কে বাঁশি বাজায় রে পর্ব-১৩

0
184

#কে_বাঁশি_বাজায়_রে
#পর্ব_১৩
#নুর_নবী_হাসান_অধির

সোনালী আলোয় সজীব মনোমুগ্ধকর পরিবেশের শীতল হাওয়ায় সকলেই মুগ্ধ৷ প্রাণ ফিরে পেয়েছে নতুন করে ভালোবাসার৷ মুগ্ধতা বিরাজ করছে চার জোড়া চোখে৷ পরী সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“শীতে সরিষা ক্ষেতের পাশ দিয়ে হাঁটতে ভীষণ ভালো লাগে৷ সব সময় সরিষা ফুলের সৌরভ মুগ্ধ করে আমাদের।”

সমাপ্তি গায়ের শক্তভাবে চাদর প্যাঁচিয়ে বলল,

“নদীর ওই পাড়ে সরিষা ক্ষেত বেশি৷ চল আমরা ওই পাড়ে যাই৷ পরী তো নৌকা চালাতেই পারে৷”

কনকনে শীতে নৌকা চালিয়ে নদী পার হয়৷ শীতল হাওয়া গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে৷ পরী ধানের খড় জমিয়ে আগুন ধরাল৷ সবাই বসে বসে আগুনের তা নিচ্ছে। ঘন কুয়াশায় সরিষার ক্ষেতের মাঠ দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে তিনটি প্রাণ৷ পরী কোন কথাই শুনছে না৷ নষ্ট করছে কৃষকের সরিষা ক্ষেত।মধ্যবয়স্ক লোকের কাশির শব্দে হাতে জীবন নিয়ে পালানোর চেষ্টা করল চারজন৷ নৌকায় উঠে হাঁপাচ্ছে সবাই৷ পরী ক্ষোভ নিয়ে বলল,

“তোদের কত করে বললাম সরিষা ক্ষেত নষ্ট না করতে৷ ধরতে পারলে সবাইকে বেঁধে রাখত৷”

দৌড়ানোর জন্য কুহুর চশমা সরে যায়৷ কুহু চশমা ঠিক করতে করতে বলল,

“দোস্ত যাই বলিস না কেন? আমার অনেক ভালো লেগেছে৷ লোকটা না আসলে আমি আরও একটু দৌড়াতে পারতাম৷”

ছোঁয়া চোখ বড় বড় করে বলল,

“তোকে ওই লোকটার সাথে বিয়ে দিলে সারাদিন দৌড়াতে পারবি৷ তখন আমরাও দৌড়াতে পারব৷”

সমাপ্তি ওড়নার ভাজ থেকে সরিষা ফুল বের করতে করতে বলল,

“দেখ, আমি অনেক ফুল ধরেছি৷ হলুদ রঙের সরিষা ফুল অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে।”

ছোঁয়া সরিষা ফুল নিতে নিতে বলল,

“সরিষা ফুল দিয়ে ডিম ভাজি খেতে ভীষণ ভালো লাগে৷ সবগুলো রেখে দে৷ সবাই সরিষা ফুল দিয়ে ডিম ভাজি করে খেতে পারব৷”
_______________

হাসি খেলে কেটে গেল দু’দিন৷ যেন চোখের পলকে কেটে গেল৷ কেউ বুঝতে পারল না। থাকার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও গ্রাম পঞ্চায়েতের খারাপ নজর থেকে বাঁচার জন্য ঢাকায় পাঠিয়ে দেন আয়েশা বেগম৷ আইয়ুব আলীর উদ্দেশ্য হলো পরীকে শ্যামলের বউ করার৷ মূলত নির্বাচনে জয়লাভের জন্য এমন নোংরা খেলায় মেতে উঠতে চেয়েছিলেন৷ বিদায়ের ঘন্টা কারোর জন্য৷ ভালো হলো না৷ সমাপ্তি দুইদিন মায়ের ভালোবাসা পেয়েছে৷ যাওয়ার পথে আয়েশা বেগমকে জড়িয়ে ধরে কান্না করেই যাচ্ছে৷ সামান্য ভালোবাসা পাওয়ার জন্য মানুষের মাঝে কত ত্যাগ কত মায়া কত অজানা গল্প।
_______

আয়েশা বেগম আইয়ুব আলী বাড়ি থেকে আজ একা ফিরছেন৷ কিছুদিন হলো আরিফ গ্রামে ফিরে এসেছে৷ আয়েশা বেগমের পথ আটকিয়ে বলল,

“গ্রামে ছিলাম না বলে অনেক কিছু করেছেন৷ এখন দেখবেন আরিফ কি করে? আরিফকে যে মাঠে বেঁধে রেখেছিলেন। আপনাকেই সেই মাঠে বেঁধে রাখব৷ অপবাদ দিয়ে গ্রাম ছাড়া করাব৷ মুখ দেখাতে পারবেন না৷ কলঙ্ক করে দিব।”

আয়েশা বেগম কষিয়ে থাপ্পড় বসিয়ে দিল৷ রাগে সমস্ত গা থিরথির করছে৷ রাতে শীতের রাতেও শরীর থেকে ঘাম ঝরছে। ঘৃণার সাথে বলেন,

“আমি বাতাসে বড় হয়নি৷ জীবনের সাথে যু্ক্ত করে বড় হয়েছি৷ আমার সাথে ভদ্রতা বজায় রেখে কথা বলবে৷ নয়তো খুন করে ফেলব৷ কোন প্রমাণ থাকবে না৷”

আরিফ ত্যাড়ে আয়েশা বেগমের কাছে গেলে আরও একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল৷ পুনরায় বলল,

“দুর থেকেই কথা বল৷ কাছে আসলে এখনই জাহান্নামের টিকেট কেটে দিব৷ মেয়ে বলে অবহেলার পাত্রী নয়৷”

আরিফ আঙুল তুলিয়ে বলল,

“নির্বাচনের পর্যন্ত তুই এই সুন্দর পৃথিবী দেখতে পারবি৷ নির্বাচন শেষ মানে তোর নিঃশ্বাস পর্যন্ত পাওয়া যাবে না৷ জাহান্নাম কাকে বলে? আমি দেখাব!”
_____________

নির্বাচন প্রচারে দলে দলে লোক ছড়িয়ে পড়েছে৷ কৃষক কৃষাণীদের দুয়ারে চলে গেছেন আইয়ুব আলী। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে বিরোধী দলকে বসিয়ে রেখেছে৷ প্রচারে করতে দেখলেই তাদের দলের কেউ না কেউ মারা যায়৷ এমনভাবে খুন করে তার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়না৷ মানুষকে সভায় ঢেকে বিরোধী দলের চক্রান্ত বলে চালিয়ে দেয়৷ ভয়ে বিরোধী দল প্রচার কাজ থেকে বিরত থাকে৷

দেখতে দেখতে চলে আসে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনে আইয়ুব আলী জয়লাভ করেন৷ বাড়িতে নানারকমের আয়োজন। গরু জবাই করে সাধারণ জনগনকে খাওয়ানো হয়৷

নির্বাচনের পর আইয়ুব আলীর ভালো মানুষের মুখোশ বেরিয়ে আসে৷ শ্যামলকে গার্মেন্টসের কাজে গাজীপুর পাঠিয়ে দেন৷ শ্যামল গ্রামে থাকলে এসব কাজের প্রতিবাদ করবে৷ শুরু হয় গরীব মানুষের উপর অমানবিক অত্যাচার৷ গরিবের গরু নিয়ে এসে জবাই করে, হাঁটে বিক্রি করছে আরিফ৷ প্রতিবাদ করতে আসলে প্রহরী দিয়ে হাত পা ভেঙে দিচ্ছে৷ ভয়ে ভয়ে জীবন পার করছে গ্রামের অসহায় মানুষ৷

আয়েশা বেগমের চোখ লেগে আসতেই কেউ ঘুমের মাঝে হানা দেয়৷ আয়েশা বেগমের সম্মানের উপর হানা দেয়৷ আয়েশা বেগম বুঝতে পারে বাহিরে লোকজন আছে৷ মূলত সম্মান হানী নয়৷ সমাজের চোখে কলঙ্ক করে দিবে৷ বাহির থেকে আরিফের আওয়াজ শুনা যাচ্ছে৷ সবাইকে উঁচু স্বরে বলছে,

“আপনাদের ম্যাডাম ঘরটাকে প্রতিতালয় বানিয়েছে৷ রাত হতেই পুরুষ মানুষকে ঘরে তুলে৷ এসব দেখেই পলক হোসাইন আর একটা বিয়ে করেছে৷”

আয়েশা বেগম নিজের সম্মান বাঁচাতে ঘরে ঢুকা লোকটার উপর আক্রমণ করে৷ লোকটার চিৎকারে ঘরের কপাঠ ভাঙার চেষ্টা করছে৷ কপাট ভাঙার আগেই এলোপাতাড়িভাবে রামদা দিয়ে লোকটার উপর আঘাত করছে৷ অন্ধকার ঘরে বুঝতে পারছে না লোকটি কে? লোকটির চিৎকার বন্ধ হলে আয়েশা বেগম লন্ঠন জ্বালিয়ে দরজা খুলে বাহিরে আসেন৷ সমস্ত গ্রামের মানুষ জড়ো হয়ে গেছে৷ আরিফ আয়েশা বেগমকে দেখে চমকে উঠে৷ যেন রক্ত দিয়ে স্নান করে আসলেন৷ সমস্ত দেহে রক্ত লেগে আছে। আয়েশা বেগম রাগী গলায় বলল,

“ভুল মানুষকে কলঙ্ক করতে এসেছিলেন৷ আমি আয়েশা বেগম। পাক হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছি৷ সেখানে এসব বাচ্চা আমার কলঙ্ক করবে৷ যে লোক আমায় কলঙ্ক করতে আসছিল তার জীবনকে শেষ করে দিয়েছি৷ খুন করেছি তাকে৷”

কারো মুখে কোন কথা নেই৷ কয়েকজন লোক দৌড়ে ঘরে ঢুকে৷ জামিলকে ধরে নিয়ে আসে৷ জামিল আইয়ুব আলীর ডানহাত বলা চলে৷ সকল খারাপ কাজে জামিলকে দেখা যায়৷ আইয়ুব আলীর দিকে এগিয়ে এসে বলল,

“আমার নামে পুলিশ ক্যাস করবেন না নতুন এমপি সাহেব৷ সম্মান বাঁচাতে খুন করেছি এতে আমার জেল হবে না৷ জেল হলে আপনার হবে৷ গ্রামের লোক জানে জামিল কার কাজ করে৷”

আইয়ুব আলী মাথা নিচু করে চলে যায়৷ জামিলের লাশ কলা গাছের ভেলা বানিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দেয়৷

আয়েশা বেগম গ্রামবাসীদের উদ্দেশ্যে বলেন,

“নিজের সম্মান বাঁচাতে এসব নর পশুদের খুন করে ফেলেন৷ ধর্ষকের বেঁচে থাকার অধিকার নেই।”
________

কেউ ভালোভাবে রাত্রি যাপনও করতে পারছেন না৷ এমপি হওয়ার পর অত্যচার অনেক বেড়ে গেছে৷ লোকমুখে শুনা যায়, মাঝে মধ্যে নদীতে লাশ ভেসে যেতে দেখা যাচ্ছে৷ বেশির ভাগ লাশ মেয়ে৷ আয়েশা বেগম এসব ভাবনায় আর ঘুমাতে পারছেন না৷ যতগুলো লাশ পাওয়া গেছে সবই পাশের গ্রামের৷ সাবালিকা মেয়েরা স্কুলে যেতে ভয় পাচ্ছে৷ দিনের আলো ফুটতেই আয়েশা বেগম বেরিয়ে পরেন সেসব মেয়ের খুঁজ নিতে৷ সবথেকে বেশি সন্দেহজনক হচ্ছে মানুষের অর্গান নিয়ে৷ ধর্ষণের পর দেহ থেকে ভিতরের অঙ্গগুলে খুলে নিচ্ছে কেন? কেউ কি এগুলোর ব্যবসা করছে?

আয়েশা বেগম সকলের বাড়িতে ঘুরেও কোন উত্তর পেল না৷ ধর্ষণের কাজ হলে আরিফ জড়িত থাকত৷ দেহের অঙ্গ নিয়ে ব্যবসা করার মতো নয়৷ তাছাড়া এই গ্রামে উন্নতি প্রযুক্তি নেই যে, সেগুলো বিক্রয় উপযুক্ত রাখবে৷ বেশির ভাগ মানুষ কবিরাজের উপর নির্ভর করে৷ শূন্যে ঢিল ছুঁড়ে মারার জন্য আয়েশা বেগম গ্রাম পঞ্চায়েতের বাড়িতে যান৷ কিন্তু আয়েশা বেগমকে বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি৷ গেইট থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে৷

আর কিছু ভাবতে পারছে না৷ শরীর খুব অবশ লাগছে৷ তীব্র মাথা ব্যাথায় খোলা বারান্দার চৌকির উপর ঘুমিয়ে পড়েন৷ ঘুম থেকে উঠে দেখেন অনেক রাত৷ আকাশে থালার মতো ঝলমলে চাঁদ। মনটা ভালো করার জন্য নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন৷ আর সেখানেই রহস্যের সন্ধ্যান পান৷

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে