিয়াজ মুখ টিপে হাসছে। মৃত্তিকা ওর দিকে তাকিয়ে জিভে কা°ম°ড় দেয়। ইমতিয়াজ ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাছে এনে বলে,
“বাবার কাছে মাম চলে এসেছে।”

মৃত্তিকা ওর কাঁধে মাথা রেখে বলল,
“অস্ট্রেলিয়া যাবেন না কেন? ট্রেনিং নিতে হবে না?”
“অস্ট্রেলিয়া গেলে মিউকোর ভাইবোন কিভাবে আসবে?”

মৃত্তিকা মাথা তুলে ওর দিকে তাকায়। ইমতিয়াজ অন্যদিকে তাকিয়ে হাসছে। মৃত্তিকা ওর মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
“ফাজলামো না, সিরিয়াস।”

ইমতিয়াজ এখন বেশ গম্ভীর চেহারা করে বলল,
“শাফিন যতদিন বেঁচে আছে, ততদিন আমি তোমাকে একা রাখতে পারবো না।”

মৃত্তিকা হেসে দুহাতে ইমতিয়াজকে জড়িয়ে ধরে। মিউকো এসে আবারো ইমতিয়াজের গা ঘেষে শুয়ে পড়ে। ইমতিয়াজ একহাতে মৃত্তিকাকে জড়িয়ে ধরে, আরেকহাতে মিউকোকে আদর করে দেয়। মৃত্তিকা বেশ আরাম করে আধশোয়া হয়ে থাকতে থাকতে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে। ইমতিয়াজ ওকে নিজের কোলে শুইয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। মৃত্তিকার চেহারার দিকে তাকায় সে। ছোটবেলা থেকে যু°দ্ধ করে বড় হওয়া মেয়েটার বাহিরটা শক্ত হলেও ভেতরে একদম ছোট বাচ্চার মতো।

“যতন করে সাজিয়ে রাখতে ইচ্ছা করে, পুতুল আমার।”

মৃত্তিকা জেগে থাকলে এ কথা কখনোই ইমতিয়াজ বলতে পারতো না। তবে এখন বলছে। মৃত্তিকার আড়ালে প্রকাশ করছে নিজের অনুভূতি।
______________________________________

দিন আগায়, এক সপ্তাহ পেরিয়ে যায়। আজ রাতেই শাফিনের ফাঁ°সি হবে। তাই আজ পরিবারের মানুষজন তার সাথে দেখা করতে আসতে পারবে। দেলোয়ারা আজ প্রথমবারের মতো শাফিনের সাথে দেখা করতে এসেছে। সুরভিও সাথে এসেছে।

সুরভিকে দেখে এগিয়ে আসে শাফিন। সুরভি বলে,
“পরশুদিন আমার ডেলিভারির ডেইট দিয়েছে বাবা। তাহমিনা থাকতে পারতো আমার সাথে, তাহসিনাও থাকতো। রিপা আন্টি থাকতো, কিন্তু তুমি তা হতে দাওনি।”

সুরভির চোখ বেয়ে পানি পড়ে। ডানহাতের উলটো পিঠ দিয়ে মুছে নাক টে°নে বলল,
“আমার বাবুটাকে তার বাবা দেখবে আর শুধুই খরচ দিবে। কোলে নিবে না। (একটু থামে) তোমার কোলে প্রথম তুলে দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু তুমি তা হতে দিলে না।”

সুরভি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। শাফিন অনুভূতিহীন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এসবে তার আদৌ কি কিছু আসে যায়?

“আমার সংসার আর স্বপ্নগুলো ধ্বং°স করেছো তুমি বাবা।”

সুরভি কথা বললেও দেলোয়ারা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে কোনো ভাষা নেই। এক নিরব, নির্জনতা ভর করেছে তার উপর। এতোবছর যার সাথে সংসার করেছে সে একটা অ°মানুষ। দেলোয়ারা বিশ্বাস করতে পারছে না। নিজের স্বামীকে অনেক ভালোবাসতেন উনি, যা এখন কেবলই ঘৃ°ণা।

“তুমি কিছু বলবে না, দেলোয়ারা?”

শাফিনের প্রশ্নে ঘৃ°ণায় চোখ সরায় দেলোয়ারা। সুরভির থেকে সে সবটাই জেনেছে। ঠিক কেমন আচরণ তাহমিনার সাথে করেছে তাও জানে। যদিও এখনো পুরোটা সে বিশ্বাস করেনি।

নিচুস্বরে একটা কথাই দেলোয়ারা বলে,
“আপনার ম°রা মুখটাও আমি দেখতে চাই না।”
______________________________________

সারাহ্ ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে। আহনাফের সাথে সকালেই ঢাকায় এসেছে সে। আব্বাস সাহেবও এসেছেন। মূলত জাহাঙ্গীর সাহেবের দাওয়াত রক্ষায় এসেছে সবাই।

আহনাফ এসে ওর পেছনে দাঁড়িয়ে শার্টের কলার ঠিক করছে। বোঝা যাচ্ছে সে বাইরে যাবে। সারাহ্ আয়নার দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে বলল,
“কোথায় যাবেন?
“যাবো কোথাও।”

সারাহ্ ওর দিকে ফিরে বলল,
“এখন কেন, মাত্রই তো ইফতার করলেন।”

আহনাফ হেসে ওর দুগালে চুম্বন করে বলে,
“সমস্যা নাই, চলে আসবো।”
“কখন আসবেন?”
“সেহরির আগেই।”

সারাহ্ কপাল কুঁচকায়।
“সেহরির আগে মানে সারারাত বাইরে থাকবেন?”

আহনাফ হেসে পারফিউম দিয়ে বলল,
“চিন্তা করো না, মেয়ে নিয়ে থাকবো না।”

সারাহ্ ওর বুকে একটা হালকা ধা°ক্কা দেয়, আবার নিজেই শার্ট খা°ম°চে কাছে নিয়ে আসে। বলে,
“না গেলে হয় না?”

আহনাফ মুচকি হেসে হাঁটু গেড়ে বসে সারাহ্-র পেটে হাত রেখে বলল,
“বাবা আমার, আম্মুকে সামলে রেখো। তোমার আম্মু কিন্তু অনেক ভীতু। সে বাবাকে মিস করে সারাদিন। গল্প করো আম্মুর সাথে।”

সারাহ্ ওর কান্ডকারখানা দেখে হাসে। আহনাফ মাথা উঠিয়ে সারাহ্-কে দেখে বলল,
“তোমার আম্মুর লজ্জাও কমে যাচ্ছে, দিনদিন বে°হা°য়া হচ্ছে আর আমাকেও তাই বানিয়ে দিলো।”
“ইশ, লজ্জাশীল ব্যক্তি আমার।”

আহনাফ ওর পেটে চুম্বন করে, সারাহ্ লাফিয়ে উঠে বলল,
“সরুন, কি করছেন?”

আহনাফ উঠে দাঁড়িয়ে হেসে বেরিয়ে যায়। সারাহ্ আয়নার দিকে ফিরে নিজের পেটে হাত রেখে বলে,
“বাবাটা বেশি দুষ্ট হয়েছে, একদম লাগাম ছাড়া।”
______________________________________

আহনাফ জেলে এসেছে। শাফিনের সাথে দেখা করাই উদ্দেশ্য। সুরভি আর দেলোয়ারা বের হলেই আহনাফ দেখা করতে যায়। ওকে দেখে শাফিন বাঁকা হেসে বলে,
“সারাহ্ ভালো আছে?”

উত্তর না দিয়ে আহনাফ পালটা প্রশ্ন করে,
“অপরূপা কে? আর জামিলের সাথে আপনার কি সম্পর্ক?”

শাফিনে হেসে বলল,
“অপরূপা মানে যে প্রচুর সুন্দরী, রূপবতী। একদম রূপকথার গল্পের রাজকুমারীর মতো। (নিচুস্বরে) তাহসিনার মতো।”

আহনাফ বুঝতে পারে অপরূপাকে শাফিন চেনে আর এখন শাফিনের মূল উদ্দেশ্য ওকে রাগানো। আহনাফ শান্ত মেজাজে বলল,
“আর জামিল?”
“বন্ধু, তোমার আর সারাহ্-র বিয়ের প্ল্যানটা ওই গাধাই দিয়েছিল। এতে সারাহ্ হাতে না থেকে হাতছাড়া হয়ে গেছে।”

আহনাফ চোখ বুলিয়ে শাফিনকে ভালো করে দেখে। তার মধ্যে মৃ°ত্যুর ভয় নেই, চিন্তা নেই। কেমন যেন অদ্ভুত এক চেহারা। আহনাফ আর কিছু না বলে বেরিয়ে যায়।

শাফিন পেছন থেকে চেঁ°চিয়ে উঠে বলে,
“সারাহ্ মানে তোমার আদরের ঐশীকে সামলে রেখো।”

আহনাফ পাত্তা না দিয়ে বাইরে চলে আসে।বাইরে তানজিম আর ইমতিয়াজের সাথে দেখা হয়। দুজনে একই উদ্দেশ্যে এসেছে। আহনাফ তানজিমকে বলে,
“তুমি ঠিক বলেছিলে বিয়েটা পরিকল্পিত। জামিল ফুপা এক সাথে জড়িত আছে।”

তানজিম মাথা নেড়ে বলল,
“হুম, আমার সন্দেহ হয়েছিল। তবে এখনো আমি কারণটা নিয়ে কনফিউজড।”

তানজিম বি°ভ্রা°ন্ত হলেও আহনাফ মোটেও নয়। নার্গিস পারভিনকে দুর্বল করার জন্যই সারাহ্-কে ব্যবহার করতে চেয়েছিল ওরা। কিন্তু এখন ওরা ব্যর্থ।

“ভাইয়া, মিউকোপু কোথায়?”

তানজিমের কথায় ইমতিয়াজ আশেপাশে তাকায়। মৃত্তিকা ওর পাশেই ছিল কিন্তু এখন নেই। ইমতিয়াজ অন্য দিকে দেখতে থাকে। অবশেষে মৃত্তিকাকে ভিতরে যেতে দেখে ইমতিয়াজও যায়।

শাফিনের কাছে গিয়ে মৃত্তিকা বলে,
“মিজানের পা°ল্লার কথা ভেবেও তো তোমার শুধরে যাওয়া উচিত ছিল। কিভাবে দাঁড়াবে আল্লাহ্-র সামনে? কবরের আ°যা°ব কিভাবে সহ্য করবে?”
কথা বলতে বলতে মৃত্তিকার কন্ঠ কেঁপে উঠছে।

হিসাবের খাতা নিয়ে একবার বসে দেখো আমাদের পা°পের বোঝা ঠিক কতটা। যেন মনে হয় সমস্তটা জীবন পা°প করেই কাটিয়ে দিয়েছি। গুনাহ করতে করতে এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছি যে এখন গুনাহ করলেও তা নিয়ে ভাবনার সময় আমাদের নেই।

ইমতিয়াজ চলে আসায় শাফিন বলে,
“তোমার বউ স্বেচ্ছায় আমার কাছে এসেছে।”

মৃত্তিকা পিছনে তাকায়। ইমতিয়াজ ওর হাত ধরে শাফিনের দিকে তাকিয়ে মৃত্তিকাকে বলল,
“চলো।”

শাফিন হেসে বলল,
“দুলালের যে ভিডিওটা করেছিলে সেটা আদালতে দেখাও নি কেন?”
“সেটা আদালতের জন্য না, সেটা শুধুমাত্র তোমার জন্য।”

ইমতিয়াজ মৃত্তিকাকে নিয়ে বাইরে চলে আসে। প্রচুর মানুষের ভীড় এখানে। মৃত্তিকার হাত বেশ শক্ত করে ধরে হাঁটছে। মৃত্তিকা ঘাড় ঘুরিয়ে বারবার শাফিনের দিকে তাকাচ্ছে। শাফিনের আচরণ আর কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছে সে তার বের হওয়ার সব বন্দোবস্ত করে ফেলেছে।

বাইরে এসে ইমতিয়াজ তানজিমকে বলল,
“মৃত্তিকাকে নিয়ে বাসায় যাও, তানজিম।”
“আর আপনি?”
“ওর ফাঁ°সির পর আসবো।”
“আমি আপনাকে ছাড়া যাবো না।”

ইমতিয়াজ আড়চোখে একবার তানজিমের দিকে তাকায়। তারপর বলে,
“মৃত্তিকা, যা বলছি করো। এখানের পরিস্থিতি যেকোনো সময় যা খুশি হতে পারে।”
“আপনি থাকলে আমিও থাকবো।”

“যাও।”
ইমতিয়াজ এবারে ধ°ম°ক দেয়৷ ধ°ম°কে কাজ হয়, মৃত্তিকা চলে যেতে রাজি হয়।

উবার কল করে মৃত্তিকা আর তানজিমকে বাসায় পাঠিয়ে দেয় ইমতিয়াজ। কিছুদূর গিয়েই মৃত্তিকা গাড়ি থেকে নেমে তানজিমকে বলে,
“ইমতিয়াজকে জানাবে না আমি নেমে গেছি, বাসায় যাও।”
“কিন্তু আপু..”

ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই মৃত্তিকা ধ°ম°ক দেয়,
“যা বলছি তাই, বাসায় যাও। বড়মণি আর খালু একা ওখানে।”

মৃত্তিকা হাঁটা শুরু করে। তানজিম ড্রাইভারকে বলে,
“ভাইয়া চলুন।”

গাড়ি চলতে শুরু করলে তানজিম ইমতিয়াজকে কল দেয়।
“ভাইয়া, আপু নেমে গেছে গাড়ি থেকে।”
“এই মেয়েটা? আচ্ছা, তুমি বাসায় যাও, আমি দেখছি।”

ইমতিয়াজ ফোন রেখে আহনাফকে বলল,
“একটু অপেক্ষা করো, আমি আসছি।”
ইমতিয়াজ মৃত্তিকাকে খুঁজতে যায়৷

এদিকে মৃত্তিকা ফেরার পথে কারাগারের সামনের সড়কে অপরূপাকে দেখে। কালো চাদর গায়ে জড়ানো মেয়েটাকে আলাদা করে চেনার কারণ এই চাদরটাই। এখন বেশ গরম পড়েছে, চাদর দেয়ার অবশ্যই বিশেষ কোনো কারণ আছে।

মৃত্তিকাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অপরূপা বলে,
“কি দেখো?”
“কিছু না।”

অপরূপা রহস্যময় একটা হাসি দিয়ে বলল,
“চাদর দিয়েছি তাই দেখছো?”
“হুম।”
মৃত্তিকা জোরপূর্বক হাসে।

অপরূপা চাদর খুলে গুছিয়ে ডানহাতে ঝুলিয়ে নিয়ে বলে,
“মাঝেমাঝে নিজেকে লুকাতে হয়, আবার মাঝেমাঝে প্রকাশ্যে আনতে হয়।”

অপরূপা অন্যদিকে চলে যায়। মৃত্তিকা কয়েক মুহূর্ত ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে আবারো নিজের পথে হাঁটে৷

ইমতিয়াজের কাছে এখন ধরা না দিয়ে শাফিনের সাথে দেখা করে। শাফিন ওকে দেখে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল,
“কি ব্যাপার? আবার আসলে যে?”

মৃত্তিকা আশেপাশে তাকিয়ে তাড়াহুড়া করে বলে,
“তাহমিনার সাথে ওরকম আচরণ কেন করেছো? শুধুই কি সত্য জানার জন্য নাকি আরো কোনো কারণ আছে?”

শাফিন এগিয়ে এসে লোহার বেড়াজালে হাত রেখে বলল,
“তোমার মায়ের দুই ফ্রেন্ডের সাথেও এই আচরণ করেছিলাম, (ফিসফিসিয়ে বলে) তুমি গ°র্ভে থাকতে তোমার মায়ের সাথেও একই কাজ করতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছিলাম।”

মৃত্তিকা রাগে গ°জ°গ°জ করতে করতে বলল,
“এখানে তাহমিনার সাথে কি সম্পর্ক? শুধু অন্তঃসত্ত্বা ছিল বলে?”

শাফিন মাথানিচু করে হালকা মাথা ঝাকিয়ে মুখে “চু, চু” মতো একটা আওয়াজ করে। তারপর হাসিহাসি মুখে বলে,
“অনেক কিছু এখনো তোমার জানা বাকি। যা দুলাল জানতোই না। বেচারা শুধু ব্যবসা বাঁচানোর জন্য আমার সাথে ছিল।”

মৃত্তিকা কপাল কুঁচকে চোখ ছোট করে। শাফিন বলে,
“নিজেকে সামলে রেখো, আর মনে রেখো যে শাফিনকে এতোবছরে কেউ শা°স্তি দিতে পারেনি তাকে সামান্য ফাঁ°সির দড়ি কিছুই করতে পারবে না।”

মৃত্তিকার মাথায় খু°ন চেপে বসে। লোহার ছোট ফাঁক দিয়ে ডানহাতের তিন আঙ্গুল ভিতরে ঢুকিয়ে শাফিনের ফতুয়া ধরে হেঁচকা টা°ন দেয়। হঠাৎ করে টা°ন পড়ায় শাফিনের মাথা লোহায় বা°রি খায়। পরপর দুবার টা°ন দিতেই দুজন মহিলা কন্সটেবল এসে মৃত্তিকাকে সরিয়ে নেয়।

শাফিনের কপালের মাঝ বরাবর কে°টে গেছে, র°ক্ত ঝরছে সেখান থেকে। মৃত্তিকা এখনো রাগে ফোঁ°সফোঁ°স করছে।

মৃত্তিকা জোর গলায় বলে,
“মনে রেখো শাফিন, সিংহী কিন্তু শি°কার করে সিংহ নয়।”

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে