Monday, July 7, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 330



যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-১১+১২

0

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১১.

গতকাল রাতের বন্দী সেই তিন ছেলের উপর এতক্ষণ পাষবিক অত্যাচার চালিয়েছে পার্থ। তার সম্পূর্ণ শরীর ঘামে জর্জরিত। একটা চেয়ারে বসে সে পানির বোতল থেকে কিছুটা পানি খেয়ে নেয়৷ অত:পর শামীমের দিকে তাকিয়ে বলে,

“ যেকোনো সরকারি হাসপাতালে নিয়ে এখন ভর্তি করিয়ে দে। আর মুখ যেন জীবনে না খুলে। “

শামীম সহ আরো কয়েকজন মিলে ছেলেগুলোকে টেনে তুলে নিয়ে যেতে নিলেই পার্থ সেই ছেলেগুলোকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

“ আমার আজাব থেকে তো বেঁচে গেলি। কিন্তু যেই মহিলার নিষ্পাপ ছেলেকে কুপিয়ে হত্যা করেছিস সেই মহিলার বদদোয়া হবে তোদের সবথেকে বড় শাস্তি। জাহান্নামও নসিব হবে না তোদের। “

ছেলেগুলোকে নিয়ে যেতেই পার্থ চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে চোখ বুজে রয়। কালকে থেকে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনার রাগ ঝেড়ে এখন কিছুটা হালকা লাগছে তার। একের পর এক ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো তাকে বেশ পীড়া দিচ্ছিলো। পার্থর পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা আসিফ বলে,

“ ভাই আপনে এখন বাসাত যান। অনেক ক্লান্ত লাগতাসে আপনারে। দুইদিন ধইরা ঘুমাইতাসেন না। “

পার্থ চোখ বুজে রেখেই মৃদু হাসে৷ অত:পর প্রশ্ন করে,

“ তোর কি আমাকে খারাপ মনে হচ্ছে না আসিফ? জোর করে ডাক্তার সাহেবাকে বিয়ে করলাম নিজের লাভের জন্য। আমার ব্যক্তিগত ঝামেলার বলিদান আমার বোন হলো। সবকিছুর জন্য আমি দায়ী না? “

“ ভাই আপনি যা করসেন একদম ঠিক করসেন। অপরাধীগোরে যদি আইন শাস্তি না দেয় তাইলে নিজেগোই হেই শাস্তি দিয়া দেওন উচিত। কালকা ভাবীরে যদি না আটকাইতেন তাইলে উনি এই সব ফাঁস কইরা দিতো। আর তখন ক্ষমতাশীল দলরা এইডার ফায়দা নিতো। কেউ কখনো জানার চেষ্টা করতো না আসল অপরাধী কে। কেউ জানলেও বিষয়ডা ধামাচাপা দিয়া দিতো। সবার কাছে আপনেরে কালার করতো। “

“ আর এখন যা করছি তা ঠিক করছি আমি? একজনকে জোর করে বিয়ে করলাম। আমিতো এখনো এটাও জানিনা সারাজীবন এই বিয়ে কিভাবে চালাবো আমি। আর আমার বোনেরই বা কি হবে? “

“ বিয়া তো একখান ফরজ কাম। আজকে হোক কালকে হোক এইডা আপনার করতেই হয়তো। হ, একটা ছোট সমস্যা আছে। হেইডা হইলো ভাবী হইসে ধানী মরিচের মতো। কিন্তু আপনেও বা কম কিসে? নায়কের মতো সুন্দর দেখতে। দুইদিন পরেই দেখবেন ভাবী আপনার প্রেমে পইড়া গড়াগড়ি খাইবো৷ তখন আর আপনার সংসার করতে অসুবিধা হইবো না। “

আসিফের কথা শুনে পার্থ হাসে। এর মাঝেই আসিফের ফোন বেজে উঠে। ফোনে শোভনের নাম দেখতেই আসিফ বলে,

“ শোভন ভাই কল দিতাসে। “

“ রিসিভ কর। “

আসিফ ফোনে কথা শেষ করেই আতংকিত সুরে বলে উঠে,

“ ভাই, পৃথা নাকি সিঁড়ি থেইক্যা পইড়া গেসে। আপনার আব্বা, আম্মা সবাই তরী ভাবীগোর বাসায় যাইতাসে। আপনারেও যাইতে কইসে। “

বোনের কথা শুনতেই পার্থ আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা করে না। সোজা দৌঁড়ে বেরিয়ে যায় তরীদের বাসার উদ্দেশ্যে।

__________

তূর্যের গালে থাপ্পড়টা পড়তেই সে বিস্ফোরিত গলায় উচ্চারণ করলো,

“ পাপা! “

হুমায়ুন সাহেব বেশ ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষ। কিন্তু আপাতত উনার সম্পূর্ণ শরীর রাগে থরথর করে কাঁপছে। হাতের ল্যাগেজটা বাইরে ফেলেই তিনি হনহনিয়ে লিভিং রুমে প্রবেশ করেন। তূর্য সেই ল্যাগেজটা দরজার ভিতরে টেনে এনে দরজা লাগিয়ে দেয়। হুমায়ুন রশীদ ক্রোধান্বিত স্বরে বলে উঠে,

“ খুব লায়েক হয়ে গিয়েছো তুমি? আমাকে না জানিয়ে বিয়ে সেড়ে ফেলছো আর তা আমার জানতে হচ্ছে হয় এলাকার মানুষদের ফোনকল থেকে নাহয় দাঁড়োয়ানের কল থেকে। “

তূর্য কিছু বলে না। চুপচাপ মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রয়। হুমায়ুন রশীদ গর্জন করে উঠে,

“ তরী কোথায়? নিশ্চয়ই ও নিজেও এসবে জড়িত। এজন্যই আজ সারাদিন আমার ফোন রিসিভ করছে না। কল দাও ওকে এক্ষুণি। হসপিটাল থেকে বাসায় ফিরতে বলো। তোমাদের দুই ভাই বোনের সাথে আজ আমার বোঝাপড়া আছে। “

তূর্য শান্ত স্বরে জবাব দেয়,

“ আপি হসপিটালে নেই। “

“ তাহলে কোথায়? “

“ নিজের শশুড়বাড়ি। “

হুমায়ুন রশীদের পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সড়ে গিয়েছে। এসব কি হচ্ছে? উনি কিছু বলবে তার আগেই আবার কলিংবেল বেজে উঠে। তূর্য এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই অবাক হয়। তরী এসেছে! সাথে পিছনে মানুষ গুলো কে হতে পারে তা-ও বুঝতে অসুবিধে হয় না তার। তরী তূর্যর দিকে এক মুহুর্ত তাকিয়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করে। তার পিছু পিছু আফজাল সাহেব, সাদিকা বেগম এবং শোভনও প্রবেশ করে। সকলেই তূর্যকে আড়চোখে দেখছিলো। তরী ভিতরে প্রবেশ করতেই অবাক হয়। লিভিং রুমে তার পাপা দাঁড়িয়ে! এতদিন পর নিজের পাপাকে দেখে সে দৌঁড়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। আদুরে গলায় বলে উঠে,

“ আই মিসড ইউ সো মাচ পাপা। “

দৃশ্যটা দূর হতে দেখেন আফজাল সাহেব। তার অশান্ত দৃষ্টিও নিজের মেয়েকে খুঁজতে ব্যস্ত। হুমায়ুন সাহেব সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করে,

“ সব কিছু আমাকে খুলে বলো। আমার অনুপস্থিতিতে আমার ছেলে মেয়ের জীবনে কি হয়েছে আমি সব জানতে চাই৷ “

তরী হুমায়ুন সাহেবকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ আপনারা বসুন। আমি পৃথাকে ডেকে নিয়ে আসছি। “

কথাটা বলতে বলতেই পৃথাকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসতে দেখা যায়। সে কলিংবেলের শব্দ শুনে কৌতূহল বসত বেড়িয়েছে রুম থেকে। হুমায়ুন সাহেব সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসা নিজের পুত্রবধূকে দেখে বিস্মিত হয়। এটাই কি সেই মেয়ে যাকে তার ছেলে বিয়ে করে এনেছে? শভ্র আলতা মিশ্রিত গায়ের রঙের মেয়েটার চেহারা দেখেই মনে হচ্ছে সদ্য কলেজে ভর্তি হওয়া কোনো কিশোরী।

পৃথাকে দেখতে পেয়েই সবার আগে সাদিকা বেগম ছুটে যায় মেয়ের দিকে। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে উনি কান্না জুড়ে বসে। মায়ের ছোঁয়া পেয়ে পৃথাও ঠোঁট উল্টে গুটিসুটি মেরে মায়ের বুকে পড়ে রয়।

উহু! এভাবে তো সব হবে না। তরী সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ আপনারা সবাই বসুন। আমি সব ক্লিয়ার করে জানাচ্ছি। “

হুমায়ুন রশীদ মেয়ের কথায় আশ্বস্ত হয়। আপাতত কি হয়েছে এটা জানা সবথেকে জরুরি। উনি শান্ত হয়ে একটা সোফায় বসে। আফজাল সাহেব এবং শোভনও বসেন। সাদিকা বেগম পৃথাকে টেনে নিজের সাথে বসায়। অবশিষ্ট রয় একটি সোফা। তরী সেটাতে সোজা হয়ে বসে চুপ করে রয়। সবার মধ্যে কেবল তূর্যই দাঁড়িয়ে আছে অপরাধীর ন্যায়।

হুমায়ুন রশীদ তরীকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ এখন সব খুলে বলো। “

“ ওয়েট পাপা। আরেকজন আসা বাকি। “

কথাটা বলতে বলতেই আবার কলিংবেল বেজে উঠে। তূর্য এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই পার্থ হন্তদন্ত পায়ে প্রবেশ করতে করতে বলে উঠে,

“ পৃথা কোথায়? “

তরী ভিতর থেকে বলে উঠে,

“ পৃথা ইজ অলরাইট। আমিই আপনার ভাইকে বলেছিলাম আপনাকে কল দিয়ে এই ফেক এক্সকিউজ জানাতে। যাতে সুরসুর করে আপনি এসে পড়েন। “

পার্থ লিভিং রুমে উপস্থিত সবার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

“ এখানে কি চলছে? “

তরী শান্ত ভঙ্গিতে ওই তিন ছেলের ঘটনা বাদে বাকি সব কিছু খুলে বলে। সব শুনে আফজাল সাহেব আর শান্ত থাকতে পারে না। উঠে গিয়ে পার্থর গালে চড় বসিয়ে দিয়ে বলে,

“ এই শিক্ষা দিয়েছি আমি তোমাকে? তুমি আমার গর্ব ছিলে, অথচ আজ তোমার কারণেই আমার লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। একটা মেয়েকে জোর করে বিয়ে করা কোথাকার কোন ভদ্রতা? তোমার যদি ওকে এতোই পছন্দ হয়ে থাকে আমাকে বলে দেখতে। ভদ্র সমাজের মানুষের ন্যায় আমি সমন্ধ পাঠাতাম। “

পার্থ জবাব দেয় না। তূর্যর পাশে চুপচাপ মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রয়। হুমায়ুন রশীদ আফজাল সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

“ আপনি ঠান্ডা হয়ে বসুন। এর একটা বিহিত করতে হবে। “

আফজাল সাহেব গরম মস্তিষ্ক নিয়েই সোফায় বসে। হুমায়ুন রশীদ শান্ত ভঙ্গিতে বলে উঠে,

“ এই ঘটনাতে দোষী হলো পার্থ আর তূর্য। মাঝখান দিয়ে তরী আর পৃথার জীবনটাকে ওরা এলোমেলো করে দিলো। “

আফজাল সাহেব গরম চোখে একবার নিজের ছেলেকে দেখে নিয়ে হুমায়ুন সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলে,

“ ওরা সম্মান যতটুকু ডুবানোর ডুবিয়েছে। বাকি বিষয়টা এখন আমাদেরই সামলে নিতে হবে। “

সাদিকা বেগম পাশ থেকে ফিসফিসিয়ে বলে,

“ কি করতে চাইছো তুমি? “

আফজাল সাহেব স্ত্রীর দিকে ফিরে নিচু স্বরে বলে,

“ যা আমার শশুড় আব্বা করেছিলো। “

অত:পর হুমায়ুন সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

“ আপনি রাজি থাকলে আমি পার্থ এবং তরীর বিয়ে দিতে চাই। সাথে তূর্য এবং পৃথারও। “

পার্থ জোর গলায় বলে উঠে,

“ বিয়ে তো হয়ে গিয়েছে। নতুন করে আবার কিসের বিয়ে? “

আফজাল সাহেব গর্জে উঠে,

“ চুপ করো তুমি নালায়েক। আইনগত ভাবে তোমাদের কেবল বিয়ে হয়েছে, কিন্তু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তোমাদের বিয়ে জায়েজ হয়নি। “

হুমায়ুন রশীদ শান্ত ভঙ্গিতে বলে উঠে,

“ এইখানে আমার মর্জির কিছু নেই। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তরী এবং পৃথার। ওদের আপত্তি না থাকলে আমার কোনো সমস্যা নেই। “

পৃথা যে তূর্যকে ভালোবাসে তে ইতিমধ্যে কারো অজানা নয়। তাই তার এই সিদ্ধান্তেও কোনো অসুবিধা থাকার কথা না। তাই আফজাল সাহেব সরাসরি তরীকে প্রশ্ন করে,

“ তোমার কোনো আপত্তি নেই তো মা? “

তরী নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দেয়,

“ আপনার ছেলে অলরেডি আমার লাইফ অনেক মেসড আপ করে দিয়েছে। ডিভোর্সির ট্যাগ লাগিয়ে আমি আমার লাইফের প্রব্লেমস আর বাড়াতে চাই না। তাই আমার কোনো সমস্যা নেই। “

আফজাল সাহেব হুমায়ুন রশীদের দিকে তাকিয়ে বলে,

“ সামনের মাসে আমি আমার ছোট ছেলের বিয়ে ঠিক করে এসেছি। তাই তরী এবং পার্থর বিয়েটা সামনের সপ্তাহে পড়ালে কেমন হয়? “

হুমায়ুন রশীদ বলে,

“ তা না হয় হলো কিন্তু তূর্য এবং পৃথার কি হবে? “

“ ওদের না হয় এখন হুজুর ডেকে বিয়ে পড়িয়ে রাখি? আর এক দুই বছর পর অনুষ্ঠান করে মেয়েকে তুলে দিবো আমি। “

তূর্য এতে বাঁধ সেধে বলে,

“ বিয়ে পড়ানোর হলে পড়ান কিন্তু পৃথা এই বাসায়ই থাকবে। “

ছেলের এমন নির্লজ্জের ন্যায় কথায় হুমায়ুন রশীদ বিরক্ত হয়। এতো বড় অপরাধের পরও যে এই দুই ব্যাটাকে জেল হাজতে না পাঠিয়ে বিয়ের মালা পড়ানো হচ্ছে তা যেন এদের হজম হচ্ছে না। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে সাদিকা বেগমও তূর্যের পক্ষ নিয়ে বলে উঠে,

“ হ্যাঁ। যেহেতু ওদের মধ্যে এখন স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক আছে তাই ওদের আলাদা থাকার কোনো মানে হয় না। ভাইজানের যদি কোনো সমস্যা না থাকে তাহলে পৃথা আপাতত এখানে থেকেই নিজের পড়াশোনাটা চালাক। একটু দায়িত্বজ্ঞান আসুক ওর মাঝে তারপর নাহয় ওদের ধুমধাম করে রিসিপশন করা হবে। “

হুমায়ুন রশীদ বলে,

“ কি বলেন আপা! পড়াশোনা নিয়ে আমার তরফ থেকে কখনো কোনো বাঁধা ফেস করবে না পৃথা কথা দিচ্ছি। উল্টো আমার বাসায় ও মেয়ের মতোই আদরে থাকবে। “

__________

রাত ৮ টা নাগাদ কাজী ডেকে সবার উপস্থিতিতে তূর্য এবং পৃথার বিয়ে পড়ানো হয়। যদিও তূর্য এবং পার্থর প্রতি আফজাল সাহেবের রাগ এখনো কমে নি কিন্তু তরী এবং হুমায়ুন সাহেবকে উনার পছন্দ হয়েছে। উনি হুমায়ুন সাহেবের উদ্দেশ্যে বলে উঠে,

“ বেয়াইন নিজের এক মেয়েকে আজ আপনার আমানতে দিয়ে দিলাম। আর আরেক মেয়েকে আপাতত আপনার কাছে রেখে যাচ্ছি। ইনশাআল্লাহ এক সপ্তাহ পর তরীকে নিজের বড় ছেলের পুত্রবধূ হিসেবে নিতে আসবো। “

“ অপেক্ষায় থাকবো আমি। “

আফজাল সাহেবরা বেরিয়ে যাওয়ার সময় পার্থ আড়চোখে একবার তরীর দিকে তাকায়। তরী পার্থর দৃষ্টি দেখতে পেয়েই অগ্নিমুখ করে অন্যদিকে ফিরে যায়। মনে মনে বলে,

“ একবার খালি এই অসভ্যকে বাগে পাই, তরী কি জিনিস চিনিয়ে দিবো। “

__________

পার্থ বাসায় ফিরেই আর কারো সাথে কোনো কথা না বলে নিজের রুমে গিয়ে গোছল সেরে নেয়। গোছল সেরে বের হতেই দেখে শোভন তার রুমে বসে আছে। নিজের পুলিশের সন্দেহজনক দৃষ্টি তাক করে পার্থকে আগাগোড়া পরখ করছে। পার্থ বিরক্তির সুরে প্রশ্ন করে,

“ কি? “

“ আমাকে বুদ্ধি দিয়ে নিজেই মেয়ে তুলে বিয়ে করে ফেললি? তোর পার্সোনালিটির সাথে এটা যায় না দাদা। “

“ তুইও তো বেয়াদবের মতো বড় ভাইয়ের আগে নিজে ঢেইঢেই করে বিয়ে করার প্ল্যান করছিলি। সেজন্য তাড়াহুড়ো করে আমি আগে শুভ কাজ সেড়ে নিলাম। “

“ তুই যেটাকে শুভ কাজ বলছিস সেটা একটা ক্রাইম ছিলো। ভাগ্যিস ভাবী কোনো মামলা ঠুকে নি তোর বিরুদ্ধে। নাহলে আমি তোকে গ্রেফতার করার জন্য একপায়ে রাজী ছিলাম। “

“ বিরক্ত করিস না তো। যা। ঘুমাবো আমি। “

শোভন এবার মুখ সামান্য কালো করে বলে,

“ পৃথাকে মিস করছি। “

পার্থ ভাইয়ের দিকে তাকায়। সে নিজেও বোনকে মিস করছে খুব। শোভন নিজ থেকেই বলে,

“ আংকেল কে তো ভালোই মনে হলো। আর পৃথা নিজেও ওই ছেলেকে পছন্দ করে। তবুও যদি ওই ছেলে আমার বোনের সাথে উল্টাপাল্টা কোনো বিহেভ করে তাহলে ডিরেক্ট কেস করে দিবো। “

“ তোর মাথায় কি সারাদিন শুধু কেস ঠুকার প্ল্যানই ঘুরে? কখনো আমাকে জেলে নিতে চাস, কখনো নিজের বোন জামাইকে। “

“ আমি তো শুধু কেস ঠুকার কথা বলছি। একবার ভাব যদি নানাজান এসব ঘটনা জানতে পারে তাহলে কি হবে! “

পার্থ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

“ আব্বার রফাদফা করে দিবে। “

__________

গতকাল থেকে এক থ্রি পিস পড়ে থাকায় বেশ অশান্তি লাগছিলো পৃথার। ভাগ্যিস তরী নিজ থেকে তাকে একটা জামা এনে দিয়েছে পড়ার জন্য। জামাটা একদম নতুন। কিন্তু সমস্যা হলো ড্রেসের ফিটিং নিয়ে। তরী বেশ লম্বা আর চিকন। দেখে মনে হয় গায়ে কঙ্কাল কোনো। সেই তুলনায় পৃথা বেশ ছোটখাটো দেখতে। আবার গায়ে গড়নের দিক দিয়েও তার স্বাস্থ্য সুন্দর। তাই জামাটা তার গায়ে বেশ বেমানান লাগছে। কিন্তু আপাতত একদিনের জন্য তার এটা পড়েই কাটাতে হবে। তূর্য তখন জানিয়ে গেলো যে সে কাল অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে। সকালে নাস্তা করেই সে পৃথাকে নিয়ে শপিংয়ে বের হবে।

নতুন পরিবেশ নতুন ঘরে বেশ অদ্ভুত লাগছে পৃথার। কে জানতো একদিনেই তার জীবনে এতো পরিবর্তন এসে পড়বে? কিন্তু মনে মনে সে কিছুটা খুশিও। ভাগ্যিস আম্মা তাকে এই বাসায় রেখে গিয়েছে। নাহয় এখন ওই বাসায় ফিরে গেলে তার আরও অস্বস্তি হতো।

পৃথার ভাবনার মাঝেই তূর্য রুমে প্রবেশ করে। তার হাতে একটা শপিং ব্যাগ। পৃথা চুপচাপ নিজের ফোন হাতে নিয়ে বসে রয়। তূর্য তার দিকে শপিং ব্যাগটা এগিয়ে দিয়ে বলে,

“ ভাগ্য ভালো একটা শো রুম খোলা পেয়েছি। আপির ড্রেসে আনকোমফর্টেবল ফিল করছো। তাই এটা পড়ে নাও। “

পৃথা অবাক হয়। তূর্য কিভাবে বুঝলো সে আনকমফোর্টেবল ফিল করছে? পৃথা সেই প্রশ্ন আর করে না। চুপচাপ তূর্যর হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। তূর্যও নিজের শার্ট বদলে নিয়ে বিছানায় বসে ফোন চালাতে থাকে। কিছুক্ষণ পরই পৃথা তার আনা লাল রঙের থ্রি পিস পড়ে বের হয়। তূর্য এক পলক পৃথাকে দেখে নিয়ে হেসে বলে উঠে,

“ বাহ! বউ বউ লাগছে। “

তূর্যর কথা শুনে পৃথা লজ্জায় পড়ে যায়। এই লোক বেশ শেয়ানা। ইচ্ছে করে এই রঙের জামা নিয়ে এসেছে যেন এই কথাটা বলে পৃথাকে লজ্জা দিতে পারে। তূর্য ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলে উঠে,

“ কেবিনেটের উপর রাখা বক্স এবং খামটা তোমার। খুলে দেখো। “

পৃথা আগ্রহ নিয়ে গিয়ে আগে খাম খুলে দেখে। সেটার ভিতর একটা চেক পেপার ও ক্রেডিট কার্ড ছিলো। চেক পেপারের উপর একটা নির্ধারিত এমাউন্টও লেখা আছে। পৃথা অবাক সুরে প্রশ্ন করে,

“ এগুলো কি? “

“ চেক পেপারটা তোমার দেনমোহরের জন্য। আর সাথে ক্রেডিট কার্ডটাও তোমার। এখন থেকে এটা ইউজ করবে। “

“ আমার কাছে তো আমার ক্রেডিট কার্ড আছে। “

“ সেটা তোমার আব্বার দেওয়া। এতদিন উনার দায়িত্বে ছিলে তুমি। কিন্তু এখন থেকে যেহেতু তুমি আমার দায়িত্ব সো তোমার সব কিছুই আমার রেস্পন্সিবিলিটি। “

পৃথা আর কোনো কথা বলে না। সে পাশের চতুর্ভুজাকৃতির বক্সটা হাতে নিয়ে খুলে। সাথে সাথে দেখতে পায় বক্সের ভিতর একটা ডায়মন্ডের নাকফুল। তূর্য এবার নিজ থেকেই বলে উঠে,

“ এটা তোমার বিয়ের গিফট। “

পৃথা গতবছরই তার আম্মার জোরাজুরিতে নাক ফুটিয়েছিলো। কিন্তু তার খুব একটা পছন্দ না দেখে তেমন একটা জিনিস পড়তো না। অথচ তূর্য ঘুরেফিরে তাকে এটাই গিফট করলো। পৃথা নিজের মনের কথা চাপা দিয়ে মুখ কালো করে বলে,

“ ওহ। কিন্তু আমি তো আপনার জন্য কোনো গিফট কেনার সুযোগ পায় নি। “

তূর্যর এই মুহুর্তে বেশ হাসি পাচ্ছে পৃথার এমন বোকা কথা শুনে। সে কোনোমতে নিজের হাসি চাপিয়ে রেখে বলে,

“ এটা চুপচাপ পড়ে নাও। সেটাই আমার গিফট হবে। “

পৃথা কোনো কথা না বলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নাকফুলটা পড়ে নেয়। অদ্ভুতভাবে তার নাকে এটা বেশ সুন্দর মানিয়েছে। এখন তার মনে হচ্ছে আম্মা ঠিকই বলতো, যে তার নাকে নাকফুল সুন্দর লাগবে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে ব্যস্ত পৃথা খেয়াল করে নি তূর্য কখন তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। যখন লক্ষ্য করে তখন আর পালানোর সাহস কিংবা জায়গা কোনটাই খুঁজে পায় না সে। তূর্য নিঃশব্দে পিছনে দাঁড়িয়ে থেকেই পৃথার ওড়না টেনে মাথায় দিয়ে দেয়। অত:পর মুখ কিছুটা নিচে নামিয়ে পৃথার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,

“ এখন আমার বউ লাগছে। “

লালে রাঙা অষ্টাদশী লজ্জায় নিজের দৃষ্টি নত করে ফেলে। সেই দৃশ্যটা একধ্যানে দেখে তূর্য। সে একই ভঙ্গিতে আবার বলে উঠে,

“ ভালোবাসতে পারবো কবে তা জানি না। কিন্তু এই মুহুর্তে প্রেমে পড়ে গেলাম তা অস্বীকার করবো না। “

পৃথা চোখ তুলে আয়নার মধ্য দিয়ে তূর্যর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

“ দুটো কি আলাদা জিনিস? “

“ হ্যাঁ। খুব আলাদা। “

চলবে…

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১২.

শা শা শব্দ তুলে গাড়ি এসে থামে পুরান ঢাকার বেশ বড় এক বাড়ির সামনে। গাড়ি থেকে নেমে আসে আফজাল সাহেব, সাদিকা বেগম, পার্থ ও শোভন। বাড়ির সামনে খেলতে থাকা দুটি ছোট বাচ্চা তাদের দেখেই দৌড়ে ভেতরে চলে যায়। আফজাল সাহেব সবার অগোচরে নিজের বুকে সামান্য ফু দেয়। এই বাড়িতে আসলেই উনার মনে হয় এই বুঝি হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে। সবার উপর কর্তৃত্ব চালানো আফজাল সাহেব নিজের শশুড় উজ্জ্বল মোল্লাকে বেশ ভয় পান। এই একজনের সামনেই উনি বাঘ থেকে বিড়াল হয়ে যায়।

আফজাল সাহেবরা দরজা পেরিয়ে ঘরের আঙিনায় প্রবেশ করতেই দুজন হাস্যজ্বল মহিলা উনাদের দিকে এগিয়ে আসে। সম্পর্কে তারা পার্থর দুই মামার স্ত্রী হন। সাদিকা বেগম নিজের ভাবিদের সাথে কুশল বিনিময় করে প্রশ্ন করে,

“ আব্বা কোথায়? ভাইজানদেরও দেখছি না যে। “

পার্থর বড় মামী বলে উঠে,

“ আব্বা তো ঘরের ভিতরে। আর তোমার দুই ভাইজান এবং ভাইপো কাজে গেসে। তোমরা দাঁড়ায় আছো কেন? ভিতরে আইসা বসো। “

আফজাল সাহেবরা বসার ঘরে বসতেই দুই মামী নাস্তা পানির ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সাদিকা বেগমের ভাজতি শর্মী এবং ভাইপোর স্ত্রী রাহেলা শরবত পরিবেশন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শর্মী পার্থকে শরবত এগিয়ে দেওয়ার সময় ইচ্ছে করেই পার্থর আঙুল ছুঁয়ে দেয়। পার্থ গরম চোখে তাকাতেই সে লজ্জায় দূরে সড়ে দাঁড়ায়।

এরই মাঝে পান চিবুতে চিবুতে বসার ঘরে প্রবেশ করেন উজ্জ্বল মোল্লা। উনাকে দেখতেই সবাই উঠে দাঁড়ায়। আফজাল সাহেব এগিয়ে গিয়ে সালাম জানায় উনাকে। উজ্জ্বল মোল্লা সেই সালামের জবাব নেয় না। বরং কিছুটা তিরষ্কার করে বলেন,

“ আহারে! আমার মাইয়াডা কি সুন্দর চাঁদের লাহান আসিলো। এখন তো শরীরে একটা মাংসও নাই। তুমি কি আমার মাইয়ার যত্ন নাও না গো পার্থর আব্বা? “

আফজাল সাহেব মাথা নত করে বিনয়ী ভঙ্গিতে বলে,

“ ছি, ছি কি বলেন আব্বা! “

উজ্জ্বল সাহেব চারিদিকে একবার নজর বুলিয়ে বলে,

“ আমার নাতনিডা কই? পৃথারে লগে কইরা আনো নাই ক্যালা? “

সাদিকা বেগম বলে উঠে,

“ পরের বার ওকে সাথে করে নিয়ে আসবো আব্বা। “

উজ্জ্বল সাহেব সতর্ক দৃষ্টি তাক করেন মেয়ে এবং মেয়ের জামাইর দিকে। তার বিচক্ষণ দৃষ্টি সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে যায় এখানে কোনো ঘাপলা আছে। উনি প্রশ্ন করে,

“ কি হইসে? চেহারার এমন বারোডা বাইজ্জা আছে ক্যালা? “

সাদিকা বেগম বলে,

“ সবাই আসুক আব্বা। তারপর বলছি। “

পার্থর দুই মামা এবং মামাতো ভাই আধঘন্টার ভেতরেই এসে পৌঁছায়। সবার সাথে কুশল বিনিময় করে তারা বসতেই আফজাল সাহেব বলেন,

“ আসলে আব্বা একটা গুরুত্বপূর্ণ খুশির খবর জানাতে আজকে এসেছি। “

উজ্জ্বল মোল্লা প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাতেই উনি বলে উঠে,

“ সামনের সপ্তাহে পার্থর বিয়ের ডেট ঠিক করেছি আমরা। “

উপস্থিত সবাই বেশ অবাক হলো। তাদের মধ্যে শর্মী সবথেকে বেশি অবাক হলো মনে হচ্ছে। উজ্জ্বল সাহেব বলে,

“ কিছু জানলাম না, হুনলাম না ডাইরেক্ট বিয়ার দাওয়াত দিতে আইয়্যা পড়সো। “

“ আসলে আব্বা মেয়ে পার্থর পছন্দ করা। গতকালই কথা পাকা করে এলাম। “

“ পোলা দেখি এক্কেরে বাপের মতন হইসে। নিজের পছন্দে বিয়া করবো। “

আফজাল সাহেব মনে মনে বিরক্ত হয়। তাকে খোঁটা না দিলে যেনো তার শশুড়ের ভাত হজম হয় না। এটাই শেষ বার। এর পরের জনমে জীবনেও আর কারো মেয়ে নিয়ে ভাগবেন না তিনি। এই জনমেই ঢের শিক্ষে হয়েছে। আফজাল সাহেব ভয়ে ভয়ে বলে,

“ আরেকটাও কথা বলার ছিলো আব্বা। “

“ কি কথা? “

“ পার্থ যেই মেয়েকে পছন্দ করেছে ওই মেয়ের একটা ছোট ভাই আছে। শিক্ষিত, ভালো চাকরি করে। ছেলেটাকে আমাদের বেশ পছন্দ হয়েছে। তাই কাল আমরা পৃথার আকদ পড়িয়ে দিয়েছি। এক দুই বছর পর অনুষ্ঠান করা হবে। “

উজ্জ্বল সাহেবের মাথায় হাত,

“ খাইসেরে! কি গো পার্থর বাপ? তুমি নিজেও লুকায়া বিয়া করসিলা এখন পোলাপাইনগোর বিয়াডাও দেখি লুকাইয়াই সাইরা ফালাইতাসো। “

সাদিকা বেগম কথার মাঝে ফোড়ন কেটে বলে,

“ যেই যুগ আসছে আব্বা! ভালো ছেলে মেয়ে পাওয়া মুশকিল। তাই এতো ভালো একটা ছেলে পেয়ে আমরা আর অপেক্ষা করি নি। “

উজ্জ্বল সাহেব সেই কথায় পাত্তা না দিয়ে বলে,

“ হেইসব বাদ দে তুই। আগে ক আমার নাতনিরে জোর কইরা বিয়া দেস নাই তো? ওয় রাজি আছিলো? “

“ হ্যাঁ আব্বা। পৃথার মতেই বিয়ে হয়েছে। “

উজ্জ্বল সাহেবের উপস্থিতিতে উনার ছেলেরা এবং ছেলের বউরা এই বিষয়ে আর কোনো কথা বলে না। কিন্তু তারা কেউই যে এই পরিস্থিতিতে সন্তুষ্ট না তা তাদের চোখে মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠছে। বিশেষ করে পার্থর ছোট মামী এই বিষয়ে বেশ অসন্তুষ্ট। উনি নিজের মেয়ে শর্মীর জন্য পার্থকে পাত্র হিসেবে চাইতেন সবসময়। নিজের ননদ সাদিকা বেগমকে আকারে ইঙ্গিতে বেশ কয়েকবার এটা বলেছেনও উনি। কিন্তু সাদিকা বেগম সবসময় বুঝেও না বুঝে থাকার ভান করতো। উনার চাঁদের মতন মেয়েকে রেখে এখন কোন মেয়েকে পার্থর বউ করে আনবে তা উনিও দেখতে চায়।

__________

ফোন আসায় উঠানের একপাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো পার্থ। কথা বলা শেষ হতেই পাশ ফিরে তাকাতেই দেখে শর্মী তার দিকে টলমলে চোখে তাকিয়ে আছে। পার্থ বিরক্ত হয়। এই মেয়েকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য সে এই বাসায় আসতেও চায় না। শর্মী কাদো কাদো স্বরে বলে,

“ আপনি বিয়ে করে ফেলবেন পার্থ ভাই? ওই মেয়ে কি আমার থেকেও বেশি সুন্দর? “

পার্থ কঠিন স্বরে জবাব দেয়,

“ অন্তত তোমার মতো বারবার প্রত্যাখ্যান পেয়েও নিজের আত্মসম্মান বিকিয়ে সে আমার পিছনে পড়েছিলো না কখনো। এরকম ব্যক্তিত্ববান মেয়েই একমাত্র আমার স্ত্রী হওয়ার যোগ্য। “

কথাটা বলেই পার্থ সেখান থেকে সড়ে যায়। এরকম একটা অপমানের পরও শর্মীর মাঝে ভাবান্তর দেখা গেলো না। সে এখনো জানতে আগ্রহী পার্থ কোন মেয়েটাকে বিয়ে করছে।

__________

সকালে নাস্তা সেরেই শপিংয়ে বেড়িয়েছিলো তূর্য এবং পৃথা। কিছুক্ষণ আগেই মাত্র বাসায় ফিরেছে। পৃথা নিজের জন্য বেশ কিছু রেডি মেড থ্রি পিসের পাশাপাশি কয়েকটা শাড়িও কিনে নিয়েছে। আম্মাকে সে সবসময় শাড়ি পরিহিত অবস্থায় দেখে বড় হয়েছে। সেই থেকে তার মাথায় একটা জিনিস সেট হয়ে গিয়েছে। যে বিয়ের পর একটা মেয়ের শাড়িই পড়া উচিত। এতে তাকে বেশ সংসারী দেখায়। কিন্তু তূর্যর গতরাতে তাকে দেওয়া লজ্জার কথা মনে পড়তেই সে শাড়িগুলো তুলে ক্লসেটে রেখে দেয়। এই লোকের সামনে আর লজ্জায় পড়তে রাজি না সে।

বাসায় এই মুহুর্তে কেউ নেই। তরী এবং হুমায়ুন সাহেব দুজনেই সকাল সকাল হসপিটাল চলে গিয়েছেন। বাকি রইলো তূর্য। সে-ও বাসায় ফেরার পর থেকে লাপাত্তা। হয়তো বাহিরে গিয়েছে। পৃথা করার মতো কিছু না পেয়ে বিছানায় উবুড় হয়ে শুয়ে ফোনে গেমস খেলতে শুরু করে। কিছুক্ষণ পরই পিছন থেকে তূর্য বলে উঠে,

“ এই বয়সে কেউ সাবওয়ে সারফারস খেলে নাকি? “

পৃথা সাথে সাথে সোজা হয়ে উঠে বসে। তার একটা অদ্ভুত স্বভাব আছে। সে বেশিক্ষণ কোনো এক বিষয় মনে রেখে তা নিয়ে জীবন পাড় করতে পারে না। যেমন গতকাল সারাদিন তূর্যর প্রতি তার একধরনের অভিমান কাজ করছিলো। কিন্তু হুট করেই সব অভিমান গায়েব হয়ে গিয়েছে তার। পৃথা অত:পর সরু চোখে তূর্যর দিকে তাকিয়ে বলে,

“ বয়সের সাথে গেমসের কি সম্পর্ক? “

“ এডমিশনের পড়াশোনা বাদ দিয়ে বসে বসে গেমস খেললে ইউনিভার্সিটি তে চান্স পাবে না। “

পৃথা আনমনে বলে উঠে,

“ বিয়ে করেছি কি পড়াশোনা করার জন্য নাকি? “

তূর্য কেবিনেটের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের হ্যান্ড ওয়াচ খুলছিলো। পৃথার কথা শুনে সে ভ্রু কুচকে পিছনে তাকায়। নিজের বলা কথায় পৃথা নিজেও হতভম্ব হয়ে পড়েছে। সে সাথে সাথে নিজের দৃষ্টি লুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তূর্য পৃথার সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠে,

“ এইযে মিস এ বি সি। মতলব কি বলো তো? “

পৃথা ঘাড় ঘুরিয়ে পিটপিটিয়ে তূর্যর দিকে তাকায়। অত:পর একটা বোকা হাসি দিয়ে বলে উঠে,

“ একচুয়্যালি আমার ছোট বেলা থেকেই এইম ইন লাইফ হচ্ছে বিয়ে করা আর পড়াশোনা থেকে মুক্তি লাভ করা। “

তূর্য মাথায় হাত দিয়ে বলে,

“ ওহ মাই গড! মারাত্মক অবস্থা! এই এইম নিয়ে তুমি এইচ এস সি তে এ প্লাস কিভাবে পেলে? “

পৃথা সরু চোখ করে বলে,

“ ইট ইজ এ সিক্রেট। একচুয়্যালি আমার আম্মা আব্বা এক্সেপশনাল পিস। মানুষরা তাদের মেয়ে এক্সামে খারাপ করলে বিয়ে দিয়ে দেয়। আর আমার কেসে আমার পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগে আম্মা আব্বার বিয়ে দেওয়ার প্ল্যান ছিলো না। তাই তাড়াতাড়ি পড়াশোনা শেষ করার জন্য আমি মন দিয়ে সারাদিন পড়তাম। কারণ পড়া শেষ হলেই বিয়ে করতে পারবো। কিন্তু আল্লাহর কি মেহেরবানি দেখেন! পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগেই আমার বিয়ে হয়ে গেলো। “

পৃথার এক নিঃশ্বাসে বলে যাওয়া কথা শুনে তূর্য হতাশ হয়ে বসে পড়ে। এই মেয়েকে সে বোকা ভাবছিলো? এখন তো তার নিজেকেই বলদ মনে হচ্ছে। তূর্য একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠে,

“ উহু! এভাবে চলবে না। তোমার যত বইখাতা আছে সব কালকের মধ্যে ওই বাসা থেকে আনার ব্যবস্থা করো। এরকম ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট নিয়ে পড়াশোনা বাদ দেওয়ার চিন্তা করলে তোমাকে কিন্তু আমি ছেড়ে দিবো না। “

পৃথা গাল ফুলিয়ে বলে,

“ অদ্ভুত তো! আপনি জামাই না ছাই? মাস্টার মশাই সাজার ভূত চড়েছে কেনো আপনার মাথায়? “

“ বউ এরকম পড়া চোর হলে জামাইদের আর কি-ই বা করার থাকে বলো? আর তাছাড়াও এটা করতে আমি বেশ মজা পাচ্ছি। আগে পাপা আর আপি সারাদিন পড়াশোনা নিয়ে আমার উপর চিল্লাতো। এখন আমি তোমার উপর চিল্লাবো। শোধবোধ। “

“ আপনার এতো চিল্লানোর শখ থাকলে নিজের বাচ্চাদের উপর চিল্লিয়েন। আমাকে মাফ করেন। “

কথাটা বলেই পৃথা নিজেই হতভম্ব হয়ে যায়। তার এই এক বাজে স্বভাব! একবার কারো সাথে ফ্রি হয়ে গেলে তার সামনে না বুঝে শুনেই পকপক করতে শুরু করে দেয়। তূর্য ভ্রু কুচকে পৃথার দিকে তাকিয়ে আছে। পৃথা সাথে সাথে সরি বলে সেখান থেকে ছুটে পালায়।

__________

হসপিটাল থেকে বের হতেই ল্যাম্পপোস্টের আলোয় পার্থর মুখটা দেখতে পেয়েই তরী বিরক্ত হলো। অত:পর পার্থর দিকে এগিয়ে গিয়ে কাঠকাঠ গলায় বলে উঠে,

“ দেখতে তো সম্পূর্ণ সুস্থই লাগছে। তাহলে এখানে কি কাজ আপনার? আবার কাকে তুলে নিতে এসেছেন? “

“ আপনাকে। “

“ মানে? “

“ আম্মা বলেছে আপনাকে নিয়ে গিয়ে দুটো রিং পছন্দ করে নিতে। “

“ আমি এই মুহুর্তে খুব টায়ার্ড। বাসায় গিয়ে ঘুমোবো। “

পার্থ তরীর হাত ধরে বলে,

“ তা তো হচ্ছে না। আপনি এখন আগে আমার সাথে রিং কিনতে যাবেন। তারপর আমরা ডিনারে যাবো। “

তরী চোখ গরম করে বলে,

“ আপনি আমাকে জোর করতে পারেন না। “

“ অবশ্যই পারি। অধিকার আছে। “

“ আপনার সাথে ডিনার করার থেকে বিষ খেয়ে মরে যাওয়া ভালো। “

পার্থ হেসে বলে,

“ আপনাকে কে বললো আমি আপনাকে নিয়ে স্পেশাল ডিনারে যাচ্ছি? এই ডিনার তো শোভন প্ল্যান করেছে। ও এবং ওর ফিয়ন্সেও আমাদের সাথে যোগ দিবে। ওরা আপনার সাথে পরিচিত হতে আগ্রহী। “

তরী ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে। তার ঝামেলা হচ্ছে কেবল পার্থর সাথে। কিন্তু যেহেতু দু’দিন পর আসলেই তাদের বিয়ে হবে তাই এধরণের সোশ্যালাইজিং সে চাইলেও এড়িয়ে যেতে পারবে না। তাই অগ্যতা সে যাওয়ার জন্য রাজি হয়।

__________

“ শোভন তো সবসময় বলতো আপনি অনেক স্ট্রিক্ট দাদা। কিন্তু আপনাকে দেখে তো একদমই মনে হচ্ছে না। “

মধুমিতার কথা শুনে পার্থ কেবল মৃদু হাসে। শোভন তাদের কথার মাঝে বাগড়া দিয়ে বলে,

“ ভাবি যদিও আমি সবসময় আইন মেনে চলি, কিন্তু ভাইয়ার আপনাকে তুলে নিয়ে বিয়ে করার ব্যাপারে কিন্তু আমি আপনাকে কোনো হেল্প করতে পারবো না। কারণ দু’দিন আগে আমি নিজেও এরকম কিছুই প্ল্যান করছিলাম। “

তরী খেতে খেতে বলে উঠে,

“ এটা তো কোরাপশনের আওতায় পড়ে। আমি ভেবেছিলাম তুমি একজন দায়িত্বশীল পুলিশ অফিসার। “

“ ভালোবাসার কেসে টুকটাক কোরাপশন মেনে নেওয়া যায় ভাবি। আফটার অল এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ। “

তরী আচমকা তাদের থেকে কয়েক হাত দূরে একটা টেবিলের দিকে তাকিয়ে তার দৃষ্টি স্থির হয়ে যায়। সাথে সাথেই সে পাথরের ন্যায় জমে যায়। চোখ মুখ শক্ত করে সে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। অত:পর আবার তাকায় সেদিকে। সেই টেবিল হতে এক জোড়া চোখও তার দিকে তাকায়। তরী আচমকা হেসে পার্থর দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

“ আমাদের এখন যাওয়া উচিত। বেশ দেরি হয়ে গিয়েছে আজকে। “

আচমকা তরীর এরকম হাসিমুখ দেখে পার্থ সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকায়। তরী সেদিকে পাত্তা না দিয়ে শোভন এবং মধুমিতার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

“ তোমরা ইঞ্জয় করো। পার্থ আমাকে ড্রপ করে দিয়ে আসবে। “

শোভন আর মধুমিতা সামান্য অবাক হলেও তারা হাসিমুখে বিদায় জানায়। পার্থ টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই তরী তার দিকে এগিয়ে এসে তার একহাত ধরে দাঁড়ায়। পার্থ অবাক হয়। এই ডাক্তার সাহেবার হঠাৎ করে কি হলো? একটু আগেও তো পার্থর দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করছিলো। আর এখন একদম নাইন্টি ডিগ্রি এংগেলে ঘুরে গেলো! আসিফের কথামতো কি এই ধানী মরিচ তার চার্মনেসে ডুব দিলো নাকি? কথাটা ভাবতেই পার্থ আপনমনে হেসে দেয়।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-১০

0

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১০.

পৃথার জ্ঞান নেই বুঝতে পেরেই তূর্য তাদের এলাকার পরিচিত একজন ডাক্তারকে ডাকেন। উনার নাম রইস রহমান। উনি এসে পৃথাকে দেখে সর্ব প্রথম প্রশ্ন করে,

“ এই মেয়েকে তো আগে তোমাদের বাসায় কখনো দেখিনি। কে? “

তূর্য বিনা দ্বিধায় জবাব দেয়,

“ শি ইজ মাই ওয়াইফ আংকেল। “

রইস সাহেব বেশ অবাক হয়। এইতো দু’দিন আগেও তার তরীর সাথে দেখা হলো। কই তরী তো একবারও এই ব্যাপারে কিছু বললো না। দু’দিনের মাঝে কি তূর্যর জীবনে আকাশ থেকে বউ নেমে আসলো? তার উপর হুমায়ুনও এখন দেশের বাহিরে। আসল ব্যাপারটা কি?

রইস সাহেব নিজের কৌতূহলকে ক্ষণিকের জন্য সাইডে রেখে পৃথার চেকাপ শুরু করে। অত:পর আতংকিত গলায় বলে,

“ ওহ মাই গড! তোমার ওয়াইফের দেখছি ডায়েবেটিস আছে। তার উপর হাইপোগ্লাইসেমিয়া কেস। বয়স কত ওর? “

তূর্য চিন্তিত সুরে বলে,

“ ১৮। “

রইস সাহেব হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রয়। মেয়েটাকে দেখে তার বেশ ছোটই মনে হচ্ছিলো। এতো কম বয়সের একটা মেয়েকে তূর্যর মতো শিক্ষিত ছেলে কিভাবে বিয়ে করলো? রইস সাহেব এক ডোজ ইনসুলিন দিতে দিতে বলে উঠেন,

“ ব্লাডে সুগার লেভেল লো হয়ে যাওয়ার ফলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। হাসব্যান্ড যেহেতু হয়েছো সেহেতু একটু খেয়াল রেখো ওর ডায়েটের প্রতি। এতো কম বয়সে ডায়েবেটিস থাকলে খাবার দাবারের প্রতি একটু সতর্ক থাকা উচিত। “

রইস সাহেব চলে যাওয়ার পর পরই তূর্য রুমে এসে বসে। তার বাসার কাজের আন্টিও তিনদিনের ছুটিতে আছে। ঘরের অবস্থা কি বিচ্ছিরি! পৃথার জ্ঞান ফেরার আগে তাকে খাবার কিংবা ওষুধ কিছু দেওয়াও যাবে না। তূর্য একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। শার্টের হাতা গুটিয়ে কনুই পর্যন্ত তুলে সে। অত:পর শক্ত হাতে পৃথাকে পাজাকোলে তুলে নিয়ে তাকে পাশের রুমে শুইয়ে দিয়ে আসে।

সবার আগে সে নিজের সব ফাইলস আর বই গুছিয়ে বুকশেলফ এবং টেবিলে রাখে। তারপর সম্পূর্ণ নতুন একটা বেডশিট বিছিয়ে বিছানা গুছিয়ে নেয়। দু’দিনে মিররেও প্রচুর ময়লা জমেছে। তূর্য ক্লিনসার দিয়ে সম্পূর্ণ মিরর ভালো করে মুছে কেবিনটটাও গুছিয়ে নেয়। এসব দিকে তার তেমন একটা লক্ষ্য করা হয়নি কখনো। সে, আপি আর তার পাপা প্রায় সবসময়ই কাজের কারণে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাহিরেই থাকে। বাসায় ফিরে দু মুঠো খেয়ে ঘুমিয়ে পড়াই তার নিত্যদিনের অভ্যাস। সেখানে এতো কিছু নোটিশ করার সময় কোথায়?

একঘন্টার ব্যবধানেই তূর্যের ঘর গুছানো সম্পন্ন হয়ে যায়। সাথে সাথে সে দেরি না করে পাঁচ মিনিটের ভেতর ইন্সট্যান্ট শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে আসে। গায়ের ফর্মাল আউটফিট চেঞ্জ করে একটা আকাশি রঙের টি শার্ট পড়েছে এখন। পাশের রুম থেকে পৃথাকে নিয়ে আসার সময় পৃথা নড়ে উঠে। অত:পর পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। তূর্য তা দেখে। নীরবে পৃথাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বলে উঠে,

“ তোমার তো মারাত্মক অবস্থা! এতো কম বয়সে ডায়েবেটিস কেন? “

পৃথা উত্তর দেয় না। সে আড়চোখে সম্পূর্ণ রুম দেখতে ব্যস্ত। এতো পরিবর্তন? আলাদিনের জ্বিনের কারসাজি নাকি? তূর্য আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হেয়ার ব্রাশ করতে করতে পৃথার চারিদিকে বোলানো বিস্মিত দৃষ্টি লক্ষ্য করে। বেরিয়ে যাওয়ার সময় বলে উঠে,

“ খাবার রেডি আছে। আমি গরম করে নিয়ে আসছি। ওয়েট ফর মি। “

পৃথা একপাশে ফিরে পাশের মাথার বালিশটাকে বুকে নিয়ে জড়িয়ে ধরে। তার আম্মা আব্বা কোথায়? উনারা কি জানতে পেরেছেন তাদের মেয়ে কত বড় এক কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে? জানতে পেরেও একবারও কথা বলতে চায় নি উনারা? পৃথার প্রতি খুব রাগ বুঝি তাদের?

__________

সন্ধ্যার ফ্লাইটেই সিলেট থেকে ঢাকা ফিরে এসেছে আফজাল সাহেবরা। দুপুরে জমিলার কল পেয়ে জানা ঘটনা শুনে আর এক মুহুর্ত স্থির থাকতে পারে নি তারা? তার দুই ছেলে মেয়ে বিয়ে করে নিয়েছে মানে কি? বিয়ে কোনো মগের মুল্লুক নাকি?

দরজায় জোরে জোরে হওয়া করাঘাতের কর্কষ শব্দে তরী ভ্রু কুচকে মাথা তুলে। হাত ঘড়িতে সময় দেখে বুঝতে পারে এখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। তরী উঠে বসে নিজের চোখ কচলে নেয় কিছুক্ষণ। অত:পর ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে দরজা খুলে দিতেই সামনে আতংকিত জমিলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।

“ ওগো বড় বউ। তোমার শশুর, শাশুড়ি, দেবর আইস্যা পড়সে। নিচে তুফান শুরু হইসে। পার্থ বাপও তো হেই সকালে বাইর হইসে এখনো ফিরে নাই। তুমি নিচে চলো। “

তরী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সবে তো মাত্র শুরু। এখন এই ফ্যামিলি, তারপর নিজের পাপা, তারপর পরিচিত সকলকেই তার এখন হ্যান্ডেল করতে হবে। ওই স্ক্রাউন্ডেলটা ঠিকই নিজে ঝামেলা বাঁধিয়ে এখন কুরক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়েছে। তরী বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,

“ ভীতুর বাচ্চা কোথাকার। “

নিচে নামতেই সে সর্বপ্রথম দেখতে পায় নিজের শাশুড়িকে। ভদ্র মহিলা সোফায় বসে চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছে এবং বিলাপ পারছে,

“ আমার ছেলে মেয়ে দুইটা কই গেলো? এই শোভন! তোর দাদা আর বোনরে ফোন দে। ওদের আমার কাছে আসতে বল। “

মহিলার থেকে কয়েক হাত দূরে ফোন কানে ব্যস্ত পায়ে হাঁটা ব্যক্তিটা তার দেবর তা বুঝতে অসুবিধা হয় না তরীর। এই সকল কিছুর মাঝে শান্ত চুপচাপ বসে থাকা আফজাল সাহেবও তরীর দৃষ্টিগোচর হয় না। তরী একটা প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেয়। অত:পর লিভিং রুমে প্রবেশ করে বলে উঠে,

“ আসসালামু আলাইকুম এভ্রিওয়ান। আমি আপনাদের বড় ছেলের বউ তরী। যদিও এই ইন্ট্রোডাকশনটা আপনাদের ছেলের করানোর কথা ছিলো। কিন্তু আনফরচুনেটলি হি ইজ এ ম্যানারলেস। এজন্যই জোর করে একটা মেয়েকে তার মতের বিরুদ্ধে বিয়ে করতে পেরেছে। “

আফজাল সাহেব, সাদিকা বেগম এবং শোভন বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে দেখছে তাদের ঘরের নব বিবাহিত বড় বউকে। আফজাল সাহেব প্রশ্ন করে,

“ ওহ! তুমিই সেই মেয়ে! সবার প্রথমে তুমি আমার এই কথার জবাব দাও আমার ছেলের তোমাকে জোর করে বিয়ে করার পিছনে কারণ কি? “

তরী বুকের কাছে দুই হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে বলে,

“ তা আপনি নিজের ছেলের থেকেই জেনে নিয়েন। আর বাকি রইলো আপনাদের ঘরের মেয়ের কথা তাহলে সে এই মুহুর্তে আমার বাবার বাসায় আছে। ওর বিয়েটা আমার ভাইয়ের সাথে হয়েছে। “

সাদিকা বেগম আবার কান্না জুড়ে বসে। শোভন বিরক্তিকর গলায় বলে,

“ আম্মা প্লিজ একটু থামো আপাতত। পুরো বিষয়টা ক্লিয়ার হতে দাও। “

সাদিকা বেগমের কান্নার শব্দ এখন কিছুটা কমে আসে। শোভন তরীর দিকে দু কদম এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করে,

“ আপনার আর ভাইয়ার ব্যাপার পরে ক্লিয়ার হওয়া যাবে। আগে বলুন আমার বোন আর আপনার ভাইয়ের বিয়েটা কিভাবে হলো? “

“ ওরা খুব সম্ভবত আগে থেকেই পরিচিত ছিলো। পৃথার মুখে শুনলাম ও আমার ভাইকে ভালোবেসে স্ব ইচ্ছায়ই বিয়ে করেছে। যদিও এই ঘটনায় আমার ভাইয়েরও কিছুটা দোষ আছে। ও এই বাসায় আমাকে সিকিউরিটি দেওয়ার উদ্দেশ্যে তোমার বোনকে বিয়ে করেছে। ইউ ক্যান সে কাইন্ড অফ ক্রস কানেকশন। “

শোভনসহ ঘরের সবাই হতভম্ব। সাদিকা বেগম চিন্তিত সুরে বলে,

“ আমি আমার মেয়ের কাছে যাবো। “

তরী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

“ আমার সাথে চলুন আপনারা। “

__________

জ্ঞান ফেরার পর থেকে পৃথা এখনো নিজ থেকে তূর্যের সাথে একটা কথাও বলে নি। কেবল চুপচাপ খাবার এবং ওষুধ খেয়ে বিছানার এককোণে বসে আছে। এর মাঝে তূর্য ল্যাপটপে নিজের একটা আর্টিকেলে কাজ শেষ করে নিয়েছে। আজকের জন্য সে ফ্রি আপাতত। হাতে আর কোনো কাজ নেই।

তাই সে পৃথার সামনে এসে বসে প্রশ্ন করে,

“ এখন শরীর কেমন লাগছে? “

পৃথা উত্তর দেয় না। অষ্টাদশীর অভিমান চরম শিখরে। বিশ্বাস ভাঙায় সে নীরব অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে তূর্যর বিরুদ্ধে। তূর্য অধৈর্য্য হয় না। বরং প্রশ্ন করে,

“ সংসারের কোনো দায়িত্ব তোমার উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে না। এতদিন তোমার লাইফ যেভাবে লিড করছিলে এখনো সেভাবেই করবে। পড়াশোনার বয়স তোমার। সো নিজের ফোকাস নিজের লাইফের উপর দেওয়াটাই ভালো। বাই দ্যা ওয়ে, ভার্সিটি নিয়ে প্ল্যান কি তোমার? হাতে তো এখনো তিনমাস সময় আছে। এডমিশনের প্রিপারেশন নিবে নাকি প্রাইভেটে পড়ার ইচ্ছে তোমার? “

পৃথা জবাব না দিয়ে ফট করে তূর্যর সামনে থেকে উঠে চলে যেতে নেয়। তূর্য পৃথার একহাত খপ করে ধরে তাকে টেনে আবার নিজের সামনে বসায়। কঠিন স্বরে বলে,

“ ডোন্ট টার্ন ইউর ব্যাক অন মি। যা ফিল হচ্ছে আমাকে বলো। আমার উপর রাগ থাকলে সেটা প্রকাশ করো। অভিযোগ থাকলে আমাকে জানাও। আমি শুনছি। “

সারাদিনের জমে থাকা পৃথার রাগ এখন মুক্তোর দানার মতো গাল গড়িয়ে টুপটুপ করে পড়তে শুরু করে। তূর্য শান্তস্বরে বলে,

“ যা করে শান্তি পাও আপাতত তা-ই করো। কেঁদে শান্তি পেলে মন খুলে কাঁদো। আমাকে ঘৃণা করে শান্তি পেলে সেটাই করো। “

পৃথার ভরাট সুশ্রী রূপ ইতিমধ্যে কান্নার ফলে লাল রঙ ধারণ করেছে। সে নাক টানতে টানতে বলে উঠে,

“ আমি বোকা। আমি আপনাকে ঘৃণা করতে না পারায় নিজের প্রতি চরম বিরক্ত। আমি কখনো ঘৃণা করতে শিখি নি। কিভাবে করবো? “

তূর্য কণ্ঠস্বর গভীর খাদে নামিয়ে বলে উঠে,

“ তাহলে ভালোবাসো। নিজের জীবন ও নিজেকে আপাতত আমার হাতে ছেড়ে দাও। যতটুকু যা এলোমেলো করেছি সব নিজ হাতে গুছিয়ে দিবো আই প্রমিস। “

পৃথা ফোলা ফোলা চোখ মেলে প্রশ্ন করে,

“ এই রুমের মতো? “

তূর্য এই পর্যায়ে হেসে দেয়। হাসতে হাসতে বলে উঠে,

“ হ্যাঁ। এই রুমের মতো। “

তূর্যের হাসি দেখে পৃথা অবাক হয়। এইখানে সে হাসার মতো কি এমন বলেছে? তূর্য হাসতে হাসতেই লক্ষ্য করে অষ্টাদশীর দৃষ্টি। এই বয়সের মেয়েদের আবেগ হলো বরফের ন্যায়। আগুনের ফুলকির কাছে এতেই গলে পানি হয়ে যায়।

কলিংবেলের শব্দ ভেসে আসতেই তূর্য নিচে চলে যায় দরজা খুলতে। দরজা খুলে সে কিছু বলার আগেই তার গালে সজোরে একটা চড় পড়ে।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-০৯

0

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৯.

সদ্য বিয়ে করা নববধূকে নিয়ে তূর্য যখন নিজের বাসায় প্রবেশ করে তখন কেবল ভোর ৬ টা বাজে। সম্পূর্ণ রাস্তা দু’জন নীরব ছিলো। এখনো নীরব। পৃথা চুপচাপ চলে তো এসেছে তূর্যের সাথে, কিন্তু এখন কি করবে বুঝতে পারছে না। তাদের বিয়েটা তো আর আট দশটা সাধারণ বিয়ের মতো ছিলো না। কিন্তু তার ভাবাভাবির পাল্লা শেষ হলো নিজের হাতের টানে। তূর্য তার হাত ধরে সিঁড়ি ডিঙিয়ে দো তলায় উঠছে। পৃথা কোনো রা শব্দ করলো না। কেবল তূর্যের সাথে পা মিলিয়ে উপরে উঠলো।

পৃথা সদা গোলাপি রঙ প্রেমি। তার রুমটাও বেবি পিংক কালার থিমে সাজানো ও গুছানো। সেই মেয়ে যখন তার স্বামীর রুমে পহেলা কদম রেখে দেখে সম্পূর্ণ রুম সাদা কালোর মিশেলে সাজানো এবং বড্ড অগোছালো তখন তার মাথা ভনভন করে উঠে। রুমের বেডশিটটা বেশ কুচকানো, তার উপর বালিশ একটা মাথার কাছে তো একটা পায়ের কাছে অবহেলায় পড়ে আছে। রুমের একপাশে থাকা বুকশেলফ এবং টেবিল দুটো গাদা গাদা বই, ফাইলস দিয়ে উঁচু করে রাখা। কোনো ড্রেসিং টেবিল না থাকলেও রুমের একপাশে একটা লম্বা আয়তাকার আয়না রাখা আছে, তার পাশেই কালো রঙের ক্লসেট।

পৃথা আর কিছু দেখার সুযোগ পেলো না। তার আগেই তূর্য তাকে বিছানার একপাশে বসিয়ে দেয়। অবাক করার বিষয় হচ্ছে সে নিজেও হাঁটু গেড়ে পৃথার সামনে বসে। পৃথার নরম হাত দুটো এখনো তার দখলে। পৃথার নিঃশ্বাস রুদ্ধ হলো। দৃষ্টি হলো এলোমেলো। সেই এলোমেলো দৃষ্টি নিজের দিকে স্থির করতে তূর্য একহাতে তার গাল ধরে নিজের দিকে তার মুখ ফিরায়। অত:পর বলে,

“ দৃষ্টি এড়ানো বন্ধ করো। ইউ আর নট এনি কালপ্রিট। “

পৃথা তবুও তূর্যর দিকে তাকাতে পারছে না। মানুষটা তার বিশ্বাস ভেঙেছে। বোকা পৃথার সরলতার সুযোগ নিয়েছে। তূর্য প্রথম নিজের ভুল স্বীকার করে বলে,

“ আই নো আমি তোমার অজান্তে তোমাকে বিট্রে করেছি। তোমার কাছে আমি অপরাধী। সেজন্য আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। ক্ষমা করা কিংবা না করা তোমার ব্যক্তিগত বিষয়। চাইলে যেকোনো শাস্তিও জারি করতে পারো। ডিভোর্স দেওয়া ছাড়া তোমার যেকোনো শাস্তিই আমি মাথা পেতে নিবো। “

পৃথা চুপচাপ নিচের দিকে দৃষ্টি মেলে রেখেছে। তূর্য এবার নিজের এতক্ষণের নরম স্বরকে কিছুটা কঠোর করে বলে,

“ লুক এট মি পৃথা। “

পৃথা মৃদু কেঁপে উঠে। উচ্চ বাক্যে কথা শোনার অভ্যাস নেই তার। অন্তত তার সাথে তো কেউ গলার স্বর উঁচু করে কভু কথা বলেই নি। পৃথা তূর্যের দিকে তাকাতেই তূর্য নিজের গলার কাঠিন্যতা বজায় রেখে বলে,

“ আজ থেকে এই ঘর, এই রুম এবং আমি তিনটাই তোমার। আমার ইনটেনশন যেটাই থাকুক আমাদের বিয়েটা মিথ্যে না। আমার তরফ থেকে কখনো কোনো অভিযোগের সুযোগ পাবে না তুমি। তবুও যদি কোনো অভিযোগ কখনো থেকে থাকে তা আমাকে সরাসরি বলবে। আমি শুধরে নিবো। “

পৃথা নিষ্প্রভ স্বরে প্রশ্ন করে,

“ আপনি আমাকে ভালোবাসেন তূর্য। “

তূর্য থমকায়। কিন্তু মেয়েটাকে আঁধারেও রাখতে রাজি না সে। তাই জানায়,

“ আনফরচুনেটলি আমার হৃদয় তোমার হৃদয় থেকে আলাদা। শুরু থেকেই আমি কেবল তোমার প্রতি আগ্রহী ছিলাম। যেই আগ্রহ ভালোবাসায় রূপ পাওয়ার সুযোগ পেলো না। তুমি আমার আগ্রহ থেকে সরাসরি স্ত্রীতে পরিণত হয়েছো। “

পৃথা আর তূর্যকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলে উঠে,

“ একা থাকতে চাই আমি। সম্পূর্ণ একা। “

তূর্য উঠে দাঁড়ায়। এক পল পৃথাকে দেখে সে এগিয়ে যায় নিজের ক্লসেটের দিকে। অত:পর ক্লসেট হতে নিজের শার্ট এবং প্যান্ট নিয়ে বলে উঠে,

“ আমার অফিস যেতে হবে। আজকে ছুটি ম্যানেজ করা ইম্পসিবল। সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত নিজেকে সময় দাও। কি করতে চাও সেটা সিদ্ধান্ত নাও। আপাতত আমি নিচে ব্রেকফাস্ট রেডি করে রেখে যাচ্ছি। খেয়ে নিবে। আর দুপুরে আমি খাবার অর্ডার করে দিবো বাসার এড্রেসে। দাঁড়োয়ান আংকেল এনে দিয়ে যাবে। আর যাই করো, চুপচাপ খাবারটুকু খেয়ে নিও অন্তত। সন্ধ্যায় ফিরে আমি তোমাকে নিয়ে বের হবো। তোমার প্রয়োজনীয় এবং যাবতীয় যা কেনাকাটা করতে হবে তা শপিং করে নিবো। “

নিজের কথাটুকু শেষ করেই তূর্য বেরিয়ে যায়। পৃথা একই ভঙ্গিতে বসে রয়। এটা কি তার শাস্তি? আবেগের তাড়নায় নিজের আম্মা আব্বাকে না জানিয়ে এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার শাস্তি? পৃথার বুদ্ধিদীপ্ততা কি কেবল পাঠ্যপুস্তক পর্যন্তই সীমাবদ্ধ? জীবনের আসল পরীক্ষায় এতো বড় করে জিরো পাওনা ছিলো তার?

__________

পার্থর ব্যাক্তিগত লিভিং এরিয়ার একটা সোফায় তরী বসে আছে। তার বরাবর বসে আছে পার্থ। যে আপাতত নিজের ভ্রু কুচকে তরীর দিকে তাকিয়ে আছে। তরী আপন মনে নাস্তা করতে ব্যস্ত। কিছুক্ষণ আগেই সে জমিলা খালাকে বলে নিজের জন্য ব্রেড এবং জ্যাম আনিয়েছে। তাই বসে বসে খাচ্ছে সে। তাকে দেখে বোঝা দায় যে মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে কিরকম একটা বাজে সিচুয়েশনের মাঝে তার বিয়ে হয়েছে। পার্থ মনে মনে ধরে নেয় হয়তো ডাক্তার সাহেবা পাগল হয়ে গিয়েছে। নাহয় এভাবে তার নিজের স্ব ঘোষিত শত্রুর বাসার দানাপানি মুখে তোলাটা বড্ড বেমানান লাগছে।

তরী পার্থর সেই দৃষ্টি লক্ষ্য করে। তার খাওয়া ইতিমধ্যে শেষ। সোফার সামনে থাকা টি টেবিল হতে স্বচ্ছ পানির গ্লাসটা নিয়ে আগে গলা ভিজিয়ে নেয়। গতরাত থেকে খিদেয় করা বুক ব্যাথাটা এখন কিছুটা কম মনে হচ্ছে। তবে নির্ঘুম রাত পারের ফলে মাথা বেশ ব্যাথা করছে তার। হাতের গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে বলে উঠে,

“ কি এক্সপেক্ট করছিলেন আপনি? এতো বড় একটা কান্ড ঘটিয়ে ফেলবেন আপনি আমার লাইফের সাথে আর আমি সেই দুঃখে উপোষ থেকে অশ্রু বিসর্জন দিবো? “

পার্থ হাসে। যদিও তার এই হাসিটা মেকি। ভিতরে ভিতরে নিজের বোনের চিন্তা তাকে কুঁড়ে খাচ্ছে। তার সামনে বসে থাকা ডাক্তার সাহেবার মতো এতো সহজে এই সিচুয়েশন হ্যান্ডেল করার ক্ষমতা পৃথার নেই। মেয়েটা নাজুক। তার জগৎটা কেবল এই চৌধুরী নিবাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। তার সকল চঞ্চলতা, দৎসীপনা কেবল নিজের দুই ভাইকে ঘিরেই ছিলো। তার বোন এই ঝড় কিভাবে সামলে উঠবে?

তরী পার্থর কপালে চিন্তার মৃদু ভাজ দেখতে পায়। অত:পর বলে উঠে,

“ আপনার বোন কোনো গুন্ডা, মাফিয়ার বাসায় যায় নি। আমি যদি একজন মাফিয়ার বাসায় এমন নির্বিঘ্নে বসে নাস্তাপানি করতে পারি, তাহলে সে-ও ওখানে ঠিকই মানিয়ে নিতে পারবে। “

পার্থ তরীর দিকে তাকায়। অত:পর শক্ত গলায় বলে,

“ যেই ছেলে আমার বোনকে বোকা বানিয়ে বিয়ে করতে পারে তাকে আমি কখনো বিশ্বাস করি না। আমার বোনের সাথে যে সেখানে খারাপ কিছু হবে না তার গ্যারান্টি কি? “

তরী নিজের এক পায়ের উপর পা তুলে সোফায় হেলান দিয়ে বসে বলে,

“ আমার সাথেও যে এই বাসায় খারাপ কিছু হবে না তার গ্যারান্টি কি পার্থ মুন্তাসির চৌধুরী? “

পার্থ কঠিন দৃষ্টি বজায় রেখে তরীর দিকে স্থির তাকিয়ে আছে। তরী নিজেই আবার বলে,

“ পৃথা ওই বাসায় খারাপ থাকবে না তার গ্যারান্টি আমি নিজে দিচ্ছি। কারণ ছোটর মাঝে আমার পাপার রক্ত আছে। আর আমার পাপা ভালো করেই জানে হাও টু ট্রিট এ উইমেন। কিন্তু আপনি পার্থ মুন্তাসির চৌধুরী? গতকালের নিজের স্ব চোক্ষে দেখা ঘটনার পর আপনার গ্যারান্টি কে দিবে? কার মতো হয়েছেন আপনি? নিজের বাবার মতো? উনিও এমন? নাকি আপনার শরীরে অন্য কোনো অমানুষের রক্ত রয়েছে? “

তরীর বলা শেষ কথাটুকুতে পার্থর মাথা গরম হয়ে যায়। সে চকিতে উঠে দাঁড়িয়ে এক কদম দু কদম করে তরীর দিকে এগিয়ে আসে। তরী ভয় পায় না। নিজের মতো চুপচাপ বসে রয়। পার্থ তার সামনে এসে দাঁড়ায় স্থির হয়ে। অত:পর নিজের এক পা তুলে তরীর পাশে সোফায় ঠেক দিয়ে আরেকহাতে তরীর মুখ চেপে ধরে। ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,

“ মুখের ভাষার লাগাম দেন ডাক্তার সাহেবা। নাহয় আমি নিজেও নিজের গ্যারান্টি দিতে পারবো না। “

তরী দু’হাতে পার্থকে ধাক্কা দিয়ে পিছু সরিয়ে দেয়। অত:পর হেসে সম্পূর্ণ রুমে একবার নজর বুলিয়ে বলে,

“ পৃথিবীতে কোনো কিছু ফ্রি তে পাওয়া যায় না নেতা সাহেব। গতকাল রাত হতে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনায় কেবল আপনার লাভটুকুই ছিলো। নিজের আসল চেহারা নির্মোচন হওয়া থেকে নিজেকে বাঁচালেন। অত:পর আমাকে বিয়ে করে ফ্রি-তে একখানা বউ আর জবানবন্দি দুটোই আত্মসাৎ করলেন। এই সম্পূর্ণ বিষয়ে আমার লাভটুকু কোথায়? “

“ লাভ চাই আপনার? “

“ আলবাত চাই। আপনার রুমের ডিজাইন আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। এই দরজার ভেতরে থাকা দুটি কামরার মধ্যে আমি ভেতরের কামরায় থাকবো। আর আপনি এই লিভিং এরিয়া তে থাকবেন। আমার ব্যক্তিগত কিংবা প্রফেশনাল লাইফে হস্তক্ষেপের চেষ্টাও করবেন না কখনো। আর আমার কাছাকাছি আসার চেষ্টাও করলে মেরে শরীরের প্রতিটা হাড্ডির বিশ টুকরো করে দিবো। মনে থাকে যেন। “

পার্থ নিজের দু’হাত পিঠের পিছনে ভাজ করে প্রশ্ন করে,

“ আর আপনার এই শর্তগুলো আমি কেন মানবো? “

“ ভবিষ্যতে কোনো ধরনের ঝামেলা এড়ানোর জন্য। আর আমার মুখ বন্ধ রাখার দাম হিসেবে। “

পার্থ নিজের চোয়াল শক্ত করে বলে,

“ আমি এভাবেও আপনার প্রতি অনাগ্রহী। আপনার বলা সবগুলো শর্ত আমি নিজ থেকেই পালন করতাম। “

কথাটুকু বলেই সে ধপধপ পা ফেলে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। তরী সেদিকে তাকিয়ে থেকে মনে মনে বলে,

“ আর আমাকে নিজের স্ত্রী বানানোই হবে আপনার সবথেকে বড় শাস্তি। এমন শাস্তি যেই শাস্তির জন্য আপনি আজীবন পস্তাবেন। “

কথাটুকু বলেই তরী ভিতরের রুমে গিয়ে দরজা আটকে দেয়। নিজের ফোন অন করে সে সবার আগে হসপিটালে কল করে আজকের ডে অফ নিয়ে নেয়। আজকের জন্য আর কোনো তামাশা হ্যান্ডেল করতে পারবে না সে। তার এখন একটা লম্বা ঘুমের প্রয়োজন। কালকে তার পরপর তিনটা গুরুত্বপূর্ণ সার্জারি আছে। সেটার জন্য হলেও ঘুমটা তার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।

__________

সবেমাত্র একটা নিউজ কাভার করে অফিসে ফিরেছে তূর্য। দিনের মধ্যাহ্ন ভাগ। ঘড়ির কাঁটা ১ টায় স্থির। অফিসে বসে লাঞ্চ শুরু করবে এমন সময়ই তার ফোনটা বেজে উঠে। ফোনের স্ক্রিনে পাপার নাম ভেসে উঠেছে। তূর্য কলটা রিসিভ করে না। কেটে দেয়। যেই না সে আবার খাবার মুখে তুলতে নিবে তখন আবার তার ফোন বেজে উঠে। কিন্তু এবার কলটা তার বাসার দাঁড়োয়ান আংকেল করেছে। তূর্য ফোনটা রিসিভ করেই বলে উঠে,

“ খাবার পৃথার কাছে পৌঁছে দিয়েছেন আংকেল? “

“ বাবা, আমি গত আধাঘন্টা ধইরা ঘরের কলিংবেল বাজাইতাসি। কিন্তু মাইয়াডা তো দরজা খুলতাসে না। কি করমু এখন? “

তূর্যর কপালে ভাজ পড়ে। সে চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করে,

“ দরজা খুলছে না মানে? “

“ হ বাবা। কোনো সাড়াশব্দও নাই। “

তূর্যর মনের ভেতর অজানা ভয় হানা দিলো। মেয়েটা কোনো স্টুপিডিটি করে ফেলে নি তো? এতোকিছুর মাঝে এই ধরনের চিন্তা তূর্যের মাথায় আসে নি এক মুহুর্তের জন্য। একবারও যদি এরকম খেয়াল আসতো তাহলে কখনোই পৃথাকে বাসায় একা রেখে আসতো না।

তূর্য ফোনটা কেটে খাবার রেখে উঠে সবার আগে হাফ ডে অফ নিতে উদ্যত হয়। আজকের দিনে তার আর কোনো নিউজ কাভার করার শিডিউল না থাকায় সহজে বাকি দিনটার জন্য ছুটি পেয়ে যায় সে। সাথে সাথে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয় সে।

বাসায় ফিরে তূর্য দেখে দাঁড়োয়ান আংকেল এখনো দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। তূর্য অপেক্ষা না করে চাবি দিয়ে লক খুলে উপরে দৌঁড়ে যায়। নিজের রুমে প্রবেশ করতেই সে দেখে পৃথা বিছানার একপাশে গুটিসুটি মেরে ঘুমাচ্ছে। তূর্য অবাক হয়। এরকম কুম্ভকর্ণের ন্যায় ঘুমায় কেউ? তবুও সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এটা ভেবে যে অন্তত উল্টাপাল্টা কিছু তো করেনি। তূর্য নিজের গলা সামান্য ঝেড়ে ডাকে,

“ পৃথা? পৃথা? “

এখনো কোনো সাড়াশব্দ নেই। তূর্য বাধ্য হয়ে তাই তার পাশে বসে পৃথার হাত ধরে সামান্য ঝাকিয়ে তাকে ডাকে। এখনও পৃথা চোখ খুলে না। তূর্য এবার কিছুটা আতংকিত হয়। কাছে গিয়ে পৃথার গালে আলতো করে কয়েকটা চাপড় মেরে তার নাম ধরে ডাকে। পৃথা নিরুত্তর। তূর্য আতংকে বলে উঠে,

“ ড্যাম! এই মেয়ে কি করেছো তুমি? “

__________

আবু হায়দার বিচক্ষণ চোখে পরখ করছে শোভনকে। নিজের মেয়ের কাছে যেমন বিবরণ শুনেছে ঠিক তেমনই। ছেলেটা বেশ বিনয়ী। আদব কায়দাও ভালো জানে মনে হচ্ছে। কিন্তু ছেলের চাকরি এবং পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড তেমন একটা ভালো লাগছে না তার। ছেলের বাপ ও ভাই ব্যবসায় জড়িত। তার পাশাপাশি নাকি আবার বড় ভাই ব্যবসার পাশাপাশি রাজনীতিতেও জড়িত। আবার ছেলে নিজেও পুলিশের চাকরি করে। পুলিশ আর রাজনীতি দুটি পেশাই হলো বর্তমান যুগে দূর্নীতিতে পরিপূর্ণ। পুরো জীবন নিজের মোরাল মেনে জীবন ধারণ করা আবু হায়দারের মেয়ের কিনা এইরকম এক ফ্যামিলির ছেলেই পছন্দ হতে হলো?

আবু হায়দারের স্ত্রী ফরিনা বেগম শোভনের মা’য়ের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে,

“ তা ভাবী, আপনারা বড় ছেলেকে রেখে ছোট ছেলের বিয়ে আগে দিতে চাচ্ছেন কেন? “

সাদিকা বেগম হেসে বিচক্ষণতার সাথে জবাব দেয়,

“ আমার বড় ছেলের জন্য এখনো ওর যোগ্য জীবনসঙ্গী পাই নি। আর এসব বিষয় তো উপরওয়ালার হুকুমে হয়। যার যেখানে জুটি ঠিক করে রাখা আছে তার সেখানেই বিয়ে হবে। “

ফরিনা বেগম হেসে শুধায়,

“ তা তো অবশ্যই। “

আফজাল সাহেব এতক্ষণে নীরবতা ভেঙে প্রশ্ন করে,

“ তা হায়দার সাহেব, দেখা সাক্ষাৎ আলাপ সবই তো হলো। এবার আমরা যেই উদ্দেশ্যে এসেছি তা নিয়ে কথা বলা যাক। আমার ছোট ছেলে শোভনের জন্য আমরা আপনার মেয়ে মধুমিতার সমন্ধ চাচ্ছি। আপনি কি এই বিয়েতে রাজি? “

আবু হায়দার আড়চোখে নিজের মেয়ের দিকে তাকায়। মধুমিতা হাসিহাসি মুখ করে নিজের বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। হায়দার সাহেব ভাবেন তার মেয়ে সবসময় তার বিশ্বাসের মান রেখেছে। আর তাছাড়া তার মেয়ে বেশ বিচক্ষণও। সে যে নিজের জন্য খারাপ কাউকে পছন্দ করবে না তা নিয়েও উনার সন্দেহ নেই। তাই তিনি বলে উঠেন,

“ আমার কোনো আপত্তি নেই। “

শোভন সাথে সাথে মনে মনে আলহামদুলিল্লাহ বলে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। এতক্ষণ তার রুদ্ধশ্বাস আটকে ছিলো। মনে হচ্ছিলো বুঝি কোনো বিসিএসের ভাইবা দিতে এসেছে। কিন্তু এখন নিজেকে অনেকটা হালকা লাগছে। শোভন আড়চোখে মধুমিতার দিকে তাকায়। বড়রা তখন মিষ্টিমুখ করতে ব্যস্ত। শোভন মধুমিতার দিকে তাকিয়েই নিজের হাসি চওড়া করে একটা ফ্লায়িং কিস ছুঁড়ে দেয়।

মধুমিতা বিষম খায়। এই ডিউটিওয়ালা দিন দিন খুব দুঃসাহসিক হয়ে যাচ্ছে তো! উহু। মধুর সাহস কম নাকি? সে-ও পাল্টা শোভনের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে এক চোখ মারে। শোভন হেসে সবার আড়ালে নিজের ফোন বের করে মধুকে ম্যাসেজ লিখে,

“ শীঘ্রই দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে। এখন মধু দিয়ে মিষ্টিমুখ করাও তো। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-০৮

0

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৮.

কালো চিকেনকারির একটা থ্রি পিস পরিহিত, এলোমেলো চুল, চেহারার বিধ্বস্ত অবস্থার নববধূ হয়তো কাজী সাহেব আগে কোথাও দেখে নি। তাই তো আড়চোখে বারবার তরীর দিকে তাকাচ্ছে উনি। এই বিয়েটা যে মোটেও স্বাভাবিক ভাবে হয়নি তা নিয়ে উনার কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আপাতত সে এই ভয়ংকর পরিত্যক্ত জায়গার ভূতুড়ে বিয়ের সকল কার্যক্রম মিটিয়ে বের হতে পারলেই হাফ ছেড়ে বাঁচবে।

তরীর হাত পায়ের বাঁধন খুলে দেওয়া হয়েছে অনেকক্ষণ আগে। এতক্ষণ এভাবে বেঁধে রাখায় তার হাতে এবং পায়ে কালসিটে দাগ হয়ে গিয়েছে। শরীরটাও বেশ দূর্বল লাগছে। তার মনে পড়ে যায় লাস্ট সন্ধ্যার সময় কেবল এক কাপ কফি খেয়েছিলো সে। এরপর পেরিয়ে গেলো ১০ ঘন্টা। এখনো মুখে একটা দানাপানি পড়ে নি তার।

এসব ভাবতে ভাবতেই তরী সামনে বসে থাকা পার্থর দিকে তাকায়। কি সাবলীল ভঙ্গিতে কাজির সাথে কথা বলতে ব্যস্ত সে। যেন দুনিয়ার সবথেকে নিষ্পাপ মানুষ। একদম কিচ্ছু বুঝে না। কিছুক্ষণ আগে কবুল বলার সময় তরী মনে মনে কসম খায় যে এই অসভ্যের জীবন সে জাহান্নাম বানিয়ে ছাড়বে। তরীকে বিয়ে করে যে সে কত বড় ভুল করেছে তা সে পদে পদে টের পাবে।

কাগজপত্রের ঝামেলা মিটে যেতেই পার্থ একজনকে ডেকে নিজের ওয়ালেট থেকে এক হাজার টাকার বেশ কয়েকটা নোট দিয়ে বলে,

“ কাজী সাহেবকে মিষ্টিসহ সহি সালামতে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসবি। আর নিজেদের জন্যও মিষ্টি কিনে খেয়ে নিস। “

তরী বিদ্রুপের হাসি হেসে বলে,

“ সেই মিষ্টির ভেতর যেন মাছি ডিম পেরে থাকে। খেয়ে ফুড পয়জনিং হয়ে মরে যাক সবকয়টা। “

পার্থ তরীর কথার তেমন একটা তোয়াক্কা করে না। কিন্তু বাকিদের চেহারা চুপসে গিয়েছে। তরীর কথা শুনে তাদের সকলেরই মিষ্টি খাওয়ার শখ মিটে গিয়েছে। কাজী চলে যেতেই তরী উঠে দাঁড়ায়। পার্থর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে,

“ ছেলে তিনটার কি হবে? “

পার্থ একহাত পাঞ্জাবির পকেটে গুজে আরেক হাতে নিজের ঘাড়ের একপাশে সামান্য ম্যাসাজ করতে করতে বলে,

“ আমাদের বিয়ে উপলক্ষে ওদের ডিসকাউন্ট দেওয়া উচিত। কি বলেন? ওদের জীবন নিবো না আর। আই প্রমিজ। “

তরী পার্থর কথায় বিশ্বাস করলো কিনা বুঝা গেলো না। কিন্তু সে বলে উঠে,

“ যা যা চেয়েছেন সব হয়েছে। নাও লেট মি গো টু হোম। আমার ভাই অপেক্ষা করছে। “

পার্থ ভ্রু কুচকে আসিফকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

“ আসিফ। তোর ভাবী মেডিকেলের পড়াশোনা করতে করতে হয়তো বেসিক জ্ঞান ভুলে বসেছে। তুই বল তো, বিয়ের পর একটা মেয়ে কোথায় যায়? “

“ তার জামাইয়ের বাসায় যায় ভাই। “

তরী হেসে বলে,

“ নো ওয়ে। আমি নিজের বাসায় ফিরে যাবো। “

আসিফ পিছন থেকে বলে উঠে,

“ ভাই, ভাবী মনে হয় রাগ করসে। বিয়ের পর তো মাইয়াগোরে কোলে তুইলা জামাইর বাসায় নিয়া যাইতে হয় শুনসিলাম। আপনে এরকম করতেসেন না দেইখ্যা ভাবী রাগ কইরা বাপের বাড়ি যাওয়ার কথা বলতাসে। “

তরী অগ্নিদৃষ্টিতে আসিফের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

“ এই ছেলে! আরেকবার ভাবী ডাকলে একদম জিভে এসিড ঢেলে দিবো। অসভ্য কোথাকার! “

কথা শেষ করতে করতেই তরী নিজেকে হাওয়ায় অনুভব করে। সে ভয়ে চিৎকার করে উঠে। দু’হাতে পার্থর ঘাড় ধরে নিজেকে সামলে নিলো। আশেপাশের সকলেই ওওও বলে চিল্লিয়ে উঠে। দু একজন তো সিটি বাজাতেও ভুললো না। তরী যখন ধাতস্থ হয়ে উপলব্ধি করে যে এই ভদ্ররূপী অসভ্য লোকটা তার পারমিশন ব্যতীত কেবল তাকে টাচ করে ক্ষান্ত হয়নি বরং তাকে ডিরেক্ট কোলে তুলে নিয়েছে, তখনই সে শিং মাছের ন্যায় লাফাতে শুরু করে। পার্থর তাতে তেমন একটা ভাবান্তর হলো না। সে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। আসিফ এই সুযোগে নিজের ফোন হতে তেনু লেকে মে যাভাঙ্গা গান ছেড়ে কয়েকজন ছেলেপেলে নিয়ে নাচতে নাচতে পার্থর পিছু পিছু যাওয়া শুরু করে।

গানের শব্দে এবং তরীর চিল্লাচিল্লিতে নীরব জায়গাটা মুহুর্তেই কোলাহল পূর্ণ হয়ে গেলো। তরী চিৎকার করে বলছে,

“ একটাকেও ছাড়বো না আমি। সবগুলোর হাড্ডি গুড়ো গুড়ো করে নিজের হসপিটালে এডমিট করিয়ে বিনা চিকিৎসায় মারবো। আই হেইট ইউ পার্থ মুন্তাসির চৌধুরী। “

__________

কাজী অফিসে একটা বেঞ্চিতে মাথা নত করে চুপচাপ বসে আছে পৃথা। নিজের ওড়নার আঁচলের এক কোণা দু’হাতে নিয়ে তা নাড়াচাড়া করতে ব্যস্ত সে। এছাড়া আর করার মতো কিছুও পাচ্ছে না সে। তূর্য নিজের সদ্য বিবাহিত নববধূকে বসিয়ে রেখে ভিতরে কিছু পেপারস ওয়ার্ক নিয়ে ব্যস্ত। পৃথার মনে পড়ে যায় কয়েক ঘন্টা আগে তূর্যর করা ফোন কলটা। তূর্যর প্রশ্নের পিঠে পৃথা তাকে জানিয়েছিলো যে সে তাকে বিশ্বাস করে। সাথে সাথে তূর্য কোনো ভনিতা না করে তাকে ফের প্রশ্ন করে,

“ আমাকে ভালোবাসেন? “

তূর্যর আকস্মিক প্রশ্নের প্রকোপে পৃথার শান্ত কোমল হৃদয়ে ঝড় উঠে। সেই ঝড় মনে নিয়েই পৃথা নিজের উপলব্ধি করা সত্যি জবাবটা দেয়,

“ বাসি। “

অবশেষে তূর্য শেষ এবং সবথেকে কঠিন প্রশ্নটা করে,

“ আমাকে আজকে এবং এই মুহুর্তে বিয়ে করবেন আপনি? “

পৃথা বহু জায়গায় দেখেছে এবং শুনেছে অনেকেই নাকি নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে শেষ অব্দি পায় না। সেখানে পৃথার ভাগ্য বেশ সুপ্রসন্ন বলা চলে। তার ভালোবাসার মানুষটা নিজে তাকে সারাজীবনের সম্পর্কে জড়ানোর নিবেদন জানাচ্ছে। তাদের এই অল্প কয়েকদিনের নামহীন সম্পর্ককে একটা নাম দেওয়ার লোভ পৃথা সামলাতে পারে না। সে বলে উঠে,

“ করবো। “

ব্যস। সেই ফোন কেটে পৃথা তূর্যর কথা মতো কেবল নিজের প্রয়োজনীয় দু একটা কাগজ ব্যাগে ভরে এক কাপড়ে বাসা থেকে বেরিয়ে আসে। ভাগ্যিস আজ বাসায় কেউ ছিলো না! যে দু একজন কাজের লোক ছিলো তাদের চোখ ফাঁকি দেওয়া তার দ্বারা খুব একটা কঠিন কাজ ছিলো না।

এরপর তারা কাজি অফিসে আসে। বিনাবাক্য ব্যয়ে তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। আর তূর্য তাকে কাজি সাহেবের রুমের বাহিরে বসিয়ে রেখে নিজে ভিতরে কাবিননামার কাগজ বুঝে নিতে গিয়েছে।

পৃথার বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। তূর্য কয়েক মিনিটের মধ্যেই বেরিয়ে আসে। নিঃশব্দে পৃথার পাশে বসে তাকে প্রশ্ন করে,

“ আমাকে তোমার কোনো প্রশ্ন করার নেই? “

তূর্যর মুখ থেকে তুমি সম্বোধন শুনে পৃথা মৃদু অবাক হয়। তাদের এতদিন যতবারই কথা হয়েছে তূর্য সবসময় তাকে আপনি বলেই ডেকেছে। তবে আজ ভিন্ন কেন? কিছুক্ষণ আগে তাদের বিয়ে হলো বলে? এটা কি স্বামী হিসেবে তূর্যের এক অলিখিত অধিকার? এতকিছু জানে না পৃথা। জানতেও চায় না। তূর্যর মুখে তুমি ডাকটা মন্দ লাগছে না তার।

পৃথাকে নিজের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে তূর্যর বুকের ভিতর হুহু করে উঠে। মেয়েটার চোখে প্রবল মায়া আর অনুভূতি। সে কোনো অন্যায় করছে না তো মেয়েটার সাথে? কিন্তু তূর্যর কাছেও করার মতো কিছু ছিলো না। নিজের বোনের লাইফের সেফটি এবং গ্যারান্টির জন্য সে পৃথাকে একটা ট্রাম কার্ডের ন্যায় ইউজ করছে। আপাতত তার আপির সেফটিই তার কাছে ফার্স্ট প্রায়োরিটি।

তূর্য নীরবে উঠে দাঁড়ায়। অত:পর পৃথার দিকে তাকিয়ে বলে,

“ চলো। যাওয়া যাক। “

পৃথা ধীর স্বরে প্রশ্ন করে,

“ কোথায় যাবো আমরা? “

“ আগে তোমার বাসায়। “

কথাটুকু বলেই তূর্য একহাত বাড়িয়ে পৃথার একটা হাত ধরে সামনের দিকে হাঁটা শুরু করে। মুহুর্তেই পৃথার চেহারায় লজ্জার আভা ছড়িয়ে পড়লো। তূর্যর প্রথম ছোঁয়া! তাও একেবারে স্বামী হিসেবে। কি তীব্র অধিকারবোধ! মনে মনে কিছুটা অবাকও হয় পৃথা। ছোটবেলা থেকেই তার কারো হাত ধরে হাঁটা পছন্দ নয়। কিন্তু এখন আর তার খারাপ লাগছে না। বিয়ের মাঝে কি কোনো অলৌকিক শক্তি আছে? তিন কবুল বলেই একটা মানুষের উপর এতো অধিকার চলে আসে?

__________

রাত পেরিয়ে ভোর হয়েছে। সবেমাত্র ফজরের আযান দিয়েছে। ধানমন্ডির চৌধুরী নিবাসে সকাল সকাল একটা প্রাইভেট কার প্রবেশ করলো। গাড়ির ফ্রন্ট সিটে পার্থর পাশে আরেকজন অপরিচিত নারীকে দেখে দাড়োয়ান সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এরকম দৃশ্য এই প্রথম দেখলেন তিনি। উনার অবাকের মাত্রা আরো বেড়ে যায় যখন দেখেন যে পার্থ গাড়ি থেকে নেমে সেই নারীকে পাজাকোলে তুলে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরেছে। দাড়োয়ান বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,

“ সক্কাল সক্কাল বাইত নতুন সিনেমা হইবো নি! “

কলিংবেলের শব্দ পেয়ে জমিলা দরজা খুলতে এসে দেখে মেইন গেটের লক খোলা ভেতর থেকে। তিনি অবাক হয়। তবুও দরজা খুলে দিতেই আরেকদফা বিস্মিত হয়ে যায়। পার্থ চমকিত জমিলাকে তেমন একটা পরোয়া না করে তরীকে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। তরী তখনও শিং মাছের ন্যায় লাফালাফি করছে আর চেঁচামেচি করে যাচ্ছে।

লিভিং রুমে এনে তরীকে নামিয়ে দিতেই তরী সবার আগে সোফা থেকে একটা কুশন তুলে পার্থর দিকে ঢিল মেরে ঝাঁঝালো স্বরে বলে,

“ অসভ্য কোথাকার! বিয়ে করেছেন দেখে মাথা কিনে নিয়েছেন নাকি? আমাকে কোলে তোলার সাহস কিভাবে হলো? হিন্দি সিনেমা চলছে এখানে? “

তরীর ছুড়ে মারা কুশনটা পার্থ একহাতে ধরে ফেলে। অত:পর বলে,

“ ভুল বলেন নি। আমাদের বিয়েটা অবশ্য কোনো সিনেমার থেকে কম ছিলো না। “

পার্থর এরকম জবাবে তরীর শরীর জ্বলে যায়। জমিলা খালা বোকার ন্যায় দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছিলো। এখানে যা হচ্ছে সব তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। উনার ভাবনার মাঝেই আবার কলিংবেল বেজে উঠে। এতো ভোর বেলায় কলিংবেলের শব্দ শুনে পার্থ ভ্রু কুচকে তাকায়। জমিলা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই পৃথা নীরব পায়ে ঘরে প্রবেশ করে।

সাত সকালে নিজের বোনকে ঘরের বাইরে থেকে আসতে দেখে যেন পার্থর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। সে বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে,

“ তুই কোথায় ছিলি? “

বিস্মিত কেবল পার্থ একা নয়, বরং পৃথাও। সে এতক্ষণ ভাবছিলো বাসায় ফিরে কি জবাব দিবে। কিন্তু এখন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তরীকে দেখে ভাবছে এই মেয়েটা কে? পৃথার আর উত্তর দিতে হলো না কষ্ট করে। তার পিছন হতে একটা পূরুষ স্বর ভেতরে প্রবেশ করতে করতে বলে উঠে,

“ আমার সাথে ছিলো। “

তূর্যকে দেখে এবার তরীও চমকে যায়। সে অবাক স্বরে বলে,

“ ছোট তুই? “

পার্থ, তরী, পৃথা তিনজনই বিস্মিত। কেউই সম্পূর্ণ ঘটনা বুঝতে পারছে না। জমিলা খালা নিজের কৌতূহল সামলাতে না পেরে বলেই ফেললো,

“ এইখানে হইতেসেডা কি? “

তূর্য নিজের বোনকে একবার মা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিলো। তার আপি ঠিক আছে দেখতে পেয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। অত:পর নির্বিঘ্নে বলে উঠে,

“ পার্থ মুন্তাসির চৌধুরী জোর করে আমার আপিকে বিয়ে করেছে। একইভাবে আমি আর পৃথাও বিয়ে করেছি। কিন্তু আমি পার্থ মুন্তাসিরের মতো অমানুষ নই। আমাদের বিয়েটা পৃথার মর্জিতেই হয়েছে। “

চৌধুরী নিবাসের বিশাল লিভিং রুমে উপস্থিত মানুষগুলোর মধ্যে দিয়ে মুহুর্তেই যেন বজ্রপাত খেলে গেলো। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই পার্থ হিংস্র ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে তূর্যর গালে একটা ঘুষি বসালো। তূর্যও কম না। সে কাল রাত হতে পার্থর প্রতি পুষে রাখা নিজের রাগ বহিঃপ্রকাশের জন্য পার্থকে পাল্টা আঘাত করলো। তাদের এই মারামারি থামানোর তাড়াহুড়ো কারো মধ্যে দেখা গেলো না। তরী এবং পৃথা দুজনেই নিজেদের ভাইয়ের কর্মকান্ডে বাকহারা হয়ে পড়েছে। জমিলা খালা তো চেয়েও অন্যের বাড়ির ব্যাপারে মুখ খুলতে পারছে না।

মারধরের মাঝেই পার্থর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,

“ তোর সাহস কিভাবে হয় আমার বোনের দিকে হাত দেওয়ার? “

তূর্য পাল্টা জবাব দেয়,

“ তুই কি ভেবেছিস, তুই একাই ব্ল্যাকমেইল করতে পারিস? তোর বোনও এখন আমার স্ত্রী। আমার বোনের সাথে কোনো অন্যায় করার আগে ১০০ বার এই কথাটা স্মরণ করবি। “

তূর্যর কথা শুনে তরী এবং পৃথা দুজনেই তাজ্জব বনে যায়। তূর্য পার্থকে আঘাত করার জন্য আবার হাত তুলতে নিলে তরী তার হাত ধরে থামিয়ে দেয়। তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে,

“ তুই আমার সিকিউরিটির জন্য এই মেয়েকে বিয়ে করেছিস? “

তরীর প্রশ্ন শুনে পৃথাও উত্তরের আশায় তূর্যর মুখের দিকে তাকিয়ে রয়। তূর্য ভনিতা না করে সোজাসাপ্টা উত্তর দেয়,

“ এছাড়া অন্য কোনো অপশন ছিলো না আমার কাছে। আমি যা করেছি তোর জন্য করেছি। এই লোক এখন আর তোকে ইউজ করে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করতে পারবে না। “

তূর্যর কথা শেষ হতে না হতেই তার গালে স্ব শব্দে একটা চড় বসালো তরী। তূর্য বিস্ময় নিয়ে তরীর দিকে তাকাতেই তরী বলে উঠে,

“ তুই এতো অমানুষ কবে হলি ছোট? ছি! “

“ আমি কি করেছি আপি? “

“ তুইও এই পার্থ মুন্তাসিরের মতো ব্ল্যাকমেইলিং গেম শুরু করলি? তোর আর এই অসভ্যের মধ্যে পার্থক্য কই থাকলো? ইউ বোথ আর সেম। দুজনেই নিজেদের স্বার্থে বিয়ের খেলা শুরু করেছিস। পুতুল পেয়ে রেখেছিস আমাদের? “

কথাটা বলেই তরী রাগে কাপতে থাকলো। পৃথা তূর্যের জবাব শুনে তখনই ধপ করে একটা সোফায় বসে পড়ে। তার দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ। মস্তিষ্ক শূন্য। তরী জোরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে পৃথার দিকে ফিরে তাকালো। শান্ত গলায় তাকে প্রশ্ন করে,

“ তুমি এসবের কিছু জানতে? “

পৃথা কেবল মাথা নেড়ে না বললো। তরী ফের প্রশ্ন করে,

“ তাহলে ওকে বিয়ে করলে কেন? “

পৃথা টলমলে চোখে তূর্যর দিকে তাকিয়ে জবাব দেয়,

“ ভালোবেসে। “

সাথে সাথে তার গাল গড়িয়ে অশ্রু পড়ে। তূর্য তা দেখে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। তরী নিজের মাথায় হাত দিয়ে একপাশে সোফায় বসে পড়ে। তার মাথা ভনভন করছে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুটো পুরুষের প্রতিই তার তীব্র ঘৃণা কাজ করছে। সে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলে উঠে,

“ আমি পৃথার সাথে আলাদা কথা বলতে চাই। “

তূর্য অধৈর্য্য গলায় বলে,

“ তোর কারো সাথে কথা বলতে হবে না আপি। তুই বাসায় ফিরে চল। তোর যত রাগ দেখানোর বাসায় গিয়ে দেখাস। “

তরী অগ্নি দৃষ্টি তাক করে বলে উঠে,

“ কোথাও যাবো না আমি। এখানেই থাকবো। তুই কে আমার উপর হুকুম চালানোর? “

পার্থ মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। যাক! অন্তত এই বিষয় নিয়ে তার এখন মাথা ঘামাতে হবে না। সবাইকে এখনো মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তরী পৃথার দিকে তাকিয়ে বলে,

“ আমার তোমার সাথে কথা আছে। অন্য কোথাও চলে। “

পৃথা নীরবে উঠে দাঁড়িয়ে নিচ তলার গেস্ট রুমের দিকে হাঁটা ধরে। তরীও তার পিছু পিছু যায়। তারা চলে যেতেই পার্থ জমিলা খালাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

“ খালা আমাদের একা থাকতে দিন। “

তিনিও সাথে সাথে চলে যায়। পার্থ ক্রোধভরা দৃষ্টি নিয়ে তূর্যর দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

“ আমার বোন বোকা। কিন্তু আমি নই। “

তূর্য চোয়াল শক্ত করে বলে,

“ আমার বোন নিজে এখানে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেখে আকাশে উড়া বন্ধ কর। আমার বোনের কোনো ক্ষতি করার চিন্তা করলে আমি তোকে মেরে দশ হাত মাটির নিচে পুতে দিবো। “

__________

গেস্টরুমে আসতেই তরী ভিতর থেকে দরজা লক করে আগে নিজেকে শান্ত করে। পৃথা এখনো নিশ্চুপ বসে আছে। তরী পৃথার পাশে বসে সর্বপ্রথম প্রশ্ন করে,

“ বয়স কত তোমার? “

“ ১৮। “

তরী রাগে নিজের মাথা চাপড়ায়। তার পৃথাকে দেখেই মনে হচ্ছিলো মেয়েটা তার তুলনায় বয়সে অনেক ছোট। তরীর এই মুহুর্তে তূর্যকে আরেকটা চড় মারতে ইচ্ছে করছে। তরী নিজেকে সামলে নিয়ে পৃথার দুটো হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,

“ আমি এখন যা বলবো মন দিয়ে শুনবে পৃথা। উই বোথ আর ভিক্টিম। তোমার ভাই ব্ল্যাকমেইল করে জোর করে আমাকে বিয়ে করেছে। আমার ভাইয়ের সন্দেহ ছিলো তোমার ভাই হয়তো আমার সাথে খারাপ কিছু করতে পারে। সেজন্য ও তোমাকে বিয়ে করে কাইন্ড অফ সেফটি ইন্সুইরেন্স হিসেবে যেটা সম্পূর্ণ অনুচিত হয়েছে। এই পর্যন্ত আমরা ওদের স্টুপিডিটির স্বীকার হয়েছি। কিন্তু এখন আমাদের ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে হবে। তোমার ভাইকে হ্যান্ডেল করার জন্য আমি যথেষ্ট। কিন্তু তোমার সাথে যেই অন্যায় হয়েছে সেটার শোধ তোমাকে তুলতে হবে। তুমি তূর্যর সাথে যাবে। নিজেকে একা ভাববে না। আমি আছি তোমার সাথে। আমার পাপাও এক দু’দিনের মধ্যে ফিরে আসবে। সব শোনার পর উনিও তোমার পাশে থাকবে। তোমার শুধু একটাই কাজ। নিজের খেয়াল রাখবে আর তূর্যর উপর যেভাবে ইচ্ছে প্রতিশোধ নিবে। কারণ তোমার ভাইয়ের উপর আমি মোটেও দয়া করবো না। এদের উপর দয়া করা উচিতও না। দয়া এবং ক্ষমার অযোগ্য এরা। জাস্ট রিমেম্বার, এদের এইটুকুই বুঝাতে হবে যে আমাদের বিয়ে করা এদের লাইফের সবথেকে বড় ভুল। “

পৃথা কোনো জবাব দেয় না। সে ফ্যালফ্যাল করে তরীর দিকে তাকিয়ে রয় কেবল।

__________

তরী এবং পৃথা লিভিং রুমে এসে উপস্থিত হতেই তূর্য একদন্ড নিজের বোনের দিকে তাকিয়ে পৃথার হাত ধরে বলে উঠে,

“ চলো। “

পার্থ শান্ত কিন্তু ভয়ংকর সুরে বলে,

“ আমার বোন কোথাও যাবে না। “

তূর্য রক্তিম চোখে পার্থর দিকে তাকিয়ে বলে,

“ আমার বউ আমার সাথে যাবে। কারো বুকে কলিজা থাকলে বাঁধা দিয়ে দেখাক। “

পার্থ কিছু বলতে যাবে তার আগে পৃথা নিষ্প্রাণ গলায় বলে উঠে,

“ তুই যা করেছিস এটা তার শাস্তি বড় দা। “

পার্থ আর কিছু বলতে পারে না। সে নিশ্চুপ বোনের দিকে তাকিয়ে রয়। তার চোখের সামনে দিয়েই তূর্য পৃথার হাত ধরে বেরিয়ে যায়। তরী পার্থর দিকে তাকিয়ে হেসে বলে উঠে,

“ ডোন্ট ওয়ারি। আই’ল মেক শিওর টু টার্ন ইউর লাইফ ইনটু হেল। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-০৭

0

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৭.

হীম শীতল রুমে বসে মধুমিতার সাথে ফোনালাপে ব্যস্ত শোভন। আজ সন্ধ্যায়ই সে তার আব্বা আম্মার সাথে সিলেট এসে পৌঁছেছে। আপাতত তারা একটা রিসোর্টে উঠেছে। আগামীকাল মধুর পরিবারের সাথে দেখা করে আবার ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হবে তারা। মধুমিতা শান্ত স্বরে বলে,

“ আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে তোমার ফ্যামিলি এতো সহজে আমাকে মেনে নিলো। “

“ মেনে না নেওয়ার মতো কি আছে? “

মধুমিতা জবাব খুঁজে পায় না। সে আপাতত খুব নার্ভাস। আগামীকাল দুই ফ্যামিলি মুখোমুখি এলে কি হবে তা ভাবতেই তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। তার বাবাতো বেশ বিচক্ষণ মানুষ। যদি কোনো একটা লজিক দেখিয়ে বিয়েতে নাকোচ করে দেয়? না না। নেগেটিভ ভাবা যাবে না মোটেও। নাহয় পরে নেগেটিভই ঘটবে তার সাথে।

শোভন ফোনের অপরপাশ হতে ডাকে,

“ এই মধু। “

“ হ্যাঁ বলো। “

“ আই লাভ ইউ। “

মধু সামান্য হেসে বলে,

“ আম্মার রান্না করা কাচ্চির থেকেও বেশি? “

শোভন গাল ফুলিয়ে বলে,

“ আমাদের ভালোবাসা মাঝে তোমার সবসময় কাচ্চিকে না টানলে চলে না? কাচ্চি যদি আমার হৃদয় হয় তাইলে তুমি সেই হৃদয়ের হৃৎস্পন্দন। “

মধু এখন শব্দ করে হেসে দেয়। হাসতে হাসতে বলে উঠে,

“ ভালোই মাঞ্জা মারা শিখেছো। “

শোভন মাথায় হাত দিয়ে বলে,

“ আরেএএ! এখনো বউ হয়ে আসো নি অথচ শাশুড়ির পুরান ঢাকার ভাষা শিখে গেলে। ভেরি ফাস্ট! “

“ আপনার সাথে থাকতে থাকতে বহু কিছু শিখে গিয়েছি শোভন সাহেব। একবার বিয়েটা হোক। তারপর দেখতে পারবেন। “

__________

শা শা বাতাসে তরীর চুল এলোমেলো ভঙ্গিতে উড়ছে। কিন্তু তার সেদিকে খেয়াল নেই। সে ঘৃণাভরা দৃষ্টি নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। তার হাতে থাকা ফোনে সম্পূর্ণ দৃশ্যটা রেকর্ড করে নিচ্ছে সে। ভিডিও করতে করতে বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,

“ আপনার এই ভালো মানুষির মুখোশ আমি টেনে হিচড়ে ছিড়ে ফেলবো নেতা সাহেব। “

সর্বদা শান্তশিষ্ট থাকা পার্থকে আজ বেশ অন্যরকম লাগছে। গায়ে জড়িয়ে থাকা শুভ্র পাঞ্জাবির হাতা কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে সে বেরহম ভাবে তিনটা ছেলেকে মারতে ব্যস্ত। মারতে মারতে একটা সময় তার দু’হাত রক্তাক্ত হয়ে যায়। তার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা তার লোকেদের মুখে পৈশাচিক হাসি। মার খেতে খেতে তিনটা ছেলেরই প্রায় আধমরা অবস্থা। তাদের মধ্যে একজন আর্তনাদ করতে করতে পার্থর পা জড়িয়ে ধরে। নিজের জীবন ভিক্ষা চায়। কিন্তু তার এই আহাজারি পার্থর উপর কোনো প্রভাব ফেলে না। সে ছেলেটার নাক বরাবর এক লাথি মেরে তাকে দূরে ছিটকে ফেলে।

এরকম দৃশ্য দেখে তরীর বেশ রাগ হয়। কিন্তু সে এগিয়ে গিয়ে কিছু বলতে পারে না। তিনটা ছেলেকে আরো বেশ কিছুক্ষণ মেরে পার্থ ক্ষান্ত হয়। সোজা হয়ে দু’হাত পিঠের পিছনে ভাজ করে দাঁড়ায় সে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে তার। কিন্তু চেহারায় এক ফোটাও ক্লান্তির ছাপ নেই। পাশ ফিরে একজনকে কিছু একটা ইশারা করে সে। সাথে সাথে একজন ছেলে একটা পানিয়র বোতল হাতে এগিয়ে আসে।

পার্থ কেমন ভয়ংকর এক হাসি দেয়। অত:পর বলে উঠে,

“ অপেক্ষা কিসের? উনাদের কাজের ইনাম দেওয়া হোক তবে। “

পার্থর আদেশ পেতেই সেই ছেলেটা বোতলের মুখ খুলে কিছুটা পানীয় সেই তিনজনের মধ্যে একজনের হাতের উপর ছিটিয়ে দেয়। সাথে সাথে সেই ছেলেটা গগণবিদারী চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। গলা কাটা মুরগির ন্যায় ছটফট করতে শুরু করে। তার অবস্থা দেখে বাকি দুটো ছেলে আরো জোরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।

দূর হতে এই দৃশ্য দেখে তরীর শরীর ঝিমঝিম করতে শুরু করে। বোতলের পানীয়টা যে এসিড ছিলো তা আর বুঝতে বাকি নেই তার। শরীর খারাপ লাগায় তরী এক কদম পিছিয়ে যেতে নেয়। সাথে সাথে তার পায়ে লেগে একটা ইট শব্দ তুলে সিঁড়ি ঘেঁষে নিচে পড়ে যায়। সাথে সাথে সবাই সতর্ক দৃষ্টিতে সিঁড়িঘরের দিকে তাকায়। পার্থ ভ্রু কুচকে সেদিকে তাকিয়ে আছে। দূর হতে অন্ধকারে মুখশ্রী স্পষ্ট না দেখা গেলেও কেউ যে সেখানে আছে তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

তরী আতংকে যেন জমে যাচ্ছে। এখান থেকে দৌঁড়ে যে সে বেশিদূর পালাতে পারবে না সেই সম্পর্কে সে নিশ্চিত। সেজন্য সে সাথে সাথে এইমাত্র রেকর্ড করা ভিডিওটা তূর্যর কাছে সেন্ড করে নিজের ফোনের লোকেশনটা অন করে ফেলে। এক মুহুর্তও অপেক্ষা না করে সে দ্রুত উল্টো দিকে ফিরে দৌঁড়ানো শুরু করে। দূর হতে সেই ছায়ামানবীকে দৌঁড়ে যেতে দেখে পার্থও তার পিছে ছুটে।

নিজের শরীরের সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে তরী দিক বেদিক ভুলে দৌড়াচ্ছে। ইতিমধ্যে সে বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে এসেছে। লক্ষ্য একটাই। কোনোমতে দৌঁড়ে একবার এই মেইন গেট পেরিয়ে নিজের গাড়িতে উঠতে পারলেই হবে। কিন্তু তরী আর বেশি দূর যেতে পারে না। পার্থ বড় বড় কদম ফেলে দৌঁড়ে এসে তাকে পিছন থেকে ধরে ফেলে।

ছায়ামানবীর একহাত পিঠের পিছে মুচড়ে ধরে তাকে নিজের দিকে ফিরাতেই পার্থ হিংস্র চোখে তাকায় তার দিকে। আজকে জোৎস্নার রাত। চাঁদের আলোয় চারিদিক আলোকিত। সেই উজ্জ্বল চাঁদের আলোয় তরীর মুখ দেখে পার্থ গম্ভীর স্বরে বলে উঠে,

“ ভুল করলেন ডাক্তার সাহেবা। “

ইতিমধ্যে পার্থর পিছু পিছু তার আরো কয়েকজন ছেলেপুলে দৌড়ে আসে। তাদের মধ্যে আসিফ এবং শামীমও ছিলো। তরীকে দেখতেই আসিফ বলে উঠে,

“ খাইসে রে! এই ধানি মরিচ এনে করে? “

তরীর এই মুহুর্তে ভয় পাওয়ার কথা। কিন্তু সে মোটেও ভয় পাচ্ছে না। সে ঘাড় ঘুরিয়ে চারিপাশে তাকায়। পার্থর ছেলেরা চারিদিক থেকে তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। অর্থাৎ এখান থেকে পালানোর আর কোনো রাস্তা নেই। তরী সবার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে পার্থর দিকে তাকিয়েই শব্দ করে হেসে উঠে। তার হাসি দেখে পার্থ ব্যতীত সবাই-ই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। আসিফ নিজের পাশে দাঁড়ানো শামীমকে কনুই মেরে বলে উঠে,

“ কিরে মামা! এইডা কি ওই ডাক্তার আপা নাকি তার রূপধারী কোনো প্রেতাত্মা? একে তো কালা জামা পড়া, তার উপর চান্দের আলোয় মুখ কেমন চিকচিক করতাসে, এখন আবার এমন শাকচুন্নির মতো হাসতাসে কেন? “

শামীম যদিও কখনো ভূত প্রেতে বিশ্বাস করে না। কিন্তু এই মুহুর্তে সে আসিফের কথাটাকে সম্পূর্ণ এড়িয়েও যেতে পারছে না। তরীর হাসিটা তারও স্বাভাবিক লাগছে না। হাসতে হাসতেই তরী নিজের একহাতের কনুই দিয়ে পার্থর বুকে আঘাত করে। মুখে শব্দ না করলেও পার্থ তরীকে ছেড়ে দিয়ে ব্যাথায় কুকড়ে উঠে। সব ছেলেরা পার্থর দিকে এগিয়ে আসতে নিলেও পার্থ হাতের ইশারায় সবাইকে থামিয়ে দেয়। তরী নিজের দু’হাত বুকের উপর ভাজ করে বলে উঠে,

“ সরি টু সে নেতা সাহেব, কিন্তু আমি আপনার জনসেবা দেখতে খুব ইঞ্জয় করছিলাম। তাই সেটা লাইভ রেকর্ড করে অলরেডি জায়গা মতো পৌঁছে দিয়েছি। এখন আপনার জনসেবার সাক্ষী সম্পূর্ণ দেশ হবে। ব্যাড লাক ফর ইউ গাইস। “

কথাটা বলেই তরী আবার হাসতে শুরু করে। পার্থ দুটো বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে সে তরীর দিকে তাকায়। তরীর হাতে থাকা ফোনটাও তার দৃষ্টিগোচর হয় না। সে একপা একপা করে তরীর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। নিজের ভয়ংকর রকম শীতল কণ্ঠস্বরে বলতে থাকে,

“ আজকের পর থেকে আপনার জীবনে যা হবে তার জন্য কেবল আপনি একক ভাবে দায়ী ডাক্তার সাহেবা। “

পার্থকে নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে তরী অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। সে রুদ্ধস্বরে প্রশ্ন করে,

“ মানে? “

তরীকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পার্থ তার মুখে একটা রুমাল চেপে ধরে। সাথে সাথে তরী হাত পা ছোটাছুটি করতে করতে শান্ত হয়ে আসে। নিজের শরীরের ভার সম্পূর্ণটা পার্থর উপর ছেড়ে দিয়ে ঢলে পড়ে সে। কিন্তু মাটিতে পড়ার আগেই পার্থ একহাতে আগলে নেয়।

__________

মুখে এক পশলা পানি এসে পড়তেই তরী সামান্য নড়ে উঠে। পিটপিট করে ধীরে ধীরে চোখ মেলার চেষ্টা করে সে। মাথা বেশ ঝিমঝিম করছে। চোখ খুলতেই সে নিজের সামনে এক চেয়ারে পার্থকে পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকতে দেখে। তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে তার ছেলেপেলেরা। একপাশে সেই তিনটা ছেলের মধ্যে দু’জন বাধা অবস্থায় বসে আছে। আরেকজন হয়তো চেতনাহীন অবস্থায় পড়ে আছে।

সাথে সাথে তরীর মনে পড়ে যায় সকল ঘটনা। সে তড়িৎ উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই অনুভব করে সে নড়তে পারছে না। তার দুই হাত পিছনে নিয়ে চেয়ারের সাথে বাঁধা। পা দুটোও শক্ত করে দড়ি দিয়ে বাঁধা। তরী ব্যস্ত চোখে বাহিরের দিকে তাকায়। এখনো চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। তারমানে এখনো সকাল হয়নি। তরী পার্থর দিকে তাকিয়ে হিংস্র গলায় বলে উঠে,

“ লেট মি গো। নাহয় আই সুয়্যার জানে মেরে ফেলবো। “

আসিফ বলে উঠে,

“ আমরা বাঁইচ্চা থাকতে আপনে ভাইয়ের কিছু করতে পারবেন না। তাই হুদাই এসব সুয়্যার মুয়্যার বইলেন না তো। নিজেই মিথ্যা কসম খাইয়া মইরা যাইবেন। “

তরী সাথে সাথে আসিফের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে। আসিফ সাথে সাথে চুপসে যায়। পার্থ তরীর কথার প্রতুত্তর করে না। সে নিজের হাতে থাকা তরীর ফোন হতে কাউকে কল করে ফোনটা স্পিকারে দেয়। মুহুর্তেই কল রিসিভ হয়ে অপরপাশ থেকে একটি উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর ভেসে আসে,

“ আপি? তুই ঠিক আছিস? কতক্ষণ ধরে কল করছি তোকে। তুই বেরিয়েছিস ওখান থেকে? “

পার্থ শান্ত গলায় বলে,

“ তোমার আপি আপাতত আমার কাছে। “

তরী চেঁচিয়ে বলে উঠে,

“ ছোট তুই তাড়াতাড়ি আমার পাঠানো ভিডিও নিয়ে পুলিশকে দে। এই স্ক্রাউন্ডেলের কথায় কান দিবি না। “

পার্থ চোখ পাকিয়ে তরীর দিকে তাকায়। রাগী স্বরে বলে উঠে,

“ আমার কথার মাঝে অন্য কারো চেঁচামেচি আমার পছন্দ নয়। “

কথাটুকু বলেই সে আসিফকে ডেকে বলে,

“ এই আসিফ। ম্যাডামের মুখে টেপ মার তো। “

পার্থর আদেশ দিতে দেরি কিন্তু আসিফের কাজ করতে নয়। ওদিকে ফোনের অপরপাশ হতে তূর্য লাগাতার চেঁচাচ্ছে,

“ পার্থ মুন্তাসির চৌধুরী। আই’ল কিল ইউ। আমার আপিকে ছেড়ে দে। আই অলরেডি হ্যাভ প্রুভ এগেইন্সট ইউ। তোর লাইফ শেষ করতে আমার এক মিনিটও সময় লাগবে না। “

পার্থ বিরক্তি মিশ্রিত সুরে বলে,

“ তোমরা দু’জন যে আপন ভাই বোন তা নিয়ে আমার আর কোনো সন্দেহ নেই। দুজনেই খালি মারার হুমকি দিতে পারো। কিন্তু ব্রেইন ইউজ করতে জানো না। ব্রেইনলেস। “

তূর্য আরো রেগে যায়। সে দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠে,

“ আমার বোনের গায়ে একটা টোকাও পড়লে তোর পুরা গুষ্টিকে আমি হাজতে পাঠাবো। “

“ তোমার বোন এখন কিরকম ট্রিটমেন্ট পাবে সেটা তোমার হাতে। “

“ মানে? “

“ আমার কয়েকজন লোক তোমার বাসার সামনে অপেক্ষা করছে। চুপচাপ কোনো শব্দ না করে দরজা খুলে দাও। ওরা কেবল প্রমাণটা মিটিয়ে চলে আসবে। তোমার বোনের গায়ে একটা ফুলের টোকাও পড়বে না। “

পার্থর কথা শুনে তরী মাথা নেড়ে না না বলতে থাকে কেবল। সে চায় না এতদূর অব্দি এসে প্রমাণ জোগাড় করে এখন হার মানতে। পার্থ আবার বলে উঠে,

“ খুব ইজি একটা ডিল। হয় মেনে নাও, নাহয় তোমার বোনের লাইফের গ্যারান্টি আমি দিতে পারছি না। “

তূর্য ক্ষিপ্ত গলায় বলে উঠে,

“ ইউ কান্ট ব্ল্যাকমেইল মি। “

“ ইয়েস আই ক্যান। তোমার বোন আপাতত আমার জিম্মিতে সেটা ভুলে যেও না। “

তূর্য দ্বিধায় পড়ে যায়। এই কেসটা তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সে যদি একবার এই প্রমাণটা নিউজে আনতে পারে এতে করে তার ক্যারিয়ারে অনেক লাভ হবে। কিন্তু নিজের বোনের জীবনও তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তার বোনের জীবনের মূল্যে সে কখনোই এরকম একটা কাজ করবে না। তূর্য প্রশ্ন করে,

“ এই প্রমাণ মিটে গেলেই যে আমার বোন সেফ থাকবে তার গ্যারান্টি কি? “

“ আমি তোমায় এখানে কোনো গ্যারান্টি কার্ড দিবো না। ইউ হ্যাভ টু ট্রাস্ট মি। কারণ তোমার কাছে আর অন্য কোনো রাস্তা নেই। “

তূর্য রাগে একহাতে নিজের মাথার চুল টেনে ধরে। আপি সবসময় ঠিকই বলতো। এই পলিটিশিয়ানরা হলো মানুষ রূপী পিশাচ। এরা জনসম্মুখে এক, আর পর্দার আড়ালে আরেক রূপ নিয়ে চলে। আর কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে তূর্য বলে,

“ আমি রাজি। কিন্তু আমার বোনের কোনো ক্ষতি হলে কিন্তু আমি কাউকে ছেড়ে দিবো না। “

পার্থ মৃদু হেসে বলে,

“ চিন্তা করো না। ডক্টর সাহেবা একদম নিরাপদে থাকবে। “

তূর্য নিঃশব্দে উঠে গিয়ে নিজের বাসার মেইন গেট খুলে দেয়। মুহুর্তেই তার বাসায় প্রবেশ করে চার পাঁচজন ছেলে। তাদের একজন তূর্যর হাত থেকে ফোন নিয়ে সবার আগে সেই ভিডিও ডিলিট করে। অত:পর সেই ভিডিও অন্য কোথাও সেন্ড করা হয়েছিলো কিনা সেই হিস্ট্রি চেক করে নেয়। যখন নিশ্চিত হয় এই ভিডিওর আর কোনো কপি নেই তখন তারা পার্থকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

“ ভাই। কাজ হইসে। “

“ তোরা এখন যা তাইলে। “

তূর্য নিজের ফোন ছিনিয়ে নিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠে,

“ এখন আমার আপিকে যেতে দে। “

পার্থ হাসে। অত:পর ফিসফিসিয়ে বলে,

“ হুশ? এতো বোকা নাকি? আমি এখন তোমার বোনকে যেতে দিলে যে তোমরা আমার বিরুদ্ধে পুলিশে কিছু বলবে না তার গ্যারান্টি কি? “

তূর্যর ধৈর্য্যের সীমা ভেঙে যায়। সে একটা গালি দিয়ে বলে উঠে,

“ তুই যা বলেছিস আমি মেনে নিয়েছি। এখন চুপচাপ আমার আপিকে যেতে দে। “

“ তোমার বোন একটা মস্ত বড় ভুল করেছে তূর্য। সেই ভুলের মাশুল এখন তার লাইফটাইম গ্যারান্টি দিয়ে পরিশোধ করতে হবে। তোমার মুখ যেন বাকি জীবনের জন্য বন্ধ থাকে সে জন্য তোমার বোনকে আমি এই মুহুর্তে বিয়ে করবো। আমার লাইফ বরবাদ করতে আসলে আমি তোমার বোনকেও বরবাদ করে দিবো। “

কথাটা বলেই পার্থ ফট করে কল কেটে দেয়। তরী কোনো শব্দ না করতে পারলেও সে চোখ দ্বারা প্রতিবাদ করে যাচ্ছে। পার্থ ইশারা করতেই আসিফ তরীর মুখ থেকে কোচ স্টেপ খুলে দেয়। সাথে সাথে তরী চিল্লিয়ে উঠে,

“ আর ইউ আউট অফ ইউর মাইন্ড? আমি মরে যাবো কিন্তু এই বিয়ে করবো না। আমি কারো হাতের পুতুল না। “

পার্থ উঠে দাঁড়িয়ে তরীর দিকে এগিয়ে আসে ধীরে ধীরে। আর বলে উঠে,

“ সেটা আপনার আমার ব্যাপারে নাক গোলানোর আগে ভাবা উচিত ছিলো। “

তরীর এই মুহুর্তে ইচ্ছে করছে এক লাত্থি মেরে পার্থর মুখের ভৌগোলিক চিত্র বদলে দিতে। কিন্তু তার হাত পা বাঁধা থাকায় সে এটা করতে না পেরে রাগে ফোস ফোস করছে। যেন সুযোগ পেলেই পার্থকে ছোবল মেরে বসবে সে। আসিফ এই দৃশ্য দেখে পার্থর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,

“ ভাই। ইউ ডিজার্ভ বেটার। এই ফণা তোলা বেডি মাইনষেরে কেম্নে আমি নিজের ভাবী হিসাবে মাইন্না নিমু? “

পার্থ গরম চোখে তাকাতেই আসিফ চুপ হয়ে যায়। মনে মনে বলে,

“ মাইনষের ভালা চাওয়াই উচিত না। কেউ যদি সাইধ্যা কুমির ভর্তি খালে লাফ দেয় তাইলে আমারই বা তাতে কি করনের আছে? “

আসিফের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে পার্থ অগ্নি দৃষ্টি তরীর দিকে তাক করে বলে,

“ বিয়ে তো আপনাকে করতেই হবে। আদারওয়াইজ… “

কথাটা বলেই পার্থ নিজের পকেট থেকে একটা রিভলবার বের করে তরীর মাথায় তাক করে। মুহুর্তেই পুরো পরিবেশ ঠান্ডা হয়ে যায়। পার্থর কাছে যে লাইসেন্স প্রাপ্ত রিভলবার রয়েছে তা কারো অজানা নয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত কখনো তা ইউজ করতে দেখেনি তারা। এই প্রথম পার্থর হাতে এটা দেখে তারা সবাই-ই আতংকিত হয়ে পড়ে।

কিন্তু তরী আতংকিত হয় না। সে ক্ষিপ্ত চোখে পার্থর দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,

“ জানোয়ার বিয়ে করে নিজের জীবন ধ্বংস করার থেকে মরে যাওয়া বেশি সহজ। “

তরীর কথা শুনে পার্থ হাসে। হাসতে হাসতে সে কয়েক কদম পিছিয়ে যায়। রিভলবারটাও নামিয়ে নেয়। অত:পর বলে,

“ আপনার যে নিজের জীবনের মায়া নেই তা আপনার কর্মকান্ড দেখেই বুঝে গিয়েছিলাম আমি। কিন্তু অন্যের জীবনের মায়া নিশ্চয়ই আছে আপনার। আফটার অল ইউ আর এ ডক্টর। “

কথাটা বলেই পার্থ সেই তিনটা ছেলের মধ্যে একটা ছেলের দিকে রিভলবার তাক করে। আর বলে উঠে,

“ আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে এখানে কাজী এসে উপস্থিত হবে। যদি চুপচাপ কবুল না বলেন, আর কোনো নাটক করেন তাহলে সর্বপ্রথম আমি এই তিনজনকে আপনার চোখের সামনে মারবো আমি। অত:পর আপনার ভাইয়ের কাছে নিজের লোক পাঠিয়ে তাকে মারবো আমি। আর সবশেষে এখানে উপস্থিত সেই কাজীকেও মারবো আমি। নাও দ্যা ডিসিশন ইজ আপ টু ইউ। কি চান আপনি? পার্থ মুন্তাসির চৌধুরীর স্ত্রীর ট্যাগ চান নাকি পাঁচটা মানুষের জীবন? আই সুয়্যার, আপনি যা চাইবেন তাই হবে। ‘’

পার্থর কথা শুনে তরী থমকে যায়। ভিতরে ভিতরে পার্থর প্রতি তার ঘৃণা তীব্র থেকে তীব্রতর রূপ ধারণ করছে। এই মানুষটাকে তার ভস্ম করে দিতে মন চাচ্ছে। নিজের ভিতরের থমকে যাওয়া টুকু আড়াল করে কেবল ঘৃণাটুকু প্রকাশ করে বলে,

“ আই উইল মেক ইউ রিগ্রেট দিস ডে টিল দ্যা লাস্ট ব্রিথ অফ ইউর লাইফ। “

__________

পার্থ ফোন কাটার পর থেকে তূর্য বেশ কয়েকবার আবার কল করার চেষ্টা করে। কিন্তু ফোন এখন বন্ধ জানাচ্ছে। তূর্য ধপ করে সোফায় বসে পড়ে। মনে মনে ভাবতে থাকে পার্থর কথা। পৃথা কি গর্ব করে নিজের বড় দা’র কথা তাকে বলছিলো। মেয়েটা কি নিজের ভাইয়ের আসল রূপ সম্পর্কে অবগত নয়?

নিজের আপির চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই তূর্য শান্ত হয়ে যায়। মনে মনে নিজেকে স্থির করে। এই পরিস্থিতিতে তার এখন ঠান্ডা মাথায় যা করার করতে হবে। তূর্য কিছুক্ষণ কিছু একটা ভেবে পৃথার নাম্বারে কল করে। ফোন রিসিভ হতেই তূর্য কোনো ভনিতা না করে প্রশ্ন করে,

“ ডু ইউ ট্রাস্ট মি পৃথা? “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-০৬

0

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৬.

আকাশের এককোণে মস্ত বড় চাঁদ। নীরবে নিভৃতে একই শহরের দুই প্রান্তের দুটি মানুষের ফোনালাপ শুনতে ব্যস্ত সে। আজ আর পৃথা আচমকা ফোন কেটে দেয় নি। বরং যেচে চুপচাপ শেয়ানা মানুষটা দ্বারা কাবু হতে ব্যস্ত সে। পৃথা নিজের বিছানায় বসে একটা বিশাল টেডি বিয়ার জড়িয়ে ধরে আছে। ফোনের অপর পাশ থেকে তূর্য বলে উঠে,

“ আপনি কি রাত জাগাদের দলে নিজের নাম লেখাতে চান নাকি? “

পৃথা শান্ত শীতল স্বরে বলে,

“ এমন কেন মনে হলো? “

“ এতো রাতে কল দিলাম, অথচ আপনি জেগে ছিলেন। “

“ আমার ভাইদের সাথে ছিলাম এতক্ষণ। “

তূর্য একগাল হেসে বলে,

“ আপনার সেই পলিটিশিয়ান এবং পুলিশ ভাই? “

পৃথা লজ্জা পায়। মনে মনে ঠিক করে আর কখনো অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসলে নিজে আগে কথা বলে উঠবে না সে। কি একটা লজ্জাজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো! তূর্য হয়তো তার লজ্জা বুঝতে পারলো। তাই কথা ঘুরিয়ে সে বলে উঠে,

“ এখন তবে ঘুমোতে যাই মিস এ বি সি। কাল সকালে আমার অফিস আছে। “

পৃথা অকপটে প্রশ্ন করে বসে,

“ আপনি কালও ফোন করবেন? “

তূর্য রহস্যময় গলায় প্রশ্ন করে,

“ আপনি কি চান? “

লজ্জায় কথা পৃথার গলায় আটকে আছে। সে মুখ ফুটে লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বলতে পারে না,

“ অবশ্যই করবেন। “

কোনো জবাব না পেয়ে তূর্য নিজ থেকেই হেসে বলে,

“ বলুন তো মিস।
আপনি প্রেমিকা হতে চান না বউ? “

মেয়েদের কেসে আঠারো বয়স এবং প্রথম প্রেমে পড়া দুটোই খুব আবেগের সময়। পৃথার কেসে আঠারো বয়সেই তার জীবনে প্রথম প্রেম এসেছে। এই বয়সে কেউ ভেবে চিন্তে প্রেমে পড়ে না। এই প্রেমটা যতটা লজিকলেস হয় ততটাই মিষ্টি অনুভূতির বার্তার ন্যায় হয়। নিজের ঘরে সবসময় মুক্ত পাখির ন্যায় উড়ে বেড়ানো চঞ্চল পৃথা লাজে মুখ ফুটে তূর্যের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। চুপ রয়। তূর্য নিজেই কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলে,

“ কাল রাতে আবার কল করবে আপনার ফোনালাপের স্বামী।
আপনি নাহয় ততক্ষণ অপেক্ষা করবেন সাজিয়ে ফুলদানি। “

তূর্যের এতোটুকু কথাই অষ্টাদশীর শান্ত মনে ঝড় তুললো। অপেক্ষা নিবেদন কভু এতো মধুর হয়? হয়তো হয়। পৃথার কাছে এই অনুভূতি খুব নতুন। তাই তো তূর্য তাকে আর বেশি এলোমেলো করে দেয়না। চুপচাপ ভদ্র ছেলের ন্যায় কল কেটে দেয়।

__________

আজকে সন্ধ্যার পর একটা পেশেন্টের কেস নিয়ে কার্ডিওলোজি ডিপার্টমেন্টের ডাক্তারদের বোর্ড মিটিং বসে। সেই মিটিং শেষ হতে হতে প্রায় বেশ রাত হয়ে যায়। তরী ডিরেক্ট সার্জারি থেকে মিটিংয়ে যোগ দেওয়ায় ওর পড়নে সার্জিক্যাল ইউনিফর্ম ছিলো। এখন বাসায় ফিরার আগে নিজের কেবিনে ফিরে ড্রেস চেঞ্জ করে নেওয়ার জন্য আসে সে। কেবিনের ভিতর থেকে ডোর লক করেই তরী রুমের একপাশের একটা কেবিনেট থেকে নিজের ড্রেস বের করে নিতে থাকে। হঠাৎ কিছু একটার শব্দ শুনে সে পিছনে ফিরে তাকায়। সাথে সাথে দেখতে পায় ডক্টর রায়হানকে। তার কেবিনের পেশেন্ট চেক আপ এরিয়া এবং বাকি রুমের মাঝে একটা বিশাল পর্দা আছে। সেই পর্দার আড়ালেই এতক্ষণ রায়হান দাঁড়িয়ে ছিলো। যাকে দেখে তরীর মেজাজ ইতিমধ্যে সপ্তম আকাশে পৌঁছে গিয়েছে। সে চেঁচিয়ে উঠে,

“ এটা কোন ধরনের অভদ্রতা? আমার অনুপস্থিতিতে আমার কেবিনে প্রবেশ করার পারমিশন কে দিয়েছে আপনাকে? গেট আউট রাইট নাও। “

রায়হান তরীর দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,

“ আমি আপনার সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে এসেছি। আপনি প্লিজ ঠান্ডা মাথায় আমার কথা শুনুন। “

“ আমার আপনার সাথে জব লাইফের বাহিরে কোনো ধরনের কথা থাকতে পারে না। তাই এই মুহুর্তে বেরিয়ে যান। “

“ কথা আছে তরী। আমি আপনাকে আমার মনের কথা জানাতে চাই। “

কথাটা বলতে বলতে রায়হান তরীর ঘাড়ে হাত রাখে। সাথে সাথে তরীর পুরো শরীরে যেনো আগুন ধরে যায়। সে রাগে পা দিয়ে রায়হানের হাঁটুর জয়েন্ট বরাবর লাথি মারে। এতে রায়হান কিছুটা দূরে ছিটকে পড়ে। লাথিটা এতো জোরে লেগেছে যে তার মনে হচ্ছে তার পায়ের হাড় হয়তো ভেঙে গুড়িয়ে গিয়েছে। এই শুটকির মতো শরীরের মেয়েটার গায়ে এতো জোর কই থেকে এলো তা বুঝতে পারে না রায়হান। সে আপাতত পায়ের ব্যাথায় আর্তনাদ করতে ব্যস্ত।

রাগে থরথর করে কাপতে থাকা তরী উঁচু গলায় বলে উঠে,

“ অসভ্য, পাভার্ট কোথাকার। ইউ চুজড দ্যা রং পার্সন। তোর পার্সোনাল লাইফ আর ক্যারিয়ার আমি এখন কিভাবে শেষ করি শুধু দেখ। ঘরে বউ বাচ্চা রেখে হসপিটালে ডাক্তারির নাম করে লুইচ্চামি করতে আসোস? “

কথাটা বলেই তরী দরজা খুলে বেরিয়ে উচ্চস্বরে সিকিউরিটিকে ডাকতে থাকে। বেশ রাত হওয়ায় ওপিডি এরিয়াটায় তেমন একটা মানুষ ছিলো না। কিন্তু তরীর উচ্চস্বর শুনে মুহুর্তেই কয়েকজন ডাক্তার, নার্স এবং সিকিউরিটি এগিয়ে আসে। সকলেই তরীর কেবিনে এভাবে রায়হানকে পড়ে থাকতে দেখে তরীকে প্রশ্ন করে,

“ কি হয়েছে? “

তরী তেজী গলায় সিকিউরিটিকে উদ্দেশ্য করে বলে দেয়,

“ এই পাভার্টকে বাহিরে নিয়ে ছুড়ে ফেলেন। আর আজকের পর যদি কেউ এই ক্যারেক্টারলেসকে হসপিটালে প্রবেশ করতে দেয় তাহলে তাকে আমি দেখে নিবো। “

রায়হান যতই সিনিয়র ডাক্তার হোক না কেনো, তরী হলো হসপিটালের সিইওর মেয়ে। তার কথাই প্রাধান্য পাওয়া স্বাভাবিক। আর তাছাড়া ডক্টর রায়হানের দৃষ্টি যে খুব একটা ভালো না তা নিয়ে হসপিটালের সকলের মধ্যেই কম বেশি গুঞ্জন শোনা যায়। তাই সকলেই সহজে তরীর কথা বিশ্বাস করে নেয়।

একজন সিকিউরিটি রায়হানের দিকে এগিয়ে আসতে নিলেই রায়হান চেঁচিয়ে বলে উঠে,

“ শি ইজ লায়িং। ও শুধুমাত্র আমাকে ডিফেম করে এটেনশিন সিকিং এর চেষ্টা করছে। ক্যারেক্টারলেস যে কে তা সকলের জানা আছে। আমি একজন হ্যাপিলি ম্যারিড লোক। আর মিস তরীর অলরেডি একবার এনগেজমেন্ট ভেঙেছে। বয়স ২৭ অথচ এখনো উনার বিয়ে হয়নি। নিশ্চয়ই উনার ক্যারেক্টারেই কোনো সমস্যা আছে। তাই তো হুমায়ুন স্যারের মেয়েকে বিদায় করতে এতো কাঠখড় পোহাতে হচ্ছে। “

রায়হানের কথা যেন জ্বলন্ত পেট্রোলের মতো কাজ করে তরীর উপর। সে কিছুক্ষণ আগে রায়হানের বাম পায়ের হাঁটু বরাবর লাথি মেরেছিলো। এবার সে রায়হানের ডান হাঁটু বরাবর আরেকটা জোরে লাথি মারে। একজন নার্স দূর হতে ফিসফিসিয়ে বলে,

“ শিট। এই লোক জীবনে আর উঠে দাঁড়াতে পারবে কিনা তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। “

পাশ থেকে একজন নতুন ইন্টার্ন আগ্রহী সুরে প্রশ্ন করে,

“ এমন কেন? “

“ ডক্টর তরী ক্যারাটে জানে। উনার লাথির বেশ জোর আছে। “

তাদের কথার মাঝেই তরী আবার চেঁচিয়ে উঠে। সাথে সাথে সিকিউরিটি দৌড়ে এসে রায়হানকে টেনে হিচড়ে হসপিটালের বাহিরে নিয়ে যায়। তরী তার কেবিনের সামনে ভীড় জমানো মানুষদের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,

“ আই ওয়ান্ট টু স্টে এলোন। “

ধীরে ধীরে কেবিনের সামনে থেকে ভীড় কমে আসতেই তরী ধপ করে তার টেবিলের সামনে একটি চেয়ারে বসে পড়ে। দু মিনিট ব্রিথিং এক্সারসাইজ করে আগে নিজেকে শান্ত করে। পরপরই নিজের পাপার নাম্বারে কল করে সে এইমাত্র ঘটে যাওয়া সম্পূর্ণ ঘটনা উনাকে জানায়। সব শুনে ফোনের অপর পাশ হতে হুমায়ুন রশীদ বলে উঠেন,

“ আ’ম প্রাউড অফ ইউ মাই প্রিন্সেস। তুমি একটুও চিন্তা করো না। আই’ল টেক কেয়ার অফ দিস কেস। “

ফোন রাখতেই তরী নিজেকে হালকা অনুভব করে। এই একটা অভ্যাস তার ছোটবেলা থেকে। যেকোনো বিষয় কিংবা যেকোনো ঘটনা সে সবসময় নিজের পাপার সাথে শেয়ার করে। নাহয় মোটেও হালকা অনুভব করে না সে। হঠাৎ তরীর মনে পড়ে রায়হানের তার এনগেজমেন্ট ভাঙা নিয়ে বলা কথাটা। সবাই যা ইচ্ছা ভাবুক। তা দিয়ে তরীর কিছু আসে যায় না। সে আর তার পরিবার তো সত্যিটা জানে। এটাই তার জন্য যথেষ্ট।

__________

সবেমাত্র বাসায় ফিরেছে শোভন। লিভিং রুম পেরিয়ে উপরে যাওয়ার সময় দেখতে পায় তার পরিবারের সকলেই লিভিং রুমে উপস্থিত। শোভন চুপচাপ সালাম দিয়ে উপরে যেতে নিলেই আফজাল সাহেব বলে উঠে,

“ তুমি একা সিলেট যাবে না। আমি আর তোমার আম্মাও তোমার সাথে যাবো বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। “

শোভনের এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো সে ভুল শুনছে। সে অবাক স্বরে প্রশ্ন করে,

“ আর ইউ সিরিয়াস? “

আফজাল সাহেব মিছে রাগ দেখিয়ে বলে,

“ এই ছেলে? তোমার সাথে কি আমার রসিকতার সম্পর্ক? “

শোভন পার্থর দিকে তাকিয়ে বলে,

“ তুইও যাবি দাদা? “

“ উহু। আব্বা আম্মা শুধু যাবে এখন। আমার ব্যবসার কিছু কাজ আছে। একবার কথা বলে সব ঠিকঠাক হয়ে গেলে তো পরে আমরা আছিই। “

পৃথা লাফিয়ে শোভনের পাশে এসে বলে,

“ সিলেট থেকে ফিরেই আমাকে ছোট ভাবীর সাথে সবার আগে দেখা করিয়ে দিবি ছোট দা। “

শোভনের চোখেমুখে খুশি ফুটে উঠে। পৃথা মজা করে বলে উঠে,

“ একবার ছোট ভাবি আসুক। পরে আমরা দুজন মিলে বড় দার জন্যও বউ খুঁজে বের করবো। “

পার্থ উঠে এসে পৃথার মাথায় গাট্টা মেরে বলে,

“ খুব পেকেছিস তুই। সবার আগে তোকে বিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বিদায় করা উচিত। “

পার্থর কথা শুনে পৃথা গাল ফুলিয়ে বসে রয়। তা দেখে দুই ভাই হাসিতে মেতে উঠে। দূর হতে এই দৃশ্য দেখে আফজাল সাহেবের চেহারায় স্বস্তি ফুটে উঠে। নিজের তিন ছেলেমেয়ের খুশির থেকে মূখ্য আর কোনো কিছুই নেই উনার কাছে।

__________

আজ তরীর মনটা বেশ ফুরফুরে। সামনের সপ্তাহেই তার পাপা দেশে ফিরে আসছে। হসপিটাল থেকে বের হতেই এক দমকা হাওয়া এসে তার গায়ে লাগে। উড়িয়ে দেয় ওড়নার আচল। তরী মৃদু হেসে নিজের গাড়িতে উঠে বসে। গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার আগ মুহুর্তেই সে দেখতে পায় রাস্তার অপরপাশে সেদিনের ওই কালো রঙের গাড়িটা। তরী ভালো করে লক্ষ্য করে দেখে গাড়ির ভিতর সেদিনের একটা লোক বসা আর তার সাথে অন্য আরেকটা নতুন লোক বসা। তরী আগ্রহ ভরা দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। তখনই সে লক্ষ্য করে হসপিটাল থেকে একটা ছেলে বের হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিজের পকেট হতে ফোন বের করে কল করে কারো সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে দেয়।

তরী বুঝতে পারছে না এখানে কি হচ্ছে। কিন্তু সেই ছেলেটার দিকে গাড়ির সেই লোক দুটোর স্থির দৃষ্টি দেখে বুঝতে পারে নিশ্চিত কোনো একটা ঘ্যাপলা আছে। তরী অধৈর্য্য হয় না। চুপচাপ অপেক্ষা করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা বাইক এসে সেই ছেলেটার সামনে থামে। ছেলেটা হাসতে হাসতে সেই বাইকে উঠে পড়ে। বাইকটা চলতে শুরু করলেই সেই গাড়িটাও বাইকের পিছু পিছু চলতে শুরু করে। তরী মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় আজ সে এই ঘটনার পিছনের কাহিনী জেনেই ছাড়বে।

সে নিজেও ওই গাড়িকে ফলো করতে শুরু করে। এক হাতে ড্রাইভ করতে করতে আরেক হাতে নিজের ফোন বের করে তূর্যকে কল দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তূর্য কল রিসিভ করে। তরী ফোন স্পিকারে রেখে বলে উঠে,

“ শুন ছোট। ইম্পোর্টেন্ট কথা বলবো। মোটেও রিয়েক্ট করবি না। একটা গাড়ির নাম্বার বলছি। তাড়াতাড়ি নোট কর। “

তূর্য কেবল মাত্র বাসায় ফিরেছে। এমন সময় বোনের থেকে এই অনাকাঙ্ক্ষিত কল পেয়ে সে কিছুটা চিন্তিত হয়। ঘাবড়ে প্রশ্ন করে,

“ আপি? তুই ঠিক আছিস? “

“ অযথা প্রশ্ন করিস না তো। যা বলছি তা কর। “

তূর্য বোনের কথামতো একটা কাগজে গাড়ির নাম্বারটা তুলে। তারপর প্রশ্ন করে,

“ কি হয়েছে এখন বল। “

তরী সাবধানতার সহিত ড্রাইভ করতে করতে তূর্যকে সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বলে। তূর্য সাথে সাথে আতংকিত গলায় বলে,

“ আপি তুই কোথায়? আমাকে এড্রেস বল। আর তুই ফোলো করা বন্ধ কর। “

তরী বিরক্তিকর ভঙ্গিতে বলে,

“ আমি কিভাবে জানবো ওরা কোথায় যাচ্ছে? কিন্তু তুই আমার সাথে কলে কানেক্টেড থাক। কোনো কিছু ঘাপলা মনে হলে আমি তোকে জানাবো। “

তূর্য ফোনের অপরপাশ থেকে বোনের উপর রাগারাগি করতে থাকে। কিন্তু তরী সেটার তোয়াক্কা করে না। আচমকা সে দেখে তারা শহর ছেড়ে কিছুটা দূরে শুনশান জায়গার দিকে যাচ্ছে। বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী তরীর মনে ভূত প্রেত নিয়ে কোনো ভয় নেই। কিন্তু তার ভয় অন্য জায়গায়। সে সাথে সাথে গাড়ির সব দরজা লক করে দেয় আর গাড়ির লাইটও বন্ধ করে দেয়।

সে যথেষ্ট দূরত্ব মেইনটেইন করে গাড়িটাকে ফোলো করছে যেনো তারা কোনোভাবেই টের না পায়। আচমকা সামনের গাড়িটা সেই বাইককে পিছন থেকে হিট করে রাস্তার একপাশে ফেলে গাড়ি ব্রেক করে। এই দৃশ্য দেখে তরী তাড়াতাড়ি গাড়ি স্লো করে ফেলে নিজের।

সেই কালো রঙের গাড়িটা থেকে দুজন পুরুষ নামে। বাইকের সেই দুটো ছেলেকে বেশ কিছুক্ষণ মারধর করে তাদের দড়ি দিয়ে বেধে গাড়িতে তুলে। এই সম্পূর্ণ দৃশ্যটা তরী নিজের ফোনে রেকর্ড করে। তূর্যর কলটা কেটে দিয়ে সে এই ভিডিওটা তূর্যকে সেন্ড করে আর নিজের ফোন সাইলেন্ট মুডে দিয়ে দেয়।

কালো রঙের গাড়িটা আবার চলতে শুরু করে। তরীও নীরবে সেই গাড়ি ফোলো করতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে দেখে ওই গাড়িটা একটা প্রাইভেট প্রোপার্টি জাতীয় এরিয়ায় প্রবেশ করছে। তরী নিজের গাড়ি দূরেই একটা ঝোপের আড়ালে পার্ক করে। দূর হতে সে ভ্রু কুচকে সেই প্রাইভেট প্রোপার্টির ভিতরের সুউচ্চ দালানটা দেখতে থাকে। এটা তো একটা আন্ডার কন্সট্রাকশন বিল্ডিং। এখানে এই লোক গুলোর কি কাজ?

তরী আয়াতুল কুরসি পড়ে বুকে ফু দিয়ে গাড়ি থেকে নামে। সাথে করে নিজের ফোনটা নিতে ভুলে না। শব্দহীন ভঙ্গিতে পা ফেলে সে ওই প্রাইভেট প্রোপার্টির ভিতর প্রবেশ করে। লোক দুটো ওই ছেলে দুটোকে ধরে বেধে বিল্ডিংয়ের ভিতর নিয়ে যাচ্ছে। তরী নিজেকে যথাসম্ভব আড়াল করে তাদের অনুসরণ করতে থাকে।

দ্বিতীয় তলায় উঠতেই ছেলে দুটোকে ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দেয় তারা। চারিদিকে দেয়ালহীন হওয়ায় শা শা বাতাস এসে তরীর গায়ে লাগছে। সে আড়াল হয়ে সিঁড়িকোঠার এখানেই দাঁড়িয়ে রয়। ভ্রু কুচকে বুঝার চেষ্টা করছে এখানে চলছে কি।

মাঝখানে একটা হলদে রঙের বাল্বের আলোতে চারিদিকটা তেমন স্পষ্ট নয়। সেই আলোর নিচেই অপরদিকে ফিরে চেয়ারের উপর বসে আছে একজন পুরুষ। তার আশেপাশে বেশ কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। তরী নিজের ফোন অন করে সম্পূর্ণ দৃশ্যটা রেকর্ড করতে থাকে। আচমকা সে একপাশে সেদিনের ওই বাইকের ছেলেটাকে দেখে অবাক হয়। তাকেও একই ভঙ্গিতে বেধে রাখা হয়েছে।

তিনটা ছেলে হাত পা বাধা অবস্থা হতে মুক্তি পাওয়ার জন্য ছোটাছুটি করছে। ইনিয়ে বিনিয়ে মাফও চাইছে। কিন্তু কেউই তাদের কথা কানে তুলছে না। তখনই সেখানে একটা লোক বলে উঠে,

“ শু’রের পোলা গুলারে ধইরা আনসি ভাই। “

চেয়ারে বসা লোকটা বেশ শান্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ায়। একহাতে নিজের ঘাড়ের একপাশে কিছুটা ম্যাসাজ করে পিছনে ফিরে তাকায়। লোকটাকে দেখতেই তরীর সম্পূর্ণ শরীর জমে যায় পাথরের ন্যায়। ঘৃণায়, রাগে তার সারা শরীর কাঁপতে থাকে। অস্ফুটে বলে উঠে,

“ স্ক্রাউন্ডেল। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-০৫

0

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৫.

মেরুন রঙের একটি সুতির থ্রি পিস পরিহিত নারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি পলাশী মোড়ের পরিচিত এক চায়ের দোকানে বসে রয়েছে। বিকেলের এই আবহাওয়াটা তার খুব প্রিয়। বছরের যেকোনো ঋতুই হোক না কেন বিকেল বেলার এই প্রশান্তিদায়ক অনুভূতিটা সবসময় একই থাকে। ইউনিফর্ম পরিহিত পুরুষটা তার পাশে এসে বসেই সবার আগে তার ওড়নার আচল টেনে নিজের ঘর্মাক্ত মুখটা মুছে নেয়। পরপরই ক্লান্ত গলায় বলে উঠে,

“ বুঝলে মধু, ডিসিশন ফাইনাল। হবু শশুড় আব্বা যদি তোমাকে আমার হাতে তুলে না দেয় তাহলে নিজেই তোমাকে তুলে নিয়ে যাবো। পুলিশ মানুষ বলে কথা। এইটুকু সাহসিকতা না দেখালে বুড়ো বয়সে নাতি নাতনিদের শোনানোর জন্য গল্প খুঁজে পাবো না। “

মধুমিতা নিজের হাতের ছোট হ্যান্ড ফ্যানটা শোভনের মুখের দিকে ধরে। ঘেমে নেয়ে মানুষটা একাকার। বিচলিত গলায় বলে,

“ এতো ঘেমে গেলে কিভাবে? “

“ রাস্তার মাঝে জ্যাম লেগেছিলো। অপেক্ষা করলে আগামী এক ঘন্টায়ও এসে পৌঁছাতে পারতাম না। তাই গাড়ি একপাশে পার্ক করে দৌড়ে এসেছি। “

মধুমিতা নিজের টোটে ব্যাগ থেকে একটা পানির বোতল বের করে শোভনের দিকে এগিয়ে দেয়। শোভন বিনা বাক্যে সেই বোতল নিয়ে অর্ধেকটা পানি খেয়ে নেয়। পরপর নিজের হাতের শপিং ব্যাগ থেকে একটা টিফিন বক্স বের করে মধুমিতার হাতে দিয়ে বলে,

“ তোমার শাশুড়ি মা স্পেশাল কাচ্চি। “

মধুমিতা বিনাবাক্য ব্যয়ে সামান্য পানি দিয়ে হাত ধুয়ে বক্সের ঢাকনা খুলে এক লোকমা বিরিয়ানি তুলে শোভনের দিকে ধরে। শোভন চুপচাপ সেই লোকমা মুখে নিয়ে বলে,

“ আম্মার রান্না আর তোমার হাতে খাওয়ার সৌভাগ্য ইজ দ্যা বেস্ট কম্বিনেশন। “

নিজের মুখেও এক লোকমা নিয়ে মধুমিতা বলে উঠে,

“ আন্টির মতো এতো অথেনটিক টেস্ট আসে না আমার রান্না করা কাচ্চিতে। “

শোভন মৃদু হেসে বলে,

“ আম্মা পুরান ঢাকার মেয়ে। উনাকে কাচ্চি রান্নায় হারাতে পারবে না জীবনে। “

মধুমিতা সামান্য হেসে কথার ফাঁকে ফাঁকে শোভনকে খাইয়ে দিতে ব্যস্ত। আচমকা সে প্রশ্ন করে,

“ এরকম মিডেল ক্লাস স্টাইলে প্রেম করতে কি তুমি কখনো বিরক্তবোধ করো না? “

শোভন হেসে শুধায়,

“ আমার কাছে তিক্ততা মেটানোর জন্য মধু আছে। মধুর সাথে কাটানো প্রতিটা মুহুর্ত এবং মধু সম্পর্কিত প্রতিটা বিষয়ই আমার মধুময় মনে হয়। “

__________

রাতের দিকে পরিবারের সবাই যখন বাড়িতে উপস্থিত তখন তিন ছেলেমেয়েকেই লিভিং রুমে ডেকে পাঠান আফজাল সাহেব। পার্থ, শোভন, পৃথা তিনজনই এই মুহুর্তে আফজাল সাহেবের মুখোমুখি সোফায় বসে আছে। সাদিকা বেগমও একপাশে নীরব দর্শকের ন্যায় বসে আছে। সবার প্রথম আফজাল সাহেব মুখ খুলেন,

“ মেয়েটার পরিবার সম্পর্কে বলো। “

কথাটা যে শোভনকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে তা সবাই বুঝতে পারে। শোভন ভদ্র ছেলের ন্যায় জবাব দেয়,

“ আংকেল সিলেটের একটি প্রাইমারি স্কুলের টিচার। আন্টি হাউজ ওয়াইফ। আর ওর বড় বোন ম্যারিড। “

মধুমিতার পারিবারিক বিবরণে যে আফজাল সাহেব খুব একটা সন্তুষ্ট না তা উনার মুখশ্রী দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। তবুও উনি আবার প্রশ্ন করে,

“ মেয়ে কি করে? “

“ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী। “

আফজাল সাহেব আরো একবার চোখমুখ কালো করে ফেলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শুনে কিছুটা ভালো মনে হলেও সাবজেক্টটা উনার মোটেও পছন্দ হয়নি। উনি মুখ কিছুটা বিকৃত করে বলে,

“ এই মেয়ে কোথায় পেলো তোমাকে? “

শোভনের সোজাসাপ্টা জবাব,

“ মধু আমাকে পায় নি বরং আমি ওকে পেয়েছি। ওর জন্য আমার থেকেও আরো বেটার অপশন ছিলো কিন্তু আমি কৃতজ্ঞ যে ও আমার ভালোবাসা গ্রহণ করেছে। আমাকে অপশন নয় বরং প্রায়োরিটি হিসেবে ট্রিট করে ও। “

পৃথা দুই ভাইয়ের মাঝে বসে গালে হাত দিয়ে নিজের ছোট দা’র কথা শুনতে ব্যস্ত। ঠোঁটের কোণে লেপ্টে সুদীর্ঘ হাসি। এসব বিষয়ে তার আগ্রহ বরাবরই বেশি৷ আফজাল সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

“ আমাদের সাথে এই মেয়ের ফ্যামিলি স্ট্যাটাস যায় না। “

শোভন শব্দ করে হেসে উঠে। পরপর বলে,

“ আপনার এই হাই ক্লাস সোশ্যাল ইমেজের সাথে তো আমার জবটাও যায় না আব্বা। আপনি কিভাবে ভাবলেন যেই ছেলে জবের ক্ষেত্রেই আপনার কথা মানেনি, সে নিজের লাইফের এতো গুরুত্বপূর্ণ একটা ডিসিশনে আপনার অপিনিয়নের তোয়াক্কা করবে? “

আফজাল সাহেব রাগে গর্জে উঠে।

“ তোমার জীবনে কি আমার অপিনিয়নের কোনো ভ্যালু নেই? “

“ অবশ্যই আছে। তবে আপনার ভুলভাল অপিনিয়নকে আমি কখনো ফাইনাল ডিসিশন হিসেবে মেনে নিবো না। “

কথাটা বলেই শোভন উঠে চলে যেতে নিয়েও ফিরে তাকায়। শান্ত গলায় বলে,

“ সামনের সপ্তাহে আমি সিলেট যাচ্ছি মধুর ফ্যামিলির সাথে দেখা করতে। উনাদের রাজি করিয়ে বিয়েটা তো আমি অবশ্যই করবো। কিন্তু আপনারা কি করবেন সেটা আপনাদের ডিসিশন। মধুকে মেনে নিতে যদি আপনাদের জাত যায় দ্যান আই হ্যাভ নো প্রব্লেম। আমি আমাদের থাকার জন্য আলাদা ব্যবস্থা করবো। “

কথাটুকু শেষ করেই শোভন বড় বড় কদম ফেলে সেখান থেকে প্রস্থান করে। আফজাল সাহেব স্তব্ধ মূর্তির ন্যায় বসে আছেন। সাদিকা বেগম আঁতকে বলে উঠেন,

“ পার্থর আব্বা? আমার ছেলে ঘর ছেড়ে গেলে কিন্তু আমি মরে যাবো। “

আফজাল সাহেব নিরুত্তর বসে রয়। পার্থ এতক্ষণে নীরবতা ভেঙে বলে,

“ আপনাকে আমি সম্মান করি আব্বা। কিন্তু শোভন ইতিমধ্যে অনেকটা দূরে চলে গিয়েছে আমাদের থেকে। ওকে আর দূরে ঠেলে দিয়েন না। মধুমিতা এই ঘরের বউ হয়ে আসলে আমাদের সম্মান যাবে না, বরং ঘরের ছেলে এবং ছেলের বউ ঘর ছেড়ে গেলে আমাদের আর কোনো সম্মান থাকবে না। বিষয়টা ভেবে সিদ্ধান্ত নিবেন। “

কথাটা বলেই পার্থ উঠে উপরে চলে যায়। পৃথাও ভাইয়ের পিছু পিছু নিজের রুমের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। বিশাল লিভিং রুমে রয়ে যায় কেবল আফজাল সাহেব এবং সাদিকা বেগম। সাদিকা বেগম উঠে এসে আফজাল সাহেবের পাশে বসে। ছলছল চোখ মেলে বলে,

“ আমার পয়ত্রিশ বছরের তিলে তিলে সাজানো সংসার আপনার এই সামান্য জিদের জন্য তছনছ করে দিয়েন না পার্থর আব্বা। যেই সোশ্যাল স্ট্যাটাসের আপনি অযুহাত দেখাচ্ছেন সেই সোশ্যাল স্ট্যাটাস দেখে আমি আপনাকে বিয়ে করি নি। আমি যখন আপনাকে বিয়ে করি তখন এসব কিছুই ছিলো না আপনার। বহু বছর আগে আমার আব্বা যেই কারণ দেখিয়ে আমাদের বিয়েতে বাধা দিয়েছিলো, আপনিও সেই একই কারণ দেখিয়ে নিজের ছেলেকে দূরে যেতে বাধ্য করবেন না। “

আফজাল সাহেব কোনো জবাব দেন না। তিনি নীরবে উঠে প্রস্থান করেন।

__________

পার্থর রুমটা মূলত দুই রুম বিশিষ্ট। দোতলার বাম পাশের তৃতীয় ঘরটাতে ঢুকতেই প্রথমে একটা মোটামুটি লিভিং রুমের মতো রুম লক্ষনীয়। সেই লিভিং রুমের একপাশের দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলে পার্থর বেডরুমে যাওয়া যায়। এরকম ধরনের রুম সেটাপের পিছনে একটা কারণও আছে বটে। পার্থর সাথে কেউ দেখা করতে এলে সে বাহিরের সেই লিভিং রুম পর্যন্তই আসার অনুমতি পায়। নিজের বেডরুমে বাহিরের কারো প্রবেশ তার কখনোই পছন্দের না। তার দলীয় কেউ আসলেও তার সাথে নিজের প্রয়োজনীয় আলাপটুকু পার্থ ওই লিভিং এরিয়াটুকুতেই বসে সেড়ে নেয়।

রাতের মধ্য প্রহর। দরজার ঠকঠক শব্দে পার্থ চোখ মুখ কুচকে উঠে বসে। সবসময় ফর্মাল গেটাপে থাকা সে আপাতত একটা টি-শার্ট এবং ট্রাউজার পড়ে এলোমেলো চুল নিয়ে দরজা খুলতে উদ্যত হয়। নিজের বেডরুম পেরিয়ে পার্সোনাল লিভিং রুমের দরজাটা ভিতর থেকে খুলে দিতেই দরজার সামনে পৃথার হাসি হাসি মুখটা দেখে সে বোকা বনে যায়। রাত ২ টা ২৪ বাজে তার ছোট বোনের তার কাছে কি কাজ তা সে বুঝতে পারছে না। সে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

“ কি হয়েছে? এতো রাতে করে না ঘুমিয়ে এখানে কি করছিস? “

পৃথা কোনো জবাব না দিয়ে বড় ভাইয়ের হাত ধরে নিজের সাথে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলে উঠে,

“ তুই এখন আমার সাথে যাবি। “

“ কিন্তু কোথায়? “

“ গেলেই দেখতে পারবি। “

অগ্যতা পার্থ আর কোনো প্রশ্ন না করে বোনের সাথে যেতে থাকে। দুজনে একসাথে রান্নাঘরে প্রবেশ করতেই দেখতে পায় শোভন অলরেডি কিচেন কেবিনেটের একপাশে দাঁড়িয়ে ক্যাপসিকাম কাটতে ব্যস্ত। পার্থ ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

“ কি করছিস শোভন? “

পৃথা নিজেই জবাব দিয়ে বলে উঠে,

“ ছোট দা ক্যাপসিকাম কাটছে। আর তুমি এখন চিকেন কাটতে লেগে পড়ো। “

শোভন অসহায় মুখ করে পার্থর দিকে তাকিয়ে আছে। তাকে দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে তাকেও এইমাত্র ঘুম থেকে টেনে তুলে আনা হয়েছে। পার্থ হাই তুলতে তুলতে প্রশ্ন করে,

“ কিন্তু ক্যাপসিকাম আর চিকেন দিয়ে তুই কি করবি? “

“ সারপ্রাইজ। আমার তরফ থেকে মিড নাইট পিজ্জা পার্টি ফর ইউ গাইস। আমাকে থ্যাংকস বলার কোনো প্রয়োজন নেই। “

পার্থ আর শোভন দুজনেই চোখমুখ কুচকে পৃথার দিকে তাকিয়ে আছে। পার্থ বলে,

“ তোর পিজ্জা খেতে মন চাইলে অর্ডার দিয়ে খা। আমাদের ডেকে তুলছিস কেন? “

পৃথা নিজের মাথা চাপড়ে বলে,

“ ওহ গড বড় দা! আমার বাসায় যখন আগে থেকেই দুজন ওয়ার্ল্ড ক্লাস শেফ হাজির আছে, তখন আমি শুধু শুধু মাঝরাতে অন্য মানুষদের কেন বিরক্ত করবো? “

শোভন বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে উঠে,

“ ভেজিটেবল আর চিকেন কাটবো আমরা। পিজ্জার টপিংস সাজাবো আমরা। পিজ্জা বেকও করবো আমরা। আর পার্টি তোর তরফ থেকে? এটা কেমন হিসাব? “

“ সেসব তোমরা বুঝবে না। আপাতত তাড়াতাড়ি নিজেদের কাজ করো তোমরা। “

যতই বিরক্ত হোক না কেন, আদরের বোনের আবদার ফেলার সাধ্যি নেই দুই ভাইয়ের। তাই দু’জনই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে চপিং বোর্ডে পিজ্জার টপিংস কাটতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পৃথা হাসি হাসি মুখে একপাশে কেবিনেটের উপর বসে পা ঝুলাতে ব্যস্ত। হাতে থাকা নিজের সেলফোনে একটা হিন্দি গানও প্লে করতে ভুলে না সে। শোভন আচমকা প্রশ্ন করে,

“ বাই দ্যা ওয়ে। হঠাৎ করে তোর এই মিড নাইট পার্টির পিছনে কারণ কি? “

“ কারণ তো তিনটা আছে। প্রথমটা হলো যে আমার এতো ভালো একটা রেজাল্ট এসেছে। দ্বিতীয়টা হলো তুই খুব শীঘ্রই বিয়ে করতে যাচ্ছিস। আর তৃতীয়টা হলো বড় দা ও খুব শীঘ্রই ইলেকশনটা জিতে যাবে। “

পার্থ ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

“ তুই কিভাবে শিওর যে আমি ইলেকশন জিতবো? “

পৃথা গুরু মাতার মতো মুখের ভাবমূর্তি করে বলে উঠে,

“ আই ক্যান ফিল ইট বড় দ্যা। আমার ইনার ফিলিংস বলছে খুব শীঘ্রই আমাদের লাইফে চেঞ্জেস আসতে চলেছে। “

পৃথা কথা বলতে বলতে শোভন আর পার্থ একটা পিজ্জা সাজিয়ে সেটা ওভেনেও দিয়ে দেয়। অত:পর পার্থ খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে,

“ কিন্তু তোর পার্টি খুব বোরিং। মোটেও জমে নি। “

পৃথা ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

“ আমার কি এখন পার্টি জমানোর জন্য সাউন্ড বক্সে গান প্লে করা উচিত? “

পার্থ শোভনের দিকে তাকিয়ে বাকা হাসে। শোভনও মৃদু হেসে শুধায়,

“ উহু। আমাদের কাছে তার থেকেও বেটার অপশন আছে। “

কথাটুকু বলেই শোভন হাত ভর্তি এক মুঠো আটার গুড়ো পৃথার দিকে ছুড়ে মারে। আকস্মিক ঘটনায় পৃথা হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রয়। তার চুল মুখ সব আটায় একদম সাদা হয়ে গিয়েছে। তাকে দেখে শোভন হাসতে হাসতে বলে উঠে,

“ পারফেক্ট। একদম তেঁতুল গাছের ভূতনি লাগছে তোকে। “

শোভনের হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। আচমকা তার দিকেও একমুঠো আটার গুড়ো নিক্ষেপ করা হয়। পার্থ এবার হাসতে হাসতে বলে উঠে,

“ এখন মানাচ্ছে তোদের। একদম ভূত আর ভূতনি। “

শোভন আর পৃথা দুজনেই একে অপরের দিকে তাকায়। পরমুহুর্তেই দুজনে নিজেদের দুহাত ভর্তি আটা নিয়ে পার্থর দিকে তেড়ে আসে। আত্মরক্ষার জন্য পার্থ সম্পূর্ণ রান্নাঘর জুড়ে দৌড়ানো শুরু করে। কিন্তু বেশিক্ষণ পালাতে পারে না। পিছন থেকে শোভন আর সামনে থেকে পৃথা এসে ঘিরে ধরে তাকে। দুজনই একসাথে তাকে জাপ্টে ধরে তার সারা মুখে আটা মেখে দেয়। তিন ভাই বোনের এই অমূল্য মুহুর্ত চলে বেশ অনেকক্ষণ। তিনজনেই একসাথে জগতের সকল চিন্তা ভুলে বসে।

__________

ঘড়িতে কয়টা বাজে সেদিকে খেয়াল নেই তূর্যর। সে কফির মগ হাতে ঘরময় পায়চারি করতে ব্যস্ত। মনে মনে ভাবছে এক অদ্ভুত জিনিস। সেই মিস এ বি সি তথা পৃথা নামক মেয়েটা আজ রাতে আর তাকে কল করলো না কেন? গত দু’দিনে কি বেশ লজ্জা দিয়ে ফেলেছে সে? তূর্যর কি উচিত ছিলো বোকা, সহজ সরল মেয়েটার সামনে নিজেও বোকা সাজা? উহু। তাহলে তো মোটেও ঠিক হতো না। সেই অষ্টাদশীর জানা উচিত যে সে যাকে এপ্রোচ করছে সেই মানুষটা তার ভাবনার মতো এতোটা বোকা নয়। সেদিন কলেজে মেয়েটার তার দিকে চঞ্চল দৃষ্টি তূর্য লক্ষ্য করেছিলো। তার কেন জানি মনে হচ্ছিলো মেয়েটা তার প্রতি আগ্রহী। তার ধারণা ঠিক হয়। আগ্রহী মেয়েটা পরপর দুদিন তাকে কল করে নিজের আগ্রহ প্রকাশ সরূপ। প্রথম দিন কল করে যখন সেই অদ্ভুত প্রশ্ন করে বসে পৃথা তখন তূর্য নীরবে বেশ ক্ষাণিকক্ষণ হেসেও ছিলো।

এসব ভাবতে ভাবতেই তূর্য নিজের ফোন হাতে নেয়। তার দুটো সিম আছে ফোনে। একটা জবের জন্য ইউজ করে। আরেকটা পার্সোনাল ইউজের জন্য রয়েছে। পৃথা সেদিন যেই নাম্বারে কল দিয়েছিলো সেটা তার অফিশিয়াল নাম্বার ছিলো। তাই আজ সে নিজের পার্সোনাল নাম্বার থেকে কল করে পৃথাকে। কিছুক্ষণ কল বাজার পরই কল রিসিভ হয়। অপরপাশ থেকে একটি চঞ্চলতায় পূর্ণ স্বর বলে উঠে,

“ যদি অন্য কারো উদ্দেশ্যে কলটা হয়ে থাকে তাহলে সরি রং নাম্বার। আর যদি আমাকে ডিস্টার্ব করার উদ্দেশ্যে কলটা হয়ে থাকে তাহলে আমার এক ভাই পুলিশে আরেক ভাই পলিটিক্সে জড়িত। একদম মেরে তক্তা বানিয়ে দিবে। “

“ যদি বলি কলটা আপনার তথাকথিত স্বামীর তরফ থেকে আপনার খোঁজ নেওয়ার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে? “

পৃথার চঞ্চল কণ্ঠস্বর মুহুর্তেই শীতল হয়ে গেলো। সে কম্পিত সুরে প্রশ্ন করে,

“ কে? “

“ কে আর? আপনার ফোনালাপের স্বামী। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-০৪

0

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪.

তরী যখন হসপিটাল থেকে বের হয় তখন মাথার উপর রুটির ন্যায় গোলাকৃতির চাঁদটা নিজের সোনালী আভা চারিদিকে ছড়াতে ব্যস্ত। আজকে লাস্ট মোমেন্টে ডক্টর রায়হানের আদেশে ইমার্জেন্সি একটা সার্জারি এসিস্ট করতে হয়েছে তার। সারাদিনের ক্লান্তি তার চোখে মুখে ফুটে আছে। নীরব পায়ে পার্কিং ধরে হেঁটে নিজের নীল রঙা গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় সে। হ্যান্ড পার্স থেকে কার কি খুঁজে বের করতে করতেই তার চোখ পড়ে রাস্তার অপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাইভেট কারটার দিকে।

তরী ভ্রু কুচকে গাড়ির ভেতর ফ্রন্ট সিটে বসে থাকা ছেলে দুটোর দিকে ক্ষানিকক্ষন তাকিয়ে রয়। তার মনে হচ্ছে এই ছেলে দুটোকে সে আগেও কোথাও দেখেছে। অসভ্য মস্তিষ্ক এই মুহুর্তে তা মনে করতে পারছে না। তরী আপাতত মনে করার চেষ্টা বাদ দেয়। সে সূক্ষ্ম চোখে ছেলে দুটোর দৃষ্টি পরখ করে। হসপিটালের মেইন গেটের দিকেই তাদের দৃষ্টি স্থির।

ফোনের রিংটোনের শব্দে তরীর মনযোগ ভাঙ্গে। ব্যাগ থেকে গাড়ির চাবি এবং ফোন দুটোই বের করে হাতে নেয় সে। কল রিসিভ করে আবার সামনের দিকে দৃষ্টি রেখেই সে বলে উঠে,

“ হ্যাঁ ছোট। “

তূর্য সামান্য চিন্তিত গলায় বলে,

“ আপি, বের হয়েছিস? আমি পিক করতে আসবো তোকে? “

তরী সামান্য শাসিয়ে বলে,

“ আমি গুনে গুনে তোর থেকে ২ বছরের বড়। একদম আমার বড় ভাই সাজতে আসবি না। “

তূর্য বিরক্তিকর গলায় বলে,

“ রাত ১২ টা ১৮ বাজে। সেজন্যই তোকে তূর্য পিক আপ সার্ভিসের অফার করছিলাম। নাহয় আমার এছাড়াও বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে করার মতো। “

“ আই এম এন ইন্ডিপেন্ডেন্ট এডাল্ট ওমেন ছোট। আই নো মাই ওয়ে ব্যাক টু হোম। যদি কিছু করতে চাস তাহলে পাস্তা বেক কর। আই এম সো হাংরি। “

কথাটা বলতে বলতেই তরীর দৃষ্টি যায় হসপিটাল থেকে বেরিয়ে বাইকে উঠে বসা একটা ছেলের দিকে। ছেলেটা বাইক স্টার্ট দিতেই সে গাড়িটা সেই বাইকের পিছু পিছু স্টার্ট দেয়। তরীর সতর্ক মস্তিষ্ক সাথে সাথে কিছু একটা আঁচ করে। সে গাড়িতে উঠে বসতে বসতে তূর্যকে বলে উঠে,

“ তোর যেহেতু এতো চিন্তা হচ্ছে তাহলে ফোন কাটিস না। ফোন স্পিকারে রেখে রান্না করতে থাক। আমি গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছি। “

তূর্য অপরপাশ থেকে বলে,

“ ওকে ওকে। “

তরী গাড়ি স্টার্ট দিয়েই সাথে সাথে সেই গাড়িকে ফলো করা শুরু করে। মূলত সে একটা মিথ্যে অযুহাত দেখিয়ে ইচ্ছে করেই তূর্যকে কলে রেখেছে। কোনো ব্যাক আপ ছাড়া অপরিচিত একটা গাড়িকে ফলো করার মতো বোকা নয় সে।

কিছুদূর যেতেই তরীর সন্দেহ সত্যি হয়। ওই গাড়িটা আসলেই ওই বাইকটাকে ফলো করছে। কিন্তু কারণ কি হতে পারে? তরী ড্রাইভিং করার মাঝেই টুকটাক হুম হা বলে তূর্যের কথার প্রতুত্তর করে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই তার গাড়ির সামনে একটা রিকশা এসে পড়তেই সে গাড়ির স্পিড কমিয়ে ফেলে। চোখের পলকেই সে ওই বাইক এবং গাড়ি দুটোকেই হারিয়ে ফেলে। বিরক্ত ভঙ্গিতে তরী নিজের বাসার রাস্তায় গাড়ি ঘুরায়। মাথায় তার ঘুরতে থাকে এতক্ষণের ঘটনাটা। ক্রাইম রিলেটেড কোনো ঘটনা না তো?

__________

“ আমি একটা মেয়েকে পছন্দ করি। “

সকাল সকাল খাবার টেবিলে শোভনের বলা কথায় যেন একটা ছোট খাটো বিস্ফোরণ ঘটে গেলো। পৃথা প্রবল আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করে,

“ মেয়েটা কে রে ছোট দা? কোথায় পেয়েছিস? পরিচয় কতদিনের? সে-ও কি তোর মতো পুলিশে? “

সাদিকা বেগমেরও বেশ আগ্রহ দেখা গেলো। তিনি শান্ত মন্ত সুরে প্রশ্ন করেন,

“ নাম কি মেয়েটার? “

শোভন বেশ শান্ত গলায় জবাই দেয়,

“ মধুমিতা হায়দার। “

পার্থ এতক্ষণে নীরবতা ভেঙে বলে,

“ পছন্দ করিস ভালো কথা। বিয়ে করতে চাচ্ছিস? “

“ বিয়ে করার ইনটেনশন না থাকলে নিশ্চয়ই আমি ওর কথা তোমাদের জানাতাম না। তাই না? “

ছোট ভাইয়ের সামান্য বাকা কথায় পার্থর মাঝে তেমন একটা ভাবান্তর দেখা গেলো না। সে আপনমনে খেতে খেতে জবাব দেয়,

“ বিয়ে করতে চাইলে মেয়ের পরিবারের সাথে কথা বল। বড়দের পারমিশন চেয়ে দেখ। দিলে দিবে আর না দিলে আমাকে জানাবি। মেয়ে তুলে কাজি অফিসে তোর কাছে সহি সালামতে পৌঁছে দিবো। “

পার্থর এহেন কথায় আফজাল সাহেব হতভম্ব। উনার খাবার গলায় আটকে কাশি উঠে গিয়েছে। সাদিকা বেগমও বোকার ন্যায় তাকিয়ে আছে। তাদের আশ্চর্যের পরিমাণ আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে শোভন বলে উঠে,

“ তা নিয়ে তোমার চিন্তা না করলেও চলবে দাদা। প্রেম যেহেতু করতে পেরেছি, তুলে নিয়ে বিয়ে করাটাও সেহেতু অসম্ভব না আমার দ্বারা। “

দুই ভাইয়ের কথা শুনে পৃথা বেশ মজা পাচ্ছে। তার ভাইদের এই ডেয়ারিং এটিটিউডটা তার বেশ পছন্দের। সে খুশিতে গদগদ হয়ে বলে,

“ ছোট দা, কেউ না মানলেও আমি কিন্তু তোর পাশে আছি। আমাকে না জানিয়ে কিন্তু কিছু করবি না। “

ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিজের গলাটা ভিজিয়ে নেয় আফজাল সাহেব। পর মুহুর্তেই হুংকার ছেড়ে বলে উঠে,

“ আমি এখানে উপস্থিত আছি সেই খেয়াল কি কারো আছে? “

শোভন নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দেয়,

“ তোমার ছেলেরা অন্ধ না আব্বা। ৮২ কেজি ওজনের তুমি আমাদের দৃষ্টিগোচর নও। “

আফজাল সাহেব আবার ধমকে বলে উঠে,

“ এই ছেলে। পুরো জীবন তোমাদের বয়স স্কুলে পড়িয়েছি যেনো কোনো মেয়ে জাতীয় বিষয়ে জড়িয়ে না পড়ো তোমরা। আর এখন পরিপূর্ণ বয়সে এসে কিনা দুই ভাই মিলে আরেক বাড়ির মেয়ে তুলে আনার পরিকল্পনা করছো? বলি মাথাটা কি গেছে তোমাদের? বাসায় কি মা বোন নেই তোমাদের? “

পার্থ এই পর্যায়ে বলে উঠে,

“ আমাদের বাসায় মা-ও আছে এবং বোন-ও আছে। সেজন্যই সসম্মানে একটা মেয়েকে এই বাড়ির বৌ করে আনার প্ল্যান করছি। আর বিয়ে করা তো কোনো অপরাধ নয়। উল্টো আ’ম প্রাউড অফ শোভন। ও তোমাদের কষ্ট হবে ভেবে নিজেই মেয়ে পছন্দ করে নিয়েছে। “

শোভন খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

“ আই হ্যাভ টু গো নাও। আল্লাহ হাফেজ। বাকি কথা রাতে হবে। “

পার্থও পরপর বলে উঠে,

“ আমারও কাজ আছে। রাতে এসে কথা হবে। “

খাবারের টেবিলে রয়ে যায় কেবল পৃথা, আফজাল সাহেব এবং সাদিকা বেগম। আফজাল সাহেবের মাথা দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। উনি রাগী সুরে সাদিকা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

“ পার্থর মা? তুমি নিশ্চিত এই দুটো আমারই ছেলে তো? হসপিটালে অন্য কারো সাথে আমাদের বাচ্চা চেঞ্জ হয়ে যায় নি তো? এরকম বেপরোয়া ছেলে কখনোই আমার হতে পারে না। আমি কখনো আমার আব্বার দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহসও করতাম না। “

সাদিকা বেগম কি জবাব দিবে খুঁজে পায় না। তার ছেলে দুটো খুবই ভদ্র শান্ত। মাঝেমধ্যে দু চারটে ত্যাড়া কথাবার্তা বলে। এই যা! পৃথা কথার মাঝে ফোঁড়ন কেটে বলে,

“ আব্বা, তুমি কিন্তু একটা বিষয় ভুলে যাচ্ছো। “

আফজাল সাহেব চোখ ভাজ করে প্রশ্ন করে,

“ কি? “

“ তুমি আর আম্মাও কিন্তু নানাজানের মতের বিপক্ষে গিয়ে পালিয়ে বিয়ে করেছিলে। “

কথাটা বলেই পৃথা আর এক দন্ড অপেক্ষা করে না। সাথে সাথে সেখান থেকে কেটে পড়ে। মেয়ের মুখে এই কথা শুনে আফজাল সাহেবের মুখটা চুপসে যায়। তিনি সাদিকা বেগমের দিকে চোখ পাকিয়ে বলে,

“ ছেলে মেয়েদের আরো নিজের বিয়ের গল্প শুনাও। দেখলে? শশুড় আব্বা এতদিন কম ছিলো? এখন নিজের মেয়েও এই কথা বলে খোঁচা মারে। “

সাদিকা বেগম কোনো জবাব দেয় না। কিন্তু আড়ালে একগাল হাসতেও ভুলেন না তিনি।

__________

“ আপনার এই ব্যাথাটা ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছে? “

তরীর প্রশ্নের পিঠে তার সামনে বসে থাকা পঞ্চাশোর্ধ মহিলাটি দুখী দুখী মুখ করে বলে উঠে,

“ আমার ভাইটা মারা যাওয়ার দু সপ্তাহ আগে থেকেই খালি এভাবে বুকে চিপ দিয়ে ধরতো থেকে থেকে। আমার সারাদিন মনে হতো কোনো কুলক্ষণে সংকেত এটা। হলো ও তাই। ঠিক দুই সপ্তাহ পরেই আমার ভাইটা মারা যায়। আমি তখন নিশ্চিত হয়ে গিয়েছি যে আমার ভাই মারা যাবে তা আগে থেকেই আমার মন জেনে গিয়েছিলো। এজন্যই তো থেকে থেকে এমন ব্যাথা হয় শুধু। “

ভদ্রমহিলার এতো অপ্রয়োজনীয় উত্তর শুনে তরী হতাশ হয়। এরকম ঘটনা আজ নতুন নয়। ইন্টার্নশিপের শুরু থেকে, জব লাইফের গত এক বছরে এরকম বহু অদ্ভুত অদ্ভুত পেশেন্টের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়েছে। এদের প্রশ্ন করা হয় একটা এবং এরা জবাব দেয় আরেকটা। তরী রেগে যায় না, বিরক্তও হয় না। বরং বেশ বিনয়ী ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে,

“ আমি সময়টা জানতে চাচ্ছি। মানে কতদিন ধরে আপনার এই সমস্যা? “

“ সাত মাস ধরে। “

তরী ফাইলে কিছু টেস্টস লিখে দিয়ে মহিলার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,

“ আপনি এই টেস্ট গুলো করে আগামী সোমবার রিপোর্ট সহ আমার সাথে দেখা করতে আসবেন। “

ফাইলে লিখে দেওয়া টেস্টের লিস্ট দেখে মহিলার পাশে বসে থাকা উনার স্বামী বেশ চটে যায়। বিদ্রুপের সুরে বলে উঠে,

“ হসপিটাল গুলো কসাইখানা হয়ে গিয়েছে আর ডাক্তার গুলো কষাই। “

কথাটা তরীর কর্ণগোচর হয় না। সে বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে অমায়িক হেসে লোকটার উদ্দেশ্যে বলে উঠে,

“ প্রথমত রোগ প্রাথমিক পর্যায়ে থাকা অবস্থায় আপনারা নিজেরাই সেটাকে গুরুত্ব দেন না। তারপর যখন সমস্যা বেড়ে কোনো বিশাল আকার ধারণ করে তখন এই কষাইদের কাছেই আসেন। অথচ প্রথমে সমস্যা অনুভব করতেই যদি আপনারা ডাক্তারদের কাছে আসতেন তাহলে কিন্তু এতো টেস্টের প্রয়োজন পড়তো না। নিজেদের দোষটা আপনারা দেখতে পান না কখনো, সব দোষ হয়ে যায় কষাইদের। কি অদ্ভুত তাই না? “

মহিলা আর লোকটার মুখ বেশ থমথমে দেখা যায়। তরী নিজেই আবার বলে উঠে,

“ ফাইলে লিখে দেওয়া একটা টেস্টও অপ্রয়োজনীয় না। উনার কি কি রোগ হয়ে থাকতে পারে সেই ধারণা করেই এই টেস্টগুলো দেওয়া হয়েছে। আর যেকোনো অসুখের প্রথম ট্রিটমেন্টই হচ্ছে নিজের ডাক্তারকে বিশ্বাস করতে শিখুন। আই হোপ ইউ উইল রিমেম্বার ইট। “

সেই ভদ্রমহিলা এবং তার স্বামী বেরিয়ে যেতেই একজন পুরুষ নক করে তরীর কেবিনে প্রবেশ করে। তরীকে একবার দেখে উনি হেসে শুধায়,

“ আপনাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে ডক্টর তরী। খারাপ লাগছে? “

ডক্টর রায়হানের এরকম অযাচিত চিন্তা তরীকে বেশ অস্বস্তি দেয়। লোকটা তার সিনিয়র। তার উপর বিবাহিত। তবুও বিভিন্ন ছুঁতোয় উনি তরীর সাথে খোশগল্পে মেতে উঠার চেষ্টায় ব্যস্ত থাকে সবসময়। ঝামেলা এড়াতে এবং ভদ্রতার খাতিরে তরী সবসময় হাসি মুখেই উনার সাথে কথা বলে। কিন্তু তার এই হাসি মুখে কথা বলাটাকে যেন এই লোক প্রশ্রয় ভেবে বসেছে। তরী মিথ্যা হাসি না দিয়ে মুখে নিজের বিরক্তিটা স্পষ্ট করে বলে উঠে,

“ আমি খুব ব্যস্ত ডক্টর রায়হান। প্লিজ এক্সকিউজ মি। “

কথাটা বলেই তরী ল্যান্ডলাইনে কল করে বাহিরে বসে থাকা এসিস্ট্যান্টকে বলে পরবর্তী পেশেন্টকে পাঠাতে। অপমানে থমথমে মুখ নিয়ে রায়হান চুপচাপ কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতেই তরী প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেয়। মেয়ে মানুষের একটা গুণ আছে। কে তার দিকে কোন দৃষ্টিতে তাকায় তা সে স্পষ্ট বুঝতে পারে। তরীও তার ব্যতিক্রম নয়। তার বয়স বর্তমানে ২৭ ছুঁই ছুঁই। জীবনে বহু ধরনের পুরুষ মানুষকেই সে দেখেছে। তাদের কল্যাণে এখন মানুষ চিনতে মোটেও ভুল হয় না তার।

__________

রাত ১২ টা প্রায়। পৃথা এইমাত্র নতুন একটা সিম ফোনে ইনসার্ট করেছে। বহু সংশয় কাটিয়ে মুখস্ত নাম্বারটা ডায়াল করে সে। আজ ঠিক করে রেখেছে কোনো কথা বলবে না। কেবল একবার সেই অতি শেয়ানা লোকটার কণ্ঠস্বর শুনেই ফোন রেখে দিবে। তার কণ্ঠ না শুনলে নিশ্চয়ই লোকটা তাকে চিনতে পারবে না আর?

যেমন ভাবনা তেমন কাজ। কিছুক্ষণ রিং হতেই কল রিসিভ হয়। পৃথা কোনো কথা বলে না। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে অপর পাশের মানুষটাও টু শব্দ করে না। পৃথা অপেক্ষা করে। মৃদু অধৈর্য্যও হয় বটে। খানিকক্ষণ পার হওয়ার পর অপর পাশ থেকে গভীর কণ্ঠ ভেসে আসে,

“ মিস এ বি সি। আজ কি কথা না বলার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছেন? “

পৃথা অবাক হয়। মিস এ বি সি? কে? তাকে কি এ বি সি বলে সম্বোধন করলো লোকটা? কিন্তু বুঝলো কিভাবে এটা পৃথা? একই স্বর আবার ভেসে আসে,

“ আপনার নাম আমার জানা নেই। আর ম্যাথ বই হতে মান অথবা নাম না জানা যেকোনো কিছুকে এ বি সি কিংবা এক্স ওয়াই জেট হিসেবে ধরা শিখেছি আমি। আরেকটা কথা হলো এই এতো রাতে আননোন নাম্বার থেকে খোঁজ নেওয়ার মতো কোনো বউ নেই আমার। “

পৃথা নিজের মাথা চাপড়ালো। সে কি বেশি বোকা? নাকি এই লোকটা বেশি চালাক? উত্তর খুঁজে পেলো না সে। বলার মতো কোনো কথাও নয়।

“ পৃথা আমি। মিস এ বি সি অথবা কারো বউ নই। “

কথাটা বলেই পৃথা ফট করে ফোন কেটে দেয়। সবসময় তোতাপাখির ন্যায় কথা বলে বেড়ানো অষ্টাদশী পরপর দুবার একই মানুষের সামনে কথার খেই হারিয়ে ফেলেছে। এ যে মোটেও মেনে নেওয়ার মতো বিষয় নয়।

পৃথার ফোনে টুং করে নোটিফিকেশন বারের শব্দ হয়। আনমনে ফোন আনলক করে ম্যাসেজটা দেখতেই তার চক্ষু চরাকগাছ হয়ে যায়।

“ আমি আপনাকে প্রেমিকা কিংবা বউ হওয়ার অফার করি নি মিস। আর না আমি আপনাকে একবারও কল করেছি। শুরুটা কিন্তু আপনিই করেছেন। তাই বলে শেষ করার অধিকার আমি আপনাকে দেই নি মোটেও। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-০৩

0

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩.

শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত করিডোরের একটি বেঞ্চিতে ঠাঁই বসে আছে পার্থ। সামনেই কেবিনের ভিতর হতে ভেসে আসছে সদ্য নিজের সন্তান হারানো এক মায়ের আর্তনাদ। স্তব্ধ পার্থর কানে সেই আর্তনাদ স্পষ্ট আঘাত হানছে।

“ কতবার বলসি এসব রাজনীতি করিস না। ছাইড়া দে। মায়ের কথা শুনলি না। আল্লাহ আমি এখন কি নিয়া বাঁচমু? আমার পোলাডারে খাইয়া ফেললো অমানুষের দল। “

এতক্ষণ কেবিনে অনুভূতিহীন মানুষের ন্যায় দাঁড়িয়ে থেকে বিভিন্ন পেপার ওয়ার্কস করছিলো তরী। সিয়ামের মায়ের তীক্ষ্ণ আর্তনাদে যেন তার মাথার প্রতিটা নিউরন ছিড়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছিলো। পেপার ওয়ার্কস শেষ হতেই সে কেবিন থেকে বের হয়ে আসে। কেবিনের সামনেই পার্থকে বসে থাকতে দেখে সে মিনিট দুয়েক কিছু একটা ভাবে। পরপর মাঝখানে বেশ কয়েক হাত ব্যবধান রেখে বেঞ্চির অপর প্রান্তে বসে সে। শান্ত স্বরে বলে,

“ জীবনে প্রথম সামনাসামনি কারো মৃত্যু দেখলেন নেতা সাহেব? “

পার্থ কোনো জবাব দেয় না। ফিরেও তাকায় না। সে স্থির বসে রয়। তরী নিজেই আবার বলে,

“ আমার জন্য এরকম ঘটনা নতুন কিছু না। এর আগেও অগণিত বার আমি মৃত্যু দেখেছি। একপ্রকার বলতে পারেন প্রায় রোজই আমার মৃত্যুর সাথে দেখা হয়। “

পার্থ এবার শীতল দৃষ্টি মেলে তরীর দিকে তাকায়। তরী মৃদু অবজ্ঞার হাসি হেসে বলে,

“ ভিতরে যেই ভদ্রমহিলা নিজের ছেলের শোকে কাতর সেটাও নতুন কোনো ঘটনা না। আপনাদের মতো সো কল্ড জন সেবকদের পিছনে এরকম বহু মায়ের সন্তানরা হারিয়ে যায়। কিন্তু আপনাদের তাতে কি আসে যায়? আপনাদের ইমেজে তো এক বিন্দু দাগ লাগে না। আপনাদের জীবন তো আপন গতিতেই চলে। “

তরীর কথা শেষ হতেই নীরব করিডোরে রুবেলের হাস্যজ্বল স্বর শুনা যায়,

“ আরে…রে… আসতে দেরি করে ফেললাম মনে হচ্ছে। “

পার্থ ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে ফিরে রুবেলকে দেখতেই তার ভিতরের জমে থাকা রাগ ফুসে উঠে। কিন্তু নিজেকে সংবরণ করে সে চুপচাপ উঠে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে বলে,

“ তোর চ্যালাপেলারা সিক্সথ ফ্লোরে। ভুল ফ্লোরে এসে পড়েছিস তুই। “

রুবেল গা কাপানো হাসি দিয়ে বলে,

“ আমি ঠিক জায়গায়ই এসেছি। আসলে ব্যাপার হলো রাজনীতি নিজের জায়গায় কিন্তু মনুষ্যত্ব তার আপন জায়গায়। ভাবলাম এসে সিয়াম ছেলেটার খবর নিয়ে যাবো। দেখ ওর সুস্বাস্থ্য কামনা করে আমি ফুলের তোড়াও নিয়ে এসেছি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই ফুল আমার ওর কবরের উপর দিতে হবে। “

পার্থর চাপিয়ে রাখা রাগ এতক্ষণে বেরিয়ে আসে। সে উগ্রভাবে ক্ষেপে গিয়ে রুবেলের কলার চেপে ধরে। সাথে সাথে রুবেলের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা তার সাঙ্গ পাঙ্গরা ক্ষিপ্ত ভাবে এগিয়ে আসতে নেয়। রুবেল হাতের ইশারায় সবাইকে থামতে বলে। পার্থর পিছনে নীরব ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা তরী ভ্রু কুচকে দাঁড়িয়ে আছে। বাহিরের শোরগোলে ইতিমধ্যে পার্থর ছেলেপেলেরাও কেবিন থেকে বেরিয়ে এসেছে। তারাও ক্ষিপ্ত চোখে রুবেল আর তার লোকেদের দিকে তাকিয়ে আছে। আসিফ দাঁত চিবিয়ে বলে উঠে,

“ ভাই আপনি খালি একবার কন, এক্ষুনি এই সবগুলারে এইখানে গাইড়া দিমু। “

মুহুর্তেই যেন শান্ত হসপিটালের করিডোরটা ছোট খাটো একটা রণক্ষেত্রে রূপ নেয়। পার্থ শীতল কিন্তু ভয়ংকর স্বরে বলে,

“ সিয়ামের খুনীদের এতো সহজে ছেড়ে দিবো না। কথাটা মাথায় রাখবি। “

কথাটা বলেই পার্থ এক ধাক্কা দিয়ে রুবেলকে পিছনে ফেলে দেয়। সুজন পিছন থেকে রুবেলকে ধরে ফেলে। রুবেল কিছুটা সিরিয়াস ভঙ্গিতে তরীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

“ ডাক্তার আপা, সিক্সথ ফ্লোরে এডমিট আমার ছেলেদের দিকে ভালো করে খেয়াল রাখবেন। আশেপাশে খুন খারাবির পরিমাণ খুব বেড়েছে ইদানীং। “

কথাটা দ্বারা যে আকারে ইঙ্গিতে পার্থ হতে ওই ছেলে গুলোকে বাঁচানোর কথা বলা হয়েছে তা বুঝতে আর বাকি নেই তরীর। রুবেল আর অপেক্ষা না করে গটগট পায়ে সেখান থেকে প্রস্থান করে। তরী একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে সবার দিকে তাকিয়ে নিজের কেবিনে ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।

__________

গ্রীষ্মের এক পড়ন্ত বিকেল। টিএসসির সামনে এলোমেলো চুলে এবং ঘর্মাক্ত গায়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে শোভন। বিকেলের শান্ত শীতল হাওয়াটাও যেন আশেপাশে মানুষের কোলাহলে আর উপভোগ্য ঠেকছে না। ঠিক তখনই এক জোড়া নরম শীতল হাত তার দু চোখের পাতা আড়াল করে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,

“ হ্যান্ডস আপ। আইন নিজের হাতে তুলে নিবেন না। “

শোভনের এতক্ষণের ক্লান্তি এবং অপেক্ষা মুহুর্তেই স্বস্তিতে রূপ নেয়। শোভন হেসে শুধায়,

“ আমার অপরাধ কি মাননীয় আইন অধিদপ্তরের প্রধান? “

“ চুরি করেছেন। এক রমণীর মন চুরির অপরাধে আপনাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলো। “

কথাটা বলেই রমণী শোভনের চোখের পাতা থেকে হাত সরিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। শোভন চোখ মেলেই দেখতে পায় তার সামনে দাঁড়ানো রমণীর মুখে লেপ্টে থাকা আদুরে ঝলমলে হাসি। শোভন হেসে বলে উঠে,

“ অপরাধ তো আপনিও করেছেন মধু। আমাকে ঘড়ি ধরে ঠিক বাইশ মিনিট অপেক্ষা করিয়েছেন। আপনাকে কি শাস্তি দেওয়া যায়? “

মধুমিতা সামান্য রাগ দেখিয়ে শোভনের বুকে আলতো কিল মেরে বলে,

“ হেহ! প্রেম করতে এসেছো অথচ অধৈর্য্য এতো? এরকম নড়বড়ে ধৈর্য্য দিয়ে প্রেম হয় না মশাই। “

এই পর্যায়ে শোভন মধুমিতার হাত ধরে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বলে,

“ দুই বছরের সাধনার পরও আমার ধৈর্য্য নিয়ে তোমার সন্দেহ আছে? “

মধুমিতা বেশ কৌশলে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। শোভনের দিকে পিঠ করে উল্টো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বলে উঠে,

“ সন্দেহ তো সম্পূর্ণ তোমার প্রতিই আছে। ডিউটিওয়ালা মানুষদের চরিত্রের ঠিক নেই কোনো। পুলিশ সম্প্রদায় যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তখন তার তোষামোদ করে চলে সবসময়। একইভাবে আজ আমার প্রতি ভালোবাসা কাল অন্য কারো প্রতি তোমার ভালোবাসা জাগলে? “

প্রেয়সীর করা ঠাট্টায় একজন কর্তব্যমান প্রেমিকের ন্যায় হাসে শোভন। বড় বড় কদম ফেলে মধুমিতার পাশে এসে তার সাথে কদম মিলিয়ে বলে,

“ এই সামান্য ডিউটিওয়ালা কি করলে আপনি তার বিশ্বস্ততার প্রমাণ পাবেন? “

“ আপাতত প্রেমিকার পিতা মহাশয়ের বিশ্বাস অর্জন করুন। বাড়িতে আমার বিয়ের কথা চলছিলো। সেই বিয়ের গুঞ্জনের ইতি টানতে আমি আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারটা বাসায় জানিয়ে দিয়েছি। এখন বাবা আপনার সাথে দেখা করতে আগ্রহী। “

কথার এই পর্যায়ে শোভন দাঁড়িয়ে পড়ে। বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করে,

“ আংকেল কে জানিয়ে দিয়েছো? উনার রিয়্যাকশন কেমন ছিলো? “

“ সেটা তো সামনাসামনি গেলেই বুঝতে পারবো। সামনের সপ্তাহে আমি হল থেকে বাসায় ফিরছি। তুমিও সাথে যেতে চাইলে চলতে পারো। আমাদের সিলেটের সৌন্দর্যও দর্শনের সুযোগ পাবে আর সঙ্গে নিজের হবু শশুড় শাশুড়ি পটানোর সুযোগও পেয়ে যাবে। “

__________

আজকে পৃথার রেজাল্ট দেওয়া সত্ত্বেও সারাদিন তাকে অভিনন্দন জানানোর সুযোগটুকু পায় নি পার্থ। হসপিটালের ফর্মালিটিস শেষে বাদ আসর জানাজার ব্যবস্থা করা হয়। জানাজা শেষে সে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে হসপিটালে গিয়েছিলো। উদ্দেশ্য ছিল সকালের করিডোরের সামনের সিসিটিভি ফুটেজ চেক করা। যদিও ডক্টর বলেছে ইন্টার্নাল ব্লিডিংয়ের ফলেই সিয়ামের মৃত্যু ঘটেছে। কিন্তু পার্থ তা মানতে নারাজ। তার মনে একধরনের খচখচ রয়েই যায়। সেই সন্দেহ তার বিশ্বাসে পরিণত হয় যখন সিসিটিভি ফুটেজের ফাইল হতে সকালের রেকর্ডিংয়ের অংশটুকু ডিলেটেড শো করে।

আপাতত নিজের পার্টি অফিসে বসে এসবকিছুই চিন্তা করছিলো সে। তখনই তার সামনে বসা আসিফ বলে উঠে,

“ ভাই, আমি তো আগে থেকেই জানতাম এই রুবেল এতো চুপচাপ থাকবো না। যেই না পার্টি থেকে নির্বাচনের জন্য আপনারে মনোনয়ন দেওয়া হইলো, লগে লগে ওই হালার পুতের ইবলিশগিরি শুরু হইয়া গেসে। আপনি এর জবাব দিবেন না? “

চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে থাকা পার্থ শীতল স্বরে জবাব দেয়,

“ ইটের বিনিময়ে পাটকেল আর জানের বিনিময়ে জান। “

আসিফ সামান্য ভ্রু কুচকে তাকায়। বুঝার চেষ্টা করছে পার্থ কি ইঙ্গিত করছে। নিজের কৌতূহল দমাতে না পেরে সে প্রশ্ন করেই বসে,

“ বুঝি নাই ভাই। “

“ আপাতত কিছু করিস না কেউ। সিয়ামকে কোপানো ওই ছেলেগুলোর উপর নজর রাখ। সঠিক সময়ের অপেক্ষা কর। আগে সেবাযত্ন পেয়ে ওদের হাসপাতাল থেকে বের হতে দে। তারপর আমরাও নাহয় একটু খাতিরযত্ন করবো তাদের। “

আসিফ মনে মনে খুশি হয়। সিয়াম ছেলেটা নব্য রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলো। এখনো কারো সাথে কোনো ঝামেলায় জড়ায় নি। সকলকে বেশ সমীহ করে চলা একটা সৎ ছেলে ছিলো। ছেলেটার সাথে অল্প দিনের পরিচয় হলেও তার মৃত্যুতে তারা সকলেই গভীরভাবে শোকাহত। এই মৃত্যুর বিচার বর্তমান ক্ষমতায় থাকা দলের আওতায় পাওয়া কখনোই সম্ভব নয়। কারণ রুবেল হলো সরকারি দলের একজন সদস্য আর তারা সরকার বিরোধী পার্টি।

আর তাছাড়াও পার্থ যেচে কারো সাথে ঝামেলা করার মানুষ না। রাজনীতিতে তার বেশ ক্লিন ইমেজ রয়েছে এজন্য। কিন্তু কেউ সেধে এসে তার সাথে শত্রুতার সম্পর্ক গড়তে চাইলে সেই সম্পর্কও সে সম্পূর্ণ মন দিয়ে পালন করে।

আসিফের ভাবনার মধ্যেই পার্থ প্রশ্ন করে,

“ তোকে আরেকটাও কাজ দিয়েছিলাম। তা হয়েছে? “

আসিফ কিছু একটা মনে করার ভান করে বলে,

“ ওহ। ওই ডাক্তার আপার পরিচয়? উনার পুরা নাম তরী রশীদ। বাপের নাম হুমায়ুন রশীদ। উনার বাপ এই হসপিটাল তৈরির মেম্বারদের মধ্যে একজন আর তাছাড়াও উনি হসপিটালের চিফ এডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার পদে আছেন। আর ওই ডাক্তার আপা একজন কার্ডিওলজিস্ট। “

পার্থ চোখ মেলে তাকায়। শান্ত ভঙ্গিতে বলে উঠে,

“ তার মানে ডাক্তার সাহেবা মিথ্যা বলে নাই। “

আসিফ গা ছাড়া ভাবে বলে,

“ হ ভাই। উনার বাপের হসপিটাল দেইখাই এতো ভাব দেখায়সিলো আপনারে। আর তাছাড়াও বেডি মানুষ হইসে পাপা কি পারি টাইপ প্রজাতি। এরা নিজেদের বাপ ছাড়া আর কোনো পুরুষরে গোণায় ধরে না। “

পার্থ আসিফের দিকে তাকিয়ে বলে,

“ শুধু এইটুকুই জেনেছিস? “

আসিফ ভ্রু কুচকে তাকায়। পর মুহুর্তেই কিছু একটা মনে পরার ভান করে বলে,

“ ওহ। আর উনার একটা ছোট ভাইও আছে। তূর্য রশীদ। চ্যানেল ২৪ এর ক্রাইম বিষয়ক জার্নালিস্ট। “

__________

গোছল সেরে নিজের রুমে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছছিলো তূর্য। তখনই তার ফোনটা বেজে উঠে। এগিয়ে গিয়ে ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রিনে আননোন নাম্বারটা দেখতেই তার শিথিল ভ্রু জোড়ায় সামান্য ভাজ পড়ে। রাত ১১ টার উপর বাজে। এই সময় কে তাকে কল করবে? কথাটা ভাবতে ভাবতেই সে ফোনটা রিসিভ করে। সাথে সাথেই ফোনের অপরপাশ থেকে একটি রিনঝিন নারী স্বর বলে উঠে,

“ বলো তো মশাই। তুমি প্রেমিক হতে চাও নাকি স্বামী? “

এতো রাতে এক অপরিচিত রমণীর মুখ থেকে এমন একখান প্রশ্ন পেয়ে তূর্যর বিব্রত হয়ে পড়ার কথা। কিন্তু সে বিব্রত হলো না। উল্টো ফোনের অপর পাশের রমণীকে বিব্রত করে বলে,

“ প্রেমিক হলে তো অধিকারবোধ নিয়ে সংশয়ে পড়বো। তার থেকে নাহয় স্বামীই হলাম। সম্পূর্ণ অধিকার সহিত স্বামী। “

তূর্যর থেকে এমন একটা উত্তর পেয়ে পৃথার লজ্জায় মূর্ছা যাওয়ার জোগাড়। এই লোকটা এরকম শেয়ানা? কোথায়? সকালে তো এই লোকটাকে দেখে পৃথার একবারও মনে হয়নি যে অষ্টাদশীর মনে কড়া নাড়া এই ভদ্রলোকটা এতো শেয়ানা হতে পারে। প্রথম দেখায় এই মানুষটাকে শান্ত, ভদ্র ভাবায় তার নিজের প্রতিই এখন মায়া হচ্ছে। এক মুহুর্তের জন্য স্তম্ভিত হয়ে যাওয়া পৃথা নিজেকে সামলে নিয়ে বলে উঠে,

“ বুঝলাম। পুরুষ মানুষের অলিখিত স্বভাব হলো তারা নারীদের উপর অধিকার খাঁটাতে খুব পছন্দ করে। “

“ আর সদ্য যৌবনে পদার্পণকারী অষ্টাদশীর স্বভাব কি রাত বিরাতে একজন আগুন্তক পুরুষকে ফোন দিয়ে অদ্ভুত প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া? “

তূর্যর কথায় আরো একবার অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো পৃথা। এটাতো হওয়ার কথা ছিলো না। চাল সম্পূর্ণ ঘুরে গেলো। তূর্যকে কাবু করার বদলে পৃথা নিজে তূর্যর দ্বারা কাবু হয়ে যাচ্ছে। নীরব পৃথার মনে আরেকদফা ঝড় তুলে দিতে তূর্য বলে উঠলো,

“ সকালে শোনা কণ্ঠস্বর রাত পেরোনোর আগেই ভুলে যাওয়ার মতো ভুলো মনা নই আমি। “

সদ্য এলোমেলো হয়ে যাওয়া পৃথা বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পেলো না। নিজের বুকের ভেতর বাজতে থাকা বাদ্যকে অবসর দিতে ফট করে ফোন কেটে দিলো। এইমাত্র এই লোকটাকে ফোন করে সে এক মস্ত ভুল করে বসলো। এই ভুলের মাশুল কি?

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-০২

0

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২.

নিজের পার্টি অফিসে বসে সকাল সকাল খবরের কাগজে চোখ বুলাতে ব্যস্ত রুবেল। সেই মুহুর্তে হন্তদন্ত হয়ে সুজন রুমে প্রবেশ করে বলে উঠে,

“ ভাই। একটা সমস্যা হইয়া গেসে। “

সাত সকালে সুজনের এই কথা শুনে মেজাজ বিগড়ে যায় রুবেলের। সে বিরক্তিকর ভঙ্গিতে বলে উঠে,

“ তোর কাজই কি আমাকে আইসা খারাপ খবর দেওয়া? “

সুজন মনে মনে বিরক্ত হয়। এখন খারাপ কোনো খবর থাকলে সেটা এসে সবার আগে রুবেলকে জানানোও তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এতে তার দোষ কোথায়? রুবেল হাতের সংবাদপত্রটা টেবিলের উপর রেখে বলে,

“ কি হইসে? কি সমস্যা? বল শুনি। “

“ সিয়ামের উপর আমাদের যেই ছেলেরা হামলা করছিলো গতরাতে তারা সকলে দূর্বৃত্তদের মুখোমুখি হয়। সবাই আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। “

রুবেল অবাক হয় না। এরকমটা হওয়ারই ছিলো। এরকম একটা ঘটনার পর পার্থ মুন্তাসির চৌধুরী যে চুপচাপ বসে থাকবে না তা তার ভালো করেই জানা ছিলো। কিন্তু যদি কাজের কাজ করে তারপর এই ছেলেগুলো আহত হতো তাহলে তার আর আফসোস থাকতো না। রুবেল বেরস মুখে জিজ্ঞেস করে,

“ কোন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ওদের? “

“ গ্রীন কেয়ার হসপিটাল। “

রুবেল ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

“ এই হসপিটালেই না সিয়াম ভর্তি? “

“ হ্যাঁ ভাই। “

রুবেল চুপচাপ বসে কিছু একটা ভাবে। পরপর বলে উঠে,

“ ফুলের তোড়া নিয়ে আসতে বল। আমরা হসপিটালে যাবো। “

সুজন কিছুটা আতংকিত হয় রুবেলের কথা শুনে। হসপিটালে হয়তো পার্থও আছে। দুজন মুখোমুখি হলে কি হবে? সুজনের ভাবনার মাঝেই রুবেল রাগী স্বরে তাকে ধমকে উঠে। সাথে সাথে সে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যায়।

__________

সকাল সকাল নাস্তার টেবিলে বসে আছে চৌধুরী ভবনের সকল সদস্য। ঘরের রাধুনি জমিলা বেগম সকলকে নাস্তা পরিবেশন করতে ব্যস্ত। পার্থর অষ্টাদশী ছোট বোন পৃথা সাত সকালে নাস্তায় পরোটা এবং গরুর মাংসের ভুনা দেখে কিছুটা মুখ কালো করে বলে,

“ খালা। আমার আলুভাজি কোথায়? সকাল সকাল আমি মাংস খেতে পারিনা, তা তুমি জানোনা? “

পৃথার পাশে বসা ইউনিফর্ম পরিহিত শোভন তার মাথায় গাট্টা মেরে বলে,

“ খাবার খেতে পারছিস তার জন্য শুকরিয়া আদায় করতে শিখ। সবসময় খালি অভিযোগ করে বেড়াবি না। তুই জানিস কত মানুষের ভাগ্যে এই নাস্তাটুকু জুটে না? “

পৃথা কিছু বলার আগেই আফজাল সাহেব সামান্য গলা ঝাড়া দিয়ে বলে উঠে,

“ এভাবে মাথায় মারাটা আমার পছন্দ নয় তা কি তুমি জানোনা? “

শোভন সামান্য হেসে মুখে সামান্য পরোটা ছিড়ে পুরে দেয়। পরপরই সে বলে উঠে,

“ তোমার কাছে তো আমার চাকরিও অপছন্দ আব্বা। কিন্তু আমি কবে সেটার তোয়াক্কা করেছি? “

এতক্ষণ ধরে নীরব ভূমিকা পালন করা পার্থ এবার নীরবতা ভেঙে বলে উঠে,

“ খাওয়ার সময় এতো কথা হচ্ছে কেনো টেবিলে? আর শোভন বাদদে না। পৃথার যা মর্জি তা খাক। ক্ষতি কোথায়? “

শোভন কোনো জবাব দেয় না। সে গটগট করে এক গ্লাস পানি খেয়ে উঠে সোজা বেরিয়ে যায়। আফজাল সাহেব এবং পার্থর সাথে সবসময়ই শোভনের এক ধরনের নীরব দ্বন্দ্ব চলে আসছে। এর মূল কারণ বলা যেতে পারে তাদের পেশাগত ভিন্নতা। নিজের চাকরির সুবাদে রাজনীতির সম্পর্কে বেশ অনেক তথ্যই শোভনের অজানা নয়। ক্ষমতার অপব্যবহারের হাজার প্রমাণের ফলেই এই রাজনীতির প্রতি সে সম্মান হারিয়েছে বহু আগেই। তার আচরণে সেই বিষয়ের বহিঃপ্রকাশ প্রায়ই লক্ষ্যনীয়।

শোভন বেরিয়ে যেতেই সাদিকা বেগম মুখ খুলে,

“ ছেলেটা ঠিকঠাক নাস্তা না করে চলে গেলো। আর ও ভুল কি বললো? পৃথার আব্বা আপনি মেয়েকে লাই দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছেন অনেক। মেয়ে মানুষের এতো মর্জি দেখানো ভালো না। দুইদিন পর শশুর বাড়ি গেলে ওখানে রোজ সকালে কে ওর জন্য আলু ভাজি নিয়ে বসে থাকবে? “

জমিলা বেগম ইতিমধ্যে আলুভাজি এনে পৃথার সামনে দিয়েছে। পার্থ মায়ের কথার জবাব দিয়ে বলে উঠে,

“ আমার বোনের যা ইচ্ছা তা করবে। অযথা ওকে শাসন করো না তো আম্মা। আমাদের সাথে মর্জি দেখাবে না তো কার সাথে দেখাবে? “

ভাইয়ের আস্কারা পেয়ে পৃথা আহ্লাদে গদগদ হয়ে ভাইয়ের একহাত জড়িয়ে ধরে বলে,

“ আই লাভ ইউ বড় দা। “

পার্থও হেসে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। পার্থ এবং শোভন দুজনের কাছেই তাদের বোন খুব আদরের। পার্থর বয়স যখন ১৪ এবং শোভনের বয়স যখন ৬ তখন পৃথার জন্ম হয়। বাড়ির সবাই পৃথাকে খুব আদর করলেও সবার আদরের ধরণ আলাদা। যেমন আফজাল সাহেব এবং পার্থ সবসময়ই পৃথার কোনো আবদার ফেলে না। অপরদিকে সাদিকা বেগম এবং শোভন মাঝেমধ্যে টুকটাক শাসন করে। এজন্য দেখা যায় পৃথাও নিজের আব্বা এবং বড় দা কে একটু বেশিই পছন্দ করে।

নাস্তার মাঝেই পার্থর ফোন বেজে উঠে। সে কল রিসিভ করে টুকটাক কথা বলে ফোন রাখতেই আফজাল সাহেব বলে,

“ তোমার সমাবেশের প্রস্তুতি কেমন চলছে? “

“ এখন পর্যন্ত তো ভালোই চলছে সব কিছু। আশা করছি সামনেও কোনো ঝামেলা হবে না। “

“ আমি বলবো যে ঝামেলা হতে পারে সেটা মাথায় রেখেই প্রস্তুতি নাও তোমরা। একে তো সরকার বিরোধী দলের অংশ তোমরা। তার উপর এই জেলায় বিপরীত পার্টির তুলনায় তোমার সমর্থক বেশি। সুতরাং রুবেল হোসেন সহ বাকি বিরোধী পার্টিরাও কিন্তু ঝামেলা বাধানোর চেষ্টা করতে পিছুপা হবে না। “

পার্থ মৃদু হেসে মনে মনে বলে,

“ রুবেল আগে নিজের ঝামেলা সামলে কুল পায় কিনা সেটা দেখেন বসে বসে। “

__________

ঢাকার সনামধন্য এক কলেজ হতে এইবার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে পৃথা। আজ তার রেজাল্ট দেওয়ার কথা। সেজন্য নাস্তা করে ১০ টার দিকেই কলেজ প্রাঙ্গণে এসে উপস্থিত হয়েছে সে। যদিও তার রেজাল্ট নিয়ে তেমন একটা চিন্তা নেই। কারণ একদম খারাপ পরীক্ষা দেয় নি সে। তাই কলেজের একপাশে দাঁড়িয়ে নিজের দুই বান্ধুবীর সাথে আড্ডায় মশগুল সে।

১১ টা বাজতেই নোটিশ বোর্ডে রেজাল্ট টাঙিয়ে দেওয়া হয়। ভীড় ঠেলে নিজের রোল এবং রেজিস্ট্রেশন নাম্বারের পাশে জিপিএ ৫ দেখতে পেয়েই সে সামান্য হেসে ভীড় ছেড়ে বেরিয়ে আসে। পার্স থেকে ফোন বের করে নিজের আব্বাকে কল দেওয়ার উদ্দেশ্যে। যদিও তার আব্বা আর বড় দা ইতিমধ্যে দুটো গরু আনিয়ে রেখেছে তার আম্মার আদেশে। তার আম্মা পুরান ঢাকার মেয়ে হওয়ায় এসব বিষয়ে বেশ সৌখিন। যেকোনো উপলক্ষেই তিনি কাচ্চি কিংবা বিরিয়ানি রান্না করে এতিমখানায় খাবার পাঠান। নিজের মেয়ের রেজাল্ট উপলক্ষে আজও তার ব্যতিক্রম নয়।

কল লিস্ট থেকে আফজাল সাহেবের নাম্বার বের করে ডায়াল করার পূর্ব মুহুর্তেই একটি অমায়িক পুরুষালি কণ্ঠস্বর সামনে থেকে বলে উঠে,

“ এক্সকিউজ মি প্লিজ। “

পৃথা কিছুটা প্রশ্নবোধক দৃষ্টি মেলে সামনে তাকাতেই দেখতে পায় হালকা আকাশি রঙের একটা শার্ট গায়ে জোড়ানো পুরুষ তার দিকে তাকিয়ে আছে। পৃথা অবাক স্বরে বলে,

“ আমাকে ডাকছেন? “

“ জ্বি। একচুয়্যালি আমরা টিভি চ্যানেল থেকে নিউজ কাভারের জন্য এসেছি। আপনার কি এক মিনিট সময় হবে আমাদের সাথে কো অপারেট করার জন্য? “

পৃথা এতক্ষণে খেয়াল করে সেই পুরুষের পিছনে একজন ক্যামেরা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। অমায়িক হাসির এই পুরুষকে ফিরিয়ে দিতে ইচ্ছা হয় না পৃথার। সে সম্মতি জানিয়ে বলে,

“ শিওর। “

ইন্টারভিউ শেষ হতেই সেই লোকটা পৃথাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ থ্যাঙ্কিউ এন্ড কংগ্রেচুলেশনস। “

আগুন্তক পুরুষের অমায়িক কথার ধরন এবং মুগ্ধতা মাখা মুখশ্রী আচমকা অষ্টাদশীর মনে দাগ কাটে। আগুন্তক ততক্ষণে অন্য আরেকজন শিক্ষার্থীর দিকে এগিয়ে গিয়েছে। দূর হতে শ্যাম পুরুষের থুতনির কাটা দাগের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেই পৃথা আনমনে সেই ক্যামেরাম্যানকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করে,

“ কে উনি? “

ক্যামেরাম্যান কিছুটা অবাক হয়ে পৃথার দিকে তাকায়। পরপর জবাব দেয়,

“ নিউজ ২৪ চ্যানেলের ক্রাইম বিষয়ক জার্নালিস্ট তূর্য রশীদ। “

ক্যামেরাম্যানের জবাবে পৃথা কিছুটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,

“ ক্রাইম বিষয়ক জার্নালিস্ট এখানে কি করছে? “

“ উনি তো আরেকজনের প্রক্সিতে এসেছে। “

পৃথা দুদন্ড কিছু একটা ভাবে। পরপর মিষ্টি হেসে সেই ক্যামেরাম্যানকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ একটা সাহায্যের প্রয়োজন ছিলো ভাইয়া। “

ক্যামেরাম্যান ভ্রু কুচকে হাস্যজ্জ্বল পৃথার দিকে তাকিয়ে আছে। বুঝার চেষ্টা করছে সে এই অপরিচিত অষ্টাদশীর কি-ই বা সাহায্য করতে পারে?

__________

সবে মাত্র নিজের কেবিনে এসে এক গ্লাস কফি বানিয়ে বসেছে তরী। হুট করে বেশ মাথা ধরেছে তার। ভাগ্যিস আজ ওপিডি নেই তার। নাহলে বেশ ঝামেলা পোহাতে হতো। চিনি ছাড়া এস্প্রেসোতে চুমুক দিতেই সে চোখ বুজে ফেলে। এই একটা জিনিস তার প্রতিদিনের অভ্যাস। এজন্যই তার কেবিনে সবসময় কফি বানানোর প্রয়োজনীয় সব কিছু উপস্থিত থাকে।

ফোনের রিংটোনের শব্দে সে চোখ মেলে তাকায়। স্ক্রিনে ইংরেজি অক্ষরে লেখা পাপা দেখেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠে। ফোন রিসিভ করেই আদুরে স্বরে বলে উঠে,

“ তুমি কিভাবে জানলে যে আই ওয়াজ মিসিং ইউ? “

ফোনের অপর পাশ হতে তরীর বাবা হুমায়ুন রশীদ হেসে জবাব দেয়,

“ পাপা তার প্রিন্সেসের মনের খবর বুঝতে কখনো ভুল করে না। “

“ তোমার এই সেমিনার কবে শেষ হবে? ছোট আর আমি তোমাকে অনেক মিস করছি। “

“ এই সেমিনারটা আমাদের হসপিটালের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ইনশাআল্লাহ শীঘ্রই দেশে ফিরে আসবো। “

ফোনে কথা বলা অবস্থায়ই তরীর রুমে একজন নার্স তড়িঘড়ি করে প্রবেশ করে। তরী প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। নার্স বলে,

“ কেবিন নং ৮০৩ এর পেশেন্টের হঠাৎ করে ইন্টার্নাল ব্লিডিং শুরু হয়েছে ডক্টর। আপনি প্লিজ চলুন। “

তরী তাড়াতাড়ি ফোন রেখে দৌড়ে কেবিন ছেড়ে বের হয়। লিফটে উঠে ৮ম ফ্লোরের বাটনে ক্লিক করেই হাতের এপ্রোনটা পড়ে নেয় সে। লিফট ৮ম ফ্লোরে এসে থামতেই সে লিফট থেকে নেমে বাম দিকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায়। কেবিন নং ৮০৩ এর সামনে সে দেখতে পায় সিয়ামের মা কে। মহিলা কান্নাকাটি জুড়ে বসেছেন। তার সাথে আরো দুজন ছেলে তাকে সামলানোর চেষ্টায় ব্যস্ত। তরী অপেক্ষা করে না। সে দ্রুত কেবিনের ভিতর প্রবেশ করে।

__________

পার্থ হসপিটালের কাছাকাছি আসতেই খবর পায় সিয়ামের আশংকাজনক অবস্থার কথা। সে তাড়াতাড়ি হসপিটালে এসে ৮০৩ নম্বর কেবিনের সামনে আসতেই আসিফ আর শামীমকে দেখতে পায় সিয়ামের মায়ের সাথে। পার্থ বিচলিত গলায় আসিফকে প্রশ্ন করে,

“ কি হয়েছে? সিয়ামের কি অবস্থা? “

“ ডাক্তার ভিতরে আছে ভাই। এখনো কিছু জানিনা আমরা। “

কেবিনের ভিতর থেকে হন্তদন্ত হয়ে নার্সকে বেরিয়ে যেতে দেখে সিয়ামের মা আর অপেক্ষা করে না। তিনি দৌড়ে কেবিনের ভিতর প্রবেশ করে। পার্থ পিছন থেকে ডাকে,

“ খালাম্মা! “

কিন্তু সিয়ামের মা থামে না। পার্থ উপায়ন্তর না পেয়ে নিজেও পিছু পিছু কেবিনে প্রবেশ করে। তরী ইতিমধ্যে ওটি রেডি করতে এবং ব্লাড ট্রান্সফিউশনের জন্য বলে পাঠিয়েছে। আচমকা এরকম ইন্টার্নাল ব্লিডিং শুরু হওয়াটা খুব অপ্রত্যাশিত ছিলো। সিয়ামের রক্তবমির পাশাপাশি বেশ কিছু লক্ষণ দেখে তরী নিশ্চিত হয় যে ব্লিডিং চেস্ট অথবা এবডোমেনে হচ্ছে।

সিয়ামের মা ভিতরে প্রবেশ করেই ছেলের এরকম ভয়ংকর অবস্থা দেখে আর্তনাদ করে উঠে। পার্থ পিছন থেকে উনাকে সামলানোর চেষ্টা করলেও উনি সেই কথা কানে তুলছেন না। তরী ব্যস্ত গলায় বলে,

“ ম্যাম আপনি প্লিজ বাহিরে ওয়েট করুন। পেশেন্টকে ওটিতে নিয়ে যেতে হবে। “

তরীর কথা শুনে ভদ্রমহিলা কিছুটা সরে দাঁড়ালেও উনার আর্তনাদ বিন্দু পারি কমে না। আচমকা বেডের বাম পাশের মনিটরে শব্দ করে ধীরে ধীরে সমান্তরাল রেখা দৃশ্যমান হয়। সেই সমান্তরাল রেখার সাথে সিয়ামের দেহও নিথর হয়ে পড়ে রয়। দু চোখ বুজে থাকা নিথর দেহকে দেখে সিয়ামের মা নিশ্চুপ হয়ে পড়ে। তরী বেশ শান্ত ভঙ্গিতে সিয়ামের বাম হাতের কব্জি ধরে পালস চেক করে। যখন বুঝতে পারে যে সিয়াম ইতিমধ্যে মৃত তখন নিজের হাতের ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে পাশের নার্সকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ ডেথ টাইম ১১.৪৭। “

তরীর বলা কথা পার্থর কর্ণগোচর হতেই সে বিস্ফোরিত চোখে তরীর দিকে তাকায়। পরপর নিষ্প্রাণ দৃষ্টি মেলে সিয়ামের চেহারার দিকে একবার তাকায়। গত রাতেও তো ছেলেটাকে দেখে গিয়েছিলো সে। সদা হাসিখুশি ছেলেটা একরাতের ব্যবধানেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো। মৃত্যু কি এতোই সহজ?

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]