কে বাঁশি বাজায় রে পর্ব-১১+১২

0
199

#কে_বাঁশি_বাজায়_রে
#পর্ব_১১
#নুর_নবী_হাসান_অধির

সুখের জোয়ারে আনন্দ পুরের সকল জনগন৷ শিক্ষার দিক থেকে সবাই এগিয়ে যাচ্ছে৷ কাঁধে কাঁধ রেখে কাজ করে যাচ্ছে৷ সন্ধ্যায় সময়মতো নিজেকে পাঠ্যদান সম্পুর্ন করছে৷ রেষারেষির রেশ অনেক আগেই কেটে গেছে৷

আইয়ুব আলী নিজের গ্রামে নয়৷ ঘুরে ঘুরে পাশের গ্রামেও যারা লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত তাদের লেখাপড়া করার জন্য উৎসাহিত করেছেন৷ কৃষকদের বীজ সার দিয়ে কৃষি কাজে সাহায্য করছে৷ নিত্য নতুন ভালো কাজের সাক্ষী হচ্ছে জনগন৷ আইয়ুব আলীর এমন পরিবর্তন সকলের মনে ভালোবাসার বীজ জন্ম নিয়েছে৷ দিন দিন তাঁর সম্মান গ্রাম থেকে গ্রাম ছড়িয়ে যাচ্ছে৷ দূর দূরান্তেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে৷
_______

লন্ঠনের আলো কমিয়ে রাতের আঁধারে নিরিবিলি মনের সুখে নৌকা বাইছে আয়েশা বেগম৷ এখন আর নদীতে আসতে ইচ্ছা করে৷ ভালোবাসার মানুষগুলো অনেক দূরে৷ ছয় মাস পর পরীর চিঠি এসেছে৷ সেই আনন্দে নিরিবিলি পরিবেশের খুঁজে নৌকা নিয়ে বের হওয়া৷ শান্ত নদী৷ হালকা স্রোত বয়ে যাচ্ছে৷ শীতল হাওয়া গায়ে কাটা দিচ্ছে৷ শান্ত নদীতের মাঝখানে বৈঠা দিয়ে নৌকা থামিয়ে নিল৷ অতি যত্নসহকারে চিরকুট বের করল৷ জ্যােংসার আলোয় ছলমল করছে স্বচ্ছ নদীর জল৷ অনুভূতি নীড়ে ফিরে গেছে৷ চিঠির ভাজ খুলতে ভীষণ ভয় হচ্ছে৷ চোখে টলমল পানি৷ শুকনো ঠোঁট। অশান্ত হৃদয় আর চিঠি খুলতে পারল না৷ মন খারাপ করে চিরকুট রেখে দিল৷ মনে মনে বলল,

“নিরবে নিভৃতে তোর চিঠি খুলে সিদ্ধ ভালোবাসার ঘ্রাণ নেওয়া হলো না৷ মনের অনেক ভয়ের আশঙ্কা নাড়া দিচ্ছে৷ মনে হচ্ছে এই বুঝি কোন বিপদ ছুঁয়ে দিল৷ আমি তোকে ছাড়া ভালো নয়৷”

চোখের জল মুছে বাড়ির দিকে যাত্রা শুরু করল৷ নৌকার পাঠা ঘাড়ে পৌঁছার আগে মসজিদ থেকে ফজর আযানের মধুর প্রতিধ্বনি ভেসে যাচ্ছে৷ অশান্ত হৃদয়টা মুহুর্তেই ভালো হয়ে গেল৷

মহান আল্লাহ তায়াল আযানের মাধ্যমে আরও একটা সুন্দর দিনের সূচনা করলেন৷ মুসলিম জাতির জন্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুর আযানের ধ্বনি৷ ফজরের আযানে একটি বাক্য যুক্ত করা হয়৷

❝আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম❞ যার বাংলা অর্থ ❝ঘুম থেকে নামাজ উত্তম৷❞

ফজরের নামাজ দুনিয়ার সব কিছুর চেয়ে উত্তম : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “ফজরের দুই রাকাত নামাজ দুনিয়া ও তার সব কিছুর চেয়ে উত্তম। ফেরেশতাদের সাক্ষাৎ : ফজরের সময় ফেরেশতাদের পালাবদল হয়। আর এ সময় বান্দা যা কিছু করে ফেরেশতারা আল্লাহর কাছে তা পেশ করেন তা মহান আল্লাহ তায়লা পূরণ করেন৷”

রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, “যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ আদায় করল সে মহান আল্লাহর রক্ষণাবেক্ষণের অন্তর্ভুক্ত হলো…।” (মুসলিম, হাদিস : ১৩৭৯)

ঘাটে থেকে অজু করে এসে নামাজ আদায় করে নিল৷ ভোরের আলো ফুটতেই কপাট খুলে কুরআন তেলাওয়াত শুরু করেন৷ গ্রামের মুসলিম নারীরা সাধারণ ভোরের আলোয় নিজ বাড়ির ভিটায় পড়তে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করে৷ কুরআন তেলাওয়াতের পর মন থেকে সব ভয় কেটে যায়৷ আয়েশা বেগম চিরকুট খুলেন,

ভালোবাসার মা,
আসসালামু আলাইকুম। প্রথমে আমার সালাম নিবেন৷ আল্লাহর রহমতে আমি ভালো আছি৷ মানসিকভাবে একটুও ভালো নেই৷ তোমায় ছাড়া আমার দিন কাটে না৷ তোমায় ছাড়া আমার চোখ মরুভূমি হয়ে গেছে৷ ভালোবাসার আদ্রতায় ভেজা গহীন বুকে ভালোবাসার অভাবে খরার পাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে৷ আমি ছাড়া আমি নষ্ট। তোমায় ছাড়া একটা মুহুর্ত কল্পনা করতে পারি না৷ আমি কিছুদিন পরই গ্রামে যাচ্ছি৷ তোমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমাব৷ কতকাল হয়ে গেল কোলে মাথা রেখে ঘুমাই না৷ আমার মাথায় ভিলি কেটে ঘুম পাঠিয়ে দাও না৷ আমি যে খুবই ঘুমের কাঙ্গাল।

জান মা! তোমার সেই ছেট্ট পরীটা আজ অনেক বড় হয়ে গেছে৷ তোমার ছোট্ট মেয়ের জায়গায় হয়নি বাবার বুকে৷ এক বুক কষ্ট নিয়ে তোমার ছোট্ট মেয়ে হলের করিডরে ঘুমাচ্ছে৷ প্রতিনিয়ত অবহেলায় বেড়ে উঠেছে৷ জান মা, আমি এখন শিখে গিয়েছে মাটিতে পড়ে গেলে কারো সাহায্য না নিয়ে একা উঠার৷

তোমার কষ্ট হলে আমি সহ্য করতে পারব না৷ তুমি নিজের যত্ন নিবে৷ ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করবে। আল্লাহর কাছে একটাই চাওয়া আমার জনম দুঃখিনী মায়ের কষ্ট দূর করার৷

ইতি,
তোমার ভালোবাসার
ছোট্ট পরী৷

আয়েশা বেগম চিঠি বুকে চেপে ধরল৷ চোখ আজ কোন বাঁধা মানছে না৷ অঝোরে অশ্রুকণা ঝড়ে যাচ্ছে৷ ভালোবাসার যেন মোহ মায়ায় পরিণত হচ্ছে৷ ভীষণ রাগ হচ্ছে পলক হোসাইনের উপর৷ মায়ের মনে কালবৈশাখীর ঝড় বয়ে যাচ্ছে৷
_____________

বাস স্ট্যান্ডের এক কোণায় অধীর আগ্রহে বসে আছেন এক মা৷ তার মেয়ে যে ঘরে ফিরে আসছে৷ শূন্য বুকটা ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দিতে চলে এসেছে৷

পরীর কিছুদিন পর আরও একটা চিঠি পাঠায় মায়ের কাছে৷ যেখানে লেখা ছিল পরী শীতের ছুটিতে বাড়িতে আসছে৷ পরী একা নয়৷ সাথে সাথে সমাপ্তি, কুহু চশমাওয়ালী, ছোঁয়া। সকাল সকাল রান্না শেষ করে বাস স্ট্যান্ড চলে আসেন৷ দীর্ঘ দুই ঘন্টার পর পরীর দেখা মিলে৷ কুহু রাস্তায় দুইবার বমি করে ফেলেছে৷ শহরের মেয়ে হয়েও বাস ভ্রমণ করতে পারে না৷ লোক সমাজে এ কথা জানলে মুহুর্তের মাঝেই রটে যাবে৷

পরী বাস থেকে নেমে চারদিকে এক পলক তাকিয়ে প্রদক্ষিণ করে নিল৷ কাউকে দেখতে পেল না। অবশ্য পাবে কি করে? মা’কে বাস স্ট্যান্ডে আসতে মানা করেছে৷ পরীর ভাবনার মাঝেই আয়েশা বেগম কোথা থেকে উড়ে এসে ঝাপটে ধরে৷ প্রথমে পরী বুঝতে না পারলেও মুহুর্তেই বুঝে নিল সেটা আর কেউ না৷ একমাত্র ভালোবাসা। পরীর জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল৷ মা মেয়ের মিলন যেন ভালোবাসায় পরিপূর্ণ।
____________

পড়ন্ত সূর্যের লালচে আলোয় নৌকা নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে চার বান্ধবী। কুহু আহ্লাদী স্বরে বলে উঠে,

“মানুষ কি নদীতে গোসল করে৷ আমিও নদীতে নদীতে গোসল করব৷ চলনা আমরা সবাই একদিন গোসল করি৷”

সমাপ্তি কুহুর আহ্লাদী স্বরের জবাব দিলে,

“নদীতে মানুষ গোসল করে না৷ তোর মতো কিছু বলদ আছে তারা গোসল করে৷”

কুহু কাঁদু কাঁদু ভাব নিয়ে বলল,

“পরী সমাপ্তিকে কিছু বলবি না! কিছু না বললে এখানেই সবকিছু সমাপ্ত করে দিব।”

ছোঁয়া কুহুর চশমা হাতে নিতে নিতে বলল,

“এখনই সবকিছু সমাপ্ত হোক৷ তোকে ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দিব৷ তুই সাঁতার জানস না৷ এখন মইরা যাবি৷ চশমা রেখে দিলাম৷ মরার পর দেখা হলে দিয়ে দিব৷”

ছোঁয়ার কথায় সমাপ্তি, পরী দু’জনেই হেঁসে উঠল৷ পরী নৌকায় একটু ঝাঁকি দিয়ে বলল,

“আমাদের গ্রামের নব্বই শতাংশ মানুষ নদীতে গোসল করে৷ শুধু খাওয়ার পানি চাপ কল থেকে নিয়ে আসা হয়৷ গ্রামে যারা উচ্চ বিত্তবান মানুষ তারা শুধু চাপ কলের ব্যবহার করেন। আর সবাই নদীতে গোসল করি৷”

কুহু চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল,
“খোলা মাঠে মেয়েরা কিভাবে গোসল করে? কোনদিন সম্ভব নয়৷”

“গ্রামের যুবতী মেয়ে বউরা নদী থেকে পানি নিয়ে বাড়িতে গোসল করে৷ সবার বাড়িতে গোসল করার জন্য আলাদা একটা জায়গা আছে৷”

হঠাৎ করেই তাদের নৌকার সামনে চলে আসল..

চলবে….

#কে_বাঁশি_বাজায়_রে
#পর্ব_১২
#নুর_নবী_হাসান_অধির

হঠাৎ করেই নৌকার সামনে বড় একটা ট্রলার চলে আসল৷ বর্তমানে তাদের নৌকা নদী পথের মাঝখানে৷ এখানে নদীটা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে৷ যার জন্য স্রোতের প্রকোপ অনেকটা বেশি৷ ট্রলারের টেউয়ে নৌকা দুলছে৷ ভয়ে কাবুকাত চোখ জোড়া চোখ৷ পরী বুঝতে পারেরি কখন এতোদূর এসে পড়েছে৷ ট্রলার থেকে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার নদীর মাঝে একটা বস্তা ফেলে চলে যায়৷ ট্রলারটা খুব দ্রুত গতিতে চলে যায়৷ নিজেরা কিছু একটা থেকে লুকানোর জন্য এমন করছে৷ পাশে চার জোড়া চোখের দেখা মিলেনি৷
ছোঁয়া চিৎকার করে বলল,

“পরী নদীর মাঝখানে একটা বস্তা ফেলে গেল৷ নৌকা ঘুরিয়ে ওখানে নিয়ে যায়৷ পরী নৌকা ঘুরিয়ে নিয়ে গেল৷ বৈঠা দিয়ে নদীর তল খুঁজে পেল না৷ পরী সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,

” আমি নদীতে নামছি৷ তোরা কেউ কোন কথা বলবি না৷ তোরা কেউ নৌকা চালাতে পারিস না, এমন কিছু করবি না যেন স্রোতের টানে কোথাও চলে যান৷”

পরী ঝাপ দিয়ে কিছুক্ষণের মাঝে নদীর তলদেশ থেকে বস্তটি তুলে আনল৷ পানিতে সাধারণত প্রতিটি বস্তুর ওজন ভারসাম্য অবস্থায় থাকে৷ সবাই মিলে বস্তা নৌকায় তুলল৷ বস্তা খুলে মাঝবয়সী একজন মেয়েকে দেখতে পেল৷ কুহু আতঙ্কে চিৎকার করে ঘটনা স্থলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে৷ মেয়েটিকে দেখে বুঝা গেল প্রথমে নরপশুর দল মেয়েটিকে ধর্ষণ করেছে৷ তারপর শরীরের সমস্ত অর্গান নেওয়া হয়েছে৷ ছোঁয়া ভয়ে ভয়ে বলল,

“পরী আমার ভীষণ ভয় লাগছে৷ তুই তাড়াতাড়ি একে নদীতে ফেলে দে৷ কেউ দেখে নিলে অনেক বড় সমস্যা হবে৷”

সমাপ্তি ভয়ে চুপসে আছে৷ বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে৷ এমন দৃশ্য সিনেমা থিয়েটারে মানায়৷ বাস্তবে এমন কিছু ঘটবে বুঝতে পারেনি৷ পরী মেয়েটিকে পুনরায় বস্তা ভরে নদীতে ফেলে দিল৷ বিপদের আঁচ বুঝতে পেরে দ্রুত গতিতে নৌকা বাড়ির দিকে ঘুরিয়ে ফেলে৷ নদী পথে আর কেউ কথা বলেনি৷ মাঝপথে কুহুর জ্ঞান ফিরে আসে৷ ঘাটে নৌকা বেঁধে পরী সকলের উদ্দেশ্য বলল,

“আজ আমরা চারজন যা কিছু দেখেছি তা কোনদিন কাউকে বলবি না৷ এই বিষয়টা মাথা থেকে ঝেরে ফেলে দে৷”
__________

রাতের খাবার শেষে উঠানে মাদুর বিছিয়ে সকলে গল্প করছে৷ ক্যাম্পাসে কে কেমন? কার সাথে মিশতে ভালো লাগে? কে কতটা শয়তানি করে? সবাই পরীর নামে অভিযোগ করছে৷ আয়েশা বেগম মেয়েদের বাচ্চা বাচ্চা কথাগুলো মন দিয়ে শুনছেন৷ ভীষণ ভালো লাগছে৷ অনেক দিন পর সবার সাথে মন খুলে কথা বলছেন৷ সমাপ্তি পরীর মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে৷

সমাপ্তি মেয়েটা আদরের জন্য পাগল৷ একটু আদর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য চাতক পাখির মতো আকাশ প্রাণে তাকিয়ে থাকে৷ মা মরা মেয়েটা মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত। আয়েশা বেগমের ভালোবাসায় একদম বাচ্চা হয়ে গেছে৷ কোমর জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে৷ আয়েশা বেগম দুই হাতে আগলে রেখেছেন সমাপ্তিকে৷

তাদের মুখ রচিত গল্পের মাঝে গ্রাম পঞ্চায়েত আইয়ুব আলী উপস্থিত হোন৷ বাড়িতে প্রবেশের আগে আইয়ুব আলী একজন মহিলাকে পাঠান৷ আয়েশা বেগম সবাইকে ঘরে যাওয়ার আদেশ দেন এবং আইয়ুব আলীকে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করতে বলেন৷

আইয়ুব আলীর জন্য চেয়ার নিয়ে আসা হলো৷ আইয়ুব আলী আয়েশ করে চেয়ারে বসলেন৷ বসতে বসতে বলে উঠলেন,

“আপনার কাছে একটা পরামর্শ নিতে এসেছি৷ আপনার পরামর্শ ছাড়া এখন কোন কাজ করিই না৷”

আয়েশা বেগম বুঝার চেষ্টা করলেন কিসের জন্য রাতে এসেছে? কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলেন না৷ অবুঝের মতো আইয়ুব আলীর দিকে তাকিয়ে আছে৷ আইয়ুব আলী পুনরায় প্রশ্ন করলেন,

“আমায় সাহায্য করবেন তো৷ আপনার কাছ থেকে সাহায্য নিতে এসেছি৷”

আয়েশা বেগম এদিক ওদিক এক পলক তাকিয়ে নিলেন৷ মেয়েরা সবাই ঘরে প্রবেশ করেছে কিনা৷ বাহিরে কাউকে দেখতে না পেয়ে স্বস্থির নিঃশ্বাস নিলেন৷ আইয়ুব আলীর দিকে তাকিয়ে বললেন,

“আপনি গ্রামের জন্য ভালো কাজ করছেন৷ সকালে ছেলেমেয়ে জন্য মক্তবের ব্যবস্থা করেছেন৷ সবাই মধুর কন্ঠে কুরআন পাঠদানের শিক্ষা পাচ্ছে৷ আপনি পৃথিবীর সবথেকে মহান কাজ করেছেন৷ আপনাকে তো সাহায্য করতেই হবে৷”

কুরআন শিক্ষার কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক:-
কুরআন (القرآن) শব্দের অর্থ পঠিত। যা সবকিছুকে শামিল করে। আর কুরআনকে ❝কুরআন❞ এজন্যই বলা হয় যে, তাতে শুরু-শেষ, আদেশ-নিষেধ, বিধি-বিধান, হালাল-হারাম, প্রতিশ্রুতি-ধমক, শিক্ষণীয় ঘটনাবলী, উপদেশ, দুনিয়া ও আখিরাতের সবকিছুর ইঙ্গিত রয়েছে। আর সেসাথে রয়েছে আয়াত গুলো একে অপরের সাথে অনন্য সমন্বয় ও সুসামঞ্জস্য।

সমাজে বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ রয়েছেন। সকল শ্রেণী ও পেশার লোকদের চাইতে কুরআন শিক্ষাগ্রহণকারী ও শিক্ষাদানকারীগণ সর্বশেষ্ঠ মানুষ হিসাবে পরিগণিত। ওছমান (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন,خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ- “তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সেই ব্যক্তি, যে নিজে কুরআন শিখে ও অন্যকে শিখায়।” অন্য বর্ণনায় এসেছে,إِنَّ أَفْضَلَكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ- ❝নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সেই ব্যক্তি, যে কুরআন শিক্ষা করে ও অন্যকে শিখায়।❞ কুরআন নিয়মিত তেলাওয়াত করতে হবে এবং এর সঠিক মর্ম অনুধাবন করে তদনুযায়ী জীবন গঠন করতে হবে।

বিশুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াত করা জরুরি। কুরআন তেলাওয়াতের সময় মাখরাজ সমূহ সঠিকভাবে উচ্চারণ না করলে বা তাজবীদের নিয়ম পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ না করলে অনেক সময় আয়াতের মর্ম পরিবর্তন হয়ে যায়। যাতে পাপ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। ধীরে-সুস্থে ও বিশুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াত করা জরুরি। যেমন আল্লাহ বলেন, وَرَتِّلِ الْقُرْآنَ تَرْتِيلاً- ❝আর কুরআন তেলাওয়াত কর ধীরে ধীরে, সৌন্দর্যমন্ডিত পন্থায়।❞(মুযযাম্মিল ৭৩/৪)। তিনি আরও বলেন, وَرَتَّلْنَاهُ تَرْتِيلاَ- ❝আর আমরা তোমার উপর পর্যায়ক্রমে সুন্দরভাবে কুরআন নাযিল করেছি।❞ (ফুরক্বান ২৫/৩২)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,حَسِّنُوا الْقُرْآنَ بِأَصْوَاتِكُمْ، فَإِنَّ الصَّوْتَ الْحَسَنَ يَزِيدُ الْقُرْآنَ حُسْنًا- ❝তোমরা তোমাদের কণ্ঠস্বরের দ্বারা কুরআনকে সৌন্দর্যমন্ডিত কর। কেননা সুমধুর কণ্ঠস্বর কুরআনের সৌন্দর্যকে আরও বৃদ্ধি করে দেয়।❞

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিভিন্ন সময় ছাহাবায়ে কেরামকে নানা উদাহরণের মাধ্যমে দ্বীন শিক্ষা দিতেন। যেমনটি তিনি অন্যান্য মুমিনের চাইতে কুরআন তেলাওয়াতকারী মুমিনের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনার সময় শিক্ষা দিয়েছিলেন। আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَثَلُ الْمُؤْمِنِ الَّذِى يَقْرَأُ الْقُرْآنَ كَمَثَلِ الأُتْرُجَّةِ رِيحُهَا طَيِّبٌ وَطَعْمُهَا طَيِّبٌ، وَمَثَلُ الْمُؤْمِنِ الَّذِى لاَ يَقْرَأُ الْقُرْآنَ كَمَثَلِ التَّمْرَةِ لاَ رِيحَ لَهَا وَطَعْمُهَا حُلْوٌ، وَمَثَلُ الْمُنَافِقِ الَّذِى يَقْرَأُ الْقُرْآنَ مَثَلُ الرَّيْحَانَةِ رِيحُهَا طَيِّبٌ وَطَعْمُهَا مُرٌّ، وَمَثَلُ الْمُنَافِقِ الَّذِى لاَ يَقْرَأُ الْقُرْآنَ كَمَثَلِ الْحَنْظَلَةِ لَيْسَ لَهَا رِيحٌ وَطَعْمُهَا مُرٌّ- ❝যে মুমিন কুরআন তেলাওয়াত করে, সে হলো উৎরুজ্জা ফলের (কমলালেবুর) ন্যায়। ফলটি সুগন্ধিযুক্ত এবং স্বাদও উত্তম। আর যে মুমিন কুরআন তেলাওয়াত করে না, তাঁর উদাহরণ হলো খেজুরের ন্যায়। যার ঘ্রাণ নেই কিন্তু সুস্বাদু। আর যে মুনাফিক কুরআন তেলাওয়াত করে, সে হলো রায়হানা (লতানো) ফুলের ন্যায়। যা সুগন্ধিযুক্ত, কিন্তু স্বাদ তিক্ত। যে মুনাফিক কুরআন তেলাওয়াত করে না, সে হলো মাকাল (লতানো লেবুজাতীয় তিক্ত) ফলের ন্যায়। যার ঘ্রাণ নেই এবং স্বাদও তিক্ত।❞

[বি.দ্র. ❝উম্মে ফারজানা চৌধুরী❞ নামক পাঠক আমায় এগুলো লিখে দিয়েছেন৷ গতকালের পর্ব পোস্ট করার পর তিনি বলেন এগুলোর সাথে আরবি থাকলে ভালো হতো৷]

আইয়ুব কিছুটা বিরক্তি নিয়ে শুনলেন৷ আয়েশা বেগমের কথা শেষ হওয়াতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,

“জাতীয় সংসদ নির্বাচন চলে এসেছে৷ আমি নির্বাচনে এমপি পদে দাঁড়াচ্ছি৷ ওইদিকে মোল্লা সাহেবও দাঁড়াচ্ছেন৷ মানুষদের জন্য এতো কিছু করছি তারা কি আমায় এমপি বানাবে না৷”

আয়েশা বেগম মুচকি হেঁসে বলল,

“যে ব্যাক্তি গরিব মানুষকে সাহায্য করেন৷ স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা তাকে সাহায্য করেন৷ আপনার সুনাম শুধু আমাদের গ্রামে নয়৷ সব জায়গায় আপনার সুনাম রয়েছে৷ আপনি নিশ্চয় বিজয় লাভ করবেন৷”

প্রাণ ভরে শ্বাস নিয়ে বলল,

“আমার গ্রামের লোকজন আমার কাছে অমূল্য ধন৷ তাদের ভালোবাসা পেয়ে আমি সত্যিই বিমোহিত। এতোদিন অনেক অন্যায় করেছি৷ আরিফ, আসিফ আমার কথা বলে অনেক অন্যায় করেছে৷ আমার ভীষণ ভয় হয়৷ তাদের অন্যায়ের জন্য আমাকে দূরে ঠেলে দিবে না তো৷”

“গ্রামের কৃষক কৃষাণীরা হলো কাঁদা মাটি৷ আপনি তাদের যে রুপ দিবেন তারা সেই রুপে রাঙিয়ে উঠবে। আসিফ, আরিফ অন্যায় করেছে৷ আসিফ নিজের অন্যায়ের শাস্তি পেয়েছে৷ আরিফ এখন গ্রামে নেই৷ সে ঢাকায় আছে৷ গ্রামের লোকদের জড়ো করে সকল বিষয় খুলে বললে তারা বুঝতে পারবে৷ গ্রামের লোকদের ভয় নয়৷ ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখতে হয়৷”

আইয়ুব আলী শ্যামলের দিকে এক পলক তাকিয়ে বলল,
“আপনার কাছে আরও একটা আবদার নিয়ে এসেছি৷ আপনি দয়া করে আমাকে ফিরিয়ে দিবেন না৷”

আয়েশা বেগম সন্দিহান দৃষ্টিতে বাপ ব্যাটার দিকে তাকাল৷ শ্যামল মাথা নিচু করে ফেলে৷ চোখে মুখে লজ্জার ভাব স্পর্শ। কিছুটা অস্বাভাবিক কন্ঠে বলেন,

“আমার কাছ থেকে কি চান? দেওয়ার মতো আমার কাছে কিছুই নেই৷”

“আমি আপনার কাছ থেকে মহান মূল্যবান জিনিসটাই চাইব৷ আপনি সেটি খুব যত্নে আগলে রেখেছেন প্রতিনিয়ত।”

আইয়ুব আলী আরও কিছু বলতে চেয়েছিল৷ তার আগেই থামিয়ে দিয়ে বলল,

“কাজের কথায় বলেন৷ ভূমিকা, সংলাপ, বিবর্তন বাদ দিয়ে কাজের কথা বলেন৷”

“আরিফকে অনেক আগেই বিয়ে করানো হয়েছে৷ শ্যামল বিবাহযোগ্য ছেলে৷ সরকারি ভালো চাকরি করে৷ আমি পরীকে অনেক আগেই আসিফের বউ করে নিতে চেয়েছিলাম৷ ভাগ্যের পরিহাসে সবকিছু উল্টাপাল্টা হয়ে গেছে৷ আমার শ্যামলের জন্য পরীকে আপনার কাছে চাই। শ্যামল অনেক ভালো ছেলে৷ আরিফের মতো নয়৷”

আয়েশা বেগম সোজাসাপ্টা উত্তর দিলেন,

“শ্যামলের জন্য অনেক ভালো মেয়ে খুঁজে পাবেন৷ আমি এখন পরীকে বিয়ের জন্য জন্য জোর করতে পারব না৷ একবার জোর করে রাজি করিয়েছিলাম৷ আর পারব না৷ এখন আপনারা আসতে পারেন৷”

আইয়ুব আলী আবারও অপমান হলেন৷ তবুও হাল ছাড়লেন না৷ বসা থেকে দাঁড়িয়ে বলল,

“শ্যামল পরীকে অনেক ভালোবাসে৷ তাকে সব সময় আগলে রাখবে৷”

“আমি জানি পঞ্চায়েত মশাই৷ সেটা ভালোবাসা বলে না৷ শ্যামল ভালোবাসা আর মোহ এর মাঝে পার্থক্য জানে না৷ এটাও জানি শ্যামল পরীর জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকত৷ কখনও বটগাছের নিচে৷ কখনও স্কুলের সামনের দোকানে৷ কখনও আবার দীঘিনালা মন্দিরের সামনে৷”

আইয়ুব আলী শ্যামলের দিকে তাকালে শ্যামল মাথা নিচু করে ফেলে৷ যার অর্থ আয়েশা বেগম সবকিছু ঠিক বলেছে৷ আইয়ুব আলী বলল,

“ভালোবাসে জেনেও না করে দিলেন৷ পৃথিবীতে সবকিছুর ঊর্ধ্বে ভালোবাসা। ভালোবাসার মানুষকে আলাদা করার মতো পাপ আপনি করতে চাচ্ছেন৷”

“মেয়ের ভালোর জন্য এমন শতশত পাপ কাজ করতে পারি।”
কঠিন গলায় ক্ষোভ নিয়ে বলেন,
“এখনই আপনার ছেলেকে নিয়ে চলে যান৷ সাথে আপনার সাথে যারা এসেছে সবাইকে নিয়ে যান৷ আমি এখানে একা থাকি৷ এতোরাত অব্ধি কাউকে আমার বাড়িতে থাকার অনুমতি দিব না৷”

আইয়ুব আলী চোখ গরম করে ছেলের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলেন,

“ভালোভাবে কিছুই পাওয়া যাইনা৷ আঙ্গুল বাঁকালে সবই পাওয়া যায়৷”
__________

পাখির কিচির মিচির শব্দে সবার ঘুম ভাঙে৷ প্রচন্ড শীতে সবাই কাঁপছে। শহরের তুলনায় গ্রামে প্রচুর শীত৷ কুয়াশার চাদরে ঢাকা সমস্ত গ্রাম। পরী সবাইকে টানতে টানতে নদীর পাড়ে নিয়ে আসল৷ ঘাসের উপর শিশির জমে আছে৷ মুক্তর দানার মতো ঝলমল করছে৷ ছোঁয়া চোখ ঠলতে ঠলতে বলল,

“আমি কবি হলে, ‘ঘাসের ডগার উপর শিশির বিন্দু জমে থাকা দেখে কবিতা রচয়িতা করতাম৷’ বিন্দু বিন্দু শিশির ফোঁটা ঘাসের ডগায় মুক্ত দানার মতো৷ নদীর শীতলতম হাওয়া চার রমনী৷ অল্প সময়ের চোখের পাপড়ি দেশে শিশির বিন্দু জমে যাচ্ছে।”

সমাপ্তি বিরক্তি নিয়ে বলল,

“তুই কবি হলে তোর কবিতা কুত্তাও পড়বে না৷ মানুষের আর কোন কাজ নেই৷ মানুষ কবি ছোঁয়া রবীন্দ্রনাথের গল্প, কবিতা পড়বে৷”

কুহু ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে বলল,

“সমাপ্তি তুই কি জানিস? মানুষের মাঝে প্রতি নিয়ত প্রতিভা দেখা দেয়৷ ছোঁয়া প্রতিটি প্রতিভায় প্রতিভাবান।” হুট করেই চকিত গলায় বলল,
“ওই দিকে দেখ পরী খালী পায়ে ঘাসের উপর হাঁটছে। এটাও একটা প্রতিভা৷”

সমাপ্তি গায়ে চাঁদর ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়ে বলল,

“তোর কাছে যত প্রতিভা আছে সব গরু চোরের৷ তোর প্রতিভা দেখার সময় নেই৷”

পরী সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল…..

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে