অতঃপর গল্পটা তোমার আমার পর্ব-২৪ এবং শেষ পর্ব

0
399

#অতঃপর_গল্পটা_তোমার_আমার
#সর্বশেষ_পর্ব
#হুমায়রা_আঞ্জুম (লেখনীতে)

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খোঁপায় গাজরাটা বেঁধে নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে শাড়ি পরিহিত সাড়ে আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা সানাত। এতবড় পেট নিয়ে সে শাড়ি পরেছে। নিজের কাছেই নিজেকে জোকার মনে হচ্ছে। হাজার অনিচ্ছা থাকা সত্বেও অন্তিমের জোরাজুরির কাছে হার মেনে শাড়ি পড়েছে। আজকে ছোঁয়ার বৌভাত। সবকিছু ভুলে ছোঁয়া নিজেকে শুধরে নিয়ে নতুন করে একটা চাকরিতে জয়েন করেছিলো। সেখানেই তার কলিগ ফাহাদের সাথে আলাপ এবং যা অবশেষে বিয়েতে পরিণত হয়েছে। সানাত বেজার মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। এমন মুহূর্তেই ঘরে প্রবেশ করলো অন্তিম। আয়নার সামনে এসে সানাতকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাধে থুতনি ঠেকিয়ে বললো,

বাহ্ আমার শ্যামবতীকে তো খুব সুন্দর লাগছে। চোখ ফেরানোই যাচ্ছেনা।

থামুন আপনি। একদম বাড়িয়ে বলবেন না। দেখুন আমাকে পুরো ঢোলের মতো লাগছে।

কে বলেছে তোমাকে বলেছে তোমাকে ঢোলের মতো লাগছে?

কারো বলতে কেনো হবে? আমার চোখ আছে। আমি নিজেই তো দেখতে পাচ্ছি।

হ্যাঁ চোখ তো আমারও আছে। কিন্তু আমার চোখে তোমাকে মোটেও ঢোলের মতো লাগছে না বরং মিষ্টি আলুর মতো লাগছে।

ব্যাস সানাত সঙ্গে সঙ্গে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। তারপর রাগে গজগজ করে বললো,

কীইই আপনার আমাকে আলু মনে হচ্ছে?

অন্তিম ঢোক গিলে বললো,

হ্যাঁ, মিষ্টি আলু।

একদম চুপ। অসভ্য লোক কোথাকার! সরুন বলছি!

একি সানাত ডার্লিং তুমি ক্ষেপে কেনো যাচ্ছো? মিষ্টি আলু কি খারাপ নাকি? ওটা তো সুইট একদম তোমার মতো।

একটাও কথা বলবেন না আপনি। আপনার জন্যই হয়েছে সব। নিজে তো একদম হিরো সেজে যাচ্ছেন। মেয়েরা তো হুমড়ি খেয়ে পড়বে। আর আমাকে আলু বানিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

উফফও সানাত মেয়েরা আমার উপর হুমড়ি খেলো কি খেলো না তাতে আমার কিছু আসে যায় না। আমার শুধু তুমি হুমড়ি খেলেই হলো। আর আমার সানাতকে মোটেও আলু লাগছে না। গলুমোলু লাগছে। ইচ্ছে করছে কি যে করিইইই!!

সানাত লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। তবুও রাগ দেখিয়ে বললো,

থামুন নির্লজ্জ লোক!

তুমি যাই বলো সানাত আমি নির্লজ্জ না হলে তুমি প্রেগনেন্ট হতে না! তোমাকে এতো গলুমলু কিউট লাগছে দেখে আমার তো ইচ্ছা করছে বারো মাসই তোমাকে প্রেগনেন্ট বানিয়ে রাখি। আমার ফ্যামিলি প্ল্যানিং বন্ধ করা যাবেনা।

ছিঃ ছিঃ থামুন। ঠোঁটকাটা লোক! মুখে কিচ্ছু বাঁধেনা। অসভ্য!

অন্তিম হো হো করে ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলো।
.
.

🌻
ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি চালাচ্ছে অন্তিম। তার পাশেই বসে আছে সানাত। সানাত বাইরের দিকে তাকিয়েই বলে উঠলো,

আচ্ছা আর কতক্ষন লাগবে পৌঁছাতে?

অন্তিম ড্রাইভ করতে করতেই বললো,

বেশিক্ষণ না। বিশ মিনিটের মতো লাগবে।

ওহ্।

কিছুক্ষণ পর সানাত আচমকা জানালা দিয়ে বমির জন্য মুখ বাড়িয়ে দিলো। অন্তিম সঙ্গে সঙ্গে ফিরে তাকালো। তারপর একহাতে সানাতকে ধরে বললো,

সানাত খারাপ লাগছে? আমাকে বলো।

সানাত বমির কারণে কিছুই বলতে পারছেনা। এদিকে অন্তিম অস্থির হয়ে পড়েছে। এরমধ্যে সামনে তাকাতেই দেখলো একটা চলন্ত ট্রাকের মুখোমুখি তারা। অন্তিম কোনো রকমে গাড়ি কন্ট্রোল করে কাটিয়ে নিলেও শেষ রক্ষা হলোনা। মুহূর্তেই তারা একটা খাম্বার সাথে সংঘর্ষ হলো। কিছুক্ষণ পর অন্তিম কোনরকমে চোখ খুলে তাকিয়ে সানাতের দিকে তাকাতেই তার শ্বাস বন্ধ হওয়ার জোগাড়। সানাত রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছে। একটা হাত জানালার বাইরে। হাত থেকে রক্ত চুইয়ে পড়ছে। অন্তিম শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠলো। তারপর পাগলের মতো সানাতকে ধরে বললো,

সানাত! এই সানাত চোখ খোলো। জান প্লীজ এমন করে না। সানাত! কলিজা আমার কষ্ট হচ্ছে দেখো। কথা বলোনা সানাত। আমি পাগল হয়ে যাবো সানাত তোমার কিছু হলে। মরেই যাবো। বলেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো অন্তিম।
.
.

🌻
হসপিটালে ওটির সামনে করিডোরে ফ্লোরে এলোমেলো হয়ে বসে আছে অন্তিম। তার থেকে একটু দূরেই চেয়ারে বসে সেই কখন থেকে কাঁদছে ওহী। সানাতের এই খবর শোনার পর নিজেকে কোনোভাবেই সামলাতে পারছেনা ওহী। রাদিফ বারবার বোঝাচ্ছে। কিন্তু ওহী মানতেই পারছেনা।
অন্তিমের মা অর্পিতা আঞ্জুম উঠে এসে ছেলের সামনে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

অন্তিম! বাবা এখানে এমন করে বসে থাকিস না। ঠিক হয়ে যাবে সানাত।

অন্তিম ছলছল চোখে মায়ের দিকে তাকালো। তারপর মুহূর্তেই গলার ভেতরে এতক্ষণ ধরে দলা পাকানো কান্নাগুলো বেরিয়ে আসলো। মাকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে বলে উঠলো,

মা! আ..আমার সানাত! আমার সানাতকে এনে দেও মা। আমি আর কিচ্ছু চাইনা। শুধু সানাতকে চাই। মা আমি বাঁচবো না ওর কিছু হলে। আমি কেনো একটু সচেতন হলাম না মা। আমার জন্য আমার সানাতের আজ এই হাল।

অন্তিম বাবা শান্ত হ। কিচ্ছু হবে না দেখিস।

আমি কিভাবে শান্ত হবো মা। আজ সকালেও সানাত একদম ঠিক ছিলো। আমার সাথে রাগ দেখাচ্ছিল। আর সেই সানাত আমার চোখের সামনে রক্তাক্ত হয়ে পড়েছিল। আমি কি করে নিজেকে বুঝ দেবো মা?

অন্তিমের কান্নার মাঝেই একজন নার্স বেরিয়ে এসে বললো,

পেশেন্টের দুই ব্যাগ ব্লাড লাগবে। প্লিজ ইমিডিয়েটলি জোগাড় করুন।

অন্তিম তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো। তারপর বললো,

আমার ওয়াইফের অবস্থা কেমন?

এখনি কিছু বলা যাচ্ছেনা। প্রচুর ব্লাড গেছে। আর উনি প্রেগনেন্ট ইনজুরিও হয়েছে। আপনারা ব্লাডের ব্যবস্থা করুন। বলেই নার্স চলে গেলো।
.
.

করিডোরে এখনো ঠায় বসে আছে অন্তিম, ওহী, রাদিফ, অর্পিতা আঞ্জুম, ওয়ালিদ আহসান। কিছুক্ষণ হলো ছোঁয়ারাও এসেছে। সকলেই অপেক্ষায় আছে একটা ভালো খবরের। সানাতের সিজার অপারেশন চলছে। কিছুক্ষণ পরেই ভেতর থেকে একটা নতুন প্রাণ চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। তার কান্নার মাধ্যমে সে জানান দিচ্ছে যে সে এসে গেছে। অন্তিম সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালো। এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে তার ভেতর। তারপর কিছুক্ষন পরেই একজন নার্স একটা ফুটফুটে বাচ্চা নিয়ে বেরিয়ে এলো। অন্তিম কোলে দিয়ে বললো,

আলহামুলিল্লাহ আপনার মেয়ে হয়েছে।

অন্তিম সেসবে কান না দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

আগে বলুন আমার ওয়াইফ কেমন আছে?

আলহামদুলিল্লাহ মা আর বেবি দুজনেই রিস্ক থেকে মুক্ত, ভালো আছে।

অন্তিম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর নিষ্প্রভ চোখে তাকালো সদ্য তাঁর কোলে দেওয়া নবজাতকের মুখের দিকে। চেহারা কার মত ঠিক বোঝা যাচ্ছে না তবে গায়ের রঙ যে মায়ের মতো পেয়েছে তা একদম স্পষ্ট। বাচ্চাটা ড্যাবড্যাব চোখে তাঁর বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। অন্তিমের চোখের কোটর বেয়ে গড়িয়ে পড়ল এক ফোঁটা নোনা জল। তারপর আলতো করে মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বললো,

আমার শ্যামবতীর শ্যামকন্যা। আমার আরেকটা আম্মু। পাপা তোমার জন্য কতো এক্সাইটেড ছিলো তুমি জানো!

শুধু তুমি একা এক্সাইটেড ছিলে না আমরাও ছিলাম। পেছন থেকে বললো ওহী।

আমি বেশি ছিলাম তোর থেকে বুঝলি।

বললেই হলো নাকি। দেও বাবুকে আমার কোলে দেও তো। আমার সানাতের সন্তান। আমি ওকে নেব না ? ও আমার কত্তো আদরের হবে জানো তুমি। মাথায় করে রাখবো ওকে আমি।

অন্তিম হাসলো। তারপর বাচ্চাকে ওহীর কোলে দিলো। ওহী নিয়েই বললো,

ভাইয়া, আম্মু, আব্বু দেখো একদম সানাতের মতো মিষ্টি হয়েছে। আমার খুব আনন্দ হচ্ছে এটা ভেবেই যে ও আমার সানাতের অংশ। মাশাআল্লাহ।

এই ওহী আমার নাতনিকে আমার কোলে দে বলছি। তুই যেভাবে নাচানাচি করছিস আমার নাতনি ভয় পাবে। বললেন অর্পিতা আঞ্জুম।

আম্মু আমি তো মাত্রই নিয়েছি।

চুপ কর। দে আমার কাছে।

না না আমি নেবো আমার নাতনিকে। আমার নাতনি ওর দাদাভাইয়ের কাছে আসতে চাচ্ছে। সরো তোমরা। বললেন অন্তিমের বাবা ওয়ালিদ আহসান।

না আমার নাতনি ওর দাদুর কাছে যাবে।

আরেহ না মা বাবু এখন ওর ফুফা আংকেলের কাছে যাবে। বললো রাদিফ।

ওহীও দেবেনা আরি দিয়ে বসলো।
অন্তিম দাড়িয়ে দাড়িয়ে এদের বাচ্চামো কাণ্ড কারখানা দেখছে। তারপর সে ওহীর কোল থেকে মেয়েকে নিয়ে বলে উঠলো,

আমার মেয়ে আমার কাছেই থাকবে। এখন সে তার পাপার সাথে মাম্মাকে দেখতে যাবে। বলেই বাবুকে নিয়ে সানাতের কেবিনের দিকে পা বাড়ালো। এদিকে উপস্থিত সকলেই হেসে ফেললো এমন কাণ্ড দেখে।
.
.

অন্তিম দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই দেখলো ধবধবে সাদা বেডে সানাত ঘুমিয়ে আছে। অন্তিম মেয়েকে নিয়ে আস্তে করে সানাতের সামনে দাঁড়ালো। তারপর আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো সানাতের কপালে। সানাত চোখ পিটপিট করে তাকালো। অন্তিম সানাতের দিকে তাকিয়ে বললো,

কেমন আছো?

সানাত দুর্বল কণ্ঠে বললো,

ভালো। আমার বেবি?

অন্তিম নিজের কোলের দিকে ইশারা করে বললো,

এইযে। আমি আর আমার মেয়ে তোমাকে দেখতে এসেছি।

সানাত ক্যানেলা লাগানো হাতটা বাচ্চার গায়ে আলতো করে রেখে বললো,

কার মতো হয়েছে?

আমার শ্যামবতীর মতো।

আমার মতো কেনো হলো আপনার মত সুন্দর হলেই তো পারতো।

অন্তিম সানাতের ঠোঁটে এক আঙ্গুল রেখে বললো,

চুপ। আমার মেয়ে আমার ঘরের পূর্নিমার চাঁদের মতো হয়েছে।

সানাত হাসলো। তারপর বললো,

বাবাহ মেয়ে তো দেখছি আসতে না আসতেই বাবার ভক্ত হয়ে গেছে। একদম বাবার বুকের সাথে চুপটি করে লেগে আছে।

অন্তিম হাসলো। তারপর বললো,

হ্যাঁ ও ওর পাপার হার্টবিট শুনছে। ওর পাপা ওকে আর ওর মাম্মাকে কতোটা ভালোবাসে সেটাই দেখছে।

বাকিরা কোথায়?

বাইরে দাঁড়িয়ে ঝগড়া করছে।

কেনো?

কে আগে কোলে নেবে এই নিয়ে! আমার মেয়ে অতিষ্ঠ হয়ে গেছিলো তাই আমি পালিয়ে এসেছি মেয়েকে নিয়ে।

সানাত খিলখিল করে হেসে উঠলো। অন্তিম বুকে হাত চেপে ধরে বললো,

ইসস্ আমি আবারও মরলাম সানাত তোমার ঘায়েল করা হাসিতে।

সানাত হাসলো। অন্তিম বলে উঠলো,

কে কে জানতো যেই মেয়েটাকে একসময় জেদের বশে, সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় এনেছিলাম সে একদিন আমার সন্তানের মা হবে! তাকে কখনো নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসবো!

সানাত হাসলো। অন্তিম বলে উঠলো,

অতঃপর গল্পটা তোমার আমার ছিলো!

~সমাপ্ত~

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে