যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-০৮

0
329

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৮.

কালো চিকেনকারির একটা থ্রি পিস পরিহিত, এলোমেলো চুল, চেহারার বিধ্বস্ত অবস্থার নববধূ হয়তো কাজী সাহেব আগে কোথাও দেখে নি। তাই তো আড়চোখে বারবার তরীর দিকে তাকাচ্ছে উনি। এই বিয়েটা যে মোটেও স্বাভাবিক ভাবে হয়নি তা নিয়ে উনার কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আপাতত সে এই ভয়ংকর পরিত্যক্ত জায়গার ভূতুড়ে বিয়ের সকল কার্যক্রম মিটিয়ে বের হতে পারলেই হাফ ছেড়ে বাঁচবে।

তরীর হাত পায়ের বাঁধন খুলে দেওয়া হয়েছে অনেকক্ষণ আগে। এতক্ষণ এভাবে বেঁধে রাখায় তার হাতে এবং পায়ে কালসিটে দাগ হয়ে গিয়েছে। শরীরটাও বেশ দূর্বল লাগছে। তার মনে পড়ে যায় লাস্ট সন্ধ্যার সময় কেবল এক কাপ কফি খেয়েছিলো সে। এরপর পেরিয়ে গেলো ১০ ঘন্টা। এখনো মুখে একটা দানাপানি পড়ে নি তার।

এসব ভাবতে ভাবতেই তরী সামনে বসে থাকা পার্থর দিকে তাকায়। কি সাবলীল ভঙ্গিতে কাজির সাথে কথা বলতে ব্যস্ত সে। যেন দুনিয়ার সবথেকে নিষ্পাপ মানুষ। একদম কিচ্ছু বুঝে না। কিছুক্ষণ আগে কবুল বলার সময় তরী মনে মনে কসম খায় যে এই অসভ্যের জীবন সে জাহান্নাম বানিয়ে ছাড়বে। তরীকে বিয়ে করে যে সে কত বড় ভুল করেছে তা সে পদে পদে টের পাবে।

কাগজপত্রের ঝামেলা মিটে যেতেই পার্থ একজনকে ডেকে নিজের ওয়ালেট থেকে এক হাজার টাকার বেশ কয়েকটা নোট দিয়ে বলে,

“ কাজী সাহেবকে মিষ্টিসহ সহি সালামতে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসবি। আর নিজেদের জন্যও মিষ্টি কিনে খেয়ে নিস। “

তরী বিদ্রুপের হাসি হেসে বলে,

“ সেই মিষ্টির ভেতর যেন মাছি ডিম পেরে থাকে। খেয়ে ফুড পয়জনিং হয়ে মরে যাক সবকয়টা। “

পার্থ তরীর কথার তেমন একটা তোয়াক্কা করে না। কিন্তু বাকিদের চেহারা চুপসে গিয়েছে। তরীর কথা শুনে তাদের সকলেরই মিষ্টি খাওয়ার শখ মিটে গিয়েছে। কাজী চলে যেতেই তরী উঠে দাঁড়ায়। পার্থর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে,

“ ছেলে তিনটার কি হবে? “

পার্থ একহাত পাঞ্জাবির পকেটে গুজে আরেক হাতে নিজের ঘাড়ের একপাশে সামান্য ম্যাসাজ করতে করতে বলে,

“ আমাদের বিয়ে উপলক্ষে ওদের ডিসকাউন্ট দেওয়া উচিত। কি বলেন? ওদের জীবন নিবো না আর। আই প্রমিজ। “

তরী পার্থর কথায় বিশ্বাস করলো কিনা বুঝা গেলো না। কিন্তু সে বলে উঠে,

“ যা যা চেয়েছেন সব হয়েছে। নাও লেট মি গো টু হোম। আমার ভাই অপেক্ষা করছে। “

পার্থ ভ্রু কুচকে আসিফকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

“ আসিফ। তোর ভাবী মেডিকেলের পড়াশোনা করতে করতে হয়তো বেসিক জ্ঞান ভুলে বসেছে। তুই বল তো, বিয়ের পর একটা মেয়ে কোথায় যায়? “

“ তার জামাইয়ের বাসায় যায় ভাই। “

তরী হেসে বলে,

“ নো ওয়ে। আমি নিজের বাসায় ফিরে যাবো। “

আসিফ পিছন থেকে বলে উঠে,

“ ভাই, ভাবী মনে হয় রাগ করসে। বিয়ের পর তো মাইয়াগোরে কোলে তুইলা জামাইর বাসায় নিয়া যাইতে হয় শুনসিলাম। আপনে এরকম করতেসেন না দেইখ্যা ভাবী রাগ কইরা বাপের বাড়ি যাওয়ার কথা বলতাসে। “

তরী অগ্নিদৃষ্টিতে আসিফের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

“ এই ছেলে! আরেকবার ভাবী ডাকলে একদম জিভে এসিড ঢেলে দিবো। অসভ্য কোথাকার! “

কথা শেষ করতে করতেই তরী নিজেকে হাওয়ায় অনুভব করে। সে ভয়ে চিৎকার করে উঠে। দু’হাতে পার্থর ঘাড় ধরে নিজেকে সামলে নিলো। আশেপাশের সকলেই ওওও বলে চিল্লিয়ে উঠে। দু একজন তো সিটি বাজাতেও ভুললো না। তরী যখন ধাতস্থ হয়ে উপলব্ধি করে যে এই ভদ্ররূপী অসভ্য লোকটা তার পারমিশন ব্যতীত কেবল তাকে টাচ করে ক্ষান্ত হয়নি বরং তাকে ডিরেক্ট কোলে তুলে নিয়েছে, তখনই সে শিং মাছের ন্যায় লাফাতে শুরু করে। পার্থর তাতে তেমন একটা ভাবান্তর হলো না। সে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। আসিফ এই সুযোগে নিজের ফোন হতে তেনু লেকে মে যাভাঙ্গা গান ছেড়ে কয়েকজন ছেলেপেলে নিয়ে নাচতে নাচতে পার্থর পিছু পিছু যাওয়া শুরু করে।

গানের শব্দে এবং তরীর চিল্লাচিল্লিতে নীরব জায়গাটা মুহুর্তেই কোলাহল পূর্ণ হয়ে গেলো। তরী চিৎকার করে বলছে,

“ একটাকেও ছাড়বো না আমি। সবগুলোর হাড্ডি গুড়ো গুড়ো করে নিজের হসপিটালে এডমিট করিয়ে বিনা চিকিৎসায় মারবো। আই হেইট ইউ পার্থ মুন্তাসির চৌধুরী। “

__________

কাজী অফিসে একটা বেঞ্চিতে মাথা নত করে চুপচাপ বসে আছে পৃথা। নিজের ওড়নার আঁচলের এক কোণা দু’হাতে নিয়ে তা নাড়াচাড়া করতে ব্যস্ত সে। এছাড়া আর করার মতো কিছুও পাচ্ছে না সে। তূর্য নিজের সদ্য বিবাহিত নববধূকে বসিয়ে রেখে ভিতরে কিছু পেপারস ওয়ার্ক নিয়ে ব্যস্ত। পৃথার মনে পড়ে যায় কয়েক ঘন্টা আগে তূর্যর করা ফোন কলটা। তূর্যর প্রশ্নের পিঠে পৃথা তাকে জানিয়েছিলো যে সে তাকে বিশ্বাস করে। সাথে সাথে তূর্য কোনো ভনিতা না করে তাকে ফের প্রশ্ন করে,

“ আমাকে ভালোবাসেন? “

তূর্যর আকস্মিক প্রশ্নের প্রকোপে পৃথার শান্ত কোমল হৃদয়ে ঝড় উঠে। সেই ঝড় মনে নিয়েই পৃথা নিজের উপলব্ধি করা সত্যি জবাবটা দেয়,

“ বাসি। “

অবশেষে তূর্য শেষ এবং সবথেকে কঠিন প্রশ্নটা করে,

“ আমাকে আজকে এবং এই মুহুর্তে বিয়ে করবেন আপনি? “

পৃথা বহু জায়গায় দেখেছে এবং শুনেছে অনেকেই নাকি নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে শেষ অব্দি পায় না। সেখানে পৃথার ভাগ্য বেশ সুপ্রসন্ন বলা চলে। তার ভালোবাসার মানুষটা নিজে তাকে সারাজীবনের সম্পর্কে জড়ানোর নিবেদন জানাচ্ছে। তাদের এই অল্প কয়েকদিনের নামহীন সম্পর্ককে একটা নাম দেওয়ার লোভ পৃথা সামলাতে পারে না। সে বলে উঠে,

“ করবো। “

ব্যস। সেই ফোন কেটে পৃথা তূর্যর কথা মতো কেবল নিজের প্রয়োজনীয় দু একটা কাগজ ব্যাগে ভরে এক কাপড়ে বাসা থেকে বেরিয়ে আসে। ভাগ্যিস আজ বাসায় কেউ ছিলো না! যে দু একজন কাজের লোক ছিলো তাদের চোখ ফাঁকি দেওয়া তার দ্বারা খুব একটা কঠিন কাজ ছিলো না।

এরপর তারা কাজি অফিসে আসে। বিনাবাক্য ব্যয়ে তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। আর তূর্য তাকে কাজি সাহেবের রুমের বাহিরে বসিয়ে রেখে নিজে ভিতরে কাবিননামার কাগজ বুঝে নিতে গিয়েছে।

পৃথার বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। তূর্য কয়েক মিনিটের মধ্যেই বেরিয়ে আসে। নিঃশব্দে পৃথার পাশে বসে তাকে প্রশ্ন করে,

“ আমাকে তোমার কোনো প্রশ্ন করার নেই? “

তূর্যর মুখ থেকে তুমি সম্বোধন শুনে পৃথা মৃদু অবাক হয়। তাদের এতদিন যতবারই কথা হয়েছে তূর্য সবসময় তাকে আপনি বলেই ডেকেছে। তবে আজ ভিন্ন কেন? কিছুক্ষণ আগে তাদের বিয়ে হলো বলে? এটা কি স্বামী হিসেবে তূর্যের এক অলিখিত অধিকার? এতকিছু জানে না পৃথা। জানতেও চায় না। তূর্যর মুখে তুমি ডাকটা মন্দ লাগছে না তার।

পৃথাকে নিজের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে তূর্যর বুকের ভিতর হুহু করে উঠে। মেয়েটার চোখে প্রবল মায়া আর অনুভূতি। সে কোনো অন্যায় করছে না তো মেয়েটার সাথে? কিন্তু তূর্যর কাছেও করার মতো কিছু ছিলো না। নিজের বোনের লাইফের সেফটি এবং গ্যারান্টির জন্য সে পৃথাকে একটা ট্রাম কার্ডের ন্যায় ইউজ করছে। আপাতত তার আপির সেফটিই তার কাছে ফার্স্ট প্রায়োরিটি।

তূর্য নীরবে উঠে দাঁড়ায়। অত:পর পৃথার দিকে তাকিয়ে বলে,

“ চলো। যাওয়া যাক। “

পৃথা ধীর স্বরে প্রশ্ন করে,

“ কোথায় যাবো আমরা? “

“ আগে তোমার বাসায়। “

কথাটুকু বলেই তূর্য একহাত বাড়িয়ে পৃথার একটা হাত ধরে সামনের দিকে হাঁটা শুরু করে। মুহুর্তেই পৃথার চেহারায় লজ্জার আভা ছড়িয়ে পড়লো। তূর্যর প্রথম ছোঁয়া! তাও একেবারে স্বামী হিসেবে। কি তীব্র অধিকারবোধ! মনে মনে কিছুটা অবাকও হয় পৃথা। ছোটবেলা থেকেই তার কারো হাত ধরে হাঁটা পছন্দ নয়। কিন্তু এখন আর তার খারাপ লাগছে না। বিয়ের মাঝে কি কোনো অলৌকিক শক্তি আছে? তিন কবুল বলেই একটা মানুষের উপর এতো অধিকার চলে আসে?

__________

রাত পেরিয়ে ভোর হয়েছে। সবেমাত্র ফজরের আযান দিয়েছে। ধানমন্ডির চৌধুরী নিবাসে সকাল সকাল একটা প্রাইভেট কার প্রবেশ করলো। গাড়ির ফ্রন্ট সিটে পার্থর পাশে আরেকজন অপরিচিত নারীকে দেখে দাড়োয়ান সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এরকম দৃশ্য এই প্রথম দেখলেন তিনি। উনার অবাকের মাত্রা আরো বেড়ে যায় যখন দেখেন যে পার্থ গাড়ি থেকে নেমে সেই নারীকে পাজাকোলে তুলে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরেছে। দাড়োয়ান বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,

“ সক্কাল সক্কাল বাইত নতুন সিনেমা হইবো নি! “

কলিংবেলের শব্দ পেয়ে জমিলা দরজা খুলতে এসে দেখে মেইন গেটের লক খোলা ভেতর থেকে। তিনি অবাক হয়। তবুও দরজা খুলে দিতেই আরেকদফা বিস্মিত হয়ে যায়। পার্থ চমকিত জমিলাকে তেমন একটা পরোয়া না করে তরীকে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। তরী তখনও শিং মাছের ন্যায় লাফালাফি করছে আর চেঁচামেচি করে যাচ্ছে।

লিভিং রুমে এনে তরীকে নামিয়ে দিতেই তরী সবার আগে সোফা থেকে একটা কুশন তুলে পার্থর দিকে ঢিল মেরে ঝাঁঝালো স্বরে বলে,

“ অসভ্য কোথাকার! বিয়ে করেছেন দেখে মাথা কিনে নিয়েছেন নাকি? আমাকে কোলে তোলার সাহস কিভাবে হলো? হিন্দি সিনেমা চলছে এখানে? “

তরীর ছুড়ে মারা কুশনটা পার্থ একহাতে ধরে ফেলে। অত:পর বলে,

“ ভুল বলেন নি। আমাদের বিয়েটা অবশ্য কোনো সিনেমার থেকে কম ছিলো না। “

পার্থর এরকম জবাবে তরীর শরীর জ্বলে যায়। জমিলা খালা বোকার ন্যায় দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছিলো। এখানে যা হচ্ছে সব তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। উনার ভাবনার মাঝেই আবার কলিংবেল বেজে উঠে। এতো ভোর বেলায় কলিংবেলের শব্দ শুনে পার্থ ভ্রু কুচকে তাকায়। জমিলা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই পৃথা নীরব পায়ে ঘরে প্রবেশ করে।

সাত সকালে নিজের বোনকে ঘরের বাইরে থেকে আসতে দেখে যেন পার্থর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। সে বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে,

“ তুই কোথায় ছিলি? “

বিস্মিত কেবল পার্থ একা নয়, বরং পৃথাও। সে এতক্ষণ ভাবছিলো বাসায় ফিরে কি জবাব দিবে। কিন্তু এখন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তরীকে দেখে ভাবছে এই মেয়েটা কে? পৃথার আর উত্তর দিতে হলো না কষ্ট করে। তার পিছন হতে একটা পূরুষ স্বর ভেতরে প্রবেশ করতে করতে বলে উঠে,

“ আমার সাথে ছিলো। “

তূর্যকে দেখে এবার তরীও চমকে যায়। সে অবাক স্বরে বলে,

“ ছোট তুই? “

পার্থ, তরী, পৃথা তিনজনই বিস্মিত। কেউই সম্পূর্ণ ঘটনা বুঝতে পারছে না। জমিলা খালা নিজের কৌতূহল সামলাতে না পেরে বলেই ফেললো,

“ এইখানে হইতেসেডা কি? “

তূর্য নিজের বোনকে একবার মা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিলো। তার আপি ঠিক আছে দেখতে পেয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। অত:পর নির্বিঘ্নে বলে উঠে,

“ পার্থ মুন্তাসির চৌধুরী জোর করে আমার আপিকে বিয়ে করেছে। একইভাবে আমি আর পৃথাও বিয়ে করেছি। কিন্তু আমি পার্থ মুন্তাসিরের মতো অমানুষ নই। আমাদের বিয়েটা পৃথার মর্জিতেই হয়েছে। “

চৌধুরী নিবাসের বিশাল লিভিং রুমে উপস্থিত মানুষগুলোর মধ্যে দিয়ে মুহুর্তেই যেন বজ্রপাত খেলে গেলো। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই পার্থ হিংস্র ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে তূর্যর গালে একটা ঘুষি বসালো। তূর্যও কম না। সে কাল রাত হতে পার্থর প্রতি পুষে রাখা নিজের রাগ বহিঃপ্রকাশের জন্য পার্থকে পাল্টা আঘাত করলো। তাদের এই মারামারি থামানোর তাড়াহুড়ো কারো মধ্যে দেখা গেলো না। তরী এবং পৃথা দুজনেই নিজেদের ভাইয়ের কর্মকান্ডে বাকহারা হয়ে পড়েছে। জমিলা খালা তো চেয়েও অন্যের বাড়ির ব্যাপারে মুখ খুলতে পারছে না।

মারধরের মাঝেই পার্থর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,

“ তোর সাহস কিভাবে হয় আমার বোনের দিকে হাত দেওয়ার? “

তূর্য পাল্টা জবাব দেয়,

“ তুই কি ভেবেছিস, তুই একাই ব্ল্যাকমেইল করতে পারিস? তোর বোনও এখন আমার স্ত্রী। আমার বোনের সাথে কোনো অন্যায় করার আগে ১০০ বার এই কথাটা স্মরণ করবি। “

তূর্যর কথা শুনে তরী এবং পৃথা দুজনেই তাজ্জব বনে যায়। তূর্য পার্থকে আঘাত করার জন্য আবার হাত তুলতে নিলে তরী তার হাত ধরে থামিয়ে দেয়। তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে,

“ তুই আমার সিকিউরিটির জন্য এই মেয়েকে বিয়ে করেছিস? “

তরীর প্রশ্ন শুনে পৃথাও উত্তরের আশায় তূর্যর মুখের দিকে তাকিয়ে রয়। তূর্য ভনিতা না করে সোজাসাপ্টা উত্তর দেয়,

“ এছাড়া অন্য কোনো অপশন ছিলো না আমার কাছে। আমি যা করেছি তোর জন্য করেছি। এই লোক এখন আর তোকে ইউজ করে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করতে পারবে না। “

তূর্যর কথা শেষ হতে না হতেই তার গালে স্ব শব্দে একটা চড় বসালো তরী। তূর্য বিস্ময় নিয়ে তরীর দিকে তাকাতেই তরী বলে উঠে,

“ তুই এতো অমানুষ কবে হলি ছোট? ছি! “

“ আমি কি করেছি আপি? “

“ তুইও এই পার্থ মুন্তাসিরের মতো ব্ল্যাকমেইলিং গেম শুরু করলি? তোর আর এই অসভ্যের মধ্যে পার্থক্য কই থাকলো? ইউ বোথ আর সেম। দুজনেই নিজেদের স্বার্থে বিয়ের খেলা শুরু করেছিস। পুতুল পেয়ে রেখেছিস আমাদের? “

কথাটা বলেই তরী রাগে কাপতে থাকলো। পৃথা তূর্যের জবাব শুনে তখনই ধপ করে একটা সোফায় বসে পড়ে। তার দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ। মস্তিষ্ক শূন্য। তরী জোরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে পৃথার দিকে ফিরে তাকালো। শান্ত গলায় তাকে প্রশ্ন করে,

“ তুমি এসবের কিছু জানতে? “

পৃথা কেবল মাথা নেড়ে না বললো। তরী ফের প্রশ্ন করে,

“ তাহলে ওকে বিয়ে করলে কেন? “

পৃথা টলমলে চোখে তূর্যর দিকে তাকিয়ে জবাব দেয়,

“ ভালোবেসে। “

সাথে সাথে তার গাল গড়িয়ে অশ্রু পড়ে। তূর্য তা দেখে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। তরী নিজের মাথায় হাত দিয়ে একপাশে সোফায় বসে পড়ে। তার মাথা ভনভন করছে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুটো পুরুষের প্রতিই তার তীব্র ঘৃণা কাজ করছে। সে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলে উঠে,

“ আমি পৃথার সাথে আলাদা কথা বলতে চাই। “

তূর্য অধৈর্য্য গলায় বলে,

“ তোর কারো সাথে কথা বলতে হবে না আপি। তুই বাসায় ফিরে চল। তোর যত রাগ দেখানোর বাসায় গিয়ে দেখাস। “

তরী অগ্নি দৃষ্টি তাক করে বলে উঠে,

“ কোথাও যাবো না আমি। এখানেই থাকবো। তুই কে আমার উপর হুকুম চালানোর? “

পার্থ মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। যাক! অন্তত এই বিষয় নিয়ে তার এখন মাথা ঘামাতে হবে না। সবাইকে এখনো মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তরী পৃথার দিকে তাকিয়ে বলে,

“ আমার তোমার সাথে কথা আছে। অন্য কোথাও চলে। “

পৃথা নীরবে উঠে দাঁড়িয়ে নিচ তলার গেস্ট রুমের দিকে হাঁটা ধরে। তরীও তার পিছু পিছু যায়। তারা চলে যেতেই পার্থ জমিলা খালাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

“ খালা আমাদের একা থাকতে দিন। “

তিনিও সাথে সাথে চলে যায়। পার্থ ক্রোধভরা দৃষ্টি নিয়ে তূর্যর দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

“ আমার বোন বোকা। কিন্তু আমি নই। “

তূর্য চোয়াল শক্ত করে বলে,

“ আমার বোন নিজে এখানে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেখে আকাশে উড়া বন্ধ কর। আমার বোনের কোনো ক্ষতি করার চিন্তা করলে আমি তোকে মেরে দশ হাত মাটির নিচে পুতে দিবো। “

__________

গেস্টরুমে আসতেই তরী ভিতর থেকে দরজা লক করে আগে নিজেকে শান্ত করে। পৃথা এখনো নিশ্চুপ বসে আছে। তরী পৃথার পাশে বসে সর্বপ্রথম প্রশ্ন করে,

“ বয়স কত তোমার? “

“ ১৮। “

তরী রাগে নিজের মাথা চাপড়ায়। তার পৃথাকে দেখেই মনে হচ্ছিলো মেয়েটা তার তুলনায় বয়সে অনেক ছোট। তরীর এই মুহুর্তে তূর্যকে আরেকটা চড় মারতে ইচ্ছে করছে। তরী নিজেকে সামলে নিয়ে পৃথার দুটো হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,

“ আমি এখন যা বলবো মন দিয়ে শুনবে পৃথা। উই বোথ আর ভিক্টিম। তোমার ভাই ব্ল্যাকমেইল করে জোর করে আমাকে বিয়ে করেছে। আমার ভাইয়ের সন্দেহ ছিলো তোমার ভাই হয়তো আমার সাথে খারাপ কিছু করতে পারে। সেজন্য ও তোমাকে বিয়ে করে কাইন্ড অফ সেফটি ইন্সুইরেন্স হিসেবে যেটা সম্পূর্ণ অনুচিত হয়েছে। এই পর্যন্ত আমরা ওদের স্টুপিডিটির স্বীকার হয়েছি। কিন্তু এখন আমাদের ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে হবে। তোমার ভাইকে হ্যান্ডেল করার জন্য আমি যথেষ্ট। কিন্তু তোমার সাথে যেই অন্যায় হয়েছে সেটার শোধ তোমাকে তুলতে হবে। তুমি তূর্যর সাথে যাবে। নিজেকে একা ভাববে না। আমি আছি তোমার সাথে। আমার পাপাও এক দু’দিনের মধ্যে ফিরে আসবে। সব শোনার পর উনিও তোমার পাশে থাকবে। তোমার শুধু একটাই কাজ। নিজের খেয়াল রাখবে আর তূর্যর উপর যেভাবে ইচ্ছে প্রতিশোধ নিবে। কারণ তোমার ভাইয়ের উপর আমি মোটেও দয়া করবো না। এদের উপর দয়া করা উচিতও না। দয়া এবং ক্ষমার অযোগ্য এরা। জাস্ট রিমেম্বার, এদের এইটুকুই বুঝাতে হবে যে আমাদের বিয়ে করা এদের লাইফের সবথেকে বড় ভুল। “

পৃথা কোনো জবাব দেয় না। সে ফ্যালফ্যাল করে তরীর দিকে তাকিয়ে রয় কেবল।

__________

তরী এবং পৃথা লিভিং রুমে এসে উপস্থিত হতেই তূর্য একদন্ড নিজের বোনের দিকে তাকিয়ে পৃথার হাত ধরে বলে উঠে,

“ চলো। “

পার্থ শান্ত কিন্তু ভয়ংকর সুরে বলে,

“ আমার বোন কোথাও যাবে না। “

তূর্য রক্তিম চোখে পার্থর দিকে তাকিয়ে বলে,

“ আমার বউ আমার সাথে যাবে। কারো বুকে কলিজা থাকলে বাঁধা দিয়ে দেখাক। “

পার্থ কিছু বলতে যাবে তার আগে পৃথা নিষ্প্রাণ গলায় বলে উঠে,

“ তুই যা করেছিস এটা তার শাস্তি বড় দা। “

পার্থ আর কিছু বলতে পারে না। সে নিশ্চুপ বোনের দিকে তাকিয়ে রয়। তার চোখের সামনে দিয়েই তূর্য পৃথার হাত ধরে বেরিয়ে যায়। তরী পার্থর দিকে তাকিয়ে হেসে বলে উঠে,

“ ডোন্ট ওয়ারি। আই’ল মেক শিওর টু টার্ন ইউর লাইফ ইনটু হেল। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে