Saturday, July 19, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 217



তুমি এলে তাই পর্ব-০২

0

#তুমি_এলে_তাই
#লেখিকাঃইশরাত_জাহান_অধরা
#পর্বঃ০২
চৈতি লিফট থেকে নেমে বাসায় গিয়ে বিছানায় ফ্যান ছেড়ে শুয়ে পড়ল।আচ্ছা লোকটা নিশ্চয়ই লিফট ব*ন্ধ করার কথা বলছিল।অন্য কোন কথা বলার তো প্রশ্নই উঠে না।কারন লোকটাকে ও চিনে না।নির্ঘাত কোন জরুরি কাজ ছিল।নয়তো একটা মানুষ সামান্য লিফটের জন্য এভাবে দৌড়ায় না।দুর আমি কেন আগে বুঝলাম না।আর লিফটের দরজাটাও কিছু বুঝে উঠার আগেই ব*ন্ধ হয়ে গেল।লোকটা আমাকে নিয়ে কি ভাবল?আমি কোন কাজেরই না।কারোর জন্যই না।যাইহোক যা হবার হইছে। আমি তো আর ইচ্ছা করে এমন করি নাই।উনার সাথে দেখা হলে ক্ষমা চেয়ে নিব। তাইলেই তো সব সমস্যা শেষ।হুম! তাই করতে হবে।
এসব ভেবেই বিছানা থেকে উঠে বাথরুমে চলে গেল।হাত মুখ ধুয়ার জন্য। হাত মুখ ধুয়ে বাথরুম থেকে বের হতেই দেখল মা বসে আছে।হাতে থাকা তোয়ালেটা চেয়ারের উপর রেখে মার পাশে বসে পরল।মা একটা ছবি চৈতিকে দিলেন।চৈতি ছবিটা রেখে দিয়ে বলল,

“আমার পছন্দে কি আসবে যাবে মা?আমি পছন্দ করলেই কি আর না করলেই কি?কেও তো আমাকে বিয়ে করবে না।শুধু শুধু এসব কেন করছ?এই কথা তুমিও জানো আমিও জানি।তাহলে কেন বারবার আমাকে ওদের সামনে মাথা নত করতে দাও?কেন ওদের সামনে আমাকে হাসির পাত্র বানাও?আমি ক্লান্ত। আমি আর পারছি না।এত তাড়া কিসের আমাকে তাড়ানোর?আমি এতটাই বোঝা হয়ে গেছি তোমাদের উপর?যে এখন কোনমতে বিয়ে দিতে পারলেই বাঁচো তোমরা?এইবার তো থামো!আমি সত্যিই আর পারছি না।তোমাদের যদি এতোই সমস্যা হয় আমাকে নিয়ে তাহলে বলে দিও।আমি চলে যাব কোথাও। তাও আমার উপর এভাবে মানসিক টর্চার করো না।”

বলেই রুম থেকে বেরিয়ে গেল।রেহানা বেগম মেয়ের কথা শুনে চুপ হয়ে বসে রইলেন।
.
.
শুভ্র ছাদে এসে ফোনে কথা বলছিল।এমন সময় হঠাত কারোর ফোপানো কান্নার আওয়াজ শুনে ফোনটা রেখে ভ্রু কুচকে আশেপাশে খুজে দেখল লিফটের সেই মেয়েটা কান্না করছে ছাদের ফ্লোরে হাটু মুড়ে বসে।মেয়েটাকে এভাবে কান্না করতে দেখে আরও অবাক হলো সে।আশেপাশে তাকিয়ে দেখল কেও নেই।শুভ্র কি করবে সেটাই বুঝতে পারছে না।এখানে থাকবে নাকি চলে যাবে?বরং চলে যাওয়াই ভালো। মেয়েটাকে ডিস্টার্ব করার কোন মানেই হয় না।ও ওর মতো কান্না করুক।এসব ভেবেই ছাদ থেকে নেমে নিজের রুমে এসে বিছানায় বসে কি যেন ভেবে পাশের টেবিল থেকে টিস্যুর বক্স নিয়ে আবার ছাদে চলে গেল।মেয়েটার সামনে টিস্যুর বক্সটা রেখে দিয়ে পাশে বসে গেল।হুট করে সামনে টিস্যুর বক্স দেখে চৈতি চমকে পাশে ফিরে দেখল শুভ্র ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।চৈতিকে তাকাতে দেখে শুভ্র বলল,
এভাবে রাতের বেলা ছাদে এসে কান্না করবেন না।
চৈতি অন্ধকারে শুভ্রর লিপ রিডিং করতে পারল না।সামনে টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু নিয়ে নাক মুখ মুছল। অতঃপর বসা থেকে উঠে চলে গেল।শুভ্র চৈতির যাওয়ার দিকে হা করে তাকিয়ে মনে মনে বলল,

“এই মেয়ে এমন কেন?আমাকে একটা ধন্যবাদও দিয়ে গেল না?আজব মেয়ে তো!এজন্যই মানুষ বলে নিজ থেকে উপকার করতে নেই।আমিও না!৫ টা মিনিট লস আমার।কিন্তু মেয়েটা কান্না কেন করতেছিল?যেই কারনেই কান্না করুক। আমার কি?আমার জেনে লাভ কি?”

ভেবেই বসা থেকে উঠে নিজের রুমে চলে গেল।
পরেরদিন,
চৈতি সকাল সকাল উঠে রেডি হয়ে ব্রেকফাস্ট খেয়েই কলেজে চলে গেল।নিজের সিটে বসতেই আশরাফ ক্লাসে প্রবেশ করল।চৈতি মনে মনে ভাবল এই লোকটাই কেন আমাদের ক্লাসে পরল?দুনিয়াতে কি স্যারের অভাব পরছিল?আশরাফ ক্লাসে প্রবেশ করেই চৈতির দিকে এক পলক তাকাল।দেখল চৈতি মাথা নিচু করে বসে আছে।আশরাফ হালকা কেশে বলল,

“সবাই সোজা হয়ে বসুন।স্পেশালি মিস চৈতি আপনি।নাকি সোজা হয়েও বসতে পারেন না?”

আরশি চৈতিকে বলল সোজা হয়ে বসতে।চৈতি সোজা হয়ে বসে ব্লাকবোর্ডের দিকে তাকাল।আশরাফ আর কিছু না বলে ক্লাস করানোতে মনযোগ দিল।ক্লাসে শেষে চৈতি আরশিকে বাই বলে রাস্তা দিয়ে হাটছিল।হঠাত শুভ্রকে সামনে দেখে দাড়িয়ে গেল।শুভ্রও চৈতিকে দেখে অবাক হয়ে গেছে।মনে মনে ভাবল,
“এই মেয়েকে সব জায়গাতেই দেখি কেন?”

চৈতি হঠাত দেখল শুভ্র দৌড়ে এসে চৈতির হাত ধরে রাস্তার পাশে নিয়ে আসল।চৈতি প্রথমে কিছু না বুঝল না।শুধু পাশে তাকিয়ে একটা ট্রাককে চলে যেতে দেখল।

“কানে শুনেন না নাকি আপনি?পিছনে ট্রাক আসছে খেয়াল নাই?নাকি সুসাইড করার জন্য দাড়িয়ে ছিলেন?”

চৈতি ব্যাগ থেকে একটা খাতা আর কলম বের করে কিছু লিখে শুভ্রের হাতে দিল।শুভ্র ভ্রু কুচকে খাতাটা নিয়ে দেখল,

“গতকালের ব্যবহারের জন্য আমি দুঃখিত।আসলে আমি বুঝতে পারিনি আপনি যে লিফট খোলা রাখার কথা বলছিলেন।আর যখন বুঝলাম তখন লিফট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।টিস্যু দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। সাথে এখনের জন্যও।আর হ্যা আপনি ঠিক বলেছেন আমি কানতে শুনতে পাই না।সাথে কথাও বলতে পারি না।নয়তো মুখেই আপনাকে ধন্যবাদ দিতাম।আসি।ভালো থাকবেন।আল্লাহ হাফেজ।”

শুভ্র লেখাটা পড়েই স্তব্দ হয়ে গেল।ও কিনা মেয়েটাকে কি না কি ভেবেছিল।নিজের উপর নিজেরই রাগ লাগছে।চৈতি ততক্ষনে খাতা নিয়ে চলে গিয়েছে।
শুভ্র বাসায় গিয়ে ইউটিউবে সার্চ দিল কিভাবে সাইন ল্যাংগুয়েজে কথা বলতে হয়।শাওন ওকে এসব করতে দেখে বলল,

“কিরে তুই হঠাত এসব শিখছিস কেন?”

“একজনের সাথে কথা বলব তাই।”

“অই একজন টা কে?কোন মেয়ে?”

‘তুই বেশি কথা বলিস।তোর কাজ তুই কর।আর আমার কাজ আমি করি”

“হ্যা হ্যা এখন তো এইসবই বলবি পুরান হয়ে গেছি না।নতুন বন্ধু পাইছো বলে কথা!”

“তুই কি যাবি এখান থেকে?নাকি আমি বের করব তোকে?”

“আরেকটা কথা।এটাই লাস্ট।”

“বল।”

“দোস্ত মেয়েরা কে রে?কেমন দেখতে?কিসে পড়ে?কই থাকে?”

শুভ্র শাওনের দিকে তাকাতেই শাওন দাত কেলিয়ে বলল,

“মজা করছিলাম দোস্ত।এমন করস কেন?যাইতাছি তো!”

বলেই রুম থেকে চলে গেল।শুভ্র শাওনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে লেপটপে মনযোগ দিল।
বিকেলবেলা,
শুভ্র হাঁটতে বেরিয়েছিল।হঠাত চৈতিকে দোকানের সামনে দেখে থেমে গেল।অতঃপর কি একটা ভেবে দোকানে গিয়ে বলল,

‘মামা এক কেজি তেল দেন তো!”
দোকানদার ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘এক কেজি?নাকি এক লিটার?”
যে ছেলে কোনদিন দোকান থেকে তেল, ডাল কিনে নি সে কি করে জানবে তেল কেজি তে না বরং লিটারে মাপা হয়?বিড়বিড় করে শুভ্র কোনমতে হেসে বলল,

“অই তো অই আরকি!এক লিটার তেল দেন।”

বলেই চৈতির দিকে তাকিয়ে দেখল চৈতি মোবাইলেে নোটে কি যেন টাইপ করছে।শুভ্র উঁকি দিয়ে লেখাটা পড়ে বলল,

“আর ভাইয়া ওকে এক ডজন ডিম দেন।আমার তেল পরে দিলেও চলবে।”

দোকানদার এক ডজন ডিম চৈতির দিকে দিতেই চৈতি অবাক হয়ে পাশে তাকিয়ে শুভ্রকে দেখল।দোকানদারকে টাকা দিয়ে চৈতি দোকান থেকে বের হতেই শুভ্রও বের হলো।চৈতি মোবাইলে লিখল,

“আপনি কি করে জানলেন যে আমার ডিম লাগবে?”

শুভ্রকে লেখাটা দেখাতেই শুভ্র পকেট থেকে মোবাইল বের করে লিখল,

“আপনার লেখা দেখে।”

“অহ আচ্ছা।”

এইবার শুভ্র চৈতির সামনে দাঁড়িয়ে ইশারায় বলল,

“আমার নাম শুভ্র।আপনার?”

শুভ্রকে সাইন ল্যাংগুয়েজে কথা বলতে দেখে চৈতি অবাক হয়ে তাকাতেই শুভ্র বলল মাথা চুলকে বলল,

“অই একটু আকটু পারি আরকি।আপনার নামটা কিন্তু বললেন না।”

“চৈতি আমার নাম।”
শুভ্র চৈতির ইশারা না বুঝে বলল,

“এটার মানে কি?আমি বুঝিনি।”

চৈতি মোবাইলে টাইপ করে শুভ্রকে দেখাল।নাম দেখে শুভ্র বলল,

“অহ আচ্ছা।”

লিফটে ঢু*কেই কিছুক্ষন চুপ থাকার পর শুভ্র বলল,

“কয়তলা থাকেন আপনি?”

“চারতলা।”

‘আমি পাঁচতলায় থাকি।কোন দরকার হলে বলিয়েন।”

চৈতি উপর নিচে মাথা নাড়ালো।
অতঃপর দুইজনের মাঝে আর কোন কথা হলো না।লিফট চার তলায় আসতেই শুভ্র বলল,

“বাই।ভালো থাকবেন।”
চৈতি মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে লিফট থেকে নেমে গেল।শুভ্রও নিজের বাসায় চলে গেল।
#চলবে………

তুমি এলে তাই পর্ব-০১

0

#তুমি_এলে_তাই
#লেখিকাঃইশরাত_জাহান_অধরা
#সুচনা_পর্ব

২০ টা বিয়ে ভেং*গে যাবার পর ২১ নম্বর বিয়েটাও যে ভাং*বে তা নিয়ে নিশ্চিত ছিল চৈতি।আর হলোও তাই।পাত্রপক্ষ বাসায় এসে মেয়ে দেখতে চাইলেই চৈতিকে তার কাজিনেরা সাজিয়ে ড্রয়িংরুমে পাত্রপক্ষের সামনে নিয়ে যাওয়া হলো।যথারীতি আগেরবারগুলোর মতোই সবাই ওর সৌন্দর্যের প্রশংসা করল।তারপরই পাত্রের মা পান চি*বুতে চি*বুতে বললেন,
“তা মেয়ে তোমার নাম কি?”

উত্তর দিতে পারল না চৈতি।চৈতির মা বলল,
“ওর নাম চৈতি।”

-“বাহ্ বেশ সুন্দর নাম।শুনলাম সবে কলেজে উঠেছো।”

এবারও চৈতির মা-ই উত্তর দিলেন।
“বয়স তো কম।তা রান্না বান্না জানো তো?”

“হ্যা ও রান্না অনেক ভালো করেই জানে।”
“তা তো বুঝলাম।কিন্তু সব কথার উত্তর আপনি কেন দিচ্ছেন?আমি চৈতি মাকে জিজ্ঞেস করেছি।”
“আসলে ও একটু লজ্জাবতী তো।অপরিচিত মানুষের সাথে সহজে কথা বলে না।”

“হুম।লজ্জা থাকা ভালো।”

আরও কিছু বলতে যাবার আগেই চৈতি পাশ থেকে খাতা কলম নিয়ে কি যেন লিখে মহিলার হাতে দিলেন।মহিলা ভ্রু কুচকে তার ছেলেকে বললেন,
“কি লিখেছে দেখতো।আমি আমার চশমাটা আনতে ভুলে গিয়েছি।”

মার কথা শুনে আশরাফ খাতাটা নিয়ে লেখাটা পড়ে কিছুক্ষন স্তব্দ হয়ে বসে রইল।

“কি হলো কি লিখেছে?”

“আম্মু,উনি কথা বলতে পারেন না আর কানেও শুনতে পান না।”

“কিহ?আপনারা এই কথা আগে বলেন নি কেন?”

“আমরা বলতেই যাচ্ছিলাম।আমরা……”

“আপনার কাহিনি শুনতে আমি আসি নি।আমি আমার ছেলেকে এই মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে পারব না।আশরাফ আয়।”

“আমার কথাটা তো শুনুন…..”

কিছু না শুনেই পাত্রপক্ষরা চলে গেল।চৈতির মা দপ করে সোফায় বসে পড়লেন।অতঃপর উঠে মেয়ের কাছে গিয়ে স*জোড়ে দুইটা চ*ড় বসিয়ে দিলেন।

“শান্তি হয়েছে তোর?এইবারের বিয়েটাও ভেং*গে গেল।আমি তোকে নিয়ে আর পারিনা। তোকে জম্ম দেওয়াটাই আমার পাপ হয়েছে।জানিনা এই পাপের খে*শারত কতদিন দিতে হবে।”

চৈতি ওর মার কথাগুলো শুনতে না পেলেও লিপ রিডিং করে সবগুলো কথা বুঝল।নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে ওর।কিন্তু একটা ফ্যামিলিকে কি করে ঠ*কাবে সে?আর সবচেয়ে বড় কথা ওরা তো পরে জানতে পারবেই।তখন কি উনারা মেনে নিবে?
কিছুতেই না।চৈতি কিছু না বলে চুপ করে নিজের রুমে চলে গেল।বিছানায় বসে আনমনে সামনে থাকা চেয়ারটার দিকে তাকিয়ে রইল।নিজের এই অক্ষমতার কারনে ওর সব বন্ধুরা ওকে ছেড়ে চলে গিয়েছে।এখন সবাই ওকে নরমাল মানুষ বলে না বরং এবনরমাল বলে।এসব ভেবেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।রাতের খাবার না খে*য়েই ঘুমিয়ে পরল।
.
.
পরদিন,
চৈতি কলেজে গিয়ে রুমের শেষের বেঞ্চটাতে গিয়ে বসে পরল।এটাই ওর সিট।সবার শেষে।কিছুক্ষনের মধ্যেই একটা মেয়ে এসে চৈতির পাশে বসলো।মেয়েটাকে দেখেই চৈতির মুখে হাসি ফুটে উঠল।
আরশি হাত দিয়ে ইশারা করে বলল,
“কিরে কেমন আছিস?”
চৈতিও হাত ইশারা করে বলল,”হুম ভালো।”

“তোর বিয়ের কি খবর?পাত্রপক্ষ রাজি হয়েছে?”

“নাহ।”

“আমি বুঝিনা ওরা কেন রাজি হয় না।কানে শুনতে না পারা, কথা বলতে না পারাটা কি অপরাধ?তুই তো ইচ্ছা করে এমন হসনি।”

“কেউই চায় না তার ছেলে বধির,বোবা মেয়েকে বিয়ে করুক।এতে ওদেরই বা দোষ কোথায় বল!”

“আমি যদি ছেলে হতাম তোকে নির্ঘাত বিয়ে করতাম।
চৈতিঃআবার শয়*তানি শুরু করে দিয়েছিস?”

“আরে শ*য়তানি না।সত্যি।তুই জানিস না তোকে ফ্রেন্ড হিসেবে পেয়ে আমি কত্ত লাকি।”

“হইছে।পা*ম দেওয়া লাগবে না।”

বলতে বলতেই ক্লাসে টিচার প্রবেশ করল।আরশি ইশারায় বলল,

“স্যার এসেছে।”

চৈতি সামনে তাকাতেই শক খেল।
“হ্যালো!আমি আশরাফ। আপনাদের নতুন ম্যাথ টিচার।সবাই নিজ নিজ পরিচয় দিন।”

সবাই একে একে পরিচয় দিতে দিতে চৈতির পাল্লা আসল। আরশি ওর হয়ে বলল,
“স্যার ওর নাম চৈতি।”

“কিন্তু আমি তো আপনাকে জিজ্ঞেস করিনি।ওর পরিচয় ও দিবে।আপনি কেন দিবেন?”

এরমধ্যেই একজন মেয়ে বলে উঠল,
“স্যার ও বোবা। সাথে কানেও শুনতে পায় না।”

“এই কলেজে যে এমন স্টুডেন্ট আছে জানতামই না।জানলে কোনদিন জয়েন হতাম না।”

“স্যার ও বোবা,বধির হতে পারে কিন্তু ও এতটাও খারাপ ছাত্রী না। আপনার পড়া বুঝাতে কোন অসুবিধা হবে না।”

“অহ, তাই নাকি?”
আশরাফ কিছু না বলে ব্লাকবোর্ডে একটা অংকের প্রশ্ন তুলে দিয়ে বলল,
“এই অংকটাকি কেও পারো?একচুয়ালি আমি পারি না।”

সবাই বলে উঠল, “নাহ স্যার।”

“চৈতি যেহেতু এত ভালো স্টুডেন্ট সেহেতু ও পারবে আমি সিউর।”

অতঃপর চৈতিকে উদ্দেশ্য করে আশরাফ বলল,
“মিস চৈতি। প্লিজ এই অংকটা করে আমাদের সবাইকে বুঝিয়ে দিন।”

আরশি অংক দেখে বলল,
“কিন্তু এই চ্যাপ্টার তো আমাদেরকে এখনো করানো হয়নি।”

“আপনিই তো বললেন ও অনেক ভালো স্টুডেন্ট।আমার বিশ্বাস ও এই অংকটা পারবে।ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্টদের এত অংক করা লাগে না।ওরা সব অংকই পারে।কই মিস চৈতি আসুন।একটু পর ঘন্টা দিয়ে দিবে।”

চৈতি ব্লাকবোর্ডের দিকে এগিয়ে গেল। গিয়ে চুপচাপ দাড়িয়ে রইল।

“কি হলো অংকটা করুন?আই থিংক কথা আর শ্রবনশক্তির সাথে সাথে উনার ব্রেনটাও আকাশে উড়ে গেছে।”

এই কথা শুনতেই সারা ক্লাসে হাসির রোল পরে গেল।চৈতি মাথা নিচু করে আছে।উনি কেন ওর সাথে এরকম বিহেভ করছে তা বুঝতে পারছে না।এই অপমানগুলো করার মানে কি?চোখ ফে*টে কা*ন্না আসছে চৈতির।কিন্তু ও ওর কা*ন্না কাওকে দেখাতে চায় না।

“যান।সিটে গিয়ে বসুন।অহ আপনি তো আবার কানে শুনেন না।মিস আরশি আপনার বান্ধবীকে সিটে বসতে বলুন।”
.
.

“আমি বুঝলাম না।উনি তোর সাথে এরকম ব্যবহার করল কেন?মানুষের অ*ক্ষমতা নিয়ে ঠা*ট্তা করতে মনে হয় উনার ভালো লাগে।বা*জে লোক কোথাকার।”

চৈতি হালকা হেসে ইশারায় বলল,
“উনিই গতকালকে আমাকে দেখতে এসেছিলেন।”

“কিহ?তারমানে উনি সবটা জেনেও তোকে এতগুলা কথা শুনালো?কি আজব লোক!”

“বাদ দে।আমি কিছু মনে করিনি।এসব শুনতে শুনতে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে।”

“ভালোই হয়েছে তোর সাথে উনার বিয়েটা হয়নি।নয়তো ভবিষ্যতে তোকে উঠতে বসতে অ*পমান করত।”

চৈতি হেসে বলল,
“অ*পমান করলেও ভালো হতো।এটলিস্ট বিয়েটা তো হতো।আম্মুর চিন্তিত মুখ দেখতে আমার ভালো লাগে না।”

“দেখিস একদিন এক রাজপুত্র এসে তোর সব ক*ষ্ট দুর করে দিবে।”

“রাজপুত্র?আমাকে রিকশাওয়ালাও বিয়ে করবে না।রাজপুত্র তো দুরের কথা।”

“দেখ এবার কিন্তু তুই নিজেকে নিজে অপমান করছিস।আমার কথা ভবিষ্যতে মিলিয়ে নিস।বলব কথা ভবিষ্যতে।”

চৈতি হেসে দিল আরশির কথা শুনে।অতঃপর বলল,
“দেখা যাবে। ”
.
.

“লিফটের দরজাটা ব*ন্ধ করবেন না প্লিজ।”

লিফটে উঠতেই লিফটের বাইরে থাকা ছেলেটা লিফটের দিকে দৌড়াতে দৌড়াতে কথাটি বলে উঠল।চৈতি ছেলেটার কথা বুঝে উঠার আগেই লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে গেল।শুভ্র লিফটের গায়ে রাগে স*জোড়ে পা দিয়ে বা*রি দিল।

“আচ্ছা বেয়া*দপ মেয়েতো!আমি ওকে বললাম লিফটের দরজা খো*লা রাখতে আর ও কিনা ভ্যাব*লার মতো তাকিয়ে রইল?ইচ্ছা করে এমন করছে অই মেয়ে।ভ*দ্রতার ভ ও শিখেনাই।আর একবার খালি দেখা হোক ভ*দ্রতা শিখিয়ে দিব।”
চলবে….

তুমি ছিলে বলেই ২ পর্ব-১৬ এবং শেষ পর্ব

0

#তুমি_ছিলে_বলেই২
#পর্বঃ১৬(অন্তিম)
#দিশা_মনি

স্নেহা নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে নিজের ঘরের মাঝে। তার মনে নানান চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। অনেক অনিশ্চয়তা অনেক কষ্ট অনুভব করছে সে। তবুও নিজেকে শান্ত রাখার বৃথা চেষ্টা দেখা যাচ্ছে তার মধ্যে।

স্নেহা বর্তমানে একটি রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এই রুমেই থাকেন আব্বাস চৌধুরী। যিনি স্নেহার জন্মদাতা পিতা। তবে আব্বাস চৌধুরীর বর্তমান অবস্থা বেশি ভালো না। কারণ তিনি অনেক দিন থেকে প্যারালাইজড হয়ে পড়ে আছেন। স্নেহা ধুপধাপ পা ফেলে এসে উপস্থিত হলো আব্বাস চৌধুরীর রুমে। আব্বাস চৌধুরী তখন গভীর ঘুমে আছন্ন। স্নেহা তার পাশে বসল। তার দিকে তাকিয়ে রইল অপলক। এই লোকটার চেহারার সাথে তার চেহারার অনেক সাদৃশ্য আছে। স্নেহা আব্বাস চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল,
‘আপনি আমার মাকে কেন ঠকালেন? কি দোষ করেছিলেন উনি?’

আব্বাস চৌধুরী যেন জেগে বসলেন। স্নেহাকে দেখে কিছু বলার চেষ্টা করল কিন্তু স্নেহা তার কথার কিছুই বুঝল না। শুধু ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল। এমন সময় রুমে চলে আসলো দীপ্র। স্নেহাকে আব্বাস চৌধুরীর রুমে দেখে সে জিজ্ঞেস করল,
‘তুমি চাচার রুমে কি করছ?’

স্নেহা উঠে বসে। বলে,
‘ভুল করে এখানে চলে এসেছিলাম।’

দীপ্র স্নেহার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায়। এরপর বলে,
‘ভুল করে চলে এসেছিলে সেটা নাহয় মানলাম কিন্তু ওনার পাশে বসেছিলে কেন? সেটাও কি ভুল করে?’

স্নেহা কি বলবে সেটা বুঝতে পারে না। দীপ্র স্নেহার হাত শক্ত করে ধরে বলে,
‘তোমার আসল উদ্দ্যেশ্য করে সেটা আমায় বলো।’

‘আমার কোন উদ্দ্যেশ্য নেই।’

‘তুমি যাই বলো, আমি আর তোমায় বিশ্বাস করতে পারছি না। তোমার নিশ্চয়ই কোন বাজে মোটিভ আছে তাই না? এই জন্য তো তুমি গ্রাম বাসীদের ফুসলিয়ে আমায় বিয়ে করেছ।’

স্নেহা হতবাক নয়নে তাকায়। দীপ্র বলে,
‘তুমি নিশ্চয়ই এটাই ভাবছ যে আমি এতকিছু জানলাম কিভাবে। তোমার ভাবনার জবাব আমি দিচ্ছি,আমি সবকিছু জেনেছি একজন গ্রামবাসীর মাধ্যমে। এখন ভালোয় ভালোয় তোমার সব উদ্দ্যেশ্য সম্পর্কে আমায় বলো।’

স্নেহা বুঝল এখন আর চুপ থেকে কোন লাভ নেই। সে চুপ থেকে এখন আর কিছু হ্যান্ডেল করতে পারবে না। তাই সে বলল,
‘আমি সব কিছু করেছি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য।’

‘ প্রতিশোধ? কিসের প্রতিশোধ?’

‘আমার মায়ের সাথে হয়ে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ।’

‘কে অন্যায় করেছে তোমার মায়ের সাথে?’

‘আপনার পরিবার।’

দীপ্র স্নেহার দিকে ভালো করে দেখতে লাগল। এতদিন তার মনে হতো স্নেহার সাথে এই বাড়ির কারো চেহারার অনেক মিল। তবে আজ সে শতভাগ নিশ্চিত হয়েছে যে স্নেহার সাথে কার মিল। দীপ্র নিজের ধারণা মেলানোর জন্য আব্বাস চৌধুরীর কাছে গেল। একবার আব্বাস চৌধুরীকে দেখল তো একবার স্নেহাকে। অবাক হয়ে বললো,
‘তার মানে তুমি কি….’

‘আপনি যেটা ভাবছেন সেটাই ঠিক। আমি আব্বাস চৌধুরীর মেয়ে। তবে কোন অবৈধ সন্তান নই। আপনার চাচা আমার মাকে ইসলাম মতে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু আপনাদের পরিবারের লোকজন নিজেদের বংশ মর্যাদার কথা বলে এই বিয়েটাকে স্বীকৃতি দেয়নি। আমার মাকে বারবার অপমান করে তাড়িয়েছি। এমনকি আমার মাকে হ**ত্যাও করা হয়েছে আর এর পেছনে রয়েছে আপনার পরিবারের হাত।’

‘তুমি এসব কিছু কিভাবে এত নিশ্চিত হয়ে বলতে পারছ? তোমার জানার মধ্যে কোন ভুলও তো থাকতে পারে। তাইনা?’

‘আমার জানায় কোন ভুল নেই। আমি যা জানি তা শতভাগ সঠিক।’

‘প্রমাণ কি?’

‘আপাতত আমার কাছে কোন প্রমাণ নেই। তবে আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি সব প্রমাণ করে দেব। আর যদি না পারি তাহলে আমার এই মুখ আর আপনাকে দেখাব না।’

‘ঠিক আছে, আগে সব প্রমাণ করো তারপর বড় বড় কথা বলিও। আর আমি তোমার উপর সব সময় নজর রাখবো। আমার পরিবারের কোন ক্ষতি করতে আমি তোমায় দেব না।’

স্নেহা দীপ্রকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,
‘আপনার পরিবার আমার যে ক্ষতি করেছে তা অপূরণীয়। আর এর শাস্তি তো তাদের পেতেই হবে। আমি তাদের এর শাস্তি দেবোই।’

‘আমি ঢাল হয়ে দাড়াবো আমার পরিবারের সামনে। দেখি তুমি কি করতে পারো।’

‘আমি কি করতে পারি সেই সম্পর্কে আপনার কোন ধারণাই নেই মিস্টার দীপ্র চৌধুরী। আমার মায়ের উপর হওয়া অন্যায়ের বদলা নেওয়ার জন্য আমি অনেক নিচে নামতে পারি। যা আপনি ধারণাই করে উঠতে পারবেন না। কারণ এটা আপনার ধারণার বাইরে।’

‘তুমি কি আমাকে ভয় দেখাতে চাচ্ছ?’

‘মনে করুন তাই। আমি ভয় দেখাচ্ছি। কারণ এটা আমার মায়ের উপর হওয়া অন্যায়ের জন্য আমায় করতে হবে।’

‘ঠিক আছে। আমিও দেখি কার কত দম।’

দীপ্র বেরিয়ে যায়। স্নেহা দীপ্রর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘আমার মায়ের সাথে হওয়া সকল অন্যায়ের বদলাই আমি নেব। আমাকে আমার উদ্দ্যেশ্য থেকে কেউ পিছে ফেলতে পারবে না। আপনিও না। আমার উদ্দ্যেশ্য আমি যে করেই হোক সফল করব।’


নিপুণের হুশ ফিরলে সে নিজের চোখের সামনে রুদ্রকে দেখতে পায়। দ্রুত উঠে বসে এবং বলে,
‘আপনি? আমি এটা কোথায়?’

‘আপনি এখন আমার রুমে রেস্ট নিচ্ছেন।’

‘আপনার রুমে?’

‘হ্যাঁ। আমার অফিসেই নিজের থাকার জন্য অন্য একটা রুম আমি বানিয়েছি। এই রুমে আমি থাকি।’

‘ও ঠিক আছে।’

সে উঠে বসতে নিতেই রুদ্র বলল,
‘আপনি অসুস্থ। বিশ্রাম নিন।’

নিপুণ তবুও উঠে বলে,
‘আমি এখন ঠিক আছি। ধন্যবাদ।’

জীবনের মোড় কোথায় নিয়ে যাবে নিপুণ রুদ্র আর দীপ্র-স্নেহাকে। জানতে হলে অপেক্ষা করতে হবে তৃতীয় সিজনের জন্য।

সমাপ্ত
[আমার খুব কাছের এক বন্ধুকে হারিয়ে ফেলেছি। আমি অনেক কষ্টে গল্পটা লিখলাম। আপাতত গল্পটা শেষ হলো তবে অসম্পূর্ণ কাহিনি তৃতীয় সিজনে শেষ করব ইনশাআল্লাহ। আমি বর্তমানে মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছি। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন এবং আমার বন্ধুর জন্য দোয়া করবেন। আল্লাহ যেন তাকে জান্নাত বাসী করে ]

তুমি ছিলে বলেই ২ পর্ব-১৫

0

#তুমি_ছিলে_বলেই২
#পর্বঃ১৫
#দিশা_মনি

স্নেহা আজ সকালে উঠেছে থেকে দম ফেলার সময় পাচ্ছে না। খোদেজা চৌধুরী তাকে টেনে নিয়ে এসেছে বাইরে। তারপর তার দিকে অনেকগুলো কাপড় বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
‘যাও গিয়ে এই কাপড় গুলো ভালো করে পরিস্কার করে রাখো। তুমি যে এই বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছ এটাই অনেক। এখন এই বাড়িতে বউ হয়ে নয় কাজের লোক হয়ে থাকতে হবে।’

খোদেজা চৌধুরী যখন রাহেলাকে এই ব্যাপারে বলছিল তখন রাহেলা চৌধুরী সেখান দিয়েই যাচ্ছিলেন। তিনি বলেন,
‘একদম ঠিক কাজ করছ তুমি। এই মেয়েকে আরো খাটাও৷ একদম শান্তিতে থাকতে দেবে না। একে দেখলেই আমার মাথায় আগু*ন জ্বলছে। শুধুমাত্র এর জন্য আমার নিপুণ এখন ঘরছাড়া।’

স্নেহা কোন প্রতিবাদ করল না। মুখ বুজে সব কাজ করল। তবে ভিতরে ভিতরে সে ঠিকই নিজের সব পরিকল্পনা সাজিয়ে রেখেছে। কিন্তু নিজের মায়ের আসল খু**নি সম্পর্কে যতদিন না পর্যন্ত সে জানতে পারছে ততদিন তাকে এসব কিছু সহ্য করতেই হবে। নাহলে তো সে এখানে টিকতেই পারবে না। এখানে টিকে থাকার জন্য হলেও তাকে এখন কিছুদিন নিজের শক্ত খোলস ত্যাগ করে নরম হয়ে থাকতে হবে। এটা মোটেই তার দূর্বলতা নয়। বরং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে টিকে থাকার পন্থা।

স্নেহা যখন সব কাপড় চোপড ধুয়ে ছাদে সেসব শোকানোর জন্য গেল তখন হঠাৎ করেই তার দেখা হয়ে গেল দিলারা চৌধুরীর সাথে। দিলারা চৌধুরী স্নেহার দিকে ভালো ভাবে তাকিয়ে বললেন,
‘আমার ছেলে যে তোমায় কি দেখে বিয়ে করল, আমি জানি না। যাইহোক, তুমি এই সাজসজ্জা বদলে নাও। আমাদের বাড়ির মেয়ে বউরা এমন ভাবে থাকে না। তুমি আমার সাথে আমার রুমে চলো আমি তোমাকে আমার শাড়ি পড়তে দিচ্ছি।’

স্নেহা মাথা নাড়ায়। দিলারা চৌধুরী স্নেহাকে তার রুমে নিয়ে গিয়ে নিজের খুব সুন্দর একটা দামি শাড়ি স্নেহাকে দিয়ে বলে,
‘নাও। এটা পড়ো।’

স্নেহা শাড়িটা দেখেই বুঝতে পারে এটা অনেক দামি। তাই সে বলে,
‘এত দামি শাড়ি আমি পড়ব?’

‘হ্যাঁ, পড়বে। আমার ছেলেকে যখন বিয়ে করতে পেরেছ তখন এই শাড়িও তুমি পড়তে পারবে। আর একটা কথা, তোমাকে এই বাড়ির সব কাজ করতে হবে না। বাড়ির কাজ করার জন্য কাজের লোক আছে। খোদেজা, রাহেলা তোমায় মেনে নিতে পারছে না তাই তোমাকে এভাবে খাটাচ্ছে।’

স্নেহা হঠাৎ কি মনে করে যেন দিলারা চৌধুরীকে প্রশ্ন করে বসল,
‘আপনি কি আমায় মেনে নিতে পেরেছেন?’

দিলারা চৌধুরী এই প্রশ্নের কোন উত্তর দিলেন না। স্নেহার যা বোঝার সে বুঝে নিলো। দিলারা চৌধুরীকে স্নেহার এই চৌধুরী বাড়ির একজন ভেজালহীন সদস্য মনে হলো। যিনি হয়তো খুব ভালো মনের অধিকারী। কিন্তু নিজের স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির জন্য যাকে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে হয় সবসময়।

স্নেহা ধ্যান থেকে বেরিয়ে আসে। দিলারা চৌধুরী ততক্ষণে রুম থেকে বেড়িয়ে গেছে৷ স্নেহা তার দেওয়া শাড়িটা পড়ে নেয়। এই প্রথম শাড়ি পড়লো স্নেহা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে নিজেই অবাক হলো সে। বড্ড অচেনা লাগছে তার নিজেকে। সর্বদা শার্ট-প্যান্টে নিজেকে আবৃত রাখা এই মেয়েটাকে শাড়ি পড়ে যে এত সুন্দর লাগতে পারে সেটা তার কল্পনাতেই ছিল না কখনো। কিছুক্ষণ পরেই দিলারা চৌধুরী রুমে এলেন৷ স্নেহাকে দেখে তিনি নিজেও বেশ অবাক হলেন৷ একটু আগেই যেই মেয়েটাকে বেশ উগ্র এবং উশৃংখল লাগছিল শাড়ি পড়েই কেমন যেন কোমলতায় মুড়িয়ে গেল তার শরীর।

দিলারা চৌধুরী কিছু বলবেন তার আগেই খোদেজা চৌধুরী এসে স্নেহাকে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,
‘এই মেয়ে তুমি এখানে কি করছ হ্যাঁ? তোমার কি কোন কথা কানে যায়না? এই বাড়িতে থাকতে চাইলে কিন্তু এমন পটের বিবি সেজে থাকলে চলবে না। যাও গিয়ে সকলের জন্য রান্না করো।’

স্নেহা চুপসে যাওয়া মুখে বলে,
‘কিন্তু আমি তো রান্না পারি না।’

দিলারা চৌধুরী বললেন,
‘আহ, খোদেজা। তুমি ওকে এসব করতে বলছ কেন? বাড়িতে তো কাজের লোক আছেই।’

‘আমি সেটা জানি ভাবি। কিন্তু ভাইজানের আদেশেই আমি ওকে এসব করতে বলছি। ভাইজান আমাকে বলে দিয়েছেন এই মেয়েটাকে দিয়ে এসব করাতে। নিশ্চয়ই তুমি চাওনা আমি ভাইজানের কথার অবাধ্য হই?’

দিলারা চৌধুরী আর কিছু বললেন না।
নিজের স্বামীকে বড্ড সম্মান করেন তিনি। কখনো তার কোন কথার অবাধ্য হন না। এমনকি সেটা যদি তার মনের বিরুদ্ধেও করতে হয় তবুও। এইজন্য তো তার মেয়েকে যখন তার স্বামী ত্যাগ করল তখনও চুপ ছিলেন। তাই যখন জানলেন তার স্বামীর আদেশেই স্নেহাকে সব করতে হবে তখন তিনি আর বিরুদ্ধাচারণ করতে চাইলেন না। স্নেহাকে বললেন,
‘ও যা বলছে তাই করো। রান্না না পারলে কোনভাবে ম্যানেজ করার চেষ্টা করো। এখন তো মডার্ন যুগ তাই আশা করি খুব একটা অসুবিধা হবে না।’

স্নেহা বুঝল দিলারা চৌধুরী পক্ষান্তরে তাকে সাহায্য করল এই কথা বলে। দিলারা চৌধুরীর ইঙ্গিত বুঝতে পেরে স্নেহা নিজের ফোন সাথে নিয়ে খোদেজা চৌধুরীর উদ্দ্যেশ্যে বললেন,
‘চলুন আমি যাচ্ছি আপনার সাথে।’

✨✨✨✨
নিপুণ রুদ্র চৌধুরীর অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় আধঘন্টা হতে চলল৷ কিন্তু রুদ্রর কোন পাত্তাই নেই। যারপরনাই বিরক্ত হলো নিপুণ। এমন সময় রুদ্র চৌধুরীর ম্যানেজার এসে তাকে বললো,
‘স্যার আজ অনেক বিজি আছেন। তাই আজ আপনার সাথে দেখা করতে পারবেন না।’

‘বিজি মানে? আমি আধঘন্টা ধরে এখানে বসে আছি। আমার সময়ের কি কোন দাম নেই? আপনার স্যার নিজেকে কি ভাবেন? প্রাইম মিনিস্টার? ৮ বছর জেল খেটেছেন আবার গতকালই জামিন পেলেন..তার এত এটিটিউড মানায় না।’

‘এটিটিউড আমার রক্তে আছে যেটা আমি চাইলেই ছাড়তে পারি না।’

কথাটা বলেই ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে এলো রুদ্র। এসে দাঁড়ালো নিপুণের সামনে। নিপুণ রুদ্র চৌধুরীকে দেখে বললো,
‘আমি আপনার থেকে বেশি সময় নেব না। জাস্ট আমাকে দশ মিনিট দিন। আমি কিন্তু আমার নিজের প্রয়োজনে এখানে আসিনি আপনার মা-বাবাকে ন্যায়বিচার..’

‘আমার মা-বাবাকে ন্যায়বিচার পাইয়ে দিতে আমার কোন উকিল বা আইনের প্রয়োজন নেই। এর জন্য আমি একাই যথেষ্ট।’

এতটুকু বলে রুদ্র চৌধুরী চলে যেতে নিলে নিপুণ পেছন থেকে বলে ওঠে,
‘আপনি বোঝার চেষ্টা করুন মিস্টার চৌধুরী….আপনি এভাবে একা কিছু করতে পারবেন না। কেসটা এতটা সহজ না..’

‘সেটা আমি বুঝে নেব।’

‘এত ত্যাড়ামো করবেন না। এতে আপনারই ক্ষতি।’

রুদ্র হঠাৎ থেমে গিয়ে নিপুণের দিকে এগোতে থাকে। আর নিপুণ একটু একটু পিছাতে থাকে। রুদ্র নিপুণের একদম কাছে এসে বলে,
‘কি ক্ষতি হবে আমার?’

‘আপনাকে আবার জেলে যেতে হতে পারে।’

‘আই ডোন্ট কেয়ার। আমার জীবনের একমাত্র উদ্দ্যেশ্য এখন আমার মা-বাবার খু–নিকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া। তারপর আমাকে জেল যেতে হোক বা জাহান্নাম,,,,আমার কিছুই আসে যায়না।’

এই কথা বলে রুদ্র চৌধুরী চলে যায় নিপুণের সামনে থেকে। এদিকে নিপুণ অসহায় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে। একেই দীপ্রর ব্যাপারটা নিয়ে সে ডিপ্রেসড আবার এখানে কেসে এসেও ঝামেলা। হঠাৎ করেই নিপুণের মাথাটা কেমন ঘুরতে লাগল। চারপাশের সবকিছু ঝাপসা দেখতে পাচ্ছিল সে। শরীরের সবটুকু শক্তি যেন ফুড়িয়ে আসছিল। নিপুণ বুঝতে পারে সে আর বেশি সময় দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। অবশ্য এটা হওয়ারই ছিল। একেই গতকাল রাত থেকে সে এখনো অব্দি কিছু খায়নু তার উপর এত স্ট্রেস আর সহ্য হচ্ছিল না।
রুদ্র কি মনে করে যেন পিছনে তাকালো। নিপুণকে দেখে সে বুঝল ওর কোন সমস্যা হয়েছে। রুদ্র নিপুণের দিকে এগোতে যাবে এমন সময় নিপুণ জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যেতে নেয়। রুদ্র একদম সঠিক সময় এসে নিপুণকে ধরে নেয়। নিপুণের মুখের দিকে ভালো ভাবে তাকায়। অনেক ইনোসেন্ট লাগছিল নিপুণকে। চোখমুখের অবস্থা দেখেই মনে হচ্ছে মেয়েটা হয়তো খুব খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। চোখের নিচের ডার্ক সার্কেল বুঝিয়ে দিচ্ছে নির্ঘুম রাত কেটেছে তার। তবুও নিজের দায়িত্বে কতটা অবিচল সে। রুদ্র নিপুণের থেকে চোখ সরিয়ে তার ম্যানেজারকে বলল,
‘ইমিডিয়েটলি কল দা ডক্টর, ফাস্ট।’

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

তুমি ছিলে বলেই ২ পর্ব-১৪

0

#তুমি_ছিলে_বলেই২
#পর্বঃ১৪
#দিশা_মনি

দীপ্র ও স্নেহাকে চৌধুরী বাড়িতে থাকার পারমিশন দিয়ে দিলেন আলতাফ চৌধুরী। অতঃপর তিনি আর কিছু না বলেই নিজের স্ত্রী দিলারা চৌধুরীকে নিয়ে নিজের রুমের দিকে রওনা দিলেন। তবে যাওয়ার আগে আবারো দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,
‘এই বিয়ে আমি মানি না এবং আমৃত্যু মানব না।’

তিনি চলে যাওয়ার পর রাহেলা চৌধুরীও স্নেহার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে যান। খোদেজা চৌধুরী এগিয়ে আসেন। স্নেহার উদ্দ্যেশ্যে বলেন,
‘তোমাকে তো আমার খুব একটা সুবিধার মনে হচ্ছে না। ভালোই তো বড়লোকের ছেলে পটিয়ে বিয়ে করে নিলে।’

স্নেহা কিছু বলল না। সে যেই উদ্দ্যেশ্যে এখানে এসেছে সেই উদ্দ্যেশ্য পূরণের লক্ষ্যে তাকে চুপ করে সবটা সহ্য করতে হবে, ধৈর্য ধরতে হবে। তবেই এখানে টিকতে পারবে সে। তাছাড়া চৌধুরীদের অহংকার তো সে একসময় ভাঙবেই। সেটা যে করেই হোক। স্নেহার থেকে কোন উত্তর না পেয়ে খোদেজা চৌধুরী আরো রেগে যান। বলেন,
‘চৌধুরী পরিবারের ঐতিহ্য সম্পর্কে তুমি কিছু জানো না মেয়ে। এই বাড়িতে তোমার মতো চুনোপুঁটি টিকবে না। তোমার মতো মেয়েকে তো এই বাড়ির কাজের লোক..’

খোদেজা চৌধুরী আর কিছু বলার আগেই দীপ্র বলে ওঠে,
‘আমি তোমায় অনুরোধ করছি ফুফু। এসব কথা বলা বন্ধ করো। আমার এসব ভালো লাগছে না।’

‘এই মেয়ে নিশ্চয়ই তোকে তাবিজ কবজ করেছে। আমার তো এখন এই মেয়েটাকেই সন্দেহ হচ্ছে। এই নিশ্চয়ই চক্রান্ত করে তোকে বিয়ে করেছে। এসব মেয়েদের আমি ভালো করেই চিনি। আজ থেকে ২৫ বছর আগেও তো এরকম একটা মেয়ে আমার ছোট ভাইয়ের উপর পড়েছিল। এসব রাস্তার মেয়ে তো…’

স্নেহার ধৈর্যের বাধ ভেঙে যেতে থাকে। নিজের সম্পর্কে বলা কথাগুলো নিয়ে তার কোন মাথাব্যথা নেই কিন্তু নিজের মায়ের সম্পর্কে কিছু সে শুনবে না। তাই সে প্রতিবাদ করে বলে,
‘আপনি না জেনে কিছু বলবেন না। আমি মোটেই রাস্তার মেয়ে নই..আর না তো…’

বলতে গিয়ে সে থেমে যায়। দীপ্র স্নেহাকে বলে,
‘তুমি আমার সাথে চলো। এখানে থাকলে তোমায় আরো অনেক কথা শুনতে হবে।’

দীপ্র স্নেহাকে নিজের সাথে নিয়ে চলে যায়। খোদেজা চৌধুরী তাদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে বলেন,
‘এটা আমার বাপের বাড়ি। তাই এখানে আমি কোন এলেবেলে ফালতু মেয়েকে থাকতে দেব না। বউ হিসেবে তো একদমই না। এই স্নেহাকেও আমি যে করেই হোক তাড়াবোই।’


খোদেজা চৌধুরী এসেছেন আলতাফ চৌধুরীর সাথে কথা বলতে। আলতাফ চৌধুরীকে দেখতে পেয়েই তিনি বললেন,
‘ভাইজান তুমি কিছু করো, নাহলে তো ঐ মেয়েটা এই বাড়িতে জেকে বসবে। এমন একটা চালচুলোহীন মেয়েকে তো আমরা চৌধুরী বাড়ির বউ হিসেবে মানতে পারি না। তার উপর তুমি ঐ মেয়ের সাজসজ্জা দেখেছ? কেমন ছেলেদের মতো সাজ। ওকে দেখেই তো উশৃংখল মনে হয়। আমাদের কিন্তু কিছু করতেই হবে।’

আলতাফ চৌধুরী ভাবুক ভঙ্গিতে বলেন,
‘আমিও সেটাই ভাবছি। নিপুণ যদি দীপ্রকে বিয়ে করতে না চায় কোন ব্যাপার না। আলতাফ চৌধুরীর একমাত্র ছেলের জন্য ভালো মেয়ের কোন অভাব হবে না। ঐ মেয়ে এই বাড়ির যোগ্য বউ নয়। এর আগেও আমি আব্বাসের প্রথম বউকে এই বাড়ির বউয়ের মর্যাদা দেইনি এবারও ঐ মেয়েকে মর্যাদা দেব না।’

খোদেজা চৌধুরী ব্যাকুল হয়ে বলেন,
‘কিন্তু ভাইজান এখন সময় অনেক এগিয়েছে। এখন কত নারী অধিকার সংস্থা গড়ে উঠেছে। আমার তো ভয় করছে ঐ মেয়েটা যদি আমাদের দীপ্রকে বশ করে নেয় তাহলে কি হবে? তাছাড়া আজ তো ওরা একরুমে আছে। হিসাব মতো আজ ওদের বাসর রাত। যদি ওদের মধ্যে কিছু হয়ে যায়।’

আলতাফ চৌধুরী হুংকার দিয়ে বলেন,
‘এটা কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না।’

খোদেজা চৌধুরী কিছুক্ষণ ভাবেন৷ হঠাৎ করেই তার মাথায় কুমতলব চলে আসে। তিনি নিয়মিত সিরিয়াল দেখেন। তাই সেখান থেকেই অনেক কূটনীতি শিখেছেন। এসব ভেবেই তিনি বলেন,
‘তুমি কোন চিন্তা করো না ভাইজান। কিভাবে ওদের বাসর রাত নষ্ট করতে হবে সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি।’

বলেই তিনি কুটিল হাসি দিয়ে দীপ্রর রুমের দিকে পা বাড়ান। আলতাফ চৌধুরী ভাবতে থাকেন তার সামনের পদক্ষেপ কি হবে।


দীপ্র ও স্নেহা একইরুমে অবস্থান করছে। দীপ্র স্নেহার উদ্দ্যেশ্যে বলে,
‘তুমি বিছানায় থাকো। আমি ডিভানে থাকি।’

‘এটা তো আপনার রুম। আপনি ডিভানে থাকবেন কেন?’

‘আমার অভ্যাস আছে। এমনিতে আমাকে অনেক রাত জেগে কোম্পানির কাজ করতে হয়। তোমাকে যখন আমি বিয়ে করেছি তখন তো তোমায় কষ্টে থাকতে দিতে পারি না।’

স্নেহা আর কথা বাড়ায় না। তার নিজেরও অনেক ক্লান্ত লাগছে। তাই সে বিছানায় শুয়ে পড়ে। দীপ্রও ডিভানে শুয়ে পড়ে। এমন সময় হঠাৎ কেউ দীপ্রর দরজায় নক করে। দীপ্র উঠে গিয়ে দরজা খুলে অবাক হয়ে যায়। কারণ খোদেজা চৌধুরী বাইরে দাঁড়িয়ে৷ দীপ্র অবাক গলায় বলে,
‘ফুফু তুমি!’

খোদেজা চৌধুরী কোন উত্তর দেন না৷ দীপ্রকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে স্নেহার পাশে বিছানায় শুয়ে পড়েন। অতঃপর দীপ্রকে বলেন,
‘এই মেয়ের সাথে তুই রাত কাটাতে পারবি না৷ এটা ভাইজানের আদেশ। তাই তোদের এক রুমে থাকা যাবে না। আজকের মতো তুই গিয়ে অন্য রুমে থাক। কাল আমি এই মেয়েকে গেস্টরুমে পাঠানোর ব্যবস্থা করব।’

‘কিন্তু ফুফু এটা কি করে হয়? ও আমার স্ত্রী ও কেন অন্য রুমে থাকবে।’

‘এই মেয়ে তোর স্ত্রী নয়, এটা কোন বিয়েও নয়। এখন তুই আমার কথা শোন। ভাইজান কিন্তু শুধু ভাবির কথায় তোদের এখানে থাকতে দিয়েছে। তাই ভালো চাইলে আমার কথা শোন।’

দীপ্র আর কোন উপায় খুঁজে পায় না। তাই সে বলে,
‘ঠিক আছে। আমি যাচ্ছি এই রুম থেকে।’


নিপুণ তার মামার বাড়িতেই আছে। তার একটুও ভালো লাগছে না। দীপ্রর কথা খুব মনে পড়ছে। কান্না পাচ্ছে খুব। কিন্তু নিপুণ নিজেকে সামলাচ্ছে। নিজেকে বুঝ দিচ্ছে দীপ্রর জন্য এক ফোটা অশ্রুও ব্যয় করবে না। এরমধ্যে হঠাৎ করে ইসমাইল হোসেন তাকে ফোন করে। নিপুণ ধাতস্থ হয়ে ফোনটা রিসিভ করতেই ইসমাইল হোসেন বলে ওঠেন,
‘নিপুণ জানো কি হয়েছে? ‘

‘কি হয়েছে স্যার?’

‘রুদ্র চৌধুরীকে আবার পুলিশ এরেস্ট করেছে?’

‘কেন?’

‘উনি নাকি কোন একটা লোককে গিয়ে পিটাচ্ছিলেন আর বলছিলেন তার বাবা-মায়ের খু**নির নাম বলতে।’

‘তার মানে এইজন্য উনি আমাদের অবজ্ঞা করছিলেন? কারণ উনি আইনের সহায়তা চান না৷ নিজে থেকেই নিজের মা-বাবার খু**নিদের শাস্তি দিতে চান।’

‘এক্সাকলি। আমার মনে হয়, এতদিন বিনা অপরাধে জেল খাটার জন্য আইনে উপর থেকে ওনার ভরসা উঠে গেছে৷ এতে কিন্তু উনি লাভবান হবেন না।’

নিপুণ বলে,
‘আপনি ঠিক বলেছেন স্যার, আমাদের ওনাকে বোঝাতে হবে যে আইনের উপর ভরসা রাখা উচিৎ। আমাদের সাথে কো ওপারেট করলেই উনি নিজের মা-বাবার খু**নিকে খুঁজে পাবে।’

‘তোমার উপর আমার ভরসা আছে নিপুণ। আমি জানি তুমিই এটা পারবে?’

‘আমি?’

‘হ্যা, তুমি।’

নিপুণ কিছু না বলেই ফোনটা রেখে দেয়। সে কিছুটা চিন্তা করে বলে,
‘দীপ্র ভাইয়ার চিন্তা মাথা থেকে বের করার এখন এটাই একমাত্র উপায়। আমায় এখন কাজে ডুবে থাকতে হবে।’

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

তুমি ছিলে বলেই ২ পর্ব-১৩

0

#তুমি_ছিলে_বলেই২
#পর্বঃ১৩
#দিশা_মনি

দীপ্র নিপুণকে সামলাতে তার কাছে যেতে নিতেই রাহেলা চৌধুরী থামিয়ে দিলেন তাকে। অতঃপর কড়া গলায় বললেন,
‘তোমায় আমার মেয়েকে সামলাতে হবে না। আমার মেয়ের জন্য আমি আছি। তুমি গিয়ে তোমার নতুন বউকে সামলাও।’

দীপ্র অসহায় চোখে তাকিয়ে রইল। নিপুণ কিছুক্ষণ পর পিটপিট করে তাকালো। অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে দীপ্রর উদ্দ্যেশ্যে বলল,
‘কেন করলে তুমি আমার সাথে এমন? আমি তোমার কি ক্ষতি করেছিলাম দীপ্র ভাইয়া? তুমি যদি এমনটাই চেয়েছিলে তাহলে আমায় মিথ্যা আশা কেন দেখালে? কেন করলে আমার সাথে এমন কেন?’

বলেই সে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। দিলারা চৌধুরী এগিয়ে গেলেন নিজের ছেলের দিকে। তিনি জিজ্ঞাংসু কন্ঠে বললেন,
‘তুই কি সত্যি এই মেয়েটাকে বিয়ে করেছিস?’

বলেই তিনি ভালো করে তাকালেন স্নেহার দিকে। স্নেহার পুরুষালি সাজ দেখে তিনি বললেন,
‘তোর থেকে এটা আশা করিনি দীপ্র। আমি বুঝতে পারছি না কি দোষ করেছিলাম আমি। তোরা দুই ভাইবোন কেন এভাবে আমার মুখ ছোট করছিস। তোরা কি হিরা চিনতে শিখিস নি? সবসময় এভাবে হিরা ফেলে কাচ বেছে নিস কেন?’

দীপ্র কিছু বলার মতো খুঁজে পেল না। আলতাফ চৌধুরী রাহেলা চৌধুরীকে বললেন,
‘তুমি নিপুণ মাকে নিয়ে ঘরে যাও। ওর উপর দিয়ে অনেক ঝড় বয়ে গেছে। এখানে এই কুলাঙ্গারটার সামনে ও যদি আরো থাকে তাহলে ওর আরো কষ্ট হবে। তাই তুমি ওকে এখান থেকে নিয়ে যাও।’

রাহেলা চৌধুরী নিজের ভাসুরের কথা মতো কাজ করেন। নিপুণকে নিয়ে যেতে থাকেন। নিপুণ আর একটিবারও দীপ্রর দিকে তাকায় না। হঠাৎ করেই মেয়েটা যেন কেমন শক্ত হয়ে গেছে। বড় ধাক্কা যেন তার জীবনকে অনেক বদলে দিয়েছে।

আলতাফ চৌধুরী দীপ্রর সামনে এলেন। দীপ্রর গালে ঠাস করে চ*ড় বসিয়ে দিলেন। দীপ্র কোন প্রতিবাদ করল না। স্নেহা এসব কিছুর নীরব দর্শক হলো। চৌধুরী বাড়িতে এসব ঝামেলা দেখে মনে মনে শান্তি পেল। তার মনে হতে লাগল তার মৃত মায়ের আত্মা বোধহয় এসব দেখে অনেক শান্তি পাচ্ছে।

আলতাফ চৌধুরী চিৎকার করে বলে উঠলেন,
‘এটা কি করলে তুমি? তোমরা দুই ভাইবোন কি আমার মান সম্মান নষ্ট করার জন্য এই পৃথিবীতে এসেছিলে? এই তো সেদিন তুমি নিজে নিপুণের বিয়ে আটকালে। ওকে ভালোবাসার দাবি জানালে। তাহলে আজ হঠাৎ এটা কি হলো?’

দীপ্র তার বাবাকে সমস্ত ঘটনা খুলে বললো৷ সব শুনে আলতাফ চৌধুরী হতবাক হয়ে গেলেন। তিনি বলে উঠলেন,
‘যা হবার হয়ে গেছে। এখন আমি আর কোন নাটক চাইছি না। তুমি এই মেয়েকে এখান থেকে দূর করো। এই বিয়েটা আমি মানি না।’

খোদেজা চৌধুরী নিজের ভাইয়ের তালে তাল মিলিয়ে বলেন,
‘তুমি একদম ঠিক বলেছ ভাইয়া। এই বিয়ের কোন মানে নেই। না জানি এই মেয়ে কোন বংশের। কোথাকার কোন রাস্তার মেয়েকে তুলে এনে আমাদের চৌধুরী বাড়ির বউ করতে চাইলেই তো আর হলো না।’

দিলারা চৌধুরী নিশ্চুপ রইলেন। এরইমাঝে দীপ্র বলে উঠল,
‘তোমরা প্লিজ স্নেহার সম্পর্কে কোন অসম্মানজনক কথা বলো না। ও তো এই বিয়েটা করতে চায়নি। পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হয়েই এই বিয়েটা হয়েছে। আর বিয়ে কোন ছেলেখেলা নয়। একবার যখন বিয়েটা হয়ে গেছে, সেটা যেভাবেই হোক স্নেহা এখন আমার স্ত্রী। ওর দায়িত্ব এখন আমার। ওর সম্মান রক্ষা করার আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তাই তোমরা দয়া করে ওকে নিয়ে এমন কথা বলো না।’

আলতাফ চৌধুরী বলেন,
‘আমি কিছুতেই এই চাল চুলোহীন মেয়েকে নিজের বাড়ির বউ হিসেবে মানব না। এটাই আমার সাফ কথা। তুমি ওকে ছেড়ে দাও, নিপুণের সাথেই তোমার বিয়ে হবে।’

দীপ্র স্নেহার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘তুমি প্লিজ আমার ফ্যামিলির কারো কথায় কিছু মনে করো। বুঝতেই পারছ পরিস্থিতিটা।’

স্নেহা বলে,
‘আমি সবটাই বুঝতে পারছি। আপনি চিন্তা করবেন না। আমাকে নিয়ে যাতে আপনার ফ্যামিলিতে আর কোন সমস্যা না হয় আমি সেই ব্যবস্থা করব। আমি এখুনি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।’

আলতাফ চৌধুরী বলে,
‘এই মেয়ে শোন, তোমাকে কোন চিন্তা করতে হবে না। তোমার কত টাকার প্রয়োজন আমাকে বলো আমি তোমাকে তত টাকাই দেব। তুমি শুধু এই বিয়েটা ভুলে যাও। আর এই বাড়ি থেকে বের হও।’

স্নেহা এখন বুঝতে পারে না সে কি করবে। নিজের মাকে ন্যায়বিচার পাইয়ে দিতে হলে তাকে এই চৌধুরী বাড়িতেই থাকতে হবে। কিন্তু সে কিভাবে থাকবে এখানে? স্নেহা যখন এসব চিন্তায় ব্যস্ত ছিল তখনই হঠাৎ নিপুণ এসে উপস্থিত হলো সেখানে। সে এসেই আলতাফ চৌধুরীর সামনে গিয়ে উপস্থিত হলো। আলতাফ চৌধুরী নিপুণকে দীপ্রর ব্যাপারে সমস্ত কিছু খুলে বলল। অত:পর বললেন,
‘তুই চিন্তা করিস না মা, এই মেয়েটাকে আমি বউ হিসেবে মানব না। তুই দীপ্রর বউ হবি।’
সব শুনেও নিপুণ কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। বরং সে বলল,
‘আমি আত্মসম্মানহীন হতে পারব না বড় আব্বু। তোমার ছেলেকে নিয়ে তুমি কি সিদ্ধান্ত নেবে সেটা তোমার ব্যাপার। তবে আমি নিজের ব্যাপারে বলি, আজকের ঘটনার পর তোমার ছেলের সাথে এক ছাদের তলায় থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আমি এখান থেকে চলে যাব।’

আলতাফ চৌধুরী হতবাক স্বরে বলেন,
‘এটা তুই কি বলছিস মা? এটা তো তোর বাড়ি তুই এখান থেকে কোথায় যাবি?’

নিপুণ বলে,
‘আমি কিছুদিন আপাতত আমার মামার বাড়ি গিয়ে থাকব। তারপর কোন একটা ব্যবস্থা করে নেব। তোমাকে সেটা ভাবতে হবে না। আমি শুধু তোমাকে আমার সিদ্ধান্তটা জানাতে এসেছি।’

রাহেলা চৌধুরী ছুটে এসে আলতাফ চৌধুরীকে বলেন,
‘আপনি ওকে বাধা দেবেন না। আমার মেয়ে যেটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমি সেটাকে সমর্থন করি।’

নিপুণ বাড়ির সবার থেকে বিদায় নেয়৷ তারপর নিজের সব জিনিসপত্র নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার পূর্বে দীপ্র তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলে নিপুণ কড়া গলায় বলে,
‘দ্বিতীয়বার আর এই স্পর্ধা দেখাবে না। আর কোনদিন যে তোমাকে আমার ত্রিসীমানায় না দেখি।’

দীপ্র থমকে তাকিয়ে রইলো। নিপুণ বেড়িয়ে গেল চৌধুরী বাড়ি থেকে। নিপুণ চলে যাবার পর রাহেলা চৌধুরী স্নেহার দিকে ইশারা করে বললেন,
‘এই মেয়েটা সবকিছুর জন্য দায়ী। এই মেয়েটার জন্যই আমার মেয়ে এই বাড়ি থেকে চলে গেল। একে তো আমি…’

রাহেলা চৌধুরী স্নেহার দিকে এগোতে গেলেই দীপ্র ঢাল হয়ে দাঁড়ায়। অতঃপর বলে,
‘তোমার কিছু বলতে হলে তুমি আমায় বলো চাচি, ওকে কিছু বলো না। আমি যেহেতু ওকে বিয়ে করেছি সেহেতু সব দোষ আমার। নিপুণের এই বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার জন্য আমি দায়ী। তাই আমি নিজেও আর এই বাড়িতে থাকব না। আমিও চলে যাব এখান থেকে।’

এটুকু বলেই সে স্নেহাকে বলে,
‘তুমি চলো আমার সাথে। তুমি আমার স্ত্রী, আমার দায়িত্ব। তাই আমি তোমাকে অবহেলা করতে পারব না।’

দীপ্র আর স্নেহা বাড়ি থেকে চলে যেতে নেবে তখনই দিলারা চৌধুরী হঠাৎ করে অসুস্থ বোধ করেন। আলতাফ চৌধুরী তাকে সামলাতে গেলে তিনি বিড়বিড় করে বলেন,
‘আমার মেয়েটা বিয়ে করে চলে গেল এখনো ওর কোন খবর পেলাম না। এখন আমাত ছেলেটাও চলে যাচ্ছে। এবার আমি কি নিয়ে থাকব দীপ্রর বাবা?’

আলতাফ চৌধুরী অসহায় চোখে নিজের ৩০ বছরের জীবনসঙ্গিনীর দিকে তাকান। দিলারা চৌধুরী করুণ গলায় হাতজোড় করে নিজের স্বামীর উদ্দ্যেশ্যে বলেন,
‘আপনি দয়া করে আমার ছেলেকে এখান থেকে যেতে দেবেন না। ওকে আটকান আপনি। আমার ছেলেকে হারালে আমি যে আমার সব হারিয়ে ফেলব। সারাজীবন তো আমি আপনার কাছে কিছু চাইনি। আজ প্রথমবার কিছু চাইছি। আপনি আমার কথা রাখবেন না? এতদিন আমি নিজের স্ত্রী হওয়ার দায়িত্ব পালন করেছি। আপনি আমার মেয়েকে ত্যাগ করেছেন তখনও আমি কিছু বলিনি কিন্তু আজ আমি একজন মা হিসেবে আপনার কাছে অনুরোধ করছি। দয়া করে আমায় ফেরাবেন না।’

আলতাফ চৌধুরী হার মেনে নেন। দীপ্রর উদ্দ্যেশ্যে বলে,
‘তোমাকে কোথাও যেতে হবে না। তুমি নিজের স্ত্রীকে নিয়ে চৌধুরী বাড়িতেই থাকো।’

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

তুমি ছিলে বলেই ২ পর্ব-১২

0

#তুমি_ছিলে_বলেই২
#পর্বঃ১২
#দিশা_মনি

দীপ্র ও স্নেহাকে মুখোমুখি বসানো হয়েছে। কাজি সাহেব বিয়ে পড়ানো শেষে বলে উঠলেন,
‘এবার তুমি কবুল বলো মা।’

স্নেহা একটু সময় নিলো। তারপর তাকালো দীপ্রর দিকে। দীপ্র উপরের দিকে তাকিয়ে আছে। স্নেহা বলে উঠল,
‘কবুল।’

দীপ্রর এই সময় মনে পড়লো নিপুণের কথা। নিপুণকে দেওয়া তার কথা। সে তো নিপুণকে বলেছিল মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই তাদের আলাদা করতে পারবে না। তাহলে আজ এমন কেন হলো? দীপ্র কিছুতেই পারল না কবুল বলতে। কিছু সময় অপেক্ষা করল। ভাবল নিপুণের কথা। নিপুণের মুখটা ভেসে আসছে তার মনের মাঝে। দীপ্র খুব কষ্ট পাচ্ছে এই মুহুর্তে। সে বুঝতে পারছে না কিভাবে নিজের মনের কথা প্রকাশ করবে। দীপ্রর এখন কিছুতেই এই বিয়েটা করতে ইচ্ছা করছে না। সে উঠে দাঁড়ায়। বলে,
‘আমার পক্ষে এই বিয়ে করা সম্ভব নয়। আমার ক্ষমা করে দেবেন আপনারা।’

দীপ্র চলে যেতে উদ্যত হলেই গ্রামের লোকেরা তাকে ঘিরে ধরে। বলে,
‘এই বিয়েটা না করে তুমি কোথাও যেতে পারবে না। যদি না করো তাহলে তোমাদের দুজনকে পাথর নিক্ষেপ করে মা*রা হবে।’

দীপ্র স্নেহার দিকে তাকায়৷ তার মনে হতে থাকে শুধুমাত্র তার জন্য কেন এই মেয়েটি বিপদে পড়বে। এখন পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, সে আর পিছু হটতে পারবে না। তাই দীপ্র পরিস্থিতির মানে বুঝল। ভাগ্যের কাছে নতি স্বীকার করল। ধীর পায়ে হেটে এসে বসলো স্নেহার পাশে৷ ব্যাথাতুর কণ্ঠে বলল,
‘কবুল।’

তারপর চোখ বন্ধ করে নিপুণের কথা মনে করে ভাবল,
‘কখনো ভাবিনি নিপুণ, তোকে ছাড়া অন্য কারো নামে কবুল বলতে হবে আমায়। তবে আমি তোকে ভালোবাসি। জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত তুই আমার মনেই থাকবি। আর এই বিয়েটা শুধুই আমার দায়িত্ব হিসেবে থাকবে। এই মেয়েটা আমি অস্বীকার করতে পারব না। কিন্তু ও শুধুমাত্র আমার কাছে একটা দায়িত্ব ব্যতীত আর কিছুই নয়।’

এদিকে স্নেহা দীপ্রর পানে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
‘আপনার জন্য আমার সত্যিই খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমার কিছুই করার নেই। আপনার বাবা, নিপুণের বাবা-মা সবাই আমার মায়ের সাথে অন্যায় করেছিল। তাদের সেই অন্যায়ের শাস্তি কিছুটা আপনাদের উপরেও তো বর্তায়। মা-বাবার কৃতকর্মের শাস্তি তো তার সন্তানকে পেতে হবে। আপনাদের হয়তো কোন অপরাধ নেই কিন্তু আপনাদের সবথেকে বড় অপরাধ যে আপনারা চৌধুরী পরিবারে জন্ম নিয়েছেন। তবে চিন্তা করবেন না। আমার প্রতিশোধ নেওয়া শেষ হলে আমি সবকিছু ঠিক করে দেবার চেষ্টা করব।’


নিপুণকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিচ্ছে পার্লারের লোকেরা। তাকে ঘিরে ধরেছে তার বন্ধু-বান্ধব এবং কাজিনেরা৷ সবার মুখে হাসি আর ধরে না। নিপুণ নিজেও অনেক খু্শি। নিপুণের এক বান্ধবী বলে,
‘বাহ, নিপুণ। তোকে তো অনেক সুন্দরী লাগছে। দীপ্র ভাইয়া তো আজ তোকে দেখে পাগল হয়ে যাবে।’

নিপুণ বলে,
‘তোরাও না, এমন কথা বলিস যে আমি লজ্জা পেয়ে যাই।’

এমন সময় খোদেজা চৌধুরী, রাহেলা চৌধুরী এবং দিলারা চৌধুরী এসে উপস্থিত হলেন সেখানে। রাহেলা চৌধুরী এগিয়ে এসে বললেন,
‘বাহ, আমাদের মেয়েকে কি সুন্দর লাগছে। কারো নজর না লাগুক।’

দিলারা চৌধুরীর মন মেজাজ এমনিই ভালো নেই। তার মেয়ের সাথে তার কোন যোগাযোগ নেই। তিনি জানেনও না তার মেয়েটা এখন কোথায় আছে, কেমন আছে। এরই মাঝে আবার তার ছেলের বিয়ের দামামা বেজে গেছে। সব মিলিয়ে তিনি বিরক্ত ভীষণ। কিন্তু নিজের স্বামীর সিদ্ধান্তর বিরোধিতা তিনি করেননি। এমনিতেও নিপুণকে নিয়ে তার কোন সমস্যা নেই। নিপুণ যথেষ্ট ভালো মেয়ে। তার সামনেই বেড়ে উঠেছে মেয়েটা, যথেষ্ট সংস্কারী এবং ভালো মনের। নিপুণ যে দীপ্রর যোগ্য এব্যাপারেও কোন সন্দেহ নেই। সবথেকে বড় ব্যাপার দীপ্র নিপুণকে পছন্দ করে। এরপর দিলারা চৌধুরীর আপত্তির কোন কারণ নেই। কিন্তু তার সমস্যা একটাই। তার মেয়েকে নিয়ে চিন্তার কারণেই তিনি মন থেকে এসব মানতে পারছেন না। এরমধ্যে খোদেজা চৌধুরী বলেন,
‘যা হচ্ছে ভালোই তো হচ্ছে। বাড়ির মেয়ে বাড়িতেই থাকছে। তাই না বলো বড় ভাবি?’

দিলারা চৌধুরী মলিন হাসেন। নিপুণের কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,
‘অনেক সুখী হ। আর আমার ছেলেটাকেও সুখে রাখিস।’


স্নেহা ও দীপ্র চুপচাপ বসে আছে। গ্রামবাসীরা তাদেরকে ঘিরে আছে। দীপ্র সকলের উদ্দ্যেশ্য বলে,
‘শান্তি পেয়েছেন তো আপনারা? আপনারা যা চেয়েছেন তাই হয়েছে। এখন আপনারা প্লিজ আমাদের যেতে দিন।’

একজন গ্রামবাসী বলে,
‘ঠিক আছে। তোমরা এখন যেতে পারো। তোমাদের বিবাহিত জীবন সুখের হোক এই দোয়া করি।’

দীপ্র মলিন হেসে বলে,
‘আমার জীবনের সব সুখ কেড়ে নিয়ে এখন আপনারা আমার সুখের জন্য দোয়া করছেন। হাহ, হাস্যকর!’

দীপ্র আর স্নেহা সেখান থেকে রওনা দেয়। স্নেহা বুঝতে পারে দীপ্র এখন কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। তাই সে কিছু বলে না৷ কিন্তু হোস্টেলে পৌঁছে স্নেহা দীপ্রর উদ্দ্যেশ্যে বলে,
‘আপনি চাইলে আমি সবটা ভুলে যাব। আপনি আপনার পথে আর আমি আমার..’

স্নেহাকে থামিয়ে দিয়ে দীপ্র বলে,
‘আমি যখন এই বিয়েটা করেছি তখন নিজের দায়িত্ব থেকে পিছিয়ে আসতে পারি না। তুমি আমার স্ত্রী, আমি কবুল বলে তোমায় বিয়ে করেছি। তাই এখন চাইলেও আমি পিছিয়ে আসতে পারব না।’

‘কিন্তু আপনি তো এই বিয়েটা মন থেকে মেনে নিতে পারেন নি স্যার।’

‘এটা নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। তুমি এখন থেকে আমার স্ত্রী। আর আমি একজন স্বামী হিসেবে তোমার প্রতি সব দায়িত্ব পালন করব।’

স্নেহা কিছুটা থেমে বলে,
‘আপনি চিন্তা করবেন না। এই সম্পর্ক আপনাকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে না। আমি খুব শীঘ্রই আপনাকে এই সম্পর্ক থেকে মুক্তি দেব।’

‘এসব নিয়ে পড়ে কথা বলা যাবে। তুমি এখন তৈরি হয়ে নাও। তোমাকে আমার সাথে আমার বাড়িতে যেতে হবে। না জানি ওখানে গিয়ে আমাকে আর কি কি সহ্য করতে হবে।’

স্নেহা মনে মনে বলে,
‘আজ তাহলে আবার আমি চৌধুরী বাড়িতে পা রাখব। মেয়ের অধিকার আমি পাই নি। কিন্তু বউয়ের অধিকার অবশ্যই পাবো।’

স্নেহাকে নিয়ে চৌধুরী বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়েছে দীপ্র। স্নেহা চৌধুরী বাড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,
‘এই সেই চৌধুরী বাড়ি। যেখানে আমার মায়ের সাথে এক বার না। বারংবার অন্যায় হয়েছে। এবার সেই অন্যায়ের উপযুক্ত প্রতিশোধ আমি নেব। আমার মায়ের খু*নিকেও আমি খুঁজে বের করব।’

এদিকে নিপুণ বসেছিল সবার মধ্যমনি হয়ে। অপেক্ষা করছিল দীপ্রর জন্য। এনগেজমেন্টের সময় হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দীপ্রর আসার কোন কথা নেই। তাই রাহেলা চৌধুরী আলতাফ চৌধুরীর কাছে গিয়ে বলে,
‘ভাইয়া একটু দীপ্রকে ফোন করে বলুন তো ও কখন আসবে।’

আলতাফ চৌধুরী দীপ্রকে ফোন করতে যাবে এমন সময় দীপ্র চলে এলো। দীপ্রকে আসতে দেখে নিপুণ উঠে দাঁড়ালো। হাসি ফুটে উঠল তার মুখে। কিন্তু এই হাসি ছিল শৈবালের নীড়ের মতো। দীপ্রর পাশে দাঁড়ানো স্নেহাকে দেখে নিপুণের সব হাসি উবে গেল। তার মনে পড়ল এই মেয়েটাকেই সে সেদিন দীপ্রর অফিসে দেখেছিল। হঠাৎ করেই অজানা আশংকা দানা বাধল মনে। আলতাফ চৌধুরী দীপ্রকে দেখে এগিয়ে গিয়ে বললেন,
‘তোমার আসতে এত দেরি হলো কেন দীপ্র? এসো এনগেজমেন্টের সময় তো হয়ে গেছে।’

দীপ্র একবার করুণ চোখে নিপুণের দিকে তাকায়। অতঃপর স্নেহার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘এই এনগেজমেন্ট হবে না। কারণ আমার বিয়ে হয়েছে। আর ও হলো আমার স্ত্রী।’

দীপ্রর কথায় যেন এখানে উপস্থিত সবার সামনে বাজ পড়ল। নিপুণের পায়ের তলার মাটি যেন সরে গেল। অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে সে তাকালো দীপ্রর দিকে। পরক্ষণেই দেখল স্নেহাকে। একটা বিকট চিৎকার দিয়ে বলল,
‘এটা হতে পারে না দীপ্র ভাইয়া। তুমি এভাবে আমায় ঠকাতে পারো না।’

বলেই সে হঠাৎ করে মাটিতে বসে পড়লো। পুরো পৃথিবী যেন তার থমকে গেছে। নিপুণের বেঁচে থাকার ইচ্ছা শেষ হয়ে গেল। সে আল্লাহর কাছে নিজের মৃত্যু প্রার্থনা করতেও দ্বিধা করল না৷ কিছুক্ষণের মাঝেই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

তুমি ছিলে বলেই ২ পর্ব-১১

0

#তুমি_ছিলে_বলেই২
#পর্বঃ১১(মহাধামাকা পর্ব)
#দিশা_মনি

দীপ্র আর নিপুণ একসাথে আড্ডা দিতে বসেছে। এই আড্ডার একটা কারণ অবশ্য আছে। কিছুক্ষণ পরেই দীপ্র চলে যাবে গ্রামের উদ্দ্যেশ্যে। নিপুণ একলা হয়ে যাবে। সেই এখন নিপুণের মন হালকা করার জন্য তার সাথে আড্ডা দিতে বসেছে দীপ্র। কথায় কথায় নিপুণ দীপ্রকে জিজ্ঞেস করে,
‘আচ্ছা তুমি আজকেই ফিরছ তো?’

দীপ্র বলল,
‘হ্যাঁ, আজই তো ফিরব। আর কাল খুব ধুমধাম করে আমাদের এনগেজমেন্ট হবে।’

নিপুণ খুব খুশি হয়ে যায়। কিছুক্ষণ আড্ডা দেওয়ার পর দীপ্র নিপুণের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
‘তাহলে এখন আমি উঠি। আমায় এখন বের হতে হবে।’

দীপ্র উঠতে গেলে নিপুণ বলে,
‘সাবধানে যেও আর তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।’


দীপ্র গ্রামের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিয়ে দিয়েছে। তার সাথে রয়েছে স্নেহা। দীপ্র যেতে যেতে স্নেহার সাথে এই প্রজেক্টের ব্যাপারে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছিল। কিন্তু স্নেহার সেসব কথায় যেন কোন মনই ছিল না। সে তো শুধু ভাবছিল তার নিজের প্রজেক্টের ব্যাপারে। কিভাবে নিজের করা পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করবে সেই ব্যাপারেই ভাবছিল সে। তার এরূপ ভাবনার মাঝেই হঠাৎ করে দীপ্র বলে উঠল,
‘আচ্ছা আমি তোমাকে একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে পারি?’

দীপ্রর থেকে এমন প্রশ্ন আশা করে নি স্নেহা। এই কদিন দীপ্রকে যতদূর সে চিনেছে তাতে দীপ্র যথেষ্ট ম্যাচিউর এবং প্রফেশনাল এটা বুঝেছে সে। লোকটা অফিসে এসেও কাজের বাইরে একটা শব্দও উচ্চারণ করে না। সে হঠাৎ এমন ভাবে ব্যক্তিগত কিছু জানতে চাইছে ব্যাপারটা স্নেহার কাছে স্বাভাবিক মনে হলো না। তবুও সে বলল,
‘জ্বি স্যার, আপনি প্রশ্ন করুন। আমার যদি উত্তর দেওয়ার সামর্থ্য থাকে তাহলে আমি উত্তর দেব।’

‘তুমি সবসময় এরকম পুরুষের বেশভূষায় কেন থাকো?’

স্নেহা কিছুটা থতমত খেয়ে যায়। এমন প্রশ্নের মুখোমুখী জীবনে বহুবার হয়েছে সে তাই একটু সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
‘আসলে আমার এই বেশভূষায় নিজেকে অনেক স্ট্রং মনে হয়।’

‘পুরুষের বেশভূষায় থাকার মধ্যে স্ট্রং হওয়ার কি সম্পর্ক?’

‘আমাদের সমাজে একটা প্রচলিত ধারণা আছে না যে, নারীরা দূর্বল এবং পুরুষেরা শক্তিশালী। আমার মাঝে তাদের এই ধারণা প্রভাব ফেলেছে। আমি ছোটবেলা থেকেই সমাজকে দেখাতে চেয়েছি যে নারীরা দূর্বল নয় তারাও চাইলে পুরুষদের মতো সাহসিকতার পরিচয় দিতে পারে। এজন্য আমি নিজের মধ্যে কখনো দূর্বলতাকে প্রশয় দেই নি। এই জন্য আমার জীবনে কোন পিছুটান, কোন দূর্বলতার স্থান নেই। আমি নিজেকে এমন ভাবে গড়ে তুলেছি যাতে আমার জীবনের উদ্দ্যেশ্য পূরণের পথে কোন বাধাই তৈরি না হয়।’

‘তোমার জীবনের উদ্দ্যেশ্য কি?’

স্নেহা মৃদু হেসে বলে,
‘সেটা সময় হলেই জানতে পারবেন।’

এরকম কথা বলতে বলতেই তারা গ্রামের মাঝে পৌঁছে যায়৷ দীপ্র স্নেহাকে বলে,
‘আমরা পৌঁছে গেছি।’

স্নেহা বলে,
‘হুম বুঝতে পারছি।’

স্নেহা গাড়ি থেকে নামে। চারিপাশে দেখতে থাকে গ্রামের সুন্দর মনোরম পরিবেশ। কিন্তু সে আরো একটা জিনিস লক্ষ্য করে। আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা। এটা দেখে সে মনে মনে বলে,
‘তাহলে প্রকৃতিও কি আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে?’

স্নেহার ভাবনাই সত্যি হলো। সেদিন আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। যা চলল সারাদিন ব্যাপী। ঝড়বৃষ্টির জন্য সেদিন দীপ্র প্রজেক্টের ব্যাপারে কোন কাজ এগোতে পারল না। তাই সেদিন রাতে সে ফিরে যেতে চাইল। কিন্তু সে সময় এখানকার প্রজেক্টের সাথে সংযুক্ত একজন লোক তাকে বলল,
‘রাতে এখানকার রাস্তা নিরাপদ নাও থাকতে পারে। তাই আপনাদের আজকের রাত এখানেই থাকা উচিৎ।’

সব দিক বিবেচনা করে দীপ্র বুঝতে পারল লোকটার কথাই সঠিক। তাই সে সেদিন রাতটা সেখানেই কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। নিপুণকে ফোন করে ব্যাপারটা জানাতেই সে বলল,
‘যদি রাস্তা অনিরাপদ থাকে তাহলে তোমায় আজ আসতে হবে না৷ কাল সকাল সকাল চলে এলো। আমি তোমার জন্য অপেক্ষায় আছি।’

দীপ্র নিশ্চিত হলো। সে নিপুণের সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বললো। স্নেহা দূরে বসে সমস্ত বিষয় দেখল। সে বেশ ভালোই বুঝতে পারল দীপ্র আর নিপুণের মধ্যে সম্পর্কটা বেশ গভীর৷ সেদিন অফিসে তাদের একসাথে দেখার পর নিপুণের প্রতিক্রিয়ার কথাও মনে পড়লো তার। তার মনে হঠাৎ করে দ্বিধা কাজ করতে লাগল। সে ভাবতে লাগল সে যেই পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সেটা বাস্তবায়ন করা ঠিক হবে কিনা। এমন সময় হঠাৎ করে তার মনে পড়লো নিজের মায়ের কথা। তার সাথে হওয়া সকল অন্যায়ের কথা। তখন আবার সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠল। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলল,
‘যাই হয়ে যাক নিজের পরিকল্পনা থেকে এক চুল সরব না আমি। ঐ রাহেলা চৌধুরী আমার মায়ের সাথে যা করেছে তার কাছে তো এটা কিছুই না। আমায় এখন আবেগে গা ভাসালে চলবে না। আমায় নিজের মায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ আগে পূরণ করতে হবে। তারপর নাহয় আমি নিজে দীপ্র আর নিপুণকে মিলিয়ে দেব।’

এমনটা ভাবার পর স্নেহা নিজের পরিকল্পনা মাফিক কাজ করতে লাগল। দীপ্রর কাছে গিয়ে তার উদ্দ্যেশ্যে বলল,
‘স্যার, আপনি তো কাল সকাল সকাল এখান থেকে চলেই যাবেন। তাহলে আজ একটু গ্রামটা ঘুরে দেখুন না। তাহলে এই প্রজেক্ট সম্পর্কে কিছুটা হলেও আইডিয়া পাবেন।’

দীপ্র কাছে স্নেহার পরিকল্পনাটা ভালো লাগল। তাই সে বলল,
‘আচ্ছা। তাহলে চলো যাওয়া যাক।’

স্নেহা মৃদু হাসল। তারা দুজনেই গ্রামটা ঘুরে দেখতে লাগল। হঠাৎ একটা পুকুরের কাছে এসে স্নেহা বলল,
‘আমি একটু কাছ থেকে গিয়ে পুকুর দেখি।’

স্নেহা পুকুরের কাছে যায়। দীপ্র আশপাশটা দেখতে থাকে। একটু পরেই একটা শব্দ শুনে দীপ্র পুকুরের দিকে চলে যায়। দীপ্র দেখতে পায় স্নেহা পুকুরে পড়ে গেছে। সে বাঁচার জন্য সাহায্য চাইছে। দীপ্র আশেপাশে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই। সে আর কোন উপায় না পেয়ে স্নেহাকে বাচানোর জন্য পুকুরে ঝাপ দেয়। স্নেহা প্রায় ডুবে যেতে ধরেছিল কারণ পুকুরটা অনেক বড় আর গভীর। স্নেহাকে দীপ্র পুকুর থেকে তুলে আনে। স্নেহার মুখে পানি ঢুকে গিয়েছিল এবং সে সেন্সলেস ছিল। তাই দীপ্র তার পেট চেপে পানি বের করে এবং তার জ্ঞান ফেরানোর জন্য স্নেহাকে সিপিআর দেয়। এমন সময় কিছু গ্রামবাসী সেখানে চলে আসে। দীপ্র স্নেহাকে সিপিআর দিচ্ছে এটা দেখে গ্রামবাসীরা ভুল বুঝে নেয় যে তারা অনৈতিক কোন কাজ করছে। একে একে সব গ্রামবাসী তাদের ঘিরে ফেলে। দীপ্র কিছুই বুঝতে পারে না। স্নেহার জ্ঞানও ততক্ষণে ফিরেছে। একজন গ্রাম্য পুরুষ বলতে থাকে,
‘কে তোমরা? আর এত রাতে এখানে সব কি নষ্টামো হচ্ছে?’

দীপ্র লোকটার কথা কিছুই বুঝতে পারে না। সে বলে,
‘নষ্টামো মানে কি বলতে চাইছেন আপনারা? এই মেয়েটা পুকুরে পড়ে গিয়েছিল আর তাই..’

আরেকজন দীপ্রকে থামিয়ে বলে,
‘এসব নাটক বন্ধ করো৷ আমরা কিছু বুঝিনা ভেবেছ? আমরা নিজের চোখে দেখেছি তুমি ঐ মেয়েটার কত কাছে ছিলে।’

‘আরে আপনারা বুঝছেন না কেন? দেখুন আমাদের দুজনের শরীর ভেজা..’

‘নষ্টামো করে আবার বড় গলা। এই এদেরকে নিয়ে চল। এদেরকে নিয়ে গিয়ে গাছের সাথে বেধে পাথর নিক্ষেপ করলেই এরা সোজা হয়ে যাবে।’

স্নেহা আতকে বলে ওঠে,
‘এসব কি বলছেন আপনারা? বিশ্বাস করুন উনি যা বলছেন তাই সত্যি।’

‘এই মেয়ে তুমি চুপ করো। আমাদের গ্রামে এসব নষ্টামো আমরা বরদাস্ত করব না।’

দীপ্র বলে ওঠে,
‘আপনারা কি বলছেন এসব? দেশে কি আইন কানুন নেই যে আপনারা আমাদের এভাবে শাস্তি দেবেন? আমি এখনই পুলিশে যোগাযোগ করছি।’

একজন বলে,
‘আমাদের গ্রামে কোন পুলিশের আইন চলে না। এখানে আমাদের আইন চলে। এই তোমরা দাঁড়িয়ে কি তামাসা দেখছ? এদেরকে নিয়ে চলো। গ্রামের বটগাছের সাথে বাধি এদের। তারপর সবাই মিলে পাথর তুলে নিয়ে এদের মা*-রব। তারপর বুঝবে মজা।’

দীপ্র বলে,
‘দেখুন এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।’

গ্রামবাসীরা তাদের কোন কথাই শোনে না। প্রথমে স্নেহাকে নিয়ে গিয়ে বটগাছের সাথে বাধা হয়। তারপর গ্রামবাসীরা তাদের দিকে পাথর নিক্ষেপ করতে উদ্যত হয়। স্নেহা অনেক আকুতি করে আর্তনাদ করে কিন্তু কোন লাচ হয়না। অবস্থা বেগতিক দেখে দীপ্র বলে ওঠে,
‘আপনারা প্লিজ ওকে ছেড়ে দিন। এমন করবেন না।’

তখন গ্রামের প্রধান বলে,
‘ওকে ছেড়ে দেব একটা শর্তেই। আর সেটা হলো তোমাদের বিয়ে করতে হবে।’

দীপ্র বলে ওঠে,
‘অসম্ভব। এটা হতে পারে না।’

তখন গ্রামের প্রধান গ্রামবাসীর উদ্দ্যেশ্যে বলে,
‘তোমরা পাথর ছোড়া শুরু করো।’

একজন গ্রামবাসী পাথর ছোড়ে। যেটা স্নেহার কপালে গিয়ে লাগে। সেখান থেকে ক্রমাগত রক্ত পড়ছিল। স্নেহা বাচার আকুতি জানাতে থাকে। দীপ্র আর কোন উপায়ান্তর না দেখে বলে,
‘প্লিজ থামুন আপনারা। আমি আপনাদের সব শর্তে রাজি তবু ওকে ছেড়ে দিন।’

গ্রামবাসীরা থেমে যায়। এরপর কাজি ডাকা হয়। স্নেহাকে বউ সাজাতে নিয়ে যাওয়া হয়। স্নেহা গ্রামবাসীকে বলে,
‘আপনাদের কাজে আমি খুশি। আপনারা যত টাকা চান, ঠিক ততো টাকাই পাবেন। ধন্যবাদ আমার কথামতো কাজ করার জন্য।’

এরপর নিজের কপালে আঘাতের যায়গায় হাত দিয়ে বলে,
‘বড় বড় কাজে এমন ছোট ছোট আত্নত্যাগ তো করতেই হয়।’

বলেই অদ্ভুত ভাবে হেসে ওঠে।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

তুমি ছিলে বলেই ২ পর্ব-১০

0

#তুমি_ছিলে_বলেই২
#পর্বঃ১০
#দিশা_মনি

দীপ্র বসে বসে অফিসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছিল। এমন সময় তার পাশে এসে বসে নিপুণ। দীপ্র কাজে ব্যস্ত থাকায় তার উপস্থিতি টের পায় না। নিপুণ একটা সময় পর বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে যায়। নিজের উপস্থিতি বোঝানোর জন্য হালকা কাশি দেয়। যা শুনে দীপ্রর নজর যায় নিপুণের দিকে। নিপুণকে দেখে দীপ্র ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। অবাক হয়ে বলে,
‘তুই কখন এলি?’

নিপুণ হাপিত্যেশ করে বলে,
‘অনেক আগেই এসেছি। কিন্তু তুমি তো নিজের কাজে এতটাই ব্যস্ত ছিলে যে আমার দিকে খেয়ালই ছিল না।’

‘সরি নিপুণ, আসলে আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছিলাম। এটা আমার ড্রিম প্রজেক্ট। গ্রাম্য এলাকায় আমাদের কোম্পানি নতুন একটা কারখানা খুলব খুব শীঘ্রই। যার দরুণ গ্রামের অনেক বেকার তরুণের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। কত মানুষের উপকার হবে এই প্রজেক্টে।’

নিপুণ এসব শুনে খুব খুশি হয়। বলে,
‘শুনে ভালো লাগল। তো এই প্রজেক্ট কবে শুরু হবে?’

‘মাস খানেকের মধ্যেই শুরু হবে। আর পরশু আমি গ্রামে যাচ্ছি এই প্রজেক্টের কাজ কতদূর এগোলো সেটা দেখতে।’

নিপুণের মন এবার একটু খারাপ হয়ে যায় কারণ পরশুদিনের পরের দিনই তাদের এনগেজমেন্ট। তাই নিপুণ বলে,
‘তোমার গ্রামে যাওয়ার ডেট একটু পিছিয়ে নিলে হয়না? আমাদের এনগেজমেন্টের পর নাহয়..’

‘নাহ, নিপুণ। এমনিতেই এই প্রজেক্ট অনেক দিন ধরে পড়ে আছে। তাই আমি আর দেরি করতে চাই না। আর এমনিতেও সামনে কিছুদিন আমার অনেক ব্যস্ত সিডিউল আছে। আমি আর সময় পাবো না।’

নিপুণ ব্যাপারটা বুঝতে পারে। তাই সে আর মন খারাপ করে থাকে না। এরমধ্যে তার ফোনে একটি ম্যাসেজ আসে। নিপুণ ম্যাসেজটা চেক করে দেখে এডভোকেট ইসমাইল হোসেন তাকে ম্যাসেজ দিয়েছে। তিনি তাকে যত দ্রুত সম্ভব কোর্টে পৌঁছাতে বলেছেন একটা জরুরি কাজে। নিপুণ দীপ্রর উদ্দ্যেশ্যে বলে,
‘আমাকে এখনই কোর্টে যেতে হবে। ইসমাইল স্যার আমাকে জরুরি তলব করেছেন।’

‘আচ্ছা, যা। সাবধানে যাস।’

~~~~~
নিপুণ কোর্টে পৌঁছে গেছে। এখানে এসে সে অনেক অবাক হয়ে গেছে। কারণ ইসমাইল হোসেন তাকে এখানে ডেকে অনেক পুরাতন একটি কেসের ফাইল চেক করতে দিয়েছেন। নিপুণ ফাইলটা একনজর দেখে বলে,
‘স্যার, এটা তো ৮ বছর আগের একটা কেইস। আপনি আমাকে এই ফাইল কেন দিলেন?’

‘তোমাকে এই কেসটা স্টাডি করতে হবে নিপুণ।’

‘ঠিক বুঝলাম না।’

‘আজ থেকে ৮ বছর আগে একজন ব্যবসায়ীকে সস্ত্রীক মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় তাদের বাড়িতে। আর তাদের খু**নের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় তাদেরই আপন পুত্রকে।’

নিপুণ হতবাক হয়ে যায় এই কথা শুনে। সে বলে ওঠে,
‘একজন সন্তান কতটা নিষ্ঠুর আর অমানুষ হলে তার মা বাবাকে এভাবে খু**ন করতে পারে।’

ইসমাইল হোসেন একটা ফাইল দেখতে দেখতে বলেন,
‘এই কেসটা এতটাও সহজ নয় নিপুণ। কেসটা বেশ জটিল। সেই সময় ছেলেটা দোষী সাব্যস্ত হলেও আজ ৮ বছর পর নতুন তথ্য সামনে এসেছে।’

‘নতুন তথ্য?’

‘জ্বি, আর যতদূর জানা যাচ্ছে এই খু**নের পেছনে তাদের ছেলের কোন হাত নেই। বরঞ্চ তাদের কোম্পানির ম্যানেজার রয়েছে এর পেছনে। তবে আমার মনে হয় তাদের কোম্পানির ম্যানেজার নিজে থেকে এসব করেনি। বরঞ্চ অন্য কেউ তাদের দিয়ে এই কাজ করিয়েছে।’

‘তাহলে তো সেই ম্যানেজারকে জেরা করা উচিৎ।’

‘সেটা আর সম্ভব নয়। কারণ সেই ম্যানেজার কিছুদিন আগে সড়ক দূর্ঘটনায় মারা গেছে। আর এতে আমার সন্দেহ আরো বেশি গাঢ় হয়েছে যে আসল কালপ্রিট অন্য কেউ।’

নিপুণ বুঝতে পারে ব্যাপারটা আসলেই অনেক জটিল। সে ইসমাইল হোসেনকে প্রশ্ন করে,
‘তাহলে স্যার এখন আপনি কি করবেন?’

‘সেটাই ভাবছি। নতুন করে এই কেসের দায়িত্ব আমার কাধে এসে পড়েছে। আমার এসিট্যান্ট হিসেবে তোমাকেও আমার পাশে চাই। আমি জানি তুমি খুব ট্যালেন্ডেড তাই তুমি আমার পাশে থাকলে আমি এই কেসের সমাধান করতে পারব।’

‘জ্বি, স্যার। আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।’

‘ঠিক আছে। তুমি তৈরি হয়ে নাও।’

‘আমাদের কি কোথাও যেতে হবে স্যার?’

‘হ্যাঁ, আমাদের জেলে যেতে হবে।’

~~~
জেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন ইসমাইল হোসেন এবং নিপুণ। তারা দুজনেই কারো আগমনের জন্য অপেক্ষা করছিল।

আজ সুদীর্ঘ ৮ বছর পর জেল থেকে মুক্তি পেল রুদ্র চৌধুরী। জেলের বাইরে এসে অনেকদিন পর প্রাণভরে বাইরের খোলা খাওয়া উপভোগ করল। দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলো একটা। তারপর নিজের দুচোখ বন্ধ করে নিল। মনে করল ৮ বছর আগের সেই অন্ধকার রাতের কথা। তার চোয়াল শক্ত হলো। নিজের মা-বাবার রক্তাক্ত দেহের কথা মনে পড়লো। মনে পড়ল তাদের বাঁচার আকুতি, আর্তনাদের কথা। আর মনে পড়লো কিছু নরপিশাচদের শয়তানী হাসির কথা। রুদ্র চৌধুরী যেন জেল থেকে বের হতেই নিয়ে নিলো প্রতিশোধের শপথ। তার মা-বাবার প্রতি হওয়া নৃশংসতা, তার জীবনে নষ্ট হয়ে যাওয়া ৮ বছর সবকিছুর হিসাব সে নিয়েই ছাড়বে।

ত্রস্ত পায়ে সামনে এগোয় রুদ্র চৌধুরী। কিছুদূর সামনে এগোতেই ইসমাইল হোসেন তার সম্মুখে এসে বলে,
‘তুমিই তাহলে রুদ্র চৌধুরী? রুবেল চৌধুরী আর প্রজ্ঞা চৌধুরীর ছেলে?’

রুদ্র চোখ তুলে তাকালো ইসমাইল হোসেনের দিকে। তাকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করল। কিন্তু কিছু বললো না।

এইদিকে নিপুণ ভালো করে দেখতে লাগল রুদ্র চৌধুরীর দিকে। ধবধবে ফর্সা দেহ, সুঠাম শরীর। দেখে বোঝাই যাচ্ছে যথেষ্ট সুদর্শন সে। তবে নিপুণের চোখ আটকে যায় রুদ্র চৌধুরীর চোখের নিচে থাকা কা’টা দাগে। সে বুঝতে পারে না এই দাগ কিভাবে হলো।সাথে নজর এড়ালো না মুখভর্তি লম্বা দাড়ি। ৮ বছর জেলে থাকায় হয়তোবা অযত্নে বেড়ে উঠেছে এই দাড়ি। রুদ্র চৌধুরী ইসমাইল হোসেনকে কোন রূপ পাত্তা না দিয়েই সামনে এগোতে লাগল। ইসমাইল হোসেন বারকয়েক তাকে থামানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। রুদ্র চৌধুরীর এমন আচরণে নিপুণও ভড়কে গেল। বিড়বিড় করে বলল,
‘এত এটিটিউড কেন লোকটার? নিজের মা-বাবার খু***নিকে ধরার জন্য তো ওনাকে আমাদের সাথে কো অপারেট করতেই হবে। সেটা কি উনি বুঝতে পারছেন না?’

ইসমাইল হোসেন রুদ্রর পেছন পেছন গেলে নিপুণও তার সাথে যায়। রুদ্র চৌধুরীর জন্য বাইরে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল তার চাচা। মিডিয়ার লোকজনও এসে ঘিরে ধরল তাকে। রুদ্র চৌধুরীর চাচা তাকে মিডিয়ার লোকের থেকে বাচিয়ে নিয়ে গেল। এসবকিছুই দেখল নিপুণ। ইসমাইল হোসেন নিপুণকে বলল,
‘যে করেই হোক রুদ্র চৌধুরীর সাথে আমাদের কথা বলতেই হবে। উনি ছাড়া এই কেসে আমাদের কেউ সাহায্য করতে পারবে না।’

নিপুণ বলল,
‘আপনি চিন্তা করবেন না স্যার। আমরা সফল হবোই।’

~~~~~~
স্নেহা আজ অফিসে এসেছে একটু লেট করেই। আর এতেই দীপ্রর ম্যানেজার তাকে নানান কথা শোনালো। স্নেহা তাকে সরি বলে কোনরকমে ব্যাপারটা ম্যানেজ করল। অতঃপর দীপ্রর কেবিনে গেল। দীপ্র খুব একটা রিয়্যাক্ট করল না। শুধু পরের দিন থেকে দ্রুত আসতে বলল। কিছুক্ষণ পর দীপ্র নিপুণের উদ্দ্যেশ্যে বলল,
‘আগামীকাল তোমাকে আমার সাথে গ্রামের দিকে যেতে হবে। আমার একটা প্রজেক্টের জন্য ওখানে যাব।’

স্নেহা বলল,
‘জ্বি স্যার।’

অতঃপর সে কিছু একটা ভেবে হাসলো। তার এই হাসির পেছনে লুকিয়ে থাকা রহস্যটা দীপ্র বুঝল না। সে নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকল। স্নেহা মনে মনে বলল,
‘আগামীকাল খুব বড় একটা ধামাকা হবে। যা চৌধুরীদের ভীত আরো একবার নাড়িয়ে দেবে।’

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

তুমি ছিলে বলেই ২ পর্ব-০৯

0

#তুমি_ছিলে_বলেই২
#পর্বঃ৯
#দিশা_মনি

স্নেহা বসে আছে একটি লেকের ধারে। তার মন মেজাজ আজ ভালো নেই। আজ ২২ মার্চ। এই তারিখটাকে সে ঘৃণা করে। কারণ আজকের দিনেই সে তার মাকে হারিয়ে ফেলেছিল। স্নেহা যখন বিষন্ন মনে বসে ছিল তখন হঠাৎ করে সোহাগ এসে তার পাশে বসে। সোহাগকে দেখে স্নেহা কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। কিছুক্ষণ মৌনতা বজায় রেখে বলে,
‘দিশা কি এখনো তোমার সাথে আগের মতোই ব্যবহার করছে?’

সোহাগ আফসোস করে বলে,
‘ঐ মেয়ে পরিবর্তন হওয়ার নয়। চৌধুরী পরিবারের রক্ত ওর গায়ে বইছে তো। তবে তুমি চিন্তা করো না। আমি খুব শীঘ্রই ঐ মেয়েকে লাইনে আনব।’

‘আনতে পারলেই ভালো। আমার মনে হয়, আমি তোমার ঘাড়ে একটা ঝামেলা ঝুলিয়ে দিলাম।’

‘তুমি এমন ভেবো না স্নেহা। ঐ মেয়ে এটারই যোগ্য ছিল।’

‘আচ্ছা, বাদ দাও৷ তুমি আজ হঠাৎ এখানে এলে যে?’

‘বাড়িতে দিশার ঘ্যানঘ্যান শুনতে ভালো লাগছিল না। তাই চলে এলাম।’

‘ওহ।’

‘তোমার মন কি খারাপ স্নেহা?’

‘হুম।’

‘কারণটা জানতে পারি?’

‘আজকের দিনে আমি আমার খুব প্রিয় একজনকে হারিয়েছিলাম। আমার মাকে।’

‘শুনে খুব খারাপ লাগল। আচ্ছা, আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিবে?’

‘হ্যাঁ, বলো।’

‘চৌধুরী পরিবারের সাথে তোমার কিসের শত্রুতা?’

চৌধুরী পরিবারের নাম শুনতেই স্নেহার মাথায় রাগ চেপে গেল। সে নিজেকে শান্ত করে বলল,
‘এই চৌধুরী পরিবারের জন্যই আমার জীবনের সুখ শান্তি সব নষ্ট হয়েছে। ওরা আমার সব সুখ কেড়ে নিয়েছে। আমার মাকে আমি হারিয়েছি শুধু ঐ চৌধুরী পরিবারের জন্যই।’

সোহাগ উদগ্রীব হয়ে জানতে চায়,
‘কি করেছিল চৌধুরী পরিবার তোমার সাথে, আমাকে বলো।’

স্নেহা বলতে শুরু করে,
‘আমার মা শিউলি ছিলেন এক ছাপোষা বাঙালি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই তিনি অনেক মেধাবী ছিলেন। তার আরও একটা গুণ ছিল। তিনি অনেক ভালো গান গাইতে পারতেন। আমার নানুজান নিম্নমধ্যবিত্ত হলেও তার নিজের মেয়েদেরকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। তাই তো উনি আমার মাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠান। সেখানেই আমার মায়ের সাথে পরিচয় হয় আব্বাস চৌধুরীর। আলতাফ চৌধুরীর ছোট ভাই। আব্বাস চৌধুরী আমার মায়ের গান শুনে তার প্রেমে পড়ে যান। তিনি সবসময় আমার মায়ের পেছনে পড়ে যান। কিন্তু আমার মা তাকে বিশেষ পাত্তা দেয়নি প্রথমদিকে। তবে একসময় মাও তার পাগলামি দেখে আর মুখ ফিরিয়ে থাকতে চান নি। আব্বাস চৌধুরী একদিন আমার মাকে বলেন তিনি আমার মাকে বিয়ে করতে চান। মা প্রথমে রাজি হয়নি তখন তিনি নিজের মৃত্যুর হুমকি দিয়ে মাকে রাজি করান। ওনারা বিয়ে করে নেন। কিছুমাস সব ভালোই চলছিল। তারপর উনি নিজের পরিবারকে এই বিয়ের কথা জানালে আব্বাস চৌধুরীর বাবা আতিউর চৌধুরী আর ভাই আলতাফ চৌধুরী কিছুতেই এই বিয়ে মেনে নেন না। কারণ আমার মা একজন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ছিলেন। তারা তখন জোরপূর্বক আব্বাস চৌধুরীর সাথে অন্য কারো বিয়ে ঠিক করেন। আর তিনি ছিলেন রাহেলা চৌধুরী। আমার মা এই ব্যাপারটা জানতে পেরে রাহেলা চৌধুরীর কাছে যান। আমি তখন মায়ের পেটে ছিলাম। কিন্তু রাহেলা চৌধুরীর কাছে গিয়ে যখন আমার মা সব বলেন তখন রাহেলা চৌধুরী আমার মাকে বাজে ভাবে অপমান করে। আমার মাকে বে*শ্যা এমনকি আমাকে জারজ সন্তান বলেন। এছাড়া আরো অনেক অপমান করে তাড়িয়ে দেন। শেষপর্যন্ত মা চৌধুরী বাড়িতেও গিয়েছিল সন্তানের দাবি নিয়ে। কিন্তু চৌধুরীরা আমার মাকে অপমান করে তাড়িয়ে দেয়।’

সোহাগ ভাঙা গলায় বলে,
‘তারপর?’

‘তারপর আর কি? আব্বাস চৌধুরী আর রাহেলা চৌধুরী বিয়ে করে নেন। যেই আব্বাস চৌধুরী আমার মাকে এত ভালোবেসেছিলেন তিনি রাহেলা চৌধুরীর সাথে মানিয়ে নিয়ে সংসার করতে থাকেন। কিছুদিনের মধ্যে নিপুণ আসে তাদের ঘরে। তিনি তো সুখী হলেন কিন্তু আমার অভাগী মার কপালে সুখ বলে কিছু রইল না। আমাকে জন্ম দেওয়ার পর তার দুঃখ আরো বাড়ল। সবাই বলতে লাগল, আমি নাকি জারজ সন্তান। আমার নাকি পিতৃপরিচয় নেই। আমার নানুজান এই অপমান সইতে পারলেন না। আমার মা তখন নানুজানকে নিয়ে চৌধুরী বাড়িতে গেলেন। সেদিন নিপুণের আকিকার অনুষ্ঠান চলছিল। সেদিন ঐ রাহেলা চৌধুরী আমার মাকে সবার সামনে বে**, মা**- গী আরো অনেক কিছু বলেছেন। সবার সামনে আমার মাকে জু**-তার মালা পড়িয়ে দিয়েছেন। আমার নানুজান তার মেয়ের এত অপমান সহ্য করতে পারেন নি। সাথে পাড়া প্রতিবেশীর গঞ্জনা তো রয়েইছে। এত কিছু সইতে না পেরে তিনি আত্ম**হত্যা করেন। আমার মা এতে আরো ভেঙে পড়েন। কিন্তু তিনি দমে যান নি। পাড়ার লোকের মন্দ কথা থেকে বাঁচতে তিনি আমার খালা এবং ছোট্ট আমিকে নিয়ে ঢাকায় চলে যান। সেখানে গিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করতে থাকেন। এরপর সবকিছু ভালোই যাচ্ছিল কিন্তু আমার যখন দশ বছর বয়স তখন ঘটে যায় আমাদের জীবনের সবথেকে বড় অঘটন। আব্বাস চৌধুরী আসেন আমাদের বাড়িতে। তিনি আমাকে মায়ের কাছ থেকে নিয়ে গিয়ে নিজের পরিচয় দিতে চান কিন্তু মা রাজি হন নি। কিন্তু তিনি হাল ছাড়ার পাত্র নন, নিয়মিতই আমাদের বাসায় আসতেন। আমায় চকলেট, খেলনা আরো অনেক কিছু দিতেন। কিন্তু আমি মায়ের কথামতো সবকিছু ডাস্টবিনে ফেলে দিতাম। এসব কথা জানতে পেরে একদিন রাহেলা চৌধুরী আসেন আমাদের বাসায়। সেদিন তিনি সব সীমা অতিক্রম করেন। আমার সামনেই আমার মায়ের চু**লের মুঠি ধরে টানেন, তাকে অজস্র নোংরা ভাষায় গালি দেন। আমাকেও জা**রজ বলেন। আমার মা সেদিন তার পা ধরে অনুরোধ করেন যেন তার সন্তানের সামনে তাকে অপমান করা না হয় কিন্তু তিনি তা শোনেন নি। বরং আমার সামনে আমার মায়ের মুখে টাকা ছুড়ে বলেছেন এসব নিয়ে যেন উনি দূরে সরে আসেন। আমার মা এত অপমান সইতে না পেরে ওনার গালে সপাটে চ*ড় বসিয়ে দিয়ে বলেন, উনি রাহেলা চৌধুরীর থেকে কিছু কেড়ে নেন নি। বরং রাহেলা চৌধুরীই আমার মায়ের কাছ থেকে সব কেড়ে নিয়েছেন। রাহেলা চৌধুরী সেদিন খুব ক্ষেপে যায়। তিনি আমার মাকে হুমকি দিয়ে বলেন, তিনি এসবের শেষ দেখে ছাড়বেন। সেদিন রাত ছিল আমাদের জীবনের সবথেকে ভয়াবহ রাত। রাতে যখন আমরা ঘুমিয়েছিলাম তখন হঠাৎ পোড়া গন্ধে আমার ঘুম ভাঙে। খালামনি আর আমি এক ঘরে শুয়েছিলাম আর আম্মু ছিল অন্য ঘরে। আমাদের ঘুম ভাঙতেই আমরা দেখতে পাই চারিদিকে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। আমি আম্মু আম্মু করে চিৎকার করতে করতে আম্মুর ঘরে ছুটে গিয়ে দেখি আম্মু আগুনে দাউ দাউ করে পুড়ছে। খালামনি ছুটে যেতেই আম্মু শুধু এটা বলেন,❝ যা তোরা এখান থেকে। আমার মেয়েটাকে দেখে রাখিস শিউলি।’
আর আমাকে বলেন,❝ভালো থাকিস মা। আর কখনো কাউকে অন্ধবিশ্বাস করিস না।❞

কথা বলতে বলতে স্নেহার চোখ ভিজে যায়। সে নিজের চোখের জল মুছে বলে,
‘এভাবেই আজকের দিনে আমি নিজের মাকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলেছিলাম। তবে আমি নিশ্চিত এটা কোন সাধারণ ঘটনা ছিল না। কেউ বা কারা পরিকল্পনা করে আমার মাকে খু***ন করেছিল। আর সেটা চৌধুরী পরিবারেরই কেউ। সেদিন তাদের উদ্দ্যেশ্য ছিল আমাদের সবাইকে শেষ করে দেওয়া। যদিও আমার সন্দেহ রাহেলা চৌধুরীর দিকে, তবে আমি নিশ্চিত হয়ে কিছু বলতে পারছি না। সব সত্য বের করতে, নিজের মায়ের আসল খু-**নিকে খোঁজার জন্য আমায় চৌধুরী বাড়িতে যেতে হবে। সেখানেই আমি খুঁজে পাব আমার মায়ের খু**নিকে।’

সোহাগ জানতে চায়,
‘কিন্তু তুমি চৌধুরী বাড়িতে কিভাবে যাবে?’

স্নেহা বলে,
‘সেই মোতাবেক পরিকল্পনা করা আমার শেষ। এবার শুধু সেই অনুযায়ী কাজ করতে হবে। আমি খুব শীঘ্রই চৌধুরী বাড়িতে পা রাখব। তবে মেয়ে হয়ে না, বউ হয়ে।’

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨