কে বাঁশি বাজায় রে পর্ব-০৫

0
191

#কে_বাঁশি_বাজায়_রে
#পর্ব_০৫
#নুর_নবী_হাসান_অধির

আঁধার কেটে ধরনী নব পল্লবের মতো আলোয় আলোকিত হয়ে উঠে৷ মানবজাতি বেঁচে থাকার নতুন অধ্যায়ে পা রাখে৷ এক টুকরো সুখের জন্য তেপান্তর পেরিয়ে কাজে যায়। কৃষির সাথে কৃষকদের গড়ে উঠে নতুন অনুষঙ্গ।

পরীর গা থেকে জ্বর নেমে গেছে৷ গতকালের পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিল না৷ সকল পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করে নিল৷ আরিয়ানকে নিয়ে নদীর ঘাটে চলে যায়৷ নদীতে ছিপ ফেলে মাছ ধরবে৷ পরীর কাছে ছিপ ফেলে মাছ ধরার মতো বৃথা চেষ্টা করার মতো কাজ পৃথিবীতে অদ্বিতীয়। শখের বসে ছিপ ফেলে বসে থাকা যায়৷ নদীতে ছিপ ফেলে মাছ ধরার জন্য প্রহরের পর প্রহর বসে থাকতে হয়৷

পলক হোসাইন সকালের খাবার শেষ করে আয়েশা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“পরীকে নিয়ে কি ভাবলে? ভার্সিটির কোচিং করাবে নাকি মেডিক্যাল কোচিং৷ আমার মতে ভার্সিটির কোচিং করানোই ভালো হবে৷”

আয়েশা বেগম লাহাড়ি ঘরের সামনে বসে চাল ঝার দিচ্ছিল৷ পলক হোসাইনের কথায় মাথা তুলে তাকালেন৷ ঠোঁট কিঞ্চিৎ প্রসারিত করে বলেন,

“পরীকে নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না। পরীকে নিয়ে ভাবার জন্য আমি আছি৷ স্কুল প্রধানের কাছে বদলির জন্য চিঠি লিখেছি৷ মেয়ের পড়াশোনার জন্য আমরা কোথায় যাচ্ছি সেটার খুঁজ আপনি কোনদিন পাবে না৷”

রাগে গা শিহরিত হয়ে উঠল৷ ক্ষোভ নিয়ে প্রশ্ন করল,

“পরী কি তোমার একার মেয়ে?”

“জন্ম দিলেই বাবা হওয়া যায়না৷ বাবা হওয়ার দায়িত্ব পালন করতে হয়৷ কোনদিন বাবার দায়িত্ব পালন করেছেন। সেই ৭৪ থেকে আমি পরীকে দেখে রেখেছি৷ পরীর গায়ে কোন আঁচ আসতে দেয়নি৷ আর কখনও আসতেও দিব না৷”

“দায়িত্বশীল মা হয়ে বড় মেয়েকে বাঁচাতে পারলে না কেন? পরী আমার মেয়ে৷ ঢাকায় যাওয়ার সময় আমি পরীকে সাথে নিয়েই যাব৷ সাহস থাকলে আটকিয়ে দেখিও৷ এই গ্রামে আমি পরীকে রাখতে চাইনা৷”
আয়েশা বেগম পারুলের কথা শুনে কিছুটা কষ্ট পান৷ কিন্তু সেই কষ্ট বাহিরে প্রকাশ করলেন না। শান্ত গলায় বলেন,

“পরী যেতে চাইলে নিয়ে যান৷ এমন যেন না হয় আপনার লাশের উপর দিয়ে পরীকে অন্য কোথাও নিয়ে যায়৷ পারুল, পরীর জন্য তো ভালো বাবা হতে পারলেন না৷ অন্তত আরিয়ানের জন্য ভালো বাবা হোন৷ আরিয়ানের জন্য আপনি এখনও আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন৷ নয়তো আপনার ঘাড়ে মাথা থাকত না৷ আমি আমার সন্তানদের এতিম করতে চাইনা৷”

আয়েশা বেগমের কথায় আরও রেগে যান৷ সামনের রাখা চেয়ালে লাথি দিয়ে কর্কশ কন্ঠে বলল,

“অস্ত্র তুমি একা চালাতে জানো না৷ আমিও প্রয়োজনে অস্ত্র হাতে তুলতে পারি৷ আমাকে তুমি মেয়ের কাছ থেকে আলাদা করতে পারবে না৷”

আয়েশা বেগম মুচকি হেঁসে চাল নিয়ে লাহাড়ি ঘরে চলে যান৷ আয়েশা বেগম বিচক্ষণ মানুষ৷ সব সময় বুদ্ধি বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন৷ মুক্তিযুদ্ধে তার উপস্থিতির বুদ্ধি দেখে নারীদের দলে প্রধান করা হয়েছিল৷ তার হাসিতে রহস্যের গন্ধ পাওয়া যায়৷
_________

পঞ্চায়েত মশাই একেবারে ভেঙে পড়েন৷ উনার মেজো ছেলে আসিফের মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না৷ আসিফ যাদের সাথে চলাফেরা করত সবাইকে তুলে আনা হয়েছে৷ চলছে তাদের উপর নির্মম অত্যাচার৷ পঞ্চায়েতের মতোই উনার বড় ছেলে আরিফ৷ খারাপের সকল বৈশিষ্ট্য তার মাঝে বিরাজ করে৷ এমন কোন কাজ নেই সে করে না৷ আরিফ ইউসুফের পায়ে গরম তেল ঢেলে বলল,

“বল, আসিফকে কে হত্যা করেছে? মুখ না খুললে তোদের কারোর বেঁচে থাকার অধিকার নেই৷ গরম তুলে তোদের ডুবিয়ে মা’রব।”

ইউসুফ, জুয়েল, শামীম সকলের চোখে মৃত্যুর ভয়৷ কোনদিন ভাবেনি এমন কিছু হবে৷ ইউসুফ আকুল আবেদনের সাথে মিনতি করে বলল,

“বিশ্বাস করেন ভাই৷ আসিফের সাথে আমরা ছিলাম না৷ তুহিন ছিল৷ তুহিনকে মে’রে ফেলেছে৷ আমরা তো মাঝে মধ্যে আড্ডা দিতাম৷”

তাদের কারো কথা আরিফের বিশ্বাস করছে না৷ গরম তেলে ইউসুফের পা ঝলসে গেছে৷ এর থেকে মৃত্যুই ভালো ছিল৷ জুয়েলের কাছে যেতেই আরিফের ডাক পড়ে৷ বসার ঘরে আয়েশা বেগম বসে আছেন৷ আয়েশা বেগমকে দেখে অনেকটা রাগ হয়৷ কিন্তু সময় পরিস্থিতি বুঝে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখে৷ উচ্চস্বরে বলল,

“কাজের সময় বিরক্ত করা একদম পছন্দ করিনা৷”

“তোমার কাজ মানুষদের ভয় দেখানো৷ তাদের জায়গা সম্পত্তি দখল করা৷ নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে কিছু করতে পারনা৷ নিশ্চয় কাউকে বেঁধে রেখেছো?”
আরিফ অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

“ম্যাডাম আমাকে ক্ষেপিয়ে দিবেন না৷ আমি ক্ষেপে গেলে ফল ভালো হবে না৷”

আরিফের রাগ আয়েশা বেগম একটু ভয় পেলেন না৷ অন্য কেউ হলে এতোক্ষণে ভয়ে হিসু করে দিত৷ গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলোকে একটু ভয় দেখালেই রুখে দাঁড়ানোর সাহস পাইনা৷ আয়েশা বেগম শান্ত স্বরে বলেন,

“হুমকি অন্য জায়গায় দেখাবে৷ আমার সামনে ফাঁকা আওয়াজের কোন দাম নেই৷ নিজেকে সাবধানে রাখবে৷ তোমার অত্যাচারের মাত্রা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে৷ কে জানে? আসিফের পর তোমাকেই লক্ষ্য করতে পারে৷”

টেবিলের উপর দুই হাত দিয়ে জোরে শব্দ করে৷ আয়েশা বেগমের দিকে ঝুঁকে বলেন,

“আসিফ পরীকে ভালোবাসত৷ ভালোবাসার মানুষকে ভাইয়ের কাছে পাঠাতে পারি! মেয়ে নিয়ে মেয়েকে নিয়ে সাবধানে থাকবেন৷”
আয়েশা বেগম মুচকি হেঁসে জবাব দিলেন,

“খেলা শুরু৷ খেলায় কে জিতে দেখা যাবে?”
__________

আয়েশা বেগম আর পরী দাঁড়িয়ে আছে একটা গণকবরের সামনে৷ অঝোরে অশ্রুকণা ঝরে যাচ্ছে৷ কোন কিছুতেই বাঁধ মানছে না৷ নিজেকে সবথেকে অসহায় মনে হচ্ছে৷ আয়েশা বেগমের আপন বলতে দুনিয়াতে কেউ নেই৷ এই গণকবরে শায়িত আছে আয়েশার মা, বাবা, ভাই, বোন। পাক সেনারা কাউকে বাঁচতে দেয়নি৷ নির্মমভাবে হত্যা করেছে সপরিবারকে। গ্রামের লোকজন কোন রকম সবাইকে একসাথে সমাধি করেন৷ আয়েশা বেগম কবরের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন,

“নিজের সাথে আর যুদ্ধ করতে পারছি না৷ খুব ক্লান্ত লাগছে নিজেকে৷ পলককে ভালোবেসে ঘর বেঁধেছিলাম৷ আমার ভালোবাসায় কোন কমতি ছিল না৷ আজও তাকে অনেক ভালোবাসি৷ তাকে সামনে দেখলে নিজেই দুর্বল হয়ে পড়ি৷ কেন ভালোবাসার মোহ থেকে বের হতে পারছি না?”

কথা বলতে বলতে হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ে৷ অভিযোগ করার একমাত্র আশ্রয় কবর। মনের গহীনে যত অভিযোগ ছিল সবই বহিঃপ্রকাশ পাচ্ছে৷ পুনরায় উদাসী কন্ঠে বলল,

“আমাকে সাহস ভরসা দেওয়ার মতো কেউ নেই৷ আমি বেঁচে থেকেও জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে আছি৷ ভালোবাসার মানুষ যখন ছেড়ে চলে যায় তখন পুরো পৃথিবী অন্ধকার। এতোটায় ভালোবাসি যে ঘৃণার প্রশ্নই আসে না৷ আমার কাছ থেকে সবকিছু কেঁড়ে নিয়েছে৷ আমি কিছু বলিনি৷ আমার মেয়ের দিকে হাত বাড়ালে আমি ভালোবাসা ভুলে তার হাত কেটে ফেলব৷”

পরীর চোখেও জল৷ মায়ের কান্না দেখে নিজের অজান্তেই কখন যে চোখে জল এসে পড়েছে খেয়াল নেই। পরীর মায়ের কাঁধে হাত রেখে বলল,

“যা হারানোর তা অনেক আগেই হারিয়েছো৷ এখন আর হারানোর ভয় নেই৷ আমি কোনদিন তোমাকে ছেড়ে যাব না৷ তোমায় সব সময় আমি আগলে রাখব। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তোমার পাশে থাকব৷”

আয়েশা বেগম মেয়ের হাতের তালুতে আলতো করে ঠোঁট স্পর্শ করল৷ ভালোবাসায় ভরিয়ে দিল হাতে৷ বেঁচে থাকার জন্য মনে জোর পেল৷ বুকের গহীনে থাকা পাথরটা হালকা হলো৷ আড়ালে আবডালে থেকে উঁকি দেওয়া ভয়গুলো আড়াল থেকেই দেশান্তর হলো৷ নিকটে আসার সাহস নাহি পেল ৷ মায়ায় জড়ানো কন্ঠে বলল,

“তুই আমার পাশে থাকলে তোকে কেউ আমার কাছ থেকে আলাদা করতে পারবে না৷ জীবনের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে হলেও তোকে রক্ষা করব৷ তুই শুধু আমার পাশে থাক৷”
_________________

পলক হোসাইনকে রাতেই ঢাকা ফিরতে বাধ্য করেছে৷ আসরের নামাজ শেষ করে পলক হোসাইনের সামনে যাই আয়েশা বেগম। পাশে বসে ছিল আশালতা এবং আরিয়ান৷ সরাসরি সবার উদ্দেশ্য বলে উঠল,

“আপনারা আজই ঢাকায় চলে যান৷ এই বাড়িতে আর থাকতে পারবেন না৷ থাকলে থাকতে পারেন সমস্যা নেই৷ আমি আর পরী একটা কাজের জন্য শহরে যাচ্ছি৷ ফিরতে দুইদিন সময় লাগবে৷ দুই দিন থেকে যেতে পারেন।”
পলক হোসাইন আরিয়ানকে পরীর কাছে পাঠিয়ে দিল৷ এক পলক তাকিয়ে বলল,

“হঠাৎ শহরে কেন যাচ্ছো? আমার মতে, এমন কোন বিশেষ কোন কাজ নেই৷”

“কাজ আছে৷ পরীকে নিয়ে আমি শহরের দিকে থাকব৷ সেখান থেকে পরী ঠিকমতো কোচিং করতে পারবে৷ বাসা দেখতে যাব৷ দুইদিন আমরা এক ম্যাডামের বাসায় থাকব৷”

“কিন্তু… ”

“কোন কিন্তু নয়৷ আমি যেতে বলেছি মনেই এখন যাবেন৷ আপনাকে আর অপমান করতে চাইনা৷ পরীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নেন। আপনার সাথে পরী যেতে চাইলে নিয়ে যান৷ আমি আটকাব না৷”

পরী কখনও বাবার সাথে যাবে না অটুট বিশ্বাস আছে। পলক হোসাইন প্রস্থান করলে আশালতার উদ্দেশ্য করে বলেন,

“সব কিছুর ঊর্ধ্বে ভালোবাসা। ভালোবাসা দিয়েই সবকিছু জয় করা যায়৷ ভালোবাসা দিয়েই আবার সবকিছু ধ্বংস করা যায়৷ তোমার উপর আমার কোন রাগ, অভিমান, ক্ষোভ কিছুই নেই৷ সবথেকে বড় কথা তুমি একজন মা৷ মা হয়ে তুমি সব করতে পারবে৷”

“আমাদের সাথে ঢাকায় চলেন৷ পরীকে আমি নিজের মেয়ে মনে করি। আমাদের বাসা থেকে পরী লেখাপড়া করবে৷ আপনাদের কখনোও অবহেলা করব না৷ মাথায় করে রাখব।”
আশালতার হাত ধরে বলল,

“তোমাকে আমার যতই ভালো লাগুক। যাকে মন থেকে ভালোবেসেছি সে যখন তোমার সাথে সময় কাটাবে তা দেখতে পারব না। অন্য কারোর সাথে দেখার থেকে মৃত্যু অনিবার্য। দূর থেকে সবকিছু সহ্য করতে পারব৷ কাছ থেকে কিছুই সহ্য করতে পারব না৷ দোয়া করি, তোমাকে যেন কোনো কষ্ট ছুঁতে না পারে৷”

“আপনাকে আমিও আজ একটা কথা দিচ্ছি৷ আমি আপনার চোখের জল একদিন মুছে দিব৷ আপনি আমাদের সাথেই থাকবেন৷ সবকিছু ভাগ দেওয়া যায়৷ ভালোবাসার কোন ভাগ হয়না৷ আমি আপনার ভালোবাসা কেঁড়ে নিছি৷ আপনার চোখে আমি সবথেকে বড় শত্রু৷ আমিই আপনার কষ্ট দূর করব৷ বড় বোনের থেকেও অনেক ভালোবাসি আপনাকে৷”

আয়েশা বেগম আশালতাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল৷ মেয়েটা অন্য সকল মেয়ের থেকে ভিন্ন। কেউ সতিন দেখতে পারে না৷ সেখানে মেয়েটা অনেক ভালোবাসে৷ সব সময় সম্মান করে৷ কতই না অপমান করেছে৷ তবুও কিছুই বলেনি৷ নিজে সব দোয়া কাঁধে নিয়েছে৷
____________

নিখুঁত মৃত্যু আরিফ এর আগে কখনও দেখেনি৷ নিজের বাড়িতেই এসে কেউ এভাবে নাকের ডগা দিয়ে চলে যাবে বুঝতে পারেনি৷ কে হতে পারে? পাগলা কুকুরকেও হার মানিয়েছে৷ ইউসুফ, জুয়েল, শামীমকেও মুক্ত করেছে৷ কেউ কিছুই বুঝতে পারছে না৷ আরিফের ভয়টা আরও তীব্র হয়৷

চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে