অতঃপর গল্পটা তোমার আমার পর্ব-১৪

0
313

#অতঃপর_গল্পটা_তোমার_আমার
#পর্ব-১৪
#হুমায়রা_আঞ্জুম (লেখনীতে)

আমি সকালে থাকবো না।

কথাটা শোনা মাত্রই উপস্থিত সকলেই অবাক।মুহূর্তেই সানাতের চাচা বলে উঠলেন,

থাকবি না মানে?

আমি সন্ধ্যায় বাড়ি চলে যাবো।

সানাত তুমি এসব কি বলছো? বললো অন্তিম।

হ্যাঁ আমি চলে যাবো।

পাগল হইছস ছেরি! কইতাছস কি যাইবিগা মানে? হগ্গলে মাত্র তর বাপেরে দাফন দিয়া আইলো আর তুই যাইবি গা?

তাতে কি হয়েছে চাচী? সব কাজ তো হয়েই গেছে। আমার আর থেকে কি কাজ?

কিসব বলছিস তুই জানিস সানাত? ভাইয়ের আজকে মাত্র দাফন হয়েছে আর তুই আজকেই চলে যাবি? এতদিন পর এসেছিস।

আমি তো এখানে বেড়াতে আসিনি চাঁচা। আমার বাবার মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে এসেছি। দাফন হয়ে গেছে এখন আর আমার কি কাজ!

এটা কোন ধরনের কথা বলছিস সানাত? তোর বাবা আজ মারা গেছে আর তুই একটা রাত থাকবি না?

চাচা আমি যেদিন থেকে ঢাকামুখী হয়েছি তারপর থেকে একটা সময় পরপর এই বাড়িটাতে আসতাম আমার অসুস্থ বাবার টানে। আজ সেই টানের ইতি ঘটেছে। এখন থেকে এখানে আমার আসার আর কোনো কারণ নেই। আজকের পর আর কবে আসবো বা আদেও কখনো আসবো কিনা জানা নেই। এতদিন বাবা অসুস্থ ছিলো, বিছানায় পড়ে ছিলো যেমনি ছিলো কিন্তু বাবা ছিলো তাই বাবার বাড়িও ছিলো কিন্তু আজ আর বাবা নেই তাই আমার বাবার বাড়িও নেই। যেটা আছে এটা এখন তোমাদের বাড়ি। এই পৃথিবীতে বাবার পর তুমি আমাকে সবচেয়ে ভালো বোঝো। তাই আমার অনুরোধ তুমি আমাকে আর যাই বলো এই শূন্য বাড়িটাতে থাকতে বলোনা। আমি পারবো না।

আমি বুঝতে পেরেছি। আমি জোর করবনা তোকে। তুই ফিরে যাস। তবে মাঝে মাঝে এই বাবার মতো চাচাটাকে মনে হলে দেখতে আসিস।
বলেই তিনি সানাতের মাথায় হাত বুলিয়ে উঠতে লাগলেন। সানাত বলে উঠলো,

চাচা তোমার হাতে একটা জিনিস তুলে দেওয়ার ছিলো?

কি?

সানাত উঠে ভেতর গিয়ে ব্যাগ থেকে কিছু একটা বের করে নিয়ে এসে বললো,

এখানে পনেরো হাজার টাকা আছে। বাবার চিকিৎসার জন্য জমিয়েছিলাম। কিন্তু সেটা তো আর লাগলোনা। এখান থেকে আড়াই হাজার টাকা আলিফ কাকার ফার্মেসীতে দিয়ে দিও বাকিতে ওষুধ আনা হয়েছিল। আর শাকিলের ফ্রমফিলাপ আর সাবার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে আমি কিছুই দিতে পারিনি বোন হিসেবে তাই দুই হাজার টাকা দিও ওর হাতে। আর বাকি টাকা বাবার মিলাদে খরচ করো।

শাহআলম সাহেব মলিন হাসলেন। তারপর টাকাটা হাতে নিয়ে বললেন,

অনেক তো করলি বিনিময়ে কি পেলি?

আমি বিনিময়ের আশায় কিছু করিনা চাচা। আমার দায়িত্বের মধ্যে ছিলো এগুলো তাই করেছি।

যাওয়ার সময় রহমান স্টেশন অব্দি ওর সিএনজি দিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসবে।

সানাত মাথা নাড়ালো। এই পুরোটা সময় অন্তিমের দৃষ্টি ছিলো শুধুমাত্র সানাতে।
.
.
বিকাল সাড়ে পাঁচটা। বাড়ির সদর দরজায় অন্তিম সানাত দাঁড়িয়ে বিদায় নিচ্ছে। সাড়ে সাতটায় ট্রেন তাদের। সানাত শাকিলের মাথায় হাত রেখে বললো,

ভালো করে পড়াশোনা করিস। শুধু ক্রিকেট ফুটবল দিয়ে পড়ে থাকিস না। আর যখন যা প্রয়োজন হবে আমাকে জানাবি। কেমন?

শাকিল বোনের দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো,

তুমি আবার কবে আসবে আপু?

সানাত একটু চুপ থেকে বলে উঠলো,

জানিনা। তবে আমার ভাই যদি কখনো নিজের উপার্জনে একটা বাড়ি করে আমি তখন নিশ্চই আসবো। তখন যদি আমার ভাইয়ের বউ আমায় পছন্দ নাও করে আমি তবুও আসবো। বলেই সানাত হাসলো। হাসলো শাকিলও। এরপর সাবা, আত্মীয় স্বজন সকলের থেকেই বিদায় নিয়ে গাড়ীতে উঠে বসলো। তারপর মুহূর্তেই গাড়ি সো সো করে ছুটতে লাগলো। সানাত পেছন ফিরে তাকালো। দু চোখ ভরে দেখে নিলো দাঁড়িয়ে থাকা স্বজনদের মুখ, পরিচিত বাড়িটা, পরিচিত রাস্তাটা। তারপর ফেলে আসলো সকল পিছু টান। গাড়ি অনেকটা দূর যেতেই সানাত আচমকা বলে উঠলো,

রহমান কাকা গাড়িটা একটু থামান।

অন্তিম চমকে উঠে বললো,

কেনো? গাড়ি কেনো থামাবে?

একটু দরকার আছে। একজনের সাথে দেখা করবো। এতদিন পর এলাম আর কবে আসবো জানা নেই আর এতকিছুর মাঝে তাঁর সাথে দেখা করা হয়ে ওঠেনি তাই একটু দেখা করে আসবো। আমি বেশি সময় নেবনা।

এখন তুমি কার সাথে দেখা করবে?

সানাত কিছু বললোনা। সামনে থেকে রহমান নামের লোকটি বলে উঠলো,

পত্তেক বার আইলেই তো যাও। এইবার নাই গ্যালা। আর এমনেও সাঁঝ নাইমা গ্যাছে মা। অন্ধকার হওয়া আইছে। অহন যাইও না। আয়যানের সময় অহন।

আপনিও ভয় পাচ্ছেন কাকা? বলেই মলিন হাসলো সানাত। তারপর নেমে দাড়িয়ে বললো,

আপনি ভয় পাবেননা কাকা। আমি যাচ্ছি আপনারা একটু অপেক্ষা করুন। বলেই সে পা বাড়ালো একটা পুরাতন বাড়ির গেটে। অন্তিম অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
.
.

সানাত এসে দাঁড়িয়ে আছে কাঙ্ক্ষিত জায়গাটির সামনে। শেওলা পরা পুরাতন দেওয়ালে লেখা পারিবারিক কবরস্থান। সানাত দরজাটা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো তারপর সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটির কবরস্থানের সামনে গিয়ে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলোনা। এতক্ষণ ধরে শক্ত, কঠিন খোলসটা মুহূর্তেই ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো। হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো। তারপর বলে উঠলো,

মা! আমি এসেছি দেখো। আজ সব হারিয়ে তোমার কাছে এসেছি মা। আমি বড্ডো ক্লান্ত, বুকটা ভারী হয়ে আছে কিন্তু আমার কথা শোনার মতো কেউ নেই। তাই তোমার কাছে এসেছি একটু হালকা হতে। আজ তোমার কোলের শূন্যতাটা খুব বেশিই অনুভব করছি। তুমি তো জন্মের পরই ছেড়ে চলে গেলে মা আজ বাবাও ছেড়ে চলে গেছে মা। বাবা মায়েরা তো স্বার্থপর হয়না তাহলে তোমরা কেনো হলে মা? কেনো হলে বলতে পারো? এতো বড়ো দুনিয়াটা আমার কাছে নিকৃষ্ট মনে হচ্ছে। আমি আর কার ভরসায় বাঁচবো মা? কার মুখের দিকে তাকিয়ে বাঁচবো? আমার কলিজাটা এতো জ্বলছে কেনো মা? তোমাকে হারানোর ব্যাথা আমি পাইনি। সেই বুঝই আমার হয়নি তখন তুমি ফাঁকি দিয়েছো। কিন্তু বাবা হারানোর যন্ত্রণা এতো কেনো মা? আগে তো বুঝিনি এতো জ্বলে বাবা মা হারালে! এই কষ্ট আমি সহ্য করতে পারছিনা মা। আমাকে কেনো এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে একা ফেলে চলে গেলে মা?এর থেকে তোমার সাথেই নিয়ে যেতে তাহলে আজ এতো অবহেলিত হতাম না আমি। মা ছাড়া পৃথিবীটা বিষের মতো, হজম করা যায়না। তুমি জানো মা তোমার মতন কেউ নয়। মায়ের মতন কেউ হয়না মা আমি আজ বুঝি। তোমাকে আমি দেখিনি মা তবে তোমার বোনকে দেখেছি মা। তারমধ্যে তোমাকে খুঁজে পেতাম। কিন্তু ঐযে সেও মায়ের মতন ছিলো মা নয়। যখন নিজের সন্তানের স্বার্থে ঘা লেগেছে তখন ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। সত্যি মা তুমি তুমিই, তোমার মতন কেউ নয়। আজ যদি তুমি থাকতে তাহলে কি আমায় ছুঁড়ে ফেলতে? ফেলতে না তো। হাজার হলেও বুকে আগলে রাখতে কিন্তু তোমার বোন রাখেনি মা। আজ বাবা মারা গেছে সেই খবর তার কাছে গেছে অথচ সে ফিরেও তাকালো না। তুমি জানো মা আমি তোমার কবর থেকেও মা মা ঘ্রাণ পাই। তোমার সামান্য ভালোবাসা পাওয়ার আফসোস আমার আজন্ম থেকে যাবে। চোখের সামনে যখন অন্যদের মা-বাবার ভালোবাসা পেতে দেখবো আমি কেমন করে সহ্য করবো মা? আমার বুকটা যে খা খা করবে! আমার এতো কষ্ট দেখেও তুমি কি করে ওই অন্ধকার কবরের মাঝে এতো শান্তিতে ঘুমিয়ে আছো মা? তোমার বুকটা কি আমার জন্য একটুও জ্বলেনা? আমার হাহাকার শুনেও কি তোমার ঘুম ভাঙ্গে না? একটুও মায়া হয় না আমার মুখটা দেখে! নাকি তুমিও শ্যাম বর্ণকে কুৎসিত মনে করো? মায়েরা তো নির্দয় না। তাহলে তুমি কি করে এভাবে মায়া কাটিয়ে চলে যেতে পারলে? আমি কার কাছে যাবো মা কেউ নেই আমার। কেউ নেই।

কে বলেছে কেউ নেই?

আচমকা কাধে কারো স্পর্শ আর কণ্ঠ শুনতেই সানাত কান্না থামিয়ে ঘুরে তাকালো। অন্তিম আবারও বলে উঠলো,

আমি আছি সানাত। তোমার পাশেই আছি। দেখো।

আপনি? আপনি কি করে এলেন?

কি করে এসেছি সেটা পরে বলবো। তুমি এখানে বসে এভাবে পাগলের হাউমাউ করে কাঁদছো কেনো সানাত? কি হাল করেছো নিজের একবার দেখেছো? এতোটা বিধ্বস্ত সানাতকে তো আমি কখনো দেখিনি।

আপনার এখানে আসতে ভয় লাগেনি?

ভয় কেনো লাগবে? মায়ের কাছে আসতে ভয় কিসের?

কিন্তু আমার মা তো…

মৃত, তাই তো। মায়েরা জীবিত আর মৃত কি? মা তো মা-ই হয়। মায়েরা জীবিত থাকলেও মা, মারা গেলেও মা। মায়ের কোনো পরিবর্তন নেই।

কিন্তু এটা তো আমার মা।

তোমার আর আমার আবার কি? মা নিয়েও ভাগাভাগি করছো? এদিকে যে আমার পুরো জীবনের ভাগ নিয়ে বসে আছো। আর সামান্য তোমার মা কে মা বলেছি বলে এতো হিংসেমি করছো! আমার মা তো এখন আমার থেকেও তোমাকে বেশি ভালোবাসে কই আমি তো হিংসেমি করিনা।

সানাত বোকার মতো তাকিয়ে আছে। অন্তিম বলতে লাগলো,

দেখেছেন মা আপনার মেয়েটা কি হিংসুটে! আজ আমিও আপনাকে খুব মিস করছি। আপনি থাকলে অন্তত আপনার মেয়েটা এমন হিংসুটে হতো না। ওহ্ শিট! এতক্ষণ ধরে এতো কথা বলছি অথচ নিজের পরিচয়টাই দেইনি।আপনি নিশ্চই আমাকে চিনতে পারেননি। আমি আপনার শ্যামবতী রাজকন্যার রাজকুমার অন্তিম। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ শ্যামবতীকে নিজের প্রাণের বিনিময়ে পৃথিবীতে আনার জন্য। তাকে না পেলে হয়তো জানতেই পারতামনা শ্যাম বর্ণ পৃথিবীর সবথেকে পবিত্র বর্ণ। আর না বুঝতে পারতাম পুরুষ তার প্রথম নারীর কাছে ঠকে আর দ্বিতীয় নারীর কাছে মরে।
এই টুকু বলেই অন্তিম সানাতের চোখে চোখ রাখলো। সেই দৃষ্টিতে কি ছিল জানেনা সানাত। সে শুধু জানে ওই চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা সম্ভব নয়। তাই সে তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।
#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে