Friday, July 18, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 220



কুসুম কাঁটা পর্ব-১৪+১৫

0

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-১৪
রঙ্গনা নিচে এসে তুলিকে বলল,

“বুবু তোদের ওই পেয়িং গেস্ট কে স্পেশাল দাওয়াত করিস নি?”

তুলি কেকে চকলেট লাগাচ্ছিল। রঙ্গনার কথায় মৃদু হাসলো। বলল,

“স্পেশাল দাওয়াত মানে? ও তো আমাদের ই একজন। ”

রঙ্গনা ভেংচি কেটে বলল, সবেতে বাড়াবাড়ি তোদের। থাকছে, খাচ্ছে টাকা দিয়ে। তাকে নিজের লোক বানিয়ে নিয়েছে!

তুলি হেসে বলল,

“ব্যাপার টা কী? আজ ও’কে নিয়ে কেন পড়লি!”

রঙ্গনা উপরের ঘটনা টুকু বলল না। মিশুকের ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখটা! একটু স্মার্ট সাজতে গিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলা! এই ছেলেটা বিরক্তিকর সেটা প্রথম দিনের কথাতেই বোঝা গেছে। একটা মেয়ে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে গেছে অমনি একশ ডিগ্রী এঙ্গেলে ভাব বেড়ে গেল। সেই টিপিক্যাল বাঙ্গালী ছেলে। রঙ্গনা এমন ছেলে একটুও পছন্দ করে না। মানুষ যত সহজ হয়, ততো ভালো।

***
শ্রাবণ্য মেরুন রঙের জামদানী শাড়ি পরেছে। চুলটা খোপা করা। স্বপ্নীল বলল,

“খোপা করা চুলে তোমাকে বড় লাগে। খোলা চুলে ভালো লাগে।”

শ্রাবণ্য বিরসমুখে আচ্ছা বলল। স্বপ্নীলও আর কিছু বলে নি। ও ভেবেছিল শ্রাবণ্য হয়তো এরপর চুল টা খুলে রাখবে। কিন্তু সেটা করে নি। ওভাবেই ঘোরাঘুরি করছিল।

***
গেস্ট রা চলে এলো সাত টা নাগাদ। সাত, আটজন আসার কথা বলে সতেরো জন এসেছে৷ পাত্র এখনো আসে নি। তার একটা বিশেষ কাজ আছে৷ সেটা সেড়ে আসবে। পাত্রের বড় খালা, খালু এসেছেন। মা আসেন নি, তিনি সেজেগুজে রওনা হবার সময় পা স্লিপ করে পড়ে গেছেন। পাত্রের বাবা এসেছেন। সঙ্গে ছোট মামা, মামী। পাঁচ জন কাজিন এসেছে। আর বাকীরা বাচ্চাকাচ্চা। শিলা একটু ভ্রু কুঁচকালেন৷ যদিও তাদের আয়োজন কম না, ত্রিশ জনের আয়োজন করেছে। তবুও এতো মানুষের আগমন মন:পুত হয় নি। পাত্রের নাম রাফাত। রাফাতের বড় খালা বেশ স্বাস্থ্যবতী। শাড়িটা কেমন যেন পেঁচিয়ে পরেছেন। দেখে মনে হচ্ছে যেকোনো সময় খুলে যাবে। তিনি কোনোভাবে হেটে এসে সোফায় বসলেন। ঘনঘন নি:শ্বাস নিতে লাগলেন। বোঝা গেল এটুকুতেই উনি হাপিয়ে গেছেন। ওনার সাথে বসেছেন মামী। তিনি পার্লার থেকে মেকাপ করে এসেছেন নাকি নিজে করেছে বোঝা যাচ্ছে না। অতিরিক্ত মেকাপের কারণে তার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। একই বয়সী তিনটা মেয়ে একই ডিজাইনের আলাদা রঙের জামা পরেছে। তাদের মেকাপ নরমাল, দেখতে ভালো লাগছে। সঙ্গে যে ছেলে দুটো এসেছে তাদের সঙ্গে ঘরে ঢুকেই হা হা হি হি করছে।

রাফাতের বড় খালা ঘরে ঢুকেই সুপুরি কাটতে শুরু করেছেন। তার মুখ দেখেও বোঝা যাচ্ছে পানখোর।

মামী এদিক ওদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

“রঞ্জনা কি করে?”

তুলি পাশে ছিলো। ও মৃদু হেসে বলল,

“আমার বোনের নাম রঙ্গনা। ”

মামী মুখটা কেমন যেন করলেন। যেন তুলি ভুলটা ধরিয়ে দিয়ে মহা অন্যায় করেছে।

রঙ্গনাকে দেখা নিয়ে তাদের তেমন আগ্রহ দেখা গেল না। দাদু গল্প জুড়ে দিয়েছেন সবার সঙ্গে। তিনি আজ আমুদে মেজাজে আছেন। দাদীও সেখানে বসে আছেন। তিনিও আজ সেজেগুজে আছেন। হঠাৎ দেখলে কেউ ভাববে তিনি ওই বাড়ির লোক।

দুটো ছেলের একজন শ্রাবণ্যকে দেখছে বারবার। মেয়েগুলো সেটা নিয়ে হাসাহাসি করছে।

শিলার এদেরকে পছন্দ হয় নি। এদের কে যেমন সামাজিক বলা যায় না, তেমনি অসামাজিকও বলা যায় না। শ্রাবণ্য শাশুড়ী কে বলল,

“আম্মু, আপনি এদের দেখে ভয় কেন পাচ্ছেন? রাফাত ভাইয়া তো এদের সাথে থাকেন না। সে থাকে তার বাবা মায়ের সঙ্গে। ”

শ্রাবণ্যর কথা শিলার মনে ধরলো৷ তবুও আত্মীয়দের ফেলে দেয়া যায় না।

এদিকে রঙ্গনার বিরক্ত লাগলো রাফাতের ঠিক সময়ে না আসার ব্যাপার টায়। ভদ্রলোকের সঙ্গে ওর একবার কথা হয়েছে। কথাবার্তায় স্মার্ট, ভালো লেগেছে। কিন্তু এর ফ্যামিলির আচরণ একটুও পছন্দ হচ্ছে না। তারমধ্যে বাচ্চাগুলো হৈচৈ করছে। ওর মাথা ধরে গেছে। এতগুলো বাচ্চা নিয়ে কেউ আসে!

রাফাতের খালা খানিকক্ষণ পর জানালেন যে তার মেয়ে জামাই আসবে। একটু সমস্যার কারণে তারা আসতে পারে নি তাদের সঙ্গে।

***
সবাই আসার পর রঙ্গনাকে আনা হলো। ওর চোয়াল শক্ত। তুলি কানে কানে বলল,

“তুই নরমাল হ। এমন শক্ত মুখ করে আছিস! দেখে মনে হচ্ছে দাঁত পড়েছে।”

রঙ্গনা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“স্বপ্নকে গিয়ে একটা থাপ্পড় মার। ওর বউকে নিয়ে পালিয়ে গেলেও হা করে বসে থাকবে। গাধা কোথাকার! ”

উল্লেখ্য, রঙ্গনা কথাবার্তায় বুঝলো যে লাল শার্ট পরা কালো ছেলেটা শ্রাবণ্যর প্রেমে পড়েছে। ওরা শ্রাবণ্যকে রঙ্গনার বোন ভেবেছে। এদিকে স্বপ্নীল দূরে দূরে আছে। রঙ্গনা মনে মনে ভাবলো যদি এই পরিবারে ওর বিয়ে হয় তবে এই কালো ছেলেটাকে মেরে ও নীল বানিয়ে দিবে।

রঙ্গনাকে তেমন প্রশ্ন করা হলো না। শুধু মামী একঘর লোকের সামনে জিজ্ঞেস করলেন,

“কোন পার্লার দিয়া সাজছ রঞ্জনা? সাজ ভালো হয় নাই। কালা লাগতেছে। ”

রঙ্গনা তুলির দিকে একবার তাকালো। তুলি ইশারায় চুপ থাকতে বলল। বাচ্চাদের দল এবার এই ঘরে এসেছে। এখানে এসে একটা হৈ হুল্লোড় করার চেষ্টা করছে। মন্টি, রিন্টিও যুক্ত হয়েছে। কেউ কিছু বলছে না। সবাই এর মধ্যেই কথাবার্তা বলছে। দাদু একবার মন্টি রিন্টির নাম ধরে ডাকলেন। ওরা আজ সেটা পাত্তা দেবার প্রয়োজন মনে করলো না।

রঙ্গনা নিজের মেজাজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মন্টি, রিন্টিকে দুটো থাপ্পড় মারলো। ওরা দুজন কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। বাকী বাচ্চাগুলো চুপচাপ হয়ে গেছে। ঘরে পিনপতন নীরবতা। রঙ্গনা এসে নিজের সিটে বসে লাল শার্ট পরা কালো ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল,

“শ্রাবণ্য আমার বোন না। ভাইয়ের বউ। আর কোন ইনস্টিটিউটে শিখেছ অপরিচিত জায়গায় গিয়ে এমন করার!”

পুরো পরিবেশ বদলে গেল। শিলা এখানে নেই। শ্রাবণ্য গিয়ে বলল,

“এখন আর টেনশন কইরেন না আম্মু। বিয়ে ভেঙে গেছে। ছোট আপু তার ফর্ম চিনিয়ে দিয়েছে।”

শিলা হেসে ফেলল। শ্রাবণ্যও হাসলো।

***
রাফাত এলো রাত দশটা নাগাদ। ত্রিশ কেজি কাঁচাগোল্লা নিয়ে। রঙ্গনা তখন তুলির ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়েছে। বড় খালা পান চিবুতে চিবুতে বলল,

“রাফাত রঙ্গুনার সাথে কথা বলুক। আমরা বড় রা বিয়ের ডেট ফাইনাল করি। আপারেও(শিলাকে) ডাকো।

এতো ঝামেলা, গন্ডগোল কিছুই টের পেল না মিশুক। তবে বাইরে যাবার সময় রাফাত কে দেখে একটু ধাক্কা খেল। ছেলেটা অত্যন্ত সুপুরুষ।

চলবে….

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-১৫
রাফাত কে এতো মিষ্টি আনতে দেখে রঙ্গনার দাদী ভীষণ খুশি হলেন। তিনি শিলাকে বললেন,

“বউ শুনো, ছোট্ট বুর বিয়া এইখানে দেওন দরকার। পোলার কলিজা বড়। ওরে রানী বানায়ে রাখবে। ”

শিলা অবশ্য কারোর কথায় কান দিচ্ছেন না, দিবেনও না৷ রঙ্গনার যাকে ভালো লাগবে, যেখানে ভালো লাগবে করবে। এই ব্যাপারে অন্য কারো মতামত শুনবে না।

রঙ্গনা গিয়ে শ্রাবণ্যর ঘরের দরজা আটকে দিলো। ওর মেজাজ ঠিক না হওয়া পর্যন্ত বের হবে না। এদিকে রাফাতের বাড়ির লোকজন এমন ভাব করছে যে কিছুই ঘটে নি। তারা খেতে বসেছেন। খেতে বসে রাফাতের মামী তুলিকে বলল,

“বিরিয়ানি কে রান্না করছে? এতো এঁলাচ দিছে ক্যান? ”

তুলি কিছু বলল না। শ্রাবণ্য পাশে দাঁড়িয়ে মুখ টিপে হাসলো।

রাফাতের কাজিন দল এখন যথেষ্ট ভদ্র হয়ে বসে আছে। কেউ কারোর দিকে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। এমনভাবে একেকজন বিরিয়ানি মুখে দিচ্ছে যেন নিমপাতা ভাজি খাচ্ছে।

এদিকে স্বপ্নীল কে কঠিন বকা খেতে হলো রঙ্গনার কাছে। স্বপ্নীল বকাঝকায় তেমন রিয়েক্ট না করলেও কানমলায় খুব মাইন্ড করলো। তারচেয়েও বেশী অভিমান হলো শ্রাবণ্যর হাসি দেখে।

স্বপ্নীল ছাদে গিয়ে অন্ধকারে বসে রইলো। রাত বেশী হয় নি, সাড়ে দশটার মতন বাজে। নির্মল বাতাস বইছে। মিশুক আজ এখনো খেতে যায় নি। দোতলার ব্যাপারে ওর যথেষ্ট ইন্টেরেস্ট ছিলো, কিন্তু রাফাত কে দেখার পর সব কেমন বদলে গেল। খেতে ইচ্ছে করছে না। সকালে অফিসে নতুন প্রজেক্টের ব্রিফিং আছে। সেটা নিয়ে একটু স্টাডি করা দরকার। কিন্তু ল্যাপটপ টা দেখেই বিরক্ত লাগছে।

ছাদে এসেছিল এমনিই। দেখলো স্বপ্নীল দাঁড়িয়ে আছে। মিশুক বিস্মিত গলায় বলল,

“ওমা স্বপ্নীল যে! এখানে কী করছ?”

স্বপ্নীল বেরিয়ে এলো। আলোর কাছাকাছি আসতেই ওর থমথমে মুখ টা দেখতে পেল মিশুক। জিজ্ঞেস করলো,

“কী হয়েছে স্বপ্নীল? কোনো ঝামেলা? ”

স্বপ্নীল আক্ষেপের সুরে বলল,

“ছোটপা যেখানে আছে সেখানে ঝামেলা তো হবেই। আমি শিওর এই বিয়ে হবে না৷ ”

মিশুক হেসে বলল,

“কেন হবে না?”

“কেন আবার? ওর ওভার রিয়েক্টের জন্য। ওর আসলে বিয়ে হওয়া উচিত। ও সবাই কে ভীষণ বিরক্ত করে। ও না থাকলেই আমরা ভালো থাকব।”

মিশুক কিছু বলল না, মৃদু হাসলো। রাগী স্বপ্নীল কে দেখছে। এই ছেলেটা অনেক কিছুই বোঝে না। যে কাজগুলো ওর করা উচিত সেগুলো ওর ছোট আপা করে। তবুও ও চাইছে ওদের জীবনে না থাকুক!

মিশুক হেসে বলল,

“তবুও ভালো, তোমার যে রাগটাগ হয় সেটা আজ দেখলাম। ”

স্বপ্নীল মন খারাপ করা গলায় বলল,

“আজ শ্রাবণ্য আমাকে দেখে হেসেছে। ও তো এমন ছিলো না। ও আমায় অন্যরকম দেখতো। ”

“অন্যরকম কেমন? ”

স্বপ্নীল মিশুকের দিকে তাকিয়ে বলল,

“ও কখনো আমাকে নিয়ে হাসতো না৷ ”

মিশুক সরল ছেলেটাকে দেখে হাসলো। এই ছেলেটার বিয়ের গল্প, পাগলামী ও জানে। শ্রাবণ্যর সঙ্গে একসঙ্গে অনেক বার দেখেছে। সবসময় ই মনে হয়েছে এই ছেলেটা সত্যিই সরল। জগতে জটিল কিছু না বোঝা কিছু মানুষ বোধহয় ওর মতো হয়।

মিশুক স্বপ্নীলের কাঁধে হাত রেখে বলল,

“এই নিয়ে মন খারাপ কোরো না। শ্রাবণ্যর সঙ্গে কথা বলে ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে নিও। আমি যতদূর বুঝেছি, ও ভালো মেয়ে। এভাবে হাসা ওর উচিত হয় নি৷ ”

স্বপ্নীলের মন খারাপ ভাব তবুও গেল না। ও একা একা দাঁড়িয়ে রইলো। ও’কে স্পেস দেবার জন্য মিশুক সেখান থেকে চলে গেল৷

***
রাফাত কে পয়তাল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হলো। পয়তাল্লিশ মিনিট রঙ্গনার মেজাজ ঠিক হলো। ও বেরিয়ে এসে কৃত্রিম হাসি দিয়ে বলল,

“কেমন আছ? এতো রসগোল্লা ঠিক কী কারণে এনেছ? আমাদের রাক্ষস মনে হচ্ছে?”

রাফাত হেসে ফেলল। বলল,

“আমার খালা বলেন, বেশী মিষ্টি আনা মানে বেশী গুরুত্ব দেয়া।

রঙ্গনা হাসলো। খালাকে এখন ভালো লাগলো, একটু আগে অবশ্য মনে মনে মোটা মহিলা বলে গালাগালি দিচ্ছিল।

রাফাত কে বাড়ির সকলের ভীষণ পছন্দ হলো। ইনক্লুডিং রঙ্গনা। রাফাত দেখতে অত্যন্ত সুপুরুষ। ফ্যাশন সেন্সও বেশ ভালো। স্মার্টলি কথাও বলে। অল্প কিছু সময় অথচ রঙ্গনার কথা বলে ভালোই লাগলো।

কিছুক্ষনের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নেয়া হলো আজ ই বিয়ে হবে। দাদু মালেক মামাকে খুঁজছেন। সে গিয়ে কাজী নিয়ে আসবে। রঙ্গনা হুংকার দিয়ে বলল,

“দাদু এমন ফকিরের মতো আমি বিয়ে করব না। আমার বিয়ে ধীরেসুস্থে হবে। ”

রঙ্গনার সঙ্গে বাড়ির অন্যান্য সবাই সহমত পোষন করলো। রাফাত সহ বাকী সবাই বিদায় নিতে নিতে একটা বেজে গেল।

***
তুলি খাবার দাবার নিয়ে মিশুকের কাছে এলো একটার পর। মিশুক তখনও ঘুমায় নি। তুলি ব্যস্ত গলায় বলল,

“ভাই তুমি নিচে কেন গেলে না? আমরা এতো ঝামেলায় খেয়াল ই করিনি যে তুমি নেই। ”

“এরকম হয় আপু৷ আপনাদের ঝামেলা মিটেছে। ”

“হ্যাঁ ফাইনালি। বিয়ের ডেট টা ফিক্সড হয় নি। ওরা রঙ কে আংটি পরিয়ে গেছে।”

মিশুক আচ্ছা বলল। ওর মুখ দেখে মনে হলো তুলির কাছ থেকে ও এমন কিছু শুনতে চায় নি।

চলবে….

কুসুম কাঁটা পর্ব-১২+১৩

0

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-১২
স্বপ্নীল অফিসে এসে দেখলো ওর মতো আরও কয়েকজন এসেছে। সবাই ই ফর্মাল ড্রেসে। কিন্তু তাদের দেখতে ভালো লাগছে। ও’কে কেমন যেন অন্যরকম লাগছে। চারজনের মধ্যে একজন মেয়ে আছে। সে বোধহয় একটু বেশি বিরক্ত। কেমন যেন বিরক্তি নিয়ে সবার দিকে তাকাচ্ছে। স্বপ্নীলের ভীষণ নার্ভাস লাগলো৷ ইচ্ছে করছে বেরিয়ে যেতে, কিন্তু সেটা যাবে না। এই চাকরি টা যদি করতে পারে তাহলে দাদু নাকি ও’কে আর গাধা, গরু ডাকবে না।

কিছুক্ষন পর ওদের টিমে ভাগ করে দেয়া হলো। প্রথম দিন তেমন কাজ নেই, সবার সঙ্গে হাই, হ্যালো করলো। অন্যদের কাজ দেখলো, কফি খেল। সবাইকে দেখে বুঝলো যে এমন সেজেগুজে না আসলেও চলবে। অফিসের পরিবেশ টা ভালোই। ফ্যামিলি টাইপ ভাইব পাওয়া যায়৷ দুপুরের দিকে মনে হলো এখানে খারাপ লাগবে না৷

***
শ্রাবণ্য শপিংমলে গিয়েছিল একটু। নিজের দরকারী কিছু জিনিস কিনলো। একাই চকলেট, কফি খেয়ে ঘুরে বেড়ালো। দুপুরের দিকে স্বপ্নীল ফোন করে জিজ্ঞেস করলো,

“শ্রাবণ্য তুমি পৌছে গেছ?”

“না আমি একটু বসুন্ধরায় এসেছি।”

“ওহ। একা গেলে কেন? আমাকেও বলতে।”

“একা একা ঘুরতে ভালো লাগে আমার। আপনার কী খবর? অফিস কেমন লাগছে? ”

“তেমন ভালো না।”

“আস্তে আস্তে লাগবে। এখন রাখি।”

“আচ্ছা।”

***
শ্রাবণ্য বাড়ি ফিরে দেখলো বাবা, মা এসেছেন। আজ যে আসবে সেটা ও’কে জানায় নি। বাবা ও’কে দেখে বললেন,

“তোমার সঙ্গে কথা আছে।”

শ্রাবণ্য বুঝতে পারলো কি বিষয়ে কথা বলবে। বাবার কাছে সব খবর যায়। যতই আকাশীকে অস্বীকার করুক, তার খবর বাবা জানেন। শ্রাবণ্য নির্লিপ্ত গলায় বলল,

“আমি ফ্রেশ হয়ে আসি। ”

মা গেলেন শ্রাবণ্যর সঙ্গে। তিনি অস্থির প্রকৃতির মানুষ। বললেন,

“তোর সাহস দেখে আমি অবাক হই। কত বড় বেয়াদব মেয়ে হইছিস তুই।”

শ্রাবণ্য জবাব দিলো না। মা যে ওর শ্বশুর বাড়ি এসে এভাবে কথা বলছেন এই বিষয়ে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই৷ আসলে মা কোনোদিন ই ওদের পক্ষের লোক না৷ সে সবসময় বাবার হয়ে কথা বলেন। বাবার অনুপস্থিতিতে ওরা ভুল কিছু করলেও সে বাবাকে সেটা বলে দিতেন। তার মাথার মধ্যে এটা ঢুকে গেছে, জগতে সব সঠিক কাজ শুধু তার স্বামীই করেন।

মা আবারও বললেন,

“তুই তোর বাবার কথা অমান্য করলি কোন সাহসে?”

শ্রাবণ্য মায়ের চোখে চোখ রেখে বলল,

“এখন তো আর বাবার বাড়িতে থাকি না যে অমান্য করা যাবে না। এখানে তো যা খুশি তাই করতে পারি। ‘

রেহানা রেগে গেলেন সঙ্গে সঙ্গে। বললেন,

“এক থাপ্পড় মারব। দুদিন হলো বিয়ের, এরমধ্যে এতো ডানা গজিয়েছে। তুই যা খুশি করতে পারিস না। তুই চলবি এই বাড়ির নিয়মে। স্বপ্নীল, আর বড়দের কথা শুনে।”

শ্রাবণ্য এই কথার জবাবে কিছু বলল না। রেহানাকে ওভাবে রেখেই বেরিয়ে গেল।

***
শ্রাবণ্যর বাবা মুনসুর আলী ব্যবসায়ী মানুষ। পৈতৃক সম্পত্তি কে বাড়িয়ে চাড়িয়ে অনেক কিছু করেছেন। তিনি গম্ভীর, রাগী স্বভাবের। নিজের যুক্তিতে চলেন। মান, মর্জাদা নিয়ে খুব ই খুতখুতে ধরনের। তিনি যে সিদ্ধান্ত নেন, সেটার নড়চড় খুব কম ই হন। ছেলেমেয়েদের প্রতি যে মায়া মমতা আছে সেটার বহিপ্রকাশও ঘটে খুব কম।

শ্রাবণ্য বাবার মুখোমুখি বসলো। একটু পর রেহানা এসে বসলেন। ওদের ফ্যামিলির আলাপ বলে কেউ এদিকে ভিড়ছে না। মন্টি, রিন্টি পর্দার ফাঁক থেকে মাঝেমধ্যে দেখে যায়। মামীর মোচওয়ালা বাবাটাও ওদের বাবার মতোই। চকলেট, জুস আনে ঠিকই। কিন্তু ভীষণ রাগী।

মুনসুর শ্রাবণ্যকে জিজ্ঞেস করলেন,

“আকাশীর কথা এই বাড়ির লোকজনকে তুমি কী বলেছ?”

শ্রাবণ্যর জবাবও বাবার মতো সোজা সাপ্টা। বলল,

“স্বপ্নীল ছাড়া আর কাউকে কিছু বলিনি। স্বপ্নীল চাইছিল আমি আপুকে হেল্প করি।”

“আকাশী এখন কোথায়? ”

“আমি যেখানে ছিলাম। ”

রেহানা শ্রাবণ্যকে কিছু বলতে গেলে মুনসুর থামিয়ে দিয়ে বলল,

“ও কী ওই ছেলের সঙ্গে থাকবে না?”

“সেরকম ই জানালো৷ ”

মুনসুর কিছু সময় নীরব থেকে বলল,

“আকাশীকে তুমি জানাবে, ও যদি আমার কথা শুনে চলে তাহলে আরও একবার আমার ঘরে ওর জায়গা হবে। সব মানুষের ই আরেকবার সুযোগের দরকার হয়। তবে এটাই লাস্ট সুযোগ। এবং ও’কে আমার কথা শুনে চলতে হবে। আমি যে ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেব তাকে বিয়ে করতে হবে।”

শ্রাবণ্য মায়ের দিকে তাকালো। মায়ের মুখ টা থমথমে। বাবার সিদ্ধান্ত এমন কিছু হবে সেটা আশা করে নি৷

এই সুযোগে বাড়ির লোক আকাশীর কথা জেনে গেল। দাদু, তুলি সবাই বলল আকাশীকে এখানে এনে রাখতে। শ্রাবণ্যর সেটা মন:পুত হলো না। ও কাউকে কিছু বলল না অবশ্য।

***
স্বপ্নীল সন্ধ্যেবেলা ফিরলো ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে। একটা দিন অফিস করেই হাপিয়ে গেছে বেচারা। শ্রাবণ্যর ভীষণ হাসি পেল। ওর মাঝেমধ্যে ভাবতে কষ্ট হয় যে এই ছেলেটা বয়সে বড় একজন কে পছন্দ করেছিল। সবকিছুতে যে অল্পেই বিচলিত হয় সে কিভাবে এরকম দু:সাহসিক কাজ করলো।

স্বপ্নীল ঘরে ঢুকে শ্রাবণ্যকে বলল,

“তুমি তো আমাকে বললে না যে আমাকে হাস্যকর লাগছিল।”

শ্রাবণ্য হেসে ফেলল। বলল,

“কেউ বলেছে?”

“হ্যাঁ। অফিসের একটা মেয়ে হাসলো আমাকে দেখে। ”

“অফিস কেমন লাগলো? ”

“ভালো না। আমার আসলে লোকজন ভালো লাগে না। ”

“তাহলে চাকরি কিভাবে করবেন?”

“মনে হয় করতে পারব না। ওখানে সবাই কাজে ভীষণ দক্ষ, আমি ওদের সঙ্গে পারব না। ”

শ্রাবণ্য ঠোঁট টিপে হেসে বলল, অনেক কিছুই ভালো লাগে না, এই যে আপনার পায়ের কাছে মাথা রেখে আমি ঘুমাই, মানে একটা মেয়ের সাথে বেড শেয়ার করতে ভালো লাগে?

স্বপ্নীল শ্রাবণ্যর দিকে তাকালো। একটা মেয়ে শব্দটাই তো অদ্ভুত। দূরের কারো কথা বললে এমন লাগে। শ্রাবণ্য তো দূরের কেউ না।

স্বপ্নীল বলল, তুমি একটা মেয়ে কেন হবে? তুমি তো আমার বউ।

শ্রাবণ্যও স্বপ্নীলের দিকে অন্য চোখে তাকালো। স্বপ্নীল চোখ নামিয়ে নেয়। ও নীলাকে ভালোবাসে, তবুও শ্রাবণ্য ওর জীবনে কেমন যেন অন্যরকম একজন।

শ্রাবণ্য মনে মনে ভাবে, একটা কিছু সমস্যা হচ্ছে। স্বপ্নীল দিন দিন জীবনের অংশ হয়ে যাচ্ছে। না চাইতেও সবচেয়ে বেশী কথা ওর স্বপ্নীলের সঙ্গেই হয়।

***
মাস খানেক পরের ঘটনা।

মিশুক এই বাড়িতেই আছে। বাতাসী খালা এখন ওর সঙ্গে কথা কম বলেন। অল্প কিছু সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করে চলে যান। তার দু:খের গল্পগুলোও এখন আর মিশুকের সঙ্গে শেয়ার করে না।

বাড়ির লোকজন আগে যেমন ছিলো তেমন ই আছে। স্বপ্নীলের সঙ্গে সম্পর্ক আপনি থেকে তুমিতে এসেছে। স্বপ্নীল ওর কাছ থেকে ইকোনমিকস এর বইগুলো নিয়ে পড়ছে ইদানীং।

দাদু আগের মতোই গম্ভীর স্বরে কথা বলেন। দাদী এসেছেন অনেক দিন বাদে। তিনি মিশুকের সামনে আসেন। পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখেন। মন্টি, রিন্টি আঙ্কেল ডাকার পরিবর্তে মামা বলে ডাকে। মিশুক অবশ্য বাচ্চা দুটোকে অতো সিরিয়াসলি নিচ্ছে না। বাচ্চা দুটো ইচড়ে পাকা। ওর নিজেরও একটা ভাগ্নে আছে। বাসার বাইরে খেলতে গিয়ে প্রতিবার ই মার খেয়ে আসে। এই বাচ্চাদের মতো না।

একদিন সন্ধ্যেবেলা শ্রাবণ্য এলো কিছু বরফি, সন্দেশ নিয়ে। এসে বলল,

“আপনি ভালো আছেন?”

“হ্যাঁ। আপনি?”

“আমিও ভালো। আমাকে তুমি করে বলুন। আমি ইউনিভার্সিটি তে পড়ছি এখনো। এই নিন মিষ্টি খান।”

মিশুক প্লেট টা হাতে নিয়ে বলল,

“থ্যাংক ইউ। কিসের মিষ্টি? ”

এই বাসায় প্রতি শুক্রবারে মিলাদের মিষ্টি আসে। আজ শুক্রবার না বলেই মিশুক জিজ্ঞেস করলো।

শ্রাবণ্য স্বাভাবিক গলায় বলল, ছোট আপুর বিয়ের।

মিশুক মুখ ফসকে জিজ্ঞেস করলো,

“কার?”

“রঙ আপুর। বিয়েতে মত দিয়েছে।”

মিশুক স্বাভাবিক ভাবেই দুটো মিষ্টি খেল। বিষয় টা স্বাভাবিক ই। তবুও ওর কৌতূহল গেল না। কোথায় বিয়ে ঠিক হয়েছে, কার সঙ্গে হয়েছে এগুলো জানার ইচ্ছে হলো খুব।

রঙ্গনার সঙ্গে ওর এই এক মাসে দুটো কথা হয়েছে। কারেন্টের লাইনের কাজ চলছিল তখন বলেছিল, সবকিছু অফ রাখতে। এছাড়া বাড়তি কথা হয় নি।

***
রঙ্গনা বিয়েতে মত দিয়েছে। তার জন্য পাত্রকে হতে হবে পুলিশ অথবা পাইলট। ভুড়ি থাকলে চলবে না। আর গায়ের রঙ যেন ফর্সা হয়। কারণ ওর অনেকগুলো সুন্দর সুন্দর ছেলেমেয়ে লাগবে। নিজের রঙ টা ঘষেমেজে ফর্সা বানালেও লাভ নেই। দুদিন পর আগের রঙেই ফিরে আসে।

চলবে….

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-১৩
আকাশী শ্রাবণ্যর দুটো টিউশনি থেকে সাত হাজার পায়। এর আগে যেগুলো ও করেছে তাতে এতো টাকা পেত না। শ্রাবণ্য পরীক্ষার অজুহাতে এই দুটো ও’কে পাইয়ে দিয়েছিল। আরও দুটো যদি এমন জুটে যায় তাহলে ওর আর আপাতত অন্য ইনকাম সোর্স না খুঁজলেও হবে। পার্লারের টাকাটা রয়ে গেছে। চব্বিশ দিনের টাকা পাবে। সেটা আনতে যেতেও ইচ্ছে করছে না। হ্যাপি আপার মুখ টা দেখার আর ইচ্ছে নেই। ওই এলাকায় গেলে শুভর সঙ্গে দেখা হবে ভেবেও যেতে ইচ্ছে করছে না। এখানে ও বেশ আছে। কিছু মেয়ের সাথে ওর দারুন বন্ধুত্ব হয়েছে। শ্রাবণ্যর ইউনিভার্সিটির কাছের হোস্টেল বলে ও মাঝেমধ্যে আসে। আকাশীর এতেই ভালো লাগে। পড়াশোনা করছে ভালো মতোই। এবারের পরীক্ষা টা শেষ হয়ে গেলে বাকী থাকবে আর একটা বছর৷ তারপর অনেক টা সহজ হবে জীবন। জীবন সম্পর্কে আকাশী এখন আর ভাবে না। ভেবে আসলে কিছু হয়ও না। ও যা ভেবেছে ওর সঙ্গে তা কিছুই হয় নি৷ তাজা গোলাপ দেখে যে প্রেমিকে মুগ্ধ হতো সেই প্রেমিক বিয়ের কয়েকমাসেই হারিয়ে যায়। সংসারের চাল, ডালের হিসাব নিকাশের ব্যপারটাও আকাশী বুঝে যায় তখন। গোলাপের প্রতি সেই আকর্ষনও মরে যায়।

শ্রাবণ্যর দেয়া নতুন সিম কার্ডটা ব্যবহার করে। পুরোনো ফেসবুক একাউন্টটাও ডিলিট করে দিয়েছে। ওর আসলে শান্তি দরকার এখন। বিয়ের মাস পাঁচেক পর থেকে যে অশান্তি, অনিশ্চয়তার জীবন শুরু হয়েছে সেটাতে ও ক্লান্ত হয়ে গেছে। যারা অভাব দেখে বড় হয় তারা সহজে অভাব মানিয়ে নিতে পারে। কিন্তু সব পেয়ে বড় হওয়া মানুষের জীবনে অভাব জিনিসটা গলার কাঁটার মতো। প্রতিনিয়ত দিন গুনতে হয় সেই কাঁটা কবে নামবে গলা থেকে।

আকাশী এখানে ভালো আছে। শ্রাবণ্য হোস্টেলের টাকা এই মাসেও দিয়ে গেছে। ও বারন করার পর বলেছে,

“তোর টাকা তোর থাকুক, আমি যেটা দিচ্ছি সেটাও বাবার ই দেয়া। আমাকে দিয়েছিল বিয়ের পর। যেন প্রয়োজনে খরচ করতে পারি৷ তোকে সেখান থেকে দিচ্ছি। নিজের যেটা আছে সেটা খরচ করিস না। রেখে দে লাগবে, বিপদে মানুষ লাগে না। টাকাই লাগে সবার আগে।”

আকাশী চমৎকৃত হয়েছে। শ্রাবণ্য ওর মতো হয় নি৷ নরমের মধ্যে শক্ত ধাঁচের। বোধহয় বাবার স্বভাব পেয়েছে খানিকটা। ওর ই বা কত বয়স! তবুও সব টা কী সুন্দর গুছিয়ে ম্যানেজ করে!

শ্রাবণ্য আকাশীকে বাবার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। শুনে আকাশীর বোধহয় খুশি হওয়া উচিত ছিলো। এই তিন বছরে বাবা, মা’কে একবার চোখের দেখাও দেখতে পারে নি৷ মা’কে ফোন করলে সে অভিশাপ দিতেন। তবুও তার কন্ঠস্বর শোনার সৌভাগ্য ওর হয়েছিল। বাবাকে কখনো ফোন করার সাহস ও পায় নি।

আকাশী শ্রাবণ্য কে বলেছে, তুই বাবাকে বলিস আমাকে যদি ক্ষমা করে দেয় তাহলে যেন একবার সামনাসামনি দেখা করার সুযোগ দেয়। আর কিছু আমার চাই না। যা কিছু ভুল আমি করেছি সেগুলো একান্ত আমার ই। এর দায় আমার, এর জন্য মাশুল যা গুনতে হবে গুনব। বাবাকে আর কষ্ট দিতে চাই না।

শ্রাবণ্য বাবাকে সেকথা জানিয়েছেন। বাবা নাকি জবাবে কিছু বলে নি৷ তবে আকাশীর ভীষণ লোভ হয় বাড়ি যাবার। আনন্দের দিন গুলো সবার সাথে কাটাতে। সেই সুযোগ কোনোদিন আসবে কিনা ওর জানা নেই।

***
আজ স্বপ্নীল ছুটি নিয়েছে। একটা মাস যে কিভাবে গেল! ও বুঝে গেছে যে চাকরি বাকরি ও’কে দিয়ে হবে না। তবুও আরও দুটো মাস কাটাতে হবে। চুক্তি অনুযায়ী মেজর কোনো প্রবলেম না হলে তিনটা মাস কন্টিনিউ করতে হবে৷ স্বপ্নীল সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে যে তিন মাস পর ও আর অফিসে যাবে না। বাসায় থাকবে, দাদু যা বলে বলুক। গাধা, গরু যা বলছে মুখে বলছে। ওর গায়ে তো আর লাগছে না।

স্বপ্নীল ভেবে লজ্জা পায় যে ও নীলাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। নীলার বাচ্চার দায়িত্বও নিবে। চাকরি করে খাওয়াবে। নীলা ঠিকই করেছে৷ দেখা যেত বেচারি ও’কে বিয়ে করে না খেয়ে আছে। এই কটা টাকায় কী ই বা খাওয়াতে পারতো৷ ওর নাহয় এক পিস মাছ, একবাটি ডালে হয়ে যায়। নীলা তো প্লেট সাজিয়ে ভাত খেত। তাছাড়া বাচ্চার স্কুলের খরচ আছে।

স্বপ্নীল আর ভাবতে চায় না। ইশ! জীবন এতো জটিল কেন! টাকা ইনকাম করা এতো কষ্টের কেন!

শ্রাবণ্য আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে ফেসপ্যাক লাগাচ্ছে। ও আবার রুপের ব্যাপারে ভীষণ সচেতন। খায়ও অল্প। ওর সেমিস্টার ফাইনাল শেষ হলো৷ রাত জেগে পড়াশোনা করতে গিয়ে কটা পিম্পল হওয়ায় কী দু:খই না পেয়েছিল। স্বপ্নীল হেসে ফেলল সেই কথা ভেবে।

শ্রাবণ্য পেছনে ফিরে ও’কে একবার জিজ্ঞাসু চোখে দেখে আবার আয়নার দিকে তাকালো। শ্রাবণ্য সাজতেও ভীষণ ভালোবাসে। কাজল, লিপস্টিক না পরে বেরোয় না। সেদিন সবাই মিলে ফুচকা খেতে গেল, সেখানেও সেজে গেছে। অবশ্য সাজলে ও’কে ভীষণ ভালোও লাগে। চোখে কাজল পরলে একদম অন্যরকম লাগে। ওর চুলগুলোও ভীষণ সুন্দর। কিন্তু সেটা বাইরের কেউ দেখার সুযোগ পায় না। হিজাব পরে সবসময়। স্বপ্নীলের মাঝেমধ্যে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। লজ্জায় ছুঁয়ে দেয় না।

স্বপ্নীল হঠাৎ জিজ্ঞেস করে,

“শ্রাবণ্য, তোমার কী কোনো প্রেমিক আছে? ”

শ্রাবণ্য আবার ওর দিকে তাকায়। ও’কে দেখতে অদ্ভুত লাগে। অরেঞ্জ কালার মুখ।

শ্রাবণ্য বলে,

“না। কেন?”

“তুমি তো অনেক সুন্দর এজন্য। ”

শ্রাবণ্যর মুখ টা হাসি হাসি হয়ে যায়। স্বপ্নীল আবারও বলে,

“আজ ছোটপাকে দেখতে আসবে? তোমাকে সুন্দর দেখাতে হবে কেন?”

“কেন? আমাকে সুন্দর দেখালে ক্ষতি কী”

“না এমনি জিজ্ঞেস করলাম। ”

শ্রাবণ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলল। স্বপ্নীল বুঝলো না সেটা। ওর প্রেমিক ছিলো না কেউ। বাবার ভয়ে কাউকে কখনো ধারে, কাছে ঘেঁষতে দিতো না। তবে মনে মনে চাইতো সুন্দর হ্যান্ডসাম একজনের সঙ্গে ওর বিয়ে হোক। শাহরুখ খানের মতো রোমান্টিক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকুক। ওগুলো শুধু স্বপ্নই থেকে গেল! বাস্তব তো……!

***
রঙ্গনাকে আজ দেখতে আসবে। পাইলট পাত্র পাওয়া গেছে একজন। দাদুর ইচ্ছে ছিলো পুলিশের সঙ্গে বিয়ে দেবার। কিন্তু বাড়ির লোক এই ছেলেটাকে পছন্দ করেছে। বিয়েতে দাদু খুব একটা মাতব্বরি করতে পারছে না। রঙ্গনার মা মেয়ের বিয়ে নিয়ে ভীষণ সিরিয়াস। তিনি শ্বশুর কে বিশেষ পাত্তা দিচ্ছেন না।

সন্ধ্যেবেলা আসার কথা। বাড়িতে এলাহি আয়োজন। বিরিয়ানি, রোস্ট, দুই তিন পদের কাবাব করা হয়েছে। ডেজার্টে কাস্টার্ড, পায়েশ, পুডিং। এছাড়া নাশতায় সিঙ্গারা, সমুচা, লুচি, হালিম জাতীয় অনেক খাবার।

রঙ্গনাকে দেখে মনে হচ্ছে বিয়েতে ভালোই সিরিয়াস। চুল রিবন্ডিং করে এসেছে। ফেশিয়াল, পেডিকিওর, মেনিকিওর কিচ্ছু বাদ দেয় নি। শাড়ি বাছাবাছি করলো অনেক সময় নিয়ে। শ্রাবণ্য আর তুলিকে দিয়ে সাজগোজ ঠিকঠাক করলো।

শিলার একটু সন্দেহ হয়। রঙ্গনাকে বললেন,

“তুই কী উল্টাপাল্টা কিছু ভাবছিস? বিয়ে নিয়ে তোকে জোর করব না। কিন্তু খবরদার রেগে উল্টাপাল্টা কিছু করবি না। ”

রঙ্গনা হেসে বলল, না না এবার বিয়ে করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেব।

শিলা মেয়েকে বিশ্বাস করেন না। ভয়ে থাকেন, মেয়ে না জানি কী অঘটন ঘটায়।

***
স্বপ্নীল গিয়ে মিশুক কে বলে আসলো নিচে আসার কথা। দাদু থাকতে বলেছেন। মিশুক বলল,

“তোমার শ্বশুর বাড়ি থেকে গেস্ট আসছে?”

“আরে না ভাইয়া, ছোটপাকে দেখতে আসছে। ”

মিশুক কয়েক সেকেন্ড স্বপ্নীল কে দেখলো। তারপর বলল,

“তোমার ছোট আপা সত্যিই বিয়ে করছেন?”

“বোধহয়। আজ দেখতে আসবে। পছন্দ হলে তারপর। অবশ্য ছবি দেখে আগেই দুজন দুজন কে পছন্দ করেছে।”

মিশুক গম্ভীর গলায় বলল,

“আচ্ছা। ”

স্বপ্নীল চলে যাবার পর মিশুক দরজা বন্ধ করে রইলো। ও আজ আর বেরোবে না। বোধহয় সবাই মিলে ও’কে সূক্ষ্ম অপমান করতে চাইছে। অবশ্য অপমানের বিষয় টা মোটেও আসবার কথা না, ও তো রঙ্গনাকে রিজেক্ট করে নি সেভাবে। মানে, ব্যাপার টা তো হতে হতেও হয়ে ওঠে নি।

রঙ্গনা উপরে এলো নিজের কিছু একটা খুঁজতে। মিশুক টের পেল, হিলের শব্দ। কান সজাগ করে রইলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই টের পেল রঙ্গনা শ্রাবণ্যকে ডাকছে। ও ঘর থেকে বেরোলো। রঙ্গনাও তখন বেরিয়েছে। দুজনের চোখাচোখি হলো। রঙ্গনা সুন্দর সেজেছে। সাদার সঙ্গে রানী গোলাপি ব্লাউজে খুব মানিয়েছে। চুলের কারনে ভীষণ অন্যরকম লাগছে। মিশুক হেসে বলল,

“হাই রঙ্গনা।”

রঙ্গনা বিস্ময় লুকিয়ে বলল,

“হ্যালো মিশুক। ”

“সুন্দর লাগছে ভীষণ। ”

রঙ্গনা কপালে কৃত্রিম ভাজ এনে বলল,

“রিয়েলি? থ্যাংক ইউ সো মাচ।”

“বাই দ্য ওয়ে, কনগ্রাচুলেশন। ”

“থ্যাংক ইউ। ওয়ান্স এগেইন। ”

মিশুক আরও একবার রঙ্গনাকে আপদামস্তক দেখে বলল,

“আপনার বিয়ের যেকোনো কাজে আমাকে ডাকবেন। প্রয়োজনে অফিস থেকে সিক লিভ নেব। ”

রঙ্গনার ঠোঁটে দুষ্ট হাসি। দুজনে চোখে চোখ রেখে কথা বলছে।

শ্রাবণ্য সিড়ির কাছে এসে রঙ্গনাকে ডাকলো। রঙ্গনা এগিয়ে যাচ্ছে ওর চোখের দৃষ্টি তখনও মিশুকে আবদ্ধ। হঠাৎ দরজার কাছে গিয়ে পেছনে ফিরে তাকালো। মিশুক হাত ভাজ করে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রঙ্গনা বলল,

“তুমি নিচে এসো, সবার ভালো লাগবে। আর তোমারও লাগবে। ”

মিশুক ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়লো।

চলবে….

কুসুম কাঁটা পর্ব-১০+১১

0

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-১০
সকাল হতেই শ্রাবণ্য তৈরী হয়ে নিলো। আকাশীকে দেখতে একবার যাওয়া দরকার। স্বপ্নীল একটু ঘুমিয়েছিল। শ্রাবণ্যর আর ঘুম হয় নি টেনশনে।

স্বপ্নীল শ্রাবণ্যকে বলল,

“পাঁচ টা মিনিট বসো শ্রাবণ্য, আমি একটু রেডি হয়ে নেই।”

“আপনি ঘুমান। আমি একাই যেতে পারব। ”

“না না। আমি অবশ্যই যাব।”

শ্রাবণ্য অপেক্ষা করলো৷ স্বপ্নীল পাঁচ মিনিটের জায়গায় সাতাশ মিনিট নিলো। শ্রাবণ্য কিছু বলল না। ও চটজলদি তৈরি হতে পারে। স্বপ্নীলের সব কিছুতে সময় লাগে। ভাত খাওয়ার সময়ও এতো সতর্ক হয়ে কাটা বাছে যে শ্রাবণ্যর মায়া লাগে।

শিলা দুজন কে একসঙ্গে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,

“তোমরা এতো সকালে কোথায় যাচ্ছ?”

শ্রাবণ্য জবাব দেবার আগে স্বপ্নীল বলল,

“আমরা একটু বাইরে যাচ্ছি মা। একটু ঘুরতে আর কী। ”

শিলা হাসলেন। বললেন,

“একটু বসো। চা করে দেই। ”

শ্রাবণ্য স্বপ্নীলের দিকে তাকালো। স্বপ্নীল মা’কে বলল,

“থাক না মা। এখন যাই। ”

শিলা আর আটকালেন না। বললেন,

“আচ্ছা। ”

শিলা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। স্বপ্নীল এবার বড় হচ্ছে। ছেলেটা ইউনিভার্সিটিতে ঢুকেও মায়ের হাতে ভাত খেত। গুছিয়ে ভাত খাওয়া তখনও শিখে উঠতে পারে নি। শিলা যখন অসুস্থ থাকতো তখনও তুলিকে বলতো, বুবু ভাত টা মাখিয়ে দাও। আমি মাখলে মজা হয় না।

শ্রাবণ্যর সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে সহজেই। অবশ্য এটার ক্রেডিট শুধু স্বপ্নীল কে একা দেয়া উচিত না। শ্রাবণ্যও ভীষণ ভালো মেয়ে। এই যুগের স্মার্ট মেয়েদের কাতারে ও’কে অনায়াসেই রাখা যায়। স্বপ্নীল সেই কাতারে পুরোপুরি পড়ে না। কিছুটা সহজ, সরল বোকা টাইপ। কোথায় কিভাবে বলতে হয় ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারে না। বন্ধু সংখ্যাও তেমন নেই, আত্মীয়মহলে আজও স্বপ্নীল কে নিয়ে অনেকে ঠাট্টা করে। ছেলেটা চুপচাপ নত মস্তকে সব টা মেনে নেয়। কাউকে ঠোঁট কাঁটা জবাব দিতে পারে না। সেটা তুলিও পারে না, রঙ্গনা পারে। তবে তুলির বিশেষ গুন আছে, হাসি, ঠাট্টা অপমান গুলো হাসিমুখে মেনে নিয়ে নীরব জবাব দিতে পারে।

সেদিন নাশতার টেবিলে স্বপ্নীল কে নিয়ে কী একটা হাসির কথা হলো। সবাই হাসছে, শ্রাবণ্যর মুখে হাসি নেই। ও আড়চোখে স্বপ্নীল কে দেখলো একবার। স্বপ্নীল তখনও চুপচাপ মাথানিচু করে খাচ্ছে। শিলার ব্যাপার টা ভালো লাগলো ভীষণ। এমন একটা মেয়েকেই স্বপ্নীলের জীবনে দরকার ছিলো আসলে৷ যে সবার আগে ওর বন্ধু হয়ে উঠবে। মায়ের সঙ্গে যতই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকুক, সব কথা বলা যায় না। কিছু গোপন অনুভব, একান্ত অনুভূতি ব্যক্ত করার জন্যও একজন লোক লাগে। একজন নিজের মানুষের দরকার হয়। স্বপ্নীলের জীবনে শ্রাবণ্য নামের মেয়েটা তেমনই একজন হোক।

***
সকালের বাতাস টা বেশ ঠাণ্ডা। রিকশা চলছে মাঝারি গতিতে। বসন্তের শুরু কেবল। পুরোপুরি শীত যায় নি। স্বপ্নীল বলল,

“তুমি কী তোমার আপুর উপর রেগে ছিলে?”

শ্রাবণ্যর মনে পড়লো গত রাতের কথা। আমতাআমতা করে বলল,

“না মানে…

“বুঝতে পারছি। পরিবারের মানুষজন ভুল করলেও তাদের উপর রেগে থাকতে নেই। ছোটপা এতো অকাজ করে তবুও আমরা কেউ তার উপর রেগে থাকি না।”

স্বপ্নীলের কথার ধরন দেখে শ্রাবণ্য হেসে ফেলল। স্বপ্নীলও হাসলো। শ্রাবণ্যর সঙ্গে কথা বলার সময় ও একটু বেশী কথা বলে ফেলে।

***
বাতাসী খালা উপরে আসতেই মিশুক বলল,

“খালা একটু তুলী আপুকে আসতে বলুন তো জরুরী কথা আছে।”

বাতাসী খালা বুঝলেন পরিবেশ ভালো না। তার বেঁফাস কথাবার্তা না বলাই ভালো। তাই মিশুকের কথামতো তুলিকে ডেকে আনলো। তুলি এসে জিজ্ঞেস করলো,

“কোনো সমস্যা? ”

“হ্যাঁ আপু। এজন্যই আপনাকে ডাকা। আপনার দাদুর কী মাথায় একটু সমস্যা আছে? মানে বার্ধক্যজনিত কারণে অনেকের হয়।”

তুলি হেসে ফেলল। বলল,

“তা বোধহয় আছে। ”

মিশুক নিজেও হাসলো। বুঝতে পারলো ও যে টপিকে কথা বলতে চাচ্ছে সেটা তুলি জানে। মিশুক বলল,

“খালার কথাবার্তায় আন্দাজ করলাম, খুব সম্ভবত আমাকে কারোর জন্য পাত্র বানানো হচ্ছে।”

তুলি বিস্মিত গলায় বলল,

“খালা আবার কী বলল?”

“তেমন কিছু না। তার গল্প শুনে আন্দাজ করলাম। আসলে আপু আমার এই মুহুর্তে বিয়ে করার ইচ্ছে নেই। আর আমার পছন্দও একটু অন্যরকম। সরি টু সে, আমি কথাটা কাউকে ছোট করে বলছি না। আসলে আমার এখন কী করা উচিত? দাদু তো ছয়মাসের এগ্রিমেন্ট করেছিল। আমার কী বাসা ছাড়া উচিত?”

তুলি জবাব দেবার আগেই দরজার ওদিক থেকে আরেকটি প্রশ্ন ভেসে এলো।

“এই বুবু, কিসের বিয়ের কথা হচ্ছে? দাদু কার বিয়ের কথা বলছে?”

তুলি আর মিশুক একসঙ্গেই রঙ্গনার দিকে তাকালো। রঙ্গনা উত্তরের অপেক্ষা না করে ঝড়ের বেগে ছুটলো। তুলিও পেছনে পেছনে গেল। মিশুক কে বলল,

“আপনি রিলাক্স থাকুন। আমি এই বিষয়ে পরে কথা বলব। আগে নিচের ঝড়টা সামলে আসি। ”

মিশুকের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। এই বিবাহঘটিত নাটক টা কে ও সিরিয়াস ইস্যু ভেবেছিল। ওর ধারণা ছিলো রঙ্গনাও জানে। এখন মনে হচ্ছে সবই ওই বৃদ্ধ লোকটার কারসাজি।

***
আকাশী রাতে এসে হোস্টেলে পৌছেছে। শ্রাবণ্যর বন্ধু আফরিন সাহায্য করেছে। এই হোস্টেল টা সুন্দর। এক রুমে তিনটা করে সিট। স্টিলের সিঙ্গেল খাটের সঙ্গে একটা করে টেবিল চেয়ার। আর দেয়াল আলমারি আছে একটা। যেটা সবাই ই ব্যবহার করে।

আকাশী তোশক, বালিশ সব পেল। শ্রাবণ্য ওগুলো রেখে গেছে। বিছানায় শুয়েই সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লো। সারাদিনের টেনশন, ধকল কিছু মনে রইলো না।

আকাশীর ঘুম ভাঙলো শ্রাবণ্যর ডাকে। চোখ খুলে দেখলো শ্রাবণ্য ওর মাথার কাছে বসে আছে। ঠান্ডা হাত টা কপালে ধরে রেখেছে। ও’কে বলল,

“ওঠ। হাত, মুখ ধুয়ে খেয়ে তারপর ঘুমা। তোর কপাল টা গরম লাগছে। দাঁড়া দেখি আমার কাছে ওষুধ আছে কি না।”

আকাশীর ভীষণ কান্না পেল। শেষ কবে এমন আদর পেয়েছে মনে পড়ে না। কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখার মানুষের অভাব টা বুঝতে পেরেছে এই কয় বছরে। শুভ দিন দিন এতটা পাল্টে যেতে লাগলো যে আকাশীর অসুস্থতায়ও ওর মন নরম হতো না।

শ্রাবণ্য ওর জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। গরম পরোটা, নেহারি, হালুয়া। আকাশী খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলো,

“তুই খাবি না?”

“আমরা খেয়েছি।”

“আমরা? আর কে?”

“স্বপ্নীলও এসেছে। নিচে দাঁড়িয়ে আছে। ”

আকাশীর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বলল,

“কই? আমি একটু দেখি।”

শ্রাবণ্য আকাশীকে জানালার কাছে এনে দাঁড় করালো। ওখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায়না। শ্রাবণ্য স্বপ্নীল কে ফোন করে ঠিকঠাক জায়গায় দাঁড় করালো। আকাশী চশমা পরা ফর্সা, রোগা ছেলেটাকে দেখে বলল,

“ও তো মনে হয় আগের মতোই আছে। অনেক আগে দেখেছিলাম। তখন কলেজে পড়তো। ”

শ্রাবণ্য কিছু বলল না। আকাশী বলল,

“ছেলেটা ভালো? ”

শ্রাবণ্য মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। আকাশী হাসলো। একটা কথা বলতে গিয়েও বলল না। শ্রাবণ্য বলল,

“আজ তুই রেস্ট নে। অন্য আরেকদিন তোর সঙ্গে সামনাসামনি আলাপ করিয়ে দেব।”

****
মিশুকের মন টা খারাপ হলো। রঙ্গনা ব্যাগপত্র নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। পরনে ছাই রঙা টিশার্ট আর থ্রি কোয়ার্টার ঢোলা জিন্স। দেখে মনে হচ্ছে ব্রাশও করে নি। তবে ও’কে কাঁদতে দেখে ওর মন টা খারাপ হলো। দাদুর সঙ্গে ঝগড়াঝাটি টের পেয়েছে ও। দাদু বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছে। তুলি সামলানোর চেষ্টা করছে। রিন্টি, মন্টিও কাঁদছে।

“ও মনি তুমি যাইয়ো না। আমাদের কে ভুতের গল্প শোনাবে মনি। ডাল দিয়ে ভাত কে খাওয়ায়ে দিবে। মা তো ভাতে লবন নেয় না, তাই মজাও লাগে না। ”

রঙ্গনা চলে গেল সিএনজি করে একাই। মিশুক নিচে এসে তুলিকে বলল,

“আপু আমি আসলে বুঝতে পারিনি। সরি আপু। ”

তুলি হাসার চেষ্টা করে কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই মন্টি বলল,

“আপনি কথা বলবেন না। আপনি মনিরে বিয়ে করলে মনি আজকে যাইতে পারতো না।”

মিশুক তাকিয়ে আছে বাচ্চাটার দিকে।

চলবে….

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-১১
শুভর আজ মেজাজ টা ভীষণ খারাপ। বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে। এদিকে পানির ট্যাংকিতে কী এক সমস্যা হয়েছে, সারা বাড়ি পানিতে ভরে গেছে। ওর ঘরেও ঢুকেছে দরজার ফাঁকা দিয়ে। ও কিছুই টের পায় নি। ঘুম ভাঙতেই দেখলো মেঝে ভেসে যাচ্ছে। মেঝেতে বাটি, প্লেট যেগুলো ছিলো সেগুলো ভাসছে। দেখেই মাথাটা ফাঁকা লাগলো। চা করতে রান্নাঘরে গেল, কেউ চুলা দিলো না। সবাই দুপুরের রান্না চাপিয়েছে। শুভ কে দেখে পাশের বাসার ভদ্রমহিলা বলল, এখন চা বানান যাইব না। বারোটার পর যে জমিদারের চা খাওয়া লাগে সে বাইরে গিয়ে খেয়ে আসুক।

শুভ আর কিছু বলল না চলে এলো। সমস্ত রাগ গিয়ে পড়লো আকাশীর উপর। আকাশীর এই ঢং কবে শেষ হবে কে জানে! এই মেয়েকে তার হ্যাপি আপা কতদিন তার বাসায় রাখে সেটাও দেখা যাক। যাবে আর কই! বাড়িতে পি*শাচ বাপ, মা তো জায়গা দিবে না। জায়গা না দিক, অন্তত যদি ভালো চোখে দেখতো তাতেও কপাল টা খুলে যেত।

অসময়ে মায়ের ফোন দেখে আরও বেশী বিরক্ত লাগলো। মায়ের ইদানীং নাই, নাই স্বভাব আরও বেড়েছে। মুনার এটা লাগবে, ওটা লাগবে এছাড়া যুক্ত হয়েছে একটা বাথরুম লাগবে। এমন ভাঙাচোরা বাথরুম থাকলে মুনার বিয়ের সম্বন্ধ আসবে না। এদিকে শুভ নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারছে না কোথাও। একটা না একটা ঝামেলা সবজায়গায়ই থাকে। তাও ভরসার জায়গা ছিলো আকাশীর পার্লারের চাকরি টা। ভাত, ডাল, সবজি ভালো মতোই জুটতো। অন্যান্য খরচাপাতিও সেখান থেকে চালিয়ে নেয়া যেত। কিন্তু এখন কি হবে! সামনে নতুন মাস শুরু হবে। পাঁচ তারিখের মধ্যে ভাড়া দিতে না পারলে বাড়িওয়ালি খবিশের মতন আচরণ শুরু করবে। এদিকে ওর পকেটে খাওয়ার টাকাও নাই। ওর স্যালারি কবে হবে সেটারও ঠিক নাই। সামনের ভাতের হোটেলে তিন দিন বাকীতে খেয়েছে। গত রাতে খেতে গিয়ে দেখলো গরম রুই মাছ আলু পটল দিয়ে রান্না হয়েছে। দেখতে বেশ লোভনীয়। তেল ভাসছে ঝোলের উপরে। শুভ অর্ডার করলো। দোকানের ম্যানেজার নাক খুটতে খুটতে নির্লিপ্ত গলায় বলল,

“নগদ টাকা দিয়া যারা খাবে মাছ তাগোর জন্য। আপনে ডাল, ভাত খান।”

শুভ আকাশীর ফোনে কল করলো। নাম্বার টা বন্ধ। আকাশী কী সত্যিই বড় কোনো স্টেপ নিতে চাচ্ছে! তাও এভাবে! নাকি শুভ কে শিক্ষা দিতে চাইছে!

****
আকাশীকে মোটামুটি গুছিয়ে দিয়ে গেছে শ্রাবণ্য। ওর জিনিসপত্র যা ছিলো সেগুলো বাদে বাদবাকি সব কিনে দিয়ে গেছে। এছাড়া এক মাসের টাকাও পে করে গেছে। আকাশী বারন করেছিল। বলেছিল লাগবে না আমার কাছে আছে। শ্রাবণ্য বলেছে, তোর যা আছে সেটা রাখ। অনেক খরচ আছে। আপাতত কদিন রেস্ট নে। মাস শুরু হলে আমার টিউশনি দুটো তোকে দিয়ে দেব।

আকাশী বিস্মিত হচ্ছে শুধু। শ্রাবণ্য ও’কে এতো সাহায্য করছে! বাবার নিষেধ অমান্য করে এর আগে দেখা করতেও চাইতো না। আকাশী এলে বিরক্ত হতো কিংবা ভয় পেত। তবুও আকাশী আসতো। শ্রাবণ্য ঢাকায় পড়ছে জানার পর থেকে মাসে দু’বার তিনবারও দেখা করতে আসতো। একটা সময় ভেবেছিল শুভ কে পেলে আর কিছু লাগবে না। পরে ঠিকই বুঝতে পেরেছে, খেয়ে পরে বাঁচা ছাড়াও জীবনে অনেক কিছু লাগে। একটা বয়স পর্যন্ত মাথার উপর বাবা, মায়ার ছায়া লাগে। স্নেহ, মায়া মমতা সব লাগে।

আকাশী শুভ কে ছেড়ে চলে যাবার সিদ্ধান্ত সিরিয়াস ভাবে কখনোই নেয় নি। প্রায় ই ভাবতো, এভাবে আর কতদিন! মুক্তি দরকার, জীবনে শান্তি দরকার।

রাগের মাথায় যখন বাড়ি ছাড়লো তখন ভেবে নিলো, আর ফেরা হবে না। উচিতও নয় ফেরা। যে ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে একবার বেরোনো হয় সেখানে আর ফিরতে নেই। কারণ দ্বিতীয়বার ফিরলে মান থাকে না।

****
স্বপ্নীলের অফিসের আজ প্রথম দিন। ইস্ত্রি করা, শার্ট, টাই পরে চুল একপাশে সমান করে আঁচড়ে রেডি হলো৷ শ্রাবণ্য হাসতে গিয়েও হাসলো না। মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করে, তোর কি হয়েছে শ্রাবণ্য! স্বপ্নীলের সঙ্গে তুই একদম অন্য মানুষ৷ ও’কে কষ্ট দিতে চাস না। ওর আজেবাজে বকবক মনযোগ দিয়ে শুনিস। একটুও বিরক্তি প্রকাশ করিস না। তুই তো এমন না।

স্বপ্নীল জিজ্ঞেস করলো,

“আমাকে কেমন লাগছে? ”

“একটু অন্যরকম। ভালোই। ”

শ্রাবণ্যর আজ ক্লাশ নেই। সপ্তাহে চারদিন ওর ক্লাশ। স্বপ্নীলের একটু অস্বস্তি হচ্ছে শ্রাবণ্যকে ওর সঙ্গে যেতে বলতে। শ্রাবণ্য খুব ভালো মেয়ে। কখনো ওর উপর রাগ, কিংবা বিরক্ত হয় না। তবুও এই কথাটা বলতে কেমন লাগছে।

শ্রাবণ্য স্বপ্নীল কে দেখেই বুঝলো কিছু একটা বলতে চাইছে। জিজ্ঞেস করলো,

“আপনি কী কিছু বলবেন?”

“তোমার কী বাসায় কোনো কাজ আছে শ্রাবণ্য?”

শ্রাবণ্য একটু সময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“আপনার সঙ্গে যেতে হবে? ”

স্বপ্নীল হাসলো। বলল,

“তুমি চলো। একা থাকলে আমার নার্ভাস লাগবে। মা যেতে পারবে না। ”

শ্রাবণ্য মেনে নিলো। বলল,

“আচ্ছা আমি যাব। ”

দাদু দুজন কে একসঙ্গে দেখে খুশি হলেন। তার ছেলের অপূর্ণ ইচ্ছে পূর্ণ হয়েছে৷ স্বপ্নীলের মাথার ভুতও নেমেছে। বাড়ির মানুষগুলোও যদি এবার তাকে একটু ভরসা করতে পারে৷ দাদু গর্বিত গলায় বললেন,

“দেখলি তুলি, আমার হিসাব নিকাশে কোনো ভুল নাই। গরুটা সেজেগুজে কী সুন্দর অফিসে গেল!”

তুলি কিছু বলল না। ব্যাপার টা ও খেয়াল করেছে। ভালোবাসা দুজনের মধ্যে থাকুক না থাকুক সকলের সামনে কী সুন্দর সহজ! কোনো ভান নেই।

***
শিলা এসেছেন রঙ্গনাকে নিতে। তুলি আর স্বপ্নীল যেটুকু ভালোবাসা শিলার কাছে পেয়েছেন রঙ্গনা সেই তুলনায় কম পেয়েছে। মেয়েটা বাবার ন্যাওটা ছিলো। বাবাও একটু অধিক স্নেহ করতেন এই মেয়েটাকে । বাবা চলে যাবার পর মেয়েটা বদলে গেল যেন৷ রাগী, বদমেজাজী, বেপরোয়া রঙ্গনাকে সবাই দেখে। মাঝরাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাঝেমধ্যে কাঁদতে দেখে শুধু শিলাই। শিলা কাঁধে আলতো করে হাত রাখতেই চমকে উঠে বলে,

“আরে তুমি ঘুমাও না ক্যান? ভুতের মতো কেন চলো! ”

শিলা স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করেন,

“কিসের জন্য কাঁদছিস? ধার দেনায় ডুবে গেছিস আবারও! ”

রঙ্গনা উদাস গলায় বলে,

“বা*লের একটা লাইফ কাটাইতেছি মা। কিচ্ছু ঠিকঠাক হয় না। একদিক ঠিক তো অন্যদিকে ঝামেলা। ”

“প্রেমিকের ঝামেলা? ”

“ইশ ছি:! একটা ছেলের জন্য কান্নাকাটি করার মেয়ে আমি না। একজন গেলে আরেকজন আসবে। কান্নাকাটি করে মরব না।”

শিলা জানেন তার এই মেয়েটির স্বভাব। ছবি এঁকে লাখ লাখ টাকা উপার্জনের গল্প যেমন আছে, তেমনি না খেয়ে থাকার গল্পও আছে। তবুও রঙ্গনাকে নিয়ে তার টেনশন নেই। এই মেয়েটা ভালো থাকতে জানে, অন্ধকারে আলো খুঁজেও নিতে পারবে ঠিকই। মন ভালো করার জন্য ট্যুর দিয়ে আসতে পারবে যখন তখন। ওর জন্য শুধু একটাই চাওয়া, কেউ ও’কে উজাড় করে ভালোবাসুক।

রঙ্গনা মা’কে দেখে কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলল,

“তোমার ওই বাড়ি জীবনেও যাব না মা।”

শিলা রঙ্গনার ঘরের দিকে তাকালেন। ঘর টা এলোমেলো। একটা জিনিসও ঠিকঠাক নেই। বললেন,

“তোর দাদু যে কেন তোকে বিয়ে দিতে চায় আমিও বুঝিনা। তোর মতো মেয়েকে বিয়ে করে কেউ ঘরে তুললে সেই সংসার টাই ধ্বংস হবে। ”

রঙ্গনা চুপ করে রইলো। শিলা এদিক ওদিক তাকিয়ে বললেন,

“কোথায় বসব? বসার মতো জায়গা তো নেই। ইশ ছি:!”

রঙ্গনা অভিমানী গলায় বলল,

“মা তুমি এক্ষুনি বের হও। আমি ওই বাড়ি আর যাব না। ”

“কেন যাবি না?”

“তোমার শ্বশুরের সাহস দেখো, একটা ছেলেকে বাড়িতে উঠিয়েছে শুধু আমাকে বিয়ে করানোর জন্য। অথচ ছেলেটাকে আমার পছন্দ কিনা সেটা একবারও জানতে চাইলো না।”

“তোর পছন্দের যে আছে তাকে দাদুর সামনে নিয়ে দাঁড় করা।”

রঙ্গনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেঝেতে বসলো। শিলাও সেখানে বসেছেন। বললেন,

“তোর পছন্দের কেউ নাই?”

“না থাকলে তো কবেই বিয়ে করে নিতাম। ”

“কেন? ফেসবুকে একটা ছেলের সাথে ছবি দিতি না। ওই যে তোর চুলের গোছা ধরে ছবি তুলতো।”

রঙ্গনা হেসে ফেলল। বলল,

“তোমাকে সব দেখতে হয়! ওটা শুধু বন্ধু।”

শিলা হাত বাড়িয়ে মেয়ের হাত ধরলেন। বললেন,

“বাড়ি চল। তোকে ছাড়া ভালো লাগে না। ”

রঙ্গনা মায়ের অনুনয় উপেক্ষা করতে পারলো না। বাবা চলে যাবার পর মা ওদের আর বকাবকি করেন না। এতো নরম গলায় কথা বলেন। কিছু বললে না করা যায় না।

***
মন্টি, রিন্টি ছুটে এসেছে। অকারণে ওরা হিহি করে হাসছে, লাফাচ্ছে। রঙ্গনা বলল,

“এই তোরা সর, ভিখিরির মতো জামা কাপড় পরে আছিস। যা আমার সামনে থেকে। ”

ওরা গেল না। আরও হা হা হি হি করতে লাগলো। মিশুকের সাথে সন্ধ্যেবেলা রঙ্গনার দেখা হলো। রঙ্গনা আগ বাড়িয়ে বলল,

“হাই, আপনি রিলাক্সে থাকুন। আমি আপনাকে বিয়ে করব না। কারণ আপনাকে আমার পছন্দ হয় নি। এই কারণে দাদু আর এগোবে না। ”

মন্টি বলল,

“আমাদের মনি যাকে বিয়ে করবে সে মনিকে কোলে নিবে। আপনি কী কোলে নিতে পারবেন? ”

মিশুক হেসে ফেলল। রঙ্গনা মন্টিকে চোখ রাঙানি দিয়ে বলল, এক থাপ্পড় খাবি।

মিশুক তখনও হাসছে।

চলবে….

কুসুম_কাঁটা পর্ব-৮+৯

0

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-৮
আকাশী আছে হ্যাপি আপার বাসায়। পার্লারের ম্যানেজার সে। মালিক মাসে একদিন আসে। তাছাড়া আর এদিকে পা রাখার সময় পায় না। ঢাকা শহরে তার আরও চার টা পার্লার আছে।

হ্যাপি আপা লোক ভালো। বয়স তেত্রিশ বলে, কিন্তু দেখলে আটত্রিশ উনচল্লিশ মনে হয়। একটু স্বাস্থ্যবতী অবশ্য। তার একটা ভালো গুন হচ্ছে সে যেকোনো মানুষের সঙ্গে দুই মিনিটে মিশে যেতে পারে। আকাশীকে সে পছন্দ করে। অনেকবার ই ও’কে বলেছে তার বাসায় গিয়ে থাকতে। তাহলে শুভর একটা শিক্ষা হবে। কাজকর্ম, সংসারে মন আসবে। আকাশী সেসব কানে নেয় নি। সেদিন বাসা থেকে বেরোনোর পর মনে হয়েছে হ্যাপি আপার কাছে যাওয়া যায়।

হ্যাপি আপার বাসাটা বড়ই। তিন রুমের বিশাল ফ্ল্যাট। দুটো বাচ্চা নিয়ে হাজবেন্ডের সঙ্গে থাকে। উনি আকাশীকে বললেন,

“তোর যত দিন মনে চায় থাক, নিজের বাসা মনে করে থাক। ”

আকাশী নিশ্চিন্ত হলো। ওর কাছে টাকা আছে। মাসের এই সময়ে খুঁজলে হয়তো হোস্টেলও পেয়ে যেত। কিন্তু সেখানে অনেক খরচ। লালমাটিয়ায় একটা হোস্টেলে থাকা খাওয়া সহ সাত হাজার চাইলো। ওর সাহস হয় নি। ও সিদ্ধান্ত নিয়েছে হ্যাপি আপার এখানেও টাকা দিবে। বেশীদিন থাকবেও না, একটা মোটামুটি মানের হোস্টেল কিংবা মেস পেয়ে গেলে উঠে যাবে।

আর শুভর কাছে আপাতত ফেরার ওর ইচ্ছে নেই। শুভ দুদিন আগে পার্লারের সামনে এসেছিল। আকাশী যে সময় বেরোয় তখন রাস্তা আটকে বলল,

“তোমার নাটক শেষ হয়েছ?”

আকাশী রাস্তাঘাটে ঝামেলা করতে চাইলো না। বলল,

“যাও এখান থেকে। ”

“কার বাসায় আছ? ওই মহিলার বাসায়! যে শরীর ভাড়া দেয়?”

আকাশীর মেজাজ খারাপ হলো মুহুর্তেই। এক থাপ্পড় দিয়ে শুভর গাল লাল করে দিতে পারলে ভালো লাগতো। ও চাপা গলায় বলল,

“মুখে লাগাম দাও। মানুষের সম্পর্কে উল্টাপাল্টা বলবে না। ”

শুভকেও ভীষণ ক্ষিপ্ত দেখালো। বলল,

“লাস্ট টাইম বলছি, এখন ফিরে গেলে আমার বাসায় তোমার জায়গা হবে। নাহলে এরপর পা ধরে কান্নাকাটি করেও লাভ হবে না। ”

আকাশীর ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি। বলল,

“পা ধরার মতো পাগল আমি না। অনেক হয়েছে….

শুভ কথা শেষ করতে দিলো না। বলল,

“কয়টা পয়সা হাতে আসায় তোর ডানা গজিয়েছে সেটা তো দেখেছি। এখন নিজেকে রাস্তায় নামিয়ে ফেলেছিস! ছি:! ”

আকাশী চোখে চোখ রেখে কঠিন গলায় বলল,

“আগে নিজেকে ভালো করে দেখো। তুমি নিজে কী সেটা আগে ভাবো। ”

শুভকে আর কিছু বলার সুযোগ দেয় নি ও। সেখান থেকে চলে এসেছে। হ্যাপি আপা এসব জানেন। তিনি বলেছেন,

“ভালো করছিস। এমন পুরুষ মানুষের সংসার করার দরকার নেই। তুই এইখানে থাক। ”

***
মিশুক ছুটির দিনগুলোও বাসায় থাকে। ঢাকায় ওর বন্ধু, পরিচিত যারা আছেন তারাও ওর মতোই। সারা সপ্তাহ ব্যস্ত থাকার পর নিজের মতো থাকতে ভালোবাসে। ও বাসায় থাকলেও আরাম করার সুযোগ পায় না। চাকরির পাশাপাশি বিজনেস করার প্ল্যান আছে। বিভিন্ন আর্টিকেল, সাবজেক্ট নিয়ে রিসার্চ করছে। কোথায় ইনভেস্ট করলে ভালো হবে, এসব নিয়েই ব্যস্ত থাকে।

বাতাসী খালা সকালের খাবার নিয়ে আসে। রাতে ও সবার সঙ্গে খেতে যায়। বাড়ির লোকজন মোটামুটি ভালোই। স্বপ্নীল সহজ সরল ভালো ছেলে। দাদু মানুষ টা গম্ভীর এবং বাঁচাল টাইপ। তাকে ভালো লাগে নি। শিলা আন্টি আন্তরিক, তুলি আপুও তেমন। শ্রাবণ্যকে ঠিকঠাক চিনে উঠতে পারে নি। বাচ্চা টাইপ মেয়ে, শান্ত বোধহয়। বাচ্চা দুটো ইচড়ে পাকা। রঙ্গনার সঙ্গে সেদিন আলাপের পর দেখা হলেও কথা হয়েছে আর একদিন। সিড়িতে দেখা। ও নামছিল, আর রঙ্গনা উঠছিল। দুজনের পায়ের স্টেপ একই রকম ছিলো। মিশুক ই বলল,

“আপনি আগে যান। ”

রঙ্গনা উঠে চলে গেল। ওর দিকে ফিরেও তাকালো না। এই মেয়েটা বোধহয় ওর উপর ক্ষেপে আছে। প্রথম দিনের আলাপের কনভার্সেশন সম্ভবত পছন্দ হয় নি। তবে মিশুকের পাশের রুম টায় থাকে। রাতে উচ্চশব্দে হিন্দি গান চালায়। ফোনে কথা বলার সময় প্রায় ই শব্দ করে হাসে। বাচ্চা দুটোর সঙ্গে প্রায় ই রুমের মধ্যে হৈচৈ মারামারি করে। মিশুক না চাইতেও সেগুলো শোনে।

আজ সকালে বাতাসী খালা এসেছেন খাবার নিয়ে। গরম ধোঁয়া ওঠা সবজি খিঁচুড়ি, বেগুন ভাজা, ডিম ভাজা। এই বাসায় রান্না করে দুজন। শিলা আর তুলি। দুজনের রান্নার হাত ই ভালো। ছুটির দিনে রান্না করেন শিলা। তবে মাঝেমধ্যে কোনো আইটেমে লবন বেশী হয়। সেটা নাকি দাদীর কাজ, সে নাকি রান্নাঘরে ঢোকেই লবন দিতে। কেউ না থাকলে এক চামচ লবন দিয়ে আসে। শেষ বার এই নিয়ে ঝগড়া হয়েছে দাদুর সঙ্গে। শ্রাবণ্যর বাবা, মা এসেছিলেন। মাংস টা মুখে তুলতেই টের পেলেন অতিরিক্ত লবন। দাদু তুলিকে বললেন,

“এই মহিলাকে হয় দশবার কান ধরে ওঠবস করাবি, নাহলে এক কেজি লবন খাওয়াবি। তা নাহলে আমি ভাত খাব না। ”

দাদির হয়ে রঙ্গনা খানিকক্ষণ ঝগড়াঝাটি করে শেষমেস সোনাডাঙ্গার বাসে উঠিয়ে দিয়ে এসেছে। দাদির বাপের বাড়ি সেখানে। প্রায় ই রাগ করে সেখানে যায়, দাদু গিয়ে মান ভাঙিয়ে নিয়ে আসেন।

বাতাসী খালা মিশুকের সঙ্গে এসে রাজ্যের গল্প করেন। তার ছেলের বউ কেমন পি*শাচ। সেদিন একশ বিশ টাকা দিয়ে একটা লাউ কিনে আনছে। এই সিজনে লাউয়ের কোনো স্বাদ, টাদ কিছু নাই। কতগুলো টাকি মাছ দিয়ে সেই লাউ রানছে। একটুও মজা হয় নি। মিশুক এসব গল্প না শোনার ভান করে। ভদ্রমহিলা গল্প করতে ইচ্ছে হয়েছে করুক।

কিন্তু এই ভদ্রমহিলার একটা সমস্যা অবশ্য আছে। সে ইনিয়ে বিনিয়ে ছোট মনি মানে রঙ্গনার গল্প বলে। সেগুলো ভালো গল্প।

“বুঝলেন ভাইজান, এমন মেয়ে ঘরে থাকা ভালো। ছেলের কাজ সাড়ে। বাজারে গিয়া কী সোন্দর মাছ কিনা আনে। একটা মাছও পঁচা হয় না। এমন মাইয়া থাকলে পোলার দরকার হয় না। পোলা যেটা আছে ওইটা তো বাদাইম্যা। মায়ের কাছ থিকা রিকশা ভাড়া নিয়া বউরে কলেজে দিয়াসে। আর ছোট মনিরে দেখেন, তার তো মেলা টাকা। কীসব ছবিটবি আঁকে, সেগুলান বেঁচে। ”

মিশুক প্রথমে এইসব গল্প না শোনার ভান করে গেছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই গল্পে অন্য টুইস্ট আছে। দাদু লোকটা অতি চালাক। এইসব গল্পে তার হাত থাকলেও থাকতে পারে।

***
হ্যাপি আপার হাসিখুশি ভদ্রমানুষের আড়ালে আরও একটা রুপ আছে সেটা আকাশী জানতে পারলো দশ বারো দিন পর। তার বাসায় এক ভদ্রলোক এসেছেন। বয়স্ক ভদ্রলোকের সঙ্গে অল্প বয়সী এক মেয়ে। তারা এক রুমে ঢুকে গেছে। বেরিয়েছে ঘন্টাখানেক পর। এই তিন ঘন্টা ও অন্যরুমে ছিলো। ও’কে যে ঘর টায় থাকতে দিয়েছিল তারা সেই ঘরে গেছেন। হ্যাপি আপা ও’কে একটা আজগুবি গল্প শুনিয়ে দিলেন। ও বিশ্বাস করলো না। এই তিন বছরে ও অনেক কিছু দেখেছে, এসব ব্যাপার এখন আর ও’কে বলে বোঝানোর দরকার নেই। এগুলো ও বোঝে।

চলবে….

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-৯
মাঝরাতে শ্রাবণ্যর ঘুম ভাঙলো ফোনের শব্দে। অ্যালার্মের জন্য ফোন সাইলেন্ট রাখে না। ও টের পাওয়ার আগে স্বপ্নীল টের পেল। স্বপ্নীলের পায়ের দিকে রাখা ছিলো। ওর ঘুম ভাঙলো, শ্রাবণ্যকে ডেকে বলল,

“ফোন টা ধরো তাড়াতাড়ি। ”

শ্রাবণ্য শুনেও অতো গুরুত্ব দিলো না। তিন বার বাজার পর স্বপ্নীল উঠে ফোন টা হাতে নিয়ে বলল,

“ও শ্রাবণ্য ওঠো, তোমার আপু ফোন করছে।”

শ্রাবণ্য উঠলো অনিচ্ছায়। বলল,

“দিতে থাকুক। এখন কেউ কাউকে দেয়। ”

স্বপ্নীল সময় দেখলো। দুটোর বেশী বাজে। বলল,

“মনে হয় কোনো বিপদ হয়েছে। তুমি কলব্যাক করো। ”

“হলে হোক, আমার তাতে কিছু যায় আসে না। ”

স্বপ্নীল বিস্মিত গলায় বলল,

“তুমি এভাবে কেন কথা বলছ শ্রাবণ্য, স্বার্থপরের মতো। ”

শ্রাবণ্য চোখ খুলে তাকালো ভালো করে। স্বার্থপর শব্দ টা কানে লাগলো ভীষণ। স্বপ্নীল তখনও ওর দিকে তাকিয়ে আছে জিজ্ঞাসু চোখে। স্বপ্নীলের গলার স্বর এবার নরম হলো। বলল,

“তোমার আপুর বিপদ হতে পারে। তোমার কলব্যাক করা উচিত। ”

***
আকাশী দাঁড়িয়ে আছে মাঝরাস্তায়। হ্যাপি আপার বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছে। আকাশীর গাল ভেজা, এতক্ষন কেঁদেছে। এখন আর কাঁদছে না, গলার কাছে কেমন অবশ ভাব। সামনে একটা হসপিটাল দেখা যাচ্ছে, ওখানে গেলে মনে হয় রাতের বাকী সময় টুকু কাটিয়ে দেয়া যাবে। তবে এখন আর ভয় নেই। যে ভয় পেয়েছিল!

হ্যাপি আপার হাবভাব ওর পছন্দ হয় নি। ওনাকে ভদ্রমহিলা ভাবলেও ভেতরে ইবলিশের বসবাস সেটা আকাশী স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি। ওই বয়স্ক লোকটা যাবার পর হ্যাপি আপাকে ফোন করে আকাশীর কথা কী যেন বলেছে। ও স্পষ্ট শুনতে পায় নি। তবে হ্যাপি ফোন রেখে বলল,

“ভাইজান রে তোর কথা বললাম। সে তোর কথা শুনে বলল একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিবে অতিদ্রুত। ”

“কিন্তু আপা আমার তো গ্রাজুয়েশন এর সার্টিফিকেট নাই। কমপ্লিট হয় নাই। ”

“আরে সমস্যা নাই। ভাইজানের কাছে চাকরিতে সার্টিফিকেট লাগবে না। ”

আকাশী শুকনো ঢোক গিলে বলল,

“পার্লারের চাকরি আমার খারাপ লাগে না আপা। আমার অন্য চাকরির দরকার নাই। ”

“আরে এইগুলান কী বালছালের কাজ করবি! পার্লারে কাজ করা আর বাসায় বুয়াগিরি করা একই। ভাইজান বলছে তোর চেহারা ভালো আছে, চাকরিতে সমস্যা হবে না। অফিসের বসদের পিএস হইতে কোনো সমস্যাই হবে না। কোনো কাজ নাই এসব জায়গায়। আরামে মোবাইল দেখবি। সপ্তাহে একদিন দুইদিন প্রাইভেট টাইম স্পেন্ড করবি। দেখবি এরপর আর তোর পিছনে ফিরে তাকাইতে হবে না। ”

আকাশী সব টা শুনলো। হ্যাপি সরাসরি বুঝিয়ে দিলো ও’কে কী কাজ করতে হবে। কোনো তর্কে গেল না। বলল,

“আপা আমি আপনার বাসায় থাকব না। ”

হ্যাপি আপা শান্তস্বরে কথা বলা আকাশীকে অতো গুরুত্ব দিলেন না। বললেন,

“কই যাবি বাদাইম্যা জামাইর কাছে। একটা সোজা জিনিস বুঝাইয়া দেই, ব্যডা মানুষ সব ই এক। ওই বাদাইম্যার সাথে থাইকা কিছু পাবি না। কিন্তু সেই সময় টা অন্য জায়গায় দিলে লাখ লাখ টাকার মালিক হইতে বেশী সময় লাগবে না। ”

আকাশী রাগে কাঁপছিল। বলল,

“আমি এখনই যাব আপা। আপনি আমার সঙ্গে ঝামেলা করবেন না। আপনার বাসার ঠিকানা, মোবাইল নাম্বার সবকিছুই আমার বোনের কাছে দেয়া আছে। ও আপনাকে ছাড়বে না। ”

হ্যাপি আপার কপালে ভাজ পড়লেও মুখের হাসি টা মিলিয়ে গেল না। বলল,

“আরে যা যা। তুই আমার বা*ল করবি। বের হ আমার বাসা থেকে। ”

আকাশী বের হওয়ার সময় হ্যাপিকে চার হাজার টাকা দিয়ে আসলো। এই ক’দিন থাকা খাওয়ার খরচসহ। হ্যাপি টাকা হাতে নিয়ে বলল,

“আমার অফার মনে ধরলে ফোন করিস। এই লাইনে একবার গেলে লাইফ সেট হয়ে যাবে।”

আকাশী বেরিয়ে এলো রাস্তায়। মানুষ না চিনতে পারার দু:খে ভীষণ কাঁদলো। সব মানুষেরই কী এমন দুইটা রূপ থাকে!

খানিকক্ষণ কেঁদে কেটে ঘড়িতে সময় দেখলো। প্রায় দুটোর কাছাকাছি। এতো সময় পেরিয়ে গেছে! চারদিকে এতো উজ্জ্বল আলো যে দেখে বোঝার উপায় নেই। ফোন বের করে হাতে নিলো। এই দুনিয়ায় এখন দুজন মানুষ ই আছে যাদের রাত, বিরাতে ফোন করা যায়৷ একজন ভাবী, আরেকজন শ্রাবণ্য। ভাবীকে ফোন করলো, তার নাম্বার টা যথারীতি বন্ধ আছে। রাতে ফোন বন্ধ করে ঘুমায়। বাকী রইলো শ্রাবণ্য। ও তো ছোট মানুষ! কী আর সাহায্য করতে পারবে। নতুন বিয়ে হওয়া শ্বশুর বাড়িতে আশ্রয় দিতে চাইলেও সেটা নেয়া উচিত না।

সাত, পাঁচ ভেবে শেষমেস শ্রাবণ্যকেই ফোন করলো।

***
শ্রাবণ্য কল ব্যাক করে বিরক্ত গলায় বলল,

“আপু এটা কী ফোন করার সময়? আমি তো ঘুমাচ্ছিলাম।”

আকাশী কিছু বলল না। নি:শব্দে চোখের জল বিসর্জনের শব্দ শ্রাবণ্য শুনতে পেল না। ও জিজ্ঞেস করলো,

“কী হয়েছে?”

আকাশী বলল,

“আমি রাস্তায় আছি বনু। আমার কোথাও যাবার জায়গা নেই। আমি এখন কী করব?”

এতো রাগের মাঝেও শ্রাবণ্যর ভীষণ খারাপ লাগলো। স্বপ্নীলের সামনে থেকে উঠে গিয়ে চাপা গলায় বলল,

“কী হইছে তোর আপু? শুভ ভাইয়া ঠিক আছে? ”

আকাশী ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলল,

“আমি অনেক দিন আগে শুভর বাসা ছেড়ে আসছি বনু। ”

শ্রাবণ্য অবাক গলায় বলল,

“কেন?”

আকাশী সংক্ষেপে যা বলার বলল। শ্রাবণ্য সব শুনলো। আকাশী ও’কে প্রশ্ন করলো,

“আমি এখন কী করব শ্রাবণ্য?”

শ্রাবণ্য চুপ করে থাকে। মেয়েদের জীবনে এই মুহুর্ত টা বোধহয় সবসময় ই আসে। আকাশী যেদিন শুভর হাত ধরে পালিয়ে এলো সেদিন রেহানা হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, ও শ্রাবণ্য আমি এখন কী করব! মানুষজন রে কেমনে মুখ দেখাব!

শ্রাবণ্যর জীবনেও এমন একটা দিন এসেছিল। ও শিউলিকে কাতর গলায় জিজ্ঞেস করেছিল, আমি এখন কী করব?

আজ আকাশীও সেই একই অসহায় প্রশ্নের মুখোমুখি। শ্রাবণ্য সময় নেয়। বলে,

“আমি দেখছি। কোথায় আছিস তুই। পুলিশ বক্সে গিয়ে দাঁড়া। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফোন করছি। ”

***
স্বপ্নীল জিজ্ঞেস করলো,

“কোনো সমস্যা শ্রাবণ্য?”

“হ্যাঁ। আমার আপু বাসা থেকে ঝগড়া করে বেরিয়ে এসেছে?”

“এখন কোথায়? ”

“রাস্তায়। ”

“তোমাদের বাড়িতে যাবে না?”

“না। আমার বাবার কাছে ও মরে গেছে। বাবা এখন সবাইকে বলে আমি তার একমাত্র মেয়ে। ”

স্বপ্নীলের গলার স্বর কোমল হলো। বলল,

“আমি বুবুকে জাগাই। তুমি তোমার আপুকে আসতে বলো। এই বাড়িতে গেস্ট রুম আছে। উনি এখানে থাকবেন। ”

“না থাক। ”

“কেন?”

“আমি অন্য ব্যবস্থা করছি। ”

“কী ব্যবস্থা করবে?”

শ্রাবণ্য স্বপ্নীলের কথার জবাব না দিয়ে আফরিন কে ফোন করলো। হোস্টেলে ওর সিট টা এখনো আছে। তিন মাসের এন্ট্রি করা। অন্য কাউকে ওঠানোর কথা না। তবুও আফরিন কে ফোন করে কনফার্ম হয়ে নিলো।

শ্রাবণ্য আকাশীকে ফোন করে হোস্টেলের ঠিকানা দিলো। বলল, সিএনজি নিয়ে যেতে। যতক্ষন না পৌছায় ততক্ষন যেন ফোনে ওর সঙ্গে কথা বলে। সবচেয়ে ভালো হয় পুলিশ বক্সে যারা আছে তাদের কেউ সিএনজি খুঁজে দিলে। আকাশী সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করলো।

হঠাৎ আকাশীর মনে হলো শ্রাবণ্যর যে বুদ্ধি আছে সেই বুদ্ধি ওর নেই। ওর আসলে বুদ্ধিই নেই কোনো।

চলবে….

কুসুম_কাঁটা পর্ব-৬+৭

0

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-৬
রঙ্গনা নিজে গিয়ে মিশুকের সঙ্গে আলাপ করলো। ও অফিস থেকে এসে মৃদু ভলিউম দিয়ে গান শুনছিল। রঙ্গনা চা নিয়ে গেল। অবশ্য নিয়ে গেল বললে ভুল হবে। তুলিই পাঠালো। ও অবশ্য দাদুর এই সব প্ল্যান সম্পর্কে জানে না। এখনো পর্যন্ত প্রাথমিক অবস্থায় দাদুর কোনো পেয়িং গেস্ট কেই পছন্দ হয় নি। প্রাথমিক অবস্থা বলতে প্রথম তিন মাস। একটা মানুষের আচরণ, স্বভাব, বদ অভ্যাস জানতে হলে তাকে তিন মাস দেখতে হয়। প্রথম প্রথম সবাই ই ভালো থাকে। ভেতরের শয়তান বেরিয়ে আসতে একটু সময় লাগে। এর আগে যে তিনজন ছিলো তাদের কে বিতাড়িত করেছেন স্বভাব, পছন্দে মিলে নি বলে। তবে তার মিশুক কে প্রথম দেখায় ই পছন্দ হয়েছে। ছেলেটা অত্যন্ত সুপুরুষ। এটা একটা প্লাস পয়েন্ট। আরেকটা বিষয় ভালো, ছেলেটার পরিবার ছোট। বড় পরিবার রঙ্গনার জন্য ভালো হবে না। গ্যাঞ্জাম ও নিজেই করবে। তার এই নাতনি টা বদের হাড্ডি। এর কারণে ভালো একটা পরিবার নষ্ট হোক সেটা চায়ও না। তাছাড়া মিশুকের কথা বলার ধরন তার ভালো লেগেছে। এতদিনে বোধহয় বন্য ওলের সঙ্গে বাঘা তেঁতুল।

রঙ্গনা হেসে বলল,

“আমি রঙতুলির রঙ। আমার বুবুর সঙ্গে আলাপ আছে তো। ”

মিশুক স্বাভাবিক গলায় বলল,

“জি। ”

“কেমন আছেন?”

মিশুক একটু অপ্রস্তুত হলো। এমন ভাবে কেমন আছেন কথা টা জিজ্ঞেস করলো যেন অনেক দিনের আলাপ। ও কৃত্রিম হাসি দিয়ে বলল,

“ভালো। আপনি? ”

“ভালো। আপনার বয়স কত?”

মিশুক হকচকিয়ে গেল। এতো দেখি দাদুর আদর্শ নাতনি। বয়স জিজ্ঞেস করছে, এরপর আবার ফ্যামিলি হিস্ট্রি জিজ্ঞেস করবে। ও বলল,

“বায়োডাটা আপনার দাদুর কাছে আছে?”

রঙ্গনা হেসে ফেলল৷ বলল,

“আমি আপনার প্রতিবেশী৷ উঠতে বসতে দেখা হবে। কথাবার্তা হবে। আপনার বয়স জানতে চাচ্ছি এই কারণে যে আমি আপনাকে তুমি সম্বোধনে ডাকব, নাকি তুই বলে ডাকব। ”

মিশুক এবার আর অবাক হলো না। বেশভুষায় যেমন আধুনিক তেমন কথাবার্তায়ও বেশ আধুনিক। ও বলল,

“আমি আসলে নিজের সার্কেল ছাড়া কারো কাছে তুমি, তুই সম্বোধনে অভ্যস্ত নই। আমার ছোট কিংবা বড় যেই হোক। আপনি বরং আমাকে এখন যেভাবে বলছেন তেমন ই বলুন। ”

রঙ্গনা এবার একটু চমকালো৷ এটা যে সূক্ষ্ম অপমান সেটাও বুঝলো। তবুও মৃদু হেসে বলল,

“ওকে। ”

মিশুক আবারও কৃত্রিম হাসি দিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। রঙ্গনা নিচে গিয়ে তুলি কে বলল,

“এসব ভাবওয়ালা ছেলেগুলো দাদু কোথায় পায় বুবু? মেয়েদের সাথে একটু ভালো করে কথা বলতে পর্যন্ত পারে না। ”

তুলি মিটিমিটি হাসলো। দাদুর দেখেশুনে বিয়ে দেবার শখ বোধহয় এই জীবনে পূরণ হবে না।

***
মন্টি, রিন্টি আজ শ্রাবণ্যকে বিরক্ত করছে। ও হাসিমুখেই মেনে নিচ্ছে। এতো ছোট বাচ্চাদের রাগ দেখানো যায় না। মায়া লাগে। স্বপ্নীল গেছে দাদুর কাছে জ্ঞান আহরন করতে। রিন্টি শ্রাবণ্যকে বলল,

“জানো মামী আমাদের বাবা অনেক রাগী। ”

শ্রাবণ্য হেসে বলল,

“তাহলে তোমরা দুষ্টমি কেন করো?”

মন্টি বলল,

“আরে আমাদের উপর রাগে না। রাগে তো মায়ের উপর। মা যতক্ষন পর্যন্ত চুমু না দেয় ততক্ষন পর্যন্ত রেগে থাকে। ”

রিন্টি আবার সাথে যোগ করে বলল, অনেক গুলো চুমু দিয়ে আমাদের রাগ ভাঙায় মা৷ আমাদের মা অনেক ভালো।

শ্রাবণ্যর চোখ বড় হয়ে গেল। কীসব ভয়ংকর কথাবার্তা। বলল,

“ইশ! তোমরা এসব পঁচা কথা কোথায় শিখেছ! ”

দুজনেই মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। শ্রাবণ্য দুজনকেই কাছে টেনে বলল,

“এসব আর বলবে না। আমাকেও না, অন্য কাউকেও না। মনে থাকবে?”

রিন্টি বলল,

“আচ্ছা। তাহলে কী চকলেট দিবা?”

“আমি কাল তোমাদের চকলেট দেব। ”

খাবার টেবিলে মন্টি গিয়ে বলল,

“মা জানো মামী কী বলেছে? চুমু দেয়া খারাপ কাজ। এজন্য মামী মামাকে চুমু দেয় না৷ ”

স্বপ্নীল মুখভর্তি ভাত নিয়েই কাশতে শুরু করলো। শ্রাবণ্য একবার তুলির দিকে তাকালো।

শিলা এমন ভান করলেন যে কিছু শুনলেন না। রঙ্গনা হো হো করে হেসে উঠলো। তুলি কে বলল,

“বুবু এখানে দাদু থাকলে ভালো হতো। এরপর জোর করে তোর মেয়েদেরও বিয়ে দিয়ে দিতো। ”

স্বপ্নীল শ্রাবণ্য দুজনেই লজ্জায় কারোর দিকে তাকাচ্ছে না।

***
আকাশী আজ বাসায় ফিরলো রাত করে। শুভ আগেই ফিরেছে। একা চা করে খেয়েছে। ঘরে ঢুকতেই মেজাজ টা খারাপ হয়ে গেল। ঘরভর্তি সিগারেটের গন্ধ। এতো টাকা পয়সার টানাটানি অথচ সিগারেট খাওয়া বন্ধ হয় না। আকাশী এই নিয়ে একদিন বলেছিল। শুভ জবাবে নির্লিপ্ত গলায় বলেছে,

“তোমার লিপস্টিক পরাও তো বন্ধ হয় না। ”

কিসের সঙ্গে কিসের তুলনা! পার্লারের দিনা আপা সেদিন একটা কথা বলেছে, শোন আকাশী অশিক্ষিত মানুষের কাছে কখনো লজিক, ম্যানার আশা করবি না। এদের সঙ্গে তর্ক করার চেয়ে চুপ থাকাই ভালো। শুভ গ্রাজুয়েশন শেষ করা ছেলে হলেও চিন্তাধারায় একটুও এগোয় নি। আকাশীর খারাপ লাগে। একটা মানুষ শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবে! একটুও ওর কথা ভাবলো না!

ঘরে ঢুকে কোনো কথা বলল না। সবজিগুলো কাটতে শুরু করলো। শুভ আড়চোখে দেখছে। বলল,

“শ্রাবণ্যর নাকি বিয়ে হয়েছে?”

আকাশী নির্লিপ্ত গলায় বলল,

“কার থেকে শুনলে?”

“মুনা বলল। মায়ের কাছেও শুনলাম যে তোমার বাবা এলাহি আয়োজন করে শ্রাবণ্যর বিয়ে দিয়েছেন। ”

“আচ্ছা। ”

“শুধু আচ্ছা!”

“আর কী বলব?”

“শুনলাম কার সঙ্গে নাকি ধরা পড়েছে তারপর….

আকাশী রুক্ষ গলায় বলল,

“ঠিক করে কথা বলো শুভ। ”

শুভ ভয় পাবার ভান করে বলল,

“নাহলে কী গলায় বটি বসিয়ে দিবে?”

আকাশী রাগে ফুসছে। শুভ খ্যাকখ্যাক করে হেসে বলল,

“যেখানে গর্জে ওঠার সেখানে গর্জাতে পারো না। বুদ্ধি থাকলে এইরকম ঘরে পঁচে মরতাম না আমরা। ”

“কেন? কী নির্বোধের মতো কাজ করেছি আমি?”

“সেটা তোমাকে বলে বুঝাতে হবে? ”

আকাশী চুপ করে রইলো। সবজিগুলো পড়ে রইলো অমনই। শুভ আর ওর মা চায় আকাশী বাবার হাতে পায়ে ধরে টাকা পয়সা এনে শুভকে দিক। লাখ পাঁচেক টাকা হলে ও ব্যবসা শুরু করতে পারবে। ঠিকঠাক গুছিয়ে চাকরি ওর পক্ষে সম্ভব না। কোথাও স্থায়ী হতে পারে না। একটা না একটা ঝামেলা লেগেই যায়। আকাশীর কাছে সত্তর হাজার টাকা আছে অবশ্য। দুই ঈদে ভাবী কিছু টাকা দিয়েছিলেন। পার্লারে কাজ ছাড়াও দুটো টিউশনি ছিলো। সেখান থেকে জমিয়েছে টাকাটা শুভ কে দেবার জন্য। প্রায় দুই বছর ধরে জমানো টাকা৷ ইদানীং শুভর সঙ্গে সম্পর্কের সমীকরণ বদলে গেছে বলে ও সেসব জানাচ্ছে না। সেই সঙ্গে আছে শুভর মায়ের মানসিক টর্চার। তাদের উদ্দেশ্য এখন আকাশীর কাছে পরিষ্কার। ইশ! বাবা ঠিক এমন কথাই বলেছিল। ও মানতে চায় নি। তার ফল এখন ভোগ করছে।

শুভ আকাশীকে বসে থাকতে দেখে বলল,

“আজ কী রান্না হবে?”

আকাশী কঠিন গলায় বলল,

“না।”

“ঢং কোরো না তো। রোজ রোজ ঢং ভালো লাগে না।”

“নিজের টা নিজে করে খাও। ”

শুভ আবারও বলল,

“যার কোথাও যাবার জায়গা নেই সে এতো রাগ দেখায় কিভাবে? কোথাও একবেলা ভাত জুটবে? এমন একটা জায়গা দেখাও তো। ”

আকাশীর চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝড়ছে। উঠে দাঁড়িয়ে ঝড়ের গতিতে নিজের জামা কাপড়, প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে নিলো। শুভর ঠোঁটে তীর্যক হাসি। সবকিছু গুছিয়ে শুভর দিকে তাকিয়ে বলল,

“আজীবনের জন্য যাচ্ছি। ”

শুভ ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলল,

“আজীবন! ”

আকাশী উত্তর দিলো না। তিন বছর আগে যেমন বাড়ি থেকে চলে এসেছিল, আজও তেমন বেরিয়ে গেল।

চলবে….

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-৭
শ্রাবণ্য ডিপার্টমেন্টের সামনে আকাশী কে দেখে উল্টো পথে হাটা শুরু করলো। আকাশী পিছু পিছু ছুটলো। দৌড়ে গিয়ে শ্রাবণ্যর পথ আটকালো। ও কিছু বলার আগেই শ্রাবণ্য বলল,

“আমি তোর কোনো কথা শুনতে চাই না। ”

আকাশী অনুনয় করে বলল,

“পাঁচ টা মিনিট সময় দে আমাকে বনু। পাঁচ মিনিটের বেশী লাগবে না।”

শ্রাবণ্য এদিক ওদিক তাকালো। এমনিতেই ওর বিয়ে নিয়ে অনেক লোক নতুন গসিপের টপিক পেয়ে গেছে। ও বলল,

“এখান থেকে চল। এখানে আর নাটক না হোক। ”

ওরা ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে খানিক দূরের রেস্টুরেন্টে বসলো। এখন সময় টা দুপুরের খাবার সময় নয়। আকাশী বলল,

“কিছু খা। তোর মুখ টা শুকনো লাগছে। সারাদিনে কিছু খাস নি?”

শ্রাবণ্য মেঘস্বরে বলল,

“ঢং করিস না আপু। তুই কেন আসছিস বল তো!”

আকাশীর খারাপ লাগলো না। ওর কারণে শ্রাবণ্যর জীবন টা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়েছে। বাবা ও’কে যে স্বাধীনতা দিয়েছেন সেটা শ্রাবণ্যকে দেন নি। উল্টো সার্বক্ষণিক লোক ছিলো ওকে দেখার জন্য। শ্রাবণ্য সেটা প্রথম দিকে টের পায় নি। একদিন আফরিনের সঙ্গে নিউমার্কেট গেল, দশটা দোকান ঘুরে ওড়না, পায়েল, ক্লিপ কিনলো। সেদিন ই বাবা ফোন করে খোঁজ নিলেন। কথায় কথায় বললেন,

“তোমার কাজ হচ্ছে পড়াশোনা করা। দোকানে দোকানে হাটা না। জামাকাপড় সহ বাদ বাকী সব জিনিস তোমার মা কিনে দিবেন।”

শ্রাবণ্যর উচিত ছিলো সেদিনের পর সতর্ক হওয়া। বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে নিজেকে নির্বোধ প্রমাণ করার কোনো দরকার ছিলো না।

আকাশী গভীর মমতা নিয়ে ছোট বোনের দিকে তাকিয়ে আছে। নাকে সাদা পাথরের দুল টার কারনে চেহারার ধরন টা একটু অন্যরকম লাগলেও আর কিছু বদলায় নি। বলল,

“কেমন আছিস বনু?”

শ্রাবণ্য তাকিয়ে রইলো। আকাশী এই প্রশ্ন টা কেন করলো! ও কতটুকু খারাপ আছে সেটা জানার জন্য! নতুন পরিবেশ, নতুন কিছু মানুষ হলেও ও তো খারাপ নেই। তবুও বলল,

“আমার ভালো থাকার খবর কারোর রাখার দরকার নেই। সবাই নিজের মতো ভালো থাকুক। ”

আকাশী অতি সন্ত:র্পনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ও কতটুকু ভালো আছে সেটা তো কেবল ও জানে। শুভর ওখান থেকে বেরিয়ে এসেছে দুদিন। এর মধ্যে একবারও শুভ ফোন করে নি। আকাশী ফোন করে মিনা ভাবীর কাছে খোঁজ নিয়ে জেনেছে শুভর সব ঠিকঠাক ই চলছে। চা করে খাচ্ছে সকাল বিকাল। গতকাল রাতে বেহায়ার মতন মিনা ভাবীর কাছে ভাত খেতে চলল।

আকাশী নিজের কথা শ্রাবণ্য কে বলল না। ও নিজের চেয়ার টা এগিয়ে শ্রাবণ্যর কাছাকাছি বসে ও’কে জড়িয়ে ধরলো। শ্রাবণ্য বোনের এই আদরটুকু অস্বীকার করলো না, নিজে থেকে আকাশীকেও জড়িয়ে ধরলো না।

***
স্বপ্নীল একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে ইন্টার্নশিপের অফার পেয়েছে। ছয়মাসের ইন্টার্নিশিপ। এর আগেও কয়েকটা কোম্পানির অফার ছেড়েছে। ওর আবার এসবে ভয় হয়। এসব জায়গায় একটু বেশি স্মার্ট লোকজন থাকে। তাদের সামনে গুছিয়ে কথা বার্তা না বলতে পারলে আবার প্র‍্যাস্টিজ থাকবে না৷

রঙ্গনা শসা চিবুতে চিবুতে বলল,

“তোর কী প্ল্যান? মায়ের হাতে খেয়ে বউয়ের কোলে শুয়ে পড়ার?”

স্বপ্নীলের মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে রঙ্গনার উপর কঠিন রাগ করতে। কিন্তু সেটা পারে না। কারণ ওর কঠিন রাগ হচ্ছে খানিকক্ষণ ঘো ঘো শব্দ করে নিজের চুল টানা, এটা ওটা ছুড়ে ফেলা। আর শেষকালে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলা। তবুও আজ স্বপ্নীল রঙ্গনা কে কঠিন গলায় বলল,

“তুমি আমাকে আজেবাজে কথা বলবে না ছোটপা। ”

রঙ্গনা সেটার জবাব না দিয়ে বলল,

“শোন, এভাবে ঘরে বসে থাকলে কিছুই হবে না। যে মেয়েটাকে বিয়ে করেছিস নাচতে নাচতে সেই মেয়েটা তোকে দুই আনার দামও দিবে না। ”

স্বপ্নীল সেকথার জবাব দিলো না। ওর পেটের মধ্যে গুড়গুড় করছে। পরীক্ষার সময় এমন হতো।

রঙ্গনা স্বপ্নীল কে দেখলো। এই ছেলেটা সারাজীবন শুধু পড়াশোনা করেই গেল। মা, বুবুর অতি আদরে ছেলেটা বাইরে সহজ হলো না। ছেলে মানুষ হবে বেপরোয়া, সারা দুনিয়া চষে বেড়াবে। তা না করে ঘরে বসে থাকে। আড্ডা পর্যন্ত দেয় না। পঁচিশ বছর হলো আজ অবধি মনে হয় সিগারেটও খায় নি। একটা প্রেমে পড়লো, তাও আবার বেঠিক মানুষের।

রঙ্গনার স্বপ্নীলের জন্য মায়া হয়। তুলির মতোই মায়া হয়। তবে ওর সেটা দেখাতে ইচ্ছে করে না। ওর সবসময় ই স্বপ্নীল কে বকাবকি করতে ইচ্ছে করে।

***
মিশুক আজকে খেতে এলো নিচে। দাদু ও’কে বলেছে সবার সঙ্গে বসে খেতে। মিশুক প্রথমে বলেছিল দরকার নেই। ওখানেই ঠিক আছে। একা খেতে খারাপ লাগে না। কিন্তু শিলার এই স্নেহ টুকু ফেরাতে পারলো না।

খাবার টেবিলে তুলি শ্রাবণ্যর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো। বলল,

“ও শ্রাবণ্য, আমার ভাইয়ের বউ। স্বপ্নীলের সঙ্গে তো আপনার আলাপ আছে। ”

মিশুক হেসে বলল,

“হ্যাঁ। স্বপ্নীল তো ভীষণ ভালো ছেলে। ”

তুলি এবার রঙ্গনার দিকে তাকিয়ে বলল,

“ও আমার ছোট বোন। স্বপ্নীলের বড়। ”

কথাটা বলে ঠোঁট চেপে হাসি আড়াল করলো। মিশুক তুলির দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বলল,

“ওনার সঙ্গেও আলাপ হয়েছে। ”

রঙ্গনা ফিরেও তাকালো না মিশুকের দিকে। ও ওর মতো খেতে লাগলো।

তুলি মনে মনে ভাবলো, দাদুর প্ল্যান এবারও ফেল করবে। এরা দুজন দুজন কে জীবনেও পছন্দ করবে না।

***
বিছানায় ওরা ঘুমায় উল্টোভাবে। শ্রাবণ্য যেদিকে পা দিয়ে ঘুমায় স্বপ্নীল সেদিকে মাথা দেয়। ঘুমে অবশ্য দুজনের কারোরই সমস্যা নেই। তবে স্বপ্নীলের শুরুর দিকে ঘাড় ব্যথা হতো। এখন সেটা সয়ে গেছে।

শ্রাবণ্য খাবার পর দুই ঘন্টা পড়ে। স্বপ্নীল সেই সময়ে ল্যাপটপে সিরিজ দেখে। চোখ যখন ক্লান্ত হয়, তখন ঘুমাতে যায়৷

স্বপ্নীল ঘরে ঢুকে বলল,

“তোমার জন্য বই এনেছি। তুমি বই খুঁজছিলে না সেদিন। ”

শ্রাবণ্য বইটা হাতে নিলো। ওর ভীষণ পছন্দের উপন্যাস সাতকাহন। হোস্টেলে একজনের থেকে ধার করে পড়েছিল। নীলক্ষেতে যেগুলো পেয়েছিল ওগুলোর ছাপা অক্ষর স্পষ্ট না। শ্রাবণ্য বইটা হাতে নিয়ে বলল,

“থ্যাংক ইউ। একবার পড়া বই, অথচ আবারও পড়তে ইচ্ছে করছে।”

“তোমার না পরীক্ষা। পরীক্ষার পর পড়বে।”

শ্রাবণ্য হাসলো। স্বপ্নীল বলল,

“আরেকটা জিনিস এনেছি তোমার জন্য। ”

“কী?”

স্বপ্লীল একটা প্যাকেট দিলো। দুটো স্টোনের হিজাব পিন। একটা গোলাপি রঙের, শ্রাবণ্যর ওই রঙের হিজাব আছে। ও মুগ্ধ গলায় বলল,

“খুব সুন্দর। থ্যাংক ইউ।”

স্বপ্নীল খুশি হলো। খুশি হলে ও চোখ নামিয়ে নিয়ে ঠোঁট চেপে হাসে। শ্রাবণ্য সেদিন হিজাব পিন হারিয়ে ফেলেছিল। এজন্য আজ ও সামনে পেয়ে কিনেছে। দুজনের জন্যই এটা সুন্দর এক অনুভূতি। তবে কেউ কারও প্রেমে পড়ে নি বলে অনুভূতিটুকুর মূল্য বুঝলো না। যদি ওরা একে অপরের প্রেমে পড়ে তবে এই মুহুর্ত টা’কে দুজনেই মনে রাখবে।

চলবে….

কুসুম কাঁটা পর্ব-০৫

0

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-৫
শ্রাবণ্য রঙতুলিতে মানিয়ে নিলো কয়েক দিনেই। বাড়ির লোকগুলো ভালোই। শিলা, তুলি, দাদী সবাই ই ও’কে ভালোবাসেন। দাদু মানুষ টা গম্ভীর। শ্রাবণ্যর সঙ্গে যখনই দেখা হয় গম্ভীর গলায় কথা বলেন। দাদী অবশ্য দাদুর নামে শ্রাবণ্যকে নিন্দে করেছেন। বলেছেন,

“বুঝলা ভাবী, লোকটা হইলো গিয়া একটা খাটাশ। আমার বাপে ভালো দেখে বিয়া দিছে। আমি তো জানি কী ঘাউড়া লোক। তবে জীবনে কোনোদিন বাপের বাড়ি গিয়া ব্যটার বদনাম করি নাই৷ আমার বুড়া বাপ কষ্ট পাবে তাই৷ ”

শ্রাবণ্য হেসে ফেলে। বলে,

“আপনি আমাকে নাম ধরে ডাকুন দাদী। ”

“নাম ধরে তো তোমারে সবাই ই ডাকে। কিন্তু ভাবী ডাকার কেউ তো নাই তাই আমিই তোমাকে ভাবী ডাকলাম। ”

শ্রাবণ্য হাসে। মানুষগুলো ভীষণ ভালো। এমনিতে অন্যদের সাথে মন্দ কিনা তাতে ওর কিছু যায় আসে না। ওর সঙ্গে ভালো হলেই হবে। এই বাড়িতে দাদু ছাড়া বাকীদের কাছে স্বপ্নীল ভীষণ প্রিয়। মা এখনো সুযোগ পেলে স্বপ্নীল কে ভাত মেখে খাইয়ে দেয়। ছেলেটাও এই বয়সে মায়ের হাতে ভাত খায়।

স্বপ্নীল তুলিকে বুবু ডাকে বলে শ্রাবণ্যও বুবু ডাকে। তুলিরও যে ভাইয়ের প্রতি দূর্বলতা আছে সেটা ও বুঝতে পেরেছে।

তবে এই বাড়িতে মন্টি, রিন্টি শ্রাবণ্যকে ভীষণ বিরক্ত করে। ওর লিপস্টিক ভেঙে ফেলেছে, নেইল পলিশের বোতলে পানি দিয়েছে।

এছাড়া আরও আছে মালেক মামা। উনি স্বপ্নীলের নিজের মামা নন। শিলার দু:সম্পর্কের ভাই প্লাস বাড়ির কেয়ারটেকার। বাড়ির সমস্ত দেখাশোনা সে করে। তিনি বাচাল স্বভাবের মানুষ। শ্রাবণ্যর সঙ্গে একদিন কথা হয়েছিল। ও’কে ভার্সিটিতে দিয়ে আসার জন্য গিয়েছিল। সারা রাস্তা লোকটা এতো কথা বলেছে যে ওর মাথা ব্যথা শুরু হয়ে গেছে।

রান্নার কাজে সাহায্য করেন বাতাসী খালা। তার খুব মেজাজ। তিনি মালেক মামাকে একদম পছন্দ করেন না। তাকে ডাকে কাইল্যা ব্যডা সম্বোধনে। অথচ লোকটার গায়ের রঙ ফর্সা। ওনার স্বভাব হচ্ছে সবার ই কম বেশী বদনাম করা। বেশীরভাগ সময়েই বদনাম শুরু করে তার ছেলে আর ছেলের বউকে নিয়ে। তারপর আস্তে আস্তে এই বাড়ির লোকেরা এসে যায়। এই বাড়িতে তিনি কাজ করেন তেরো বছর ধরে। বলতে গেলে বাড়ির সদস্যই।

***
আজ প্রথম শ্রাবণ্যর দেখা হলো রঙ্গনার সঙ্গে। ও’কে ভোরবেলা ঘুম থেকে তুলল স্বপ্নীল। বলল,

“একটু ওঠো। ছোটপা এসেছে। ”

শ্রাবণ্য বুঝতে না পেরে বলল,

“কে এসেছে?”

স্বপ্নীল গলা নামিয়ে বলল,

“আমার ছোটপা। ওর আবার রাগ বেশী। একটু ওঠো। ”

শ্রাবণ্য উঠতেই স্বপ্নীল দরজা খুলে দিলো। রঙ্গনা ভেতরে ঢুকে বলল,

“কই দেখি, দেখি নতুন বউকে দেখি। ”

শ্রাবণ্যর সঙ্গে রঙ্গনার এই প্রথম দেখা। রঙ্গনা দেখতে তুলির মতো সুন্দরী না। কাঁধ পর্যন্ত কোকড়া চুল। পরনে কালো শার্ট আর জিন্স। রোগা, পাতলা। গায়ের রঙ টা শ্যামলা ধরনের। রোদে পুড়ে কালো হয়ে গেছে। শ্রাবণ্য আপদামস্তক রঙ্গনা কে দেখলো। দাদি রঙ্গনার গল্প করেছে শ্রাবণ্যর সঙ্গে। লক্ষ্মীছাড়া মেয়ে, কারোর কথা শোনেনা। শ্রাবণ্য সালাম দিলো। রঙ্গনা সালামের জবাব দিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,

“কোন সাবজেক্টে পড়ছ?”

“ইতিহাস। ”

“থার্ড ইয়ার?”

শ্রাবণ্য মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। স্বপ্নীল চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণ্যর পাশে। রঙ্গনা আর প্রশ্ন করলো না। স্বপ্নীল কে বলল,

“তুই একটু আমার সঙ্গে আয়। ”

তারপর শ্রাবণ্যর দিকে তাকিয়ে বলল,

“তুমি ঘুমাও। ”

শ্রাবণ্য মৃদু হেসে মাথা নাড়লো।

***
রঙ্গনা স্বপ্নীল কে বাইরে নিয়ে গিয়ে বলল,

“দাদু তোর জোর করে বিয়ে দিয়ে দিলো কী করে?”

স্বপ্নীল কি বলবে বুঝতে পারছে না।

“কথা বলছিস না কেন? জোর করে কাউকে বিয়ে করানো যায়? কেমন ছেলে তুই? দুইবেলা জুতাপেটার উপর রাখতে হবে তোকে। একটা মানুষ কে কী করে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে করানো যায়!”

স্বপ্নীল চুপ করে রইলো। এমন বড় কথা আসলে রঙ্গনাই বলতে পারে। দাদু তার উপর জোর খাটায় নি। স্বপ্নীল কে তো এক ধমকেই রাজী করে ফেলেছে। অবশ্য মায়েরও এখানে গুরুত্ব কম না। তিনিও মাথায় হাত বুলিয়ে বুঝিয়ে পাঠিয়েছেন। তখন ওর মন টাও তো ভালো ছিলো না। নীলার ব্যাপার নিয়ে আপসেট ছিলো। এসব আসলে রঙ্গনাকে বলে ওর লাভ নেই। রঙ্গনা যুক্তি তর্কের ধার ধারে না।

রঙ্গনা আবারও বলল,

“চুপ করে আছিস কেন? বউ খুব মনে ধরেছে?”

স্বপ্নীল রঙ্গনার খোঁচা টা বুঝতে পারলো না। ও অবশ্য একটু বেখেয়ালে ছিলো। তবুও মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

রঙ্গনা হতাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এখন ওর যে কথাটা বলতে ইচ্ছে করছে সেটা স্বপ্নীল কে বলা ঠিক হবে না। বড় বোন বলে সংযত হলো। বলল,

“যা এখন। ”

রঙ্গনা ঘুরতে গিয়েছিল টেকনাফ। এমন এক অঞ্চলে গেছে যেখানে নেটওয়ার্ক পায় না। বাড়িতে কথা হয় নি তিন দিন। তিন দিন পর ফোন করে এই খবর শুনে ওর মাথাটা গরম হলো। তারচেয়েও বেশি মেজাজ খারাপ হলো স্বপ্নীলের উপর। বেকার ছেলে বিয়ে করে বসে আছে। এক ফোঁটা লজ্জা নেই।

***
শ্রাবণ্যর আর ঘুম হলো না। স্বপ্নীল ল্যাপটপ নিয়ে বসলো। ও সবসময়ই সকালে ওঠে। অনেক দিনের অভ্যাস বলে বেশী ঘুমানোর বদ অভ্যাস নেই। শ্রাবণ্য বলল,

“আপনার ছোট আপু একটু রাগী না?”

“একটু না, খুব। ওর কথাবার্তা খুব খারাপ। নিচের বস্তিতে ঝগড়া হলে যেসব পঁচা গালি দেয়, সেগুলো ও জানে। ”

শ্রাবণ্য শব্দ করে হেসে ফেলল। স্বপ্নীল নিজেও হাসলো। শ্রাবণ্যর সঙ্গে ওর কথা বলতে ভালো লাগে৷ ওর অবশ্য সবার সঙ্গেই কথা বলতে ভালো লাগে কিন্তু ও’কে তেমন কেউ পাত্তা দেয় না। বলে ওর সেন্স অফ হিউমার কম। কিভাবে সেন্স অফ হিউমার বাড়ানো যায় এই নিয়ে ইন্টারনেটে অনেক ঘাটাঘাটি করেছে। নীলক্ষেত থেকে একশ টাকায় একটা বইও কিনেছিল। সেগুলো দিয়ে লাভের লাভ কিছু হয় নি।

শ্রাবণ্য সেদিক দিয়ে ব্যতিক্রম। এখনো পর্যন্ত ও’কে একবারও বলে নি যে ও বোরিং। ওর কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনে।

“তুমি আজ ভার্সিটিতে যাবে না?”

“যাব। আপনি আমার একটা উপকার করতে পারবেন? ”

“হ্যাঁ পারব।”

“দাদুকে বলবেন যে মালেক মামাকে আমার সঙ্গে যাবার দরকার নেই। আমি একাই যেতে পারব। উনি এতো কথা বলেন যে আমার মাথা ধরে যায়। ”

“দাদু শুনবে না। তবে আমি তোমার সঙ্গে যেতে পারি। দাদু তাতে কিছু বলবে না। ”

“আচ্ছা তাহলে আপনিই চলুন। ”

স্বপ্নীল একটু খুশিই হলো। এই বাড়িতে মা আর বুবুর পর আরেকজন ও’কে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে।

***
বাতাসী খালা নাশতার প্লেট নিয়ে উপরে গেল। মিশুক কে সে ভাইজান বলে ডাকছে। মিশুক অপ্রস্তুত গলায় বলল,

“খালা নাম ধরে ডাকুন। ভাইজান বলে ডাকতে হবে না। ”

খালা শুনছেন না। তিনি যতবার ভাইজান বলেন ততবার অস্বস্তিতে পড়ে। এত বয়স্ক একজন মানুষ ও’কে ভাইজান বলে ডাকছেন।

এই বাড়ির খাবার ভালো। এরা অতিরিক্ত তেল খায় না। এর আগে যে বাসায় ছিলো সেখানে দুদিন পর পর ই কঠিন ডাইরিয়ায় ভুগতে হতো।

বাতাসী খালা মিশুক কে খাবার টা দিয়ে পাশের রুম পরিস্কার করতে গেল। কিছুক্ষন পর এসে বলল,

“ভাইজান একটা কথা, আপনি বিয়ে করবেন না?”

মিশুক শুকনো কাশলো। বাসা বাড়ির খালারা বেশ ভালো ঘটকালিও করেন আজকাল। এসব করে দুই পক্ষের থেকে বড় অংকের টাকা পায়। সাইড বিজনেস বলা যায়।

মিশুক বলল, ওরকম কিছু ভাবিনি। সময় আরও একটু যাক। নিজেকে গুছিয়ে নেই।

“ভাবা উচিত। আপনার বিয়ার বয়স হইছে। ”

মিশুক চুপ করে রইলো। এই ব্যাপারে যত কম কথা বলা যায় ততই ভালো। নাহলে উনি আরও কথা বাড়াবেন।

খালা বললেন,

“আপনে এমন ফর্সা মানুষ, আপনের উচিত একটা শ্যামলা মাইয়া বিয়া করা। ভালো মানাইব আপনের পাশে। ”

মিশুক উঠে গেল। ফোন হাতে নিয়ে বারান্দার দিকে গেল। ভাব করলো যে ওর গুরুত্বপূর্ণ ফোন এসেছে।

বাতাসী খালা হাল ছাড়লেন না। তিনি কাজে মন দিলেন। খালুজান তাকে একশ টাকা দিছে। এই ব্যটার মনের খবর জানার জন্য৷ এই ব্যটার অন্য কোনো জায়গায় লাইন আছে কি না।

চলবে….

(নিয়মিত পাঠক রা সাড়া দিবেন।)

কুসুম কাঁটা পর্ব-০৪

0

#কুসুম কাঁটা
#পর্ব-৪
আফতাব সাহেব চশমার ফাঁক দিয়ে ছেলেটাকে আপদামস্তক দেখলেন। দেখতে বেশ ভদ্রই মনে হচ্ছে। সরাসরি তার চোখের দিকেই তাকিয়ে আছেন। এমন ছেলেদের আত্মবিশ্বাস প্রখর হয়।

“বাড়ি যেন কোথায় বললে?”

“হালিশহর। ”

“পড়াশোনা? ”

“পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ”

“চাকরি ঢাকায়? ”

“জি। ”

“বাড়িতে কে কে আছে?”

“মা, বাবা আর আপু। ”

“বোনের বিয়ে হয়ে গেছে?”

ছেলেটা এবার বিরক্ত হলো৷ পেয়িং গেস্ট আবশ্যক বিজ্ঞাপন দেখে এসেছে৷ অথচ প্রশ্ন করছে বিয়ের বাজারে পাত্রকে যেমন প্রশ্ন করা হয় তেমন।

ছেলেটার নাম মিশুক। একটা রিসার্চ ফার্মে চাকরি হয়েছে রিসেন্টলি। সেই সূত্রেই এখানে আসা। ঢাকায় ভাড়া বাসায় থাকার চেয়ে পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকার সুবিধা আছে। মিশুক হোটেলের খাবার তেমন খেতে পারে না। তাই খাবার ঝামেলা এড়াতে বিজ্ঞাপন দেখে এসেছে৷

আফতাব সাহেব আবারও প্রশ্ন করলেন,

“তোমার বয়স এখানে যেমন দেয়া আছে সেটা কী আসল বয়স?”

মিশুক এবার বিরক্তি প্রকাশ করে জিজ্ঞেস করলো,

“আপনাদের এখানে থাকার জন্য সেটা জানানোও জরুরী?”

আফতাব সাহেব চশমার ফাঁকে আবারও একবার ছেলেটাকে দেখলেন। তিনি ওর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তুলিকে ডেকে বললেন,

“তুলি তিনতলার ডানদিকের চাবিটা নিয়ে আয় তো। ”

তুলি চাবি নিয়ে এসে বলল,

“দাদু তুমি এখানে থাকো। আমি ওনাকে নিয়ে যাচ্ছি। ”

***
তিনতলার ডানদিকের ফ্ল্যাট টা ছোট। দুই রুম, ড্রয়িং রুমের সঙ্গে ডাইনিং স্পেস। আর ছোট রান্নাঘর।

মিশুক জিজ্ঞেস করলো,

“এখানে থাকব?”

তুলি রুমদুটো খুলে দিয়ে বলল,

“দেখুন কোন টা পছন্দ হয়?”

মিশুক বড় রুম টা পছন্দ করলো। বারান্দাটাও সুন্দর। রুমে একটা খাট, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল রাখা। দেখেই বোঝা যায় নিয়মিত পরিষ্কার করে রাখে। মিশুকের পছন্দ হলো। বলল,

“পাশের রুমে কেউ থাকে না?”

“আমার ছোট বোন বাড়িতে এলে থাকে। আর মাঝেমধ্যে গেস্ট রা এলে। ”

“আচ্ছা। ”

“আপনার পছন্দ হয়েছে?”

“হ্যাঁ। ”

“টাকা পয়সার ব্যাপারে দাদুর সঙ্গে কথা বললেই হবে। আর রাতের খাবার আমরা সাড়ে নয়টায় খাই। আপনি চাইলে আগে খেতে পারবেন। চাইলে আমাদের সঙ্গে নিচেও খেতে পারবেন। ”

মিশুক স্মিত হেসে বলল,

“থ্যাংক ইউ। ”

“ঘর পরিষ্কার করবে আমাদের খালা। চাইলে কাপড়ও পরিষ্কার করবে। তবে এর জন্য আলাদা চার্জ লাগবে না। ”

“আচ্ছা। আমি কী যেকোনো দিন শিফট করতে পারব?”

“জি। আমাদের তাতে সমস্যা নেই। ”

“আচ্ছা। ”

তুলি নিচে নেমে এলো। দাদুর পাগলামী গেল না। রঙ্গনার জন্য পাত্র খোঁজে এভাবে। কতজন যে এমনি করে গেল! কেউই শেষমেস দাদুর মনমতো হয়ে উঠতে পারে না। আর রঙের কথা তো কিছু বলার ই নেই।

***
স্বপ্নীলের এখানে ভালো লাগছে না। সারাদিন খাওয়ার উপর থাকতে হয়। সকালে নাশতা খাবার পর পর ই শ্রাবণ্যর ভাবী এক থালা ভাপা পিঠা নিয়ে এলো। ভরা পেটে দুটো পিঠা খেতেই ওর কষ্ট হয়ে গেল। দুপুরে দশ পদের আইটেম দেখে ও একটুর জন্য অজ্ঞান হয় নি। মাছের মাথাটা যখন পাতে তুলে দিলো তখন ও শ্রাবণ্যর দিকে তাকালো। ও নিজের খাওয়ায় ব্যস্ত। স্বপ্নীলের দিকে ফিরেও তাকালো না। স্বপ্নীল এতো খাওয়া জীবনে খায় নি৷ বাড়িতেও অল্প খায়। এতসব খাবার দেখে ওর বলতে ইচ্ছে করে, আমাকে এসব না দিয়ে একটা ডিম ভাজী করে দেন। নাহলে এক পিস মাছ ভেজে সঙ্গে একটু পাতলা ডাল দিন। এক প্লেট ভাত আমি পেট ভরে খেতে পারব।

খাওয়া দাওয়ার এই অত্যাচার থেকে বাঁচতেই শ্রাবণ্যকে বলল,

“আমরা ঢাকায় ফিরব কবে?”

শ্রাবণ্য ঠোঁট উল্টে বলে, আপনার যেদিন ইচ্ছে।

“তুমি একটু বলো। আমার এখানে সমস্যা হচ্ছে। ”

“আপনি বলুন। আমি বললেও শুনবে না। এখানে আমার দাম দুই পয়সাও না। ”

স্বপ্নীল মনে মনে বলল,

“নিজের বাড়িতে কারোরই দাম থাকে না। দাদু এখনো সবার সামনে আমাকে গরু, গাধা বলে। ”

শ্রাবণ্য বলল,

“আপনি বাবাকে বলুন আর্জেন্ট কাজ আছে। ”

“শ্রাবণ্য, বড়দের সামনে আমি মিথ্যে বলতে পারি না। ”

শ্রাবণ্য হেসে ফেলল। বলল,

“ছোটদের সামনে পারেন?”

“ওভাবে গুছিয়ে পারি না। মিথ্যে বলাও আসলে একটা আর্ট। ”

শ্রাবণ্য মনে মনে ভাবলো, কী বোরিং মানুষ! ও যাদের সাথে মিশতো তারা কেউই এমন ছিলো না।

***
শ্রাবণ্য ভাবীকে যাবার কথা বলল। স্বপ্নীলের কাজ আছে শুনে বাবা, মা’ও আপত্তি করলেন না। শ্রাবণ্যরা সেদিন বিকেলেই রওনা হয়ে গেল। রেহানা দেখলেন, মেয়ে তার সাথে অতো বেশী কথা বললেন না। সারাদিন ঘরেই থেকেছে। বাইরে যেটুকু সময় থেকেছে সেটাও শিউলির আঁচল ধরে। স্বপ্নীলের সঙ্গে কেমন কী ভাব হলো সেটাও জানতে পারলেন না। তবে মেয়ের অভিমান বুঝলেন। অভিমান করলে করুক, বিয়ে দিয়েছেন ভালো করেছেন। ওর বাবার সিদ্ধান্ত কী আর ভুল হবে! এমনিতেই একজন যা ডোবানোর ডুবিয়ে গেছে। বাড়ির নাম খারাপ করেছে, বাপের মান খুইয়েছে। কতো আদরের মেয়ে ছিলো আকাশী। বাবা পাতের খাবার তুলে মেয়েকে দিতেন। সেই মেয়ে বাপের বুকে লাত্থি মেরে একটা ছোটলোকের সঙ্গে গেছে। একটা বার কারোর কথা ভাবে নি।

শ্রাবণ্য যাবার পর রেহানা শিউলি কে বললেন,

“শ্রাবণ্যর কানে ইচ্ছেমতো আমার বিষ ঢালতে পারছ তো?”

শিউলি বিস্মিত গলায় বলে,

“কী বলছেন মা?”

“সারাক্ষন তো তোমার আঁচল ধরেই ছিলো! ”

শিউলি স্মিত হেসে বলল,

“যে আঁচলে স্নেহ পাবে সেখানেই তো ঘুরবে মা।”

রেহানার গলার স্বর আরও রুক্ষ হয়। বলেন,

“আমার মেয়ের জন্য আমার চেয়ে তোমার দরদ বেশী?”

“তর্কে যাব না মা। তবে আপনারা আকাশীর শাস্তি কম বেশি ও’কেই দিয়েছেন। ”

রেহানার চোখ দিয়ে যেন আগুন বেরোচ্ছে। পারলে শিউলিকে এক থাপ্পড় দিতেন। মুখে মুখে তর্ক করা শিখেছে বে*য়াদব মেয়ে।

শিউলি শাশুড়ীর রাগ দেখেও চুপ করে রইলো। সত্যি সবসময় তেতো হয়। সেটা সবাই নিতে পারে না।

***
শুভ’র সঙ্গে আকাশীর দুটো ভালো কথা হলে দশ টা হয় মন্দ কথা। আকাশী যাই করে শুভর সেটা অপছন্দ। ও চায় প্রতি মাসে বেতনের সব টাকা আকাশী ওর হাতে তুলে দিক। তারপর নিজের ইচ্ছেমতো খরচ করুক। ইনকাম শুরুর প্রথম দিকে এমন ই করতো। কিন্তু পনেরো তারিখের পর দেখা যেত সংসারে অভাব লেগে আছে। ভর্তা ভাতের যোগান দিতেও হিমশিম খেতে হয়। এরপর থেকে আকাশী টাকা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বলেছে নিজে সংসার চালাবে।

পরশু রাতে ঝগড়া হলো খুব ই তুচ্ছ বিষয় নিয়ে। মাংসের বাটিটা দেখেই শুভ বিরক্ত গলায় বলল,

“আম্মা আজও ভাত খাইছে পাটশাক দিয়া। আর আমরা মাংস খাইতেছি। ”

আকাশীর মেজাজ খারাপ হলো। অমন শাক ভাত ওরাও কম বেশী খায়। কোনো কোনো দিন শুধু মসুর ডাল দিয়েও আকাশী ভাত গিলেছে। সংসারে অমন টানাপোড়েন যে হয় সেটা ও গত তিন বছরে বুঝেছে। তবুও শুভ’র ওই খোঁচা দেয়া স্বভাব যায় না।

আকাশীর নিজের কিছু খরচ আছে। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির পড়া বাদ দিয়ে ন্যাশনালে পড়ছে। গ্রাজুয়েশন এর সার্টিফিকেট হলে একটা চাকরিও জুটবে। পার্লারে গাধার খাটুনি আর ভালো লাগে না। শুভ সেটা বুঝবে না, ও শুধু নিজের টা বোঝে।

তিন বছর আগে যে ভালোবাসার জন্য ও বাড়ি ছেড়েছিল সেখানে আজ অশান্তি, ঝামেলা ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। জীবনের রঙ হারিয়ে গেছে। শুধু মনে হয় দিনগুলো কোনোরকম কেটে গেলেই হয়। রাতটা যেন না কাটে, নতুন একটা দিন শুরু যেন নাহয়। আবার তো সেই ঝামেলা। তারচেয়ে গভীর, নিশ্চুপ রাতে ঘুমিয়ে থাকুক। শান্তি তো শুধু ওইটুকুতেই পাওয়া যায়।

***
শ্রাবণ্যর এখন জেদ নিজের সঙ্গে। ওদের কলেজের প্রিন্সিপাল স্যার একবার বলেছিলেন, এই জগতে সবচেয়ে বেশী সাকসেসফুল তারাই হয়, যারা জেদের সঙ্গে আপোষ করে না। বাবার কথামতো নীরবে বিয়ে করেছে। জন্মদাতা, জন্মদাত্রীর প্রতি দায় এড়াতে কোনো সন্তান ই পারে না। ও পারে নি। তবে তাদের কাছে প্রত্যাশা নেই কিছুই৷ এখন ও শুধু নিজেকে নিয়ে ভাববে।

স্বপ্নীল মোবাইলে সময় দেখতে গিয়ে দেখলো শ্রাবণ্য কাঁদছে। ও হতভম্ব গলায় বলল,

“এই তোমার কী হয়েছে?”

শ্রাবণ্য চোখের পানি মুছে বলল,

“কিছু না। ”

স্বপ্নীলের লজ্জা লাগছিল। নাহলে ও শ্রাবণ্যর চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলতো,

“থাক কেঁদো না। আমি তো আছি। ”

স্বপ্নীল মনে মনে বলে, না আমি আছি কই! এই কথা তো শুধু পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি যাকে দেয়া যায় তাকে বলা যায়।

ওদিকে শ্রাবণ্য মনে মনে ভাবে, এই বিয়ে আমি মানব না। সুযোগ আর সময় আসলে আমি বেরিয়ে যাব এই সম্পর্ক থেকে। জোর করে চাপিয়ে দেয়া সম্পর্ক আমি জীবনেও মানব না। অনুশোচনার আগুনে সবাই সেদিন জ্বলবে।

দুজনের মনের কথা কেউই কাউকে বলতে চায় না। অবচেতন মন বাঁধা দেয়।

চলবে….

সাবিকুন নাহার নিপা

কুসুম কাঁটা পর্ব-০৩

0

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-৩
শ্রাবণ্য বাবার বাড়িতে যেতে চাইলো না। এই কথাটা ও শাশুড়ীকে জানিয়েছে। শিলা নরম গলায় বললেন,

“বাবা তোমার আড়ম্বরহীন বিয়ে দিয়েছে বলে রেগে আছ?”

শ্রাবণ্য মৃদু হেসে বলল,

“না। ”

“আমার শাশুড়ী বলেন যে বিয়েতে আড়ম্বর কম হয়, সেই বিয়েতে অনেক বেশী আল্লাহর রহমত নাজিল হয়। তুমি বাবা মায়ের উপর রেগে থেকো না। ”

শ্রাবণ্য কিছু বলে না। ও ওর মনের কথাটা কাউকে বলতে পারছে না। ভাবী ফোন করেছিল তার সঙ্গেও তেমন কথা বলে নি।

এভাবে বিয়েটা শিলারও ভালো লাগে নি। তবে একটা ব্যাপারে সে খুশি। স্বপ্নীলের বাবার ইচ্ছে ছিলো শ্রাবণ্যদের পরিবারে আত্মীয়তার সম্পর্ক করার। তিনি চেয়েছিলেন মেয়েদের কারো সঙ্গে শ্রাবণ্যর ভাইয়ের বিয়ে দিতে। সেটা সম্ভব হয় নি। তুলি বিয়ে করেছে নিজের পছন্দে৷ রঙ্গনা নিজের মর্জিতে চলে। পরিবারের নিয়মে সে আটকে থাকে নি।

স্বপ্নীল কে দিয়ে সেই ইচ্ছেটা পূরণ হলো অবশেষে। এখন ছেলে মেয়ে দুটো ভালো থাক। যুগ এখন বদলেছে, আগের যুগের মতো নেই। ছেলে মেয়েরা নিজেদের পছন্দে বিয়ে করে। পছন্দ টা মানানসই হলে পরিবারের কোনো অমত থাকে না। কিন্তু ছেলেমেয়েগুলোও যে অবুঝ। সাময়িক আবেগ কে প্রশ্রয় দিয়ে সবাইকে নিয়েই নরকযন্ত্রনা ভোগ করে।

শিলা স্বপ্নীলের পছন্দ মেনে নিতে পারে নি। সমাজে ওরা এতটাও বোল্ড এখনো পর্যন্ত হয়ে উঠতে পারে নি। স্বপ্নীলের বাবা, দাদুর সম্মান আছে। দশজনের কাছ থেকে যে শ্রদ্ধা এখন পায়, দেখা যেত তারাই উঠতে বসতে কটুকথা বলছে। আর স্বপ্নীলও এমন জেদ করলো! অবশ্য সেটা ওর দোষ না। কিছু টা বয়স আর অনেকটা পরিস্থিতির দোষ। ছেলেটার পাশে বাবা থাকলে অনেক কিছুই সহজ হতো।

শিলার শ্রাবণ্যকে ভালো লেগেছে। কী সুন্দর মিষ্টি মেয়ে! প্রথমবার যখন তাদের বাসায় এসেছিল তখন অনেক দিন পর দেখা হয়েছিল। ওর বাবা মাঝেমধ্যে আসলেও ওরা আসতো না। এখন স্বপ্নীল সবকিছু সহজ ভাবে মেনে নিলেই হয়।

***
শ্রাবণ্যকে বাবার বাড়িতে যেতে হলো। বাবা নিজে এসেছেন। ওর সাধ্য নেই তার মুখের উপর না বলা। স্বপ্নীলও যাওয়া নিয়ে তেমন একটা অনাগ্রহ দেখালো না। দেখালে ওর জন্য ভালো হতো।

শ্রাবণ্য যাবার আগে স্বপ্নীল কে বলল,

“আমরা কিন্তু বেশী দিন থাকব না। ”

স্বপ্নীল চুলে ব্রাশ করতে করতে জবাব দিলো,

“আচ্ছা। ”

“আপনি বলবেন যে এখানে কাজ আছে?”

“কেন? বাড়িতে থাকতে কোনো সমস্যা? ”

“না আসলে… আমি ক্লাশগুলো মিস করতে চাইছি না। ”

“কিন্তু আমি তো বেকার মানুষ। যদি জিজ্ঞেস করে কী কাজ?”

স্বপ্নীলের প্রশ্ন শুনে শ্রাবণ্যও বোকার মতো তাকিয়ে থাকে।

শ্রাবণ্য কে বিশাল বড় দুটো ট্রলি নিতে দেখে স্বপ্নীল প্রশ্ন করে,

“তুমি না বললে অল্প কিছুদিন থাকবে? তাহলে এতো জিনিস কেন নিচ্ছো?”

শ্রাবণ্য একটু লজ্জা পেল। মা ফোন করে বলেছে, সবকিছু নিয়ে যেতে। ওখানে গেলে নাকি সবাইকে সব দেখাতে হবে। তাড়াহুড়ায় সেদিন শ্বশুর বাড়ি থেকে দেয়া জিনিসপত্র সবাই দেখতেও পারে নি।

শ্রাবণ্য জবাব না দিয়ে মিষ্টি করে হাসলো। যখন ও কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে চায় না তখন ওভাবে হাসে। স্বপ্নীল এটার সঙ্গে পরিচিত না। তবে শ্রাবণ্যর হাসি দেখে ও বিব্রতবোধ করলো।

বাবা গাড়ি নিয়ে এসেছিলেন ওদের জন্য। যখন রওনা হলো তখন গোধূলি বেলা। মন্টি, রিন্টি ওদের সঙ্গে যাবার জন্য অস্থির হয়ে গেল। শ্রাবণ্যর বাবাও নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু শিলা, তুলি কেউ দিতে চাইলেন না। শ্রাবণ্য অবশ্য একবার বলেছিল। পাশে এসে স্বপ্নীল বলল,

“এই দুটো বুবুকে ছাড়া গেলে ভয়ানক হয়ে যায়। দেখা গেল ওদের পিছনে ছুটতে ছুটতে কেউ স্ট্রোক করে মারা গেছে। আর বলার দরকার নাই। ”

শ্রাবণ্যও তাই আর বলল না।

***
গাড়িতে বসে শ্রাবণ্য টের পেল ফোন বাজছে। বাবা বসেছেন ড্রাইভারের পাশের সিটে। পিছনে স্বপ্নীল আর ও। আর একদম পিছনের সিটে ওর ফুপাতো ভাই রিপন আর বাবার সার্বক্ষণিক সঙ্গী জাহিদ।

শ্রাবণ্য ফোন কেটে দিলো। আফরিন ফোন করেছে। স্বপ্নীল একবার তাকালো, দ্বিতীয় বার ফোন বাজার পর বলল,

“ফোন টা ধরো, যে ফোন করেছে তার কাছে মনে হয় জরুরী মনে হচ্ছে। ”

শ্রাবণ্য বলল,

“না থাক। ও আমার রুমমেট ছিল। এমনিই ফোন করেছে হয়তো। ”

স্বপ্নীল আর কিছু বলল না।

ওদের নরসিংদী পৌছুতে রাত হলো। শ্রাবণ্য গাড়ি থেকে নেমে মায়ের কাছে আগে না গিয়ে ভাবীর কাছে গেল। শ্রাবণ্যর মা রেহানার সেটা চোখে লাগলো। তিনি মন খারাপ করে ফেললেন।

স্বপ্নীল এই পরিবেশে একটু অপ্রস্তুত হলো। তবে বাকীরা ও’কে সামলে নিলো।

রাতে খাওয়া দাওয়ার আয়োজনও হলো ভালোই। শ্রাবণ্য পটল ভাজা আর শসা কুচি দিয়ে কয়েক লোকমা পোলাও খেল। স্বপ্নীলকে থালা সাজিয়ে এতো এতো খাবার দিলো যে ও ভালো করে কিছু খেতেও পারে নি। সেই সঙ্গে শ্রাবণ্যর কাছের দূরের কিছু কাজিন এসে রসিকতা শুরু করেছে। পোলাওয়ের মধ্যে এক চামচ পাতলা ডাল দিয়ে দিলো। বেচারা স্বপ্নীল এদিক ওদিক তাকিয়ে শ্রাবণ্যকে খুঁজলো। ও ছাড়া বাকীরা সবাই ই তো অচেনা।

রেহানা এসে সামলে নিলেন। তিনি সবাইকে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে পাশে বসলেন। তাতে স্বপ্নীলের অস্বস্তি কমার বদলে আরও বাড়লো।

****
“হ্যালো শ্রাবণ্য?”

“হ্যাঁ বল। কেন ফোন করেছিস?”

আফরিন একটু সময় নিলো। বলল,

“তোর আপু এসেছিল। তুই নাকি তাকে ব্লক করে রেখেছিস!”

শ্রাবণ্য জবাব দিলো না। আকাশী ওর আড়াই বছরের বড়। ছোটবেলা থেকে কী সুন্দর একটা সম্পর্ক ছিলো। আকাশী কখনো ও’কে বকে নি। ওদের সব জিনিস একই রকম ছিলো। সবার ছোট হলেও শ্রাবণ্য কখনো অবাধ্য ছিলো না। সেই সুন্দর সম্পর্ক টা বদলে গেল আকাশীর নিজের সিদ্ধান্তের কারণে। যে একবারও নিজের বাবা, বোনের কথা ভাবে নি।

“শ্রাবণ্য শুনছিস?”

“হ্যাঁ। আমি কারোর সঙ্গে দেখা করতে চাই না। আমার কাউকে লাগবে না। কেউ আমার সঙ্গে দেখা করতে এলে আমাকে আর ফোন করবি না। ”

আফরিনের খারাপ লাগলো। ওর ইচ্ছে ছিলো সাকিবের ব্যাপারে বলার। একদিনে এতবার শ্রাবণ্যর মন খারাপ করিয়ে দেয়ার আসলে কোনো মানে হয় না!

***
রাতের এই সময়টায় রান্নাঘর ফাঁকা পাওয়া যায়। এক চুলায় ভাত আরেক চুলায় ডাল বসিয়ে পাটায় মশলা বাটতে বসলো আকাশী। আজ একটা মুরগী এনেছে। একটু ভালো, মন্দ যা রান্না হয় সেটা শুক্রবারেই হয়। মাসের ১৭ তারিখে টানাটানি কম না। তবুও শাকভাত কেন যেন মুখে তুলতে ইচ্ছে করে না।

আকাশী একটা পার্লারে চাকরি করে। সকালে বেরিয়ে যায়, সন্ধ্যায় ফেরে। সপ্তাহে ছয় দিন ই এমন নিয়ম। দুপুরে অবশ্য এক ঘন্টার রেস্ট আছে। বেতন সব মিলিয়ে তেরো হাজারের মতো। শুভ চাকরি করে একটা মোবাইলের দোকানে। সেখানে বেতন পায় বারো হাজারের মতো। বাড়িতে দেবার পর সংসারে দেবার মতো কিছু থাকে না। আকাশীর এই টাকাটাই সংসারে ভরসা।

এই রান্নাঘর টা পাঁচ জনের সঙ্গে শেয়ার করতে হয়। মোহাম্মদপুরের বেঁরিবাধে কমের মধ্যে এই বাসাটা পাওয়ায় সুবিধাই হয়েছে ওদের। নাহলে ঢাকা শহরে বাসা ভাড়ার সঙ্গে কুলানো যায় না। প্রতিবেশী ভাড়াটিয়ারাও আকাশীকে পছন্দ করে। পাশের রুমের মিনা ভাবীর ফ্রিজে জিনিসপত্র রাখে। কখনো রাগ করে না। মাঝেমধ্যে এটাসেটা রেঁধে দেয়।

আকাশী ডাল উঠিয়ে নেয়। ভাতটাও হয়ে গেছে। মাংস টা আগে রেঁধে ফেলতে হবে। শুভ ঘরে ঢুকেই ভাত খেতে চাইবে। রান্না হয় নি দেখলে মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে। সেই মেজাজ খারাপ ঝগড়াঝাটিতে রুপ নিবে। আকাশী নিজেকে দেখে অবাক হয়। বাড়িতে ও বাবা মা’কে জীবনেও ঝগড়া করতে দেখে নি। অথচ ও নিজে শুভর সঙ্গে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করে।

আকাশীর মন টা খারাপ হয় আবারও। ভাবী শ্রাবণ্যর কথা জানিয়েছে। শ্রাবণ্যর জীবনে বাবার কঠিন অনুশাসনের জন্য ও দায়ী। ওর জন্য ছোট্ট বোনটাকে কতকিছু সহ্য করতে হচ্ছে!

চলবে….

কুসুম কাঁটা পর্ব-০২

0

#কুসুম_কাঁটা
#পর্ব-২
(কপি করা নিষেধ )
স্বপ্নীলদের বাড়িতে সদস্য সংখ্যা আট জন। স্বপ্নীলের মা শিলা, বোন তুলি, তুলির দুটো বাচ্চা মন্টি আর রিন্টি। স্বপ্নীলের দাদি, দাদু আর মালেক মামা। এখন যুক্ত হলো শ্রাবণ্য। সেই হিসেবে বাড়ির সদস্য সংখ্যা নয় জন। তবে অস্থায়ী সদস্য আছে কয়েকজন। স্বপ্নীলের আরেক বোন রঙ্গনা আর মালেক মামার বউ বিউটি মামী।

স্বপ্নীলের দাদু এককালে জাঁদরেল পুলিশ অফিসার ছিলেন। বাবার একমাত্র ছেলে ছিলেন বলে স্বভাবটাও একগুয়ে ছিলো। স্বপ্নীলের বাবা অবশ্য সেরকম ছিলেন না। বিচক্ষন, ধীর স্থির স্বভাবের।

স্বপ্নীলের মা কলেজে ইতিহাস পড়ান। স্বভাবে তিনিও ভীষণ শান্ত। তবে ছেলেকে ভীষণ ভালোবাসেন। রঙ্গনা আর তুলির বয়সের ব্যবধান উনিশ মাসের। তুলি বড়। হাসিখুশি প্রানবন্ত, বুদ্ধিমতি মেয়ে। কিন্তু তার স্বামী রোমেল একদম ব্যতিক্রম। বোকা, রাগী, জেদি। ফিনল্যান্ডে একটা ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। তুলিরও বাচ্চাসমেত ওখানে যাবার কথা ছিলো। একটা না একটা ঝামেলায় যাওয়া টা আটকে যায়।

রঙ্গনা ছোট। স্বভাব পেয়েছে দাদুর মতো। নিজে যেটা ঠিক মনে করে সেটা একশ শতাংশ ভুল হলেও সেটাই ওর অভিধানে ঠিক বলে বিবেচিত। এখনো পর্যন্ত বিয়ে করে নি। দাদু যে জোর টা স্বপ্নীলের ক্ষেত্রে খাটাতে পেরেছেন সেটা রঙ্গনার ক্ষেত্রে পারে নি। রঙ্গনা বাসার বাইরে থাকে বন্ধুদের সঙ্গে ফ্ল্যাট ভাড়া করে। সেখানে ঝগড়া হলে বাড়ি আসে। যতদিন না বাড়ির কারোর সঙ্গে ঝগড়া হয় ততদিন বাড়িতে থাকে। তারপর আবার চলে যায়। আর প্রত্যেকবার যাবার সময় বলে যায় আর আসবে না, সম্পত্তির ভাগ চাইতেও আসবে না, মরে গেলেও আসবে না।

রঙ্গনার ডাক নাম রঙ। স্বপ্নীলের বাবা তুলির সঙ্গে মিলিয়ে নাম রেখেছেন। স্বপ্নীলের নাম টাও তার রাখা। কিন্তু এই ছেলেমেয়ে গুলো বড় অভাগা। বাবার সান্নিধ্যে বেশী সময় থাকতে পারে নি।

স্বপ্নীল স্বভাব পেয়েছে বাবা মা দুজনেরটাই। শান্ত, ধীর স্থির, মিশুকে স্বভাবের হলেও কেন যেন ওর তেমন বন্ধু হতো না। সহপাঠীরা ও’কে কেমন যেন এড়িয়ে চলতো। যত বড় হতে লাগলো বিষয় টা ততো বাড়তে লাগলো। স্বপ্নীল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে আহসানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি থেকে৷ আপাতত বেকার। তবে দাদু হুকুম দিয়েছেন অতি জলদি একটা চাকরি যোগাড় করার।

স্বপ্নীলের দাদু আফতাব হোসেন শ্রাবণ্যকে বিয়ের দুদিন পর ডাকলেন। শ্রাবণ্যর তুলির সঙ্গে গেল। দাদু একটা বই পড়ছিলেন। শ্রাবণ্যকে বসিয়ে রাখলেন দশ মিনিট। দশ মিনিট পর বইটা বন্ধ করে তুলির দিকে তাকিয়ে বললেন,

“তুমি যাও। ওর সঙ্গে আমার কথা আছে। ”

শ্রাবণ্য ভীত চোখে তুলির দিকে একবার তাকালো। ও চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

দাদু শ্রাবণ্য’র সঙ্গে কথা বললেন গম্ভীর স্বরে। জিজ্ঞেস করলেন,

“কেমন আছ?”

শ্রাবণ্য মাথা নেড়ে বলল,

“ভালো। ”

“কেউ কেমন আছ জিজ্ঞেস করলে, তাকেও জিজ্ঞেস করতে হয়। ”

শ্রাবণ্য শুকনো ঢোক গিলে বলল,

“আপনি কেমন আছেন?”

“আমি তোমার কী হই?”

শ্রাবণ্য অস্বস্তিতে পড়ে গেল। বলল,

“দাদু। ”

“হ্যাঁ৷ শোনো, গরুটা তোমার সঙ্গে কথাবার্তা বলছে? ”

“হ্যাঁ। ”

শ্রাবণ্যর বুঝতে বাকী রইলো না যে গরুটা আসলে স্বপ্নীল।

“এই বাড়িতে সবকিছু কঠিন নিয়মে চলে। নিয়মের কোনো হেরফের আমি পছন্দ করি না। এই বাড়ির সবাই শিক্ষিত৷ পড়াশোনার ব্যাপারে কোনো আলসেমি করবে না। তোমাকে ঘরের কাজ করতে হবে না। আপাতত তোমার কাজ গরুটাকে দেখে রাখা আর পড়াশোনা করা। ”

দাদু এতবার স্বপ্নীল কে গরু বলছে যে শ্রাবণ্যর এখন নিজেকে গোয়ালিনী মনে হচ্ছে।

দাদুর হাত থেকে নিস্তার পেল দাদির কারনে৷ দাদু ঠিক যতটা গম্ভীর, দাদী ততটাই মিষ্টি। শ্রাবণ্যর ওনাকে প্রথম দিন দেখেই ভালো লাগছে। দাদী ও’কে নাম ধরে না ডেকে ভাবী বলে ডাকছে।

স্বপ্নীলের মা, তুলি আপুকেও শ্রাবণ্যর ভালো লাগছে। তবুও দুদিনে তো আর মানুষ চেনা যায় না৷ মায়ের কথা টা কানে বাজে। শ্বশুর বাড়ি কখনো মধুর হাড়ি হয় না।

***
স্বপ্নীল আর শ্রাবণ্য একসাথে হোস্টেলের দিকে যাচ্ছে। স্বপ্নীল বলল,

“আমাদের বাসা থেকে তোমার ইউনিভার্সিটি কী দূরে হবে? ”

“একটু দূরে হবে। হোস্টেলে থাকলে আমার জন্য ভালো হতো। এখন তো ঘুম থেকে উঠেই বাস ধরতে হবে। ”

“হ্যাঁ। দাদু রাজী হবে না। ”

স্বপ্নীল কে শ্রাবণ্যর অতো খারাপ লাগছে না। হয় ছেলেটা সোজাসাপটা, নাহয় বুদ্ধি কম। কাল ও’কে নীলার গল্প বলেছে। দাদু কীজন্য এতো তাড়াহুড়ো করে ওর বিয়ে সেটাও বলেছে। শ্রাবণ্য অবশ্য নিজের কথা বলে নি। স্বপ্নীল এই বিয়ে নিয়ে খুব অনুতপ্ত। ওর জন্য শ্রাবণ্যকেও বিপদে পড়তে হয়েছে। তবে ও বলেছে, শ্রাবণ্যকে আর বিপদে ফেলবে না। যতরকম সাহায্য দরকার ও করবে। শ্রাবণ্যর ভালো লাগলো। শঙ্কা, ভীতি যা ছিলো তা অনেকটাই কম মনে হচ্ছে।

***
আফরিন সাকিব কে পেল টিএসসিতে। দাঁড়িয়ে বার্গার খাচ্ছিলো। বলল,

“তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ কর। কথা আছে জরুরী। ”

সাকিব মুখভর্তি খাবার নিয়ে প্রশ্ন করলো,

“শ্রাবণ্য এসেছে?”

“হ্যাঁ। ”

“কি করছে এখন?”

আফরিন সাকিব কে দেখলো কঠিন চোখে। এই ছেলেটাকে কষিয়ে একটা থাপ্পড় দিতে পারলে ওর ভালো লাগতো। কিন্তু সেটা করার সাহস নেই। ও জবাব দিচ্ছে না বলে সাকিবও আর প্রশ্ন করলো না। ধীরে, সুস্থে বার্গার শেষ করে লাচ্ছি নিলো। আফরিনের দিকে লাচ্ছি এগিয়ে দিতেই ও বলল,

“আমার লাগবে না। তুই খা। ”

“কী যেন বলবি? শ্রাবণ্যর কোনো সমস্যা আছে?”

“শ্রাবণ্য সমস্যায় থাকলে তোর খুব ভালো লাগে?”

সাকিব বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসলো। আফরিন বলল,

“শ্রাবণ্য দের বাড়িতে তুই ফোন করে ঘুরতে যাবার ব্যাপার টা জানিয়েছিস, তাই না?”

“নাহ!”

“তাহলে কে জানিয়েছে!”

সাকিব ভাবলেশহীন গলায় বলল, আমি কী জানি!

“সাকিব শোন, তুই নিজেকে খুব চালাক ভাবিস তাই না? তবে একটা ব্যাপার জেনে রাখ, তুই চালাক না। তুই রামবলদ। শ্রাবণ্য হোস্টেলে এসে সব জিনিসপত্র নিয়ে গেছে। যেদিন ও চলে গিয়েছিল, সেদিন সন্ধ্যায় ই ওর বিয়ে হয়েছে। এই খবর টা জানাতেই আমি এসেছি। ”

আফরিন আর দাঁড়ালো না। চলে গেল ঝড়ের গতিতে। যাবার সময় হাতে রাখা লাচ্ছিটা ছুড়ে ফেলে দিলো। সাকিব স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এটা কী হয়ে গেল! ও তো চেয়েছিল শ্রাবণ্যকে একটা শিক্ষা দিতে। শ্রাবণ্য ওর ভালোবাসা প্রত্যাখ্যান করায় একটা ছোট শিক্ষা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু এখন! এখন যে ও একদম ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেল।

চলবে….
সাবিকুন নাহার নিপা

কুসুম কাঁটা পর্ব-০১

0

#কুসুম কাঁটা
#পর্ব-১
সাবিকুন নাহার নিপা

শ্রাবণ মাসে জন্ম হয়েছিল বলে বাবা নাম রাখলেন শ্রাবণ্য। বাড়িতে অবশ্য সবাই নানান নামে ডাকে। আজ ওর বিয়ে। এতো তাড়াতাড়ি কারো বিয়ে হতে পারে সেটা শ্রাবণ্য কল্পনায়ও ভাবতে পারে না। অবশ্য নাটক, সিনেমায় হরহামেশাই ঘটে এমন। নায়িকাকে জোর করে বাবা অন্য কারোর সঙ্গে বিয়ে দিতে চান। এদিকে নায়ক তার ভালোবাসার জোরে কিভাবে কিভাবেআ নায়িকা কে বিয়ে করে সিনেমার কাহিনীআ শেষ করে হ্যাপি এন্ডিং এর পর্দা টানেন।
শ্রাবণ্যর বিয়েটা আসলে হ্যাপি এন্ডিং হপবে নাকি স্যাড এন্ডিং হবে বোঝা যাচ্ছে না। ওর বিয়ে ঠিক করা হয়েছে তিন দিন আগে। সেটা ও’কে কেউ জানায় নি। এমনকি ওর মা’ও না। শ্রাবণ্যর মা অবশ্য স্বামীভক্ত ভদ্রমহিলা। স্বামীর কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করাই যেন তার আসল ধর্ম।

শ্রাবণ্য একটা গুরুতর অপরাধ করেছে। যেটার শাস্তিস্বরূপ এই না জানিয়ে বিয়ে ঠিক করা। শ্রাবণ্য ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে গেছে বাড়িতে না জানিয়ে। বাবা সেটা জানতে পারেন। এই মীরজাফরি কাজ টা কে করেছে সেটা ও এখনো জানেনা। বাবা গতকাল লোক পাঠালেন। লোক বলতে শ্রাবণ্যর ফুপাতো ভাই। সে গিয়ে নিয়ে আসলো। ঘরে ঢুকে ও এক গ্লাস পানি খাবার পর ই জানতে পারলো সন্ধ্যেবেলা ওর বিয়ে৷ বাড়িতে সবাই সেটা নিয়েই ভীষণ ব্যস্ত এখন। এখনো পর্যন্ত বাবার সঙ্গে ওর দেখা হয় নি।

শ্রাবণ্য বসে আছে শিউলির ঘরে। শিউলি ওর একমাত্র ভাইয়ের বউ। মায়ের মতো ভাইটাও বাবাভক্ত। বাবার আশেপাশেই ঘুরঘুর করে সবসময়। ভাবীকে শ্রাবণ্য পছন্দ করে। শিউলিও একমাত্র ননদ কে খুব স্নেহ করে। শিউলি একটা প্লেটে পিঠে নিয়ে এলো। এই পিঠে টা শ্রাবণ্যর পছন্দ৷ ওর খেতে ইচ্ছে করলো না এখন।

শ্রাবণ্য দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বলল,

“আমাকে কী বিয়ে দিয়ে শাস্তি দেয়া হচ্ছে ভাবী?”

শিউলি হেসে বলল,

“ধুর বোকা মেয়ে! বিয়ে শাস্তি হবে কেন?”

“তাহলে এটা কী হচ্ছে? আমার বিয়ে অথচ জানলাম কিছুক্ষন আগে। আমার মতামতের কোনো গুরুত্ব কী কেউ দিচ্ছে!”

শিউলির মন খারাপ লাগছে। শ্রাবণ্য কে সেটা অবশ্য ও বুঝতে দিতে চায় না। মেয়েটার কতই বা বয়স হলো! শিউলিও অবশ্য এই বয়সেই বিয়ে হয়ে এই বাড়িতে এসেছিল।

“শ্রাবণ্য তোর ভালো ঘরেই বিয়ে হচ্ছে। ছেলেটাও চমৎকার। দেখতে সুন্দর আছে কিন্তু। তুই তো সবসময়ই চাইতি সুন্দর দেখতে একটা ছেলে যেন তোর বর হয়।”

শ্রাবণ্য শিউলির দিকে অসহায় চোখে তাকালো। এই চাওয়া ছিলো আরও বছর পাঁচেক আগের চাওয়া৷ তখন ও কতটুকু ছিলো। এই পাঁচ বছরে ওর মানসিকতা, চিন্তাভাবনা সবকিছুই তো বদলেছে৷ যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বাবা কেন বদলাচ্ছেন না! তাদেরকার সময়ে যেমন বিয়ে হতো তেমন বিয়ে নিজের মেয়ের জন্যও ভাবছেন।

শ্রাবণ্য হঠাৎ দাঁড়িয়ে বলল,

“ভাবী আমি যদি এই বিয়েতে না বলি! যদি বাড়ি ছেড়ে চলে যাই। ”

“তারপর কী হবে? কিভাবে চলবি?”

“একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আমি টিউশন পড়িয়ে নিজের ব্যবস্থা করে নেব। দুটো বছর কষ্ট হবে৷ তারপর চাকরি হয়ে যাবে একটা না একটা। ”

“তারপর তোকেও আকাশীর মতো এই সংসার থেকে দূরে সরিয়ে দিবে শ্রাবণ্য৷ জীবন এতোও সহজ না, যতটা তুই ভাবছিস। ”

শ্রাবণ্য বসে পড়ে বিছানার উপর। বুকের মধ্যে হৃৎপিন্ড টা দ্রুত গতিতে চলছে। এতো অস্থির লাগছে। শিউলি ওর পাশে বসে বলল,

“ভয় পাস না। যার সঙ্গে তোর বিয়ে হবে সেই ছেলেটা ভালোই। তারচেয়েও বড় কথা হলো ওদের বাড়ির মানুষজনও ভালো। তুই তো তাদের কে চিনিস একটু। ”

শ্রাবণ্যর আর কথা বলতে ইচ্ছে করে না। আসলে দোষ টা ওর। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ও নিজের সীমা ভুলে গিয়েছিল। বাবা ও’কে বাড়ির বাইরে রেখে ইউনিভার্সিটিতে পড়াতে চায় নি। কিন্তু ওর চোখের পানি দেখে নরম হয়েছেন। মা’কে বলেছিল, একবার চুন খেয়ে মুখ পুড়ে গেছে। এবার যেন তা না হয়।

বাড়িতে ঢুকতেই মা কঠিন গলায় বলেছেন,

“দুটো ডানা গজিয়েছিল তোর না? এখন বুঝবি কেমন লাগে। শ্বশুর বাড়ি কিন্তু মামাবাড়ির মতন মধুর হাড়ি না। ”

***
সত্যি সত্যিই সন্ধ্যেবেলা শ্রাবণ্যর বিয়ে হয়ে গেল। আটপৌরে বেনারশী, গয়নাগাটি পরে শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। শ্রাবণ্যর মা মেয়ের জন্য এক ফোঁটা চোখের পানিও ফেললেন না। আকাশী তাকে কঠিন বানিয়ে দিয়ে গেছেন নাকি জগতে স্বামী ছাড়া আর কারোর প্রতিই তার সেরকম অর্থে মায়া কাজ করে না এই ব্যাপার টা কেউই জানে না। তবে শিউলি নীরবে কাঁদলো। আহারে এভাবেও বিয়েটা হতে হলো। এই মেয়েটা যেন ভীষণ ভালো থাকে।

***
বাড়ির নাম রঙতুলি এই বাড়িতে শ্রাবণ্য এর আগেও একবার এসেছিল বাবার সঙ্গে। বাবার প্রিয় বন্ধুর বাড়ি এটা। সেই বন্ধু বেঁচে নেই। তবে বাড়ির লোকজনের সঙ্গে শ্রাবণ্যর বাবার সম্পর্ক এখনো আন্তরিক। শ্রাবণ্য আজ এই বাড়ির বউ। যেদিন এসেছিল সেদিনও ভাবতে পারে নি এই বাড়িটা একদিন ওর স্থায়ী ঠিকানা হবে।

শ্রাবণ্য এসেছে সকালে। প্রাথমিক বধূবরণ শেষ হবার পর শ্রাবণ্যকে ঘুমাতে পাঠিয়ে দিলো। ভালো করে ঘুমিয়ে নিক একটু। বউ দেখতে সবাই বিকেলে আসবে। নতুন জায়গায় শ্রাবণ্যর একটুও অসুবিধে হলো না ঘুমের। বালিশে মাথা দিতেই চোখের পাতা ভারী হয়ে এলো। সব জল্পনা কল্পনা, মন খারাপ একপাশে রেখে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেল।

***
স্বপ্নীল তাকিয়ে আছে সামনের মাখন রঙের বাড়িটায়। ওর হাতে দিয়াশলাই আর সিগারেটের প্যাকেট। এর আগে কখনো ও সিগারেট ছুঁয়েও দেখে নি। দাদু এই বিয়েটা করিয়েছে ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে। ও তো ভালোবাসতো নীলা কে। নীলা ওর বয়সে চার বছরের বড়, এক মেয়ের মা। শুধুমাত্র এই কারণে কেউ রাজী হলো না। স্বপ্নীল তবুও নিয়ম ভাঙতে রাজী ছিলো। কিন্তু নীলা রাজী হলো না। সিগারেটের শেষ অংশের মতো অযত্ন, অবহেলায় ফেলে দিলো ও’কে। তীর্যক হেসে বলল,

“বড়লোকদের এসব আদিখ্যেতায় আমি ভুলি না স্বপ্নীল। যা ভাগ এখান থেকে। থাপড়িয়ে দাঁত ফেলে দেব নাহলে। ”

স্বপ্নীল আহত চোখে তাকিয়ে ছিলো। দুটো মানুষের এক হওয়ার জন্য সমাজ কেন বাঁধা হবে! কেন কিছু যুক্তিহীন নিয়ম বেঁধে দেয়া হয় সেটা আজও স্বপ্নীল বোঝে না।

***
শ্রাবণ্যর ঘুম ভাঙলো দুপুরের পর। তুলি এসে ঘুম ভাঙালো।

“এই শ্রাবণ্য ওঠো। ”

শ্রাবণ্য ঘুমের মধ্যে হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,

“আরেকটু ঘুমাই। ভাত ঢেকে রাখো। ”

তুলি তবুও জোর করে ওঠায়। শ্রাবণ্য উঠে বসে এদিক ওদিক তাকিয়ে বুঝতে পারে যে ও এখন অন্য জায়গায় আছে। ক্লান্ত পায়ে চলে যায় ফ্রেশ হতে। পাটভাঙা নতুন শাড়ি পরে। ঘরে বসেই তুলির আনা ভাত খেতে বসে যায়। আলু দিয়ে মুরগীর মাংসের তরকারি টা দিয়ে অল্প একটু ভাত খায়। হঠাৎ যেন ওর কী হলো। শরীর কাঁপিয়ে কান্না এলো। সেই সময় ঘরে ঢুকলো স্বপ্নীল। অপ্রস্তুত গলায় বলল,

“তুমি খাচ্ছিলে? ”

শ্রাবণ্য জবাব না দিয়ে তাকিয়ে রইলো। স্বপ্নীল নরম গলায় বলল,

“খাও। আমি এখানে থাকলে সমস্যা আছে?”

শ্রাবণ্য মৃদু হেসে মাথা নেড়ে না বলল।

স্বপ্নীলও একটু হাসলো। উল্টোদিকে মুখ করে চেয়ারে বসলো। শ্রাবণ্যকে ও নীলার কথা বলতে এসেছে। ও নীলাকে বিয়ে করতে চেয়েছে বলেই দাদু এতো তাড়াহুড়ো করে এই বিয়ের ব্যবস্থা করেছেন।

স্বপ্নীল আরও একটা কথা বলতে চায় ও’কে। আমি তোমাকে জীবনেও বোধহয় ভালোবাসতে পারব না শ্রাবণ্য। কিন্তু ভেতর থেকে একটা বাঁধা আসছে। অবচেতন মন বলছে, একথা বলা ঠিক না, উচিত ও না।

চলবে….