Friday, July 18, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 221



দর্পহরন পর্ব-৭১ এবং শেষ পর্ব

1

#দর্পহরন
#পর্ব-৭১

তুলতুল আর শরীফের যাওয়ার খবর শুনে এই প্রথম রিমা আওয়াজ তোলে। সে বারবার অনুনয় বিনয় করে ওদের যাওয়ায় বাঁধা দিতে থাকে৷ সালিম সাহেব নাতি ছাড়া আরও ভেঙে পড়বেন এ কথা বলেও যাওয়া ঠেকানো গেলো না। শরীফ তুলতুলকে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অনড়। শেষ মেষ রিমা হার মানে। তুলতুলের মানসিক অবস্থা ভালো হলে পাকাপাকিভাবে দেশে ফিরবে এই আশ্বাস দিয়ে শরীফ আর তুলতুল লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। বিমানে উঠে তুলতুলের চোখে বিশ্বজয়ের আনন্দ। শরীফ মুগ্ধ হয়ে সে আনন্দ দেখে। ওর আশা একদিন ওই চোখে ওর জন্য ভালোবাসা দেখতে পাবে আর সেইদিন ওর বিবাহিত জীবন শুরু হবে। শরীফ সেই দিনের অপেক্ষায় প্রহর গুনে।

শরীফ আর তুলতুলের জন্য শুভ্রা মন থেকে খুশি। বিশেষ করে তুলতুলের জন্য। দীর্ঘ কষ্টের পর শরীফের সাথে ভীষণ সুখে থাকবে তুলতুল। এক সময় দু’জন শ্রেষ্ঠ জোড়া হবে এই বিশ্বাস আছে শুভ্রার।
“কি ভাবছিস?”
তাহের এসে বসেছে শুভ্রার পাশে। শুভ্রা প্রথমে চমকে গেলেও তাহেরকে দেখে নিজেকে সামলে নিলো-“ওহহহ, তুমি?”
“কি ভাবছিস?”
শুভ্রা মাথা নাড়ে-“কিছু না। তুমি হঠাৎ আমার কাছে? দরকার ছিল কোন?”
তাহের মাথা দুলায়-“বাসায় কাকে কি বলবো? ভাবির যে মানসিক অবস্থা তাতে তাকে কিছু বলা না বলা সমান কথা। তাই তোকেই বলতে এলাম।”
শুভ্রা প্রশ্নবোধক চাহনি দিয়ে তাকায়-“কি বলবে বলো?”
“কয়জন গেস্ট আসবে কাল রাতে। তাদের জন্য প্রপার এরেন্জমেন্ট করতে হবে। পারবি?”
“রাতে ডিনার করবে?”
তাহের মাথা দুলায়। শুভ্রা হাসলো-“পারবো।”
“ভেবে বলছিস? সব রান্না কিন্তু নিজ হাতে করতে হবে।”
শুভ্রা ঠোঁট টিপে ভেবে বললো-“পারবো। টুকটাক রান্না জানি আমি। তুমি ভেবনা।”
“বেশ। তুই কিছু ভেবেছিস?”
“কোন ব্যাপারে?”
“চাইলে অফিসে বসতে পারিস। বাসায় বসে বোর হওয়ার চাইতে অফিস ভালো৷ কাজে ব্যস্ত থাকতে পারলি। আমারও সঙ্গ হলো। আমি একদম একা পড়ে গেছি রে। হুট করে এতো চাপ নিতে পারছি না। বাড়িটাও কেমন নীরব হয়ে গেছে দেখেছিস? এক সময় মানুষের পদচারনায় গমগম করা বাড়িটা এখন ভুতবাড়ির মতো লাগে।”
চাচার মুখের দিকে তাকায় শুভ্রা। মানুষটাকে অসহায় দেখাচ্ছে। শুভ্রা খুব ধীরে উত্তর দিলো-“অফিসে বসবো কিনা ভেবে জানাব চাচ্চু।”
তাহের হুট করে এলো হুট করে চলে গেলো। শুভ্রা ওভাবেই বসে রইলো আরও কিছু সময়। উঠে বারান্দায় গেলো, গাছগুলোতে পানি দিতে হবে।

*****

সন্ধ্যায় সব খাবার রান্না করে টেবিলে গুছিয়ে দিয়ে শুভ্রা তাহের ডাকলো-“চাচ্চু, সব গুছিয়ে দিয়েছি। বাকি কিছু লাগলে কাজের মেয়েগুলোকে বললেই হবে। আমি একটু রুমে যাচ্ছি। প্লিজ আমাকে কারো সামনে ডেকনা।”
তাহের হেসে বললো-“কেনরে? তুই কি সন্যাসী হবি? লোকসমক্ষে আসবি না?”
শুভ্রা বিরক্ত হলেও জবাব দিলো না। চুপচাপ রুমে এসে শাওয়ার নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। এপাশ ওপাশ করছে প্রতিনিয়ত। অব্যক্ত কষ্ট প্রতিনিয়ত কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে তাকে। কাউকে কিছু বলবে সে উপায়ও নেই। এ বাড়ি এখন জনমানবহীন। মা নিজের মতো থাকে আর বাবা তো বিছানায়। প্রায়ই দম বন্ধ হয়ে আসে তার। এমন অবস্থায় কি তার থাকার কথা ছিলো? তার তো এখন রণর বাড়িতে থাকার কথা। স্বামী সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে হাসি আনন্দে দিন পার করার কথা। বাবার জেদ কিংবা তার কাজের জের যাইহোক তার জীবনটাই তো এলোমেলো হলো। কিন্তু উপর ওয়ালা তাকে অভিযোগ দেওয়ার পরিস্থিতিতেও রাখেনি। কার কাছে অভিযোগ দেবে? বাবাকে নাকি রণকে? কে শুনবে তার কথা? কার উপর অধিকার দেখাবে? আবার দেশের বাইরে চলে যেতে ইচ্ছে করছে কিন্তু বাবার এমন অবস্থায় সেটাও সম্ভব না। সব কিছু ভেবে শুভ্রা হাউমাউ করে ডুকরে উঠলো। কেন আল্লাহ কেন এমন হলো জীবনটা? কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে একসময় ঘুমিয়ে গেল শুভ্রা।

ঘুমের মধ্যে নড়াচড়া করতে গিয়ে টের পেলো কেউ আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে তাকে। খুব চেনা গন্ধটা তাকে ব্যাকুল করে তুললো। তার উপস্থিতি এখানে কি করে সম্ভব? শুভ্রা ধড়ফড়িয়ে উঠে বসতে চাইলো কিন্তু জাপ্টে ধরা মানুষটা তার বাঁধন দৃঢ় করলো। পরিচিত গম্ভীর গলায় সুধায়-“উফফ, এতো ছটফট করছো কেন? কতোদিন পরে একটু আরাম করে ঘুমাচ্ছিলাম দিলে তো ঘুমটা ভাঙিয়ে।”
শুভ্রা চমকে উঠে জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে হাত বাড়িয়ে বেড সুইচটা জ্বালায়। রণর শুয়ে মিষ্টি করে হাসছে। তার পরনে পাঞ্জাবি পাজামা আর কালো কোটি। শুভ্রা হা করে তাকিয়ে থেকে চেচিয়ে উঠলো-“রণ! আপনি!”
শুভ্রার দিকে তাকিয়ে স্বভাবসুলভ হাসি দিলো রণ-“আর কে আসবে তোমায় এতো গভীর ভাবে ছুঁয়ে দিতে?”
শুভ্রা তখনো বুঝতে পারছে না যেন। সে অবিশ্বাস নিয়ে জানতে চাইলো-“কিন্তু আপনি এখানে? আমাদের তো ডিভোর্স…”
শুভ্রা কথা শেষ করতে পারে না। রণ তাকে থামিয়ে দিলে ইশারায়। উঠে বসলো সে, হাতে একটা কাগজ ধরা। সে হাতে ঝাঁকিয়ে বললো-“সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি এটা নিয়ে। তোমার বাবা পাঠিয়েছিল। আজ তোমার সামনে এটা ছিঁড়ে ফেলছি। একজনার ইচ্ছায় কিছু হয় না শুভ্রা, বিয়ে ভাঙা বা টিকিয়ে রাখা দুটোতেই দু’জনার ইচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ। আর আমাদের দু’জনার ইচ্ছে সংসার করার, তাই না?”
শুভ্রা জবাব দিলে না। রণ ডিভোর্স পেপারটা ছিড়ে কুঁচি কুঁচি করলো। শুভ্রা রণকে দেখছে একনজরে। কতদিন পরে জীবন্ত মানুষটাকে দেখছে। মন চাইছে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখতে। কিন্তু পারলো না। অজানা অভিমান তাকে রুদ্ধ করে দিচ্ছে। সে অভিমানী বালিকার মতো ঠোঁট ফুলিয়ে বললো-“এতোদিন পরে কেন এসেছেন রণ? না একবার ফোন দিয়েছেন না দেখা করেছেন। কিভাবে ছিলাম এতোদিন জানেন? মনে মনে কত কি ভেবেছি।”
রণ হাত বাড়িয়ে শুভ্রার কোমল হাত দু’টো ধরলো। শুভ্রা অভিমানে সে হাত ছাড়িয়ে নেন। রণ এবার শক্ত করে হাত ধরে-“তোমার প্রতিটা ক্ষণের খবর জানি আমি। এতোটা দায়িত্বহীন মনেহয় আমাকে যে বউয়ের খবর রাখবো না? এতোদিনে একটুও ভরসা আসেনি আমার উপর?”
শুভ্রা তবুও মুখ ফিরিয়ে রাখে-“বিশ্বাস করি না। প্রমান আছে কোন?”
রণ শুভ্রাকে কাছে টানে। শুভ্রার মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে বললো-“তুলতুল ভাবিকে জিজ্ঞেস করো তাহলেই হবে।”
রণর বুকের ধুকপুকানি শুনতে শুনতে শুভ্রা চোখ বড় করে তাকায়-“মানে কি?”
রণ শুভ্রার মাথায় ঠোঁট ছুঁইয়ে বললো-“মানে কিছুই না। তুমি এখন তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও তো। ফিরতে হবে আমাদের। মন্ত্রীর বউ ঘরে ফিরবে কি এভাবে?”
“কিন্তু মা! মা মেনে নেবে না আমাকে।”
শুভ্রা মন খারাপ করে বলতেই রণ গম্ভীর হলো-“বউকে সন্মানের সাথে নিয়ে যাব বলে এতোদিন ধৈর্য্য ধরে চুপ করে ছিলাম শুভ্রা। মা ড্রয়িং রুমে বসে আছে। তুমি তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। আমরা দু’জনে একসাথে তোমার বাবাকে দেখবো।”
শুভ্রা বিস্মিত হয়ে তাকায়-“সত্যি মা এসেছেন? আমাকে নিতে?”
রণ মাথা নাড়ে-“মা তোমায় ঘর ছাড়া করেছে তাই মাই তোমাকে সন্মান দিয়ে ঘরে তুলবে।”
শুভ্রা কেঁদে দিলো-“আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।”
রণ মিষ্টি করে হাসলো-“কাঁদে না বোকা মেয়ে। আমি সত্যি বলছি। যাও তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। বাইরের ঘরে ওরা অপেক্ষা করছে।”

শুভ্রা আর রণ সালিম সাহেবের কাছে এসে বসলো। রণকে দেখেই সালিম সাহেব কিছু একটা বলার চেষ্টা করলো। রণ শুভ্রাকে তার বাবার কাছে বসায়-“তোমার বাবার সামনে আজ কিছু কথা তোমাকে বলতে চাই শুভ্রা। কারণ আমি চাই না নতুন করে কোন ভুল বোঝাবুঝি হোক আমাদের মাঝে। আচ্ছা বলোতো, তুমি কি কখনো তোমার প্রতি মায়ের রাগের কারণ জানতে চেয়েছ শুভ্রা?”
শুভ্রা মাতা নাড়ে। রণ বললো-“বলতে না চাইলেও আজ তোমার বাবার সামনেই কথাগুলো বলি। তোমার বাবা খুব ঘৃন্য ভাবে আমার বাবাকে মেরে ফেলেছেন। কারণ আমার বাবা তোমার বাবার বিপরীতে নির্বাচনের সাহস দেখিয়েছিলেন। ঠিক নির্বাচনের আগের দিন বাবা অপহরণ হয়, আজ পর্যন্ত তার কোন খোঁজ পাইনি। যাদের প্রতি খুব বেশি রাগ থাকে তাদের এসিডে গলিয়ে মৃত্যু দিত তোমার বাবা। আমার বাবার ভাগ্য হয়তো এমনটাই ঘটেছে। নিজের স্বামীর খুনির মেয়েকে ছেলের বউ বানানো খুব সহজ নয় শুভ্রা। আমার মা সেটাই করেছে হাসিমুখে। তারপরও তোমার পরিবার অনুতপ্ত হওয়ার বদলে নানা ঘটনা ঘটিয়েছে।
এখন তুমিই বলো, মায়ের তোমার প্রতি রাগটা কি ঠিক না ভুল? আমি জানি তোমাকে অপহরণ করে আমি অন্যায় করেছিলাম কিন্তু আমি নিরুপায় ছিলাম। আঠারোতে বাবা হারিয়ে কতটা কষ্ট করতে হয়েছে আমাকে সেসব আজ নতুন করে বলবো না। তবে দীর্ঘ বারো বছর ধরে এই দিন দেখার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছিলাম শুভ্রা। তোমাকে অপহরণ না করলে আমার কখনোই নির্বাচন করা সম্ভব হতো না। তোমার বাবা সেই সুযোগ দিতেন না। হয়তো আমাকেও বাবার মতো মেরে ফেলতেন। সেই সুযোগ তাকে দিতে চাইনি। তোমার কথা ভেবে অন্তত সে চুপ ছিলো কিছুদিন। আমার জন্য ওই সময়টা খুব জরুরি ছিলো।”
রণ থামলো একটু দম নিলো তারপর আবার বলতে শুরু করলো-“বাবার মৃত্যুর শোধ নিতে আরেকটা মৃত্যু দেওয়ার কোন ইচ্ছে আমার ছিলো না কিন্তু অন্যায়কারীকে একটা শিক্ষা দেওয়ার ইচ্ছে অবশ্যই ছিলো। আমি চেয়েছি অন্যায়কারী যেন তার বাকী জীবন নিজের কৃতকর্মের জন্য আফসোস করে। আমি জানি না তোমার বাবা আফসোস করে কিনা। কিন্তু আফসোস করার পরিস্থিতিতে সে দাঁড়িয়ে আছে। হাজারো লোকের পদচারণায় মুখর থাকা বাড়িটায় আজ ঘুঘু চড়ে, একটা সন্তান মারা গেছে আরেকজন দূরদেশে। একা একা বিছানায় দিন কাটবে এর চেয়ে খারাপ আর কি হতে পারে। আশাকরি আমার আজকের কথাগুলোতে তুমি ভুল বুঝবে না।”
শুভ্রার চোখ থেকে জল গড়ায়, ভেজা গলায় বললো-“বাবার কাজের জন্য আমি লজ্জিত রণ। যা হয়ে গেছে তার কিছুই বদলাতে পারবোনা শুধু বলবো মায়ের দুঃখের কোন কারন না হওয়ার চেষ্টা করবো সবসময়। আর বাবার জন্য ক্ষমাও চাইবো না। সে যেন তার কর্মের সাজা পায়। বাবা আমাকে ক্ষমা করো। সন্তান হিসেবে তোমার জন্য দোয়া করবো কিন্তু অপরাধী হিসেবে তোমার সাজাও চাইবো বাবা।”
সালিম সাহেবের মুখ বেকে গেলো। কিছু বলার আপ্রান চেষ্টা করলো কিন্তু পারলোনা। চোখ থেকে জল আর মুখ থেকে লালা পড়ে বালিশ ভিজে যাচ্ছে। শুভ্রা বাবার মুখ মুছিয়ে দিয়ে ভেজা গলায় বললো-“আমি চলে যাচ্ছি বাবা। ভালো থেক। দোয়া করো যেন ওর সাথে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাটাতে পারি।”

জলি শুভ্রার হাত ধরলো-“তোমার প্রতি অন্যায় করেছি বউমা। আমাকে ক্ষমা করো।”
“ছিহ মা। ক্ষমা চাইবেন না প্লিজ। আমি কিছু মনে রাখিনি। আপনি মা আদর আর শাসন দু’টো করার অধিকার আপনার আছে।”
জলি শুভ্রা মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। রণ ঠোঁটের কোনে হাসি লুকায়। রিমার চোখ ছলছল-“তুইও চলে যাবি শুভ্রা? এই শশ্বানে কেমনে থাকবো আমি?”
শুভ্রা ছুটে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। জলি সান্ত্বনা দিলো-“মেয়েকে দেখতে ইচ্ছে করলে চলে আসবেন আপা। মেয়ের কাছে থেকে আসবেন।”
ডলি মাথা দুলায়-“মেয়ে সুখে থাকলে আর কিছু চাই না আমার। শুভ্রা আমার ভালো মেয়ে। সারাজীবন বাইরে বাইরে থাকছে। মেয়েটা নিজের সংসারে থিতু হোক।”

গভীর রাতে নিজের চেনা রুমটাতে রণর বাহুডোরে বন্দী হয়ে শুভ্রা ছটফট করে। রণ দুষ্ট হেসে ফিসফিস করলো-“কি হলো? এতো ছটফট করছো কেন?”
শুভ্রা রণর বুকে মুখ ঘষে জবাব দিলো-“সত্যিই কি আমি আপনার বুকে আছি? বিশ্বাস হচ্ছে না।”
রণ আদর মাখা হাসি দিয়ে শুভ্রার কপালে গালে চুম্বন করলো। অধরে অধর ছুঁইয়ে দিয়ে বললো-“এবার বিশ্বাস হয়?”
শুভ্রা মাথা নাড়ে। রণ দুষ্ট হেসে শুভ্রার কানের লতিতে চুমু আঁকে, কন্ঠার নিচে নিজের পুরুষালী গাল ছুঁইয়ে দেয়, দাঁতে আঁচড় কাটে-“এবার বিশ্বাস হয়?”
শুভ্রার ঠোঁটের কোনে হাসির আভা। সে মাথা নাড়ে। রণ আরেকটু নিচে নামে। বুকের মাঝ বরাবর ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতেই শুভ্রা রণর চুল খামচে ধরে-“কি করছেন?”
“তোমাকে বিশ্বাস করাচ্ছি।” রণর স্বর গাঢ় হলো।
“করেছি বিশ্বাস। এবার ছাড়ুন।”
“কিন্তু আমার যে এখনো বিশ্বাস হয়নি আমি তোমাকে আবার ফিরে পেলাম।”
“কি করলে বিশ্বাস হবে?”
শুভ্রার কন্ঠে মদিরার নেশা। রণ সে নেশায় চুর হতে হতে বললো-“আমার একটা মেয়ে চাই শুভ্রা। একটা গুলুমুলু মেয়ে পায়ে নুপুর পরে ঝনঝন শব্দে হেঁটে বেড়াবে। আমি মুগ্ধ চোখে চেয়ে দেখবো মেয়েকে।”
শুভ্রা একই সাথে লজ্জা পেলো আবার তীব্র ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হলো। তুলতুলের ছেলেকে দেখার পর ঠিক এমন অনুভূতি তারও হয়েছিল। মা হবার আকুলতা মন প্রান জুড়ে ছেয়ে ছিলো। আজ রণর মুখে তার মনের ইচ্ছে শুনে হাজার প্রজাপ্রতি উঠছে হৃদয়ে। রণ শুভ্রার চোখের দিকে তাকায়-“দেবে একটা মেয়ে?”
শুভ্রার গালে লালিমা ছড়ালো। আঁধারে তা নজরে না এলেও শুভ্রার নিরবতায় অনেক কিছু বোঝা হয়ে যায় রণ। সে শুভ্রার কানে কানে ফিসফিস করলো-“ভালোবাসি শুভ্রা, আমার ভবিষ্যৎ বাচ্চাদের মাকে ভীষণ ভালোবাসি। আমার অর্ধাঙ্গীকে ভালোবাসি।”
“আমিও আপনাকে ভালোবাসি রণ, আমার ভবিষ্যৎ বাচ্চাদের বাবাকে ভীষণ ভালোবাসি।”

সমাপ্ত।
©Farhana_Yesmin

দর্পহরন পর্ব-৭০

0

#দর্পহরন
#পর্ব-৭০

সারাজীবন জেলে পচার চাইতে দেশের বাইরে সেটেল হওয়া লাভজনক মনে হয়েছে মোর্শেদ দম্পতির। অন্তত জেলের চার দেওয়ালের বন্দী জীবনের চেয়ে ভালো তন্ময় স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকতে পারবে এই আশায় রণর প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলো তারা। সব প্রসেসিং শেষ করতে সাতদিন সময় লেগেছে তাদের। কাগজপত্রের সবকাজ শেষ হওয়ার পর রণর কাছে এসেছে তন্ময়ের মুক্তির আর্জি নিয়ে। রণ চুপচাপ মন দিয়ে সব কাগজ দেখে ফোন দিয়েছে দিলশাদকে। কি করতে হবে তা পইপই করে বুঝিয়ে দিয়েছে। মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই মোর্শেদের। কারণ তারা এখন নখদন্তহীন বাঘ, কেউ ভয় পায় না।

তন্ময় প্লেনে ওঠার পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রণ। একটা আপদ বিদায় হয়েছে তার জীবন থেকে। এবার অন্য কাজগুলোর উপর দৃষ্টি দেওয়া যায়। এই ভাবনা থেকেই একদিন গভীর রাতে নেত্রীর বাসায় চলে গেলো রণ। প্রতিবারের মতো আর অবাক হলো না নেত্রী। এতোদিনে রণর স্বভাব সম্পর্কে বেশ ভালোভাবেই অবগত হয়ে গেছেন তিনি। জরুরি আর ব্যক্তিগত আলাপ রাতের আঁধারে করতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করে সে। নেত্রী রণর সামনে হাসিমুখে বসলেন-“বলো রাগীব, এবার কি নিয়ে চিন্তিত?”
রণ হেসে দিলো-“আপনি কি জানেন ফুপু, আপনার এই স্বভাবের জন্যই আপনাকে ভালো লাগে আমার। সবদিকে তীক্ষ্ণ নজর থাকে আপনার। সবার সবকিছু মনে রাখেন। সবাইকে বিশেষ ভাবতে বাধ্য করেন।”
নেত্রীর মুখের হাসি চওড়া হলো-“আজ কি বাটারের দাম কমে গেছে নাকি রাগীব? হঠাৎ করে এতো বাটারের ব্যবহার কেন?”
রণ হাসি ধরে রাখলো-“নাহ ফুপু, আমি মিথ্যা স্তুতি গাইতে পারি না এটা আপনি জানেন। সত্য কথাই বললাম। আপনার এই গুনাবলী আপনাকে বিশেষ করেছে। বাবা আপনার খুব প্রসংশা করতেন।”
নেত্রীর মুখে বিষাদের ছায়া নামে-“তোমার বাবা মানুষটা খুব সৎ হলেও একরোখা ছিলেন। রাজনীতিতে এই ব্যাপারটা যায় না জানো তো? তোমাকে বুদ্ধি করে সবার সাথে মিলে চলতে হবে। শত্রুকে সাথে রাখতে হবে। সেটাই রাজনীতির মাঠে সবচেয়ে বড় যোগ্যতা। আফসোস তোমার বাবা এই ব্যাপারটা বুঝতে অপারগ ছিলেন। যে কারণে তাকে বেঘোরে প্রান দিতে হয়েছে।”
রণর মুখে আঁধার নামে-“আপনি জানতেন সালিম সাহেব বাবাকে মেরে ফেলতে পারে তবুও তাকে বাঁধা দেননি ফুপু। একটাবার তাকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা করেননি। কেন ফুপু?”
নেত্রীর চেহারায় বিস্ময়। কিছুক্ষণ নির্লিপ্ত থেকে উনি মাথা নাড়েন-“ভুল বুঝো না রাগীব। তোমার মতো বুদ্ধিমান মানুষের কাছ থেকে এই অভিযোগ আশা করিনি। সালিমের কথা বারবার বলার পরও তোমার বাবা কানে তোলেননি। বরং সব জায়গায় যেচে পড়ে সালিমের সাথে ঝামেলা পাকিয়েছে। তখন সালিমের দূর্দান্ত প্রতাপ, আমার ওকে মেনে চলতে হতো। বলা যায় আমি বাধ্য ছিলাম।”
রুম জুড়ে নিরবতা নেমে এলো। নেত্রীর দীর্ঘ শ্বাস অনেক কিছু বলে দেয়। সে কিছুটা ভরাক্রান্ত স্বরে বললো-“তোমার মধ্যে স্পিরিট দেখেছি বলেই তোমাকে ডেকেছিলাম রাগীব। তুমি প্রমান করলে বুদ্ধিমত্তায় তুমি বাবাকে ছাড়িয়ে গেছ। সালিমের পরিবারের দুই যুগের শাসন ব্যবস্থা গুড়িয়ে দিয়েছ। আই ফিল প্রাউড রাগীন।”
রণ স্মিত হেসে বললো-“ফুপু, চন্দ্র কিংবা আপনার পরিবারের অন্য কেউ যদি আপনার জায়গায় আসে সে আমার পরিপূর্ণ সাপোর্ট পাবে। লিডারশীপের জায়গা নিয়ে আমার কখনো কোন ভাবনা ছিলো না। আপনি আমাকে নিয়ে ভেবেছেন এতোদূর এসেছি আপনার সাহায্য সহযোগিতায়, আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু ফুপু আমি আমার স্ত্রী শুভ্রাকে ভীষণ ভালোবাসি। ওকে ছেড়ে দেওয়া সম্ভব হবে না ফুপু।”
নেত্রীকে বিব্রত দেখায়-“হুট করে এসব কেন বলছো রাগীব?”
“কারণ মা জেদ ধরে আছে শুভ্রাকে ডিভোর্স দিয়ে চন্দ্রের সাথে আমার বিয়ে দেবে। আমার কোন মতামত মা শুনছে না। ফুপু ওই নিষ্পাপ মেয়েটাকে আমি ছাড়ব না কিছুতেই। তাছাড়া চন্দ্রের সাথে আমার কথা হয়েছে। ওকে আপনারা জোর করে দেশে নিয়ে এলেও ও এখনো মনে প্রানে জ্যাককে ভালোবাসে। এই অবস্থায় ওকে নিয়ে অন্য কিছু ভাবা মোটেও ভালো কিছু হবে বলে মনেহয় না। আমাকে ভুল বুঝবেন না ফুপু। আমার আসলে জানতে হয়েছে এসব। বিয়েটা ছেলেখেলা নয় এটা আপনার চাইতে ভালো কে জানে। একজনকে ভালোবেসে আরেকজনের সাথে সংসার করা কতোটা কঠিন তা আপনি ভালো জানেন। তাই চন্দ্রের ব্যাপারে এমন কিছু করবেন না আশাকরি। ফুপু আমাকে মাফ করবেন। আপনাদের পারিবারিক ব্যাপারে এসব কিছুই বলতে চাইনি আমি। যেহেতু আমাকে নিয়ে ঘটনা ঘটছে তাই মনে হলে আপনাকে বলা দরকার। আশাকরি চন্দ্রের সাথে বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা এখানেই থেমে যাবে। মাকে বোঝানোর দায়িত্বটাও আপনার ফুপু।”
রণ উঠে দাঁড়িয়ে আবার বসলো-“ফুপু, আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে জানি। আপনার জন্য দলের জন্য কিছু করতে আপনার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্কে থাকতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। আপনি জেনে রাখুন, আপনার আর দলের যে কোন প্রয়োজনে আমি আছি। আসছি আজ।”
নেত্রীর পা ছুঁয়ে বেরিয়ে এলো রণ। মনটা খুব নির্ভার লাগছে আজ। মনের মধ্যে এতোদিনের জমে থাকা কথাগুলো বলতে পেরে অদ্ভুত শান্তি লাগছে। মাকে নিয়েও আর চিন্তা হচ্ছে না। জানে, আজ হোক কাল মা ঠিক শান্ত হয়ে যাবে। মাকে শান্ত করার কাজটা নেত্রী ওরফে ফুপুই করবে। অসংখ্য বিনিদ্র রজনী পার করে আজ বহুদিন পরে রণ শান্তির ঘুম দেবে।

*****

ইব্রাহিম নিবাসে অনেক পরিবর্তন এসেছে। মোর্শেদ আর মিনু নেই। তারা তন্ময়ের সাথেই দেশের বাইরে গেছে। কবে আসবে বলে যায়নি। সালিম সাহেব কথা বলার ক্ষমতা হারিয়েছেন কেবল গো গো করেন। রিমা একদম চুপচাপ হয়ে গেছে। কারো সাথেই কোন কথা বলে না সে। দশটা প্রশ্ন করলে একটা উত্তর দেয় অবিচ্ছায়। তাহের আপাতত ইব্রাহিম পরিবারের কান্ডারী। সে তার নরম স্বভাবের খোলস থেকে বেড়িয়ে দায়িত্ববান মানুষে রুপ নিয়েছে।

তুলতুলের চল্লিশ দিন পার হওয়ার পরেই শরীফ তুলতুলকে বিয়ে করেছে। তারপর থেকে শরীফ দায়িত্ববান বাবার মতো সারারাত তুলতুলের ছেলেকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়ায় আর তুলতুল ঘুমায়। সারাদিন তুলতুলের যা কিছু প্রয়োজন তা সাথে সাথে দিতে যেন বদ্ধপরিকর শরীফ। তুলতুলের গরম মেজাজ, বাচ্চার কান্না সব সামলে নিচ্ছে দক্ষ হাতে। কোন একটা সময়ও বিরক্ত হয় না সে। ধৈর্য্য ধরে সব দায়িত্ব পালন করছে নিয়ম করে। মাঝে মাঝে তুলতুল অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে শরীফকে। একই মায়ের পেটে এরকম বিপরীতমুখী স্বভাব কিভাবে হলো দুই ভাইয়ের? একজন উত্তর তো আরেকজন দক্ষিণ? তুলতুল মুগ্ধ হবে না হবে না বোঝে না। মনে বড় দ্বিধা। একদিন কি ভেবে যেন বলে ফেলেছিল-“আমার এ বাড়িতে দমবন্ধ লাগে। অন্য কোথাও থাকা যায় না?”
শরীফ গম্ভীর হয়ে জানতে চাইলো-“দেশের বাইরে যাবে? আমার সাথে লন্ডনে শিফট করবে?”
তুলতুলের চোখ চিকচিক করে। সে অবিশ্বাস নিয়ে জানতে চাইলো-“আমি আর বাবু যেতে পারবো?”
“কেন পারবেনা? আমার তো ওয়ার্ক পারমিট আছে সেই সূত্রে তুমি আর বাবু সহজেই যেতে পারবে। চাইলে ওখানকার নাগরিক হতে পারবে।”
“তাহলে আমাকে নিয়ে চলুন প্লিজ। আর ভালো লাগছে না এই প্রাসাদ।”
“ঠিক আছে। আমাকে ক’দিন সময় দাও। কাগজ করতে দেই হলেই চলে যাব আমরা।”
তুলতুল মাথা দোলায়। যদিও তখন ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেনা শরীফকে। শরীফ অবশ্য বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করলো না। যখন হবে তখন নিজেই দেখে নেবে এই ভেবে উঠে গেলো।

শুভ্রা খুব দরদ দিয়েই বাবার কাজগুলো করে। খাওয়াতে গেলে বারবার লালা গড়িয়ে পড়ে বারবার শুভ্রা মুছে দেয়। হাত পা ম্যাসাজের লোক এলে তাদের সাহায্য করে। বাবার পাশে বসে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। সালিম সাহেব চুপচাপ তাকিয়ে থাকেন ঘরের ছাদের দিকে অথবা দেয়ালের দিকে। বেশিরভাগ সময় সেটা শুন্য দৃষ্টি হয়। শুভ্রা মাঝে মাঝে তুলতুলের ছেলেকে কোলে
আসে বাবাকে দেখায়। নাতিকে দেখে চোখ উজ্জ্বল হয় সালিম সাহেবের। কিছু যেন বলতে চায়। দূর্ভেদ্য আওয়াজে কি বলে তা বোঝা মুশকিল হয় শুভ্রার। সে কেবল বাবার আনন্দটা বোঝে।

মানসিকভাবে ক্লান্ত বিদ্ধস্ত শুভ্রা মাঝে মাঝে বিনাশব্দে টিভিতে রণর ভিডিও ছেড়ে রাখে। রণকে দেখলে কেন যেন চোখ দুটো আপনাতেই জলে টলমল করে, বুকটা পোড়ে শুভ্রার। মিস করে ভীষণ। ভাত মুখে নিতে গেলে হাত থেমে যায় শুভ্রার। খুব যত্ন করে রণ খাইয়ে দিত তাকে। আর ভাত খাওয়া হয় না তার। কবে একটু একটু করে এই নিষ্ঠুর লোকটার প্রেমে পড়লো তা বুঝে পায় না শুভ্রা। নিজের মধ্যকার পরিবর্তন পুরোটাই মন্ত্রী মশাইয়ের অবদান সেটা ভালোই বোঝে শুভ্রা। মানুষটার সাথে সত্যিই কি তার সব সম্পর্ক শেষ? আর কোনই কি আশা নেই? ভাবতে ভাবতে শুভ্রা এলোমেলো পায়চারি করে পুরো বাড়ি জুড়ে। অবাক হয়ে দেখে তাদের বাড়ির সেই পুরনো জৌলুশ আর নেই। একসময় লোকের পদচারণায় মুখর বাড়িটা আজ সুনসান নিরব। ভাইয়া আর ভাবি শিগগিরই দেশের বাইরে চলে যাবে। হয়তো শেষ পর্যন্ত সেই একমাত্র থেকে যাবে এ বাড়িতে।

চলবে।

দর্পহরন পর্ব-৬৯

0

#দর্পহরন
#পর্ব-৬৯

তাহের আর মোর্শেদ মিলে তন্ময়কে থানা থেকে ছাড়িয়ে আনার চেষ্টা করলেও সফল হতে পারলোনা। দিলশাদ বলেই দিলো-“নির্বাচনের পরে আসেন। এইমুহূর্তে কোনভাবেই সম্ভব না। তাছাড়া আপনার ছেলে যে অপরাধ করেছে তার জামিন পাওয়া বা জেল থেকে ছাড়িয়ে নেওয়া সম্ভব না আসলে। নির্বাচন হয়ে যাক, তখন মন্ত্রী স্যারের সাথে পারসোনালি কথা বলে মিটমাটের চেষ্টা করেন। অন্যথায় আপনার ছেলের জীবন শেষ।”
মোর্শেদ পড়লো বিপদে। মিনু তো খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তার এক কথা ছেলে না বাড়ি ফিরলে খাবে না। দুই মেয়ের পরে এই এক ছেলে তার। বেশ আদরে মানুষ হয়েছে বলা যায়। সেই ছেলে কি করে থানায় নোংরা পরিবেশে থাকবে? ভেবে মাথা নষ্ট হওয়ার জোগার মোর্শেদের। কিন্তু নিরুপায় হয়ে মেনে নিয়ে যতটুকু সম্ভব টাকা দিয়ে সুব্যবস্থা দেওয়ার চেষ্টা করলো। আপাতত এর বেশি কিছু করা সম্ভব হচ্ছে না। মোর্শেদ ঠিক করলো নির্বাচন হওয়ার পরই রণর কাছে যাবে। দরকার হলে রণর পায়ে পড়বে ছেলের জন্য।

এদিকে নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে দুটো জিনিস ভাইরাল হয়ে গেলো। একটা রাতের আঁধারে দিলশাদকে মারার ভিডিও আরেকটা ফোন রেকর্ড যেখানে সরকারি দলের খুব উচ্চ পদস্থ একজনের সাথে সালিম সাহেবের কথোপকথন। নির্বাচনি এলাকা তো বটেই সরকারি দলের মধ্যেও শোরগোল পড়ে গেলো। সালিম সাহেবের জন্য এটা বেশ বড়সড় একটা ধাক্কা বটে। এমনিতেই বাড়িতে তন্ময়কে নিয়ে বেশ চাপে আছেন তারউপর নির্বাচনের মাঠে এরকম কোনঠাসা অবস্থা। এই অবস্থায় সালিম সাহেব একেবারেই চুপচাপ হয়ে গেলেন। বাড়ির ভেতর বাহির কোন দিক থেকেই কারো সাহায্য পাচ্ছেন না। তিনি বুঝতে পারছেন নির্বাচনে তার হার আসন্ন। মনে মনে ভীষণ মুড়ষে পড়লেও বাইরে শক্ত ভাব ধরে রেখেছেন। আগের রাতে নিজের কাছের
ছেলেপেলেদের বলে ভোটকেন্দ্র দখলের কথা বলে রাখলো।

মেয়র নির্বাচন মোটেও শান্তিপূর্ন হলো না। সালিম সাহেব সর্ব্বোচ্চ চেষ্টা করলেন। তবে সফল হলেন না। কয়েকটা ভোটকেন্দ্রের ভোট গ্রহন বাতিল হলেও পুলিশী তৎপরতায় ভোটগ্রহন শেষ হলো। বিকেলের দিকে ফলাফল আসতে শুরু করলো। শুরুর দিকে বেশ অনেকগুলো কেন্দ্রে সালিম সাহেব এগিয়ে থাকলেও শেষ মেষ দেখা গেলো সুমনা জিতে গেছে। রাত গভীর হতে হতে প্রায় বেশিরভাগ কেন্দ্রের ফলাফল চলে এলো। দেখা গেলো সুমনা বিপুল ব্যবধানে সালিম সাহেবকে হারাতে চলেছে। প্রথমে দীর্ঘদিনের পারিবারিক আসন সংসদ নির্বাচনে হারানো তারপর মেয়র নির্বাচনে ভরাডুবি, পারিবারিক ভাবে হেও হওয়া সবমিলিয়ে সালিম সাহেবের জন্য বিরাট একটা ধাক্কা। ফলাফল ঘোষণার পর সালিম সাহেব মুষড়ে পড়লো। সারাক্ষণ বাড়িতে চুপচাপ বসে থাকা বা শুয়ে থাকা। দিন দুয়েক পরে ভোরের দিকে সালিম সাহেব ঘুমের মাঝে হার্ট অ্যাটাক করলেন।

*****

নির্বাচনের পরের দিনই মোর্শেদ ছুটে এসেছে রণর কাছে৷ রাজিব যখন বললো মোর্শেদ দেখা করতে চায় তখনই রণর চেহারা গম্ভীর হলো। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে তাদের ভেতরে আসতে বললো। মোর্শেদ আর মিনু দু’জনই এসেছে একসাথে। ওরা বসার ঘরে বসে ছিলো। কিছুক্ষণ পর রণ এলো। মোর্শেদ অসহায় চাহুনি দিয়ে আর্জি জানায়-“বাবা, তন্ময়ের হয়ে মাফ চাই। আমার ছেলেটা ভুল করে ফেলছে। তাকে এবারের মতো মাফ করে দাও। কথা দিচ্ছি আর এমন কিছু হবে না।”
মিনু মোর্শেদের সাথে তাল দিলো-“হ্যা বাবা, এইবারের মতো তন্ময়কে মাফ করে দাও। আমি মা হয়ে অনুরোধ করছি বাবা।”
রণ মাথা নাড়ে-“এটা তো ভুল না। তন্ময় অপরাধ করেছে। আপনারা একবার ভাবেন আমার বোনটাকে সময় মতো উদ্ধার না করলে কি হতো? ওর এই অতিরিক্ত সাহস দেখানো মোটেও ঠিক হয়নি। এই অপরাধের কোন ক্ষমা নেই, হবে না।”
মোর্শেদ হাঁটু গেড়ে বসে যায়-“বাবা, আমার একটামাত্র ছেলে। আবেগের বশে একটা কাজ করে ফেলেছে তার জন্য ওর ভবিষ্যত নষ্ট করে দিয় না বাবা। মানলাম ও খারাপ কাজ করেছে। তোমার বোনকে কিডন্যাপ করেছে কিন্তু যেভাবেই হোক তোমার বোনের কোন ক্ষতি হয়নি। বাবা, এবারের মতো একটা সুযোগ দাও। আমরা ওর বাবা মা, আমাদের জন্য হলেও না দাও।”
“সুযোগ দিলে ভবিষ্যতে আবার এমন কিছু করবেনা এর কি কোন গ্যারান্টি আছে? আপনি জোর দিয়ে বলতে পারবেন যে ও আবার এমন কিছু করবেনা? বলতে পারলে ওকে ছেড়ে দেব।”
মোর্শেদের চেহারা গম্ভীর হলো-“করবে না বাবা। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি।”
রণ মাথা নাড়ে, হেসে বললো-“একটা ব্যাপার জানেন, কথা দেওয়া জিনিসটা খুব খারাপ। কথা দেওয়া হয় কথা না রাখর জন্য। তাই আপনাদের কথা দেওয়ার ব্যাপারটা মানতে পারছি না। একটা কাজ করতে পারেন।”
এতক্ষণে আশার আলো দেখলো মোর্শেদ। সে ব্যস্ত হয়ে জানতে চাইলো-“বাবা, কি করার কথা বলবে? তুমি যা বলবে তাই করবো তবুও আমার ছেলেটাকে জেল থেকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করো।”
“তন্ময়কে চিরদিনের মতো দেশ ছাড়তে হবে। ও আর কোনদিন এদেশে আসতে পারবে না। এবং সেটা হবে এই তিনদিনের মধ্যে। একটা বন্ড লিখে এই শর্তে সাইন করবেন আপনারা সবাই। তাতে যদি রাজি থাকেন তাহলে ভেবে দেখতে পারি।”
মোর্শেদ আর মিনু দু’জনই একে অপরকে দেখলো বোকার মতো। রণ কথা কর্নকুহরে ঢুকাতে কিছুটা বেগ পেতে হলো। কথা মগজে গেথে যাওয়ার পরই দু’জনই হাউমাউ করে উঠলো। মিনু বললো-“ছেলেকে না দেখে কি করে থাকবো বাবা। তাছাড়া আমাদের পরে আমাদের সম্পদের উত্তরাধিকার তো তন্ময়ই। এ কেমন শর্ত বাবা?”
“বোকার মতো কথা বলছেন আন্টি। ক’দিন আগেই তিনমাস মেয়ের কাছে থেকো এসেছেন। এভাবেই ছেলেকে যখন দেখতে মন চাইবে তখন যেয়ে দেখে আসবেন। এ আর এমন কি কঠিন ব্যাপার?”
“তবুও বাবা, এমন কঠিন শর্ত দিয় না বাবা মাকে। সন্তানের জন্য বুক হাহাকার করে বাবা।”
রণ উঠে দাঁড়ায়-“আমার কথা আমি বলে দিলাম আন্টি। আপনাদের কিংবা তন্ময় কাউকেই আর বিশ্বাস করতে পারছি না। আমার বোনের সিকিউরিটির জন্য এতটুকু আমাকে করতেই হবে। আপনারা যদি আমার শর্ত রাজি থাকেন তাহলে তন্ময়ের কাগজপত্র, টিকেট, বন্ডের সাক্ষর সব কাজ শেষ করে নিয়ে আসবেন। আমি সব দেখে তন্ময়কে জেল থেকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করবো।”
বলেই রণ ঘড়ি দেখলো-“সরি আপনাদের আর সময় দিতে পারছি না। জরুরি মিটিং আছে আমার। কি করতে চান আমাকে জানাবেন। আসছি।”

*****

সেদিন ইব্রাহিম নিবাসের সকালটা হলো ভীষণ রকম ভয়ংকর। এমনিতেই গত কয়েক রাত ধরে সবাই দেরিতে ঘুমাতে যায়। সকালে রিমার আর্তচিৎকার সবার আগে শুনতে পেলো শুভ্রাই। ছুটেও এলো সবার আগে। বাবাকে দেখেই ঘটনা আঁচ করতে সময় লাগলো না তার। সে চিৎকার করে শরীফ আর তাহেরকে ডাকলো। তুহিনকে গাড়ি বের করতে বলে হাসপাতালে ফোন করে দিলো। একঘন্টার মধ্যে সালিম সাহেব হাসপাতালের আইসিইউতে। আইসিইউতে একের পর এক টেস্টের পর জানা গেলো হার্ট অ্যাটাকের খবর। শুভ্রা মাথায় হাত দিয়ে বসে যায়। কেন জানে না বাবার এই অবস্থায় জন্য বারবার নিজেকে দায়ী মনেহচ্ছে। নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তার। কেন এমন হলো? সে তো বেশি কিছু চায়নি্ কেবল চেয়েছে বাবার দ্বারা যেন আর কোন খারাপ কাজ না হয়, আর কারো ক্ষতি না হয়। এই চাওয়া কি অন্যায়? শুভ্রা ভীষন মুষড়ে পড়লো। শরীফ তাকে সান্তনা দিলো-“অযথাই নিজেকে দোষ দিস না শুভ্রা। তুই একদম ঠিক আছিস। এমনটা হওয়ারই ছিলো। বাবাকে আর কোনোভাবে থামানো যেত না শুভ্রা।”
“কিন্তু বাবার এই অবস্থার জন্য আমি দায়ী ভাইয়া।”
শুভ্রা কেঁদে দেয়। শরীফ ওর মাথায় হাত রাখে-“বাবা নিজে দায়ী শুভ্রা। সোহেল মারা যাওয়ার পর বাবার নিজেকে শুধরে নেওয়া উচিত ছিলো কিন্তু বাবা তা করেনি। এসব তো হতই আগে অথবা পরে। তুই শুধু শুধু নিজেকে দোষ দিস না।”
শরীফের সান্ত্বনায় সাময়িক সস্তি মিললেও মনটা ছোট হয়ে রইলো শুভ্রার। বারবার আল্লাহকে ডাকে শুভ্রা। এবারের মতো বাবাকে যেন জীবিত ফিরে পায় না হলে মায়ের চোখে সারাজীবনের মতো অপরাধী হয়ে থাকতে হবে। শুভ্রার দোয়া শুনেই বুঝি আল্লাহ সালিম সাহেবের জান বকসে দিলেন। টানা তিনদিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে সালিম সাহেব জীবন ফেরত পেলেন। আরও দু’দিন পরে জানা গেলো সালিম সাহেবের ডান পাশ সম্পূর্ণ প্যারালাইজ।

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

দর্পহরন পর্ব-৬৬+৬৭+৬৮

0

#দর্পহরন
#পর্ব-৬৬

তুলতুলের ছেলে হয়েছে সিজারে। পেটে পানি ভেঙে যাওয়ার কারনে আগেভাগে সিজারের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। সময়ের আগে পৃথিবীতে এসেছে বলে বাচ্চাটাকে ইনকিউবেটরে রাখা হয়েছে। তুলতুলের অবস্থা ক্রিটিক্যাল। সিজারের মাঝে হঠাৎ তার খিচুনি শুরু হয়ে শ্বাস কষ্ট হতে থাকে। তাড়াহুড়ো করে তাকে আইসিইউততে শিফট করা হয়েছে।

নাতির মুখ দেখে সালিম সাহেব যারপরনাই আনন্দিত। তার মনে হলে বাচ্চাটা তার জন্য অত্যান্ত ভাগ্যবান। বাচ্চাটা দু’টো সুসংবাদ নিয়ে এলো তার জন্য। বাচ্চা দেখতে দারুণ সুন্দর হয়েছে। একেবারে তাদের বংশের ধারা পেয়েছে। ভারী স্নেহার্দ হয় সালিম সাহেবের মন। তার সোহেল যেমন তাকে ভালোবাসতো তার সন্তান যেন তার দ্বিগুণ ভালোবাসা দিচ্ছে দাদাকে। নাতির প্রতি অপার স্নেহ অনুভব করে সালিম সাহেব। সে মনে মনে নিশ্চিত হয়ে যায় নির্বাচনে তার জয় সুনিশ্চিত।

এদিকে শরীফ ছোটাছুটি করছে তুলতুলকে নিয়ে। মেয়েটা কিসের জন্য যেন ভয় পেয়েছিল। বারবার মায়ের কথা বলছিল। সেই জন্য ওর মাকে খবর দিয়ে হাসপাতালে এনেছে শরীফ। কিন্তু মনেহচ্ছে এনে আরও বিপাকে পড়েছে। মহিলা সেই থেকে মেয়ের জন্য কেঁদে যাচ্ছেন তো যাচ্ছেন। কোন কিছুতে শান্ত হচ্ছে না। এদিকে ডাক্তারও কোন কথা বলছে না। তুলতুলের অবস্থা আদৌও কেমন সেটা বলছে না। নিজের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। শান্ত হয়ে বসা যাচ্ছে না। শরীফ হাসপাতালের এ মাথা থেকে ও মাথা হেঁটে বেড়ায়।বারবার নিজেকে বলছে, তুলতুলের যেন কিছু না হয়। এই মেয়েটা অনেক কিছু সয়েছে। এবার ওর সুখের পালা। আমি ওকে সুখের স্বাদ পাওয়াতে চাই। তাই ওকে বাঁচতে হবে, বাঁচতেই হবে।

উপরওয়ালা শরীফের প্রার্থনা শুনলেন বলেই দুইদিন পরে তুলতুলের শারীরিক অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল হলো। তাকে আইসিইউ থেকে কেবিনে স্থানান্তর করা হলো। শরীফ যেন নতুন করে নিজের মধ্যে প্রান ফিরে পেলো।

*****

“তোমার আর ও বাড়ি যেতে হবে না ফাহিম। তোমার উচিত হয়নি আমার কথা অমান্য করে ওনার সাথে কাজ করতে রাজি হওয়ার। এতো রিস্ক কেন নিয়েছ?”
ফাহিম অবাক হয়ে রণর দিকে তাকালো-“ভাই, আপনার জন্য এইটুকু করবো না।”
“না করবে না। আমি চাই না আমার কারনে কারো বিন্দু পরিমাণ ক্ষতি হোক। কাল একটা অনর্থ হয়ে যেতে পারতো। দেখেছ তো দিলশাদের অবস্থা? ও পুলিশ কর্মকর্তা হয়েও রেহাই পায়নি। বুঝতে পারছ উনি কতটা ডেয়ারিং?”
“আমি ওনাকে ভয় পাই না ভাই। উনি কিছু করতে পারবে না আমার।”
রণ এবার বিরক্ত হলো-“নায়কোচিত কথা বলো নাতো ফাহিম। তুমি কথা দাও আপাতত ওনার ডোরায় আর যাবে না ফাহিম। সুমনা আপার জন্য ভালো মতো কাজ করো। সুমনা আপা এলে তোমাকে স্থানীয় ভাবে একটা পদ দেওয়ার ব্যবস্থা করবো। আর কাজের ব্যবস্থা করে দেব।”
“ঠিক আছে ভাই আপনি মানা করছেন আর যাব না। একটা কথা ভাই।”
“কি কথা?”
“গতদিন দুপুরে তালই সাহেবের সাথে আমার বাইরে যাওয়ার কথা ছিলো। হঠাৎ ভাবি অসুস্থ হয়ে গেলো। পরে ভাবি ঠিক হইলেও তালই মশাই আর আমাকে নিয়ে বের হয় নাই। আমাকে বাদ দিয়ে তুহিনকে সাথে নিয়ে কই যেন গেছিল। আজব ব্যাপার হইলো এই দুইদিনে তুলতুলকে নিয়ে এতো হইচই হইলো ভাবিকে কোথাও দেখলাম না। না হাসপাতালে না বাসায়।”
রণর ভ্রু কুঁচকে গেলো ফাহিমের কথা শুনে। শুভ্রাকে নিয়ে চিন্তা হলো। এতোকিছুর মধ্যেও শুভ্রার জন্য কনসার্ন এড়াতে পারে না সে। ওর কথা শুনেই বুকের ধকধক বাড়ে। মেয়েটা সেই যে গেলো আর যোগাযোগ হয়নি। মেয়েটা কি তাকে ভুল বুঝলো? হুট করে শুভ্রাকে দেখার তীব্র আকাঙ্খা হলো তার। তবে সেটা ফাহিমকে জানান দিলো না। সে চিন্তাটুকু নিজের মধ্যে রেখে বললো-“নির্বাচন পর্যন্ত সাবধানে থাকবে। একা চলাফেরা করবে না।”

পরদিন বাসায় ফিরতেই মায়ের ডাক এলো-“বাবাই, খুব তো মাকে দোষী বানিয়ে দিয়েছিলি। ওরা বাপ মেয়ে মিলেই চুড়ান্ত খেলাটা খেলছে সেটা আর বিশ্বাস হয় না তাই না?”
রণর মনটা এমনিতেই ভার হয়ে ছিলো। সে কন্ঠে উষ্মা ঢেলে জানতে চাইলো-“আবার কি হলো মা?”
“হচ্ছে তো অনেক কিছুই। বউ বউ করে তোমার মাথা গেছে। তুমি অন্য কিছুই আর দেখছো না।”
“মা পরিস্কার করে বলবে কি হয়েছে?”
“তোমার আদরের বউ ডিভোর্স পেপার সাইন করে পাঠিয়েছে। আশাকরি তোমার এবার আপত্তি নেই ডিভোর্সে।”
রণ থমকায়, ওর মুখের কথাগুলো গুহায় লুকিয়ে যায়। মুখটায় কেউ যেন কসটেপ মেরে দিয়েছে। রণ ধীর পায়ে রুমে ফিরে এলো। কোথায় যেন জীবনের সুর কেটে গেছে। এমনটা কি হওয়ার ছিলো? সে চেয়েছিল বাবার স্বপ্নটা পূরণ করতে। তার অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করতে। সেই ভেবেই দিনরাত পরিশ্রম করে নিজেকে যোগ্য বানিয়ে রাজনীতির মাঠে আগমন। এখন মনেহচ্ছে না এলেই ভালো হতো। এতোদিনের নিয়ম মেনে চলা জীবনটা হঠাৎ অনিয়মের বেড়াজালে বন্দী হয়ে গেলো। মনমগজ ওলট-পালট হয়ে গেলো। একটা সাধারণ সুখের সংসারের স্বপ্নটা কেবলই দূরে সরে যাচ্ছে।

*****

সুমনা আর সালিম সাহেব ময়দানে পাল্টাপাল্টি সমাবেশ ডাকায় সমাবেশ করা নিষিদ্ধ হলো। অতীত টেনে একে অপরকে কাঁদা ছোড়াছুড়ি অব্যাহত থাকলো। নির্বাচন ঘিরে সরকারি দলে একটা বিভক্তি টের পাওয়া গেলো। বয়োজ্যেষ্ঠ কয়েকজন খোলাখুলি ভাবে সালিম সাহেবকে সাপোর্ট দিচ্ছে। আরেকদিকে সুমনার সাপের্টে আছে রণ। নেত্রী নিজে এখন দোটানায় ভুগছেন তিনি কার পক্ষ নেবেন। তার ভীষণ ইচ্ছে ছিলো সালিমকে দল থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার। শুধু সালিম না বয়স্ক যারা তাদেরকে একে একে সরিয়ে দেওয়া। দলে লম্বা সময় ধরে যারা আছেন তারা বেশিরভাগ ক্ষমতা পেলে নিজেদের সম্পদ বাড়াতে তৎপর। দেশের ও জনগনের জন্য কিছু করায় তাদের উৎসাহ কম। এসব দেখে বেশ বিরক্ত হয়েছেন নেত্রী। আসলে নেত্রী চাইছেন দলকে ঢেলে সাজাতে। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য স্মার্ট, শিক্ষিত, টেকনোলজিতে ভালো জ্ঞান আছে এমন তরুন এনার্জিটিক ছেলেমেয়েদের নিয়ে দল সাজাতে। তাছাড়া তার পরে দলের ভার নেওয়ার জন্য কে উপযুক্ত সেটাও যাচাই বাছাই করতে চাইছেন এই সুযোগে। এখন এমন পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে যে ভবিষ্যত ভাবতে গেলে বর্তমানটা ছাড় দিতে হচ্ছে। আজকাল তাই বেশিরভাগ সময় গভীর ভাবনায় মগ্ন থাকছেন নেত্রী।
“মাজহার, সিদ্ধান্তে ভুল হচ্ছে নাকি? সালিমকে কি সামাল দিতে পারবো?”
মাজহার সে কথার উত্তর না দিয়ে জানতে চাইলো-“আচ্ছা, চন্দ্রের সাথে রণর ব্যাপারে কথা হয়েছে কি? সে কি চায়?”
নেত্রী অবাক হলেও নিজেকে সামলে নিলো। প্রশ্নবোধক চাহনি নিয়ে তাকাতেই মাজহার খানিকটা আনমনা হলো-“রণ ছেলেটা বেশ ঠান্ডা মাথার। দেখো সে হয়তো বুঝেছে সালিম সাহেব গ্রীন সিগনাল পেয়েছে আমাদের থেকে অথচ কোন উচ্চবাচ্য করছে না।”
“হতে পারে ব্যক্তিগত জীবনে ব্যস্ত।”
নেত্রীর কথায় মাজহারের ভাবনার জগতে কোন হেরফের হলো কিনা বোঝা গেলোনা।
“ছেলেটার মধ্যে নেতৃত্ব দানের গুণাবলি আছে। সেই সাথে প্রচন্ড সৎ, দায়বদ্ধ। এমন মানুষ পার্টনারের প্রতি লয়াল হয়। এদিকটায় এসে রণর উপর সামান্য দ্বিধা আসছে আমার। মনেহচ্ছে সালিমের মেয়েটাকে সহজে ছাড়তে পারবেনা। ছাড়লেও ওর জীবনে একটা টানাপোড়েন থাকবে।”
নেত্রীর কপালে ভাজ পড়লো দেখে মাজহার হাসলো-“এরকম আরও কয়েকজন পেলে দল নিয়ে তোমার চিন্তা দূর হয়ে যাবে। আরেকটা কথা, রণর কাছে সত্য লুকাবে না। বিয়ের কথা হলে চন্দ্রের ডিপ রিলেশনশিপের ব্যাপারটা ওর কাছে অবশ্যই খোলাসা করে বলবে। না হলে খুব সমস্যা হবে। কারন রণকে কেবল তুমি সত্য দিয়ে বাঁধতে পারবে অন্য কোন কিছু দিয়ে নয়।”
একটু থেমে নিয়ে আবার মুখ খুললো মাজহার-“আর একটা কথা কি জানো, সালিম একবার যখন দূরে সরে গেছে ওকে দূরে রাখাই ভালো হবে।”
নেত্রীকে দ্বিধান্বিত দেখায়-“কিন্তু এখন পিছিয়ে আসার উপায় নেই। তাছাড়া সব সিনিয়ররা ওর পক্ষে।”
“হুমমম। আচ্ছা, ভাগ্যের উপর ছেড়ে দাও সব। যাইহোক তাতে তোমার কোন লস নেই। কাজেই কোন ব্যাপার নিয়ে ভেবোনা।”

একদিকে নেত্রীর ভাবনা অন্যদিকে উত্তপ্ত নির্বাচনের মঞ্চ। এরমধ্যেই ঘটনাটা ঘটলো। রণ সত্যিই ভীষণ অন্যমনস্ক থাকে আজকাল। এই সুযোগে একটা অঘটন ঘটে গেলো। অন্যভাবে বলা যায় সুযোগ পেলে অঘটন ঘটিয়ে ফেললো তন্ময়। খুশিতে তুলে নিলো কিংবা বলা যায় অপহরণ করলো। অথবা আরেকভাবে বলা যায় তন্ময়কে সু্যোগ দেওয়া হলো খুশিকে তুলে নেওয়ার।

#দর্পহরন
#পর্ব-৬৭

মন খারাপ করে জানালার কাছে বসে ছিলো শুভ্রা। তখনই তন্ময়ের গাড়ি ঢুকতে দেখলো। কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে ছিলো শুভ্রা। গাড়িটা না থেমে ভেতর বাড়ির দিকে চলে গেলো। শুভ্রার হুট করে কি মনে হলো সে উঠে দাঁড়ায়। দ্রুত পায়ে ছাদে উঠে এলো। গাড়িটা রঙমহলের সামনে থেমেছে। ভেতরের ওই বাড়িটায় কখনো যাওয়া হয় নি শুভ্রার। ওটা বাবার চ্যালাদের আস্তানা বলে ওখানে বাড়ির মেয়েদের যাওয়া নিষেধ ছিল। তন্ময়ের ওখানে কি কাজ? শুভ্রা সরু চোখে তাকিয়ে থেকে দেখলো তন্ময় নেমে এসে পছনের দরজা খুললো। একটা মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে ভেতরের দিকে গেলো। দূরত্ব বলে মেয়েটার চেহারা পরিস্কার দেখতে না পেলেও শুভ্রার মনটা কেঁপে উঠলো অজানা আশঙ্কায়। তন্ময় কাকে তুলে এনেছে? খুশিকে নয়তো? না তা কি করে হয়? রণ নিশ্চয়ই খুশিদের সিকিউরিটিতে কোন ছাড় দেয়নি? খুশি না হলে কে? মনের মধ্যে আশা প্রশ্নগুলো শুভ্রাকে চঞ্চল করে তুললো। শিরদাঁড়া বেয়ে ভয়ের একটা স্রোত নেমে যাচ্ছে। এরইমধ্যে তন্ময়কে বেড়িয়ে আসতে দেখলো। তন্ময় আশেপাশে তাকালো চোরা চোখে। শুভ্রা লুকিয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর উঁকি দিয়ে তন্ময়কে দেখতে পেলো না কোথাও।

দ্রুত ছাঁদ থেকে নেমে এলো শুভ্রা। নিজের কামরায় বসে ছটফট করছে কি করবে। কোন মেয়েকে তুলে এনেছে সেটা দেখতে হবে তাকে। কিন্তু কার সাহায্য নেবে? হাসপাতাল থেকে ছুটি হয়নি তুলতুলের তাই বাড়ির সকলে তুলতুল আর বাচ্চাকে নিয়ে ব্যস্ত। কাকে বলবে কাকে বলবে না বুঝতে পারছে না শুভ্রা। আবার চুপচাপ বসেও থাকতে পারছে না। মনটা অশান্ত হয়ে আছে। শরীফ থাকলে তাকে বলা যেত কিন্তু সে তুলতুলকে নিয়ে ব্যাস্ত। শুভ্রা ছটফট করতে করতে বসার ঘরে এলো। একবার বাইরে উঁকি দিলো। আজ বাড়ি একটু বেশি নিরব। কাজের লোকগুলো কাজ করছে নিঃশব্দে। বাবা চাচা মিলে কোথাও প্রচারনায় গেছে। চাচী আর মা হয়তো হাসপাতালে। ছোট চাচা ঢাকায়। বাড়ীটাকে আজ মৃত্যু পুরী লাগছে। শুভ্রা কি একবার দেখে আসবে? তন্ময় কোথাও আছে এখন? মেয়েটার সাথে কিছু করছে নাতো? ভয়ে শিউরে উঠলো শুভ্রা। সে তন্ময়ের খোঁজে বেরুল।

*****

ইউনিভার্সিটি থেকে গায়েব হয়েছে খুশি। এই খবর পেতে পেতে বেলা গড়িয়ে গেছে রণর। ততক্ষণে সিকিউরিটির লোকজন পুরো ইউনিভার্সিটিতে খুশিকে খুঁজেছে। চব্বিশ ঘণ্টার আগে নিখোঁজ এর মামলা করা যায় না। রণ এতো কিছুর ধার দিয়ে গেলো না। সে সরাসরি অপহরণের মামলা করলো। প্রধান আসামি করা হলো তন্ময়কে। তাৎক্ষণিকভাবে ইব্রাহিম নিবাসে অপারেশন চালানোর অর্ডার দিলো। অপারেশন এর দায়িত্ব দিলশাদের উপর।

এরপরের ঘটনা অতিদ্রুত ঘটলো। দিলশাদ ফোর্স নিয়ে ইব্রাহিম নিবাসে এলো। কিন্তু প্রবেশ করতে পারলোনা কিছুতেই। গেট খোলা হচ্ছে না। কারণ এ বাড়িতে পুলিশ ঢোকার অনুমতি নেই। হাজারো বাকবিতন্ডার পরর দরজা খুলে দিতে রাজি না হওয়ায় গেটম্যানের হাতে গুলি ছুড়লো দিলশাদ। বলে দিলো সরকারি কাজে বাঁধা দিলে জানে মেরে ফেলবে। ভয়ে বাকীরা গেট থেকে সরে গেলো। একে একে সবাই ইব্রাহিম নিবাসে প্রবেশ করে। পুলিশ ইব্রাহিম নিবাসের প্রধান ভবন তল্লাশি শুরু করে। তন্নতন্ন করে প্রতিটা কামড়া চেক করছে। শুভ্রা বেরিয়ে এসেছে। ও পুলিশ দেখে অবাক হলো। দিলশাদ শুভ্রাকে দেখে সালাম ঠুকলো। শুভ্রা পুলিশী তল্লাশীর কারন জানতে চাইলো। এরইমধ্যে খবর পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন সালিম আর মোর্শেদ। দিলশাদকে দেখেই তেড়ে মারতে এলেন সালিম সাহেব-“কোন সাহসে আমার বাড়িতে ঢুকছোস তুই?”
দিলশাদ হাসলো-“সাহস তো এই পোশাকের। তাছাড়া আদালত থেকে অনুমতি নিয়েই ঢুকছি। দেখি কি কি খাজানা লুকায় রাখছেন বাড়িতে যে এতো লুকোচুরি।”
দিলশাদের উত্তরে সালিমের প্রচন্ত হুঙ্কার শোনা গেলো-“তোরে ওইদিন ছাইড়া দিয়া ভুল করছি। তয় আইজকা ছাড়ুম না। এক্ষন বাইর হ বাড়ি থিকা নাইলে খারাপ হইবো।”
“বের তো হবোই তবে কাজ শেষ হোক আগে। এখন বলুন আপনাদের সুযোগ্য পুত্র তন্ময় কোথায়? কোথায় রেখেছে মন্ত্রী স্যারের বোনকে। যত তাড়াতাড়ি বলবেন তত তাড়াতাড়ি বাঁচবেন। যদি স্যারের বোনের কিছু হয় তাহলে আজ এই ইব্রাহিম নিবাস ধ্বংসস্তুপে পরিনত হবে।”
দিলশাদের ঠান্ডা স্বরে বলা কথাগুলো শুনে মোর্শেদ চমকে উঠলো-“অফিসার আমার ছেলে তো বাসাতেই আছে। তোমার হয়তো বুঝতে ভুল হইছে। তার দ্বারা এমন কিছু করা সম্ভব না।”
দিলশাদ হাসলো-“ডাকেন আপনের ছেলেকে।”
সালিম গজগজ করলো-“তন্ময় বাসায় থাকলে তোর খবর আছে আইজ।”
মোর্শেদ তুহিনকে ইশারায় তন্ময়কে ডেকে আনতে বলে। কিছুক্ষণ পরেই তন্ময় এলো হেলতে দুলতে। পুলিশ দেখে মনে মনে ভরকে গেলেও মুখটা স্বাভাবিক রাখলো। হাই তুলে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো-“আব্বা ডাকছিলেন আমাকে?”
“হহহ। তুই আছিলি কই? পুলিশ আইছে টের পাস নাই?”
“ঘুমায় আছিলাম আব্বা কেমনে টের পাবো?”
তন্ময় আবারও হাই তুললো। সালিম দিলশাদের দিকে তাকিয়ে বললো-“দেখছোস। ওয় বাসাতেই আছিল। কি করবি এখন?”
দিলশাদের অবিচল থেকে বললো-“পুরো বাড়ি তল্লাশি করবো। এই তোমরা যা করছিলে করো। আর খুঁজে দেখো স্যারের বোন আছে কিনা। কোন ঘর যেন বাদ না পড়ে।”
“এই কেউ ঘরে যাবি না কইলাম।”
সালিম সাহেব আঙুল তুলে শাসালেন। তন্ময় অবাক হওয়ার ভান করে বললো-“কাকে খুঁজতেছেন আপনারা? কি হইছে?”
দিলশাদ জবাব দিলো-“কি হইছে একটু পরেই টের পাবা।”
তন্ময় নরম কন্ঠে বললো-“অফিসার, কি বলছেন বুঝতে পারছি না। আমাদের মতো গন্যমান্য মানুষের মান সন্মান নিয়ে এরকম তামাশা করা কি উচিত হচ্ছে?”
দিলশাদ মোলায়েম হাসি ফেরত দিলো-“তামাশা করা কাকে বলে তা আপনার কাছ থেকে শিখতে হবে না স্যার। একটু পরেই টের পাবেন কে তামাশা করছে।”
তন্ময় রেগে গেলো-“আপনি কিন্তু অপমান করছেন আমাদের।”
“ডাকাতদের আবার মান আছে?”
তন্ময় কিছু বলতে যাচ্ছিল তখন দুইজন হাবিলদার আর সাব ইন্সপেক্টর ফিরে এলো-“পেলাম না স্যার। কোনদিকেই খোঁজ পেলাম না।”
দিলশাদের কপালে ভাঁজ পড়লো। যতটুকু শুনেছে তন্ময় আজ একা আসেনি এ বাড়িতে। তাহলে গেলো কোথায় মেয়েটা? অন্য কোথাও রেখেছে?
দিলশাদের ভাবনার মাঝের সালিম তেড়ে এলো-“তোর মন্ত্রী বাপরে যাইয়া ক তার বোন এইখানে নাই। আমাগো রুচি এতো খারাপ হয় নাই যে তার বোনের লাইগা পাগল হইবো আমাগো পোলা। কার না কার লগে ভাইগা গেছে এখন আমাগো নাম দিতেছে। যা ভাগ এখন। তোর এই কাজের সাজা তো তোকে দিবই। নির্বাচনটা পাড় হইতে দে তারপর তোরে দেখতেছি।”
দিলশাদ দাঁতে দাঁত চাপে। বাইরে বেরুতে যাবে তখন হুট করে পেছন থেকে শুভ্রা ডাকলো-“ওসি সাহেব, দাঁড়ান।”
ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা সকলেই বিস্মিত। সালিম সাহেব অবাক হয়ে মেয়েকে দেখলো-“আম্মাজান, কি হইছে?”
শুভ্রা বাবার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এগিয়ে এলো দিলশাদের দিকে-“ওপাশে আমাদের আরেকটা বিল্ডিং আছে। প্লিজ ওদিকটায় একটু দেখুন। আপনারা যার খোঁজ করছেন তার খোঁজ পেয়ে যাবেন হয়তো।”
দিলশাদের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো। সে সাব ইন্সপেক্টর আর হাবিলদারদের ইশারায় সেদিকে যেতে বললো। মোর্শেদ বিস্ময় নিয়ে তন্ময়কে দেখলো। তন্ময় মাথা নামিয়ে নিল। সালিম সাহেব এগিয়ে এসে মেয়ের গালে চড় কষালেন-“আম্মাজান, আপনারে কে কথা কইতে কইছে? জানেন না এই বাড়ির মাইয়ারা বাইরের কোন ব্যাপারে কথা কয় না?”
শুভ্রা অবাক হলো না। সে কেবল গালে হাত দিয়ে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। দিলশাদ এগিয়ে এলো-“বিবাহিত মেয়ের গায়ে হাত তোলা গর্হীত অপরাধ।”
সালিম ঝট করে দিলশাদের গায়ে হাত তুলতে যাচ্ছিল। দিলশাদ হাত ধরে ফেলে ঝাটকা দিলো-“নেভার ডেয়ার সামথিং লাইক দ্যাট। একবার ভুল হয়েছে বলে বারবার মাফ পাবেন না।”
“স্যার, তাড়াতাড়ি আসেন।”
দিলশাদ দৌড়ে গেলো। তন্ময় কটমট করে তাকিয়ে আছে শুভ্রার দিকে-“কাজটা ভালো করলি না শুভ্রা।”
শুভ্রা অসহায় চোখে হাসলো-“তোমাকে বাঁচিয়ে দিলাম।
“পূন্য করছোস। পূন্যের পুরস্কার পাবি।”

“এবার কি বলবেন আপনি মিস্টার সালিম ইব্রাহিম?”
জ্ঞানহীন খুশিকে দেখে মনচোখ কুঁচকে গেলো সালিমের। শুভ্রার বুকের রক্ত ছলকে উঠলো। সে ছুটে গিয়ে খুশিকে ধরলো। আহা! তার মন তবে তাকে ঠিকই বলেছিল? কেন যেন বুকের উপর থেকে একটা পাথর সরে গেলো। সে তাহলে বাঁচাতে পারলো খুশিকে? রণকে দেওয়া কথা রাখতে পারলো, এই আনন্দে লাফ দিতে মন চাইলো।
“মিস্টার তন্ময়, ইউ আর আন্ডার এরেস্ট। চলুন থানায় যাওয়া যাক। আপনার আসল শশুর বাড়িতে।”
হ্যান্ডকাফ নিয়ে এগিয়ে যেতেই মোর্শেদ মাঝে টপকে পড়লো-“খবরদার ওসি, আমার পোলাকে কিছু করবা না। কোথাও যাইবো না আমার পোলা।”
“আমাদের কাজ করতে দিন না হলে খারাপ হবে।”
“দিমু না। কি করবি? এই তুহিন যা তো জিনিস নিয়ায়।”
সালিমের কথা শুনে দিলশাদ বললো-“আমাদের পথ থেকে সরে দাঁড়ান। অনেক ঝামেলা হয়েছে আর করবেন না।”
“সরুম না। যা করার কর দেখি কি করতে পারোস।”
সালিম আর মোর্শেদ অনড় হয়ে তন্ময়ের সামনে দাঁড়ায়। তুহিন কিছুক্ষণ পরই ফিরলো পিস্তল নিয়ে। দিলশাদ তা দেখে শেষ বারের মতো বললো-“সরে যান সালিম সাহেব না হলে গুলি ছুড়তে বাঁধ্য হবো।”
“আমরা বইসা তোমারে চুমা দিমু।”
বলা মাত্রই দিলশাদ সেকেন্ডের গতিতে পিস্তাল বের করে সালিম সাহেবের হাত লক্ষ করে গুলি ছুড়লেন। গুলিটা ডান হাত এফোর ওফোড় করে বেরিয়ে গেলো। সালিম সাহেব ব্যাথায় ককিয়ে উঠলে। দিলশাদ অপেক্ষা না করে পিস্তলের বাট দিয়ে তন্ময়ের মাথায় মারলেন। শেষ পর্যন্ত মোর্শেদের দিকে বন্দুক ধরতেই মোর্শেদ দুইহাত উপরে তুলে সারেন্ডার করলেন। দিলশাদ কেবল তন্ময়কে তুলে নিয়ে চলে গেলো। যাওয়ার আগে শুভ্রাকে কেবল বিদায় জ্বানালো। ফিসফিস করে শুভ্রাকে বললো-“আপনি যোগ্য ভাবির মতো কাজ করলেন। স্যার শুনলে খুব খুশি হবে। স্যারকে বাঁচিয়ে দিলেন ভাবি।”

চলবে।

#দর্পহরন
#পর্ব-৬৮

সালিম সাহেব হাসপাতালে। হাতের তালু ফুটো হয়ে গুলি বেরিয়ে গেছে। রক্ত বন্ধ হচ্ছে না বলে বাধ্য হয়ে তুহিনকে সাথে নিয়ে হাসপাতালে যেতে হয়েছে। মোর্শেদ মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। কি থেকে কি হয়ে গেলো তার মাথায় খেলছে না। সে বাধ্য হয়ে ছোট ভাই তাহেরকে ফোন দিয়ে আসতে বলেছে। তার ভয় হচ্ছে মিনু ফিরে তন্ময়ের কথা জানলে কি করবে? সেই চিন্তায় তার ব্লাড প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে। উকিলের সাথে কথা বলা দরকার কিন্তু সাহস পেলো না। কিভাবে কি করবে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। সে আশেপাশে তাকালো শুভ্রাকে দেখা যায় কিনা। একটু আলাপ সারতেন শুভ্রার সাথে। কিন্তু শুভ্রাকে কোথাও দেখা গেলোনা। নিশ্চয়ই নিজের ঘরে বসে আছে। মনে মনে রেগে গেলো মোর্শেদ। শুভ্রার আজকের কাজের জন্য তার শাস্তি পাওনা হয়েছে। সালিম যদি এবার মেয়েকে কিছু না বলে তাহলে সে নিজে শুভ্রাকে সাজা দেবে। তার ছেলেকে জেলে ঢুকানোর সাজা তো ওকে পেতেই হবে।

বিকেলে শরীফ তুলতুল আর বাচ্চাকে নিয়ে মিনু আর রিমা বাড়ি ফিরলো। তারা তখনো জানতো না ঘটনা। পুরো ঘটনা জানতেই মিনু ভীষণ হইহই করে উঠলো। তখনই পারলে শুভ্রাকে কাঁচা খেয়ে ফেলে অবস্থা। শুভ্রা বড় চাচীর ভয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে রইলো। এরমধ্যে সালিম সাহেব ফিরলো হাত ব্যান্ডেজ করে। তখন মিনু আর রিমার মধ্যে মৃদুস্বরে ঝগড়া চলছে। মিনু সমানে শুভ্রাকে গালিগালাজ করে যাচ্ছিল। রিমা না পেরে প্রতিবাদ করলো-“আপা, বলতে গেলে তন্ময়ের কারণে আমার শুভ্রার ঘর ভাঙছে তবুও কোনদিন কিছু বলি নাই। কিন্তু আপনে তো সম্পর্কের লেহাজ করতেছেন না। যা নয় তাই বলতেছেন আমার মেয়েকে।”
“তো কি করবো? চুমা দিব তোর মেয়েকে? এই বাড়িতে কোনদিন পুলিশ ঢুকে নাই এবার সেইটাও হয়ে গেলো।”
“তাতে শুভ্রার দোষ কোথায় আপা?”
“শুভ্রার দোষ না থাকলে কার দোষ? তোর মাইয়া
বিয়ার আগে কই না কই থাইকা নষ্টামি কইরা আইসা আমাগো ঝামেলায় ফালাইছে। এখন আমার পোলার জীবন ঝুঁকিতে ফালাইলো। তোরে বইলা দিতেছি রিমা, আমার পোলার কিছু হইলে তোরা মাইয়ার জীবন বিষায় দিমু কইলাম।”
“আপা!”
আর্তনাদ করে উঠলো রিমা-“আপনে এই কথা বলতে পারলেন? শুভ্রাকে কি আপনে চিনেন না? ছোট থিকা আপনের হাতেই তো বড় হইছে। কেমনে ওর নামে এইসব বলতে পারলেন? আপনার থিকা এইসব আশা করি নাই আপা। যেইখানে আমার মেয়ের সাজানো সংসারে আপনের ছেলে ঝামেলা করলো, শুভ্রার শাশুড়ী ওকে বের করে দিলো তাও আপনের ছেলে শুধরাইলো না। আর আপনে এখন আইসা আমার মেয়েকে দায়ী করতেছেন? বাহ আপা।”
কথাগুলো সালিম সাহেবের কানে যেতেই সে গর্জে উঠলো-“চুপ করো তোমরা। কি শুরু করছো এইসব? মানুষ তো এইসব দেখলে খুশি হইবো। সবাই চায় আমাদের মধ্যে মিল না থাক। তোমরা সেই দিকে যাইতেছ।”
দুই বউ ভয়ে চুপসে গেলো। কথা বলতে বলতে সালিম সাহেব হাতের যন্ত্রণায় মুখ কুঁচকে ফেললেন। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো-“ভাবি, তোমার কথাগুলো শুনে খুব খারাপ লাগলো। আমি কখনোই আমার বাচ্চা আর তোমার বাচ্চাদের আলাদা চোখে দেখি নাই। ওরা সবাই আমার কাছে এক। যদি তাই না হইতো তাইলে তন্ময়কে আগেই শাসন করতাম। এমনকি ওর জন্য শুভ্রা কষ্ট পাইতেছে জানার পরও আমি তন্ময়কে কিছু কই নাই। আর তুমি আজকে আমার মেয়েকে কতকিছু বললা। খুব কষ্ট পাইলাম তোমার আচরণে।”
মিনু কিছু না বললেও মোর্শেদ মুখ খুললো-“শোন সালিম, কি হইছে না হইছে এইসব জানি না। আমি আমার পোলা ফেরত চাই। নাইলে ভাইরে ভুইলা যাইস।”
বলেই মোর্শেদ উঠে চলে গেলো। তার পিছনে মিনুও গেলো। একেতো হাতের যন্ত্রণা তারউপর মোর্শেদের ব্যবহার। সালিম সাহেব হাতের যন্ত্রণায় টিকে থাকতে না পেরে টলে পড়লেন সোফাতেই।

*****

রণ এলাকায় নিজের বাসায় বসে ছিলো। দিলশাদের পোশাকে লাগানো গোপন ক্যামেরায় ইব্রাহিম নিবাসের সমস্ত ঘটনা লাইভ দেখেছে সে। শেষ মেষ বোনকে সহিসালামত দেখে সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে। খুশি হলো শুভ্রাকে দেখেও। তবে মনের খবর মনেই রাখলো রণ। দিলশাদ খুশিকে নিয়ে আসতেই ঢাকায় আসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় রণ। তার আগে দিলশাদ খুশিকে বুঝিয়ে দিয়ে হাসলো-“ভাই, ভাবি কি করেছে দেখেছেন তো?”
রণ সে কথার জবাব না দিয়ে বললো-“এককাজ কর দিলশাদ। দুটো ভিডিও আপলোড করে দে। নির্বাচনের আর কয়েকটা দিন তো বাকী। শেষ তুরুপের তাসটা ব্যবহার করে ফেল। আশাকরি কাজে দেবে। আর তন্ময় যেন কোন ক্রমেই বেল না পায়। ওর মুখ থেকে স্বীকারোত্তি নিবি যেভাবে হোক।”
দিলশাদ মাথা দুলিয়ে সায় দেয়। রণ খুশিকে নিয়ে ঢাকায় চলে এলো। জলি ভীষণ অস্থির হয়ে আছে। খুশিকে চোখে না দেখা অবধি ঠান্ডা হবে না। খুশি তখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি। ভয়ে শরীর কাঁপছে তার। রণ তাকে শান্ত করার জন্য অনেক কিছু বলছে কিন্তু কোন কিছু তার কানে যাচ্ছে বলে মনেহয় না। শেষে হুট করে ভাইয়ের দিকে তাকায়-“ভাইয়া, আজ ভাবি বাঁচিয়েছে আমাকে। ভাবিকে প্লিজ ফিরিয়ে আনো। মানুষটা কষ্ট পাচ্ছে তোমাকে ছাড়া।”
“মা মানবে না খুশি। তাছাড়া এখন এসব নিয়ে কথা বলার সময় না খুশি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হোক তখন ভেবে দেখবো।”
“ভাবির বাবা ভাবিকে মেরেছে জানে তো? আমাকে বাঁচানোর জন্য না জানি আরও কতকিছু সহ্য করবে মানুষটা।”
রণ বোনের দিকে স্নেহময় দৃষ্টি নিয়ে তাকালো। খুশি এখনো ভয়ে ভীত হয়ে আছে। রণ খুশির মাথায় হাত বুলায়-“এসব নিয়ে ভাবিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

জলি মেয়েকে দেখেই জড়িয়ে ধরলো-“আমার খুশি আসছে রে। আম্মু তুই ঠিক আছিস?”
এতোক্ষণে খুশি কি ছুটা ধাতস্থ, নিজেকে সামলে নিতে পেরেছে। সে মাকে জড়িয়ে ধরে বললো-“আমি ঠিক আছি আম্মু। জানে আর কার কারণে ঠিক আছি? ভাবি। ভাবি আমাকে তন্ময় নামক বিপদের হাত থেকে বাঁচিয়েছে। ভাবি যদি চুপ করে থাকতো তাহলে আমার সাথে জি হ্তো তা ভাবতেও পারছি না।”
“সবই আল্লাহর ইচ্ছা।”
“মা, ভাবি কিন্তু চাইলে আমার জন্য কিছু করলেও পারতো। জানো ভাবির মার খেতে হয়েছে। আরও না জানি কত কি সহ্য করবে।”
জলির মেজাজ খারাপ হলো শুভ্রার গুনগান শুনে-“কি বলতে চাইছিস খুশি?”
“ভাবিকে মেনে নাও মা। কেন যেন ওনাকে আপন আপন লাগে।”
“হয়েছে এসব ফালতু প্যাচাল। হাতমুখ ধুয়ে আয় খাবার দিচ্ছি।”
জলি চলে যাচ্ছিল খুশি পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে জলিকে-“ভাবির উপর খামোখাই রেগে আছো মা। মানুষটা কিন্তু খারাপ না। আচ্ছা তুমি না ভাইয়াকে ভালোবাসো? তুমি তো ভালোমতোই জানো ভাইয়ার খুশি কিসে? তাহলে কেন জেদ করছো মা?”
জলি থমকে গেলো। খুশির সাথে এবার হাসিও জোগ দিলো-“খুশি সত্যি বলছেমা। ভাবি কিন্তু কখনো পরিবারের সাপোর্ট নেয়নি। তাহলে কেন তাকে এরকম সাজা দিচ্ছ? মেনে নাও মা, ভাইয়া খুশি হবে। দেখছো না ভাইয়ার অবস্থা। মুখে না বললেও মনে মনে গুমড়ে মরছে। তুমি চাইলে সবকিছু আগের মতো সুন্দর হয়ে যাবে মা।”
জলি অভিমানে ঠোঁট ওল্টায়-“তোদের সবার কাছে আমিই খারাপ তাই না। অথচ আমি কেন এমন করছি কেউ বুঝতে চাইছে না। তাহলে আমি চলে যাই অন্য কোথায়। তোদের ঝামেলা হবে না। যা খুশি তাই কর তোরা।”
হাসিখুশির মুখের জ্যোতি নিভে গেলো-“মা, কেন বুঝতে চাইছো না?”
আড়াল থেকে মা বোনদের আলাপ শুনলো রণ। মায়ের অনড় মনোভাব দেখে দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। তারপর ধীর পায়ে নিজের ঘরে ফিরে গেলো। আজ শুভ্রাকে মন দিয়ে দেখেছে সে। শুভ্রা বলেছিল, হাসিখুশিকে বোনের নজরে দেখে। কথার কথা ছিলো না সেটা আজ শুভ্রা প্রমান করে দিয়েছে। ভিডিওতে দেখেছে রণ, মেয়েটা এরইমধ্যে ভীষণ শুকিয়ে গেছে। কি যে খারাপ লেগেছে। সালিম সাহেব যখন ওকে মারলো যেন নিজের বুকে আঘাত টের পেলো রণ। আর কখনো কি শুভ্রাকে পাবে না সে? সত্যি কি শুভ্রাকে হারিয়ে ফেললো?

চলবে।
©Farhana_Yesmin

দর্পহরন পর্ব-৬৩+৬৪+৬৫

0

#দর্পহরন
#পর্ব-৬৩

“আম্মা, আপনে আমার হইয়া প্রচারনা করবেন। নির্বাচনে জিতা ওই মা পোলারে শায়েস্তা করুম। গতবার আপনাকে আটকাইয়া থুইয়া আমারে নির্বাচন করতে দেয় নাই। এইবারও আমারে হারাইতে আপনারে ব্যবহার করতেছে। ডিভোর্স লেটার পাঠাইছে যাতে আমি নির্বাচনে প্রচারনা না করি। আপনে কি চান আম্মা? আমি হাইড়া যাই?
বলেন আম্মা, বাপের জন্য করবেন না এইটুক?”
শুভ্রা গাঁট হয়ে বসে ছিলো। মুহুর্তের জন্য একবার বাপের মুখ দেখলো। সালিম সাহেব থামলেন না-“আমার সোহেলকে ইচ্ছা কইরা গুলি কইরা মারছে। তবুও আপনের কথা ভাইবা চুপ কইরা আছিলাম। কিন্তু সেই আপনেই যদি সুখে না থাকেন তাইলে আমি চুপ থাকুম কেন? গতবার আপনের লাইগা নির্বাচন করি নাই এইবার আপনে আমারে নির্বাচনে জিতাইবেন আম্মা। আমার হারানো গৌরব ফেরত আনবেন।”
শুভ্রা চুপচাপ বসে ছিলো। চমকে বাবাকে দেখে ধীরে সুস্থে মাথা ঝাঁকিয়ে বললো-“ঠিক আছে আব্বা। আপনে যা চান তাই হবে। তবে আমার শর্ত আছে একটা।”
সালিম অবাক হয়ে বললো-“নিজের বাপকে শর্ত দিতেছেন আম্মা?”
শুভ্রা জবাব দিলো না। সালিম সাহেব শ্বাস ফেলেন-“কি শর্ত?”
শুভ্রা শান্ত ধীরস্থির ভাবে নিজের শর্ত বললো। সালিম সাহেব মাথা নাড়েন-“ভুল করতেছেন আম্মা। এইরকম কাম আমি করবো না কিছুতেই।”
“নিজের মেয়ের জন্য এতোটুকু পারবেন না আব্বা? আর আপনে দাবি করেন আমাকে ভালোবাসেন। আপনে আসলে নিজেরে ছাড়া কাউরে ভালোবাসেন না। আপনের কাছে আপনের মানসম্মানই বড়।”
সালিম সাহেব চুপ করে যান। মেয়ের এই রুপ দেখা হয়নি আগে। তার সহজ সরল মেয়েটা এতোটা পাল্টে গেলো কবে?

*****

সুমনা আর সালিম সাহেবের প্রচারনা যুদ্ধ খুব খারাপ পর্যায়ে চলে গেলো যখন সুমনার কিছু ব্যক্তিগত ছবি মিডিয়ায় তোলপাড় হলো। ইউনিভার্সিটি জীবনের বিশেষ মানুষের সাথে তোলা ছবি নিয়ে সুমনার চরিত্র তুলোধুনো করা হলো। সেই সাথে তার বিবাহিত জীবন প্রশ্নবিদ্ধ করা হলো। এমন একজন মানুষ যার ব্যক্তিজীবন ঠিক নেই সে কি করে একজন যোগ্য জনপ্রতিনিধি হতে পারে সে প্রশ্ম তোলা হলো সমাবেশগুলোতে।

সালিম সাহেবের উপর পাল্টা আঘাত এলো। শুভ্রার বিদেশ জীবনের কিছু ভিডিও ভাইরাল হয়ে গেলো। ছেলে বন্ধুদের সাথে বারে নাচানাচি, শর্ট ড্রেস পরে ছবি। সালিম সাহেবের দূর্নিতীর কিছু চিত্র। কিভাবে সোহেল মেয়েদের তুলে নিতো যত্রতত্র তার নানা তথ্য। বলা যায় রনাঙ্গন গরম হয়ে গেলো। তবে যেটা হলো শুভ্রা কান্ডে রণ ভীষণ আপসেট হলো। সে এমনিতেই মানসিক ভাবে লো ছিল৷ তারউপর এসব দেখে ভীষণ রেগে গেলো। সরাসরি সুমনাকে চার্জ করে বসলো-“এসব কি সুমনা আপা? আপনাকে তো ভালো ভেবেছিলাম। নেত্রীর কাছে আপনার নাম আমিই রেকমেন্ড করেছিলাম আর আপনি কিনা আমার ব্যক্তিজীবন নিয়ে টানা হেচরা করছেন?”
সুমনাকে বিচলিত দেখালো-“সত্যি বলছি রণ, আমি এসব করিনি। কিভাবে কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না।”
রণর মেজাজ চড়া-“কিভাবে বিশ্বাস করি আপা? আপনি না করালে কে করাবে এসব। শুভ্রাকে নিয়ে তো কারো ব্যক্তিগত আগ্রহ থাকার কথা না।”
“রণ, সত্যি বলছি এসব আমি করিনি। আমার কি মনেহয় জানো, সালিম সাহেব নিজেই এসব করছেন। উনি এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চান। এক নির্বাচনে জিততে চান দুই তোমার আর শুভ্রার ডিভোর্স চান। তুমিই বলো, আমি এসব কেন করবো যেখানে তুমি আমাকে সবরকম সাহায্য করলে নির্বাচন করতে। চাইলে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারো। তাহলে হয়তো বিশ্বাস হবে।”
রণর মাথা দিপদিপ করছে। সে জানে শুভ্রার অতীত কেমন তবুও কেন যেন এসব মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। আফটারঅল শুভ্রা এখন তার বউহয়। রণর বুকে চিনচিনে ব্যথা হয়৷ এই মেয়েটার জন্য আর কতো ভুগতে হবে কে জানে।

নিজের ছবি আর ভিডিও ফাঁস হওয়ার ঘটনা নিয়ে টিভি মিডিয়ায় একের পর এক তথ্য বিশ্লেষণ চলছে। শুভ্রা মন দিয়ে সেসব দেখে। রণর বক্তব্য চাওয়া হয়েছে অনেকবার। প্রতিবার সে নো কমেন্ট বলে এড়িয়ে গেছে। শুভ্রা সেসবও দেখে চুপচাপ। তাকে যেন আর কিছুই ছুঁয়ে যায় না।

*****

“ভাবি, আপনে ডিভোর্স পেপারে সাইন কইরেন না।”
শুভ্রা চমকে তাকায়। দেখলো সামনে ফাহিম দাঁড়িয়ে। ফাহিম আড়চোখে আসপাশ তাকিয়ে দেখলো। শুভ্রা ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে আছে-“কি বলছেন বুঝতে পারছি না। আপনি ভাবির ভাই না?”
ফাহিম মাথা দুলায়-“আপনে ডিভোর্স পেপারে সাইন দিয়েন না। ভাই খুব কষ্ট পাবে।”
শুভ্রার মেজাজ খারাপ হলো। নিজে না পেরে চামচা পাঠিয়েছে রণ। সে রুঢ় ভাষায় বললো-
“সেটা আপনার ভাই এসে বলছে না কেন?”
ফাহিম ফিসফিস করলো-“বলার অবস্থা নাই। তাছাড়া ডিভোর্স পেপার তো সে পাঠায় নাই। তাকে ভুল বুঝে আপনি কাগজে সাইন দিয়েন না।”
“তাহলে কে পাঠিয়েছে?”
শুভ্রার বিস্মিত নজর। ফাহিম আরও একবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে ফিসফিস করলো-“এইসব আপনাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। আপনাদের ডিভোর্স নিয়ে বেশ বড় ডিল হইছে।”
“কি বলছেন এসব? মাথা ঠিক আছে আপনার? কিসের ডিল কার সাথে ডিল?”
ফাহিম মাথা নাড়ে, কিছু বলবে তার আগেই তুহিন এলো। সন্দিহান নজরে তাকিয়ে রইলো ফাহিমের দিকে-“তুমি এইখানে কি করো?”
ফাহিম শুকনো ঠোঁট চেটে নিলো জিভ দিয়ে-“বোনটাকে একটু দেখতে আসছিলাম। মা খাবার রান্না করে পাঠাইছে।”
তুহিনের চোখ থেকে সন্দেহ গেলোনা। তবে কন্ঠ স্বাভাবিক রেখে বললো-“খাবার রেখে যাও। বউমা তো শরীফের সাথে ডাক্তারের কাছে গেছে।”
“আচ্ছা।”
ফাহিম স্বাভাবিক ভাবেই ফিরে গেলো। ওর যেটা কাজ ছিলো সেটা করা হয়েছে বলে খানিকটা সন্তুষ্ট দেখালো ওকে। বোনকে নিয়ে তার অতোটা ভাবনা নেই। কেন যেন শরীফকে ভরসা করছে মন। শরীফ মোটেও সোহেলের মতো নয়। সে ঠিক সামলে নেবে তুলতুলকে। তার চিন্তা সালিম সাহেবকে নিয়ে। এই লোকটাকে কিছুতেই পুনরায় ক্ষমতায় আসতে দেবে না সে।

*****

“চাচা, দিলশাদকে চিনছেন?”
“কার কথা কছ? ওই ওসি?”
সালিম সাহেব তুহিনকে দেখলো। তুহিন মাথা দুলিয়ে বললো-“সোহেলরে গুলি করছিল।”
সালিম সাহেবের চোয়াল শক্ত হলো। তুহিন বুঝেই বললো-“আপনের জামাই এর সহচর। ওর মা টা পাগল। শিকলে বাইন্ধা রাখতে হয়।”
“বাপ কেডা?”
“চিনি না।”
“হুমমম। তুই হঠাৎ ওরে নিয়া পড়লি কেন? হইছেটা কি?”
“কালকা সতন্ত্র দলের সাথে গন্ডগোল হইছে আমাগো পোলাগো। ওসির নির্দেশে আমাগো পাঁচ ছয়জনকে তুইলা নিছে পুলিশ। আপনের পোস্টার ছিড়া ফালাইছে। কয়, আচরণবিধি লংঘন হইছে।
সুমনার হইয়া কাজ করতাছে সরাসরি।”
“কস কি? ওসির সাহস তো ভালোই।”
তুহিন একটু মাথা চুলকায়-“আপনের মনে নাই মনেহয়, ওয় সোহেলরে গ্রেফতার করছিল ছাড়তে চায় নাই। লাগে নিজের ব্যক্তিগত আক্রোশ দেখায়।”
সালিম সাহেবকে চিন্তিত দেখায়। তুহিন গলার স্বর আরও একটু নিচু করলো-“আমাগো ব্যবসায় কড়া নজর রাখছে। কোন বেতাল পাইলেই ধইরা ফালায়। বেচাবিক্রি মেলা কম।”
“আইজকা রাতে দেখা করতে যামু ওসির লগে ওর বাসায়। ব্যবস্থা কর।”
“আরেকটা কথা চাচা। ফাহিমকে শুভ্রার লগে কথা কইতে দেখছি। কেন জানি মনে হইলো, ফাহিম ওরে গোপনে কিছু কইছে।”
চমকে তুহিনকে দেখলো-“তুই কইতে চাস ফাহিম আমার হইয়া কাজ করতেছে এইটা আইওয়াশ?”
“শিওর না। তবে হইতে পারে। ও হঠাৎ কইরা আপনের লাইগা কাজ করতে চাইছে এইটা তো স্বাভাবিক না।”
সালিম সাহেব হাসলেন। উঠে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে পর্দা সরিয়ে বাইরেটা দেখলেন। আনমনা হয়ে বিরবির করলো-“সবাই দেখি আমার লগে খেলা শুরু করছে? আচ্ছা, ক দেখি তুহিন আমি কেমন আছিলাম? সবাই কি ভুইলা গেছে আমি কি করতে পারি? মনে হইতেছে অতীতের সালিমকে ফিরায় আনা লাগবে। এই নির্বাচনে জয়ের লাইগা দরকার হইলে তাই করুম।”
তুহিন সালিম সাহেবকে দেখলো ভয়ে ভয়ে। আবছা আলোয় তাকে দেখে তুহিনের ভয় লাগে।

*****

আজ বাড়ি ফিরতে একটু বেশি রাত হয়ে গেলো দিলশাদের। নির্বাচনের চক্করে ব্যস্ততা বেড়েছে। নির্বাচন না হওয়া অবধি এই ব্যস্ততা থাকবে। এমনিতেই ডিউটি দিতে তার কোন সমস্যা নেই কিন্তু মায়ের জন্য চিন্তা হয়। সে খাবার না দিলে মায়ের খাওয়া হয় না। দুপুরে আজ খাবার খাইয়ে দিয়ে গেছিল। এখন রাত সাড়ে বারোটা। নিশ্চয়ই মানুষটা খিদের জ্বালায় ছটফট করছে? অস্থির হয়ে গাড়ি থেকে নামে দিলশাদ। কলিংবেল বাজাতে গিয়ে টের পেলো দরজা ভেজানো। ভ্রু কুঁচকে গেলো তার। কাজের খালাটা কি নেই? দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতেই গো গো আওয়াজটা কানে এলো। এরকম আওয়াজ তো মা ভয় পেলে বা বাথরুম এলে করে। দিলশাদ ছুটে মায়ের ঘরে আসতেই ওর পা জোড়া থমকে গেলো। ঘরের মধ্যে দু’জন মানুষকে দেখে। ওর মায়ের মুখটা যন্ত্রণায় কালচে হয়ে আছে। সামনের মানুষটা কুৎসিত হাসি দিচ্ছে। মাথার বাঁকা রগটা চিনচিন করে উঠলো। দিলশান চেচিয়ে উঠলো-“আপনি! আমার বাসায়? ঢুকলেন কি করে?”
চমকে দিলশাদের দিকে ফিরলো সালিম। মুখের কুৎসিত হাসি ফিরে এলো-“আরে! আইসা পড়ছো? তোমারে খুব চেনা চেনা লাগতেছিল কিন্তু কই দেখছি মনে করতে পারতেছিলাম না। তাই ভাবলাম তোমার পরিবারকে দেইখা যদি কিছু মনে আসে। এখন তোমার মাকে দেইখা মনে পড়লো। চুকচুক, তোমার মাকে দেইখা খুব কষ্ট পাইলাম। কবে হইছে এমন কও তো? তোমার বাপ ভাই মরার পর? খুবই দুঃখজনক ঘটনা। তোমার জীবন তো বহুত কষ্ট কাটছে দেখা যায়।”
দিলশাদ নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। রাগে দিগবিদিক শুন্য লাগছে তার। সে দাঁতে দাঁত চেপে বললো-“আমার মায়ের কাছ থেকে উঠে আসেন। কি চান আপনে? কেন আসছেন? আর বিনা অনুমতিতে একজন পুলিশ কর্মকর্তার বাসায় ঢোকা গর্হিত অপরাধ।”
সালিম শয়তানের মতো হো হো করে হাসতে লাগলো। তার উচ্চ কন্ঠের হাসি শুনে দিলশাদের মা কেঁপে উঠলো। কো কো করে কাঁদতে লাগলো। দিলশাদের খুব মন চাইলো সালিম সাহেবের কপাল বরাবর গুলি করে মাথা ফাটিয়ে দিতে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালো। সালিম সাহেব বললো-“আমার এলাকায় আমিই আইন এইটা তুমি ভালো মতোই জানো ওসি। শুধু তুমি না তোমার পাগল মাও জানে। দেখো কেমনে কাঁপতেছে। আমাকে দেইখা মুইতা দিছে তোমার মা৷ দেওয়ারই কথা, আমি মানুষটাই এমন ভয়ংকর।”
দিলশাদের হাত পা কাঁপে, শরীর থরথর করে। কথা বলতে চাইলেও পারলো না অতি রাগে। সালিম উঠে এসে দিলশাদের সামনে দাঁড়ায়। তার মুখ থেকে হাসি মুছে গেছে। হিংস্র মুখটায় নিষ্ঠুরতার চিন্হ স্পষ্ট-“তোর ভাইটা বাড়াবাড়ি করছিল তার ফল সে পাইছিল। তোর বাপ মা বাড়াবাড়ি করছিল। অনেকবার ভদ্র ভাষায় মানা করার পরও শোনে নাই। বাধ্য হইয়া তোর মাকে সমাজের সামনে নেংটা করছিলাম। সেই অপমানে তোর বাপ মরছে। সব মনে আছে না তোর? তুই জানোস আমি কি করতে পারি। তুই কি ভাবছেস, আমারে শেষ করবি? এই সালিমরে শেষ করবি? আমার পোলার বুকে গুলি চালাইছোস না তুই? তোর দিন গুনতে থাক। যেদিন আমার মন চাইবো সেই দিন এই দুনিয়ায় তোর শেষ দিন হইবো। তারপর তোরে হারায়া তোর পাগল মা নেংটা হইয়া রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবো। হাহাহা।”

চলবে।

#দর্পহরন
#পর্ব-৬৪

আজকের দিনের ভাইরাল ভিডিও হলো, সুমনার সাথে সরকারি দলের একাধিক মন্ত্রীর গোপন বৈঠক। সেখানে পরিকল্পনা হচ্ছে, সুমনা সতন্ত্র থেকে নির্বাচিত হলে তাকে দলে টেনে নেওয়া হবে। যেহেতু সে মেয়র হবে তাই এলাকায় তার দাপট বাড়াতে সকলে তাকেই সাপোর্ট দেবে, দলের অলিখিত কান্ডারী সেই হবে এবং রণকে একঘরে করে দেওয়া হবে। কারণ প্রথমবার হিসেবে রণ খুব বেশি নেত্রীর এটেনশন সিক করে নিয়েছে। ফলে বাকীরা নেত্রীর কাছে পাত্তা পাচ্ছে না। বড় বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে রণর সাথে পরামর্শ করে যা বর্শীয়ানরা পছন্দ করছে না। এবং যা দলের ভারসাম্য নষ্ট করছে। কাজেই সময় এসেছে রণকে কোনঠাসা করার।

রণ হতভম্ব হয়ে গেলো। হুট করে কি হচ্ছে সে কিছুই বুঝতে পারছে না। সুমনা সতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনের আগ মুহূর্তে কেন গেলো সরকারি দলের কোন মন্ত্রীর বাসায় রণর বুঝে এলো না। সুমনার তো এমন করার কথা না? সে কি রণকে এভয়েড করতে চাইছে? লিয়াজো করে কি করতে চাইছে সুমনা? রণর মাথা গরম হয়ে গেলো। এই মুহূর্তে এমনিতেই তার এলোমেলো হাল এখন নতুন মাথাব্যথা হলো সুমনা। এ যেন হাতে ধরে বিপদ ডেকে আনা।

চারিদিকে তুমুল আলোচনা সমালোচনায় পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইর চলে যাচ্ছে বুঝতে পেরে সুমনা চলে এসেছে রণর আস্তানায়-“রণ, কিছু করো ভাই।”
রাগে দিগবিদিক শুন্য রণ নিজের মেজাজ সামাল দিতে দিতে বললো-“আমার কাছে কেন এসেছেন সুমনা আপা? যাদের সাথে বলো আলোচনা করে আমাকে কোনঠাসা করার পরিকল্পনা করছিলেন তাদের কাছে যান। তারা আপনাকে সাহায্য করবে।”
সুমনাকে অসহায় দেখালো-“কি বলবো রণ, আমি সত্যিই জানতাম না ওখানে তোমাকে নিয়ে আলোচনা হবে। ওনারা খুব ফোর্স করলেন আমাকে যাওয়ার জন্য। তারপর নিজেরাই এটা সেটা বললেন। আমি না বুঝে তাদের কথায় সায় দিয়েছি। তবে এতটুকু বিশ্বাস রাখতে পারো এই সুমনা আপা তোমার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করবে না।”
“বিশ্বাস! আপনাকে? আর মনেহয় সম্ভব না আপা। আপনি জানেন ওরা সালিম সাহেবের লোক। ওরা ওনাকে সাপোর্ট দিচ্ছে। তারপরও কেন গেলেন আপা। ওখানে গেছেন মানে আমার উপর ভরসা নেই আপনার।”
“কিন্তু ওরা চায় আমি জিতি।”
সুমনা নিজেকে বাঁচাতে চাইলো। রণ অস্থির হয়ে চেচিয়ে উঠলো-“আর আপনি বিশ্বাস করলেন? হতে পারে এটা আপনাকে বিতর্কিত করতে কোন চাল।”
সুমনা কিছু বলতে যেয়েও থেমে যায়। কিছুক্ষণ থেমে ম্লান গলায় বললো-“তুমি বিশ্বাস করবেনা হয়তো তবুও বলি। আমি এ ধরনের কোন মানুষের কাছে যেতে চাইনি। বাধ্য হয়ে যেতে হয়েছে। কিভাবে বাধ্য হয়েছি সে বিষয়ে খোলামেলা বলতে পারছি না। তবে কেন যেন মনেহচ্ছে সবাই চায় সালিম সাহেব ক্ষমতায় আসুক।”
“আপা, উনি পুরনো মানুষ ওনার কিছু সাপোর্টার তো থাকবেই। সব দলেই দু’টো পক্ষ থাকে এটা কোন বড় ব্যাপার না। কে কাকে চায় না চায় এটা কি খুব চিন্তার ব্যাপার? আপনি এটা নিশ্চিত থাকুন নেত্রী তাকে চায় না। আর নেত্রী যাকে না চায় তার পক্ষে নির্বাচনে জেতা অসম্ভব ব্যাপার যদি জনগণ পাশে না থাকে। আপনার মোটেও উচিত হয় নাই ওনাদের সাথে দেখা করার। তাহলে আজকে ভিডিও লিক হইতো না। বোঝাই যাচ্ছে কাছের কেউ ইচ্ছা করে ভিডিও লিক করছে আপনাকে কালার করতে। আপনার সাথে আমার সম্পর্ক নষ্ট করতে। এতটুকু না বুঝলে তো আপা আপনার পক্ষে রাজনীতি করা সম্ভব হবে না। যেখানে আপনার প্রতিপক্ষ সালিম সাহেবের মতো কেউ।”
“না যেয়ে কি করতাম রণ? ওনাদের ক্ষমতা কিন্তু কম নয়। আমার তো রাস্ট্রের সব কর্মকর্তার সাপোর্ট লাগবে। কেউ বেঁকে বসলো তো পারবো না ভাই। তুমি একটা জিনিস ভাবো রণ সালিম সাহেব হুট করে এতোটা জ্বলে উঠলো কেন? নিশ্চিত উপর মহলের কেউ তাকে সাহস দিয়েছে। তা না হলে তার হুট করে এতোটা বাড়াবাড়ি করার কথা না। উনি দিলশাদকে কাল রাতে ভীষণ ভাবে মেরেছে জানো এটা? একজন পুলিশের গায়ে হাত তোলা যেনতেন কথা নয় রণ তাও আবার উনি যখন ক্ষমতায় নেই।”
রণ অবাক হলো-“দিলশাদকে? কখন হলো এসব? আমাকে কেউ জানায়নি কেন?”
“কাল রাতের ঘটনা রণ। গতদিন সালিম সাহেবের ছেলেদের সাথে আমার ছেলেদের বচসা হয়েছিল। দিলশাদ সালিম সাহেবের লোকদের গ্রেফতার করেছে। তারপর কাল রাতে এই অবস্থা। এখন বুঝে নাও কি হয়েছে।”
শুনতে শুনতে হুট করে রণ ব্যস্ত হয়ে গেলো। মনটা কেন যেন কু ডাকছে তার। সে সুমনাকে বিদায় দিলো-“আপা, আপনি আর কারে সাথে কোন ধরনের যোগাযোগ করবেন না। ভিডিও নিয়েও কোন স্টেটমেন্ট দেবেন না। আপনি শুধু নিজের মতো প্রচারনা করতে থাকেন। আমি আপনার পেছনে আছি। আপাতত আমার জরুরি কাজে যেতে হবে আপা। আমি আপনার সাথে পরে কথা বলে নেব। ঠিক আছে?”
সুমনা মাথা দুলিয়ে বিদায় নিলো। রণ চেচিয়ে মিহিরকে ডাকে-“দিলশাদের ঘটনা জানোস? ফাহিম কই?”
মিহির মাথা নিচু করলো-“জানি। ওর বাসায় ঘটছে এই ঘটনা। দিলশাদ ঠিক আছে আপাতত কয়েকদিন ছুটি নিয়ে রেস্টে আছে। ফাহিম তো ওইখানে যায়।”
“আমাকে জানাস নাই কেন মিহির?”
রণ চেচিয়ে উঠলো। মিহির ভয় পেলো রণর এমন রুপ দেখে-“আপনে এমনিতেই অনেক টেনশনে তাই আর জানাই নাই ভাই।”
“ফাহিমকে তাড়াতাড়ি ফোন দে। আমার কাছে আসতে বল এখনি।”
মিহির এবার বিস্মিত হয়ে বললো-“কেন? কি হইছে?”
“কথা বাড়াইস না। তাড়াতাড়ি কল দে ফাহিমকে।”
রণ তাড়া দিতেই মিহির দ্রুত হাতে ফাহিমের নাম্বারে কল দিলো। না ফোন ধরছে না ফাহিম। দুইবার তিনবার। রণ ধমকে উঠলো-“ধরছে ফোন?”
মিহির মাথা নাড়ে। রণ নিজের ফোন বেড় করলো দ্রুত হাতে। তার হাত কাঁপছে। কোন অঘটন না ঘটে যায়। কিছু হলে নিজেকে মাফ করতে পারবেনা রণ। তার কপাল বেয়ে ঘাম পড়ছে টপটপ করে। মাথার শিরা দপদপ করে। ফোনটা বেজে যাচ্ছে। ওপাশ থেকে কেউ ধরছে না কেন?

*****

সালিম সাহেব আজ ফাহিমকে সাথে নিয়ে খেতে বসেছেন। সচরাচর এমনটা করেন তিনি। দুপুরে বাসায় খাওয়া হয় না। আজ কি মনে করে খেলেন সাথে ফাহিমকে ডেকে নিলেন। তুলতুল ভাইকে দেখে খুশি হলো আবার হলো না। ফাহিমকে শশুরের ডোরায় দেখে খুব একটা খুশি হয় না সে। শশুর কেমন মানুষ তা সে আর তার পরিবার ভালো জানে। তবুও কেন ফাহিম আগ বাড়িয়ে এ বাড়িতে আসে সেটা সে বোঝে না। শশুরই বা কেন হুট করে তার ভাইয়ের সাথে ভাব করছে সেটাও বোঝে না তুলতুল। এতটুকু বোঝে এখানে হয়তো বিশাল স্বার্থ জড়িয়ে আছে। তা নয়তো ফাহিমকে কাছে টানবে কেন শশুর। সেই চিন্তা থেকেই সে ভাইকে বলেও ফেলেছিল-“ভাইয়া, কেন আসিস? ওনার মতো মানুষের সাথে তোর কিসের কাজ?”
ফাহিম স্বস্নেহে উত্তর দিয়েছে-“তোর জন্য আসি পাগলি। তোকে দেখতে পাই এটাও তো কম না।”
“আমাকে দেখতে হবে না ভাইয়া। তুই আসিস না এখানে। আমার ভালো লাগে না।”
“শরীফ ভাই মানুষটা ভালো তাই নারে বোন? লাগে ওনার সাথে তুই সুখে থাকবি।”
তুলতুল ভাইকে দেখলো কিছু সময় তারপর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে জবাব দিলো-“আমাকে দেখছিস ভাই আর আসিস না। তুই বরং মায়ের খেয়াল রাখিস।”
ফাহিম তুলতুলের কথা কানে তোলেনি। সে বারবার আসছে সালিম সাহেবের কাজ করছে।

আজ খাওয়ার টেবিলে তুলতুলের ডাক পড়লো। ভারি পেট নিয়ে ভীষণ সংকোচে তুলতুলে ডাইনিং এ এলে সালিম সাহেব তাকে বলে-“বউমা, তোমার ভাই প্রথমবার আমাদের সাথে খাইতেছে তাই তোমারে ডাকলাম। ওকে একটু আপ্যায়ন করো। হাজার হোক তোমার শশুরের বাড়িতে প্রথমবার খাইতেছে।”
তুলতুল কথা না বাড়িয়ে ভাই আর শশুরের প্লেটে এটা সেটা তুলে দিলো। সালিম সাহেব আচমকা প্রশ্ন করলো-“বউমা তোমার ডেট যেন কবে?”
“বারো তারিখ।” তুলতুল নিস্প্রভ হয়ে জবাব দিলো।
“নির্বাচনের পরে। ভালোই হইছে। একলগে ডাবল খুশি সেলিব্রেট করবো। শোন ফাহিম, বাচ্চা হওয়ার পর চল্লিশ দিন পার হইলে বউমার লগে শরীরের বিয়া দিমু ধুমধাম কইরা। ঠিক আছে না? তুমি কি কও?”
ফাহিম হাসে-“ঠিক আছে।”
ওদের কথা শুনে খেতে আসা শরীফ খুকখুক কাশে আড়চোখে তুলতুলকে দেখে। মেয়েটা ভাবলেশহীন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেন কোন কিছুতে কিছু আসে যায় না তার।

শুভ্রা নিজের ঘরেই ছিলো। একবার কি কারনে যেন ডাইনিং এ এলো। ফাহিমকে দেখে এগুলো না। চুপচাপ ঘরে ফিরে গেলো। কিছুক্ষন পরে কি মনে করে ফিরে এলো। সালিম সাহেব তখন খাবার শেষ করে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। শুভ্রাকে দেখে জানতে চাইলো-“আম্মাজান, কি হইছে? কিছু কইবেন?”
“আপনি কি কোথাও যাচ্ছেন আব্বা?”
“হহহ। জরুরি কাজে যাইতেছি। কেন?”
শুভ্রাকে অস্থির দেখালো-“আমার কেমুন জানি লাগতাছে আব্বা। আজকে কোথাও যাইয়েন না আপনে।”
সালিম সাহেব চমকে উঠে মেয়ের দিকে তাকালেন। মুখ দেখে বোঝার চেষ্টা করলেন কিছু একটা। মেয়ে কি তার মনের কথা কিছু বুঝতে পারলো? তিনি হাসার চেষ্টা করে বললো-“ডাক্তার ডাকুম? কি হইছে আপনের? আচ্ছা শরীফকে কইতাছি ডাক্তার ডাকতে। আমি এই যামু আর আমু।”
শুভ্রা পাগলের মতো চেচিয়ে উঠলো-“নাহ আব্বা, আপনে যাইয়েন না। আমার মনে হইতেছে আমি বাঁচবো না। আব্বা, আব্বা।”
বলতে বলতে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো শুভ্রা। সালিম সাহেবকে হতবিহ্বল দেখায়। সে ‘আম্মাজান’ বলে চেচিয়ে উঠে মেয়েকে ধরার জন্য ছুটলো।

চলবে।

#দর্পহরন
#পর্ব-৬৫

“আব্বা, বসেন আমার কাছে। কোথাও যাবেন না আপনি।”
শুভ্রার আবদারে সালিম সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন-“আপনে ইচ্ছা কইরা নাটক করছেন আম্মাজান?”
“হ্যা, কারণ আমি চাই না আপনে আর একটাও অন্যায় করেন।”
“কিসের অন্যায়ের কথা কইতেছেন আম্মাজান?”
“যে মেয়েটা ইচ্ছার বিরুদ্ধে আপনার ছেলের সন্তান তার পেটে ধরছে আপনে তার ভাইকে মাইরা ফেলতে চান? কেন আব্বা? এতো নিষ্ঠুরতা কেমনে করতে পারেন?”
সালিম চমকে উঠলো-“এইগুলা কি কন আম্মাজান?”
শুভ্রা বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ভাঙা গলায় বললো-“আপনের বিরুদ্ধে কত অভিযোগ শুনছি, পত্র পত্রিকায় কতো লেখা পড়ছি আব্বা তাও বিশ্বাস হয় নাই। গতকালই আপনারে আর তুহিন ভাইকে কথা কইতে শুইনা ফেলছিলাম। কথাগুলা বিশ্বাস করতে মনচায় না কিন্তু নিজের কানকে অবিশ্বাস করি কেমনে? আমার আব্বা এমন খারাপ মানুষ কেমনে বিশ্বাস করি আব্বা?”
“আম্মাজান, থামেন।”
“কেন থামবো আব্বা? ফাহিমকে কেন মারবেন? ও আপনার জন্য কাজ করে না তাই নাকি আপনার জামাই এর হয়ে কাজ করে তাই? নিজের স্বার্থের জন্য মেয়ের সুখের পথে কাটা হইতেও বাঁধবে না আব্বা?”
শুভ্রার কাটা কাটা কথায় সালিম সাহেবের মেজাজ চড়েছিল। সে হুঙ্কার দিলো-“না বাঁধে না। আপনে কইছিলেন প্রতিশোধ নিতে বিয়া করতেছেন। এখন জামাই জামাই কইরা মরতেছেন। এইদিকে বাপের ইজ্জত নিলামে উঠতেছে তার কোন পরোয়া নাই আপনের। এই আপনের বাপের প্রতি ভালোবাসা?”
শুভ্রা বিস্ময়ে মুক হয়ে গেলো। বাবার এমন রুপ আগে দেখেনি সে। সালিম সাহেবের মেজাজ চড়েছে। সেই চড়া মেজাজ নিয়ে সে বলে উঠলো-“আপনার কথা ভাইবা শত্রুর পোলার লগে আত্মীয়তা করতে রাজি হইছিলাম। আপনার কারণে আমার পোলা মরছে। আপনে আমাগো না জানায়ে দেশে না আসলে এই যে এতোকিছু হইছে এইসবের কিছুই হইতো না। আমি এতোদিনে মন্ত্রী থাকতাম। আপনে দায়ী সবকিছুর জন্য আপনে দায়ী। আপনার কারনে আমি আমার পোলা হারাইছি।”
সালিম সাহেব উঠে দাঁড়ান-“ওই ফকিরের বাচ্চাকে মারবো আমি। বহুত ভদ্রতা দেখাইছি আর না।”
শুভ্রা কিছু না ভেবে পথ রোধ করে দাঁড়ায়-“না আব্বা, এই পাপ আপনাকে করতে দেব না আমি। কোনমতেই না। আপনার পাপের কারনে আমি সাজা পাইছি আর কেউ এই সাজা না পাক আব্বা।”
“পথ ছাড়েন আম্মাজান। আমার কাজে বাঁধা দিয়েন না।”
সালিম সাহেবের হুঙ্কার শুনেও শুভ্রা অটল হয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে-“কিছুতেই না আব্বা। আজকে যদি আপনে চলে যান তাহলে আপনার মেয়ের লাশের উপর দিয়ে যাইতে হবে।”
সালিম সাহেব থেমে যান। হেসে দিলেন শুভ্রার আচরণ দেখে-“আপনে চান আমি না যাই? ফাহিম বাঁইচা থাক?”
শুভ্রা মাথা দুলায়। সালিম সাহেব গম্ভীর হয়ে বললো-“তাইলে ডিভোর্স পেপারে সাইন কইরা দেন। বেশি কিছু চায় না আপনের আব্বা।”
“আব্বা!” শুভ্রা আর্তনাদ করে উঠলো।
“বলেন দিবেন কিনা? নাইলে আইজ অথবা কাইল ফাহিমকে মরতেই হইবো।”
শুভ্রা নিরব হয়ে গেলো। বুকের ভেতর তোলপাড় হচ্ছে। তার বাবা এমন শর্ত আরোপ করতে পারে ভাবেনি কোনদিন। শুভ্রা কাতর গলায় বললো-“কেমন শর্ত দিতেছেন আব্বা? আপনার মেয়ের জীবনের খুশি কাইড়া নিতে চান? কেমন বাপ আপনে?”
“আমি কেমন বাপ তা আপনে জানেন আম্মা। এখন কথা বাড়ায়া লাভ নাই। আপনে যা কিছু করেন না কেন লাভ নাই। হয় ডিভোর্স পেপারে সাইন করেন নয়তো পথ ছাড়েন। আপনে মহান সাজতে চান তো সাজেন। কিন্তু মহান সাজা খুব কঠিন আম্মাজান। এর জন্য অনেক মুল্য চুকাইতে হয়।”
“আব্বা এমন কইরেন না। জেদ কইরা বিয়া করলেও মানুষট ভালো আব্বা। সে তার ভালোবাসা আর ভদ্র ব্যবহার দিয়ে আমাকে পাল্টায়া দিছে। এমন কইরেন না। আমাকে কষ্ট দিয়েন না।”
শুভ্রা কাতর গলায় আকুতি জানায়। ওর চোখ দিয়ে জল গড়াতে শুরু করেছে এরইমধ্যে। সালিম সাহেব জবাব না দিয়ে ডিভোর্স পেপার খুঁজে সামনে মেলে ধরেন-“সাইন করেন নয়তো পথ ছাড়েন। আমি খুব কঠিন মানুষ আম্মাজান। আমাকে এখনো আপনি চেনেন নাই পুরাপুরি।”
শুভ্রাকে হতবিহ্বল দেখায়। কতদিন ধরে এই কাগজটাকে এড়িয়ে যাচ্ছে সে। অথচ আজ আর এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। তুলতুলের সেদিনের বলা কথাগুলো কানে বেজে উঠলো। এই মেয়েটাকে আরও একবার কষ্ট দেওয়ার চিন্তা করাও পাপ হবে। এই পাপ করা তার পক্ষে সম্ভব না।
তুলতুলের মুখটা ভেবে শুভ্রা কাগজ টেনে নিলো। শেষবারের মতো আশায় তাকালো বাবার দিকে-“ভুল করতেছেন আব্বা।”
“আমি ঠিক করতেছি না ভুল তা তাড়াতাড়ি জানবেন আম্মা। সাইন করেন।”
শুভ্রা অশ্রুসিক্ত নয়নে কলম ধরে। কাগজে কলম চেপে ধরতেই বুকটা হুহু করে উঠলো তার।

*****

তুলতুল ভয়ে কাঁপছিল থরথর করে। সোহেল মা*রা যাওয়ার পর ভয়ের জীবন থেকে খানিকটা মুক্তি পেয়েছিল সে। বাচ্চার উসিলায় খানিকটা ভালো জীবন পেয়েছে। আজ হুট করে সব মিছে মনেহচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে টের পাওয়া সত্যিটা তাকে ভীষণ অস্থিরতায় পোড়াচ্ছে। বারবার মা আর ভাইয়ের চেহারা ভাসছে চোখের সামনে। হুট করে তার অসুস্থ লাগতে লাগলো। সে বিছানায় শুয়ে হাসফাস করছে। মালা কয়েকবার করে জানতে চাইলো কিন্তু তুলতুল জবাব দিলো না। কিছুক্ষণ পরে উঠে বসে বমি করে ঘর ভাসিয়ে ফেললো তুলতুল। মালা আতঙ্কিত হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে শরীফকে ডাকতে গেলো-“ভাইজান, ভাবি জানি কেমন করে?”
শরীফ ছুটে এসে দেখে তুলতুলের এই অবস্থা। আতঙ্কিত হয়ে সে তুলতুলকে ধরে-“কি হয়েছে তুলতুল? খারাপ লাগছে?”
তুলতুল বিরবির করলো-“আমার ভাইটাকে ডাকেন তাড়াতাড়ি। ওর কিছু হইলে মা বাঁচবে না। আপনি আমার ভাইটাকে বাঁচান। আপনার পায়ে পড়ি। কথা দিতেছি বাচ্চাটা হইলেই আমি আপনাকে বিয়ে করলো, বাচ্চাটাকেও ভালো বাসবো। সত্যি বলতেছি। আমি শুধু আমার ভাইটাকে বাঁচান।”
শরীফ হতভম্ব হয়ে গেলো-“কি বলো এইসব আবোলতাবোল। হইছেটা কি? শরীর বেশি খারাপ লাগে? দাঁড়াও ডাক্তার ডাকতেছি।”
তুলতুল শরীফের হাত আঁকড়ে ধরলো-“আমার ভাইটাকে ডাকেন। ওকে দেখতে চাই আমি। প্লিজ।”
শরীফ মালাকে বললো-“মাকে ডাক। আর ফাহিম আছে কিনা দেখ। তুহিন ভাইকে এম্বুলেন্স ডাকতে বল।”
মালা ছুটে বেড়িয়ে এলো। মুহূর্তেই সালিম নিবাসে হুড়োহুড়ি পড়ে গেলো। তুলতুল জ্ঞান হারিয়ে ফেললো তখনই। এম্বুলেন্সে যেতে যেতে তুলতুল আঁধবোজা চোখে দেখলো ফাহিম ওর হাত জড়িয়ে ধরে আছে। তুলতুল চোখ দুটো মেলতেই ফাহিম হাউমাউ করলো-“তুলতুল, বোন আমার। আমি এই যে এখানে। তোর কাছে বসে আছি। কিছু ভাবিস না তুই। তুই সুস্থ হয়ে যাবি।”
তুলতুল শুনলো আবারও চোখ বুঁজলো। বিরবির করে কিছু বললো। ফাহিম কান লাগিয়ে কথা শুনতে চাইলো। তুলতুলে বারবার একই কথা বিরবির করছে-“আমার মা বাঁচবে না। মাকে বাঁচাও।”

*****

সালিম সাহেব বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছেন। নিজের অফিস ঘরে বসে আছেন তিনি। সামনে শুভ্রার সাইন করা কাগজ। পা দোলাতে দোলাতে মোবাইল হাতে নিয়ে হাসলো। একটু বুদ্ধি করে না চললে মুসকিল আসলে। এই যে যখন মনেহচ্ছিল তার নির্বাচনে জেতার সব পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে তখনই আচমকা এই পথটা সামনে এলো। এখন নিজের কাজে নিজেরই ভীষণ গর্ব অনুভব হচ্ছে। সালিম সাহেব পা দোলাতে দোলাতে ফোন করলেন। কয়েকবার রিং হতেই ওপাশের মানুষটার কথা শোনা গেলো-“কাজ হয়ে গেছে?”
সালিম হাসলো-“আপনি যা চাইছেন করলাম। এইবার আপনের কথা রাখার পালা। আমার পদ পাক্কা তো?”
“অবশ্যই। কথার নড়চড় হবে না সালিম। তবে তোমাকেও কথা দিতে হবে, রণর পিছু লাগা বন্ধ করবে তুমি। ঠিক আছে?”
“লাগবো না।”
“আর নির্বাচনে উল্টো পাল্টা কিছু করো না।”
“করবো না।”
“তাহলে আর কি। এখন নাকে তেল দিয়ে ঘুমাও। বাকীসব কাজ হয়ে যাবে। আর হ্যা, কাল মনে করে কাগজটা পাঠিয়ে দিয় বাকী কাজ শেষ করার জন্য।”
ওপাশের জন ফোন নামিয়ে রেখেছে। সালিম সাহেব তৃপ্তির হাসি হাসেন। অবশেষে নির্বাচনটা তার হতে যাচ্ছে। নির্বাচনে জিতে প্রথম কাজ হবে ওই দিলশাদকে শেষ করা। শত্রুকে বাঁচিয়ে রাখতে নেই। নয়তো সুযোগ মতে ফনা তুলে ফেলে৷ সালিম সাহেব খ্যাকখ্যাক করে হাসেন। অবশেষে জীবনটা আগের মতো হতে যাচ্ছে দেখে মনটা তুষ্ট। রণ, সুমনা, নেত্র্রীসহ এক ঢিলে কতগুলো পাখিকে শায়েস্তা করা যাবে তা ভেবেই মনটা বাকবাকম করতে চাইছে তার।

চলবে—
©Farhana_Yesmin

দর্পহরন পর্ব-৬০+৬১+৬২

0

#দর্পহরন
#পর্ব-৬০

এলাকার রাজনৈতিক ময়দান উত্তপ্ত। মেয়র নির্বাচনের হাওয়া লেগেছে। নতুন একজনকে নির্বাচনের ময়দানে দেখে সালিম সাহেব অবাক হয়ে মুচকি হাসলো। গতবার সতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিল সিরাজ আহমেদ। সালিম সাহেব জিতলেও ভালো টক্কর দিয়েছিল সিরাজ। হয়তো জিতেও যেত যদি না শেষ মুহূর্তের খেলাটা না খেলতো সালিম। সে কথা ভেবে মিটিমিটি হাসতে হাসতে চেয়ারে দোল খেলো কিছু সময়। গতবারের শিক্ষাটা কি ভুলে গেছে সিরাজ আহমেদ? নাকি সেই ভয়ে নিজে মাঠে না নেমে মেয়েকে এগিয়ে দিয়েছে? অবশ্য যে কান্ড হয়েছিল তাতে তার মুখ দেখানোর অবস্থা নেই। এজন্যই হয়তো মেয়েকে ঠেলে দিয়েছে। সালিম সাহেব নিশ্চিত মনে শ্বাস ফেলে।

চিন্তার বিষয় কেবল মেয়েটা। ওর ভবিষ্যত কি হবে তাই ভাবছে। রণর থেকে কোন সারা নেই। ওর মাতো বলেই দিলো শুভ্রা চায় না ওরা। তাহলে উপায় কি ডিভোর্স ছাড়া? বুকটা চিনচিন করে উঠলো। তাদের পরিবারে ডিভোর্স এর কোন ইতিহাস ছিলো না। শুভ্রার হাত ধরে বুঝি সেটারও চল হয়ে যাবে।

“চাচা, জামাই আসছে এলাকায়।”
তুহিনের কথায় নড়েচড়ে বসলেন সালিম-“কবে?”
“মেলাদিনই হয়ে গেলো।”
“ওহহহ। কিছু করে?”
“মেলা কিছুই তো করে। সুমনা আপা তো ওইখানেই থাকে সারাদিন। এলাকার যারা আপনের এন্টি পার্টি তাদের সাথে দফায় দফায় মিটিং করতেছে। নিজে প্রচরনায় না থাকলেও বুদ্ধি দিতেছে। দক্ষিণ মুড়াপাড়ায় পুরান ব্রিজের পাশে নতুন ব্রিজ বানায় দিলো। ওই দিকের যত নোংরা খাল ছিলো সব সাফ কইরা ফেলছে। আবর্জনা ফেলার মাঠটা খেলার মাঠ বানায়া দিছে। রাস্তা সংস্কারের ঘোষণাও দিছে। শুনলাম আগামী শনিবার সুমনা আপা শো ডাউন কইরা সমাবেশ করবো।”
বিরক্ত হলেন সালিম-“স্বতন্ত্ররে সমর্থন দিছে? ঢাকায় যায় না?”
“কাজ থাকলে যায় আবার চইলা আসে।”
“কি মনেহয়? সবাই কারে চায়?”
তুহিন চুপ করে রইলো। সালিম সাহেব অবশ্য জবাবের আশায় বসে নেই-“মুড়াপাড়ার ওইদিকে যে ময়লার ভাগার আছিল ওইটা কি ঠিক করছে?”
তুহিন অবাক হলো-“নাহ। খুব দূর্গন্ধ হয়। লোকজনের যাওয়া আসার সমস্যা করে।”
“ওইটা পরিস্কারের ব্যবস্থা কর। আর ওইখানে খালের উপর একটা ব্রিজ বানানের কাজও কইরা ফেল। আর কালকে আমি গার্মেন্টস মালিকদের সাথে মিটিং করবো। ব্যবস্থা করিস।”
তুহিন মাথা দুলায়। উসখুস করে। সালিম সাহেব জানতে চাইলো-“কিছু কবি?”
“ফাহিম।”
সালিম সাহেব হাত দেখালেন-“বাদ দে। জোর করার দরকার নাই।”
“না, জোর করমু কেন? সে থাকতে চায় আপনের সাথে।”
“সত্যি কইতাছোস!”
“হুমমম। তাইলে কি কালকে ডাকুম ওরে?”
কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলেন।

রাতে খাওয়ার টেবিলে সবাই যখন উপস্থিত তখনই কথা তুললো সালিম-“ভাইজান, এইবার সবাই একটু নির্বাচনে মন দেই। বাড়ির মেয়েরা যারা আছো সবাই সকাল থিকা প্রচারনায় যাইয়েন।”
মোর্শেদ বললো-“সবাই তো শুনতেছি সতন্ত্ররে সাপোর্ট করতেছে।”
“করুক। আমরা এইবার চেষ্টা করবো মন থিকা, কোন অবহেলা করা যাইব না। আমার জিততেই হইবো নাইলে টিকতে পারুম না। হাত থিকা কাজ সব চইলা যাইতেছে একে একে। ওইদিন মোহন কইলো, চান্দা দিতে চায় না কেউ। এইদিকে ট্যাবলেটের বিক্রি কম। পুলিশের ব্যাপক ধরপাকর চলতাছে। সরকারি একটা কাজও পাই নাই গত একবছরে। কেমনে চলুন বুঝতাছেন?”
শরীফ চুপচাপ খাচ্ছিলো। সালিম সাহেব ওকে ধরলো-“তুই আর তন্ময় আমার সাথে থাকবি শরীফ। ভাইজানতো থাকবোই। নিজের মানুষ থাকলে ভরসা হয়। সোহেল থাকলে অবশ্য তোদের কাউকেই লাগতো না।”
মানা করতে চাইলেও পারলোনা শরীফ। সোহেলের কথা ভেবেই পারলোনা। বলতে পারলোনা, এইসব পাপের সম্রাজ্যে সে সামিল হতে চায় না।

*****

সারাদিনের ক্লান্তি শেষে নিজের রুমে ফিরলো রণ। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে এখানেই থাকছে সে। কাজ থাকলে ঢাকায় যায়, কাজ সেরে ফিরে আসে। মাঝে মাঝে মায়ের খোঁজও নেয় নিয়ম করে তবে ফিরে আসে এখানেই। বলা যায় এক প্রকার মায়ের কাছ থেকে পালিয়ে থাকা।ক্লান্ত শরীরে কাপড় নিয়ে শাওয়ারে ঢুকলো রণ। বেরিয়ে এসে কাপড় পড়ে রান্নাঘরে এসে কড়া করে এককাপ কফি বানালো। পেটে খিদে থাকলেও খাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে না কোন। তীব্র মাথা ব্যাথায় কাতর হয়ে আছে দুপুর থেকে। কফি নিয়ে ঘরেই ফিরে এলো। কফি খেতে খেতে কি মনে করে মোবাইলের গ্যালারিতে ঢুকলো। আমেরিকায় কিছু ছবি তুলেছিল শুভ্রার। সেগুলো বের করে দেখতে লাগলো। মনটা উচাটন হলো খুব। এতো কাছাকাছি থেকে নিজের বউকে না দেখতে পারার বেদনায় হৃদয় তোলপাড় হচ্ছে। খুব মন চায় মেয়েটাকে কাছে ডাকতে। কিন্তু এবার সবকিছুর একটা হেনস্তা করতেই হবে। এভাবে আর ভালো লাগছে না। কিন্তু সমাপ্তিটা কেমন হবে সেটাই সিদ্ধান্ত নিতে পারছেনা। তাতে কি শুভ্রার সাথে তার যোগাযোগ চিরদিনের মধ্যে বন্ধ হবে? মনে দ্বিধা। সে কোন সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে শুভ্রা কি আদৌও তাকে বুঝবে? অসহ্য হয়ে ফোনটা বন্ধ করে রণ। মাথাটা টনটন করে উঠলো। না পেরে চোখ বুঁজে হেলান দিলো।
“আমাকে না দেখতে পেলে আপনার কষ্ট হয় জানতাম। তাহলে কি করে মাস পার করে ফেললেন মন্ত্রী মশায়?”
রণ চমকে উঠে বসলো। ঘোলাটে দৃষ্টি নিয়ে তাকাতেই সামনে শুভ্রাকে দেখতে পেলো। শান্ত হয়ে নিয়ে রণর দিকে তাকিয়ে আছে সে। রন দেখলো কয়েকদিনে বেশ শুকিয়ে গেছে শুভ্রা। তাতে অবশ্য ওর সৌন্দর্য বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। রণ বিস্ময়ে বিমুঢ় হয়ে জানতে চাইলো-“তুমি! এখানে?”
শুভ্রা তাচ্ছিল্যভরে হাসলো-“কেন? এখানে আসতে নেই? এখন কাগজে কলমে আপনার বউ আমি। আসতে পারি তো, তাই না?”
রণ কি বলবে ভেবে পেলো না কেবল মাথা দুলালো। সে তৃষিতের মতো শুভ্রাকে দেখতে লাগলো। শুভ্রার দৃষ্টি স্থির-“আমাকে ছাড়া বেশ ভালোই আছেন দেখা যায়। চন্দ্রের সাথে ভালো সময় কাটছে তাহলে?”
রণর ভ্রু কুঁচকে গেলো-“এসব বলতে এসেছ?”
শুভ্রা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে-“নাহ, আপনার জন্মদিনে উইশ করতে এসেছি। উইশ করা হলে চলে যাব।”
এতোক্ষণে রণর ঠোঁটের হাসির আভাস দেখা দিলো-“তো করছো না কেন?”
শুভ্রা ভ্যাবচ্যাকা খায়। রণকে এতোটা শান্ত দেখে নিজেকে অনাহুত মনেহয়। অতি আবেগি হয়ে খামোখাই চলে আসার জন্য আফসোস হয়। সে কঠিন কন্ঠে বললো-“শুভ জন্মদিন মন্ত্রী মশায়।”
রণ হাসলো-“ধন্যবাদ।”
“আমি আসছি তাহলে।”
শুভ্রা উঠে দাঁড়াতেই রণ এগিয়ে এলো দ্রুত পায়ে-“সেকি! কেক না কেটেই চলে যাবে? তাছাড়া শুধু উইশ করলে হবে? গিফট দিতে হবে না?”
শুভ্রা দু’পা পিছিয়ে যান। রণকে আসতে দেখে ওর বুক কাঁপে। তুললিয়ে বললো-“কি কি কিসের গিফট? খবরদার এগুবেন না আমার দিকে। এতোগুলো দিন একবারের জন্যও খবর না নিয়ে এখন কোন অভিনয় করবেন না।”
রণ ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে এসে শুভ্রার কোমড় জড়িয়ে ধরে-“একশোবার ধরবো হাজারবার ধরবো। তুমিই তো বললে তুমি এখনো আমার বউ। তোমার উপর অধিকার আছে আমার।”
“কিসের অধিকার? অধিকার বুঝলে এভাবে আমায় ছাড়া ভালো থাকতে পারতেন না।”
শুভ্রা নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে মোচড়ামুচড়ি করলে রণ আরও শক্ত করে এটে ধরে তাকে। শরীরের সাথে মিশিয়ে নিয়ে ওর চিবুক ধরে চোখে চোখ রাখে-“নিজের শক্তির অপচয় করো না। আমার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিতে পারবেনা নিজেকে। তাছাড়া আমি ভালো আছি কে বললো তোমাকে? সবসময় বেশি বোঝ। আমি সব ঠিক করার চেষ্টা করছি এইজন্য চুপচাপ আছি।”
শুভ্রা চুপ করে গেলো। দু’জনই একে অপরকে দেখছে। শুভ্রার চোখ ছলছল, দাঁতে ঠোঁট চেপে নিজেকে সামলে নেওয়ার আপ্রান চেষ্টা করছে। রণর সামনে কিছুতেই দূর্বল হবে না সে। রণ হুট করে শুভ্রার কপালে চুমু দেয়। ওর মাথাটা বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়-“আর কয়েকটা দিন ধৈর্য্য ধরবে? সব ঠিক করে দেব আমি। বিশ্বাস রাখো আমার উপর।”
শুভ্রা কাঁদছিল, রণর কথা শুনে ফুঁসে উঠলো-“বিশ্বাস! আপনি রেখেছেন আমার উপর? সেই তো আন্টি যা বলেছে তাই তো বিশ্বাস করেছেন। আর আপনি বলছেন বিশ্বাসের কথা?”
“হ্যা বলছি। কাকে বিশ্বাস করেছি কাকে নয় সেসব এখন ব্যখ্যা করে বলবো না শুভ্রা শুধু বলবো একটু ধৈর্য্য ধরো। কিছুদিন পর সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে।”
শুভ্রা এবার জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো-“কিভাবে ধৈর্য্য ধরবো বলুন তো? যেখানে আপনি আপনার জন্মদিনে আমাকে এতোবড় উপহার দিলেন?”
“কিসের উপহার দিলাম?”
রণ অবাক হতেই শুভ্রার চোখের সামনে কাগজ মেলে দিলো-“ভাবিনি, আপনার এতো তাড়া আছে। আমি আসায় ছিলাম আপনি ফোন করবেন আমাকে। না হলে নিতে আসবেন। কিন্তু সব ধারণা ভুল প্রমান করে এটা পাঠিয়েছেন। ভালো করেছেন। আসলে ভুল তো আমারই। আপনাকে জোর করে বিয়ে করেছিলাম কিনা।”
“আমি এটা করিনি মানে আমি তুমি ভুল…। আমি তোমাকে ফোন করেছিলাম শুভ্রা। তুমিই মোবাইল ফেলে গেছ। আমি কিভাবে…”
রণর কথা শেষ করতে দেয় না শুভ্রা-“আমাদের সম্পর্ক তো শুরু থেকেই শেষের মতো। এটাই ভালো। রোজ রোজকার ঝামেলা থেকে এমনটাই ভালো হবে। শত্রুর সাথে সংসার হয় না আসলে। আমিই বুঝিনি। যাক, ভুল শুধরে নিচ্ছি। আমি সাইন করে দিয়েছি। আপনার জন্মদিনের গিফটের কথা বলছিলেন না। দিয়ে দিলাম সবচেয়ে দামী গিফট। ভালো থাকবেন মন্ত্রী মশায়।”

চলবে।

#দর্পহরন
#পর্ব-৬১

“আমি এমন কিছু করিনি শুভ্রা। প্লিজ ভুল বুঝো না। আমাকে সময় দাও একটু। শুভ্রা চলে যেয় না।”
রণ ভীষণ চিৎকার করে উঠে বসলো। ঘেমে নেয়ে উঠেছে সে। বুকটা ধড়ফড় করছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। কয়েকবার ঢোক গিললো রণ। পানির তৃষ্ণায় মরমর অবস্থা। নিশ্বাস বন্ধ হবো হবো করছে। অনেক কষ্টে বেড সাইড টেবিলের উপর থেকে হাত বাড়িয়ে বোতলটা নিলো সে। ঢকঢক করে প্রায় অর্ধেক বোতল পানি পান করলো। তারপর চুপচাপ বসে থাকলো। এখনো মাথাটা ঠিকঠাক কাজ করছে না তার। অতি জঘন্য স্বপ্নটা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কি মনে হতে ঘড়িটা দেখলো একবার। সাড়ে এগারো বাজছে। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলো গায়ে বাইরের কাপড়। গা চিটচিট করছে।
মাথা থেকে চিন্তা দূর করতেই শাওয়ার নিতে উঠে দাঁড়ায় রণ। মনটা চরম বিষন্ন হয়ে আছে। আজ মায়ের সাথে ভীষণ রকম কথা কাটাকাটি হয়েছে। সেটা ভেবে মনটা আরও সংকুচিত হলো রণর। একদিকে শুভ্রা আরেকদিকে মা। কোনদিকে যাবে সেটাই বুঝতে পারছে না। যে জটিলতা ভয় পেত সেটাই এখন সকাল বিকেল মোকাবিলা করতে হচ্ছে। অসহ্য লাগছে জীবন। শরীর বেয়ে নেমে যাওয়া জল যদি সব সমস্যাগুলো শুষে নিতো তাহলে কতইনা ভালো হতো।

শাওয়ার নিতে নিতে টের পেলো ফোনটা বাজছে।
কোনরকমে গা মুছে ট্রাউজার পরে বেড়িয়ে আসতেই থমকে গেলো সে। বিছানার উপর শুভ্রা বসে আছে। রণর মনে হলো তার হ্যালুশিনেশন হচ্ছে। বারবার চোখ ডলে নিলো। পুনরায় তাকিয়ে দেখলো শুভ্রাকে। হ্যা শুভ্রাই। কেমন কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রণকে হতবিহ্বল দেখায়-“তুমি! সত্যিই তুমি এসেছ!”

উদোম গায়ের রণকে দেখে শুভ্রার ঘোর লাগে। চোখের কঠিন দৃষ্টি কোমল হতে শুরু করে। তার দু চোখ থেকে মুগ্ধতা সরাতে পারে না। মানুষটাকে সেই প্রথম থেকেই ভালো লাগতো শুভ্রার? বিয়েটা কি শুধুই জেদ ছিলো নাকি মনের কোনে কোথাও ভালোলাগাটুকুও ছিলো? আজও বুঝে উঠতে পারে না শুভ্রা। তবে যতটা রাগ রণর উপর হওয়ার কথা ছিলে ততটা রাগ সে কখনোই হতে পারেনি। কেন যেন রণকে দেখলে রাগটা আসে না ঠিকঠাক। আজও অভিমান দেখাতে পারলোনা। রণর দেহসৌষ্ঠব শুভ্রাকে মোহাবিষ্টের টানলো। সে আপনাতেই রণর কাছে এসে দাঁড়ালো। ফোঁটা ফোঁটা জল তখনও রণর গা জুড়ে। তাকিয়ে থাকলে একটা শীতল অনুভূতি ছুঁয়ে যাচ্ছে শরীর জুড়ে। শুভ্রা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো-“আমাকে ছাড়া দিব্যি ভালো আছেন দেখছি। না আমার খবর নিয়েছেন না নিজের খবর দিয়েছেন। তাহলে যা রটেছে তা সত্যি?”
রণ শুভ্রাকে দেখছে একদৃষ্টিতে। মেয়েটাকে কিছুটা এলোমেলো লাগে। স্বাস্থ্য কমেছে, চেহারায় বিষাদ ছেঁয়ে আছে। পরনে সবুজ রঙা তাঁতের শাড়ী চোখে প্রশান্তি দেয়। হুট করে দুঃস্বপ্নটা মনের কোনো উঁকি দিয়ে গেলো। একদম স্বপ্নের মতোই ঘটছে না সবকিছু? যেন নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করছে রণ। বুকের মধ্যে জেঁকে বসা ভয়ের অনুভূতি ফিরে আসছে। তাকে হতবিহ্বল দেখলো। সে হুট করে শুভ্রার কোমড় জড়িয়ে ধরে কাছে টানলো-“ফোনটা ফেলে গেলে কি করে ফোন দেব শুভ্রা? তবুও তো টিভিতে আমার খবর পাচ্ছ তুমি। আমার কি অবস্থা বোঝ? এতদিনে একবার তোমার দেখা পাইনি।”
শুভ্রার চোখের ঘোর বাড়ে। তবুও শ্লেষের সাথে বললো-“আমাকে দেখার ইচ্ছে হয় আপনার?”
শুভ্রার কথায় কষ্ট পেলেও তা প্রকাশ করলোনা রণ-“খুব হয়। যদি অন্য কাউকে দেখে চোখ জুড়াতে পারতাম তাহলে খুশি হতাম মেয়ে। মনের মধ্যে অহর্নিশ যে চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে তা থেকে রেহাই পেতাম। তোমার অভিশাপ এবার কাজে লেগেই গেলো শুভ্রা। তুমি অভিশাপ দিয়েছিলে আমি যেন কষ্ট পাই। এখন নিশ্চয়ই তুমি খুশি?”
রণর কথাগুলো শুনতে শুনতে হৃদয় তোলপাড় হয় শুভ্রার। সে বলেই ফেলে-“মোটেও এরকম কিছু আমি দোয়া করিনি৷ আর আমার খুশির কথা আসছে কেন? আপনার থেকে দূরে যেয়ে থাকায় যদি আমার খুশি হতো তাহলে আমি আপনার সাথে জুড়ে থাকতে চাইতাম না। আফসোস আমাকে বুঝতে পারেননি আপনি।”
রণ শুভ্রার কপালে চুমু দিলো-“তুমিও তো আমাকে বুঝতে চাইছো না শুভ্রা। বারবার দোষী বানিয়ে দিচ্ছ আমাকে। বিশ্বাস করো আমি দোষী না আর না হতে চাই।”
শুভ্রা হুট করে রণকে জড়িয়ে ধরে। ওর বুকে মাথা রেখে হু হু করে কাঁদে-“আর কতদিন এমন চলবে? আমার ভালো লাগছে না কিছু। একটু শান্তিতে থাকতে পারবো কবে বলতে পারেন? আমি মনেহয় পাগল হয়ে যাবো।”
রণর কষ্ট লাগে। নিজেকে অক্ষম মনেহয়। শুভ্রা ফিসফিস করলো-“সারাদিন সবাই আপনাকে উইশ করলো সেই ভিডিও দেখলাম। অথচ আপনার এবারের জন্মদিনের প্রথম উইশটা আমার হওয়ার কথা ছিলো। সেই আমি কিনা উইশ করতে পারলাম না। আপনার বউ হওয়ার পরেও রাতের আঁধারে চুপিচুপি আপনার কাছে আসতে হলো। এই অপমান মানতে কষ্ট হচ্ছে রণ।”
রণ পরপর কয়েকটা চুমু দেয় শুভ্রার গালে। আর্দ্র গলায় বললো-“আর কয়েকটা দিন শুভ্রা। আমি তোমাকে স্বসন্মানে বাড়িতে তুলবো।”
“কিন্তু আন্টি কখনো রাজি হবে না।”
“মাকে মানাবো আমি। এ দায়িত্ব আমার। তুমি ভেবো না।”
“সত্যি বলছেন?”
অধীনে আগ্রহে জানতে চাইলো শুভ্রা। রণ তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকের মাঝে-“হ্যা। দেখে নিয় তুমি।”

*****

এলাকার নির্বাচনী প্রচারনা বেশ জমজমাট। দুই পক্ষ বেশ জোর দিয়ে প্রচারনা করছে। সালিম সাহেব বড়সড় শো ডাইন করলো। এলাকার ছোট মাঝারি সমস্যা সমাধান করছে নিমিষেই। নির্বাচনের বদৌলতেই অনেকদিনের পুরনো ভাগার পরিস্কার হয়ে গেলো। পুরনো ব্রিজটা সারানো হলো। এলাকায় কয়েকটা গভীর কুপ হয়ে গেলো। তবুও যেন নিজের জন্য যতটা জোরালো আওয়াজ চাইছেন ততটা পাচ্ছেন না।

অপরদিকে সুমনার প্রচারনা কিছুটা ভিন্ন। যেহেতু এটা শিল্পাঞ্চল, গার্মেন্টস এলাকা। সে বুদ্ধি করে প্রতিটা গার্মেন্টসে যাচ্ছে মেয়ে কর্মীদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে কিনা দেখতে। যেখানে নেই সেখানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করছে নিজে উদ্যোগ নিচ্ছে। স্কুল কলেজগুলোতে একই কাজ করলো। কিশোর, তরুণ ও যুবকদের প্রোডাক্টিভ বানাতে এলাকায় পাঠাগার ও সংগঠন করার ঘোষণা দিলো। বলাই বাহুল্য, সুমনার উদ্যোগগুলো বেশ প্রসংশা পেলো। অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে দু’জনার জনপ্রিয়তা দেখে বোঝার উপায় নাই কে জিতবে।

এমন অবস্থায় খুব সংবেদনশীল একটা ঘটনা ঘটে গেলো। একদিন সকালে সত্যি সত্যি ডিভোর্স লেটার এলো ইব্রাহিম নিবাসে। পুরো বাড়ি জুড়ে শোকের পরিবেশ সৃষ্টি হলো। শুভ্রা যেন দারুণ শক পেলো। সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারে না। বারবার নেড়েচেড়ে কাগজ দেখতে লাগলো। বলা হয়েছে পুরো কাগজটা যেন শুভ্রা ভালোমতো পড়ে দেখে। কোন শর্তে যদি রাজি না হয় তাহলে জানালে সেই বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। আর যদি আপত্তি না থাকে তাহলে যেন সাইন করে পাঠিয়ে দেয়।

শুভ্রা অবিশ্বাস নিয়ে কাগজটার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে রাতে রণ তাকে আশ্বাস দিয়েছিল সব ঠিক করে ফেলবে। এই কি ঠিক করা! শুভ্রা হু হু করে কেঁদে দিলো। দুইদিন সব নাওয়া খাওয়া বন্ধ তার। বুকের ভেতর উথাল পাথাল দুঃখ। নিজেকেই শেষ করে দিতে মন চাইছে। মেয়ের না খেয়ে থাকার কথা শুনে সালিম সাহেব এলো মেয়ের ঘরে-“আম্মাজান, আপনি নাকি খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিছেন?”
শুভ্রা চুপ করে রইলো। সালিম সাহেব ধৈর্য্য ধরে প্রশ্ন করলো-“আম্মাজান, এমনে থাকলে কি সমস্যা সমাধান হইবো? কথা কন। কি চান আপনে?”
“আমি ওনাকে চাই। ওনারে ছাড়া বাঁচবো না আব্বা। বলেন পারবেন ওনাকে আনতে?”
সালিম সাহেব হতবাক। মেয়ে এতোটা নির্লজ্জ হবে ভাবেননি। শুভ্রা এতটুকুতে ক্ষান্ত হলো না। সে বললো-“আপনাকে কতবার তন্ময় ভাইয়ের কথা বলছি আব্বা। আপনি কি ইচ্ছা করেই আমার কথা কানে নেয় নাই? মেয়ের সংসার হোক তা আপনে চান না আব্বা? কেন নিজ হাতে আমার সংসারটা নষ্ট করলেন?”
“আম্মা, এইসব কি বলতেছেন আপনে? ওরা শত্রু জানার পরও আমি মেনে নিছি। আপনে যেমনে চাইছেন তেমনে সব করছি তাও এই কথা বললেন? আর কেমন স্বামীর জন্য পাগল হইছেন আপনে? যে বেটা বউকে এতোদিন ধরে বাপের বাড়ি ফালায় রাখছে। একদিন দেখতে পর্যন্ত আসে নাই। মায়ের কথায় বউকে ছাড়তে পারে তার জন্য এমন করতেছেন? এইদিন দেখার জন্য আপনাকে এতো ভালোবাসছি?”
শুভ্রার চোখ লাল, মুখটা ক্রোধান্বিত। বাবার কথার প্রতিউত্তর দিতে পারলোনা। সালিম সাহেব বললেন-“ডিভোর্স লেটার পাঠাইছে আর আপনে এখনও ওই বাড়ি যাওয়ার আসা রাখেন? মাথায় কি ঢুকছে আপনের? এইবার তো আমি কিছুতেই আপনারে ওইখানে পাঠাবো না আম্মা। আমার সন্মান এতো ঠুনকো না। আপনে ডিভোর্স দিবেন ওই গোলামের পুতরে। মেলা সহ্য করছি আর না।”
শুভ্রা ভয় পেয়ে চমকে উঠলো। বাবার এমন মেজাজি রুপ অনেক দিন পরে দেখলো কিনা। কিছু বলার সাহস করতে পারে না। সে আকুল হয়ে কাঁদতে শুরু করে। এমন কিছু হোক সে কোনদিন চায়নি কিছুতেই চায়নি।

চলবে।

#দর্পহরন
#পর্ব-৬২

শুভ্রা দিনরাত কাঁদে। তার কান্নায় ঘি ঢাললো সংবাদমাধ্যম আর টিভি মিডিয়া। খবর কিভাবে বাইরে গেলো তা কেউ জানে না। তবে দু’দিনের মধ্যে মন্ত্রী আর তার স্ত্রীর বিচ্ছেদের খবর টক অফ দা কান্ট্রিতে পরিনত হলো। টিভি ছাড়লেই এই খবর। শুভ্রা নিজের মেজাজ ধরে রাখতে পারে না। রিমোট আছড়ে দেয় টিভিতে। রণ কি করে পারলো এসব করতে? বড় বড় আশ্বাস দিয়ে কিনা শেষে ধোঁকাবাজি! অথচ সবার উপরে সে রণকে স্হান দিয়েছিল। শুভ্রার নিজেকে পাগল পাগল লাগে। কারো কোন স্বান্তনা আদরই ওর গায়ে লাগছে না। উল্টো বিষের মতো লাগছে। ইচ্ছে করছে সব ধ্বংস করে দিতে। সালিম সাহেব জোর দিচ্ছেন ডিভোর্স পেপার সাইন করতে। শুভ্রা গাঁট হয়ে বসে থাকে। সেই নিয়ে বাপ মেয়েতে তুমুল অশান্তি। সালিম সাহেবকে তন্ময় আরও বেশি করে উস্কে দিচ্ছে। রিমা কার পক্ষ নেবে তাই বোঝে না। একদিকে মেয়ে আরেকদিকে স্বামী। ইব্রাহিম নিবাসের শান্তি যেন বিদায় নিয়েছে।

বাড়িতে তুলতুলই একমাত্র বিন্দাস। খাচ্ছে ঘুমাচ্ছে বই পড়ছে। শরীফ ওকে নিয়ম করে ডাক্তারের কাছে নিচ্ছে। তুলতুলের সময় ঘনিয়ে আসছে দ্রুত। শরীর ভারি হয়েছে। হাঁটাচলায় কষ্ট হয়। তবুও নিয়ম করে হাঁটতে হয় তাকে। শরীফের আদেশে মালা দায়িত্ব পালনে অনড়। সেদিন অসাবধানে হাঁটতে যেয়ে পড়ে যেতে নেয় তুলতুল৷ শরীফ এসে ওকে ধরে ফেলে। তুলতুল অবাক হলো-“আপনি কি সারাক্ষণ আমার পেছনে থাকেন নাকি?”
শরীফ গম্ভীর-“না থাকলে কি হতো তাই ভাবো।”
“আপনার কাজ নেই? আমার পেছনে পড়ে থাকলে কাজ করেন কখন?”
শরীফ হাসলো-‘”সেসব তোমার না ভাবলেও চলবে। শোন তুলতুল, আমি ভাবছি চল্লিশ দিন পার হলেই তোমার সাথে বিয়েটা করে ফেলবো। কি বলো তুমি?”
তুলতুলের হিঁচকি উঠে যায় শরীফের কথা শুনে। একজন ওয়েল এডুকেটেড ছেলে, ভালো চাকরি করতো। এই লোক কি জন্য তার মতো বিবাহিত মেয়েকে বিয়ে করতে চায় সেটাই বোঝে না তুলতুল। মনে মনে করুনা করে কি? নিজের ভাইয়ের অন্যায়ের দায় চুকাতে চায়? ভাবনাটা মাথায় আসতেই তুলতুলের শরীর ভেঙে আসতে চায়। একজনের ভোগের বস্তু আরেকজনার কাছে করুনার। আসলে সে কি কারো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না?
“কিছু বলছো না যে?”
“কি বলবো? সব সিদ্ধান্ত তো আপনারাই নিচ্ছেন তাহলে আমার বলা না বলায় কিছু আসে যায় কি?”
শরীফ হেসে দেয়-“সবসময় এতো নেগেটিভ ভাবো কেন বলোতো? আমি তো তোমার কথা ভেবে বিয়ে করতে চাইছি। নতুন মা হবে শরীরে হরমোনের হেরফের হবে। তোমার অনেক বেশি বিশ্রাম লাগবে। আমি থাকলে বাচ্চার খেয়াল রাখতে সুবিধা হবে তুমিও পর্যাপ্ত বিশ্রাম পাবে। এখানে অন্য কোন ইস্যু নাই তুলতুল।”
তুলতুল ভ্রুকুটি করলো-“আপনার এতএত ভালো চিন্তা আমার বোঝার কথা না। আর না এগুলো আমি বিশ্বাস করছি। বাচ্চাটা তো আসলে আপনাদেরই। আমি এর বাহক মাত্র। আমি জানি আপনারা যা করতে চাইছেন সবই বাচ্চার ভালোর জন্য।”
শরীফের মুখ মলিন হয়ে গেলো। হতাশা তার চোখেমুখে। কেন যেন সে যাই করে তাতেই তুলতুল ভুল খুঁজে পায়। মানছে সোহেল খারাপ ছিলো অনেক খারাপ আচরণ করেছে তুলতুলের সাথে। তাই বলে সেই দায় শরীফের ভাগ্যে কেন আসবো? শরীফ তো কখনো তুলতুলের সাথে বেয়াদবি করেনি। শরীফ মন খারাপ গলায় বললো-“তোমার কিছু লাগলে মালাকে বলো আমি আসছি।”
শরীফ আচমকা চলে গেলো দেখে তুলতুল অবাক হলো। সে ভেবেছিল আজ আবার নতুন কিছু বইয়ের লিষ্ট ধরিয়ে দেবে শরীফকে কিন্তু সেই সুযোগই পেলো না। তুলতুলের কোন আচরণে কি কষ্ট পেলো শরীফ? তুলতুল কাঁধ ঝাঁকাল। পেলেইবা, তার কি?”

****

“তুহিন, কি অবস্থা? সুমনার আপডেট দে।”
সালিম সাহেবের কথা শুনে তুহিন ঢোক গিললো-“চাচা, আপার কাজের রেসপন্স ভালো। সবাই পছন্দ করতাছে। যদিও ভোট কারে দিব তা বোঝার উপায় নেই।”
সালিম দাঁতে দাঁত চাপে-“বুদ্ধি তো হা*রা*ম*জা*দা জামাই দিতেছে। ওর বুদ্ধি নিয়া সুমনা উড়তাছে। ওর জামাই এর লগে কি হইছে কোন খবর বাইর করতে পারছোস?”
তুহিন মাথা নাড়ে-“সব কিছু ঠিকঠাক। কেমনে খবর বাইর করুম? কোন কিছু পাইতেছি না।”
“কিছু না থাকলে এইখানে পইড়া আছে কেন? বাইর কর খোঁজ। ভুল ছাড়া কোন মানুষ হয় না। অবশ্যই ওর কোন না কোন দূর্বলতা আছে। লোক লাগায়া রাখ কিছু না কিছু পাওয়া যাইবোই।”
তুহিন মাথা দুলায়। সালিম সাহেব খানিকটা সময় ভাবলেন-“শোন, এক কাজ কর। একটা খবর লিক কর।”
তুহিন উৎসাহের সাথে জানতে চাইলো-“কি খবর?”
সালিম সাহেব তুহিনকে কাছে ডাকলো। ফিসফিস করে যা বললো তা শুনে তুহিনের চোখ কপালে-“কিন্তু আপা!”
“আমি সামলায় নিমুনে তুই খালি ম্যাচের কাঠিতে আগুন জ্বালা।”
“আচ্ছা।”
তুহিন চলে গেলো। সালিম সাহেব চেয়ারে দোল খায়। ঠোঁটের কোনে ক্রুর হাসির রেখা। সালিমের মতো পাকা খেলোয়াড়ের সাথে টক্কর দেওয়ার সিদ্ধান্ত ভুল, শত্রু পক্ষ এবার হাড়ে হাড়ে টের পাবে সেটা।

*****

“মা, তুমি এতোটা নিচে নামবে ভাবিনি।”
রণর এমন কথায় জলি অবাক হলো-“কোন বিষয়ে মাকে দোষী ভাবছিস বাবাই?”
“এই যে শুভ্রার সাথে আমার ডিভোর্স নিউজ মিডিয়ায় ঘুরছে এটা নিশ্চয়ই তোমার কাজ। আমাকে বাধ্য করতে চাইছো যাতে বিয়েটা ভেঙে দেই।”
জলি হতবাক হয়ে ছেলেকে দেখলো। তারপর হেসে দিলো-“ছেলেরা বিয়ের পর সত্যিই পাল্টে যায় দেখছি। সবাই বলতো আমি ভাবতাম আমার বাবাই কখনো পাল্টাবে না। কিন্তু আমার ভাবনা ভুল প্রমান করে দিয়ে তুইও পাল্টে গেলি?”
রণ থতমত খায়৷ কি জবাব দেবে মাকে বুঝে পেলো না। তাহলে কি জলি এ কাজ করেনি? কে করেছে তবে? জলির মুখের হাসি বদলে গেছে। চেহারায় গম্ভীরতা-“আপার সাথে কথা হয়েছে আমার। মেয়েটা ডিভোর্স লেটার সই করে পাঠালে তোর আর চন্দ্রের বিয়ের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবে আপা।”
রণর চোয়াল শক্ত হলো-“তুমি মিছে স্বপ্ন দেখছো মা। এরকমটা কখনোই সম্ভব হবে না।”
“অনেক বলেছ রণ আর না। ভাবো কি তুমি নিজেকে? তুমি যা করছো সব ঠিক আর আমি ভুল? চুল সব এমনিতেই পেকেছে বলে মনেহয় তোমার। প্রথমত তুমি একটা অন্যায় করেছিলে ওই খুনির মেয়েটাকে আঁটকে রেখে। তোমার ভুলের কারণে আমরা পস্তাচ্ছি সবাই। শত্রুর মেয়েকে ঘরে তুলতে হয়েছে। তবুও তোমার মধ্যে অনুশোচনা নেই। শোন, পরিস্কার বলে দিচ্ছি তোমাকে, এরপর তোমার এমন কোন ভুল আর মানবো না আমি। আমি চাই তুমি মায়ের কথা শুনবে বাধ্য ছেলের মতো। আপা যখন আগ্রহ দেখিয়েছেন তার সাথে আত্মীয়তা করতে চাই আমি। এতে তোমার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে উন্নতির সাথে সাথে জীবনের নিশ্চয়তা পাবে। আমি নিশ্চিত ওই খুনিটা এবার তোমাকে টার্গেট করবে। তুমি ভুলে যেয় না ওর ছেলেটা মারা গেছে তোমার কারণে। ও নির্ঘাত প্রতিশোধ নিতে চাইবে। এখন তোমাকে একমাত্র আপাই বাঁচাতে পারে। আপার ছত্রছায়ায় থাকলে সালিম কখনো সাহস পাবে না তোমার কিছু করতে।”
“আমি নিজেকে বাঁচাতে পারি মা। অন্য কাউকে প্রয়োজন নেই।”
“তোর বাবাও এসব বলতো বাবাই। তারপর কি হয়েছে নিজের চোখে দেখেছিস। আমি চাই না হিস্ট্রি রিপিট হোক। আত্মবিশ্বাস ভালো তবে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস না।”
“তুমি খামোখাই ভয় পাও মা। বলছি তো কিছু হবে না।”
“আমি স্বামীকে হারিয়েছি বাবাই সন্তান হারানোর মতো মানসিক জোর নেই আমার। তোর জীবনের বিনিময়ে আপোষ করেছিলাম। বুকে পাথর রেখে মেয়েটাকে বউ বানিয়েছিলাম। কিন্তু আর পারছি না রণ। সত্যি বলতে আমার কষ্ট হয় ওকে দেখলে। আমার বৈধব্যের জীবন মনে পড়ে, তোর কষ্টের কথা মনে পড়ে। আর বেশি কিছু বলতে চাই না আমি। এরপরও তোর যদি এতই নিজের জেদ বজায় রাখতে মন চায় তাহলে বরং আমাকে মেরে ফেল তারপর যা খুশি তাই কর।”
“মা!”
আর্তনাদ করে উঠলো রণ-“মেয়েটাকে ভুল বুঝছো তুমি। ও ওর বাবার মতো নয় মা। শুধু শুধু ওকে সাজা দিয় না। তোমারও দু’টো মেয়ে আছে, তাদের কথা ভাবো মা।”
জলি অটল গলায় বললো-“কোন কিছুই ভাববো না আমি। ওদের তরফ থেকে ডিভোর্স লেটার এলে তোকে সবটা মেনে নিতে হবে রণ।”
“মানে কি মা? কি বলতে চাইছো তুমি?”
“মানে ডিভোর্স লেটার আমি পাঠাইনি। কিন্তু যদি ওই মেয়েটার সাইন করা লেটার আসে তাহলে তোকে মেনে নিতে হবে। জীবনে এগিয়ে যেতে হনে। বল, রাজি আছিস?”
রণকে দ্বিধান্বিত দেখায়। মা ডিভোর্স লেটার না পাঠালে কিসের ভিত্তিতে এতো নিউজ হচ্ছে? কে করছে এসব? কার কি লাভ এতে? আর শুভ্রা কি সত্যিই ডিভোর্স লেটারে সাইন করবে? নিশ্চয়ই না। যদি করে? রণ কি করবে তখন?

চলবে।

দর্পহরন পর্ব-৫৮+৫৯

0

#দর্পহরন
#পর্ব-৫৮

ইব্রাহিম নিবাস মৃত্যুপুরীর চাইতেও শান্ত হয়ে আছে। এ যেন ঝড় ওঠার আগের মুহূর্ত। কাজের লোকগুলোও ত্রস্ত পায়ে কাজ সাড়ে। সামান্য আওয়াজে চমকে ওঠে। বাড়ির সবার খাবারে অনিয়ম হলেও এক তুলতুলের জন্য নিয়ম করে উনুন জ্বলে। বাকি কেউই ঠিকঠাক খায় না। সালিম সাহেব আজকাল বাড়িতেই থাকছেন না। মেয়র নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন জোরেশোরে। সেই সু্যোগে মেয়ের চোখের সামনে থাকতে হচ্ছে না তার। জানে, মেয়েকে দেখলে মাথা এলোমেলো হবে।

আর শুভ্রা একেবারেই চুপ মেরে গেছে। আসার পর থেকে কারো সাথে কোন কথা নেই। চুপচাপ নিজের ঘরে বসে থাকে। ঠিক যেমনটা ছিল বিয়ের আগে থাকতো। সালিম সাহেব মনেকরে ফোন কিনে এনেছেন পরদিনই। কিন্তু শুভ্রা তা ছুঁয়েও দেখেনি। যে নাম্বারে রণ ফোন দেবে সেটা তো ফেলেই এসেছে। আর নিজ থেকে রণকে ফোন দেওয়ার ইচ্ছে বা সাহস কোনটাই নেই তার৷ রণ যদি মায়ের মতো তাকে ভুল বোঝে অপমান করে তাহলে মেনে নিতে পারবে না শুভ্রা। হতাশা ঘিরে ধরে তাকে। রণর সাথে তার সম্পর্কটা কতটা গভীর হয়েছে সেসব ভাবার সুযোগ কখনো হয়নি। শুধু এতোটুকু বিশ্বাস ছিলো, রণ ওকে কাছে টেনেছে মানে সম্পর্কটা নিয়ে সে সিরিয়াস। কিন্তু এখন কয়দিনে একবারও রণর ফোন না পেয়ে সেই বিশ্বাসটা ধীরে ধীরে কমে আসছে। টিভি চালিয়ে বসলো শুভ্রা। ইউটিউব খুঁজে খুঁজে রণর খবরগুলো দেখে সে। তার ফেরার খবরটাও এভাবেই পেয়েছে। তারপর মনে মনে প্রতীক্ষা করেছে রণ হয়তো ওকে নিতে আসবে। ধীরে ধীরে বুঝে গেছে রণ আসবে না। সেও হয়তো মায়ের কথা শুনে শুভ্রাকে দোষী ভেবে বসেছে। শুভ্রা টিভির সাউন্ড মিউট করে দিয়ে একদৃষ্টিতে রণকে দেখতে লাগলো। কালকের কোন একটা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছে। রণকে দেখতে দেখতে শুভ্রার চোখ ঝাপসা হলো।
“আপা, কি করছো?”
তুলতুলের কন্ঠ শুনে দ্রুত হাতে চোখ মুছলো শুভ্রা। টিভির রিমোট হাতে নিলো কিন্তু তার আগেই তুলতুল টিভিতে চলা রণর ভিডিও দেখে ফেললো। হেসে এগিয়ে এসে শুভ্রার সামনে বসলো-“ভাইয়াকে দেখছো?”
শুভ্রা টিভি বন্ধ করে দিলো। তুলতুল বললো-“তুমি কি কাঁদছিলে নাকি আপা?”
শুভ্রা এবারও জবাব দিলো না। তুলতুলের হাতের বইটা দেখলো একবার। হুমায়ুন আহমেদের এলেবেলে বইতা ওর হাতে। তুলতুল শুভ্রার দৃষ্টি লক্ষ্য করে হাসলো-“এটা পড়বে? ভীষণ হাসির বই। তোমার মন ভালো হয়ে যাবে।”
শুভ্রা ক্ষীণস্বরে বললো-“আমার মন খারাপ কে বললো?”
“আচ্ছা, মন ভালো? তাহলে তো ভালোই হলো। শোন, আজ আমার সাথে যাবে?”
শুভ্রা অবাক হলো-“কোথায়?”
“ডাক্তারের কাছে। আজ আমার রেগুলার ভিজিট ডে।”
শুভ্রা মিইয়ে গেলো-“নাহ, তুমি যাও ভাবি। আমার ভালো লাগে না বাইরে যেতে।”
“তুমি বুঝি দুলাভাইকে ভালোবাসো?”
শুভ্রার ভ্রু কুঁচকে গেলো-“হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?”
“এমনিতেই। ভালোবাসা জিনিসটা কেমন সেটা খুব বুঝতে ইচ্ছে করে।”
শুভ্রা থমকে গেলো। তুলতুল এমনভাবে বললো যে উত্তর যোগালো না শুভ্রার মুখে। তুলতুল মৃদুস্বরে বললো-“তোমার ভাই তো আমাকে তুলে এনেছিল তারপর দিনভর রে*প করলো। তখন খুব হট্টগোল হচ্ছিল বলে বাঁচার জন্য তোমার বাবা জোর করে বিয়ে করয়ে দিলো। তারপর প্রতিদিন বৈধ ভাবে রে*প হতাম। মজার না ব্যাপারটা?”
বলতে বলতে তুলতুল খিলখিলিয়ে হাসে। শুভ্রা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। তুলতুল হাসতে হাসতে পেটে হাত দেয়-“তোমার ভাইয়ের আবার মরার আগে শখ জেগেছিল। আমাকে প্রায়ই বলতো, আমি কেন নিজ থেকে তার কাছে যাই না। বলো দেখি, কে সেধে সেধে নিজের ইজ্জত খোঁয়াতে চাইবে? আমার তো তাকে ঘৃনা হতো নিজ থেকে কিভাবে কাছে যাব? সত্যি বলতে তোমার ভাইটা মরার পর আমি খুব খুশি হয়েছিলাম জানো। মনে হয়েছিল এবার আমি মুক্তি পেলাম। অথচ কপাল দেখো, মানুষটা যেতে যেতে ঠিকই আমার পায়ে শিকল পরিয়ে দিলো। হা হা হা। শয়তান যে সহজে পিছু ছাড়ে না সেটা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। হিহিহি।”
তুলতুল হাসতে হাসতে মুখে আঁচল চাপা দিলো। শুভ্রা অস্ফুটে চেচিয়ে উঠলো-“ভাবি!”
তুলতুল থেমে যায়, পেটের দিকে ইশারা করলো-“যদি ছেলে হয় তাহলে নিশ্চিত বাবা দাদাদের মতো গুন্ডা বদমাশ হবে। আর মেয়ে হলে তোমার মতো। হিহিহি।”
শুভ্রা বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো-“কি বলছো এসব? আমার মতো হলে কি খারাপ হবে?”
“তুমি কি ভালো? আমার কথা কখনো ভেবেছ? একটা মেয়েকে জোর করে আঁটকে রাখতে দেখেও চুপ করে থাকতে। তোমার বাবা আর ভাইরা মিলে কত মানুষের জীবন নরক করেছে সেসব কিছুই কি জানো না তুমি? আমার মনেহয় তুমি সব জানো কিন্তু না জানার ভান করে থাকো। তুমি নিজেও তো ওদের মতই। প্রতিশোধ নিতে বিয়ে করেছিলে। জামাইয়ের ক্ষতি করবে জেনেও বাবাকে তার কথা বলতে। সেদিন তোমার ভাইয়ের গুলিটা মিস না হলে কি হতো ভেবেছ কোনদিন? তুমি মাথামোটা, স্বার্থপর একটা মেয়ে। জানো তোমার বাবা ভাই কেমন কিন্তু তবুও কোনদিন তাদের কিছু বলোনি। নেহাত তোমার জামাই ভালো মানুষ বলে তোমাকে সহ্য করেছে।”
তুলতুলের এমন কঠিন কথা শুনে শুভ্রা বাকহারা হয়ে গেলো। তুলতুলের তখনো যেন কথা বলা শেষ হয়নি। সে শান্ত গলায় বললো-“এ বাড়ির মানুষের পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়ে গেছে বুঝলে? এখন সাজা পাওয়া শুরু হয়েছে। তোমার এই হাল সেই সাজার একটা অংশ। ভেবে দেখ, তোমার এই হালের জন্য কে দায়ী? তোমার পরিবারই কিন্তু দায়ী। আমার বিশ্বাস এসব কেবল শুরু। আরও অনেক কিছু ঘটবে এই পরিবারের সাথে।”
“ভাবি!”
শুভ্রা আর্তনাদ করে উঠলো। তুলতুল হাসলো-“পরের মেয়ের সাথে কতকিছু হয়েছে এ বাড়ির কারো চোখে সহানুভূতি দেখিনি। এখন যখন নিজের মেয়ে কষ্ট পাচ্ছে তখন সবার নাওয়া খাওয়া বন্ধ। এমন দ্বিচরিত দেখে ঘেন্না লাগে আপা। তবুও তো তোমার বর তোমাকে ভালোবেসে আগলে রেখেছে শত্রুর মেয়ে জেনেও। তোমার ভাগ্য বটে। কিছু মনে করো না আপা, অনেকদিনের জমানো রাগ তোমার উপর ঝেড়ে ফেললাম। মাফ করে দিয়।”
তুলতুল বইটা হাতে নিয়ে বেড়িয়ে গেলো। শুভ্রা ঠায় বসে রইলো বিছানায়। কেন যেন তার মধ্যে কোন অনুভূতিই আসছে না। না রাগ না দুঃখ কিছুই না।

****

রণ আছে বিশেষ মিটিং এ। ওর এলাকায় মেয়র নির্বাচনে শেষ মুহূর্তে কি দান খেলা হবে সে বিষয় গোপন মিটিং। বুকের মাঝে অহর্নিশ তীব্র জ্বালা তবুও ওর মুখ দেখে সেকথা বোঝার উপায় নেই। আজকাল মেজাজ খুব খিচিয়ে থাকে। সেই মেজাজ দেখানোর জায়গা নেই বলে বেশির ভাগ সময় তার রেশ রাজিব আর মিহিরের উপর দিয়ে যায়। আজ মেজাজ অতিরিক্ত খারাপ কিন্তু মিটিং বাদ দেওয়ার উপায় নেই। আজ এখানে বিশেষ একজন মানুষ উপস্থিত আছে। ওনার কথা অনেকবার শুনলেও দেখার সৌভাগ্য হয়নি। মাজহার আমিন নাম তার। বলা হয়ে থাকে নেত্রী যত বড় বড় সিদ্ধান্ত নেন তার পেছনে উনার হাত থাকে। রণ চুপচাপ বসে দেখছে মানুষটাকে। নেত্রীর পাশে বসে নিচু স্বরে কথা বলছে। ছোটখাটো মানুষটার চেহারা বেশ সৌম্য দর্শন। বিশেষ কিছু বলতে গেলে অবশ্যই তার তীক্ষ্ণ নজরের কথা উল্লেখ করতে হবে। যেন কাউকে একবার দেখলেই তার মন পড়তে পারেন। আজ এখানে আরও কয়েকজন উপস্থিত আছে। সালিম সাহেবের বিপরীত পক্ষের আব্দুস সবুর, ইমাদ করিম আছেন।
“রণ।”
নিজের নামটা শুনে চমকে উঠলো রণ। দেখলো মাজহার আমিন হাসি মুখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। রণ আড়ষ্ট হয়ে হাসলো-“জ্বি।”
“তুমি বলেছিলে শেষ মুহুর্তে সামলে নেবে। তুমি কি ভেবেছ শেয়ার করবে কি? সালিম এবার আটঘাট বেঁধে নেমেছে। খুব সহজে হাল ছাড়বে না। মনোনয়ন জমা দিয়ে দিয়েছে। সতন্ত্র হিসেবে দু’জন দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু ওরা কেউই সালিমের প্রতিপক্ষ হিসেবে মানানসই নয়।”
রণ বিচলিত হলো। ইদানীং মনের ক্ষত ব্রেনকে চিন্তা করতে বাঁধা প্রদান করে। অনেককিছু ভেবেছিল সে কিন্তু সত্যি বলতে এখন কোন কিছুতে উৎসাহ পাছে না। তবুও কিছু একটা বলতে হবে ভেবেই মুখ খুললো-“আমি ভেবেছিলাম এলাকায় প্রবীন রাজনীতিবিধ সিরাজ আহমেদের মেয়ে সুমনা আপাকে সতন্ত্র হিসেবে দাঁড়াতে বলবো। উনি একদম ফ্রেশ মুখ, শিক্ষিত মহিলা। সুযোগ পেলে ভালো করবে মনে হয়েছে।”
মাজহার অবাক হলো-“কিন্তু তার পূর্বের কোন রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নেই।”
রণ হাসলো-“সেজন্যই ভেবেছি। সালিম সাহেব তাকে প্রতিদন্দী হিসেবে কখনোই চিন্তা করবে না। আর ভদ্রমহিলাকে যতদূর দেখেছি কথার মারপ্যাচ বেশ ভালো পারে। আপনারা কি বলেন ইমাদ ভাই?”
“সে তো সরাসরি রাজনীতি করে নাই। এই পদ সামলাতে পারবে?”
ইমাদ দ্বিধা নিয়ে উত্তর দিলো। রণ আশ্বাস দিলো-“আমার মনেহয় আপনারা সমর্থন দিলে পারবে। বাকীটা নেত্রীর বিবেচনা।”
মাজহার হাসলেন-“তোমাকে বিচক্ষণ মনে হয়েছিল। এখন দেখছি তুমি আমার ভাবনার চাইতে বেশি বুদ্ধিমান। তুমি কি রণর সাথে একমত?”
নেত্রীর দিকে তাকাতেই তিনি মাথা দুলালেন-“ওর উপর আস্থা আছে আমার।”
রণ বললো-“আপনি ভাববেন না ফুপু, সালিম সাহেব বাদে বাকি সবাই ওনার জন্য কাজ করবে। আমি কথা বলে রেখেছি সবার সাথে।”
“কিন্তু সুমনা কি রাজি হবে?”
“হবে। গতবার ওনার বাবার সাথে যা হয়েছিল তাতে উনি কষ্ট পেয়েছিলেন। সুযোগ পেলে দলের হয়ে কাজ করতে চান।”
“তাহলে তো হয়েই গেলো। ওনাকে একদম শেষ মুহূর্তে মনোনয়ন পত্র জমা দিতে বলবে। বাকী কাজ আমরা দেখে নেব। এলাকায় কি করতে হবে সেসব তুমি ম্যানেজ করে নেবে।”
“ঠিক আছে। আজ আসছি ফুফু।”
রণ বিদায় নিতেই নেত্রী প্রশ্ন ছুড়ে দিলো-“কেমন দেখলে?”
“চন্দ্রর জন্য একেবারে পারফেক্ট। দলের জন্যও বটে৷ ও চন্দ্রের সাথে জুড়ে গেলে তোমার দলের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতে হবে না। কিন্তু একটা ভ করেছ। ওকে বিয়েটা করতে দেওয়া উচিত হয়নি।”
“বিয়েটা ভেঙে যাওয়ার কাছাকাছি। ওর মা খুব রাজি চন্দ্রকে বউ বানাতে। তখন বিয়েটা না করলেও চলছিল না। সালিমকে চোখে চোখে রাখা জরুরি ছিলো।”
নেত্রী জবাবদিহিতা করলো। মাজহার সন্তুষ্ট হলো কিনা বোঝা গেলো না। সে মৃদুস্বরে বললো-“সালিমের মেয়ে ওকে ছেড়ে দেবে?”
“ছেড়ে গেছে অলরেডি।”
“তাহলে দেরি করো না। শুভ কাজ তাড়াতাড়ি সারতে হয়।”

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-৫৯

“তুলতুল, আসবো?”
শরীফ দরজায় টোকা দিলো। তুলতুল এলেবেলে পড়তে পড়তে খিলখিলিয়ে হাসছিল। শরীফের আওয়াজ পেয়ে হাসি আটকানোর চেষ্টা করলো-“আসুন।”
বলেই আবারও মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসতে লাগলো। শরীফ রুমে ঢুকলো, তার হাতে স্ট্রবেরি ভর্তি বাটি। তুলতুলের দিকে বাড়িয়ে দিলো বাটিটা-“সেদিন খেতে চেয়েছিলে।”
তুলতুল অবাক হয়ে হাত বাড়িয়ে বাটিটা নিলো-“এতো অরিজিনাল মনেহচ্ছে। কোথায় পেলেন?”
“খুঁজলে পাওয়া কঠিন না। খেয়ে দেখো কেমন।”
শরীফ চেয়ার টেনে বসলো। তুলতুল একটা স্ট্রবেরি তুলে মুখে দিলো-“দারুন মজা। আপনিও খান না।”
মাথা নাড়লো শরীফ-“তুমি খাও।”
তুলতুল খেতে খেতে বইয়ে ডুবে গেলো আবার। শরীফ ওকে দেখলো চেয়ে চেয়ে। মাঝে মাঝেই হাহা হিহি করে হেসে উঠছে। শরীফের ভালো লাগছে দেখতে। সে হঠাৎ ডাকলো-“তুলতুল একটা কথা বলি?”
“হ্যা, বলুন না।”
“শুভ্রাকে ওসব বলা উচিত হয়নি তোমার। এমনিতেই ওর মনটা খারাপ তার উপর তুমি উল্টো পাল্টা বলে ওর মন আরও খারাপ করে দিয়েছ।”
তুলতুল থতমত খেলো। বইটা বন্ধ করে পাশে রেখে শরীফের দিকে তাকালো-“মাঝে মাঝে অনুচিত কাজ করতে হয়।”
“আমি তোমার কথা মেনে নিচ্ছি কিন্তু সেটা সবসময় নয়। শুভ্রা বরাবরই বাসা থেকে দূরে থেকেছে। বাবার হয়তো ওর উপর দূর্বলতা ছিলো তাই চাইতো না ও কিছু জানুক বা বুঝুক। এমনকি স্কুল বা কলেজের বন্ধেও ওকে বেশি বাসায় থাকতে দিত না আব্বা। ও হয়তো বড় হয়ে সব বুঝে গেছে কিন্তু বুঝলেও বলার উপায় ছিলো না। এখন যখন বাড়িতে আসে আব্বা ওকে ভালোবাসে সেটা বুঝেই কিছু বলতে পারে না। সবসময় দূরে থাকাতে এই ভালোবাসাটা হয়তো ওর ভালোলাগে। কিন্তু সেজন্য এসব কথা ওর শোনার কথা না৷ ও দোষী না আসলে। মানলাম তোমার উপর অন্যায় হয়েছে। কিন্তু আমি তো সেই অন্যায়কে শোধরাবার চেষ্টা করছি।”
তুলতুল চুপচাপ শরীফের কথা শুনলো। ও থামতেই তুলতুল বিচিত্র ভাবে হাসলো-“কিছু কিছু অন্যায়ের বদলা অন্যায় করেই নিতে হয়। জানেন, আপনার ভাই কি পরিমান অন্যায় করেছে তার তিরিশ বছর জীবনে? আমার আব্বাকে তুলে আনছিল। তারপর তিনদিন পরে আব্বার লাশ পাওয়া গেছিল শীতলক্ষ্যায়। আর আমার কপাল দেখেন, আব্বার খুনির সাথে সংসার করা লাগছে। এখন তার বাচ্চা পেটে নিয়ে ঘুরতেছি। আপনের কাছে হয়তো কোন ব্যাপার না এসব কিন্তু ভাবলে আমার মাথা ঘুরায়। জীবনটাকে কেমন যেন অর্থহীন মনেহয়। মাঝে মাঝে আমার পেটের বাচ্চাটাকে মেরে ফেলতে মনচায়, ভীষণ মনচায়।”
শরীফ চুপ করে রইলো। সত্যি বড্ড লজ্জা লাগে তার। সেই সাথে তুলতুলের মানসিক অবস্থা ভেবে গা শিউরে ওঠে। তুলতুল হাসলো-“ভয় পাবেন না, এমন কিছু করবো না আমি। আর হ্যা, আপাকে ওসব বলেছি তার ভালোর জন্য। মানুষটার মন নরম। নরম না হলে তন্ময় ভাইকে আগেই থামাতে পারতেন। তার জন্য নিজের বিবাহিত জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলতো না। কে ভুল কে ঠিক এই বুঝটা হওয়া দরকার আছে আপার। সঠিক মানুষ চিনতে না পারলে তার জীবন অন্ধকার হয়ে যাবে।”
“কিন্তু শুভ্রা বুঝলেই হবে? আরেকদিকের মানুষটাকেও তো বুঝতে হবে। এভাবে ঘাড় ধরে বের করে দেওয়ার পরে কি ফিরে যাওয়া উচিত হবে ওর?”
“সেসব তো আমি জানি না। তবে মেয়েরা কত কিছু করে জীবনে। ভালোবাসার মানুষের জন্য কিছু করতে পারাও ভাগ্য।”
“তুমি বলতে চাইছো শুভ্রা রণকে ভালোবাসে?”
“অবশ্যই।”
শরীফ অবাক হয়ে জানতে চাইলো- “এতো শিওর হয়ে বলছো কি করে?”
“বোঝা যায়। এমন কঠিন কিছু না।”
“আচ্ছা! আমি কেন বুঝি না? তুমি কি কাউকে ভালোবেসেছ জীবনে? অভিজ্ঞতা আছে?”
হঠাৎ শরীফ বেফাঁস প্রশ্ন করে। তুুলতুল ভ্যাবাচ্যাকা খায়-“এসব বোঝার জন্য বুঝি ভালেবাসতে হয়? কি জানি? আমি তো যা মনে এলো তাই বললাম।”
বলতে বলতে আনমনা হলো তুলতুল। সামনে বসে থাকা শরীফকে এমনভাবে দেখলো যেন বহুদূরের মানুষকে দেখছে। তারপর বিরবির করলো-“কাউকে ভালোলাগার ভালোবাসার সু্যোগ পেলাম কোথায়? তার আগেই জীবনে কালিমা লেপন হয়ে গেলো।”

*****

ক্লান্ত শ্রান্ত রণ ঘরে ঢুকতেই জলির মুখোমুখি হলো। রণ বুঝলো মা রেগে আছে। সে হাসার চেষ্টা করলো-“মা, কেমন আছো তুমি? শরীর ঠিক আছে তো? ওষুধ ঠিকঠাক নিচ্ছ?”
জলি সে প্রশ্নের ধার দিয়ে গেলো না। সে গম্ভীর মুখে বললো-“বাবাই, কি শুরু করেছিল বলতো? ভোরে বেড়িয়ে যাস গভীর রাতে ফিরিস। বাসায় মা আছে বোন আছে কারো কোন খোঁজ রাখার প্রয়োজন নেই তোর?”
রণ অনেক কিছু বলতে চাইলেও শেষ মুহূর্তে কি মনে করে চুপ রইলো। ছেলের উত্তর না পেয়ে জলির মেজাজ চড়ে যাচ্ছে। সে গম্ভীর হয়ে বললো-“তুই একটু বোস আমার কাছে জরুরি কথা আছে।”
রণ হতাশ চোখে তাকালো-“কাল কথা বলি মা?”
জলি গোঁয়ারের মতন মাথা নাড়ে-“না, এখনই। আয় বোস।”
রণ হার মেনে বসলো মায়ের কাছে-“কি বলবে বলো।”
জলি ভনিতা করলো না-“শোন, উকিলের সাথে কথা বলেছি। ভাইয়া আলাপ করিয়ে দিয়েছে। তোর কাগজ তৈরি করতে বলেছি।”
রণ অবাক হয়ে তাকায়-“কিসের কাগজ!”
“কিসের আবার? ডিভোর্স পেপার। আমি তোর জন্য একজনকে পছন্দ করেছি। কথাও এগিয়ে রেখেছি।”
রণ বিস্মিত হয়ে মাকে দেখলো তারপর হেসে দিলো-“বাহ! দারুণ তো? আমি জানতাম না পাত্র হিসেবে আমি এতো দামী।”
“তুই অনেক দামী বাবাই। যাইহোক, কাগজ এসে যাবে দুই একদিনের মধ্যে। আশাকরি ভনিতা না করে সাইন করে দিবি। আমি ওই খুনিটাকে কোন সুযোগ দিতে চাই না।”
“কার সাথে বিয়ে ঠিক করেছ মা?”
“চন্দ্রানী। সারাদিন ওর সাথেই তো ঘুরিস।”
রণ হতবিহ্বল হয়ে তাকালো-“আর চন্দ্র রাজি হলো? নাকি সে জানেই না?”
“তার আমি কি জানি? স্বয়ং নেত্রী রাজি হয়েছেন প্রস্তাবে।”
রণ বাকরুদ্ধ। জলি অবস্থা এতোকিছু ভাবলো না-“শোন বাবাই, এবার তোর বিয়ের পর হাসি খুশির বিয়ে দেব। বলা যায় না ওই ছেলেটা আবার কোন ঝামেলা না করে। তুই ওদের জন্য ভালো পাত্র খুঁজে বের কর।”
রণ মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুসময়। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে সামনে বসে থাকা মানুষটা তার মা। কেমন যেন অচেনা লাগে জলিকে। সে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো-“আমি কাল এলাকায় যাচ্ছি মা। কয়েকদিন থাকতে হবে। নির্বাচনের কাজ আছে।”
জলি সন্দিহান নজরে তাকাতেই রণ মৃদু হাসে-“ভয় পেয়ো না মা, আমি শুভ্রার সাথে কোন যোগাযোগ করবো না। তাছাড়া আমি যোগাযোগ করতে চাইলেও শুভ্রা হয়তো করবেনা। ওকে এতোটাও হ্যাংলা ভেবো না মা। আর একটা কথা, শুভ্রাকে আমি ডিভোর্স দেব না কোনদিন। বাকী তুমি কি করবে করো।”
“ওই খুনির মেয়ে আর এ বাড়িতে ঢুকবে না বাবাই।”
“ও তো ঢুকে গেছে মা। অনেক আগে ঢুকেছে। তুমি ওকে ঢুকিয়েছ এ বাড়িতে। তাছাড়া দোষ ওর বাবার। ও কোন দোষ করেনি মা। তাই ওকে শাস্তি দেওয়াটা আমি মানতে পারলাম না। তুমি ওকে বের করে দিয়েছ আমি মেনে নিয়েছি কিন্তু এর বেশি কিছু করবো না আমি।”
রণ উঠে দাঁড়ায়। রুম থেকে বেরুবে এমন সময় জলি ক্রুদ্ধ স্বরে বললো-“যদি ও তোকে ডিভোর্স দেয় তাহলে কি করবি?”
রণর পা থেমে গেলো। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো পনের সেকেন্ড তারপর জবাব না দিয়ে নিজের রুমে ফিরে এলো। বিছানার এসে বসলো চুপচাপ। শুভ্রার পাশটাতে ফিরে তাকালো একবার। আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তারপর নিজের জায়গায় শুয়ে পড়লো। শুভ্রার মাথার বালিশটা টেনে বুকে জড়িয়ে নিলো, গন্ধে শুকলো চোখ বুঁজে। বার কয়েক গভীর শ্বাস টানলো তারপর বিরবির করলো-“ভালোবাসি তো বোকা মেয়ে।”

চলবে।
©Farhana_Yesmin

দর্পহরন পর্ব-৫৫+৫৬+৫৭

0

#দর্পহরন
#পর্ব-৫৫

সালিম সাহেবের ডাক পেয়ে ফাহিম যারপরনাই অবাক হলো। সবার আগে যে প্রশ্নটা মাথায় ঘুরপাক খেলো তা হচ্ছে, ওরা কি কোনভাবে জেনে গেছে যে সোহেলের ব্যাপারটায় ও জড়িত? মনে মনে ভয়ে ভীত হয়ে গেলো ফাহিম। খুব দ্বিধায় ছিলো যাবে কিনা সেটা ভেবে। পরে যখন বলা হলো তুলতুলের বিষয় নিয়ে কথা বলবে তখন ভয়টা একপাশে রেখে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো। বোনের বিষয়ে কি কথা বলবে সালিম সাহেব সেটা জানতে হবে। বোনটাকে কি ফিরিয়ে দেবে? তাহলে সানন্দে বোনকে নিয়ে আসবে ফাহিম। সালিম সাহেবের অফিস ঘরে বসে নানা ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে ফাহিম। তখন তুহিন ভেতরে যেতে বললো। ফাহিম সালিম সাহেবের কামড়ায় ঢুকলো।
“আরে, আসছো তুমি? আসো বসো।”
ফাহিম ভ্যাবাচ্যাকা খায়। এই খাতিরের কোন অর্থ খুঁ’জে পেলো না। ফাহিম কিছুটা রুক্ষ স্বরে বললো-“কি বলতে ডেকেছেন আমাকে?”
সালিম সাহেব মোটেও রাগলেন না। হাসি হাসি মুখ করে বললো-“শুনলাম তুমি নাকি পার্টি করতেছ। আমরা একই পার্টির মানুষ তাই আলাপ পরিচয়ের জন্য ডাকলাম আরকি।”
ফাহিম জবাব দিলো না। সে বোঝার চেষ্টা করছে সালিম সাহেব কি বলতে চাইছেন। সালিম সাহেব হাসলো-“তুমি আমার আত্মীয় হয়ে আরেকজনের জন্য কাজ করবা এইটা কেমন জানি লাগে দেখতে।”
এবার যেন সালিম সাহেবকে খানিকটা বুঝতে পারছে ফাহিম। সে কঠিন গলায় বললো-“তো? আমি কার হয়ে কাজ করবো না করবো সেটা তো একান্তই আমার ইচ্ছে। তাতে আপনার বলার কিছু আছে বলে মনেহয় না।”
“না, তা ভুল কিছু বলো নাই। কিন্তু তবুও বিষয়টা বিবেচনা করা দরকার। আমি এবার মেয়র পদে ইলেকশন করবো। তুমি তরুণ প্রজন্মের মানুষ, আমার হয়ে যদি কাজ করতা খুব খুশি হইতাম। এলাকার সাংসদ আমার মেয়ের জামাই তুমি তার হয়ে কাজ করো তাতে আমার দুঃখ নাই বরং আমি খুশি। তুমি আমার বউমার ভাই। শেষ পর্যন্ত আমরা সবাই মিলে একটা পরিবারই তো। সবাই যদি সবার পাশে দাঁড়াই তাহলে আমাদেরই লাভ। বুঝলা না?”
“না বুঝি নাই। আপনে কোনদিন আমাদের পাশে দাঁড়াইছেন বলে মনে পড়ে না। তাছাড়া বিয়ের পর আমার বোনটা আপনাদের কাছে বন্দী বলা যায়। এখন আবার বাচ্চা দিয়ে বন্দী করছেন। আর আপনে আশা করেন আমি আপনের জন্য কাজ করবো।”
সালিম সাহেব চুপ করে গেলেন। নম্রস্বরে বললো-“তুমি যা বলছো তা একান্ত পারিবারিক বিষয়। তবুও যা বলছো ভুল বলো নাই। বউমাকে কিন্তু আমি মুক্তি দিয়ে দিছিলাম। বিশ্বাস না হইলে তোমার বোনকেই জিজ্ঞেস কইরো। তারপর জানলাম নাতি আসতেছে। আমার ছেলেটা নাই তার পরবর্তী বংশধর আসার খবর শুনে আমি আবেগী হয়ে গেছি। নিজের রক্তের জন্য অন্যরকম টান হয় বাবা সেটা তুমি আমার বয়সে না আসলে বুঝবা না। যাইহোক, এখন আমরা বউমার কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমার বড় ছেলে শরীফের সাথে বউমার বিয়ে দিব। তাতে নাতি আর বউমা দু’জনই আমাদের ঘরে থাকবে। শরীফ ভালো ছেলে, তোমার বোন ভালো থাকবে তার সাথে।”
“আমার বোন কি রাজি আপনার আরেক ছেলেকে বিয়ে করতে? নাকি এবারও জোর করে বিয়ে দিবেন?”
সালিম সাহেব চেয়ারে হেলান দিয়ে ফাহিমের দিকে তাকায়-“ধরো বোনকে নিয়ে গেলা। তারপর কি করবা? বাচ্চাসহ নতুন করে শুরু করতে পারবে তোমার বোন? কিংবা আমাদের কাছে বাচ্চা রেখে দিলাম তবুও কি সব আগের মতো হবে? তারচেয়ে এই কি ভালো না যে শরীফকো বিয়ে করে জামাই বাচ্চা নিয়ে সুখে সংসার করবে? যাইহোক, তুমি দেখো কি করবা? আমার কাজ করলে আমি খুশি হবো না করলেও কোন ক্ষতি নেই। সবার ব্যক্ স্বাধীনতা আছে। জোর করা ঠিক না। যাও তাহলে।”
ফাহিমকে পুরোপুরি দ্বিধায় ফেলে দিলো সালিম সাহেব। ফাহিম অনেকটা মোহগ্রস্তের মতই বাড়ি ফিরে এলো।

*****

মোর্শেদ বেশ চিন্তিত হয়ে গেছে। তন্ময় ঘুরে ফিরে খুশির কথা বলছে। সে খুশিকে বিয়ে করবে বলে জেদ ধরে বসে আছে। দু’দিন ধরে খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়েছে। বারবার বুঝিয়ে বলার পরও তন্ময় গো ধরে আছে। বিরক্ত হচ্ছে মিনুও। ছেলের সাথে কয়েকদফা মিটিং করেও তাকে নিজের সিদ্ধান্ত থেকে একচুল নড়ানো গেল না। মোর্শেদ অসহায় চাহুনি দিয়ে মিনুকে দেখলো। দুজনই ছেলের উপর বিরক্ত। মোর্শেদ পড়েছে বিপদে। তার ভয় হচ্ছে পাছে তন্ময়ের জেদে পড়ে ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক না খারাপ হয়। এখন বসে বসে ভাবছে কি করবে। মিনু ডাকলো-“আপনে না হয় সালিমের সাথে কথা বলে দেখেন একবার। রণর মায়ের সাথে কথা বলে দেখেন সে কি বলে। শুনছি সেই নাকি শুভ্রারে বিয়ে করাইছে। তাহলে তন্ময়ের সাথে তার সমস্যা হওয়ায় কথা না।”
“কিন্তু রণ তো শুনছি আগেই মানা করে দিছে। শুভ্রা কথা তুলছিল তো।”
“একবার মানা করছে এইবার হ্যা বলতেও পারে। একবার কথা বলতে দোষ কি?”
মিনুর কথা মোর্শেদের কাছে গ্রহনযোগ্য মনেহয়। সে কথাটা ভাইয়ের সাথে আলোচনার উদ্দেশ্যে রুম থেকে বের হয়।

“সালিম আছোস?”
“হুমমম, ভাইজান। আসেন ভিতরে আসেন।”
মোর্শেদ ঘরে ঢুকে বসলেন, ইতস্তত করতে করতে বারবার ঘরে নজর ঘুরিয়ে চলছেন। সালিম সাহেব বুঝলো ভাইজান কিছু বলতে চায় কিন্তু কোন কারন বশত দ্বিধায় ভুগছে।
“আপনি কি কিছু বলতে চান ভাইজান?”
“হহহ। তন্ময়টা খুব জ্বালাইতেছে। দুইদিন ধইরা খায় দায় না। তার এক কথা খুশিরে বিয়া করবো। বহুত বুঝাইছি কিন্তু মানে না। তোর ভাবিও বুঝাইছে অনেকবার, কোন কথাই শোনে না। এখন কি করি ক।”
সালিম সাহেব অবাক হলেন। এই পরিবারের সবার হইছেটা কি? যা করা যাবে না সবাই যেন তাই করার জন্য উঠে পড়ে লাগছে। এটা কি ধ্বংসের আগের পরিস্থিতি? হাসফাস লাগে সালিম সাহেবের। মোর্শেদ দোনোমোনো করে বলে-“তোর ভাবি কইতেছিল, একবার বেয়াইনকে বলতে। সেই তো শুভ্রারে বিয়া করাইছে, মন নরম মানুষ। তাই তারে কইলে হয়তো মাইনা নিতে পারে। একবার কথা কয়া দেখবি নাকি? জামাই তো অহন দেশে নাই। চল কাইলকা তুই আমি যাই শুভ্রার বাসায়। ওর শাশুড়ীর লগে কথা কইয়া আসি।”
সালিম সাহেব কিছুক্ষণ ভেবে রাজি হয়ে গেলেন-“ঠিক আছে ভাইজান তাইলে দেরি করুন যাইবো না। কাইলই যামু আমরা। দেখি বেয়াইন কি কয়।”

*****

বাবা আর চাচাকে একসাথে দেখে ভীষণ অবাক হলো শুভ্রা। তাদের দু’হাত ভরা মিষ্টির প্যাকেট। কিছু বুঝে পাচ্ছে না সে। হুট করে কিছু না জানিয়ে বাবা চাচা তার বাসায় কেন এলো? শুভ্রা সালাম জানিয়ে বলেই ফেললো-“আব্বা, আপনেরা হঠাৎ? কি হইছে আব্বা?”
সালিম সাহেব হাসলো-“তেমুন কিছু না আম্মাজান। আপনে তো বাড়ির রাস্তা ভুলছেন তাই আমরাই আইলাম আপনেরে দেখতে। ভিতরে যাইতে কইবেন না আব্বারে?”
শুভ্রা দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়-“আসেন আব্বা।”
খাবারের প্যাকেটগুলো টেবিলে রেখে সোফায় বসলো। সালিম সাহেব বললো-“আপনে কেমুন আছেন আম্মাজান? কত্তদিন হইলো বাড়ি যান না।”
“উনি ব্যস্ত থাকেন আব্বা। আমারই সব দেখে রাখতে হয় তাই যাওয়া হয় না কোথাও।”
সালিম সাহেব মেয়েকে দেখলেন একনজর। শাড়ী পরে থাকা শুভ্রাকে কেমন অচেনা লাগে তার কাছে। তার মেয়ে কোনদিন শাড়ী পরেছে বলে মনে পড়ে না। ঈদ পার্বনে দুই একবার সালোয়ার কামিজ পরেছে হয়তো। সালিম সাহেব দীর্ঘ শ্বাস গোপন করলেন। মেয়েটা যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে তার জীবন থেকে।

মোর্শেদ ভাইকে খোঁচা দিলে সালিম নিজেকে সামলে নিলো। মোর্শেদ জানতে চাইলো-“বাসায় আর কেউ নাই? আপনের শাশুড়ী মা কই শুভ্রা? তারে খবর দেন কথাটথা বলি।”
শুভ্রা মাথা নেড়ে ভেতরে গেল। কিছুক্ষণ পরই ফিরে এলো-“আসতেছে।”
বলে চুপচাপ বসলো। শুভ্রা মনটা খচখচ করছে কেন যেন। মনেহচ্ছে বাবা চাচা কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এ বাড়িতে এসেছে। হুট করে কেন যেন ভয় লাগতে শুরু করলো তার। মনটা অকারণে ছটফট করতে লাগলো৷ কেন তার মনেহচ্ছে খুব খারাপ কিছু ঘটবে?

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-৫৬

শুভ্রার বাবা আর চাচার একসাথে আসার খবর শুনে জলি প্রথমে বিস্মিত হলো। তারপর খানিকক্ষণ ভাবার পরে পুরো ব্যাপারটা বুঝে তার মুখে অদ্ভুত ধরনের একটা হাসি ফুটে উঠলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ভালো ভাবে পরিপাটি করে ফেললো। বহুদিন আগের গভীর ক্ষততে আজ প্রলেপ পড়বে ভেবে তার মনটা কি ভীষণ রকম আনন্দিত হচ্ছে তা বাইরে থেকে জলিকে দেখে কারো বোঝা সম্ভব নয়। নিজেকে দেখে সন্তুষ্ট জলি শাড়ীর আঁচল মাথায় তুলে রুম থেকে বেড়িয়ে এলো। ড্রয়িং রুমে এসে দাঁড়াতেই সালিম আর মোর্শেদ উঠে দাঁড়ায়, সালাম দেয়। জলি প্রতিউত্তর দিয়ে তাদের বসতে বলে। শুভ্রাকে বললো-“হাসিখুশিকে ডাকো আর তোমার বাবা চাচার জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করো। তাদের কি খালিমুখে বিদায় জানাবে নাকি?”
শুভ্রাকে বিচলিত দেখায়। জলির কন্ঠে মিষ্টি কথা শুনে তার অস্থির লাগে। সে দ্বিধা নিয়ে মাথা নিচু করে ভেতরে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর হাসি খুশি এসে সালাম দিলো। দু’চারটে ভালো মন্দ আলাপের পরে ওরা ভেতরে চলে গেলো। এরমধ্যে মোর্শেদ নতুন করে খুশিকে দেখলো মন দিয়ে। ছেলের পছন্দের প্রসংশা করলো মনে মনে। ওরা ভেতরে ফিরে যেতেই জলি কথা বললো-“তা আপনারা হুট করে এলেন। কোন বিশেষ প্রয়োজনে?”
দুই ভাই একে অপরকে দেখলো চোরা চোখে। সালিম সাহেব হাসলো-“অনেক দিন আম্মাকে না দেখে খারাপ লাগতেছিল আপা। তাই ভাবলাম আম্মাজানকে একটু দেখে যাই।”
“আচ্ছা, ভালো করেছেন। মেয়ের প্রতি বাবাদের টান অন্যরকম হয়। আপনার মেয়ে ভাগ্যবান তার বাবার স্নেহ ভালোবাসা পেলো। আর আমার মেয়েদের কপাল দেখেন।”
জলির কথা শুনে মোর্শেদ খুকখুক করে কাশে-“আপা, অনুমতি দিলে একটা কথা বলার ছিলো।”
জলি থামলো, তার মুখের রেখার প্রশ্ন দেখা দিলো-“জ্বি বলেন। কি বলতে চান?”
সালিম সাহেব চুপ করে আছেন। কেন যেন মনেহচ্ছে তন্ময়ের কথা বলাটা উচিত হবে না। কিন্তু ভাইকে থামতে বলবেন কিনা সে বিষয়ে দ্বিধা আছে। মোর্শেদ হাসার চেষ্টা করলো-“আমার ছেলে তন্ময়কে তো দেখেছেন।”
“হ্যা দেখেছি তো। কিছুদিন আগে আমাদের বাসায় আসতো প্রায়ই।”
মোর্শেদ বিগলিত হলো-“আমার ছেলেটা মাশাল্লাহ ভালো ছাত্র। অস্ট্রেলিয়ান ডিগ্রি আছে, চাইলে ওখানেই কিছু করতে পারবে নতুবা আমাদের তো কম কিছু নাই। এখানেও চাইলে নিজের মতো কিছু করতে পারবে। ওর যা ইচ্ছে হবে করবে আর কি।”
“হ্যা, সবই ঠিক আছে কিন্তু এসব আমাকে বলছেন কেন?”
জলি অবাক হলো। মোর্শেদ গলা পরিস্কার করে-“না মানে আপা, আপনার তো দুই মেয়ে মাশাল্লাহ দেখতে বেশ ভালো। পড়ালেখাতেও ভালো ওরা। বলছিলাম কি, আপনার মেয়ে খুশিকে যদি আমাদের ছেলে তন্ময়ের জন্য দিতেন বড়ই আনন্দিত হইতাম।”
শুভ্রা চা আর নাস্তা নিয়ে এসেছিল ওর পা কেঁপে উঠলো। টি র্যাকে আচমকা ধাক্কায় চা ছলকে পড়লো। নিজেকে কোনরকমে সামনে বাবা চাচার দিকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিয়ে বললো-“চাচাজান, আমিতো আব্বাকে এই বিষয়ে আগেই সব পরিস্কার বলেছি। আজকে আবার নতুন করে এসব কথা উঠতেছে কেন?”
মোর্শেদের মুখের রেখায় বিরক্তির আভাস। জলি বলে ফেললো-“আমি তো কথা বলছি বউমা। তুমি এরমধ্যে কোন কথা বলো না।”
শুভ্রা চমকে গেলেও উত্তর করলো না। জলিকে ইদানীং তার ভয় লাগে। সেই নরম মনের মানুষটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। কেমন করে যেন তাকায় শুভ্রার দিকে। শুভ্রা চুপচাপ এককোনে বসলো। জলি কথা বলে-“ভাই, কি যেন বলছিলেন আপনে? আপনার ছেলের কথা তাই না?”
মোর্শেদ মাথা দুলায়। জলি হাসলো-“আসলে হয়েছে কি ভাই আমরা আমাদের অতীতটা খুব সহজে ভুলে যাই। যাইহোক, আমার যদি ভুল না হয় তাহলে আপনার যোগ্য ছেলে তন্ময় মনেহয় একবার মেয়ে ঘটিত কেসে ফেঁসে গেছিল। ভুলক্রমে সেই মেয়েটা আবার আমাদের এলাকার প্রতাপশালী রঘুনাথ দাসের মেয়ে ছিলো। বাধ্য হয়ে ওদের সাথে আপোষ করে ছেলেকে দেশের বাইরে পাঠিয়েছিলেন।”
মোর্শেদ আমতাআমতা করলো-“আপা, তখন অল্প বয়স ছিল, ওই বয়সে এরকম পাগলামি নরমাল।”
“নরমাল! আমার ছেলের এরকম একটা কেস দেখান। জীবনে কোনদিন কোন মেয়ের দিকে কুদৃষ্টি দেয়নি আমার ছেলে এটা হলপ করে বলতে পারি। আচ্ছা, তখনকার কথা বাদ দিলাম এখনকার কথা বলি। অস্ট্রেলিয়াতে কি করেছে আপনার ছেলে? শুনেছি এক পাকিস্তানি মেয়েকে রে*প করার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।”
মোর্শেদ গর্জে উঠলো-“এসব মিথ্যা অভিযোগ আপা। জানেন তো পাকিস্তানিরা একাত্তরে কি করেছিল আমাদের সাথে। ওরা সবসময় সুযোগ পেলেই বাঙালিদের ক্ষতি করার চেষ্টা করে।”
জলি মৃদুস্বরে হাসলো-“বুঝলাম পাকিস্তানিরা খারাপ। তাছাড়াও আপনার ছেলের আরও কর্মকান্ডের কথা কি বলবেন।”
মোর্শেদ এবার হাতের কাপটা স্বশব্দে নামিয়ে রাখলো-“বুঝেছি আপা। আপনি মেয়ে বিয়ে দিবেন না। সুযোগ পেয়ে আমাদের অপমান করতেছেন।”
জলি হেসে দিলো-“অপমান করতেছি? আমি শুধু আপনাদের সাহস দেখতেছি। কি ভাবছেন, আপনাদের মেয়ে বিয়ে করায়ে আনছি, আত্মীয় হইছেন তাই আপনাদের অতীতের কুকীর্তি সব ভুলে গেছি, মাফ করে দিয়েছি?”
মোর্শেদ আর সালিম ওকে অপরকে দেখলো। শুভ্রা কি করবে বুঝতে না পেরে একবার শাশুড়ীকে দেখে আরেকবার বাবা চাচাকে দেখে। জলি বললো-“তেরো বছর আগে কি করেছিলেন আপনারা মনে আছে? আমার স্বামী নির্বাচনে আপনার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিল বলে তাকে গুম করলেন। তারপর তাকে আর দেখার সৌভাগ্য হলো না আমাদের। রণ তখন আঠারো বছরের তরুণ। আমার হাসিখুশি মাত্র আট বছরের।”
সালিম সাহেব আড়চোখে মেয়েকে দেখলো। শুভ্রার চোখে বিভ্রান্তি। সে অবিশ্বাস নিয়ে বাবা চাচাকে দেখছে। সালিম সাহেব বললো-“আপা, কি বলতেছেন এইসব? আমরা কেন এমন কিছু করবো?”
জলি তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে থেকে বললো-“আমি প্রতিদিন আপনার বাসায় যেতাম। কত আকুতি মিনতি করেছি আপনাদের। একফোঁটা মন গলেনি আপনার। আপনারা কি ভেবেছিলেন, সেসব দিনের কথা ভুলে গেছি? আপনি আপনারা ভুলে যেতে পারেন কিন্তু আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভুলবো না। নিজের স্বামীর কবর পর্যন্ত নসীব হয় নাই। আমার সন্তানেরা জানেই না বাবার পরিনতি। এসব কখনো ভুলে যাওয়া যায়? সেই আপনার মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে বউ করে এনেছি। কি মনেহয় আপনার? এমনিতেই?”
সালিম সাহেব বাকহারা হয়ে গেলেন। জলির কথাগুলো তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। কি বলছে এসব মানুষটা? শুভ্রাকে বিয়ে করানোটা পরিকল্পিত? শুভ্রাও হতবাক হয়ে চেয়ে আছে শাশুড়ীর দিকে-“আন্টি, কি বলেন এসব?”
জলি ক্রুর হাসলো-“আমার আঠারো বছর বয়সী ছেলের কাঁধে সংসারের জোয়াল উঠলো। ছেলের সুন্দর দিনগুলো পরিশ্রমে বদলে গেলো। আমার মেয়েদের শৈশব হলো অবহেলিত। প্রতিরাত একা একা ছটফট করতে করতে ভেবেছি কি করলে আপনাকে শাস্তি দেওয়া যাবে? কি করলে আমার স্বামীর প্রতি আপনাদের জঘন্য আচরণের বিচার হবে। ভাবতে ভাবতে একদিন উপর ওয়ালা সুযোগ দিলো। সালিম সাহেবের কন্যা তার জানের জান। সেই কন্যার জীবনটা যদি নিলামে তোলা যায় তাহলে কেমন হয়?”
“আপা!”
জলি আঙুল তুললো-“চিৎকার করবেন না ভাই। আপনি এখন কোথায় আছেন এটা ভুলে যাবেন না। আপনারা কি আশা করে এ বাড়িতে এসেছেন? আপনার অকর্মার ঢেঁকি মেয়েকে আমি মেনে নিয়ে মাথায় তুলে নাচবো? তারপর আপনার লম্পট ছেলের হাতে আমার মেয়ে তুলে দেব? এতো সহজ? এতো সস্তা ভাবেন আমাদের? অপরাধ নিজে করেছেন বলেই দোষ চোখে পড়ছে না ভাই সাহেব। সমস্যা নেই। একদিকে খুব ভালো হয়েছে আজ আপনারা এসেছেন। আল্লাহ প্রতিবার আমাকে দারুণ সুযোগ করে দিয়েছেন। এবারও দিলেন।”
“মানে? কি বলতেছেন আমি বুঝতেছিনা।”
সালিম বিস্ময় নিয়ে বললো।
“বুঝবেন সব বুঝে যাবেন এখনই। খুব সহজ ভাষায় বলি, আপনার গুনধর মেয়েকে আপনি এবার নিজের সাথে নিয়ে যাবেন। সে আমার ছেলের উপযুক্ত না মোটেও। ছেলেকে আমি আবার বিয়ে করাবো।”
“আন্টি!”
শুভ্রা আর্তনাদ করে উঠলো। জলি খেঁকিয়ে উঠলো-“কিসের আন্টি হ্যাহ? যাও নিজের সব গুছিয়ে নাও। বাবার সাথে ফিরে যাও নিজের বাসায়। আমার বাবাই এর জীবন যথেষ্ট খারাপ করেছ আর না।”
সালিম আর মোর্শেদ দু’জনই দাঁড়িয়ে গেলো। সালিম সাহেব হুঙ্কার দিলেন-“কি বলতেছেন এইসব। আপনে আমাদের অপমান করতেছেন? নিজে সাইধা আমার মেয়েকে বিয়ে করাইছেন এখন উল্টা পাল্টা বলতেছেন। মেয়েকে নিয়ে যাবো মানে কি? কেন নিয়ে যাব?”
“কারন আমি আর ওকে বউমা হিসেবে স্বীকার করতে চাই না। বাবাই ফিরলে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেব। আপাতত নিয়ে যান ওকে।”
“আন্টি, এসব কি বলছেন? কেন বলছেন? কি করেছি আমি?”
বলতে বলতে শুভ্রা কেঁদে দিলো। জলি বিরক্তি নিয়ে হাত ঝাকায়-“এরকম নাকি কান্না কেঁদো নাতো। তোমার বিয়ে দিতে কোন সমস্যা হবে না তোমার বাবার। তাই না ভাই সাহেব? আজ ডিভোর্স হলে কাল পাত্রের ভীড় জমিয়ে দেবেন। যাও, তাড়াতাড়ি নিজের জিনিস গুছিয়ে নিয়ে এ বাড়ি থেকে বিদায় হও।”
শুভ্রা ফুপিয়ে কেঁদে দিলো-“আমি যাবো না আন্টি। উনি আমাকে চলে যেতে বলেননি। ওনার সাথে কথা না বলে আমি যাবো না।”
“বাবাই আমার কথার উপর কথা বলবে বলে মনেহয় তোমার? এখনো বোকার স্বর্গে বাস করছে দেখছি। শোন মেয়ে, তোমাকে বিয়ে করানোর সিদ্ধান্ত যেমন আমার ছিলো তেমনি তোমার এ বাড়ি থাকা না থাকার সিদ্ধান্তও আমারই হবে। বুঝতে পেরেছ?”
“আমি মানি না আপনার সিদ্ধান্ত। কেন এমন করছেন আপনি? আন্টি প্লিজ এমন করবেন না। আব্বা, আপনি কিছু বলেন না। বলেন আপনি কিছু করেন নাই।”
শুভ্রা জলির পায়ের কাছে পড়লো। সালিম সাহেব চেচিয়ে উঠলো-“কাজটা ভালো করতেছেন না আপা। খুব অন্যায় করতেছেন? আপনে আমার সবচেয়ে বড় দূর্বলতা নিয়ে খেলতেছেন।”
জলি হাসলো-“আপনার চাইতে বেশি অন্যায় কি করছি? এ যে দেখছি ভুতের মুখে রাম নাম।”
মোর্শেদ এগিয়ে এসে শুভ্রার হাত ধরলো-“চল শুভ্রা। যেখানে মান থাকেনা সেখানে থাকতে হয় নারে মা। চল।”
“না আমি যাব না চাচ্চু। উনি বিদেশ থেকে ফিরুক, নিজের মুখে বলুক আমাকে চায় না তাহলে চলে যাব।”
“আম্মাজান, চলেন। এইখানে আর এক মুহূর্ত না। এই বাড়ির কিছুই নিবেন না। আপনের আব্বার কিছু কম নাই। সব আপনার পায়ে লুটায় দিব। কিন্তু অসন্মানের জায়গায় আর না আম্মা।”
“না আমি যাবো না। ওনার সাথে কথা না বলে যাবো না।”
সালিম সাহেব এবার গর্জে উঠলো-“আম্মাজান, আপনার আব্বার মান ডুবায়েন না। চলেন বলতেছি। না গেলে আপনার আব্বার মরা মুখ দেখবেন কইলাম।”
শুভ্রা আর্তনাদ করে উঠলো-“আব্বা এমন কথা বইলেন না। কেন এমন করতেছেন আপনারা? আমার দোষটা কোথায়?”
“তোমার দোষ তুমি আমার কাছে এসেছিলে আমার ছেলের সর্বনাশের ইচ্ছে নিয়ে। তোমাদের পরিবারের বড় গর্ব, দাম্ভিকতা তোমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। অন্যায় করেও তোমরা বীরদর্পে চলাফেরা করো। আমাদের প্রতি এতো বড় অন্যায় করেও তোমার বাবা থামতে চায়নি। তোমার একভাই আমার ছেলেকে মারতে চায় আরেক ভাই আমার মেয়ের দিকে নজর দেয়। আজ তুমি ফিরে গেলে যদি তোমার বাবার অহংকার চূর্ণ হয়।”
শুভ্রা অবাক চোখে জলিকে দেখলো-“আপনি এইজন্য আমাকে বিয়ে করিয়েছিলেন? আপনার ছেলে ভালোবাসে আমাকে। তার কথাও ভাবলেন না?”
“ভালোবাসলে ভুলেও যাওয়া যায়। তুমি ওকে নিয়ে ভেবোনা শুভ্রা। ও ঠিক সামলে নিতে পারবে। তুমি নিজেকে নিয়ে ভাবো।”
শুভ্রা বিস্ময় নিয়ে তাকায়। এতোদিনের পরিচিত মুখটাকে ভীষণ অচেনা লাগে তার কাছে। জলির মুখটায় আগে মা মা ছায়া থাকতো। আজ কেমন ভয়ংকর লাগছে। মুখটা আজ কেবলমাত্র একজন প্রতিশোধ পরায়ন নারীর মুখ হয়ে গেছে।

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-৫৭

পুরোটা পথ কেটে গেলো নিরবতায়। মোর্শেদ, সালিম কিংবা শুভ্রা কেউই কারো সাথে কথা বললো না। শুভ্রা মনে মনে প্রথমে শাশুড়ীর উপর তারপর নিজের বাবা চাচার উপর ভীষণ রেগে থাকলো। ওরা আজ না গেলে নিশ্চয়ই এমন কিছু হতো না। রণ থাকলে ওর মার এরকম উল্টো পাল্টা কিছু করার প্রশ্নই আসে না। এখন রণ ফেরার পর যখন শুনবে বাবা আর চাচা তার অনুপস্থিতিতে তার বোনের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে তখন নিজের মাকেই ঠিক মনেহবে তার। নিশ্চয়ই শুভ্রাকে দোষ দেবে। অথচ এসব বিষয়ে শুভ্রা কিছুই জানে না। শুভ্রার মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। শরীর জ্বলছে মেজাজের চাপে। নিজের বাবার দিকে একবার তাকালো সে। এতোদিন জানতো বাবা তাকে ভালোবাসে। আজ সেই ভালোবাসা নিয়ে মনে প্রশ্ন জাগছে। ভালোবাসলে নিজের মেয়ের সাথে কেউ এমন করতে পারে? জেনেবুঝে মেয়ের জীবন নষ্ট করবে কেন? শুভ্রা দাঁতে দাঁত চেপে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। তার কান্না পেয়ে যাচ্ছে। ভালো লাগছে না কিছু ভালো লাগছে না।

সালিম সাহেব মেয়েকে দেখলো একনজর। মলিন মুখটা দেখে বুকটা হুহু করে উঠলো। যেভাবেই হোক বিয়েটা হয়েছিল। এখন মেয়েটা ফিরে গেলে লোকসমাজে ছিছি তো হবেই সেই সাথে হেরে যাওয়ার সূক্ষ্ম ক্ষত তৈরি হবে। যে ক্ষত চুইয়ে রক্ত ঝড়বে চিরজীবন। তাদের পরিবারের উপর নজর লেগে গেছে বোঝা যাচ্ছে। সবদিক দিয়ে চাপে পড়ে গেছে। এরমধ্যে ছেলেটাকে হারিয়ে ফেলে যেন একহাত হারিয়ে ফেললো সালিম সাহেব। এখন মেয়ের এই অবস্থা কিভাবে সামাল দেবেন? পুরনো রাগের ধারা ফিরে আসছে তার মধ্যে। নাহ, নরম হয়ে বেশ বিপদে পড়ে গেছেন দেখা যায়। এখন তো সেই পুরনো রুপে ফেরা ছাড়া গতি নেই তার। সেই খুনো সালিম যাকে দেখে বাঘা বাঘা নেতারা মাথা নুইয়ে থাকতো। সালিম ঠিক করে ফেললো, এবার মেয়র নির্বাচনে যে কোন মুল্যে জিতবেন৷ তারপর এই শহর চালানোর ক্ষমতা নিজের হাতে নেবেন। রণকে দেখিয়ে দেবেন পুরনো চাল ভাতে বাড়ে। রণর মা আজ যা করলো তার জন্য আফসোস করতে হবে তাকে। সে ভুলে গেছে কার সাথে কথা বলেছে। ইব্রাহিম সালিম কোন মামুলি মানুষ না। এখন হয়তো তার সময় খারাপ তাই বলে শেষ হয়ে যায়নি সে। তার মেয়ের সাথে খারাপ করে রণ টিকতে পারবেনা এই পৃথিবীতে। দরকার পড়লে রণকে ওর বাপের মতোই নিশ্চিন্হ করে দেবে। তখন দেখবে রণর মা কিভাবে বড়াই করে। সালিমের চোয়াল শক্ত হয়, হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ।

এদিকে মোর্শেদ কিছুটা সংকোচ নিয়ে বসে আছে। নিজের কাছে বড্ড অপরাধী লাগছে। ছেলের বিয়ের কথা বলতে এসে এমন কান্ড হবে টের পায়নি। সালিম একবার বলেছিল বটে কিন্তু সত্যি সত্যি পরিস্থিতি এভাবে বদলে যাবে ভাবেনি। এখন শুভ্রাকে দেখে বুক গুড়গুড় করছে। মেয়েটা মনেহয় জামাইকে ভালোবাসে তা নয়তো এভাবে শাশুড়ির পায়ে পড়তো না। এখনতো ভয় হচ্ছে তাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে সম্পর্কের সমীকরণ পাল্টে না যায়। মোর্শেদ অপরাধী মুখ নিয়ে বসে রইলো চুপচাপ।

*****

দুইদিন পরে রণ ফিরলো। মনটা ভীষণ উৎফুল্ল ছিলো। এবার সব কাজে বেশ ভালো পারফরম্যান্স করেছে তারা। ইনভেস্টমেন্ট এর ব্যাপারে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। বন্দর ঘিরে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকা গড়ে তুলতে বেশ ভালো প্রস্তাব এসেছে। এখন সে প্রস্তাব বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। নেত্রী ভীষণ খুশি বলা যায়। গাড়িতে আসতে আসতে শুভ্রার কথা ভাবলো বারকয়েক। ফোন দিতে গিয়ে থেমে গেলো। ভাবলো ফোন না দিয়ে সরাসরি বাসায় গিয়ে একটা সারপ্রাইজ দেওয়া যাক মেয়েটা খুব খুশি হবে।

ফুরফুরে মেজাজে বাসায় ঢুকলো রণ। যথারীতি মায়ের ঘরে গেলো প্রথমে। টুকটাক আলাপ সারতে সারতে রণ ভেতর ভেতর ছটফট করে। কখন দেখতে পাবে শুভ্রাকে। সে এলে শুভ্রাই দরজা খোলে, শরবত তৈরি করে নিয়ে আসে। আজ শুভ্রার ছায়াও দেখলো না। গেলো কোথায় মেয়েটা। রণ অস্থির হয়ে বলেই ফেললো-“আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসছি মা। দীর্ঘ জার্নি তো শরীর খুব ক্লান্ত লাগছে।”
জলি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। ঠোঁট দু’টো চেপে রইলো। রণ উত্তরের অপেক্ষা করলোনা। ছুটে এলো নিজের কামড়ায়। শুভ্রাকে ডাকলো বারকয়েক। কোন সারা না পেয়ে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। গোসল সেরে আসার পরও যখন শুভ্রার পাত্তা নেই তখন তার ভ্রু যুগল কুঁচকে গেলো। এরকম তো কখনো করে না শুভ্রা। ফোন নিয়ে ঝটপট ফোন লাগায়। ফোনটা বিছানার উপরই একবার বেজে বন্ধ হয়ে গেলো। হাতে নিয়ে দেখলো চার্জ শেষ। সে কি মনে করে একবার রান্না ঘরে উঁকি দিলো। সেখানে কাজের মেয়েটা কাজ করছে। রণ ছুটে এলো মায়ের ঘরে-“মা, শুভ্রা কোথায়? আমি এলাম এতোক্ষণ হলো কিন্তু ওকে দেখলাম না।”
জলির মুখের রেখাগুলো বদল হলো। নিজেকে শান্ত রাখার আপ্রান চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। রণ যেন জলিকে কিছুটা পড়তে পারে। বুঝলো কিছু একটা হয়েছে, ঘরে কোন একটা গন্ডগোল হয়েছে। তার বুকটা ধকধক করছে। মনে কু ডাকছে। সে উত্তেজিত হয়ে চেচিয়ে উঠলো-“মূ, তুমি চুপ করে আছো কেন? কি হয়েছে? শুভ্রা কোথায়?”
জলিকে কিছুটা বিচলিত দেখায়। কয়েকবার চোখ পিটপিট করে ছেলেকে দেখলো। শীতল কণ্ঠে বললো-“শান্ত হয়ে আমার সামনে বোস। কথা আছে তোর সাথে।”
রণর ছটফটানি বাড়লো। সে চঞ্চল হয়ে জলির সামনে বসলো-“কি বলবে বলো। তার আগে বলো শুভ্রা কোথায়?”
জলি নিজেকে শান্ত রেখে স্থিমিত কন্ঠে বললো-“সে নাই চলে গেছে।”
“চলে গেছে! কোথায় চলে গেছে?”
রণ না বুঝে প্রশ্ন ছুড়ে দিলে জলি দীর্ঘ শ্বাস ফেললো-“ক’দিন ছিলি না। তোর অনুপস্থিতিতে অনেক কিছু ঘটে গেছে বাবাই। তোর শশুর আর চাচা শশুর এসেছিল আমাদের এখানে। তারা খুশির বিয়ের প্রস্তাব এনেছে তন্ময়ের সাথে। তুই ভাবতে পারিস ওদের সাহস কতো?”
রণর চোয়াল শক্ত হলো। সে ঠান্ডা গলায় বললো-“তুমি আমাকে ফোন দাওনি কেন মা? ওদেরকে তখনই শায়েস্তা করতাম।”
“তুই গেছিস কাজে তাই তোকে বিরক্ত করিনি। কিন্তু কথা হলো তোর বউ কিভাবে এলাও করলো এসব? তুই মানা করার পরও ওর বাবা আর চাচাকে খুশির বিয়ের প্রস্তাব আনতে বললো কেন?”
রণকে দ্বিধান্বিত দেখায়-“কিন্তু মা, শুভ্রার এমন কিছু করার কথা না। ও নিজেই তন্ময়ের সাথে বিয়েতে রাজি ছিলো না। ওর বাবাকে নিষেধ করে দিয়েছিল। ও হয়তো জানতো না ওরা প্রস্তাব নিয়ে আসবে।”
জলিকে অসন্তুষ্ট দেখায়-“মানতে পারলাম না বাবাই। তুই বলতে চাস ওর বাবা ওকে না জানিয়ে এখানে এসেছিল? এটা কি সম্ভব?”
রণ জবাব দিতে পারলোনা। চুপ করে রইলো।
“ওর বাবা আর চাচার সাথে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে আমি শুভ্রাকে বলেছি নিজের পরিবার নিয়ে এসব করার ইচ্ছে থাকলে যেন সে চলে যায় তার বাবার সাথে। বিয়ের পর তো আমাদের আপন ভাবেনি। বাবা ভাইয়ের জন্য টান সর্বদা তাহলে এ বাড়িতে থেকে কি হবে। তাই না বল?”
রণ অবিশ্বাস নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না মা কি বলছে। মায়ের মাথাটাথা খারাপ হলো নাকি? সে বড়বড় চোখপ জানতে চাইলো-“তুমি কি বলছো আমি বুঝতে পারছি না। শুভ্রাকে চলে যেতে বলেছ মানে কি?”
“গতবার এমন একটা ঘটনা ঘটালো ওর ভাই তবুও শুভ্রা তারই পক্ষ নিলো। এবার ও বাবা চলে এলো প্রস্তাব নিয়ে। মেয়েটা এ বাড়িতে থাকলে এসব চলতেই থাকবে এটা ভেবেই আমি বলেছি ও না হয় বাড়ির হয়ে থাকুক না হয়ে ও বাড়ি ফিরে যাক। দোটানায় তো সংসার হয় না বাবাই। ওর জন্য আমি আমার মেয়েদের জীবন রিস্কে ফেলবো কেন? আজ ঘরে প্রস্তাব নিয়ে এসেছে কাল যে জোর করে তুলে নিতে চাইবে না তার কি গ্যারান্টি?”
“এসবের সাথে শুভ্রার সম্পর্ক কি মা? ও তো কাউকে এসব করতে বলেনি।”
জলির চেহারা কঠিন হলো-“শক্ত হয়ে মানাও তো করছে না। অনেকদিন সহ্য করেছি বাবাই। সবচেয়ে বড় কথা তোর বউ চলে গেছে ওর বাবার সাথে। ওর যদি তোর জন্য আমাদের জন্য সামান্যতম টান থাকতো তাহলে কি যেতে পারতো? বরং ও বাড়ির সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করতো। কিন্তু তা না করে কি করলো? একবারও তোর আমার কথা ভাবেনি। প্রতিশোধের জন্য বিয়ে করেছিল তা কমপ্লিট করে এখন বিদায় নিয়েছে। বুঝেছিস?”
কিছুই বুঝলো না রণ। মায়ের কথার কোথাও শুভ্রার দোষ না পেলেও মায়ের সামনে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পারলোনা। মায়ের একটা কথায় সে সহমত পোষণ করলো। আসলেই তো, এতো সহজে ও চলে গেলো কেন? নিজের সংসার ফেলে কেন গেলো? সেদিনই না রণকে ভালোবাসার কথা জিজ্ঞেস করলো? কেন জানতে চেয়েছিল তাহলে? যদি সংসারই না করবে তবে ভালোবাসা দিয়ে কি হবে? রণর বুকটা ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা লাগতে লাগলো। হাসফাস করে রণ উঠে দাঁড়ায়। জলি বারকয়েক খাওয়ার কথা জানতে চাইলো কিন্তু সেসব কথা রণর মাথায় ঢুকলো না। সে মোহগ্রস্তের মতো মায়ের কামড়া থেকে নিজের কামড়ায় এলো। অদ্ভুত ঘোরলাগা দৃষ্টিতে পুরো কামড়ায় নজর ঘুরালো। পুরো কামড়া শুভ্রাময়। মেয়েটা ওকে ছেড়ে চলে গেছে! ওর বাবার বাড়িতে ফিরে গেছে! অথচ ও ভেবেছিল শুভ্রা ভালোবাসা ওকে। জেদের বিয়ে ভালোবাসায় গড়িয়ে গেছে ভেবে খুশি হয়েছিল। বাবার খুনির মেয়েকে নিয়ে সংসারের স্বপ্ন দেখেছিল রণ। রণ পাগলের মতো কিছুক্ষণ ঘরে পায়চারি করে। বিরবির করলো, কেন চলে গেলে শুভা? আমার জন্য একটা বার অপেক্ষাও করলেনা? কেন শুভ্রা কেন? এতোদিনে তোমার মনে একটুও কি ভালোবাসা, বিশ্বাস জন্মেনি আমার জন্য? আহহহহ! কেন এমন করলে? রণ হুট করে শুভ্রার মোবাইল ছুঁড়ে দিলো ড্রেসিং টেবিলের আয়নায়। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করলো-“শুভ্রাআআআআআ!”

চলবে—
©Farhana_Yesmin

দর্পহরন পর্ব-৫১+৫২+৫৩

0

#দর্পহরন
#পর্ব-৫১

“রাগীব, সালিম সাহেব যে কোন মুল্যে মেয়র পদে মনোনয়ন চায়। ওকে অনেক ভাবে দমাতে চেয়েছি কিন্তু কিছুতেই মানছে না। কি করি বলো তো?”
নেত্রীর এমন প্রশ্নে রণ কিছুটা বিচলিত হলো-“উনি তো কোনভাবেই মনোনয়ন এর যোগ্য হয় না ফুপু। ওখানকার পরিবেশ কেবলই কিছুটা সুস্থির হতে শুরু করেছে। এখন যদি আবার উনি ফিরে আসে তাহলে আবার আগের মতো ত্রাশ সৃষ্টির চেষ্টা করবে। কাজ সব নিজের আয়ত্তে নেওয়ার চেষ্টা করবে। এলাকার মানুষের শান্তি বিনষ্ট হবে।”
নেত্রীর মুখে বিরক্তির রেখা ফুটে উঠলো-“সেসব তো আমি জানি রাগীব। কথা হলো তাকে ঠেকাবো কি করে? সালিম বেশ মরিয়া হয়ে গেছে। মনোনয়ন না পেলে ও কি করবে আমি জানি না।”
চুপ করে থেকে কিছু একটা ভাবলো রণ। নেত্রী বললো-“আর ওকে মনোনয়ন দিলে যে কোন মুল্যে হোক ও জিতবে। যত ভালো প্রার্থীই দাও না কেন।”
“আপনি ওনাকে মনোনয়ন দিন ফুপু।”
রণর কথায় চমকে উঠলো নেত্রী-“মানে? কি বলছো বুঝতে পারছো? ওকে মনোনয়ন দেওয়া ওকে ওই এলাকার নিয়ন্ত্রণ দিয়ে দেওয়া।”
রণ গম্ভীর হয়ে জবাব দিলো-“উনি মনোনয়ন পাবে কিন্তু জিতবে না এই শিওরিটি আমার। যতদূর জানি আজ পর্যন্ত উনি বা ওনার পরিবার নির্বাচনে হারেনি কখনো, তাই তো? এবার হারবে এবং ওনার দর্ম্ভ চূর্ন হবে।”
“যদি না হয়? সালিমকে মাত দেওয়া এতো সহজ না রাগীব। আমার এতোদিনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থাকার পরও ওকে নিয়ে খেলতে ভয় পাই। বুঝতে পারছো তো তুমি?”
রণ এবার ঠোঁট টিপে জবাব দিলো-“আমার উপর ভরসা করুন ফুপু। আপনি পুরো ব্যাপারটা আমার উপর ছেড়ে দিন। দল থেকে ওনাকে মনোনয়ন দিন। তবে সতন্ত্র একজন কিন্তু থাকবে। তার প্রতি প্রছন্নভাবে সাপোর্ট করতে হবে আপনাকে।”
নেত্রীর সন্দিহান নজরে রণকে দেখলো-“কাকে দেবে সতন্ত্রতে?”
রণ এবার সামান্য ঠোঁট ফাঁক করলো-“দেখি কাকে দিলে সুবিধা হয়। আপনি প্লিজ দলের মধ্যকার আলোচনা সামলে নেবেন ফুপু।”
নেত্রী মাথা নাড়ে-“ঠিক আছে। তোমার মা কেমন আছে?”
হুট করে মায়ের প্রসঙ্গ আসায় একটু হকচকিয়ে গেল রণ-“ভালো আছে।”
তোমার মাকে একদিন নিয়ে এসো এখানে। অনেক দিন দেখা হয় না। আমি তো সময় করতে পারি না তাই বলাও হয়ে ওঠে না।”
“জ্বি আনবো। আজ তাহলে আসছি ফুপু।”
নেত্রী মাথা দুলালেন। রণ চলে এলো। নেত্রীর মাথায় অন্য চিন্তা। সালিম এবার খুব খারাপ কাজ করেছে৷ তার অত্যন্ত স্পর্শকাতর জায়গায় হাত দিয়ে ফেলেছে। এবার সালিমকে ছাড়া যাবে না কিছুতেই। ঘটনা দু’চার কান হলে বাকী সদস্যরা যে কোনদিন বেয়াদবি করবে না তার কি গ্যারান্টি? সমস্যা বিষফোড়া হওয়ার আগেই তাকে গোড়া থেকে উৎপাটন করা জরুরি। সেটাই করতে হবে তাড়াতাড়ি।

*****

তন্ময়ের মাথায় খুশির ভুত চেপেছে। কিছুতেই খুশিকে মাথা থেকে বের করতে পারছে না। তন্ময় বুঝতে পারছে না খুশিকে বিয়ে করতে চাইলে সমস্যা কোথায়? সে তো ছেলে হিসেবে খুব খারাপ না৷ তাহলে? গাড়ির জানালা দিয়ে উঁকি দিলো তন্ময়। খুশি কি আজ ভার্সিটিতে আসবে না? ভাবনার মাঝেই খুশিদের গাড়িটা দেখলো। ভার্সিটির গেটে খুশিকে একা নামতে দেখে তন্ময় মনে মনে পুলকিত হয়ে উঠলো। আরেহ! আজ হাসি আসেনি দেখা যাচ্ছে। তন্ময়ের চেহারায় একটা পৈশাচিক খুশি ফুটে উঠে মিলিয়ে গেলো। সে ঘড়ি দেখলো। সকাল দশটা বাজে। কিছুক্ষণ বসে ভাবলো কি করবে। আজকের সু্যোগটা কাজে লাগাতে হবে। কিছুতেই ছাড়া যাবে না। তন্ময় চুপচাপ বসে রইলো।

ঘন্টা দেড়েক বাদে ফোনটা হাতে নিলো সে। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে ডায়াল করলো খুশির নাম্বারে-“হ্যালো, খুশি বলছো?”
“জ্বি। আপনি কে?”
ওপাশে খুশির গলা পেয়ে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটলো তন্ময়ের-“আমি তন্ময়।”
“তন্ময়, আপনি কেন ফোন করেছেন? সরি, আপনার সাথে কথা বলতে পারবো না।”
খুশি ফোন কেটে দিলো। তন্ময় আবার ফোন দিলো। কয়েকবার দেওয়ার পরেও খুশি ফোন না ধরলে তন্ময় ম্যাসেজ দিলো-“জরুরি না হলে কি ফোন দিতাম? তোমাদের বাসায় এসেছিলাম। তোমার ভাবি বাসায় একা, দেখি সে অসুস্থ হয়ে গেছে। তুমি কি আসতে পারবে? ও তোমাকে নিতে পাঠিয়েছে আমাকে। আমি ইউনিভার্সিটির গেটে তোমার অপেক্ষা করছি।”
শুভ্রার অসুস্থতার কথা শুনে খুশি ঘাবড়ে গেল-“কককি বলছেন এসব? সকালে তো ভাবি ঠিকই ছিলো। কি হলো হঠাৎ?”
“জানি না। তুমি কি আসবে নাকি আমি চলে যাব?”
“না না আমি আসছি।”
খুশি তড়িৎ উত্তর দিলো। তন্ময় ফোন নামিয়ে রেখে হাসছে। পাঁচ মিনিট পরেই খুশিকে হন্তদন্ত হয়ে গেটের দিকে ছুটে আসতে দেখলো। গম্ভীর হয়ে তন্ময় খুশির দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লো-“খুশি, এই যে এখানে।”
খুশি প্রায় ছুটে এলো-“চলুন যাওয়া যাক। ভাবি কি এখনো একা আছে? আমি তাহলে মাকে ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি।”
তন্ময় বাঁধা দিলো-“না দরকার নেই। কাজের মেয়েটাকে বসিয়ে দিয়ে এসেছি। আপনার মাকে জানাতে মানা করলো শুভ্রা। কি নাকি জরুরি কাজে গেছে। আপনি বরং গাড়িতে বসুন তাড়াতাড়ি।”
খুশি মাথা নেড়ে গাড়িতে বসলো। তন্ময়ের গাড়ি চলতে শুরু করলো। পরিচিত রাস্তা ছেড়ে অপরিচিত রাস্তায় গাড়ি ঢুকতেই খুশি চমকে গেলো-“এদিকে কেন ঢুকলেন? এদিক দিয়ে তো দেরি হবে বাসায় যেতে।”
তন্ময় খুশির দিকে তাকিয়ে হাসলো-“ভয় পেয় না। তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেব তার আগে কিছু কথা বলতে চাই তোমার সাথে।”
খুশির বুক ধরাস ধরাস করছে। সে বুঝে গেলো তন্ময় তাকে মিথ্যে বলেছে। সে চেচিয়ে উঠলো-“আপনি মিথ্যে বলেছেন তাই না? ভাবি অসুর না।”
তন্ময় মুচকি হেসে মাথা নাড়ে-“ভাবিকে এতে ভালোবাসো জানা ছিলো না।”
“আপনি গাড়ি থামান প্লিজ। আমাকে নামিয়ে দিন। আপনার সাথে কোন কথা নেই আমার।”
তন্ময়ের চোয়াল শক্ত হলো-“খুব ভালো মতো বলছি খুশি। শুধু কিছু কথা বলবো তোমার সাথে। তারপর ছেড়ে দেব তোমাকে।”
খুশি অস্থির হয়ে হাতপা ছুড়লো। গাড়ির দরজা খোলার চেষ্টা করলো কিন্তু তন্ময় দরজা লক করে দিয়েছে। খুশি চেঁচালো-“প্লিজ আমাকে নামিয়ে দিন। বললাম তো আপনার সাথে কোন কথা নেই।”
তন্ময়ের চেহারায় কাঠিন্যে ফুটে উঠলো। সে গাড়ি থামিয়ে খুশির দিকে তাকালো-“এখনই এসব বন্ধ না করলে আপনাকে কিডন্যাপ করবো খুশি। কেউ বাঁচাতে পারবে না আপনাকে।”
খুশি চমকে উঠে নিশ্চুপ হয়ে গেলো। তন্ময় ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো-“এই তো লক্ষী মেয়ে। এবার বলুন তো আমার মধ্যে কি সমস্যা? মানে পাত্র হিসেবে আমি কি যোগ্য না?”
খুশি জবাব না দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো। তন্ময় তাড়া দিলো-“বলুন। কথা বলছেন না কেন? আমি বিয়ে করতে চাই আপনাকে। আপনি কি রাজি না?”
খুশি ঝট করে ফিরে তাকালো-“শুনুন, বিয়ে নিয়ে ভাববার জন্য মা আর ভাইয়া আছে। আমি এসব নিয়ে এখনও ভাবছি না পরেও ভাববো না। কাজেই আমার কাছে মতামত জানতে চেয়ে খুব একটা লাভ নেই। আপনার যদি কিছু বলার থাকে তাহলে তাদের বলুন কিংবা ভাবিকে বলুন। সে তো আপনার বোন তাই না?”
“বলেছিলাম কিন্তু শুভ্রা মানছে না। সে বলেছে সম্ভব না।”
খুশি হেসে দিলো-“তাহলে তো হয়েই গেলো। উত্তর তো পেয়েই গেছেন।”
তন্ময় গম্ভীর হয়ে উত্তর দিলো-“কিন্তু উত্তরে আমি খুশি না। খুশি হওয়ার জন্য যা করতে হবে তাই করতে চাই আমি।”
খুশি ভীত কন্ঠে জানতে চাইলো-“মানে? কি করতে চাইছেন আপনি?”
“আপনাকে বিয়ে। আপনার নিশ্চয়ই আপত্তি নেই?”
খুশি ভীত চোখে চেয়ে আছে। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। ঠিক ওই সময় তন্ময়ের জানালায় নক হলো। একজন ঝুকে পড়লো সেদিকে। তন্ময়ের মেজাজ খিঁচে গেলো। জরুরি আলাপে কে বিরক্ত করে? ধমক দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে দ্রুত হাতে জানালা খুলতেই চমকে গেলো সে। এভাবে ধরা পড়ে যাবে জানা ছিলো না। তন্ময় পুনরায় মাথা ঢুকিয়ে জানালা বন্ধ করতে চাইলে বাঁধা পেলো। উল্টো ওর দিকের দরজাটা খুলে গেলো সহসাই। তন্ময় ভয় পেয়ে ঢোক গিললো।

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-৫২

“আমি বলেছিলাম খুশির দিকে না তাকাতে। শুনলে না কেন তন্ময় ভাই?”
তন্ময় কাচুমাচু দৃষ্টিতে শুভ্রাকে দেখলো। শুভ্রা কঠিন চেহারা নিয়ে তন্ময়কে দেখছে-“আজ তুমি কি করতে যাচ্ছিলে ভাইয়া? তোমার কোন আইডিয়া আছে ওর কানে গেলে কি হবে?”
শুভ্রার হুঙ্কারে কেঁপে উঠলো তন্ময়-“আমার অন্য কোন মতলব ছিলো না শুভ্রা। আমি কেবল খুশির সাথে কথা বলে আমার ব্যাপারে ওর মতামত জানতে চেয়েছি। আর কিছু না।”
“সিরিয়াসলি! ওকে মিথ্যে বলে ডেকে নিয়ে তুমি ওর মতামত জানতে চাইছো? আর ইউ ম্যাড? ও কি কখনো তোমাকে বলেছে বা ইঙ্গিত দিয়েছে যে ও তোমাকে পছন্দ করে?”
“আর খুশি, বোকা মেয়ে! তুই কি মনে করে তন্ময় ভাইয়ের ডাকে সারা দিলি? তোকে কি বলেছিলাম? আমি ফোন না দিলে বেরুবি না।”
খুশি কেঁদে দিলো-“তোমার অসুস্থতার কথা শুনে ভয় পেয়েছিলাম ভাবি। মাথা কাজ করছিল না।”
শুভ্রা খুশিকে জড়িয়ে ধরে-“আর কখনো এমন করবি না খুশি। যা গাড়িতে গিয়ে বয়।”
খুশি মাথা নেড়ে চুপচাপ গাড়িতে বসলো। তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে শুভ্রা বললো-“তোমাকে অনেকদিন বলেছি কিন্তু তুমি শোননি আমার কথা। এখন ও জানলে তোমার কি হাল করবে আমি জানি না। আমি তোমার সাহস দেখে অবাক হচ্ছি। কোন সাহসে তুমি ওকে মিথ্যে বলে ক্লাস থেকে বের করে আনলে?”
তন্ময় হঠাৎ করে শুভ্রার হাত চেপে ধরে-“শুভ্রা, আমি ওকে বিয়ে করতে চাই। প্লিজ শুভ্রা, তুই না আমার বোন। তুই একটু কথা বলে দেখ না রণর সাথে।”
শুভ্রা হাত ছাড়িয়ে নিলো-“আমার মাথা খারাপ হয়নি ভাইয়া যে তোমার জন্য প্রস্তাব দেব। যাদের মেয়ে তারা সিদ্ধান্ত নেবে কি করবে। আর তুমি কি কথা বলার মতো অবস্থা রেখেছ? তুমি আজ যা করলে তাতে তুমি নিজেকেই বিপদে ফেলে দিলে৷ আমি এখন বাবাকে জানাবো তোমার ঘটনা। তা না হলে উনি কিছু একটা করবেন আর বাবা ওনাকে ভুল বুঝবে।”
শুভ্রা মোবাইল বের করতেই তন্ময় শুভ্রার হাত চেপে ধরে-“প্লিজ বোন, চাচ্চুকে জানাস না। খুব রাগ হবে চাচ্চু।”
শুভ্রা হাত ছাড়িয়ে নিলো-“আর কোন কথা নেই তোমার সাথে। আশাকরি আজকের পরে খুশির আশেপাশে তোমাকে দেখবো না। নেহাৎ তুমি আমার ভাই তাই নিজের উপর রিস্ক নিয়ে তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি। ভালো থেক।”
শুভ্রা গাড়িতে উঠে বসলো। খুশি কৌতূহলে জানতে চাইলো-“তুমি কি করে আমাদের ধরতে পারলে ভাবি?”
শুভ্রা অন্যমনস্ক হয়ে ছিলো। বারবার ভাবছে তন্ময় আজ কি করতো খুশির সাথে। তাতে ওর আর রণর সম্পর্ক কোথায় দাঁড়াতো? ভয়ে গায়ে কাটা দিলো শুভ্রার। খুশি আবার ডাকলো-“ভাবি কি ভাবছো?”
“কিছু না। তুই কি যেন বলছিলি?”
“”তুমি কিভাবে জানলে ওনার ব্যাপারে? আমাকে কেন ফোন করে বললে ওনার কথা মেনে নিয়ে নাটক করতে? ওনার তালে তাল দিতে।”
শুভ্রা হাসলো-“তোকে নামিয়ে ফিরে যেতে ভাইয়াকে দেখে ফেলেছিলাম। তারপর বুঝলাম তোকে আজ একা নামতে দেখেছে। কি মনে করে আমি ভাইয়ার আড়ালে গাড়ি নিয়ে থেকে গেছিলাম। ভাগ্যিস থেকে গেছিছিলাম।”
“কিন্তু তোমার ইন্টারভিউ মিস হলো যে?”
খুশি মন খারাপ গলায় জবাব দিতেই শুভ্রা হেসে দিয়ে খুশির চিবুক ছুঁয়ে দিলো আলতো করে-“তোর চেয়ে কি চাকরি বড়? চাকরি আসবে যাবে তোর কিছু হলে তোর ভাইয়াকে কি জবাব দিতাম?”
খুশির চেহারায় ভয়ের ছাপ স্পষ্ট হলো-“ভাইয়াকে বলো না ভাবি। অযথাই ভুল বুঝবেো তোমাকে।”
শুভ্রার চেহারা মলিন হলো-“না বললেও সে খবর পাবে খুশি। তোমার ভাইয়াকে বোকা ভেব না। সে হয়তো লোক লাগিয়ে রেখেছে তোমাদের পেছনে।”
খুশি ভয় পেয়ে ঢোক গিললে শুভ্রা অভয় দিলো-“তোমাকে কিছু বলবে না। ভেব না।”

সারাদিন নিজের মেজাজ কোনরকমে ধরে রেখেছিল রণ।বাসায় ফিরে শুভ্রার উপর সেই মেজাজের তাপ ঢাললো-“তুমি জানতে তন্ময় এমন কিছু করতে পারে, তাই না?”
শুভ্রা অবিচল হয়ে মাথা নাড়ে-“না, জানতাম না।”
“অনেক সহ্য করেছি শুভ্রা আর না। এবার ওর কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করছি দাঁড়াও। ওর এতো সাহস আমার বোনকে কিডন্যাপ করতে চায়।”
শুভ্রা রণর দিকে তাকিয়ে থেকে মৃদু হাসলো-“আপনিও সাহস করেছিলেন। ইব্রাহিম সালিমের মেয়েকে কিডন্যাপ করেছিলেন। কেন? নির্বাচনে ওনাকে পরাস্ত করতে। তাই না? আপনি জানতেন সালিম সাহেব মেয়ের প্রতি দূর্বল, তাকে দূর্বল করতে চাইলে মেয়েকে ব্যবহার করতে হবে। তা না হলে সালিম সাহেবকে পথ থেকে সরানো যাবে না।”
রণর মুখে কথা জুটলো না। শুভ্রা কিছুক্ষন থেমে বললো-“আপনার বুদ্ধি সত্যিই কাজে লেগেছিল। বাবাকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে আমাকে আঁটকে রাখার বুদ্ধিটা সফল হয়েছিল। অথচ দেখুন আপনাদের রাজনীতির খেলায় মাঝখানে আমি ফুটবল বনে গেলাম। সবাই আমাকে নিয়েই তাদের খেলা চালিয়ে যাচ্ছে।”
রণর চেহারা টকবগ করে ফুটছে। সে ছটফটিয়ে উঠে বললো-“সেসব কথা এখন আসছে কেন? আজকের ঘটনার সাথে সেসব ঘটনার সম্পর্ক কি?”
“সম্পর্ক নেই? না থাকলে ভালো। শুনুন, মাত্রই সোহেল ভাইয়ার ঘটনা ঘটেছে। এমনিতেই সবাই মুড়ষে আছে। আমি চাই না আর কিছু হোক আমাদের পরিবারে। তাই এবারকার মতো তন্ময় ভাইকে একটা সু্যোগ দেবেন আপনি। আপনার নিজের দোষ যদি মাফ হওয়ার মতো হয় তাহলে এটাও মাফ করতে হবে আপনাকে।”
“শুভ্রা!”
রণ ফুঁসে উঠলো। শুভ্রা হাসলো-“নিজের দোষ মানতে শিখুন মিস্টার মন্ত্রী মশায়।”
“কাজটা মোটেও ভালো করছো না শুভ্রা। ভবিষ্যতে কিছু হলে তার দায়ভার সম্পূর্ণ তোমার হবে।”
শুভ্রা জবাব দিলো না। বুকে ভয় থাকলেও বুঝতে দিলো না সে।

*****

“ভাইজান, একটা জরুরি কথা আছে।”
খেতে খেতে থেমে গেলো মোর্শেদ। ছোট ভাইয়ের কন্ঠ ভালো ঠেকলো না মোর্শেদের কানে। চিন্তিত হয়ে শুধায়-“কি কথা সালিম? কি হইছে?”
“তন্ময় কি পাগলামি শুরু করছে ভাইজান?”
“তন্ময় আবার কি করছে?”
“শুভ্রার ননদের পিছনে পইড়া আছে তন্ময়। বিরক্ত করতাছে। আইজকা তো বাড়াবাড়ি কইরা ফালাইছে। জামাই জানলে কি হইবো বুঝছেন?”
মোর্শেদ বিরক্ত হয়ে তন্ময়কে দেখলো-“কিরে তন্ময়, সমস্যা কি তোর? এইসব করতেছোস কেন?”
তন্ময়ের খাওয়া বন্ধ হয়েছে আগেই। সে মুখ শক্ত করে বললো-“আমি বিয়ে করতে চাই আব্বা। শুভ্রার ননদকে আমার ভালো লাগছে। বিয়ে করলে ওকেই বিয়ে করবো আর কাউকে না।”
সালিম সাহেব মেজাজ হারিয়ে চেচিয়ে উঠলো-“ফাজলামি করস নাকি তমাল? জামাই স্পষ্ট মানা করছে তার বোনের ব্যাপারে। তারপর কি আর কথা থাকে?”
তন্ময় হাত ঝাড়লো-“তোমাদের সামনে ফাজলামি করবো এমন সাহস আমার নাই। যেমন ভালোলাগার উপর কারো হাত নাই। আমি আমার কথা ক্লিয়ার বলে দিলাম, বিয়ে করলে খুশিকে করবো। এখন তোমরা কেমনে ম্যানেজ করবা করো।”
সালিম সাহেব হুঙ্কার দিলেন-“মাইয়ার শশুরবাড়ি ভাইজান। কোন ভ্যাজাল করতে চাই না। তারউপর ওয় এখন ক্ষমতায় আছে। আর কারো সোহেলের মতো পরিনতি হোক এইটদ আমি কিছুতেই চাই না। ওরে বুঝান ভাইজান।”
তন্ময় গোয়ারের মাথা নাড়ে-“বুঝাইলেও আমি বুঝবো না। যা বলছি তা বলছি। কথা শেষ।”
খাবার থেকে হাত ঝাড়লো তন্ময়। হনহন করে চলে গেলো নিজের কামরায়। মোর্শেদ ডাকলো কয়েকবার, সারা দিলো না। সালিম সাহেব মোর্শেদের দিকে তাকিয়ে রাগত স্বরে বললো-“দেখছেন ভাইজান, দেখছেন? পোলাগুলা সব এইরকম হইছে কেন? কথা শুনতে চায় না? আমরা কি ওদের খারাপ চাই? পরিস্থিতি বোঝা লাগবে না? যা মন চায় তাই করার দিন কি এখন আছে? এমনিতেই সবাই কোপানলে আছি। একটু উঁচুনিচু কিছু হইলে সব শেষ। এদের এইসব কেমনে বুঝাই? এতোসব কাদের জন্য করি আমরা? ওদের ভবিষ্যত ভাইবাই তো করি নাকি?”
মোর্শেদ চিন্তিত হয়ে ছেলের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে ছিলো। ছোট ভাইয়ের কথায় কপালে চিন্তার ভাজ বাড়লো। তন্ময় ভীষণ গোয়ার। একবার বলে ফেলেছে মানে ও সিরিয়াস। এদিকে সালিম তো মানবেই না কারণ মেয়ে আছে সেখানে। এ কি জ্বালায় পরা গেলো?
“ভাইজান, আপনে চুপ কইরা আছেন কেন? কিছু কন?”
“তুই কিছু ভাবিস না সালিম। আমি তন্ময়ের লগে কথা কমু।”
মুখে বললেও মনে মনে শঙ্কিত হয়ে ভাবছেন, মহা মুছিবতে পড়া গেলো তো! তন্ময়কে কিভাবে বোঝাবেন তিনি?

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-৫৩

মেয়র নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু হয়েছে বেশ ভালো ভাবেই। তফসিল ঘোষণার সময় ঘনিয়ে আসছে। সালিম সাহেব নিজ থেকে বেশ তোরজোর শুরু করেছেন। কিছু সামাজিক কাজ শুরু করেছেন। মসজিদ মাদ্রাসায় ডোনেশন দেওয়া, স্কুলে ফান্ডিং করা ছাড়াও এলাকার পার্টি কর্মীদের সাথে সক্ষ্যতা বাড়াতে ছোট ছোট করে পার্টি দিচ্ছেন। আগে এসব কাজ সোহেলই করতো এখন সালিম সাহেব নিজে দেখছেন সাথে আছে তুহিন। সালিম সাহেব বুঝতে পারছেন পার্টির সবাই দ্বিধান্বিত। তার মুখের উপর কেউ মানা না করলেও পেছনে বোশ আলাপ হচ্ছে তাকে নিয়ে। সালিম
সাহেব পাত্তা দিচ্ছেন না। তিনি নিজের মতো করে প্রচারনা করে যাচ্ছেন। নিজের মধ্যে ভীষণ জেদ চেপে যাচ্ছে। এই ক্ষমতার দ্বন্দে নিজের ছেলেকে হারিয়েছেন, হারিয়েছেন সন্মান। সন্তান ফিরে পাবেন না কিন্তু পুরনো গৌরবটা ফিরিয়ে আনতে হবে। আর এইজন্য ক্ষমতা ফিরে পাওয়া ভীষণ জরুরি। হোক তা এলাকার মেয়র পদ। জানে মেয়র হলে সংসদে যাওয়া হবে না কিন্তু তবুও দীর্ঘ দিন ক্ষমতা থেকে দূরে থাকার চাইতে ভালো।
“স্যার, আসবো?”
চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুঁজে ছিলো সালিম সাহেব। তুহিনের গলা পেয়ে উঠে বসলো-“আয়।”
তুহিন কাচুমাচু হয়ে বললো-“স্যার, একটা কথা বলতাম।”
“কি কথা?”
“বউমার ভাইটা নাকি দল করে। তলেতলে আপনের অপজিটে কাজ করে।”
সালিম সাহেবের ভ্রু কুঁচকে গেলো-“সত্যি জানোস নাকি কেউ ভাঙানি দিছে?”
তুহিন মাথা দুলায়-“না সত্য খবর। আমি অনেকদিন ধরে খোঁজ নিতেছিলাম। আজই শিওর হইলাম।”
“জামাইয়ের জন্য কাজ করে?”
তুহিন মাথা দুলায়। চিন্তায় ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে গেলো সালিম সাহেবের। তুহিন দ্বিধা নিয়ে বলে-“ওকে কি অফিসে ডাকবো?”
“ওরে নিয়ে চিন্তার কিছু আছে? দুইদিনের পোলা রাজনীতির কি বোঝে?”
তুহিন চুপ করে রইলো। মনেহচ্ছে কিছু বলতে চান কিন্তু সাহসে কুলাচ্ছে না। সালিম সাহেব বললো-“কি বলতে চাস বল।”
“ও ভালো কাজ করে। অল্প বয়স কিন্তু কথা দিয়া মানুষরে বশ করতে পারে। এইজন্যই জামাই ওরে হাতে রাখছে।”
“তো? আর এমনেও ওয় আমাগো পছন্দ করে না এই তো জানোস।”
“জানি। তয় ওরে কাজ করাইতে রাজি করতে পারলে আপনের অনেক সুবিধা হইতো।”
আবারও চেয়ারে হেলান দিয়েন সালিম সাহেব। কিছুক্ষণ ভাবলেন বসে বসে তারপর বললেন-“আচ্ছা, ডাক ওরে। আলাপ কইরা দেখি কি কয়।”
তুহিনের মুখে হাসি ফুটলো। সে রুম থেকে বেরুবে এমন মুহূর্তে সালিম সাহেব ডাকে-“তুহিন।”
অবাক হয়ে পিছু ফেরে তুহিন-“জ্বি স্যার।”
সালিম সাহেব মৃদু হাসেন-“তুই আমাকে স্যার ডাকিস না। চাচা কবি আইজ থিকা। ঠিক আছে?”
তুহিন বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থেকে হেসে দিলো। খুশিতে কান্না এলেও নিজেকে সামলে নিলো সে। মাথা নেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তার চোখের কোলে জলের আভাস বেশ টের পেলো সালিম সাহেব।

*****

কয়দিন ধরে শুভ্রার সাথে কথা বলে না রণ। গভীর রাতে বাসায় ফিরে সরাসরি বিছানায়। শুভ্রা খাবার আনলে খায় না কথাও বলে না। আজ জেগে বসে ছিল শুভ্রা। ঠিক করে রেখেছে রণ আজ কথা না বললে সে ঝগড়া শুরু করবে। সেজেগুজে ঝগড়ার প্রস্তুতি নিয়ে বসে রইলো সে। রণ রুমে ঢুকেই থতমত খেলো। শুভ্রা সোফায় বসে আছে টুকটুকে লাল শাড়ি পরে। ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া রণ না দেখার ভান করে নিজের কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। ফিরে এসে দেখলো টি টেবিলের উপর খাবার রাখা। বরাবরের মতো না দেখার ভান করে রণ শুয়ে পড়তে চাইছিল কিন্তু শুভ্রা ডাকলো-“শুনুন। এখানে আসুন।”
রণ সে ডাক অগ্রায্য করে বিছানায় বসলো। শুভ্রা শান্ত হয়ে দেখছে তার কান্ড। সে শান্ত গলায় বললো-“মন্ত্রী মশায়, আজ যদি না আসেন খাবার না খান তাহলে আমি চেচামেচি শুরু করবো। আন্টি শুনে দৌড়ে আসবে। সে অবশ্য এসব দেখলে খুশি হবে। এমনিতেই সে চায় আমি আপনার জীবন থেকে বিদায় নেই। এখন আপনি কি চান আপনি বলুন।”
রণ ভ্রু কুঁচকে শুভ্রার দিকে তাকিয়ে আছে। চেহারায় গাম্ভীর্যের আড়ালে খানিকটা বিরক্তি। শুভ্রার হুমকি আমলে নিয়েছে বলে মনেহয় না। শুভ্রা হাসলো-“আপনি মনেহয় ভাবছেন আমি দুষ্টামি করছি। আমি যে ফান করছি না এটা কি প্রমান করতে হবে?”
রণ এবার চুপচাপ উঠে এলো। বসলো শুভ্রার সামনে। খাবারের প্লেটটা দেখলো একনজর। শুভ্রার চেহারায় চোরা হাসি ফুটে উঠে মিলিয়ে গেলো। রণ ওর দিকে তাকিয়ে চোখ নাচায়-“তুমি ভেবোনা তোমার হুমকিতে ভয় পেয়েছি। শুধু জানতে চাইছি এসব কি?”
শুভ্রা অবাক হওয়ার ভান করলো-“খাবার। প্রতিদিন না খেয়ে শুয়ে পড়েন সেটা ঠিক আছে। কিন্তু তারপর যা করেন তাতে আমার ঘুমের খুব সমস্যা হচ্ছে।”
“মানে?”
“মানে খুব সিম্পল। আপনি খিদের জ্বালায় সারারাত ছটফট করেন আমার ঘুম হয় না। তাছাড়া আপনি খান না বলে আমারও খাওয়া হয় না। রাতে আপনার হাতে খাওয়ার অভ্যেস হয়ে গেছে তো।”
রন খুকখুক করে কেশে মৃদুস্বরে বলে-“এবার কিন্তু অতিরিক্ত হচ্ছে। কে বলেছে তোমাকে না খেয়ে থাকতে?”
শুভ্রা চোখ পিটপিট করে-“ওমা! কে বলবে আবার? এটাই তো নিয়ম। বর না খেলে বুঝি বউ খেতে পারে?”
“মরলুম একেবারে।”
রণর ঢিমে গলায় বলা কথাটা শুভ্রা শুনলো-“কিছু বললেন?”
“না কিছু না।”
“নিন শুরু করুন। নিজে খান আমাকেও খাইয়ে দিন।”
“এহহহ, ঠেকা পড়েছে আমার। প্রেমে একেবারে গদগদ।”
“হ্যা, আপনারই ঠেকা মশাই। বউ যেহেতু আপনার তাই ঠেকাটাও আপনার। নিন তাড়াতাড়ি শুরু করুন। তিন রাত হলো ঘুম নেই। আজ যদি না ঘুমাতে দেন তবে সত্যি সত্যি খবর আছে আপনার। আপনার নামে অভিযোগ চলে যাবে নেত্রীর কাছে।”
রণ কৌতুহলে উত্তর জানতে চাইলো-“তা অভিযোগটা কি হবে?”
শুভ্রা ঝটপটো উত্তর দিলো-“রাতে ঘুমাতে দেন না একদমই- এটাই অভিযোগ। আপনার নেত্রী খুব বুঝবে আমার দুঃখ। দেখে নেবেন।”
এবার হেসে দিলো রণ-“এই অভিযোগ তুলতে লজ্জা লাগবে না আপনার?”
“লজ্জা কেন লাগবে? আপনি না খেয়ে ঘুমিয়ে যাচ্ছেন তারপর মাঝরাতে খিদের জ্বালায় জ্বলছেন। এতে লজ্জার কি আছে? অবশ্য আমিও জেগে যাচ্ছি। আসলে না খেয়ে থাকার অভ্যেস নেই তো।”
বলতে বলতে লাজুক হয় শুভ্রা। বউকে আরেকটু খোঁচানের সুযোগ মিস করে না রণ-“নেত্রী যদি অন্য কোন কিছু বোঝে। না মানে খিদের ব্যাপার তার উপর সারারাত তো তাই বলছিলাম। কিন্তু তুমি যখন বলবে তখন হয়তো ভুল বলবে না।”
এবার যেন শুভ্রার টনক নড়ে। রণ কথার ডাবল মিনিং অনুধাবন করে ভীষণ লজ্জা পেলো। কিন্তু এও বুঝলো লজ্জা পেলেই শেষ। রণ জ্বালানোর একটা সু্যোগও মিস করবে না। সে জোর দেখিয়ে বললো-“আপনি খুব খারাপ লোক। কোথাকার কথা কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন। এদিকে ভাত ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, খিদেয় পেটে ছুঁচো দৌড়াচ্ছে ওনার কোন খবর নেই। নিষ্ঠুর মানব।”
রণ মুচকি হেসে ভাত মাখিয়ে প্রথম লোকমা শুভ্রার দিকে বাড়িয়ে দিলো-“নিন ম্যাডাম, খেয়ে আমাকে ধন্য করুক। আর হ্যা, দয়া করে উল্টো পাল্টা অভিযোগ দেবেন না আমার নামে। আমি নিরিহ জনগণ, আমাকে ভাতে মারবেন না। ক’দিন সত্যি খুব কষ্ট হয়েছে রাতে।”
ভাত চাবাতে চাবাতে শুভ্রা হেসে দেয়-“এরপর তাহলে সত্যি সত্যি ভাতের কষ্ট দেব।”
“দিয়ে দেখো। আমিও তাহলে…”
শুভ্রা রণর মুখ চেপে ধরে-“খাওয়ার সময় এতো কথা বলতে নেই। আগে খেয়ে নিন।”
এরপর কিছুক্ষণ চুপচাপ খাওয়া দাওয়া। খাওয়া শেষে শুভ্রা হুট করে বললো-“একটা প্রশ্ন করি রণ? ঠিক ঠিক জবাব দেবেন তো?”
“হুমম বলে কি জানতে চাও।”
পাতের ভাতটুকু শেষ করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে রণ। শুভ্রা তাকিয়ে আছে রণর দিকে-“আপনি কি আমায় ভালোবাসেন?”
রণর হাত থামে, চোখ দুটো স্থির হয়ে থাকে শুভ্রাতে।

চলবে—
©Farhana_Yesmin

দর্পহরন পর্ব-৪৭+৪৮+৪৯

0

.#দর্পহরন
#পর্ব-৪৭

দীর্ঘ দিন পরে তুলতুলকে নিজেদের বাড়িতে দেখে সবাই বিস্ময়ে বিস্মিত। তুলতুলের চাচা গোলাম রাব্বানীর মেয়ে হিমি তুলতুলকে দেখে খুশিতে চেঁচিয়ে উঠলো-“তুলতুলি! তুমি এসেছ? মা, চাচী দেখো তুলতুলি এসেছে।”
বলেই ছুটে এসে তুলতুলকে জাপ্টে ধরে হিমি। মিতা আর তহুরা ছুটে এসে তুলতুলকে দেখে চমকে যায়। তারা খুশি হবে না ভীত হবে তাই বুঝতে পারছে না। তুলতুল হঠাৎ কি করে এলো? ওরা এতো সহজে ওকে আসতে দিলো? নাকি তুলতুল পালিয়ে এসেছে? নানা প্রশ্ন মনকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। মেয়েকে এতো কাছে পেয়েও কাছে টানতে দ্বিধা। তুলতুলের বিরক্ত লাগছিল। বেশ কিছু সময় পরে তহুরা কম্পিত কন্ঠে বললো-“ও তুলতুল, তুই সত্যি আসছিস নাকি আমি স্বপ্ন দেখতেছি?”
তুলতুল প্রায় ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে-“সত্যি আসছি মা।”
মিতা পাশ থেকে বললো-‘ওরা আসতে দিলো নাকি তুই…”
তুলতুল হেসে দেয়-“কি বলো চাচী? একা কিভাবে আসবো? উনি নিয়ে আসছে।”
এবার পেছনে দাঁড়ানো মানুষটাকে নজরে পড়ে সবার। শরীফ সংকোচ নিয়ে হাসলো সালাম দিলো তুলতুলের মা আর চাচীকে-“আসলে ডাক্তার দেখাতে আসছিলাম। উনি আপনার কাছে আসার জন্য জেদ করতেছিল তাই আমি নিয়ে আসছি।”
তহুরার চোখ ছলছল, মুখজুড়ে কৃতজ্ঞতার ছায়া-“বাবাজী, কিযে খুশি দিলা এই মাকে। মেয়েটাকে আজকে আট দশ মাস পরে নিজের কাছে পাইলাম।”
তহুরার গলা কাঁপে। তুলতুল মাকে তাড়া দেয়-“মা এইসব আলাপ বাদ দেও তো। তুমি আমাকে তাড়াতাড়ি ঝালঝাল করে শুঁটকির ভর্তা আর ইলিশ মাছ ভাজা খাওয়াও। অনেক খাইতে মন চাইছে।”
তহুরা মেয়ের আবদার শুনে হতবিহ্বল বোধ করেন। মিতার দিকে চাইতেই মিতা আশ্বস্ত করলো-“ভাবি, রান্নাঘরে চ্যাপার শুটকি আর ফ্রিজে ইলিশ মাছ আছে বাইর করেন। আমি তাড়াতাড়ি হিমির আব্বা আর ফাহিমকে ফোন দিয়ে ডাকি। ওরা খুশি হবে।”
তহুরা ছুটে গিয়ে ফ্রিজ থেকে ইলিশ মাছ বের করে রান্নাঘরের দিকে গেলো। হিমি তুলতুলের গা ঘেঁষে জড়িয়ে আছে-তুলতুলি চলো ঘরে যাই। অনেক গল্প করবো তোমার সাথে।”
তুলতুল অনুমতির আসায় শরীফের দিকে তাকালে শরীফ হাসলো-“যান যান গল্প করুন। কিন্তু শরীরের দিকে খেয়াল রাখবেন। আব্বা আম্মার আমানত যেন ঠিকঠাক থাকে না হলে কিন্তু আমার উপর খড়গ নামবে।”
তুলতুল খিলখিলিয়ে হেসে দিলো। বোনের হাত ধরে ভেতর ঘরে চলে গেলো। ও জানলো না ওর এই প্রানখোলা হাসি দেখে কি পরিমান চমকে গেছে শরীফ। চমকের সাথে সাথে মুগ্ধতাও জায়গা করে নিলো ওর মনে। মেয়েটা এতো সুন্দর করে হাসতে পারে? কই বাড়িতে তো কোনদিন এভাবে হাসতে দেখেনি তুলতুলকে? শরীফ অনেকটা মোহগ্রস্তের মতন একা একা বসে রইলো সোফায়।

পরবর্তী একটা ঘন্টা চমৎকার সময় কাটলো তুলতুলের। তুলতুলের ভাই ফাহিম আর চাচা রাব্বী তুলতুলের আসার খবর শুনে ছুটে চলে এলো। ভাই আর চাচাকে পেয়ে কেঁদে দিলো তুলতুল। এক হৃদয় বিদারক পরিস্থিতি তৈরি হলো। সবার চোখে পানি মাঝে শরীফের নিজেকে ক্লাউন মনেহচ্ছিল। সেই সাথে তীব্র অপরাধবোধ মনে বাসা বাঁধছিল। মেয়েটাকে এভাবে আঁটকে রাখার মানেই হয় না। সে বুঝলো তার বাবা মা খুব অন্যায় একটা কাজ করছে মেয়েটাকে তার পরিবার থেকে দূরে রেখে। কিন্তু কিভাবে তুলতুলকে ওই বন্দীদশা থেকে মুক্ত করবে? সোহেলের বাচ্চা মেয়েটার জঠরে বড় হচ্ছে। সে পৃথিবীতে এলে মেয়েটার দায়িত্ব বাড়বে, মায়ের মমতার শেকলে বন্দী হবে। সব ভেবেই মনটা ভারী চঞ্চল হলো শরীফের।

তুলতুল পেটপুরে খেলো। শরীফ অবাক হয়ে তুলতুলকে অনাহারে থাকা মানুষের মতো খেতে দেখলো। তহুরাও মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। হুট করে চারপাশে তাকাতেই তুলতুলের খাওয়া থেমে যায়-“কি হইছে মা? তোমরা এমনভাবে তাকায় আছো কেন? আমি কি করছি?”
তহুরার চোখের কোনে পানি তবুও সে মিষ্টি করে হাসলো-“তুই কিছু করিস নাই তুলতুল। অনেকদিন পরে তো তাই তোকে দেখতেছি। আরেকটু ভাত নেরে মা। চ্যাপার ভর্তাটা নে।”
তুলতুল আঁতকে উঠলো-“আর না মা। পেট ফেটে যাবে এমন মনে হইতেছে। অনেক শান্তি করে ভাত খাইছি আজকে।”
তহুরা কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে শরীফের দিকে তাকায়-“সবই বাবাজীর কল্যানে।”
তুলতুলও দেখলো শরীফকে। ভারী লজ্জা লাগে শরীফের। সে তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়ায়-“আমাদের যেতে হবে। বেশি দেরি করলে আব্বা অস্থির হয়ে যাবে।”
রাব্বী মাথা দুলায়-“হ্যা হ্যা যাও। সুযোগ পেলে মেয়েটাকে আবার নিয়ে আসিও। খুব খুশি হবো আমরা।”
শরীফ মাথা দুলায়। সুযোগ পেলে সে সত্যি সত্যি তুলতুলকে নিয়ে আসবে মাঝে মাঝে, এটা সে ভেবে রেখেছে।

*****

নেত্রীর বিশেষ অনুমতি নিয়ে রণ আরও দু’দিন আমেরিকা থেকে গেলো। শুভ্রা ভীষণ খুশি হয়ে গেলো। এতোটা সে আশাই করেনি অথচ রণ করে ফেললো। কৃতজ্ঞতায় মনটা আরেকটু দ্রবীভুত হয়ে যায় শুভ্রার। রণর প্রতি মুগ্ধতার পারদ বাড়লো আরেকপ্রস্ত। ভারী চমৎকার সময় কাটাচ্ছে তারা। বিয়ের এতোগুলো দিন পরে যেন সত্যিকার অর্থেই সে বিয়ের আমেজ পাচ্ছে। রণ পুরোটা সময় একজন সাধারণ স্বামীর মতো শুভ্রার সাথে সেটে রইলো। একসাথে খাওয়া, ঘুরে বেড়ানো, শপিং সব মিলিয়ে জীবনের মধুরতম সময়টা কাটছে শুভ্রার।
“ম্যাডাম, কোথায় হারিয়ে গেলেন? গোছগাছ শেষ?”
শুভ্রার সম্বিত ফেরে। তাকিয়ে দেখলো রণ দাঁড়িয়ে আছে। ওর দিকে তাকিয়ে রণ হাসলো-“আমার গোছগাছ কিন্তু শেষ।”
শুভ্রা নিজের হাতের দিকে তাকালো। ব্র্যান্ডেড ব্যাগ দুই ননদের জন্য। নতুন লাগেজটাতে জায়গা হচ্ছে না। শুভ্রা অসহায় চোখে তাকিয়ে চোখ নাচালো-“আপনি কি এই দু’টো আপনার লাগেজে নেবেন? এটা ফুল হয়ে গেছে।”
শুভ্রা নতুন লাগেজটা দেখালো ইশারায়। রণর মুখে দুষ্ট হাসি খেলে গেলো। গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করে বললো-“নেব কিন্তু ফিস দিতে হবে।”
রণর মতলব বুঝে শুভ্রার গাল লাল হলো-“হাসিখুশির জিনিস এগুলো। এরজন্য ফিস দিতে পারবোনা।”
রণ শুভ্রার কাছাকাছি চলে এলো। হাত থেকে ব্যাগ দু’টো নিয়ে বললো-“আমি ফিস ছাড়া কাজ করি না। এগুলো রেখে আসছি ফিস নিতে। আমাদের বেরুতে হবে আর দু’ঘন্টার মধ্যে। তাড়াতাড়ি সব ক্লোজ করো।”
বলেই টুপ করে চুমু দিলো শুভ্রার গালে। গালে হাত দিয়ে শুভ্রা ফিক করে হেসে দেয়। মন্ত্রী মশায় এর আচরণগুলো জনগণ টের পেলে বেশ হতো। দায়িত্ববান মানুষটাও যে এমন দুষ্ট মিষ্টি হতে পারে তা কে জানতো? গত দু’দিনের কথা ভেবে শুভ্রার রঙিন গাল আরও রঙিন হলো।

ওরা দেশে ফিরতেই ছেলে আর বউকে দেখেই জলি সব বুঝে গেছে। মেয়েটা হয়তো এ কারনেই আমেরিকা গেছিল। রণকে দখল করতে। জলির মনোভাব নিশ্চয়ই বুঝেছে শুভ্রা। এ বাড়িতে নিজের অবস্থান পোক্ত করতে তাই উঠেপড়ে লেগেছে শুভ্রা। কিন্তু যত যাই করুক জলি শুভ্রাকে কিছুতেই সুযোগ দেবে না। রণকে কারো হাতের পুতুল হতে দেবে না কিছুতেই। তাইতো শুভ্রা যখন জলিকে গিফট দিলো জলি মুখ কালো করে থাকলো-“ছেলের এতোগুলা টাকা নষ্ট করার কি দরকার ছিলো?”
শুভ্রা সহসা জবাব দিতে পারে না। বুঝলো জলির অপছন্দের মানুষের তালিকায় তার নাম উঠে গেছে। এখন হাজার চেষ্টা করলেও কিছু হবে না। তবুও চেষ্টা করে যেতে হবে। এটাই হয়তো তার নিয়নি।

এসে পড় থেকে রণ ভীষণ ব্যস্ত। দেখা হওয়াই দুষ্কর হয়ে গেছে। জায়গায় জায়গায় সফর করতে হচ্ছে। এরমধ্যে সামনে আবার একটা সম্মেলন বলে বেশ জমজমাট সিডিউল মেইনটেন করতে হচ্ছে। শুভ্রা জেগে থাকার চেষ্টা করলেও বেশিরভাগ দিন ঘুমিয়ে যায়। সকালে ঘুম ভাঙার পরে ভীষণ আফসোস হয়। আজ একটু আগেই বাসায় ফিরে এলো রণ। শুভ্রা তখন কিচেনে কাজ করছিল। রণ এসেই ওকে ডাকলো। শুভ্রা কাছে যেতেই ফিসফিস করলো-“ঘুমিয়ে যেয় না। আমি মায়ের সাথে আলাপ সেরে আসতেছি।”
প্রতক্ষ্য প্রস্তাব, অস্বীকার করার কোন কারণই নেই। শুভ্রা বরং পুলকিত হয়। নিজেকে মনেমনে প্রস্তুত করে। কিন্তু রণ ফিরে এসেই ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। বের হয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো-“এখনো বসে আছো? খেতে দাও প্লিজ। চরম খিদে পেয়েছে।”
শুভ্রা বুঝতে না পেরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তাতে রণর ধমক খেতে হলো-“আরে, এভাবে তাকিয়ে আছ কেন? খাবার চেয়ে অন্যায় করলাম?”
শুভ্রা বুঝতে পারছে না হঠাৎ করে কি হলো রণর? মা কি কিছু বলেছে? আজকের ঘটনার ব্যাপারে?

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-৪৮

শুভ্রার কান্না পেয়ে গেলো। সে হুহু করে কেঁদে দিলো। রণ যেন বোকা বনে গেলো। ছুটে এসে শুভ্রার কাছে বসে ওর হাত ধরে নরম গলায় বললো-“কি হয়েছে? কাঁদছো কেন?”
কাঁদতে কাঁদতে জবাব দিলো শুভ্রা-“আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন আমার সাথে? কি করেছি আমি?”
রণ এবার কিছুটা লজ্জিত হলো। আসলেই তো এই মেয়েটার সাথে রুড আচরণ কেন করছে সে? মনে মনে নিজেকে কষে ধমক দিলো। অপরাধী মনে যত্ন নিয়ে শুভ্রার চোখের জল মুছে দিলো-“সরি সরি, প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও।”
রণর মুখে সরি শুনে কিছুটা শান্ত হলো শুভ্রা-“আমার কোন ভুল থাকলে বলবেন আমি ভুল শোধরাতে চেষ্টা করবো। কিন্তু এরকম ব্যবহার মেনে নিতে পারবোনা।”
রণ শুভ্রাকে কাছে টানলো। নিজের বুকের কাছটাতে শুভ্রার মাথাটা ঠেকিয়ে জড়িয়ে ধরলো-“সরি বলছি আবারও। আসলে মায়ের কথা শুনে খুব মেজাজ খারাপ হয়েছিল। সেই রাগটা তোমার উপর দেখিয়েছি। কিছু মনে করো না প্লিজ।”
শুভ্রা কিছুক্ষন পোষা বিড়ালের মতো রণর বুকে থাকলো চুপটি করে। তারপর বললো-“আন্টি আমার কথা কি বলেছে আপনাকে?”
রণ চমকে উঠলেও শুভ্রাকে বুঝতে দিলো না। কন্ঠ স্বাভাবিক রেখে বললো-“তেমন কিছু না। বাদ দাও। ভুল আমারই, নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না। যে যাই বলুক তাতে আমার প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত না অথচ দেখিয়ে ফেলছি। সরি এগেইন।”
শুভ্রা আর কথা বাড়ালো না। দীর্ঘ শ্বাস গোপন করে উঠে বসলো। তার ইদানীং খুব ভয় লাগে। রণকে হারিয়ে ফেলার ভয়। পারিপার্শ্বিকের সবকিছু মিলিয়ে প্রায়ই মনেহচ্ছে রণকে সে হারিয়ে ফেলবে। শরীর কাটা দিলো শুভ্রা। সেটা লুকাতেই দ্রুত উঠে যেতে চাইলো। রণ উদ্বিগ্ন হয়ে শুভ্রার হাত ধরে-“কি হলো? কোথায় যাচ্ছ?”
“আপনার খাবার?”
রণ মাথা নাড়ে-“উহু, লাগবে না। এখন আর খেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি বসো প্লিজ।”
রণ শুভ্রার হাত ধরে টানলো। নিজের কাছে বসিয়ে দিলো। শুভ্রার দিকে তাকিয়ে স্মাল হাসলো-“তুমি নিশ্চয়ই মায়ের ব্যবহারে খুব অবাক হচ্ছ। ভাবছো যে মানুষটাকে ব্লাকমেল করে তুমি আমাকে বিয়ে করলে সে তোমার প্রতি এতো কঠোর কিভাবে হচ্ছে, তাই না?”
শুভ্রা চুপ করে রইলো। রণ শ্বাস টানলো-“যখন তোমাকে বিয়ে করানোর জেদ ধরেছিল তখন আমিও ঠিক এমনটাই অবাক হয়েছিলাম।”
শুভ্রা খানিকটা কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইলো-“কেন?”
রণ কয়েক মুহূর্ত শুভ্রার মুখপানে তাকিয়ে রইলো। কি সুন্দর টলটলে মুখশ্রী। প্রসাধন বিহীন তবুও তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগছে। এই মুহূর্তে একদম নিস্পাপ দেখাচ্ছে। রণর কথা বলতে ইচ্ছে করে না। মন চাইছে অনেকটা সময় ওই মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে। শুভ্রা তাড়া দিলো-“কি হলো বলুন।”
রণর ধ্যানভঙ্গ হয়। মুখে খানিকটা বিষাদের ছায়া পড়ে-“কথাগুলো তোমাকে বলার ইচ্ছে ছিলো না কিন্তু মনে হলো ভবিষ্যতের জন্যই বলে ফেলা উচিত। আমার জন্য মেয়ে পছন্দ করতে হলে তুমি যদি পৃথিবীর সর্বশেষ মেয়ে হতে তবুও হয়তো মা তোমাকে পছন্দ করতো না কারণ তুমি ইব্রাহিম সালিমের মেয়ে। সেই মা হুট করে তোমাকে বউ বানাতে মরিয়া হয়ে গেলে আমি তাই ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। মাকে অনেক করে বোঝাতে চেয়েছিলাম সে যা করছে তা ঠিক না।বিয়ে কোন ছেলেখেলা না। চিরশত্রুর মেয়েকে বিয়ে করা যায় না। কিন্তু মা তখন জেদ আঁকড়ে ধরলো। এখন দেখুন আপনাকে সহ্য করতে পারছে না। অবশ্য এক্ষেত্রে মাকে পুরোপুরি দোষ দেওয়া যায় না। তোমার পরিবারের হাত আছে ষোল আনা। তারা নিজের আচরণে লাগাম টানতে পারছে না। যার ফলে মায়ের পুরনো রাগ ফিরে আসছে।”
রণর কথা শুনতে শুনতে শুভ্রার মুখের আদল বদলে যাচ্ছে বারবার। শুভ্রা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। রণ থামতেই প্রশ্ন নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লো-“আন্টি কেন পছন্দ করে না? আবার কি করেছে আমার পরিবার?”
রণ প্রসঙ্গ বদলে বললে-“তুমি কি জানো খুশির ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে খুশিকে বিরক্ত করছে তন্ময়? বেশ অনেকদিন যাবত এমন চলছে। খুশি ভয়ে বলেনি আমাকে। আজ খুব বাড়াবাড়ি করেছে তন্ময়। মা জানতে পেরে রাগারাগি করছে আমার সাথে। তুমি এ বাড়িতে আছো বলেই নাকি এমন হচ্ছে।”
শুভ্রার বুক ধরফর করে তন্ময়ের কথা শুনে। এতো কিছু কবে করলো তন্ময়? বাবাকে বলার পরও বাবা কেন কিছু করলো না? শাশুড়ীর রাগটা তো তাহলে দোষের নয়। শুভ্রার নিজেকে খুব অসহায় লাগে। রণ হতাশ হয়ে বললো-“আমাকে বলো কি করবো? খুশির যদি সামান্য বিপদও হয় মা তোমার সাথে কি করবে আমি জানি না। আমি জানি তোমার কোন দোষ নেই কিন্তু তোমার পরিবারের এইসব কাজ আর কতোইবা মেনে নেব বলো তো শুভ্রা? আমাকে বলে দাও কি করবো আমি? কোনদিকে যাব?”
রণকে ভীষণ অসহায় দেখালো। অসহায় দেখায় শুভ্রাকেও। ও কি বলবে ভেবে পেলো না। তন্ময় এমন কেন করছে? মেয়ের কি অভাব পড়েছে? কেন খুশির পেছনে পড়ে আছে? রণ বললো-“দেখো শুভ্রা, যেভাবেই হোক বিয়ে করেছি তোমাকে। বউ তুমি আমার। আমি কোনভাবেই চাই না তোমার প্রতি সামান্য অন্যায় করি, অসন্মান করি। কিন্তু সেই সাথে এটাও চাই না আমার মা বোন আমার কারনে সাফারার হোক। তাহলে হয়তো আমার দ্বারাও কোন অন্যায় হয়ে যেতে পারে। তুমি বলো, এখন তন্ময়কে কি করা উচিত আমার? তোমার বোনের সাথে কেউ এমন করলে কি করতে তুমি?”
শুভ্রা মাথা ফাঁকা হয়ে গেলো। কি বলবে বুঝে পেলো না। এই প্রথম নিজেকে ভীষণ অসহায় আবিস্কার করলো।

*****

রাতে শরীফকে ডেকে পাঠালেন সালিম সাহেব। শরীফ ঘরে ঢুকে বললো-“আমাকে ডাকছেন আব্বা?”
“হ্যা। বসো। তোমার লগে কথা আছে।”
শরীর খানিকটা অবাক হয়েই একবার মা আর একবার বাবার দিকে তাকালো। রিমা ইশারায় শরীফকে বসতে বললো। সালিম সাহেব শোয়া থেকে উঠে বসলো। শরীফের দিকে তাকিয়ে বললো-“সোহেল তো আর দুনিয়ায় নাই। আমার সন্তান বলতে তুমি আর শুভ্রা। আর সোহেল নাই যেহেতু তাই ওর সন্তান আমার সোহেলের জায়গা নিব। বাচ্চাটা জন্মের আগেই বাপ হারা। ওর মা ওকে চায়না হয়তো। সবই বুঝি কিন্তু নিরুপায় আমি। সন্তানের মায়া বড় মায়া। আমি চাইনা আমার সোহেলের বাচ্চা এতিমের মতো বড় হোক। তাই আমি আর তোমার মা একটা সিদ্ধান্ত নিছি। আমাদের মনে হইছে এমনটা হইলে সবদিক রক্ষা হবে।”
শরীফ ভ্রু কুঁচকে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে না তার বাবা কি বলতে চাইছে। সালিম সাহেব ছেলের দিকে তাকিয়ে মন বুঝতে চাইলো পারলো না। সংকোচ হচ্ছে শরীফকে বলতে। বরাবরই শরীফের সাথে তার দূরত্ব ছিলো। এখন তাই হুট করে ছেলের কাছে বায়না ধরতে দ্বিধা লাগে। রিমা স্বামীর কাজ সহজ করতেই মুখ খুললো-“তুলতুল তোরে মানে শরীফ। ও আমার নাতি মা হইবো কিন্তু ও যোয়ান মাইয়া, ওরে এই বাড়িতে চিরকাল রাখার উপায় নাই। আবার ও না থাকলে আমার নাতি মা হারা হইবো ভাবলেই বুক কাঁপে। ভাইবা দেখলাম সব সমস্যার একটাই উপায়। তুই যদি তুলতুলরে বিয়া করোস তাইলে বাচ্চাটা বাপ মা দুজনকেই পাইবো, তুলতুলও চিরজীবন এই বাড়িতে থাকতে পারবো।”
শরীফ হা করে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে। মায়ের বলা কথাটা মগজে ঠিকঠাক ঢুকতেই অদ্ভুত একটা অনুভবি হলো। সে ফট করে হেসে দিলো-“তোমরা পাগল হইছো আম্মা। ওই মেয়ে কি পরিমান ঘিন্না করে আমাদের তা তুমি জানো না। তোমরা ওকে জোর করে আঁটকায় রাখছো এখন আবার আমার সাথে বিয়া দিতে চাও। এই খবর শুনলে নির্ঘাত গলায় দড়ি দিব। আম্মা, ওরে ছাইড়া দাও। নিজের মতন বাঁচতে দাও। এইসব বিয়া শাদীর চিন্তা বাদ দাও। তাছাড়া বাচ্চা পেটে বিয়া হয় না।”
রিমা খেঁকিয়ে উঠলো-“তুই পাগল হইছোস শরীফ। বাপ মায়ের কাছ থিকা সারাজীবন দূরে দূরে থাইকা তুই স্বার্থপর হইছোস। নাইলে তুই বাপ মায়ের কথা বাদ দিয়া ওই মাইয়া নিয়ে ভবোস কেন? নিজের ভাইয়ের বাচ্চার জন্যও তোর মহব্বত নাই। কেমুন ভাই তুই?”
মায়ের আক্রমনে শরীফ হতবিহ্বল বোধ করে। নিজেকে বাঁচাতে বললো-“এইসব কেমন কথা আম্মা? নিজেদের নিয়ে এতো ভাবতে যাইয়া আপনে অন্যের জীবন নিয়ে খেলতেছেন। এইগুলা ঠিক না আম্মা।”
“আচ্ছা! কি অন্যায় করতেছি ক তুই। বাচ্চা হওয়ার পর ধর তুলতুলরে যাইতে দিলাম। তারপর কি হইবো? ওয় কি হাতিঘোড়া উদ্ধার করবো জীবনে? কেডা বিয়া করবো ওরে? আর বিয়া করলেও জামাই ভালো হইবো সেই গ্যারান্টি কি? আমরা তোর মতন না। তুলতুলকে নিয়ে ভাবছি দেইখাই তোরে কইছি ওরে বিয়া করতে। তোর যদি এতই চিন্তা থাকে তাইলে তুই ওরে বিয়া কইরা ওর শখ পূরণ কর। নাইলে বড় বড় কথা কইস না।”
সালিম সাহেব বিরক্ত হলেন-“আহ রিমা, থামো তো। শোন শরীফ, এতো কথার কাম নাই। তুই আমাকে পরিস্কার কইরা ক তুই কি করবি। তুলতুলের এমনেও এই বাড়িতে থাকতে হইবো সোহেলের বাচ্চার মা হইয়া। আল্লাহর ইচ্ছাও তাই। তা না হইলে ওর পেটে সোহেলের বাচ্চা আইতো না। এখন কথা হইলো, তুই যদি ওরে সন্মান দিয়ে এই বাড়িতে রাখতে চাস তাইলে বিয়া কর নাইলে এমনেই থাক। এতো কথা চালাচালির কাম নাই। ভাইবা দেখ তুই কি করবি।”
শরীফ উঠে এলো। অবাক হলো সালিম সাহেব ওকে জোর করলো না দেখে। মায়ের বলা কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে হেঁটে নিজের ঘরে ফিরছিল। হুট করে সামনে তুলতুল এসে দাঁড়ায়-“আমার একটা কাজ করে দিবেন?”
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় শরীফ। সেদিনের পর থেকে তার সাথে বেশ সহজ হয়ে গেছে তুলতুল। অন্য কারো সাথে না হলেও তার বেশ কথাটথা বলে। শরীফ হাসার চেষ্টা করে বললো-“কি কাজ?”
“আমার কিছু বই লাগবে। সময় কাটে না মনে খুব আজেবাজে ভাবনা আসে। তাই বই পড়ে সময় কাটাতে চাই। ভালো ভালো গল্পের বই যেগুলো পড়লে মন ভালো হবে সেগুলো এনে দিন। দেবেন তো?”
তুলতুল উত্তর শোনার জন্য শরীফের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। শরীফ হাসলো-“আচ্ছা ঠিক আছে। এনে দেব।”
“থ্যাংক ইউ।”
তুলতুল চলে যাচ্ছিলো শরীফ ডাকলো-“তুলতুল, শোনো।”
তুলতুল সাথে সাথে ফিরলো-“জ্বি, বলুন।”
শরীফের লজ্জা লাগলো হঠাৎ। কি মনে করে সে তুলতুলকে ডাকলো? সে সাথে সাথে বললো-“কিছু না। এমনিতেই ডেকেছি।”
বলেই সে হাটা দিয়ে চলে গেলো। তুলতুল বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে।

চলবে
©Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-৪৯

মৃত্যু জীবন থামিয়ে দেয় না। পৃথিবী আপন গতিতে চলতে থাকে। ছেলের মৃত্যুতে কিছুটা স্থবির সালিম সাহেবের জীবন। বেশিরভাগ সময় বাসায় মাঝে মাঝে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চুপচাপ বসে থাকেন। আগে বেশিরভাগ কাজ সোহেল সামলে নিত এখন তুহিন দেখে। এই বসে থাকার মাঝেই অনেকরকম খবর কানে আসে। ক’দিন চুপচাপ সব শুনলেন, সত্য যাচাই করলেন। তারপর আজ
সালিম সাহেব নেত্রীর সাথে দেখা করতে এসেছেন। ভয়ে ভয়ে ছিলেন নেত্রী তার সাথে দেখা করবেন কিনা। কিন্তু নেত্রী তাকে অবাক করে দিয়ে দেখা দিলেন।
“সালিম, কেমন আছো?”
“কেমন আছি তা আপনার থেকে ভালো কেউ বুঝবে না আপা। আমার যেমন থাকার আমি তেমনই আছি।”
নেত্রী খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলো। সালিম সাহেব বেশ শান্ত মেজাজে বসে রইলো। নেত্রীই জানতে চাইলো-“হঠাৎ দেখা করতে আসলা? কোন জরুরি দরকার?”
একটু সময় নিলো সালিম সাহেব। মনে মনে কথা গুছিয়ে মুখ খুললো-“আপা, আপনার সাথে আছি কত বছর তা কি জানা আছে আপনের?”
হুট করে এমন প্রশ্ন শুনে নেত্রী কিছুটা বিস্ময় নিয়ে সালিম সাহেবকে দেখলো। সালিম সাহেব ম্লান হাসলো-“বেয়াদবী নিয়েন না আপা। প্রশ্নটা করলাম এই কারনে যে মাঝে মাঝে সবারই অতীত মনে করা দরকার তাতে হয় কি আপনার বিপদে কে পাশে ছিলো তা নতুন করে মনে পড়ে। আমরা বর্তমানে বাঁচি এটা যেমন সত্য তেমন বিপদের বন্ধু কে হয় তাদেরও চিনে রাখা দরকার। আপা, আপনে আমার উপর অসন্তুষ্ট ছিলেন নানা কাজে। আমার যে ছেলে এইসব কাজে জড়িত ছিলো আল্লহ তাকে নিজের কাছে ডেকে নিছে। এখন নিশ্চয়ই আমাকে নিয়ে আপনার কোন সমস্যা নাই?”
নেত্রীর চেহারা খানিকটা পরিবর্তন হলো। যদিও চেহারা দেখে মনোভাব আন্দাজ করা যায় না। নেত্রী জানতে চাইলো-“তুমি আসলে কি বলতে চাও সালিম সরাসরি বলে ফেলো।”
“আপা, আপনি বলছিলেন সংসদ নির্বাচন থেকে সরে যাইতে। আমাকে মেয়র পদে নমিনেশন দিবেন। এখন কানাঘুষা শুনতেছি আব্দুস সবুরকে নমিনেশন দিবেন। আপা, আমি আপনার বাবার সাথে কাজ করছি। এখন আমাকে এমন কোনঠাসা করা মানে অপমান করা। এই অপমান আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারতেছি না। মানলাম আমার অনেক ভুল আছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করছি কিন্তু আপা আপনার জন্য অনেক কিছু করছি। যখন যা বলছেন আমি জান দিয়া চেষ্টা করছি। এখন আমার এই অপমানে যদি আপনি সায় দেন তাইলে আমি কষ্ট পাবো আপা। এমনিতেই ছেলের শোকে কাতর হয়ে আছি তার উপর যদি এমন ঘটনা ঘটে তাহলে আমার দ্বারা নতুন করে ভুল হয়ে যাইতে পারে।”
নেত্রীর চোয়াল শক্ত হলো। সাথে সাথে আবার নিজেকে সামলে নিয়ে হাসলো-“রাজনীতিতে ইমোশনাল হলে চলে না সালিম। এইবার সাংসদ হইতে পারো নাই বলে কি জীবন শেষ হয়ে যাবে? আগামীবারের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করলেই তো পারো। এখন যদি তোমাকে মেয়র পদে নমিনেশন দেই তাহলে আগামী বারের ইলেকশন করতে পারবা না। আর তুমি ভালো মতোই জানো সংসদ নির্বাচন মেয়রের চাইতে অনেক বেশি কাজের। ক্ষমতার দাপট বেশি।”
সালিম সাহেব মাথা নাড়েন-“না আপা, পাঁচ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা অনেক কঠিন। তাছাড়া আমি যদি পাতি নেতা হতাম মেনে নিতাম। আমি পুরনো মানুষ নতুনদের নেতৃত্ব মেনে নেওয়া কষ্টকর আমার জন্য।”
“তোমার নিজেকে শোধরাবার কথা বলেছিলাম সালিম। পাঁচ বছর ধৈর্য্য ধরে নিজেকে শোধরাও তারপর ফিরে আসো।কিন্তু তুমি দেখি কোন কথা শুনতেছ না। এমনিতেই তোমাকে নিয়ে বিতর্কের শেষ নাই। এরকম করলে তো আমি টিকতে পারবোনা।”
নেত্রীর কথায় সালিম সাহেব প্রচন্ড অপমান হলেন। নিজেকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে হাতের শেষ অস্ত্র ব্যবহার করে বসলো-“আপা, আমি তাহলে মাজহার ভাইয়ের সাথে দেখা করি। সে কি বলে শুনি।”
নেত্রীর চেহারা বদলে গেলো। মুখটা ক্রমশ লাল হয়ে গেলো-“সীমা অতিক্রম করে ফেললে সালিম। আমি তোমার ভালো চেয়েছিলাম কিন্তু তুমি বুঝলে না।”
সালিম নত না হয়ে বললো-“আপনি আর কোন উপায় রাখেন নাই আপা। আমি বাধ্য হয়ে কথাগুলো বললাম। আমি মেয়র নির্বাচনে মনোনয়ন চাই আপা। সংসদ নির্বাচন আসুক তখন দেখা যাবে। আজ আসি আপা। আপনাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য মাফ করবেন।”
সালিম সাহেব দাঁড়ালেন না ঝটপট রুম থেকে বেড়িয়ে গেলেন। থমথমে মুখ নিয়ে নেত্রী তখন চেয়ারে বসে আছেন।

*****

“দিলশাদ, তন্ময়টা খুব বাড়াবাড়ি করতেছে। কি করি বলতো?”
দিলশাদ হাসলো-“সোহেলের মতো ফিনিশ করে দিব ভাই?”
ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা রণ হাসলো না-“পাগল হইছিস? সালিম সাহেব শান্ত আছে মানে যা খুশি তাই করা যাবে না। এই লোককে বিশ্বাস নাই কোন। অন্য কোন উপায় বল।”
দিলশাদ অভয় দেওয়া গলায় বললো-“তাহলে সিভিল ড্রেসে তুলে নেওয়া যায় ভাই। তারপর দিন কতোক আঁটকে রেখে রগরে দিলে ঠিক হয়ে যাবে।”
“একটাকে আঁটকে রেখে এখন পস্তাচ্ছি আবার আরেকটাকে আঁটকাবো? মাফ চাই।”
আঁতকে উঠে বিরবির করলো রণ। দিলশাদ বললো-“কিছু বললেন ভাই?”
রণ সাথে সাথে জবাব দিলো-“বলছি এটাও না অন্য কোন বুদ্ধি বল।”
“আর কি বলবো? এরা সহজ মানুষ না তাই সোজা আঙুলে ঘি তুলতে পারবেন না। এরা বেকা মানুষ এদের সাথে তেড়ামি না করলে হবে না। তন্ময় ছেলেটা খুব একটা সহজ না। ছোট বেলায় সোহেলদের সাথে থাকতো, স্কুলে মেলা কিছু করছে। কলেজে একবার মেয়েঘটিত একটা ব্যাপার ঘটাইছিল। তারপরই তড়িঘড়ি করে দেশের বাইরে গেলো। এইবারও হঠাৎ দেশে আসছে। খোঁজ নিতে পারেন কোন ঘাপলা করছে নাকি।”
“আচ্ছা, দেখছি। কিছু পেলে জানাবো তোকে।”
“ঠিক আছে ভাই।”

ফোনটা কাটতেই শুভ্রার ফোন ঢুকলো। রণ মুচকি হাসলো। আজকাল খুব ভালো বউ হওয়ার চেষ্টা করছে শুভ্রা। সকালের নাস্তা না করে বের হতে দেবে না রণকে। খুব ভোরে যেদিন বের হবে সেদিন একদম খেতে মন চায় না রণর কিন্তু শুভ্রার জেদের কারনে পেরে ওঠে না। তারপর বেলায় বেলায় ফোন তো আছেই। বারবার চন্দ্রানীর কথা জানতে চায়। রণ হাজার বার বলেও বোঝাতে পারেনি চন্দ্রানীর সাথে কাজ করে সে। এর বাইরে কোন সম্পর্ক নেই। শ্বাস ফেলে ফোন ধরলো রণ-
“হ্যালো।”
“কি করছেন?”
“বসে বসে চন্দ্রানীর সাথে গল্প করছি।”
ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো না। রণ মিটমিটিয়ে হাসছে নিঃশব্দে-“এটাই ভাবছো তো? আরে বাবা নিজের ভাবনার লাগাম টানো। জরুরি কাজ করছিলাম। ফোন করেছ কেন? দরকার কোন?”
শুভ্রার কন্ঠে অভিমান ঝরে পড়ে-“বাহ! এমনিতে ফোন দিতে পারি না? আপনি নিজে তো ফোন দেনই না আমি দিলেও খুশি হন না।”
“মিথ্যে অভিযোগ।”
শুভ্রা তেতে উঠলো-“সত্য মিথ্যা জানি না। শুনুন, তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরবেন। আজ বিশেষ কিছু আছে। আপনার তো কিছু মনে থাকে না। কাজ করে দেশ উদ্ধার করছেন। রাখছি।”
রণকে কথা বলার কোন সুযোগ না দিয়ে শুভ্রা সাথে সাথে ফোন কেটে দিলো। রণ ভারি ভাবনায় ডুবে গেলো। আজ বিশেষ দিন কেন? আজ কি শুভ্রার জন্মদিন? উহু, জন্মদিন আসতে দেরি আছে। তাহলে? হাসি খুশির কিংবা মায়ের জন্মদিন? আজ তারিখ কতো? পরি মড়ি করে ক্যালেন্ডার দেখলো রণ। সাত তারিখ? আজ সাত তারিখ! লাফিয়ে উঠলো রণ। এতো বড় ভুল সে কিভাবে করলো? দ্রুত হাতের কাছের জিনিস গুছিয়ে নিলো।

*****

তুলতুল বই পড়ছে আর হিহি করে হাসছে। মাঝে মাঝে লাজুকলতা হয়ে যাচ্ছে। গাল দু’টো উত্তাপ ছড়াচ্ছে। আবার মাঝে মাঝে উদাস হয়ে বই বন্ধ করে উদাস হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকছে। মালা ওকে আড়চোখে দেখছে আর বিরবির করে গালি দিচ্ছে। হঠাৎ দরজা আওয়াজ হলো। মালা দরজা খুলতেই শরীফকে দেখা গেলো-“তুলতুল আমি কি ভিতরে আসবো?”
তুলতুল অবাক হলো। ত্রস্ত হরিণীর মতো দ্রুততায় নিজেকে ফিটফাট করলো-“হ্যা,আসেন।”
শরীফ ঘরে ঢুকে একবার তুলতুলকে দেখে মুখ নিচু করলো। চেয়ার টেনে দূরত্ব রেখে বসলো। মালাকে বললো-“আমাদের জন্য দুইকাপ চা বানিয়ে আনতো মালা।”
মালা বেরিয়ে গেলে শরীফ তুলতুলের দিকে তাকালো। বেশ ফ্রেশ দেখাচ্ছে তুলতুলকে। শরীফ বললো-“বই পড়ে কেমন লাগছে?”
“অনেক ভালো লাগতেছে। আপনাকে ধন্যবাদ। মনটা শান্তি পাইতেছে।”
শরীফ মাথা নেড়ে চুপ করে বসে রইলো। তুলতুল এবার অবাক হলো কিছুটা। মানুষটা এভাবে বসে আছে কেন? তুলতুল বলেই ফেললো-“আপনি কি কিছু বলবেন?”
শরীফ মাথা দুলায়। সে দ্বিধা নিয়ে এদিক সেদিক তাকায়। চঞ্চল চোখদুটো লুকিয়ে বললো-“আব্বা আম্মা একটা প্রস্তাব রাখছে আমার কাছে।”
তুলতুল না বুঝে জানতে চাইলো-“কিসের প্রস্তাব।”
“তারা চায় আমি তোমাকে বিয়ে করি।”
তুলতুল হা করে শরীফের দিকে তাকিয়ে রইলো।

চলবে—
©Farhana_Yesmin