Saturday, July 19, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 218



তুমি ছিলে বলেই ২ পর্ব-০৮

0

#তুমি_ছিলে_বলেই২
#পর্বঃ৮
#দিশা_মনি

স্নেহা আর দীপ্রকে কাছাকাছি দেখে নিপুণ খুব কষ্ট পেয়ে ছুটে বেরিয়ে যেতে নেয়। দীপ্র যার তার পেছন পেছন। স্নেহা পুরো ব্যাপারটা বেশ ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করে। সে কিছুটা উপলব্ধি করতে পারে ঠিক কি হয়েছে। এই মেয়েটাকে চেনে সে। চৌধুরী বাড়িতে থাকা তার শুভাকাঙ্ক্ষী এই মেয়ের ছবি দিয়েছিল তাকে। স্নেহা বিড়বিড় করে বলে,
‘এই নাহলে নিপুণ চৌধুরী। আব্বাস চৌধুরী আর রাহেলা চৌধুরীর মেয়ে। তোমাকে তো আমি সবথেকে বেশি কাঁদাবো মেয়ে। এই তো সবে তোমার কান্নার শুরু। তোমার ভালোবাসার যা কিছু আছে সবই আমি তোমার থেকে কেড়ে নেব যেভাবে তোমার মা কেড়ে নিয়েছিল আমার মায়ের থেকে।’

একথা বলেই সে অতীতে ডুব দেয়। মনে করে নিজের মায়ের মুখটা।

এদিকে দীপ্র নিপুণকে আটকানোর জন্য তার পিছন পিছন যেতে থাকে। একসময় নিপুণকে আটকে ফেলে। নিপুণ জেদ দেখিয়ে বলতে থাকে,
‘আমাকে আটকিও না। আমাকে যেতে দাও। তুমি যাও ঐ মেয়েটাকে নিয়ে থাকো।’

দীপ্র নিপুণকে আরো শক্ত করে ধরে। নিপুণকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলে,
‘আগে আমার সব কথা শোন তুই তারপর যেখানে যাওয়ার যাস।’

‘কি বলবে তুমি? তোমার কি কিছু বলার মুখ আছে? কিভাবে পারলে তুমি ঐ মেয়েটার এত কাছে আসতে?’

‘নিপুণ, বিলিভ মি। ঐ মেয়েটাকে আমি চিনি না। তাড়াহুড়ো করে অফিসে ঢোকার সময় হঠাৎ করে ওর সাথে ধাক্কা লেগে গেল আর…’

নিপুণ দীপ্রর কথা শুনে নিজের ভুলটা বুঝতে পারে। তারপর নিজের কান ধরে বলে,
‘সরি। আসলে আমি তোমাকে নিয়ে অনেক বেশি পজেসিভ হয়ে গেছিলাম। আর তাই…’

দীপ্র নিপুণের অনেক কাছে এসে বলে,
‘কোন ব্যাপার না। আই লাইক ইউর দিস পজেসিভনেস।’

নিপুণ লাজুক হাসে। অতঃপর ভেবে বলে,
‘ইস, আমি কি একটা গড়বড় করে দিলাম। মা তোমার জন্য খাবার পাঠিয়েছিল আর আমি সেই খাবার ফেলে দিলাম। এবার তুমি কি খাবে?’

‘কোন ব্যাপার না। আমি ক্যান্টিনে খেয়ে নেব।’

‘সত্যি বলছ তো?’

‘হুম।’

‘তাহলে আমাকে ছুয়ে প্রমিস করো যে তুমি ক্যান্টিনে খেয়ে নেবে। তাহলে আমি নিশ্চিন্তে বাড়িতে ফিরতে পারব।’

দীপ্র নিপুণের হাতটা ধরে বলে,
‘আচ্ছা, তোকে ছুয়ে প্রমিস করলাম।’

‘ঠিক আছে। তুমি খেয়ে নিও। আমি যাচ্ছি। আমাকে আবার এখান থেকে আদালতে যেতে হবে।’

‘আদালতে কেন?’

‘আরে তোমাকে তো বলতেই ভুলে গেছিলাম, আমাকে আগামী কিছুদিন একটি ল ফার্মে একজন লইয়্যারের থেকে বেসিক ট্রেনিং নিতে হবে। তারপরই তো আমি একজন পরিপূর্ণ উকিল হতে পারব। যার মাধ্যমে আমি আমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারব।’

‘আচ্ছা যা। সাবধানে যাস কিন্তু।’

নিপুণ দীপ্রর থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। দূরে দাঁড়িয়ে এই সব দৃশ্য দেখছিল স্নেহা। সে এসব দেখে বলে,
‘তোমাকে আমি কিছুতেই এত সুখী থাকতে দেব না নিপুণ। তোমার মায়ের জন্য আমার মা সুখী হতে পারে নি। এবার তোমার সব সুখ কেড়ে নিয়ে আমি আমার মায়ের সাথে হওয়া সকল অন্যায়ের বদলা নেবোই।’

✨✨✨
দীপ্র মিটিং শেষ করে নিজের কেবিনে এসে বিশ্রাম নেয়। তারপর সে নিজের কোম্পানির নতুন ম্যানেজারকে ডেকে পাঠায়। তার ম্যানেজার এলে সে তাকে জিজ্ঞেস করে,
“আমার নতুন পিএর জন্য যে ইন্টারভিউ ডেকেছিলাম তার ব্যবস্থা করেছ?”

দীপ্রর ম্যানেজার বলে,
“হ্যাঁ, আপনার বাবা তো ইন্টারভিউ নিয়েছেন। আর উনি আপনার জন্য নতুন পিএও সিলেক্ট করে দিয়েছেন।”

“আব্বু ইন্টারভিউ নিয়েছে? আচ্ছা, ঠিক আছে। তুমি আমার নতুন পিএকে কাজগুলো বুঝিয়ে দিও। আর ওকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার কেবিনে আসতে বলো।”

“জ্বি, স্যার।”

দীপ্র নিজের কাজ গুলো মনযোগ দিয়ে করতে লাগল। আগামী কিছুদিন তার অনেক ব্যস্ত সিডিউল। এক সপ্তাহ পর তার এনগেজমেন্ট। তার আগে অনেক কাজ করতে হবে। কোম্পানির অনেক বড় বড় ডিল আছে, অনেক মিটিং আছে। দীপ্র তখন কাজে ব্যস্ত ছিল এমন সময় স্নেহা এসে তার দরজায় নক করে বলে,
‘মে আই কাম ইন স্যার?’

‘ইয়েস কাম।’

‘আমি আপনার নতুন পিএ। আমার নাম স্নেহা চৌ..না মানে স্নেহা ইসলাম।’

‘ম্যানেজারের কাছ থেকে নিজের কাজগুলো বুঝিয়ে নিয়েছ তো?’

‘জ্বি, স্যার।’

‘গুড।’

দীপ্র তখনও স্নেহার দিকে তাকায় নি। নিজের কাজ করতে ব্যস্ত ছিল। হঠাৎ করে স্নেহার দিকে চোখ যেতেই সে অবাক হয়ে যায়। তার মনে পড়ে যায় এই মেয়ের সাথেই তো তখন তার ধাক্কা লেগেছিল।

দীপ্র অবাক স্বরে বলে,
‘তুমি এখানে? তুমি সেই মেয়েটা না যার সাথে সকালে আমার ধাক্কা লেগেছিল?’

‘জ্বি, স্যার। আসলে..’

‘আমি কিছু শুনতে চাইনা। এই জবটা তোমাএ হবে না।’

‘স্যার প্লিজ।’

‘নো মোর ওয়ার্ডস।’

আসলে দীপ্র ভাবে নিপুণ যদি জানতে পারে যে স্নেহাই এই চাকরিটা পেয়েছে তাহলে সে অন্য কিছু ভাবতে পারে। এইজন্যই সে স্নেহাকে চাকরিটা দিতে চাইছিল না। কিন্তু স্নেহাও তো কম যায়না। সে দীপ্রর একেবারে পায়ের কাছে এসে বসে পড়ে। কান্নারত গলায় বলে,
‘স্যার, প্লিজ আমায় একটা সুযোগ দিন।’

দীপ্র বলে,
‘আরে ছাড়ো আমায়। এটা কি করছ তুমি?’

‘স্যার, এই চাকরিটার আমার অনেক দরকার। আমার বাবা অনেক অসুস্থ, আমার ঘরে দুটো ছোট ছোট ভাইবোন আছে। আমি ছাড়া আমার পরিবারকে দেখার মতো কেউ নেই। প্লিজ আমায় জব থেকে ছাড়িয়ে দেবেন না। ‘

স্নেহার জন্য দীপ্রর মায়া লাগতে থাকে। সে ভাবে,
‘মেয়েটা তো নিজের যোগ্যতাতেই চাকরি পেয়েছে। এখন ওকে এভাবে ছাড়িয়ে দিলে সেটা অন্যায় হবে। আর নিপুণ তো আমার অফিসে সেরকম আসেও না। তাই ও কিভাবে জানবে আমার পিএ কে?’

তাই দীপ্র স্নেহাকে বলে,
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। তোমায় আমি ছাড়িয়ে দেব না। তুমি প্লিজ আমার পায়ের কাছ থেকে সরো।’

স্নেহা উঠে দাঁড়ায়। তার মুখে বিজয়ীর হাসি। স্নেহা হাসিটা বজায় রেখেই বলে,
‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ স্যার। আমার এই চাকরিটার অনেক দরকার ছিল।’

আর মনে মনে বলে,
‘আমি তাহলে ঠিকই শুনেছিলাম। এই দীপ্র চৌধুরী তাহলে সত্যিই খুব ভালো মনের মানুষ। তাই তো আমার বানোয়াট কথা শুনে রাজি হয়ে গেলেন। এইভাবে ধীরে ধীরে আমি নিজের সব প্ল্যান এক্সিকিউড করব।’

✨✨
দু-তিনটা দিন এভাবেই অতিবাহিত হতে লাগল। স্নেহার কাজে দীপ্র বেশ খুশি। কারণ সে তার দায়িত্ব খুব ভালো ভাবেই পালন করে। আজ দীপ্র বেশ তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরল কারণ আজ সে নিপুণকে কথা দিয়েছে সে নিপুণকে নিয়ে এনগেজমেন্টের শপিং করতে যাবে। স্নেহা দীপ্রকে বেরিয়ে যেতে দেখে বলে,
‘স্যার, আজ এত তাড়াতাড়ি যাচ্ছেন যে?’

‘আসলে আজ আমার কিছু জরুরি কাজ আছে। তুমি এদিকটা একটু সামলে নিও।’

‘আচ্ছা।’

দীপ্র চলে যাবার পর স্নেহা বাকা হেসে বললো,
‘চৌধুরী পরিবারে আবার উৎসবের আমেজ লেগেছে। কোন ব্যাপার না। গতবারের মতো এবারের উৎসবেও একটা বাওড়া হবে।’

~~~~~~
নিপুণকে নিয়ে শপিং করতে থাকে দীপ্র। নিপুণের সব চাওয়া পাওয়া পূর্ণ করতে থাকে। নিপুণের পছন্দমতো ড্রেস থেকে শুরু করে সবকিছু কিনে দেয়। এমনকি নিজের পাঞ্জাবিও কেনে নিপুণের পছন্দমতো। অতঃপর তারা দুজনে রেস্টুরেন্টে যায় খেতে। সেখানে নিপুণ দীপ্রকে বলে,
‘তুমি আমাকে খুব ভালোবাসো তাই না?’

‘হঠাৎ এই প্রশ্ন করলি যে?’

‘আমি কখনো ভাবতে পারিনি জানো যে তুমি আমায় ভালোবাসো। সবসময় তোমার রাগ, জেদ দেখে আমি ভেবেছিলাম তুমি আমায় পছন্দ করো না। কিন্তু আমার ভাবনা যে একদম ভুল।’

একটু থেমে,
‘আচ্ছা আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা সবসময় এমন থাকবে তো? কখনো এই ভালোবাসায় ভাটা পড়বে না তো?’

‘কখনো না।’

‘আমার না ইদানীং খুব ভয় হয় দীপ্র। এত ভালোবাসা আমার কপালে সইবে তো? আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলব না তো?’

‘তুই এত চিন্তা করিস না নিপুণ। মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই আমাদের আলাদা করতে পারবে না।’

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

তুমি ছিলে বলেই ২ পর্ব-০৭

0

#তুমি_ছিলে_বলেই২
#পর্বঃ৭
#দিশা_মনি

চৌধুরী বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল অনুপম ও প্রেরণার বিয়ে। বিয়ের পর তাদের বিদায় অনুষ্ঠিত হয়। বিদায়ের সময় খোদেজা চৌধুরী অনেক কান্নাকাটি করেন। তবে তিনি অনেক খুশিও হন কারণ তার মেয়ে অনেক সুখী হতে চলেছে।

এদিকে দীপ্র ও নিপুণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। নিপুণ এখনো কিছু বলতে পারছে না। তার মনে দীপ্রর জন্য অনুভূতি ছিল কিন্তু দীপ্রর মনেও যে একই রকম অনুভূতি ছিল সেটা সে কল্পনাও করতে পারে নি। দীপ্র নিপুণের কিছুটা কাছে এসে বলে,
“এভাবে কি দেখছিস আমার দিকে? আমার দিকে একদম তাকাবি না।”

“এত নিষ্ঠুর কেন তুমি দীপ্র ভাইয়া?”

“নিষ্ঠুর আমি নই নিষ্ঠুর তুই। খুব তো ডেং ডেং করে বিয়ের আসরে বসে পড়েছিলি। তোর বিয়েটা হয়ে গেলে আমার কি হতো ভাবতে পারছিস?”

নিপুণ নিজের পক্ষে বলে,
“আমি কি করতাম দীপ্র ভাইয়া? বড় আব্বু এমন ভাবে বলল যে…”

“তুই আর কিছু বলিস না। এসব কিছুর শোধ আমি সুদে আসলে তুলব।”

নিপুণ চুপ হয়ে যায়। তার এবার খুব খারাপ লাগতে শুরু করে। এদিকে প্রেরণাকে বিদায় দিয়ে আলতাফ চৌধুরী এগিয়ে আসেন তাদের দিকে। এসেই তিনি দীপ্রকে উদ্দ্যেশ্য করে বলেন,
“তুই তো আজ আমায় চমকে দিলি দীপ্র।”

“আসলে আব্বু..”

“তুই চুপ কর। আমি নিপুণ মায়ের সাথে কথা বলতে চাই। নিপুণ মা, তোমার কি দীপ্রকে পছন্দ? দীপ্রকে নিজের স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারবে?”

নিপুণ থতমত খেয়ে যায়। কিভাবে কি বলবে বুঝতে পারছিল না।

“কি হলো মা বলো?”

নিপুণ মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায়। দীপ্রর মুখেও হাসি ফুটে ওঠে। আলতাফ চৌধুরী মৃদু হেসে বলেন,
“বাহ, বেশ ভালো তো। মিয়া, বিবি রাজি তো কেয়া কারে গি কাজি? আমি খুব শীঘ্রই তোমাদের চার হাত এক করার ব্যবস্থা করছি।”

আলতাফ চৌধুরীর এই কথা তাদেরকে অনেক খুশি করে দেয়। আলতাফ চৌধুরী দীপ্র ও নিপুণ দুজনকেই নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে রাহেলা চৌধুরীকে বলে,
“ওদেরকে এক সাথে সুন্দর লাগছে না?”

রাহেলা চৌধুরী সম্মতি দেন। আলতাফ চৌধুরী বলেন,
“আমার ছেলেকে নিজের মেয়ের স্বামী হিসেবে মানতে তোমার কি কোন অসুবিধা আছে?”

“না, অসুবিধা থাকবে কেন? দীপ্রকে মেয়ের জামাই হিসেবে পাওয়া তো আমার সৌভাগ্য।”

“বেশ, তাহলে তো সব সমস্যা মিটেই গেল। আজ আমি এখানে ঘোষণা করছি আর এক সপ্তাহ পরেই ওদের এনগেজমেন্ট হবে।”

✨✨
সালমা বেগম হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন দিশার দিকে। এদিকে রাজ্জাক মন্ডল রেগে গিয়ে সোহাগকে বলেন,
“এটা কি করলে তুমি? আমি তোমার মায়ের সাথে এত বছর সংসার করেছি অথচ কোনদিন তার গায়ে ফুলের টোকা পর্যন্ত দেই নি। আর তুমি বিয়ে হতে না হতেই নিজের মা-বাবার সামনে নিজের স্ত্রীর গায়ে হাত তুললে।”

দিশা বলে ওঠে,
“আপনাদের এত ভালোমানুষি দেখাতে হবে না। এসব আমার ডায়জাস্ট হচ্ছে না। আমি সব বুঝতে পারছি। আপনারাই সবাই মিলে আপনাদের ছেলেকে আমার পেছনে লেলিয়ে দিয়েছেন। বড়লোকের মেয়ে বলে কথা। কি ভেবেছিলেন আমাকে দিয়ে আমার বাবার সম্পত্তির ভাগ পাবেন? তাহলে শুনে রাখুন সেটা হচ্ছে না। আমার বাবা আমাকে ত্যাজ্য করেছে। তার কোন কিছুর সিকি ভাগ আমি পাবো না। তাই আপনাদের সব ষড়যন্ত্র বিফলে গেল।”

সোহাগ বলে,
“তুমি ভুল ভাবছ দিশা। আমি বা আমার মা-বাবা কেউ লোভী নই। আর তোমার বাবার সম্পত্তিরও আমাদের কোন প্রয়োজন নেই। আমাদের যা আছে আমরা তাই নিয়ে খুশি।”

“নাটক।”

“তুমি যাই বলো আর তাই বলো এখন তোমায় আমাদের সাথেই থাকতে হবে। তাই নিজের ভালো চাইলে আমার মা-বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে আমাদের বাড়িতে চলো।”

“সরি মাই ফুট।”

বলেই দিশা সোহাগের বাড়িতে ঢুকে যায়। তারপর সালমা বেগমকে বলে,
“আমাকে এই বাড়ির সবথেকে সুন্দর রুমটা দেখিয়ে দিন তো। আর আমার জন্য রাতে ভালো কোন খাবারের ব্যবস্থা করুন। এখানে এমনিতেও আমি বেশিদিন থাকব না। এখন ঠ্যাকায় পড়ে আছি। আপনার ছেলেকে জেলের ভাত খাইয়ে তারপর আমি এখান থেকে বিদায় নেবো।”

দিশার কথায় সালমা বেগম ও রাজ্জাক মন্ডল দুজনেই ভয় পেয়ে যায়। এদিকে সোহাগ বাকা হেসে বলে,
“তুমি কিছুই জানো না দিশা। ঐ স্নেহা নামের মেয়েটা যে তোমার পরিবার আর তোমার কি হাল করবে সেটা সময় এলেই বুঝবে।”

✨✨
দীপ্র আজ সকাল সকাল অফিসে যাওয়ার জন্য বেড়িয়েছে। আজ অফিসে অনেক জরুরি একটা মিটিং আছে। আলতাফ চৌধুরীও তাকে তাড়া দিচ্ছে। ব্রেকফাস্ট করার জন্য ডাইনিং টেবিলে বসার পর সে তার মাকে দেখতে না পেয়ে রাহেলা চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করে,
“মা কোথায় চাচি?”

রাহেলা চৌধুরী কিছু বলার আগেই খোদেজা চৌধুরী পান চিবোতে চিবোতে বলেন,
“তোর মা যে সেই কাল ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করেছে তারপর আর খোলে নি।”

“এ কথা আমায় আগে বলো নি কেন?”

দীপ্র দ্রুত উঠে যায় তার মায়ের রুমের সামনে। সে অনেক ডাকে কিন্তু দিলারা চৌধুরী তার ডাকে কোন সাড়া দেয় না। অনেকক্ষণ পর বলেন,
“তুই যা দীপ্র। আমার কিছু ভালো লাগছে না। আমায় একা থাকতে দে। প্লিজ যা এখান থেকে।”

দীপ্রর মিটিং এ দেরি হচ্ছিল। তাই সেও আর কথা না বাড়িয়ে চলে যায়। যাওয়ার পথে রাহেলা চৌধুরী তাকে আটকে বলে,
“এভাবে না খেয়ে কোথায় যাচ্ছিস? কিছু খেয়ে যা।”

“আমার খিদে নেই।”

বলেই দীপ্র চলে যায়। দীপ্র যাওয়ার পর রাহেলা চৌধুরী রেগে গিয়ে খোদেজা চৌধুরীকে বলেন,
“কি দরকার ছিল দীপ্রকে এসব বলার? ছেলেটা এখন না খেয়েই অফিসে চলে গেল।”

“কেন বলবো না? তোমার শুধু দীপ্রকে নিয়েই যত চিন্তা। আর বড় ভাবি যে না খেয়ে আছে সে ব্যাপারে তো একটি বারও ভাবছ না।”

“ভাবিকে আমি ঠিকই বুঝিয়ে খাওয়াতাম। ছেলেটা অফিসে গেল। ও যা কাজপাগল মনে হয়না আর সারাদিন কিছু খাবে।”

এরমধ্যে নিপুণ সেখানে এসে বলে,
“কি হয়েছে আম্মু?”

“দেখ না, দীপ্র কিছু না খেয়েই অফিসে চলে গেল।”

“ও এই ব্যাপার। আচ্ছা, তুমি একটা কাজ করো খাবারগুলো টিফিন বক্সে করে আমাকে দাও। আমি গিয়ে দীপ্র ভাইয়ার অফিসে খাবার গুলো দিয়ে আসব।”

“আচ্ছা তুই দাড়া আমি দিচ্ছি।'”

খোদেজা চৌধুরী বিড়বিড় করে বলেন,
“এদের মা-মেয়ের ঢং দেখে আর বাঁচি না।”

✨✨✨
স্নেহা আজ চৌধুরী এন্টারপ্রাইজে এসেছে দীপ্রর পিএর জব পাওয়ার জন্য ইন্টারভিউ দিতে। সে চুপচাপ বসে আছে অন্যান্য আরো অনেক ব্যক্তির সাথে। আশপাশটা ভালো ভাবে নজর বুলিয়ে দেখছে সে।

“এই তাহলে সেই চৌধুরী এন্টারপ্রাইজ। যাকে নিয়ে চৌধুরীদের এত স্বপ্ন, এত অহংকার।”

এরমধ্যে একজন এসে বলে,
“ইন্টারভিউ একটু দেরিতে শুরু হবে। আজ স্যারের একটা ইম্পোট্যান্ট মিটিং আছে।”

সবাই হতাশ হয়ে যায়। স্নেহার আর বসে থাকতে ভালো লাগছিল না। তাই সে চারপাশটা ঘুরে দেখার জন্য উঠে দাঁড়ায়। কিছুটা সামনের দিকে যেতে থাকে। এমন সময় দীপ্রও তাড়াহুড়ো করে অফিসে ঢুকছিল। হঠাৎ করেই দীপ্রর সাথে স্নেহার ধাক্কা লেগে যায় এবং স্নেহা তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যাচ্ছিল এমন সময় দীপ্র স্নেহাকে ধরে ফেলে। স্নেহা দীপ্রর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। দীপ্রও অদ্ভুতভাবে দেখতে থাকে পুরুষের বেশভূষায় থাকা এই মেয়েটিকে। তার চেহারার সাথে কারো যেন প্রচণ্ড মিল খুঁজে পাচ্ছিল। এমন সময় নিপুণও দীপ্রর জন্য খাবার নিয়ে ছুটে আসে। সে তো প্রথম দেখায় ভেবেছিল দীপ্র কোন ছেলেকে ধরে আছে কিন্তু একটু এগিয়ে গিয়ে যখন বুঝতে পারে এটা কোন ছেলে নয় মে তখন তার চোয়াল শক্ত হয়। রেগে গিয়ে সে টিফিনের বাক্সটা আছাড় দেয়। দীপ্র সজাগ হয়ে স্নেহাকে সোজা করে দাড় করিয়ে নিপুণের দিকে তাকায়। নিপুণ তাদের দিকে রাগী চোখে তাকায়। তার চোখ থেকে যেন অশ্রুরা গড়িয়ে পড়ার জন্য অপেক্ষা করছিল।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

তুমি ছিলে বলেই ২ পর্ব-০৬

0

#তুমি_ছিলে_বলেই২
#পর্বঃ৬
#দিশা_মনি

নিপুণ বিয়ের আসরে বসে পড়েছে৷ তার চোখে মুখে হাসির লেশমাত্র নেই। দুচোখে জমে আছে জলের ফোয়ারা৷ তারা অপেক্ষা করছে নদীর স্রোতের মতো বয়ে আসার জন্য। কিন্তু নিপুণ অনেক কষ্টে সেটাকে আটকে রেখেছে। অনুপম নিপুণকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে মনে মনে বলছে,
“ঐ দিশার থেকে এই নিপুণ বেশি সুন্দরী। সেদিক দিয়ে বলতে হয় ঐ মেয়েটা পালিয়ে গিয়ে ভালোই করেছে। এইজন্যই আমার আম্মু বলত, যা হয় ভালোর জন্যই হয়।”

আলতাফ চৌধুরী, রাহেলা চৌধুরী সবাই দাঁড়িয়ে আছেন পাশেই। আলতাফ চৌধুরী এবার অনেকটা স্বস্তি পান। তার মেয়ে তার মুখে চুনকালি মাখালেও তার ভাইয়ের মেয়ে এই যাত্রায় তাকে উদ্ধার করলো। অপরদিকে রাহেলা চৌধুরী শুধু নিজের মেয়ের জন্য প্রার্থনা করে চলেছেন। অন্যদিকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছেন খোদেজা চৌধুরী। এই বিয়েতে তিনি একটুও খু্শি নন। তার মেয়ে প্রেরণা রাজরানী করার স্বপ্ন তার স্বপ্নই রয়ে গেলো।

কাজি বিয়ে পড়ানো শুরু করে দিয়েছেন। এক সময় তিনি নিপুণের উদ্দ্যেশ্যে বলেন,
“বলো মা কবুল।”

নিপুণ দীর্ঘক্ষণ চুপ করে থাকে। অনুপম এতে বিরক্ত হয়। নিপুণের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“এই মেয়ে তুমি চুপ করে আছ কেন? কবুল বলো।”

নিপুণ দুচোখ বন্ধ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেয়। শেষবারের মতো দীপ্রর মুখটা মনে করে। তার দুচোখ বেয়ে নোনাজলের স্রোত নামে। আর হয়তো তার দীপ্রকে নিজের করে পাওয়া হবে না। ভালোবাসার মানুষটাকে হয়তো চিরকালের মতো হারিয়ে ফেলতে হবে।

সবার জোরাজুরিতে সে কবুল বলতেই যাবে এমন সময় হঠাৎ চেনা পরিচিত কন্ঠ তার কানে এসে বাজে। দীপ্র এসে বলতে থাকে,
“নিপুণ কবুল বলবে না, এই বিয়েটাও হবে না। এই নিপুণ তুই উঠে আয় বলছি।”

নিপুণ দুচোখ মেলে দীপ্রকেই দেখতে থাকে। তার মুখে এতক্ষণে হাসি ফুটে ওঠে। সে উঠে দাঁড়ায়। দৌড়ে চলে আসে দীপ্রর কাছে। অনুপমও সাথে সাথে উঠে বসে। রাগী গলায় বলে,
“এসব হচ্ছে টা কি? একবার নয় দু, দু বার আমার সাথে অন্যায় করা হচ্ছে। মিস্টার চৌধুরী আপনি কিছু বলুন।”

আলতাফ চৌধুরী বলেন,
“দীপ্র তুই কেন এই বিয়েতে বাধা দিচ্ছিস? এই বিয়েটার সাথে আমাদের কোম্পানির ভবিষ্যৎ জড়িয়ে আছে।”

দীপ্র কোন রাখঢাক না রেখেই বলে দেয়,
“দুঃখিত আব্বু। এই বিয়ে হতে পারে না। কারণ আমি নিপুণকে ভালোবাসি। তাই আমি বেঁচে থাকতে ওকে অন্য কারো হতে দিতে পারব না।”

দীপ্রর এই কথা যেন চৌধুরী ভিলার ভিত নড়িয়ে দেয়। আলতাফ চৌধুরী, রাহেলা চৌধুরী এমনকি নিপুণও হতবাক হয়ে যায় দীপ্রর কথা শুনে। উপস্থিত মেহমানরাও স্তম্ভিত। সবাই কানাঘুষা শুরু করে দেয় চৌধুরী বাড়িতে ঘটে যাওয়া একের পর এক ঘটনা নিয়ে। আলতাফ চৌধুরী দীপ্রকে উদ্দ্যেশ্য করে বলেন,
“এসব কি পাগলের মতো কথা বলছ তুমি দীপ্র? নিপুণ তোমার চাচাতো বোন হয়। ওকে তুমি সবসময় বোনের নজরেই তো দেখেছ তাহলে এখন হঠাৎ….”

“তুমি ভুল ভাবছ আব্বু। আমি কখনো নিপুণকে বোনের নজরে দেখিনি। আমি ছোটবেলা থেকেই ওকে পছন্দ করি।”

আলতাফ চৌধুরী আর কিছু বলার মতো খুঁজে পান না। এদিকে অনুপম রেগে গিয়ে একটা ফুলদানি ছু*ড়ে মে*রে বলে,
“এখানে এসব কি নাটক হচ্ছে? আমাকে বিয়ের জন্য ডেকে এনে বারবার এভাবে অপমান করা হচ্ছে। এর চড়া মাশুল কিন্তু আপনাদের সবাইকে গুনতে হবে।”

খোদেজা চৌধুরী যেন আরেকটা সুযোগ হাতের কাছে পেয়ে যায়। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে এগিয়ে এসে তিনি আলতাফ চৌধুরীকে বলেন,
“প্রেরণা কিন্তু এখনো রাজি আছে ভাইজান। তুমি যদি অনুমতি দাও তাহলে…”

আলতাফ চৌধুরী অনুপমের কাছে গিয়ে বলে,
“আমাদের বাড়ির আরো একজন মেয়ে আছে প্রেরণা। আমার বোনের মেয়ে। তুমি চাইলে ওকে বিয়ে করতে পারো।”

অনুপম রেগে গিয়ে বলে,
“আমাকে আপনার কি মনে হয়? আমি বানের জলে ভেসে এসেছি? যখন পারছেন যার সঙ্গে পারছেন আমাকে বিয়ে দিতে চাইছেন? প্রথমে আপনার মেয়ে, তারপর আপনার ভাইয়ের মেয়ে আর এখন আপনার বোনের মেয়ে! সিরিয়াসলি!”

এমন সময় অনুপমের বাবা এগিয়ে আসে। আলতাফ চৌধুরীর উদ্দ্যেশ্যে বলেন,
“আমার কোন আপত্তি নেই। আমি আপনার বোনের মেয়েকেই নিজের বৌমা করব।”

অনুপম রেগে গিয়ে তার বাবাকে বলে,
“এসব তুমি কি বলছ?”

অনুপমের বাবা তাকে একটু সাইডে টেনে নিয়ে গিয়ে বলেন,
“তুই বেশি কথা বলিস না অনুপম। তুই নিজেও খুব ভালো করে জানিস যে, এই ডিলটা চৌধুরীদের জন্য যতটা গুরুত্বপূর্ণ আমাদের জন্যেও ঠিক ততটা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চৌধুরীদের কোম্পানিতে ইনভেস্ট করলে আখেরে লাভটা আমাদেরই হবে। আর তুই এত ভাবছিস কেন? প্রেরণা মেয়েটাও তো খারাপ না। আমি দেখেছি ওকে বেশ সুন্দরী আর সহজ সরল মেয়ে। আমাদের জন্য এরকম মেয়েই তো দরকার।”

নিজের বাবার মুখে এমন কথা শুনে অনুপম আর কথা বাড়ায় না। সে আলতাফ চৌধুরীর সামনে গিয়ে বলে,
“আমি আপনার প্রস্তাব মেনে নিলাম। প্রেরণাকেই আমি বিয়ে করবো।”

খোদেজা চৌধুরীর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। অবশেষে তার স্বপ্নই সত্যি হলো। তার মেয়ে এখন রাজরাণী হবে।

✨✨
দিশাকে নিয়ে নিজের বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়েছে সোহাগ। কলিং বেল বাজানোর কিছুক্ষণ পর সোহাগের মা এসে দরজা খুলে দেয়। সোহাগের পাশে একটা মেয়েকে কনের সাজে দেখে তিনি অবাক হয়ে বললেন,
“এই মেয়েটা কে সোহাগ?”

“ও আমার স্ত্রী। তোমার বৌমা।”

সোহাগের মা হতবাক হয়ে গেলেন। তার ছেলে যে হঠাৎ এভাবে বিয়ে করে নতুন বৌ নিয়ে বাড়িতে ফিরবে সেটা তার ধারণার বাইরে ছিল। সোহাগ তার মায়ের উদ্দ্যেশ্যে বলল,
“কি হলো চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলে কেন? যাও বরণডালা নিয়ে এসো। আমাদের বরণ করে ঘরে তুলবে না?”

সোহাগের মা সালমা বেগম তার বাবাকে ডাক দিলেন। সোহাগের বাবা রাজ্জাক মন্ডল এসে উপস্থিত হলেন। এসে বললেন,
“কি হলো সোহাগের মা? আমায় ডাকছিলে?”

“তোমার ছেলের কাণ্ড দেখে যাও! একটা মেয়েকে বিয়ে করে এনেছে।”

রাজ্জাক মন্ডল দিশাকে ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করে তাকে জিজ্ঞেস করেন,
“তোমার নাম কি মা?”

দিশা রুডলি উত্তর দেয়,
“দিশা চৌধুরী।”

রাজ্জাক মন্ডল নিজের স্ত্রীকে বলেন,
“যাও। গিয়ে বরণ ডালা নিয়ে এসো। বিয়ে যখন হয়েই গেছে এখন তো আর কিছু বলে লাভ নেই। আগে ওরা ঘরে আসুক তারপর ঠান্ডা মাথায় কথা বলা যাবে।”

সালমা বেগম বরণ ডালা এনে হাজির হোন। দিশাকে বরণ করতে যাবেন ঠিক তখনই দিশা বরণ ডাকা ছুড়ে ফেলে বলে,
“বরণ ডালা মাই ফুট। আমি মানি না এই বিয়ে। আপনাদের ছেলে আমার সাথে প্রতারণা করেছে। আপনাদের ফুল ফ্যামিলি প্রতারক। আপনাদের সবাইকে আমি জেলের ভাত খাওয়াবো।”

সোহাগ রেগে চিৎকার করে বলে,
“দিশা…”
তারপর দিশাকে ঠাস.. করে একটা চ*ড় বসিয়ে দেয়। দিশা নিজের গালে হাত দিয়ে রাগী চোখে সোহাগের দিকে তাকায়।

✨✨
টংয়ের দোকানের সামনে বসে পা দোলাচ্ছিল স্নেহা। একটা সিগারেট নিয়ে সেটা জ্বালিয়ে খাওয়া শুরু করেছে সবেমাত্র। আশেপাশে দু একজন তার দিকে অদ্ভুত নজর দেখছে। একেই তো পুরুষের মতো বেশভূষা তার উপর আবার সিগারেট খায়! ক’জন স্নেহাকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করল। এসবে অবশ্য স্নেহার কিছু যায় আসে না। সে কল লাগালো কাউকে। ফোনটা রিসিভ হতেই বললো,
“কোন ব্যবস্থা হলো?”

বিপরীত দিক থেকে উত্তর এলো,
“চৌধুরী এন্টারপ্রাইজে দীপ্র চৌধুরীর জন্য একজন নতুন পিএ দরকার। ওনার আগের পিএ জব থেকে রিজাইন করেছে।”

স্নেহা নিকোটিনের ধোঁলয়া উড়িয়ে জোরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,
“মেক শিওর, এই জবটা যেন আমি পাই।”

তারপর কল কেটে আধপোড়া সি*গারেট টা ফেলে দিয়ে পায়ের তলায় পিষে বলে,
“আই উইল সি ইউ সুন মিস্টার দীপ্র চৌধুরী।”

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

তুমি ছিলে বলেই ২ পর্ব-০৫

0

#তুমি_ছিলে_বলেই২
#পর্বঃ৫
#দিশা_মনি

দিশা অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার পরিবারের দিকে। তারা আজ এভাবে তাকে ত্যাজ্য করে দিতে পারল?! রাগী চোখে সে তাকালো সোহাগের দিকে। সোহাগ ইশারায় দিশাকে নিজের সাথে আসতে বললো৷ দিশা তবু ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। আলতাফ চৌধুরী দিশার উদ্দ্যেশ্যে বলল,
“এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন তুমি? কি বললাম সেটা শুনতে পাও নি? বেড়িয়ে যাও এখান থেকে। আমার মান সম্মান সব তুমি ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছ। তোমার এখানে থাকার কোন অধিকার নেই।”

দিশা চুপ রইল। তাকালো নিজের মা এবং ভাইয়ের দিকে। যাতে তারা তার সমর্থনে কিছু বলে। কিন্তু কেউ কিছু বলল না। দিশা বুঝল চৌধুরী পরিবারের কাছে এখনো তাদের সম্মানটাই সবথেকে বড়। আর এখানে আলতাফ চৌধুরীর মুখের উপর কেউ কিছু বলবেও না।

দিশার ফুফু খোদেজা চৌধুরী দিশার উদ্দ্যেশ্যে বলল,
“এখানে সংয়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে তোর লজ্জা করছে না? একেই তো আমাদের পরিবারের সম্মান মাটিতে মিলিয়ে দিয়েছিস। এখন আবার এসেছিস কেন? আমাদের সবার কাছে এখন তুই মৃত। যা দূর হয়ে যা।”

এটুকু বলেই খোদেজা চৌধুরী এগিয়ে এসে দিশাকে ঠেলে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে তার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলেন। দিশা অসহায় চোখে তাকিয়ে রইল। সোহাগ দিশার উদ্দ্যেশ্যে বলল,
“এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে আমার সাথে আমার বাড়িতে চলো। এই রাজপ্রাসাদে তোমার আর ঠাঁই হবে না।”

দিশা চিৎকার করে বলতে লাগল,
“আজ শুধুমাত্র তোমার জন্য আমার এই অবস্থা। তোমায় আমি কোনমতেই ছাড়ব না।”

“কি করবে?”

দিশা শুধু রাগী চোখে তাকালো। তার বাবা-মা তাকে ত্যাগ করেছে। এখন আর তার যাওয়ার কোন যায়গা নেই। এখন তাকে বাধ্য হয়েই সোহাগের সাথে যেতে হবে। তবে সোহাগের জীবন ধ্বংস করার পণ করে নিলো সে।

✨✨✨
চৌধুরী ভিলায় পিনপিতন নীরবতা। আলতাফ চৌধুরী অনুপমের পরিবারের সামনে কিভাবে মুখ দেখাবেন সেটাই ভাবছেন। আজীবন তিনি মাথা উচু করে বেঁচেছেন। কিন্তু আজ তার নিজের মেয়ের জন্য তার মাথা সবার সামনে নিচু হয়ে গেছে। অন্যদিকে দিলারা চৌধুরী সমানে কেঁদে চলেছেন। নিজের স্বামীর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে তিনি কিছু করতে পারেন নি কিন্তু নিজের মেয়েকে দেওয়া এত বড় শাস্তিও তিনি মানতে পারছেন না। রাহেলা চৌধুরী তাকে সামলানোর অনেক চেষ্টা করে চলেছেন।

আলতাফ চৌধুরী মুখোমুখি হলো অনুপমের। অতঃপর শান্তস্বরে বললেন,
“দিশা অন্য কাউকে বিয়ে করে নিয়েছে। তাই এই বিয়েটা হওয়া সম্ভব নয়।”

অনুপম রেগে বললো,
“বিয়ে হবে না বললেই হলো? আপনি ভুলে যাবেন না মিস্টার চৌধুরী এই বিয়েটা কোন সাধারণ বিয়ে নয় এই বিয়ের উপর আমাদের কোম্পানির সাথে আপনার কোম্পানির আগামী দিনের সম্পর্ক নির্ভর করছে। এই বিয়েটা না হলে আমাদের কোম্পানি আপনাদের কোম্পানিতে কোন ইনভেস্ট করবে না।”

আলতাফ চৌধুরী চিন্তায় পড়ে যান। খান এন্টারপ্রাইজের সাথে চুক্তি না হলে যে তার কোম্পানির অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। এমনিতেই শেয়ার বাজারে দরপতন চলছে তার উপর এখন এই চুক্তিটাও যদি না হয় তাহলে অনেক লস হবে। তাই আলতাফ চৌধুরী কোন উপায় খুঁজে পেলেন না। এমন সময় তার বোন খোদেজা চৌধুরী এগিয়ে এসে বললো,
“আমার কাছে একটা উপায় আছে ভাইজান। যাতে সব দিক উদ্ধার হবে।”

আলতাফ চৌধুরী তার বোনের কাছে জানতে চান,
“কি সেই উপায়?”

খোদেজা চৌধুরী বলেন,
“বিয়ে তো দুই পরিবারের মধ্যেই হয়। এখন তোমার মেয়ে দিশার সাথে তো বিয়েটা হলো না। কিন্তু এই বাড়িতে তো আর মেয়ের অভাব নেই। এই যেমন নিপুণ আছে আমার মেয়ে প্রেরণা আছে। তুমি একটু ভেবে দেখ যদি এদের মধ্যে কাউকে…আমার প্রেরণার কিন্তু এই বিয়ে করতে আপত্তি নেই। ছোটবেলা থেকে তো ও মামাবাড়িতেই মানুষ হয়েছে। মামাবাড়ির প্রতি একটা দায়িত্ব কর্তব্য তো আছেই।”

অনুপম সব কথা শুনলো। সে বারকয়েক নিপুণকে দেখেছে। নিপুণকে তার বড্ড ভালো লেগে গেছে। তাই সে বলে,
“আমি আপনার ভাইঝি নিপুণকে বিয়ে করতে চাই।”

অনুপমের কথা শুনে খোদেজা চৌধুরীর মাথায় হাত। কারণ তিনি তো নিজের মেয়ে প্রেরণার সাথে অনুপমের বিয়ের কথা ভেবেছিলেন। যাতে তার মেয়ে রাজরাণী হয়৷ কিন্তু তার সব চাল ভেস্তে গেল। আলতাফ চৌধুরী চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন,
“আমাকে একটু ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”

✨✨✨
আলতাফ চৌধুরী এসে দাঁড়িয়েছেন নিপুণের সামনে। নিপুণ আলতাফ চৌধুরীকে দেখে বলল,
“তুমি কি আমায় কিছু বলবে বড় আব্বু?”

“তোর কাছে একটা অন্যায় আবদার করব মা?”

“এভাবে কেন বলছ বড় আব্বু? তুমি আমাকে আদেশ করো।”

“তুই তো জানিস, এই বিয়েটা আমার এবং আমার কোম্পানির জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু দিশা যে এমন একটা কাজ করবে সেটা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। আমার সম্মান, আমার পুরো পরিবারের সম্মান একেবারে ধুলোয় মিশে গেল। কিন্তু এখন আমাদের কোম্পানির ভবিষ্যতও ঝুলে আছে তোর একটা সিদ্ধান্তর উপর।”

নিপুণ অবাক হয়ে জানতে চায়,
“আমার কোন সিদ্ধান্তর উপর তোমার কোম্পানির ভবিষ্যৎ দাঁড়িয়ে আছে?”

“অনুপম তোকে বিয়ে করতে চায় নিপুণ। তুই যদি এই বিয়েটা করতে রাজি হোস তাহলে আমাদের কোম্পানি বেঁচে যাবে।”

নিপুণ বিস্ফোরিত চোখে তাকায় আলতাফ চৌধুরীর দিকে। এ কেমন কথা শোনালেন তিনি? নিপুণ যে দীপ্রকে ভালোবাসে। তার পক্ষে কি করে সম্ভব অন্য কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেওয়া। কিন্তু তার বড় আব্বুর এই অসহায় অবস্থা, আকুতিও যে তাকে ভাবাচ্ছে। নিপুণ যেন উভয় সংকটে পড়েছে। আলতাফ চৌধুরী বলেন,
“কিরে নিপুণ? কিছু বলছিস না কেন? তোর সিদ্ধান্তের উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে মা। দয়া করে একটু ভেবে সিদ্ধান্ত নিস।”

“আমাকে একটু ভাবতে দাও বড় আব্বু।”

আলতাফ চৌধুরী নিপুণের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
“আমার ভরসা আছে তোর উপর। আমি জানি তুই সবদিক ভেবেই সিদ্ধান্ত নিবি।”

এটুকু বলেই তিনি প্রস্থান করেন। আলতাফ চৌধুরী চলে যাওয়ার পর নিপুণ মেঝেতে বসে পড়ে। একটু পড়েই ডুকরে কেঁদে ওঠে মেয়েটা। ভাগ্য আজ তাকে এ কোন অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি ফেলল?

✨✨
চৌধুরী ভিলার অদূরে একটা ক্যাফেতে বসে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে স্নেহা। সাথে আনন্দে গুণগুণ করছে। তার প্রতিশোধের খেলা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। আর শুরুতেই সে বাজিমাত করেছে। স্নেহা বলতে থাকে,
“প্রথম ঝটকাটা কেমন লাগল চৌধুরী পরিবারের? এটা তো শুধু ট্রেলার ছিল। আসল মুভি তো এখনো বাকি। তোমাদের চোখের জল পড়া তো সবে শুরু হলো। আমি প্রমিস করছি, তোমাদের সবার এমন হাল করব যে তোমাদের চোখের জলের সমুদ্র তৈরি হয়ে যাবে।”

“হা হা হা হা।”

উন্মাদের মতো হাসতে লাগল সে।

✨✨✨
আলতাফ চৌধুরী অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন। অনেকক্ষণ হলো তিনি নিপুণের সাথে কথা বলে এসেছেন। কিন্তু এখনো নিপুণের কোন পাত্তা নেই। তিনি উদগ্রীব হয়ে উঠেছেন। রাহেলা বেগম তার পাশেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। নিজের স্বামীকে কখনো সেভাবে পাশে পান নি তিনি। তার এবং নিপুণের যাবতীয় দায়িত্ব সবসময় আলতাফ চৌধুরীই পালন করে এসেছেন। তাই তিনি এই মানুষটাকে বড্ড শ্রদ্ধা করেন। ওনার বিপক্ষে যাওয়ার সামর্থ্যও তার নেই। তাই আলতাফ চৌধুরী যখন জানালেন পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে এবং কোম্পানিকে বাঁচাতে তার মেয়েকে অনুপমকে বিয়ে করতে হবে তখন তিনি বিনাবাক্যে মেনে নিয়েছেন। তার অমতের তেমন কারণ নেই। অনুপম তো পাত্র হিসেবে খারাপ হয়। অন্যদিকে খোদেজা চৌধুরী মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছেন। দিলারা চৌধুরী সেই যে দিশা চলে যাওয়ার পর নিজেকে ঘরবন্দি করেছেন তারপর থেকে আর ঘর থেকে বের হন নি। আর দীপ্রর তো কোন খোঁজ খবরই নেই।

এরইমধ্যে নিপুণ এসে হাজির হলো সেখানে। পরণে তার বিয়ের জামদানী শাড়ি। একদম কনে সেজেই এখানে উপস্থিত হয়েছে সে। নিপুণ এগিয়ে এলো। মলিন কন্ঠে বলল,
“আমি প্রস্তুত বিয়ের জন্য!”

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

তুমি ছিলে বলেই ২ পর্ব-০৪

0

#তুমি_ছিলে_বলেই২
#পর্বঃ৪(মহাধামাকা পর্ব)
#দিশা_মনি

দিশার বিয়ে উপলক্ষে চারিদিকে সাজ সাজ রব। দিশারও অনেক ভালো লাগছে আজ। অবশেষে তার এতদিনের স্বপ্ন পূরণ হবে। সে তো সবসময় চেয়েছিল কোন বড়লোক পরিবারে রাজকীয় ভাবে তার বিয়ে হোক। অবশেষে তাই হচ্ছে। দিশার খুশি আর ধরে না।

দিশার মনে এখন লাড্ডু ফুটছে। সে অনেক বেশি আগ্রহের সাথে অপেক্ষা করে চলেছে সেই মাহেন্দ্রক্ষণের। কিন্তু ভাগ্যে যে অন্য কিছু ছিল সেটা সে ঘুণাক্ষরেও টের পায় নি। যদি টের পেত তাহলে বোধহয় এত খুশি হতে পারত না। বরং নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে আফসোস করত!

✨✨✨
স্নেহা ও সোহাগ পৌঁছে গেছে রাজশাহীতে। বর্তমানে তারা খান ভিলার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। স্নেহা সোহাগকে তার পরিকল্পনা বুঝিয়ে দিচ্ছে। সব শুনে সোহাগ একটা ঢোক গিলে বলে,
“এটা একটু বেশি রিস্কি হয়ে যাচ্ছে না? বাইরে এত এত সিকিউরিটি গার্ড। তাদের চোখ ফাকি দিয়ে কিভাবে..”

“আপনাকে এত চিন্তা করতে হবে না। আপনি আমার কথামতো কাজ করে যান শুধু। আমার সবকিছু ম্যানেজ করা আছে।”

বলেই সে কাউকে একটা ম্যাসেজ করে। এই চৌধুরী ভিলাতেই যে লুকিয়ে আছে এক ঘর শত্রু বিভীষণ। তার সাহায্যেই তো সে সব কাজ উদ্ধার করবে। স্নেহা সেই ঘর শত্রু বিভীষণকে ম্যাসেজ দিয়ে বলে,
“সব কিছু প্ল্যান মাফিক রেডি তো?”

“হুম।”

“বেশ, আমরা তাহলে খান ভিলায় প্রবেশ করছি।”

স্নেহা ও সোহাগ দুজনেই ছন্দবেশে আছে। তারা মূলত পার্লারের লোক সেজে এখানে এসেছে। দুজনে ভেতর ঢোকার সময় সিকিউরিটি গার্ডের বাধার সম্মুখীন হয়। কিন্তু স্নেহা তো আটঘাট বেধেই মাঠে নেমেছিল। তাই তো সে নকল কার্ড বের করে দেখায়। যেটা দেখে সিকিউরিটি গার্ডরা তাদের ভেতরে ঢুকতে দেয়। খান ভিলায় প্রবেশ করেই রহস্যজনক হাসি দেয় স্নেহা। মনে মনে বলে,
“অবশেষে আমার ২৩ বছরের জীবনে প্রথমবারের মতো খান ভিলায় আমার পা পড়েই গেলো। একবার যখন আমি এখানে এসেছি তখন আমি একা আসিনি। এসেছি ধ্বংস নিয়ে । এই খান ভিলার সকল সুখ আমি ধ্বংস করে দেব।”

স্নেহা ও সোহাগ দুজনেই চলে যায় দিশার কক্ষে। সোহাগ মাস্ক পড়ে থাকায় দিশা তাকে চিনতে পারে না। দিশা তাদের মেকআপ আর্টিস্টই মনে করে। স্নেহা দিশাকে বলে,
“ম্যাম আপনি বসে পড়ুন। আমি আপনাকে সাজাতে এসেছি।”

দিশা চুপচাপ বসে পড়ে। সেইসময় রুমে অন্য কেউ ছিল না। দিশা বসে পড়ে। স্নেহা মেকআপ করানোর নাম করে ক্লোরোফোম মিশ্রিত একটি পাউডার দিশার মুখের সামনে ধরে। যার ফলশ্রুতিতে সে জ্ঞান হারায়৷ সোহাগের ভয় করতে থাকে। সে বলে,
“যদি কেউ জেনে যায়!”

“এই ছেলে? আপনি এত ভিতু কেন? বলছিনা সব ব্যবস্থা করা আছে। কই আপনি আসুন তাড়াতাড়ি।”

স্নেহার ডাক কেউ একজন রুমে প্রবেশ করল। স্নেহা তার উদ্দ্যেশ্যে বলল,
“একে এখান থেকে কিভাবে নিয়ে যাব সেই ব্যবস্থা করেছেন তো?”

সে বলল,
“হ্যাঁ, সব ব্যবস্থা করা আছে। এই বস্তায় ওকে ভড়াও। বাকিটা আমি দেখে নিচ্ছি।”

সোহাগ ও স্নেহা মিলে দিশাকে বস্তাবন্দি করে। তারপর ঐ ঘরশত্রু বিভীষণ খুবই সন্তপর্ণে দিশাকে টানতে টানতে নিয়ে যায়। বাইরে এসে কয়েকজন গার্ডকে ডেকে বলে,
“এখানে কিছু আবর্জনা আছে। যাও এগুলো বাইরে ফেলে এসো।”

সিকিউরিটি গার্ডেরা তার কথামতো কাজ করে। কারণ সে এই খান পরিবারেরই এক সদস্য। তাকে অমান্য করার সাধ্যি কারো নেই। দিশাকে আবর্জনা ভেবে তারা বাইরে ফেলে আসে। আর তারপর সোহাগ ও স্নেহা দিশাকে তুলে নিয়ে যায়।

✨✨✨
দিশার জ্ঞান ফেরার পর সে নিজেকে আবিষ্কার করে একটা অন্ধকারছন্ন যায়গায়। জ্ঞান ফিরতেই সে চিৎকার চেচামেচি শুরু করে। বলতে থাকে,
“আমি কোথায়? আজ তো আমার বিয়ে? কে এনেছে এখানে আমায়?”

তখনই দিশার সামনে চলে আসে সোহাগ। অট্টহেসে বলে,
“আমি এনেছি এখানে তোমায়। কি ভেবেছিলে তুমি? আমাকে ঠকিয়ে নিজে ভালো থাকবে?”

“সোহাগ তুমি?! ভালো চাইলে আমায় ছেড়ে দাও। নাহলে আমি তোমাকে জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়ব।”

সোহাগ আবারো হাসিতে ফেটে পড়ে। তারপর বলে,
“কে কাকে জেলের ভাত খাওয়াবে সেটা তো সময়ই বলে দেবে। তার আগে এই ভিডিওটা দেখ।”

দিশা হতবাক হয়ে ভিডিওটা দেখে। এখানে সোহাগ ও দিশার ঘনিষ্ঠ কিছু মুহুর্ত দেখা যাচ্ছে। সোহাগ দিশাকে হুমকি দিয়ে বলে,
“এই ভিডিও যদি তোমার ফ্যামিলি বা হবু স্বামীর হাতে যায় তাহলে তোমার কি হবে ভেবে দেখ…আর যদি আমি এই ভিডিও অনলাইনে ভাইরাল করে দেই তাহলে…”

“তোমাকে তো আমি..”

“তুমি আমার কিছু করতে পারবে না দিশা। বরং আমি চাইলে তোমার সব মান সম্মান শেষ করে দিতে পারি। এমন হাল করতে পারি যাতে তুমি আর সমাজে মুখ দেখাতে না পারো।”

“কি চাও তুমি?”

“তুমি যদি চাও যে এই ভিডিও ভাইরাল না হোক তাহলে তোমায় আমাকে বিয়ে করতে হবে।”

“কি! তুমি কি করে ভাবলে যে আমি তোমায় বিয়ে করব?!”

“নিজের ভালো পাগলেও বোঝে এখন তুমি ভাবো তুমি কি করবে।”

দিশার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়। সে খুব বাজে ভাবে ফেসে গেছে। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকে সে। অনেক ভেবে বলে,
“আমি তোমার সব শর্তে রাজি। শুধু এই ভিডিওটা যেন কারো হাতে না পড়ে।”

✨✨
খান ভিলায় হুলস্থুল পড়ে গেছে। খান বাড়ির মেয়ে যার আজ বিয়ে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এ কথা ঝড়ের বেগে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সবাই কানাঘুষা শুরু করে দিয়েছে। বেশিরভাগই বলছে এই মেয়ের হয়তো অন্য কোথায় চক্কর ছিল তাই সে পালিয়ে গেছে।

এদিকে দিলারা চৌধুরী থেকে থেকে আহাজারি করে চলেছেন। তার মতে, তার মেয়ে পালিয়ে যেতে পারে না। বরং কেউ তাকে তুলে নিয়ে গেছে। দিলারা চৌধুরীকে সামলানোর চেষ্টা করছেন নিপুণ, নিপুণের মা রাহেলা চৌধুরী ও ফুফু খোদেজা চৌধুরী। খোদেজা চৌধুরীর স্বামী মারা যাবার পর থেকে তিনি বাবার বাড়িতে থাকেন। নিজের ভাতিজির নিখোঁজ হয়ে যাওয়া নিয়ে তাকে খুব বেশি বিচলিত মনে হচ্ছে না। কারণ তারও মনে হচ্ছে দিশা পালিয়ে গেছে। কারণ দিশা যা দস্যি মেয়ে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া কারো কর্ম নয়। এদিকে দিপ্র ও আলতাফ চৌধুরীকে এখন অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তাদের একাধারে অনুপমের পরিবারকে সামলাতে হচ্ছে। তাদের একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দিতে হচ্ছে। আবার দিশার খোঁজও চালিয়ে যেতে হচ্ছে। নিজের মায়ের মতো দীপ্ররও মনে হচ্ছে তার বোনকে কেউ তুলে নিয়ে গেছে৷ তার এই সন্দেহ গাঢ় হয়েছে সিসিটিভি ফুটেজের কারণে। কারণ সিসিটিভি ফুটেজে ২০ মিনিটের ফুটেজ গায়েব হয়ে আছে। দীপ্র জানতে পারে সর্বশেষ পার্লারের লোকেরা দিশাকে সাজাতে এসেছিল তাই সে এ ব্যাপারে খোঁজ নেওয়ার জন্য বের হতে যায়।

ঠিক এমন সময় দিশা ফেরত আসে। দিশাকে দেখে দীপ্র ছুটে যায় তার কাছে। গিয়ে বলে,
“কোথায় গিয়েছিলি তুই দিশা? তোর কি বিন্দুমাত্র কাণ্ডজ্ঞান নেই? আজ তোর বিয়ে আর তুই এইভাবে.. ”

সোহাগ দিশার সাথেই এসেছে। সোহাগকে দেখে দীপ্র জিজ্ঞেস করে,
“আপনি কে?”

সোহাগ দিশাকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,
“তুমি কি আমার পরিচয় সবাইকে দেবে নাকি আমি দেবো?”

দিশা নিচু স্বরে বলে,
“ও সোহাগ। আমরা বিয়ে করেছি।”

দিশার এই নিচু স্বরে বলা কথাটাই খান ভিলায় তাণ্ডব তোলার জন্য যথেষ্ট ছিল। দীপ্র দিশার দিকে অবিশ্বাস্যের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
“এসব কি বলছিস তুই?”

এরমধ্যে দিলারা চৌধুরী দিশার ফিরে আসার কথা শুনে ছুটে আসেন৷ দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরেন নিজের মেয়েকে। আলতাফ চৌধুরী দিশার সব কথা শুনে ফেলেছেন। তাই তিনি বলে ওঠেন,
“তুমি এদিকে চলে এসো দিলারা। আজকে থেকে এই মেয়ের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। ও আমাদের কাছে মৃত।”

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

তুমি ছিলে বলেই ২ পর্ব-০৩

0

#তুমি_ছিলে_বলেই২
#পর্বঃ৩
#দিশা_মনি

স্নেহা আজ সকাল সকাল বাসা থেকে বেরিয়েছে। শেফালি বেগম তাকে দেখেও কিছু বললেন না। মেয়েটা যখন তার কোন কথা শুনবেই না তখন বলে আর কি হবে?

স্নেহার পরণে একটা কালো হুডি। বাইরে এসে কাউকে একটা কল লাগালো স্নেহা। ফোনটা রিসিভ হতেই প্রশ্ন করল,
“ছেলেটা কোথায় এখন?”

“নিউমার্কেটের সামনে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে।”

“ঠিক আছে। ওর দিকে নজর রাখো। আমি যাচ্ছি।”

স্নেহা নিউমার্কেটের দিকে রওনা দেয়৷ যেতে যেতে ভাবে,
“কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গেছে। চৌধুরীদের সর্বনাশের আর বেশি দেরি নেই।”


নিউমার্কেটে পৌঁছে সোহাগের মুখোমুখি দাঁড়ালো স্নেহা। সে মাস্ক পড়ে থাকায় সোহাগ তাকে চিনতে পারল না। বলল,
“কে আপনি?”

স্নেহা মাস্ক খুলে বলে,
“আমায় চিনতে পেরেছেন? নাকি ভুলে গেছেন?”

সোহাগ স্নেহাকে দেখে অবাক হয়ে বললো,
“আরে! আপনি। আপনাকে কিভাবে ভুলবো? আমি তো ভাবতেও পারিনি আপনার সাথে আমার আবার দেখা হবে।”

“দেখাটা হবারই ছিল।”

“ওহ। তো কিছু বলবেন?”

“হ্যাঁ, আপনার সাথে খুব গোপন কথা আছে। একটু সাইডে আসবেন?”

সোহাগ তার বন্ধুদের অপেক্ষা করতে বলে স্নেহার সাথে একটা রেস্টুরেন্টে যায়৷ তারপর বলে,
“এখন বলুন কি বলবেন।”

স্নেহা বলল,
“দিশা চৌধুরীকে চেনেন আপনি?”

দিশার নামটা শুনতেই সোহাগের মাথা গরম হয়ে গেল। সে বলে উঠলো,
“ঐ মেয়েটার নামও নেবেন না আমার সামনে। ও একটা প্রতারক।”

“আই নো। আমি সবকিছুই জানি। মেয়েটা আপনাকে খুব বাজেভাবে ঠকিয়েছে।”

“আপনি এত কিছু জানলেন কিভাবে?”

“সেটা বড় কথা নয়। আমি আপনার সাথে একটা প্রয়োজনেই কথা বলতে এসেছি।”

“প্রয়োজন! কিসের প্রয়োজন?”

“আপনি চান না দিশা চৌধুরীর উপর প্রতিশোধ নিতে?”

“হ্যাঁ, চাই তো৷ কিন্তু আপনি এ ব্যাপারে কি করবেন?”

“আমি দিশা চৌধুরীর উপর প্রতিশোধ নিতে আপনাকে সাহায্য করব।”

“কিন্তু এতে আপনার লাভ কি?”

“লাভ আছে জন্যই তো আমি আপনাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছি। কি লাভ সেটা আপনার না জানলেও চলবে৷ আপনি শুধু বলুন আমার সাথে হাত মিলিয়ে ঐ দিশা চৌধুরীর উপর প্রতিশোধ নেবেন কিনা?”

“হ্যাঁ, নেব আমি প্রতিশোধ।”

“ঠিক আছে। তৈরি হয়ে নিন। দু একদিনের মধ্যেই আমরা রাজশাহী যাচ্ছি। এই নিন, এখানে আমার ফোন নম্বর আছে। আমি তাহলে আজ চলি।”

বলেই চলে গেলো স্নেহা। সোহাগ স্নেহার যাওয়ার পানে তাকিয়ে বললো,
“মেয়েটা অদ্ভুত! কিন্তু তাতে আমার কি? আমি তো এখন শুধু চাই ঐ দিশার উপর প্রতিশোধ নিতে। ও আমায় ঠকিয়েছে। আমার সাথে ভালোবাসার নাটক করে এখন অন্য কাউকে বিয়ে করে নিচ্ছে। আমাকে ঠকিয়ে ও সুখে থাকবে এটা আমি কিছুতেই মানব না।”

✨✨✨
চৌধুরী বাড়িতে ইতিমধ্যেই উৎসবের আমেজ নেমেছে। আর মাত্র দুদিন পরেই দিশার বিয়ে। তাই আয়োজনের কোন ত্রুটি রাখতে চায় না চৌধুরীরা৷ হাজার হাজার গেস্টকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বিয়ে উপলক্ষে চলছে এলাহি আয়োজন।

এসব কিছুর মাঝে মন ভালো নেই নিপুণের। কারণ বেশ কিছুদিন থেকেই সে অসুস্থ। বাড়িতে অনেক আত্মীয় স্বজন এসেছে। নিপুণের মামাতো-ফুফাতো বোনেরাও এসেছে। তাদের সাথে মজা করতে না পারার জন্যই নিপুণের মনটা এত খারাপ। সে উদাস মনে যখন নিজের রুমে বসে ছিল ঠিক সেই সময় আগমন ঘটে দীপ্রর। দীপ্র এসে নিপুণকে জিজ্ঞেস করে,
“এখন তোর শরীর কেমন আছে?”

“আছি, মোটামুটি। তুমি হঠাৎ এলে যে?”

“তুই কেমন আছিস সেটা দেখতে এলাম।”

দীপ্রর তার প্রতি এত কেয়ার দেখে নিপুণের অনেক ভালো লাগল। সে আনন্দিত হয়ে মনে মনে বলল,
“তুমি যদি এভাবেই আমার কেয়ার করো তাহলে আমি একবার না বারবার এমন অসুস্থ হতে রাজি আছি।”

দীপ্র এগিয়ে আসে। নিপুণের মাথায় হাত দিয়ে জ্বর পর্যবেক্ষণ করে বলে,
“তুই বেশি বেশি রেস্ট নে। তোর রেস্টের প্রয়োজন। আর হ্যাঁ, ওষুধ খাবি নিয়মিত। কোন অনিয়ম কিন্তু আমি বরদাস্ত করব না।”

“জ্বি, আচ্ছা।”

“হুম। আচ্ছা থাক। আমি যাচ্ছি। নিজের খেয়াল রাখিস।”

দীপ্র চলে যাবার পর নিপুণ বললো,
“তুমি কি কখনো আমার ভালোবাসা বুঝতে পারবা দীপ্র ভাইয়া? নাকি এই অনুভূতি আমার একান্ত আপন থেকে যাবে চিরকাল?”

✨✨
নিপুণ তার কয়েকজন কাজিনের সাথে নিচে নামলো। আজ দিশার গায়ে হলুদ। তাই সবার সাথে সেও আনন্দে মেতে উঠলো। এদিকে নিপুণকে নিচে দেখে রেগে গেল দীপ্র। তার সামনে এসে বললো,
“তুই না অসুস্থ? এই অবস্থায় নিচে এসেছিস কেন? যা নিজের ঘরে গিয়ে রেস্ট নে।”

“ভাইয়া..”

“চুপ। আর একটা কথা বলবি না। তোর কোন কথা আমি শুনতে চাই না। যা বলছি।”

দীপ্রর কথায় নিপুণ মন খারাপ করে নিজের রুমে চলে গেলো। সে যাবার পর দিশা এসে বললো,
“ভাইয়া। তুমি শুধু শুধুই ওকে এভাবে বলবে। বেচারির আনন্দ করাই হলো না।”

“অসুস্থ শরীর নিয়ে কোন আনন্দ চলবে না। ওর নিজের প্রতি কোন খেয়ালই থাকে না। কি যে হবে এই মেয়ের!”

দিশা চুপিচুপি দীপ্রর কানে বলে,
“কি আর হবে? তুমি আছ না ওর খেয়াল রাখার জন্য? তুমিই ওর খেয়াল রাখবে।”

দীপ্র দিশাকে চোখ রাঙায়। দিশা দাত কেলিয়ে হাসতে থাকে।

✨✨✨
ঢাকা থেকে রাজশাহী গামী একটি বাসে রয়েছে সোহাগ ও স্নেহা। স্নেহা ভাবতে থাকে আজ এখানে আসার জন্য তার খালার সাথে কত কাটাকাটি হয়েছে। তিনি তো স্নেহাকে আসতে দিতে রাজিই ছিল না। অনেক বুঝিয়ে তারপর স্নেহা এসেছে। এদিকে সোহাগ যার চোখ এখন প্রতিশোধের নেশায় অন্ধ। সে শুধু অপেক্ষা করছে রাজশাহী পৌঁছানোর। তারপরই দিশার উপর সে উপযুক্ত প্রতিশোধ নেবে। মেয়েটা তাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। সব সুদে আসলে ফেরত দিতে হবে।

✨✨
দিশার বিয়ে উপলক্ষে আজ চৌধুরী বাড়িতে নাচ গানের আসর বসেছে। নিপুণও সেখানে উপস্থিত হয়েছে তবে দর্শক হিসেবে। নিপুণের খুব ইচ্ছা ছিল দিশার বিয়েতে সে অনেক নাচবে। নিপুণ অনেক ভালো নাচতে পারে। কিন্তু অসুস্থতাই তার কাল হলো। এখন চুপচাপ অন্যের নাচ দেখতে হচ্ছে। নিপুণ একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। এরইমধ্যে নিপুণের নজর যায় দীপ্রর মামাতো বোন নেহার দিকে। নেহা দীপ্রর দিকে কিভাবে যেন তাকিয়ে আছে। এই নেহা মেয়েটাকে নিপুণ একদম সহ্যই করতে পারে না। সবসময় সে দীপ্রর সাথে চিপকে থাকার চেষ্টা করে। এরমধ্যে হঠাৎ করে নেহা এসে দীপ্রর হাত ধরে বলে,
“ভাইয়া এসো আমরা ডান্স করি।”

যদিও দীপ্রর কোন ইচ্ছা ছিল না কিন্তু নেহা দীপ্রকে একপ্রকার টেনে নিয়ে যায়। দুজনে নাচতে থাকে একটি রোম্যান্টিক গানে। যা নিপুণের একদম সহ্য হয়না। রাগী সে নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়। তারপর দ্রুত উঠে চলে যায়। নিপুণকে যেতে দেখে দীপ্রও তার পিছনে আসে। নিজের রুমে এসে ডুকরে কাঁদতে থাকে নিপুণ। দীপ্র রুমের সামনে এসে বলে,
“এভাবে কাঁদছিস কেন তুই?”

নিপুণ কাঁদতে কাঁদতেই বলে,
“এখানে কেন এলে তুমি?! যাই নাচো। এখানে তোমার কি? ঐ নেহার সাথে নাচতে তো খুব ভালো লাগছিল।”

“তুই এমন করে কেন বলছিস? আমি তো নেহার সাথে নাচতে চাইনি..ঐ তো জোর করে..আর যদি নাচিও তাতে তোর সমস্যা কি?”

নিপুণ বলে,
“তুমি বোঝো না আমার সমস্যা কোথায়? এত অবুঝ কেন তুমি?”

দীপ্র রুমে ঢুকে নিপুণের চোখের অশ্রু মুছিয়ে দিয়ে বলে,
“আমি সব বুঝি।”

নিপুণ অনিমেষ তাকিয়ে থাকে দীপ্রর দিকে।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

তুমি ছিলে বলেই ২ পর্ব-০২

0

#তুমি_ছিলে_বলেই২
#পর্বঃ২
#দিশা_মনি

দীপ্র সবদিক আজ একা হাতে সামলাচ্ছে। তার ছোট বোনের এনগেজমেন্ট বলে কথা তার তো দায়িত্ব অনেক বেশি। এরইমধ্যে তার নজর গেলো নিপুণের দিকে। লাল পেড়ে একটা খুব সুন্দর শাড়ি পড়ে দীপ্রর সামনে দাঁড়ালো নিপুণ। অতঃপর মৃদু হেসে বললো,
“আমাকে কেমন লাগছে ভাইয়া?”

“খারাপ লাগছে না।”

নিপুণের মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে আরো ভালো কোন কথা শুনতে চাইছিল। এরইমধ্যে দিশাও সেখানে এলো। নিপুণকে দেখে বললো,
“বাহ, নিপুণ। শাড়িতে তো তোকে খুব সুন্দরী লাগছে।”

নিপুণ এবার খুশি হয়ে গেলো। দিশা এরপর দীপ্রকে বললো,
“ভাইয়া আমার একটা উপকার করতে পারবি?”

“কি উপকার?”

“আমি একটু উপরে যাচ্ছি। বেশিক্ষণ টাইম লাগবে না। মাত্র দশ মিনিট৷ তুমি এদিকটা একটু সামলে নিও।”

“উপরে কি কাজ তোর?”

“তেমন কিছু না। আসলে একটু ওয়াশরুমে যাব।”

“আচ্ছা, ঠিক আছে। যা।”

দীপ্রর থেকে অনুমতি পেয়ে দিশা চলে এলো উপরে। এসেই নিজের ফোন বের করল। ফোনের উপরে এখনো সোহাগ নামটা জ্বলজ্বল করছে। দিশা বিরক্ত হয়ে বললো,
“এই ছেলেটা আমায় একটুও শান্তি দেবে না। ধুর।”

বলেই ফোনটা রিসিভ করল। বিপরীত দিক থেকে সোহাগ উত্তেজিত গলায় বলল,
“এসব আমি কি শুনছি দিশা? আজ নাকি তোমার এনগেজমেন্ট?”

“একদম ঠিক শুনেছ তুমি। আজ সত্যিই আমার এনগেজমেন্ট।”

“তুমি আমার সাথে কিভাবে এটা করতে পারলে? আমি ভালোবাসি তোমাকে?”

“ভালোবাসা মাই ফুট। তুমি কি করে ভাবলে তোমার মতো একটা মিডেল ক্লাস ছেলেকে আমি বিয়ে করবো? তুমি কোন দিক দিয়ে আমার যোগ্য?”

“বাহ, কি সুন্দর কথা বললে। মিডেল ক্লাস ছেলের সাথে প্রেম করা যায় কিন্তু তাকে বিয়ে করা যায়না!”

“এই শোনো, আমার এত ফালতু কথা বলার টাইম নেই। তুমি কিভাবে ভেবে নিয়েছিলে যে আমি তোমায় বিয়ে করব? তুমি কোন দিক দিয়ে আমার যোগ্য? আমার হবু বর কে জানো? অনুপম খান, খান গ্রুপ অব ইন্ড্রাস্টিজ এর মালিক। যেমন বড়লোক তেমনই সুন্দর। তুমি তার নখের যোগ্য নও।”

বলেই ফোন রেখে দিলো দিশা। এদিকে সোহাগ ফোন আছাড় দিয়ে বলল,
“আজ আমার ভাগ্যটাই খারাপ। একে তো আজ প্রথমবারের মতো বাইক রেসে হেরে গেলাম এখন আবার আমার গার্লফ্রেন্ডও আমায় চিট করল। আমি ছাড়ব না দিশাকে। এর শেষ দেখে ছাড়ব।”


মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অনুপম ও দিশা। সবাই অপেক্ষা করে আছে সেই মাহেন্দেক্ষণের। অবশেষে সেই সময় এসে উপস্থিতও হলো। অনুপম এনগেজমেন্ট রিং পড়িয়ে দিলো দিশার হাতে। দিশাও হাসিমুখে সবটা দেখলো। সেও একটা ডায়মন্ড রিং পড়িয়ে দিলো অনুপমকে।

সবাই হাততালি দিয়ে এই অনুষ্ঠানটা উপভোগ করতে লাগল। এরইমধ্যে নিপুণ তাকালো দীপ্রর দিকে। অনুপমের স্থলে দীপ্রকে এবং দিশার স্থলে নিজেকে কল্পনা করে সে ভাবতে লাগল। কল্পনা ভাঙতেই নিজেই নিজেকে গালি দিয়ে বলল,
“দূর, এসব কি ভাবছি আমি! দীপ্র ভাইয়া যদি আমার ভাবনা জানতে পারে তাহলে তো আমায় খু**নই করে ফেলবে। যা রাগী লোকটা!”

এরমধ্যে দীপ্রও তাকালো নিপুণের দিকে। নিপুণকে আপাদমস্তক ভালো করে দেখে নিলো। স্মিত হেসে মনে মনে বললো,
“আজ সত্যিই তোকে অনেক সুন্দর লাগছে নিপুণ।”

✨✨
স্নেহা এসে উপস্থিত হলো তার খালা শেফালি বেগমের বাড়িতে। শেফালি বেগম এত রাতে স্নেহার বাড়িতে ফেরা নিয়ে চেচামেচি করতে লাগলেন। তিনি বলতে লাগলেন,
“তোকে আর মানুষ করতে পারলাম না রে স্নেহা! একেই তো সারাদিন এমন পুরুষের বেশভূষা নিয়ে থাকিস যেটা আমার একদম পছন্দ নয় তার উপর রাত ১০ টায় বাসায় ফিরলি। এসব কি হচ্ছেটা কি? তোর মা বেঁচে থাকলে তোর এই অধঃপতন দেখে খুব কষ্ট পেত। একটা মেয়ের জন্য এত রাতে বাইরে থাকা কতটা বিপজ্জনক হতে পারে সেটা তুই জানিস না?”

স্নেহা কোন রিয়্যাক্ট না করে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“তুমি তো জানো খালামনি আমি আর পাঁচটা মেয়ের মতো নই। আমি নিজেকে সবসময় স্ট্রং ভাবি এবং সেভাবেই নিজেকে গড়ে তুলেছি। তোমার বা মার মতো নরম নয়। তোমাদের এত কোমলতার জন্যই তো তোমাদের আজ এই দশা।”

শেফালি বেগম আর কিছু বলার মতো খুঁজে পেলেন না। কি বলবেন তিনি? স্নেহার মনে যেই ধারণা তৈরি হয়েছে সেটা তো পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির জন্যই হয়েছে। শেফালি বেগম নিজের অতীতের কথা ভাবেন। তিনি এবং তার বড় বোন শিউলি দুজনেই নরম স্বভাবের ছিলেন। আর দুজনেই জীবনে ঠকে গেছেন বাজেভাবে। শেফালি বেগম যেই লোকটাকে সবকিছু উজার করে ভালোবেসেছিলেন। যাকে নিজের স্বামীর আসনে বসিয়েছিলেন তিনিই তার সন্তান না হওয়ার কারণে তাকে ছেড়ে অন্য মেয়েকে বিয়ে করে নেন। তালাক দেন শেফালি বেগমকে। অন্যদিকে তার বড় বোন…

অতীতের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো শেফালি বেগম। স্নেহা ততক্ষণে নিজের রুমে চলে গেছে। শেফালি বেগম একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন,
“সব কিছু কেমন জেনো এলোমেলো হয়ে গেছে। আপু তো চেয়েছিল তার মেয়ে শক্ত হোক কিন্তু কখনোই চায়নি এভাবে বখে যাক। কিভাবে এই মেয়েকে আমি আবার ঠিক পথে ফেরাবো? হে আল্লাহ, তুমি আমাকে পথ দেখাও। আমি যদি ওকে ঠিক পথে ফেরাতে না পারি তাহলে ওর জীবনে এমন একজন মানুষকে পাঠাও যে ওকে ঠিক পথে ফেরাবে। ওর মাথায় সবসময় যে প্রতিশোধের নেশা ঘুরছে সেই নেশা থেকে ওকে বের করবে।”

✨✨
স্নেহা নিজের রুমে এসে কাউকে একটা ফোন করে। ফোনটা রিসিভ হতেই সে বলে,
“চৌধুরী বাড়ির আজকের আপডেট কি?”

বিপরীত দিক থেকে কেউ বলে ওঠে,
“আজ তো চৌধুরী বাড়িতে চাঁদের হাট বসেছে। আতিফ চৌধুরী ও দিলারা চৌধুরীর মেয়ে দিশা চৌধুরীর এনগেজমেন্ট আজ। তাও রাজশাহী শহরের অন্যতম ধনী ব্যবসায়ী অনুপম খানের সাথে।”

“তোমাকে যে ঐ দিশা চৌধুরী সম্পর্কে খোঁজ নিতে বলেছিলাম তা তুমি কি খোঁজ নিয়েছ?”

“হুম, নিয়েছি।”

“বলো কি জানতে পারলে ঐ মেয়েটার ব্যাপারে।”

“ও একটা ছেলের সাথে প্রেম করত। ছেলেটা ঢাকার তবে এখানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করত। সেখান থেকেই ওদের পরিচয় ও প্রেম।”

“তার মানে ঐ ছেলেটাকে ধোকা দিয়েছে?”

“হ্যাঁ, আসলে ছেলেটা মধ্যবিত্ত পরিবারের তো তাই।”

স্নেহা বিদ্রুপাত্মক হেসে বললো,
“এমন তো হবেই। রক্ত তো কথা বলবেই। রক্তের দোষ না।”

“সেটাই।”

“আচ্ছা, তুমি কি দিশার প্রেমিকের সব বায়োডাটা সংগ্রহ করেছ?”

“হুম। সব আমার কাছে আছে।”

“গুড জব। আমাকে ওর সব বায়োডাটা পাঠিয়ে দাও। ঢাকাতেই যখন আছে তখন আমি খুঁজে নেব।”

ব্যক্তিটি স্নেহাকে সব বায়োডাটা পাঠিয়ে দিলো। সব দেখে স্নেহা মৃদু হেসে বললো,
“সত্যিই পৃথিবীটা গোল। তাহলে আপনার সাথে আমার আবার দেখা হচ্ছে মিস্টার সোহাগ ইসলাম। তৈরি থাকুন। শত্রুর শত্রু তো বন্ধুই হয়। এবার আমরা দুইজন মিলে আমাদের এক ও অদ্বিতীয় শত্রুর বিরুদ্ধে প্রথম কিস্তিমাত করব। চৌধুরীরা তোমরা এখন যত আনন্দ করার করে নাও। খুব শীঘ্রই আমি রাজশাহীতে যাচ্ছি। আমি রাজশাহীতে গেলে তোমাদের সব আনন্দ বের করে দেব। এমন হাল করে রেখে দেব যে তোমরা হাসতে ভুলে যাবে। নিজেদের বংশ, গৌরব,টাকা পয়সা নিয়ে খুব অহংকার না তোমাদের? তোমাদের এই অহংকার ধুলোয় না মেশাতে পারলে আমিও শিউলির মেয়ে স্নেহা না।”

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

তুমি ছিলে বলেই ২ পর্ব-০১

0

#তুমি_ছিলে_বলেই২
#পর্বঃ১
#দিশা_মনি

১.
“ছেঁড়া শাড়ি পড়ে এত বড় অনুষ্ঠানে এসেছিস কেন? তোর কি কোন ভালো শাড়ি নেই?!”

সিংহের মতো গর্জন করে কথাটুকু বলল দীপ্র চৌধুরী। দীপ্রর হুংকারে কেপে উঠল নিপুণ। আমতাআমতা করে বলল,
“আসলে আমি বুঝতে পারি নি যে… ”

নিপুণ নিজের কথা সম্পূর্ণ করতে পারল না৷ তার পূর্বেই দীপ্র পুনরায় হুংকার দিয়ে বলল,
“নিজের ভালো চাইলে এক্ষুনি এই শাড়িটা পালটে আয়। নাহলে কিন্ত…”

নিপুণ ঘাবড়ে গেল। ইতস্তত বোধ করতে লাগল মেয়েটা। মিনমিন স্বরে বলল,
“আসলে আমার কাছে আর কোন শাড়ি নেই ভাইয়া। তুমি তো জানো আমি শাড়ি পড়ি না। আজ দিশার এনগেজমেন্ট জন্য প্রথম পড়লাম তাই..”

“তাহলে একটা কাজ কর। আম্মুর রুমে যা। গিয়ে আম্মুর থেকে একটা ভালো শাড়ি নিয়ে পড়। এখানে থেকে আর লোক হাসাস না।”

“ঠিক আছে, তুমি চিন্তা করো না। আমি শাড়িটা বদলে আসছি।”

বলেই নিপুণ গুটিগুটি পায়ে চলে যেতে লাগল। দীপ্রর থেকে দূরে এসেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে৷ ছোটবেলা থেকেই দীপ্রকে ভয় পায় নিপুণ। ভয় পাওয়ার কারণও আছে বৈকি৷ দীপ্র রেগে গেলে সাংঘাতিক হয়ে ওঠে। আর সেই রাগের মাত্রাও ভয়াবহ হয়৷ নিপুণ আর দীপ্র চাচাতো ভাইবোন। নিপুণের থেকে পাঁচ বছরের বড় দীপ্র। নিপুণ একেবারে সহজ সরল একটা মেয়ে। বাবা-মায়ের খুব আদুরে। তার এই পৃথিবীতে কাউকে নিয়ে তেমন ভয় নেই কিন্তু দীপ্রকে যমের মতো ভয় পায় সে। নিপুণ আর কিছু ভাবতে পারল না। নিজেই নিজেকে দোষ দিয়ে বললো,
“আমার এই শাড়ি পড়তে চাওয়াই উচিৎ হয়নি। তার থেকে ভালো রোজকার মতো সালোয়ার পড়তাম।”

নিপুণ যখন এসব ভাবতে ব্যস্ত ছিল তখনই তার মা রাহেলা চৌধুরী তার সামনে আসে। নিপুণের উদ্দ্যেশ্যে বলে, “আরে, এদিকে কোথায় যাচ্ছিস? দিশার এনগেজমেন্ট তো শুরু হয়ে যাবে একটু পর।”

“আম্মু, আসলে আমার শাড়ি ছিড়ে গেছে। আমাকে নতুন শাড়ি পড়তে হবে।”

রাহেলা চৌধুরী নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন,
“ধুর। এসব শাড়ি-টাড়ি পড়তে গেছিস কেন তুই? যদি সামলাতেই না পারিস? যা গিয়ে সেলোয়ার পড়ে নে।”

“আম্মু, আজ তো সবাই শাড়ি পড়েছে তাই.. ”

“সবাই পড়েছে কারণ ওরা সামলাতে পারে। আচ্ছা, তুই যদি শাড়ি পড়তে চাস তাহলে আমার সাথে আয়। আমি পড়িয়ে দিচ্ছি।”

রাহেলা চৌধুরীের কথা শুনে নিপুণ চুপচাপ তার পেছনে যেতে থাকে। নিপুণকে নিজের একটা শাড়ি পড়িয়ে দেন রাহেলা চৌধুরী। তারপর আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে বলেন,
“মাশাল্লাহ, আমার মেয়েটাকে কি সুন্দর লাগছে! দেখতে হবে না মেয়েটা কার? কারো নজর না লাগুক।”

নিপুণ সামান্য লজ্জা পেলো।


নিজের বোনের এনগেজমেন্ট উপলক্ষ্যে সব আয়োজন করে নিয়েছে দীপ্র। কোন কিছুর কোন কমতি রাখে নি। এরইমধ্যে দীপ্রর মা দিলারা চৌধুরী এসে উপস্থিত হলেন নিজের ছেলের সামনে। তাকে শুধালেন,
“কিরে দীপ্র? সব এরেঞ্জমেন্ট কমপ্লিট তো?”

“জ্বি, আম্মু। তুমি কোন চিন্তা করো না। সব একদম ঠিকঠাক।”

“হ্যাঁ, সেটাই। কোন কিছুর যেন কোন কমতি না থাকে। লোকে যেন বুঝতে পারে চৌধুরী বাড়ির মেয়ের এনগেজমেন্ট হচ্ছে। আমার একমাত্র মেয়ের এনগেজমেন্টে আমি কোন খামতি রাখতে চাই না।”

দীপ্র মাথা দুলালো সামান্য।

এদিকে দিশা তার বান্ধবীদের সাথে গল্প করতে ব্যস্ত। দিশার এক বান্ধবী তাকে প্রশ্ন করে,
“কিরে দিশা? তোর সাথে কার বিয়ে ঠিক হয়েছে বললি নাতো? সে কি খুব বড়লোক নাকি?”

দিশা বললো,
“আমার বয়ফ্রেন্ডের থেকে অনেক বড়লোক। এটা নিয়েই আমি খুশি।”

“কিন্তু যদি হ্যান্ডসাম না হয়?”

“আমার বয়ফ্রেন্ডের থেকেও হ্যান্ডসাম। আমি ছবি দেখেছি। তাই তো এই বিয়েতে মত দিয়েছি।”

“নাম কি রে তোর বরের আর কি করে সে?”

“অনুপম খান। খান গ্রুপ অব ইন্ড্রাস্ট্রিজ এর মালিক।”


রাস্তায় ছুটে চলেছে কয়েকটা বাইক। মূলত আজ এখানে একটা বাইক রেসের আয়োজন করা হয়েছে। শুরু থেকেই সামনে ছিল গত পাঁচ বারের বাইক রেসের চ্যাম্পিয়ন সোহাগ ইসলাম। সে খুব আত্মবিশ্বাসী ছিল যে আজ আবারো সে ষষ্ঠবারের মতো এই রেসে জয়লাভ করবে। গন্তব্যের খুব কাছে পৌঁছে গেছিল সে। আর সামান্য দূরত্বই ছিল কিন্তু তখনই দ্রুতবেগে আরেকটি বাইক এসে তাকে টপকে যায়। বাইকটি একদম ঝড়ের বেগে আসে। সোহাগ বুঝতেই পারে না কখন সে পিছনে পড়ে গেল৷ অবশেষে সোহাগের থেকে বিজয়ের ট্রফি ছিনিয়ে নিলো অন্য কেউ। সোহাগ বাইক থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। বাইক থেকে নেমে নিজের হেলমেট খুলল। তার আত্মসম্মানে খুব লাগলো ঘটনাটা। সোহাগের বন্ধুরা এগিয়ে এলো তার দিকে। সোহাগের উদ্দ্যেশে বললো,”এটা কে রে? তোকে এভাবে হারিয়ে দিলো?”

সোহাগ বললো,”জানি না। চল তো গিয়ে দেখি।”

সোহাগ এগিয়ে গেলো সম্মুখে। গিয়ে দাঁড়ালো নতুন চ্যাম্পিয়নের সামনে। ততক্ষণে সে হাতে ট্রফি তুলে নিয়েছে। সোহাগ তার দিকে হাত বাড়িয়ে বললো,
“অভিনন্দন ভাই। তুমি আমার দীর্ঘ দিনের রেকর্ড ভেঙে দিলে।”

মাথা থেকে হেমলেটটা নামিয়ে নিলো সে। সামান্য হেসে বললো,”ভাই নই আমি আপু।”

সোহাগ হতবাক হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত কিনা একটা মেয়ে তাকে হারিয়ে দিলো। সে ভালো করে পরখ করে দেখতে লাগল মেয়েটাকে। স্বাভাবিক নারীসুলভ নয় এই মেয়েটি। মাথায় ঘন লম্বা চুলের বদলে ছেলেদের মতো ছেটে ফেলা ছোট চুল, পরণে প্যান্ট, শার্ট, চেহারাতেও নেই নারীসুলভ কোমলতা।

সোহাগ কঠিন গলায় বললো,”কে তুমি?”

মেয়েটি বললো,”আমার নাম স্নেহা। এটুকুই আমার পরিচয়। এর বেশি কিছু নয়।”

বলেই সে সামনের দিকে যেতে লাগলো। সোহাগের এক বন্ধু তাকে নিয়ে মজা করে বললো,”শেষ পর্যন্ত একটা মেয়ে তোকে হারিয়ে দিলো সোহাগ?”

সোহাগ বলল,”ব্যাপারটা দেখতে হবে।”

এদিকে স্নেহা যেতে যেতে ভাবতে লাগল,
“এখান থেকেই আমার জয়যাত্রা শুরু হলো। মা, তুমি চিন্তা করো না। তোমার সাথে হওয়া সব অন্যায়ের প্রতিশোধ আমি নেবোই। খুব শীঘ্রই আমি রাজশাহীতে যাচ্ছি। সেখানে গিয়ে চৌধুরীদের উপর আমার প্রতিশোধ নেওয়া শুরু হবে। ওদের সব কৃতকর্মের শাস্তি আমি ওদের দেবো। ওদের সব সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দেব।”

স্নেহা সামনে এগিয়ে চলছিল। তার পেছন পেছন সোহাগও আসছিল। স্নেহা বুঝতে পারে কেউ তাকে ফলো করছে তাই সে সজাগ হয়ে যায়। এরমধ্যে হঠাৎ কিছু ছেলে তার সম্মুখে এসে বিশ্রীভাবে হেসে বলে,
“এই ভালোয় ভালোয় তোর কাছে যা যা আছে দিয়ে দে নয়তো..”

“নয়তো কি করবি?”

“এর তো তেজ কম নয়। এই চল এর তেজ বের করে দেই।”

বলে যেই না স্নেহার দিকে হাত বাড়াতে যাবে ওমনি স্নেহা লোকটার মেইন পয়েন্ট বরাবর লা*থি মা**রে। এরপর সকলের সাথে লড়াই করতে থাকে। সোহাগও এসে তাকে সাহায্য করতে থাকে। দুজনে মিলে গুন্ডাদের মজা বুঝিয়ে দেয়। গুন্ডাগুলো ভয় পেয়ে বাপ বাপ বলে পালায়। ওরা চলে যেতেই সোহাগ স্নেহাকে বলে,
“তুমি তো দেখছি বাইকিং এর মতো ভালো ফাইটিংও পারো।”

স্নেহা বলে,
“আমি এভাবেই নিজেকে গড়ে তুলেছি। সবদিক দিয়ে নিজেকে একদম পারদর্শী বানিয়েছি। ছোটবেলায় আমার মা আমাকে বলতেন নরম মাটি পেলে মানুষ সহজেই আঘাত করার সাহস দেখায়, তাই তো আমি নিজেকে শক্ত করে গড়ে তুলেছি। যাইহোক, ধন্যবাদ আপনাকে।”

বলেই স্নেহা সামনের দিকে এগোয়। সাগর পিছন থেকে স্নেহার উদ্দ্যেশ্যে দিয়ে বলে,
“আমাদের আবার দেখা হবে।”

স্নেহা পিছন ফিরে তাকায়। সামান্য হেসে বলে,
“আমিও তাই চাই।”

[আসসালামু আলাইকুম আমার পাঠকগণ ❤️ এটা সিজন ২ হলেও ১ম সিজনের সাথে গল্পের কোন মিল নেই। তাই যারা প্রথম সিজন পড়েন নি তারাও পড়তে পারবেন। অবশেষে আমি আবার ফিরে এলাম আপনাদের কাছে একদম নতুন গল্প নিয়ে। আশা করি, আপনারা আমায় ভোলেন নি। অনেকদিন পর গল্প লিখলাম জানি না কেমন হয়েছে। আশা করি আপনাদের ভালো লেগেছে। মন্তব্য করে জানা কেমন লাগল। ]

#চলবে

তুমি ছিলে বলেই সিজন ০১ পড়তে লেখাটির উপর ক্লিক করুন।

কুসুম কাঁটা পর্ব-৩৮ এবং শেষ পর্ব

0

#কুসুম_কাঁটা
#৩৯ও শেষ পর্ব
পাথরবাড়িতে সময় কাটিয়ে অবশেষে সবাই বাড়ি ফিরলো। যাবার সময় যতটা আনন্দ ছিলো, ফেরার পথে আনন্দ যেন দ্বিগুণ হলো। সবার মনের থমথমে ভাবটুকু যেন কেটে গেছে। তৌহিদ তুলিকে একশবার সরি বলেছে। রঙ্গনা বলেছে এক লক্ষ বার সরি বলতে। বুবু এমনিতে ঠান্ডা মানুষ হলে কী হবে, তার রাগ কিন্তু কঠিনের চেয়েও কঠিন। তৌহিদ হাল ছাড়ছে না। ঢাকায় ফিরে খাতা কলমে সরির হিসাব লিখে রাখবে।

***
ঢাকায় ফিরে সবাই সবার মতো ব্যস্ত হয়ে গেল। শ্রাবণ্যর পড়াশোনা, স্বপ্নীলের জব সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। স্বপ্নীলের এখন আর নিজেকে কোথাও বোকা বোকা লাগে না। কনফারেন্স রুমে যখন দাঁড়িয়ে ব্রিফ দেয় তখন নিজেকে সবার মধ্যে স্মার্ট লাগে। কেউ আর ও’কে খুঁচিয়ে কিছু বলতে পারে না। কাউকে কটু কথা না বলতে পারলেও ইগ্নোরটুকু ভালো করতে পারে।

একদিন শ্রাবণ্যকে নিয়ে সায়েন্সল্যাব আড়ং এ গিয়েছিল কিছু গিফট কিনবে বলে। সেখানে হঠাৎ একটা পরিচিত গলা শুনতে পেল। পরিচিত কন্ঠস্বর ডেকে উঠলো,

“এই স্বপ্নীল না!…

স্বপ্নীল তাকালো। পরিচিত মানুষ টাকে দেখে ও জমে গেল। নীলা….

নীলা এগিয়ে এলো। ঠোঁটে মিষ্টি হাসি। স্বপ্নীলকে জিজ্ঞেস করলো,

“এই তুই কেমন আছিস?”

স্বপ্নীলের জবাবের অপেক্ষা না করেই প্রশ্ন করলো,

“তোর বউ? কী নাম ওর?”

স্বপ্নীলের গলা শুকিয়ে আসছে। সেই শুকনো গলায় ই জবাব দিলো। ওর নাম শ্রাবণ্য।

নীলা শ্রাবণ্যকে দেখে মুগ্ধ গলায় বলল,

“বাহ! কী মিষ্টি দেখতে! এই ও কী তোমাকে শ্রাবণ বলে ডাকে? ”

শ্রাবণ্য এতক্ষনে অবশ্য বুঝতে পারলো চটপটে দারুণ মানুষ টা বোধহয় নীলা। বেচারা স্বপ্নীলের করুন চেহারা অবশ্য সেটা বুঝিয়ে ছাড়লো৷ শ্রাবণ্য হেসে বলল,

“নাহ!”

নীলা এক নাগাড়ে অনেক গুলো কথা বলল। জোর করে পাশের ফুডকোর্টে নিয়ে গেল। শ্রাবণ্য একদম সহজ, স্বপ্নীল ঘাবড়ে গেছে। স্বপ্নীল কিছুই খাবে না। আড়চোখে শ্রাবণ্যর দিকে তাকাচ্ছে বারবার। শ্রাবণ্য পেস্ট্রি আর ব্রাউনি অর্ডার করলো। নীলা চকলেট কফি নিলো৷ জোর করেও স্বপ্নীল কে দিয়ে কিছু অর্ডার করানো গেল না।

নীলা বলল,

“এই তুই কিছু নিচ্ছিস না কেন? বিল নিয়ে ভাবিস না, আমি দেব তো। ”

স্বপ্নীল কোনো কিছুতে জবাব দিচ্ছে না। নীলা নিজেই বলল,

“শ্রাবণ্য, ও যেহেতু আমার পরিচয় দিচ্ছে না, আমি কী নিজের পরিচয় দেব?”

শ্রাবণ্য হেসে বলল,

“আমি জানি, আপনি নীলা আপু। ”

নীলা স্বপ্নীলের দিকে তাকিয়ে বলল,

“ভাই তুই তো জিতছিস! তোর বউয়ের অনেক বুদ্ধিও কিন্তু। ”

স্বপ্নীল একটু হাসার চেষ্টা করলো। শ্রাবণ্যকে এতটা সহজ দেখে ওর নার্ভাসনেস কেটে গেছে। নীলা বলল,

“কী বলেছিলাম তোকে, খুব সুন্দর একটা বউ পাবি! আমার কথা মিলল তো, বড়দের কথা মিথ্যে হয় না।”

স্বপ্নীল শ্রাবণ্যর দিকে তাকালো। শ্রাবণ্য মিষ্টি করে হাসছে। নীলা আরও কিছুক্ষন গল্প করলো। যাবার সময় বলল,

“এই ছেলেটা এমনিতে ভীষণ ভালো বুঝলে। এতো পিওর, ডাউন টু আর্থ! ওর সবকিছুই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করতো। শুধু যেদিন বলল আমাকে ভালোবাসে সেদিন একটা থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করলো। এখন নিশ্চয়ই ভালোবাসার সংজ্ঞা বুঝবে। ”

যাবার সময় স্বপ্নীল কে বলল,

” এই তুই ভীষণ ভালো থাকবি। পরেরবার দেখা হলে আমাকে ট্রিট দিবি কিন্তু। আর এমন বিশ্রী এটিচ্যুড দেখাবি না কিন্তু। ”

নীলা চলে যাবার পর শ্রাবণ্য জিজ্ঞেস করলো,

“ওনার সঙ্গে এমন কেন করলে? ভালো করে দুটো কথাও তো বলতে পারতে?”

স্বপ্নীল চোখ নামিয়ে বলল,

“লজ্জা লাগছিল, ভয়ও। ”

“লজ্জা? ভয়? কেন?”

স্বপ্নীল হাসলো। ওর অমূলক ভয়ের কথা শ্রাবণ্যকে জানালো না। গাঢ় গলায় বলল,

“আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি, শুধু তোমাকেই। ”

শ্রাবণ্য ঠোঁট টিপে হাসলো। একবার বলতে ইচ্ছে করলো, এতবার বলার কী আছে, আমি জানি তো। কিন্তু স্বপ্নীলের সুন্দর অভিব্যক্তি টুকু দেখে আর কিছু বলল না।

***
রঙ্গনাদের সুন্দর ছিমছাম একটা সংসার হলো। রঙ্গনা ভীষণ আনন্দ নিয়ে সংসার সাজাচ্ছে। মিমি, তুলিরাও সঙ্গ দিচ্ছে দারুন। মিশুক সবকিছুতেই রঙ্গনার সাথে আছে, যেমনটা থাকার কথা ছিলো। মাঝেমধ্যে মনে হয় এই মেয়েটাকে পাহাড়ে জঙ্গলে যেমন মানায় তেমনি সংসারেও মানিয়ে গেছে। ভাত, ডাল, মাছের ঝোল রান্নার পারদর্শীতা দেখে আরও একবার মনে মনে বলে, এই মেয়েটা আসলে ঠিক স্পেশালও না। ঠিক যেন ম্যাজিশিয়ান।

***
রাফাতের গল্পটা বোধহয় গতানুগতিক ই থেকে যাবে। রাফাত শহরের নামী রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করছিল মায়ের পছন্দ করা পাত্রী দিয়ার জন্য। এইসব মেয়েদের মা কিভাবে ম্যানেজ করে সেটা ও ধারণা করতে পারে না। মেয়েটা এলো। শাড়ি পরে এসেছে। ভীষণ গর্জিয়াস শাড়িটার দাম সম্পর্কে ওর আইডিয়া না থাকলেও বুঝতে পারলো এটা অনেক দামী। শাড়িটারির ব্যাপার ও যতটুকু জেনেছে সেটা আকাশীর জন্য। দিয়া মেয়েটার কথা বলার ধরনও অন্যরকম। ভীষণ স্মার্ট। মেনিকিওর করা হাত, চকচকে মুখ। তবুও রাফাতের চোখ জুড়োয় না। অতি সাধারণে যে মুগ্ধ হয় তার সম্ভবত গর্জিয়াস অতো পছন্দ হয় না। রাফাত দিয়াকে বলল,

“তোমাকে কিছু কথা জানানো প্রয়োজন। ”

“আমি সব জানি, সব শুনেছি।”

রাফাত বিরক্ত গলায় বলল,

“মায়ের মিথ্যের সঙ্গে আরও কিছু মিথ্যে যুক্ত করে সত্যি বানানো গল্পটা নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেছ।”

দিয়া অত্যন্ত নরম গলায় বলল,

“তোমার মায়ের প্রতি এই অভিমান টুকুও আমি জানি। আমি সব সামলে নেব। ”

রাফাত হাসলো। এই মেয়েটাকে ও স্মার্ট ভেবেছে, ভুল ভেবেছে। স্মার্ট হবার অভিনয়ে এখনো বেশ কাঁচা।

রাফাতের পরের কথাটা ছিলো।

“আমার ব্যাংক, ব্যালেন্স কিচ্ছু নেই। যা ইনকাম সব ইচ্ছেমতো উড়িয়ে খরচ করে দেউলিয়া হই। এতো দামী শাড়ি, জুয়েলারি আমি জীবনেও কিনে দিতে পারব না। ”

মেয়েটা একটুও সময় না নিয়ে জবাব দিলো,

“ইটস ওকে। আমি নিজেও তো ইনকাম করি। নিজের শাড়ি কেনার মতো ক্যপাবিলিটি আমার আছে। ”

রাফাত হেসে বলল,

“তাহলে এবার অর্ডার করা যাক। আজকের বিল টা যেহেতু তুমি পে করবে তাহলে ইচ্ছেমতো অর্ডার করতে পারি তাই তো?”

দিয়া ভ্রু নাচিয়ে বলল,

“শিওর। ”

রাফাত তেমন কিছু অর্ডার করলো না। স্যুপ, পাস্তা আর কফি৷ খাওয়া শেষে বিল টা নিজেই দিলো। দিয়া বলল,

“বিল টা আমার দেয়ার কথা ছিলো তো… ওকে, নেক্সট টাইম। ”

রাফাত প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে বলল,

“নেক্সট টাইম কেন? আমাদের আর কোনো টাইমেই দেখা হবে না। ”

দিয়া ভ্রু কুঁচকে তাকালো। জিজ্ঞাসু চোখে। রাফাত বলল,

“তুমি ঠিক আমার ফ্যামিলি টাইপ দিয়া। কিন্তু আমার টাইপ না। আমি এতটা অভিনয়ে অভ্যস্ত নই। উঁহু আমি অভিনয় জানিনা। ”

“তুমি আমাকে অপমান করছ?”

“সরি। ওকে ফাইন, আমি সবটুকু দোষ নিজের মাথায় নিলাম। আমি তোমার পাশে বেমানান। এতো স্টাইলিশ, এতো স্মার্ট জীবনেও হতে পারব না।”

দিয়ার মুখের কোমলভাব টুকু ফিরে এলো। বলল,

“ওকে আই উইল ম্যানেজ। ”

রাফাত বিরক্ত হলো। এই মেয়েটাকে ওর আর কিছু বলতে ইচ্ছে করলো না। মেয়েটা ওর হাত ধরে বলল,

“সব ঠিক হয়ে যাবে। সব ঠিক করে দেব আমি। ”

“তুমি সেই মানুষ নও। আই এম সরি। ”

****
রাত নয়টার কাছাকাছি৷ আজ আকাশী এতো ব্যস্ত ছিলো। হঠাৎ মনে হলো, বাজার করা দরকার৷ ফ্রিজে তেমন কিছু নেই। চার, পাঁচ দিনের রান্না করে রাখতে হবে। কাঁচা বাজারে গিয়ে কিছু সবজি, মাংস কিনলো৷ আসার সময় স্টেশনারি দোকান থেকেও কিছু জিনিস কিনলো। দুই হাতে দুটো ব্যাগ নিয়ে গেটের কাছাকাছি আসতেই চমকে উঠলো। রাফাত! রাফাত অবশ্য ওর নাম ধরে ডেকেছিল। আকাশী উচ্ছ্বসিত গলায় বলল,

“আপনি? কখন এলেন?”

“তুমি ব্যাগ গুলো রেখে আসবে? আমার এই মুহুর্তে কফি খাওয়া দরকার। ”

“আমার সঙ্গে চলুন। আমি কফি বানিয়ে খাওয়াব। ”

রাফাত বিনাবাক্য ব্যয়ে আকাশীর সঙ্গে গেল। আকাশী তালা খুলে ঘরে ঢোকা অবধি ও চুপচাপ ছিলো। ঘরে ঢুকে এদিক ওদিক তাকালো। আকাশী বলল,

“আফরিনের আসতে লেট হবে। ওর একটা রিসার্চ প্রজেক্টের জন্য ব্যাচমেট দের সঙ্গে থাকতে হবে। ”

বাসায় কেউ নেই সেই কথাটাই বোধহয় বলার জন্য এভাবে বলা। আকাশী সবকিছু বের করে ফ্রিজে গুছিয়ে রাখলো। রাফাত ডাইনিং স্পেস টা দেখছে। এতটুকু বাসাটা কী সুন্দর গুছিয়ে রেখেছে।

আকাশী রাফাত কে দেখে বলল,

“কোথাও গিয়েছিলেন নাকি? সাজগোজ অন্যরকম যে।”

রাফাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

“হ্যাঁ। পাত্রী দেখতে। ”

আকাশীর অভিব্যক্তি টা অন্যরকম হলো। রাফাত দেখতে পেল না। প্রশ্ন করলো,

“বিয়ে কবে?”

“খুব শিগগিরই। ”

“গ্রেট। ”

“তোমার কাছ থেকে শাড়ির ডিজাইন করাব ভাবছি। পারবে না? ডোন্ট ওরি, আমি ডাবল পেমেন্ট করব। ”

আকাশী হেসে ফেলল। বলল,

“ডেট ফিক্সড হয়েছে?”

“হ্যাঁ। মেয়ে আমাকে বিয়ে করার জন্য পাগল। পারলে আজই বিয়ের মালা পরিয়ে দিতো। ”

“বাহ!”

“এটাই হওয়া উচিত তাই না? অথচ রঙ্গনা বলে আমি নাকি বিয়ের জন্য পাত্রী পাব না। ”

আকাশী সেই কথার জবাব দিলো না। কফির মগ টা হাতে দিয়ে বলল,

“বারান্দায় বসবেন? আপনাকে এতো অস্থির লাগছে কেন?”

রাফাত কফির মগে চুমুক দিয়েই মুখ পুড়িয়ে ফেলল। আকাশী বলল,

“কী করছেন? এতো অস্থির কেন হচ্ছেন? ”

“এতো ভালো করে কফি করার কোনো দরকার ছিলো না। আমার ব্ল্যাক কফি দরকার। ”

আকাশী কোমল গলায় বলল,

“আপনি শান্ত হয়ে বসুন তো। ”

রাফাত বসে পড়লো। কফির মগ টা টেবিলে রেখে বলল,

“তোমাকে যে ইমেইল গুলো পাঠিয়েছি সেগুলো তুমি পড়ো নি?”

আকাশী অন্যদিকে তাকিয়ে জবাব দিলো

“পড়েছি। ”

রাফাত বলল,

“আকাশী আমার দিকে তাকাবে প্লিজ। অন্যদিকে তাকিয়ে কথা বলছ আমার তাতে খারাপ লাগছে। ”

আকাশী তাকিয়ে বলল,

“আপনার বিয়ের ডেট টা বললেন না যে?”

“যে মেয়েটার সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে, তাকে আমার পছন্দ হয় নি৷ সে সুন্দর, স্মার্ট। কিন্তু আমার টাইপ না। আমার ফ্যামিলি তাকে পছন্দ করেছে। মেয়েটা আসলে তাদের টাইপ। আমি তাদের মতো না। আমি জীবন কে সহজ ভাবে দেখি। আমি যাকে পছন্দ করি সে একশ তে একজন। তাকে দেখলে অনুপম রায়ের ওই গান টার কথা মনে পড়ে।
‘আমি একলা ক্লান্ত ঘুড়ি, যে আমাকে বাসবে ভালো তার আকাশে উড়ি৷’

আমি সেই মানুষটার আকাশে উড়তে চাই।

আকাশী চুপ করে রইলো। কফির মগ টা স্থির হয়ে আছে দুই হাতের মাঝখানে। রাফাত তাকিয়ে আছে গভীর চোখে। আকাশী চোখ ফিরিয়ে নিতে চায় পারে না। রাফাত গভীর গলায় বলে,

“এখানে আসার আগে আমি শ্রাবণ্য কে ফোন করেছি। ওরা বিয়ের সব আয়োজন করে ফেলবে। তোমার বাবা, মা’কে ম্যানেজ করার দায়িত্বও ওর। তুমি কিছু বলো। ”

আকাশী যা বলতে চায় সব গুলিয়ে যায়। কোনোভাবে বলে,

“আপনি এখন আসুন। ”

“এটাই তোমার উত্তর? ”

“হ্যাঁ। ”

“আর আসব না?”

এই প্রশ্নটার জবাব দিতে আকাশী সময় নেয়। বলে,

“কাল তৈরী হয়ে থাকব। ক’টার সময় আসবেন আপনি? ”

রাফাত ঝড়ের গতিতে এগিয়ে এসে আকাশীর কপালে চুমু খেল। অনেকটা সময় নিয়ে। আকাশী যখন ওর চোখের দিকে তাকালো তখন দেখলো চোখভর্তি জল।

সমাপ্ত….

কুসুম কাঁটা পর্ব-৩৬+৩৭

0

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-৩৬ ও ৩৭
তুলি নিজের ঘরে চলে গেল। যাবার আগে শান্ত গলায় বলল,

“আমি ঘরে যাচ্ছি। খাবার সময় ডেকো প্লিজ। আর আজ আমি আকাশীর সঙ্গে থাকব। ”

তৌহিদ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলো না। সবার আগে ও গেল রঙ্গনার কাছে। বলল,

“এই রঙ্গনা, ও কী বলে গেল এসব? ওর কী আসলেই মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ”

রঙ্গনা তৌহিদ কে শান্ত করার চেষ্টা করলো। স্বপ্নীল ছুটে গেল পানি আনতে। রঙ্গনা বলল,

“আপনি মাথা ঠান্ডা করুন। এতো প্যানিক করবেন না প্লিজ।”

দাদু গম্ভীর গলায় বললেন,

“তুলি যে সিদ্ধান্ত নিবে সেটাই সই। এর বাইরে আর কোনো কথা হবে না। ”

তৌহিদ হতভম্ব চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলো। শিলা রিন্টি, মন্টিকে নিয়ে ঘরের দিকে গেল। বড়দের এমন নিষ্ঠুর আচরণ দেখে তৌহিদ বিকট শব্দ করে কাঁদতে লাগলো। স্বপ্নীল পানি নিয়ে এলো বালতিতে করে। যে অবস্থা তাতে দুলাভাই অজ্ঞান হয়ে পড়বে কিছুক্ষনের মধ্যে। রঙ্গনা তৌহিদ কে সামলানোর চেষ্টা করছে। দাদী এমনিতে নাতজামাইদের সামনে ভীষণ লাজুক তবে এখন তিনি এসে তৌহিদের পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রঙ্গনা বেশ কয়েকবার বলল,

“আমরা আছি তো, সব ঠিক হয়ে যাবে। ”

তৌহিদের কান্নাকাটি পর্ব আরও চলল কিছুক্ষন। ঘরের দরজা আটকে কাঁদতে গেল কিন্তু সেটা ওরা হতে দিলো না,স্বপ্নীল সঙ্গেই থাকলো। বেচারা যদি একটা কিছু অঘটন ঘটিয়ে ফেলে।

রাতে খাওয়া দাওয়ার আয়োজনেও ভাটা পড়লো। একটা মানুষ কাঁদছে আর সবাই এভাবে খাবে ব্যাপার টা খারাপ দেখায়। বারবিকিউ ঠান্ডা হয়ে যাবে ভেবে সবাই খেতে গেল। শ্রাবণ্য মিশুক কে বলল,

“সবকিছু কেমন একটু অন্যরকম লাগছে না? আমি ব্যাপার টা সিরিয়াসলি নিতে পারছি না আসলে। ”

মিশুকও ব্যাপার টা ভেবেছে। বড়রা এই ব্যাপারটায় নির্লিপ্ত থাকছে বলে দুশ্চিন্তা একটু বেশী হচ্ছে। মিশুক শ্রাবণ্য কে বলল,

“ডিভোর্স পেপার টা আমি দেখলাম তো। ওটা সত্যি। ”

শ্রাবণ্য পরোটার টুকরো মুখে দিতে দিতে বলল,

“আপনার বউয়ের পেট থেকে কথা বের করুন তো। আমার কেমন যেন সন্দেহ লাগছে সবকিছু। স্বপ্নীল ছাড়া বাকীদের আচরণ একটু অন্যরকম। ”

মিশুক হেসে বলল,

“আমাদের আচরণও তো অন্যরকম। আমরা রিলাক্স ম্যুডে খাচ্ছি। ”

ঘুমানোর সময় হয়ে গেল বলে সবাই যার যার ঘরে চলে গেল। এমনিতেই সারাদিন ঘুরেফিরে সবাই ক্লান্ত। কিন্তু সমস্যা হলো তৌহিদের চিৎকার করে কাঁদার ব্যাপার টা থামার পরিবর্তে আরও বাড়তে লাগলো। সেই সঙ্গে আহাজারি, কেউ ওর কষ্ট বুঝছে না।

স্বপ্নীল যখন বেরিয়ে এলো তখন ও রীতিমতো ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত। বেরিয়ে এসে শ্রাবণ্যকে বলল,

“ছোটপা কে গিয়ে বলো মিশুক ভাইয়া কে পাঠাতে। ওনাকে সামলানো আর পাগলা গরু সামলানো একই কথা। আমি পারব না।”

শ্রাবণ্য এই সিরিয়াস সময়েও হেসে ফেলল। আগে স্বপ্নীলকে দাদু গরু বলতো, আর এখন ও অন্য একজন কে বলছে। স্বপ্নীলও হেসে ফেলল। নত মুখে লাজুক গলায় বলল,

“তাছাড়া আমি ওনার সঙ্গে ঘুমুতে পারব না। আমার ঘুম হবে না। আমি তোমাকে ছাড়া ঘুমাতে পারি না।”

শেষ বাক্যটা বলল ছোট করে। শ্রাবণ্য শুনতে পেল। রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়লো মুখমন্ডলে। শ্রাবণ্য জিজ্ঞেস করলো,

“যখন আমি ছিলাম না?”

স্বপ্নীল চোখ তুলে তাকালো। বলল,

“আমি তো ভালো করে ঘুমাতে পারিনি। দিতি আপাকে ফোন করো, আপা প্রতিদিন ই বলতো আমার চোখ লাল, আমার ঘুমের বারোটা বেজে গেছে শরীর খারাপ করবে। ”

শ্রাবণ্য হাসলো শব্দ করে।

আজ রাতেও ওদের ঘুমের জায়গার ব্যতিক্রম হলো। শ্রাবণ্য শুয়ে পড়লো আগে, স্বপ্নীল এক হাত দূরত্বে। দুজনের যখন চোখাচোখি হলো তখন স্বপ্নীল অপ্রস্তুত হাসি হেসে বলল,

“অভ্যাস হয়ে গেলে ঠিক হয়ে যাবে তাই না! পাশাপাশি কদিন ঘুমালে ঠিক হয়ে যাবে। ”

শ্রাবণ্য মিষ্টি হেসে পাশ ফিরলো। স্বপ্নীল বলল,

“তোমার যদি হাত, পা ছোড়ার অভ্যাস থাকে, তাতে কিন্তু আমার সমস্যা নেই। ”

শ্রাবণ্য নি:শব্দে হেসে বলল,

“আমার হাত পা ছোড়ার অভ্যাস নেই। ”

মাঝরাতে শ্রাবণ্য আবিষ্কার করলো স্বপ্নীল ওর গায়ে একটা হাত রেখেছে। দূরত্ব আগের মতোই একই, একহাত সমান। শ্রাবণ্য আরেকটু এগিয়ে এলো। এগিয়ে আসার ব্যাপার টা স্বপ্নীল তো কম করলো না, বাকীটুকু নাহয় ও করলো।

***
তুলি শুয়েছে আকাশীর সঙ্গে। কিন্তু একেকবার তৌহিদের কান্নার শব্দে ঘুম টা চটে যাচ্ছে। তুলিকে অস্থির হয়ে এপাশ ওপাশ করতে দেখে আকাশীও ঘুমাতে পারলো না। তুলি বলল,

“কী করা যায় বলো তো? ঘুমানো তো মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। ”

“কানে হেডফোন গুজে গান শোনো আপু। ”

আকাশীর একবার অন্যকিছু বলতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু থেমে গেল। কিছু ব্যাপার একান্ত ব্যক্তিগত। সেখানে ওর কিছু বলা অনুচিত।

তুলি বলল,

“ভালো কমেডি মুভি সাজেস্ট করো তো। আমার ঘুম চটে গেছে। ”

আকাশী নিজেও উঠে বসলো। রিভিউ দেখে মুভি দেখতে বসলো। আকাশী চা করে নিয়ে এলো, ঘরে কুকিজ ছিলো কিছু। সবকিছু ভুলে ওরা মুভিতে মনোযোগ দিলো।

***
রিন্টি, মন্টি দুজনের ই মন খারাপ। আজকে ওদের বাবার জন্য ভীষণ খারাপ করেছে। খ্যাপাটে, পাগল বাবাকে ওদের একটু অপছন্দ হলেও দু:খী বাবাকে ওদের একদম ভালো লাগে নি। তার উপর একটা নতুন শব্দ শুনেছে। ডিভোর্স! এই শব্দটার সঙ্গে পরিচিত নয়। নিশ্চয়ই পঁচা একটা ওয়ার্ড নাহলে বাবা ওরকম কাঁদবে কেন! দুই বোন মিলে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলো ওরা বাবার সঙ্গে বিদেশে যাবে। মা ওদের ছাড়া থাকতে পারবে না। ওরা গেলে মাও যাবে, তাহলে দুজনের আর ঝগড়া থাকবে না।

***
মিশুক রঙ্গনাকে বলল,

“আমাকে ব্যাপার টা বুঝিয়ে বলো তো?”

রঙ্গনা হ্যান্ডক্রিম মাখছিল। মিশুক কে এক পলক দেখে বলল,

“কী?”

“কী চলছে তোমার মাথায়? ”

“অনেক কিছু। ”

“তুলি আপু আর ভাইয়ার বিষয় টা আগে থেকে তোমরা জানতে? মানে তোমাদের এক্সপ্রেশন দেখে আমার কেমন যেন লাগছিল। ”

“হ্যাঁ জানতাম। ”

মিশুক রঙ্গনার হাত ধরে নিজের দিকে টেনে বলল,

“এখানে কী সেজন্য এসেছ?”

রঙ্গনা অন্যদিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে বলল,

“হতে পারে। ”

মিশুক চোখ কপালে তুলে বলল,

“কী ভয়ংকর! এখানে এসে একটা মানুষ কে এভাবে শায়েস্তা করছ!”

রঙ্গনা বলল,

“শায়েস্তা, টায়েস্তা কিছু না। তার আসলে একটা শিক্ষার দরকার। অনেক দিন ধরেই সে এরকম। কোথায় কী বলতে হয় এটা সে বুঝেও ইচ্ছে করে ঝামেলা করে। আমরা ভাবছিলাম ব্যাপার টা আস্তেধীরে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ঠিক হবার নাম নেই। তাই একটা ছোটখাট শক দেয়া। ”

মিশুক শুয়ে পড়লো। রঙ্গনাকে নিজের কাছে টেনে এনে বলল,

“এরকম ভয়ংকর প্ল্যান তোমার কাছেই আশা করা যায়, সিরিয়াসলি। ”

রঙ্গনা মিষ্টি হেসে বলল,

“থ্যাংক ইউ। ”

মিশুক দুহাতে চেপে ধরলো রঙ্গনার গাল। রঙ্গনার নি:শ্বাস ভারী হতে শুরু করলো। মিশুক ফিসফিস করে বলল,

“তুমি কী জানো, তুমি অনেক স্পেশাল ”

রঙ্গনা মিশুকের চোখে চোখ রেখে বলল,

“হ্যাঁ জানি। ”

মিশুক হাসলো। আরেকটু এগিয়ে এসে ঠোঁটজোড়া ধখল করে নিলো। রঙ্গনা এক হাতে মিশুকের চুল খামচে ধরলো।

****
আরেকটি সুন্দর সকাল শুরু হলো। এই সকাল টা অবশ্য তৌহিদের কাছে বিশ্রী রকম অসুন্দর। কাল রাতে ওর হঠাৎ মনে হয়েছিল তুলি ওর সাথে প্রাঙ্ক করছিল। কিন্তু মাঝরাতে তুলির ঘরের সামনে কান পেতে শুনলো হাসির শব্দ । কিছু একটা হাসির জিনিস দেখছিল। আবার কিচেনে এসে চা নিয়ে গেল। এসব তো মিথ্যে হতে পারে না। তৌহিদ পুরো ব্যাপার টায় হতভম্ব। যতটা দু:খ পেয়েছে তার চেয়ে বেশী এটেনশন পাওয়ার চেষ্টা করেছে। স্বপ্নীলও একসময় বিরক্ত হয়ে চলে গেল। অন্যরা কেউ তেমন এটেনশন দেয় নি। রঙ্গনাকে ধরতে হবে। এই মেয়েটাই পারে একটা ব্যবস্থা করতে।

শিলা এসে তৌহিদ কে বলল,

“খেতে চলো তৌহিদ। ”

তৌহিদ অসহায় গলায় বলল,

“আপনার কী মনে হয় আমি খাওয়ার অবস্থায় আছি আসলেই?”

শিলা বললেন,

“কাল রাতে খাও নি। এসো খাবে। খাবার পর তোমার কথা শুনব। ”

তৌহিদ আর কথা বাড়ালো না। খেতে বসলো। এদের সাথে আর তর্ক করা যাবে না। এরা চাইলে ওর সংসার টা বাঁচতে পারে।

খাবার সময় তুলি একবারও তৌহিদের দিকে তাকালো না। তৌহিদ তাকিয়েছে বেশ কয়েকবার।

খাওয়া দাওয়া শেষে একঘরে সবাই একত্রিত হলো। দাদু শিলার উদ্দেশ্যে বললেন,

“বৌমা তুমি কথা বলো। আমি তো আগেই আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছিলাম। তুলি যা চাইবে তাই হবে। ”

শিলা তুলিকে বললেন,

“তুমি এই সিদ্ধান্ত ভেবেচিন্তে নিয়েছ?”

তুলি নির্লিপ্ত গলায় বলল,

“হ্যাঁ। ”

তৌহিদ অধৈর্য্য গলায় বলল,

“তুমি একা একা এতবড় সিদ্ধান্ত নিতে পারো না…. আমার ডিসিশন ছাড়া…

শিলা তৌহিদ কে প্রায় ধমকের সুরে বলল,

“তুমি চুপ করো। আর ও’কে কেন সবসময় তোমার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে? অর্থনৈতিক ভাবে তোমার উপর ডিপেন্ডেন্ট বলে! তোমার কী মনে হয় ওর নিজের কিছু করার যোগ্যতা নেই?”

তৌহিদ অসহায় গলায় বলল,

“আমি তো সেরকম কিছু বলিনি মা। আমি তো যা কিছু করি সব ওদের জন্যই করি। ”

“এই ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তুমি দিনরাত এটা শোনাও যে তুমি অনেক কিছু করো, তুলি কী কিছু করছে না। মেয়েদের দেখাশোনার দায়িত্ব কী শুধু ওর? সেটা নিয়ে ও কখনো কিছু বলেছে?”

তৌহিদ চুপ করে রইলো। তুলি বলল,

“কোথায় কী বলতে হয়, কাকে কী বলছ এগুলো তুমি আসলেই বোঝো না, নাকি বুঝতে চাও না এটা জানিনা। কিন্তু আমার খারাপ লাগে। তুমি যেমন আমার হাজবেন্ড তেমনি বাকীরাও আমার আপনজন। রঙ্গনাকে কাল যা বলেছ তাতে ও যতটা হার্ট হয়েছে তারচেয়ে বেশি আমি হয়েছি। আমার এসব ভালো লাগে না। কাউকে আমি বদলাতে চাই না, আর যদি প্রাপ্তবয়স্ক একজন নিজেকে বদলাতে না চায় তাকে নিয়ে আর এক্সপেক্টেশন রাখা ঠিক না। ”

তৌহিদ প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,

“আই এম সরি রঙ্গনা। আসলে আমি বুঝতে পারি নি…

তৌহিদ কে কথা শেষ করতে না দিয়ে তুলি বলল,

“তুমি সব বোঝো। ”

রঙ্গনা দুজনের হতে যাওয়া ঝগড়া থামিয়ে দিয়ে বলল,

“ইটস ওকে। আমিও আসলে দু:খিত। আমিও ভাইয়াকে অতো সিরিয়াসলি নেই না। ”

রঙ্গনার স্বীকারোক্তি শুনে মিশুক হাসিটা আড়াল করলো।

শিলা বললেন,

“তৌহিদ তুমি কী মন থেকে সরি ফিল করছ? তুলি কে বলতে চাও?”

তৌহিদ দাঁড়িয়ে উঠে বলল,

“আই এম সরি। আমি কথা দিচ্ছি, বেস্ট হাজবেন্ড হয়ে দেখাব। তুমি যা বলবে তাই শুনব। সব শুনব। ”

শিলা তুলির দিকে তাকালেন উত্তরের আশায়। বাকীরাও তাকিয়ে আছে। তুলি একটু সময় নিয়ে বলল,

“ভালো হাজবেন্ড হবার আগে ভালো মানুষ হওয়া জরুরী। ”

তৌহিদ সহ বাকীরা কেউ ই কিছু বললেন না। দাদু এতক্ষন চুপ ছিলেন। এবার বললেন,

“তোমরা বাবা, মা নিজেদের ব্যাপার ভাবার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের কথাও ভাববে। ”

তৌহিদ কথা দিলো ও এবার সত্যিই পালটে যাবে। অকারণে মেজাজ খারাপ করবে না, কাউকে ছোট করেও কিছু বলবে না।

রিন্টি, মন্টি মিমি আর আকাশীর সঙ্গে ছাদে ছিলো। ফ্যামিলি মিটিংয়ে ওরা থাকে নি। ছাদ থেকে আসার পর মন্টি বলল,

“বাবা চিন্তা কোরোনা, আমরা তোমার সঙ্গে যাব। মা তো আমাদের ছাড়া থাকতে পারে না তাই মাও কাঁদতে কাঁদতে ঠিক চলে যাবে। ”

তৌহিদের মন আদ্র হলো। মেয়েদের বুকের সঙ্গে জড়িয়ে রাখলো অনেকক্ষন। আরেকটুর জন্য সবকিছু হারাতে বসেছিল।

***
পাথর বাড়িতে আজকেই শেষ রাত। আজ আবার আয়োজন করা হলো। সবাই মিলে বিরিয়ানির আয়োজন করলো। শিলা রান্নার দায়িত্ব নিলো। স্বপ্নীল রঙ্গনাকে জানালো কালকের খেলা বুবুর জন্য নষ্ট হয়েছে আমরা অংশগ্রহণ করতে পারিনি। রঙ্গনা আবার খেলা শুরু করলো। দাদু, দাদী নেই, তিনি বিরিয়ানি রান্নার ওখানে আছেন। স্থানীয় একজন কে পেয়েছেন তার সঙ্গে গল্প শুরু করেছে৷ খেলার নিয়ম অনুযায়ী লটারিতে নাম পড়লো এবার শ্রাবণ্যর। শ্রাবণ্যকে একটু নার্ভাস দেখালো। রঙ্গনা বলল,

“যেটা শুনলে স্বপ্নীলের মন খারাপ হবে সেটা বলার দরকার নেই। তোমার জীবনের কোনো ভালো গল্পও বলতে পারো। ”

তৌহিদ আজ রসিকতার ম্যুডে আছে। বলল,

“স্বপ্নীল কে নিয়ে দুটো রোমান্টিক কথা বলতে পারো। ও খুশি হবে, আমরাও আনন্দ পাব।”

শ্রাবণ্যকে তবুও নার্ভাস দেখাচ্ছে। আকাশীও তাকিয়ে আছে বোনের দিকে। শ্রাবণ্য বুদ্ধিমতি মেয়ে। তবুও আকাশী সবসময় খেয়াল করতো বোন কে। এই বাড়িতে ও ভালোই ছিলো বলে মনে হয়েছে। ওর জীবনে এমন কী সিক্রেট থাকতে পারে যেটা বলতে গিয়ে অপ্রস্তুত হচ্ছে।

শ্রাবণ্য গভীর নি:শ্বাস নিয়ে বলল,

“আমার জীবনে আসলে কোনো গল্প নেই। মানুষ হিসেবে বাড়িতে আমাকে কখনো দেখেনি৷ বাবা, মা আমাকে দেখেছে মেয়ে হিসেবে। আপুর চলে যাবার পর তারাও ভেবেছে আমি ওই পথে যাবে। বেশ একটা চাপের জীবন গেছে। আমার আসলে একটা না, বেশ কয়েকটা সিক্রেট আছে। আমি ছোট আপুকে ভীষণ হিংসে করি, হিংসা না ঠিক ঈর্ষা। তাকে দেখে ভাবতাম ইশ আমারও এমন একটা ঘুরে বেড়ানো জীবন হতো! হাল ফ্যাশনের জামা কাপড় গুলো যদি আমিও পরতে পারতাম। ”

সবাই চুপচাপ। তুলি প্রথমে মুখ খুলল। বলল,

“আমাদের বাড়িতে সবার স্বাধীনতা সমান শ্রাবণ্য। মা তো বলেছে তুমি যা খুশি তাই করতে পারবে৷ তোমার যা ভালো লাগবে তাই পরবে।”

স্বপ্নীল তাকিয়ে আছে অপলক চোখে। ওর সব অভিমান, দু:খের গল্প যার কাছে জমা হয় তার অভিমান, দু:খের খবর তো ও কখনো নেয় নি৷

শ্রাবণ্য এবার সহজ। বলল,

“জানি, এই বাড়িতে যে আদর সম্মান, ভালোবাসা পাচ্ছি তা কখনো পাই নি। এমনকি স্বপ্নেও ভাবিনি। আমি সবসময় স্বপ্ন দেখতাম আমার যে পার্টনার হবে সে হিরোর মতো হবে। একদিন জয় করে আমাকে নিয়ে যাবে।

স্বপ্নীল মাথানিচু করলো। শ্রাবণ্য বলল,

“স্বপ্নে দেখা হিরোর সন্ধান আমি পাই নি ঠিক ই৷ তবে আমার জীবনে যে সহজ সাধারণ হয়ে এসেছে সে হিরোকে টেক্কা দিতে পারবে। ”

স্বপ্নীল চোখ তুলে তাকালো। সবার মুখ হাসি, হাসি। রঙ্গনা বলল,

“একদম ঠিক। তবে সে কিন্তু আজকাল হিরো হয়ে যাচ্ছে শ্রাবণ্য। কথায় কথায় ফ্যাচ ফ্যাচ করে না কাঁদলে পুরোপুরি হিরো হয়ে যাবে।”

শ্রাবণ্য আবার নার্ভাস হয়ে গেল। কপাল, মুখ ঘামছে। চোখ ছলছল করছে। স্বপ্নীলের উদ্দেশ্যে বলল,

“স্বপ্নীল তুমি যেমন আছ, তেমনই থাকো। বেশী জটিল হওয়ার দরকার নেই। শুধু কেউ পিষে ফেলতে চাইলে শক্ত হলেই হবে। তুমি যেমন, তেমন তোমাকেই আমি ভালোবাসি। ”

সবাই একসঙ্গে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলো। তুলি স্বপ্নীলের পিঠে হাত রাখলো। স্বপ্নীলের চোখে মুগ্ধতা। খুব খুশি হলে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না তেমন অনুভূতি।

মিশুক স্বপ্নীলের হাত ধরে বলল,

“শ্রাবণ্যকে যা বলতে চাও বলে ফেলো। ”

স্বপ্নীল অনেক কিছু সাজিয়েছে মনে মনে। সেসব ভুলে গেল। কী বলবে ও! ভেবেছিল নীলা ওর জীবনে প্রথম ভালোবাসা। স্বপ্নীল তো আসলে প্রেম, ভালোবাসা বুঝতোও না। নীলা একমাত্র বাইরের মানুষ ছিলো যে ও’কে বোকা, গাধা ভাবতো না। ও যখন আবোলতাবোল, হাবিজাবি কথাবার্তা বলতো নীলা মনোযোগ দিয়ে শুনতো। এমন গুরুত্ব কেউ ও’কে দেয় নি। কোনো মেয়েও না। এইটাকে ও ভালোবাসা ভেবে নিলো। কিন্তু ভালোবাসা তো শিখিয়েছে শ্রাবণ্য। অনেকবার ও শ্রাবণ্যকে বলতে চেয়েছিল যে তুমি নীলার মতো। কিন্তু না, শ্রাবণ্য নীলার মতো না। নীলার থেকে ভালো। ওর দূর্বলতা নিয়ে কখনো মজা করে নি। অদৃশ্য হাতে সোজা, ভঙ্গুর পথ চিনিয়েছে৷ স্বপ্নীল আদ্র কন্ঠে বলল,

“মা আমাকে যে সুন্দর পরীর গল্প বলতো। তুমি সেই সুন্দর পরীর থেকেও সুন্দর। আমি তোমাকে পাহাড়, জঙ্গল সব জায়গায় নিয়ে যাব। তুমি শুধু আমার হাত ধরে থেকো। পথ হারিয়ে যেতে দেব না কোথাও। ”

চলবে….