তুমি ছিলে বলেই ২ পর্ব-১১

0
105

#তুমি_ছিলে_বলেই২
#পর্বঃ১১(মহাধামাকা পর্ব)
#দিশা_মনি

দীপ্র আর নিপুণ একসাথে আড্ডা দিতে বসেছে। এই আড্ডার একটা কারণ অবশ্য আছে। কিছুক্ষণ পরেই দীপ্র চলে যাবে গ্রামের উদ্দ্যেশ্যে। নিপুণ একলা হয়ে যাবে। সেই এখন নিপুণের মন হালকা করার জন্য তার সাথে আড্ডা দিতে বসেছে দীপ্র। কথায় কথায় নিপুণ দীপ্রকে জিজ্ঞেস করে,
‘আচ্ছা তুমি আজকেই ফিরছ তো?’

দীপ্র বলল,
‘হ্যাঁ, আজই তো ফিরব। আর কাল খুব ধুমধাম করে আমাদের এনগেজমেন্ট হবে।’

নিপুণ খুব খুশি হয়ে যায়। কিছুক্ষণ আড্ডা দেওয়ার পর দীপ্র নিপুণের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
‘তাহলে এখন আমি উঠি। আমায় এখন বের হতে হবে।’

দীপ্র উঠতে গেলে নিপুণ বলে,
‘সাবধানে যেও আর তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।’


দীপ্র গ্রামের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিয়ে দিয়েছে। তার সাথে রয়েছে স্নেহা। দীপ্র যেতে যেতে স্নেহার সাথে এই প্রজেক্টের ব্যাপারে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছিল। কিন্তু স্নেহার সেসব কথায় যেন কোন মনই ছিল না। সে তো শুধু ভাবছিল তার নিজের প্রজেক্টের ব্যাপারে। কিভাবে নিজের করা পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করবে সেই ব্যাপারেই ভাবছিল সে। তার এরূপ ভাবনার মাঝেই হঠাৎ করে দীপ্র বলে উঠল,
‘আচ্ছা আমি তোমাকে একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে পারি?’

দীপ্রর থেকে এমন প্রশ্ন আশা করে নি স্নেহা। এই কদিন দীপ্রকে যতদূর সে চিনেছে তাতে দীপ্র যথেষ্ট ম্যাচিউর এবং প্রফেশনাল এটা বুঝেছে সে। লোকটা অফিসে এসেও কাজের বাইরে একটা শব্দও উচ্চারণ করে না। সে হঠাৎ এমন ভাবে ব্যক্তিগত কিছু জানতে চাইছে ব্যাপারটা স্নেহার কাছে স্বাভাবিক মনে হলো না। তবুও সে বলল,
‘জ্বি স্যার, আপনি প্রশ্ন করুন। আমার যদি উত্তর দেওয়ার সামর্থ্য থাকে তাহলে আমি উত্তর দেব।’

‘তুমি সবসময় এরকম পুরুষের বেশভূষায় কেন থাকো?’

স্নেহা কিছুটা থতমত খেয়ে যায়। এমন প্রশ্নের মুখোমুখী জীবনে বহুবার হয়েছে সে তাই একটু সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
‘আসলে আমার এই বেশভূষায় নিজেকে অনেক স্ট্রং মনে হয়।’

‘পুরুষের বেশভূষায় থাকার মধ্যে স্ট্রং হওয়ার কি সম্পর্ক?’

‘আমাদের সমাজে একটা প্রচলিত ধারণা আছে না যে, নারীরা দূর্বল এবং পুরুষেরা শক্তিশালী। আমার মাঝে তাদের এই ধারণা প্রভাব ফেলেছে। আমি ছোটবেলা থেকেই সমাজকে দেখাতে চেয়েছি যে নারীরা দূর্বল নয় তারাও চাইলে পুরুষদের মতো সাহসিকতার পরিচয় দিতে পারে। এজন্য আমি নিজের মধ্যে কখনো দূর্বলতাকে প্রশয় দেই নি। এই জন্য আমার জীবনে কোন পিছুটান, কোন দূর্বলতার স্থান নেই। আমি নিজেকে এমন ভাবে গড়ে তুলেছি যাতে আমার জীবনের উদ্দ্যেশ্য পূরণের পথে কোন বাধাই তৈরি না হয়।’

‘তোমার জীবনের উদ্দ্যেশ্য কি?’

স্নেহা মৃদু হেসে বলে,
‘সেটা সময় হলেই জানতে পারবেন।’

এরকম কথা বলতে বলতেই তারা গ্রামের মাঝে পৌঁছে যায়৷ দীপ্র স্নেহাকে বলে,
‘আমরা পৌঁছে গেছি।’

স্নেহা বলে,
‘হুম বুঝতে পারছি।’

স্নেহা গাড়ি থেকে নামে। চারিপাশে দেখতে থাকে গ্রামের সুন্দর মনোরম পরিবেশ। কিন্তু সে আরো একটা জিনিস লক্ষ্য করে। আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা। এটা দেখে সে মনে মনে বলে,
‘তাহলে প্রকৃতিও কি আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে?’

স্নেহার ভাবনাই সত্যি হলো। সেদিন আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। যা চলল সারাদিন ব্যাপী। ঝড়বৃষ্টির জন্য সেদিন দীপ্র প্রজেক্টের ব্যাপারে কোন কাজ এগোতে পারল না। তাই সেদিন রাতে সে ফিরে যেতে চাইল। কিন্তু সে সময় এখানকার প্রজেক্টের সাথে সংযুক্ত একজন লোক তাকে বলল,
‘রাতে এখানকার রাস্তা নিরাপদ নাও থাকতে পারে। তাই আপনাদের আজকের রাত এখানেই থাকা উচিৎ।’

সব দিক বিবেচনা করে দীপ্র বুঝতে পারল লোকটার কথাই সঠিক। তাই সে সেদিন রাতটা সেখানেই কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। নিপুণকে ফোন করে ব্যাপারটা জানাতেই সে বলল,
‘যদি রাস্তা অনিরাপদ থাকে তাহলে তোমায় আজ আসতে হবে না৷ কাল সকাল সকাল চলে এলো। আমি তোমার জন্য অপেক্ষায় আছি।’

দীপ্র নিশ্চিত হলো। সে নিপুণের সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বললো। স্নেহা দূরে বসে সমস্ত বিষয় দেখল। সে বেশ ভালোই বুঝতে পারল দীপ্র আর নিপুণের মধ্যে সম্পর্কটা বেশ গভীর৷ সেদিন অফিসে তাদের একসাথে দেখার পর নিপুণের প্রতিক্রিয়ার কথাও মনে পড়লো তার। তার মনে হঠাৎ করে দ্বিধা কাজ করতে লাগল। সে ভাবতে লাগল সে যেই পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সেটা বাস্তবায়ন করা ঠিক হবে কিনা। এমন সময় হঠাৎ করে তার মনে পড়লো নিজের মায়ের কথা। তার সাথে হওয়া সকল অন্যায়ের কথা। তখন আবার সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠল। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলল,
‘যাই হয়ে যাক নিজের পরিকল্পনা থেকে এক চুল সরব না আমি। ঐ রাহেলা চৌধুরী আমার মায়ের সাথে যা করেছে তার কাছে তো এটা কিছুই না। আমায় এখন আবেগে গা ভাসালে চলবে না। আমায় নিজের মায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ আগে পূরণ করতে হবে। তারপর নাহয় আমি নিজে দীপ্র আর নিপুণকে মিলিয়ে দেব।’

এমনটা ভাবার পর স্নেহা নিজের পরিকল্পনা মাফিক কাজ করতে লাগল। দীপ্রর কাছে গিয়ে তার উদ্দ্যেশ্যে বলল,
‘স্যার, আপনি তো কাল সকাল সকাল এখান থেকে চলেই যাবেন। তাহলে আজ একটু গ্রামটা ঘুরে দেখুন না। তাহলে এই প্রজেক্ট সম্পর্কে কিছুটা হলেও আইডিয়া পাবেন।’

দীপ্র কাছে স্নেহার পরিকল্পনাটা ভালো লাগল। তাই সে বলল,
‘আচ্ছা। তাহলে চলো যাওয়া যাক।’

স্নেহা মৃদু হাসল। তারা দুজনেই গ্রামটা ঘুরে দেখতে লাগল। হঠাৎ একটা পুকুরের কাছে এসে স্নেহা বলল,
‘আমি একটু কাছ থেকে গিয়ে পুকুর দেখি।’

স্নেহা পুকুরের কাছে যায়। দীপ্র আশপাশটা দেখতে থাকে। একটু পরেই একটা শব্দ শুনে দীপ্র পুকুরের দিকে চলে যায়। দীপ্র দেখতে পায় স্নেহা পুকুরে পড়ে গেছে। সে বাঁচার জন্য সাহায্য চাইছে। দীপ্র আশেপাশে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই। সে আর কোন উপায় না পেয়ে স্নেহাকে বাচানোর জন্য পুকুরে ঝাপ দেয়। স্নেহা প্রায় ডুবে যেতে ধরেছিল কারণ পুকুরটা অনেক বড় আর গভীর। স্নেহাকে দীপ্র পুকুর থেকে তুলে আনে। স্নেহার মুখে পানি ঢুকে গিয়েছিল এবং সে সেন্সলেস ছিল। তাই দীপ্র তার পেট চেপে পানি বের করে এবং তার জ্ঞান ফেরানোর জন্য স্নেহাকে সিপিআর দেয়। এমন সময় কিছু গ্রামবাসী সেখানে চলে আসে। দীপ্র স্নেহাকে সিপিআর দিচ্ছে এটা দেখে গ্রামবাসীরা ভুল বুঝে নেয় যে তারা অনৈতিক কোন কাজ করছে। একে একে সব গ্রামবাসী তাদের ঘিরে ফেলে। দীপ্র কিছুই বুঝতে পারে না। স্নেহার জ্ঞানও ততক্ষণে ফিরেছে। একজন গ্রাম্য পুরুষ বলতে থাকে,
‘কে তোমরা? আর এত রাতে এখানে সব কি নষ্টামো হচ্ছে?’

দীপ্র লোকটার কথা কিছুই বুঝতে পারে না। সে বলে,
‘নষ্টামো মানে কি বলতে চাইছেন আপনারা? এই মেয়েটা পুকুরে পড়ে গিয়েছিল আর তাই..’

আরেকজন দীপ্রকে থামিয়ে বলে,
‘এসব নাটক বন্ধ করো৷ আমরা কিছু বুঝিনা ভেবেছ? আমরা নিজের চোখে দেখেছি তুমি ঐ মেয়েটার কত কাছে ছিলে।’

‘আরে আপনারা বুঝছেন না কেন? দেখুন আমাদের দুজনের শরীর ভেজা..’

‘নষ্টামো করে আবার বড় গলা। এই এদেরকে নিয়ে চল। এদেরকে নিয়ে গিয়ে গাছের সাথে বেধে পাথর নিক্ষেপ করলেই এরা সোজা হয়ে যাবে।’

স্নেহা আতকে বলে ওঠে,
‘এসব কি বলছেন আপনারা? বিশ্বাস করুন উনি যা বলছেন তাই সত্যি।’

‘এই মেয়ে তুমি চুপ করো। আমাদের গ্রামে এসব নষ্টামো আমরা বরদাস্ত করব না।’

দীপ্র বলে ওঠে,
‘আপনারা কি বলছেন এসব? দেশে কি আইন কানুন নেই যে আপনারা আমাদের এভাবে শাস্তি দেবেন? আমি এখনই পুলিশে যোগাযোগ করছি।’

একজন বলে,
‘আমাদের গ্রামে কোন পুলিশের আইন চলে না। এখানে আমাদের আইন চলে। এই তোমরা দাঁড়িয়ে কি তামাসা দেখছ? এদেরকে নিয়ে চলো। গ্রামের বটগাছের সাথে বাধি এদের। তারপর সবাই মিলে পাথর তুলে নিয়ে এদের মা*-রব। তারপর বুঝবে মজা।’

দীপ্র বলে,
‘দেখুন এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।’

গ্রামবাসীরা তাদের কোন কথাই শোনে না। প্রথমে স্নেহাকে নিয়ে গিয়ে বটগাছের সাথে বাধা হয়। তারপর গ্রামবাসীরা তাদের দিকে পাথর নিক্ষেপ করতে উদ্যত হয়। স্নেহা অনেক আকুতি করে আর্তনাদ করে কিন্তু কোন লাচ হয়না। অবস্থা বেগতিক দেখে দীপ্র বলে ওঠে,
‘আপনারা প্লিজ ওকে ছেড়ে দিন। এমন করবেন না।’

তখন গ্রামের প্রধান বলে,
‘ওকে ছেড়ে দেব একটা শর্তেই। আর সেটা হলো তোমাদের বিয়ে করতে হবে।’

দীপ্র বলে ওঠে,
‘অসম্ভব। এটা হতে পারে না।’

তখন গ্রামের প্রধান গ্রামবাসীর উদ্দ্যেশ্যে বলে,
‘তোমরা পাথর ছোড়া শুরু করো।’

একজন গ্রামবাসী পাথর ছোড়ে। যেটা স্নেহার কপালে গিয়ে লাগে। সেখান থেকে ক্রমাগত রক্ত পড়ছিল। স্নেহা বাচার আকুতি জানাতে থাকে। দীপ্র আর কোন উপায়ান্তর না দেখে বলে,
‘প্লিজ থামুন আপনারা। আমি আপনাদের সব শর্তে রাজি তবু ওকে ছেড়ে দিন।’

গ্রামবাসীরা থেমে যায়। এরপর কাজি ডাকা হয়। স্নেহাকে বউ সাজাতে নিয়ে যাওয়া হয়। স্নেহা গ্রামবাসীকে বলে,
‘আপনাদের কাজে আমি খুশি। আপনারা যত টাকা চান, ঠিক ততো টাকাই পাবেন। ধন্যবাদ আমার কথামতো কাজ করার জন্য।’

এরপর নিজের কপালে আঘাতের যায়গায় হাত দিয়ে বলে,
‘বড় বড় কাজে এমন ছোট ছোট আত্নত্যাগ তো করতেই হয়।’

বলেই অদ্ভুত ভাবে হেসে ওঠে।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে