Monday, July 7, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 329



যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-৩১+৩২

0

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩১.

নিজের বড় ছেলে এবং একমাত্র মেয়ের হুট করে হয়ে যাওয়া বিয়েতে মনের অনেক শখ আহ্লাদই পূরণ করতে পারে নি আফজাল সাহেব এবং সাদিকা বেগম। কিন্তু সেইসব শখ ছোট ছেলের বিয়ের উছিলায় পূরণ করে নেওয়ার একটা সুযোগ পেতেই তারা তা লুফে নেন।

আজ শোভন এবং মধুমিতার হলুদ সন্ধ্যার অনুষ্ঠান। শোভনের ইচ্ছে অনুযায়ী দুজনের একসাথেই হলুদ হবে। হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য চৌধুরী নিবাসের বাড়ির বাগান এবং ছাদ বেশ আকর্ষণীয় ভাবে সাজানো হয়েছে। ছাদে মূলত বর ও কনেকে হলুদ দেওয়া হবে। আর বাড়ির বাগানে গেস্টদের খাবারের আয়োজন করা হয়েছে।

বাড়ির বড় বউ হিসেবে তরী আজ সারাদিন শাশুড়ির সাথে বিভিন্ন কাজে হাত মেলাচ্ছে। সবশেষে শাশুড়ির কথা মতন মধুমিতা ঠিকঠাক তৈরি হচ্ছে কিনা কিংবা কিছু প্রয়োজন কিনা সেদিকটা দেখতে ব্যস্ত সে।

পার্থও আজ সারাদিন একমাত্র ভাইয়ের হলুদের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিয়ে বেশ দৌড়াদৌড়ি করছে। এক মুহুর্তের জন্যও তরীর দেখা পায়নি সে। সকল গেস্টরা ইতিমধ্যে এসে পড়েছে। সকলেই পালাক্রমে বাড়ির বড় বউয়ের খোঁজ করছে। পার্থ তাই আর অপেক্ষা না করে নিচে চলে আসে তরী তৈরি হয়েছে কিনা দেখতে।

__________

নিজের বেডরুমের কাঠের দরজাটা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করতেই আয়নার সামনে একটা অপ্সরা দেখতে পায় পার্থ। কমলা এবং গোলাপি রঙের মিশেলে জামদানি শাড়ি পরিহিত তরী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হলুদের বাটির থালাটা ফুল দিয়ে সাজাতে ব্যস্ত। দরজা খোলার শব্দ পেয়েই ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে পার্থকে দেখে বলে উঠে,

“ দেখুন না কেমন হয়েছে? আমি আগে কখনো সাজাই নি। “

তরী মূলত হলুদের স্বচ্ছ কাচের বাটিকে বুঝিয়ে এই কথাটা বলে। কিন্তু পার্থ তা শুনে না। সে এগিয়ে গিয়ে তরীর দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে বলে,

“ অপূর্ব লাগছে। “

তরী সরু চোখে পার্থর দিকে মুখ তুলে তাকায়। মুহুর্তেই সে পার্থর দৃষ্টি দেখে তার বুকে মৃদু আঘাত করে রুম থেকে ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে,

“ আপনার এই দৃষ্টি আমি ভালো করে চিনি। একশো হাত দূরে থাকবেন আজকে আমার থেকে। বহু কষ্টে এই মেকাপ করেছি আর চুল খোপা করেছি। “

কথাটুকু বলে বেশিদূর যেতে পারে না তরী তার আগেই হাতে টান লেগে পিছিয়ে আসে সে। ব্যালেন্স বিগড়ে একহাতে থাকা হলুদের বাটিটা পড়ে যেতে নিলেই পার্থ নিজের ডানহাতে তা ধরে ফেলে। তরী সাথে সাথে ফুসে উঠে,

“ পার্থ! আম্মা আমাকে তাড়াতাড়ি উপরে যেতে বলেছে। শোভন আর মধুমিতাও অলরেডি উপরে চলে গিয়েছে। হলুদের অনুষ্ঠানে বর কনে সহ সকলে উপস্থিত কেবল হলুদই নেই। “

পার্থ ভ্রু কুচকে বলে,

“ যেতে মানা করেছে কে আপনাকে? “

“ হাত ছাড়ুন তাহলে। “

“ আমি কখন বললাম ছাড়বো না? “

“ উফ পার্থ! “

তরীর তাড়াকে তোয়াক্কা করে না পার্থ। সে একহাতে স্বচ্ছ কাঁচের বাটি হতে সামান্য হলুদ বাটা তুলে নিয়ে তরীর ঘাড়ের পিছনে লাগিয়ে দেয়। তরী চোখ বড় বড় করে বলে,

“ পাগল হয়ে গিয়েছেন? কার হলুদ কাকে দিচ্ছেন? “

“ আমাদের বিয়ের সময় আমি ব্যতীত সবাই আপনাকে হলুদ লাগিয়েছিলো। সেই হিসাবের খাতাটা তোলা ছিলো। আজ পূরণ করে নিলাম। “

তরীর বিরক্ত মাখা মুখে মুহুর্তেই সলজ্জ হাসি ফুটে উঠে। সেই হাসি দেখে পার্থ কপোকাত হয়। সকল তাড়া নিমিষেই মস্তিষ্ক থেকে মুছে যায়। কাচের বাটিটা একপাশে রেখে হাত বাড়িয়ে তরীর খোপায় গোজা বেলী ফুলের মালাটা একটানে খুলে ফেলে। মুহুর্তেই ঝরঝর করে পিঠময় ছড়িয়ে পড়ে কালো চুলের গোছা। পার্থ আবার খানিকটা হলুদ বাটা হাতে নিয়ে শাড়ির আঁচল ভেদ করে তরীর নির্মেদ পেটের একপাশে তা মেখে দেয়। অত:পর ফিসফিসিয়ে বলে,

“ হিসাব বুঝে নিয়েছি তরী রশীদ। চাইলে যেতে পারেন এখন। বাঁধা দিবো না। “

এইটুকু বাক্য শুনতেই তরী সাথে সাথে একহাতে বাটি এবং অন্য হাতে শাড়ির কুচি সামলে দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নেয়। দরজার কাছাকাছি যেতেই পার্থ পিছন থেকে বলে উঠে,

“ কেউ দেখে ফেলার ভয় মনে রাখবেন না। পার্থ মুন্তাসিরের স্ত্রী বাকি সকলের জন্য নিষিদ্ধ। যে চোখ তুলে তাকানোর সাহস করবে সে নিজের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলবে। “

__________

সকলের দৃষ্টি বর কনের দিকে থাকলেও বর ও কনে ব্যস্ত একে অপরকে দেখতে। কখনো নজর লুকিয়ে তো কখনো প্রকাশ্যে। অবশ্য এটা নিয়ে এই পর্যন্ত তাদের বন্ধুমহল কম লেগ পুল করে নি। তবুও তারা সেটার তোয়াক্কা করলো না। যেই প্রেমিক যুগল প্রেম করার সময়ই কখনো কারো তোয়াক্কা করে নি তারা বিয়ের একদিন আগেই বা কার পরোয়া করবে?

হলুদের একফাঁকে শোভন মধুমিতার দিকে অনিমেষ তাকিয়ে থেকে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,

“ অবশেষে তোমাকে আমার পাওয়া হলো মধু। “

মধুমিতা জবাব দেয় না। তাদের আজকের এই পরিণতির পিছনে সবটাই অবদান শোভনের। নিলখেত রোড হতে শুরু করে টিএসসি রোড পর্যন্ত সম্পূর্ণ সড়ক সাক্ষী শোভনের সেই অবদানের। উড়নচণ্ডী এক রমণীর মনে প্রথমে প্রেমের বীজ বুনন করে। অত:পর রোজ নিয়ম করে সেই ছোট্ট প্রেম চারায় পানি দিয়ে তাকে বৃদ্ধি পেতে সাহায্য করে। সেই ছোট্ট চারা আজ বড় বৃক্ষে রূপ ধারণ করেছে। শাখা-প্রশাখা, ডাল-পালা ছড়িয়ে ছায়া দিতে শিখেছে। সেইজন্য মধুমিতা শোভনের কাছে চির কৃতজ্ঞ।

__________

নিজের ছোট দা’র বিয়ে নিয়ে সবথেকে এক্সাইটেড থাকা পৃথা ছাদের এককোণে বসে আছে নীরব ভঙ্গিতে। বেশ অস্থির লাগছে তার। এতো লাউড মিউজিক ও মানুষের সমাগম আচমকাই তার কাছে বেশ অস্বস্তিকর ঠেকছে। তূর্যটাও উধাও হয়ে গিয়েছে যেনো এই বাসায় আসার পর থেকে। তার আম্মা বিয়ের এতো ব্যস্ততার মাঝেও একমাত্র মেয়ে জামাইর খাতির যত্নে কোনো কমতি রাখছে না। বরং ঢের বেশিই করছেন। তূর্য যদিও অনেকবার বলেছে তাকে নিয়ে এতো ব্যস্ত না হতে কিন্তু সাদিকা বেগম তা শুনলে তো!

পৃথার আর বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু চাইলেও এখান থেকে যেতে পারছে না। তাই দম খিচে বসে বসে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার প্রহর গুনছে। আচমকা তরী তার পাশে এসে বসে প্রশ্ন করে,

“ খারাপ লাগছে পৃথা? “

পৃথা শুকনো গলাটা এক ঢোক গিলে ভিজিয়ে সামান্য হেসে বলে,

“ না বড় ভাবী। এভাবেই বসে আছি। “

তরী শান্ত গলায় বলে,

“ ঠিক থাকলে তুমি এখানে চুপচাপ বসে থাকতে না। শরীর খারাপ লাগছে নাকি মন খারাপ? “

“ আসলে একটু মাথা ধরেছে ভাবী। “

তরী চিন্তিত গলায় বলে,

“ তাহলে এখানে বসে আছো কেন? নিচে রুমে যাও। রেস্ট করো। “

“ না ভাবী। আমি এখন ভাইয়ের বিয়ে রেখে গিয়ে নিচে বসে থাকলে কেমন দেখায় না বিষয়টা? “

“ বোকা মেয়ে। কেউ কিছু বলবে না। তুমি তোমার রুমে গিয়ে রেস্ট করো। আমি ছোটকে খুঁজে পাঠাচ্ছি। বলদটা এই বাসায় আসার পর থেকে বউ কিংবা বোন কাউকেই চিনছে না। “

পৃথা হেসে উঠে নিচে চলে যায়। তরী ব্যস্ত হয়ে সম্পূর্ণ ছাদ ঘুরে তূর্যকে খুঁজে বের করে। তারপর তাকে পৃথার কাছে পাঠিয়ে দেয়।

__________

তূর্য নিচে নেমে পৃথার রুমে প্রবেশ করতেই দেখে পৃথা দুই হাতে মাথা চেপে ধরে বিছানার এককোণে বসে আছে। তূর্য ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে গিয়ে তার সামনে বসে প্রশ্ন করে,

“ বেশি খারাপ লাগছে? মাথা টিপে দিবো? “

পৃথা কথা বলে না। কেবল মাথাটা সামনের দিকে ঝুকিয়ে তূর্যের হাতের বাহুতে ঠেক দেয়। তূর্য অপর হাতে আলতো করে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। আচমকা পৃথা তার একহাত জাপ্টে ধরে বলে,

“ তূর্য মাথা ঘুরাচ্ছে প্রচুর। “

কথাটা বলতে বলতেই তার শরীর ঢলে পড়ে। তূর্য চিন্তিত ভঙ্গিতে পৃথাকে আগলে ধরে। সাথে সাথে তার মনে পড়ে যায় পৃথার ডায়াবেটিস আছে। আবারও কি ব্লাডে সুগার লেভেল কম হয়ে গিয়েছে নাকি? সে সাথে সাথে তরীকে কল করে। কিন্তু কিছুক্ষণ কল করার পরও তরী ফোন রিসিভ করে না। তূর্য পৃথাকে ডাকতে ডাকতে নিজের পাপার নাম্বার ডায়াল করতে নেয় কিন্তু তখনই তার রুমে সাদিকা বেগম প্রবেশ করে। তূর্য উনাকে দেখে সাথে সাথে বলে,

“ আম্মা আপিকে একটু ডেকে আনেন প্লিজ। পৃথা সেন্সলেস হয়ে গিয়েছে। “

__________

রুমের মধ্যে পৃথা, তরী এবং সাদিকা বেগম উপস্থিত কেবল। বাকি সকলে দরজার অপরপাশে দাঁড়ানো। হলুদের অনুষ্ঠান ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গিয়েছে। গেস্টরা সকলেই ফিরে গিয়েছে।

তরী পৃথার ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,

“ তোমার সুগার লেভেল তো নরমাল আছে। “

পৃথা ক্লান্ত গলায় বলে,

“ জানিনা ভাবী, প্রচুর মাথা ঘুরাচ্ছে হঠাৎ করে। “

সাদিকা বেগম তরীকে রুমের একপাশে ডেকে নিয়ে নিচু স্বরে কিছু কথা বলে। সাথে সাথে তরীর মস্তিষ্ক সচল হয়। এতক্ষণ সে-ও এই সন্দেহ করে নি। নিশ্চিত হওয়ার জন্য তার একটু বের হতে হবে। তাই সাদিকা বেগমকে বলে,

“ আম্মা আপনি পৃথার সাথে থাকুন। আমি পাঁচ মিনিটেই ফিরছি। “

বলেই সে বেরিয়ে যায়। রুম থেকে বের হতেই সকলে তাকে ঘিরে ধরে। তরী আপাতত কিছু একটা বুঝ দিয়ে পার্থকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ আমার সাথে একটু সামনের ফার্মেসি চলুন। “

পার্থ চিন্তিত গলায় বলে,

“ কি লাগবে আমাকে বলো। আমি গিয়ে নিয়ে আসছি। “

“ না। আমার সাথে যেতে হবে। “

পার্থ আর বাড়াবাড়ি করে না। তরীকে নিয়ে এলাকার ফার্মেসিতে চলে যায়। ভাগ্যিস ফার্মেসি তখনো খোলা ছিলো। তরী একাই ভিতরে প্রবেশ করে কিছু একটা কিনে বেরিয়ে আসে। বাসায় ফিরে সাথে সাথে আবার পৃথার রুমের ভেতর চলে যায় সে। প্রায় পনেরো মিনিট পর সাদিকা বেগম ও তরী দুজনই বেরিয়ে আসে রুম থেকে। তরী শান্ত গলায় তূর্যকে বলে,

“ তুই ভিতরে যা। “

স্ত্রীর কাছে যাওয়ার অনুমতি পেতেই আর এক মুহুর্ত দেরি করে না তূর্য। দরজাটা লক করে রুমের ভেতর প্রবেশ করতেই বিছানার এককোণে বসে থাকা পৃথা তার দিকে মুখ তুলে তাকায়। তূর্য তার সামনে গিয়ে চিন্তিত গলায় বলে,

“ কি হয়েছে পৃথা? “

পৃথা কোনো জবাব না দিয়ে হাতে থাকা প্রেগন্যান্সি কিটটা তূর্যর দিকে তুলে ধরে। কিছুটা ডিজিটাল থার্মোমিটারের ন্যায় দেখতে বস্তুটির দিকে তূর্য ভ্রু কুচকে দুই সেকেন্ড তাকায়। অত:পর সেটাতে নীল রঙের দুটো দাগ দেখতে পেয়েই বিস্মিত নয়নে পৃথার দিকে তাকায়। পৃথা মনে সামান্য ভয় নিয়ে কাঁপা গলায় বলে,

“ আই এম প্রেগন্যান্ট তূর্য। “

চলবে…

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩২.

অনাকাঙ্ক্ষিত সংবাদে সম্পূর্ণ চৌধুরী নিবাস যেন স্তব্ধ বনে গিয়েছে। লিভিং রুমে উপস্থিত আফজাল সাহেব বেশ চিন্তিত মুখে বসে আছে। সরাসরি কিছু না বললেও উনার মুখে সেই চিন্তার ছাপ স্পষ্ট ফুটে আছে। এমন নয় যে উনি খুশি নয়। নানা হতে যাচ্ছেন এই খুশিতে যেমন উনি ভিতরে ভিতরে গদগদ অনুভব করছেন, একইভাবে নিজের একমাত্র মেয়ের চিন্তাও উনাকে ক্লান্ত করে তুলছেন।

মেয়েটা এখনো ছোট, নাজুক। সবেমাত্র তার জীবন শুরু হলো। কিভাবে কি সামলাবে তার মেয়ে? সাদিকা বেগম অবশ্য তেমন একটা চিন্তা করছেন না। উনি খুশি মনে মিষ্টির প্লেট হাতে নিয়ে উপস্থিত হন লিভিং রুমে। সবার আগে নিজের বেয়াই হুমায়ুন রশীদের উদ্দেশ্যে বলেন,

“ ভাইসাব! দাদা হচ্ছেন। মিষ্টি মুখ করেন। “

হুমায়ুন রশীদ হাসিমুখে প্লেট হতে একটি কালো মিষ্টি তুলে নেয়। মনে মনে উনিও বেশ চিন্তিত। তার বুঝদার ছেলেটা এতো হতচ্ছাড়া কবে হলো? এক দুটো বছর কি অপেক্ষা করা যেতো না? মেয়েটা সবে মেডিক্যালে টিকেছে। হুমায়ুন রশীদ আরো কতো স্বপ্ন দেখছিলো। উনার একমাত্র পুত্রবধূও ডাক্তার হবে। উনার মুখ উজ্জ্বল করবে। কিন্তু এখন এই বাচ্চা মেয়েটা কিভাবে কি সামলাবে? সংসার সামলাবে, পড়াশোনা সামলাবে নাকি বাচ্চা সামলাবে?

তরী নিচু স্বরে শাশুড়িকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ আম্মা, আগামীকাল তো রাতে বিয়ে। সকালের দিকে আমি পৃথাকে নিয়ে হসপিটাল যাই? একবার চেকাপ করিয়ে শিওর হয়ে নেওয়াটা ভালো না? “

সাদিকা বেগম মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। উনি জানে চেকাপেও একই রিপোর্ট আসবে। তিন তিন সন্তানের জননী তিনি। উনার বিচক্ষণ দৃষ্টি এক দেখাতেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে যে উনি নানি হতে চলেছেন। এই সম্পূর্ণ ঘটনায় নীরব ভূমিকা পালন করছে পার্থ এবং শোভন। নিজেদের খুশি প্রকাশে অপরিপক্ক দুই ভাই নীরব থাকাটাই শ্রেয় মনে করছে আপাতত।

__________

পৃথার শরীর ভয়ে ঠান্ডা হয়ে আছে। তূর্যকে গুড নিউজটা দেওয়ার পর থেকেই তূর্য একদম স্রোতহীন নদীর ন্যায় শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে। দেখে মনে হচ্ছে খুব কঠিন কিছু হিসেব মিলাচ্ছে। পৃথা কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে ডাকে,

“ তূর্য? “

“ তুমি কি সেদিন মেডিসিনটা খাও নি পৃথা? “

সহজ একটা প্রশ্ন। এই সহজ প্রশ্নের উত্তরও একদম ছোট এবং সহজ। কিন্তু আপাতত ভয়ের চোটে এই উত্তর দেওয়াটা বেশ কঠিন মনে হচ্ছে পৃথার। তূর্য কি খুব রেগে যাবে উত্তরটা শুনলে? কোনো মতে মাথা দুলিয়ে না বলে পৃথা।

তূর্য একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মনে মনে নিজেকে হতচ্ছাড়া বলে দু চারটে গালি দিতেও ভুলে না। পৃথা এখন যেই বয়সটাতে আছে সেখানে তার কাছে সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। সেই স্বপ্নের জগতে এই ছোট অতিথিকেও তার কাছে খুশির বার্তা মনে হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। তূর্যের আগেই উচিত ছিলো পৃথাকে খুলে সব বুঝিয়ে বলা।

তূর্যের ভাবনার মাঝেই পৃথা ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করে,

“ আপনি কি খুশি না? “

পৃথার প্রশ্নটা শুনতেই তূর্যের ধ্যান ফিরে। দ্বিতীয় দফায় নিজের বোকামির উপর বিরক্ত হয় সে। তার নিশ্চুপতায় নিশ্চয়ই মেয়েটা ভয় পেয়েছে? হয়তো এটাও ভাবছিলো যে তূর্য খুশি নয়?

তূর্য স্ত্রীর ছোট্ট দেহটা টেনে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে। হৃদয় শীতল করা স্বরে শুধায়,

“ অনেক খুশি আমি। “

পৃথার অস্থির মন শান্ত হয়। ঠিক এইটুকু আলিঙ্গনের আশায় সে মুখিয়ে ছিলো এতক্ষণ। তা পেতেই সে প্রশান্তি নিয়ে চোখ বুজে ফেলে। তূর্য ফের বলে,

“ আঠারো যেমন তোমার লাকি সংখ্যা, একইভাবে পঁচিশ আমার লাকি সংখ্যা আজ থেকে। আর কোনো অপ্রাপ্তি নেই। “

তূর্যের কাধে দায়িত্বের পরিমাণ বেড়েছে। এই দায়িত্ব নিয়ে সে মোটেও ভয় পাচ্ছে না। বরং সর্বাঙ্গে এক অদ্ভুত অনুভূতি টের পাচ্ছে সে। ছেলে, ভাই, স্বামী হওয়ার থেকে বড্ড অন্যরকমের অনুভূতি এটা। প্রতিরাতে ঘুমানোর সময় পৃথা তার বুকে লেপ্টে ঘুমিয়ে থাকে। সেই প্রশস্ত বুকে জায়গা হবে এখন আরেকটা ছোট্ট দেহের। দৃশ্যটা কল্পনা করতেই তূর্যের ঠোঁটের কোণের হাসি দীর্ঘ হয়। পৃথাকে আরেকটু বুকে টেনে নিয়ে বলে,

“ এখন থেকে আমার সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। আমার কথার বাহিরে কিচ্ছু করবে না। আমাদের বেবির জন্য যা বেস্ট হবে সব করবো আমি। “

__________

পৃথাদের বাসার ছাদে রেলিং ধরে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে তূর্য। আগামী দু’দিন তারা এই বাসায়ই থাকবে। পৃথাটা বেশ কিছুক্ষণ আগেই খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়েছে। নতুন জায়গায় তূর্যের সহজে ঘুম আসে না। বেশ কিছুক্ষণ রুম জুড়ে পায়চারি করে তাই ছাদে এসে দাঁড়িয়েছে সে। এখানে অবশ্য কিছুটা স্বস্তি অনুভব করছে সে। মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে অসংখ্য চিন্তা ও ভাবনা। সকল চিন্তাই তার পৃথা আর বেবিকে ঘিরে। কিভাবে কি করবে। কিভাবে সব ম্যানেজ করবে। কিভাবে পৃথার জন্য সব সহজ করা যাবে। এই প্রেগন্যান্সি জার্নির সবটা শারীরিক কষ্ট পৃথা একা সহ্য করবে। সেই কষ্টটুকুর ভাগ তূর্য না নিতে পারলেও অন্তত সেই কষ্ট কিভাবে কিছুটা কমিয়ে আনা যায় সেই চিন্তা করাটা তার সাধ্যের মধ্যে আছে।

তূর্যের ভাবনার মাঝেই তার পাশে এসে দাঁড়ায় একজন। তূর্য ঘাড় ঘুরিয়ে মানুষটাকে দেখতেই অবাক হয়। এই বাসায় একমাত্র এই মানুষটার সাথেই তার সম্পর্ক স্বাভাবিক হয় নি এখনো। কোথাও একটা অস্বস্তি কাজ করে তার মধ্যে। তার বোন এই লোকটাকে মেনে নিতে পারলেও সে পারে না।

পার্থ বিনা জড়তায় বলে উঠে,

“ কংগ্রেচুলেশনস। “

তূর্য যথাসম্ভব স্বাভাবিক গলায় বলে,

“ ধন্যবাদ। “

পার্থ জানে এই ছেলেটার মনে তার প্রতি রাগ জমে আছে। কিন্তু যেহেতু তাদের মাঝে আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে সেহেতু নিজেদের মধ্যে একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরী করার চেষ্টা করতে হবে। আর সেই চেষ্টার শুরুটা নাহয় পার্থই করলো। সে শান্ত স্বরে বলে,

“ পৃথাকে ভালো রাখার জন্য ধন্যবাদ। “

“ আমার স্ত্রীকে ভালো রাখা আমার দায়িত্ব। সেটার জন্য ধন্যবাদের প্রয়োজন নেই। “

“ আমি তোমার স্ত্রীকে ভালো রাখার জন্য ধন্যবাদ বলছি না। আমার বোনকে ভালো রাখার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। “

তূর্য সরু চোখে তাকিয়ে বলে,

“ আপনি আমার বোনের উপর কি জাদু করেছেন? আপি আপনাকে মেনে নিলো কি করে? “

পার্থ হাসে। হাসতে হাসতেই বলে,

“ আমার বোন তোমার উপর যেই জাদু করেছে একই জাদু দ্বারা তোমার বোনকে কাবু করেছি আমি। তোমার চোখে তাকালেই এখন যেমন পৃথার জন্য ভালোবাসা দেখা যায় একইভাবে তোমার বোনও এখন আমাকে চোখে হারায়। “

তূর্য কিছু বলে না। পার্থ এই মুহুর্তে হাসি থামিয়ে বলে,

“ তরীকে আমি আগে থেকেই ভালোবাসতাম তূর্য। তোমাকে দেওয়া আমার থ্রেটগুলো সব মিথ্যে ছিলো। শুধুমাত্র তোমাকে ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যেই সেসব বলেছিলাম। “

তূর্য কিছুটা অবাক হয়। কিন্তু সেটা নিজের মনে চেপে রেখে শান্ত গলায় বলে,

“ কিভাবে কি হয়েছে এসব কিছুই আমি জানতে চাই না। যেহেতু দাবি করছেন যে আমার আপিকে ভালোবাসেন সেহেতু তাকে ভালোও রাখার চেষ্টা করুন। ভাই হিসেবে এইটুকুই চাওয়া রইলো আপনার কাছে। “

পার্থ মৃদু হেসে তূর্যর কাধে হাত রাখে। অত:পর দুষ্টুমি করে বলে উঠে,

“ বাই দ্যা ওয়ে, হানিমুনে গেলাম আমি আর তরী। মামা হওয়ার কথা ছিলো তোমার। অথচ এখানে আমিই মামা হয়ে গেলাম। “

পার্থর ঠাট্টা শুনে এবার তূর্যও মৃদু হাসে।

__________

সকাল সকাল তূর্য এবং বড় ভাবীর সাথে হসপিটালে গিয়ে বেশ কিছু টেস্ট করিয়ে এসেছে পৃথা। এই সামান্য দৌড়াদৌড়ির ধকলেই তার ছোট্ট নাজুক শরীর বেশ নেতিয়ে পড়েছে। বাড়িতে ফিরেই মুখ ভরে বমি করে এখন ক্লান্ত চিত্ত নিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে সে। বিয়ে বাড়ির এতো ঝামেলা। সেসব ফেলে সাদিকা বেগম চাইলেও মেয়ের কাছে দু দন্ড এসে বসতে পারছে না। কিন্তু তরীর কারণে তার চিন্তা কিছুটা কম হচ্ছে। মেয়েটা আঠার মতো পৃথার সাথে সাথে থাকছে।

পৃথার পাশে বসে একটা বাটিতে দুটো আনার খুলে আলাদা করতে ব্যস্ত। ফুপ্পি হওয়ার খুশির পাশাপাশি একমাত্র ননদের সব খেয়াল রাখার দায়িত্বও যেন সে তুলে নিয়েছে। রুমের একপাশে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে তূর্য। তার শক্ত মন হঠাৎই ভীষণ নরম হয়ে গিয়েছে। একদিনের সামান্য ধকলেই পৃথার এই অবস্থা, এই কয়েকটা মাস মেয়েটা কিভাবে পার করবে?

তরী আনার খুলে পৃথার দিকে বাটিটা এগিয়ে দিতেই পৃথা ক্লান্ত গলায় বলে,

“ আমার এটা পছন্দ না ভাবী। “

তূর্য সামান্য ধমকে উঠে বলে,

“ পছন্দ না মানে কি হ্যাঁ? শরীরে রক্ত নেই আবার এতো কথা বলো। চুপচাপ খাও। “

তরী পাল্টা ভাইকে ধমকে উঠে বলে,

“ কমনসেন্স কোথায় গিয়েছে তোর ছোট? ওর উপর চিল্লাচ্ছিস কেন? পার্সোনাল চয়েস থাকতেই পারে ওর। “

তূর্য সাথে সাথে দমে যায়। তরী আদুরে গলায় পৃথাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ তোমার পছন্দ না জানি। কিন্তু বাবুর হয়তো এটা পছন্দ। আর তুমি জাস্ট চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। খাবারটা বাবুর পেটে যাবে। সো আর চিন্তা কিসের? “

পৃথা বাধ্য হয়ে নাক মুখ ছিটকে চামচ দিয়ে অল্প অল্প আনার দানা তুলে মুখে দেওয়া শুরু করে। তরী হেসে বলে উঠে,

“ প্রথম কয়েক মাসই এসব প্রবলেমস বেশি হবে। এরপর দেখবে বমি আর অস্থিরতা অনেকটাই কমে আসবে। “

তরীর কথায় পৃথা কিছুটা আশ্বস্ত হলেও তূর্য হয়না। পৃথা যে খাবার দাবার নিয়ে কি পরিমাণে পিকি তা তার ইতিমধ্যে জানা হয়ে গিয়েছে। এই মেয়েকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু খাওয়াতে রাজি করানো আর একটা যুদ্ধ জয় করা এক সমান। তূর্য মনে মনে বলে,

“ বেবি তুমি অন্তত তোমার মা’য়ের মতো হয়ো না। এক পিকিকে সামলাতেই আমার হিমশিম অবস্থা, তুমিও যদি এরকম হও পরে বাবা কিভাবে সামলাবো বলো? “

__________

সাধারণত বিয়ের দিন বিদায়ের বেলায় সবসময়ই একটা থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করে। কনে নিজের পরিবার থেকে দূরে যাওয়ার দুঃখে অশ্রুও বিসর্জন দেয়। এটাই বহুকাল ধরে চলে আসা রীতি। কিন্তু সেই রীতি যেন মধুমিতার বেলায় খাটলো না। সারা বিয়ের অনুষ্ঠান জুড়ে তার মুখে লেপ্টে থাকা হাসিটা বিদায় বেলায়ও মলিন হলো না। শোভন মজার ছলে তার কানে ফিসফিসিয়ে বলে,

“ অন্তত ফরমালিটির জন্য হলেও দু ফোটা অশ্রু বিসর্জন দেও। “

মধুমিতা বেশ হাসি মুখে নিয়েই জবাব দেয়,

“ কাদবে আমার শত্রুরা। তোমাকে পেয়েছি এখন আবার কিসের কান্নাকাটি হ্যাঁ? “

মধুমিতার কথা শুনে শোভন হাসে। এই সন্ধ্যাটা তার কাছে স্বপ্নের ন্যায়। জীবনের নতুন আর প্রিয় অধ্যায় শুরু হতে চলেছে তাদের। সেই অধ্যায় তো হাসিমুখেই শুরু হওয়া উচিত। শোভন অস্ফুটে বলে,

“ তোমার এই হাসির স্থায়িত্ব অমর হোক মধু। “

__________

চশমার গ্লাস ভেদ করে নিজের হাতের স্মার্ট ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছেন আফজাল সাহেব। সাদিকা বেগম সবেমাত্র শোভনকে নিজের রুমে পাঠিয়ে এসেছেন। রুমে ঢুকতেই আফজাল সাহেবের মুখে লেপ্টে থাকা মৃদু হাসি দেখে প্রশ্ন করে,

“ কি দেখে হাসছেন? “

আফজাল সাহেব আগ্রহভরা গলায় স্ত্রীকে ডেকে বলে,

“ এদিকে আসো পার্থর আম্মা। “

সাদিকা বেগম পাশে এসে বসতেই নিজের ফোনটা স্ত্রীর দিকে ধরে আফজাল সাহেব। ফোনের স্ক্রিনে নিজেদের কম্পলিট ফ্যামিলি ফোটোটা দেখে সাদিকা বেগমেরও মুখে হাসি ফুটে উঠে। এই ছবিটা আজকের তোলা। ছবিতে সোফার মাঝে বসে আছে শোভন এবং মধুমিতা। তাদের দুইপাশে বসে আছে আফজাল সাহেব এবং সাদিকা বেগম। সোফার পিছনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে তাদের পরিবারের আরো দুটি যুগল। তরী, পার্থ, তূর্য এবং পৃথা। সকলের মুখে লেপ্টে আছে খুশির ছাপ। আফজাল সাহেব উৎফুল্ল গলায় বলে উঠে,

“ ছবিটা অনেক সুন্দর আসছে না পার্থর আম্মা? “

“ হ্যাঁ। “

“ ভাবতেসি ছবিটা ফ্রেমে বাধাই করে আমাদের রুমে টানাবো। “

“ হ্যাঁ। ভালো হবে। আমাদের প্রথম ফ্যামিলি পিকচার এটা। “

আফজাল সাহেব শব্দ করে হেসে বলে উঠে,

“ নাতি নাতনিরা আসলে তখন আরেকটা ফ্যামিলি ফোটো তুলে টানাবো আমি। “

স্বামীর কথা শুনে সাদিকা বেগমও হাসেন। ছেলেমেয়েদের সামনে আফজাল সাহেব যতটা গম্ভীর হয়ে থাকে তাদের আড়ালে ততটাই নরম এবং কোমল মনের মানুষ তিনি। এই কোমল হৃদয়ের আফজাল সাহেবকে ভালোবেসেই তো নিজের পিতার অবাধ্য হয়েছিলো সাদিকা বেগম। অবশ্য তা নিয়ে কোনো আফসোসও নেই উনার মধ্যে। কারণ সেই পিতা নিজেই আফজাল সাহেবকে জামাই বলে মেনে নিয়েছেন।

__________

রাত একটা বাজে হঠাৎ শোভনের জরুরি তলবে ছাদে এসে উপস্থিত হয় পার্থ, তরী, পৃথা ও তূর্য। এতো রাতে তাদের এভাবে ছাদে ডাকার কারণ কেউই জানে না। ছাদে আসতেই তারা দেখে শোভন আর মধুমিতা আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত।

পৃথা লাগামহীন প্রশ্ন করে বসে,

“ এই ছোট দা! নিজের বাসর রেখে ছাদে কি করিস? “

তূর্য সাথে সাথে পৃথার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকায়। বড় ভাইয়ের সাথে এমন কথা কেউ বলে বুঝি? অন্য সময় হলে শোভন জোরে সোরে একটা ধমক দিতো পৃথাকে। কিন্তু আজ তার মন বেশ ফুরফুরে আর পৃথাও এখন প্রেগন্যান্ট তাই আর সে ধমক দেয় না। উল্টো হাসি হাসি মুখে বলে,

“ মধুর অনেক ইচ্ছা ছিলো আমরা ছয়জন মিলে ট্রিয়ো কাপল ডেটে যাবো। কিন্তু কখন কে ফ্রি থাকি তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। তাই আজ যেহেতু সবাই একসাথে আছি ভাবছি আজ রাত সবাই একসাথে আড্ডা দেই। “

শোভন আর মধুর এই আবদার কেউই নাকোচ করে না। পৃথা আর তূর্য ছাদের একপাশে ইট সিমেন্টের তৈরী বসার জায়গাটায় পাশাপাশি বসে। তাদের মুখোমুখিই বসে মধু আর শোভন। পার্থ আর তরী অবশ্য বসলো না। তারা রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। সকলের গায়েই এখনো অনুষ্ঠানের পোশাক। মুহুর্তেই নিস্তব্ধ রাত মুখোরিত হয় তিন জোড়া কপোত-কপোতীর মিষ্টি আলাপে। এদের মধ্যে পৃথা, মধু আর শোভন মিলেই আড্ডা আরো বেশি জমিয়ে তুলেছে।

তরী আজ সোনালী রঙের মসলিন শাড়ি পড়েছে। শাড়ির গায়ে ডার্ক মেরুন রঙের পাথরের কারচুপি কাজ করা। আড্ডায় মশগুল পার্থের চোখ ঘুরে ফিরে বারবার তরীর দিকে গিয়ে ঠেকছে। আচমকা তার ধ্যান ভাঙে পৃথার ডাকে। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায় সে। পৃথা প্রবল উৎসাহ নিয়ে বলে উঠে,

“ অনেকদিন তোর আর ছোট’দার সাথে গলা মিলিয়ে গান গাওয়া হয় না আমার। চল না এখন গান গাই। “

তূর্য এবং তরী অবাক হয়। এই তিন ভাই বোনই যে এতো গান পাগল তা তাদের জানা ছিলো না। তরী মনে মনে ভয় পায়। তার স্বামীর যেই বেহায়া প্লেলিস্ট তা যদি এখানে বেজে উঠে তাহলে সে লজ্জায় ছাদ থেকে লাফ দিবে। শোভন বলে উঠে,

“ কোনটা গাবি ডিসাইড কর। “

পৃথা দাঁত বের করে হেসে বলে,

“ আমাদের প্রিয় জ্যামিং সং। “

শোভন আর পার্থও একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে দেয়। পৃথা মধুমিতা, তরী ও তূর্যের উদ্দেশ্যে বলে উঠে,

“ আমরা স্টার্ট করছি তোমরাও সাথে জয়েন করো। “

মুহুর্তেই তিন ভাই বোন পালাক্রমে গেয়ে উঠে,

“ দো লাফজ কি হে
বাত এক হি হে
কিউ দারমিয়া ফির
রুকি রুকি,
কেহ ভি না পায়ে
রেহ ভি না পায়ে
কিউ বেওয়াজা হে
ইয়ে বেবাসি। “

তিন ভাইবোন এতদূর গেয়ে বাকিদের দিকে তাকাতেই বাকিরাও হেসে তাদের সাথে গলা মিলায়,

“ তুম মে হাম হে,
হাম মে তুম হো,
তুমসে হাম হো,
হামসে তুম হো,
কিসমাতো সে মিলতে হে
দো দিল ইয়াহা।
হার কিসিকো নেহি মিলতা
ইয়াহা পেয়ার জিন্দেগী মে,
খুশ নাসিব হে হাম
জিনকো হে মিলি
ইয়ে বাহার জিন্দেগী মে। “

গলা ছেড়ে গান গাওয়া তিন যুগলের চোখে মুখেই অকৃত্রিম হাসি লেপ্টে আছে। গানের লাইনের অর্থ বুঝার সময় নেই কারো। সবাই ব্যস্ত মুক্ত তারার মেলার নিচে নিজেদের এই মুহুর্তটুকু উপভোগ করতে। সকলের কণ্ঠেই রাজ্যের উচ্ছ্বাস।

পৃথা গান গাইতে গাইতে তূর্যের একহাত জড়িয়ে ধরে তার কাধে মাথা রাখে। তূর্য আশেপাশে তাকিয়ে টুপ করে পৃথার কপালে নীরবে চুমু আকে। শোভন আর মধুমিতা ইতিমধ্যে গান গাইতে গাইতে একে অপরের চোখে হারিয়ে গিয়েছে। পার্থ সবার আড়ালে নিজের একহাত তরীর পিঠের পিছন দিয়ে নিয়ে তার কোমর জড়িয়ে ধরে। সাথে সাথে তরী তার দিকে ফিরে তাকায়। পার্থ সেই চোখে চেয়ে থেকেই নিষ্প্রভ গলায় শুধায়,

“ আপনি হতে তুমিতে নেমে আসা উচিত আমাদের। তাই না তরী? “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-২৯+৩০

0

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৯.

সকাল ১০ টা বাজে শুরু হওয়া সমাবেশ দুপুর পর্যন্ত বেশ ভালোভাবেই এগোচ্ছিলো। সমাবেশে উপস্থিত ছিলো পার্থর পার্টির সকল উচ্চপদস্থ নেতারাও। আচমকা সেই চলতি সমাবেশ স্তব্ধ হয়ে যায় দূর হতে নিক্ষিপ্ত এক টিয়ার সেলের ধোঁয়া দেখে। মুহুর্তেই পরিবেশ বিক্ষিপ্ত রূপ ধারণ করে। সেই সাথে টিয়ার সেল এবং বোমা হামলার গতি বেড়েই চলে। এরকম অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সমাবেশ বানচাল হয়। অনেকে আহত হয় তো অনেকে নিহত। আবার কেউ কেউ জীবন নিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে বের হয় তো কেউ কেউ সেই হামলার মধ্যেই ঝাপিয়ে পড়ে আক্রমণকারীদের খুঁজতে।

পরিস্থিতি সামলানোর জন্য কিছু সময়ের ব্যবধানেই পুলিশ এসে উপস্থিত হয় সেখানে। কিন্তু ততক্ষণে ক্ষয়ক্ষতি যতদূর হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে। দূর্বৃত্তরা ততক্ষণে পালিয়ে গিয়েছে। তবে পরিস্থিতি তখনো ভীতিকর। রাস্তা জুড়ে বিভিন্ন আহত মানুষের মেলা। বিভিন্ন যানবাহন এবং দোকান আগুনে জ্বলজ্বল করছে।

সেই পরিস্থিতির মাঝেই সেখানে এসে উপস্থিত হয় তরী। আসিফের মুখ থেকে খবরটা পেতেই সে দৌড়ে কোনোমতে গাড়িতে করে ড্রাইভ করে এসে এখানে পৌঁছেছে। পায়ে এখনো হসপিটালের স্লিপারস তার। আর সামনে গাড়ি নেওয়ার পরিস্থিতি নেই। তাই সেখানেই নেমে পড়ে সে। ভীত চোখে চারিদিক দেখছে সে। ছোট ছোট কদম ফেলে বিশাল রাস্তা ধরে সামনে এগুতে এগুতে আবার পার্থর নাম্বার ডায়াল করে। নাম্বারটা এখনো আনরিচেবল আসছে। এতো মানুষের ভীড়ে এখন পার্থকে কিভাবে খুঁজে বের করবে সে?

আরেকটু সামনে যেতেই তরী দেখে রাস্তার একপাশে আহত অবস্থায় পড়ে আছে একজন লোক। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে এখনো কোনো এম্বুলেন্স এসে পৌঁছায় নি। তরী দ্রুত লোকটার কাছে এগিয়ে গিয়ে উনার ফেটে যাওয়া মাথার জখম দেখতে শুরু করে। আশপাশ হতে আরেকটা ছেলেকে ডেকে উনার মাথা চেপে ধরে সামনের দিকে যেতে বলে। আর নিজের ফোন থেকে হসপিটালে কল করে কিছু এম্বুলেন্স ইমারজেন্সি এখানে পাঠাতে বলে।

ফোনটা রাখতেই কাছ থেকে শোভনের গলার স্বর ভেসে আসে,

“ ভাবী? “

তরী চকিতে নিজের বামে ফিরে তাকায়। তরীকে এখানে দেখে যেন শোভন বিস্মিত। সে অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,

“ আপনি এখানে কেন? “

“ তোমার দাদা? পার্থ কোথায়? “

তরীর উৎকণ্ঠা দেখে শোভন বুঝে যে সে-ও তার মতো এখানকার পরিস্থিতির কথা জানতে পেরেই ছুটে এসেছে। শোভন আশাহত গলায় বলে,

“ দাদার দলের একজনের সাথে দেখা হলো একটু আগে। দাদা নাকি যেদিক থেকে টিয়ার সেল নিক্ষেপ করা হচ্ছিলো সেদিকে ছুটে গিয়েছিলো। এরপর আর কেউ দাদাকে দেখে নি। “

তরীর শরীর ভয়ে যেন ঠান্ডা হয়ে আসছে। তবুও সে দৃঢ় মনবল রেখে বলে,

“ কিছু হয় নি। হি ইজ অলরাইট। “

শোভন চিন্তিত গলায় বলে,

“ ভাবী আমার সাথে চলুন। আপনার এখানে থাকা উচিত হবে না। দাদা জানতে পারলে রাগ হবে। “

তরী আশেপাশে তাকিয়ে দেখে সে বাদে আর কোনো নারী এখানে উপস্থিত নেই। পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে সে আরেকবার পার্থর নাম্বারের কল করে। এবার কল বেজে গিয়েছে। কিন্তু রিসিভ হয় না। কিছুদূর বেজেই কেটে যায়। কিন্তু সাথে সাথেই তরীর নাম্বারে একটা ম্যাসেজ আসে।

“ ঠিক আছি জান৷ “

ম্যাসেজটুকু দেখেই তরী একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। শোভনের দিকে তাকিয়ে বলে,

“ পার্থ ম্যাসেজ করেছেন। ঠিক আছেন উনি। “

“ যাক আলহামদুলিল্লাহ। “

তরী শোভনের সাথে নিজের গাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলে উঠে,

“ এসব যারা করেছে ওদের ধরে জেলে দেওয়া হবে না? “

“ এসব কারা করেছে সেটা তো একটা ওপেন সিক্রেট ভাবী। কিন্তু আমাদের উপর উপরমহল থেকেও প্রেশার থাকে। চাইলেই সবাইকে এরেস্ট করা যায় না। “

“ তুমি এসবের তোয়াক্কা করো শোভন? “

প্রশ্নটা সরাসরি শোভনের চোখের দিকে তাকিয়ে করে তরী। শোভন হেসে জবাব দেয়,

“ আমি এখানে পুলিশ অফিসার হিসেবে নয় ভাই হিসেবে এসেছি ভাবী। তাই এই কেসের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু যেসব কেস আমি নিজে সামলাই সেগুলোর ক্ষেত্রে কেবল সত্যের তোয়াক্কা করি আমি। “

শোভনের উত্তর শুনে তরী মৃদু হেসে তার হাতের বাহুতে হাত রেখে বলে উঠে,

“ সবসময় এমন থেকো। ইনশাআল্লাহ একদিন তুমি তোমার সততার পুরুষ্কার পাবে। সেদিন সবথেকে বেশি খুশি আব্বাই হবে দেখে নিও। “

তরীর কথা শুনে শোভন চুপচাপ হাসে। আসলেই কি তার আব্বা কখনো তার প্রতি সন্তুষ্ট হতে পারবে? আব্বা তো তার এই চাকরিটা কখনোই পছন্দ করে না।

__________

একটা আন্ডার কন্সট্রাকশনের বহুতল ভবনে দাঁড়িয়ে আছে পার্থ। তার সাথে রয়েছে কেবল দু’জন মানুষ। একজন হলো আসিফ এবং অন্যজন এই মুহুর্তে তাদের থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়ানো। পার্থ আসিফের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলে উঠে,

“ এতো বোকা কেন তুই আফিস? তরী ফোন করলেই তোর ওকে সব বলতে হবে? “

“ সরি ভাই। তখন আসলে মাথা কাম করতেসিলো না। একদিকে এমন পরিস্থিতি আরেকদিকে ভাবী ফোন দিসে। তাই মুখ ফসকায় বইলা ফেলসি। “

“ আর কখনো এসব সিচুয়েশন সম্পর্কে তরী কিংবা আম্মা আব্বাকে জানাবি না। রাজনীতি যেহেতু করছি তাই এরকম বহু পরিস্থিতিতে পরতেই হবে। কিন্তু তার জন্য পরিবারকে টেনশনে রাখার মানে হয় না। ভাগ্যিস জহিরকে তরীকে ফোলো করার জন্য রেখেছি। নাহয় তো জানতেও পারতাম না যে তরী আমাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়বে। “

“ থাক ভাই আর চিন্তা কইরেন না। বেডি মাইনষে জামাইর ব্যাপারে একটু আবেগী হয়। কিন্তু জহিরে তো কইলোই যে ভাবী শোভন ভাইর লগে হসপিটাল গেসে গা। তাইলে আর চিন্তার কিছু নাই। “

“ তুই যা এখন। আমার এর সাথে জরুরি কথা আছে। “

আসিফ সরু চোখে তাদের থেকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষকে দেখে বলে উঠে,

“ আপনি শিওর এরে বিশ্বাস করা উচিত হইবো ভাই? “

পার্থও একই দিকে দৃষ্টি রেখে বলে উঠে,

“ কথাটা বিশ্বাস অবিশ্বাসের নয়। আমার দিকে আগুন ছুড়ে মারা হয়েছিলো। ও যদি সেই মুহুর্তে আমাকে টেনে না সড়াতো তাহলে এতক্ষণে আমার জানাজা পড়তি তোরা। “

আসিফ আঁতকে উঠে বলে,

“ আল্লাহ মাফ করুক ভাই। “

পার্থ আর কথা না বাড়িয়ে বলে,

“ এখন যা। “

আসিফ চলে যেতেই পার্থ দু কদম এগিয়ে গিয়ে একটা চেয়ারের উপর বসে প্রশ্ন করে,

“ এখন বলো আমাকে বাঁচানোর পিছনে তোমার কি স্বার্থ রয়েছে? “

__________

ভর সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে পার্থ। সাদিকা বেগম এবং আফজাল সাহেব তখন লিভিং রুমেই বসে ছিলেন। টেলিভিশন নিউজের কল্যাণে ইতিমধ্যে আজকের সমাবেশ বানচালের পরিস্থিতি সম্পর্কে তারা অবগত। তরী হতে এটাও জেনেছে যে পার্থ ঠিক আছে। তবুও সন্তানের জন্য পিতামাতার মনে যেই ভয় থাকে একই ভয় তাদের ভিতরেও কাজ করছিলো। কিন্তু ছেলেকে স্বচক্ষে সুস্থ দেখে কিছুটা শান্ত হয় তারা। পার্থ সাদিকা বেগমকে প্রশ্ন করে,

“ তরী বাসায় ফিরেছে আম্মা? “

“ হ্যাঁ। কিছুক্ষণ আগেই তো ফিরলো। “

পার্থ অবাক হয়। সাধারণত তরী আগে বাসায় ফিরলে সবসময় পার্থ বাসায় ফিরে তাকে নিচতলায়ই আব্বা আম্মার সাথে দেখতে পায়। তাহলে আজ তরী নামলো না কেন? সে আর অপেক্ষা না করে উপরে চলে আসে। বেডরুমে প্রবেশ করতেই তরী দৌড়ে এসে তার বুকে হামলে পড়ে। এতক্ষণ রুমে বসে সে পার্থর উপরে আসার অপেক্ষায়ই ছিলো। আচমকা তরী জড়িয়ে ধরতেই পার্থর বুক শীতল হয়ে আসে। কিন্তু পিঠে অনুভব করে বিষের ন্যায় ব্যাথা। না চাইতেও মুখ দিয়ে চাপা আর্তনাদ করে উঠে সে।

সাথে সাথে তরী ছিটকে তার থেকে দূরে সড়ে যায়। এতক্ষণের আকুল চোখে এখন চিন্তার রাজ্য এসে ভর করেছে তার। সে উৎকণ্ঠিত গলায় প্রশ্ন করে,

“ কি হয়েছে আপনার? “

পার্থ জবাব দেয় না। দাঁতে দাঁত খিচে চোখের পলকে ব্যথাটুকু গিলে নেয় সে। হাসিমুখে বলে,

“ কিছুনা। “

তরী পার্থর কথাটুকু বিশ্বাস করে না। তাকে টেনে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে বলে,

“ পাঞ্জাবি খুলুন। “

পার্থ ঠাট্টার স্বরে বলে,

“ নির্লজ্জের হাওয়া লেগেছে বুঝি আপনার? “

তরী চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বলে,

“ আমি আপনার সাথে মশকরা করছি না। “

স্ত্রীর চোখ পাকানো দেখে পার্থ হার মেনে নেয়। সাবধানে নিজের পাঞ্জাবিটুকু খুলতেই তরী ব্যস্ত নয়নে তার পিঠের দিকে তাকায়। সাথে সাথে তরী আঁতকে উঠে,

“ আল্লাহ! কিভাবে হয়েছে এসব? “

পার্থর শুভ্র পিঠের একপাশে কালসিটে দাগ হয়ে আছে। অপরপাশে বিশাল এক ব্যান্ডেজ। সেই ব্যান্ডেজের কাপড় ভেদ করে গাঢ় খয়েরী রক্তও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এতটুকু দৃশ্য দেখেই তরীর মস্তিষ্ক এলোমেলো হয়ে যায়। সকালেই তো মানুষটা সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় বেরিয়েছিলো। দুপুরে সেই ঘটনার পর তরীকে জানিয়েছে যে উনি ঠিক আছে। তবে সন্ধ্যা বেলায় এ কি অবস্থা দেখছে সে?

তরীর আতংকিত দৃষ্টি দেখে পার্থ তাড়াতাড়ি নিজের পিঠ আড়াল করে ফেলে। তরীকে টেনে নিজের সামনে বসিয়ে দিয়ে বলে,

“ ওদিকে আপনার তাকাতে হবে না। আমার চোখের দিকে তাকান। “

তরী পার্থর চোখের দিকে তাকাতেই তার অশ্রুসিক্ত চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। আহত গলায় বলে,

“ মিথ্যা বলেছেন আপনি। “

“ মিথ্যা বলি নি তরী। ঠিক না থাকলে কি এখন আপনার সামনে থাকতাম আমি? “

তরী পার্থর কথার ধরনে বিরক্ত হয়। রাগ মিশিয়ে বলে,

“ ঠিক থাকলে পিঠে কি হয়েছে আপনার? “

পার্থর মনে পড়ে যায় দুপুরের দৃশ্য। মানুষের দৌড়াদৌড়ির মাঝে আচমকা একটা ইট এসে তার পিঠের উপর পড়ে। সেইটার আঘাত সামলে উঠতে উঠতে আরেকটা ইটের কোণা এসে পিঠে লেগে মুহুর্তেই শুভ্র পাঞ্জাবির পিঠের কাছটা রক্তে ভিজে যায়। এজন্যই পিঠে ব্যান্ডেজ করানোর পর সে আসিফকে দিয়ে একটা নতুন পাঞ্জাবি কিনে আনিয়ে পড়ে বাসায় ফিরে। কিন্তু সেইসব বিবরণ আপাতত তরীকে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে না তার। মেয়েটা দুপুর থেকে বেশ ভীতিকর একটা পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এসব পরিস্থিতি তার পরিবারের জন্য পুরনো হলেও তরীর জন্য নতুন। পার্থ তাই বলে,

“ তেমন কিছু না। ব্যান্ডেজ করানো হয়েছে। সেড়ে যাবে। “

তরী এবার অধৈর্য্য গলায় বলে,

“ আপনার এই কিছু না শুনে আমার প্রচুর রাগ উঠছে পার্থ। সারাদিন আমি কি অবস্থার মধ্যে দিয়ে গিয়েছি আপনার ধারণা আছে কোনো? থাকলে আপনি আমায় অন্তত একটা কল দিতেন। সারাদিন আপনাকে নিজ চোখে দেখার জন্য আকুল হয়ে বসেছিলাম। হসপিটাল থেকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে এসেছি শুধু আপনাকে দেখার জন্য। আর আপনি আমাকে কিছু খুলে বলছেন না। “

পার্থ এই মুহুর্তে তরীকে টেনে বুকে আগলে নিয়ে বলে,

“ আপনি কি অবস্থায় ছিলেন সেই ধারণা আছে বলেই এখন এই ব্যাপারে কিছু খুলে বলছি না। আর তাছাড়া খুব মাথা ব্যথা করছে আমার। সারাদিন প্রচুর ধকল গিয়েছে। “

তরীর সাথে সাথে ধ্যান হয়। পার্থকে এই অবস্থায় দেখে সে এতক্ষণ অস্থির আচরণ করছিলো। নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলে,

“ আ’ম সরি। আপনি ভুলেও কোথাও পিঠ ঠেকাবেন না। উবুড় হয়ে শুয়ে পড়ুন। আমি ফার্স্ট এইড করে দিচ্ছি ঠিক করে। “

পার্থ নীরবে হেসে বলে,

“ ওকে ডক্টর। “

ব্যান্ডেজ করা শেষ হতেই তরী ফার্স্ট এইড বক্স রেখে বলে উঠে,

“ আপনি নড়বেন না, উঠবেনও না। আমি গিয়ে খাবার নিয়ে আসছি। এসে যাতে দেখি এখানেই আছেন। “

পার্থ বিছানায় একটা বালিশ জড়িয়ে উবুড় হয়ে ছিলো। সে ঘাড় ঘুরিয়ে তরীর দিকে তাকায়। তরী দরজার কাছে যেয়ে আচমকা থেমে পার্থর দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

“ একটা জিনিস রিয়েলাইজ করলাম আজকে। “

“ কি? “

“ ভালোবেসে ফেলেছি। “

কথাটুকু বলেই তরী সাথে সাথে বেডরুম ছেড়ে বেরিয়ে যায়। পার্থ উৎফুল্ল গলায় পিছন থেকে প্রশ্ন করে,

“ কাকে? “

তরী তখনো সিটিং এরিয়া পেরিয়ে বেরোয়নি। পার্থর এমন বোকার ন্যায় প্রশ্ন শুনে সে সেখান থেকেই জবাব দেয়,

“ কলা গাছের মূলাকে। “

__________

রাত তখন দুটো বাজে। পার্থর উবুড় হয়ে শুয়ে থেকে ঘুম আসছিলো না। তরী এতক্ষণ জেগে থেকে তার উপর নজর রাখছিলো। কিছুক্ষণ আগেই ক্লান্তিতে চোখ বুজতেই ঘুমে তলিয়ে যায় সে। পার্থ শোয়া থেকে নীরবে উঠে বসে। বেশ তেষ্টা পাচ্ছে তার। বেডসাইড টেবিলের উপর থেকে পানির বোতল নিয়ে সামান্য পানি খায় সে। অত:পর নীরবেই নিজের রুম ছেড়ে বেরিয়ে আসে সে।

রুম থেকে বের হতেই সে দেখে শোভনের রুমের দরজা খোলা। রুমের ভেতর আলোও জ্বলছে। পার্থর ভ্রু কুচকে আসে। শোভন কি এখনো ঘুমায় নি? কৌতূহল বসত একবার চেক করার জন্য এগিয়ে যায় পার্থ। কিন্তু রুমের দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই সে দেখে রুমে কেউ নেই। এসময় শোভনকে রুম ব্যতীত আর কোথায় পাওয়া যেতে পারে তা ভালো করেই জানে পার্থ। তাই দাঁড়িয়ে না থেকে ছাদের দিকে পা বাড়ায় সে।

ছাদের এককোণে ইট সিমেন্টের তৈরী একটা বসার জায়গায় বসে একটা ফাইল দেখছে শোভন। ছাদের এইপাশটা বেশ গাছপালা এবং রঙ বেরঙের লাইট দ্বারা সাজানো। ছাদের এইটুকু অংশ পৃথার সাজানো।

আচমকা পার্থ ভরাট কণ্ঠে বলে উঠে,

“ এখানে একা বসে আছিস কেনো? “

শোভন মাথা তুলে একবার ভাইকে দেখে নিয়ে আবার ফাইলের দিকে দৃষ্টিপাত করে বলে,

“ একা কোথায়? এতক্ষণ মধু আমাকে কোম্পানি দিচ্ছিলো আর এখন এই ফাইল আমাকে কোম্পানি দিচ্ছে। ‘“

পার্থ নিঃশব্দে ভাইয়ের পাশে বসে। পার্থকে বসতে দেখে শোভন ফাইলটা বন্ধ করে পাশে রেখে বলে,

“ কিছু বলবি? “

“ কিছু নিয়ে স্ট্রেসড তুই? “

শোভন লুকায় না। সোজাসাপ্টা বলে,

“ একটা কেস নিয়ে সামান্য স্ট্রেসড। এখনো সলভ করতে পারছি না। “

পার্থ বিষয়টা আর বেশি ঘাটায় না। কেবল শোভনের কাধে হাত রেখে আশ্বস্তের সুরে বলে উঠে,

“ তুই পারবি আমি জানি। “

শোভন বলে,

“ ভাবী অনেক ভয় পেয়েছিলো আজকে। এখনো এই রাজনীতি ছাড়বি না তুই? “

পার্থ হাসে। হাসতে হাসতেই বলে,

“ তুই সবসময় বলিস না আব্বা তোর চাকরি অপছন্দ করে? বিষয়টা আসলে সেটা নয়। আব্বা তোকে নিয়ে চিন্তা করে। সেই চিন্তা থেকেই উনি তোকে অনেক কথা বলে। কিন্তু তুই কথাগুলো অন্যভাবে বুঝিস। “

কথাটুকু বলেই পার্থ এবার সিরিয়াস মুখে বলে,

“ কথা সেটা না। কথা হলো আমাদের চিন্তার জন্য কি তুই তোর চাকরি কখনো ছাড়তে পারবি? জানি পারবি না। একইভাবে রাজনীতিটাও আমি কখনো ছাড়তে পারবো না। রিস্ক সব কিছুতেই আছে। ভালো খারাপ সব কিছুতেই আছে। তাই বলে তো আমরা সব ছেড়েছুড়ে ঘরে বসে থাকতে পারবো না। তাই না? “

শোভন ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে একমনে কথাগুলো শুনে। সে কিছু বলবে তার আগেই একটা নারীকণ্ঠ ভেসে আসে,

“ সরি টু ডিস্টার্ব ইউ গাইস বাট আমি কি আসতে পারি? “

তরীকে দেখতে পেয়েই শোভন উঠে গিয়ে তার হাত থেকে কফির ট্রে নিয়ে বলে উঠে,

“ আরে ভাবী। আপনি দাঁড়িয়ে কেন? আসুন বসুন। “

তরী এসে বসতে বসতে বলে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যেতেই দেখি পার্থ রুমে নেই। উনাকে খুঁজতে বেরিয়ে দেখি তুমিও রুমে নেই। ছাদের দরজা খোলা দেখে দৌড়ে গিয়ে তিনজনের জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে আসি।

পার্থ হেসে বলে উঠে,

“ আর কয়েকদিন পর থেকে চারজনের জন্য কফি বানিয়ে আনতে হবে আপনাকে। “

তরী হেসে শোভনের দিকে তাকিয়ে বলে,

“ তা শোভন? মাঝরাতে ছাদে বসে মধুমিতার সাথে জমিয়ে প্রেম করছিলে বুঝি? “

“ ইশ ভাবী। ইউ মিসড ইট। আপনিও যদি বিয়ের আগে দাদার প্রেমে পড়ে যেতেন তাহলে প্রি ম্যারিড লাইফের প্রেমের এক্সপেরিয়েন্স হয়ে যেতো। “

তরী পার্থর দিকে তাকিয়ে লাজুক হেসে বলে,

“ পোস্ট ম্যারিড লাইফের প্রেমও মন্দ নয়। “

চলবে…

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩০.

ঘড়িতে সময় সকাল ১০টা। তূর্য ল্যাপটপের সামনে বসে আছে। পৃথা তার পাশে বসে একবার তূর্যর চেহারা দেখছে তো আবার ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকাচ্ছে। তার তুলনায় তূর্যের চেহারায় চিন্তার ছাপ বেশি। পৃথা বিরক্তি মাখা গলায় বলে,

“ এতো টেনশন নিয়ে লাভ নেই। মেডিক্যালে আমি জীবনেও টিকবো না জানি। পরীক্ষা দিয়েছে লাখ লাখ স্টুডেন্ট। সবাই তুখোড় মেধাবী। তাদের মাঝে সিলেক্ট হবে মাত্র কয়েক হাজার। সুতরাং আমার টিকার চান্স জিরো। “

তূর্য বিরক্তি মাখা গলায় বলে,

“ একদম ব্যাডবাজ দিবে না পৃথা। আর তুমি এতো চিলড হয়ে বসে আছো কেন? যাও নামাজে বসে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করো। “

পৃথা ভ্রু কুচকে বলে,

“ এইযে মশাই! অতি চিন্তায় আক্কেল কি গোয়াল ঘরে ফেলে এসেছেন? এখন ফজরের ওয়াক্তও না, যোহরের ওয়াক্তও না। তাহলে আমি কোন ওয়াক্তের নামাজ পড়বো? “

পৃথার কথা শুনে তূর্য সামান্য চোখ পাকিয়ে তাকায়। পৃথা তার তোয়াক্কা না করে তূর্যের কোলে মাথা রেখে শুয়ে বলে উঠে,

“ আর তাছাড়া আল্লাহ অলরেডি আমাকে এতো কিছু দিয়ে রেখেছে যে আমার আর চাওয়ার কিছু নেই। “

তূর্য প্রশ্ন করে,

“ কি কি পেয়েছো শুনি? “

পৃথা একগাল হেসে জবাব দেয়,

“ এতো হ্যান্ডসাম হাজবেন্ড, কেয়ারিং পাপা, হ্যাপি ফ্যামিলি, আবার একই বছরে দুইটা ভাবীও পেয়ে গেলাম। আমার তো মনে হয় এটা আমার লাকি ইয়ার। ১৮ তেই সব পেয়ে গিয়েছি আমি। “

তূর্য পৃথার কথা শুনতে মশগুল তখনই তার ফোন বেজে উঠে। সে ফোন হাতে নিয়ে বিছানা থেকে নামতে নামতে পৃথাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ ল্যাপটপের দিকে নজর রাখো। এনি মোমেন্ট রেজাল্ট এসে পড়বে। “

কথাটুকু বলে সে ফোন রিসিভ করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। পৃথা বিছানায় উবুড় হয়ে শুয়ে অলস নয়নে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে থাকে। বার কয়েক নিজের রোল নম্বর বসিয়ে ট্রাইও করতে থাকে। এরকম করতে করতে আচমকা রেজাল্টের পেজ তার সামনে ওপেন হয়ে যায়।

পৃথা ভাবলেশহীন ভাবে নিজের নাম দেখে চোখ বুলিয়ে নিচের দিকে তাকাতেই একলাফে উঠে বসে। চোখ কচলে নিয়ে আবার স্ক্রিনের দিকে তাকায় সে। সাথে সাথে সে চিৎকার করে তূর্যর নাম ডাকে। এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। নিচ থেকে তূর্যের কথা বলার শব্দ ভেসে আসছে।

পৃথার চিৎকার শুনে তূর্যও কথা বলতে বলতে সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছিলো। কিন্তু পৃথাকে দৌঁড়ে নিচে নামতে দেখে সে সেখানেই থেমে যায়। মনে মনে বিরক্ত হয়। এভাবে লাফিয়ে নামার মানে কি? পড়ে হাড্ডি ভাঙতে চায় নাকি এই মেয়ে?

সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমেই পৃথা একলাফে তূর্যের গলা জড়িয়ে ধরে। তূর্য একহাতে কানে ফোন ধরে রেখে আরেক হাতে পৃথার কোমর জড়িয়ে ধরে। এখন আর পৃথার পা জোড়া মেঝে স্পর্শ করছে না। সে তূর্যের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,

‘’ আই পাসড তূর্য। আই ডিড ইট। “

তূর্য সাথে সাথেই প্রশান্তির সাথে চোখ বুজে ফেলে। তাড়াতাড়ি কোনো এক বাহানা দেখিয়ে ফোনটা কেটে পকেটে রেখে এবার দু’হাতে পৃথাকে আগলে ধরে সে। কপালে শান্ত ভঙ্গিতে একটা চুমু খেয়ে কোমল গলায় বলে,

“ জানতাম তুমি পারবে। “

পৃথা তূর্যকে ছেড়ে দিয়ে বলে,

“ আমি আম্মা, আব্বা আর পাপাকে জানিয়ে আসি। উনারা নিশ্চয়ই অনেক খুশি হবে। “

কথাটা বলেই পৃথা যেভাবে দৌড়ে নিচে নেমেছিলো একইভাবে দৌড়ে উপরে চলে যায়। তূর্য তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে হাসে। অত:পর নিজের ফোন বের করে জার্নালিস্ট হারুনুর খলিদকে কল দিয়ে বলে,

“ সেদিন আপনার প্রক্সিতে আমাকে পাঠানোর জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ ভাই। নেক্সট যেদিন দেখা হচ্ছে আপনি আমার থেকে ট্রিট পাবেন। লিখে রাখেন। “

__________

দুপুর বেলায়ই পাঁচ কেজি মিষ্টি নিয়ে স্ত্রী সমেত শশুড় বাড়ি হাজির হয় তূর্য। বিয়ের পর কেবল তরীর বিয়ের উছিলায়ই কয়েকবার এই বাসায় আসা হয়েছে তার। এরপর একদিনের জন্যও তার সময় কিংবা সুযোগ হয় নি আসার। কিন্তু আজ না আসলে তা বেমানান দেখাতো।

ফোন কলের মাধ্যমে সকালেই এই বাড়ির সকলে পৃথার রেজাল্ট সম্পর্কে জেনে যায়। আফজাল সাহেব সাথে সাথে বেরিয়ে যায় বাজারের উদ্দেশ্যে। সাদিকা বেগমও একমাত্র মেয়ে এবং মেয়ে জামাইর জন্য নিজ হাতে রান্না করে হরেক রকমের খাবার।

পৃথা ঘরে প্রবেশ করতেই সবার আগে শোভনকে সামনে পায়। এক দৌড়ে এগিয়ে গিয়ে ভাইকে জড়িয়ে ধরতেই শোভন থাট্টার স্বরে বলে উঠে,

“ তূর্য ভাই। এই পড়া চোরকে কি গুলিয়ে খাইয়েছেন আপনি? আমার তো এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। এটা আসলেই আমার বোন তো? “

তূর্য ঘরে প্রবেশ করতে করতে হেসে বলে উঠে,

“ তোমারই বোন। বিশ্বাস না হলে ডিএনএ টেস্ট করিয়ে দেখতে পারো। “

পৃথা মুখ ফুলিয়ে বলে,

“ একদম মজা নিবি না ছোট দা। “

সাদিকা বেগম ব্যস্ত পায়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আগে মেয়ে জামাইর কাছে যায়। শাশুড়িকে দেখেই তূর্য সালাম দিয়ে বলে,

“ ভালো আছেন আম্মা? “

“ আলহামদুলিল্লাহ বাবা। বেঁচে থাকো। “

আফজাল সাহেবও উপর থেকে নেমে আগে মেয়ে জামাইর কাছে যায়। কুশল বিনিময় করেই তারা একসাথে লিভিং রুমে গিয়ে বসে। মুহুর্তেই বাসায় উৎসব উৎসব রব লেগে যায়। সকলেই পৃথাকে রেখে তূর্যকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পৃথা দূর হতে এই দৃশ্য দেখে কোমরে হাত রেখে বলে,

“ রেজাল্ট আমার দিলো নাকি তূর্যর? সবাই আমাকে রেখে উনাকে নিয়ে মাতামাতি করছে কেন? “

তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শোভন তার মাথায় গাট্টা মেরে বলে,

“ রেজাল্ট তোর দিয়েছে। কিন্তু ক্রেডিট তূর্য ভাইয়ের। আর তাছাড়াও উনি এই বাড়ির একমাত্র জামাই। উনার খাতিরযত্ন হবে না তাহলে কি তোর মতো ভুতনির খাতিরযত্ন হবে? “

পৃথা ঠোঁট উল্টে চেচিয়ে বলে,

“ আম্মা! তোমার ছোট ছেলে আমাকে ভূতনি বলেছে। “

মুহুর্তেই লিভিং রুমের সকলের মনযোগ তাদের দিকে স্থির হয়। সাদিকা বেগম কিছু বলবে তার আগেই শোভন পৃথাকে ভেংচি কেটে বলে,

“ ক্রাই বেবি। এখনো আমাকে বিচার দিতে হয় তোর? ভূতনিকে ভূতনি বলবো না তাহলে কি পেত্নী বলবো? “

পৃথা রাগে হাতের কাছে থাকা ফুলদানি হতে একগুচ্ছ কৃত্রিম ফুল নিয়ে শোভনকে ধাওয়া করে। শোভন দৌড়ে ডাইনিং টেবিলের চারিদিক দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে বলতে থাকে,

“ পৃথা ইজ এ ভূতনি।
ক্রাইস লাইক এ পেত্নী। “

পৃথা চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠে,

“ ছোট’দার বাচ্চা। থাম এখুনি। “

শোভন দৌড়াতে দৌড়াতেই বলে,

“ বিয়ে হয় নি এখনো আমার বাচ্চা কই থেকে আসলো? “

লিভিং রুম হতে এই দৃশ্য দেখে সাদিকা বেগম এবং আফজাল সাহেব বার কয়েক ছেলে মেয়ে দুটোকে ডাকে। কিন্তু এদের থামার কোনো নামগন্ধ নেই। এতোদিন পর দেখা হয়েছে সাথে সাথে তাদের টম এন্ড জেরির চ্যাপ্টার শুরু। তূর্য ভ্রু কুচকে দেখছে পৃথাকে। নিজের ঘরে ফিরে আসতেই এই মেয়ের দস্যীপনা শুরু। যেভাবে দৌড়াচ্ছে এখন যদি পড়ে পায়ে একটা ব্যথা পায়?

তূর্যর ভাবতে দেরি কিন্তু তা ঘটতে দেরি না। নিজের ওড়নার সাথে পা পেচিয়ে পৃথা পড়ে যেতে নিলেই সে দৌড়ে এগিয়ে যায়। কিন্তু সে পৃথার কাছে পৌঁছানোর আগেই একটা বলিষ্ঠ হাত পৃথাকে আগলে ধরে। দূর হতে পার্থকে দেখে তূর্য আর এগোয় না।

সবেমাত্র একসাথে বাড়ি ফিরেছে পার্থ এবং তরী। ঘরের দরজা খোলা থাকায় সোজা তারা ভিতরে প্রবেশ করে। পৃথাকে পড়ে যেতে দেখেই পার্থ এগিয়ে এসে তাকে সামলে কঠিন স্বরে বলে,

“ তোর কি আক্কেল জ্ঞান হবে না কখনো? “

বড় ভাইয়ের ধমক শুনে পৃথা ঠোঁট উল্টে বলে,

“ আমার দোষ নেই। তোর ভাই আমাকে আজেবাজে নামে ডাকছিলো। শাসন করতে মন চাইলে ওকে কর। “

পার্থ একবার শোভনের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

“ কি আজেবাজে নামে ডেকেছে ও তোকে? “

পৃথা এবার নালিশের সুরে বলে,

“ আমাকে ভূতনি, পেত্নী আর ক্রাইবেবি বলেছে। “

পার্থ কুচকানো ভ্রু দ্বয় শিথিল করে বলে,

“ ভুল কি বলেছে? “

পৃথা হা করে বড় ভাইয়ের দিকে তাকায়। পার্থ তার দিকে তাকিয়ে মিটমিটিয়ে হাসছিলো। পৃথার রাগান্বিত দৃষ্টি দেখেই সে দৌড়াতে দৌড়াতে বলে উঠে,

“ শোভন ভাগ। পেত্নী ঘাড় মটকাতে আসবে। “

মুহুর্তেই পৃথা দুই ভাইকে ধাওয়া করতে শুরু করে। টম এন্ড জেরি এখন ওগি এন্ড দ্যা কোক্রোচেসে পরিণত হয়। তরী সেদিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে নিজের ভাইয়ের দিকে এগিয়ে যায়। তূর্য বোনকে দেখেই উঠে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলে,

“ কেমন আছিস আপি? “

“ অনেক ভালো। “

তরী এবং তূর্যের মধ্যের মনমালিন্য অনেক আগেই মিটে গিয়েছে। কিন্তু তখনও তরী খুশি ছিলো না। কিন্তু আজকে তরীকে দেখে সত্যিকার অর্থেই খুশি মনে হচ্ছে। তূর্য একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে মনে দোয়া করে তার বোন যেন সবসময়ই খুশি থাকে।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-২৭+২৮

0

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৭.

খুব ভোর সকালে এক আদুরে স্নিগ্ধ বাতাস গায়ে এসে বাড়ি লাগতেই তরীর ঘুম ভেঙে যায়। রুমের এককোণে থাকা খোলা জানালাটা দিয়ে এই কনকনে বাতাসের আগমন। তরী শুয়ে থাকা অবস্থায়ই সেই খোলা জানালার দিকে তাকিয়ে রয়। মনে পড়ে যায় গতরাতের সেই তুখোড় বর্ষণ এবং নিজের অবাধ্য মনের সাড়া দেওয়াটা। চকিতেই বিছানার দু’পাশে চোখ বুলায় সে। অত:পর চোখ বুলায় সম্পূর্ণ রুমে। উহু। পার্থ নেই কোথাও। কোথায় গিয়েছে?

কম্বলটা গায়ে জড়িয়েই উঠে বসে তরী। গতরাতের বৃষ্টিতে ভেজা শাড়িটা অবহেলায় মেঝেতে পড়ে আছে। নিচে নেমে গিয়ে সেই শাড়িটা তুলতে ইচ্ছে হয় না তরীর। তাই বিছানার একপাশে থাকা পার্থর সেই সাদা শার্টটাই গায়ে জড়িয়ে নেমে আসে সে। এগিয়ে যায় সেই খোলা জানালার সামনে। যেখানে গত রাতে তার হাত থেকে ঝিনুক দুটো পড়েছিলো।

ঝিনুক দুটো এখনো আপন জায়গায়ই পড়ে আছে। তরী সেই দুটো শ্বেত ঝিনুককে তুলে নেয় সন্তর্পণে। ঝিনুক দুটোর দিকে তাকিয়ে থেকেই ভাবতে থাকে নিজের মনের অবাধ্যতার কারণ।

সময় পেরোয়। তরী ভাবনার জগতে বুদ হয়ে থাকে। ধ্যান ভাঙে পার্থর কোমল স্বরের ডাক শুনে। পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখে পার্থ তার থেকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে। পার্থর হাতে থাকা টাওয়ালটা দেখে বুঝতে পারে কেবল গোসল করে বেরিয়েছে সে।

তরী নিরুত্তর রয়। পার্থর মনের ভয় গভীর হয়। সে যা ভেবে ভয় পাচ্ছিলো তাই কি হচ্ছে? তরী কি তাকে ভুল বুঝছে? এই মুহুর্তে কি পার্থর নিজেকে এক্সপ্লেইন করা উচিত? মনে দ্বন্দ্ব নিয়ে পার্থ ঠিক করে আপাতত তরীকে সময় দেওয়া উচিত। তাই উল্টো দিকে ফিরে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নেয়। কিন্তু ঠিক সেই মুহুর্তে নিজের এক হাতে টান অনুভব করে সে। পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখে তরী তার একহাত ধরে রেখেছে। পার্থ প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাতেই তরী বলে,

“ কাল রাতে যা যা বলেছিলেন ডিড ইউ মিন দ্যাট? “

পার্থ এগিয়ে এসে গভীর স্বরে প্রশ্ন করে,

“ কি বলেছিলাম? “

তরী অপ্রস্তুত হয়। তবুও দৃঢ গলায় বলে উঠে,

“ ভুলে যাওয়ার অভিনয় করবেন না। “

পার্থ আরো এক কদম এগিয়ে এসে বলে,

“ জান? “

তরী সাথে সাথে নিজের দৃষ্টি নত করে ফেলে। পার্থ সেই লজ্জা মাখা মুখশ্রী দেখে সিদ্ধান্ত নেয় যেহেতু অনুভূতিরা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেই সেহেতু আর কিছু লুকিয়েও লাভ নেই। সে একহাতে তরীর থুতনি ধরে উপরে তুলে। তরী তার চোখে চোখ রাখতেই গাঢ় শীতল স্বরে বলে উঠে,

“ আই মেন্ট এভ্রি সিংগেল থিং। “

তরীর লজ্জা আর আড়ষ্টতা গাঢ় হয়। সে অস্থির অনুভব করে। পার্থ তার সেই অস্থিরতা উপলব্ধি করে প্রশ্ন করে,

“ আপনি কি রিগ্রেট করছেন? “

তরী জবাব দেয় না। নিরুত্তর রয়। পার্থর থেকে এক কদম দু কদম করে সড়ে যায়। পার্থ আহত হয়। মনে মনে আশাহত হয়। তরী শান্ত গলায় বলে,

“ ক্যান ইউ প্লিজ গো আউট? “

পার্থ আহত চোখে তরীর দিকে তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে পিছিয়ে যায়। রুমের দরজার বাহিরে পা রাখতেই তরী শান্ত পায়ে এগিয়ে আসে দরজা বন্ধ করতে। পার্থর দৃষ্টি তখনো তরীর দিকে নিবদ্ধ। তরী দরজা বন্ধ করার আগে পার্থর দিকে তাকিয়ে নরম সুরে বলে,

“ আপনি চিন্তা করবেন না। আমার সম্মতি ছিলো পার্থ। “

ব্যস! এরপরই দরজা ভিতর থেকে বন্ধ হয়ে যায়। পার্থ কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে বদ্ধ দ্বারের পানে চেয়ে রয়। অত:পর তরীর কথার অর্থ বোধগম্য হতেই তার মুখে ফুটে উঠে প্রশান্তির হাসি। সাথে সাথে দরজায় করাঘাত করে বলে উঠে,

“ তাহলে মুখের উপর দরজা দিলেন কেনো? “

ভিতর থেকে তরীর গলা শোনা যায়,

“ তবে কি এই অবস্থায় আপনার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম? “

পার্থ ইচ্ছাকৃতভাবে তরীকে লজ্জা দিতে বলে উঠে,

“ আপনার লজ্জা এখনো ভাঙে নি তরী? “

তরী লাগেজ থেকে নিজের জামা বের করতে করতে বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,

“ নির্লজ্জ। “

__________

ভর দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে অলস সময় পাড় করতে ফোন নিয়ে বসে ছিলো পৃথা। পাপা আর তূর্য কেউই বাসায় নেই। একা একা কিছু ভালোও লাগছিলো না তার। তাই নিজের ছোট দা কে কল দেয়।

থানায় বসে একটা জরুরি কেসের সম্পর্কে কেবল ডিসকাশন শেষ করলো শোভন। আজকাল তার উপর দিয়ে বেশ ধকল যাচ্ছে। বিয়ের আর বেশিদিন বাকি নেই। অথচ সেই রহস্যময় কেস এখনো একই জায়গায় আটকে আছে। না পাচ্ছে কোনো তথ্য প্রমাণ, আর না পাচ্ছে কোনো ক্লু। উপরের অফিসারদেরও এই কেস নিয়ে তেমন একটা মাথা ব্যাথা নেই। সকল তৎপরতা যেন শোভনের একা। তার মন বলছে এই কেসটা কোনো সাধারণ কেস নয়।

শোভনের ভাবনার মাঝেই তার ফোন বেজে উঠে। স্ক্রিনে আদরের ছোট বোনের নামটা দেখতেই মুহুর্তেই তার মুখের চিন্তা উবে যায়। ফুটে উঠে হাসি। ফোনটা রিসিভ করে প্রফুল্ল গলায় বলে,

“ কিরে! ভাইয়ের কথা কিভাবে মনে পড়লো? “

পৃথা অভিমানী গলায় শুধায়,

“ তোদের ভুলেছি কবে? “

“ ভুলছিস না বলছিস? বিয়ে হয়েছে দু দিনও হয় নি অথচ দাদা’র বিয়ের পর একবারো দেখা করতে এলি না। তূর্য ভাই কি এমন জাদু করেছে বল তো। তোর ছোট ভাবীর উপরও সেই জাদুর ছড়ি ঘুরাবো। তাহলে বিয়ের পর আর আমাকে ফেলে বাপের বাড়ি চলে যাবে না। “

শোভনের কথা শুনে পৃথা নিঃশব্দে হাসে। ছোট দা সবসময় তাকে এটা সেটা নিয়ে শাসন করতো। কিন্তু পৃথার বিয়ের পর থেকে কথা হলে প্রায়ই হাসি থাট্টা করে শাসনের বদলে। বোন দূরে চলে গিয়েছে দেখে কি তার ছোট দা এখন নিজের শাসনটাও কমিয়ে দিয়েছে?

বোনের নিঃশব্দের হাসিটাও ফোনের অপর পাশ থেকে ঠিকই টের পায় শোভন। তার বোন বাহিরের জগৎ সম্পর্কে ধারণা কম রাখে। তবুও নিজের জন্য ঠিকই ভালো একজন জীবনসঙ্গীই খুঁজে নিয়েছে এতেই শোভন খুশি। তূর্য যে পৃথাকে খুশি রাখছে তার প্রমাণ পৃথা নিজেই। মেয়েটার সাথে কথা বললে বা দেখলেই স্পষ্ট বুঝা যায় যে সে খুশি আছে।

এই কারণেই তূর্যকে এতো সহজে তারা মেনে নিতে পেরেছে। এমনকি শোভন, আফজাল সাহেব এবং সাদিকা বেগমের সাথে তূর্যর সম্পর্ক অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। কেবল পার্থ আর তূর্যের মধ্যের নীরব দ্বন্দ্বের ইতিই এখনো ঘটলো না।

আপাতত সেসব চিন্তা বাদ দিয়ে শোভন প্রশ্ন করে,

“ এডমিশনের প্রিপারেশন কেমন তোর? আম্মার কাছে শুনলাম মেডিক্যাল টেস্টও নাকি দিবি। “

“ না দিয়ে উপায় আছে? মানুষ বিয়ের পর কি আরামসে জীবন যাপন করে। আর আমি এমন এক বাসায় এসে পড়েছি যে সকাল বিকাল খালি পড়াশোনার জ্ঞান গুলিয়ে খাওয়ানো হয় আমাকে। “

শোভন হাসতে হাসতে বলে,

“ তোর নিজের কি ইচ্ছা? কি নিয়ে পড়তে চাচ্ছিস? “

“ আমার কোনো ইচ্ছা নেই। তূর্য বলেছে ঢাকার পাবলিক ভার্সিটি গুলোতে এডমিশন দিয়ে দেখতে। আর পাপা মেডিক্যাল লাইনে পড়াশোনা নিয়ে এতো ইনফরমেশন জানিয়েছে যে আমি এখন মেডিক্যালের প্রিপারেশনও নিচ্ছি। যদি কোনোটাতেই না হয় তাহলে প্রাইভেটে ভর্তি হবো। “

“ তোর এই একটাই সমস্যা। রেজাল্ট চমৎকার কিন্তু নিজের মন থেকে কোনো ইচ্ছা নেই। আই হোপ তূর্য ভাইয়ের সাথে থেকে মাথায় একটু সুবুদ্ধি হবে আর নিজের লাইফ গোল খুঁজে পাবি। “

কথার মাঝেই একজন কনস্টেবল হন্তদন্ত হয়ে শোভনের রুমে প্রবেশ করতেই শোভন পৃথার থেকে বিদায় নিয়ে ফোন রেখে দেয়। প্রশ্ন করে,

“ কি হয়েছে? “

“ স্যার কল আসছে। গতরাতে ধানমন্ডি লেকের কাছে একটা ছেলের লাশ পাওয়া গিয়েছে। “

“ লাশ এখন কোথায়? “

“ স্যার পোস্ট মার্টামের জন্য নেওয়া হইসে। “

কথাটুকু বলেই লোকটা নিজের ফোন হতে একটা ছবি বের করে এগিয়ে দেয় শোভনের দিকে। শোভন ফোনটা নিয়ে ছবিটার দিকে সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। ধানমন্ডির লেকের পাশে পাওয়া সেই লাশটার অন স্পট ছবি। ছবির ভিতরের এই মানুষটাকে চেনা অনুভব করে শোভন। মুহুর্তেই তার মনে পড়ে যায়। হন্তদন্ত ভঙ্গিতে নিজের ফোন নিতে নিতে বলে উঠে,

“ আমাদের হসপিটালে যেতে হবে। “

“ কি হয়েছে স্যার? “

শোভন বেরিয়ে যেতে যেতে বলে উঠে,

“ এটা সেই নিখোঁজ ছেলেগুলোর মাঝে একজন। “

__________

গতকালের সেই ঝড়ের তাণ্ডবের চিহ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সম্পূর্ণ সেইন্ট মার্টিন দ্বীপ জুড়ে। আপাতত বাহিরে বের হওয়ার মতো অবস্থাও নেই। তাই সারাদিন বাংলোতেই পাড় করে দেয় পার্থ এবং তরী। পার্থ অবশ্য বেশিরভাগ সময় নিজের রুমে ফোনে কথা বলেই কাটিয়ে দিয়েছে। সেই কথার কিছু অংশ তরীর কানেও এসেছে। তা থেকে বুঝতে পেরেছে যে পার্থ ইলেকশনটা করছে। এটা শুনে তরী মনে মনে খুশি হয়। পার্থর প্রতিপক্ষ রুবেলের কার্যকলাপ সম্পর্কে অবগত হয়ে তরীরও তার প্রতি ঘৃণা কাজ করছে। এরকম একজন মানুষ ইলেকশন জিতে গেলে তা নিশ্চয়ই জনগণের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না?

সন্ধ্যায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে আপনমমে এসব ভাবতেই ব্যস্ত ছিলো তরী। মিঠা সোনালী রঙের আলোয় আলোকিত বারান্দা হঠাৎই আঁধারে ছেয়ে যায়। তখনই তরী অনুভব করে তার মেরুন রঙের শাড়ির আঁচল ভেদ করে তার পেটের অনেকাংশ গ্রাস করে নিচ্ছে একটা শক্ত, শীতল পুরুষালি হাত। আচমকা হীম শীতল স্পর্শে তরী ঘাবড়ায় না। তাকে বিনা অনুমতিতে ছোঁয়ার সাহস আপাতত একজনেরই আছে। তরী নিজে গতকাল এই অনুমতি এবং অধিকার সেই একজনের অধীনে তুলে দিয়েছে।

তরীর খোলা চুলগুলো বাম পাশের কাধের দিকে নীরবে সরিয়ে দেয় পার্থ। অত:পর ডান পাশের কাধের সোনালী ব্লাউজটা কিছুটা সরিয়ে নিজের প্রিয় কালো তিলটায় অধর ছোয়ায় সে। তরীর দীঘল চোখ জোড়া মুহুর্তেই বুজে আসে। আজ সকালে খোলা জানালার সামনে ঝিনুক দুটো হাতে নিয়ে তরী নিজের মনকে প্রশ্ন করেছিলো, পার্থর প্রতি তার অনুভূতির নাম কি? জবাবে তিনটি শব্দ খুঁজে পায় সে। নির্ভরতা, ভালোলাগা আর বিশ্বাস।

তরীর মনের এই তিনটা বিশেষ অনুভূতিতে নিজের নাম বেশ পরিষ্কার আকারেই লেখে নিয়েছে পার্থ। ভালোবাসা? ভালোবাসার অনুভূতি বেশ আগেই ভোতা করে দিয়ে গিয়েছে সাদ। যা এখন তরীর কাছে এক গভীর ক্ষতের ন্যায়। সেই ক্ষতের মলম হলো বিশ্বাস। যা অর্জন করে পার্থ ধীরে ধীরে তার ক্ষত সারিয়ে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে। একবার সম্পূর্ণ ক্ষত সেরে গেলে যে ভালোবাসাটুকুও এসে পড়বে তা তরীর বিচক্ষণ মস্তিষ্ক বেশ ভালোই জানে।

সারাদিনের ব্যস্ততায় তরীকে সময় দিতে না পারাটা যেন মুহুর্তেই ঘুচিয়ে দেয় পার্থ। গাঢ় স্বরে বলে,

“ অপেক্ষা করালাম? “

এই স্বরটা শুনতে তরীর ভালো লাগে। গতরাতেও পার্থর স্বর এরকমই শোনাচ্ছিল। ঠিক এতটা গভীর। তরী জবাবে বলে,

“ পাশের রুমেই তো ছিলেন। “

“ ফেরার তাড়া ছিলো। “

“ তাই বুঝি এতো দেরি? “

পার্থ হেসে বলে,

“ তারমানে অপেক্ষা করছিলেন। “

কথায় হেরে তরীও হাসে। নিজের হার স্বীকার করতে নিজের পিঠ ছেড়ে দেয় পার্থর প্রশস্ত বুকে। পার্থ একই স্বরে বলে উঠে,

“ কোনো তাড়া নেই তরী। আপনি নাহয় ধীরে সুস্থেই আমাকে ভালোবাসুন। আমিও নাহয় অপেক্ষায় রইলাম। “

তরী নীরবতা ভেঙে প্রশ্ন করে,

“ আগে থেকে ভালোবাসতেন? “

নিজের স্ত্রীর বিচক্ষণতায় পার্থ মুগ্ধ হয়। বিমোহিত গলায় শুধায়,

“ কিভাবে বুঝলেন? “

“ আপনার কর্মকাণ্ড আপনার অনুভূতির প্রমাণ। শব্দে ভেঙে না বললেও বুঝতাম। তবে বিশ্বাস করতে চাইতাম না। দ্বন্দ্বে ভুগতাম। “

“ দ্বন্দ্ব মিটলো কি করে? “

তরী এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে হাসে। পার্থর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বলে,

“ নির্বাচন করুন। স্ত্রী হিসেবে আমার তরফ থেকে সম্পূর্ণ সমর্থন পাবেন। “

পার্থ অবিশ্বাস্যকর দৃষ্টি মেলে তাকায়। বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে,

“ রাজনীতি না আপনার অপছন্দের? “

“ আপনার রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পিছনে উদ্দেশ্য কি? “

“ মানব সেবা ব্রত। “

“ নিয়ত গুরুত্বপূর্ণ। নিয়ত যদি সঠিক হয় তাহলে আপনার বিপক্ষে কেন যাবো আমি? “

তরীর কথা শুনে পার্থর বুক থেকে যেন একটা বিরাট পাথর সড়ে যায়। এমন না যে তরীর বিরোধিতায় সে রাজনীতি থেকে সরে যেতো। কিন্তু তরীর সাপোর্টটুকু তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

পার্থ হাসিমাখা মুখে বলে,

“ অসংখ্য ধন্যবাদ জান। “

তরী শুনেও ইচ্ছে করে না শোনার ভান করে বলে,

“ কি বললেন? “

“ অসংখ্য ধন্যবাদ। “

“ তারপর কি বললেন? “

পার্থর চোখে দুষ্ট হাসি খেলে যায়। সে শীতল স্বরে বলে,

“ আপনি লোভী হয়ে যাচ্ছেন তরী। “

তরী দৃষ্টি ফিরিয়ে বলে,

“ মোটেও না। “

পার্থ একহাতে তরীর ঘাড় ধরে নিজের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে,

“ আমার সাথে কথা বলার সময় নজর লুকাবেন না। চোখে চোখ রেখে কথা বলবেন। “

তরী নিরুত্তর রয় কিন্তু দৃষ্টিও ফেরায় না। পার্থর হাতের আঙুল গুলো তরীর ঘাড় বেয়ে নেমে ধীরে ধীরে তার সরু আঙুলগুলোর ভাজে স্থান পায়। পার্থ তরীর দিকে তাকিয়ে থেকেই বলে উঠে,

“ রাজনীতি দূর থেকে যতটা সহজ দেখতে মনে হয় কাছ থেকে ততটাই ভয়ংকর। এইখানে প্রতি পদে পদে ওঁৎ পেতে থাকে বিভিন্ন ফাঁদ। একবার আমার কারণে আপনাকে এই বাজে সিচুয়েশনে পড়তে হয়েছে। ওয়াদা করছি আর কখনো আমার রাজনীতির খারাপ প্রভাব আপনার উপর পড়তে দিবো না আমি। “

পার্থর কথা শেষ হতে না হতেই তরী নিজের পা জোড়া উঁচু করে তার গলা জড়িয়ে ধরে নিজের অপছন্দের সিগারেটের গন্ধে আবৃত্ত ওষ্ঠদ্বয় ছুঁয়ে দেয় পরম আবেশে। পার্থর নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়। অনাকাঙ্ক্ষিত মুহুর্তের ধাক্কা সামলে উঠতেই সে নিজেও নিজের পেশল হাত দ্বারা তরীর নির্মেদ কোমর জড়িয়ে ধরে। নব আবেগে বেষ্টিত পার্থ মুন্তাসির নিভৃতে ফিসফিসিয়ে তরীর স্ব-জ্ঞানে তার কাছে এলান করে,

“ আপনাকে ভালোবাসি তরী রশীদ। এই হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন যতদিন চলমান থাকবে ততদিন পার্থ মুন্তাসির কেবল আপনাকেই ভালোবাসবে। “

চলবে…

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৮.

চট্টগ্রামে পার্থ এবং তরীর সেই অল্প দিনের স্থায়িত্ব ফুরিয়ে আসে খুব তাড়াতাড়িই। তারা ফিরে আসে ঢাকায়। এতোদিন পর ছেলে এবং ছেলের বউ ঘরে ফিরে আসায় নিষ্প্রাণ ঘর আবার প্রাণ ফিরে পায়। আফজাল চৌধুরী এবং সাদিকা বেগম তাদের ছেলে এবং ছেলে বউয়ের মধ্যকার স্বাভাবিক সম্পর্কের আভাস উপলব্ধি করে। খুশি হয় দু’জনই।

পার্থ নিজের নির্বাচনের প্রস্তুতি বেশ তোড়জোড় করেই নেওয়া শুরু করেছে। তরী ফিরে গিয়েছে নিজের প্রফেশনে। দেখতে দেখতে বিশটা দিন চোখের পলকেই পেরিয়ে যায়। সামনের সপ্তাহে শোভন এবং মধুমিতার বিয়ে। বাড়ি জুড়ে বিয়ের প্রস্তুতি চলছে।

আজ ওপিডি ডে থাকায় দুপুরের মধ্যেই সব পেশেন্ট দেখে বাসায় ফিরে আসে তরী। বাসায় ফিরতেই দেখে তার দুই মামী শাশুড়ী লিভিং রুমে বসে। সাদিকা বেগমও তাদের বিকেলের চা নাস্তার আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত। তরী তাদের দেখেই এগিয়ে গিয়ে সালাম দেয়।

পথে চল্লিশ মিনিট এই তপ্ত আবহাওয়ায় জ্যামে বসে থাকার দরুন তরীর মুখশ্রীর রঙ কিছুটা ফ্যাকাসে লাগছিলো। তা দেখেই পার্থর ছোট মামী খোঁচা মেরে বলে উঠে,

“ আপা? ছেলের বউয়ের গায়ের রঙ দেখি একমাসেই ময়লা হয়ে গেছে। এই ছিলো আমাদের পার্থর পছন্দ? “

তরীর নিজের ব্যাপারে এরকম অহেতুক একটা কমেন্ট পছন্দ হয় না। সে হাসিমুখে একটা পাল্টা জবাব দেওয়ার প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু তার আগেই পিছন থেকে একটা পুরুষালী কণ্ঠ ভেসে আসে,

“ ঘরের মেয়েকে নিয়ে এরকম অহেতুক মন্তব্য আমার পছন্দ নয় পার্থর আম্মা। ভাবীরা হয়তো বিষয়টা জানে না। “

আফজাল সাহেবের গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনতেই পার্থর ছোট মামীর মুখ কালো হয়ে যায়। উনি আর কিছু বলার সাহস রাখে না। তরী শশুড়ের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার হাসি দিতেই আফজাল সাহেব হাতের টুপিটা মাথায় দিতে দিতে বলে উঠে,

“ আমি মসজিদে যাচ্ছি নামাজের জন্য। তরী আম্মু তুমি উপরে গিয়ে বিশ্রাম করো। ক্লান্ত দেখাচ্ছে। “

তরী আফজাল সাহেবের পিছু পিছু দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে বলে উঠে,

“ সাবধানে যাবেন আব্বা। “

আফজাল সাহেব মৃদু হেসে বেরিয়ে যায়। তরীও আসছি বলে উপরে নিজের রুমে চলে যায়। ঘরের বউকে এতো মাথায় তুলে রাখার বিষয়টা ছোট মামীর পছন্দ হয় না। যেই বউ কিনা সারাদিন ঘরের বাইরে কাটায়, সংসারের কোনো দায়িত্ব পালন করে না, তাকে এতো গুরুত্ব দেওয়ার কি আছে? এর থেকে হাজার গুণ ভালো তো তার মেয়ে শর্মী ছিলো। পার্থর যে কি বুঝে শর্মীর মতো সংসারী মেয়েকে রেখে তরীর মতো এমন উড়নচণ্ডী মেয়ে ভালো লাগলো তা মাথায় ধরে না উনার৷

__________

নিজের রুমের দরজার সামনে আসতেই তরীর ভ্রু কুচকে যায়। দরজা ভিতর থেকে মৃূদু চাপিয়ে রাখা হয়েছে। তরীর জানামতে পার্থ এই মুহুর্তে বাসায় নেই। আর বাড়ির অন্য কেউও তাদের অনুপস্থিতিতে তাদের রুমে প্রবেশ করে না। তাহলে ভিতরে কে?

প্রশ্নটা মাথায় উঁকি দিতেই তরী নীরবে দরজা খুলে সিটিং এরিয়া পেরিয়ে বেডরুমে প্রবেশ করে। সাথে সাথে সে দেখতে পায় একটা বিরক্তিকর দৃশ্য। সকালে বেরোনোর আগে পার্থ নিজের গায়ের টি শার্ট খুলে একটা শার্ট পড়ে বেরিয়েছে। সেই টি শার্ট হাতে নিয়েই শর্মী তার আর পার্থর বেডে বসে আছে। বিরক্তিকর দৃশ্যটা দেখতেই তরীর পায়ের রক্ত মাথায় উঠে। সে ঝাঁঝালো স্বরে বলে উঠে,

“ অন্য কারো রুমে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করে একজন বিবাহিত পুরুষের টি শার্ট হাতে নিয়ে বসে থাকাটা কোনো ভদ্র মেয়ের কাজ নয়। “

তরীর কণ্ঠস্বর শুনতেই শর্মী চকিতে পিছনে ফিরে তাকায়। তরী ব্যতীত অন্য কাউকে না দেখে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়। অত:পর মৃদু হেসে বলে উঠে,

“ পার্থ ভাইয়ের বিয়ে করে লাভ হলো কি? তার টি শার্টটাও তার বউ গুছিয়ে রাখতে পারে না। অবহেলায় রুমের এককোণে পড়ে রয়। “

শর্মী নামক এই মেয়েটাকে বিয়ের সময় দেখেছিলো তরী। তাদের বিয়ের পর একবার বাসায়ও এসেছিলো। আর এসেই সর্বক্ষণ পার্থর ব্যাপারে আগ্রহ দেখাতো। তখনই তরী বুঝতে পেরেছিলো শর্মীর মনের খবর। সে শর্মীর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে উঠে,

“ পার্থর চিন্তা করার জন্য তার বউ আছে শর্মী। তোমার নিজের ভাইকে নিয়ে এতো চিন্তা না করলেও চলবে। “

তরীর বলা ‘ তোমার ভাই ‘ কথাটাটুকু শুনে শর্মীর গা জ্বলে যায়। তরী যে ইচ্ছে করে তাকে জ্বালানোর জন্যই এই কথাটা বলেছে তা বুঝতে বাকি থাকে না তার। কপট রাগ দেখিয়েই বেরিয়ে যায় সে।

শর্মীর যাওয়ার পানে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তরী। জীবনের পথে বহু কাঁটাই থাকবে। বিশ বছরের বোকা তরী হলে এখন ঠিকই এই কাঁটার উপর দিয়ে হেঁটে গিয়ে পায়ে জখম বানাতো। কিন্তু এখন সে আর বোকা নয়। পথে কাঁটা পেলে সেই কাঁটা তুলে তবেই সেই পথে হাঁটে সে। এরকম বিবাহিত পুরুষের দিকে নজর দেওয়া মেয়েদেরকে দু চারটা কঠিন কথা শুনালে কোনো ক্ষতি নেই।

__________

রাতের নিস্তব্ধতা ছাপিয়ে শা শা বেগে হাইওয়েতে ছুটে চলেছে একটা বাইক। বাইকের সামনে টি শার্টের উপর জ্যাকেট গায়ে জড়িয়ে বসে বাইক চালাচ্ছে একটা শ্যামবর্ণের যুবক। পিছন থেকে তার পেট জড়িয়ে বসে আছে এক স্নিগ্ধ রমণী। তার মাথা ঠেকে আছে যুবকের পিঠে। দেখে মনে হচ্ছে সদ্য প্রণয়ে আসক্ত এক প্রেমিক যুগল।

আচমকা রমণী উৎফুল্ল গলায় বলে উঠে,

“ তূর্য থামুন। “

তূর্য প্রশ্ন করে,

“ কি হয়েছে? “

“ ভূট্টা। “

তূর্য সাথে সাথে বাইক ব্রেক করে থামায় রাস্তার একপাশে। তার বাইক থামাতে দেরি কিন্তু পৃথার নেমে দৌড়ে রাস্তার অপরপাশে থাকা ভূট্টাওয়ালার ভ্যানের কাছে যেতে দেরি হয় না। তূর্য নিজের মাথার হেলমেটটা খুলে বাইকের চাবি পকেটে নিয়ে পৃথার পিছুপিছু আসে। তাড়াহুড়ো করে পৃথা নিজের মাথার হেলমেটও খুলে আসে নি। তূর্য এগিয়ে এসে আগে পৃথার মাথা থেকে হেলমেট খুলে অত:পর সামনের বৃদ্ধ লোকটার উদ্দেশ্যে বলে উঠে,

“ মামা একটা ভূট্টা দেন। “

লোকটা সাথে সাথে একটা ভূট্টার খোসা ছাড়িয়ে তা কয়লার উপরে দেয়। পৃথা চোখ বাকিয়ে প্রশ্ন করে,

“ একটা কেনো? আপনি খাবেন না? “

“ না। “

বলে তূর্য পৃথার এলোমেলো চুল নিজের হাতের সাহায্যে ঠিক করতে থাকে। বৃদ্ধ লোকটা আবার প্রশ্ন করে,

“ লেবুর টক দিবো নাকি তেঁতুলের? “

পৃথা সাথে সাথে জবাব দেয়,

“ তেঁতুলের। “

পত্রিকার কাগজে মোড়ানো কয়লায় পোড়া ভূট্টা হাতে নিয়ে টাকা মিটিয়ে দু’জনে বাইকের কাছে এসে দাঁড়ায়। পৃথা বাইকের উপর একপাশ হয়ে উঠে বসে। তূর্য তার সামনে দাঁড়িয়ে আশেপাশের রাস্তার দিকে দৃষ্টি বুলাতে থাকে। পৃথা ভূট্টায় একটা কামড় বসিয়ে ফুলে থাকা গাল নিয়ে প্রশ্ন করে,

“ বাই দ্যা ওয়ে, আজকে কোন খুশিতে আমাকে নিয়ে এই মাঝরাতে বাইক ড্রাইভে বেড়িয়েছেন? “

তূর্য পৃথার দিকে তাকিয়ে জবাব দেয়,

“ মেডিক্যাল এডমিশন টেস্ট দিয়েছো আজকে। সেই খুশিতে। “

পৃথা চোখ সরু করে বলে,

“ শুধু তো এডমিশন টেস্টই দিলাম। এতে সেলিব্রেশনের কি আছে? রেজাল্ট দেক আগে। “

“ পড়াশোনা করে টেস্ট দিয়েছো এটাই বা কম কিসে? আপাতত এটা সেলিব্রেট করি। টিকে গেলে আরেকবার সেলিব্রেশন করবো। “

তূর্যর কথাটা পৃথার পছন্দ হয়। সে ভূট্টা তূর্যর দিকে এগিয়ে ধরে। তূর্য প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাতেই বলে,

“ আমি একা পুরোটা কিভাবে খাবো? রাক্ষস নাকি আমি? বাকিটা আপনি শেষ করেন। “

তূর্য হেসে বলে,

“ জানতাম। এজন্যই একটা নিয়েছি। “

পৃথা তূর্যের দিকে তাকিয়ে একগাল হাসে। পৃথার সকল অভ্যাস পৃথার থেকেও ভালো এই মানুষটা জানে। এই মানুষ তার সাথে থাকতে তার কোনো চিন্তা নেই।

__________

সকাল সকাল ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে বসে চুল আছড়াতে ব্যস্ত তরী। তার পিছনে দাঁড়িয়ে পার্থ নিজের স্কিন কেয়ার নিয়ে ব্যস্ত। সেই দৃশ্যটা সরু চোখে দেখছে তরী। সে নিজে মেয়ে হয়েও আলসেমি করে কখনো স্কিন কেয়ার করার ধৈর্য্য কুলিয়ে উঠতে পারে না। অথচ পার্থর এইসব ব্যাপারে খুব ধৈর্য্য। সেল্ফ পেম্পারে এই লোককে কেউ হারাতে পারবে না।

পার্থ আয়নার দিকে নিজের দৃষ্টি স্থির রেখে বলে উঠে,

“ আপনি যদি নেক্সট পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে দৃষ্টি না ফেরান তাহলে আজ আপনারও হসপিটালে যাওয়া হবে না আর আমারও সমাবেশে যাওয়া হবে না। “

তরী সাথে সাথে নিজের দৃষ্টি নত করে। এই লোকের ভরসা নেই। পার্থ মৃদু হেসে মেনস পারফিউম গায়ে মেখে হাতে হাতঘড়ি পড়তে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তরীও ততক্ষণে রেডি হয়ে ব্যাগ কাধে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। বেরিয়ে যেতে নিলেই পার্থ তাকে হাত ধরে টেনে থামিয়ে দেয়। তরী ফিরে তাকাতেই তার মোমের মতো গালে নিজের ওষ্ঠদ্বয় চেপে ধরে পার্থ। নরম গালটা ছুঁয়ে দিয়েই পার্থ গভীর স্বরে বলে,

“ আজকে ফিরতে হয়তো দেরি হবে। টায়ার্ড লাগলে অপেক্ষা করবেন না। ঘুমিয়ে পড়বেন। সকালে উঠে আমাকে পাশে পাবেন। “

তরী পার্থর কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে উঠে,

“ সাবধানে থাকবেন। সাবধানে ফিরবেন। “

__________

সবেমাত্র একটা সার্জারি সেরে বেড়িয়েছে তরী। দুপুর বাজে একটা। সকালে হসপিটালে আসার পর থেকে এখনো পার্থর সাথে কথা হয়নি তার। বেশ অস্থির লাগছে। তাই লাঞ্চ রেখে আগে কেবিনে এসে পার্থর নাম্বারে কল করে সে। কিন্তু ফোনটা বন্ধ পায় সে। সাথে সাথে নিজের বোকামির উপর বিরক্ত হয় সে। পার্থ এখন হয়তো সমাবেশে ব্যস্ত। তাকে কল দিয়েও লাভ নেই। তাই সে আসিফের নাম্বারে কল করে। কিছুক্ষণ ফোনটা বাজতেই অপরপাশ থেকে ফোন রিসিভ হয়। সাথে সাথে তরীর কানে একটা তীক্ষ্ণ শব্দ এসে ঠেকে। সেই তীক্ষ্ণ শব্দ ভেদ করে আসিফ হন্তদন্ত স্বরে বলে উঠে,

“ এইখানে টিয়ার সেল আর বোমা ফালানো হইতেসে ভাবী। পরিস্থিতি বিগড়ায় আছে। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-২৫+২৬

0

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৫.

গভীর রাত। ফ্লোরে বসেই বিছানার সাথে ঠেক দিয়ে রয়েছে পার্থ। সবেমাত্র তার চোখে ঘুম নেমে এসেছে। কিন্তু সেই ঘুম দীর্ঘস্থায়ী হলো না। ফোনের রিংটোনের শব্দে পার্থ আড়মোড়া ভেঙে চোখ মেলে তাকায়। মুহুর্তেই তার টনক নড়ে উঠে। দ্রুত ফোনটা রিসিভ করে কানে দিতেই অপরপাশ থেকে আসিফ বলে উঠে,

“ সরি টু ডিস্টার্ব ইউ ভাই কিন্তু একটা খবর জানানোর ছিলো আপনারে। “

পার্থ ঘুম জড়ানো গলায় প্রশ্ন করে,

“ কাজ হয়ে গিয়েছে? “

“ হ ভাই। “

“ এখন কি করতে হবে তা নিশ্চয়ই তোকে আর বলে দিতে হবে না। কালকের মধ্যে বাকি কাজটা কম্পলিট করে ফেলবি। “

আসিফ আত্মবিশ্বাসের সহিত বলে উঠে,

“ চিন্তা করবেন না ভাই। “

কথাটুকু বলেই আসিফ নিজেই আবার বলে উঠে,

“ ভাই? হানিমুন কেমন ইঞ্জয় করতেসেন? ধানি মরিচ আই মিন ভাবি আপনার বশে আসছে? “

পার্থ তরীর দিকে তাকায়। মেয়েটা এখনো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। বিছানার সর্বত্র জুড়ে এখনো তার দখল। পার্থ বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,

“ এমন হানিমুন আমার শত্রুরও না হোক। “

__________

উষ্ণ সকালে প্রেমাময় উষ্ণ অনুভূতি চিত্ত জুড়ে লেপ্টে চোখ মেলে তাকায় পৃথা। তূর্যের মুখ জুড়ে বিচরণ করে তার দৃষ্টি। গত রাতের চিত্র চোখের সামনে ভেসে উঠতেই লজ্জায় আড়ষ্ট হয় সে। তূর্যের হাতের বন্ধন থেকে মুক্তি খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে থাকা পৃথা লক্ষ্য করে নি যে তূর্যও ইতিমধ্যে জেগে গিয়েছে। তূর্য পৃথাকে টেনে নিজের উন্মুক্ত বুকে আগলে ধরে ঘুম জড়ানো গলায় বলে,

“ আরেকটু থাকো। “

পৃথা প্রতিবাদ করে না। চুপচাপ তূর্যের বুকের সাথে লেপ্টে রয়। কিছু মুহুর্ত গড়াতেই সে অনুভব করে তূর্যের হাত তার গায়ে থাকা টি শার্ট ভেদ করে অভ্যন্তরে বিচরণ করছে। শরৎতের শান্ত প্রকৃতির ন্যায় শান্ত হয়ে যায় পৃথা। তূর্য আবেশী ভঙ্গিতে পৃথার ওষ্ঠে ঠোঁট ছোঁয়ায়। সময় পার হয় অনেকক্ষণ। তূর্য নরম গলায় বলে,

“ মিস এবিসি। অফিসে যাওয়ার আগে একটা মেডিসিন এনে দিয়ে যাবো। খেয়ে নিও। “

পৃথা প্রশ্ন করে,

“ কিসের মেডিসিন? “

“ শরীর ব্যথা করছে না? “

“ হু। “

“ সেটার জন্যই। “

তূর্য আসলেই অফিসে যাওয়ার আগে একটা মেডিসিন এনে দিয়ে যায় পৃথাকে। বলে দেয় যেন নাস্তা করে এটা খেয়ে নেয়। নাস্তা শেষ করে পৃথা মেডিসিনের নাম লক্ষ্য করে একটু অবাক হয়। এই নামের পেইনকিলার মেডিসিন সে আগে কখনো দেখে নি। তাই আগ্রহ বসত মেডিসিনের নাম লিখে ফোনে সার্চ করে। সাথে সাথেই সে অবাক হয়। অপেক্ষা না করে মেডিসিনটা লুকিয়ে ফেলে দেয়।

__________

সকালের নাস্তা সেড়ে হোটেলের রুফটপে চলে যায় পার্থ এবং তরী। রুফটপের একপাশ জুড়ে রয়েছে বিশাল প্রাইভেট সুইমিং পুল। তার বিপরীতেই রয়েছে একটা জুস বার এরিয়া। তরী সুইমিং পুলের পাশে একটি ডেক চেয়ারে ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে। না চাইতেও তার দৃষ্টি ঘুরে ফিরে পুলে অর্ধ উদোম দেহে সাতার কাটা পার্থর দিকে চলে যাচ্ছে। কি এক মুসিবত! তার গায়েও কি পার্থর বেহায়া হাওয়া লেগেছে নাকি? নাহয় এমন বেহায়ার মতো ঘুরে ফিরে এই নির্লজ্জ লোকের দিকেই কেন তার বারবার তাকাতে হবে?

পার্থ অবশ্য এসব কিছু লক্ষ্য করছে না। সে আপন মনে সুইমিং করতে ব্যস্ত। তরী নিজের মনযোগ অন্যদিকে সরাতে ঘুরে বার এরিয়ার দিকে মুখ করে বসে। সাথে সাথে সে দেখতে পায় বারের সামনে দুজন মেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পার্থকে অবজারভ করছে। সাথে সাথে তরীর ভ্রু জোড়া কুচকে আসে। মেয়েগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে সদ্য কুড়িতে পা দিয়েছে। আর এখনই এমন বুড়িদের মতো আচরণ?

তরী বিরক্তিকর দৃষ্টি নিয়ে মেয়ে দুটোকে দেখতে থাকে। মেয়ে দুটো পার্থকে দেখে নিজেদের মধ্যে কিছু আলোচনা করছে এবং মিটিমিটি হাসছে। তরীর ধৈর্য্যের সীমা ভাঙে। সে হাসি হাসি মুখে কিন্তু কঠিন স্বরে মেয়েগুলোকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

“ আরে এতো দূরে দাঁড়িয়ে আছো কেন তোমরা? কাছে এসে বসে দেখো। এখান থেকে আরো ভালো ভিউ পাবে। “

মেয়েগুলো সাথে সাথে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। পার্থর কানেও কথাগুলো পৌঁছায়। সে সাবধানে পুল ছেড়ে উঠে আসে। তরীর পাশের ডেক সিট হতে একটা টাওয়াল তুলে নিজের ভেজা চুলগুলো মুছতে মুছতে ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বলে,

“ আপনি কি কোথাও থেকে পোড়া গন্ধ পাচ্ছেন তরী? আমার নাকে পোড়া গন্ধ লাগছে। “

পার্থর মশকরা তরীর পছন্দ হয় না। সে ঝাঁঝালো স্বরে বলে,

“ ওহ! হাঁটুর বয়সী মেয়েদের আর কি দোষ! মিষ্টি যদি নিজেই খোলা থাকে মাছি তো চারিদিকে ভনভন করবেই। বিবাহিত হয়েও ব্যাচেলর সেজে ঘুরে বেড়ান বুঝি সেই মৌমাছি রূপী মাছিদের সংস্পর্শ পেতেই? “

পার্থ এবার চুল মুছা বাদ দিয়ে ধীর পায়ে তরীর দিকে আগায়। তরীর সামনে দাঁড়িয়ে তার দিকে ঝুকে আসে। তরী সাথে সাথে পিছিয়ে যায়। এক পর্যায়ে তার পিঠ গিয়ে ঠেকে ডেকের হেলান দেওয়ার অংশের সাথে। আর পেছানোর সুযোগ নেই। মনে মনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেও চোখে তা প্রকাশ করে না তরী। অনড় রয়। পার্থ তরীর দিকে ঝুকে একহাত তার পাশ দিয়ে নিয়ে পিছনে ঠেক দেয়। তরী কিছু বলার আগেই নিজের মাথা সামান্য ঝাকায়। মুহুর্তেই তার চুল হতে জল ছিটকে তরীর শুষ্ক মুখশ্রী আদ্র রূপ ধারণ করে। পার্থ সেই অবস্থাতেই গলার স্বর নিচে নামিয়ে বলে উঠে,

“ বিবাহিত পুরুষকে ব্যাচেলর থাকার সুযোগ আপনি নিজেই দিচ্ছেন তরী। আপনি মৌমাছি হয়ে যান। আর কোনো মাছি মিষ্টির আশেপাশে ঘেঁষতে পারবে না। “

কথাটুকু বলেই পার্থ নিজের হাতের টাওয়ালটা তরীর কোলে রেখে চেঞ্জিং রুমে চলে যায়। তরী হতবিহ্বলের ন্যায় সেখানেই বসে রয়। অত:পর স্তম্ভিত ফিরে পেতেই বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,

“ নির্লজ্জ লোক! “

সেই মুহুর্তে মেয়ে দুটি তরীর পাশ দিয়ে যেতে যেতে বলে উঠে,

“ আংকেল ইজ সো ড্যাম হট আন্টি। “

তরী অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে মেয়ে দুটোর দিকে তাকাতেই তারা চোখ মেরে হাসতে হাসতে চলে যায়। তরী রাগ মিশ্রিত সুরে বলে উঠে,

“ ম্যানারলেস মেয়ে কোথাকার। আমাকে দেখে কোন এংগেলে আন্টি মনে হয়? নিজে আন্টি, নিজেদের চৌদ্দ গুষ্টি আন্টি। মিষ্টি প্রেমী মাছির দল যত্তসব। “

__________

রুবেলের মুড ইদানিং খুব ভালো আছে। তার সবথেকে বড় পথের কাঁটাকে সরিয়ে বেশ নিশ্চিন্তে ইলেকশনের প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। আর একমাসেরও কম সময় বাকি। আগামীকাল তার একটা সমাবেশও রয়েছে। সেই সমাবেশকে ঘিরে চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি। সমাবেশের প্যান্ডেল টাঙানোসহ বাকি সকল কাজ শেষ বারের মতো দেখতে এসেছে সে। বেশ ফুরফুরে মেজাজে চারিদিক ঘুরে ঘুরে দেখছে সে। তখনই সেখানে বেশ কিছু বাইক শব্দ তুলে এসে থামে। বাইক থেকে নেমে আসে পার্থর দলের লোকজন। তাদের দেখেই রুবেল ভ্রু কুচকায়। এরা এখানে কেন এসেছে?

তারা কাছাকাছি এগিয়ে আসতেই রুবেল প্রশ্ন করে,

“ এইখানে কি চাই? “

আসিফ উৎফুল্ল মুখে বলে উঠে,

“ হুদাই এতো খরচ কইরা এসব সমাবেশ করতেসেন। দিনশেষে জিতবো তো আমগোর পার্থ ভাই-ই। “

রুবেলের কুচকানো কপালের ভাজ গভীর হয়। অত:পর ঠাট্টার স্বরে বলে উঠে,

“ পার্থ যে নির্বাচন প্রত্যাহার করসে তা কি ভুইলা গেসো নাকি? “

আসিফ হাসে। হাসতে শুরু করে দলের বাকিরাও। হাসতে হাসতে আসিফ বলে,

“ আরে আহাম্মক! ভাইয়ে কি এতো পাগল যে কইবেন আর নির্বাচন প্রত্যাহার কইরা দিবো? মানে তখন ভাইয়ের কাছে নির্বাচন প্রত্যাহার করার কারণ ছিলো। তাই সাময়িকের জন্য নির্বাচন রাইখ্যা আগে ভাবীরে বাঁচায় নিসে। এখন আর ভাইয়ের হাত পা বাঁধা নাই। পার্টির বড় বড় মন্ত্রীরা আইসা ভাইয়ের হাতে পায়ে ধরসে। আমগোর ভাই হইসে উদার মনের মানুষ। কাউরে প্রত্যাখ্যান করে নাই। “

রুবেলের মেজাজ তুঙ্গে পৌঁছে যায়। পার্থ মুন্তাসির চৌধুরী এভাবে পল্টি মারলো? আসিফ আবারও বলে উঠে,

“ খেলা হইবো এবার মুখোমুখি। যদি বাপের বেটা হইয়া থাকোস তাইলে সামনাসামনি লড়াই করতে নাম। আর ভুলেও যদি ভাবীরে ইউজ কইরা ভাইয়ের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার পরিকল্পনা কইরা থাকোস তাইলে হেই চিন্তা বাদ দে। একবার যেই ভুল কইরা পাড় পাইসোস দ্বিতীয়বার হেই সুযোগ পাবি না। “

কথাটা বলেই আসিফ ও তার সাথের সাঙ্গপাঙ্গরা যেভাবে এসেছিলো সেভাবেই প্রস্থান করে। রুবেল স্ব শব্দে চেচিয়ে সুজনকে ডাকে। সুজন দূরে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ চেয়ারের সেটাপ দেখতে ব্যস্ত ছিলো। পার্থর দলের লোকদের আসতে দেখেও এগোনোর সাহস পায় নি সে। দূর হতে তাদের কোনো কথাও শুনে নি। কিন্তু এখন রুবেলের ডাক শুনে সে তড়িঘড়ি করে এগিয়ে যায়। রুবেল রাগান্বিত স্বরে প্রশ্ন করে,

“ পার্থ মুন্তাসির চৌধুরী এই মুহুর্তে কোথায়? “

সুজন বোকার ন্যায় জবাব দেয়,

“ উনি তো আর নির্বাচন করবো না ভাই। উনার খবর রাইখা কি আর লাভ আছে? “

সাথে সাথে সুজনের গালে একটা কষে থাপ্পড় পড়ে। সুজন গালে হাত দিয়ে হতভম্ব ভঙ্গিতে তাকায়। রুবেল বিক্ষিপ্ত গলায় বলে উঠে,

“ শু*রের বাচ্চা! পার্থ মুন্তাসির চৌধুরী নির্বাচন করবো। শালায় আমারে বলদ বানাইসে নিজের বউরে বাঁচানোর জন্য। তোরা কোনো খবর রাইখিস না। বইসা বইসা আঙুল চুষতে থাক। “

বলেই রুবেল সেখান থেকে প্রস্থান করে। সুজন অপমানে থমথমে মুখ নিয়ে চারিদিকে চোখ বুলায়। সবাই তার দিকে কেমন করে তাকিয়ে আছে। সুজনের মনে এই অপমান গভীর ভাবে দাগ কাটে।

__________

সারাদিন আজকে হোটেল রুমেই বসে কাটিয়ে দিয়েছে তরী। সমুদ্রের কাছে এসেও সমুদ্র তাকে টানছে না মোটেও। অবশ্য তার বিবাহিত ব্যাচেলর হাজবেন্ড ঠিকই আপন ফূর্তিতে মেতে আছে। সেই যে দুপুরের লাঞ্চ করে বেরিয়েছে এখনো ফেরার নাম গন্ধ নেই। একবারও কল করে তরীর খোঁজও নিলো না। ইরিসপন্সিবেল একটা! তরী মুখ কালো করে বসে থাকে। ওই নির্লজ্জ লোক নিশ্চয়ই বাহিরে গিয়ে হাটুর বয়সী মেয়েদের নিজের চার্মনেস দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। তরীর ভাবনার মধ্যেই পার্থ রুমে প্রবেশ করে। পার্থকে এক পলক দেখেই তরী গটগট পায়ে বিছানা ছেড়ে নেমে যায়। এইখানে আর এক মুহুর্ত থাকবে না সে। তাই বারান্দায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। পার্থ পিছন থেকে প্রশ্ন করে,

“ কোথায় যাচ্ছেন? “

“ জাহান্নামে। “

পার্থ কৌতূহলি চোখে আশেপাশে তাকিয়ে বলে উঠে,

“ এখানে আশেপাশেই আছে নাকি জাহান্নাম? “

পার্থর এহেন মশকরা তরীর পছন্দ হয় না। সে বারান্দায় গিয়ে পা তুলে একটা আরামকেদারায় বসে রয়। আজকে আবহাওয়া পরিষ্কার হলেও ঠান্ডার আমেজ রয়েছে বেশ। রাগ দেখিয়ে বারান্দায় এসে তো পড়েছে তরী। কিন্তু এখন নিজেই ঠান্ডায় কাপছে। গায়ে থাকা পাতলা শাড়িতে উষ্ণতা মিলছে না মোটেও। তখনই পার্থ ফোন হাতে বারান্দায় প্রবেশ করে। তরী পার্থকে দেখেও না দেখার ভান করে। পার্থ তার সামনে ফোনটা এগিয়ে ধরতেই তরী ভ্রু উঁচিয়ে তাকায়। পার্থ শান্ত গলায় বলে,

“ দেখুন। “

তরী পার্থর ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকায়। ফোনের স্ক্রিনে থাকা অফিশিয়াল লেটারটা দেখে অবিশ্বাস্য দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে কতক্ষণ। অত:পর পার্থর দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাতেই পার্থ বলে উঠে,

“ ডক্টর রায়হান নামক আপনার প্রফেশনাল লাইফের কোনো এক শত্রু নিজের আক্রোশ মেটাতে আপনার ক্যারিয়ার শেষ করতে চেয়েছিলো। সেজন্য সে আপনার কফিতে সেদিন ড্রাগস মিলিয়ে দিয়েছিলো। সেটার ফলেই সেদিন আপনার পেশেন্টের জীবন এবং আপনার চাকরি দুটোই হারাতে হয়েছিলো। মৃত মানুষকে জীবিত করার ক্ষমতা আমার কাছে নেই। নাহয় সেই নিষ্পাপ বাচ্চার প্রাণটাও ফিরিয়ে দিতাম। “

তরীর চোখ ছলছল করছে। সে আবার ফোনের স্ক্রিনে নিজের মেডিক্যাল লাইসেন্স রিস্টোরের লেটারটা দেখে নেয়। অত:পর প্রশ্ন করে,

“ আপনি এসব কিভাবে বের করলেন? “

পার্থ গা ছাড়া ভাবে বলে উঠে,

“ আমি কে ভুলে যাচ্ছেন ম্যাডাম? কাল রাতেই রায়হানকে জেলে নেওয়া হয়েছে। তার স্টেটম্যান্টও আপনার হসপিটাল অথরিটি পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সব সাক্ষ্য প্রমাণের সহিত আপনি নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন। “

পার্থ তরীর থেকে মোটেও থ্যাঙ্কিউ বাক্য শোনার আশা রাখে না। তাই সে নীরবে বারান্দা থেকে প্রস্থান করতে চায়। কিন্তু তা আর হয় না। তরী উৎফুল্ল গলায় পিছু ডাকে,

“ পার্থ? “

পার্থ অবাক দৃষ্টিতে ফিরে তাকায়। কিন্তু কিছু বুঝে উঠার আগেই আরেক দফায় অবাক হয় সে। তরী দৌড়ে এসে তার বুকে হামলে পড়ে। আচমকা এই আলিঙ্গনে পার্থ ব্যালেন্স হারায়। দু তিন পা পিছিয়ে গিয়ে বেলকনির রেলিঙে নিজের একহাত দিয়ে ব্যালেন্স সামলায়। আরেক হাতে আগলে ধরে তরীর উন্মুক্ত কমোর। তরী একইভাবে উৎফুল্ল গলায় বলে উঠে,

“ এই তিনদিন জল ছাড়া মাছের ন্যায় তড়পাচ্ছিলাম। আমাকে সমুদ্রে এনে ছাড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। “

পার্থ বুঝে অতি খুশিতে এই মুহুর্তে তরীর বিবেক শাট ডাউন হয়ে আবেগ টার্ন অন হয়েছে। তাইতো এভাবে তাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। পার্থ এবার কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলে উঠে,

“ ভদ্র সমাজের কাছে আমি বেশ ভদ্র পুরুষ মানুষ হলেও নিজের বিবাহিত স্ত্রীর কাছে আমি নির্লজ্জ ট্যাগ পাওয়া মানুষ। তো এই নির্লজ্জ ট্যাগ পাওয়া মানুষের সংস্পর্শে এসে কি আপনার ভয় করছে না তরী? “

মুহুর্তেই তরীর আবেগ শাট ডাউন হয়ে তার বিবেক টার্ন অন হয়। এক ঝটকায় সে পার্থর থেকে দূরে সড়ে দাঁড়ায়। তরীর সড়ে যাওয়া দেখে পার্থ নিঃশব্দে হাসে। তরী সরু চোখে সেই দৃশ্য দেখে। সবসময় পাঞ্জাবি গায়ে লেগে ঘুরে বেড়ানো পার্থ মুন্তাসির রূপ বদলেছে। আজ সে এক সাদা প্যান্টের সাথে হালকা আকাশি রঙের শার্ট পড়ে আছে।

পার্থ হাসতে হাসতেই বলে উঠে,

“ গান শুনবেন তরী? “

তরীর সরু চোখ আরো ছোট হয়ে আসে। কিন্তু সে মানা করে না। ধন্যবাদ সরূপ লোকটার এই ছোট আবদার মানাই যায়। তাই মৃদু মাথা নেড়ে সে সম্মতি জানায়। পার্থ একইভাবে রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায়ই তরীর দিকে গভীর দৃষ্টি তাক করে গেয়ে উঠে,

“ তালাব হে তু, তু হে নাশা
গুলাম হে দিল ইয়ে তেরা
খুলকে যারা জি লু তুঝে
আ যা মেরি সাসো মে আ।
মারিজে ইষ্ক হু মে কার দে দাওয়া,
হাত রাখ দে তু দিল পে যারা। “

এতটুকু গান শুনে তরী পার্থর দৃষ্টি উপেক্ষা করে অভ্যাসবশত মৃদু হেসে বলে উঠে,

“ নির্লজ্জ। “

তরী অপরপাশের রেলিঙের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে হাসছিলো। আচমকা নিজের সামনে কারো অস্তিত্ব টের পেতেই তার মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। সামনে তাকিয়ে দেখে পার্থ তার দু’পাশ হয়ে রেলিঙে হাত রেখে তার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে আছে। গভীর দৃষ্টি তরীর চোখের দিকে নিবদ্ধ। আচমকা শীতল হাওয়া এসে ছুঁয়ে দেয় তরীর সম্পূর্ণ চিত্ত। সেই সাথে পার্থর শীতল গলা গেয়ে উঠে,

“ তুঝে মেরে রাব নে মিলায়া
মেনে তুঝে আপনা বানায়া
আব না বিছাড়না খুদায়া।
মোহাব্বাত রুহ কি হে লাজিম রিজা
হাত রাখ দে তু দিল পে যারা
হো ও হাত রাখ দে তু দিল পে যারা। “

চলবে…

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৬.

গভীর রাত। পার্থ বেশ অনেকক্ষণ আগেই বিছানার এককোণে স্থির মূর্তির ন্যায় ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু ঘুম নেই তরীর চোখে। রাতে বারান্দায় ঘটে যাওয়া দৃশ্যটা তার মস্তিষ্ক থেকে দূর হচ্ছে না। না দূর হচ্ছে পার্থর সেই গভীর দৃষ্টি। কি সত্যি কি মিথ্যা সেই দ্বন্দ্বে তার মন পিষে যাচ্ছে। তরী তো মানুষ চিনতে ভুল করে না। তবে পার্থকে নিয়ে তার মন এবং মস্তিষ্কের রায় ভিন্ন কেন?

যেহেতু সারাজীবন একসাথে থাকার ডিসিশন সে নিয়েই ফেলেছে তাই পার্থর ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তরীর পার্থকে জানতে হবে। এক মুহুর্তের জন্য নিজের চোখে দেখা সত্যিকে ভুলে গিয়ে আসল সত্যি জানতে হবে। তরী বিছানা ছেড়ে নেমে সাবধানে পার্থর ফোন নিয়ে বারান্দায় চলে আসে। ভাগ্য ভালো থাকায় তরী কক্সবাজার আসার পথে পার্থর ফোনের লক প্যাটার্ন একবার দেখেছিলো। সেই প্যাটার্ন বসাতেই ফোন আনলক হয়ে যায়। তরী সাথে সাথে ফোনের কনট্যাক্ট লিস্টে চলে যায়। সামান্য নিচে স্ক্রল করতেই দেখতে পায় আসিফের নাম। এই ছেলেটা পার্থর বেশ কাছের এবং বিশ্বস্ত। তরী আসিফের নাম্বার নিজের ফোনে তুলে নিয়ে ডায়াল করে।

রাত বিরাতে হঠাৎ কল আসায় আসিফের ঘুমের বেঘাত ঘটে। সে বেশ বিরক্তিকর ভঙ্গিতে ঘুমের মাঝে ফোন হাতড়ে রিসিভ করে বলে উঠে,

“ কে? “

তরী বিরক্ত হয়। না সালাম না কিছু ডিরেক্ট এভাবে কে বলাটা তার পছন্দ হয় না। তবুও নিজ থেকে সালাম দিয়ে বলে উঠে,

“ আমি তোমার ভাবী। “

“ এই মিয়া! রাত বিরাতে মশকরা করেন? আমার বাপ মা’র একমাত্র পোলা আমি। দূর দূর পর্যন্ত আমার চাচাতো, মামাতো, খালাতো, ফুফাতো কোনো ভাই নাই। তাইলে আপনে আমার ভাবী কেমনে হোন? “

“ রাজনীতিগত ভাই তো আছে তোমার। সেই ভাইয়ের বউ আমি। মিসেস পার্থ মুন্তাসির চৌধুরী। যার বিয়েতে তুমি গান ছেড়ে উড়াধুরা নেচেছিলে। “

সাথে সাথে আসিফের টনক নড়ে উঠে। সে এক লাফে উঠে বসে বলে উঠে,

“ আরেএ ভাবী? তরী ভাবী? আপনে? এই রাইতে কইরা ফোন দিসেন সব ঠিক আছে? ভাইয়ের কিছু হইসে? “

আসিফের পার্থর প্রতি এই চিন্তা দেখে তরীর অজানা কারণে সামান্য ভালো লাগে। অত:পর বেশ সিরিয়াস গলায় বলে উঠে,

“ সব ঠিক আছে। আমার তোমার কাছে কিছু প্রশ্ন ছিলো। আশা করছি সেগুলোর সঠিক উত্তর দিবে তুমি। “

আসিফ ভাবুক হয়। ভাবীর তার কাছের কি প্রশ্ন থাকতে পারে? তবুও সে বলে উঠে,

“ অবশ্যই ভাবী। “

“ যেদিন রাতে তোমার ভাই আমাকে জোর করে আটকে রেখে বিয়ে করেছিলো সেদিন ওখানে তিনটা ছেলে উপস্থিত ছিলো। সেই ছেলেগুলো কে এবং তাদের কেনো ওভাবে মারা হচ্ছিলো? “

আসিফ অবাক হয়। এতদিন পর এই প্রশ্ন করার মানে কি? কিন্তু ভাবীর থেকে এটা লুকানোর মতোও কিছু না। তাই বলে,

“ আপনার একজন পেশেন্ট ছিলো না? সিয়াম? ওকে ওরা তিনজন মিলে কোপায়সিলো। আর এইসব হইসিলো ভাইয়ের প্রতিপক্ষ রুবেলের আদেশে। কিন্তু এইখানে একটা সমস্যা হয়। সেটা হইসে রুবেল আদেশ দিসিলো আমারে কুপানোর জন্য। কিন্তু ভুল কইরা ওরা আমার জায়গায় এই নিষ্পাপ পোলাডারে কোপায়। “

“ তোমাকে কেন মারাতে চাইছিলো? “

“ কারণ সামনে ইলেকশন। আর আমি ভাইয়ের ডানহাত। আমারে মাইরা ভাইরে দূর্বল কইরা দিতে চাইসিলো। “

“ এরকম হলে তোমরা ওদের পুলিশের হাতে তুলে দেও নি কেনো? নিজেরা কেনো ক্রাইমে জড়ালে? “

আসিফ হাসে এই মুহুর্তে। হাসতে হাসতে বলে,

“ রাজনীতির বর্তমান সিচুয়েশন কেবল যারা রাজনীতিতে জড়িত তারাই ভালো জানে ভাবী। আমি বুঝতে পারসি যে আপনি রাজনীতি মানেই গুন্ডা, মাফিয়া মনে করেন। কিন্তু এইডা আপনার ভুল ধারণা। একটা পয়সার যেমন দুইটা পিঠ থাকে তেমন রাজনীতিতেও ভালো খারাপ দুই দিকই আছে। বর্তমানে ক্ষমতাসীনরা তাদের ক্ষমতার দাপটে হাজারটা অন্যায় করে যাইতেসে। তাদের ধইরা বাইন্ধা রাখার কারো সাধ্য নাই। প্রশাসনের আশায় বইস্যা থাকলে ওগোরে শিক্ষা দেওয়া যাইতো না। তাই ভাই নিজেই ওগোরে তুইল্যা আনসিলো শিক্ষা দেওয়ার জন্য। “

কথাটুকু বলে আসিফ থামে। এক দন্ড দম নিয়ে আবার বলে উঠে,

“ রাজনীতির মতো ভাইয়েরও দুইটা রূপ আছে ভাবী। কপালবশত আপনে ভাইয়ের সেই রূপটা আগে দেইখ্যা ফেলসেন যেইটা আপনার দেখা উচিত হয় নাই। কিন্তু ভাইয়ের আরেকটাও রূপ আছে। হেই রূপটা দেখার আর বুঝার চেষ্টা করেন। উনার বিপক্ষে না গিয়া এই কঠিন পরিস্থিতিতে উনার পাশে থাকেন। বিশ্বাস রাখেন ঠকবেন না। “

কথাটুকু বলেই আসিফ ফোন রেখে দেয়। আসিফের কথাগুলো তরীকে ভাবায়।

__________

এক সপ্তাহের জন্য চট্টগ্রাম এসেছে তরী এবং পার্থ। প্রথম দু’দিন তরী হোটেল রুমে বসেই কাটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু নিজের লাইসেন্স রিস্টোরের লেটার দেখার পর থেকে তার মন বেশ ফুরফুরে। এখন আর তার মন খারাপ করে থাকার কোনো কারণ নেই। তাই পরের দিন সে বেশ খুশি মনেই কক্সবাজারে ঘুরে বেড়িয়েছে। আজ তারা এসেছে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপ বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে বঙ্গপোসাগরের উত্তর পূর্বাংশে অবস্থিত একটি ছোট্ট প্রবাল দ্বীপ। কক্সবাজার জেলার টেকনাফ হতে প্রায় ৯ কি.মি দক্ষিণে এবং মায়ানমারের উপকূল হতে ৮ কি.মি পশ্চিমে নাফ নদীর মোহনায় অবস্থিত।

আফজাল সাহেব বেশ পাগলাটে ধরনের মানুষ। উনি সেইন্ট মার্টিনে রিসোর্টের বদলে এক সম্পূর্ণ বাংলো বুক করেছেন পার্থ আর তরীর জন্য। দোতলার এই বাংলো বাড়িটি দেখভালের জন্য দুজন কেয়ারটেকার রয়েছে। পার্থ এবং তরীর হাতে তারা বাড়ির চাবি বুঝিয়ে দিয়ে আউট হাউসে চলে যায়। বাড়িরটার নিচতলায় লিভিং রুম, ডাইনিং রুম, কিচেন এবং আরো দুটো রুম রয়েছে। দ্বিতীয় তলায় রয়েছে মোট চারটি রুম। সেই চারটি রুমের একটিতে উঠেছে তরী এবং তার বিপরীতে থাকা অন্য রুমে উঠেছে পার্থ।

বাংলোতে পৌঁছেই দুজনে পুরো দুপুর পাড় করে ঘুমিয়ে। বিকেলের দিকে দুজন হালকা খাওয়া দাওয়া করে বেরিয়ে পড়ে বিচে ঘুরতে। পুরো বিকেল হতে সন্ধ্যা বিচেই ঘুরে বেড়ায় তারা। হাঁটতে হাঁটতে বাংলো হতে বেশ দূরে চলে এসেছে ইতিমধ্যে। সমুদ্রের উত্তাল গর্জন আর শীতল বাতাস তরীর হৃদয় শিহরিত করে। চারপাশে সমুদ্র এবং মাথার উপর একরাশ নক্ষত্রপুঞ্জ যেন স্বর্গীয় সুখের এক নিয়ামক। তরীর ভাবনার মাঝেই পার্থ আচমকা ডেকে উঠে,

“ তরী ক্যাচ। “

আচমকা ডাকে তরী তাকাতেই দেখে পার্থ তার দিকে কিছু একটা ছুড়ে মেরেছে। সে সঙ্গে সঙ্গেই হাত বাড়িয়ে তা ক্যাচ ধরে নেয়। তরী নিজের হাতের মুঠো খুলে তাকাতেই দেখে ছোট একটা ঝিনুক। সাথে সাথেই পার্থ আবার ডেকে তার দিকে আরেকটা ঝিনুক ছুড়ে মারে। এবারও তরী সেটা একইভাবে ধরে ফেলে। অত:পর ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

“ আমাকে এগুলো ছুড়ে মারছেন কেন? “

“ সমুদ্রে আসবেন অথচ সমুদ্রের স্মৃতিচিহ্ন কুড়িয়ে নিবেন না। তা হয় নাকি? “

তরী হাসে মৃদু। সে হাতের ঝিনুকগুলো দেখতে দেখতে পার্থর পিছু পিছু হাঁটতে থাকে। কক্সবাজারের তুলনায় সেন্ট মার্টিন বেশ নির্জন। এই নির্জনতা যেন এখানকার সৌন্দর্য আরো কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আচমকা নির্জনতা ছাপিয়ে পার্থ বলে উঠে,

“ শিট। বৃষ্টি নামবে নাকি? “

তরী পার্থর কথা শুনে অবাক হয়ে আকাশ পানে তাকায়। চাঁদ এবং নক্ষত্রপুঞ্জিরা ইতিমধ্যে মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে। শীতল হাওয়াও হঠাৎ দমকা হাওয়ার রূপ ধারণ করেছে। তরী আশেপাশে তাকিয়ে দেখে দূরে নারিকেল গাছের সারি ব্যতীত আর কোনো জায়গা নেই আশ্রয় নেওয়ার জন্য। কিন্তু সেটাও সেফ নয়। তার ভাবনার মাঝেই পার্থ তার হাত ধরে উল্টো পথে দৌড়ানো শুরু করে। তরী বিস্ফোরিত গলায় প্রশ্ন করে,

“ কি করছেন? “

“ এখানেই দাঁড়িয়ে ভিজবেন না বাংলোতে ফিরবেন? “

তরী আর কোনো কথা বলে না। সে একহাতে ঝিনুক দুটো শক্ত করে ধরে পার্থর সাথে তাল মিলিয়ে দৌড়াতে শুরু করে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। পথিমধ্যেই মেঘ গলে বৃষ্টির বিন্দু হয়ে নেমে আসে দ্বীপের বুকে। বৃষ্টিতে ভিজেই বাংলোতে প্রবেশ করে তারা। কেয়ারটেকার ললিতা বেগম এতক্ষণ তাদের অপেক্ষায়ই পথ চেয়ে ছিলো। তাদের বাংলোর ভিতর প্রবেশ করতে দেখে তিনি আউট হাউসের ভেতর গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়।

বাংলোর ভেতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে আছে। বৃষ্টির কল্যাণে বিদ্যুৎ চলে গিয়েছে। তরী আর পার্থ ফোনের ফ্ল্যাশলাইট অন করে উপরে চলে আসে। পার্থ মোমবাতি খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আর তরী তার রুমের বারান্দার দরজা জানালা লাগাতে। বাহিরে পুরো দমে বৃষ্টির পাশাপাশি ঝড়ো হাওয়া বইছে।

পার্থ একটা মোমবাতি খুঁজে পেয়ে তা জ্বালিয়ে তরীর রুমে প্রবেশ করে। তরী সবেমাত্র বারান্দার দরজা লাগিয়ে জানালা লাগাচ্ছিলো। মোমবাতির মৃদু আলোতে দূর হতে তরীকে দেখে পার্থ। ভেজা জারুল রঙা শাড়ি গায়ে লেপ্টে দাঁড়িয়ে থাকা মানবীকে বর্ষায় সদ্য ফোটা ফুলের ন্যায় স্নিগ্ধ লাগছে তার। ঠান্ডায় মৃদু কাপছে সেই লতানো দেহ। শাড়ির আঁচল চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে বিন্দু বিন্দু জল। সেই টুপটাপ জলে মেঝে ভিজে যাচ্ছে। সম্পূর্ণ দৃশ্যটা দেখে পার্থর মতিভ্রম হয়। নিজের মনের গহীনে লুকিয়ে রাখা এতদিনের অনুভূতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে তার। নীরবে মোমবাতিটা একটা ড্রয়ারের উপর রেখে তরীর দিকে এগিয়ে যায়।

পিছনে কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে তরী প্রশ্ন করে,

“ মোমবাতি পেয়েছেন? “

সময় পেরোয় কিন্তু কোনো জবাব আসে না। আচমকা মনে উঁকি দেওয়া সন্দেহ বশত তরীর জানালা আটকানোর চেষ্টায় ব্যস্ত হাত জোড়া থেমে যায়। সে চকিতে পিছনে ফিরে তাকায়। পার্থ এখনো তার থেকে কয়েক কদম দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো। মন এবং মস্তিষ্কের দ্বন্দ্বে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলো। কিন্তু তরীর ফিরে তাকানোর সাথে সাথেই তার মন জিতে যায়। মনের প্রতি সম্মতি জানিয়ে সে বুক ফুলিয়ে গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিয়ে তরীর দিকে এগোয়। পার্থর গভীর দৃষ্টি এবং সেই বড় বড় কদম ফেলে এগিয়ে আসা দেখে তরী নিজের দৃষ্টি নত করে। আচমকা তার সকল তেজ যেন এক পশলা বৃষ্টিতে শান্ত রূপ ধারণ করেছে।

পার্থ কাছাকাছি এগিয়ে এসে একহাত বাড়িয়ে তরীর গাল ছুয়ে দেয়। অত:পর নত মুখটা মৃদু উঁচু করে ধরে। তরী বাধ্য হয় তাকাতে। মুহুর্তেই তার সাক্ষাৎ হয় অন্য এক পার্থর সাথে। মায়াকাতর দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকা এই পুরুষ তার বড্ড অচেনা ও নতুন। প্রকৃতির মাতালতা এসে হানা দেয় তরীর হৃদয়ে। সেই মাতালতা দ্বিগুণ করে দিতে পার্থ গাঢ় শীতল স্বরে বলে উঠে,

“ পার্থ মুন্তাসির নিজেকে আপনার আওতায় সঁপতে চাইছে তরী। অনুমতি আছে কি? “

তরী বাকহারা হয়ে পড়ে। জীবনে বহু প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে সে। কিন্তু এরকম প্রশ্নের সম্মুখীন এই প্রথম হলো। পার্থ কাতর চোখে অনুমতির অপেক্ষা করে। তরী নিরুত্তর রয়। কিছু মুহুর্তের ব্যবধানে নিজের চোখ বুজে নেয় সে। পার্থ বিভোর হয়। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠে তার মৃদু হাসি। তরীর বুজে রাখা চোখ জোড়ায় ওষ্ঠ ছোঁয়ায়। অবাধ্য হাত জোড়া শাড়ির আঁচল ভেদ করে তরীর কোমর ছুঁয়ে দেয়। বৃষ্টির তোলপাড় তুখোড় বাইরে। সেই তুখোড় ঝড়ো হাওয়া পার্থর মনের শান্ত পর্দা মুহুর্তেই উড়িয়ে দেয়। ভেঙে দেয় তরীর আত্ম প্রতিশ্রুতি।

আরেকটু উষ্ণতার আশায় তরী পার্থর শার্টের বুকের কাছটা আঁকড়ে ধরে। সম্মতির ইশারা পেতেই পার্থ অশান্ত হয়ে পড়ে। অপেক্ষা না করে তরীর চোখ জোড়া থেকে নেমে তার অধর নিজের দখলে নিয়ে নেয়। তরীর হাত জোড়া ব্যস্ত হয়ে পড়ে পার্থর শার্টের বোতাম খুলতে। আচমকা তার শীতল হাতজোড়া থেমে যায়। এক কদম পিছিয়ে গিয়ে নিচু স্বরে ডাকে,

“ পার্থ? “

এই এক কদমের দূরত্বও আর সয় না পার্থর। তরীর কোমর ধরে নিজের কাছে টেনে এনে গভীর ব্যকুল স্বরে জবাব দেয়,

“ হ্যাঁ জান। “

পার্থর এই সম্বোধনে তরীর সর্বাঙ্গে এক অদ্ভুত শিহরণ ছড়িয়ে পড়ে। কেপে উঠে তার সম্পূর্ণ স্বত্তা৷ চোখ তুলে তাকাতেই দেখে পার্থ তার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে থেকেই তরী সম্মোহনী গলায় শুধায়,

“ গান শুনাবেন? “

পার্থর হাসির রেখা গভীর হয়। ইষৎ কম্পিত তরীর কানের কাছে মুখ নামায়। নিজের কানের লতিতে শীতল ঠোঁটের স্পর্শ এবং ঘাড়ে শীতল নিঃশ্বাস টের পেতেই ফের চোখ বুজে ফেলে তরী।

“ তেরে এহসাসো মে
ভিগে লামহাতো মে
মুঝকো ডুবা তিশমাগিসি হে,
তেরি আদাও সে
দিলকাশ খাতাও সে
ইন লামহো মে জিন্দেগী সি হে,
হায়া কো যারা ভুল যাও
মেরি হি তারহা পেশ আও। “

এতটুকু গেয়েই পার্থ নীরব বনে যায়। নীরবতায় তরী অধৈর্য্য হয়ে চোখ মেলে তাকাতেই দুজনের দৃষ্টি মিলন হয়। পার্থ এই পর্যায়ে নিজের গায়ের সাদা শার্টটা খুলে দূরে ছুড়ে ফেলে বলে উঠে,

“ আমাকে নির্লজ্জ বলার জন্য প্রস্তুত হও জান। “

পার্থর ধারালো কথা শুনে তরীর শরীর অসাড় হয়ে আসে। হাতের মুঠোয় থাকা ঝিনুক দুটো শব্দ তুলে ফ্লোরে পড়ে যায়। বজ্রপাতের গর্জনের সাথে সাথে নিজেকে পার্থর জিম্মায় ছেড়ে দেয় সে। পার্থর অব্যক্ত সন্ধি প্রকাশ পায় অন্য রূপে, অন্যভাবে।

__________

সেইন্ট মার্টিন দ্বীপে নেমে আসা বর্ষণ তখনও থামে নি। প্রকৃতি তখনও নিজের উথাল-পাতাল তাণ্ডব চালাতে ব্যস্ত। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই গভীর রাতের তাণ্ডব দেখতে ব্যস্ত পার্থ। উদোম শরীরটা দমকা হাওয়ার সাথে ছিটকে আসা বৃষ্টির ফোটায় ভিজে যাচ্ছে। একহাত প্যান্টের পকেটে গুজে রাখা তার। অপরহাতের আঙুলের ভাজে থাকা জ্বলন্ত সিগারেটটা দু ঠোঁটের মাঝে চেপে ধরেছে। মুহুর্তেই সিগারেটটা মুখ থেকে সরিয়ে হাওয়ায় ধুয়ো উড়িয়ে দেয়।

কিছুক্ষণ আগেও তার হাতের আঙুলের ভাজে তরীর আঙুল ছিলো। তার অধরের সাথে তরীর অধর মিলিয়ে ছিলো। উষ্ণতার চাদরে ঢাকা পড়ে তরী নিদ্রায় আচ্ছন্ন হতেই পার্থর মস্তিষ্ক সচল হয়। বুঝতে পারলো সে আবেগের বর্শবর্তী হয়ে কত বড় ভুল করলো। তরীও নাহয় এই মুহুর্তে তার আবেগে সাড়া দিয়েছে। কিন্তু আগামীকাল? তখন তরী তার ব্যাপারে কি ভাববে? যদি বোকা তরী তার মন না বুঝে উল্টো ভেবে বসে পার্থ সিচুয়েশনের ফায়দা তুলেছে?

এরকমটা তো কখনোই চায় নি পার্থ। তরীর বেলায় সবকিছু কেন তার প্ল্যানের বিপরীত হচ্ছে? প্রথমে তাদের বিয়েটা, অত:পর আজকের রাতটা। কেন প্রতিবারই পার্থ নিজের মনের কথা জানানোর আগেই তাদের সম্পর্ক এক পা দু পা করে এগিয়ে যাচ্ছে? এভাবে তো তাদের মনের মিলটাই কখনো হবে না।

পার্থ সিগারেটটা ফেলে রুমে প্রবেশ করে। বিছানার চারিদিকে থাকা শুভ্র পর্দার ফলে বিছানার মাঝে শুয়ে থাকা তরী আড়াল হয়ে আছে। পার্থ এগিয়ে গিয়ে তরীর পিছনে বসতেই তার দৃষ্টি পড়ে তরীর ঘুমন্ত মুখশ্রীর দিকে। পার্থ এগিয়ে গিয়ে কম্বলটা আরেকটু টেনে তরীর উন্মুক্ত পিঠ ঢেকে দেয়। অত:পর নিজে বিছানার হেড সাইডে হেলান দিয়ে বসে। কম্বলের উষ্ণতা টের পেতেই তরী ঘুমের ঘোরে পার্থর দিকে এগিয়ে গিয়ে তার কোলে মাথা তুলে দেয়। অত:পর বুকের কাছে কম্বল জড়িয়ে ধরে গুটিসুটি মেরে রয়।

পার্থর সাথে সাথে নিঃশব্দে হেসে দেয়। এটা তরীর প্রতিদিনকার অভ্যাস। বাসায় থাকা অবস্থায় তরী ঘুমিয়ে যাওয়ার পর পার্থ প্রতিদিন রাতে নিজের বেডরুমের এক্সট্রা কি দ্বারা দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করে তরীর মাথার কাছে বসলেই তরী ঘুরেফিরে বালিশ ছেড়ে পার্থর কোলে মাথা রেখে ঘুমাতো। এই মেয়ের ঘুম এতো গাঢ় যে ভূমিকম্প হলেও কখনো টের পাবে না।

পার্থ মৃদু হেসে তরীর চুলের ফাঁকে নিজের ডানহাতের পাঁচ আঙুল গুজে দিয়ে হাত বুলিয়ে দেয়। সাথে সাথে তার বুকের ভেতরটা শীতল হয়ে আসে। কোমল স্বরে অনুভূতির প্রগাঢ়তা ঢেলে দিয়ে বলে উঠে,

“ হৃদয়ের ডাক্তার, স্টেথোস্কোপ ছাড়া আমার হৃৎস্পন্দনের গতি কি টের পান না আপনি? এক মুহুর্তের জন্যও বুঝতে পারেন না যে কতটা ভালোবাসি? “

তরী নিরুত্তর। পার্থ মলিন হেসে মাথা নামিয়ে তরীর উন্মুক্ত কাধের কালো তিলটায় অধর ছোয়ায়। অত:পর ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,

“ আই লাভ ইউ জান। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-২৩+২৪

0

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৩.

তরীর হাত ধরে নিজের গাড়ির সামনে এনে তাকে দাঁড় করিয়ে পার্থ ইশারা করে উঠে বসতে। তরী সেই ইশারা অগ্রাহ্য করে বলে,

“ আমি সাথে গাড়ি এনেছি। চলে যেতে পারবো। “

পার্থ কঠিন স্বরে বলে,

“ আপনার গাড়ি বাসায় পৌঁছে যাবে। আপনি আমার সাথে চলুন। “

তরী তেজ দেখিয়ে বলে,

“ আমি একা যেতে পারবো। “

“ আমার মাথা যথেষ্ট গরম হয়ে আছে তরী। চুপচাপ আমার সাথে চলুন। নাহয় তুলে নিয়ে যাওয়ার আগে আমি এক মুহুর্তও ভাববো না। “

তরীর রাগ লাগে। কুকুরের লেজ যেমন কখনো সোজা হবে না, তেমনই এই লোকের হুমকি দেওয়ার স্বভাব জীবনেও বদলাবে না। তরী আশেপাশে তাকিয়ে দেখে অনেকেই উৎসুক চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। এই মুহুর্তে আরো সিন ক্রিয়েট সহ্য করার মতো ধৈর্য্য নেই তরীর মধ্যে। তাই সে রাগ নিয়েই চুপচাপ পার্থর গাড়িতে উঠে বসে। পার্থও উঠে বসে গাড়ি স্টার্ট দেয়।

__________

নদীর পাড়ে নিরিবিলি এক জায়গায় এসে গাড়ি থামিয়েছে পার্থ। সারা রাস্তায় দুজনেই নীরব ছিলো। কিন্তু এখন নীরবতা ভেঙে পার্থ প্রশ্ন করে,

“ ওই মানুষ গুলো আপনার পূর্ব পরিচিত? “

তরী এক মুহুর্ত পার্থর দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে জানালার বাহিরে তাকায়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে দৃষ্টি দূর নদীর পানে স্থির রেখে জবাব দেয়,

“ সাদ আমার বাগদত্তা ছিলো আর আয়রা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। “

পার্থ স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করে,

“ গতকাল যেই বাচ্চাটা মারা গিয়েছে সেটা ওদের বাচ্চা ছিলো? “

“ হুম। “

“ আপনি যেখানে কোনো ভুল করেন নি সেখানে কেনো ক্ষমা চাইতে গিয়েছেন? “

তরী এবার পার্থর দিকে ফিরে তাকায়। সহজ ভাষায় বলে,

“ ক্ষমা চাইলে আমি ছোট হয়ে যাবো না। আমি শুধু নিজের চাকরিটা হারিয়েছি। ওরা নিজেদের সন্তান হারিয়েছে। ওদের কষ্টটা নিশ্চয়ই আমার থেকে বড়? আমার সামান্য সরিতে ওদের ক্ষতিপূরণ হবে না। কিন্তু আমার মন বলছিলো যে একবার সরি বলা উচিত আমার। “

“ কষ্ট তো আপনিও পেয়ে আসছেন এতো বছর ধরে। কই ওরা তো একবারও আপনাদের কাছে ক্ষমা চায় নি? “

তরী অবাক সুরে প্রশ্ন করে,

“ আপনি জানতেন? “

“ গায়ে হলুদের দিন আপনার পাপার সাথে আমার বেশ অনেকক্ষণ একান্তে কথা হয়। উনি তখন আমাকে এই বিষয়ে জানিয়েছিলেন। কিন্তু খুব একটা ডিটেইলসে কিছু বলেন নি উনি। “

তরী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সিটে গা এলিয়ে দেয়। চোখ বুজে বলা শুরু করে,

“ আমার সাথে এনগেজড থাকা অবস্থায়ই সাদ আয়রার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ে। আমার আড়ালেই ওদের সম্পর্ক চলছিলো। ওদের সম্পর্ক এতটাই গভীর পর্যায়ে চলে যায় যে একদিন সাদ জানতে পারে আয়রা প্রেগন্যান্ট। ও প্রচুর অপরাধ বোধে ভুগছিলো। সবশেষে ডিসিশন নেয় যে ও আয়রাকে ছেড়ে দিবে। আমাকেই বিয়ে করবে। আমি তখনও এসবের কিছু ঘুনাক্ষরে টের পাই নি। এরই মাঝে আমি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়ি একবার। হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার পর বেশ কিছু টেস্ট করা হয়। এরমধ্যে একটা টেস্টের রিপোর্ট কিছুটা এরকম ছিলো যে আমি কখনো কনসিভ করতে পারবো না। মুহুর্তেই সাদের অপরাধবোধ থেকে নেওয়া ডিসিশন বদলে যায়। সেদিন হসপিটালেই ও আমাকে নিজের এবং আয়রার সম্পর্কের ব্যাপারে জানায়। আর এটাও বলে আমাকে বিয়ে করা ওর দ্বারা সম্ভব নয়। আমি ওকে আটকাই নি। যেতে দেই। “

পার্থ এক ধ্যানে তরীর দিকে তাকিয়ে আছে। কি সহজে সম্পূর্ণ ঘটনা বলে দিলো মেয়েটা। কিন্তু যত সহজে বলেছে তত সহজে কি সইতে পেরেছিলো? পার্থ প্রশ্ন করে,

“ তাহলে সিড়ির ওখানে আয়রা যা বলছিলো তা সত্যি? “

তরী চোখ মেলে ঘাড় ঘুরিয়ে পার্থর দিকে তাকায়। অত:পর নিঃশব্দে হেসে প্রশ্ন করে,

“ কেন? আফসোস হচ্ছে? ঠকে গিয়েছেন মনে হচ্ছে? “

“ আমি তা বুঝাই নি। “

তরী আবার চোখ বুজে বলে উঠে,

“ আল্লাহ আমার প্রতি সদয় ছিলেন। নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরেকবার টেস্ট করাই আমি। এইবার রিপোর্ট নরমাল আসে। আগের সেই রিপোর্ট ভুল ছিলো। “

“ এই কথা তাহলে সাদকে জানান নি কেন? আজকে যখন আয়রা আপনাকে এরকম সেনসেটিভ একটা টপিক তুলে কটু কথা শোনাচ্ছিল তখন তাহলে একবারও তার মুখের উপর সত্যিটা বলেন নি কেন? “

তরী শান্ত স্বরে জবাব দেয়,

“ প্রয়োজন মনে করি নি। সাদের চ্যাপ্টার আমি আমার লাইফ থেকে ছিড়ে ফেলে দিয়েছি বহু আগেই। ওরা আমাকে নিয়ে কি ভাবলো না ভাবলো তা দিয়ে আমার কিছু যায় আসে না। “

পার্থ তরীর দিকে তাকিয়ে থাকে। আচমকা একহাত বাড়িয়ে তরীর ডান হাতের কনুই স্পর্শ করতেই তরী ব্যথায় মৃদু আর্তনাদ করে উঠে। অত:পর চোখ কুচকে পার্থর দিকে তাকায়। পার্থ শীতল গলায় বলে উঠে,

“ আঘাত লাগলে মুখ ফুটে বলবেন। আমি অন্তর্জামী নই যে আপনার সকল ব্যাথা নিজ থেকেই টের পাবো। “

__________

“ স্যার। ওই ম্যানহোলের ডেথকেসে একটা নতুন তথ্য পাওয়া গিয়েছে। “

শোভন চোখ তুলে তাকায় তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ অফিসারের দিকে। সিরিয়াস ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে,

“ কি তথ্য? কোনো ক্লু পেলে? “

“ স্যার নিহতের নাম ছিলো আহনাফ রফিক। সেই নিহত ব্যক্তি গত ১ বছর ধরে নিখোঁজ ছিলো। উনার পরিবার উনার জন্য একটা মিসিং ডায়েরিও ফাইল করেছিলো। “

শোভনের ভ্রু জোড়া কুচকে আসে। সে প্রশ্ন করে,

“ আর? “

“ আর স্যার, এই আহনাফ নামক ছেলেটা নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট ছিলো। বেশ সম্ভ্রান্ত ফ্যামিলির ছেলে। উনার ফ্যামিলি নিজে উনার পরিচয় কনফার্ম করেছে। “

শোভনের কপালের চিন্তার রেখা গাঢ় হয়। সে বলে,

“ সেই ছেলের ভার্সিটি যাও। খোঁজ লাগাও। তার বন্ধুদের সাথে কথা বলো। কারো সাথে কোনো ঝামেলা ছিলো নাকি শিওর হয়ে আসো। “

পুলিশ অফিসার চিন্তিত গলায় বলে উঠে,

“ ওকে স্যার। কিন্তু আপনার কি মনে হচ্ছে? কেসটা কি? “

“ এতদিন তো আমার এটাকে পলিটিক্যাল ইস্যু মনে হচ্ছিলো। কিন্তু এখন নিজেও বুঝে উঠতে পারছি না আসল ব্যাপার কি। যতদিন না কোনো ক্লু পাবো ততদিন এই কেসটা একটা গোলকধাঁধাই রয়ে যাবে। “

শোভনের কথার মাঝেই একজন কনস্টেবল দৌড়ে এসে বলে,

“ স্যার। দুজন মানুষ এসেছে। একটা মিসিং ডায়েরি করাতে। “

শোভন বলে,

“ আসতে দাও। “

দু’জন পুরুষ মানুষ শোভনের রুমে প্রবেশ করে। একজনের বয়স সম্ভবত পঞ্চাশের ঘরে এবং আরেকজনের খুব সম্ভবত ত্রিশ বছর হবে। চেহারার বিধ্বস্ত অবস্থা। শোভন প্রশ্ন করে,

“ জ্বি বলুন। কার মিসিং ডায়েরি ফাইল করাতে চাচ্ছেন? “

ত্রিশ বছরের পুরুষটা বলে উঠে,

“ আমার ছোট ভাই। গতকাল ভার্সিটি যাওয়ার জন্য বেরিয়েছিলো। কিন্তু একদিন পেরিয়ে গিয়েছে এখনো বাসায় ফিরে নি। ফোন করছি কিন্তু ফোন বন্ধ আসছে। ওর বন্ধুদের কল করেছি। ওরা বলছে আমার ভাই নাকি ভার্সিটি যায়ই নি গতকালকে। “

“ এমনও তো হতে পারে আপনার ভাই নিজের ইচ্ছায়ই আত্মগোপন করে আছে। “

সামনে বসা বয়স্ক পুরুষটা এবার চটে গিয়ে বলে উঠে,

“ আমার ছেলে অনেক ভদ্র নম্র স্বভাবের। ও কোনো ধরনের ফালতু কাজে কখনো জড়ায় না। আমি নিশ্চিত আমার ছেলেকে কেউ কিডন্যাপ করেছে। “

শোভন কিছুটা রহস্যময় দৃষ্টি নিয়ে তার সামনে দাঁড়ানো পুলিশ অফিসারের দিকে তাকায়। অত:পর তার সামনে বসে থাকা লোক দুটোর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে,

“ আপনার ছেলে কি কোনো প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়তো? “

“ হ্যাঁ। “

__________

তরী এবং পার্থ বাসায় ফিরতেই আফজাল সাহেব পার্থকে একান্তে কথা বলার জন্য ডেকে পাঠায়। পার্থ এসে উনার সামনে বসতেই উনি একটা খাম এগিয়ে দেয় তার দিকে। পার্থ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

“ এটা কি? “

আফজাল সাহেব সোজাসাপ্টা জবাব দেয়,

“ ফ্লাইট টিকেট। “

“ কার ফ্লাইট টিকেট? “

“ তোমার এবং তরীর। “

পার্থ অবাক সুরে প্রশ্ন করে,

“ আমাদের ফ্লাইট টিকেট মানে? কোথায় যাচ্ছি আমরা? “

“ কক্সবাজার যাচ্ছো। আমি সব বুক করে রেখেছি। কাল সকালে তোমাদের ফ্লাইট। গিয়ে এখন নিজেদের ব্যাগ প্যাক করে নাও। “

পার্থ বিরক্তি মিশ্রিত গলায় বলে উঠে,

“ এখানে কি দুই মিনিটের ইন্সট্যান্ট ম্যাগি নুডুলস রান্না হচ্ছে নাকি? কথা নেই বার্তা নেই, হুট করে টিকেট ধরিয়ে দিয়ে বলছেন কক্সবাজার যেতে। কক্সবাজার আমাদের কি কাজ? “

আফজাল সাহেব রাগান্বিত সুরে বলে,

“ গাধার বাচ্চা তোমাদের কথা ভেবেই আমি এই কাজ করেছি। বিয়ের পর থেকে প্রচুর ঝামেলা যাচ্ছে তোমাদের উপর দিয়ে। তাই এই হানিমুন ট্রিপটা আমার তরফ থেকে গিফট। কিছুদিন গিয়ে ঘুরে আসো। তরীর মনও ভালো হয়ে যাবে আর নিজেরা একান্তে সময়ও পাবে একটু। এদিকটা আমি সামলে নিবো। “

পার্থ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে কিছু একটা ভাবে। অত:পর বলে উঠে,

“ আপনার আদরের পুত্রবধূ হানিমুন ট্রিপে যাওয়ার জন্য রাজি হবে বলে আমার মনে হয়না। “

“ তোমার আম্মা কথা বলতে গিয়েছে ওর সাথে। রাজি করিয়ে ফেলবে। চিন্তা করো না। “

পার্থ মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসতে নেয়। আচমকা দরজার কাছে গিয়ে সে পিছে ফিরে বলে,

“ আব্বা? “

“ কি? “

“ আমাকে গাধার বাচ্চা বললে কিন্তু আলটিমেটলি আপনি নিজেকেই গাধা বলছেন। “

কথাটা বলেই পার্থ আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা করে না। বেরিয়ে যায়। আফজাল সাহেব কিড়মিড়িয়ে বলে উঠে,

“ অসভ্যের বাচ্চা। বাপের সাথে মশকরা করো। এরকম ইতরদের বউ ছাড়া হানিমুনে পাঠানো উচিত। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৪.

সকাল সকাল লাগেজ হাতে সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে নিচে নেমে আসলো পার্থ এবং তরী। এখন ঘড়ির কাঁটা ছয়টা পনেরো মিনিটে স্থির। তাদের ফ্লাইট হলো সকাল দশটায়। বাসা থেকে আগে আগেই বেরুতে হবে তাদের। তরী প্রথমে যেতে চাচ্ছিলো না। কিন্তু পরে এটা ভেবে রাজি হয় যে আফজাল সাহেব তার কথা ভেবে এই ট্রিপ প্ল্যান করেছে। মানুষটা পিতার ন্যায় তার মন ভালো করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এভাবে প্রত্যাখ্যান করাটা সমীচীন হবে না। আর তাছাড়াও কিছুদিনের জন্য দূরে গেলে যদি তার অন্তরের জ্বালা কিছুটা কমে তবে দোষ কোথায়?

ঘরের বড় ছেলে এবং পুত্রবধূকে বিদায় জানাতে সকলেই সকাল সকাল নিচে অপেক্ষা করছে। গতরাতে তরীর শাশুড়ি তরীকে বেশ কিছু নতুন শাড়ি এনে দিয়েছিলো সাথে নেওয়ার জন্য। সেখান থেকেই একটা জারুল রঙের শাড়ি পড়েছে তরী। নিচে নেমেই সে শাশুড়ির দিকে এগিয়ে গিয়ে আগে উনাকে জড়িয়ে ধরে। অত:পর শশুড়ের কাছে এগিয়ে যেতেই আফজাল সাহেব কিছু সুরা পড়ে তরীর মাথায় ফু দিয়ে হাত বুলিয়ে দেয়। শোভন হাই তুলতে তুলতে বলে উঠে,

“ জলদি গিয়ে জলদি ফিরে আসবেন ভাবী। একমাত্র দেবরের বিয়ের সব দায়িত্ব কিন্তু আপনার উপরই। “

তরী মৃদু হেসে বলে,

“ অবশ্যই। “

__________

চট্টগ্রাম এসে পৌঁছাতেই পার্থ এবং তরী প্রাইভেট কারে করে হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। ঢাকায় যেরকম স্বচ্ছ আকাশ দেখে এসেছিলো এখানে সম্পূর্ণ তার বিপরীত। গুমোট আকাশ ইতিমধ্যে গর্জন তুলে বর্ষণ নামিয়েছে। প্রকৃতি বেশ শীতল। পার্থ ড্রাইভ করতে করতে একবার পাশ ফিরে তরীর দিকে তাকায়। সম্পূর্ণ রাস্তায় তরী চুপচাপ ছিলো। এখনো চুপচাপ জানালা ভেদ করে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে।

পার্থ দৃষ্টি ফিরিয়ে আবার বাহিরে তাকায়। এই আবহাওয়া দেখে তার একটা গানের কথা মনে পড়ে। অপেক্ষা না করে গাড়িতে সেই গানটা প্লে করে দেয়। ভলিউমটাও কিছুটা মাঝামাঝি পর্যায়ে বাড়িয়ে দিয়ে গানের সাথে নিজে সুর মিলিয়ে গুনগুন করতে থাকে।

“ লাখ রোকা, পার রুকা না
ইষ্ক ইয়ে সারসোর হে
আপনি চাহাত, ওর কুছ হে
ইষ্ক কি কুছ ওর হে
তেরে মেরে বাস মে কেয়া হে
হো রাহা হে যো লিখা হে
ইস লামহে কি খওয়াহিশো মে
জিন্দেগানি কি রাজা হে
ইউ হি রে ইউ হি রে
মিলতে রাহে হাম
তুঝি মে তুঝি মে খোকে রাহে হাম। “

এই গান এর পূর্বে কখনো শুনে নি তরী। কিন্তু গানটা তার কাছে সুন্দর লাগছে শুনতে। তাই আগ্রহ বসত সে তার ফোনের ইউটিউবে গিয়ে গানের নামটা লিখে সার্চ করে। ফোনের ভলিউম লো করে গানটা প্লে করতেই লজ্জায় তার কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হতে থাকে। সাথে সাথে সে ফোন বন্ধ করে দেয়। এগিয়ে গিয়ে গাড়িতে বাজতে থাকা গানের ভলিউমও সম্পূর্ণ কমিয়ে দেয়। অত:পর রাগে লাল হওয়া মুখ নিয়ে বাহিরে দৃষ্টিপাত করে। কিন্তু তবুও সে নিস্তার পায় না। তার পাশে বসে থাকা জ্বলজ্যান্ত স্পোটিফাই এখনো গান গেয়ে চলেছে।

“ না গাভারা থা মুঝে যো
দিল কো ও মানজুর হে
তুঝসে মিলকে দিল ইয়ে জানে
কিস নাশে মে চোর হে
ও হো সাথ মিলকে দিল সে তেরে
হো গায়া হু বাখুদা মে
তেরি কুরবাত সে ভি কেসি
রেহ সাকুঙ্গি আব জুদা
মেরি নিগাহো কি বাহো মে আও না
চাহাত কে হামেসা রাহো মে রাহু না। “

শেষের দুটো লাইন পার্থ তরীর দিকে ফিরে গায়। তরীর ধৈর্যের বাধ ভাঙে। সে পাশ ফিরে পার্থর দিকে তাকিয়ে রাগ নিয়ে বলে উঠে,

“ আপনার প্লেলিস্টে কি সব এরকম নির্লজ্জ মার্কা গান? “

পার্থ গান থামিয়ে ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

“ গানের মাঝেও কি নির্লজ্জ এবং সভ্যের ভেদাভেদ করা হয় নাকি? আমার জানা ছিলো না। “

“ এক্সকিউজ মি। আমি খুব ভালো করে বুঝছি আপনার ইনটেনশন কি। এসব গান গেয়ে আমাকে দূর্বল করে সত্যিকারের হানিমুন ট্রিপ ইঞ্জয় করার প্ল্যান মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। এরকমটা কখনো হবে না। “

“ আপনি মন পড়তে খুব কাঁচা তরী। আর কখনো মন পড়ার চেষ্টা করবেন না। “

__________

একটা কাগজে বসে বসে খসড়া করছে শোভন। কাগজের মধ্যখানে বড় করে আট সংখ্যাটা লিখে তার চার পাশ দিয়ে লাল কালির কলম দিয়ে একটা বৃত্ত আঁকে। অত:পর কাগজের একপাশে আটটা নাম লিখে সে। নামগুলো হলো সেইসব ছেলের যারা গত এক বছরে নিখোঁজ হয়েছে। এদের সবার মধ্যে একটা কমন বিষয় হচ্ছে এরা সবাই প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির সম্ভ্রান্ত ফ্যামিলির ছেলে। এতদিন এই মিসিং ফাইল গুলো অবহেলায় থানার এক কোণে পড়ে থাকলেও গতকাল ওই দুই ভদ্রলোকের নিজেদের ছেলের জন্য মিসিং ডায়েরি করতে আসার পর শোভন বিষয়টা আমলে নেয়। সবগুলো ফাইল ঘেটে এই সেম কানেকশনের কেস খুঁজে বের করে। এই ছেলে গুলোর উধাও হয়ে যাওয়ার পিছনে সেম কোনো মানুষের হাত আছে নাকি তাও তাকে বেশ ভাবায়।

শোভনের ভাবনার মাঝেই একজন কন্সটেবল এসে হাজির হয়। বিনয়ী ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে,

“ আসবো স্যার? “

“ হ্যাঁ। কথা হয়েছে? “

“ স্যার যেই ছেলেটা কাল মিসিং হয়েছে তার সকল বন্ধু বান্ধব ও পরিচিত মানুষদের সাথে কথা হয়েছে আমার। সবাই একই কথা বলছে। ছেলেটার কারো সাথেই কোনো ঝামেলা ছিলো না। “

শোভনের কপালের ভাজ সূক্ষ্ম হয়। সে চিন্তিত সুরে বলে,

“ এইসব গুলো কেস একই সূত্রে গাথা। এর মূল হোতা যে কে তা না জানা পর্যন্ত আমি শান্তি পাবো না। “

“ স্যার, ওই ম্যানহোল কেসের খুনী খুব চালাক। একটা কোনো চিহ্ন রেখে যায়নি যার সাহায্যে আমরা তার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবো। “

শোভন কোনো কথা না বলে চেয়ারে গা এলিয়ে চোখ বুজে রয়। অত:পর বলে,

“ গরম গরম এক কাপ চা পাঠাতে বলুন। “

__________

হোটেলের রুমে প্রবেশ করতেই তরীর ভ্রু কুচকে আসে। বিছানার উপর টাওয়াল দিয়ে দুটো জোড়া রাজহাঁস বানিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। তার আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা বেশ কিছু গোলাপের পাপড়ি। তরী বিরক্তি নিয়ে চারিদিকে তাকিয়ে দেখে রুমে একটা সোফাও নেই। সে তড়িৎ পার্থর দিকে ফিরে তাকিয়ে বলে উঠে,

“ এই রুমে একসাথে থাকা অসম্ভব। নিজের জন্য আলাদা রুম বুক করুন আপনি। “

পার্থ লাগেজ থেকেই নিজের কাপড় বের করতে করতে বলে উঠে,

“ আপনার শশুড়ের কাছে ইমিডিয়েটলি এই খবর পৌঁছে যাবে। তখন কি জবাব দিবেন উনাকে? “

“ আব্বা কিভাবে জানবে? “

“ আব্বার পরিচিত এক বন্ধুর হোটেল এটা। উনি যখন দেখবে যে আমরা হানিমুনে এসে আলাদা আলাদা রুমে থাকছি তখন নিশ্চয়ই আব্বাকে এই খবর পাঠাতে দেরি করবেন না। “

তরীর রাগ লাগে খুব। রাগে সে ওই রাজহাঁস আর গোলাপের পাপড়িদের ঝেড়ে মাটিতে ফেলে। অত:পর হন্তদন্ত হয়ে লাগেজ থেকে একটা শাড়ি নিয়ে পার্থকে ধাক্কা মেরে দৌড়ে আগে ওয়াশরুমে প্রবেশ করে। পার্থ প্রথমে হন্তদন্ত হয়ে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তরীর যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে চেচিয়ে বলে উঠে,

“ দজ্জাল মহিলা! ওয়াশরুমে যেতে চান সেটা মুখ ফুটে বললেই আমি রাস্তা থেকে সরে দাঁড়াতাম। সব জায়গায় নিজের হাত পা না চালালে হয় না? “

তরী ভিতর থেকে একইভাবে চেচিয়ে বলে উঠে,

“ গো টু হেল। “

__________

ল্যাপটপে বসে একটা আর্টিকেল লিখছিলো তূর্য। লেখা শেষ হতেই সে পাশ ফিরে দেখে পৃথা পড়তে পড়তে বই বুকের উপর নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। তূর্য সাবধানে নিজের ল্যাপটপটা রেখে পৃথার বুকের উপর থেকে বইটা সরিয়ে রাখে। অত:পর পৃথার উপর দিয়ে ঝুকে বেডসাইড কেবিনেটের উপর রাখা ল্যাম্পটা বন্ধ করতে। ল্যাম্প বন্ধ করে ধীরে সড়ে যেতে নিলেই তূর্য নিজের টি শার্টের বুকের দিকে কিছুটা টান অনুভব করে। তাকাতেই দেখে পৃথা তার দিকে তাকিয়ে আছে। তূর্য সামান্য হেসে বলে,

“ আমি ভেবেছিলাম ঘুমিয়ে পড়েছো। “

তূর্যর কথা শেষ হয় কিন্তু পৃথা এখনো তার টি শার্ট ছাড়ে না। তূর্য প্রশ্নবোধক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

“ কি? “

পৃথা কথা বলে না। কিছুক্ষণ তূর্যের দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা তুলে তূর্যের গলায় দীর্ঘ সময় নিয়ে চুমু খায়। তূর্য চমকায়। অবাক সুরে ডাকে,

“ এই পৃথা? “

পৃথা তূর্যকে ছেড়ে দিয়ে আবার বালিশে নিজের মাথা ঠেকায়। ঘোর মাখা দৃষ্টি নিয়ে প্রশ্ন করে,

“ অষ্টাদশীর মনে ঝড় তুলেছেন তূর্য। সেই ঝড় শান্ত করবেন না? “

তূর্য বিমোহিত হয়। লজ্জা ভুলে এইটুকু কথা বলেছে পৃথা। কিন্তু এখন তূর্যর দৃষ্টি দেখে তার নড়চড় করার ক্ষমতা শূন্য। তূর্য গায়ে কাপন ধরানো শীতল স্বরে বলে উঠে,

“ স্বামী যেহেতু হয়েছি সেহেতু মনের ঝড় শান্ত করার দায়িত্ব তো আমারই। কি দিয়ে শুরু করবো? এইমাত্র আমার গলায় যেভাবে নিজের মনে চলমান ঝড়ের চিহ্ন আঁকলে সেভাবে? “

কথাটুকু বলেই তূর্য পৃথার গলায় মুখ ডোবায়। পৃথার শুভ্র মুখ লজ্জায় লাল হয়। অত:পর খুশিতে তা রক্তিম আভা ধারণ করে। তার জীবন এতো সহজ ভাবতেই আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া আদায় করে মনে মনে। তীব্র কাঠখড় না পেরিয়েই কতো সহজেই কাঙ্ক্ষিত মানুষকে স্বামী হিসেবে পেয়ে গেলো সে। এই জীবনে আর কি চাওয়ার থাকতে পারে তার? পরিপূর্ণ সে। উহু। শেষ একটা জিনিস চাওয়ার আছে। জ্বলজ্যান্ত পুতুল। যে দেখতে অবিকল তূর্যের অনুরূপ হবে।

__________

দু ঘন্টা ঝগড়ার পর তরী পার্থকে বিছানায় ঘুমানোর পারমিশন দিয়েছে। তাও এক সহস্র হুমকির সাথে। বিছানার মাঝখানে বর্ডারের ন্যায় রেখে দিয়েছে দুটো রাক্ষসের ন্যায় বালিশকে। বারবার বলেছে যে পার্থ যদি ভুলেও এই বালিশ অতিক্রম করে তরীর দিকে এগোনোর চেষ্টা করে তাহলে পার্থর একটাও হাড্ডি আস্ত রাখবে না সে। পার্থ তরীর সেই সকল নিষেধাজ্ঞা মেনে বিছানার এককোণে রোবটের ন্যায় সটান শুয়ে থাকে। আজ কতদিন পর বিছানায় শোয়ার সুযোগ পেলো। ছোটবেলায় ঈদের সময় সালামি পেলেও বোধহয় পার্থ এতো খুশি হতো না। আরামে তার চোখে ঘুম নেমে আসে। তখনই উপলব্ধি করে তার আর তরীর মাঝখানের বর্ডার হিসেবে থাকা বালিশ দুটির আর উপস্থিতি টের পাচ্ছে না সে। পার্থ চোখ মেলে তাকাবে তার আগেই নিজের শরীরের উপর একটা নরম হাত এবং পায়ের ভার টের পায়।

পার্থ চোখ মেলে দেখে তরী ঘুমের ঘোরে বালিশ ছেড়ে তাকে অক্টোপাসের নেয় জাপ্টে ধরেছে। পার্থ ভ্রু কুচকে ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলে উঠে,

“ আমি নাকি উনার উপর চান্স মারবো। একা এই রুমে নিজের পাশে এরকম হ্যান্ডসাম ছেলে পেতেই নিজের লোভ আর সামলাতে পারলো না। সিচুয়েশনের এডভান্টেজ নিয়ে কিভাবে আমার সাথে লেপ্টে আছে। চালাক মহিলা। “

কথাটুকু বলে পার্থ ধীরে ধীরে নিজের শরীরের উপর থেকে তরীর হাত পা সরিয়ে অপরদিকে ফিরে শুয়ে পড়ে। কিন্তু কিছুক্ষণ না যেতেই আচমকা সে ধড়ফড়িয়ে বিছানার নিচে নিজেকে আবিষ্কার করে। পার্থ হতভম্ব ভঙ্গিতে উঠে বসে তরীর দিকে তাকায়। কি নিষ্পাপ মুখভঙ্গি করে সম্পূর্ণ বিছানা দখল করে ঘুমোচ্ছে। কেউ দেখলে বলবে যে এইমাত্র সে পার্থর মতো নিষ্পাপ একজন মানুষকে বিনা দোষে লাথি মেরে ফেলে দিয়েছে?

পার্থ ফ্লোরে বসে থাকা অবস্থায়ই ক্লান্ত গলায় বলে,

“ এই দজ্জাল মহিলাকে আমি অভিশাপ দিলাম। যেই পার্থ মুন্তাসিরের উপর আজ এতো অত্যাচার করছে একদিন সেই পার্থ মুন্তাসিরের তীরে এসেই উনার তরী ডুববে। আমিন। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-২১+২২

0

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২১.

পড়ন্ত বিকেলে তরী ক্লান্ত চোখ মেলে তাকাতেই প্রচন্ড দূর্বল অনুভব করে। ব্যথা উপশমের জন্য ইঞ্জেকশন দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো সে। সেই তীব্র ব্যথার প্রভাব এখন কিছুটা কম অনুভব হলেও তার রেশ কিছুটা রয়ে গিয়েছে এখনো। তরী ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে ফিরে তাকাতেই দেখে পার্থ বেডের পাশে একটা চেয়ারে বসে আছে। তরীকে চোখ মেলতে দেখেই সে বসা থেকে উঠে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করে,

“ এখন কেমন লাগছে? “

তরী জবাব দেয় না। সে একহাতে ভর দিয়ে উঠে বসে। ক্লান্ত গলায় বলে,

“ পানি। “

পার্থ সাথে সাথে একটা পানির বোতল খুলে এগিয়ে দেয় তার দিকে। কিছুটা পানি মুখে দিতেই তরীর আচমকা মনে পড়ে আইয়াদের কথা। সে তো সার্জারি চলাকালীন অবস্থায় সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলো। তাহলে আইয়াদের পরে কি হয়েছে? তরী সাথে সাথে পানির বোতল রেখে বেড থেকে নামতে উদ্যত হয়। পার্থ মৃদু চিন্তিত গলায় বলে,

“ কোথায় যাচ্ছেন? ইউ নিড রেস্ট। “

তরী চিন্তিত দৃষ্টি মেলে পার্থর দিকে তাকিয়ে শুধায়,

“ আমার পেশেন্ট… আই নিড টু সি হিম। “

বলেই তরী কোনোমতে তাড়াতাড়ি বেড থেকে নামে। তখনই কেবিনে প্রবেশ করে হুমায়ুন রশীদ এবং ডক্টর আনিকা। তরী তাদের দেখে প্রশ্ন করে,

“ পাপা? আইয়াদ? সার্জারি কেমন হয়েছে? “

হুমায়ুন রশীদ জবাব দেয় না। তিনি নীরব ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু ডক্টর আনিকা অগ্নিদৃষ্টি মেলে তরীকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

“ আপনি ড্রাগস নিয়ে সার্জারি করার সাহস কোথা থেকে পেলেন ডক্টর তরী? “

তরী বিস্মিত হয়। অবাক সুরে প্রশ্ন করে,

“ ড্রাগস মানে? “

“ বিশ্বাস না হলে নিজে রিপোর্টস চেক করুন নিজের। “

তরী হুমায়ুন রশীদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

“ পাপা? কি বলছে এসব? “

ডক্টর আনিকা রাগী সুরে বলে উঠে,

“ আপনার শরীরে যেসব রিয়্যাকশন হচ্ছিলো সেসব ড্রাগস নেওয়ার ফলে হয়েছে। “

তরীর মাথার উপর যেন বজ্রপাত হয়। সে বলে,

“ আমি কোনো ড্রাগস নেই নি। আমি কেন ড্রাগস নিবো? “

“ আপনি কেন ড্রাগস নিবেন তা আমরা জানিনা ডক্টর তরী। কিন্তু আপনার ভুলের কারণে একজনের মৃত্যু হয়েছে। ইউ কিলড এ চাইল্ড। অপারেশন থিয়েটারে উপস্থিত সকলে আপনার এই ভুলের সাক্ষী। “

তরী সাথে সাথে কেদে দেয়। সে কান্না জর্জরিত গলায় বলে,

“ আইয়াদ ইজ ডেড? “

ডক্টর আনিকা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,

“ থ্যাংকস টু ইউ। “

তরী হুমায়ুন রশীদের দিকে এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরে বলে,

“ পাপা ট্রাস্ট মি আমি ড্রাগস নেই নি। আমি কোনো ভুল করি নি। বিশ্বাস করো। “

ডক্টর আনিকা পাশ থেকে বলে উঠে,

“ স্যার? নিজের মেয়ে আর নিজের হসপিটাল দেখে কি এখন ডক্টর তরীকে ছাড় দিয়ে দিবেন? একটা পেশেন্টের লাইফের কি কোনো মূল্য নেই আপনার কাছে? “

হুমায়ুন রশীদ হেরে যাওয়া দৃষ্টি নিয়ে নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

“ আই ট্রাস্ট ইউ। আমি জানি তুমি কখনোই ড্রাগস নিতে পারো না। কিন্তু যেই মুহুর্তে তোমার মনে হয়েছে যে ইউ আর ফিলিং নট গুড সেই মুহুর্তে তুমি সার্জারি অন্য কারো হাতে হ্যান্ডভার করো নি কেন? “

এতক্ষণের কথায় তরী যতটা না আঘাত পেয়েছে তার থেকে বেশি যন্ত্রণা এই মুহুর্তে অনুভব করছে সে। ডক্টর আনিকা বলে উঠে,

“ বোর্ড মিটিং ডাকা হয়েছে। ইউ হ্যাভ টু জয়েন আস ডক্টর তরী। “

তরী মূর্তির ন্যায় তার পাপার দিকে তাকিয়ে রয়। হুমায়ুন রশীদ বলে,

“ চলো তরী। “

কথাটা বলেই উনি বেরিয়ে যায়। উনার পিছুপিছু ডক্টর আনিকাও বেরিয়ে যায়। তরী নিশ্চুপ ভঙ্গিতে মাথা নত করে বেরিয়ে যেতে নিলে পিছন থেকে হাতে টান অনুভব করে। পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখে পার্থ তার একহাত ধরে রেখেছে। পার্থ শান্ত স্বরে বলে উঠে,

“ আই ট্রাস্ট ইউ। নিজের মাথা নত করবেন না। “

তরী ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজের হাত আলতো করে ছাড়িয়ে বেরিয়ে পড়ে।

__________

এক ঘন্টার থেকেও দীর্ঘ সময়ের বোর্ড মিটিংয়ে সকলেই তরীর বিপক্ষে নিজেদের স্টেটমেন্ট দেয়। সবার মতেই তরীর এই ভুল কোনো ভাবেই ক্ষমার যোগ্য নয়। তরী নীরব দর্শকের ন্যায় মাথা নত করে সবার কথা শুনে। সর্বদা নিজের জন্য স্ট্যান্ড নেওয়া তরী এইবার নিজের সাফাইয়ে একটা বাক্যও উচ্চারণ করে না। কিছুক্ষণের ব্যবধানেই তরীর সামনে একটা লিগ্যাল পেপার এনে রাখে একজন ডক্টর। তরীর অনুভূতি যেন ভোতা হয়ে গিয়েছে। সে চুপচাপ সেই পেপারের দিকে তাকিয়ে রয়। হুমায়ুন রশীদ নিজের চোখের সামনে এই দৃশ্য সহ্য করতে পারছে না। তবুও উনি নিজেকে শক্ত করে। নিজের ব্লেজারের পকেট হতে একটা কলম বের করে তা তরীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

“ সব ভুলের ক্ষমা আছে, কিন্তু একজন ডক্টরের ভুলের কোনো ক্ষমা নেই। ডক্টরস আর নট এলাউড টু ডু এনি মিস্টেক। ইউর মেডিক্যাল লাইসেন্স ইজ টার্মিনিটেড। ইউ আর নট এ ডক্টর এনিমোর। “

শেষের দিকে হুমায়ুন রশীদের গলা ধরে আসে। তিনি একটা ঢোক গিয়ে আবার বলে উঠে,

“ সাইন দ্যা পেপারস। “

তরী মাথা তুলে তাকায় না। সে নিঃশব্দে কলমটা নিয়ে পেপারের উপর মৃদু ঝুকে সাইন করার উদ্দেশ্যে। মুহুর্তেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠে নিজের সম্পূর্ণ জীবনের অক্লান্ত পরিশ্রম। শত নির্ঘুম রাত জেগে অক্লান্ত পরিশ্রমের পর নিজের স্বপ্ন পূরণ করার পর হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে যেরকম অনুভব হয়, তার সেরকম অনুভব হচ্ছে। তরীর নীরব অশ্রু টপটপ করে পড়ে কাগজ গুলো ভিজিয়ে দিচ্ছে। আরেকজন বোর্ড মেম্বার কঠিন স্বরে বলে উঠে,

“ দ্রুত সাইন করুন। “

তরী কাঁপা হাতে নিজের এতদিনের পরিচয় নিঃশেষ হওয়ার পত্রে সিগনেচার করে। ডক্টর আনিকা কাঠকাঠ গলায় বলে,

“ যাওয়ার আগে পেশেন্টের ফ্যামিলি মেম্বারদের থেকে ক্ষমা চেয়ে নিবেন। ইউ আর লাকি যে উনারা আপনার বিরুদ্ধে কোনো কেস ফাইল করে নি। “

তরী মাথা নত করেই বেরিয়ে যেতে নিলে ডক্টর আনিকা আবার বলে উঠে,

“ আপনার এপ্রোন এবং স্টেথোস্কোপটা রেখে যান। ইউ ডোন্ট নিড দ্যাট এনিমোর। “

তরী নিজের গায়ে থাকা এপ্রোনের একটা কোণা শক্ত হাতে চেপে ধরে। যেন কেউ তার গা থেকে এই এপ্রোন কেড়ে নিতে পারবে না। অন্য হাতে সে নিজের হাতে থাকা স্টেথোস্কোপটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রয়। ডক্টর সীমা এগিয়ে এসে তরীর হাত থেকে স্টেথোস্কোপটা নিয়ে শক্ত গলায় বলে উঠে,

“ এই পোশাক আর এইসব সরঞ্জাম আমরা জীবন বাঁচানোর জন্য ব্যবহার করি। আপনার কাছে এসব শোভা পাচ্ছে না। “

তরী দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে নিজের কান্না দমিয়ে রেখে গায়ের এপ্রোন খুলে এক দৌড়ে সেখান থেকে প্রস্থান করে। দৌড়াতে দৌড়াতে থার্ড ফ্লোরের শেষ মাথায় এসে সে পার্থর মুখোমুখি হয়। পার্থ কোনো প্রশ্ন করার আগেই তরী বলে,

“ বাসায় ফিরবো আমি। নিয়ে চলুন প্লিজ। “

__________

সন্ধ্যা বেলায় আজ চৌধুরী নিবাসে ছোট খাটো আনন্দ উৎসবে মেতে উঠেছেন সকলে। সাদিকা বেগমের আবদারে শোভন আজ মধুকে নিয়ে বাসায় এসেছে। আফজাল সাহেবও বাসায় উপস্থিত আছেন। সকলেই সন্ধ্যার নাস্তার পাশাপাশি খোশ গল্পে ব্যস্ত। আফজাল সাহেব ইতিমধ্যে তার হবু ছোট ছেলে বউয়ের গুণে মুগ্ধ। মেয়েটা বেশ হাসিখুশি এবং খোলা মনের। সহজেই সবার সাথে মিশে যেতে পারে। এই সন্ধ্যার নাস্তা গুলোও মেয়েটা নিজ হাতে বানিয়েছে, যার স্বাদ দুর্দান্ত।

সাদিকা বেগম মধুর সাথে গল্পের মাঝেই শোভনকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

“ এই শোভন। তোর দাদা আর ভাবীকে ফোন দে। কখন ফিরবে জিজ্ঞেস কর। মেয়েটা আজকে এতো সকাল সকাল বেরিয়ে গেলো। এতো করে বললাম নাস্তাও করে যায় নি। সারাদিন খেয়েছে কিনা কে জানে। এতো বার ফোন দিলাম ফোন অফ আসছে। “

“ দিচ্ছি আম্মা। “

বলেই শোভন আগে নিজের ভাবীর নাম্বারে ডায়াল করে। কিন্তু ফোন সুইচড অফ আসছে। সে পার্থর নাম্বার ডায়াল করতে নিবে তখনই বাসার কলিংবেল বেজে উঠে। জমিলা খালা গিয়ে দরজা খুলে দেয়। তরী আর পার্থ ভিতরে প্রবেশ করতেই সাদিকা বেগম হেসে বলে উঠে,

“ আম্মু? সারাদিন তোমাকে ফোন দিচ্ছি নাম্বার বন্ধ আসছিলো কেন? “

তরী কারো দিকে ফিরে তাকায় না। এক মুহুর্ত দাঁড়ায়ও না। সে নীরব পায়ে হেঁটে উপরে চলে যায়। তার এহেন আচরণে সকলে বেশ অবাক হয়। আফজাল সাহেব পার্থকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করে,

“ ওর কি হয়েছে? “

পার্থ সিঁড়ির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রয়। তরীর মেডিক্যাল লাইসেন্স টার্মিনেশনের ব্যাপারটা তার অজানা নয়। সে জমিলা খালার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

“ খালা ভাত আছে? “

“ না। “

“ তাহলে একটু ভাত বসান। আর তরকারি গরম করে একটু বেড়ে দিন। “

জমিলা খালা রান্নাঘরে চলে যায়। আফজাল সাহেব আবার প্রশ্ন করেন,

“ এবার বলো কি হয়েছে? “

__________

ভাতের প্লেট হাতে বেডরুমে প্রবেশ করতেই পার্থ দেখে চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে আছে। সে অন্ধকারেই হাতড়ে পরিচিত সুইচবোর্ড হতে সুইচ চেপে রুমের লাইট জ্বালিয়ে দেয়। চারিদিকে চোখ বুলাতেই দেখতে পায় তরী রুমের এককোণে ফ্লোরে হাঁটুতে মুখ গুজে বসে আছে। পার্থ এগিয়ে গিয়ে তরীর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে। প্লেটটা একপাশে রেখে সে একহাত বাড়িয়ে স্ত্রীর মাথার উপর রেখে নরম সুরে ডাকে,

“ তরী? “

তরী উত্তর দেয় না। পার্থ আবারও ডেকে বলে,

“ সকালে নাস্তা করে যান নি। সারাদিন না খাওয়া। ভাত খেয়ে নিন। “

তরী মাথা তুলে তাকায়। পার্থ নিজের স্ত্রীর লাল টকটকে চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে ভাষা হারায়। তরী থমথমে গলায় বলে,

“ খাবো না। চলে যান। “

পার্থ একদন্ড নিজের শুকনো গলা ভিজিয়ে নিয়ে বলে উঠে,

“ প্লিজ তরী। “

তরী আচমকা একটা অদ্ভুত কান্ড ঘটিয়ে বসে। সে তার পাশে রাখে প্লেট তুলে দূরে ছুড়ে ফেলে বলে উঠে,

“ চলে যেতে বলেছি না? সমস্যা কি? যাচ্ছেন না কেন? “

কথাটা বলতে বলতে তরী আবার হাতের কাছের আরেকটা জিনিস তুলে নিতে নেয় আছাড় মারার জন্য। পার্থ সেই সুযোগ না দিয়ে তরীর দুই হাত শক্ত করে নিজের হাতের মুঠোয় আঁকড়ে ধরে বলে উঠে,

“ নিজেকে সামলান। “

তরীর সারাদিনের চেপে রাখা কান্না তার সবথেকে অপছন্দের মানুষের সামনেই বাধ ভাঙলো। সে হাত পা ছেড়ে দিয়ে বসে দু’হাতে নিজের মাথার চুল টেনে ধরে বলে উঠলো,

“ আমি বাচ্চাটাকে মারি নি। আমি ড্রাগস নেই নি। “

অত:পর আরো কিছু বললো তরী যা পার্থর বোধগম্য হলো না। সে কেবল এগিয়ে একহাতে তরীকে আগলে ধরলো। আপন দুঃখে হয়তো এই মুহুর্তে তরীর মাথা কাজ করছে না। তাই তো কাঁদতে কাঁদতে সে তার সামনে বসে থাকা মানুষটার বুকে মাথা ঠেকায়। পার্থ নিজের দ্বিধা দন্ড কাটিয়ে এক হাত তরীর মাথায় রাখে। তরী এবার পার্থর পাঞ্জাবির বুকের অংশ খামচে ধরে অশ্রুসিক্ত স্বরে বলে উঠে,

“ আমার সম্পূর্ণ ক্যারিয়ার শেষ। আমার ১২ বছরের পরিশ্রম সব শেষ। আমি আর ডক্টর নই। কি করবো আমি? এই খুনের দায় নিয়ে কিভাবে বাঁচবো আমি? কিভাবে সবাইকে বিশ্বাস করাবো আমি খুনী নই? “

পার্থ নরম গলায় বলে,

“ আমি আছি তরী। আমি জানি আপনার কোনো দোষ নেই। “

তরী হঠাৎ হিংস্র হয়ে ফুসে উঠে। সে পার্থর থেকে সরে গিয়ে তার দুই হাত দ্বারা পার্থর বলিষ্ঠ বুকে ধাক্কা দেয়। পার্থ কিছুটা পিছনে সড়ে যেতেই তরী ফোস ফোস করে বলে উঠে,

“ এসব আপনি করেছেন তাই না? আমার কারণে আপনার নিজের ইলেকশন প্রত্যাহার করতে হয়েছে। সেটার প্রতিশোধ নিচ্ছেন? “

পার্থ অবিশ্বাস্যকর সুরে প্রশ্ন করে,

“ আমি কেন আপনার উপর প্রতিশোধ নিবো? “

“ কারণ আপনি ছাড়া আমার জীবনে আর কোনো কাল নেই। আপনি আমার জীবনের সবথেকে বড় কাল। এক ইলেকশনের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আপনি আমার থেকে আমার অস্তিত্বের একটা অংশ কেড়ে নিয়েছেন। আমার কষ্ট করে উপার্জিত পরিচয় ছিনিয়ে নিয়ে কেমন অনুভব করছেন? “

পার্থ গরম চোখে তাকিয়ে বলে,

“ মুখে লাগাম টানুন। “

তরী রেগে পার্থর দিকে ঝুকে তার কলার টেনে বলে,

“ আপনি নিজের কর্মকান্ডে লাগাম টানুন। আর কতো মানুষের জীবন নষ্ট করবেন? “

পার্থর এইবার রাগ উঠে। সে তরীর দুই বাহু চেপে ধরে বলে উঠে,

“ আমি এক মুহুর্তের জন্যও আপনার কোনো ধরনের ক্ষতি করার কথা চিন্তা করি নি। “

“ আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করে আমার সবথেকে বড় ক্ষতি করেও বলছেন আমার ক্ষতি করার চিন্তা করেন নি? “

পার্থ এই পর্যায়ে এসে দমে যায়। তরী ভুল তো আর বলে নি। সত্যিই তো সে তাকে ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করেছে। তরী ক্লান্ত ভঙ্গিতে আবারও দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে। দুই হাঁটু ভাজ করে বুকের কাছে এনে তাতে মুখ গুজে রয়। পার্থ নীরবে তরীর পাশে এসে দেয়ালের সাথে মাথা হেলান দিয়ে বসে।

রাত গভীর হয়। পার্থ একই ভঙ্গিতে বসে রয়। আচমকা নিজের কাধে মৃদু ভার অনুভব করে। ঘাড় ঘুরিয়ে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখে তরী তার কাধে হেলান দিয়ে ঘুমোচ্ছে। তার তপ্ত নিঃশ্বাস এবার চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু পার্থর পাঞ্জাবির কাপড় ভেদ করে তার চামড়া স্পর্শ করে। পার্থ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার দেয়ালে নিজের মাথা ঠেকায়। ক্লান্ত স্বরে বলে উঠে,

“ আপনাকে কোনো অবস্থাতেই আমি ডিভোর্স দিবো না তরী। কিন্তু আপনার এলোমেলো জীবন সাজিয়ে দেওয়ার কথা দিচ্ছি। কথার বরখেলাপ হলে নিজেকে আপনার হাতে তুলে দিবো। ব্যর্থ আসামীকে নাহয় তখন সাজা শুনিয়েন। “

চলবে…

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২২.

হুমায়ুন রশীদের মুখ হতে সম্পূর্ণ ঘটনা শুনে তূর্যর রাগে শরীর কাঁপতে থাকে। সে ক্ষিপ্ত সুরে বলে,

“ তুমি আপির সাথে এরকম কি করে হতে দিলে পাপা? আপিকে ফাঁসানো হচ্ছে। আপি ড্রাগস কেন নিতে যাবে? “

তূর্যর রাগান্বিত রূপ দেখে পৃথা আর কিছু বলার সাহস পায় না। সে নীরব ভূমিকা পালন করে। কিন্তু মনে মনে তারও বিশ্বাস বড় ভাবীকে কোনো ভাবে ফাঁসানো হচ্ছে। হুমায়ুন রশীদ বলে,

“ তরী নিজ থেকে ড্রাগস নিবে না কখনো সেটা আমিও জানি। কিন্তু এখানে তরী ইচ্ছাকৃতভাবে ড্রাগস নিয়েছে কিনা সেটা মূখ্য নয়। মূখ্য হলো তরীর দায়িত্বে থাকা একজন পেশেন্ট মারা গিয়েছে। তরী চাইলেই নিজের সার্জারি অন্যের হাতে হ্যান্ডভার করতে পারতো। হসপিটালে আরও কার্ডিওলজিস্ট এভেইলেবেল ছিলো। “

তূর্য অবিশ্বাস্যকর সুরে বলে,

“ তুমি এই কথা বলছো পাপা? তোমার মনে হয় আপি ইচ্ছে করে সার্জারি অন্য কাউকে হ্যান্ডভার করে নি? আপি কি এতো বোকা যে নিজের ক্যারিয়ার রিস্কে ফেলে এরকম এক বোকামি করবে? “

হুমায়ুন রশীদের প্রচুর মাথা ব্যাথা করছে। তিনি সামান্য কপাল কুচকে বলে উঠেন,

“ আমি শুধু তরীর পাপা নই। তরীর জায়গায় অন্য যেকোনো ডক্টর হলেও আমি একিই ডিসিশন নিতাম। নিজের মেয়ে দেখে ওর প্রতি নরম হলে সম্পূর্ণ বোর্ড কমিটি আমার উপর প্রশ্ন তুলতো। “

পৃথা নীরবে লিভিং রুম ছেড়ে রান্নাঘরে চলে যায়। হুমায়ুন রশীদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

“ বাচ্চাটা সাদ এবং আয়রার ছেলে ছিলো। “

তূর্য চোখ বড় বড় করে তাকায় হুমায়ুন রশীদের দিকে। বিস্মিত গলায় প্রশ্ন করে,

“ সিরিয়াসলি? “

“ তাহলে তোমার কি মনে হয় আমি এই মুহুর্তে মজা করছি? “

তূর্য আর কিছু বলবে তার আগেই পৃথা এক কাপ কফি হাতে লিভিং রুমে প্রবেশ করে। পৃথাকে দেখে তূর্য চুপ হয়ে যায়। পৃথা এগিয়ে হুমায়ুন রশীদের দিকে কফির মগটা দিয়ে বলে,

“ পাপা আপনার জন্য। মাথা কম ভার লাগবে এটা খেলে। “

হুমায়ুন রশীদের মন ভালো লাগায় ছেয়ে যায়। মেয়েটা দু’দিন হয়েছে না ঘরে বউ হয়ে এসেছে, অথচ কি সুন্দর সব সামলে নিয়েছে একহাতে। তার নিজের ছেলে মেয়েও সবসময় পড়াশোনা এবং চাকরি নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। কেবল রাতের খাবারটুকু খাওয়ার সময় তারা একত্রে বসতো। কিন্তু এই মেয়েটা তার নিজের মেয়ে না হয়েও আলাদা করে হুমায়ুন রশীদকে সময় দেয়। হুমায়ুন সাহেব মলিন হেসে কফির মগটা নিয়ে বলে,

“ থ্যাঙ্কিউ আম্মু। “

পৃথা জবাবে সামান্য হাসে কেবল। তূর্য উঠে নিজের রুমে চলে আসে। নিজের ফোন বের করে তরীর নাম্বারে ম্যাসেজ দেয়,

“ সব ঠিক হয়ে যাবে আপি। আল্লাহ ভরসা। ভেঙে পরিস না। “

__________

সকাল সকাল ফোনের তীক্ষ্ণ এলার্মের শব্দে তরীর ঘুম ভেঙে যায়। সে হাই তুলতে তুলতে উঠে বসে এলার্ম বন্ধ করে। চোখ ডলতে ডলতে আচমকা তার মনে পড়ে রাতে সে ফ্লোরে বসে ছিলো। তাহলে বিছানায় কিভাবে পৌঁছালো সে? পার্থ কি তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে গিয়েছে? কথাটা মাথায় আসতেই তরীর রাগ হয়। এই লোকের সাহায্য এবং সিমপ্যাথি দুটোই তার কাছে অপছন্দের।

তরী বিছানা ছেড়ে নামতে নিলেই তার মনে পড়ে যায় এইসময় প্রতিদিন সে হসপিটাল যাওয়ার জন্য রেডি হতো। কিন্তু আজ? আজ কি করবে সে? মুহুর্তেই তার চেহারায় মলিনতা ফুটে উঠে। পার্থ সেই মুহুর্তে বেডরুমে প্রবেশ করে। দুজনে দৃষ্টি মিলন হতেই পার্থ নিঃশব্দে ওয়াশরুমে চলে যায়। তরী একই ভঙ্গিতে বসে রয়। মনে মনে ভাবছে নিচে কিভাবে যাবে সে? গতকাল কেমন বেয়াদবের মতো কারো কথার জবাব না দিয়ে হনহনিয়ে উপরে চলে এসেছিলো সে। পার্থর সাথে তার বিয়ের মাধ্যমে এই ঘর এবং এই ঘরের মানুষগুলোর সাথেও সে একটা সম্পর্কে বাঁধা পড়েছে। এই পর্যন্ত তরী এই বাড়ির বড় বউ হওয়া সত্ত্বেও ঘরের কোনো কাজে হাত দেয় নি। তা নিয়ে ঘরের কারো কোনো অভিযোগ নেই। উল্টো তার শাশুড়ি বেশ আদরের সাথেই সব পরিস্থিতিতে তাকে আগলে রেখেছে। নিজের দুঃখ কষ্টে নিমজ্জিত হয়ে এই মানুষ গুলোকে অবহেলা করা মোটেও সমীচীন নয়।

__________

নাস্তা তৈরি করতে ব্যস্ত জমিলা খালা। সাদিকা বেগম পাশে দাঁড়িয়ে তদারকি করে যাচ্ছেন। সেই মুহুর্তে রান্নাঘরে তরীর আগমন ঘটে। সে শান্ত স্বরে জমিলা খালাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ খালা, আমি বাকিটা দেখে নিবো। আপনি টেবিলে প্লেট গুলো সাজিয়ে ফেলুন। “

জমিলা বেগম কিছু বলতে নিলেই সাদিকা বেগম ইশারা করে তরী যা বলছে তা করতে। জমিলা খালা তাই চুপচাপ পরিষ্কার প্লেট গুলো নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। সাদিকা বেগম মমতা নিয়ে পুত্রবধূকে দেখছে। মেয়েটা কষ্টে আছে তা উনি জানেন। কিন্তু কষ্টটা কতটুকু গভীর সেই সম্পর্কে উনার ধারণা নেই। হয়তো ঘরের কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখে সেই কষ্টটা ভুলে থাকতে চাইছে তরী। তাই সাদিকা বেগমও আর বাঁধা দেন না।

নাস্তার টেবিলে বসে আছেন চৌধুরী বাড়ির সদস্যরা। পার্থ এখনো নিচে নামে নি। তরী গরম গরম রুটির প্লেট হাতে ডাইনিং রুমে প্রবেশ করে সকলকে খাবার পরিবেশন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। টেবিলে বসে থাকা আফজাল সাহেব, সাদিকা বেগম এবং শোভন নীরব দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। পার্থও তখনো নিচে নেমে আসে। আফজাল সাহেবের পাশে নিজের চেয়ারটা টেনে বসতে নিলেই আফজাল সাহেব বলে উঠে,

“ তুমি অন্য চেয়ারে বসো। “

পার্থসহ সকলে ভ্রু কুচকে তাকায়। পার্থ বলে,

“ আমি তো সবসময় এখানেই বসি। “

“ আজ থেকে বসবে না। “

বলেই আফজাল সাহেব তরীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

“ তরী মা। তুমি এসে বসো এখানে। দাঁড়িয়ে আছো কেন? “

তরী হকচকিয়ে যায়। নিজেকে সামলে বলে,

“ আপনারা নাস্তা করুন আব্বা। আমি পরে বসছি। “

আফজাল সাহেব এবার আরেকটু আদর মিশিয়ে বলে,

“ মেয়ে না খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে বাপের গলা দিয়ে খাবার নামবে কখনো? “

শোভন পাশ থেকে বলে উঠে,

“ বসে পড়ুন ভাবী। কাল রাতে আপনি খান নি দেখে আব্বাও আর খায় নি। আব্বা খায় নি দেখে আম্মাও খায় নি। দাদাও রাতের খাবার খায় নি। আর সবাই যেখানে খায় নি সেখানে আমি আর কিভাবে রাজাকারের মতো খাই বলুন? “

তরী অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। পার্থ তরীকে এক পলক দেখে নিয়ে নীরবে নিজের চেয়ারটা ছেড়ে দেয়। তার পাশের চেয়ারে বসে পড়ে। তরী মাথা নিচু করে গিয়ে নিজের শশুড়ের পাশে বসে। শোভন উঠে তরীর প্লেটে খাবার বেড়ে দিতে উদ্যত হয়। হাস্যজ্বল মুখে বলে,

“ ভাবী আজ আপনার দেবর আপনার সেবায় নিয়োজিত থাকবে। কি কি দিবো বলুন? “

সাদিকা বেগম বলে উঠে,

“ তরী সকাল সকাল এসব খায় না। ওকে রুটি সবজি এসব দিস না। “

শোভন ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

“ হ্যাঁ? ভাবী তাহলে কি খায়? “

সাদিকা বেগম জমিলাকে ডাকতেই জমিলা খালা একটা প্লেট আর মগ হাতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে। প্লেট আর মগ তরীর সামনে রাখতেই তরী দেখে সেখানে ফ্রেঞ্চ টোস্ট, অমলেট আর কফি। তরী অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। সকাল সকাল তরী সবসময় এসব খেয়েই অভ্যস্ত। আম্মা এসবও লক্ষ্য করেছে?

এতো আদর আর যত্ন দেখে তরী কিশোরীদের ন্যায় আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। চোখ উপচে তার জল গড়িয়ে পড়ে। জমিলা খালা আঁতকে বলে উঠেন,

“ কি গো বড় বউ? কান্দতাসো ক্যান তুমি? “

আফজাল সাহেব নরম সুরে প্রশ্ন করে,

“ খাবার পছন্দ হয় নি মা? “

আবেগে বর্শভূত তরী আফজাল সাহেবকে একপাশ হতে জড়িয়ে ধরে। ছোটবেলা থেকেই কান্না পেলে সে সবসময় নিজের পাপাকে জড়িয়ে ধরে কাদতো। সেই অভ্যাস থেকেই সে আফজাল সাহেবকে পিতা রূপে জড়িয়ে ধরে। আফজাল সাহেবসহ সকলেই অবাক হয়।

আফজাল সাহেব আগে কখনো এরকম পরিস্থিতিতে পড়েন নি। উনার নিজের ছেলে মেয়েদের সাথে সম্পর্কটাও উনার সেই পর্যায়ে কখনো ছিলো না যে চাইলেই তারা নিরদ্বিধায় উনাকে জড়িয়ে ধরতে পারবে। নিজের মনের দ্বিধাকে সরিয়ে উনি স্নেহ নিয়ে তরীর মাথায় হাত রেখে বলে,

“ আরে আরে বোকা মেয়ে। কাদে না। “

তরী ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্নার মাঝে বলে উঠে,

“ আমাকে মাফ করবেন আব্বা। আমার কারণে আপনাদের সম্মান নষ্ট হচ্ছে। “

আফজাল সাহেব নরম গলায় বলে,

“ আমি জানি তুমি কখনো আমাদের সম্মান নষ্ট হওয়ার মতো কিছু করবে না। আমি যতদিন তোমার মাথার উপর আছি তুমি কিছু নিয়ে চিন্তা করো না মা। আল্লাহ আছেন উপরে। উনি ইনসাফ করবেন অবশ্যই। তুমি হাসিখুশি থাকো শুধু। “

পার্থ নীরবে সম্পূর্ণ দৃশ্যটা দেখে। অত:পর সবার চোখের আড়ালেই সে সামান্য হাসে। তার আব্বা ছেলেদের সাথে যতটা কঠোর থাকেন মেয়েদের বেলায় তার সম্পূর্ণ বিপরীত। যাক! এই পরিস্থিতিতেও তরীকে নিয়ে তার মোটেও চিন্তা হচ্ছে না। তার দ্বারা চব্বিশ ঘণ্টা তরীর পাশে থাকা সম্ভব হবে না। কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে তার পরিবার ঠিকই তরীর কোনো অযত্ন করবে না তা নিয়ে সে নিশ্চিত।

__________

পার্টির কিছু সিনিয়র নেতার সাথে মিটিংয়ে ব্যস্ত পার্থ। তখনই তার সাইলেন্ট করা ফোনটা ভাইব্রেট করে বেজে উঠে। পার্থর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় টেবিলের উপর থাকা নিজের ফোনের স্ক্রিনে। এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ের মাঝে অন্য কেউ কল করলে পার্থ কখনোই রিসিভ করতো না। কিন্তু জহিরের নাম দেখে সে এক মুহুর্ত দেরি না করে ফোনটা রিসিভ করে।

“ জহির? কি হয়েছে? “

“ ভাই, ভাবী বাসা থেকে বের হইসে। একা একা গাড়ি ড্রাইভ করতেসে। আমি উনার পিছনেই গাড়িতে আছি। ফলো করতেসি। “

“ কোথায় যাচ্ছে ও? “

“ সেইটা তো জানিনা ভাই। মনে হইতেসে মিরপুরের দিকে যাইতেসে। “

“ আচ্ছা তুই ফলো কর। পৌঁছালে আমাকে এক্সাক্ট এড্রেস টেক্সট করে পাঠা। “

“ আচ্ছা ভাই। “

__________

মিরপুর ২ এ কাঙ্ক্ষিত বাসাটার সামনে এসে গাড়ি থামায় তরী। সাত তলা এই বিল্ডিংটায় এর আগেও বেশ কয়েকদিন এসেছিলো সে। কিন্তু তখন আর আজকের মধ্যে বিস্তার ফারাক। তরী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নেমে বাসার ভেতর প্রবেশ করে। দ্বিতীয় তলার ডান পাশের এপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়াতেই তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। তবুও সাহস সঞ্চয় করে সে কলিংবেল বাজায়।

কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন মধ্য বয়স্ক নারী দরজা খুলে। তরীকে দেখতেই উনি চমকে যায়। শব্দ করে কাউকে ডাকতে ডাকতে ভিতরে চলে যায় উনি। কিছুক্ষণের ব্যবধানেই সাদ এসে দাঁড়ায় দরজার সামনে। চেহারা তার বিধ্বস্ত হয়ে আছে। তরীকে দেখতেই সে বলে,

“ তুমি এখানে? “

“ ক্ষমা চাইতে এসেছি। “

সাদ কিছু বলবে তার আগেই আয়রা এসে দরজার সামনে উপস্থিত হয়। তরীকে দেখতেই সে ক্ষুধার্ত বাঘিনীর ন্যায় তরীর দিকে তেড়ে যেতে নেয়। কিন্তু সাদ তাকে আটকে ফেলে। আয়রা দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

“ কেন এসেছিস? এখন খুশি তুই? তোর প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে গিয়েছে। সাত বছর আগে আমি তোর থেকে তোর বাগদত্তা কেড়ে নিয়েছি, তাই তুইও সুযোগ বুঝে আমার থেকে আমার ছেলেকে কেড়ে নিয়েছিস। খুনী তুই। “

আয়রার উচ্চ শব্দের দাপটে আশেপাশের এপার্টমেন্ট থেকে আরো মানুষ বেরিয়ে আসে। সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। তরী নরম গলায় বলে,

“ ট্রাস্ট মি আয়রা আমি ইচ্ছে করে কিছু করি নি। তুই তো ছোটবেলা থেকে আমাকে চিনিস। আমি কখনো কোনো বাচ্চার ক্ষতি করার কথা চিন্তাও করতে পারি না। “

আয়রা সাদকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে তরীর দিকে এগিয়ে যায়। তরী আয়রাকে নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে কয়েক কদম পিছিয়ে যায়। আয়রা ঘৃণাভরা দৃষ্টি নিয়ে তরীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

“ তুই পারিস। তুই করে দেখিয়েছিস। এসব কিছু তুই হিংসা থেকে করেছিস। আমার বাচ্চাকে দেখে তোর হিংসা হয়েছে। তুই কিভাবে বুঝবি একটা বাচ্চার মর্ম? যে নিজে জীবনে বাচ্চার মুখ দেখতে পারবে না সে কিভাবে বাচ্চার মর্ম বুঝবে? তুই ইচ্ছে করে আমার ছেলেকে মেরেছিস। “

কথাটুকু বলেই আয়রা তরীকে ধাক্কা দেয়। সিড়ির কাছে দাঁড়িয়ে থাকায় ধাক্কা খেয়ে সামলাতে না পেরে তরী সিড়ি থেকে পড়ে যায়। মুহুর্তেই পরিস্থিতি উত্তেজনামূলক রূপ ধারণ করে। পার্থ তখন কেবল একতোলার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছিলো। এই দৃশ্য দেখে সে সাথে সাথে দৌড়ে সিড়ির নিচে পড়ে থাকা তরীর কাছে এগিয়ে যায়। সাদও ততক্ষণে এগিয়ে এসে আয়রাকে ধরে বাসার ভেতর নিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়।

পার্থ তরীর কাছে আসতেই দেখে তরী নিজেই একা একা উঠে বসছে। পার্থ উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করে,

“ ব্যথা পেয়েছেন? “

প্রশ্নটা করেই পার্থ ক্ষিপ্ত দৃষ্টি মেলে উপরে তাকায়। গর্জে উঠে,

“ কার বুকে এতো বড় পাঠা হয়ে গিয়েছে যে আমার বউয়ের গায়ে হাত দেয়? “

বলেই পার্থ সাদের এপার্টমেন্টের দিকে এগিয়ে যেতে নেয়। কিন্তু তরী তার একহাত ধরে বাঁধা দেয়। চোখের ইশারায় মানা করে কোনো ঝামেলা করতে। পার্থর রাগ ঠান্ডা হয় না। কিন্তু চারিদিকে তাকিয়ে সবার আগ্রহী দৃষ্টি দেখে এই মুহুর্তে এখান থেকে প্রস্থান করাই উত্তম মনে করে সে। তরীর দিকে নিজের একহাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

“ চলুন। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-১৯+২০

0

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৯.

পার্থ দুঃসাহসিক কাজটা করে তরীর থেকে দুটো কঠিন কথা শোনার অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু যখন দেখে তার মাঝে তেমন কোনো হেলদোল নেই তখন বুঝতে পারে তরী ইতিমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে। পার্থ হতাশ হয়। ডাক্তারকে তার আর লজ্জা দেওয়া হলো না। সে চুপচাপ আরো কিছুক্ষণ তরীর মাথায় পানি ঢেলে তারপর তাকে রুমে নিয়ে আসে।

__________

ভাগ্য ভালো থাকায় সেদিন রাতেই তরীর শরীরের তাপমাত্রা নেমে যায়। পরের দিনই তরী হসপিটালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। যদিও আফজাল সাহেব এবং সাদিকা বেগম তাকে ড্রাইভার নিয়ে বের হতে বলছিলো বারবার। কিন্তু পার্থ তাদের বলে দেয় তরীকে নিশ্চিন্তে একাই যেতে দিতে।

রাস্তায় জ্যাম প্রচুর। গতরাতের আকাশে জমে থাকা মেঘগুলো সড়ে এখন আকাশ পরিষ্কার দেখাচ্ছে। মাথার উপর তপ্ত সূর্যের তাপ চারিদিকে বিকিরিত হচ্ছে। তরী গাড়িতে বসে থেকেই এসি কিছুটা বাড়িয়ে দেয়। অপেক্ষা করছে জ্যাম ছোটার।

স্টিয়ারিংয়ে নিজের চঞ্চল দু’হাত রেখে তরী বাহিরে দৃষ্টি বোলাচ্ছে। আচমকা তার পাশের গাড়িতে একটা পরিচিত মুখ দেখতে পায় সে। সাথে সাথে তরীর চঞ্চল হাত স্থির হয়ে যায়। সে সাথে সাথে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। জ্যাম ছুটতেই সাথে সাথে সে সেখান থেকে প্রস্থান করে হসপিটালে এসে পৌঁছায়।

কারো সাথে কথা না বলে সে সোজা চলে যায় নিজের কেবিনে। প্রচুর অস্থির অনুভব করছে সে। এক গ্লাস পানি খেয়ে নিজেকে ঠান্ডা করতেই তার কেবিনের টেলিফোনে কল আসে। তরী টেলিফোন তুলে কানে দিতেই অপরপাশ থেকে বলে উঠে,

“ ডক্টর তরী, দেয়ার ইজ এ ইমারজেন্সি কেস। প্লিজ কাম টু দ্যা ইমারজেন্সি ইউনিট। “

তরী ফোন রেখে উঠে নিজের এপ্রোন গায়ে জড়িয়ে নেয়। টেবিল থেকে নিজের স্টেথোস্কোপ এবং ফোন তুলে নিয়ে ইমারজেন্সি ইউনিটের দিকে দৌড় দেয় সে।

ইমারজেন্সি ইউনিটে পৌঁছাতেই একজন নার্স তার দিকে তড়িঘড়ি করে দৌড়ে এসে বলে,

“ ম্যাম, পেশেন্টের নাম আইয়াদ জহির। বয়স ছয়। মেডিক্যাল সিম্পটমস… “

নার্সের কথা শুনতে শুনতে তরী ইমারজেন্সি ইউনিটের শেষ বেডটার কাছাকাছি পৌঁছে যায়। কিন্তু বেডের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তার দু পা থমকে যায়। একটু আগে রাস্তায় যেই মানুষটাকে দেখে সে তাড়াতাড়ি পালিয়ে এসেছিলো সেই মানুষটাই এখন তার সামনে দাঁড়ানো। বেডে শুয়ে থাকা ছোট্ট বাচ্চা ছেলেটির একহাত ধরে ব্যস্ত সুরে বলছে,

“ সব ঠিক হয়ে যাবে বাবা। আরেকটু ওয়েট করো। “

তরী নিজেকে ধাতস্থ করে বেডের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে উঠে,

“ বাচ্চার একমাস ধরে ব্রিথিংয়ে প্রবলেম হচ্ছে, আর আপনারা আজ হসপিটালে নিয়ে আসলেন? “

বেডের অপরপাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুটো নর নারী হতবাক দৃষ্টিতে তরীর দিকে তাকায়। তরী সেদিকে তোয়াক্কা করে না। সে তার স্টেথোস্কোপটা পেশেন্টের বুকের বাম পাশে ধরে বেশ শান্ত গলায় বলে উঠে,

“ জোরে জোরে নিঃশ্বাস নাও তো বাবু। “

বাচ্চাটা তার কথা অনুযায়ী কাজ করতেই তরী পাশে বোর্ড হাতে দাঁড়িয়ে থাকা নার্সকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলে। নার্স তরীর কথা শুনতে শুনতে ব্যস্ত হাতে কাগজে কিছু লিখতে থাকে। তরী এবার সামনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

“ কিছু টেস্টস করাতে হবে। আজকের মধ্যে টেস্টস করিয়ে নিন আপনারা। কাল যদিও আমার ওপিডি নেই। কিন্তু আপনারা কাল দুপুর দুটোর দিকে একবার রিপোর্টস কালেক্ট করে আমার সাথে দেখা করবেন। “

বেডের অপরপাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটা বলে উঠে,

“ আপাতত কোনো মেডিসিন সাজেস্ট করবেন না? “

“ বাচ্চা মানুষ। প্রবলেম সম্পর্কে শিওর না হয়ে কোনো মেডিসিন দেওয়াটা ঠিক হবে না। “

কথাটুকু বলে তরী বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে বলে উঠে,

“ আইয়াদ বাবু। একমাস কষ্ট করেছো, আরেকটা দিন সহ্য করে নাও প্লিজ? আন্টি কালকে তোমার ব্যথা দূর করার মেডিসিন দিয়ে দিবো। ওকে? “

বাচ্চাটা ব্যাথাতুর মুখ নিয়েও মৃদু মাথা ঝাকিয়ে হ্যাঁ বলে। তরী হেসে আইয়াদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করে। পিছনে রয়ে যায় বিস্মিত দুটো মুখ।

__________

দূরদৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে পার্থ। তার পকেটে থাকা ফোন লাগাতার বেজে যাচ্ছে। তার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা আসিফ বলে উঠে,

“ ভাই আপনার এই সিদ্ধান্তে দলের কেউ খুশি না। পার্টির উপর থেকে প্রেশার আসতাসে প্রচুর। এখন তো ভাবী ঠিক আছে। আপনার গুপ্তচরও চব্বিশ ঘণ্টা ভাবীর উপর নজর রাখতাসে। এখন নির্বাচন করলে কি সমস্যা? দল থেকে অন্য কোনো প্রার্থীরে নমিনি দেওয়ার আগেই আপনি আবার ইলেকশনে যোগ দেন। “

পার্থ শান্ত স্বরে বলে,

“ আমি কিছুক্ষণ কোলাহল মুক্ত পরিবেশে থাকতে চাই দেখে এতো দূর ড্রাইভ করে এলাম। তাই আমার কানের কাছে এখন চিল্লাচিল্লি করিস না প্লিজ। “

আসিফ চুপ হয়ে যায় সাথে সাথে। পার্থ বেশ ক্ষাণিকক্ষণ দূরে থাকা সারি সারি সবুজ জমির দিকে চেয়ে রয়। অত:পর হঠাৎ সামান্য হেসে বলে,

“ রুবেল এখন নিশ্চয়ই নিজের জয় উল্লাসে ব্যস্ত? “

আসিফ মুখ কালো করে বলে,

“ এইডা ছাড়া আর কি করবো হালায়। হালার একমাত্র শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ছিলেন আপনি। বাকি যেই কয়জন প্রার্থী আছে, হেরা ইলেকশন করলেও যা না করলেও তা। “

পার্থ পূণরায় হাসে। মুখে হাসি বজায় রেখেই সে বলে উঠে,

“ তাহলে ওকে আপাতত উল্লাস করতে দে। এই ক্ষণস্থায়ী সুখটা আপাতত ওকে উপভোগ করতে দেওয়াই শ্রেয়। কারণ এরপর ও আর জীবনে সুখের মুখ দেখতে পারবে না। “

আসিফের চোখ মুখ মুহুর্তেই জ্বলজ্বল করে উঠে। সে খুশিতে গদগদ হয়ে প্রশ্ন করে,

“ আপনি কি ওই রুবেলের মাথায় কদবেল ভাঙবেন নি ভাই? “

পার্থ আসিফের দিকে ফিরে মৃদু হাসে। অত:পর মুহুর্তেই তার চেহারার ভাবমূর্তি পরিবর্তন হয়। সে চোখ মুখ শক্ত করে বলে উঠে,

“ ও নিজেও জানে না যে ও কত বড় ভুল করেছে। ব্যাপারটা রাজনীতি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকলে আমি হয়তো তবুও ওকে ছাড় দিতাম। কিন্তু বিষয়টা এখন পার্সেনাল হয়ে গিয়েছে। ওদিন রাতের তরীর চেহারা যতবার আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে, ততবার আমার শরীরের রক্ত গরম হয়ে যাচ্ছে। সম্পূর্ণ লোডেড রিভলবার দিয়ে যদি ওর সারা শরীর ছিন্নভিন্ন করতে পারতাম, তাহলে আমার এই রক্ত ঠান্ডা হতো। ও ভুল জায়গায় হাত দিয়ে ফেলেছে। “

আসিফ পার্থর কথা শুনতে শুনতে মাথা নাড়ে। হঠাৎ সে মুখ ফসকে বলে ফেলে,

“ আপনি আজকাল ভাবীর খুব চিন্তা করতেসেন ভাই। “

পার্থ আসিফের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

“ অন্যের বউয়ের চিন্তা করাটা আমার স্বভাবের সাথে যায় না। তাই নিজের বউয়ের চিন্তাই করছি। “

__________

তূর্য আজ কিছুটা তাড়াহুড়ো করে বাসায় ফিরেছে। পৃথা সারাদিন বাসায় একা থাকে। আজ তূর্য প্ল্যান করেছে ওকে নিয়ে বাহিরে ঘুরতে গেলে মন্দ হয়না। কলিংবেল বাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। কিছুক্ষণের মাঝেই পৃথা উঠে এসে দরজা খুলে দেয়। তার দৃষ্টি হাতের ফোনের দিকে নিবদ্ধ। দরজা খুলে দিয়ে আবার ফোনের দিকে দৃষ্টি রেখেই সে হাঁটতে হাঁটতে লিভিং রুম এরিয়ার দিকে চলে যায়। তূর্য অবাক হয়। এই মেয়ে ফোনের মাঝে এতটা বিভোর হয়ে গিয়েছে যে চোখ তুলে একবার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তূর্যকে দেখলোও না।

তূর্য জুতা খুলে বাসায় প্রবেশ করতে করতে বলে উঠে,

“ মহারাণীর ফোন কি স্বামীর থেকে বেশি ইম্পোরট্যান্ট হয়ে গেলো? “

লিভিং রুমের সামনে আসতেই তূর্যর কথা থেমে যায়। সোফায় পৃথার সাথে হুমায়ুন রশীদও বসে আছেন। তূর্য মনে মনে ভাবলো পাপা আজ এতো তাড়াতাড়ি বাসায় কি করছে? হুমায়ুন রশীদ নিজের ফোনের স্ক্রিন থেকে ছেলের দিকে দৃষ্টি স্থির করে বলে,

“ আমাদের এখন বিরক্ত করবে না। “

তূর্য ভ্রু কুচকে তাকায়। বিরক্ত করবে না মানে? কি এমন মহা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে তারা যে বিরক্ত করা যাবে না? তূর্য এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করে,

“ কি করছো তোমরা? “

পৃথা ফোন থেকে দৃষ্টি না তুলে বলে উঠে,

“ আমি আর পাপা গেমস খেলছি। সাবওয়ে সারফারস। মোটেও বিরক্ত করবেন না। গেম ওভার হলে আপনি রাতের খাবার পাবেন না। “

তূর্য তাজ্জব বনে যায়। এক সামান্য গেমসের জন্য তার বাপ আর বউ তাকে ইগ্নোর করছে? তূর্য কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলে উঠে,

“ পরে খেলো। আমরা এখন বাহিরে যাবো। “

পৃথা নাছোড়বান্দার ন্যায় বলে,

“ আমি এখন কোথাও যাবো না। “

হুমায়ুন রশীদের সামনে তূর্য চাইলেও বেশি কিছু বলতে পারছে না। সে রাগ নিয়ে উপরে চলে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই হুমায়ুন রশীদ ইচ্ছে করেই গেম ওভার করে বলে উঠে,

“ আজকের জন্য এতটুকুই থাকুক আম্মু। তোমরা এখন বাহির থেকে ঘুরে আসো। “

পৃথা বলে উঠে,

“ বাহিরে গেলে তিনজন একসাথেই যাই চলুন। “

“ উহু। আজকে তোমরা যাও। বিয়ের পর থেকে এভাবেও তোমরা একসাথে বাহিরে যাওয়ার সুযোগ পাও নি তেমন একটা। তূর্য যেহেতু আজকে ফ্রি আছে তাই এই চান্স মিস দিও না। “

পৃথা আর কথা বাড়ায় না। সে চুপচাপ উপরে চলে যায়। তূর্য সবেমাত্র গায়ের শার্ট খুলেছে। পৃথা তা দেখে বলে উঠে,

“ শার্ট খুলছেন কেন? বাহিরে না যাবেন? “

“ কেন? তোমার গেমস খেলা শেষ? “

“ হ্যাঁ। “

কথাটুকু বলেই পৃথা আবার বলে উঠে,

“ আচ্ছা, পাপাও আমাদের সাথে চলুক? “

তূর্য হেসে বলে,

‘’ হ্যাঁ, শিওর। শুধু পাপা কেন? তোমার আব্বা, আম্মা, বড় দা, ছোট দা আর তোমার বড় ভাবী ওরফে আমার আপিকেও সাথে নিয়ে যাই ডেটে? “

তূর্য যে মশকরা করে কথাটা বলেছে তা বুঝতে অসুবিধা হয়না পৃথার। সে মুখ ফুলিয়ে ক্লসেট থেকে নিজের একটা শাড়ি বের করতে এগিয়ে আসে। হঠাৎ সে বিস্ময় নিয়ে তূর্যর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

“ ওয়েট, ডেট মানে? “

তূর্য এগিয়ে এসে পৃথার সামনে দাঁড়ায়। পৃথার পিঠ তখন ক্লসেটের সাথে ঠেকে রয়েছে। তূর্য মাথা সামান্য ঝুকিয়ে বলে উঠে,

“ বিয়ের পর স্ত্রীর পাশাপাশি প্রেমিকা হতে কি আপনার আপত্তি আছে ম্যাডাম? “

পৃথা মৃদু মাথা নেড়ে না বলে। তূর্য একইভাবে বলে উঠে,

“ সো মিস পৃথা মুমতাহিনা চৌধুরী, আ’ম টেকিং ইউ অন এ ডেট টুনাইট। গেট রেডি নাও। “

কথাটা বলে তূর্য চলে যাচ্ছিলো। পৃথা পিছন থেকে বলে উঠে,

“ আমি আপনার বাইকে করে যাবো। “

তূর্য পিছনে না ফিরেই জবাব দেয়,

“ এজ ইউর উইশ। “

__________

শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কেবিনে তরীর মুখোমুখি বসে আছে আয়রা এবং সাদ। তরীর হাতে তাদের ছেলে আইয়াদের রিপোর্ট। ইকো কার্ডিওগ্রামের রিপোর্টটা বিচক্ষণ নজরে দেখছে তরী। রিপোর্ট দেখা শেষ হতেই তরী আইয়াদের মা বাবার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

“ দেয়ার ইজ এ হোল ইন আইয়াদ’স হার্ট। “

আয়রা সাথে সাথে কান্নায় ভেঙে পড়ে। সাদ চিন্তিত সুরে প্রশ্ন করে,

“ এটার কোনো ট্রিটমেন্ট আছে? “

“ দেখুন, একোর্ডিং টু দ্যা রিপোর্ট এই হোলের সাইজ মোটামুটি বড় আকারের। আপনারা মানসিক ভাবে শক্ত থাকুন। প্রয়োজন পড়লে সার্জারি করতে হতে পারে। “

আয়রা কান্না জর্জরিত গলায় বলে উঠে,

“ আমার বাচ্চার শরীরে আমি কোনো কাটাছেঁড়া সহ্য করতে পারবো না সাদ। প্লিজ অন্য কোনো উপায় বের করো। মেডিসিন দিয়ে ওকে সুস্থ করা যাবে না? “

আয়রার কান্না দেখে তরীর মায়া হয়। অতীতে যতো তিক্ত স্মৃতিই থাকুক না কেন, এই মুহুর্তে তার সামনে এই মানুষ দুটো কেবলমাত্র তার পেশেন্টের গার্ডিয়ান। সেই হিসেবে মানবতা থেকেই তার মাঝে খারাপ লাগা কাজ করছে। তরী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

“ শুধুমাত্র মেডিসিন দ্বারা ট্রিট করার স্টেজে নেই কেসটা। অপারেশন ইজ মাস্ট রাইট নাও। কিন্তু তার আগে আই নিড টু ডিসকাস দ্যা কেস উইথ মাই সিনিয়র কার্ডিওলজিস্টস। উনাদের অপিনিয়নের প্রয়োজন পড়বে আমার। আপনারা আগামী সোমবার আমার সাথে দেখা করতে আসুন। আর প্লিজ আইয়াদকে জোর করে হলেও আনার, বিটরুট, আপেল আর খেজুরটা বেশি করে খাওয়ান এর মাঝে। ওর সিবিসি রিপোর্টে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কম। হিমোগ্লোবিন লো থাকলে সার্জারি করা পসিবল হবে না। “

সাদ এবং আয়রা চলে যেতেই তরী আইয়াদের কেস নিয়ে হুমায়ুন রশীদ এবং আনিকা রহমানের সাথে ডিসকাস করে। সব রিপোর্টস দেখে তারাও সাজেস্ট করে সার্জারি করার জন্য। হুমায়ুন রশীদ তরীকে একা পেয়ে প্রশ্ন করে,

“ পেশেন্টের গার্ডিয়ানের নাম আমি লক্ষ্য করেছি। তুমি আমাকে আগে বলো নি কেন? “

“ তারা সাদ এবং আয়রা হিসেবে আমার কাছে আসে নি পাপা। আইয়াদের পেরেন্টস হিসেবে এসেছে। এজ এ ডক্টর আমি শুধু নিজের কাজটুকু করছি। ব্যক্তিগত ব্যাপারে তাদের সাথে আমি কোনো কথাই বলি নি। “

হুমায়ুন রশীদ চোখ ছোট করে প্রশ্ন করে,

“ তোমার খারাপ লাগছে না প্রিন্সেস? “

“ মোটেও না পাপা। ওরা আমার পাস্টের এমন একটা চ্যাপ্টার যেটা আমি অনেক আগেই ছিড়ে ফেলে দিয়েছি। আমি এখন বিবাহিত। আরেকজনের স্ত্রী হয়ে নিজের এক্সকে মনে করে কষ্ট পাওয়ার শিক্ষা আমাকে দাও নি তুমি। “

হুমায়ুন রশীদ কিছু না বলে নিজের মেয়েকে জড়িয়ে ধরে। এটাই শুনতে চাচ্ছিলো সে। তরী নিজের পাপার বুকে মুখ গুজে বলে উঠে,

“ ওরা আমার সাথে যাই করে থাকুক না কেন পাপা, আমি তবুও ওদের ছেলের সার্জারিটা করবো। এসবে তো ওদের ছেলের কোনো দোষ নেই। তাই না? আই’ল ট্রিট হিম রাইট। “

“ আই নো মা। “

__________

রাত বেড়েছে। তরী ল্যাপটপ কোলে নিয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে। ল্যাপটপের স্ক্রিনে চলছে ওয়ান ডিরেকশনের বিখ্যাত বেস্ট সং এভার গানটি। স্যান সিরো স্টেডিয়ামে এই গানের লাইভ পারফরম্যান্সটা তরীর খুব প্রিয়। ছোট বেলা থেকেই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে সে সময় পেলে ওয়ান ডিরেকশনের গান শুনে সময় পাড় করতো। কালের বিবর্তনে ওয়ান ডিরেকশনের মেম্বারদের মধ্যে ভাটা পড়লেও তরীর এই অভ্যাসে কোনো পরিবর্তন আসে নি।

পার্থ সবেমাত্র রুমে প্রবেশ করে দরজা আটকেছে। ভিতরের বেডরুম হতে গানের আওয়াজ পেতেই সে ভ্রু কুচকে তাকায়। ধীর পায়ে হেঁটে বেডরুমে পা রাখতেই দেখে তরী ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসছে। ল্যাপটপের স্ক্রিনে চলমান গানের লিরিক্সের সাথে হালকা ঠোঁটও নাড়াচ্ছে।

পার্থ ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হাতঘড়ি খুলতে খুলতে বলে উঠে,

“ কি দেখছেন? “

তরী স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থেকেই জবাব দেয়,

“ হ্যারিকে। “

পার্থ ভ্রু কুচকে পিছনে ফিরে তাকায়। হ্যারি মানে? কিসের হ্যারি? কোথাকার হ্যারি? হ্যারি পটার? পার্থ তরীর পাশে বেডসাইড কেবিনেটের উপর নিজের ফোন রাখার বাহানায় এসে স্ক্রিনের দিকে সামান্য উঁকি মারে। এই ব্যান্ডের গান তার কখনো শোনা হয় নি। ইংরেজি গান কখনোই তার তেমন একটা পছন্দ ছিলো না। পার্থ কপালে ভাজ নিয়ে প্রশ্ন করে,

“ এখানে তো স্টেজে পাঁচটা হাটুর বয়সী ছেলে বাদরের মতো লাফালাফি করছে। এদের মধ্যে হ্যারি কে? “

পার্থর কথা শুনতেই তরীর হাস্যজ্বল মুখ বিরক্তিতে ছেয়ে যায়। সে বিরক্তিকর সুরে বলে,

“ আপনার তা দিয়ে কি আসে যায়? নিজের বালিশ নিয়ে এই রুম থেকে বিদায় হোন। আর কখনো ওয়ান ডি নিয়ে আমার সামনে আজেবাজে বকবেন না। “

পার্থ নিজের গায়ের পাঞ্জাবি খুলতে খুলতে বলে উঠে,

“ আপনার সং টেস্ট খুব বাজে। “

পার্থর কথায় যেনো তরীর গায়ে আগুন ধরে যায়। সে ল্যাপটপ রেখে এক লাফে বিছানা ছেড়ে নেমে বলে,

“ এই! সমস্যা কি আপনার? আমার সং টেস্ট বাজে? আর নিজে সেদিন রাতে আমাকে ওয়াশরুমে কিসব গান শোনাচ্ছিলেন হ্যাঁ? আপনি নিজেও দেখতে যেমন আপনার গানের টেস্টও তেমন। “

কথাটা শুনে পার্থ এগিয়ে আসে তরীর দিকে। শান্ত গলায় প্রশ্ন করে,

“ কেমন দেখতে আমি? “

“ একদম গরুর মতো। ষাড় গরু। “

তরী কথাটুকু বলতেই তার ফোন বেজে উঠে। সে আর কোনো কথা না বলে ফোন নিয়ে বারান্দায় চলে যায়। পার্থ ঘাড় ঘুরিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে একবার নিজেকে দেখে নেয়। তার মেদহীন উন্মুক্ত সুঠাম দেহ দেখেও এই মহিলা তাকে গরু বলতে পারলো? যেখানে তার দলের সবাই বলে বেড়ায় যে তাকে নাকি সাউথ ইন্ডিয়ান হিরোদের মতো লাগে সেখানে তার বউ রাত বিরাতে তাকে গরু বলে অপমান করবে, এটা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। পার্থ বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,

“ ছোট বেলায় মনে হয় শশুর আব্বা ডাক্তার সাহেবাকে ছোট মাছ খাওয়ায় নি। এজন্যই তো নিজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সুপুরুষকে গরু বলার দুঃসাহস দেখিয়েছে এই নারী। “

তরী বারান্দায় এসে কল রিসিভ করে কানে দিতেই অপরপাশ থেকে একটা পুরুষালী কণ্ঠ ভেসে আসে,

“ আমার কর্মের শাস্তি কি আমার বাচ্চা পাচ্ছে তরী? “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২০.

হঠাৎ মধ্যরাতে সাদের এরকম অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে তরী অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। অত:পর নিজেকে সামলে নিয়ে জবাব দেয়,

“ বাচ্চাটা নিষ্পাপ। একটা নিষ্পাপ বাচ্চার অসুস্থতাকে অভিশাপ হিসেবে না ভেবে তার শেফার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করো। “

“ এই বাচ্চার জন্যই তো সাত বছর আগে আমি তোমাকে ছেড়ে দিয়ে আয়রাকে বিয়ে করি। তোমার কি আমাদের সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার কারণ হিসেবে ওকে দায়ী মনে হয়না? “

তরীর মেজাজ খারাপ হয়। এতো বছর পর অতীত খুড়ে তার সামনে তুলে ধরে কি প্রমাণ করতে চাইছে সাদ? যে সে অনুতপ্ত? তরী কঠিন গলায় বলে উঠে,

“ তোমার আর আমার সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার কারণ আইয়াদ ছিলো না, বরং তুমি নিজে ছিলে। আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথে মিলে আমার উপর চিট করার সময় একবারও তোমার মনে পড়ে নি যে তুমি কমিটেড কারো সাথে? “

এতটুকু বলে তরী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সেসব পুরনো কথা সে আর মনে করতে চায় না। তাই ঠান্ডা গলায় বলে,

“ তোমার এবং আয়রার সাথে বর্তমানে আমার শুধু একটাই সম্পর্ক আছে। সেটা হলো যে তোমরা আমার পেশেন্টের গার্ডিয়ান। তাই আমার সাথে তোমাদের যোগাযোগটা কেবল হসপিটাল পর্যন্তই যেন সীমাবদ্ধ থাকে। ফার্দার এরকম আউট অফ নো হোয়ার আমাকে আর কল করবে না। মাঝ রাত্রে অন্য কারো স্ত্রীকে কল করা মোটেও কোনো ভদ্রলোকের কাজ না। “

কথাটুকু বলেই তরী ফোন কেটে দেয়। তার এতক্ষণের ফুরফুরে মেজাজটা ইতিমধ্যে এই ফোন কলের মাধ্যমে সাদ নষ্ট করে দিয়েছে। বিরক্তি নিয়ে রুমে প্রবেশ করতেই দেখে পার্থ রুমে নেই। বিছানার এক কোণে একটা বালিশও উধাও। তরী ফোন রেখে দরজা ভিতর থেকে লক করার জন্য এগিয়ে যায়। দরজার রূপালী রঙের নবটা ধরেও হঠাৎ তার হাত থেমে যায়। কৌতূহল বসত সামান্য উঁকি দিয়ে বাহিরে তাকায়। পার্থ অলরেডি পাঞ্জাবি বদলে একটা টি শার্ট গায়ে জড়িয়েছে। সিটিং এরিয়ার একপাশের ল্যাম্পের আবছা আলোতেও তার ঘুমন্ত মুখশ্রী স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। সোফায় সোজা হয়ে শুয়ে একহাত দিয়ে নিজের চোখ ঢেকে রয়েছে সে।

তরী পা টিপে টিপে সোফার দিকে এগিয়ে যায়। বেশ কিছুক্ষণ একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থেকে যখন নিশ্চিত হয় যে পার্থ ঘুমোচ্ছে তখন দুই হাঁটু গেড়ে সোফার সামনে বসে সে। তার পিঠ ঠেক খেয়ে আছে ছোট টি টেবিলের সাথে। এক পলকে সে পার্থর দিকে তাকিয়ে রয়। মনে মনে তার হাজার হাজার ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে। ভালো তো সে একবার বেসেই ছিলো। কিন্তু সেই ভালোবাসা তার সাথে প্রতারণা করে। সেই প্রতারণার ধাক্কা সামলে উঠে তরী সিদ্ধান্ত নেয় নিজের মনের দ্বার চিরকালের জন্য বন্ধ করে দিবে। সময়মতো পাপার পছন্দের কোনো ভালো ছেলেকে বিয়ে করে নিবে। তখনই তার জীবনে ঝড়ো হাওয়ার ন্যায় আগমন হয় পার্থ মুন্তাসির চৌধুরীর। কিছু বুঝে উঠার আগেই তার জীবন বাঁধা পড়ে এই ভদ্র মুখোশধারী প্রতারকের সাথে।

এরকম কেন হচ্ছে তার সাথে? আজীবন মেডিক্যাল টেস্টের জন্য প্রিপারেশন নিতে ব্যস্ত তরী যদি আগে জানতো তার লাইফ এতটা মেসড আপ হয়ে যাবে, তাহলে বায়োলজির বদলে সারাদিন লাইফ লেসনের বই নিয়ে বসে থাকতো সে। এই মুখোশধারী প্রতারকের সাথে সারাটা জীবন কিভাবে পাড় করবে সে? কিন্তু এছাড়া অন্য কোনো উপায়ও নেই তার। নিজের নামের পাশে ডিভোর্সী ট্যাগ লাগিয়ে তার পাপাকে সে আরও কটু কথা শোনার সুযোগ করে দিতে চায় না। ইতিমধ্যে তার সেই এনগেজমেন্ট ভাঙার পর থেকে তার আত্মীয় স্বজন সবাই ঘুরে ফিরে তরীর মধ্যেই দোষ খুঁজে বেড়ায়। সুযোগ পেলেই তার পাপাকে এই টপিক তুলে পিঞ্চ করতেও ভুলতো না তারা। এই একই পরিস্থিতিতে তরী আর পড়তে চায় না। তার কাছে তার পাপার সম্মান সবার আগে। তার বদলে এরকম একটা স্ক্রাউন্ডেলকে তার সারাজীবন সহ্য করতে হলে সে সেটাও করতে রাজি।

ভাবনার দেশ থেকে ফিরে আসতেই তরী সাথে সাথে উঠে ভিতরে বেডরুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। এতক্ষণ ঘুমের ভান ধরে শুয়ে থাকা পার্থ এবার চোখের উপর থেকে নিজের ডান হাত সরিয়ে বেডরুমের দরজার দিকে তাকায়। অত:পর বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,

“ আমাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে হলে নিজেকে বেঁধে রাখবেন না তরী। এতে আমাদের জীবনই সহজ হয়ে যাবে। বিশ্বাস রাখুন আপনার ভালোবাসার প্রতিদান দিতে মোটেও কার্পণ্য করবে না এই পার্থ মুন্তাসির চৌধুরী। “

__________

শোভন সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে হাতের মোটা ফাইলের দিকে তাকিয়ে আছে। ফাইলটা মূলত রিসেন্ট ঘটে যাওয়া একটা রহস্যময় ডেথ কেসের ব্যাপারে। সপ্তাহ তিনেক আগেই বনানীর একটা ম্যানহোল হতে একটা লাশ উদ্ধার করে তারা। পোস্ট মার্টাম রিপোর্ট অনুযায়ী এটা একটা মার্ডার কেস। কিন্তু হাজার তল্লাশী চালিয়েও এই মার্ডার কেস রিলেটেড কোনো ক্লু খুঁজে পাচ্ছে না তারা। সামনে ইলেকশন। এখন এরকম একটা কাজ কোনো পার্টি ইচ্ছে করে ঘটায় নি তো?

শোভনের গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী সে এতটুকু জানে যে এই ইলেকশন হলো ক্রাইমের একটা পিক মোমেন্ট। এই সময়টায় দেশের ভেতর অনেক বড় বড় অপরাধ ঘটে যায়। আর সেই অপরাধ গুলো ধামাচাপা দেওয়ার জন্য অপরাধীরা এই ধরনের কাজ করে থাকে। পুলিশ, সাংবাদিক, মিডিয়া সবাই যখন ব্যস্ত থাকে এরকম রহস্যময় কেস সলভ করার জন্য, তখন মোক্ষম সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের ক্ষমতার দাপটে বিভিন্ন অপরাধ করে বেড়ায়।

কিন্তু এই কেসটা এতো সহজে ছেড়ে দিবে না শোভন। প্রত্যেক ক্রিমিনালই নিজের কোনো না কোনো ক্লু রেখেই যায়। একবার সেই ক্লু ধরে এই কেস সলভ করতে গেলেই অনেক কিছুর খোলাসা হয়ে যাবে। শোভন কেবল একটাই দোয়া করছে। সেই মিসিং ক্লু যেন সামনের মাসের ইলেকশন এবং তার বিয়ের আগেই সে পেয়ে যায়।

শোভনের গভীর মনযোগের বিঘ্ন ঘটে ফোনের রিংটোনের শব্দে। সে ফাইলটা বিছানার একপাশে রেখে ফোন রিসিভ করতেই অপরপাশ থেকে হাস্যজ্বল রিনঝিন স্বর বলে উঠে,

“ ডিউটি টাইম শেষ হলে আমাকেও একটু সময় দিন জনাব। “

“ ডিউটি টাইম শেষ হতে হয়? আপনি একবার বলে দেখুন ডিউটির মাঝেও আপনার জন্য সময় বের করে ফেলতে পারি আমি। “

মধুমিতা শব্দ করে হেসে উঠে। অত:পর খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে উঠে,

“ আমি খুব জরুরি একটা কথা বলার জন্য কল করেছি। এই মাঝরাতে খুব বড় এক ডিসিশন নিয়েছি আমি। “

শোভন ভ্রু কুচকে বলে উঠে,

“ দেখো মধু, লাস্ট মোমেন্টে এসে যদি তুমি বলো আমার মতো সাধারণ ডিউটিওয়ালাকে তুমি বিয়ে টিয়ে করবে না তাহলে কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে। সোজা তুলে নিয়ে হাজতে আটকে দিবো। তখন তোমার জামিনের জন্য কেবল একটাই উপায় খোলা থাকবে। সেটা হলো তিন বার কবুল বলা। “

শোভনের কথায় ফুল স্টপ বসিয়ে মধু বলে উঠে,

“ এই! থামো, থামো। চেন্নাই এক্সপ্রেসের মতো চলা শুরু করেছো, কোনো থামার নাম নেই। পুরো কথা না শুনেই তুলে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছো। দাদার ধারা বজায় রাখার ইচ্ছে আছে নাকি? “

“ প্রয়োজন হলে তা-ই করবো। ইভেন আমার ছেলে, ভাতিজা, ভাগিনাকেও শিখিয়ে দিবো কিভাবে সাহসিকতার সাথে পছন্দের নারীকে তুলে বিবাহ করিতে হয়। “

“ আর ধরো উল্টো হলো। তোমার মেয়ে, ভাতিজি এবং ভাগ্নীকে কেউ তুলে নিয়ে বিয়ে করলো? “

শোভন কিছুটা গম্ভীর স্বরে জবাব দেয়,

“ ডিরেক্ট ক্রস ফায়ার করে দিবো শালাকে। “

“ এই যাহ! নিজেদের বেলায় ষোল আনা আর অন্যের বেলায় ক্রস ফায়ার। তুমি তো পুরাই একটা থাঙ্গাবালী। “

শোভন ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

“ থাঙ্গাবালী কে? “

“ আরেএ! চেন্নাই এক্সপ্রেসের ভিলেন। “

শোভন চেন্নাই এক্সপ্রেসকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে বলে উঠে,

“ তুমি কি জরুরি কথা বলতে চাইছিলে? “

“ ধ্যাৎ! এখন আর বলার মুড নেই। কাল বলবো। “

__________

নিজের কেবিনে বসে ফোনে কারো সাথে কথা বলতে ব্যস্ত তরী। টেবিলের উপর রাখা ফাইলটার দিকে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ। কেবিনের দরজায় নকের শব্দ হতেই তরী চোখ তুলে তাকায়। একজন ওয়ার্ড বয় একটা কফির মগ ট্রে-তে করে নিয়ে প্রবেশ করে। তরী ফোন রেখে তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

“ সুগার ফ্রি তো? “

“ হ্যাঁ ম্যাডাম। “

কথাটুকু বলতে বলতে সে ট্রে হতে কফির ওয়ান টাইম কাপটা নামিয়ে তরীর সামনে রাখে। অত:পর ভদ্রতার সুরে প্রশ্ন করে,

“ আর কিছু লাগবে ম্যাডাম? “

তরী কফির মগে একটা চুমুক দিয়ে বলে উঠে,

“ আমার কেবিনের কফি মেকারটা সরিয়ে ফেলো। নষ্ট হয়ে গিয়েছে। গতকাল থেকে কাজ করছে না। “

“ আচ্ছা ম্যাডাম। আমি কাউকে পাঠিয়ে দিবো পরে এটা নিয়ে যাওয়ার জন্য। “

“ যেতে পারো এখন। “

তরী ঘড়ির কাঁটার দিকে সময় দেখতে দেখতে তাড়াতাড়ি কফি শেষ করে। সকাল ৮ টা বাজে আইয়াদকে ওটিতে নেওয়া হবে। এখন বাজে ৭ টা ১৫। লম্বা সময়ের কোনো সার্জারিতে যাওয়ার আগে তরী সবসময় কফি খেয়ে নেয়। এতে ওটিতে থাকা অবস্থায় কখনোই ঘুম ঘুম ভাব অনুভব করে না সে।

__________

আইয়াদের মতো এরকম সেম কেসের সার্জারি করার পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে তরীর। তাই এই সার্জারির মূল দায়িত্বে সে নিজেই আছে। সঙ্গে রয়েছে আরো কয়েকজন ডক্টর তাকে এসিস্ট করার জন্য। ইতিমধ্যে এনেস্থিসিয়ার সাহায্যে আইয়াদকে সেন্সলেস করা হয়েছে। সার্জারি শুরু হওয়ার পর প্রথম আধা ঘণ্টা সব স্মুথলি যাচ্ছিলো। কিন্তু হঠাৎ করেই তরীর মাথা ঝিমঝিম করে উঠে। চোখের সামনে সব এক মুহুর্তের জন্য ঝাপসা হয়ে আসে তার। সাথে সাথে আইয়াদের উন্মুক্ত বুকে তার হাতে থাকা স্ক্যালপেলের গতি স্থির হয়ে যায়। তরীর পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা ডক্টর ফাবিহা বলে উঠেন,

“ ডক্টর? এভ্রিথিং অলরাইট? “

তরী নিজের স্তম্ভিত ফিরে পায়। সে মাথা নেড়ে বুঝায় যে সব ঠিক আছে। আবার সার্জারিতে মন দেয় সে। কিছুক্ষণের ব্যবধানে তরী অনুভব করে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ওটিতেও তার অত্যাধিক গরম লাগছে। কান ঘাড় দিয়ে যেন গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। গলাও শুকিয়ে প্রচুর তেষ্টা পাচ্ছে। তরী কিছু বলবে তার আগেই আবার চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসে তার। ঠিক সেই মুহুর্তেই তার দ্বারা তার ক্যারিয়ারের সবথেকে বড় ভুলটা হয়। তার হাতে থাকা স্ক্যালপেল দ্বারা ভুল করে হার্টের রক্ত সঞ্চালনের ভেইন কেঁটে ফেলে সে। মুহুর্তেই ফিনকি দিয়ে রক্তপাত শুরু হয়। এই দৃশ্য দেখে অন্য ডাক্তাররা আতংকিত হয়ে আর্তনাদ করে উঠে। কিন্তু সেই আর্তনাদের আওয়াজ তরীর কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। তার আগেই সে চেতনা হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।

__________

তরীর পাশে শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে পার্থ। ঘন্টা খানিক আগে হসপিটাল থেকে তার কাছে কল আসে যে তরী হসপিটালে সার্জারী চলাকালীন অবস্থায় সেন্সলেস হয়ে পড়েছে। সাথে সাথে পার্থ নিজের হাতের সব কাজ ফেলে হসপিটালে আসে। হুমায়ুন রশীদ এখনো হসপিটালে পৌঁছায় নি। কিন্তু উনার কাছেও ইতিমধ্যে খবর পৌঁছে গেছে।

চেতনা ফিরে পেতেই পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায় তরী। চোখের সামনে এখনো সব ঝাপসা দেখছে সে। ধীরে ধীরে তার চোখের সামনে সব পরিষ্কার হয়ে উঠে তার। মস্তিষ্ক এবং চেতনাবোধ সজাগ হয়। সাথে সাথে সম্পূর্ণ শরীরে এক বিভৎসকর ব্যাথা অনুভব করে সে। তরী ব্যথায় কুকড়ে উঠে আর্তনাদ শুরু করে। পার্থ সাথে সাথে এগিয়ে এসে তার পাশে বসে তার এক হাত ধরে উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন শুরু করে,

“ কি হয়েছে তরী? কষ্ট হচ্ছে? আমাকে বলুন। “

তরী জবাব দিতে পারে না। শরীরে হাজারটা সূঁচ বিধার যন্ত্রণা টের পাচ্ছে সে। একপাশে ফিরে সে আরেকটু কুকড়ে চিৎকার করা শুরু করে। পার্থ আচমকা পরিস্থিতিতে বিস্মিত হয়ে পড়ে। সে সাথে সাথে ইমার্জেন্সি নার্সকে কল করে তরীকে পিছন থেকে জাপ্টে ধরে। মুহুর্তেই কক্ষে একজন ডক্টর এবং নার্স প্রবেশ করে। এই অবস্থা দেখে তারাও ভয় পেয়ে যায়। ডক্টর রাগী সুরে বলে উঠে,

“ উনার রিপোর্টস কোথায়? এখনো পৌঁছায় নি কেন? “

“ আমি এখনই পাঠাতে বলছি ডক্টর। “

বলে নার্স দৌড়ে বেরিয়ে যায়। তরী চিৎকার করতে করতে পার্থর একহাত শক্ত করে জাপ্টে ধরে। তার নখের আঁচড়ে পার্থর হাতের উপরের পিঠের সামান্য অংশ কেঁটে যায়। পার্থ সেদিকে তোয়াক্কা না করে রাগী স্বরে ডক্টরকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

“ কিছু করছেন না কেন? যন্ত্রণা হচ্ছে ওর। পেইনকিলার ওর সামথিং কোনো মেডিসিন দেন। “

সেই মুহুর্তে রুমে প্রবেশ করে হুমায়ুন রশীদ। মেয়ের খবর পেতেই তিনি ছুটে হসপিটাল এসেছেন। স্ব চক্ষে নিজের মেয়ের এই অবস্থা দেখে উনি বাকরুদ্ধ। এগিয়ে এসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

“ প্রিন্সেস? কি হচ্ছে মা? পাপাকে বলো। পাপা এসে পড়েছি। সব ঠিক হয়ে যাবে। “

হুমায়ুন রশীদের কথা থামে নার্সের আগমনে। নার্স এগিয়ে এসে ডক্টরের হাতে ব্লাড রিপোর্টস দিতেই তিনি বিচক্ষণ চোখে একবার সেটাতে নজর বুলিয়ে বিস্মিত গলায় বলে উঠে,

“ দেয়ার ইজ ড্রাগস ইন হার ব্লাড। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-১৭+১৮

0

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৭.

নিঃশ্বাসের উঠানামার গতি ক্রমান্বয়ে ক্ষীণ হয়ে আসছে। আতংকিত চোখ জোড়াও এখন বেশ ক্লান্ত। মনের ভীতি বেশ ভালো করেই কাবু করে ফেলেছে তরীকে। তার প্রভাব তার শারীরিক অবস্থায়ও পরছে। এতক্ষণ যথাসাধ্য নিজের মানসিক অবস্থা শক্ত রাখার চেষ্টা করেছে সে। কিন্তু এখন আর কোনো বল পাচ্ছে না সে। দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখা অসাড় চিত্ত ধীরে ধীরে ভর ছেড়ে হেলে পড়ে ফ্লোরের দিকে। মনে মনে তরী স্থির করে সে আর জেগে থাকবে না। এতো ভীতি নিয়ে জেগে থাকাটা তার দ্বারা সম্ভব নয়। তার থেকে উত্তম ঘুমিয়ে পড়া। অন্তত এই আতংকিত অনুভূতি থেকে ক্ষণিকের মুক্তি তো মিলবে তার।

তরীর ক্লান্ত চোখ জোড়া যখন প্রায় বুজে আসছে তখনই অন্ধকার রুমের দরজা শব্দ করে খুলে যায়। এক গুচ্ছ আলোক রশ্মি রুমের ভেতর প্রবেশ করে। বাহিরে তখন তুমুল বর্ষণ এবং ভয়ংকর বজ্রপাত। সেই আলোক রশ্মি চিড়ে একটা লম্বা চওড়া অবয়ব রুমে প্রবেশ করে। ভেজা শুভ্র পাঞ্জাবি পরিহিত মানুষটাকে চিনতে অসুবিধা হয় না তরীর। কিন্তু আপাতত কিছু বলার মতো শক্তি নেই তার গলায়। সে নিষ্প্রাণ দৃষ্টি মেলে সামনের মানুষটার বিধ্বস্ত চোখ দুটির দিকে চেয়ে রয়।

পার্থর নিঃশ্বাস যেন গলার মধ্যে আটকে গেছে। ফ্লোরে অর্ধ চেতনায় পড়ে থাকা নিজের অর্ধাঙ্গিনীর এহেন অবস্থা দেখে মনে মনে রুবেলকে ধ্বংস করার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। যত এক পা এক পা করে এগোচ্ছে, তত নিজের নিঃশ্বাসের প্রখরতার বুকের পিষ্টনে আঘাত হানা অনুভব করছে সে। তরীর কাছাকাছি এসে সে হাঁটু গেড়ে বসে তার সামনে। তরী এক দন্ড পার্থকে দেখে নিয়ে নিজের এক কম্পিত হাত বাড়িয়ে পার্থর হাত ধরে। পার্থর যেনো এতক্ষণে হুশ ফিরে। সে অশান্ত গলায় প্রশ্ন করে,

“ আপনি ঠিক আছেন। “

এতক্ষণে নিজেকে সামলে নেওয়া তরীর সাহসের দূর্গ ভেঙে যায় এই প্রশ্ন। তার চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়ে। পার্থ একবার তরীর মুখশ্রী দেখে নিয়ে পুরো রুমের দিকে নিজের দৃষ্টি বুলিয়ে নেয়। এক পরিত্যক্ত বিল্ডিংয়ের পুরনো স্টোর রুম এটা। রুমের চারিদিকে বেশ অপ্রয়োজনীয় পুরনো জিনিসপত্র, মাকড়সার জাল এবং ইদুর, ছাড়পোকা দিয়ে ঠাসা। এই দৃশ্য দেখে পার্থ আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে তরীকে তুলে নেয়। এই জায়গায় সে আর এক মুহুর্ত তরীকে রাখতে চায় না। দরজার বাহিরেই তার দলের ছেলে পেলেরা অপেক্ষা করছিলো। পার্থ দরজা দিয়ে বের হয়েই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে উঠে,

“ যে যার বাসায় ফিরে যা। “

ছোট্ট বাক্যটা যেন আদেশ সরূপ মেনে নিলো। পার্থ নিজের মতো হেঁটে বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে গেলো। গাড়ি কিছুটা দূরে পার্ক করায় এতটুকু রাস্তা বৃষ্টি মাথায় নিয়েই অতিক্রম করতে হয় তার। তরী নির্বিকার ভঙ্গিতে পুরোটা সময় পার্থকে দেখছিলো। পার্থর ঘন চুল এবং দাঁড়ি বেয়ে পড়া পানি দেখতে দেখতে আচমকা সে উপলব্ধি করলো এই মুহুর্তে তার আর ভয় অনুভব হচ্ছে না। উল্টো বেশ আয়েশী ভাবে চোখ বুজে আসছে। নিজের মনকে সে বুঝ দেয় এইরাত কেবল দুঃস্বপ্ন। আগামীকাল সকালে ঘুম ভাঙতেই সে দেখবে সব আগের মতো আছে।

__________

চৌধুরী নিবাসের বয়জৈষ্ঠ দুই সদস্যের চোখে এখনো ঘুম নেই। ঘড়ির কাঁটা রাত দুইটা ছুঁই ছুঁই। ঘরের বড় পুত্রবধূ বিয়ের প্রথম দিনই নিখোঁজ। তাকে খুঁজতে গিয়ে বাড়ির দুই ছেলেও লাপাত্তা। সাদিকা বেগম তজবি হাতে চিন্তিত মুখে বসে আছেন। আফজাল সাহেবের চোখে মুখেও চিন্তার ছাপ। উনি হতাশ গলায় বলে উঠেন,

“ মন দিয়ে দোয়া করো পার্থর আম্মা। মেয়েটা ঘরের বউ হয়ে এলো চব্বিশ ঘণ্টা হয় নি তার মধ্যেই এতো বড় এক বিপদ নেমে আসলো। বেয়াই যে খবরটা শুনলে কি করবে তাই ভাবছি। উনার বাসায় আমার মেয়ের ঠিকই কোনো অযত্ন হচ্ছে না, অথচ উনার মেয়ের নিরাপত্তাটুকুও আমরা ঠিকঠাক নিশ্চিত করতে পারলাম না। “

সাদিকা বেগম স্বামীর কথা শুনে আরো চিন্তায় ডুব দেয়। তার ছেলের তো শত্রুর অভাব নেই। এতদিন চব্বিশ ঘণ্টা নিজের ছেলের চিন্তা তাকে কুড়ে খেতো। এখন ছেলের বউয়ের চিন্তাও সাথে যোগ হলো। উনার চিন্তার মাঝেই বাসার বাইরে থেকে গাড়ির হর্ণের শব্দ ভেসে আসে। লিভিং রুমের এককোণে দাঁড়িয়ে ছিলো জমিলা খালা। হর্ণের শব্দ শুনতে পেয়েই উনি দৌঁড়ে দরজা খুলতে চলে যায়। সাদিকা বেগম এবং আফজাল সাহেবও চিন্তিত ভঙ্গিতে দরজার কাছে এগিয়ে যায়। দরজা খুলতেই পার্থর কোলে অবচেতন তরীকে দেখে জমিলা খালা আর্তনাদ করে উঠে,

“ ও আল্লাহ গো! বড় বউর কি হইসে? “

পার্থ এবং তরী দুজনেই ভিজে জবজবে অবস্থায় আছে। সাদিকা বেগম কিছু প্রশ্ন করবে তার আগেই পার্থ সিড়ি বেয়ে নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে বলে উঠে,

“ আম্মা আমার সাথে চলো। “

সাদিকা বেগম আর প্রশ্ন করে না। উনি ছেলের পিছু পিছু উপরের দিকে দৌড় লাগায়। আফজাল সাহেবও আপাতত আর কিছু ঘাটে না। পার্থ যে মেয়েটাকে নিরাপদে ঘরে ফিরিয়ে আনতে পেরেছে এটার জন্যই মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানায় তিনি। ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে যায় ছোট ছেলেকে ফোন করে খবরটা জানাতে। জমিলা খালাও রান্নাঘরের দিকে দৌড়ে এগিয়ে যায়। বৃষ্টির পানিতে ভেজা পার্থর কথা চিন্তা করে চুলোয় চায়ের জন্য পানি বসায়।

__________

বিছানার এককোণে কম্বল মুড়ি দিয়ে জোড়োসড় হয়ে শুয়ে আছে তরী। তার মাথার কাছেই শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে পার্থ। সাদিকা বেগম এসে তখন তরীর গায়ের শাড়ি বদলে একটা থ্রি পিস পড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু তরীর মাথার চুল ভেজা ছিলো। সেই চুল শুকানোর জন্যই হেয়ার ড্রায়ার হাতে তার মাথার কাছে বসে আছে পার্থ। মোটামুটি চুল শুকিয়ে আসতেই সে হেয়ার ড্রায়ারটা রেখে দেয়৷ মৃদু আলোকিত রুমটার বারান্দা হতে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ ভেসে আসছে। পার্থ বিছানার হেড সাইটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে।

কিছুক্ষণ পরই নিজের রুমের দরজায় মৃদু কষাঘাতের শব্দ শুনতে পেয়ে সে চোখ মেলে তাকায়। উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখে জমিলা খালা দাঁড়িয়ে আছে। জমিলা খালা বেশ বিনয়ী ভঙ্গিতে বলে উঠেন,

“ খালাম্মা খালু আপনারে নিচে ডাকসে। “

পার্থ চোখ বুজে একহাতে সামান্য ঘাড় ম্যাসাজ করে ফের জমিলা খালার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,

“ আপনি আমি ফেরার আগ পর্যন্ত তরীর কাছে থাকুন। “

জমিলা খালা বিনাবাক্য ব্যয়ে পার্থর কথা মেনে নেয়। পার্থ নিচে নেমে যায় তার পরিবারের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে। শোভনও ইতিমধ্যে আফজাল সাহেবের কল পেয়ে বাসায় ফিরে এসেছে।

লিভিং রুমে উপস্থিত তিনটা মানুষের দৃষ্টিই আপাতত পার্থর উপর স্থির। আফজাল সাহেব সর্ব প্রথম প্রশ্ন করে,

“ সম্পূর্ণ ঘটনা কি? “

পার্থ কোনো ভনিতা ছাড়া জবাব দেয়,

“ আমার সাথে শত্রুতার জের ধরে রুবেল হোসাইন তরীকে হসপিটাল থেকে বাসায় ফেরার পথে কিডন্যাপ করেছিলো। “

সাদিকা বেগম সাথে সাথে আঁতকে উঠেন। আফজাল সাহেব বিচক্ষণ মানুষ। উনি বিচলিত হলেন না। বরং ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করে,

“ তুমি কিভাবে তরীকে খুঁজে পেলে? “

“ রুবেল নিজেই আমাকে এড্রেস দিয়েছে। “

আফজাল সাহেব ভ্রু কুচকে রইলেন। অত:পর সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করে,

“ তরীর বিনিময়ে সে নিশ্চয়ই তোমার থেকে কিছু চেয়েছে? “

পার্থ এক দন্ড সময় নেয়। অত:পর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে উঠে,

“ নির্বাচন প্রত্যাহার ঘোষণা করেছি আমি। আগামীকাল আমার প্রত্যাহার পত্র জমা দিতে যাবো। “

শোভন এবং সাদিকা বেগম দুজনেই চমকে তাকায় পার্থর দিকে। যেন এই কথাটা তারা বিশ্বাস করতে পারছে না। আফজাল সাহেব হতাশ গলায় বলে,

“ নির্বাচনের আগেই তবে হেরে গেলে। “

পার্থ এবার বেশ দৃঢ় গলায় বলে উঠে,

“ নির্বাচন আসবে যাবে। কিন্তু যদি আজকে তরীর কোনো ক্ষতি হতো তাহলে সেটা আমার হার হতো। সেই হারের বোঝা আমার জন্য বয়ে বেড়ানো বেশি কষ্টের হতো। “

কথাটা বলেই পার্থ আর অপেক্ষা না করে সেখান থেকে প্রস্থান করে। শোভন অবাক হয়ে চেয়ে রয়। দু’দিন আগ পর্যন্তও তার দাদার জীবনে রাজনীতি ফার্স্ট প্রায়োরিটি ছিলো। আর সেই একই মানুষ কিনা আজ নিজের স্ত্রীর জন্য নির্বাচন প্রত্যাহার করার আগেও একবার ভাবলো না? তার দাদা এতটা কবে বদলে গেলো?

__________

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে তূর্য। গায়ে মেনস পারফিউমটা লাগাতে লাগাতে আড়চোখে আয়না দিয়ে বুকশেলফের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানবীকে দেখছে সে। পৃথা বুকশেলফের সামনে পা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। শেলফের সবথেকে উঁচু তাক থেকে একটা বই নেওয়ার প্রচেষ্টায় বিভোর সে। বইটার নাগাল পেতেই সে আনাড়ি হাতে বইটা টেনে ধরে। সাথে সাথে সেই বইয়ের উপর স্তুপ আকারে রাখা বাকি বই গুলোও পৃথার উপর হেলে পড়ে। পৃথা ভয়ে চোখ খিচে মাথা নিচের দিকে ঝুকিয়ে ফেলে। বইগুলো শব্দ করে ফ্লোরে পড়ে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে একটাও বই পৃথার মাথা স্পর্শ করে না। চোখে ভয় নিয়েই পৃথা তাকিয়ে দেখে তার সামনে লম্বা দেহী তূর্য দাঁড়িয়ে আছে। নিজের লম্বা চওড়া দেহ দিয়ে সে পৃথাকে আড়াল করে রেখেছে। ফলে বইগুলো সব তার পিঠে বাড়ি খেয়ে নিচে পড়েছে। পৃথা চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করে,

“ ব্যথা পেয়েছেন? “

তূর্য সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চোখ সরু করে প্রশ্ন করে,

“ সারাদিন বাসায় একা একা কি এসব অকাজই করে বেড়াও তুমি? “

“ আমি আবার কি করলাম? “

“ এভাবে কেউ বই পাড়ে? ভাগ্যিস শুধু বই পড়েছে। তুমি যেভাবে একহাতে বুকশেলফের উপর ব্যালেন্স রেখে বইয়ের নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করছিলে সেভাবে বুকশেলফও উল্টে তোমার উপর পড়তে পারতো। “

“ সারাদিন বাসায় বসে টেক্সট বুক পড়ে আর টিভি দেখে আমি বোর হয়ে যাই। করার মতো কিছু পাই না। আপনি আর পাপা আমাকে ঘরের কাজও করার পারমিশন দিচ্ছেন না। আমার দোষটা কোথায় বলুন? “

তূর্য চোখ পাকিয়ে বলে,

“ মানে এখন সব দোষ আমার আর পাপার? “

পৃথা কপট রাগ দেখিয়ে বলে,

“ অবশ্যই আপনাদের দোষ। আপনারা আমাকে এই বাসায় মেহমানের মতো ট্রিট করেন। “

তূর্য অবাক হয়ে বলে,

“ এরকম কেন মনে হচ্ছে তোমার? “

“ কারণ আমি যদি এই বাসার বউ হতাম তবে আপনারা নির্দ্বিধায় আমার উপর সম্পূর্ণ ঘরের দায়িত্ব ছেড়ে দিতেন। “

তূর্য ভ্রু কুচকে পৃথার দিকে তাকিয়ে রয়। পৃথা এক কদম এগিয়ে এসে তূর্যের হাত ধরে বলে উঠে,

“ আমি জানি আমি অনেক কিছুই পারি না৷ কিন্তু প্লিজ ট্রাস্ট মি। সংসারটা যেহেতু আমার তাহলে সেটার দায়িত্বও আমাকে তুলতে দিন। প্রথম প্রথম সব সামলাতে হয়তো আমি হিমশিম খাবো, কিন্তু ধীরে ধীরে সব সামলে নিবো। আই প্রমিজ এসবের মাঝে আমি আমার পড়াশোনাও ঠিকঠাক চালাবো। কিন্তু এভাবে আনপ্রোডাক্টিভ হয়ে দিন পাড় করাটা আমার দ্বারা আর সম্ভব নয়। “

পৃথার স্পষ্ট আবদার তূর্য মেনে নিলো কিনা বুঝা গেলো না। পৃথা জবাবের অপেক্ষায় চেয়ে রইলো। তূর্য নিজের হাতঘড়িটা পড়ে নিতে নিতে বলে উঠে,

“ তোমার আবদার ফেলার সাধ্যি কার? “

পৃথার মুখে সাথে সাথে হাসি ফুটে উঠে। সে এগিয়ে গিয়ে তূর্যকে জড়িয়ে ধরে উৎফুল্ল সুরে বলে উঠে,

“ আই লাভ ইউ সো মাচ! “

__________

জ্বরতপ্ত একটি হাত পার্থর পাঞ্জাবির কোণা আঁকড়ে ধরতেই পার্থ চোখ মেলে তাকায়। সবে মাত্র তার চোখ লেগে এসেছিলো। কিন্তু চিন্তায় সেই তন্দ্রা ভাবটা আর গাঢ় হওয়ার সুযোগ পায় নি। গত রাতেই তরীর গা কাপিয়ে জ্বর এসেছে। সারারাত পার্থ তরীর পাশে বসে কপালে জলপট্টি দিয়েছে। কিন্তু শরীরের জ্বর তেমন একটা কমেছে বলে মনে হচ্ছে না।

পার্থ তরীর ঘুমন্ত শুকনো মুখখানা দেখে নিয়ে পাশে রাখা থার্মোমিটার দিয়ে আরেকবার টেম্পারেচার চেক করে নেয়। প্রায় ১০৪° ছুঁই ছুঁই। পার্থ ক্লান্ত ভঙ্গিতে আবার বেডের হেড সাইটে নিজের পিঠ হেলান দেয়। তরীর এতো জ্বর আসার পিছনে কারণ কি? বৃষ্টিতে ভেজা? নাকি ভয়? দ্বিতীয় কারণটা পার্থর বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না। যেই মেয়ের কপালে রিভলবার ঠেকালেও সে ভয়ে চোখের পলক ফেলে না সে এতো দূর্বল হতে পারে না।

পার্থর ভাবনার মাঝেই তরী তার দিকে ফিরে নিজের উত্তপ্ত মাথাটা তার হাঁটুর উপর তুলে দেয়। পার্থর অনুভব হলো তার কোলে যেন এক টুকরো জ্বলন্ত কয়লা এনে কেউ ছেড়ে দিয়েছে। তবুও সে চুপচাপ সেই উত্তাপ সহ্য করে নেয়। তার চোখের সামনে ভেসে উঠে ক্ষমতার জোরে প্রতিনিয়ত অপকর্ম চালিয়ে যাওয়া রুবেলের চেহারাটা। কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো পার্থর এই মুহুর্তে রুবেলের বদলে নিজের প্রতি ধিক্কার এবং আক্ষেপ অনুভব হচ্ছে। এতদিন সে একা ছিলো। নিজের জীবনের প্রতি ভয় কাজ করতো না কখনো। কিন্তু এখন তরীও তার জীবনের অংশ। আর তার সবথেকে বড় প্রতিপক্ষ ইতিমধ্যে তরীর দিকে নিজের দৃষ্টিপাত করে ফেলেছে। যদিও পার্থ নির্বাচন প্রত্যাহার করেছে। কিন্তু এই যুদ্ধ এখানে শেষ হবে না। যতদিন না পার্থ জয় নিজের নামে লিখে নিচ্ছে ততদিন এই যুদ্ধ চলবে। তার শুধু এখন একটাই চিন্তা। তার এই যুদ্ধের মাঝে যেনো তরী তুরুপের তাস না হয়।

পার্থ নিজের বাধ্য হাতটা বাড়িয়ে তরীর চুলের ভাজে তা ডুবিয়ে দেয়। অন্যহাতে কম্বলটা টেনে তরীর গা ঢেকে দিয়ে শান্ত স্বরে বলে উঠে,

“ নিশ্চিন্তে থাকুন তরী। মনের সম্পর্ক না থাকুক কিন্তু কোনো ধরনের অবহেলা হবে না আপনার প্রতি। পার্থ মুন্তাসির চৌধুরীর নিজের স্ত্রীর প্রতি ওয়াদা রইলো। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৮.

তরীর যখন জ্ঞান ফিরে তখন প্রায় দুপুর। শরীরের তাপমাত্রা সামান্য কমেছে এখন। কিছুটা ভয় ও জড়তার সাথে চোখ মেলে তাকায় তরী। কিন্তু যার মুখশ্রী দেখে নিশ্চিন্তে ঝড়ো রাতে নিজের চোখ বুজেছিলো সে তার সামনে নেই। বরং জমিলা খালা তার মাথার কাছে বসে জলপট্টি দিচ্ছেন। তরীকে চোখ মেলতে দেখেই উনি বলে উঠেন,

“ বড় বউ গো! তোমার হুশ ফিরসে? যাক আলহামদুলিল্লাহ। “

তরী গায়ে অসহন জ্বর অনুভব করছে। সে ক্লান্ত গলায় বলে উঠে,

“ পানি খাবো। “

জমিলা খালা অপেক্ষা করে না। সাথে সাথে বেডসাইড টেবিলে রাখা পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে তরীকে উঠে বসতে সাহায্য করে। তার পিঠের পিছে দুটো বালিশ দিয়ে গ্লাসটা এগিয়ে ধরে। তরী দূর্বল হাতে গ্লাস নিয়ে কিছুটা পানি খেয়ে নেয়। নিজের গায়ের পরিবর্তিত জামার দিকে তাকিয়ে সে প্রশ্ন করে,

“ আমার শাড়ি কে বদলেছে? “

“ তোমার শাশুড়ি বদলায় দিসে। তোমার লাইগ্যা যে তার কি মোহব্বত! কপাল কইরা একখান শাশুড়ি পাইসো বড় বউ। আমারে তোমার কাছে পাঠায় দিয়া নিজ হাতে তোমার লাইগ্যা রানতাসে। “

তরী জমিলা খালার কথার জবাব দেয় না। সে একহাত নিজের চুলের ভেতর দিয়ে নিয়ে ঘাড় স্পর্শ করতেই টের পায় সেখানে ব্যান্ডেজ করা। এই জায়গাটাতেই কালকে তাকে পিছন থেকে আঘাত করা হয়েছিলো। তরী এক মুহুর্ত প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে দূর্বল গলায় প্রশ্ন করে,

“ পার্থ কোথায়? “

জমিলা খালা মুখ কালো করে বলে,

“ নির্বাচনের প্রত্যাহার পত্র জমা দিতে গেসে। তাড়াতাড়ি আইসা পড়বো বলসে। “

তরীর ক্লান্ত মস্তিষ্ক যেন হঠাৎ সজাগ হয়। সে চোখ মৃদু সরু করে প্রশ্ন করে,

“ নির্বাচনের প্রত্যাহার পত্র কেন জমা দিচ্ছে? “

“ আর বইলো না। বিপরীত দলের লোকেরা তোমারে তুইল্যা নিয়া গেসিলো। তোমারে মুক্ত করার বিনিময়ে পার্থরে নির্বাচন প্রত্যাহার করতে কইসে। পার্থ বাপজানে তোমারে এতো মোহাব্বত করে যে লগে লগে নির্বাচন প্রত্যাহার ঘোষণা কইরা তোমারে উদ্ধার কইরা আনসে। সারাডা রাইত তোমার মাথায় জলপট্টি দিসে। ডাক্তারও ডাকসিলো। “

তরী শুকনো মুখে জমিলা খালার কথা শুনছে। জমিলা খালা নিজেই আবার বলে উঠে,

“ একটা কথা কইতাছি বড় বউ। পার্থ বাপজান তোমারে জোর কইরা তুইল্যা বিয়া করসে দেইখ্যা তুমি হের উপর গুস্সা এইডা আমি জানি। কিন্তু যেহেতু বিয়াডা হইয়াই গেসে তাই এইডা মাইন্না নেওয়ার চেষ্টা করো। এই বাসার সবাই কিন্তু তোমারে মন থেইক্যা আপন কইরা নিসে। “

“ আমার ফোনটা একটু এনে দিবেন খালা? পাপার সাথে কথা বলবো। “

জমিলা খালা হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে। তরী যে পার্থর ব্যাপারে কোনো কথাই শুনতে চাচ্ছে না তা স্পষ্ট। উনি চুপচাপ তরীর ফোনটা এনে দিয়ে নিজে রুমের বাহিরে চলে যায়। তরী নিজের কল লিস্ট থেকে তার পাপার নাম্বারে ডায়াল করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফোন রিসিভ হয়। অপরপাশ থেকে হুমায়ুন রশীদ বলে উঠে,

“ প্রিন্সেস? আজ হসপিটাল এলে না যে! কাউকে ইনফর্মও করো নি। “

তরী দূর্বল গলায় ডাকে,

“ পাপা। “

মেয়ের কণ্ঠ শুনেই মেয়ে যে ঠিক নেই তা বুঝতে পারে হুমায়ুন রশীদ। উনি সাথে সাথে চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করে,

“ কি হয়েছে প্রিন্সেস? তোমার গলা এমন শোনাচ্ছে কেন? “

“ বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর এসেছে পাপা। “

হুমায়ুন রশীদ ভ্রু কুচকে বলে,

“ তোমাদের দুই ভাই বোনেরই দেখি গায়ে নতুন হাওয়া লেগেছে। আগে তো কখনো তোমরা বৃষ্টিতে ভিজতে না! জ্বর কেমন এখন? কমেছে? “

তরী মৃদু গলায় জবাব দেয়,

“ হ্যাঁ। “

দুই বাপ মেয়েই এখন কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করে। হুমায়ুন রশীদ হঠাৎ সিরিয়াস ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে,

“ ওই বাড়িতে তোমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো মা? পার্থ তোমার খেয়াল রাখছে তো? আর বাকি সবাই? “

তরীর গলা ধরে আসছে। সে বলে,

“ হ্যাঁ পাপা। সবাই ভালো। কিন্তু আ’ম মিসিং ইউ। “

হুমায়ুন রশীদের বেশ মন খারাপ হয়। তার সর্বদা শক্ত খোলসে আবৃত মেয়ে একমাত্র তার কাছেই আহ্লাদ করতো সবসময়। তার মেয়েকে কি পার্থ তার মতো আগলে রাখতে পারবে সবসময়?

__________

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি পলাশীর মোড়ের চিরচেনা চায়ের দোকানে বসে গরম কাচের কাপে চুমুক দিচ্ছে মধুমিতা। অপেক্ষা তার চিরচেনা প্রেমিকের। যে আপাতত ঢাকার জ্যামে ফেসে আছে হয়তোবা।

মধুমিতার অপেক্ষা দীর্ঘ হয় না। সিভিল ড্রেসে নিজের প্রেমিককে দেখে সে ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

“ আজকে কি ডিউটি নেই বুঝি জনাব? “

“ আজ সিভিল ড্রেসে ডিউটি করছি। “

কথাটা বলেই শোভন মধুমিতার হাত থেকে তার আধা খাওয়া চায়ের কাপটা নিয়ে সেটাতে চুমুক বসায়। অত:পর চোখ বুজে বলে উঠে,

“ চায়ে আজকাল চিনির বদলে মধু দেন নাকি চাচা? “

টংয়ের ভেতর বসে থাকা দোকানদার দাঁত বের করে বলে,

“ চায়ে তো সবসময়ের মতো দু চামচ চিনিই দিয়েছি। “

“ তাহলে মধুর টেস্ট কিভাবে পাচ্ছি আমি? “

শোভনের মশকরা দেখে মধু তার বাহুতে একটা চাপড় দিয়ে বলে,

“ একদম ঢং করবে না। “

শোভন মধুর কথার জবাব দেয় না। সে চা খেতে খেতে বলে উঠে,

“ দাদা নির্বাচন প্রত্যাহার করে দিয়েছে। “

মধু বিস্মিত স্বরে প্রশ্ন করে,

“ কি? “

শোভন গতকালের ঘটে যাওয়া সব ঘটনা মধুকে খুলে বলতেই মধু বিস্ময় নিয়ে বলে উঠে,

“ কিন্তু এরকম ঘটনা হলে তো ওই রুবেল টুবেলকে জেলে পাঠানো উচিত। “

“ কেউ তো ওর বিপক্ষে থানায় মামলা করে নি। তাহলে গ্রেফতার কিভাবে করবো? “

মধু খানিকটা ভাবুক ভঙ্গিতে বসে রয়। অত:পর বলে,

“ একদিক দিয়ে ঠিকই আছে। রুবেল ক্ষমতাশালী লোক। তাকে জেলে পাঠালেও দু’দিন পর ক্ষমতার দাপটে বেরিয়ে আসবে। পরে দাদার সাথে শত্রুতা আরো গভীর হবে। এর থেকে ঝামেলা না করাই ভালো। “

শোভন বিরক্ত মিশ্রিত সুরে বলে,

“ একদম দাদার সুরে কথা বলবে না মধু। “

“ আমি দাদার সুরে নয় বরং সত্যি কথা বলছি। তুমি একজন কর্তব্যপরায়ণ অফিসার হিসেবে বিষয়টা ভাবছো তাই তোমার মনে হচ্ছে রুবেলকে জেলে পাঠালেই প্রবলেম সলভড। কিন্তু বস্তুত পক্ষে এতে আরো ঝামেলা বাড়বে। আর আই এম শিওর দাদা ভাবীর লাইফ নিয়ে রিস্ক নিবে না। “

__________

রাত তখন দশটা প্রায়। বাহিরে তুমুল বর্ষণ। যদিও পার্থ বলেছিলো বিকালের মধ্যে ফিরে আসবে কিন্তু ফ্যাক্টরিতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ পড়ে যাওয়ায় তার বাসায় ফিরতে এতো দেরি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু টাইম টু টাইম সে জমিলা খালার থেকে তরীর আপডেট নিতে ভুলে নি। তার অনুপস্থিতিতে তরীর যে মোটেও অযত্ন হয়নি তা সে ভালো করেই জানে।

পার্থ ঘরে ফিরে লিভিং রুমে বসতেই সাদিকা বেগম এক গ্লাস পানি হাতে ছেলের দিকে এগিয়ে আসে। পার্থ পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে প্রশ্ন করে,

“ আব্বা কোথায়? “

“ তোর আব্বা খাওয়া দাওয়া করে শুয়ে পড়েছে। উনার প্রেশারটা বেড়েছে আবার। “

আফজাল সাহেবের আচমকা এরকম প্রেশার বাড়ার পিছনের কারণটা পার্থর অজানা নয়। তার আব্বার তার প্রতি খুব আশা ছিলো যে এবারের ইলেকশনটা পার্থই জিতবে। কিন্তু ছেলের ইলেকশন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তে উনার সেই আশায় গুড়ে বালি হওয়ায় বিষয়টা মানতে উনার সময় লাগছে। পার্থ পানিটুকু মুখের কাছে নিয়েই থেমে যায়। সাদিকা বেগমের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

“ তরী খেয়েছে? “

“ হ্যাঁ। মাত্র খাইয়ে ওষুধ দিয়ে আসলাম। সন্ধ্যার পর থেকে জ্বরটা আবার বেড়েছে মনে হচ্ছে। “

পার্থ পানি খেয়ে উপরে নিজের রুমে চলে যায়। সিটিং এরিয়াটা পাড় করে বেড রুমে প্রবেশ করতেই তরীর মুখোমুখি হয়।

তরী সবে ওয়াশরুম থেকে বের হয়েছে। রুমে একা ছিলো বিধায় ওড়না বিছানার এককোণে রেখে গিয়েছিল সে। তার মুখ জুড়ে বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে। সেগুলো চোখ, নাক, ঠোঁট বেয়ে তার উন্মুক্ত গলায় গড়িয়ে যাচ্ছে। পার্থ নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে রূপালী রঙের হাতঘড়ি খুলতে থাকে। তখনই পিছন থেকে তরীর দূর্বল গলা শোনা যায়,

“ সবার সামনে নিজের পারফেক্ট হাজবেন্ডের ইমেজ ক্রিয়েট করে কেমন অনুভব করছেন? “

পার্থ ভ্রু কুচকে তরীর দিকে ফিরে তাকায়। তরী ছোট ছোট কদম ফেলে তার দিকে এগিয়ে আসছে। জ্বরের আবেশের শুকনো মুখটা হঠাৎ কেমন দৃঢ়ভাব ধারণ করেছে। পার্থ প্রশ্ন করে,

“ কি বলছেন? “

“ এই রুমে এখন আপনি আমি ব্যতীত আর কেউ নেই। তাই নিজের ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে থাকার চেষ্টা করবেন না আর। নির্বাচন প্রত্যাহার করে কি প্রমাণ করতে চাইছেন? যে আপনি খুব ভালো স্বামী? আমাকে খুব ভালোবাসেন? আপনার আসল রূপ আমি খুব ভালো করে চিনি পার্থ মুন্তাসির। সবাইকে ধোকা দিলেও আপনি আমাকে কখনো ধোকা দিতে পারবেন না। “

কথা বলতে বলতে তরী পার্থর কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। পার্থ চুপচাপ নিজের একহাত বাড়িয়ে তরীর কপাল ছুঁয়ে দেখতে নেয় শরীরের তাপমাত্রা কেমন। কিন্তু তার আগেই তরী ঝাড়া মেরে তার হাত সরিয়ে দিয়ে বলে,

“ আমার উপর স্বামীগিরি ফলাতে আসবেন না। একদম হাত ভেঙে গলায় ঝুলিয়ে দিবো মনে রাখবেন। “

কথাটা বলে ঘুরে তরী বিছানার দিকে যেতে নেয়। কিন্তু সাথে সাথে নিজের বাম হাতে হ্যাঁচকা টান অনুভব করে। পার্থ তরীর একহাত ধরে টেনে তাকে নিজের কাছে এনে তার সেই হাত কোমরের পিছনে নিয়ে শক্ত করে ধরে গভীর স্বরে বলে উঠে,

“ আপনার সম্মান আমার কাছে যেকোনো
ইলেকশনের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। “

কথাটুকু বলতে বলতে সে আরেক হাত দিয়ে তরীর ডান হাত নিজের দখলে নিয়ে নেয়। আঙ্গুলের প্রতিটা ফাঁকে ফাঁকে নিজের আঙ্গুল গুজে দিয়ে নরম সুরে বলে,

“ আর যেটাকে আপনি স্বামীগিরি বলছেন সেটা আমার অধিকার। সম্পূর্ণ দেনমোহর পরিশোধ করেছি। আপনার কাধের ছোট্ট তিল তূল্য বিন্দু হতে শুরু করে আপনার সম্পূর্ণ চিত্তের উপর আমার অধিকার রয়েছে। আপনার শরীরের তাপমাত্রা বুঝার জন্য আমি চাইলেই থার্মোমিটারের বদলে নিজে ছুঁয়ে দেখতে পারি। “

তরীর অত্যাধিক দূর্বল ক্ষিপ্ত দৃষ্টি আচমকা শিথিল হয়ে আসে। নিজের উষ্ণ শরীরের ভার সে ছেড়ে দেয় পার্থর বুকে। পার্থ প্রথমে থমকায়। ঘটনা বুঝতে পেয়েই সে নিচু গলায় ডাকে,

“ তরী? এই তরী? ঠিক আছেন? পুড়ে যাচ্ছেন আপনি। “

তরী সাড়াশব্দ করে না। পার্থ তাকে বিছানায় তুলে শুইয়ে দেয়। বিছানার সাইড কেবিনেট হতে ডিজিটাল থার্মোমিটার নিয়ে সেটা তরীর দু ঠোঁটের মাঝে গুজে দেয়। দিনে একশোর ঘরে নামা তাপমাত্রাটা এখন হু হু করে আবার একশো চার ডিগ্রী ছুঁই ছুঁই পর্যায়ে চলে গিয়েছে। গায়ের চামড়া দগ্ধ অনলে পুড়ে যাচ্ছে। পার্থ কম্বল টেনে তরীকে ঢেকে দেয়। অত:পর আবার ডাকে,

“ তরী? আম্মা যে ওষুধ দিয়ে গিয়েছিলো খেয়েছেন? “

তরী এবার মৃদু চোখ মেলে হালকা মাথা নাড়ায়। পার্থ নিশ্চিত হয় যে জ্ঞান হারায় নি। কেবল দূর্বল শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি পাচ্ছিলো না সে। তখনই পার্থর ফোন বেজে উঠে। ফোনের স্ক্রিনে হুমায়ুন রশীদের নাম্বার দেখে পার্থ অবাক হয়। এই রাতের বেলায় পার্থকে কেন কল করছে উনি? সব ঠিক আছে তো?

পার্থ দেরি না করে ফোন রিসিভ করে সালাম দিতেই হুমায়ুন রশীদ বলে উঠে,

“ তরীর সাথে দুপুরের দিকে আমার কথা হয়েছিলো। ওর নাকি জ্বর এসেছে? এখন জ্বর আবার বেড়েছে? “

পার্থ বলে,

“ হ্যাঁ। মাত্রই টেম্পারেচার চেক করলাম। এভাবে জ্বর বাড়তে থাকাটা তো চিন্তার বিষয়। হসপিটালে নিয়ে আসবো? “

“ না। তার প্রয়োজন হবে না। আমি তোমাকে যেই মেডিসিনের নাম ম্যাসেজ করে দিবো সেটা এনে খাইয়ে দেও। আর মাথায় পানি দাও। তাহলেই হবে। “

পার্থ চিন্তিত সুরে বলে,

“ আপনার মেয়ে যদি মাথায় পানি দিতে রাজি না হয়? “

“ আমার মেয়ের জ্বর আসলে ও কখনোই মাথায় পানি দিতে রাজি হতো না। জোর করে ধমকে দিয়ে দিতে হতো। এখন তোমার স্ত্রীর কেসে তুমি তাকে কিভাবে হ্যান্ডেল করবে সেটা তোমার বিষয়। খালি এতটুকু মাথায় রাখো যে আমার আগামী পরশু একটা সার্জারি আছে। এন্ড আই নিড ডক্টর তরী টু এসিস্ট মি দ্যাট ডে। “

কথাটুকু বলে হুমায়ুন রশীদ ফোন রেখে দেয়। পার্থ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তরীকে বলে উঠে,

“ চলুন। মাথায় পানি ঢালতে হবে। “

পানির কথা শুনতেই তরী কম্বল আরো শক্ত করে চেপে ধরে মাথা নেড়ে না বলে। পার্থ একটানে কম্বল সরিয়ে বলে উঠে,

“ সুন্দর করে বলছি চুপচাপ চলুন। রাগাবেন না আমাকে। তুলে নিয়ে যেতে বাধ্য হবো। “

এই কথাতেও তরীর মধ্যে তেমন একটা হেলদোল দেখা দিলো না। সে শক্ত করে বালিশ আঁকড়ে দূরে সড়ে যায়। পার্থ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দাঁড়িয়ে নিজের পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে নিতে নিতে বলে উঠে,

“ বুঝতে পেরেছি। কোলে উঠতে চাইছেন সেটা আগে বললেই পারতেন। “

কথাটা বলেই পার্থ তরীকে তুলে ওয়াশরুমে নিয়ে বাথটাবের সামনে বসিয়ে দেয়। অত:পর নিজেও তার পাশে বসে তরীর চুল এবং মাথা বাথটাবের ভিতর দিকে রেখে শাওয়ারের পানি ছেড়ে দেয়। ঠান্ডা পানির পশলা তরীর মাথা স্পর্শ করতেই সে ঠান্ডায় কুকড়ে উঠলো। পানির নিচ থেকে নিজের মাথা সরানোর জন্য সে জোর খাটানোর চেষ্টা করে। কিন্তু বিশেষ লাভ হয়না। উল্টো তার অতিরিক্ত নড়াচড়ার ফলে পানি আরো ছিটে পার্থর বুকে লাগে। পার্থ অধৈর্য্য হয়না। বরং শান্ত গলায় বলে,

“ তরী গান শুনবেন? “

তরী পার্থর কথায় নিজের ছোটছোট চোখ আরো ছোট করে তাকায়। পার্থ তা দেখে মৃদু হেসে বলে,

“ কিন্তু শর্ত আছে। চুপচাপ বসে থাকতে হবে। “

কথাটুকু বলে পার্থ তরীর শিক্ত আদ্র চুল নিজের একহাতের মুঠোয় নিয়ে পানির নিচে স্থির ভঙ্গিতে তা ধরে রাখে। পানির ছলছল ধ্বনির সাথে তাল মিলিয়ে পার্থ নরম সুরে গেয়ে উঠলো,

“ আমি তোমার কাছেই রাখবো
আজ মনের কথা হাজার,
দিয়ে তোমার কাজল আঁকবো
আজ সারা দিনটা আমার,
তুমি বৃষ্টি হয়ে নামলে
তুমি বৃষ্টি হয়ে নামলে
আর কমলো চিন্তা আমার। “

তরীর মনযোগ ইতিমধ্যে ঠান্ডা পানি থেকে পার্থর গানের দিকে স্থির হয়েছে। জ্বরের কারণে তপ্ত ভার হয়ে থাকা মাথাটা সে আর সোজা করে রাখতে পারছে না। মাথাটা বা দিকে হেলে দিতেই তা পার্থর বুকে গিয়ে ঠেকে। মুহুর্তেই পার্থর প্রসস্থ বুক আদ্র সংস্পর্শ অনুভব করলো। পার্থ তবুও গান থামায় না।

“ হালকা হাওয়ার মতন
চাইছি এসো এখন,
করছে তোমায় দেখে
অল্প বেইমানী মন,
বাঁধবো তোমার সাথে
আমি আমার জীবন। “

চোখ বুজে গান শুনতে শুনতে আচমকা তরীর চোখের সামনে গানের দৃশ্যগুলো ভেসে উঠে। সাথে সাথে সে অস্ফুটে বলে উঠে,

“ নির্লজ্জ লোকের নির্লজ্জ গান। “

তরীর কথা পার্থর কর্ণগোচর হয় না। সে মৃদু হাসে। মনে মনে চিন্তা করে তাকে যেই তকমা দেওয়া হয়েছে সেরকম একটা কাজ করে দেখালে কেমন হয়? ডাক্তার এখন রেগে গেলেও তাকে আঘাত করতে পারবে না। যেরকম ভাবনা সেরকম কাজ। সাথে সাথে পার্থ একটা দুঃসাহসিক কাজ করে ফেলে। তরীর ডান কাধের উন্মুক্ত ছোট্ট তিলটায় নিজের শীতল ঠোঁট ছোঁয়ায়। সেই অবস্থায়ই ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,

“ আমার নির্লজ্জতার ছোট একটা ডেমো। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-১৫+১৬

0

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৫.

রাতের কাল বৈশাখীর তান্ডব পেরিয়ে ঝলমলে সকালের আগমন ঘটে। তরীর ঘুম ভাঙে সকাল ৭ টার দিকে। যদিও সাধারণত সে খুব তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে। কিন্তু এই বিয়ের ধকলের কারণে আজ কিছুটা দেরি হয়ে গিয়েছে তার। তরী চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসে। চোখ মেলে ভোরের আলোয় বিভিন্ন ফুল দিয়ে সজ্জিত রুমটা দেখতেই তার মন আবার বিরক্তিতে ভরে উঠে। সে আজ পর্যন্ত এই ফুল দিয়ে বাসর ঘর সাজানোর লজিক বুঝলো না। এদের প্রয়োজনীয়তা কি আসলে? শুধু শুধু এদের অপচয় হয়। এই তুলনায় গাছেই এদের বেশি ভালো মানায়।

তরী উঠে গিয়ে নিজের লাগেজ খুলে একটা থ্রি পিস বের করে নেয়। অভ্যাসবশত সোজা ওয়াশরুমে চলে যায় শাওয়ার নেওয়ার জন্য। শাওয়ার নিয়ে ওয়াশরুমের আয়নার সামনে দাঁড়াতেই সে আয়নায় নিজের স্নিগ্ধ মুখটা দেখতে পায়। বিয়ের গেটাপে কালকে থেকে বেশ হাসফাস অনুভব করছিলো সে। ফাইনালি এখন মনে হচ্ছে সে নিজেকে ফিরে পেয়েছে।

তরী ওয়াশরুম থেকে বের হতে নিয়েও ফিরে আসে। একটা ব্রাশ হোল্ডারের একপাশে তার ব্রাশ রাখা এবং অপরপাশের সেই বড় ব্রাশটা নিশ্চয়ই নেতা সাহেবের? তরীর মাথায় একটা বুদ্ধি কাজ করে। সে দৌড়ে রুমের ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে পার্থর একটা হেয়ার ব্রাশ নিয়ে ফিরে আসে। অত:পর পার্থর টুথব্রাশ দিয়ে সেই হেয়ার ব্রাশটা ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার করে। মুহুর্তেই ফকফকা সফেদ টুথব্রাশটা একটা বিদঘুটে রঙ ধারণ করে। তরী সেটা পূর্বের জায়গায় রেখে দিয়ে পৈশাচিক হেসে বলে উঠে,

“ বেস্ট অফ লাক ফর ইউর ম্যারিড লাইফ মাই লাভ। “

__________

সকাল সকাল নাস্তার টেবিলে থমথমে মুখে বসে আছে পার্থ। কিছুক্ষণ আগে ফ্রেশ হতে গিয়ে সে একটা বিদঘুটে সিচুয়েশন ফেস করেছে। তার টুথব্রাশের কেউ ইজ্জত মেরে দিয়েছে। ঘটনাটার সাথে যে রান্নাঘরে নাস্তা বানাতে ব্যস্ত তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রী জড়িত তা নিয়ে পার্থর মনে তিল পরিমাণ সন্দেহ নেই। মহারাণী আগেই তাকে ওয়ার্নিং দিয়েছিলো যে বিয়ের পর সে পার্থর জীবন দূর্বিষহ করে তুলবে। পার্থও তা মেনে নিয়েছিলো। তাই এই নিয়ে কোনো অভিযোগ করা তাকে সাজে না। বরংচ পার্থ দেখতে চায় তরী তার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিতে কত দূর যেতে পারে।

বাড়ির বাকি সকল সদস্য ইতিমধ্যে নতুন বউর হাতে তৈরি করা নাস্তা খেয়ে যে যার কাজে বেরিয়ে পড়েছে। সকালে তরী যখন নিচে নামে তখন সে সাদিকা বেগমের সম্মুখীন হয় সর্বপ্রথম। উনি তরীর হাতে একটা নতুন জামদানি শাড়ি দিয়ে বলেছিলেন নববধূকে শাড়িতে বেশি মানায়। তরী নিজের শাশুড়ির কথা ফেলে নি। উপরে গিয়ে নিজের থ্রি পিস বদলে শাড়ি পড়ে নিয়েছে, সাথে হালকা কিছু অলংকারও।

শাড়ির আঁচল কোমরে গুজে তরী একহাতে পরোটার প্লেট নিয়ে ডাইনিং রুমে প্রবেশ করে। ডাইনিং টেবিলে পার্থর সাথে তখন আসিফ, শামীমসহ আর চার পাঁচজন ছেলে বসে ছিলো। সবাই-ই তরীকে এই রূপে দেখে বেশ অবাক। তরী হাসিমুখে সবার প্লেটে পরোটা তুলে দিয়ে নিজের হাতে রান্না করা গরুর মাংস পরিবেশন করে। আফিস শামীমের কানে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,

“ দেখসোস আমগোর ভাইয়ের জাদু? একদিনেই ভাবীরে বাঘের তে বিলাই বানায় ফেলসে। “

শামীমও কথাটা শুনে মুখ টিপে হাসে। তরী সৌজন্যমূলক হাসি হেসে পার্থর উদ্দেশ্যে বলে উঠে,

“ এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? খাওয়া শুরু করুন। আমি খুব ভালোবেসে আপনার প্রিয় গরুর মাংস রান্না করেছি এই সকাল সকাল। খেয়ে বলুন কেমন হয়েছে। “

পার্থ সন্দিহান দৃষ্টি নিয়ে তরীর দিকে তাকিয়ে আছে। তরীর এই হাসির পিছনে যে কোনো ইবলিশ মার্কা রহস্য আছে তা সে নিশ্চিত। সে একটু পরোটা ছিড়ে মাংসের ঝোলে ভিজিয়ে মুখে দেয়। অত:পর বেশ স্বাভাবিক গলায় বলে উঠে,

“ ভালো রান্না জানেন আপনি। “

তরীর হাসির রেখা কিছুটা কমে আসে। ইতিমধ্যে বাকিরাও খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু খাবার মুখে দিতেই তাদের সকলের চেহারার রঙ বদলে যায়। তা দেখে তরী আবার হেসে দিয়ে বলে উঠে,

“ আমার জানামতে আপনাদের রাজনীতির একটা অলিখিত নিয়ম আছে। নিজেদের নেতা যাই করুক না কেন, আপনারা সর্বদা সহমত ভাই, ঠিক ভাই বলে বেড়ান। একইভাবে এখন থেকে নেতার স্ত্রী যা-ই খেতে দেক না কেন, মজা হয়েছে ভাবী, সুস্বাদু হয়েছে ভাবি বলে বেড়াবেন। ওকে? “

তরীর কথা কেউ কানে তুললো কিনা বুঝা গেলো না। সবাই পানি খেতে ব্যস্ত। ঝালের চোটে তাদের চোখ দিয়ে পানি ঝরবে প্রায়। পার্থ খাবার ছেড়ে উঠে তরীর হাত ধরে রান্নাঘরে নিয়ে আসে। অত:পর শক্ত গলায় বলে উঠে,

“ ব্যক্তিগত আক্রোশ আমার উপর একশোবার মেটান আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আজকের পর থেকে আমার আশেপাশের কোনো মানুষের সাথে এধরণের বেহুদা ইয়ার্কি করলে আমার খারাপ রূপ দেখাতে বাধ্য হবো। “

তরী তাচ্ছিল্য ভরা হাসি দিয়ে বলে,

“ খারাপ রূপ নাকি আসল রূপ? “

পার্থ তরীর হাত ছেড়ে দিতেই তরী একটা বড় ফিরনির বাটি হাতে নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যায়। পার্থও তার পিছু পিছু বেরিয়ে আসে। তরী সবাইকে ফিরনি সার্ভ করতে করতে বলে উঠে,

“ এটা আপনাদের পাওনা ছিলো। সেদিন রাতের হিসাব মিটিয়ে নিলাম। এখন নিশ্চিন্তে এটা খেতে পারেন। “

ফিরনি মুখে দিতেই সকলের ঝালে জ্বলে যাওয়া জিভ স্বস্তি খুঁজে পায়। তরী আরেক বাটি ফিরনি নিয়ে পার্থর দিকে এগিয়ে ধরে। পার্থ এক মুহুর্ত তরীকে দেখে হনহনিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। তার পিছু পিছু বাকিরাও বেরিয়ে যায়।

__________

নাস্তার টেবিলে খাবারের বাটির টুনটান শব্দের পাশাপাশি আরো দুটো মানবীর ঠান্ডায় হাচ্চির শব্দ ভেসে আসছে। পৃথা নিজের লাল হয়ে থাকা চোখটা সামান্য কচলে হুমায়ুন রশীদকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

“ আরেকটা রুটি দেই পাপা? “

হুমায়ুন পরম আদর মিশিয়ে পুত্রবধূকে বলে,

“ না আম্মু। তুমি আগে তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করো। আমি ঠান্ডার এবং এলার্জির মেডিসিন দিচ্ছি সেট খেয়ে নাও। তাহলে আরাম পাবে। “

পৃথা লজ্জায় নিচের দিকে তাকিয়ে খেতে থাকে। গত রাতের এই তূর্যের সাথে এডভেঞ্চারাস বৃষ্টি বিলাস করতে গিয়েই তার এই ঠান্ডা বেঁধেছে। ঠান্ডার কবল থেকে তূর্যও রেহাই পায় নি। নিজের বউয়ের সাথে দু দন্ড ব্যক্তিগত মুহুর্ত কাটানোর খেসারত হিসেবে ক্রমাগত হাচ্ছি দিয়ে যাচ্ছে সে।

হুমায়ুন রশীদ আড়চোখে ছেলের দিকে তাকায়। অত:পর কিছুটা গলা ঝেড়ে খাবার টেবিল ছাড়ার আগে বলে উঠে,

“ এরপর থেকে রাতে ছাদে যাওয়ার আগে আবহাওয়া চেক করে যাবে। “

কথাটা শুনতেই তূর্যর খাবার গলায় আটকে যায়। পৃথাও লজ্জায় মিশে যাচ্ছে। পাপা তবে বুঝতে পেরেছিলো যে কাল রাতে ছাদে তারাই গিয়েছিলো? হুমায়ুন রশীদ ততক্ষণে নিজের রুমে চলে গিয়েছে। পৃথা একবার আড়চোখে তূর্যর দিকে তাকায়। তূর্যও ততক্ষণে নাস্তা সেরে উঠে গিয়েছে। তার অফিসের সময় হয়ে গিয়েছে। পৃথা তূর্যর পিছু পিছু দরজা পর্যন্ত এগিয়ে আসে। বের হওয়ার আগে তূর্য আচমকা পিছনে ফিরে পৃথার গালে নিবিড়ভাবে ওষ্ঠ স্পর্শ করে। আকস্মিক ঘটনায় পৃথা লজ্জা পায়। তূর্য একইভাবে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,

“ আই লাভ ইউ। “

বলে সে আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা করে না। সাথে সাথে বেরিয়ে যায়। ভালো লাগার আবেশে পরিপূর্ণ অষ্টাদশী দরজার সাথে হেলান দিয়ে তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রয়।

__________

“ রুবেল এখনো নির্বাচন প্রত্যাহার ঘোষণা করলো না কেন? “

শামীমের প্রশ্ন শুনে আসিফ বলে উঠে,

“ আজকের সারাদিন তো এখনো সময় আছে। যেকোনো সময়ই দেখবি নিউজ পাবি যে বেডায় গা ঢাকা দিসে। “

পার্থ এতক্ষণ নীরবে বসে ছিলো। তার মাথায় ঘুরছে অন্য চিন্তা। সে রফিকের উদ্দেশ্যে বলে উঠে,

“ রফিক একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে তোমার জন্য। “

“ হ্যাঁ ভাই বলেন। “

“ কাল থেকে তরী আবার হসপিটালে যাওয়া শুরু করবে। উনি যতক্ষণ হসপিটালে থাকবে উনার উপর নজর রাখবে। উনি আসা যাওয়ার সময়ও চোখ কান খোলা রাখবে। মেক শিওর শি ইজ অলরাইট। “

আসিফ অবিশ্বাসের সুরে বলে,

“ ভাই আপনে কি ওই রুবেলের থ্রেটরে সিরিয়াসলি নিয়া নিসেন? আপনার মনে হয় ওর এতো বড় কলিজা আছে? “

পার্থ শান্ত ভঙ্গিতে জবাব দেয়,

“ প্রতিপক্ষের প্রতিটা বিষয়কেই আমি সিরিয়াসলি নেই। রুবেল ইলেকশনে টিকে থাকার জন্য যে কোনো কিছু করতে পারে। তাই সব ধরনের সম্ভাবনাই আমার ভেবে রাখতে হবে। আর তাছাড়া তরীর সেফটিও আমার দায়িত্ব। “

আসিফ মুখ টিপে হেসে বলে,

“ ভাই আপনি তো ভাবীর প্রেমে পইড়া গেসেন মনে হইতেসে। “

পার্থ গরম দৃষ্টিতে তাকায় আসিফের দিকে। অত:পর বলে উঠে,

“ দায়িত্ব আর ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য আছে। আমি শুধু আমার দায়িত্ব পালন করছি। “

__________

এতো বিশাল বাড়ির মধ্যে এই মুহুর্তে সাদিকা বেগম এবং তরী ছাড়া আপাতত আর কেউ উপস্থিত নেই। আফজাল সাহেব আর পার্থ ঘন্টা খানিকের মধ্যেই ফিরে আসবে। শোভনের ফিরতেও সময় লাগবে। সন্ধ্যা বেলায় ঝড়ো হাওয়া বইছে বাহিরে। তরী নিজের রুমে বসে অলস সময় পার করছে। সাদিকা বেগম এতক্ষণ তার সাথে বসে গল্প করছিলেন। কিছুক্ষণ আগেই তিনি নামাজ পড়ার জন্য নিজের রুমে ফিরে যান।

আচমকা ফোনের রিংটোনটা বেজে উঠতেই তরী ফোনের দিকে তাকায়। হসপিটাল থেকে কল আসছে। তরীর ভ্রু কুচকে আসে। এই মুহুর্তে হসপিটাল থেকে কেনো কল আসবে? আজকে তো তার ডে অফ। তবে? ইমার্জেন্সি কোনো কেস নাকি?

তরী দেরি না করে ফোন রিসিভ করে। তার ধারণাই ঠিক হয়। কেবিন নং ৮০৬ এর পেশেন্টের আচমকা শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে। উনার সার্জারির শিডিউল আগামীকাল ছিলো। কিন্তু উনার বর্তমান অবস্থার উপর নির্ভর করে এই মুহুর্তে সার্জারি করা আবশ্যক। যেহেতু উনি তরীর পেশেন্ট সেজন্য তরীর সেখানে উপস্থিত থাকতে হবে।

ফোন রেখে তরী তাড়াহুড়ো করে নিজের গাড়ির চাবি নিয়ে নেয়। হাতে আপাতত তার সময় নেই তাই গায়ের শাড়িটাও বদলায় না সে। ব্যস্ত পায়ে নিচে নেমে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে নিলেই পিছন থেকে সাদিকা বেগমের গলা ভেসে আসে,

“ কোথায় যাচ্ছো তরী? “

“ হসপিটালে যেতে হবে আম্মা। একটা ইমার্জেন্সি কেস। চিন্তা করবেন না আমি গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি। “

সাদিকা বেগমের কপালে চিন্তার ভাজ ফুটে উঠে। তিনি কিছু বলবে তার আগেই তরী ব্যস্ত পায়ে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরিয়ে যায়। সাদিকা বেগম এতক্ষণ দো তলার সিড়ির পাটে দাঁড়িয়ে ছিলো। এখন তিনি নিচে নেমে আসে। বাহিরের দিকে তাকাতেই দেখে তুফানি তান্ডব চলছে। তার উপর তিনে সন্ধ্যার প্রহর। উনার মনে কিছু একটা কু ডাকছে। মেয়েটা এক দন্ড অপেক্ষাও করলো না। লোক মুখে শোনা কিছু কু প্রথার কথা উনার মাথায় ঘুরছে। নতুন বউদের নাকি এরকম ভর দুপুর, তিনে সন্ধ্যা এবং মাঝ রাত্রে বাহিরে যেতে নেই। এতে নাকি গায়ে খারাপ বাতাস লাগে। সাদিকা বেগম চিন্তিত সুরে বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,

“ আল্লাহ রক্ষা করো। “

চলবে…

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৬.

বৃষ্টির দিনে ঢাকা শহরের জ্যাম যেন দ্বিগুণ মাত্রায় বৃদ্ধি হয়। যেখানে সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার কথা পার্থর, সেখানে তার বাসায় পৌঁছাতে রাত ১০ টা বেজে যায়। বাড়ি ফেরার পর আব্বা আম্মা নিশ্চিত কিছু কঠিন কথা শুনাবে। আম্মা বারবার করে বলে দিয়েছিলো, বিয়ের পরে আজ প্রথমদিন সারাদিন বাসায় থাকতে। কিন্তু বললেই কি তা সম্ভব হয়? নির্বাচনের জন্য পার্থর মাথায় উপর প্রচুর কাজের বোঝা। তার উপর আব্বার ব্যবসার দিকটাও তার সামলাতে হয়। এসব নিয়েই আজ সারাদিন ব্যস্ত ছিলো সে।

পার্থ ঘরে প্রবেশ করতেই দেখে লিভিং রুমে আফজাল সাহেব ও শোভন বসে আছে। সাদিকা বেগম কলিংবেলের শব্দ শুনে ইতিমধ্যে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। আফজাল সাহেব গম্ভীর স্বরে বলে,

“ আজকের দিনটা কি বাড়িতে থাকলে খুব বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যেতো তোমার? “

পার্থ সোফায় বসে ক্লান্ত গলায় বলে,

“ আমি কতটা প্রেশারের উপর আছি তা তো আপনার অজানা নয় আব্বা। আপনার মুখে এরকম প্রশ্ন সাজে না। “

সাদিকা বেগম চিন্তিত সুরে বলে,

“ তোরা যে কি করিস! তরীটাও এখনো ফিরলো না। “

সাদিকা বেগমের কথা কর্ণগোচর হতেই পার্থর ভ্রু কুচকে আসে। সে অবাক সুরে প্রশ্ন করে,

“ তরী এখনো ফিরলো না মানে? কোথায় তরী? “

সাদিকা বেগম জবাব দেয়,

“ সন্ধ্যা করে দৌড়ে হসপিটাল গেলো। ওর নাকি জরুরি কেস ছিলো। “

শোভন পাশ থেকে বলে উঠে,

“ আমি বাসায় ফিরে আম্মার কাছ থেকে জানতে পারি যে ভাবী হসপিটালে। ভেবেছিলাম তুমি যেহেতু বাসায় নেই আর বাহিরের আবহাওয়াও ভালো নয় তাহলে আমিই গিয়ে ভাবীকে নিয়ে আসবো। কিন্তু ভাবীকে কল দিতেই ভাবী জানায় উনি অলরেডি হসপিটাল থেকে বেরিয়ে পড়েছে। বাসায় ফিরছে। “

পার্থ নিজের পকেট থেকে ফোন বের করে তরীর নাম্বার ডায়াল করতে করতে প্রশ্ন করে,

“ কখন কথা হয়েছিলো তোর তরীর সাথে? “

“ ৯ টার দিকে। “

প্রায় এক ঘন্টার উপর হয়ে গিয়েছে। হসপিটাল থেকে বাসার দূরত্ব এতো দূর নয় যে পৌঁছাতে এতো সময় লাগবে। পার্থ চিন্তিত ভঙ্গিতে লিভিং রুমে পায়চারি করতে করতে তরীর নাম্বার ডায়াল করতে থাকে। ফোন সুইচড অফ দেখাচ্ছে।

পার্থর চেহারায় চিন্তার ছাপ গভীর হয়। তাকে চিন্তিত দেখে আফজাল সাহেব প্রশ্ন করে,

“ কি হয়েছে? “

“ তরীর ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। “

সাদিকা বেগম চিন্তিত সুরে বলে,

“ দাঁড়িয়ে আছিস কেন? গিয়ে দেখ মেয়েটা কই। “

পার্থ এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে সাথে সাথে বেরিয়ে যায়। শোভনও তার পিছু পিছু নিজের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরে।

__________

হসপিটালে যাওয়ার পথে এক নীরব সুনসান জায়গায় গাড়ি ব্রেক করে থামায় পার্থ। দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে সে রাস্তার একপাশে থাকা তরীর নীল রঙা গাড়ির দিকে তাকায়। পার্থ দ্রুত গতিতে হেঁটে গাড়ির কাছে যায়। কিন্তু ভিতরে কেউ নেই। পার্থ আশেপাশে অশান্ত দৃষ্টি মেলে তাকায়। চারিদিকে কোথাও কেউ নেই। তরীর গাড়ি এখানে হলে সে কোথায়?

পার্থ নিজের ফোন বের করে আবার তরীর নাম্বার ডায়াল করে। এবারও একটি নারীকণ্ঠ তার আশায় পানি ঢেলে বলে উঠে,

“ আপনি যেই নাম্বারে ডায়াল করছেন তা এই মুহুর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। “

তখনই সরু রাস্তা ধরে আরেকটি গাড়ি এসে সেখানে থামে। শোভন তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে পার্থর দিকে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করে,

“ ভাবীর গাড়ি না এটা? ভাবী কোথায়? “

পার্থ হতাশ গলায় বলে,

“ নেই এখানে। “

এবার শোভনকেও বেশ চিন্তিত দেখালো। সে উদ্বিগ্ন গলায় বলে,

“ কোনো ছিনতাইকারীর হাতে পরে নি তো? শিট! ২৪ ঘন্টার আগে থানায় মিসিং ডায়েরিও করা যাবে না। কিন্তু তুই চিন্তা করিস না। আমি এখনই আমার লোক লাগাচ্ছি। “

পার্থ আগুন চোখে শোভনের দিকে তাকিয়ে কিড়মিড়িয়ে বলে উঠে,

“ তোর এই আইনের প্রতি আমার কোনো বিশ্বাস নেই। আমার বউকে খোঁজার জন্য আমিই যথেষ্ট। তোর দেশের আইন তো এখন ক্ষমতাশীলদের পা চাটতে ব্যস্ত। তারা সেটাই করুক। “

কথাটা বলেই পার্থ হনহনিয়ে নিজের গাড়িতে উঠে সেখান থেকে প্রস্থান করে। শোভন নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়। অত:পর কল করে একজনকে বলে তরীর গাড়ি বাসায় পৌঁছে দিতে।

__________

অন্ধকার রুমে হাত পা বাঁধা অবস্থায় ফ্লোরে বসে আছে তরী। বৃষ্টিতে ভেজা শাড়ি ইতিমধ্যে শুকিয়ে গেলেও বেশ ঠান্ডা লাগছে তার। ঘাড়ের দিকে কি দিয়ে আঘাত করা হয়েছিলো তা তার জানা নেই। কিন্তু সেখান থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত স্পষ্ট অনুভব করছে সে। যন্ত্রণায় চোখ ফেটে এক বিন্দু পানি গড়িয়ে পড়ে। তরী চোখ বুজে মনে করে তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাচক্র।

সার্জারি শেষ করে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে সে বাসায় ফিরছিলো। বাহিরে তখন তুমুল বৃষ্টি। পথিমধ্যে আচমকা একটা লোক তার গাড়ির সামনে এসে পড়ায় সে দ্রুত গাড়ির ডিরেকশন ঘুরিয়ে ব্রেক করে। গাড়ির সিট বেল্ট পরিহিত অবস্থায় থাকায় তেমন একটা ক্ষতি হয়না তরীর। সে দ্রুত ঘাড় ঘুরিয়ে রাস্তার দিকে তাকাতেই দেখতে পায় সেই লোকটা রাস্তায় উপুড় হয়ে পরে আছে। তরীর ভয় হয়। বাই এনি চান্স লোকেরা কি তার গাড়ি দ্বারা হিট হলো? সে দ্রুত বৃষ্টি মাথায় নিয়েই গাড়ি থেকে নেমে লোকটার দিকে এগিয়ে যায়। কাছাকাছি যেতেই আচমকা তার ঘাড়ে কিছু একটা দিয়ে খুব জোরে আঘাত করা হয়। সাথে সাথে সে চেতনা হারিয়ে ফেলে।

যখন জ্ঞান ফিরে তখন চোখ খুলে সে নিজেকে এই অন্ধকার বদ্ধ রুমে আবিষ্কার করে। জ্ঞান ফেরার পর সে বেশ অনেকক্ষণ চিল্লিয়েছে সাহায্যের জন্য। চিল্লাতে চিল্লাতে তার গলা দিয়ে এখন আর শব্দ বের হচ্ছে না। তার নিঃশ্বাস যেন গলার মধ্যে আটকে আছে। তার সাথে কি হচ্ছে, কেন হচ্ছে এসব কিছুই তার জানা নেই। সে শুধু এটুকু জানে যে সে এখানে মোটেও সেফ না। এরকম বিপদের একটা সময় তরীর কেবল একজনের কথাই মনে পড়ে। তার পাপা। তরী চোখ মেলে তাকায়। কম্পিত এবং ক্লান্ত চিত্ত নিয়ে মনে মনে বলে উঠে,

“ আই মিস ইউ পাপা। তোমার কাছে যতদিন ছিলাম ততদিন সেফ ছিলাম। আমাকে অন্যের হাতে তুলে দিয়েছো চব্বিশ ঘণ্টা হয় নি এখনো, অথচ দেখো আমি এখন কোন বিপদে ফেসে গেলাম। “

কথাটা বলেই সাথে সাথে তরী চিৎকার করে উঠে। তার পায়ে ছোট নরম কোনো এক জীবের লোমকূপ অনুভব করছে সে। প্রাণীটা যে ইদুর তা বুঝতে পেরেই সে ভয়ে ছোটার জন্য আবার ছটফট করতে শুরু করে। একটা প্রবাদ বাক্য আছে। “ বিপদ যখন আসে তখন সবদিক দিয়েই আসে। “ তরীর হয়েছে এখন সেরকম অবস্থা। বাকি সবকিছু সে সহ্য করে নিতে পারলেও এই ইদুর সে সহ্য করতে পারে না। দূর থেকে দেখলেও তার গা গুলিয়ে আসে। অথচ এখন ইদুর তার শরীর স্পর্শ করছে আর সে আত্মরক্ষার জন্য কিছু করতেও পারছে না। এতটা নিরুপায় অনুভব করে এবার সে না পেরে কেদে দেয়। কেউ কি তাকে সাহায্য করতে আসবে না?

__________

সাধারণত সন্ধ্যার পর রুবেল কখনো পার্টি অফিসে থাকে না। কিন্তু আজ রাত নেমে গেলেও সে নিজের পার্টি অফিসে আয়েশী ভঙ্গিতে বসে আছে। চোখে মুখে তার বেশ প্রশান্তি ভাব। তার থেকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে সুজন। সে-ও বেশ ভালো করে জানে রুবেলের মুখের এই ভাবের কারণ। কিন্তু সে এতটা শান্ত থাকতে পারছে না। পার্টি অফিসে এই মুহুর্তে রুবেল এবং সে বাদে আর কেউ উপস্থিত নেই। এই বিষয়টাই তার ভয়ের কারণ।

শান্ত পার্টি অফিসটার দরজা আচমকা এক বিকট শব্দ করে খুলে যায়। কিছু বুঝে উঠার আগেই বিধ্বস্ত অবস্থায় রুমে প্রবেশ করে পার্থ। সে নিজের হাতের রিভলবারের ট্রিগার পুল করে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় চেয়ারে বসে থাকা রুবেলের দিকে। রুবেলের মুখে হাসি ফুটে উঠে। পার্থ সোজা তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে নিজের এক পা চেয়ারের একপাশে তুলে ঠেক দেয় এবং হাতের রিভলবারটা রুবেলের গলা বরাবর ধরে বলে,

“ আমার বউ কোথায়? “

সুজন এই দৃশ্য দেখে পার্থর দিকে এগিয়ে যেতে নেয়। কিন্তু সাথে সাথে সে দেখে দরজা দিয়ে আরো দশজন প্রবেশ করছে। এরা পার্থর পার্টির লোকজন। পার্থর পার্টির সব মানুষের সাথেই পার্থর খুব ভালো সখ্যতা আছে। কিন্তু এই দশজনকে সর্বদা সব পরিস্থিতিতে পার্থর আশেপাশে দেখা যায়। আসিফ এবং শামীমও এর মধ্যে অন্যতম।

পার্থর চোখে ঠিকরে যেনো আগুন বের হচ্ছে। সে রিভলবারটা আরেকটু চেপে ধরে ক্ষুব্ধ স্বরে প্রশ্ন করে,

“ তরী কোথায়? “

রুবেল এবার শব্দ করে হাসে। মশকরার সুরে বলে উঠে,

“ এজন্যই মুরগীকে খাঁচার ভেতর বন্দী করে রাখতে হয়। মুরগী যদি খাঁচার বাহিরে যায় তবে এতে শিয়ালের কি দোষ বল? “

পার্থ এখানে মোটেও নিজের ধৈর্য্য পরীক্ষা দিতে আসে নি। সে রুবেলের চেয়ার বরাবর আঘাত করে বলে উঠে,

“ আমি শুট করার আগে একবারও চিন্তা করবো না। আমার মাথা গরম করবি না। “

রুবেল হাসতে হাসতে বলে উঠে,

“ ধ্যাৎ! সব মজা নষ্ট হয়ে গেলো। আমি আরো চাইসিলাম সারারাত পাগলা কুত্তার মতো তোকে হয়রানি করাবো। তারপর সকালে তোকে জানাবো যে তোর বউ আমার কাছে। কিন্তু তুই সকাল হওয়ার আগেই বুঝে গিয়েছিস যে এটা আমার কাজ। খুব বুদ্ধি আছে তোর। “

“ কথা ঘুরাবি না। তরী কোথায় সোজাসাপ্টা বল। “

“ আরে! কুল। ভাবীর আমি বেশ ভালো খাতিরযত্ন করছি। তা নিয়ে তুই চিন্তা করিস না। তুই আপাতত আমাদের ডিল নিয়ে ভাব। “

“ কিসের ডিল? “

“ ভাবীর মুক্তিপণের ডিল। আমি ভাবীকে ছেড়ে দিবো। বিনিময়ে তুই আমাকে কিছু দিবি না? “

পার্থ স্বভাববসত খুব শান্ত প্রকৃতির মানুষ। কিন্তু একবার সে রেগে গেলে তাকে শান্ত করাটা খুব কঠিন কাজ। এবারও তাই হলো। সে রাগে রুবেলের বুক বরাবর লাথি মেরে তাকে চেয়ার সহ ফেলে দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠে,

“ কোনো ডিল হবে না। তুই আমাকে তরীর ঠিকানা বলবি নাহয় মরবি। “

এতক্ষণ রুবেল বেশ হাসিখুশি থাকলেও এবারের আঘাতে তার রাগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। সে সোজা হয়ে উঠে এসেছে হিংস্র স্বরে বলে উঠে,

“ আওয়াজ নিচে রেখে কথা বল। ভুলে যাবি না তোর বউ আমার কাছে জিম্মি। ওর জীবন সম্পূর্ণ এখন আমার হাতে। আমি চাইলে মেরে এমনভাবে লাশ গুম করে দিতে পারবো যে কেউ ওর লাশও খুঁজে পাবে না। “

আসিফ একটা বিশ্রী গালি দিয়ে বলে উঠে,

“ তোর লাশও কেউ খুঁইজ্জা পাইবো না রুবেইল্লা। মাথা গরম করাবি না। ভাবী কই ভালোয় ভালোয় বইলা দে। “

রুবেল আসিফকে পাত্তা দেয় না। সে সোজা হয়ে আবার চেয়ারে বসে পার্থর দিকে দৃষ্টি স্থির করে বলে উঠে,

“ তুই যদি আমাকে পুলিশে দেস, তাহলে দুইদিনের মধ্যে উপরমহল থেকে আমাকে জামিনের ব্যবস্থা করে দিবে। মাঝখান দিয়ে আমাকে পুলিশে দেওয়ার অপরাধে তোর বউ মরবে। আবার তুই যদি এখন আমাকে মেরে ফেলস এতেও তোর লস। সারাজীবন খুনের অপরাধে জেলে পড়ে থাকবি। কেউ তোর জামিন করাইতে পারবে না। আবার ওদিক দিয়ে তোর বউও মরবে। এটাও ব্যাড অপশন। তোর কাছে এই মুহুর্তে শুধু একটা অপশন আছে। সেটা হলো সেই ভিডিওর যত কপি আছে আমার সামনে বসে সব ডিলিট করাবি আর তার পাশাপাশি তুই নির্বাচনও প্রত্যাহার করবি। “

রুবেলের কথা শুনে পার্থর ক্রুদ্ধ দৃষ্টি জ্বলজ্বল করে উঠে। তা দেখে রুবেল হেসে বলে,

“ পার্থ মুন্তাসির চৌধুরী। বউ নাকি ইলেকশন? কোনটার মূল্য বেশি তোর কাছে? “

পার্থ চোখ মুখ শক্ত করে রুবেলের দিকে তাকিয়ে আছে। কুদরতের এ কেমন লীলা? দু’দিন আগে সে নিরপরাধ দুজন মানুষকে নিজ স্বার্থে ব্ল্যাকমেইল করেছিলো। আজ ভাগ্য তাকে একই পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছে। এজন্যই হয়তো বলে, আল্লাহ ছাড় দেয় কিন্তু ছেড়ে দেয় না।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-১৩+১৪

0

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৩.

রেস্টুরেন্ট হতে বের হতেই তরী পার্থর হাত ছেড়ে দেয় এক ঝাটকা মেরে। পার্থ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলে উঠে,

“ আপনি নিজে আমার হাত ধরেছেন। এখন আবার হাত ঝাড়া মারছেন কেনো? “

“ এক্সকিউজ মি। দুই মিনিটের জন্য হাত ধরেছি দেখে এটা ভেবে বসবেন না যে আমার সাথে আপনার কোনো চান্স আছে। “

পার্থ মুখ শক্ত করে তরীর দিকে তাকিয়ে থাকে। নারী জাতির এই এক সমস্যা! এরা কখন কি চায় নিজেরাও জানে না। আজব এক প্রজাতি!

তরী চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসতেই পার্থ এসে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ে। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। তরী বসে বসে নিজের ফোন চালাতে ব্যস্ত। পার্থও আপন মনে ড্রাইভিং করছে। হঠাৎ সে প্রশ্ন করে,

“ বিয়ে যেহেতু অফিসিয়ালি হয়েই যাচ্ছে তো বিয়ের পরের প্ল্যান কি আপনার? “

তরী ফোন চালাতে চালাতেই জবাব দেয়,

“ আপনার জীবন বরবাদ করার প্ল্যান। “

পার্থ হাসে মৃদু। অত:পর বলে,

“ আপনার অনেস্টি আমার ভালো লেগেছে। “

তরী পার্থর কথায় আর পাত্তা দেয় না। এই লোক কি সেধে তার সাথে কথা বলে তাদের মধ্যের সম্পর্ক নরমাল করার চেষ্টা করছে? উহু। এরকম কখনো হবে না। তরী হতেই দিবে না। এরকম একটা স্ক্রাউন্ডেল দ্বারা ইম্প্রেস হওয়ার চেয়ে কচু গাছে কোমর দড়ি বেঁধে মরে যাওয়া ভালো।

__________

আকাশে আজ সূর্যের দেখা নেই। ঘন কালো মেঘে ঢেকে আছে আজ আকাশ। তূর্য এবং পৃথার কাবিনের এক সপ্তাহ হয়ে গিয়েছে। এই এক সপ্তাহে পৃথা বাড়ির সকলের সাথেই অনেকটা ফ্রি হয়ে গিয়েছে। বড় দা’র প্রতি রাগ টাও প্রায় শূণ্যের কোঠায় নেমে এসেছে। উল্টো কাল তার বড় দা এবং বড় ভাবীর হলুদের জন্য বেশ এক্সাইটেড সে।

তরী, হুমায়ুন রশীদ, তূর্য কেউই বাসায় নেই। কাজের মহিলাও সকাল ১০ টার মধ্যে সব কাজ সেড়ে চলে গিয়েছে। তারপর থেকে পৃথা পড়ার টেবিলে বসে অলস সময় পাড় করছে। তূর্যর সাথে কথা বলে সে ডিসাইড করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিবে। সে জন্যই সারাদিন বইয়ে ডুবে থাকতে হচ্ছে। কিন্তু আজকের এই গুমোট আবহাওয়া দেখে অষ্টাদশীর আর পড়ার টেবিলে মন বসছে না।

অবশেষে সে বই রেখে উঠে রুমের সকল দরজা জানালা লাগিয়ে দেয়। যেকোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে। পৃথা ক্লসেট থেকে একটা সবুজ তাতের শাড়ি বের করে পড়ে নেয়। ভাগ্যিস আম্মা তাকে শাড়ি পড়াটা শিখিয়েছিল। নাহয় এখন শাড়ি পড়তে গিয়ে বিপাকে পড়তে হতো তাকে। শাড়ি পড়া শেষ হতেই পৃথা নিচে নেমে রান্নাঘরে চলে যায়। আজ সে ইচ্ছে করেই আন্টিকে বলেছিলো রান্না করতে হবে না।

ফোনে ইউটিউব হতে সে গরু মাংস দিয়ে ভুনা খিচুড়ি রান্না করার রেসিপি দেখে নিজেও অপরিপক্ক হাতে রান্না করা শুরু করে। মনে মনে ভেবে রেখেছে চমৎকার রান্না করে তূর্যকে চমকে দিলে কেমন হয়? আম্মার কাছে সে শুনেছিলো পুরুষের মনের রাস্তা পেট হয়ে যায়। সুতরাং পৃথার মজার রান্নার উপর ডিপেন্ড করছে তূর্যর মনে তার প্রতি ভালোবাসা জাগবে কিনা তা!

রান্নার মাঝেই তূর্যর কল আসে। পৃথা কোনো মতে একটা টিস্যু নিয়ে একহাত মুছে কল রিসিভ করতেই ফোনের অপর পাশ থেকে তূর্য বলে উঠে,

‘’ হ্যালো মি এ বি সি। কি করছো? “

“ আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করছিলাম। আপনি তার মাঝে কল করে বিরক্ত করছেন। “

“ আমার কলের থেকেও কি বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেলো তোমার জন্য? “

“ আপনাকে কেনো বলবো? “

“ আমি বুঝতে পারছি। বিয়ের আগে তো খুব স্বামী মেনে চলতে। বিয়ের পর আর এখন আমাকে ভাল্লাগছে না, তাই না? এক সপ্তাহেই ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালিয়ে গেলো? “

পৃথা তূর্যের কথা শুনে মুখ টিপে হাসে। অত:পর খুব ব্যস্ত আছে এমন ভঙ্গিতে বলে উঠে,

“ বিরক্ত করবেন না তো। রাখছি। “

তূর্য বেক্কলের ন্যায় ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। এটা কি হলো? অন্য সময় তো পৃথা নিজে এটা ওটার ছুঁতোয় তাকে কল দিতো একটু পর পর। আর আজ তূর্যকে পাত্তাই দিচ্ছে না?

__________

“ আরেব্বাস। ইলেকশনের আগ মুহুর্তে পার্থ মুন্তাসির বিয়ে করতে চলেছে। তা পাত্রী কে? “

রুবেলের প্রশ্ন শুনতেই সুজন হাতের একটা ছবি এগিয়ে দেয় তার দিকে। ছবির দিকে তাকিয়ে থেকেই রুবেল ভ্রু কুচকে বলে উঠে,

“ এই মেয়েকে আগেও কোথাও দেখেছি মনে হচ্ছে। “

“ হসপিটালে দেখসেন ভাই। ওই সিয়ামের ডাক্তার আসিলো উনি। “

রুবেল হেসে বলে,

“ ভালো মাল খুঁজসে তো পার্থ। রাজনীতি করতে গেলে আহত হইলেও সমস্যা নাই। বাসায় বউ সেবা যত্ন করবো। “

কথাটা বলেই রুবেল হাসতে থাকে। তখনই তার পার্টি অফিস রুমের দরজাটা সুরসুর করে খুলে গেলো। দরজা দিয়ে প্রবেশ করা মানুষটাকে দেখে রুবেল অবাক হয়। অত:পর নিজের বিস্ময় লুকিয়ে বলে,

“ আরেএ পার্থ মুন্তাসির চৌধুরী। আসেন আসেন। আপনাকে নিয়েই কথা বলছিলাম। শুনলাম নাকি বিয়ে করছেন। তা দাওয়াত দিতে আসলেন নাকি? “

পার্থ রুবেলের বরাবর টেবিলের অপর পাশে থাকা চেয়ারটায় পায়ের উপর পা তুলে বসে। মুখে তার হাসি লেপ্টে আছে। তার সাথে আসা দলের কয়েকজন ছেলেপুলে তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। পার্থ মুখের হাসি বজায় রেখে বলে,

“ নির্বাচনের প্রস্তুতি কতদূর গড়ালো? শুনলাম নাকি নিজের নামের বড় বড় ব্যানার এবং পোস্টার ছাপানোর অর্ডার দিয়েছেন। “

রুবেল নিজের হাতে থাকা তরীর ছবিটা উল্টো করে টেবিলে রাখে। এতে করে পার্থ আর সেই ছবিটা দেখতে পারে না। রুবেল বলে উঠে,

“ হঠাৎ আজ আমার খোঁজ খবর নিচ্ছেন খুব। সব ঠিকঠাক আছে তো? “

“ আপনার এতো প্রস্তুতি দেখে খারাপ লাগছে। দিনশেষে নির্বাচন প্রত্যাহার করতে হবে আপনাকে। বেশ লস হয়ে গেলো। “

রুবেল ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

“ নির্বাচন প্রত্যাহার করতে হবে মানে? “

পার্থ আসিফের হাত থেকে একটা ফোন নিয়ে তা রুবেলের দিকে এগিয়ে দেয়। রুবেল ফোনটা হাতে নিয়েই দেখে একটা ভিডিও ওপেন হয়ে আছে। রুবেলের কপালের ভাজ আরেকটু গভীর হয় যখন সে দেখতে পায় ভিডিওটিতে তার দলের সেই তিন ছেলে নিজেদের জবানবন্দী দিচ্ছে যে রুবেলের আদেশেই তারা পার্থ মুন্তাসির চৌধুরীর পার্টির ছেলে সিয়ামকে কুপিয়েছে।

রুবেল সাথে সাথে ব্যস্ত হাতে ভিডিওটা ডিলিট করে দেয়। তা দেখে পার্থ হেসে বলে,

“ রাজনীতি করেন অথচ কোনো বুদ্ধি নেই মাথায়। এই ভিডিওর আরো অনেক কপি আমার কাছে সংরক্ষিত আছে। ভাবুন নির্বাচনের আগে এমন একটা ভিডিও যদি আমি গণমাধ্যমে ছড়িয়ে দেই তাহলে আপনার ইমেজের উপর এর কেমন প্রভাব পড়বে? “

রুবেল চোয়াল শক্ত করে বলে,

“ ভুল করছো পার্থ। “

পার্থ রুবেলের হাত থেকে ফোনটা ছিনিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ায়। নিজের দু হাত পিঠের পিছে ভাজ করে সে গম্ভীর স্বরে বলে উঠে,

“ হাতে ৩ দিন সময় আছে। এর মধ্যে সিদ্ধান্ত নিন যে নির্বাচন প্রত্যাহার করবেন নাকি গণমাধ্যমে ভাইরাল হবেন। “

কথাটা বলে পার্থ উল্টো দিকে ফিরে হাঁটা ধরতেই রুবেল বলে উঠে,

“ মুরগী কিন্তু খাঁচার বাইরে গেলে শিয়ালের থাবায় পড়ার ঝুঁকি থাকে। ভাবি কিন্তু দেখতে বেশ হেব্বি। সামলে রেখেন। “

পার্থ ভয়ংকর আশ্চর্যজনক চাহনিতে পিছনে ফিরে তাকায়। রুবেল কুটিল হেসে নিজের টেবিলের উপর থাকা তরীর ছবিটা উল্টে সেটার দিকে তাকিয়ে বলে,

“ মালটা কিন্তু সেই। “

পার্থ ধীর কদমে এগিয়ে এসে টেবিলের উপর থেকে তরীর ছবিটা তুলে নিজের পকেটে গুজে নেয়। অত:পর রুবেলের দিকে তাকিয়ে বলে,

“ চোখ আর জিভের হেফাজত করে চল। নাইলে দেখার জন্য চোখ আর কমেন্টস করার জন্য জিভ খুঁজে পাবি না। “

কথাটা বলেই পার্থ বেরিয়ে যায়। রুবেলের চেহারায় আবার চিন্তার ছাপ ফুটে উঠে। রাগ সামলাতে না পেরে সে পার্থকে উদ্দেশ্য করে একটা বিশ্রী গালি দেয়।

__________

সন্ধ্যা করে তূর্য বাড়িতে ফিরতেই পৃথা মুখ ফুলিয়ে দরজা খুলে। তূর্য অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,

“ মুখ ফুলিয়ে আছো কেনো? “

পৃথা জবাব না দিয়ে ঘরের ভেতর চলে যায়। তূর্য পিছু পিছু ঘরে প্রবেশ করে দরজা লাগায়। পৃথা লিভিং রুমে সোফায় বসে ছিলো। তূর্য তার সামনের সোফায় গিয়ে বসে। আশেপাশে কাউকে দেখতে না পেয়ে বুঝে যায় তার পাপা এবং আপি এখনো বাসায় ফিরে নি। অত:পর সে আবার পৃথার দিকে তাকায়। এতক্ষণে সে লক্ষ্য করে পৃথা আজকে শাড়ি পড়েছে। তূর্য মজার ছলে বলে উঠে,

“ মন খারাপ উপলক্ষে আজ শাড়ি পড়েছো নাকি? “

পৃথার মন আরো খারাপ হয়ে যায়। সে উঠে উপরে নিজের রুমে চলে যায়। দুপুরে যেই খিচুড়ি রান্না করেছিলো সে তা জঘন্য হয়েছে একেবারে। তার উপর বাসায় অন্য কিছু রান্নাও করা নেই যে সে তূর্যকে এখন খেতে দিবে। কি বিশ্রী একটা বিষয়! নিজেকে বেশ অকর্মা মনে হচ্ছে পৃথার। তার এই অকর্মা স্বভাবের জন্য তূর্যর তাকে ভালোবাসার চান্স প্রায় নেই ই বলতে গেলে।

পৃথা মন খারাপ করে বারান্দায় গিয়ে বসে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ পর তূর্য বারান্দায় আসে। নীরবে পৃথার পাশে বসে। অত:পর বলে,

“ মন খারাপ কেন পৃথা? “

“ খিচুড়ি রান্না করেছিলাম দুপুরে। জঘন্য হয়েছে। রাতের জন্য আর কোনো রান্নাও নেই। “

তূর্য ভ্রু কুচকে বলে,

“ এইটুকু বিষয়ের জন্য মন খারাপ? “

পৃথা মাথা নত করে বলে,

“ আ’ম সরি। আমি কোনো কাজের না। “

“ তোমাকে কাজ করতে বলেছে কে? “

“ কেউ না। “

তূর্য বুঝতে পারে অষ্টাদশীর মন একটু বেশিই খারাপ আজ। একদম আজকের আবহাওয়ার মতো। তূর্য একহাত বাড়িয়ে পৃথার হাত ধরে। অত:পর বলে উঠে,

“ কেউ হান্ড্রেড পার্সেন্ট পারফেক্ট হয়না পৃথা। এজন্যই দুটো ইম্পার্ফেক্ট পার্সন বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। যেনো নিজেদের মিসিং পিস গুলো ফিলাপ করতে পারে। আমি তোমাকে রান্না শিখিয়ে দিবো। তুমি নাহয় আমাকে ভালোবাসাটা শিখিয়ে দিয়ো। “

পৃথা চোখ বড় করে তূর্যর দিকে তাকায়। তূর্য মৃদু হেসে আচমকা পৃথার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। পৃথা লজ্জায় জমে যায়। তূর্য নিচু স্বরে বলে,

“ গান জানো পৃথা? “

“ আপনি কিভাবে বুঝলেন? “

“ তোমার কণ্ঠ শুনে বুঝা যায়। গান শুনাও তো একটা। “

পৃথা লজ্জা পায়। সে টুকটাক গান জানে। কিন্তু বড় দা আর ছোট দা ছাড়া আর কারো সামনে কখনো গায় নি। তূর্য পৃথার লজ্জাটুকু বুঝতে পেরে পৃথার একহাত নিজের চোখের উপর রেখে বলে,

“ নাও চোখ বন্ধ করে রাখছি। আর লজ্জা পেতে হবে না। “

পৃথা সামান্য হেসে গান শুরু করে,

“ এসে গেছে দিন, কতনা রঙিন,
নামে তোর, এ শহর,
দেব লিখে সব আমার।
তুই এলি তাই, মন হলো ঠিক,
কাছে তোর, ঘুম ঘোর,
নেব চেয়ে যা চাওয়ার।
চেনা তোর ইশারায়
ফেলেছে কি জ্বালায়,
এসেছে এ কি ঝড় অবেলায়। “

চলবে…

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৪.

দমকা বাতাসের চোটে তরীর শাড়ির আচল এবং চুল উড়ছে। কাল বৈশাখীর আবহাওয়া। এই কাল বৈশাখী যেমন গ্রীষ্মের উগ্রতা কমিয়ে এনেছে তেমন প্রকৃতিতে এক নতুন তান্ডব শুরু করেছে। তান্ডব তো তরীর জীবনেও কম হয়নি। এই যেমন কিছুক্ষণ আগেই তার জীবন এক নতুন ঝড়ের সাথে বাঁধা পড়েছে। সেই ঝড়ের নাম পার্থ মুন্তাসির চৌধুরী।

সেই ভয়ংকর রাতে যখন পার্থ তাকে জোর করে বিয়ে করে সেদিন ওর গায়ে শোক রঙা কাপড় ছিলো, যা পরিস্থিতি অনুযায়ী একেবারে মানানসই ছিলো। কিন্তু আজ তার গায়ে কালোর বদলে লাল রঙ শোভা পাচ্ছে। এই লাল রঙ আসলে কিসের প্রতীক? ভালোবাসার নাকি ঘৃণার?

রুমে প্রবেশ করতেই পার্থ দূর হতে তরীকে বারান্দার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। আচমকাই তার মনে পড়ে যায় রুবেলের বলা সেদিনের কথাটি। মনে জায়গা না পাক, কিন্তু সকলের সামনে তিন বার কবুল বলে পার্থর জীবনে তো তরীর জায়গা হয়েছে। তা পার্থ কখনোই অস্বীকার করবে না। সেই সম্পর্কের ভিত্তি হতেই এই নারীর নিরাপত্তার দায়িত্ব এখন থেকে তার। কেউ যদি ক্ষতি করার কথা চিন্তাও করে তাহলে তাকে পিচঢালা পথে পিষে দিবে পার্থ।

তরী আচমকা ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে দরজার কাছে পার্থকে বিয়ের শেরওয়ানিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। তরী ভ্রু কুচকে সাথে সাথে বলে উঠে,

“ এই ফুল টুল দিয়ে রুম সাজানোর আইডিয়া কার ছিলো? “

পার্থ নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে আপনমনে পাঞ্জাবির উপর হতে শেরওয়ানি খুলতে খুলতে বলে উঠে,

“ আপনার দেবর, ননদের আইডিয়া। “

তরী সাথে সাথে চিল্লিয়ে উঠে,

“ এই! করছেন কি আপনি? “

পার্থ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় তরীর আচমকা চিৎকারে। অত:পর বিরক্ত মিশ্রিত সুরে বলে,

“ ছাগলের মতো চিল্লাচ্ছেন কেন? “

তরী দুই পা এগিয়ে এসে বলে,

“ শেরওয়ানি খুলছেন কেন? “

পার্থ অবাক হয়। কি অদ্ভুত প্রশ্ন! ডাক্তার সাহেবার এসব আজগুবি প্রশ্ন শুনলে মাঝে মাঝে তার মনে হয় তরী বুঝি চিটিং করে সব এক্সাম পাশ করে ডাক্তার হয়েছে। নাহয় আইকিউ লেভেল এরকম কেন হবে? পার্থ বিরক্তি নিয়েই বলে,

“ আপনি নিজের সকল গয়না খুলে আর আটা ময়দা তুলে বসে আছেন কেন? যাতে একটু আরামে ঘুমোতে পারেন। আমিও সেজন্যই শেরওয়ানি খুলছি। “

তরী নিজের দুই হাত বুকের উপর ভাজ করে বলে,

“ আমাকে আপনার বোকা মনে হয়? আমি খুব ভালো করে বুঝি আপনাদের মতো পুরুষদের ইনটেনশন কি। প্রথমে শেরওয়ানি খুলবেন, তারপর পাঞ্জাবি। আর তারপর নিজেদের জিম করা বডি দেখিয়ে মেয়ে মানুষকে সিডিউস করার ট্রাই করবেন। কিন্তু আমি এসব দ্বারা মোটেও ইম্প্রেসড হবো না। “

পার্থ তাজ্জব বনে যায়। সে তো এতো ডিপ চিন্তাভাবনা করেও নি। অথচ এই ডাক্তার একটা ছোট বিষয়ের কতো গভীরে চলে গেলো। পার্থ ফুস করে উঠে নিজের গায়ের পাঞ্জাবিটাও খুলে ফেলে। তরী সাথে সাথে রাগে লাল হয়ে যায়। কি নির্লজ্জ বেহায়া পুরুষ মানুষ! শরম হায়া নামে কোনো জিনিস এই লোকের ভেতরে নেই।

পার্থ এক পা করে তরীর দিকে এগিয়ে আসে। তরী এক বিন্দুও নড়ে না। সে হাতে শক্ত করে মুষ্টি করে রেখেছে। আজকে সে এই বেহায়া পুরুষের মুখের নকশা বদলেই ছাড়বে। পার্থ তরীর কাছাকাছি এসে দাঁড়াতেই তরী নিজের মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে ধরে আঘাত করার উদ্দেশ্য। কিন্তু সেই হাত পার্থকে ছোঁয়ার আগেই পার্থ একহাতে তা শক্ত করে ধরে ফেলে। তরী আবার আরেক হাত তুলে। এবারও পার্থ তা ধরে ফেলে। অত:পর তরীর দুই হাত কোমরের পিছনে নিয়ে শক্ত করে আটকে ধরে তার কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,

“ আপনাকে ইম্প্রেস করার আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহও নেই। উল্টো আমার তো মনে হচ্ছে আপনি আমাকে সিডিউস করার প্ল্যান করেছেন। শাড়ির আঁচল সড়ে যে আপনার কোমরের বাক দৃশ্যমান সেই খেয়াল কি আছে? “

তরী হতভম্ব হয়ে যায়। দুই হাত আবদ্ধ থাকায় পার্থকে লাথি মারার উদ্দেশ্যে ঠিক করা পা বরফের ন্যায় জমে গিয়েছে ইতিমধ্যে। এই নির্লজ্জ লোকের কথায় রাগে তার কান দিয়ে যেন গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। পার্থ তরীর হাত সামান্য আলগা করে একই সুরে আবার বলে উঠে,

“ স্টিল আই হ্যাভ কন্ট্রোল অভার মাইসেল্ফ। একইভাবে আপনিও নিজের উপর কন্ট্রোল রাখতে শিখুন তরী। “

কথাটা বলেই পার্থ তরীকে ছেড়ে পাশ কেটে চলে যেতে নেয়। যাওয়ার সময় সে আরেকটা কাজ করে। তরীর কাধে তুলে রাখা শাড়ির আচলটা ছেড়ে দেয়। সাথে সাথেই তরীর এতক্ষণের দৃশ্যমান কমোরের বাক ঢেকে যায়। তরী হতভম্ব দৃষ্টি নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকায়। পার্থ আলমারি হতে নিজের টি শার্ট এবং বিছানা হতে একটা বালিশ নিয়ে বাহিরের সোফার রুমে চলে যায়।

তরী দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে ভিতর থেকে দরজা লক করে গায়ের শাড়ি পরিবর্তন করে নেয়। আর জীবনে এই নির্লজ্জের সামনে শাড়ি পড়তে যাবে না সে।

__________

দীর্ঘ রাত। সারাদিন মানুষে গিজগিজ করা বিয়ে বাড়িটা এখন বেশ শান্ত। আকাশটা থেমে থেমেই গর্জন করে উঠছে আপন ছন্দে। যেকোনো সময়ই মেঘগুলো বৃষ্টির বিন্দু হয়ে ঝড়ে পড়তে শুরু করবে। পৃথা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বারবার ঘুরেফিরে নিজেকে দেখতে ব্যস্ত। তার বড় দা আর বড় ভাবীর বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ কয়েক ঘন্টা হয়ে গেলো। অথচ সে এখনো নিজের পরিহিত লেহেঙ্গা বদলাচ্ছে না। নিজেকে দেখতে নিজের কাছেই বেশ সুন্দর লাগছে তার। এই লেভেন্ডার রঙের লেহেঙ্গাটা তূর্য তার জন্য পছন্দ করে এনেছিলো।

তূর্য নিজেও আজকে লেভেন্ডার রঙের পাঞ্জাবি পড়েছে। সে চুপচাপ বিছানায় বসে আড়চোখে পৃথাকে দেখতে ব্যস্ত। এইযে এই অষ্টাদশী সারাদিন তার বউ রূপে তার সামনে এই রুমময় পায়চারি করে বেড়ায় বিষয়টা তূর্যর কাছে বেশ উপভোগ্য। তার অবচেতন মন ক্ষণে ক্ষণে পৃথামোহে ডুব দিয়েছে তার অজান্তেই। কিন্তু ঠিক করে রেখেছিলো সেই কথা পৃথাকে এখন জানতে দিবে না। নাহয় পড়াশোনা চাঙ্গে তুলে এই মেয়ে গভীর প্রেমে ডুব দিবে। কিন্তু তূর্যর মন এখন তাকে শাসিয়ে বলছে,

“ পড়াশোনা গাঙ্গে ভাসুক, তুই তোর মনের কথা জানিয়ে দে। নিজের বউকেই তো ভালোবেসেছিস। এটা নিয়েও এতো ভাবাভাবির কি আছে? “

তূর্য মনকে সায় দেয়। ফোন রেখে উঠে গিয়ে সে পৃথার পিছনে দাঁড়ায়। পৃথা তাকে দেখেই চোখ ছোট করে বলে,

“ আপনার ঘুম পেলে লাইট অফ করে ঘুমিয়ে পড়ুন। আমার এসব মেকাপ তুলতে টাইম লাগবে। “

তূর্য একবার বারান্দার থাই গ্লাস দিয়ে বাহিরে তাকায়। অত:পর প্রশ্ন করে,

“ ছাদে যাবে? “

পৃথা চোখ ছোট করে বলে,

“ এখন? বৃষ্টি নামবে মনে হচ্ছে। “

“ ভিজতে সমস্যা আছে? “

পৃথার ছোট ছোট চোখ মুহুর্তেই প্রফুল্ল হয়ে উঠে। সে হাসি দিয়ে বলে,

“ আপনিও কি বৃষ্টিতে ভিজতে পছন্দ করেন? ওহ মাই গড! আই মিন থ্যাংক গড! জানেন আম্মা কখনোই আমাকে পারমিশন দিতো না। “

তূর্য পৃথার হাত ধরে বলে,

“ এখন চলো। “

নিশ্চুপ অন্ধকারে তলিয়ে আছে সম্পূর্ণ ঘর। তূর্য আর পৃথা সাবধানে রুম থেকে বের হয়। ছাদের সিঁড়ি পেরিয়ে দরজা খুলে ছাদে প্রবেশ করতেই পৃথা বলে উঠে,

“ থ্যাংক গড পাপা ঘুমোচ্ছে। পাপার সামনে ধরা খেলে লজ্জায় পড়তে হতো। “

কথাটা বলতে বলতেই সিঁড়ির কাছ থেকে হুমায়ুন রশীদের গলা ভেসে আসে,

“ ছাদে কে রে? “

সাথে সাথে পৃথার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। তূর্য নিচু গলায় শিট বলে পৃথার হাত ধরে ছাদের পিছনের দিকে দৌড় লাগায়। পৃথার একহাত তূর্যর হাতের মুঠোয় ও অন্য হাত তার লেহেঙ্গা সামলাতে ব্যস্ত। ছাদের রেলিঙের কাছাকাছি যেতেই তূর্য পৃথাকে কোলে তুলে পাশের ছাদে নামিয়ে দেয়। পরপর নিজেও লাফ মেরে পাশের ছাদে নেমে আবার পৃথার হাত ধরে দৌঁড়ে সেই ছাদের একটা পিলারের আড়াল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।

এত কম সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো চোখের পলকে ঘটে যাওয়ায় পৃথার বোধগম্য হয় না। যখন বোধগম্য হয় ততক্ষণে সে তূর্যের দু হাতের সীমানার ভেতর আবদ্ধ। মাথা তুলে তাকাতেই দেখে তূর্য পিলারের আড়াল হতে উঁকি দিয়ে তাদের বাসার ছাদের দিকে দেখছে। পৃথা কিছু বলতে নিলেই তূর্য তার ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,

“ পাপা ছাদে। শব্দ করো না। “

পৃথা নিচু স্বরে প্রশ্ন করে,

“ কিন্তু আমরা এভাবে পালাচ্ছি কেন? ইলিগ্যাল কিছু করছি না তো আমরা। “

তূর্য মৃদু স্বরে হুশ বলে পৃথাকে থামিয়ে দেয়। হুমায়ুন রশীদ চলে যেতেই তূর্য পৃথার দিকে ফিরে তাকায়। সাথে সাথে বিদ্যুৎ চমকে উঠে। বিদ্যুতের আলোয় পৃথার মুখের দিকে তাকিয়েই বলে দেয়,

“ আই লাভ ইউ। “

পৃথার চঞ্চল দৃষ্টি স্থির হয়। কিন্তু আবহাওয়া আর স্থির থাকে না। ঝপঝপিয়ে বৃষ্টি নামে ধরণীর বুকে। পৃথা লজ্জায় মিইয়ে গিয়ে দৃষ্টি নত করে ফেলে। কঠোর চেতনার তূর্যর মনে আচমকা পৃথাকে ছুঁয়ে দেওয়ার বাসনা জাগে। সেই বাসনাকে সে অগ্রাহ্য করে না। নিবিড়ভাবে একহাত বাড়িয়ে সে পৃথার গালে রাখে আর অন্য হাত তার কমোরে। ধরে আসা গলায় বলে,

“ আগ্রহ নয় ভালোবাসা থেকে ছুঁইছি। “

পৃথা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে বলতে নেয়,

“ তূর্য আপনি… “

কথা শেষ করার আগেই অষ্টাদশীর ওষ্ঠ যুগল তূর্যর দখলে চলে যায়। বৃষ্টির পানিতে পৃথার ভেজা চুলগুলো তূর্যর হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে আবদ্ধ। কিছু সময়ের ব্যবধানেই তূর্য পৃথার কানের কাছে মুখ নিয়ে তাকে লজ্জা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বলে উঠে,

“ বলো তো মেয়ে, তুমি প্রেমিকা নাকি স্ত্রী? “

পৃথা জবাব দেয় না। নিজের রুদ্ধশ্বাস গুণতে ব্যস্ত সে। তার রক্তিম আবিরে রাঙা চেহারা দেখে তূর্য মৃদু হেসে আবার বলে,

“ দেনমোহর তো বিয়ের দিনই পরিশোধ করে দিয়েছিলাম। এখন কি তাহলে নিজের হক বুঝে নিবো? “

পৃথা তূর্যর বুকে দু’হাতের সাহায্যে আলতো ধাক্কা দিয়ে তাকে দূরে সরিয়ে দৌড়ে ছাদের রেলিঙের কাছে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু সাথে সাথে সে বুঝতে পারে এই ছাদের রেলিঙ একা টপকানোর সাধ্যি তার নেই। অর্থাৎ তূর্যর থেকে পালানোর কোনো রাস্তাও নেই। পৃথা ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে তাকায়। তূর্য এখনো বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি পৃথাতেই নিবদ্ধ। পৃথাকে তাকাতে দেখেই সে নিজের দু’হাত মেলে দিয়ে বলে,

“ ক্যান আই হ্যাভ ইউ ইন মাই আর্মস রাইট নাও? “

পৃথা আকুল চোখে তাকিয়ে রয়। এতোদিন তো সে এটাই চাচ্ছিলো। তূর্যকে সে পেয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু তূর্যর হৃদয় পাওয়া তার বাকি ছিলো। আজ তূর্য আর তার হৃদয় দুটোই পৃথার হয়ে গিয়েছে। তাহলে এতো সংশয় কেন?

অষ্টাদশী আর অপেক্ষা করে না। ভারী বর্ষণ চিড়ে সে দৌড়ে তূর্যর কাছে এসে এক লাফে তার গলা জড়িয়ে ধরে। তূর্যও পৃথার কোমর নিজের পেশল বাহুর বেষ্টনীতে আবদ্ধ করে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। পৃথার পা এখন আর মাটি ছুঁইছে না। পৃথাকে আগলে রেখেই তূর্য বলে উঠে,

“ ভাগ্যিস সে রাতে তুমি কল করেছিলে। “

পৃথা নিজের ছোট্ট মুখটুকু তূর্যের ঘাড়ে লুকিয়ে উত্তপ্ত নিঃশব্দ ছেড়ে বলে উঠে,

“ ভাগ্যিস সেদিন আপনি আমার ইন্টারভিউ নিতে এসেছিলেন। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]