যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-১৫+১৬

0
334

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৫.

রাতের কাল বৈশাখীর তান্ডব পেরিয়ে ঝলমলে সকালের আগমন ঘটে। তরীর ঘুম ভাঙে সকাল ৭ টার দিকে। যদিও সাধারণত সে খুব তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে। কিন্তু এই বিয়ের ধকলের কারণে আজ কিছুটা দেরি হয়ে গিয়েছে তার। তরী চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসে। চোখ মেলে ভোরের আলোয় বিভিন্ন ফুল দিয়ে সজ্জিত রুমটা দেখতেই তার মন আবার বিরক্তিতে ভরে উঠে। সে আজ পর্যন্ত এই ফুল দিয়ে বাসর ঘর সাজানোর লজিক বুঝলো না। এদের প্রয়োজনীয়তা কি আসলে? শুধু শুধু এদের অপচয় হয়। এই তুলনায় গাছেই এদের বেশি ভালো মানায়।

তরী উঠে গিয়ে নিজের লাগেজ খুলে একটা থ্রি পিস বের করে নেয়। অভ্যাসবশত সোজা ওয়াশরুমে চলে যায় শাওয়ার নেওয়ার জন্য। শাওয়ার নিয়ে ওয়াশরুমের আয়নার সামনে দাঁড়াতেই সে আয়নায় নিজের স্নিগ্ধ মুখটা দেখতে পায়। বিয়ের গেটাপে কালকে থেকে বেশ হাসফাস অনুভব করছিলো সে। ফাইনালি এখন মনে হচ্ছে সে নিজেকে ফিরে পেয়েছে।

তরী ওয়াশরুম থেকে বের হতে নিয়েও ফিরে আসে। একটা ব্রাশ হোল্ডারের একপাশে তার ব্রাশ রাখা এবং অপরপাশের সেই বড় ব্রাশটা নিশ্চয়ই নেতা সাহেবের? তরীর মাথায় একটা বুদ্ধি কাজ করে। সে দৌড়ে রুমের ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে পার্থর একটা হেয়ার ব্রাশ নিয়ে ফিরে আসে। অত:পর পার্থর টুথব্রাশ দিয়ে সেই হেয়ার ব্রাশটা ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার করে। মুহুর্তেই ফকফকা সফেদ টুথব্রাশটা একটা বিদঘুটে রঙ ধারণ করে। তরী সেটা পূর্বের জায়গায় রেখে দিয়ে পৈশাচিক হেসে বলে উঠে,

“ বেস্ট অফ লাক ফর ইউর ম্যারিড লাইফ মাই লাভ। “

__________

সকাল সকাল নাস্তার টেবিলে থমথমে মুখে বসে আছে পার্থ। কিছুক্ষণ আগে ফ্রেশ হতে গিয়ে সে একটা বিদঘুটে সিচুয়েশন ফেস করেছে। তার টুথব্রাশের কেউ ইজ্জত মেরে দিয়েছে। ঘটনাটার সাথে যে রান্নাঘরে নাস্তা বানাতে ব্যস্ত তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রী জড়িত তা নিয়ে পার্থর মনে তিল পরিমাণ সন্দেহ নেই। মহারাণী আগেই তাকে ওয়ার্নিং দিয়েছিলো যে বিয়ের পর সে পার্থর জীবন দূর্বিষহ করে তুলবে। পার্থও তা মেনে নিয়েছিলো। তাই এই নিয়ে কোনো অভিযোগ করা তাকে সাজে না। বরংচ পার্থ দেখতে চায় তরী তার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিতে কত দূর যেতে পারে।

বাড়ির বাকি সকল সদস্য ইতিমধ্যে নতুন বউর হাতে তৈরি করা নাস্তা খেয়ে যে যার কাজে বেরিয়ে পড়েছে। সকালে তরী যখন নিচে নামে তখন সে সাদিকা বেগমের সম্মুখীন হয় সর্বপ্রথম। উনি তরীর হাতে একটা নতুন জামদানি শাড়ি দিয়ে বলেছিলেন নববধূকে শাড়িতে বেশি মানায়। তরী নিজের শাশুড়ির কথা ফেলে নি। উপরে গিয়ে নিজের থ্রি পিস বদলে শাড়ি পড়ে নিয়েছে, সাথে হালকা কিছু অলংকারও।

শাড়ির আঁচল কোমরে গুজে তরী একহাতে পরোটার প্লেট নিয়ে ডাইনিং রুমে প্রবেশ করে। ডাইনিং টেবিলে পার্থর সাথে তখন আসিফ, শামীমসহ আর চার পাঁচজন ছেলে বসে ছিলো। সবাই-ই তরীকে এই রূপে দেখে বেশ অবাক। তরী হাসিমুখে সবার প্লেটে পরোটা তুলে দিয়ে নিজের হাতে রান্না করা গরুর মাংস পরিবেশন করে। আফিস শামীমের কানে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,

“ দেখসোস আমগোর ভাইয়ের জাদু? একদিনেই ভাবীরে বাঘের তে বিলাই বানায় ফেলসে। “

শামীমও কথাটা শুনে মুখ টিপে হাসে। তরী সৌজন্যমূলক হাসি হেসে পার্থর উদ্দেশ্যে বলে উঠে,

“ এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? খাওয়া শুরু করুন। আমি খুব ভালোবেসে আপনার প্রিয় গরুর মাংস রান্না করেছি এই সকাল সকাল। খেয়ে বলুন কেমন হয়েছে। “

পার্থ সন্দিহান দৃষ্টি নিয়ে তরীর দিকে তাকিয়ে আছে। তরীর এই হাসির পিছনে যে কোনো ইবলিশ মার্কা রহস্য আছে তা সে নিশ্চিত। সে একটু পরোটা ছিড়ে মাংসের ঝোলে ভিজিয়ে মুখে দেয়। অত:পর বেশ স্বাভাবিক গলায় বলে উঠে,

“ ভালো রান্না জানেন আপনি। “

তরীর হাসির রেখা কিছুটা কমে আসে। ইতিমধ্যে বাকিরাও খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু খাবার মুখে দিতেই তাদের সকলের চেহারার রঙ বদলে যায়। তা দেখে তরী আবার হেসে দিয়ে বলে উঠে,

“ আমার জানামতে আপনাদের রাজনীতির একটা অলিখিত নিয়ম আছে। নিজেদের নেতা যাই করুক না কেন, আপনারা সর্বদা সহমত ভাই, ঠিক ভাই বলে বেড়ান। একইভাবে এখন থেকে নেতার স্ত্রী যা-ই খেতে দেক না কেন, মজা হয়েছে ভাবী, সুস্বাদু হয়েছে ভাবি বলে বেড়াবেন। ওকে? “

তরীর কথা কেউ কানে তুললো কিনা বুঝা গেলো না। সবাই পানি খেতে ব্যস্ত। ঝালের চোটে তাদের চোখ দিয়ে পানি ঝরবে প্রায়। পার্থ খাবার ছেড়ে উঠে তরীর হাত ধরে রান্নাঘরে নিয়ে আসে। অত:পর শক্ত গলায় বলে উঠে,

“ ব্যক্তিগত আক্রোশ আমার উপর একশোবার মেটান আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আজকের পর থেকে আমার আশেপাশের কোনো মানুষের সাথে এধরণের বেহুদা ইয়ার্কি করলে আমার খারাপ রূপ দেখাতে বাধ্য হবো। “

তরী তাচ্ছিল্য ভরা হাসি দিয়ে বলে,

“ খারাপ রূপ নাকি আসল রূপ? “

পার্থ তরীর হাত ছেড়ে দিতেই তরী একটা বড় ফিরনির বাটি হাতে নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যায়। পার্থও তার পিছু পিছু বেরিয়ে আসে। তরী সবাইকে ফিরনি সার্ভ করতে করতে বলে উঠে,

“ এটা আপনাদের পাওনা ছিলো। সেদিন রাতের হিসাব মিটিয়ে নিলাম। এখন নিশ্চিন্তে এটা খেতে পারেন। “

ফিরনি মুখে দিতেই সকলের ঝালে জ্বলে যাওয়া জিভ স্বস্তি খুঁজে পায়। তরী আরেক বাটি ফিরনি নিয়ে পার্থর দিকে এগিয়ে ধরে। পার্থ এক মুহুর্ত তরীকে দেখে হনহনিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। তার পিছু পিছু বাকিরাও বেরিয়ে যায়।

__________

নাস্তার টেবিলে খাবারের বাটির টুনটান শব্দের পাশাপাশি আরো দুটো মানবীর ঠান্ডায় হাচ্চির শব্দ ভেসে আসছে। পৃথা নিজের লাল হয়ে থাকা চোখটা সামান্য কচলে হুমায়ুন রশীদকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

“ আরেকটা রুটি দেই পাপা? “

হুমায়ুন পরম আদর মিশিয়ে পুত্রবধূকে বলে,

“ না আম্মু। তুমি আগে তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করো। আমি ঠান্ডার এবং এলার্জির মেডিসিন দিচ্ছি সেট খেয়ে নাও। তাহলে আরাম পাবে। “

পৃথা লজ্জায় নিচের দিকে তাকিয়ে খেতে থাকে। গত রাতের এই তূর্যের সাথে এডভেঞ্চারাস বৃষ্টি বিলাস করতে গিয়েই তার এই ঠান্ডা বেঁধেছে। ঠান্ডার কবল থেকে তূর্যও রেহাই পায় নি। নিজের বউয়ের সাথে দু দন্ড ব্যক্তিগত মুহুর্ত কাটানোর খেসারত হিসেবে ক্রমাগত হাচ্ছি দিয়ে যাচ্ছে সে।

হুমায়ুন রশীদ আড়চোখে ছেলের দিকে তাকায়। অত:পর কিছুটা গলা ঝেড়ে খাবার টেবিল ছাড়ার আগে বলে উঠে,

“ এরপর থেকে রাতে ছাদে যাওয়ার আগে আবহাওয়া চেক করে যাবে। “

কথাটা শুনতেই তূর্যর খাবার গলায় আটকে যায়। পৃথাও লজ্জায় মিশে যাচ্ছে। পাপা তবে বুঝতে পেরেছিলো যে কাল রাতে ছাদে তারাই গিয়েছিলো? হুমায়ুন রশীদ ততক্ষণে নিজের রুমে চলে গিয়েছে। পৃথা একবার আড়চোখে তূর্যর দিকে তাকায়। তূর্যও ততক্ষণে নাস্তা সেরে উঠে গিয়েছে। তার অফিসের সময় হয়ে গিয়েছে। পৃথা তূর্যর পিছু পিছু দরজা পর্যন্ত এগিয়ে আসে। বের হওয়ার আগে তূর্য আচমকা পিছনে ফিরে পৃথার গালে নিবিড়ভাবে ওষ্ঠ স্পর্শ করে। আকস্মিক ঘটনায় পৃথা লজ্জা পায়। তূর্য একইভাবে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,

“ আই লাভ ইউ। “

বলে সে আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা করে না। সাথে সাথে বেরিয়ে যায়। ভালো লাগার আবেশে পরিপূর্ণ অষ্টাদশী দরজার সাথে হেলান দিয়ে তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রয়।

__________

“ রুবেল এখনো নির্বাচন প্রত্যাহার ঘোষণা করলো না কেন? “

শামীমের প্রশ্ন শুনে আসিফ বলে উঠে,

“ আজকের সারাদিন তো এখনো সময় আছে। যেকোনো সময়ই দেখবি নিউজ পাবি যে বেডায় গা ঢাকা দিসে। “

পার্থ এতক্ষণ নীরবে বসে ছিলো। তার মাথায় ঘুরছে অন্য চিন্তা। সে রফিকের উদ্দেশ্যে বলে উঠে,

“ রফিক একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে তোমার জন্য। “

“ হ্যাঁ ভাই বলেন। “

“ কাল থেকে তরী আবার হসপিটালে যাওয়া শুরু করবে। উনি যতক্ষণ হসপিটালে থাকবে উনার উপর নজর রাখবে। উনি আসা যাওয়ার সময়ও চোখ কান খোলা রাখবে। মেক শিওর শি ইজ অলরাইট। “

আসিফ অবিশ্বাসের সুরে বলে,

“ ভাই আপনে কি ওই রুবেলের থ্রেটরে সিরিয়াসলি নিয়া নিসেন? আপনার মনে হয় ওর এতো বড় কলিজা আছে? “

পার্থ শান্ত ভঙ্গিতে জবাব দেয়,

“ প্রতিপক্ষের প্রতিটা বিষয়কেই আমি সিরিয়াসলি নেই। রুবেল ইলেকশনে টিকে থাকার জন্য যে কোনো কিছু করতে পারে। তাই সব ধরনের সম্ভাবনাই আমার ভেবে রাখতে হবে। আর তাছাড়া তরীর সেফটিও আমার দায়িত্ব। “

আসিফ মুখ টিপে হেসে বলে,

“ ভাই আপনি তো ভাবীর প্রেমে পইড়া গেসেন মনে হইতেসে। “

পার্থ গরম দৃষ্টিতে তাকায় আসিফের দিকে। অত:পর বলে উঠে,

“ দায়িত্ব আর ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য আছে। আমি শুধু আমার দায়িত্ব পালন করছি। “

__________

এতো বিশাল বাড়ির মধ্যে এই মুহুর্তে সাদিকা বেগম এবং তরী ছাড়া আপাতত আর কেউ উপস্থিত নেই। আফজাল সাহেব আর পার্থ ঘন্টা খানিকের মধ্যেই ফিরে আসবে। শোভনের ফিরতেও সময় লাগবে। সন্ধ্যা বেলায় ঝড়ো হাওয়া বইছে বাহিরে। তরী নিজের রুমে বসে অলস সময় পার করছে। সাদিকা বেগম এতক্ষণ তার সাথে বসে গল্প করছিলেন। কিছুক্ষণ আগেই তিনি নামাজ পড়ার জন্য নিজের রুমে ফিরে যান।

আচমকা ফোনের রিংটোনটা বেজে উঠতেই তরী ফোনের দিকে তাকায়। হসপিটাল থেকে কল আসছে। তরীর ভ্রু কুচকে আসে। এই মুহুর্তে হসপিটাল থেকে কেনো কল আসবে? আজকে তো তার ডে অফ। তবে? ইমার্জেন্সি কোনো কেস নাকি?

তরী দেরি না করে ফোন রিসিভ করে। তার ধারণাই ঠিক হয়। কেবিন নং ৮০৬ এর পেশেন্টের আচমকা শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে। উনার সার্জারির শিডিউল আগামীকাল ছিলো। কিন্তু উনার বর্তমান অবস্থার উপর নির্ভর করে এই মুহুর্তে সার্জারি করা আবশ্যক। যেহেতু উনি তরীর পেশেন্ট সেজন্য তরীর সেখানে উপস্থিত থাকতে হবে।

ফোন রেখে তরী তাড়াহুড়ো করে নিজের গাড়ির চাবি নিয়ে নেয়। হাতে আপাতত তার সময় নেই তাই গায়ের শাড়িটাও বদলায় না সে। ব্যস্ত পায়ে নিচে নেমে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে নিলেই পিছন থেকে সাদিকা বেগমের গলা ভেসে আসে,

“ কোথায় যাচ্ছো তরী? “

“ হসপিটালে যেতে হবে আম্মা। একটা ইমার্জেন্সি কেস। চিন্তা করবেন না আমি গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি। “

সাদিকা বেগমের কপালে চিন্তার ভাজ ফুটে উঠে। তিনি কিছু বলবে তার আগেই তরী ব্যস্ত পায়ে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরিয়ে যায়। সাদিকা বেগম এতক্ষণ দো তলার সিড়ির পাটে দাঁড়িয়ে ছিলো। এখন তিনি নিচে নেমে আসে। বাহিরের দিকে তাকাতেই দেখে তুফানি তান্ডব চলছে। তার উপর তিনে সন্ধ্যার প্রহর। উনার মনে কিছু একটা কু ডাকছে। মেয়েটা এক দন্ড অপেক্ষাও করলো না। লোক মুখে শোনা কিছু কু প্রথার কথা উনার মাথায় ঘুরছে। নতুন বউদের নাকি এরকম ভর দুপুর, তিনে সন্ধ্যা এবং মাঝ রাত্রে বাহিরে যেতে নেই। এতে নাকি গায়ে খারাপ বাতাস লাগে। সাদিকা বেগম চিন্তিত সুরে বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,

“ আল্লাহ রক্ষা করো। “

চলবে…

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৬.

বৃষ্টির দিনে ঢাকা শহরের জ্যাম যেন দ্বিগুণ মাত্রায় বৃদ্ধি হয়। যেখানে সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার কথা পার্থর, সেখানে তার বাসায় পৌঁছাতে রাত ১০ টা বেজে যায়। বাড়ি ফেরার পর আব্বা আম্মা নিশ্চিত কিছু কঠিন কথা শুনাবে। আম্মা বারবার করে বলে দিয়েছিলো, বিয়ের পরে আজ প্রথমদিন সারাদিন বাসায় থাকতে। কিন্তু বললেই কি তা সম্ভব হয়? নির্বাচনের জন্য পার্থর মাথায় উপর প্রচুর কাজের বোঝা। তার উপর আব্বার ব্যবসার দিকটাও তার সামলাতে হয়। এসব নিয়েই আজ সারাদিন ব্যস্ত ছিলো সে।

পার্থ ঘরে প্রবেশ করতেই দেখে লিভিং রুমে আফজাল সাহেব ও শোভন বসে আছে। সাদিকা বেগম কলিংবেলের শব্দ শুনে ইতিমধ্যে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। আফজাল সাহেব গম্ভীর স্বরে বলে,

“ আজকের দিনটা কি বাড়িতে থাকলে খুব বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যেতো তোমার? “

পার্থ সোফায় বসে ক্লান্ত গলায় বলে,

“ আমি কতটা প্রেশারের উপর আছি তা তো আপনার অজানা নয় আব্বা। আপনার মুখে এরকম প্রশ্ন সাজে না। “

সাদিকা বেগম চিন্তিত সুরে বলে,

“ তোরা যে কি করিস! তরীটাও এখনো ফিরলো না। “

সাদিকা বেগমের কথা কর্ণগোচর হতেই পার্থর ভ্রু কুচকে আসে। সে অবাক সুরে প্রশ্ন করে,

“ তরী এখনো ফিরলো না মানে? কোথায় তরী? “

সাদিকা বেগম জবাব দেয়,

“ সন্ধ্যা করে দৌড়ে হসপিটাল গেলো। ওর নাকি জরুরি কেস ছিলো। “

শোভন পাশ থেকে বলে উঠে,

“ আমি বাসায় ফিরে আম্মার কাছ থেকে জানতে পারি যে ভাবী হসপিটালে। ভেবেছিলাম তুমি যেহেতু বাসায় নেই আর বাহিরের আবহাওয়াও ভালো নয় তাহলে আমিই গিয়ে ভাবীকে নিয়ে আসবো। কিন্তু ভাবীকে কল দিতেই ভাবী জানায় উনি অলরেডি হসপিটাল থেকে বেরিয়ে পড়েছে। বাসায় ফিরছে। “

পার্থ নিজের পকেট থেকে ফোন বের করে তরীর নাম্বার ডায়াল করতে করতে প্রশ্ন করে,

“ কখন কথা হয়েছিলো তোর তরীর সাথে? “

“ ৯ টার দিকে। “

প্রায় এক ঘন্টার উপর হয়ে গিয়েছে। হসপিটাল থেকে বাসার দূরত্ব এতো দূর নয় যে পৌঁছাতে এতো সময় লাগবে। পার্থ চিন্তিত ভঙ্গিতে লিভিং রুমে পায়চারি করতে করতে তরীর নাম্বার ডায়াল করতে থাকে। ফোন সুইচড অফ দেখাচ্ছে।

পার্থর চেহারায় চিন্তার ছাপ গভীর হয়। তাকে চিন্তিত দেখে আফজাল সাহেব প্রশ্ন করে,

“ কি হয়েছে? “

“ তরীর ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। “

সাদিকা বেগম চিন্তিত সুরে বলে,

“ দাঁড়িয়ে আছিস কেন? গিয়ে দেখ মেয়েটা কই। “

পার্থ এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে সাথে সাথে বেরিয়ে যায়। শোভনও তার পিছু পিছু নিজের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরে।

__________

হসপিটালে যাওয়ার পথে এক নীরব সুনসান জায়গায় গাড়ি ব্রেক করে থামায় পার্থ। দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে সে রাস্তার একপাশে থাকা তরীর নীল রঙা গাড়ির দিকে তাকায়। পার্থ দ্রুত গতিতে হেঁটে গাড়ির কাছে যায়। কিন্তু ভিতরে কেউ নেই। পার্থ আশেপাশে অশান্ত দৃষ্টি মেলে তাকায়। চারিদিকে কোথাও কেউ নেই। তরীর গাড়ি এখানে হলে সে কোথায়?

পার্থ নিজের ফোন বের করে আবার তরীর নাম্বার ডায়াল করে। এবারও একটি নারীকণ্ঠ তার আশায় পানি ঢেলে বলে উঠে,

“ আপনি যেই নাম্বারে ডায়াল করছেন তা এই মুহুর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। “

তখনই সরু রাস্তা ধরে আরেকটি গাড়ি এসে সেখানে থামে। শোভন তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে পার্থর দিকে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করে,

“ ভাবীর গাড়ি না এটা? ভাবী কোথায়? “

পার্থ হতাশ গলায় বলে,

“ নেই এখানে। “

এবার শোভনকেও বেশ চিন্তিত দেখালো। সে উদ্বিগ্ন গলায় বলে,

“ কোনো ছিনতাইকারীর হাতে পরে নি তো? শিট! ২৪ ঘন্টার আগে থানায় মিসিং ডায়েরিও করা যাবে না। কিন্তু তুই চিন্তা করিস না। আমি এখনই আমার লোক লাগাচ্ছি। “

পার্থ আগুন চোখে শোভনের দিকে তাকিয়ে কিড়মিড়িয়ে বলে উঠে,

“ তোর এই আইনের প্রতি আমার কোনো বিশ্বাস নেই। আমার বউকে খোঁজার জন্য আমিই যথেষ্ট। তোর দেশের আইন তো এখন ক্ষমতাশীলদের পা চাটতে ব্যস্ত। তারা সেটাই করুক। “

কথাটা বলেই পার্থ হনহনিয়ে নিজের গাড়িতে উঠে সেখান থেকে প্রস্থান করে। শোভন নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়। অত:পর কল করে একজনকে বলে তরীর গাড়ি বাসায় পৌঁছে দিতে।

__________

অন্ধকার রুমে হাত পা বাঁধা অবস্থায় ফ্লোরে বসে আছে তরী। বৃষ্টিতে ভেজা শাড়ি ইতিমধ্যে শুকিয়ে গেলেও বেশ ঠান্ডা লাগছে তার। ঘাড়ের দিকে কি দিয়ে আঘাত করা হয়েছিলো তা তার জানা নেই। কিন্তু সেখান থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত স্পষ্ট অনুভব করছে সে। যন্ত্রণায় চোখ ফেটে এক বিন্দু পানি গড়িয়ে পড়ে। তরী চোখ বুজে মনে করে তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাচক্র।

সার্জারি শেষ করে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে সে বাসায় ফিরছিলো। বাহিরে তখন তুমুল বৃষ্টি। পথিমধ্যে আচমকা একটা লোক তার গাড়ির সামনে এসে পড়ায় সে দ্রুত গাড়ির ডিরেকশন ঘুরিয়ে ব্রেক করে। গাড়ির সিট বেল্ট পরিহিত অবস্থায় থাকায় তেমন একটা ক্ষতি হয়না তরীর। সে দ্রুত ঘাড় ঘুরিয়ে রাস্তার দিকে তাকাতেই দেখতে পায় সেই লোকটা রাস্তায় উপুড় হয়ে পরে আছে। তরীর ভয় হয়। বাই এনি চান্স লোকেরা কি তার গাড়ি দ্বারা হিট হলো? সে দ্রুত বৃষ্টি মাথায় নিয়েই গাড়ি থেকে নেমে লোকটার দিকে এগিয়ে যায়। কাছাকাছি যেতেই আচমকা তার ঘাড়ে কিছু একটা দিয়ে খুব জোরে আঘাত করা হয়। সাথে সাথে সে চেতনা হারিয়ে ফেলে।

যখন জ্ঞান ফিরে তখন চোখ খুলে সে নিজেকে এই অন্ধকার বদ্ধ রুমে আবিষ্কার করে। জ্ঞান ফেরার পর সে বেশ অনেকক্ষণ চিল্লিয়েছে সাহায্যের জন্য। চিল্লাতে চিল্লাতে তার গলা দিয়ে এখন আর শব্দ বের হচ্ছে না। তার নিঃশ্বাস যেন গলার মধ্যে আটকে আছে। তার সাথে কি হচ্ছে, কেন হচ্ছে এসব কিছুই তার জানা নেই। সে শুধু এটুকু জানে যে সে এখানে মোটেও সেফ না। এরকম বিপদের একটা সময় তরীর কেবল একজনের কথাই মনে পড়ে। তার পাপা। তরী চোখ মেলে তাকায়। কম্পিত এবং ক্লান্ত চিত্ত নিয়ে মনে মনে বলে উঠে,

“ আই মিস ইউ পাপা। তোমার কাছে যতদিন ছিলাম ততদিন সেফ ছিলাম। আমাকে অন্যের হাতে তুলে দিয়েছো চব্বিশ ঘণ্টা হয় নি এখনো, অথচ দেখো আমি এখন কোন বিপদে ফেসে গেলাম। “

কথাটা বলেই সাথে সাথে তরী চিৎকার করে উঠে। তার পায়ে ছোট নরম কোনো এক জীবের লোমকূপ অনুভব করছে সে। প্রাণীটা যে ইদুর তা বুঝতে পেরেই সে ভয়ে ছোটার জন্য আবার ছটফট করতে শুরু করে। একটা প্রবাদ বাক্য আছে। “ বিপদ যখন আসে তখন সবদিক দিয়েই আসে। “ তরীর হয়েছে এখন সেরকম অবস্থা। বাকি সবকিছু সে সহ্য করে নিতে পারলেও এই ইদুর সে সহ্য করতে পারে না। দূর থেকে দেখলেও তার গা গুলিয়ে আসে। অথচ এখন ইদুর তার শরীর স্পর্শ করছে আর সে আত্মরক্ষার জন্য কিছু করতেও পারছে না। এতটা নিরুপায় অনুভব করে এবার সে না পেরে কেদে দেয়। কেউ কি তাকে সাহায্য করতে আসবে না?

__________

সাধারণত সন্ধ্যার পর রুবেল কখনো পার্টি অফিসে থাকে না। কিন্তু আজ রাত নেমে গেলেও সে নিজের পার্টি অফিসে আয়েশী ভঙ্গিতে বসে আছে। চোখে মুখে তার বেশ প্রশান্তি ভাব। তার থেকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে সুজন। সে-ও বেশ ভালো করে জানে রুবেলের মুখের এই ভাবের কারণ। কিন্তু সে এতটা শান্ত থাকতে পারছে না। পার্টি অফিসে এই মুহুর্তে রুবেল এবং সে বাদে আর কেউ উপস্থিত নেই। এই বিষয়টাই তার ভয়ের কারণ।

শান্ত পার্টি অফিসটার দরজা আচমকা এক বিকট শব্দ করে খুলে যায়। কিছু বুঝে উঠার আগেই বিধ্বস্ত অবস্থায় রুমে প্রবেশ করে পার্থ। সে নিজের হাতের রিভলবারের ট্রিগার পুল করে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় চেয়ারে বসে থাকা রুবেলের দিকে। রুবেলের মুখে হাসি ফুটে উঠে। পার্থ সোজা তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে নিজের এক পা চেয়ারের একপাশে তুলে ঠেক দেয় এবং হাতের রিভলবারটা রুবেলের গলা বরাবর ধরে বলে,

“ আমার বউ কোথায়? “

সুজন এই দৃশ্য দেখে পার্থর দিকে এগিয়ে যেতে নেয়। কিন্তু সাথে সাথে সে দেখে দরজা দিয়ে আরো দশজন প্রবেশ করছে। এরা পার্থর পার্টির লোকজন। পার্থর পার্টির সব মানুষের সাথেই পার্থর খুব ভালো সখ্যতা আছে। কিন্তু এই দশজনকে সর্বদা সব পরিস্থিতিতে পার্থর আশেপাশে দেখা যায়। আসিফ এবং শামীমও এর মধ্যে অন্যতম।

পার্থর চোখে ঠিকরে যেনো আগুন বের হচ্ছে। সে রিভলবারটা আরেকটু চেপে ধরে ক্ষুব্ধ স্বরে প্রশ্ন করে,

“ তরী কোথায়? “

রুবেল এবার শব্দ করে হাসে। মশকরার সুরে বলে উঠে,

“ এজন্যই মুরগীকে খাঁচার ভেতর বন্দী করে রাখতে হয়। মুরগী যদি খাঁচার বাহিরে যায় তবে এতে শিয়ালের কি দোষ বল? “

পার্থ এখানে মোটেও নিজের ধৈর্য্য পরীক্ষা দিতে আসে নি। সে রুবেলের চেয়ার বরাবর আঘাত করে বলে উঠে,

“ আমি শুট করার আগে একবারও চিন্তা করবো না। আমার মাথা গরম করবি না। “

রুবেল হাসতে হাসতে বলে উঠে,

“ ধ্যাৎ! সব মজা নষ্ট হয়ে গেলো। আমি আরো চাইসিলাম সারারাত পাগলা কুত্তার মতো তোকে হয়রানি করাবো। তারপর সকালে তোকে জানাবো যে তোর বউ আমার কাছে। কিন্তু তুই সকাল হওয়ার আগেই বুঝে গিয়েছিস যে এটা আমার কাজ। খুব বুদ্ধি আছে তোর। “

“ কথা ঘুরাবি না। তরী কোথায় সোজাসাপ্টা বল। “

“ আরে! কুল। ভাবীর আমি বেশ ভালো খাতিরযত্ন করছি। তা নিয়ে তুই চিন্তা করিস না। তুই আপাতত আমাদের ডিল নিয়ে ভাব। “

“ কিসের ডিল? “

“ ভাবীর মুক্তিপণের ডিল। আমি ভাবীকে ছেড়ে দিবো। বিনিময়ে তুই আমাকে কিছু দিবি না? “

পার্থ স্বভাববসত খুব শান্ত প্রকৃতির মানুষ। কিন্তু একবার সে রেগে গেলে তাকে শান্ত করাটা খুব কঠিন কাজ। এবারও তাই হলো। সে রাগে রুবেলের বুক বরাবর লাথি মেরে তাকে চেয়ার সহ ফেলে দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠে,

“ কোনো ডিল হবে না। তুই আমাকে তরীর ঠিকানা বলবি নাহয় মরবি। “

এতক্ষণ রুবেল বেশ হাসিখুশি থাকলেও এবারের আঘাতে তার রাগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। সে সোজা হয়ে উঠে এসেছে হিংস্র স্বরে বলে উঠে,

“ আওয়াজ নিচে রেখে কথা বল। ভুলে যাবি না তোর বউ আমার কাছে জিম্মি। ওর জীবন সম্পূর্ণ এখন আমার হাতে। আমি চাইলে মেরে এমনভাবে লাশ গুম করে দিতে পারবো যে কেউ ওর লাশও খুঁজে পাবে না। “

আসিফ একটা বিশ্রী গালি দিয়ে বলে উঠে,

“ তোর লাশও কেউ খুঁইজ্জা পাইবো না রুবেইল্লা। মাথা গরম করাবি না। ভাবী কই ভালোয় ভালোয় বইলা দে। “

রুবেল আসিফকে পাত্তা দেয় না। সে সোজা হয়ে আবার চেয়ারে বসে পার্থর দিকে দৃষ্টি স্থির করে বলে উঠে,

“ তুই যদি আমাকে পুলিশে দেস, তাহলে দুইদিনের মধ্যে উপরমহল থেকে আমাকে জামিনের ব্যবস্থা করে দিবে। মাঝখান দিয়ে আমাকে পুলিশে দেওয়ার অপরাধে তোর বউ মরবে। আবার তুই যদি এখন আমাকে মেরে ফেলস এতেও তোর লস। সারাজীবন খুনের অপরাধে জেলে পড়ে থাকবি। কেউ তোর জামিন করাইতে পারবে না। আবার ওদিক দিয়ে তোর বউও মরবে। এটাও ব্যাড অপশন। তোর কাছে এই মুহুর্তে শুধু একটা অপশন আছে। সেটা হলো সেই ভিডিওর যত কপি আছে আমার সামনে বসে সব ডিলিট করাবি আর তার পাশাপাশি তুই নির্বাচনও প্রত্যাহার করবি। “

রুবেলের কথা শুনে পার্থর ক্রুদ্ধ দৃষ্টি জ্বলজ্বল করে উঠে। তা দেখে রুবেল হেসে বলে,

“ পার্থ মুন্তাসির চৌধুরী। বউ নাকি ইলেকশন? কোনটার মূল্য বেশি তোর কাছে? “

পার্থ চোখ মুখ শক্ত করে রুবেলের দিকে তাকিয়ে আছে। কুদরতের এ কেমন লীলা? দু’দিন আগে সে নিরপরাধ দুজন মানুষকে নিজ স্বার্থে ব্ল্যাকমেইল করেছিলো। আজ ভাগ্য তাকে একই পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছে। এজন্যই হয়তো বলে, আল্লাহ ছাড় দেয় কিন্তু ছেড়ে দেয় না।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে