তুমি ছিলে বলেই ২ পর্ব-১৩

0
105

#তুমি_ছিলে_বলেই২
#পর্বঃ১৩
#দিশা_মনি

দীপ্র নিপুণকে সামলাতে তার কাছে যেতে নিতেই রাহেলা চৌধুরী থামিয়ে দিলেন তাকে। অতঃপর কড়া গলায় বললেন,
‘তোমায় আমার মেয়েকে সামলাতে হবে না। আমার মেয়ের জন্য আমি আছি। তুমি গিয়ে তোমার নতুন বউকে সামলাও।’

দীপ্র অসহায় চোখে তাকিয়ে রইল। নিপুণ কিছুক্ষণ পর পিটপিট করে তাকালো। অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে দীপ্রর উদ্দ্যেশ্যে বলল,
‘কেন করলে তুমি আমার সাথে এমন? আমি তোমার কি ক্ষতি করেছিলাম দীপ্র ভাইয়া? তুমি যদি এমনটাই চেয়েছিলে তাহলে আমায় মিথ্যা আশা কেন দেখালে? কেন করলে আমার সাথে এমন কেন?’

বলেই সে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। দিলারা চৌধুরী এগিয়ে গেলেন নিজের ছেলের দিকে। তিনি জিজ্ঞাংসু কন্ঠে বললেন,
‘তুই কি সত্যি এই মেয়েটাকে বিয়ে করেছিস?’

বলেই তিনি ভালো করে তাকালেন স্নেহার দিকে। স্নেহার পুরুষালি সাজ দেখে তিনি বললেন,
‘তোর থেকে এটা আশা করিনি দীপ্র। আমি বুঝতে পারছি না কি দোষ করেছিলাম আমি। তোরা দুই ভাইবোন কেন এভাবে আমার মুখ ছোট করছিস। তোরা কি হিরা চিনতে শিখিস নি? সবসময় এভাবে হিরা ফেলে কাচ বেছে নিস কেন?’

দীপ্র কিছু বলার মতো খুঁজে পেল না। আলতাফ চৌধুরী রাহেলা চৌধুরীকে বললেন,
‘তুমি নিপুণ মাকে নিয়ে ঘরে যাও। ওর উপর দিয়ে অনেক ঝড় বয়ে গেছে। এখানে এই কুলাঙ্গারটার সামনে ও যদি আরো থাকে তাহলে ওর আরো কষ্ট হবে। তাই তুমি ওকে এখান থেকে নিয়ে যাও।’

রাহেলা চৌধুরী নিজের ভাসুরের কথা মতো কাজ করেন। নিপুণকে নিয়ে যেতে থাকেন। নিপুণ আর একটিবারও দীপ্রর দিকে তাকায় না। হঠাৎ করেই মেয়েটা যেন কেমন শক্ত হয়ে গেছে। বড় ধাক্কা যেন তার জীবনকে অনেক বদলে দিয়েছে।

আলতাফ চৌধুরী দীপ্রর সামনে এলেন। দীপ্রর গালে ঠাস করে চ*ড় বসিয়ে দিলেন। দীপ্র কোন প্রতিবাদ করল না। স্নেহা এসব কিছুর নীরব দর্শক হলো। চৌধুরী বাড়িতে এসব ঝামেলা দেখে মনে মনে শান্তি পেল। তার মনে হতে লাগল তার মৃত মায়ের আত্মা বোধহয় এসব দেখে অনেক শান্তি পাচ্ছে।

আলতাফ চৌধুরী চিৎকার করে বলে উঠলেন,
‘এটা কি করলে তুমি? তোমরা দুই ভাইবোন কি আমার মান সম্মান নষ্ট করার জন্য এই পৃথিবীতে এসেছিলে? এই তো সেদিন তুমি নিজে নিপুণের বিয়ে আটকালে। ওকে ভালোবাসার দাবি জানালে। তাহলে আজ হঠাৎ এটা কি হলো?’

দীপ্র তার বাবাকে সমস্ত ঘটনা খুলে বললো৷ সব শুনে আলতাফ চৌধুরী হতবাক হয়ে গেলেন। তিনি বলে উঠলেন,
‘যা হবার হয়ে গেছে। এখন আমি আর কোন নাটক চাইছি না। তুমি এই মেয়েকে এখান থেকে দূর করো। এই বিয়েটা আমি মানি না।’

খোদেজা চৌধুরী নিজের ভাইয়ের তালে তাল মিলিয়ে বলেন,
‘তুমি একদম ঠিক বলেছ ভাইয়া। এই বিয়ের কোন মানে নেই। না জানি এই মেয়ে কোন বংশের। কোথাকার কোন রাস্তার মেয়েকে তুলে এনে আমাদের চৌধুরী বাড়ির বউ করতে চাইলেই তো আর হলো না।’

দিলারা চৌধুরী নিশ্চুপ রইলেন। এরইমাঝে দীপ্র বলে উঠল,
‘তোমরা প্লিজ স্নেহার সম্পর্কে কোন অসম্মানজনক কথা বলো না। ও তো এই বিয়েটা করতে চায়নি। পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হয়েই এই বিয়েটা হয়েছে। আর বিয়ে কোন ছেলেখেলা নয়। একবার যখন বিয়েটা হয়ে গেছে, সেটা যেভাবেই হোক স্নেহা এখন আমার স্ত্রী। ওর দায়িত্ব এখন আমার। ওর সম্মান রক্ষা করার আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তাই তোমরা দয়া করে ওকে নিয়ে এমন কথা বলো না।’

আলতাফ চৌধুরী বলেন,
‘আমি কিছুতেই এই চাল চুলোহীন মেয়েকে নিজের বাড়ির বউ হিসেবে মানব না। এটাই আমার সাফ কথা। তুমি ওকে ছেড়ে দাও, নিপুণের সাথেই তোমার বিয়ে হবে।’

দীপ্র স্নেহার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘তুমি প্লিজ আমার ফ্যামিলির কারো কথায় কিছু মনে করো। বুঝতেই পারছ পরিস্থিতিটা।’

স্নেহা বলে,
‘আমি সবটাই বুঝতে পারছি। আপনি চিন্তা করবেন না। আমাকে নিয়ে যাতে আপনার ফ্যামিলিতে আর কোন সমস্যা না হয় আমি সেই ব্যবস্থা করব। আমি এখুনি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।’

আলতাফ চৌধুরী বলে,
‘এই মেয়ে শোন, তোমাকে কোন চিন্তা করতে হবে না। তোমার কত টাকার প্রয়োজন আমাকে বলো আমি তোমাকে তত টাকাই দেব। তুমি শুধু এই বিয়েটা ভুলে যাও। আর এই বাড়ি থেকে বের হও।’

স্নেহা এখন বুঝতে পারে না সে কি করবে। নিজের মাকে ন্যায়বিচার পাইয়ে দিতে হলে তাকে এই চৌধুরী বাড়িতেই থাকতে হবে। কিন্তু সে কিভাবে থাকবে এখানে? স্নেহা যখন এসব চিন্তায় ব্যস্ত ছিল তখনই হঠাৎ নিপুণ এসে উপস্থিত হলো সেখানে। সে এসেই আলতাফ চৌধুরীর সামনে গিয়ে উপস্থিত হলো। আলতাফ চৌধুরী নিপুণকে দীপ্রর ব্যাপারে সমস্ত কিছু খুলে বলল। অত:পর বললেন,
‘তুই চিন্তা করিস না মা, এই মেয়েটাকে আমি বউ হিসেবে মানব না। তুই দীপ্রর বউ হবি।’
সব শুনেও নিপুণ কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। বরং সে বলল,
‘আমি আত্মসম্মানহীন হতে পারব না বড় আব্বু। তোমার ছেলেকে নিয়ে তুমি কি সিদ্ধান্ত নেবে সেটা তোমার ব্যাপার। তবে আমি নিজের ব্যাপারে বলি, আজকের ঘটনার পর তোমার ছেলের সাথে এক ছাদের তলায় থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আমি এখান থেকে চলে যাব।’

আলতাফ চৌধুরী হতবাক স্বরে বলেন,
‘এটা তুই কি বলছিস মা? এটা তো তোর বাড়ি তুই এখান থেকে কোথায় যাবি?’

নিপুণ বলে,
‘আমি কিছুদিন আপাতত আমার মামার বাড়ি গিয়ে থাকব। তারপর কোন একটা ব্যবস্থা করে নেব। তোমাকে সেটা ভাবতে হবে না। আমি শুধু তোমাকে আমার সিদ্ধান্তটা জানাতে এসেছি।’

রাহেলা চৌধুরী ছুটে এসে আলতাফ চৌধুরীকে বলেন,
‘আপনি ওকে বাধা দেবেন না। আমার মেয়ে যেটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমি সেটাকে সমর্থন করি।’

নিপুণ বাড়ির সবার থেকে বিদায় নেয়৷ তারপর নিজের সব জিনিসপত্র নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার পূর্বে দীপ্র তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলে নিপুণ কড়া গলায় বলে,
‘দ্বিতীয়বার আর এই স্পর্ধা দেখাবে না। আর কোনদিন যে তোমাকে আমার ত্রিসীমানায় না দেখি।’

দীপ্র থমকে তাকিয়ে রইলো। নিপুণ বেড়িয়ে গেল চৌধুরী বাড়ি থেকে। নিপুণ চলে যাবার পর রাহেলা চৌধুরী স্নেহার দিকে ইশারা করে বললেন,
‘এই মেয়েটা সবকিছুর জন্য দায়ী। এই মেয়েটার জন্যই আমার মেয়ে এই বাড়ি থেকে চলে গেল। একে তো আমি…’

রাহেলা চৌধুরী স্নেহার দিকে এগোতে গেলেই দীপ্র ঢাল হয়ে দাঁড়ায়। অতঃপর বলে,
‘তোমার কিছু বলতে হলে তুমি আমায় বলো চাচি, ওকে কিছু বলো না। আমি যেহেতু ওকে বিয়ে করেছি সেহেতু সব দোষ আমার। নিপুণের এই বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার জন্য আমি দায়ী। তাই আমি নিজেও আর এই বাড়িতে থাকব না। আমিও চলে যাব এখান থেকে।’

এটুকু বলেই সে স্নেহাকে বলে,
‘তুমি চলো আমার সাথে। তুমি আমার স্ত্রী, আমার দায়িত্ব। তাই আমি তোমাকে অবহেলা করতে পারব না।’

দীপ্র আর স্নেহা বাড়ি থেকে চলে যেতে নেবে তখনই দিলারা চৌধুরী হঠাৎ করে অসুস্থ বোধ করেন। আলতাফ চৌধুরী তাকে সামলাতে গেলে তিনি বিড়বিড় করে বলেন,
‘আমার মেয়েটা বিয়ে করে চলে গেল এখনো ওর কোন খবর পেলাম না। এখন আমাত ছেলেটাও চলে যাচ্ছে। এবার আমি কি নিয়ে থাকব দীপ্রর বাবা?’

আলতাফ চৌধুরী অসহায় চোখে নিজের ৩০ বছরের জীবনসঙ্গিনীর দিকে তাকান। দিলারা চৌধুরী করুণ গলায় হাতজোড় করে নিজের স্বামীর উদ্দ্যেশ্যে বলেন,
‘আপনি দয়া করে আমার ছেলেকে এখান থেকে যেতে দেবেন না। ওকে আটকান আপনি। আমার ছেলেকে হারালে আমি যে আমার সব হারিয়ে ফেলব। সারাজীবন তো আমি আপনার কাছে কিছু চাইনি। আজ প্রথমবার কিছু চাইছি। আপনি আমার কথা রাখবেন না? এতদিন আমি নিজের স্ত্রী হওয়ার দায়িত্ব পালন করেছি। আপনি আমার মেয়েকে ত্যাগ করেছেন তখনও আমি কিছু বলিনি কিন্তু আজ আমি একজন মা হিসেবে আপনার কাছে অনুরোধ করছি। দয়া করে আমায় ফেরাবেন না।’

আলতাফ চৌধুরী হার মেনে নেন। দীপ্রর উদ্দ্যেশ্যে বলে,
‘তোমাকে কোথাও যেতে হবে না। তুমি নিজের স্ত্রীকে নিয়ে চৌধুরী বাড়িতেই থাকো।’

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে