যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-২৩+২৪

0
346

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৩.

তরীর হাত ধরে নিজের গাড়ির সামনে এনে তাকে দাঁড় করিয়ে পার্থ ইশারা করে উঠে বসতে। তরী সেই ইশারা অগ্রাহ্য করে বলে,

“ আমি সাথে গাড়ি এনেছি। চলে যেতে পারবো। “

পার্থ কঠিন স্বরে বলে,

“ আপনার গাড়ি বাসায় পৌঁছে যাবে। আপনি আমার সাথে চলুন। “

তরী তেজ দেখিয়ে বলে,

“ আমি একা যেতে পারবো। “

“ আমার মাথা যথেষ্ট গরম হয়ে আছে তরী। চুপচাপ আমার সাথে চলুন। নাহয় তুলে নিয়ে যাওয়ার আগে আমি এক মুহুর্তও ভাববো না। “

তরীর রাগ লাগে। কুকুরের লেজ যেমন কখনো সোজা হবে না, তেমনই এই লোকের হুমকি দেওয়ার স্বভাব জীবনেও বদলাবে না। তরী আশেপাশে তাকিয়ে দেখে অনেকেই উৎসুক চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। এই মুহুর্তে আরো সিন ক্রিয়েট সহ্য করার মতো ধৈর্য্য নেই তরীর মধ্যে। তাই সে রাগ নিয়েই চুপচাপ পার্থর গাড়িতে উঠে বসে। পার্থও উঠে বসে গাড়ি স্টার্ট দেয়।

__________

নদীর পাড়ে নিরিবিলি এক জায়গায় এসে গাড়ি থামিয়েছে পার্থ। সারা রাস্তায় দুজনেই নীরব ছিলো। কিন্তু এখন নীরবতা ভেঙে পার্থ প্রশ্ন করে,

“ ওই মানুষ গুলো আপনার পূর্ব পরিচিত? “

তরী এক মুহুর্ত পার্থর দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে জানালার বাহিরে তাকায়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে দৃষ্টি দূর নদীর পানে স্থির রেখে জবাব দেয়,

“ সাদ আমার বাগদত্তা ছিলো আর আয়রা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। “

পার্থ স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করে,

“ গতকাল যেই বাচ্চাটা মারা গিয়েছে সেটা ওদের বাচ্চা ছিলো? “

“ হুম। “

“ আপনি যেখানে কোনো ভুল করেন নি সেখানে কেনো ক্ষমা চাইতে গিয়েছেন? “

তরী এবার পার্থর দিকে ফিরে তাকায়। সহজ ভাষায় বলে,

“ ক্ষমা চাইলে আমি ছোট হয়ে যাবো না। আমি শুধু নিজের চাকরিটা হারিয়েছি। ওরা নিজেদের সন্তান হারিয়েছে। ওদের কষ্টটা নিশ্চয়ই আমার থেকে বড়? আমার সামান্য সরিতে ওদের ক্ষতিপূরণ হবে না। কিন্তু আমার মন বলছিলো যে একবার সরি বলা উচিত আমার। “

“ কষ্ট তো আপনিও পেয়ে আসছেন এতো বছর ধরে। কই ওরা তো একবারও আপনাদের কাছে ক্ষমা চায় নি? “

তরী অবাক সুরে প্রশ্ন করে,

“ আপনি জানতেন? “

“ গায়ে হলুদের দিন আপনার পাপার সাথে আমার বেশ অনেকক্ষণ একান্তে কথা হয়। উনি তখন আমাকে এই বিষয়ে জানিয়েছিলেন। কিন্তু খুব একটা ডিটেইলসে কিছু বলেন নি উনি। “

তরী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সিটে গা এলিয়ে দেয়। চোখ বুজে বলা শুরু করে,

“ আমার সাথে এনগেজড থাকা অবস্থায়ই সাদ আয়রার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ে। আমার আড়ালেই ওদের সম্পর্ক চলছিলো। ওদের সম্পর্ক এতটাই গভীর পর্যায়ে চলে যায় যে একদিন সাদ জানতে পারে আয়রা প্রেগন্যান্ট। ও প্রচুর অপরাধ বোধে ভুগছিলো। সবশেষে ডিসিশন নেয় যে ও আয়রাকে ছেড়ে দিবে। আমাকেই বিয়ে করবে। আমি তখনও এসবের কিছু ঘুনাক্ষরে টের পাই নি। এরই মাঝে আমি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়ি একবার। হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার পর বেশ কিছু টেস্ট করা হয়। এরমধ্যে একটা টেস্টের রিপোর্ট কিছুটা এরকম ছিলো যে আমি কখনো কনসিভ করতে পারবো না। মুহুর্তেই সাদের অপরাধবোধ থেকে নেওয়া ডিসিশন বদলে যায়। সেদিন হসপিটালেই ও আমাকে নিজের এবং আয়রার সম্পর্কের ব্যাপারে জানায়। আর এটাও বলে আমাকে বিয়ে করা ওর দ্বারা সম্ভব নয়। আমি ওকে আটকাই নি। যেতে দেই। “

পার্থ এক ধ্যানে তরীর দিকে তাকিয়ে আছে। কি সহজে সম্পূর্ণ ঘটনা বলে দিলো মেয়েটা। কিন্তু যত সহজে বলেছে তত সহজে কি সইতে পেরেছিলো? পার্থ প্রশ্ন করে,

“ তাহলে সিড়ির ওখানে আয়রা যা বলছিলো তা সত্যি? “

তরী চোখ মেলে ঘাড় ঘুরিয়ে পার্থর দিকে তাকায়। অত:পর নিঃশব্দে হেসে প্রশ্ন করে,

“ কেন? আফসোস হচ্ছে? ঠকে গিয়েছেন মনে হচ্ছে? “

“ আমি তা বুঝাই নি। “

তরী আবার চোখ বুজে বলে উঠে,

“ আল্লাহ আমার প্রতি সদয় ছিলেন। নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরেকবার টেস্ট করাই আমি। এইবার রিপোর্ট নরমাল আসে। আগের সেই রিপোর্ট ভুল ছিলো। “

“ এই কথা তাহলে সাদকে জানান নি কেন? আজকে যখন আয়রা আপনাকে এরকম সেনসেটিভ একটা টপিক তুলে কটু কথা শোনাচ্ছিল তখন তাহলে একবারও তার মুখের উপর সত্যিটা বলেন নি কেন? “

তরী শান্ত স্বরে জবাব দেয়,

“ প্রয়োজন মনে করি নি। সাদের চ্যাপ্টার আমি আমার লাইফ থেকে ছিড়ে ফেলে দিয়েছি বহু আগেই। ওরা আমাকে নিয়ে কি ভাবলো না ভাবলো তা দিয়ে আমার কিছু যায় আসে না। “

পার্থ তরীর দিকে তাকিয়ে থাকে। আচমকা একহাত বাড়িয়ে তরীর ডান হাতের কনুই স্পর্শ করতেই তরী ব্যথায় মৃদু আর্তনাদ করে উঠে। অত:পর চোখ কুচকে পার্থর দিকে তাকায়। পার্থ শীতল গলায় বলে উঠে,

“ আঘাত লাগলে মুখ ফুটে বলবেন। আমি অন্তর্জামী নই যে আপনার সকল ব্যাথা নিজ থেকেই টের পাবো। “

__________

“ স্যার। ওই ম্যানহোলের ডেথকেসে একটা নতুন তথ্য পাওয়া গিয়েছে। “

শোভন চোখ তুলে তাকায় তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ অফিসারের দিকে। সিরিয়াস ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে,

“ কি তথ্য? কোনো ক্লু পেলে? “

“ স্যার নিহতের নাম ছিলো আহনাফ রফিক। সেই নিহত ব্যক্তি গত ১ বছর ধরে নিখোঁজ ছিলো। উনার পরিবার উনার জন্য একটা মিসিং ডায়েরিও ফাইল করেছিলো। “

শোভনের ভ্রু জোড়া কুচকে আসে। সে প্রশ্ন করে,

“ আর? “

“ আর স্যার, এই আহনাফ নামক ছেলেটা নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট ছিলো। বেশ সম্ভ্রান্ত ফ্যামিলির ছেলে। উনার ফ্যামিলি নিজে উনার পরিচয় কনফার্ম করেছে। “

শোভনের কপালের চিন্তার রেখা গাঢ় হয়। সে বলে,

“ সেই ছেলের ভার্সিটি যাও। খোঁজ লাগাও। তার বন্ধুদের সাথে কথা বলো। কারো সাথে কোনো ঝামেলা ছিলো নাকি শিওর হয়ে আসো। “

পুলিশ অফিসার চিন্তিত গলায় বলে উঠে,

“ ওকে স্যার। কিন্তু আপনার কি মনে হচ্ছে? কেসটা কি? “

“ এতদিন তো আমার এটাকে পলিটিক্যাল ইস্যু মনে হচ্ছিলো। কিন্তু এখন নিজেও বুঝে উঠতে পারছি না আসল ব্যাপার কি। যতদিন না কোনো ক্লু পাবো ততদিন এই কেসটা একটা গোলকধাঁধাই রয়ে যাবে। “

শোভনের কথার মাঝেই একজন কনস্টেবল দৌড়ে এসে বলে,

“ স্যার। দুজন মানুষ এসেছে। একটা মিসিং ডায়েরি করাতে। “

শোভন বলে,

“ আসতে দাও। “

দু’জন পুরুষ মানুষ শোভনের রুমে প্রবেশ করে। একজনের বয়স সম্ভবত পঞ্চাশের ঘরে এবং আরেকজনের খুব সম্ভবত ত্রিশ বছর হবে। চেহারার বিধ্বস্ত অবস্থা। শোভন প্রশ্ন করে,

“ জ্বি বলুন। কার মিসিং ডায়েরি ফাইল করাতে চাচ্ছেন? “

ত্রিশ বছরের পুরুষটা বলে উঠে,

“ আমার ছোট ভাই। গতকাল ভার্সিটি যাওয়ার জন্য বেরিয়েছিলো। কিন্তু একদিন পেরিয়ে গিয়েছে এখনো বাসায় ফিরে নি। ফোন করছি কিন্তু ফোন বন্ধ আসছে। ওর বন্ধুদের কল করেছি। ওরা বলছে আমার ভাই নাকি ভার্সিটি যায়ই নি গতকালকে। “

“ এমনও তো হতে পারে আপনার ভাই নিজের ইচ্ছায়ই আত্মগোপন করে আছে। “

সামনে বসা বয়স্ক পুরুষটা এবার চটে গিয়ে বলে উঠে,

“ আমার ছেলে অনেক ভদ্র নম্র স্বভাবের। ও কোনো ধরনের ফালতু কাজে কখনো জড়ায় না। আমি নিশ্চিত আমার ছেলেকে কেউ কিডন্যাপ করেছে। “

শোভন কিছুটা রহস্যময় দৃষ্টি নিয়ে তার সামনে দাঁড়ানো পুলিশ অফিসারের দিকে তাকায়। অত:পর তার সামনে বসে থাকা লোক দুটোর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে,

“ আপনার ছেলে কি কোনো প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়তো? “

“ হ্যাঁ। “

__________

তরী এবং পার্থ বাসায় ফিরতেই আফজাল সাহেব পার্থকে একান্তে কথা বলার জন্য ডেকে পাঠায়। পার্থ এসে উনার সামনে বসতেই উনি একটা খাম এগিয়ে দেয় তার দিকে। পার্থ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

“ এটা কি? “

আফজাল সাহেব সোজাসাপ্টা জবাব দেয়,

“ ফ্লাইট টিকেট। “

“ কার ফ্লাইট টিকেট? “

“ তোমার এবং তরীর। “

পার্থ অবাক সুরে প্রশ্ন করে,

“ আমাদের ফ্লাইট টিকেট মানে? কোথায় যাচ্ছি আমরা? “

“ কক্সবাজার যাচ্ছো। আমি সব বুক করে রেখেছি। কাল সকালে তোমাদের ফ্লাইট। গিয়ে এখন নিজেদের ব্যাগ প্যাক করে নাও। “

পার্থ বিরক্তি মিশ্রিত গলায় বলে উঠে,

“ এখানে কি দুই মিনিটের ইন্সট্যান্ট ম্যাগি নুডুলস রান্না হচ্ছে নাকি? কথা নেই বার্তা নেই, হুট করে টিকেট ধরিয়ে দিয়ে বলছেন কক্সবাজার যেতে। কক্সবাজার আমাদের কি কাজ? “

আফজাল সাহেব রাগান্বিত সুরে বলে,

“ গাধার বাচ্চা তোমাদের কথা ভেবেই আমি এই কাজ করেছি। বিয়ের পর থেকে প্রচুর ঝামেলা যাচ্ছে তোমাদের উপর দিয়ে। তাই এই হানিমুন ট্রিপটা আমার তরফ থেকে গিফট। কিছুদিন গিয়ে ঘুরে আসো। তরীর মনও ভালো হয়ে যাবে আর নিজেরা একান্তে সময়ও পাবে একটু। এদিকটা আমি সামলে নিবো। “

পার্থ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে কিছু একটা ভাবে। অত:পর বলে উঠে,

“ আপনার আদরের পুত্রবধূ হানিমুন ট্রিপে যাওয়ার জন্য রাজি হবে বলে আমার মনে হয়না। “

“ তোমার আম্মা কথা বলতে গিয়েছে ওর সাথে। রাজি করিয়ে ফেলবে। চিন্তা করো না। “

পার্থ মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসতে নেয়। আচমকা দরজার কাছে গিয়ে সে পিছে ফিরে বলে,

“ আব্বা? “

“ কি? “

“ আমাকে গাধার বাচ্চা বললে কিন্তু আলটিমেটলি আপনি নিজেকেই গাধা বলছেন। “

কথাটা বলেই পার্থ আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা করে না। বেরিয়ে যায়। আফজাল সাহেব কিড়মিড়িয়ে বলে উঠে,

“ অসভ্যের বাচ্চা। বাপের সাথে মশকরা করো। এরকম ইতরদের বউ ছাড়া হানিমুনে পাঠানো উচিত। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৪.

সকাল সকাল লাগেজ হাতে সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে নিচে নেমে আসলো পার্থ এবং তরী। এখন ঘড়ির কাঁটা ছয়টা পনেরো মিনিটে স্থির। তাদের ফ্লাইট হলো সকাল দশটায়। বাসা থেকে আগে আগেই বেরুতে হবে তাদের। তরী প্রথমে যেতে চাচ্ছিলো না। কিন্তু পরে এটা ভেবে রাজি হয় যে আফজাল সাহেব তার কথা ভেবে এই ট্রিপ প্ল্যান করেছে। মানুষটা পিতার ন্যায় তার মন ভালো করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এভাবে প্রত্যাখ্যান করাটা সমীচীন হবে না। আর তাছাড়াও কিছুদিনের জন্য দূরে গেলে যদি তার অন্তরের জ্বালা কিছুটা কমে তবে দোষ কোথায়?

ঘরের বড় ছেলে এবং পুত্রবধূকে বিদায় জানাতে সকলেই সকাল সকাল নিচে অপেক্ষা করছে। গতরাতে তরীর শাশুড়ি তরীকে বেশ কিছু নতুন শাড়ি এনে দিয়েছিলো সাথে নেওয়ার জন্য। সেখান থেকেই একটা জারুল রঙের শাড়ি পড়েছে তরী। নিচে নেমেই সে শাশুড়ির দিকে এগিয়ে গিয়ে আগে উনাকে জড়িয়ে ধরে। অত:পর শশুড়ের কাছে এগিয়ে যেতেই আফজাল সাহেব কিছু সুরা পড়ে তরীর মাথায় ফু দিয়ে হাত বুলিয়ে দেয়। শোভন হাই তুলতে তুলতে বলে উঠে,

“ জলদি গিয়ে জলদি ফিরে আসবেন ভাবী। একমাত্র দেবরের বিয়ের সব দায়িত্ব কিন্তু আপনার উপরই। “

তরী মৃদু হেসে বলে,

“ অবশ্যই। “

__________

চট্টগ্রাম এসে পৌঁছাতেই পার্থ এবং তরী প্রাইভেট কারে করে হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। ঢাকায় যেরকম স্বচ্ছ আকাশ দেখে এসেছিলো এখানে সম্পূর্ণ তার বিপরীত। গুমোট আকাশ ইতিমধ্যে গর্জন তুলে বর্ষণ নামিয়েছে। প্রকৃতি বেশ শীতল। পার্থ ড্রাইভ করতে করতে একবার পাশ ফিরে তরীর দিকে তাকায়। সম্পূর্ণ রাস্তায় তরী চুপচাপ ছিলো। এখনো চুপচাপ জানালা ভেদ করে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে।

পার্থ দৃষ্টি ফিরিয়ে আবার বাহিরে তাকায়। এই আবহাওয়া দেখে তার একটা গানের কথা মনে পড়ে। অপেক্ষা না করে গাড়িতে সেই গানটা প্লে করে দেয়। ভলিউমটাও কিছুটা মাঝামাঝি পর্যায়ে বাড়িয়ে দিয়ে গানের সাথে নিজে সুর মিলিয়ে গুনগুন করতে থাকে।

“ লাখ রোকা, পার রুকা না
ইষ্ক ইয়ে সারসোর হে
আপনি চাহাত, ওর কুছ হে
ইষ্ক কি কুছ ওর হে
তেরে মেরে বাস মে কেয়া হে
হো রাহা হে যো লিখা হে
ইস লামহে কি খওয়াহিশো মে
জিন্দেগানি কি রাজা হে
ইউ হি রে ইউ হি রে
মিলতে রাহে হাম
তুঝি মে তুঝি মে খোকে রাহে হাম। “

এই গান এর পূর্বে কখনো শুনে নি তরী। কিন্তু গানটা তার কাছে সুন্দর লাগছে শুনতে। তাই আগ্রহ বসত সে তার ফোনের ইউটিউবে গিয়ে গানের নামটা লিখে সার্চ করে। ফোনের ভলিউম লো করে গানটা প্লে করতেই লজ্জায় তার কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হতে থাকে। সাথে সাথে সে ফোন বন্ধ করে দেয়। এগিয়ে গিয়ে গাড়িতে বাজতে থাকা গানের ভলিউমও সম্পূর্ণ কমিয়ে দেয়। অত:পর রাগে লাল হওয়া মুখ নিয়ে বাহিরে দৃষ্টিপাত করে। কিন্তু তবুও সে নিস্তার পায় না। তার পাশে বসে থাকা জ্বলজ্যান্ত স্পোটিফাই এখনো গান গেয়ে চলেছে।

“ না গাভারা থা মুঝে যো
দিল কো ও মানজুর হে
তুঝসে মিলকে দিল ইয়ে জানে
কিস নাশে মে চোর হে
ও হো সাথ মিলকে দিল সে তেরে
হো গায়া হু বাখুদা মে
তেরি কুরবাত সে ভি কেসি
রেহ সাকুঙ্গি আব জুদা
মেরি নিগাহো কি বাহো মে আও না
চাহাত কে হামেসা রাহো মে রাহু না। “

শেষের দুটো লাইন পার্থ তরীর দিকে ফিরে গায়। তরীর ধৈর্যের বাধ ভাঙে। সে পাশ ফিরে পার্থর দিকে তাকিয়ে রাগ নিয়ে বলে উঠে,

“ আপনার প্লেলিস্টে কি সব এরকম নির্লজ্জ মার্কা গান? “

পার্থ গান থামিয়ে ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

“ গানের মাঝেও কি নির্লজ্জ এবং সভ্যের ভেদাভেদ করা হয় নাকি? আমার জানা ছিলো না। “

“ এক্সকিউজ মি। আমি খুব ভালো করে বুঝছি আপনার ইনটেনশন কি। এসব গান গেয়ে আমাকে দূর্বল করে সত্যিকারের হানিমুন ট্রিপ ইঞ্জয় করার প্ল্যান মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। এরকমটা কখনো হবে না। “

“ আপনি মন পড়তে খুব কাঁচা তরী। আর কখনো মন পড়ার চেষ্টা করবেন না। “

__________

একটা কাগজে বসে বসে খসড়া করছে শোভন। কাগজের মধ্যখানে বড় করে আট সংখ্যাটা লিখে তার চার পাশ দিয়ে লাল কালির কলম দিয়ে একটা বৃত্ত আঁকে। অত:পর কাগজের একপাশে আটটা নাম লিখে সে। নামগুলো হলো সেইসব ছেলের যারা গত এক বছরে নিখোঁজ হয়েছে। এদের সবার মধ্যে একটা কমন বিষয় হচ্ছে এরা সবাই প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির সম্ভ্রান্ত ফ্যামিলির ছেলে। এতদিন এই মিসিং ফাইল গুলো অবহেলায় থানার এক কোণে পড়ে থাকলেও গতকাল ওই দুই ভদ্রলোকের নিজেদের ছেলের জন্য মিসিং ডায়েরি করতে আসার পর শোভন বিষয়টা আমলে নেয়। সবগুলো ফাইল ঘেটে এই সেম কানেকশনের কেস খুঁজে বের করে। এই ছেলে গুলোর উধাও হয়ে যাওয়ার পিছনে সেম কোনো মানুষের হাত আছে নাকি তাও তাকে বেশ ভাবায়।

শোভনের ভাবনার মাঝেই একজন কন্সটেবল এসে হাজির হয়। বিনয়ী ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে,

“ আসবো স্যার? “

“ হ্যাঁ। কথা হয়েছে? “

“ স্যার যেই ছেলেটা কাল মিসিং হয়েছে তার সকল বন্ধু বান্ধব ও পরিচিত মানুষদের সাথে কথা হয়েছে আমার। সবাই একই কথা বলছে। ছেলেটার কারো সাথেই কোনো ঝামেলা ছিলো না। “

শোভনের কপালের ভাজ সূক্ষ্ম হয়। সে চিন্তিত সুরে বলে,

“ এইসব গুলো কেস একই সূত্রে গাথা। এর মূল হোতা যে কে তা না জানা পর্যন্ত আমি শান্তি পাবো না। “

“ স্যার, ওই ম্যানহোল কেসের খুনী খুব চালাক। একটা কোনো চিহ্ন রেখে যায়নি যার সাহায্যে আমরা তার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবো। “

শোভন কোনো কথা না বলে চেয়ারে গা এলিয়ে চোখ বুজে রয়। অত:পর বলে,

“ গরম গরম এক কাপ চা পাঠাতে বলুন। “

__________

হোটেলের রুমে প্রবেশ করতেই তরীর ভ্রু কুচকে আসে। বিছানার উপর টাওয়াল দিয়ে দুটো জোড়া রাজহাঁস বানিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। তার আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা বেশ কিছু গোলাপের পাপড়ি। তরী বিরক্তি নিয়ে চারিদিকে তাকিয়ে দেখে রুমে একটা সোফাও নেই। সে তড়িৎ পার্থর দিকে ফিরে তাকিয়ে বলে উঠে,

“ এই রুমে একসাথে থাকা অসম্ভব। নিজের জন্য আলাদা রুম বুক করুন আপনি। “

পার্থ লাগেজ থেকেই নিজের কাপড় বের করতে করতে বলে উঠে,

“ আপনার শশুড়ের কাছে ইমিডিয়েটলি এই খবর পৌঁছে যাবে। তখন কি জবাব দিবেন উনাকে? “

“ আব্বা কিভাবে জানবে? “

“ আব্বার পরিচিত এক বন্ধুর হোটেল এটা। উনি যখন দেখবে যে আমরা হানিমুনে এসে আলাদা আলাদা রুমে থাকছি তখন নিশ্চয়ই আব্বাকে এই খবর পাঠাতে দেরি করবেন না। “

তরীর রাগ লাগে খুব। রাগে সে ওই রাজহাঁস আর গোলাপের পাপড়িদের ঝেড়ে মাটিতে ফেলে। অত:পর হন্তদন্ত হয়ে লাগেজ থেকে একটা শাড়ি নিয়ে পার্থকে ধাক্কা মেরে দৌড়ে আগে ওয়াশরুমে প্রবেশ করে। পার্থ প্রথমে হন্তদন্ত হয়ে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তরীর যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে চেচিয়ে বলে উঠে,

“ দজ্জাল মহিলা! ওয়াশরুমে যেতে চান সেটা মুখ ফুটে বললেই আমি রাস্তা থেকে সরে দাঁড়াতাম। সব জায়গায় নিজের হাত পা না চালালে হয় না? “

তরী ভিতর থেকে একইভাবে চেচিয়ে বলে উঠে,

“ গো টু হেল। “

__________

ল্যাপটপে বসে একটা আর্টিকেল লিখছিলো তূর্য। লেখা শেষ হতেই সে পাশ ফিরে দেখে পৃথা পড়তে পড়তে বই বুকের উপর নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। তূর্য সাবধানে নিজের ল্যাপটপটা রেখে পৃথার বুকের উপর থেকে বইটা সরিয়ে রাখে। অত:পর পৃথার উপর দিয়ে ঝুকে বেডসাইড কেবিনেটের উপর রাখা ল্যাম্পটা বন্ধ করতে। ল্যাম্প বন্ধ করে ধীরে সড়ে যেতে নিলেই তূর্য নিজের টি শার্টের বুকের দিকে কিছুটা টান অনুভব করে। তাকাতেই দেখে পৃথা তার দিকে তাকিয়ে আছে। তূর্য সামান্য হেসে বলে,

“ আমি ভেবেছিলাম ঘুমিয়ে পড়েছো। “

তূর্যর কথা শেষ হয় কিন্তু পৃথা এখনো তার টি শার্ট ছাড়ে না। তূর্য প্রশ্নবোধক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

“ কি? “

পৃথা কথা বলে না। কিছুক্ষণ তূর্যের দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা তুলে তূর্যের গলায় দীর্ঘ সময় নিয়ে চুমু খায়। তূর্য চমকায়। অবাক সুরে ডাকে,

“ এই পৃথা? “

পৃথা তূর্যকে ছেড়ে দিয়ে আবার বালিশে নিজের মাথা ঠেকায়। ঘোর মাখা দৃষ্টি নিয়ে প্রশ্ন করে,

“ অষ্টাদশীর মনে ঝড় তুলেছেন তূর্য। সেই ঝড় শান্ত করবেন না? “

তূর্য বিমোহিত হয়। লজ্জা ভুলে এইটুকু কথা বলেছে পৃথা। কিন্তু এখন তূর্যর দৃষ্টি দেখে তার নড়চড় করার ক্ষমতা শূন্য। তূর্য গায়ে কাপন ধরানো শীতল স্বরে বলে উঠে,

“ স্বামী যেহেতু হয়েছি সেহেতু মনের ঝড় শান্ত করার দায়িত্ব তো আমারই। কি দিয়ে শুরু করবো? এইমাত্র আমার গলায় যেভাবে নিজের মনে চলমান ঝড়ের চিহ্ন আঁকলে সেভাবে? “

কথাটুকু বলেই তূর্য পৃথার গলায় মুখ ডোবায়। পৃথার শুভ্র মুখ লজ্জায় লাল হয়। অত:পর খুশিতে তা রক্তিম আভা ধারণ করে। তার জীবন এতো সহজ ভাবতেই আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া আদায় করে মনে মনে। তীব্র কাঠখড় না পেরিয়েই কতো সহজেই কাঙ্ক্ষিত মানুষকে স্বামী হিসেবে পেয়ে গেলো সে। এই জীবনে আর কি চাওয়ার থাকতে পারে তার? পরিপূর্ণ সে। উহু। শেষ একটা জিনিস চাওয়ার আছে। জ্বলজ্যান্ত পুতুল। যে দেখতে অবিকল তূর্যের অনুরূপ হবে।

__________

দু ঘন্টা ঝগড়ার পর তরী পার্থকে বিছানায় ঘুমানোর পারমিশন দিয়েছে। তাও এক সহস্র হুমকির সাথে। বিছানার মাঝখানে বর্ডারের ন্যায় রেখে দিয়েছে দুটো রাক্ষসের ন্যায় বালিশকে। বারবার বলেছে যে পার্থ যদি ভুলেও এই বালিশ অতিক্রম করে তরীর দিকে এগোনোর চেষ্টা করে তাহলে পার্থর একটাও হাড্ডি আস্ত রাখবে না সে। পার্থ তরীর সেই সকল নিষেধাজ্ঞা মেনে বিছানার এককোণে রোবটের ন্যায় সটান শুয়ে থাকে। আজ কতদিন পর বিছানায় শোয়ার সুযোগ পেলো। ছোটবেলায় ঈদের সময় সালামি পেলেও বোধহয় পার্থ এতো খুশি হতো না। আরামে তার চোখে ঘুম নেমে আসে। তখনই উপলব্ধি করে তার আর তরীর মাঝখানের বর্ডার হিসেবে থাকা বালিশ দুটির আর উপস্থিতি টের পাচ্ছে না সে। পার্থ চোখ মেলে তাকাবে তার আগেই নিজের শরীরের উপর একটা নরম হাত এবং পায়ের ভার টের পায়।

পার্থ চোখ মেলে দেখে তরী ঘুমের ঘোরে বালিশ ছেড়ে তাকে অক্টোপাসের নেয় জাপ্টে ধরেছে। পার্থ ভ্রু কুচকে ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলে উঠে,

“ আমি নাকি উনার উপর চান্স মারবো। একা এই রুমে নিজের পাশে এরকম হ্যান্ডসাম ছেলে পেতেই নিজের লোভ আর সামলাতে পারলো না। সিচুয়েশনের এডভান্টেজ নিয়ে কিভাবে আমার সাথে লেপ্টে আছে। চালাক মহিলা। “

কথাটুকু বলে পার্থ ধীরে ধীরে নিজের শরীরের উপর থেকে তরীর হাত পা সরিয়ে অপরদিকে ফিরে শুয়ে পড়ে। কিন্তু কিছুক্ষণ না যেতেই আচমকা সে ধড়ফড়িয়ে বিছানার নিচে নিজেকে আবিষ্কার করে। পার্থ হতভম্ব ভঙ্গিতে উঠে বসে তরীর দিকে তাকায়। কি নিষ্পাপ মুখভঙ্গি করে সম্পূর্ণ বিছানা দখল করে ঘুমোচ্ছে। কেউ দেখলে বলবে যে এইমাত্র সে পার্থর মতো নিষ্পাপ একজন মানুষকে বিনা দোষে লাথি মেরে ফেলে দিয়েছে?

পার্থ ফ্লোরে বসে থাকা অবস্থায়ই ক্লান্ত গলায় বলে,

“ এই দজ্জাল মহিলাকে আমি অভিশাপ দিলাম। যেই পার্থ মুন্তাসিরের উপর আজ এতো অত্যাচার করছে একদিন সেই পার্থ মুন্তাসিরের তীরে এসেই উনার তরী ডুববে। আমিন। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে