Saturday, June 28, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 304



কে বাঁশি বাজায় রে পর্ব-১৩

0

#কে_বাঁশি_বাজায়_রে
#পর্ব_১৩
#নুর_নবী_হাসান_অধির

সোনালী আলোয় সজীব মনোমুগ্ধকর পরিবেশের শীতল হাওয়ায় সকলেই মুগ্ধ৷ প্রাণ ফিরে পেয়েছে নতুন করে ভালোবাসার৷ মুগ্ধতা বিরাজ করছে চার জোড়া চোখে৷ পরী সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“শীতে সরিষা ক্ষেতের পাশ দিয়ে হাঁটতে ভীষণ ভালো লাগে৷ সব সময় সরিষা ফুলের সৌরভ মুগ্ধ করে আমাদের।”

সমাপ্তি গায়ের শক্তভাবে চাদর প্যাঁচিয়ে বলল,

“নদীর ওই পাড়ে সরিষা ক্ষেত বেশি৷ চল আমরা ওই পাড়ে যাই৷ পরী তো নৌকা চালাতেই পারে৷”

কনকনে শীতে নৌকা চালিয়ে নদী পার হয়৷ শীতল হাওয়া গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে৷ পরী ধানের খড় জমিয়ে আগুন ধরাল৷ সবাই বসে বসে আগুনের তা নিচ্ছে। ঘন কুয়াশায় সরিষার ক্ষেতের মাঠ দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে তিনটি প্রাণ৷ পরী কোন কথাই শুনছে না৷ নষ্ট করছে কৃষকের সরিষা ক্ষেত।মধ্যবয়স্ক লোকের কাশির শব্দে হাতে জীবন নিয়ে পালানোর চেষ্টা করল চারজন৷ নৌকায় উঠে হাঁপাচ্ছে সবাই৷ পরী ক্ষোভ নিয়ে বলল,

“তোদের কত করে বললাম সরিষা ক্ষেত নষ্ট না করতে৷ ধরতে পারলে সবাইকে বেঁধে রাখত৷”

দৌড়ানোর জন্য কুহুর চশমা সরে যায়৷ কুহু চশমা ঠিক করতে করতে বলল,

“দোস্ত যাই বলিস না কেন? আমার অনেক ভালো লেগেছে৷ লোকটা না আসলে আমি আরও একটু দৌড়াতে পারতাম৷”

ছোঁয়া চোখ বড় বড় করে বলল,

“তোকে ওই লোকটার সাথে বিয়ে দিলে সারাদিন দৌড়াতে পারবি৷ তখন আমরাও দৌড়াতে পারব৷”

সমাপ্তি ওড়নার ভাজ থেকে সরিষা ফুল বের করতে করতে বলল,

“দেখ, আমি অনেক ফুল ধরেছি৷ হলুদ রঙের সরিষা ফুল অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে।”

ছোঁয়া সরিষা ফুল নিতে নিতে বলল,

“সরিষা ফুল দিয়ে ডিম ভাজি খেতে ভীষণ ভালো লাগে৷ সবগুলো রেখে দে৷ সবাই সরিষা ফুল দিয়ে ডিম ভাজি করে খেতে পারব৷”
_______________

হাসি খেলে কেটে গেল দু’দিন৷ যেন চোখের পলকে কেটে গেল৷ কেউ বুঝতে পারল না। থাকার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও গ্রাম পঞ্চায়েতের খারাপ নজর থেকে বাঁচার জন্য ঢাকায় পাঠিয়ে দেন আয়েশা বেগম৷ আইয়ুব আলীর উদ্দেশ্য হলো পরীকে শ্যামলের বউ করার৷ মূলত নির্বাচনে জয়লাভের জন্য এমন নোংরা খেলায় মেতে উঠতে চেয়েছিলেন৷ বিদায়ের ঘন্টা কারোর জন্য৷ ভালো হলো না৷ সমাপ্তি দুইদিন মায়ের ভালোবাসা পেয়েছে৷ যাওয়ার পথে আয়েশা বেগমকে জড়িয়ে ধরে কান্না করেই যাচ্ছে৷ সামান্য ভালোবাসা পাওয়ার জন্য মানুষের মাঝে কত ত্যাগ কত মায়া কত অজানা গল্প।
_______

আয়েশা বেগম আইয়ুব আলী বাড়ি থেকে আজ একা ফিরছেন৷ কিছুদিন হলো আরিফ গ্রামে ফিরে এসেছে৷ আয়েশা বেগমের পথ আটকিয়ে বলল,

“গ্রামে ছিলাম না বলে অনেক কিছু করেছেন৷ এখন দেখবেন আরিফ কি করে? আরিফকে যে মাঠে বেঁধে রেখেছিলেন। আপনাকেই সেই মাঠে বেঁধে রাখব৷ অপবাদ দিয়ে গ্রাম ছাড়া করাব৷ মুখ দেখাতে পারবেন না৷ কলঙ্ক করে দিব।”

আয়েশা বেগম কষিয়ে থাপ্পড় বসিয়ে দিল৷ রাগে সমস্ত গা থিরথির করছে৷ রাতে শীতের রাতেও শরীর থেকে ঘাম ঝরছে। ঘৃণার সাথে বলেন,

“আমি বাতাসে বড় হয়নি৷ জীবনের সাথে যু্ক্ত করে বড় হয়েছি৷ আমার সাথে ভদ্রতা বজায় রেখে কথা বলবে৷ নয়তো খুন করে ফেলব৷ কোন প্রমাণ থাকবে না৷”

আরিফ ত্যাড়ে আয়েশা বেগমের কাছে গেলে আরও একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল৷ পুনরায় বলল,

“দুর থেকেই কথা বল৷ কাছে আসলে এখনই জাহান্নামের টিকেট কেটে দিব৷ মেয়ে বলে অবহেলার পাত্রী নয়৷”

আরিফ আঙুল তুলিয়ে বলল,

“নির্বাচনের পর্যন্ত তুই এই সুন্দর পৃথিবী দেখতে পারবি৷ নির্বাচন শেষ মানে তোর নিঃশ্বাস পর্যন্ত পাওয়া যাবে না৷ জাহান্নাম কাকে বলে? আমি দেখাব!”
_____________

নির্বাচন প্রচারে দলে দলে লোক ছড়িয়ে পড়েছে৷ কৃষক কৃষাণীদের দুয়ারে চলে গেছেন আইয়ুব আলী। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে বিরোধী দলকে বসিয়ে রেখেছে৷ প্রচারে করতে দেখলেই তাদের দলের কেউ না কেউ মারা যায়৷ এমনভাবে খুন করে তার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়না৷ মানুষকে সভায় ঢেকে বিরোধী দলের চক্রান্ত বলে চালিয়ে দেয়৷ ভয়ে বিরোধী দল প্রচার কাজ থেকে বিরত থাকে৷

দেখতে দেখতে চলে আসে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনে আইয়ুব আলী জয়লাভ করেন৷ বাড়িতে নানারকমের আয়োজন। গরু জবাই করে সাধারণ জনগনকে খাওয়ানো হয়৷

নির্বাচনের পর আইয়ুব আলীর ভালো মানুষের মুখোশ বেরিয়ে আসে৷ শ্যামলকে গার্মেন্টসের কাজে গাজীপুর পাঠিয়ে দেন৷ শ্যামল গ্রামে থাকলে এসব কাজের প্রতিবাদ করবে৷ শুরু হয় গরীব মানুষের উপর অমানবিক অত্যাচার৷ গরিবের গরু নিয়ে এসে জবাই করে, হাঁটে বিক্রি করছে আরিফ৷ প্রতিবাদ করতে আসলে প্রহরী দিয়ে হাত পা ভেঙে দিচ্ছে৷ ভয়ে ভয়ে জীবন পার করছে গ্রামের অসহায় মানুষ৷

আয়েশা বেগমের চোখ লেগে আসতেই কেউ ঘুমের মাঝে হানা দেয়৷ আয়েশা বেগমের সম্মানের উপর হানা দেয়৷ আয়েশা বেগম বুঝতে পারে বাহিরে লোকজন আছে৷ মূলত সম্মান হানী নয়৷ সমাজের চোখে কলঙ্ক করে দিবে৷ বাহির থেকে আরিফের আওয়াজ শুনা যাচ্ছে৷ সবাইকে উঁচু স্বরে বলছে,

“আপনাদের ম্যাডাম ঘরটাকে প্রতিতালয় বানিয়েছে৷ রাত হতেই পুরুষ মানুষকে ঘরে তুলে৷ এসব দেখেই পলক হোসাইন আর একটা বিয়ে করেছে৷”

আয়েশা বেগম নিজের সম্মান বাঁচাতে ঘরে ঢুকা লোকটার উপর আক্রমণ করে৷ লোকটার চিৎকারে ঘরের কপাঠ ভাঙার চেষ্টা করছে৷ কপাট ভাঙার আগেই এলোপাতাড়িভাবে রামদা দিয়ে লোকটার উপর আঘাত করছে৷ অন্ধকার ঘরে বুঝতে পারছে না লোকটি কে? লোকটির চিৎকার বন্ধ হলে আয়েশা বেগম লন্ঠন জ্বালিয়ে দরজা খুলে বাহিরে আসেন৷ সমস্ত গ্রামের মানুষ জড়ো হয়ে গেছে৷ আরিফ আয়েশা বেগমকে দেখে চমকে উঠে৷ যেন রক্ত দিয়ে স্নান করে আসলেন৷ সমস্ত দেহে রক্ত লেগে আছে। আয়েশা বেগম রাগী গলায় বলল,

“ভুল মানুষকে কলঙ্ক করতে এসেছিলেন৷ আমি আয়েশা বেগম। পাক হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছি৷ সেখানে এসব বাচ্চা আমার কলঙ্ক করবে৷ যে লোক আমায় কলঙ্ক করতে আসছিল তার জীবনকে শেষ করে দিয়েছি৷ খুন করেছি তাকে৷”

কারো মুখে কোন কথা নেই৷ কয়েকজন লোক দৌড়ে ঘরে ঢুকে৷ জামিলকে ধরে নিয়ে আসে৷ জামিল আইয়ুব আলীর ডানহাত বলা চলে৷ সকল খারাপ কাজে জামিলকে দেখা যায়৷ আইয়ুব আলীর দিকে এগিয়ে এসে বলল,

“আমার নামে পুলিশ ক্যাস করবেন না নতুন এমপি সাহেব৷ সম্মান বাঁচাতে খুন করেছি এতে আমার জেল হবে না৷ জেল হলে আপনার হবে৷ গ্রামের লোক জানে জামিল কার কাজ করে৷”

আইয়ুব আলী মাথা নিচু করে চলে যায়৷ জামিলের লাশ কলা গাছের ভেলা বানিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দেয়৷

আয়েশা বেগম গ্রামবাসীদের উদ্দেশ্যে বলেন,

“নিজের সম্মান বাঁচাতে এসব নর পশুদের খুন করে ফেলেন৷ ধর্ষকের বেঁচে থাকার অধিকার নেই।”
________

কেউ ভালোভাবে রাত্রি যাপনও করতে পারছেন না৷ এমপি হওয়ার পর অত্যচার অনেক বেড়ে গেছে৷ লোকমুখে শুনা যায়, মাঝে মধ্যে নদীতে লাশ ভেসে যেতে দেখা যাচ্ছে৷ বেশির ভাগ লাশ মেয়ে৷ আয়েশা বেগম এসব ভাবনায় আর ঘুমাতে পারছেন না৷ যতগুলো লাশ পাওয়া গেছে সবই পাশের গ্রামের৷ সাবালিকা মেয়েরা স্কুলে যেতে ভয় পাচ্ছে৷ দিনের আলো ফুটতেই আয়েশা বেগম বেরিয়ে পরেন সেসব মেয়ের খুঁজ নিতে৷ সবথেকে বেশি সন্দেহজনক হচ্ছে মানুষের অর্গান নিয়ে৷ ধর্ষণের পর দেহ থেকে ভিতরের অঙ্গগুলে খুলে নিচ্ছে কেন? কেউ কি এগুলোর ব্যবসা করছে?

আয়েশা বেগম সকলের বাড়িতে ঘুরেও কোন উত্তর পেল না৷ ধর্ষণের কাজ হলে আরিফ জড়িত থাকত৷ দেহের অঙ্গ নিয়ে ব্যবসা করার মতো নয়৷ তাছাড়া এই গ্রামে উন্নতি প্রযুক্তি নেই যে, সেগুলো বিক্রয় উপযুক্ত রাখবে৷ বেশির ভাগ মানুষ কবিরাজের উপর নির্ভর করে৷ শূন্যে ঢিল ছুঁড়ে মারার জন্য আয়েশা বেগম গ্রাম পঞ্চায়েতের বাড়িতে যান৷ কিন্তু আয়েশা বেগমকে বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি৷ গেইট থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে৷

আর কিছু ভাবতে পারছে না৷ শরীর খুব অবশ লাগছে৷ তীব্র মাথা ব্যাথায় খোলা বারান্দার চৌকির উপর ঘুমিয়ে পড়েন৷ ঘুম থেকে উঠে দেখেন অনেক রাত৷ আকাশে থালার মতো ঝলমলে চাঁদ। মনটা ভালো করার জন্য নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন৷ আর সেখানেই রহস্যের সন্ধ্যান পান৷

চলবে……

কে বাঁশি বাজায় রে পর্ব-১১+১২

0

#কে_বাঁশি_বাজায়_রে
#পর্ব_১১
#নুর_নবী_হাসান_অধির

সুখের জোয়ারে আনন্দ পুরের সকল জনগন৷ শিক্ষার দিক থেকে সবাই এগিয়ে যাচ্ছে৷ কাঁধে কাঁধ রেখে কাজ করে যাচ্ছে৷ সন্ধ্যায় সময়মতো নিজেকে পাঠ্যদান সম্পুর্ন করছে৷ রেষারেষির রেশ অনেক আগেই কেটে গেছে৷

আইয়ুব আলী নিজের গ্রামে নয়৷ ঘুরে ঘুরে পাশের গ্রামেও যারা লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত তাদের লেখাপড়া করার জন্য উৎসাহিত করেছেন৷ কৃষকদের বীজ সার দিয়ে কৃষি কাজে সাহায্য করছে৷ নিত্য নতুন ভালো কাজের সাক্ষী হচ্ছে জনগন৷ আইয়ুব আলীর এমন পরিবর্তন সকলের মনে ভালোবাসার বীজ জন্ম নিয়েছে৷ দিন দিন তাঁর সম্মান গ্রাম থেকে গ্রাম ছড়িয়ে যাচ্ছে৷ দূর দূরান্তেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে৷
_______

লন্ঠনের আলো কমিয়ে রাতের আঁধারে নিরিবিলি মনের সুখে নৌকা বাইছে আয়েশা বেগম৷ এখন আর নদীতে আসতে ইচ্ছা করে৷ ভালোবাসার মানুষগুলো অনেক দূরে৷ ছয় মাস পর পরীর চিঠি এসেছে৷ সেই আনন্দে নিরিবিলি পরিবেশের খুঁজে নৌকা নিয়ে বের হওয়া৷ শান্ত নদী৷ হালকা স্রোত বয়ে যাচ্ছে৷ শীতল হাওয়া গায়ে কাটা দিচ্ছে৷ শান্ত নদীতের মাঝখানে বৈঠা দিয়ে নৌকা থামিয়ে নিল৷ অতি যত্নসহকারে চিরকুট বের করল৷ জ্যােংসার আলোয় ছলমল করছে স্বচ্ছ নদীর জল৷ অনুভূতি নীড়ে ফিরে গেছে৷ চিঠির ভাজ খুলতে ভীষণ ভয় হচ্ছে৷ চোখে টলমল পানি৷ শুকনো ঠোঁট। অশান্ত হৃদয় আর চিঠি খুলতে পারল না৷ মন খারাপ করে চিরকুট রেখে দিল৷ মনে মনে বলল,

“নিরবে নিভৃতে তোর চিঠি খুলে সিদ্ধ ভালোবাসার ঘ্রাণ নেওয়া হলো না৷ মনের অনেক ভয়ের আশঙ্কা নাড়া দিচ্ছে৷ মনে হচ্ছে এই বুঝি কোন বিপদ ছুঁয়ে দিল৷ আমি তোকে ছাড়া ভালো নয়৷”

চোখের জল মুছে বাড়ির দিকে যাত্রা শুরু করল৷ নৌকার পাঠা ঘাড়ে পৌঁছার আগে মসজিদ থেকে ফজর আযানের মধুর প্রতিধ্বনি ভেসে যাচ্ছে৷ অশান্ত হৃদয়টা মুহুর্তেই ভালো হয়ে গেল৷

মহান আল্লাহ তায়াল আযানের মাধ্যমে আরও একটা সুন্দর দিনের সূচনা করলেন৷ মুসলিম জাতির জন্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুর আযানের ধ্বনি৷ ফজরের আযানে একটি বাক্য যুক্ত করা হয়৷

❝আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম❞ যার বাংলা অর্থ ❝ঘুম থেকে নামাজ উত্তম৷❞

ফজরের নামাজ দুনিয়ার সব কিছুর চেয়ে উত্তম : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “ফজরের দুই রাকাত নামাজ দুনিয়া ও তার সব কিছুর চেয়ে উত্তম। ফেরেশতাদের সাক্ষাৎ : ফজরের সময় ফেরেশতাদের পালাবদল হয়। আর এ সময় বান্দা যা কিছু করে ফেরেশতারা আল্লাহর কাছে তা পেশ করেন তা মহান আল্লাহ তায়লা পূরণ করেন৷”

রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, “যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ আদায় করল সে মহান আল্লাহর রক্ষণাবেক্ষণের অন্তর্ভুক্ত হলো…।” (মুসলিম, হাদিস : ১৩৭৯)

ঘাটে থেকে অজু করে এসে নামাজ আদায় করে নিল৷ ভোরের আলো ফুটতেই কপাট খুলে কুরআন তেলাওয়াত শুরু করেন৷ গ্রামের মুসলিম নারীরা সাধারণ ভোরের আলোয় নিজ বাড়ির ভিটায় পড়তে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করে৷ কুরআন তেলাওয়াতের পর মন থেকে সব ভয় কেটে যায়৷ আয়েশা বেগম চিরকুট খুলেন,

ভালোবাসার মা,
আসসালামু আলাইকুম। প্রথমে আমার সালাম নিবেন৷ আল্লাহর রহমতে আমি ভালো আছি৷ মানসিকভাবে একটুও ভালো নেই৷ তোমায় ছাড়া আমার দিন কাটে না৷ তোমায় ছাড়া আমার চোখ মরুভূমি হয়ে গেছে৷ ভালোবাসার আদ্রতায় ভেজা গহীন বুকে ভালোবাসার অভাবে খরার পাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে৷ আমি ছাড়া আমি নষ্ট। তোমায় ছাড়া একটা মুহুর্ত কল্পনা করতে পারি না৷ আমি কিছুদিন পরই গ্রামে যাচ্ছি৷ তোমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমাব৷ কতকাল হয়ে গেল কোলে মাথা রেখে ঘুমাই না৷ আমার মাথায় ভিলি কেটে ঘুম পাঠিয়ে দাও না৷ আমি যে খুবই ঘুমের কাঙ্গাল।

জান মা! তোমার সেই ছেট্ট পরীটা আজ অনেক বড় হয়ে গেছে৷ তোমার ছোট্ট মেয়ের জায়গায় হয়নি বাবার বুকে৷ এক বুক কষ্ট নিয়ে তোমার ছোট্ট মেয়ে হলের করিডরে ঘুমাচ্ছে৷ প্রতিনিয়ত অবহেলায় বেড়ে উঠেছে৷ জান মা, আমি এখন শিখে গিয়েছে মাটিতে পড়ে গেলে কারো সাহায্য না নিয়ে একা উঠার৷

তোমার কষ্ট হলে আমি সহ্য করতে পারব না৷ তুমি নিজের যত্ন নিবে৷ ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করবে। আল্লাহর কাছে একটাই চাওয়া আমার জনম দুঃখিনী মায়ের কষ্ট দূর করার৷

ইতি,
তোমার ভালোবাসার
ছোট্ট পরী৷

আয়েশা বেগম চিঠি বুকে চেপে ধরল৷ চোখ আজ কোন বাঁধা মানছে না৷ অঝোরে অশ্রুকণা ঝড়ে যাচ্ছে৷ ভালোবাসার যেন মোহ মায়ায় পরিণত হচ্ছে৷ ভীষণ রাগ হচ্ছে পলক হোসাইনের উপর৷ মায়ের মনে কালবৈশাখীর ঝড় বয়ে যাচ্ছে৷
_____________

বাস স্ট্যান্ডের এক কোণায় অধীর আগ্রহে বসে আছেন এক মা৷ তার মেয়ে যে ঘরে ফিরে আসছে৷ শূন্য বুকটা ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দিতে চলে এসেছে৷

পরীর কিছুদিন পর আরও একটা চিঠি পাঠায় মায়ের কাছে৷ যেখানে লেখা ছিল পরী শীতের ছুটিতে বাড়িতে আসছে৷ পরী একা নয়৷ সাথে সাথে সমাপ্তি, কুহু চশমাওয়ালী, ছোঁয়া। সকাল সকাল রান্না শেষ করে বাস স্ট্যান্ড চলে আসেন৷ দীর্ঘ দুই ঘন্টার পর পরীর দেখা মিলে৷ কুহু রাস্তায় দুইবার বমি করে ফেলেছে৷ শহরের মেয়ে হয়েও বাস ভ্রমণ করতে পারে না৷ লোক সমাজে এ কথা জানলে মুহুর্তের মাঝেই রটে যাবে৷

পরী বাস থেকে নেমে চারদিকে এক পলক তাকিয়ে প্রদক্ষিণ করে নিল৷ কাউকে দেখতে পেল না। অবশ্য পাবে কি করে? মা’কে বাস স্ট্যান্ডে আসতে মানা করেছে৷ পরীর ভাবনার মাঝেই আয়েশা বেগম কোথা থেকে উড়ে এসে ঝাপটে ধরে৷ প্রথমে পরী বুঝতে না পারলেও মুহুর্তেই বুঝে নিল সেটা আর কেউ না৷ একমাত্র ভালোবাসা। পরীর জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল৷ মা মেয়ের মিলন যেন ভালোবাসায় পরিপূর্ণ।
____________

পড়ন্ত সূর্যের লালচে আলোয় নৌকা নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে চার বান্ধবী। কুহু আহ্লাদী স্বরে বলে উঠে,

“মানুষ কি নদীতে গোসল করে৷ আমিও নদীতে নদীতে গোসল করব৷ চলনা আমরা সবাই একদিন গোসল করি৷”

সমাপ্তি কুহুর আহ্লাদী স্বরের জবাব দিলে,

“নদীতে মানুষ গোসল করে না৷ তোর মতো কিছু বলদ আছে তারা গোসল করে৷”

কুহু কাঁদু কাঁদু ভাব নিয়ে বলল,

“পরী সমাপ্তিকে কিছু বলবি না! কিছু না বললে এখানেই সবকিছু সমাপ্ত করে দিব।”

ছোঁয়া কুহুর চশমা হাতে নিতে নিতে বলল,

“এখনই সবকিছু সমাপ্ত হোক৷ তোকে ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দিব৷ তুই সাঁতার জানস না৷ এখন মইরা যাবি৷ চশমা রেখে দিলাম৷ মরার পর দেখা হলে দিয়ে দিব৷”

ছোঁয়ার কথায় সমাপ্তি, পরী দু’জনেই হেঁসে উঠল৷ পরী নৌকায় একটু ঝাঁকি দিয়ে বলল,

“আমাদের গ্রামের নব্বই শতাংশ মানুষ নদীতে গোসল করে৷ শুধু খাওয়ার পানি চাপ কল থেকে নিয়ে আসা হয়৷ গ্রামে যারা উচ্চ বিত্তবান মানুষ তারা শুধু চাপ কলের ব্যবহার করেন। আর সবাই নদীতে গোসল করি৷”

কুহু চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল,
“খোলা মাঠে মেয়েরা কিভাবে গোসল করে? কোনদিন সম্ভব নয়৷”

“গ্রামের যুবতী মেয়ে বউরা নদী থেকে পানি নিয়ে বাড়িতে গোসল করে৷ সবার বাড়িতে গোসল করার জন্য আলাদা একটা জায়গা আছে৷”

হঠাৎ করেই তাদের নৌকার সামনে চলে আসল..

চলবে….

#কে_বাঁশি_বাজায়_রে
#পর্ব_১২
#নুর_নবী_হাসান_অধির

হঠাৎ করেই নৌকার সামনে বড় একটা ট্রলার চলে আসল৷ বর্তমানে তাদের নৌকা নদী পথের মাঝখানে৷ এখানে নদীটা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে৷ যার জন্য স্রোতের প্রকোপ অনেকটা বেশি৷ ট্রলারের টেউয়ে নৌকা দুলছে৷ ভয়ে কাবুকাত চোখ জোড়া চোখ৷ পরী বুঝতে পারেরি কখন এতোদূর এসে পড়েছে৷ ট্রলার থেকে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার নদীর মাঝে একটা বস্তা ফেলে চলে যায়৷ ট্রলারটা খুব দ্রুত গতিতে চলে যায়৷ নিজেরা কিছু একটা থেকে লুকানোর জন্য এমন করছে৷ পাশে চার জোড়া চোখের দেখা মিলেনি৷
ছোঁয়া চিৎকার করে বলল,

“পরী নদীর মাঝখানে একটা বস্তা ফেলে গেল৷ নৌকা ঘুরিয়ে ওখানে নিয়ে যায়৷ পরী নৌকা ঘুরিয়ে নিয়ে গেল৷ বৈঠা দিয়ে নদীর তল খুঁজে পেল না৷ পরী সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,

” আমি নদীতে নামছি৷ তোরা কেউ কোন কথা বলবি না৷ তোরা কেউ নৌকা চালাতে পারিস না, এমন কিছু করবি না যেন স্রোতের টানে কোথাও চলে যান৷”

পরী ঝাপ দিয়ে কিছুক্ষণের মাঝে নদীর তলদেশ থেকে বস্তটি তুলে আনল৷ পানিতে সাধারণত প্রতিটি বস্তুর ওজন ভারসাম্য অবস্থায় থাকে৷ সবাই মিলে বস্তা নৌকায় তুলল৷ বস্তা খুলে মাঝবয়সী একজন মেয়েকে দেখতে পেল৷ কুহু আতঙ্কে চিৎকার করে ঘটনা স্থলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে৷ মেয়েটিকে দেখে বুঝা গেল প্রথমে নরপশুর দল মেয়েটিকে ধর্ষণ করেছে৷ তারপর শরীরের সমস্ত অর্গান নেওয়া হয়েছে৷ ছোঁয়া ভয়ে ভয়ে বলল,

“পরী আমার ভীষণ ভয় লাগছে৷ তুই তাড়াতাড়ি একে নদীতে ফেলে দে৷ কেউ দেখে নিলে অনেক বড় সমস্যা হবে৷”

সমাপ্তি ভয়ে চুপসে আছে৷ বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে৷ এমন দৃশ্য সিনেমা থিয়েটারে মানায়৷ বাস্তবে এমন কিছু ঘটবে বুঝতে পারেনি৷ পরী মেয়েটিকে পুনরায় বস্তা ভরে নদীতে ফেলে দিল৷ বিপদের আঁচ বুঝতে পেরে দ্রুত গতিতে নৌকা বাড়ির দিকে ঘুরিয়ে ফেলে৷ নদী পথে আর কেউ কথা বলেনি৷ মাঝপথে কুহুর জ্ঞান ফিরে আসে৷ ঘাটে নৌকা বেঁধে পরী সকলের উদ্দেশ্য বলল,

“আজ আমরা চারজন যা কিছু দেখেছি তা কোনদিন কাউকে বলবি না৷ এই বিষয়টা মাথা থেকে ঝেরে ফেলে দে৷”
__________

রাতের খাবার শেষে উঠানে মাদুর বিছিয়ে সকলে গল্প করছে৷ ক্যাম্পাসে কে কেমন? কার সাথে মিশতে ভালো লাগে? কে কতটা শয়তানি করে? সবাই পরীর নামে অভিযোগ করছে৷ আয়েশা বেগম মেয়েদের বাচ্চা বাচ্চা কথাগুলো মন দিয়ে শুনছেন৷ ভীষণ ভালো লাগছে৷ অনেক দিন পর সবার সাথে মন খুলে কথা বলছেন৷ সমাপ্তি পরীর মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে৷

সমাপ্তি মেয়েটা আদরের জন্য পাগল৷ একটু আদর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য চাতক পাখির মতো আকাশ প্রাণে তাকিয়ে থাকে৷ মা মরা মেয়েটা মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত। আয়েশা বেগমের ভালোবাসায় একদম বাচ্চা হয়ে গেছে৷ কোমর জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে৷ আয়েশা বেগম দুই হাতে আগলে রেখেছেন সমাপ্তিকে৷

তাদের মুখ রচিত গল্পের মাঝে গ্রাম পঞ্চায়েত আইয়ুব আলী উপস্থিত হোন৷ বাড়িতে প্রবেশের আগে আইয়ুব আলী একজন মহিলাকে পাঠান৷ আয়েশা বেগম সবাইকে ঘরে যাওয়ার আদেশ দেন এবং আইয়ুব আলীকে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করতে বলেন৷

আইয়ুব আলীর জন্য চেয়ার নিয়ে আসা হলো৷ আইয়ুব আলী আয়েশ করে চেয়ারে বসলেন৷ বসতে বসতে বলে উঠলেন,

“আপনার কাছে একটা পরামর্শ নিতে এসেছি৷ আপনার পরামর্শ ছাড়া এখন কোন কাজ করিই না৷”

আয়েশা বেগম বুঝার চেষ্টা করলেন কিসের জন্য রাতে এসেছে? কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলেন না৷ অবুঝের মতো আইয়ুব আলীর দিকে তাকিয়ে আছে৷ আইয়ুব আলী পুনরায় প্রশ্ন করলেন,

“আমায় সাহায্য করবেন তো৷ আপনার কাছ থেকে সাহায্য নিতে এসেছি৷”

আয়েশা বেগম এদিক ওদিক এক পলক তাকিয়ে নিলেন৷ মেয়েরা সবাই ঘরে প্রবেশ করেছে কিনা৷ বাহিরে কাউকে দেখতে না পেয়ে স্বস্থির নিঃশ্বাস নিলেন৷ আইয়ুব আলীর দিকে তাকিয়ে বললেন,

“আপনি গ্রামের জন্য ভালো কাজ করছেন৷ সকালে ছেলেমেয়ে জন্য মক্তবের ব্যবস্থা করেছেন৷ সবাই মধুর কন্ঠে কুরআন পাঠদানের শিক্ষা পাচ্ছে৷ আপনি পৃথিবীর সবথেকে মহান কাজ করেছেন৷ আপনাকে তো সাহায্য করতেই হবে৷”

কুরআন শিক্ষার কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক:-
কুরআন (القرآن) শব্দের অর্থ পঠিত। যা সবকিছুকে শামিল করে। আর কুরআনকে ❝কুরআন❞ এজন্যই বলা হয় যে, তাতে শুরু-শেষ, আদেশ-নিষেধ, বিধি-বিধান, হালাল-হারাম, প্রতিশ্রুতি-ধমক, শিক্ষণীয় ঘটনাবলী, উপদেশ, দুনিয়া ও আখিরাতের সবকিছুর ইঙ্গিত রয়েছে। আর সেসাথে রয়েছে আয়াত গুলো একে অপরের সাথে অনন্য সমন্বয় ও সুসামঞ্জস্য।

সমাজে বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ রয়েছেন। সকল শ্রেণী ও পেশার লোকদের চাইতে কুরআন শিক্ষাগ্রহণকারী ও শিক্ষাদানকারীগণ সর্বশেষ্ঠ মানুষ হিসাবে পরিগণিত। ওছমান (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন,خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ- “তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সেই ব্যক্তি, যে নিজে কুরআন শিখে ও অন্যকে শিখায়।” অন্য বর্ণনায় এসেছে,إِنَّ أَفْضَلَكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ- ❝নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সেই ব্যক্তি, যে কুরআন শিক্ষা করে ও অন্যকে শিখায়।❞ কুরআন নিয়মিত তেলাওয়াত করতে হবে এবং এর সঠিক মর্ম অনুধাবন করে তদনুযায়ী জীবন গঠন করতে হবে।

বিশুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াত করা জরুরি। কুরআন তেলাওয়াতের সময় মাখরাজ সমূহ সঠিকভাবে উচ্চারণ না করলে বা তাজবীদের নিয়ম পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ না করলে অনেক সময় আয়াতের মর্ম পরিবর্তন হয়ে যায়। যাতে পাপ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। ধীরে-সুস্থে ও বিশুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াত করা জরুরি। যেমন আল্লাহ বলেন, وَرَتِّلِ الْقُرْآنَ تَرْتِيلاً- ❝আর কুরআন তেলাওয়াত কর ধীরে ধীরে, সৌন্দর্যমন্ডিত পন্থায়।❞(মুযযাম্মিল ৭৩/৪)। তিনি আরও বলেন, وَرَتَّلْنَاهُ تَرْتِيلاَ- ❝আর আমরা তোমার উপর পর্যায়ক্রমে সুন্দরভাবে কুরআন নাযিল করেছি।❞ (ফুরক্বান ২৫/৩২)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,حَسِّنُوا الْقُرْآنَ بِأَصْوَاتِكُمْ، فَإِنَّ الصَّوْتَ الْحَسَنَ يَزِيدُ الْقُرْآنَ حُسْنًا- ❝তোমরা তোমাদের কণ্ঠস্বরের দ্বারা কুরআনকে সৌন্দর্যমন্ডিত কর। কেননা সুমধুর কণ্ঠস্বর কুরআনের সৌন্দর্যকে আরও বৃদ্ধি করে দেয়।❞

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিভিন্ন সময় ছাহাবায়ে কেরামকে নানা উদাহরণের মাধ্যমে দ্বীন শিক্ষা দিতেন। যেমনটি তিনি অন্যান্য মুমিনের চাইতে কুরআন তেলাওয়াতকারী মুমিনের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনার সময় শিক্ষা দিয়েছিলেন। আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَثَلُ الْمُؤْمِنِ الَّذِى يَقْرَأُ الْقُرْآنَ كَمَثَلِ الأُتْرُجَّةِ رِيحُهَا طَيِّبٌ وَطَعْمُهَا طَيِّبٌ، وَمَثَلُ الْمُؤْمِنِ الَّذِى لاَ يَقْرَأُ الْقُرْآنَ كَمَثَلِ التَّمْرَةِ لاَ رِيحَ لَهَا وَطَعْمُهَا حُلْوٌ، وَمَثَلُ الْمُنَافِقِ الَّذِى يَقْرَأُ الْقُرْآنَ مَثَلُ الرَّيْحَانَةِ رِيحُهَا طَيِّبٌ وَطَعْمُهَا مُرٌّ، وَمَثَلُ الْمُنَافِقِ الَّذِى لاَ يَقْرَأُ الْقُرْآنَ كَمَثَلِ الْحَنْظَلَةِ لَيْسَ لَهَا رِيحٌ وَطَعْمُهَا مُرٌّ- ❝যে মুমিন কুরআন তেলাওয়াত করে, সে হলো উৎরুজ্জা ফলের (কমলালেবুর) ন্যায়। ফলটি সুগন্ধিযুক্ত এবং স্বাদও উত্তম। আর যে মুমিন কুরআন তেলাওয়াত করে না, তাঁর উদাহরণ হলো খেজুরের ন্যায়। যার ঘ্রাণ নেই কিন্তু সুস্বাদু। আর যে মুনাফিক কুরআন তেলাওয়াত করে, সে হলো রায়হানা (লতানো) ফুলের ন্যায়। যা সুগন্ধিযুক্ত, কিন্তু স্বাদ তিক্ত। যে মুনাফিক কুরআন তেলাওয়াত করে না, সে হলো মাকাল (লতানো লেবুজাতীয় তিক্ত) ফলের ন্যায়। যার ঘ্রাণ নেই এবং স্বাদও তিক্ত।❞

[বি.দ্র. ❝উম্মে ফারজানা চৌধুরী❞ নামক পাঠক আমায় এগুলো লিখে দিয়েছেন৷ গতকালের পর্ব পোস্ট করার পর তিনি বলেন এগুলোর সাথে আরবি থাকলে ভালো হতো৷]

আইয়ুব কিছুটা বিরক্তি নিয়ে শুনলেন৷ আয়েশা বেগমের কথা শেষ হওয়াতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,

“জাতীয় সংসদ নির্বাচন চলে এসেছে৷ আমি নির্বাচনে এমপি পদে দাঁড়াচ্ছি৷ ওইদিকে মোল্লা সাহেবও দাঁড়াচ্ছেন৷ মানুষদের জন্য এতো কিছু করছি তারা কি আমায় এমপি বানাবে না৷”

আয়েশা বেগম মুচকি হেঁসে বলল,

“যে ব্যাক্তি গরিব মানুষকে সাহায্য করেন৷ স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা তাকে সাহায্য করেন৷ আপনার সুনাম শুধু আমাদের গ্রামে নয়৷ সব জায়গায় আপনার সুনাম রয়েছে৷ আপনি নিশ্চয় বিজয় লাভ করবেন৷”

প্রাণ ভরে শ্বাস নিয়ে বলল,

“আমার গ্রামের লোকজন আমার কাছে অমূল্য ধন৷ তাদের ভালোবাসা পেয়ে আমি সত্যিই বিমোহিত। এতোদিন অনেক অন্যায় করেছি৷ আরিফ, আসিফ আমার কথা বলে অনেক অন্যায় করেছে৷ আমার ভীষণ ভয় হয়৷ তাদের অন্যায়ের জন্য আমাকে দূরে ঠেলে দিবে না তো৷”

“গ্রামের কৃষক কৃষাণীরা হলো কাঁদা মাটি৷ আপনি তাদের যে রুপ দিবেন তারা সেই রুপে রাঙিয়ে উঠবে। আসিফ, আরিফ অন্যায় করেছে৷ আসিফ নিজের অন্যায়ের শাস্তি পেয়েছে৷ আরিফ এখন গ্রামে নেই৷ সে ঢাকায় আছে৷ গ্রামের লোকদের জড়ো করে সকল বিষয় খুলে বললে তারা বুঝতে পারবে৷ গ্রামের লোকদের ভয় নয়৷ ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখতে হয়৷”

আইয়ুব আলী শ্যামলের দিকে এক পলক তাকিয়ে বলল,
“আপনার কাছে আরও একটা আবদার নিয়ে এসেছি৷ আপনি দয়া করে আমাকে ফিরিয়ে দিবেন না৷”

আয়েশা বেগম সন্দিহান দৃষ্টিতে বাপ ব্যাটার দিকে তাকাল৷ শ্যামল মাথা নিচু করে ফেলে৷ চোখে মুখে লজ্জার ভাব স্পর্শ। কিছুটা অস্বাভাবিক কন্ঠে বলেন,

“আমার কাছ থেকে কি চান? দেওয়ার মতো আমার কাছে কিছুই নেই৷”

“আমি আপনার কাছ থেকে মহান মূল্যবান জিনিসটাই চাইব৷ আপনি সেটি খুব যত্নে আগলে রেখেছেন প্রতিনিয়ত।”

আইয়ুব আলী আরও কিছু বলতে চেয়েছিল৷ তার আগেই থামিয়ে দিয়ে বলল,

“কাজের কথায় বলেন৷ ভূমিকা, সংলাপ, বিবর্তন বাদ দিয়ে কাজের কথা বলেন৷”

“আরিফকে অনেক আগেই বিয়ে করানো হয়েছে৷ শ্যামল বিবাহযোগ্য ছেলে৷ সরকারি ভালো চাকরি করে৷ আমি পরীকে অনেক আগেই আসিফের বউ করে নিতে চেয়েছিলাম৷ ভাগ্যের পরিহাসে সবকিছু উল্টাপাল্টা হয়ে গেছে৷ আমার শ্যামলের জন্য পরীকে আপনার কাছে চাই। শ্যামল অনেক ভালো ছেলে৷ আরিফের মতো নয়৷”

আয়েশা বেগম সোজাসাপ্টা উত্তর দিলেন,

“শ্যামলের জন্য অনেক ভালো মেয়ে খুঁজে পাবেন৷ আমি এখন পরীকে বিয়ের জন্য জন্য জোর করতে পারব না৷ একবার জোর করে রাজি করিয়েছিলাম৷ আর পারব না৷ এখন আপনারা আসতে পারেন৷”

আইয়ুব আলী আবারও অপমান হলেন৷ তবুও হাল ছাড়লেন না৷ বসা থেকে দাঁড়িয়ে বলল,

“শ্যামল পরীকে অনেক ভালোবাসে৷ তাকে সব সময় আগলে রাখবে৷”

“আমি জানি পঞ্চায়েত মশাই৷ সেটা ভালোবাসা বলে না৷ শ্যামল ভালোবাসা আর মোহ এর মাঝে পার্থক্য জানে না৷ এটাও জানি শ্যামল পরীর জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকত৷ কখনও বটগাছের নিচে৷ কখনও স্কুলের সামনের দোকানে৷ কখনও আবার দীঘিনালা মন্দিরের সামনে৷”

আইয়ুব আলী শ্যামলের দিকে তাকালে শ্যামল মাথা নিচু করে ফেলে৷ যার অর্থ আয়েশা বেগম সবকিছু ঠিক বলেছে৷ আইয়ুব আলী বলল,

“ভালোবাসে জেনেও না করে দিলেন৷ পৃথিবীতে সবকিছুর ঊর্ধ্বে ভালোবাসা। ভালোবাসার মানুষকে আলাদা করার মতো পাপ আপনি করতে চাচ্ছেন৷”

“মেয়ের ভালোর জন্য এমন শতশত পাপ কাজ করতে পারি।”
কঠিন গলায় ক্ষোভ নিয়ে বলেন,
“এখনই আপনার ছেলেকে নিয়ে চলে যান৷ সাথে আপনার সাথে যারা এসেছে সবাইকে নিয়ে যান৷ আমি এখানে একা থাকি৷ এতোরাত অব্ধি কাউকে আমার বাড়িতে থাকার অনুমতি দিব না৷”

আইয়ুব আলী চোখ গরম করে ছেলের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলেন,

“ভালোভাবে কিছুই পাওয়া যাইনা৷ আঙ্গুল বাঁকালে সবই পাওয়া যায়৷”
__________

পাখির কিচির মিচির শব্দে সবার ঘুম ভাঙে৷ প্রচন্ড শীতে সবাই কাঁপছে। শহরের তুলনায় গ্রামে প্রচুর শীত৷ কুয়াশার চাদরে ঢাকা সমস্ত গ্রাম। পরী সবাইকে টানতে টানতে নদীর পাড়ে নিয়ে আসল৷ ঘাসের উপর শিশির জমে আছে৷ মুক্তর দানার মতো ঝলমল করছে৷ ছোঁয়া চোখ ঠলতে ঠলতে বলল,

“আমি কবি হলে, ‘ঘাসের ডগার উপর শিশির বিন্দু জমে থাকা দেখে কবিতা রচয়িতা করতাম৷’ বিন্দু বিন্দু শিশির ফোঁটা ঘাসের ডগায় মুক্ত দানার মতো৷ নদীর শীতলতম হাওয়া চার রমনী৷ অল্প সময়ের চোখের পাপড়ি দেশে শিশির বিন্দু জমে যাচ্ছে।”

সমাপ্তি বিরক্তি নিয়ে বলল,

“তুই কবি হলে তোর কবিতা কুত্তাও পড়বে না৷ মানুষের আর কোন কাজ নেই৷ মানুষ কবি ছোঁয়া রবীন্দ্রনাথের গল্প, কবিতা পড়বে৷”

কুহু ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে বলল,

“সমাপ্তি তুই কি জানিস? মানুষের মাঝে প্রতি নিয়ত প্রতিভা দেখা দেয়৷ ছোঁয়া প্রতিটি প্রতিভায় প্রতিভাবান।” হুট করেই চকিত গলায় বলল,
“ওই দিকে দেখ পরী খালী পায়ে ঘাসের উপর হাঁটছে। এটাও একটা প্রতিভা৷”

সমাপ্তি গায়ে চাঁদর ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়ে বলল,

“তোর কাছে যত প্রতিভা আছে সব গরু চোরের৷ তোর প্রতিভা দেখার সময় নেই৷”

পরী সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল…..

চলবে….

কে বাঁশি বাজায় রে পর্ব-১০

0

#কে_বাঁশি_বাজায়_রে
#পর্ব_১০
#নুর_নবী_হাসান_অধির

আশালতা কিছুতেই পরীর অপমান সহ্য করতে পারল না৷ তিনি পরীকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার জন্য সকল প্রকার প্রচেষ্টা করে৷ পলক হোসাইন কিছুতেই পরীকে বাসা থেকে বের করে দিবেন না। এগুলো পরী নিতে পারছে না৷ পরী সকলের সামনে বলল,

“আমাকে নিয়ে তোমাদের কোন চিন্তা করতে হবে না৷ আমি হলে উঠব৷ আমি কথা বলে রেখেছি৷”

পলক হোসাইন দুঃখভরা মন নিয়ে বলল,
“কেন তুই হলে থাকবি৷ হলে সব রকম সুবিধা নেই৷ হলের খাবার খেতে পারবি না৷ কেন জিত করছিস?”

আশালতার দিকে তাকিয়ে বলল,
“হলে যাই হোক মানসিক শান্তি আছে৷ যেখানে মানসিক শান্তি নেই সেখানে না থাকা অনেক ভালো৷ মানুষ মানসিক শান্তির জন্য সবকিছু করতে পারে৷ উনি কখন আমায় মেরে ফেলেন জানা নেই৷”

পলক হোসাইন রাগারাগি করে বাসা থেকে বের হয়ে যায়৷ আশালতা ভীষণ খুশী পরী তাদের সাথে থাকবে না৷ পরীও রাগ করে নিজের রুমে চলে যায়৷ আশালতা পরীর পিছন পিছন এসে বলে উঠল,

“তোর মায়ের কাছে চিঠি পাঠানোর ব্যবস্থা কর৷ টাকা পাঠাতে বল৷ এতোদিন যত অন্ন ধ্বংস করেছিস তার টাকা দিয়ে বাসা থেকে বের হবি৷”

পরীর মন খুব খারাপ ছিল৷ ভেবেছিল মায়ের মতো ভালোবাসা পাবে৷ বাবার আদর পাশে৷ ভাইয়ের সাথে হাসি খেলায় দুষ্টুমিতে দিন কেটে যাবে৷ সেখানে তার জীবন হয়ে উঠেছে নরক৷ আশালতার হীন কথায় পরীর ভীষণ রাগ হয়৷ পরী চোখের জল মুখে রুমের দরজা লাগিয়ে দিল৷ আশালতা ভয়ে ভয়ে ভীত গলায় বলল,

“রুমের দরজা লাগালি কেন? দরকা খুল বলছি৷”

“আমার আদরের ছোট মা। তোমাক সকল রকমের পাওয়া দিব। জ্ঞানীরা বলেছেন কখনও ঋণ রাখতে নেই৷”

আশালতা কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই পরী কষিয়ে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে বলল,

“এটা আমার বাবাকে বিয়ে করার জন্য৷ নিজের হিংসাত্মক মেটানোর জন্য এই বিয়ে করেছিলেন৷ আপনার বিষয়ে আমি সব জেনে গেছি৷”

আশালতা বিছানায় ছিঁটকে পড়ে৷ রাগী ভাব নিয়ে উঠলে আরও একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল। পরীর চোখে মুখে প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে৷ আশালতার মুখ চেপে ধরে বলল,

“আমার মাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য এই শাস্তি। বাবা সম্পর্কে খারাপ ধারণা মায়ের কাছে উপস্থাপনেরধ জন্য৷ মায়ের চিন্তা ধারণা অন্য দিকে ঘুরানোর জন্য। তোদের মতো কিছু মেয়ের জন্য বাংলাদেশের প্রতিটি মেয়ে আজ অবহেলিত। তাদের কোথাও কোন কদর নেই৷ তোদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই৷”

আশালতা ক্ষোভ নিয়ে কঠিন কন্ঠে জবাব দিল,

“পরী কাজটা কিন্তু ঠিক করছিস না৷ আমি কি করতে পারি এখনও জানিস না? তোকে গুন্ডা দিয়ে মেরে ফেলতে পারি৷ তোর সম্মানের বারোটা …”

আর কিছু বলার সুযোগ হলো না৷ তার আগেই পরী আরও একটা থাপ্পড় বসাল৷ ক্ষোভ নিয়ে বলল,

“এটা আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য। আমার মা জানতে পারলে তো কষ্ট পাবে জানো৷ কষ্টে নিজেকে বিলুপ্ত করেও দিতে পারে৷ পৃথিবীতে তোমার সবার আছে৷ আমার মা ছাড়া কেউ নেই৷”

ঘৃণার সাথে বলে উঠল,

“কাউকে হিংসা, ঘৃণা করলে তাকে খুন করে ফেল৷ তবুও তার কাছ থেকে ভালোবাসা কেঁড়ে নিবে না৷ ভালোবাসা ছাড়া মানুষটি প্রতিটি মুহুর্তে মা*রা যায়৷ বেঁচে থেকেও জীবন্ত লাশ।”

পরী হুট করেই আশালতার পা ধরে কেঁদে ফেলল। যে কন্ঠে ছিল সিংহের মতো গর্জন এখন সেই কন্ঠ ভেজা বিড়ালের রুপ ধারণা করেছে৷ পরী ভেজা গলায় বলল,

“ছোট মা আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি৷ আমি কখনও তোমার সাথে এমন খারাপ ব্যবহার করতে চাইনি৷ তোমার কাছ থেকে সবকিছু কেঁড়ে নিলে কি করবে? তোমাকে এখানে থাকব বলে সব থেকে খুশী আমি ছিলাম৷ বাবার আদর পাব৷ তোমার সাথে হাসিখুশিতে ভরপুর আয়োজনের মাধ্যমে কেটে যাবে প্রতিটি মুহুর্ত৷ আরিয়ানের সাথে দুষ্টামিতে কাটবে জীবন। পারুল চলে যাওয়ার পর কাউকে আর খেলার সঙ্গী হিসাবে পাইনি৷ কেন করলে আমার সাথে?”

পরীর কান্না দেখে কিছু সময়ের জন্য আশালতার চোখে জল এসে পড়েছে। পরীরে পাশ কাটিয়ে রুম ত্যাগ করেন৷ পরী বিছানায় হেলান দিয়ে বলল,

“হ্যাঁ কেন আমার কাছ থেকে সবকিছু কেঁড়ে নিচ্ছ? আমার মাকে দূরে সরিয়ে দিলে৷ আমি ঢাকার বুকে শ্বাস নিতে পারি না। আমার ধম বন্ধ হয়ে আসে৷ আমার মা কেন আমাকে স্বার্থ ছাড়া ভালোবাসে৷ মায়েরা কি স্বার্থ খুঁজে না? অথচও ছোট মা আমায় সহ্য করতে পারে না৷ ভালোবাসার কোন সংখ্যা উনার কাছে নেই৷”

পরীর চোখে আষাঢ়ের ঘনঘটা। বিষন্নতা মেঘ দু’চোখে বিরাজ করছে। ছায়া পতন ছন্দ হয়ে ঝরে যাচ্ছে অশ্রুকণা। এমন সময় প্রতিটি মেয়ে মায়ের কোল খুঁজে। মায়ের কোলে মাথা রেখে প্রতিটি অভিযোগ করতে চাই৷ মা নামক ছায়া যার কাছে নেই সেই বুঝে এই মুহুর্তের কথা৷
__________

চারিদিকে আসরের আযান দিচ্ছে৷ আয়েশা বেগম বাহিরের মাটির চূলায় রান্না করতে ব্যস্ত। বৃষ্টি বাদলের দিকে ঘরে রান্না করা হয়। বৃষ্টি ব্যতীত বাহিরে রান্না করা হয়৷ সেখানে খড়, গাছের শুকনাে পাতা বিশেষ প্রাধান্য পায়৷ আইয়ুব আলী এবং তার ছোট ছেলে শ্যামল উপস্থিত হয় আয়েশা বেগমের বাড়িতে৷ সেদিনের পর থেকে গ্রাম পঞ্চায়েত অনেকটা সর্তক হয়ে গেছেন৷ আরিফকে গাজীপুর পাঠিয়ে দিয়েছেন৷ নিজের গরুর পাল থেকে আশিকুরকে গরু দিয়েছেন। আয়েশা বেগম চূলার মুখ থেকে শুকনো পাতা সরিয়ে তাদের খোলা বারান্দায় চৌকির উপর বসতে দিলেন৷ আইয়ুব আলী বসতে বসতে বলল,

“আপনার কাছে একটা কাজে এসেছি৷ আমি জানি আপনি আমায় না করবেন না৷ আপনি গ্রামের প্রতিটি মানুষের জন্য ভাবেন৷ আশা করি আপনি আমার কথা মেনে নিবেন৷”

আয়েশা বেগম বুঝতে পারছে না কি বলবে? কখনও কোন আবদার নিয়ে আসেনি৷ মনটা কেমন জানি খচখচ করছে৷ সাথে কোন মানুষ নেই৷ মূলত আইয়ুব আলী কখনও একা চলাচল করেন না৷ তার সাথে সব সময় তার কাজের লোক থাকে৷ আজ শুধু তার ছেলে শ্যামল আছে৷ ভীতুকর কন্ঠে বলল,

“আপনি কি বলতে চান? আপনার কথা সত্যের পথে এবং ভালো উদ্দেশ্যের হলে আমি অবশ্যই মেনে নিব৷”

আইয়ুব আলী শ্যামলের দিকে এক তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন,

“অসময়ে আপনার বাড়িতে আসার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি৷ আমি এসেছিলাম একটা স্কুলের জন্য৷ গ্রামের ছেলেমেয়েরা পড়তে পারছে৷ কিন্তু যাদের একটু বয়স আছে তারা পড়া থেকে বঞ্চিত। কৃষকদের কোন শিক্ষা নেই৷ তারা ভালো মন্দ বুঝতে পারলেও শিক্ষার আলো তাদের মধ্যে নেই৷ একটা চিঠি আসলে সেটা অন্যের কাছে নিয়ে যায়। আমি কৃষক, কৃষাণী এবং মধ্য বয়স্কদের লেখাপড়া ব্যবস্থা করতে চাই৷ সেজন্য আপনার সাহায্য লাগবে৷”

আইয়ুব আলীর চিন্তা ধারণা এতোটা পরিবর্তন দেখে আয়েশা বেগম সত্যি খুব খুশী৷ আনন্দের সহিত জবাব দিলেন,

“অনেক সুন্দর কাজ৷ পৃথিবীর সবথেকে বেশি মহৎ কাজের মাঝে অন্যতম৷ আমি আপনার পাশে থাকব। আমি এ মহান কাজে শরীক হতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করব। গ্রামের সবাই লেখাপড়া করলে গ্রামটা অনেক উন্নতি হবে৷”

“সন্ধ্যার পর সবাই আমার বাড়িতে চলে আসবে৷ আপনি আর শ্যামল তাদের পড়াবেন৷ আপনার জন্য আরও একটা প্রস্তাব আছে৷ আমি মানতে না চাইলেও এটা করতে হবে৷ ধরে নেন আমি জোর করে চাপিয়ে দিলাম।”

বিষ্ময়কর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

“কি করতে চান? যা জোর করে চাপিয়ে দিবেন৷”

“সন্ধ্যায় আসা যাওয়া আপনার সমস্যা হবে না৷ আমার লোক আপনাকে নিয়ে যাবে৷ আবার ক্লাস শেষে আপনাকে দিয়ে যাবে৷ আপনি একা থাকেন৷ পরী এখন আপনার সাথে নেই৷ সেজন্য আপনি প্রতিদিন রাতে আমার বাসায় খাবেন৷ আপনার কোন কথা আমি মানব না৷”

“কিন্তু পঞ্চায়েত মশাই আপনার বাসায় খাওয়াটা কেমন দেখায় না৷ একদিন দুইদিন ঠিক আছে৷ প্রতিদিন খাওয়া ঠিক হবে না৷”

“কোন কিন্তু নয়৷ আপনার জন্য আলাদা কোন রান্না হচ্ছে না৷ আমরা যা খাব আপনি তাই খাবেন৷ এমনি আপনি অনেক কষ্ট করেন৷ স্কুল থেকে এসে অনেক বাচ্চাকে পড়ান৷ তাদের কাছ থেকে কোন টাকা নেননা৷ সত্যি আপনার মন অনেক বড়৷ আবার আমার বাড়িতে যেতে হবে৷ আর কষ্ট করতে হবে না৷ পরী বাড়িতে থাকলে অন্য বিষয় ছিল৷”

আয়েশা বেগমের এতোদিনের পরিশ্রম যেন স্বার্থক হলো৷ আল্লাহর কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া জানাল৷

চলবে……..।

কে বাঁশি বাজায় রে পর্ব-০৯

0

#কে_বাঁশি_বাজায়_রে
#পর্ব_০৯
#নুর_নবী_হাসান_অধির

সময় কখনও কারো জন্য অপেক্ষা করে না। ভাটা শুরু হয়েছে। পানির পরিমাণ কমে গেছে৷ কৃষকরা জমিতে ধান রোপণে ব্যস্ত৷ গবাদিপশুর জাতীয় খাবার ঘাসের পরিমাণ কমে গেছে। মানুষের পাশাপাশি গবাদিপশুও পুষ্টিহীনতায় ভোগছে৷ আয়েশা বেগম ক্লাস শেষ করে আইয়ুব আলীর বাড়িতে পা রাখেন৷ এখানে পা রাখা মানে ঝড়ের পূর্বাভাস। আইয়ুব আলীর অর্থবিত্তের অভাব নেই৷ গ্রামে প্রচুর জমিজমা। গাজীপুরের বোর্ড বাজারে গার্মেন্টস আছে৷ তাছাড়া শহরে কিছু দোকান আছে৷ সে দোকানগুলো পঞ্চায়েত মশাই দেখাশোনা করেন৷

আয়েশা বেগম চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন,
“আপনি কি ভিক্ষুক হয়ে গেছেন? এখনও অন্যের জমি, গরু দখল করতে মন বাঁধা দেয় না৷”

আইয়ুব আলী কথাগুলো ঠিক বুঝতে পারল না৷ বোকার মতো আয়েশা বেগমের দিকে তাকিয়ে রইল৷ আয়েশা বেগম পুনরায় বলতে শুরু করেন,

“কি হলো কথা বলেন না কেন? এতো টাকা পয়সা থাকতেও অন্যের গরু কেঁড়ে নেওয়ার মানে কি? আপনার তো লজ্জা থাকা দরকার৷ আপনি গ্রামের প্রধান৷ আপনার আদর্শে সবাই জেগে উঠবে৷ কিন্তু আপনি গ্রামের চোরে পরিণত হচ্ছেন।”

আয়েশা বেগমের কথা শুনে আইয়ুব আলীর পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায়৷ রাগী চোখ মুখ লাল হয়ে যায়৷ আইয়ুব আলী আগে যা করেছে এখন তা করে না৷ কারোর গরু ছাগল লোড করে নিয়ে আসে না৷ গরিবের উপর জোর ঝুলুম করে৷ বিপদে ফেলে মোটা অঙ্কের সুধ নেওয়া উনার কাজ৷ কঠিন গলায় বললেন,

“আপনি না জেনে অনেক কথা বলেছেন৷ অনেক সহ্য করেছি আপনার কথা৷ আপনার কাছে কি প্রমাণ আছে? আমি অন্যের গরু নিয়ে আসছি।”

“কেন আপনি জানেন না? আপনার ছেলে আরিফ আশিকুরের গরু নিয়ে আসে নি৷ সেদিন তার স্ত্রী খোদেজা বানু আমাকে বলল৷ না বললে তো জানতাই না৷”

আইয়ুব আলী উচ্চ স্বরে আরিফকে ডাক দেন৷ আরিফ দ্রুত গতিতে বাবার সামনে হাজির হয়৷ আয়েশা বেগমকে দেখে মুখ চুপসে যায়৷ চোখে মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। আরিফ ভীত গলায় বলল,

“কিছু বলবেন বাবা?”

আরিফের গায়ে কষিয়ে থাপ্পড় বসিয়ে বলল,
আশিকুরের গরু কে নিয়ে আসছে? আমি গরু নিয়ে আসতে বলছিলাম৷ আমার নাম বলে গরু নিয়ে আসছোস কেন?”

আয়েশা বেগম বুঝতে পারে আইয়ুব এসবের কিছু জানে না৷ আরিফ উনার অগোচরে অনেক কাজ করে৷ সেদিন আয়েশা বেগমকে খুন করার কথা আইয়ুব আলী বলেনি৷ আরিফ নিজে থেকেই গেছিল৷ আরিফ গালে হাত দিয়ে বলল,

“আশিকুরের সাহস হয় কিভাবে আমার কাছ থেকে দুধের টাকা নেওয়া? বাজারে মানুষের সামনে কিছু বলতে পারিনি৷ হ্যাঁ আমি গরু নিয়ে বাজারে বিক্রি করে দিছি৷ দরকার পরলে আরও নিব৷ নিছি ভালো করছি৷”

আইয়ুব আলী কষিয়ে আরও একটা থাপ্পড় বসিয়ে বলল,

“এতো নিচ তুই৷ আমার নাম বলে বলে গ্রামের লোকদের সাথে খারাপ ব্যবহার৷ তোর মতো ছেলে থাকার চেয়ে না থাকা অনেক ভালো৷”

আরিফ ক্ষোভ নিয়ে আঙ্গুল তুলে বলল,

“আমি এই মহিলাকে খুন করে ফেলব৷ এই মহিলার জন্য আমি কিছু করতে পারি না৷ আমি এই মহিলাকে ছাড়ব না৷”

আইয়ুব আলী কিছু লাঠিয়াল বাহিনীকে চোখের ইশারায় আরিফকে নিয়ে যেতে বলেন৷ আইয়ুব আলী বুঝতে পারে তার ছেলে গ্রামে অনেক অন্যায় কাজ করছে৷ যার জন্য গ্রামে আইয়ুব আলীর আধিপত্য কমে যাচ্ছে৷ নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে রেখে বলেন,

“আরিফ ছোট মানুষ৷ এই বয়সে রক্ত গরম থাকে৷ ন্যায় অন্যায় বোধ হারিয়ে ফেলে৷ আরিফ ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে৷ তাকে আমি বুঝিয়ে সৎ পথে নিয়ে আসব৷ আরিফের গ্রামের মানুষের আর অত্যাচার করবে না৷”

“শাসনটা অনেক আগে করার দরকার ছিল৷ বাবা হিসেবে সব দিকে নজর রাখা দরকার ছিল৷ শুধু এগুলো তার কাজ নয়৷ আরও খারাপ কাজ করে৷ সবদিকে নজর দিবেন৷ আসিফ খারাপ কাজ করত যার ফলে আসিফকে হারিয়েছেন৷ আরিফকে হারাতে না চাইলে সঠিক পথে নিয়ে আসেন।”

চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বলল,

“সময়ের কাজ সময়ে করতে হয়৷ আপনি নিজে সবকিছু জেনেও কাউকে কিছু বলেন নি৷ আমি ঘাসে মুখ দিয়ে চলি না৷ সবার খরব রাখি৷ মোল্লা সাহেব সামনে এমপি দাঁড়াবেন৷ নিজের মর্যাদা টিকিয়ে রাখেন৷”

আয়েশা বেগম চলে যেতে নিলেই আইয়ুব আলী বলেন,

“আসিফকে কে হত্যা করেছে আপনি জানেন?”

আয়েশা বেগম মুচকি হেঁসে জবাব দিলেন,

“সবার আগে খরব আমার কাছে পৌঁছায়৷ আসিফ একজন মেয়েকে ধর্ষণ করার ফলে প্রাণ হারিয়েছে৷ শুধু সে নয়৷ তারা তিনজন মিলে সম্মান হানি করেছিল। পৃথিবীতে তিনজনের মাঝে কেউ নেই৷ কিন্তু ধর্ষিত মেয়েটা আজও বেঁচে আছে৷”

আয়েশা বেগমের চোখে জল চলে আসল৷ মনে মনে বলেন,
“হ্যাঁ পারুল আমার মনের মাঝে বেঁচে আছে৷ আমি যতদিন জীবিত থাকব আমার সোনার টুকরো মেয়েটাও জীবিত থাকবে৷
__________

পারী এসাইনমেন্ট করছিল৷ এমন সময় রুমে আশালতা আসেন৷ পরীকে পড়ার টেবিলে দেখে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেন৷ মনের মাঝে রাগ বাসা বেঁধে নিল৷ কিছুতেই পরীর পড়া মেনে নিতে পারল না৷ রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে উঠল,

“নবাবজাদি তুই এখানে বসে থাকলে রান্না করে করবে কে? তোর মা এসে রান্না করে দিবে৷”

পারী দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,

“হ্যাঁ আমার মা রান্না করবে৷ আমার আদরের ছোট মা রান্না করবে৷ মা রান্নাটা করে নাও৷ সাথে আমার রুমটাও পরিষ্কার করে দিও। মেয়ের কষ্ট একমাত্র মায়েরাই বুঝে৷”

পরীর কথায় আশালতার মাথা গরম হয়ে যায়৷ এমনি সতিনের মেয়ে দু’বেলা চোখের সামনে থাকলে রাগে শরীর জ্বলে যায়৷ তার কথা আরও রাগ হচ্ছে৷ নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে পরীর এসাইনমেন্ট টেনে ছিঁড়ে ফেলে৷ পরীর গায়ে হাত তুলতে নিলে পরী হাত ধরে ফেলে। পরী নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারল না৷ অনেক সহ্য করেছে এই মহিলাকে৷ পরী কষিয়ে কয়েকটি থাপ্পড় বসিয়ে দিল৷ হুংকার দিয়ে বলল,

“পরীকে রাগিও দিও না৷ খুন করে ফেলব সোজা৷ আজকেরটা সামান্য নমুনা৷ আমার সাথে লাগতে আসলে আরও খারাপ কিছু করতে পারি। গ্রামের মেয়ে ভেবে ভুল করবে না৷ রাগ উঠলে বড় বলে ছেড়ে দিব না৷”

তাদের চেঁচামেচি শুনে পলক হোসাইন এবং বাড়ির কাজের লোক আসতে নিলেই পরী তড়িঘড়ি করে আশালতার হাত নিজের গলায় নিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল,

“আম্মাগো আমাকে ছেড়ে দেন৷ আমি আপনার পায়ে পড়ি৷ আমি আর এই বাড়িতে থাকব না৷ মায়ের কাছে চলে যাব৷ আল্লাহর দোহাই লাগে আমাকে ছেড়ে দেন৷”

বাড়ির সকলে ইতিমধ্যে চলে এসেছে৷ এমন দৃশ্য দেখে পলক হোসাইন মেয়েকে ছাড়িয়ে নিয়ে আশালতার গালে কষিয়ে থাপ্পড় বসিয়ে বলল,

“ছি! তুমি এতো নিচ। পরী তোমার নিজের মেয়ে নয় বলে তাকে মেরে ফেলতেও একবার ভাবলে না৷ শিক্ষিত মানুষের এমন নিষ্ঠুর রুপ দেখিনি৷ পরী আমাকে আগেই বলেছিল তুমি তাকে দিয়ে বাসার সকল কাজ করাও৷ কাজে ভুল হলে গায়ে হাত তুল৷ বিশ্বাস করতাম না৷ আজ চোখের সামনে যা দেখলাম৷”

আশালতা কান্না করতে করতে বলল,

“বিশ্বাস কর, আমি এসব কিছু করিনি৷ পরী সব বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা কথা বলেছে৷ আমি পরীকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি৷”

পলক হোসাইন রাগী গলায় বলল,

“আমরা নিজের চোখে দেখলাম৷ একটু দেরি করলে হয়তো পরীর লাশ এখানে পাওয়া যেত৷”

দূরে দাঁড়িয়ে পরী কান্না করছে৷ পলক হোসাইন এক হাত দিয়ে আগলে রাখার চেষ্টা করছে৷ আশালতা রাগী গলায় বলল,

“আমি এই মেয়েকে দেখে নিব৷ এই মেয়ে কিভাবে বেঁচে থাকে আমিও দেখব৷ আমি নিজ হাতে খুন করব৷”

একে একে সবাই রুম থেকে চলে যায়৷ পলক হোসাইন চলে যাওয়ার আগে বলল,

“ভয় নেই৷ তোমার কোন ক্ষতি কেউ করতে পারবে না৷ তোমার ছোট মাকে আমি বুঝিয়ে সব ঠিক করে দিব৷”

পরী মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল৷ পলক হোসাইন রুম থেকে চলে গেলে পরীর রুমের দরজা লাগিয়ে চোখের জল মুছল৷ বিশ্ব জয়ের হাসি দিয়ে মনে মনে বলল,

“পরীকে ভালোবাসা দিলে সব কাজ করে দিত৷ মায়ের মতো ভালোবাসত৷ আগলে রাখত৷ যারা ভালোবাসার যোগ্য নয় পরী তাদের সাথে এমনই করবে৷”
____

সমাপ্তির বাসা ধানমন্ডি। প্রতিদিন গাড়ি করে আসা যাওয়া। ড্রাইভারের দরকারে গাড়ি নিয়ে কোথাও গেছে৷ অবশ্য সমাপ্তিকে বলে গেছে৷ বিশ মিনিটের মাঝে চলে আসবে৷ সমাপ্তি যাইনি বলে হুকু তার সঙ্গ দিয়েছে৷ একপ্রকার ধরে বেঁধে আটকিয়ে রেখেছে পরীকে৷ খোলা মাঠের নিচে বসে আছে তিনজন। কুহু চশমা ঠিক করতে করতে বলল,

“ছোঁয়া থাকলে খুব ভালো হতো৷ আমরা চারজন কথা বলতে পারতাম৷ ভালো লাগত অনেক৷”

কুহুর বার বার চশমায় হাত দেওয়া সমাপ্তি কিছুতেই মেনে নিতে পারে না৷ বিরক্তির সাথে বলে উঠল,

“কুহু আর কেউ কি চশমা পড়ে না৷ তুই একাই চশমা পড়োস৷ বার বার চশমায় হাত দেওয়ার মানে কি? নাকি মানুষকে দেখাস তোর চশমা আছে৷”

কুহু অভিমানী কন্ঠে বলল,
আমার চশমা নিয়ে কোন কথা বলবি না৷ হ্যাঁ আমি দেখাই আমার চশমা আছে৷ দরকার পড়লে তুইও দেখা৷”

পরী বিরক্ত স্বরে বলল,
থামাবি তোদের ঝগড়া। মন চাচ্ছে ধাক্কা দিয়ে দুটোকেই বুড়িগঙ্গায় ফেলে আসি৷”

কুহু ন্যাকা স্বরে বলল,
“সমাপ্তিকে ফেলে আয়৷ সে আমার পিছনে সব সময় লেগে থাকে৷ আমি যা করি তার কাছে সবই ভুল৷”

সমাপ্তি পরীর কাঁধে হাত রেখে বলল,
“তোর সৎ মা তোর সাথে এতো খারাপ ব্যবহার করে তুই কিছু বলস না৷”

“আমি এখন আর বসে নেই৷ আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করলে আমিও খারাপ ব্যবহার করি৷ প্রথম দিকে গ্রামের মেয়ে ভেবে অনেক অত্যাচার করেছে৷ সময়ের সাথে অত্যাচার বাড়ছিল৷ প্রতিবাদ করায় এখন একটু কম৷”

“তোর বাবা কিছু বলে না৷ তোর সাথে এতো খারাপ ব্যবহার করে৷”

“আমি বাবার জন্য বসে থাকিনা৷ বাবাকে এক সময় অনেক ভালোবাসতাম৷ এখন ভালোবাসা মন থেকে উঠে গেছে৷ আর্দশ বাবা হয়ে উঠতে পারেনি৷”
পরী দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,
“সমাপ্তির গাড়ি চলে এসেছে৷ এখন সবাই বাড়িতে যাহ৷ আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে কাল আবার দেখা হবে৷”

চলবে….

কে বাঁশি বাজায় রে পর্ব-৭+৮

0

#কে_বাঁশি_বাজায়_রে
#পর্ব_০৭
#নুর_নবী_হাসান_অধির

চা নিয়ে উদাস মনে তাকিয়ে আছে৷ কিছুই ভালো লাগছে না৷ পরী ভাবতে পারেনি তার ছোট মা তার সাথে এমন ব্যবহার করবে। চিরকুট লিখে ছোট মায়ের কাছে যায়৷ আনন্দপুরে চিঠি পাঠানোর কথা বলায় আশালতা বলেন,

“গ্রামে চিঠি পাঠানোর কোন দরকার নেই৷ ঢাকায় দুইদিন না হতেই চিঠি পাঠানো শুরু করছো৷ আরও তো দিন পড়ে আছে৷ হাওয়ায় চিঠি যায় না৷ সাথে মোটা অঙ্কের টাকা লাগে৷”

পরী কিছু বলার আগেই আশালতা চিরকুট নিয়ে ছিঁড়ে ফেললেন৷ নিমিষেই মনটা ভেঙে গেল৷ বুকের গহীনে তীব্র ব্যথা শুরু হলো৷ অজান্তেই চোখ থেকে দুই ফোঁটা অশ্রু কণা গড়িয়ে পড়ল। পরী চোখের জল মুছে নিজের রুমে চলে আসেন৷ রাতে খাওয়া হলো না আর৷ ঘুমটা নিশাচর পাখির মতো চলে গেল। মায়ের জন্য চিন্তা করতে করতে ভোর হয়ে গেছে৷
সমাপ্তির ডাকে পরীর ঘোর কাটে৷ সমাপ্তি আলতো করে ধাক্কা দিয়ে বলল,

“কি হয়েছে তোর? চা তো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে৷ খাচ্ছিস না কেন? মন খারাপ!
পরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

“খেতে ইচ্ছা করছে না৷ কিছু ভালো লাগছে না। এক সাথে এতো প্রশ্ন কেউ করে।

“তোর কি মন খারাপ? সকাল থেকে তোকে উদাসীন লাগছে৷”

“তেমন কিছু না৷ মা’কে ছাড়া কোনদিন থাকি নাই৷ আজ মাকে খুব মিস করছি৷ কাছে থাকতে মায়ের অভাব বুঝতে পারিনি। একটু চোখের আড়াল হতেই খুব মিস করছি৷”
সমাপ্তি পরীর কাঁধে হাত রেখে বলল,

“আমাদের জীবনটাই এমনই৷ কোন কিছুতেই মন আটকায় না৷ ভালো লাগে না কিছু৷ তোর মা বেঁচে আছেন৷ আর দেখ দুনিয়াতে আমার মা বেঁচে নেই৷ চিন্তা করিস না আন্টি আল্লাহর রহমতে ভালো আছেন।”

সকলের চায়ের বিল তন্মায় দিয়ে দিল৷ তন্ময় পরীর পাশে দাঁড়াতেই হৃদয় কঠিন কন্ঠে বলল,

“তন্মায় নিজেকে সংযত রাখ৷ পাশে ভালোই মানিয়েছে৷ কিন্তু বেশি কিছু নয়৷”

হৃদয় কথাগুলো তন্ময়ের কানে কানে বলল৷ ছোঁয়া তাদের উদ্দেশ্যে বলল,

“তোরা ফিসফিস করে কি বলস? তোদের দেখে সন্দেহ হচ্ছে৷ আমাদের কাছ থেকে কিছু লুকাবি না৷”
হৃদয় মুচকি হেঁসে বলল,

“তেমন কিছু নয়৷ তোরা কি কোথাও ঘুরতে যাবি? একসাথে ঘুরতে গেলে ভালো লাগবে৷”
কুহু চশমা ঠিক করতে করতে বলল,

“তোরা কোথায় ঘুরতে যাবি? একসাথে কোথাও ঘুরতে গেলে সবার অনেক ভালো লাগবে৷ চল একসাথে ঘুরতে যায়৷”
পরী সকলের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,

“দোস্ত তোরা ঘুরতে যা৷ আমি কোথাও ঘুরতে যাব না৷ আমি দেরি করে বাসায় ফিরতে পারব না৷ ছোট মা বকা দিবেন৷ তিনি বলে দিয়েছেন ক্লাস শেষ হলেই সোজা বাড়ি ফিরতে৷”
সমাপ্তি আড় চোখে তাকিয়ে বলল,

“তোর মা বলে গ্রামে৷ তুই এখানে ছোট মা কোথা থেকে পেলি৷ তোর কথা কিছুই বুঝলাম না৷”
পরী মুচকি হেঁসে বলল,

“সময় হলে সব জানতে পারবি৷ এখন আমি আসি৷ তোরা সবাই মন খুলে ঘুরাঘুরি কর৷ আমি অন্যদিন তোদের সঙ্গ দিব৷”
_____________

আয়েশা বেগম আরিফকে স্কুলের মাঠে বড় আম গাছের সাথে বেঁধে রেখেছেন৷ এলাকার প্রতিটি মানুষের কানে পৌঁছে গেছে৷ কাজ কাম ফেলে সকলেই চলে এসেছে স্কুল মাঠে৷ পঞ্চায়েত মশাইয়ের ছেলেকে বেঁধে রেখেছেন৷ কি হবে? তা দেখার জন্য সকলেই অধীর আগ্রহে বসে আছেন৷ কানে কানে অনেক ফিসফিস কথা চলছে। গ্রাম পঞ্চায়েত মশাই এখনও আসেন নি৷ উনার জন্য অপেক্ষা করছেন সবাই৷ অবশেষে গ্রাম পঞ্চায়েত আইয়ুব আলীর দেখা মেনে৷ আইয়ুব আলী আসতেই সকলেই দাড়িয়ে যায়। হাত উঁচু করে বসতে বলে৷ আয়েশা বেগমের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাগী কন্ঠে বলল,

“আরিফকে ছেড়ে দেন৷ নয়তো আপনার লাশ পড়ে যাবে৷”
আয়েশা বেগম সকলের উদ্দেশ্যে বলেন,

“যে অন্যায় কাজ করবে তার শাস্তি চান কি আপনারা? আপনারা যদি অন্যায়ের শাস্তি না চান আমি আপনার মাঝে একজনকে মেরে ফেলব৷ কেউ শাস্তি চাইতে পারবেন না৷ কারণ আপনারা অন্যায়ের শাস্তি চাননা।”

সকলের মাঝে ভয় কাজ করে৷ কেননা আয়েশা বেগম যা বলেন তাই করেন৷ এখন কিছু না বললে হয়তো কাউকে সকলের সামনে মেরে ফেলবেন৷ অন্যদিকে আইয়ুব আলীর বিপক্ষে কথা বলাও বিপদজনক। সকলের মাঝখান থেকে একজন বলে উঠেন,
“হ্যা শাস্তি চাই।”
তার সাথে সকলে একজোট হয়ে বলল,

“হ্যাঁ, হ্যাঁ৷ আমরা অন্যায়ের শাস্তি চাই৷ অপরাধীর শাস্তি চাই৷”

পঞ্চায়েত মশাইয়ের চোখে মুখে ভয়ের ছাপ ধরা দিল৷ তিনি বুঝতে পারলেন গ্রামের মানুষদের উনার বিরুদ্ধে করে ফেলেছে৷ এখন কিছু বললে এর বিপরীত হবে৷ আয়েশা বেগম উচ্চ স্বরে বললেন,

“আপনারা কি জানতে চান আরিফের অন্যায়? আরিফ কি অন্যায় করেছে জানেন? কেন আমি আরিফকে বেঁধে রেখেছি।”

“হ্যাঁ জানতে চাই৷”
আয়েশা বেগম বলতে শুরু করেন,

“আরিফ শুধু একটা অন্যায় কাজ করে শান্ত হয়নি৷ একাধিক অন্যায় কাজ করেছে৷ তার আগে বলেন, আপনারা কি আপনাদের ছেলেদের কৃষক বানাতে চান? নাকি শিক্ষক, পুলিশ, ডাক্তার, ইন্জিনিয়ারিং বা প্রতিষ্ঠিত দেখতে চান৷”

“হ্যাঁ, আমরা আমাদের সন্তানদের ডাক্তার..পুলিশ বানাতে চাই৷”

“আপনাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ নষ্ট করেছে এই আরিফ। স্কুলের প্রতিটি দরজা ভেঙে ফেলেছে৷ আপনারা কি আরিফের বিচার নিজ হাতে করতে চান? সবাই যদি একজোট হোন৷ তাহলে কেউ আপনাদের ক্ষতি করতে পারবে না৷”

“হ্যাঁ হ্যাঁ আরিফকে আমাদের হাতে ছেঁড়ে দেন৷ আমরা তার শাস্তি দিব৷ স্কুল ভেঙে ফেলবে৷ আমরা সবাই তার হাত কেটে দিব৷ আমাদের হাতে তুলে দেন৷”

গ্রামের লোকজনের মনে যেন প্রতিশোধের আগুন হানা দিয়েছে। শত চেষ্টার পর একটা সুযোগ ধরা দিয়েছে তাদের হাতে। এই সুযোগ কিছুতেই হাত ছাড়া করবে না৷ ভীড়ের মাঝখান থেকে দুই একজন তো ঢিল ছুঁড়ে মেরেছে৷ পারলে ঢিল ছুঁড়ে মেরে ফেলবে। গ্রাম পঞ্চায়েত মশাই হাত তুলে বলেন,

“শান্ত হোন আপনারা৷ আরিফ যা করেছে তার জন্য আমি খুবই লজ্জিত। আমি স্কুলের দরজা জানালা সব ঠিক করে দিব৷ আর সবাইকে লেখাপড়া করতে উৎসাহিত করব৷ আরিফকে এবারের মতো ক্ষমা করে দেন৷”

গ্রাম পঞ্চায়েতের মূল শত্রু মোল্লা সাহেব বলেন,

“অন্যায়ের কোন ক্ষমা নেই৷ আপনারা যদি আরিফের হাত কেটে দেন তাহলেই আরিফের শাস্তি হবে৷ আপনারা কি চান?”

গ্রাম পঞ্চায়েত কোনঠাসায় পড়ে গেলেন৷ আয়েশা বেগম হাত উঁচু করে উচ্চ স্বরে বলেন,

“আরিফের অন্যায়ের কোন ক্ষমা হয়না৷ আমি আপনাদের ছেলেমেয়েদের পড়াই বলে আমাকে খুন করতেও চাইছিল৷ আমাকে মারার জন্য বাড়িতে গুন্ডা পাঠিয়েছিল৷”
গ্রামের লোকজন একসাথে শব্দ করে বলেন,

“আপনার কিছু হলে পঞ্চায়েত মশাইয়ের বাড়ি উড়িয়ে দিব৷ কাউকে বাঁচতে দিব না৷ আমরা আর অন্যায় অত্যাচার সহ্য করব না৷ আমরা অন্যায় সহ্য করেছি বলে আমাদের ছেলেমেয়েরাও সহ্য করবে৷ স্বৈরাচারী শাসন আর চলবে না৷”

আয়েশা বেগম পঞ্চায়েত মশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বিশ্ব জয়ের হাসি দিয়ে বলেন,

“কি পঞ্চায়েত মশাই! আমাকে মেরে ফেলবেন না৷ আপনি নাকি স্কুল ভেঙে দিবেন৷ স্কুল আমার প্রাণ। আপনি আমার জীবনে হাত দিয়েছেন৷ আমি বেঁচে থাকলে আপনার শাসন আর থাকবে না৷ যুদ্ধ করে সোনার বাংলা গড়ে তুলেছি৷ সেখানে শাসকের জায়গা নেই।”

পঞ্চায়েত মশাই হাত জোড় করে মিনতি স্বরে বলেন,

“আমার ছেলেকে বাঁচান। নয়তো বোকা গ্রামের আরিফকে লোকজন মেরে ফেলবে৷”
আয়েশা বেগম উঁচু স্বরে বলেন,

“পঞ্চায়েতের কথা বিবেচনা করে আরিফকে ক্ষমা করা যায়৷ যা ক্ষতি হয়েছে পঞ্চায়েত মশাই সব ঠিক করে দিবেন৷ আর স্কুলের সামনের জমিটা স্কুলের নামে লিখে দিবেন৷ সেখানে ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করতে পারবে৷”
_________

পরী বুঝতে পারে আশালতার উদ্দেশ্য। তিনি কিছুতেই পরীকে সহ্য করতে পারেন না৷ দিনদিন খোলস ছেড়ে বের হচ্ছেন৷ পরী সোফায় বসে বিটিভি দেখছিল৷ টিভি বন্ধ করে বলেন,

“বাড়িতে কাজ ফেলে টিভি দেখার শখ হয়েছে৷ অনেক টিভি দেখা হয়েছে৷ এখন বাড়ির কাজ কর৷ এখন তো আর ছোট নয়৷ অন্যের ঘাড়ে বসে বসে খেতে লজ্জা করবে না৷”
পরী মাথা নিচু করে বলল,

“ছোট মা, কি করব এখন? একটু আগে তো রান্না করেছি৷”

“কি করবে মানে? চোখ কি কানা হয়েছে৷ কিছুই দেখতে পাওনা৷ ফ্লোরে কত ময়লা হয়ে গেছে৷ হাঁটতে পায়ে বালি লাগছে৷ পানি দিয়ে ভালোভাবে ঠলে ঠলে পরিষ্কার কর৷”

পরী মাথা নাড়িয়ে কাজ করতে চলে যায়৷ বাড়িতে কাজ করেছে৷ কখনও কাজ করতে খারাপ লাগেনি৷ এখানে কাজ করতে খারাপ লাগার মূল কারণ হলো কথা বলার ধরণ৷ আশালতার কথা বলার ধরণ খুবই বাজে৷ ভালোবাসে একটুও কথা বলে না৷ যতটা পারেন বাজে ব্যবহার করেন৷ পরী বাবাকে এসব জানালে বাবা বলেন সবই মিথ্যা৷ যে বাবাকে সব সময় ভালো মানুষ মনে করেছেন৷ সত্যের পক্ষ থাকেন৷ আজ সেই বাবা কিছুই দেখেন না৷ পরী ঠিক করেছে হলে উঠবে৷ এখানে পড়ে থাকবে না৷ জ্ঞানীরা ঠিকই বলেছেন ‘আপন কখন পর হওয়া৷’ স্বার্থের জন্য মানুষ আপন হয়৷ পরীর চোখে জল টলমল করছে৷ মাকে খুব মিস করছে৷ কাছে পেলে জড়িয়ে ধরে কান্না করবে৷ পরী মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করল, “এখান থেকে ঠিকই যাবে তবে আশলতার অহংকার ভেঙে৷”

চলবে…..

#কে_বাঁশি_বাজায়_রে
#পর্ব_০৮
#নুর_নবী_হাসান_অধির

আষাঢ়ের ঘনঘটায় ভারী বৃষ্টি হচ্ছে৷ বাহিরে যাওয়া যাচ্ছে না৷ ঝড়ো হাওয়ায় গাছের ঢাল পালা ভেঙে যাচ্ছে৷ বৃষ্টির জন্য পরী আজ ক্লাসে যাইনি৷ পরীকে বাড়িতে পেয়ে যেন আশালতা হাতে স্বর্গ পেল৷ রান্নাঘর থেকে ঢেকে বলল,

“বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে৷ খিচুড়ি রান্না কর৷ খিচুড়ি খারাপ রান্না করলে সবটায় তোমাকে খাওয়াব৷”

পরী মুখের উপর জবাব দিল,
“আমি রান্না করতে পারব না৷ আমি আপনার দাসী নয়৷ মহারানীর হুকুম পালন করতে পারব না৷”

পরীর কথায় আশালতা ক্ষেপে যান৷ পরীর গায়ে হাত তুলতে নিলে পরী হাত ধরে ফেলে৷ পরী অগ্নি মূর্তি ধারণ করে৷ চোখে মুখে রাগ স্পষ্ট। রাগ ও প্রতিশোধের অনুষঙ্গ এখনই জ্বালিয়ে দিবে সবকিছু। পরী কঠিন গলায় জবাব দিল,

“আমার সাথে ভালো ব্যবহার করলে কাজ করে দিতে সমস্যা নেই৷ নিজের কাজ নিজে করতে কোন লজ্জার বিষয় নয়৷ আপনি আমাকে নিচু চোখে দেখেন৷ কাজ করতে বাধ্য করেন৷ দুই দিনে আমি আপনার ভিতরের রুপ দেখে নিয়েছি৷”

“এটা আমার বাসা৷ এখানে থাকতে আমার কথামতো চলতে হবে৷ নয়তো ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিব৷”

“হাত ঘাড় অব্দি পৌঁছাবে না৷ তার আগেই হাত কেটে দিব৷ আমাকে ভিতু নয়৷ আপনার অত্যাচার মেনে নিব৷”

“আমাকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।”

“প্রিয় ছোট মা৷ আপনাকে হুমকি নয়৷ ভালোবেসে কথাগুলো বলে গেলাম৷ আমার অনেক কাজ আছে৷ আপনি খিচুড়ি ভালো করে রান্না করেন৷ আমার অনেক ক্ষুধা লাগছে৷”

পরী আশালতার কপালে আলতো করে ঠোঁট স্পর্শ করে চলে আসে৷ পরীকে আজ সহ্য হলো না৷ কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না৷ পরীর দেওয়া চুমুটা কাটা গায়ে নুনের ছিঁটার মতো লাগল৷ আশালতা রাগ ক্ষোভ নিয়ে কাজের মহিলা মর্জিনাকে খিচুড়ি রান্না করতে বলে রুমে চলে যায়৷
__________

টানা বৃষ্টিতে মানুষ বাহিরে বের হতে পারছে না৷ দিন দিন নদীর পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ পানি একটু বাড়তেই ফসলের ক্ষেতে উঠবে৷ ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে ফসলের ক্ষেতে পানি উঠতে সময় লাগবে না৷ ভারী বৃষ্টির জন্য স্কুল বন্ধ দেওয়া হয়েছে৷ আয়েশা বেগম বারান্দায় চৌকির উপর বসে বৃষ্টি দেখতে৷ হাতে নকশিকাঁথা৷ বৃষ্টির ছন্দে নকশিকাঁথা সেলাই করছে৷ একাকিত্ব ভালো লাগে না৷ পরী পারুল থাকলে বৃষ্টির মাঝে কত কাজ করত৷ নদীতে জাল ফেলে মাছ ধরত৷ পরী কচু গাছ টেনে টেনে চিংড়ি মাছ ধরত৷ মেয়েটা ভীষণ পছন্দ করে চিংড়ি৷ ভাবতেই চোখ দু’টো ভিজে উঠল৷

বাঙালির নকশিকাঁথায় কত স্মৃতি জড়িয়ে থাকে! হাসি, কান্না, দুঃখ, উদাসীনতা, মন খারাপ আরও অনেক কথা লুকিয়ে থাকে প্রতিটি সেলাইয়ে। মাথায় কলাপাতা দিয়ে পাশের বাড়ি খোদেজা বানু আসেন খুস গল্পের জন্য৷ খোদেজা চৌকির এক কোণায় বসতে বসতে বলল,

“একটু পান দিবেন৷ আঙ্গোর ঘরে পান শেষ হইয়া গেছে৷ এহন আন্নের কাছে পাই খাইতে আইছি৷”

“ভালোই করেছেন৷ বসেন, আমি পান নিয়ে আসছি৷”

আয়েশা বেগম পান এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“আপনার ছেলে আনিস ঠিকমতো লেখাপড়া করে না৷ বাড়িতে পড়ার কথা বলেন না!”

পান মুখে দিতে দিতে বলল,
“আর কইয়েন না ভাবী! পোলাডারে নিয়ে চিন্তায় আছি৷ কথা হুনে না৷ আপনি স্কুলে একটু বকা দিবেন।”

“মা হলো বড় শিক্ষক৷ আপনি তাকে বুঝিয়ে পড়তে বসাবেন৷ বুঝিয়ে বললে সবই সম্ভব৷ আমি স্কুলে বলে দিব।”

“ঠিকই কইছেন ভাবী৷ পোলাডা খারাপ ছেলের পাল্লায় পড়ে এমন হয়েছে৷ প্রতিদিন রাইতে বেড়িয়ে পড়ে৷ রাইত বিয়াতে বাইরে থাকলে কেমনডা লাগে৷”

এরপর বাহিরে বের হলে বাড়িতে উঠতে দিবেন না৷ দরকার পড়লে এক বেলা খাবার দিবেন না৷ যখন কেউ জায়গা বা খাবার দিবে না তখন ঠিকই আপনার কাছে আসবে৷ ঠিকঠাক লেখাপড়া করবে, কথা শুনবে৷”

“কি যে কন না ভাবী! পোলা না খাইয়ে থাকলে আমি খাইতাম কি করে? রাতে ঘরে ঢুকতে না দিলে কই না কই থাকবে? চোর টোর ভেবে মানুষ পিটাবে৷”

“একবেলা খাবার না দিলে কিছুই হবে না৷ না খেয়ে থাকবে কেন? লেখাপড়ার বিষয়ে একটু কঠোর হোন৷ দেখবেন আপনার ছেলে ভবিষ্যৎ অনেক সুন্দর হবে৷”

“ভাবী আন্নেরে একটা কথা কইতে আইছি৷ গ্রাম পঞ্চায়েতের ছেলে আমাদের বড় গরুডা নিয়া গেছে৷ আন্নের ভাই গাভীটা কুরবানির জন্য রাখা হইছে৷ বাড়িতে গেছিলাম। না করে দিছে৷ আন্নে একটু কইলে গরুটা ফিরিয়ে দিবে৷”

“তাদের অত্যাচার দিনদিন বেড়েই চলেছে৷ এর সমাপ্তি আমাকে করতে হবে৷ আর বাড়তে দেওয়া যাবে না৷ তাদের শাসন শোষনে আর কতদিন আমরা চলব৷ আপনারা সবাই একত্রিত হয়ে মোকাবিলা করতে পারেন না৷”

“আমরা কি কইমু? কিছু কইলেই লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে সবাইকে পিটাই৷ সেজন্য কিছু কইতে পারি না। আমাদের জীবন তো সবার আগে৷”

“আমি বেঁচে থাকতে এমন কিছু হতে দিব না৷ আইয়ুব খান ছিল পাকিস্তানের একজন। এখন বাংলাদেশে দালাল আইয়ুব আলী।”

“ভাবী আরও একটা কথা হুনছেন৷ পঞ্চায়েতের ছেলে শ্যামল এসেছে বাড়িতে৷ ঝর্নার কাছ থেকে আরও একটা কথা হুনছি৷”

“কি কথা?”

“আসিফ পরীকে কেন বিয়ে করতে চাইছিল জানেন?”

আয়েশা বেগম ভুলেই গেছিল এ কথা৷ আজ মাথায় নতুন করে নাড়া দিল৷ চকিত দৃষ্টি মেলে তাকাল৷ বিষ্ময় কন্ঠে বলল,

“কেন? আপনি কি কিছু জানেন?”

“গ্রাম পঞ্চায়েতের ছোট ছেলে শ্যামল পরীকে ভালোবসত৷ আসিফও পরীকে ভালোবাসত৷ দু’ভাই পরীকে ভালোবাসত৷ শ্যামলের কথা কোন ভাবে আসিফ জেনে যায়৷ তারপর শ্যামলকে গ্রেরাম থেকে দূরে পাঠিয়ে দেয়। পরীকে দেখার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকত৷ আপনার ভয়ে আসিফ পরীকে কিছু কইতে পারে নি৷ শ্যামল চিঠি লিখলে আসিফ পাগল হয়ে যায়৷ তাই বিয়ের ব্যবস্থা করে৷ কিন্তু বিয়ের আগের দিন কি হলো? সবাই তো জানে৷”

শ্যামলের গায়ের রং উজ্জল শ্যাম বর্ণের৷ সেজন্য তার নাম রাখা হয় শ্যামল৷ দেখতে শুনতে খারাপ নয়৷ লেখাপড়ায় অনেক ভালো৷ বাকী দুই ভাইয়ের মতো নয়৷ গ্রামের লোকদের সাথে ভালো উঠা নামা ছিল৷
______________

কেটারের উল্টা দোলকের ল্যাব ক্লাস চলছে৷ পরীর হাতে থামা ঘড়ি৷ থামা ঘড়িতেও মন দিতে পারছে না৷ বার বার উত্তর দিতে ভুল করছে৷ একের পর এক দোল দিচ্ছে হৃদয়৷ হৃদয় দোলনের মাঝে বলে উঠল,

“তোকে ঠিক আগের মতো দেখাচ্ছে না৷ অনেকটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে তোর মাঝে। ঠিকমতো কথা বলস না৷ চোখের নিচে কালি জমা পড়েছে৷ নিজের খেয়াল রাখোস না৷”

“দোস্ত তুই কি মনোবিজ্ঞানী হলি নাকি? আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিস যে৷ মতলব কি?”

হৃদয় আমতা আমতা করে বলল,
“কিসের মতলব? তুই সব সময় এক লাইন বেশি বুঝতে পারিস”

“বেশি না৷ শোন আমার বইয়ের ভাজে চিরকুট কে রেখেছে জানিস?”

“আমি কি করে জানব? ক্লাস শেষে এসব নিয়ে আলোচনা হবে৷”


একে একে চিরকুট সবাই পড়ল৷ কুহু চশমা ঠিক নাকের ডাগায় নিয়ে বলল,

“দোস্ত, তোকে এতো সুন্দর করে প্রপোজ কে করেছে? সত্যি করে বল? তুই আমাদের কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছিস না।”

ছোঁয়া চিরকুট হাতে নিয়ে বলল,

“প্রিয়তমা আমি তোমায় প্রথম দেখায় ভালোবেসে ফেলেছি। শয়নে স্বপনে, নয়নে শুধু তোমায় দেখি৷ আমি তোমাতেই আসক্ত। প্রথম দেখায় কাউকে ভালো লাগবে জানা ছিল না৷ তুমি আমার হৃদয়ের গহীন থেকে গহীনে রয়ে গেছো….।”

ছোঁয়া চিরকুটটা আর পড়তে পারল না৷ সমাপ্তি চিরকুট নিয়ে বলল,

“এখন মজা করার বিষয় নয়৷ আমরা ক্যাম্পাসে এসেছি দুই দুই চারদিন৷ কে হতে পারে? পরীর ক্ষতি করার জন্যও কেউ এমন করতে পারে৷ প্রথম দেখায় কাউকে এতোটা ভালো লাগে না৷ এগুলো সিনেমা থিয়েটারে হয়৷ বাস্তবতার সাথে কোনটায় মিল নেই৷”

কুহু চিন্তিত কন্ঠে বলল,

“দাদীমাদের মতো কথা বলা বন্ধ কর৷ আমাদের কেউ তেমন চিনে না৷ ক্ষতি করবে কে? অপরিচিত লোক কখনও ক্ষতি করে না৷ চেনা জানাশোনা লোক ক্ষতি করে৷”

সমাপ্তি বলল,

“তুই তাকে চিঠি লিখে আসতে বল৷ তারপর সবাই মিলে গণধোলাই দিব৷”

চলবে……

কে বাঁশি বাজায় রে পর্ব-০৬

0

#কে_বাঁশি_বাজায়_রে
#পর্ব_০৬
#নুর_নবী_হাসান_অধির

পরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এডমিশন পরীক্ষা দেয়৷ মর্মান্তিক বিষয় হলো পরীর ঢাবিতে চান্স হয়নি৷ সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছার স্বপ্নটা ভেঙে যায় নিমিষেই৷ পরবর্তীতে পরীক্ষা দেওয়ার মন মানসিকতা হারিয়ে ফেলে৷ পরিশেষে পলক হোসাইনের নির্দেশ অনুযায়ী সরকারি তিতুমীর কলেজে পদার্থবিজ্ঞান ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হয়৷

আয়েশা বেগম মেয়ের জন্য এই প্রথম আরিয়ানের মায়ের বাড়িতে পা রাখেন৷ তাদের বাসা বনানী ৮ নং রোড়ে৷ আরিয়ান বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুলে লেখাপড়া করছে। বিশাল বাড়িতে এলাহী কান্ড৷ সেসব বিষয়ে কোন আগ্রহ নেই৷ আশালতাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“পরীকে দেখে রাখবে৷ সতিনের মেয়ে ভেবে দূরে ঠেলে দিও না৷ পরীর কষ্ট হলে সবথেকে বেশি কষ্ট আমি পাব৷”
আয়েশা বেগমের হাত ধরে বলল,

“পরী আমারও মেয়ে৷ তাকে নিয়ে আপনি কোন চিন্তা করবেন না৷ আমার ভালোবাসায় কোন কমতি থাকবে না৷ আপনাদের আমি মাথায় করে রাখব৷”

দৃষ্টি নন্দন কথাগুলো মন ছুঁয়ে গেল৷ মেয়েকে ছেড়ে যেতে যেন বুক ফেটে যাচ্ছে৷ মনোবেদনার সহিত বলল,

“আমি গ্রামে চলে যাব৷ এখানে থাকব না৷ আমার বদলি হয়নি৷ আমার চোখে অনেক স্বপ্ন। আনন্দপুর গ্রামটাকে শিক্ষার নগরী বানাব৷ ভালোবাসা দিয়ে সকলের মনে অন্ধকার দূর করব৷”

“গ্রামে কেউ নেই৷ আপনি কেন গ্রামে একা একা থাকবেন৷ আপনাকে গ্রামে যেতে দিব না৷”
আয়েশা বেগমের চোখের কোণা ভেজে উঠল৷ ভেজা গলায় বলেন,

“আমার পারুল সেখানে একা আছে৷ আমি এখানে কিভাবে থাকব? আমাকে ছাড়া ভয় পাবে তো৷”
_____________

আরিফ অনেক চেষ্টা করেছে আসিফের খুনীকে বের করার৷ ফলাফল সব সময় শূন্য হয়েছে৷ ইউসুফ, জুয়েল, শামীমের কোন খুঁজ পাওয়া যায়নি৷ তাদের মা বাবা জানিয়ে দিয়েছেন তারা কখনও বাড়িতে ফিরে নি৷ তবুও কথাগুলো বিশ্বাস হয়নি৷ সকলের বাড়িতেই গোপন পাহারা বসিয়েছিল৷ মোটকথা, ফলাফল শূন্য।

আয়েশা বেগম গ্রাম পঞ্চায়েতের সামনে বসে আছেন৷ সামনে চা, বিস্কুট রাখা৷ চা অবহেলায় ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে৷ ঠান্ডা চায়ের কাপে চুমু দিয়ে বলেন,

“পঞ্চায়েত মশাই আপনাকে একটা কাজ করে দিতে হবে৷ আপনার কথা গ্রামের সবাই শুনেন৷ আপনি বললে সবাই এক কথায় রাজি হবে৷”
গ্রাম পঞ্চায়েত মশাই নড়েচড়ে বসে বলল,

“কাজটা কি? সরাসরি কাজের কথা বলেন৷ আমি কাজ ছাড়া অন্য কোন কথা পাত্তা দেইনা৷”

“গ্রামের সকল ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর কথা বলবেন। কৃষকের ছেলেরা কি সারাজীবন কৃষকই থাকবে? আমি কৃষিকাজকে ছোট করছি না৷ অক্ষর জ্ঞান থাকলেও এসব কৃষকরা কৃষিকাজে অনেক উন্নতি করবে৷ সঠিক সময়ে সার প্রয়োগ করবে৷ ফসল ভালো হবে৷”

“কৃষকের ছেলেদের পড়তে হবে না৷ আর মেয়ে মানুষের কিসের লেখাপড়া? তারা ঘরের কাজ করবে৷ মেয়ে মানুষের কোন লেখাপড়া লাগবে না৷ আর দামাল ছেলেরা কৃষি কাজ না করলে কে করবে? তাদের গায়ে অনেক জোর৷ লাঙ্গল চাষে জোর লাগে৷ আমি ভাবতেছি আমাদের গ্রামের স্কুলটা ভেঙে দিব৷ কলেজটাও ভেঙে দিব৷ লেখাপড়ার নামে ছেলেরা খারাপ হয়ে যাচ্ছে৷ সারাদিন স্কুলে পড়ে থাকে৷”

আয়েশা বেগম জানতেন এমন উত্তরই আসবে৷ তিনি মুচকি হেসে বলেন,

“পঞ্চায়েত মশাই আমি জানতাম আপনি এমন কথায় বলবেন৷ আমি স্কুলে যাওয়ার পর এমন কথা শুনেছি৷ আপনি স্কুল ভেঙে দিবেন৷ তাই আপনার কাছে এসেছি৷”

“ঠিকই শুনেছো৷ আমার জমিতে আমি স্কুল রাখব না৷ লেখাপড়া করার কোন দরকার নেই৷ আমি সব স্যারদের চলে যেতে বলেছি৷”

ঠান্ডা চায়ের কাপে আরও একটা চুমু দিয়ে বলেন,

“ঠান্ডা চা একদম ভালো লাগছে না৷ তেমনই আপনাকে উপড়ে ফেলে দিতেও গ্রামের লোকজনের দুই মিনিট সময় লাগবে না৷ আপনার অত্যাচার অনেক সহ্য করেছে৷ স্কুলের জমি সরকারের৷ সে জমিতে হাত দিলে আপনার হাত কেটে ফেলব৷ নিরক্ষরতা দূর করার জন্য অনেক কিছু করতে পারি৷”

গ্রাম পঞ্চায়েত মশাই রাগী কন্ঠে বলল,

“এই মাস্টন্নি, আপনাকে খুন করে ফেলব৷ বস্তা ভরে নদীতে ফেলে দিব৷ কোন কাক পক্ষী টেরও পাবে না৷”

“আমি আমার চিন্তা কখনও করিনা৷ আমি ছাত্রদের পক্ষে। তাদের গায়ে যদি ফুলের টুকাও পড়ে আপনাকে গ্রাম পঞ্চায়েত হওয়ার স্বাদ মিটিয়ে দিব৷”

আয়েশা বেগম কথাগুলো বলে এক মুহুর্ত দেরি করলেন না৷ তিনি সোজা বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন৷ রাগে আরিফের চোখের মণির চারপাশ লালচে বর্ণ ধারণ করেছে৷ ক্ষোভ নিয়ে বলল,

“বাবা আপনি ওই মহিলাকে যেতে দিলেন কেন? আপনাকে হুমকি দেওয়ার সাহস হয় কিভাবে? আদেশ করেন, উনার জীবনের ইতি টানব।”

“ধৈর্য ধারণ কর৷ আয়েশা বেগমকে আমি দেখে নিব৷ অতি বাড় বেড়েছে৷ ভেঙে পড়ার দিন চলে এসেছে৷ উলি পোকা পাখা গজায় মরিবার কালে৷ উনার পাখা গজিয়েছে৷ পাখাগুলো কেটে দিতে হবে৷”
______

ক্লাস শেষে পরীর কিছু বান্ধবীর সাথে পরিচয় হয়৷ ১৬০ জন শিক্ষার্থীর মাঝে ছাত্রীর সংখ্যা ১৬ জন৷ সব সব জায়গায় মেয়েদেরকে পিছিয়ে রাখা হয়েছে। লেখাপড়া করার কোন সুযোগ দিচ্ছে না৷ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মেয়েদের কোন মূল্য নয়৷ বেগম রোকেয়ার বানী আজও সকলের কাছে পৌঁছানো হলো না৷ মেয়েদের শিক্ষার জন্য কত সংগ্রাম করেছে৷ বিশ্বাস আছে একদিন প্রতিটি ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়বে৷

ক্লাস শেষে বান্ধবীদের সাথে বিজ্ঞান ভবনের সামনে কিছুক্ষণ আড্ডা দেয়৷ সকলের সাথে পরিচয় হয়৷ প্রথম দিনেই বন্ধুত্ব হয়ে যায় তিনজন মেয়ে এবং দুইজন ছেলের সাথে৷ সব থেকে প্রিয় মানুষে পরিণত হয় “সমাপ্তি” মানের মেয়েটা৷ বড়লোক বাবার মেয়ে হয়েও মনের মাঝে কোন অহংকার নেই৷ একসাথে অনেক সময় আড্ডা দিয়েছে৷ পরীর নামটা ভীষণ পছন্দ হয়েছে৷ জীবন চলার পথে একজন বন্ধুর প্রয়োজন৷ যে বন্ধু বিপদে পাশে থাকবে৷ দিনশেষে আজাইরা কথাগুলো শেয়ার করা যাবে৷ পরী সবাইকে বিদায় জানিয়ে বাসায় চলে আসে৷ চিঠি লিখতে বসে মা আয়েশা বেগমের কাছে৷

প্রিয় মা,
আসসালামু আলাইকুম। আমার সালাম নিবে৷ কেমন আছো? আল্লাহর রহমতে আমি ভালো আছি৷ “মা” ছোট্ট একটি শব্দ। যার কোন বিশ্লেষণ হয়না৷ প্রতিটি মুহুর্তে তোমাকে মিস করি৷ দিন শেষ রাতের বেলায় তোমায় একাকিত্ব বোধ করি৷ রাত যত গভীর হয় তোমাকে তত মিস করি৷ ইচ্ছা করে তোমার কাছে ছুটে যেতে৷ দুই হাতে তোমায় জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছা তোমায় খুব ভালোবাসি৷ তোমায় ছেড়ে কোথাও যাব না৷
নিজের খেয়াল রাখবে৷ সঠিক সময়ে খাবার খাবে৷

ইতি
তোমার ছোট্ট মেয়ে
পরী

অল্পকথাগুলো লিখতেই পরীর চোখে জল চলে আসে৷ একমাত্র ভালোবাসার ছায়াকে ছেড়ে দূরে থাকার মতো কষ্ট কিছুই নেই৷ কাছে থাকলে কখনও সন্তানরা মা, বাবার কদর বুঝে না৷ একটু চোখের আড়াল হলে বুঝতে পারে মা বাবা ছাড়া পুরো পৃথিবী অন্ধকার।
____________

গভীর রাতে আরিফ তার দলবল নিয়ে আয়েশা বেগমের বাড়িতে হামলা করে৷ কিন্তু মনোবেদনার বিষয় আয়েশা বেগম বাড়িতে নেই৷ বাড়ির সদর দরজা হাঁক করে খোলা৷ বাসায় ঢুকে আয়েশা বেগমকে কোথাও পেল না৷ আরিফ রাগ নিয়ে বলল,

“এই মহিলা এতো রাতে কোথায় যেতে পারে? সে কি আমাদের ভয়ে পালিয়েছে? বুঝতে পেরেছে আরিফ কি জিনিস?”
পিছন থেকে একজন বলে উঠল,

“উনি মনে হয় ঢাকায় চলে গেছেন৷ পরী এখন ঢাকা থাকে৷ পরীর সাথে থাকবে এখন থেকে৷”
আরিফ উচ্চ হাসি দিয়ে বলল,

“কথা বলার সময় সব সময় সবার উপরে থাকে৷ কাজের বেলায় ভেজা বিড়ালের মতো লেজ গুটিয়ে পালায়।”

প্রকৃতির নিয়মেই প্রতিদিন ভোরের আলো ফুটে৷ সোনালী আলোয় মেঠো পথ ধরে আয়েশা বেগম স্কুলে পৌঁছাল৷ ক্লাস রুমের সকল দরজা জানালা কে জানি ভেঙে ফেলেছে৷ শিক্ষার্থীরা স্কুল মাঠে জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ আয়েশা বেগম স্কুল গেইটে প্রবেশ করতেই সকল শিক্ষার্থী অভিযোগ শুরু করল৷ আয়েশা বেগম সবার উদ্দেশ্য বলেন,

“সভ্যতার শুরুতে পন্ডিতরা গাছের নিচে শিক্ষা দান দিতেন৷ সেখানে স্কুলের দরজা বিশেষ কিছু নয়৷ দরজা খুব তাড়াতাড়ি লাগানো হবে৷ তোমরা মন দিয়ে ক্লাস কর৷”

শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ ক্লাসে চলে যায়৷ আয়েশা বেগম ক্লাস শেষে গ্রাম পঞ্চায়েত মশাইয়ের বাড়িতে যান৷ আয়েশা বেগমকে দেখেই পঞ্চায়েত বলেন,

“আমি জানতাম আপনি আসবেন। কিন্তু ভরদুপুরে আসবেন জানা ছিল না৷ ভেবে ছিলাম সকালেই আসবেন৷”
অন্ধরমহলের দিকে হাঁক করে বলেন,

“কে আছিস? স্কুল শিক্ষিকাকে চা বিস্কুট দে।”
আয়েশা বেগম চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলেন,

“আপনি কাজটা খুব অন্যায় করেছেন৷ আপনার সাথে আমার কোন শত্রুতা ছিল না৷ আপনি সেই শত্রুতার সূত্রপাত করলেন৷ আপনার এতো ক্ষমতা আসিফের খুনীকে বের করতে পারলেন না৷ স্কুল একটা পবিত্র জিনিস৷ ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ জীবনের চাবিকাঠি। আপনি সেটা নিয়ে পড়ে আছেন৷
পঞ্চায়েত মশাই অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলেন,

” আমার ছেলেকে খুন করে এই পৃথিবীতে কেউ বেঁচে থাকতে পারেনি৷ তার বন্ধুদের খুঁজ এখনও পাওয়া যাইনি৷ আমি ঘাসে মুখ দিয়ে চলি না৷”
আয়েশা বেগম মুচকি হেসে বলেন,

“আপনি সত্যিই খুবই বোকা৷ তাদেরকে কোনদিন খুঁজে পাননি৷ অনেক তো অত্যাচার করেছিলেন৷ তাদের তিনজনের খুঁজ একমাত্র আমি জানি৷ আমার সাথে মিথ্যা বলতে আসবেন না৷”

আয়েশা বেগমের কথায় গ্রাম পঞ্চায়েতের হিঁচকি উঠে৷ পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলল,

“পানি খান। এমন অনেক অজানা তথ্য আমার কাছে আছে৷ যেমন আপনাকে না জানিয়ে আরিফ রাতে আমাকে হত্যা করতে গিয়েছিল৷ ভাগ্য আরিফের ভালো ছিল৷ নয়তো আরিফের লাশ পাওয়া যেত নদীর জলে৷ স্রোতে অন্য কোথাও নিয়েও যেতে পারত৷”

গ্রাম পঞ্চায়েত মশাই নড়েচড়ে বসলেন৷ এতোদিন আয়েশা বেগমকে সহজ মানুষ হিসেবে ধরে নিছিলেন৷ ভুলেই গেছিলেন তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা৷ জীবন বাজি রেখেছে যুদ্ধ করেছিলেন৷ ১৯৯৭ সালে বেগম রোকেয়া হলে থাকাকালীন ৮০% মেয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন৷ গ্রাম পঞ্চায়েত মশাই ক্ষোভ নিয়ে বলল,

“আপনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন সেজন্য আপনাকে ভয় পাব! আপনার ধারণা ভুল৷ স্কুল আপনার কাছ থেকে খুব দ্রুত কেঁড়ে নিচ্ছি৷”

“শুভকামনা রইল৷ আপনি কাজগুলো মনোযোগ সহকারে করবেন৷ আয়েশা বেগমের অগ্নি রুপ দেখতে পারবেন৷ কারণ আমার হারানোর কিছু নেই৷”

চলবে……

কে বাঁশি বাজায় রে পর্ব-০৫

0

#কে_বাঁশি_বাজায়_রে
#পর্ব_০৫
#নুর_নবী_হাসান_অধির

আঁধার কেটে ধরনী নব পল্লবের মতো আলোয় আলোকিত হয়ে উঠে৷ মানবজাতি বেঁচে থাকার নতুন অধ্যায়ে পা রাখে৷ এক টুকরো সুখের জন্য তেপান্তর পেরিয়ে কাজে যায়। কৃষির সাথে কৃষকদের গড়ে উঠে নতুন অনুষঙ্গ।

পরীর গা থেকে জ্বর নেমে গেছে৷ গতকালের পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিল না৷ সকল পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করে নিল৷ আরিয়ানকে নিয়ে নদীর ঘাটে চলে যায়৷ নদীতে ছিপ ফেলে মাছ ধরবে৷ পরীর কাছে ছিপ ফেলে মাছ ধরার মতো বৃথা চেষ্টা করার মতো কাজ পৃথিবীতে অদ্বিতীয়। শখের বসে ছিপ ফেলে বসে থাকা যায়৷ নদীতে ছিপ ফেলে মাছ ধরার জন্য প্রহরের পর প্রহর বসে থাকতে হয়৷

পলক হোসাইন সকালের খাবার শেষ করে আয়েশা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“পরীকে নিয়ে কি ভাবলে? ভার্সিটির কোচিং করাবে নাকি মেডিক্যাল কোচিং৷ আমার মতে ভার্সিটির কোচিং করানোই ভালো হবে৷”

আয়েশা বেগম লাহাড়ি ঘরের সামনে বসে চাল ঝার দিচ্ছিল৷ পলক হোসাইনের কথায় মাথা তুলে তাকালেন৷ ঠোঁট কিঞ্চিৎ প্রসারিত করে বলেন,

“পরীকে নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না। পরীকে নিয়ে ভাবার জন্য আমি আছি৷ স্কুল প্রধানের কাছে বদলির জন্য চিঠি লিখেছি৷ মেয়ের পড়াশোনার জন্য আমরা কোথায় যাচ্ছি সেটার খুঁজ আপনি কোনদিন পাবে না৷”

রাগে গা শিহরিত হয়ে উঠল৷ ক্ষোভ নিয়ে প্রশ্ন করল,

“পরী কি তোমার একার মেয়ে?”

“জন্ম দিলেই বাবা হওয়া যায়না৷ বাবা হওয়ার দায়িত্ব পালন করতে হয়৷ কোনদিন বাবার দায়িত্ব পালন করেছেন। সেই ৭৪ থেকে আমি পরীকে দেখে রেখেছি৷ পরীর গায়ে কোন আঁচ আসতে দেয়নি৷ আর কখনও আসতেও দিব না৷”

“দায়িত্বশীল মা হয়ে বড় মেয়েকে বাঁচাতে পারলে না কেন? পরী আমার মেয়ে৷ ঢাকায় যাওয়ার সময় আমি পরীকে সাথে নিয়েই যাব৷ সাহস থাকলে আটকিয়ে দেখিও৷ এই গ্রামে আমি পরীকে রাখতে চাইনা৷”
আয়েশা বেগম পারুলের কথা শুনে কিছুটা কষ্ট পান৷ কিন্তু সেই কষ্ট বাহিরে প্রকাশ করলেন না। শান্ত গলায় বলেন,

“পরী যেতে চাইলে নিয়ে যান৷ এমন যেন না হয় আপনার লাশের উপর দিয়ে পরীকে অন্য কোথাও নিয়ে যায়৷ পারুল, পরীর জন্য তো ভালো বাবা হতে পারলেন না৷ অন্তত আরিয়ানের জন্য ভালো বাবা হোন৷ আরিয়ানের জন্য আপনি এখনও আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন৷ নয়তো আপনার ঘাড়ে মাথা থাকত না৷ আমি আমার সন্তানদের এতিম করতে চাইনা৷”

আয়েশা বেগমের কথায় আরও রেগে যান৷ সামনের রাখা চেয়ালে লাথি দিয়ে কর্কশ কন্ঠে বলল,

“অস্ত্র তুমি একা চালাতে জানো না৷ আমিও প্রয়োজনে অস্ত্র হাতে তুলতে পারি৷ আমাকে তুমি মেয়ের কাছ থেকে আলাদা করতে পারবে না৷”

আয়েশা বেগম মুচকি হেঁসে চাল নিয়ে লাহাড়ি ঘরে চলে যান৷ আয়েশা বেগম বিচক্ষণ মানুষ৷ সব সময় বুদ্ধি বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন৷ মুক্তিযুদ্ধে তার উপস্থিতির বুদ্ধি দেখে নারীদের দলে প্রধান করা হয়েছিল৷ তার হাসিতে রহস্যের গন্ধ পাওয়া যায়৷
_________

পঞ্চায়েত মশাই একেবারে ভেঙে পড়েন৷ উনার মেজো ছেলে আসিফের মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না৷ আসিফ যাদের সাথে চলাফেরা করত সবাইকে তুলে আনা হয়েছে৷ চলছে তাদের উপর নির্মম অত্যাচার৷ পঞ্চায়েতের মতোই উনার বড় ছেলে আরিফ৷ খারাপের সকল বৈশিষ্ট্য তার মাঝে বিরাজ করে৷ এমন কোন কাজ নেই সে করে না৷ আরিফ ইউসুফের পায়ে গরম তেল ঢেলে বলল,

“বল, আসিফকে কে হত্যা করেছে? মুখ না খুললে তোদের কারোর বেঁচে থাকার অধিকার নেই৷ গরম তুলে তোদের ডুবিয়ে মা’রব।”

ইউসুফ, জুয়েল, শামীম সকলের চোখে মৃত্যুর ভয়৷ কোনদিন ভাবেনি এমন কিছু হবে৷ ইউসুফ আকুল আবেদনের সাথে মিনতি করে বলল,

“বিশ্বাস করেন ভাই৷ আসিফের সাথে আমরা ছিলাম না৷ তুহিন ছিল৷ তুহিনকে মে’রে ফেলেছে৷ আমরা তো মাঝে মধ্যে আড্ডা দিতাম৷”

তাদের কারো কথা আরিফের বিশ্বাস করছে না৷ গরম তেলে ইউসুফের পা ঝলসে গেছে৷ এর থেকে মৃত্যুই ভালো ছিল৷ জুয়েলের কাছে যেতেই আরিফের ডাক পড়ে৷ বসার ঘরে আয়েশা বেগম বসে আছেন৷ আয়েশা বেগমকে দেখে অনেকটা রাগ হয়৷ কিন্তু সময় পরিস্থিতি বুঝে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখে৷ উচ্চস্বরে বলল,

“কাজের সময় বিরক্ত করা একদম পছন্দ করিনা৷”

“তোমার কাজ মানুষদের ভয় দেখানো৷ তাদের জায়গা সম্পত্তি দখল করা৷ নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে কিছু করতে পারনা৷ নিশ্চয় কাউকে বেঁধে রেখেছো?”
আরিফ অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

“ম্যাডাম আমাকে ক্ষেপিয়ে দিবেন না৷ আমি ক্ষেপে গেলে ফল ভালো হবে না৷”

আরিফের রাগ আয়েশা বেগম একটু ভয় পেলেন না৷ অন্য কেউ হলে এতোক্ষণে ভয়ে হিসু করে দিত৷ গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলোকে একটু ভয় দেখালেই রুখে দাঁড়ানোর সাহস পাইনা৷ আয়েশা বেগম শান্ত স্বরে বলেন,

“হুমকি অন্য জায়গায় দেখাবে৷ আমার সামনে ফাঁকা আওয়াজের কোন দাম নেই৷ নিজেকে সাবধানে রাখবে৷ তোমার অত্যাচারের মাত্রা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে৷ কে জানে? আসিফের পর তোমাকেই লক্ষ্য করতে পারে৷”

টেবিলের উপর দুই হাত দিয়ে জোরে শব্দ করে৷ আয়েশা বেগমের দিকে ঝুঁকে বলেন,

“আসিফ পরীকে ভালোবাসত৷ ভালোবাসার মানুষকে ভাইয়ের কাছে পাঠাতে পারি! মেয়ে নিয়ে মেয়েকে নিয়ে সাবধানে থাকবেন৷”
আয়েশা বেগম মুচকি হেঁসে জবাব দিলেন,

“খেলা শুরু৷ খেলায় কে জিতে দেখা যাবে?”
__________

আয়েশা বেগম আর পরী দাঁড়িয়ে আছে একটা গণকবরের সামনে৷ অঝোরে অশ্রুকণা ঝরে যাচ্ছে৷ কোন কিছুতেই বাঁধ মানছে না৷ নিজেকে সবথেকে অসহায় মনে হচ্ছে৷ আয়েশা বেগমের আপন বলতে দুনিয়াতে কেউ নেই৷ এই গণকবরে শায়িত আছে আয়েশার মা, বাবা, ভাই, বোন। পাক সেনারা কাউকে বাঁচতে দেয়নি৷ নির্মমভাবে হত্যা করেছে সপরিবারকে। গ্রামের লোকজন কোন রকম সবাইকে একসাথে সমাধি করেন৷ আয়েশা বেগম কবরের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন,

“নিজের সাথে আর যুদ্ধ করতে পারছি না৷ খুব ক্লান্ত লাগছে নিজেকে৷ পলককে ভালোবেসে ঘর বেঁধেছিলাম৷ আমার ভালোবাসায় কোন কমতি ছিল না৷ আজও তাকে অনেক ভালোবাসি৷ তাকে সামনে দেখলে নিজেই দুর্বল হয়ে পড়ি৷ কেন ভালোবাসার মোহ থেকে বের হতে পারছি না?”

কথা বলতে বলতে হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ে৷ অভিযোগ করার একমাত্র আশ্রয় কবর। মনের গহীনে যত অভিযোগ ছিল সবই বহিঃপ্রকাশ পাচ্ছে৷ পুনরায় উদাসী কন্ঠে বলল,

“আমাকে সাহস ভরসা দেওয়ার মতো কেউ নেই৷ আমি বেঁচে থেকেও জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে আছি৷ ভালোবাসার মানুষ যখন ছেড়ে চলে যায় তখন পুরো পৃথিবী অন্ধকার। এতোটায় ভালোবাসি যে ঘৃণার প্রশ্নই আসে না৷ আমার কাছ থেকে সবকিছু কেঁড়ে নিয়েছে৷ আমি কিছু বলিনি৷ আমার মেয়ের দিকে হাত বাড়ালে আমি ভালোবাসা ভুলে তার হাত কেটে ফেলব৷”

পরীর চোখেও জল৷ মায়ের কান্না দেখে নিজের অজান্তেই কখন যে চোখে জল এসে পড়েছে খেয়াল নেই। পরীর মায়ের কাঁধে হাত রেখে বলল,

“যা হারানোর তা অনেক আগেই হারিয়েছো৷ এখন আর হারানোর ভয় নেই৷ আমি কোনদিন তোমাকে ছেড়ে যাব না৷ তোমায় সব সময় আমি আগলে রাখব। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তোমার পাশে থাকব৷”

আয়েশা বেগম মেয়ের হাতের তালুতে আলতো করে ঠোঁট স্পর্শ করল৷ ভালোবাসায় ভরিয়ে দিল হাতে৷ বেঁচে থাকার জন্য মনে জোর পেল৷ বুকের গহীনে থাকা পাথরটা হালকা হলো৷ আড়ালে আবডালে থেকে উঁকি দেওয়া ভয়গুলো আড়াল থেকেই দেশান্তর হলো৷ নিকটে আসার সাহস নাহি পেল ৷ মায়ায় জড়ানো কন্ঠে বলল,

“তুই আমার পাশে থাকলে তোকে কেউ আমার কাছ থেকে আলাদা করতে পারবে না৷ জীবনের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে হলেও তোকে রক্ষা করব৷ তুই শুধু আমার পাশে থাক৷”
_________________

পলক হোসাইনকে রাতেই ঢাকা ফিরতে বাধ্য করেছে৷ আসরের নামাজ শেষ করে পলক হোসাইনের সামনে যাই আয়েশা বেগম। পাশে বসে ছিল আশালতা এবং আরিয়ান৷ সরাসরি সবার উদ্দেশ্য বলে উঠল,

“আপনারা আজই ঢাকায় চলে যান৷ এই বাড়িতে আর থাকতে পারবেন না৷ থাকলে থাকতে পারেন সমস্যা নেই৷ আমি আর পরী একটা কাজের জন্য শহরে যাচ্ছি৷ ফিরতে দুইদিন সময় লাগবে৷ দুই দিন থেকে যেতে পারেন।”
পলক হোসাইন আরিয়ানকে পরীর কাছে পাঠিয়ে দিল৷ এক পলক তাকিয়ে বলল,

“হঠাৎ শহরে কেন যাচ্ছো? আমার মতে, এমন কোন বিশেষ কোন কাজ নেই৷”

“কাজ আছে৷ পরীকে নিয়ে আমি শহরের দিকে থাকব৷ সেখান থেকে পরী ঠিকমতো কোচিং করতে পারবে৷ বাসা দেখতে যাব৷ দুইদিন আমরা এক ম্যাডামের বাসায় থাকব৷”

“কিন্তু… ”

“কোন কিন্তু নয়৷ আমি যেতে বলেছি মনেই এখন যাবেন৷ আপনাকে আর অপমান করতে চাইনা৷ পরীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নেন। আপনার সাথে পরী যেতে চাইলে নিয়ে যান৷ আমি আটকাব না৷”

পরী কখনও বাবার সাথে যাবে না অটুট বিশ্বাস আছে। পলক হোসাইন প্রস্থান করলে আশালতার উদ্দেশ্য করে বলেন,

“সব কিছুর ঊর্ধ্বে ভালোবাসা। ভালোবাসা দিয়েই সবকিছু জয় করা যায়৷ ভালোবাসা দিয়েই আবার সবকিছু ধ্বংস করা যায়৷ তোমার উপর আমার কোন রাগ, অভিমান, ক্ষোভ কিছুই নেই৷ সবথেকে বড় কথা তুমি একজন মা৷ মা হয়ে তুমি সব করতে পারবে৷”

“আমাদের সাথে ঢাকায় চলেন৷ পরীকে আমি নিজের মেয়ে মনে করি। আমাদের বাসা থেকে পরী লেখাপড়া করবে৷ আপনাদের কখনোও অবহেলা করব না৷ মাথায় করে রাখব।”
আশালতার হাত ধরে বলল,

“তোমাকে আমার যতই ভালো লাগুক। যাকে মন থেকে ভালোবেসেছি সে যখন তোমার সাথে সময় কাটাবে তা দেখতে পারব না। অন্য কারোর সাথে দেখার থেকে মৃত্যু অনিবার্য। দূর থেকে সবকিছু সহ্য করতে পারব৷ কাছ থেকে কিছুই সহ্য করতে পারব না৷ দোয়া করি, তোমাকে যেন কোনো কষ্ট ছুঁতে না পারে৷”

“আপনাকে আমিও আজ একটা কথা দিচ্ছি৷ আমি আপনার চোখের জল একদিন মুছে দিব৷ আপনি আমাদের সাথেই থাকবেন৷ সবকিছু ভাগ দেওয়া যায়৷ ভালোবাসার কোন ভাগ হয়না৷ আমি আপনার ভালোবাসা কেঁড়ে নিছি৷ আপনার চোখে আমি সবথেকে বড় শত্রু৷ আমিই আপনার কষ্ট দূর করব৷ বড় বোনের থেকেও অনেক ভালোবাসি আপনাকে৷”

আয়েশা বেগম আশালতাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল৷ মেয়েটা অন্য সকল মেয়ের থেকে ভিন্ন। কেউ সতিন দেখতে পারে না৷ সেখানে মেয়েটা অনেক ভালোবাসে৷ সব সময় সম্মান করে৷ কতই না অপমান করেছে৷ তবুও কিছুই বলেনি৷ নিজে সব দোয়া কাঁধে নিয়েছে৷
____________

নিখুঁত মৃত্যু আরিফ এর আগে কখনও দেখেনি৷ নিজের বাড়িতেই এসে কেউ এভাবে নাকের ডগা দিয়ে চলে যাবে বুঝতে পারেনি৷ কে হতে পারে? পাগলা কুকুরকেও হার মানিয়েছে৷ ইউসুফ, জুয়েল, শামীমকেও মুক্ত করেছে৷ কেউ কিছুই বুঝতে পারছে না৷ আরিফের ভয়টা আরও তীব্র হয়৷

চলবে…….

কে বাঁশি বাজায় রে পর্ব-০৪

0

#কে_বাঁশি_বাজায়_রে
#পর্ব_০৪
#নুর_নবী_হাসান_অধির

গ্রাম পঞ্চায়েত বাড়ির বউ হতে চলছে পরী৷ সারা গ্রাম জুড়ে পরীর কথা লটে যাচ্ছে৷ বিয়ের বাকী মাত্র একদিন৷ সমস্ত গ্রাম জুড়ে এলাহি আয়োজন। শহর থেকে রাজকীয় পালকি ভাড়া করে নিয়ে আসা হয়েছে। আসিফের জন্য ঘোড়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ আসিফ ঘোড়ার পিঠে চড়ে বিয়ে করতে যাবে৷

পলক হোসাইন পা স্থির রাখার সুযোগ পাচ্ছে না৷ মেয়ের বিয়ের জন্য দৌড়ে দৌড়ে কাজ করছে৷ রমরমা পরিবেশ। বাড়িতে অনেক লোকের আগমন। পরী মাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে৷ ভেজা গলায় বলল,

“আমি কিছুতেই আসিফকে বিয়ে করব না৷ আসিফের মতো খারাপ ছেলের সাথে সারাজীবন সংসার করতে পারব না৷ সেখানে কিছুতেই সুখী হতে পারব না৷ আসিফ এক নারীতে আসক্ত নয়৷ আমার টাকা পয়সা চাইনা৷ যে পুরুষ এক নারীতে আসক্ত সেই পুরুষকে ভালোবাসতে চাই৷”

মেয়ের পিঠে আলতো করে হাত রেখে বলল,

“চিন্তার কোন কারণ নেই৷ আমাদের কাছে পুরো দিনটাই আছে৷ আল্লাহর নীলা খেলা কেউ বুঝতে পারে না! কে বলতে পারে কাল সূর্যোদয় আসিফের নসিবে নেই?”
পরী চকিত স্বরে বলল,

“মা, তোমার কথার মাঝে কেমন জানি রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি৷ তুমি কি করতে চাও৷ একবার মনে হয় বিয়েটা হবে৷ আরেকবার মনে হয় বিয়েটা হবে না৷

“সময়ের হাতে সবকিছু ছেড়ে দে৷ সময় সবকিছু মানুষকে ফিরিয়ে দিবে৷ আমার কানে এখনও পারুলের কন্ঠ ভেসে আসে৷ আমি কাউকে ছাড়ব না৷”

বলতে বলতে চোখ দু’টো ভেজে উঠল৷ পরীর চোখের জল টলমল করছে৷ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বলল,

“আপু আমাদের মাঝে থাকতে আমরা কতই না সুখে ছিলাম৷ মাঝ রাতে মাঝে মধ্যে নৌকা নিয়ে দক্ষিণ দিকে ছুঁড়ে চলতাম৷ নদীর বয়ে চলা পানি দেখতাম৷ এখন সবকিছু স্মৃতি হয়ে রবে৷ আমাদের মন থেকে ভালোবাসা নামক শব্দটির পরিসমাপ্তি ঘটেছে৷”

“পারুলের জন্য মন খারাপ করবি না৷ আল্লাহর কাছে পারুলের জন্য দোয়া কর৷ পরকালে পারুল যেন ভালো থাকে৷ মনে মনে পণ নে, পারুলের এমন অবস্থার পিছনে যারা আছে তাদের ছেড়ে কথা বলবি না৷”
___________

রাতের খাবার শেষ করে মা মেয়ে চুপিসারে বেরিয়ে পড়ে৷ প্রকৃতি আজ নৌকা ভবনে তাদের সঙ্গী হচ্ছে না৷ সন্ধ্যার দিকে চাঁদের দেখা পেলেও রাতে মেঘমালার সাথে মিশে গেছে। নৌকার বৈঠা নিয়ে মাটিতে ধাক্কা দিয়ে নদীর মাঝে আসল৷ নৌকা চলল আইয়ুব আলী বাড়ির দিকে৷ প্রতিদিন দক্ষিণ দিকে নৌকা নিয়ে ঘুরতে যেত৷ সেদিকে নদীর স্রোতে যাওয়া যায়৷ নদীর প্রসস্থ বেশি৷ আজ স্রোতের বিপরীত দিকে যাচ্ছে৷ কৌতুহল নিয়ে পরী প্রশ্ন করল,

“মা, আমরা তো এদিকে কোনদিন যাইনি৷ আমরা সব সময় দক্ষিণপাড়ার দিকে যেতাম৷”

“সময়ের সাথে সাথে সবার চাওয়া পাওয়া ভিন্ন হয়৷ আজ তোকে বিশেষ দু’জন মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দিব৷”

রাতের আঁধারে মা মেয়ের মুখমন্ডল স্পষ্ট দেখা না গেলেও পরীর মুখে ভয়ের ছাঁপ বুঝা যাচ্ছে৷ চকিত হয়ে উত্তেজিত কন্ঠে বলল,

“কে আসবে আমাদের সাথে দেখা করতে? প্রতিটি মানুষ এখন ঘুমের দেশে।”

“আজ তোর জীবনের পরীক্ষা হবে৷ যেই আসুক তোকে পরীক্ষা দিতেই হবে৷ এটা তোর জীবনের পরীক্ষা। তুমি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারলে আসিফকে তোমার বিয়ে করতে হবে৷”

আয়েশা বেগমের কথা শুনে পরীর মুখ শুকিয়ে যায়৷ কি বলবে বুঝতে পারছে না? মনের সাথে রীতিমতো যুদ্ধ করে যাচ্ছে৷ পরী ভীতু কন্ঠে বলল,

“চরিত্রহীন ছেলে কোনদিন বিয়ে করব না৷ প্রয়োজন পড়লে নিজেকে শেষ করে দিব৷ তবুও আসিফকে বিয়ে করব না৷”
নৌকার গতি কমিয়ে বলল,

“নিজেকে নয়৷ অন্যকে শেষ করতে হবে৷ পারবি তুই নিজেকে বাঁচানোর জন্য অন্যকে হত্যা করতে! পারবি কি কাউকে খুন করতে৷ পারবি কি হাতে অস্ত্র তুলে নিতে?”

পরীর হাত পায়ে কম্পন শুরু হয়েছে রীতিমতো৷ ভীতু মন পরিস্থিতির সাথে যুদ্ধ করতে পারছে না৷ কি বলবে বুঝতে পারছে না? আয়েশা বেগম লন্ঠনের প্রতীপ তুলে লন্ঠনের আলো বাড়িয়ে দিল৷ নৌকার পাঠা থেকে বের করল দুইটা রামদা৷ দু’টো হাতে নিয়ে বললেন,

“তুই যদি কাউকে খুন করতে না পারিস আজ আমি নিজেকে শেষ করে দিব৷ কোনদিন মায়ের মুখ দেখতে পারবি না৷ মা নামক ছায়া তোর জীবনে থাকবে না৷ এখনই নিজেকে শেষ করে দিব৷”
রামদা আয়েশা বেগম নিজের গলার দিকে নিয়ে যেতেই পরী চিৎকার করে বলল,

“আমি তোমার জন্য সবকিছু করতে পারি৷ একটা কেন হাজারটা খু’ন করতে পারি।”
গম্ভীর স্বরে বলেন,

“চোখের জল মুছে ফেল৷ সময় আসন্ন। এখনই তোর পরীক্ষা শুরু হবে৷ মনে ভয় থাকলে আমাকে চিরদিনের জন্য হারাবি৷”

পরী হাতের পিছনের অংশ দিয়ে চোখের পানি মুছল৷ মন কিছুতেই সায় দিচ্ছে না৷ কখনও মা’কে এমন নিষ্ঠুর হতে দেখেনি৷ কাউকে মা’রার জন্য উৎসাহিত করবে। চোখে মুখে প্রতিশোধের আগুন৷ কিছুক্ষণের মাঝে নৌকা ঘাটে থামল৷ আসিফ এবং তুহিন নৌকায় উঠল৷ তাদের দেখে পরী রীতিমতো অবাক৷ মনে পড়ল দুপুরের কথা৷ ‘আসিফের নসিবে সূর্যোদয় না থাকে৷’ মনে পড়তে সমস্ত শরীর শিহরিত হয়ে মনের অজান্তেঔ ঝাঁকুনি দিল৷ আয়েশা বেগম স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

“তোমরা এখানে এসেছো কেউ জানে না? কেউ জানলে আমি কাল বিয়ে ভেঙে দিব৷”

গোপনে তুহিনের সাথে আয়েশা বেগমের কথা হয়৷ তিনি তুহিনকে বলেন,
“পরীকে তোমার সাথে বিয়ে দিব৷ তার বিনিময়ে আসিফকে এক জায়গায় বন্ধি করে রেখে দিব৷ বিয়ের পর আমরা তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসব৷” বোকা তুহিন আয়েশা বেগমের কথায় ভুলে যায়৷ অবশ্য পরী দেখতে শুনতে বাবার মতোন৷ গায়ের রং উজ্জল ফর্সা৷ সমাজে ফর্সা চেহারার কদর বেশি৷ তুহিন বলল,

“কেউ জানে না৷ সবাই ঘুমিয়ে পড়েছেন৷ কবিরাজের কাছ থেকে ঘুমের ওষুধ নিয়ে গেছিলাম৷ তরকারির সাথে মিশিয়ে দিয়েছিলাম। খাওয়ার কিছুক্ষণ পরই ঘুমিয়ে পড়েছে৷ আমরা দু’জন সে খাবার খাইনি৷”

আসিফ পরীর দিকে তাকাচ্ছে আর মুচকি হাসি দিচ্ছে৷ পরী অনমনে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। সবকিছু লক্ষ্য করল আয়েশা বেগম৷ আসিফের চাহনি খুবই বাজে৷ মুচকি হাসির সাথে জিহ্ব দিয়ে ঠোঁট ভেজাচ্ছে৷ নৌকা ঘাটে থামাল৷ লাফ দিয়ে আসিফ আর তুহিন নেমে পড়ে৷ পরী নামার আগে আয়েশা বেগম পরীর হাত ধরে ফিসফিস করে বলল,

“তুই তুহিনের মাথায় আঘাত করে অজ্ঞান করে দিবি৷ তারপর হাত পা বেঁধে এখানে দাঁড়াবি।”

আয়েশা বেগম নৌকা থেকে নেমে আসিফকে নিজের কাছে ঢেকে বলল,

“তোমার সাথে কিছু কথা আছে৷ কথাগুলো আমি একান্ত বলতে চাই৷ তাই এতো রাতে তোমাকে নিয়ে এসেছি৷”
তুহিনকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“পরী একা ভয় পাবে৷ তুমি একটু তার সাথে যাও৷ দূরে কোথাও যাবে না৷ এখানেই থাকবে৷”

তুহিন পরীর কাছে আসতেই পরী তুহিনের মাথায় পরপর দুইটা আঘাত করল৷ তুহিনের চিৎকারে আসিফ পিছনে ঘুরার সঙ্গে সঙ্গে আয়েশা বেগম রামদা দিয়ে আসিফের পায়ে আঘাত করে একটা পা কেটে দেন৷ ঘটনা এতো তাড়াতাড়ি ঘটে যে কিছুই বুঝতে পারেনা৷

পরী রশি দিয়ে তুহিনের হাত পা বেঁধে ফেলে৷ মাথা থেকে রক্তের ফোয়ারা বয়ে যাচ্ছে৷ এই মুহুর্তে নিজেকে সব থেকে নিষ্ঠুর মানুষ মনে হচ্ছে৷ পরী আসিফের চিৎকার শুনে কাছে আসে৷ এতোক্ষণে আসিফের দুটো পা কেটে ফেলেছে৷ আসিফ বাঁচার জন্য আকুতি মিনতি করছে৷ হাত জোড় করে বলল,

“আপনাকে মা’রবেন না৷ আমি আপনার পায়ে পড়ি৷ আমি পরীকে বিয়ে করব না৷ এখন আমার পা দু’টোর মাঝে একটিও নেই৷ তবুও আমি বাঁচতে চাই৷ আমাকে বাঁচতে দেন৷”
আয়েশা বেগম গম্ভীর স্বরে বলেন,

“আমার কলিজার টুকরো, আমার পারুলকে তোরা বাঁচতে দেসনি৷ সারারাত তার উপর অমানবিক নির্যাতন করেছিস৷ ক্ষুধার্ত পশুর মতো ঝাপিয়ে পড়ছিলি৷ আমাকে মেয়ে বাঁচতে দিলি না৷ আমি তোকে কিভাবে বাঁচতে দিব৷”
আসিফ হামাগুড়ি দিয়ে আয়েশা বেগমের দিকে আসতে আসতে বলল,

“জীবনেও এমন কাজ করব না৷ আমাকে পৃথিবীর আলো দেখার একটা সুযোগ দেন৷”
আসিফের দেহ থেকে একটা হাত কেটে ফেলল। দেহ থেকে রক্ত ছিঁটকে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল৷ গম্ভীর স্বরে বলেন,

“তুই বেঁচে থাকলে তো ভালো হবি৷ তোদের এমন শাস্তি দিব যে ধ’র্ষণ তো দূর কেউ কোন মেয়ের দিকে খারাপ নজরে তাকাতেও পারবে না৷”

আসিফের চিৎকার কেউ শুনতে পাচ্ছে না৷ জনমানবহীন এলাকায় কেউ নেই৷ চারদিকে ধূ ধূ বন৷ ঠান্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে৷ আসিফকে আর কিছু বলার সুযোগ দিল না৷ আসিফের আরও একটা হাত কেটে ফেলল। বাঁচার জন্য অনেক আকুতি মিনতি করছে৷ নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও বাঁচার জন্য একটু চেষ্টা করছে৷ তারপর আসিফের লিঙ্ক কেটে ফেলল৷ সর্বশেষে আসিফের গলা কেটে ফেলল৷ তবুও থেমে নেই৷ বুকের উপর একের পর এক আঘাত করে৷ উম্মাত হয়ে গেছে৷
আসিফের রক্ত দিয়ে মাটির উপর লিখেল, ❝ধ’র্ষকদের পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার নেই।❞

তুহিনকেও বাঁচতে দেয়নি৷ তুহিনকে নির্মম মৃত্যু দেয়নি৷ কিন্তু রামদা দিয়ে গলা কেটে দিয়েছে৷
_____________

পরী মাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে৷ জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে৷ আয়েশা বেগম মেয়েকে ছেড়ে উঠতে পারছে না৷ এদিকে খবর এসেছে উত্তর পাড়ায় আসিফের মৃত দেহ পাওয়া গেছে৷ কে বা কারা জানি নির্মমভাবে হত্যা করেছে৷ বেলা ১০ টার দিকে আয়েশা বেগম পরীকে উঠানের চেয়ারে বসিয়ে দিল৷ সকালের রান্না পরীর সৎ মা করেছে৷ পরীর বিয়ে উপলক্ষে এসেছিল৷ গ্রাম বাসীর ধারনা আসিফের মৃত্যুতে পরীর এমন জ্বর এসেছে৷ অনেকে বলাবলি করছে সুন্দরী মেয়ের কপালে ভালো বর পাওয়া যায় না৷ মেয়ে সুন্দরী হলে কি হবে? পরী একজন অপয়া। তা নাহলে বিয়ের দিন হবু বর খুন হয়৷

আয়েশা বেগম পাড়া প্রতিবেশীর কথায় কান দেন না৷ অনেকে অনেক প্রশ্ন করে যাচ্ছে৷ তিনি তাদের কথার কোন কান দিলেন না৷ আশালতা সবার উদ্দেশ্যে বলেন,

“পরীর কেন জ্বর আসল? কিসের জন্য অসুস্থ? এসব নিয়ে আপনাদের ভাবতে কে বলেছে? পরীকে নিয়ে ভাবার লোক আছে৷ পরীর মা আছে, বাবা আছে।”

তাদের মাঝে একজন মহিলা বলে উঠল,
“পরীর বাপ তো আর এখানে থাকে না৷ পরীর বাপ তোমার লগে থাকে। সোয়ামিকে হাত করে রাখছো৷”
আশালতা কিছু বলতে যাবে তার আগেই আয়েশা বেগম বলেন,

“আপনাদের কি এখানে ডাকা হয়েছে। নাটক দেখতে আসছেন এখানে৷ যার যার বাড়িতে যান৷ বাঁচলেও আমার মেয়ে, মরলেও আমার মেয়ে৷ পরীকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না৷”

আয়েশার টান টান কথায় সবাই চলে যায়৷ ভাত মাখিয়ে পরী আর আরিয়ানকে খাইয়ে দিচ্ছে৷ আরিয়ান এক লোকমা খাবার মুখে নিয়ে বলল,

“বড় মা আমাদের সাথে ঢাকা যাবে। আমরা সবাই একসাথে থাকব৷ তুমি আম্মু, আব্বু৷ আমরা সবাই থাকব৷”
আর এক লোকমা খাবার মুখে দিয়ে বলল,

“না রে বাবা! আমার কাছে গ্রাম ভালো লাগে৷ আমি ঢাকা যাব না৷ মনে পড়লে আমাকে দেখতে চলে আসবে৷”
পিছন থেকে আশালতা বলে উঠল,

“আফা, আপনি তো কোনদিন আমাদের বাসায় গেলেন না৷ সেখানে না থাকলেন একবার তো ঘুরেও আসা যায়৷”

আশালতার কথার কোন প্রতিউত্তর করলেন না৷ মেয়েটার কোন দোষ নেই৷ মেয়েটা সবাইকে আপন করেই নিয়েছে৷ পারুল, পরীকে অনেক ভালোবাসত৷ মায়ার মোহে পড়ে বিয়ে করেছিল। অনেক মিশুক৷ পলক হোসাইন বাড়িতে ক্ষোভ নিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বলেন,

“পঞ্চায়েত মশাই নিজেকে কি মনে করেন? উনি আমাদের শাসিয়ে যান৷ আমার মেয়ের জন্য এমন হয়েছে৷ উনার লাফাঙ্গা ছেলে বিয়ের রাতেও বেরিয়ে পড়ে৷ কোন মেয়েকে ধ’র্ষণ করতে গিয়ে ধরা পড়ে৷ দোষ দিচ্ছে আমার মেয়ের। ভালো হয়েছে বিয়ে না হওয়ায়৷”

আয়েশা বেগম ইশারায় পানি দিতে বলেন৷ আশালতা রান্না ঘর থেকে পানি এনে দিল৷ পলক হোসাইন একা একা বকে যাচ্ছেন৷ আয়েশা বেগম শান্ত গলায় বলল,

“রাগারাগির কি আছে? উনার ছেলেকে হারিয়েছেন৷ উনার কথায় কান দিতে হবে না৷ সকাল থেকে তো কিছুই খাননি৷ ভাত খেয়ে নেন৷ ঘাট থেকে হাত মুখ ধুয়ে আসেন৷”

পরীর মাথায় বিলি কেটে তেল দিয়ে দিচ্ছে৷ সবাই চলে গেলে আয়েশা বেগম বলেন,

“মানুষের জীবন দুইদিনের৷ তুই যা দেখেছিস সব কাল্পনিক মনে কর৷ যুদ্ধের কথা মনে কর৷ পাক সেনারা কিভাবে আমাদের হত্যা করেছে৷ বুকে সাহস রাখ৷”

“আমি সে জন্য ভয় পাচ্ছি না৷ যদি কেউ কিছু জেনে যায়৷ পুলিশ যদি জানতে পারে৷ আমাদের জেল হয়ে যাবে৷”

“কিছুই জানতে পারবে না৷ সেখানে কোন প্রমান নেই৷ রক্তমাখা পোশাক পুড়িয়ে ফেলেছি৷ শুধু কথাগুলো দু’জনের মাঝে থাকলেই হবে৷”

চলবে…….
ভুল ত্রুটিগুলো মার্জনীয় দৃষ্টিতে দেখবেন।

কে বাঁশি বাজায় রে পর্ব-০৩

0

#কে_বাঁশি_বাজায়_রে
#পর্ব_০৩
#নুর_নবী_হাসান_অধির

বাবার কান্না দেখে পীরও বাবার সাথে কান্না করে দিল৷ পলক হোসাইনের কান্না সহ্য হচ্ছো না আয়েশা বেগমের৷ উনার কাছে কুমিরের কান্না মনে হচ্ছে৷ পরীর হাত ধরে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসল৷ কড়া গলায় জবাব দিলেন,

“গ্রামে আপনার কোন জায়গা নেই৷ এখনই গ্রাম থেকে চলে যান৷ আপনার জীবনে পারুল, পরী বা আশেয়ার কোন অস্তিত্ব নেই৷ সবাই মৃত।”

পলক হোসাইন নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে ওঠে দাঁড়াল৷ তীব্র কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে৷ ওষ্ঠদ্বয় কথা বলার জন্য কাঁপছে৷ কিন্তু কথাগুলো গলায় দলা পেকে প্যাচিয়ে যাচ্ছে৷ তবুও কাঁপা কাঁপা ভেজা গলায় বলল,

“তুমি এতো পাষাণ হলে কিভাবে? কেন বুঝ না? আমি তোমাদের আজও সেই আগের মতোই ভালোবাসি৷ আমার ভালোবাসায় একটুও কমতি নেই৷”
আয়েশা বেগম রাগী গলায় বলেন,

“মুখে লাগাম দেন৷ আপনার মুখে ভালোবাসার কথা শোভা পাইনা৷ আপনার ভালোবাসা সেদিন কোথায় ছিল, যখন স্ত্রী সন্তান ভুলে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছিলেন৷ যখন নর পশুরা মেয়েকে ছিঁড়ে খেয়েছিল তখন কোথায় ছিল আপনার ভালোবাসা? কোনদিন পালন করেছেন বাবার দায়িত্ব। আজ হঠাৎ পিতৃত্ববোধ ফুটে ওঠেছে৷ আপনাকে যদি আমার চোখের সামনে দেখি মা, মেয়ে বিষ খেয়ে মা’রা যাব।”

আয়েশা বেগম পরীকে টানতে টানতে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যান৷ আর পিছুটান নয়, নিজেকে ভালোবাসায় ঢুবাতে চাননা৷ পরীকে নিয়েই গোটা পৃথিবী সাজাতে চান৷ পলক হোসাইন পিছন পিছন আসেন৷ এসে দেখতে পায় ভিতর থেকে কপাট লাগানো৷ পলক হোসাইন কপাট বন্ধ পেয়ে সেখানেই বসে পড়ল৷ ভেজা গলায় বলল,

“পরী, মা পরী দরজা খোল৷ তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে৷ মা দরজা খোল৷”
পরী জবাব দেওয়ার আগে আয়েশা বেগম রাগী গলায় জবাব দিলেন,

“আমার মেয়ের সাথে আপনার কোন কথা নেই৷ আমার দেহে শেষ নিঃশ্বাস থাকা পর্যন্ত পরীকে আগলে রাখব৷ নর পশুরা পরীকে ছুঁতেও পারবে না৷”

“পারুলের কি হয়েছিল? কেন বার বার নর পশু বলে যাচ্ছে? তার সাথে কি হয়েছিল৷”
আয়েশা বেগম দরজা খুলে বলেন,

“পারুলের কিছু হয়নি৷ আমার নিষ্পাপ মেয়েকে তারা বাঁচতে দেয়নি৷ আমি সেসব ধ’র্ষনকারীদের বাঁচতে দিব না৷”
চোখের জল মুছে বলল,
“আরিয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে আপনাদের থাকার অনুমতি দিলাম৷ কাল যথাসময়ে ঢাকায় চলে যাবেন৷”
__________

আসিফ কিছুতেই অপমানের কথা ভুলতে পারছে না৷ যেভাবেই হোক পরীকে তার লাগবে৷ এক রাতের জন্য হলেও পরীকে চাই। পরীর সেই ডাগর আঁখি। ঘন পাপড়িতে মধুর চাহনি৷ যেকোন ছেলেকে নিজের দিকে আসক্ত করতে পারবে৷ আসিফ তার বাবা আইয়ুব আলী ওরফে গ্রাম পঞ্চায়েতের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

“বাবা আমি পরীকে বিয়ে করতে চাই৷ পরীকে ছড়া আমি বাঁচব না৷ আমি তাকে ভালোবেসে ফেলেছি৷”

ছেলের কথায় গ্রাম পঞ্চায়েতের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। পরীকে বিয়ে করালে মোটা অঙ্কের যৌতুক পাবে না৷ আসিফের গালে থাপ্পড় বসিয়ে বলল,

“পরীকে বিয়ে করলে কোন যৌতুক পাবি না৷ পাশের গ্রামের মোড়ল সাহেবের মেয়ের সাথে তোর বিয়ে ঠিক করেছি৷ মোড়ল সাহেবের মেয়ের সাথেই তোর বিয়ে হবে৷ মোড়ল সাহেবের অনেক জমিজমা। যৌতুকে অনেক টাকা দিবে।”
বাবার অবাধ্য হয়ে বলল,

“আমি পরী ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করব না৷ বিয়ে করলে পরীকেই করব৷ দরকার পড়লে বিয়ের পরের দিনই পরীকে নিষিদ্ধ পল্লীতে বিক্রি করে দিব৷ তবুও পরীকেই বিয়ে করব৷”

ছেলের কথায় আইয়ুব আলীর মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি উঁকি দিল৷ ঠোঁটের কোণে পৈশাচিক হাসি ফুটে উঠে।
_________

ঢাকা যাওয়ার অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঢাকার উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু করতে হচ্ছে৷ পরী মন খারাপ করে বসে আছে৷ কিছুদিন থাকার জন্য পলক হোসাইন মেয়েকে কিছু বলেও লাভ হয়নি৷ বাড়ি থেকে বের হবার আগ মুহুর্তে গ্রাম পঞ্চায়েত এসে উপস্থিত। পলক হোসাইন সম্মানের সহিত সালাম দিলেন৷ আয়েশা বেগম শাড়ীর আঁচল ঠিক করে সামনে এসে সবাইকে বসতে বলেন৷ আইয়ুব আলী বলেন,

“বিচলিত হওয়ার কিছু নেই৷ আমি তোমাদের বাড়িতে একটা কাজে এসেছি৷ যদি জানতাম পলক হোসাইন ঢাকা থেকে এসেছে তাহলে রাতেই দেখা করতে আসতাম৷”
আরও কিছু বলতে চেয়েছিল৷ আয়েশা বেগম গ্রাম পঞ্চায়েত মশাইকে থামিয়ে দিয়ে বলেন,

“পঞ্চায়েত মশাই ঘুরিয়ে কথা না বলে সরাসরি কাজের কথা বলেন৷ এতো বাজার করে কেন নিয়ে এসেছেন?”
গ্রাম পঞ্চায়েত পানের পিক ফেলে বলল,

“ঘুরিয়ে কথা বলতে আমিও পছন্দ করিনা৷ বাজার করে নিয়ে আসছি নতুন আত্মীয় করার জন্য৷ পরীকে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে৷ আসিফের বউ করে আমার বাড়িতে তুলতে চাই৷”
আয়েশা বেগম কিছু বলতে নিলে গ্রাম পঞ্চায়েত হাত তুলে থামিয়ে দেন৷ তিনি পুনরায় বলেন,

“আমার কথা শেষ হওয়ার কর কথা বল৷ পরী আমার বাড়িতে রাজরানীর মতো থাকবে৷ কোন কাজই করতে হবে না৷ অন্দরমহলে কাজের লোকের অভাব নেই৷ তোমার মেয়ে সুখেই থাকবে৷ তোমার কথা থাকলে বলতে পার? পলক হোসাইন কি বলে? বাবা যেহেতু বাড়িতেই আছে৷”

আয়েশা বেগম কড়া গলায় জবাব দিলেন,

“এখন আমি পরীকে বিয়ে দিব না৷ পরীর লেখাপড়া শেষ হয়নি৷ পরীকে মানুষের মতো মানুষ করব৷ আনন্দপুর তার জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হবে৷ তাকে দেখে অনেকে উৎসাহিত হয়ে পড়াশোনা করবে৷”

গ্রাম পঞ্চায়েত মশাই ছেলে আসিফের দিকে রাগী চোখে তাকালেন৷ এখন অব্দি উনার কথার কেউ অমান্য করতে পারেনি৷ মিথ্যা হাসি দিয়ে বলল,

“মাশাল্লাহ! পরী বিয়ের পর পড়তে চাইলে পড়বে৷ আমরা কোন বাঁধা দিব না৷”

পঞ্চায়েতের কথা সহজ মনে হচ্ছে না৷ তিনি চাননা কোন মেয়ে লেখাপড়া করুন৷ উনার উক্তিতে মেয়েরা ভোগের সামগ্রি৷ তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছা বলতে কিছু থাকতে পারে না৷ আয়েশা বেগমের সন্দেহ হওয়ায় কড়া গলায় জবাব দিলেন,

“অনেক হয়েছে পঞ্চায়েত মশাই। আমার মেয়েকে আপনার লাফাঙ্গা ছেলের সাথে বিয়ে দিব না৷ তার কোন যোগ্যতা নেই আমার মেয়েকে বিয়ে করার৷ লেখাপড়ার জন্য দেশের বাহিরে পাঠিয়েছিলেন৷ কিন্তু লেখাপড়া শেষ করতে পারেনি। এমন ছেলের সাথে আমি পরীকে বিয়ে দিব না৷”

পঞ্চায়েত মশাই কথাগুলো হজম করে নিলেন৷ উনাকে এভাবে অপমান করবে বুঝতে পারেনি৷ এতোগুলাে কাজের লোকের সামনে মেনে নিত পারল না৷ অন্তরে বিষ রেখে মুচকি হাসি দিয়ে হুমকিস্বরূপ বলেন

“আপনাকে কিছুদিন ভাবার সময় দেওয়া হলো৷ ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত জানাবেন৷”
দাঁতের চিবুকে পান দিয়ে বলেন,
“কোন সিদ্ধান্ত নয়৷ পরীই হবে আসিফের বউ৷ সময় মতো তাদের বিয়ে হবে। সে নিয়ে কোন চিন্তা করতে হবে না৷”

এক প্রকার হুমকি দিয়ে পঞ্চায়েত মশাই চলে যান৷ পলক হোসাইন বসা থেকে দাঁড়িয়ে বলেন,

“পরীকে বিয়ে দিতে সমস্যা কি? পরী বিয়ের বয়স হয়েছে৷ সেখানে পরীকে বিয়েতে দিলে অনেক সুখেই থাকবে৷ তাদের টাকা পয়সার অভাব নেই৷”

“আমার মেয়েকে নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না৷ টাকা পয়সা সুখ এনে দিতে পারে না৷ আপনি তো বড় চাকরি করেন৷ ঢাকায় গাড়ি বাড়ি আছে৷ টাকা পয়সা আমাকে সুখ এনে দিয়েছে৷ যুদ্ধের সময় আপনার জীবন বাঁচিয়েছিলাম বলে বিয়ে করেছিলেন৷ যখন পরী গর্ভে আসেন৷ তখন আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন৷ এখন দায়িত্ব দেখাতে এসেছেন৷ পরীর জন্য তার মা আছে৷ শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত পরীর পাশে থাকব৷”

আয়েশা বেগমের খোঁচা দেওয়া কথা একদম অপছন্দ পলক হোসাইনের৷ সে সময় পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে ঢাকায় যেতে হয়েছিল৷ ৭৪ এর অভাব অনটনের কথা চিন্তা করেই এসব করতে হয়েছিল৷ ভাবতেই গা শিহরিত হয়ে উঠে।

বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের মার্চে শুরু হয়ে সেই বছরেরই ডিসেম্বরের দিকে গিয়ে শেষ হয় দুর্ভিক্ষ। এই দুর্ভিক্ষে অসংখ্য মানুষ অনাহারে মারা গিয়েছিল। সরকারী হিসাব অনুসারে ২৭,০০০ মানুষ অনাহারে মৃত্যুবরণ করে। বেসরকারি হিসেবে অনুমানিক ১,০০,০০০ থেকে ৪,৫০,০০০ জন প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে মৃত্যুবরণ করে। এই দুর্ভিক্ষকে স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক হিসেবে গন্য করা হয়।

তখন পরিবারের কথা চিন্তা করেই পলক হোসাইন ঢাকায় যাত্রা শুরু করেন৷ ঢাকার মাঝেও দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে৷ চারিদিকে হাহাকার। খেতে না পাওয়ার কষ্ট। পথে দ্বিতীয় স্ত্রী তথা আশালতার সাথে দেখা হয়৷ আশালতা ধনী পরিবারের মেয়ে থাকায় মিথ্যা পরিচয় নিয়ে আশালতাকে বিয়ে করেন৷ সেখান থেকেই আশালতা তার দ্বিতীয় স্ত্রী। সে পরিবারেরও রয়েছে ছোট্ট এক রাজকুমার আরিয়ান৷
_________

সময় ও স্রোত কারোর জন্য অপেক্ষা করে না৷ চোখের পলকে শীত বসন্ত চলে গেছে৷ গ্রীষ্মের প্রখর তাপের মধ্যে দিয়ে বাড়িতে ফিরে আয়েশা বেগম৷ বাড়িতে প্রবেশ করতেই ঢাক ঢোলের আওয়াজ কানে আসে৷ পঞ্চায়েত মশাইয়ের পাশে বসে আছে পরী৷ আয়েশা বেগম বাড়িতে প্রবেশ করতেই ঢাক ঢোলের আওয়াজ বন্ধ করে৷ পঞ্চায়েত মশাই সামনে এগিয়ে এসে বলেন,

“আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম৷ পরশু পরীকে আমার বাড়ির বউ করে নিয়ে যাব৷ দুই দিন পরীকে দেখে রাখবেন৷ আমার কথার অন্যতা হবে না৷”

পঞ্চায়েতের কথা শুনে আয়েশা বেগমের ভীষণ রাগ হয়৷ আয়েশা বেগমকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বাড়ি থেকে চলে যান৷ পরী মায়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। দুই হাতে মেয়েকে আগলে নেন৷ দু’চোখের জল বাঁধ মানছে না৷ অশ্রুপাত হয়েই যাচ্ছে৷ কাঁপা কাঁপা ভেজা গলায় বলল,

“মা, আমি আসিফকে বিয়ে করব না৷ আমি কিছুতেই আসিফকে বিয়ে করব না৷ তার চরিত্রের ঠিক নেই৷ সে অনেক মেয়ের সাথে….।”

আয়েশা বেগম পরীর মাথায় হাত ভুলিয়ে সান্ত্বনা দিল৷ পরীকে আভয় বানী দিয়ে বলল,

“তোর সাথে আসিফের বিয়ে হবে না৷ তুই বিয়েতে শুধু নাম মাত্র রাজি হয়ে যাহ৷ বাকীটা আমি দেখে নিব।”
পরী চকিত হয়ে বলল,

“বিয়েতে রাজি হব মানে? বিয়ে হতে দিবে না আবার বিয়েতে রাজি হতে বলছো৷ বিয়েতে রাজি হওয়া মানে আসিফের সাথে সংসার করা৷”
আয়েশা বেগম মুচকি হেসে বলেন,

“রহস্য৷ কোন ভাবেই আসিফের সাথে তোর বিয়ে হবে না৷ তুই শুধু আমার কথা মেনে চল।”

“কিসেেেেেেসসসরররর রহস্য…!”

চলবে………

কে বাঁশি বাজায় রে পর্ব-০২

0

#কে_বাঁশি_বাজায়_রে
#পর্ব_০২
#নুর_নবী_হাসান_অধির

ধ’র্ষকদের পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার নেই। তারা পৃথিবীতে বিরাজ করলে অবুঝ নিষ্পাপ মেয়েদের মনে সাহসের সঞ্চার হবে না। জীবনে উন্নতি করতে সাহস করবে না৷

ফিরোজ মিয়ার অবস্থা দেখে সবাই কেঁপে উঠেছে৷ এতোটা নিষ্ঠুরভাবে কে হ’ত্যা করতে পারে? তার শরীরের প্রতিটি অঙ্গ বিভিন্ন অংশে কাটা হয়েছে৷ হাতের প্রতিটি আঙ্গুলের নখ উপড়ে ফেলা হয়েছে, পা দু’টো দেহ থেকে আলাদা৷ দেহ থেকে গর্দান আলাদা৷ তাছাড়া দেহের সমস্ত অংশ কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। পরী আয়েশা বেগমের হাত ধরে নিশ্চুপ অন্যত্র দাঁড়িয়ে আছে৷ আজ পরীর মনে কোন ভয় হচ্ছে না৷ মনের মাঝে রঙিন প্রজাপতি নৃত্য করছে৷ মনে মনে আল্লাহকে শুকরিয়া জানাল৷ গ্রামের লোকজন ফিরোজকে ধরার সাহস পাচ্ছে না৷ ফিরোজের জন্য জানাযা নামাজ হলো না৷ কিছু লোক নদীর তীরে গর্ত করে মাটি চাপা দিল৷ ফিরোজের অবস্থা দেখে বাকী দুষ্টু লোকগুলো সাবধান হয়ে যায়৷

হেমন্তের শেষের না হতেই চারদিকে শীতের আমেজের অনুষঙ্গ দেখা দিয়েছে। পানি কমে যাওয়ায় নদীর তলানী দেখা যাচ্ছে৷ চিক চিক করছে বালী৷ ঝড়ে যাচ্ছে গাছ থেকে পাতাগুলো। শুষ্ক আবহাওয়ায় পানির অভাবে গাছের পাতা নিজের অস্বস্তি টিকিয়ে রাখতে পারে না৷ পরী নদী থেকে চিংড়ি মাছ ধরে এনে বলল,

“মা, আজ লাউ রান্না কর৷ গাছের কচি লাউ চিংড়ি মাছ দিয়ে রান্না করলে অনেক স্বাদ লাগে৷”

আয়েশা বেগম মেয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন৷ পরীর জীর্ণ শরীরটা খাবারের প্রতি একটু বেশিই লোভ৷ প্রচুর খাবার খাওয়ার পরও জীর্ণ হয়েই গেল৷ স্বাস্থ্যের কোন উন্নতি নেই৷ অবশ্য মায়ের কাছে প্রতিটি সন্তানই স্বাস্থ্যবান৷ কিন্তু পাড়ার দাদী কাকিমারা চিকনা বলে ক্ষেপায়৷ অবুঝ পরীও তাদের কথায় কান দিবে৷ মায়ের মুখের মুচকি হাসি দেখেই পরী দৌড়ে লাউ নিয়ে আসে৷ খাবারের সময় পরী বলল,

“তোমার হাতের রান্না একদম অমৃত৷ যে একবার খাবে সে কখনও ভুলবে না৷”

“খাবারের সময় কথা বলতে নেই৷ চুপচাপ খাবার খেয়ে নে।”

“মা, তোমাকে একটা কথা বলতে ভুলে গেছিলাম৷ তুমি অনুমতি দিলে কথা বলব৷”
আয়েশা বেগম সরু চোখ করে মেয়ের দিকে তাকাল৷ ব্রো প্রসারিত করে বলল,

“কি কথা? আজ কাল সব কথাই ভুলে যাস৷ আর অনুমতি নেওয়া কবে থেকে শিখলি?”
পরী আমতা আমতা করে বলল,

“আসলে আব্বা চিঠি লিখেছেন৷ শীতে গ্রামের বাড়িতে আসবেন৷ সাথে… ”
পরী কথাটা শেষ করতে পারল না৷ কঠিন কন্ঠে জবাব দিলেন,

“থাক এসব কথা আমায় বলতে হবে না৷ আসলে আসবে, না আসলে নেই৷ উনার জন্য আমি থেমে নেই৷ আমি প্রকৃতির নিয়মে আপন গতিতেই চলব৷”
আয়েশা বেগম দ্রুত খাবার শেষ করে উঠে পড়ল৷ চোখ থেকে দুই ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল৷ আড়াল করতে চাইলেও পরীর চোখ ফাঁকি দিতে পারল না৷ পরী মনে মনে বলল,

“আমার কাছ থেকে আড়াল করে লাভ নেই৷ তুমিও অনেক ভালোবাসাে৷ শুধু মান অভিমান, রাগের জন্য এমন কর৷”
_________

আয়েশা বেগমের ক্লাসে যেতে আজ একটু দেরি হয়ে যায়৷ ক্লাস রুমে যাওয়ার আগে রুম থেকে গন্ডগোল শোনা যায়৷ রুমে ঢুকতেই সবাই সম্মান জানালেন৷ তিনি সবার দিকে একটা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন? ❝শিক্ষা কি?❞ একে একে অনেক ছাত্রকে প্রশ্নটা করা হলো৷ কেউ তেমন গুছিয়ে সুন্দর উত্তর দিতে পারলেন না৷ আয়েশা বেগম বলে উঠলেন,

“শিক্ষা হলো জ্ঞানলাভের একটি পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া এবং ব্যক্তির সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের অব্যাহত অনুশীলন। শিক্ষা প্রক্রিয়ায় কোনো ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণাবলীর পূর্ণ বিকাশের জন্য উৎসাহ দেওয়া হয় এবং তাকে সমাজের একজন উৎপাদনশীল সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভের জন্য যে সব দক্ষতা প্রয়োজন সেগুলি অর্জনে সহায়তা করা হয়। সাধারণ অর্থে দক্ষতা বা জ্ঞান অর্জনই হলো শিক্ষা।
সক্রেটিসের ভাষায়, “শিক্ষা হলো মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের বিকাশ।” এরিস্টটল বলেন, “সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করাই হলো শিক্ষা।” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, “শিক্ষা হলো তাই, যা আমাদের কেবল তথ্য পরিবেশনই করে না; বিশ্বসত্তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকেও গড়ে তোলে।”

আমরা এখানে সবাই জ্ঞান লাভের জন্য এসেছি৷ শিক্ষা আমাদের মনের অন্ধকার দূর করে৷ আমাদের সম্মানের উচ্চতর শিখরে পৌঁছে দেয়৷ কিন্তু আমরা নিজেরাই সে শিক্ষাকে অবহেলা করছি৷ যেমন ধর, ‘আমি একটু দেরি করে রুমে ঢুকতেই তোমরা উচ্চ স্বরে কথা বলতে শুরু কর। পাশে ক্লাস নিতে সমস্যা হচ্ছে৷ নিজে কিছু শিখা নয়৷ অন্যকে শিখার মাঝেই মানুষের শিক্ষার গুণাবলি ফুটে উঠে৷ আজ থেকে কোন শিক্ষক রুমে দেরি করে প্রবেশ করলে বই খুলে পড়া রিভিসন দিবে৷ এখানে সবাই কষ্ট করে পড়তে আসো৷
আয়েশা বেগমের কথাগুলো সকল ছাত্রছাত্রী মনোযোগ সহকারে শুনল৷ স্কুল শেষ করে বাড়িতে চলে আসেন৷
________

গ্রাম পঞ্চায়েত মশাই লাঠি খেলার আয়োজন করেছেন৷ সাধারণত তিনি শীতের সময় এমন খেলার আয়োজন করেন৷ উনার ধারনা এই মৌসুমে খেললে মন চাঙ্গা থাকে৷ গ্রামের দামাল ছেলেরা খেলায় অংশ গ্রহণ করেছে৷ গ্রামে আয়েশা বেগম একজন সম্মানিত ব্যক্তি বলে তিনিও এখানে এসেছেন৷ পরীকে লাঠি খেলায় অংশগ্রহণ করার জন্য অনেক জোর করা হয়৷ কিন্তু কিছুতেই পরী লাঠি খেলায় অংশগ্রহণ করবে না৷ যার জন্য আয়েশা বেগম একাই চলে এসেছে৷

রেফারির বাঁশি ফুঁ দিলেই খেলা শুরু হয়ে যাবে৷ এমন সময় মুখে ওড়না প্যাচিয়ে খেলায় উপস্থিত হয় পরী৷ গ্রাম পঞ্চায়েতের সামনে দাঁড়িয়ে মিহি কন্ঠে বলল,

“পঞ্চায়েত মশাই আমিও খেলায় অংশগ্রহণ করতে চাই৷”
পরীর কথায় গ্রাম পঞ্চায়েত কিছুটা রেগে যান৷ তিনি রাগান্বিত কঠিন গলায় বললেন,

“মেয়ে মানুষ হয়ে লাঠি খেলতে চাও৷ এগুলো ছেলেদের খেলা৷ লজ্জা করে না এসব কথা বলতে৷”

“কোন কাজ ছেলে মেয়ে ভাগাভাগি করে হয়না৷ আপনার ছেলে আমার কাছে হেরে যাবে বিধায় আমার খেলতে মানা করছেন৷”
পরীর কথা শুনে পঞ্চায়েত মশাই বসা থেকে দাঁড়িয়ে যান৷ সিংহের মতো গর্জন দিয়ে বলেন,

“তোমার কিছু ধারণা আছে! তুমি কার সাথে কথা বলছো৷ আমি চাইলে এখনই তোমাকে গ্রাম থেকে বের করে দিতে পারি৷”
পরী এবার নিজের ক্ষোভ নিয়ে রাগী স্বরে বলল,

“ক্ষমতার দাপট চিরকাল থাকে না৷ আপনার ক্ষমতা থাকলে আমাকে খেলার সুযোগ দেন। আমি খেলায় হেরে গেলে নিজেই আনন্দপুর থেকে চলে যাব৷ আর আমার যদি খেলায় সুয়োগ না দেন আপনি হেরে গেছেন।”

পরীর সাথে কিছু লোক সুর মেলায়৷ গ্রাম পঞ্চায়েত মশাই বাধ্য হয়ে পরীকে খেলার অনুমতি দেন৷ পরীকে কেউ চিনতে না পারলেও আয়েশা বেগম চিনে নিয়েছেন৷ পরী মায়ের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় আভয় বানী দিল৷ পরী আর গ্রাম পঞ্চায়েতের ছেলে আসিফের খেলা শুরু হলো৷ আর অন্যরা খেলা থেকে বিরত রইল৷ হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে৷ আয়েশা বেগম আল্লাহর কাছে পরীর জন্য দোয়া করছেন৷ গ্রামের লোকজন আসিফ আসিফ বলে উৎসাহ দিচ্ছে৷ প্রায় ২ ঘন্টা খেলা হয়৷ পরীর কাছে পরাজিত হয় আসিফ৷ পরী মুখের ওড়না সরিয়ে বলল,

“পঞ্চায়েত মশাই আমাদের আর ছোট নজরে দেখবেন না৷ মা, মেয়ে থাকি বলে দুর্বল ভাববেন না৷ কখন সিংহের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ব বুঝতে পারবেন না৷ তাই মানুষ দিয়ে আমাদের অত্যাচার করা বন্ধ করেন৷”

আয়েশা বেগম স্কুল শিক্ষিকা বলে অনেকে মেনে নিতে পারে না৷ বিভিন্ন ভাবে তাদের অত্যাচার করে৷ ফসলের জমি নষ্ট করে৷ পঞ্চায়েত মশাই কিছু বলতে যাবে আবারও পরী বলে উঠল,

“আপনার ছোট ছেলেকে সাবধান হতে বলবেন৷ আমার পথ আটকিয়ে ছিল দুইদিন৷ মাকে না জানিয়ে আপনাকে বিচার দিছিলাম৷ কিন্তু কোন বিচার করেননি৷ এরপর নিজেই শাস্তি দিব৷”

আয়েশা বেগম মেয়ের বাঘীনি রুপ দেখে মুগ্ধ। তিনি চেয়েছিলেন পরী প্রতিবাদী মেয়ে হয়ে উঠুক৷ মেয়ের বিজয় দেখে চোখ থেকে দুই ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। পরী আরও সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“যে মেয়েরা লাঠি খেলা শিখতে চাও আমাদের বাড়িতে চলে আসবে৷ আমি তোমাদের লাঠি খেলা শিখাব৷”
________

কিছুদিন পরই পরীর এসএসসি পরীক্ষা। পরীকে এখন আর স্কুলে যেতে হয়না৷ আয়েশা বেগম স্কুলে চলে গেছেন৷ শীতের দুপুরে সোনালী রোদের আলোয় নদীর ঘাটে বসে আছে পরী৷ সেই কবে বাবা চিঠি লিখলছিল? এখনও আসছে না কেন! আনমনে বসে বসে এগুলো ভাবছে৷ সেখান দিয়ে যাচ্ছিল আসিফ আর তুহিন৷ পরীকে দেখে তারা দাঁড়িয়ে পড়ে৷ আসিফ পরীর গা ঘেঁষে বসতেই পরী উঠে দাঁড়াল। আসিফ বাজে দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

“পরী তোকে আমার খুব ভাল্লাগে৷ তোর যে তেজ, তোর সাথে রাত কাটাতে ভালোই লাগবে৷ লোক পাঠালে চলে আসিস৷ না আসলে জোর করে তুলে নিয়ে যাব৷”
পরী কষিয়ে আসিফের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিল৷ চোখ বড় বড় করে বলল,

“আমাকে ছোঁয়ার অধিকার তোর নেই৷ তোর বাবা গ্রাম পঞ্চায়েত বলে তোকে আমি মেনে চলব! এটা আশির দশক৷ তোর জমিদারি চলবে না৷”
আসিফ পরীর দিকে এগিয়ে আসতেই পরী আরও একটা থাপ্পড় বসিয়ে বলল,

“যেখানে আসিস সেখানেই দাঁড়িয়ে থাক৷ আমি অন্য মেয়েদের মতো তোর কাছে সম্মান ভিলিয়ে দিব না৷ ফিরোজের মতো অবস্থা হতে পারে৷ ধ’র্ষকদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই৷ তোর বিষয়ে বান্ধবীদের কাছ থেকে জেনেছি৷ ফিরোজকে যে হত্যা করেছে তার কাছে তোর কু কর্মের খবর যেতে দেরি লাগবে না৷ সাবধান হয়ে যায়৷”

পরী হন হন করে বাড়িতে চলে আসে৷
_________

পলক হোসাইন বাড়ির গেইটে আসতেই পরী দৌড়ে জড়িয়ে ধরে৷ প্রতিটি বাবার কাছে মেয়ে তার রাজ্যের রাজকুমারী। তেমনই মেয়ের কাছে বাবার তার রাজ্যের রাজা৷ জড়িয়ে ধরেই কান্না করে দেয়৷ বছরে এক, দুই বার গ্রামে আসে৷ তখন পারুল, পরীর জীবনে স্বর্গীয় সুখ নেমে আসে৷ এবার পলক হোসাইন একা আসেনি৷ সাথে দ্বিতীয় স্ত্রী ও তার ছেলে এসেছে৷ পরী তার সৎ মাকে দেখে মুহুর্তের মাঝেই সকল সুখ তেপান্তরে পালিয়ে যায়৷ আয়েশা বেগম আসতেই আরিয়ান বড় মা বলে দৌড়ে গেল৷ পলক হোসাইন এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,

“পারুল কোথায়? তাকে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না যে৷”
পারুলের নাম নিতেই আয়েশা বেগম ও পরীর মুখ কালো হয়ে যায়৷ আয়েশা বেগম শাড়ীর আঁচল টেনে কান্না করে দিল৷ পলক হোসাইন আয়েশা বেগমের কাঁধে হাত রেখে ঝাঁকি দিয়ে বলল,

“আমার পারুল কই? তুমি এভাবে কান্না করছো কেন? পারুলের কি হয়েছে?”
আয়েশা বেগম রাগী গলায় বললেন,

“এখন আপনার মনে পিতৃ স্নেহ জেগে উঠেছে৷ যখন পারুল ছটফট করছিল তখন কই ছিল আপনার ভালোবাসা?”
পলক হোসাইন হাতের মুষ্টি বদ্ধ করে বলল,

“পারুলের কি হয়েছে? কেউ আমায় দয়া করে বলবে?”
আয়েশা বেগম সবাইকে বাড়ির পিছনে নিয়ে আসে৷ আঙ্গুল দিয়ে পারুলের কবর দেখিয়ে বললেন,

“ঐ যে পারুল৷ মনের সুখে ঘুমাচ্ছে৷ আমাদের ছেড়ে বহুদূরে চলে গেছে৷”

পলক হোসাইন ধপাস করে মাটিতে পড়ল৷ মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল৷ পুরানো স্মৃতি সাড়া দিল মস্তিষ্কের নিউরনে৷ চোখ থেকে অঝোরে ঝড়ে যাচ্ছে অশ্রুকণা। আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল,

“পারুল মা আমার! পারুল!”

চলবে….