যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-২৫+২৬

0
389

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৫.

গভীর রাত। ফ্লোরে বসেই বিছানার সাথে ঠেক দিয়ে রয়েছে পার্থ। সবেমাত্র তার চোখে ঘুম নেমে এসেছে। কিন্তু সেই ঘুম দীর্ঘস্থায়ী হলো না। ফোনের রিংটোনের শব্দে পার্থ আড়মোড়া ভেঙে চোখ মেলে তাকায়। মুহুর্তেই তার টনক নড়ে উঠে। দ্রুত ফোনটা রিসিভ করে কানে দিতেই অপরপাশ থেকে আসিফ বলে উঠে,

“ সরি টু ডিস্টার্ব ইউ ভাই কিন্তু একটা খবর জানানোর ছিলো আপনারে। “

পার্থ ঘুম জড়ানো গলায় প্রশ্ন করে,

“ কাজ হয়ে গিয়েছে? “

“ হ ভাই। “

“ এখন কি করতে হবে তা নিশ্চয়ই তোকে আর বলে দিতে হবে না। কালকের মধ্যে বাকি কাজটা কম্পলিট করে ফেলবি। “

আসিফ আত্মবিশ্বাসের সহিত বলে উঠে,

“ চিন্তা করবেন না ভাই। “

কথাটুকু বলেই আসিফ নিজেই আবার বলে উঠে,

“ ভাই? হানিমুন কেমন ইঞ্জয় করতেসেন? ধানি মরিচ আই মিন ভাবি আপনার বশে আসছে? “

পার্থ তরীর দিকে তাকায়। মেয়েটা এখনো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। বিছানার সর্বত্র জুড়ে এখনো তার দখল। পার্থ বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,

“ এমন হানিমুন আমার শত্রুরও না হোক। “

__________

উষ্ণ সকালে প্রেমাময় উষ্ণ অনুভূতি চিত্ত জুড়ে লেপ্টে চোখ মেলে তাকায় পৃথা। তূর্যের মুখ জুড়ে বিচরণ করে তার দৃষ্টি। গত রাতের চিত্র চোখের সামনে ভেসে উঠতেই লজ্জায় আড়ষ্ট হয় সে। তূর্যের হাতের বন্ধন থেকে মুক্তি খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে থাকা পৃথা লক্ষ্য করে নি যে তূর্যও ইতিমধ্যে জেগে গিয়েছে। তূর্য পৃথাকে টেনে নিজের উন্মুক্ত বুকে আগলে ধরে ঘুম জড়ানো গলায় বলে,

“ আরেকটু থাকো। “

পৃথা প্রতিবাদ করে না। চুপচাপ তূর্যের বুকের সাথে লেপ্টে রয়। কিছু মুহুর্ত গড়াতেই সে অনুভব করে তূর্যের হাত তার গায়ে থাকা টি শার্ট ভেদ করে অভ্যন্তরে বিচরণ করছে। শরৎতের শান্ত প্রকৃতির ন্যায় শান্ত হয়ে যায় পৃথা। তূর্য আবেশী ভঙ্গিতে পৃথার ওষ্ঠে ঠোঁট ছোঁয়ায়। সময় পার হয় অনেকক্ষণ। তূর্য নরম গলায় বলে,

“ মিস এবিসি। অফিসে যাওয়ার আগে একটা মেডিসিন এনে দিয়ে যাবো। খেয়ে নিও। “

পৃথা প্রশ্ন করে,

“ কিসের মেডিসিন? “

“ শরীর ব্যথা করছে না? “

“ হু। “

“ সেটার জন্যই। “

তূর্য আসলেই অফিসে যাওয়ার আগে একটা মেডিসিন এনে দিয়ে যায় পৃথাকে। বলে দেয় যেন নাস্তা করে এটা খেয়ে নেয়। নাস্তা শেষ করে পৃথা মেডিসিনের নাম লক্ষ্য করে একটু অবাক হয়। এই নামের পেইনকিলার মেডিসিন সে আগে কখনো দেখে নি। তাই আগ্রহ বসত মেডিসিনের নাম লিখে ফোনে সার্চ করে। সাথে সাথেই সে অবাক হয়। অপেক্ষা না করে মেডিসিনটা লুকিয়ে ফেলে দেয়।

__________

সকালের নাস্তা সেড়ে হোটেলের রুফটপে চলে যায় পার্থ এবং তরী। রুফটপের একপাশ জুড়ে রয়েছে বিশাল প্রাইভেট সুইমিং পুল। তার বিপরীতেই রয়েছে একটা জুস বার এরিয়া। তরী সুইমিং পুলের পাশে একটি ডেক চেয়ারে ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে। না চাইতেও তার দৃষ্টি ঘুরে ফিরে পুলে অর্ধ উদোম দেহে সাতার কাটা পার্থর দিকে চলে যাচ্ছে। কি এক মুসিবত! তার গায়েও কি পার্থর বেহায়া হাওয়া লেগেছে নাকি? নাহয় এমন বেহায়ার মতো ঘুরে ফিরে এই নির্লজ্জ লোকের দিকেই কেন তার বারবার তাকাতে হবে?

পার্থ অবশ্য এসব কিছু লক্ষ্য করছে না। সে আপন মনে সুইমিং করতে ব্যস্ত। তরী নিজের মনযোগ অন্যদিকে সরাতে ঘুরে বার এরিয়ার দিকে মুখ করে বসে। সাথে সাথে সে দেখতে পায় বারের সামনে দুজন মেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পার্থকে অবজারভ করছে। সাথে সাথে তরীর ভ্রু জোড়া কুচকে আসে। মেয়েগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে সদ্য কুড়িতে পা দিয়েছে। আর এখনই এমন বুড়িদের মতো আচরণ?

তরী বিরক্তিকর দৃষ্টি নিয়ে মেয়ে দুটোকে দেখতে থাকে। মেয়ে দুটো পার্থকে দেখে নিজেদের মধ্যে কিছু আলোচনা করছে এবং মিটিমিটি হাসছে। তরীর ধৈর্য্যের সীমা ভাঙে। সে হাসি হাসি মুখে কিন্তু কঠিন স্বরে মেয়েগুলোকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

“ আরে এতো দূরে দাঁড়িয়ে আছো কেন তোমরা? কাছে এসে বসে দেখো। এখান থেকে আরো ভালো ভিউ পাবে। “

মেয়েগুলো সাথে সাথে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। পার্থর কানেও কথাগুলো পৌঁছায়। সে সাবধানে পুল ছেড়ে উঠে আসে। তরীর পাশের ডেক সিট হতে একটা টাওয়াল তুলে নিজের ভেজা চুলগুলো মুছতে মুছতে ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বলে,

“ আপনি কি কোথাও থেকে পোড়া গন্ধ পাচ্ছেন তরী? আমার নাকে পোড়া গন্ধ লাগছে। “

পার্থর মশকরা তরীর পছন্দ হয় না। সে ঝাঁঝালো স্বরে বলে,

“ ওহ! হাঁটুর বয়সী মেয়েদের আর কি দোষ! মিষ্টি যদি নিজেই খোলা থাকে মাছি তো চারিদিকে ভনভন করবেই। বিবাহিত হয়েও ব্যাচেলর সেজে ঘুরে বেড়ান বুঝি সেই মৌমাছি রূপী মাছিদের সংস্পর্শ পেতেই? “

পার্থ এবার চুল মুছা বাদ দিয়ে ধীর পায়ে তরীর দিকে আগায়। তরীর সামনে দাঁড়িয়ে তার দিকে ঝুকে আসে। তরী সাথে সাথে পিছিয়ে যায়। এক পর্যায়ে তার পিঠ গিয়ে ঠেকে ডেকের হেলান দেওয়ার অংশের সাথে। আর পেছানোর সুযোগ নেই। মনে মনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেও চোখে তা প্রকাশ করে না তরী। অনড় রয়। পার্থ তরীর দিকে ঝুকে একহাত তার পাশ দিয়ে নিয়ে পিছনে ঠেক দেয়। তরী কিছু বলার আগেই নিজের মাথা সামান্য ঝাকায়। মুহুর্তেই তার চুল হতে জল ছিটকে তরীর শুষ্ক মুখশ্রী আদ্র রূপ ধারণ করে। পার্থ সেই অবস্থাতেই গলার স্বর নিচে নামিয়ে বলে উঠে,

“ বিবাহিত পুরুষকে ব্যাচেলর থাকার সুযোগ আপনি নিজেই দিচ্ছেন তরী। আপনি মৌমাছি হয়ে যান। আর কোনো মাছি মিষ্টির আশেপাশে ঘেঁষতে পারবে না। “

কথাটুকু বলেই পার্থ নিজের হাতের টাওয়ালটা তরীর কোলে রেখে চেঞ্জিং রুমে চলে যায়। তরী হতবিহ্বলের ন্যায় সেখানেই বসে রয়। অত:পর স্তম্ভিত ফিরে পেতেই বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,

“ নির্লজ্জ লোক! “

সেই মুহুর্তে মেয়ে দুটি তরীর পাশ দিয়ে যেতে যেতে বলে উঠে,

“ আংকেল ইজ সো ড্যাম হট আন্টি। “

তরী অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে মেয়ে দুটোর দিকে তাকাতেই তারা চোখ মেরে হাসতে হাসতে চলে যায়। তরী রাগ মিশ্রিত সুরে বলে উঠে,

“ ম্যানারলেস মেয়ে কোথাকার। আমাকে দেখে কোন এংগেলে আন্টি মনে হয়? নিজে আন্টি, নিজেদের চৌদ্দ গুষ্টি আন্টি। মিষ্টি প্রেমী মাছির দল যত্তসব। “

__________

রুবেলের মুড ইদানিং খুব ভালো আছে। তার সবথেকে বড় পথের কাঁটাকে সরিয়ে বেশ নিশ্চিন্তে ইলেকশনের প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। আর একমাসেরও কম সময় বাকি। আগামীকাল তার একটা সমাবেশও রয়েছে। সেই সমাবেশকে ঘিরে চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি। সমাবেশের প্যান্ডেল টাঙানোসহ বাকি সকল কাজ শেষ বারের মতো দেখতে এসেছে সে। বেশ ফুরফুরে মেজাজে চারিদিক ঘুরে ঘুরে দেখছে সে। তখনই সেখানে বেশ কিছু বাইক শব্দ তুলে এসে থামে। বাইক থেকে নেমে আসে পার্থর দলের লোকজন। তাদের দেখেই রুবেল ভ্রু কুচকায়। এরা এখানে কেন এসেছে?

তারা কাছাকাছি এগিয়ে আসতেই রুবেল প্রশ্ন করে,

“ এইখানে কি চাই? “

আসিফ উৎফুল্ল মুখে বলে উঠে,

“ হুদাই এতো খরচ কইরা এসব সমাবেশ করতেসেন। দিনশেষে জিতবো তো আমগোর পার্থ ভাই-ই। “

রুবেলের কুচকানো কপালের ভাজ গভীর হয়। অত:পর ঠাট্টার স্বরে বলে উঠে,

“ পার্থ যে নির্বাচন প্রত্যাহার করসে তা কি ভুইলা গেসো নাকি? “

আসিফ হাসে। হাসতে শুরু করে দলের বাকিরাও। হাসতে হাসতে আসিফ বলে,

“ আরে আহাম্মক! ভাইয়ে কি এতো পাগল যে কইবেন আর নির্বাচন প্রত্যাহার কইরা দিবো? মানে তখন ভাইয়ের কাছে নির্বাচন প্রত্যাহার করার কারণ ছিলো। তাই সাময়িকের জন্য নির্বাচন রাইখ্যা আগে ভাবীরে বাঁচায় নিসে। এখন আর ভাইয়ের হাত পা বাঁধা নাই। পার্টির বড় বড় মন্ত্রীরা আইসা ভাইয়ের হাতে পায়ে ধরসে। আমগোর ভাই হইসে উদার মনের মানুষ। কাউরে প্রত্যাখ্যান করে নাই। “

রুবেলের মেজাজ তুঙ্গে পৌঁছে যায়। পার্থ মুন্তাসির চৌধুরী এভাবে পল্টি মারলো? আসিফ আবারও বলে উঠে,

“ খেলা হইবো এবার মুখোমুখি। যদি বাপের বেটা হইয়া থাকোস তাইলে সামনাসামনি লড়াই করতে নাম। আর ভুলেও যদি ভাবীরে ইউজ কইরা ভাইয়ের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার পরিকল্পনা কইরা থাকোস তাইলে হেই চিন্তা বাদ দে। একবার যেই ভুল কইরা পাড় পাইসোস দ্বিতীয়বার হেই সুযোগ পাবি না। “

কথাটা বলেই আসিফ ও তার সাথের সাঙ্গপাঙ্গরা যেভাবে এসেছিলো সেভাবেই প্রস্থান করে। রুবেল স্ব শব্দে চেচিয়ে সুজনকে ডাকে। সুজন দূরে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ চেয়ারের সেটাপ দেখতে ব্যস্ত ছিলো। পার্থর দলের লোকদের আসতে দেখেও এগোনোর সাহস পায় নি সে। দূর হতে তাদের কোনো কথাও শুনে নি। কিন্তু এখন রুবেলের ডাক শুনে সে তড়িঘড়ি করে এগিয়ে যায়। রুবেল রাগান্বিত স্বরে প্রশ্ন করে,

“ পার্থ মুন্তাসির চৌধুরী এই মুহুর্তে কোথায়? “

সুজন বোকার ন্যায় জবাব দেয়,

“ উনি তো আর নির্বাচন করবো না ভাই। উনার খবর রাইখা কি আর লাভ আছে? “

সাথে সাথে সুজনের গালে একটা কষে থাপ্পড় পড়ে। সুজন গালে হাত দিয়ে হতভম্ব ভঙ্গিতে তাকায়। রুবেল বিক্ষিপ্ত গলায় বলে উঠে,

“ শু*রের বাচ্চা! পার্থ মুন্তাসির চৌধুরী নির্বাচন করবো। শালায় আমারে বলদ বানাইসে নিজের বউরে বাঁচানোর জন্য। তোরা কোনো খবর রাইখিস না। বইসা বইসা আঙুল চুষতে থাক। “

বলেই রুবেল সেখান থেকে প্রস্থান করে। সুজন অপমানে থমথমে মুখ নিয়ে চারিদিকে চোখ বুলায়। সবাই তার দিকে কেমন করে তাকিয়ে আছে। সুজনের মনে এই অপমান গভীর ভাবে দাগ কাটে।

__________

সারাদিন আজকে হোটেল রুমেই বসে কাটিয়ে দিয়েছে তরী। সমুদ্রের কাছে এসেও সমুদ্র তাকে টানছে না মোটেও। অবশ্য তার বিবাহিত ব্যাচেলর হাজবেন্ড ঠিকই আপন ফূর্তিতে মেতে আছে। সেই যে দুপুরের লাঞ্চ করে বেরিয়েছে এখনো ফেরার নাম গন্ধ নেই। একবারও কল করে তরীর খোঁজও নিলো না। ইরিসপন্সিবেল একটা! তরী মুখ কালো করে বসে থাকে। ওই নির্লজ্জ লোক নিশ্চয়ই বাহিরে গিয়ে হাটুর বয়সী মেয়েদের নিজের চার্মনেস দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। তরীর ভাবনার মধ্যেই পার্থ রুমে প্রবেশ করে। পার্থকে এক পলক দেখেই তরী গটগট পায়ে বিছানা ছেড়ে নেমে যায়। এইখানে আর এক মুহুর্ত থাকবে না সে। তাই বারান্দায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। পার্থ পিছন থেকে প্রশ্ন করে,

“ কোথায় যাচ্ছেন? “

“ জাহান্নামে। “

পার্থ কৌতূহলি চোখে আশেপাশে তাকিয়ে বলে উঠে,

“ এখানে আশেপাশেই আছে নাকি জাহান্নাম? “

পার্থর এহেন মশকরা তরীর পছন্দ হয় না। সে বারান্দায় গিয়ে পা তুলে একটা আরামকেদারায় বসে রয়। আজকে আবহাওয়া পরিষ্কার হলেও ঠান্ডার আমেজ রয়েছে বেশ। রাগ দেখিয়ে বারান্দায় এসে তো পড়েছে তরী। কিন্তু এখন নিজেই ঠান্ডায় কাপছে। গায়ে থাকা পাতলা শাড়িতে উষ্ণতা মিলছে না মোটেও। তখনই পার্থ ফোন হাতে বারান্দায় প্রবেশ করে। তরী পার্থকে দেখেও না দেখার ভান করে। পার্থ তার সামনে ফোনটা এগিয়ে ধরতেই তরী ভ্রু উঁচিয়ে তাকায়। পার্থ শান্ত গলায় বলে,

“ দেখুন। “

তরী পার্থর ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকায়। ফোনের স্ক্রিনে থাকা অফিশিয়াল লেটারটা দেখে অবিশ্বাস্য দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে কতক্ষণ। অত:পর পার্থর দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাতেই পার্থ বলে উঠে,

“ ডক্টর রায়হান নামক আপনার প্রফেশনাল লাইফের কোনো এক শত্রু নিজের আক্রোশ মেটাতে আপনার ক্যারিয়ার শেষ করতে চেয়েছিলো। সেজন্য সে আপনার কফিতে সেদিন ড্রাগস মিলিয়ে দিয়েছিলো। সেটার ফলেই সেদিন আপনার পেশেন্টের জীবন এবং আপনার চাকরি দুটোই হারাতে হয়েছিলো। মৃত মানুষকে জীবিত করার ক্ষমতা আমার কাছে নেই। নাহয় সেই নিষ্পাপ বাচ্চার প্রাণটাও ফিরিয়ে দিতাম। “

তরীর চোখ ছলছল করছে। সে আবার ফোনের স্ক্রিনে নিজের মেডিক্যাল লাইসেন্স রিস্টোরের লেটারটা দেখে নেয়। অত:পর প্রশ্ন করে,

“ আপনি এসব কিভাবে বের করলেন? “

পার্থ গা ছাড়া ভাবে বলে উঠে,

“ আমি কে ভুলে যাচ্ছেন ম্যাডাম? কাল রাতেই রায়হানকে জেলে নেওয়া হয়েছে। তার স্টেটম্যান্টও আপনার হসপিটাল অথরিটি পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সব সাক্ষ্য প্রমাণের সহিত আপনি নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন। “

পার্থ তরীর থেকে মোটেও থ্যাঙ্কিউ বাক্য শোনার আশা রাখে না। তাই সে নীরবে বারান্দা থেকে প্রস্থান করতে চায়। কিন্তু তা আর হয় না। তরী উৎফুল্ল গলায় পিছু ডাকে,

“ পার্থ? “

পার্থ অবাক দৃষ্টিতে ফিরে তাকায়। কিন্তু কিছু বুঝে উঠার আগেই আরেক দফায় অবাক হয় সে। তরী দৌড়ে এসে তার বুকে হামলে পড়ে। আচমকা এই আলিঙ্গনে পার্থ ব্যালেন্স হারায়। দু তিন পা পিছিয়ে গিয়ে বেলকনির রেলিঙে নিজের একহাত দিয়ে ব্যালেন্স সামলায়। আরেক হাতে আগলে ধরে তরীর উন্মুক্ত কমোর। তরী একইভাবে উৎফুল্ল গলায় বলে উঠে,

“ এই তিনদিন জল ছাড়া মাছের ন্যায় তড়পাচ্ছিলাম। আমাকে সমুদ্রে এনে ছাড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। “

পার্থ বুঝে অতি খুশিতে এই মুহুর্তে তরীর বিবেক শাট ডাউন হয়ে আবেগ টার্ন অন হয়েছে। তাইতো এভাবে তাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। পার্থ এবার কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলে উঠে,

“ ভদ্র সমাজের কাছে আমি বেশ ভদ্র পুরুষ মানুষ হলেও নিজের বিবাহিত স্ত্রীর কাছে আমি নির্লজ্জ ট্যাগ পাওয়া মানুষ। তো এই নির্লজ্জ ট্যাগ পাওয়া মানুষের সংস্পর্শে এসে কি আপনার ভয় করছে না তরী? “

মুহুর্তেই তরীর আবেগ শাট ডাউন হয়ে তার বিবেক টার্ন অন হয়। এক ঝটকায় সে পার্থর থেকে দূরে সড়ে দাঁড়ায়। তরীর সড়ে যাওয়া দেখে পার্থ নিঃশব্দে হাসে। তরী সরু চোখে সেই দৃশ্য দেখে। সবসময় পাঞ্জাবি গায়ে লেগে ঘুরে বেড়ানো পার্থ মুন্তাসির রূপ বদলেছে। আজ সে এক সাদা প্যান্টের সাথে হালকা আকাশি রঙের শার্ট পড়ে আছে।

পার্থ হাসতে হাসতেই বলে উঠে,

“ গান শুনবেন তরী? “

তরীর সরু চোখ আরো ছোট হয়ে আসে। কিন্তু সে মানা করে না। ধন্যবাদ সরূপ লোকটার এই ছোট আবদার মানাই যায়। তাই মৃদু মাথা নেড়ে সে সম্মতি জানায়। পার্থ একইভাবে রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায়ই তরীর দিকে গভীর দৃষ্টি তাক করে গেয়ে উঠে,

“ তালাব হে তু, তু হে নাশা
গুলাম হে দিল ইয়ে তেরা
খুলকে যারা জি লু তুঝে
আ যা মেরি সাসো মে আ।
মারিজে ইষ্ক হু মে কার দে দাওয়া,
হাত রাখ দে তু দিল পে যারা। “

এতটুকু গান শুনে তরী পার্থর দৃষ্টি উপেক্ষা করে অভ্যাসবশত মৃদু হেসে বলে উঠে,

“ নির্লজ্জ। “

তরী অপরপাশের রেলিঙের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে হাসছিলো। আচমকা নিজের সামনে কারো অস্তিত্ব টের পেতেই তার মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। সামনে তাকিয়ে দেখে পার্থ তার দু’পাশ হয়ে রেলিঙে হাত রেখে তার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে আছে। গভীর দৃষ্টি তরীর চোখের দিকে নিবদ্ধ। আচমকা শীতল হাওয়া এসে ছুঁয়ে দেয় তরীর সম্পূর্ণ চিত্ত। সেই সাথে পার্থর শীতল গলা গেয়ে উঠে,

“ তুঝে মেরে রাব নে মিলায়া
মেনে তুঝে আপনা বানায়া
আব না বিছাড়না খুদায়া।
মোহাব্বাত রুহ কি হে লাজিম রিজা
হাত রাখ দে তু দিল পে যারা
হো ও হাত রাখ দে তু দিল পে যারা। “

চলবে…

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৬.

গভীর রাত। পার্থ বেশ অনেকক্ষণ আগেই বিছানার এককোণে স্থির মূর্তির ন্যায় ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু ঘুম নেই তরীর চোখে। রাতে বারান্দায় ঘটে যাওয়া দৃশ্যটা তার মস্তিষ্ক থেকে দূর হচ্ছে না। না দূর হচ্ছে পার্থর সেই গভীর দৃষ্টি। কি সত্যি কি মিথ্যা সেই দ্বন্দ্বে তার মন পিষে যাচ্ছে। তরী তো মানুষ চিনতে ভুল করে না। তবে পার্থকে নিয়ে তার মন এবং মস্তিষ্কের রায় ভিন্ন কেন?

যেহেতু সারাজীবন একসাথে থাকার ডিসিশন সে নিয়েই ফেলেছে তাই পার্থর ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তরীর পার্থকে জানতে হবে। এক মুহুর্তের জন্য নিজের চোখে দেখা সত্যিকে ভুলে গিয়ে আসল সত্যি জানতে হবে। তরী বিছানা ছেড়ে নেমে সাবধানে পার্থর ফোন নিয়ে বারান্দায় চলে আসে। ভাগ্য ভালো থাকায় তরী কক্সবাজার আসার পথে পার্থর ফোনের লক প্যাটার্ন একবার দেখেছিলো। সেই প্যাটার্ন বসাতেই ফোন আনলক হয়ে যায়। তরী সাথে সাথে ফোনের কনট্যাক্ট লিস্টে চলে যায়। সামান্য নিচে স্ক্রল করতেই দেখতে পায় আসিফের নাম। এই ছেলেটা পার্থর বেশ কাছের এবং বিশ্বস্ত। তরী আসিফের নাম্বার নিজের ফোনে তুলে নিয়ে ডায়াল করে।

রাত বিরাতে হঠাৎ কল আসায় আসিফের ঘুমের বেঘাত ঘটে। সে বেশ বিরক্তিকর ভঙ্গিতে ঘুমের মাঝে ফোন হাতড়ে রিসিভ করে বলে উঠে,

“ কে? “

তরী বিরক্ত হয়। না সালাম না কিছু ডিরেক্ট এভাবে কে বলাটা তার পছন্দ হয় না। তবুও নিজ থেকে সালাম দিয়ে বলে উঠে,

“ আমি তোমার ভাবী। “

“ এই মিয়া! রাত বিরাতে মশকরা করেন? আমার বাপ মা’র একমাত্র পোলা আমি। দূর দূর পর্যন্ত আমার চাচাতো, মামাতো, খালাতো, ফুফাতো কোনো ভাই নাই। তাইলে আপনে আমার ভাবী কেমনে হোন? “

“ রাজনীতিগত ভাই তো আছে তোমার। সেই ভাইয়ের বউ আমি। মিসেস পার্থ মুন্তাসির চৌধুরী। যার বিয়েতে তুমি গান ছেড়ে উড়াধুরা নেচেছিলে। “

সাথে সাথে আসিফের টনক নড়ে উঠে। সে এক লাফে উঠে বসে বলে উঠে,

“ আরেএ ভাবী? তরী ভাবী? আপনে? এই রাইতে কইরা ফোন দিসেন সব ঠিক আছে? ভাইয়ের কিছু হইসে? “

আসিফের পার্থর প্রতি এই চিন্তা দেখে তরীর অজানা কারণে সামান্য ভালো লাগে। অত:পর বেশ সিরিয়াস গলায় বলে উঠে,

“ সব ঠিক আছে। আমার তোমার কাছে কিছু প্রশ্ন ছিলো। আশা করছি সেগুলোর সঠিক উত্তর দিবে তুমি। “

আসিফ ভাবুক হয়। ভাবীর তার কাছের কি প্রশ্ন থাকতে পারে? তবুও সে বলে উঠে,

“ অবশ্যই ভাবী। “

“ যেদিন রাতে তোমার ভাই আমাকে জোর করে আটকে রেখে বিয়ে করেছিলো সেদিন ওখানে তিনটা ছেলে উপস্থিত ছিলো। সেই ছেলেগুলো কে এবং তাদের কেনো ওভাবে মারা হচ্ছিলো? “

আসিফ অবাক হয়। এতদিন পর এই প্রশ্ন করার মানে কি? কিন্তু ভাবীর থেকে এটা লুকানোর মতোও কিছু না। তাই বলে,

“ আপনার একজন পেশেন্ট ছিলো না? সিয়াম? ওকে ওরা তিনজন মিলে কোপায়সিলো। আর এইসব হইসিলো ভাইয়ের প্রতিপক্ষ রুবেলের আদেশে। কিন্তু এইখানে একটা সমস্যা হয়। সেটা হইসে রুবেল আদেশ দিসিলো আমারে কুপানোর জন্য। কিন্তু ভুল কইরা ওরা আমার জায়গায় এই নিষ্পাপ পোলাডারে কোপায়। “

“ তোমাকে কেন মারাতে চাইছিলো? “

“ কারণ সামনে ইলেকশন। আর আমি ভাইয়ের ডানহাত। আমারে মাইরা ভাইরে দূর্বল কইরা দিতে চাইসিলো। “

“ এরকম হলে তোমরা ওদের পুলিশের হাতে তুলে দেও নি কেনো? নিজেরা কেনো ক্রাইমে জড়ালে? “

আসিফ হাসে এই মুহুর্তে। হাসতে হাসতে বলে,

“ রাজনীতির বর্তমান সিচুয়েশন কেবল যারা রাজনীতিতে জড়িত তারাই ভালো জানে ভাবী। আমি বুঝতে পারসি যে আপনি রাজনীতি মানেই গুন্ডা, মাফিয়া মনে করেন। কিন্তু এইডা আপনার ভুল ধারণা। একটা পয়সার যেমন দুইটা পিঠ থাকে তেমন রাজনীতিতেও ভালো খারাপ দুই দিকই আছে। বর্তমানে ক্ষমতাসীনরা তাদের ক্ষমতার দাপটে হাজারটা অন্যায় করে যাইতেসে। তাদের ধইরা বাইন্ধা রাখার কারো সাধ্য নাই। প্রশাসনের আশায় বইস্যা থাকলে ওগোরে শিক্ষা দেওয়া যাইতো না। তাই ভাই নিজেই ওগোরে তুইল্যা আনসিলো শিক্ষা দেওয়ার জন্য। “

কথাটুকু বলে আসিফ থামে। এক দন্ড দম নিয়ে আবার বলে উঠে,

“ রাজনীতির মতো ভাইয়েরও দুইটা রূপ আছে ভাবী। কপালবশত আপনে ভাইয়ের সেই রূপটা আগে দেইখ্যা ফেলসেন যেইটা আপনার দেখা উচিত হয় নাই। কিন্তু ভাইয়ের আরেকটাও রূপ আছে। হেই রূপটা দেখার আর বুঝার চেষ্টা করেন। উনার বিপক্ষে না গিয়া এই কঠিন পরিস্থিতিতে উনার পাশে থাকেন। বিশ্বাস রাখেন ঠকবেন না। “

কথাটুকু বলেই আসিফ ফোন রেখে দেয়। আসিফের কথাগুলো তরীকে ভাবায়।

__________

এক সপ্তাহের জন্য চট্টগ্রাম এসেছে তরী এবং পার্থ। প্রথম দু’দিন তরী হোটেল রুমে বসেই কাটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু নিজের লাইসেন্স রিস্টোরের লেটার দেখার পর থেকে তার মন বেশ ফুরফুরে। এখন আর তার মন খারাপ করে থাকার কোনো কারণ নেই। তাই পরের দিন সে বেশ খুশি মনেই কক্সবাজারে ঘুরে বেড়িয়েছে। আজ তারা এসেছে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপ বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে বঙ্গপোসাগরের উত্তর পূর্বাংশে অবস্থিত একটি ছোট্ট প্রবাল দ্বীপ। কক্সবাজার জেলার টেকনাফ হতে প্রায় ৯ কি.মি দক্ষিণে এবং মায়ানমারের উপকূল হতে ৮ কি.মি পশ্চিমে নাফ নদীর মোহনায় অবস্থিত।

আফজাল সাহেব বেশ পাগলাটে ধরনের মানুষ। উনি সেইন্ট মার্টিনে রিসোর্টের বদলে এক সম্পূর্ণ বাংলো বুক করেছেন পার্থ আর তরীর জন্য। দোতলার এই বাংলো বাড়িটি দেখভালের জন্য দুজন কেয়ারটেকার রয়েছে। পার্থ এবং তরীর হাতে তারা বাড়ির চাবি বুঝিয়ে দিয়ে আউট হাউসে চলে যায়। বাড়িরটার নিচতলায় লিভিং রুম, ডাইনিং রুম, কিচেন এবং আরো দুটো রুম রয়েছে। দ্বিতীয় তলায় রয়েছে মোট চারটি রুম। সেই চারটি রুমের একটিতে উঠেছে তরী এবং তার বিপরীতে থাকা অন্য রুমে উঠেছে পার্থ।

বাংলোতে পৌঁছেই দুজনে পুরো দুপুর পাড় করে ঘুমিয়ে। বিকেলের দিকে দুজন হালকা খাওয়া দাওয়া করে বেরিয়ে পড়ে বিচে ঘুরতে। পুরো বিকেল হতে সন্ধ্যা বিচেই ঘুরে বেড়ায় তারা। হাঁটতে হাঁটতে বাংলো হতে বেশ দূরে চলে এসেছে ইতিমধ্যে। সমুদ্রের উত্তাল গর্জন আর শীতল বাতাস তরীর হৃদয় শিহরিত করে। চারপাশে সমুদ্র এবং মাথার উপর একরাশ নক্ষত্রপুঞ্জ যেন স্বর্গীয় সুখের এক নিয়ামক। তরীর ভাবনার মাঝেই পার্থ আচমকা ডেকে উঠে,

“ তরী ক্যাচ। “

আচমকা ডাকে তরী তাকাতেই দেখে পার্থ তার দিকে কিছু একটা ছুড়ে মেরেছে। সে সঙ্গে সঙ্গেই হাত বাড়িয়ে তা ক্যাচ ধরে নেয়। তরী নিজের হাতের মুঠো খুলে তাকাতেই দেখে ছোট একটা ঝিনুক। সাথে সাথেই পার্থ আবার ডেকে তার দিকে আরেকটা ঝিনুক ছুড়ে মারে। এবারও তরী সেটা একইভাবে ধরে ফেলে। অত:পর ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

“ আমাকে এগুলো ছুড়ে মারছেন কেন? “

“ সমুদ্রে আসবেন অথচ সমুদ্রের স্মৃতিচিহ্ন কুড়িয়ে নিবেন না। তা হয় নাকি? “

তরী হাসে মৃদু। সে হাতের ঝিনুকগুলো দেখতে দেখতে পার্থর পিছু পিছু হাঁটতে থাকে। কক্সবাজারের তুলনায় সেন্ট মার্টিন বেশ নির্জন। এই নির্জনতা যেন এখানকার সৌন্দর্য আরো কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আচমকা নির্জনতা ছাপিয়ে পার্থ বলে উঠে,

“ শিট। বৃষ্টি নামবে নাকি? “

তরী পার্থর কথা শুনে অবাক হয়ে আকাশ পানে তাকায়। চাঁদ এবং নক্ষত্রপুঞ্জিরা ইতিমধ্যে মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে। শীতল হাওয়াও হঠাৎ দমকা হাওয়ার রূপ ধারণ করেছে। তরী আশেপাশে তাকিয়ে দেখে দূরে নারিকেল গাছের সারি ব্যতীত আর কোনো জায়গা নেই আশ্রয় নেওয়ার জন্য। কিন্তু সেটাও সেফ নয়। তার ভাবনার মাঝেই পার্থ তার হাত ধরে উল্টো পথে দৌড়ানো শুরু করে। তরী বিস্ফোরিত গলায় প্রশ্ন করে,

“ কি করছেন? “

“ এখানেই দাঁড়িয়ে ভিজবেন না বাংলোতে ফিরবেন? “

তরী আর কোনো কথা বলে না। সে একহাতে ঝিনুক দুটো শক্ত করে ধরে পার্থর সাথে তাল মিলিয়ে দৌড়াতে শুরু করে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। পথিমধ্যেই মেঘ গলে বৃষ্টির বিন্দু হয়ে নেমে আসে দ্বীপের বুকে। বৃষ্টিতে ভিজেই বাংলোতে প্রবেশ করে তারা। কেয়ারটেকার ললিতা বেগম এতক্ষণ তাদের অপেক্ষায়ই পথ চেয়ে ছিলো। তাদের বাংলোর ভিতর প্রবেশ করতে দেখে তিনি আউট হাউসের ভেতর গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়।

বাংলোর ভেতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে আছে। বৃষ্টির কল্যাণে বিদ্যুৎ চলে গিয়েছে। তরী আর পার্থ ফোনের ফ্ল্যাশলাইট অন করে উপরে চলে আসে। পার্থ মোমবাতি খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আর তরী তার রুমের বারান্দার দরজা জানালা লাগাতে। বাহিরে পুরো দমে বৃষ্টির পাশাপাশি ঝড়ো হাওয়া বইছে।

পার্থ একটা মোমবাতি খুঁজে পেয়ে তা জ্বালিয়ে তরীর রুমে প্রবেশ করে। তরী সবেমাত্র বারান্দার দরজা লাগিয়ে জানালা লাগাচ্ছিলো। মোমবাতির মৃদু আলোতে দূর হতে তরীকে দেখে পার্থ। ভেজা জারুল রঙা শাড়ি গায়ে লেপ্টে দাঁড়িয়ে থাকা মানবীকে বর্ষায় সদ্য ফোটা ফুলের ন্যায় স্নিগ্ধ লাগছে তার। ঠান্ডায় মৃদু কাপছে সেই লতানো দেহ। শাড়ির আঁচল চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে বিন্দু বিন্দু জল। সেই টুপটাপ জলে মেঝে ভিজে যাচ্ছে। সম্পূর্ণ দৃশ্যটা দেখে পার্থর মতিভ্রম হয়। নিজের মনের গহীনে লুকিয়ে রাখা এতদিনের অনুভূতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে তার। নীরবে মোমবাতিটা একটা ড্রয়ারের উপর রেখে তরীর দিকে এগিয়ে যায়।

পিছনে কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে তরী প্রশ্ন করে,

“ মোমবাতি পেয়েছেন? “

সময় পেরোয় কিন্তু কোনো জবাব আসে না। আচমকা মনে উঁকি দেওয়া সন্দেহ বশত তরীর জানালা আটকানোর চেষ্টায় ব্যস্ত হাত জোড়া থেমে যায়। সে চকিতে পিছনে ফিরে তাকায়। পার্থ এখনো তার থেকে কয়েক কদম দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো। মন এবং মস্তিষ্কের দ্বন্দ্বে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলো। কিন্তু তরীর ফিরে তাকানোর সাথে সাথেই তার মন জিতে যায়। মনের প্রতি সম্মতি জানিয়ে সে বুক ফুলিয়ে গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিয়ে তরীর দিকে এগোয়। পার্থর গভীর দৃষ্টি এবং সেই বড় বড় কদম ফেলে এগিয়ে আসা দেখে তরী নিজের দৃষ্টি নত করে। আচমকা তার সকল তেজ যেন এক পশলা বৃষ্টিতে শান্ত রূপ ধারণ করেছে।

পার্থ কাছাকাছি এগিয়ে এসে একহাত বাড়িয়ে তরীর গাল ছুয়ে দেয়। অত:পর নত মুখটা মৃদু উঁচু করে ধরে। তরী বাধ্য হয় তাকাতে। মুহুর্তেই তার সাক্ষাৎ হয় অন্য এক পার্থর সাথে। মায়াকাতর দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকা এই পুরুষ তার বড্ড অচেনা ও নতুন। প্রকৃতির মাতালতা এসে হানা দেয় তরীর হৃদয়ে। সেই মাতালতা দ্বিগুণ করে দিতে পার্থ গাঢ় শীতল স্বরে বলে উঠে,

“ পার্থ মুন্তাসির নিজেকে আপনার আওতায় সঁপতে চাইছে তরী। অনুমতি আছে কি? “

তরী বাকহারা হয়ে পড়ে। জীবনে বহু প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে সে। কিন্তু এরকম প্রশ্নের সম্মুখীন এই প্রথম হলো। পার্থ কাতর চোখে অনুমতির অপেক্ষা করে। তরী নিরুত্তর রয়। কিছু মুহুর্তের ব্যবধানে নিজের চোখ বুজে নেয় সে। পার্থ বিভোর হয়। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠে তার মৃদু হাসি। তরীর বুজে রাখা চোখ জোড়ায় ওষ্ঠ ছোঁয়ায়। অবাধ্য হাত জোড়া শাড়ির আঁচল ভেদ করে তরীর কোমর ছুঁয়ে দেয়। বৃষ্টির তোলপাড় তুখোড় বাইরে। সেই তুখোড় ঝড়ো হাওয়া পার্থর মনের শান্ত পর্দা মুহুর্তেই উড়িয়ে দেয়। ভেঙে দেয় তরীর আত্ম প্রতিশ্রুতি।

আরেকটু উষ্ণতার আশায় তরী পার্থর শার্টের বুকের কাছটা আঁকড়ে ধরে। সম্মতির ইশারা পেতেই পার্থ অশান্ত হয়ে পড়ে। অপেক্ষা না করে তরীর চোখ জোড়া থেকে নেমে তার অধর নিজের দখলে নিয়ে নেয়। তরীর হাত জোড়া ব্যস্ত হয়ে পড়ে পার্থর শার্টের বোতাম খুলতে। আচমকা তার শীতল হাতজোড়া থেমে যায়। এক কদম পিছিয়ে গিয়ে নিচু স্বরে ডাকে,

“ পার্থ? “

এই এক কদমের দূরত্বও আর সয় না পার্থর। তরীর কোমর ধরে নিজের কাছে টেনে এনে গভীর ব্যকুল স্বরে জবাব দেয়,

“ হ্যাঁ জান। “

পার্থর এই সম্বোধনে তরীর সর্বাঙ্গে এক অদ্ভুত শিহরণ ছড়িয়ে পড়ে। কেপে উঠে তার সম্পূর্ণ স্বত্তা৷ চোখ তুলে তাকাতেই দেখে পার্থ তার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে থেকেই তরী সম্মোহনী গলায় শুধায়,

“ গান শুনাবেন? “

পার্থর হাসির রেখা গভীর হয়। ইষৎ কম্পিত তরীর কানের কাছে মুখ নামায়। নিজের কানের লতিতে শীতল ঠোঁটের স্পর্শ এবং ঘাড়ে শীতল নিঃশ্বাস টের পেতেই ফের চোখ বুজে ফেলে তরী।

“ তেরে এহসাসো মে
ভিগে লামহাতো মে
মুঝকো ডুবা তিশমাগিসি হে,
তেরি আদাও সে
দিলকাশ খাতাও সে
ইন লামহো মে জিন্দেগী সি হে,
হায়া কো যারা ভুল যাও
মেরি হি তারহা পেশ আও। “

এতটুকু গেয়েই পার্থ নীরব বনে যায়। নীরবতায় তরী অধৈর্য্য হয়ে চোখ মেলে তাকাতেই দুজনের দৃষ্টি মিলন হয়। পার্থ এই পর্যায়ে নিজের গায়ের সাদা শার্টটা খুলে দূরে ছুড়ে ফেলে বলে উঠে,

“ আমাকে নির্লজ্জ বলার জন্য প্রস্তুত হও জান। “

পার্থর ধারালো কথা শুনে তরীর শরীর অসাড় হয়ে আসে। হাতের মুঠোয় থাকা ঝিনুক দুটো শব্দ তুলে ফ্লোরে পড়ে যায়। বজ্রপাতের গর্জনের সাথে সাথে নিজেকে পার্থর জিম্মায় ছেড়ে দেয় সে। পার্থর অব্যক্ত সন্ধি প্রকাশ পায় অন্য রূপে, অন্যভাবে।

__________

সেইন্ট মার্টিন দ্বীপে নেমে আসা বর্ষণ তখনও থামে নি। প্রকৃতি তখনও নিজের উথাল-পাতাল তাণ্ডব চালাতে ব্যস্ত। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই গভীর রাতের তাণ্ডব দেখতে ব্যস্ত পার্থ। উদোম শরীরটা দমকা হাওয়ার সাথে ছিটকে আসা বৃষ্টির ফোটায় ভিজে যাচ্ছে। একহাত প্যান্টের পকেটে গুজে রাখা তার। অপরহাতের আঙুলের ভাজে থাকা জ্বলন্ত সিগারেটটা দু ঠোঁটের মাঝে চেপে ধরেছে। মুহুর্তেই সিগারেটটা মুখ থেকে সরিয়ে হাওয়ায় ধুয়ো উড়িয়ে দেয়।

কিছুক্ষণ আগেও তার হাতের আঙুলের ভাজে তরীর আঙুল ছিলো। তার অধরের সাথে তরীর অধর মিলিয়ে ছিলো। উষ্ণতার চাদরে ঢাকা পড়ে তরী নিদ্রায় আচ্ছন্ন হতেই পার্থর মস্তিষ্ক সচল হয়। বুঝতে পারলো সে আবেগের বর্শবর্তী হয়ে কত বড় ভুল করলো। তরীও নাহয় এই মুহুর্তে তার আবেগে সাড়া দিয়েছে। কিন্তু আগামীকাল? তখন তরী তার ব্যাপারে কি ভাববে? যদি বোকা তরী তার মন না বুঝে উল্টো ভেবে বসে পার্থ সিচুয়েশনের ফায়দা তুলেছে?

এরকমটা তো কখনোই চায় নি পার্থ। তরীর বেলায় সবকিছু কেন তার প্ল্যানের বিপরীত হচ্ছে? প্রথমে তাদের বিয়েটা, অত:পর আজকের রাতটা। কেন প্রতিবারই পার্থ নিজের মনের কথা জানানোর আগেই তাদের সম্পর্ক এক পা দু পা করে এগিয়ে যাচ্ছে? এভাবে তো তাদের মনের মিলটাই কখনো হবে না।

পার্থ সিগারেটটা ফেলে রুমে প্রবেশ করে। বিছানার চারিদিকে থাকা শুভ্র পর্দার ফলে বিছানার মাঝে শুয়ে থাকা তরী আড়াল হয়ে আছে। পার্থ এগিয়ে গিয়ে তরীর পিছনে বসতেই তার দৃষ্টি পড়ে তরীর ঘুমন্ত মুখশ্রীর দিকে। পার্থ এগিয়ে গিয়ে কম্বলটা আরেকটু টেনে তরীর উন্মুক্ত পিঠ ঢেকে দেয়। অত:পর নিজে বিছানার হেড সাইডে হেলান দিয়ে বসে। কম্বলের উষ্ণতা টের পেতেই তরী ঘুমের ঘোরে পার্থর দিকে এগিয়ে গিয়ে তার কোলে মাথা তুলে দেয়। অত:পর বুকের কাছে কম্বল জড়িয়ে ধরে গুটিসুটি মেরে রয়।

পার্থর সাথে সাথে নিঃশব্দে হেসে দেয়। এটা তরীর প্রতিদিনকার অভ্যাস। বাসায় থাকা অবস্থায় তরী ঘুমিয়ে যাওয়ার পর পার্থ প্রতিদিন রাতে নিজের বেডরুমের এক্সট্রা কি দ্বারা দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করে তরীর মাথার কাছে বসলেই তরী ঘুরেফিরে বালিশ ছেড়ে পার্থর কোলে মাথা রেখে ঘুমাতো। এই মেয়ের ঘুম এতো গাঢ় যে ভূমিকম্প হলেও কখনো টের পাবে না।

পার্থ মৃদু হেসে তরীর চুলের ফাঁকে নিজের ডানহাতের পাঁচ আঙুল গুজে দিয়ে হাত বুলিয়ে দেয়। সাথে সাথে তার বুকের ভেতরটা শীতল হয়ে আসে। কোমল স্বরে অনুভূতির প্রগাঢ়তা ঢেলে দিয়ে বলে উঠে,

“ হৃদয়ের ডাক্তার, স্টেথোস্কোপ ছাড়া আমার হৃৎস্পন্দনের গতি কি টের পান না আপনি? এক মুহুর্তের জন্যও বুঝতে পারেন না যে কতটা ভালোবাসি? “

তরী নিরুত্তর। পার্থ মলিন হেসে মাথা নামিয়ে তরীর উন্মুক্ত কাধের কালো তিলটায় অধর ছোয়ায়। অত:পর ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,

“ আই লাভ ইউ জান। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে