কুসুম কাঁটা পর্ব-২২+২৩

0
142

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-২২
তিনটা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর রঙ্গনা রাফাতের মা’কে ফোন করলো। ভদ্র মহিলা দূর্বল নাটক করার চেষ্টা করলেন। রাফাতের জন্য চিন্তিত। ফোন করেও পাচ্ছেন না। রঙ্গনার সঙ্গে আকাশী আর শ্রাবণ্য। ওরা নিজেদের মতো বোঝানোর চেষ্টা করেও লাভ হলো না। রঙ্গনা বলল,

“আমি বাড়ি যাব। আমার কিছু ভালো লাগতেছে না। অস্থির লাগতেছে। ”

সাজগোজ কমপ্লিট হতে আরও কিছু সময় বাকী। শ্রাবণ্য জোর করে সেটুকু সময় রঙ্গনা কে বসিয়ে রাখলো। রঙ্গনা বলল,

“শ্রাবণ্য, মা’কে একবার ফোন করে দেখ তো। ”

শ্রাবণ্য বাড়িতে ফোন করে শিলাকে ব্যাপার টা জানালো। শিলা মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করলেন। তুলিকে ছাড়া আর কাউকে জানান নি। রাফাতের মায়ের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলেন যে রাফাতের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। শিলা চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করে,

“খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না মানে কী? হারিয়ে গেছে?”

রাফাতের মা দু:খী গলায় বলে, জানিনা আপা। এই ছেলে কী আমার কথা শোনে! ওর যা মন চায় করে। আগেও দুইবার বিয়ের কথা ঠিক হবার পর এমন করছে।

“মানে? এসব তো আপনারা বলেন নি আগে?”

“কী বলব আপা?”

শিলা মিলাতে পারছে না হিসাব। রাফাত কে অবিবেচক মনে হয় নি কখনো। গায়ে হলুদের দিন রাফাতের মা, খালাদের সন্দেহজনক আচরণ থেকেই কী এই নাটকের সূচনা হলো।

বিকেলের মধ্যে বাড়ির অন্যান্য রা সবাই জেনে গেছেন যে রাফাত কে পাওয়া যাচ্ছে না। ফোন বেজে গেলেও ফোন টা তুলছে না।

আফতাব সাহেব কোনো কিছুতে বিচলিত হন না। প্রত্যেক টা বিষয়েই সে দুটো দিক ভাবেন। একটা কাজ না করলে অন্যটা। তার জন্য এই ঝামেলা টা অপ্রত্যাশিত। রাফাত ছেলেটা চমৎকার। রঙ্গনাও কী সুন্দর সবকিছু মেনে নিয়েছিল। রাগারাগি, বাড়াবাড়ি কিছু দেখা যায় নি। কত আনন্দ করেছে সবাইকে নিয়ে। তার এখন খারাপ লাগছে। তার নাতনীটা কতো কষ্ট পাবে। কত আত্মীয় স্বজন কে দাওয়াত করা হলো। সবাই এসে মেয়েটার ছোট হওয়া দেখে যাবে।

আফতাব সাহেব শিলার কাছে গেলেন। তিনি কখনো কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য শিলার কাছে আসেন না। আজ এলেন। শিলার ঘরে দাদী খাটে বসে সুর করে কাঁদছেন। এই মহিলা অন্যান্য সময় কাঁদলে শুধু গলা দিয়ে সুর ই বেরোয়। চোখ দিয়ে পানি পড়ে না। তবে আজ সত্যি ই কাঁদছেন।

আফতাব সাহেব শিলাকে প্রশ্ন করলেন,

“বউমা, এবার কী হবে? ”

শিলা স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন। সে তো নিজেও জানেনা যে কী হবে।

****
রঙ্গনার ভীষণ লজ্জা লাগছে। অনেক দিন পর ওর আবারও ভীষণ কান্না পাচ্ছে। শেষবার এমন হয়েছিল এইচ এস সির রেজাল্টের সময়। এতো ভালো পরীক্ষা দিলো অথচ বাংলায় ফেল এসেছে। পরে জানা গেল রেজিষ্ট্রেশন নাম্বার লিখতে ভুল করেছিল।

এতো সেজেগুজে যার জন্য এসেছে সে গায়েব। ও এতো শক্ত, তবুও আজ এতো লজ্জা লাগছে! গেট দিয়ে ঢোকার সময় স্বপ্নীল এসে জড়িয়ে ধরলো। ও’কে কাঁদানোর জন্য স্বপ্নীলের হাউমাউ করে কাঁদাটাই যথেষ্ট ছিলো।

ঘন্টাখানেক চলল এমন ই। রাফাতের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে ওই বাড়ির কাউকে দেখেই মনে হচ্ছে না যে তারা এই ব্যাপারে ব্যথিত। সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। রাফাতের বাবার সঙ্গে শিলা কথা বললেন,
ভদ্রলোক আমতা আমতা করে বলল,

“কী করতে পারি আপা বলেন? কপাল চাপড়েও তো লাভ নাই। অপেক্ষা করি ছেলে যদি ফিরে আসে…!

শিলা কঠিন গলায় বলেন,

“ফিরে আসে কথাটার মানে কী?”

“মানে অপেক্ষা করি আর কী! আজ না ফিরলে, পরে আর কী….

ভদ্রলোক কথা শেষ করার আগেই শিলা ফোন টা কেটে দিলো। ইচ্ছে করলো বয়স্ক ভদ্রলোক কে ঠাস ঠাস দুটো থাপ্পড় দিতে।

কিছুক্ষন পর রাফাতের মামী ফোন করলো রঙ্গনাকে। ফোন টা তুলল শ্রাবণ্য। মামী জিজ্ঞেস করলেন,

“রঙ্গনা কী করে? কান্নাকাটি করে?”

শ্রাবণ্য বলল,

“কান্নাকাটি কেন করবে? কান্নাকাটি করার মতো কিছু ঘটেছে? রাফাত ভাইয়া তো মারা যায় নি। ”

মামী থতমত খেল। ভেবেছিল কাঁদতে কাঁদতে এরা হয়তো বেহুশ হয়ে পড়বে। কিন্তু মায়ের গলাও স্বাভাবিক, মেয়েও নাকি কাঁদছে না! শ্রাবণ্য আবারও জিজ্ঞেস করলো,

“আপনি কী এটা জানার জন্য ফোন করছিলেন?”

“না আমাদের তো অবস্থা খারাপ। গলা দিয়া দানাপানি কিছু নামতেছে না। ”

শ্রাবণ্যর জবাবও বেশ শক্ত। বলল,

“আপনার গলা শুনে তা মনে হচ্ছে না মামী। বেশ আনন্দিত গলা শোনাচ্ছে আপনার। ”

মামী থতমত খেলেন। হাসার চেষ্টা করে বলল,

“তুমি ছোট মানুষ তো তাই মাথা গরম হয়ে গেছে। এখন রাখি, রাফাত আসলে তোমাদের সাথে দেখা হবে। ”

রঙ্গনা পাশেই ছিলো। ওকে ধরে বসে আছে আকাশী। শ্রাবণ্য ফোন রেখে বলল,

“পাজি মহিলা ফোন করছিল আপু। আপু আমার ধারণা রাফাত ভাইয়া কোনো ট্রাপে পড়েছে। সবাই মিলে গুটিবাজি করছে কিছু একটা। ”

রঙ্গনা হতাশ গলায় বলল,

“রাফাত স্বপ্নীলের মতো না শ্রাবণ্য। ও’কে আমার তেমন মনে হয় নি। ”

“আপু আমার মনে হয় উনি আসলেই কোনো ঝামেলায় ফেঁসে গেছেন। ”

রঙ্গনা এই প্রশ্নের কোনো জবাব দিলো না। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

***
আশ্চর্য হলেও সত্যি যে রেহানা এই পুরো ঘটনায় মনে মনে ভালোই খুশি। কিন্তু তাকে দু:খী দু:খী অভিনয় চালিয়ে যেতে হচ্ছে। ব্যাপার টা এমন নয় যে রঙ্গনা তার শত্রু। এই বাড়ির লোকজন কেও অপছন্দ নয়। তবুও তার খুশির কারণ হলো ঝামেলা হওয়া নিয়ে। বড় মেয়েকে নিয়ে সে যে ঝামেলা টা সহ্য করেছেন সেটা অনেক কষ্টের। লোকজনের নানান কটু কথা, অনেক আফসোস,অনেক কিছু। সেই একই কষ্ট এখন অন্যদের পেতে দেখলে ভালো লাগে।

মুনসুর অবশ্য সেই দলে না। সে শিলাকে বললেন,

“ভাবী কী করবেন? অন্য ব্যবস্থা বোধহয় করা উচিত। ”

শিলা বললেন, যাই করি মেয়েকে জোর করে অন্য কোথাও বিয়ে দেব না ভাই। ছেলের ক্ষেত্রে যে ভুল করেছি সেটার পুনরাবৃত্তি করতে চাচ্ছি না।

মুনসুর খানিকটা দমে গেলেন।

***
সন্ধ্যে অবধি রাফাতের কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। অন্যান্য আত্মীয় স্বজন রা এলো। রাফাত দের বাড়ির লোকজন অপেক্ষা করছে। রাফাত ফিরলে তারা রওনা হবে। নাহলে না। এছাড়া আর হেলদোল নেই।

শিলা আফতাব সাহেব কে বললেন, বাবা আজকের রাত টা দেখি। কাল ব্যবস্থা নেয়া যাবে।

আফতাব সাহেব জিজ্ঞেস করেন, কী ব্যবস্থা নিবা? আমার নাতনী এই অপমানের পর আর কখনো বিয়েতে রাজী হবে? সংসার করার স্বপ্ন দেখবে?”

শিলা জবাব দেয় নি। রঙ্গনার সঙ্গে তার একটাও কথা হয় নি। সামনাসামনি হবার সাহস হয় নি।

রঙ্গনা হঠাৎ বাইরে এলো। সবার সামনেই বলল,

“মা সবাইকে বলে দাও আসল ঘটনা। আর রাফাত দের বাড়িতে ফোন করে বলো, রাফাত যখনই আসুক বিয়ে হবে না। সবকিছুর ই নিয়ম আছে। পরীক্ষায় যেমন নির্ধারিত সময়ে না গেলে পরীক্ষায় বসতে দেয় না, বিয়েটাও তেমন। বিয়েও তো জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা পরীক্ষা।”

রঙ্গনাকে দাদু বোঝাতে এলেন। শিলা গম্ভীর গলায় বললেন,

“বাবা তাই ই হোক। আমি রঙ্গনার সঙ্গে একমত। ”

***
ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিলো কিছুক্ষনের মধ্যে। মিশুকের বাবা মা এসেছিলেন রঙ্গনার বিয়েতে। ওরা অবশ্য আসতে বলেনি। এরকম বিধ্বস্ত পরিবার কে বিয়েতে অংশগ্রহণ করতে বলাটা আসলে অমানবিক ই লাগে। কিন্তু তাদের মনে হয়েছে যাওয়া উচিত। যে মেয়েটার বিয়ে সে রক্ত দেবার সময় ভাবতে একটুও সময় নেয় নি। পরিবারের অন্যান্য মানুষজনও তাদের শিক্ষা, ব্যক্তিত্বের, মনুষ্যত্বের পরিচয় দিয়েছে।

বিয়ে বাড়িতে এসে মিশুকের বাবা, মা ঘটনা শুনলেন স্বপ্নীলের কাছে। মিশুকের বাবা, মা দুজনের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে সময় নিলেন মিনিট পাঁচেকের মতো। তারপর তারা শিলা আর আফতাব সাহেব কে জানালেন।

মিশুকের বাবার নাম মোস্তাফিজ হোসেন। মোস্তাফিজ সাহেব দাদুকে বললেন,

“হালিশহরে তাদের নিজেদের বাড়ি আছে। বাজারে দুটো ফার্মেসী আছে যা অন্যদের দিয়ে চালানো হয়। এছাড়া বাদবাকি সবকিছু সে চাইলে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে। তাদের আপত্তি না থাকলে এই সুন্দর পরিবার টির সঙ্গে তারা আত্মীয়তা করতে চায়। ”

আফতাব সাহেব নিমরাজি। মিশুক কে তার আগে থেকেই পছন্দ। শিলা রাজী হলেন না। মিশুক কে নিয়ে এমনিতেই এর আগে ঝামেলা হয়েছে। শিলা চাইলেনও না রঙ্গনাকে এই বিষয়ে কোনো কিছু জানাতে। তুলি গিয়ে জানালো। রঙ্গনা এসে বলল, এই বিয়ে করবে। ওর কোনো আপত্তি নেই।

মিশুকের বাবা, মা খুব খুশি হলেন। মিশুকের মা রঙ্গনাকে বলল,

“আম্মু শোনো, ইউনিভার্সিটি তে পড়ার সময় এক মেয়ের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করতো। সেই মেয়ে বিয়ে করে ইউরোপ গেছে। এছাড়া আর কোনো মেয়ের পিছনে ও ঘুরে নাই। আমাকে সব সত্যি বলে। বাদবাকি সব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তো তুমি জানোই। তোমার পাশের রুমেই তো থাকতো। ”

এই কঠিন সময়েও শ্রাবণ্য হেসে ফেলল মিশুকের মায়ের কথা শুনে।

***
মিশুক হসপিটালে বসেই জানতে পারলো ওর আজ বিয়ে। রঙ্গনার সাথে। বাবা জানালেন যে তিনি কথা দিয়ে ফেলেছেন। এই পরিবারের সঙ্গে তার রক্তের ঋন আছে। কোনোভাবেই মিশুক যেন না বলে।

মিশুক আমতা আমতা করে বলল,

“তোমরা যখন কথাই দিয়েই ফেলেছ এখন না বলে কী হবে। কী আর করা… করলাম বিয়ে। ”

ফোনের এপাশে থাকা মিশুকের উজ্জ্বল মুখ টা কেউ দেখতে পেল না।

***
পঞ্চান্ন হাজারের লেহেঙ্গা আর দুই লাখের জুয়েলারি পরে রঙ্গনার বিয়ে হলো না। ওর বিয়ে হলো আকাশীর ডিজাইন করা হালকা গোলাপি শাড়ি আর ঘরে থাকা গোল্ডের জুয়েলারি পরে। পার্লারের সাজও উঠিয়ে ফেলেছিল। আবার নতুন করে সাজতে হলো। বিয়ের সময়ে মিশুক বারবার রঙ্গনাকে দেখছিল। রঙ্গনা অদ্ভুত রকমের স্বাভাবিক। চোখে পানি নেই, রাগ নেই। কী সুন্দর স্নিগ্ধ! একবার দুজনের শুধু চোখাচোখি হলো। যখন দাদু রঙ্গনার হাত টা মিশুকের হাতে দিলো।

মিশুক হাত টা উল্টে তালুতে লেখা ‘আর’ শব্দটা দেখলো। শ্রাবণ্য পাশে ছিলো। ও বলল,

“রঙ্গনা তো আর দিয়েই শুরু হয়। ”

মিশুক হাসলো। শ্রাবণ্য বলল,

“ডোন্ট ওরি। মেহেদী আছে আমার কাছে। আপনার হাতেও লিখে দেব। ”

***
রাফাতের ঘুম ভাঙলো রাত দুইটায়। তাও কোনোভাবে চোখ খুলে তাকাতে পারছে না। ও কোথায় আছে সেটা আবিষ্কার করতেও সময় লাগলো মিনিট খানেক। মামী ও’কে নিয়ে এসেছিল। এই বাসায় একটা গয়না আছে ওর নানুর। সেটা রঙ্গনাকে দেবার কথা। সেটা নিয়ে ও যাবে রঙ্গনার কাছে, ও যখন পার্লারে যাবে। রঙ্গনাকে অতো সকালে ফোনও করেনি। বাসায় আসার পর মামী চা খেতে দিয়েছিল। আদা, দারুচিনি, এলাচি দিয়ে বানানো দুধ চা। রাফাতের পছন্দের চা। এরপর কিছু মনে নেই।

রাফাত দেখলো ওর ফোনে ৪৯১ টা মিসড কল! স্বাভাবিক ব্যাপার! রাত হয়ে গেছে এতো! বাসার সবাই চিন্তা করছে। আর রঙ্গনা! ইশ!

রাফাত ড্রইং রুম পর্যন্ত হেটে এসে মেঝেতে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষনের মধ্যে ঘুমিয়ে গেল আবারও।

***
রাফাতের মা শিলাকে ফোন করেছে ভোরের দিকে। শিলা ফোন টা তুললেন। রাফাতের মা বললেন,

“আপা রাফাতের খোঁজ পাওয়া গেছে আলহামদুলিল্লাহ। আপা আর চিন্তা করবেন না। আমরা সকালের দিকে আসব। ”

“সকালে আসতে হবে না। আমরা যাব কাল তেঁজগাও থানায়। সেখানে আপনাদের সাথে দেখা হবে ইনশাআল্লাহ। ”

চলবে….

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-২৩
মিশুকের হাতে রঙ্গনার নাম মেহেদী দিয়ে লিখে দিলো শ্রাবণ্য। ওর বিয়ে হয়েছে ফকিরের মতো। মানে রঙ্গনা যেমন বলে। বিয়েতে গায়ে হলুদ টাইপ কিছুই হলো না। মিশুকের হালকা আফসোস হচ্ছে। খুব বেশী না। চমৎকার একজন মেয়েকে জীবন সঙ্গী হিসেবে পেয়েছে বলেই আফসোস বেশীক্ষন স্থায়ী হলো না।

শ্রাবণ্য মিশুক কে দেখে বলল,

“আপনাকে ভীষণ খুশি লাগছে? আপনি আবার রাফাত ভাইয়া কে কিডন্যাপ করেন নি তো? ওনাকে পাওয়া গেল আপনাদের বিয়ের ঘন্টা তিনেক পর। ”

মিশুক শ্রাবণ্যকে দেখলো মিটিমিটি হাসছে। ও হেসে বলল,

“তুমি কী তাহলে আমার শালীর জায়গাটা নিচ্ছো?”

শ্রাবণ্য শব্দ করে হেসে ফেলে বলল,

“আপনি মনে মনে চাইছিলেন যেন বিয়েটা নাহয় তাই তো?”

“তুমি কী করে বুঝলে? ”

“আমি বেশ কিছু দিন ধরে আপনাকে লক্ষ্য করেছি। শুকিয়ে যাওয়া আপেলের মতো হয়েছিল আপনার চেহারা। দেখে মনে হতো কষ্টে আপনার বুক ফেটে যাবে এক্ষুনি। ”

মিশুক এবার শব্দ করে হাসলো। একটু সচেতন হলো অবশ্য। ওর বউ যে পরিমাণ রাগী। বেরিয়ে এসে আগুন চোখ তাকিয়েই সব কিছু ভষ্ম করে দিবে। শ্রাবণ্য ওর সঙ্গে এর আগে তেমন কথাবার্তা বলতো না প্রয়োজন ছাড়া। আর এখন কী সুন্দর কথা বলছে। এই বাড়ির মানুষজন কে মিশুকের ভালো লাগে, যাকে বিয়ে করেছে তাকে অন্য সবার চেয়ে বেশী ভালোই লাগে। তবে ওর একটু নার্ভাস লাগছে। যেভাবে সবকিছু হুট করে হয়ে গেল! এরপর কী কী হবে কে জানে! রাফাতের সঙ্গে এক্সাক্টলি কী হয়েছে জানে না ও। ভদ্রলোক এসে কী কোনো ঝামেলা করবে! সেরকম কোনো চান্স আছে কিনা!

শ্রাবণ্য বলল,

“আপনি ঘুমাবেন না?”

মিশুক ঘড়ি দেখলো। রাত প্রায় শেষ হতে চলল। চোখে ঘুম নেই অবশ্য, মাথাটা একটু ভারী লাগছে, এই যা।

মিশুক বলল,

“না ঘুমালেও হয়। তবে রেস্ট নেয়া দরকার। ”

শ্রাবণ্য হেসে বলল,

“চলুন আপুর ঘরে নিয়ে যাই। ”

“নিয়ে যেতে হবে না। আমি যেতে পারব। তুমি ঘুমাতে যাও। ”

“শিওর? একা যেতে পারবেন?”

মিশুক হেসে বলল,

“হ্যাঁ আমি রঙ্গনার ঘর চিনি। ”

“আচ্ছা। ”

মিশুক হঠাৎ শ্রাবণ্যকে ডেকে বলল,

“শোনো শ্রাবণ্য, তুমি শালীর ভূমিকায় বেশ ভালো অভিনয় করছ। দশে দশ। ”

শ্রাবণ্য হেসে বলল,

“কিছু ফকির মিসকিন খাইয়ে দিয়েন। আল্লাহ আপনার মনের আশা পূরন করছেন। ”

***
মিশুক ঘরে ঢুকলো ভয়ে ভয়ে। কিসের ভয় সেটা জানেনা। তবে বুক দুরুদুরু করছে। রঙ্গনা জানালার কাছে বসে ছিলো। দরজার শব্দ পেয়ে মিশুকের দিকে তাকালো। মিশুক বলল,

“হাই। ”

রঙ্গনা সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বিছানার কাছে এলো। বিছানার মাঝখানে কিছু গোলাপের পাপড়ি রাখা। রঙ্গনা সেগুলো একপাশে সরিয়ে রাখতে রাখতে বলল,

“একটু রেস্ট নাও। তোমার অনেক প্রেশার যাচ্ছে। ”

মিশুক স্মিত হাসলো। যে নিজে আজ মহাযুদ্ধ সামলেছে সে ওর প্রেশার নিয়ে তটস্থ।

রঙ্গনা ব্যস্ত হাতে ফুলগুলো সরাচ্ছে। মিশুকের চোখ দেয়ালের পেইন্টিং গুলোর দিকে। কী সুন্দর! ভাবতেই ভালো লাগছে এগুলো ওর বউয়ের নিজের হাতে আঁকা।

“মিশুক শু’য়ে পড়ো। ”

মিশুক চমকালো এক সেকেন্ডের জন্য। রঙ্গনা কী সুন্দর করে মিশুক ডাকলো! রঙ্গনা সম্ভবত নরমালি নাম ধরে ডেকেছে। ওর কাছে শুনতে ভালো লেগেছে। যাকে ভালো লাগে, তার সবকিছুই বোধহয় ভালো লাগে। মিশুকের মনে হলো রঙ্গনার রাগ, ঝগড়াঝাটি এগুলোও ওর ভীষণ ভালো লাগবে।

“তুমি ঘুমাবে না। ”

রঙ্গনা স্বাভাবিক গলায় বলল,

“তুমি ঘুমাও। আমার ঘুম পেলে শুয়ে পড়ব। আমার রাত জাগার অভ্যাস, এজন্য বোধহয় ঘুম আসছে না। ”

মিশুক রঙ্গনার হাত ধরলো। ধরে চমকে উঠলো।

“ইশ! তোমার এতো জ্বর!”

রঙ্গনা অপ্রস্তুত গলায় বলল,

“তেমন কিছু না।”

মিশুক তাকালো রঙ্গনার দিকে। এতো জ্বর নিয়েও বলছে তেমন কিছু না। মিশুক শ্রাবণ্য কে ফোন করে বলল কিছু খাবার আর ওষুধ নিয়ে আসতে। শ্রাবণ্য এলো কিছুক্ষনের মধ্যেই। পুডিং, ফ্রুট কাস্টার্ড নিয়ে এলো। শ্রাবণ্য থাকতে চাইলেও মিশুক থাকতে দিলো না। ও নিজেই রঙ্গনাকে জোর করে খাবার খাইয়ে দিলো, ওষুধ খাইয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো। কিছুক্ষন পর বাতি নিভিয়ে ওর পাশেই শুয়ে পড়লো।

রঙ্গনার মাথা ব্যথা করছিল। মিশুক কে সেটা বলে নি, তবুও ও মাথা টিপে দিচ্ছিলো। রঙ্গনা নিচু গলায় বলল,

“লাগবে না মিশুক। তুমি ঘুমাও।”

“লাগবে। জ্বর হলে তোমার মাথা ব্যথা হয়,আমি জানি।”

রঙ্গনা প্রশ্ন করলো না যে কিভাবে জানে ও। মিশুক জিজ্ঞেস করলো,

“এখন ভালো লাগছে? ”

“হু। ”

“স্ট্রেস নিও না আর।”

রঙ্গনা চুপ করে রইলো। মিশুকের ইচ্ছে ছিলো রঙ্গনাকে জিজ্ঞেস করবে তুমি ঝোকের মাথায় বিয়েতে হ্যাঁ বলেছ নাকি রাগের মাথায় বলেছ। রাগের মাথায় বললে সমস্যা নেই। রাগের অপর পিঠে অনুরাগ থাকে। কিন্তু ঝোকের মাথায় হলে সমস্যা। আর দাদী বলল না বিয়ের জোড়া উপরওয়ালা ঠিক করেন। মানুষের হাত থাকে না। আমারও তাই মনে হয়। আমিতো দূরেই ছিলাম, তোমার বিয়ের কোনো ইভেন্টে ছিলাম না। তাই আমার নজর লেগে কিছু হয় নি।

এসব কিছুই মিশুকের বলা হলো না। রঙ্গনা ঘুমিয়ে পড়লো। ভোরের আলো ফুটে গেছে। জানালার পর্দা সরানো, বলে আলোটা ঘরে ঢুকেছে। মিশুক জানালার পর্দাটা টেনে দিয়ে মোবাইল টা হাতে নিলো। রঙ্গনা নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। কোনো মন খারাপের চিহ্ন নেই, ক্লান্ত স্নিগ্ধ মুখ। মিশুক রঙ্গনার কপালে অনেকক্ষন ঠোঁট ছুঁইয়ে রেখে চুমু খেল। ভাগ্যিস মেয়েটা ঘুমিয়ে আছে। নাহলে এই কাজ টা করতে পারতো না।

***
শ্রাবণ্য ঘুমাতে এলো সকালের আলো ফোটার পর। না চাইতেও বিয়ের পর ও অনেক টা বড় হয়ে গেছে। বিয়ের পরের জার্নিটা মেয়েদের জীবনে এক অদ্ভুত জার্নি। অনেক অসাধ্য সাধনও কিভাবে যেন হয়ে যায়। সবকিছু সামলে ও এখন ঘুমাতে এলো। ঘরে ঢুকে দেখলো স্বপ্নীল গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। শীত লাগছে ভেবে কম্বল টা গায়ে তুলে দিতেই স্বপ্নীল বলল,

“আমি ঘুমাই নি শ্রাবণ্য।”

“কেন? অনেকক্ষন আগে এসেছেন ঘুমাতে। ”

স্বপ্নীল উঠে বসে বলল,

“আমার ভীষণ মন খারাপ।”

শ্রাবণ্য স্বপ্নীলের মাথার কাছে বসে বলল,

“আর মন খারাপ করবেন না। আপুর বিয়েতে তো হয়ে গেছে। মিশুক ভাইয়াও অনেক ভালো। ”

“জানি, তবুও আমার ভীষণ খারাপ লাগছে।”

শ্রাবণ্য আর কিছু বলল না। স্বপ্নীল আজ অনেক কেঁদেছে। ছোট আপু ও’কে শাসন করে বলে ওর অনেক রাগ। তবুও সেই রাগের চেয়ে ভালোবাসাটা অনেক বেশী দেখেছে।

শ্রাবণ্য স্বপ্নীল কে বলল, আপনি এদিকে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ুন। আমি আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ঘুম এসে যাবে।

স্বপ্নীল বাধ্য ছেলের মতো শুয়ে পড়লো।

***
আজকের সকাল টা হতে পারতো রাফাতের জীবনের সুন্দর সকাল গুলোর একটা। কিন্তু কুচক্রী রা সেটা হতে দেয় নি। রাফাত বিশ্বাস করতে পারছে না যে মা, মামী এরা এরকম একটা কাজ করতে পারে। প্রচন্ড মাথা ব্যথায় মাথা ছিড়ে যাবার উপক্রম। মাথা চেপে ধরে বসে আছে। ঘরের চারদিকে বসা লোকজন কে ও এক এক করে দেখছে। এরা ওর ই আত্মীয় স্বজন, আপনজন। যারা তাদের কৃতকর্মের জন্য একটুও অনুতপ্ত নয়। অন্তত মুখ দেখে তাই ই মনে হচ্ছে। রাফাতের বাবা, মামা এরা পরে জানতে পেরেছেন। তারাও তাদের স্ত্রী দের সাথে সহমত হয়েছেন। সাংসারিক ব্যাপার তারা কিবা বোঝেন। মহিলাদের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ভালো। তারা তাই ঠিক ই করেছেন। তবে রাফাতের খালু চিন্তিত। আফতাব সাহেব যতখানি সুবিধার লোক ততখানি অসুবিধার লোক। এই লোক নিশ্চয়ই হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না। আবার থাকতেও পারে, মেয়ের পরিবার সবসময় তেজ দেখাতে পারেন না।

রাফাত অবিশ্বাস্য গলায় বলল,

“মা তুমি! তোমাকে আমি চিনতে পারছি না। ”

রাফাতের মা অন্যদিকে মুখ করে বললেন,

“জানি চিনতে পারবি না। কারণ ওই বাড়িতে চিনি পড়া খাইয়েছে তোকে। ”

রাফাত অবাক গলায় বলল,

“তুমি অশিক্ষিত’র মতো কথা বলছ কেন?”

মামী মাঝখানে বলে উঠলো,

“মায়ের সাথে এইগুলা কেমন কথা বলো রাফাত। রঞ্জনা তোমার মাথা তো পুরাই খাইছে দেখতেছি। ”

রাফাতের মা অনুযোগের সুরে স্বামী কে বললেন,

“আমি যা করছি একদম ঠিক করছি। দশ মাস পেটে ধরছি আমি আর আমার চেয়ে বেশী গুরুত্ব পাবে পরের বাড়ির মেয়ে! সে যা বলে তাতেই তাকধিনা ধিন করে নাচে। ”

রাফাতের খালাও এই মিটিং এ উপস্থিত। তিনি পান খাওয়ায় ব্যস্ত ছিলেন এতক্ষন। এবার মুখ খুললেন। বললেন,

“আমরা তো চাইছিলাম একটা শিক্ষা দিতে। কিন্তু তারা এতো জলদি পাত্র পাইলো কোথায়! মাইয়ার চরিত্র ঠিক নাই। ”

রাফাত চিৎকার করে বলল,

“খালামনি চুপ করুন। আপনারা যা করছেন এরপর আপনাদের কেউ ভালো চরিত্রের লোক বলবে!”

রাফাতের মা ছুটে এসে ছেলের চুল ধরে কয়েকটা থাপ্পড় মারলো। মারা শেষ করার পর নিজে কাঁদতে শুরু করলো। রাফাত বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। রঙ্গনাকে ও কিভাবে ফেইস করবে! কিভাবে! ওর আসলে আরও সচেতন হওয়া উচিত ছিলো। তুলি আপু সেদিন ও’কে বলেছিল, রাফাত আমার ব্যাপার টা ভালো লাগছে না। তোমাদের বাড়ির লোকজনকে একটু বেশি ই ডেস্পারেট মনে হলো। তারা চাইছেন কিছু একটা ঝামেলা করতে। রাফাত ব্যাপার টা হালকা ভাবে নিয়েছে। ওর পরিবার একটু এরকম সেটা ও জানে। রঙ্গনারা অন্যরকম। কিন্তু মায়ের এমন রূপ থাকতে পারে সেটা ও কল্পনায়ও ভাবতে পারে নি।

ওর মান, সম্মান সব গেল। প্রফেশনাল, পার্সোনাল সব মানুষ কে বিয়েতে ইনভাইট করেছে। হোয়াটসঅ্যাপে একশর বেশী ম্যাসেজ। দশ বারোটা ম্যাসেজ দেখেই বুঝতে পারলো সবাই ও’কে শেইমলেস বলছে। আর রঙ্গনা! ও’কে কী জবাব দিবে!

রাফাতের দিশেহারা লাগলো। এতো খারাপ সময় ওর জন্য অপেক্ষা করছিল। এসবের চেয়ে মা তো মামীকে দিয়ে বিষ খাইয়ে দিতে পারতো।

***
রাফাতের মা, মামী ভেবেছিল শিলার ওটা ফাঁকা আওয়াজ। কিন্তু তাদের ধারণা ভুল প্রমানিত হলো। বারোটার দিকে মামা, মামী, খালা, খালু, বাবা, মা আর রাফাত কে পুলিশ তুলে নিয়ে গেল। তাদের বিরুদ্ধে যৌতুক মামলা আর জালিয়াতি মামলা করেছে। রাফাতের মা আর মামী যখন গুজগুজ ফিসফিস করে এবাড়ি থেকে কিছু দিবে কিনা সেটা নিয়ে আলোচনা করেছিল তখন বর্ষার মা ওখানে ছিলো। তিনি কান খাড়া করে যা শুনলেন তারচেয়ে বেশি বানিয়ে বললেন শিলাকে।

থানায় গিয়ে রাফাতের মা বললেন,

“আপা আমরা যৌতুক কবে চাইলাম? বিয়েতে তো আমাদের কোনো দাবি ছিলো না। আর রাফাত রে আমরা কেন আটকায়ে রাখব? মান সম্মানের ভয় নাই আমাদের। ”

শিলা ঠান্ডা গলায় বললেন, সব প্রমাণ আদালতে দেব। আমরা অলরেডি মামলা করেছি। আশা করছি রাফাতের চাকরিটাও চলে যাবে। সেখানেও কমপ্লেইন করব।

রাফাতের মা চোখে শর্ষেফুল দেখতে লাগলেন।

শিলা রাফাত কে বললেন, আমি মানলাম তোমার কোনো দোষ নেই। কিন্তু তুমি কী তোমার ফ্যামিলির বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারবে?

রাফাত এক বাক্যে রাজী হয়ে গেল। শিলার মনে হলো এই ছেলেটি আসলেই এসব ঝামেলায় নেই। তাই রাফাত কে ছাড় দিলো।

রাফাতের স্বাক্ষীর কারনে হোক আর অন্য কোনো কারণে হোক কেউই জামিন পেল না।

ব্যাপার টা নিয়ে অনলাইন পোর্টালেও ভীষণ লেখালেখি হলো। কিছু পত্রিকায়ও লেখা হলো।

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে