Sunday, July 6, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 328



যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-৫০ এবং শেষ পর্ব

0

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৫০. ( উপসংহার )

পাথরের মূর্তির ন্যায় শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে আফজাল সাহেব। গুমোট পরিবেশের সাথে পাল্লা দিয়ে পালন করছেন মৌন ব্রত। তার পাশে স্টিলের বেঞ্চিটাতে বসে ফুপিয়ে কাঁদছেন সাদিকা বেগম। আফজাল সাহেবের কানে সেই কান্নার শব্দ পৌঁছাচ্ছে না। খানিকক্ষণ আগে পার্থর কল পেয়েই তিনি হসপিটালে ছুটে আসেন। পার্থ জানায় সে শোভন এবং তূর্যকে নিয়ে হসপিটাল যাচ্ছে। এর বেশি আর কিছু বলে নি সে।

আফজাল সাহেবের মনে প্রশ্ন জাগে। তার ছেলে কি সামান্য আহত হয়েছে নাকি খুব বেশি আঘাত পেয়েছে? হসপিটালে আসার পর সামান্য ফার্স্ট এইড করলেই তার ছেলে সুস্থ হয়ে যাবে তো? আবার আগের মতো আফজাল সাহেবের কথার ত্যাড়া জবাব দিবে তো? আফজাল সাহেব আর কিছু ভাবতে পারে না। তিনি চোখ বুজে ফেলে। শোভনকে তিনি সবসময় বলতেন, বিপদ দেখলে সবসময় আগে নিজের জীবন যেনো বাঁচায়। কিন্তু তার বরাবরের মতো ঘাড়ত্যাড়া ছেলেটা উনার কথা কানে তুলেন নি। বিপদ দেখে পালায় নি।

আচমকা আফজাল সাহেবের কানে ভেসে আসে মেয়ে এবং পুত্রবধূর আর্তনাদ। তিনি চোখ মেলে তাকাতেই দেখেন করিডর হয়ে দুটো স্ট্রেচারে করে দুটো রক্তাক্ত দেহ দ্রুত গতিতে নিয়ে আসা হচ্ছে ওটির দিকে। সেই স্ট্রেচারের সাথে কদম মিলিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছে বিধ্বস্ত পার্থ। আফজাল সাহেব নিস্তেজ শরীর টেনে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। উনার চোখের সামনে দিয়ে শোভনকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হয়। ছেলের রক্তাক্ত দেহ দেখে আফজাল সাহেব অস্ফুটে বলে উঠে,

“ আমার বাবা! “

হুমায়ুন রশীদ এবং তরী স্ট্রেচারের সাথেই ওটির ভেতর প্রবেশ করে। চোখের সামনে ভাই এবং স্বামীকে এরকম বিধ্বংসী, রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে পৃথা নীরব বনে গিয়েছে। সে থম মেরে বসে রয়। মধুমিতার জমিয়ে রাখা আর্তনাদগুলো এই মুহুর্তে কান্নার সাথে বেরিয়ে আসছে। সাদিকা বেগম মধুমিতাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে অশ্রুসিক্ত গলায় বলে,

“ আল্লাহ ভরসা মা। এমন করে না। একটু শক্ত থাকো। “

মধুমিতা শান্ত হয় না। বরং তার কান্নার প্রকোপ আরো বাড়ে। পার্থ আফজাল সাহেবের সামনে মাথা নত করে বলে,

“ আব্বা আমি… “

আফজাল সাহেব থমথমে গলায় বলে উঠে,

“ কয়টা গুলি চালিয়েছে ওরা আমার ছেলের শরীরে? “

আফজাল সাহেবের প্রশ্নের পিঠে পার্থর শক্ত খোলস ভেঙে গুড়িয়ে যায়। আচমকাই সে নিজের স্বভাবের বাইরে গিয়ে একটা অভাবনীয় কাজ করে। আফজাল সাহেবকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। শুধায়,

“ ওকে তো আমি ছোট থাকতেও কোলে তুলেছি আব্বা। তখন তো ওকে আমার ছোট তুলোর টুকরো মনে হতো। কিন্তু আজ ওর ভার এতো কিভাবে হয়ে গেলো? আমি আমার ছোট ভাইয়ের ভার কাধে তুলতে পারবো না আব্বা। কখনোই পারবো না। “

আফজাল সাহেব কোনো জবাব দেয় না। নীরবে নিজেকে পার্থর থেকে ছাড়িয়ে নেয়। এক পা দু পা করে হেঁটে করিডর পেরিয়ে সকলের আড়ালে যেতেই উনার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। ব্যথিত স্বরে শুধায়,

“ তুমি আমার গর্ব শোভন। তুমি আমার অহংকার। আব্বাকে ভুল বুঝে যেও না। “

__________

তূর্যর সাথে অপারেশন থিয়েটারে ডাক্তারদের পাশাপাশি তরীও উপস্থিত আছে। যদিও সে সার্জারি করার অনুমতি পাবে না তবুও সে জোর করে অন্তত নিজের ভাইয়ের পাশে থাকার অনুমতিটুকু নিয়েছে। হুমায়ুন রশীদও পাশের থিয়েটারে শোভনের সাথে আছে।

অপারেশন শুরুর ঠিক আগ মুহুর্তে তরী নিজের ভাইয়ের কপালে চুমু খেয়ে শান্ত গলায় শুধায়,

“ আপি আছি তোর সাথে। কিছু হবে না ভাই। “

কথাটুকু বলতে বলতেই তরীর চোখ দিয়ে এক বিন্দু অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। শক্ত মস্তিষ্ক এবং চিত্ত নিয়ে দেখতে থাকে নিজের ভাইয়ের রক্তাক্ত বুকের উপর কাঁটাছেড়া। কিন্তু বেশিক্ষণ সেই দৃশ্য সহ্য করতে পারে না সে। দৌড়ে ওটি হতে বেরিয়ে আসে। ওটির এরিয়া পেরিয়ে দরজা দিয়ে বের হয়েই দৌড়ে গিয়ে পার্থকে জড়িয়ে ধরে। হু হু করে কেঁদে বলে উঠে,

“ আমার ভাইয়ের বুকে কিভাবে গুলি চালালো অমানুষগুলো? “

পার্থ জবাব দিতে পারে না। একই রক্তক্ষরণ যে তার বুকের ভেতরও হচ্ছে। কি অদ্ভুত লীলা এই দম্পতির জীবনে। সুখের পাশাপাশি এই দুটো মানুষের দুঃখের সমীকরণও সবসময় সমান হয়।

__________

এভার ভিউ রেস্টুরেন্টে চালানো সেই জঙ্গি হামলায় জিম্মি ৪৬ জনের মধ্যে ২৭ জন নিহত হয়েছে। আহতের সংখ্যা ৯ জন। তারা সকলেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছে। ১০ জনই কেবল সুস্থ ভাবে সেই ভয়াবহ রাতে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলো। দূর্ভাগ্যবশত আটজন জঙ্গিই নিহত হয়েছে। যাদের মধ্যে ছয়জনই অফিসার শোভন মুহতাশিম চৌধুরীর দ্বারা শুট হয়েছে। এই খবর ইতিমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে গণমাধ্যমে।

বিধ্বংসী সেই রেস্টুরেন্টের মধ্যেই নীরবে দাঁড়িয়ে আছে কালো শার্ট পরিহিত এক সুঠাম দেহী পুরুষ। রেস্টুরেন্টের প্রতিটা দেয়াল এবং ফ্লোরেই মেখে আছে সেই ভয়ানক দিনের রক্তাক্ত স্মৃতি চিহ্ন। সেরকমই এক দেয়ালে শরীরের লাল রঙের তরল পদার্থ দ্বারা লেখা একটা লাইন মনে মনে আওড়ায় সে।

“ দিজ ইজ জাস্ট দ্যা বিগিনিং। “

সেই পুরুষের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন পুলিশ অফিসার বলে উঠে,

“ সম্পূর্ণ ঘটনা থেকে আন্দাজ করা যাচ্ছে যে এই হামলা শুধুমাত্র একটা ডেমো ছিলো। সাধারণ মানুষের মনে ভয় সৃষ্টি করাই এই সংঘের মূল লক্ষ্য ছিলো। “

সেই পুরুষ মুখ ফুটে কিছু বলে না। পুলিশ অফিসার আবার বলে উঠে,

“ তদন্ত চলছে। শীঘ্রই এই ব্যাপারে আমরা কোনো না কোনো তথ্য খুঁজে পাবো। “

প্যান্টের দুই পকেটে হাত গুজে রাখা সেই পুরুষ বেশ শান্ত ভঙ্গিতে পিছু ফিরে মৃদু কটাক্ষ করে জবাব দেয়,

“ নিজেদের মূল্যবান সময় অযথা নষ্ট করবেন না। এই কেস এখন আর আপনাদের মাথা ব্যথা নয়। “

কথাটা বলেই সেই পুরুষ ধীর পায়ে হেঁটে রেস্টুরেন্ট হতে বেরিয়ে যায়। রেস্টুরেন্টের বাহিরে এসেই সে একজনকে আদেশের সুরে বলে উঠে,

“ অফিসার শোভন মুহতাশিম চৌধুরীর কাছে এই খামটা পৌঁছে দিবে। “

“ কিন্তু স্যার উনার কালকে মাত্র সার্জারি হয়েছে। এখনো জ্ঞান ফিরে নি। বাঁচবে কিনা সন্দেহ। “

হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একবার সময়টা দেখে নিয়ে সেই কালো শার্ট পরিহিত পুরুষ সামনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে উঠে,

“ হি উইল গেট ওয়েল সুন। “

__________

পড়ন্ত বিকেলের মিঠে আলো ছড়িয়ে পড়েছে শহর জুড়ে। ঘন্টা খানেক আগে শোভনের জ্ঞান ফিরেছে। আইসিইউর ভেতর একসাথে অনেকজনের প্রবেশ করে দেখা করার অনুমতি নেই। যেকোনো একজনই কেবল দেখা করার সুযোগ পাবে। শোভন আশা করছিলো হয়তো মধু কিংবা আম্মা সবার আগে তার সাথে দেখা করতে আসবে। কিন্তু তার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে আইসিইউর দরজা দিয়ে আফজাল সাহেব প্রবেশ করেন।

আহত শোভন নীরব চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে উনার দিকে। একদিনেই আফজাল সাহেবের কঠিন চেহারা ভেঙে বেশ অন্যরকম দেখাচ্ছে উনাকে। আফজাল সাহেব শোভনের পাশে এসে দাঁড়ায়। গতকাল থেকে যেই ছেলের জন্য উনার অন্তর পুড়ছিলো এখন তার সামনেই উনার মধ্যে বেশ জড়তা কাজ করছে। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও উনি বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পেলেন না।

অক্সিজেন মাস্কের মাধ্যমে কৃত্রিম অক্সিজেন নেওয়া শোভন নিজেই বেশ ভাঙা গলায় ডাকে,

“ আব্বা? “

আফজাল সাহেব উদ্বেগ নিয়ে জবাব দেয়,

“ হ্যাঁ বাবা। “

শোভন আদো হেসে শুধায়,

“ ভালো আছেন? “

ছেলের এই ছোট প্রশ্ন শুনে আফজাল সাহেব আবেগী হয়ে পড়ে। মৃত্যু শয্যায় শুয়ে থেকেও তার ছেলে নিজেকে ছেড়ে নিজের বাবার কথা চিন্তা করছে। এই ছোট বিষয়টাও আফজাল সাহেবের হৃদয় কাঁপিয়ে তুললো। তিনি বেশ রাশভারী গলায় কাঠিন্য বজায় রেখে বলে উঠে,

“ তাড়াতাড়ি সুস্থ হও বাঁদর ছেলে। বাপ হতে যাচ্ছো অথচ তোমার মাঝে বাপ হওয়ার কোনো লক্ষ্মণ নেই। আক্কেল বুদ্ধি এখনো হাঁটুর নিচেই তোমার। “

আফজাল সাহেবের মিছে রাগ দেখে শোভন মনে মনে হাসে। মুখশ্রী খুব নিষ্পাপ সেজে প্রশ্ন করে,

“ বাপ হওয়ার লক্ষ্মণগুলো কি আব্বা? “

এরকম একটা পরিস্থিতিতেও ছেলের রসিকতা দেখে এইবার আফজাল সাহেবও নিঃশব্দে হেসে উঠে। জড়তা ভুলে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে উঠে,

“ সন্তানরা নাকি পিতার পরিচয়ে পরিচিত হয়। কিন্তু আমার কি সৌভাগ্য দেখো। আমি আমার সন্তানদের পরিচয়ে পরিচিত। রাস্তায় হাঁটার সময় সবাই এখন আমাকে দেখলে বলবে, ওইযে শোভনের আব্বা যাচ্ছে। ছয়জন টেরোরিস্টকে একা হাতে দমন করা শোভনের আব্বা উনি। গর্বে তখন আমার বুক ফুলে উঠবে। আমার কথাকে উপেক্ষা করে বিপদ দেখে না পালানোর জন্য আ’ম প্রাউড অফ ইউ। “

আনন্দ অশ্রু গড়িয়ে পড়ে শোভনের চোখ বেয়ে। ছোটবেলা থেকে সে এই একটা কথা শোনার জন্যই সবসময় মুখিয়ে থাকতো। গতকাল রাতে টেরোরিস্ট ইনকাউন্টারে মারা গেলে তার বহু আফসোস বুকে নিয়ে মরতে হতো। এসব ভাবনার মাঝেই আচমকা শোভন প্রশ্ন করে উঠে,

“ আব্বা? তূর্য ভাইয়া কেমন আছেন? “

__________

চব্বিশ ঘন্টার উপর হয়ে গিয়েছে। পৃথা চুপচাপ হসপিটালে আইসিইউর সামনে করিডরে বসে আছে। গত চব্বিশ ঘণ্টায় কেউ তাকে জোর করেও বাড়ি নিয়ে যেতে পারে নি। সাদিকা বেগম বাধ্য হয়েই বেশ কয়েকবার মেয়েকে ধমকাধমকিও করেছেন। এমন তো না যে পৃথা এখানে থাকলে তূর্য সুস্থ হয়ে যাবে। উল্টো তারিণী মা কে না পেয়ে বাসায় উপোষ আছে। সাতদিনের বাচ্চাটা মাতৃদুগ্ধ ছাড়া আর কি-ই বা খাবে? কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে তরী এবং পার্থ বাসায় গিয়ে জমিলা খালার কাছ থেকে তারিণীকে হসপিটালে নিয়ে আসে।

পৃথা কেবল সময় হলে একটা নীরব কেবিনে মেয়েকে নিয়ে ফিড করে অত:পর আবার আইসিইউর সামনে এসে বসে থাকে। শোভনের জ্ঞান ফেরায় সে খুব খুশি। কিন্তু তার সেই খুশি চাপা পড়ে আছে তূর্যর প্রতি চিন্তার আড়ালে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকায় তিনটি বুলেটের একটি বুলেটও তূর্যর হৃৎপিণ্ড ভেদ করে যায় নি। তবুও জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত ডাক্তাররা সম্পূর্ণ আশংকামুক্ত ঘোষণা করতে পারছে না। অবশেষে ৩৬ ঘন্টা পরে পৃথার সেই দুঃশ্চিন্তার অবসান ঘটে। আইসিইউ হতে একজন ডাক্তার এসে জানায় তূর্যর জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু এখন ভিতরে প্রবেশের অনুমতি নেই কারো। পৃথার ছোট্ট মন অস্থির হয়ে আছে তূর্যকে দেখার জন্য। তরী তার উৎকণ্ঠা বুঝতে পেরে পৃথাকে সাথে করে আইসিইউ এরিয়ার ভেতর নিয়ে যায়। আইসিইউ রুমে প্রবেশ করার সুযোগ না পেলেও রুমের বাহির থেকে বিশাল স্বচ্ছ কাঁচ ভেদ করে পৃথা তূর্যকে দেখতে পায়। তরী পৃথাকে একান্তে রেখে অন্যদিকে চলে যায়।

নিজের শুভ্র একটা হাত কাঁচের উপর রেখে পৃথা দু চোখ ভরে দেখতে থাকে ভিতরে বেডে শুয়ে থাকা মানুষটাকে। কিছুক্ষণ আগেও এই মানুষটাকে হারানোর ভয় তাকে কুড়ে খাচ্ছিলো। কি নিদারুণ সেই ভয়! পলকেই মনে হচ্ছিলো পৃথার এতো প্রাপ্তির শেষ অংকে একটা বিশাল শূন্য বসবে। তার একশো বছরের পথচলার স্বপ্ন বুঝি এই ফুরিয়ে এলো। এসব ভাবতে ভাবতেই পৃথার কান্না পেলো। ঠিক সেই মুহুর্তে তূর্যর ক্লান্ত চোখ জোড়া এসে পৃথার দিকে নিবদ্ধ হয়। সেই দৃষ্টি পৃথার হৃদয়ে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করে। পৃথা ফুপিয়ে কান্না করে উঠে। দূর হতে তূর্য এই দৃশ্য দেখে চোখ বুজে নেয়। এক অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করে সে। পৃথা নামক এই মেয়েটা তার ভালোবাসায় ভীষণ ভাবে আহত। এই আহত মেয়েটার ভালোবাসায় সে-ও ভীষণ ভাবে আহত।

__________

ক্যালেন্ডারে কাটা পড়েছে সাতটি বছর। হিমশীতল ঠান্ডা আবহাওয়া বিরাজ করছে প্রকৃতিতে। ঢাকার কোনো এক বিশাল সড়কে জনমানবের বিশাল ভীড়। সকলেই একসঙ্গে সমাগম করে অংশগ্রহণ করেছে জাতীয় সরকার দলের নেতা পার্থ মুন্তাসির চৌধুরীর সমাবেশে। স্টেজের উপর শুভ্র পাঞ্জাবি এবং কালো শাল গায়ে জড়ানো পুরুষটি বেশ গম্ভীর মুখে ভাষণ দিয়ে যাচ্ছে। মুখ জুড়ে তার ঘন কালো দাঁড়ি। কথার গাম্ভীর্যের সাথে তার মুখভাব বেশ মানানসই।

পার্থর ভাষণে ভাটা পড়ে আচমকা তার কানের কাছে বলা আসিফের কথায়। আসিফ আতংকিত গলায় শুধায়,

“ ভাই, আপনার হোম মিনিস্টার হাফ সেঞ্চুরি বার কল দিয়া ফেলসে। “

কথাটা শুনতেই পার্থর বুক কেঁপে উঠে। ডাক্তার তাকে এতো বার কল করেছে কেন? পার্থ বাকি ভাষণটুকু বেশ সংক্ষেপে শেষ করেই দ্রুত গিয়ে নিজের ফোন হাতে নেয়। হাফ সেঞ্চুরি ক্রস করে মিসড কলের সংখ্যা এখন সত্তরের ঘরে গিয়ে ঠেকেছে। পার্থ একটা ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে নেয়। সাথে সাথে আবার তার ফোন বেজে উঠে। পার্থ কল রিসিভ করে কানে ধরতেই অপরপ্রান্ত হতে তীক্ষ্ণ নারী স্বর ভেসে আসে।

“ পার্থ মুন্তাসির চৌধুরী, বক্তৃতা শেষ হলে এখনই নিজের ছেলের স্কুলে যাও। আমার আধঘন্টা পর খুব ইম্পোরট্যান্ট একটা সার্জারি আছে। হাতে সময় নেই। “

পার্থ মিনমিনে গলায় শুধায়,

“ এখনো তো ওর ছুটি হতে সময় আছে। আর ছুটি হলে আব্বাই তো ওকে আনতে যাবে। আমি শুধু শুধু গিয়ে কি করবো? “

তরী কটাক্ষ করে বলে,

“ আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন যাকে নিয়ে কথা হচ্ছে সে আপনার ছেলে। ঘরে সারাদিন তুফান সেজে ঘুরে বেড়িয়ে আপনার ছেলের শান্তি হয়নি, এখন স্কুলেও ওর তুফান এক্সপ্রেস চালু হয়ে গিয়েছে। ফর্ম মাস্টার কল করে বলেছে আপনার ছেলের নামে নালিশ আছে। সেই নালিশ শুনতেই যাবেন আপনি। “

এতটুকু বলেই তরী ফোন কেটে দেয়। পার্থ অসহায় ভঙ্গিতে ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে আসিফকে ডাকে। আসিফ কাছে আসতেই বলে,

“ আমি প্রসূনের স্কুলে যাচ্ছি। তোরা এদিকটা সামলে নিস। “

__________

টিচার্স রুমে পাশাপাশি দুটো চেয়ারে বসে আছে পার্থ এবং প্রসূন। তাদের সামনেই টেবিলের অপরপাশে বসে আছে প্রসূনের ফর্ম মাস্টার জহিরুল ইসলাম। পার্থ ফিসফিসিয়ে ছেলের কানের কাছে প্রশ্ন করে,

“ আবার কি করেছিস বাপ? “

প্রসূন এমন একটা ভাব নিয়ে তাকায় যেন সে ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে জানে না। ছেলের এমন নিষ্পাপ মুখশ্রী দেখে পার্থ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার এই নিষ্পাপ দেখতে বাচ্চা যে একাই সবার নাকে দম করার জন্য যথেষ্ট তা সে বেশ ভালো করেই জানে। তাই অযথা সময় নষ্ট না করে সে সোজা ফর্ম মাস্টারকে প্রশ্ন করে,

“ শুনলাম প্রসূনকে নিয়ে নাকি আপনার কমপ্লেইন আছে। কি করেছে আমার ছেলে? “

জহিরুল সাহেব মাথা নেড়ে বলে উঠে,

“ পার্থ সাহেব, আপনার ছেলে ক্লাসের একটা মেয়েকে গান শুনিয়ে সারাদিন বিরক্ত করে। সেই মেয়ে আমার কাছে কমপ্লেইন করায় আমি প্রসূনের মা’কে কল করতে বাধ্য হয়েছি। “

পার্থ আড়চোখে একবার ছেলের পানে চায়। প্রসূন আপনমনে চুইংগাম চাবাতে ব্যস্ত। পার্থ সামান্য গলা ঝেড়ে বলে উঠে,

“ এটা তো তেমন বড় কোনো বিষয় না। আমার ছেলের গানের গলা ভালো। ফ্রেন্ড হিসেবে গান শুনাতেই পারে। এতে কমপ্লেইনের কি আছে? “

জহিরুল ইসলাম এবার প্রসূনের দিকে তাকিয়ে বলে,

“ প্রসূন, রাইমাকে তুমি যেই গান শুনিয়েছিলে সেই গানটা একটু গাও তো। “

প্রসূন চুইংগাম মুখে রেখেই সাথে সাথে স্পষ্ট গলায় গেয়ে উঠে,

“ সোনা আজ শেষ করো দিন গোনা
বুঝেও কেন বুঝো না
আমি হেব্বি রোম্যান্টিক
আর অল্প ডিমান্ডিং।
রাণী তুমি আর সেজো না ফানি
আমি টানবো তোমার ঘানি
যদি সাচ্চা লাভার হও
আর একটু কেয়ারিং। “

এতদূর শুনেই লজ্জায় পার্থ বিষম খায়। একহাতে ছেলের মুখ চেপে ধরে বলে,

“ থাম বাবা, থাম। “

জহিরুল ইসলাম অসহায় মুখভঙ্গি করে বলে,

“ পার্থ সাহেব, আপনার ভাইয়ের দুই ছেলে-মেয়ে মহুয়া আর সোহানও প্রসূনের সাথে একই ক্লাসে পড়ে। ওরা কি শান্ত, চুপচাপ কিন্তু আপনার ছেলে একাই পুরো ক্লাস মাথায় তুলে রাখে। এরকম হলে কিভাবে চলবে বলুন? “

পার্থ ছেলের প্রতি খুব বিরক্ত অনুভব করে। এই কাহিনী তরীর কানে গেলে তরী ছেলের পাশাপাশি তারও ক্লাস নিবে। রাগী গলায় শুধাবে,

“ নির্লজ্জ বাপের নির্লজ্জ ছেলে। “

সেই দৃশ্য কল্পনা করতেই পার্থর গা শিউরে উঠে।

__________

পূর্ণ চন্দ্রের রজনীতে ছাদে বসে আছে তিন জোড়া যুগল। পৃথার ফাইনাল প্রফ এক্সাম ক্লিয়ার উপলক্ষে সবাই একসাথে চৌধুরী নিবাসে জোড়ো হয়েছে। এতক্ষণ সবাই পরিবারের সাথে নিচেই ছিলো। বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়তেই তারা উপরে উঠে এসেছে। গল্প আড্ডার মাঝে মাঝে পৃথা আড়চোখে তূর্যর ভরাট মুখশ্রী পানে তাকায়। তূর্য চোখের ফ্রেমের চশমা ভেদ করে একবার পৃথাকে দেখে নিয়ে ফের আড্ডায় মশগুল হয়ে পড়ে।

ছয়জনের এই আড্ডা মাতিয়ে রেখেছে শোভন ও মধুমিতা। পার্থ আচমকা হাতের কোল ড্রিংকসের গ্লাসটা নামিয়ে রেখে পৃথাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

“ এই ভূতনি! অনেকদিন একসাথে গান গাওয়া হয় না। গাইবি? “

পৃথা নিজের অতি মনযোগী দৃষ্টি তূর্যর থেকে ফিরিয়ে পার্থর দিকে তাকায়। ফুসে উঠে বলে,

“ বড় দা! স্টপ কলিং মি দ্যাট। “

শোভন টিপ্পনী কেটে বলে,

“ এহ! তোরে ভূতনি ডাকবো না তাইলে পেত্নী ডাকবো? “

পৃথা চাপা রাগ নিয়ে বলে উঠে,

“ ছোট দা! “

শোভন ও পার্থ প্রাণখোলা হাসি দিয়ে কান ধরে বলে,

“ সরি। চল এখন গান শুরু কর। “

পৃথা চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

“ কি গান? “

পার্থ গানের নাম বলতেই পৃথা রাজি হয়ে যায়। শোভন বাকি তিনজনের দিকে তাকিয়ে বলে,

“ এইযে নন সিংগারের দল। আপনারাও জয়েন করবেন কিন্তু। “

তরী হেসে শুধায়,

“ শিওর দেবরজি। “

ভিন্ন তিন জোড়া। ভিন্ন তাদের গল্প। ভিন্ন তাদের অনুভূতির প্রগাঢ়তা। ভিন্ন তাদের কাছে ভালোবাসার মানে। কারো কাছে ভালোবাসার মানে স্ত্রীর সব পরিস্থিতিতে বুঝতে পারার ক্ষমতা। কারো কাছে ভালোবাসার মানে অষ্টাদশীর অভিমান। কারো কাছে ভালোবাসার মানে প্রেমিকার হাস্যজ্বল মুখশ্রী। সঠিক মানুষের প্রেমের হাওয়া ছুঁয়েছে সকলকেই। সেই হাওয়ায় মত্ত হয়ে প্রকৃতি তাদের উপহার দিয়েছে এক সুন্দর পরিণয়।

নিস্তব্ধ রাত মুখরিত হয় ছয় কণ্ঠের মিলনায়তনে,

“ যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
উড়ে গেলো মন পায়রা গুলো
তাও কেনো দেখেও দেখো নি,
আজ ছুঁয়ে বলো আমাকে তুমি
আনলে কেন এমন সুনামি
দাও মন আমাকে এখুনি।
ও রাত বিরাতে
কোনো মতে ঘুম পাড়াই নিজেকে,
দিন দুপুরে
মাঝ পুকুরে রোজ ডুবায় নিজেকে।
এসেছি তোমাকে জানাতে
এসেছি তোমাকে মানাতে,
ভালোবেসে ফেলেছি তোমায়। “

সমাপ্ত

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-৪৯

0

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪৯.

উঁচু দেয়াল টপকে তূর্য সবার অগোচরে রেস্টুরেন্টের পিছন দিয়ে বেরিয়ে আসে। আশেপাশে একবার তাকিয়ে সে সাথে সাথে ফোনে সেভ করে রাখা থানার নাম্বারে কল লাগায়। এক দু দফা কল বাজতেই অপরপাশ থেকে কল রিসিভ হয়। তূর্য ব্যস্ত গলায় রেস্টুরেন্টের এড্রেস জানিয়ে পুলিশদের দ্রুত পৌঁছানোর কথা বলে। কান থেকে ফোনটা নামিয়ে রাখতেই আচমকা রেস্টুরেন্টের ভিতর হতে তীক্ষ্ণ ফায়ারিং এর শব্দ ভেসে আসে। তূর্য হতবুদ্ধি হয়ে পিছনে ফিরে তাকায়। সেই তীক্ষ্ণ শব্দে রাস্তার কিছুসংখ্যক পথচারীরা ভয়ে আতংকিত হয়ে পড়ে। গাছের ডাল পালায় বসে থাকা পাখিরাও ভীত হয়ে শব্দ তুলে ডানা জাপ্টে উঁড়ে যায়।

তূর্য এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে যেভাবে বেরিয়ে এসেছিলো সেভাবেই দেয়াল টপকে আবার রেস্টুরেন্টের ভেতরে প্রবেশ করে। খুব সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে যায় রেস্টুরেন্টের পেছনে এক ঝোপঝাড়ের আড়ালে। একতলা রেস্টুরেন্টের চার দেয়ালের মধ্যে দুটি দেয়ালই সম্পূর্ণ কাঁচের। বাকি দুটো ইট পাথরের তৈরী। ঝোপের আড়ালে সতর্ক ভঙ্গিতে লুকিয়ে থাকা তূর্য কাঁচ ভেদ করে ভিতরের দিকে তাকাতেই আতংকিত হলো। পাঁচটে যুবকের একটি দল রেস্টুরেন্টে উপস্থিত সকল মানুষের দিকে বড়ো বড়ো রাইফেল গান তাক করে রেখেছে। আরেকজন যুবক রাইফেল হাতে সকলকে শাসিয়ে ফ্লোরে এককোণে বসার তাগাদা দিচ্ছে। উপস্থিত মানুষ সকলেই ভীত। তারা সেই রাইফেলের ইশারাই মেনে চলছে। দু চারটে বাচ্চাও রয়েছে ভিতরে। তাদের মধ্যে একটা বাচ্চা শব্দ করে কান্না করে উঠতেই একজন রাইফেল ধারী অমানুষ বাচ্চাটাকে হিংস্র গলায় ধমকে তার দিকে রাইফেল তাক করলো। সাথে সাথে বাচ্চাটার মা নিজের মেয়ের মুখ চেপে ধরে নিজের কোলে মিশিয়ে নিলো।

দৃশ্যটা দেখতেই তূর্যর বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে উঠে। ভিতরে কি চলছে এবং সেই যুবক দলের পরিচয় কি হতে পারে তা সে ইতিমধ্যে বুঝে ফেলেছে। তূর্য সতর্ক দৃষ্টি মেলে আরেকবার রেস্টুরেন্টের ভিতরটা দেখে নেয়। কিন্তু শোভনকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। শোভন কোথায়?

তূর্য আর কিছু ভাবতে পারে না। পিছন থেকে দু জোড়া পায়ের পদচারণের ধ্বনি ভেসে আসে। তূর্য নিজের নিঃশ্বাস আটকে আরেকটু আড়াল হয়ে বসে। দুটো যুবক রাইফেল হাতে চারিদিক ঘুরে দেখছে। এই দুটো যুবক রেস্টুরেন্টের ভিতরের ছয়টি যুবক হতে আলাদা বেশভূষা ধারণ করেছে। ভিতরের যুবকগুলোর মুখশ্রী উন্মুক্ত হলেও এই দুই যুবক নিজেদের মুখের অর্ধাংশ কাপড় দ্বারা ঢেকে রেখেছে। তারা সচেতন দৃষ্টি মেলে চারিদিকে চোখ বোলাচ্ছে।

তূর্য অপেক্ষা না করে অতি সাবধানে নিজের ফোন বের করে আগে ফোনের ভলিউম কমায়। অত:পর নিজের চ্যানেলের একজনকে ম্যাসেজ করে এখানে ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে জানায়। প্রমাণস্বরূপ আড়াল হতে সে কিছু ভিডিও ক্লিপও ধারণ করে সেন্ড করে।

মুহুর্তেই চ্যানেল ২৪ এর মুখ্য হেডলাইন হয়ে যায়, ‘ এই মাত্র পাওয়া খবর – বনানীর সনামধন্য এক রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলা। ’ নিউজে টেলিকাস্ট করা হয় তূর্যের পাঠানো ভিডিও ক্লিপটা। তূর্য সুযোগ বুঝে সাথে সাথে নিজের স্থান পরিবর্তন করে ফেলে। ঝোপঝাড়ের আড়াল হতে বেরিয়ে তুলনামূলক আরো নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নেয়। মনে মনে দোয়া করছে শোভন যেন ঠিক থাকে। তাদের দু’জনেরই সুস্থ ভাবে বাড়ি ফিরতে হবে। কিন্তু সেজন্য আগে তাকে শোভনকে খুঁজে বের করতে হবে। আর সেটা বাহিরে বসে থেকে কখনো সম্ভব না। তূর্য চোখ বুজে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আশেপাশে নজর বুলিয়ে প্রস্তুত হয় সবার আড়ালে রেস্টুরেন্টের ভেতরে প্রবেশের জন্য।

__________

আসরের আজান পড়েছে অনেকক্ষণ হলো। নামাজ সেড়ে বাড়ির সকলে এই মুহুর্তে লিভিং রুমে বসে গল্প করছে। তরী তারিণীকে কোলে নিয়ে বসে তার সাথে খেলতে ব্যস্ত। আফজাল সাহেব ও হুমায়ুন রশীদও বিভিন্ন আলাপ আলোচনায় মগ্ন। সাদিকা বেগম নিজের মেয়ে এবং ছোট পুত্রবধূর সাথে গল্প করছেন। এমন সময়ই তড়িঘড়ি করে লিভিং রুমে প্রবেশ করে পার্থ। একহাতে কানে সে ফোন চেপে ধরে রেখেছে। কপাল এবং চোখে ফুটে আছে চিন্তার ছাপ। কারো সাথে কোনো কথা না বলে সে সোজা রিমোট দিয়ে টিভি অন করে নিউজ ২৪ চ্যানেল দেয়। মুহুর্তেই টিভি হতে সংবাদ পাঠিকার পাঠ করা নিউজ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

“ আজ বিকেলে পাওয়া খবর, বনানীর এভার ভিউ রেস্টুরেন্টে হামলা চালিয়েছে জঙ্গি বাহিনী। বিকাল ৪ টা বেজে ৪৫ মিনিটে আচমকা গান ফায়ারিং এর শব্দে কেঁপে উঠে স্থানীয়রা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ইতিমধ্যে সেখানে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে। আমাদের নিউজ ২৪ চ্যানেলের ক্রাইম বিষয়ক সাংবাদিক তূর্য রশীদ সেই রেস্টুরেন্টের ভেতরের পরিস্থিতির একটা ভিডিও ক্লিপ দ্বারা আমাদের এই জঙ্গি হামলা পরিস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত করেন। “

এতটুকু শুনতেই পৃথা আর্তনাদ করে উঠে। আকস্মিক এরকম একটা ভয়ানক খবরে শিউরে উঠে উপস্থিত সকলে। কেউ কিছু বলবে তার আগেই মধুমিতা ভয়ার্ত গলায় বলে উঠে,

“ শোভন! শোভন আর তূর্য ভাইয়া ওই রেস্টুরেন্টে আছে। “

মুহুর্তেই এক লণ্ডভণ্ড করা ঘূর্ণিঝড় এলোমেলো করে দিয়ে গেলো একঝাঁক হাস্যজ্বল মুখ। পার্থ অপেক্ষা না করে সাথে সাথে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। হুমায়ুন রশীদ এবং আফজাল সাহেবও উঠে তার সাথে আসতে নিলে পার্থ চিন্তিত গলায় বলে,

“ আপনারা বাসায় থাকুন। আমি যাচ্ছি। দোয়া করুন সবাই। আল্লাহ ভরসা কিছু হবে না। “

বলেই পার্থ বেরিয়ে যেতে নিলে তার হাতে টান অনুভব করে। পিছু ফিরে দেখে তরী করুণ দৃষ্টি মেলে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

“ আমার দুই ভাইকে সহি সালামতে নিয়ে ফিরবে। অপেক্ষায় থাকবো। “

সবসময় জনগণকে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়ে বেড়ানো পার্থ তরীকে আশ্বাস দেওয়ার জন্য শব্দ খুঁজে পেলো না। খুব মৃদু গলায় বললো,

“ আমি ফেরার আগ পর্যন্ত সবার খেয়াল রেখো। “

এই সামান্য একটা বাক্যের ভার যে কতটুকু তা তরী টের পেলো পার্থ বেরিয়ে যাওয়ার পর। আফজাল সাহেব এবং হুমায়ুন রশীদ উপরে নিজেদের শক্ত দেখালেও তাদের ভেতর কি চলছে তা আন্দাজ করার সাধ্যি কারো নেই। পৃথা ইতিমধ্যে শব্দ করে কান্নাকাটি করে অস্থির হয়ে যাচ্ছে। তার কান্নার শব্দে তারিণীও গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে কান্না করে যাচ্ছে। ছোট বাচ্চাটা কি খিদেয় কান্না করছে না নিজের মায়ের কষ্ট এবং বাবার অনুপস্থিতি টের পেয়ে কান্না করছে তা বুঝা যাচ্ছে না। সাদিকা বেগম মেয়েকে ছেড়ে নাতনির কান্না থামানোর চেষ্টা করছে।

তরী অসহায় চোখে চারিদিকে সবাইকে দেখে নিয়ে শেষে মধুর দিকে তাকায়। রুমের এককোণে সোফায় নীরবে বসে থাকা মধু বারবার ফোনে কারো নাম্বারে কল করার চেষ্টা করছে। কিন্তু বারবার ব্যর্থ হচ্ছে সে। তরীর নিজেকে অসহায় লাগছে। সে কার খেয়াল রাখবে? কিভাবে রাখবে? এই পরিস্থিতিতে সে কি-ই বা বলে এই মানুষগুলোকে ভরসা জোগাবে? তার নিজেরও ভেতরটা গুমরে উঠছে। তার ছোট ভাই কেমন আছে? কি করছে? ঠিকঠাক বাড়ি ফিরতে পারবে তো?

তরীর ভাবনার মাঝেই জমিলা খালা চিৎকার করে উঠলো,

“ ও ছোডো বউ! আল্লাহ! ছোডো বউর কি হইসে? “

জমিলা খালার চিৎকার শুনে এবং সোফায় নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকা মধুমিতাকে দেখে তরীর টনক নড়লো। সে দ্রুত মধুমিতার কাছে এগিয়ে গেলো। আফজাল সাহেব চিন্তিত গলায় বলেন,

“ আম্মু? মধুমিতাকে হসপিটাল নিয়ে যেতে হবে? গাড়ি বের করবো? “

তরী উত্তর দেয়,

“ না আব্বা। লাগবে না। জমিলা খালা প্লিজ এক গ্লাস পানি নিয়ে আসেন। “

জমিলা খালা তড়িৎ গতিতে পানি নিয়ে এসে হাজির হতেই তরী কিছু পানি নিয়ে মধুর মুখে হালকা করে ছিটিয়ে দেয়। দু তিনবার আলতো করে তার গালে চাপড় মেরে তার নাম ধরে ডাকে। অতি দুশ্চিন্তায় চেতনা হারানো মধু পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। সাথে সাথে তার চোখ গলে পড়ে কয়েক বিন্দু অশ্রু। মধু দূর্বল গলায় বলে,

“ শোভনকে ফিরতে বলুন ভাবী। ওর বাচ্চা পৃথিবীতে আসার আগেই যেনো এতিম না হয়ে যায়। “

মধুর কথার অর্থ বুঝতে পেরেই সকলে বিস্মিত হলো। এতক্ষণ শক্ত হাতে নাতনিকে সামলানো সাদিকা বেগমও এই মুহুর্তে ভেঙে পড়লেন। কান্না জর্জরিত গলায় বললেন,

“ পার্থর আব্বা ছেলে দুইটারে ফিরিয়ে আনেন। নাতি নাতনিদের মাথার উপর থেকে যেনো বাপের ছায়া দূর না হয়। “

__________

ঘাড়ের নিচের অংশে রাইফেল দ্বারা আঘাত করতেই তূর্য হাঁটু ভেঙে আর্তনাদ করে বসে পড়লো। তার অবস্থা দেখে ভয়ে গুটিসুটি মেরে চুপ করে রইলো সকল জিম্মিরা। আঘাত করার সাথে সাথেই তূর্যর ঘাড় বেয়ে তরল রক্ত পড়তে শুরু হলো। একজন জঙ্গি তূর্যকে আরেকবার আঘাত করে বলে উঠে,

“ জানোয়ারের বাচ্চা আমাদের চোখ ফাঁকি দিতে পারবি ভাবসিলি? আমাদের ভিডিও করে নিউজ টেলিকাস্ট করস? “

বলেই তূর্যর চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে সামান্য মুখ উঁচু করে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলে,

“ তোর কি মনে হয় আমরা এসবে ভয় পাই? আমাদের কোনো মৃত্যু ভয় নাই। “

সেই জঙ্গির কথা শেষ হতে না হতেই তূর্য তার মুখ বরাবর থুথু ছুড়ে মারে। তীক্ষ্ণ স্বরে বলে,

“ কি উদ্দেশ্যে সবাইকে জিম্মি করেছিস? “

সেই জঙ্গি রাগে কিছু বলবে তার আগেই বাহির হতে আরেকজন জঙ্গি এসে চেঁচিয়ে বলে,

“ পুলিশ ভিতরে আসার চেষ্টা করছে। “

কথাটুকু শেষ হতেই সেই যুবক দল হতে দুজন রাইফেল হাতে বেরিয়ে যায়। কিছু মুহুর্তের ব্যবধানেই ছন্দপতন হয় বাহির থেকে ভেসে আসা গুলি এবং গ্রেনেডের শব্দে। এই সুযোগেই জিম্মিদের মধ্যে হতে একজন পুরুষ ঝাপিয়ে পড়ে একজন রাইফেল ধারী যুবকের উপর। শুরু হয় তাদের মধ্যে ধস্তাধস্তি। সেই ধস্তাধস্তির ইতি ঘটে রাইফেল হতে ছোঁড়া বুলেটের শব্দে। মুহুর্তেই সেই জিম্মি পুরুষ লুটিয়ে পড়ে ফ্লোরে। তার বুক চিড়ে বেরিয়ে আসা রক্তে মাখামাখি হয়ে যায় সমস্ত ফ্লোর। ক্ষোভে ফেটে পড়া সেই জঙ্গি একটা গুলি করেই ক্ষান্ত হয় নি। আরো বেশ কয়েকটা গুলি ছুড়ে সেই লোকের নিথর দেহে। চোখের পলকেই একজন জিম্মি মৃত্যু বরণ করেন।

চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনার ভয়াবহতায় সকল জিম্মিরা আর্তনাদ করে উঠলো। রাইফেল ধারী যুবকরা আবার রাইফেল তাক করে সকলকে শাসিয়ে বললো,

“ যার মুখ থেকে একটা শব্দ হবে তাকে খুন করে ফেলবো। “

সাথে সাথে সকলে চুপ বনে গেলো। তূর্য চোখের সামনে সব ঝাপসা দেখছে। ঘাড়ের আঘাতপ্রাপ্ত যেই জায়গা হতে রক্ত বের হচ্ছে সেই জায়গায় প্রচুর যন্ত্রণা অনুভব করছে। হঠাৎ সে দেখতে পায় ওয়াশরুম হতে একজন জঙ্গি বেরিয়ে আসছে। তার হাতে থাকা রাইফেলটা তাক করা সামনে হেঁটে আসা আরেক ব্যক্তির দিকে। সেই ব্যক্তি এগিয়ে আসতে আসতে তূর্যর দিকে আহত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রয়। অত:পর চোখ ফিরিয়ে এক বন্দুকধারী জঙ্গিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

“ শান্ত আরেফিন। গত এক বছর ধরে তুমি নিখোঁজ ছিলে। তোমার পরিবার হন্য হয়ে তোমাকে খুঁজছে। আমি জানিনা গত এক বছর তুমি কোথায় ছিলে কিংবা কার আদেশে এসব করছো। কিন্তু তুমি যা করছো তা ভুল। নিরপরাধ মানুষদের যেতে দাও। “

শোভনের থমথমে গলায় বলা কথায় শান্তর মাঝে কোনো ভাবান্তর হলো না। সে কিছুক্ষণ চুপ রইলো। অত:পর কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে ধীর গলায় প্রশ্ন করে,

“ আমার পরিবার কেমন আছে? “

শোভন মৃদু হাসে। এই আটজন জঙ্গির মধ্যে চারজনেই হলো তার মিসিং এইট কেসের নিখোঁজ যুবকেরা। শান্ত আরেফিন, রফিকুল আসাদ রাফি, তামিম রহমান, মাহদী তাওসিফ। বাকি চারজনকে সে চিনেনা। এই চারজনের মধ্যে শান্ত নামক ছেলেটার মধ্যেই সে তেমন একটা হিংস্রতা লক্ষ্য করে নি। তাই ইচ্ছে করে তাকে উদ্দেশ্য করেই সে এই প্রস্তাবটা রেখেছে। শান্তর প্রশ্নের জবাবে সে বলে,

“ তোমার অপেক্ষায় আছে। ঠিক যেমন এই জিম্মিদের পরিবার তাদের অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছে একইভাবে তোমার পরিবারও তোমার অপেক্ষায় আছে। সবাইকে যেতে দাও। এসবের পিছনে কে দায়ী আমাকে জানাও। আমি কথা দিচ্ছি তোমাকে তোমার পরিবারের সাথে দেখা করিয়ে দিবো। “

শান্তর দৃষ্টি এলোমেলো হয়। পরিবারের সাথে দেখা করার প্রস্তাবে মন কিছুটা দূর্বল হয়ে পড়ে। সেই সময়ই পিছন থেকে মাহদী বলে উঠে,

“ এই অফিসার তোকে ভোলানোর চেষ্টা করছে শান্ত। আমাদের কোনো পরিবার নেই, কোনো পিছুটান নেই। “

শান্তর দৃষ্টি বদলে যায় মুহুর্তে। সে শোভনের থেকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। শোভন আশাহত হয়। তাকে ঘাড় ধরে তূর্যর পাশে হাঁটু ভেঙে বসানো হয়। শোভন ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করে,

“ আপনাকে ফিরে আসতে নিষেধ করেছিলাম ভাই৷ কেন ফিরে আসলেন? “

তূর্য ধীর গলায় বলে,

“ আজকে যদি আমরা ফিরি তাহলে একসাথে ফিরবো শোভন। নাহয় একসাথে শহীদের মর্যাদা লাভ করবো। “

__________

সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমেছে। রেস্টুরেন্টের ভিতরের পরিস্থিতি সকলের অজানা। এক দল পুলিশ বাহিনী ভিতরে প্রবেশের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। উল্টো তিনজন পুলিশ জঙ্গিদের সাথে গোলাগুলিতে নিহত হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথাসাধ্য চেষ্টা করছে অন্তত কোনো চুক্তির বিনিময়ে হলেও যেনো জিম্মিদের উদ্ধার করা যায়। কিন্তু জঙ্গি বাহিনীরা যেনো কোনো চুক্তি করতে রাজি নয়। না কাউকে ছাড়তে আগ্রহী। ইতিমধ্যে এই হামলার খবর ছড়িয়ে পড়েছে দেশী, বিদেশী গণমাধ্যমে। সকলের কেবল একটাই প্রশ্ন। এই হামলার পিছনে আসল মাস্টারমাইন্ড কে?

বনানী এলাকার সড়ক গুলোতে সকল প্রকার চলাচল ইতিমধ্যে নিষেধ করা হয়েছে। পার্থ নিষেধাজ্ঞা পেরিয়ে বনানীতে সেই রেস্টুরেন্টে পৌঁছাতে পারে নি। তবে উদ্ধার অভিযান পরিকল্পনাকারী বাহিনীর সাথে সে যোগাযোগ করেছে। সতর্ক করে বলেছে যেকোনো মূল্যে যেনো অফিসার শোভন মুহতাশিম চৌধুরী এবং জার্নালিস্ট তূর্য রশীদকে যেনো সুস্থভাবে উদ্ধার করা হয়। পাশাপাশি সকল জিম্মিদেরও যেনো উদ্ধার করা হয়।

পুলিশের এই অভিযান ইতিমধ্যে সেনাবাহিনীর হাতে সমর্পণ করা হয়েছে। ঘটনা স্থলে পৌঁছেছে সেনাবাহিনীর এক বিশেষ দল। সেই দলের মেজরের নেতৃত্বে শুরু হয় উদ্ধার অপারেশন। রাত ৯ টা ১০ বাজে সেনাবাহিনীর দল পরিকল্পনা অনুযায়ী সম্পূর্ণ রেস্টুরেন্ট ঘেরাও করে নেয়।

__________

সেনাবাহিনীর উপস্থিতি টের পেতেই জঙ্গিরা ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। মুহুর্তেই রেস্টুরেন্টের ভেতর রণক্ষেত্র শুরু হয়। জঙ্গিরা এলোমেলো ভাবে সকল জিম্মিদের উপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। পরিস্থিতি বিগড়ে যেতেই শোভন সুযোগ নেয়। খুব কৌশলে একজন জঙ্গিকে আহত করে তার রাইফেল তুলে নেয়। তূর্যও পরিস্থিতি দেখে নিজেকে বাঁচানোর জন্য একটা সোফার আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। সেখান থেকে সে দেখতে পায় গুলিবর্ষণে এক নিহত মহিলার বুকের উপর একটা চার বছরের বাচ্চা মেয়ে পড়ে কান্না করছে। জঙ্গিদের একজন সেই বাচ্চার দিকে রাইফেল তাক করতেই তূর্য দ্রুত গতিতে সোফার আড়াল থেকে বেরিয়ে বাচ্চাটার দিকে এগিয়ে যায়। সেই জঙ্গি গুলি ছোঁড়ার আগ মুহুর্তেই শোভন পিছন থেকে তার পিঠে শুট করে। সেই সুযোগ তূর্যও বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে সাথে সাথে সেখান থেকে সড়ে যায়। গুলিবর্ষণের তীক্ষ্ণ শব্দ চিড়ে শোভন চিৎকার করে বলে উঠে,

“ ভাইয়া আপনি বাচ্চাটাকে নিয়ে বেরিয়ে যান। আমি আসছি। “

তূর্য শোভনের কথা শুনেও তাকে ছেড়ে যেতে মন সায় দেয় না। তবে কোলে থাকা বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে তার মায়া লাগে। এই মুহুর্তে এখানে এক মুহুর্তেরও জীবনের নিশ্চয়তা নেই। বাচ্চাটাকে বাঁচানোর চিন্তাও তার মাথায় ঘুরছে। সে ছলছল চোখে একপলক শোভনের দিকে তাকিয়ে থেকে সাথে সাথে ওয়াশরুমের দিকে দৌড়ে চলে যায়।

শোভন তূর্যকে যেতে দেখেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সাথে সাথে সে একটা পিলারের পিছনে আড়াল হয়ে ফের জঙ্গিদের উদ্দেশ্যে গুলি ছোঁড়া শুরু করে। এসবের মাঝে সে সুযোগ বুঝে একপাশের বিশাল গ্লাসেও কয়েকবার শুট করে গ্লাস ভেঙে দেয় যেনো জিম্মিরা সেখান দিয়ে পালাতে পারে। তার এই বুদ্ধি কাজে দেয়। বেশ কিছু জিম্মিই সুযোগ বুঝে ভাঙা কাঁচের দেয়ালের একপাশ দিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যায়। আর মাত্র দুজন জঙ্গি জীবিত আছে। তাদের মধ্যে একজন হলো শান্ত। সেনাবাহিনীও ইতিমধ্যে এগিয়ে এসেছে। সেনাবাহিনীকে এগিয়ে আসতে দেখে তাদের মধ্যে একজন জঙ্গি দ্রুত ওয়াশরুমের দিকে দৌঁড়ে যায়।

শান্তকে ওয়াশরুমের দিকে যেতে দেখেই শোভনের বুক কেঁপে উঠে। তূর্য না ওয়াশরুমের দিকে গিয়েছে? শান্তকে বাঁধা দেওয়ার জন্য শোভন শুট করতে নেয়। কিন্তু সাথে সাথে সে উপলব্ধি করে রাইফেলে আর কোনো বুলেট নেই। তাই সে বাধ্য হয়ে রাইফেল হাত থেকে ফেলেই শান্তর পিছু ছুটে। ঠিক সেই মুহুর্তে পিছন হতে আরেকজন জঙ্গি শোভনের পিঠে শুট করে। শোভনের পা থেমে যায়। সে টালমাটাল পায়ে পিছনে ফিরতেই সেই জঙ্গি আবার তার বুকে শুট করে। ঠিক সেই মুহুর্তে সেনাবাহিনী ভিতরে প্রবেশ করে সেই জঙ্গিকে শুট করে। শরীরে দুটি বুলেটের অস্তিত্ব নিয়ে শোভন অসাড় দেহ নিয়ে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে। চোখের সামনে ভেসে উঠে অসংখ্য স্মৃতি। চোখজোড়া বুজে ফেলার আগেই অস্ফুটে বলে উঠে,

“ এখন কি আপনি আমার প্রতি গর্ববোধ করবেন আব্বা? “

__________

ওয়াশরুমের উপরে এককোণে ছোট একটা কঁচের জানালা ছিলো। একটা ছোট বাচ্চা চাইলে অনায়াসেই সেদিক দিয়ে বের হতে পারবে। তূর্য কোলের বাচ্চা মেয়েটার কপালে একটা চুমু দিয়ে বলে,

“ দোয়া করছি এই দিনটা যেনো তোমার স্মৃতির পাতা থেকে যেনো মুছে যায়। “

বাচ্চাটা ইতিমধ্যে কান্না থামিয়ে তূর্যর দিকে ফোলা ফোলা চোখ মেলে তাকিয়ে আছে। তূর্য আর অপেক্ষা না করে খুব সাবধানতার সহিত বাচ্চাটাকে সেই জানালা দিয়ে বের করে দেয় এবং ভেতর থেকে জানালাটা আটকে দেয়ালে পিঠ হেলান দিয়ে চোখ বুজে নিঃশ্বাস নিতে থাকে। ঠিক সেই মুহুর্তে ওয়াশরুমের দরজাটা শব্দ তুলে খুলে যায়। শান্ত হিংস্র চোখে একপলক তূর্যকে দেখে। অত:পর কিছু বুঝে উঠার আগেই তূর্যর দিকে রাইফেল তাক করে শুট করা শুরু করে। রাইফেলে অবশিষ্ট শেষ চারটা বুলেটের মধ্যে তিনটা বুলেট তূর্যর বুকে চালাতেই সে অবশিষ্ট শেষ একটা বুলেট নিজের মাথায় তাক করে। আজ রাতে আর যাই হোক সে অন্য কারো হাতে মরতে রাজি না। এই ভাবনা নিয়েই শেষ বুলেটটা নিজের মাথায় শুট করে সে।

ওয়াশরুমের সিঙ্কের পাশের দেয়াল ঘেঁষে মেঝেতে বসে পড়ে তূর্য। বুকটা যেনো ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছে। প্রাণপ্রদীপ নিভু নিভু প্রায়। সাদা পাঞ্জাবিটা ইতিমধ্যে সম্পূর্ণ রক্তে লাল রঙ ধারণ করেছে। তূর্য কাঁপা কাঁপা হাতে প্যান্টের পকেট হতে নিজের ফোনটা বের করে। কল লিস্ট হতে মিস এ বি সি লেখা নাম্বারটা ডায়াল করে ফোন কানে চেপে ধরতেই চোখ বুজে একটা লম্বা নিঃশ্বাস নেয়।
অল্প মুহুর্তেই অপর পাশ হতে ফোনটা রিসিভ হয়। ভেসে আসে পৃথার কান্না মিশ্রিত স্বর,

“ তূর্য? ঠিক আছেন আপনি? ছোট দা? ছোট দা ঠিক আছে? “

পৃথা একদমে আরো অসংখ্য প্রশ্ন করে যেতে থাকে। তূর্য চোখ বুজে রেখেই মৃদু হাসে। মরণ যন্ত্রণা কমে গেলো নাকি হঠাৎ করে? পৃথার লাগাতার প্রশ্নের ভীড়েই তূর্য রুদ্ধস্বরে বলে উঠে,

“ বলো তো মেয়ে। তুমি প্রেমিকা হতে চাও নাকি স্ত্রী? “

পৃথার প্রশ্নের ঝুলি থেমে যায়। তার মনে পড়ে যায় তাদের প্রথম দিনের ফোনালাপ। এই মুহুর্তে এই রুমে সে আর তারিণী একা। সবাই চেতনা হারানো মধুমিতাকে নিয়ে ব্যস্ত নিচে। পৃথা হিচকি তুলে কাঁদছে। কান্নার দমকে তার শরীর কেঁপে উঠছে। তার সাথে তাল মিলিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকা তারিণীও কাদছে। পৃথা ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে বলে উঠে,

“ স্ত্রী। সম্পূর্ণ অধিকার সমেত স্ত্রী। “

পৃথার বলা কথাটা তূর্যর কানে পৌঁছালো নাকি বুঝা গেলো না। তার কানে চেপে ধরা ফোনটা হাত থেকে পড়ে যায়। চোখ বুজে আসে শান্ত ভঙ্গিতে। নিথর দেহের উপরের অংশ হেলে পড়ে একদিকে। রক্তে মাখামাখি অবস্থায় পড়ে থাকা ফোনের অপরপাশ হতে ভেসে আসছে তারিণীর কান্নার স্বর এবং পৃথার চিৎকার,

“ আমি আপনার স্ত্রী হতে চাই তূর্য। শুধু আপনার স্ত্রী। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-৪৭+৪৮

0

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪৭.

বছর ঘুরে আবার এসেছে শীতকাল। ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়েছে ঢাকা শহর। ফাইনাল এক্সাম দিয়ে সবেমাত্র ভার্সিটি থেকে বেরিয়েছে মধুমিতা। সাথে সাথে তার চোখে পড়লো একজন হাওয়াই মিঠাই ওয়ালাকে। মধু মনে মনে বেশ খুশি হলো। এতক্ষণ ধরে তার মিষ্টি কিছু খেতে ইচ্ছে হচ্ছিলো। মনের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে মধুমিতা একটা গোলাপি রঙা হাওয়াই মিঠাই কিনে নিলো। অত:পর টিএসসি চত্ত্বরের একপাশে বসে সে রাস্তার দিকে দৃষ্টিপাত করে হাওয়াই মিঠাই খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

এরকমই কোনো এক শীতের বিকেলে তার আর শোভনের প্রথম দেখা হয়েছিলো। ঠিক তার ভার্সিটির সামনেই। কিছুদিন যেতেই মধু লক্ষ্য করে শোভন নামক এই ছেলেটাকে প্রায়শই তার ভার্সিটি এরিয়া তে দেখা যায়। প্রথম প্রথম মধুমিতা দেখেও না দেখার ভান করে হলে ফিরে যেতো। কিন্তু একদিন সে সাহস নিয়ে শোভনের মুখোমুখি হয়। কপট রাগ দেখিয়ে প্রশ্ন করে,

“ কি চাই? “

শোভনের অকপটে জবাব,

“ তোমাকে চাই। নিজের ঘরের বউ হিসেবে। “

লোকটার এমন লাগামহীন কথায় মধু সেদিন বিরক্ত হয়। রাগ নিয়ে বলে,

“ এই ছেলে? কি মনে করো নিজেকে? কোন সিনেমা দেখে এসে এসব ফিল্মি ডায়লগ ছাড়ছো? “

“ আমি বড় হয়েছি কেবল একজনের সিনেমা দেখেই। দেব দা। শিরায় শিরায় রক্ত, আমি দে দা’র ভক্ত। “

শেষের লাইনটা বলে শোভন বিস্তর হাসে। মধুমিতার গা জ্বলে যায় সেই হাসি দেখে। সে শাসিয়ে বলে,

“ আর কখনো যেনো আমার আশেপাশে না দেখি। নাহলে গুন্ডা ভাড়া করে ধরে পেটাবো। আর তবুও দূর না হলে পুলিশে কেস করবো। “

“ এনিটাইম ম্যাডাম। আমি থানায় ডায়েরি খুলে বসে থাকবো আপনার অভিযোগ তুলে নিতে। “

মধুমিতা বিরক্ত হয়। এই লোককে হুমকি ধামকি দিয়ে লাভ নেই বুঝতে পারে। তাই সে নীরবে চলে যেতে উদ্যত হয়। শোভন সেদিন তাকে পিছু ডেকে বলেছিলো,

“ এইযে মিস মধু। আপনাকে কিছু বলার ছিলো। “

মধু ঘাড় ঘুরিয়ে ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করে কি? শোভন হাসতে হাসতে দু লাইন গেয়ে উঠে,

“ ও মধু, ও মধু,
আই লাভ ইউ,
আই লাভ ইউ। “

মধু বিস্ময়ে বাকহারা হয়ে পড়ে। অত:পর ফুসে উঠে বলে,

“ আপনি কি এইমাত্র আমাকে টিজ করলেন? “

“ মোটেও না। আমি শুধু দেব দা’র সিনেমার একটা গানের দুটো চরণ গেলাম। “

পুরনো স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠতেই মধুমিতা আপনমনে হেসে উঠে। তাদের সাদামাটা প্রেমের সাক্ষী এই টিএসসিকে হঠাৎ করেই তার খুব ভালো লাগছে। টিএসসির বাতাসে হাজারো প্রেমের কাহিনীর মাঝে মিশে আছে তাদের সাদামাটা প্রেমের ঘ্রাণও।

__________

হসপিটাল থেকে বেরয়েই ধানমন্ডির একটা শপিং মলের বেবি শপে এসেছে তরী। উদ্দেশ্য নিজের ভাজতির জন্য সুন্দর কিছু জামা এবং খেলনা কেনা। যদিও আম্মা ইতিমধ্যে নিজের নাতনির জন্য অসংখ্য জামা এবং নিমা বানিয়েছেন। তবুও তরীর ইচ্ছা সে নিজেও পছন্দ করে তার ভাজতিকে কিছু জামা এবং খেলনা উপহার দিবে। বেবি শপে ঘুরতে ঘুরতে তরী আচমকা দেয়ালের পাশে থাকা এক আয়নার দিকে তাকায়। সাথে সাথে সে তড়িৎ গতিতে পিছনে ফিরে তাকিয়ে সামান্য গলা উঁচু করে ডাকে,

“ ছোট? “

তরীর গলা শুনে আশেপাশের কিছু মানুষ ক্ষানিকের জন্য তার দিকে তাকায়। অত:পর যে যার কাজে ফের মন দেয়। তূর্যও ফিরে তাকায়। বোনের সাথে অপ্রত্যাশিতভাবে দেখা হয়ে সে অবাকও হয় এবং খুশিও। তরী এগিয়ে যেতেই প্রশ্ন করে,

“ তুই এখানে কি করিস আপি? “

তরী নিজের ভাইয়ের দু’হাতে থাকা কতগুলো মেয়ে বাচ্চার জামা দেখে বলে,

“ তুই যেই কাজে এসেছিস আমিও সেই কাজেই এসেছি। “

তরীর কথার মানে বুঝতে পেরে তূর্য হাসে। তরী প্রশ্ন করে,

“ একা এসেছিস? “

“ হ্যাঁ। অফিস থেকে বের হয়ে সোজা এখানে আসলাম। পৃথার পায়ে পানি জমার কারণে ওকে আপাতত বাসা থেকে বের হতে দেই না। তাই ও বাসায় বসে অনলাইন শপিং করে আর আমি স্ব শরীরে এসে। “

তরী হেসে বলে,

“ তোরা দুইটাই পাগল। আমাদেরও সুযোগ দে কিছু কেনার। “

তূর্য আর তরী গল্প করতে করতে আরো কিছু শপিং করে বেরিয়ে একটা কফিশপে বসে। কফি অর্ডার দিয়েই তরী বলে,

“ দেখ আমি কিন্তু আগেই বলে দিচ্ছি, বেবি আমাকে ফুপ্পি ডাকবে। যদি পার্থর পাল্লায় পড়ে ওকে মামী ডাক শিখিয়েছিস তাহলে তোকে আর পার্থকে আমি তুলে আছাড় মারবো। “

“ বাপরে! তুই এটা নিয়ে আবার ভাইয়ার সাথে ঝগড়া করেছিস নাকি? “

“ আলবাত করেছি। অসভ্য লোক বলছিলো ও মামা হলে আমি মামী হবো। আমিও বলে দিয়েছি আমি ফুপ্পি হলে উনি ফুফা হবে। ব্যস! এই নিয়ে ওর সাথে আমার খুব সিরিয়াস ঝগড়া হয়েছে। “

তূর্য হেসে বলে,

“ শিট। তারমানে তোদের বেবি আসলে এরকম ঝগড়া আমার আর পৃথারও ফেস করতে হবে। “

তরী চোখ টিপে বলে,

“ চাপ নিস না। আমার বাচ্চা তোকে মামাই ডাকবে। আফটার অল আমার একমাত্র ভাই তুই। “

তূর্য হেসে একটা প্রশান্তির নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,

“ একবছরে আমাদের জীবন কতো বদলে গেলো না আপি? গতবছরও আমার জীবনে প্রায়োরিটি লিস্টে শুধু কাজ আর ফ্যামিলি ছিলো। আর এখন বছর ঘুরতে না ঘুরতে আমার ফ্যামিলিতে এবং প্রায়োরিটি লিস্টে দুজন নতুন মানুষ যোগ হয়ে গেলো। টু বি অনেস্ট আমি ছোট থাকতে জেলাস ফিল করতাম যে পাপা হয়তো তোকে বেশি আদর করে। কিন্তু এখন নিজে ফিল করতে পারছি। মেয়ের বাবা হওয়া ইজ সাচ এ ব্লেসিং। আই এম অলরেডি এটাচড টু হার। তুই দেখিস আমার মেয়েও তার পাপার প্রিন্সেস হবে। “

তরী মুগ্ধ চোখে নিজের ভাইকে দেখতে ব্যস্ত। তূর্যর চোখে মুখে ফুটে আছে খুশির রেখা। তরী টেবিলের উপর থাকা ভাইয়ের একহাতের উপর নিজের হাত রেখে বলে উঠে,

“ ইউ উইল বি এ গুড ফাদার আই নো। আমাদের ছোট্ট মা অলরেডি তার পাপার প্রিন্সেস। “

__________

সেন্ট মার্টিন দ্বীপের বুকে ফের ফিরেছে পার্থ এবং তরী। গতবার শাশুড়ির কথায় বাধ্য হয়ে আসলেও এবার তরী স্ব ইচ্ছায় ঘুরতে এসেছে। আচমকা সমুদ্র তাকে খুব টানছিলো। মনের টানকে নাকি কখনো ফিরিয়ে দিতে নেই। তরী পার্থর কাছে প্রস্তাব রাখে সমুদ্রে ঘুরে আসার প্রসঙ্গে। পার্থ নাকোচ না করলেও বলেছিলো ব্যস্ততা মিটলেই সে তরীকে নিয়ে যাবে সমুদ্রে। পার্থর সেই ব্যস্ততা মিটতে লেগে গেলো একটা মাস। এক মাস পর হলেও দ্বীপে এসে তরী খুশিতে উৎফুল্ল হয়। বহু কষ্টে সে তিনদিনের ছুটি ম্যানেজ করেছে হসপিটাল থেকে। কর্ম জীবনের ব্যস্ততা থেকে মাঝেমধ্যে ছোট খাটো ব্রেক মস্তিষ্ক এবং বদনে সজীবতা এনে দেয়।

সেই একই বাংলোতে এসে তরী মনটা দূর্দান্ত রকমের ভালো হয়ে যায়। সে মনে মনে এই বাংলোটাতেই আসতে চাইছিলো। কিন্তু মুখ ফুটে আর পার্থকে বলা হয়নি। ভাগ্যিস পার্থ অন্য কোথাও তাকে নিয়ে যায় নি।

বাংলোতে প্রথম দিন তাদের পৌঁছাতে পৌঁছাতেই সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো। একে তো জার্নির ক্লান্তি ভাব তার উপর রাতের বেলা তাই তারা আর বেরোয় নি। খেয়েদেয়ে সোজা ঘুমিয়ে শরীর সতেজ করে। পরের দিন দুপুরে সি ফুড দিয়ে লাঞ্চ করে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়েই দু’জন বেরিয়ে পড়ে দ্বীপ ঘুরে দেখতে। বাসায় সবসময় তরী থ্রি পিস পড়ে থাকলেও এখানে আসার সময় লাগেজে করে শুধু শাড়িই নিয়ে এসেছে। আজকে সে হালকা ধূসর এবং লাল রঙের মিশ্রিত একটা শাড়ি পড়েছে। আয়োজন করে বেশ সেজেছেও।

কিন্তু যার জন্য এতো আয়োজন তার কোনো পাত্তাই নেই। পার্থ আপনমনে সমুদ্রের তীরে পা ভিজিয়ে হেঁটে চলেছে। তার দৃষ্টি স্থির এই অপার্থিব সুন্দর প্রকৃতির দিকে। দূরে বালির উপর হেঁটে চলা তরীর মন খারাপ হয়। সে হাঁটা ছেড়ে বালির উপর নিজের জুতো জোড়া খুলে তার পাশে পা ভেঙে বসে পড়ে। অত:পর দূর হতে পার্থকে দেখতে থাকে। হালকা গোলাপি রঙের শার্ট এবং সাদা রঙের প্যান্ট পরিহিত সেই পুরুষ আপনমনে সমুদ্রের তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে বেশ দূরে চলে যায়। তরী যে তার পাশ হতে কখন সড়ে গেলো যেনো টেরও পেলো না।

তরী নিজের মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকায়। এই শীতকালে দূর দূর পর্যন্ত দ্বীপের বুকে বৃষ্টি নামার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবুও যদি প্রকৃতি নিয়ম বদলে বর্ষণ ঘটাতো তবে কেমন হতো? পার্থ কি তবে এই মুহুর্তে দৌড়ে এসে তরীর হাত ধরে বাংলোর দিকে ছুট লাগাতো সেদিনের মতো? পুরো দ্বীপ জুড়ে কি ইলেক্ট্রিসিটি নিশ্চল হয়ে পড়তো? আসতো কি সেই ঝড়ো বেপরোয়া রাত?

তরীর কান মুহুর্তেই গরম হয়ে উঠলো। মনে মনে নিজেকে শুধালো,

“ দিন দিন খুব নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছিস তরী। “

পরমুহূর্তেই তার মস্তিষ্ক বলে উঠে,

“ কিসের নির্লজ্জ টির্লজ্জ? কোনো পরপুরুষ নিয়ে তো আর ভাবছিস না। যাকে নিয়ে ভাবছিস সে তোর নিজেরই স্বামী। এই লোককে তুই চোখ দিয়ে গিলে খেলেও কোনো পাপ নেই। “

তরীর ভাবনার মাঝেই পার্থ আচমকা তার সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসলো। দৌড়ে আসার ফলে বার কয়েক হাফ ছাড়লো। অত:পর বলে,

“ হাত দাও তো তরী। “

আচমকা পার্থ এভাবে সামনে এসে পড়ায় তরী হকচকিয়ে উঠে। কিছুক্ষণ পার্থর দিকে তাকিয়ে থেকে শান্ত গলায় প্রশ্ন করে,

“ কি? “

পার্থ নিজেই তরীর একহাত টেনে ধরে। অত:পর তার হাতের তালুতে কিছু একটা দেয়। তরী প্রথমে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেও পরে নিজের হাতের তালুতে থাকা তিনটা ছোট শুভ্র ঝিনুককে দেখে খুশি হয়। হাসিমুখে বলে,

“ এতক্ষণ ঝিনুক কুড়াচ্ছিলে? “

পার্থ হাসি চেপে বলে,

“ উহু। নিজেকে সংবরণও করছিলাম। অতি সুন্দর বউয়ের দিকে তাকিয়ে ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙতে চাইছিলাম না। “

পার্থর চাপা হাসি দেখে তরীর শ্যাম বর্ণের মুখশ্রী লজ্জায় লাল হয়। সে তড়িৎ অপর হাতে নিজের জুতো জোড়া তুলে উঠে দাঁড়িয়ে মিছে রাগ দেখিয়ে বলে,

“ মিথ্যুক। “

তরীর কথা শেষ হওয়ার আগেই সে নিজেকে শূন্যে অনুভব করে। দুই হাতে পার্থর ঘাড় জড়িয়ে ধরে বলে,

“ কি করছো? “

পার্থ তরীকে পাজাকোলে তুলে নিয়ে বাংলোর পথে হাঁটতে হাঁটতে প্রাণখোলা হাসি নিয়ে গেয়ে উঠে,

“ সারদি কি রাতো মে,
হাম সোয়ে রাহে এক চাদার মে,
হাম দোনো তানহা হো,
না কোয়ি ভি রাহে ইস ঘার মে। “

এই দফায় আর তরী লজ্জা পায় না। বরং মুগ্ধ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে পার্থর দিকে। তার মুগ্ধতার সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে থাকে পার্থর গুনগুনিয়ে গাওয়া গানের চরণ।

__________

শীত ঋতু বিদায় নিয়েছে সবে ক’দিন হলো। কোনো এক শুক্রবার সন্ধ্যার ঘটনা। পৃথার লেবার পেইন উঠে। খিচুনিযুক্ত ব্যথা তীব্র থেকে তীব্রতর রূপ ধারণ করে। তূর্য ঘাবড়ে যায়। ডেলিভারি ডেট তো পরের মাসে দিয়েছে ডক্টর। এই আগাম পেইনের মানে কি? দিশাহারা তূর্য দ্রুত নিজের পাপাকে ডেকে পৃথাকে নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। সম্পূর্ণ রাস্তা জুড়ে আগলে রাখে পৃথাকে নিজের বুকে। হুমায়ুন রশীদ গাড়ির লুকিং গ্লাসে ছেলের চিন্তিত মুখশ্রী এবং পুত্রবধূর কান্না দেখে সাবধানের সহিত গাড়ির স্পিড বাড়ায়। পৃথা কান্না জর্জরিত স্বরে বারবার বলে যাচ্ছিলো,

“ আমার আব্বা আম্মাকে কল করুন প্লিজ। আমি মনে হয় আর বাঁচবো না। “

পৃথার যন্ত্রণায় জড়িত কণ্ঠ শুনে তূর্য অসহায় অনুভব করে। ঘাবড়ানো পৃথাকে আশ্বাস দিয়ে বলে,

“ কিছু হবে না তোমাদের। দুজনেই সুস্থ থাকবে ইনশাআল্লাহ। “

ওটির ভেতর নিয়ে যাওয়া হয়েছে পৃথাকে। ডক্টর জানিয়েছে তার নরমাল ডেলিভারির লেবার পেইন উঠেছে তাই তারা নরমালেই চেষ্টা করছেন। ইতিমধ্যে সবাই হসপিটালে এসে পৌঁছেছে। তরী ভাগ্যক্রমে আগে থেকেই হসপিটালে উপস্থিত ছিলো। ও তাই পারমিশন নিয়ে ওটির ভেতর নিজেও সামিল থাকছে পৃথার পাশে। তূর্য অশান্ত ভঙ্গিতে ওটির সামনে করিডর জুড়ে পায়চারি করছে। বুকের ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে উঠছে। সময়ের আগে তার মেয়ের আগমন ঘটার কারণ কি? তূর্য তো পৃথার ব্যাপারে সব নিজ দায়িত্বে হ্যান্ডেল করেছে। তার দ্বারা কি কোথাও ভুল হয়েছে? পৃথা ঠিক থাকবে তো?

তূর্যর ভয়ে ধুকপুক করা হৃদয়টা শান্ত হয় ওটির দরজা খুলে তরীকে বেরিয়ে আসতে দেখে। তরীর কোলে হালকা গোলাপি রঙের টাওয়ালে মোড়ানো একটা ফুটফুটে শিশু। তরী ভাইয়ের দিকে আগে এগিয়ে গিয়ে বাচ্চাকে এগিয়ে দেয়। তূর্য আগে রুদ্ধস্বরে প্রশ্ন করে,

“ পৃথা? “

তরী হেসে শুধায়,

“ আলহামদুলিল্লাহ। ঠিক আছে। “

তূর্যর বুকের ওপর থেকে যেনো বিশাল পাথর সড়ে গেলো। সে মেয়েকে কোলে নিতে গিয়েও থেমে যায়। হুমায়ুন রশীদের দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন গলায় বলে,

“ পাপা ও অনেক ছোট। আমার হাত গড়িয়ে পড়ে গেলে? “

ছেলের এমন কথা শুনে হুমায়ুন রশীদ হাসেন। হাসে বাকিরাও। পার্থ তূর্যর পিঠ চাপড়ে বলে,

“ বুকে আগলে নাও মেয়েকে। কিছু হবে না। “

তূর্য কম্পিত হাতে মেয়েকে তুলে নেয় কোলে। মেয়ে তার ছোট ছোট চোখ মেলে নিজের পাপাকে দেখতে ব্যস্ত। তূর্যর মনে হয় তার মেয়ে তাকে বলছে,

“ হ্যালো পাপা। অগ্রীম এসে চমকে দিলাম তো? “

নিজের মনের উদ্ভট ভাবনার উপর তূর্য নিঃশব্দে হাসে। আফজাল সাহেব মেয়ের জামাইকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

“ বাচ্চার কানের কাছে আজান দাও বাবা। “

__________

হসপিটাল হতে চারদিনের মাথায় বাড়ি ফিরেছে পৃথা। তার বাবার বাড়ির সবাইও আজ এই বাসায় উপস্থিত। সবাই ব্যস্ত তারিণীকে ঘিরে। হুমায়ুন রশীদ এবং তূর্য মিলে ঠিক করেছে তিনদিন পর পবিত্র শুক্রবারে তারিণীর আকিকার অনুষ্ঠান আয়োজন করবে। সেই বিষয়ে আলোচনা চলছে লিভিং রুম জুড়ে। পৃথা বাড়ি ফিরে কিছুক্ষণ নিচে সবার সাথে বসে ছিলো। তূর্য তাকে বসিয়ে রেখে উপরে রুমে কি যেনো করতে গিয়েছে।

পৃথা যখন নীরবে সাদিকা বেগমের পাশে বসে বিভিন্ন আদেশ বাক্য শুনতে ব্যস্ত তখনই তূর্য উপর থেকে নেমে এলো। শাশুড়ি মায়ের দিকে তাকিয়ে হেসে শুধায়,

“ আমি পৃথা আর তারিণীকে রুমে নিয়ে যাই আম্মা? “

সাদিকা বেগম ব্যস্ত গলায় নাতনিকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

“ হ্যাঁ বাবা। চলো। “

তূর্য সামান্য ইতস্ত অনুভব করে। মাথা নিচু করে বলে,

“ আমি দুজনকেই সামলে নিতে পারবো আম্মা। “

সাদিকা বেগম সেকেন্ড খানিক চুপ থাকে। অত:পর হেসে তারিণীকে তূর্যর কোলে দিয়ে বলে,

“ আচ্ছা সমস্যা নেই। “

তূর্য হেসে একহাতে তারিণীকে কোলে নিয়ে এবং অন্যহাতে পৃথার হাত ধরে লিভিং রুম থেকে বেরিয়ে আসে। সিঁড়ির কাছাকাছি আসতেই সে তাকিয়ে দেখে আশেপাশে কেউ আছে নাকি। কেউ নেই বুঝতেই তারিণীকে পৃথার কোলে দিয়ে দু’জনকে একসাথে কোলে তুলে নেয়। পৃথা ঘাবড়ে উঠে। শক্ত করে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে মিনমিনে গলায় শুধায়,

“ পড়ে যাবো। প্লিজ নামান। “

তূর্য সিঁড়ি ভেঙে উঠতে উঠতে বলে,

“ পড়তে দিলে তো পড়বে! “

রুমের দরজা আগে থেকেই খোলা ছিলো। তূর্য দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একবার মেয়ে অত:পর স্ত্রীর পানে তাকিয়ে হেসে বলে,

“ ওয়েলকাম টু আওয়ার ফেইরিল্যান্ড। “

চলবে…

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪৮.

মধ্যরাতে মেয়েকে কোলে নিয়ে রুম জুড়ে পায়চারি করছে তূর্য। গত এক ঘন্টা ধরে মেয়ের গলা ফাটানো কান্না থেমে সবেমাত্র তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়েছে। মেয়েকে চোখ বুজতে দেখেই তূর্য একটা প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। খুব সাবধানে তারিণীকে বেবি কটে শুইয়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। পিছনে ফিরে তাকায় পৃথার দিকে। পৃথা জেগেই ছিলো। তূর্য নীরবে পৃথার পাশে এসে বসতেই পৃথা ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,

“ আপনি তারিণীর অভ্যাস খারাপ করছেন। মহারাণীর ডিমান্ড দেখেছেন? দু’দিনেই বাপের নেওটা হয়ে গিয়েছে। বাপের কোল ছাড়া অন্য কারো কোলে ঘুমাতে রাজি না ও। “

“ তো? আমার মেয়ে মন চাইলে হাজারটা ডিমান্ড করবে। পূরণের জন্য ওর পাপা এখনো বেঁচে আছে। “

পৃথা মুখ কুচকে বলে,

“ যখন আপনি থাকবেন না তখন আপনার মেয়েকে সামলাতে আমার কাঠখড় পোহাতে হবে। “

তূর্য প্রশ্ন করে,

“ আমি আবার কোথায় যাবো? “

“ দিনের অর্ধেক সময় যে অফিসে পাড় করেন ভুলে গিয়েছেন? পাপাও হসপিটাল থাকে। বাসায় আমরা মা মেয়ে একা থাকবো। আমাকে একদম জ্বালিয়ে মারবে। “

তূর্য নিঃশব্দে প্রাণখোলা হেসে হিসহিসিয়ে শুধায়,

“ তুমিও তো আমাকে বহু জ্বালাও পৃথা। আমার মেয়ে নাহয় তার কিছুটা শোধ তুললো। সইতে পারবে না? “

পৃথা ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তূর্যর হাসি দেখতে দেখতে অস্ফুটে জবাব দেয়,

“ সব পারবো। “

পৃথার দৃষ্টি তূর্যর চোখ এড়ায় না। সেই ঘোর লাগা দৃষ্টি সে উপেক্ষাও করে না। এগিয়ে গিয়ে নিজের কোমল অধর ছোঁয়ায় পৃথার ললাটে। ললাট হতে ধীরে ধীরে গালে অত:পর পৃথার অধরে এসে থামে তা। পৃথার হৃদয় অচিনপুরে ছটফট অনুভূত হয়। মনের কোণে উঁড়ে বেড়ায় রঙ বেরঙের ভালোবাসার প্রজাপতি। সেই উড়ন্ত প্রজাপতির ফাঁক গলে পৃথা তূর্যর শার্টের কলার টেনে আরেকটু নিজের দিকে নিয়ে আসে। তূর্য পৃথার নরম শরীর টেনে নিজের আয়ত্তে নিয়ে অতি সঙ্গোপনে পৃথার ঘাড়ে চিবুক ছুঁইয়ে নরম স্বরে বলে,

“ মেয়েকে ঘুম পাড়িয়েছি। এখন মেয়ের মায়ের পালা। “

__________

সকাল সকাল পশু কুরবানির মাধ্যমে তারিণীর আকিকার প্রাথমিক কাজটুকু সেড়ে ফেলা হয়েছে। সম্পূর্ণ নাম রাখা হয়েছে তারিণী রশীদ। আপাতত ছাদে বড়সড় হাড়িতে বাবুর্চির রান্না বান্না চলছে। বাড়ির পুরুষরা ছাদে সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে ব্যস্ত। পুরুষরা জুম্মার নামাজটা মসজিদ হতে সেড়ে আসতেই খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হয়।

পৃথার রুমে তারিণীকে কোলে নিয়ে বসে আছে তরী। আপনমনে ভাইজির সঙ্গে বলে যাচ্ছে ডিজনিল্যান্ড প্রসঙ্গে অনেক কথা। রুমে আরো উপস্থিত রয়েছে পৃথা এবং মধুমিতা। তারা তরীর আর তারিণীর আলোচ্য বিষয় গভীর মনে উপভোগ করে চলেছে। তরী আচমকা পৃথার দিকে ফিরে বলে,

“ বাই দ্যা ওয়ে পৃথা খুব শীঘ্রই তোমার প্রমোশন হতে চলেছে। “

পৃথা আগ্রহী গলায় বলে,

“ কিসের প্রমোশন বড় ভাবী? “

মধুমিতা আড়ষ্ট ভঙ্গিতে তরীকে বলে,

“ ভাবী প্লিজ। “

পৃথা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকায়। তরী হেসে বলে,

“ পৃথার কাছে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই মধুমিতা। পৃথা যে খুব সম্ভাব্য ফুপ্পি হতে চলেছে এটা খুব চমৎকার একটা সংবাদ। “

পৃথা অবাক হয়। বিস্মিত দৃষ্টি মেলে মধুমিতার দিকে তাকায়। অত:পর উল্লাসে ফেটে পড়ে চেঁচিয়ে উঠে,

“ সত্যি ছোট ভাবী? “

পৃথার চিৎকারের জোরে তারিণী ভীত হয়। কিছুক্ষণ টলমল চোখে চেয়ে থেকেই অত:পর গলা ফাটিয়ে কান্না শুরু করে দেয়। তূর্য, শোভন, পার্থ হয়তো এদিকেই ছিলো। মেয়ের কান্না শুনতেই তূর্য দরজা নক করে তড়িঘড়ি রুমে প্রবেশ করে। তার পিছন পিছন প্রবেশ করে তারিণীর দুই মামাও। তূর্য মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে কান্না থামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পৃথার দিকে এক পলক ফিরে প্রশ্ন করে,

“ কান্না করছে কেনো? “

পৃথা কিঞ্চিৎ ভয় নিয়ে জবাব দেয়,

“ আমি একটু জোরে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম। ভয় পেয়ে হয়তো কাঁদছে। “

তূর্য রাগ হয় না। শান্ত গলায় বলে,

“ সমস্যা নেই। এখনি চুপ হয়ে যাবে। “

শোভন পাশ থেকে পৃথার মাথায় গাট্টা মেরে বলে,

“ এই ভূতনি। আর কখনো তোর পেত্নি মার্কা গলা নিয়ে আমার ভাগনির সামনে চিল্লালে তোকে একদম গাছে উল্টো লটকিয়ে রাখবো। “

পৃথা ফুসে উঠে বলে,

“ আমার মেয়ের সামনে আমাকে আজেবাজে নামে ডাকবি না ছোট দা। “

“ একশো বার ডাকবো। কি করবি? “

“ তাহলে আমিও তোকে তোর বাচ্চার সামনে মামতো ভূত ডাকবো। “

শোভন হেসে বলে,

“ আমার বাচ্চা কই পেলি? “

পৃথা নাক ফুলিয়ে বলে,

“ ছোট ভাবী প্রেগন্যান্ট। খুব শীঘ্রই বাপ হচ্ছিস। “

পৃথার কথা শুনে পার্থ এবং তূর্য চমকালেও শোভন স্বাভাবিক থাকে। জবাবে বলে,

“ এখনো কনফার্ম না। একটু পর হসপিটাল গিয়ে রিপোর্ট নিয়ে আসবো। “

তারিণী ইতিমধ্যে কান্না থামিয়েছে। তূর্য শোভন ও মধুমিতার উদ্দেশ্যে বলে উঠে,

“ এডভান্স কংগ্রেচুলেশন। “

পার্থ তরীর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে শুধায়,

“ বাপ হওয়ার বয়সে মামা, চাচা হয়ে যাচ্ছি ডাক্তার। আপনার কি মনে হয় না, আপনার ভাই এবং আমার ভাইকেও মামা, চাচা ডাক শোনার ব্যবস্থা করে দেওয়া উচিত আমাদের? “

তরী নিজের একটা কনুই দিয়ে পার্থর পেটে গুতা মেরে বলে,

“ চুপ থাকো তো। “

শোভন হাতঘড়ি দেখে বলে,

“ আমি বের হই তাহলে। হসপিটাল থেকে রিপোর্ট নিয়ে সোজা ফিরবো। “

তূর্য তারিণীকে পৃথার কোলে এনে দিয়ে বলে উঠে,

“ দাঁড়াও। একসাথে যাই তাহলে। আমারও ওদিকে একটু কাজ আছে। “

শোভন মাথা নেড়ে বলে,

“ আমি তাহলে নিচে গিয়ে ওয়েট করছি ভাইয়া। আপনি আসুন। “

বলেই শোভন আর মধুমিতা বেরিয়ে যায়। তাদের পিছুপিছু পার্থ আর তরীও বেরিয়ে যায়। পৃথা তারিণীকে সহ উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে,

“ আপনি কোথায় যাচ্ছেন? “

“ এই একটু কাজ আছে। চিন্তা করো না। শোভনের সাথেই ব্যাক করবো। “

বলতে বলতে তূর্য আয়নার সামনে গিয়ে হেয়ার ব্রাশ দিয়ে চুল সামান্য ব্রাশ করে নেয়। অত:পর নিজের ওয়ালেট এবং ফোন প্যান্টের পকেটে নিয়ে পৃথার দিকে এগিয়ে এসে কোলে থাকা মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে পৃথার কপালে চুমু খায়। হেসে বলে,

“ যাই। “

কথাটা বলে তূর্য সড়ে যেতে নিয়েও পারে না। তারিণী নিজের হাতের ছোট ছোট আঙ্গুল দিয়ে তার পাঞ্জাবির বুকের একপাশ খামচে ধরে রেখেছে। তূর্য মৃদু হেসে বলে,

“ মা? পাপা তাড়াতাড়ি চলে আসবো। যেতে দাও। “

তারিণী তূর্যর পাঞ্জাবি ছাড়ে না। এতক্ষণ কেঁদে চোখ মুখ লাল করে রেখেছে সে। সেই টলমল করা ফোলা চোখ নিয়ে নিজের পাপার দিকে তাকিয়ে রয়। তূর্য নিজের হাতের সাহায্যে সাবধানে মেয়ের বাঁধন ছাড়ায়। অত:পর মেয়ের হাতের পিঠে চুমু খেয়ে পৃথার দিকে তাকিয়ে বলে,

“ সাবধানে থেকো। আর তারিণীর খেয়াল রেখো। “

তূর্যর কথা পৃথার কাছে অদ্ভুত লাগে। সে চোখ ছোট করে বলে,

“ এভাবে বলছেন কেন? “

পৃথার প্রশ্নের পিঠে তূর্য জবাব খুঁজে পায় না। এই কথাটা সে কেনো বললো সে নিজেও জানে না। তাই আর কিছু না বলে হালকা হেসে বেড়িয়ে যায়।

__________

লিভিং রুম পেরিয়ে বাড়ির মেইন গেটের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে শোভন ও মধুমিতা। শোভন মধুমিতার দিকে তাকিয়ে বলে,

“ অস্থিরতা কমাও তো মধু। রিপোর্ট যাই আসুক আই হ্যাভ নো প্রবলেম। “

শোভনের কথায় মধু শান্ত হয় না। তার মনের অস্থিরতা বাড়ছে বৈকি কমছে না। এই অস্থিরতা কি শুধুমাত্র রিপোর্ট কি হতে পারে সেই বিষয়ের চিন্তা হতেই কাজ করছে? নাকি অন্যকিছু? শোভন মধুমিতার মুড ঠিক করার জন্য হেসে মৃদু গলায় গুনগুনিয়ে উঠে,

“ ও মধু ও মধু
আই লাভ ইউ
আই লাভ ইউ। “

সেই পরিচিত গান শুনতেই মধু হেসে দেয়। শোভন বলে,

“ ফিরে এসে যেনো এই হাসিমুখটাই দেখি। “

বলেই শোভন উল্টো ঘুরে বেড়িয়ে যেতে নিলে আচমকা তার কদম নড়বড়ে হয়ে উঠে। পড়ে যেতে নিয়েও একটা শক্ত হাতের সাহায্যে সামলে নেয় নিজেকে। আফজাল সাহেব সামান্য ধমকে বলে উঠে,

“ সাবধানে হাঁটো। “

শোভন মাথা নেড়ে আচ্ছা বলেই বেড়িয়ে যায়।

__________

একটা রেস্টুরেন্টে মুখোমুখি বসে আছে তূর্য ও শোভন। তূর্য কফির মগে চুমুক দিতে দিতে লক্ষ্য করে শোভনের চেহারার স্পষ্ট খুশির ঝলক। শোভন বারবার রিপোর্ট ফাইলটা দেখছে আর আপনমনে হাসছে। তূর্য বলে,

“ বাড়িতে ফেরার পথে কিন্তু মিষ্টি নিতে ভুলো না শোভন। “

শোভন হেসে বলে,

“ শুধু মিষ্টি বলছেন ভাই? আমি পারলে পুরো মিষ্টির দোকান তুলে নিয়ে যাই। “

তূর্য ফোনের স্ক্রিনে সময়টা দেখে নিয়ে বলে উঠে,

“ আর বিশ মিনিট বসি আমরা। জুয়েলারি শপটা খুললেই ওখান থেকে তোমার বোন আর ভাগ্নির গিফট পিক করে বাসায় রওনা হবো আমরা। “

শোভন বলে,

“ আমি ভাবছি মধুর জন্যও ওখান থেকে একটা কিছু গিফট নিয়ে নিবো। ও আমাকে এতো বড় গিফট দিচ্ছে, আমারও ওকে কিছু গিফট দেওয়া উচিত। “

“ শিওর। “

মধুমিতার অস্থিরতা এখন শোভনের উপর এসে ভর করেছে। তার ইচ্ছে করছে চিল্লিয়ে সবাইকে এই গুড নিউজটা জানাতে। বাসায় ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করার ধৈর্য্য কাজ করছে না তার মধ্যে। সবাইকে জানাতে না পারলেও অন্তত মধুকে তো এখনই জানিয়ে দেওয়া যায়। তাই না? এতে মধুর টেনশনও কমে যাবে।

যেই ভাবনা সেই কাজ। শোভন নিজের ফোনটা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

“ ভাইয়া আমি এক মিনিট একটা ইমপোর্ট্যান্ট কল এটেন্ড করে আসছি। “

তূর্য বুঝতে পারে শোভনের গুরুত্বপূর্ণ কল কার উদ্দেশ্যে হতে পারে। সে হেসে মাথা নাড়ে। শোভন ফোন নিয়ে রেস্টুরেন্টের আউটডোর এরিয়ায় এসে দাঁড়ায়। ডায়াল করে মধুর নাম্বার। কিছুক্ষণের মধ্যেই কল রিসিভ হতে শোভন উৎফুল্ল গলায় বলে,

“ আমরা প্যারেন্টস হবো মধু। রিপোর্ট পজেটিভ। “

ফোনের অপর পাশ হতে মধু কিছু বলে। শোভন হাসিমুখে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতে থাকে। আচমকা বেখেয়ালি বসত একজনের সাথে ধাক্কা লেগে তার হাত থেকে ফোনটা পড়ে যায়। শোভন সাথে সাথে সরি বলে ফোন তুলে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তার পাশ কেটে সেই আগুন্তকও ভিতরে প্রবেশ করে। সাথে সাথে শোভনের টনক নড়ে উঠে। সে দ্রুত ঘাড় ঘুরিয়ে কাঁচের দরজা ভেদ করে রেস্টুরেন্টের ইনডোর এরিয়ার দিকে তাকায়। এইমাত্র যেই ছেলেটার সাথে তার ধাক্কা লেগেছে তাকে বিচক্ষণ ভঙ্গিতে মাথা থেকে পা পর্যন্ত পরখ করে। ছেলেটা তার চোখের সামনে দিয়েই সবগুলো টেবিল ক্রস করে ওয়াশরুমের দিকে চলে যায়। শোভন আবারও সতর্ক দৃষ্টি মেলে চারিদিকে তাকায়। সাথে সাথে তার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে। দ্রুত ভিতরে প্রবেশ করে আগে নিজেদের টেবিলের কাছে যায়। তূর্যর কাছে গিয়ে তাড়া দিয়ে বলে,

“ ভাই লিভ দিজ প্লেস রাইট নাও। সামনের মেইন এন্টারেন্স দিয়ে বের হবেন না। সবার অগোচরে তাড়াতাড়ি রেস্টুরেন্টের পিছন দিয়ে বেরিয়ে যান এন্ড কল দ্যা কপস। “

শোভনের আকস্মিক এতগুলো কথা শুনে তূর্য ঘাবড়ে যায়। চিন্তিত সুরে প্রশ্ন করে,

“ কি হয়েছে শোভন? “

“ ভাই সময় নষ্ট করবেন না। যান প্লিজ। যাই হয়ে যাক না কেনো ভিতরে ফিরে আসবেন না। এট এনি কস্ট দ্রুত পুলিশ ফোর্সকে এখানে আসতে ইনফর্ম করুন। “

বলেই শোভন তূর্যকে টেনে তাড়াতাড়ি এখান থেকে বের করার চেষ্টা করে। তূর্য বুঝে উঠতে পারছে না শোভন এমন কেন করছে। কিন্তু খুব সাংঘাতিক কোনো বিষয় ঘটতে চলেছে তা সে আঁচ করতে পারছে। তাই আর সময় নষ্ট না করে সে শোভনের কাধে হাত রেখে বলে,

“ টেক কেয়ার। আমাদের জন্য বাসায় সবাই অপেক্ষা করছে ভুলে যেও না। “

শোভন মাথা নাড়ে। তূর্য আর কিছু না বলে বেরিয়ে যায় দ্রুত। শোভন এক পলক তূর্যর যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। অত:পর নিজের প্যান্টের পিছন হতে খুব সাবধানে একটা রিভলবার বের করে সবার আড়ালে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে যায়।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-৪৫+৪৬

0

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪৫.

আঁধার আসমানে ভেসে আছে এক ধবধবে অর্ধ আকৃতির চিকন চাঁদ। সেই চাঁদের আশেপাশে জ্বলজ্বল করছে নক্ষত্রপুঞ্জিরা। একত্রে মিলে জানান দিচ্ছে আজ চাঁদ রাত অর্থাৎ আগামীকাল পবিত্র ঈদুল ফিতর।

চৌধুরী নিবাসের পুরুষেরা এক সঙ্গে বসে লিভিং রুমে খবর দেখতে ব্যস্ত। সাদিকা বেগম এবং জমিলা খালা মিলে আগামীকাল যা যা রান্না করবেন তা আজ রাতেই গুছিয়ে রাখছেন। মধুমিতা ব্যস্ত বাহারি রকমের ডেজার্ট আইটেম বানাতে। রান্নাবান্নার ক্ষেত্রে এই কাজটা করতে মেয়েটা খুব উপভোগ করে। বিয়ে করে এই বাড়ির বউ হয়ে আসার পর থেকে সবসময় যে কোনো উপলক্ষেই ডেজার্ট বানানোর দায়িত্বটা সে অলিখিত ভাবে নিজের কাধে তুলে নিয়েছে।

পার্থ খবর দেখার মাঝে একবার আড়চোখে চারিদিকে চোখ বুলায়। তরীকে কোথাও দেখছে না সে। কোথায় গেলো? এতক্ষণ তো রান্নাঘরে আম্মার সাথেই ছিলো। ভাবতে ভাবতেই পার্থ উঠে উপরের দিকে হাঁটা ধরে।

নিজের রুমে নীরবে প্রবেশ করতেই দেখে বিছানায় বসা তরীকে। হালকা সোনালী রঙের একটা অরগাঞ্জা থ্রি পিস পড়ে আছে সে। মাথার চুলগুলো একটা ক্লাচার দিয়ে খোপা করে রাখা। হাতে থাকা মেহেদীর কোন দিয়ে বাম হাতের তালুতে কিছু একটা আঁকিবুঁকি করার চেষ্টা চালাতে ব্যস্ত সে।

পার্থ এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করে,

“ মেহেদি দিতে জানেন ম্যাডাম? “

তরী অসহায় মুখে পার্থর দিকে তাকিয়ে বলে,

“ এর থেকে সহজ তো আমার বায়োলজি প্র্যাক্টিকালের ড্রইং ছিলো। “

“ আগে কখনো ঈদে মেহেদী লাগাও নি? “

“ মাঝে মধ্যে সময় পেলে মেহেদি আর্টিস্ট বাসায় কল করে নিতাম। এসে সুন্দর করে ডিজাইন করে দিয়ে যেতো। “

“ তাহলে আজ ডাকো নি কেনো? “

“ খেয়াল ছিলো না। “

পার্থ তরীর পাশে বসে বলে,

“ সবসময় যে ডিজাইনই করতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। চাইলে হাতের মাঝে গোল করে একটা বৃত্ত আর আঙুল ভরে মেহেদি লাগালেই পারো। ওটা আরো বেশি সুন্দর লাগবে। “

তরীর বুদ্ধিটা বেশ পছন্দ হয়। সে একটা টিস্যু নিয়ে হাতের এলোমেলো মেহেদীর ডিজাইন মুছে পার্থর কথা মতো লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পার্থ তার পাশে বসে একহাতে ফোন চালাতে চালাতে অপরহাতে তরীর ক্লাচার টেনে খোপা খুলে দেয়। সাথে সাথে তরী বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করে,

“ সমস্যা কি? “

পার্থ ফোনের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেই নিজের একহাতে তরীর চুলের গোছা পেঁচিয়ে ধরে বলে,

“ আমি তোমাকে বিরক্ত করবো না, তুমিও এখন আর আমাকে বিরক্ত করো না তো। “

তরী ফুসে উঠে সামনে ফিরে ফের হাতে মেহেদী লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই লোকের সাথে বেশি তর্ক করাও জ্বালা। সর্বদা বেশ শান্ত সেজে ঘুরে বেড়ানো এই অতিশয় ভদ্রলোক যে কতটা নির্লজ্জ তা তরী ছাড়া আর কেউ জানেনা। তাই আপাতত নিজের কাজে মনযোগ দেওয়াই উত্তম মনে করে সে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বেডরুমের দরজায় নকের শব্দ হয়। পার্থ তরীর চুল ছেড়ে দিয়ে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। রুমে প্রবেশ করে শোভন ও মধুমিতা। মধুমিতার হাতে একটা ট্রে তে সবেমাত্র রান্না করা চার বাটি ফিরনি। তরী হাসিমুখে বলে,

“ গরম গরম খাবে নাকি? “

“ হ্যাঁ ভাবী। ছাদে চলুন। চাঁদ রাতে চাঁদ দেখতে দেখতে গল্পও করা হয়ে যাবে। “

তরীর কাছে প্রস্তাবটা ভালো লাগে। তার একহাতে মেহেদী দেওয়াও শেষ। অপর হাতে আরেকটা মেহেদীর কোন আর কিছু টিস্যু নিয়ে সে বিছানা থেকে নেমে বলে,

“ চলো। “

মধুমিতা পার্থর দিকে তাকিয়ে বলে,

“ দাদা আপনিও চলুন। চারজনের জন্যই ফিরনি নিয়েছি আমি। “

পার্থ মৃদু হেসে বলে,

“ তোমরা যাও। আমার একটু কলে কথা বলতে হবে। “

তরী একহাতে পার্থর ফোন টেনে নিয়ে বলে,

“ ফ্যামিলি টাইমের মাঝে নিজের ফোনকে একটু বিরতি দাও তো। “

শোভন ভাবীর সাথে সুর মিলিয়ে বলে,

“ চল না। তোর ফোন আর ফোনকল কোথাও পালিয়ে যাবে না। কিন্তু দুই দিনের জীবনে এই সুযোগ দ্বিতীয় বার না-ও আসতে পারে। “

শোভনের কথা শুনে তিনজনই তার দিকে সরু চোখে তাকায়। তিনজনের দৃষ্টি দেখে শোভন অস্বস্তিতে পড়ে যায়। সে গলা ঝেড়ে বলে,

“ আমি তো কথার কথা বললাম। “

পার্থ আলতো হাতে নিজের ঘাড়ের একপাশ ম্যাসাজ করতে করতে বলে উঠে,

“ ওকে। নো ফোনকল। অনলি ফ্যামিলি টাইম নাও। “

__________

মুষুলধারে বৃষ্টির শব্দ নিস্তব্ধ রাতের সৌন্দর্য কয়েক গুণ বাড়িয়ে তুলেছে। সেই সুন্দর রাতে আরেকটা সুন্দর দৃশ্য হলো একজন যুবক বসে খুব মনযোগ দিয়ে নিজের স্ত্রীর হাতে মেহেদী দিয়ে দিচ্ছে। সেই রমণীর সেদিকে খেয়াল নেই। সে আপনমনে চরম বিরক্তি নিয়ে বলে চলেছে,

“ লোকে আপনাকে দুইদিনের মধ্যে বউ পাগল উপাধি দিবে তূর্য। ভাববে আমি আপনাকে জাদু টোনা করে বিয়ে করেছি। “

তূর্য সামান্য গম্ভীর স্বরে বলে,

“ তোমাকে কে বলেছিলো রান্নাঘরে গিয়ে মাতাব্বরি করতে? আয়না খালা তো আছেই। “

পৃথা অবাক গলায় বলে,

“ তো? উনি আছে দেখে কি আমি যেতে পারবো না নাকি? কালকে ঈদ অথচ ঘরের বউয়ের রান্না করা কোনো খাবার না খেয়ে তুমি আর পাপা কালকে নামাজ পড়তে যাবে এটা কেমন দেখায়? “

“ আর এখন যে রান্নায় হাত লাগাতে গিয়ে মাছ মাংসের গন্ধে বমি করেছো এটা খুব ভালো হয়েছে তাইনা? “

পৃথা মুখ ফুলিয়ে অন্য দিকে ফিরে তাকায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তূর্য তার হাত ছেড়ে দিয়ে বলে,

“ হয়ে গিয়েছে। “

পৃথা আগ্রহ নিয়ে নিজের হাতের তালুর দিকে তাকাতেই দেখে একপাশে একটা চাঁদ আর তার পাশেই মেহেদী দিয়ে ইংরেজি লেটারে টি পি টি লেখা। পৃথা চোখ সরু করে প্রশ্ন করে,

“ একটা টি ফর তূর্য এবং পি ফর পৃথা নাহয় বুঝলাম। আরেকটা টি কার জন্য? “

তূর্য এবার বেশ আগ্রহী গলায় বলে,

“ আমাদের বেবির নাম। “

“ আপনি ঠিক করে ফেলেছেন? “

“ ফাইনাল ডিসিশন তোমার। তোমার পছন্দ হলে রাখবো। “

কথাটা বলেই তূর্য ফের আগ্রহী গলায় বলে,

“ আমার মনে হয় ইট ইজ এ বেবি গার্ল। “

“ আপনি কিভাবে বুঝলেন? “

“ শি ইজ এটাচড টু মি। মেয়ে বেবিরা না বাবাদের সাথে খুব এটাচড হয়? “

পৃথা ভাবুক গলায় বলে,

“ ইউ আর রাইট। এখন থেকেই কি জেদ রে বাবা! আপনি কিছুদিনের জন্য দূরে গিয়েছেন ও একদম খাবার দাবারের বিরুদ্ধে অনশণ জারি করে বসেছে। “

তূর্য নিঃশব্দে হাসে। পৃথা ফের আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করে,

“ নাম কি ভেবেছেন বলুন না। “

“ তারিণী। “

পৃথা খুশিতে আটখানা হয়ে পড়ে। নামটা কি সুন্দর! তার বেশ পছন্দ হয়েছে। সে তূর্যর দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে আওড়ায়,

“ তারিণীর পাপা। “

‘ তারিণীর পাপা ‘ কথাটা শুনতেই তূর্যের বুকের ভেতর প্রগাঢ় আবেগের সমারোহ ঘটে। সেই আবেগকে পশ্রয় দিয়েই ও পৃথার পেটের কাছে মাথা নিয়ে সেখানে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

“ মা? আমাকে শুনতে পাচ্ছো? তাড়াতাড়ি এসে পড়ো। পাপা ইজ ওয়েটিং ফর ইউ। লাভ ইউ। “

পৃথা হাসিমুখে বসে দেখতে থাকে সেই দৃশ্য। একটা ছোট্ট মেয়ে বাচ্চা কোলে তূর্যকে কেমন লাগবে ভাবতেই আবেগের আন্দোলনে কেঁপে উঠে সে।

__________

ঈদের দিন বিকেলে পরিবারের সাথে দেখা করতে চৌধুরী নিবাসে এসেছে পৃথা। সাথে তূর্য আর হুমায়ুন রশীদও রয়েছে। সবার সাথে কুশল বিনিময় করে শোভনের কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরতেই শোভন ঠাট্টা করে বলে,

“ এই ভূতনি। তোর এই অবস্থা কেন? আমার ভাগিনা কিংবা ভাগ্নিকেও কি নিজের মতো পাতলু বানাতে চাস নাকি? “

পৃথা ঠোঁট উল্টে বলে,

“ আমি এখন এক বাচ্চার মা। প্রমোশন হয়েছে। সম্মান দিয়ে কথা বল আমাকে। আমার সাথে ফাইজলামি করলে বেবির কাছেও ঘেঁষতে দিবো না তোকে। “

“ তোর পারমিশনের অপেক্ষা কে করবে? “

পার্থ পাশ থেকে বলে উঠে,

“ তোর দিন শেষ পৃথা। এখন আমাদের সব আদর লুটে নেওয়ার জন্য জুনিয়র আছে। দুই মামা মিলে ওকে আদরে একদম বাঁদড় বানিয়ে ছাড়বো। তখন টের পাবি ছোটবেলায় তুই কেমন বাঁদড় ছিলি। “

পৃথা ভয়ে আঁতকে উঠে। তার বাচ্চা তার মতো দস্যি হলে সে পাগলই হয়ে যাবে। তার থেকে ভালো যদি তূর্যর মতো ঠান্ডা চুপচাপ হয়। তার ভয়ার্ত মুখ দেখে পার্থ আর শোভন চোখাচোখি করে একসাথে হেসে উঠে। দুইপাশ থেকে দুজন বোনের কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলে,

“ বেক্কল! মজা নিচ্ছিলাম। “

ভাইদের আস্কারা পেতেই পৃথা আহ্লাদে ভেসে যায়। মুখ ফুলিয়ে বলে,

“ ছোট দা, তোর আইনের কোনো ধারা তে এই নীতি লেখা নেই যে একটা প্রেগন্যান্ট মহিলাকে রাগানো দণ্ডনীয় অপরাধ? “

পৃথার অযৌক্তিক বোকা কথা শুনে পার্থ ও শোভন আরেকদফা হাসে। দূর হতে মধুমিতা এই দৃশ্য দেখে বলে,

“ ইশ! আমারও যদি ভাইবোন থাকতো! “

তরী আর তূর্য মধুমিতার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো। কথাটা তাদের কর্ণগোচর হয় না। তরী হেসে মধুমিতাকে টেনে একহাতে জড়িয়ে ধরে অপরহাতে তূর্যর হাত জড়িয়ে ধরে বলে,

“ আমরা আছি না? “

মধুমিতার মুখে হাসি ফুটে উঠে। সে আবার চোখ তুলে তূর্যর দিকে তাকায়। তূর্য হেসে বলে,

“ দুই বোন থাকলে কিন্তু মন্দ হয় না। “

চলবে…

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪৬.

শরতের শেষের সময়। প্রকৃতিতে বিরাজমান ঠান্ডা আবহাওয়ার ফলে মৃদু গায়ে কাপন ধরছে। অন্ধকার রাতে কাথা গায়ে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে তরী। হাত পায়ের ভঙ্গি স্বভাবত কিছুটা এলোমেলো। বিছানার অর্ধেকের বেশি অংশ তার দখলে। বিছানার অপর দিকে একপাশ ফিরে স্থির ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে আছে পার্থ। সামান্য এদিক ওদিক হলেই সে ডিরেক্ট নিচে পড়ে যাবে অবস্থা।

নিস্তব্ধ রাতের নিস্তব্ধতা ছাপিয়ে আচমকা একটা ফোন বেজে উঠে। কিছুক্ষণ বাজতেই রিংটোনের শব্দে পার্থ কপাল কুচকে পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। মাঝ রাতে ঘুম ভাঙায় যেন সে খুব বিরক্ত। একবার পাশ ফিরে তরীকে দেখে নিয়ে হাতড়ে নিজের ফোনটা তুলে নেয়। রিসিভ করে কানের কাছে ধরতেই একটা পুরুষ স্বর বিদ্যুৎ গতিতে বলে উঠে,

“ আসসালামু আলাইকুম ভাই। মাঝরাতে ডিস্টার্ব করার জন্য সো সরি। কিন্তু এটার জন্য আপনে পরে আমার ক্লাস নিয়েন। এখন তাড়াতাড়ি আমার টেক্সট করা এড্রেসে ভাবীরে নিয়া আইস্যা পড়েন। আল্লাহ হাফেজ। “

ব্যস! এইটুকু কথা বলেই ফোনটা কেটে দিলো অপরপাশ থেকে। পার্থ হতভম্ব হয়ে বসে রইলো। এইমাত্র কি ঘটলো যেন তার বোধগম্য হচ্ছে না। ফোনে টুং করে ম্যাসেজের শব্দ হতেই সে আবার ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকালো। ম্যাসেজে লেখা এড্রেসটা দেখতেই সে আরেক দফা বিস্মিত হলো। মধ্যরাতে এসব নাটকের মানে কি? পাগল নাকি?

পার্থ তড়িৎ উঠে দাঁড়ালো। নিজের গায়ের টি শার্ট আর ট্রাউজার বদলে একটা শার্ট আর জিন্স পড়ে নিলো। অত:পর বিছানার কাছে গিয়ে তরীর মাথায় হাত বুলিয়ে কিছুক্ষণ আলতো গলায় ডাকলো। পর মুহুর্তেই তার মনে পড়লো নিজের স্ত্রীর কুম্ভকর্ণের ন্যায় ঘুমানোর অভ্যাসের কথা। সাথে সাথেই পার্থ এবার কিছুটা জোরে জোরে ডাকা শুরু করলো।

তরী ঘুমের মধ্যেই নিজের মাথার উপর একটা বালিশ চেপে ধরে বিরক্তি মিশ্রিত গলায় বলে উঠে,

“ ছাগলের মতো চিল্লিও না প্লিজ। সারাদিন পাগলের মতো দৌড়াতে হয়েছে আমার হসপিটালে। একটু ঘুমাতে দাও। “

পার্থ তরীকে ঠেলে তোলার চেষ্টা করতে করতে বলে উঠে,

“ প্লিজ জান উঠো। ইমারজেন্সি। “

তরী এরকম কান্ডে খুব রাগ হয়। সে নিজের ঘুমন্ত চোখ জোড়া মেলে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পার্থর দিকে। ক্ষিপ্ত গলায় বলে,

“ আমি তোমাকে মেরে তক্তা বানিয়ে ফেলবো পার্থ মুন্তাসির। মাঝরাতে তুমি আমার প্রিয় ঘুম ভাঙিয়ে জান জান করতে এসেছো? কি এমন ইমারজেন্সি? ডোনাল্ড ট্রাম্প হার্ট অ্যাটাক করেছে নাকি লাদেন স্ট্রোক করেছে? “

বউয়ের গরম কথার টোপের মাঝে পড়ে পার্থ অসহায় অনুভব করে। মনে মনে সেই কল করা পুরুষকে রামছাগল বলে গালি দিতেও ভুলে না সে। অত:পর বেশ নরম গলায় তরীকে সব খুলে বলে। সব শুনে তরী ঘুমন্ত শরীর টেনে উঠে বসে। তার শরীর বিছানা ছাড়তে না চাইলেও মস্তিষ্ক বলছে তার পার্থর সাথে গিয়ে বিষয়টা দেখা উচিত। অবশেষে মস্তিষ্ককে সায় দিয়ে সে জামা বদলাতে চলে যায়। এই ফাঁকে পার্থও নিজের ফোন, ওয়ালেট আর গাড়ির চাবিটা নিয়ে নেয়। সবশেষে আলমারির এক গোপন জায়গা হতে সুরক্ষিত রিভলবারটা বের করে আড়ালে পকেটে ভরে সে। অত:পর বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,

“ আবার নতুন কি আকাম করেছে আল্লাহ জানে। “

__________

কাজি অফিসের সম্মুখে এসে থামা গাড়িটা হতে ব্যস্ত পায়ে নেমে এলো পার্থ ও তরী। তাড়াহুড়ো করে ভিতরে প্রবেশ করতেই কাজির রুমের বাহিরে একটা বেঞ্চির দু মাথায় বসে থাকতে দেখলো এক জোড়া যুবক ও যুবতীকে। পার্থ ও তরীকে দেখতে পেয়েই সেই যুবক উঠে এসে বলে,

“ ভাই – ভাবী আমি জানতাম আপনারা আইবেন। “

পার্থ রাগী গলায় প্রশ্ন করে,

“ এই রাত বিরাতে কাজি অফিসে কি আকাম করতে এসেছিস তুই? “

আসিফের ভ্রু জোড়া কুচকে আসে। সে বেশ বিজ্ঞের ন্যায় বলে উঠে,

“ আকাম? সিরিয়াসলি ভাই? আমি জীবনে কোনো আকাম করসি? আমার করা সব কাজই হইসে সুকাম। দেশ আর জাতির জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দেওয়া পুরুষ আজকে নিজের জন্য একটা সুকাম করতে কাজি অফিসে আসছে। ওইযে বেঞ্চে ওই মাইয়াডারে দেখতাসেন না? ওর নাম সুচিত্রা। আমরা দুইজন দুইজনরে ভালোবাসি। বিয়া করমু। “

তরী প্রশ্ন করে,

“ ভালোবাসো, বিয়ে করবে ভালো কথা। বাসায় না জানিয়ে কাজি অফিসে কেনো এসেছো? “

আসিফ মাথা চুলকে বলে,

“ আসলে ভাবী আমার ছোডোবেলার থেকেই নায়িকা সুচিত্রারে সেই লাগতো। উত্তম কুমারের সামনে কি মিষ্টি মিষ্টি নরম নরম কথা কইতো। দেখলেই পরাণডা জুড়ায় যাইতো। ভাগ্যক্রমে বাস্তব জীবনেও এক সুচিত্রার প্রেমে পড়লাম। কিন্তু এই সুচিত্রা নরম কম গরম কথা বেশি কয়। অবশ্য ওর কোনো দোষও নাই। বাপের মতো হইসে এক্কেবারে। হালায় আস্তা এক হিটলার। “

শেষ লাইনটা বলেই আসিফ জিভ কাটে। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে দেখে বধূ বেশে বসে থাকা সুচিত্রা তার দিকে চোখ কটমট করে তাকিয়ে আছে। আসিফ ভীতস্বরে বলে,

“ সরি বেবি। ভুলে মুখ দিয়া সত্যি কথা বাইর হইয়া গেসে। “

সুচিত্রা ফের রাগ নিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আসিফ হাফ ছেড়ে সামনে ফিরে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,

“ সুচিত্রার বাপ মানে আমার শশুর আমগোর প্রেম মাইন্না নেয় নাই। আমি রাজনীতিতে জড়িত হুইনাই বেডায় নাক ছিটকাইসে। বেডারে এতো বুঝাইলাম যে উনার মাইয়্যার লাইগ্যা আমার তে উত্তম জামাই জগৎ খুঁইজ্জাও পাইতো না। বেডায় আমার কথা কানে তুললো না। ধইরা বাইন্ধা এক দামড়া বিসিএস ক্যাডারের লগে ওর বিয়া দিতে নিসিল। হেন তে ওরে ভাগায় আনসি। আপনিই কন ভাই সুচিত্রার লগে আমার মতো উত্তম পুরুষ রাইখ্যা কি ওই রসকষহীন ব্যাডারে মানাইতো? আমি ঠিক করসি না? “

আসিফের বিশাল গল্পের সারমর্ম শুনে পার্থ ও তরী হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রয়। আচমকা তরী শব্দ করে হেসে উঠে। হাসতে হাসতে সে একপাশের দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়। কোনো মতে হাসি থামিয়ে পার্থর দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

“ তুমিই ট্রেন্ড সেট করেছো। এখন সামলাও ঠ্যালা। “

পার্থ আসিফের দিকে ফিরে প্রশ্ন করে,

“ এখন এই বিষয়ে আমরা কি করতে পারি? “

আসিফ দাঁত বের করে হেসে বলে,

“ জীবনের এতো বড় একটা কাম কি আমি আপনেরে ছাড়া করতে পারি ভাই? আপনে আর ভাবী বিয়াতে খালি সাক্ষী দিয়েন। আর আমার বাসায় গিয়ে আব্বার সামনে আমার হইয়া একটু ওকালতি কইরেন। তাইলেই চলবো। “

আসিফের প্ল্যান শুনে পার্থ রাগী চোখে তাকাতেই আসিফ নিষ্পাপ মুখভঙ্গি করে বলে উঠে,

“ প্লিজ ভাই। আমি বিয়া কইরা বউ নিয়া বাড়িত গেলে আব্বায় আমার দিকে জুতা খুইল্যা মারবো। আপনে গিয়া একটু বুঝায় কইলে আব্বারে একটু ঠান্ডা করন যাইবো। “

তরী পাশ থেকে প্রশ্ন করে,

“ আর সুচিত্রার ফ্যামিলি? “

“ চিন্তা কইরেন না ভাবী৷ আমার বাসায় আগে সব সামলায়া পরে ওর বাপের কাছে গিয়া মাফ চাইয়া নিমু। তবুও রাগ না ভাঙলে পরের বছর একটা নাতি গিফট কইরা দিমু নে হিটলাররে। শশুর খুশি হইয়্যা রাগ ভুইল্যা সব মাইন্না নিবো। “

তরী হতাশার নিঃশ্বাস ছাড়ে। কথায় আছে সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে। পার্থর মতো নির্লজ্জ লোকের হাওয়া শেষমেশ আসিফেরও লাগলো। এরকম বাচ্চাকাচ্চার কথা কেউ পাব্লিক্যালি বলে নাকি? পার্থ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

“ এক শর্তে আমরা এখন বিয়েতে সাক্ষী হবো। “

আসিফ প্রশ্ন করে,

“ কি শর্ত ভাই? “

“ রাজনীতির পাশাপাশি চাকরির ব্যবস্থা কর একটা। ঢাকার সব অফিসে নিজের সিভি জমা দিবি। ফাইন্যান্সিয়ালি সিকিউরিটির গ্যারান্টি ছাড়া কোনো বাপ তোকে মেয়ের জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। “

আসিফ রাজি হয়। অত:পর বিনা বাধায় পার্থ এবং তরীর উপস্থিতিতে তার আর সুচিত্রার বিয়েটা হয়ে যায়।

__________

নতুন বছরের আগমন ঘটেছে বেশ ক’দিন হলো। দেশ জুড়ে বিরাজ করছে হাড় কাঁপানো শীতল আবহাওয়া। নিজের বড়সড় পেটটা নিয়ে চলাফেরা করতে বেশ ঝামেলা হয় পৃথার। অসুবিধা হয় রাতে ঘুমোতেও। সাত মাসের পেট নিয়ে আরাম করে পাশ ফিরে ঘুমোনো বেশ কষ্টসাধ্যকর বটে। ইদানীং আবার তার পায়েও পানি জমেছে। একদিকে শীতের যন্ত্রণা তো অপরদিকে রাতে এই আরামে ঘুমোতে না পারার যন্ত্রণা। এসব যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে সে প্রায়ই মাঝরাতে একা ফুঁপিয়ে কাঁদে।

তূর্য তখন তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অসহায় ভঙ্গিতে শুনে যায় পৃথার সকল অভিযোগ। বেশ কষ্ট করে সারারাত জেগে পৃথার পায়ে তেল মালিশ করে। কখনো পৃথা আরাম পেয়ে ঘুমিয়ে যায় তো কখনো ক্লান্ত হয়ে। তূর্যর তখন বেশ মন খারাপ হয়। পৃথার শারীরিক কষ্টের একভাগও অংশীদার না হতে পেরে নিজেকে বেশ অসহায় মনে হয়। মনে মনে ঠিক করে সে আর বাচ্চা কাচ্চা নিবে না। একটা মেয়ে নিয়ে বেশ হাসিখুশি জীবন পাড় করে দিতে পারবে তারা। পৃথার তিনমাসের সময় তূর্য নিজের আন্দাজে মেয়ের নাম ঠিক করলেও এখন সে সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে তাদের মেয়ে হবে। সোনোগ্রাফির রিপোর্ট পেয়ে এই বিষয়ে কনফার্ম হওয়ার পর থেকেই পৃথা দিন রাত তার কানের কাছে ‘তারিণীর পাপা’ বলে সম্বোধন করে কিচিরমিচির করে। তূর্য অবশ্য এই ডাকটা খুব উপভোগ করে। হৃদয় শীতল হয়ে আসে।

জানুয়ারির কোনো এক রাতের ঘটনা। পৃথা উদাসীন ভঙ্গিতে বারান্দায় থাকা দুই সিটের বেঁতের সোফার একপাশে বসে আছে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আঁধারে নিমজ্জিত আকাশটার দিকে। আকাশ জুড়ে ছেয়ে আছে কালো মেঘের ভেলা। সেই মেঘগুচ্ছের আড়ালে ঢাকা পড়েছে চাঁদ ও নক্ষত্রপুঞ্জিরাও। আচমকা তূর্য এসে একটা শাল তার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে তার পাশের খালি জায়গাটায় বসতে বসতে বলে,

“ এই কনকনে শীতে না তোমাকে বারান্দায় আসতে মানা করেছিলাম? খুব অবাধ্য হয়ে গিয়েছো। ইদানীং কোনো কথা মানছো না। “

পৃথা ঘাড় ঘুরিয়ে বারান্দার এককোণে জ্বালানো লাইটের টিমটিমে আলোয় স্বামীর স্নিগ্ধ, চিন্তাভরা মুখটা দেখে। তার চোখ গিয়ে আটকায় তূর্যর থুতনির কাঁটা দাগটার দিকে। পাপার মুখে সে শুনেছে তূর্য ছোটবেলায় একবার স্কুল মাঠে পড়ে ব্যথা পেয়েছিলো। সেই দূর্ঘটনার চিহ্ন হিসেবে এই দাগটা রয়ে গিয়েছে। তূর্যর দিকে তাকিয়ে থেকেই পৃথা একটা ছোট নিঃশ্বাস ছাড়ে।

পৃথাকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে তূর্য ভ্রু উঁচিয়ে চোখের ইশারায় প্রশ্ন করে কি? পৃথা কিছু না বলে তূর্যর ডানহাতটা জড়িয়ে ধরে তার কাধে মাথা এলিয়ে দেয়। তূর্য ছোট গলায় ডাকে,

“ পৃথা? “

“ হু। “

“ কি হয়েছে? মন খারাপ? “

পৃথা শান্ত গলায় বলে,

“ এক জীবনে আমি অনেক কিছু পেয়ে গিয়েছি তারিণীর পাপা। হুটহাট ভয় লাগে। মানুষের জীবনে নাকি সব চাওয়া পূরণ হয় না। অথচ আমি না চাইতেই সব পেয়ে যাওয়াতে ভয়টা আরো বেশি ঘিরে ধরছে আমাকে। “

তূর্য এবার নিঃশব্দে হেসে বলে,

“ তোমার তো খুশি হওয়া উচিত। অযথাই ভয় পাচ্ছো। “

পৃথা এবার তূর্যের হাতটা আরেকটু দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে। মনের এককোণ হতে দলা বাঁধা কান্না ঠেলেঠুলে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। পৃথা বেশিক্ষণ সেটাকে চাপিয়ে রাখতেও পারে না। তার চোখ ফেঁটে গড়িয়ে পড়ে অবাধ্য নোনা জলরাশি। রুদ্ধস্বরে বলে,

“ হঠাৎ করে এই এক জীবনকে খুব ছোট মনে হচ্ছে আমার। আমাদের সংসার কি কোনোভাবে একশো বছরের হতে পারে না? এই অল্প কয়েকদিনের জীবনে আপনাকে পেয়ে আমার মন ভরবে না। আমি খুব লোভী হয়ে গিয়েছি তারিণীর পাপা। আপনার প্রতি আমার লোভ চক্রাকার হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে কেবল দিনকে দিন। “

পৃথার এই অল্প কিছু কথা তূর্যর বুকে কাঁপন ধরালো। এই অসম্ভব ভালোবাসতে জানা মেয়েটাকে সেও প্রচন্ডরকমের ভালোবাসে। তূর্য পৃথার পিঠের পিছন দিয়ে হাত নিয়ে তাকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। মাথা নামিয়ে পৃথার জ্বলজ্বল করা নাকফুলে সজ্জিত নাকটায় চুমু খায়। গভীর কণ্ঠে বলে,

“ আমি যে তোমাকে কতটা ভালোবাসি তা হয়তো কখনো মুখ ফুটে আয়োজন করে তোমাকে বলা হয়নি পৃথা। কিন্তু তুমি জেনে রেখো তোমার প্রতি আমার ভালোবাসাটা অনন্তকালের। অনন্ত মানে জানো তো? “

তূর্যের কথা শুনে পৃথা এবার ফুঁপিয়ে উঠলো। মনের হাজারো জমানো কথা চাপা পড়লো তার কান্না এবং রাতের আধারের ভীড়ে। এতো তাড়া কিসের? এখনো যে খুব সময় আছে।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-৪৩+৪৪

0

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪৩.

বিছানার এককোণে বালিশ জড়িয়ে উবুড় হয়ে শুয়ে থাকা নারী চোখ মেলে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ল্যাম্পের পানে। হাতে থাকা ল্যাম্পের ওয়্যার কানেকশনের সুইচটা পর্যায়ক্রমে অন এবং অফ করছে সে। তার অটল দৃষ্টি কোণে জমে আছে বিন্দু বিন্দু পানি। আজ দুপুরে পার্থকে দেখে আসার পর থেকেই নিজেকে বেশ এলোমেলো লাগছে। সদা পরিপাটি থাকা মানুষটা এতো নোংরা এবং বিচ্ছিরি একটা জায়গায় কিভাবে থাকছে? পার্থর দৃশ্যমান আঘাত গুলোও তার দৃষ্টি এড়ায় নি। তরীর ইচ্ছে করছিলো শিক ভেঙে সেলে প্রবেশ করে পার্থর প্রতিটা জখমে মলম লাগাতে। কিন্তু চাইলেই কি সব আর পারা যায়? উহু।

রাজনীতির পিছনে নিজের জীবন বিলিয়ে দিচ্ছে তবুও রাজনীতি ছাড়তে রাজি না। এতো জেদ? একবার বাড়ি ফিরুক সব জেদ দূর করে ছাড়বে তরী। এসব ছাইপাঁশের পিছনে আর পার্থকে নিজের জীবন নষ্ট করতে দিবে না সে। যথেষ্ট হয়েছে। পার্থকে বুঝতে হবে যে রাজনীতির নোংরা মাঠে পরিচ্ছন্ন উপায়ে টিকে থাকার কোনো অবকাশ নেই।

আপাতত তরীর মনে কেবল একটাই আশা। শোভন এবং পার্থর শুভাকাঙ্ক্ষীদের চেষ্টা যেনো সফল হয়। ওই নরক তূল্য জায়গাটা থেকে যেনো মানুষটাকে বের করে আনতে পারে তারা।

__________

কোর্ট রুমে বসে আছে দুই পক্ষীয় মানুষজন। তাদেরই একপাশে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে শোভন। পার্থর পক্ষ হতে কেবল সে আর দলের কয়েকজন ছেলে পেলে এখানে উপস্থিত আছে। পার্থ কড়া করে জানিয়ে দিয়েছিলো সে তার কোনো ফ্যামিলি মেম্বারকে কোর্টে দেখতে চায় না। শোভন সেই কথা রেখেছে। যদিও আপাতত যেই কয়জন উপস্থিত আছে তারাই যথেষ্ট।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বিচারপতি এসে উপস্থিত হন। তিনি আদেশ দিতেই পার্থকে নিয়ে প্রবেশ করে দুজন পুলিশ। দূর হতে পার্থকে দেখেই শোভনের কঠোর রূপ নরম হয়ে আসে। পার্থর চেহারা দেখেই স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে তার উপর কি অমানবিক অত্যাচার করা হয়েছে রিমান্ডের নাম করে। নিজের দাদার হাতে সেই হ্যান্ডকাফটাকেও বিষের মতো লাগছে শোভনের। আর কিছুক্ষণের অপেক্ষা। তারপর দাদাকে মুক্ত করে ঘরে নিয়ে ফিরবে সে। তার দাদার মুক্তির পাশাপাশি এই শুনানির উপর তার চাকরিও নির্ভর করছে।

পার্থ নীরবে কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়াতেই তার দৃষ্টি গিয়ে পড়ে সবার আগে তার পক্ষের উকিলের পিছনে বসে থাকা আসিফের দিকে। আসিফের চোখ ছলছল করছিলো। পার্থ অবাক হয়। সে কি ভুল দেখছে? তার রাগচটা স্বভাবের এই ছোট ভাইটা এতো আবেগী কবে থেকে হয়ে গেলো? পার্থকে নিজের দিকে তাকাতে দেখে মুহুর্তেই আসিফ দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসি দেয়। চোখের ভাষায় বুঝিয়ে দেয়, ‘ চিন্তা করবেন না ভাই। আমরা আছি। ‘

পার্থর ব্যথায় জর্জরিত চিত্ত প্রশান্তি অনুভব করে। তখনই তার চোখ গিয়ে আটকায় বিপরীত পক্ষের উকিলের পিছনে বসে থাকা শামীমের দিকে। সাথে সাথে তার ভ্রু কুচকে আসে। শামীম ওই পাশে বসে আছে কেন? পার্থ আগ্রহী চোখে নিজের পাশের সাড়িতে লক্ষ্য করে। শেষের বেঞ্চিটাতে তো এখনো বসার জায়গা আছে। তাহলে শামীম সেখানে না বসে ওই পাশে কি করছে?

পার্থর গভীর ভাবনায় ভাটা পড়ে বিচারকার্য শুরুর মধ্য দিয়ে। পার্থর পক্ষের উকিল রওশন জাহান সর্ব প্রথম বিচারপতির সামনে প্রশ্ন রাখে অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার আগেই কেন তার মক্কেলকে রিমান্ডে নিয়ে এরকম টর্চার করা হলো?

রিমান্ডে পার্থর উপর পাষবিক আচরণ চালানো একজন পুলিশকে বিপরীত কাঠগড়ায় ডেকে এই প্রশ্ন করতেই সে জানায় পার্থ কিছু স্বীকার না করায় এবং তার নির্লিপ্ত ব্যবহারের ফলে সে বাধ্য হয়েছে আঘাত করতে। সেই পুলিশের এরকম কচি খুকি সাজার নাটক দেখে শোভন এবং আসিফের শরীর জ্বলে যাচ্ছে যেনো। আসিফের মন চাচ্ছে উঠে গিয়ে এই ঘুষখোর জানোয়ারকে ঘুষি মারতে মারতে রক্তাক্ত করে তরী ভাবীর হসপিটালে এডমিট করিয়ে বিনা চিকিৎসায় মারতে।

রওশন জাহানের প্রশ্নের মধ্যে বাগড়া দিয়ে বিপরীত পক্ষের উকিল হারুনুর কালাম নিজে কিছু বলার অনুমতি চায়। বিচারপতি হতে অনুমতি মিলতেই সে বলে উঠে,

“ আমি এই কেসের সাক্ষীকে আদালতে পেশ করতে চাই অনুমতি থাকলে। “

অনুমতি পেতেই হারুনুর কালাম পিছনে ফিরে বেঞ্চির দিকে তাকায়। সেই দৃষ্টি অনুসরণ করে পার্থও সেদিকে তাকায়। মুহুর্তেই তার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসে। স্তব্ধ দৃষ্টি মেলে সে দেখতে থাকে শামীমের তার বিপরীত কাঠগড়ায় এসে দাঁড়ানোর দৃশ্য। শামীম দৃঢ় গলায় বলে উঠে,

“ পার্থ মুন্তাসির আমার সামনেই রুবেল হোসেনকে গুলি করে খুন করে। উনি একজন আসামী। উনার কঠিন থেকে কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত। “

রিমান্ডে পাড় করা সেই বিভীষিকাময় দিনগুলোতেও হয়তো পার্থ এতটা আহত হয় নি যতটা এই মুহুর্তে নিজের প্রতিপক্ষের সাক্ষীকে দেখে সে হচ্ছে। মনে হচ্ছে তার কাঁটা ঘা গুলোতে কেউ লবণ মরিচ মাখিয়ে দিয়েছে। তার রাশভারী চিত্ত বিশ্বাসঘাতকতার আঘাতে জর্জরিত অনুভব করছে।

হারুনুর কালাম ফের শামীমের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে,

“ ওই ঘটনার সময় কি সেখানে আরো কেউ উপস্থিত ছিলো? “

শামীম ভাবলেশহীন গলায় জবাব দেয়,

“ অফিসার শোভন আর আসিফও এই ঘটনার সাক্ষী। “

রওশন জাহান অবজেকশন জানিয়ে আসিফকে কাঠগড়ায় ডাকার অনুমতি চায়। অনুমতি পেতেই শামীমের জায়গায় আসিফ এসে কাঠগড়ায় দাঁড়ায়। রওশন জাহান প্রশ্ন করে,

“ শামীম যা বলে গিয়েছে তার সত্যতা কতটুকু? “

আসিফ মুখে বিরক্তি নিয়ে বলে উঠে,

“ ওর কথায় সত্যতা খোঁজা, আর দিনে আকাশে চাঁদ খোঁজা একই। এই হালায় তো দিনে একশো কথা কইলে তার মধ্যে নব্বইটাই মিছা হয়। আমারে বিশ্বাস না করলে এই হালার যত এক্স গার্লফ্রেন্ড আছে আপনে ওগোরে ডাইক্কা জিগান। সবগুলার লগে হালার ব্রেকাপ হইসে এইডার কাইষ্ঠা স্বভাবের কারণে। “

রওশন জাহান সামান্য গলা ঝেড়ে আসিফকে সামান্য চোখ রাঙায় উল্টোপালটা সম্বোধন করা হতে নিজেকে সংবরণ করতে। আসিফ সেই দৃষ্টি দেখে নিজেকে সামলে নেয়। আসলে নিজের রাগ সামলাতে তার বেশ কষ্ট হচ্ছে। সে পারলে শামীমকে গালির ডিকশনারি খুলে বসে সেখান থেকে এ টু জেট সব গালি দিতো। রওশন জাহান ফের প্রশ্ন করে,

“ শামীম এইমাত্র বলে গেলো যে সেদিন রুবেল হোসেনের মৃত্যুর সময় সেখানে আপনি এবং অফিসার শোভনও উপস্থিত ছিলো। এটা কি সত্যি? “

“ পুরাই ডাহা মিছা কথা বলসে ও। ওইদিন ওই মুহুর্তে ভাই আমার বাসায় ছিলো। ভাবীর অবস্থা দেইখ্যা উনি খুব ভাইঙ্গা পড়সিলো। আমি তাই হসপিটাল থেকে উনারে সোজা নিজের বাসায় নিয়া গেসিলাম। দুপুরে উনি আমগোর বাসায় আসিলো। বিশ্বাস না হইলে আমার আম্মারেও আপনে জিগাইতে পারেন। আম্মায় দুপুরে ভাইয়ে আইবো দেইখ্যা খুব আয়োজন কইরা রান্না বান্না করসিল। এমনকি দুপুরে খাওয়ার সময় মুরগীর দুইডা রানই ভাইয়ের প্লেটে তুইল্যা দিসিলো। কিন্তু ভাইয়ে তখন অতি শোকে পাথর হইয়্যা ছিলো। উনার গলা দিয়া খাবার নামে নাই। ওইদিন আমার ওই মুরগির রান দুইডার থেকেও বেশি ভাইয়ের লাইগ্যা খারাপ লাগসিলো। “

রওশন জাহান মনে মনে বিরক্ত হয়। ছেলেটার বুদ্ধি দেখে উনি ভেবেছিলেন ছেলেটা খুব বুদ্ধিমান। কিন্তু এই ছেলের দেখি প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত কথা বলার অভ্যাস আছে। রওশন জাহান তাড়াতাড়ি মূল কথায় গিয়ে প্রশ্ন করে,

“ তার মানে শামীমের বলা করা সকল অভিযোগ মিথ্যা তাইতো? “

“ অবশ্যই। “

“ কিন্তু আমার জানামতে তো শামীম পার্থ মুন্তাসির চৌধুরীর লোক। তাহলে তিনি কেন এই মিথ্যা অভিযোগ করবেন? এতে উনার কি লাভ? আপনার কাছে কোনো প্রমাণ আছে? “

আসিফ দৃঢ় গলায় বলে,

“ প্রমাণ আছে। “

আসিফের এতো কনফিডেন্সের সাথে বলা কথাটা শামীমকে নার্ভাস করে তুলে। প্রমাণ আছে মানে? কি প্রমাণ? শোভন এগিয়ে এসে একটা পেন ড্রাইভ এগিয়ে দেয়। সেই পেন ড্রাইভের ফাইল ল্যাপটপে ওপেন করতেই দেখা যায়, শোভন শামীমকে প্রশ্ন করছে এমনটা সে কেনো করলো? সেই প্রশ্নের পিঠে শামীম বেশ হাসিমুখেই জবাব দেয়,

“ আমি কি বলদ নাকি যে আজীবন পার্থ ভাইয়ের ছাঁয়াতলে থাকবো? ইশতিয়াক ভুইয়া নিজ থেকে আমাকে দশ লাখ টাকা আর পার্টিতে পদ অফার করেছে। সেই অফার ফিরিয়ে দেওয়ার মতো বোকামি আমি কিভাবে করি? তাই পার্থ ভাইয়ের বিপক্ষে গিয়ে থানায় সাক্ষী দিয়েছি। “

ব্যস! এতটুকু ক্লিপ। শামীমের শরীরে তিরতির করে ঘামছে। কি এক বোকামি করে ফেললো সে। কথার মাঝে তো কোথাও সে এটা মেনশন করে নি যে সে পার্থর সিক্রেট ফাঁস করেছে। আসিফটা এতো শেয়ানা! শামীমের আড়ালে তার কথা রেকর্ড করে রেখেছে।

রওশন জাহান মুখে জয়ের হাসি নিয়ে বিচারপতির উদ্দেশ্যে বলে,

“ এই ভিডিও হতে স্পষ্ট প্রমাণিত যে শামীম টাকার এবং পদের লোভে ইশতিয়াক ভুইয়ার কথায় আমার মক্কেল পার্থ মুন্তাসির চৌধুরীকে মিথ্যা বানোয়াট একটা কেসে ফাঁসিয়েছে। “

শামীম পিছন থেকে চেঁচিয়ে উঠে,

“ আমার অভিযোগ মিথ্যা নয়। “

বিচারপতি বেশ গম্ভীর স্বরে বলে উঠে,

“ আপনি নিজ মুখে স্বীকার করেছেন যে আপনি ইশতিয়াক ভুইয়ার সাথে হাত মিলিয়ে পার্থ মুন্তাসির চৌধুরীর বিপক্ষে সাক্ষী দিয়েছেন। “

শামীম আর কিছু বলতে পারে না। তার আগেই বিচারপতি নিজের রায় শোনায়। মিথ্যা বানোয়াট কেস এবং মানহানীর দায়ে শামীম এবং ইশতিয়াক ভুইয়ার বিপক্ষ শাস্তি ঘোষণা করা হয়।

পার্থর হাতের হ্যান্ডকাফ খুলে দেওয়া হচ্ছে। পার্থর সেদিকে খেয়াল নেই। সে নীরবে তাকিয়ে আছে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা শামীমের দিকে। শামীম রাগে ফোস ফোস করছে। আসিফ তার পাশ পেরিয়ে আসার সময় এক মুহুর্তের জন্য দাঁড়িয়ে মাছি তাড়ানোর মতো করে হাত নাড়ায়। অত:পর শামীমের চোখে চোখ রেখে বলে,

“ ইউ স্টুপিড মেল, নাও গো টু হেল। ফট! “

বলেই আসিফ পার্থর কাছে এগিয়ে এসে বত্রিশ দাঁত বের করে হেসে বলে,

“ ভাই! মিষ্টির আশেপাশে নোংরা মাছি ঘুরঘুর করবোই। ওইগুলোর দিকে তাকাইয়েন না। আমার মতো মৌমাছি আপনার পাশে থাকতে মাছিদের কোনো বেল নাই। “

শোভন তাড়া দেখিয়ে বলে,

“ এইখানে অপেক্ষা করা আর ঠিক হবে না। আসিফ তুমি দলের ছেলেদের নিয়ে সামনের দিক সামলাও। আমি দাদাকে নিয়ে আড়ালে বের হয়ে বাসায় চলে যাই। সাংবাদিকদের সামনে পড়লে এরা সহজে ছাড়বে না আর। “

“ ঠিক বলসেন ভাই। “

__________

পার্থ জেল থেকে মুক্তি পেয়েছে এই খবর পেতেই যেনো সাদিকা বেগম অলৌকিক ভাবে সুস্থ হয়ে গেলো। মধুমিতা ভার্সিটিতে থাকায় তিনি জমিলা খালাকে নিয়ে নিজেই রান্নার তোড়জোড় শুরু করলেন। তার ছেলেটা এই কয়দিন ওই আজাবের ভিতর কি খেয়েছে না খেয়েছে আল্লাহ জানে। আজ ইফতারের সময় ছেলেকে নিজ হাতে রান্না করা ভালো মন্দ না খাওয়ালে তিনি শান্তি পাবে না একটুও। তাই তিনি পুরান ঢাকার স্টাইলে কাচ্চি রান্না করছেন। পাশাপাশি শোভনকে ফোন করে বলেছে যেনো পার্থর দলের ছেলেদেরও ইফতারে বাসায় আসতে বলে।

আফজাল সাহেবও ছেলের অপেক্ষায় বেশ অস্থির হয়ে আছে। বারবার দরজার সামনে পায়চারি করছে। বড় দা’র মুক্তির খবর পেয়ে পৃথাও ছুটে এসেছে চৌধুরী নিবাসে। সবার চোখেই এক সমুদ্র অপেক্ষা।

কেবল তরীই বেশ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে রয়েছে। এসবের প্রতি কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। সেদিকে অবশ্য কারো খেয়ালও নেই।

অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটে। বাড়ির দুই ছেলে স্ব শরীরে বাড়িতে প্রবেশ করে। সাদিকা বেগম দৌড়ে গিয়ে বড় ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। এতক্ষণ তীব্র উত্তেজনা নিয়ে পায়চারি করা আফজাল সাহেব বড় ছেলেকে দেখতেই উনার বুক ধক করে উঠে। এই কয়েকটা দিনেই তার ছেলের কি অবস্থা করে দিয়েছে জানোয়াররা? আফজাল সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত কান্ড ঘটায়। হুট করে তিনি শোভনকে জড়িয়ে ধরে।

আকস্মিক নিজের আব্বার আলিঙ্গনে শোভন অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। কিছু কারণে তার আব্বার সাথে তার সম্পর্কটা খুব একটা স্বাভাবিক নয়। এই কারণে এই জড়িয়ে ধরাটা তার কাছে খুব অপ্রত্যাশিতই বটে। আফজাল সাহেব ধরে আসা গলায় কিছু বলতে চায়। কিন্তু কথা উনার গলায় আটকে রয়। তাই তিনি নীরবে শোভনকে ছেড়ে আবার পার্থকে জড়িয়ে ধরে। শোভন শান্ত দৃষ্টিতে সেই দৃশ্য দেখে। মনে মনে বলে,

“ ভাইকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনার পুরস্কার সরূপ এই আলিঙ্গন ছিলো আমি জানি। এছাড়া আপনি কখনোই আমাকে নিয়ে গর্ব করবেন না। কখনোই আমার প্রতি গর্ব করে আমাকে জড়িয়ে ধরবেন না আপনি আব্বা। “

__________

আম্মা, আব্বা, পৃথা, জমিলা খালা সবাই নিচে থাকলেও পার্থর দৃষ্টি আরেকজনকে খুঁজতে ব্যস্ত। সেই কৌতূহলী দৃষ্টি দেখে পৃথা নীরবে ভাইয়ের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলে,

“ বড় ভাবী উপরে রুমে আছে বড় দা। “

পার্থ আর অপেক্ষা করে না। রেস্ট নেওয়ার কথা বলে সোজা উপরে নিজের রুমে চলে যায়। সিটিং এরিয়ার দরজা লক করে বেডরুমে প্রবেশ করতেই দেখতে পায় বেডের উপর তরী পা ঝুলিয়ে নীরব ভঙ্গিতে বসে আছে। তার পাশে রয়েছে একটা ফার্স্ট এইড বক্স। পার্থ এক দন্ড দাঁড়িয়ে থেকে বেড রুমের দরজা লক করে দেয়। অত:পর গায়ের পাঞ্জাবি খুলে ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে ফার্স্ট এইড বক্সের অপর পাশে বসে।

তরী নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে পার্থর দিকে ফিরে তাকায়। এক পলক পার্থর বুকের এবং পিঠের তাজা আঘাত গুলো দেখেই উঠে ফার্স্ট এইড বক্স হাতে নেয়। পার্থর তাজা জখমে ওষুধ লাগায় সচেতন হাতে। ওষুধ লাগাতেই পার্থর কাঁটা ক্ষতগুলো জ্বলে উঠে। তবুও সে মুখ দিয়ে একটা টু শব্দও করে না।

প্রয়োজনীয় মেডিসিন লাগানো শেষ হতেই তরী হাত ধোয়ার জন্য উল্টো ফিরে ওয়াশরুমের দিকে যেতে নেয়। কিন্তু সাথে সাথে নিজের ডান হাতের কব্জিতে টান অনুভব করে। তরী ফিরে তাকায় না। পার্থ নরম সুরে বলে উঠে,

“ এখনো কিছু আঘাতে মলম লাগানো বাকি তরী। “

তরী প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে ফিরে তাকায়। পার্থ তার হাতের কব্জি ধরে রাখা অবস্থায়ই উঠে দাঁড়ায়। তরীর চোখে চোখ রেখে বলে,

“ বিশ্বাসঘাতকতার আঘাতে সৃষ্ট জখমে মলম লাগানো বাকি। “

আরো এককদম এগিয়ে গিয়ে তরীর হাত নিজের উন্মুক্ত বক্ষস্থলের বাম পাশে রেখে দূর্বল গলায় বলে,

“ এই কয়েকদিনের বিচ্ছেদের যন্ত্রণা এখনো আমাকে কাতড়াচ্ছে। আর সহ্য হচ্ছে না। সারিয়ে তুলো তরী। “

তরীর চক্ষুকোণের শেষ প্রান্ত জলে চিকচিক করে উঠে। পার্থর দূর্বল গলার আবদারে তার অন্তঃপুরের গুমোট ভাব উবে গিয়ে তীব্র অনুরাগ হানা দেয়। কঠিন চিত্তের খোলস ছেড়ে কোমল রূপ বেরিয়ে আসে। নিজেদের মাঝের দূরত্ব মিটিয়ে পার্থর ক্ষত বিক্ষত দেহে আশ্রয় খুঁজে নেয়।

শূন্য বুকটাতে তরীর মাথা ঠেকতেই পার্থ তাকে দু’হাতের কারাগৃহে আগলে নেয়। তরী কান্না মিশ্রিত সুরে বলে,

“ যে জিনিসটা আমি নিজে পারবো না কখনো করতে সেই একই জিনিসের আবদার করেছি আমি তোমার থেকে। অভিমান দেখিয়ে তোমার থেকে মুখ ফিরিয়ে চলে এসেছিলাম। সরি ফর দ্যাট। “

“ একশো বার অভিমান দেখাবে। অধিকার আছে তোমার। সরি বলতে হবে না। “

তরী ফের বলে উঠে,

“ ছাড়তে হবে না তোমার রাজনীতি। শুধু নিজে সেফ থাকো। আর কিছু চাই না। “

পার্থ থমথমে স্বরে বলে উঠে,

“ এই শিক্ষাটার খুব দরকার ছিলো আমার। রাগ আর বিশ্বাসের ফলাফল নিজ চোখে দেখে নিয়েছি। এই ভুল জীবনে আর দ্বিতীয়বার হবে না। “

তরী চোখ তুলে তাকায় পার্থর মুখশ্রীর দিকে। মুখ থেকে ধীরে ধীরে পার্থর অধর যুগলের দিকে দৃষ্টি স্থির করে। সেই দৃষ্টি দেখে পার্থ আহত হেসে বলে,

“ খবরদার। নোংরা, জীবাণুযুক্ত ঠোঁটে চুমু খাবে না। “

তরী সেই বারণ মানলো না। পার্থর ঘাড় আগলে ধরে এক সমুদ্র শীতল ছোঁয়ার পরশ আঁকে পার্থর ওষ্ঠযুগলে। অধর সন্ধি হতে ক্ষানিকের বিরতি নিয়ে বলে,

“ জীবাণু দূর করার জন্য সেনিটাইজড করে দিচ্ছি। “

চলবে…

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪৪.

সন্ধ্যা নেমেছে অনেকক্ষণ হলো। ফেইরি লাইটের সোনালী টিমটিমে আলোয় রুমটা আচ্ছাদিত হয়ে আছে। এককালে সর্বদা সম্পূর্ণ এলোমেলো হয়ে থাকা তূর্যের রুমটা তার অনুপস্থিতিতেও এখন বেশ গোছানো থাকে। সেই গুছিয়ে রাখার পিছনে অবদানকারী রমণী পরিপাটি বিছানার এককোণে শুয়ে আছে ফোন কানে গুজে। বাংলাদেশ সময় এখন সন্ধ্যা সাতটা হলেও নিউজিল্যান্ডে এখন রাত দুটো বাজে। ফোনের এপাশ হতে রমণী একরাশ অভিমান নিয়ে বলে উঠে,

“ আমাদের প্রথম রমজানের মাস ছিলো তূর্য। প্রথম চাঁদ রাত, প্রথম ঈদ। আপনার অনুপস্থিতি আমার আর সহ্য হচ্ছে না। “

“ পনেরো দিন চলে গিয়েছে। আর পনেরোটা দিন অপেক্ষা করো। ফিরে আসবো তো শীঘ্রই। “

তূর্যর ফিরতে আরো পনেরো দিন বাকি ভাবতেও পৃথার দমবন্ধকর অনুভূতি হয়। সে বেশ নরম গলায় বলে উঠে,

“ আমি খুব অধৈর্য্য কিশোরীর ন্যায় আচরণ করছি। তাই না? বিয়ে হয়েছে, এক বাচ্চার মা হতে চলেছি তবুও নিজের এইরকম স্বভাব দূর করতে না পেরে আমি নিজের প্রতিই খুব বিরক্ত। “

ফোনের অপর পাশ হতে তূর্য স্লান হেসে বলে,

“ আমি তো তোমার প্রতি বিরক্ত অনুভব করি না পৃথা। “

শরতের সময় এখন। বর্ষার শুরুর দিকে পৃথা একটা বেলি ফুলের চারা কিনে বারান্দায় লাগিয়েছে। কিছুদিন হয়ে তাতে ফুল এসেছে। বারান্দার থাই দরজা খোলা থাকায় শিরশিরে বাতাসের সাথে সেই সুবাস ভেসে আসছে। সেটার সুবাসে মৌ মৌ করছে সম্পূর্ণ রুম।

ফোনের অপরপাশ হতে তূর্য ক্ষানিকক্ষণ চুপ থেকে প্রশ্ন করে,

“ বেবি কি করে? “

পৃথা মন খারাপ নিয়ে জবাব দেয়,

“ জানি না। আমি মা হয়েও ওর ব্যাপারে কিছু বুঝতে পারি না। আপনি ওর প্রয়োজন অপ্রয়োজন আমার থেকেও ভালো বুঝেন। “

তূর্য শান্ত গলায় বলে,

“ আমি তোমাকেও বুঝি পৃথা। “

পৃথা আর কিছু বলে না। আচমকা সে ফোন কেটে দেয়। তার টানা টানা অভিমানী চোখ জোড়া থেকে টপটপ করে পানি পড়তে শুরু হয়। তূর্যকে ছাড়া তার খুব শূন্য লাগছে। এই শূন্যতা কেবল তূর্যই মেটাতে পারবে। কবে আসবে তূর্য?

__________

সন্ধ্যায় ইফতারি সেড়ে এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে বেরিয়েছিল শোভন। এতোদিন পর বিদেশ ফেরত বন্ধুর সাথে দেখা হওয়ায় গল্প আড্ডায় কখন যে রাত নেমে আসে সেদিকে তার খেয়াল ছিলো না। বাড়ি ফিরতে ফিরতে দশটার উপর বেজে যায়। দশটার দিকেই তাদের বাড়ির সবাই যে যার রুমে ঘুমাতে চলে যায়। তাই শোভনও বাহির থেকে ফিরে সোজা নিজের রুমে চলে আসে।

নিজের রুমে প্রবেশ করতেই দেখে মধুমিতা বেশ আয়োজন করে গোলাপি রঙের একটা তাঁতের শাড়ি পড়ে বিছানায় শুয়ে বই পড়ছে। শোভন গায়ের ঘর্মাক্ত শার্টটা খুলতে খুলতে বলে উঠে,

“ এতো আয়োজন কিসের? “

মধুমিতা বইয়ে মুখ গুজে রেখে জবাব দেয়,

“ নিজের জন্য সকল আয়োজন। “

শোভন আর কোনো পাল্টা কথা বলে না। চুপচাপ গিয়ে বিছানার এককোণে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত জায়গাটায় সোজা হয়ে শুয়ে পড়ে। একহাত কপালের উপর আড়াআড়ি ভাবে রেখে চোখ বুজে ঘুমানোর চেষ্টায় মগ্ন হয়। শোভনের এই কাজে মধুমিতা বেশ রাগ হয়। এই ডিউটিওয়ালা কি এই মাত্র তার মতো সুন্দরী বউকে ইগনোর করে ঘুম বেছে নিলো? এর শোধ মধুমিতা তুলেই ছাড়বে। দেখে নিবে এই ডিউটিওয়ালা শান্তিতে ঘুমায় কিভাবে।

মধুমিতা চুপচাপ বিছানা ছেড়ে নেমে রুমের যত লাইট আছে সব জ্বেলে দেয়। বিছানার কাছে এসে ল্যাম্পের লাইটও শব্দ তুলে জ্বেলে দেয়। অত:পর বড় বড় পা ফেলে বিছানায় গিয়ে একপাশ ফিরে চোখ বুজে শুয়ে রয়। লাইট অন থাকলে যে শোভনের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে তা তার অজানা নয়। তাই ইচ্ছে করেই এই কাজটা করেছে সে।

বেশ কিছুক্ষণ সময় পেরোয়। মধুমিতা হঠাৎ টের পায় শোভন বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। সাথে সাথে মধুমিতা শক্ত করে নিজের চোখ বুজে ঘুমানোর অভিনয় করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শোভন সব লাইট বন্ধ করে ফের বিছানায় এসে শুতেই মধুমিতা পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। মনে মনে ঠিক করে সে আবার নেমে সব লাইট অন করে দিবে। ঠিক সেই মুহুর্তেই পিছন থেকে ঠান্ডা একজোড়া হাত তাকে নিজের কাছে টেনে পিছন থেকে আঁকড়ে ধরে। তার কাধে নিজের নাক ঘষে বলে উঠে,

“ একজনের জন্য করা আয়োজনকে নিজের নামে বলে চালিয়ে দেওয়া একটা দণ্ডনীয় অপরাধ। এই অপরাধে আপনার জরিমানা দায়ের করা হলো। “

মধুমিতা ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,

“ কি জরিমানা? “

“ সুন্দরী বলে জরিমানার পরিমাণ কমিয়ে দিলাম। কেবল একশো মধুময় চুমুতেই চলবে। “

__________

সন্ধ্যায় ডাইনিং টেবিলে পার্থ আর শোভন মুখোমুখি বসে আছে। টেবিলে বসে আছে আফজাল সাহেব এবং সাদিকা বেগমও। মাগরিবের আজান হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ। আফজাল সাহেব বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ইফতারি খেলেও সাদিকা বেগম মুখ টিপে হাসছে। এমনকি জমিলা খালাও বাদ যাচ্ছে না। শোভন এবং পার্থ একে অপরের দিকে আড়চোখে বারবার তাকাচ্ছে। তাদের স্বীয় স্ত্রী দ্বয় আজ রান্নাঘর ছেড়ে বের হচ্ছে না। কেবল খেজুর খেয়ে রোজা খুলেই কাজের অযুহাত দেখিয়ে রান্নাঘরে চলে গিয়েছে। এর কারণও তারা বেশ ভালো করে বুঝতে পারছে। অপরাধ করে তাদের ফাঁসিয়ে দিয়ে অপরাধীরা ঠিকই এখন নিজেরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে।

পার্থ এবং শোভন দুজনেই খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে নিজেদের শার্টের কলার টেনে গলার একপাশে রক্ত জমে যাওয়া কালচে দাগটা ঢাকতে ব্যস্ত। আজ সারাদিন সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ঘরের বাইরে থাকলেও এই মুহুর্তে আর তাদের পালানোর কোনো জায়গা নেই। আফজাল সাহেব যত দ্রুত সম্ভব খাবার সেড়ে সেখান থেকে কেটে পড়লেন। নিজের রুমে গিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি গলা ছেড়ে স্ত্রীকে তলব করেন। স্বামীর ডাক শুনতেই সাদিকা বেগম হাসতে হাসতে নিজের রুমের দিকে চলে যায়। ডাইনিং রুমে এখন পার্থ আর শোভন ব্যতীত আর কেউ নেই।

পার্থ তরীর বানানো কাবাবের শেষ অংশটুকু মুখে পুড়ে বেশ বিরক্ত মুখে বলে উঠে,

“ বাসায় হঠাৎ ছাড়পোকা খুব বেড়েছে মনে হচ্ছে। এদের কামড়ের জ্বালায় আর টেকা যাচ্ছে না। এশার নামাজ পড়ে বাসায় ফেরার পথে ছাড়পোকার ওষুধ কিনে আনতে হবে। “

শোভনও খাওয়া শেষ করে পানি খেয়ে উঠে দাঁড়ায়। কিছু বুঝে না এমন একটা ভাব করে ভাইয়ের সাথে তাল মিলিয়ে বিরক্ত মিশ্রিত সুরে বলে উঠে,

“ তেলাপোকার পরিমাণও খুব বেড়েছে। আমিও বাসায় ফেরার সময় তেলাপোকা মারার ওষুধ কিনে আনবো। “

তাদের কথার মাঝেই রান্নাঘরের দরজা হতে হাসির শব্দ ভেসে আসে। পার্থ আর শোভন হতভম্ব ভঙ্গিতে সেদিকে তাকাতেই দেখে তরী এবং মধুমিতা খাবারের বাটি হাতে লজ্জায় মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সামনে দাঁড়ানো জমিলা খালাই শব্দ করে হাসছে। পার্থ আর শোভন মনে মনে ভাবে জমিলা খালা কি তাদের বলা কথা শুনে ফেললো নাকি? দুজনেই আরেকদফা লজ্জায় পড়ে যায়। পার্থ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে উঠে,

“ তরী, আমি বাহিরে যাচ্ছি। বাসায় ফিরতে রাত হবে। কেউ জেগে আমার অপেক্ষা করো না। “

শোভনও তাড়া দেখিয়ে বলে উঠে,

“ মধু, এসে দরজা লাগাও। আমিও বাহিরে যাচ্ছি। “

কথা শেষ করতেই দুই ভাই তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে দুই দিকে হাঁটা ধরে। আজকে আর কারো মুখোমুখি পড়তে চায় না তারা। মাঝরাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে তবেই বাড়ি ফিরবে বলে ঠিক করে তারা।

___________

দেখতে দেখতে সাতাশটা রোজা চলে গেলো। ঘড়িতে ক’টা বাজে জানা নেই পৃথার। অন্ধকার রুমটা জ্যোৎস্নার মেলায় মৃদু আলোকিত। বারান্দার খোলা থাই দরজা হয়ে ঝিরঝিরে বাতাসের সঙ্গে মৃদু ঠান্ডাভাব বয়ে আসছে। আম্মা থাকলে নিশ্চিত এখন পৃথাকে বড় করে একটা ধমক দিতো এই রাতের দিকে দরজা খোলা রাখার অপরাধে। আম্মার ভাষ্যমতে গর্ভাবস্থায় নাকি সহজেই মেয়েদের খারাপ বাতাস লেগে যায়। এ নিয়ে পৃথাকে বেশ নিষেধাজ্ঞার তালিকাও তিনি ধরিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু পৃথা সেসবের প্রতি খুবই উদাসীন। এসব ধরাবাঁধা নিয়ম মেনে চলার অভ্যাস তার নেই কখনো।

বিছানার হেডসাইডে পিঠ হেলান দিয়ে বসে আছে সে। শাড়ির আঁচলটা বিছানা গড়িয়ে মেঝেতে পড়ে আছে অবহেলায়। উদাসী দৃষ্টি বয়ে অভিমানের অশ্রু ঝড়ছে। চরম অভিমান নিয়ে সেদিন ফোন কেটে দেওয়ার পর থেকে সে আর তূর্যর কোনো ফোনকল রিসিভ করে নি। সিন করেনি কোনো ম্যাসেজও। তূর্য নামক মানুষটার উপর তার জমে রয়েছে চরম অভিমান। এই লোকটা পৃথার মিষ্টতাও চুরি করে সাথে নিয়ে দূর দেশে চলে গিয়েছে। পৃথার সব কিছুই এখন তিক্ত মনে হয়।

তার পাশাপাশি তার বাচ্চাটাও হয়তো নিজের বাবার অনুপস্থিতি হারে হারে টের পাচ্ছে। সেজন্যই হয়তো খাবার দাবারের প্রতি জারি করেছে নীরব বিদ্রোহ। গত ক’দিন ধরে পৃথা যাই মুখে দিচ্ছে তা-ই গলা দিয়ে আর নামছে না। বমি হয়ে শরীর ছেড়ে দিচ্ছে বারবার। হুমায়ুন রশীদ আর আম্মার ঠিক করা আয়না খালা এ নিয়ে বেশ চিন্তিত।

আচমকা কলিংবেলের শব্দটা সম্পূর্ণ বাড়ির নিস্তব্ধতা ভেঙে তীক্ষ্ণ স্বরে বেজে উঠে। এই সময়ে আবার কে এলো? প্রশ্নটা মনে উঁকি দিলেও পৃথা উঠে গিয়ে দেখার শক্তি খুঁজে পায় না। পাপা আর আয়না খালা নিচে আছে। উনারাই নাহয় দেখে নিবে ভেবে পৃথা নিজের ক্লান্ত চোখ জোড়া বুজে নেয়।

পনেরো থেকে বিশ মিনিটের মাথায় রুমের দরজার নব ঘুরানোর শব্দ কানে পৌঁছাতেই পৃথা চোখ মেলে পাশ ফিরে তাকায়। মুহুর্তেই তার বিস্মিত, স্তম্ভিত চোখ জোড়া বেয়ে গড়িয়ে পড়লো দু ফোটা জল। তড়িৎ গতিতে বিছানা ছেড়ে নামতে নিলেই শাড়ির আঁচলের সাথে পা পেঁচিয়ে পড়তে নেয়। কিন্তু ভাগ্যক্রমে একটা বলিষ্ঠ বুকে তার জায়গা হয়। স্তম্ভিত পৃথা সেখান থেকে সড়ে যাওয়ার আর সাহস পেলো না। যদি এটা স্বপ্ন হয়? এই ভয়ে তার শরীর কাঁপিয়ে কান্না পাচ্ছে। কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণ করে একটা শীতল স্বর বলে উঠে,

“ তোমাকে রেখে কোথাও গিয়ে শান্তি পাবো না আমি। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-৪১+৪২

0

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪১.

অপটিক্যাল ফাইবার দ্বারা যেই গতিতে তরঙ্গ চালিত হয় ঠিক একই গতিতে এমপি এবং সংসদ সদস্য পার্থ মুন্তাসির চৌধুরীকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার খবরটা ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে। পার্থর আওতায় থাকা পার্টির কর্মীরা ইতিমধ্যে থানার বাহিরে ভীড় জমিয়েছে। সাংবাদিকরা হুলুস্থুল কান্ড বাঁধিয়ে বসে আছে। টিভি চ্যানেল গুলোতেও বর্তমানে হ্যাডলাইন জুড়ে রয়েছে এই খবর। কিন্তু পার্থকে পুলিশ ধরে নেওয়ার কারণ এখনো সবার অজানা।

কিছুক্ষণের মধ্যেই কয়েকজন পুলিশ থানা হতে বের হয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়। সকলের প্রশ্নের উত্তর হিসেবে জানানো হয় যে পার্থ মুন্তাসির চৌধুরীকে রুবেল হোসেনের খুনের দায়ে গ্রেফতার করা হয়েছে। পরিস্থিতি আরো উত্তেজনামূলক হয়ে পড়ে। পুলিশের এরকম ব্রিফ শুনে আসিফ গালাগালি বাদ দিয়ে শান্ত হয়ে পড়ে। মুহুর্তেই সে ভীড় ঠেলে নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে শোভনকে ফোন করে। কিছুক্ষণ রিং বাজতেই শোভন কল রিসিভ করে জানায় সে থানায় আসছে। আসিফ বলে থানায় প্রবেশের আগে যেন তার সাথে একবার দেখা করে শোভন।

পার্থর প্রতি এমন আরোপে পার্টিও বেশ আশ্চর্য হয়ে পড়েছে। যেহেতু বিষয়টা পার্টির রেপুটেশনের সাথে জড়িত তাই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সঠিক তথ্য প্রমাণসহ যদি পার্থ দোষী সাব্যস্ত হয় তবে ওর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধূলিসাৎ করার আগে তারা একবারও ভাববে না।

উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে আরেকটু ঘি ঢালার জন্য এবং টিভি চ্যানেল গুলো আরেকটু টিআরপির আশায় পুলিশের সেই এক লাইন ব্রিফিংয়ের সাথে ভুংচুং মিশিয়ে নতুন নতুন মুখরোচক কিসসা রটানো শুরু করেছে। একটা সম্মান তৈরী করতে মানুষের সম্পূর্ণ জীবন পাড় হয়ে যায় অথচ সেই সম্মানে দাগ লাগাটা কেবল ক্ষানিকের বিষয়।

__________

কিছুক্ষণ আগেও বেশ আমেজে মেতে থাকা চৌধুরী নিবাসে যেন মুহুর্তেই শকুনের নজর লেগেছে। সাদিকা বেগম নিজ চোখে বড় ছেলেকে এই পরিস্থিতিতে পড়তে দেখে শারীরিক ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেন নি। কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়ে বেশ নাজুক অবস্থা হয়ে গিয়েছে উনার। অপরদিকে আফজাল সাহেবও এতক্ষণ উপরে উপরে নিজেকে শক্ত দেখালেও পার্থকে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই উনার শরীর অসাড় হয়ে আসে। স্বভাবত বিপি হাই হওয়ার বদলে উল্টো লো হয়ে যায় উনার। মধুমিতা শশুর এবং শাশুড়িকে সামলাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। জমিলা খালা থাকায় কিছুটা রক্ষা হয়েছে তার। তূর্য এবং শোভন দুজনেই বেরিয়েছে পার্থর পিছু পিছু।

বাকি রইলো হুমায়ুন রশীদ তো তিনি নিজের মেয়ে এবং পুত্রবধূর চিন্তায় তটস্থ। মেয়ে তো ঘরের দরজা দিয়ে বসে আছে, অপরদিকে পৃথাও স্ট্রেস নিচ্ছে। হুমায়ুন রশীদ যেনো নদীর মাঝে পড়ে গিয়েছেন। এক কূলে দরজার অপরপাশে তার মেয়ে ঠিক আছে কিনা এই চিন্তা তাকে দংশন করছে, তো অপর কূলে তার পুত্রবধূ এই অবস্থায় মোটেও শান্ত থাকছে না। হুমায়ুন রশীদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চিন্তা করে তার মেয়ে ঠিকই নিজেকে সামলে নিবে, তার থেকে ভালো আপাতত এই মুহুর্তে পৃথার দিকে খেয়াল রাখা।

__________

থানায় প্রবেশের আগেই শোভন সবার আড়ালে নিরিবিলি এক স্থানে আসিফের সাথে দেখা করতে যায়। শোভন আসতেই আসিফ হতভম্ব গলায় বলে,

“ শোভন ভাই? রুবেলের ওই কাহিনী কি আপনে পুলিশের কাছে ফাস করসেন? “

মুহুর্তেই একটা বিকট ধমকে আসিফের কান তব্দা লেগে যায়। শোভন আগুন ভরা স্বরে বলে,

“ আমাকে তোমার পাগল মনে হয় আসিফ? আমার যদি দাদাকে পুলিশেই দেওয়ার হতো তাহলে আমি একমাস অপেক্ষা করতাম কেন? “

শোভনের গলা শুনে আসিফ ভয়ে একটা ঢোক গিলে। পর মুহুর্তেই সে বলে উঠে,

“ ওইদিন তো ওইখানে শুধুমাত্র আমরা তিনজন এই ঘটনার সাক্ষী ছিলাম। আমরা কেউই যদি এই ঘটনা ফাঁস না কইরা থাকি তাহলে অন্য কেউ কিভাবে জানবো? আমরা ছাড়া অন্য কেউও ওইখানে ছিলো নাকি? “

শোভনের কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ দেখা যায়। আপাতত সে মনে মনে আসিফ, শামীম দু’জনকেই সন্দেহের তালিকায় ফেলে রেখেছে। পাশাপাশি আসিফের ধারণাটাও সে মস্তিষ্কে তুলে রেখেছে। এমনও হতে পারে অন্য কেউ সেই ঘটনার সাক্ষী ছিলো। কিন্তু যদি এমন হয় তবে সে একমাস কেন অপেক্ষা করলো এই তথ্য ফাঁস করতে? শোভন গভীর ভাবনা থেকে বেরিয়ে বলে,

“ আমি ভিতরে যাই। কথা বলে পরিস্থিতি বুঝে আসি। “

কথাটুকু বলেই শোভন আর অপেক্ষা না করে সেখান থেকে প্রস্থান করে।

__________

অন্ধকারাচ্ছন্ন রুমে বিছানার এককোণে নীরবে বসে আছে তরী। তার পাশেই ফোনে লাইভ নিউজ চলছে। সাংবাদিকদের বলা প্রতিটা কথা তীক্ষ্ণ ভাবে তার কানে বারি খাচ্ছে। নিষ্প্রাণ দৃষ্টি মেলে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে সে। রুবেল হোসেনের মৃত্যুতে পার্থকে দায়ী করাটা তার মোটেও অস্বাভাবিক লাগছে না। তরীর ওই এক্সিডেন্টের পিছনে যে রুবেলের হাত ছিলো তা কারো অজানা নয়। আর সেই এক্সিডেন্টের জের ধরে যে পার্থ রুবেলকে মারতে পারে তাও অবাক করার মতো কিছু নয়। তরী বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,

“ আরেকবার তোমার রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আমাদের স্বাভাবিক জীবনের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। “

ফের তরী বিছানার হেড সাইডে মাথা এলিয়ে দেয়। মস্তিষ্কের প্রতিটা নিউরন মনে হচ্ছে এক এক করে ছিড়ে যাচ্ছে। পার্থর চিন্তা কোনোভাবেই মাথা থেকে দূর হচ্ছে না। জেলে ওর সাথে কি কি হতে পারে ভেবেই তরী শিউরে উঠছে। মস্তিষ্কের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে তরী বেড সাইড কেবিনেটের উপর থাকা একটা শো পিস হাতড়ে সামনের দেয়াল বরাবর ঢিল মারে। নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে বলে,

“ আমি যত সব সাজিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি, তুমি ততই সব এলোমেলো কেনো করে দিচ্ছো? নিজের রাগের উপর কেন সামান্য নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারলে না? তোমার রাজনীতি, তোমার রাগ বারবার কেন আমাদের জীবনে এতো ঝড় বয়ে আনে? “

__________

শেষ রাতে শোভন বাড়ি ফিরে আসে। আফজাল সাহেব এবং সাদিকা বেগম তখন নিজেদের রুমে রেস্ট নিচ্ছেন। পৃথাকেও বহু কষ্টে তূর্য ঘুম পাড়িয়ে রেখে এসেছে। আপাতত লিভিং রুমে উপস্থিত রয়েছে কেবল হুমায়ুন রশীদ, তূর্য ও মধুমিতা। শোভন বাড়ি ফিরতেই তিনজন তাকে ঘিরে ধরে। সর্ব প্রথম হুমায়ুন রশীদ শোভনকে প্রশ্ন করে,

“ পার্থর উপর যেই অভিযোগ লাগানো হচ্ছে তার সত্যতা কতদূর? “

শোভন নিজের ক্লান্ত শরীরটা সোফায় এলিয়ে ক্ষানিকক্ষণ চোখ বুজে রয়। মুহুর্তেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠে শৈশবের কিছু স্মৃতিমাখা চিত্র। শোভনের করা কত শত ভুল যে পার্থ নিজের উপর তুলে নিতো তা অগণিত। মায়ের কতো মার থেকে যে দাদা তাকে বাঁচাতো সেজন্য শোভন কখনো দাদাকে একবার ধন্যবাদও বলে নি। তবে আজ অকপটে একটা মিথ্যা বলে সেই হিসাবটা মিটিয়ে দেয় শোভন। ক্লান্ত গলায় শুধায়,

“ সব অভিযোগ ভিত্তিহীন। “

মধুমিতা স্বামীর জন্য এক গ্লাস পানি এনে এগিয়ে দিয়ে বলে,

“ দাদার কি অবস্থা? তোমার দেখা হয়েছে উনার সাথে? ছাড়ানোর কোনো উপায় নেই? আব্বা, আম্মা আর ভাবীর অবস্থা ভয়ানক। উনাদের কি বলবো? “

শোভন পানির গ্লাসটা হাতে নিলেও আর সামান্যতম পানি মুখে না তুলেই জবাব দেয়,

“ অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু দেখা করার কোনো সুযোগ দেয় নি। সব পুলিশ কেমন একগুঁয়ে আচরণ করছে। তার উপর ভাইয়ার নামে চার দিনের রিমান্ড জারি করে দিয়েছে। আগামী চার দিনে দেখা করার আর কোনো সুযোগ নেই। “

মধুমিতা ব্যস্ত গলায় বলে,

“ তুমিও তো পুলিশ। তোমাকে কেন দেখা করার অনুমতি দেয় নি? “

শোভন এবার শান্ত গলায় বলে উঠে,

“ আমার নিজের চাকরি সংকটে পড়ে গিয়েছে মধু। সবাই এতোদিন জানতো রুবেল হোসেন পুলিশের ইনকাউন্টারে আমার গান দ্বারা নিহত হয়েছে। আজ আচমকাই সবাই এক নতুন তথ্য পেলো। সব দিক থেকে আমি বাঁধা পড়ে যাচ্ছি। “

মধুমিতা আহত দৃষ্টি মেলে শোভনের দিকে তাকিয়ে রয়। হুমায়ুন রশীদও নীরব থাকে। তূর্য এই মুহুর্তে বলার মতো কথা খুঁজে পায় না। সে নিজের তরফ থেকে কেবল ভুয়া নিউজ প্রচার হতে যতদুর রোধ করা সম্ভব তা চেষ্টা করে যাচ্ছে। এর বাহিরে তার আর কিছু করার নেই।

এরকম থমথমে পরিবেশে জমিলা খালা কাচুমাচু করে সেখানে উপস্থিত হয়ে বলে উঠে,

“ সেহেরির সময় হইয়া গেসে। আপনেরা সেহরি করবেন না? “

কেউ কোনো জবাব দেয় না। মধুমিতা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে উঠে,

“ আংকেল, তূর্য ভাইয়া প্লিজ চলুন আপনারা। “

হুমায়ুন রশীদ কোনো কথা বলে না। তার মেয়ে কি অবস্থায় আছে কে জানে! এই অবস্থায় উনার গলা দিয়ে এক লোকমাও ভাত নামবে না। মধুমিতা আবার কিছু বলতে নিবে তখনই পিছন থেকে একটা থমথমে নারী স্বর বলে উঠে,

“ শোভন, পাপা, তূর্য চুপচাপ উঠে খেয়ে নাও তোমরা। “

মুহুর্তেই সবাই চমকে তাকায় পিছনে। তরীকে দেখেই হুমায়ুন রশীদের বুক মুচড়ে উঠে। তার মেয়ের চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে এতক্ষণ কান্নাকাটি করেছে। তরী আর তাদের জবাবের অপেক্ষায় থাকে না। জমিলা খালাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

“ খালা টেবিলে খাবার নিয়ে আসুন। “

জমিলা খালা আচ্ছা বলে চলে যেতেই তরী মধুমিতার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

“ আব্বা আম্মা কি করছেন? “

“ দুজনেই রুমে জেগে আছেন। “

তরী এবার একহাতে নিজের চুলগুলোকে হাত খোপা করে নিতে নিতে বলে,

“ তুমি সবাইকে নিয়ে খেতে বসো। আমি আব্বা আম্মার খাবার নিয়ে যাচ্ছি। “

বলেই তরী রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। এরপর আর কেউ কোনো কথা বলে না। সবাই নীরবে উঠে যায় সেহেরি করতে।

__________

সদা শক্ত চিত্তে ঘুরে বেড়ানো চৌধুরী নিবাসের প্রধান খুঁটি আফজাল সাহেব কেবল কিছু ঘন্টার ব্যবধানেই বেশ নরম হয়ে পড়েছেন। শরীরে কিংবা মনে কোনো ধরনের জোর অনুভব করছেন না তিনি। উনার একপাশেই বিছানায় শুয়ে নীরবে ফুপিয়ে কাঁদতে ব্যস্ত সাদিকা বেগম। আর তাদের সামনে খাবারের প্লেট হাতে বসে রয়েছে তরী। সে বেশ শান্ত গলায় বলে উঠে,

“ দয়া করে খেয়ে নিন আপনারা। এসব করে নিজেরা অসুস্থ হয়ে পড়বেন না। “

আফজাল সাহেব মৃদু গলায় বলে,

“ তোমার আম্মাকে জোর করে একটু খাইয়ে দাও। আমার খিদে নেই মা। “

“ খিদে মিটানোর জন্য খেতে হবে না আব্বা। আমার আবদারটুকু রাখতেই নাহয় খেয়ে নিন। “

কথাটুকু বলেই তরী সাদিকা বেগমের পায়ের পাতা মৃদু হাতে ছুঁয়ে বলে,

“ আম্মা প্লিজ উঠুন। “

সাদিকা বেগম চাপা স্বরে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠে,

“ আমার ছেলেকে কেউ বাসায় নিয়ে আসো। শোভনরে! তোর দাদাকে বাসায় নিয়ে আয় রে বাবা। আমার ছেলে ওইখানে থাকতে পারবে না। “

সাদিকা বেগমের আর্তনাদ শুনেও তরী দমে যায় না। সে বেশ জোর খাটিয়েই দু’জনকে কিছুটা খাইয়ে দিয়ে নিজে দেখে ওষুধ খাওয়ায়। অত:পর বের হওয়ার আগে সে দুজনের সামনে বসে বলে উঠে,

“ আপনাদের ছেলের চিন্তা করে নিজেরা ভেঙে পড়বেন না প্লিজ। চিন্তার ভারটা দয়া করে আমার উপর ছেড়ে দিয়ে আপনারা শক্ত থাকুন। “

__________

শোভন নামেমাত্র দুয়েক লোকমা মুখে তুলে সেহেরিটা কেবল সেরেছে। এই মুহুর্তে সে ছাদে দাঁড়িয়ে আছে নীরবে। আজান পড়তে এখনো বিশ-পঁচিশ মিনিট বাকি। সে শান্ত মস্তিষ্কে কিছু একটা ভাবতে ব্যস্ত। তখনই পিছন হতে একটা নারী কণ্ঠ শুনে সে চমকে ফিরে তাকায়। তরী বেশ শান্ত ভঙ্গিতে তার থেকে কিছুটা দূরে এসে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে,

“ ওকে কি ওখানে অন্তত সেহরির খাবারটুকু দিবে? “

শোভন নীরবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,

“ আপনি অভুক্ত না থেকে খেয়ে নিন ভাবী। “

তরী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। শোভনের তার প্রশ্নে নিরুত্তর রয়ে বলা অন্য কথাটার মানে সে ভালোই বুঝতে পারছে। তাই সে আর কোনো ভনিতা না করে বলে,

“ আমি তোমার দাদার সাথে দেখা করতে চাই শোভন। যেকোনো মূল্যে। তুমি ব্যবস্থা করে দিতে পারবে? “

শোভন আঁতকে উঠে বলে,

“ দাদা মানা করে গিয়েছে যেনো আপনাকে কোনো ভাবেই থানায় যেতে না দেই। আর আপনার জন্যও সেটা শোচনীয় জায়গা নয়। “

“ তুমি তোমার দাদার এতো বড় ভক্ত তা আমার আগে জানা ছিলো না। “

তরীর দৃঢ় স্বরের চাপে শোভন পিষ্ট হয়। আসলেই তো। সে তো আগে কখনো ভাইয়ের নেওটা ছিলো না। ইদানীং তার কি হয়েছে? নিজের মনের ভাবনাগুলোকে একপাশে রেখে শোভন বলে উঠে,

“ শুধু মাত্র দাদা আদেশ দিয়েছে বলে আমি মানা করছি না। বিষয়টা বুঝার চেষ্টা করুন। “

“ তুমি ব্যবস্থা করতে না চাইলে স্পষ্ট জানাও শোভন। আমি নিজের মতো করে অন্য ব্যবস্থা করে নিবো। “

শোভন আরেকবার আঁতকে উঠে বলে,

“ প্লিজ ভাবী এসব বলবেন না। আমার সিচুয়েশনটা বুঝুন। “

“ আমি সবার সিচুয়েশনই খুব ভালো করে বুঝছি শোভন। কিন্তু কেউ আমার সিচুয়েশন বুঝতে চাইছো না। আমার জন্য পরিস্থিতিটা আর জটিল করে তুলো না। আই নিড টু সি হিম। “

শোভন হাল ছেড়ে বলে,

“ আগামী চারদিনের মধ্যে দেখা করানো সম্ভব না ভাবী। দাদাকে রিমান্ডে নেওয়া হবে আগামীকাল। “

রিমান্ডের কথা শুনতেই তরীর খোলসে আবৃত রূপে ভাটা পড়ে। রিমান্ডে প্রশ্ন করার নাম করে কি ধরনের পাষবিক নির্যাতন করা হয় সেই সম্পর্কে একবার শুনেছিলো তরী। সেই বিবরণ অনুযায়ীই কি পার্থর উপর নির্যাতন চলবে? তরীর সম্পূর্ণ শরীর কাঁটা দিয়ে উঠে। কিন্তু সে এই মুহুর্তে শোভনের সামনে কান্না করতে চায় না। তাই দ্রুত হেঁটে সেখান থেকে প্রস্থান করে।

তরীর যাওয়ার পানের দিকে তাকিয়ে থেকে শোভন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তখনই নীরবতা ভেঙে তার ফোনটা শব্দ তুলে বেজে উঠলো। শোভন ফোন রিসিভ করে কানে ধরতেই অপরপ্রান্ত হতে কিছু কথা ভেসে এলো। সেই কথার পিঠে শোভন জ্বলে উঠা গলায় বলে উঠে,

“ তুমি কি নিশ্চিত তথ্য দিচ্ছো? “

পরপর ওইপাশ থেকে আরো দু চারটে কথা ভেসে আসে। শোভন কেবল দ্রুত গলায় বলে উঠে,

“ আমি আসছি। ওকে দ্রুত খুঁজে বের করে আমার পাঠানো ঠিকানা অনুযায়ী নিয়ে আসো। একটা কাক পক্ষী যেনো টের না পায়। “

__________

নির্দিষ্ট ঠিকানা অনুযায়ী পৌঁছাতেই শোভন দেখতে পায় চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা অবস্থায় একজনকে। তার পাশেই নীরবে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে দাঁড়িয়ে আছে আরেকজন। শোভন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের রাগ কিছুটা সামলে নেয়। অত:পর সেই বাঁধা মানুষটার সামনাসামনি গিয়ে তার দিয়ে কিছুটা ঝুঁকে প্রশ্ন করে,

“ কেনো করলে এমন? “

চলবে…

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪২.

শক্ত পোক্ত রোলারের আঘাত গায়ে পড়তেই পার্থ দাঁত ও চোখ খিচে ব্যথাটা সহ্য করে নেয়। গত চারদিন ধরে রিমান্ডে আছে সে। আজ শেষ দিন। তবুও এই দানবীয় পুলিশদের থামাথামির কোনো নাম নেই। তাদের এই অত্যাচারের কারণ যে শুধুমাত্র পার্থর মুখ বন্ধ রাখা নয় তা সে বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে। সুযোগ পেয়ে তার শত্রুরা ভিতরের কিছু সংখ্যক পুলিশকে কিনে নিয়েছে। আদেশ একটাই যেন পার্থ মুন্তাসির মরণের আগ মুহুর্ত পর্যন্ত নিজের জেলে কাটানো এই দিনগুলোর অভিজ্ঞতা না ভুলতে পারে।

আসলেই পার্থ এই দিনগুলো কখনো স্মৃতির পাতা থেকে মুছতে সক্ষম হবে না। এইযে তার দু’হাত বেঁধে তাকে বেধড়ক ভাবে মারতে মারতে সম্পূর্ণ শরীর ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলেছে এই স্মৃতি কি আদৌ ভুলে যাওয়া সম্ভব? উঁহু।

একজন পুলিশ আরেকদফা পার্থর শরীরে আঘাত করে প্রশ্ন করে,

“ তুই কি মুখ খুলবি না? “

পার্থ মুখ খুলে না। রিমান্ডে আসার আগে তার উকিল খুব স্বল্প সময়ের জন্য তার সাথে দেখা করেছিলো। তখন তিনি পার্থকে বলে, রিমান্ডে যাই হয়ে যাক না কেন পার্থ যেন হ্যাঁ না কোনো জবাব না দেয়। এই সময়ের মধ্যে তিনি নিজের মতো করে কেসটা সাজিয়ে নিবেন। পার্থ ভুলেও হ্যাঁ জবাব দিলে তাকে এই জেল থেকে ছাড়ানোর সাধ্যি কারো নেই।

পার্থ উকিলের কথা মেনে নেয়। যদিও রুবেলের মতো জানোয়ারকে মেরেছে এই কথা স্বীকার করতে তার কোনো ভয় নেই। কিন্তু আজীবন এই জেলে বন্দী জীবন পাড় করাও তার দ্বারা সম্ভব নয়। আব্বা, আম্মা, তরী এই তিনটা গুরুত্বপূর্ণ মানুষের ভালো থাকার জন্য হলেও তার এখান থেকে বের হতে হবে। মানুষগুলো নিশ্চয়ই তার অপেক্ষায় পথ চেয়ে রয়েছে? মুহুর্তেই পার্থর চোখের সামনে ভেসে উঠে তরীর প্রতিচ্ছবি। তীব্র যন্ত্রণা গায়ে নিয়েও পার্থ চোখ বুজে মৃদু হাসে। এই দৃশ্য দেখে একজন পুলিশ বলে উঠে,

“ মাইর খাইতে খাইতে পাগল হইয়া গেলো নাকি? “

অপর পুলিশ আরো রাগে ফেটে পড়ে এবার পার্থর বা পায়ের হাঁটু বরাবর জোরে রোলার দ্বারা আঘাত করে। পার্থ এবার চোখ মেলে সামনের পুলিশের দিকে তাকায়। তীব্র ব্যথা নিয়েও সে চোখ দ্বারা বুঝিয়ে দেয় যে এসব কিছুই তার মুখ খোলাতে পারবে না। ব্যর্থ পুলিশ এবার রাগ হয়ে হনহন করে হেঁটে বেরিয়ে যায়। অপরজনও তার পিছু পিছু বেরিয়ে যায়। পার্থ ফের চোখ বুজে নেয়। মনে মনে আওড়ায়,

“ দেশে লুটপাট চালানো কালো সম্পত্তির অধিকারী খুনীদের কি কখনো এভাবে অতিথি আপ্যায়ন করা হবে না আদৌ? “

__________

গায়ে হালকা ঘিয়ে রঙের একটা থ্রি-পিস এবং তার সাথে বিশাল শাল জড়ানো নারীটা একজন পুলিশ কর্মকর্তার পিছু পিছু হাঁটছে। দিনের বেলা হওয়া সত্ত্বেও জেলের ভিতরের এই জায়গাটা মৃদু আলো এবং ব্যাপক আধারের সমান্বয়ে ছেঁয়ে আছে। আরো কয়েক কদম হেঁটে এগুতেই পুলিশ অফিসারটা থেমে গেলো। তাকে অনুসরণ করে সেই নারীর কদম জোড়াও থেমে গেলো। অফিসার পিছু ফিরে বেশ ভদ্র ও বিনয়ী ভঙ্গিতে বললো,

“ এই বাম দিকের লাস্ট সেলটার সামনে গেলেই দেখতে পারবেন। কিন্তু সময় বেশিক্ষণ দেওয়া যাবে না। আমারও চাকরির চিন্তা আছে। আশা করি বিষয়টার তাৎপর্য বুঝবেন ম্যাডাম। “

সেই নারী কোনো প্রতুত্তর করলো না। কেবল নীরবে মাথা নেড়ে বাম দিকের দেখিয়ে দেওয়া পথ অনুসরণ করলো। ধীরে সুস্থে বাইশ কদম এগিয়ে যেতেই সে পৌঁছে যায় কাঙ্ক্ষিত সেলটার সামনে। তার পা জোড়া আপনা আপনি গতিহীন হয়ে পড়ে। নীরবে দাঁড়িয়ে নিষ্প্রভ দৃষ্টি মেলে সেলের ভিতরের দিকে তাকিয়ে রয়।

দূর হতে কারো অস্তিত্ব টের পেতেই মাথা তুলে তাকায় পার্থ। শিকের অপর পাশে থাকা নারীর অর্ধ মুখশ্রী মাস্কের আড়ালে ঢাকা। কিন্তু তাকে চিনতে মোটেও অসুবিধা হয়না পার্থর। সে সম্বিত হারিয়ে তড়াক উঠে দাঁড়াতে নিলেই পায়ের তীক্ষ্ণ ব্যথায় চোখ খিচে বন্ধ করে ফেলে। অত:পর ফের চোখ মেলে যথাসম্ভব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেঁটে এগিয়ে যায় সামনে। লোহার শিকের কাছাকাছি আসতেই সে বেশ থমথমে গলায় বলে উঠে,

“ শোভনকে মানা করেছিলাম যেন তোমাকে থানার দর্শন না করায়। ও সোজা তোমাকে জেলের দর্শন করার ব্যবস্থা করে দিলো। “

কি তেজ সেই কণ্ঠে। কে বলবে এই মানুষ গত চারদিন রিমান্ডে ছিলো? সেই তেজী স্বরে বলা বাক্য দুটিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে তরী নীরবে দুই পা এগিয়ে লোহার শিকের কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। তাদের মাঝে কেবল এক কদমের দূরত্ব এই মুহুর্তে। কিন্তু এই লোহার শিক যেন সেই এক কদমের দূরত্ব ঘোচানোর পথে সুউচ্চ বেড়ির ন্যায় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

তরী শিকের ফাঁক গলে নিজের একহাতে ছুঁয়ে দেয় পার্থর গাল। সাথে সাথে পার্থ চোখ বুজে নেয়। গাল গড়িয়ে সেই হাতের ছোঁয়া গিয়ে পৌঁছে পার্থর ডান চোখ হতে এক আঙ্গুল সমান দূরের জায়গাটিতে। মুহুর্তেই ক্ষত স্থান তীব্র ব্যথায় বিষিয়ে উঠে। পার্থ তবুও তরীর সামনে শক্ত থাকতে দাঁত খিচে সেই যন্ত্রণাটা সয়ে নেয়। কিন্তু তরী আর শক্ত থাকতে পারে না। গত ক’টা দিন ধরে এই শক্ত খোলসে আবৃত থেকে সে হাপিয়ে উঠেছে। মাস্কের ভিতর সে ঠোঁট কামড়ে কান্নার স্বর আটকে রাখার চেষ্টা করে। মুহুর্তেই ধপ করে শিকের কাছ ঘেঁষে নিচে বসে পড়ে সে। দু হাতে মুখ ঢেকে নিজের কান্না আড়াল করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

পার্থ চোখ মেলে দেখে তরী নিচে বসে আছে। তার বুক চিড়ে বেরিয়ে আসে একটা দীর্ঘশ্বাস। পার্থ নিজেও ধীরে তরীর মুখোমুখি হয়ে বসে। কিছু বলতে নিবে তার আগেই তরী রুদ্ধস্বরে বলে উঠে,

“ আর কারো সামনে আমি নিজের আবেগ প্রকাশ করি নি। আপনার সামনেই কেবল করছি। বাঁধা দিবেন না দয়া করে। সম্ভব হলে আমার এই আবেগের যথার্থ মূল্যায়ন করুন। “

এতোদিন পর স্বীয় স্ত্রীর মুখে আপনি সম্বোধন শুনে পার্থ নীরব বনে যায়। একসময় তরী সবসময় তাকে আপনি বলে সম্বোধন করলেও, সময়ের পরিক্রমায় এখন কেবল অভিমান কিংবা রাগ হলেই তরী আপনি টার্মটা ব্যবহার করে। কিছু মুহুর্তের ব্যবধানেই তরী নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ মুছে সোজা হয়ে তাকায় পার্থর পানে। দৃষ্টি মিলন হতেই তরী বলে,

“ আরো একবার আপনার রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আমাদের সুখে ভাটা দিয়ে গেলো। “

পার্থ নীরবতা ভেঙে বলে,

“ আমি তোমাকে সত্যিকার অর্থেই সুখী রাখতে চাই তরী। “

তরী বেদনাদায়ক হাসি দিয়ে বলে,

“ আপনি আমাকে বলেছিলেন সিচুয়েশন সেফ এন্ড সিকিউরড হতেই আমাদের স্বপ্নের ভাই কিংবা বোনকে আমরা পৃথিবীতে আনবো। কিন্তু তা কখনো সম্ভব না। ইউ নো হোয়াই? কারণ আপনি যতদিন রাজনীতিতে জড়িত ততদিন আমাদের লাইফে সেফ এন্ড সিকিউরড টার্মটা কখনোই আসবে না। আপনার রাজনীতি আপনারসহ আপনার পুরো পরিবারের নিরাপত্তায় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরকম অবস্থায় আপনার মামির বলা কথাটাই এখন আমার সত্যি মনে হচ্ছে। আপনি রাজনীতিতে জড়িত থাকায় আমাদের এক সন্তান হারানোর দুঃখ বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। আপনি যদি রাজনীতিতে আজীবন জড়িত থাকেন তাহলে হয়তো আসলেই আমার বাচ্চা কখনোই পৃথিবীর আলো দেখতে পারবে না। “

পার্থ ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করে,

“ কি বলতে চাইছো? “

তরী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

“ আমি যথেষ্ট চেষ্টা করেছি পার্থ। কিন্তু দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে আমার। এই অনিশ্চয়তাপূর্ণ জীবন থেকে আমাকে মুক্তি দিন। রাজনীতিটা ছেড়ে দিন। আমরা ভালো থাকবো। “

তরীর কথার পিঠে পার্থ একটাও টু শব্দ করে না। তরী অধৈর্য্য গলায় বলে,

“ আব্বা আম্মার কথা ভাবুন একবার। এই বয়সে উনাদের এই চিন্তাটা না দিলেই কি নয়? আপনাকে এই অবস্থায় দেখে আমার কেমন লাগছে তা কি আপনি বুঝতে পারছেন না? এই জ্বলজ্যান্ত মানুষগুলোর অনুভূতির মূল্যায়ন কি আপনি তাদের কষ্ট দিয়ে করবেন? “

পার্থ এবারও নীরব রয়। তরী ফের হাত বাড়িয়ে পার্থর গাল ছুঁয়ে লোহার শিকে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজে নেয়। রুদ্ধশ্বাস ছেড়ে বলে,

“ সত্যি বলছি আমরা ভালো থাকবো। ভালো থেকে দেখিয়ে দিবো। আমার এই আবদারটা মেনে নিন। “

তরীর কণ্ঠে মিশ্রিত তীব্র আকুলতা পার্থর হৃদয় দ্বারে তুফান হয়ে হানা দেয়। তবে সেই তুফানের প্রকোপ পার্থর হৃদয়ের তুখোড় দ্বার পেরিয়ে আর চৌকাঠে প্রবেশ করতে পারে না। সে তরীর কপাল বরাবর শিকের অপর পাশ হতে নিজের কপাল ঠেকায়। নিজের গালে থাকা তরীর হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে তাতে চুমু খায়। এতদিন পর পার্থর স্পর্শ পেয়ে তরীর নয়ন যুগল ফের ভরে আসে। রাগ অভিমানের পাল্লা ভুলে গিয়ে সে নরম সুরে অভিযোগ তুলে,

“ আমি ভালো নেই পার্থ। ওই ঘরটাতে তোমাকে ছাড়া আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। এসব ছেড়ে দয়া করে ফিরে আসো। তোমার ঘর, তোমার পরিবার, তোমার তরী সবাই তোমার অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছে। “

পার্থ এবার শান্ত স্বরে শুধায়,

“ আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তরী। প্রতিজ্ঞা ভেঙে বেইমানি করা আমার স্বভাবে নেই। হোক সেইটা রাজনীতির ক্ষেত্রে অথবা সম্পর্কের ক্ষেত্রে। “

পার্থর এহেন কথা শুনে তরী সাথে সাথে দূরে সড়ে যায়। এক মুহুর্ত পার্থকে দেখে নিয়ে নিজের চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়। অপরদিকে মুখ ফিরিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলেই পিছন থেকে পার্থর স্বর ভেসে আসে,

“ ডাক্তার, এতদূর এসেছেন অন্তত মুখদর্শনের সুযোগ দিন এই অধমকে। “

তরী নরম হয় না। পার্থ কি তার আবদার রেখেছে যে সে পার্থর আবদার মানবে? কখনোই না। তরী দুই হাতে গায়ের শাল দৃঢ় ভঙ্গিতে আঁকড়ে ধরে পিছু না ফিরেই সেখান থেকে প্রস্থান করে। পার্থ নীরবে সেই পানে চেয়ে হাসে। অত:পর অস্ফুটে বলে উঠে,

“ বড় নিষ্ঠুর আপনি ডাক্তার। প্রাণ পিপাসায় তৃষ্ণার্ত মরিজকে চিকিৎসা না দিয়ে উল্টো তার সামান্য ওষুধের আবদারও নাকোচ করলেন। “

__________

বিশ্বাসঘাতকতা কখনো দূরের মানুষ করে না। বরং খুব কাছের মানুষই আজীবন নীরবে পিঠে ছুড়ি চালায়। ইশতিয়াক ভুইয়ার লোক পার্থর উপর নজর রাখছে জানতে পেরে আসিফ পার্থর কথায় নিজের বিশ্বস্ত দু’জন লোককে ইশতিয়াক ভুইয়ার উপর নজর রাখতে পাঠায়। তাদের মধ্যে একজন দূর্ভাগ্যবশত ধরা খেয়ে যায়। সেই একজনকে ইশতিয়াক ভুইয়ার সামনে পেশ করা হলে ইশতিয়াক ভুইয়া তাকে বেশ লোভনীয় কিছু প্রস্তাব দেয়। তার মধ্যে একটা প্রস্তাব ছিলো যে তাকে বড় পদ দেওয়া হবে। বিনিময়ে তাকে পার্থর ব্যাপারে যেকোনো এমন তথ্য দিতে হবে যা দ্বারা পার্থর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করা যাবে।

কথায় বলে লোভ হলো মানুষের স্বভাবের একটা বৈশিষ্ট্য মাত্র। কিন্তু এই লোভ সংবরণ করার চাবিকাঠিও মানুষের হাতেই থাকে। কেউ যদি নিজ হতে নিজের লোভের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পারে তবে অন্য কেউ তাকে সেই পথ থেকে ফেরাতে পারবে না। কথাটা একদম যথার্থ। ইশতিয়াক ভুইয়ার এমন প্রস্তাবে নিজের লোভ সামলাতে না পেরে সেই ব্যক্তি পার্থর ব্যাপারে একটা সিক্রেট ফাঁস করে দেয়। এমনকি নিজে পার্থর বিপক্ষে সাক্ষীও দেয় পুলিশের কাছে।

এই সম্পূর্ণ ব্যাপারে সবথেকে দুঃখজনক বিষয় হলো মানুষটা আর কেউ নয় বরং শামীম। পার্থর খুব কাছের, খুব বিশ্বস্ত মানুষ। আর এই সত্যিটা জানার পর থেকেই আসিফ খুব চটে আছে। সে ঘুণাক্ষরেও একবারের জন্য শামীমকে সন্দেহ করে নি। কিভাবে করবে? তার মতো শামীমও এতো বছর ধরে পার্থর ভালো খারাপ সময়ে তার পাশে ছিলো। এই যুগে বিশ্বস্ততা কি এতোই সস্তা যে কেবল সামান্য এক পদের লোভে এত বছরের একনিষ্ঠতা ভুলে যেতেও মানুষ সময় নেয় না? কে জানে!

শামীমের ভাগ্য ভালো যে শোভন তাকে ছেড়ে দিয়েছে। নাহলে রাগচটা আসিফ পারলে শামীমকে সোজা খুন করে ফেলতো। আসিফের মাথায় এখন কেবল একটাই চিন্তা কি করে পার্থকে জেল থেকে বের করে আনা যায়। ইতিমধ্যে পার্থর শুনানির তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। আর দু’দিন পরেই তার কেসের শুনানি হবে। শোভন আর পার্থর উকিল মিলে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে যেন সেদিনই পার্থকে ছাড়াতে পারে। কিন্তু আদৌ তা সম্ভব হবে তো?

আচমকা আসিফের মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। সে সাথে সাথে শোভনের নাম্বারে কল দেয়। শোভন কল রিসিভ করতেই আসিফ বলে,

“ ভাই উকিলের সাথে কি দেখা করা যাইবো? ভাইরে নির্দোষ প্রমাণ করার একটা পথ খুঁইজা পাইসি। “

__________

রুম জুড়ে পায়চারি করতে করতে ফোনকলে ব্যস্ত তূর্য। অফিসে জরুরি বিষয়ে ফোন আলাপের মাঝেও আড়চোখে পৃথাকে দেখছে সে। গোলগাল ফর্সা মুখটায় ছেঁয়ে আছে এক আকাশ পরিমাণ আধার। নীরবে বসে সে তূর্যর হ্যান্ড লাগেজ গোছাতে ব্যস্ত। আগামীকাল তূর্যর ফ্লাইট আছে নিউজিল্যান্ডে। স্পোর্টস নিউজ কাভারের জন্য তার অফিস থেকে চার জনকে নির্ধারণ করা হয় নিউজিল্যান্ডে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তাদের মধ্যে একজন অনাকাঙ্ক্ষিত শারীরিক অবনতির ফলে হাসপাতালে ভর্তি। তাই তার জায়গায় প্রক্সিতে তূর্যকে যাওয়ার অফার করা হয়। তূর্য সেই অফার নাকোচ করে না। বস তাকে ভরসা করে একটা দায়িত্ব দিয়েছে সেটা মানা করে দিলে একটা বাজে ইম্প্রেশন ক্রিয়েট হতো তার। আর তাছাড়া বসের গুড বুকসে থাকার মানে হলো প্রমোশনের দিকে এক পা এক পা করে এগিয়ে যাওয়া। কোন মানুষই বা নিজের শখের চাকরিতে পদোন্নতি পাওয়ার চান্স হাত ছাড়া করবে?

ফোনে কথা বলতে বলতেই তূর্য বারান্দায় চলে যায়। পৃথা মুখ কালো করে বসে রয়। এভাবেই বড় দা’র চিন্তায় সে সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকে। এসবের মাঝে তূর্যও আগামীকাল চলে যাবে। অথচ আজ পৃথাকে একটু সময়ও দিচ্ছে না। লোকটা কি তার প্রতি ইন্টারেস্ট হারিয়ে ফেলছে? এসব উদ্ভট ভাবনার ফলে অষ্টাদশীর মন আকাশে মেঘ জমে। তখনই হঠাৎ তার ফোন শব্দ তুলে বেজে উঠে। পৃথা চমকে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকায়। অত:পর তার ভ্রু জোড়া কুচকে আসে। ফোনের স্ক্রিনে গোটা ইংরেজিতে ভেসে উঠেছে মিস্টার এক্স ওয়াই জেট নামটি। তূর্য বারান্দা থেকে তাকে কল করছে কেন? পৃথা ফোন হাতে নিয়েই গলা ছেড়ে ডাকে,

“ তূর্য? বারান্দা থেকে কল দিচ্ছেন কেন? “

কোনো জবাব আসে না। থাই গ্লাসের সামনের পর্দা দুটো টানা থাকায় তূর্যকে দেখাও যাচ্ছে না। পৃথা ভ্রু কুচকে রেখেই ফোন রিসিভ করে কানে দেয়। সে কিছু বলার আগেই অপরপাশ থেকে তূর্য গভীর স্বরে বলে উঠে,

“ চলো আবার ফিরে যাই ফোনালাপের সেই সময়ে, যখন তুমি আমার জীবনে এসেছিলে মিস এ বি সি হয়ে। “

তূর্যর ভরাট গলায় বলা এমন অদ্ভূত কবিতা পৃথার ভারী পছন্দ হয়। সে কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করে,

“ কি হয়েছে বলুন তো? হঠাৎ কবিগুরু সাজতে চাইছেন? “

“ এই সাময়িক বিচ্ছেদ আমাকে বানিয়ে দিয়েছে কবি, যদি থাকতো আমার কোনো ছোট ভাই তবে ডাকতো তোমায় ভাবি। “

পৃথা এবার খিলখিলিয়ে হেসে উঠে। হাসতে হাসতে সে বলে,

“ নাইস ট্রাই। রেটিং ফাইফ আউট অফ টেন। “

পৃথার হাসির পিঠে তূর্য আর হাসে না। সে একই স্বরে বলে,

“ রেটিং দিয়ে ভেঙো না আমার মন,
আমি চলে গেলে পাশে রবে ক’জন? “

পৃথা ততক্ষণে ফোন কানে ধরে রেখেই ধীর পায়ে বারান্দায় পৌঁছে যায়। বারান্দায় প্রবেশ করতেই দেখে তূর্য অপরপাশে রেলিঙের সাথে হেলান দিয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। একহাত নিজের ট্রাউজারের পকেটে গুজে অপর হাতে ফোন কানে ধরে পৃথার দিকে তাকিয়ে আছে। পৃথা ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে আসতেই তূর্য কান থেকে ফোন নামিয়ে পৃথাকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে। নরম স্বরে বলে,

“ হ্যাপি বার্থডে ওয়াইফি। “

তূর্যর বুকে লেপ্টে থাকা অবস্থায়ও পৃথা কানে ফোন গুজে রেখেছে। তূর্যর কোমল উইশ পেতেই পৃথার এতক্ষণের মন খারাপটা সুতো কাঁটা ঘুড়ির ন্যায় উড়ে চলে গেলো। মুখ তুলে উচ্ছ্বসিত গলায় বলে,

“ আপনার মনে ছিলো? “

“ অবশ্যই। পাপাও জানে। ইতিমধ্যে নিচে আমাদের জন্য ওয়েট করছে কেক নিয়ে। “

পৃথা ফোন নামিয়ে বলে উঠে,

“ তাহলে অপেক্ষা করছেন কেন? চলুন। “

বলেই পৃথা যেতে উদ্যত হয়। কিন্তু তূর্য তাকে আবার টেনে নিজের সামনে এনে দাঁড় করায়। পৃথার ঘাড়ে পড়ে থাকা রেশমী চুলগুলোকে খুব যত্নে দু’হাতে তার কানের পিছনে গুজে দিয়ে বলে,

“ আপাতত পাঁচ মিনিট আমার জন্য বরাদ্দ থাকুক। “

পৃথা লজ্জা আড়াল করে তাড়া দেখিয়ে বলে,

“ কি বলবেন চটজলদি বলুন। “

তূর্য পৃথার কোমর জড়িয়ে ধরে বলে,

“ পরের বছর থেকে রাত বারোটায় তোমাকে উইশ করার সুযোগ আর পাবো না। প্লিজ তাড়া দেখিও না আজ। “

পৃথা চোখ কুচকে প্রশ্ন করে,

“ মানে? “

“ মানে তখন আর এভাবে তোমাকে একা পাওয়া হবে না। বেবিও থাকবে সাথে। তখন অন্যভাবে উইশ করবো। “

পৃথা মুখ টিপে হেসে বলে,

“ বেবি তো এখনো আমাদের মাঝে আছে। “

তূর্য হাসে। কোমর থেকে একটা হাত সরিয়ে তা পৃথার পেটের উপর রাখতেই পৃথা প্রশ্ন করে,

“ কি করছেন? “

তূর্য খানিকটা ঘনিষ্ঠ হয়ে গভীর স্বরে বলে,

“ এখন ও আর দেখবে না। “

পৃথা প্রশ্ন করতে চায় কি। কিন্তু সেই সুযোগ আর পায় না। নিজের অধরে অনাকাঙ্ক্ষিত ছোঁয়া টের পেতেই শরীর জুড়ে শিরশিরে অনুভূতি বয়ে যায়। তূর্য নিজের ঠোঁট জোড়া পৃথার কানের কাছে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

“ আগামী একমাসের জন্য সত্যিকার অর্থে তোমার ফোনালাপের স্বামী হতে যাচ্ছি। উইশ মি লাক। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-৩৯+৪০

0

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩৯.

সকাল সকাল তরীর চলে যাওয়ার খবর শুনে হুমায়ুন রশীদ বেশ অবাক হলেন। তার মেয়ের কি কোনো ভাবে যত্ন আত্মী কম হয়েছে যে মেয়েটা মাঝ রাতে বাড়ি ছেড়ে চলে গেলো? হুমায়ুন রশীদের চিন্তা তূর্য বুঝতে পারে। তাই বলে উঠে,

“ আপির এই মুহুর্তে পার্থ ভাইয়ার সঙ্গের সবথেকে বেশি প্রয়োজন। এই বাসায় এসেও হয়তো সেই অভাবই অনুভব করছিলো। সেটা বুঝতে পেরেই ভাইয়ার কাছে চলে গিয়েছে। ভালোই হয়েছে। এই মুহুর্তে দু’জন একসাথে থাকলেই দ্রুত এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে পারবে। “

তূর্যর কথার পিঠে হুমায়ুন রশীদ আর কিছু বলে না। যদিও মনে মনে সে পার্থর প্রতি ক্ষুদ্ধ। কিন্তু তা সবার সামনে অযথা প্রকাশ করার মানে হয় না। যেখানে তার মেয়ে নিজেই সেই ছেলেটাকে ক্ষমা করে দিলো সেখানে হুমায়ুন রশীদের রাগ দিয়েই বা কি আসে যায়? উনার কেবল একটাই চাওয়া, যে উনার মেয়ে যেনো ভালো থাকে। তার মেয়ে যদি পার্থ নামক মানুষটার কাছে ভালো থাকা খুঁজে পায় তাহলে সেটাই নাহয় হোক।

নাস্তার টেবিলে তূর্যের কথা শুনে সাদিকা বেগম চিন্তিত হয়ে পড়ে। মধুমিতার তো প্রায়ই দিনের বেলা ক্লাস থাকে। আফজাল সাহেব, শোভন এবং পার্থও দিনের বেলা বাহিরে থাকে। ঘরে থাকে শুধু জমিলা। জমিলা ঠিকঠাক খেয়াল রাখতে পারবে তো তরীর?

কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই সাদিকা বেগম রুমের ভেতর গিয়ে জমিলাকে ফোন দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যে জমিলা খালা ফোন রিসিভ করে বলে উঠে,

“ আসসালামু আলাইকুম খালাম্মা। “

“ ওয়ালাইকুম আস সালাম জমিলা। কেমন আছো? “

“ আলহামদুলিল্লাহ খালাম্মা। মেলা ভালো আছি। আপনে কেমন আছেন? পৃথার শরীরডা কেমন? “

“ আলহামদুলিল্লাহ ভালো। শুনো জমিলা, গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে ফোন দিয়েছি। তরী এখন কি করছে? “

“ পার্থ আব্বায় তো বড় বউরে নিয়া হসপিটালে গেসে ডাক্তার দেখাইতে সক্কাল সক্কাল। “

“ আচ্ছা। জমিলা যেহেতু এখন আমিও ওখানে নেই আর বাসার সবাইও সারাদিন ব্যস্ত থাকে তাই তুমি তরীর দিকে একটু ভালো করে খেয়াল রেখো। বাসায় কেউ না থাকলে একটু পর পর ওর কাছে গিয়ে দেখে আসবে। কখন কি প্রয়োজন হয়। “

“ আচ্ছা খালাম্মা, আপনে চিন্তা কইরেন না। “

“ আর শুনো শিং মাছ আনিয়ে তরীর জন্য সুন্দর করে শিং মাছ ভুনা করো। সাথে গরুর কলিজা ভুনাও করো। মেয়েটার শরীরে একেবারেই রক্ত নেই। আর আমি পার্থকে বিটরুট কিনে বাসায় নিয়ে যেতে বলবো। ওই বিটরুট ফলের মতো টুকরো টুকরো করে কেটে গরম পানিতে দিয়ে ভালো করে জাল দিবে। সাথে সামান্য লবণও দিও। একবার জাল এসে পড়লে পরে চায়ের মতো ছেঁকে শুধু পানিটা একটু ঠান্ডা করে তরীকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় খেতে দিবে। বুঝতে পেরেছো? “

এতো এতো নির্দেশ শুনে জমিলা খালার মাথা ঘুরাচ্ছিলো। তিনি আচ্ছা বলে ফোনটা রেখেই বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,

“ বড় বউয়ের চান্দের লাহান একখান কপাল। “

__________

সকাল সকাল তরীকে হসপিটালে নিয়ে গিয়ে পায়ে ভালো করে ড্রেসিং করিয়ে তাকে বাসায় ড্রপ করে দেয় পার্থ। অত:পর নিজে বেরিয়ে পড়ে নিজের কাজে। ফ্যাক্টরিতে কিছু কাজ মিটিয়ে সে পৌঁছে যায় হাজারীবাগে। হাজারীবাগে এক এলাকায় রাস্তার অবস্থা বেশ বিপর্যস্ত। বর্ষাকাল হওয়ায় সেই পথে চলাচল খুব কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। এলাকা ঘুরে নিজের দলীয় কর্মীদের সঙ্গে সবটা একবার পর্যবেক্ষন করে নেয় পার্থ। নিজের পরিকল্পনার খাতায় তুলে নেয় আরেকটি নতুন প্রকল্প। অবিলম্বে এই রাস্তা ঠিক করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে আশ্বাস দেয় এলাকার জনগণকে।

অত:পর গাড়িতে করে এলাকা ছাড়তেই আসিফ গাড়ি চালাতে চালাতে বলে উঠে,

“ ভাই একটা খবর জানানোর ছিলো আপনারে। “

পার্থ মনযোগ ফোনের স্ক্রিনের দিকে স্থির। সে তরীকে ম্যাসেজ দিয়ে তার খবর নিতে ব্যস্ত। সেই ব্যস্ততার মধ্যেই পার্থ হালকা স্বরে বলে,

“ কি খবর? “

“ ভাই এলাকার লোক যখন আপনারে ঘিরা ধরসিলো আর আপনে সবার লগে কথা কইতে ব্যস্ত ছিলেন তখন আমি একটা জিনিস লক্ষ্য করসি। “

পার্থ এবার ফোনের স্ক্রিন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আসিফের দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকায়। আসিফ নিজ হতেই বলতে থাকে,

“ আমি দূরে এক দোকানের চিপা থেকে ইশতিয়াক ভুইয়ার এক লোকরে আপনার উপর নজর রাখতে দেখসি। “

পার্থর ভ্রু দ্বয় কুচকে আসে। সে প্রশ্ন করে,

“ তুই আগে কেনো বলিস নি আমাকে? “

“ ভাই আপনে তখন ব্যস্ত আছিলেন। আর আমি শিওর হইয়া একবার দেইখ্যা সাথে সাথে নিজেও ওইদিকে আর তাকাই নাই। যদি বুইঝা যায় যে আমরা দেইখ্যা ফেলসি তাইলে আরো সতর্ক হইয়া যাইতো। “

পার্থ কপাল কুচকে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়। ইশতিয়াক ভুইয়ার উদ্দেশ্য কি? নিজের পার্টির সদস্যর সাথেই কি শত্রুতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইছে নাকি লোকটা? শত্রুতা শব্দটা মাথায় আসতেই পার্থর শরীর শিউরে উঠে। তার শত্রুতার হিসাব সবসময় তার কাছের মানুষদের পরিশোধ করতে হয়। ইশতিয়াক ভুইয়াকে এই সুযোগ কোনো ভাবেই দেওয়া যাবে না। পার্থর খুব সতর্ক হয়ে কদম ফেলতে হবে এখন থেকে। রাজনীতির মঞ্চে লাইমলাইটে এসে পড়ায় সবার দৃষ্টি এই মুহুর্তে তার উপর।

পার্থ শান্ত গলায় বলে,

“ আমাদের সবথেকে বিশ্বস্ত দু জন মানুষকে ইশতিয়াক ভুইয়ার উপর নজর রাখার দায়িত্ব দে আসিফ। উনার মতলব ভালো ঠেকছে না। নমিনেশন না পাওয়ার শোকে খুব সাংঘাতিক কিছু ঘটানোর পরিকল্পনা করছেন তিনি। “

__________

সবেমাত্র ভার্সিটি থেকে ফিরেছে মধুমিতা। ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘরে ঢুকেই অভ্যাসবশত সবার আগে ডাইনিং টেবিলের কাছে গিয়ে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। জমিলা খালা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে মধুমিতার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে,

“ ছোট বউ ভাত বাইরা দিমু? “

“ না খালা। আগে গিয়ে গোসল করে আসি। ভাবী আর তুমি খেয়েছো? “

“ হ। বড় বউয়ের খাবার আমি রুমে নিয়া গেসিলাম। নিজে সামনে বইসা ছিলাম খাবার শেষ করার আগ পর্যন্ত। “

মধুমিতা মিষ্টি হেসে বলে,

“ ওয়েল ডান। “

অত:পর মধুমিতা উপরে নিজের রুমে চলে যায় আগে গোসল সেরে নিতে। তখনই বাড়ির কলিংবেলটা বেজে উঠে। জমিলা খালা গিয়ে দরজাটা খুলে দিতেই পার্থর দুই মামী আর শর্মী সুরসুর করে ঘরে প্রবেশ করে। এই অসময়ে বিনা নোটিশে উনাদের আগমনে জমিলা খালা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। তবুও বিনয়ী ভঙ্গিতে উনাদের বলে লিভিং রুমে বসতে। পার্থর ছোট মামী বলে উঠে,

“ এতো ব্যস্ত হইতে হবে না। আমরা বড় বউরে দেখতে আসছি। বড় বউ নিজের রুমে আছে? “

বলতে বলতে উনারা উপরের দিকে এগিয়ে যায়। জমিলা খালা উনাদের বাঁধা দিতে পারে না।

__________

নিজের রুমে শুয়ে ফোনে কিছু একটা করছিলো তরী। তখনই আচমকা তার বেডরুমের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে পার্থর এক জোড়া মামী ও শর্মী। তাদের আকস্মিক আগমনে তরী অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। বিছানার একপাশে থাকা ওড়নাটা নিয়ে উঠে বসতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। একা উঠে বসতে গিয়ে মৃদু হিমশিম খেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে তরী তাদের উদ্দেশ্যে সালাম দেয়। পার্থর মামীরা বিছানার কোণে বসে আয়েশী ভঙ্গিতে। অত:পর বড় মামী বলে উঠে,

“ থাক ব্যস্ত হতে হবে না। আমরা আরো তোমাকে দেখতে এসেছি। তা শরীর কেমন এখন তোমার? “

তরী আড়চোখে ড্রেসিং টেবিলের সামনে পার্থর পারফিউম হাতে দাঁড়ানো শর্মীকে দেখে নিয়ে জবাব দেয়,

“ আলহামদুলিল্লাহ। “

ছোট মামী কিছুটা অতিরিক্ত মায়া দেখিয়ে বলে,

“ আহারে! কি একটা অবস্থা! এক্সিডেন্ট তো করসো সাথে বাচ্চাটাও গেলো। এই কারণেই বলে পোয়াতি অবস্থায় মেয়ে মানুষের এতো বাইরে ঘুরে বেড়ানো উচিত না। “

ছোট মামীর কথাগুলো যেন তরীর কাঁচা আঘাতে মরিচ গুঁড়োর মতে লেপ্টে যায়। এই মুহুর্তে তার এই ব্যাপারে এই দুই মহিলার সাথে কোনো রকমের কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। শর্মী মনে হয় দূর হতে বুঝতে পারে তরীর মনের অবস্থা। সে তরীকে জ্বলানোর জন্য বলে উঠে,

“ একে তো বয়স ত্রিশ ছুঁই ছুঁই। তার উপর বাচ্চাটাও থাকলো না। তোমাকে বিয়ে করে পার্থ ভাইয়ের কপালে মনে হয় আর বাচ্চার সুখটা রইলো না। “

মধুমিতা মামীদের আগমনের খবর পেতেই গোসলে না গিয়ে দ্রুত জামা বদলে তরীর রুমে ছুটে আসে। দরজার কাছাকাছি আসতেই সে শর্মীর এরকম কথা শুনে বেশ বিরক্ত বোধ করে। সাথে সাথে ভাবে এই মেয়েকে দু চারটে কড়া কথা শুনাবে। কিন্তু তার আগেই তরী বেশ হাসিমুখে জবাব দেয়,

“ তোমার জ্ঞানের সীমা খুব অল্প শর্মী। প্রথমত আমার বয়স সাতাশ। দ্বিতীয়ত ত্রিশ হয়ে গেলেই যে কেউ কনসিভ করতে পারে না এটা একটা ভুল ধারণা কেবল। তাই ইনশাআল্লাহ আল্লাহ চাইলে তোমার পার্থ ভাই অবশ্যই সন্তানের সুখ পাবে। আর তৃতীয়ত তোমার জ্ঞানের পাশাপাশি ভদ্রতার সীমাও খুব অল্প। তাইতো একজন বিবাহিত পুরুষের রুমে এসে তার অনুমতি ব্যতীত তার জিনিস ধরে ঘাটাঘাটি করছো। “

তরীর কথা দ্বারা নিঃশব্দে শর্মীর গালে একটা অপমানের সিল লেগে যায়। সাথে সাথে তার চোখ মুখ কালো অন্ধকারে ছেঁয়ে যায়। ক্ষুদ্ধ হয় দুই মামীও। বিশেষ করে ছোট মামী। উনি সাথে সাথে চেঁচিয়ে উঠেন,

“ এতো তেজ? আমার মেয়ের এখন তোমার থেকে জ্ঞান আর ভদ্রতা শিখতে হবে? নিজের ভাইয়ের রুমে এসে কিছু একটা ধরেছে দেখে তুমি ওকে এভাবে কথা শুনালে? “

তরী উদ্বিগ্ন হয় না। সে বেশ শান্ত গলায় জবাব দেয়,

“ পার্থ শুধু এখন আপনার মেয়ের ফুফাতো ভাই নয় বরং কারো স্বামীও। সেটা ভুলে যাবেন না মামী। “

ছোট মামী তেজী স্বরে বলে,

“ এতো দেমাগ তোমার? শুধু শুধু এখানে মানবতা দেখিয়ে খোঁজ নিতে এসেছি আমি। এরকম মেয়েদের পেটে বাচ্চা কখনো টিকেও না। আজ একটা গেছে, আগামীতে যে কয়টা আসবে সেগুলোও যাবে। “

শেষের কথাটা তরীর বুকে বিঁধে। তার চোখ ছলছল করে উঠে। মধুমিতা বেশ রাগ হয়। এই কারণে তার আন্টি সমাজ একটুও পছন্দ নয়। এরা সারাক্ষণ অন্যের ব্যাপারে মাথা ঘামাতে ব্যস্ত থাকে। আর যখন মাথা ঘামিয়েও শান্তি পায় না তখন তারা নিজেদের অভিশাপ ঝারতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মধুমিতা বেশ রাগ নিয়ে বলে,

“ তা নিয়ে আপনার চিন্তা না করলেও চলবে মামি। আপনারা চাইলে এখন আসতে পারেন। “

মধুমিতার কথায় দুই মামীর রাগ আরো কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ছোট মামী শর্মীর হাত ধরে টেনে সোজা বেরিয়ে যায়। বড় মামীও বেরিয়ে যাওয়ার আগে বলে,

“ খুঁজে খুঁজে দুই আদব-কায়দাহীন মেয়েকেই এই দুই ভাই পেলো বিয়ে করার জন্য। ছি! “

মামীরা বেরিয়ে যেতেই মধুমিতা তরীর কাছে এসে বলে,

“ উনাদের কথা গায়ে মাখবেন না ভাবী। আমার বিয়ের সময়ও উনারা আমার বাবার ফাইন্যান্সিয়াল অবস্থা নিয়ে প্রচুর আজেবাজে কমেন্টস করেছে। আমি নাকি এতো বড় ফ্যামিলি দেখে শোভনকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করেছি। “

তরী কিছু বলে না। উনাদের স্বভাব কেমন সেই সম্পর্কে তরীরও ইতিমধ্যে ভালো ধারণা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এরকম একটা সেনসিটিভ ইস্যু নিয়ে এরকম একটা বদদোয়ায় সে মনে মনে আঘাত পেয়েছে বেশ।

__________

ইশতিয়াক ভুইয়া আপন বাসায় সোফায় বসে খুব গুরুত্বপূর্ণ এক আলোচনায় ব্যস্ত। উনার সামনে বসে আছে উনারই লোক আশিক। তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু হলো পার্থ। আশিক বলে উঠে,

“ পার্থ মুন্তাসির তো তোড়জোড় করে উন্নয়ন কর্মসূচী নিয়ে ব্যস্ত। কিছুদিন বাদেই সংসদ সদস্য হিসেবে শপথও গ্রহণ করে ফেলবে। তখন তো ও ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে। “

ইশতিয়াক ভুইয়া চায়ের কাপে একটা বিস্কুট অর্ধেক ডুবিয়ে সেদিকে তাকিয়ে ছিলো। চায়ের কাপ হতে বিস্কুটটা তুলে মুখে দিতে নিবে তখনই বিস্কুটটার অর্ধেক অংশ নরম হয়ে ফের চায়ের কাপেই পড়ে যায়। এতে ইশতিয়াক ভুইয়া বেশ বিরক্ত হয়। এই সম্পূর্ণ দৃশ্যটা এতক্ষণ ধরে অবলোকন করছিলো আশিক। ইশতিয়াক ভুইয়া হাতের কাপটা টি টেবিলের উপর রেখে বলে উঠে,

“ বুঝলে আশিক বিস্কুটের ওই অংশটুকু কেন ভেঙে পড়লো? “

এহেন প্রশ্নের মানে খুঁজে পায়না আশিক। এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার মধ্যে নেতা চা বিস্কুট নিয়ে তাকে প্রশ্ন কেন করছে? আশিকের আর কষ্ট করে কিছু বলতে হয়না। ইশতিয়াক ভুইয়া নিজেই বলে উঠে,

“ কারণ এটাকে অধিক সময় ধরে চায়ে ডুবিয়ে রাখা হয়েছিলো। “

আশিক বিরক্ত হয়। মনে মনে আওড়ায় অন্তিক মাহমুদের ভিডিও হতে শোনা দুইটা বিখ্যাত লাইন,

“ তাই নাকি? আমি তো জানতামই না। তুমি কেম্নে জানলে? “

মনে মনে এটা বললেও আশিক মুখে কোনো শব্দ করে না। ইশতিয়াক ভুইয়া আবারও নিজ থেকেই বলে উঠে,

“ পার্থ মুন্তাসিরের অবস্থাও এখন এই বিস্কুটের মতো। মাত্রাতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না। ওর এই সব কাজ যে কেবল পার্টির চোখে নিজেকে ভালো প্রমাণ করার জন্য তা আমি বেশ ভালো করে বুঝতে পারছি। কিন্তু ওর পরিণাম হবে এই বিস্কুটের ন্যায়। শীঘ্রই ঝরে পড়বে। “

আশিক সামান্য কৌতূহলি গলায় প্রশ্ন করে,

“ কি করার চিন্তা করছেন আপনি? রুবেল হোসেনের মতো পার্থ মুন্তাসিরের আপনজনের ক্ষতি করার ভয় দেখাবেন? “

ইশতিয়াক ভুইয়া বেশ শব্দ করে হাসে এই কথা শুনে। ফের আফসোসের সুরে বলে,

“ রুবেল বলদামি করেছে দেখে কি আমিও ওর পথে হাঁটবো নাকি? পার্থ মুন্তাসিরের কাছের মানুষের ক্ষতি করে আমার কি লাভ? তবে পার্থ মুন্তাসিরের ক্ষতি করে আমার লাভ আছে। খুব পাখনা গজিয়েছে না ওর? আমার অধিকার মেরে খায়। ও রাজনীতিতে এসেছে কয়দিন হলো? আমি পুরো জীবন এই রাজনীতির পিছনে খেটে গিয়েছি আর এই দুইদিনের ছেলে কিনা আমার জায়গায় এমপি আর সংসদ সদস্য হবে? আমি ওকে দেখে নিবো ও রাজনীতি কিভাবে করে। “

শেষের কথাটুকু বলতেই ইশতিয়াক ভুইয়ার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে।

__________

আফজাল সাহেব বিকেল বেলায় বাড়ি ফিরতেই পার্থর মামীদের আগমনের কথা জানতে পারে। জমিলা খালা উনাকে এ-ও জানায় যে মামীরা বেশ রাগ হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। সম্পূর্ণ ঘটনা বিস্তারিত জানার জন্য আফজাল সাহেব তরী এবং মধুমিতার সাথে কথা বলে। দুজনই তাকে যতটুকু যা ঘটেছে ঠিক ততটুকুই বলে। এক লাইনও বাড়িয়ে কিংবা কমিয়ে বলে না। সব শুনে আফজাল সাহেব বেশ রাগ হোন। তার বাড়ির সদস্যদের ব্যাপারে বাহিরের মানুষের এতো মাথা ব্যথা তার কোনো কালেই পছন্দ ছিলো না। আর সেখানে কিনা উনারা এসে তার ঘরের পুত্রবধূদের আজেবাজে কথা শুনিয়ে যাবে তা উনি কিভাবে মেনে নিবেন? তাই নিজের শশুড়কে কল করে সম্পূর্ণ ঘটনা জানায় তিনি। পাশাপাশি এ-ও বলেন,

“ আপনার ঘরের পুত্রবধূরা যেন আর কখনো আমার বাড়ির পুত্রবধূদের এসব আজেবাজে কথা না বলতে পারে আব্বা। এই দায়িত্বটা আপনার রইলো। “

রাতে যখন পার্থ আর শোভন বাড়ি ফিরে তখন তারাও এই বিষয় নিয়ে বেশ রাগ হয়। কিন্তু যখন শুনে যে আফজাল সাহেব ইতিমধ্যে এই বিষয় নিয়ে নানাজানের সাথে কথা বলেছে তখন তারা কিছুটা শান্ত হয়।

পার্থ বাসায় ফেরার পর থেকেই লক্ষ্য করে তরী বেশ মনমরা হয়ে আছে। এর কারণ কি তা ও ভালোই বুঝতে পারে। কিন্তু আপাতত এই বিষয়ে কোনো কথা বলে না। রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে পার্থ বসে তরীর পায়ে ওষুধ লাগাচ্ছিলো। এই পা আর মাথার আঘাত নিয়ে যে মেয়েটা কতটা কষ্ট পাচ্ছে তা গতরাতেই দেখেছে পার্থ। যেহেতু তরীর ঘুমের মধ্যে অনেক নড়াচড়া করার অভ্যাস। কিন্তু এই ব্যান্ডেজ আর আঘাতের ফলে সে চাইলেও পাশ ফিরে কিংবা আরাম করে ঘুমাতে পারছে না। সারা রাত একটু পর পর উঠে বসেছিলো সে।

পার্থর ভাবনার মাঝেই তরী আচমকা বলে উঠে,

“ তোমার কি আমার বয়স খুব বেশি মনে হয় পার্থ? “

তরীর এমন প্রশ্ন শুনে পার্থ অবাক হয়। এই ধরনের প্রশ্নের মানে কি? তরী কি নিজের প্রতি কনফিডেন্স হারাচ্ছে? হতেই পারে! তরীর বর্তমাম মানসিক অবস্থার সাপেক্ষে এটা স্বাভাবিক বিষয়।

পার্থ শান্ত গলায় বলে,

“ তুমি আমার কাছে পারফেকশনের ডেফিনেশন। তোমার ব্যাপারে কোনো কিছুই আমার কম বেশি মনে হয়না। ইউ আর বেলেন্সড। “

তরীর মনের খুতখুত ভাবটা রয়েই যায়। পার্থ চুপচাপ উঠে মেডিসিন রেখে এসে তরীর পায়ের নিচে একটা বালিশ রেখে দেয়। অত:পর তরীর সামনে বসে তার কপালের ব্যান্ডেজের উপর দিয়েই আলতো করে চুমু খেয়ে বলে,

“ আমাকে সময় দাও। সব আরেকটু গুছিয়ে নেই। তুমিও সুস্থ হও। সিচুয়েশন যখন আরেকটু সেফ আর সিকিউরড হবে তখন আমরা স্বপ্নর ভাই কিংবা বোনকে আনবো। ওকে? “

পার্থর কথা শুনে তরীর চোখ ছলছল করে উঠে আবার। ইদানীং তার কি হয়েছে কে জানে। হুটহাট খুব কান্না পায়। এরকম ছিচে কাদুনী তো তরী আগে ছিলো না। পার্থ বুঝতে পারে এসব কথায় কাজ হবে না। তরীর মস্তিষ্ক অন্যদিকে ঘুরাতে সে শান্ত গলায় বলে উঠে,

“ তোমার কি মনে হয় তরী, আমি তোমাকে শুধুমাত্র ওই রাতের ওই ঘটনার সাক্ষী হওয়ার ফলস্বরূপ জোর করে বিয়ে করেছি? “

এবার তরীর চোখে কৌতূহল দেখা যায়। সে আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করে,

“ তা নয়তো কি? “

পার্থ তরীর দিকে তাকিয়ে শীতল হাসে।

চলবে…

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪০.

“ তোমার মনে আছে সাত মাস আগে আমাদের পার্টির কলাবাগান এরিয়ার ওদিকে একটা বিশাল সমাবেশ হয়েছিলো? “

পার্থর প্রশ্ন শুনে তরীর ভ্রু জোড়া কুচকে আসে। যদিও কোনো কিছু মনে রাখার ক্ষেত্রে তার মেমোরি খুব শার্প। কিন্তু রাজনীতি বিষয়ক কোনো তথ্যের প্রতি তার কখনো তেমন কোনো আগ্রহ ছিলো না। তাই এই ব্যাপারে সে চাইলেও কিছু মনে করতে পারছে না। পার্থ বুঝতে পারে তরীর মনে পড়ছে না। তাই সে নিজ উদ্যেগে ফের বলে উঠে,

“ সেই সমাবেশে বোমা হামলা হয়েছিলো। পরিস্থিতি খুব ভয়াবহ ছিলো। আহতের সংখ্যাও প্রায় শ খানেক ছিলো। “

আচমকা তরীর চোখ জোড়ায় মৃূদু বিস্ময় ফুটে উঠে। সে কিছুটা উচ্চস্বরে প্রশ্ন করে,

“ ওটা তোমাদের সমাবেশ ছিলো? “

পার্থ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে। তরী অবাক গলায় বলে,

“ কোন দলের সমাবেশ ছিলো এতো কিছু আমি খেয়াল করি নি তখন। আমি আমার এক ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে ওদিকে গিয়েছিলাম। ফেরার পথেই এই সিচুয়েশনের মাঝে ফেসে যাই। “

“ ওখানে তুমি একজন আহত যুবককে সাহায্য করেছিলে। মনে আছে? সেই যুবকের মাথা ফেটে গিয়েছিলো। তুমি নিজের গাড়িতে করে তাকে হসপিটাল নিয়ে গিয়েছিলে। “

তরী এবার উত্তেজিত হয়ে পড়ে। সে আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করে,

“ তুমি কিভাবে জানো? “

পার্থ এবার বেশ শীতল গলায় বলে,

“ ওই যুবককে তোমার গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে একজন তোমাকে সাহায্য করেছিলো। সেই একজনটা আমি ছিলাম। “

তরী অবাক হয়ে পার্থকে দেখতে থাকে। সেদিন সেই যুবককে তার গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে এক আগুন্তক সাহায্য করেছিলো। সেই আগুন্তকের তেমন একটা বর্ণনা তরীর মনে নেই। কেবল এইটুকু তার মনে পড়ে যে সেই আগুন্তক একটা মাস্ক পরিহিত ছিলো। তরী এবার পার্থর হাত চেপে ধরে প্রশ্ন করে,

“ ওই মাস্ক পড়া লোকটা তুমি ছিলে? “

পার্থ মৃদু হেসে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। তরী কিছুক্ষণ অবাক নয়নে পার্থর দিকে তাকিয়ে থাকে। অত:পর সন্দিহান গলায় বলে উঠে,

“ তুমি কথা ঘুরাচ্ছো কেন? আমাকে বিয়ে করার কারণ নিয়ে কথা হচ্ছিলো। “

পার্থ এবার সোজা হয়ে সামান্য গলা ঝেড়ে বলে উঠে,

“ এটাই তোমাকে বিয়ে করার কারণ। “

“ মানে? “

“ মানে আমার তোমাকে প্রথম দেখায় ভালো লেগেছিলো। যেই ছেলেকে তুমি সাহায্য করেছিলে ও আমারই দলের একজন ছিলো। ওর নাম ফুয়াদ। সেই প্রথম সাক্ষাতের পর আমি আবার তোমাকে হসপিটালের ইমার্জেন্সি এরিয়ায় দেখি। “

পার্থর বলা প্রথম কথাটুকু শুনে তরী আরেক দফা বিস্মিত হয়। সে প্রশ্ন করে,

“ সিয়ামকে যখন হসপিটালে নিয়ে আসা হয়েছিলো তখনকার কথা বলছো? “

পার্থ মাথা নেড়ে বলে উঠে,

“ না। ফুয়াদ আহত অবস্থায় যখন হসপিটালে ভর্তি ছিলো তখন আমি ওকে দেখতে গিয়েছিলাম। সেদিনও অবশ্য আমি মাস্ক পরিহিত ছিলাম। ইমারজেন্সি ইউনিটের সামনে দিয়ে লিফটের দিকে এগোনোর সময় আচমকা দেখি মেইন এন্ট্রেস হতে অনেক চিৎকার চেঁচামেচি ভেসে আসছে। আমি আগ্রহী হয়ে পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখতে পাই স্ট্রেচারে করে একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে দৌড়ে তুমি হসপিটালে প্রবেশ করছো। তোমাকে দেখেই আমি থেমে যাই। তুমি আমার চোখের সামনে দিয়েই ইমারজেন্সি ইউনিটে প্রবেশ করো। বাচ্চাটার কি সমস্যা ছিলো আমার জানা নেই। আমি কেবল তোমাকে দেখতে ব্যস্ত ছিলাম। স্বচ্ছ কাঁচের অপরপাশ হতে আমি দেখছিলাম তোমাকে সেই বাচ্চার জীবন বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করতে। আশেপাশে আরো কয়েক নার্স এবং ডাক্তার ছিলো। সকলের চোখে মুখেই আতংক ছিলো। কেবল তোমার চোখে আমি দৃঢ়তা খুঁজে পাই। সব চেষ্টা শেষে সবার চোখে যখন নিরাশা দেখতে পাই সেই মুহুর্তে তুমি বাচ্চাটার গায়ের ফ্রক কেঁটে ডিফিব্রিলেশন দেওয়া শুরু করো। আল্লাহর রহমতে বাচ্চাটা বেঁচে যায়। “

পার্থর মুখে সম্পূর্ণ ঘটনা শুনে তরী নিস্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। পার্থ তাকে এতো আগে থেকে নোটিশ করেছে? কই তরী তো কখনো পার্থকে আগে নোটিশ করে নি! পার্থ আবার বলে উঠে,

“ আই নো তুমি হয়তো ভাবছো এসবের সাথে তোমাকে বিয়ে করার সম্পর্ক কোথায়? এর উত্তর হলো সেই সময়টায় আমি নিজের লাইফের খুব ক্রুশাল একটা পিরিয়ড পার করছিলাম। সামনে ইলেকশন ছিলো অথচ আমি মনে জোর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। রাজনীতির প্রতি পদে পদে আমি হতাশার দেখা পাচ্ছিলাম। রাজনীতি করার সাহসও হারিয়ে ফেলছিলাম প্রায়। বারবার মনে হচ্ছিলো এই করাপ্টেড সিস্টেমের মাঝে আমি কখনোই টিকতে পারবো না। কিন্তু দ্যাট ডে ইউ ইন্সপায়ার্ড মি সামহাও। আই ফেল্ট দ্যাট আই শুড অলসো ট্রাই। সেদিন আরেকটা জিনিসও মনে হয়েছিলো আমার। যে এই মেয়েটাকে সারাজীবনের প্রেরণা হিসেবে নিজের পাশে পেলেও হয়তো মন্দ হয়না। কিন্তু তোমার ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি রাজনীতির প্রতি তোমার তীব্র বিতৃষ্ণা। এরকম একটা মেয়ের জন্য বিয়ের সমন্ধ পাঠালেও যে সে দরজা থেকেই আমাকে প্রত্যাখ্যান করবে তা-ও আমার বুঝা হয়ে গিয়েছিল। তাই নিজের সেই আশায় বালি চাপা দিয়ে দেই আমি। “

কথাটুকু বলে এক দন্ড দম নেয় পার্থ। অত:পর আবার বলতে শুরু করে,

“ যেদিন রাতে আমি তোমাকে ওই কনস্ট্রাকটেড বিল্ডিংয়ে দেখি সেদিন আমার মস্তিষ্ক এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো। বারবার মনে হচ্ছিলো তুমি আগে থেকেই রাজনীতি করার ফলে আমাকে অপছন্দ করো। আর সেদিন রাতে স্ব চক্ষে ওই দৃশ্য দেখার পর হয়তো আমাকে আরো অপছন্দ করতে শুরু করে দিয়েছো। কিছু ভাবতে না পেরে আমি তোমার মুখে রুমাল চেপে ধরে তোমাকে অজ্ঞান করে ফেলি। যতক্ষণ তোমার জ্ঞান ছিলো না ততক্ষণ আমি কিভাবে এই সিচুয়েশন সামলাবো সেই চিন্তায় বিভোর ছিলাম। আচমকা আমার মনে হয় এটাই ভালো সুযোগ। তূর্যকে ব্লেকমেইল করে আমি ওই ফুটেজ গুলোও ডিলিট করিয়ে ফেলি আর তোমার সাথে আমার বিয়েটাও হয়ে যায়। বাট তরী ট্রাস্ট মি ওইদিন ওই ছেলেগুলোকে মারার পিছনে আমার কাছে কারণ ছিলো। ওরা নির্দোষ ছিলো না। “

তরী এতক্ষণ শান্ত ভঙ্গিতে সব শুনছিলো। এই পর্যায়ে সে বলে উঠে,

“ আমি জানি ওরা নির্দোষ ছিলো না। “

পার্থ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,

“ তুমি কিভাবে জানো? “

তরীর সোজা হয়ে বসে থেকে পিঠ ব্যথা করছিলো। সে পিছনে বালিশের সাথে হেলান দিয়ে বলে,

“ তোমার কি মনে হয় আমি কিছু না জেনেই তোমাকে মেনে নিয়েছি? “

পার্থ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রয়। এই প্রশ্ন তার মনের মধ্যেও ছিলো যে তরী তাকে হঠাৎ কেন মেনে নিলো। কিন্তু কখনো এই ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়নি। তরী এবার পার্থর এক হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে উঠে,

“ আমি নিজের মন আর মস্তিষ্ক দুটো দিয়ে বিচার করেই তোমাকে মেনে নিয়েছিলাম পার্থ। এটা সত্যি ওই মুহুর্তে হয়তো আমি তোমাকে ভালোবাসতাম না। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই অনুভূতিতেও বাঁধা পড়ে যাই আমি। “

পার্থ মৃদু হেসে বলে,

“ এই বিশ্বাস নিয়েই আমি তোমাকে বিয়ে করি। “

কথাটুকু বলেই পার্থ তরীর একগালে হাত রেখে বলে,

“ আমি যেই তরীকে ভালোবেসেছি সে সবার সামনে নিজের দৃঢ়তা বজায় রাখে সবসময়। কারো অপ্রয়োজনীয় কথায় নিজে ভেঙে পড়বে না। তোমার ব্যাপারে অন্য কারো মন্তব্যের কোনো দাম নেই আমার কাছে। তুমি কি, তুমি কেমন সব জেনেই আমি তোমাকে বিয়ে করেছি। তাই অন্যের মূল্যহীন কথায় ইনসিকিউরড ফিল করা বন্ধ করো। আবেগ এতো সস্তা না তরী। অন্যের কথায় আবেগী না হয়ে সেই আবেগটা আমার জন্য তুলে রাখো। কথা দিচ্ছি যথাযথ তোমার আবেগের মূল্যায়ন করবো। “

__________

ক্যালেন্ডারের আরেকটি পাতা উল্টে গেলো। মাঝে চলে গেলো আরেকটি মাস। তরী ইতিমধ্যে আগের তুলনায় অনেকটাই সুস্থ হয়ে গিয়েছে। কেবল বাম পা টা এখনো সম্পূর্ণ সেড়ে উঠে নি। ডক্টরের কথা অনুযায়ী ফিজিওথেরাপি চলছে এখনো। আরো একমাসের মধ্যে আশা করা যায় এই জখমটাও সম্পূর্ণ সেড়ে যাবে। যদিও সে এখনই আবার হসপিটালে ফিরে যেতে চাচ্ছিলো কিন্তু হুমায়ুন রশীদ বলে দিয়েছেন সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েই নিজের কাজে ফিরে যেতে। তাই আপাতত তরীর বেশিরভাগ সময় বাসায়ই পাড় হয়ে যায়। সাদিকা বেগমও ইতিমধ্যে নিজের সংসারে ফিরে এসেছে। পৃথার জন্য তিনি অনেক খুঁজে একজন বিশ্বস্ত বাঁধা বুয়া ঠিক করে দিয়েছেন। তাই আপাতত মেয়েকে নিয়ে তিনি মোটামুটি চিন্তা মুক্তই আছেন।

আজকে বছরের প্রথম রোজা। সেই উপলক্ষে আফজাল সাহেব ইচ্ছা পোষণ করেছে যে তিনি নিজের সম্পূর্ণ পরিবার নিয়ে প্রথম ইফতারটা এক সঙ্গে করতে চান। উনার ইচ্ছা মোতাবেকই প্রস্তুতি চলছে। আফজাল সাহেব নিজে হুমায়ুন রশীদকে ফোন করে তূর্য এবং পৃথাকে সহ ইফতারের দাওয়াত দিয়েছেন। হুমায়ুন রশীদও সেই আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দেন নি। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন যে তিনি সময়মতো পৌঁছে যাবে।

দুপুর বেলা থেকেই চৌধুরী নিবাসের বধূরা ইফতারের প্রস্তুতিতে মেতে আছে। আফজাল সাহেব একবার বলেছিলেন যে তিনি খাবার বাহির থেকে কিনে আনবে। কিন্তু সাদিকা বেগম সেই ব্যাপারে বাঁধ সাধে। উনার মতে বাহির থেকে ইফতার কিনে আনলে তাতে রমজানের আমেজ পাওয়া যাবে না। তরী আর মধুমিতাও শাশুড়ীর সাথে একমত। তাই দুপুর থেকে শাশুড়ি এবং পুত্র বধূরা মিলে বিভিন্ন ডিশ রেডি করছে। তরীর যেন বেশি দৌড়াদৌড়ি না করতে হয় সেজন্য সাদিকা বেগম তাকে টেবিলে বসে চপিং এর দায়িত্বটা দিয়েছে। মধুমিতা খুব মন দিয়ে বিভিন্ন ডেজার্ট আইটেম এবং শরবত বানাতে ব্যস্ত। ভাজাপোড়ার কাজ গুলো সাদিকা বেগম এবং জমিলা খালা করছেন।

বিকেলের দিকে হুমায়ুন রশীদ এবং পৃথা চৌধুরী নিবাসে এসে পৌঁছায়। তূর্য অফিস থেকে ডিরেক্ট আসবে বলে জানিয়েছে। পৃথা বাদে বাড়ির সকলেই রোজা। তাই পৃথা রান্নাঘরে গিয়ে ঘুরেফিরে সব খাবারই টেস্ট করে দেখছে। সন্ধ্যার আগ মুহুর্তে পার্থ, শোভন, তূর্য তিনজনই বাড়ি ফিরে।

মাগরিবের আজান পড়তেই সকলে একসাথে দোয়া পড়ে খেজুর মুখে দিয়ে ইফতার খুলে। অনেকদিন পর চৌধুরী নিবাসের ডাইনিং টেবিলে শোনা যায় তিন ভাই বোনের খুনসুটির গুঞ্জন। তাদের সাথে যোগ দেয় তাদের স্ত্রী ও স্বামীও। বেশ আনন্দে সম্পূর্ণ সন্ধ্যাটা পাড় করে তারা।

ইফতার শেষে সকলেই লিভিং রুমে যে যার মতো গল্পে মশগুল ছিলো। তরী সুযোগ বুঝে সবার আড়ালে হুমায়ুন রশীদকে ডেকে বলে,

“ পাপা তোমার সাথে কথা ছিলো। “

হুমায়ুন রশীদ মেয়ের গুরুত্বপূর্ণ কথা শোনার জন্য নীরবে লিভিং রুম থেকে প্রস্থান করে তরীর পিছু পিছু তরীর রুমে যায়। সিটিং এরিয়ার একটা সোফায় বসে হুমায়ুন রশীদ। তার মুখোমুখি বসে আছে তরী। তরী কোনো ভনিতা না করেই বলে,

“ তুমি পার্থর উপর রেগে আছো তা আমি জানি পাপা। কিন্তু ওই ঘটনার অলরেডি একমাসের উপর সময় পার হয়ে গিয়েছে। এখন কি এই রাগটা বাদ দেওয়া যায় না? “

হুমায়ুন রশীদ ভ্রু সরু করে বলে,

“ কে বললো আমি রেগে আছি? রেগে থাকলে কি আমি এই বাড়ি আসতাম নাকি? “

“ তাহলে তুমি সবার সাথে কথা বললেও পার্থর সাথে কথা বলছো না কেন? ওকে ইগনোর কেন করছো? “

মেয়ের প্রশ্নের পিঠে হুমায়ুন রশীদ নীরব বনে যায়। তরী এবার কিছুটা ব্যকুল গলায় বলে উঠে,

“ পাপা ওই এক্সিডেন্টে ওর কি দোষ বলো? তুমি অযথা ওর উপর রেগে আছো। ওই এক্সিডেন্টে আল্লাহর রহমতে তুমি কিছু হারাও নি কিন্তু পার্থ হারিয়েছে পাপা। তোমার মেয়ের শরীরের ক্ষত সেরে যাবে কিন্তু পার্থর ক্ষতিটা অপূরণীয়। তোমার এই পরিস্থিতিতে ওকে বুঝার চেষ্টা করা উচিত ছিলো পাপা। প্লিজ এই রাগ পুষে রেখো না। ওকে এই গিল্ট ট্র্যাপ থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ দাও। পার্থ এখনো নিজেকে দায়ী মনে করছে এই সবকিছুর পিছনে। প্রতি রাতে ও আমার আড়ালে আমাদের বেবির আল্ট্রাসাউন্ডের ছবি দেখে রাত পার করে। ওর উপর অলরেডি অনেক প্রেশার পাপা। এই মেন্টাল প্রেশারটুকু থেকে ওকে মুক্তি দিতে আমাকে হেল্প করো। “

এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে তরী থামে। হুমায়ুন রশীদ এতক্ষণ শান্ত মস্তিষ্কে মেয়ের কথা শুনছিলো। এই পর্যায়ে তিনি প্রশ্ন করে,

“ পার্থ তোমার খুব খেয়াল রাখে, তাইনা? “

তরী মৃদু হেসে বলে,

“ তার প্রমাণ তোমার সামনেই। “

হুমায়ুন রশীদ নীরবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার মেয়ে যে কতটা যত্নে আছে তা নিয়ে উনার সন্দেহ নেই। কেবল উনি এটাই ভেবে পায়না যেই মেয়ের রাজনীতির প্রতি এতো বিরূপ ধারণা ছিলো সেই মেয়ে কিভাবে এক রাজনীতিবীদকে এতটা ভালোবেসে ফেললো? তবে কি পার্থ রাজনীতি সম্পর্কে তরীর ধারণা বদলে দিয়েছে নাকি সবটাই বিয়ের মতো পবিত্র সম্পর্কের জোর?

হুমায়ুন রশীদ গলা সামান্য ঝেড়ে বলে উঠে,

“ আচ্ছা… “

হুমায়ুন রশীদের কথা অপূর্ণ রয়ে যায়। আচমকা বাসার বাহির থেকে ভেসে আসে তীক্ষ্ণ সাইরেনের শব্দ। তরী এবং হুমায়ুন রশীদের আলাপন থেমে যায়। দুজনেই ভ্রু কুচকে একে অপরের দিকে তাকায়। মুহুর্তেই নিচ থেকে ভেসে আসে জমিলা খালার অদ্ভুৎ আর্তনাদের শব্দ। তরীর বুক ধক করে উঠে। সে সাথে সাথে উঠে নিজের রুমের বারান্দার দিকে ছুটে। হুমায়ুন রশীদ দ্রুত পায়ে নিচে চলে যায়। বারান্দা হতে তরী যেই দৃশ্য দেখতে পায় তাতে তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। উল্টো ফিরে আবার রুম পেরিয়ে সে দ্রুত পায়ে দৌড়ে নিচে আসতে নেয়। সিঁড়ির এখানে দু বার পড়তে নিয়েও নিজেকে সামলে নেয় সে। কিছুক্ষণ আগের আড্ডায় মশগুল লিভিং রুমটা নীরব ভঙ্গিতে শূন্য হয়ে রয়েছে। টি টেবিলের উপর রয়ে গিয়েছে পার্থর অর্ধেক খাওয়া কফির মগটা। সেসব কিছুর দিকে ফিরে না তাকিয়েই তরী ঘরের বাইরে ছুটে যায়।

আফজাল সাহেব, শোভন এবং পার্থর সাথে একদল ইউনিফর্ম পরিহিত পুলিশ ফোর্সের তুলকালাম তর্কাতর্কি হচ্ছে। দূর হতে এই দৃশ্য দেখে তরীর মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পড়ে। তার পা জোড়া আর সামনে এগোনোর সাহস পায় না। সে ঠাই দাঁড়িয়ে রয় দরজার বাহিরটায়। মধুমিতা আর পৃথা সাদিকা বেগমকে সামলাতে ব্যস্ত। আতংকিত সাদিকা বেগম ইতিমধ্যে কান্না জুড়ে দিয়েছেন। আফজাল সাহেব বার দুয়েক স্ত্রীকে কঠিন ধমক দিয়ে চুপ হতে বলে। কিন্তু অস্থির মায়ের মন শান্ত হয় না সেই ধমকে।

তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে পুলিশ বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি আশংকাজনক দেখে পার্থ ব্যকুল দৃষ্টি মেলে ঘরের দরজার পানে তাকায়। সাথে সাথে তরীর সাথে তার দৃষ্টি মিলন হয়। তরীর আতংক মিশ্রিত চোখ পার্থর দিকেই স্থির ছিলো। পার্থ তাকাতেই সেই ছলছল চোখ হতে এক বিন্দু পানি গড়িয়ে পড়ে। পার্থ সাথে সাথে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। বেশ শান্ত শীতল গলায় বলে,

“ আব্বা, শোভন আর কোনো কথা হবে না। আমি যাচ্ছি। আল্লাহ হাফেজ। “

কথাটুকু বলেই পার্থ নিজেকে পুলিশের আন্ডারে সমর্পণ করে দেয়। দূর হতে পার্থকে হ্যান্ডকাফ পড়ানোর দৃশ্যটা দেখেই তরীর শরীর অসাড় হয়ে পড়ে। সে দেয়ালে পিঠ দিয়ে ধপ করে নিচে বসে পড়ে। হুমায়ুন রশীদ দৌড়ে এসে নিজের মেয়েকে বুকে জড়িয়ে তার দৃষ্টি আড়াল করে ফেলে যেন এই দৃশ্যর সাক্ষী তার মেয়ের না হতে হয়।

পার্থকে পুলিশের গাড়িতে টেনে তোলার আগে পার্থ শোভনের উদ্দেশ্যে নীরব আদেশ দেয়,

“ যা-ই হয়ে যাক না কেন, তোর ভাবী যেন থানায় না আসে। “

শোভন অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রয়। পার্থ অপেক্ষা না করে সাথে সাথে আফজাল সাহেবের দিকে তাকিয়ে নিষ্প্রভ গলায় বলে,

“ আম্মার খেয়াল রাখবেন আব্বা। আমার জন্য নিজের বিপিটাও বাড়াবেন না দয়া করে। আর তরীকে আপনার আমানতে রেখে যাচ্ছি। “

ব্যস! সঙ্গে সঙ্গেই পার্থকে গাড়িতে তুলে ফেলা হয়। গাড়ি ছাড়বে এমন মুহুর্তে ভীড় ঠেলে তরীকে দৌড়ে আসতে দেখে পার্থ। মুহুর্তেই তার চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে উঠে। কিন্তু তরী গাড়ির কাছাকাছি পৌঁছানোর আগেই গাড়ি ছেড়ে দেয়। আফজাল সাহেবও তরীকে একহাত ধরে আটকে ফেলে। তরী পার্থর দিকে তাকিয়ে থেকেই অশ্রুসিক্ত গলায় বলে উঠে,

“ ওরা পার্থকে ছাড়বে না আব্বা। ওরা ছাড়বে না ওকে। “

দূর হতে তরীকে এই অবস্থায় দেখে পার্থর বুক পুড়ে যাচ্ছে। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। এই বিচ্ছেদের স্থায়িত্ব কত সময়ের তা তার জানা নেই। কিন্তু এই সময়কাল জুড়ে যে তরী ভালো থাকবে না তা তার ভালো করেই জানা আছে। পার্থ অস্ফুটে বলে উঠে,

“ ঘুরেফিরে বারবার আমি-ই কেনো তোমার খারাপ থাকার কারণ হচ্ছি, বলো তো তরী? “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-৩৭+৩৮

0

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩৭.

সদ্য নির্বাচিত নব এমপি গত দু’দিন ধরে নাওয়া খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়ে গ্রীন কেয়ার হসপিটালের আইসিইউ রুমটার সামনে স্থবির হয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছে। আইসিইউর ভেতর ভিজিটিং আওয়ার হচ্ছে সারাদিনে কেবল এক ঘন্টা। সেই এক ঘন্টায় পরিবারের সকলেই একজন একজন করে ভিতরে প্রবেশ করে তরীকে দেখে আসে। কেবল পার্থই ভিতরে যায় না। চুপচাপ মাথা নত করে এই বেঞ্চিটাতে ঠাই বসে রয়। তার থমথমে মুখ, অসম্ভব লাল চোখ জোড়া এবং স্থির দৃষ্টি দেখে কারো সাহস হয় না আগ বাড়িয়ে তার সাথে কোনো কথা বলার।

৭০ ঘন্টা। ৪২০০ মিনিট। ২৫২০০০ সেকেন্ড। অপেক্ষা জিনিসটা যে কতটা যন্ত্রণাদায়ক তা গত ৭০ ঘন্টা ধরে হারে হারে টের পাচ্ছে পার্থ। ডক্টরের থেকে বেঁধে দেওয়া ৭২ ঘন্টার মধ্যে ইতিমধ্যে ৭০ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। অবশিষ্ট আছে কেবল আর দুই ঘন্টা। কিন্তু এখনো তরীর জ্ঞান ফেরার কোনো নাম নেই। সময় যত গড়াচ্ছে বুকের ভেতরের ব্যথাটা ততই তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।

পার্থর মুখোমুখি আরেকটা বেঞ্চিতে বসে আছে হুমায়ুন রশীদ। পার্থর সাথে পাঞ্জা দিয়ে এই অপেক্ষার ভাগীদার তিনিও। গত তিনদিনে তিনি টুকটাক সবার সাথে কথা বললেও কেবল পার্থর সাথেই কোনো কথা বলে নি। তার মেয়ের এহেন পরিস্থিতির পিছনে যে পার্থর রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব দায়ী তা জানার পর থেকে পার্থর দিকে ফিরেও তাকাচ্ছেন না তিনি।

এই মধ্যরাতে হাসপাতালে এক প্রকার মানুষের সমাগম কিংবা ভীড় নেই বললেই চলে। মাঝে মাঝে কেবল আইসিইউ হতে দু একজন নার্স ব্যস্ত পায়ে আসা যাওয়া করে যাচ্ছে। সময় যখন আর এক ঘন্টা কেবল বাকি তখন আচমকা কারো ফুপিয়ে কান্নার শব্দে পার্থ মুখ তুলে তাকায়। হুমায়ুন রশীদ চাইলেও আর নিজেকে সামলে রাখতে পারছেন না। একমাত্র মেয়েকে হারানোর ভয়ে তিনি ফুপিয়ে বাচ্চাদের ন্যায় কান্না করছেন। পার্থ বিচলিত হয় না। উঠেও যায় না। আগের মতো নিজের জায়গায়ই বসে রয়।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আইসিইউ হতে একজন পুরুষ ডক্টর বেরিয়ে আসেন। করিডোরে বসে থাকা পার্থ এবং হুমায়ুন রশীদকে এক মুহুর্ত দেখে নিয়ে তিনি বলে উঠেন,

“ হুমায়ুন স্যার? “

হুমায়ুন রশীদ এবং পার্থ সাথে সাথে চোখ তুলে তাকায়। হুমায়ুন রশীদ নিজের চোখ মুছে উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে,

“ হ্যাঁ। আমার মেয়ে? “

ডক্টর কিছুটা হাসিহাসি মুখ করে বলে,

“ সম্পূর্ণ জ্ঞান ফিরে নি। তবে ডক্টর তরী ইজ রিস্পোন্ডিং। চিন্তা মুক্ত থাকুন এখন। “

হুমায়ুন রশীদের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা পার্থ সাথে সাথে চোখ বুজে বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,

“ আলহামদুলিল্লাহ। “

অত:পর চোখ মেলে ডক্টরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

“ আর কোনো রিস্ক নেই তো? “

“ চিন্তা করবেন না। সম্পূর্ণ জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত আমরা আরও কিছুক্ষণ অবজারভেশনে রাখবো। একবার জ্ঞান ফিরলেই কেবিনে শিফট করে দেওয়া হবে। “

হুমায়ুন রশীদ তাগাদা দেখিয়ে বলে,

“ আমি আমার মেয়ের কাছে যাবো। “

হুমায়ুন রশীদকে মানা করার সাধ্য কারো নেই৷ তাছাড়া তিনি নিজেও একজন ডক্টর। তাই কারো অপেক্ষা না করে তিনি হন্তদন্ত পায়ে চলে যান আইসিইউ তে প্রবেশের জন্য প্রয়োজনীয় গেটাপে তৈরি হতে। পার্থ কোনো কথা না বলে চুপচাপ করিডরেই বসে রয়।

__________

তরীর অবস্থা এখন আশংকা মুক্ত সেই খবর ইতিমধ্যে দুই বাড়িতেই পৌঁছে গেছে। কিন্তু মধ্যরাত হওয়ায় এখন কেউ আর হসপিটালের উদ্দেশ্যে বের হয় না। তরীকে কেবিনে দিলে একেবারে সকাল সকাল তারা দেখা করতে যাবে বলে ঠিক করে রেখেছে। কিন্তু তূর্য বাসায় বসে সকাল হওয়ার অপেক্ষা করতে পারে না। সে পৃথাকে সাদিকা বেগমের দায়িত্বে রেখে নিজের বাইক নিয়ে বেরিয়ে যায় হসপিটালের উদ্দেশ্যে। পৃথাও অবশ্য বাঁধা দেয় না। এই তিনদিন বোনের চিন্তায় তূর্য কতটা অস্থির হয়ে ছিলো তা তার অজানা নয়।

__________

ভোর ৪ টা বেজে ২৫ মিনিট। তরীকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। সাধারণত যে কোনো পেশেন্টের জ্ঞান ফিরলে সে সবার আগে নিজের আপনজনের সান্নিধ্য খুঁজে। কিন্তু তরীর বেলায় হলো উল্টো। সে জ্ঞান ফিরতেই সবার আগে কেবিনে উপস্থিত নার্সকে প্রশ্ন করে তার বাচ্চা কেমন আছে। তরী অবুঝ নয়। একজন ডক্টর হওয়ার সুবাদে সে ভালো করেই জানে এতো বড় এক্সিডেন্টের ধাক্কা সেই ছোট্ট প্রাণ কখনোই সামলাতে পারবে না। তবুও তার অবচেতন মন ভিন্ন উত্তরের আশায় এই প্রশ্নটা করে। কিন্তু নার্সের মুখে যখন সে শুনে তার বাচ্চাটা আর নেই তখন শান্ত ভঙ্গিতে জানায় কেউ যেন তাকে আর বিরক্ত না করে। সে একা থাকতে চায়।

তরীর এই কথা শুনে নার্স বেশ অবাক হয়। এরকম পেশেন্ট সে এই প্রথম দেখলো। চুপচাপ কেবিনের বাইরে এসে অপেক্ষারত তিন পুরুষকে জানায় তরী কারো সাথে দেখা করতে চায় না। তরীর এমন কথায় হুমায়ুন রশীদ ব্যথিত হয়। তার মেয়ে এতটা কষ্টে আছে অথচ তবুও সেই কষ্ট কারো সাথে ভাগ করতে রাজি না। হুমায়ুন রশীদ মাথা নত করে চুপচাপ সেখান থেকে প্রস্থান করে। তূর্যও নিজের বোনকে আর বিরক্ত করে না। সে চায় না তার আপি এই অবস্থায় উত্তেজিত হয়ে শরীর আরো খারাপ করুক।

পার্থ নার্সের কথা শুনে নিশ্চুপ ভঙ্গিতে বেঞ্চিতে বসে পড়ে। তার গায়ে এই মুহুর্তে একটা হালকা বাদামী রঙের শার্ট ও প্যান্ট রয়েছে। সাধারণত সবসময়ের তুলনায় বেশ ভিন্ন দেখাচ্ছে তাকে। তূর্য নীরবে পার্থর পাশে বসে শান্ত গলায় শুধায়,

“ আপি মুখে বলবে না কখনো, কিন্তু মনে মনে ঠিকই আপনার অপেক্ষা করছে ভাইয়া। “

পার্থ চোখ তুলে তূর্যর দিকে তাকায়। এর আগে তূর্য তাকে কখনো কিছু বলে সম্বোধন করে নি। এই প্রথম নিজ থাকে তাকে ভাইয়া বলে ডাকলো। তূর্যের চোখে পার্থ নিজের জন্য কোনো ঘৃণাও খুঁজে পায় না।

তূর্য একইভাবে শান্ত ভঙ্গিতে বলে,

“ আপনি জানেন পৃথা সেদিন আম্মার প্রস্তাবে রাজি হয়নি কেন? কারণ ও নিজের এই প্রেগন্যান্সির জার্নিটাতে আমাকে নিজের পাশে চায়। যতই সবাই ওর সাথে থাকুক না কেন আমাকে ছাড়া ওর এই প্রেগ্ন্যাসির জার্নি কখনো কমপ্লিট হবে না। একইভাবে আপিরও এই মুহুর্তে আপনাকে পাশে প্রয়োজন। শরীরের ক্ষত না হয় ট্রিটমেন্টে সেরে যাবে, তবে মনের ক্ষত ঠিক করার দায়িত্বটুকু আপনারই। “

পার্থ চোখ বুজে একটা দীর্ঘশ্বাস নেয়। অত:পর শান্ত স্বরে বলে উঠে,

“ তুমি খুব বুঝতে জানো তূর্য। আমার বোনের জন্য তোমার থেকে উত্তম জীবনসঙ্গী আর কেউ হতে পারতো না। “

__________

প্রাইভেট কেবিনের শুভ্র বিছানায় চোখ বুজে শুয়ে আছে তরী। আচমকা নিজের পেটের উপরে কিছু একটার ভার অনুভব করতেই সে নিজের জ্বলতে থাকা চোখ দুটো মেলে তাকায়। মানুষটা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে দু’হাতে তার কোমর জড়িয়ে ধরে পেটের উপর মাথা রেখে বসে আছে। তরী চোখ ফিরিয়ে কেবিনের একপাশের স্বচ্ছ থাই গ্লাসের জানালা দিয়ে বাহিরে তাকায়। ভোরের আলো এখনো ফুটে নি। বৃষ্টির দমকে এবং মেঘের আড়ালে তা লুকিয়ে রয়েছে। বাহিরের দিকে তাকাতেই তরীর চোখের সামনে ভেসে উঠে সেদিন রাতের সেই ভয়ানক চিত্র। সম্পূর্ণ স্পিডে এগিয়ে আসা একটা ট্রাক, সেই ট্রাকের সঙ্গে তার গাড়ির সংঘর্ষ, দু তিনটা ডিগবাজি খেয়ে গাড়ি উল্টো অবস্থায় রাস্তার এককোণে পড়ে থাকা, সেই নির্মম বৃষ্টি, অত:পর তরীর দু চোখের পাতা বন্ধ হয়ে যাওয়া।

তরী ক্ষীণ স্বরে বাহিরের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেই বলে উঠে,

“ ও আর নেই। “

তরী সাথে সাথে নিজের পেটের উপর থাকা চাদর ভেদ করে পার্থর তপ্ত নিঃশ্বাস এবং কয়েক বিন্দু নোনাজল টের পায়। পার্থ রুদ্ধস্বরে বলে,

“ তুমি আছো তো। আমি আছি তো। আমরা তো আছি। “

তরী নির্লিপ্ত গলায় বলে,

“ কোথায় ছিলে তুমি পার্থ? জ্ঞান হারানোর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত আমি তোমার নাম জপছিলাম। তোমার অপেক্ষায় সকল যন্ত্রণা সয়ে কাতরাচ্ছিলাম। তুমি আসো নি। “

পার্থ কিছু বলবে তার আগেই তরী আবার বলে,

“ একটা প্রশ্ন করবো শুধু। সত্যি সত্যি উত্তর দাও। “

পার্থ মাথা তুলে এবার তরীর শ্যাম রক্তশূণ্য মুখের দিকে তাকায়। তরী শান্ত গলায় প্রশ্ন করে,

“ আমার বাচ্চা কিসের দায়ে পৃথিবীতে আসার আগেই চলে গেলো? “

প্রশ্নটা করার সময় তরীর চোখ ছলছল করছিলো। পার্থ সেই চোখে তাকিয়ে থেকেই থমথমে গলায় জবাব দেয়,

“ তার বাবার রাজনীতি করার দায়ে। “

তরী সাথে সাথে নিজের চোখ বুজে নেয়। এতক্ষণ ধরে চোখে জমে থাকা অশ্রু এখন চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। পার্থ মাথা নত করে বলে,

“ আমাকে মাফ করে দাও। “

“ আমি একা থাকতে চাই। “

পার্থ হালকা উদ্বেগ নিয়ে কিছু বলতে নিবে তার আগেই তরী অত্যন্ত শীতল গলায় বলে,

“ আমি একা থাকতে চাইছি পার্থ মুন্তাসির। আপনার উপস্থিতি আমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। “

পার্থ অসহনীয় যন্ত্রণা অনুভব করে। রুদ্ধস্বরে প্রশ্ন করে,

“ আমি তোমার যন্ত্রণার কারণ? “

তরী কোনো জবাব দেয় না। সে কেবল চোখ বুজে রাখা অবস্থায়ই নিজের মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নেয়। এতে মাথায় কাঁচা আঘাতের জায়গায় প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করে। তবে সেই ব্যথাটুকু তরী ঠোঁট কামড়ে সহ্য করে নেয়। পার্থ কেবিন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে শেষ বারের মতো বলে,

“ আর সামনে আসবো না। নিজের প্রতি অযত্ন করো না কোনো। “

পার্থ কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতেই তরী চোখ মেলে তাকায়। এক অবর্ননীয় যন্ত্রণা তার বুকের এফোঁড় ওফোঁড় সম্পূর্ণটা ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে। জ্ঞান ফেরার পর থেকে চেপে রাখা কান্নাটা এই মুহুর্তে ঠেলে বেরিয়ে আসে। তরী একহাতে বেডের চাদর খামচে আর্তনাদ করে কেঁদে উঠে। জোরে আর্তনাদ করার ফলে তার সম্পূর্ণ শরীর ব্যথায় নীল হয়ে আসে। তবুও তরী থামে না। এই সকল যন্ত্রণা তার মনের যন্ত্রণার তুলনায় বেশি নয়। তরী কাঁদতে কাঁদতে অস্ফুটে বলে উঠে,

“ তোমার রাজনীতি নামক এই ঝড় আমাদের সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেলো পার্থ। “

চলবে…

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩৮.

মাঝে কেটে গেলো সাতটা দিন। এই সাত দিনে দুই পরিবারের সকল মানুষ তরীকে দেখতে এলেও পার্থ ভুলেও আর তরীর সামনে আসে নি। অথচ এই সাতটা দিন মানুষটা তরীর কেবিনের বাহিরেই রাত্রি যাপন করেছে। তরী এবং পার্থর এই নীরব দূরত্ব কারো চোখ এড়ায় নি। সবাই-ই মোটামুটি নিশ্চিত যে এই দুজনের মাঝে কোনো সমস্যা চলছে। তাদের সন্দেহটাকে সম্পূর্ণ সত্যিতে রূপ দিতে তরী জানায় যে সে হসপিটাল থেকে রিলিজ পেয়ে নিজের বাড়ি ফিরতে চায়। তার কথা শুনে আফজাল সাহেব বলেন,

“ বেশ তো। একবার সুস্থ হও, তোমাকে সাদরে ঘরে বরণ করে নিতে আমরা অপেক্ষমাণ। “

আফজাল সাহেবের কথার পিঠে তরী বেশ শান্ত ভঙ্গিতে জবাব দেয়,

“ আমি যে বাড়িতে বেড়ে উঠেছি সেই বাড়িতে ফিরতে চাই আব্বা। “

আফজাল সাহেব এ নিয়ে আর কোনো টু শব্দ করে না। বাকি কেউও আপত্তি করে না। হুমায়ুন রশীদ মেয়ের জন্য নিচতলার গেস্ট রুমটা সাজিয়ে গুছিয়ে রাখার তদারকি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তরীর পায়ের ফ্র্যাকচারটা সারতে বেশ সময় নিবে। এই অবস্থায় তরীর সিঁড়ি বেয়ে উপরের ঘরে থাকাটা মোটেও সমীচীন হবে না। মেয়ের জন্য কিভাবে কি সুবিধা হয় তাই এখন হুমায়ুন রশীদের একমাত্র চিন্তা।

সাদিকা বেগমও এ নিয়ে দ্বিমত পোষণ করে না। এই অবস্থায় তরী এই বাড়িতে থাকলে সাদিকা বেগমের দুই মেয়ের খেয়াল রাখতেই বেশ সুবিধা হবে। এতো বড় এক্সিডেন্টের পর মেয়েটার শরীরের কি অবস্থা হয়েছে! সাদিকা বেগম তরীর আপন মা না হলেও মায়ের তুলনায় কোনো অংশে কম যত্ন করবেন না বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

__________

নিজ দলের বেশ কিছু সিনিয়র নেতা কর্মীর সঙ্গে গোল মিটিংয়ে বসেছে পার্থ। মিটিংয়ে অংশগ্রহণকারী বেশ কিছু নেতা কর্মীই আকারে ইঙ্গিতে পার্থকে ছোট করে কথা বলতে ব্যস্ত। তাদের ভাষ্যমতে সিনিয়র এতো যোগ্য নেতাকর্মী থাকতে পার্টি কেন পার্থকে নমিনেশন দিলো? এ এক ঘোর অন্যায়! পার্থ সোনার থালে সাজানো অবস্থায়ই এমপি পদটা পেয়ে গিয়েছে।

পার্থ এতক্ষণ নীরব স্রোতার ন্যায় সব শুনে যাচ্ছিলো। কিন্তু এই ধরনের মন্তব্যের পর সে আর চুপ থাকতে পারে না। থমথমে গলায় বলে উঠে,

“ ভুল বললেন ইশতিয়াক ভুইয়া। সোনার থালে সাজিয়ে আমাকে এই পদ দেওয়া হলে কখনোই আমার নিজের একনিষ্ঠ কাছের কর্মীদের বিভিন্ন হামলার মুখোমুখি হতে হতো না। না আমার সন্তান বিপরীত দলের ক্ষুধার্তদের হাতে খুন হতো আর না আমার স্ত্রীকে এতো বড় একটা ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হতো। পার্টি হতে আমার সততা আর একনিষ্ঠতা দেখেই আমাকে নমিনেশন দিয়েছে। জনগণও তা দেখেই আমাকে ভোট দিয়ে জয়ী করেছে। “

পার্থর এহেন জবাব ইশতিয়াক ভুইয়ার যুতসই মনে হয় না। তার মনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিলো এবার পার্টির তরফ থেকে নমিনেশন সে পাবে। কিন্তু পার্টি তাকে রেখে দু দিনের এই ছোকরাকে নমিনেশন দিয়ে দিলো। অভিজ্ঞতার দিক দিয়ে কি এই তরুণ তার থেকে বড় নাকি? উহু! কখনোই না।

ইশতিয়াক ভুইয়া আড়চোখে পার্থকে একবার পরখ করে নেয়। পার্থর শান্ত দৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে থাকা তীক্ষ্ণতা এবং গম্ভীর মুখশ্রী তার চোখ এড়ায় না। এর আগেও বেশ কয়েকবার রাজনৈতিক গোল মিটিং কিংবা সমাবেশে পার্থর সাথে তার সাক্ষাৎ হয়েছে। প্রতিবারই ইশতিয়াক ভুইয়া একটা জিনিস লক্ষ্য করেছেন। পার্থ বেশিরভাগ সময়ই চুপচাপ থাকে। কিন্তু যখন মুখ খুলে তখন তার ধারালো কথার পিঠে অন্য কেউ কথা খুঁজে পায়না। ইশতিয়াক ভুইয়ার এই পর্যবেক্ষণ মূলক দৃষ্টি পার্থ নীরবে পরোক্ষ করে নেয়।

মিটিং শেষ হতেই পার্থ পার্টি অফিস হতে বেরিয়ে নিজের গাড়িতে উঠে বসে। তার পাশেই বসা রয়েছে আসিফ। পার্থ গাড়িটা স্টার্ট দেয় না। চুপচাপ ড্রাইভিং সিটে শরীরটা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে রয়। পার্থর এরকম থমথমে মুখ দেখে আসিফ আজকাল নিজ থেকে সেধে কোনো কথা বলার সাহস পায় না। ভাবীর সেই এক্সিডেন্টের পর থেকেই পার্থকে দেখলে তার ভয় করে। এর অবশ্য কারণও রয়েছে। রুবেলের মৃত্যুর সেই মুহুর্তে পার্থর হিংস্র দৃষ্টি আসিফ এখনো ভুলতে পারছে না। ওই অমানুষ গুলো তার ভাইকে কি থেকে কি বানিয়ে দিয়েছে তা ভাবতেই আসিফের শরীরে চরম ক্ষোভ এসে ভর করে।

বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর পার্থ চোখ বুজে রেখেই বলে উঠে,

“ বুঝলি আসিফ, ইলেকশনের আগ পর্যন্ত অন্য পার্টির মানুষরা আমাকে শত্রু হিসেবে দেখতো। কিন্তু ইলেকশনটা জিতে যাওয়ার পর থেকে এখন নিজের পার্টির লোকরাই আমাকে শত্রু হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। “

আসিফ উদ্বিগ্ন গলায় বলে,

“ আপনে কি ইশতিয়াক ভুইয়ার কথা কইতাসেন ভাই? আমিও খেয়াল করসি ওই বেডায় যাওয়ার সময় আপনের দিকে কেমন শকুনের নজরে তাকাইতাসিলো। “

পার্থ ক্লান্ত গলায় বলে,

“ ইলেকশন জিতে গিয়েছি বলে সংগ্রাম শেষ হয়ে যায় নি আসিফ। আসল সংগ্রাম তো কেবল শুরু। এতদিন অন্য পার্টিকে কেবল ট্যাকেল দিতে হতো আমাদের, কিন্তু এখন নিজের পার্টির কিছু মুখোশধারী শুভাকাঙ্ক্ষীদের হতে নিজেদের বাঁচিয়ে চলতে হবে আমাদের। “

আসিফ মাথা নাড়ে। অত:পর নিজের হাতের ঘড়ির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে দেখে দুপুর প্রায় বারোটা বাজে। আসিফ সাহস করে বলে,

“ ভাই, ভাবীরে তো মনে হয় আজকে হসপিটাল থেকে ছাইড়া দিবো। ডিসচার্জ টাইম না দুপুর বারোটা বলসিলো? ভাবীর কাছে যাইবেন না? “

পার্থ চোখ মেলে তাকায়। তবে আসিফের প্রশ্নের কোনো জবাব দেয় না। উল্টো প্রসঙ্গ বদলে বলে,

“ তোকে বাসায় ড্রপ করে দেই চল। “

আসিফ ব্যস্ত গলায় বলে,

“ কি বলেন ভাই! আমি রিকশা নিয়া যামুগা নে। আপনে আমারে কেন ড্রপ করবেন? “

পার্থ শীতল দৃষ্টি মেলে আসিফের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে শুধায়,

“ আমি তোকে ড্রপ করতে গেলে কি তোর জাত যাবে আসিফ? “

“ নাউজুবিল্লাহ ভাই। কি বলেন এইসব! “

পার্থ আর কোনো কথা না বলে চুপচাপ গাড়ি স্টার্ট দেয়। বাসায় ফেরার পথে আসিফ লক্ষ্য করে পার্থ চার রাস্তার সেই মেইন রোড এভোয়েড করে অন্য রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। বিষয়টা আসিফ গত কয়েক দিন ধরেই নোটিশ করছে। ভাই কি ইচ্ছা করেই ওই রাস্তায় গাড়ি চালায় না? মনের প্রশ্ন মনেই চেপে যায় আসিফ। কিছু তিক্ত স্মৃতি এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। এতে যদি ভালো থাকা যায় তবে তাতে দোষের কিছু নেই।

__________

তূর্য এবং হুমায়ুন রশীদ মিলে দুপুরের দিকে তরীকে নিয়ে নিজেদের বাসায় ফিরে। তরীর বাড়ি ফেরা নিয়ে যেনো এক উৎসব মুখোর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। আফজাল সাহেব, শোভন, মধুমিতা সবাই-ই এই বাসায় এসে উপস্থিত হয়েছেন। পৃথাও বেশ উদগ্রীব হয়েছিলো বড় ভাবীর অপেক্ষায়। তরী কেবিনে থাকা অবস্থায় কেবল দুইদিনই তূর্য তাকে হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিলো। এ নিয়ে পৃথা তূর্যর উপর বেশ রেগেও আছে।

গাড়ি থেকে নামতেই তূর্যের হাত ধরে বেশ ধীরে ধীরে হেটে ভিতরে প্রবেশ করে তরী। মাথার আঘাতের তুলনায় পায়ের এই ফ্র্যাকচারটা বেশি পীড়া দিচ্ছে তাকে। পায়ের উপর নূন্যতম ভরটুকু ফেলতে পারছে না সে। যদিও ডক্টর সাজেস্ট করেছিলো চাইলে হুইলচেয়ার ইউজ করতে পারে। কিন্তু তরী তাতে রাজি হয়নি। অগ্যতা তূর্যের হাতে ভর রেখেই সে সোজা নিজের জন্য বরাদ্দকৃত রুমটায় এসে বিছানায় উঠে বসে। এই কিছুক্ষণের হাঁটার ফলেই ব্যথায় তার সম্পূর্ণ শরীর নীল হয়ে গিয়েছে।

ইতিমধ্যে সবাই রুমে এসে তাকে ঘিরে ধরেছে। সকলেই বিভিন্ন ভাবে তার মন ভালো রাখার চেষ্টায় ব্যস্ত। তরীর জ্ঞান ফেরার পর থেকে এখনো কেউই তার সামনে বাচ্চা নিয়ে কোনো কথা বলে নি। অযথা কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়ার কোনো মানে হয়না।

পৃথা তরীর পাশে এসে বসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

“ ওয়েলকাম হোম ভাবী। “

পৃথার এই আকস্মিক আলিঙ্গনে তরী না চাইতেও চোখ খিচে হালকা ব্যথাতুর শব্দ করে উঠে। শরীরের কাচা ক্ষত গুলো ব্যথায় কামড়ে ধরেছে যেনো। সাথে সাথে পৃথা দূরে সড়ে অপরাধীর ন্যায় মুখ করে বলে,

“ সরি ভাবী। আমার খেয়াল ছিলো না। “

তরী কিছু বলবে তার আগেই শোভন পৃথার মাথায় গাট্টা মেরে বলে,

“ ছাগল একটা। দুইদিন পর এক বাচ্চার মা হবি অথচ এখনো ছাগলের মতো কাজ কারবার করস। তূর্য ভাই সামনের কুরবানি ঈদে আপনি চাইলে এই ছাগলকে হাটে তুলতে পারেন। ভালো দাম পাবেন এটাকে বিক্রি করলে। “

শোভনের কথা শুনে পৃথা, তরী এবং আফজাল সাহেব ব্যতীত সকলেই হাসে। আফজাল সাহেব ছেলেকে আড়ালে চোখ রাঙায়। নিজের বোনের শশুড়বাড়ি এসে সকলের সামনে বোনকে নিয়ে এরকম ঠাট্টা করাটা তার পছন্দ হয়না। পৃথাও রেগে ঠোঁট উল্টে বলে,

“ তোর কি ধারণা আছে যে তুই আস্ত একটা বলদ ছোট দা? ছোট ভাবী, তোমার এই জামাইকে সরি আই মিন বলদকেও চাইলে তুমি কুরবানির হাটে তুলতে পারো। “

সাদিকা বেগম বাগড়া দিয়ে বলে,

“ দুইজনকেই হাটে তুলবো। এবার খুশি? “

তরীর কাউকেই ভালো লাগছে না। সবকিছু বিরক্তিকর ঠেকছে তার কাছে। সাদিকা বেগম হয়তো তার মনের খবর বুঝতে পারেন। তাইতো সবাইকে তাড়া দিয়ে রুম থেকে বের করে দেন। তরীকে রেস্ট করতে বলে তিনি নিজেও বেরিয়ে যান।

তরী বিছানায় হেলান দিয়ে বসে থাকা অবস্থায়ই চোখ বুজে নেয়। এতো মানুষের ভীড়ে পার্থ নেই। এ নিয়ে কি তরীর অভিমান হওয়া উচিত? মোটেও না। তরী নিজেই মানুষটাকে বলেছে যে সে তার উপস্থিতি সহ্য করতে পারছে না। তবে এখন কেন এতটা শূন্যতা অনুভব করছে সে? তরী অভিমানী গলায় আওড়ায়,

“ কি করবো আমি? তোমার উপস্থিতি আমাকে সেই তিক্ত রাতের কথা মনে করিয়ে দেয়। তোমার অনুপস্থিতিও আমাকে শান্তি দিচ্ছে না। আমার কাউকে ভালো লাগছে না। সব অসহ্যকর লাগছে। দমবন্ধ হয়ে আসছে। “

__________

মুখ গোমড়া করে ফোন চালাতে ব্যস্ত পৃথা। তূর্য পাশে বসে ল্যাপটপ চালানোর মাঝে আড়চোখে সবটাই পরখ করে। অত:পর ঠাট্টা করে বলে,

“ মুখ ফুলিয়ে রেখেছো কেনো? আর দুই তিন মাসের মধ্যে নিজ থেকেই তুমি ফুলে যাবে। “

পৃথা তূর্যর দিকে গরম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,

“ হ্যাঁ। অল ক্রেডিট গোস টু ইউ। “

পৃথার কথার ধরন দেখে তূর্য বিষম খায়। এই মেয়ের আবার কি হলো? তূর্য সিরিয়াস মুখভঙ্গি করে বলে,

“ হোয়াট হ্যাপেনড পৃথা? দু দিন পরে মোটা হয়ে যাবে সেই চিন্তায় মুখ ফুলিয়ে রেখেছো নাকি অন্য কোনো কারণ? “

পৃথা এবার গরম স্বরে বলে,

“ বারবার মোটা হওয়ার কথা কেন বলছেন? মোটা কি আমি সাধে হবো? সব আপনার দোষ। আপনি বাচ্চা দিয়েছেন কেন? “

পৃথার এহেন কথায় তূর্য দ্বিতীয় দফায় বিষম খায়। অত:পর সাথে সাথেই নিজেকে সামলে নেয়। মনে মনে নিজেকে শুধায়,

“ নে বেটা এখন বউয়ের মুড সুইং সামলা। “

তূর্য ল্যাপটপটা একপাশে রেখে পৃথাকে বুকে টেনে নিয়ে তার মাথায় বিলি কেটে দিতে দিতে বলে,

“ সরি বেবি। এখন বলো রেগে আছো কেনো? “

“ বড় দা একবারও ভাবীকে দেখতে এলো না। পুরুষ মানুষ কি নির্দয়! এই অবস্থায় বড় দা’র উচিত ছিলো ভাবীর পাশে থাকা। “

“ আমরা উনাদের পরিস্থিতিতে নেই পৃথা। তাই এই ব্যাপার আমাদের কোনো মন্তব্যও করা উচিত নয়। “

পৃথা ঠোঁট উল্টে বলে,

“ তবুও! “

“ তবুও টবুও কিচ্ছু না। সারাদিন মাথায় এতো কথা ঘুরে কেনো তোমার? তোমার এই অভার থিংকিং এর যন্ত্রণায় হয়তো আমার বেবিও পেটের ভেতর শান্তিতে ঘুমাতে পারে না। মাথার সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে চোখ বন্ধ করে এখুনি ঘুমাও। “

পৃথা ভেংচি কেটে বলে,

“ সব চিন্তা শুধু বেবির। “

তূর্য হেসে বলে,

“ বেবির মাম্মা বুঝে কম। নাহয় এটাও বুঝতো যে আমি তারও চিন্তা করি। “

__________

মধ্যরাতে আচমকা ভয়ংকর এক স্বপ্ন দেখে তরীর ঘুম ছুটে যায়। সম্পূর্ণ শরীর তার আতংকে ঘামছে। তরী বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতেই টের পায় তার শরীর কাঁপছে। রুমটা ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে আছে। সেই অন্ধকার রুমেই আচমকা এক বাচ্চার কান্না ভেসে আসে তরীর কানে। সাধারণ কোনো কান্না নয়। কোনো নবজাতক শিশুর গলা ফাটিয়ে কান্নার আওয়াজ।

তরী ভীত নয়নে অন্ধকার কক্ষটায় একবার চোখ বুলায়। কান্নার শব্দ ধীরে ধীরে তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। তরী দু’হাতে কান চেপে ধরে নিজের। তার গাল বেয়ে পড়ছে অবিরাম জল। সে বিড়বিড় করতে থাকে,

“ আই এম সরি মা। মাফ করে দাও। তোমার খেয়াল রাখতে পারি নি। “

তবুও কান্নার শব্দ থামে না। তরী অন্ধকারের মাঝেই বালিশের পাশে হাতড়ে নিজের ফোনটা খুঁজে বের করে। কল লিস্টে গিয়ে সোজা একটা নাম্বার ডায়াল করে সে ফোনটা কানে চেপে ধরে। ফোনের মালিক মুহুর্তের মধ্যেই কল রিসিভ করে। তরী কান্না করতে করতে বলে,

“ আমি থাকবো না এখানে। আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। “

অপরপাশ থেকে কেবল জবাবে একটাই কথা ভেসে আসে,

“ এখুনি আসছি। “

অত:পর ফোনটা কেটে যায়। তরী অন্ধকারের মধ্যেই ফোন হাতে নিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়ে। পায়ে চাপ পড়তেই সম্পূর্ণ শরীর যন্ত্রণায় বিষিয়ে উঠে। তবে সেদিকে আপাতত তরীর খেয়াল নেই। সে উদ্ভ্রান্তের ন্যায় কোনো মতে দেয়াল ধরে খুড়িয়ে খুড়িয়ে রুম থেকে বের হয়। নিচতলা সম্পূর্ণটা অন্ধকারে তলিয়ে আছে। তরী জোরে শ্বাস টেনে মেইন দরজার দিকে এগিয়ে যায়।

তরী মেইন দরজা খুলে বেরিয়ে আসতেই বাড়ির দাড়োয়ান হতভম্ব ভঙ্গিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। বাড়ির মেয়ে এরকম মাঝরাতে খালি পায়ে এহেন বিধ্বস্ত অবস্থায় ঘরের বাইরে কি করছে? দাড়োয়ান চাচা বহু বছর ধরে এই বাড়িতে কর্মরত রয়েছেন। তরীর সাথে যে এমন দৃশ্য মোটেও যায় না তা তিনি ভালো করে জানেন। তাই ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে এসে তরীকে প্রশ্ন করে,

“ কি হইসে আম্মা। কিছু লাগবো? “

তরী ভীত দৃষ্টি মেলে একবার লোকটার দিকে তাকায়। অত:পর আবার উদ্ভ্রান্তের ন্যায় মেইন গেটের বাহিরে রাস্তার দিকে ছুটে বেরিয়ে যায় সে। দাড়োয়ান আংকেল হতভম্ব চোখে সেই দৃশ্য দেখে। এই প্রথম তরীকে এমন উদ্ভট আচরণ করতে দেখছে সে। তরীর মতো ভদ্র বিচক্ষণ মেয়ের এমন আচরণ কি মেনে নেওয়া যায়? বিস্ময় কাটিয়ে উঠতেই দাড়োয়ান আংকেল তাড়াতাড়ি ফোন বের করে তূর্যর নাম্বারে কল লাগায়। প্রথম বারে কল রিসিভ না হলেও দ্বিতীয় বারের বেলায় কল রিসিভ হয়। দাড়োয়ান আংকেল চিন্তিত গলায় বলে,

“ তরী আম্মা এইমাত্র পাগলের মতো দৌড়াইতে দৌড়াইতে ঘর থেকে বাইর হইয়া গেসে বাবা। “

__________

শান্ত নীরব রাস্তায় কান্না করতে করতে দৌড়ে এগোচ্ছে তরী। এই বাসা থেকে দূরে যাওয়াই তার মূল উদ্দেশ্য। এতো দূরে যাবে যেনো সেই কান্নার আওয়াজ আর তার শুনতে না হয়। আচমকা নিস্তব্ধ রাস্তার মাঝে একটা গাড়ির হেডলাইট এসে তরীর মুখের উপর পড়ে। সাথে সাথে সে রাস্তার মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে পড়ে। গাড়িটাও দূর হতে তাকে দেখে ব্রেক কষে।

কালো গাড়িটা হতে নেমে আসে এক দীর্ঘদেহী পুরুষ। দূর হতে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় মানুষটাকে চিনতে একটুও অসুবিধা হয় না তরীর। সে আবারও দৌড়ে এগিয়ে যায় পুরুষটার দিকে।

দূর হতে তরীকে দেখেই পার্থর বুক কেপে উঠে। কি এমন হয়েছে তরীর যে পার্থর আসার অপেক্ষাটুকুও করলো না? নিজেই ছুটে বেরিয়ে এসেছে! পার্থ আরেকদফা দূর হতে তরীকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত পরখ করে। গায়ে একটা সাদা রঙের ঢিলেঢালা কুর্তি ও পাজামা। সাথে কোনো ওড়না নেই। পার্থর দৃষ্টি স্থির হয় তরীর পায়ের দিকে গিয়ে। তরীর পায়ের সাদা ব্যান্ডেজ ভেদ করে রক্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

পার্থ আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা করে না। দৌড়ে এগিয়ে যায় তরীর দিকে। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানেই নিজেদের মধ্যে থাকা দূরত্ব মিটিয়ে দিয়ে তরীকে জাপ্টে ধরে সে। স্ত্রীকে খালি পায়ে রাস্তায় এই অবস্থায় আর এক মুহুর্ত রাখতে চায় না পার্থ তাই তরীর কোমর জড়িয়ে ধরেই সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে তরীর পা মাটি থেকে উঁচুতে চলে যায়। এই আলিঙ্গনে তরীর সমস্ত শরীর ব্যথা করে উঠে। তবুও সে দাঁত খিচে পার্থর কাধে মুখ গুজে রয়। নীরব অশ্রুতে ভিজিয়ে দেয় পার্থর ছাই রঙা টি শার্টটা।

পার্থ উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করে,

“ কি হয়েছে জান? “

পার্থর প্রশ্নে তরীর কান্নার তোপ আরেকটু বেড়ে যায়। সে চোখ বুজে রেখেই এলোমেলো শব্দে কিছু বলে যা পার্থর বোধগম্য হয় না। পার্থ ফের প্রশ্ন করে,

“ তোমার পুরো শরীর কাপছে। কি হয়েছে আমাকে বলো? “

তরী এবার কাঁদতে কাঁদতে বলে,

“ একটা বাচ্চা কাদছিলো ওই অন্ধকার রুমে। আমি এখানে থাকতে চাই না। নিয়ে চলো আমাকে। “

তরীর কথা শুনে পার্থ বিস্মিত হয়। বাচ্চা কাদছিলো মানে? তরীর কি হ্যালুসিয়েশন হচ্ছে? ডক্টর তো বলেছিলো ওই এক্সিডেন্ট এবং মিসক্যারেজের ফলে তরী অলরেডি ডিপ্রেশনে ভুগছে। সেই কারণেই কি এসব ইমাজিন করছে তরী? পার্থর ভাবনার মাঝেই রাস্তার অপরপাশ হতে তূর্যকে দৌড়ে আসতে দেখা যায়। দূর হতে তূর্য পার্থকে তরীর সাথে দেখে থেমে যায়। হাফ ছেড়ে নিঃশ্বাস ফেলে সে। দাড়োয়ান আংকেলের কল পেয়েই সে কাউকে কিছু না বলে ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়েছে। বোনের চিন্তায় তার বুক ঢিপঢিপ করছিলো। কিন্তু পার্থর সাথে তরীকে দেখে সে স্বস্তি পায়। চোখের ইশারায় পার্থকে প্রশ্ন করে তরী ঠিক আছে নাকি। পার্থও একইভাবে চোখের ইশারায় বলে চিন্তা না করতে, তরীকে সে সাথে নিয়ে যাচ্ছে।

তূর্য আর কিছু না বলে বেস্ট অফ লাক দেখিয়ে উল্টো রাস্তায় হাঁটা শুরু করে। তরী এখনো একইভাবে কাঁদছে। পার্থ নীরবে এবার তরীকে কোলে তুলে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে, সিট বেল্ট পড়িয়ে দিয়ে বলে,

“ আর ভয় পেও না। আমি আছি। “

__________

বাড়িতে ফিরেও পার্থ তরীকে কোলে তুলে বাসায় প্রবেশ করে। জমিলা খালা দরজা খুলে দিতেই পার্থ কোনো কথা না বলে সোজা সিঁড়ি ধরে উপরের দিকে হাঁটা শুরু করে। তরী পার্থর কাধ জড়িয়ে বুকে মুখ গুজে রয়। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই অপ্রত্যাশিতভাবে পার্থ শোভনের মুখোমুখি হয়। শোভন মধুকে পাজাকোলে নিয়ে ছাদ থেকে নামছিলো। এরকম একটা সময় পার্থর সামনে পড়তেই সে তাজ্জব বনে যায়। মধুমিতাও লজ্জায় নিজের দৃষ্টি নত করে রেখেছে। শোভন গলাটা সামান্য ভিজিয়ে নিয়ে বলে উঠে,

“ ওয়েলকাম ব্যাক ভাবী। “

তরী প্রতুত্তর করে না। মুখ তুলেও তাকায় না। পার্থ এই পরিস্থিতি আর দীর্ঘ না করে নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে বলে উঠে,

“ দাঁড়িয়ে না থেকে রুমে যা। “

পার্থ নিজের রুমে চলে যেতেই মধুমিতা শোভনের ঘাড় খামচে ধরে বলে,

“ আরো বউকে কোলে তুলে ঢেংঢেং করে ঘুরে বেড়াও। দাদার সামনে আমাকে এমন লজ্জায় না ফেললে তোমার চলতো না? “

শোভন ডোন্ট কেয়ার এটিটিউডে বলে উঠে,

“ এজন্যই আজ তোমার রক্ষা নেই সুন্দরী। দু চারটা বাচ্চাকাচ্চা এসে পড়লে তখন তোমাকে ফেলে ওদেরকে কোলে তুলেই ঢেংঢেং করে ঘুরবো। “

মধুমিতা মশকরা করে বলে,

“ তোমার নামে মানহানীর মামলা করবো আমি অফিসার। “

শোভন রুমের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,

“ আগে মানহানি তো করতে দাও। “

__________

বিছানায় নীরব ভঙ্গিতে বসে আছে তরী। পার্থ তার সামনে বসে তার পায়ের ব্যান্ডেজ চেঞ্জ করতে ব্যস্ত। মানুষটা এই কাজে বেশ অপটু তা তার ব্যান্ডেজ করার স্টাইল দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তবুও নিজের বেস্ট ট্রাই করে যাচ্ছে যেন তরীকে কষ্ট না দিয়ে পার্ফেক্টলি কাজটা করতে পারে।

ব্যান্ডেজ করা শেষ হতেই পার্থ চিন্তিত গলায় বলে,

“ কাল সকালেই একবার হসপিটালে যাবো। প্রোপার ড্রেসিং করাতে হবে তোমার। “

কথাটা বলেই পার্থ ফার্স্ট এইড বক্সটা হাতে নিয়ে উঠে যেতে নেয়। কিন্তু হাতে টান অনুভব করতেই সে ফিরে তাকায়। তরী তার হাত ধরে তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। এতক্ষণে দুজনের দৃষ্টি মিলন হয়। তরী খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে থাকে পার্থকে। পার্থর মুখের দাঁড়ি আগের তুলনায় আরেকটু বেশি ঘন লাগছে। চেহারায় ফুটে আছে স্পষ্ট অবহেলার ছাপ। শীতল চোখ দুটোতে দৃষ্টি স্থির রেখেই তরী বলে,

“ তুমি আর আমি একই জিনিস হারিয়েছি। কষ্টের অনুপাতটাও আমাদের এক। তবুও আমি তোমাকে একা দায়ী করেছি। আমাকে মাফ করে দাও। “

কথাটুকু বলতে বলতেই তরীর চোখ বেয়ে আবার পানি পড়ে। পার্থ নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকিয়ে রয় তরীর দিকে। অত:পর নিজের হাতের ফার্স্ট এইড বক্সটা একপাশে রেখে পুরোপুরি বিছানায় উঠে তরীর কোলে মাথা এলিয়ে দেয়। শক্ত হাতে তরীর কোমর জাপ্টে ধরে তার পেটে মুখ গুজে। আজ আর তরী তাকে ফিরিয়ে দেয় না। বরং নিজের দূর্বল হাত পার্থর মাথায় রেখে তার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। পার্থ রুদ্ধস্বরে বলে,

“ এইসব কিছুর পিছনে দায়ী কেবল আমিই। আমার কারণে তোমার এই অবস্থা। আমার কারণে আমাদের বাচ্চা আর নেই। সব আমার দোষ। “

কথাটুকু বলেই পার্থ ফুপিয়ে কেদে উঠে। তরী দাঁতে ঠোঁট চেপে কান্নাটুকু গিলে নিয়ে বলে,

“ ও আমাদের ভাগ্যে ছিলো না পার্থ। ও আরো ভালো এবং নিরাপদ জায়গায় আছে এখন। “

কান্নার দমকে পার্থর শরীর মৃদু কাপছে। সে একইভাবে রুদ্ধস্বরে বলে,

“ ওকে আমরা স্বপ্ন ডাকি তরী? “

তরীর নীরবে কান্নার বেগ বাড়ে। আহ স্বপ্ন! তাদের তন্দ্রায় আসা ক্ষানিকের এক স্বপ্ন। তরী মাথা নেড়ে বলে,

“ আচ্ছা। “

পার্থ এবার নিজের স্বভাবের বাইরে গিয়ে প্রিয়তমার সান্নিধ্যে সন্তান হারানোর বেদনায় হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। কি বেদনাদায়ক সেই কান্নার সুর! তরী নিজেও কাঁদছিলো। মানুষটা এই কয়টা দিন কিভাবে নিজের কষ্ট আড়াল করে ছিলো? ভাবতেই তরীর শরীরের পাশাপাশি মনের ব্যথাও কয়েকগুণ বেড়ে যায়। সে মাথাটা সামান্য নুইয়ে পার্থর মাথায় একটা চুমু খেয়ে বলে,

“ কেঁদে নাও। বুকটা হালকা করো। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-৩৫+৩৬

0

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩৫.

রাত পেরিয়ে নতুন ভোরের আগমন ঘটছে ধীরে ধীরে। এই ভোরের আগমন হওয়ার কথা ছিলো কোনো এক সুখকর বার্তা নিয়ে। কিন্তু তা আর হলো না। এই ভোর বড় অলুক্ষণে। এই অনবরত বর্ষণ খুব অলুক্ষণে। গতরাতে যে ব্যক্তি বিজয়ীর বেশে জনগণের সামনে বক্তব্য পেশ করেছিলো, আজ সেই একই ব্যক্তি একজন হেরে যাওয়া ব্যক্তির ন্যায় মেঝেতে মাথা নত করে বসে আছে। তার আশেপাশে কারো অস্তিত্বই সে অনুভব করতে পারছে না। সব মলিন লাগছে।

দূর হতে বেঞ্চিতে বসা আফজাল সাহেব ছেলের দিকে এক পলক তাকিয়ে থেকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। চোখের সামনে ছেলের এই অবস্থা তার সহ্য হচ্ছে না। উনার পাশে বসে থাকা মধুমিতা আশ্বাস দেওয়ার সুরে বলে উঠে,

“ আল্লাহ সহায় হবেন আব্বা। আপনি শক্ত থাকুন। আম্মাও পৃথাকে একা রেখে আসতে পারছে না। শোভনও এখানে উপস্থিত নেই। আপনি ভেঙে পড়লে দাদা, হুমায়ুন আংকেল আর তূর্য ভাইয়াকে কে সাহস জোগাবে বলুন? “

পুত্র বধূর কথা শুনে আফজাল সাহেব চোখ তুলে তার সামনের বেঞ্চিতে বসে থাকা হুমায়ুন রশীদ এবং তূর্যের দিকে তাকায়। হুমায়ুন রশীদের বেশ বিধ্বস্ত অবস্থা। তূর্যও গত মধ্যরাত হতে এখানে উপস্থিত। সবার সামনে না কাদলেও ছেলেটা যে আড়ালে নিজের একমাত্র বোনের জন্য অশ্রু বিসর্জন দিয়েছে তা তার চেহারা দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে।

আফজাল সাহেব আরেকবার ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের ছেলের দিকে তাকায়।

__________

গতরাতে পার্টি অফিসে বসে সকলের অভিনন্দন বার্তার জবাব দিতে ব্যস্ত পার্থর কাছে আচমকা জহিরের কল আসে। ফোনের স্ক্রিনে আচমকা জহিরের নাম দেখতেই পার্থর বুক ধক করে উঠে। সে ফোন রিসিভ করে কিছু বলবে তার আগেই অপরপাশ থেকে জহিরের চিৎকার ভেসে আসে,

“ ভাই, ভাবীর এক্সিডেন্ট হইসে। গ্রীন কেয়ার হসপিটালে নিয়ে যাইতেসি আমি। আপনি আসেন। “

ব্যস! এই তিনটি বাক্যই পার্থর পৃথিবী দুমড়ে মুচড়ে দেয়। সে উদ্ভ্রান্তের ন্যায় দৌড়ে পার্টি অফিস থেকে বের হয়। তার সাথে থাকা শামীম,আসিফ সহ বেশ কয়েকজন তার এই অবস্থা দেখে নিজে ড্রাইভ করে তাকে হসপিটালে নিয়ে আসে। হসপিটালে এসে এক্সিডেন্টের বর্ণনা শোনার পরই পার্থ ধপ করে এই ওটির রুমের সামনে বসে পড়ে। এরপর থেকে কারো সাথে কোনো বাক্য বিনিময় করে নি সে। অনুভূতিহীন পাথরের মূর্তির ন্যায় একইভাবে বসে আছে।

দীর্ঘ চার ঘন্টার অপেক্ষার পর ওটির বাহিরের রুমের দরজা খুলে। বেরিয়ে আসে একজন সার্জিক্যাল এপ্রোন পরিহিত মহিলা ডক্টর। তার পিছনে রয়েছেন একজন নার্স। পার্থ যেন কিছুটা শক্তি ফিরে পায়। ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে উঠে দাঁড়িয়ে ডক্টরের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না তার। সামান্য ছোট একটা প্রশ্ন করার সাহসটুকুও খুঁজে পাচ্ছে না সে। এগিয়ে আসে বাকিরাও। হুমায়ুন সাহেব বেশ আশা নিয়ে দুঃসাহসিক প্রশ্নটা করে বসে,

“ আমার মেয়েটা ঠিক আছে তো ডক্টর? “

ডক্টর ফারহানা নিরাশ গলায় প্রশ্ন করে,

“ আপনারা কি জানেন না? “

মধুমিতা ডক্টরের প্রশ্ন শুনে মনে মনে কিছু একটা আন্দাজ করে। গতরাত হতে সে এই বিষয়টা নিয়ে কারো সামনে মুখ খুলে নি। যেই ব্যাপারে সে নিশ্চিত নয় সেই ব্যাপারে আশংকা করে সবার কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়ার পক্ষে সে ছিল না। মধুমিতার ভাবনার মাঝেই হুমায়ুন রশীদ বলেন,

“ কি জানি না? আমার মেয়ে কেমন আছে? “

ডক্টর ফারহানা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

“ এক্সিডেন্টের শিকার আপনার মেয়ে একা হয় নি। তার গর্ভে থাকা দুই মাসের আরেকটা প্রাণও এই এক্সিডেন্টের শিকার। কিন্তু নাজুক প্রাণটা এতো বড় ধাক্কা সামলাতে পারে নি। বাচ্চাটা আর নেই। “

মুহুর্তেই কান্নার তীব্রতা হু হু করে বেড়ে যায়। আফজাল সাহেবের মতো কঠিন একজন মানুষও নিজের কান্না দমিয়ে রাখতে পারে না। মধুমিতাও শব্দ করে কেদে উঠে।

পার্থর সম্পূর্ণ শরীর নিস্তেজ লাগছে। সে দুই পা পিছিয়ে যেতেই করিডোরের দেয়ালে গিয়ে তার পিঠ ঠেকে। তার তরী প্রেগন্যান্ট ছিলো? তার বাচ্চাটাকে ওরা বাঁচতে দিলো না? বাচ্চাটার কি দোষ ছিলো? তার তরী আর তার বাচ্চা তো নিষ্পাপ ছিলো। প্রশ্নগুলো পার্থর মস্তিষ্কে বেশ এলোমেলো ভঙ্গিতে উঁকি দেয়।

ডক্টর ফারহানা আবার হুমায়ুন রশীদের উদ্দেশ্যে বলে উঠে,

“ ডক্টর তরী কাল আমার কাছে এসেছিলো প্রেগন্যান্সি টেস্ট করাতে। আমার সামনে বসেই উনি বিকেলে নিজের রিপোর্ট দেখেছিলেন। খুশিতে আমার চেম্বারে বসে বেশ কিছুক্ষণ কেদেও ছিলেন। বারবার বলছিলেন আমি যেনো আপনাকে এই বিষয়ে না জানাই। উনি সবার আগে নিজের হাজবেন্ডকে এই গুড নিউজটা দিতে চায়। “

ডক্টর ফারহানার এক একটা কথা পার্থর কানে তীক্ষ্ণ ভাবে বারি খাচ্ছে। উনার উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ পার্থর বুকে গিয়ে বিঁধছে। তূর্য ঢোক গিলে নিজের কান্নাটুকু দমিয়ে রেখে প্রশ্ন করে,

“ আমার আপি? হাও ইজ শি? আপি ঠিক আছে তো? “

“ আমাদের যতদূর যা করার ছিলো সবটা করেছি। উনার ইঞ্জুরি গুলো খুব সিরিয়াস। গাড়ি কয়েকবার ডিগবাজি খাওয়াতে মাথায় বেশ সিরিয়াস ইঞ্জুরি হয়েছে। ডান পায়েও হয়তো বেকায়দায় আঘাত পেয়েছে বেশ। ফ্র্যাকচার হয়ে গিয়েছে। পুরো শরীরে আরো অসংখ্য ইঞ্জুরি রয়েছে। উনাকে এখন আইসিইউতে শিফট করা হবে। আগামী ৭২ ঘন্টার মধ্যে যেনো জ্ঞান ফিরে আসে সেই দোয়া করেন। নাহয় আমাদের আর কিছু করার নেই। “

আফজাল সাহেব, মধুমিতা ও তূর্য আবার বেঞ্চিতে বসে পড়ে। হুমায়ুন রশীদ ডক্টর ফারহানার সাথে তরীর ব্যাপারে কথা বলার জন্য তার কেবিনে চলে যায়। পার্থ দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে পরাস্তের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে। তখনই আবার ওটির দরজা খুলে যায়। দরজার ভেতর থেকে একটা চাকা চালিত হসপিটাল বেড বেরিয়ে আসে। তিনজন ওয়ার্ড বয় এবং একজন নার্স সেই বেড নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বেডে শুয়ে থাকা মানবীর বুক পর্যন্ত একটা শুভ্র চাদর দ্বারা ঢাকা। সম্পূর্ণ মাথার অর্ধেকটাই ব্যান্ডেজ করা। আঘাত প্রাপ্ত একহাতে ক্যানেলাসহ আরো বিভিন্ন নাম না জিনিস লাগানো। বেডটা চোখের আড়াল হওয়ার আগেই পার্থ এক পলক সেই মানবীর মুখশ্রীর দিকে নিজের দৃষ্টি স্থির করে। গাড়ির ভাঙা কাঁচের সাথে লেগে তরীর ডান গালের বড় গভীর কাঁটাটা পার্থর চোখে বিঁধে। সে এলোমেলো কদম ফেলে বেডটার দিকে এগিয়ে যেতে নিলে আসিফ ও শামীম এসে তাকে পিছন থেকে জাপ্টে ধরে। আসিফ বলে,

“ ভাই যাইয়েন না। সহ্য করতে পারবেন না। “

পার্থ তাদের বাধা মানে না। ছোটার জন্য ছটফট করতে থাকে। কিন্তু ক্লান্ত শরীরে জোর না থাকায় পরাজিত হয়ে থেমে যায় সে। তার অসম্ভব লাল চোখ জোড়ায় জমে থাকা পানি গড়িয়ে পড়ার আগেই হাতের উলটো পিঠের সাহায্যে তা মুছে নেয় সে। অত:পর বড় বড় কদম ফেলে লিফটের দিকে এগিয়ে যায়। আফজাল সাহেব ক্লান্ত গলায় আসিফ ও শামীমকে বলে,

“ ওকে একা ছেড়ো না। সাথে যাও। “

আসিফ আর শামীমও পার্থর পিছু পিছু চলে যায়।

__________

শান্ত শিষ্ট থানাটা সদ্য নির্বাচিত এমপির আগমনে গরম হয়ে যায়। সকলেই এগিয়ে আসে পার্থর দিকে তাকে বিভিন্ন শুভেচ্ছা বার্তা জানানোর জন্য। কিন্তু পার্থ সকলকে উপেক্ষা করে সোজা একটা রুমে প্রবেশ করে।

টেবিলের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কনসটেবেলের সাথে কথা বলছিলো শোভন। আচমকা নিজের বড় ভাইয়ের আগমনে সে অবাক হয়। গতরাতে ভাবীর এক্সিডেন্টের খবরটা পাওয়ার পর সে সোজা এক্সিডেন্ট স্পটটা তে চলে যায়। এই কেসটা নিয়েই ইনভেস্টিগেশনে ব্যস্ত সে। তাই পার্থর সাথে আর তার দেখা হয় নি। কিন্তু এই মুহুর্তে নিজের ভাইকে এরকম বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে তার বেশ খারাপ লাগে। কিন্তু সেটা সে প্রকাশ করতে পারে না। চুপচাপ কনসটেবলকে চোখের ইশারায় বলে বেরিয়ে যেতে।

পার্থ এগিয়ে এসে শোভনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নির্লিপ্ত গলায় বলে উঠে,

“ এই এক্সিডেন্টের সাথে রুবেল হোসেন জড়িত। ওকে বাসা থেকে তুলে আন। বাকিটা আমি দেখবো। “

শোভন ভাইকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে বলে,

“ তুই ঠান্ডা হয়ে বস দাদা। “

পার্থ শান্ত হয় না। বরং আক্রোশে ফেটে পড়ে। চিৎকার করে উঠে,

“ আমার সন্তানের হত্যাকারীকে যদি তুই আমার হাতে না তুলে দিতে পারিস তাহলে আমি নিজে তাকে খুঁজে বের করবো। কিন্তু কোনো ভাবেই ও আমার থেকে রেহাই পাবে না। “

শোভন বিস্মিত হয়। অবাক সুরে প্রশ্ন করে,

“ তোর সন্তান মানে? “

“ আমার তরী প্রেগন্যান্ট ছিলো। ওই কুলাঙ্গার আমার বাচ্চাকে মেরে ফেলেছে। আমার বউ ওর কারণে ক্রিটিকাল অবস্থায় আইসিইউতে পড়ে আছে। আমার ভেতরে যেই আগুন ও জ্বালিয়েছে সেই আগুন নিভানোর আগ পর্যন্ত আমি শান্ত হবো না। জানোয়ারের বাচ্চাকে আমি খুন করে ফেলবো। “

শেষের কথাটুকু বেশ হিংস্র ভঙ্গিতে বলে পার্থ। শোভন পার্থকে জোর করে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে তার সামনে একটা পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলে,

“ আমি জানি রুবেল এর সাথে জড়িত। প্রমাণ পেয়েছি। “

পার্থ পানির গ্লাসটাকে উপেক্ষা করে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায়। শোভন হাতের গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে শান্ত গলায় বলে,

“ যেই রোডে ভাবীর এক্সিডেন্ট হয়েছে তার কিছু দূরেই একটা খাদে সেই ট্রাকটাকে খুঁজে পাই আমরা। ট্রাকের ভেতর ড্রাইভারের সিটে আমরা রুবেলের লোক সুজনের ডেড বডি খুঁজে পাই। রুবেলের আদেশ মতেই হয়তো সুজন এই কাজটা করেছে। ভাগ্য খারাপ যে এক্সিডেন্ট স্পটে কোনো সিসিটিভি ছিলো না। তাহলে প্রমাণটা আরো পাকাপোক্ত হতো। কিন্তু তুই চিন্তা করিস না। আমি অলরেডি আমার লোক পাঠিয়েছি রুবেলকে ধরে আনার জন্য। “

সুজনের নাম শুনতেই পার্থ স্তব্ধ হয়ে যায়। তার সাহায্য করার প্রতিদান ছেলেটাকে নিজের জীবন দিয়ে চুকাতে হলো? রুবেল কি টের পেয়ে গিয়েছিলো যে সুজন তার হয়ে রুবেলের বিরুদ্ধে কাজ করছে?

__________

চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় বসে আছে রুবেল হোসেন। তার সম্পূর্ণ শরীর হতে রক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। রডের আঘাতে করা তার আর্তনাদ কাপিয়ে তুলছে সম্পূর্ণ আন্ডার কন্সট্রাক্টশন বিল্ডিংটা। দূর হতে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে এই নৃশংস দৃশ্য দেখছে শোভন, আসিফ ও শামীম।

পাঞ্জাবির হাতা কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে অমানবিক ভাবে একের পর এক আঘাত করে যাচ্ছে পার্থ। তার সম্পূর্ণ শরীর ঘেমে একাকার। ঘর্মাক্ত পাঞ্জাবিটা গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। থেকে থেকে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে। নিঃশ্বাস নেওয়ার দমকে তার বুক পিঠ কিছুক্ষণ পর পর ফুলে উঠছে। তবুও থামার কোনো নাম নেই। রড দিয়ে লাগাতার আঘাত করতে করতে পার্থ চেঁচিয়ে বলে উঠে,

“ শু*রের বাচ্চা, তোর শত্রুতা আমার সাথে। তোর প্রতিশোধ নেওয়ার হলে তুই আমার উপর নিতি। এই দ্বন্দ্বের ভেতর তুই আমার বউকে কেন টেনে আনলি? “

পার্থর কথা শুনে রুবেল আর্তনাদ থামিয়ে এবার গা কাপিয়ে হেসে উঠে। গা জ্বালানো সুরে বলে উঠে,

“ খুব বাড় বেড়েছিলো না তোর? তোকে আমি সতর্ক করেছিলাম আমার পিছনে না লেগে নিজের বউয়ের দিকে খেয়াল রাখতে। কিন্তু তুই আমার কথা শুনোস নাই। ওই সুজন কুত্তার বাচ্চার সাথে মিলে আমার পিছে হাত ধুয়ে পড়েছিলি। কি ভেবেছিলি? আমি জানতে পারবো না? মন তো চাচ্ছিলো তোর বউকে তুলে এনে গ্যাং রেপ করাই। যাতে কখনো আর মাথা উঁচু করে সমাজে দাঁড়াতে না পারোস। কিন্তু আমি তোর বউকে সহজ মৃত্যু ভিক্ষা দিয়েছি। তোর উচিত আমার কাছে শুকরিয়া আদায় করা। “

রুবেলের কথা যেনো পার্থর বুকের জ্বলন্ত আগুনে পেট্রোলের ন্যায় কাজ করে। বন্য জন্তুর ন্যায় ফুসে উঠে সে। সাথে সাথে হাতের রডটা ঢিল মেরে দূরে ফেলে দিয়ে চেয়ার সহ রুবেলকে এক লাথি মেরে মেঝেতে ফেলে দেয়। অত:পর রুবেলের উপর বসে সে বেসামাল ভঙ্গিতে এলোপাথাড়ি ঘুষি মারতে থাকে। হিংস্র স্বরে বলে উঠে,

“ জানোয়ারের বাচ্চা তোকে আমার হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না আজকে। তুই মরার আগে আমাকে শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর দে। আমার বাচ্চাকে কেন মারলি তুই? আমার বাচ্চার কি দোষ ছিলো? কেন মারলি? “

প্রশ্নটুকু করে পার্থ জবাবের অপেক্ষা করে না। বরং একহাতে রুবেলের চুল মুঠি করে ধরে মেঝেতে তার মাথা জোরে জোরে ঠুকতে শুরু করে। রুবেলের মাথা ফেটে রক্ত বের হওয়া শুরু হয়। এই পর্যায়ে ব্যথাটা অসহনীয় ঠেকে তার কাছে। এতক্ষণের পৈশাচিক রূপ থেকে বেরিয়ে আচমকা আর্তনাদ করে উঠে,

“ ছেড়ে দে পার্থ মুন্তাসির। “

এই আর্তনাদ পার্থর কলিজা শান্ত করতে পারে না। সে এই আকুতি আরো শুনতে চায়। তাই লাগাতার এলোপাথাড়ি মারতে থাকে রুবেলকে। মুখে হিংস্র গলায় শুধায়,

“ তোকে ছাড়বো? তুই ছেড়েছিলি? আমার তরীকে? আমার বাচ্চাকে? তুই ওদের ছাড় দিয়েছিস? তোকে ছাড় দিলে আমার বাচ্চার আত্মাও কখনো শান্তি পাবে না। তোকে ছাড় দিলে আমার তরীর সাথে অন্যায় হবে। ছাড়বো না তোকে আমি। একটুও ছাড় পাবি না। “

কথাটুকু বলতে বলতে পার্থর দু’হাত থেমে যায়। সে ক্লান্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ায়। দু দন্ড জোরে নিঃশ্বাস নেয়। এক মুহুর্তের জন্য আঘাত থেকে মুক্তি পেয়ে রুবেল একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে নেয়। কিন্তু তার আগেই সে গগনবিদারী চিৎকার করে উঠে। পার্থ তার গোপন অঙ্গে পরপর কয়েকটা জোরে লাথি মারে। এই পর্যায়ে শোভন দৌড়ে এসে ভাইকে দূরে সরিয়ে আনার চেষ্টা করে বলে,

“ মরে যাবে দাদা। ছেড়ে দে। বাকি শাস্তিটুকু আইনের জন্য তোলা রাখ। “

শোভন একা ভাইকে আটকাতে পারছিলো না। পার্থর উপর যেনো দশটা জ্বিনের অলৌকিক শক্তি এসে ভর করেছে। সে হিংস্র স্বরে ফুসছে। আসিফ ও শামীমও এগিয়ে এসে শোভনের সাথে মিলে পার্থকে জাপ্টে ধরে পিছিয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু তারা সকলেই পার্থকে আটকে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। শোভন পার্থকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে বলে উঠে,

“ ভাবী অপেক্ষা করছে দাদা। এখানে আর সময় নষ্ট করিস না। তোর এই মুহুর্তে ভাবীর পাশে থাকা উচিত। “

শোভনের কথাটুকু যেন টনিকের মতো কাজ করে। হিংস্র পার্থ মুহুর্তেই শান্ত হয়ে যায়। তাকে শান্ত হতে দেখে শোভন, আসিফ আর শামীম তাকে ছেড়ে দেয়। পার্থ নিষ্প্রভ দৃষ্টি মেলে শোভনের দিকে তাকায়। শোভন আবার কোমল স্বরে বলে,

“ ভাবীর কাছে যা দাদা। “

পার্থ কোনো জবাব দেয় না। সে এক দৃষ্টিতে শোভনের দিকে তাকিয়ে থাকে। আচমকা গান শুটের বিকট শব্দে শোভন, আসিফ ও শামীম কেপে উঠে। বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে তারা কিছুটা দূরে মেঝেতে পড়ে থাকা রুবেলের দিকে তাকায়। অত:পর তাকায় রুবেলের দিকে রিভলবার তাক করে দাঁড়িয়ে থাকা পার্থর দিকে। পার্থ এখনো শোভনের দিকে তাকিয়ে আছে। শোভন বিস্ময় নিয়ে নিজের পকেট হাতড়ে নিজের রিভলবারটা খুঁজে। পার্থ তার অজান্তেই তার রিভলবার নিয়ে নিয়েছে বুঝতেই সে আরেক দফা অবাক হয়ে নিজের ভাইয়ের দিকে তাকায়। পার্থ সাথে সাথে আরো কয়েকবার শুট করে। লোডেড রিভলবারের সবগুলো গুলি রুবেলের দেহে প্রবেশ করিয়ে তবেই সে ক্ষান্ত হয়। এখন তাকে দেখতে বেশ শান্ত লাগছে। চেহারার ভঙ্গিমা এমন যেন এইমাত্র সে কিছুই করে নি। রিভলবারটা এবার শোভনের হাতে দিয়ে পার্থ অতি শীতল গলায় বলে,

“ এখন আমি গিয়ে তরীর সামনে দাঁড়াতে পারবো। “

চলবে…

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩৬.

শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আইসিউ রুমটা বেশ নীরব এবং নিস্তব্ধ হয়ে আছে। এই নীরব রুমটাতেই বেডসাইড মনিটরের বিপ বিপ আওয়াজটা বেশ তীক্ষ্ণ ঠেকছে। শুভ্র বেডটার পাশে একটা টুলে নিশ্চুপ ভঙ্গিতে বসে আছে পার্থ। তার গায়ে নীল রঙের একটা এপ্রোন। মাথায় রয়েছে সার্জিক্যাল হেয়ার ক্যাপ। মুখের মাস্কটা অবশ্য নামিয়ে গলায় ঝুলিয়ে রেখেছে সে। এসব না পড়ে আইসিইউতে প্রবেশ করা যায় না। পাছে আবার পেশেন্টের কোনো ধরনের ইনফেকশন হয় কি-না!

স্ত্রী’র নিষ্প্রাণ মুখশ্রীর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে পার্থ। এই গভীর ঘুমের মেয়েটা কি এই মনিটরের তীক্ষ্ণ শব্দে বিরক্ত বোধ করছে না? এতো নিশ্চিন্তে কিভাবে ঘুমিয়ে আছে সে?

পার্থর দৃষ্টি তরীর মুখ থেকে নেমে তার পেটের দিকে স্থির হয়। তরীর বামহাতটা খুব সন্তর্পণে পেটের উপর রাখা। সেই হাতের তর্জনী আঙুলে লাগানো পালস অক্সিমিটারটায় স্পষ্ট হয়ে আছে দুটি সংখ্যা। ৭৪ এবং ৫০।

পার্থ নিজের মৃদু কম্পিত হাতটা বাড়িয়ে আলতো করে তরীর সেই হাত ছুঁয়ে দেয়। অত:পর বেশ কোমল ভঙ্গিতে নিজের হাতটা তরীর পেটের উপর রাখে। ঠিক এইখানটাতেই তার বাচ্চাটা ছিলো। এরকমটাও কখনো হয়? নিজের সন্তানের অস্তিত্ব সম্পর্কে জেনে কি কোনো বাবা এতটা ভেঙে পড়তে পারে? হয়তো পারে! পার্থ সেই হতভাগাদের একজন। ভেঙে পড়বেই না বা কেন? নিজের সন্তানের অস্তিত্ব অনুভব করার আগেই তার সন্তানের অস্তিত্ব শেষ হয়ে গিয়েছে।

পার্থ পেটের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে কোমল স্বরে বলে,

“ বাবাকে ক্ষমা করে দিও। বাবা তোমার আর মা’র খেয়াল রাখতে ব্যর্থ হয়েছি। “

কথাটুকু বলতে বলতে পার্থর চোখ জোড়া অশ্রুতে টইটুম্বুর হয়ে উঠে। সে আবার বলে উঠে,

“ পরপারে তোমার সাথে দেখা হবে বাবা। চিন্তা করো না। বাবা ঠিকই তোমাকে খুঁজে নিবো। তোমাকে কোলে তুলে অনেক আদরও করবো। কিন্তু তোমার মা কে এখন নিজের কাছে ডেকে নিও না। এতো বড় শাস্তি দিও না বাবাকে। “

পার্থ সাথে সাথে মাথা নত করে ফেলে। তার গলা ধরে আসছে। মনে হচ্ছে কেউ বুকের ভেতর বিষযুক্ত ছুড়ি চালিয়ে জখম করে দিচ্ছে। পার্থ এবার উঠে তরীর মাথার কাছটায় গিয়ে দাঁড়ায়। কিছুটা ঝুঁকে তরীর কপালের ব্যান্ডেজ কাপড়ের উপরেই নিজের ঠোঁট জোড়া ছোঁয়ায়। এতটা আলতো ভাবে ছোঁয় যেন এতটুকু ছোঁয়াতেও তরী ব্যথা পাবে। কপাল থেকে মুখ সরিয়ে কানের কাছে এসে থামে পার্থ। নিজের তপ্ত নিঃশ্বাসটুকু ফেলে গভীর স্বরে শুধায়,

“ কোথাও যেতে দিচ্ছি না তোমাকে। “

__________

পুরো দেশে সকল টিভি চ্যানেলে খবর হয়ে গেলো পুলিশের সাথে ক্রস ফায়ারে রুবেল হোসেন নিহত হয়েছে। এরকম একটা নিউজ যেনো পুরো দেশে উত্তেজনামূলক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দেয়। মৃত্যুর একদিন পূর্বেই রুবেল হোসেন পার্থ মুন্তাসির চৌধুরীর বিপক্ষে ইলেকশন হেরেছে। সেদিন রাতেই আবার ঢাকার কোনো এক মহা সড়কে পার্থ মুন্তাসির চৌধুরীর স্ত্রীর এক্সিডেন্ট হলো। পুলিশ ইনভেস্টিগেশনে সেই এক্সিডেন্টের পিছনে দায়ীর নাম হিসেবে আসে রুবেল হোসেনের নাম। তার পর দিনই আবার পুলিশ ইনকাউন্টারে রুবেল হোসেনের মৃত্যু। সম্পূর্ণ ঘটনাটা আসলেই বেশ চাঞ্চল্যকর এবং উত্তেজনামূলকই বটে।

থানায় নিজের রুমে বসে ডগডগ করে এক গ্লাস পানি খেয়ে নেয় শোভন। সারাদিন তার উপর দিয়ে বেশ ঝামেলা গিয়েছে। বিষয়টাকে কোনো মতে ক্রস ফায়ার বলে চালিয়ে দিতেও তার হাজার জায়গায় দৌঁড়াতে হয়েছে। দুপুর থেকে সে পার্থর উপর বেশ চটে ছিলো। একজন পুলিশের পকেট থেকে তার রিভলবার নিয়ে আসামীকে শুট করার দুঃসাহসিকতা দেখিয়ে পার্থ বেশ সাবলীল ভঙ্গিতেই সেখান থেকে প্রস্থান করে। শোভন যে নিজের চাকরি সংকটে ফেলে অপরাধীকে জেলে না নিয়ে পার্থর কাছে নিয়ে এসেছে সেই ব্যাপারে যেনো কোনো কৃতজ্ঞতা বোধই নেই পার্থর। তখন থেকেই শোভন রাগে গিজগিজ করছিলো।

নিজের আপন ভাই দেখে কি সে পার্থকে যেতে দিবে নাকি? কাউকে সামনে না পেয়ে সেখানে উপস্থিত আসিফ ও শামীমের উপর বেশ রাগ ঝাড়ে সে। আসিফ ও শামীম সুরসুর করে সেখান থেকে প্রস্থান করে সোজা হসপিটাল চলে আসে পার্থর পিছুপিছু। শোভন কেমন ধরনের মানুষ তা তাদের বেশ ভালোই জানা আছে। এরকম একটা অবস্থায় তারা কোনো মতেই পার্থকে নতুন কোনো বিপদে পড়তে দিবে না বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

শোভন যেন পার্থর বিরুদ্ধে কোনো লিগ্যাল একশন না নিতে পারে সেজন্য তারা সবথেকে বড় ট্রাম্প কার্ডের শরণাপন্ন হয়। মধুমিতাকে আড়ালে নিয়ে সম্পূর্ণ ঘটনা তারা খুলে বলে। সাথে এটাও বলে শোভন যেনো পার্থর বিপক্ষে কোনো একশন না নেয় সেই ব্যাপারে যেনো মধুমিতা শোভনকে বুঝায়। সবটা শুনে মধুমিতা অপেক্ষা না করে থানায় যায় শোভনের সাথে দেখা করতে।

শোভনকে বুঝানোর জন্য বাধ্য হয়ে মধুমিতা রাগ হয়ে বলে,

“ যদি আজকে ভাবীর জায়গায় আমি থাকতাম আর আমরা নিজেদের বাচ্চা হারাতাম তখন তুমি কি করতে? অপরাধীকে সামনে পেয়ে ছেড়ে দিতে? নিজের সন্তানের হত্যাকারীকে খুন করতে না? “

শোভন সাথে সাথে থমকে গিয়েছিলো। আর একটাও শব্দ উচ্চারণ করে নি। মধুমিতা যাওয়ার আগে বলেছিলো,

“ নিজেকে একবার দাদার জায়গায় রেখে সিচুয়েশনটা ভেবে দেখো। তুমি খুব ভালো একজন পুলিশ অফিসার। আমি সেজন্য তোমাকে যথেষ্ট রেসপেক্ট করি। কিন্তু এখন নিজের পুলিশের দায়িত্বটা একটু একপাশে রেখে ভাই হওয়ার দায়িত্বটুকু পালন করো। “

ব্যস! এইটুকু বলে যে মধু গিয়েছে সারাদিন আর একবারও কল করে নি। তবে মধুর কথায় বেশ কাজ হয়েছে। শোভন পার্থকে বাঁচিয়ে সম্পূর্ণ বিষয়টা ধামাচাপা দিয়ে দেয়। নিজেকে পার্থর জায়গায় এবং মধুকে তরীর জায়গায় কল্পনা করতেও তার গা শিউরে উঠে। তার দাদার জায়গায় সে হলেও এই একই কাজ করতো। হয়ত আরও বেশি কিছু করতো।

শোভনের ভাবনার মাঝেই একজন পুলিশ এসে তার রুমের দরজায় নক করে। শোভন অনুমতি দিতেই তিনি ভিতরে প্রবেশ করে। কাচুমাচু করে প্রশ্ন করে,

“ স্যার, ওই মিসিং এইট কেসটা আপনি আসলেই ক্লোজ করতে চাচ্ছেন? “

শোভন ক্লান্ত গলায় বলে,

“ হ্যাঁ। “

শোভনের রুমে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের পোশাক পরিধেয় লোকটার যেনো এই কথাটা বিশ্বাস হয় না। শোভন স্যার যেভাবে হাত ধুয়ে এই কেসের পিছনে পড়েছিলো সবাই ভেবেছিলো শোভন নিশ্চয়ই এই রহস্যের জোট খুলবে। অথচ হঠাৎ করেই কথা নেই বার্তা নেই শোভন স্যার আদেশ দিলো সকল ইনভেস্টিগেশন থামিয়ে এই কেস ক্লোজ করে দিতে। বড় অদ্ভুত ঘটনা!

__________

তূর্য সবেমাত্র হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরেছে। পাপাকে হাজার বার বলেছে বাসায় এসে রেস্ট করতে। কিন্তু হুমায়ুন সাহেব মেয়েকে হসপিটালে রেখে বাসায় ফিরতে নারাজ। হসপিটালে এখন কেবল পার্থ এবং হুমায়ুন রশীদই উপস্থিত আছে। বাকি সকলকে হুমায়ুন রশীদ বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছেন।

কলিংবেল বাজিয়ে দরজার সামনে অপেক্ষা করছিলো তূর্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজা খুলে যায়। সাদিকা বেগমকে দেখে তূর্য ক্লান্ত স্বরে সালাম জানায়। সাদিকা বেগম নরম স্বরে প্রশ্ন করে,

“ তরীর কি অবস্থা বাবা? জ্ঞান ফিরেছে? “

যদিও সাদিকা বেগম সারাদিন একটু পরপর হসপিটালে কল করে খোঁজ নিয়েছেন তরীর তবুও এখন ভালো কোনো উত্তরের আশায় নিজেকে প্রশ্ন করা থেকে সংবরণ করতে পারেন না। কিন্তু তূর্য উনার আশায় পানি ঢেলে জবাব দেয়,

“ না আম্মা। “

সাদিকা বেগম বেশ আশাহত হয়। মেয়েকে সামলানোর জন্য উনি চাইলেও মন খুলে তরী কিংবা তার সন্তানের জন্য একটু কাদতেও পারেন নি সারাদিন। আহারে! না জানি মেয়েটা কতটা কষ্টে আছেন। সাদিকা বেগমের চিন্তার মধ্যেই তূর্য নিজের হাতের টিফিন ক্যারির ব্যাগটা সাদিকা বেগমের হাতে তুলে দিয়ে প্রশ্ন করে,

“ পৃথা খেয়েছে আম্মা? “

“ হ্যাঁ। সারাদিন তরীর জন্য কান্নাকাটি করেছে। এরকম অবস্থায় এভাবে কান্নাকাটি করলে চলে বলো? কতবার বুঝালাম যে কান্না না করে ভাবীর জন্য দোয়া করতে। কিন্তু ও আমার কথা কানে তুললে তো। “

তূর্য আর কোনো কথা না বলে উপরের দিকে চলে যায়। সাদিকা বেগম টিফিন ক্যারির বক্স গুলো খুলে দেখে। যাক! অন্তত সবাই একটু খাবার তো মুখে তুলেছে। এই অবস্থায় বাসা থেকে সাদিকা বেগম যতটুকু সম্ভব হচ্ছে সাপোর্ট দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু এতে তার মন ভরছে না। কাল একবার মধুকে পৃথার কাছে রেখে নিজে হসপিটালে গিয়ে তরীকে কাছ থেকে না দেখলে উনার মন শান্ত হবে না।

রুমে প্রবেশ করতেই তূর্য দেখে পৃথা দরজার দিকে পিঠ করে একপাশ ফিরে শুয়ে আছে। তূর্য চুপচাপ নিজের টাওয়াল আর টিশার্ট ট্রাউজার নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। সারাদিন হসপিটালে ছিলো। কত ধরনের জীবাণু শরীরে লেগে আছে হয়তো। এই অবস্থায় পৃথার কাছে কখনোই যাবে না সে। তাই ভালো করে একটা শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে আসে সে।

পৃথা তখনো অপরদিকে ফিরে শুয়ে ছিলো। তূর্য নীরবে বিছানায় উঠে পৃথার পিছনে হেলান দিয়ে বসে। নরম সুরে ডাকে,

“ পৃথা? “

পৃথা জেগেই ছিলো। তূর্যের কণ্ঠ শুনতেই তার খানিকের বিরতি পাওয়া কান্নাটা আবার ফিরে আসে। সে সাথে সাথে পিছনে ফিরে তূর্যকে জাপ্টে ধরে কেঁদে দেয়। তূর্য একইভাবে নরম গলায় বলে,

“ এরকম করে না সোনা। বেবি কিন্তু কষ্ট পাচ্ছে। “

পৃথা হিচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলে,

“ ভাবী ঠিক হয়ে যাবে তো? আমার দাদা আর ভাবীর জন্য অনেক কষ্ট হচ্ছে। বাচ্চাটার কথা ভাবতেই আমার অনেক কান্না পাচ্ছে তূর্য। “

খারাপ তূর্যরও লাগছে। কিন্তু তা প্রকাশ করার সাধ্যি তার নেই। সে ভেঙে পড়লে সবাইকে সামলাবে কে এই পরিস্থিতিতে? তূর্য বলে,

“ দোয়া করো পৃথা। আমার আপি সুস্থ হয়ে গেলেই সব আগের মতো হয়ে যাবে আবার। “

পৃথার কান্নার দমক কিছুটা কমে আসে। সারাদিনে তার মনে এক ধরনের ভয় সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। তূর্য পৃথাকে টেনে বুকে আগলে নেয়। সাথে সাথে পৃথার বুকের ভয়টা কিছু শব্দের আকারে প্রকাশ পায়।

“ আমাদের বেবিকে ঠিকঠাক ভাবে পৃথিবীর আলো দেখাতে পারবো তো তূর্য? “

তূর্য পৃথাকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলে,

“ হুশ। এসব বলতে হয়না। ইনশাআল্লাহ বেবি ঠিকঠাক ভাবেই আসবে আমাদের কোলে। “

পৃথা মুখটা আরেকটু ছোট করে বলে,

“ আমি শুনেছি ডেলিভারির টাইমে অনেকসময় বেবি কিংবা মা যেকোনো একজনকে চুজ করতে হয়। এরকম সিচুয়েশ যদি কখনো আসে আপনি প্লিজ আমাদের বেবিকে চুজ করবেন। আমি মানসিকভাবে এতো শক্ত নই। আমি ভাবীর মতো এরকম কষ্ট ফেস করতে চাই না। “

তূর্যর কোমল কণ্ঠস্বর মুহুর্তেই পরিবর্তন হয়। সে জোরে পৃথাকে একটা ধমক দিয়ে বলে,

“ এরকম ফালতু কথাবার্তা আমার সামনে আর কখনো বললে একদম কানের নিচে একটা দিবো। “

পৃথা সাথে সাথে চুপ হয়ে যায়। তূর্যের ধমক শুনে বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছে সে। তূর্য কণ্ঠে কাঠিন্য বজায় রেখেই আবার বলে উঠে,

“ চুপচাপ ঘুমাও। তোমার এসব অহেতুক চিন্তার কারণে আমার বেবির কোনো ক্ষতি হলে তোমাকে মাথায় তুলে একটা আছাড় মারবো। “

তূর্যের এরকম কঠিন কঠিন কথা শুনে অষ্টাদশীর মন অভিমানে ভরে উঠে। সে সাথে সাথে তূর্যের বুক থেকে দূরে সরে যেতে চাইলে তূর্য আরো দৃঢ়ভাবে তাকে জড়িয়ে রেখে গম্ভীর স্বরে শুধায়,

“ সমস্যা কি? “

পৃথা আর সরে যাওয়ার চেষ্টা করে না। কোনো জবাবও দেয় না। অভিমানী অষ্টাদশী মনে অভিমান জমিয়ে রেখেই চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ে।

__________

কালো চাঁদরে মোড়ানো আকাশ থেকে থেকে শব্দ তুলে বজ্রপাতের জানান দিচ্ছে। সম্পূর্ণ চৌধুরী নিবাস আজ বেশ নিস্তব্ধ। নিস্তব্ধ পার্থ এবং তরীর ব্যক্তিগত রুমটাও। যেই রুমটায় এখন আনন্দের গুঞ্জন ভেসে বেড়ানোর কথা ছিলো, ভাগ্যের জোরে সেই রুমটা এখন ছেয়ে আছে আঁধারে জোড়ানো শোকের সাগরে।

সেই আধারে তলিয়ে থাকা রুমটায় ধীর পায়ে প্রবেশ করে পার্থ। সিটিং এরিয়ার দরজাটা নীরবে লক করে এগিয়ে যায় বেডরুমের দিকে। বেডরুমের দরজা দিয়ে রুমে প্রবেশ করেই সে আগে হাত বাড়িয়ে সুইচ বোর্ড হতে একটা সুইচ অন করে দেয়। মুহুর্তেই অন্ধকার রুমটা আলোর ছোঁয়া পায়। বেডরুমের দরজাটাও ভেতর থেকে লক করে সামনে এগোতে নিলেই পার্থর চোখ স্থির হয়ে বিছানার এককোণে। দু চারটে জিপলক ব্যাগ সেখানে রাখা আছে।

জিপলক ব্যাগ গুলোকে দূর থেকে দেখতেই পার্থর বুক দুমড়ে মুচড়ে যায়। ধীর পায়ে সে এগিয়ে গিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে একটা জিপলক ব্যাগ তুলে নেয়। ব্যাগের ভেতর রয়েছে তরীর রক্তাক্ত গোলাপি রঙের কামিজটা। সেটা খুলে দেখার আর সাহস হয় না তার। পার্থ সেই ব্যাগটা রেখে অন্য একটা ব্যাগ হাতে তুলে নেয়। এটার ভেতর তরীর ভাঙা ফোনটা আর একটা মেডিক্যাল ফাইল। জিপলকের মুখটা খুলে ভিতর থেকে কেবল মেডিক্যাল ফাইলটা বের করে হাতে নেয় পার্থ। ফাইলটা খুলতেই তার চোখ গিয়ে আটকায় আল্ট্রাসাউন্ডের সেই ছোট্ট চিত্রটায়।

এই নিস্তব্ধ রুমে এখন পার্থ ব্যতীত আর কেউ নেই। চাইলেও প্রবেশ করতে পারবে না। তাই পার্থর রক্তাক্ত রঙ ধারণ করা চোখ জোড়া ঠিকরে অশ্রু বেরিয়ে আসতেও এখন কোনো বাঁধা নেই। পার্থ আলতো করে আল্ট্রাসাউন্ডের ছবিটাতে একটা চুমু খায়। সাথে সাথে তার চোখ বেয়ে টলটল করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।

পার্থ সন্তর্পণে ফাইলটাকে আলমারির নিজের তাকে যত্নের সাথে তুলে রাখে। অত:পর ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার ছেড়ে দু হাত দিয়ে দেয়ালে ঠেক দিয়ে নীরব ভঙ্গিতে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে রয়। শাওয়ারের পানিতে তার গায়ের পাঞ্জাবিটা ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে যায়। পার্থ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করে না।

আচমকা সে অনুভব করে তার বুকের দু পাশে এক জোড়া হাত ধীরে ধীরে তাকে আঁকড়ে ধরছে। পার্থ চোখ বুজে থাকা অবস্থায়ই সেই ছোঁয়াটুকু অনুভব করে। পার্থর পিঠে একটা মাথা এসে ঠেকতেই পার্থ অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে বলে উঠে,

“ মাফ করে দাও জান। “

পিছন থেকে একটা শান্ত নারী কণ্ঠ ভেসে আসে,

“ তোমার তো দোষ নেই। তুমি কেন মাফ চাইছো? “

পার্থ অশ্রু মিশ্রিত গলায় বলে,

“ সব দোষ আমার। আমার শত্রুতার দাম তোমাকে দিতে হচ্ছে। আমার শত্রুতায় আমাদের সন্তান বলিদান হয়েছে। মাফ করে দাও আমাকে। কোনো কথা রাখতে পারি নি আমি। “

কথাটুকু বলতে বলতে পার্থ হিংস্র হয়ে চোখ মেলে তাকায়। বাথরুমের একপাশে থাকা কাচের আয়নার দিকে এগিয়ে গিয়ে উন্মাদের ন্যায় একহাতে সেই আয়নায় এলোপাথাড়ি ঘুষি দিতে শুরু করে। ততক্ষণ থামে না যতক্ষণ না নিজের হাত সম্পূর্ণ ক্ষত বিক্ষত হয়ে আসে।

দেয়াল জুড়ে বিশাল আয়নাটার একটা অংশও যখন আর চূর্ণ বিচূর্ণ হতে অবশিষ্ট থাকে না তখন পার্থ ধপ করে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়ে। বুকের উথাল-পাথাল ঝড় তীব্র আর্তনাদ ও অশ্রু হয়ে বেরিয়ে আসে। সর্বদা ঠান্ডা মস্তিষ্ক নিয়ে চলা পার্থর এই বিধ্বস্ত রূপ দেখলে যে কেউই বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যেতো। কিন্তু তার এই কান্না বা চিৎকার দেখার জন্য কেউ নেই।

ব্যস্ত ঢাকা শহরের দু কোণে দুই পিতা এভাবেই অশ্রু বিসর্জন দিয়ে পাড় করে দেয় একটা নির্ঘুম রাত। একজন পিতা যখন নিজের সন্তানের সংকটাপন্ন জীবনের জন্য সুস্থতা কামনা করে নীরবে অশ্রু ফেলতে ব্যস্ত তখন অন্য এক পিতা নিজের অনাগত সন্তানকে হারিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে ব্যস্ত। দুজনের ব্যথা দুই ধরনের হওয়া সত্ত্বেও যেনো একই সূত্রে গাঁথা।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-৩৩+৩৪

0

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩৩.

সকাল সকাল সাদিকা বেগমের অদ্ভুত আবদার শুনে খাবার গলায় আটকে তূর্যের কাশি উঠে যায়। সাথে সাথে পৃথা তার দিকে একটা পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়। খাবার টেবিলে উপস্থিত আফজাল সাহেব কিছুটা রাগী সুরে বলে উঠে,

“ আহ পার্থর আম্মা। খাওয়ার মাঝখানে ছেলেটাকে বিরক্ত করছো কেন? “

সাদিকা বেগম কিছুটা চিন্তিত গলায় বলে,

“ আমি তো ভেবে চিন্তেই এই কথা বলছি। ভাইসাব আর তূর্য বাবা তো সারাদিন বাইরেই থাকে। এই অবস্থায় পৃথার একা থাকাটা ঠিক হবে? একা ঘরে যদি আল্লাহ না করুক মেয়েটার কিছু হয়ে যায়? এইখানে থাকলে তো সারাক্ষণ কেউ না কেউ ওর সাথে থাকবে। চিন্তা কিছুটা কম হবে। “

কথাটুকু বলেই সাদিকা বেগম তরীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

“ আম্মু তুমি তো ডাক্তার। ভালো বুঝো। তুমি বলো আমি ঠিক বলসি না? “

তরী আড়চোখে খাবার টেবিলে বসে থাকা নিজের ভাই এবং ননদের দিকে তাকায়। দুজনের চেহারাই চুপসে যাওয়া বেলুনের ন্যায় দেখাচ্ছে। তরী কিছু বলবে তার আগেই পৃথা বলে উঠে,

“ আমার ওই বাসায় কোনো সমস্যা হবে না আম্মা। “

স্ত্রীর কথা শুনে এবার তূর্য সাহস পায়। এতক্ষণ সে এটা ভেবেই চুপ ছিলো যে পৃথা যদি থাকতে চায়। কিন্তু যেহেতু পৃথা নিজেই থাকতে চাইছে না তাই তূর্য সাহস করে বলে,

“ আমি পৃথার সম্পূর্ণ খেয়াল রাখবো আম্মা। ওর কোনো অসুবিধা হবে না। “

সাদিকা বেগম সন্তুষ্ট হয় না এই কথায়। পার্থ, শোভন ও মধুমিতা খাবার টেবিলে আপাতত নীরব ভূমিকা পালন করছে। এটা সত্য যে তূর্য লাইফের এই ইম্পোরট্যান্ট সময়টা পৃথাকে ছাড়া কাটাতে চায় না। কিন্তু সাদিকা বেগমের চিন্তাটাও যে অযথা নয় তা-ও সে ভালো করে জানে। কারণ কাজের কারণে তার আর হুমায়ুন রশীদের সারাদিন বাহিরে থাকতে হয়। দিনের এই সময়টুকু পৃৃথাকে অন্য কারো ভরসায় রেখে গিয়েও সে শান্তি পাবে না। তাই কিছুটা বিনয়ের সুরে সে আবদার করে,

“ আম্মা, আপনার কোনো সমস্যা না থাকলে আপনি আমাদের সাথে চলুন। “

সাদিকা বেগম প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকায়। আফজাল সাহেব বলেন,

“ মেয়ের কাছে থাকাটা এখন তোমার বেশি জরুরি পার্থর আম্মা। সংসার নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। দুইজন বউমা ঘরে আছে এখন। তারা ঠিকই মিলেমিশে সংসার সামলাতে পারবে। ভুল বলেছি আম্মাজানেরা? “

শেষের প্রশ্নটা ছেলের বউদের দিকে তাকিয়ে করেন আফজাল সাহেব। তরী এবং মধুমিতা একই সাথে বলে উঠে,

“ আমরা পারবো আব্বা। “

অত:পর দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি বিনিময় করে। সাদিকা বেগম যেনো এবার কিছুটা নিশ্চিন্ত হন। তূর্য এবং পৃথাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। এতক্ষণ একে অপরের থেকে দূরে থাকার কথা ভেবেই তাদের নিঃশ্বাস আটকে ছিলো।

__________

ক্যালেন্ডারে কাটা পড়লো আরও একটা মাস। গ্রীষ্মের তপ্ততা পেরিয়ে প্রকৃতি বরণ করে নিয়েছে বর্ষার মৃদু উগ্রতাকে। সময় ঘনিয়ে এসেছে নির্বাচনের। আজ বাদে কালকেই হবে জাতীয় নির্বাচন। এই একমাস পার্থ একপ্রকার দৌড়ের উপর ছিলো। ব্যস্ত ছিলো শোভনও। চৌধুরী নিবাসের দুই পুত্রবধূও যেনো শাশুড়ির অনুপস্থিতিতে সংসারের হাল আরো শক্ত হাতে আগলে ধরেছে।

সকাল থেকেই গা গুলিয়ে বারবার বমি পাচ্ছে তরীর। বিরক্ত হয়ে সে হসপিটালে কল করে একটা দিনের জন্য লিভ নেয়। সকালে মুখে দেওয়া সামান্য নাস্তাটুকুও বেশিক্ষণ পেটে টিকে নি। ক্লান্ত চিত্তে সে বিছানায় শুয়ে আছে। তখনই রুমের দরজায় নকের শব্দ হয়। তরী চোখ মেলে প্রশ্ন করে,

“ কে? “

“ আমি ভাবী। “

মধুমিতার গলা শুনেই তরী দূর্বল শরীর নিয়ে উঠে বসে বলে,

“ এসো মধুমিতা। “

মধুমিতা হাসিমুখে রুমে প্রবেশ করে বিছানার একপাশে বসে। অত:পর তরীর চেহারা দেখে প্রশ্ন করে,

“ অসুস্থ লাগছে ভাবী? “

“ আর বলো না। সকাল থেকে বমি হচ্ছে শুধু। শরীর একদম ছেড়ে দিয়েছে। “

মধুমিতা চিন্তিত গলায় বলে,

“ তুমিতো বাহিরের কিছুও খাও নি। তাহলে এমন হচ্ছে কেনো? “

“ কি জানি। “

মধুমিতা কিছুক্ষণ চুপচাপ কিছু একটা ভাবে। অত:পর উল্লাস নিয়ে প্রশ্ন করে,

“ এনি গুড নিউজ ভাবী? “

মধুমিতার প্রশ্ন শুনে তরীর দূর্বল মস্তিষ্ক মুহুর্তেই দপ করে জ্বলে উঠে। সে এক দন্ড মধুমিতার দিকে তাকিয়ে থেকে তড়িৎ গতিতে নিজের ফোনটা হাতে নেয়। ক্যালেন্ডার চেক করে কিছু একটা হিসাব করতেই তারও সন্দেহ হয়। অত:পর মধুমিতার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

“ আমি শিওর না। “

মধুমিতা দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বলে,

“ দাদা জানে ভাবী আপনি যে অসুস্থ? “

“ এই না। একদমই না। ও এখন এভাবেই এতো টেনশন মাথায় নিয়ে ঘুরছে। আগে নিজে শিওর হই তারপর ওকে জানাবো আমি। “

“ তাহলে ভাবী আজকে চলুন হসপিটাল যাই। “

“ আজ না মধুমিতা। আজ হসপিটাল থেকে লিভ নিয়েছি। বাসায় একটু রেস্ট করি। কাল একেবারে হসপিটাল গিয়ে ডক্টর দেখিয়ে নিবো। “

মধুমিতা খুশি খুশি মুখ নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

“ আপনি রেস্ট করুন ভাবী। আমি লেবুর শরবত করে নিয়ে আসছি। খেলে বমি বমি ভাবটা কম লাগবে। “

“ শুধু শুধু কষ্ট করো না। “

“ ভাবী, আমার জ্বর আসার পর আপনি কি আমার খেয়াল রাখেন নি? আমাকেও সুযোগ দিন। “

তরী হেসে বলে,

“ আচ্ছা যাও। কিন্তু চিনি কম দিও। “

“ ওকে। “

বলে মধুমিতা বেরিয়ে যায়। তরী ক্লান্ত শরীরের মধ্যে সম্ভাব্য আশংকা যেনো কিছুটা শীতলতা এনে দিয়েছে। কাল পর্যন্ত তো সে ফুপ্পি হওয়ার আনন্দে ভেসে বেড়াচ্ছিলো। কিন্তু নিজে মা হওয়ার সম্ভাবনা ভাবতেই তার অন্যরকম অনূভুতি হচ্ছে। আগামীকালটা আসতে আর কতো দেরি? কখন সে নিজে নিশ্চিত হতে পারবে? তার ধারণা যদি সত্যি হয় তাহলে পার্থকে কিভাবে জানাবে সে? এসব ভাবতে ভাবতেই তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে।

__________

নির্বাচনের আগের দিনের প্রস্তুতির পাট চুকিয়ে সবেমাত্র পার্টি অফিসে পা রেখেছে পার্থ। তখনই তার ফোনটা একটা কল আসে। কলটা রিসিভ করে কানে দিতেই অপরপাশ থেকে কিছু কথা ভেসে আসে। পার্থ জবাবে কেবল আসছি বলে রেখে দেয়। আসিফ তার সাথেই ছিলো। সে বলে উঠে,

“ ভাই আমিও আসি? “

“ না। তুই এদিকটা সামলা। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বো। “

কথাটুকু বলেই পার্থ ব্যস্ত পায়ে আবার বেরিয়ে যায়। সম্পূর্ণ রাস্তায় বেশ নিশ্চিন্তে ড্রাইভ করে সে পৌঁছে যায় একটা নিরিবিলি সুনসান জায়গায়। গাড়িটা রাস্তার একপাশে থামিয়ে নামতেই তার মুখোমুখি হয় একজন পুরুষ। পার্থকে দেখেই সে হেসে বলে উঠে,

“ কালকের দিনটার শুধু অপেক্ষা এখন। তারপর আপনিই হবেন এই আসনের নতুন এমপি। “

পার্থ হেসে বলে,

“ তোমার সাহায্যর জন্যই গত এক মাসে রুবেল হোসেইনের সকল ফাঁদ এড়িয়ে গিয়ে আজ এইখানে দাঁড়িয়ে আছি আমি। সেজন্য তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সুজন। সেদিন সমাবেশেও তুমি আমার জীবন বাঁচিয়েছিলে। আল্লাহ তোমার উছিলায় সেদিন আমাকে এতো বড় একটা বিপদ থেকে রক্ষা করলো। “

সুজন হেসে শুধায়,

“ ওর মতো কুলাঙ্গারের উপর আমি থুথু মারি ভাই। হালায় পুরাডা জীবন আমারে দিয়া কামলা খাডাইসে আবার জনসম্মুখে অপমানও করসে। সবসময় মাইনসের ক্ষতি করার ধান্দায় থাকতো। এমন কুলাঙ্গারের রাজনীতি ছাইড়া আমার কোনো আফসোস নাই। “

কথাটুকু বলে সুজন আবার বলে উঠে,

“ জনগণ আপনার মতো একজন নেতা ডিজার্ভ করে ভাই। রুবেলের মতো কুলাঙ্গাররা ক্ষমতা পাইলে খালি নিজের পকেটই ভারী করা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। জনগণের দিকে ফিরে তাকানোর সময় নাই। “

পার্থ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

“ কালকের নির্বাচনের রেজাল্টের উপর অনেক কিছু ডিপেন্ড করছে সুজন। লেট’স প্রে যেনো রুবেল আর কোনো ব্লেন্ডার করার সুযোগ না পায়। “

“ আপনি চিন্তা করবেন না ভাই। আমার নজর আছে ওর উপর চব্বিশ ঘণ্টা। উল্টাপাল্টা কিছু মনে হইলেই আপনাকে কল দিয়ে জানায় দিবো। “

দূরে আড়াল হতে এক জোড়া চোখ এই দৃশ্যটার সাক্ষী হয় খুব সন্তর্পণে। তার মুখে ফুটে উঠে হিংস্রতার ছাপ। অস্ফুটে একটা বিশ্রী গালি দেয় সে।

__________

এবার মেডিকেলে চান্স হওয়া সত্ত্বেও পৃথা আর ভর্তি হয়নি। তার দুই পরিবারের মানুষের সিদ্ধান্তই এটা। কিছুদিন পর তার শরীর ভারী হয়ে আসবে। তার উপর রয়েছে শারীরিক দূর্বলতা। এরকম একটা অবস্থায় তার এতটা প্রেশার নেওয়ার পক্ষে কেউই নেই। আল্লাহ চাইলে নেক্সট ইয়ার নাহয় সে আরেকবার ট্রাই করবে। ততদিনে তার বেবিও পৃথিবীতে এসে পড়বে।

আজকাল পৃথার জেদ যেনো কয়েকগুণ বেড়েছে। খাবার নিয়ে প্রচুর অনিহা দেখানো পৃথা হুটহাট মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে বলে তার খিদে পেয়েছে। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। মধ্যরাতে আচমকা পৃথার ডাকে তূর্যের ঘুম ভেঙে যায়। সে চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসতেই পৃথা বলে,

“ ঘুম আসছে না আমার। “

তূর্যের ঘুম ততক্ষণে পুরোপুরি উবে গিয়েছে। সে প্রশ্ন করে,

“ খিদে পেয়েছে? “

সাথে সাথে পৃথার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। সে আদুরে মুখে তাকিয়ে থেকে বলে,

“ কাবাব খেতে ইচ্ছে করছে। “

তূর্য সাথে সাথে ব্যস্ত পায়ে রান্নাঘরে চলে যায়। সে পৃথার জন্য বেশ কিছু কাবাব আর চিকেন নাগেটস বানিয়ে ফ্রোজেন করে রেখেছিলো। যাতে যখনই খেতে ইচ্ছে করবে তখনই যেন সাথে সাথে ভেজে দিতে পারে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই তূর্য একটা প্লেটে কিছু কাবাব আর একটা পানির গ্লাস নিয়ে রুমে প্রবেশ করে। পৃথার সামনে সেই প্লেট এবং গ্লাস রেখে বসতেই পৃথা খেতে ব্যস্ত হয়ে পরে। আচমকা তার খেয়াল হয় তূর্যের দিকে। তূর্য বসে বসে ঘুমে ঢুলছে। সাথে সাথে পৃথার খুব মায়া লাগে। মানুষটা সারাদিন অফিস করে এসে আবার বাসায় তার দিকে খেয়াল রাখে। রাতে যেই কয়েক ঘন্টা একটু ঘুমানোর সুযোগ পায় সেটাও পৃথার কারণে ঠিকঠাক ঘুমাতে পারে না।

এই কথাটুকু মনে পড়তেই পৃথার খারাপ লাগে। অপরাধবোধও কাজ করে। আবেগপ্রবণ হয়ে সে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। সাথে সাথে তূর্যের তন্দ্রাভাব কেটে যায়। সে হুড়মুড়িয়ে নিজের পাশে বসে থাকা পৃথার দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন গলায় শুধায়,

“ এই পৃথা? কি হয়েছে? খারাপ লাগছে? পাপাকে ডাকবো? আম্মাকে আসতে বলবো? “

কথাটুকু বলতে বলতেই তূর্য উঠে যেতে নেয় রুম থেকে বের হওয়ার উদ্দেশ্যে। সাথে সাথে পৃথা তার হাত টেনে ধরে। তূর্য আর এগোয় না। পৃথার পাশে বসে চিন্তিত গলায় এটা সেটা প্রশ্ন করতে থাকে। পৃথা কাঁদতে কাঁদতে বলে,

“ আ’ম সরি তূর্য। আমি আপনাকে অনেক বিরক্ত করছি না? আমার কারণে আপনি ঠিকঠাক ঘুমোতে পারেন না। “

পৃথা কি কারণে কান্না করছে বুঝতে পেরেই তূর্য কিছুটা শান্ত হয়। তার চেহারা থেকে চিন্তা ভাবটা উড়ে গিয়ে হাসি ফুটে উঠে। সে পৃথার চোখ মুছে দিয়ে বলে,

“ তুমি যে আমার বাচ্চার জন্য এতো শারীরিক কষ্ট সহ্য করছো তার একভাগও তো আমার সহ্য করতে হচ্ছে না। অন্তত এইটুকুর ভাগীদার আমাকে হতে দাও। “

এইটুকু বলেই তূর্য আবার হেসে বলে উঠে,

“ আর তাছাড়াও তূর্য ইজ নাও টুয়েন্টি ফর আওয়ারস এভেইলেবেল ফর হিজ বোথ বেবিস। “

পৃথার কান্না থেমে যায়। সে নিজের চোখ সরু করে প্রশ্ন করে,

“ বোথ বেবিস? দুটো বেবি কই পেলেন? “

তূর্য নিজের একটা আঙুল দ্বারা পৃথার পেটের দিকে ইশারা করে বলে,

“ একজন হচ্ছে এই বেবি। “

অত:পর আবার তার আঙুল দ্বারা পৃথার দিকে ইশারা করে বলে,

“ আরেকজন হচ্ছে এই বেবি। “

তূর্যের কথার মর্মার্থ বুঝতে পেরেই পৃথা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়। তূর্য মুগ্ধ চোখে সেই লজ্জা ভরা দৃষ্টি দেখতে দেখতে মনে মনে ভাবে ভাগ্যিস সে কখনো কোনো প্রেম করে নি। তাইতো নিজের সকল অনুভূতি এই মানবীর জন্য উজাড় করে দিতে পারছে আজ।

__________

রাতের আধারে অনেকটা চোরের মতোই ঘরের থেকে বেরিয়ে নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছে যায় শোভন। কিছুক্ষণ আগে পাওয়া ফোনকলটা রিসিভ করার পর থেকেই উত্তেজনায় তার হাত পা কাপছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে কল করা ব্যক্তিটার সাক্ষাৎ পাওয়া গেলো। লম্বা চওড়া সেই পুরুষের প্রথম দর্শনেই শোভন লোকটার কঠোর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আন্দাজ করে ফেললো। লোকটার বয়স হয়তো আনুমানিক ২৬ কিংবা ২৭। শোভন হাত বাড়িয়ে দিতেই লোকটা বেশ সু কৌশলে তার সাথে হাত মিলিয়ে কুশল বিনিময় করলো। অত:পর নিজের গভীর গলায় বলে উঠে,

“ আপনার সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগলো অফিসার শোভন মুহতাশিম চৌধুরী। “

“ সৌভাগ্য তো আমার যে আপনার সাথে দেখা করার সুযোগ পেলাম। “

“ দেশের স্বার্থে আজ আমাদের এই সাক্ষাৎ অফিসার শোভন। আপনার মতো নিঃস্বার্থে দেশকে ভালোবাসা একজন দেশপ্রেমিকের সাহায্যের প্রয়োজন আমার। “

“ অবশ্যই বলুন। কিভাবে সাহায্য করতে পারি? “

“ আপনার মিসিং এইট নামক কেসটা নিয়ে কথা বলতে এসেছি আমি। “

শোভন অবাক হয়। এই আটটা মিসিং কেস এবং সেই ম্যানহোলে পাওয়া লাশের কেস নিয়ে সবাই যখন সব আশা ছেড়ে দিয়েছে তখন শোভন এগুলোর মধ্যে কানেকশন খুঁজে বের করে আলাদা এক কেসের নাম দেয় এটাকে। কিন্তু তা খুব গোপনে। সেই খবর এই ভদ্রলোক পর্যন্ত কিভাবে পৌঁছে গেলো? অবশ্য এই ভদ্রলোকের প্রফেশন অনুযায়ী এই খবর জানা তার জন্য কোনো অসম্ভব বিষয় নয়।

শোভন আগ্রহী স্বর মিশিয়ে প্রশ্ন করে,

“ এই কেসের প্রতি আপনি আগ্রহের কারণ কি জানতে পারি আমি? কারণ এই পর্যন্ত এই কেস নিয়ে আমি আমার উপরমহলের অনেকের কাছে গিয়েছি। কিন্তু উনারা কেউ এই কেসের ইনভেস্টিগেশনের প্রতি আগ্রহী না। “

লোকটা নিঃশব্দে মেপে মৃদু হাসে। যেনো এর থেকে বেশি হাসি তার ব্যক্তিত্বের সাথে যায় না। অত:পর বলে উঠে,

“ আপনি যে কেসগুলোর মধ্যে কানেকশন খুঁজে বের করেছেন সেটা জেনেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম আপনি বেশ বিচক্ষণ। যা আর কারো চোখে ধরা পড়ে নি তা আপনার দৃষ্টি এড়াতে পারে নি। তাই আপনাকে আমি বেশ স্বল্প শব্দে কিছু কথা বলবো। আশা করছি সেই কথাগুলো শুনলেই আপনি বুঝতে পারবেন এই কেসের প্রতি আমার আগ্রহের কারণ। “

শোভন আগ্রহী চোখে তাকিয়ে রয়। লোকটা আপন ভঙ্গিতে বলে উঠে,

“ এই কেসের মিসিং ছেলেগুলো সব প্রাইভেট ভার্সিটির স্টুডেন্ট। ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাটাস সবার বেশ ভালো পর্যায়ের। সবাই ব্যক্তিগত জীবনে সম্পূর্ণ নির্ভেজাল টাইপ মানুষ। এই ধরনের ছেলেগুলো হুট করে উধাও হয়ে যাওয়ার মানে বুঝতে পারছেন আপনি? কোন ধরনের চক্রের এর পিছনে হাত থাকতে পারে আপনি আন্দাজ করতে পারছেন? “

শোভন এক দন্ড খুব মনযোগ নিয়ে কথাটুকু শুনে। আচমকাই তার মস্তিষ্কে গেঁথে থাকা সকল রহস্যের জট খুলে যায়। বিস্ফোরিত গলায় প্রশ্ন করে,

“ আর ইউ শিওর? “

“ শিওর না হলে আমি এই মুহুর্তে আপনার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম না। এই কেসটা খুব কনফিডেন্সিয়াল অফিসার শোভন। এন্ড উই মাস্ট কিপ এভ্রিথিং রিলেটেড টু দিজ কনফিডেন্সিয়াল। “

শোভন আর সেই আগুন্তকঃ ভদ্রলোকের কথাপোকথন দীর্ঘস্থায়ী হয় আরো বেশ কিছুক্ষণ। কথা শেষে বিদায় বেলায় সেই আগুন্তকঃ শোভনের সাথে হাত মিলাতেই শোভন বলে উঠে,

“ খুব বড় একটা কেসের পিছনে পড়েছেন আপনি। সামলে চলবেন। আশা করছি দ্রুতই এই কেসের মূল কেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছে যাবেন। সেই চক্র এদেশের জন্য আতঙ্কে রূপ নেওয়ার আগে আপনি যেনো তাদের আতঙ্কের কারণ হতে পারেন। “

“ মে আওয়ার কান্ট্রি লিভ লং। “

কথাটুকু বলেই সেই লোকটা প্রস্থান করে। শোভন মুগ্ধ চোখে সেই লোকের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। দেশের প্রতি এই মানুষটার ভক্তি দেখেই সে মূলত এতো মুগ্ধ। এই মানুষটার সাথে তার আর কখনো দেখা হবে নাকি তা নিয়ে সে নিশ্চিত নয়। কিন্তু এই মানুষটা যেনো তার উদ্দেশ্যে সফল হয় সেই দোয়া সে সবসময় করবে।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩৪.

সারাদিনের ক্লান্তি গায়ে মেখে পার্থ যখন বাসায় ফিরে তখন প্রায় মধ্যরাত। ব্যস্ততার টানাপোড়েনে আজ সারাদিন তরীকে কলও করা হয় নি তার এক মুহুর্তের জন্য। ডাক্তার নিশ্চয়ই এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে? এসব ব্যাপারে তো মহারাণী খুব পাংচুয়াল। পার্থ নীরবে বাড়িতে প্রবেশ করতেই তার চোখ আটকে যায় ডাইনিং টেবিলের দিকে। সারাদিনের ক্লান্তি মুহুর্তেই প্রশান্তিতে বদলে যায়।

সে ছোট ছোট কদম ফেলে ধীর গতিতে টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়। অত:পর নিঃশব্দে একটা চেয়ার টেনে সে বসে পড়ে। তার সামনে বরাবর চেয়ারেই তরী বসে আছে। টেবিলের উপর রাখা তার একহাতের উপর মাথা এলিয়ে দিয়ে ঘুমোচ্ছে। আরেকহাত সোজা করে টেবিলের উপর রাখা। পার্থ নিষ্পলক সেই ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। টেবিলের একপাশে রাখা খাবার প্লেট এবং গ্লাস দেখে পার্থ নিশ্চিত হয় যে তার স্ত্রী তার ফেরার অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে।

রাজনীতির উছিলায় বিয়ের আগেও অনেক সময়ই পার্থর রাতে বাড়ি ফিরতে দেরি হতো। সাদিকা বেগম প্রথম প্রথম রাত জেগে ছেলের জন্য অপেক্ষা করতো। কিন্তু পার্থ স্পষ্ট ভাষায় মানা করে দেয় তার জন্য কাউকে রাত জাগতে। এরপর থেকে সাদিকা বেগম নিজে অপেক্ষা না করলেও জমিলা খালাকে কড়া নির্দেশনা দিয়ে রাখতেন যেনো পার্থ বাড়ি ফিরলে তাকে খালি পেটে না ঘুমাতে দেয়। জমিলা খালাও সেই আদেশ পালন করতেন। কিন্তু তখন পার্থর কখনোই আলাদা কোনো অনুভূতি কাজ করে নি। তবে আজ করছে। তরীর তার জন্য করা অপেক্ষাতেও সে সুখ খুঁজে পাচ্ছে। পার্থ কি কখনো ঘুণাক্ষরেও ভেবেছিলো যে তার পছন্দসই নারী একদিন তারই স্ত্রী রূপে তার বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় পথ চেয়ে রইবে?

ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে পার্থ। আরেক দন্ড দেখে নেয় তরীকে। কতক্ষণ ধরে এভাবে ঘুমাচ্ছে? ঘাড় ব্যথা করছে না? পার্থ চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে গিয়ে তরীর পাশে দাঁড়ায়। তরীকে চেয়ার থেকে তুলতে নিলেই তরী নড়েচড়ে উঠে। কিন্তু গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকায় আবার চোখ বুজে ফেলে সে। পার্থ তরীকে পাজাকোলে তুলে নিয়ে এক দন্ড সেই ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখে নেয়। অত:পর মুখ নামিয়ে তার কপালে চুমু খেয়ে নিজের রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।

__________

নির্বাচন শব্দটা শুনতে যত সাধারণ মনে হয় এর অর্থ ততটাই ভারী। এই একটা জিনিসকে কেন্দ্র করে ঘুরে আরো অনেক গুলো বিষয়। একটা দেশের উন্নয়ন, জনগণের আশা, প্রার্থীদের জয় পরাজয় সব এই শব্দটার সাথে সংশ্লিষ্ট।

খুব সকাল থেকেই নির্বাচনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। নির্ধারিত স্কুল কেন্দ্রগুলোকে ঘিরে আছে বিভিন্ন চ্যানেলের সাংবাদিকরা। টিভিতে চলছে নির্বাচনের লাইভ টেলিকাস্ট। পার্থর এরিয়ার কেন্দ্রগুলোতে তার ছেলেদের রয়েছে কঠোর পাহারা। কোথাও কোনো অনৈতিকতা করার সুযোগ দিবে না যেনো তারা। জিতুক কিংবা হারুক তা গুরুত্বপূর্ণ না। একটা সুষ্ঠু নির্বাচন বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাদের কাছে। পুলিশের টহলে সেই নিরাপত্তা আরো দ্বিগুণ রূপ ধারণ করেছে। স্কুল মাঠ গুলোতে রয়েছে ভোটারদের লম্বা লাইন।

পার্থ খুব ভোর বেলায়ই গোসল সেরে গায়ে একখান শুভ্র পাঞ্জাবি জড়িয়ে বেরিয়ে পড়েছে। তরী তখনও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তাই আসার আগে তার সাথে কথাও হয় নি। আকাশটা আজ সকাল থেকে খুব পরিষ্কার। আবহাওয়া অধিদপ্তরের মতে আগামী এক দু’দিনের মধ্যে নাকি ভারী বর্ষণের আশংকা করছে তারা। কিন্তু আবহাওয়া অধিদপ্তরকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সকাল পনে নয়টার দিকেই সূর্যের দেখা মিললো।

প্রকৃতি যতটাই উজ্জ্বল থাকুক না কেন পার্থর বুকের ভেতর ডিংডিং করে চিন্তার ঘন্টা বেজে চলেছে। এই চিন্তার কারণ তার অজানা। সে তো একটু পর পরই ভোট কেন্দ্র গুলোর ভেতরকার অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছে। সব তো ঠিকঠাকই আছে। তবে এই চিন্তা এই ভয় কিসের জন্য?

ভোর বেলায় তরীকে রেখে আসার সময় তরী ঘুমের ঘোরে আষ্টেপৃষ্টে তাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলো। পার্থ নিজেকে সেই বাধন থেকে মুক্ত করে উঠে বিছানা ছেড়ে নামতে নিলেই তরী ঘুমের ঘোরে আবার তার হাত জড়িয়ে ধরে। যেনো কোনো ভাবেই তাকে যেতে দিবে না আজ। পার্থ সেই সকল বাঁধা পেরিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে আজ।

আরেকটা খটকা লাগার বিষয় হচ্ছে রুবেল গতকাল থেকে খুব শান্ত আছে। কোনো রকমের মাথা ব্যাথা যেনো নেই তার। এরকম কেন হচ্ছে? রুবেলের তো এতটা শান্ত থাকার কথা না। আর কিছু ভাবার সুযোগ পায় না পার্থ। তার আগেই তাকে ঘিরে ধরে বেশ কিছু সাংবাদিক। পার্থ স্বল্প কিছু প্রশ্নের জবাব দিয়ে প্রশ্ন উত্তরের পাটটা চুকিয়ে ফেলে। সাথে সাথে পার্থর সাথে থাকা তার দলের কিছু ছেলে তাকে সেই ভীড় ঠেলে বের করে এনে একটা নীরব জায়গায় পৌঁছে দেয়। এইদিকটা বেশ নিরিবিলি। লোক সমাগম নেই বললেই চলে। স্কুলের পিছনের এই খোলা মাঠটার একপাশেই পার্থর গাড়ি পার্ক করা। পার্থ শামীমের হাতে নিজের গাড়ির চাবিটা দিয়ে বলে,

“ শামীম আমার সাথে চল। “

শামীম বাকি সকলকে কেন্দ্রের দিকে পাঠিয়ে দিয়ে পার্থর সাথে এসে গাড়িতে উঠে বসে। অত:পর প্রশ্ন করে,

“ কোথায় যাবেন ভাই? “

পার্থ পিছনের সিটে বসে নিজের পিঠ এলিয়ে দিয়ে শান্ত স্বরে বলে,

“ সেগুনবাগিচার জমির ওদিকটায় চল। “

__________

চৌধুরী নিবাসে আজ সকাল থেকেই সবাই টিভির সামনে বসে। আফজাল সাহেব, মধুমিতা, জমিলা খালা সবাই টিভির দিকে তাকিয়ে। ভোট গ্রহণ শুরু হয়েছে কিছুক্ষণ হলো। আফজাল সাহেবের থেকে থেকে ছেলের চিন্তায় বিপি হাই হয়ে যাচ্ছে। মধুমিতা শশুড়কে কখনো ওষুধ এনে দিচ্ছে তো কখনো পানি। তবুও আফজাল সাহেবের চিন্তার সিকি ভাগও কমছে না। তার ছেলের রাজনীতির প্রতি ঝোকে তিনিই সর্বপ্রথম সমর্থন জানিয়েছিলেন। তার সমর্থনেই ছেলের সাহস এবং মনোবল আরো জোড়দার হয়। তীব্র সংগ্রামের পর ছেলের জয়ই কেবল উনার কাম্য।

__________

নিজের কেবিনে বসে উসখুস করছে তরী। একদিকে পার্থর জন্য চিন্তা তো অপরদিকে টেস্টের রিপোর্টের জন্য চিন্তা হচ্ছে তার। কিন্তু আপাতত পার্থর জন্য তার চিন্তাটাই মুখ্য। সকালে মানুষটাকে সে ঠিক করে বিদায়ও দিতে পারে নি। মরার মতো পরে ঘুমোচ্ছিলো। পার্থ রাতেও কিছু খায় নি সকালেও কিছু খেয়ে যায় নি। সেই মানুষটার চিন্তায় তরীও গতরাত থেকে না খাওয়া। রাতে ভেবেছিলো পার্থ বাড়ি ফিরলে একসাথে খাবে। কিন্তু কখন যে চোখ লেগে আসে সে টেরই পায় নি। সকালে যখন জমিলা খালার কাছে শুনলো পার্থ নাস্তা না করেই বেরিয়ে পড়েছে তখন তারও মুখে আর খাবার উঠে নি। তাড়াতাড়ি শশুড়ের চোখ ফাকি দিয়ে হসপিটাল এসে পড়ে। বাসায় থাকলে আফজাল সাহেব কখনোই তাকে নাস্তা না করে বের হওয়ার অনুমতি দিতো না।

তরীর আকাশ কুসুম চিন্তার মাঝেই তার ফোনে একটা ছোট ম্যাসেজ আসে। ম্যাসেজটা ওপেন করতেই তার চোখে মুখে হাসি ফুটে উঠে। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,

“ আই নিড ইউ বাই মাই সাইড জান।
মিট মি এট সেগুনবাগিচা। “

ছোট্ট দুই লাইনের ম্যাসেজ এবং তার সাথে এটাচড গুগল ম্যাপে লোকেশনের লিংকের এটাচমেন্টটা তরীর মন ফুরফুরে করে দেয়। সে সাথে সাথে গায়ের এপ্রোন খুলে রেখে নিজের মাথার খোপাটা খুলে হাতের সাহায্যে চুল সামান্য ঠিক করে নেয়। অত:পর নিজের পার্স নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে।

__________

নীল রঙা গাড়িটা ব্রেক করে তরী তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নামে। তার মুখোমুখি কালো গাড়িটার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে শামীম। তরীকে দেখেই সে সালাম দিয়ে বিনয়ী ভঙ্গিতে বলে,

“ ভাই গাড়ির ভেতর আছে ভাবী। “

তরী হেসে নিজের হাতের দুটো ব্যাগ হতে শামিমের হাতে একটা ছোট ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বলে তুমি আমার গাড়িতে বসে লাঞ্চটা করে নাও। শামীম বিস্মিত হয়ে যায়। তরী বলে,

“ চিন্তায় যে তোমাদের কারো গলা দিয়ে আজ খাবার নামবে না আমি জানি। কিন্তু না খেলে আমি রাগ হবো। তাই কোনো কথা না বলে গিয়ে লাঞ্চ করে নাও। “

শামীম আর কিছু বলার সুযোগ পায় না। তার আগেই তরী দৌঁড়ে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। তরী গাড়ির দরজা বন্ধ করেই পার্থর বুকে হামলে পড়ে। পার্থ নিজের প্রশস্ত বুকে স্ত্রীকে জড়িয়ে নিতেই তরী বলে,

“ খুব চিন্তায় ছিলাম। “

পার্থও একই ভঙ্গিতে বলে,

“ খুব অস্থির ছিলাম। “

পার্থর কথা শুনে তরী হেসে চোখ বুজে। অত:পর পার্থর বুক থেকে মাথা তুলে তার দিকে তাকায়। এসি তো চলমান। তবুও পার্থর কপাল চুইয়ে ঘাম পড়ছে। তরী নিজের গোলাপি রঙা ওড়নার আঁচল দিয়ে সেই ঘামটুকু মুছে দিতেই পার্থ হেসে বলে,

“ তোমার মধ্যে গিন্নি টাইপ ব্যাপার এসে পড়েছে। “

তরী লজ্জা পায়। পার্থ ভালো করেই জানে এই ধরনের টিপিক্যাল কথা শুনলে সাধারণত তরী রাগ হয়। অথচ আজ তার উল্টো হতে দেখে সে বেশ অবাক হয়। তরী নিজের সাথে আনা আরেকটা ব্যাগ হতে একটা বিরিয়ানির প্যাকেট ও পানির বোতল বের করে। অত:পর গাড়ির জানালা খুলে নিজের হাত ধুয়ে নিয়ে পার্থর সামনে লোকমা তুলে বলে,

“ মাথা চক্কর খেয়ে পড়ে আমার হসপিটালে এডমিট হতে না চাইলে চুপচাপ খেয়ে নাও। গত রাত থেকে না খেয়ে দেবদাস সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছো। এসব আমার একদম পছন্দ না। “

তরীর এই হালকা শাসন পার্থ উপভোগ করে। সে বিনাবাক্য ব্যয়ে লোকমাটুকু মুখে নিয়ে নেয়। অত:পর তরীকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ আমি দেবদাস হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি সেটা অপরাধ। আর আপনি যে পারু সেজে স্বামীর সাথে তাল মিলিয়ে অভুক্ত রয়েছেন সেটা কি অপরাধ নয় তরী রশীদ? “

তরী অবাক হয়। পার্থ কি বাসায় তার পিছনে স্পাই লাগিয়ে রেখেছে নাকি? অবশ্য সেই স্পাইটা যে কে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না তরীর। জমিলা খালা যে পার্থর কত বড় নেওটা তা তার বেশ জানা আছে। পার্থ মৃদু ধমকে বলে,

“ আর পার্বতী সেজে ঘুরে বেড়াতে হবে না। তুমিও খেয়ে নাও। “

তরী এবার পালাক্রমে পার্থর পাশাপাশি নিজের মুখেও খাবার তুলে নেয়। খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই তরী হাত ধুয়ে বসতেই পার্থ তার ওড়নার আঁচল টেনে নিয়ে নিজের ভেজা মুখ মুছে নেয়। তা দেখে তরী হেসে বলে,

“ তুমিও কিন্তু টিপিক্যাল হাজবেন্ড হয়ে যাচ্ছো। “

পার্থ হেসে নিজের হাতঘড়ি দেখে বলে,

“ হসপিটালে যাবে নাকি বাসায় ফিরবে? “

“ হসপিটাল যেতে হবে। একঘন্টার ব্রেক নিয়ে এসেছি আমি। “

তরী নিজের পার্স হাতে নিয়ে অপরদিকে ফিরে দরজা খুলতে উদ্যত হলেই সাথে সাথে নিজের পেটের কাছে পার্থর বলিষ্ঠ হাতের ছোঁয়া অনুভব করে। তরী সাথে সাথে আবেশে চোখ বুজে ফেলে। আপনাআপনিই তার হাত চলে যায় পার্থর হাতের উপরের পিঠে। মনে মনে ভাবে যদি টেস্টের রিপোর্ট পজেটিভ আসে? তার মানে এখন ঠিক এই জায়গাটায় আরেকটা প্রাণও রয়েছে। যাকে নিজের অজান্তেই পার্থ ছুঁয়ে দিচ্ছে। তরীর ভাবনার মাঝেই পার্থ তার কাধে নিজের থুতনি ঠেকিয়ে বলে,

“ সকাল থেকে এক অজানা আতংক আর অস্থিরতা অনুভব করছিলাম। তোমার খানিকের সান্নিধ্যে তা কিছুটা কম অনুভব করছি এখন। “

তরী মৃদু হাসে। অত:পর নরম সুরে ডাকে,

“ পার্থ? “

“ হ্যাঁ, জান। “

তরী আর কিছু বলতে পারে না। তার ইচ্ছে করছে চিল্লিয়ে পার্থকে জানাতে যে হয়তো তুমি বাবা হতে চলেছো। কিন্তু নিশ্চিত না হয়ে সে কিছু বলতে চায় না। তাই কথাটা চেপে গিয়ে সে বলে,

“ নির্বাচনের ফলাফল যা-ই হোক না কেন তুমি প্লিজ রাতে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরো। “

“ কিছু বলবে? “

“ না, এমনি। “

তরী চলে যায়। পার্থ আবার এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করে। আজ সকাল থেকে তার সাথে হচ্ছেটা কি? এরকম অদ্ভুত অনুভূতি কেনো হচ্ছে না? এতটা অস্থির কেনো লাগছে? নির্বাচনের জন্য নাকি অন্য কিছু?

__________

ভোট প্রক্রিয়া শেষ হয়ে এখন গণনাকার্য চলছে। সারাদিনের উজ্জ্বল আবহাওয়া হঠাৎ করেই গুমোট রূপ ধারণ করেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের কথাটা যেনো সত্যি হতে চলেছে। যেকোনো মুহুর্তে আকাশ ছাপিয়ে নামবে ভারী বর্ষণ। সন্ধ্যা লগ্ন পেরিয়ে নিশ্চুপ রাতের আগমন হয়েছে। নিশ্চুপ হয়ে আছে সকল প্রার্থীও। আর কিছু মুহুর্তের ব্যবধান। যেকোনো মুহুর্তেই বিজয়ী প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হবে।

টিভির সামনে বসে আছে উৎসুক দেশবাসী। বসে আছে পার্থর পরিবারও। শোভন খুব একটা ইন্টারেস্ট না দেখালেও, সে-ও ঠিকই আড়ালে নিজের রুমে বসে ফোনে নিউজের লাইভ টেলিকাস্ট দেখছে।

অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ঘোষণা করা হলো বিজয়ীর নাম। পার্থ মুন্তাসির চৌধুরী। নামটা ঘোষণা করা হতেই উল্লাসে ফেটে পড়লো সকলে। আফজাল সাহেবের চোখ ভিজে আসে ছেলের কাঙ্ক্ষিত বিজয় দেখে। সাদিকা বেগম সাথে সাথে চলে যায় দু রাকাত নফল নামাজ আদায় করতে। শোভন নিজের খুশিটা চেপে যায়। পৃথা খুশিতে ইয়েস বলে লাফিয়ে উঠে। তার উল্লাস দেখে তূর্যও নীরবে হাসে। লোকটা স্বামী হিসেবে এখন পর্যন্ত তার আপিকে কোনো অভিযোগের সুযোগ দেয় নি। এখন একজন নেতা হিসেবেও যেনো নিজের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করে তা-ই তূর্যর কাম্য।

জনগণের সিংহভাগই পার্থের পক্ষে ভোট দিয়ে তার ব্যালেট ভারী করেছে। কথাটা যেনো পার্থর এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। সবটা তার স্বপ্ন মনে হচ্ছে। নিজের প্রতিপালকের প্রতি সে মনে মনে শুকরিয়া আদায় করে। তার উপর আল্লাহর মেহেরবানি আছে বলেই আজ সে এই অবস্থানে পৌঁছাতে পেরেছে। প্রথমে তরীর ভালোবাসা এখন জনগণের ভালোবাসা। এই সবটা তার ভাগ্যে ছিলো ভাবতেই পার্থর শরীরে শীতল হাওয়া বয়ে যায়।

চারিদিক থেকে পার্থকে ঘিরে ধরেছে সাংবাদিকেরা। পার্থকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য তার সাথে রয়েছে তার দলের লোকেরা এবং পুলিশ। উৎসুক ও উদগ্রীব জনতার উদ্দেশ্যে পার্থ ক্যামেরায় নিজের দৃষ্টি স্থির করে দৃঢ় গলায় বলে উঠে,

“ এই জয় আমার নয়। এই জয় আপনাদের সকলের। সেই প্রতিটা মানুষের যারা ভোট কেন্দ্রে এসে এই নগন্য মানুষের উপর আস্থা রেখে তাকে বিজয়ী হতে সাহায্য করেছেন। “

কথাটুকু বলেই পার্থ মৃদু হাসে। অত:পর বলিষ্ঠ গলায় ফের বলে উঠে,

“ একজন বাচ্চা ছোট বেলা থেকেই নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিভিন্ন স্বপ্ন সাজায়। আমার সকল স্বপ্ন ছিলো নিজের দেশ ও দেশের মানুষদের ঘিরে। সেই স্বপ্ন মনে লালন করেই আমি বেড়ে উঠেছি। আমার এই চলার পথে বহু বিপদ এসেছে। কিন্তু মহান আল্লাহর রহমত এবং আমার আব্বা আম্মার দোয়ায় আমি সেই সকল বিপদ কাটিয়ে আজ আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আরেকজন মানুষের কথাও না বললে নয়। আমার আব্বা আম্মার দোয়া যেমন আমার ঢাল হয়েছিলো তেমনই সেই মানুষটা আমার শক্তির উৎস হয়ে সাথে ছিলো। সেই মানুষটা আমার স্ত্রী, আমার প্রেরণা। “

কথাটুকু বলে পার্থ এবার কিছুটা সিরিয়াস মুখে বলে,

“ আমিও আপনাদের মতো এই দেশের একজন অতি সাধারণ মানুষ। কিন্তু আপনাদের সেবার মাধ্যমে নিজেকে অসাধারণ করে তোলার প্রচেষ্টা আমার আমরণ থাকবে। তাই আপনারা আপনাদের সকল সমস্যা আমার কাছে তুলে ধরতে দ্বিধা বোধ করবেন না। সকলে ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন। এই প্রত্যাশা রেখে আজকের জন্য আল্লাহ হাফেজ। “

দেশের প্রতিটা টিভি চ্যানেলে টেলিকাস্ট হচ্ছে পার্থর এই লাইভ বক্তব্য। বক্তব্যের পাট চুকিয়ে বেরিয়ে আসতেই পার্থর দলের সকলে তাকে ঘিরে ধরলো। দেশের বিভিন্ন মন্ত্রী এমপির ফোন কলে তার ফোন ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ফুলের অভ্যর্থনায় সকলেই পার্থকে ঘিরে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এতো মানুষের সমারোহেও পার্থর মস্তিষ্কে বাজছে একটাক কথা। তরী তার জন্য অপেক্ষা করছে।

__________

ভারী বর্ষণ নেমেছে ধরায়। নীল রঙা গাড়ির উইন্ডশেল্ড ওয়াইপার ক্রমাগত গাড়ির সামনের কাঁচে বেয়ে পড়া বৃষ্টির পানি সরিয়ে দিতে ব্যস্ত। তরী ফোনের স্ক্রিনের দিকে গাড়ি চালানোর ফাঁকে ফাঁকে তাকাচ্ছে। মুখে তার মুচকি হাসি লেপ্টে। এতক্ষণ পার্থর লাইভ ইন্টারভিউ সম্পূর্ণটা সে দেখেছে।

গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে নিজের হাত রেখেই তরী আবার ঘাড় ঘুরিয়ে পাশের সিটে থাকা ফাইলটার দিকে তাকায়। সাথে সাথে তার হাসির রেখা দীর্ঘ হয়। খুশির পরিমাণ অত্যাধিক বেশি হলে মানুষ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। তরীও তার ব্যতিক্রম নয়। তার চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। মনে মনে ভাবছে পার্থকে কিভাবে খুশির খবরটা জানাবে। বাবা হতে চলেছে জানার পর পার্থর সেই হাসিমাখা মুখটা তরীর চোখের সামনে ভেসে উঠে। সাথে সাথে তরী ফিক করে হেসে দেয়।

ড্রাইভ করতে করতে একটা হাত নিজের পেটের উপর সন্তর্পণে রেখে সে বলে উঠে,

“ তোমার বাবা তোমার কথা জানলে খুশিতে পাগল হয়ে যাবে। “

কথাটুকু বলেই তরী নীরবে হাসে। অত:পর বেশ আগ্রহী গলায় বলে,

“ তোমার বাবার গান শুনবে? খুব ভালো গান গায়। আমার মতো ফাটা বাঁশ নয় একদম। “

কথাটুকু বলেই তরী একহাত বাড়িয়ে ফোনে একটা রেকর্ডিং প্লে করে দেয়। কোনো এক একান্ত রাতে পার্থ তাকে বুকে জড়িয়ে এই গান শোনানোর সময় তরী এটা রেকর্ড করে রেখেছিলো। হসপিটালে নিজের কর্মব্যস্ততায় যখন সে খুব ক্লান্ত অনুভব করে তখন এই রেকর্ডিংটা শুনে সে। ফোনের ভলিউম সম্পূর্ণ বাড়িয়ে দেয় তরী। বর্ষণের সাথে তাল মিলিয়ে পার্থর গান শুনতে বেশ শ্রুতিমধুর লাগছে। সবসময়ের মতোই পার্থ নিজের নির্লজ্জ মার্কা গানই গাইছে,

“ ভিগে ভিগে তেরে লাব
মুঝকো কুছ কেহতে হে
দিল হে খুশ মেরা
কে খেয়াল এক জেয়সে হে
রোকো না আব খুদকো ইউ
সুন লো দিল কি বাত কো
ঢাল জানে দো শাম
ওর আজা নে দো রাত কো। “

গানটুকু শুনতে শুনতেই তরী হেসে বলে উঠে,

“ তোমার বাবার প্লে লিস্ট এমনই। কিন্তু চিন্তা করো না, তুমি আসার আগেই মা বাবাকে ভালো গান শিখিয়ে দিবো। তোমাকে সেগুলোই শুনাবে। এইসব গান শুধু মায়ের জন্যই সীমাবদ্ধ। “

কথাটুকু বলতে বলতেই তরী একটা চার রাস্তার মোড় পেরিয়ে সোজা যাচ্ছিলো। ঠিক সেই সময় হঠাৎ ডানপাশ হতে একটা বড় ট্রাক এসে নীল রঙা গাড়িটা সজোরে ধাক্কা দিয়ে চুরমার করে দিয়ে শা শা শব্দ তুলে সেখান থেকে প্রস্থান করে। পুরো ঘটনাটা ঘটে চোখের পলকে।

চার রাস্তার মিলন মোড়ের মাঝে নীল রঙা গাড়িটা তিন চারটে ডিগবাজি খেয়ে উলটে পড়ে রয়। গাড়ির সব কাঁচ গুড়ো গুড়ো হয়ে রাস্তা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। গাড়ির একপাশের জানালা দিয়ে বেরিয়ে আছে একটা নারী হাত। মৃদু কাপছে সেই হাতটি। সম্পূর্ণ হাত রক্তাক্ত। রক্তে ভেসে যাচ্ছে সম্পূর্ণ রাস্তাও। সেই রক্ত ধুয়ে মুছে নেওয়ার দায়িত্ব যেনো কাধে তুলে নিয়েছে এই নির্মম বর্ষণ। গাড়ির ভেতর হতে একটা ভাঙা ফোন হতে ভেসে আসছে একটা পুরুষের গাওয়া কিছু বেহায়া চরণ,

“ কিতনা হাসিন ইয়ে লামহা হে,
কিসমাত সে মেনে চুরায়া হে। “

এতদূর আসতেই রেকর্ডিংটা বন্ধ হয়ে যায়। সেই নারী হাতের মৃদু কম্পনও থেমে যায়। নিস্তেজ হাতটা অসাড় হয়ে পড়ে।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]