তুমি ছিলে বলেই ২ পর্ব-১৫

0
117

#তুমি_ছিলে_বলেই২
#পর্বঃ১৫
#দিশা_মনি

স্নেহা আজ সকালে উঠেছে থেকে দম ফেলার সময় পাচ্ছে না। খোদেজা চৌধুরী তাকে টেনে নিয়ে এসেছে বাইরে। তারপর তার দিকে অনেকগুলো কাপড় বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
‘যাও গিয়ে এই কাপড় গুলো ভালো করে পরিস্কার করে রাখো। তুমি যে এই বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছ এটাই অনেক। এখন এই বাড়িতে বউ হয়ে নয় কাজের লোক হয়ে থাকতে হবে।’

খোদেজা চৌধুরী যখন রাহেলাকে এই ব্যাপারে বলছিল তখন রাহেলা চৌধুরী সেখান দিয়েই যাচ্ছিলেন। তিনি বলেন,
‘একদম ঠিক কাজ করছ তুমি। এই মেয়েকে আরো খাটাও৷ একদম শান্তিতে থাকতে দেবে না। একে দেখলেই আমার মাথায় আগু*ন জ্বলছে। শুধুমাত্র এর জন্য আমার নিপুণ এখন ঘরছাড়া।’

স্নেহা কোন প্রতিবাদ করল না। মুখ বুজে সব কাজ করল। তবে ভিতরে ভিতরে সে ঠিকই নিজের সব পরিকল্পনা সাজিয়ে রেখেছে। কিন্তু নিজের মায়ের আসল খু**নি সম্পর্কে যতদিন না পর্যন্ত সে জানতে পারছে ততদিন তাকে এসব কিছু সহ্য করতেই হবে। নাহলে তো সে এখানে টিকতেই পারবে না। এখানে টিকে থাকার জন্য হলেও তাকে এখন কিছুদিন নিজের শক্ত খোলস ত্যাগ করে নরম হয়ে থাকতে হবে। এটা মোটেই তার দূর্বলতা নয়। বরং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে টিকে থাকার পন্থা।

স্নেহা যখন সব কাপড় চোপড ধুয়ে ছাদে সেসব শোকানোর জন্য গেল তখন হঠাৎ করেই তার দেখা হয়ে গেল দিলারা চৌধুরীর সাথে। দিলারা চৌধুরী স্নেহার দিকে ভালো ভাবে তাকিয়ে বললেন,
‘আমার ছেলে যে তোমায় কি দেখে বিয়ে করল, আমি জানি না। যাইহোক, তুমি এই সাজসজ্জা বদলে নাও। আমাদের বাড়ির মেয়ে বউরা এমন ভাবে থাকে না। তুমি আমার সাথে আমার রুমে চলো আমি তোমাকে আমার শাড়ি পড়তে দিচ্ছি।’

স্নেহা মাথা নাড়ায়। দিলারা চৌধুরী স্নেহাকে তার রুমে নিয়ে গিয়ে নিজের খুব সুন্দর একটা দামি শাড়ি স্নেহাকে দিয়ে বলে,
‘নাও। এটা পড়ো।’

স্নেহা শাড়িটা দেখেই বুঝতে পারে এটা অনেক দামি। তাই সে বলে,
‘এত দামি শাড়ি আমি পড়ব?’

‘হ্যাঁ, পড়বে। আমার ছেলেকে যখন বিয়ে করতে পেরেছ তখন এই শাড়িও তুমি পড়তে পারবে। আর একটা কথা, তোমাকে এই বাড়ির সব কাজ করতে হবে না। বাড়ির কাজ করার জন্য কাজের লোক আছে। খোদেজা, রাহেলা তোমায় মেনে নিতে পারছে না তাই তোমাকে এভাবে খাটাচ্ছে।’

স্নেহা হঠাৎ কি মনে করে যেন দিলারা চৌধুরীকে প্রশ্ন করে বসল,
‘আপনি কি আমায় মেনে নিতে পেরেছেন?’

দিলারা চৌধুরী এই প্রশ্নের কোন উত্তর দিলেন না। স্নেহার যা বোঝার সে বুঝে নিলো। দিলারা চৌধুরীকে স্নেহার এই চৌধুরী বাড়ির একজন ভেজালহীন সদস্য মনে হলো। যিনি হয়তো খুব ভালো মনের অধিকারী। কিন্তু নিজের স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির জন্য যাকে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে হয় সবসময়।

স্নেহা ধ্যান থেকে বেরিয়ে আসে। দিলারা চৌধুরী ততক্ষণে রুম থেকে বেড়িয়ে গেছে৷ স্নেহা তার দেওয়া শাড়িটা পড়ে নেয়। এই প্রথম শাড়ি পড়লো স্নেহা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে নিজেই অবাক হলো সে। বড্ড অচেনা লাগছে তার নিজেকে। সর্বদা শার্ট-প্যান্টে নিজেকে আবৃত রাখা এই মেয়েটাকে শাড়ি পড়ে যে এত সুন্দর লাগতে পারে সেটা তার কল্পনাতেই ছিল না কখনো। কিছুক্ষণ পরেই দিলারা চৌধুরী রুমে এলেন৷ স্নেহাকে দেখে তিনি নিজেও বেশ অবাক হলেন৷ একটু আগেই যেই মেয়েটাকে বেশ উগ্র এবং উশৃংখল লাগছিল শাড়ি পড়েই কেমন যেন কোমলতায় মুড়িয়ে গেল তার শরীর।

দিলারা চৌধুরী কিছু বলবেন তার আগেই খোদেজা চৌধুরী এসে স্নেহাকে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,
‘এই মেয়ে তুমি এখানে কি করছ হ্যাঁ? তোমার কি কোন কথা কানে যায়না? এই বাড়িতে থাকতে চাইলে কিন্তু এমন পটের বিবি সেজে থাকলে চলবে না। যাও গিয়ে সকলের জন্য রান্না করো।’

স্নেহা চুপসে যাওয়া মুখে বলে,
‘কিন্তু আমি তো রান্না পারি না।’

দিলারা চৌধুরী বললেন,
‘আহ, খোদেজা। তুমি ওকে এসব করতে বলছ কেন? বাড়িতে তো কাজের লোক আছেই।’

‘আমি সেটা জানি ভাবি। কিন্তু ভাইজানের আদেশেই আমি ওকে এসব করতে বলছি। ভাইজান আমাকে বলে দিয়েছেন এই মেয়েটাকে দিয়ে এসব করাতে। নিশ্চয়ই তুমি চাওনা আমি ভাইজানের কথার অবাধ্য হই?’

দিলারা চৌধুরী আর কিছু বললেন না।
নিজের স্বামীকে বড্ড সম্মান করেন তিনি। কখনো তার কোন কথার অবাধ্য হন না। এমনকি সেটা যদি তার মনের বিরুদ্ধেও করতে হয় তবুও। এইজন্য তো তার মেয়েকে যখন তার স্বামী ত্যাগ করল তখনও চুপ ছিলেন। তাই যখন জানলেন তার স্বামীর আদেশেই স্নেহাকে সব করতে হবে তখন তিনি আর বিরুদ্ধাচারণ করতে চাইলেন না। স্নেহাকে বললেন,
‘ও যা বলছে তাই করো। রান্না না পারলে কোনভাবে ম্যানেজ করার চেষ্টা করো। এখন তো মডার্ন যুগ তাই আশা করি খুব একটা অসুবিধা হবে না।’

স্নেহা বুঝল দিলারা চৌধুরী পক্ষান্তরে তাকে সাহায্য করল এই কথা বলে। দিলারা চৌধুরীর ইঙ্গিত বুঝতে পেরে স্নেহা নিজের ফোন সাথে নিয়ে খোদেজা চৌধুরীর উদ্দ্যেশ্যে বললেন,
‘চলুন আমি যাচ্ছি আপনার সাথে।’

✨✨✨✨
নিপুণ রুদ্র চৌধুরীর অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় আধঘন্টা হতে চলল৷ কিন্তু রুদ্রর কোন পাত্তাই নেই। যারপরনাই বিরক্ত হলো নিপুণ। এমন সময় রুদ্র চৌধুরীর ম্যানেজার এসে তাকে বললো,
‘স্যার আজ অনেক বিজি আছেন। তাই আজ আপনার সাথে দেখা করতে পারবেন না।’

‘বিজি মানে? আমি আধঘন্টা ধরে এখানে বসে আছি। আমার সময়ের কি কোন দাম নেই? আপনার স্যার নিজেকে কি ভাবেন? প্রাইম মিনিস্টার? ৮ বছর জেল খেটেছেন আবার গতকালই জামিন পেলেন..তার এত এটিটিউড মানায় না।’

‘এটিটিউড আমার রক্তে আছে যেটা আমি চাইলেই ছাড়তে পারি না।’

কথাটা বলেই ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে এলো রুদ্র। এসে দাঁড়ালো নিপুণের সামনে। নিপুণ রুদ্র চৌধুরীকে দেখে বললো,
‘আমি আপনার থেকে বেশি সময় নেব না। জাস্ট আমাকে দশ মিনিট দিন। আমি কিন্তু আমার নিজের প্রয়োজনে এখানে আসিনি আপনার মা-বাবাকে ন্যায়বিচার..’

‘আমার মা-বাবাকে ন্যায়বিচার পাইয়ে দিতে আমার কোন উকিল বা আইনের প্রয়োজন নেই। এর জন্য আমি একাই যথেষ্ট।’

এতটুকু বলে রুদ্র চৌধুরী চলে যেতে নিলে নিপুণ পেছন থেকে বলে ওঠে,
‘আপনি বোঝার চেষ্টা করুন মিস্টার চৌধুরী….আপনি এভাবে একা কিছু করতে পারবেন না। কেসটা এতটা সহজ না..’

‘সেটা আমি বুঝে নেব।’

‘এত ত্যাড়ামো করবেন না। এতে আপনারই ক্ষতি।’

রুদ্র হঠাৎ থেমে গিয়ে নিপুণের দিকে এগোতে থাকে। আর নিপুণ একটু একটু পিছাতে থাকে। রুদ্র নিপুণের একদম কাছে এসে বলে,
‘কি ক্ষতি হবে আমার?’

‘আপনাকে আবার জেলে যেতে হতে পারে।’

‘আই ডোন্ট কেয়ার। আমার জীবনের একমাত্র উদ্দ্যেশ্য এখন আমার মা-বাবার খু–নিকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া। তারপর আমাকে জেল যেতে হোক বা জাহান্নাম,,,,আমার কিছুই আসে যায়না।’

এই কথা বলে রুদ্র চৌধুরী চলে যায় নিপুণের সামনে থেকে। এদিকে নিপুণ অসহায় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে। একেই দীপ্রর ব্যাপারটা নিয়ে সে ডিপ্রেসড আবার এখানে কেসে এসেও ঝামেলা। হঠাৎ করেই নিপুণের মাথাটা কেমন ঘুরতে লাগল। চারপাশের সবকিছু ঝাপসা দেখতে পাচ্ছিল সে। শরীরের সবটুকু শক্তি যেন ফুড়িয়ে আসছিল। নিপুণ বুঝতে পারে সে আর বেশি সময় দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। অবশ্য এটা হওয়ারই ছিল। একেই গতকাল রাত থেকে সে এখনো অব্দি কিছু খায়নু তার উপর এত স্ট্রেস আর সহ্য হচ্ছিল না।
রুদ্র কি মনে করে যেন পিছনে তাকালো। নিপুণকে দেখে সে বুঝল ওর কোন সমস্যা হয়েছে। রুদ্র নিপুণের দিকে এগোতে যাবে এমন সময় নিপুণ জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যেতে নেয়। রুদ্র একদম সঠিক সময় এসে নিপুণকে ধরে নেয়। নিপুণের মুখের দিকে ভালো ভাবে তাকায়। অনেক ইনোসেন্ট লাগছিল নিপুণকে। চোখমুখের অবস্থা দেখেই মনে হচ্ছে মেয়েটা হয়তো খুব খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। চোখের নিচের ডার্ক সার্কেল বুঝিয়ে দিচ্ছে নির্ঘুম রাত কেটেছে তার। তবুও নিজের দায়িত্বে কতটা অবিচল সে। রুদ্র নিপুণের থেকে চোখ সরিয়ে তার ম্যানেজারকে বলল,
‘ইমিডিয়েটলি কল দা ডক্টর, ফাস্ট।’

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে