Saturday, July 19, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 219



কুসুম কাঁটা পর্ব-৩৪+৩৫

0

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-৩৪ ও ৩৫
রঙ্গনার এই ঘুরতে যাবার প্ল্যানে সবাই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অংশগ্রহন করলো। কোথায় যাবে সেটা কাউকে জানানো হলো না। ওটাকে সারপ্রাইজ প্ল্যান হিসেবে সিক্রেট রাখা হলো। একেকজন একেক রকম ভেবে নিলো। তৌহিদ ভাবলো কক্সবাজার হবে হয়তো। এখন যে আবহাওয়া তাতে কক্সবাজার বেটার প্লেস। তাছাড়া তুলির ভীষণ পছন্দের জায়গা। ওদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকীতে তুলি আদুরে গলায় তৌহিদ কে বলেছিল,

“এই আমরা এখানে থাকতে পারি না, একটা বাসা ভাড়া করে!”

তৌহিদ হো হো করে হেসে উঠে বলেছিল, চাকরি বাকরি বাদ দিয়ে এখানে থেকে কী করব? বীচে ঝালমুড়ি বেঁচব নাকি ডাব বেঁচব!

তুলি বেচারি অভিমানে আর কিছু বললও না। ততদিনে অবশ্য ও টের পেয়ে গেছিল যে লোকটা বোরিং এর চেয়েও কঠিন কিছু।

এদিকে স্বপ্নীল ভেবেছে পাহাড় টাইপ কোথাও যাবে। অনলাইনে বেশ কিছু জুতাও দেখেশুনে কিনলো। পাহাড়ের চূড়ায় উঠে শ্রাবণ্যকে সেই বিশেষ কথাটা বলবে! দারুন মোমেন্ট ক্রিয়েট হবে। একটা জাপানিজ ফিল্মে দেখেছিল।

অন্যরা অবশ্য এমন কিছু এক্সপেক্ট করে নি। তবুও তাদের ধারনায় ছিলো সুন্দর কোনো জায়গা হবে। কিন্তু সকলের ধারণা পাল্টে গেল নির্ধারিত জায়গায় গিয়ে।

রঙ্গনা সবাইকে নিয়ে একটা গ্রামের দিকে গেল। মূল শহর থেকে বেশ দূরে। অনেকের ই মোবাইল নেটওয়ার্কের অবস্থা যাচ্ছেতাই! তৌহিদ রেগে গিয়ে বলল,

“এই মাথাপাগলা মেয়েটার কথায় আসাই ভুল হয়েছে। ”

তুলি নির্লিপ্ত গলায় বলল,

“তুমি ফিরে যাও। আমি খোঁজ নিয়ে আসি যে লোকাল ট্রেন ক’টায় যায়। ”

তৌহিদ হা করে তাকিয়ে রইলো। শক্ত কিছু কথা মুখ দিয়ে বের করবার আগেই তুলি অন্যদিকে গেল।

ওরা এখন যে বাজারে আছে সেই বাজারের নাম মথুরাপুর। এখান থেকেই গাড়িতে উঠবে। কিছুক্ষনের মধ্যেই গাড়ি এসে যাবে। বাকীরা কেউই তেমন বিচলিত না। দুপুরের সময় দোকানপাট বন্ধ বলে বাজারে লোকজন কম। সবাই বিশ্রাম নিচ্ছে। তৌহিদ একটু বেশি উত্তেজিত। তুলির কথায় সে রীতিমতো দু:খী। শাশুড়ীর কাছে এসে নালিশ করেছে। শিলা হাসিমুখে নালিশ শুনলো, কিছু বলল না। তৌহিদ এই ব্যাপারেও একটু দু:খ পেল অবশ্য। মায়ের উচিত ছিলো তুলিকে ডেকে একটু কঠিন গলায় কিছু কথা বলা। তুলিকে দেখা গেল রঙ্গনার বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছে।

মিশুক কে দেখেও তৌহিদের মেজাজ খারাপ হলো। এই ব্যটা সবকিছুতে বউকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। অবশ্য দিবে না কেন নতুন বউ বলে কথা! তাই বলে বন, জঙ্গলে নিয়ে এলো সবাই কে সেটা নিয়েও কিছু বলবে না! স্ট্রেঞ্জ! অবশ্য ও নিজেও মনে হয় আগে থেকে জানতো। ও’কে তো একটুও অধৈর্য্য লাগছে না! রিন্টি, মন্টির সাথে খুব হাসছে৷

দেখা গেল তৌহিদের রাগ ঘুরেঘুরে সবার উপরেই পড়ছে। দাদী সুন্দর করে সেজেগুজে আসছে। একটা ম্যাজেন্টা রঙের জামদানী পরনে। এই শাড়িটা পরে রংঢং দেখতেও ওর বিরক্ত লাগছে। এই বুড়াবুড়ির তো আসার দরকার ই ছিলো না!

দাদু একজন লোক পেয়েছেন৷ তার সঙ্গে গল্প জুড়েছেন। ব্রিটিশ আমলের গল্প শুরু করেছেন, সময় পেলে সম্ভবত সাতচল্লিশ এর দেশভাগ, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গনঅভুত্থান সবকিছু নিয়েই আলোচনা করবেন।

তৌহিদ ছাড়া আরেকজন মানুষ একদম ভেঙেচুরে মুষড়ে পড়েছে। সেটা হলো স্বপ্নীল। ওর মেজাজের প্রথম নমুনা দেখালো আকাশীর সঙ্গে। আকাশী শ্রাবণ্যর পাশে বসে ছিলো। ওখানে গিয়ে বলল,

“আকাশী তুমি ওখান থেকে ওঠো। আমি বসব। ”

আকাশী হেসে ফেলল। শ্রাবণ্য অপ্রস্তুত হলো। আকাশী বলল,

“আচ্ছা আপনি বসুন। ”

রেহানাও এসেছে। তারও খারাপ লাগছে। গ্রাম কী দেখার মতো কিছু! সেই তো কিছু গাছপালা, ফ্যা ফ্যা বাতাসের শব্দ! তবে রেহানার এখান থেকে ফিরে যাবার ইচ্ছে। সে বাহানা খুঁজতেছে। ফাঁক পেয়ে এখান থেকে কেটে পড়বে।

গাড়ি এলো কিছুক্ষনের মধ্যেই। গাড়ি বলতে অটো টাইপের, কিন্তু সাইজে বড়। তিনটা গাড়ি সবাইকে নিয়ে রওনা হলো পাথর বাড়ির উদ্দেশ্যে। এখানকার বিখ্যাত জায়গা পাথর বাড়ি। রঙ্গনা এর আগে একবার এসেছিল ঘুরতে, জায়গাটা এতো পছন্দ হয়েছিল!

***
সত্যি সত্যি ই পাথর বাড়ি সবার পছন্দ হলো। সামনে গাছপালায় ঘেরা, মাঝখানে বাড়ি। পেছনে বড় পুকুর। বাড়ির মালিক অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। ফ্যামিলি সহ ছুটি কাটাতে আসবেন বলে বন জঙ্গলে অত্যন্ত যত্ন করে বাড়ি বানিয়েছিলেন। কিন্তু একবারও সুযোগ হয় নি। এখন ট্যুরিস্ট রাই আসে তাই।

অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই সবাই নিজেকে গুছিয়ে নিলো। দুপুরের খাবার খেতে খেতে বিকেল হয়ে গেল। খাবার দাবারের আয়োজন সাদামাটা। পাবদা মাছ বাটা মশলায় পাতলা ঝোলে রান্না, চিংড়ি ভাপা, আলুভাজি, পাতলা ডাল। খাবারের আয়োজন দেখে নাক শিটকানো তৌহিদ প্লেট উঁচু করে ভাত নিলো দু’বার।

***
একদিন পরেই সবার এখানে ভালো লাগতে শুরু করলো। স্বপ্নীলেরও মন ভালো হয়ে গেল। এভাবে এতো ভালো করে গ্রামীণ সৌন্দর্য দেখা প্রথমবার। ওদের গ্রামে কোনো আত্মীয় স্বজন নেই। নানুর বাড়িও শহরের দিকে ছিলো। তৌহিদ সবকিছু তে বিরক্ত ভাব প্রকাশ করলেও সবচেয়ে বেশি উপভোগ সে করছে। পুকুরে গোসল করছে, বড়শি দিয়ে মাছ ধরার আয়োজন করছে। গোটা সাতেক পুঁটি মাছ ধরে সেগুলো ভাজার আয়োজন করলো।

রঙ্গনা এখানে এসে একদম ঘুমিয়ে সময় কাটাচ্ছে। মিশুক বলল,

“সবাইকে নিয়ে ঘুরতে এসে শেষমেস তুমি নিজেই দেখি শুয়ে, ঘুমিয়ে কাটাচ্ছ? ব্যাপার কী বলো তো? ”

রঙ্গনা নির্লিপ্ত গলায় বলল,

“কোনো ব্যাপার নেই। আমি এখানে এর আগেও এসেছি। আলাদা করে তাই কিছুই মুগ্ধ করছে না। ”

মিশুক বুঝলো রঙ্গনার মাথায় অন্য কোনো প্ল্যান চলছে। সবাইকে এক করে নিয়ে আসার পেছনে নিশ্চয়ই অন্য উদ্দেশ্য আছে। ওর বাবা, মা, আপু আজ আসবে। এরপর আর কেউ বাকী আছে কিনা কে জানে!

মিশুক কে গভীর মনোযোগী দেখে রঙ্গনা বলল,

“তুমি কী ভাবছ? আমার মাথায় অন্য প্ল্যান আছে? আরে না, এমনিই সবাইকে ঘুরাতে ইচ্ছে করলো। পিকনিক, পিকনিক ভাইব দরকার ছিলো। পশ কোনো জায়গায় এমন ভাব পাওয়া যেত না। ”

মিশুক হাসলো। তবে রঙ্গনার কথা সত্যি। গাছপালা, মাটির গন্ধে যে স্নিগ্ধতা আছে সেটা পাহাড়, সমুদ্রে গেলে পাওয়া যেত না।

রেহানার একদিন যেতেই শিলাকে বলল,

“আমাকে ফিরতে হবে, বাড়িতে হাজার টা ঝামেলা। তার উপর শিউলির শরীরও ভালো না। ”

শিলা মাথা নেড়ে হাসিমুখে সায় দিলেন। এতদূরের পথ একা যেতে অস্বস্তি হচ্ছিলো বলে আকাশীকে নিয়ে যেতে চাইলেন। আকাশী স্বাভাবিক গলায় বলল,

“আমিও এখানে বেড়াতে এসেছি মা। আমি যাব না। ”

রেহানা রাগ দেখাতে পারলেন না। অগত্যা একাই রওনা হয়ে গেল যাবার জন্য।

***
রাতে বারবিকিউ পার্টির আয়োজন হলো। সেই সঙ্গে জম্পেশ আড্ডা। রঙ্গনা হঠাৎ দাঁড়িয়ে বলল,

“আমি সবার উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চাই?”

সবাই এদিক ওদিক ছড়িয়ে বসেছিল। রঙ্গনার বলার ধরনে ওর দিকে তাকালো। দাদু বললেন,

“কোনো খারাপ সংবাদ হলে চুপচাপ বসে পড়। এখন না।”

তৌহিদ বলল,

“ওয়াও রঙ্গনা, তোমাকে কেমন লিডার লিডার লাগছে। হাতে একটা মাইক থাকলে ভালো হতো। ”

রঙ্গনা বলল,

“পরের বছর এই সময় টায় বুবু আমাদের সঙ্গে থাকবে না। রিন্টি, মন্টিও না। এই সময় টা আমাদের খুব ই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চাই বুবু যেটুকু সময় আমাদের সঙ্গে আছে আনন্দে থাকুক। ”

সবাই সায় দিলো। রিন্টি মাঝখানে বলল,

“আমরা কিন্তু যাব না। আমরা মনির সঙ্গে থাকব। প্লেনে চড়ার ইচ্ছা আমাদের আর নাই। তাছাড়া আমার দাঁত নেই, এই অবস্থায় আমি প্লেনে উঠব না। ”

শিলা রিন্টির গাল টিপে দিলো মিষ্টি হেসে।

রঙ্গনা বলল,

“আজ আমরা সবাই একটা করে সত্যি স্বীকার করব। যার যেটা মনে আছে, কিন্তু প্রকাশ করতে পারছি না। ”

বাকীরা কেউই প্রথমে বুঝতে পারছিল না। রঙ্গনা ব্যাপার টা বুঝিয়ে বলল। ইন্টেরেস্টিং খেলা ভেবে কেউ কেউ রাজী হলো। প্রথমে শুরু হলো শিলাকে দিয়ে। লটারিতে প্রথম নাম টা তার উঠলো। শিলা একটু সময় নিয়ে গুছিয়ে বলল,

“আমি নিজের ব্যাপারে একটা সত্যি কথা বলতে চাই। আমি আসলে প্রচন্ডরকম ভীতু মানুষ। সবাই ভাবে একটা ভারী চাকরি করছি, একহাতে সংসার চালাচ্ছি আমি ভীষণ সাহসী। আসলে তা নয়। চাকরি আমি করছি ঠিকই, ওখানেও অনেক মানুষ আছে বলে টিকে আছি। তেমনি সংসারেও, বাবা, মা না থাকলে আমার আসলে কিছুই হতো না। ”

সবাই খুবই উচ্ছ্বসিত হলো। ঠিকঠাক গোপন কথা বলে মনে না হলেও মন খুলে প্রশংসার ধরন পছন্দ হলো। শিলা আবারও বললেন,

“আমি আরও একটা কথা বলতে চাই। কথাটা আমার সন্তানদের নিয়ে। তুলনামূলক ভাবে আমি স্বপ্নীল কে বেশী ভালোবেসেছি। এর জন্য যেন আমার মেয়েরা আমাকে ক্ষমার চোখে দেখে। ”

এবারও সবাই মুগ্ধ হলো। রঙ্গনা বলল,

“মা আমরা তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি। সবসময়ই। ”

এইবারে খেলার ধরন টা সবাই বুঝলো। পরের বার নাম উঠলো মিমি আপুর। তিনি তার কলেজের এক ক্রাশের ঘটনা বলল। ব্যাপারটায় সবাই খুব মজা পেল।

পরেরবার নাম উঠলো তৌহিদের। এতক্ষন বেচারা অপেক্ষায় ছিলো। বাকীরা সবাই বসে কথা বললেও সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

“আমার আসলে তুলিকে বলার কিছু নাই। তুলি তো সব ই জানে, আমি ও’কে কতোটা ভালোবাসি। আমি বলতে চাই রঙ্গনাকে। ”

মিশুক জিজ্ঞাসু চোখে রঙ্গনার দিকে একবার তাকালো। রঙ্গনা স্বাভাবিক ই আছে। বলল,

“বলে ফেলুন। আপনি যাই বলেন আমি আজ ম্যুড অফ করব না।”

তৌহিদ বেশ খুশি খুশি গলায় বলল,

“আমার আগেই মনে হয়েছিল রঙ্গনার বিয়েতে ঝামেলা হবে। আর ও পঁচা শামুকে পা কাটবে। ”

ভরা মজলিশে হঠাৎই যেন পারমাণবিক বো*মা বিস্ফোরণ ঘটলো। সবার আগে মিমি আপু জিজ্ঞেস করলো,

“এটা আপনার কেমন ধরনের কথা? আপনি কী মূর্খ নাকি গবেট?”

মিশুক থামিয়ে দিয়ে বলল,

“আপু ওনাকে কথা শেষ করতে দাও। ”

এরপর তৌহিদের দিকে তাকিয়ে বলল,

“আপনি বলুন। ‘

তৌহিদের কোনো ভাবান্তর হলো না। বরং কথাটা বলে উনি ভীষণ খুশি যেন। ঠোঁট উল্টে বলল,

“আমার মনে এটাই ছিলো। হতে পারে কথাটা তিতা টাইপ… বাট আই এম নট সরি ফর দ্যাট। ”

মিমি আপু তেড়ে উঠলেন রীতিমতো। রঙ্গনা থামিয়ে দিয়ে বলল,

“থাক বাদ দাও। এটা তো খেলাই। ”

দাদু ভীষণ রেগে গেছেন। তিনি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তৌহিদের দিকে। দাদী ফিসফিস করে শিলাকে বললেন,

“কতো বড় একটা মন্দ কথা বলল শ*য়তান টা। কিছু বলো তুমি। ”

“আপাতত থাক মা। ও সম্ভবত চাইছে ইস্যু ক্রিয়েট করতে। ও এখানে এসেই ঝামেলা করার চেষ্টা করছে। ”

রঙ্গনা এতক্ষণে মুখ খুলল। বলল,
“আমি ওনার কথায় কিছু মনে করিনি। কারণ আজ আমার ম্যুড অনেক ভালো। ”

স্বপ্নীল ক্ষেপে উঠেছিল। শ্রাবণ্য ওর হাত খামচে ধরে বলল,

“তোমার রাগ সামলে রাখো। যখন তোমার পালা আসবে তখন ওনাকে একটা খারাপ কথা শুনিয়ে দিলেই তো হবে!”

আকাশী বসেছিল তুলির পাশে। তুলি নিশ্চুপ, তবুও অপরাধবোধের ছায়া ফুটে উঠেছে। আকাশী চোখ নামিয়ে নিলো, এই সিচুয়েশন টা ও বুঝতে পারলো।

পরিস্থিতি হাল্কা হলো। পরের নামটা উঠলো আকাশীর। আকাশী বোকার মতো কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল,

“আমার আসলে ওভাবে বলার কিছু নেই। ”

রঙ্গনা বলল, সেটা শুনছি না। বলো বলো।

মিশুক বলল, তুমি একটা দারুণ হাসির কিছু বলো। আমরা অনেকক্ষন হাসি।

আকাশী অপ্রস্তুত গলায় বলল,

“কী বলব খুঁজে পাচ্ছি না। ”

রঙ্গনা বলল,

” আচ্ছা তাহলে তুমি বাদ। তুমি আজ ডিনারে একটা পরোটা কম পাবে। ”

সবাই হাসলো। শিলা বললেন,

“তোমাদের খেলার নিয়মবহির্ভুত হবে কিনা জানিনা, তবে আমি আকাশীকে নিয়ে একটা কথা বলতে চাই। এই মেয়েটা ভীষণ ভালো। ওর এই অদম্য জেদ সবসময় অটুট থাকুক। ”

রঙ্গনা বলল,

“আচ্ছা ঠিক আছে ওর পরোটা কাটা হবে না। এবার তুমি বসো। ”

পরের নামটা রঙ্গনার। সবাই ভীষণ উচ্ছ্বসিত। এবার বুঝি আরেকবার বি*স্ফোরন ঘটবে। রঙ্গনা নিজেও ভীষণ উত্তেজিত। বলল,

“আমি দুটো কথা বলব। প্রথম টা দাদুকে, দাদু তোমার পছন্দ আসলের টপ লেভেলের। আমার আর স্বপ্ন দুজনের ক্ষেত্রেই। ”

দাদুই সবার আগে হো হো করে হাসলেন।

“আর দ্বিতীয় কথাটা অন্য একজন কে। ”

মিশুক রঙ্গনার দিকে হাসিমুখে তাকালো। সবাই জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে আছে রঙ্গনার দিকে। রঙ্গনা লাজুক গলায় বলল,

“একজন কে দেখে মনে হয়েছিল প্রথম দর্শনে, বিয়েটা তার সঙ্গে হলে খারাপ হবে না। বোধহয় সেই কারণেই বিয়েটা তার সঙ্গে হয়েছে। ”

মিশুক নিজেও লজ্জা পেল। শ্রাবণ্য বলল,

“ভাইয়া, আমাদের সবাইকে ট্রিট দিতে হবে। ”

মিশুকের সত্যিই ভীষণ লজ্জা লাগছিল। বড়রাও আছেন। তৌহিদের কপাল কুঁচকে আছে। ও আসলে মিশুক কে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী কেন ভাবছে সেটা অন্যরা বুঝতে পারলো না।

***
তুলি মাঝখানে কিছু সময়ের জন্য উঠে গিয়েছিল। ফিরে যখন আসলো তখন হাতে একটা কাগজ টাইপ ছিলো। ওর নাম ওঠার আগেই হঠাৎ দাঁড়িয়ে বলল,

“আমি আমার কথা টা বলতে চাই। ”

ওর মুখ থমথমে। সবাই তাকিয়ে আছে জিজ্ঞাসু চোখে। শান্ত, মিষ্টি তুলিকে তেমন রাগতে দেখা যায় না। আজ কী ও রেগে আছে! নাকি ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিল। ”

তুলি বলল,

“ব্যাপার টা হয়তো সবার কাছে ধাক্কার মতো মনে হবে। তবে আমার মনে হলো এটাই উপযুক্ত সময় আমার মনে যা চলছে সেগুলো বলার জন্য। ”

তৌহিদ বলল,

“তোমাকে এমন কেন লাগছে? কী এমন বলতে চাও?”

“একটু বেশী সিরিয়াস লাগছে বোধহয়! কারণ আমি আজ বেশী ই সিরিয়াস। ”

দাদু কোমল গলায় ডাকলেন।

“তুলি!”

তুলি নরম গলায় বলল,

“সরি দাদু, এই সিদ্ধান্ত টা আমি ভেবেচিন্তে নিয়েছি। তোমাদের কারো মতামত নেই নি, নেয়া উচিত ছিলো বোধহয়। ”

উপস্থিত সকলে তাকিয়ে আছে। বুক ঢিপঢিপ করছে তৌহিদেরও। কী বলতে চায় তুলি।

তুলি বড় করে নি:শ্বাস ফেলে বলল,

“আমি রিন্টি, মন্টির বাবার সঙ্গে কানাডা যেতে চাই না। ”

তৌহিদ আর্তচিৎকার করে উঠে বলল,

“হোয়াট! ফাই*জলামি পাইছ!….

তুলি গম্ভীর গলায় বলল,

“লেট মি ফিনিশ, আমি শুধু কানাডা যেতে চাই না সেটা ছাড়াও আরও কিছু কথা আছে। ”

“আর কী বলবা তুমি! তুমি যা বলবা তাই হবে? কত্তো ঝামেলার পর সব ম্যানেজ হইছে.. আর এখন এসব বলতেছ! ”

শিলা ধমকের সুরে বলল,

“ও’কে কথা বলতে দাও। ও বলুক আগে, তারপর তোমার কথাও শুনব।”

তুলি বলল,

“গত কয়েক বছরে দেশের বাইরে যাবার যে জটিলতা গুলো ছিলো সেগুলো আমার ই তৈরী। দাদু জানতেন সেকথা। মায়েরও বুঝে ফেলবার কথা। আমি চাই নি মেয়েদের নিয়ে তোমার কাছে যেতে। তুমি খারাপ মানুষ বোধহয় না। তবে ভীষণ ডমিনেটিং। আমি আসলে এই কয় বছরে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আর না… আমি বিবাহ বিচ্ছেদ চাইছি। শুধু বিবাহ বিচ্ছেদ ই। বাকী সব ঠিক থাকবে। মেয়েদের সঙ্গে যোগাযোগ, ওদের ব্যাপারে মিউচুয়ালি সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার সব ঠিক থাকবে। শুধু আমি মুক্তি চাই। আমি সত্যিই ক্লান্ত। ”

তৌহিদ অপলক তাকিয়ে আছে। মুখটা রঙহীন। প্রবল ব্যথায় যেমন মুখ হয় তেমন। তুলি পেপার টা এগিয়ে দিলো। আগে থেকেই তৈরী হয়ে এসেছে।

চলবে

কুসুম কাঁটা পর্ব-৩২+৩৩

0

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-৩২
স্বপ্নীল কয়েকদিন শ্রাবণ্যকে ভীষণ বিরক্ত করলো। সকালে, দুপুরে, সন্ধ্যায় ফোন করে বলছে,

“এই শ্রাবণ্য আমি তোমাকে একটা কথা বলতে চাই। ”

শ্রাবণ্য স্বাভাবিক গলায় বলে,

“বলুন। ”

স্বপ্নীল দুটো অক্ষর বলে থেমে যায়। শ্রাবণ্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে। স্বপ্নীল বলে,

“না থাক। এখন না, পরে। ”

“এখন কী সমস্যা? ”

স্বপ্নীল মিথ্যে জবাব দেয়,

“আমার লজ্জা করে।”

আসলে স্বপ্নীলের লজ্জা করে না। লজ্জা খানিকটা ভেঙে গেছে ওইদিন চুমু খাবার পর। ওইভাবে লজ্জা করে না এখন আর।
কিন্তু কথাগুলো ও গুছিয়ে বলতে চাইছে। শ্রাবণ্য যতবারই বলে বলুন ততবারই সব গুলিয়ে যায়।

শ্রাবণ্য প্রথম দু’বার ফোনের ওপাশে নীরবে হেসেছে। এখন বিরক্ত হয়। বিরক্ত হয়ে বলে,

“আচ্ছা থাক আপনাকে কিছু বলতে হবে না।”

স্বপ্নীল অধৈর্য গলায় বলে,

“তুমি আপনি আপনি করো বলে আমি বলতে পারছি না। ”

শ্রাবণ্য হাসি আড়াল করে গম্ভীর গলায় বলে,

“তোমার যদি গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা না থাকে তাহলে ফোন টা রাখো। আমার স্যার চলে আসবে এক্ষুনি। ”

স্বপ্নীল আচ্ছা বলে ফোন রেখে দেয় মন খারাপ করে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ওর মুখ উজ্জ্বল হয়। শ্রাবণ্য ও’কে তুমি করে বলল না! কথাটাও একটু কেমন আদুরে গলায় বলল! সেই ভরদুপুরে স্বপ্নীল চোখ বন্ধ করে কল্পনায় খানিকক্ষণ আকাশে উড়ে বেড়ালো।

স্বপ্নীলের কথা গোছানো হয়ে ওঠার আগেই শ্রাবণ্যকে শহর ছাড়তে হয়। ইউনিভার্সিটি থেকে চব্বিশ দিনের জন্য সীতাকুণ্ড যেতে হয়। স্বপ্নীলের এতো মন খারাপ হলো। কাতর গলায় বলল,

“শ্রাবণ্য, না গেলে হয় না?”

শ্রাবণ্য হেসে বলে,

“না হয়না। ”

“আমি বৃহস্পতিবার যাব কেমন! ”

“নাহ! তার দরকার নেই, আমরা এতো ঝামেলার মধ্যে থাকব। কোথায় না কোথায় থাকব তার ঠিক নেই। আজ এক জায়গায়, কাল আরেক জায়গায় এভাবেই তো কেটে যাবে। ”

স্বপ্নীল আর কিছু বলল না। দ্রুত প্রস্থান করলো।

শ্রাবণ্যর যখন যাবার সময় হয় তখন বাড়ির সবার সামনেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। বাড়ির লোকজন ছুটে এলো ও’কে সামলানোর জন্য। শ্রাবণ্যর এতো অসহায় লাগলো! এভাবে কাঁদলে ওর কী যেতে ভালো লাগবে। রঙ্গনা স্বপ্নীল কে কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

“গাধা তুই? জীবনে মানুষ হবি না। মেয়েটা যাচ্ছে কী আজীবনের জন্য! সীতাকুণ্ড গিয়ে কী ও আরেকটা ছেলেকে বিয়ে করে ফেলবে আজব!”

রঙ্গনা শ্রাবণ্যকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“চলো ওর যেতে হবে না। আমি তোমার সঙ্গে যাচ্ছি।”

শ্রাবণ্য নিচে নেমে বারান্দার দিকে তাকালো একবার। স্বপ্নীল বারান্দায় নেই। রঙ্গনা স্মিত হেসে বলল,

“ভ্যা ভ্যা শেষ হয় নি৷ কাঁদুক তো, চলো যাই।”

গাড়িতে বসে শ্রাবণ্যর চোখ টা ভিজে উঠলো। বিয়ের পর নরসিংদী গিয়ে ঠিকঠাক দুদিনও থাকে নি। বাবা, মায়ের অভিমানের কারণে যায় নি। এতটা সময় একসঙ্গে থেকে কখন যে স্বপ্নীল ওর অভ্যাস হয়ে গেল!

রঙ্গনা টিস্যু বক্স এগিয়ে দিলো। শ্রাবণ্য জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো।

রঙ্গনা হেসে বলল,

“চোখ মুছে ফেলো। কাঁদছিলে তুমি! স্বপ্ন’র চেয়ে কম যাও না তুমিও। ”

শ্রাবণ্য ঠোঁট চেপে হাসার চেষ্টা করলো। রঙ্গনা বলল,

“দাদুর চয়েজ ঠিকঠাক হয় বুঝলে। এই সত্যিটা আমি স্বীকার করি না কারোর সামনে। কিন্তু মনে মনে ঠিকই স্বীকার করি। আমিও অন্যদের মতো ভাবতাম আমার এই বোকাসোকা ভাইকে কে বুঝবে। বিয়ে ওর আটকে থাকবে না ঠিকই, কিন্তু ওকে বোঝার, ভালোবাসার মানুষ টা আসবে তো।”

শ্রাবণ্য শুধু শুনছিল। মন টা ভীষণ খারাপ লাগছে। কিছু ভালো লাগছে না।

রঙ্গনা খেয়াল করলো শ্রাবণ্য অন্যমনস্ক। হঠাৎ কিছু না বলে ওর মাথায় হাত রাখলো। শ্রাবণ্য এক পলক দেখলো রঙ্গনাকে। পরের পলকেই জমে থাকা জল চোখ বেয়ে পড়লো।

ওরা স্টেশনে পৌছালো আগেই। বাকীদের কেউ কেউ এসেছে। রঙ্গনা পানি কিনে এনে শ্রাবণ্যকে বলল,

“মুখ টা মুছে নাও। কী বিশ্রী লাগছে তোমাকে ইশ!”

শ্রাবণ্য হেসে ফেলল। রঙ্গনা বলল,

“কিছু খাবে? পেয়ারা, ঝালমুড়ি?”

“না। ”

“তোমার মন খারাপ কমেছে?”

শ্রাবণ্য হেসে বলল,

“না। ”

রঙ্গনা হেসে ফেলল শ্রাবণ্যর সরল জবাবে। ট্রেন ছাড়া পর্যন্ত রঙ্গনা অপেক্ষা করলো।

****
রঙ্গনা মিশুকের সঙ্গে বিয়ে নিয়ে যে দ্বিধায় ছিলো সেটা কেটে গেছে প্রায়। ওদের সম্পর্ক দিন দিন সহজও হয়েছে। তবে রঙ্গনা এবারও নিজেকে ছাড় দিয়েছে। মিশুকের পরিবারের তাতে আপত্তি নেই। মিশুকেরও কোনো কিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি টাইপ ব্যাপার নেই। এটা ভালো, কিছুদিন আগে রঙ্গনা সলো ট্রিপে গেল। মিশুক আপত্তি করে নি, রঙ্গনা ভেবেছিল এটা নিয়ে হয়তো একটা ইস্যু ক্রিয়েট হবে। কিন্তু মিশুক ভীষণ কেয়ারফুল থাকে এসব ব্যাপারে। রঙ্গনাকে কোনো কিছু নিয়েই কিছু বলে না।

তবে এই ট্রিপে গিয়ে রঙ্গনা একটা বিষয় বেশ টের পেল। মিশুক ও’কে ভালোই মিস করেছে। পাহাড়, জঙ্গলে নেটওয়ার্ক কম থাকায় মিশুক একদিন ও’কে ফোনে পেল না। সারাদিনে কারোর সঙ্গে ও যোগাযোগ করতে পারলো না। সন্ধ্যেবেলা নেটওয়ার্ক পেয়ে ফোন করতেই মিশুকের অস্থির গলা। ও রওনাও হয়েছিল রঙ্গনা যেখানে আছে সেখানে যাবার জন্য। এই বিষয়টাও ওর ভালো লেগেছে। ভান মনে হয় নি, মনে হয়েছে সত্যিই ওর জন্য ছিলো ওই স্পেশাল ফিলিংস টুকু।

মিশুক দিল্লীতে গিয়েছিল হেড অফিসের একটা মিটিং এর জন্য। তিন দিনের জায়গায় ওদের সাতদিন থাকতে হলো। রঙ্গনা যতবারই ফোন করেছে মিশুক আফসোসের সুরে বলেছে, তোমাকে নিয়ে আসা উচিত ছিলো। এতোদিন থাকতে হবে বুঝলে নিয়ে আসতাম।

রঙ্গনা ফোনের এপাশে মিষ্টি করে হাসলো। কয়েক দিন আগেই ও স্বপ্নীল কে ভীষণ বকাবকি করছিল। কিন্তু মিশুকের এই অস্থিরতা ভালো লাগছে।

***
এক সপ্তাহ পর মিশুক ফিরলো। বেচারা ক্লান্ত বিধ্বস্ত। বাড়ি ফেরার পর রেস্ট নেবার আগে সবার সঙ্গে দেখা করতে যেতে হলো। রঙ্গনা আশেপাশে নেই, একবার একটু দর্শন দিয়ে যে গেছে আর দেখতে পেল না।

মিশুক ঘরে এসে দেখলো রঙ্গনা ঘরে বসে আছে। ফোন দেখতে ব্যস্ত। মিশুক দরজাটা বন্ধ করে রঙ্গনাকে ভালো করে দেখলো। সাদা জর্জেটের শাড়ি, স্লিভলেস ব্লাউজ, চুলগুলো পেঁচিয়ে খোঁপা করে। কোনো জুয়েলারি নেই, তবুও কী সুন্দর লাগছিল। মিশুকের ধারণা এই সুন্দর লাগার ব্যাপার টা আসলে ওর চোখের সমস্যা। এমন মিষ্টি সমস্যা থাকুক, সারাজীবন থাকুক।

রঙ্গনা মিশুক কে অপলক তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল,

“দরজায় ওভাবে দাঁড়িয়ে আছ যে! আর তোমার এই অবস্থা কেন? ভীষণ বিশ্রী দেখাচ্ছে। অন্যসময় অবশ্য খুব সুশ্রী দেখায় ব্যপার টা তেমন না। ”

মিশুক তবুও তাকিয়ে রইলো। রঙ্গনাও খানিকক্ষণ তাকিয়ে হেসে ফেলল। মিশুক বলল,

“তোমার বিরহে আমার এই অবস্থা। ”

“সিরিয়াসলি! সস্তা ফিল্মি ডায়লগ। ”

“হোক সেটা। তবুও কথাটা সত্যি। ”

মিশুক এগিয়ে এসে আচমকাই রঙ্গনাকে জড়িয়ে ধরলো। রঙ্গনা আলিঙ্গন প্রত্যাখ্যান করলো না। মিশুক ঘাড়ের পাশে চুমু খেয়ে গাঢ় গলায় বলল,

“আই লাভ ইউ রঙ্গনা। ”

রঙ্গনা নিশ্চুপে হেসে বলল,

“ওহ! থ্যাংক ইউ।”

***
রেহানা ভালো করে সবকিছু দেখছে। খুটিয়ে খুটিয়ে জিনিসপত্র দেখছিল। আকাশীকে বলল,

“একাই থাকিস তোরা?”

“আমি আর আফরিন মা।”

“আর কেউ আসে না?”

“আসে, আফরিনের মা আসে। শ্রাবণ্য আসে, তুমিও এলে। এইতো….

রেহানার আর কেউ কথাটার মিনিং স্পষ্ট বুঝলো আকাশী। কোনো ছেলে বন্ধু আসে কিনা।

রেহানা আবারও বলল,

“তোর বাবা চাইছেন বাড়ি গিয়ে থাক।”

“এখানে আমার সব কাজ। সুযোগ পেলে বাড়িতে বেরিয়ে আসব।”

রেহানা খাটের উপর বসে বলল,

“যা বলতে আসছি বলি, তোর রিনা খালা একটা বিয়ের প্রস্তাব এনেছে। ছেলে ভালো, একবার বিয়ে হয়েছিল কিন্তু বউ থাকে নি। পার্সোনাল ইস্যু। কথা বলে দেখব?”

আকাশী কঠিন গলায় বলল,

“না।”

“কেন?”

“আমি এখন বিয়ে করতে চাই না। ”

“এবার আমরা দেখেশুনে বিয়ে দেব। আমাদের সিদ্ধান্ত ভুল হবে না। শ্রাবণ্যকে দেখেছিস কতো ভালো আছে! তুই নিজের কপাল নিজে পুড়িয়েছিস।”

“আমি তো আগেই বলেছি মা, নিজের ক্ষত তে প্রলেপ লাগাতে আমি পারব।”

রেহানা আর কিছু বললেন না। আকাশীর সঙ্গে এবার আর মেজাজ দেখালেন না। তার মেজাজের কারণে মেয়েরা নাকি তার সঙ্গে সহজ হয় না। মুনসুরের এই অভিযোগ। মেয়েদের সঙ্গে তার ভালো করে কথা বলতে হবে। এজন্য এবার নরম গলায় কথা বললেন। তিনি নিজেও ব্যাপার টা উপলব্ধি করছেন। মেয়েরা আসলেই তার মাঝে দেয়াল তুলে দিয়েছে। এতটা নিষ্ঠুরও তো সে না।

রেহানা চলে যাবার পর আকাশীর রাফাতের কথা মনে পড়ে গেল। রাফাত সেই রাত ভোর হওয়া দিনটার পর আর ওর সঙ্গে দেখা করে নি। আকাশীর মন খারাপ হয়েছে। কোথাও গিয়ে মনে হয় একটা অনুভূতি ওর মনেও সৃষ্টি হয়েছিল। ভীষণ খারাপ লাগছিল। প্রায় ই ফোন টা হাতে নিয়ে রাফাত কে ফোন করতে গিয়ে থেমে যায়। ও কী আরেকবার তাড়াহুড়ো করে ফেলছে! বোধহয়। সেই ভাবনা থেকে আর যোগাযোগ করা হয় না।

****
রাফাত জয়েন করেছে মাস খানেক। তিন মাসের ছুটির প্ল্যান ক্যান্সেল করেছে। কাজে ডুবে থাকলে সব ভুলে যাবে। একটু একটু করে স্বাভাবিক হচ্ছে। আকাশীকে ওর অনুভূতি জানানো হয়েছে। হ্যাঁ, মুখে কিছু বলে নি। কিন্তু ওর আচরণ স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছে। বাকী সিদ্ধান্ত আকাশীর। ও যদি রাফাত কে নিজের জীবনে রাখার যোগ্য মনে করে তো রাখবে। জোর করে কিছু চাপিয়ে দিবে না।

রোজ রাতে রাফাত আকাশীর একাউন্ট, পেজ চেক করে। শাড়ি,জামাকাপড় এর ছবি দেখে। এতে মনে হয় যেন আকাশী ওর পাশেই আছে। আজ রাতে একটা আনন্দের ব্যাপার ঘটলো। আকাশী ও’কে মেসেঞ্জারে টেক্সট করেছে।

“আপনি কেমন আছেন? ”

রাফাতের এতো আনন্দ হলো! ভালোবাসার কথা বললেও বোধহয় এমন আনন্দের অনুভূতি হবে না। রাফাত লিখলো,

“তুমি কেমন আছ? ”

অনেক দূরে রাতের শহরে একা মেয়েটি মোবাইল হাতে নিয়ে মেসেজ টির দিকে তাকিয়ে রইলো। উত্তরে কী লিখবে সেটা বুঝে উঠতে পারছে না।

চলবে….

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-৩৩
শ্রাবণ্য ট্রেন থেকে নামলো। ভোরের ট্রেন, শহরে এখন একটু একটু শীত নেমেছে। ওর গায়ে পাতলা চাদর চাপানো। শ্রাবণ্য প্ল্যাটফর্মে নেমে এদিক ওদিক খুঁজলো। স্বপ্নীল কোথায়! কাল রাত থেকে অন্তত দশবার ফোন করে বলেছে। আসব, আসব! এখন কোথায়! শ্রাবণ্য অস্থির নয়নে এদিক ওদিক খুঁজছিল। ফোন হাতে নিয়ে নাম্বার ডায়াল করার আগেই স্বপ্নীল তারস্বরে ডাকলো,

“এই শ্রাবণ্য, এই যে আমি!”

শ্রাবণ্য পেছনে ফিরে তাকালো। স্বপ্নীল ছুটে আসছে। ছুটে আসার ধরন টা সন্দেহজনক। ভয়ংকর কোনো ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে না তো আবার! ওহ মাই গড! হালিশহরের সেই মোমেন্ট রিক্রিয়েট হতে যাচ্ছে! শ্রাবণ্য এদিক ওদিক তাকালো। ব্যাচমেট রা এখনো প্ল্যাটফর্মে আছে। তাদের সামনেই ঘটতে যাচ্ছে কেলেঙ্কারি ঘটনা। শ্রাবণ্য ভীষণ নার্ভাস হলো, এই তো স্বপ্নীল কাছাকাছি এসে গেল!

স্বপ্নীল ছুটে এসে সত্যি সত্যিই শ্রাবণ্যকে জড়িয়ে ধরলো। এবার আর হুমড়ি খেয়ে পড়লো না। শ্রাবণ্যও সতর্ক থাকার জন্য দু’হাত বাড়িয়ে স্বপ্নীল কে ধরলো। প্ল্যাটফর্মে মানুষজনের অভাব নেই। কেউ কেউ দেখলো দৃশ্যটা। কেউ কেউ বিরক্তও হলো। শ্রাবণ্য হাসলো, স্বপ্নীল ও’কে ছেড়ে দিলো প্রায় মিনিট খানেক পর। ব্যস্ত প্ল্যাটফর্মে ওই মিনিট খানেক একজন আরেকজন কে জড়িয়ে ধরে রাখলো। শ্রাবণ্যর ফ্রেন্ডরা কেউ কেউ ছবি তুলে, ভিডিও করে রাখলো।

কমলাপুর স্টেশন থেকে বেরিয়ে ওরা রিকশা ধরলো। সকালের মিষ্টি রোদ টা উঠেছে কেবল। স্বপ্নীলের চোখে, মুখে বাচ্চাদের মতো ঈদ আনন্দ। স্বপ্নীল হড়বড় করে কথা বলে যাচ্ছে।

“জানো কী হয়েছে, রিন্টির একটা দাঁত পড়ে গেছে। সেকি ভয়ংকর কান্না! মা ব্যাপার টা বুঝিয়ে বলল, তবুও বুঝতে চায় না। মন্টির কেন পড়লো না, ওর একার কেন পড়েছে এই নিয়ে ভীষণ ঝামেলা করেছে পা*জি দুটো।
এদিকে ভাইয়ার সঙ্গে ছোটপার আবার তর্কযুদ্ধ হলো। খুব ই সিরিয়াস!

শ্রাবণ্য হঠাৎ স্বপ্নীলের হাত চেপে ধরে গাঢ় গলায় বলল,

“তুমি আমাকে কী যেন বলতে চাইছিলে না! বলো নি কিন্তু…!

স্বপ্নীল সুন্দর করে হাসলো। এই সুন্দর সকালে ওর একটা ভয়ংকর কাজ করতে ইচ্ছে করলো।

***
শ্রাবণ্য বাড়ি গিয়ে দুটো খবর পেল। প্রথম খবরটাতে ওর মন খারাপ হয়ে গেল। তুলির পাসপোর্ট সংক্রান্ত জটিলতা শেষ হয়ে গেছে। মাস দুয়েকের মধ্যে রিন্টি, মন্টিকে নিয়ে যেতে পারবে। আর দ্বিতীয়ত খবর টি হলো বাড়ির সবাই মিলে ঘুরতে যাবার প্ল্যান করেছে। শুধু বাড়ির লোক না সঙ্গে মিশুকের বোন, দুলাভাই, বাবা, মা আর আকাশীও যাবে। শ্রাবণ্যকে সারপ্রাইজ দেয়া হবে বলে আগে থেকে কিছু জানায় নি।

তুলির চলে যাবার খবরটায় শ্রাবণ্যর ভীষণ মন খারাপ হলো। শিলা হেসে বললেন, এই মন খারাপ অমূলক না। সবার ই ভীষণ খারাপ লাগবে। কিন্তু পরে ঠিক হয়ে যাবে। দিনশেষে ছেলে মেয়েরা আনন্দে আছে, হাসিখুশি আছে এটাই আসল। আমি মন খারাপ করব না, তোমরাও করবে না কেমন!

রিন্টি তার দু:খের গল্প মামীকে শোনালো। শোনাতে গিয়ে কেঁদে ফেলল। চিপসের প্যাকেট দাঁত দিয়ে ছিড়তে গিয়ে ওর দাঁত টা ভেঙে গেছে। আর ওই চিপস ও খাবে না। এমন ভাঙা দাঁত নিয়ে বিদেশে যেতে ওর খুব লজ্জা লাগবে। কী করবে ও! মন্টিকে মা, বাবার সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়ে ও মনির কাছে থেকে যাবে।

শ্রাবণ্য হাসলো রিন্টির কথা শুনে। এই বাড়িটা সত্যিই নিষ্প্রাণ হয়ে যাবে ওদের ছাড়া। দাদুও ভীষণ কষ্ট পাবে। তুলিকে সে অন্যরকম পছন্দ করে, এটা টের পাওয়া যায়। অনেক সিদ্ধান্ত সে মেনে নেয় শুধু তুলির জন্য।

শ্রাবণ্য সারা দুপুর শুয়ে কাটালো। স্বপ্নীল অফিসে আছে। এতদিন পর বাড়িতে ফিরে মন টা খারাপ হয়ে গেল। নানান ভাবনারা এসে মাথায় উঁকিঝুঁকি দেয়। এই বাড়িতে যেদিন প্রথম এসেছিল সেদিনও ভাবেনি একদিন এটাকে নিজের বাড়ি ভাববে। এখন এটাই ওর বাড়ি। স্বপ্নীল ওর জীবনের ব্যক্তিগত মানুষ। বাড়ির মানুষগুলো ওর ই আপনজন। সকালে ওর ক্লাশ থাকে, ঘুম ভাঙতেই কোনোরকম তৈরী হয়ে বেরিয়ে যেতে হয়। ওর জন্য আলাদা করে খাবার বানানো থাকে। এই কাজ টা কেউ না কেউ করেই। হয় তুলি নাহয় শিলা। একদিন দেখলো দাদী ওর জন্য খাবার বানাচ্ছেন। কী সুন্দর একটা ব্যাপার! একবারও মনে হয় না এটা শ্বশুর বাড়ি, মানুষগুলো ওর নিজের নয়।

শ্রাবণ্য উঠে ল্যাপটপ টা খুলল। এলোমেলো কিছু মনের কথাটা লিখছে। দু’হাতে টাইপ করছে। লিখছে বাবাকে, এই কথাগুলো বাবার জানা উচিত। বাবা, মায়ের সঙ্গে ও যে নীরব দেয়াল টা তুলে দিয়েছিল সেটা মা বুঝতে না পারলেও বাবা বুঝেছেন। তিনি হয়তো অপরাধবোধে ভুগছিল। কখনো কিছু জিজ্ঞেস করে নি শ্রাবণ্যকে। হতে পারে শ্রাবণ্যর মনের ভুল। তবুও ওর মনে যে কথাগুলো অব্যক্ত ছিলো, সেগুলো বাবার জানা উচিত।

বাবা,

সামনাসামনি এই কথাগুলো বলতে পারব না বলেই এভাবে বলা। তোমার প্রতি আমার আসলে কোনো অভিমান নেই। যা আছে সব ই রাগ। রাগ আর অভিমান শব্দ দুটো যেমন আলাদা তেমনি অর্থও আলাদা। স্রেফ তোমার অবাধ্য হয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাবার মতো তুচ্ছ ঘটনায় যে শাস্তি হিসেবে আমার বিয়েটা হতে পারে সেটা আমার কাছে কল্পনাতীত ছিলো সবসময় ই। আমি বিশ্বাস করতে পারিনি যে আমার সঙ্গে সত্যিই ওরকম কিছু ঘটনা ঘটতে পারে। আমি ভেবেছিলাম বিয়ের পর জীবন টা দূর্বিষহ হয়ে উঠবে। সেটার জন্য অনেকটা আমিও দায়ী থাকব। কোনো বিধিনিষেধ মানামানির ধারে, কাছে যাব না। আমার যা ভালো লাগবে করব। কেউ যদি না মানতে পারে তাহলে সেটা নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপও থাকবে না। বিয়ে নামক শেকল তো আর আমি নিজে গলায় জড়াই নি।

বাবা আমার সেই ভাবনা ধূর হলো কয়েক মাসেই। আমি যেটাকে শেকল ভেবেছি সেটা আসলে ফুলের মালা। যা ইচ্ছে হয় সেটা আমি করতে পারি। কেউ প্রশ্ন করে না। কোনো বিধিনিষেধ না মেনেও দেখেছি, কিছুই বদলায় নি। এই বাড়ির মানুষ গুলো ভালো, তাই না? বাবা আমিও কিন্তু একেবারে খারাপ নই। এঁরা সেটা জানে, কিন্তু তোমরা সেটা কখনো জানার বা বোঝার চেষ্টা করো নি। রাত করে বাড়ি ফিরলে এই বাড়ির মানুষজন শুধু অস্থির হয় বিপদে পড়েছি কিনা সেটা ভেবে। এক ফোঁটা অবিশ্বাসও করে না। আপু আর আমি দুজন আলাদা মানুষ বাবা। আমাদের চিন্তা, ভাবনা, ধ্যান, জ্ঞান, পছন্দ অপছন্দ সব আলাদা। চরিত্রও আলাদা। যে ভুল আপু করেছে সেটা আমিও করতে পারি ভেবে তোমরা তটস্থ থাকতে। অথচ আমরা দুজন আলাদা সব দিক থেকেই। বাবা, তোমাদের মেয়ে বলেই কিনা জানিনা, আমারও খুব ইচ্ছে হয়েছিল খুব বড়সড় একটা ভুল করতে বিয়ের পর। যাতে তোমাদেরও আফসোস হয়। পরে সেই সিদ্ধান্ত আপনাআপনিই মাথা থেকে বেরিয়ে যায়। স্বপ্নীল ভীষণ ভালো সৎ একজন মানুষ। মনে যা, মুখেও তাই। এমন মানুষ ঠকে বেশী। আমার তাই আর ও’কে ঠকাতে ইচ্ছে করে নি। বরং এখন মনে হচ্ছে আমি নিজেই জিতে গেলাম।

আমি যতটুকু ভালো আছি তার সব কৃতিত্ব আমার। আমি এখানে তোমাদের কোনো ক্রেডিট খুঁজে পাচ্ছি না আসলে। কথাটা স্বার্থপরের মতো হলেও এটাই সত্যি যে স্বপ্নীল আর ওর পরিবার কে আমি ডিজার্ভ করি বলেই ওরা আমার ভাগ্যে আছে। আমার এই কথাটা আপুর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ঠিক, ভুলের হিসাব কী মানুষ করতে পারে! ভাগ্য নির্ধারণ তো করেন উপরে যিনি আছেন তিনি।

আপুকে তার মতো ছেড়ে দাও। তোমরা দেখেশুনে বিয়ে দিবে বলে ভাগ্য খুলে যাবে এই ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত।

শ্রাবণ্য লেখা শেষ করে চোখ ভুলিয়ে নিলো একবার। অনেক দ্বিধা দ্বন্দের পর লেখাটা বাবাকে পাঠিয়ে দিলো। কিছু কথা, কিছু ব্যাপার জানা উচিত।

***
আকাশী দিন রাত এক করে পরিশ্রম করছে। ব্যবসায়ে সময় দিতে হয় সারাক্ষণ। এক, দুই ঘন্টা কাজ করলে হয় না। নিজের একটা ইয়ারের পড়া শেষ হলো এসব ব্যস্ততার মধ্যে। বিজনেস টাকে আরেকটু বাড়ানোর প্ল্যান আছে৷ অনলাইনের দিক টা সামলানোর জন্য একজন লোক রাখলো। অফলাইনেও একজন লোক রাখা আবশ্যক হয়ে গেছে। তাহলে যদি একটু দম ফেলার সুযোগ পায়। দিনশেষে যখন বিছানায় গা এলিয়ে দেয় তখন অন্য কিছু ভাববার সময় পায় না। চোখে ক্লান্ত ঘুমেরা এসে ভর করে। তবুও হঠাৎ এক উদাস দুপুরে আকাশীর মনে হলো অবেলার কফিটা শেয়ার করার জন্য একজন লোক জীবনে থাকা দরকার৷ ওর ক্লান্ত গল্প, স্বপ্ন, পরিশ্রম সবকিছুর মন্ত্রমুগ্ধ একজন শ্রোতা থাকলে ভালো হতো। এমন ভাবনা কেন মাথায় আসে কে জানে! রাফাতের কথাও মনে পড়ে ওর! সেই বেচারা কতো অভিমান পুষে রেখেছে। আকাশী বুঝতে পারে। ফোনের ওপাশে হ্যালো বলার ধরনে বুঝে যায়। আকাশী তবুও স্বার্থপর ই থেকে যায়৷ নিজের সীমা অতিক্রম করতে চায় না৷ বড় হতে চায় নিজের ছায়ার চেয়েও বেশী।

সেই উদাস দুপুরে আকাশী রাফাত কে ফোন করলো। একবা, দুবার, তিনবার! রাফাত ফোন টা ধরলো না। হয়তো উড়ছিল ওই মাঝ আকাশে। তবুও আকাশী ফোন করেছিল বারবার। রাফাত ফোন করলো ঘন্টা চারেক পর। আকাশী তখন ফেসবুকে লাইভ করছিল। বেশ কিছু টিশার্ট কালেকশন দেখাচ্ছিল। রাফাতের ফোন পেয়ে লাইভ টা বন্ধ করে দিলো। ফোন রিসিভ করে কথা বলল। রাফাত যখন জিজ্ঞেস করলো কেমন আছ! তখন আকাশীর মনে হলো ওর অবস্থাও ঠিক রাফাতের মতো। কয়েকমাস আগে রাফাত যেমন ছিলো। ছুটে আসতো বারবার ওর কাছে। বটবৃক্ষেরও মনে হয় মাঝেমধ্যে ছায়ার দরকার হয়।

চলবে….

কুসুম কাঁটা পর্ব-৩০+৩১

0

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-৩০
ডিভোর্স পেপার টা হাতে নিয়ে বসে রইলো শুভ। রাগে গা রীতিমতো কাঁপছে। শ্রাবণ্য দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে শক্তমুখে। সঙ্গে রাফাত আর স্বপ্নীল। একা শ্রাবণ্যকে দেখলে শুভ ভয় পাবে না। রাফাত কে পরিচয় দিলো পুলিশের লোক হিসেবে। শুভ শ্রাবণ্যকে বলল,

“আমি সই করব না। আকাশীর সাথে কথা বলতে চাই আমি। ”

শ্রাবণ্য বলল,

“কেন সই করবে না তুমি? ফা*ইজলামি পাইছ? ”

স্বপ্নীল শক্ত গলায় বলল,

“অবশ্যই সই করবেন। আপনার কী মনে হয় আপনি সই না করলে আমরা চুপচাপ বসে থাকব? কোনোভাবেই বসে থাকব না, আমরা যথাযথ স্টেপ নেব।”

শ্রাবণ্য স্বপ্নীলের দিকে তাকালো। এই মুহুর্তে ওর ভীষণ হাসি পাচ্ছে। হেসে পরিবেশ টা হালকা করতে চাইছে না। স্বপ্নীল সুযোগ পেলেই আজকাল মেজাজ দেখায়। যেখানে দেখানো লাগে না, সেখানেও ভয়ংকর ভাবে ফোঁস করে ওঠে৷

রাফাত চুপ করে আছে। আকাশী এমন হা*রামি ছেলের পাল্লায় পড়লো! আহারে এমন চমৎকার মেয়ে!

শুভ রাফাত, স্বপ্নীল কাউকেই চিনলো না। দুজনকে দেখে ভয়ও পেল না। ওর ভাবনায় অন্যকিছু। আকাশী একমাত্র মানুষ যে ও’কে এই জাহান্নাম থেকে বাঁচাতে পারবে! ওর পাঁচ লাখ টাকা দরকার। আকাশী পাঁচ লাখ টাকা দিলে প্রয়োজনে ও সারাজীবন ওর পা ধরে থাকবে ।

শ্রাবণ্য আবারও জিজ্ঞেস করলো,

“ডিভোর্স পেপারে সাইন করতে সমস্যা কী?”

শুভ নির্লিপ্ত গলায় বলল, আমার ইচ্ছে। তুমি যে বা* করবা করো।

ঠিক সেই সময়ে জেরিন উপস্থিত হলো। অফিস থেকে স্পেশাল ট্যুরে গিয়েছিল৷ আরও কয়েক দিন পরে আসার কথা, কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলার কারণে চলে এলো।

জেরিন সকলের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলো,

“আপনারা কারা?”

রাফাত শ্রাবণ্যকে জিজ্ঞেস করলো, উনি কে?

“ওনার বউ।”

“সিরিয়াসলি! তোমরা এই লোক কে এইভাবে হ্যান্ডেল করতে আসছ?”

“ও এই কাজ টা করছে তাতে আপুর লাভ হইছে। ডিভোর্স নিলেই হবে। ”

রাফাতের ভীষণ রাগ হলো। জেরিন বলল,

“কী সমস্যা? ”

শ্রাবণ্য সমস্যা বলল। জেরিন শুভ কে বলল,

“সাইন চাইছে দিয়া দাও না ক্যান? তাও ভালো টাকা, পয়সা দেয়া লাগতেছে না।”

শুভ আবারও নির্লিপ্ত গলায় বলল,

“সাইন করব না। কী করবি তুই মা**

রাফাত শুভ’র নাক বরাবর ঘুষি মারলো প্রথমে। তারপর হঠাৎই বেল্ট দিয়ে পি*টাতে শুরু করলো। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই হতভম্ব হলেও কেউ শুভ কে বাঁচাতে এলো না। জেরিন কে দেখে বোঝা গেল তার শোকতাপ কিছুই নেই।

শান্ত,ভদ্র রাফাত হঠাৎই এতো রেগে গেল! এই রাগ ভয়ংকর রাগ। শুভ কে পুলিশে দেয়া হলো। জেরিন কে বলা হলো যেন না ছাড়ায় জেল থেকে। সবকিছু এতো জলদি হয়ে গেল যে শুভ কিছু ভাবার সময় পেল না। ডিভোর্স পেপারে সাইন নেবার সময় রাফাত দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“আকাশীর আশেপাশে যদি তোকে দেখা যায় আর তাইলে কী অবস্থা হবে ভাবতেও পারবি না।”

শ্রাবণ্য, স্বপ্নীল সব টা দেখলো। শ্রাবণ্য মনে মনে অনেক কিছু ভাবছে। স্বপ্নীল বলল,

“তোমার আপুর সঙ্গে ওনার বিয়ে দিলে ভালো হবে। উনি মনে হয় তোমার আপুকে পছন্দ করেন। ভালোবাসা টাইপ পছন্দ। ”

শ্রাবণ্য হেসে বলল,

“আপনি কী করে বুঝলেন?”

“বুঝি। নীলাকে নিয়ে কেউ কিছু বললেও আমার ভীষণ রাগ হতো। আমি রাগ দেখাতে পারতাম না এমন। ”

শ্রাবণ্যর মন টা খারাপ হয়ে গেল। ওর জীবনের আরেকটা দীর্ঘশ্বাসের নাম নীলা। সেই মহিলাকে ও দেখে নি পর্যন্ত। এইদিকে ভাইয়ের বাসায় থাকতো। সবাই এলাকা ছেড়েছে। নীলা নাকি রংপুরে থাকে। এনজিও তে চাকরি করে। স্বপ্নীল নিশ্চয়ই এখনো সেই নীলাকে মিস করে!

স্বপ্নীল দেখলো শ্রাবণ্যর হাসি হাসি মুখ টা মিলিয়ে গেল। নীলার কথাটা যে বলা ঠিক হয় নি সেটা বুঝতে পারলো।

***
মিশুক ঘুমিয়ে আছে। হাত, পা ভেঙে শিশুদের মতো। রঙ্গনা নি:শব্দে হাসলো। ফেসবুকে হঠাৎ আকাশীর শাড়ির পেজ টা দেখতে পেল। ভালো লাগলো। শ্রাবণ্য কিছু বলে নি, আকাশী সেদিন এসেছিল ডিজাইন দেখাতে। দুজনের সঙ্গে ম্যাচিং করে কাপল ড্রেস বানাবে।

হঠাৎ একটা ছবিতে আটকে গেল। ছবিটা আকাশীর প্রোফাইলে হলেও চিনতে ভুল হলো না। রাফাতের হাত ওটা। ঘড়িটাও চেনা। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রঙ্গনা তেমন কোনো অনুভূতি হলো না। ও একবার মিশুকের দিকে তাকালো। এই ছেলেটা ভীষণ ডিস্টার্বিং ঠিকই তবে ডমিনেটিং না।

রঙ্গনা রাফাত কে টেক্সট করলো,

“তোমার কী অবস্থা? ”

টেক্সট করার আগেপিছে কিছু ভাবে নি। করার পর মনে হলো মিশুক কে একবার জিজ্ঞেস করা কী উচিত ছিলো? তারপর ভাবলো না, কোনো দরকার নেই। ও আগে যেমন ছিলো তেমন ই থাকবে। এতো বাছবিচার করে জীবন কাটাবে না।

রাফাত কিছুক্ষনের মধ্যেই জবাব পাঠালো। লিখলো,

“রঙ্গনা আমি তোমার কথা ভাবছিলাম আজ।”

রঙ্গনার মনে হলো ওর আসলে রাফাত কে টেক্সট করা ভুল হয়েছে। রাফাত কী এখন ইমোশনাল কথাবার্তা শুরু করবে?

রঙ্গনা লিখলো, রাফাত তুমি কী বোকা বোকা ইমোশনাল কথাগুলো বলবে? তাহলে আমি তোমাকে এক্ষুনি ব্লক করব!

রাফাত কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই কল করলো। রঙ্গনা বারান্দায় গিয়ে ফোন টা ধরলো।

“রঙ্গনা একটা জরুরী কথা বলার জন্য ফোন করেছি। ”

“কী তোমার জরুরী কথা? বোকাবোকা কথা বলবে না প্লিজ। আমি আমার ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসছি। উলটাপালটা কিছু বলবে না।”

“না না। সেসব কিছু না। পার্সোনাল কিছু কথা। ”

“কী কথা? ”

রাফাত একটু সময় নিয়ে বলল,

“আই এম ইন লাভ… আই থিংক। ”

রঙ্গনা হেসে বলল,

“আকাশী?”

“হ্যাঁ। কিন্তু আমার ভীষণ সংকোচ হচ্ছে। ”

“সংকোচ হলে হোক, তাতে সমস্যা কী?”

“আমার ধারণা আমি ভালোরকম প্রেমে পড়েছি। ঠিক বোঝাতে পারছি না, আসলে আলাপ করার সেরকম কেউ নেই। ভাবলাম তোমাকে বলি। ”

“কনগ্রাচুলেশন রাফাত।”

“থ্যাংক ইউ।”

“আকাশী চমৎকার মেয়ে। তুমিও ভালো, তবে তোমার ফ্যামিলি ভয়ংকর। আকাশী একবার ভয়ংকর লাইফ কাটিয়েছি। তাই তুমি যত ভালোই হও, ওর জন্য ক্ষতিকর। কথা টা শুনতে খারাপ লাগলেও সত্যি। ”

“ওটা এবার আমি সামলে নেব। এখন আমার কী করা উচিত? সরাসরি ও’কে ভালোলাগার কথা বলা উচিত? ”

“অবশ্যই। ”

“এক্ষুনি বলি?”

“বলো। ”

রাফাত আচ্ছা বলে ফোন রেখে দিলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আবারও ফোন করে বলল,

“হ্যালো রঙ্গনা, আমার কী কথা টা সামনাসামনি বলা উচিত? ”

“হ্যাঁ। রিয়েকশন বুঝতে হলে সামনাসামনি বলা উচিত। ”

“থ্যাংক ইউ।”

“আচ্ছা রাখি।”

রাফাতের ভীষণ নার্ভাস লাগছে। আকাশীর উত্তর যদি না হয়? না হলেও কিছু করার নেই, ও লেগেই থাকবে। তিন মাসের ছুটি আছে। এর মধ্যে বিয়ে হানিমুন সব সেড়ে ফেলা যায়। আকাশীকে হ্যাঁ বলতে হবে।

***
রঙ্গনা ঘরে এসে দেখলো মিশুক জেগে আছে। ও’কে বলল,

“এক কাপ চা দাও। ভীষণ মাথা ব্যথা করছে।”

রঙ্গনা বলল,

“তুমি লুকিয়ে আমার ফোনে কথা বলা শুনছিলে?”

“ছি:! আমি এতো ছোটলোক না। তাছাড়া আমার এতো ভয় কিসের! কাগজে,কলমে সম্পদ তো আমার ই। ”

রঙ্গনা স্মিত হেসে চা বানাতে গেল। রঙ্গনা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ও মিশুক কে একটা গোপন কথা বলবে।

***
স্বপ্নীল বুঝতে পারছে শ্রাবণ্য রেগে আছে। কথা বলছে কম। স্বপ্নীল বলল,

“শ্রাবণ্য আমি কী তোমার পাশে মাথা রেখে শুতে পারি?”

“না। আপনি রাতে নাক ডাকেন।”

এটা মিথ্যে কথা। স্বপ্নীল কে ক্ষ্যাপানোর জন্য বলল। স্বপ্নীল তবুও বালিশ নিয়ে এসে শুয়ে পড়লো। শ্রাবণ্য বলল,

“কী চান আপনি? ”

“তুমি আমাকে তুমি করে কেন বলো না? দুলাভাই হাসাহাসি করে, আমার ভালো লাগে না।”

শ্রাবণ্য মৃদু হাসলো। স্বপ্নীল সেটা দেখতে পেল না। স্বপ্নীল উঠে বসে শ্রাবণ্যর হাত ধরে বলল,

“শ্রাবণ্য ওঠো, আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই। ”

শ্রাবণ্য বিরক্ত গলায় বলল,

“কী সমস্যা বলুন। ”

“উঠে বসো।”

শ্রাবণ্য উঠে বসলো, স্বপ্নীলের মুখোমুখি। স্বপ্নীল হাত বাড়িয়ে চশমা টা নিলো। নিজের চুল ঠিক করে শ্রাবণ্যকে চমকে দেবার মতো একটা কান্ড করলো। আচমকাই শ্রাবণ্যর ঠোঁটে চুমু খেল। আনাড়ি চুমু, নিজে ভীষণ লজ্জা পেল। গাঢ় গলায় বলল,

“আমি তোমাকে একটা বিশেষ কথা বলতে চাই… শুনবে? শুনতে হলে আমাকে তুমি করে বলতে হবে। ”

চলবে…..

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-৩১
রাফাত কে ভীষণ নার্ভাস দেখালো। এতো সকালে ও কি কারনে এখানে এসেছে সেটাও বলে নি৷ চোখ লাল, বোধহয় রাতে ঘুমায় নি। আকাশী আবারও জিজ্ঞেস করলো,

“আপনার শরীর খারাপ? ”

“হ্যাঁ। সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে যাওয়া দরকার। ”

“সাইকিয়াট্রিস্ট? ”

“না মানে আজ ডেট আছে। যেতেও পারি, নাও যেতে পারি৷ ”

“কেন? আপনি অনিয়ম কেন করছেন?”

রাফাত ঠিক করে গুছিয়ে কথাগুলো বলতে পারছে না। আকাশী ভদ্র মেয়ে, ও যদি রাফাত কে রিজেক্টও করে তাহলে ভদ্রভাবে করবে। ভয়ের কিছু নেই৷ কিন্তু সমস্যা হলো ও তো রিজেকশন চাইছে না। জীবনে প্রথম কোনো মেয়ের জন্য গোটা একটা রাত নির্ঘুম কেটেছে। আকাশী সেনসিটিভ মেয়ে বোধহয়। ও যদি বলে এরমধ্যে কী করে ওর প্রেমে পড়লো! সেটার জন্য একটা ঠিকঠাক জবাব রেডি করে রাখতে হবে। এখন মনে হচ্ছে এই ব্যাপার টা নিয়ে আরেকটু হোমওয়ার্ক করা উচিত ছিলো।

আকাশী ভাবনায় মগ্ন রাফাত কে দেখে চিন্তিত হলো। বেচারার উপর থেকে যে ধকল গেছে! আকাশী রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে রাফাতের কপালে হাত রাখলো। রাফাত চমকে উঠলো। রাফাত কে চমকে উঠতে দেখে আকাশী ভরকে গেল। বলল,

“আপনাকে দেখে অস্বাভাবিক লাগছিল, তাই দেখলাম জ্বর আছে কী না!”

রাফাত বোকার মতো তাকিয়ে রইলো। আকাশী বলল,

“আপনি একজন ডাক্তার দেখান তো। রুটিন চেকাপ গুলো করে নিন। ”

রাফাত কাতর গলায় বলল,

“ডাক্তারের কাছে একা যাওয়া যায় না? তুমিও চলো। ”

আকাশী হেসে ফেলল। বলল,

“আপনি কোথাও গিয়ে ঘুরে আসুন।”

রাফাত এবারও বলল,

“তুমিও চলো।”

আকাশী স্বাভাবিক গলায় বলল,

“আমি যেতে পারব না। আমার অনেক কাজ, অনেক কাজ হাতে নিয়েছি। সেগুলো কমপ্লিট করতে হবে। ”

রাফাত মূর্তির মতো বলল,

“আচ্ছা।”

“এখন যাই?”

“কোথায় যাবে?”

“রঙতুলিতে যাব। রঙ্গনা আপুকে কিছু ডিজাইন দেখাব। আপনি ডাক্তার দেখান।”

রাফাত যন্ত্রের মতো জবাব দিলো,

“আচ্ছা।”

আকাশী কিছুদূর গিয়ে ফিরে এসে বলল,

“আপনি সকালে কিছু খান নি তাই না?”

এই একটা প্রশ্নেই রাফাতের মন টা ভালো হয়ে গেল। মনে হচ্ছে আজকে দিন টাও ওর ভালো যাবে।

রেস্টুরেন্টে ভরপেট খেয়ে রাফাত রঙ্গনাকে ফোন করলো। রঙ্গনা ফোনের কাছে নেই। মিশুক ফোন টা দিতে গেল। রঙ্গনা রাফাত কে বলল,

“কী ব্যাপার? ”

“তোমার রিসিপশন কবে?”

“আগামী মাসের ১২ তারিখ। কেন?”

“এমনি। ”

“এটা জানার জন্য ফোন করেছ?”

“না। ”

“তাহলে? ”

“আমার আসলে নার্ভাস লাগছে। ”

“লাগতেই পারে, স্বাভাবিক। তোমাকে দেখে মনে হয় না।”

“আসলে আমিও নিজেকে দেখে চিনতে পারছি না।”

“ইটস ওকে। এরকম হয়। হতে পারে তোমার ফ্যামিলির ওই ঝামেলার পর কনফিডেন্স লেভেল জিরোতে নেমে গেছে। ”

“আচ্ছা আকাশীর আমাকে রিজেক্ট করার সম্ভাবনা কতটুকু? ”

“হান্ড্রেড পার্সেন্ট। ”

রাফাত আতঙ্কিত গলায় বলল,

“কি!?”

“হ্যাঁ। ”

“কেন?”

“অবশ্যই তোমার খ*বিশ পরিবার। আমার ধারণা তুমি দুই, চার দশ বছরে বিয়ের জন্য মেয়ে পাবে না। ”

“কী বলছ এসব! রাগ ঝাড়ছো?”

“না এটা সত্যি। ”

রাফাত কথা শেষ না করে ফোন কেটে দিলো। রঙ্গনার কথাগুলো খটোমটো হলেও ঠিক। লজিক আছে, এড়ানো যায় না।

***
মিশুক অফিসে যাবে। রঙ্গনার মোবাইলে রাফাতের নাম টা স্ক্রিনে দেখেও কোনো প্রশ্ন করলো না। রঙ্গনা নিজেই জিজ্ঞেস করলো,

“তুমি কী আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইছ?”

“কোন ব্যাপারে?”

রঙ্গনা চোখ নাচিয়ে বলল,

“যেকোনো ব্যাপারে? ”

“না তো।”

“আমার ফোন কল নিয়েও কিছু না?”

মিশুক হেসে ফেলল। বলল,

“না। ”

“শিওর?”

মিশুক দুই পা এগিয়ে কাছে এলো। রঙ্গনার কানের পাশের চুল সরিয়ে বলল,

“যার বউ এতোটা স্মার্ট আর বোল্ড, তার হাজবেন্ড কেও খানিকটা ওরকম হতে হয়। ”

রঙ্গনা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। চোখের ইশারায় প্রশ্ন করলো, আচ্ছা!?

মিশুকও চোখের ইশারায় জবাব দিলো।

***
স্বপ্নীলের অফিসে কাজে মন বসছে না। দুপুরে ব্রেক নিয়ে বাসায় চলে যাবে ভাবছে। এই অফিসে ও একদিনও ছুটি নেয় নি এখনো পর্যন্ত, কারণ এমনিতেই ও’কে দেখে সবাই ভাবতো কাজ পারবে না। ছুটি নিলে মান, সম্মান যাবে এমন একটা ব্যাপার হবে ভেবে কখনো ছুটি নেবার কথা ভাবে নি।

স্বপ্নীলের নিজের একটা ডেস্ক আছে। ডেস্কটা সুন্দর করে গুছিয়েছে। ওর এই গোছানো স্বভাব টা বুবুর থেকে পাওয়া। বুবুও সব কিছু সুন্দর করে গুছিয়ে রাখে। অগোছালো কিছু তার পছন্দ না, তবে স্বপ্নীল কে সেটা কখনো বলতো না।

স্বপ্নীল ডেস্কের একপাশে গুছিয়ে নিজের জিনিসপত্র রাখলো। লাঞ্চবক্স, মোবাইল, চার্জার, পানির বোতল, ওয়ালেট ডায়েরি এসব। সেইসব জিনিসের সঙ্গে যুক্ত হলো শ্রাবণ্যর একটা ছবি। এই ছবিটা ঝাপসা, স্পষ্ট না। তবুও ছবিটা ওর পছন্দ কারণ ও ছবি টা তুলেছে। অফিসে থাকাকালীন অসংখ্য বার এই ছবিটা দেখবে।

দিতি আপা ফটোফ্রেম টা দেখে বলল,

“স্বপ্নীল ভাই একটা কথা বলি, তুমি কিন্তু মিয়া নায়িকা বিয়ে করছ। যেমনি স্মার্ট, তেমনি সুন্দর। ”

স্বপ্নীল আনন্দে ঝলমল করে ওঠে। শ্রাবণ্যকে কেউ ভালো বললে তাকে ওর আপন মানুষ লাগে। খারাপ বললে তাকে ভালো লাগে না। এমন ব্যাপার আগে মায়ের ক্ষেত্রে হতো। ওদের কিছু আত্মীয় আছে যারা মা’কে তেমন পছন্দ করতো না। তারা স্বপ্নীল কে যতই ভালোবাসুক, স্বপ্নীল তাদের পছন্দ করতো না। ওদের এক চাচা আছেন মিজান। মিজান আঙ্কেল বলে ডাকেন। সেই মিজান আঙ্কেল কী কারণে যেন একবার মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করলেন। স্বপ্নীলের মনে নেই। স্বপ্নীল যখন এইচএসসি তে ভালো রেজাল্ট করলো তখন মিজান আঙ্কেল একটা ঘড়ি পাঠালেন। স্মার্ট ওয়াচ তখন মার্কেটে অল্প কিছু সৌখিন মানুষজন ব্যবহার করে। স্বপ্নীল সেই দামী উপহার ফিরিয়ে দিলো। সবাই ভীষণ অবাক!

***
স্বপ্নীল অফিস ছুটি নিয়ে মায়ের কাছে গেল। বহুবছর পর এমন ঘটনা ঘটলো। শিলা স্বপ্নীল কে দেখে ভীষণ খুশি হলো। জিজ্ঞেস করলো,

“বাবু তুই? কোনো সমস্যা নেই তো?”

স্বপ্নীল মিষ্টি করে হেসে বলল,

“এমনিই মা। আজ তোমার সঙ্গে বাসায় যাব।”

শিলার বহুদিন পর আনন্দে চোখে পানি এসে গেল। মাঝেমধ্যে তার ভীষণ স্বার্থপর হতে ইচ্ছে করে। বলতে ইচ্ছে করে, তুই এমন ই থাক বাবু। তোর একটুও চেঞ্জ হবার দরকার নাই। তুই একটুও বদলাস না। তুই আমার সহজ সরল স্বপ্নীল ই থাকিস।

***
রঙ্গনা আজ মিমি আপুর বাসায় গেল। দুলাভাই এখন অনেক সুস্থ। মিমি আপু রঙ্গনাকে খুব পছন্দ করেন। রঙ্গনার শ্বশুর, শাশুড়ী এরাও। মিশুকের কাছের, দূরের সব আত্মীয় স্বজনরা রঙ্গনাকে এক নজর দেখার জন্য অস্থির। যারা ও’কে দেখেন নি। এতে শ্বশুর শাশুড়ীর ক্রেডিট অনেকখানি। তারা স্পেশাল ফিল করাচ্ছে।

মিমি আপু রঙ্গনাকে বলল,

“এই রঙ্গনা তোমাকে এতো শাড়ি পরতে হবে না। তোমার যা ভালো লাগে তাই পরবা। ওয়েস্টার্নে কম্ফোর্ট ফিল করলে ওয়েস্টার্ন পরবা। কে কী ভাবছে সেটা নিয়ে ভাববে না।”

রঙ্গনা হাসলো। এই হাসির আড়ালে ওর আরও একবার মনে পড়ে গেল এক ধুরন্ধর ফ্যামিলির কথা৷

***
রাফাত বসে আছে রাস্তায়। আকাশী আসবে। এখন ঘড়িতে বাজে এগারো টা বেজে তেইশ মিনিট। আকাশী আসছে। পরনে সাধারণ সালোয়ার কামিজ। গরমে চুল একত্র করে উপরে উঠিয়ে বাঁধা৷ রাফাত হঠাৎ খেয়াল করলো এই মেয়েটা দিন দিন ছোট হয়ে যাচ্ছে। দ্যাট মিনস রোগা হচ্ছে৷

আকাশী ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। বলল,

“এতো রাতে? কী যেন বলবেন বলছিলেন? ”

“আমার বাসায় একা থাকতে ইচ্ছে করলো না।”

আকাশী এক পাশে বসলো। ঢাকা শহরে রাত এগারো টা বেশী কিছু না। এখনো কত রিকশা, গাড়ি, মানুষ ছুটছে। ব্যস্ত শহরে সবাই ব্যস্ত।

আকাশী বলল,

“আমি বেশীক্ষন বসতে পারব না। বারোটার মধ্যে গেট অফ হবে। ”

“আচ্ছা।”

“আপনার কী মন খারাপ? ”

“বুঝতে পারছি না।”

“একটা কথা বলি, আপনি বাড়ি ফিরে যান। আপনার একা ভালো লাগছে না, বাড়িতে গেলে ভালো লাগবে। ”

রাফাত হেসে বলল,

“বাড়ির মানুষের সঙ্গে আমার নীতির মিল নেই আকাশী। আমি যেমন করে জীবন কে ভাবি ওরা তেমন ভাবে না। আমার মামা পররাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ে চাকরি করে, তার কেমন স্যালারি হতে পারে! আশুলিয়ায় প্লট কিনেছে, আবাসিকে ফ্ল্যাট বুকিং দিয়েছে। মার্সিডিজ গাড়ি, ডায়মন্ড জুয়েলারি। এসব কোত্থেকে আসে আমি জানি, বাকীরাও জানে। তবুও তারা এই জিনিস টা বড় চোখে দেখে। ধনবান আত্মীয়ের সাথে সম্পর্ক রাখার জন্য মরিয়া হয়ে যায় সবাই। ”

আকাশী গভীর মনোযোগে কথাগুলো শোনে। স্মিত হেসে বলে,

“আপনি একজন অন্যরকম মানুষ। ”

“অন্যরকম তো তুমি। আমি সাধারণ ই।”

“আমিও সাধারণ। তবে সাধারণ থাকতে চাই না। অসাধারণ হতে চাই।”

“কেমন অসাধারণ হতে চাও?”

“আমি অনেক বড়লোক হতে চাই। পৃথিবীর সবচেয়ে দামী দেশগুলো তে ঘুরে বেড়াতে চাই। অনেক অনেক টাকা ইনকাম করতে চাই।”

রাফাত হেসে ফেলে বলল,

“টাকা ইনকামের সঙ্গে অসাধারণ হবার কী কোনো সম্পর্ক আছে?”

“আছে। আমি জীবনের লাস্ট তিনটে বছরে শিখেছি জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে টাকা। টাকা থাকলে আপনার সব আছে। ডিপ্রেশন, এংজাইটি এসবের জন্য আপনার সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে যেতে হলেও কিন্তু টাকা লাগবে৷ যদি অসুখে পড়েন, ভালো ট্রিটমেন্টের জন্যও টাকা লাগবে৷ আপনার মন খারাপ হলে কোথাও থেকে ঘুরে আসার জন্য টাকা লাগবে। ”

রাফাত তাকিয়ে রইলো আকাশীর দিকে। হেসে বলল,

“তুমি সাধারণ মেয়ে না। কী সুন্দর গুছিয়ে ব্যবসা করছ, এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি করছ। খুচরো পয়সা গুলোও সযত্নে জমিয়ে রাখছ। পড়াশোনা, বিজনেস, টিউশনি সব একসঙ্গে সামলাচ্ছ! তুমি কী করে সাধারণ হও? তুমি তো অসাধারণ ই। ”

আকাশী গভীর চোখে তাকিয়ে রইলো। রাফাত এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে বলল,

“তুমি যে পৃথিবী দেখছ, সেই পৃথিবীর বাইরে আরও একটা পৃথিবী আছে। মুদ্রার এপিঠ, ওপিঠ দুই পিঠ ই আছে। দুর্ভাগ্য তো সেই হতভাগা হা*রামজাদার। যে তোমার কদর বুঝলো না।”

আকাশীর গভীর চোখে জল টলমল করছে। বৃষ্টি ফোঁটা হয়ে পড়ার আগে রাফাত ওর ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো ওর কপালে।

সকাল হতে আর কিছুক্ষন বাকী! মসজিদের মাইকে আজান হচ্ছে। আকাশী চমকে উঠলো। এতক্ষন! মনে হলো মিনিট দশেক আগে ও বেরিয়ে এসেছে!

চলবে…..

সাবিকুন নাহার নিপা

কুসুম কাঁটা পর্ব-২৮+২৯

0

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-২৮
শ্রাবণ্য আজ অনেক দিন পর নরসিংদী এলো। একাই এসেছে, কাউকে জানায়ও নি। রেহানা, মুনসুর দুজনেই ভীষণ অবাক হলো। শ্রাবণ্য এই বাড়িতে আসতে চায় না। পড়াশোনার অজুহাত ছাড়াও আরও নানা অজুহাতে এড়িয়ে যায়। মুনসুর বুঝতে পারেন শ্রাবণ্যর অভিমান আছে। তবে রেহানা সেটা বুঝতে চায় না। তার ধারণা মেয়ে সবকিছু অতিরিক্ত বোঝে। রেহানা বললেন,

“ঝগড়াঝাটি করে আসলি? জানালি না আগে কিছু? ”

শ্রাবণ্য নির্লিপ্ত গলায় বলল,

“ঝগড়াঝাটি করে এখানে কেন আসব? আর না জানিয়ে আসলে সমস্যা কী! ”

রেহানার মেজাজ খারাপ হলেও তিনি শান্ত রইলেন। মেয়েদের কাছে তিনি এমনিতেই দূরের মানুষ৷ মুনসুরও আজকাল তাকে দোষারোপ করতে ছাড়ছেন না। মেয়েরা, ছেলের বউ কারও সঙ্গে তেমন সদ্ভাব নেই এই দোষ যেন রেহানার একারই কেবল। কেন সে তো চেয়েছে সবার সাথে মিশতে। শ্রাবণ্যকে প্রতিদিন ফোন করে। শ্রাবণ্যই তো বিরক্ত গলায় বলে, আমি প্রতিদিন ই খাই মা, ভালোও থাকি। আর খারাপ থাকলেও সেটা তোমাকে জানাব না। প্রতিদিন ফোন করার দরকার নেই।

রেহানা আবারও প্রশ্ন করে,

“ব্যাগপত্র কিছু আনো নাই? থাকবি না?”

“না। বাবার সাথে আমার কথা আছে। আজ সন্ধ্যের বাসেই ফিরে যাব। ”

“এইভাবে কেউ আসে? দুটো দিন থাকলে কী হয়!”

“আমার ভালোও তো লাগতে হবে। আমার ভালো লাগে না। ”

রেহানার এবার খারাপ লাগলো। শ্রাবণ্য তার সাড়ে নয় মাস পেটে ধরা মেয়ে। এই মেয়ে কেন তার সাথে এভাবে কথা বলবে! কই অন্যদের সঙ্গে কথা বলার সময় তো ওর চোয়াল শক্ত হয় না। রেহানা আবারও বলল,

“শিউলিকে ফোন করি, ও আসুক। আজ থেকে যা। ”

শ্রাবণ্য জবাব দিলো না।

শ্রাবণ্য মুনসুরের সঙ্গে কথা বলল ঘরের দরজা বন্ধ করে। বন্ধ ঘরে কী কথা চলছিল সেটা রেহানা জানে না। তিনি শ্রাবণ্যর জন্য রান্না চাপিয়েছিল। বড় চিংড়ি নারকেলের দুধ দিয়ে রান্না করলে শ্রাবণ্য খুব পছন্দ করে। শ্রাবণ্য সেসব কিছু খেল না। ঠিকে কামলাদের জন্য বাসার সামনে বড় হাড়িতে গরুর মাংস, পাতলা ডাল রান্না হলো সেটা দিয়ে ভাত খেল। রেহানা রাগে, দু:খে বললেন,

“কী সমস্যা তোর? আমার সাথে এমন কী কারনে করতেছিস?”

শ্রাবণ্য নির্লিপ্ত গলায় বলল,

“ছোট আপুর বিয়ে নিয়ে বর্ষার মা’কে তুমি কিছু বলেছিলে?”

রেহানা এক সেকেন্ডের জন্য থম মেরে থাকলেও সঙ্গে সঙ্গে অস্বীকার করে বলল,

“নাহ। ”

“বর্ষার মা মামী যদি ওই কথাগুলো বানিয়েও বলে থাকে তবে তোমার নাম কেন বলল? ”

রেহানা রঙ্গনাকে নিয়ে কিছু কথা বলেছিল। রঙ্গনার স্বভাব, মেজাজ এসবের কারণে বিয়েতে ঝামেলা হয়েছে। এমন মেয়েকে কেই বা ঘরের বউ বানাতে চাইবে। কিন্তু বর্ষার মা সেটা আবার বলে দিলো! তিনি নিজেও তো তখন রেহানার কথায় সায় দিয়েছিল!

শ্রাবণ্য বলল,

“ওই বাড়ির সবাই তোমার বলা কথাগুলো জানে। প্লিজ মা, এতোটা ঘৃনায় কাউকে আর দেখো না। খুব খারাপ লাগে। তোমার যেটা অপছন্দ সেটা বেঠিক, আর যেটা পছন্দ সেটা ঠিক এটা ভাবা বন্ধ করো। ”

রেহানা কথা বলছে না। মেয়ের মুখে জ্ঞানের কথা শুনতেও ভালো লাগছে না। তবুও চুপচাপ রইলেন।

***
শ্রাবণ্য বাবার কাছে বড় অংকের টাকা চাইতে এসেছে। এই টাকাটা আকাশীকে দিবে, ও গুছিয়ে ব্যবসা দাঁড় করুক। পরিশ্রম করার মানসিকতা আছে, ঠিক পারবে। বাবার টাকা এরপর ফিরিয়ে দিলেই হবে। শ্রাবণ্য পারতো মায়ের কাছ থেকে নির্লিপ্ত থাকা শিখতে। আকাশীর জন্য ও অনেক কিছু সহ্য করেছে। সেই রাগে হিংস্র হতে পারতো। কিন্তু ও জানে হিংস্রতা রাগ দিয়ে আসলে কিছু লাভ হয় না। বরং কাছের দূরের মানুষ গুলোকে হারাতে হয়। এই উপলিব্ধি এসেছে শিউলি আর শিলার থেকে। দুজনেই ও’কে বুঝিয়েছে ভালোবাসার চেয়ে বড় কিছু হয় না। সত্যিই কিছু হয় না।

***
রঙতুলিতে আজ একজন নতুন মানুষ এসেছে। রিন্টি, মন্টির বাবা। ভীষণ মেধাবী এই ভদ্রলোকের নাম তৌহিদ। তৌহিদ কে এই বাড়ির অনেকেই পছন্দ করে না। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রঙ্গনা আর দাদু। তৌহিদ খুব ডমিনেটিং স্বভাবের। তুলির মতো শান্ত, লাজুক মেয়ের জন্য কোনোভাবেই ঠিক চয়েজ না। তবুও তুলি তাকে পছন্দ করলো। তুলির বিয়ে অন্য জায়গায় ঠিক করেছিল দাদু। বেচারি লজ্জায় তার পছন্দের কথা কাউকে বলতে পারলো না। রঙ্গনা তখন তুলির সঙ্গে একসাথে ঘুমায়। গায়ে গা মিশিয়ে। পর পর কয়েকদিন টের পেল তুলি কাঁদছে। দাদু সেটা শুনে বিয়ে ভাঙলেন। তুলির পছন্দের পাত্রের সঙ্গে বিয়ের আয়োজন করলেন। পাত্র সব দিক থেকে ভালো। তার পরিবারও সবাই শিক্ষিত। বিশেষ অনুষ্ঠান কিংবা মিলাদে সবাই একত্রিত হয়। এছাড়া যে যার মতো থাকে। বিয়ের রাতে রঙ্গনা বন্ধু, কাজিন দের সঙ্গে আড্ডা টাইপ একটা আয়োজন করেছিল। সেখানে হঠাৎ বলে উঠলো,

“এক্সকিউজ মি রঙ্গনা। তোমাদের এসব খ্যাচর ম্যাচর কবে শেষ হবে? আমার ভীষণ মাথা ধরেছে।”

রঙ্গনা হতভম্ব হয়ে গেল। নতুন দুলাভাই কে নিয়ে ওর সমস্ত আগ্রহ নিভে গেল। এই কথা শিলা শুনে খুব হেসেছে। বলেছে, তোর এতো রাগ কেন লাগছে? তুই নিজেও তো এমন।

এরপর আর কোনোভাবেই রঙ্গনার তৌহিদ কে ভালো লাগে নি৷ আর দাদুর অপছন্দের কারণ অন্য। তৌহিদ তুলিকে কানাডা নিয়ে যেতে চায়। সেই কারণে তার অপছন্দ।

তৌহিদ ফেরার পর পর ই দাদুর ঘরে গিয়ে বলল,

“দুই দুইটা বিয়ে আমাকে ছাড়াই হচ্ছে? আমার কোনো গুরুত্ব নেই?”

দাদু চশমার ফাঁকে একবার দেখে বললেন,

“আসছ বিশ্রাম নাও। পরে কথা হবে। ”

“বিশ্রামের তো কিছু নেই৷ আমি তো প্লেনে আসছি। বাস, ট্রেনে আসি নাই৷ ”

দাদু বই সামনে ধরে বসে আছেন। এই ছেলেটাকে দুটো থাপ্পড় দিতে পারলে স্বস্তি লাগতো। কিন্তু তুলি মন খারাপ করবে তাই করা যায় না।

দাদুকে তৌহিদের হাত থেকে বাঁচালেন শিলা। শিলাকে আবার তৌহিদ সমীহ করে। তৌহিদ ঘরে গেল, ও না জানিয়ে এসেছে। তেমন কারোর মধ্যে উচ্ছ্বাস নেই। রিন্টি, মন্টি ও’কে দেখে বলল,

“বাবা আমরা বিদেশ যাব না। তুমি মা’কে নিয়ে যেও। আমাদের মনি আর মিশুক বাবার কাছে রেখে যাও। ওরা আমাদের দত্তক নিবে। ”

তৌহিদের মেজাজ খারাপ হলো। তুলিকে দেখেও মনে হচ্ছে খুশি না। তুলিকে বলল,

“তুমি খুশি হও নাই?”

তুলি বিস্মিত গলায় বলল,

“হ্যাঁ খুশি তো৷ এভাবে কেন বলছ?”

“তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে না। তোমার মুখে আলগা হাসি। আমাকে দেখে তোমার অট্টহাসিতে ফেটে পড়া উচিত ছিলো। ”

তুলি অতি সন্ত:র্পনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অট্টহাসিতে কিভাবে খুশি প্রকাশ পায় সেটা বুঝতে পারছে না।

***
তৌহিদের মেজাজ ঠিক হলো মিশুক কে দেখে। হ্যান্ডসাম, জেন্টেলম্যান মিশুক কে দেখে নিজের মাথায় হাত চলে গেল আপনাআপনি৷ টেনশন, প্রেশারে চুল কমতে শুরু করেছে। মিশুক কে অন্য কিছু জিজ্ঞেস করার আগে বলল,

“রেগুলার জিম করো?”

মিশুক একটু খুঁতখুঁতে টাইপ। প্রথম দর্শনে তুমি ব্যাপার টা হজম করতে একটু কষ্ট হচ্ছে। কষ্ট হলেও মানিয়ে নিতে হবে। এই বাড়ির মানুষজন অন্যরকমই। এই যেমন দাদী ও’কে দেখলে লজ্জা পায়। লাজুক হেসে মুখ ঢেকে রাখে। এই লজ্জা রঙ্গনা পাবার বদলে উনি কেন পাচ্ছেন মিশুক সেই লজিক খুঁজে পায় নি। তবে তার মধ্যে সুইট একটা ব্যাপার আছে৷ শ্রাবণ্য কে ভাবী আর মিশুক কে দুলাভাই বলে ডাকেন। এই ডাক টা আন্তরিক।

তৌহিদ একে একে মিশুকের খোঁজ খবর নিলো। মিশুকের ইনকাম, সম্পত্তি সবকিছু শুনে শেষমেস বুঝলো যে না জামাই হিসেবে সে এগিয়ে। একদম দশে দশ পাবার মতো। মিশুকের চেয়ে চারগুণ ইনকাম তার। ঢাকায় বাবার সম্পত্তি থেকেও ভালো কিছু পেয়েছে। তাছাড়া নিজেও কিছু প্রোপার্টি করার চেষ্টায় আছে। এরপর ফুরফুরে মেজাজে দেখা গেল। মেজাজ এতোটাই ফুরফুরে ছিলো যে আটজনের রান্না মাংস একা খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লো।

****
ফোনের ওপাশ থেকে ফ্যাচফ্যাচ করে কান্নার শব্দ আসছে।

“রাফু, আমার সোনা বাবা। আমার ময়না পাখি আর কত রাগ করে থাকবি? তুই কী চাস আমি মরে যাই।”

রাফাত চুপ করে আছে। মায়ের নতুন নাটক শুরু হয়েছে ইদানীং। এতো সুন্দর, কোমল গলায় সে কখনো কথা বলে না। এর আগে যেকোনো ব্যাপারে রাফাতের সাথে না মিললে বিভিন্ন প্রানীর বাচ্চা বলে গালিগালাজ করে অসুস্থ হবার নাটক করতেন। এইবার ব্যতিক্রম ব্যাপার ঘটছে।

রাফাত হাই তুলে বলল,

“তুমি কী চাও মা পরিষ্কার করে বলো। টাকা, পয়সা নেই। পথের ভিখিরি আমি। ”

রাফাতের মা কান্নার সুর আরেকটু বাড়িয়ে বলে, বাসায় আয় কতদিন দেখি না তোরে।

রাফাতের মনে দুশ্চিন্তা। মা আবার কী প্ল্যান করছে! ওর জন্য এতো আদর, ভালোবাসা যার সে তো বিয়ের দিন ক্রিমিনালের মতো আচরণ করবে না।

রাফাত গম্ভীর গলায় বলল,

“মা আমি আর তোমার মিষ্টি কথায় ভুলছি না। তোমাকে ক্ষমা করতে সময় লাগবে। আমাকে সময় দাও। সীতা যেমন অগ্নিপরীক্ষা দিয়েছিল তেমন তোমাকেও পরীক্ষা দিতে হবে। ”

রাফাতের মা গুনগুন করে কান্নাকাটি করলেন আরও কিছুক্ষন। তার দোষ নাই, সব দোষ রাফাতের মামীর। সে এতো খারাপ না। রঙ্গনাদের বাড়ির সবার পা ধরে বসে থাকবে তিন দিন।

রাফাতের হালকা একটু মন নরম হলো। সেই সময় ঘটলো বিপত্তি। ডোর বেল বাজলো। আকাশী এসেছে। রাফাত ফোন হাতে নিয়ে দরজা খুলে উচ্ছ্বসিত গলায় বলল,

“তুমি?”

আকাশী মিষ্টি হেসে বলল,

“খাবার নিয়ে আসছিলাম। খাওয়া হয় নি তো?”

“না, না। এসো এসো। ”

রাফাতের মা পুরো কনভার্সেশন শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। অকথ্য ভাষায় গালাগালি শুরু করে দিলো।

চলবে….

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-২৯
শ্রাবণ্যর কাছ থেকে টাকা পেয়ে আকাশী প্রথমেই একটা বাসা ভাড়া নিলো। এটা করতে অবশ্য ওর খুব ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। একলা মেয়েকে কেউ বাসা ভাড়া দিবে না, এদিকে ওর বাসা দরকার। হোস্টেলের ছোট জায়গায় জিনিসপত্র রাখার জায়গা কম, সবাই ঘুমিয়ে গেলে রান্নাঘরে চুপি চুপি শাড়িতে লাগানোর জন্য রঙ জ্বাল দিতে হয়। এরপর ডিজাইন শেষ করে শুকানোর জন্য বড় স্পেস লাগে।

আকাশী আফরিন কে সঙ্গে নিয়ে নিলো। দুজন মিলে দুই রুমের ফ্ল্যাট নিলো। সেখানে নিজের ঘরে গুছিয়ে কাজ শুরু করলো। অনলাইনে অর্ডার কম হলেও অফলাইনে অর্ডার ভালোই পাচ্ছে৷ রঙ্গনার বন্ধুদের কারণে কাজের পরিমাণ বেশী। তারা অনলাইনে পজিটিভ রিভিউও দিচ্ছে। আকাশী শাড়ির পেজের নাম দিলো রঙ্গনা। রঙ্গনা প্রথম দেখায় ও’কে বিশাল এমাউন্ট এডভান্স দিয়েছিল। রঙতুলির মানুষজন ও’কে এপ্রিশিয়েট করেছে। পেজের নাম এটা হলেই ভালো হয়।

দ্বিতীয় কাজ টা করলো শুভ রিলেটেড। শুভ কে ডিভোর্সের নোটিশ পাঠালো। এখানেও জীবন টাকে আরেকটু গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা। শুভ হুটহাট চলে আসে। জীবনে আরেকবার পা হড়কে খাদে ও পরতে চায় না। শুভ নিজের জীবনে যে ভুল করেছে সেটার মাশুল ও গুনুক। আর কোনো দায় ও নিতে চায় না।

আকাশীর সকাল হয় ব্যস্ততা দিয়ে, দুপুরে খাবার খায় কাজের মধ্যে, রাতেও তেমন। এখন আর ঘুমের সমস্যা নেই। ঠিক, ভুল ভেবে রাত পাড় হয় না।

***
রাফাত নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল। বাড়ির সঙ্গে যে দূরত্বটা আছে সেটা এমনই থাকুক। মা, বাবা, আত্মীয়দের আসলেই একটা শিক্ষার দরকার। নাহলে একই ভুল বারবার করবে। হতে পারে এরচেয়ে বড় ভুল করে বসে রইলো। তার চেয়ে এই দূরত্ব ঠিক আছে।

রাফাতের এই নির্বাসনে ও ছোট বড় অনেক ব্যাপার শিখেছে। ইউটিউব দেখে কিছু রান্না শিখেছে, ঘর গোছানো, নিত্য নৈমিত্তিক কাজের শর্টকাট কিছু টেকনিক শিখেছি। আসলে আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব না থাকলেও জীবন অতো কঠিন হয় না। শুধু ভালো থাকার পদ্ধতিটা জানতে হয়। প্রচুর মুভি, সিরিজ জমেছিল ওগুলো শেষ করে। ভালো মন্দ মিলিয়ে বেশ কিছু বইও পড়া হয়েছে। এই লাইফ টাকে আরেকটু উপভোগ করার জন্য অফিসে মেইল করেছে আরও তিন মাস ছুটির জন্য। পুরোপুরি মেন্টালি ফিট হয়ে ফিরতে চায়। অফিস এখনো এপ্রুভাল মেইল পাঠায় নি। পাঠালে আরও কিছু প্ল্যান বাড়বে।

তবে রাফাতের একটা জায়গায় এসে ভীষণ সমস্যা হয়। একজন মানুষের অভাব তখনই ফিল করে যখন কথা বলতে ইচ্ছে করে। দুর্দান্ত সিরিজ টা শেষ করে সেটা নিয়ে আলোচনা করার জন্য একজন মানুষের দরকার হয়। পছন্দের বইটার শেষটুকু ভালো না লাগলে ক্ষোভ প্রকাশ করার জন্য একজন মানুষ কে লাগে। রাফাতের সেই একজন মানুষের জায়গাটা আকাশী পূরন করে ফেলল। কিন্তু মেয়েটা মারাত্মক ব্যস্ত থাকে। রাফাতের মতো না। টিউশন পড়িয়ে, ব্যবসার কাজে ছুটছে। তারপর রাত জেগে পড়াশোনা করছে।

রাফাত প্রায় রাতেই ফোন করে। দুটো, তিন টে যখন ফোন করে মেয়েটা জেগে থাকে। হয় কাজ করে নাহয় পড়াশোনা করে। কাজ করলে রাফাতের লাভ, ও কিছুক্ষন মন খুলে কথা বলতে পারে। পড়াশোনা করলে লস, তখন সৌজন্যতা দেখিয়ে ফোন রাখতে হয়।

এই অভ্যাস দিন দিন খারাপ অভ্যাসে পরিনত হচ্ছে। রাফাতের বোধহয় উচিত এটাকে বাড়তে না দেয়া, কিন্তু সেটা পারছে না। আকাশী যেদিন দেখা করবার সময় দেয়, সেদিন ওর অন্যরকম লাগে। ছোটবেলায় কোথাও বেড়াতে যাবার আগে আনন্দ অনুভব হতো ঠিক তেমন অনুভূতি।

রাফাত আজ এসেছে আকাশীর সঙ্গে দেখা করতে। আকাশী এলো মিনিট দশেকের মধ্যে। সব চুল একসঙ্গে উঠিয়ে উঁচু করে বাঁধা, রোদে পুড়ে ফর্সা রঙ টা তামাটে লাগছে, ঠোঁটও শুকনো। মুগ্ধ হবার মতো কিছু নেই, তবুও ওর মনে হলো এখানেই আসল মুগ্ধতা! মুগ্ধতা ব্যাপার টা বোধহয় এমন ই হওয়া উচিত। যেখানে কোনো ভান নেই, বাড়াবাড়ি, ছড়াছড়ি নেই। ঠিক যেমন এই মেয়েটা আসার সময় ঠোঁটে লিপস্টিক, গালে পাউডার ঘষে আসে নি। ও জানে যে যেমন ও, তেমনই ঠিক। যার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে তাকে আলাদা করে মুগ্ধ করার প্রয়োজন নেই।

রাফাত আকাশীকে নিয়ে রাস্তার পাশে আলুর চপ, বেগুনি, ডালপুরি খেল। চা খেতে গেল টঙ দোকানে। বেশী চিনি দিয়ে ঘন দুধের চা। রাফাত আকাশীকে বলল,

“আমি তো অলমোস্ট বেকার ই। তুমি চাইলে আমাকে জব দিতে পারো। ”

আকাশী হাসলো। রাফাত এই কথাটা ও’কে প্রায় ই বলে। আকাশী কথাটা মজা হিসেবে নেয়। রাফাত আবারও বলল,

“সিরিয়াসলি আকাশী… তোমার কিছু কাজ আমি করে দিলাম। এই যেমন ধরো ডেলিভারি ম্যান হলাম, অল্প কিছু বকশিস দিলেই হবে। ”

“আপনি সত্যিই সিরিয়াস?”

“হ্যাঁ। আবার তোমার সঙ্গে মার্কেটে ঘুরে ঘুরে কাপড় কেনাও দেখতে পারি। এতে দুটো লাভ, আমি তোমার কাছ থেকে বিজনেস শিখতে পারি, আবার বেকারও রইলাম না।”

“আপনি জয়েন করবেন না?”

“না, ছুটির মেইল করেছি। ওরা এপ্রুভাল মেইল পাঠাবে আশা করছি। ”

“তাহলে এই সময় টা আপনি নিজের মতো কাটান। ভালো লাগবে, কোথাও ঘুরেটুরে আসুন। ”

“তোমার সাথে কাজ করলেও ভালো লাগবে। তাছাড়া তোমার নিজেরও একটু সুবিধে হবে। অন্তত নিজের একটু যত্ন নেবার সময় পাবে।”

আকাশী অন্যরকম চোখে তাকালো। নিজের একটু যত্ন! নিজের মানুষ তো কখনো ও’কে এভাবে বলে নি। কতো পরিশ্রম করেছে, তবুও রান্নার এদিক সেদিক হলে কথা শুনিয়েছে! আকাশীর মন কেমন করে উঠলো। কেন আমাদের জীবনে আমাদের মতন একজন আসে না!

****
তৌহিদ খেয়াল করলো মিশুক এই বাড়িতে প্রায় সকলের ই প্রিয়৷ দাদুও ভীষণ পছন্দ করছেন। ব্যাপার টা ওর জন্য পীড়াদায়ক, কারণ ও’কে সেভাবে কেউ গুরুত্ব দেয় না। সেটা অবশ্য ওর একার ধারণা। যেমন মেয়েরা ও’কে পছন্দ করে না। দুটো মেয়ে ফাজিলের চূড়ান্ত। ধমক দেয়ায় একজন বলল, তুমি যাবা কবে বাবা, আর গেলেও আসবা না। কী ভয়ংকর কথাবার্তা। এই মেয়েদের বাপ ও, তার সঙ্গে এমন কথা বলছে। অথচ রঙ্গনা এসে দুটোকে পিঠে ধড়াম ধড়াম দিলেও বলে, মনির মা*ইরে ব্যথা নেই।

তুলিকেও কেমন যেন বিরক্ত মনে হচ্ছে। বাড়িতে এতসব ঘটনা ঘটে গেল অথচ কাউকে জানালোই না। রঙ্গনার বিয়ে ঠিক হয়েছিল একজনের সঙ্গে, অথচ বিয়ে হলো আরেকজনের সঙ্গে এসব ব্যাপার ও’কে কিছু জানায় নি৷ তাছাড়া ও এই বাড়ির বড় জামাই ওর মতামত নেয়া উচিত সবকিছু তে। এটা শুনে তুলি শক্ত মুখে বলল,

“কেন? দাদু কী মরে গেছে? আমাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য মা তো আছেন!”

তৌহিদ বেশ অপমানিত বোধ করলো এই কথায়। তার চেয়েও ভয়ংকর ঘটনা ঘটলো ডাইনিং টেবিলে। সবাই এক সঙ্গে খেতে বসেছে। টুকটাক গল্প করতে করতে খাওয়া এগুচ্ছে। তখন বলল,

“কি স্বপ্নীল, তুমি তো বলদ থেকে একদম মানুষ হয়ে উঠলা। তোমার বউয়ের এলেম আছে। ”

স্বপ্নীলের মন খারাপ হলো। একবার বুবুর দিকে তাকালো, আরেকবার শ্রাবণ্যর দিকে৷ শ্রাবণ্য স্বপ্নীল কে ইশারায় খেতে বলল। বাকী কেউ কিছু বলল না। রঙ্গনা মুখ খুলতে যাবে সেই মুহুর্তে মিশুক হাত চেপে ধরলো।

আজ দুপুরে আকাশী এসেছিল। শ্রাবণ্য পরিচয় করিয়ে দিলো। তৌহিদ বলল,

“তোমার নাম আকাশী! আমি এক মুহুর্তের জন্য ভাবলাম বাতাসী খালার মেয়ে তুমি!”

শ্রাবণ্য বিরক্ত হলো। আকাশী মিষ্টি করে হেসে বলল, না আমি তার মেয়ে নই। তবে মেয়ের মতোই। বাতাসী খালা শুনলেন তার আবার শ্রাবণ্য দের দুই বোন কে পছন্দ। সেদিন ই শ্রাবণ্য ওর একদম নতুন একটা শাড়ি তাকে দিয়ে দিয়েছেন। বাতাসী খালা শাড়িটার দিকে লোভাতুর চোখে তাকিয়ে ছিলেন। শ্রাবণ্য সেটা দিয়ে দিলো৷ ওর আলমারিতে অসংখ্য শাড়ি। একটা দুটো মানুষ কে দিতেই পারে। খালা সেই শাড়ি নিয়ে তাদের লোকাল মার্কেটে গেল। দোকানদার রা জানালো এই শাড়ির দাম বেশি। হাজার পাঁচেক তো হবেই। আকাশী মেয়েটাও ভালো, এই বাড়িতে যখন ছিলো তখন অমায়িক ব্যবহার করেছে। দুলাভাই যে আকাশীকে সূক্ষ্ম খোঁচা দেবার জন্য কথাটা বললেন সেটা উনি বুঝলেন৷ বললেন,

“দুলাভাই, আপনের ঢং আছে ভালোই৷ আপনে তো জানেন আমার নাম ফাতিমা। মা ফাতিমার নাম টারে মানুষ ফাতু, ফাত্তু কইয়া ডাকে তাই আমি বাতাসী নামে চলি। ”

শ্রাবণ্য হেসে ফেলল। তৌহিদ বিব্রতবোধ করলো। ও আসলে একটু রসিকতা করার চেষ্টা করেছিল। ব্যাপার টা অন্যদিকে গেল।

খাবার টেবিলে এবার মিশুক কে ধরলো। বলল,

“তুমি কী এখানে থাকবে রঙ্গনাকে নিয়ে?”

মিশুক অপ্রস্তুত হলো না। এই ভদ্রলোক কে ওর চেনা হয়ে গেছে৷ ও হেসে বলল,

“জি। মা চাইছেন ঘরজামাই থাকি। আমার সমস্যা নেই, অন্যদেরও সমস্যা নেই।”

“আচ্ছা, আচ্ছা। তবে ঘর জামাই দের কেউ ভালো চোখে দেখে না। ”

রঙ্গনা জবাব দিলো,

“না দেখলে না দেখবে তাতে আপনার সমস্যা কী?”

তৌহিদ হাসার চেষ্টা করে বলল,

“আরে না না সমস্যা না। আর ভালোই হইছে তোমরা থাকবে। তুলি থাকবে না, মাকে কে সামলাবে। স্বপ্নীলের তো বুদ্ধি কম। ”

স্বপ্নীল এবার রেগে গেল। রেগে গিয়ে বলল,

“আপনার বুদ্ধি কম, আপনার মাথা ভরা গু। ”

তৌহিদ হতবুদ্ধি হয়ে বসে রইলো। রঙ্গনা বলল,

“ঠিক বলছিস। ”

এরপর একটা ছোটখাট ঝগড়াটাইপ হয়ে গেল। শিলা তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিলেন তিনি এসে সামলালেন। দাদু সব শুনেও এলেন না। তবে স্বপ্নীলের উপর খুশি হলেন। তার মনের কথাটা বলে দিয়েছে।

শেষমেস ঝগড়াঝাটি থেমে যে যার মতো ঘুমাতে গেল। তুলি একটা কথাও বলল না। ভয়ংকর চাহনী দিতেই তৌহিদ ঠান্ডা হলো।

মিশুক রঙ্গনার ম্যুড ভালো করতে ও’কে নিয়ে মাওয়া যাবে। সাথে শ্রাবণ্য আর স্বপ্নীলও। কিভাবে যেন রিন্টি, মন্টিও টের পেল। তারাও যাবে। সবাই রেডি হয়ে গেছে। তৌহিদ এসে রিন্টি, মন্টিকে বলল,

“এই তোমরা ঘুমাতে যাও, কোথাও যাবে না। ”

মন্টি দাঁত কিড়মিড় করে বলল,

“বাবা, এভাবে কথা বলবে না। আমি আর আমার বোন কী তোমার চাকর?”

তুলি রঙ্গনাকে বলল, ওদের খেয়াল রাখিস।

রঙ্গনার মেজাজ খারাপ । বলল,

“পারব না। ”

এরপর তুলিও ওদের সঙ্গে যাবার জন্য তৈরী হয়ে নিলো। তৌহিদ হতভম্ব হয়ে বসে রইলো। শিলাকে বলল,

“দেখছেন মা, কেউ একবার আমাকে যেতেও বলল না। আমার কিন্তু যাবার ইচ্ছে ছিলো। ”

শিলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

“থাক তুমি ঘুমাতে যাও। তোমার এমনিতেই শরীর ভালো না.. হসপিটাল ঘুরে এলে।”

তৌহিদ ভীষণ মন খারাপ করে বসে রইলো। তুলি, রঙ্গনা, মিশুক কে ফোন করলো৷ ওরা কতদূর গেল, যদি ও’কেও নিয়ে যেত।

চলবে….

কুসুম কাঁটা পর্ব-২৬+২৭

0

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-২৬
শিলা ভীষণ খুশি হলেন। চাকরি করতে গিয়ে স্বপ্নীলের নাজেহাল অবস্থা তার চোখে পড়েছে বারবার। কিন্তু বারন করতে পারেন নি। করা যায়ও না অবশ্য। জোর করে হলেও ওর উপর আরেকজনের দায়িত্ব আছে। শ্রাবণ্য ভীষণ ভালো মেয়ে। শিলার মনে হয় শুধু ভালো শব্দ টা দিয়ে শ্রাবণ্যকে বিশেষায়িত করলে কম করা হবে। স্বপ্নীলের সঙ্গে মানিয়ে নেবার ব্যাপার টুকুও ওর দারুন।শিলা জানতেন না যে শ্রাবণ্যকে ওর বাবা বিয়ে দিয়েছেন জোর করে। শুধু শিলা না, এই ব্যাপার টা কেউ ই জানে না। বাড়ির সবাই এই কথাটা যখন জেনেছে সবাই ই মর্মাহত হয়েছে। শিলা মুনসুর সাহেব কে জিজ্ঞেস করেছিল, ভাই মেয়ের বিয়েতে মত আছে তো। মুনসুর জবাবে বলেছেন,

“আছে। মেয়ে ভীষণ রক্ষনশীল। ওর ব্যাপারে আমার সিদ্ধান্ত ই সব। ”

শিলা মেনে নিয়েছে। এই যুগে এসব ব্যাপার যদিও খুব কম ই দেখা যায়। তবুও ব্যতিক্রম তো দুয়েকজন থাকেই। শ্রাবণ্যকে সেই ব্যতিক্রম দলের একজন ভেবেছিলেন। কিন্তু বিয়ের পর আসল ঘটনা জানতে পেরেছিল। শিলা শ্রাবণ্য কে জিজ্ঞেস করেছিল,

“তুমি কী চাও শ্রাবণ্য?”

শ্রাবণ্য কঠিন গলায় বলেছিল, আমার চাওয়া পাওয়ার আসলে কোনো দাম ই তো নেই।

“বাবা মায়ের কাছে না থাকলেও এখানে আছে। তুমি এখানে ঠিক সেরকম স্বাধীনতা পাবে, যেটা তুলি আর রঙ্গনা পেয়েছে। তবে আমি চাই স্বপ্নীল কে চিনতে জানতে তুমি সময় নাও। অন্তত ছয়মাস সময় নাও। স্বপ্নীল বুঝদার ছেলে। তুমি না চাইলে ও লিমিট ক্রস করবে না কখনো। আমি তোমাকে সময় দিলাম। ”

শ্রাবণ্য তখন বলেছিল,

“আমাকে আপনি গ্রাজুয়েশন শেষ হওয়া অবধি সময় দিন। ”

শিলা রাজী হয়েছে। দুজনের এই কথোপকথন আর কেউ জানেনা। শিলা লক্ষ্য করেছে শ্রাবণ্য দিন দিন কিভাবে স্বপ্নীলের একজন এই বাড়ির একজন হয়ে উঠেছে। আন্টি থেকে আম্মু সম্বোধনে নামতেও বেশী সময় লাগে নি। স্বপ্নীলের পাশে আছে ছায়া হয়ে।

শিলা মনে মনে ভাবেন, স্বপ্নীলের এই সাফল্যের কৃতিত্ব শুধু শ্রাবণ্য’র ই।

***
কথা ছিলো মিশুক দুই তিন দিন থেকে চলে যাবে। কিন্তু সেখানে চারদিন হয়ে গেছে এখনো যাওয়ার নাম করছে না। ওদিকে আপু দুলাভাই এর সঙ্গে একা আছে। দুলাভাই কে নিয়ে এখন এক আত্মীয়ের বাসায় উঠেছে। বাসাটা হসপিটালের কাছে বলে সেখানে ওঠা। রঙ্গনা মিশুক কে বলল,

“তুমি ঢাকায় কবে যাবে?”

মিশুক মাত্র ঘরে এসেছে। রঙ্গনা ড্রেসিং টেবিলের সামনে। চুলে ব্রাশ করছে। বিয়ের পর বোধহয় সাজগোজের ব্যাপারে একটু সচেতন হয়েছে। প্রায় ই সেজেগুজে থাকে।

মিশুক ভ্রু নাচিয়ে বলল,

“আমার বাড়ি থেকে আমাকেই বের করার প্ল্যান করছ?”

“তোমার বাড়ি? এটা তো বাবার বাড়ি।”

মিশুকের ভালো লাগলো, রঙ্গনার মুখে বাবা শব্দটা শুনে। বাবা, মাও অবশ্য রঙ্গনা কে মাথায় করে রাখছে। রাখার মতোই অবশ্য।

মিশুক বলল,

“বাই দ্য ওয়ে, আমাদের কিন্তু ঢাকায় ফ্ল্যাট নিতে হবে? কোথায় নিলে ভালো হবে তোমার জন্য? ”

“কেন? রঙতুলিতে সমস্যা কী?”

“ব্যাপার টা ঘর জামাই টাইপ হয়ে যায় না?”

“তাতে কী? আমি এখন রঙতুলিতে থাকব। ”

মিশুক মাথা নেড়ে বলল,

“আচ্ছা। ”

“তবে মাঝেমধ্যে এখানে এসেও থাকতে পারি। এই বাড়িটাও ভালো লাগছে। ”

মিশুক হাসলো। বলল,

“আমারও শাশুড়ী পরিবারের সঙ্গে থাকতে আপত্তি নেই। তারাও আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করেন। ”

রঙ্গনা বাঁকা চোখে একবার মিশুক কে দেখলো।

বিছানায় দুজন দুইপাশে শুয়ে পড়লো। রঙ্গনা হঠাৎ বলল,

“আমার একটা কথা আছে। ”

মিশুক ওর দিকে না তাকিয়েই বলল,

“বলো। ”

“ব্যাপার টা আরও আগেই বলা উচিত ছিলো…

মিশুক থামিয়ে দিয়ে বলল,

“এক মিনিট! বাই এনি চান্স তুমি কী বলতে চাইছ, আমাকে মেনে নিতে পারবে না। তোমার মনে শুধু ওই লোক টাই আছে। কী যেন নাম…

রঙ্গনা স্থির চোখে কিছু সময় দেখে বলল,

“হ্যাঁ। ”

“ইশ! ভীষণ সস্তা ডায়লগ। আর এসব আমাকে বলেও লাভ নেই। ”

“কেন?”

“কেন মানে? আমি তো জানি কিভাবে মানিয়ে নিতে হয়।”

রঙ্গনা কিছু বলল না। চুপ করে রইলো। মিশুক একটু এগুতে গেলে রঙ্গনা শাসিয়ে বলল,

“একদম না। আমার সীমানায় আসবে না। ”

মিশুক হেসে ফেলল। ও সীমানা অতিক্রম করার আগেই নিচে হৈচৈ এর শব্দ হলো। দুজনেই দ্রুত নিচে নেমে এলো।

নিচে ভয়াবহ এক কান্ড ঘটে গেছে। স্বপ্নীলের আরও আগে আসার কথা ছিলো। ব্যস্ততার অজুহাতে আসে নি, সারপ্রাইজ দিবে শ্রাবণ্য কে। আজ এসে ফোন করেছে শ্রাবণ্য কে। শ্রাবণ্য কয়েক সিড়ি নামতেই স্বপ্নীল দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো। বেচারা এমন ভাবে জড়িয়ে ধরলো যে শ্রাবণ্যসহ পড়ে গেল। শব্দ পেয়ে বাড়ির সবাই ছুটে এসেছে। মিশুকের মা শ্রাবণ্য কে হাত ধরে ওঠাতে ওঠাতে বলল,

“আহারে! ব্যথা পাইছ?”

শ্রাবণ্য লজ্জায় তাকাতে পারলো না। স্বপ্নীল নিজেও নাকে ব্যথা পেয়েছে। কিন্তু চোরের মতো এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে। মিশুক রঙ্গনাকে ফিসফিস করে বলল,

“দেখো, স্বপ্নীল কয়েকদিন বউকে না দেখে অস্থির হয়ে গেছে! তোমার ভাই, দেখলে মনে হয় না।”

রঙ্গনা মিশুক কে কিলার টাইপ লুক দিয়ে স্বপ্নীল কে বলল,

“তুই এই কাজ টাও ঠিক করে করতে পারলি না! জড়িয়ে ধরার বদলে কী লাফিয়ে ওর গায়ে ওঠার চেষ্টা করেছিস। ”

স্বপ্নীল মাথা আরও নিচু করে ফেলেছে। মিশুক বলল,

“স্বপ্নীল কে এই ব্যাপারে আমি বুঝিয়ে বলব। তুমি যাও। ”

মন্টি, রিন্টিও উঠে এসেছে। ওরা শ্রাবণ্যর ঘরে ছিলো। ওরা বলল,

“মনি আমরা তোমার ঘরে ঘুমাই। মামা যদি রাতে আবার লাফিয়ে পড়ে। ”

রঙ্গনা দুজন কে কঠিন এক ধমক দিতে যাবে তখনই মিশুক হেসে ফেলল।

***
রাফাত প্লেটে আরও ভাত নিলো। সঙ্গে ঝোলে মাখা এক টুকরো রুই মাছের পেটি। খেতে খেতে বলল,

“আকাশী, তুমি চাইলে ভাতের হোটেল দিতে পারো। চমৎকার রান্না কিন্তু তোমার। ”

আকাশী স্মিত হাসলো। ও এদিক ওদিক তাকিয়ে ঘরটা দেখছে। দুই রুমের ফ্ল্যাটে তেমন আসবাব নেই। কিছু বইপত্র, দেয়ালে হ্যাংগার ঝুলিয়ে জামাকাপড় রাখা। আর ছোট টেবিলে প্রয়োজনীয় জিনিস।

“আপনি এখানে একা থাকেন?”

“হ্যাঁ। ”

“ভয় লাগে না?”

“হ্যাঁ লাগে। রাতে দেখলাম ভীষণ মোটা একটা টিকটিকি লাফিয়ে গায়ে পড়লো। ভয়ে এক চিৎকার দিলাম। ”

আকাশী হেসে ফেলল। রাফাত বলল,

“তুমি রান্না কার থেকে শিখেছ?”

“কারোর থেকে না। করতে করতে শিখেছি। ”

রাফাত খাওয়া বন্ধ করে অবাক চোখে আকাশীকে দেখে বলল,

“স্ট্রেঞ্জ! এতো কঠিন বিষয় একা একা শিখেছ! তুমি তো ব্রিলিয়ান্ট। ”

আকাশীর বুকে একটা ধাক্কার মতো লাগলো। শুভর সঙ্গে থাকার সময় প্রায় ই একটা কথা শুনতো, রান্না এ আর এমন কী! ভাব করছ যেন হিল্লিদিল্লি জয় করে ফেলছ! আকাশীর ভীষণ মন খারাপ হতো। ও রাঁধতে পারে না প্রথমে সেটা শুনেও শুভ বলেছিল, এতো সহজ জিনিস টাও পারো না। বাড়িতে মোমের পুতুল হয়ে ছিলে! আকাশী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মানুষে মানুষে কত তফাৎ!

চলবে….

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-২৭
শুভ দাঁড়িয়ে আছে আকাশীর কলেজের সামনে। এর আগেও দুদিন দাঁড়িয়ে ছিলো। আকাশীর দেখা পায় না। যেখানেই থাকুক, পড়াশোনা নিশ্চয়ই ছেড়ে দেয় নি। পড়াশোনা নিয়ে হঠাৎ ভীষণ সিরিয়াস হয়ে উঠেছিল। গত বছরও খুব পড়াশোনা করেছে। রান্না, বান্না, পার্লারের কাজ সব শেষ করে পড়তে বসতো। মোবাইলের লাইট জ্বালিয়ে রাতের অধিকাংশ সময় পড়েছে। ফজরের নামাজের পর ঘন্টা দুয়েক ঘুমিয়ে আবার কাজে ছুটেছে। শুভ ভীষণ অবাক হতো, প্রকাশ করতো না। একটা মানুষ এতটা কাজের উদ্দীপনা কোথা থেকে পায়!

আকাশীকে দেখা গেল। আগের থেকে রোগা হলেও গায়ের রঙ উজ্জ্বল হয়েছে। মুখের ত্বক চকচকেও। শুভ’র বুকের ভেতর একটু চিনচিনে ব্যথা হলো। আকাশী তাহলে ভালোই আছে৷ না ভীষণ ভালো আছে।

শুভ নাম ধরে ডাকলো।

“আকাশী….!”

আকাশী থমকে দাঁড়ালো। পরিচিত কন্ঠস্বর। শুভ সামনে এসে দাঁড়ালো। শক্ত চোখ, মুখের পরিবর্তে অন্য এক মানুষ কে দেখলো আকাশী। নির্লিপ্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো,

“এখানে কেন এসেছ?”

“এতটা স্বার্থপর সত্যিই কী তুমি আকাশী? আমার বিশ্বাস হয় না। ”

“না হবার তো কিছু নেই। আমি স্বার্থপর ই। বাবা, মা’কে নাহলে কেন ছেড়েছি। ”

শুভর গলার স্বর খুবই মিঠা। বলল,

“আমাকে ভালোবেসে ছেড়েছিলে। আমি জানি সেটা। কিন্তু তাই বলে এতো অভিমান! কতগুলো মাস তোমার আমার দেখা হয় না।”

“দেখার দরকার আছে শুভ? ”

“কেন? সব কী শেষ হয়ে গেছে? ”

রাস্তায় দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে কথাগুলো হচ্ছিলো। আকাশী আশেপাশে দেখলো। কেউ কেউ ও’কে চিনে এখানে। এসব প্লেসে সিন ক্রিয়েট করার আসলে কোনো মানে হয় না। আকাশী শুভ কে বলল,

“তোমার সঙ্গে আমার আর কথা নেই। আমি আমার মতো গুছিয়ে নিচ্ছি। তুমি ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিও। সাইন করে দেব। ”

শুভ যতটুকু নরম আচরণ দেখাচ্ছে সেটুকু স্রেফ নাটক ছাড়া আর কিছুই না। জেরিন নামের কাঁটা টা ওর জীবনে না আসলে ও বুঝতেই পারতো না আকাশী ওর জীবনে খাটি সোনা ছিলো।

শুভ কঠিন গলায় বলল,

“বাহ! ডিভোর্স পর্যন্ত চলে গেছ? তা হঠাৎ জীবনে কী এমন সোনার হরিন পেলে যে আমাকে ছুড়ে ফেলতে চাইছ!”

আকাশী স্বাভাবিক গলায় বলল,

“সোনার হরিন তো তুমি পেয়েছ শুভ। সেই সোনার হরিনের নাম তো জেরিন তাই না?”

শুভ হকচকিয়ে গেল। বলল,

“আমি সব বুঝিয়ে বলছি তোমাকে…. যা শুনেছ সেটা পুরোটা সত্যি না। ”

আকাশী রুক্ষ গলায় বলল,

“আমি কিছু শুনতে চাই না৷ যদি চাইতাম তাহলে তোমার সামনে যেতাম। তোমার সঙ্গে সেদিন ই সব কিছু শেষ হয়ে গেছে যেদিন ঘর ছেড়েছি৷ রোজ রোজ ঘর ছাড়ার মেয়ে যে আমি নই সেটা তোমার বোঝা উচিত অন্তত।”

আকাশীকে শুভ’র বিয়ের খবর শ্রাবণ্য জানিয়েছে টেক্সট করে। ফোনে কিংবা সামনাসামনি বলতে ওর অস্বস্তি হচ্ছিলো বোধহয়। আশ্চর্য ব্যাপার হলো আকাশীর তাতে দু:খবোধ হবার বদলে নির্ভার লেগেছে। নিজেকে মুক্ত পাখির মতো মনে হয়েছে। খাঁচা ছাড়া পাখিরা যেমন হয় তেমন।

শুভ নরম গলায় বলল,

“আমি বিপদে পড়েছি আকাশী। তুমি প্লিজ আমার কথা শোনো। ”

“আমি কিছু শুনতে চাই না। তুমি জেনে দু:খ পেতে পারো, তবুও বলি বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্ক এখন সহজ। তোমাকে ছেড়েছি বলেই সে আমাকে আরেকটা সুযোগ দেবার কথা ভেবেছে। তোমার ধারণা ঠিক। আমি আসলেই স্বার্থপর। আমি সেই সুযোগ গ্রহন করেছি।”

শুভ বিস্মিত গলায় বলল,

“তার মানে তোমার জীবনে আমার আর কোনো গুরুত্ব নেই। ”

“হ্যাঁ নেই। তোমারও তো নেই। তুমিও তো তোমার মায়ের পছন্দের পাত্রীকে বেছে নিয়েছ। আমি কিন্তু কোনো ঝামেলা করি নি। পুলিশ, কানুন সব তো আমার পক্ষে থাকবে তাই না!”

শুভ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। জেরিন নামের যে মেয়েটা ওর গলার কাঁটা হয়ে আছে সেই মেয়েটার আসল পরিচয় হলো সে ডিজিটাল প্রস্টিটিউট। প্রায় ই বসের সাথে রিসোর্টে যায়। বিনিময়ে দামী গিফট, গয়না টাকা পয়সা হাতিয়ে নেয়। এই নিয়ে বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই। নির্লজ্জের মতো বলে, আরেকজনের সঙ্গে শুইলে কী সমস্যা? তোমার কাছে যখন আসব তখন তো গোসল করেই আসব। গোসল করলেই তো পরিষ্কার। এই কথা শোনার পর শুভর ভীষণ বমি পেল। ছি:! এমন মেয়েও হয়। এই মেয়ের হাত থেকে নিস্তার পেতে হলে শুভ কে পাঁচ লাখ টাকা দিতে হবে। কোথায় পাবে এতো টাকা ও!

***
রঙ্গনা আর মিশুকের রিসিপশনের অনুষ্ঠানের জন্য কার্ড ছাপানো হলো। স্বপ্নীল অফিসে অনেকগুলো কার্ড নিয়ে এসেছে। সবাই কে দিলো। কেউই প্রশ্ন করলো না৷ শাফি ভাই শেয়ালের মতো হেসে বলল(শেয়ালের মতো হাসি স্বপ্নীলের মনে হয়। ও শেয়াল দেখে নি তবুও মনে হয়।)

“তোমার বোনের বিয়েতে না ঝামেলা হইছিল?”

স্বপ্নীল রাগী গলায় বলল,

“তাতে আপনার কী সমস্যা? ”

শাফি ভাই স্বপ্নীলের রাগ দেখে মিইয়ে গেল। বলল,

“আরে মিয়া সমস্যা হবে কেন? এমনিই জিজ্ঞেস করি। ভাই ব্রাদার রা জিজ্ঞেস করতে পারে না!”

“না পারে না। এগুলো অভদ্রতা। আমি কখনো অভদ্র আচরণ করি? তৃষাকে নিয়ে কখনো কিছু বলেছি!”

এক অফিস লোকের সামনে শাফি ভাই জবাব না দিয়ে পালালো যেন। স্বপ্নীল উঠে গিয়ে এক গ্লাস পানি খেল। নিজের সাহসে নিজেই স্তম্ভিত। দিতি আপা হেসে স্বপ্নীল কে বলল,

“ওয়েলডান ম্যান। তোমাকে ট্রেনিং যে দিচ্ছে তার জন্য আমার তরফ থেকে কফি ট্রিট আছে।”

স্বপ্নীল হাসলো। বিশ্বজয়ী হাসি।

***
শ্রাবণ্যর আগের সেমিস্টারের সিজি ভালো এসেছে। অনেক ভালো। কেউ কেউ বলছে লাস্ট পর্যন্ত এমন ধরে রাখতে পারলে ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডির জন্য রেফার করবে। আফরিন বলল,

“কিরে তুই বিদেশ যাবি তো। ”

শ্রাবণ্য জবাব দিতে পারে না। দেশের বাইরে পড়াশোনা, চাকরির স্বপ্ন সেই কবে থেকে। তবুও খুশি হতে পারে না। স্বপ্নীলের মুখ টা মানসপটে ভেসে ওঠে। স্বপ্নীল দিন দিন ওর উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে। কীভাবে এই মায়া কাটিয়ে দূরে যাবে।

ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে শ্রাবণ্য বাসার দিকে না গিয়ে স্বপ্নীলের অফিসে গেল। এর আগে গেট পর্যন্ত গিয়েছে শুধু। আজ একদম ফ্লোরে চলে গেল। যেতে অসুবিধে হয় নি। স্বপ্নীলের থেকে শুনতে শুনতে অলিগলি সব মুখস্থ।

স্বপ্নীল শ্রাবণ্যকে দেখে এতো খুশি হলো! চোখ, মুখ আনন্দে ঝলমল করছিল। অন্যরাও সবাই ও’কে ভালোভাবে ওয়েলকাম করলো। দিতি আপা, রোজ আপু উঠে এসে বলল,

“আজ ই তোমার কথা হচ্ছিলো। আজ ই তুমি এসে গেলে। ”

শ্রাবণ্যরও ভালো লাগলো। ঘন্টা দুয়েক সেখানে থেকে শ্রাবণ্য চলে এলো। স্বপ্নীল রিকশায় উঠিয়ে দিয়েছে। সেই বিকেলে শ্রাবণ্য বুঝলো ওর জীবনে স্বপ্নীল আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে। শ্রাবণ্যর স্বপ্নের পুরুষ মোটেও এমন ছিলো না। সিনেমার নায়ক দের মতো ছিলো। তারা কেউ আর স্বপ্নে আসে না। স্বপ্নে আসে বোকাসোকা ছেলেটা। যে জড়িয়ে ধরতে পর্যন্ত পারেনা ভালো করে।

***
“এই শাড়িটা তোমাকে ভালো লাগছে না রঙ্গনা। ”

রঙ্গনা বাঁকা চোখে মিশুক কে দেখলো। শপিংমলে এসেও আঠার মতো লেগে আছে। রঙ্গনা শাড়ি দেখতে দেখতে বলল,

“আমি কী কিছু জিজ্ঞেস করেছি তোমাকে?”

“না জিজ্ঞেস করলেও বলা উচিত। তাই বললাম।”

রঙ্গনা সেই শাড়িটা নিলো। বলল,

“তুমি মনে হয় কিপটে। রাফাত কিন্তু কিপটে ছিলো না। ও আমাকে বলতো, যা ভালো লাগে নিয়ে নাও। তোমাকে সব কিছুতে ভালো লাগে।”

মিশুকের কথাটা পছন্দ হলো না। বলল,

“আমি তো রাফাত না। ”

এরপরের পুরো সময়টা মিশুক চুপ করে রইলো। রঙ্গনারও মনে হলো একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে৷ ও তো রসিকতা করতে চেয়েছিল।

ঘন্টাখানেক কেনাকাটার পর ওরা কফিশপে গেল। মিশুক সেখানেও নিশ্চুপ। রঙ্গনা বলল,

“তোমার ম্যুড ঠিক আছে? ”

মিশুকের চোখের দৃষ্টি কোল্ড কফির গ্লাসে। বলল,

“আমি তো আর আকাশ না যে ম্যুড চেঞ্জ হবে। ”

রঙ্গনা বুঝলো ভাবওয়ালা ভদ্রলোক এবার সত্যিই রেগে গেছে।

“আচ্ছা ঠিক আছে আমি আমার ভুল মেনে নিচ্ছি। আই এম সরি।”

মিশুক তাকালো। রেগে থাকার অভিনয় আর হলো না। মুচকি হেসে বলল,

“আমি ওই শাড়িটা নিতে বারন করেছি একটা কারনে। তুমি নিজেই তো রঙধনু। সব রঙ তো তোমায় মানাবে না। ”

রঙ্গনা নিজেও হাসলো। এখন যা হচ্ছে একটু তাড়াতাড়িই হচ্ছে, মনে হচ্ছে ভালোই হচ্ছে।

***
আকাশীর মন মেজাজ বিক্ষিপ্ত। রুমে এসে শুয়ে থেকেছে৷ কিছু খায়ও নি। আফরিন এসে খোঁজ নিয়েছে। আবার শরীর খারাপ হলো কিনা। আকাশীর এই সময় টা ভালো যাচ্ছে। সব ভালো মানুষ দের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। আফরিনও সেই দলের একজন।

বিকেলে রাফাত ফোন করলো। আকাশী ফোন ধরতেই বলল,

“তুমি ব্যস্ত?”

“না ভাইয়া।”

“আমি একটা ব্যাপার ভেবেছি। তোমার বিজনেসে পার্টনার হবো। ”

আকাশী বুঝতে না পেরে বলল,

“বুঝতে পারছি না ভাইয়া।”

“আরে রঙ্গনা সব জিনিসপত্র পাঠিয়েছে। শাড়ি, লেহেঙ্গা, টপ সব। এগুলো কী করব! ও বলল বেঁচে দিতে।”

আকাশী হেসে ফেলল। রাফাত বলল,

“ভাবছি তোমার সঙ্গে ডিসকাস করব৷ তুমি তো ব্যবসায়ী মানুষ। ”

আকাশী হাসলো। রাফাতের কথাগুলো শুনতে ভালো লাগছে। রাফাত বলল,

“তুমি খুব বেশী ব্যস্ত না হলে ধানমন্ডিতে চলে আসো। বিজনেস নিয়ে একটা প্ল্যান করলাম, তোমাকে ট্রিটও দিলাম। তুমি আমাকে রুই মাছের চমৎকার প্রিপারেশন টা খাইয়েছিলে।”

“ট্রিট লাগবে না। আমি এমনিই আসব।”

“আচ্ছা আসো। আমি খাব, তুমি নাহয় বসে বসে দেখো। ”

আকাশী হাসলো।

রাফাত ফোন রাখলো৷ ওর আসলে কথা বলার এখন তেমন কেউ নেই। বেকার মানুষ দের তেমন কেউ দাম দেয় না। এই ব্যাপার টা টের পাচ্ছে। আকাশী ভেরি গুড লিসেনার। কথা কম বললেও কথা বলে আরাম পাওয়া যায়।

চলবে….

কুসুম কাঁটা পর্ব-২৪+২৫

0

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-২৪
রঙ্গনা হঠাৎ ই ভীষণ চুপচাপ হয়ে গেল। তেমন রাগছে না, কথাও বলছে কম। বাড়ির সবাই ভীষণ অস্থির হলো। যাই বলুক, মনে মনে ও এখনো এই ধাক্কাটা সামলাতে পারে নি। ও জেনে ভীষণ অবাক হলো যে ওর স্ট্রেটফরোয়ার্ড স্বভাবের জন্য রাফাতের মা তার ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিতে চান নি। আরও একটা ব্যাপার, মিশুকের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো ব্যাপার টাও তাদের ইনসাল্টিং লেগেছে। এটাও যে সমস্যা হতে পারে সেটা জেনেই বরং অবাক হলো। মা কখনো বলে নি রঙ্গনা তোমাকে বদলাতে হবে। বাড়ির সবাই ই বলতো ও তো একটু অমনই। দাদুর তো সোজা কথা ছিলো, তার নাতনী যেমন তেমন দেখে যে ছেলে বিয়ে করতে চাইবে তার সঙ্গেই বিয়ে হবে। না চাইলে বিয়ে হবে না।

রাফাত ফোন করেছে, টেক্সট করেছে। রঙ্গনার ইচ্ছে করেনি কথা বলতে। ও অনেক বার সরি বলার পর রঙ্গনা জবাবে লিখেছে,

“আমি আমার ভাগ্য কেঅ মেনে নিলাম। আল্লাহ আমাকে এমন ডাকাত ফ্যামিলির হাত থেকে বাঁচিয়েছে তার জন্য শুকরিয়া আদায় করছি। আশা করি তুমি তোমার পরবর্তী জীবনে একটু সচেতন হবে। অবশ্য নিজের ফ্যামিলি নিয়ে আরও আগে সচেতন হওয়া উচিত ছিলো। আর তুমি বারবার কেন ক্ষমা চাইছ? তুমি নিজেও তো ভিক্টিম। ক্ষমা চাইবে তোমার পরিবার। ভালো থেকো।”

মেসেজ টা পাঠানোর পর রঙ্গনা শান্তি পেল। ওর ধৈর্য্যশক্তি বেশী, এতদিন তেমন ই জানতো। বাবার মৃত্যু ছাড়া কখনোই কোথাও সেভাবে ভেঙে পড়ে নি। এখনো যে খুব ভেঙে পড়েছে তেমন না। কিন্তু ওর মধ্যে একটা ব্যাপার চলে এসেছে। নিশ্চয়ই ও ভীষণ খারাপ। তাই ও’কে শিক্ষা দেবার ব্যবস্থা করেছে। পরে আবার মনে হয় ও কেন খারাপ হবে। যারা অন্যায় করেছে তারা খারাপ মানুষ। এসব সাত, পাঁচ ভাবনা বেশ কিছুদিন ধরে মাথায় ঘুরছে।

ওয়াশরুমের দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো দু’বার।

“রঙ্গনা!”

রঙ্গনা শাওয়ার বন্ধ করলো। মিশুক ডাকছে। আবারও ডাকলো।

“রঙ্গনা!”

“হ্যাঁ। ”

“তুমি ঠিক আছ?”

“ঠিক থাকব না কেন?”

মিশুক হেসে ফেলল। দেরি হচ্ছে বলে ও টেনশন করছিল। রঙ্গনা বেরিয়ে এলো পাঁচ মিনিটের মধ্যে। মিশুক দাঁড়িয়ে আছে তটস্থ হয়ে। ও কিছু বলার আগে বলল,

“আমার শাওয়ার নিতে সময় লাগে। এতো অস্থির হবার কিছু নেই। আমাকে নিয়ে ভয়ও পেতে হবে না। আমি নিজেকে ভীষণ ভালোবাসি।”

মিশুক মৃদু হেসে তাকালো। রঙ্গনার ভেজা চুল। পরনে ট্রাউজার আর টিশার্ট। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ক্রিম মাখছে। মিশুক টাওয়াল নিয়ে চুল টা মুছে দিতে গেল। হঠাৎ মিশুকের চুল মুছিয়ে দিতে আসায় রঙ্গনা হকচকিয়ে গেল। মিশুক অতি যত্নে চুল মুছিয়ে দিচ্ছে। রঙ্গনার একটু একটু ভালো লাগছে। মিশুক হঠাৎ অন্যরকম গলায় বলল,

“অস্থির হবার দরকার অবশ্যই আছে। কদিন আগেই আমাদের বিয়ে হলো। বউকে না দেখে আমি অস্থির হতেই পারি।”

রঙ্গনা পিছু ফিরে তাকালো। দুজনের মাঝখানে অল্প দূরত্ব। চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে রইলো। রঙ্গনার ঠোঁটে স্মিত হাসি। বলল,

“একটা সত্যি কথা বলব?”

মিশুক আগের মতোই চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে। বলল,

“সত্যি, মিথ্যে যা বলতে ইচ্ছে হয় বলো।”

“আমি তোমাকে পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারছি না। প্রথমে মনে হলো ধুরন্ধর, তারপর মনে হচ্ছে মিচকে শয়তান। ”

“আর এখন?”

“ঠিকঠাক বিশেষন খুঁজে পাচ্ছি না। আগের সবকিছু ছাড়িয়ে গেছ। ”

মিশুক নি:শব্দে হাসলো। রঙ্গনাকে আরেকটু বিস্মিত করতে আচমকাই ওর গালে চুমু খেল। বলল,

“আমি অপেক্ষায় রইলাম ঠিকঠাক বিশেষনের। এখন তৈরী হয়ে নাও। আমাদের বেরোতে হবে। ”

রঙ্গনা অবশ্য তেমন বিস্মিত হয় নি। মিশুক এমন কাজ এই প্রথম করে নি। এর আগেও করেছে। দুদিন আগেই টের পেল প্রথম। কপালের পাশের চুলগুলো সরিয়ে আলতো চুমু খেল। রঙ্গনা শক্ত হয়ে রইলো। মিশুক একটু সময় নিয়ে গালে চুমু খেল। রঙ্গনা শিহরিত হলো। এই প্রথম কোনো পুরুষের ঠোঁটের স্পর্শে শিহরিত হলো। এর আগে ওর জীবনে প্রেম এসেছে। তবে নিজেকে নিয়ে বরাবরই ও সংবেদনশীল ছিলো। সবকিছু থেকে নিজেকে দূরে রেখেছে। অবচেতন মনে একটা ব্যাপার ছিলো যে ওর সবকিছুর অধিকার শুধুমাত্র যে স্বামী হবে তার ই।

আজ রঙ্গনা শ্বশুর বাড়ি যাবে। মিশুকের দুলাভাই এখনো হসপিটালে আছে। বাবা, মা বাড়িতে গিয়ে একটু গুছিয়ে নিয়ে রঙ্গনাকে নিতে এসেছেন। পরিবারের সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এরপর ঢাকায় বড় করে রিসিপশন হবে। রঙ্গনা এখন আর আলাদা করে নিজের মতামত দিচ্ছে না। মা, দাদু যা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তাতেই সায় দিচ্ছে। আলাদা করে এখন আর কোনো মতামতও নেই।

মিশুকের বাবা, মা ভীষণ আন্তরিক। আপুও ভালো। দুলাভাই কথা বলার অবস্থায় এখনো আসে নি। রঙ্গনা সহ বাকীরা হসপিটালে গিয়ে দেখে আসছে। শুধু মিশুক কেই ওর মিচকে শয়তান মনে হয়।

রঙ্গনা মেরুন রঙের জামদানী পরলো। সঙ্গে হালকা গোল্ডের গহনা। গহনাগুলো মিশুকদের বাড়ি থেকে পাঠানো। তার নিজেদের পছন্দে শপিং করে পাঠিয়েছে। আপু আবার ফোন করে বলেছে,

“রঙ্গনা রিসিপশনের আগে আমরা নিজেদের পছন্দে শপিং করব কিন্তু। ”

রঙ্গনা বলেছে,

“লাগবে না আপু। যা আছে তাতেই হবে। ”

“মোটেও হবে না। দেখি মিশুকের সঙ্গে কথা বলে, ও বেশী ছুটি ম্যানেজ করতে পারলে তোমরা ইন্ডিয়া যাবে। ”

রঙ্গনা কিছু বলে নি। ভালোও লাগে, আবার ভয়ও হয়। মানুষ চেনা ভীষণ মুশকিল।

রঙ্গনা বসার ঘরে ঢুকতেই মিশুক তাকালো। ফোনে কিছু একটা দেখছিল। তাকিয়ে রইলো তো রইলোই। রঙ্গনা মনে মনে বলল,

“ব*দমায়েশ একটা। এতো সুন্দর নিশ্চয়ই লাগছে না আমাকে!”
***
স্বপ্নীলের ভীষণ মন খারাপ। ও কিছুতেই ছুটি ম্যানেজ করতে পারছে না। বৃহস্পতিবার এর মান্থলি মিটিং এ থাকতেই হবে। এদিকে শ্রাবণ্য সেজেগুজে রঙ্গনার শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে। স্বপ্নীল ভীষণ মন খারাপ করে বলল,

“তোমার যেতেই হবে। ”

“হ্যাঁ, রিন্টি মন্টিও যাবে।”

“তোমার ক্লাশ মিস হবে না?”

শ্রাবণ্য চোখের মেকাপ টা ঠিক করতে করতে জবাব দিলো,

“হবে। তাতে কী?”

স্বপ্নীল মনমরা হয়ে বলল,

“আমি তো যেতে পারছি না। চাকরি বাকরি আমার ভালো লাগে না এজন্য, কোনো ফ্রিডম নেই। আর এক সপ্তাহ বাকী। আমাকে অফিস থেকে বের করে দিলে ভীষণ খুশি হবো।”

শ্রাবণ্য হেসে ফেলল। বলল,

“আপনার মতো এমন অলস আমি দেখি নি। ”

“আমি অলস না। আমার কষ্ট হয়।”

শ্রাবণ্য সংযত হলো। স্বপ্নীলের সামনে হাসলে ও ভীষণ রাগ করে। ও বলল,

“বুধবারের মিটিং শেষ করে রাতের ট্রেনে চলে যাবেন। ”

স্বপ্নীল মন খারাপ করে আচ্ছা বলল। শ্রাবণ্য তো যাবেই। তাছাড়া ও তো ভুলিয়ে ভালিয়ে আটকেও রাখতে পারবে না। মন্টি, রিন্টির বয়সী হলে একটা জিনিসের লোভ দেখিয়ে আটকে রাখতো।

***
যাবার আগে রঙ্গনা কাঁদলো। তুলি আর শিলা কাঁদছে বলেই হয়তো কেঁদে ফেলল। স্বপ্নীল কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,

“আমি সবসময় বলি না তোকে বদলাতে হবে। সেটার দরকার নাই। যেমন আছিস তেমন ই থাক। এরকম পিওর থাকিস।”

***
আকাশী এই সাত টা পাঞ্জাবি নিয়ে কী করবে বুঝতে পারছে না। রঙ্গনাকে শাড়ি পাঠিয়েছে। পাঞ্জাবীর কথা বলতে সাহস হয় নি। মিশুক কে দিতে চেয়েছিল তুলি বারন করেছে। বলেছে রাস্তায় ফেলে দিতে। আকাশীর খারাপ লাগছে। এগুলোর ডিজাইন করতে ওর অনেক কষ্ট হয়েছে। কতো রাত জেগেছে। ও শ্রাবণ্যকে ফোন করলো। শ্রাবণ্য বলল,

“ওগুলো রাফাত ভাইকে দিয়ে দে।”

“উনি এখন পাঞ্জাবী নিয়ে কি করবে?”

“সেটা আমি কী জানি! তুই বলবি যে আপনার নামে বুকড, আপনাকে নিতে হবে। ”

আকাশী আমতা আমতা করলো। শ্রাবণ্য জোর করে রাফাতের নাম্বার দিলো। সেই সঙ্গে বলে দিলো যেন পেমেন্ট নিতে ভুল না করে।

শ্রাবণ্যর সূক্ষ্ম চাল আকাশী ধরতে পারলো না। রাফাত ভাইয়াকে ওর খারাপ মানুষ মনে হয় নি। সে এখন প্রায় নির্বাসিত। এই সময়ে একজন বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষীর দরকার। আকাশী হলেও হতে পারে রাফাতের একটু কাছের বন্ধু। শুভর ব্যাপার টা ও জানে। মা, বাবা, সবাই জানে। শ্রাবণ্য বারন করেছে আকাশীকে জানাতে। এতো আনন্দ করছিল রঙ্গনার বিয়েতে। ওর ভীষণ মায়া লেগেছে। আনন্দের সময় টা আনন্দে কাটুক ওর। দু:খের গল্প পড়ে শুনুক।

চলবে….

সাবিকুন নাহার নিপা

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-২৫
টুকটাক রান্নাবান্না রাফাত জানে। ভাত, ডিম, ডাল, মাংস, ভাজি এসব। গত এক মাস ধরে এসব চলছে। মা বাবা একমাস পর ছাড়া পেয়েছেন জেল থেকে। সেই বাসায় অবশ্য ও থাকে না, তবুও সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত। মামী জেল থেকে ছাড়া পায় নি। তার বিরুদ্ধে স্ট্রং প্রমাণ আছে। রাফাত নিজেও স্বাক্ষী দিয়েছে। কবে ছাড়া পাবে জানেনা। মা অসুস্থ হয়ে গেছেন। তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল নাকি। রাফাত শিলাকে ফোন করে রিকোয়েস্ট করেছিল। শিলা শুনেছে।

রাফাত তিন মাসের ছুটিতে আছে। ম্যানেজমেন্ট থেকে ও’কে মেইল করেছে মেন্টাল হেলথের ট্রিটমেন্ট নিতে। সব মিলিয়ে লাইফ টা পুরোপুরি এলোমেলো। সোসাইটিতে বাবা মায়ের থাকাও মুশকিল। শিগগিরই তাদের ফ্ল্যাট বিক্রি করে অন্য কোথাও শিফট হবার নোটিশ দেয়া হয়েছে। তাতে রাফাতের তেমন দু:খবোধ নেই। যে যেমন কর্ম করবে তেমন ই ফল পাবে। তবে ওর এখন অনেক ডিপ্রেসড লাগে। একা একা থাকে, বই পড়ে, সিরিজ দেখে, এক্সারসাইজ করে সময় কাটে, তবুও যেন কাটতে চায় না। মানুষ বলে সৃষ্টিকর্তা দু:সময় দেয় সুসময়ের জন্যই। ঠিক কী ভালো ওর জন্য অপেক্ষা করছে ও জানেনা। তবে এই দু:সময় কাটিয়ে ওঠা বেশ মুশকিল।

অপরিচিত নাম্বার টা দেখে রাফাত অবাক হলো। হাতে গোনা কয়েকজন এই নাম্বার জানে। রাফাত ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে মিষ্টি গলায় একজন বলল,

“হ্যালো আপনি কী রাফাত ভাইয়া?”

“জি। আপনি কে?”

“আমাকে চিনবেন না।”

“আচ্ছা নাহয় না চিনলাম। কিন্তু আপনার নাম নেই?”

ওপাশ থেকে জবাব আসতে একটু সময় লাগলো। বলল,

“আমি আকাশী। শ্রাবণ্যর বোন।”

“আমি তো তোমাকে চিনি। তুমি ভালো মেহেদী দিতে পারো।”

আকাশী স্মিত হাসলো। ভদ্রলোক কথা বলছেন পরিচিত ভঙ্গিতে। পরিচিত মানুষের সঙ্গে দেখা হলে যেমন কথা বলে তেমন। আকাশী বলল,

“ভাইয়া আপনার কিছু জিনিস আমার কাছে আছে?”

“আমার? কী জিনিস? ”

“কিছু কাস্টমাইজড পাঞ্জাবী। ”

রাফাত মনে করার চেষ্টা করলো। ওর স্মৃতিশক্তি তেমন দূর্বল না। বলল,

“আমি অর্ডার করেছিলাম? শিওর?”

“উঁহু। আপু দিয়েছিল।”

“রঙ্গনা?”

“হ্যাঁ। ”

“তাহলে আমাকে কেন দিচ্ছো। ও’কে দাও। ওর হাজবেন্ড পরুক। আমি তো আর ওর হাজবেন্ড না। ”

“পাঞ্জাবী গুলো আপনার মাপের। আপু মিশুক ভাইয়ের জন্য নতুন ডিজাইনের অর্ডার করেছেন। ”

রাফাত দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,

“আচ্ছা। আমি তোমার পেমেন্ট পাঠিয়ে দিচ্ছি। পাঞ্জাবী লাগবে না। ”

আকাশী একটু থেমে প্রশ্ন করলো,

“কেন লাগবে না? আপনি আর কখনো বিয়ে করবেন না? তখন পরবেন, তখন নাহয় মিলিয়ে কাস্টমাইজড শাড়িও করে নিবেন।”

রাফাত হেসে ফেলল শব্দ করে। বলল,

“মেয়ে, তুমি তো পাক্কা বিজনেসওম্যান। আচ্ছা যাও, তোমার পাঞ্জাবী পাঠিও। আর যদি বিয়েটিয়ে করি তাহলে তোমার থেকেই শাড়ির ডিজাইন করিয়ে নেব।”

আকাশীও হেসে ফেলল। বলল,

“থ্যাংক ইউ।”

ফোন রাখার দুই মিনিট পর রাফাত আকাশীকে আবারও ফোন করলো। বলল,

“তুমি রুই মাছের কোনো প্রিপারেশন পারো? তাহলে পাঞ্জাবীর সাথে সেটাও পাঠিও। আমি ওটার পেমেন্টও পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

****
রঙ্গনা ভেবেছিল শ্বশুর বাড়িতে এসে খুব অস্বস্তিতে পড়বে। বিয়ে নিয়ে কেউ কেউ হয়তো উদ্ভট কথাবার্তা বলে ফেলবে। কিন্তু শ্বশুর শাশুড়ী ব্যাপার দারুন ভাবে সামলেছে। শাশুড়ী বললেন, রঙ্গনাকে মিশু আগেই পছন্দ করে রাখছিল। ও আরেকটা প্রোমোশনের অপেক্ষায় ছিলো। তারপর বিয়ে করে ফেলবে। জামাইর এমন অবস্থা হলো যে আমরা দিশেহারা হয়ে গেছি। তখন মীরা বলল, মা তোমার জামাই যদি মরে যায় তাহলে আফসোস থাকবে। রঙ্গনা আর মিশুকের তাড়াতাড়ি বিয়ে দাও। আমরাও আর দেরি করিনি। আল্লাহ মুখ তুলে তাকিয়েছেন। জামাই সুস্থ হইতেছে আর ঘরে নতুন বউ আসতেছে। মিশুকের বড় চাচী বললেন,

“আলহামদুলিল্লাহ, মেয়ে খুব লক্ষী।”

শাশুড়ী গর্ব করে বললেন,

“ও তো জামাই কে রক্তও দিছে। ”

রঙ্গনা অবাক হলো শাশুড়ীর আন্তরিকতায়। ভদ্রমহিলা ওর জন্য মিথ্যে কথা বলেছে! মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো, পরিস্থিতি যাই হোক, সময় যতই খারাপ হোক এই মহিলাকে ও চিরদিন মাথায় করে রাখবে।

রঙ্গনা জানেনা যে শাশুড়ীর বলা কথাগুলো অন্য একজনের মাথা থেকে এসেছে।

***
স্বপ্নীল আশায় ছিলো ও’কে অফিস থেকে না করে দিবে। অবশ্য সেরকম ধারণা সবার ছিলো। ওর পারফর্ম্যান্স খারাপ না, কিন্তু সেটা আন্ডাররেটেড। দুই একজন ছাড়া কেউ জানেই না যে গাধার খাটুনি খাটে ও আর ক্রেডিট নেয় অন্যরা। পাশের ডেস্কের দিতি আপা স্বপ্নীল কে বলছে, কর্পোরেট জবে এমনই হবে স্বপ্নীল। যতক্ষন না তুমি শক্ত হবে ততক্ষন এমন ফেস করতে হবে। এসব জায়গায় চলাফেরা, কথাবার্তায় খুব চতুর হতে হয়।

স্বপ্নীল ধরেই নিয়েছে ও এসব জায়গায় উপযুক্ত না। এতো জটিলতা, চতুরতা ও’কে দিয়ে হবে না। একটা মিথ্যে বলতে গেলেও তোতলাতে হয়। কপালে ঘাম জমে।

লাস্ট অফিস মিটিং এ স্বপ্নীল জানতে পারলো ইন্টার্ন দের মধ্যে থেকে যে চারজন কে নেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে ও একজন। শাফি ভাইয়ের টিম থেকে ও একমাত্র লোক যাকে পার্মানেন্ট করা হয়েছে। স্বপ্নীল খবর টা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। স্তব্ধ হলো শাফি ভাইও। তৃষার সঙ্গে তার মাখামাখি ভালোই চলছে। ব্যাপার টা মনে হচ্ছে প্রেম প্রেম পর্যায়ে গেছে। সে এক্সপেক্ট করেছিল, তৃষা পার্মানেন্ট হবে। অবশ্য সেভাবেই গুটি সাজিয়েছিল। তৃষাকে সব কাজের ক্রেডিট দিয়ে ম্যানেজমেন্টের কাছে হাইলাইট করার চেষ্টা করেছিল।

কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর শাহরিয়ার ভাই নরম স্বভাবের। ভীষণ ফ্রেন্ডলিও। অফিসে ফর্মাল ড্রেসে আসে না, টিশার্ট, ট্রাউজার পরে আসেন। কিন্তু তার নজর তীক্ষ্ণ। সে শাফি ভাইকে বললেন,

“শাফি তোমার টিমের ৭০% কাজের ডেটা আগে স্বপ্নীলের ল্যাপটপে তারপর তৃষার ল্যাপটপে যেত। এটার কারণ অবশ্যই নেক্সট উইকে মেইল করে জানাবে। ম্যানেজমেন্ট তোমাকে অন্যচোখে দেখছে কিন্তু। ”

শাফি ভাইয়ের মুখ ছোট হয়ে গেল। সব অকল্পনীয় ব্যাপার শাফি ভাই আর স্বপ্নীলের সাথে ঘটছে।

দিতি আপা, রেবা আপা, হায়াত ভাই, রোজ আপু সবাই স্বপ্নীল কে ওয়েলকাম ট্রিট দিলো। শাহরিয়ার ভাই ও’কে এক বক্স চকলেট আর রজনীগন্ধার বুকে দিয়ে বলল,

“ওয়েলকাম ম্যান, তুমি সত্যিই ব্রিলিয়ান্ট একজন মানুষ। আশা করি এই অফিসে তোমার পথচলা এখন থেকে স্মুথ হবে। ”

স্বপ্নীলের চোখে পানি এসে গেল। এতো বড় খুশির খবর সবার আগে দাদুকে দিতে ইচ্ছে করলো। দাদু সবসময় ও’কে গাধা বলেন। এইবার ও নিজেকে প্রমাণ করতে পেরেছে।

স্বপ্নীল শ্রাবণ্যকে ফোন করলো। খুশির খবর টা দিতে গিয়ে বিশ্রী ভাবে কেঁদেও ফেলল। ভালোলাগায় ভীষণরকম মন আদ্র হলো শ্রাবণ্যরও। কিন্তু ও তো শক্ত। স্বপ্নীল কে সেটা বুঝতে দিবে না। বলল,

“কনগ্রাচুলেশন। কিন্তু আপনি তো বলেছিলেন আর চাকরি করবেন না। তাহলে? ”

স্বপ্নীল চোখ মুছে বলল, করব।

শ্রাবণ্য হেসে বলল, আপনার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। ট্রিট দিতে হবে।

ওই সন্ধ্যায় স্বপ্নীল উপলব্ধি করলো ওর জীবনের সবচেয়ে সুন্দর স্বপ্ন আসলে শ্রাবণ্য। যাকে ও কখনো আগে দেখে নি। আল্লাহ সারপ্রাইজ হিসেবে লুকিয়ে রেখেছে।

চলবে….

কুসুম কাঁটা পর্ব-২২+২৩

0

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-২২
তিনটা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর রঙ্গনা রাফাতের মা’কে ফোন করলো। ভদ্র মহিলা দূর্বল নাটক করার চেষ্টা করলেন। রাফাতের জন্য চিন্তিত। ফোন করেও পাচ্ছেন না। রঙ্গনার সঙ্গে আকাশী আর শ্রাবণ্য। ওরা নিজেদের মতো বোঝানোর চেষ্টা করেও লাভ হলো না। রঙ্গনা বলল,

“আমি বাড়ি যাব। আমার কিছু ভালো লাগতেছে না। অস্থির লাগতেছে। ”

সাজগোজ কমপ্লিট হতে আরও কিছু সময় বাকী। শ্রাবণ্য জোর করে সেটুকু সময় রঙ্গনা কে বসিয়ে রাখলো। রঙ্গনা বলল,

“শ্রাবণ্য, মা’কে একবার ফোন করে দেখ তো। ”

শ্রাবণ্য বাড়িতে ফোন করে শিলাকে ব্যাপার টা জানালো। শিলা মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করলেন। তুলিকে ছাড়া আর কাউকে জানান নি। রাফাতের মায়ের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলেন যে রাফাতের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। শিলা চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করে,

“খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না মানে কী? হারিয়ে গেছে?”

রাফাতের মা দু:খী গলায় বলে, জানিনা আপা। এই ছেলে কী আমার কথা শোনে! ওর যা মন চায় করে। আগেও দুইবার বিয়ের কথা ঠিক হবার পর এমন করছে।

“মানে? এসব তো আপনারা বলেন নি আগে?”

“কী বলব আপা?”

শিলা মিলাতে পারছে না হিসাব। রাফাত কে অবিবেচক মনে হয় নি কখনো। গায়ে হলুদের দিন রাফাতের মা, খালাদের সন্দেহজনক আচরণ থেকেই কী এই নাটকের সূচনা হলো।

বিকেলের মধ্যে বাড়ির অন্যান্য রা সবাই জেনে গেছেন যে রাফাত কে পাওয়া যাচ্ছে না। ফোন বেজে গেলেও ফোন টা তুলছে না।

আফতাব সাহেব কোনো কিছুতে বিচলিত হন না। প্রত্যেক টা বিষয়েই সে দুটো দিক ভাবেন। একটা কাজ না করলে অন্যটা। তার জন্য এই ঝামেলা টা অপ্রত্যাশিত। রাফাত ছেলেটা চমৎকার। রঙ্গনাও কী সুন্দর সবকিছু মেনে নিয়েছিল। রাগারাগি, বাড়াবাড়ি কিছু দেখা যায় নি। কত আনন্দ করেছে সবাইকে নিয়ে। তার এখন খারাপ লাগছে। তার নাতনীটা কতো কষ্ট পাবে। কত আত্মীয় স্বজন কে দাওয়াত করা হলো। সবাই এসে মেয়েটার ছোট হওয়া দেখে যাবে।

আফতাব সাহেব শিলার কাছে গেলেন। তিনি কখনো কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য শিলার কাছে আসেন না। আজ এলেন। শিলার ঘরে দাদী খাটে বসে সুর করে কাঁদছেন। এই মহিলা অন্যান্য সময় কাঁদলে শুধু গলা দিয়ে সুর ই বেরোয়। চোখ দিয়ে পানি পড়ে না। তবে আজ সত্যি ই কাঁদছেন।

আফতাব সাহেব শিলাকে প্রশ্ন করলেন,

“বউমা, এবার কী হবে? ”

শিলা স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন। সে তো নিজেও জানেনা যে কী হবে।

****
রঙ্গনার ভীষণ লজ্জা লাগছে। অনেক দিন পর ওর আবারও ভীষণ কান্না পাচ্ছে। শেষবার এমন হয়েছিল এইচ এস সির রেজাল্টের সময়। এতো ভালো পরীক্ষা দিলো অথচ বাংলায় ফেল এসেছে। পরে জানা গেল রেজিষ্ট্রেশন নাম্বার লিখতে ভুল করেছিল।

এতো সেজেগুজে যার জন্য এসেছে সে গায়েব। ও এতো শক্ত, তবুও আজ এতো লজ্জা লাগছে! গেট দিয়ে ঢোকার সময় স্বপ্নীল এসে জড়িয়ে ধরলো। ও’কে কাঁদানোর জন্য স্বপ্নীলের হাউমাউ করে কাঁদাটাই যথেষ্ট ছিলো।

ঘন্টাখানেক চলল এমন ই। রাফাতের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে ওই বাড়ির কাউকে দেখেই মনে হচ্ছে না যে তারা এই ব্যাপারে ব্যথিত। সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। রাফাতের বাবার সঙ্গে শিলা কথা বললেন,
ভদ্রলোক আমতা আমতা করে বলল,

“কী করতে পারি আপা বলেন? কপাল চাপড়েও তো লাভ নাই। অপেক্ষা করি ছেলে যদি ফিরে আসে…!

শিলা কঠিন গলায় বলেন,

“ফিরে আসে কথাটার মানে কী?”

“মানে অপেক্ষা করি আর কী! আজ না ফিরলে, পরে আর কী….

ভদ্রলোক কথা শেষ করার আগেই শিলা ফোন টা কেটে দিলো। ইচ্ছে করলো বয়স্ক ভদ্রলোক কে ঠাস ঠাস দুটো থাপ্পড় দিতে।

কিছুক্ষন পর রাফাতের মামী ফোন করলো রঙ্গনাকে। ফোন টা তুলল শ্রাবণ্য। মামী জিজ্ঞেস করলেন,

“রঙ্গনা কী করে? কান্নাকাটি করে?”

শ্রাবণ্য বলল,

“কান্নাকাটি কেন করবে? কান্নাকাটি করার মতো কিছু ঘটেছে? রাফাত ভাইয়া তো মারা যায় নি। ”

মামী থতমত খেল। ভেবেছিল কাঁদতে কাঁদতে এরা হয়তো বেহুশ হয়ে পড়বে। কিন্তু মায়ের গলাও স্বাভাবিক, মেয়েও নাকি কাঁদছে না! শ্রাবণ্য আবারও জিজ্ঞেস করলো,

“আপনি কী এটা জানার জন্য ফোন করছিলেন?”

“না আমাদের তো অবস্থা খারাপ। গলা দিয়া দানাপানি কিছু নামতেছে না। ”

শ্রাবণ্যর জবাবও বেশ শক্ত। বলল,

“আপনার গলা শুনে তা মনে হচ্ছে না মামী। বেশ আনন্দিত গলা শোনাচ্ছে আপনার। ”

মামী থতমত খেলেন। হাসার চেষ্টা করে বলল,

“তুমি ছোট মানুষ তো তাই মাথা গরম হয়ে গেছে। এখন রাখি, রাফাত আসলে তোমাদের সাথে দেখা হবে। ”

রঙ্গনা পাশেই ছিলো। ওকে ধরে বসে আছে আকাশী। শ্রাবণ্য ফোন রেখে বলল,

“পাজি মহিলা ফোন করছিল আপু। আপু আমার ধারণা রাফাত ভাইয়া কোনো ট্রাপে পড়েছে। সবাই মিলে গুটিবাজি করছে কিছু একটা। ”

রঙ্গনা হতাশ গলায় বলল,

“রাফাত স্বপ্নীলের মতো না শ্রাবণ্য। ও’কে আমার তেমন মনে হয় নি। ”

“আপু আমার মনে হয় উনি আসলেই কোনো ঝামেলায় ফেঁসে গেছেন। ”

রঙ্গনা এই প্রশ্নের কোনো জবাব দিলো না। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

***
আশ্চর্য হলেও সত্যি যে রেহানা এই পুরো ঘটনায় মনে মনে ভালোই খুশি। কিন্তু তাকে দু:খী দু:খী অভিনয় চালিয়ে যেতে হচ্ছে। ব্যাপার টা এমন নয় যে রঙ্গনা তার শত্রু। এই বাড়ির লোকজন কেও অপছন্দ নয়। তবুও তার খুশির কারণ হলো ঝামেলা হওয়া নিয়ে। বড় মেয়েকে নিয়ে সে যে ঝামেলা টা সহ্য করেছেন সেটা অনেক কষ্টের। লোকজনের নানান কটু কথা, অনেক আফসোস,অনেক কিছু। সেই একই কষ্ট এখন অন্যদের পেতে দেখলে ভালো লাগে।

মুনসুর অবশ্য সেই দলে না। সে শিলাকে বললেন,

“ভাবী কী করবেন? অন্য ব্যবস্থা বোধহয় করা উচিত। ”

শিলা বললেন, যাই করি মেয়েকে জোর করে অন্য কোথাও বিয়ে দেব না ভাই। ছেলের ক্ষেত্রে যে ভুল করেছি সেটার পুনরাবৃত্তি করতে চাচ্ছি না।

মুনসুর খানিকটা দমে গেলেন।

***
সন্ধ্যে অবধি রাফাতের কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। অন্যান্য আত্মীয় স্বজন রা এলো। রাফাত দের বাড়ির লোকজন অপেক্ষা করছে। রাফাত ফিরলে তারা রওনা হবে। নাহলে না। এছাড়া আর হেলদোল নেই।

শিলা আফতাব সাহেব কে বললেন, বাবা আজকের রাত টা দেখি। কাল ব্যবস্থা নেয়া যাবে।

আফতাব সাহেব জিজ্ঞেস করেন, কী ব্যবস্থা নিবা? আমার নাতনী এই অপমানের পর আর কখনো বিয়েতে রাজী হবে? সংসার করার স্বপ্ন দেখবে?”

শিলা জবাব দেয় নি। রঙ্গনার সঙ্গে তার একটাও কথা হয় নি। সামনাসামনি হবার সাহস হয় নি।

রঙ্গনা হঠাৎ বাইরে এলো। সবার সামনেই বলল,

“মা সবাইকে বলে দাও আসল ঘটনা। আর রাফাত দের বাড়িতে ফোন করে বলো, রাফাত যখনই আসুক বিয়ে হবে না। সবকিছুর ই নিয়ম আছে। পরীক্ষায় যেমন নির্ধারিত সময়ে না গেলে পরীক্ষায় বসতে দেয় না, বিয়েটাও তেমন। বিয়েও তো জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা পরীক্ষা।”

রঙ্গনাকে দাদু বোঝাতে এলেন। শিলা গম্ভীর গলায় বললেন,

“বাবা তাই ই হোক। আমি রঙ্গনার সঙ্গে একমত। ”

***
ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিলো কিছুক্ষনের মধ্যে। মিশুকের বাবা মা এসেছিলেন রঙ্গনার বিয়েতে। ওরা অবশ্য আসতে বলেনি। এরকম বিধ্বস্ত পরিবার কে বিয়েতে অংশগ্রহণ করতে বলাটা আসলে অমানবিক ই লাগে। কিন্তু তাদের মনে হয়েছে যাওয়া উচিত। যে মেয়েটার বিয়ে সে রক্ত দেবার সময় ভাবতে একটুও সময় নেয় নি। পরিবারের অন্যান্য মানুষজনও তাদের শিক্ষা, ব্যক্তিত্বের, মনুষ্যত্বের পরিচয় দিয়েছে।

বিয়ে বাড়িতে এসে মিশুকের বাবা, মা ঘটনা শুনলেন স্বপ্নীলের কাছে। মিশুকের বাবা, মা দুজনের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে সময় নিলেন মিনিট পাঁচেকের মতো। তারপর তারা শিলা আর আফতাব সাহেব কে জানালেন।

মিশুকের বাবার নাম মোস্তাফিজ হোসেন। মোস্তাফিজ সাহেব দাদুকে বললেন,

“হালিশহরে তাদের নিজেদের বাড়ি আছে। বাজারে দুটো ফার্মেসী আছে যা অন্যদের দিয়ে চালানো হয়। এছাড়া বাদবাকি সবকিছু সে চাইলে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে। তাদের আপত্তি না থাকলে এই সুন্দর পরিবার টির সঙ্গে তারা আত্মীয়তা করতে চায়। ”

আফতাব সাহেব নিমরাজি। মিশুক কে তার আগে থেকেই পছন্দ। শিলা রাজী হলেন না। মিশুক কে নিয়ে এমনিতেই এর আগে ঝামেলা হয়েছে। শিলা চাইলেনও না রঙ্গনাকে এই বিষয়ে কোনো কিছু জানাতে। তুলি গিয়ে জানালো। রঙ্গনা এসে বলল, এই বিয়ে করবে। ওর কোনো আপত্তি নেই।

মিশুকের বাবা, মা খুব খুশি হলেন। মিশুকের মা রঙ্গনাকে বলল,

“আম্মু শোনো, ইউনিভার্সিটি তে পড়ার সময় এক মেয়ের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করতো। সেই মেয়ে বিয়ে করে ইউরোপ গেছে। এছাড়া আর কোনো মেয়ের পিছনে ও ঘুরে নাই। আমাকে সব সত্যি বলে। বাদবাকি সব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তো তুমি জানোই। তোমার পাশের রুমেই তো থাকতো। ”

এই কঠিন সময়েও শ্রাবণ্য হেসে ফেলল মিশুকের মায়ের কথা শুনে।

***
মিশুক হসপিটালে বসেই জানতে পারলো ওর আজ বিয়ে। রঙ্গনার সাথে। বাবা জানালেন যে তিনি কথা দিয়ে ফেলেছেন। এই পরিবারের সঙ্গে তার রক্তের ঋন আছে। কোনোভাবেই মিশুক যেন না বলে।

মিশুক আমতা আমতা করে বলল,

“তোমরা যখন কথাই দিয়েই ফেলেছ এখন না বলে কী হবে। কী আর করা… করলাম বিয়ে। ”

ফোনের এপাশে থাকা মিশুকের উজ্জ্বল মুখ টা কেউ দেখতে পেল না।

***
পঞ্চান্ন হাজারের লেহেঙ্গা আর দুই লাখের জুয়েলারি পরে রঙ্গনার বিয়ে হলো না। ওর বিয়ে হলো আকাশীর ডিজাইন করা হালকা গোলাপি শাড়ি আর ঘরে থাকা গোল্ডের জুয়েলারি পরে। পার্লারের সাজও উঠিয়ে ফেলেছিল। আবার নতুন করে সাজতে হলো। বিয়ের সময়ে মিশুক বারবার রঙ্গনাকে দেখছিল। রঙ্গনা অদ্ভুত রকমের স্বাভাবিক। চোখে পানি নেই, রাগ নেই। কী সুন্দর স্নিগ্ধ! একবার দুজনের শুধু চোখাচোখি হলো। যখন দাদু রঙ্গনার হাত টা মিশুকের হাতে দিলো।

মিশুক হাত টা উল্টে তালুতে লেখা ‘আর’ শব্দটা দেখলো। শ্রাবণ্য পাশে ছিলো। ও বলল,

“রঙ্গনা তো আর দিয়েই শুরু হয়। ”

মিশুক হাসলো। শ্রাবণ্য বলল,

“ডোন্ট ওরি। মেহেদী আছে আমার কাছে। আপনার হাতেও লিখে দেব। ”

***
রাফাতের ঘুম ভাঙলো রাত দুইটায়। তাও কোনোভাবে চোখ খুলে তাকাতে পারছে না। ও কোথায় আছে সেটা আবিষ্কার করতেও সময় লাগলো মিনিট খানেক। মামী ও’কে নিয়ে এসেছিল। এই বাসায় একটা গয়না আছে ওর নানুর। সেটা রঙ্গনাকে দেবার কথা। সেটা নিয়ে ও যাবে রঙ্গনার কাছে, ও যখন পার্লারে যাবে। রঙ্গনাকে অতো সকালে ফোনও করেনি। বাসায় আসার পর মামী চা খেতে দিয়েছিল। আদা, দারুচিনি, এলাচি দিয়ে বানানো দুধ চা। রাফাতের পছন্দের চা। এরপর কিছু মনে নেই।

রাফাত দেখলো ওর ফোনে ৪৯১ টা মিসড কল! স্বাভাবিক ব্যাপার! রাত হয়ে গেছে এতো! বাসার সবাই চিন্তা করছে। আর রঙ্গনা! ইশ!

রাফাত ড্রইং রুম পর্যন্ত হেটে এসে মেঝেতে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষনের মধ্যে ঘুমিয়ে গেল আবারও।

***
রাফাতের মা শিলাকে ফোন করেছে ভোরের দিকে। শিলা ফোন টা তুললেন। রাফাতের মা বললেন,

“আপা রাফাতের খোঁজ পাওয়া গেছে আলহামদুলিল্লাহ। আপা আর চিন্তা করবেন না। আমরা সকালের দিকে আসব। ”

“সকালে আসতে হবে না। আমরা যাব কাল তেঁজগাও থানায়। সেখানে আপনাদের সাথে দেখা হবে ইনশাআল্লাহ। ”

চলবে….

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-২৩
মিশুকের হাতে রঙ্গনার নাম মেহেদী দিয়ে লিখে দিলো শ্রাবণ্য। ওর বিয়ে হয়েছে ফকিরের মতো। মানে রঙ্গনা যেমন বলে। বিয়েতে গায়ে হলুদ টাইপ কিছুই হলো না। মিশুকের হালকা আফসোস হচ্ছে। খুব বেশী না। চমৎকার একজন মেয়েকে জীবন সঙ্গী হিসেবে পেয়েছে বলেই আফসোস বেশীক্ষন স্থায়ী হলো না।

শ্রাবণ্য মিশুক কে দেখে বলল,

“আপনাকে ভীষণ খুশি লাগছে? আপনি আবার রাফাত ভাইয়া কে কিডন্যাপ করেন নি তো? ওনাকে পাওয়া গেল আপনাদের বিয়ের ঘন্টা তিনেক পর। ”

মিশুক শ্রাবণ্যকে দেখলো মিটিমিটি হাসছে। ও হেসে বলল,

“তুমি কী তাহলে আমার শালীর জায়গাটা নিচ্ছো?”

শ্রাবণ্য শব্দ করে হেসে ফেলে বলল,

“আপনি মনে মনে চাইছিলেন যেন বিয়েটা নাহয় তাই তো?”

“তুমি কী করে বুঝলে? ”

“আমি বেশ কিছু দিন ধরে আপনাকে লক্ষ্য করেছি। শুকিয়ে যাওয়া আপেলের মতো হয়েছিল আপনার চেহারা। দেখে মনে হতো কষ্টে আপনার বুক ফেটে যাবে এক্ষুনি। ”

মিশুক এবার শব্দ করে হাসলো। একটু সচেতন হলো অবশ্য। ওর বউ যে পরিমাণ রাগী। বেরিয়ে এসে আগুন চোখ তাকিয়েই সব কিছু ভষ্ম করে দিবে। শ্রাবণ্য ওর সঙ্গে এর আগে তেমন কথাবার্তা বলতো না প্রয়োজন ছাড়া। আর এখন কী সুন্দর কথা বলছে। এই বাড়ির মানুষজন কে মিশুকের ভালো লাগে, যাকে বিয়ে করেছে তাকে অন্য সবার চেয়ে বেশী ভালোই লাগে। তবে ওর একটু নার্ভাস লাগছে। যেভাবে সবকিছু হুট করে হয়ে গেল! এরপর কী কী হবে কে জানে! রাফাতের সঙ্গে এক্সাক্টলি কী হয়েছে জানে না ও। ভদ্রলোক এসে কী কোনো ঝামেলা করবে! সেরকম কোনো চান্স আছে কিনা!

শ্রাবণ্য বলল,

“আপনি ঘুমাবেন না?”

মিশুক ঘড়ি দেখলো। রাত প্রায় শেষ হতে চলল। চোখে ঘুম নেই অবশ্য, মাথাটা একটু ভারী লাগছে, এই যা।

মিশুক বলল,

“না ঘুমালেও হয়। তবে রেস্ট নেয়া দরকার। ”

শ্রাবণ্য হেসে বলল,

“চলুন আপুর ঘরে নিয়ে যাই। ”

“নিয়ে যেতে হবে না। আমি যেতে পারব। তুমি ঘুমাতে যাও। ”

“শিওর? একা যেতে পারবেন?”

মিশুক হেসে বলল,

“হ্যাঁ আমি রঙ্গনার ঘর চিনি। ”

“আচ্ছা। ”

মিশুক হঠাৎ শ্রাবণ্যকে ডেকে বলল,

“শোনো শ্রাবণ্য, তুমি শালীর ভূমিকায় বেশ ভালো অভিনয় করছ। দশে দশ। ”

শ্রাবণ্য হেসে বলল,

“কিছু ফকির মিসকিন খাইয়ে দিয়েন। আল্লাহ আপনার মনের আশা পূরন করছেন। ”

***
মিশুক ঘরে ঢুকলো ভয়ে ভয়ে। কিসের ভয় সেটা জানেনা। তবে বুক দুরুদুরু করছে। রঙ্গনা জানালার কাছে বসে ছিলো। দরজার শব্দ পেয়ে মিশুকের দিকে তাকালো। মিশুক বলল,

“হাই। ”

রঙ্গনা সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বিছানার কাছে এলো। বিছানার মাঝখানে কিছু গোলাপের পাপড়ি রাখা। রঙ্গনা সেগুলো একপাশে সরিয়ে রাখতে রাখতে বলল,

“একটু রেস্ট নাও। তোমার অনেক প্রেশার যাচ্ছে। ”

মিশুক স্মিত হাসলো। যে নিজে আজ মহাযুদ্ধ সামলেছে সে ওর প্রেশার নিয়ে তটস্থ।

রঙ্গনা ব্যস্ত হাতে ফুলগুলো সরাচ্ছে। মিশুকের চোখ দেয়ালের পেইন্টিং গুলোর দিকে। কী সুন্দর! ভাবতেই ভালো লাগছে এগুলো ওর বউয়ের নিজের হাতে আঁকা।

“মিশুক শু’য়ে পড়ো। ”

মিশুক চমকালো এক সেকেন্ডের জন্য। রঙ্গনা কী সুন্দর করে মিশুক ডাকলো! রঙ্গনা সম্ভবত নরমালি নাম ধরে ডেকেছে। ওর কাছে শুনতে ভালো লেগেছে। যাকে ভালো লাগে, তার সবকিছুই বোধহয় ভালো লাগে। মিশুকের মনে হলো রঙ্গনার রাগ, ঝগড়াঝাটি এগুলোও ওর ভীষণ ভালো লাগবে।

“তুমি ঘুমাবে না। ”

রঙ্গনা স্বাভাবিক গলায় বলল,

“তুমি ঘুমাও। আমার ঘুম পেলে শুয়ে পড়ব। আমার রাত জাগার অভ্যাস, এজন্য বোধহয় ঘুম আসছে না। ”

মিশুক রঙ্গনার হাত ধরলো। ধরে চমকে উঠলো।

“ইশ! তোমার এতো জ্বর!”

রঙ্গনা অপ্রস্তুত গলায় বলল,

“তেমন কিছু না।”

মিশুক তাকালো রঙ্গনার দিকে। এতো জ্বর নিয়েও বলছে তেমন কিছু না। মিশুক শ্রাবণ্য কে ফোন করে বলল কিছু খাবার আর ওষুধ নিয়ে আসতে। শ্রাবণ্য এলো কিছুক্ষনের মধ্যেই। পুডিং, ফ্রুট কাস্টার্ড নিয়ে এলো। শ্রাবণ্য থাকতে চাইলেও মিশুক থাকতে দিলো না। ও নিজেই রঙ্গনাকে জোর করে খাবার খাইয়ে দিলো, ওষুধ খাইয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো। কিছুক্ষন পর বাতি নিভিয়ে ওর পাশেই শুয়ে পড়লো।

রঙ্গনার মাথা ব্যথা করছিল। মিশুক কে সেটা বলে নি, তবুও ও মাথা টিপে দিচ্ছিলো। রঙ্গনা নিচু গলায় বলল,

“লাগবে না মিশুক। তুমি ঘুমাও।”

“লাগবে। জ্বর হলে তোমার মাথা ব্যথা হয়,আমি জানি।”

রঙ্গনা প্রশ্ন করলো না যে কিভাবে জানে ও। মিশুক জিজ্ঞেস করলো,

“এখন ভালো লাগছে? ”

“হু। ”

“স্ট্রেস নিও না আর।”

রঙ্গনা চুপ করে রইলো। মিশুকের ইচ্ছে ছিলো রঙ্গনাকে জিজ্ঞেস করবে তুমি ঝোকের মাথায় বিয়েতে হ্যাঁ বলেছ নাকি রাগের মাথায় বলেছ। রাগের মাথায় বললে সমস্যা নেই। রাগের অপর পিঠে অনুরাগ থাকে। কিন্তু ঝোকের মাথায় হলে সমস্যা। আর দাদী বলল না বিয়ের জোড়া উপরওয়ালা ঠিক করেন। মানুষের হাত থাকে না। আমারও তাই মনে হয়। আমিতো দূরেই ছিলাম, তোমার বিয়ের কোনো ইভেন্টে ছিলাম না। তাই আমার নজর লেগে কিছু হয় নি।

এসব কিছুই মিশুকের বলা হলো না। রঙ্গনা ঘুমিয়ে পড়লো। ভোরের আলো ফুটে গেছে। জানালার পর্দা সরানো, বলে আলোটা ঘরে ঢুকেছে। মিশুক জানালার পর্দাটা টেনে দিয়ে মোবাইল টা হাতে নিলো। রঙ্গনা নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। কোনো মন খারাপের চিহ্ন নেই, ক্লান্ত স্নিগ্ধ মুখ। মিশুক রঙ্গনার কপালে অনেকক্ষন ঠোঁট ছুঁইয়ে রেখে চুমু খেল। ভাগ্যিস মেয়েটা ঘুমিয়ে আছে। নাহলে এই কাজ টা করতে পারতো না।

***
শ্রাবণ্য ঘুমাতে এলো সকালের আলো ফোটার পর। না চাইতেও বিয়ের পর ও অনেক টা বড় হয়ে গেছে। বিয়ের পরের জার্নিটা মেয়েদের জীবনে এক অদ্ভুত জার্নি। অনেক অসাধ্য সাধনও কিভাবে যেন হয়ে যায়। সবকিছু সামলে ও এখন ঘুমাতে এলো। ঘরে ঢুকে দেখলো স্বপ্নীল গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। শীত লাগছে ভেবে কম্বল টা গায়ে তুলে দিতেই স্বপ্নীল বলল,

“আমি ঘুমাই নি শ্রাবণ্য।”

“কেন? অনেকক্ষন আগে এসেছেন ঘুমাতে। ”

স্বপ্নীল উঠে বসে বলল,

“আমার ভীষণ মন খারাপ।”

শ্রাবণ্য স্বপ্নীলের মাথার কাছে বসে বলল,

“আর মন খারাপ করবেন না। আপুর বিয়েতে তো হয়ে গেছে। মিশুক ভাইয়াও অনেক ভালো। ”

“জানি, তবুও আমার ভীষণ খারাপ লাগছে।”

শ্রাবণ্য আর কিছু বলল না। স্বপ্নীল আজ অনেক কেঁদেছে। ছোট আপু ও’কে শাসন করে বলে ওর অনেক রাগ। তবুও সেই রাগের চেয়ে ভালোবাসাটা অনেক বেশী দেখেছে।

শ্রাবণ্য স্বপ্নীল কে বলল, আপনি এদিকে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ুন। আমি আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ঘুম এসে যাবে।

স্বপ্নীল বাধ্য ছেলের মতো শুয়ে পড়লো।

***
আজকের সকাল টা হতে পারতো রাফাতের জীবনের সুন্দর সকাল গুলোর একটা। কিন্তু কুচক্রী রা সেটা হতে দেয় নি। রাফাত বিশ্বাস করতে পারছে না যে মা, মামী এরা এরকম একটা কাজ করতে পারে। প্রচন্ড মাথা ব্যথায় মাথা ছিড়ে যাবার উপক্রম। মাথা চেপে ধরে বসে আছে। ঘরের চারদিকে বসা লোকজন কে ও এক এক করে দেখছে। এরা ওর ই আত্মীয় স্বজন, আপনজন। যারা তাদের কৃতকর্মের জন্য একটুও অনুতপ্ত নয়। অন্তত মুখ দেখে তাই ই মনে হচ্ছে। রাফাতের বাবা, মামা এরা পরে জানতে পেরেছেন। তারাও তাদের স্ত্রী দের সাথে সহমত হয়েছেন। সাংসারিক ব্যাপার তারা কিবা বোঝেন। মহিলাদের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ভালো। তারা তাই ঠিক ই করেছেন। তবে রাফাতের খালু চিন্তিত। আফতাব সাহেব যতখানি সুবিধার লোক ততখানি অসুবিধার লোক। এই লোক নিশ্চয়ই হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না। আবার থাকতেও পারে, মেয়ের পরিবার সবসময় তেজ দেখাতে পারেন না।

রাফাত অবিশ্বাস্য গলায় বলল,

“মা তুমি! তোমাকে আমি চিনতে পারছি না। ”

রাফাতের মা অন্যদিকে মুখ করে বললেন,

“জানি চিনতে পারবি না। কারণ ওই বাড়িতে চিনি পড়া খাইয়েছে তোকে। ”

রাফাত অবাক গলায় বলল,

“তুমি অশিক্ষিত’র মতো কথা বলছ কেন?”

মামী মাঝখানে বলে উঠলো,

“মায়ের সাথে এইগুলা কেমন কথা বলো রাফাত। রঞ্জনা তোমার মাথা তো পুরাই খাইছে দেখতেছি। ”

রাফাতের মা অনুযোগের সুরে স্বামী কে বললেন,

“আমি যা করছি একদম ঠিক করছি। দশ মাস পেটে ধরছি আমি আর আমার চেয়ে বেশী গুরুত্ব পাবে পরের বাড়ির মেয়ে! সে যা বলে তাতেই তাকধিনা ধিন করে নাচে। ”

রাফাতের খালাও এই মিটিং এ উপস্থিত। তিনি পান খাওয়ায় ব্যস্ত ছিলেন এতক্ষন। এবার মুখ খুললেন। বললেন,

“আমরা তো চাইছিলাম একটা শিক্ষা দিতে। কিন্তু তারা এতো জলদি পাত্র পাইলো কোথায়! মাইয়ার চরিত্র ঠিক নাই। ”

রাফাত চিৎকার করে বলল,

“খালামনি চুপ করুন। আপনারা যা করছেন এরপর আপনাদের কেউ ভালো চরিত্রের লোক বলবে!”

রাফাতের মা ছুটে এসে ছেলের চুল ধরে কয়েকটা থাপ্পড় মারলো। মারা শেষ করার পর নিজে কাঁদতে শুরু করলো। রাফাত বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। রঙ্গনাকে ও কিভাবে ফেইস করবে! কিভাবে! ওর আসলে আরও সচেতন হওয়া উচিত ছিলো। তুলি আপু সেদিন ও’কে বলেছিল, রাফাত আমার ব্যাপার টা ভালো লাগছে না। তোমাদের বাড়ির লোকজনকে একটু বেশি ই ডেস্পারেট মনে হলো। তারা চাইছেন কিছু একটা ঝামেলা করতে। রাফাত ব্যাপার টা হালকা ভাবে নিয়েছে। ওর পরিবার একটু এরকম সেটা ও জানে। রঙ্গনারা অন্যরকম। কিন্তু মায়ের এমন রূপ থাকতে পারে সেটা ও কল্পনায়ও ভাবতে পারে নি।

ওর মান, সম্মান সব গেল। প্রফেশনাল, পার্সোনাল সব মানুষ কে বিয়েতে ইনভাইট করেছে। হোয়াটসঅ্যাপে একশর বেশী ম্যাসেজ। দশ বারোটা ম্যাসেজ দেখেই বুঝতে পারলো সবাই ও’কে শেইমলেস বলছে। আর রঙ্গনা! ও’কে কী জবাব দিবে!

রাফাতের দিশেহারা লাগলো। এতো খারাপ সময় ওর জন্য অপেক্ষা করছিল। এসবের চেয়ে মা তো মামীকে দিয়ে বিষ খাইয়ে দিতে পারতো।

***
রাফাতের মা, মামী ভেবেছিল শিলার ওটা ফাঁকা আওয়াজ। কিন্তু তাদের ধারণা ভুল প্রমানিত হলো। বারোটার দিকে মামা, মামী, খালা, খালু, বাবা, মা আর রাফাত কে পুলিশ তুলে নিয়ে গেল। তাদের বিরুদ্ধে যৌতুক মামলা আর জালিয়াতি মামলা করেছে। রাফাতের মা আর মামী যখন গুজগুজ ফিসফিস করে এবাড়ি থেকে কিছু দিবে কিনা সেটা নিয়ে আলোচনা করেছিল তখন বর্ষার মা ওখানে ছিলো। তিনি কান খাড়া করে যা শুনলেন তারচেয়ে বেশি বানিয়ে বললেন শিলাকে।

থানায় গিয়ে রাফাতের মা বললেন,

“আপা আমরা যৌতুক কবে চাইলাম? বিয়েতে তো আমাদের কোনো দাবি ছিলো না। আর রাফাত রে আমরা কেন আটকায়ে রাখব? মান সম্মানের ভয় নাই আমাদের। ”

শিলা ঠান্ডা গলায় বললেন, সব প্রমাণ আদালতে দেব। আমরা অলরেডি মামলা করেছি। আশা করছি রাফাতের চাকরিটাও চলে যাবে। সেখানেও কমপ্লেইন করব।

রাফাতের মা চোখে শর্ষেফুল দেখতে লাগলেন।

শিলা রাফাত কে বললেন, আমি মানলাম তোমার কোনো দোষ নেই। কিন্তু তুমি কী তোমার ফ্যামিলির বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারবে?

রাফাত এক বাক্যে রাজী হয়ে গেল। শিলার মনে হলো এই ছেলেটি আসলেই এসব ঝামেলায় নেই। তাই রাফাত কে ছাড় দিলো।

রাফাতের স্বাক্ষীর কারনে হোক আর অন্য কোনো কারণে হোক কেউই জামিন পেল না।

ব্যাপার টা নিয়ে অনলাইন পোর্টালেও ভীষণ লেখালেখি হলো। কিছু পত্রিকায়ও লেখা হলো।

চলবে…..

কুসুম কাঁটা পর্ব-২০+২১

0

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-২০
ব্যস্ততা মানুষ কে সবকিছু ভুলিয়ে দেয়। আকাশীর ক্ষেত্রে ব্যাপার টা তাই হলো। আগে রাত জেগে নিজের জীবনের ভুল ভাবনা গুলো ভেবে সময় নষ্ট হতো। এখন রাত জেগে শাড়ির কাজ চলে। রঙ্গনার বিয়ের শাড়িগুলোর ডিজাইন, স্টুডেন্ট দের জন্য নোট তৈরী করা, নিজের পড়াশোনায় আকাশী মোহাম্মদপুরের ঝগড়াঝাটি মান অভিমানে পাতানো সংসার আর সেই মানুষ টাকে প্রায় ভুলতে চলল। শুভ কেমন আছে, কোথায় আছে এখন আর জানতেও ইচ্ছে করে না।

ওদিকে শুভকে মায়ের চাপে পড়ে জেসমিন খালার মেয়ে জেরিন কে বিয়ে করেছে। শুভ আসলে নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না যে ওর সাথে ঠিক কী ঘটতেছে! আকাশী চলে গেল রাগ করে, এরচেয়ে বেশী ঝগড়াঝাটি ভাংচুর হয়েছে এর আগে ওদের সংসারে। আকাশী নিজেও জেদ দেখিয়েছে। ঘন্টা দুয়েক পর আবার সব ঠিক হয়ে গেছে। আকাশী ভাত রেঁধে ডিম ভেজে শুভ কে নিয়ে থমথমে মুখে খেতে বসেছে। অথচ সেদিন তেমন কোনো ঝগড়াও না। স্রেফ কথা-কাটাকাটিই তো ছিলো। তবুও এমনভাবে চলে গেল যে একবার যোগাযোগের নাম পর্যন্ত করলো না।

জেরিনের পয়সা আছে ভালোই। পড়াশোনা এসএসসি পর্যন্ত। আগে গার্মেন্টসে চাকরি করতো এখন একটা প্লাস্টিক কোম্পানিতে চাকরি করছে। টাকা পয়সা ভালোই জমিয়েছে। শুভ কে পাঁচ লাখ দিবে ব্যবসার জন্য। শুভর মা মূলত এই লোভেই জেরিনের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে শুভর।

জেরিন ঘরে ঢুকেছে। শুভ আগে থেকেই ঘরে ছিলো। জেরিন কে দেখেই ওর মেজাজ টা খারাপ হয়ে গেল। এর আগে জেরিনের সঙ্গে দুই তিন বার দেখা হলেও তেমন কথাবার্তা হয় নি৷ শুভর তখনও ও’কে ভালো লাগতো না। বিবাহিত ছিলো তখনও এমন সব সস্তা রসিকতা করতো। শুভ ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে গেলে জেরিন পথ আটকালো। শুভ তাকালো জেরিনের দিকে। বাড়াবাড়ি রকমের সাজগোজ। কড়া লিপস্টিক ঠোঁটে, শাড়িটাও কেমন করে পড়েছে। সাজগোজে কমলতার পরিবর্তে উগ্র ভাব বেশী। শুভ হাত ছাড়িয়ে নিতে গেলে জেরিন বলল,

“তেজ একটু পর দেখাও। আগে আমার কিছু ক্লিয়ার কথা শুনবা। ”

শুভ আবারও হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলো। জেরিন জোর করে শুভ কে বসিয়ে দিয়ে গা ঘেঁষে বসে বলল,

“আগের বেডিরে ডিফোজ দেয়ার ব্যবস্থা করবা তাড়াতাড়ি। তারপর টাকা পাইবা। আর সেই বেডির লগে কথাবার্তা দেখা সাক্ষাৎ সব বন্ধ। ভুলেও এইসব করতে যাবা না। আমি কিন্তু সহজ জিনিস না। ”

শুভ আগুন দৃষ্টিতে তাকালো। জেরিন শব্দ করে হেসে বলল, পাঁচ লাখ টাকা দিয়া কিনলাম তোমারে। একটা দুইটা কথা তো শুনতেই হইবে।

শুভ বুঝতে পারলো সামনে আরও কঠিন এবং ভয়ংকর পরিস্থিতি আসতে যাচ্ছে।

***
রঙ্গনার গায়ে হলুদ আগামীকাল। আরও দুদিন আগে থেকেই বাড়িতে উৎসবের আমেজ তৈরী হয়েছে। মালেক মামার বউ এসেছেন মেয়েকে নিয়ে। মেয়ের নাম বর্ষা। বর্ষা কলেজে পড়ে। এই বাড়িতে এর আগে অনেকবার এসেছে। আগে তো একমাস দুইমাস থাকতোও এসে। লাস্টবার মায়ের বেঁফাস কথাবার্তার কারণে দাদু আসতে বারন করে দিলেন। বর্ষার আগে স্বপ্নীল কে ভালো লাগতো একটু একটু। ওর ঘরের আশেপাশে ঘুরঘুর করতো। ঘরে ঢোকার সাহস পেত না। একদিন গিয়েছিল ছুতোনাতায়। স্বপ্নীল তখন মুভি দেখতে দেখতে চিপস খাচ্ছিল। বর্ষা মিনিট দুয়েক ওখানে ছিলো। স্বপ্নীল এয়ারফোন খুলে ও’কে বলল,

“তুমি কিছু বলবে?”

বর্ষা মাথা নেড়ে না বলল। স্বপ্নীল অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বলল,

“তাহলে যাও এখান থেকে। ”

বর্ষা অভিমানে সেদিন অনেক কাঁদলো। এক তরফা প্রেম টা এগুতে পারলো না মায়ের কারনে। বর্ষার মা কঠিন গলায় বলল, সিধা বলদ পোলার সঙ্গে তোর বিয়ে আমি কোনোদিন দিমু না।

বর্ষা সুন্দর স্বপ্ন দেখা তবুও বন্ধ হলো না। একদিন এত বড় বাড়ির মালকিন ও হবে। দাদু তখন মরে যাবে। স্বপ্নীল চাকরি বাকরি নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। বাড়ি সামলাবে ও। স্বপ্নীলের মা মিউ মিউ করে ওর সঙ্গে কথা বলবে।

বর্ষার স্বপ্ন ভেঙে গেল স্বপ্নীলের বিয়ের খবর শুনে। দুদিন কান্নাকাটি করলো। ওর গায়ের রঙ ফর্সা। এখনই অনেক সম্বন্ধ আসে। ও রাজী হয় না৷ এমন বড় বাড়িওয়ালা কাউকে বিয়ে করতে ইচ্ছে করে।

বর্ষা শ্রাবণ্য কে দেখে মন ছোট করে থাকে। এতো সুন্দর একটা মেয়ে। পাতলা ঠোঁট, তারমধ্যে গোলাপি। মাথাভর্তি সিল্কি চুল। ও যদি এমন সুন্দর হতো তাহলে ওর নিশ্চয়ই স্বপ্নীলের সঙ্গে বিয়ে হতো।

বর্ষার মায়ের নাম বীনা। বীনা মেয়েকে নিয়ে পটুয়াখালী থাকেন। তার আসলে এই বাড়িতে থাকার ইচ্ছে। কিন্তু আফতাব চাচা তাকে পছন্দ করেন না। তিনি বলেন বীনা নাকি অনেক কথা বলেন। শুধু কথাই বলেন না এর কথা ওকে আর ওর কথা একে বলে ঝামেলা সৃষ্টি করেন। সে কারনে এতদিন এই বাড়িতে আসা বন্ধ ছিলো। আসল ঘটনা অন্য। আফতাব চাচা কোনো কারণে বুঝে গেছেন যে বর্ষার স্বপ্নীল কে পছন্দ।

বীনা এই বাড়িতে এসে মিশুক কে দেখে পছন্দ করে ফেললেন। কী সুন্দর চেহারা। বাপ, মায়ের একমাত্র ছেলে। বর্ষার সঙ্গে যদি বিয়ে হয়! কী ভালো মানাবে দুজন কে।

***
স্বপ্নীল অফিসে কিছু কার্ড নিয়ে গেল। শিলা বললেন নিয়ে যেতে। সবাই কে দিতে৷ শ্রাবণ্য বলল,

“সবাই কে দেবার দরকার নেই। অল্প কিছু মানুষ কে দিয়েন। যারা আপনাকে পছন্দ করে। ”

স্বপ্নীল দেখলো পুরো অফিসে তাকে মোটে তিনজন মানুষ পছন্দ করেন। প্রোজেক্ট ইন চার্জ শাকুর ভাই, কল সেন্টারের রিনা দিদি আর একাউন্ট ম্যানেজার আংকেল। শ্রাবণ্যর হিসাব অনুযায়ী এই তিনজন ছাড়া আর কাউকে দেয়া উচিত না। কিন্তু ম্যানেজার কে দিতে হবে। তাছাড়া অফিসের চেয়ারম্যান কে দেয়া দরকার।

তিনজন কে কার্ড দিতে গিয়ে স্বপ্নীল বিপদে পড়লো। বাকীরাও ছুটে এলো। ওর পাশের ডেস্কে একটা ছেলে বসে নাদিম নামে। সে সবাই কে ডেকে জড়ো করলো। শেষমেস দেখা গেল কার্ড যা এনেছে তা শেষ। ওর বোনের বিয়ে নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই। ঘন্টা খানেকের মধ্যে প্ল্যান পরিকল্পনা হয়েও গেল কে কে যাবে! খেয়েদেয়ে আসবে! অনেক দিন বিয়ের বাড়ির খাবার খায় না।

***
মিশুক চাচ্ছিলো না বিয়েতে থাকতে। কিন্তুও চলেও যাওয়া যায় না আসলে। ব্যাপার টা তখন অন্য গসিপে চলে যায়। যদিও ওর মনে হয় ও একটু বেশি কিছু ভাবছে। এসব গসিপ টসিপ আসলে কেউই করবে না। শিলা আন্টি, তুলি আপু গসিপের মানুষ না। রঙ্গনা ওকে পাত্তা যতটুকু দেয় সেটা কেবল পেয়িং গেস্ট হিসেবেই। দাদু সবসময়ের জন্যই কঠিন চোখে দেখেন।

শিলা আন্টি মিশুক কে বলেছিল বাড়িতে কার্ড পাঠানোর জন্য। মিশুকের আগ্রহ হয় নি।

গায়ে হলুদের আগের দিন বাড়িতে অনুষ্ঠান চলছে। পিঠে বানানো হচ্ছে নানানরকম। দাদী বলেছেন জামাইর সামনে অন্তত দশ রকমের পিঠে দিতে। সেটা বানানোর প্রস্তুতি চলছে। আকাশী আর শ্রাবণ্য মিলে মেহেদী পরানোর দায়িত্ব পালন করেছে। আকাশীর মনোযোগ মেহেদী পরানোর চেয়েও অন্যদিকে বেশী। কাল বাবা, মা’ও এখানে থাকবেন। ও কী করবে! সুযোগ বুঝে এখান থেকে বেরিয়ে যাবে!

***
বারোটা নাগাদ মিশুক বেরিয়ে এলো। গেটের সামনে বিশাল প্যান্ডেল করে হই হট্টগোল হচ্ছিলো। ও’কে যেতে দেখে শ্রাবণ্য বলল,

“এই যে ভাইয়া খাবার সময় আপনাকে দেখলাম না। খাওয়া হয় নি তাই তো। ”

মিশুক অস্থির হয়ে আছে। বেশী কথা বলার সময় নেই। ও বলল,

“শ্রাবণ্য আমি খাব না। আমাকে বাইরে যেতে হবে। ”

শ্রাবণ্য আবারও জিজ্ঞেস করলো, কোনো সমস্যা? ”

“হ্যাঁ, মানে আমার আপুর হাজবেন্ডের এক্সিডেন্ট হয়েছে। ঢাকায় আনা হচ্ছে। অবস্থা ক্রিটিকাল। ”

শ্রাবণ্য ছুটে গিয়ে খবর টা দিলো সবাই কে।

সেই রাতে সবকিছু বন্ধ রেখে তুলি, রঙ্গনা, শ্রাবণ্য, স্বপ্নীল, শিলা সবাই মিশুকের সঙ্গে হসপিটালে গেল।

মিশুকের দুলাভাই কে চৌদ্দব্যাগ রক্ত দেয়া হলো। সেই চৌদ্দ ব্যাগের দুই ব্যাগ রঙ্গনা আর স্বপ্নীলের। স্বপ্নীল রক্ত দিতে চায় নি। রক্ত দেবার পর বেচারা জ্ঞান হারালো। তবুও শ্রাবণ্য আর রঙ্গনার চাপে রক্ত দিতে হলো।

চলবে….

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-২১
মিশুক দের ঢাকায় আত্মীয় স্বজন তেমন নেই। তবুও পরিচিত, অপরিচিত যারা ছিলো খবর পেয়ে ছুটে এলো। বাবা, মা আপু আর তার শ্বশুর বাড়ির লোকজন এলো। হাসপাতালের করিডোর, সিড়ি সব জায়গায় ই ওদের লোক। তবে এতো লোকের মধ্যে কাজের কাজ রঙতুলির লোকজনই করেছে। রঙ্গনা, তুলি আর শ্রাবণ্য মিলে আট ব্যাগ রক্ত যোগাড় করেছে। রঙ্গনা যেখানে যাদের পারছে ফোন করে নিয়ে আসছে।

সারারাত সবাই হসপিটালেই রইলো। বিয়ের কনে এমনভাবে হসপিটালে আছে ব্যাপার টা অনেকের ই নজরে পড়লো। বিষয়টিতে কেউ কেউ মুগ্ধও হলো। এরা আসলেই ভালো মানুষ, নাহলে বিয়ে বাড়ির আয়োজন ছেড়ে কেউ এভাবে এসে বসে থাকে!

মিশুক ভীষণ নার্ভাস। জীবনে এই পরিস্থিতিতে প্রথম। এক মুহুর্তের জন্য মনে হচ্ছিলো সবকিছু যেন শেষ হয়ে যাচ্ছে। আপুর মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। বাচ্চাটা বুঝতে পারছে না যে ওর বাবার সঙ্গে ঠিক কী হচ্ছে!

সকাল এগারো টার দিকে পেশেন্ট কে কেবিনে দেয়া হলে সবাই নিশ্চিন্ত হলো। সকাল হতেই অনেকে চলে গেছেন। তাদের থেকেও অবশ্য তেমন লাভ কিছু নেই। কিন্তু রঙ্গনা রা ছিলো। মিশুক শিলাকে বলল,

“আন্টি এবার আপনারা চলে যান। বাড়ির দিক টা দেখতে হবে তো। ”

শিলা রাজী হলেন। তিনি মিশুকের বাবা মা’কেও জোর করে নিয়ে গেলেন। তারা অনেক মুষড়ে পড়েছে। একটু রেস্টের দরকার।

মিশুক রঙ্গনাকেও বলল চলে যেতে। রঙ্গনা চলে যাবার আগে মিশুক কে বলল,

“তুমি ঠিক আছ?”

মিশুক তখনও ক্লান্ত বিধ্বস্ত। তবুও হাসার চেষ্টা করে বলল,

“এখন ঠিক আছি। ”

রঙ্গনা স্মিত হাসলো। আজ মেয়েটার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান। দুহাত ভর্তি মেহেদী পরেছে। পরিস্থিতি অন্যরকম না হলে মিশুক আজ ও’কে বলতো, রঙ্গনা তোমাকে রঙধনুর মতো সুন্দর লাগছে।

রঙ্গনা বলল,

“এখন যাই। কিছু দরকার হলে ফোন কোরো। ”

মিশুক স্মিত হেসে মাথা নাড়লো। রঙ্গনা কয়েক পা হেটে এগিয়ে যেতেই মিশুক ডাকলো,

“রঙ্গনা!’

রঙ্গনা পিছু ফিরে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো। মিশুক বলল,

“বেস্ট অফ লাক।”

রঙ্গনা হেসে বলল,

“থ্যাংক ইউ। ”

তুলি থেকে গেল হসপিটালে। মিশুকের বাবা, মা না আসা পর্যন্ত থাকবে। বাড়ি থেকে খাবার দাবার পাঠানো হয়েছে কিছু। মিশুক আর ওর বোন কিছুই মুখে তুলে নি।

***
রঙ্গনা বাড়ি ফিরে ঘুমালো। সারা রাত নির্ঘুম কেটেছে। রাফাতের সঙ্গে ওর কথা হয়েছে। সবকিছু বলেছে, সেই সঙ্গে এটাও বলেছে যে গায়ে হলুদের যে নাচ গানের প্ল্যান ছিলো সেটা বাদ। একটা মানুষ প্রায় মরতে বসেছে, হসপিটালে তার অবস্থা দেখে এখন নাচানাচি, আনন্দ কোনো কিছুর ম্যুড নেই। রাফাত সানন্দে মেনে নিয়েছে।

বাড়িতে সাউন্ড বক্স কাল রাত থেকে বন্ধ। হলুদ নিয়ে ওই বাড়ি থেকে বিকেলে আসবে। সেসবের আয়োজন চলছে। মিশুকের বাবা, মা ফ্রেশ হয়ে হসপিটালে গেলেন। জোর করে তাদের একটু খাওয়ানো হলো। তারা হসপিটালে যাবার পর তুলি এলো। বাড়িতে কাজ আছে এখনো, সেগুলো সামলাতে হবে।

***
স্বপ্নীল রক্ত দিলো প্রথমবার। অল্পতেই নার্ভাস হয়ে গেছিল। নি:শ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হলো। অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায় ওর নিজের ই লজ্জা লাগছিল। রঙ্গনা কঠিন গলায় বলল,

“এরপর থেকে তিন মাস পর পর রক্ত দিবি তুই। নাহলে খবর আছে। ”

স্বপ্নীল ভীষণ লজ্জা পেল। বাড়ি ফেরার আগে মিশুক কে সরি বলে এসেছে। মিশুক বুঝতে না পেরে বলল,

“সরি কেন স্বপ্নীল?”

স্বপ্নীল লজ্জায় আর বলতে পারে নি যে ও অজ্ঞান হয়ে গেছিল সেজন্য সরি বলছে।

ফেরার সময় স্বপ্নীল শ্রাবণ্যকে বলল, বাসায় যেন কাউকে না বলে যে ও রক্ত দিতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে। শ্রাবণ্য ভুলে আবারও হেসে ফেলল। বলল, আচ্ছা কাউকে বলব না।

***
আকাশীর সঙ্গে বাবা মায়ের দেখা হলো তিন বছরেরও বেশী সময়ের পর। দেখা হবার পরের ঘটনাটা খানিকটা নাটুকে হতে পারতো। মা এতদিন পর মেয়েকে দেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছেন। বাবা আদ্র চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়েছেন। সেসব কিছুই হলো না। মা তাকালেন শক্ত চোখে। যেই চোখের ভাষা আকাশী সহজেই পড়ে ফেলল। মানে ও এখানে কেন আছে! বাবা ওর দিকে তাকালেন না। তিনি দাদুর সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত। দাদু খেয়াল করলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, মুনসুর তোমার বড় মেয়ের সঙ্গে কথা বলো। সব জায়গায় জেদ খাটে না। তুমি ব্যবসায়ী মানুষ, তাই বলে সব জায়গায় শক্ত হবা এটার কোনো মানে নাই। ছেলে মেয়েদের ক্ষেত্রে তোমার আরও নরম হওয়া দরকার।

বাবা সেকথা বুঝলেন কিনা বোঝা গেল না। আকাশীও খুব একটা সামনে পড়ছে না। রেহানার খুব বিরক্ত লাগলো মেয়েকে দেখে। কী বেহায়া মেয়ে! লজ্জা থাকলে ওর কী এখানে আসা উচিত। দশজনের সঙ্গে দেখা হবে, নানান প্রশ্ন করবে। সেই প্রশ্নগুলোর জবাব দিতে গিয়েও বাবা মা’কে বিব্রত হতে হবে। এইটুক জ্ঞান মেয়ের থাকবে না।

***
রঙ্গনা ঘুম থেকে উঠে জানালো পার্লারে যাবে না। আকাশীর কাছ থেকে সাজবে। তাও বাড়াবাড়ি রকমের সাজের দরকার নাই। কোনোরকম সাজিয়ে দিলে হবে। আকাশী খুশি মনেই দায়িত্ব নিলো। শ্রাবণ্যও সঙ্গে আছে। রঙ্গনার কথা শোনা হলো না। হলুদের সাজ যেমন হয় তেমন ই হলো।

রাফাত দের বাড়ির লোকজন আসলো বিকেল শুরু হবার পর। এদের যে লোকজনের জ্ঞান নেই সেটা আবারও বোঝা গেল। পঞ্চাশের মতো মানুষ এসেছে। রাফাতের খালা আজও এসে পান সুপুরির বক্স নিয়ে বসলেন। রাফাতের মা এসেছেন আজ। তিনি একটু বিরক্ত। এসে দেখলেন বাড়িতে গান, বাজনার আয়োজন নেই, হৈ হুল্লোড় নেই।

মামী আজও খুব সেজে এসেছেন। কোমড়ে বিছা পরতেও ভুল করেন নি। তার মুখের অতিরিক্ত মেকাপের জন্য তাকানো যাচ্ছে না৷ শ্রাবণ্য আকাশীর কানে কানে বলল, বিয়ে আর বউভাতে কীরকম সাজবে সেটার অপেক্ষায় আছি।

উনি এসে আজও বললেন, রঞ্জনা মেকাপ কোন পার্লার দিয়া করছ ভালো হয় নাই।

রঙ্গনা হেসে বলল, মামী আসলে আমার চেহারা ভালো না। চেহারা ভালো হইলে মেকাপ ভালো হইতো।

শ্রাবণ্য এখানেও ভুল করে হেসে ফেলল।

স্বপ্নীল এবার খুব সচেতন। রাফাত দের বাড়ি থেকে আসা ছেলেগুলোর দিকে খুব নজর রাখছে। ছেলেগুলো আজ অতি সাবধানী। ওদের অন্য প্ল্যান আছে সেটা পরশুর জন্য তোলা। আপাতত ভালো মানুষের অভিনয় চালিয়ে যেতে হবে।

রাফাতের মা, খালা, মামী কারোরই গায়ে হলুদের আয়োজন পছন্দ হয় নি। পেয়িং গেস্ট এর ফ্যামিলি ক্রাইসিসে এদের কেন এতো শোকতাপ সেটা নিয়ে খানিকক্ষণ গুজগুজ করলো। তার উপর রঙ্গনার অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি তাদের পছন্দ হচ্ছে না। এতো খরচ করে বিয়ে করার কোনো মানে আছে। বিয়েতে বিশ হাজারের লেহেঙ্গাও তার পছন্দ না, পঞ্চান্ন হাজারে লেহেঙ্গা কিনতে হলো। গোল্ড প্লেটের গয়নার দামও লাখের উপর। ওই টাকায় সোনার গয়না হয়ে যেত এক ভরি আন্দাজ। তারপর বউভাতের জন্য কাস্টমাইজড শাড়ি। সেটার খরচও পয়ত্রিশ হাজারের উপরে। মানে এতো পয়সা খরচের মানে হয়! পঞ্চান্ন হাজারের লেহেঙ্গা তো তুই একদিন ই পরবি। এমন ভারী লেহেঙ্গা পরে কোথায় যাবি এরপর। তাছাড়া এতো খরচ করে বিয়ের ই বা কী আছে! বিয়েশাদি তে আল্লাহর রহমত টাই আসল। দুটো পয়সা থাকলে সেটা ব্যাংকে জমাবি। বলে কিনা বিয়েতে শখ পূরণ করবে! এতো শখ ই বা কিসের!

রাফাতের মা বিরক্ত রীতিমতো। বান্ডেল বান্ডেল টাকা গচ্ছা যাচ্ছে। এই বাড়ি থেকে ফার্নিচার কিছু এখনো যায় নি। আগ বাড়িয়ে কিছু বলাও যায় না। মেয়ে মুখরা আছে ভালোই। তাছাড়া এখন মনে হচ্ছে বিয়েতে রাজী হয়ে ভুল করেছে। এই মেয়ে গত দুই সপ্তাহে রীতিমতো মাথায় উঠে নেচেছে বিয়ের শপিং নিয়ে। বাড়ি থেকে গয়নাগাটি, ফার্নিচার কেমন কী যাবে কে জানে! সোসাইটিতে মান থাকবে তো। গুলনাহার ভাবীর ছেলের বিয়েতে একটা ফ্ল্যাট দিয়েছে একদম গুছিয়ে। গা ভর্তি গয়না, গাড়িও নাকি দিবে।

এই বিয়েতে রাজী হবার কারণ ছিলো দুটো। একটা ছেলের পছন্দ। বদমায়েশের বাচ্চা কোনো মেয়েকে পছন্দ করে উঠতে পারছিল না। গাছ বাওয়া মেয়ে পছন্দ হলো। দ্বিতীয় কারণ পরিবার। মা উচ্চশিক্ষিত। কলেজের প্রিন্সিপাল। বাবার সম্পদও কম নয়। ভালুকায় বিশাল সম্পত্তি আছে মায়ের। তাছাড়া সোসাইটিতে চালানো যাবে। মেয়েও যথেষ্ট স্মার্ট। এখন মনে হচ্ছে একটু বেশি প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে।

রাফাতের মামী মায়ের কানে বিষ ঢালার দায়িত্বটুকু পালন করলেন। বললেন,

“আপা মেয়ের কথাবার্তা দেখছেন! একদম মানুষ রে গোনায় ধরে না। রাফাত রে কী দেখাইয়া ভুলাইছে। এখন পা আসমানে তুলে হাটে। বাড়ির লোকজনও কেমন। কে না কে মরছে, তাদের আত্মীয়ও না, অথচ নাটক করতেছে। দুই আনার দাম আমাদের দিতাছে না। ”

রাফাতের মা চুপ করে রইলেন। এই বিষয় নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে। এখন বাকী নাটকটুকু হজম করে নিক।

***
গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান হলো নির্বিঘ্নে। রাফাত দের বাড়ি থেকে আসা মহিলাদের আচরণ সন্দেহজনক মনে হলো শিলার। এদের মুখে হাসি নেই। একটু পর পর নিচু গলায় ফিসফাস করছে। শিলার হঠাৎ ভয় হলো। বিয়ে ঠিক হবার পর ভেঙে গেলে সমস্যা নেই। কিন্তু গায়ে হলুদের পর ঝামেলা হলে….! এই ভয়টা যেন অমূলক ই হয়। রঙ্গনা বিয়ে নিয়ে এতো খুশি! এই খুশিটুকু যেন থাকে।

***
পরদিন রাফাতের গায়ে হলুদে ওরা গেল।শ্রাবণ্য, তুলি, স্বপ্নীল, রিন্টি মন্টি। সব আয়োজন ঠিকঠাক থাকলেও ওদের আচরণ টা খটকা লাগার মতো। একটু কেমন যেন। শরবতে ট্যাঙের পরিবর্তে হলুদ মরিচ দিলো। এমন রসিকতা নাকি হয়েই থাকে বিয়ে বাড়িতে। খাবার খেতে বসার পর প্রত্যেকের মুখে স্নো স্প্রে করলো। পুরোপুরি হেনস্তা করলো। তুলি প্রথমে কিছু না বললেও পরে কড়া গলায় বলল, এসব ঠিক কী হচ্ছে? আর আপনারা বড় রাও মনে হচ্ছে ব্যাপার টা খুব এনজয় করছেন?

রাফাত এসে কাজিন দের ধমকাধমকি করলো ভীষণ। মামী এসে বললেন, বিয়ে বাড়িতে তো এসব হরহামেশাই হয়। আমার বিয়ে হইছিল মাঘ মাসে। বিয়ের পর দিন আমার চাচাতো দেবর কোলে করে পুকুরে ফালায়ে দিছিল। আমরা তো এমন মাইন্ড করিনি। এখন সবেতে বাড়াবাড়ি।

তুলি আর কিছু বলল না। রাফাত কেও বলে আসলো যে এই বিষয়ে রঙ্গনাকে কিছু না জানাতে। রঙ্গনার অল্পে মেজাজ গরম হয়। কালকের দিন টা দেখা যাবে ম্যুড অফ করে থাকবে।

***
রঙ্গনা হসপিটালে এসেছে। সঙ্গে আকাশী। মিশুকের সঙ্গে চোখাচোখি হলো। বিয়ের সময় মেয়েদের স্নিগ্ধ লাগে। রঙ্গনাকেও আজ সুন্দর লাগছে। একদম অন্যরকম। ও অবশ্য বেশীক্ষন থাকলো না। চলে এলো। বাসায় আসার পর দেখলো শ্রাবণ্যরা চলে এসেছে। রিন্টি, মন্টিকে সারা রাস্তা মুখস্থ করিয়ে এনেছে যেন বাসায় এসে কিছু না বলে। ওরা রঙ্গনাকে দেখেই সব ঘটনা গড়গড় করে বলে দিলো।

রঙ্গনা রাগের পরিবর্তে মন খারাপ করলো। ওই বাড়ির মানুষজন অন্যরকম। সেটা ওর মাথা ব্যথার বিষয় না। রাফাত আগেই বলেছে কারোর সঙ্গে ককম্প্রোমাইজ করে থাকতে হবে না। ওরা থাকবে ওদের মতো। তাই এখন এগুলো দেখেও না দেখার ভান করে যেন থাকে। কিন্তু সব ব্যাপারে অন্ধ সেজে থাকার ভান করা যায় না। এইসব ছোট ছোট খারাপ লাগা গুলো মনে থেকে যায়।

****
শিলা যে ভয়টা পাচ্ছিলেন সেটাই হলো। বরযাত্রী আসবে সন্ধ্যার দিকে। রঙ্গনার ঘুম ভাঙলো দশটায়। খেয়েই পার্লারে যাবে। আকাশী সব গুছিয়ে রেখেছে। রঙ্গনা ঘুম থেকে উঠে ফোন টা হাতে নিয়ে রাফাত কে ফোন করলো। প্রতিদিন ও একবার ফোন করে, রিসিভ না হলে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিয়ে রাখে। আজ ব্যতিক্রম হলো। রঙ্গনা ফোন করে পেল না। অল্পতে ও অস্থির হয় না, কিন্তু আজ বিশ মিনিটেও না পেয়ে অস্থির হলো। বাড়ি ভরা আত্মীয় স্বজন। ও গিয়ে মা’কে ব্যাপার টা জানালো। শিলা আগে থেকেই ভয়ে ছিলেন। তবুও নার্ভাসনেস মেয়েকে বুঝতে দিলেন না। বললেন,

“এতো অস্থির কেন হচ্ছিস? ওর মা’কে একবার ফোন করে দেখ। ”

“তুমি করো মা। ”

শিলা আর প্রশ্ন করলেন না মেয়েকে। নিজে ফোন করলেন। রাফাতের মা ফোন ধরে স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করলেন,

“হ্যালো কে?”

শিলা মৃদু হেসে বললেন,

“কী আশ্চর্য! আমার ফোন নম্বর টি আপনার ফোনে সেভ করা না।”

ফোনের ওপাশে থতমত খায় রাফাতের মা। বলেন,

“আরে আপা কাজের বাড়ি। খেয়াল করি নাই তো। ”

“রাফাত কোথায়? ও’কে তো পাওয়া যাচ্ছে না ফোনে।”

“কই যেন গেল সকালে উঠে। বলল বারোটার দিকে আসবে। ”

শিলা নিশ্চিন্ত হলেন। এতক্ষন তার মনের মধ্যে কী চলছিল সেটা কেবল তিনি ছাড়া আর উপরওয়ালাই জানতেন। রঙ্গনা পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো। শিলা বললেন,

“চিন্তা করিস না তো। তুই যা এখন। ও নাকি কোন কাজে বেরিয়েছে। পরে ফোন করবে। ”

রঙ্গনা পার্লারে গেল। ওর টেনশন দূর হচ্ছে না। রাফাতের সঙ্গে কথা না বলা অবধি শান্তি পাবে না। কোনো কারণ ছাড়াই ওর ভীষণ অস্থির লাগতে শুরু করলো।

***
রাফাতের মা, মামী আর খালা ছাড়া আর কেউই জানেন না যে কোথায় আছে ও। এইটুকু রিস্ক তাদের নেয়ার দরকার ছিলো। বিয়ে ভাঙলে তাদের ছেলের তেমন কিছু হবে না। ছেলেদের এসবে কিছু হয় না। বউ বাচ্চা থাকা পুরুষও হাসতে খেলতে একাধিক বিয়ে করতে পারে। ঝামেলা হয় মেয়েদের। খুব ই দিল দরদিয়া পরিবার। কে না কে মরছে তাতে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান বন্ধ রাখছে। এখন সবাই কান্নাকাটি করুক গলাগলি করে। ঠাস ঠাস কথা বলা মেয়েটার গলা দিয়ে কেমন আওয়াজ বের হয় সেটাও দেখা যাবে। রাফাত কে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ দেয়া হইছে। আজ সারাদিনে, রাতে ঘুম ভাঙবে না। বেহুশ হয়ে ঘুমাবে। ঘুমাক বেচারা। কোথায় আছে কেউ জানেও না। মামীর বাসায় নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। বিয়েশাদির ঝামেলায় ওদিকে কেউ যাবেও না। এখন ঘরের ব্যটাগুলোকে ম্যানেজ করতে হবে। এদের বোধ কম আবেগ বেশী। এইগুলারে ম্যানেজ করতে হবে।

চলবে….

কুসুম কাঁটা পর্ব-১৮+১৯

0

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-১৮
বাড়িতে বিয়ের আমেজ শুরু হয়ে গেছে এক্ষুনি। দাদু নিজেও ভীষণ খুশি। তার ঘাড়ত্যাড়া নাতনিটি এবার সত্যিই বিয়ের পিড়িতে বসতে প্রস্তুত। দাদু এমনিতে গম্ভীর হলেও নাতি নাতনিদের ভীষণ ভালোবাসেন। তিন জন তিন স্বভাবের হলেও সবাই ই তার হৃদয়ের কাছের। স্বপ্নীল কে সে যতই গাধা, গরু বলুক মনে মনে চান এই ছেলেটা একদিন আদুরে খোলস টা ছেড়ে অন্য আর দশ টা ছেলের মতোই হোক। তুলির বিদেশে যাবার ব্যবস্থা কখনোই পাকাপোক্ত না হোক। একটা না একটা ঝামেলায় এভাবেই আটকে যাক। অন্তত তিনি যে কদিন বেঁচে থাকেন সেই কদিন থাকুক।

এমন ভরা সংসারে, সবার মধ্যে মরে যেতে চান তিনি।

রঙ্গনা বিয়ের প্ল্যান করছে নিজেই। নিজের রুমের দেয়ালের ডিজাইনগুলোও যত্ন করে করছে। পার্লারে এপোয়েনমেন্ট নিয়ে রাখছে আগেভাগে। শাড়ী, জুয়েলারি সমস্ত ডিজাইন দেখছে। এই নিয়ে হৈচৈ লেগে আছে বাড়িতে একের পর এক। ওর দুজন বন্ধু আসছে। শার্ট, প্যান্ট পরা ছোট চুলের মেয়ে হলেও মেয়েদুটো ভালো। বসে বসে হাসিমুখে দাদুর লেকচার শুনেছে। দাদুর এখন আর মেয়ে দুটোকে খারাপ লাগছে না। ওরাও বেশ মাতিয়ে রেখেছে।

সেদিন মিশুকের সঙ্গে দেখা হলো। দাদু সরু চোখে দেখলেন। ভালো করে কথাও বললেন না। এগ্রিমেন্ট শেষ হলে এই ব্যটাকে বাড়ি থেকে বিদায় দিবেন। ফাজিল ব্যটা তার নাতনিকে রিজেক্ট করার দু:সাহস করেছে। শেষ মাসে ওকে কঠিন শিক্ষা দিতে হবে। বেশী কিছু না, মন্টি রিন্টিকে লেলিয়ে দিলেই হবে। এই বাচ্চাদুটো হয়েছে বাপের মতো বজ্জাত। এরা লোকজন ভালো শায়েস্তা করতে পারে।

***
আকাশী এই প্রথম রঙতুলিতে এলো বড় হবার পর। ছোটবেলায় একবার এসেছিল। ভাসা ভাসা স্মৃতি মনে আসছে। গেট দিয়ে ঢুকতেই কুকুর টা দৌড়ে এলো। কুকুর টা রঙতুলিতে এসেছে কয়েকদিন হয়েছে। রঙ্গনা রাস্তা থেকে তুলে এনেছে। কারা যেন গরম পানি গায়ে ঢেলে দিয়েছিল। চিকিৎসা করিয়ে বাড়িতে এনে রেখেছে। মালেক মামা দেখেশুনে রাখছেন। রঙ্গনা অবশ্য নিজেই কুকুর টার জন্য আলাদা করে খাবার রান্না করে।

মালেক মামা এসে বললেন,

“আপনি কাকে খুঁজেন?”

আকাশী স্মিত হেসে বলল,

“আমি শ্রাবণ্যর আপু। ”

মালেক মামা আকাশীকে ভেতরে নিয়ে যায়। শ্রাবণ্য সামনেই ছিলো। তুলি মা’কে ডেকে নিয়ে এলো। শিলা এসে আকাশীকে দেখলেন। বললেন,

“কেমন আছ তুমি?”

আকাশী স্মিত হেসে বললেন,

“আমি ভালো। আপনি কেমন আছেন?”

শিলা আকাশীকে দেখলেন। সুন্দর মুখশ্রী তবে অযত্ন, মানসিক টেনশনে মুখের মলিনতা হারিয়ে গেছে। কী সুন্দর বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। আহারে মেয়েটা! না বুঝে একটা ভুল করে কত মাশুল ই না গুনছে। শিলা কী ভেবে যেন আকাশীকে জড়িয়ে ধরলেন। আকাশী অপ্রস্তুত হলো। তবুও এই আদরে ওর চোখে পানি এসে গেল। শ্রাবণ্যর ভালো লাগলো।

আকাশীকে বাড়ির সবাই পছন্দ করলো। দাদুও পছন্দ করলেন। তিনি বললেন,

“শুনেছি তুমি নাকি তোমার বাবার অফার প্রত্যাখ্যান করেছ?”

আকাশী জবাব দিলো না। দাদু বললেন,

“এতো ছোট মেয়ে অথচ তোমার সাহসে আমি মুগ্ধ হয়েছি। ”

আকাশী হাসলো। বহুদিন পর কিছু মানুষ কে পেয়ে মনে হলো এরা দূরের কেউ না। এরা ওরই আপন মানুষজন।

দাদু আরও কিছুক্ষন লেকচার দিলেন। তবে কিছু কথা আকাশীর ভালো লাগলো।

“শোনো মেয়ে, মানুষ ছোট থেকে বড় হয়। একদিনে কেউ তালগাছে উঠতে পারে না। সময় লাগে। সামনের দিনে পরিশ্রম করে বড় হও। কারোর উপর নির্ভরশীল হবে না। আর যেখানে সম্মান না পেয়ে ফিরে এসেছ সেখানে ভুলেও ফিরে যাবে না। আরেকবার কারও হাত ধরলে দেখেশুনে বুঝে ধরবে। ”

***
শুভ বাড়িতে আসার পর মা নতুন চাল চালতে শুরু করেছেন। বড় বাড়ির মেয়েকে ভাগিয়ে আনায় বেশ খুশি ছিলেন। আজ নাহয় কাল মেনেই নিবে। না মেনে নিয়ে যাবে কই। কিন্তু দেখলেন সে আশায় গুড়ে বালি। তারপর শুভ কে কানপড়া দিলেন যেন একটা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে নেয়। নাতির মুখ দেখলে আকাশীর বাপ, মা গলে জল হবে। কিন্তু আকাশী বড় শক্ত মেয়ে। তার সাফ কথা! আগে শুভ কাজে ভালো করে থিতু হোক। নিজেদের চলতেই হিমশিম খেতে হয় সেখানে আরেকটা প্রাণ পৃথিবীতে এনে কষ্ট দেবার কোনো মানে হয় না।

এতো অভাব, টানাটানিতে থেকেও বাপের কাছে হাত পাতে নি। বাপও ফিরে তাকায় নি। এতো চক্ষুলজ্জা থাকলে দুনিয়ায় থাকা যায় না।

আকাশীর এখন চলে যাওয়ায় শুভর মা ভীষণ খুশি হলেন। তার মাথায় অন্যকিছু চলছে। তার চাচাতো বোন জেসমিনের একটা মেয়ে আছে। আগে একবার বিয়ে হইছিল, জামাইর সঙ্গে বনিবনা হয় নি তাই ছাড়াছাড়ি হইছে। সেখান থেকে তিনলাখ টাকা পাইছে। টাকাটা পোস্ট অফিসে রাখছে ফিক্সড করে। মাসে সাতাশ’শ টাকা পায় সেখান থেকে। তাছাড়া একটা প্লাস্টিক কোম্পানিতে চাকরি করে। উপরি ইনকাম সহ আঠারো হাজার বেতন।
সব মিলিয়ে সোনার ডিম পাড়া হাঁস। এই হাঁস ঘরে ওঠানোর প্ল্যান চলতেছে। যেভাবে হোক এই মেয়েরে ঘরে ওঠাতে হবে।

***
রঙ্গনার বিয়ের কার্ড এখন মিশুকের হাতে। কার্ড দেখে ভ্রু কুঞ্চিত হলো কিছুটা। এরা এরমধ্যে কার্ড পর্যন্ত ছাপিয়ে ফেলেছে। এদিকে সেটা দেখে ওর বুকের মধ্যে চিনচিনে একটা ব্যথা অনুভব হচ্ছে। মনে হচ্ছে এক বুক জ্বালা নিয়েই ও’কে রঙ্গনার বিয়ে খেতে হবে। পালিয়ে থাকারও উপায় নেই। ওরা অন্যকিছু ভাবতে পারে।

চলবে……

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-১৯
রঙতুলিতে আসার পর আকাশীর ভাগ্য খুলে গেছে বলা যায়। রঙ্গনা সাত টা শাড়ি ডিজাইনের অর্ডার দিয়েছে। হানিমুনে সাত রঙের শাড়ি পরবে। সেই সঙ্গে সাত টা পাঞ্জাবী। আকাশীর জন্য ব্যাপার টা ভীষণ চাপ ও আতঙ্কের হয়ে গেল। রঙ্গনা ব্যাপার টাকে ভীষণ সিরিয়াসলি নিয়ে নিলো। ও পার্লারের কাজ জানে শুনে বাড়ির সবাই মেহেদীর জন্য বুকড করে রাখলো। তুলি সহ রঙ্গনার অন্যান্য বন্ধুরা।

রঙ্গনা শাড়ির জন্য ও’কে এডভান্স টাকাও দিয়ে দিয়েছে। সবকিছু এতো তাড়াতাড়ি হচ্ছে যে ও নিজেও অনেক কিছু বুঝে উঠতে পারছে না।

শ্রাবণ্য আকাশীকে বলল,

“তুই এখানে থাকবি এই ক’দিন। তোর ভালো লাগবে। মন খারাপ করে থাকিস। ”

আকাশী রাজী হলো না। বলল,

“নারে। আমি মাঝেমধ্যে আসব। ”

শ্রাবণ্য বলে,

“মা তোকে কিছু বলেছে?”

আকাশী বুঝতে না পেরে বলল,

“কোন ব্যাপারে? ”

শ্রাবণ্য বুঝলো যে রেহানা তার ভয়ংকর কথাগুলো আকাশীকে বলেন নি। শ্রাবণ্য এড়িয়ে যায়। আকাশী তবুও জোর করে। শ্রাবণ্য বলতে চায় না। মা যে ভয়ংকর কথাগুলো আকাশীকে নিয়ে বলেছে সেগুলো কোনো মা মেয়েকে নিয়ে বলে না। ওদের মা ব্যতিক্রম। ব্যাপার টা এমন নয় যে তিনি খারাপ। ঘরে যারা কাজ করেন তাদের কে না দিয়ে কোনো ভালো জিনিস খান না। কারও অসুখ, বিসুখ কিংবা সংসারে টানাটানি শুনলে টাকা পয়সা ধার দেন। তার রুক্ষতা, নির্মম আচরণ টের পায় শুধু ওরা। আকাশী এই বাড়িতে এসেছে এই খবর টা শ্রাবণ্য বাবাকে বলেছিল। ওর উদ্দেশ্য ছিলো বাবার সঙ্গে বোনের মিল করিয়ে দেয়া। আকাশী মন ছোট করে থাকে। ও আফরিনের কাছেও শুনেছে যে সারাক্ষন মন খারাপ করে থাকে। মাঝেমধ্যে খাবার টা টেবিলে ডাকা পড়ে থাকে, আকাশী না খেয়ে ঘুমায়। মানুষের সবচেয়ে বড় অসুখ হচ্ছে মন খারাপের অসুখ। এটা এমন অসুখ যে না সাড়া অবধি সবকিছুতেই বিতৃষ্ণা লাগে।

রেহানা যখনই জানলো আকাশী এই বাড়িতে এসেছে তখনই শ্রাবণ্যকে ফোন করে বলল,

“আকাশীকে ডেকে নিয়ে মাথায় ওঠাচ্ছিস না। দেখবি এখন কী হয়! তোর সংসার ধ্বংস করবে। দেখ তোর স্বামীকে না আবার ওর মনে ধরে। ”

শ্রাবণ্য হতভম্ব গলায় বলল,

“কিসব আবোল তাবোল বলছ মা। আপু কী তোমার নিজের মেয়ে না? ”

“এইজন্যই তো বললাম যে কী বিষ পেটে ধরছি তা কেবল আমিই জানি৷ তুই তো মহান সাজার চেষ্টা করছিস। এরপর কাঁদতে কাঁদতে চোখে ঘা হবে। ”

শ্রাবণ্য রাগী গলায় বলল, ফোন রাখো মা। এরপর থেকে মেজাজ ঠান্ডা থাকলে ফোন করবে। নাহয় করবে না।

আকাশী আবারও জিজ্ঞেস করলো,

“কী বলেছে মা?”

শ্রাবণ্য হেসে বলে, মায়ের কথা বাদ দে। জানিস ই তো মা ভিনগ্রহের মানুষ। বাবা ছাড়া সবাইকে তার অসহ্য লাগে।

আকাশী আর কথা বাড়ায় না। স্মিত হাসে। বলে,

“এই বাড়ির মানুষজন ভালো। তুই মানিয়ে নিতে পারছিস তো?”

“কেন আমি কী খারাপ? ”

আকাশী হাসলো। বলল,

“নাহ! তোর অনেক বুদ্ধি। আমার মতো বোকা না তুই। ”

শ্রাবণ্য হাসে। আকাশীকে পৌছে দেবার জন্য শীলা স্বপ্নীল কে যেতে বলে। শ্রাবণ্য বারন করে। নিজের আচরণে বিরক্ত হয়। মায়ের কথার প্রভাব পড়লো নাকি৷ খারাপ জিনিসের প্রভাব বেশী পড়ে।

***
স্বপ্নীল প্রতিদিন এসে সিদ্ধান্ত নেয় আজকেই ওর অফিসে শেষ দিন। এরপর আর অফিসে যাবে না। ওই অফিসে একদল বজ্জাত লোক থাকে। যারা ও’কে মুরগী বলে ডাকে। যে গ্রুপে কাজ করে সেই গ্রুপের টিম লিডার শাফি ভাই৷ শাফি সবার সাথে ভালো ব্যবহার করে। তৃষা নামে একটা মিথ্যুক মেয়ে আছে, তার সঙ্গে কথা বলার সময় মুখ দিয়ে যেন মধু বেরোয়। আর ওর সঙ্গে কথা বলে ধমক দিয়ে। তৃষা নামে যে মেয়েটা আছে স্বপ্নীল কে উঠতে বসতে অপমান করে। সামান্য জিনিস নিয়েও অনেক কিছু শুনিয়ে দেয়। স্বপ্নীল চুপচাপ হজম করছে সবকিছু। দুটো মাস প্রায় হয়ে গেছে। আর একমাস বাকী।

সেদিন সফটওয়্যার আপডেট নিয়ে মিটিং হচ্ছিলো। সব কাজ গুছিয়ে ও করলো অথচ ক্রেডিট নিলো তৃষা। শাফি ভাই ওর দিকে তাকিয়ে দাঁত, মুখ খিচিয়ে বলল,

“খাওয়া, আর হাগা ছাড়া তুমি আর কী পারো? এইখানে যে তুমি কোনোভাবে পার্মানেন্ট হইতে পারবা না সেইটা কী বুঝতে পারছ!”

স্বপ্নীল তাকিয়ে রইলো ফ্যালফ্যাল করে খানিকক্ষণ। বাইরে তখন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। ও ভিজতে ভিজতে বাসায় চলে এলো। মা, ছোটপা, বুবুরা শপিংমলে গেছে। বাসায় শ্রাবণ্য আর দাদী ছিলো। দাদী স্বপ্নীল কে ভেজা দেখে অস্থির হয়ে মাথা মুছিয়ে দিতে গেলেন। ও সরিয়ে দিয়ে চলে গেল। এমন কখনো করে না। শ্রাবণ্য দাদীকে বলল,

“দাদী বম দেখি। ”

শ্রাবণ্য ঘরে গেল। স্বপ্নীল ওয়াশরুমে। শাওয়ারের শব্দ টের পাওয়া যাচ্ছে। এতটা ভেজার পরও শাওয়ার ছেড়ে ভিজছে! এরপর তো জ্বর হবে৷ এমনিতেই ম মাস্বপ্নীলের ঠান্ডার ধাত আছে৷

শ্রাবণ্য ডাকলো,

“স্বপ্নীল শুনছেন? বেরিয়ে আসুন। কী হয়েছে আপনার? ”

স্বপ্নীল বেরিয়ে এলো দশ মিনিট পর। চুল ভালো করে মুছে বের হয় নি। শ্রাবণ্য বলল,

“এতো ভিজে এসেছেন তার উপর এত সময় ধরে শাওয়ার নিলেন। ”

স্বপ্নীল উত্তর দিলো না। শ্রাবণ্য আবারও জিজ্ঞেস করলো,

“চা খাবেন? ”

“না।”

“কিছু হয়েছে মন খারাপ? ”

স্বপ্নীল শ্রাবণ্যর দিকে তাকালো। ওর চোখ লাল। ভাঙা গলায় বলল,

“শ্রাবণ্য, আমি কী সত্যিই লুজার?”

শ্রাবণ্য তাকিয়ে রইলো। এতবড় একটা ছেলে এভাবে দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে। ও স্বপ্নীলের কাঁধে হাত রাখলো। স্বপ্নীল কাঁদছে, বাচ্চাদের মতো। শ্রাবণ্যর ভীষণ অসহায় লাগলো। মা কিংবা বুবু কেউ একজন থাকলে ভালো হতো। স্বপ্নীল কে সামলাতে পারতো। শ্রাবণ্য দুর্বল গলায় বলল,

“কাঁদবেন না…. প্লিজ কাঁদবেন না। ”

স্বপ্নীল শ্রাবণ্য কে জড়িয়ে ধরলো। শ্রাবণ্যর মনে হয়তো কোনো অনুভূতি তৈরী হয় নি, কিংবা অজান্তেই তৈরী হয়েছে যেটা ও বুঝতে পারছে। স্বপ্নীলের আলিঙ্গনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

***
রাফাত ছেলে হিসেবে সাধারণ পর্যায়ের। সাধারণেরও সর্বনিম্ন স্তরের। ওর এর আগে তিনজন গার্লফ্রেন্ড ছিলো তারা কেউই স্থায়ী হয় নি ওর স্বভাবের কারনে। যেমন ওর ইনকাম ছয় ডিজিটের। তবুও সারাবছর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তিনটা শার্ট, প্যান্ট আর চারটা টিশার্টে চালিয়ে নেয়। একটা জুতাই সব পোশাকের সঙ্গে পরে। এমন না যে ব্যাংকে প্রচুর টাকা জমাচ্ছে। টাকা পয়সা বিভিন্ন জন কে দিয়ে বেড়াচ্ছে। রাস্তায় কোনো ফকির কে খালি হাতে ফেরায় না। ওর মা ছাড়াও অন্যান্য মানুষজনকেও টাকা পয়সা দিয়ে রাখছে। আত্মীয়দের কারো বিপদ শুনলে আগ বাড়িয়ে টাকা দিয়ে আসে। তাদের আসলেই দরকার কিনা সেটার হিসাব করে না।

প্রথম গার্লফ্রেন্ড ও’কে ছেড়ে গেছে কারন রিলেশনশিপে ও নাকি পজেসিভ ছিলো না। দিনে আট, নয়বার ফোন করা উচিত কিন্তু সেটা ও করে না।

দ্বিতীয়জন একটু বেশী সাজুগুজু করতো। সে চাইতো ও একেক দেশ থেকে ব্র‍্যান্ডেড মেকাপ প্রোডাক্ট আনুক। ডেটে আসলে তার প্রধান কাজ ছিলো একটু পর পর কম্প্যাক্ট লাগানো। ব্যাপার টা রাফাতের খুব ই বিরক্ত লাগতো। আরে আল্লাহ যে চেহারা দিয়েছেন সেটা নিয়ে এতো অসন্তুষ্টি কিসের।

তিন নম্বর জন অবশ্য গার্লফ্রেন্ড না। মা, খালারা মিলে বিয়ে ঠিক করেছিল। মেয়েটা সাউথ ইস্টে পড়ে। রেস্টুরেন্টে ইচ্ছেমতো খাবার নষ্ট করতো। রাফাতের সেটা ভালো লাগে নি। একদিন বলল, যতটুকু খেতে পারবে ততটুকু খাবার নিবে। মেয়েটা মাইন্ড করলো। মা, খালারা খুব রাগ করলেন। ওর মা রেগে গিয়ে অনেক কিছুর বাচ্চা বলেও গালি দিলো।

মেয়েটার সঙ্গে তারপরও কথাবার্তা এগোলো। মেয়েটা একদিন জানালো ওর ফোন টা পুরোনো হয়ে গেছে। এটার মানে হলো তাকে একটা ফোন কিনে দেয়া উচিত। কিন্তু রাফাত দেখলো ওর ফোন টা ঠিক ই আছে। ওর নিজের আগের ফোন টাই ছয় বছর ব্যবহার করেছে।

একদিন সেই মেয়েটাকে নিয়ে শপিংমলে গেল। সাড়ে তিন ঘন্টা লাগিয়ে জুতা, জামা, জুয়েলারি কিনে বিল দেবার সময় রাফাতের দিকে তাকালো। রাফাত ভ্রু নাচিয়ে বলল,

“আমার দিকে কেন তাকাচ্ছ? তুমি বিল পে করো। ”

বিয়েটা ভেঙে গেল। রাফাত কে ফকিরের বাচ্চা বলেও মেসেজ করেছিল মেয়েটা। তার কিছুদিন পর রাফাত শীতে গরীব দু:খীদের কম্বল দিচ্ছিল। সেটা সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করার পর কমেন্টে লিখলো, ওদের একজন কে বিয়ে করে রাস্তায় থাকুন। বন্যরা বনে সুন্দর, রাফাতরা রাস্তাঘাটে।

রঙ্গনাকে বিয়ে করতে চাওয়ার একমাত্র কারণ, স্বাধীন, আত্মপ্রত্যয়ী দৃঢ় স্বভাবের কারনে। প্রথম যেদিন রেস্টুরেন্টে দেখা হলো সেদিন তিন ঘন্টা বিরক্তিহীন আলাপে শাড়ি, গয়না, মেকাপের আলাপ হয় নি। একবারও রঙ্গনা আয়নায় নিজেকে দেখে নি। খাবার পর বাকী খাবার টা ফয়েল পেপারে মুড়ে বিড়াল, কুকুর দের জন্য।

রাফাত অমন সংসারী টাইপের ছেলে না, দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে। মাঝেমধ্যে বাড়ির কথা মনে পড়লে আসে। রঙ্গনাও প্রায় তেমনই। টিপিক্যাল বউ সেও হতে পারবে না।

এদিকে রাফাতের বাড়ির লোকের ধারণা রঙ্গনাই একমাত্র মেয়ে যে রাফাত কে সাইজ করতে পারবে।

এখন দেখা যাক এদের বিয়ের গল্প কতদূর এগোয়…..!

চলবে….

কুসুম কাঁটা পর্ব-১৬+১৭

0

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-১৬
আজকের সকাল টা রঙ মহলে খুশি খুশি সকাল। শ্রাবণ্যর ঘুম ভাঙলো দশটার পর। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখলো দাদী আর আম্মু ছাড়া আর কারোর ঘুম ভাঙে নি। শিলা শ্রাবণ্য কে বলল, তুমি বা কেন এতো তাড়াতাড়ি উঠলে!

শ্রাবণ্য হাসলো। সকালে ওঠার অভ্যাস বলে, ছুটির দিনে বেলা পর্যন্ত ঘুমাতে পারে না। শিলা শ্রাবণ্য কে বলল,

“তোমাকে আগে রুটি দিয়ে দেই। তারপর আমার একটা কাজ করবে?”

“কী কাজ আম্মু?”

শিলা একটা ব্যাগ দেখিয়ে বলল, এই ব্যাগ টা নিয়ে আকাশীর কাছে যাবে। কালকের কিছু খাবার, কেক, মিষ্টি এগুলো দিয়েছি। আর ও’কে বলবে যে আমরা ভীষণ রাগ করেছি ওর উপর। রাগ ভাঙাতে হলেও একদিন আসতে হবে আমাদের কাছে।

শ্রাবণ্য হাসলো। বলল,

“আচ্ছা যাব। ”

শ্রাবণ্যর খুশি লাগে, আবার রাগও হয়। ওর পরিবারে এতো গুরুত্ব ওর মা কখনো ও’কে দেয় নি। শিউলিকেও দেয় না, খুব ই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। তিনি মনে করেন খবরদারি করাই তার একমাত্র দায়িত্ব কর্তব্য। আর এই একজন মা! যিনি ছেলেমেয়েদের সঙ্গে চোখ তুলে পর্যন্ত কথা বলেন না। কী সুন্দর ভুল গুলোও বুঝিয়ে বলেন।

শ্রাবণ্য আর মন খারাপ করতে চায় না সকাল সকাল। দুটো রুটি খেয়ে ও তৈরী হতে গেল। ভালোই হলো, এই ফাঁকে নিজেও একটু ঘুরে আসতে পারবে।

শ্রাবণ্য বেরোনোর সময় দেখলো স্বপ্নীল গুটিশুটি মেরে এক কোনে ঘুমিয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে শীত লাগছে। এখন তো তেমন ঠান্ডাও নেই৷ শ্রাবণ্য চাদর টা ভালো করে ওর গায়ে টেনে দিলো। স্বপ্নীল কাল কী নিয়ে যেন ওর সাথে রাগ করেছে। রাতে শ্রাবণ্য দুবার কথা বললেও জবাব দেয় নি। হতে পারে ছোট আপুর সঙ্গে রাগ করেছে। কিন্তু ওর সঙ্গে কেন কথা বলল না সেটা বুঝতে পারলো না।

***
শুভ আকাশীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারলো না। একদিন গিয়েছিল হ্যাপি আপার কাছে। হ্যাপি আপা এক গাল হেসে বলল,

“আকাশী কই আছে তার আমি কী জানি! মনে হয় নতুন কোনো ভা*তার খুঁজে পাইছে। ”

শুভর ভীষণ রাগ হলো। আকাশী অমন ধরনের মেয়ে নয় সেটা ও জানে। তবুও হ্যাপিকে কিছু বলতে পারলো না। ওদিকে বাড়ি ভাড়ার জন্য বাড়িওয়ালি মহিলা আসে। তিনি অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে যান প্রতিবার। গার্মেন্টসে একটা কাজ জুটিয়েছিল সেখানেও টিকতে পারলো না। বাড়িতে মায়ের প্যানপ্যানানি আছে। তিনি কিছুতেই আকাশীকে মেনে নিতে রাজি নয়। আশেপাশের মানুষ নানান কুমন্ত্রনা দেয়, মা সেগুলো কানেও নেয়। একদিন বলল, আকাশী যদি আসে তাইলে বলবি পাঁচ লাখ নিয়ে আসতে বাপের থেকে। নাহলে ঘরে ওর জায়গা নেই। সব মিলিয়ে শুভর জীবন টা দূর্বিষহ৷ আকাশী এতদিন আছেই বা কোথায়! ও তো শ্রাবণ্যর ঠিকানাও জানেনা।

শুভ বাসার সমস্ত ফার্নিচার, হাড়িপাতিলসহ সব জিনিস বিক্রি করে দিলো। আকাশীর নিজের অতি কষ্টে টাকা জমিয়ে কেনা আলমারি, ড্রেসিং টেবিল, র‍্যাক, টিভি সবকিছুই পানির দামে বিক্রি করে বাড়িওয়ালার টাকা শোধ করে বাড়ির উদ্দেশ্যে চলে গেল৷ সেখানে অন্তত নিশ্চিন্তে কটা দিন ডাল ভাত খাওয়া যাবে। পরের চিন্তা নাহয় পরে করবে৷

মোহাম্মদপুরের ছোট্ট রুমটায় আকাশী আর শুভ যে সংসার শুরু করেছিল সেখানে এখন হয়তো অন্য কেউ সংসার সাজাবে। দেয়ালে ক্যালেন্ডার উঠবে অন্য কারোর হাতের। খাট, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল সবকিছু হবে অন্য কারোর। শুভ আর আকাশীর সংসারের আর অস্তিত্ব থাকবে না।

***
রেহানা আকাশীকে ফোন করে অনেক গালমন্দ করলেন। কেন শ্রাবণ্যকে সিড়ি হিসেবে ব্যবহার করছে ও। আকাশী জবাবে শান্তস্বরে বলল, মা হয়তো এমন কোনো দিন আসবে না যে আমি আমার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারব। কিন্তু এটুকু বলতে পারি যে আমি আমার একমাত্র বোনের কোনো ক্ষতি চাই না। ও খারাপ থাকুক সেই কাজ করার আগে যেন মরে যাই।

রেহানার কাছে আকাশীর সব কথাই বিষের মতো লাগে। এই এক মেয়ের জন্য তিনি অনেক লাঞ্চিত হয়েছে। জা’য়েদের কাছে তার মাথা নত হয়েছে। দেবরের মেয়েদের দুই কথা বলার আগেও তাকে ভাবতে হয়। কারণ তার মেয়েই হাত থেকে ছুটে গেছে। তারচেয়েও বড় কথা হলো শ্রাবণ্যর দু:সাহস। একবারও তাকে কিংবা বাবাকে জিজ্ঞেস না করে ও আকাশীকে সাহায্য করতে গেল! আবার বড় বড় কথা বলছে, বলে স্বপ্নীল দের বাড়িতে কোনো সমস্যা নেই এই ব্যাপারে। রেহানার আসল রাগ টা সেখানেই। স্বপ্নীলের মা টিচার। তার ব্যক্তিত্ব অন্যরকম। কথা বলেন সুন্দর গুছিয়ে। শ্রাবণ্য তাকে পছন্দ করে, বাড়ির অন্যান্যদেরও ভালোই পছন্দ করে। করুক তাতে রেহানার সমস্যা নেই। কিন্তু মা’কে কেন গুরুত্বহীন ভাবছে। রেহানা ভেবেছিল বিয়ের পর শ্রাবণ্য হাজার টা সমস্যার সমাধান চাইতে তাকে ফোন করবেন। তার কাছে ছুটে আসবে৷ সেটা করছে না। ও ভালো আছে নাকি খারাপ আছে সেটা জানতে চাইলে রুক্ষ গলায় বলে, সেটা তোমার না জানলেও চলবে। রেহানা অবাক হন। এই মেয়ে কখনো এভাবে তার মুখের উপর কথা বলে নি। রেহানা হেরে যান নিজেই নিজের কাছে। শিউলিকে সে বশে আনতে পারছে না। রেহানার একমাত্র ছেলে বাবু কানাডায় থাকে। বছরে দুমাসের জন্য আসে। শিউলি এতদিন এখানে থাকলেও এবার স্বামীর কানে মন্ত্র পড়ে বাপের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করেছে। মুনসুর তাতে সায় দিয়েছেন। বলেছেন মাঝেমধ্যে আসলেই হবে। মেয়েরাও কেউ তার দলে নেই। শ্রাবণ্যর সংসার কন্ট্রোল করা তো দূরে থাক, মেয়ের কাছে নিজেকে এখন পর লাগে।

রেহানা তবুও সাহস করে স্বামীকে বলেছে, আকাশীকে এখানে আনার দরকার নেই। মানুষ ছি: ছি: করবে। কাজের লোকগুলো পর্যন্ত মুখ চেপে হাসে।

মুনসুর গম্ভীর গলায় বললেন,

“তোমাকে এসব না ভাবলেও হবে। তুমি কম ভাবো। অবশ্য তোমার ভাবনা সীমিতই। তোমার ভাবনা আরেকটু বেশী হলে আকাশী শ্রাবণ্য কে ফোন করে সাহায্য না চেয়ে তোমার কাছেই চাইতো।”

রেহানার কান দিয়ে যেন আগুন বের হয়। নিজেকে সবদিক থেকেই যেন গুরুত্বহীন লাগে।

***
“শ্রাবণ্য দাঁড়াও। ”

শ্রাবণ্য দাঁড়ায়। সাকিব ছুটে আসে। শ্রাবণ্যর মুখোমুখি হবার সাহস সঞ্চার করতে ওর অনেক সময় লেগেছে।

“কেমন আছ সাকিব?”

সাকিব অপ্রস্তুত হয়। বলে,

“তুমি কেমন আছ?”

“খুব ভালো। ”

সাকিবের অনেক কথা বলার ছিলো। কিন্তু ও দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণ্যর মুখের দিকে তাকিয়ে।

“কিছু বলবে?”

“পরীক্ষা কেমন হলো? ”

“ফার্স্ট, সেকেন্ড না হলেও টপ ফাইভে থাকব। ”

“চা খাবে?”

শ্রাবণ্য হেসে বলে, না আমি বাড়ি ফিরব।

“তোমার সাথে একটু কথা আছে। ”

“সরি বলবে? ”

সাকিব অপ্রস্তুত হয়। শ্রাবণ্য হেসে বলে,

“তোমার গুরুত্ব আমার জীবনে তেমন কিছুই না। তাই তোমার সরি বলাতেও কিছু যায় আসে না, না বলাতেও কিছু যায় আসে না। ”

সাকিব মাথা নিচু করে থাকে। শ্রাবণ্য চলে আসে। একা রিকশায় নীরবে চোখের জল ফেলে।

হয়তো শ্রাবণ্য একদিন এই চোখের জলের জন্য আফসোস করবে। সাকিবের ধ্বংসাত্মক মনোভাবের জন্য ও স্বপ্নীলের মতো প্লাটিনামের দেখা পেয়েছে। যেদিন সেই প্ল্যাটিনামের মূল্য বুঝবে………!

চলবে……!

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-১৭
স্বপ্নীল দুদিন ধরে শ্রাবণ্যর সঙ্গে কথা বলছে না। শ্রাবণ্য অবশ্য কারণ বুঝতে পারলো না, ও তেমন কিছু করেও নি। ছোট আপুর রাগ ও’কে দেখাচ্ছে সেটা ভাবলো প্রথমে। কিন্তু ছোট আপুর সাথে ঠিকই কথা বলছে। শ্রাবণ্য কিছু জিজ্ঞেস করলে ঘাড় নেড়ে জবাব দেয়। মুখ দিয়ে হু, হা পর্যন্ত বেরোয় না।
সকালে চুপচাপ রেডি হচ্ছে অফিসে যাবার জন্য। অন্যান্য দিন যাবার সময় বকবক করে। ফিরে আবার অফিসের কথা বলে। এই দুদিন ব্যতিক্রম হয়েছে। ফিরে চুপচাপ ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে।

শ্রাবণ্য আজও আগ বাড়িয়ে বলল,

“অফিসে যাচ্ছেন?”

স্বপ্নীল শ্রাবণ্যর দিকে তাকিয়ে ঘাড় কাত করলো। ও হেসে ফেলল। বলল,

“আমি আসলে বুঝতে পারছি না যে আপনি কেন রেগে আছেন? বুঝতে পারলে সরি বলে রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করতাম। ”

স্বপ্নীল সিদ্ধান্ত নিলো যে কথা বলবে। আসলে এই দুদিন কথা না বলে ওরও খারাপ লাগছে। কিন্তু অভিমানও ভাঙছে না।

শ্রাবণ্য তাকিয়ে আছে জিজ্ঞাসু চোখে। স্বপ্নীল বলল,

“আমি তোমার উপর রেগে আছি। ”

“সেটা বুঝেছি। রাগের কারণ বুঝিনি।”

“তুমি সেদিন ছোটপার কথায় আমাকে নিয়ে হাসছ। আমি কষ্ট পেয়েছি। ”

শ্রাবণ্য বিস্মিত হলো। এই সামান্য ব্যাপারে ছেলেটা ওর সাথে দুদিন কথা না বলে মূক ও বধিরের মতো আচরণ করেছে। শ্রাবণ্য মৃদু হেসে বলল,

“আরেহ না তো। আমি তো আপনার জন্য হাসি নি। ”

স্বপ্নীলের চোখে কপট অভিমান। নাক ফুলিয়ে বলল,

“মিথ্যে কথা। আমি তোমাকে দেখেছি হাসতে। ”

“না। আপনাকে দেখে হাসি নি। আমি তো ছোট আপুকে দেখে হাসলাম। আপু যখন রেগে গেছে তখন ষাঁড়ের মতো লাগছিল। নাক ফুলে ফুলে উঠছিল। ”

শ্রাবণ্য এক্ষুনি একটা ঢাহা মিথ্যে বলল। আসলেই সেদিন ও স্বপ্নীল কে দেখে হাসছিল। রঙ্গনা যখন স্বপ্নীল কে বকাবকি করছিল তখন ওর মুখ টা কাঁদোকাঁদো হয়ে গেছে। অন্যদিকে রেগেও গেছিল। দেখে শ্রাবণ্যর ভীষণ হাসি পেয়েছিল। ফিক করে হেসে ফেলল।

শ্রাবণ্যর মিথ্যেটা স্বপ্নীল সত্যি ভেবে নিলো। ও হেসে বলল,

“ঠিক ই বলেছ। ছোটপা কে দেখতে ষাঁড়ের মতোই লাগে। আর স্বভাবও তেমনই। সবসময় ই দেখবে কাউকে না কাউকে গুতাচ্ছে। ”

শ্রাবণ্য হেসে ফেলল। স্বপ্নীলের মনের অভিমানী মেঘ কেটে গেছে। ওর এখন একটু খারাপ লাগলো। শুধু শুধু ও শ্রাবণ্যর সঙ্গে রেগে কথা বলল না। আসলেই ও সবকিছু কম বোঝে।

শ্রাবণ্য মনে মনে ভাবলো। আল্লাহ এই মানুষ কে কিভাবে বানিয়েছেন! আর ওরও এমন হয়েছে! স্বপ্নীল কে কষ্ট দিতেও খারাপ লাগে।

***
রঙ্গনা বিয়ের জন্য জোরেশোরে প্রস্তুতি নিচ্ছে। শিলাকে বলল,

“মা আমি ফকিরের মতো বিয়ে করব না। স্বপ্নীলের বিয়ে দিছো ফকিরের মতো। আমার বিয়ে কিন্তু ধুমধাম করে হবে। আমি পারসোনায় সাজব। মেহেন্দি, হলুদ সব হবে। নিজের বিয়েতে নিজে নাচতেও পারি, ম্যুড ভালো থাকলে। ”

শিলা হেসে ফেললেন। বললেন,

“সব হবে। তোর বিয়েতে সব আয়োজন হবে। এই বাড়ির শেষ বিয়ে।”

মন্টি, রিন্টি পাশেই ছিলো। রিন্টি মন খারাপ করে বলল,

“আপুমনি, তুমি আমার বিয়ে দিবে না? আমি আর মন্টিও বিয়ে করব। ”

মন্টি গম্ভীর গলায় বলল,

“আমি এক্ষুনি বিয়ে করব না। আগে প্লেনে চড়ে বাবার কাছে যাব।”

শিলা হেসে ফেললেন শব্দ করে। রঙ্গনা দুজনকে এক ধমক দিয়ে বলল,

“এই তোরা এক্ষুনি বিয়ের কথা বলবি না। আগে আমার চুল সাদা হবে তারপর তোদের বিয়ে!”

রিন্টি চুপ করে ভাবতে লাগলো কবে ওদের মনির চুল সাদা হবে।

রঙ্গনার বিয়ের ডেট ফাইনাল হয়েছে। হাতে বাকী দেড় মাস। এই সময়টা বাকীসব আয়োজনের জন্য নেয়া হয়েছে। যদিও রাফাত দের বাসা থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ের ঝামেলা সেড়ে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু রঙ্গনা কঠিন গলায় বলল,

“এতো কম সময়ে হবে না। আর বিয়ের ঝামেলা এটা কেমন কথা! বিয়ে তো একটা আনন্দের ব্যাপার। ঈদে যেমন আনন্দ হয় তেমন। এটাকে ঝামেলা কেন বলা হচ্ছে!”

তারপর আর কেউ কিছু বলে নি। কোনো এক বিচিত্র কারণে রাফাতদের বাসার সবাই রঙ্গনার রাগ কে ভয় পাচ্ছে। তারা তেমন অভিযোগ করছেন না। হতে পারে রাফাত কিছু বলেছে।

***
আকাশী আজ ই জানতে পারলো শুভর বাড়ি যাবার কথা। শিউলি জানিয়েছে। শুভর মা আর মুনা নাকি সবাই কে বলেছে আকাশী অন্য একজনের সাথে ভেগে গেছে। আকাশী কথাটা শুনে মন খারাপ করলো না। এগুলো স্বাভাবিক! কিছু মানুষের ভাবনাই থাকে নেতিবাচক। মেয়েদের ক্ষেত্রে নেতিবাচক ভাবনা একটু বেশী ই আসে। তাছাড়া ও আর নরসিংদী যাচ্ছে না, তাই এগুলো শুনতেও হবে না। তবুও একটুখানি খানি খারাপ লাগা থেকেই যায়। শুভর ভাবনায় ও এতো নীচ সত্যিই জানা ছিলো না। থাক, যে যেমন ভাবে ভাবুক। আকাশীর তাতে যায় আসে না। শুভ কে হয়তো সত্যিই ওর জীবন থেকে মুছে ফেলেছে। বোধহয় তাই ই হবে। রোজ রাতে ঘুমানোর আগে এই প্রশ্ন টা নিজেকে করে। কিভাবে পারলো ও এক মিনিটের সিদ্ধান্তে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে! এতো সাহস কিভাবে হলো! উত্তর খুঁজে পায় নিজের কাছেই। ও তো বরাবরই সাহসী৷ রাজার জীবন ছেড়ে ও প্রজার জীবন বেছে নিয়েছিল শুভর জন্য। বাবার দিকেও ফিরে তাকায় নি একবারের জন্য৷ শুভ তো সেখানে অন্য মানুষ! হতে পারে ওর দেখা ভুল মানুষ।

আকাশী আজ নিজের জীবনের আরেক অধ্যায় শুরু করতে যাচ্ছে। জমানো টাকা নিয়ে কিছু গজ কাপড়, রঙ এগুলো কিনলো। আঁকাআঁকি কখনোই ওর শখের অংশ ছিলো না। পড়াশোনায় ফাঁকিবাজ ছিলো বলে খাতায় ফুল এঁকে সময় নষ্ট করতো। সেটা যদি কাজে লাগিয়ে কিছু করা যায়! অনলাইনে অনেকেই তো এসব কিনছে। শুরু করতে দোষ তো নেই। এখন আর ভবিষ্যৎ ভাবতে চায় না। যা হবার হবে। হয় ভালো নাহয় খারাপ।

***
বাড়িতে রঙ মিস্ত্রী এসেছে। রঙ্গনা নিজের ঘরের দেয়ালে রঙ করাবে। মিশুক কেও বলল,

“তুমি চাইলে তোমার ঘরেও রঙ করিয়ে নিতে পারো। ”

মিশুক স্বাভাবিক গলায় জবাব দিলো,

“বিয়ে তো তোমার। আমার তো না।”

রঙ্গনা স্মিত হাসলো। এই ছেলেটা মহাপাজি। শুরুতে কী ভাব নিলো আপনি আজ্ঞে করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি…
আর এখন ও তুমি বলছে দেখে ও’কেও তুমি বলা শুরু করছে৷

মিশুক হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো,

“তোমার বিয়েটা ফাইনালি হচ্ছে!”

“কেন? তুমি কী ভেবেছিলে আমাকে বিয়ে করার জন্য বাংলাদেশে একজন পাত্রও পাওয়া যাবে না?”

“না সেরকম ভাবিনি। ”

“তাহলে কি ভেবেছ?”

“তোমাকে নিয়ে আমি কিছুই ভাবিনি। আমার অতো সময় কই?”

রঙ্গনার মুখটা লাল হয়ে গেল। রাগ কিংবা অপমানে। সামনাসামনি হেসে ফেললে দন্ডনীয় অপরাধ হবে ভেবে হাসলো না। এই মেয়েটার ভেতরে শিশুসুলভ সত্তাটি এখনো বিরাজমান। রাগ, হম্বিতম্বি দিয়ে আড়াল করে রাখছে। যার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে সে যদি একটু রোমান্টিক হয় তাহলে ভালো। বেরসিক হলে চিরকাল রাগই দেখে যাবে।

মিশুক ইদানীং বড্ড বেশী এদের নিয়ে ভাবছে। এই বাড়ির একজন হয়ে উঠছে দিন দিন। সেটায় সমস্যা না, সমস্যা হলো রঙ্গনাকে নিয়ে ভাবনা চিন্তার ব্যাপার টা। না চাইতেও ভাবনায় এসে যায়। পায়ের শব্দ শুনলে কান সজাগ হয়ে যায়। খেতে গেলে মনে হয় রঙ্গনার এখানে থাকা উচিত ছিলো। এসব কী ভালোলাগার কারণে হচ্ছে! সর্বনাশ! আগে ভালো লাগে নি আর এখন লাগতে শুরু করেছে। মিশুক নিজেই নিজেকে ধিক্কার জানায়! এ কেমন চরিত্র ওর…..!

চলবে….