Saturday, June 28, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 303



অতঃপর গল্পটা তোমার আমার পর্ব-০৮

0

#অতঃপর_গল্পটা_তোমার_আমার
#পর্ব-০৮
#হুমায়রা_আঞ্জুম (লেখনীতে)

বৃষ্টি মাথায় নিয়েই সানাতকে খুঁজে চলেছে অন্তিম। এজাজদের বাড়ির আশেপাশেও খোঁজ নিয়েছে কিন্তু কোথাও সানাতকে পায়নি। এই মুহূর্তে সে সানাতের আরেক স্টুডেন্টের বাসার নিচে দাঁড়িয়ে আছে। এখানেও সানাতকে পায়নি। অন্তিম কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। এতো রাতে ঝড় বৃষ্টির মধ্যে সানাত কোথায় যেতে পারে মাথায় আসছেনা তার। হঠাৎ কিছু মনে পড়তেই অন্তিম ভেজা চুলে একবার হাত চালিয়ে বাইকে উঠে বাইক স্টার্ট দিলো।

বাসস্ট্যান্ডের সামনে বাইক থামালো অন্তিম। সানাতকে সে এর আগে প্রায়ই এখান থেকে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে দেখেছে। তাই বাস স্ট্যান্ডের কথা মাথায় আসতেই যেনো আশার আলো খুঁজে পেয়েছিল। তবে এখানে এসে সে হতাশ হলো। কারণ এখানে কোথাও সানাতকে তার চোখে পড়লো না। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ মানুষের ভীড় নিতান্তই খুব কম, নেই বললেই চলে। অন্তিম বাইকের কাছে গিয়ে বাইক স্টার্ট দিতে নিলেই হঠাৎ চোখ পড়লো রাস্তার অপর পাশের ফুটপাতে। সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেলো অন্তিম। বৃষ্টিতে খুব একটা স্পষ্ট না দেখতে পেলেও দূর থেকে সানাতের পরনে আকাশী রঙের শাড়িটা দেখে সে চিনতে ভুল করেনি ওটা সানাত। অন্তিম বাইক থেকে নেমে দৌঁড়ে গিয়ে সানাতের সামনে দাঁড়াতেই দেখলো সানাত ফুটপাতে মাথা নিচু করে বসে আছে। অন্তিম হাঁটু ভাঁজ করে সানাতের সামনে বসে পড়লো। তারপর ডেকে উঠলো,

“সানাত!”

অন্তিমের গলার আওয়াজ কানে পৌঁছাতেই সানাত মাথা তুলে তাকালো। সানাতের মুখের দিকে তাকাতেই যেনো অন্তিমের ভেতরটা ধ্বক করে উঠলো। সানাতের চোখ দুটো ফুলে লাল হয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কেঁদেছে। এই ভাঙ্গাচোরা,বিধ্বস্ত সানাতকে এর আগে কখনো দেখেনি সে।অন্তিমকে দেখে সে ভাঙ্গা গলায় বললো,

“আপনি? আপনি এখানে কেনো?”

“সানাত তোমার কোনো সেন্স আছে আমি তোমাকে কোথায় কোথায় খুঁজেছি। ক’টা বাজে তোমার খেয়াল আছে! আমি চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। আর তুমি এখানে ফুটপাতে বৃষ্টির মধ্যে বসে আছো! আমার কতোটা টেনশন হচ্ছিলো জানো তুমি? বারবার মনে হচ্ছিলো ওইসব কথা শুনে অভিমানের বশে তুমি হয়তো সুইসাইড…”
এইটুকু বলেই থেমে গেল অন্তিম আর বলতে পারলোনা। সানাত তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,

“চিন্তা করবেন না আমি আর যাই করি আত্মহত্যা করবো না। এতকিছুর পরও যখন বেঁচে আছি তখন এতো সহজে মরবো না। আমি মরতে খুব ভয় পাই। খুব। তারজন্যই তো এতকিছুর পরও মরার কথা ভাবছিনা উল্টো বাঁচার জন্য লড়াই করছি প্রতিনিয়ত। আর আমি মরলে কি করে চলবে বলুন? আমি মরলে ঠিক তার পরের সেকেন্ডেই আমার বাবার চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যাবে, আমার ভাই-বোনের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে, আমাদের সংসারটা অচল হয়ে পড়বে। তাই চাইলেও আত্মহত্যা করতে পারবোনা এখনো যে অনেক পিছুটান রয়েছে। কিন্তু আপনি এখানে কেনো এসেছেন?”

“তোমাকে নিতে এসেছি। বাসায় চলো।”

“আমি কোথাও যাবো না। আপনি ফিরে যান।”

“যাবেনা মানে? মাথা ঠিক আছে তোমার?”

“যার জীবনটাই ঠিক নেই তার আবার কিসের মাথা ঠিক-বেঠিক। আপনি ফিরে যান। আমি কোথাও যাবনা।”

“সানাত পাগলামি করো না। তুমি জানো ওহী তোমার জন্য কতোটা টেনশন করছে?”

“আপনি আমাকে পাগল বলেছেন অথচ আপনার বোন আমার থেকেও বড় পাগল। পাগল না হলে আমার মতো একটা ফেলনা মেয়েকে নিয়ে কেউ এতোটা ভাবে বলুন? ও নিজেও জানেনা ও কতোটা বোকা আমার একটা নোংরা-খারাপ মেয়েকে এতটা ভালবাসছে?”

“সানাত ওহী জানে কে ওর কাছের আর কে নয়। তুমি প্লিজ বাড়ি চলো।”

“আপনি বেকার জেদ করছেন কেনো বুঝতে পারছেন না আমার মতো মেয়ে আপনার জীবনে থাকলে আপনার জীবনটা, আপনাদের পরিবারটা শেষ হয়ে যাবে। আমি যে অপয়া, অলক্ষ্মী! আমি এতটাই খারাপ যে নিজের মায়ের মতো খালার চোখেও আমি বেঈমান। হ্যাঁ মায়ের মতো! কিন্তু মা নয়। দিনশেষে মায়ের মতই থেকে যায় কিন্তু মা হয়ে ওঠে না। তাইতো আমিও মেয়ের মতোই রয়ে গেছি কিন্তু মেয়ে হয়ে উঠতে পারিনি। তাই আপনাকে বলছি এই জোরপূর্বক বিয়েটাকে বয়ে বেড়াবেন না। যেটা হয়েছে সেটাকে একটা দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যান। আর নতুন করে জীবনটাকে গুছিয়ে নিন।”

“আমি আমার জীবনে কি করবো না করবো সেটা তোমার থেকে শুনে করবো না সানাত। তোমাকে আমি সেচ্ছায় বিয়ে করেছি সানাত সেটা হোক মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কিংবা জেদের বশে কিন্তু করেছি। তাই তোমাকে ছাড়তে হলেও আমি সেচ্ছায় ছাড়বো তোমার বা কারো কথায় নয়। তোমার আর আমার মধ্যে একটা বিষয়ে খুব মিল আছে জানো সানাত। আমরা দুজনেই ঠকে গেছি। তুমি বন্ধুত্বে আর আমি ভালোবাসায়। আমার এখন কি মনে হয় জানো সানাত এই পুরো বিষয়টা শুধুমাত্র পরিস্থিতির জন্য ছিলোনা কোথাও না কোথাও ডেস্টিনিতে ছিলো তাই হয়েছে। তোমার আর আমার গন্তব্যটা হয়তো আলাদা কিন্তু আমাদের রাস্তাটা এক। তাই আমি তোমার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছি সানাত। ভেবোনা আমি দয়া-মায়া করছি আমি আমার আত্মগ্লানি কমাতে হাত বাড়াচ্ছি। কারণ আমি জানি তোমার আজকের এই অপমানের জন্য আমি দায়ী। আমি যদি সেদিন একবারের জন্য হলেও জানতাম তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসো তাহলে বিশ্বাস করো আমি আর যাই হোক না কেনো জেদের বশে তোমার লাইফ নিয়ে খেলতামনা। তাই বন্ধুত্বের হাত বাড়াচ্ছি সানাত তুমি কি আকড়ে ধরবে এই হাতটা? আই প্রমিজ আমি বিশ্বাস ভাংবোনা।”

সানাত কোনো কথা বলছেনা শুধু নিস্পলকভাবে তাকিয়ে আছে। অন্তিম আবারও বললো,

“ধরবে না সানাত?”

সানাত আকড়ে ধরেই কেঁদে ফেললো। অন্তিম আলতো করে সানাতের গালে হাত রেখে বললো,

“সানাত প্লিজ কান্না থামাও। এখন অনেক রাত হয়ে গেছে বাড়ি ফিরতে হবে। আর তুমিতো ভিজে একাকার হয়ে গেছো সাথে আমিও। এবারে নির্ঘাত জ্বর আসবে। তাড়াতাড়ি চলো।”

সানাত উঠে দাঁড়ালো। শীতে চোখে ঝাপসা দেখছে সে। তারপর অন্তিমের পেছনে গিয়ে বাইকে উঠে বসলো। অন্তিম একটা হেলমেট দিয়ে বাইক স্টার্ট দিতে দিতে ভিউ মিররের দিকে তাকিয়ে বললো,

“অস্বস্তি বোধ করো না। শক্ত করে ধরে বসো। তোমার গা গরম জ্বর আসবে বোধয়। আর দুর্বল আছো যেকোনো সময় সেন্সলেস হয়ে যেতে পারো। তাই শক্ত করে ধরে বসো।”

সানাত আলতো করে অন্তিমের কাধে হাত রাখলো। সানাতের ভেতরটা আজ অদ্ভুত ভালোলাগায় ছেয়ে যাচ্ছে। ইশ এতো সুখ কেনো লাগছে তার। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে সে মোটেও অভাগী নয় বরং বড্ডো ভাগ্যবতী। কেনো মন বলছে তাদের অগোছালো সম্পর্কটা ধীরে ধীরে রং পাচ্ছে।
বাইক বাসার সামনে এসে থামাতেই অন্তিম আচমকা খেয়াল করলো সানাত তার পিঠে ঢলে পড়েছে। বেশ কয়েকবার ডাক দেওয়ার পরও কোনো সাড়া দেয়নি। অন্তিম বুঝতে পেরেছে এই মেয়ে সেন্সলেস হয়ে গেছে। কোনো রকমে দাড়োয়ান চাচার হেল্প নিয়ে হ্যান্ডেল করে বাইক থেকে নেমে সানাতকে কোলে তুলে নিয়ে বাসার ভেতরে গেলো।
এদিকে সানাতকে নিয়ে বাসায় ঢোকার পর ওহী সানাতের এই হাল দেখে কেঁদে কেটে এক। তার প্রাণের প্রিয় বান্ধবীর এই অবস্থা দেখে তার ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। সে যে সানাতকে বড্ড ভালোবাসে। অন্তিম একটু বিরক্ত হলেও প্রকাশ করছেনা। সে ওহীকে বললো,

“ওহী ওর ভেজা শাড়িটা চেঞ্জ করে দে। আর জ্বর এসেছে কিছু খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দে। আজকে রাতটা তুই ওর সাথে থাক। কোনো প্রয়োজন পড়লে আমাকে ডাক দিস আমি ওই রুমেই আছি।”
বলেই বেরিয়ে গেলো অন্তিম।
#চলবে_

অতঃপর গল্পটা তোমার আমার পর্ব-০৭

0

#অতঃপর_গল্পটা_তোমার_আমার
#পর্ব-০৭
#হুমায়রা_আঞ্জুম (লেখনীতে)

বিকাল পাঁচটা বেজে কুড়ি মিনিট। কোলাহলপূর্ণ ব্যস্ত শহরে তখন গোধূলি নেমে গেছে। শহরে আজ ঠান্ডা হাওয়া বইছে। রিকশায় বসে হাত ঘড়িটার দিকে একপলক চোখ বুলিয়ে সামনে তাকালো সানাত। এই বিষণ্ণ শহরে দূষিত অক্সিজেনের মাঝে হাপিয়ে উঠেছে সে। সকালে সেই যে খেয়ে বেরিয়েছিল তারপর ভার্সিটিতে একটা রোল খেয়েছিল তারপর থেকে এখন অব্দি আর পেটে কিছু পরেনি। এই মুহূর্তে সে যাচ্ছে এক স্টুডেন্টের বাসায় তাকে পড়াতে। আজ টানা পাঁচদিন পড়ানো হয়নি। টিউশনটা চলে যায়নি এই তার কপাল। একটা তো চলেই গেছে। এটাও চলে গেলে দিশেহারা হয়ে যাবে সে। সানাতের ভাবনার মাঝেই রিকশাওয়ালা মামা বলে উঠলেন,

আফা আইয়া পড়ছি। নামেন।

সানাতের ধ্যান কাটলো। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে সামনের কাঙ্ক্ষিত বিল্ডিংয়ের দিকে তাকালো। তারপর গেটের কাছে এসে দাঁড়াতেই দারোয়ান চাচা বিনয়ী হেসে গেটটি খুলে দিলেন।

🌻
আজ অন্তিমরা চার ফ্রেন্ড একসাথে হয়েছে। হাসি, মজা, ইয়ার্কিতে মেতে উঠেছে বন্ধুমহল। গল্পের মাঝেই অন্তিমের বন্ধু এজাজ বলে উঠলো,

অন্তিম তোর বিয়েটাতে তো অ্যাটেন্ড করতে পারলামনা। দেশের বাইরে ছিলাম। বিবাহিত লাইফ কেমন যাচ্ছে বল। আমরাও একটু শুনি। আর ভাবীর সাথে কবে আলাপ করাবি?

এজাজের কথায় লিমন বলে উঠলো,

দোস্ত আমিও ওর বিয়াটা খাইতে পারিনাই। শালার কাজিনের বিয়াটাও ওইসময় পড়ছিল তাই খুলনা গেছিলাম। পরে নাদিমের থেইকা জানলাম ওর বিয়ায় পুরা সিনেমার কাহিনী হইছে।

সে যাইহোক কিন্তু তোদের মধ্যে কি এখন সব ঠিকঠাক আছে?

তোরা প্লিজ এই টপিকটা বাদ দিবি। বললো অন্তিম।

বাদ দিবো কেন? দেখ অন্তিম যা হইছে হইছে একসেপ্ট করে নে দোস্ত। আমি তোরে একটা কথাই বলবো যা হইছে ভালোই হইছে। বললো নাদিম।

ভালো হইছে? তা ঠিক কি ভালো হইছে আমারে একটু বল? আমার লাইফটা শেষ হয়ে গেছে। সব জাস্ট হেল হয়ে গেছে।

তুই সত্যিই বুঝতে পারতেছিস না কি ভালো হইছে তোর?

না। সোজা উত্তর অন্তিমের। নাদিম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

ভালো এইটাই হইছে যে ছোঁয়ার সাথে তোর লাইফটা জড়ায় নাই। যেই মেয়ের কাছে তোর ভালোবাসার কোনো মূল্য নাই সামান্য কিছু অর্থের জন্য ওই রকম লোভী, বেঈমান মেয়ের সাথে বিয়ে হয়নাই বাইচা গেছস। সানাত মেয়েটা ছোঁয়ার চেয়ে হাজার গুণ ভালো। আমি মানুষ চিনতে খুব একটা ভুল করিনা অন্তিম। তাই অভিজ্ঞতার জোর থেকেই বলছি তুই সানাতকে ছোঁয়ার সাথে গুলিয়ে ফেলিস না। মেয়েটা সত্যিই আলাদা। আর সব থেকে বড় বিষয় কি জানিস ইটস অল অ্যাবাউট ডেসটিনি।

দোস্ত আক্ষেপের বিষয় আমি এই সানাতরে থুড়ি ভাবিরে দেখলামনা। বললো লিমন।

লিমনের কথায় এজাজ বললো,

আমিও না রে।

আরেহ চাপ নিস না সময় তো আর পালাচ্ছে না।সামনে অনেক দেখা হবে। তখন দেখিস শ্যামবতীরে।

শ্যামবতী?

আরেহ আমি ডাকি ওরে এই নামে। আগে যখন ছোঁয়ার সাথে আসতো তখন এই নামেই ডাকতাম। বলেই মলিন হাসলো নাদিম। সেই হাসিতে কিছুটা বিষণ্ণতা ছিলো যা কারো দৃষ্টিগোচর হলো না।

অন্তিম কোনো কথা বললোনা। চুপচাপ বসে ছিল। কিছু সময় পর নাদিম বললো,

ওকেহ গাইস এখন যেতে হবে। ইমারেন্সি কাজ আছে।

যাহ যাহ তোর কি ইমারজেন্সি কাজ তা কি আর আমরা জানি না। বললো লিমন।

শালা তোর নেগেটিভ মাইন্ড। বলেই হেসে চলে গেল নাদিম।

🌻
এশা যেই ম্যাথ গুলো হোমওয়ার্ক দিয়েছি ওগুলো সলভ করে রাখবে। আমি কালকে এসে দেখবো।ঠিকাছে?

ওকে মিস।

ঠিকাছে তাহলে আমি এখন উঠি।

আচ্ছা।

আজকে তোমাকে শান্তিতে পড়াতে পারলামনা পাশের রুমে এতো হাসাহাসির আওয়াজ ছিলো। কারা এসেছিল এশা?

ভাইয়ার বন্ধু-বান্ধব।

ওহ।
তাদের কথার মাঝেই এশার মা ড্রয়িংরুম থেকে এশাকে ডেকে উঠলেন। এশা মায়ের ডাকে উঠে ড্রয়িংরুমে চলে গেলো। ড্রয়িংরুমে যেতেই দেখতে পেলো সেখানে তাঁর মা আয়েশা খানম তার ভাইয়ের বন্ধুদের সাথে হাসিমুখে কথা বলছে। এশাকে দেখা মাত্রই আয়েশা খানম বলে উঠেলন,

তোর পড়া শেষ?

হ্যাঁ আম্মু।

তোর মিস কোথায়?

বের হচ্ছে।

গিয়ে বল আমি ডাকছি।

এশা মায়ের কথায় সায় জানিয়ে মিসকে ডাকতে চলে গেলো। আর এদিকে আয়েশা খানম ছেলের দুই বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন,

আর বলোনা বাবা মাস শেষে তিন হাজার টাকা দেই। সেও মাত্র দুটো সাবজেক্ট পড়ায়। এরমধ্যে কামাই করে অর্ধেক মাস। এরকম করলে পড়া হয়?

অন্তিম আর লিমন জোরপূর্বক হাসলো। এজাজের মাকে তাদের খুব একটা পছন্দ নয়। মহিলার ব্যবহার মোটেও ভালো নয় সে সম্পর্কে তারা খুব ভালো করেই জানে। কিন্তু না জানি আজকে এই মাস্টারের কপালে কি আছে! তাদের ভাবনার মাঝেই সানাত এসে উপস্থিত হলো। সানাত আর অন্তিম দুজনের কেউই একজন অপরজনকে খেয়াল করেনি। অন্তিম মাথা নিচু করে ফোন চালাচ্ছে। সানাত বলে উঠলো,

আসসালামু আলাইকুম আন্টি। আমাকে ডেকেছিলেন?

পরিচিত কণ্ঠস্বর কানে যেতেই মোবাইলের ওপর চলমান আঙ্গুল থেমে গেলো। মাথা উঠিয়ে সামনে তাকাতেই থমকে গেলো সে। ঠিক সেই মুহূর্তে সানাতেরও চোখ পড়লো অন্তিমের দিকে। সেও থমকে গেলো। দুজনের মনেই একই প্রশ্ন হানা দিলো, “ও এখানে?”
তাদের ভাবনার মাঝেই আয়শা খানম বলে উঠলেন,

ওয়ালাইকুম আসসালাম। জ্বি ডেকেছিলাম তোমাকে। কিছু কথা ছিল তোমার সাথে।

সানাত অন্তিমের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এশার মায়ের দিকে তাকালো। তারপর বললো,

জ্বি বলুন।

কতদিন পর পড়াতে এলে শুনি?

জ্বি আন্টি পাঁচদিন।

পাঁচদিন পড়াওনি অথচ মাস শেষে তিনটা হাজার টাকা দেই তোমাকে সেটা কি এমনি এমনি!

আন্টি আমি সত্যিই খুবই দুঃখিত। একটু সমস্যায় ছিলাম তাই আসতে পারিনি।

তোমার সমস্যা দিয়ে কি আমাদের চলবে শুনি? আমার মেয়ের পরীক্ষার সময়ই তোমার যত সমস্যা দেখা দেয়? মশকরা করছো আমার সাথে?

আন্টি সত্যিই ভীষন প্রবলেমের মধ্যে ছিলাম তাই আসতে পারিনি।

চুপ করো। কি প্রবলেম ছিলো তা কি আর আমি জানিনা মনে করেছো? তোমার নাম্বার বন্ধ পেয়ে তোমার খালার কাছে কল করেছিলাম। সেখান থেকেই জানতে পারলাম বোনের হবু জামাইয়ের সাথে ফষ্টি-নষ্টি করে বোনের বিয়েটা ভেস্তে দিয়ে নিজে বিয়ে বসেছো।

সানাত নিষ্প্রাণ চোখে তাকিয়ে বললো,

এসব আপনি কি বলছেন আন্টি? মামণি বলেছে আপনাকে এসব?

হ্যাঁ তোমার খালা নিজে বলেছে আমাকে। তোমাকে দেখে তো ভালো মেয়েই মনে হয়েছিল যেনো ভাঁজা মাছটি উল্টে খেতে জানোনা এদিকে তো ভালই গুটি চেলেছ। শেষে কিনা নিজের বোনের ভালোবাসার মানুষ কেড়ে নিয়ে নিজে সুখী হতে চাইছো? অলক্ষ্মী, অপয়া, স্বার্থপর মেয়ে কোথাকার!

আন্টি প্লিজ আপনি না জেনে কোনো কথা বলবেননা।

খালা আর মায়ের মধ্যে তফাৎ কি? সেই মায়ের মত খালা কি মিথ্যে কথা বলেছে আর তুমি একা সত্য বলছো? বোকা পেয়েছ আমাকে?

আন্টি আমি আপনার মেয়েকে পড়াই তার বদলে পারিশ্রমিক পাই এইটুকুই আপনার সাথে আমার সম্পর্ক। এর বাইরে আপনি আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কোনো কথা বলতে পারেননা।

একদম বেশি কথা বলবেনা। তোমার মতো জঘন্য মেয়ে হওয়ার চেয়ে না হওয়া ঢের ভালো। চরিত্রহীনা মেয়ে কোথাকার!

অন্তিম এতক্ষণ অব্দি নিজেকে অনেক কষ্ট করে সংযত করে রেখেছিল কিন্তু এবারে আর পারলোনা। তৎক্ষণাৎ বলে উঠলো,

আন্টি প্লিজ এভাবে আপনি একজনের ক্যারেক্টার নিয়ে যা তা বলতে পারেননা। আপনার কোনো রাইট নেই। আপনার ঘরেও তো একটা মেয়ে আছে।

তুমি থামো অন্তিম। এসব মেয়েদের তুমি চেননা। আর এই মেয়ের সাথে আমার মেয়ের তুলনা দিওনা। আমার মেয়ে ওর মতো খারাপ নয়। তুমি ভাবতে পারছো কতোটা খারাপ মেয়ে হলে বোনের সংসার ভাঙ্গে। যার পাতে খেলো তার পাতেই থুথু ফেললো! ওর খালার থেকেই তো শুনলাম ওর মা মরে গিয়ে বেঁঁচে গেছে। এমন মেয়ে জন্ম দেওয়ার থেকে মরে যাওয়া ভালো। এরা মান সম্মান রাখেনা।

সানাত কেঁদে ফেললো। তারপর বলে উঠলো,

আপনি আমাকে নিয়ে যা বলেছেন আমি সহ্য করে নিয়েছি কিন্তু আমার মরা মাকে নিয়ে কিছু বলবেননা। আমি সহ্য করতে পারবনা। আমি আপনার মেয়েকে কাল থেকে আর পড়াতে আসবোনা।

হ্যাঁ হ্যাঁ। এসো না আর। তোমার মতো মেয়ের ছায়া আমার মেয়ের ওপর পড়লে আমার মেয়েও নষ্ট হয়ে যাবে। কেনো যে বেঁঁচে থাকো তোমরা পথে ঘাটে গাড়ি ঘোড়ার নিচে পড়ে মরে গেলেও তো পারো। তাতে অন্তত অন্যের জীবনের ভোগান্তি কমে।

অন্তিম চেঁচিয়ে উঠে বললো,

আন্টি প্লিজ। আপনি কিসব বলছেন এসব? আপনারও সন্তান আছে আন্টি। একজন মা হয়ে অন্যের সন্তানের মৃত্যু কামনা করেন আপনি? ছিঃ!

সানাত অন্তিমের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো। তারপর আয়েশা খানমের দিকে তাকিয়ে বললো,

আপনি ভাববেন না আন্টি আপনার মেয়ে কেনো আমি দোয়া করি আমার মতো জীবন যেনো কোনো মেয়ের না হয়। কোনো মেয়ের না!
বলেই বেরিয়ে যেতে নিলে আয়েশা খানম সানাতের হাতে এ মাসের বেতনটা ধরিয়ে দেন। সানাত আর এক মুহুর্ত দেরি না করে বেরিয়ে যায়।
অন্তিমের আর এখানে থাকার বিন্দু পরিমাণ ইচ্ছে নেই। সে বেরিয়ে যেতে নিলেই লিমন বলে উঠলো,

কোথায় যাস? এজাজ খাবার অর্ডার করেছিলো আনতে গেছে। এসে যাবে এখনি।

আমার ভালো লাগছে না। এজাজ আসলে তুই একটু ম্যানেজ করে নিস। বলেই সে বেরিয়ে গেলো।

🌻
রাত ৯ টা। অন্তিম একটা দোকানে বসে সিগারেট খাচ্ছিল। হঠাৎ ফোন বেজে ওঠায় পকেট থেকে বের করেই দেখলো ওহীর ফোন। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ব্যস্ত গলায় ওহী বললো,

ভাইয়া তুমি কোথায়?

বাইরে আছি। কেনো?

ভাইয়া আসলে সানাত এখনো বাসায় ফেরেনি।

অন্তিম প্রথমে খেয়াল করেনি তবে পরমুহূর্তে খেয়াল হতেই বলে উঠলো,

হোয়াট? বাসায় ফেরেনি মানে?

হ্যাঁ ভাইয়া বাসায় ফেরেনি। পড়াতে গেছিলো। কিন্তু ৮টার মধ্যেই ফিরে আসার কথা। সেখানে ৯টা বাজে। আমি ফোনও করেছিলাম সুইচস্টপ বলছে।বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। আব্বু আম্মুও বাসায় নেই ছোটো ফুপি অসুস্থ সেখানে গেছে। সকালের আগে ফিরবেনা। আমার খুব টেনশন হচ্ছে ভাইয়া। কোনো বিপদ হলো না তো।

ওহী প্লিজ কাম ডাউন। আমি দেখছি। তুই টেনশন করিসনা। ও যেখানে যেখানে পড়াতে যায় তার ঠিকানাটা আমায় পাঠিয়ে দে।

আচ্ছা।
ফোন কাটতেই অন্তিম উঠে দাঁড়ালো। তার হঠাৎ সত্যিই খুব চিন্তা হচ্ছে তার সাথে ভয়ও হচ্ছে। সানাত কোথায় চলে গেলো। অভিমানের বশে নিজের কোনো ক্ষতি করে বসবেনা তো! যদি সত্যিই এজাজের মায়ের কথা মাথায় নিয়ে গাড়ি ঘোড়ার নিচে। নাহ্ আর ভাবতে পারছেনা অন্তিম। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বেরিয়ে গেলো সে সানাতের খোঁজে।
#চলবে

অতঃপর গল্পটা তোমার আমার পর্ব-০৬

0

#অতঃপর_গল্পটা_তোমার_আমার
#পর্ব-০৬
#হুমায়রা_আঞ্জুম (লেখনীতে)

টানা তিনবার কল বেজে কেটে যাওয়ার পর চতুর্থবারের বেলায় রিসিভ করলো সানাত। ফোন কানের কাছে নিয়ে সোজা বেলকনিতে চলে গেলো।

হ্যালো, শাকিল বল।

কি ব্যাপার আপু কতদিন ধরে কল করছি তোমাকে রিসিভ করছোনা কেনো?

ফোন চার্জ দেওয়া হয়নি বন্ধ হয়ে পড়েছিল। আজকে চার্জ দিলাম। বাড়ির সবাই কেমন আছে? আর বাবা?

সবার কথা বাদ দেও। তুমি ঠিক আছো তো আপু?

সানাত মলিন হাসলো তারপর বললো,

আমি ঠিক থাকবো না কেনো! আমি একদম ঠিক আছি।

ছোঁয়া আপুদের বাসায় ফোন করেছিলাম সেখান থেকে পুরো ঘটনা জানতে পেরেছি।

বাবাকে বলেছিস নাকি আবার?

হ্যাঁ বলেছি।

তুই কি পাগল শাকিল? বাবাকে কেনো বলতে গেলি? বাবা নিশ্চই অনেক টেনশন করেছে।

কান্না করেছে অনেক।

কেনো বলতে গেলি? খুব কি দরকার ছিল?

পরে জানলে আরো কষ্ট পেতো তাই বলে দিয়েছি।

আচ্ছা বাদ দে। বাবার শরীর কেমন?

খুব একটা ভালো নেই। ওষুধ ফুরিয়ে এসেছে প্রায়। শরীরে আবার পানি আসছে। সারারাত দাহ করে।

সানাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

আমাকে একটা দিন সময় দে টাকা যোগাড় করে পাঠিয়ে দেবো। তুই করিম চাচার ফার্মেসী থেকে আপাদত বাকিতে ওষুধ নিয়ে আয় । আমি পরশু টাকা পাঠাচ্ছি।

আচ্ছা। তুমি আসবে কবে?

জানিনা। আচ্ছা এখন ফোন রাখ। বাবার খেয়াল রাখিস। আর সাবা আর তুই মন দিয়ে পড়িস। খালি টইটই করে ঘুরে বেরাস না।

ঠিকাছে। তুমি ভালো থেকো।

থাকবো। বলেই ফোন কেটে দিলো সানাত। আজকে বিকেলে এক স্টুডেন্টের মা ফোন করে না করে দিয়েছে। এতদিন কামাই করায় তারা আর তাকে দিয়ে আর পড়াবেনা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে। এ মাসের টিউশন ফি টা এসে নিয়ে যেতে বলেছে। তিনটা টিউশনের মধ্যে একটা চলে গেছে। তিনটা টিউশন করেও সে সংসার চালাতে হিমশিম খায় তাহলে এ মাসে কি করে চালাবে এই চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে সানাতের। এসব চিন্তা মাথায় নিয়েই রুমে প্রবেশ করলো সানাত। রুমে ঢুকেই অন্তিমকে দেখে সে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। অন্তিম কখন রুমে এসেছে তা একদম টের পায়নি সানাত। আচ্ছা লোকটা কি তার ফোনের কথাগুলো শুনতে পেরেছে নাকি। ভাবতেই অস্বস্তিতে পড়ে গেলো সানাত। এসব ভাবনার মাঝেই হঠাৎ চোখের সামনে কেউ তুরি বাজাতেই ঘোর কেটে গেল সানাতের। সামনে তাকাতেই দেখতে পেলো অন্তিম তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। তারপর বললো,

হোয়াট হ্যাপেনড? তুমি এভাবে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছো কেনো?

সানাত কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। প্রথমত সে অতিমাত্রায় অবাক। এতই অবাক যে কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। তার কারণ সে নিজের চোখ-কান কাউকেই বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না যে অন্তিম আহসান নিজে তার সাথে সেধে এসে কথা বলছে। অন্তিম এবার বিরক্ত হয়ে আবারও বললো,

কি ব্যাপার? কথা বলছো না কেনো? কিছু জিজ্ঞেস করছি তো নাকি!

সানাত কোনো কথা না বলে নিজের হাতে চিমটি কাটলো। তৎক্ষণাৎ ব্যথায় ককিয়ে উঠলো। আর এদিকে অন্তিম অবাক হয়ে সানাতের উদ্ভট কর্মকাণ্ড দেখছে। সানাত এবার অন্তিমের দিকে তাকিয়ে বললো,

তারমানে আপনি সত্যিই এখানে দাড়িয়ে আছেন?

হোয়াট? এই তুমি কিসব বলছো মাথা ঠিক আছে তোমার? মিথ্যে মিথ্যে আবার কিভাবে দাড়িয়ে থাকে?

না মানে আপনার মত এতো দাম্ভিক, অহংকারী মানুষ সেচ্ছায় এসে আমার সাথে কথা বলছে এটা ঠিক হজম করে উঠতে পারিনি।

অন্তিম অপরাধীর মতো তাকালো কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলে উঠলো,

সরি।

সানাত যেনো ধাক্কা খেলো। নিজের কান কি তার সাথে ফাইজলামি করছে নাকি তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছেনা সে। সে কি ঠিক শুনেছে অন্তিম আহসান তাকে সরি বলেছে? এটা কি আদেও সম্ভব? সানাত রোবটের মত বললো,

হঠাৎ সরি? কিসের জন্য?

অন্তিম বেশ শান্ত সুরেই বললো,

আসলে আমার মনে হয়েছে আমি তোমার সাথে ঠিক করিনি, অন্যায় করে ফেলেছি। হয়তো তোমার কোথাও ভুল ছিলোনা। জেদের বশে তোমার লাইফটা হেল করে দিয়েছি।
অন্তিম এইটুকু বলে সানাতের দিকে তাকাতেই দেখলো সানাত জ্ঞান হারিয়ে ফ্লোরে পড়তে নিলেই অন্তিম ধরে ফেললো। পুরো ঘটনায় অন্তিম বাকশুণ্য। তার ঠিক কি প্রতিক্রিয়া করা উচিত সে বুঝে উঠতে পারছেনা সামান্য একটা সরি বলেছে তাতেই এই মেয়ে অজ্ঞান। নিজেকে এই মুহূর্তে ভূত বা কোনো জোকার মনে হচ্ছে অন্তিমের।

🌻
চোখে মুখে পানির ছিটা পরতেই হালকা পিট পিট করে চোখ খুললো সানাত। চোখ খুলতেই দেখলো মাথার ওপর সিলিং ফ্যানটা অনবরত ঘুরছে। আর তার দিকে অনেকগুলো চোখ তাকিয়ে আছে। সানাত বেশ অস্বস্তিতে পড়লো। মাথার কাছে অন্তিমের মা অর্পিতা আঞ্জুম, পায়ের কাছে ওহী বসে আছে। আর খাটের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে অন্তিমের বাবা, বাড়ির কাজের মহিলা লতা। সবার দিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকাতেই দৃষ্টি আটকে গেলো অন্তিমে। অন্তিম বিরক্ত হয়ে তারদিকে তাকিয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে মনে পরে গেলো তার অজ্ঞান হওয়ার ঘটনা। পুরো ঘটনা মনে করতেই সানাত লজ্জায় নুইয়ে গেলো। নিজের প্রতি নিজেরই ধিক্কার জানাতে ইচ্ছে করছে তার। অন্তিমের মা অর্পিতা আঞ্জুম বলে উঠলেন,

সানাত তুমি ঠিক আছো? হঠাৎ কি হলো অজ্ঞান হয়ে গেলে কি করে?

ভূত দেখেছিল। বললো অন্তিম।

ঘরের সবাই অবাক হয়ে তাকালো অন্তিমের দিকে আর তারপর সানাতের দিকে। সবার মাঝে ওহী বলে উঠলো,

কিন্তু ভাইয়া সানাত ভূতে কেনো ভয় পাবে? না মানে ভূতের তো ওকে দেখে ভয়ে জ্ঞান হারানোর কথা।

ওহীর ইয়ার্কি মার্কা কথায় ফিক করে হেসে দিলো লতা খালা। তারপর হাসতে হাসতেই বললো,

আফনে পারেনও ছোডো আফামনি।

এদিকে চোখ পাকিয়ে তাকালো অন্তিমের মা অর্পিতা আঞ্জুম। রাগী গলায় বললো,

কানের নিচে একটা দেবো ফাজিল মেয়ে। সবসময় ফাইজলামি। দেখছিস ও অসুস্থ এই সময়ও তোর ইয়ার্কি না করলে চলেনা তাইনা!

ওহী ঠোঁট টিপে হাসছে। আর ওর হাসি দেখে সানাতের গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। অসভ্যটাকে পড়ে মজা দেখাবে সে। তার আগে নিজেকে আসন্ন তুফান থেকে বাঁচাক। অর্পিতা আঞ্জুম বলে উঠলেন,

সানাত আমি লতাকে দিয়ে গরম দুধ পাঠিয়ে দিচ্ছি খেয়ে নাও, ভালো লাগবে। আর শরীরের যা হাল তাতে দেখে তো তুলোর বস্তা মনে হয়। আমার বাসায় কিন্তু আমি আমার ছেলেমেয়েদের খাওয়া-দাওয়া নিয়ে খুব স্ট্রিক। খাওয়া-দাওয়া নিয়ে কোনো হাংকী-পাংকী চলবেনা। তোমার বেলাতেও এর কোনো ব্যতিক্রম হবে না বলে দিলাম। ওহীকে যেমন শাসন করি তোমাকেও করবো তাতে তুমি আমায় খারাপ শাশুড়ি ভাবলে ভাবতে পারো। আমি আমার মেয়েদের নিয়ে খুব পজেসিভ। বুঝেছ? সানাতের হঠাৎ কি হলো সানাত জানেনা সে আচমকা অর্পিতা আঞ্জুমকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। মায়ের পর খালাকেই মায়ের চোখে দেখেছে সে তবে একটা সময় পর সেও দূরে ঠেলে দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে আর রইলো সৎ মা সে তো সানাতের ছায়াও সহ্য করতে পারেনা। অর্পিতা আঞ্জুম বুঝতে পেরেছেন সানাতের কান্নার কারণ। তিনি খুব স্নেহের সাথে আগলে ধরলেন। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,

এই মেয়ে একদম কাঁদবেনা। এমন ছিচকাদুনে মেয়ে আমার মোটেও পছন্দ নয়। আমার মেয়েরা থাকবে স্ট্রং একদম আমার মতো বুঝলে। মা পাশে আছি সবসময় বুঝলে তাই একদম কাঁদবেনা।

পাশ থেকে ওহী নকল অভিমানের সুরে বলে উঠলো,

বাবাহ আম্মু তুমি লাস্ট কবে আমায় এভাবে জড়িয়ে আদর করেছিলে আমার তো মনে পড়ছেনা অথচ সানাতকে পেয়ে আমার কথা ভুলে গেলে! আমি কি বানের জলে ভেসে এসেছি নাকি?

নাহ তুই ড্রেনের পানি দিয়ে ভেসে এসেছিলি। পাশ থেকে বলেই শব্দ করে হেসে উঠলেন অন্তিমের বাবা ওয়ালিদ আহসান। তার কথায় যেনো পুরো ঘরময় হাসির রোল পড়ে গেলো। সানাতও হেসে দিলো। ওহীর মুখটা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেছে এতবড় অপমানে! কিন্তু কিছুক্ষণ পর সে নিজেও হেসে উঠলো। আজ অনেকদিন পর আহসান মঞ্জিলে সুখের আনাগোনা দেখা দিলো। অদ্ভুতভাবে আজকের এই দৃশ্যটা অন্তিমের কাছে খারাপ লাগলো না বরং কোথাও না কোথাও ভালোলাগা কাজ করলো। তারপর সে সানাতের দিকে এক পলক তাকিয়ে তার মায়ের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

মা তোমার ওই পাতানো মেয়ের মাথায় কিন্তু ছিট আছে তাই একটু সাবধানে থেকো।
অন্তিমের কথায় প্রথমে সবাই একটু ভ্যাবাচেকা খেলেও পরমুহূর্তে সবাই হেসে দিলো। তারপর অন্তিম বললো,

আচ্ছা আমি এখন একটু বের হবো।

কোথায় যাবি এখন? বললেন অন্তিমের বাবা।

ভার্সিটিতে চাকরির এপ্লাই করবো তাই একটু দরকার আছে।
এইটুকু বলেই সে বেরিয়ে গেলো। আর এদিকে পুরো ঘরে উপস্থিত সবাই চরম অবাক। সবার মাথায় একটাই কথা হঠাৎ এই ছেলের এতো পরিবর্তন! আর সানাত সে বেকুবের মতো তাকিয়ে আছে আর ভাবছে আজ হচ্ছেটা কি!
#চলবে

অতঃপর গল্পটা তোমার আমার পর্ব-০৫

0

#অতঃপর_গল্পটা_তোমার_আমার
#পর্ব-০৫
#হুমায়রা_আঞ্জুম (লেখনীতে)

ঘড়ির কাঁটা বারোর ঘরে অন্তিম এখনও ঘরে ফেরেনি। সারাদিনের দৌঁড়-ঝাঁপ শেষে ক্লান্ত শরীরটা সোফায় এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়েছে সানাত। শরীরটা যেনো আর চলছে না। চোখের পাতায় রাজ্যের ঘুম এসে ভর করতেই গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেলো সে।

বেশ সকালবেলাই ঘুম ভেঙে গেছে সানাতের। ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই তার দৃষ্টি গেছে বিছানায় ঘুমন্ত অন্তিমের দিকে। কালরাতে সে যখন ঘুমিয়েছিল তখন অব্দি অন্তিম আসেনি তারপর কখন এসেছে তা সে জানেনা। সানাত অন্তিমের দিকে তাকিয়ে ভাবে ছোঁয়া কতই না ভাগ্যবতী হতে পারতো যদি সে এই বিয়েটা করতো। অন্তিম ছেলেটা দেখতে যথেষ্ঠ সুদর্শন। ফর্সা গায়ের রং, উচ্চতায় একটু বেশিই লম্বা, সেইভ না করায় গালে হালকা হালকা দাড়ি হয়েছে। সানাত আনমনেই হাসে তারপর নিজেকে শাসিয়ে বলে,
ছি সানাত তুই এভাবে একটা ঘুমন্ত পুরষের দিকে অমন কুদৃষ্টিতে তাকাচ্ছিস, তার সুযোগ নিচ্ছিস। তুই তো দেখছি ভারী অভদ্র মেয়ে।

🌻
সকালে ডাইনিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সানাত। তার পাশেই গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ওহী। তবে অদ্ভুত বিষয় একটু পর পর সে সানাতের দিকে তাকিয়ে বোকার মতো মিটিমিটি হাসছে। সানাত ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে ওহীর দিকে। সকাল সকাল এই মেয়ের এমন অদ্ভুত আচরণে সে বেশ বিরক্ত। তাই এবার সে দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞাসা করেই ফেললো,

এই কি হয়েছে তোর? এভাবে গাধার মত দাঁত কেলাচ্ছিস কেনো?

ওহী কিছু বললোনা উল্টো আবারও হাসলো। সানাত ক্ষেপে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

এই ফাজিল তুই হাসছিস কেনো? মাথার তার ছিঁড়ে গেছে নাকি?

তোকে দেখে হাসছি। বলেই আবার হেসে দিলো।

কিহ! আমাকে দেখে হাসছিস মানে? আমাকে তোর কোন দিক দিয়ে হাস্যকর লাগছে?

তোকে দেখে আমার শুধু হাসি না লজ্জাও লাগছে?

কি যা তা বলছিস? পাগল হয়েছিস নাকি? আমাকে দেখে তোর লজ্জা লাগছে কেনো?

কারণ তুই সকালে গোসল করেছিস? বলেই ওহী মুখ টিপে হেসে দিলো।

তো? এতে হাসার কি আছে?

তুই সকাল সকাল কেনো গোসল করেছিস তা কি আর জানিনা ভেবেছিস?

সানাত ওহীর কথার মানে বুঝতে পেরে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তারপরই ক্ষেপে গিয়ে বললো,

অসভ্য, অশ্লীল। তোর চিন্তা ভাবনাও তোর মত! ছি ছি!

এহহ কি আমার সুশীল মেয়েরে! তোরা করতে পারবি আর আমি…
বাকি কথা টুকু বলার আগেই সানাত ওহীর মুখ চেপে ধরলো। তারপর চোখ রাঙ্গিয়ে বললো,

এই অসভ্য তোর মুখে কিছু আটকায়না? আর তুই যার সাথে আমার কথা বলছিস সে তোর বড়ো ভাই হয়! ছি ছি শেষ অব্দি কিনা নিজের ভাইয়ের… বলতেই ওহীর মুখ ছেড়ে দিলো। ওহী জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে বললো,

ফাজিল মেয়ে আরেকটু হলেই আমি মরে যেতাম। বাপরেহ!

দুজনের কথার মাঝেই হঠাৎ অন্তিমের মা অর্পিতা আঞ্জুম বলে উঠলেন,

সানাত?

হ্যা আন্টি বলুন।

অন্তিম উঠেছে?

জানিনা তো। আমি যখন উঠেছি তখন ঘুমোচ্ছিলো এখন বোধয় উঠেছে।

আচ্ছা তুমি একটু এই কফিটা ওর ঘরে দিয়ে আসো মা।

আমি?

হ্যাঁ তুমি। কেনো কোনো সমস্যা?

না মানে…

পাশ থেকে ওহী বলে উঠলো,

কোনো মানে মানে নেই। চুপচাপ কফিটা নিয়ে ভাইয়াকে দিয়ে আয়।

সানাত আর কিছুই বলে উঠতে পারলো না। কফি হাতে নিয়ে সোজা সিড়ির দিকে পা বাড়ালো।

🌻
অন্তিম ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে চুল মুছছে। এদিকে দরজার সামনে কাচুমাচু করে কফি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সানাত। ভেতরে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না। সানাত দরজায় আসতে করে টোকা দিতেই ভেতর থেকে ভরাট গলায় অন্তিম বললো,

খালা এতক্ষণ লাগে কফি আনতে?

সানাত ভয়ে রীতিমত ঘামছে। না জানি আজ কোন শনি আছে কপালে। শাড়ীর আঁচল দিয়ে কপালের ঘামটুকু মুছে নিয়ে বুকে ফু দিয়ে আস্তে করে পা রাখলো ঘরে। অন্তিম উল্টো দিকে ঘুরেছিল তাই এখনও খেয়াল করেনি। তারপর আবারও বললো,

কি হলো কফিটা… এটুকু বলেই থেমে গেলো অন্তিম। আয়নার মধ্যে দিয়ে সানাতকে দেখে ঘুরে তাকালো। তারপর চোয়াল শক্ত করে জিজ্ঞাসা করলো,

তুমি? তুমি কেনো কফি নিয়ে এসেছো?

সানাত তোতলাতে তোতলাতে বললো,

আ..আপনার ক..কফিটা। আন্টি প..পাঠিয়েছে।

অন্তিম চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ করেই সানাতের হাত থেকে কফির মগটা নিয়ে ছুঁড়ে মারলো ফ্লোরে। মুহূর্তেই ঘরজুড়ে চূর্ণবিচূর্ণর শব্দ হলো। সানাত চোখ বন্ধ করে মুখ খিচে দাড়িয়ে আছে। ধীরে ধীরে চোখ খুলতেই দেখলো ফ্লোরে কফির মগটা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। অন্তিম সানাতের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো,

আচ্ছা তোমার প্রবলেম কি? তুমি বোঝনা আমি জাস্ট তোমাকে সহ্য করতে পারি না। এতো গায়ে পড়া কেনো তুমি? ওহ শিট আমি কাকে কি বলছি? তোমরা তো গায়ে পরাই। তোমাদের ক্যারেক্টারই তো এমন। বড়োলোকের ছেলে হাত করা। তারপর রূপের জালে আর কথার মায়ায় ফাঁসিয়ে ইউজ করা। কিন্তু মানতে হবে তুমি আর তোমার বোন গেইমটা কিন্তু দারুণ খেলেছো। আই এপ্রিশিয়েট। বাট আফসোসের বিষয় পুরোপুরি সাকসেসফুল হতে পারলে না। তোমার সাহায্যে তোমার বেঈমান বোন প্লাস বেস্টফ্রেন্ড তো পালিয়েছে তার বড়লোক এক্সের সাথে। তোমারও নিশ্চই এরকমই প্ল্যান ছিল কোনো বড়োলোকের ছেলেকে হাত করে ফাসিয়ে নেওয়া। কিন্তু তুমি নিজেই খুব বাজেভাবে ফেঁসে গেছো। তোমরা ভালোবাসার নামে নোংরা খেলা খেলতে জানো। ভালোবাসা কি আদেও জানো? তোমাদের মতো ক্যারেক্টারলেস মেয়েদের দেখলে আমার জাস্ট ঘেন্না লাগে।

সানাত আর সহ্য করতে পারলো না। আজ সব ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করে গেছে। সবসময় শান্ত থাকা সানাত মুহূর্তেই রণমূর্তী ধারণ করলো। হঠাৎ করেই অন্তিমের শার্টের কলার চেপে ধরে গর্জে উঠে বললো,

ব্যাস অন্তিম আহসান। এবার থেমে যান। অনেক বলেছেন আপনি কিন্তু আর না। শুরু থেকেই শুধু আপনার কথা হজম করে আসছি তবে আজ আর সহ্য করতে পারলাম না। আমার সহ্যের সীমা আজ আপনি লঙ্ঘন করে গেছেন। প্রথম থেকেই আমাকে আপনি যা নয় তাই বলে আসছেন আমি কিচ্ছু বলিনি। মুখ বুঝে সবটা সহ্য করে গেছি শুধুমাত্র এই ভেবে যে না আপনার মাথা ঠিক নেই এতো বড়ো একটা ধাক্কা খেয়েছেন তাই হয়তো রাগের মাথায় যা খুশি বলছেন। কিন্তু না আমার এখন মনে হচ্ছে আপনার মেন্টালিটিই এরকম চিপ। ঠিক-ভুল বিচার করার বোধ আপনার নেই। বারবার আমাকে সেই একই কথা বলে আসছেন আমি চরিত্রহীন, লোভী, স্বার্থপর, সুবিধাবাদী এরকম নানান উপাধি আমায় দিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু আমি কিছুই বলিনি। কিন্তু আজ যদি আমি কিছু না বলি তার অর্থ এই হবে আমি এগুলো মেনে নিচ্ছি কারণ আমি এগুলোই। কিন্তু আমি জানি আমি এগুলোর একটাও নই। আপনি বারবার বলছেন আমি নাকি ছোঁয়াকে পালাতে হেল্প করেছি। এগুলো নাকি প্রিপ্ল্যান। আমি যদি ছোঁয়াকে পালাতে সাহায্য করেও থাকি তাতে আমার কি লাভ, আমি কেনো করতে যাবো এসব। আর ছোঁয়া তো কোনো বাচ্চা মেয়ে নয় যে আমি ওকে যা করতে বলবো ও তাই করবে। কই আপনাদের প্রেম তো আমি করিয়ে দেইনি, আপনারা নিজেরাই করেছেন। সাড়ে তিন বছর একটা সম্পর্কে ছিলেন। কতো সময় কাটিয়েছেন একসাথে, কতো সুখ-দুঃখের আলাপ করেছেন তাও কেনো অপর পাশের মানুষটাকে চিনে উঠতে পারেননি? কোথাও তো নিশ্চই খামতি ছিলো যার জন্য আজকে এই দিনটা এসেছে। ভালোবেসেছেন আপনারা অথচ আপনাদের ভালোবাসার বলি হয়েছি আমি। আচ্ছা আমার অপরাধটা কি একটু বলতে পারেন। আমার অপরাধ এটাই আমি ছোঁয়াকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছি। আচ্ছা ওহীও তো আমাদের বেস্টফ্রেন্ড। তাহলে কি ছোঁয়ার পালানোর পিছনে ওহীরও হাত আছে নাকি সে আপনার বোন বলে তার সাত খুন মাফ? আপনার কাছে এর কোনো জবাব নেই অন্তিম আহসান।
এই টুকু বলে সানাত অন্তিমের কলার ছেড়ে দিলো। অন্তিম কোনো কথা বলছেনা শুধু এক দৃষ্টিতে সানাতের দিকে তাকিয়ে আছে। সানাত কাদঁছে। চোখের পানি মুছে আবারও বলতে লাগলো,

আপনি ভালোবাসার কথা বলছিলেন তাইনা? ভালোবাসার সংজ্ঞা আমার আপনার থেকে শিখতে হবেনা। কারণ আপনার থেকেও প্রখর ভাবে আমি ভালোবেসেছি একজনকে এবং এখনও বাসি তাকে। আপনাদের কাছে ভালোবাসা মানে হচ্ছে বাহ্যিক সৌন্দর্য, তাকে দৈহিকভাবে কাছে পাওয়া। কোনো না কোনো স্বার্থ আছেই আপনাদের ভালোবাসার পেছনে। কিন্তু আমি একজনকে পাবোনা জেনেও নিঃসার্থ ভাবে ভালোবেসে গেছি। ভালোবাসলেই যে পেতে হবে এমন কোনো কথা নেই। ভালোবাসা শুধু প্রাপ্তিতে নয় অন্তিম আহসান অপ্রাপ্তিতেও ভালোবাসা লুকিয়ে আছে। আসলে সমস্যাটা আমাদের মতো মেয়েদের নয় সমস্যাটা আপনাদের। আপনাদের মতো বড়লোক ছেলেদের নিজেদের রূপ দেখিয়ে ফাঁসাবো অত সাধ্য আমাদের নেই। আপনাদের মতো ছেলেদের রুচি তো থাকে আপনাদের মতোই হাই ক্লাস ফ্যামিলির স্মার্ট, অতিমাত্রায় সুন্দরী, উশৃঙ্খল মেয়েদের দিকে। আমার মতো কালো মেয়েদের দেখলে তো আপনাদের রুচিতে বাধে, ঘেন্না পায়। এতো সাদামাটা মেয়ে আপনাদের ঠিক পোষায় না। আপনাদের দৃষ্টিতে বাহ্যিক সৌন্দর্যের কাছে আমাদের মনের সৌন্দর্যটা ফিকে পড়ে যায়। তাই তো আপনারা সুন্দর মন নয় সুন্দর রূপ খোঁজেন আর তারপর যখন সেই সুন্দর রুপের আড়ালে লুকিয়ে রাখা জঘন্য রূপটা সামনে আসে তখন আপনাদের কাছে সব মেয়েরা খারাপ। কখনো কারো ভেতরের সৌন্দর্য্য দেখে প্রেমে পড়েছেন? পড়েননি তাইনা? পরে দেখবেন সেখানে আর যাই হোক কোনো ধোঁকা, ছলনা বা মিথ্যা নেই। সেখানে শুধুমাত্র পবিত্রতা, শুদ্ধতা আর সত্যতা আছে। একজনকে দিয়ে অন্যজনকে বিচার করবেন না। সবাই এক নয় অন্তিম আহসান।
এইটুকু বলেই সানাত ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো। আর অন্তিম ঠায় দাঁড়িয়ে সানাতের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। তার কানে এখনো বাজছে সানাতের বলা প্রত্যেকটা কথা। তার অবচেতন মন বলছে সে মারাত্মক ভুল করেছে।
#চলবে

অতঃপর গল্পটা তোমার আমার পর্ব-০৪

0

#অতঃপর_গল্পটা_তোমার_আমার
#পর্ব-০৪
#হুমায়রা_আঞ্জুম (লেখনীতে)

অন্তিম সবে মাত্র নিজের রুমে ঢুকেছে। গরমে গায়ের শার্ট ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে। এই মুহূর্তে শাওয়ার না নিলে স্বস্তি মিলবে না। প্যান্টের পকেট থেকে ওয়ালেট, ফোন আর হাতের ঘড়িটা খুলে বিছানার পাশের সাইড টেবিলে রেখে সোজা আলমারি থেকে টিশার্ট বের করতে এগিয়ে গেলো। তবে আলমারি খুলতেই শান্ত মস্তিষ্ক মুহূর্তেই দপ করে জ্বলে উঠলো। রাগে সমস্ত শরীর কাঁপছে তার। তার আলমারিতে সানাতের জামাকাপড়। সানাত মাত্রই ওয়াশরুম থেকে শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছিল। তবে ঘরে অন্তিমের উপস্থিতি দেখে সে কিছুটা অস্বস্তিতে পরে গেলো। সে ধীর পায়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াতেই অন্তিম চেঁচিয়ে উঠলো। সানাত কিছু বুঝে উঠার আগেই অন্তিম তাকে টেনে এনে আলমারির সামনে দাঁড় করিয়ে বলতে লাগলো,

“হাও ডেয়ার ইউ? এতো বড় স্পর্ধা কি করে হয় তোমার? বিয়ে করেছি বলে কি নিজেকে আমার বউ ভাবতে শুরু করে দিয়েছো? অধিকার বুঝে নিচ্ছো?”

“আপনি ভুল ভাবছেন। আপনি ওগুলো রাখিনি।”

“জাস্ট শাট আপ। একদম ইনোসেন্ট সাজতে আসবেনা অন্তত আমার সামনে তো একদমই না। তোমার সাহস কি করে আমার আলমারিতে নিজের জামা কাপড় রাখার! কোনোকিছুর পারমিশন নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করোনা তাই না? অবশ্য তোমাদের মতো মেয়ের থেকে আর কিই বা এক্সপেক্ট করা যায়! তোমরা তো এই একটা কাজই পারো আদায় করতে সেটা যেভাবে হোক। যেমন ফ্যামিলি তেমন মেয়েরা!”

সানাত আহত দৃষ্টিতে তাকালো অন্তিমের দিকে। অথচ অন্তিম তার দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর বললো,

“ভবিষ্যতে কখনো এসব স্ত্রী সাজার নাটক করবেনা। তোমার মতো লোভী, স্বার্থপর, নাটকবাজ মেয়েদের আর যাইহোক স্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া যায় না। না আমি এই বিয়ে কোনোদিন মানবো আর না তোমাকে কখনো নিজের স্ত্রী হিসেবে মানবো। সো এসব সস্তা আবেগ আমার সামনে দেখাতে আসবেনা। আর ভুলে যেওনা এই বিয়েটা শুধুমাত্র তোমার আর তোমার বোনের বেইমানির রিভেঞ্জ নেওয়ার জন্য করেছি।” বলেই অন্তিম ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো।

সানাত ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লো আর তারপর হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো। কি দোষ তাঁর? সে তো কাপড়গুলো রাখেনি ওহী রেখেছিলো। আর কি বলে গেলো সস্তা আবেগ! তার আবেগ সস্তা! কতো অনায়াসে তার আবেগকে সস্তা বলে গেলো লোকটা! শুধু সস্তা নয় তাকে লোভী, স্বার্থপর, নাটকবাজ নামক উপাধি দিয়ে গেছে। আচ্ছা আদেও কি সে লোভী, স্বার্থপর? এতটা অপমান কি তার প্রাপ্য? সানাতের ভেতরের সত্তাটা বলে ওঠে,
“না সানাত তুই লোভী না, তুই স্বার্থপর না, তুই অপরাধী না। এতো অপমান তোর প্রাপ্য না। কেনো মুখ বুঁজে সহ্য করছিস? আর কতো সহ্য করে যাবি? সবাই যে তোর কোমলতার সুযোগ নিয়ে তোকে আঘাত করে যাচ্ছে। কেনো তুই অন্যের দায় নিজের ঘাড়ে নিবি? এবার তো অন্তত জবাব দে। অন্তত নিজের জন্য হলেও জবাব দিতে শিখ। চুপ করে থাকিস না আর!”
মন আর মস্তিষ্কের দ্বন্দ্বে সানাত ক্লান্ত। এরই মাঝে নিচ থেকে ডাক এলো তাকে নিচে ডাকছে। সানাত সন্তপর্নে গালের পানি মুছে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।

🌻
ড্রয়িং রুমে সোফায় মাথায় ঘোমটা টেনে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে সানাত। তাঁকে ঘিরে রেখেছে অন্তিমের ফুফু, খালা, মামীরা। সকলের মধ্যে অন্তিমের বড়ো ফুফু বেশ অদ্ভুত ভাবে সানাতকে দেখছে। কণ্ঠে বেশ গম্ভীরতার রেশ টেনেই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন,

“তা তোমার বাবার বাড়ি কোথায়?”

“জ্বি, চট্টগ্রাম।”

“ও। বাবা কি করেন?”

“জ্বি, তাত শাড়ীর ব্যবসা করেন।”

“শুনলাম মা নেই তোমার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন!”

“হ্যাঁ, আমার জন্মের সময়ই মা মারা গেছেন। এরপর বাবা বিয়ে করেছেন।”

“সে ঘরে ছেলে-পেলে নেই?”

“হ্যাঁ দুই ভাই-বোন আছে। বোন উচ্চমাধ্যমিক দেবে আর ভাই দশম শ্রেণীতে পড়ে।”

“ও।” বলেই তিনি পেছনে দাঁড়ানো অন্তিমের মায়ের পানে তাকিয়ে বলে ওঠেন,

“অন্তিমের মা যা দেখলাম তাতে এই মেয়ে অন্তিমের জন্য আনা লাগেনা। বাপের বাড়ির অবস্থাশালিও কোনো রকম তেমন ভালো নয়। মেয়েও তেমন আহামরি সুন্দরী নয়। গায়ের রং চাপা। কোথায় আমার ভাতিজা অন্তিম আর কোথায় এই মেয়ে! একদম বেমানান!”

সানাতের চোখ দুটো মুহূর্তেই ছলছল করে উঠলো। কিন্তু সে সর্বোচ্চ দিয়ে চোখের পানি আড়াল করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এরই মধ্যে অন্তিমের মা অর্পিতা আঞ্জুম বলে উঠলেন,

“আহ বড় আপা। এভাবে বলবেন না। টাকা পয়সার কথা উঠছে কেনো টাকা পয়সা কি আমাদের কম আছে! আর গায়ের রং একটু চাপা তাতে কি চেহারাটা বড্ডো মায়াবী। আমার ওহীর বান্ধবী ওকে তো আমি এর আগেও কতো দেখেছি। যথেষ্ট অমায়িক মেয়ে।”

“থামো তুমি। কতো ভালো মেয়ে তা আমার ঢের জানা আছে। এক বোনকে দিয়ে তো দেখলাম কতো ভালো! যার বোনই অমন চরিত্রহীনা সেখানে ও কেমন তা খুব ভালো করেই জানি। একদম মাথায় তুলে নাচবেনা বলে দিলাম।”

অর্পিতা আঞ্জুম বড়ো ননদের সামনে আর কিছুই বলতে পারলেন না। সানাত মাথা মাথা তুলে একবার সামনে তাকালো চোখের সামনে স্পষ্ট ডাইনিং টেবিলে অন্তিম খাচ্ছে আর টুকটাক কথা বলছে। ওখান থেকে সে সব কথাই শুনতে পেয়েছে অথচ একটাবারও ফিরে তাকালো না। সানাত নিজের ভাবনায় নিজেই তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। ভেতরের সত্ত্বাটা বলে উঠলো,
“তুই কার কাছ কি আশা করিস সানাত? অন্তিম আহসানের থেকে তুই তোর জন্য সম্মান আশা করিস! এতো পুরো মূর্খের স্বর্গে বাস! যে মানুষ তোকে অসম্মান করতে এক তিল পরিমাণ ছাড় দেয় না তাঁর কাছ থেকে কিনা তুই সম্মান আশা করিস! হাস্যকর! ধিক্কার জানানো উচিৎ তোর নিজের ওপর।”
সানাত আর ভাবতে পারলোনা। সে নিজেও জানেনা তার এতো খারাপ কেনো লাগছে। সে তো জানে তাঁর সাথে এমন কিছুই হবে তবুও কেনো কষ্ট হচ্ছে? সানাতের ভাবনার মাঝেই অন্তিমের মা অর্পিতা আঞ্জুম বলে উঠলেন,

“সানাত তুমি ওহীর সাথে ওপরে যাও গিয়ে তৈরি হয়ে নাও। রিসেপশনটা অত বড় করে করা তো আর সম্ভব হয়ে উঠলো না এই পরিস্থিতিতে। তাই ঘরোয়া ভাবেই হচ্ছে। ওহী সানাতকে নিয়ে ওপরে গিয়ে রেডি করে দে। একটু পরেই মেহমানরা আসতে শুরু করবে। ”

সানাত আর দাঁড়ালো না ওহীর সাথে ওপরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।

🌻
ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে বসে নিজেকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিল সানাত। শ্যাম বর্ণ গায়ে জড়িয়েছে মেরুন রঙের কাতান শাড়ি, সাথে কিছু ভারী অলঙ্কার আর মুখে মোটামুটি প্রসাধনী। সবমিলিয়ে সানাতের মায়াবী মুখটা আরো মায়াবী লাগছে। ওহী পেছন থেকে আয়নায় সানাতের দিকে তাকিয়ে বললো,

“কিরে কেমন সাজালাম বল? বলেছিলাম না তুই নিজেই নিজের থেকে চোখ ফেরাতে পারবিনা, মিললো তো? সত্যিই সানাত তোকে আজ খুউব সুন্দর লাগছে। মাশাআল্লাহ। দাড়া একটু কাজল ছুঁইয়ে দিই নাহলে আবার নজর লাগবে।”

“তুই থামবি ওহী! আমার মতো কালো মেয়ের দিকে কেউ নজর দিবেনা, বুঝলি।”

“একদম ফালতু কথা বলবি না সানাত। কে বলেছে তুই কালো? তুই হলি উপন্যাসের কবিদের লেখা শ্যামসুন্দরী রমণী।”

সানাত হেসে বললো,
“তোর সান্ত্বনা তোর কাছেই রাখ আমি জানি আমি দেখতে কেমন।”

“কচু জানিস তুই।”

সানাত আয়নার দিকে তাকিয়ে ওহীকে দেখে মলিন হাসলো। তারপর হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল,

“আচ্ছা ওহী আজ তো ওই বাড়ি থেকে মামণি আর খালুও আসবে, তাই না?”

ওহী কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলো তারপর
শান্ত স্বরে বলে উঠলো,

“ওনারা আসবে না সানাত।”

সানাতের উচ্ছাসটা যেন হঠাৎ করেই মিলিয়ে গেলো। ওহী বললো,

“বাবা কল করেছিলো তোর খালুকে। সে মুখের ওপর না জানিয়ে দিয়েছে।”

“ওহ।”
সানাতের বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছে। তবুও সে কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,

“আজ আমার জায়গায় ছোঁয়া হলে নিশ্চই খালা মামণি আসতো বল। আমি বলেই আসছে না। অবশ্য ঠিকই আছে। হাজার হলেও আমি তো আর তাদের নিজেদের মেয়ে নই। ছোঁয়াতো নিজের মেয়ে। নিজের সন্তানের সাথে অন্যের সন্তানের তুলনা চলে!”

“সানাত বাদ দে এসব। আজকের দিনটায় এসব ভেবে কষ্ট পাস না।”

#চলবে

অতঃপর গল্পটা তোমার আমার পর্ব-০৩

0

#অতঃপর_গল্পটা_তোমার_আমার
#পর্ব-০৩
#হুমায়রা_আঞ্জুম (লেখনীতে)

সকালবেলা কারো ধাক্কায় সানাতের ঘুম ভেঙ্গে যায়। চোখ খুলতেই দেখতে পেলো সামনে দাড়িয়ে থাকা মেয়েটি তার দিকে একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে। সানাত কিছু বলে ওঠার আগেই মেয়েটি বলতে লাগলো,

“কিরে এতক্ষনে তোর ঘুম ভাঙলো! আমি সেই কখন থেকে তোকে ডেকে যাচ্ছি আর তোর কোনো হুশই নেই। আমি তো ভয়ই পেয়ে গেছিলাম ভাবলাম বিরহে তুই আবার কিছু খেয়ে-টেয়ে নিলি নাকি?”

সানাত খুব ভালো করেই জানে এই মেয়ে তাকে আবারও খোঁচাচ্ছে। যাতে সানাত গতকালের ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে একটু স্বাভাবিক হতে পারে। সানাত সামনে দাড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললো,

“সকাল সকাল তুই শুরু করে দিয়েছিস তাইনা ওহী? সর সামনে থেকে।”

“নে সরলাম এবার ওঠ। উঠে ফ্রেশ হয়ে নিচে এসে আমায় উদ্ধার কর বান্ধবী অপস থুরি মিস্টেক ভাবী। এখন তো আর তুই শুধু আমার বান্ধবী নেই ভাবি হয়ে গেছিস।”
বলেই হাসলো ওহী। অথচ সানাতের মুখটা মলিন হয়ে গেলো। যেনো ভেতরের ক্ষতটা আবার তাজা হয়ে গেছে। ওহী বুঝতে পারলো সানাতের অবস্থা তাই সানাতকে আশ্বস্ত করতে বললো,

“দেখ সানাত যাই হয়ে যাক না কেনো তোর আর আমার বন্ধুত্বে এর কোনো প্রভাব পড়বেনা। আমার ভাইয়ের সাথে তোর বিয়ে হয়েছে বলে তোর আর আমার বন্ধুত্বের সমীকরণ বদলে যাবেনা। ভাইয়ার সাথে তোর পরিচয়ের অনেক আগে থেকে তোর সাথে আমার বন্ধুত্ত্ব। তাই আমি চাইনা আমার ভাইয়ের জন্য তোর আর আমার মাঝে এক বিন্দু পরিমাণও দূরত্ব আসুক। তুই আগেও আমার বেস্টফ্রেন্ড ছিলিস আর এখনো আছিস ভবিষ্যতেও থাকবি। শুধুমাত্র একটা জিনিসই বদলাবে আগে আমরা তিন বেস্টফ্রেন্ড ছিলাম এখন আমরা দুই বেস্টফ্রেন্ড। কারণ আরেকজন কখনো বন্ধু ছিলইনা বরং বন্ধুর আড়ালে বেঈমান ছিলো। তাই আমি বলবো ভুলে যা পেছনের সবকিছু। আর শোন তুই এখন যতই সম্পর্কে আমার ভাবী হোস না কেনো ভাবীর আগে তুই আমার বেস্টফ্রেন্ড।”

সানাত মলিন হেসে বললো,

“যেখানে তোর ভাইয়ের কাছে এই বিয়েটার কোনো ভিত্তিই নেই সেখানে কিসের ভাবী ননদের সম্পর্ক জুড়ছিস তুই?”

“এখন আর জোড়ার সময় নেই তুই জুড়ে গেছিস। এই বিয়েটা কেউ মানুক আর না মানুক তাতে সত্যিটা কখনো বদলে যাবেনা। যেই পরিস্থিতিতেই বিয়েটা হোক না কেনো বিয়ে তো হয়ে গেছে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।”

“ওহী সম্পর্ক মন থেকে তৈরি হয়, স্বীকৃতি মন থেকে দিতে হয় কিন্তু আমাদের এই সম্পর্কে যেটা আছে সেটা সম্পূর্ণ জোরপূর্বক। একটা বেরিশিকলের মতো। ওহী তুই তো জানিস আমি পরিস্থিতির শিকার, আমার কোনো অপরাধ নেই। তাহলে কেনো সবার চোখে আমি অপরাধী, স্বার্থপর, খারাপ। বলতে পারিস? ছোঁয়া কি করে পারলো এতো বড় একটা বেইমানি করতে?”
আর বলতে পারলোনা সানাত কান্নায় তার গলা জড়িয়ে আসছে। ওহী সানাতকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর সানাতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলতে লাগলো,

“সানাত তুইই তো সবসময় বলিস যা হয় ভালোর জন্য হয়। উপরওয়ালা কখনো ভালো মানুষের সাথে খারাপ করেননা। তাহলে আজ কেনো এই কথাটা বিশ্বাস করছিস না। হয়তো উপরওয়ালা অন্য কোনো পরিকল্পনা করে রেখেছে। তোর সাথে হয়তো ভাইয়ার ভাগ্যটাই জুড়ে রেখেছিল তাই আজ তোরা অনিচ্ছা সত্বেও এই বিয়ের বন্ধনে বাঁধা পড়েছিস। সানাত হয়তো আজ সময়টা খারাপ যাচ্ছে কিন্তু এর মানে এই নয় সবসময় পরিস্থিতি এমনি থাকবে। সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস। তুই অনেক সুখী হবি আমি বলছি তোকে তুই মিলিয়ে নিস। তুই সুখী না হলে আর কে সুখী হবে শুনি কারণ তুই তো পুরোটাই ভালো।”

“সান্ত্বনা দিচ্ছিস?”

“মোটেও না। জানি তুই হয়তো এখন বিশ্বাস করবিনা কিন্তু দেখিস একটা সময় আসবে যখন ভাইয়া নিজে তোকে পাগলের মত ভালোবাসবে। তোদের এই বিয়েটা তোদের জীবনে আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়াবে। এটা আমি বলছি তোকে। তুই খুব ভালো করেই জানিস সানাত আমি বরাবর আমার ভাইয়ের সাথে তোকে দেখতে চেয়েছি। কিন্তু ছোঁয়ার সাথে ভাইয়ার সম্পর্ক থাকায় আমি এই চাওয়াটা কখনো প্রকাশ করতে পারিনি। তবে আমি সবসময় চাইতাম যেনো তোর সাথেই আমার ভাইয়ার বিয়ে টা হয়ে যায়। আর দেখ উপরওয়ালা আমার ইচ্ছা পূরণ করেছে। এই বিয়েতে সবথেকে বেশি যদি কেউ খুশি হয়ে থাকে সেটা আমি। কারণ কেউ না জানলেও আমি জানি তুই আমার ভাইকে কতোটা ভালবাসিস। কেউ তোর সযত্নে লুকিয়ে রাখা ভালোবাসা বুঝতে না পারলেও আমি পেরেছি। তোর চোখে আমি ভাইয়ার জন্য যেই ভালোবাসা দেখেছি তার এক ভাগও আমি ছোঁয়ার চোখে দেখিনি। তাই সবসময় চেয়েছি তোর ভালোবাসা যেনো মর্যাদা পায়। সানাত কোনো পরিস্থিতি নয় তুই তোর ভালোবাসার জোরে ভাইকে পেয়েছিস। যে পাবেনা জেনেও নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে পারে তাকে উপরওয়ালা ঠকাবেন না। কিন্তু ওই ছোঁয়ার সাথে যদি আমার কখনো দেখা হয় তাহলে ওর সাথে প্রত্যেকটা হিসেব মেটাবো। ওর জন্য আমার ভাই, তুই, পুরো পরিবার কতোটা ভুগছে তার হিসেব ওকে দিতে হবে। আর হ্যাঁ মনে রাখিস একটা প্রবাদ আছে কিন্তু পুরুষ তার প্রথম নারীর কাছে ঠকে, আর দ্বিতীয় নারীর কাছে মরে। তাই আমি বলবো তোদের এই সম্পর্কটাকে সময়ের উপর ছেড়ে দে। যাই হোক তুই ফ্রেশ হয়ে শাড়ি পাল্টে নিচে আয়। সবাই অপেক্ষা করছে।”
বলেই ওহী চলে গেলো। আর সানাত ঠায় দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো ওহীর বলা কথা গুলো। বিশেষ করে ওহীর বলা শেষ কথাটা। আচ্ছা আদেও কি সে কোনদিন অন্তিমের দ্বিতীয় ভালোবাসা হতে পারবে? দ্বিতীয়বার কি ভালোবাসা যায়? এর উত্তর জানেনা সানাত। ওহীর সাথে তার আলাপ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কোচিংএর সময়। সেখান থেকেই তাদের বন্ধুত্ত্ব। ছোঁয়া, ওহী, সে একই সাথে কোচিং করেছিলো তবে ভাগ্যক্রমে ওহী আর তাঁর একই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ হলেও ছোঁয়ার হয়নি। ওহী মেয়েটা বরাবর সানাতের পাশে ছিলো। মেয়েটা সানাতকে সবথেকে ভালো বুঝতে পারে। ছোঁয়াও সানাতকে খুব ভালোবাসতো। তবে কেনো সে সানাতকেই বলির পাঁঠা বানালো তা জানেনা সানাত। সানাতের জীবনে দুজন ভালো বন্ধু ছিলো যার মধ্যে একজন নিজের বোন যে কিনা সময়ের সাথে সাথে আসল রূপটা দেখিয়ে দিয়েছে। অথচ আরেকজন ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। জীবনে প্রকৃত বন্ধু চিনতেও সানাত ভুল করেছে। যে ভুল তাঁর পুরো জীবনটা এক নিমেষে বদলে দিয়েছে।

🌻
সানাতের আজও স্পষ্ট মনে আছে সেই দিনটার কথা যেদিন সে জানতে পেরেছিল ছোঁয়া আর অন্তিমের সম্পর্কের কথা। সানাত তখন সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। তার খুশি তখন আকাশ ছাড়িয়েছে। এদিকে তাঁর অবাধ্য মন সেদিনের হঠাৎ দেখা হওয়া অন্তিমকে নিয়ে হাজারো স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছে। কবে থেকে কিভাবে তা জানেনা সানাত তবে এইটুকু জানে প্রথম সাক্ষাৎকারেই সে প্রেমে পড়েছে সেই লোকটির। ছেলেটির নাম ঠিকানা কিছুই জানেনা সে অথচ তাকে নিয়ে রোজ চিঠি লেখে। সেই চিঠি দিনশেষে তার টেবিলের ড্রয়ারেই পড়ে থাকে। তার কথা ভেবেই আনমনে হাসে সানাত। আর এদিকে সানাতের এই অদ্ভুত প্রেমকাহিনী শুনে ছোঁয়া মজা ওড়ায়। সে ভেবেই পায়না একটা অচেনা ছেলের সাথে প্রথম দেখায় কিছু না জেনেই কিভাবে গভীর প্রেমে পড়া যায়। ছোঁয়ার পেছনে এক ছেলে ৫ মাস যাবৎ ঘুরছে। অবশেষে ছোঁয়া ১ মাস হলো প্রোপোজে রাজি হয়েছে। প্রোপোজ একসেপ্ট করার পরে জানতে পেরেছে সেই ব্যক্তি আর কেউ না তাদেরই আরেক বেস্টফ্রেন্ড ওহীর ভাই। বেশ কিছুমাস আগেই বিদেশ থেকে পড়াশোনা শেষ করে ফিরেছে। আজ ছোঁয়া সানাতকে নিয়ে যাচ্ছে সেই বিশেষ মানুষটির সাথে দেখা করাতে। অবশ্য সাথে ওহীও যাবে।
🌻
বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ ছোঁয়া আর সানাত একটা ক্যাফেতে বসে অপেক্ষা করছে সেই বিশেষ মানুষটির জন্য। ছোঁয়া এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করতে করতে বেশ বিরক্ত। সানাত একটা পানির বোতলটা এগিয়ে দিয়ে বললো,

“ক্ষেপিস না এসে যাবে? হয়তো জ্যামে আটকে গেছে।”

“ক্ষেপবোনা মানে? কতক্ষন ধরে ওয়েট করছি অথচ অন্তিমের কোনো হুশই নেই। কেউ কারো প্রেমিকার ব্যাপারে এতোটা কেয়ারলেস কি করে হতে পারে?”

“আচ্ছা শান্ত হ। আমি ওহীকে কল করছি।”

“করে কোনো লাভ নেই। আমি ট্রাই করেছি ফোন সুইচস্টপ। আচ্ছা বাদ দে ওদের কথা। তুই তো দেখছি এখানেও তাকে খুঁজছিস। আচ্ছা সে বুঝি খুব হ্যান্ডসাম।”

“জানিনা তবে আমার চোখে তো তাই।”

“ইশ এভাবে বলিসনা দেখা গেলো আমিই প্রেমে পড়ে গেলাম। তারপর তোর কাছে তাকে চেয়ে বসলাম। তখন তোর কি হবে জানু?” বলেই ছোঁয়া হাসতে লাগলো।

“কি আর করবো তুই চেয়েছিস আমি কি আর না করতে পারি হাসি মুখে দিয়ে দেবো।”

“থাক আর চাপা মারিস না। মানুষ সবকিছু শেয়ার করতে পারে কিন্তু ভালোবাসার মানুষকে না। বুঝলি?”
কথার মাঝেই ছোঁয়া সামনে তাকাতেই দেখলো কাঙ্ক্ষিত মানুষটি এসে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে সানাতের দিকে তাকিয়ে বললো,

“এই সানাত ঐ যে তোর জিজু এসে গেছে। দেখ।”

“কোথায়?”

“আরেহ গাঁধী তোর পেছনে?”

সানাত পেছনে তাকাতেই থমকে গেলো। চোখে মুখে ফুটে উঠলো খুশির ঝিলিক। অবশেষে সে এতদিন ধরে খুঁজে আসা মানুষটির দেখা পেলো। সানাত ছোঁয়ার হাত আকড়ে বললো,

“পেয়ে গেছি ছোঁয়া।”

“যাক তোর মত কানা যে দেখতে পেয়েছে এই অনেক।”

ইতিমধ্যে ওহী ও অন্তিম দুজনেই ওদের সামনে এসে উপস্থিত হলো। অন্তিম এখনো সানাতকে খেয়াল করেনি। সে ছোঁয়ার সমানে এসেই কান ধরে বললো,

“সরি মাই লাভ এতটা অপেক্ষা করানোর জন্য।”

মুহূর্তেই সানাতের সাজানো স্বপ্নগুলো গুলো চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলো। অন্তিমের বলা কথাটা তার ভেতরে ঝঙ্কার তুলেছে। সানাত নিষ্প্রাণ চোখে তাকিয়ে রইলো সামনের মানুষটির দিকে। এদিকে ছোঁয়া বলতে লাগলো,

“হয়েছে আর নাটক করতে হবেনা। মিট হার। সি ইজ মাই কাজিন অ্যান্ড বেস্টফ্রেন্ড।”
বলেই সানাতের সাথে আলাপ করিয়ে দিলো। অন্তিম সানাতকে দেখতেই বলে উঠলো,

“আরেহ আপনি?”

“তুমি চেনো ওকে?”

“হ্যাঁ কিছুমাস আগে ওনার সাথে আমার দেখা হয়েছিলো। ঐতো উনি তখন…”

আর কিছু বলার আগেই সানাত থামিয়ে দিলো। কারণ তাদের কীভাবে দেখা হয়েছিল সেটা ছোঁয়া আর ওহী জানতে পারলে ওরা বুঝে যাবে অন্তিমই তার সেই মানুষ যাকে সানাত ভালোবাসে। সানাত বলতে লাগলো,

“আচ্ছা কিভাবে চিনি সেটা বড়ো বিষয় নয় আগে ওদের বসতে তো দে।”

সানাতের কথায় বাকিটা চাপা পড়ে গেলো। এরপর অনেক কথাই হলো কিন্তু সানাত ছিলো নিশ্চুপ। এই বিষয়টা কারো চোখে না পড়লেও ওহীর চোখে পড়েছিল। তবে সে বিষয়টা নিয়ে তখন চুপ ছিল।
#চলবে

অতঃপর গল্পটা তোমার আমার পর্ব-০২

0

#অতঃপর_গল্পটা_তোমার_আমার
#পর্ব-০২
#হুমায়রা_আঞ্জুম (লেখনীতে)

আচমকা পুরো মুখে পানি পরতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো সানাত। হঠাৎ পানি ছুঁড়ে মারাতে সানাতের নাকে কানেও পানি গেছে শাড়িও বেশ খানিকটা ভিজে গেছে। ঘুমের রেশ ঠিক মত না কাটলেও চোখ মুখ কুচকে সামনে তাকাতেই অন্তিমকে দেখে থমকালো সে। তার সামনেই অন্তিম একটা ফাঁকা গ্লাস নিয়ে চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। সানাত কিছু বলার আগেই অন্তিম সানাতের হাত ধরে টেনে বিছানা থেকে নামিয়ে ধাক্কা মারতেই সানাত ছিটকে ফ্লোরে পড়লো। তারপর অন্তিম চেঁচিয়ে বলে উঠলো,

“কোন সাহসে আমার বেডে শুয়েছো? বিয়ে করেছি বলে কি সব কিনে নিয়েছো ভাবছো? নাকি ভাবছো তোমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি? যদি তাই ভেবে থাকো তাহলে শুনে নেও তোমাদের মত থার্ড ক্লাস মেয়েদের আর যাই হোক ভালোবাসা যায় না।”

সানাত আহত দৃষ্টিতে তাকালো অন্তিমের দিকে। অন্তিম আবারও বলতে লাগলো,

“কি ভেবেছিলে তুমি আর তোমার বেস্টফ্রেন্ড বড়োলোকের ছেলের সাথে টাইম পাস করে কেটে পরবে! অবশ্য তোমাদের মত মেয়েরা তো এসবই পারে বড়লোক ছেলেদের নিজেদের কথা আর রূপের জালে ফাঁসাতে। এই একটা কাজেই তোমরা পারফেক্ট। তোমরা শুধু টাকা চেনো।”

“ভুল ভাবছেন আপনি।”

“একদম চুপ। কিচ্ছু ভুল ভাবছিনা যা ভাবছি একদম ঠিক ভাবছি। তোমার সো কল্ড বেস্টফ্রেন্ডকে যে তুমি পালাতে হেল্প করেছো সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি তাই এসব মিথ্যে বানোয়াট কাহিনী আমাকে শোনাবে না। তুমি আর তোমার বেস্টফ্রেন্ড এই সবকিছু প্ল্যান করে করেছো। তবে তুমি তোমার নিজের পাতা ফাঁদেই ফেঁসে গেছো। তোমাকে বিয়ে করেছি শুধুমাত্র নিজের জেদ আর প্রতিশোধ নিতে আর তোমার লাইফটা হেল করে দিতে। তোমার বেস্টফ্রেন্ড নাহয় পালিয়ে গেছে কিন্তু তুমি? তোমার মুক্তি নেই। তোমার বেস্টফ্রেন্ডের ভুলের মাশুল তোমাকে দিতে হবে। মাইন্ড ইট।”
বলেই অন্তিম লাইট নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো। আর এদিকে সানাত অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে রইলো। আজ অন্তিমের বলা প্রত্যেকটা কথা তাকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। সে বারবার একটা কথাই ভাবছে ভুলের মাশুল দিতে হবে কিন্তু কিসের ভুল! সে কোন ভুলের মাশুল দেবে! তার ভুলটা কোথায় সে নিজেই তো পরিস্থিতির শিকার। সবটা কেমন ওলোট পালোট হয়ে গেলো এক নিমিষেই। সানাতের চোখে ভাসতে থাকলো অতীতের সেই দিনগুলো।
সানাত তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় তার খালামণি অর্থাৎ ছোঁয়াদের বাসায় আসে। এখানে আসার পথেই অন্তিমের সাথে তার প্রথমবারের মতো দেখা হয়। ভোর ৪ টায় বাস ঢাকার কাউন্টারে পৌঁছায়। সানাত এই প্রথম একা এতদূর এসেছে। এর আগে হয় বাবা না হয় খালামণি কাউকে নিতে পাঠিয়েছে। বাইরে তখনও অন্ধকার। শহরটা বেশ নিঃস্তব্ধ। সানাত গাড়ি থেকে নেমে আশেপাশে চোখ বুলালো। খুব একটা মানুষের আনাগোনা নেই বললেই চলে। এই নিঃস্তব্ধ শহরের ফুটপাতে শুয়ে আছে কিছু কুকুর। মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে বন্ধ হয়ে আছে। হাত ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে দেখলো ৪ টা বেজে ১০ মিনিট। রাতে বৃষ্টি হওয়ার ফলে আবহাওয়াটা বেশ শীতল। রাস্তায় কাকে জিজ্ঞেস করবে সেটা খুঁজতেই হঠাৎ এক লোককে দেখতে পেয়েই সানাত এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

এইযে ভাই শুনছেন?

লোকটি ফিরে তাকাতেই সানাত বললো,

জামে মসজিদ রোডটা কোন দিকে একটু বলবেন? আসলে আমি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছি। আমার এক আত্মীয়ের বাসায় যাবো। জামে মসজিদ রোডটা একটু দেখিয়ে দেবেন। আমার আত্মীয়ের আমাকে ওখান থেকে নিতে আসার কথা।

আচ্ছা চলুন আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।

সানাত যেনো একটু ভরসা পেলো। সে লোকটির সাথে হাঁটতে লাগলো। কিন্তু কিছুদূর যেতেই তার মনে অদ্ভুত ভয় কাজ করতে লাগলো। কারণ লোকটি তাকে বেশ সরু গলি দিয়ে কোথায় যেনো নিয়ে যাচ্ছে। এর আগেও সে তার খালামণিদের বাসায় এসেছে তবে এমন রাস্তা দিয়ে সে আসেনি। সানাত থেমে গেলো। তারপর লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলো,

এটা কোন রাস্তা? আপনি আমায় কোন রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন?

আরে আপনি ভয় পাবেননা। আসলে সামনের রাস্তাটা গতরাতে ঝড়ের ফলে গাছ পড়ে ব্লক হয়ে আছে। তাই এই রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আরেকটু সামনেই প্রায় এসেই পড়েছি।

সানাতের সন্দেহ যেনো দূর হলো না। সে বলল,

না না আমি এই রাস্তা দিয়ে যাবনা। আমি মেইন রোড দিয়েই চলে যাবো।

লোকটি আচমকা সানাতের হাত চেপে ধরে বললো,
আরেহ যাবেনা মানে? এতদূর এনেছি কি এমনি এমনি নাকি?

সানাত ঘাবড়ে গেলো। তার আর বুঝতে বাকি নেই সে ভুল মানুষের সাথে এসেছে। নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা চালাতে চালাতে সানাত বললো,

ছাড়ুন আমার হাত।

এতো সহজে তো ছাড়বোনা ।

ছেড়ে দিন বলছি। কোনো রকমে হাত ছাড়িয়ে সানাত ফাঁকা রাস্তায় ছুটতে লাগলো। আর তার পেছন পেছন ছুটতে লাগলো সেই লোকটি। সানাত দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় আচমকা ধাক্কা খেলো কারো বলিষ্ঠ পিঠে। আচমকা পেছন থেকে আক্রমনে অন্তিম কিছুটা পিছিয়ে গেলো তবে পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে পেছনে ঘাড় ঘুরাতেই দেখতে পেলো একটি শ্যাম বর্ণের মেয়ে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখে মুখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ। মেয়েটি রীতিমত হাঁপাচ্ছে। অন্তিম কিছু বলার আগেই মেয়েটির পেছনে দাঁড়ানো লোকটিকে দেখতেই বুঝতে পারলো পুরো ঘটনা। লোকটি বিশ্রী হেসে বলে,

কি মামণি এবার কোথায় পালাবে? পালানোর সব রাস্তা তো বন্ধ।

সানাত অসহায় দৃষ্টিতে অন্তিমের দিকে তাকায়। অন্তিম এবার একটু ঠিকঠাক হয়ে দাড়িয়ে বলে,

কি ব্রো এভাবে এই সময় একটা মেয়ের পেছনে দৌড়াচ্ছ কেনো? মনে ধরে গেছে নাকি?

মনে ধরবে না আবার এইসময় ফাঁকা রাস্তায় আকাশের চাঁদ পেয়ে গেছি মনে না ধরে উপায় আছে ?

বাট আফসোস চাঁদটা আর হাতে পাওয়া হলো না?

মানে?

মানে এখান থেকে কেটে পর। নোংরামি অন্য কোথাও গিয়ে কর। একটা মেয়ের পিছনে জা*নো*য়া*রে*র মতো হামলে পড়েছিস কেনো?

শালা গেঞ্জাম করিসনা। আমারটা আমাকে বুঝে নিতে দে। হিরোগিরি পরে করিস। এখন সর।

তুই বোধয় বাংলা ভাষা বুঝিসনা। তোকে এখনো ভালোভাবে বলছি চলে যা নইলে আমি ক্ষেপে গেলে তোর মরা ছাড়া গতি নেই।

দেখ আমি আবারও বলছি সমস্যা করিস না। এর থেকে চল দুজনে ভাগ করে মজা নেই। মেয়েটা হেব্বি আছে কিন্তু।

অন্তিমের ধৈর্যের বাঁধ মুহূর্তেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলো। শরীরের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে লোকটির গাল বরাবর ঘুষি মারলো। মুহূর্তেই লোকটি মুখ থুবড়ে রাস্তায় পড়লো। অন্তিম লোকটির ডান হাতটা পা দিয়ে রাস্তার সাথে পিষে ধরে বললো,

কু*ত্তা*র বা*চ্চা। মেয়ে দেখলেই তোদের নোংরামির ইচ্ছা জাগে তাইনা? তোদের জন্য সমাজের এই হাল। ঘরে মা বোন নেই তোদের!

সানাত পেছন থেকে কাপাকাপা গলায় বললো,

ছ.. ছেড়ে দিন। ম.. মরে যাবে।

অন্তিম ছেড়ে দিলো। তারপর এগিয়ে এসে সানাতের মুখ বরাবর দাড়িয়ে কঠিন ঝাড়ি দিয়ে বললো,

এই সময় একা বাসা থেকে বেড়িয়েছেন কেনো? ননসেন্স! আজকে একটা বিপদ হলে কে দেখতো আপনাকে? আন্সার মি ! বেশি স্বাধীনতা পেলে যা হয় আর কি!

সানাত কেপে উঠলো। তারপর কাপাকাপা গলায় বললো,

আ..আমি চ..চট্টগ্রাম থেকে এসেছি আমার খালামনির বাসায়। ফ..ফোনের চার্জ শ..শেষ।
জামে ম..মসজিদ রোড থেকে আমাকে নি..নিতে আসার কথা তাই জায়গা চিনতে ওই লোকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম । কিন্তু ঐ লোকটা…
অন্তিম কিছুটা নরম হলো। তারপর বললো,

ঠিকাছে চলুন। বলেই সে সামনে হাঁটতে লাগলো। কিন্তু একটু সামনে এগোতেই দেখলো মেয়েটি তার পাশে নেই। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখলো মেয়েটি সেই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে। অন্তিম গলা ছেড়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

আমি খারাপ লোক নই। আশা করি মাথায় এইটুকু যাচাই করার ঘিলু আছে। তাই ড্রামা না করে চলুন।

সানাত কিছু বললোনা। চুপচাপ হাঁটতে লাগলো।
জামে মসজিদ রোডের পাশে একটা দোকানের বেঞ্চে তারা দুজনেই বসে আছে। অন্তিম সানাতের দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলো,
আপনার চক্করে পরে আমার ফ্রেন্ডদের সাথে ট্যুরে যাওয়াটা মাটি হয়ে গেলো। ডিসগাস্টিং! কোথায় আপনার রিলেটিভ? এখনো আসছেনা কেনো?

কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে যাবে বোধয়।

আপনি এখানে একটু বসুন। আমি দু মিনিটের মধ্যেই আসছি।

সানাত মাথা নেড়ে সায় জানালো। অন্তিম যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে নিতে আব্দুর চাচা এসে পড়লো। আব্দুর তার খালামনির বাসার অনেক পুরোনো ড্রাইভার। সানাত চলে যাওয়ার আগে বেশ কিছুক্ষণ অন্তিমের অপেক্ষায় ছিলো কারণ লোকটিকে একটা ধন্যবাদ দেওয়া যে বাকি। আর সানাত বকেয়া আর ঋণ জিনিসটা মোটেও পছন্দ করেনা। তবে অপেক্ষা করেও যখন লাভ হলো না। অন্তিমের দেখা তার আর মেলেনি। সানাত ব্যাগ থেকে একটা নোটবুক বের করে তার পাতায় লিখলো,

“আপনি অপেক্ষা করতে বলেছিলেন কিন্তু আমায় নিতে লোক এসে পড়েছে। আপনার অপেক্ষা করেছিলাম কিন্তু তা আর হয়ে উঠলো না। আজকের সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ। আপনার এই উপকার আমি তোলা রাখলাম যদি কখনো ভাগ্য সুযোগ করে দেয় তবে তা ফিরিয়ে দেবো। আমি ঋণ আর বকেয়া রাখতে পছন্দ করিনা।”
এইটুকু লিখে সানাত কাগজটা তারা যে দোকানের বেঞ্চে বসেছিল সেখানেই ভাঁজ করে রেখে চলে গেলো। সে জানেনা আদেও এই চিঠি প্রাপক অব্দি পৌঁছাবে কি না? আর না তার সাথে আর কখনো এই আগন্তুকের দেখা হবে কি না?

#চলবে

অতঃপর গল্পটা তোমার আমার পর্ব-০১

0

#অতঃপর_গল্পটা_তোমার_আমার
#পর্ব-০১
#হুমায়রা_আঞ্জুম (লেখনীতে)

নিজের বেস্টফ্রেন্ডের বাসর ঘরে তার বদলে বধূ বেশে জড়োসড়ো হয়ে বসে রয়েছি আমি! আজ এখানে যার বধূ বেশে থাকার কথা ছিল তার পরিবর্তে আমি বসে আছি। আমি সানাত। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। আজ আমার বেস্টফ্রেন্ড ওরফে আমার খালাতো বোন ছোঁয়ার বিয়ে ছিলো। টানা সাড়ে তিন বছরের প্রেমের সম্পর্কটা আজ বিবাহ নামক পবিত্র সম্পর্কে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছিল তবে শেষ মুহূর্তে ভাগ্যের অদ্ভুত খেলায় ছোঁয়ার বদলে অন্তিম আহসানের সাথে স্বামী-স্ত্রী নামক পবিত্র বন্ধনে বাঁধা পরে গেছি আমি। অন্তিম আহসান এই নামটার সাথে অনেক অনুভূতি জড়িয়ে আছে আমার। জীবনে প্রথমবার কার প্রেমে পড়েছিলাম এটা কেউ জানতে চাইলে আমি বলবো আমি অন্তিম আহসানের প্রেমে পড়েছিলাম। আমার কিশোরী হৃদয়ে প্রথমবার যাকে দেখে ভালোবাসার সূক্ষ অনুভুতি সঞ্চার হয়েছিল সে হলো অন্তিম আহসান। তখন অবশ্য জানতামনা এই মানুষটা আমার বোন আমার বেস্টফ্রেন্ডের প্রেমিক। যেদিন এই কথাটা জানতে পেরেছিলাম সেদিন তৎক্ষণাৎ সরে এসেছিলাম। নিজের ভেতরেই দাফন দিয়ে দিয়েছিলাম তাকে নিয়ে ঘেরা সব অনুভূতির। তবে আমার বেহায়া মন তাকে ভালোবাসা বন্ধ করতে পারেনি। তাকে পাবেনা জেনেও আড়াল থেকে অকারনেই ভালোবেসে গেছি। কিন্তু আজকের এই পরিস্থিতিটা আমি চাইনি। ঘড়ির কাঁটায় এখন রাত ২ টা। তবে ঘরে আসেনি সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটি। সানাত আজ বড্ডো ক্লান্ত। দু চোখ বুজে আসতে চাইছে। বসে বসে একনাগাড়ে মনে করতে থাকে আজকের পুরো ঘটনাটা।

🌻
আজ সকাল থেকেই মির্জা বাড়িতে প্রচণ্ড কাজের ব্যস্ততা। ব্যস্ত হবে নাই বা কেনো আরহাম মির্জার একমাত্র মেয়ে ছোঁয়ার বিয়ে বলে কথা। বেশ ধুমধামের সাথেই মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন তিনি। সারা বাড়ি আত্মীয়-স্বজন,মেহমানে ভরপুর। সানাত সেই ভোরে উঠে হাতে হাতে কাজ করে যাচ্ছে। এই বিয়েতে তার উপরে কম ধকল যাচ্ছে না! সানাত চোখে মুখে পানি দিয়ে আবারো কাজে লেগে পড়লো। জন্মের পরেই মা মরে যাওয়া সানাত বড়ো হয়েছে তার খালার কাছে। বাবার বাড়ি,খালার বাড়ি দুটো মিলিয়েই সানাতের বড়ো হয়ে ওঠা। এখানে সে পাকাপাকি ভাবে ভার্সিটির এডমিশন টেস্টের সময় এসেছে। এর আগে বেড়াতে আসতো।
দুপুর ১২ টা। সানাত, ছোঁয়া তাদের আরো কিছু বান্ধুবী, কাজিনরা পার্লারে সাজতে এসেছিল। সবার সাজ কমপ্লিট হয়ে গেছে। তাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য একটা হাইজ এসেছে। সবাই উঠে গেলেও ছোঁয়ার সাজ এখনো শেষ হয়নি। টানা ৪৫ মিনিট ধরে সবাই অপেক্ষা করছে। ছোঁয়া তাদের পাশের পার্লারে সাজতে গিয়েছে। সানাত আর অপেক্ষা না করে ছোঁয়াকে কল করলো। দু-বার রিং হতেই ওপাশ থেকে রিসিভ করলো ছোঁয়া।

হ্যালো ছোঁয়া?

হ্যা বল সানাত।

কিরে আর কতক্ষন লাগবে তোর? আমরা সবাই সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি তোর জন্য। মামণি ফোন দিয়ে তাড়া দিচ্ছে। বরযাত্রী রওনা দিয়ে দিয়েছে। তাড়াতাড়ি কর।

সানাত আমার সাজ কমপ্লিট হতে এখনো মিনিট পঁচিশ লাগবে।

কি বলছিস তুই?

হ্যা রে তুই বরং এক কাজ কর তুই ওদের সবাইকে পাঠিয়ে দে। তারপর সাজ শেষ হলে আমি আর তুই একসাথে চলে যাবো। নাহলে সবার দেরি হলে বাসার সবাই ক্ষেপে যাবে।

কিন্তু…

কোনো কিন্তু নয় যা বলছি তাই কর।

আচ্ছা।

আর হ্যা শোন।

বল।

আমার জন্য একটু কষ্ট করে ফার্মেসী থেকে গ্যাসট্রিকের এক পাতা ট্যাবলেট নে। অনেকক্ষণ কিছু খাইনি তাই বমি বমি পাচ্ছে।

আচ্ছা। তুই একটু তাড়াতাড়ি কর।

আচ্ছা।
সানাত ফোন কেটে ওদেরকে সব বুঝিয়ে বলে বাড়ি পাঠিয়ে দিলো। তারপর নিজে ছুটলো ফার্মেসীতে ওষুধ কিনতে।

🌻
ফোন অন করে দেখলো দুপুর ১টা বেজে ১০ মিনিট অথচ ছোঁয়ার কোনো পাত্তাই নেই। সানাত আট বার কল করে ফেলেছে কিন্তু রিং হয়ে কেটে যাচ্ছে বারবার। সানাত এবার আর ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারলো না। সে ছোঁয়ার পার্লারে গেলো। পার্লারে পৌঁছাতেই সে কোথাও ছোঁয়াকে দেখতে পেলো না। সানাতকে দেখে পার্লারের একজন মেয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,

আপু আপনি এখানে? কিছু চাই?

হ্যা আজকে একজন কনে এসেছিল সাজতে সে কোথায়?

সে তো প্রায় ঘণ্টা খানেক আগেই চলে গেছে। সানাত থমকে গেলো।

চলে গেছে মানে?

হ্যা ওনার সাজ তো সেই অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে তাই চলে গেছে। কেনো কোনো সমস্যা হয়েছে?

সানাত নিজেকে কোনরকমে সামলে নিয়ে বলে,

ন.. না কোনো সমস্যা হয়নি। বলেই সে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো। আবারও ফোন লাগালো ছোঁয়ার ফোনে। তবে এবারও রিসিভ করেনি। সানাতের মনে হঠাৎ করেই এক অজানা ভয় ঢুকে যায়। রীতিমত ঘামছে সে। তার ভাবনার মাঝেই হঠাৎ একটা নোটিফিকেশন এলো। সানাত নোটিফিকেশন চেক করতে নিলেই দেখলো ছোঁয়ার ম্যাসেজ। সানাত একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ম্যাসেজটা ওপেন করতেই সে স্তব্ধ হয়ে গেলো। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে সে।ছোঁয়া ম্যাসেজে লিখেছে,
সানাত এই বিয়েটা আমি করতে পারবোনা। আমি আমার এক্স রেহানের সাথে পালাচ্ছি। তুই তো জানিস আমি বরাবরই হাই ক্লাস লাইস্টাইল লিড করতে চেয়েছি। আর সে জন্য রেহান একদম পারফেক্ট। দেখ আমি বলছিনা যে অন্তিম পারফেক্ট না অন্তিম যথেষ্ট ক্লাসি ফ্যামিলির ছেলে। কিন্তু ও বিদেশ থেকে পড়াশোনা শেষ করে ফিরে গা ছাড়া ভাব নিয়ে চলে। ক্যারিয়ারের কোনো ঠিক ঠিকানা নেই তারওপর আবার ও শিক্ষকতা করতে চায়। এসবে আমার পোষাবেনা। আর অন্তিমের সাথে রিলেশন নিয়ে আমি অতটা সিরিয়াস ছিলামনা। রিলেশন করলেই যে বিয়ে করতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। তাই আমি রেহানের সাথে চলে যাচ্ছি। ও আমাকে নিয়ে কানাডা চলে যাবে আর তারপর সেখানে আমরা হ্যাপি লাইফ লিড করবো। জানি তুই আমাকে খুব সেলফিস ভাববি বাট আমার কিছুই করার নেই। আমার কাছে আমার ড্রিমটাই আগে। প্লিজ তুই ওদিকের সবটা সামলে নিস।

সানাত নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে হাতের ফোনটার দিকে তাকিয়ে আছে। সে কি জবাব দেবে সবাইকে। তার ওপরে ভরসা করে সবাই ছোঁয়ার দায়িত্ব দিয়েছিল তার কাছে কিন্তু সে ব্যর্থ। সানাত জানতো ছোঁয়ার চাওয়া পাওয়া অনেক উপরে। সে আত্মকেন্দ্রিক তবে এতটা স্বার্থপর এটা সে জানতোনা। নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য সবাইকে এতো বড়ো ধোকা দিলো! একবারও বিবেকে বাঁধলো না! নিজের বাবা মা এমনকি অন্তিম কারো কথাই ভাবলোনা! আচ্ছা আজকের এই সত্যিটা যখন অন্তিম জানবে কি হবে তার? ছেলেটা যে ভেঙেচুরে চুরমার হয়ে যাবে। এই খাটি ভালোবাসা ছোঁয়ার কাছে ক’ টা টাকার জন্য ফিকে পড়ে গেলো!

সানাত বাসায় ফিরেছে। বরযাত্রী এসে পৌঁছেছে অনেকক্ষণ। ইতিমধ্যে তারা কনের জন্য তাড়া দেওয়া শুরু করে দিয়েছে। সানাত ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করে দেখে সবাই বসে আছে। ঘড়ির কাঁটায় তখন ২ টা ৪৭ মিনিট। সানাতকে দেখেই ছোঁয়ার বাবা অর্থাৎ সানাতের খালু আরহাম মির্জা এবং তার খালা রাবেয়া এসে সামনে দাঁড়ায়। আরহাম মির্জা ঠান্ডা গলায় গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেন,

তুমি একা কেনো ছোঁয়া কোথায়? ক’ টা বাজে খেয়াল করেছো!

সানাত কাপছে। সে বরাবরই তার খালুকে বেশ ভয় পায়। কি জবাব দেবে সে তাকে!

চুপ করে দাঁড়িয়ে আছো যেনো? কিছু জিজ্ঞাসা করছি বলো ছোঁয়া কোথায়?

খা..খালু ছো..ছোঁয়াকে প..পাওয়া যাচ্ছেনা।

পাওয়া যাচ্ছেনা মানে?

ছ..ছোঁয়া পালিয়েছে। কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই কষিয়ে এক থাপ্পর পড়লো সানাতের গালে। সানাত গালে হাত চেপে দৃষ্টি ফ্লোরে রেখে দাড়িয়ে রইলো। টারপর ছোঁয়ার পাঠানো ম্যাসেজটা সবাইকে দেখালো। এই ঘটনায় ছোঁয়ার মা রাবেয়া কান্নাকাটি করে অসুস্থ হয়ে পড়েছে । এরপর আর এই ঘটনা পাঁচ কান হতে সময় নিলোনা। বরযাত্রী এই ঘটনা শুনে চরম ক্ষেপে গেছে। তাদের একটাই কথা তারা কিছুতেই বউ ছাড়া যাবেনা। তাদের মান-সম্মান আছে। এভাবে বউ ছাড়া ফিরে গেলে সমাজে মুখ দেখাতে পারবেনা। তাই মান-সম্মান বাঁচাতে আচমকা অন্তিমের বাবা ওয়ালিদ আহসান ছেলের জন্য সানাতের হাত চেয়ে বসেন। আরহাম মির্জাও না করেননি রাজি হয়ে যান। সানাত যেনো এক ঘোরের মধ্যে ছিলো। সে বুঝে উঠতে পারছিলনা তার জীবনে কি হচ্ছে। সানাত জানতো অন্তিম মরে গেলেও এই বিয়েতে মত দেবেনা তবে সানাতকে চরম অবাক করে দিয়ে অন্তিম রাজি হয়ে যায় বিয়েতে। আর তারপর আসরের আযানের পর ৩ লক্ষ টাকা কাবিন করে তিনবার কবুল বলে সে হয়ে যায় অন্তিম আহসানের বিবাহিত স্ত্রী। তারা কেউই জানেনা এই অনির্ধারিত বিয়ের ভবিষ্যৎ!

#চলবে

আমার তুমি পর্ব-১৭

0

#আমার_তুমি
#পর্ব_১৭[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ]
#জান্নাত_সুলতানা

রাহানের এরূপ কথায় সারা কুঁচকানো ভ্রু জোড়া আরও কুঁচকে গেলো।
রাহানের থেকে সামন্য কিছু টা পিছিয়ে যায়।মুখের অবস্থা আগের ন্যায় রেখেই বলে উঠে

-“সেটার জন্য ফার্মেসীতে যান।
এখানে কেন দাঁড়িয়ে ছিলেন?”

-“কৈফিয়ত চাইছো?”

প্যান্ট এর পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে রাহান।
সারা অবাক হয়ে রাহানের প্রশ্নে।
তবে খুব স্বাভাবিক ভাবে জবাব দেয়

-“তা কেন হবে?
আমার কেন জানি অন্য কিছু মনে হলো তাই বললাম।”

-“কি মনে হলো?”

রাহান কৌতূহল নিয়ে আগের ন্যায় আবারও প্রশ্ন করে।
সারা সয়তানি হাসে মনে মনে।
এবার জব্দ করা যাবে এই চালাক রাহান ভাই কে।

-“আপনাকে কেন বলবো, হু?”

কথা টা বলেই সারা মুখ ভেংচি কেটে পেছন ফিরে নিজের রুমে উদ্দেশ্য হাঁটা ধরে।
আর রাহান পেছনে দাঁড়িয়ে খুব সাবধানের সহিত সারার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলে উঠে

-“খুব শীগগির তোমার প্রতি টা কথা আমাকে বলার মতো আমি আমার অধিকার করে নেবো।”

————-

দেখতে দেখতে প্রিয়তার আর সারা টেস্ট পরীক্ষা শেষ হয়ে ফাইনাল পরীক্ষার সময়ও ঘনিয়ে এলো।
টেস্ট পরীক্ষা চলাকালীন একদিন গিয়েছে প্রিয়তা সওদাগর বাড়ি।
শুধু প্রিয়তা নয় সাদনান, রাহাত,আয়না চার জনেই গিয়েছে।
থেকেছে মাত্র এক রাত দু’দিন।
যে দু’দিন থেকেছে সে দুই দিন প্রিয়তার পরীক্ষা ছিল না।
এই দুই দিন মিতা সওদাগর ততটা কথা বলে নি প্রিয়তার সাথে।
কিন্তু সাদনানের জামাই আদরে কোনো ত্রুটি রাখে নি।
রাহাত, সাদনান দু’জনকেই বেশ যত্ন আত্তি করেছে।
এতেই প্রিয়তা ভীষণ খুশি।
প্রিয়তা এসব ভাবতে ভাবতেই বই খাতা গুছিয়ে নিচে আসার জন্য অগ্রসর হয়।
রাত এখন নয় টা বাজে নি।
সাদনান এখনো বাড়িতে আসে নি।এসে পরবে হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই।
লিভিং রুমে জাফর মির্জা সহ আম্বিয়া মির্জা, মফিজুর মির্জা,আজ্জম মির্জা আরও বাড়ির সব সদস্যরাই এখানে উপস্থিত।
প্রিয়তা সে দিকে একবার তাকাতেই দেখতে পায়
আম্বিয়া মির্জা কেমন অদ্ভুত নয়নে তাকিয়ে তার দিকে।
প্রিয়তা এটা লক্ষ করে তড়িঘড়ি করে রান্না ঘরে চলে গেলো।
রাতের খাবার রেডি করছে দু’জন কাজের লোক সহ সুফিয়া বেগম আর আয়না।প্রিয়তাও গিয়ে হাতে হাতে এটা সেটা এগিয়ে দেয়।
সুফিয়া বেগম অবশ্য বলেছে তার এ-সব করতে হবে না সে যেনো টেবিলে বসে পড়ে।
আর তাড়াতাড়ি খেয়ে রুমে চলে যায়।
সারাও খেয়ে পড়তে চলে গিয়েছে।
তবে প্রিয়তা শোনল না।
সে কাজ করতে লাগলো।
এর মধ্যে সালেহা বেগম হন্তদন্ত হয়ে রান্না ঘরে এসে কফি করে প্রিয়তার হাতে দিয়ে রুমে পাঠিয়ে দিলো।
সাদনান এসেছে আর সে ফ্রেশ হয়ে কফির জন্য বলেছে।
প্রিয়তা কফি নিয়ে উপর নিজের রুমে চলে আসে।
সাদনান মাত্র ব্যালকনি হতে রুমে এসে দেখলো প্রিয়তা কফি নিয়ে মাত্র রুমে এসছে।
সাদনান এগিয়ে এসে কফি টা হাতে নিয়ে সেটায় একবার চুমুক বসায়।
প্রিয়তা সাদনানের দিকে তাকিয়ে মাথা নুইয়ে নেয়।
কারণ সাদনান শুধু টাওয়াল পড়ে আছে।

-“পড়া কতদূর এগিয়েছে?”

সাদনান প্রিয়তার খাতা গুলো নড়াচড়া করতে করতে জিজ্ঞেস করে।
প্রিয়তা আগের স্থানে দাঁড়িয়ে থেকেই মিনমিন করে জানায়

-“রিভিশন দেওয়া বাকি এখনো।”

-“কয় টা?”

-“চার টা।”

-“কালকের দিন পর এক্সাম শুরু।”

প্রিয়তা আর কিছু বলে না মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
তার কি দোষ সব দোষ তো এই লোকের। সারা দিন তার মনের মধ্যে জেঁকে বসে থাকে।
পড়তে ইচ্ছে করে না।
অবশ্য এতো সুন্দর জামাই থাকলে কি আর পড়ায় মন বসে?
প্রিয়তার ভাবনার মাঝেই সাদনান কফি টা অর্ধেক খেয়ে বাকি টা ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে এগিয়ে আসে বউয়ের নিকট।
অতঃপর ধীরে কন্ঠে বলে উঠে

-“কালকে সকালে শহর থেকে দূরে যেতে হবে।
মিটিং আছে সেখানে দুই টা।
যদি পারি তো ফিরে আসবো নয়তো এর পর দিন সকালে।”

-“সে দিন তো পরীক্ষা শুরু।”

-“আগে আসার চেষ্টা করবো।
যদি না পারি এক্সাম এর পর নিতে যাব আমি।”

প্রিয়তা আর কিছু বলে না।
নীরব থাকে।
সাদনান আলমারি খোলে সেখান থেকে নিজের ট্রাউজার নিয়ে ওয়াশ রুম চলে যায়।
এ-র মধ্যে প্রিয়তা বিছানা আর সোফায় রাখা সাদনানের এলোমেলো করে রাখা জিনিস গুলো গুছাতে লাগলো অতঃপর সাদনান ওয়াশ রুম থেকে বেড়িয়ে এলে দুজনেই নিচে চলে আসে।

———

-“আমি এদিক দিয়ে যাচ্ছি।
তুমি আমার সাথে আসতে পারো।”

তিন্নি আজ কলেজ এসছে মাইশা আসে নি।
কলেজ বন্ধ এসএসসি পরীক্ষা শুরু হবে কাল থেকে সে জন্য।
অবশ্য ভার্সিটি খোলা আর সাথে অফিস কাজকর্ম চলে।
তাই তিন্নি এসছে নিজের কিছু জরুরি কাগজ জমা দিতে।
কিন্তু কলেজে আঙিনা হতে বেড়িয়ে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে হোস্টেল ফিরছিল।
আর ঠিক তক্ষুনি কবিরের সিলভার কালার গাড়ি টা তিন্নির পাশে এসে থামে।
কবির কে স্পষ্ট বাহির থেকে দেখা যাচ্ছিল।
আর কবির গাড়ির কাচ টা নামিয়ে উপরোক্ত অফার টা করে।
তিন্নি কেমন নার্ভাস।
সে কবির খাঁন এর কথার পিঠে তড়িঘড়ি করে মাথা নেড়ে জবাবে বলে উঠে

-“না, না স্যার।
আমি যেতে পারবো।”

তিন্নির কথায় কবির একটু বিরক্ত হলো।
এই মেয়ে এতো ঢং কেন করছে।
নিজে তো ঠিক আড়ালে থেকে সব সময় তাকিয়ে থাকে।
হ্যাঁ, কবির এই কয়েক মাসে বেশ ভালো করেই লক্ষ করেছে তিন্নির সব চালচলন।
যদিও তার আগে অস্বস্তি হতে তবে এখন এ-সব নজরে এলে আপনি আপনি মুখে হাসি ফুটে উঠে।
এটা হবার কারণ কি কবির নিজেও জানে না। হয়তো ভালোলাগা সৃষ্টি হচ্ছে।
আর এটা হতে হতে ঠিক এক দিন ভালোবাসা টাও হয়ে যাবে বলে কবির এর বিশ্বাস।
আর যে দিন সে বুঝতে পারবে সে এই মেয়ে টাকে সত্যি ভালোবেসে ফেলেছে মেয়ে টাকে ছাড়া সে থাকতে পারবে না ঠিক সে দিন এই মেয়ে টাকে নিজের মনের কথা বলে নিজের রাজ্যের রানী বানাবে।
আর কবির নিশ্চিত সেই দিন টা খুব নিকটে।
কিন্তু তার মনের কোথাও একটা সুপ্ত অনুভূতি রয়ে গিয়েছে তার প্রথম ভালোবাসার জন্য।
কিন্তু কিছু করার নেই প্রথম ভালোবাসা বলে কথা।
তবে সে টার কারণে এই মেয়ে টাকে সে কখনো অবহেলা করবে না।

কবির এর ভাবনার মাঝেই তিন্নি সালাম দিয়ে চলে যেতে হাঁটা ধরতেই কবির এবার ধমকের স্বরে বলে উঠে

-“এই মেয়ে শুনতে পাচ্ছো না কি বলছি?
গাড়িতে উঠো।”

তিন্নি আর কিছু বলার সাহস পায় না।
গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এসে দরজা টার সামনে দাঁড়াতেই কবির নিজের হাত এগিয়ে দরজা টা ভেতর হতে খোলে দেয়।
তিন্নি বসে দরজা টা লাগিয়ে দেয়।
কিন্তু কাচ টা আর তুলে না।
আর তাদের গাড়িতে পাশাপাশি বসার দৃশ্য টা দূর হতে কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো যতক্ষণ পর্যন্ত কবির এর গাড়ি টা দৃষ্টির আড়াল না হয়।

———-

-“নমিনেশন দিয়ে দেবে এই মাসের শেষ এর দিকে।”

ওয়াসিফ দেওয়ান ফোনের ওপাশ হতে বলে উঠে।
সাদনান ফোন টা ডান কান হতে বা কানে চেপে ধরে শান্ত কণ্ঠে জানায়

-“খবর পেয়েছি।”

-“মিটিং গুলো শেষ করে যত দূত সম্ভব ফিরে এসো।
আর সাবধানে থাকবে।”

মুচকি হেসে সাবধানের সহিত কথা গুলো বলে।
সাদনান ওনার কথার পৃষ্ঠে আগের ন্যায় আর গম্ভীর রাখে না মুখ।
হাসে অল্প। যা শুধু পাশে বসা রাহানের নজরে আসে তবে শব্দ নেই।
সাদনান সে দিকে একবার আঁড়চোখে তাকিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলে উঠে

-“চেষ্টা করবো।”

কথা শেষ ফোন কাটে সাদনান।
ফোন রাখে সিটে।
অতঃপর গা এলিয়ে দেয় সিটে।
পাশে বসা রাহান সে দিকে তাকিয়ে বলল

-“দ্বিতীয় নাম্বার মিটিং টা তিন টায় শুরু হবে।
আর সেখানে বর্তমান এমপি বোম রাখার প্ল্যান আছে।”

সাদনান মুচকি হাসে।
চোখ বন্ধরত অবস্থায় বলে উঠে

-“বাদা দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
এটা কিন্তু একটা আমাদের জন্য অনেক বড় সুযোগ।”

#চলবে…..

কে বাঁশি বাজায় রে পর্ব-১৪ এবং শেষ পর্ব

0

#কে_বাঁশি_বাজায়_রে
#পর্ব_১৪ ( অন্তিম পর্ব)
#নুর_নবী_হাসান_অধির

শ্যামল দুইজন মেয়েকে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে৷ শ্যামল এমন কাজ করতে পারে কখনও ভাবতে পারে নি৷ আয়েশা বেগম পরিস্থিতি থেকে নিজেকে আড়াল করতে লন্ঠনের আলো নিভিয়ে দিলেন৷ ধীর গতিতে নদীর তীরে পৌঁছে যান৷ তারপর শ্যামলকে অনুসরণ করে পিছন পিছন যান৷ নিজেকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য সাথে রাখতে রামদা নিতে ভুলেননি৷ জ্যােংসার আলোয় যদিও সবকিছু দেখা যায়৷ বড় গাছের ছায়ার নিয়ে দাঁড়ালে দূর থেকে কিছু দেখা যায়না৷

শ্যামল মেয়ে দুইজনকে তাঁদের বাড়ির পিছনের দিকে নিয়ে আসল৷ এদিকে যে রাস্তা আছে আগে জানত না৷ সবাই বাড়ির সামনের রাস্তায় জানে৷ ঝুপঝাপে ভরপুর এই জায়গায়। যে কেউ দেখে মনে করবে পরিত্যক্ত ভবন৷

বিদ্যুতের ব্যবস্থা না থাকায় চারদিকে লন্ঠন জ্বালিয়ে রেখেছে৷ তার একটু পরই জেনারেটরের মাধ্যমে ইলেক্ট্রিসিটির ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ আয়েশা বেগম চারদিকে তাকিয়ে দেখতে পান জায়গাটিতপ (১০-১২) জন লোক আছে৷ অপারেশন থিয়েটারের মতো ব্যবস্থা আছে৷ অঙ্গ জীবিত বা সুরক্ষা রাখার জন্য বিভিন্ন ক্যামিকেলের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ শ্যামল সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“আজ কোন কাজ করতে ভালো লাগছে না৷ তোদের চাহিদা মেটানোর জন্য মেয়ে দু’জনকে নিয়ে আসছি৷ আর বেঁধে রাখা শালাদের হাই পাওয়ারের ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে রাখ৷ কাল সবার অর্গান বের করে শহরে নিয়ে যাব৷”

শ্যামল আর কথা বাড়াল না। সেখান থেকে বেরিয়ে আসে৷ আয়েশা বেগম নিজেকে আড়াল করতে ঝুপের নিচে লুকিয়ে পড়েন৷ তারপর একে একে বেরিয়ে আসে আইয়ুব আলী, আরিফ সাথে কয়েকজন প্রহরী। আয়েশা বেগমের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায়৷ এদেরকে বাঁচানোর জন্য একটা দিনের সময় আছে৷ কিন্তু আজ ছাড়া বাঁচানো যাবে না৷ রাতের শেষ প্রহর চলছে৷ দুই ঘন্টা পরই আজান দিবে৷ তারমানে হাতে দুই ঘন্টা সময় আছে৷ আয়েশা বেগম আর ভাবতে পারছেন না৷ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েন৷ তখনই মনে পড়ে যায় ইউসুফ, জুয়েল, শামীমের কথা৷ তারা গ্রামেই আছে ভিন্ন পরিচয়ে৷ শুধুমাত্র আয়েশা বেগম তাদের চিনে এবং রেগুলার তাদের কিছু না কিছু ট্র্যানিং দিয়ে যাচ্ছিল৷ আজ তাদের পরীক্ষা দেওয়ার পালা৷ আয়েশা বেগম দৌড়ে তাদের তিনজনের বাড়িতে যান৷ গভীর রাতে তাদের ঢেকে তুললেন৷ ইউসুফ চোখ ঢলতে ঢলতে বলল,

“কি হয়েছে ম্যাডাম! এতো রাতে আমাদের ডাক পড়ল যে৷”

আয়েশা বেগম উত্তেজিত কন্ঠে বলল,

“এখন এসব বলার সময় নয়৷ আমাদের কিছু মানুষকে বাঁচাতে হবে৷ আজ আমাদের জীবনের ঝুঁকি নিতে হবে৷ যাওয়ার পথে তোমাদের সব বলা হবে৷”

তিন জোড়া চোখ রাতের জ্যােংসার আলোয় আয়েশা বেগমের প্রতিফলিত ছায়াকে অনুসরণ করে যাচ্ছে৷ পথিমধ্যে আয়েশা বেগম তাদের সব ঘটনা খুলে বলেন৷ সকলে চকিত হয়ে যায়৷ কখনও ভাবতে পারেনি এসব কাজ শ্যামল করতে পারে৷ শ্যামলকে প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজে পড়ানো হয়েছে৷ শ্যামলের নির্দেশনায় এসব কাজ হয়৷ কেউ কখন বুঝতে পারেনি এমন হবে৷

চুপি চুপি চারটি প্রাণ পরিত্যক্ত বাড়িতে প্রবেশ করে৷ জেনারেল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু লুন্ঠন জ্বলছে৷ প্রথমে আয়েশা বেগম তারপর তিন জোড়া চোখ অনুসরণ করে এগিয়ে যাচ্ছে৷ সাবধানে প্রতিটি পা ফেলা হচ্ছে৷ প্রথমে অপারেশন থিয়েটার রুমে তারা প্রবেশ করে৷ ক্যামিকেল দিয়ে প্রতিটি অর্গানকে জীবিত রেখেছে৷ আয়েশা বেগম ফিসফিস করে বলল,

“তোমরা কোনদিন কাউকে খুন করেছো।”

খুনের কথা শুনে সকলের ঠোঁট শুকিয়ে যায়৷ ভয়ে চুপসে যায় সবাই৷ কঠিন গলায় বলল,

“আজ যদি তোমার মা, বাবাকে এভাবে হত্যা করা হতো তুমি তাদের ছেড়ে দিতে৷ তোমরা কি কাপুরুষের মতো বসে থাকতে? এগুলো মনে কর তোমার মা বাবার লাশ৷”

তবুও চোখে মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। আয়েশা বেগম সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“দেখ কিভাবে খুন করতে হয়?”

আয়েশা বেগম ঘুমন্ত আইয়ুব আলীর একজন লোকের মুখ বেঁধে ফেলে৷ রামদা দিয়ে এক টানে গলা কেটে ফেলে। রক্তের ফোয়ারা বয়ে যাচ্ছে৷ আয়েশা বেগম অগ্নি চোখে তাকিয়ে বলল,

“সবাই হাত পা বেঁধে ফেলে এভাবে গলা কেটে ফেল৷”

ইউসুফ, জুয়েল দু’জনে একে একে সবাইকে মেরে ফেলল৷ কিন্তু শামীম কিছুতেই পারছে না৷ সে একজনের হাত পা বেঁধে রেখেছে৷ নিজেকে বাঁচানোর জন্য ছটফট করছে৷ সমস্ত ঘরে রক্তের বন্যা৷ আয়েশা বেগম শামীমের হাত ধরে লোকটার গলা কেটে ফেলে৷ রক্ত ছিটকে শামীমের গায়ে যেতেই শামীম চিৎকার করে উঠে৷ আয়েশা বেগম সাথে সাথে শামীমের মুখ চেপে ধরে বলল,

“কোন আওয়াজ নয়৷ হাতে সময় নেই৷ আযান পড়ে যাচ্ছে৷ এখন শুভ সময়৷ সবাইকে বাঁচাতে হবে৷ কাঁধে করে সবাইকে নদীর পাড়ে নিতে হবে৷”

সবার পকেট হাতিয়ে কয়েদখানার চাবি খুঁজে পেয়েছে৷ মেয়ে দু’টোকে ধর্ষণ করে উলঙ্গ অবস্থা রেখেছে৷ তাদের দিকে কাপড় এগিয়ে দিয়ে বলল,

“তাড়াতাড়ি পড়ে এখান থেকে বের হও৷ কোন কথা নয়৷”

ছয় জন ছেলেকে ঘুমের মেডিসিন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে৷ ইউসুফ, জুয়েল,শামীম কাঁধে করে তাদের নদীর ধারে নিয়ে আসে৷ আয়েশা বেগম সবাইকে নিয়ে দ্রুত গতিতে নিজের বাড়ির ঘাটে চলে যায়৷ ইশারায় সবাইকে নদীতে ফেলতে বলেন৷ নদীতে ফেলার পর সবার জ্ঞান ফিরে আসে৷
________

চারদিকে আযানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে৷ ছেলেরা আয়েশা বেগমের লাহাড়ি ঘরে আছে৷ মেয়ে দু’জন আয়েশা বেগমের সাথে আছে৷ আয়েশা বেগম তাদের দু’জনকে বুঝিয়ে বলে,
“এসব কথা যেন কোন কান পক্ষিও টেওর না পায়। কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে নাও৷”

তারা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল৷ চিন্তামুক্ত হতে পারলেন না৷ কঠিন গলায় বলল,

“কেউ জানতে পারলে তোমাদের কোন ক্ষতি করব না৷ তোমাদের মা বাবাকে খুন করে ফেলব৷ মা বাবার ভালো চাইলে সব ভুলে যায়৷ আর মলম গায়ে মাখিয়ে নাও৷”

কথায় কাজ দিয়েছে৷ চোখে মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। যুদ্ধে জয় লাভ করার মূল হাতিয়ার হলো ভয় এবং তার দুর্বলতা। মেয়েদের সবথেকে দূর্বলতা হলো তাদের মা বাবা৷ তাদের জন্য সবই করতে পারে৷
___________

পরী বনানী থানায় তার বাবাকে দেখতে এসেছেন৷ আশালতা পলকের উপর টাকা চুরির অভিযোগ নিয়ে এসেছে৷ একটু পর পলক হোসাইনকে কোর্টে চালান করা হবে৷ পরীকে দেখেই মাথা নিচু করে ফেলল৷ তাচ্ছিল্যের সাথে পরী বলল,

“কাউকে কষ্ট দিয়ে কেউ সুখী হতে পারে না৷ যার জন্য সবকিছু ছেড়ে দিলেন আজ সেই আপনাকে চোরের অপবাদ দিল৷ জানেন আজ নিজেকে সব থেকে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে৷ মা এই বিষয়টা জানলে অনেক খুশী হবে৷”

পলক হোসাইন চোখ তুলে তাকানোর সাহস পাচ্ছেন না৷ চোখ থেকে অঝোরে অশ্রুকণা ঝরে যাচ্ছে৷ পরী বুকে পাথর চেপে বলল,

“আপনার জন্য এ শাস্তি পাপ্য ছিল৷ আমার মাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য আমি আপনাকে শাস্তি দিতাম৷ কিন্তু বাবা হওয়ার জন্য পারিনি৷”

পরী দাঁড়াতে পারল না৷ দ্রুত গতিতে বেরিয়ে আসল৷ সমাপ্তি পিছন থেকে ঢেকেও আটকাতে পারল না৷ দৌড়ে ছোট মায়ের বাড়িতে উপস্থিত হলো৷ হাতজোড় করে বলল,

“ছোট মা বাবাকে ছাড়িয়ে আনেন৷ বাবার হয়ে আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। উনি তো আপনারও স্বামী হয়৷ আরিয়ানের বাবা হয়৷”

আশালতা রাগ নিয়ে বলল,

“তোর বাবা ২০ লক্ষ টাকার হিসাব দিতে পারেনি৷ আমার টাকা চুরি করে তোদের ভালো করবে৷ আমি থাকতে কোনদিন হতে দিব না৷”

পরীকে কিছু বলতে না দিল না৷ গার্ড দিয়ে পরীকে বের করে দিল৷ পরী যেতে যেতে বলল,

“তোর শাস্তি আমি দিব৷ আমার হাতের থাপ্পড় খাওয়ার জন্য বেঁচে আছিস এখন৷ খুন করে ফেলব কোন প্রমাণ রাখব না৷”
______________

পরিত্যক্ত ভবনে ঢুকেই তিনজনের মাথায় হাত। ফ্লোরে রক্তের ছাপ পড়ে আছে৷ রক্ত জমে তরল জেলির মতো হয়ে গেছে৷ শ্যামল চিৎকার করে বলল,

“এই কাজটা কে করেছে আমি তাকে কিছুতেই ছাড়ব না৷”

শ্যামল কিছু বলতে পারল না৷ তার আগেই মাটিতে লুটে পড়ল৷ দূর থেকে বিষাক্ত তীর তাক করা হয়েছিল। সেই বিষাক্ত তীর শ্যামলের গায়ে লাগে৷ সাথে সাথে আইয়ুব আলী, আরিফ মাটিতে লুটে পড়ে৷ এই বিষের প্রভাব বেশিক্ষণ থাকবে না৷ সর্বোচ্চ দুই ঘন্টা থাকবে৷ কবিরাজের কাছ থেকে এই বিষ নেওয়া হয়েছে৷ তিনি বিশেষ লতাপাতা দিয়ে তৈরি করেছেন৷ সবাইকে সেখানে বেঁধে ফেলা হলো৷ মুখে স্কচটেপ। জ্ঞান ফিরলে আয়েশা বেগমকে দেখে চমকে উঠে। ছুটার জন্য ছটফট করছে৷ আয়েশা বেগম বলেন,

“কোন লাভ হবে না৷ তোদের একটা কথা বলি৷ আসিফকে কে খুন করেছে, জানিস? তোদের প্রাণপ্রিয় আসিফকে আমি খুন করেছি৷ আমার পারুলকে আমার কাছ থেকে কেঁড়ে নিছিল৷ আমি আসিফকে কেঁড়ে নিছি৷ এখন তোদের প্রাণ কেঁড়ে নিব৷”

ইউসুফ হিংসাত্মক কন্ঠে বলল,

“এদের উপর আমি আগে গরম তেল ঢালব৷ আমার উপর গরম তেল ঢালছিল৷ আজ বুঝাব কেমন লাগে৷”

ইউসুফ কারো কথা না শুনেই আরিফের গায়ে গরম তেল ছুঁড়ে দেয়৷ বাদ পড়েনি শ্যামল, আইয়ুব আলী। ঝলছে যায় তাদের সমস্ত দেহ৷ আয়েশা বেগম শামীম ও জুয়েলকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“তোমাদের কোন রাগ থাকলে মিটাতে পার৷ আর শামীম তোমার বোনকে ধর্ষণ করে হত্যা করেছিল আরিফ৷”

শামীম হাতে ছুরি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে৷ চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে৷ মুখ বাঁধা থাকায় প্রকাশ করতে পারছে না৷ মুক্তি পাওয়ার জন্য ছটফট করছে৷ শামীম আরিফের যৌনাঙ্গে লাথি দিয়ে বলল,

“আরও করবি মা, বোনদের সম্মান হরণ৷ তোদের মতো অত্যাচারীদের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই৷”

শামীম পাগলের মতো আঘাত করতে থাকে আরিফকে৷ ঘটনাস্থলে আরিফ সেখানেই মারা যায়৷ শামীম চিৎকার করে বলল,

“আজ আমি যুদ্ধে জয়লাভ করেছি৷”

ইউসুফ জুয়েল একই ভাবে আইয়ুব আলী ও শ্যামলকে হত্যা করে৷
______________

আয়েশা বেগম পুলিশের কাছে সব স্বীকার করে৷ সকল দায় ভার নিজের কাঁধে নেন৷ এখানে ইউসুফ, জুয়েল, শামীমকে জড়াননি৷ শক্তি কোন সাক্ষ্য প্রমাণ পাইনা পুলিশ৷ আয়েশা বেগম নিজেই দোষ স্বীকার করার ফলে সাত বছরের জেল হয়৷

২০০১ সালের ১৪ জানুয়ারি আয়েশা বেগম জেল থেকে মুক্তি পান৷ ফিরে আসেন নিজের প্রাণপ্রিয় ভূমি আনন্দপুরে৷ কাঁধে তুলে নেন স্কুলের দায়িত্ব। এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে৷ গ্রামে রাস্তাঘাটের অনেক উন্নতি হয়েছে৷ কিন্তু পলক হোসাইনকে দেখে বলেন,

“তোমার কোন জায়গায় নেই আমার বাড়িতে৷ তুমি আশালতার কাছে ফিরে যাও৷ বাকী জীবন আমি এই গ্রামের মাটিতেই কাটিয়ে দিব৷ তোমার কোনদিন জায়গা হবে না৷ ভালোবাসার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা না করে আমায় খুন করলে এতো কষ্ট হতো না৷”

পরীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলেন,

“কখনও অন্যায়ের কাছে মাথানত করবি না৷”

সমাপ্ত……..