Friday, June 27, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 302



অতঃপর গল্পটা তোমার আমার পর্ব-১৮

0

#অতঃপর_গল্পটা_তোমার_আমার
#পর্ব-১৮
#হুমায়রা_আঞ্জুম (লেখনীতে)

সানাত বসে আছে ওহীর রুমে। ওহী রেডি হচ্ছে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়েই জিজ্ঞেস করলো,

ভাইয়া কিছু বলেছে আমাকে নিয়ে?

না। তুই ভাবিস না কিছু।

কি বলছিস ভাববো না মানে? ভাইয়া আমার সাথে এক সপ্তাহ হলো কোনো কথা বলেনি। আমি ভেবেছিলাম সেদিন হয়তো ভাইয়া আমাকে প্রচুর বকবে কিন্তু তাঁর কিছুই করেনি ভাইয়া।

বকলে কি তুই খুশি হতি? বরং এখন তো তোর খুশি হওয়ার কথা তোর আর রাদিফ ভাইয়ার আকদ হচ্ছে। তুই কি খুশি না?

আমি খুশি কিন্তু আমি শান্তি পাচ্ছিনা সানাত। ভাইয়া যদি আমায় মারতো বকতো তাহলে আমি বোধয় শান্তি পেতাম কিন্তু ভাইয়া আমার সাথে কোনো কথাই বলছেনা। সেদিন ওখান থেকে আসার পরে আমি কখনোই ভাবিনি ভাইয়া এসে আব্বু আম্মুকে বলে রাদিফের ফ্যামিলির সাথে পাকা কথা বলে ফেলবে। ভাইয়া কোনো বাঁধাও দিলোনা।

ওহী তুই মন খারাপ করিস না। আচ্ছা যা আমি আজকে এটা নিয়ে কথা বলবো ওনার সাথে। আর তুই এখন রেডি হ একটু পরই তোর ঘরোয়া বিয়ের শপিংয়ে যাবো।

রেডি হচ্ছি। তুই প্লিজ ভাইয়াকে বুঝিয়ে বল। আমার সত্যিই খারাপ লাগছে।

আচ্ছা মন খারাপ করিসনা আমি কথা বলবো। বলেই সানাত বেরিয়ে গেলো।
.
.

অন্তিম রেডি হচ্ছে। এমন সময় ঘরে সানাতের আগমন ঘটলো। সানাতকে দেখে অন্তিম কিছু একটা খুঁজতে খুঁজতে বলে উঠলো,

সানাত তুমি এসেছো?

হ্যাঁ, কোনো দরকার?

হ্যাঁ আমার ঘড়িটা কোথায় রেখেছো খুঁজে পাচ্ছিনা।

দেখছি দাঁড়ান। বলেই ঘড়িটা খুঁজে বের করে অন্তিমের হাতে দিয়ে বললো,

এতো অগোছালো হয়েছেন কেনো আপনি কোনো জিনিসের ঠিক ঠিকানা নেই!

তুমি আছো না গোছানোর জন্য।

এটা কি আমার চাকরী? বেতন দেন আপনি আমায়?

চাকরী কেনো হবে এটা তোমার রেসপনসিবিলিটি।

থামুন। আপনি কি আমাদের সাথে বের হবেন?

হ্যাঁ মা অনেক রিকোয়েস্ট করেছে। তাই আর না করতে পারিনি।

ওহ্।

তুমি কি কিছু বলবে?

সানাত কিছুক্ষণ কাচুমাচু করে তারপর বললো,

আসলে একটা বিষয় কথা বলার ছিলো।

কি বলো। এতো হেজিটেড ফিল করছো কেনো?

আসলে ওহী খুব কষ্ট পাচ্ছে।

অন্তিম ঘুরে সানাতের দিকে তাকালো। তারপর বললো,

কেনো? ওর কি বিয়েতে আপত্তি আছে?

না না তেমন কিছু নয়।

তাহলে?

আপনি ওর সাথে কথা বলছেন না ও খুব কষ্ট পাচ্ছে এই বিষয়টা নিয়ে। সেদিন ওখান থেকে আসার পর আপনি ওকে কিছুই বলেননি। উল্টো আকদ করিয়ে দেওয়ার জন্য বলেছেন। আপনি কি ওর ওপর রেগে আছেন? মেয়েটা খুব কষ্ট পাচ্ছে। আপনি প্লিজ রেগে থাকবেননা। আচ্ছা আপনি কি কোনোভাবে রাদিফ ভাইয়ার জন্য মানতে পারছেননা?

সানাত আমি কেনো রেগে থাকবো? ওহী তো কোনো অন্যায় করেনি। একজনকে ভালোবেসেছে। আর ভালোবাসা অন্যায়ের কিছুই না। ওহী এখন মোটেও বাচ্চা নয়। নিজের লাইফের ডিসিশন নিজেই নিতে পারে। আর রাদিফকে নিয়ে আমার কোনো প্রবলেম নেই। আর রাদিফকে নিয়ে কোনো প্রবলেম থাকার প্রশ্নই আসেনা। কারণ আমি জানি রাদিফ খুব ভালো একটা ছেলে। আমার বন্ধু বলে বলছিনা। সত্যিই খুব ভালো ছেলে। আমি নিজেও হয়তো ওহীর জন্য এতো বেস্ট কোনো পাত্র খুঁজে পেতামনা। ওহী একদম পারফেক্ট একজনকেই চুজ করেছে। আর রাদিফ এস্টাবলিসড একটা ছেলে। ওকে নিয়ে কোনো প্রব্লেম আমার নেই।

তাহলে কেনো কথা বলছেননা ওহীর সাথে?

আমি আসলে কিছুদিন পরে ওহীর বিয়ে হয়ে গেলে কেমন সব শূন্য হয়ে যাবে এটা ভেবে একটু চুপচাপ আছি। ওকে দেখলেই আমার মনে হয় ছোট্ট বোনটা আমার কতো বড় হয়ে গেছে। আমার ভাবতেই খুব কষ্ট হয় সানাত।

এই ব্যাপার! আর আপনি জানেন আপনার এই এমন আচরণে মেয়েটা কতো কষ্ট পাচ্ছে! রীতিমত কাদঁছিলো ওহী।

কি ওই বোকা মেয়ে কেঁদেছে?

হ্যাঁ। আপনি এখনি যান গিয়ে বোনের মান ভাঙ্গান।
.
.
সানাত বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে আছে অন্তিম আর ওহীর দিকে। তারপর বললো,

আপনাদের ভাই বোনের মান অভিমান শেষ হলে চলুন আমরা যাই। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে।

হ্যাঁ এবার বের হওয়া উচিত। বললো অন্তিম।

তাহলে দাড়িয়ে কেনো আছেন চলুন। আর এই ওহী তোর এই ন্যাকা কান্না বন্ধ কর। প্রেম করার সময় মনে ছিলনা যে একদিন তো ভাইকে ছেড়ে প্রেমিকের সাথে যেতে হবে।

এই তুই থামবি! তোর কি লজ্জা লাগেনা এসব বলতে?

তোর প্রেম করতে লজ্জা না লাগলে আমার বলতে কেনো লজ্জা লাগবে শুনি?

থাম সানাতের বাচ্চা।

আমার কোনো বাচ্চা নেই।

তাহলে নিয়ে নে। আমিও ফুপি হতে চাই।

ব্যাসস সানাত সঙ্গে সঙ্গে নুইয়ে পড়লো। অন্তিম সামনে থাকায় লজ্জা যেনো আকাশ ছুঁলো। এই মুহূর্তে তার এই ওহীকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছা করছে। রাগে লজ্জায় সানাত কোনো কথা না বলে চুপচাপ গাড়ীতে উঠে অন্তিমের মা অর্পিতা আঞ্জুমের পাশে বসলো। তারপর অন্তিম ওহীও উঠে বসলো। সারা রাস্তা সানাত একটা কথাও বলেনি। আর অন্তিমের দিকে তো ভুলেও তাকায়নি।
.
.

মার্কেটের মাঝেই ঘোরাঘুরি করছে সানাতরা। ওহীর শ্বশুর বাড়ি থেকেও মানুষ এসেছে। সবাই মিলেই বিয়ের শপিং করছে। সবাই বেশ হাসিখুশি ভাবেই ঘুরছে। কিন্তু সানাতের কেনো যেনো খুব অস্থির লাগছে। কেনো যেনো মনটা খুব অস্থির করছে। অন্তিম সানাতের পাশে এসে দাঁড়ালো। তারপর বলে উঠলো,

সানাত তুমি ঠিক আছো? তোমাকে আমার ঠিক লাগছেনা?

না আমি ঠিক আছি।

শিওর?

হ্যাঁ। একদম ঠিক আছি আমি। আপনি চিন্তা করবেননা।

আচ্ছা। বাট কোনো প্রব্লেম হলে বলবে কিন্তু।

হ্যাঁ একদম।
.
.
সানাতদের সব শপিং করা শেষ। এখন মূলত তারা শপিংমল থেকে বের হচ্ছে একটা রেসটুরেন্টে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। তবে সেখানেই যেনো আজ এক চরম বিপত্তি ঘটে গেলো। যা একটা সদ্য সাজানো সুখের সংসার ভেঙ্গে দিতে সক্ষম। হঠাৎ করেই অন্তিমের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো এক আগন্তুক মেয়ে। পুরো ঘটনায় হতবিহ্বল উপস্থিত সকলে। অন্তিম কোনরকমে সামলে দাড়ালো। হঠাৎ এমন কিছুর জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। বুকে ঝাঁপিয়ে পড়া মেয়েটিকে দেখা মাত্রই সানাতের সমস্ত দুনিয়া মুহূর্তেই কেঁপে উঠলো। কারণ মেয়েটি আর কেউ নয় ছোঁয়া। সানাত যেনো পাথর হয়ে গেছে। যেই ভয় সে এতদিন ধরে পেয়ে আসছিলো আজ তা সত্যি হয়ে গেলো। তার সংসারটা বোধয় আর তাঁর থাকবেনা। ভেঙেচুরে চুরমার হয়ে যাবে। সকলের দৃষ্টি উপেক্ষা করে ছোঁয়া বলে উঠলো,

অন্তিম! আমি এসে গেছি। তুমি আমার ওপর খুব রাগ করে আছো তাইনা?

অন্তিম নিজেকে ছোঁয়ার থেকে ছাড়িয়ে নিলো। মুহূর্তেই অন্তিমের মা অর্পিতা আঞ্জুম বলে উঠলেন,

এতদিন পর কোথথেকে এসেছো তুমি? আর এসব পাবলিক জায়গায় কোন ধরনের অসভ্যতামো।

ছোঁয়া অন্তিমের মায়ের কথা উপেক্ষা করে অন্তিমের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

অন্তিম আই নো তুমি অভিমান করে আছো আমার ওপর। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি অন্তিম।

ভুল বুঝতে পেরেছিস মানে? আমাদের সাথে বেইমানি করে আমাদের সম্মানহানি করে এতোদিন পর এখন হুট করে এসে ফাজলামি করছিস তুই ! বললো ওহী।

ওহী তুইও এভাবে বলছিস! আই নো আমি ভুল করেছি। আমি স্বীকার করছি তো নিজের ভুলটা।আমি অন্তিমের সাথে কথা বলে সবটা স্বাভাবিক করে নেবো।

স্বাভাবিক করবি মানে? কি স্বাভাবিক করবি তুই? তুই কেনো এসেছিস? আর ভাইয়া তোর সাথে কোনো কথা বলবে না। ভাইয়া এখন ম্যারিড সেটা ভুলে যাসনা।

কিসের ম্যারিড?

বিয়ে হয়েছে সানাতের সাথে ভাইয়ার।

ওটাকে কোনো বিয়ে বলে নাকি! অন্তিম পরিস্থিতির চাপে পড়ে বিয়ে করেছে সানাতকে । আর সানাতও তো অন্তিমকে ভালোবাসে না। এটা জাস্ট একটা এক্সিডেন্ট।

এই মেয়ে একদম চুপ করো তুমি। বেয়াদব কোথাকার! তুমি বললেই ওদের বিয়ে মিথ্যে হয়ে যাবে নাকি? তুমি কে এসব বলার? আমার ছেলের জীবনের এতো বড় সর্বনাশ করে আবার যখন আমার ছেলেটা সুখে শান্তিতে বাঁচতে চাইছে তখন তুমি আবার কেনো এসেছো? কোন অশান্তি সৃষ্টি করতে এসেছো তুমি?

আন্টি আপনি ভুল বুঝছেন। আমি আমাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক করতে চাইছি।

কিসের সম্পর্ক? আর কি স্বাভাবিক করবে তুমি? তোমার ইচ্ছা মতো সবকিছু হবে নাকি? আর বারবার ভুলে কেনো যাচ্ছো অন্তিম বিবাহিত। সানাত ওর স্ত্রী।

আমি মানিনা। আর আমি জানি অন্তিমও মানেনা এই সম্পর্ক। অন্তিম তুমিই বলো তুমি তো আমাকে ভালোবাসো। আমার জন্য পাগল ছিলে তুমি। আমি জানি আমি ভুল করেছি। তাই এখন নিজের ভুলটা সংশোধন করতে চাই। আর এই সংশোধনের উপায় তুমি সানাতকে ডিভোর্স দিয়ে দেও। তারপর চলো না আমরা আবার সবটা নতুন করে শুরু করি।

অন্তিম নিশ্চুপ। কোনো কথা সে বলছেনা।
আর সানাত সে শুধু অন্তিমের কিছু বলার অপেক্ষায় তৃষ্ণার্ত চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছে। তার ভেতরে যে ঝড় বইছে তা সে কিছুতেই সামলাতে পারছেনা। ছোঁয়া আবারও বলে উঠলো,

অন্তিম আমি তোমার সাথে আলাদা করে কথা বলতে চাই। প্লিজ আমাকে একটু সময় দেও। আমি সবটা খুলে বলবো।

না অন্তিম কোথাও যাবে না। এই মেয়ে আমার ছেলের থেকে দূরে থাকো বলছি। অন্তিম তুই চল এখান থেকে।

অন্তিম প্লিজ তুমি আমাকে একটু টাইম দেও। আমার সাথে প্লিজ চলো।

অন্তিম একবার সানাতের চোখের দিকে তাকালো। সানাত শুধু তাকিয়ে আছে। তার চোখের ভাষা আজ বড্ডো বেদনাদায়ক। অন্তিম দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে সবার আকাঙ্খা মাটিতে মিলিয়ে দিয়ে বললো,

তোমরা বাড়ি যাও মা। আমি ছোঁয়ার সাথে যাবো।
কথাটা বলেই সানাতের দিকে আরেকবার তাকালো অন্তিম। সানাত তার দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো। তার বুকটা আজ ফেটে যাচ্ছে। কেনো সুখ সয়না তার? উপরওয়ালা কেনো এতো নিষ্ঠুর তার বেলায়? আজ চিৎকার করে কাঁদতে পারলে বোধয় একটু হলেও শান্তি লাগতো! তার ভাবতেই কলিজাটা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় যে এটা সেই ছোঁয়া যে একসময় তার বেস্টফ্রেন্ড ছিলো!
#চলবে

অতঃপর গল্পটা তোমার আমার পর্ব-১৭

0

#অতঃপর_গল্পটা_তোমার_আমার
#পর্ব-১৭
#হুমায়রা_আঞ্জুম (লেখনীতে)

সানাত ভার্সিটির গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে অন্তিমের অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণ আগেই অন্তিম ম্যাসেজে লিখে পাঠিয়েছে,

সানাত ক্যাম্পাসের বাইরে আমার জন্য ২০ মিনিট অপেক্ষা করো। আমার ডিউটি এখনো শেষ হয়নি। আমি ২০ মিনিট পর আসছি। একসাথে বের হবো।

তাই সানাত চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কারণ সে চাইলেও ক্যাম্পাসের ভেতরে অন্তিমের জন্য অপেক্ষা করতে পারবেনা। কারণ অন্তিম চায়না তাদের সম্পর্কের কথা প্রফেশনাল লাইফে কেউ জানুক। সানাত বেশ বিরক্ত এতে। সে ভেবেই পায়না বাইরে যে মানুষ এত প্রেমিকপুরুষ সেজে থাকে তার সামনে সেই মানুষ কিনা ভার্সিটিতে আসলে পুরো ভোল পাল্টে ফেলে! এমন হাবভাব যেনো চেনেই না তাকে! যেনো আর পাঁচটা মেয়েদের মত সেও তেমন! রাগ হয় সানাতের পরক্ষণেই ভাবে নাহ্ বোধয় একটু বেশিই আশা করে ফেলছে সে অন্তিমের থেকে। অন্তিম তো তাকে একবারও বলেনি সে তাকে ভালোবাসে। সে যা করেছে তা হয়তো বন্ধুত্বের খাতির থেকে। এমন মুহূর্তেই পেছন থেকে আলভী সানাতকে দেখে ডেকে উঠলো,

আরেহ সানাত! তুমি এখানে একা দাড়িয়ে আছো কেনো?

সানাত আলভীকে দেখে এবার মহাবিরক্ত হলো। মনে মনে বলে উঠলো,
উফফ এই ছেলে এখানেও চলে এসেছে! একটু একা দাঁড়িয়েও শান্তি নেই!

কি ব্যাপার সানাত? কথা বলছো না যে?

না মানে একজনের জন্য অপেক্ষা করছি?

কার জন্য?

সানাত কি বলবে বুঝতে পারছেনা। আলভী আবার বললো,

তুমি কি তোমার ঐ কাজিনের জন্য ওয়েট করছো?

হ্যাঁ আলভী।

ওহ। বাট তোমার ওই কাজিন কেমন একটু জানি। মানে তুমি ওনার রিলেটিভ অথচ ভার্সিটিতে এমন ভাবে ইগনোর করে তোমাকে যেনো তুমি কিছুই হওনা ওনার।

সানাতের মনটা খারাপ হয়ে গেলো। সত্যিই তো আলভীর একটা কথাও ফেলনা না। অন্তিম কেনো করে এমন? কই ভার্সিটির বাইরে তো কতো কোমল তার প্রতি তবে ভার্সিটিতে কেনো এতো কঠিন?
অন্তিম সবে মাত্র ভার্সিটি থেকে বেরিয়েছে। বাইরে সানাতের পাশে আলভীকে দেখেই মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেলো। এই অসভ্য ছেলে তো দেখছি কিছুতেই পিছু ছাড়ছেনা। আর সানাত বেয়াদবটা কম কিসে! সেও তো দিব্যি দাড়িয়ে আছে ওর সাথে! অন্তিম গিয়ে দাঁড়াতেই আলভী বলে উঠলো,

আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া!

ভাইয়া? আমি তোমার ভাইয়া হলাম কি করে?

যা বাবা আপনি সানাতের বড়ো ভাই বলে কথা। আর সানাত আমার খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড। তাহলে ওর ভাই মানে তো আমারও ভাই। তাইনা?

অন্তিম চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। এই মুহূর্তে এক ঘুষি মেরে আলভীর সব ক’টা দাঁত ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে। আর এদিকে সানাত কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে। পরিস্থিতি ঘোলা হওয়ার আশঙ্কায় সে অন্তিমের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

চলুন যাবেন না? এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আমার পা ব্যথা হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি চলুন।

তারপর আলভীর উদ্দেশ্যে বললো,

আচ্ছা আলভী আমরা এখন আসি। বলেই অন্তিমের হাত ধরে হাঁটতে শুরু করলো। তারপর একটা রিকশা ডেকে রিকশায় উঠে বসলো। অন্তিম চোয়াল শক্ত করেই বলে উঠলো,

ওই ছেলেটার সাথে তোমার এতো কিসের মেলামেশা? বলেছিনা ওর থেকে দূরে থাকবে। আমার একদম পছন্দ নয় ওই ছেলেকে।

সানাত ইচ্ছে করেই বলে উঠলো,

কেনো? পছন্দ নয় কেনো? আলভী তো খুব ভালো ছেলে। যথেষ্ট অমায়িক।

জাস্ট শাট আপ। এতো নজর কেনো বাইরের ছেলেদের দিকে! ভালো মন্দর তুমি কি বোঝো হ্যাঁ যে বলছো অমায়িক!

আমি তো শুধু…

চুপ থাকো। আর হ্যাঁ ওহী কোথায়?

ঘুরতে গেছে… বলেই জ্বিভ কাটলো সানাত। এইরে মুখ ফস্কে কি বলে ফেললো সে! অন্তিম যদি জানতে পারে তার বোন প্রেমিকের সাথে ঘুরতে গেছে তাহলে আর রক্ষা থাকবেনা। অন্তিম ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলো,

কার সাথে ঘুরতে গেছে?

ঐশী, মিনহা ওদের সাথে। আমিও যেতাম কিন্তু আপনি তো অপেক্ষা করতে বললেন তাই আর যাওয়া হয়নি।

ওহ্। আচ্ছা।
.
.
🌻
অন্তিম আর সানাত এই মুহূর্তে বসে আছে একটা রেস্টুরেন্টে। খাবার অর্ডার করেছে। সানাত চুপ করে বসে আছে। অন্তিম উঠে দাঁড়ালো। তারপর বললো,

সানাত তুমি বসো আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসছি।

ঠিকাছে।
তারপর অন্তিম চলে গেলো। আর সানাত বসে রইলো।
.
.

অন্তিম ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসছিল আচমকা কারো সাথে ধাক্কা লাগলো। কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে শার্ট ঠিক করতে করতে বললো,

আইএম এক্সট্রিমলি সরি। আসলে… বাকি কথা আর বলতে পারলোনা। দুজন দুজনের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে পরমুহূর্তে একসঙ্গে বলে উঠলো,

তুই!

তারপর সামনের ব্যক্তিটি বলে উঠলো,

আরেহ অন্তিম তুই!

রাদিফ তুই!

তারপর দুজনেই দুজনকে জড়িয়ে ধরলো। অন্তিম বলে উঠলো,

সেই লাস্ট কবে তোর সাথে দেখা হয়েছিল! তারপর তিন চার বছর হলো কোনো যোগাযোগ নেই। জাস্ট শুনলাম তুই নাকি দেশের বাইরে চলে গেছিস।

হ্যাঁ রে হুট করেই ডিসিশন নেওয়া। তোকে খুব মিস করেছিরে।

হ্যাঁ এতোই মিস করেছিস যে যোগাযোগ করারও সময় পাসনি।

ট্রাস্ট মী তোর নাম্বারটা হারিয়ে গেছিলো। আর আগের আইডি টাও চেঞ্জ করে ফেলেছিলি।অপশন ছিলোনা কোনো। আর ব্যস্ততার মধ্যে এতো ডুবে গেলাম যে খোঁজ করার সময়ও পায়নি।

সেসব তো বুঝলাম এখন কি করছিস?

এইতো বাবার বিজনেস হ্যান্ডেল করছি পাশাপাশি ফার্মাসিস্ট হিসেবে একটা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতেও আছি।

খুব ভালো।

তুই কি করছিস?

এইতো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছি।

দারুন ব্যাপার।

তা এখানে কি ফ্যামিলির সাথে এসেছিস নাকি?

আরেহ না।

তাহলে কি ভাবীকে নিয়ে?

না দোস্ত।

বুঝতে পেরেছি প্রেমিকা নিয়ে এসেছিস।

রাদিফ লাজুক হাসলো। অন্তিম বলে উঠলো,

থাক আর লজ্জা পাস না! তা ভাবির সাথে কি দেখা করাবি না নাকি?

হ্যাঁ হ্যাঁ আজই করাবো। তার আগে বল তোর কি খবর?

আমার আর কি অবস্থা আমি তোর মতো প্রেমিকা নিয়ে আসিনি সোজা বউ নিয়ে এসেছি।

কীইইই তুই বিয়ে করে ফেলেছিস!

হ্যাঁ। তুই মিস করে গেলি।

শিট দোস্ত। কবে করলি?

এইতো প্রায় ছয় মাস।

এতো বড়ো ধোঁকা! চল ভাবীকে দেখবো।
.
.

ওহী বোরিং হয়ে বসে আছে। সে তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে রেস্টুরেন্টে এসেছে তবে সেই মানুষটি ওয়াশরুমে যাওয়ার নাম করে যে গেছে এখনও আসার নাম নেই। ওহী বোরিংনেস কাটানোর জন্য সানাতকে ভিডিও কল করলো। সানাতও বোরিং হয়ে বসেছিল এমন সময় ওহীর ভিডিও কল পেয়ে খুশি হলো। তারপর রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ওহী বললো,

কিরে শাকচুন্নি, দেখ কালকে তো তোরা ভালোই ঘুরলি রাতে। কতো রোমান্টিক সময় কাটালি দেখ এখন আমিও আসছি বান্ধবী। ওনার সাথে রেস্টুরেন্টে আসছি দেখ।

অত উড়িস না ফকিন্নি আমিও আসছি।

কিইই তুই কই গেছস আবার আর কার সাথে গেছিস?

আমি কি তোর মতো আমি আমার জামাইয়ের সাথে আসছি রেস্টুরেন্টে।

ও বাবাহ! আমার ভাইকে তো ভালো আঁচলে বেধেছিস দেখছি। যাক বাদ দে দেখ আমি কতো নামী দামী রেস্টুরেন্টে বসে আছি। বলেই সে ক্যামেরা ঘুরিয়ে দেখাতে লাগলো। সানাত বলে উঠলো,

এই একমিনিট।

কি হলো আবার?

এই তোর আর আমার ব্যাকরাউন্ড সেইম কেনো লাগছে?

মানে ? আমি তো সিপি রেস্টুরেন্টে এসেছি।

কিইই!! তুই এখানে এসেছিস?

হ্যাঁ কেনো কি হয়েছে?

আমরাও তো এখানেই এসেছি। বলেই পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখলো ওহী তার ঠিক পেছনের টেবিলেই বসা।

কীইইইই!!! কি বলতেছিস এগুলা? হায় আল্লাহ! মীর জাফর ছেমরি আগে বলছ নাই ক্যান তোরা এখানে আসছিস? আর মরার আর কোনো জায়গা পাসনাই এইনেই আইছস?

এই ফাজিল আমি কি করে জানবো তুই প্রেম করতে এখানে আসবি?

এইসব বাদ দে দোস্ত এখন ভাইয়ার থেকে কিভাবে বাঁচবো আইডিয়া দে। ভাইয়ার সামনে একবার ধরা পড়লে সব শেষ। বাঁচা আমারে।

সানাত উঠে ওহীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর বললো,

তুই তাড়াতাড়ি এখান থেকে বেরিয়ে যা।

রাদিফ তো এখন এখানে নাই। ও আসলেই ওকে বলে চলে যাবো।

তোর বয়ফ্রেন্ড কই গেছে?

ওয়াশরুমে গেছে।

হায় আল্লাহ। অন্তিমও ওয়াশরুমে গেছে।

দোস্ত আমার ভয় করতেছে। কিছু একটা করে আমারে বাঁচা। কসম আর এইসব ডেটিং ফেটিংয়ে আসমুনা।

সানাত কিছু বলতে যাবে এর মধ্যেই দেখলো অন্তিম এগিয়ে আসছে। আর তার পাশের ব্যক্তিটি আর কেউ নয় ওহীর প্রেমিক রাদিফ। দুজনকে পাশাপাশি দেখে ওহী মনে মনে বললো,
লা হাওলা কুয়াতা ইল্লাহ বিল্লাহ। আল্লাহ বাঁচাইও।
সানাত একবার ওহীর দিকে তাকিয়ে বললো,

যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়।

অন্তিম সানাতের পাশে ওহীকে দেখে বেশ অবাক হলো। কিন্তু সে কিছু বলার আগেই রাদিফ বলে উঠলো,

কিরে ভাবী কোথায়?

অন্তিম এগিয়ে গিয়ে সানাতের দিকে ইশারা করে বললো,

এই যে সানাত।

সানাত আর ওহী কেউই কিছু বুঝতে পারছেনা। অন্তিম আর রাদিফকে একসঙ্গে দেখে তাদের মাথা এই মুহূর্তে পুরো ফাঁকা। তারপর ওহীর দিকে তাকিয়ে রাদিফ বলে উঠলো,

আরেহ ওহী তুমি ভাবীকে চেনো?

তুই ওকে চিনিস? অবাক হয়ে বললো অন্তিম।

হ্যাঁ ওকে নিয়েই তো এসেছি। তোর হবু ভাবী। বলেই লাজুক হাসলো রাদিফ। আর এদিকে ওহী ঘেমে নেয়ে একাকার। আজ সে মহা ফাঁসা ফেঁসে গেছে। অন্তিম বলে উঠলো,

কি বললি?

হ্যাঁ তুই না আমার প্রেমিকাকে দেখতে চেয়েছিলি এইতো সে।

ওহী আর তুই… অন্তিমকে থামিয়ে রাদিফ বলে উঠলো,

তুই ওহীকে চিনিস? তোরা পূর্ব পরিচিত?

অন্তিম চোখ মুখ শক্ত করে গম্ভীর হয়ে বললো,

হ্যাঁ ।

ওহী তুমি তো বললে না তুমি অন্তিমকে চেনো?

ওহী কোনরকমে মাথা নিচু করে বললো,

আমার ভাইয়া।

সঙ্গে সঙ্গে রাদিফ হা হয়ে গেলো। ভয়ে তার চোখ মুখের রং বদলে গেছে। কোনো মতে অন্তিমের দিকে তাকিয়ে বললো,

দোস্ত গালতি ছে মিস্টেক! বলেই কোনো রকমে কেটে পড়লো। অন্তিম গম্ভীর হয়ে বললো,

সানাত ওকে নিয়ে বাড়ি যাও।
#চলবে

অতঃপর গল্পটা তোমার আমার পর্ব-১৬

0

#অতঃপর_গল্পটা_তোমার_আমার
#পর্ব-১৬
#হুমায়রা_আঞ্জুম (লেখনীতে)

আর কতদূর? আর এভাবে কতক্ষন আমার চোখ ধরে রাখবেন?

চুপ করে থাকো সানাত। গেলেই দেখতে পাবে। বলতে বলতেই অন্তিম সানাতের চোখ দুটো ধরে এগিয়ে যেতে লাগলো।
কাঙ্ক্ষিত জায়গাটির সামনে এসে দাঁড়াতেই অন্তিম বললো,

সানাত আর ইউ রেডী?

হ্যাঁ একদম। আমি সেই কখন থেকে অপেক্ষায় আছি এবার চোখ ছাড়ুন।

ওকে। রেডি থ্রি, টু, ওয়ান, সারপ্রাইজ! বলেই চোখ থেকে হাত সরালো অন্তিম। সানাত চোখ খুলে তাকাতেই অবাক। সে এই মুহূর্তে দাড়িয়ে আছে একটা দীঘির পাড়ে। পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় দীঘির জলের সৌন্দর্য্য আজ যেনো দশগুন বেড়ে গেছে। কিনারেই নৌকা নিয়ে মাঝি দাড়িয়ে আছে। পুরো নৌকাটা খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে।

কি কেমন লাগলো সারপ্রাইজটা?

সানাত সামনের দিকে তাকিয়েই বললো,

খুউবব সুন্দর!

চলো নৌকায় গিয়ে উঠি। আজ তোমাকে নিয়ে পূর্ণিমা রাতে নৌকায় ঘুরবো আর জোৎস্না বিলাস করবো। বলেই সানাতের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। সানাত মিষ্টি হাসলো। তারপর অন্তিমের বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা নিঃসংকোচে আকড়ে ধরে নৌকায় উঠলো। অন্তিম মাঝির উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

চাচা আপনি নৌকা বাইতে থাকুন।

আইচ্ছা আব্বা। তয় এ কি পেমিকা নাকি বউ হয়?

আমার বউ চাচা।

মাশাআল্লাহ চেহারাখান খুব মায়াবী বাজান।

অন্তিম হাসলো। আর এদিকে সানাত অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অন্তিমের দিকে। তার কানে বারবার বাজছে অন্তিমের বলা সেই একটা কথাই “আমার বৌ”। ইস্ এই দুটো শব্দ এমন মাদকের মতো কেনো মনে হচ্ছে যেনো ঘোর লেগে যাচ্ছে তার। আচ্ছা সত্যিই কি অন্তিম বলেছে এই কথা? নাকি তার কান ভুলভাল শুনেছে? সানাতের ভাবনার মাঝেই খেয়াল হলো তার হাতটা অন্তিম মুঠোয় পুরে নিয়ে কি যেনো করছে। সানাত সেদিকে নজর দিতেই দেখলো অন্তিম খুব যত্ন সহকারে তার হাতে গাজরা পরিয়ে দিচ্ছে। সানাত সেদিকেই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অন্তিম বলে উঠলো,

দেখি ওদিকে ঘোরো।

কেনো?

ঘুরতে বলেছি ঘোরো।

সানাত ঘুরে বসলো। অন্তিম সানাতের পিঠের ওপরে ছেড়ে দেওয়া কেশরাশি গুলোকে এক পাশে সরিয়ে একটা কাঁচা ফুলের মালা গলায় পরিয়ে দিলো। তারপরে একটা গোলাপি রঙের জারবেরা ফুল কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে সানাতকে তার দিকে ঘুরিয়ে বলে উঠলো,

“শাড়ি পড়া এক চোখ, মাটিতে তুমি
ফুলগুলো গেছে নেই, তবুও জন্ম নেবো আমি।”

লজ্জায় সানাত মাথা নুইয়ে ফেললো। সবটা কেমন যেনো স্বপ্ন মনে হচ্ছে তার কাছে। বিশ্বাসই হচ্ছেনা এই এতো সুন্দর মুহূর্তটা তার আর অন্তিমের শুধুমাত্র তাদের একান্ত, ব্যক্তিগত কিছু মুহূর্ত যা সানাত মুঠোয় পুরে নিতে চায়। অন্তিম বলে উঠলো,

তোমাকে আজ খুব অদ্ভুত সুন্দর লাগছে সানাত। এই জোৎস্না রাতে কোনো শ্যামবতী রমণী শাড়ি পরে, গায়ে কাঁচা ফুলের গয়না জড়িয়ে, চোখে কাজল দিয়ে নদীর মাঝে বসে জোৎস্না বিলাস করছে। পূর্ণিমার চাঁদের আলো আজ ফিকে পড়ে গেছে শ্যাম বর্ণের কাছে।

সানাত চোখ তুলে তাকালো। তারপর হেসে বললো,

কালোকে শ্যাম বলে চালিয়ে দিচ্ছেন! কালো কিন্তু কলঙ্কের রং। আর আমার সাথে পূর্ণিমার চাঁদের তুলনা দিচ্ছেন! আমি যে অমাবস্যা।

আমার কাছে কালো কলঙ্ক নয় পবিত্রতার রঙ। আর বাকি রইলো পূর্ণিমা আর অমাবশ্যার কথা। বেশ সবাই তো পূর্নিমার চাঁদের পেছনেই ঘোরে আমি না হয় অমাবশ্যার চাঁদকেই চাইলাম। তাতে ক্ষতি কি?

কিন্তু অমাবশ্যাতো অন্ধকার।

কে বলেছে আমি তো অমাবশ্যার মাঝেও পবিত্র নূরের আলো খুঁজে পেয়েছি।

সান্তনা দিচ্ছেন? মন রাখতে এসব কথা সবাই বলে।

অন্তিম সানাতের হাতের ওপরে হাত রেখে ওই গভীর চোখে নিজের প্রখর দৃষ্টি রেখে বলে উঠলো,

এই চাঁদ তারা এনে দেওয়ার কথা তো সবাই বলে আর তার সবই মিথ্যে।
তবে তুমি চাইলে আমি তোমাকে সম্মান আর অফুরন্ত ভালোবাসা দিতে পারি।

সানাত জানেনা এই দুটো লাইনের মাঝে ঠিক কি ছিলো তবে সে আবারও প্রখর ভাবে প্রেমে পড়লো তার সামনে থাকা এই প্রেমিক পুরুষটির ওপর।

সানাত!

হুঁ!

অন্তিম বলে উঠলো,

পা টা দেও।

সানাত চমকে উঠে বলে উঠলো,

কেনো?

অন্তিম আর কোনো অপেক্ষা না করে নিজেই পায়ে হাত দিলো। মুহূর্তেই সানাত বলে উঠলো,

একি পায়ে হাত দিচ্ছেন কেনো?

কেনো পায়ে হাত দিতে কি মানা? নাকি সোনায় বাঁধানো পা তোমার?

না মানে অস্বস্তি হয়।

চুপচাপ অস্বস্তি চেপে বসে থাকো। বলেই সে একটা পায়েল নিয়ে পরিয়ে দিলো সানাতের পায়ে। সানাত তাকিয়ে আছে। তারপর অবাক হয়ে বলে উঠলো,

আপনি এটা…

পছন্দ হয়েছে?

সানাত কিছুই বললোনা শুধু তার চোখ দুটো মুহূর্তেই টইটুম্বুর হয়ে উঠলো। তারপর নোনাজল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ার আগেই অন্তিম হাত পেতে তা ধরে ফেললো। তারপর বলে উঠলো,

তুমি এইটুকুতেই কাদঁছো সানাত! এখনো যে আরো একটা জিনিস বাকি!

আরো কি বাকি আছে?

আছে। বলেই সানাতের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে উঠলো,

শুভ জন্মদিন শ্যামবতী।

সানাত নিজেই নিজের জন্মদিন ভুলে বসেছিল বাবার মৃত্যুর শোকে। হঠাৎ কি হলো সানাত জানেনা মুহূর্তেই ঝাঁপিয়ে পড়লো অন্তিমের বুকে। তারপর কেঁদে ফেললো। অন্তিম সানাতকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বললো,

একি সানাত এতো কিছু করলাম যাতে তোমার মন ভালো হয় আর তুমি কিনা আমার সব পরিশ্রমে পানি ঢেলে কাদঁছো?

সানাত নাক টেনে বললো,

আমি খুবব খুশি হয়েছি। আপনি জানেন না এই প্রথম কেউ এতটা যত্ন নিয়ে আমার জন্মদিনে কিছু করেছে। আমি সত্যিই এতোটা আশা রাখিনি। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে এতো সুন্দর একটা রাত উপহার দেওয়ার জন্য। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কিছু মুহূর্তের তালিকায় এই মুহূর্তটাও আজীবন থাকবে।

আর আমার জীবনে শ্রেষ্ঠ কিছু উপহারের মাঝে তুমি অন্যতম একটি উপহার হয়ে থাকবে। যা আমায় উপরওয়ালা নিজে দিয়েছেন। আমি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো ওনার কাছে।

সানাত অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আর মনে মনে শুধু একটাই কামনা করলো তার এই সুখের মাঝে যেনো কোনো ভাঙন না আসে।
.
.

সানাত আর অন্তিম বাড়ি ফিরেছে বারোটার পর। সানাত ফ্রেশ হয়ে নিজের বিছানায় বসে বসে ফোনে তাদের আজকের কিছু বিশেষ মুহূর্তের ছবি গুলো দেখছে। এই ছবিগুলো অন্তিমের কিছু বন্ধু তুলেছে পাশের নৌকা থেকে। এছাড়াও আরো অনেক ছবি আছে। অন্তিম গেছে ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে। সানাত ছবি গুলো জুম করে উল্টে পাল্টে দেখছে আর হাসছে। এই যেমন এখন সে যে ছবিটা দেখছে তাতে সানাত লজ্জায় মাথা নিচু করে হাসছে আর অন্তিম গালে এক হাত দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইস্ এই ছবিটা যেনো একটু বেশীই সুন্দর হয়েছে। সানাত মুহূর্তেই ভেবে ফেললো এই ছবিটা সে বাঁধিয়ে তাদের রুমের দেয়ালে টাঙ্গাবে। তারপর আয়নার সামনে গিয়ে দাড়িয়ে ভাবতে লাগলো আসলেই তো আজ তার মতো কালো মেয়েকে সত্যিই হঠাৎ খুব সুন্দর লাগছে। সে নিজেই নিজের থেকে চোখ ফেরাতে পারছেনা। হঠাৎ এই সৌন্দর্যের কারণ কি? তারপর আবার ভাবতে লাগলো ইস্ ওহীকে তো বলাই হলোনা আজকের সব ঘটনা। গাধাটা আজ এতো আগে আগেই ঘুমিয়ে পড়লো! আর কেমন বেঈমান তাকে ম্যাসেজে উইশ করে ঘুমিয়ে গেলো! কোনো ব্যাপার না একবার শুধু কালকের সকালটা হোক তারপর ওকে বসিয়ে সব বলবে। সানাতের ভাবনার মাঝেই অন্তিমের ফোন বেজে উঠলো। সানাত ঘুরে তাকালো। তারপর অন্তিমের উদ্দেশ্যে জোরে বললো,

অন্তিম আপনার ফোনে বাজছে!

ওপাশ থেকে শাওয়ারের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা গেলো না। ফোনটা কেটে গিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো আবারও বেজে উঠলো। সানাত আবার বললো,

অন্তিম! আপনার ফোন বাজছে!

ওয়াশরুম থেকে অন্তিম বলে উঠলো,

একটু রিসিভ করো।

আচ্ছা।

সানাত ফোন হাতে নিতেই দেখলো কোনো নাম নেই। সানাত রিসিভ করে বললো,

হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?

ওপাশ থেকে নিরব, কোনো কথা বলছেনা। সানাত আবার বললো,

হ্যালো কে বলছেন? হ্যালো?

ওপাশে ব্যক্তিটি এবারও নিরব। সানাত ভ্রু কুঁচকে ফোনের স্ক্রিনে তাকালো। এরমধ্যে অন্তিমও বের হয়ে এসেছে। তারপর সানাতের উদ্দেশ্যে বললো,

কি হয়েছে কে ফোন করেছে?

জানিনা কোনো কথা বলছেনা।

কই আমার কাছে দেও তো। বলেই ফোন টা হাতে নিয়ে বললো,

হ্যালো কে?

ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ নিরব থেকে তারপর বলে উঠলো,

অন্তিম!

অন্তিম মুহূর্তেই থমকে গেলো। কন্ঠটা খুব পরিচিত মনে হলো। যেনো এর আগেও সে শুনেছে। তারপর সে কিছু বলতে যাবে এর আগেই ওপাশের ব্যক্তি কল কেটে দিলো। এরপর অন্তিম চেষ্টা করলেও সুইচস্টপ বলছে। সানাত জিজ্ঞাসা করলো,

কি হয়েছে কে ফোন করেছিলো?

জানিনা। শুধু আমার নামটা ডাকলো একবার।

আপনার নাম? আপনার পরিচিত কেউ?

কি জানি? কন্ঠটা কেমন খুব পরিচিত মনে হলো।

সানাতের মেরুদন্ড বেয়ে নেমে গেলো এক অজানা ভয়ের শীতল স্রোত। কেনো যেনো মনটা বারবার অশনি সংকেত দিচ্ছে। কেনো মনে হচ্ছে এই সুখ বোধয় বেশি দিন সইবেনা তার কপালে। কোনো এক তুফান এসে সব কেড়ে নিয়ে যাবে আর সে আবারও একা একেবারে শূন্য হয়ে যাবে। অন্তিম হঠাৎ সানাতের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,

কি হয়েছে সানাত? তুমি এভাবে ঘামছো কেনো?

না কিছুনা এমনি।
#চলবে

অতঃপর গল্পটা তোমার আমার পর্ব-১৫

0

#অতঃপর_গল্পটা_তোমার_আমার
#পর্ব-১৫
#হুমায়রা_আঞ্জুম (লেখনীতে)

বাবাকে রেখে এলাম
চির ঘুমের বাড়িতে।
সেই থেকে
একটা কাঁচা কবরের ঘ্রাণ
আমাকে একফোঁটা ঘুমোতে দিচ্ছেনা।
সমাধিসুরভী থেকে থেকে বলছে শুধু
‘বেঁচে থাকতে বাবা একটা মানুষ ছিলো
মরে গিয়ে মহাপৃথিবীর অংশ হয়ে গেলো’।

বাবা,
তোমার মহাপৃথিবী হওয়ার দামে
আমার পৃথিবী বড্ডো ছোটো হয়ে এলো।

এইটুকু লিখেই ডাইরিতে চলমান কলমটা থামালো সানাত। তারপর ডাইরিটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে প্রায়। ছাদে থাকতে ঠান্ডা লাগছে। ওপাশে ফিরে তাকালো। দেখলো ছাদের এক পাশে দাঁড়িয়ে ওহী বাদাম খাচ্ছে আর বেশ রেগে রেগে কথা বলছে তার প্রেমিক মানুষের সাথে। সানাতরা চলে এসেছে এক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। এখন সে যথেষ্ট স্বাভাবিক। এর প্রধান কারণ এই পরিবারটা, এই পরিবারের মানুষ গুলো। অন্তিম, অন্তিমের মা অর্পিতা আঞ্জুম, অন্তিমের বাবা ওয়ালিদ আহসান, ওহী সকলে ঘিরে রেখেছে সানাতকে। তাই শূন্যতা কাছে ঘেঁষতে পারছেনা সানাতের। সানাত ওহীর পাশে এসে দাঁড়ালো। ওহী কল কেটে দিয়েছে। সানাত বললো,

ওভাবে ফায়ার হয়ে কথা বলছিলি কেনো? কি ভাবলো?

চুপ থাক তুই। ওর ভাগ্য ভালো যে ও আমার সামনে ছিলোনা নাহলে আজ খুন করে ফেলতাম।

কি এমন করেছে যে এত ক্ষেপছিস?

তুই জানিসনা কি করেছে? তাও বলছিস আমি বেশি করেছি!

জানি কি করেছে। আরেহ বাবা তুই যেমন ভাবছিস তেমন না। ওর কলিগ হয়। আর মেয়ে কলিগ কি থাকতে পারেনা? ও তো আর যেচে যায়নি। হঠাৎ একটা প্রয়োজনে ওর হেল্প চেয়েছে আর তুই এতো রিয়েক্ট করছিস।

বেশ করেছি। শোন পুরুষ মানুষদের একটু চোটপাটের উপরেই রাখতে হয় নাহলে এদের বিশ্বাস নেই। আর তুই জানিস নিজের ভালোবাসার মানুষকে অন্য কোনো মেয়ের সাথে দেখলে ঠিক কতোটা জ্বলে? ছারখার করে দিতে ইচ্ছে করে সব। আমাকে যে বলছিস ধর এখন যদি ছোঁয়া আবার ফিরে আসে তখন সহ্য করতে পারবি ভাইয়ার পাশে ওকে?

মুহূর্তেই যেনো সানাত থমকে গেলো। সত্যিই তো ছোঁয়া যদি কখনো ফিরে আসে? তখন কি হবে? অন্তিম কি তাকে ছেড়ে দেবে? তাকে ফেলে ছোঁয়ার কাছে চলে যাবে? নাহ ভাবতে পারছেনা সানাত। তার খুব ভয় হয়। সে কিছুতেই নিজের জায়গায় ছোঁয়ার কথা ভাবতে পারেনা।

কিরে ভয় পেয়ে গেছিস না? তাহলে বোঝ আমার কেমন লেগেছে! কিরে সানাত কথা বলছিস না কেন?

সানাত কোনো মতে ঠিক হয়ে ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,

ওহী সত্যিই যদি কখনো ছোঁয়া ফিরে আসে! তখন কি অন্তিম আবারও ফিরে যাবে ছোঁয়ার কাছে?

কিসব বলছিস তুই? আমি তো জাস্ট এমনিই বলেছি। তুই সিরিয়াস কেনো হচ্ছিস? আর ছোঁয়া আসবে কি করে ওর নিশ্চই বিয়ে হয়ে গেছে এতো দিনে।

জানিনা ওহী আমার খুব ভয় করে। আমি সত্যিই সহ্য করতে পারবোনা যদি এমন কিছু হয়।

আরেহ গাধা এমন কিছুই হবেনা। আর ভাইয়া ওকে একসেপ্ট করবে নাকি মাথা খারাপ?এসব না ভেবে নিচে চল ঠান্ডা লাগছে।

ওহীর কথাও সানাতকে শান্ত করতে পারলো না। কোথাও যেনো ভয়টা থেকেই গেলো।
.
.
সন্ধ্যা বেলা,
সানাত নিজের ঘরে বসে একটা উপন্যাসের বই পড়ছে। এর মধ্যেই পাশে পরে থাকা ফোন নোটিফিকেশন বেজে উঠলো। সানাত হাতে নিতেই দেখলো অন্তিমের ম্যাসেজ । ম্যাসেজে অন্তিম লিখে পাঠিয়েছে,

“সানাত আলমারির থার্ড তাকে দেখো একটা শপিং ব্যাগ রাখা। ব্যাগের মধ্যে তিনটে শাড়ি আছে। ওখান থেকে হালকা গোলাপি রঙের শাড়িটা পড়ে তৈরি হয়ে গলির মোড়ে আসো। আমি বাইক নিয়ে অপেক্ষা করছি। আর হ্যাঁ কোনো রকম জুয়েলারি পড়বেনা। সময় ২০ মিনিট।”

সানাত পুরো ম্যাসেজ পড়ে হা হয়ে তাকিয়ে আছে। আর ভাবছে অন্তিম শাড়ি কবে কিনলো? হঠাৎ কি ভূত চাপলো মাথায় যে এই সময় শাড়ি পরে আসতে বললো? বেশি কিছু না ভেবে তৈরি হতে চলে গেলো সানাত।
.
.

অন্তিম বাইক থামিয়ে পাশের টঙের দোকানে বসে চা খাচ্ছে। সানাতকে বিশ মিনিট সময় দিয়েছিল অথচ আধা ঘণ্টার বেশি হয়ে গেছে কিন্তু সানাতের কোনো পাত্তা নেই। অন্তিম বিরক্ত হয়ে সানাতকে কল করতে নেবে এমন মুহুর্তেই চোখ গেলো সামনে গলির দিকে। কিছু সময়ের জন্য থেমে গেলো অন্তিমের পুরো পৃথিবী। সানাত অন্তিমের অমন দৃষ্টি দেখে বেশ লজ্জায় পড়ে গেলো। শ্যাম বর্ণের গায়ে হালকা গোলাপি রঙের হ্যান্ড পেইন্টেড শাড়িটি খুব সুন্দর মানিয়েছে। যেনো মনে হচ্ছে এই শাড়িটি এই শ্যাম বর্ণের রমণীর জন্যই বানানো হয়েছে। সানাত কাচুমাচু করে বললো,

আপনি এই সময় হঠাৎ ডাকলেন যে?

অন্তিম দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বললো,

হ্যাঁ কাজ আছে তাই। বলেই চা ওয়ালা মামার উদ্দেশ্যে বললো,

মামা টাকাটা নেন। বলেই সানাতের হাত ধরে বাইকের কাছে গিয়ে নিজে উঠে সানাতের হাতেও হেলমেট ধরিয়ে দিয়ে উঠে বসতে বললো। এরপর বাইক স্টার্ট দিতে দিতে বাইকের ভিউ মিররে একবার তাকালো। সানাত বাইকে বসেছে ঠিক আছে কিন্তু অন্তিমের কাধে হাত রাখবে কিনা এই নিয়ে দোটানায় আছে। অন্তিম নিজেই বলে উঠলো,

সানাত!

হুঁ।

একটা টাইট হাগ করো তো। কাম ফার্স্ট।

সানাত নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। একি শুনলো সে! বোধয় ভুলভাল শুনেছে। তাই বোকার মতো বলে উঠলো,

কি?

বলেছি শক্ত করে জড়িয়ে ধরো। একদম টাইট ভাবে ধরবে যেনো ছুটে না পরো। তাড়াতাড়ি।

সানাত বহু সাহস নিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। বুকের ভেতর উত্তেজনার উথাল-পাতাল ঢেউ উঠেছে। সামনে থেকে অন্তিম বলে উঠলো,

ভাত খাওনি অজকে? কি জড়িয়ে ধরেছো এটা? জোরে ধরো।

সানাত বোকা বনে গেলো। তারপর আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। অন্তিম বলে উঠলো,

এবারও অত একটা জোরে হয়নি।

সানাত এবার লাজ লজ্জা ভেঙ্গে ক্ষেপে গেলো। তারপর তেতে উঠে বলে উঠলো,

তো আপনি কি বলতে চাইছেন আপনাকে বুকের ভিতরে ঢুকে যাবো?

গেলে মন্দ হয়না।

সানাত বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে আছে। অন্তিম ভিউ মিররে সানাতের দিকে তাকিয়ে বললো,

নাহ্ সানাত তোমাকে একটা হাগ করার ক্লাস নিতে হবে। যতো যাই হোক এখন আমি তোমার টিচার বলে কথা। বলেই এক চোখ টিপ দিয়ে হেসে বাইক স্টার্ট করলো।

সানাত বলে উঠলো,

আপনি তো ভারী অসভ্য দেখছি।

অসভ্যতামী না করার আগেই বলছো অসভ্য তাহলে করলে কি বলবে?

চুপ করুন। চুপচাপ বাইক চালানোতে মনোযোগ দিন।

পেছনে এতো সুন্দর আকর্ষণীয় রমণী বসে আছে মনযোগ কি করে সামনে দেই বলো? মাথা নস্ট হয়ে যাচ্ছে।

ছিঃ আকষর্ণীয় আবার কি?

তুমি।

এই আপনি কি আমার সাথে ফ্লার্ট করছেন?

ফ্লার্ট? সেটা আবার কি?

ঢং কম করুন। আপনি বোঝেন না ফ্লার্ট কি?

তুমি একটু বুঝিয়ে দেওনা সানাত। আমি সত্যিই বুঝিনা।

তাহলে এতক্ষণ ধরে কি করছিলেন?

আমি তো শুধু বাস্তবটা বললাম। তোমাকে আজ যা মারাত্মক….

চুপপপ করুননন আপনিইইই!!

সঙ্গে সঙ্গে অন্তিম হো হো করে হেসে উঠলো। সানাত রাগ দেখিয়ে বললো,

হাসবেন না আপনি। ঠোঁটকাটা লোক কোথাকার!

অন্তিম আবারও হাসলো। তারপর হাসি থামিয়ে বললো,

একটা গান ধরো তো সানাত।

আমি?

হ্যাঁ তুমি।

আমি গান পারিনা।

মিথ্যে কথা বলবেনা। তুমি খুব ভালো গান করো। গাও বলছি।

বেশ। তারপর সংকোচ ভেঙ্গে সানাত গান ধরলো,

এই পথ যদি না শেষ হয়
তবে কেমন হতো তুমি বলোতো?
যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয়
তবে কেমন হতো তুমি বলোতো?

সামনে থেকে অন্তিম সুর মিলিয়ে গেয়ে উঠলো,

তুমিই বলো

এরপর সানাত গেয়ে উঠলো,

এই পথ যদি না শেষ হয়
তবে কেমন হতো তুমি বলোতো?

সামনে থেকে অন্তিম বলে উঠলো,

পথ শেষ হবে কিনা জানিনা তবে আমার বাইকের পেট্রোল খরচটা তুমি দিলে ভালো হতো।

সানাত হেসে উঠলো। তারপর বললো,

এবার আপনি একটা গান ধরুন।

এই না সানাত আমার গান শুনলে তুমি বাইক ছেড়ে পালাবে।

না না অত কিছু শুনছিনা আপনি গান।

বলছো গাইবো?

হ্যাঁ গান।

হাসবে না কিন্তু!

আচ্ছা হাসবো না।

ওকে। বলেই অন্তিম গান ধরলো,

যেতে যেতে পথে পূর্ণিমারাতে চাঁদ উঠেছিলো গগনে,
দেখা হয়েছিলো তোমাতে আমাতে, কি জানি কি মহা লগনে চাঁদ উঠেছিলো গগনে… গাইতে গাইতেই বাইক থামালো অন্তিম। পেছন থেকে সানাত বলে উঠলো,

একি থামলেন কেনো?

কারণ আমরা এসে গেছি।
#চলবে

অতঃপর গল্পটা তোমার আমার পর্ব-১৪

0

#অতঃপর_গল্পটা_তোমার_আমার
#পর্ব-১৪
#হুমায়রা_আঞ্জুম (লেখনীতে)

আমি সকালে থাকবো না।

কথাটা শোনা মাত্রই উপস্থিত সকলেই অবাক।মুহূর্তেই সানাতের চাচা বলে উঠলেন,

থাকবি না মানে?

আমি সন্ধ্যায় বাড়ি চলে যাবো।

সানাত তুমি এসব কি বলছো? বললো অন্তিম।

হ্যাঁ আমি চলে যাবো।

পাগল হইছস ছেরি! কইতাছস কি যাইবিগা মানে? হগ্গলে মাত্র তর বাপেরে দাফন দিয়া আইলো আর তুই যাইবি গা?

তাতে কি হয়েছে চাচী? সব কাজ তো হয়েই গেছে। আমার আর থেকে কি কাজ?

কিসব বলছিস তুই জানিস সানাত? ভাইয়ের আজকে মাত্র দাফন হয়েছে আর তুই আজকেই চলে যাবি? এতদিন পর এসেছিস।

আমি তো এখানে বেড়াতে আসিনি চাঁচা। আমার বাবার মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে এসেছি। দাফন হয়ে গেছে এখন আর আমার কি কাজ!

এটা কোন ধরনের কথা বলছিস সানাত? তোর বাবা আজ মারা গেছে আর তুই একটা রাত থাকবি না?

চাচা আমি যেদিন থেকে ঢাকামুখী হয়েছি তারপর থেকে একটা সময় পরপর এই বাড়িটাতে আসতাম আমার অসুস্থ বাবার টানে। আজ সেই টানের ইতি ঘটেছে। এখন থেকে এখানে আমার আসার আর কোনো কারণ নেই। আজকের পর আর কবে আসবো বা আদেও কখনো আসবো কিনা জানা নেই। এতদিন বাবা অসুস্থ ছিলো, বিছানায় পড়ে ছিলো যেমনি ছিলো কিন্তু বাবা ছিলো তাই বাবার বাড়িও ছিলো কিন্তু আজ আর বাবা নেই তাই আমার বাবার বাড়িও নেই। যেটা আছে এটা এখন তোমাদের বাড়ি। এই পৃথিবীতে বাবার পর তুমি আমাকে সবচেয়ে ভালো বোঝো। তাই আমার অনুরোধ তুমি আমাকে আর যাই বলো এই শূন্য বাড়িটাতে থাকতে বলোনা। আমি পারবো না।

আমি বুঝতে পেরেছি। আমি জোর করবনা তোকে। তুই ফিরে যাস। তবে মাঝে মাঝে এই বাবার মতো চাচাটাকে মনে হলে দেখতে আসিস।
বলেই তিনি সানাতের মাথায় হাত বুলিয়ে উঠতে লাগলেন। সানাত বলে উঠলো,

চাচা তোমার হাতে একটা জিনিস তুলে দেওয়ার ছিলো?

কি?

সানাত উঠে ভেতর গিয়ে ব্যাগ থেকে কিছু একটা বের করে নিয়ে এসে বললো,

এখানে পনেরো হাজার টাকা আছে। বাবার চিকিৎসার জন্য জমিয়েছিলাম। কিন্তু সেটা তো আর লাগলোনা। এখান থেকে আড়াই হাজার টাকা আলিফ কাকার ফার্মেসীতে দিয়ে দিও বাকিতে ওষুধ আনা হয়েছিল। আর শাকিলের ফ্রমফিলাপ আর সাবার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে আমি কিছুই দিতে পারিনি বোন হিসেবে তাই দুই হাজার টাকা দিও ওর হাতে। আর বাকি টাকা বাবার মিলাদে খরচ করো।

শাহআলম সাহেব মলিন হাসলেন। তারপর টাকাটা হাতে নিয়ে বললেন,

অনেক তো করলি বিনিময়ে কি পেলি?

আমি বিনিময়ের আশায় কিছু করিনা চাচা। আমার দায়িত্বের মধ্যে ছিলো এগুলো তাই করেছি।

যাওয়ার সময় রহমান স্টেশন অব্দি ওর সিএনজি দিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসবে।

সানাত মাথা নাড়ালো। এই পুরোটা সময় অন্তিমের দৃষ্টি ছিলো শুধুমাত্র সানাতে।
.
.
বিকাল সাড়ে পাঁচটা। বাড়ির সদর দরজায় অন্তিম সানাত দাঁড়িয়ে বিদায় নিচ্ছে। সাড়ে সাতটায় ট্রেন তাদের। সানাত শাকিলের মাথায় হাত রেখে বললো,

ভালো করে পড়াশোনা করিস। শুধু ক্রিকেট ফুটবল দিয়ে পড়ে থাকিস না। আর যখন যা প্রয়োজন হবে আমাকে জানাবি। কেমন?

শাকিল বোনের দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো,

তুমি আবার কবে আসবে আপু?

সানাত একটু চুপ থেকে বলে উঠলো,

জানিনা। তবে আমার ভাই যদি কখনো নিজের উপার্জনে একটা বাড়ি করে আমি তখন নিশ্চই আসবো। তখন যদি আমার ভাইয়ের বউ আমায় পছন্দ নাও করে আমি তবুও আসবো। বলেই সানাত হাসলো। হাসলো শাকিলও। এরপর সাবা, আত্মীয় স্বজন সকলের থেকেই বিদায় নিয়ে গাড়ীতে উঠে বসলো। তারপর মুহূর্তেই গাড়ি সো সো করে ছুটতে লাগলো। সানাত পেছন ফিরে তাকালো। দু চোখ ভরে দেখে নিলো দাঁড়িয়ে থাকা স্বজনদের মুখ, পরিচিত বাড়িটা, পরিচিত রাস্তাটা। তারপর ফেলে আসলো সকল পিছু টান। গাড়ি অনেকটা দূর যেতেই সানাত আচমকা বলে উঠলো,

রহমান কাকা গাড়িটা একটু থামান।

অন্তিম চমকে উঠে বললো,

কেনো? গাড়ি কেনো থামাবে?

একটু দরকার আছে। একজনের সাথে দেখা করবো। এতদিন পর এলাম আর কবে আসবো জানা নেই আর এতকিছুর মাঝে তাঁর সাথে দেখা করা হয়ে ওঠেনি তাই একটু দেখা করে আসবো। আমি বেশি সময় নেবনা।

এখন তুমি কার সাথে দেখা করবে?

সানাত কিছু বললোনা। সামনে থেকে রহমান নামের লোকটি বলে উঠলো,

পত্তেক বার আইলেই তো যাও। এইবার নাই গ্যালা। আর এমনেও সাঁঝ নাইমা গ্যাছে মা। অন্ধকার হওয়া আইছে। অহন যাইও না। আয়যানের সময় অহন।

আপনিও ভয় পাচ্ছেন কাকা? বলেই মলিন হাসলো সানাত। তারপর নেমে দাড়িয়ে বললো,

আপনি ভয় পাবেননা কাকা। আমি যাচ্ছি আপনারা একটু অপেক্ষা করুন। বলেই সে পা বাড়ালো একটা পুরাতন বাড়ির গেটে। অন্তিম অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
.
.

সানাত এসে দাঁড়িয়ে আছে কাঙ্ক্ষিত জায়গাটির সামনে। শেওলা পরা পুরাতন দেওয়ালে লেখা পারিবারিক কবরস্থান। সানাত দরজাটা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো তারপর সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটির কবরস্থানের সামনে গিয়ে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলোনা। এতক্ষণ ধরে শক্ত, কঠিন খোলসটা মুহূর্তেই ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো। হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো। তারপর বলে উঠলো,

মা! আমি এসেছি দেখো। আজ সব হারিয়ে তোমার কাছে এসেছি মা। আমি বড্ডো ক্লান্ত, বুকটা ভারী হয়ে আছে কিন্তু আমার কথা শোনার মতো কেউ নেই। তাই তোমার কাছে এসেছি একটু হালকা হতে। আজ তোমার কোলের শূন্যতাটা খুব বেশিই অনুভব করছি। তুমি তো জন্মের পরই ছেড়ে চলে গেলে মা আজ বাবাও ছেড়ে চলে গেছে মা। বাবা মায়েরা তো স্বার্থপর হয়না তাহলে তোমরা কেনো হলে মা? কেনো হলে বলতে পারো? এতো বড়ো দুনিয়াটা আমার কাছে নিকৃষ্ট মনে হচ্ছে। আমি আর কার ভরসায় বাঁচবো মা? কার মুখের দিকে তাকিয়ে বাঁচবো? আমার কলিজাটা এতো জ্বলছে কেনো মা? তোমাকে হারানোর ব্যাথা আমি পাইনি। সেই বুঝই আমার হয়নি তখন তুমি ফাঁকি দিয়েছো। কিন্তু বাবা হারানোর যন্ত্রণা এতো কেনো মা? আগে তো বুঝিনি এতো জ্বলে বাবা মা হারালে! এই কষ্ট আমি সহ্য করতে পারছিনা মা। আমাকে কেনো এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে একা ফেলে চলে গেলে মা?এর থেকে তোমার সাথেই নিয়ে যেতে তাহলে আজ এতো অবহেলিত হতাম না আমি। মা ছাড়া পৃথিবীটা বিষের মতো, হজম করা যায়না। তুমি জানো মা তোমার মতন কেউ নয়। মায়ের মতন কেউ হয়না মা আমি আজ বুঝি। তোমাকে আমি দেখিনি মা তবে তোমার বোনকে দেখেছি মা। তারমধ্যে তোমাকে খুঁজে পেতাম। কিন্তু ঐযে সেও মায়ের মতন ছিলো মা নয়। যখন নিজের সন্তানের স্বার্থে ঘা লেগেছে তখন ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। সত্যি মা তুমি তুমিই, তোমার মতন কেউ নয়। আজ যদি তুমি থাকতে তাহলে কি আমায় ছুঁড়ে ফেলতে? ফেলতে না তো। হাজার হলেও বুকে আগলে রাখতে কিন্তু তোমার বোন রাখেনি মা। আজ বাবা মারা গেছে সেই খবর তার কাছে গেছে অথচ সে ফিরেও তাকালো না। তুমি জানো মা আমি তোমার কবর থেকেও মা মা ঘ্রাণ পাই। তোমার সামান্য ভালোবাসা পাওয়ার আফসোস আমার আজন্ম থেকে যাবে। চোখের সামনে যখন অন্যদের মা-বাবার ভালোবাসা পেতে দেখবো আমি কেমন করে সহ্য করবো মা? আমার বুকটা যে খা খা করবে! আমার এতো কষ্ট দেখেও তুমি কি করে ওই অন্ধকার কবরের মাঝে এতো শান্তিতে ঘুমিয়ে আছো মা? তোমার বুকটা কি আমার জন্য একটুও জ্বলেনা? আমার হাহাকার শুনেও কি তোমার ঘুম ভাঙ্গে না? একটুও মায়া হয় না আমার মুখটা দেখে! নাকি তুমিও শ্যাম বর্ণকে কুৎসিত মনে করো? মায়েরা তো নির্দয় না। তাহলে তুমি কি করে এভাবে মায়া কাটিয়ে চলে যেতে পারলে? আমি কার কাছে যাবো মা কেউ নেই আমার। কেউ নেই।

কে বলেছে কেউ নেই?

আচমকা কাধে কারো স্পর্শ আর কণ্ঠ শুনতেই সানাত কান্না থামিয়ে ঘুরে তাকালো। অন্তিম আবারও বলে উঠলো,

আমি আছি সানাত। তোমার পাশেই আছি। দেখো।

আপনি? আপনি কি করে এলেন?

কি করে এসেছি সেটা পরে বলবো। তুমি এখানে বসে এভাবে পাগলের হাউমাউ করে কাঁদছো কেনো সানাত? কি হাল করেছো নিজের একবার দেখেছো? এতোটা বিধ্বস্ত সানাতকে তো আমি কখনো দেখিনি।

আপনার এখানে আসতে ভয় লাগেনি?

ভয় কেনো লাগবে? মায়ের কাছে আসতে ভয় কিসের?

কিন্তু আমার মা তো…

মৃত, তাই তো। মায়েরা জীবিত আর মৃত কি? মা তো মা-ই হয়। মায়েরা জীবিত থাকলেও মা, মারা গেলেও মা। মায়ের কোনো পরিবর্তন নেই।

কিন্তু এটা তো আমার মা।

তোমার আর আমার আবার কি? মা নিয়েও ভাগাভাগি করছো? এদিকে যে আমার পুরো জীবনের ভাগ নিয়ে বসে আছো। আর সামান্য তোমার মা কে মা বলেছি বলে এতো হিংসেমি করছো! আমার মা তো এখন আমার থেকেও তোমাকে বেশি ভালোবাসে কই আমি তো হিংসেমি করিনা।

সানাত বোকার মতো তাকিয়ে আছে। অন্তিম বলতে লাগলো,

দেখেছেন মা আপনার মেয়েটা কি হিংসুটে! আজ আমিও আপনাকে খুব মিস করছি। আপনি থাকলে অন্তত আপনার মেয়েটা এমন হিংসুটে হতো না। ওহ্ শিট! এতক্ষণ ধরে এতো কথা বলছি অথচ নিজের পরিচয়টাই দেইনি।আপনি নিশ্চই আমাকে চিনতে পারেননি। আমি আপনার শ্যামবতী রাজকন্যার রাজকুমার অন্তিম। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ শ্যামবতীকে নিজের প্রাণের বিনিময়ে পৃথিবীতে আনার জন্য। তাকে না পেলে হয়তো জানতেই পারতামনা শ্যাম বর্ণ পৃথিবীর সবথেকে পবিত্র বর্ণ। আর না বুঝতে পারতাম পুরুষ তার প্রথম নারীর কাছে ঠকে আর দ্বিতীয় নারীর কাছে মরে।
এই টুকু বলেই অন্তিম সানাতের চোখে চোখ রাখলো। সেই দৃষ্টিতে কি ছিল জানেনা সানাত। সে শুধু জানে ওই চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা সম্ভব নয়। তাই সে তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।
#চলবে

অতঃপর গল্পটা তোমার আমার পর্ব-১৩

0

#অতঃপর_গল্পটা_তোমার_আমার
#পর্ব-১৩
#হুমায়রা_আঞ্জুম (লেখনীতে)

এই এক সপ্তাহ ভীষণ ব্যস্ততার মাঝে পার করেছে সানাত। ভার্সিটি,টিউশন সামলাতে গিয়ে সে হাপিয়ে উঠেছে। অবশ্য এই সবকিছুর মাঝে এই পরিবারটার অবদান কোনো অংশে কম নয়। সানাত জানেনা অন্য কোনো শ্বশুরবাড়িতে বাড়ির বউকে ঠিক এতোটা স্বাধীনতা দেওয়া হয় কিনা। তবে সে সত্যিই খুব ভাগ্যবতী যে এমন একটা পরিবার পেয়েছে যেখানে তাকে বাড়ির বউয়ের নজরে নয় বরং ওহীর মতোই এ বাড়ির মেয়ের মতো দেখা হয়। তাই তো এখন অব্দি বিয়ের পরে সংসার ঠিক কি তা এখনো জানেনা সানাত। পুরোটাই অন্তিমের মা অর্পিতা আঞ্জুম নিজেই খুশি মনে এক হাতে সামলে নিচ্ছেন। গত দু দিন ধরে সানাতের বাবার শরীরটা খুব একটা ভালো যাচ্ছেনা। কাল সকালে উঠেই ব্যাংকে গিয়ে টাকা পাঠাতে হবে। আগামী দুইদিন ভার্সিটি বন্ধ ভাবতেই সানাত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। সব ভাবনা চিন্তা ফেলে বালিশটা ঠিক করে অন্তিমের পাশেই শুয়ে পড়লো সানাত।
.
রাত তখন তিনটা। আচমকা সানাতের ঘুম ভেঙে যাওয়ায় ধরফরিয়ে উঠে বসলো। হঠাৎ করেই তার খুব অস্থির লাগছে। কেনো লাগছে বুঝতে পারছে না। সেই মুহূর্তে অন্তিমেরও ঘুম ভেঙে গেলো। সানাতকে ওরকম হাপাতে দেখে সে নিজেও তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো। সানাত তখনো জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। তারপর সানাতের কাধে হাত রেখে বললো,

সানাত, আর ইউ ওকে? খারাপ লাগছে? আমাকে বলো।

আমার খুব অস্থির লাগছে অন্তিম। কেনো লাগছে জানিনা। কিন্তু আমার ভেতরে খুব অশান্তি লাগছে।

অন্তিম সাইড টেবিল থেকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বললো,

পানিটা খাও। সানাত আই থিঙ্ক তুমি প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যে ছিলে। ক্লান্ত তাই এমন হচ্ছে।

সানাত পানিটা খেয়ে বসে আছে। কেনো যেনো মনটা খুব অস্থির লাগছে। অন্তিম আবারও বললো,

সানাত আস্তে করে শুয়ে পরো। ঘুমানোর চেষ্টা করো।

আমি আপনাকে ঠিক বোঝাতে পারছিনা আমার ঠিক কেমন অনুভূতি হচ্ছে। আমার তো কখনো এমন হয়না। আজ হঠাৎ এমন কেনো লাগছে। শুধু কেমন যেনো একটা শূন্যতা অনুভব করছি।

অন্তিম কিছু বলতে যাবে তার আগেই সানাতের বালিশের পাশে ফোনটা বেজে উঠলো। সানাত ফোনটা হাতে নিতেই দেখলো শাকিলের ফোন। সানাতের ভেতরটা যেনো তখনই মোচড় দিয়ে উঠলো এক অজানা ভয়ে। ফোনটা রিসিভ করে স্পিকারে দিতেই ও পাশ থেকে শাকিল বলে উঠলো,

হ্যালো আপু!

হ..হ্যালো শাকিল। তুই এতো রাতে ফোন কেনো করেছিস! বাবা ঠিকা আছে?

আপু তুই রওনা হয়ে চলে আয় যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব।

হুট করেই সানাতের চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো দুই ফোঁটা নোনতা জল। কোনরকমে নিজেকে সামলে বললো,

বাবার কি অবস্থা খুব খারাপ? তাহলে হাসপাতাল নে । আমি টাকা নিয়ে আসছি।

টাকা আনতে হবেনা আপু। তুমি শুধু চলে আসো। বলেই কল কেটে দিলো শাকিল। সানাতের চোখ বেয়ে শুধু গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। পাশ থেকে অন্তিম সানাতের হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে উঠলো,

তাড়াতাড়ি রেডি হও সানাত। আমরা এখনি বের হবো। কান্নাকাটি করো না প্লীজ। আমি আছি।বলেই নিজেও তৈরি হতে চলে গেলো।

🌻
ভোর পাঁচটার টিকেটের বাসে উঠেছে সানাত আর অন্তিম। সকাল সাড়ে ছয়টার ট্রেনে আসছে অন্তিমের বাবা ওয়ালিদ আহসান। সানাত কোনো মতে সালওয়ার কামিজ পাল্টে একটা হালকা বেগুনি রঙের সুতি শাড়ি পরে একটা খোঁপা করেই চলে এসেছে। সানাত জানালার ধারের সিটে বসে আছে। অন্তিম তার পাশেই চুপচাপ বসে আছে। সে উঠে এসে জানালা লাগিয়ে দিয়ে বললো,

বাইরে ঠান্ডা বাতাস বইছে। ঠান্ডা লেগে যাবে।
.
.
দুপুর একটা। সানাত আর অন্তিম সিএনজি তে বসে আছে। পুরো রাস্তায় সানাত একটা কথাও বলেনি। কিছু সময় পর সিএনজি এসে থামলো নির্দিষ্ট গন্তব্যে। অন্তিম আর সানাত নেমে দাড়ালো। বাড়িটার সামনে আজ প্রচন্ড ভীড়। গ্রামের মানুষ জন আসছে যাচ্ছে। সানাত আর অন্তিম কারোরই বুঝতে বাকি নেই ভেতরে আজ কি হয়েছে। অন্তিম ভাড়া মিটিয়ে সানাতের দিকে তাকাতেই দেখলো সে এগিয়ে যাচ্ছে। অন্তিমও সানাতের পিছু পিছু এগিয়ে গেলো। খোলা উঠোনে আজ মানুষের ভীড় জমেছে। ভেতর থেকে কান্নাকাটির আওয়াজ ভেসে আসছে। সানাত ভীড় ঠেলে উঠোনের যথাস্থানে পা রাখতেই রক্তশূন্য চোখে তাকিয়ে রইলো সামনের খাটিয়াতে রাখা সাদা কাফনে ঢাকা লাশের দিকে। আজ বাবার চিকিৎসার তাগিদে সানাতের ক্রমশ সংগ্রাম করার লড়াইটা থেমে গেলো। সানাতকে দেখেই ছুটে আসলো ছোটো ভাই শাকিল। সানাত ভাইয়ের মাথায় হাত রেখে বললো,

কখন হলো এসব?

শাকিল অসহায় বোনের নিষ্প্রাণ চোখ দুটো দেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো। তারপর বললো,

রাত আড়াইটায়।

ওহ।
বলেই সানাত এগিয়ে গিয়ে খাটিয়াটা ধরে ধপ করে বসে পড়লো মাটিতে। তারপর কাপা কাপা হাতে মুখের ওপর থেকে ঢেকে রাখা কাপড়টা সরিয়ে নিষ্প্রাণ চোখে তাকিয়ে রইলো জন্মদাতা পিতার সেই সুন্দর মুখখানার পানে। যে বাবাকে ঘিরে তার শৈশব থেকে বেড়ে ওঠা, যার কাছে শৈশবের সকল বায়না, আবদার, যে ছিলো তার কাছে তার সুপার ম্যান, একটা ভরসার জায়গা, যতো যাই হোক না কেনো বাবা আছে সেই বিশ্বাসের জায়গা, তার মাথার ওপরে থাকা বটগাছ, যার ছায়াতলে সকল ক্লান্তি দূর হয়ে যেতো, সব থেকে নিরাপদ একটা আশ্রয়, এমন একটা মানুষ যে কিনা নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসেছিলো আজ সে মানুষটাও এতো মায়া ছেড়ে একলা ফেলে স্বার্থপরের মতো চলে গেলো। একটা বারও পিছু ফিরে দেখলো না তার সানাতটা ঠিক কতোটা অসহায়! কাল রাত অব্দি বাবা ছিলো তবে আজ আর নেই। এই নেই কথাটা মানতে যেনো সানাতের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। তার বয়সী মেয়েরা তো এই বয়সে বাবা মায়ের আদরে আহ্লাদে ভরপুর থাকে, তাদের পুরো পৃথিবীটা জুড়েই থাকে তাদের বাবা মা। বাবা মা কে চাইলেই জড়িয়ে ধরতে পারে, মনের কথা বলতে পারে। কতো সুখী তারা! এই যেমন ওহী।অথচ এই বয়সেই সানাত মা বাবা হারা এতিম মেয়ে। জীবনের শুরুতেই সে এতিম। কেনো তার জীবনটা আর পাঁচটা মেয়ের মত স্বাভাবিক হলোনা? জীবনটা কেনো এতো জটিল হয়ে গেলো? বেঁচে থাকাটাই যেনো দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্তিম সানাতের দিকে তাকিয়ে আছে। সে আজকের সানাতকে দেখে অবাক না হয়ে পারছেনা। কারণ যে সানাত কথায় কথায় কেঁদে ফেলে সেই সানাত আজ এতটা শক্ত কি করে? সানাতের জায়গায় নিজেকে দাঁড় করাতেই যেনো অন্তিমের দম বন্ধ হয়ে আসে। তাহলে সানাত কি করে এতো শক্ত হয়ে আছে? ঘরের ভেতর থেকে সানাতের সৎ মা রুমানা বেগম বের হয়ে এসে দাঁড়ালেন। তারপর সেই মুহূর্তেও তিনি সানাতকে খোটা দিতে বলে উঠলেন,

আইলি ক্যান তুই? নাই আইতি। যহন ট্যাকা পাঠানোর কতা তহন তুই পাঠাইবার পারছ নাই। তইলে অহন আইছস ক্যান? বাপের লইগা দরদ দ্যাহাইতে আইছস? তোর লইগা আমি বিদুবা হইছি, আমার পুলাপান এতিম হইছে। অলক্ষ্মী, সর্বনাশী।

সানাত কিছুই বললো না। শুধু শুনে গেলো। কারণ এসব কিছু তার কাছে নতুন নয়, অভ্যস্থ সে এসবে। কিন্তু অন্তিম সহ্য করতে পারলোনা। সে বলে উঠলো,

এসব কোন ব্যবহার করছেন আপনি ওর সাথে? এরকম একটা সময়েও আপনি ওকে কথা শোনাতে ছাড়ছেন না!

আননি কেডায়? আর অর হয় কতা কইতাছেন ক্যান?

আমি সানাতের স্বামী। তাই আমার স্ত্রীর সাথে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আপনি যা নয় তাই বলে অপমান করবেন সেটা আমি মোটেও সহ্য করবো না। বিয়ের আগে কি করেছেন না করেছেন আমি জানিনা। তবে এখন সানাত শুধুমাত্র এই বাড়ির মেয়ে নয় তাঁর আরেকটা পরিচয় আছে সে আমার বিয়ে করা স্ত্রী। তাই ভদ্র ভাবে কথা বলবেন।

রুমানা বেগম দমে গেলেন অন্তিমের হুমকিতে। আর দেখেও বুঝতে পেরেছেন কোনো বড়লোক বাড়ির ছেলে তাই আর কথা বাড়ালেন না। সানাতের পাশেই দাড়িয়ে আছে তাঁর ছোটো চাচা শাহআলম। তিনি বেশ শিক্ষিত একজন ভদ্রলোক। অন্তিমের কথায় তিনিও সহমত পোষণ করেছেন। সানাত তার চাচা শাহআলমকে উদ্দেশ্য করে বললো,

জানাজা কয়টায় চাচা?

যোহরের নামাজের পর মা।

ওহ। একটু অপেক্ষা করতে পারবেন আমার শশুর আসছেন।

কতক্ষন লাগবে বলতে পারবি?

ঘন্টা খানেকের মধ্যেই চলে আসবে চাচা।

আচ্ছা মা।
.
.
অন্তিমের বাবা এসে উপস্থিত হয়েছেন। জানাজার জন্য নিয়ে যাওয়া হবে এখন। সানাত খাটিয়ার পাশে ঠায় বসে আছে। মেয়েটা এক ফোঁটাও কাঁদেনি। সানাতের চাচা শাহআলম সানাতকে ধরে বললেন,

এবার ছাড় মা। নিয়ে যেতে হবে আমাদের। সময় হয়ে গেছে অনেক।

সানাত নিস্তেজ গলায় বললো,

নিয়ে যাবেন এখনি?

হ্যাঁ মা। এবার বাবাকে ছাড় মা।

আমার বাবাকে আরেকটু রাখা যায়না চাচা? এতো তাড়া কেনো? আরেকটু থাকুক না নিজের বাড়ির উঠোনে আলো বাতাসের মাঝে, আমার সাথে। একটু পর তো ওই অন্ধকার কবরেই থাকবে।

এরকম বোকার মতো কথা তো তোকে সাজে না মা। আমার জানা মতে তুই তো খুব স্ট্রং মেয়ে। তাহলে এমন বোকার মতো কথা কেনো বলছিস বলো। বাবাকে যেতে দে।

আমার বাবাকে কোথায় কবর দেবেন চাচা? আমার মায়ের পাশে?

তোর মায়ের কবর তো তোর নানার বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে। সেখান কি করে দেই? তাই আমাদের এখানেই দেবো।

ওহ্।

এবার তাহলে নিয়ে যেতে দে।

নিয়ে যান। বলেই গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো নোনা জল। সানাতের সৎ বোন সাবাও কাদঁছে বাবার খাটিয়া ধরে। নিয়ে যাওয়ার সময় অন্তিমও কাধে নিলো খাটিয়া। আর সানাত নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলো বাবার শেষ যাত্রার দিকে। ঠিক যতদূর পর্যন্ত দেখা গেলো সে তাকিয়ে থাকলো। তার কারণ এরপর ইহকালে আর এই বাবার দেখা পাবেনা কখনো।
.
.

দাফনের কাজ শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ। সানাত উঠোনে একটা চেয়ারে বসে আছে। অন্তিম এসে পাশে বসলো। সানাতকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা তার কাছে নেই। তবে যেভাবেই হোক সানাতকে তার স্বাভাবিক করতে হবে নাহলে সানাত মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বে। সানাতের বড় চাচী মানসুরা বেগম এসে বললেন,

সানাত ঘরে যা মা। কতক্ষন ধইরা এইনো বইয়া রইছস। ঘরে যাইয়া একটু ব। এমনে থাকলে অসুস্থ হইয়া পড়বি। যা।

সানাতের ছোটো চাঁচা শাহআলম তিনিও এসে বললেন,

হ্যাঁ যা মা ঘরে যা। সকালে ভাইয়ের মিলাদ নিয়ে আলোচনা করবো।

আমি সকালে থাকবো না চাচা।

সানাতের এমন কথায় অবাক হয়ে গেলো উপস্থিত সকলে এমনকি অন্তিম নিজেও।
#চলবে

অতঃপর গল্পটা তোমার আমার পর্ব-১২

0

#অতঃপর_গল্পটা_তোমার_আমার
#পর্ব-১২
#হুমায়রা_আঞ্জুম (লেখনীতে)

আজ সকাল থেকে একবারও অন্তিমের সামনে পরেনি সানাত। কাল রাতের ঘটনার পর থেকে লজ্জায় বেশ সাবধানে এড়িয়ে চলছে সে অন্তিমকে। আজ অন্তিমের ভার্সিটিতে চাকরির প্রথম দিন। তার যাওয়ার সময়ও সানাত ইচ্ছে করে সামনে আসেনি। আর এর মধ্যে ওহী সকাল থেকেই তারদিকে বাজপাখির নজরে তাকিয়ে আছে। সানাত ওহীকে নিয়ে খুব ভয়ে আছে। এই মেয়ে যদি একবার গতকাল রাতের ঘটনা ঘুণাক্ষরেও আঁচ করতে পারে তাহলে আর সমাজে মুখ দেখাতে হবে না।
ভার্সিটিতে ক্লাসে অলস হয়ে বসে আছে সানাত। এই মুহূর্তে ক্লাসে কোনো টিচার নেই। শুনেছে তাদের লেকচারার স্যার নাকি অসুস্থ তাই কিছুদিন ছুটিতে আছেন তাই আজকে ক্লাসটা বোধয় হবে না। এদিকে এই খবর শুনে আকাশে বাতাসে উড়ছে ওহী। সে এই চান্সে একটু প্রেমকথন আদান-প্রদান করবে তার প্রেমিক মানুষটার সাথে। এদিকে ওহীর কাণ্ড থেকে সানাত মহা বিরক্ত। সে ভেবেই পায়না প্রেমে পড়লে এতো নাচার কি আছে! কই সেও তো প্রেমে পড়েছে, গভীর ভাবে প্রেমে পড়েছে কিন্তু সে তো এই মেয়ের মতো লাফায়নি। এই মেয়ে বড্ডো আজব! আজ সানাতরা বসেছে একদম পেছনের দিকে। আর তার পাশের সারিতে তার বরাবর বসেছে আলভী। একটু পরপরই তার দিকে তাকাচ্ছে আর এটা সেটা বলছে সানাতকে। সানাত এর প্রতিও বেশ বিরক্ত। তার এই একরাশ বিরক্তির মাঝে হঠাৎ তাদের ডিপার্টমেন্টের একজন প্রফেসর স্যার এসে উপস্থিত হলেন। তৎক্ষণাৎ সকলে উঠে দাঁড়ালো। ওহী তখনও চ্যাটিং করতে ব্যস্ত। সানাত কনুই দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বললো,

এই ফাজিল। পরে চ্যাটিং করিস। প্রফেসর স্যার এসেছে এখন ফোন রাখ।

ওহী বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করে মধ্যবয়স্ক লোকটিকে কিছু গালাগাল দিয়ে ফোন ব্যাগে রেখে দিলো। সকলের উদ্দেশ্যে প্রফেসর ড এ এম আসাদুজ্জামান বলে উঠলেন,

তোমরা সকলেই জানো তোমাদের লেকচারার তন্ময় স্যার বেশ কিছুদিন ধরে একটু শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। তাই উনি কিছুদিন ছুটিতে আছেন। তাই ওনার পরিবর্তে আজ থেকে একজন নতুন লেকচারার স্যার তোমাদের এই ক্লাসটা নেবেন কিছুদিন।

সানাতের বিন্দু পরিমাণ কোনো মনোযোগ নেই ক্লাসে। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দাঁত দিয়ে নখ কাটছে। ওহী বার বার হাম তুলছে। সেও বেশ বোরিং। তাদের এই সকল বিরক্তির মধ্যে প্রফেসর স্যার বলে উঠলেন,

স্যার আপনি ভেতরে আসুন।

তৎক্ষণাৎ একজন নতুন লেকচারার এসে উপস্থিত হয় ক্লাসের মাঝে। সানাতের তখনও মনোযোগ নেই। প্রফেসর পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য বলে উঠলেন,

ইনি হচ্ছেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের তোমাদের সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টের নতুন লেকচারার জনাব অন্তিম আহসান। প্রথমে খেয়াল না করলেও একটুপরই চিরচেনা নামটা কানে পৌঁছাতেই সানাত চোখ তুলে সামনে তাকালো। আর তৎক্ষণাৎ সে সবথেকে বড়ো ধাক্কাটা খেলো। কোনো রিয়াকশন দেওয়ার কথাও সে বেমালুম ভুলে গেলো। সে আদেও কোনো ঘোরের মাঝে আছে কিনা তা ঠিক বুঝতে পারছেনা। তাই ওহীর বাহু ধরে ঝাকি দিয়ে বললো,

এই ওহী!

ওহী রোবটের মত সামনের দিকে তাকিয়ে বললো,

হুঁ বল ।

বলছি আমি যা দেখছি তুইও কি তাই দেখছিস?

তুই যা দেখছিস আমিও তাই দেখছি।

কি দেখছিস?

মীর জাফরকে।

কিহহ! মীর জাফর! ওই ব্যাটা তো কোন কালেই মরে গেছে তুই তাকে দেখিস কিভাবে? গা*জা খাইছিস?

মনে হয় এক কেজি খাইছিলাম। তুই কাকে দেখতেছিস সেটা বল?

আমি তো তোর ভাইরে দেখতেছি। কিন্তু তুই কেমনে মীর জাফররে দেখস?

ওরে ছাগল! আমার ভাই মীর জাফরের চেয়ে কম কিছু! কতো বড়ো বেঈমান হইলে মানুষ একবার নিজের বোনরে বলেনা তার কথায় চাকরি হইছে! তুই ভাবতে পারতেছিস কতো বড়ো শয়তান হইলে আমাদের ভার্সিটিতেই জয়েন করে অথচ আমাদের বলেনা। হ্যাঁ রে তুইও কি এই মাত্র আমার মতো জানলি নাকি তোকে তোর জামাই আগেই বলছে? আর তারপর জামাইর সাথে মিলা ঘসেটি বেগমের মতো আমার সাথে বেইমানি করলি?

তুই থামবি! তোর ভাই কি আমার ধার ধারে যে আমাকে বলবে! আমিও তোর মত এখনি জানতে পারছি।

বিশ্বাস কর দোস্ত ওরে আমার নিজের ভাই বইলা পরিচয় দিতে কিডনি, লিভার, পাকস্থলীতে বাঁধতেছে!

ওহীর এমন স্টুপিড মার্কা কথা শুনে সানাত ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললো,

কি? কিডনি, লিভার, পাকস্থলীতে বাঁধে মানে?

ওরে হারামজাদি তোর জামাই আমার সব আশায় এক বালতি পানি ঢেলে দিলো রে! আমার সব স্বপ্ন শেষ রে! বলেই ন্যাকা কান্নার ঢং ধরলো।

সানাত বিরক্ত হয়ে বললো,

এই কিসব বলছিস এসব? আর আমার জামাই আমার জামাই করতেছিস কেন তোর কি কিছু হয়না? আর কি করছে আমার জামাই তোর?

আমি কতো স্বপ্ন দেখছিলাম ভার্সিটির নামে রাদিফের সাথে ঘুরতে যাবো, চুটিয়ে প্রেম করবো কিন্তু তোর শয়তান জামাইয়ের কারণে এখন আর সম্ভব না। সিসি ক্যামেরার মতো আমার পিছনে লেগে থাকবে। ভাল্লাগেনা!

সামনে থেকে দাড়িয়ে পেছনে সানাত আর ওহীর সব কাণ্ড দেখছে অন্তিম। মনে মনে বলছে বেয়াদব দুটোর এখানেও এক দন্ড ভদ্রতা নেই। এই মুহূর্তে তার ইচ্ছে হচ্ছে দুটোর গালে কষিয়ে দুটো থাপ্পড় মারতে। ফাজিল কোথাকার!

🌻
ক্লাস চলছে। সামনে অন্তিম একটা ইম্পর্ট্যান্ট টপিক নিয়ে আলোচনা করছে। এদিকে পেছনে আলভী বারবার সানাতকে ডিস্টার্ব করে যাচ্ছে। সানাত শুনেও না শুনার ভান করছে। আলভী আবারও ডেকে উঠলো,

এই সানাত?

সানাত এবার বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে বললো,

কি হয়েছে আলভী? ডাকছো কেনো বারবার?

একটু কথা ছিল সানাত?

কিসের কথা? দেখছো না ক্লাস হচ্ছে।

তোমার জন্য একটা জিনিস এনেছি সানাত।

কি জিনিস?

দাড়াও দেখাচ্ছি।

না না এখন না ক্লাস শেষ হোক। পরে দেখবো…

এই যে পেছনের ব্যাকবেঞ্চার? অন্তিমের আচমকা ডাকে থেমে গেলো সানাত। অন্তিম আবারও বললো,

শেষের বেঞ্চের লেফট সাইডে যে বসে আছো তোমাকে বলছি। স্ট্যান্ড আপ!

সানাত আশেপাশে একবার তাকিয়ে সন্ধিহান গলায় বললো,

স্যার আমি?

জ্বি তুমি । স্ট্যান্ড আপ।

সানাত উঠে দাঁড়ালো। তারপর অন্তিম বললো,

নাম কি?

সানাত যেনো ধপাস করে মাটিতে পড়লো এমন প্রশ্ন শুনে। তার নাম কি মানে? এই লোক কি তার সাথে মশকরা করছে?

কি ব্যাপার আন্সার মি। নাম কি?

জ..জ্বি সানাত।

ওহ। আমি তোমাকে অনেকক্ষন ধরেই নোটিস করছি তুমি পেছনে বসে সাইড টক করছো। যেটা আমার ক্লাসে আমার একেবারেই অপছন্দের একটা কাজ। আমার ক্লাস ভালো না লাগলে বেড়িয়ে যাও। কিন্তু ক্লাসে বসে আমাকে ডিস্টার্ব করো না। এতো ম্যাচুয়েড হয়ে গেছো অথচ এই টুকু কমনসেন্স নেই যে নতুন টিচার আসলে তার সাথে ঠিক কেমন বিহেভিয়ার করা উচিত ?

স্যার আমি আসলে জাস্ট…

আমি তোমার কোনো কথা শুনতে চাইনা। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো।

সানাতের এই মুহূর্তে ভয়ংকর রাগ হচ্ছে। প্রথমত আলভীর ওপর তারপর অন্তিমের ওপর। এই লোক কালকে তার সুযোগ নিয়ে ওসব করে এখন এমন একটা হাভভাব দেখাচ্ছে যেনো কিচ্ছু হয়ইনি কাল। আর এখন দেখ এখানে এসে কিভাবে টিচরগীরি করছে। অসহ্য ! আর তখন তাঁকে কি বলে সম্মোধন করলো ব্যাকবেঞ্চার! সে একদিন বাধ্য হয়ে পেছনে বসেছে বলে সে ব্যাকবেঞ্চার হয়ে গেলো! এতো বড়ো অপমান! দেখে নেবে সে!

টানা ৪০ মিনিট দাড়িয়ে থেকে সানাতের পায়ের অবস্থা কাহিল। অন্তিম পেছনে গিয়ে সানাতের পাশাপাশি দাড়িয়ে থেকে তারপর সানাতকে অতিক্রম করতে করতে ফিসফিসিয়ে বললো,

কাল রাতে কি বলেছি মনে নেই? আলভী বা অন্য কোনো ছেলের সাথে দেখলে খুন করে ফেলবো। আর হ্যাঁ এটা ভার্সিটি, এখানে আমাদের সম্পর্ক জাস্ট প্রফেশনাল। বাইরে আমাদের সম্পর্ক যাই থাকুক না কেনো সেটা যেনো ভার্সিটিতে পাবলিশ না হয়। ওকেহ?

সানাত শুধু হাবার মতো মাথা কাত করে সায় জানিয়ে গেলো। এরপর ক্লাস শেষ হলে অন্তিম বেরিয়ে যেতেই সামনের বেঞ্চ থেকে কিছু মেয়ে বলাবলি করছে অন্তিমকে নিয়ে। তাদের মধ্যে একজন বলছে,

দেখেছিস নতুন লেকচারার স্যারটা দারুন না? যেমন হ্যান্ডসাম তেমনি পার্সোনালিটি। আমি তো পুরা ক্রাশ খাইছি রে।

তার পাশ থেকে আরেকজন বলছে,

পুরাই আগুন স্যার।

সানাত মুহূর্তেই জ্বলে উঠলো। কতবড় সাহস তার স্বামীর দিকে নজর দেয়! এদের তো ঝাটা পেটা করে বিদেয় করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সে নিরুপায়।
#চলবে

অতঃপর গল্পটা তোমার আমার পর্ব-১১

0

#অতঃপর_গল্পটা_তোমার_আমার
#পর্ব-১১
#হুমায়রা_আঞ্জুম (লেখনীতে)

সন্ধ্যাবেলা,
অন্তিম নিজের রুমে বসে ল্যাপটপে কিছু কাজ করছে। এরই মধ্যে সানাতের ফোনে বেশ কয়েকবার রিং বেজে উঠেছে। কেউ কল করছে। কিন্তু সানাত ঘরে নেই। সে ওহী আর অর্পিতা আঞ্জুমের সাথে ড্রয়িং রুমে আড্ডা দিচ্ছে। আবারও ফোন বেজে উঠলে অন্তিম সানাতকে ডাক দেয়,

সানাত ! তোমার ফোন বাজছে।

কিন্তু সানাতের কোনো পাত্তা নেই। অন্তিম বিরক্ত হয়ে নিজেই ফোন রিসিভ করতে উঠলো। ফোন হাতে নিতেই দেখলো আলভী কল করেছে। মুহূর্তেই অন্তিমের মেজাজটা বিগড়ে গেলো। সে সোজা কেটে দিলো। তারপর আবারও নিজের কাজ করতে বসলো।

কিছুক্ষনপর,
আপনি আমায় ডেকেছিলেন? বললো সানাত।

অন্তিম ল্যাপটপে দৃষ্টি রেখেই বললো,

হুঁ।

কেনো ডেকেছিলেন।

কল এসেছিল।

কে ফোন করেছে?

জানিনা। দেখে নেও।

সানাত ফোন হাতে নিয়ে কললিস্ট দেখে বললো,

আলভী কল করেছিলো।

খুব ভালো। এতো রাতে একটা বাইরের ছেলে তোমাকে কল করছে। অসাধারণ বিষয়।

এতো রাত কোথায় হলো? মাত্রতো আটটা বাজে।

অন্তিম ল্যাপটপটা বন্ধ করে বললো,

হ্যাঁ হ্যাঁ। বাইরের ছেলের জন্য দিন আর রাত আছে নাকি তুমি তো সবসময়ই ফ্রি।

এসব কি বাজে কথা বলছেন আপনি?

অন্তিম কিছু বলতে যাবে তার আগেই আবারও কল বেজে উঠলো। অন্তিম সানাতের দিকে তাকিয়ে বললো,

আবার কার ফোন?

সানাত ধীর গলায় বললো,

আলভী।

অন্তিম চোয়াল শক্ত করে বললো,

রিসিভ করে স্পিকারে দেও।

সানাত রিসিভ করে স্পিকারে দিতেই ওপাশ থেকে আলভী বললো,

হ্যালো সানাত!

সানাত একবার অন্তিমের দিকে তাকিয়ে তারপর বললো,

হ্যাঁ বলো আলভী।

তুমি কোথায় ছিলে সানাত কতবার কল করেছি! শেষের বার কেটে দিলে।

সানাত তৎক্ষণাৎ অন্তিমের দিকে তাকালো। তার বুঝতে বাকি নেই তার অনুপ্থিতিতে এই কাজ কার। ওপাশ থেকে আলভী বলে উঠলো,

আচ্ছা বাদ দেও। কি করছো?

কিছুনা। বসে আছি।

তারমানে তুমি এখন ফ্রি?

তুমি হঠাৎ এই সময় ফোন করেছো কেনো সেটা বলো।

খুব বোরিং ফিল করছিলাম। তাই ভাবলাম তোমার সাথে সময় কাটাই।

অন্তিম চোখ মুখ শক্ত করে শুধু শুনছে।

আসলে আলভী আমি একটু ব্যস্ত আছি।

কিন্তু তুমিই তো এই মাত্র বললে তুমি বসে আছো!

হ্যাঁ বসে আছি কিন্তু হাতে অনেক কাজ নিয়ে বসে আছি।

ওহ্। আচ্ছা সমস্যা নেই তুমি কাজ করতে করতে আমার সাথে কথা বলো।

অন্তিম এবার মুহূর্তেই সানাতের হাত থেকে থাবা মেরে ফোনটা নিয়ে বললো,

সানাত ব্যস্ত আছে। আর তোমার টাইমপাস করতে হলে অন্য কোথাও গিয়ে করো ওকে ডিস্টার্ব করবেনা।
বলেই কেটে দিলো। তারপর সানাতের দিকে গরম দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে গেলো। আর এদিকে সানাত ঠায় দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো,
এর আবার হলোটা কি হঠাৎ?

🌻
ঘড়ির কাঁটায় রাত ১২ টা। অন্তিম বিরক্ত হয়ে পুরো ঘরময় পায়চারি করছে। তার বিরক্তির কারণ সানাত এখনো রুমে আসেনি। পাশের রুম থেকে ওহী আর সানাতের হাসাহাসির শব্দে রুমে টিকে থাকা মুশকিল। অন্তিম আর অপেক্ষা না করে পা বাড়ালো ওহীর রুমে।

এই ওহী এতো রাতে কি শুরু করেছিস ?

অন্তিমের ধমকে সানাত ওহী দুজনেরই হাসিই থেমে গেলো। তারপর ফিরে তাকালো অন্তিমের দিকে। ওহী বলে উঠলো,

আমরা আবার কি শুরু করেছি?

তোদের হাসাহাসির যন্ত্রণায় আমি আমার রুমে টিকতে পারছিনা। আর সানাত রাত ১২ টা বাজে তুমি এখনও ওহীর সাথে ওর রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছ কেনো? ঘরে এসো।

আমি আজকে ওহীর সাথে শোবো। আপনি গিয়ে শুয়ে পড়ুন।

হোয়াট? তুমি এখানে ঘুমাবে মানে?

হ্যাঁ আজকে সানাত আমার সাথে ঘুমাবে। আমরা দুই বেস্টু একসাথে শোবো। তুমি যাও ভাইয়া।

অসম্ভব। সানাত রুমে এসো।

না। আমি আজকে ওহীর সাথেই শোবো। আপনি যান তো।

জেদ করো না সানাত। চুপচাপ আমার সাথে চলো।

না যাবেনা ও। তুমি যাও।

চুপ কর ওহী। সানাত তোমার না মাথা ব্যথা করছিল। ওহীর সাথে থাকলে ও তোমার মাথা ব্যথা বকবক করে আরো বাড়িয়ে দেবে তার চেয়ে বরং ঘরে চলো।

আমার মাথা ব্যথা নিয়ে আপনার ভাবতে হবেনা। আমি এখানেই আজকে ঘুমাবো।

সানাত এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে।

বাড়াবাড়ি তুমি করছো ভাইয়া। দাঁড়াও আব্বু আম্মুকে ডাকছি। তারপর বলছি।

ওহী একদম না।

আম্মু…

আচ্ছা আমি যাচ্ছি। বলেই অন্তিম রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেলো। এদিকে ওহী আর সানাত হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। অন্তিম ঘরে এসে শব্দ করে দরজা বন্ধ করলো। বোঝানোর চেষ্টা করলো যে সে রেগে আছে। এই মুহূর্তে তার সানাতকে কষিয়ে দুটো থাপ্পড় লাগাতে ইচ্ছে করছে। বেয়াদব মেয়ে জেদ দেখিয়ে ওহীর সাথে থেকে গেলো। আর সবথেকে বেশি রাগ তো এখন অন্তিমের নিজের বোনের ওপর হচ্ছে। এটা বোন না শত্রু! এই দুই বান্ধবীর গলায় গলায় ভাব অন্তিমও দেখে ছাড়বে। আজকে রাতে তো সে কিছুতেই ওদের একসাথে থাকতে দেবে না। তাই কিছু একটা ভাবতে লাগলো। কিছু ভাবতেই সে আবার ছুটে গেলো ওহীর রুমে। দরজায় নক করতেই দরজা খুললো সানাত,

একি আপনি আবার?

হ্যাঁ একটু দরকার ছিল।

কি দরকার ?

আমার এ্যারপডস্ খুঁজে পাচ্ছি না।

আপনার ড্রয়ারেই তো রাখা আছে।

দেখেছি নেই।

তাহলে বালিশের নিচে দেখুন।

ওখানেও নেই।

তাহলে আমি জানিনা।

সানাত একটু খুঁজে দিয়ে যাওনা প্লীজ। আমার খুব প্রয়োজন।

না না সানাত পারবেনা। তোমারটা তুমি খুঁজে নেও ভাইয়া। সানাত আমার সাথে ব্যস্ত।

অন্তিম ক্ষেপে গিয়ে বললো,

একদম চুপ থাক। ফাজিল মেয়ে। যতসব উটকো ঝামেলা।

কিহহহ আমি উটকো ঝামেলা!

অন্তিম ওহীর কথায় পাত্তা না দিয়ে সানাতের হাত ধরে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। এদিকে ওহী ভাইয়ের এই পজেশিভ লুক দেখে মিটিমিটি হাসছে।
.

সানাত ড্রয়ার খুলতেই দেখলো এ্যারপডস্ ভেতরে। সে বের করে নিয়ে অন্তিমের হাতে দিয়ে বললো,

এই যে আপনার এ্যারপডস্। আমি তো ঠিকই পেয়ে গেলাম। আপনি খুঁজেছেন ঠিক মতো?

অন্তিম এ্যারপডস্টা খাটের উপর রেখে দরজা লক করে দিলো।

একি আপনি দরজা লাগলেন কেনো? আমি যাবো তো।

ওহীর রুমে আর তোমার যাওয়া হচ্ছেনা। চুপচাপ নিজের রুমে শুয়ে পরো। ওর সাথে ঘুমালে সারারাত আর ঘুম হবেনা। তোমার মাথায় শয়তানি বুদ্ধি ভরে দেবে। আমি তোমার ভালোর জন্যই বলছি।

সানাত রেগে বলে উঠলো,
আমার ভালো নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবেনা। আপনি আমাকে মিথ্যে বলে নিয়ে এসেছেন।

হ্যাঁ নিয়ে এসেছি। বেশ করেছি। ওর রুমে তোমার কি হ্যাঁ? সারাদিন তো একসাথেই থাকো তারপরও রাতের বেলা কিসের এতো গল্প? যতো গল্প আছে পেটের মধ্যে জমিয়ে রাখো। সকালবেলা উঠে ওকে বলো। এখন ঘুমাও আমার ঘুম পাচ্ছে। তারপর ওহীর উদ্দেশ্যে জোরে বললো অন্তিম,

গুড নাইট ওহী।
তারপর হেসে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। সানাত কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সেও রাগে গজগজ করতে করতে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। এই তিনমাসে সানাতের বিছানাও পরিবর্তন হয়েছে। সে আর অন্তিম একই খাটে শোয়। তবে তাদের মাঝে ব্যারিকেড হিসেবে কাজ করে একটা কোলবালিশ। দুইজনেই দুইপাশে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে আছে। অন্তিম একবার মাথা ঘুরিয়ে দেখলো সানাত উল্টো দিকে ঘুরে ফোন টিপছে। অন্তিমও নিজের ফোনটা বের করে সানাতকে ম্যাসেঞ্জারে টেক্সট করলো,

“সানাত”

সানাত সিন করলো। তারপর সে লিখে পাঠালো,

“কি ব্যাপার আপনি পাশে শুয়ে ম্যাসেজ দিচ্ছেন কেনো? এসবের মানে কি?”

“মানে কিছুইনা। কিন্তু তুমি এখনও অনলাইনে কেনো?”

“তাতে আপনার কি?”

“আমার কি মানে? অনলাইনে কি করছো তুমি?”

“চ্যাটিং করছি।”

“কার সাথে?”

“আমার প্রেমিকের সাথে।” এটা পাঠিয়েই সানাত মিটিমিটি হাসছে। তবে আচমকাই অন্তিম তাকে টান দিয়ে সোজা করে শুইয়ে সানাতের ওপর ভর দিয়ে সানাতের এক হাত বিছানার সাথে চেপে ধরলো। সানাত মুহূর্তেই ঘাবড়ে গেলো। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের সোডিয়াম হলুদাভ আলো জানালা দিয়ে আসায় রুমে প্রায় মোটামুটি সবকিছুই স্পষ্ট। কৃত্রিম আলোতে অন্তিমের অবয়বটাও স্পষ্ট নিজের মুখের খুব কাছে দেখতে পেলো সানাত। অন্তিমের নাকটা তার নাকের ছুঁইছুঁই দূরত্বে আছে। এই প্রথম এতোটা কাছে তারা। সানাতের ভেতরে এক অদ্ভুত অনুভূতিরা আন্দোলন করছে। অন্তিম চোয়াল শক্ত করে বললো,

কি বললি তুই প্রেমিকের সাথে কথা বলছিস? ওই আলভির সাথে কথা বলছিস তুই?তোকে আর তোর প্রেমিককে পুতে ফেলবো।

সানাত নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না অন্তিম তার সাথে তুই-তোকারি করছে! তারপর ব্যথাতুর গলায় বললো,

আ..আমার লাগছে!

লাগুক। ওই আলভীর সাথে যদি তোকে আর দেখেছি খুন করে ফেলবো।
বলেই অন্তিম এই প্রথমবার সবথেকে অদ্ভুত কাজটা করে ফেললো। আচমকাই সে সানাতের ঠোঁটের মাঝে নিজের ঠোঁটজোড়া ডুবিয়ে দিলো। কতক্ষন এভাবে আকড়ে রাখলো তার খেয়াল নেই। তারপর একটা সময়পর ছেড়ে দিয়ে টিশার্টের হাতা দিয়ে ঠোঁট মুছে ওপাশ ঘুরে শুয়ে পড়লো। এদিকে পুরো ঘটনায় সানাত কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সে একবার অনুভুতিশূন্য চোখে অন্তিমের দিকে তাকালো। তার মাথায় শুধু একটা প্রশ্নই ঘুরছে,
কি হয়েছে অন্তিমের?

#চলবে

অতঃপর গল্পটা তোমার আমার পর্ব-১০

0

#অতঃপর_গল্পটা_তোমার_আমার
#পর্ব-১০
#হুমায়রা_আঞ্জুম (লেখনীতে)

কেটে গেছে তিন মাসেরও বেশি সময়। এই তিন মাসে মোটামুটি অনেককিছুই বদলেছে। এই যেমন সানাত আর অন্তিমের সম্পর্ক এখন আর আগের মতো নেই। যথেষ্ট বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়েছে তাদের। দুজনেই এখন জীবনে একটা স্বাভাবিক ছন্দে ফিরেছে। এই একমাস হলো সানাত পড়াশোনার পাশাপাশি একটা কোচিং সেন্টারে চাকরি নিয়েছে। অন্তিমেরও গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরীর পরীক্ষার ফলাফল দিয়েছে। সে একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসেবে সুযোগ পেয়েছে। তবে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে তা সে এখন অব্দি জানায়নি। শুধু বলেছে ওটা সারপ্রাইজ। এদিকে ওহীও আজকাল প্রেমে ব্যস্ত। এই মাস দুই হবে সে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছে। আজকে সে ভার্সিটি ফেলে তার প্রেমিক মানুষটির সাথে একান্তে কিছু সময় কাটাতে বেরিয়েছে। আর এদিকে সানাতকে রেখে গেছে পাহারাদার হিসেবে। যেনো কোনোকিছু হলে সে সামলে নেয়। অন্তিম আজ গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে। মূলত অপেক্ষা করছে সানাত আর ওহীর জন্য। তবে এখনও দেখা মেলেনি একজনেরও। অন্তিম হাত ঘড়িতে সময়টা দেখে নিলো। তিনটা পঞ্চাশ বাজে টানা আধা ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছে অথচ সানাত ওহীর কারোরই কোনো পাত্তা নেই। অন্তিম বেশ বিরক্ত হয়ে জানালার বাইরে দৃষ্টি ফেলতেই দেখতে পেলো সানাত আসছে। পরমুহূর্তেই চোখ গেলো সানাতের পাশে হেঁটে আসা ছেলেটির দিকে। বেশ হেসে হেসেই কথা বলছে সানাতের সাথে। সানাতও হাসছে আর হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কিছু বলছে। অন্তিমের আচমকাই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। সে ভেবেই পাচ্ছেনা এই ছেলেটার সাথে এতো হেসে কথা বলার কি আছে! অসহ্য! অন্তিম পকেট থেকে ফোন বের করে কল করলো সানাতের নাম্বারে তারপর ফোন কানের কাছে ধরে গাড়ি থেকে সানাতের দিকে তাকালো। হঠাৎ কথার মাঝে ফোন বেজে উঠতেই সামান্য বিব্রত হলো সানাত। তারপর ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই দেখলো অন্তিমের কল। সানাত রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে গম্ভীর গলায় অন্তিম বললো,

হ্যালো সানাত তুমি এখন কোথায়?

সানাত যেনো ধাক্কা খেলো। হঠাৎ উনি কোথায় আছি এই কথা জিজ্ঞেস করছে কেনো? ওহীর কথা কি জেনে গেলো নাকি? সানাত ওড়না দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বললো,

আ..আপনি হঠাৎ এই প্রশ্ন কেনো করছেন?

এটা আমার উত্তর নয়। যেটা জানতে চেয়েছি সেটা বলো।

আ..আমি আর কোথায় থাকবো ভার্সিটিতেই আছি।

ভার্সিটির কোথায় আছো?

সানাত ঢোক গিললো। তারপর বললো,

আ..আপনি এসব কেনো জানতে চাইছেন?

আগে বলো।

আমি ভার্সিটির কেন্টিনে আছি।

ওহ। আচ্ছা।

জ্বি।

ওই ছেলেটার সাথে ওখানে দাড়িয়ে দাড়িয়ে কি করছো?

অন্তিমের কথা শোনা মাত্রই সানাতের বিষম উঠে গেলো। এদিকে তার পাশে দাঁড়ানো আলভী কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। সে অবলার মতো সানাতের দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে পিঠে হাত রাখলো। এই দৃশ্য দেখা মাত্রই গাড়ীতে বসে থাকা অন্তিম তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। তার ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে ওই ছেলের হাত ভেঙ্গে দিতে আর তারপর সানাতের গালে দাবাং মার্কা একটা চর বসাতে। সানাত কাপাকাপা গলায় বললো,

আ..আপনি ক..করে জানলেন?

তোমার ডানে মেইন রোডে তাকাও।

সঙ্গে সঙ্গে সানাত তাকালো। তারপরই চোখে পড়লো অন্তিমের কালো গাড়িটি। অন্তিম বললো,

দেখা হয়ে গেলে চুপচাপ এসে গাড়ীতে এসে ওঠো। বলেই ফোন কেটে দিলো।

কি হয়েছে সানাত? বললো আলভী।

আমাকে যেতে হবে আলভী।

চলো আমি এগিয়ে দিয়ে আসি।

না না তার প্রয়োজন নেই। আমি যেতে পারবো সামনেই গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।

আরেহ আমিও এই রাস্তা দিয়েই যাবো। চলো। বলেই হাঁটতে লাগলো আলভী। সানাতও আর কথা বাড়ালো না। গাড়ির কাছে পৌঁছাতেই অন্তিম গাড়ির গ্লাস নামিয়ে দিয়ে সানাতের দিকে তাকালো। আলভী গাড়ির ভেতরে বসা ব্লু শার্ট পরা অন্তিমের দিকে তাকালো। অন্তিমের চোখে সানগ্লাস তাই তার দৃষ্টি ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা। সানাত আলভীর উদ্দেশ্যে বললো,

তুমি এখন যাও আলভী।

আলভী একবার অন্তিমের দিকে তাকিয়ে তারপর সানাতের দিকে তাকিয়ে বললো,

ইনি কে সানাত? কার সাথে যাচ্ছো তুমি?

সানাত পড়লো এক বিপাকে। কি বলবে সে? কি করে বলবে অন্তিম তার স্বামী? আর অন্তিমই বা কেমন রিয়েক্ট করবে? সানাত একবার অন্তিমের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললো,

কা..কাজিন ।

অন্তিমের মাথায় যেনো বাজ পড়লো এমন কথা শুনে। এদিকে আলভী হেসে বললো,

ওহ তা তোমার ভাই কিন্তু খুব হ্যান্ডসাম সানাত। বলেই সে চলে গেলো। আর এদিকে অন্তিম গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে চোয়াল শক্ত করে আছে। সানাত উঠে বসতেই অন্তিম সামনের দিকে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলো,

তুমি একা কেনো ওহী কোথায়?

ওহীর কথা মনে পড়তেই সানাতের দম বের হওয়ার পালা। মনে মনে মিথ্যে কথাগুলো সাজিয়ে বললো,

আসলে ওহী রাহার বাসায় গেছে। কিছু ইম্পর্ট্যান্ট নোটস তুলতে। আমিও যেতাম কিন্তু পরে যাওয়া হয়ে ওঠেনি।

ওহ। তা ওই ছেলেটা কে ছিলো?

কোন ছেলে?

অন্তিম এবার সানাতের চোখে চোখ রেখে বললো,

যেই ছেলেটার সাথে এতক্ষণ ধরে হেসে হেসে, দাঁত বের করে, হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে সুখের আলাপ করছিলে তার কথা জিজ্ঞাসা করছি? কে সে?

সানাত অন্তিমের এমন ধরনের কথায় বেশ ভরকে গেল। তারপর বললো,

ওহ আপনি আলভীর কথা বলছেন। ও আলভী। আমাদের ডিপার্টমেন্টেরই। ছেলেটা খুব মজার জানেন। আজও একটা ফানি…

আমি তোমার থেকে ওর সুনাম শুনতে চাইনি। সো প্লিজ স্টপ।

আপনি কি কোনো কারণে রেগে আছেন?

না।

আমরা কোথায় যাচ্ছি?

জাহান্নামে।

এসব কি বলছেন আপনি? আপনি নিশ্চই রেগে আছেন তাই এমন করে কথা বলছেন। কেনো রেগে আছেন? আমি কি কিছু করেছি?

বেয়াদব মেয়ে আমি তোমার কাজিন হই? কোন জন্মের কাজিন আমি তোমার?

সানাত এতক্ষনে বুঝতে পড়লো আসল কাহিনী। সে বললো,

নাহলে আর কি বলতাম?

কিছু বলতে হবে না প্লিজ চুপ থাকো।

আচ্ছা চুপ থাকবো আগে বলুন আমরা কোথায় যাচ্ছি?

টিএসসি।

তাহলে কিন্তু আজকে আপনাকে ট্রিট দিতে হবে। আপনার জব হয়ে গেছে অথচ আপনি এখনো ট্রিট দেননি।

চাকরি তো তোমারও হয়েছে। তুমিও তো ট্রিট দেওনি।

বেশ চলুন আজ আমিও আপনাকে ট্রিট দেবো আপনিও আমাকে ট্রিট দেবেন। একদম ইকুয়াল।

কিছুদূর যেতেই জ্যামে বিরক্ত সানাত অন্তিম দুজনেই। সানাত বিরক্ত হয়ে পাশে তাকাতেই তার আত্মার পানি শুকিয়ে গেলো। তাদের গাড়ির পাশেই ওহী আর তার প্রেমিক বাইকে বসে আছে। সানাতের ঘাম ছুটে গেছে। এখন যদি একবার অন্তিম দেখে ফেলে তাহলে আজ দফা-রফা হয়ে যাবে। সানাত তড়িঘড়ি করে গাড়ির গ্লাস উঠিয়ে দিলো। অন্তিম ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলো,

কি ব্যাপার গ্লাস উঠিয়ে দিলে কেনো?

আ..আমার গরম লাগছে। এসি অন করুন।

তোমার আজ হঠাৎ গরম লাগছে। অন্যান্য দিনতো আমার সাথে বিতর্ক করে জানালা খোলা রাখো আর আজ নিজেই বলছো এসি অন করতে। স্ট্রেঞ্জ!

কি আজব! আজ আমার গরম লাগছে তাই বলেছি তাতে এমন করার কি আছে?

নাহ্ কিছুনা আমার একটু অদ্ভুত লেগেছিল তাই আর কি!

🌻
বর্তমানে এখন তারা আছে টিএসসির সামনে। সানাত বসে মন ভরে ফুচকা খাচ্ছে। আর এদিকে অন্তিম নাক কুঁচকে তাকিয়ে আছে। তারপর বলে উঠলো,

ইয়াক সানাত। এসব আনহেলদি খাবার কি করে এতো মজা করে খাও তুমি? হেজিটেড ফিল করো না? আমার তো দেখেই কেমন যেনো লাগছে?

এতো আয়েস করে খাওয়ার মাঝে বিঘ্ন ঘটায় সানাত বেশ বিরক্ত। সে বিরক্তি নিয়েই বললো,

না আমার কোনো হেজিটেড ফিল হয়না। আপনাদের মতো বড়লোকদের কাছে হেজিটেড হবেই।

সানাত বিষয়টা বড়লোক বা গরীবের নয়। বিষয়টা হেলথের। তুমি এই নিয়ে তিন প্লেট খাচ্ছো। এবার প্লিজ স্টপ করো নইলে সত্যিই প্রবলেম হবে।

সানাত শেষ ফুচকাটা খেয়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর বললো,

চলুন এবার নেক্সট ট্রিটটা দেবেন। বলেই অন্তিমের হাত ধরে টেনে নিয়ে দাঁড় করালো আইসক্রিমের গাড়ির সামনে। তারপর বললো,

এবার আইসক্রিম খাবো। এবার কিন্তু আপনিও খাবেন আমার সাথে।

মোটেও না। তুমি খাচ্ছো খাও আমাকে এসবে টানবেনা। আর এমনিতেও আই ডোন্ট লাইক আইসক্রিম।

কিইই! আপনি আদেও মানুষ?

মানে? তোমার আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে আমি ভাল্লুক নাকি এলিয়েন?

ভাল্লুক না তবে আপনি ভিন গ্রহের মানুষ নিশ্চিত। নাহলে আইসক্রিম আবার কারো ভালো লাগেনা? আমি তো জন্মেও শুনিনি।

বয়স কতো তোমার যে শুনবে! বাচ্চা মানুষ!

কিহহ আপনার আমাকে বাচ্চা মনে হয়? শুণুন আমার বয়স বাইশ বছর বুঝলেন। আমি মোটেও বাচ্চা নই।

আমাকে কিছু বোঝাতে আসবেনা। তোমার থেকে গুনে গুনে ছয় বছরের বড় আমি।

সানাত আর পাত্তা না দিয়ে দুটো আইসক্রিম নিয়ে খাওয়া শুরু করে দিলো। অন্তিম দাড়িয়ে দাড়িয়ে সানাতের আইসক্রিম খাওয়া দেখছে তারপর একটুপর টিসু দিয়ে মুছিয়ে দিচ্ছে। এই যে অন্তিমের এই ছোট ছোট কেয়ারগুলো কতোটা সুখ দেয় সানাতকে তা সে ভাষায় প্রকাশ করতে পারবেনা। আইসক্রিম খাওয়া শেষে সানাত বললো,

এবার আমার ট্রিট দেওয়ার পালা। চলুন।

কি খাওয়াবে শুনি? কোনো আনহেলদি খাবার কিন্তু না?

আপনি চলুন তো।

সানাত আর অন্তিম হাঁটছিলো। আচমকাই অন্তিমের চোখ গেলো পাশের ফুলের দোকানে। কি মনে করে যেনো অন্তিম একটা গাজরা কিনে নিলো। তারপর সানাতকে থামিয়ে বললো,

সানাত তোমার হাতটা দেও তো।

কেনো?

দেও।

হাত বাড়িয়ে দিতেই গাজরাটা হাতে খুব যত্নের সাথে পরিয়ে দিলো। এদিকে সানাতের মনের খাচায় বন্দী সুপ্ত প্রজাপতি গুলো অনুভূতির তুমুল জোয়ারে উড়ে বেড়াচ্ছে।
সানাত আর অন্তিম একটা চায়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়াতেই সানাত গিয়ে দুই কাপ চা নিয়ে এসে হাজির হয়ে বললো,

নিন ধরুন। নাক ছিটকাবেন না। একবার খেয়ে দেখুন রাস্তার ধারের সস্তার মাটির ভারের চায়ের স্বাদই আলাদা।

অন্তিম হাজার দ্বিধা শর্তেও সানাতের কথা ফেলতে পারলোনা । সে চুমুক দিতেই দেখলো সত্যিই অসাধারণ। সানাত চুমুক দিয়ে অন্তিমের দিকে এক নজর তাকিয়ে বলে উঠলো,

“তোমার সাথে টিএসসি, মাটির ভাড়ে গরম চা
তোমার সাথে হঠাৎ দেখায়, থমকে গেছে শহরটা।”
#চলবে

অতঃপর গল্পটা তোমার আমার পর্ব-০৯

0

#অতঃপর_গল্পটা_তোমার_আমার
#পর্ব-০৯
#হুমায়রা_আঞ্জুম (লেখনীতে)

আজ বেশ বেলা করেই ঘুম ভাঙলো সানাতের। আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বসতেই চোখ গেলো দেয়াল ঘড়ির দিকে। ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে নয়টা। সানাত ধরফরিয়ে উঠলো এতক্ষণ অব্দি সে পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছে। তবে আচমকাই খেয়াল হলো অন্যান্য দিনের মতো আজ সে সোফাতে নয় বেডে আবিস্কার করেছে নিজেকে। কিন্তু এটা কি করে সম্ভব এটা তো যার তার বেড নয় এটা তো অন্তিম আহসানের বেড। সে কি করে এলো এই বেডে? কাল রাতে তো সে বাইকে উঠেছিলো। অন্তিম বাইক চালাচ্ছিল, সে অন্তিমের পেছনে বসে ছিলো কিন্তু এরপর তো কিছু মনে নেই। সানাতের ভাবনার মাঝেই ওহী দুই মগ কফি নিয়ে হাজির হয়ে বললো,

কিরে সানাইততা উঠে গেছিস!

ওহীর এমন কথায় সানাত ক্ষেপে গিয়ে বললো,

সকাল হতে না হতেই তোর বাঁদরামি শুরু হয়ে গেছে তাইনা? ফাজিল মেয়ে।

সানাতের কথায় ওহী দাঁত কেলিয়ে হাসলো। তারপর বললো,

আহা ক্ষেপো কেনো সানাত বেবি। কুল থাকো। কালকে রাতে তোমরা যে সিনেমা দেখিয়েছো তাতে আমি পুরাই শকড।

সানাত ওহীর কথার মানে বুঝতে না পেরে ভ্রু কুঁচকে বললো,

মানে? কিসের সিনেমা?

এহহ একদম ঢং করবিনা ফাজিল মেয়ে। যখন আমি বলেছিলাম একটু সময় দে সম্পর্কটাকে সব ঠিক হয়ে যাবে। ভাইয়া আর তোর সম্পর্কটা ঠিক আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হবে তখন তো খুব বলেছিলি না কখনই হবেনা, মিথ্যে আশা দিস না তোর ভাই আমায় সহ্য করতে পারেনা, ইত্যাদি ব্লা ব্লা আরো কতো কি। অথচ কাল রাতে জড়িয়ে ধরে বাইকে করে এসে আবার আমার ভাইয়ের কোলে চড়ে ঘরে ঢুকেছিস ফাজিল।

সানাত যেনো আকাশ থেকে পড়ল। আচমকা চিল্লিয়ে উঠে বললো,

কি বলছিস তুই? কোলে চড়ে মানে?

হ্যাঁ কোলে চড়ে। আমি তো কালকে রাতে তোর টেনশনে মরে যাই যাই অবস্থা তারপরে বারান্দা থেকে যখন তোদের রঙ্গলীলা দেখি আমি পুরা থ। মানে কিছুক্ষণের জন্য মনে হচ্ছিলো আমার চোখ আমার সাথে বেইমানি করতেছে। কিন্তু নাহ বেইমানি তো তুই করছিস। তলে তলে এতদূর টেম্পু চালিয়ে গেলি অথচ আমি কিচ্ছু টের পেলাম না। আমি জানতাম তোদের মধ্যে দ্বন্দ্বটা কেটে যাবে কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি এটা আশা করিনি। তোরা তো আমার থেকেও এক কাঠি ওপরে রে!

থামবি তুই। ছি ছি কাল রাতে এসব হয়ে গেছে ? আল্লাহ!

এহহ এখন আবার ছি ছি করে! শুধু কি কোলে নিয়েছে বাকি কথা শুনলে তো তুই হার্টফেল করবি!

সানাত ঢোক গিলে বললো,

মানে? আর কি হয়েছে?

ওহী মনে মনে নিজের বানানো জম্পেশ বুদ্ধিটা সাজিয়ে মনে মনে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। তারপর খুব সিরিয়াস হওয়ার ভান ধরে বললো,

আসলে সানাত একটা ঘটনা ঘটে গেছে। তুই প্লিজ হাইপার হোস না।

কি ঘটেছে? উত্তেজিত হয়ে বললো সানাত।

আমার বলতে শরম লাগতেছে দোস্ত।

কিসব বলছিস তুই? প্লিজ বল ওহী।

আমি বলতে পারবো না তুই একবার নিজের শরীরের দিকে তাকা।

সানাত তৎক্ষণাৎ নিজের শরীরের দিকে তাকালো। তারপর বলে উঠলো,

একি আমার গায়ে সালওয়ার কামিজ কি করে এলো?আমি তো কাল শাড়ি পড়া ছিলাম।

বৃষ্টিতে তো ভিজে গেছিলো শাড়ি তাই চেঞ্জ করেছে।

কে করেছে তুই?

না।

নাহ্ মানে? তুই করিসনি তো কে করেছে? ফাইজলামি করিস আমার সাথে?

ফাইজলামি কেন করবো আমি তোর সাথে। সত্যি বলছি আমি করাইনি। আমি কি করে করাবো আমার গায়ে অত শক্তি আছে নাকি যে তোর মত মুটি মেয়েকে টানবো!

সানাত ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,

তাহলে কে করিয়েছে?

ভাইয়ে মানে.. ভাইইয়া করিয়েছে।

সানাত লাফিয়ে উঠলো। তারপর চিৎকার দিয়ে উঠে বললো,

কিইইই!

সানাতের হাল দেখে ওহীর পেট ফেটে হাসি বেরিয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু অনেক কষ্টে হাসি চেপে রেখে বললো,

তুই প্লিজ শান্ত হ সানাত। আর তাতে কি এমন হয়েছে যদি ভাইয়া তোর কাপড় চেঞ্জ করেছে?

এসব তুই কি বলছিস ওহী?

ঠিকই তো বলছি। ভাইয়াই তো অন্য কেউ তো আর নয়। দেখ সানাত তুই ভুলে যাসনা আমার ভাই এখন তোর হাসবেন্ড। বিয়ে হয়েছে তোদের। তাই ভাইয়ার সম্পূর্ণ অধিকার আছে তোর ওপর।

থাম তুই ওহী। এসব তুই কি বলছিস? তুই তো এমন নোস।

সানাতের অবস্থা এমন যে সে এখনি কেঁদে ফেলবে। ওহী কিছু বলবে তার আগেই সানাত সত্যি সত্যিই কেঁদে ফেললো। সঙ্গে সঙ্গে ওহী ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলো। ওহীর হঠাৎ হাসি দেখে সানাত কান্না থামিয়ে বোকার মতো তাকিয়ে রইলো। ওহী হাসতে হাসতে ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। হাসতে হাসতেই বললো,

সানাত তুই মানেই পুরো বিনোদন। আল্লাহ আমারে বাঁচাও। বলেই আবারও হাসতে লাগলো। আর এদিকে সানাত ক্ষেপে গিয়ে বলে উঠলো,

তারমানে তুই এতক্ষণ ধরে আমাকে….
বাকি টুকু বলার আগেই সানাত ওহীর দিকে বালিশ ছুঁড়তে লাগলো। ওহী বলতে লাগলো,

আআআ… থাম। সানাত ভুল হয়ে গেছে। প্লিজ এবারের মতো ছেড়ে দে।

চুপ কর। শয়তান। তোকে আজ আমি মজা দেখিয়েই ছাড়বো। কুত্তা। অসভ্য। বলেই আরো একটা বালিশ ছুড়লো। তবে এবারের বালিশটা ভুলবশত ওহীর ওপর না পরে পড়লো অন্য কারো ওপর। অন্তিম সবেমাত্র ঘরে পা রেখেছিল তবে আচমকাই মুখের ওপর বালিশ পড়ায় সে হতভম্ব। তার থেকেও বেশি হতভম্ব যখন সে দেখেছে বালিশ ছুঁড়ে মারা ব্যক্তিটি আর কেউ নয় বরং সানাত। এদিকে সানাত ভয়ে জমে আছে। এই মুহূর্তে তার একটা প্রবাদ খুব মনে পড়ছে আর সেটা হলো যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। অন্তিম গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

কি ব্যাপার কি হচ্ছে এখানে এসব? এসব বালিশ ছুড়াছুড়ি আর কিসব গালাগাল শুরু করেছিস তোরা?

ভাইয়া আমি কি করলাম? সানাতই তো…

সঙ্গে সঙ্গে সানাত চোখ গরম করে তাকালো। ওহী আমতা আমতা করে বললো,

ভাইয়া আমি এখন আসি।
বলেই কেটে পড়লো ওহী। আর এদিকে সানাত লজ্জায় কোথায় পালাবে খুঁজতে খুঁজতে আচমকাই দৌঁড় লাগালো ওয়াশরুমে। তবে এখানেই বাঁধলো আরেক বিপত্তি। ওয়াশরুমে দৌঁড় দিতে গিয়েই ধুম করে বারি খেলো দেয়ালের সাথে। সঙ্গে সঙ্গে কপাল চেপে ককিয়ে উঠলো সানাত। পুরো ঘটনায় অন্তিম কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এই মেয়ের এমন অদ্ভুত আচরণ দেখে কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে সে। কোনোমতে নিজেকে সামলে ছুটে গেলো সানাতের কাছে। সানাতকে ধরে নিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে মাথায় পানি ঢালতে লাগলো। তারপর রেগে গিয়ে বলতে লাগলো,

তুমি কি পাগল? নাকি মাথার তার ছেরা? আমাকে দেখে ওভাবে পালাচ্ছিলে কেনো? আমি বাঘ না ভাল্লুক? আজব!

সানাত চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো কথা বলছেনা।

🌻
বিছানার এক কোণায় বসে সানাতের কপালে বরফ ছুঁইয়ে দিচ্ছে ওহী। পাশেই দাড়িয়ে আছে অন্তিম। সানাত কোনো কথা বলছেনা। অন্তিম বলে উঠলো,

ওহী তোর বান্ধবীর যে মাথায় সমস্যা সেটা আগে বলবিনা? ডাক্তার দেখাতে হবে মাথার।

হ্যাঁ ভাইয়া পুরো মাথাতেই সমস্যা ওর। দেখলেনা একটু আগে আমার উপর কিভাবে আক্রমণ করেছিল আর কিসব গালাগাল! ছি ছি!

সানাত ক্ষেপে গিয়ে বললো,

একদম ফালতু কথা বলবিনা ওহী। আমি এমনি এমনি তোকে মারছিলাম তখন? তুই কি বলেছিস মনে নেই?

কি এমন বলেছিলাম আমি যে তুই আমাকে ওভাবে নির্দয়ের মতো মারবি? আমি শুধু বলেছিলাম যে কাল রাতে ভাইয়া তোর শা…

ওহীর বাচ্চাআআআ….

ওমাগো পাগল ক্ষেপছে…
বলেই দৌঁড় লাগালো ওহী। আর তার পেছন পেছন খাট থেকে লাফ দিয়ে নেমে দৌঁড় লাগালো সানাতও। আর এদিকে অন্তিম অবাকের শেষ পর্যায় পৌঁছে গেছে আজকের এই একটার পর একটা অদ্ভুত কান্ড কারখানা দেখে। তার মাথার ওপর দিয়ে গেছে সব। সে মনে মনে ভাবছে, এই মেয়ে না একটু আগেও ব্যাথায় কাতরাচ্ছিল আর এখন কিনা এভাবে দৌড়াচ্ছে! এই মেয়েকে দেখে কে বলবে এই মেয়ে এতো শান্ত-শিষ্ট অথচ এর মধ্যে তো চঞ্চলতার শেষ নেই! যতো দিন যাচ্ছে এই মেয়ের নতুন নতুন রূপের সাথে পরিচিত হচ্ছে অন্তিম।
#চলবে