Friday, July 18, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 222



দর্পহরন পর্ব-৪৪

0

#দর্পহরন
#পর্ব-৪৪

সোহেল মারা যাওয়ার পনেরো দিন পরে আবারও সালিম সাহেবের ফোন এলো শুভ্রার ফোনে। শুভ্রা মনে মনে প্রস্তুত থাকলেও বাবার ফোন দেখে ঘাবড়ে গেলো। প্রতিবার ফোন করলেই কেটে দেয় তবে এবার ফোন ধরবে ভাবলো। প্রথমবারে ফোন বেজে কেটে গেলো। দ্বিতীয় বারে সাহস করে ফোন ধরলো-“হ্যালো আব্বা। কেমন আছেন?”
সালিম সাহেবের গম্ভীর কন্ঠ ভেসে এলো-“আম্মাজান, আপনে একবারও আব্বাকে দেখতে আসলেন না। কেমন আচরণ হইলো এইটা? আর সোহেল আপনের ভাই আছিল। তারে শেষ দেখা দেখলেন না? আপনে তো এমন আছিলেন না আম্মাজান। কি হইছে আপনের?”
শুভ্রা চুপচাপ বাবার কথা শুনলো। ফিরতি জবাব দিলো শান্ত গলায়-“উনি চাননা আমি আর বাসায় যাই। উনার মা খুব রেগে আছে আপনাদের উপর। গেলে একেবারে যাইতে হবে আব্বা। আর সেইটা আমাদের কারো জন্যই ভালো হবে না আব্বা। তাই আমি ওনার কথা মেনে নিছি।”
সালিম সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর চাপা গলায় বললো-“বেশি সমস্যা মনে হইলে চইলা আসেন আম্মা। আমার সমস্যা আমি সামাল দিতে পারুম।”
শুভ্রা বুঝ দিলো বাবাকে-“সবসময় মাথা গরম করে হয় না আব্বা। আমার চিন্তা আপাতত বাদ দেন। আপনে ব্যবসা আর রাজনীতিতে মন দেন। আপনের হারানো গৌরব ফেরত আনার চেষ্টা করেন।”
“আপনে কি আমার জন্য কোন কম্প্রোমাইজ করতেছেন আম্মাজান?”
সালিম সাহেবের গলা কেঁপে উঠলো। শুভ্রা ফোনের এ প্রান্তে ঠোঁট টিপে ধরলো। কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো-“ভালো থাকেন আব্বা। আমাকে নিয়ে ভাববেন না আমি ভালো আছি।”
ফোন কেটে দিয়ে দু’হাতে মুখ ঢাকলো শুভ্রা। জেদ করে বিয়ে করে সেটা এখন মানসম্মানের প্রশ্ন হয়ে গেছে। দিনগুলো খুব কঠিন কাটছে শুভ্রার। জলির ব্যবহার খুব কঠিন তার জন্য। রণর সামনে ভালো ব্যবহার করলেও বাকি সময় খুব খারাপ আচরণ করছে। রণ আজকাল এতো ব্যস্ত থাকে যে কোন কথা বলারই সু্যোগ পাওয়া যায় না। ইদানীং পত্রিকায় চন্দ্রবীর সাথে রণর ছবি দেখা যাচ্ছে ঘনঘন। সেটাও শুভ্রার আরেকটা মনোকষ্টের কারণ। সব মিলিয়ে ভীষণ এলোমেলো হয়ে আছে শুভ্রা। মন খারাপ করে নিজেকে ঘরবন্দী করে শুভ্রা।

রণ আজ সন্ধ্যাতেই বাড়ি ফিরলো। শুভ্রাকে দেখে কি বুঝলো সেই জানে। কথা না বাড়িয়ে মায়ের ঘরে গেলো। শুভ্রা ততক্ষণে খাবার তৈরি করতে রান্নাঘরে। যখন ঘরে এলো তখন রণ শাওয়ার নিয়ে ফুরফুরে মনে সোফায় বসছে। শুভ্রা হালকা নাস্তা এগিয়ে দিলো-“মায়ের সাথে রাতের খাবার খাবেন তো?”
রণ কিছুটা অবাক হয়ে বললো-“হ্যা। আগে বাসায় ফিরেছি সবাই একসাথেই তো খাবো। কেন? কি হয়েছে?”
“কিছুনা। এমনিতেই জানতে চাইলাম।”
শুভ্রার কাটখোট্টা উত্তর হয়তো রণর পছন্দ হয়নি। সে কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো-“শুনুন, আগামী পরশু তিনদিনের সফরে আমেরিকা যাব প্রধানমন্ত্রীর সাথে।”
“চন্দ্রানী যাচ্ছে?”
শুভ্রার মুখ থেকে প্রশ্নটা বেরিয়ে এলো আচমকাই। রণ চমকে মাথা দুলায়-“হ্যা,ও তো যাবেই। কিন্তু আপনি হঠাৎ কথা কেন জানতে চাইলেন?”
শুভ্রা আমতাআমতা করলো-“কিছু মনে না করলে আমি যেতে চাই আপনার সাথে। ভার্সিটিতে আমার টুকটাক কাজ আছে সেগুলো সেরে নেব এই সুযোগে।”
“কিন্তু এবারের ট্যুর তো একদম লিমিটেড মানুষের জন্য। বউ বা জামাই নেওয়ার অনুমতি নেই। খুব কনফিডেন্সিয়াল ট্যুর এটা।”
“কিন্তু আমার তো যেতেই হবে আজ না হয় কাল। আপনি যাচ্ছেন এটা একটা সুযোগ বলা যায়। একা যাওয়ার চাইতে আপনার সাথে যাওয়া বেটার না?”
রণ চিন্তায় পড়লো। কিছুক্ষণ চুপচাপ ভাবলো। তারপর বললো-“তাহলে এক কাজ করুন। আপনি একা চলে যান। আমি ওখানে আপনার সাথে মিট করবো। রাজীবকে বলছি আপনার এয়ার টিকেট কেটে দেবে। হোটেলও ঠিক করে রাখবে।”
শুভ্রা রাজি হয়ে গেলো। রণকে কেন যেন এবার একা ছাড়তে মন সায় দিচ্ছে না। নিজের আচরণে অবাক শুভ্রা হুট করে আবিস্কার করলো ও চন্দ্রানীকে হিংসে করছে। রণর পাশে মেয়েটাকে দেখলেই খুব হীনমন্যতা অনুভব করছে।

*****

তুলতুল এখন দিনরাত নজরবন্দী থাকছে। এমনকি বাথরুমে গেলেও তার দরজা লাগানোর অনুমতি নেই। দরজা চাপানো রেখে তার বাথরুমের যাবতীয় কাজ সারতে হচ্ছে। যার ফলে গোসল আর বাথরুম করে শান্তি পাচ্ছে না তুলতুল। বারবার মনেহয় এই বুঝি কেউ ঢুকে গেলো বাথরুমে। মানসিক চাপে জীবন ওষ্ঠাগত।
সারাক্ষণ তার সাথে মালা নামক এক জাঁদলের মহিলা থাকে। মালার স্বাস্থ্য আর উচ্চতা মাশাল্লাহ, প্রথম দেখায় যে কেউ চমকে যাবে। চেহারার অবশ্য বেশ সুন্দর। তবে গলাটা সেই বাজখাঁই। মালা মুখ খুললেই ভয়ে তুলতুলের বাথরুম চেপে যায়। এখন এই মহিলাকে সবসময় নিজের আশেপাশে দেখে কেমন যেন লাগে তুলতুলের। সে বেশ ভালোমতোই বুঝে গেছে বাচ্চা না হওয়া পর্যন্ত এরকমই চলবে।

সালিম সাহেব ভেবেছে তুলতুল বাচ্চার ক্ষতি করবে। তাই প্রটেকশন হিসেবে তুলতুলের সাথে মালাকে জুড়ে দিয়েছে। প্রতি সপ্তাহে নিয়ম করে ডাক্তার এসে দেখে যায় তুলতুলকে। শুধু আল্ট্রা করার প্রয়োজন হলে তুলতুলকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। তাও বলে দেওয়াই থাকে। যায় আল্ট্রাসনো করে চলে আসে। না কারো সাথে কথা বলতে দেয় না একনজর বাইরে দেখতে দেয়। এরকম বন্দী থাকতে থাকতে তুলতুলের ইদানীং নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কথা খুব মনে আসে। আত্মহত্যা মহাপাপ না হলে হয়তো এতোদিনে নিজেকে শেষ করে দিত।

নিজের পেটের দিকে তাকালো তুলতুল। একটু ফোলা ফোলা লাগে কি? মেজাজ খারাপ হয়ে যায় তুলতুলের। হা*রা*মিটা যেতে যেতেও তাকে আঁটকে রেখে গেলো এই বাড়িতে। তীব্র বিতৃষ্ণায় পেট থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তুলতুল। বাচ্চাটা নিশ্চয়ই ওর বাবার মতো হবে? মা হিসেবে তাকে কোন সন্মান দেবে না যেমন সোহেল তাকে বউ হিসেবে কখনো সন্মান দেয়নি। মেজাজটা বিচ্ছিরি রকমের তেতো হয়ে গেলো। রুমের মধ্যে দম আঁটকে আসছে তার। সে বিছানা ছেড়ে উঠতেই মালা তার বাজখাঁই গলায় চেচিয়ে উঠলো-“কই যান?”
তুলতুল কানে হাত চেপে রাগান্বিত হয়ে মালার দিকে তাকালো-“এতো চেচিয়ে কথা বলো কেন? মানা করেছি না?”
মালা তুলতুলের বারন পাত্তা দিলো না। সে একই সুরে দ্বিতীয় বার জানতে চাইলো-“কই যান?”
“ছাদে। ঘরে দমবন্ধ লাগছে। মনে হচ্ছে শ্বাস আঁটকে আসছে।”
“আপনের না সিঁড়ি ভাঙা নিষেধ। যাওয়া যাইবো না।”
তুলতুল এবার সত্যি সত্যি রাগ হলো-“দোতলার ছাঁদে যাব। সিঁড়ি ভাঙা হয় কিভাবে? তুমি অযাচিত মাতব্বরি করবে না মালা। না হলে চড় খাবে।”
বলেই দরজার সামনে এলো। মালা লাফ দিয়ে ওর সামনে পড়লো-“যাইতে পারবেন না কইছি তে পারবেন না। কিছু হইলে পরে আমার দোষ হইবো।”
মালার স্পর্ধা দেখে বিস্মিত হয়ে গেলো তুলতুল। অপমানে ওর শরীর কাঁপতে শুরু করলো। সে চেচিয়ে উঠলো-“সরো আমার সামনে থেকে বেয়াদব মেয়ে। ছাঁদে আমি যাবই যাব। দেখি তুমি কিভাবে ঠেকাও।”
মালা অনড়ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো-“চেচাইয়েন না ভাবি। শরীর খারাপ হইবো আপনের।”
“চুপ বদমাশ। তোর কাছে শুনতে হবে আমি কি করবো কি করবো না? সর আমার সামনে থেকে।”
তুলতুল রাগে দিগবিদিক শুন্য হয়ে চেচিয়ে যাচ্ছে। মালা এবার ভয় পেয়ে গেলো-“আল্লাহ দোহাই লাগে ভাবিজান, চেচাইয়েন না। আপনের পায়ে পড়ি। শরীর খারাপ হইবো আপনের। শরীর খারাপ হইলে আমি বিপদে পড়ুম।”
শরীফ ডাইনিং এ এসেছিল পানি খেতে। তুলতুলের চেচামেচি শুনে এগিয়ে এলো। দরজায় আওয়াজ দিলো-“মালা, কি হয়েছে?”
মালা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। দ্রুত হাতে দরজা খুলে দিলো-“ভাইজান, ভাবি ছাঁদে যাইতে চায়। তার সিঁড়ি ভাঙা নিষেধ। আমি মানা করছি তাই চিল্লাইতাছে।”
তুলতুল মালার উপর হামলে পড়লো-“এই তুই মানা করার কে? চাকরানী তুই, তোর কথা শুনবো কেন? বল কেন শুনবো?”
তুলতুলের ব্যবহারে হতচকিত শরীফ। তুলতুলকে বরাবর শান্ত মেয়ে হিসেবে দেখেছে। এখন এমন অগ্নিরুপ দেখে মাথা ঘুরছে। শরীফ কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো-“মালা, তুই যা।”
মালা যেন সুযোগ পেয়ে দৌড়ে পালালো। শরীফ তুলতুলের দিকে তাকিয়ে বললো-“প্লিজ তুমি শান্ত হও। ছাঁদে যাবে তো? চলো। তবুও এরকম চেচাবে না। তোমার শরীর খারাপ হবে।”
শরীফের মুখের উপর কিছু বলতে পারলো না তুলতুল। তবে মনে মনে গজগজ করলো। ছুটে যাচ্ছিলো ছাঁদে শরীফ ঠেকালো-“আস্তে হাঁটো। ইচ্ছে করে এরকম করলে কি বাবার হাত থেকে নিস্তার মিলবে? তারচেয়ে নিজের যত্ন করা ভালো না? আস্তে আস্তে এসো।”
তুলতুল গতি থামালো। ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে ছাঁদে উঠলো। শরীফ ছিলো ওর পেছনে। ছাঁদে দাঁড়াতেই শীতল হাওয়া শরীর ছুঁয়ে দিলো তুলতুলের মেজাজ খানিকটা নরম হলো। মন খারাপ ঘিরে ধরলো তাকে। কিছুক্ষণ আগের চেচামেচির কথা মনে করে সে হুট করে কেঁদে দিলো।

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

দর্পহরন পর্ব-৪০+৪১

0

#দর্পহরন
#পর্ব-৪০

রণর কাঁধে মুখ লুকিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে চলেছে শুভ্রা। হতভম্ব ভাব কাটিয়ে স্বাভাবিক হতেই আপনাতেই রণর হাত উঠে এলো শুভ্রার মাথায়। ধীরে ধীরে শুভ্রার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে রণ। কিছু সময় পার হওয়ার পর শুভ্রার কান্নার শব্দ কমে এলে রণ মোলায়েম কন্ঠে ওকে ডাকলো-“শুভ্রা, কি হয়েছে? কেন কাঁদছেন বলবেন একটু? বাড়ির জন্য খারাপ লাগছে? আবার যেতে চান?”
শুভ্রা মাথা নাড়লো। রণ ধৈর্য্য না হারিয়ে নরম কন্ঠে বললো-“তবে? কেউ কিছু বলেছে?”
শুভ্রা এবার ছোট্ট করে উত্তর দিলো-“হুমম।”
“কে বলেছে?”
“আন্টি।”
রণ শুভ্রার দু বাহু ধরে সামনে আনলো। শুভ্রা মাথা নিচু করলো সাথে সাথে। রণ কয়েক সেকেন্ড নতমুখী শুভ্রাকে দেখে অবাক গলায় বললো-“মা! মা কি এমন বলেছে বলুন তো?”
শুভ্রা ভাঙা গলায় বললো-“আন্টি আমাকে ভুল বুঝেছে। আমি নাকি আপনাকে মেরে ফেলতে চাই তাই বিয়ে করেছি।”
এ কথা শুনে রণ এবার পেছনে হেলান দিয়ে আয়েস করে বসলো-“ভুল কি বলেছে মা? মারতে তো চান আপনি আমাকে।”
শুভ্রা রেগে গেলো-“অযথাই বাজে বকবেন না। আমি কেন আপনাকে মারতে চাইবো?”
“আপনাকে কিডন্যাপ করেছিলাম বলে। দুই মাস বন্দী থেকে আপনার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। এখন আপনি প্রতিশোধ নিতে আমাকে মেরে ফেলতে চান। মা ভুল কিছু তো ভাবেনি।”
শুভ্রার প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হলো-“মানলাম প্রতিশোধ নিতে চেয়েছি তাই বলে মেরে ফেলবো? মেরে ফেললে লাভ কি হবে আমার? বরং আপনি বেঁচে থাকেন তারপর আমি রসিয়ে রসিয়ে অত্যাচার করবো আপনাকে। তাহলেই না মজা?
তাহলে বলুন মেরে ফেলার চিন্তা করবো কেন আমি?”
রণ চোখ গোল করে তাকায়-“রসিয়ে রসিয়ে অত্যাচার করবেন? তা রসালো অত্যাচারটা কেমন হতে পারে একটু বলবেন?”
শুভ্রা অপ্রস্তুত হয়ে রণর দিকে তাকালো। রণর মুখের চোরা হাসিটা অনেক কষ্টে বুঝে আসলো ওর। শুভ্রা ভেতরে ভেতরে রেগে গেলো খুব। এই লোকটা আস্ত একটা বদ। সবসময় চোরাগোপ্তা হামলা চালানোর তালে থাকে। খারাপ লোক একটা। শুভ্রা গম্ভীর মুখে বিছানা থেকে নেমে যেতে চায়। রণ উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলো-“কোথায় যাচ্ছেন?”
“আপনার খাবার আনতে। খাননি নিশ্চয়ই?”
“বেশি করে আনবেন খাবার। আজ আপনিও সারাদিন খাননি বুঝতে পারছি। আমার ভাগেরটা খেয়ে পোষাবে না আপনার। আর হ্যা, যাওয়ার আগে শাড়ীটা ঠিক করে নিন। এমন আলুথালু বেশে বাইরে গেলে কেউ দেখে ফেললে কি ভাববে বলুন তো?”
রণর ঠোঁটের কোনে দুষ্ট হাসি। শুভ্রা এবার ঝটপট নিজের শরীরের দিকে তাকালো। ভীষণ লজ্জায় নুইয়ে গেলো সে। বুকের উপর থেকে আঁচল সরে গেছে। তা কোনরকমে লুটোপুটি খাচ্ছে কাঁধের উপর। শুভ্রা একবার রণকে দেখলো। সে ঠোঁটের দুষ্টু হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। শুভ্রা দ্রুত হাতে বুকের উপর আঁচল টেনে নিলো। তার গাল লাল হয়ে গেছে এরই মধ্যে। মাথাটা লজ্জায় নুইয়ে পড়ে আছে। তার এমন অবস্থা দেখে রণ দারুণ মজা পাচ্ছে, তা বুঝতে পেরেই শুভ্রা অতিদ্রুত ঘর ছেড়ে পালায়।

*****

“আচ্ছা, আন্টি যদি আমাকে ছেড়ে দিতে বলে তাহলে ছেড়ে দেবেন?”
রণর খাওয়া থেমে যায়। শুভ্রার কথা বুঝতে চোখ কুঁচকে তাকায়-“কি বলতে চাইছেন বুঝতে পারছি না।”
শুভ্রা ইতস্তত করলো-“মানে আন্টির কথায় যেমন আমাকে বিয়ে করেছিলেন তেমনভাবেই যদি আন্টি আমাকে ডিভোর্স দিতে বলে দিয়ে দেবেন?”
এবার একটু স্বস্তি পেলো রণ। সে রহস্য করে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিলো-“আপনার কি মনেহয়? কি করা উচিত হবে আমার?”
শুভ্রা ঠোঁট উল্টো বলে-“তার আমি কি জানি? মা ভক্ত ছেলে আপনি মায়ের কথাই নিশ্চিয়ই শুনবেন?”
রণ মুচকি হাসলো-“তাই কি করা উচিত না? মায়ের কথা শুনেছিলাম বলেই তো আজ আপনার সাথে বসে খাবার খাচ্ছি। এটা কি খুব খারাপ হয়েছে?”
শুভ্রা জবাব দিতে পারলোনা। তবে মনের ভেতরটা টলমল করছে। তাহলে কি মায়ের কথায় রণ ওকে ছেড়ে দেবে? রণ খেতে খেতে বললো-“গতদিন যেটা হয়েছে তাতে মা ভয় পেয়েছে। আর ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক। এখন সেই ভয় থেকে সে যদি আপনাকে কিছু বলে তাহলে মনখারাপ করবেন না। আপনি বরং মায়ের মন জয় করার চেষ্টা করুন। তাকে বোঝান সে যা ভাবছে তা ভুল। তাহলেই তো সব প্রবলেম সলভ হয়ে যায়।”
শুভ্রা দ্বিধা নিয়ে প্রশ্ন করলো-“কিন্তু কিভাবে বুঝাবো আন্টিকে?”
রণ হেসে দিলো-“এটাও আমাকে বলে দিতে হবে?”
শুভ্রা নিরীহ মুখ করে বললো-“তো আমি কিভাবে জানবো? আগে কি বিয়ে করেছি নাকি?”
রণ চোখ বড় করে তাকায়-“আমার বুঝি এটা দ্বিতীয় বিয়ে?”
শুভ্রা গাল ফোলায়-“শাশুড়ীকে কিভাবে পটাব সেটা শাশুড়ীর ছেলেই বলে দেবে।”
রণ অবাক হয়ে তাকায়-“তাই? তা বুদ্ধি দাতার জন্য কি বরাদ্দ থাকবে?”
“আপনি খুব খারাপ জানেন এটা? সবকিছুতে বিনিময় খোঁজেন। কেন নিঃস্বার্থ ভাবে কাউকে সাহায্য করা যায় না? পূণ্যের কাজে বিনিময় খুঁজতে নেই জানেন না?”
শুভ্রার অভিমানি কথা শুনে রণ হা করে কিছুক্ষণ শুভ্রার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর হো হো করে হাসলো-“কথা তো ভালোই জানেন দেখছি। আর আমি কিনা এতোদিন ভেবেছি আপনি কম বোঝা মানুষ।”
শুভ্রা মন খারাপ করে বললো-“আমি যেমন আন্টিকে খুব ঠান্ডা মানুষ হিসেবে জানতাম। এখন দেখছি সে পুরাই আগ্নেয়গিরি।”
রণর মুখের হাসি মুছে গেলো-“মা কিন্তু ঠান্ডা মানুষই। তাকে কোনভাবেই ভুল বুঝবেন না। আমারও তাকে নিয়ে কিছু শুনতে মোটেও ভালো লাগবে না।”
শুভ্রা নিভু নিভু গলায় বললো-“ভুল আমারই। সব দিক দিয়ে আমিই দোষী।”
“আমি উঠছি। কাল আবার একটু ফরিদপুর যাব।”
রণ উঠে দাঁড়াতেই শুভ্রা ডাকলো-“শুনুন, আমি কি কিছু করতে পারি? মানে বাড়িতে বসে থাকা খুব বোরিং লাগছে।”
রণ ভাবলো কিছু সময় তারপর জবাব দিলো-“আমার আপত্তি নেই তবে মাকে একবার জিজ্ঞেস করে নেবেন।”
বলেই আর দাঁড়ালো না। শুভ্রা খাবার প্লেট গুছিয়ে নিয়ে চলে গেলো।

*****

দেরি করে ঘুম ভেঙেছে শুভ্রার। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করতে বসেছে তখনই জলি এসে দাঁড়ায়-“বউ হয়ে এসেছ কম দিন তো হয়নি। আর কতদিন এরকম নতুন বউ সেজে থাকবে? তুমি কি এখানে অতিথি? দেরি করে উঠবে, ইচ্ছেমতো সময়ে নাস্তা খাবে। সংসারে কোথায় কি হচ্ছে কোন খবর রাখবে না। এভাবে কি সংসার করা যায়? মন কি এখনো বাপের বাড়ি রেখে এসেছ? শোন মেয়ে, সংসার করার ইচ্ছে থাকলে মন দিয়ে সংসার করো। না হলে বিদায় নাও আমাদের জীবন থেকে। এমনিতেও বাপ ভাইয়ের আগে আর কিছু চোখে পড়ে না তোমার।”
শুভ্রার কান্না পেলেও চুপ করে রইলো। জলি থামার পর আস্তে করে জানতে চাইলো-“আন্টি, আপনি কেন আমার সাথে এমন করছেন আমি জানি না। তবে ভাইয়া ওনার উপর হামলা চালাবে এটা সত্যি আমি জানতাম না। আপনি শুধু শুধু আমাকে ভুল বুঝছেন। আর সংসারের কাজ নিয়ে আমার জ্ঞান কম তাই যদি বলে দিতেন কি করতে হবে আমাকে। আমি তাই করার চেষ্টা করবো। বাবার বাড়ি নিয়ে ভয় পাবেন না। আজকের পর আর বাবার বাড়ি যাবো না। কারো সাথে নিজ থেকে যোগাযোগ রাখবো না।”
এসব কথা শুনেও জলি নরম হলো না। কড়া গলায় বললো-“কাল থেকে সকালে উঠবে। বাবাই যেন না খেয়ে বাড়ি থেকে বেরোয় না। রান্না কি হবে, বাজার আছে কিনা, মেহমান এলে কি খাবে, কোথায় থাকবে, কাজ ঠিকমতো হচ্ছে কিনা সেসব দেখবে। না বুঝলে আমায় জিজ্ঞেস করে নেবে।”
জলির কথা শুনে বারকয়েক ঢোক গিললো শুভ্রা। কেথায় ভাবছিল চাকরি বাকরি করবে। এখন দেখছে তাকে ঘরকন্নার কাজ দেওয়া হচ্ছে যা করার কথা কখনো মাথায় আসেনি। সারাজীবন বাড়ি থেকে একা একা দূর দেশে থেকেছে। বাড়িতে বেড়াতে এলেও কাজ করার লোক ছিলো বলে কখনো কাজ করতে হয়নি। আর এখন কিনা তাকেই এতোসব কাজ করতে হবে? এতো এতো কাজের ফিরিস্তি শুনেই কেমন যেন লাগছে। মনেহচ্ছে এরচেয়ে কঠিন কাজ একটাও নেই। জলি তীক্ষ্ণ নজরে শুভ্রাকে মাপছিল-“শোন, তিনদিন পরে তোমার শশুরের মৃত্যুবার্ষিকি আছে। তেমন কিছু করি না। কেবল এতিম বাচ্চাদের জন্য কাপড় কিনে দেই আর নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াই। এবার তো আমার শরীর ঠিক নেই। কাজেই কাপড় কেনা আর রান্নার ভার তোমার নিতে হবে। হাতে তিনদিন আছে, মন দিয়ে রান্নাটা শিখে নাও। দেখি কেমন পারো। সালিম সাহেব ছেলেমেয়েকে খালি গুন্ডামী শিখিয়েছেন নাকি কাজও শিখিয়েছেন সেটাও দেখা হয়ে যাবে এই ফাঁকে।”
বাবার কথা শুনেই বুঝিবা শুভ্রার মন শক্ত হলো। সে মাথা দুলিয়ে বললো-“পারবো আন্টি। আমি ঠিক পারবো। আপনি ভাববেন না।”
জলি হেলাভরে জবাব দিলো-“পারলেই ভালো। না হলে বাবাইয়ের জন্য নতুন করে ভাবতে হবে। ছেলে আমার জন্য কেন ভুগবে, তাই না বলো?”
শুভ্রা কিছু না বলে চুপচাপ নাস্তা নিলো প্লেটে। যদিও খেতে ইচ্ছে করছে না তবুও সব ঠিক আছে জলিকে এটা দেখাতেই যেন জোর করে খাবার খাওয়ার চেষ্টা করলো।

চলবে।

#দর্পহরন
#পর্ব-৪১

গত তিনদিনে শুভ্রা যত চেষ্টাই করেছে সব মোটামুটি ফেল গেছে। কোনভাবেই জলিকে সন্তুষ্ট করতে পারছে না। আজ রীতিমতো বুক কাঁপছে তার। সকাল থেকে রান্নার প্রিপারেশন নিয়ে ভয়ে ভয়ে গরুর মাংস, মুরগী আর পোলাও রান্না করে গোসলে গেছে। রান্নার স্বাদ কেমন হয়েছে বুঝতে পারছে না। নিজের কাছে মোটামুটি লেগেছে এখন এই রান্না বাচ্চাগুলো তৃপ্তি নিয়ে খেতে পারলেই শুভ্রা খুশি।

এ বাড়িতে আজ খুব ভীড়। রণর বাবার মৃত্যুবার্ষিকী বলে কাছের আত্মীয়, রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা ভীড় করেছে। তাদের জন্য স্পেশাল রান্না হচ্ছে যা বাবুর্চী করছে। জলির মা, দুই বোন, ভাইয়েরা, তাদের বউ বাচ্চা সবাই এসেছে। হাসিখুশি কাজিনদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। রণও আজ তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছে। শুভ্রা তাড়াতাড়ি শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হয়ে গেলো। সালোয়ার কামিজ পরে মাথায় ঘোমটা টেনে দোতলায় এলো।

এতিম বাচ্চাগুলো চলে এসেছে। মোট বারোজন বাচ্চা। তাদের নিজ হাতে বেড়ে খাওয়ানোর আদেশ দিয়েছে জলি। শুভ্রা প্রতিটা প্লেটে যত্নের সাথে খাবার তুলে দিলো। বাচ্চাগুলোর কাছে বসে থেকে খাবার খাওয়ালো। বারবার জানতে চাইলো, খাবার কেমন হয়েছে। ছোট ছোট ফুলের মতো বাচ্চারা মিষ্টি হেসে খেতে লাগলো। বড় ভালো লাগে শুভ্রার। এরকম অভিজ্ঞতা এই প্রথম শুভ্রার। মনটা অজানা প্রশান্তিতে ভরে উঠছে তার। খাবার খাইয়ে বাচ্চাদের হাতে কিছু নতুন কাপড়, খাতা, কলমের প্যাকেট তুলে দিলে ওরা ভীষণ খুশি হয়ে গেলো।

জলি বসে চোখের পানি ফেলছে আর রণ মায়ের সামনে বসে আছে। তারও মনটা আর্দ্র হয়ে আছে। তবে মায়ের সামনে সে সহজে চোখের পানি ফেলে না। সেলিনা মেয়ের কাছে বসে আছে। জলি মায়ের দিকে তাকালো-“তেরো বছর হইলো মা। তেরো বছর ধরে লোকটা নিখোঁজ থেকে গেলো। কি জ্বালা ধরে মনে কেমনে বুঝাই।”
সেলিনা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ডুকরে উঠলো। রণর চোখ ছলছল। চোখের জল লুকাতেই মুখ ঘুরিয়ে নিলো সে। জলি চাপা গলায় বললো-“লাশ পাইলেও মনকে স্বান্তনা দিতে পারতাম। তার তো কোন কবর নাই। দোয়া করি কেমনে? জানতেও পারলাম না মানুষটা বেঁচে আছে না মারা গেছে। মারা গেলে কেমনে মারা গেছে।”
সেলিনা ভেজা গলায় বললো-“আর তুই জামাই এর অপহরণকারীর মেয়েকে ঘরে তুলে আনছিস। কেন এই কাম করছিস জলি? ওই মেয়েকে দেখলেই রাগ উঠে আমার।”
জলি চোখ মুছলো-“বাবাইকে বাঁচাতে। স্বামী নাই, ছেলেকে হারাইলে কেমন করে বাঁচবো মা? ওই শয়তানটাকে চিনি তো। সুযোগ খুঁজে বাবাইকে মারার চেষ্টা করতো। ভাবছিলাম নিজের মেয়েকে নিশ্চয়ই বিধবা করতে চাবে না। কিন্তু দেখলাম মেয়ে বোন কারো কেয়ার করে না এরা এমনই জালিমের বংশ। এখন ঠিক করছি, ওই মেয়েকে বিদায় করে দিব। আর ভয় পাবো না। বাবাইকে ভালো কোন মেয়ে দেখে বিয়ে দিব।”
রণ আঁতকে উঠলো-“মা! কি বলো এইসব? বিয়ে কি ছেলেখেলা? আজকে একে তো কালকে তাকে? দয়া করে এমন কিছু করবা না তুমি।”
জলি খেপে গেলো-“আমার উপর দিয়ে কথা বলবি না বাবাই। ওকে আমিই তো বিয়ে করতে বলেছিলাম এখন আমিই বলছি ওকে ছেড়ে দিতে। একেতো মেয়েটা এই সংসারের উপযুক্ত না তারউপর ওর বাপ ভাই। ওই লোককে কিছুতেই মাফ করবোনা আমি। ওই বদমাশ লোককে এভাবেই শায়েস্তা করতে হবে। ওর মেয়েকে ডিভোর্স দিয়ে।”
রণ খেপে গেলো-“মা, পাগল হয়ে গেছ তুমি? কিসব বলছো? আমি তো বিয়ে করতে চাইনি তুমি জোর করেছিলে। এখন এসব পাগলামির মানে কি? নানু প্লিজ মাকে বোঝাও।”
জলিও পাল্টা রাগ দেখায়-“এতো তাড়াতাড়ি বাবাকে ভুলে গেছিস বাবাই? কিভাবে পারলি?”
রণ অবাক হয়ে গেলো-“এসব কথার সাথে বাবাকে ভুলে যাওয়া না যাওয়ার সম্পর্ক কি মা?”
“সম্পর্ক নেই বলতে চাইছিস? তোর বাবাকে তুলে নেওয়া ওই খুনীর মেয়ের জন্য এতো মায়া কেন তোর? এতো তাড়াতাড়ি সব ভুলে গেলি?”
রণ চোয়াল শক্ত করে নিজেকে সামলে নেয়-“কিসব বলছো মা? তোমার মাথা দেখি সত্যিই খারাপ হয়ে গেছে। একটা সত্যি কথা হলো ওই মেয়েটার কোন দোষ নেই। ওর একমাত্র দোষ হলো ও সালিম সাহেবের কন্যা। তুমি জোর করেছিলে বলে ও এ বাড়িতে এসেছে। তাই বলে ভেবনা এখন তোমার কথা শুনে ওর সাথে কোন অন্যায় করবো আমি। আমার এখন ক্ষমতা আছে। যার সাজা তাকে দেবার চেষ্টা করবো।”
জলি ফুঁসে উঠলো-“ওই মেয়েকে আর কিছুতেই মেনে নেব না। তোকে মেরে ফেলতে চাইছিল ওরা।
তুই তোর মায়ের বিপক্ষে যেতে চাইলে যেতে পারিস কিন্তু মনে রাখিস ওই মেয়ের জন্য আমার মন থেকে কোন দোয়া আসবে না। বাকী তোর ইচ্ছে।”
রণ মরিয়া হয়ে বললো-“আমি ওকে তোমার মনের মতো বানাতে চাইছি মা আর তুমি অন্য কিছু চাইছো। গতবারও তোমার চাওয়া ভুল ছিলো এবারও তাই। পার্থক্য হলো গতবার নিজের মনের বিরুদ্ধে যেয়ে কাজ করছি এবার তোমার বিরুদ্ধে যেয়ে। ক্ষমা কর মা।”
“ক্ষমা! কখনোই না। তুই ওই মেয়ের জন্য নিজের মাকে অপমান করছিস! তুই কি আমারই বাবাই?”
জলির কন্ঠে স্পষ্ট খেদ। রণ উঠে দাঁড়ায়। জলি আরও কিছু বলতো কিন্তু সেলিনা তাকে থামিয়ে দিলো। রণ ঘর থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার পরই মেয়ের উপর হামলে পড়লো-“তোর মাথা খারাপ জলি? ছেলের সাথে এইভাবে কথা বলে? ঠিকই তো বলেছে রণ, বিয়ে করতে চায়নি ও। তুই বাধ্য করেছিলি। এখন বউয়ের সাথে খাতির হয়েছে কেন ছাড়বে বউকে?”
জলির চোখ দুটো জ্বলে উঠলো-“খাতির হয়েছে খাতির ছুটিয়ে দেব। ওই সালিম আর ওর মেয়েকে আমার পায়ে পড়াব। ওর মেয়েকে রণর জীবন থেকে বিদায় করে ছাড়বো। দেখো তুমি।”
সেলিনা মেয়েকে ঠান্ডা করতে চাইলো-“যা করবি আওয়াজ না করে করবি। কেউ যেন বুঝতে না পারে তুই কিছু করেছিস। বুঝতে পেরেছিস?”
মায়ের কথা কিছু বুঝলো কিছু বুঝলো না জলি। তার মনটা টগবগিয়ে ফুটছে কেবল। ওই শয়তানের মেয়ের জন্য তার সাথে তর্ক করলো রণ যা আগে কোনদিন করেনি।

*****

কিছুক্ষণ আগে জলির কামড়ার সামনে গেছিল শুভ্রা। বাচ্চাগুলো খেয়ে খুশি মনে বিদায় নিয়েছে সে কথা জ্বানাতেই গেছিল কিন্তু তাকে নিয়ে কথা হচ্ছে শুনেই পা থেমে গেছিল নিজের অজান্তেই। তারপর পুরো কথোপকথন শুনে আর সাহস হয়নি জলির সামনে দাঁড়ানোর। একই সাথে ভালোলাগা আর খারাপ লাগার অনুভূতি মিলে মিলে একাকার হয়ে গেছে। যে জলির হাত ধরে এ বাড়িতে এসেছিল সেই জলি তাকে আর পছন্দ করছে না এটা নিয়ে খারাপ লাগলেও রণ তাকে প্রটেক্ট করেছে এটা নিয়ে ভালোলাগায় মন ছেয়ে আছে। কিন্তু সেই সাথে মনে ভয় জেঁকে বসেছে, সত্যি যদি জলির কথা মেনে রণ ওকে ছেড়ে দেয়? জলি যেভাবে কথা বলেছে তাতে এটুকু পরিস্কার জলি ওকে ভীষণ জ্বালাবে। সহজে মেনে নেবে না। তখন কি করবে শুভ্রা? রণকে ছেড়ে চলে যাবে? মনটা খারাপ হয়ে যায়। সে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকে।

ঘরে ফিরে শুভ্রাকে ওভাবে শুয়ে থাকতে দেখে রণর ভ্রু কুঁচকে যায়। কাছে দাঁড়িয়ে শুভ্রাকে ডাকলো-“শুভ্রা শুনছেন? শুয়ে আছেন কেন অবেলায়? দুপুরের খাবার খাবেন না? বাচ্চারা খেয়ে চলে গেছে?”
শুভ্রা উঠে বসলো। নিজের মনের হাল রণকে বুঝতে দেবে না এই প্রত্যয়ে মুখে হালকা হাসি ফুটিয়ে বললো-“হ্যা, চলে গেছে। আর কেউ না খেলে একা খাওয়া যায়?”
রণ বিস্মিত হতে গিয়েও হেসে দেয়-“সবাই খাচ্ছে। আপনিও খেয়ে নিন।”
শুভ্রা জানতে চাইলো-“আপনি? আপনি খাবেন না?”
রণ কিছুটা মন খারাপ করে বিছানায় বসলো-“খেতে ইচ্ছে করছে না। খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নেব ভাবছি।”
“তাহলে তো আমারও খাওয়া উচিত হবে না।”
রণ মুচকি হাসে-“কেন? আপনি খাবেন না কেন?”
শুভ্রা জবাব দিলো-“আমারও খেতে মন চাইছে না।”
রণ ভ্রু কুঁচকে কিছু ভাবলো তারপর বললো-“এককাজ করুন, আপনি নিজ হাতে যা রান্না করেছেন সেগুলো নিয়ে আসুন আমাদের দু’জনার আন্দাজে।”
শুভ্রা খুশি হয়ে বললো-“আমার রান্না খাবেন?”
“হ্যা, কেন? খাওয়া যাবে না নাকি?”
“যাবে না কেন? আমি এখনি আনছি।”
শুভ্রা ছুটে বেড়িয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর দু’হাত ভরে খাবার নিয়ে এলো। টেবিলে সাজিয়ে রণকে ডাকলো-“আসুন, খাবার সাজিয়ে ফেলেছি।”
পোলাওটা একটু নরম নরম। গরুর মাংসে মারাত্মক ঝাল আর মুরগীটা চলনসই। চুপচাপ খাচ্ছিল রণ। শুভ্রা হঠাৎ জানতে চাইলো-“খাবার কেমন হয়েছে?”
“অতোটা ভালো না তবে খাওয়া যাচ্ছে।”
রণ অমন কথায়,সাথে সাথে শুভ্রার মুখের হাসি নিভে গেলো-“হুমম, গরুর মাংসটা মারাত্বক ঝাল। বাচ্চারা কিভাবে খেলো? রান্না করে বুঝতে পারিনি কেন?”
রণ ঝাল শুষতে শুষতে বললো-“ওরা খেতে পেয়েছে তাতেই খুশি। ঝাল মিষ্টি কোন কিছুতে আপত্তি নেই ওদের। শুনুন, আপনি আবার আমার কথা শুনে মন খারাপ করবেন না। সত্যি বলেছি, মিথ্যে প্রবোধ দেওয়ার চাইতে সত্য ভালো।”
শুভ্রা মাথা নাড়ে। নিজে খেতে যেয়ে বুঝলো রণ মিথ্যে বলেনি। প্রচুর ঝাল হয়েছে গরুর মাংসে। শুভ্রার নাক দিয়ে পানি গড়াচ্ছে। খাবার শেষ করতে পারে না ঝালের কারণে। দ্রুত হাত ধুয়ে উঠে পড়ে। রণ মুচকি হাসছে আর খাচ্ছে। শুভ্রা ওর প্লেট কেঁড়ে নিলো-“আর খাবেননা প্লিজ। অনেক ঝাল, শরীর খারাপ করবে।”
রণ হেসে দিলো-“ঝাল খেয়ে মুখ জ্বলছে মিষ্টি খেতে দিন তাড়াতাড়ি।”
শুভ্রা ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়-“আমি এখনি আনছি।”
রণ ওর হাত টেনে ধরে ঠোঁটের পানে ইশারা করলো-“আমি ওই মিষ্টি খেতে চাই। তাড়াতাড়ি দিন। লজ্জা লাগলে চোখ বন্ধ করছি আমি।”
রণ সত্যি সত্যি চোখ বন্ধ করলো। শুভ্রা ততক্ষণে লজ্জায় লাল নীল বেগুনি কিন্তু তবুও আজ কেন যেন রণর হাক ফিরিয়ে দিতে মন চায় না। রণর ফর্সা ত্বক ঝাল খেয়ে লাল, ঘামে চিকচিক করছে। শুভ্রা সম্মোহিতের মতো রণকে দেখছে। আচমকা রণর খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি সম্বৃদ্ধ গালে হাত রেখে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো। গালে চুমু পেয়ে চমকে তাকায় রণ। দু’জনার চোখাচোখি হলো, কেউ নজর ফিরিয়ে নিলো না। না বলা কতো কথা বলে ফেললো দু’জন চোখের ইশারাতে। কি হলো কে জানে শুভ্রা হঠাৎ আচমকা ঝাপিয়ে পড়লো রণর উপর। কিছুক্ষণ পর রণ টের পেলো ওর পুরুষালি অধরদ্বয় বেদখল হয়ে গেছে।

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

দর্পহরন পর্ব-৩৭+৩৮+৩৯

0

#দর্পহরন
#পর্ব-৩৭

রণর ভ্রু জোড়া বিরক্তিতে কুঁচকে আছে। শুভ্রার কথা শুনতে শুনতে তার মুখটা হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো-“একমিনিট।”
শুভ্রা থতমত খেয়ে বললো-“কি?”
“কি বললেন আপনি? আপনার বাবা কিছুতেই এমন কিছু করতে পারে না?”
শুভ্রা মাথা দুলায়। রণর মুখে হাসি ফুটলো-“তার মানে আপনার ভাইয়েরা পারে?”
শুভ্রা রণর গেঞ্জি ছেড়ে দাঁড়ায়-“এ কথা কখন বললাম?”
“আপনি বেশ চালাক মেয়ে। অভিনয়ও ভালো করেন।”
শুভ্রা ভরকে গেলো-“মমমম মানে? কি বলতে চাইছেন?”
“বলতে চাইছি আমার উপর হামলা হবে সেটা আপনি আগে থেকেই জানতেন। তারপরও হাত পা গুটিয়ে বসে ছিলেন। আমার ধারণা আপনি আপনার পরিবার সম্পর্কে সম্পুর্ন ওয়াকিবহাল। তারা কেমন কি সব। কিন্তু সব না জানার ভাব ধরে থাকেন। তাই না?”
“কেমন কথা বলছেন? তন্ময় ভাইয়ের মুখ থেকে কথাটা শোনা মাত্রই কতবার ফোন দিয়েছি আপনাকে। আপনার নাম্বার বন্ধ পাচ্ছিলাম। মিহির ভাইকেও ফোন দিয়েছি। শেষে শরীফ ভাইকে ফোন দিয়ে অনুরোধ করেছি যেন সে আপনার খোঁজ করে। বিশ্বাস না হলে ফোন দিয়ে শুনতে পারেন।”
রণ হতাশ হয়ে শ্বাস ছাড়ে-“আপনাকে আর বিশ্বাস করতে পারছি না শুভ্রা। আমি শুধু ভাবছি প্রতিশোধ স্পৃহা আপনাকে কতটা নিচে নামিয়ে দিয়েছে?”
শুভ্রা জবাব দিলো না। রণ হাসলো-“আমি আপনাকে অপহরণ করেছিলাম এটা নিয়ে ব্লাকমেল করে আমাকে বিয়ে করেছেন। অথচ এটা জানেন না যে আপনার ভাবিকে আপনার ভাই সোহেল তুলে এনে রে*প করেছে। শুধু আপনার ভাবি কেন ওর মতো কয়েকটা মেয়েকে তুলে নিয়ে রে*প করে মে*রে ফেলেছে। আর আপনার বাবা ছেলের সব কুকীর্তি গোপন করতে সিদ্ধহস্ত। আমাকে যদি অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করান তাহলে নিজের ভাইয়ের ব্যাপারে কি বলবেন? বলুন?”
শুভ্রা অটল গলায় বললো-“আপনি মিথ্যে বলছেন। প্রমান আছে কোন? এমন কোন মেয়েকে দেখান যাকে ভাই রে*প করে মেরে ফেলেছে। প্রমান ছাড়া আইনত কাউকে অপরাধী বলা যায় না, এটা জানেন না?”
“জানবো না কেন? কিন্তু মে*রে ফেললে প্রমান পাবো কোথায়? একমাত্র প্রমান হিসেবে যে বেঁচে আছে সে আপনার ভাবি তুলতুল। তাকে জিজ্ঞেস করুন সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে।”
“জিজ্ঞেস করেছিলাম কোন উত্তর পাইনি। আপনি অযথা মিথ্যে অভিযোগ দিচ্ছেন। বাংলাদেশে রাজনীতি করা মানেই মিথ্যে অভিযোগ, বদনামি তারপর দিনশেষে জেলে পঁচে ম*রা। আর কোন পরিবার যদি আমাদের মতো তিনপুরুষ ধরে রাজনীতি করা হয় তাহলে তাদের তো শত্রুর অভাব হবে না।”
শুভ্রার কথা শুনে রণ হাসবে না কাঁদবে বুঝে পেলোনা। সে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো-“আমার কি দায় পড়েছে মিথ্যে বলার? আচ্ছা আপনি বলুন, আপনার ভাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান হয়নি কেন। আপনার ভাবি তার বাবার বাড়ি যায় না কেন? কিংবা তার বাড়ির কেউ আপনাদের বাড়িতে আসে না কেন? একটাও উত্তর আছে আপনার কাছে? আমার মনেহচ্ছে সব জেনে বুঝে আপনি অবুজপনার নাটক করছেন।”
শুভ্রা নিশ্চুপ। রণ যেয়ে সোফায় বসলো-“আমি আপনাকে তুলেছিলাম তার বিশেষ কারন ছিলো। কিন্তু এটা তো বলতে পারবেন না আমি আপনার বিন্দুমাত্র অসন্মান করেছি। পারবেন বলতে? এই যে বউ হয়ে এসেছেন তবুও কি আপনার সাথে অশোভন আচরণ করেছি কখনো? কিন্তু দেখুন আপনি সবসময় আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করে গেছেন। এতোদিনেও আপনার মধ্যে বিন্দুমাত্র বদল আসেনি।”
রণ হতাশ হয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে-“আমার ক্লান্ত লাগছে শুভ্রা। বাবার কথা শুনে আমার সাথে সহজ হওয়ার অভিনয় করছেন, আমাকেও পাল্টা অভিনয় করতে হচ্ছে। এসব আর ভালো লাগছে না।”
শুভ্রা চমকে উঠলো। অবাক চেয়ে থেকে বললো-“আমার কাছাকাছি আসা আমাকে ছুঁয়ে দেওয়া এসব অভিনয় ছিলো আপনার কাছে!”
রণ উত্তর দিতে পারলোনা সাথে সাথে। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বললো-“এই অভিনয় আর নিতে পারছি না শুভ্রা। আমাকে সারাদিন সিরিয়াস ইস্যু নিয়ে ডিল করতে হয়। বাসায় এসেও সাংসারিক ইস্যু নিয়ে ভাবতে হয়। নাও আই এম ফেডআপ। বাইরের জগতের সাথে যুদ্ধ করা যায় কিন্তু ঘরে কতক্ষণ? দিনশেষে মানুষের একটা আশ্রয় দরকার হয় যার কাছে সে নিশ্চিতে মনের কথা বলতে পারে। শুভ্রা আপনার যদি এখনো আমার উপর রাগ থেকে থাকে তাহলে আমি বলবো সম্পর্ক এখানেই শেষ হোক। বিয়েটা আপনার কাছে হয়তো ক্ষনিকের জেদ হতে পারে কিন্তু আমি বিয়ে নিয়ে এরকম কখনো ভাবিনি। অথচ আমাকেই আপনার মতো করে চলতে হচ্ছে। এখন সত্যিই আর ভালো লাগছে না। আর আপনার জেদ তৈরীর পেছনে যেহেতু আমার হাত আছে তাই আমি আপনাকে সরি বলতে চাই। আমি আমার কাজের জন্য অত্যন্ত লজ্জিত শুভ্রা। এর বেশি আর কিছু করার ক্ষমতা আমার নেই।”
শুভ্রা খুব ধীর স্থির হয়ে বসলো রণর সামনে-“আপনি কি চান আমি আপনার জীবন থেকে চলে যাই? তাহলে খুশি হবেন আপনি?”
রণ এবার হেসে দিলো-“এবার বাচ্চাদের মতো কথা বলছেন শুভ্রা। আমার খুশি হওয়া না হওয়ার কথা এখানে হচ্ছে না। কথা হচ্ছে আপনি কি চান। আপনার যদি আমার সাথে জীবন কাটানোর ইচ্ছে থাকে তাহলে কিছু বিষয়ে স্ট্রং ডিসিশন নিতে হবে আপনাকে। নিজের মা আর বোনদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে চাই না আমি। বুঝতে পেরেছেন?”
শুভ্রা নত মুখে বসে ছিলো। মাথা উঁচু করে জানতে চাইলো-“কেমন ডিসিশন?”
“দেখুন, আমি চাইলে সিকিউরিটিকে বলে যেতে পারতাম তন্ময়কে যেন ঢুকতে না দেয়। কিন্তু বিষয়টা আমি আপনার উপর ছেড়ে দিয়েছিলাম। আপনি কি সিদ্ধান্ত নেন সেটা দেখতে চাইছিলাম। বলা যায় আপনার জন্য পরীক্ষা ছিলো এটা। এবং বুঝতেই পারছেন পরীক্ষায় আপনি ফেল করেছেন খুব ভালো ভাবে। আপনি প্রতিবারই সুযোগ দিয়েছেন তন্ময়কে।”
রণ থামলো। খানিকটা সময় চুপ করে থাকলো। শুভ্রার আচরণ বুঝতে চাইলো। তারপর লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বললো-“আমার সাথে সম্পর্ক রাখতে হলে আপনার পরিবারকে ছাড়তে হবে শুভ্রা। তাদের সাথে কোন সম্পর্ক রাখা যাবে না।”
শুভ্রা চমকে মুখ তুলে তাকায়। ওর চেহারা ফ্যাকাশে, রক্তশুন্য। আতঙ্কিত গলাতে বললো-“এসব কি বলছেন? নিজের পরিবারের সাথে কি সম্পর্ক ত্যাগ করা যায়?”
রণ হাতের উপর চিবুক ঠেকিয়ে ভাবলো কিছুক্ষণ। মৃদুস্বরে বলে উঠলো-“যায় কিনা জানি না তবে আপনার যে কোন একটা বেছে নিতেই হবে শুভ্রা। হয় আমার সাথে থাকবেন না হয় সব শেষ করে দিয়ে পরিবারের কাছে ফিরে যাবেন। আমার সাথে থাকলে আমি আপনার একশোভাগ লয়ালটি দাবি করবো। কোন ভাগ মেনে নেব না। আর না থাকলে তো কোন দাবী করার প্রশ্ন নেই। এখন সিদ্ধান্ত আপনার। আপনি যা সিদ্ধান্ত নেবেন আমি বিনা প্রশ্নে মেনে নেব।”
শুভ্রাকে দ্বিধান্বিত দেখায়। রণ ওর অবস্থা বুঝে ওকে আশ্বস্ত করলো-“দুই একদিন সময় নিন আপনি। ভেবে আমাকে জানান কি করতে চান। চাইলে বাড়িতে যেতে পারেন আমার কোন আপত্তি নেই। শুধু একটা অনুরোধ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর যেন তাতে অটল থাকেন।”
শুভ্রা নিশ্চুপ বসে রইলো। রণ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে উঠে গেল।

*****

রাতে শুভ্রার ফোনে ফোন এসেছিল। সালিম সাহেব ফোন করে সোহেলের খবর দিয়েছে। কাল হাসপাতালে একবার শুনেছিল রণর উপর নাকি হামলা হয়েছে। কিন্তু তন্ময়ের ভয়ে কিছু মাথায় ছিলো না শুভ্রার। বাবার ফোন পেয়ে অবাকই হলো। সালিম সাহেব পুরো ঘটনা খুলে বলেনি। উল্টো মেয়ের কাছ থেকে তথ্য নেওয়ার চেষ্টা করেছে। রণ কিছু বলেছে কিনা তা জানতে চেয়েছে। যখন দেখেছে শুভ্রা কিছুই জানে না তখন একদিকে ভীষণ অবাক হয়েছে আরেকদিকে খুশি। অবাক হয়েছে রণ শুভ্রাকে কিছু জানায়নি দেখে। খুশি হয়েছে শুভ্রা যেহেতু জানে না তাই তাকে নিজের মতো করে বুঝ দেওয়া যাবে এটা ভেবে। কাঁদো কাঁদো গলায় নিজের অসহায়তা জাহির করে মেয়েকে বাসায় আসতে বললেন। শুভ্রা জানালো সকাল হলেই সে রওনা দেবে। ভাইকে দেখতে আসবে।

সকালে শুভ্রা যখন তৈরি হচ্ছিল রণ অবাকই হলো। তার অফিস যেতে হবে, আজ নেত্রী মিটিং ডেকেছে। তার উপর কাজের লিষ্ট অনেক লম্বা। পুলিশ ফোর্সের একটা অনুষ্ঠানে আজ সে চিফ গেস্ট। তবুও জানতে চাইলো-“সাতসকালে কোথায় যাচ্ছেন?”
“বাবা ফোন করেছিল। সোহেল ভাইয়ের অবস্থা ভালো না। কান্নাকাটি করছিল বাবা। তাকে দেখতে যাচ্ছি।”
রাগে রণর চোয়াল শক্ত হলো। সে শুভ্রার কাছে এসে দাঁড়িয়ে ওর কাঁধ ধরে ঝাঁকাল-“আপনি জানেন তো সোহেল কি করেছে? কাল ও সরাসরি ব*ন্দুক তাক করেছিল আমার উপর। না না অবাক হবেন না। প্রমান আছে আমার কাছে। আপনি তো আবার প্রমান ছাড়া কিছু বিশ্বাস করেন না তাই না। ওয়েট।”
রণ নিজের ফোনটা বের করে ভিডিওটা দেখায় শুভ্রাকে। শুভ্রা চুপচাপ দেখলো, বললো-“আমরা যা দেখি সবসময় তা সত্যি হয় না। ও আপনাকে গু*লি করতো কিনা তা বোঝার আগেই পুলিশ ওকে গু*লি করেছে। হতে পারে আপনার পাশে কেউ ছিল যে ওর টার্গেট ছিলো। হতে পারে সে আপনাকে বাঁচাতে চেয়েছে।”
রণ মোবাইল ছুঁড়ে দিলো বিছানায়-“আর ইউ ম্যাড? চোখের দেখাও বিশ্বাস করছেন না? এখন কি আমার ম*রে প্রমান করতে হবে? ইউ আর জাস্ট ইম্পসিবল।”
শুভ্রা দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইলো। রণ অধৈর্য্য হয়ে বললো-“কথা বলছেন না কেন?”
শুভ্রা শান্ত গলায় জবাব দিলো-“আপনি অযথা হাইপার হচ্ছেন। আমি আমার ভাইকে দেখতে যাবো এতে আপনার আপত্তি থাকার কথা না। মানলাম সে আপনার দোষী। আমি তার বোন, অসুস্থ ভাইকে দেখতে যাওয়া আমার কর্তব্য।”
রণ অস্থির পায়চারি করলো ঘরময়। তারপর আবার শুভ্রার সামনে এসে দাঁড়ালো-“আশাকরি ঘুরে এসে সিদ্ধান্ত জানাবেন। আমি আর অপেক্ষা করতে রাজি না শুভ্রা। আমি জীবনে এগিয়ে যেতে চাই। এভাবে ঝুলে থাকতে রাজি না আর।”
বলেই মোবাইল হাতে নিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো। শুভ্রা কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ব্যাগ গুছিয়ে নিলো। আজ বাসায় যাওয়া খুব জরুরি তার জন্য। তার জীবনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু কি সিদ্ধান্ত নেবে সে?

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-৩৮

“আব্বা, আপনারা ওনাকে মেরে ফেলতে চান? ওনার সাথে যে আপনার নিজের মেয়ের জীবন জড়িয়ে আছে সেটাও কি ভুলে গেছেন?”
শুভ্রার কথা শুনে সালিম সাহেব চমকে গেলেন। তাহলে কি রণ শুভ্রাকে সব বলে দিলো? তিনি মেয়েকে কি বলে বুঝ দেবেন সেটা ভাবলো কয়েকমুহুর্ত। আমতা আমতা করে বললো-“আম্মা, এইটা কি বললেন? আপনের আব্বাজানকে চিনেন না আপনে? এমুন কাম আমি করুম আপনে ভাবলেন কেমনে? আমি খুব কষ্ট পাইলাম আম্মাজান। আপনের আব্বারে আপনে বিশ্বাস করেন না। এই দুঃখ কই রাখমু?”
সালিম সাহেবের নাকি কান্না দেখে শুভ্রা বিচলিত হলো না। সে এবার কন্ঠ খানিকটা নরম করে বললো-“আমি সোহেল ভাইয়ের ভিডিও দেখছি আব্বা। ভাই ওনার উপর গুলি চালাইতে গেছে তখনই ভাইকে পুলিশ গুলি করছে। এখন বলেন চোখের দেখা অবিশ্বাস করি কেমনে?”
সালিম সাহেব মেয়েকে তাকিয়ে দেখলো। শুভ্রাকে কেমন ধীরস্থির দেখাচ্ছে। সালিম সাহেব বোঝার চেষ্টা করলো মেয়ের মনে কি চলছে। তিনি মেয়ের হাত ধরে সামনের চেয়ারে বসিয়ে দিলো-“অবিশ্বাস তো করতে কই নাই আম্মাজান। তাই বইলা এইটাও বিশ্বাস কইরেন না আমি এমুন কাম করাইছি। সোহেল সবসময়ই একটু তার ছিঁড়া এইটা তো জানেনই। এইজন্য ওরে আমি এখন সবকিছু থিকা দূরে রাখি। কালই কেমনে কেমনে সমাবেশে আইছে আমি জানিও না। আপনে এইটা ভাবেব তো, আপা ছিলো কালকের অনুষ্ঠানে। আমি কি এমুন কোন কাম করুম যেইটাতে আপা রাগ করবো? আপনেই বলেন দেখি?”
শুভ্রাকে সাথে সাথে মাথা নাড়তে দেখে সালিম সাহেব স্বস্তি পেলো-“আম্মাজান, কালকের ঘটনার পরে দল থিকা আমাকে বহিস্কার করতে পারে। নিজের এতোদিনের গড়া মানসম্মান নিয়ে টানাটানি হইতেছে। আপার সামনে লজ্জায় দাঁড়াইতেই পারুম না। এই সোহেইল্লারে নিয়া কিযে করুম ভাইবা পাই না। আমারে শেষ কইরা দিলো এই পোলা।”
সালিম সাহেবের কন্ঠ আর্দ্র হলো। চোখ দুটো মুছে নিলো আলতো হাতে। বাবার ভেজা চোখ শুভ্রার হৃদয় আন্দোলিত করে। সে বাবার পিঠের উপর হাত রাখলো-“ডাক্তার কি বলে আব্বা? ভাইয়া ভালো হয়ে যাবে?”
সালিম সাহেব মাথা নাড়লো-“কালইকা পর্যন্ত দেখবো। জ্ঞান না ফিরলে…”
সালিম সাহেব ঝরঝর করে কাঁদেন। শুভ্রা মন খারাপ করে মাথা নিচু করে বসে রইলো। সালিম সাহেব ভেজা কন্ঠে বললো-“আপনেরা যে যাই বলেন আমার সোহেলের আমার জন্য অনেক ভালোবাসা। শুধু আমাকে সঙ্গ দিব দেইখা আমার খিতা দূরে যাইবোনা বইলা বেশিদূর পড়ালেখা করলোনা। এখন পোলা আমার বাঁচা মরার মাঝখানে। কেন এমুন করলো সোহেলে? আম্মাজান, কনতো কেন এমুন করলো?”
এবার শুভ্রার চোখদুটোও ভিজে যায়। সালিম সাহেবের কথা সত্য। সোহেল বাস্তবিক বাবাকে ভীষণ ভালোবাসে। শুভ্রা বাবাকে শান্তনা দিলো-“নিজেকে সামলান আব্বা। ভাইয়া ঠিক হয়ে যাবে।”
কিছুটা সময় দু’জন চুপ করে রইলো। শুভ্রা উঠে দাঁড়ায়-“বাসায় যাই আব্বা। আম্মার কি হাল দেখি। আমি আছি কয়েকদিন।”
সালিম সাহেব ধীরলয়ে মাথা দুলালেন।

*****

ইব্রাহিম নিবাস ভুতুড়ে বাড়ির মতো নিস্তব্ধ। সবসময় জমজমাট হয়ে থাকা বাড়িটা আজ মৃতপ্রায়। শুভ্রা অন্যমনস্ক হয়ে কিছুক্ষণ এদিক সেদিক ঘুরলো। বাড়িতে আজ প্রায় সবাই আছে তবুও কোন আওয়াজ নেই। মায়ের কাছে বসলে খুনখুন করে কাঁদে। শুভ্রা কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে এসেছে। শরীফ বাবার সাথে হাসপাতালে। শুভ্রা ছোট চাচার ঘরে উঁকি দিলো। তাহের শুয়ে শুয়ে মোবাইল কিছু একটা দেখছিলো। শুভ্রাকে দেখে অবাক হলো-“তুই কখন এলি?”
শুভ্রা ভেতরে ঢুকে হাসলো-“দুপুরের আগেই এসেছি। হাসপাতাল ঘুরে এলাম তাই দেরি হলো।”
তাহেরের মুখটা অন্ধকার হলো-“তুই তাহলে সব জেনেই এসেছিস। তোর বর আসতে দিলো?”
শুভ্রা হেঁটে এসে চাচার বিছানায় বসলো। তাহের উঠে বসেছে ততক্ষণে। শুভ্রা মাথা নাড়লো-“আসতে দিতে চায়নি। ক্যাওয়াজ করে আসতে হয়েছে।”
তাহের ভাগ্নিকে মন দিয়ে জড়িপ করলো-“ছেলেটা কিন্তু ভালো। শুধু শুধু ওর সাথে ঝামেলা করিস না।”
শুভ্রা ভাবুক হয়ে চাচার পানে চাইলো-“সত্যি বলছো? তোমার মনেহয় সে ভালো মানুষ?”
তাহের হাসলো-“এই পরিবার ওমন জামাই পাওয়ার যোগ্য না। তোরা হচ্ছিল ডাকাবুকো, সে ভদ্রলোকের ছেলে। কোনভাবেই ম্যাচ হয় না।”
শুভ্রা খিলখিল করে হাসলো কিছুক্ষণ-“তোরা বলছো কেনো? তুমি এমনভাবে বলছো যেন তুমি এ পরিবারের কেউ না। তাছাড়া নিজের পরিবারকে ডাকাবুকো বলছো। বাবা চাচ্চু কি করেছে বলো তো?”
তাহের গুম হয়ে বসে রইলো। শুভ্রা চাচাকে দেখছে চুপচাপ। তাহের ওদের চোখে ভীষণ রহস্যময় একজন। বিয়ে থা করেনি কখনো, বাড়ির কেউ বলেওনা। নির্ঝন্ঝাট থাকতে পছন্দ করে। শুভ্রা হঠাৎ করে জানতে চাইলো-“চাচ্চু, একটা সত্যি কথা বলবে?”
তাহের অবাক চেয়ে মাথা নাড়লো। শুভ্রা বললো-“তুমি বিয়ে করলে না কেন? কাউকে পছন্দ করতে?”
তাহের চমকে উঠলেও নিজেকে সামলে নিলো। ধীর স্বরে বললো-“ঘর সংসারের ঝামেলা ভালো লাগে না। বিয়ে মানেই ঝামেলা। একা একা বেশ আছি। কোন পিছুটান নেই ঘ্যানঘ্যানানি নেই।”
শুভ্রা কথা বাড়ায় না। জানে চাচার কথাগুলো সত্য না। কিন্তু কথা বাড়াতে মন চাইলো না বলে নিজের কামড়ায় ফিরে এলো।

সোহেলের অবস্থা পরিবর্তন হয়নি। সালিম সাহেব কাল থেকে হাসপাতালেই আছেন। রিমা ক্ষণেক্ষণে ছেলের কথা বলে মুর্ছা যাচ্ছে। বড় চাচী তাকে সামলাতে ব্যস্ত। একমাত্র তুলতুল খুব বেশি স্বাভাবিক। সে তিনবেলা নিয়ম করে খাবার খাচ্ছে। নিজের রুমে ঘুমাচ্ছে। তাকে বেশ সুখী দেখায়। সকাল সকাল শুভ্রাকে দেখে বললো-“আপা, যদি কিছু মনে না করেন আপনার ফোনটা আমাকে দেবেন? মার সাথে একটু কথা বলতাম।”
শুভ্রা অবাক হলেও সাথে সাথে ফোন বের করে দিলো। তুলতুল দ্রুত হাতে মায়ের নাম্বারে ফোন দিলো। কয়েকবার চেষ্টা করার পর ওপাশ থেকে যখন কেউ ফোন তুললো তুলতুল হড়বরিয়ে উঠলো। কথা বলতে বলতে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে যা বললো তাতে শুভ্রার চোখ কপালে উঠলো। দশ মিনিট কথা বলে লজ্জিত মুখে শুভ্রাকে ফোন ফিরিয়ে দিলো। শুভ্রা হতচকিত হয়ে ফোন হাতে নিয়ে বললো-“ভাবি, ভাইয়া হাসপাতালে থাকার পরেও তুমি এতো স্বাভাবিক? ভাইয়া কি তোমাকে জোর করে তুলে এনেছে? প্লিজ ভাবি, আজ কোন মিছে কথা বলো না।”
তুলতুল অসহায় হাসলো-“বেশি কিছু বলবো না। শুধু বলবো, আপনার ভাইকে আমি আমার জীবনের চাইতে বেশি ঘৃনা করি। এতোটাই ঘৃনা করি যে সে মারা গেলে আমি একটুও দুঃখ পাবো না। বাকীটা আপনি বুঝে নেন আপা।”
শুভ্রা হতবুদ্ধি হয়ে তুলতুলের দিকে তাকিয়ে রইলো। রণর কথাগুলো তাহলে সত্যি? সে কি করে এতোটা অবুঝ হয়ে থাকে? আব্বা কি তাহলে এই কারনেই ওকে সারাজীবন দূরে দূরে রেখেছে? ও যাতে কিছু টের না পায়? শুভ্রা নিজের কামরায় ফিরে এলো ধীর পায়ে।

সন্ধ্যা নাগাদ সোহেলের কোমায় চলে যাওয়ার খবর এলো। বাড়ির পরিবেশ আরও ভারী হয়ে উঠলো। আত্মীয়স্বজনরা ভীড় করতে শুরু করলো। সালিম সাহেব বিদ্ধস্ত চেহারা নিয়ে ঘরে ফিরে এলো। তাকে হতবিহ্বল লাগে। শুভ্রার হাসফাস লাগছে এমন গুমোট পরিস্থিতি। মন চাইছে ঢাকায় ফিরে যেতে। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে ঢাকায় যাওয়া খারাপ দেখায়। আসলে তার বাবাকে এরকম অবস্থায় আগে কখনো দেখেনি সে। তাই কোথায় যেন হাহাকার টের পায়। সোহেল যত খারাপ হোক তার ভাই হয়।রক্তের সম্পর্ককে অস্বীকার করা যায় না কিছুতেই। সবকিছু মিলিয়ে ভীষন হিজিবিজি পরিস্থিতি। এমন অবস্থায় হুট করে রণর ফোন-“শুভ্রা, কি অবস্থা সোহেল ভাইয়ের?”
শুভ্রা ফিসফিস করলো-“ভাইয়া কোমায় চলে গেছে মিস্টার রণ। এবার আপনি খুশি তো?”
রণ চুপ করে থেকে বললো-“কারো দুঃখে দুঃখবিলাস করার মতো মানুষ আমি না এটা আপনার জানা উচিত। যা হোক আপনাকে এসব বলা অর্থহীন। কাজের কথা বলি। আপনার বাবাকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করার দাবী উঠেছে। কালকের মধ্যে হয়তো ঘোষণা দেওয়া হতে পারে। আফটারঅল উনি আমার শশুর তাই কথাটা আপনাকে জানানো। ধাক্কাটা ওনার জন্য বেশি হতে পারে। ভাবলান আগেভাগে জানিয়ে রাখলে আঘাত কম পাবে।”
শুভ্রা দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিস করলো-“এই মহান কাজটা নিশ্চয়ই আপনি করছেন?”
রণ প্রথম অবাক তারপর উচ্চস্বরে হো হো করে হাসলো-“সত্যি মাথা খারাপ আপনার। নিজের বাপ ভাইয়ের আগে কিছু দেখেন না দেখছি। কোথায় আপনাদের ভালো ভাবলাম বলে কৃতজ্ঞতা দেখাবেন তা না সবসময়ের মতো আমাকেই দোষী বানানোর পায়তারা।”
রণর কথা শুনতে শুনতে শুভ্রা দ্রুত বাবাকে দেখলো। চুপচাপ শুয়ে আছে বিছানায়। মানুষটা এমনিতেই ছেলের দুঃখে কাতর। এমন অবস্থায় পার্টির খবর শুনলে কি হতে পারে ভেবে ভয় পেলো শুভ্রা। মাথায় জট পাকিয়ে যাচ্ছে সব ভাবনারা। শুভ্রা দ্রুত গতিতে ভেবে চলেছে-“শুনুন, বাবাকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করার ব্যাপারটা আপনি দেখুন। এই মুহুর্তে এমন কিছু হলে বাবাকে কিছুতেই সহ্য করতে পারবেন না।”
রণর গম্ভীর স্বর শোনা গেলো-“আর এসব আমি কেন করবো? কি লাভ আমার?”
“লাভ!” শুভ্রা যেন স্বগতোক্তি করলো।
“হ্যা, আমার কি লাভ এসব করে। কেনইবা করবো?”
রণ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো। শুভ্রা ঠোঁট কামড়ে ধরলো। রণ এমন কিছু বলবে আগে বোঝেনি। সে কিছু একটা ভেবে নিলো-“আপনার শর্ত মেনে নেব। পরিবারের সাথে সম্পর্ক ছেদ করবো আমি। আপনি বাবাকে এবারের মতো বাঁচিয়ে নিন আমি আমার পরিবারের সাথে সব সম্পর্ক ত্যাগ করবো।”
রণর কন্ঠস্বর ভারী হলো-“ভেবে বলছেন তো?”
শুভ্রা ঠোঁট দু’টো চেপে ধরে রাখলো তিরিশ সেকেন্ড। তারপর মাথা দুলায়-“হ্যা, ভেবে বলছি।”
“ঠিক আছে। ঠেকিয়ে নেব এবারের মতো। আপনি কাল সকাল সকাল চলে আসবেন এ বাড়ি। মা আপনার কথা বলছিল আজ। আপনাকে কাল বাসায় দেখতে চাই।”
একবার মানা করতে যেয়ে থমকে গেলো শুভ্রা, বললো-“ঠিক আছে। কাল চলে আসছি।”
রণ শেষ বারের মতো জানতে চাইলো-“ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তো শুভ্রা? পরে আবার নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে যাবেন নাতো?”
“একদম না। আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকবো। আপনি ভাববেন না। আর যদি না থাকতে পারি তাহলে আপনার যা সাজা দেবেন মাথা পেতে নেব।”
রণ অবাক গলায় বললো-“সত্যি তো!”
“সত্যি সত্যি সত্যি। তিনবার বললাম। চলবে?”
শুভ্রার কথায় চুপ করে গেলো রণ। খানিকক্ষণ বাদে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো-“রাখছি।”

চলবে।

#দর্পহরন
#পর্ব-৩৯

“রাগীব, তুমি এতো রাতে? কোন বিশেষ দরকার?”
নেত্রী অবাক কন্ঠ শুনে রণ চুপ করে রইলো। উনি সাধারণ ঘরোয়া পোশাকে দাঁড়িয়ে। রণ খানিকটা নার্ভাস হলো-“ফুপু, একটা বিষয়ে কথা ছিলো।”
নেত্রী বুঝলেন রণ কোন বিষয় নিয়ে কথা বলবে। উনি সোফায় বসে রণকে হাতের ইশারায় ডাকলেন-“বসো। কি বলবে বলো।”
“ইব্রাহিম সালিমের বহিস্কারের চিন্তা বাদ দেওয়া যায় না ফুপু? উনি দীর্ঘদিন আপনার সাথে আছে। তাছাড়া ওনার ছেলে সোহেল তো কোমায় চলে গেলো। মনেহয় না সে বেঁচে ফিরবে। আর ছেলেকে হারাতে হলে এটাই ওনার জন্য বড় শাস্তি হবে। এরচেয়ে বড় কোন শাস্তি হয় না আর।”
নেত্রী চুপ করে রইলো কিছু সময় তারপর বললো-“আমি তো তোমার জন্য ওকে শাস্তি দেওয়ার কথা ভাবছিলাম। আজ মারার জন্য হামলা করেছে কাল হয়তো মেরেই ফেলবে। ও সাংঘাতিক মানুষ, ওর কাছে সম্পর্কের কোন ভ্যালু নেই। নিজের প্রয়োজনে ছেলেমেয়েকেও তুচ্ছ করতে পারে। তবুও তুমি যখন বলছো তখন বিষয়টা আপাতত মুলতবি রাখবো। ওর এ্যাকটিভিটি দেখবো। খারাপ কিছু পেলে এ্যাকশন নেব। তখন কিন্তু কিছু বলা যাবে না?”
রণর মুখে হাসি ফুটলো-“থ্যাংক ইউ ফুপু।”
নেত্রী হাসলেন। হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন-“চন্দ্রের কাজ কেমন লাগছে? ও কি পারছে প্রজেক্ট হ্যান্ডল করতে?”
“পারছে ফুপু, বেশ ভালো ভাবেই পারছে। এ ব্যাপারে চন্দ্রর দক্ষতা আছে।”
রণর কথা শুনে নেত্রীর মুখ পরিতৃপ্তির হাসি দেখা গেলো-“ও তোমার কথা খুব বলছে। তুমি যে ভীষণ ধৈর্য্য নিয়ে ওকে সব শিখিয়ে দিচ্ছ সেটাও বলেছে ও।”
রণ লাজুক হাসলো-“আমি শুধু আমার কর্তব্য করেছি ফুপু। চন্দ্র এমনিতেই সব পারছে।”
“ওটা তোমার বড়ত্ব। তারপর বলো বউ কেমন আছে? বউয়ের সাথে সব ঠিক আছে তো?”
হুট করে ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ আসায় রণ সংকোচ বোধ করে। কি বলবে ভেবে পেলো না। নেত্রী বললেন-“বেশি সমস্যা মনে করলে সমস্যা সমুলে উপরে ফেলো। এসব বিষয়ে মায়া করতে নেই। মায়া করলে সারাজীবন ধরে পস্তাতে হয়। না বনলে জোর করে ধরে রাখবে কেন? সব ছেড়ে নতুন করে সব শুরু করো।”
“আর কিছুদিন দেখবো ফুপু৷ তারপর একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারবো আশাকরি। আপনি তো জানেন সবই। সালিম সাহেবকে আমি আসলে কোনভাবেই সহ্য করতে পারি না। কিন্তু কি আর করা।”
নেত্রী আশ্বস্ত হলেন-“বেশ ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছ।”
রণ বিদায় নিতে উঠে দাঁড়ায়-“আজ আসি ফুপু। আপনাকে এতো রাতে বিরক্ত করলাম বলে দুঃখিত।”
“এর শাস্তি পেতে হবে তাহলে। শুধু দুঃখ প্রকাশ করলে হবে না।”
“জ্বি ফুপু। যা বলবেন করবো।”
“ভেবে বলছো তো? না হলে কিন্তু এই কথা দেওয়ার জন্য বিপদে পড়বে।”
নেত্রীর কন্ঠে কৌতুক। রণকে কিছুটা বিভ্রান্ত লাগে। তা দেখে নেত্রী হাসলো-“বাড়ি যাও। না হলে মা টেনশন করবে আবার।”
রণ যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। সে প্রায় পালিয়ে এলো তার ফুপুর কাছ থেকে।

*****

সকাল হতেই শুভ্রার তৈরি হয়ে বাবার সামনে দাঁড়ায়-“আব্বা, আমি যাচ্ছি।”
সালিম সাহেব ঘোলা চোখে তাকায় মেয়ের দিকে-“কই জান আম্মা?”
“বাসায় যেতে হবে আব্বা। ওনার কোথাও যাওয়ার কথা আছে। আমাকে ডেকেছেন উনি।”
ভ্রু কুঁচকে শুভ্রার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো সালিম সাহেব। কথা বুঝতে পেরে স্তিমিত কন্ঠে বললো-“আব্বাকে এই অবস্থায় ফেলে চলে যাবেন?”
বলে থেমে গেলেন সালিম সাহেব। তারপর কি ভেবে বললেন-“যান। কারো জন্য তো জীবন থাইমা থাকো না। তবে আপনি কাছে থাকলে আপনার আব্বা সাহস পায়।”
শুভ্রা কম্পিত গলায় জবাব দিলো-“শরীফ ভাই আছে, চাচা আছে। আপনি চিন্তা করবেন না আব্বা। তাহের চাচা বললো সোহেল ভাইকে সিঙ্গাপুর নেওয়ার ব্যবস্থা করছে। ভাই ভালো হয়ে যাবে।”
সালিম সাহেব চুপ করে থাকলেন। তার মাথা নিচে ঝুঁকে আছে। বাবাকে ওরকম অসহায় অবস্থায় দেখে বুকটা হুহু করে উঠলো শুভ্রার। নিজেকে অতি দ্রুত সামলে নিয়ে বাবার নিকটে এসে দাঁড়ায়-“আমি যাই আব্বা। দোয়া করবেন আমার জন্য।”
“আব্বাকে মাঝে মাঝে দেখতে আইসেন আম্মা। এই বুড়া সন্তানকে ভুলে যাইয়েন না।”
শুভ্রা অনেক কষ্টে দাঁতে ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না আঁটকালো। তার কেন যেন খুব কান্না পাচ্ছে। বাড়ির মানুষদের চাইলেও আর দেখতে পাবে না সেই কষ্টে নাকি আর কোনদিন এ বাড়ি আসতে পারবে সেই কষ্টে কান্না আসছে সেটা সে জানে না। শুভ্রা বাবার পা ছুঁয়ে উঠে দাঁড়ায়-“আব্বা, আপনার মেয়ে খুব ভালোবাসে আপনাকে। যত দূরেই থাকি না কেন আপনার কথা সবসময় স্মরনে থাকে। আপনি আমার জন্মদাতা, নিজেকে ভোলা গেলেও আপনাকে ভোলা সম্ভব না৷ আসি আব্বা।”
শুভ্রা ছুটে বেড়িয়ে এলো বাপের রুম থেকে। কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা নিচে নেমে গাড়িতে উঠে বসলো। তার চোখ থেকে টপটপ করে জল ঝরছে। না পেরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো সে।

*****

শুভ্রাকে দেখে মোটেও খুশি হলো না জলি। মুখে অন্ধকার নেমে এলো। ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করা দূর শুভ্রার সালামের উত্তরও দিলো না। মুখ ফিরিয়ে নাস্তা করায় মন দিলো। শুভ্রা বাসা থেকে নাস্তা না করেই বেরিয়েছিল। এখন খাবার দেখে ওর খিদে পেয়ে গেলো। কাপড় না পাল্টেই ডাইনিং এ বসলো। প্লেট টেনে পরোটা আর আলুভাজি নিয়ে খেতে শুরু করলো। জলি ওকে খেতে দেখে মুখ বাঁকাল। অন্য সময় হলে নিজ থেকেই ওকে খেতে দিত। শুভ্রার খটকা লাগলেও পাত্তা দিলো না। হঠাৎ জলি বললো-“তা এবার কি পরিকল্পনা করে এলো?”
“জ্বি!”
জলির কথার মানে না বুঝতে পেরে শুভ্রা অবাক হয়ে তাকায়। জলি ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো-“একেবারে নাদান। এমন ভাব করছো যেন কিছু বোঝ না?”
শুভ্রা মুখ হা করে জানতে চাইলো-“মানে কি? কি বুঝবো? আমি সত্যি কিছু বুঝতে পারছি না।”
জলি কঠিন মুখ করে তাকিয়ে থেকে বললো-“বলছি বাবা ভাইদের সাথে বসে কি পরিকল্পনা করে এলে? গুলি করে মারবে নাকি তুমি নিজে খাবারে বিষ মিশিয়ে মারবে আমার ছেলেকে?”
শুভ্রা হতভম্ব, ও চোখ গোল করে তাকিয়ে আছে-“এসব কি বলছেন উল্টো পাল্টা?”
“কেন? ভুল কিছু বলেছি? আমার ছেলেকে মেরে ফেলতে চাও না তোমরা?”
শুভ্রা কি বলবে ভেবে পেলো না। শান্তশিষ্ট জলির এমন কঠিন রুপ সে আগে দেখেনি। সে হতবিহ্বল হয়ে বললো-“আন্টি, এসব কি বলছেন? উনাকে কেন মেরে ফেলতে চাইবো আমি? আপনার কোথাও বুঝতে ভুল হয়েছে।”
জলি তীক্ষ্ণ নজরে শুভ্রার পানে চেয়ে থেকে বললো-“এতোদিন ভুল বুঝলেও এখন ঠিকঠাক বুঝতে পারছি তোমাকে। জোর করে কান্নাকাটি করে নিজেকে অসহায় প্রমান করে কেন আমার ছেলেকে বিয়ে করেছিলে তা এখন আয়নার মতো পরিস্কার আমার কাছে। আমি ভেবেছিলাম, হাজার হোক মেয়ে তুমি। বাবা ভাইদের মতো হবে না। নিজের স্বামীকে আগলে রাখবে, ভালোবাসবে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। আমার রণ কিছুতেই বিয়ে করতে চায়নি তোমাকে। কি কুক্ষণে তোমার মায়ায় পড়েছিলাম। ছেলেটাকে বাধ্য করলাম বিয়ে করতে। ছেলেকে শত্রুর হাত থেকে বাঁচাতে তোমার সাথে বিয়ে দিলাম এখন ঘরের মধ্যে শত্রুর বাস। আমার ছেলেটার জীবন আমি নিজ হাতে আরেকজনের হাতে সঁপে দিয়েছি। মা হয়ে এই দুঃখ কোথায় রাখি।”
শুভ্রা নিশ্চুপ বসে থাকে। সে এতোটাই অবাক জলির আচরণে যে কোন কথাই মাথায় আসছে না। নিজেকে কেমম বোকা বোকা লাগে। জলি হঠাৎ পাল্টে গেলো কেন? সেদিন পর্যম্ত তো ঠিকই ছিলো। আজ শুভ্রাকে বিশ্বাস করছে না কেন? শুভ্রা নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করলো-“আন্টি, আপনি কেন এসব উল্টোপাল্টা বলছেন? কি করেছি আমি?”
জলি প্লেট ঠেলে উঠে দাঁড়ায়-“আর সাধু সেজো না মেয়ে। তোমার ভাইয়ের কীর্তি দেখে ফেলেছি আমি। এবার নিশ্চয়ই তোমার বাবা তোমার উপর দায়িত্ব দিয়েছে আমার ছেলেকে মেরে ফেলার? জেনে রাখো এমনটা করার সুযোগ তুমি কিছুতেই পাবে না। আমি যেমন নিজ থেকে তোমাকে আমার ছেলের জীবনে এনেছিলাম ঠিক তেমন করে তোমাকে ওর জীবন থেকে দূরে ঠেলে দেব। আমার ছেলের জীবন নিয়ে আর কাউকে খেলার সুযোগ দেব না। বুঝলে মেয়ে?”
জলি উঠে চলে গেলো। শুভ্রা ঠায় বসে রইলো টেবিলে। এসব কি কি বলে গেলো আন্টি ওকে! নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না। পেটে খিদে থাকলেও মুখে রুচি নেই। নাস্তা করার ইচ্ছেই উবে গেছে। শুভ্রা প্লেট ঠেলে উঠে দাঁড়ায়। মাথা ফাঁকা লাগছে। বুক ঠেলে কান্না উগলে আসছে। রণর শর্ত মেনে মনে মনে বাবার বাড়ি থেকে চিরবিদায় নিয়ে এখানে এসেছে। এখন এখানে এমন উল্টো পাল্টা শুনে মাথা ঘুরছে ওর। কি হচ্ছে ওর সাথে এসব? কোন গোলকধাঁধার চক্করে পড়ে গেছে সে? ভালো লাগছে না কিচ্ছু। শুভ্রার হঠাৎ উথালপাথাল কান্না এলো। সে ছুটে রুমে ঢুকে বিছানায় আছড়ে পড়ে হুহু কান্নায় ভেঙে পড়লো।

রণ আজ অন্যদিনের চেয়ে কিছুটা আগেভাগেই বাড়ি ফিরেছে। মনে ক্ষীন আশা আজ শুভ্রাকে দেখতে পাবে। মেয়েটার সাথে খুনসুটি বেশ মজা লাগে রণর। কিন্তু বাসায় ঢুকে মনে হলো শত্রু শিবিরের দূর্গে ঢুকেছে। এতো নিরব হয়ে আছে বাড়ি। সাধারণত শুভ্রা বাসায় থাকলে হাসিখুশিও আনন্দে থাকে। কিন্তু আজ যেন সবাই চুপচাপ। মায়ের সাথে দেখা করে নিজের কামরায় ফিরলো রণ। ঘর অন্ধকার হয়ে আছে। বাতি জ্বালাতেই দেখলো শুভ্রা গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। হাতটা চোখের উপর রাখা। পুরো মুখটা দেখা যাচ্ছে না। রণ বিস্মিত হলো। শুভ্রা ইদানীং তার জন্য জেগে থাকত। আর আজ তো আরও ঘুমানোর কথা না। কেন ঘুমিয়ে পড়লো। রণর মন চাইলো ওকে ডেকে তুলতে। কিন্তু শুভ্রা যদি আবার রাগ করে এই ভয়ে ডাকলো না। উল্টো পায়ের কাছে রাখা চাদরটা ওর গায়ের উপর টেনে দিয়ে দীর্ঘশ্বাষ ফেলে উঠে দাঁড়ায়। কোথায় ভেবেছিল আজ শুভ্রাকে জ্বালাবে কিন্তু না ম্যাডাম ঘুমিয়ে গেছেন।

শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে আসতেই দেখলো শুভ্রা বিছানায় উঠে বসেছে। ওকে দেখে ঘুমঘুম চোখে একবার তাকালেও কোন কথা বললো না। রণর ভ্রু কুঁচকে গেলো। কিছু কি হয়েছে শুভ্রার? কথা বলছে না কেন ওর সাথে? রণ এগিয়ে শুভ্রার কাছাকাছি দাঁড়ায়-“কখন এসেছেন?”
তবুও জবাব দেয় না শুভ্রা। ঘোলাটে দৃষ্টিতে রণর দেখছে যেন ওকে চিনতে পারছে না। রণ টের পেলো শুভ্রার গালে শুকনো জলের রেখা। মেয়েটা ঘুমানোর আগে কাঁদছিল নাকি? শর্ত অনুযায়ী আর বাড়ি যাওয়া হবে না শুভ্রার এই ভেবেই কাঁদছিল কি? মন বিগলীত হলো রণর, শুভ্রার কাছাকাছি এসে বসলো-“কি হয়েছে শুভ্রা? কথা বলছেন না কেন?”
শুভ্রা কিছু না বলে মাথা নাড়লো। রণ অস্থির হয়ে উঠলো-“আরে হলো কি আপনার? কথা বলছেন না কেন? সারাদিন কাজ করে বাসায় এসে কি একটু শান্তি পাবো না? কি চাইছেনটা কি আপনি? কি হয়েছে বলবেন তো?”
“আন্টি আন্টি আজকে…”
শুভ্রার গলা কেঁপে উঠলো। আবারও কান্না পাচ্ছে তার, কথা আঁটকে আসছে। জলির বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেলো। কেন ওসব বললো আন্টি? রণ শুভ্রাকে দেখে বিস্মিত হয়ে-“মা! মা কি করেছে? সে তো ঠিক আছে দেখলাম।”
শুভ্রার চোখ ছলছল হয়। সে রণর মুখের দিকে তাকায়। ঠোঁট দু’টো চেপে আছে। রণ বিরক্ত হয়ে বললো-“কাঁদছেন কেন? বাড়ি ছেড়ে আসার প্রথমদিনই এই অবস্থা? তাহলে বাকী দিনগুলো কিভাবে কাটাবেন?”
বলতে বলতে হেসে দিলো রণ। শুভ্রা এবার অদ্ভুত একটা কাজ করলো। রণকে ভীষণ রকম চমকে দিয়ে আচমকা ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো।

চলবে—
©Farhana_Yesmin

তুমি দর্পহরন পর্ব-৩৪+৩৫+৩৬

0

#দর্পহরন
#পর্ব-৩৪

“আপা, আমি খুব রাগ করলাম। আপনি আমাকে একদমই ভুলে গেছেন। আগে সকাল বিকাল ফোন দিয়ে এটা সেটা আবদার করতেন আর এখন তিনমাস পার হয়ে যায় আপনি আমার একটা খবর নেন না। আমি কি পুরনো মানুষ হয়ে ভুল করেছি?”
সালিম সাহেব প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় আকুতি জানায়। প্রধানমন্ত্রী মৃদুস্বরে হাসে-“সালিম, তুমি শুধু শুধু আমাকে ভুল বুঝতেছ। তোমার উপর আমি কেন রুষ্ট হবো? যদি রুষ্ট হইতাম তাহলে কি তোমাকে পাশে বসাইতাম?”
সালিম সাহেব কথা খুঁজে পায় না। নেত্রী থেমে থেকে বললো-“কিন্তু এটাও ঠিক আমি তোমার কাজে রুষ্ট হয়েছি। এতো বেশি অভিযোগ ছিল তোমার বিরুদ্ধে। সবাই বলতো আমার আশকারায় নাকি তুমি এতো সাহস পেয়েছ। তাই বাধ্য হয়ে নতুন কাউকে তোমার জায়গায় দিয়েছি। কি জানো, বর্তমানে তরুণ প্রজন্ম হিংস্রতা পছন্দ করে না। অতিরিক্ত দূর্নীতি, ক্ষমতায়ন এসবে তাদের এলার্জি আছে। সেই মতো চলার চেষ্টা করো।”
সালিম সাহেব খুশি হয়ে গেলো-“আপা, আপনি একদম চিন্তা করবেন না। দেখবেন আপনাকে অভিযোগের কোন সুযোগ দেব না।”
“সুযোগ না দিলে ভালো সালিম। রাগীব ছেলেটা অল্প বয়স হলেও বেশ গুছিয়ে কাজ করে। সবচেয়ে বড় কথা ও ক্লান্ত হয় না। দেখোনা এতো বড় সম্মেলন গেলো কোন ধরনের কোন অনু্যোগের সু্যোগ রাখেনি। আর এই তিনমাসে একটা অভিযোগ আসেনি তাকে নিয়ে। কাউকে সু্যোগই দিচ্ছে না।”
প্রধানমন্ত্রী মুগ্ধ চোখে রণকে দেখলো। সে তখন মাইকে ঝাঁঝালো বক্তব্য দিচ্ছে। লোকের তুমুল করতালিতে কান তালা লেগে যায় সালিম সাহেবের।
“এখান থেকে ঢাকায় যাওয়ার জন্য এক্সপ্রেসওয়ে নির্মান হবে সালিম। আর এটা কোন বিদেশি কোম্পানি করবে না। চন্দ্রানীকে তো দেখেছ। ও এসব নিয়ে পড়ালেখা করেছে। ভাবছি ওকে আর রাগীবকে এ কাজের জন্য কনসাল্টেন্ট নিয়োগ দেব। দু’জনেরই প্রচুর এনার্জি। ভালো ভাবে পরিদর্শন করে কাজ করাতে পারবে।”
“জ্বি আপা।”
ক্ষীনকন্ঠে উত্তর দিলো সালিম সাহেব। বক্তব্য দেওয়ার জন্য নাম ঘোষণা হতেই নেত্রী উঠে গেলো। সালিম সাহেব টের পেলো কিছুক্ষণ পর একের পর ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে নেত্রী ওরফে প্রধানমন্ত্রী। বারবার আকারে ইঙ্গিতে এটাই পরিস্কার করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন এলাকায় নেতা হিসেবে রণর জুরি মেলা ভার। সামনে একপ্রেসওয়ে নির্মান হবে তারপর বন্দরকে আর্ন্তজাতিক মানের বন্দর হিসেবে তৈরি করা হবে, একটা আন্তর্জাতিক শিপিং কোম্পানি এখানে ইনভেস্ট করতে চায়। এসবের পুরো কৃতিত্ব রাগীবের। সে এলাকার যোগ্য নেতা হিসেবে নিজেকে প্রমান করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

প্রশংসা বানী শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা সালিম সাহেবের। এলাকার লোকের উচ্ছ্বাস দেখার মতো। প্রাবনের মতো লোক আসছে। সালিম সাহেব শুকনো চোখে জনস্রোতে তাকালো৷ সোহেল সামনের দিকেই দাঁড়িয়ে আছে। বাবাকে তাকাতে দেখে হাত নাড়লো। সালিম সাহেব সে হাত দেখতে পেলো কিনা বোঝা গেলোনা। পাশ থেকে বিভিন্ন মন্তব্য কানে আসছে তার। মেজাজ খারাপ হচ্ছে। গত তিন মেয়াদে ইব্রাহিম পরিবার কি কি জুলুম করেছে সে বিষয়ে টুকরো টুকরো সংলাপ কানে আসছে। কেউ কেউ বলেই দিলো নেত্রী আর ইব্রাহিম পরিবারের কাউকে নমিনেশন দেবে না। নতুন মন্ত্রী ভালো কাজ করতেছে তাকেই রাখবে। মেয়র হিসেবেও নতুন কাউকে দেবে। সালিম সাহেবের পর আর কেউ নাইও যে ভালো নেতৃত্ব দেবে। কাজেই ইব্রাহিম পরিবার শেষ, ওদের রাজনৈতিক জীবন শেষ। এসব শুনে সোহেলের মধ্যে ক্ষোভ দানা বাঁধছিল সোহেলের মধ্যে।

পরের আধাঘন্টায় নেত্রী যখন ব্যবসায়ীদের সাথে মিটিং করলো তাতে রণ এলাকার নেতা হিসেবে নিরঙ্কুশ সাপোর্ট পেয়ে গেলো তখন সালিম সাহেবও চমকে গেলো। তাকে কথা দেওয়া মানুষগুলোও যখন রণর দিকে ঝুঁকে গেলো তখন সে সত্যিই হতাশ হয়ে গেলো। ভ্যাবাচ্যাকা দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইলো। বাপের নাজেহাল অবস্থা দেখে সোহেল ভেতরে ভেতরে ফুঁসছিলো। ওর ইচ্ছে করছে এখনই ছুটে গিয়ে রণর মাথা ফাঁটিয়ে দিতে। এর জন্য সব ঝামেলা পাকছে। ওদের ধ্বংস করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে রণ। আজ ওর একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। অদূরে বসে থাকা বাবাকে দেখে নিলো চোরা চোখে। চারপাশে তাকায়, তারপর ধীরে ধীরে মিটিং স্থল থেকে বেড়িয়ে গেলো।

*****

শুভ্রা হতবিহ্বল অবস্থায় আছে। জলির অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে তখনই চেচামেচি করে তন্ময়কে বিদায় করেছে। হাসিখুশিকে কাছের হাসপাতালে ফোন করে এম্বুলেন্স পাঠানোর কথা বলে নিজেকে রণর নাম্বারে ফোন দিচ্ছে। কিন্তু তার নাম্বার বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। মিহির কিংবা রাজীবের নাম্বার নেই তার কাছে। ছুটে এসে হাসিখুশির কাছে জানতে চাইলো, মিহির বা রাজীবের নাম্বার আছে কিনা। মিহিরের নাম্বার পাওয়া গেলো। কিন্তু মিহিরও ফোন ধরছে না। মাঝে মাঝে তার নাম্বারও আনরিচেবল বলছে। হাসিখুশি এরইমধ্যে ওদের মামাকে খবর দিয়েছে। জলিকে দ্রুত কাছেরই এক হাসপাতালে নেওয়া হলো। প্রতিমন্ত্রীর মা বলেই হয়তো দ্রুত চিকিৎসা পেলো জলি। আপাতত আইসিইউতে রাখা হয়েছে তাকে।

এদিকে একঘন্টায় রণ আর মিহিরকে ফোন দিতে দিতে মাথা নষ্ট হয়ে গেছে শুভ্রা। মাঝে বাবার নাম্বারেও চেষ্টা করেছে কিন্তু পায়নি। হঠাৎ কি ভেবে শরীফকে ফোন লাগায় শুভ্রা-“ভাইয়া, আব্বা কই?”
শুভ্রার ভয়ার্ত কন্ঠ শুনে শরীর উদ্বিগ্ন হয়ে বললো-“আব্বা সমাবেশে গেছে। কি হইছে শুভ্রা? এমন লাগছে কেন তোর গলা?”
“ভাইয়া, সর্বনাশ হয়ে গেছে। তন্ময় ভাই বাসায় আসছিল। উল্টা পাল্টা বলে গেছে আব্বার নামে। আজকে বলে আব্বা ওর কিছু করবে।”
শরীফের কিছুটা সময় লাগলো শুভ্রার কথা বুঝতে। ও অবাক হয়ে বললো-“কাকে কি করবে?”
শুভ্রা অস্থির হয়ে চেচিয়ে উঠলো-“তোমাদের বোন জামাইকে।”
শরীফ হেসে দিলো-“ধ্যাত, তুই এইসব বিশ্বাস করছিস কেন? আব্বা এইসব কিছু কেন করবে? তন্ময় নির্ঘাত তোকে ভয় দেখিয়েছে। কিন্তু ও তোর বাসায় গেছে কেন?”
“সে অনেক কথা ভাইয়া। তন্ময় ভাইয়া যে কি করেছে আজ। আমার শাশুড়ী এখন আইসিইউতে।”
শরীফ আঁতকে উঠলো-“কি বলছিস এসব? কি করে কি হলো?”
“সে অনেক কথা ভাইয়া। আমি ভাবছি উনি জানলে কি হবে। আমার খুব ভয় করছে ভাইয়া। কি করবো বুঝতে পারছি না। এদিকে ওনাকে অনেকক্ষণ ধরে ফোন দিয়ে বন্ধ পাচ্ছি। কোনভাবেই যোগাযোগ করতে পারছি না। ভাইয়া, তুমি কি একটু দেখবে কি অবস্থা?”
শুভ্রা হড়বড়িয়ে কথা বলে গেলো। শরীফ তাকে আশ্বস্ত করলো-“আমি দেখছি শুভ্রা। কোন প্রয়োজন হলে আমাকে বলিস। এখন কে আছে হাসপাতালে? আমি আসবো?”
“তুমি আমাকে ওর খবরটা দাও ভাইয়া। আন্টির জ্ঞান ফিরলেই ছেলেকে দেখতে চাইবে।”
“আচ্ছা, দেখছি আমি। তোকে জানাব।”
তবুও শুভ্রার মনটা খচখচ করছে। আজ হলো তাতে তার একদম মাঝ দরিয়ায় হাবুডুবু খাওয়ার মতো অবস্থা। তন্ময়ের ঘটনা রণ জানতে পারলে কি করবে সে জানেনা। মায়ের এমন অবস্থা দেখলে রণর কি প্রতিক্রিয়া হবে ভাবতেই গায়ে জ্বর চলে আসতে চাইছে শুভ্রার। আবার তন্ময়ের কিছু হলে জলি তাকে কি করবে সে জানেনা। জলির কাছে বিয়ের আর্জি নিয়ে এসেছিল একদিন। মানুষটা তার আর্জি মন্জুর করেছিল। আজ যদি তার কারণে তার ছেলেটার কিছু হয়ে যায় তাহলে জলির সাথে নজর মেলাতে পারবেনা আজীবন। ভীষণ অস্থিরতায় ডুবে রইলো শুভ্রা। পুরোটা সময় সে আনমনে পায়চারি করে গেলো।

*****

অঘটনটা ঘটলো নেত্রী গাড়িতে চড়ার মুহূর্তে। মুখে কাপড় বেঁধে কেউ একজন এগিয়ে আসলো। নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙে অস্থিরতা তৈরির জন্য কয়েকটা ককটেল বিস্ফোরণ ঘটালো। হুট করে একটা হুড়োহুড়ি শুরু হলো। নেত্রীকে তার নিরাপত্তা বহর ঘিরে ধরে গাড়িতে তুলে রওনা দিয়ে দিল। রণ ছিলো ঠিক তাদের পেছনে। পরের গাড়ি বহরে ঢাকা থেকে আগত মন্ত্রী আর দেশি বিদেশি আমলারা যাবে। সবার মধ্যে একটা অস্থিরতা শুরু হয়ে গেলো। রণ পরিস্থিতি বুঝে নিতে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে। মিহির সহ কয়েকজন ওকে ঘিরে আছে। মিহির ফিসফিস করলো-“ভাই, তাড়াতাড়ি গাড়িতে ওঠেন।”
রণ মাথ দুলিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দিলশাদ সাবধান করার পরেও আক্রমনের লক্ষ যে সে হতে পারে সেটা তার মাথায় ছিলো না। নেত্রীকে নিয়ে বিচলিত হয়ে ছিলো রণ। তার অসাবধানতার সু্যোগ নিলো সোহেল। ছোট একনলা স্বয়ংক্রিয় পিস্তলটি লোড করে খানিকটা আড়াল বেছে নিয়ে রণ বরাবর তাক করলো। তারপর চুক চুক করে আফসোস করলো-“বোনটার জন্য কষ্ট লাগতেছে। কিন্তু বাপের উপরে কিছু নাই। ক্ষমতার উপরে কোন সম্পর্ক নাই। আমার ভবিষ্যতের জন্য তোমার মরা জরুরি। টাটা বাইবাই।”
কিছুক্ষণ বাদে পরপর দু’টো গুলির আওয়াজ এলো।

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-৩৫

সোহেল গুলিবিদ্ধ। বুকের ডান পাশে একটা গুলি আর বা কাঁধে একটা গুলি লেগেছে তার। হাসপাতালে আনতে আনতে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। তার অবস্থা ক্রিটিক্যাল। সোজা অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়েছে। পুরো হাসপাতাল জুড়ে সাংবাদিক আর পুলিশে গিজগিজ করছে। কি ঘটেছে সে সম্পর্কে কেউ পরিপূর্ণ অবগত না হলেও প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠান পন্ড করার অভিযোগ আসবে অনুমান করা যায়। আর এটা মোটেও যা তা ব্যাপার নয়। সবমিলিয়ে একটা হুলুস্থল অবস্থা। সালিম সাহেব হতচকিত হয়ে এক কোনে বসে আছেন। তিনি এখনো ঘোরে আছেন। ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না কি ঘটেছে আর ঘটছে। সোহেল কেন ওখানে গেলো আর কেনইবা ওর উপর গুলিবর্ষণ হলো। পুরো বিষয়টা তার কাছে একটা ধোঁয়াশা। তিনি মাঝে মাঝেই হতবিহ্বল দৃষ্টি মেলে আশেপাশে তাকিয়ে দেখছেন আর চুপ মেরে যাচ্ছেন।

দু’টো ঘন্টা এভাবেই কাটলো। অবশেষে অপারেশন শেষে ডাক্তাররা বেরিয়ে এলো। জানা গেলো আটচল্লিশ ঘন্টার অবজারভেশনে রাখতে হবে সোহেলকে। রোগীর সিভিয়ার ব্রিডিং হয়েছে এখনো হচ্ছে। ব্লাড বন্ধ করা যাচ্ছে না কিছুতেই। দুই দিনের মধ্যে রোগী রেসপন্স করে কিনা দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে। সালিম সাহেব চুপচাপ সব শুনলেন। আবারও জায়গায় যেয়ে বসলো। ইতিমধ্যে খবর পেয়ে পুরো সালিম পরিবার হাসপাতালে উপস্থিত। মোর্শেদ বুঝে পাচ্ছে কি বলে ভাইকে শান্তনা দেবে। আজ সালিমের সাথেই ছিলো মোর্শেদ। হঠাৎ কাজ পড়ে যাওয়ায় সে চলে আসে। এরমধ্যে কি এমন হলো যে সোহেল এই কাজ করবে? এদিকে সাংবাদিকরা পাগল হয়ে আছে ইব্রাহিম পরিবারের সাথে কথা বলতে। নেত্রীর দীর্ঘদিনের মিত্র ইব্রাহিম পরিবারের সাথে কি এমন হলো যে এইরকম নাশকতার পরিকল্পনা হয়? রংচং মাখিয়ে নানা রসালো খবর করতে লাগলো টিভি চ্যানেলগুলো। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই ঘটনাটি টক অফ দা টাউন হয়ে গেলো।

*****

রণ মত পাল্টে ঢাকায় না ফিরে এলাকায় ফিরলো। তার বিহ্বল ভাব এখনো কমেনি। একটু ধাতস্থ হওয়া দরকার। এই অবস্থায় মায়ের কাছে যাওয়া ঠিক হবে না। মা সবসময় সাথে আসতে চায়। কাল অনেকবার বলার পরও আনেনি। এখন এসব শোনার পর কি বলবে তাই ভাবছে। তাছাড়া এখানে কিছু হিসেব মেলাতে হবে। কি ঘটেছে সেটা জানতে হবে। নেত্রীকে জবাব দিতে হবে, কথা গোছাতে হবে। রণ পায়চারি করলো ঘরে। সে সালিম সাহেবকে যতটা বুঝেছে তাতে এতটুকু জানে, নেত্রীর ব্যাপারে আপোষ করবে না। তাই নেত্রীর অনুষ্ঠানে তারই ছেলে হামলা করবে এটা কখনোই বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে না। হয়তো স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও এটা মানতে চাইবে না। তাহলে কি বোঝা যায়? কেন এমনটা করবে সোহেল? তাকে খারাপ বানানোর একটা পরিকল্পনা হতে পারে। সে নেত্রীর আসার ব্যাপার ঠিকঠাক হ্যান্ডেল করতে পারেনি সেটা প্রমানের চেষ্টা হতে পারে। যাতে তাকে নেত্রীর কাছে ব্যর্থ প্রমান করা যায় এবং এই কারনে তার মন্ত্রীত্ব চলে যায়। কিন্তু এটাও খুব স্ট্রং যুক্তি মনেহচ্ছে না। সে প্রতিদ্বন্দি, তাকে হারাতে অনেক কিছু করতে পারে সালিম সাহেব। কিন্তু নেত্রীর জানের উপর দিয়ে নয়। যুক্তি পাল্টা যুক্তি দিয়ে নিজেকে খন্ডন করলো রণ। অনেক ভেবে ফোনটা হাতে তুলে নিলো-“কোথায় আছিস তুই?”
“নিচে আছি ভাই।”
ওপাশে দিলশাদের বিস্মিত স্বর। রণ ডাকলো-“উপরে উঠে আয়। কথা আছে।”
এলাকায় থাকলে দিলশাদকে সাথে সাথে রাখে রণ। আজও ছিলো। দরজায় আওয়াজ হলো-“ভাই, আসবো?”
“আয় দিলশাদ, বোস।”
চেয়ারে বসার ইশারা দিলো। দিলশাদ অবাক হয়ে বসলো-“হঠাৎ ডাকলেন যে? কি হইছে?”
রণ দিলশাদকে দেখলো মন দিয়ে। তারপর আচমকা প্রশ্ন করে বসলো-“আজকের ঘটনা খুলে বলতো কি হয়েছিল?”
“আমি তো কিছু বুঝলাম না ভাই। হুরোহুরিতে আপনার সাথে চলে আসলাম।”
রণ মাথা নাড়ে-“উহু, অনেক ভেবে দেখলাম আমি। নেত্রী আছে এমন অনুষ্ঠানে সালিম সাহেব হামলা করবে এটা কাউকে মানাতে পারবোনা। কেউ বিশ্বাস করবে না।”
“কিন্তু আপনাকে বদনাম করার জন্য করতে পারে। ওই লোক সব করতে পারে আপনি জানেন।”
দিলশাদ উত্তেজিত হয়ে উঠলে রণ হাসলো-“সেটাও ভেবেছি জানিস? এমনটা করতে পারে আমিও বিশ্বাস করি কিন্তু নেত্রী যেখানে থাকবে সেখানে উনি এমন কিছু করতে দেবেন না৷ নেত্রীর প্রতি উনি বিশ্বস্ত চিরকাল এটা স্বয়ং নেত্রীও স্বীকার করে।”
দিলশাদ চুপ করে রইলো। রণ বললো-“তোকে কে সাহায্য করেছে দিলশাদ? আমি জানি কাজটা তোর। তবে তুমি একা না আরও কেউ ছিলো সাথে। আমি জানি সোহেল হলো বারুদ। বারুদে একটু ঘষা দিলেই কাজ হয়। এই ঘষাটা কে দিয়েছে জানতে চাই।”
দিলশাদ ধরা পড়া গলায় মিনমিন করলো-“ফাহিম।”
রণ হতবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বললো-“তুলতুলের ভাই!”
দিলশাদ হ্যা বোধক মাথা নাড়ে। রণ চুকচুক করলো-“কাজটা করার জন্য টাইমিংটা ঠিক বাছিসনি। এমন একটা অনুষ্ঠানে এসব না করলেও পারতি। নেত্রী নিজেই মানবে না। আর সালিম সাহেব যদি জানতে পারে তাহলে কি হবে ভেবেছিস? গোটা শহর জ্বালিয়ে দেবে। ছেলেকে কতটা ভালোবাসে সেটা টের পেয়েছিস? তার ছেলের যদি কিছু হয় তাহলে উনি কি করবে আমি ভাবতেই পারছিনা।”
দিলশাদ ভয় না পেয়ে সিনা টানটান করে বললো-“ভাই, ওনাকে আর ভয় পাই না। আর সোহেল সত্যি সত্যি আপনাকে গুলি করতো। এক সেকেন্ড দেরি হলে গুলিগুলো আপনার বুকে বিঁধতো।”
রণ চুপ করে রইলো দেখে দিলশাদ হাসলো-“আপনের বিশ্বাস হয় না তাই না? ভাবছেন, আপনি বোনজামাই আপনাকে এইরকম করবে কেন? ওরা খুব খারাপ ভাই। ওদের কাছে সম্পর্কের মুল্য নাই। ক্ষমতার চাইতে বড় কোন সম্পর্ক নাই। আমার কাছে ভিডিও আছে। দেখেন নিজের চোখে।”
দিলশাদ মোবাইল এগিয়ে দিলো। রণ দেড় মিনিটের ভিডিওটা দেখলো মন দিয়ে। তারপর মোবাইল ফিরিয়ে দিলো দিলশাদকে-“পুলিশের তরফ থেকে একটা মামলা কর। সমাবেশে নাশকতার চেষ্টা মামলা। আর ফাহিমকে সাবধানে থাকতে বলিস কয়েকটা দিন। কেউ যেন ঘুনাক্ষরেও টের না পায়। সালিম সাহেব অবশ্যই মাঠে নিজের লোক নামাবে সত্য জানার জন্য। দোয়া কর সোহেল যেন বেঁচে যায়।”
“মনেহয় না বাঁচবে।” দিলশাদের চেহারা কঠিন-“অনেকদিনের জমানো ক্ষোভ ভাই। সামান্য অংশ দেখানোর সুযোগ পেয়েছি। আর…”
মিহির হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকলো-“ভাই, খালাম্মা হাসপাতালে।”
রণ চেচিয়ে উঠে দাঁড়ায়-“কিহহ?”
মিহির মাথা দুলায়-“আপনের ফোন অন করেন। ভাবি ফোন দিতে দিতে পাগল। আমি কেবল দেখলাম।”
রণর হাত কাঁপছে। মায়ের কি হলো? কাঁপা হাতে ফোন অন করতেই টুংটাং ম্যাসেজ আসতে শুরু করলো। মামার ফোন পেলো সাথে সাথে। রিসিভ করে তিরিশ সেকেন্ড কথা বলে ‘আমি আসছি’ বলে ফোন কাটলো।

*****

জলির সব টেস্ট করে দেখা গেলো রিপোর্ট সব নরমাল আছে। মাত্রাতিরিক্ত চিন্তায় প্রেশার ফল করেছিল তাই মাথা ঘুরে পড়ে গেছিল। তবুও ডাক্তার একদিন অবজারভেশনে রাখতে চাইলে জলি থাকলো না। রণ মাকে বোঝাল কিন্তু জলি অটল। রণকে সুস্থ দেখে সে জেদ করে বাড়ি ফিরে এলো। মা বোনকে সাথে নিয়ে একসাথে রাতের খাবার খেলো। শুভ্রার দিকে তাকালো না খুব একটা।

ওদিকে রণকে সুস্থ দেখে বেশ স্বস্তি পেলো শুভ্রা। মনটা ভীষন হালকা লাগলো তার। তন্ময় তাহলে তাকে ভয়ই দেখালো? কিন্তু এতো বিশ্রি রকমের ভয় কেন দেখালো তাকে? মনটা খচখচ করছিলো তার। সে রণর আশপাশে ঘুরঘুর করছিল আর ভীষণ ভয়ে ভয়ে জলি আর হাসিখুশিকে দেখছিল। কখন না জানি তন্ময়ের কথা বলে দেয়। আর তন্ময়ের কথা শোনার পর রণ কি করবে? শুভ্রার ভালোলাগাটুকু গায়েব হয়ে যায়।

মাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে রণ নিজের ঘরে এলো। শুভ্রা চা হাতে রণর পিছুপিছু এলো। রণ কাপড় নিতে নিতে আড়চোখে শুভ্রাকে দেখলো-“ধন্যবাদ।”
শুভ্রা থমকে যায়-“কেন?”
রণ পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো-“আমার মাকে সময়মতো হাসপাতালে নিয়েছেন সেজন্য। হাসিখুশি বলেছে আপনার কথা।”
শুভ্রা মনে মনে সিটিয়ে গেলো। রণ খানিকটা এগিয়ে এসে শুভ্রার সামনে দাঁড়ায়। মায়াময় চাহুনি নিয়ে শুভ্রাকে দেখলো। ওর এলোমেলো চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে করে রণর। শুভ্রা আতঙ্কে মাথা নিচু করে থাকে। রণ ওর চিবুক ধরে মুখটা উপরে তুলে নরম গলায় বলে-“খুব টেনশনে ছিলেন তাই না?”
রনকে হতবুদ্ধি করে দিয়ে শুভ্রা ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিলো-“তন্ময় ভাই যখন আপনার উপর হামলার কথা বললো আমি খুব ভয় পেয়ে গেছি জানেন। ভেবেছিলাম আপনাকে হারিয়ে ফেলবো। পাগলের মতো ফোন দিচ্ছিলাম আপনাকে। এদিকে মা তন্ময় ভাইয়ের কথা শুনে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। আমার অবস্থাটা বুঝুন এবার।”
শুভ্রার চিবুক থেকে রণর হাত নামে, চোয়াল শক্ত হয়, হাত মুঠি হয়। শুভ্রা রণর দিকে তাকিয়ে ঢোক গিললো। ও বুঝে গেলো খুব ভুল করে ফেলেছে আজ। যে ভুলের কোন ক্ষমা নেই।

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-৩৬

তুলতুল যখন সোহেলের খবর পেলো ওর মন চাইলো খুশিতে জোরে একটা চিৎকার দিতে। এতো আনন্দ হচ্ছিল ওর মনের মধ্যে। পরক্ষণেই মনে পড়লো মায়ের কথা। মা বলেছিল, কারো বিপদে খুশি হতে নেই। তুলতুল তাই কাঁদো কাঁদো মুখ করে বসে রইলো। ওর পাশে রিমা বসে বিলাপ করছে। আর মিনু তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। তুলতুলের বিরক্ত লাগছিল। রিমাকে মাঝে মাঝে খুব বিরক্ত লাগে তুলতুলের। সোহেল মোটেও ভালো ছেলে না। সে যে শুধু তুলতুলের সাথে খারাপ আচরণ করে তা না। বরং সে সুযোগ পেলে প্রায় সবার সাথে খারাপ আচরণ করে। এমনকি রিমার সাথেও। রিমা কোন কথা বললে গুরুত্ব দেয় না। উল্টো খাবার দাবার বা অন্য কোন ব্যাপারে জোর করলে রিমাকে ঝাড়ি দেয়। মা হিসেবে ন্যনতম সন্মান রিমাকে দেয় না। রিমাও কেন যেন ছেলেকে কিছুই বলে না। এই যে তুহিন নামে লোকটা আছে তাকেও মাঝে মাঝে খুব বাজে ভাষায় গালিগালাজ করতে শুনেছে। শরীফ ওর বড় ভাই তাকেও গোনায় ধরে না। সোহেল একমাত্র সালিম সাহেবের সামনে নরম থাকে। তুলতুলের ধারণা, সালিম সাহেবকেও গোনায় ধরতো না সোহেল যদি না তিনি অঢেল ক্ষমতার অধিকারী হতেন। বাপকে হয়তো সেই কারণেই কিছুটা ভয় পায় সোহেল। তা না হলে বাপের সাথেও এমন করেই কথা বলতো। তুলতুল দুঃখ ভরাক্রান্ত চেহারা বানিয়ে চোখ মোছার অভিনয় করে উঠে এসে নিজের ঘরের দুয়ার দিলো।

দরজা বন্ধ করেই লাফিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে কিছুক্ষণ পুরো বিছানা গড়াগড়ি খেলো তারপর সিলিংয়ের পানে চেয়ে থাকলো অনেক সময়। সে মনে মনে চায় সোহেল এই ঘরে আর না ফিরুক। অনিচ্ছায় প্রতিরাতে তাকে সোহেলের মনোরন্জন আর না করতে হয় যেন। ভীষণ ক্লান্ত লাগে তার। এই বন্দী জীবন থেকে সে মুক্তি চায়। আবার পড়াশোনা শুরু করতে চায়। খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিতে চায়। আর এসব করতে চাইলে সোহেলকে ম*রতে হবে। সোহেল বেঁচে থাকলে এসব স্বপ্ন কখনো পূরণ হবে না। হতে পারে সোহেলে উল্টো তাকেই মেরে ফেললো। শিউরে উঠলো তুলতুল। তার বেঁচে থাকার জন্য হলেও সোহেলকে ম*রতে হবে। সে মনে মনে প্রার্থনা করলো সোহেল যেন এই যাত্রায় মা*রা যায়।

*****

সালিম সাহেব শরীফকে ডাকলো-“আম্মাকে খবর দিছোস? ফোন দে ওরে।”
শরীফ মাথা নাড়লো। তাকে দ্বিধান্বিত দেখায়। তন্ময়ের কথা বাবাকে বলবে কিনা ভাবছে। সালিম সাহেব ছেলের দিকে তাকালো-“কি হইছে তোর? কি ভাবতেছোস?”
শরীফ সালিম সাহেবের কাছে এগিয়ে এলো-“আব্বা, শুভ্রাকে এখন না জানাই।”
সালিম সন্দেহ নিয়ে তাকায়-“কেন? জানাবি না কেন? কি সমস্যা? আর ও তো এমনিতেও জানব। হুদাই জানাবি না কেন? ওর ভাই এইদিকে মরতেছে আর ও জানবো না?”
শরীফ মিনমিন করলো-“ঝামেলা অন্য জায়গায় আব্বা।”
“কোন জায়গায়? কি সব কস?”
সালিম সাহেব চাপা গলায় হুঙ্কার দিলো। শরীফ ভয় পেয়ে বললো-“আজকে তন্ময় গেছিল ওর শশুরবাড়ি। ওইখানে যায়া ভেজাল লাগায়া আসছে।”
“কি ভেজাল লাগাইছে?”
এবার খানিকটা নিভু নিভু শোনায় সালিম সাহেবের গলা।
“ও শুভ্রাকে বলছে, আপনেরা নাকি রণকে মা*রার চেষ্টা করবেন। এখন এইটা তো সত্যি কথা দেখা যাচ্ছে। সোহেলের ভিডিও বের হইছে। কে জানি ভিডিও কইরা ছাড়ছে। সেখানে দেখা যাইতেছে সে শুভ্রার জামাইকে গুলি করার চেষ্টা করতেছে। এখন ওরে কি বলবো তাইলে। ওর জামাই যদি সত্যটা জানে তাইলে কি হবে ভাবছেন?”
সালিম সাহেব হতবাক-“সত্যি বলতেছিস? দেখা দেখি ভিডিওটা। আমি তো কিছুই বুঝতেছি না। সোহেলকে আজকের অনুষ্ঠানে যাইতেই মানা করছিলাম। ও কখন গেলো কি করলো আমি কিছু জানি না। আর তন্ময় এইসব কথা কেন কইছে শুভ্রাকে? ও কেমনে জানলো? সোহেল কি ওরে কিছু কইছিল? কইলো ও ঠেকাইলো না কেন? আমি তো কিছুই বুঝতেছি না?”
“আমিও বুঝতেছিনা। এখন যদি শুভ্রা এই কথা জামাইকে কয় তাইলে তো আরও বিপদ। সোহেলকে এইবার জেলে যাওয়া কেউ ঠেকাইতে পারবে না।”
শরীফের কথায় সালিম সাহেবের শরীর খারাপ লাগতে শুরু করে। সে রেগে চাপা গলায় দাঁতে দাঁত চেপে গর্জন করলো-“হা*রা*ম*জাদা পোলা, নিজে তো ডুববো সাথে আমাগো পরিবাররে ডুবাইবো। আমার রাজনৈতিক জীবনটাও শেষ করবো। কি যে করমু ওরে নিয়া।”
নিরবতা নেমে এলো দু’জনার মধ্যে। শরীফ হঠাৎ করে বলে উঠলো-“ওরা সব জাইনা শুভ্রারে না ফেরত পাঠায়।”
সালিম সাহেব চমকে উঠে ছেলের দিকে তাকায়।

*****

“বাহ, আমাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র বেশ ভালোই চলছে দেখা যাচ্ছে। পুরো পরিবার মিলে মিশে আমাকে ধ্বংস করতে উঠে পড়ে লেগেছেন।”
রণর কথায় শুভ্রার শরীর কেঁপে উঠলো থরথর। সে অসহায় চাহুনি দিয়ে রণর দিকে তাকালো। রণ ওকেই দেখছে একনজরে। ওর চেহারায় ক্রোধ আর ঘৃনার মিশেল। শুভ্রার হৃদয়টা যেন চুরমার হয় সে দৃষ্টি দেখে। সে কাতর গলায় বললো-“সত্যি বলছি আমি কিছু জানতাম না। আর তন্ময় ভাইকে আমি অনেকবার মানা করেছি এখানে যেন না আসে। কিন্তু ভাইয়া শুনছে না। প্লিজ আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না।”
রণ রাগে ফেটে পড়লো-“ভুল বুঝবোনা? লাইক সিরিয়াসলি? কেন ভুল বুঝবোনা শুনি? আপনি আপনার বাবাকে আমার বিষয়ে আপডেট দেননি? আপনার বাবা আপনাকে বলেনি আমার ব্যাপারে আপডেট দিতে? বলুন?”
শুভ্রা মুক হয়ে গেলো। তার বুকের মধ্যে ধরাস ধরাস আওয়াজ হচ্ছে। এসব কি বলছে রণ! সে কি করে জানলো বাবার সাথে কি কথা হয়েছে তার? সে কম্পিত কন্ঠে জানতে চাইলো-“আপনি কি বলছেন এসব?”
রণ হাত ঝাড়লো। শুভ্রার দিকে এগিয়ে এসে হিসহিসিয়ে উঠলো-“মিথ্যে বলেছি? বলুন মিথ্যে বলেছি?”
রণর এমন রণমুর্তি দেখে শুভ্রা ভয় পেয়ে গেলো। কোন কথা জোগাল না মুখে। রণ রাগে ছটফট করছে-“এক ভাই আমাকে মারার জন্য বন্দুক তাক করে। আরেক ভাই আমার বোনের দিকে নজর দেয়। আর আমার বউ হয়ে যিনি এসেছেন তিনি তার বাবার হয়ে আমার পেছনে গোয়েন্দাগিরি করছে। কি সৌভাগ্য আমার। আচ্ছা একটা কথা বলবেন?”
শুভ্রা রণ দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু বলার সাহস হলো না তার। রণ বললো-“আজ আমার কিছু হলে আপনি নিশ্চয়ই খুব খুশি হতেন?”
শুভ্রা স্বজোরে মাথা নাড়লো। রণ হাসলো-“আমি জানি আপনি ভীষণ খুশি হতেন। কিন্তু একবারও আমার মা আর বোনদের কথা ভেবেছেন? আমি না থাকলে ওদের কে দেখবে? আপনার হয়তো তেমন কিছু যাবে আসবে না। আবার নতুন করে জীবন সাজাতে পারবেন। কিন্তু ওদের জীবনটা থমকে যাবে। বাবা চলে যাওয়ার পর আমিই ওদের জীবন। আমি না থাকলে ওরাও থাকবে না হয়তো। কিন্তু এসব আপনার মতো মোটা মাথার মানুষ বুঝবে কি করে?”
শুভ্রা কেঁদে দিলো-“সত্যি বলছি আমি এসব কিছু জানতাম না। আমার বাবা এমন কিছু কখনোই করবে না। এতো নিচে সে নামবে না কখনোই।”
রণ হাসলো-“আপনার বাবা তো মহান মানুষ। কোন কিছু করতে পারে না। শুনুন, আপনি এককাজ করুন, আপনার বাবার বাড়ি ফিরে যান। এই সংসার, বউ এসব খেলা বন্ধ করুন। চারদেয়ালের ভেতর আপনার আমার সম্পর্ক কি তা নতুন করে বলার দরকার নেই আর। আমি নিজেকে নিয়ে ভাবিও না। এই সম্পর্ক থেকে আমি কখনো বেশি কিছু পাওয়ার আশা করিনি। শুধু মায়ের খাতিরে বিয়েটা করেছিলাম। কিন্তু সেই মা আর বোনরাই যদি ভালো না থাকে, তাদের জীবনের হুমকি আসে তাহলে এই বিয়ে টিকিয়ে রেখে লাভ কি। আপনার প্রতিশোধ পূরণ হলে এবার দয়া করে আমাদের মুক্তি দিন।”
রণ করজোড়ে মিনতি করলো। শুভ্রা এতোক্ষণ কাঁদছিলো এবার কেবল হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তার হুট করে ভীষণ রাগ হয়ে গেলো। সে এগিয়ে গিয়ে রণর গেন্জির গলা মুচড়ে ধরলো-“কেন মুক্তি দেব? কেন আমার থেকে মুক্তি চাই আপনার? যেন চন্দ্রানীকে বিয়ে করতে পারেন? কি ভেবেছেন আমি কিছু বুঝবো না? আমার পরিবারের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দেবেন, তারপর নিজে নাটক বানিয়ে তাদের দোষী সাব্যস্ত করে আমাকে আপনার জীবন থেকে বিদায় দেবেন। আর আমি অসহায় মেয়ে সেজে আপনার সব সিদ্ধান্ত মেনে বাপের বাড়ি ফিরে যাব? নো মিস্টার রণ, আমাকে এতোটা বোকা ভাববেন না। আমাকে অপহরণ করে আপনি এই খেলা শুরু করেছিলেন এর শেষ আমি করবো। আমার পরিবারকে আপনি ধ্বংস করতে চাইছেন আমার পরিবার না।”
রণ হতভম্ব। শুভ্রার আচমকা আক্রমণে সে দিশেহারা বোধ করছে। শুভ্রা ওর চোখে চোখ রেখে শাসালো-“আমার কাছ থেকে এতো সহজে মুক্তি নেই আপনার। কি ভেবেছিলেন, সালিম সাহেবের কন্যাকে অপহরণ করে নির্বাচন জিতে যাবেন তারপর আয়েস করবেন সারাজীবন? আর বদনামের ভয়ে সালিম সাহেব চুপচাপ সব হজম করবে? এই শুভ্রা তা হতে দেবে না কখনোই। আমাকে যেহেতু সিড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছেন তাই আমাকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সহ্য করার জন্য তৈরী হোন। বাকী আর কেউ আসবে আপনার জীবনে। কেউ না মানে কেউ না।”

চলবে—
©Farhana_Yesmin

দর্পহরন পর্ব-৩১+৩২+৩৩

0

#দর্পহরন
#পর্ব-৩১

“খবর শুনছোস সালিম?”
মোর্শেদ উত্তেজিত কন্ঠে ফোনের ওপাশে চেচিয়ে উঠলো। সালিম সাহেব আজ এসেছে হারুনুর রশীদের সাথে আলাপ করতে। দলের মধ্যে কি চলছে সেসব জানতে। হারুন রাজনীতিতে সালিমের সমকক্ষ, বেশ ভালো বন্ধু তারা। সেই সুবাদে আসা। সালিম সাহেব দলে বেশ কোনঠাসা অবস্থায় আছেন৷ গত মেয়াদে তার ও তার পরিবারের কৃতকর্মের বেশ চর্চা হওয়ায় নেত্রীর বিরাগভাজন হয়েছেন। দলের বড় বড় নেতারাও নেত্রীর ভয়ে পারতপক্ষে তাকে এড়িয়ে চলছে। কেউ তার সাথে দলের ভেতরকার কোন কথা বলছে না। বাধ্য হয়ে বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করতে হয়েছে। বন্ধু হারুন তাকে আজ বাসায় ডেকেছে আলাপ করতে। খেতে বসে কেবলই আলাপ শুরু করেছে এরমধ্যে মোর্শেদের ফোন। সালিম ‘পরে ফোন করছি’ বলে ফোন কেটে দিলো। মোর্শেদ আরও দুইবার ফোন দিলো ফোন সাইলেন্ট থাকার কারণে সালিম সাহেব টের পেলো না।

হারুনর রশীদ বর্তমানে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী। দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে একজন। সালিমের কৃতকর্ম এবং পাওয়ার দুটো নিয়েই বেশ ভালো ভাবে অবগত। অনেকটা নিজের স্বার্থেই আজ সালিমকে ডেকে এনেছে। নেত্রী আজকাল বয়োজ্যেষ্ঠ নেতাদের চাইতে তরুণদের প্রাধান্য দিচ্ছে। দিনে দিনে তরুন নেতৃত্বে তারা কোনঠাসা হয়ে পড়ছে। এই অবস্থায় কি করা যাবে সেটা নিয়ে আলোচনা করাটাও খুব রিস্ক। কয়েকদিন আগে তারা কয়েকজন পুরনো সদস্য গোপনে আলোচনায় বসেছিল। নেত্রী টের পেয়ে মিটিং ডেকে তাদের সাবধান করেছেন। তারপর থেকে বেশ চিন্তায় পড়ে গেছে তারা। কানাঘুষা শোনা যাচ্ছে আরও কয়েকটি মন্ত্রনালয়ে নতুনদের সুযোগ দেবে। যেহেতু নতুনরা কাজ ভালো করছে। আর নতুনদের মধ্যে সালিমের মেয়ে জামাই এগিয়ে আছে। তাকে নেত্রী সব জায়গায় প্রায়োরিটি দিচ্ছে। মুরগী রানে কামড় দিতে দিতে হারুন বন্ধুকে দেখলো-“তোমার জামাই তো ভালোই খেল দেখাইতেছে সালিম। নেত্রী তাকে ছাড়া কিছু বোঝে না।”
সালিম অনিচ্ছায় হাসলো। হারুন বন্ধুর মনোভাব বোঝার চেষ্টা করলো-“শুনলাম তোমার এলাকায় শো ডাউন হবে। নেত্রী যাবে আগামী সপ্তাহে। এলাকায় দলীয় প্রধানের নির্বাচন হবে। তারপরই যাওয়ার কথা। তোমার জামাইকে সাপোর্ট দিতে।”
সালিম এবার অবাক-“কি বলো? আমি তো এমন কিছু শুনি নাই? নির্বাচন হবে আর আমি জানবো না? তুমি মনেহয় ভুল জানছো?”
হারুন বুঝলো তীর জায়গা মতো লেগেছে। সে বিজ্ঞের মতো হাসলো-“আমি ঠিক জানছি সালিম। এইগুলা ভিতরের খবর। তোমাকে জানাবে না তাই গোপনীয়তা। শুধু তুমি না দলে আমাদের সবার এই অবস্থা। কোন না কোনভাবে আমাদের চাপানোর চেষ্টা করতেছে। নেত্রী চায় নতুন মানুষ নেতৃত্বে আসুক। পুরনোদের অনেক কেচ্ছা, ঝামেলা তাই ফ্রেশ মুখ আসলেই ভালো। নেত্রী যা খুশি তাই করতে পারবে কেউ কিছু বলতে পারবে না। বুঝো নাই?”
সালিম চিন্তিত হয়ে মাথা দুলায়-“বুঝেছি। কিন্তু আমি তো এতো সহজে হাল ছাড়বো না। তিরিশ বছর হইলো নেত্রীর সেবা করতেছি এতো সহজে নিজের জায়গা ছাড়বো?”
হারুন মাথা দোলায়-“আমিও তাই বলছিলাম। তুমি কতো পুরনো মানুষ। নেত্রীর বিপদে আপদে পাশে থেকেছ। অথচ দেখো তোমাকেই আগে সরালো।”
সালিম দাঁতে দাঁত চেপে বলে-“এখনো সরি নাই বন্ধু। আমার এলাকায় আমি ছাড়া আর কাউকে দলের কান্ডারী হইতে দিব না। আমাকে সংসদের জন্য নমিনেশন দেয় নাই। সামনে মেয়র ইলেকশন ওইখানে দিতেই হবে। সেই ব্যবস্থা আমি করবো।”
“যা করার তাড়াতাড়ি করো সালিম। শুনছি মেয়র হিসেবে নতুন কাউকে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে তোমার জামাই। দেখো কি করা যায়। তোমার এলাকায় সামনে বড় বড় প্রজেক্ট হবে শুনছো তো?”
সালিম মাথা নাড়ে। হারুন অবাক হয়ে বললো-“প্রজেক্ট শীতলক্ষ্যা”র নাম শোন নাই? প্রচুর টাকার কারবার। বিশ্ব ব্যাংকের ইনভেস্টমেন্ট হবে। তার আগেই কিছু করতে হবে তোমার। না হলে কিছুই ভাগে পাইবা না।”
“হুমমম।”
চিন্তায় মুখ থেকে আর কিছু বেরুলো না। হারুন শেষ আরেকটা টোকা দিলো-“জামাই এর দিকে নজর রাইখো সালিম। নেত্রীর নজর আছে তার উপর।”
সালিম সাহেবের মাথা নষ্ট হয়ে গেলো। কোনরকমে আলাপ শেষ করে বেরিয়ে এলো হারুনের বাসা থেকে। একবার মনেহলো ফেরার আগে মেয়ের বাড়ি থেকে ঢু মেয়ে যাবে। কিন্তু পরক্ষণেই সে পরিকল্পনা বাদ দিতে হলো সোহেলের ফোন পেয়ে-“আব্বা, তাড়াতাড়ি বাড়িতে আসেন জরুরি আলাপ আছে।”
সব বাদ দিয়ে সালিম বাড়ির উদ্দেশ্যে ছুটলো। মের্শেদ, সোহেল, তুহিন সবার মুখের রেখায় চিন্তার আভাস। সালিম সাহেব ঘাবড়ে গেলো-“কি হইছে ভাইজান। এমন চেহারা কইরা বইসা আছেন কেন? আর বারবার ফোনই বা দিতেছেন কেন? আমি জরুরি কাজে বাইরে আছিলাম।”
মোর্শেদ রেগে গেলো-“তোরে কি হুদা কামে ফোন দিমু আমি? শুনছোস কিছু? রবিবার আপা আসবো এলাকায়। শুনতেছি শুক্রবার বা শনিবার ভোট হইবো। এলাকায় দলীয় প্রধান নির্বাচন হইবো। জামাই চুপে চাপে কাম করতাছে। এলাকার যত টেন্ডার হইবো সব ভাগ কইরা দিছে জামাই। আমরা সব ঠিক দেওয়ার পরেও একটা কামও পাই নাই। দিন না আমাগোরে। উল্টা জাহাজ নতুন কারখানা হইবো শুনলাম। এতোকিছু হইতেছে কিছুই জানি না আমরা। এখন কেউ কোন কথা কইতেছে না। টাকার ভাগ পাইয়া মুখে কলুপ আঁটছে। এমনে তো চলতো না সালিম। আর কয়দিন এমন গেলে আমগো ব্যবসা লাটে উঠবো। এখন কি করবি ক?”
আজ সালিম সাহেবও উত্তেজিত। এতো কিছু চিন্তা মাথায় লোড নিতে পারছে না। সে হুট করে শুভ্রাকে ফোন দিলো-“আম্মা ভালো আছেন?”
রাতের বেলা বাবার ফোন পেয়ে শুভ্রা অবাক হলো-“জ্বি আব্বা, ভালো। আপনি?”
“আপনাকে কাজ দিছিলাম। কিছু কি করতে পারছেন? আজ পর্যন্ত কিছুই তো জানাইলেন না আমাকে।”
বাবার কন্ঠে স্পষ্ট অভিমান বুঝতে পেরে শুভ্রা নরম গলায় জবাব দিলো-“সুযোগ নেই আব্বু। সে বাসাতেই থাকে না বলতে গেলে। কয়েক সপ্তাহ ধরে অনেক ব্যস্ত। কিভাবে কি করবো?”
“তনুও আম্মা। এই কথা বলতে লজ্জা হওয়া উচিত আপনার। সে আপনার স্বামী, তার একটা কাজের ব্যপারে আপনি জানেন না এইটা কেমনে হয়?”
বাবার স্পষ্ট ইঙ্গিত শুনে গাল লালিম হলো শুভ্রার। সে অতি দ্রুত ফিসফিস করলো-“সে আসছে আব্বা আমি রাখলাম।”
সালিম মেয়েকে ডাকলো-“আম্মা, আমাদের এলাকায় কি চলতেছে তার কাছ থিকা শুনে আমাকে জানান। আপনার জামাই আপনার আব্বার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতেছে। তার কাছ থিকা বাপরে উদ্ধার করেন।”
শুভ্রা জবাব না দিয়ে ফোন কেটে দিলো। সালিম সাহেব ফোন নামিয়ে কয়েক জোড়া বিস্মিত চোখকে দেখলো। সে চোখ নাচায়-“কি হইছে?”
সোহেল অবাক হলো-“শুভ্রা কি করবো? ও রাজনীতির কি বোঝে?”
“কিছু বোঝা লাগবে না খালি আমারে খবর দিবে। এইটুক পারলেই হইবো।”
সালিম সাহেবকে ভীষন অস্থির মনে হলো। হারুনের কথা শোনার পর থেকেই অস্থিরতা পেয়ে বসেছে তাকে। আসলে এখন সালিম সাহেব হন্যে হয়ে সুযোগ খুঁজছে। কোনভাবে এমন কিছু করা যাতে নেত্রী তাকে আবার কাছে টেনে নেয়। কিন্তু কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। শুধু জানেন কিছু একটা করতেই হবে।

*****

আজ গভীর রাত পর্যন্ত রণর জন্য জেগে বসে রইলো শুভ্রা। যত্ন করে শাড়ী পরলো। চোখে হালকা কাজল ঠোঁটে গোলাপি লিপবাম। আয়নায় নিজেকে দেখে লজ্জাই লাগলো। এভাবে সাজগোছ করতে দেখে ব্যাঁকা লোকটা না জানি কি বলে তাকে। নিজেই উদ্যোগী হয়ে রান্নাঘরে খাবার গরম করলো। শুভ্রাকে দরজায় দেখে অবাক হলো রণ-“আপনি ঘুমাননি? অনেক রাত হয়েছে তো?”
শুভ্রার বুক ধুকপুক করছে। মাথা নিচু করে মৃদুস্বরে বললো-“ঘুম আসছিলো না তাই মাকে ঘুমিয়ে পড়তে বলেছি। আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন আমি খাবার বেড়ে আনছি।”
রণ মাথা দুলিয়ে চলে গেলো। শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এসে দেখলো শুভ্রা এরইমধ্যে খাবার এনে ছোট টেবিলে রেখেছে। প্লেটে সামান্য ভাত আর ভাজা মুরগী। সাথে ঘন ডাল। রণ খাবার খেতে বসলে শুভ্রাও বসলো ওর সামনে। রণ বিস্মিত হলেও স্বাভাবিক মুখভঙ্গি করে বললো-“আপনি চাইলে ঘুমিয়ে যেতে পারেন। আমি খেয়ে নেব।”
শুভ্রা মাথা নাড়ে-“না থাক। আমি বসে থাকি। একা খেতে কষ্ট হবে আপনার।”
রণ আরেকবার হোঁটচ খায়। স্মিত মুখে ভাত মাখিয়ে মুখে তোলার আগে জানতে চাইলো-“আপনি খেয়েছেন?”
শুভ্রা মাথা নাড়ে-“খিদে ছিল না তাই খাইনি।”
রণ হুট করে প্রথম লোকমাটা শুভ্রার মুখের সামনে ধরে-“খিদে ছিল না তারমানে এখন আছে। নিন হা করুন।”
শুভ্র চমকিত-“আরে না না আপনি খান। সামান্য ভাত আমি খেলে আপনি কি খাবেন?”
রণ হাসলো-“যদি হয় সুজন তেতুল পাতায় দুজন। কথা না বাড়িয়ে হা করুন।”
বাধ্য হয়ে হা করে শুভ্রা। রণ ভাতের লোকমা শুভ্রার মুখে দিয়ে নিজেও খেলো এক লোকমা। আবার শুভ্রাকে দেয় নিজে খায়। তিনবার এমন হওয়ার পর শুভ্রা ফট করে উঠে দাঁড়ায়-“আর খাবো না। পেট ভরে গেছে আমার। আপনি খাওয়া শেষ করুন আমি আপনার জন্য এককাপ চা বানিয়ে আনছি।”
বলেই ছুটে বেরিয়ে গেলো মেয়েটা। রণর মনে হলো শুভ্রার চোখের কোলে জল ছিলো। নিজেকে দূর্বল দেখাবে না বলে ওর সামনে থেকে পালিয়ে গেলো। সত্যি কি তাই? রণ বেশি ভালো না। কাঁধ ঝাঁকিয়ে পুনরায় খাওয়ায় মন দিলো সে।

চলবে—
©Farhana_Yesmin

#দর্পহরন
#পর্ব-৩২

রাতে মাতাল হয়ে বাসায় ফিরলো সোহেল। রুমে ঢুকে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে তুলতুলকে নরম কন্ঠে কাছে ডেকেছে-“ও তুলতুলি, কাছে আসো।”
মদের গন্ধে তুলতুলের গা গুলায়। কিন্তু টকটকে লাল চোখের সোহেলের ডাক অগ্রাহ্য করতে পারে না। এগিয়ে যেতেই সোহেল তাকে হাত ধরে টেনে কাছে বসায়-“তুমি কি আমাকে ঘেন্না করো? এমন দূরে দূরে থাকো কেন সবসময়?”
তুলতুল কিছু বললো না। মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো। সোহেল তুলতুলের মুখ ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে নেয়-“রাগ হইছো আমার উপর? আমি খুব খারাপ মানুষ তাই না? তোমাকে অত্যাচার করি, আটকাইয়া রাখছি কোথাও যাইতে দেই না। বুঝি সবই। আচ্ছা, তুমি কি চাও আমার কাছে? একটা ইচ্ছার কথা বলো পূরণ করুম।”
তুলতুল এবার মুখ ফুটে বলে-“চাইলেই বুঝি দিবেন? বলে লাভ কি?”
সোহেল ক্ষন কাল চুপ করে থাকলো। তারপর তুলতুলকে টেনে শুইয়ে দিলো বালিশে। ঝুঁকে এলো তুলতুলের মুখের উপর। গালে হাত দিয়ে আরও মোলায়েম কন্ঠে বললো-“কইলাম তো পূরণ করুম কইয়া ফালাও।”
তুলতুলের কি মনে হলো বলে ফেললো মুখ ফুটে-“আমাকে একবার মায়ের কাছে যাইতে দেন। খুব ইচ্ছা করে মাকে দেখতে। তার শরীর ভালো না তাই একটা বার দেখতাম।”
সোহেল অাদুরে দৃষ্টি নিয়ে তুলতুলের অসহায় মুখ দেখলো। গালে চুমো দিলো, নাক নাক ঘষে বললো-“আচ্ছা, দিব যাইতে। এইবার তুমি নিজের ইচ্ছায় আমাকে একটু আদর দাও তাইলে। প্রতিদিন জোর করতে ভালো লাগে না।”
তুলতুল সিঁটিয়ে গেলো নিজের মধ্যে। যাকে ঘেন্না করে তাকে নিজ থেকে আদর দেওয়া যায় না এই কথা মোটা মাথার সোহেলকে বলা বৃথা। ওর মধ্যে একটা পশু ওত পেতে থাকে। সুযোগ পেলেই যে থাবা বসায়। সোহেল অনুনয় করে-“আরেহ কইলাম তো যাইতে দিমু। এইবার একটু আদর করো না।”
সোহেল মুখ এগিয়ে দিলো। উৎকট গন্ধে পেটের নাড়িভুড়ি উল্টে আসে তুকতুলের। জড়ভরত হয়ে শুয়ে রইলো সে। মনটা হাসফাস করে ওঠে তার। আর কতদিন এই অত্যাচার সইতে হবে সে জানে না। খুব খারাপ লাগে তার। এই বন্দী জীবন আর মেনে নিতে পারছে না। এবারও তুলতুলের কাছ থেকে সারা না পেরে রেগে গেলো সোহেল। তুলতুলের দু’হাত বিছানায় আঁটকে তুলতুলের উপর চরে বসলো সে-“কি হইলো। কথা কানে যায় না? কতবার কইরা কইলাম তবুও পাষানীর মন গলে না। তুই শোধরাবি না। ভালো ব্যবহার করলেই কি না করলেই কি। তোরে খালি ভোগ করাই ঠিক আছে।”
তুলতুল বাঁধা দেয় না। বাঁধা দিয়ে লাভটাই বা কি? শুধু শুধু নিজের শরীরকে কষ্ট দেওয়া ছাড়া। তবে একদিন সে অবশ্যই বাঁধা দেবে। সেইদিন হয়তো এই পৃথিবীতে সোহেলের শেষ দিন হবে। ততদিন পর্যন্ত তুলতুল সহ্য করবে নিজের মা আর ভাইয়ের জন্য।

*****

সালিম সাহেব আজ গোপনে নিজের অফিসে কয়েকজন ব্যবসায়ীকে ডেকেছে। উদ্দেশ্য আসন্ন নির্বাচনে এলাকায় তার সমর্থন পাকাপোক্ত করা। ব্যবসায়ীরা প্রতিমাসে নিয়মিত হারে চাঁদা দেয় দলের প্রয়োজনে। তবে রাজনীতিতে সরাসরি ইনভলভ হয় না। সালিম সাহেবের বিশ্বাস এনারা সকলে ওনাকে সমর্থন দেবে যেহেতু তিনি সবসময় এনাদের সাথে সুসম্পর্ক রেখেছেন। ওনাদের কাজে নিজ থেকে যতটা সম্ভব সাহায্য করেছেন। কিন্তু মিটিং শুরু হতে হতে তার মেজাজ খারাপ হতে শুরু করলো।
“ভাই, সামনে নেত্রী আসবে এলাকায়। শো ডাউন করতে হবে। এলাকায় দলীয় প্রধান নির্বাচন হবে এটা তো জানেন। আপনারা আমাকে সাপোর্ট দিবেন তো?”
মিল্টন নিট ওয়ারের মালিক মিল্টন খন্দকার বাকীদের দিকে তাকিয়ে হাসলো। সালিম সাহেব বললো-“কি মিল্টন ভাই, আপনারা আমাকেই চান তো দলীয় প্রধান হিসেবে। সামনে মেয়র নির্বাচনে প্রাথী হতে চাই ভাই। আপনারা যদি সাপোর্ট না দেন তাহলে বিপদে পড়বো।”
“ভাই, সবই ঠিক আছে। তবে কে এলাকায় রাজত্ব করবে তা কি আমরা ঠিক করি কখনো? যে আমাদের সু্যোগ সুবিধা দেবে, আমরা তাকেই চাইবো। তারপরও কথা থাকে কিন্তু। নেত্রী কাকে চান এটাও একটা বড় ব্যাপার। যতটুকু দেখলাম নতুন মন্ত্রী সাহেব কমবয়সী হলেও গত তিনমাসে ভালো কাজ দেখাইছে। সে আপনারই মেয়ের জামাই। যদি সেও দলীয় প্রধান হয় তাতেও আপনার কোন সমস্যা থাকার কথা না। আফটারঅল আপনারই মেয়ের জামাই। আপনার তো লাভলস নাই এখানে। সবদিক দিয়ে আপনিই জিতছেন।”
সালিম সাহেবের মুখ বন্ধ। দাঁতে দাঁত চেপে রণর প্রশংসা বাক্য গেলা ছাড়া তার করনীয় নেই কিছু। তবুও বয়সের অভিজ্ঞতার বলে বুঝলেন এখন কোনমতেই মেজাজ গরম করা যাবে না। তিনি স্মিত কন্ঠে বললো-“সবই ঠিক আছে ভাই। কিন্তু কোন পজিশনে না থাকাটাই বা কেমন দেখায়৷ রণর জন্য সেচ্ছায় সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে দিছি। এখন মেয়র তো হতে হবে। তাছাড়া এলাকায় দলীয় রাজনীতিতে আমিই সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ। দল করাটা আমার ধ্যান জ্ঞান। বাবার কাছ থেকে এটাই মন দিয়ে শিখেছি। এখন যদি রাজনীতি না করতে পারি তাহলে বেঁচে থাকা বৃথা মনে হবে আমার। আপনাদের জন্য সবসময় যথাসাধ্য করে গেছি। এখন আমার বিপদে কি আপনাদের পাশে পাবো না? আমাকে ম*রে যেতে বলছেন?”
আবেগী কথায় কাজ হলো মনেহয়। তৎখনাত তরফদার শিপিং এর মালিক বললো-“কেন পাবেন না ভাই? অবশ্যই আমরা আপনার পাশে আছি। আমাদের কি করতে হবে বলেন। সাধ্যমতো সাহায্য করবো আপনাকে।”
সালিম সাহেবের চেহারা উজ্জ্বল হলো-“তাহলে ভাই, দলের প্রধান হিসেবে আপনারা আমার নাম রেকমেন্ড কইরেন। আপা নিশ্চয়ই কাল আপনাদের সাথে মিটিং করবে তখন আপনারা আমার জন্য তদবির করবেন। বাকী ভবিষ্যতে আপনাদের প্রয়োজন আমি দেখবো। মিল্টন ভাই, আপনার কোম্পানির ব্যাংক লোনটা মওকুফ করে দিলে চলবে? জোবেদ ভাই, থানার পাশের জমি দরকার আপনার? ম্যানেজ করে দিবনে।”
হুট করে এমন একটা প্রস্তাব পেয়ে মিল্টন হচকে গেলো। সালিম সাহেব হাসলো-“আমি জানি আপনার কোম্পানি এখন কাজ কম পাচ্ছে। আপনি নতুন প্রতিষ্ঠান দিতে যাচ্ছেন। টাকার সমস্যা থাকলে আমাকে বলবেন না। এমনে পর বানায়া দিছেন আমাকে?”
শেষ পর্যন্ত পজেটিভ ইঙ্গিত দিয়ে সকলে বিদায় নিলো। সালিম সাহেবকে সন্তুষ্ট দেখালো। যে টোপ দিয়েছে তাতে মনেহয় না চিন্তার কোন কারণ আছে। পাঁচজনের মধ্যে তিনজন অন্তত তার হয়ে কথা বলবে। যেহেতু এনারা সবাই নিউট্রাল মতামত দেয়। এনাদের কাউকে সাপোর্ট দেওয়া মানে অনেকগুলো মানুষকে উৎসাহিত করা। আশাকরা যায় নেত্রী আসার পর ভালো কিছু হবে। নেত্রী আবার তার উপর ভরসা করবে। এখন শুধু একটু বুঝেশুঝে কাজ করতে হবে।

*****

আজকেও দরজা খুললো শুভ্রা। যথারীতি তার পরনে একটা হালকা বেগুনি রঙের শাড়ী লম্বা চুলগুলো মাথার পেছনে পাঞ্চ ক্লিপ দিয়ে আঁটকানে। সাদা ব্লাউজে সুন্দর মানিয়ে গেছে মেয়েটাকে। রণ মৃদু হেসে ঘরে ঢুকে গেলো। শুভ্রার কিছুটা মন খারাপ হলো আজ। পরপর তিনদিন শাড়ী পড়লো একটা দিনও রণ ওকে কোন কমপ্লিমেন্ট দেয়নি৷ তাকে কি দেখতে ভালো দেখায় না? রান্নাঘরে খাবার গরম করে নিয়ে প্লেটে বেড়ে নিজেকে আরেকপ্রস্ত দেখে নিলো। শাড়ী টেনে ঠিক করলো, চুলগুলো খুলে পিঠময় ছড়িয়ে দিলো। হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে আঁচল টেনে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। রণ মাত্রই শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে কাপড় পরেছে। তার গা দিয়ে সুগন্ধ ভেসে আসছে। শুভ্রার খানিকটা মাতাল মাতাল লাগে রণকে দেখে। মানুষটা আসলেও খুব হ্যান্ডসাম। একহারা শরীরের কোথাও বাড়তি মেদের চিন্হ নেই। ফর্সা চেহারায় কাঠিন্যতা আর সরলতার মিশেল। গম্ভীর মুখটা দেখে ভয় লাগে আবার হাসলে সরলতার প্রতীক মনেহয়। রণ মনোযোগ দিয়ে মোবাইলে কিছু করছে। শুভ্রা তার দিকে চেয়ে থেকে ঢোক গিললো বারকয়েক। হঠাৎ রণর নজর পড়লো তার দিকে-“আরে আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? খেতে দেবেন না আজ?”
“হ্যহহ, এই তো দিচ্ছি।”
শুভ্রা অতি দ্রুত খাবারটা দিতে যেয়ে প্লেট হাত থেকে নড়বড়িয়ে যায়। শেষ মুহূর্তে রণ ধরে ফেলে প্লেটটা। উদ্বিগ্ন হয়ে শুভ্রার দিকে তাকালো-“আপনার শরীর খারাপ নাকি? এরকম করছেন কেন?”
শুভ্রা পাশের সোফায় বসলো-“না সেরকম কিছু না। আমি ঠিক আছি।”
রণ মোলায়েম কন্ঠে বললো-“রাত জাগছেন কেন? ঘুমিয়ে পড়লেই পারেন।”
বলতে বলতে ভাত মাখিয়ে শুভ্রার সামনে ধরে-“নিন হা করুন।”
শুভ্রা লাজুক হেসে মাথা নাড়ে-“আরে আমি খেয়েছি তো। আপনি খান। সারাদিন পর খেতে বসেন তাতেও আমি ভাগ বসালে হবে?”
রণ তবুও লোকমাটা মুখের সামনে ধরে থাকলো-“প্লেটে যত কম খাবারই থাক না কেন বউয়ের জন্য কখনো কম পড়বে না। আমি জানি আপনি কিছু খাননি রাতে। নিন তাড়াতাড়ি হা করুন। আমাকে কষ্ট দেবেন না আর। লোকমা ধরে রাখতে রাখতে হাত ব্যাথা হয়ে গেলো।”
শুভ্রা বাধ্য হয়ে হা করে। ওকে একবার দেয় নিজে একবার খায়। এটা যেন রণর জন্য নিয়ম হয়ে গেছে। শুভ্রা মুগ্ধ হয়ে দেখছে সামনের মানুষটাকে।
শুভ্রাকে লক্ষ করে রণ মুচকি হাসলো-“আমার হাত থেকে খাওয়াটা নেশা হয়ে যাচ্ছে নাকি আপনার?”
“হুমম। খুব ভালো লাগছে।” রণকে দেখতে দেখতে শুভ্রা আনমনা হয়ে জবাব দিলো। পরক্ষনেই হুশ ফিরে পেয়ে ভীষণ লজ্জা পেলো-“আমি আপনার চা নিয়ে আসছি।”
বলেই উঠে ছুটে পালালো। কিছুক্ষণ পর যখন দুইকাপ চা হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকলো তখন রণর খাওয়া শেষ। সে আবারও মোবাইলে ব্যস্ত হয়ে গেছে। শুভ্রা ডাকলো-“আপনার চা।”
“থ্যাংক ইউ। বসুন, একসাথে চা খাই।”
শুভ্রা মাথা দুলিয়ে রণর সামনে বসলো। রণ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে শুভ্রার দিকে তাকালো। ওকে এই মুহূর্তে শান্ত দীঘির মতো লাগছে। টলটলে মুখ নিয়ে মাঝে মাঝে নিঃশব্দে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। রণ হুট করে শুভ্রার সামনে ঝুলে থাকা চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিয়ে নরম গলায় বললো-“কাল আমি এলাকায় যাব। আপনি চাইলে আমার সাথে যেতে পারেন আপনার বাবার বাসায়। যাবেন?”
রণর সামান্য স্পর্শ পেয়ে যেন মোমের মতো গলে গেলো শুভ্রা। ইচ্ছে হলে রণকে বলে আরও একবার অমন করতে। অনিচ্ছায় মাথা নাড়ে। কিন্তু পরক্ষণেই মনটা সচেতন হয়ে উঠলো-“কাল হঠাৎ যাচ্ছেন যে? বিশেষ কোন দরকার?”
রণ মাথা দুলায়-“হ্যা, ফুপু যাবে পরশু। দলের সম্মেলন হবে। আমি কাল যেয়ে সব গোছাব বলেই আজ ছুটির দিনেও অফিস করলাম।”
“হঠাৎ? কি এমন কাজ?”
রণ হাসলো-“হঠাৎ করে কিছু হয় নাকি? পরশু খুব বড় একটা প্রজেক্টের কাজের ঘোষণা দেবেন ফুপু। দলের কিছু জরুরি কাজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে।”
“কি সিদ্ধান্ত?”
শুভ্রা আলগোছে জানতে চাইলো। রণ কিছুক্ষণ চুপ থেকে শুভ্রাকে দেখলো-“সেসব আপনার না শুনলেও চলবে। যেটা শুনতে হবে সেটা বলি?”
শুভ্রা কৌতূহলে তাকায়-“কি?”
রণ মুচকি হেসে বললো-“আপনাকে সুন্দর লাগছে শুভ্রা।”
হুট করে শুভ্রার চারপাশটা রঙিন হয়ে গেলো। ওর বুকের মাঝে যেন কলকল করে ঝর্ণাধারা বয়ে যায়। এতটুকু কথায় মনটা স্নিগ্ধ কোমলতায় ভরে ওঠে। তারপরই অভিমানে মনটা কুটকুট করে-“তিনদিনে আজ প্রথম নজরে এলো?”
রণ মুচকি হাসলো-“নাহ, প্রতিদিন নজরে এসেছে। কিন্তু বললে তো আবার আপনার মাটিতে পা পড়বে না।”
শুভ্রা বড় বড় চোখে তাকায়-“তাই ভাবেন আপনি?”
রণ দুষ্ট হেসে মাথা দুলায়-“ভাবি তো। সুন্দরী মেয়েদের এমনিতেই অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না। তাই তাদের প্রসংশা ভেবেচিন্তে করতে হয়।”
শুভ্রা হুট করে উঠে দাঁড়ায়-“আপনি খুব খারাপ মানুষ তো? প্রতিদিন আপনার জন্য সেজেগুজে বসে থাকছি আর আপনি কিনা আমাকে ইচ্ছে করে ইগনোর করছেন? কথা নেই আপনার সাথে।”
শুভ্রা ঘুরতেই রণ ওর হাত ধরে ফেলে। টেনে নিজের পাশে বসিয়ে দেয়। হাতটা শক্ত করে মুঠোয় পুরে নিয়ে আচমকা ঠোঁট ছুয়ে দিয়ে বললো-“আপনি অভিমান করতেও জানেন দেখছি?”
শুভ্রা লজ্জা পেয়ে গেলো। মানুষটা হুটহাট এমন সব কাজ করে যে লাজুক হওয়ারও সুযোগ দেয় না। শুভ্রা হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলে রণ হাতটা আরও টেনে নিয়ে বুকের সাথে আঁটকে রেখে বললো-“এই বলছেন আমার জন্য সাজগোছ করেছেন আবার এপ্রিশিয়েট করলে রাগ করছেন। কি করি বলুন তো?”
রণর এমন কথায় শুভ্রা মাথা নিচু করে হাসলো। ওর ফর্সা গালে রক্ত জমেছে। তা দেখে রণ আরেকটু দুষ্টুমি করবে মনস্থির করলো। রণ শুভ্রার কানে ফিসফিস করলো-“একটা পঁচা কাজের ইচ্ছে জেগেছে মনে। করবো?”
শুভ্রা ভরকে গিয়ে রণর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে জানতে চাইলো-“কি পঁচা কাজ?”
রণ সুযোগ মতো শুভ্রার অধরে খুব আলতো করে অধর স্পর্শ করে বললো-“খুব ইচ্ছে করছিল মিষ্টি খেতে। খেয়ে নিলাম।”
শুভ্রা হতবিহ্বল। মনেহচ্ছে হুশ হারাবে যে কোন মুহূর্তে। নিজের অজান্তেই কি সে রণর খুব কাছে চলে যাচ্ছে দিনদিন? সে কি খুব ভুল কিছু করছে?

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-৩৩

ঘুম থেকে উঠেই শুভ্রা বাবাকে ফোন দিলো। মেয়ের ফোন পেয়ে সালিম সাহেবের চেহারায় হাসির আভা ফুটে উঠলো। সে উৎফুল্ল কন্ঠে ফোন ধরলো-“আম্মা, কি খবর দিবেন?”
শুভ্রা বললো-“আপনার জামাই গেছে এলাকায়। কালকের জনসভার প্রস্তুতি নিতে।”
সালিম সাহেব গম্ভীর হলেন-“আর?”
“কালকে আপনার আপা কি একটা প্রজেক্টের ঘোষণা দেবে। আর দলের বিষয়ে কিছু সিদ্ধান্ত নেবে। উনি খুলে বলেননি কিছু।”
“আচ্ছা। আপনার শরীর ভালো আছে আম্মা?”
হুট করে প্রসঙ্গ পাল্টে যাওয়াতে শুভ্রা খানিকটা অবাক হলো-“ভালো আছি আব্বা।”
“আপনি আপনের আব্বাকে ভালোবাসেন তো?”
শুভ্রা হতবাক গলায় বললো-“এইটা কেমন কথা আব্বা? ভালো না বাসলে এইসব বলতাম আপনাকে?”
সালিম সাহেব হাসলো-“আচ্ছা আচ্ছা রাগ করেন কেন? এমনি জানতে চাইলাম।”
শুভ্রা ম্লান কন্ঠে বললো-“একটা কথা বলি আব্বা। তন্ময় ভাই আসছে তো অনেকদিন হইলো। চাচাকে বইলেন তাকে এইবার একটা বিয়ে করায় যেন?”
সালিম সাহেবের ভ্রু কুঁচকে গেলো। সন্দিহান গলায় জানতে চাইলো-“কি হইছে আম্মা? তন্ময় কিছু করছে?”
বলবে কিনা দ্বিধায় পড়ে গেলো শুভ্রা। তার বাবা ব্যাপারটা কিভাবে নেবে সে জানে না। উল্টো রিয়্যাকশন হলে খুব বিপদে পড়ে যাবে সে। সালিন সাহেব উদ্বিগ্ন হয়ে আবারও প্রশ্ন করলো-“আম্মা, হইছেটা কি? কি করছে তন্ময়?”
“কিছু না আব্বা। বাদ দেন।” শুভ্রা ভীত কন্ঠে জবাব দিলো। সালিম সাহেব এবার জোর করলো-“আম্মা, কি হইছে তাড়াতাড়ি বলেন। নাইলে আমি এখনই তন্ময়কে ডেকে আনবো।”
শুভ্রা আঁতকে চেচিয়ে উঠলো-“না না আব্বা এমন কিছু কইরেন না। তন্ময় ভাই যেন কিছু না জানে আব্বা। সে আগে প্রায়ই আমার শশুরবাড়ি আসতো। আমার ননদকে নাকি পছন্দ। এইদিকে আপনের জামাই একদিন দেখে খুব রাগ হইছে। আব্বা তন্ময় ভাইকে আমি এখানে আসতে মানা করছি কিন্তু সে মানতেছে না।”
এবার সত্যি সত্যি সালিম সাহেবের কপালে ভাজ পড়লো। পরিস্থিতি এমনিতেই বিরুপ। সবদিক থেকে চাপে আছেন। এরমধ্যে যদি আবার তন্ময়ের কেস আসে তাহলে তো শেষ। কিছু একটা করতেই হবে। তন্ময়কে আঁটকাতে হবে কোনভাবে। মেয়েকে আশ্বাস দিলো-“ঠিক আছে আম্মা, আমি বিষয়টা দেখবো। আপনি চিন্তা কইরেন না।”
শুভ্রা হু বলে ফোন নামিয়ে রাখলো। বাবা আশ্বাস দিলেও শুভ্রা জানে তন্ময়কে ঠেকানো সহজ হবে না। সে আসলে চায় না ঘটনা রণর কান পর্যন্ত যাক। রণ জানলে খুব খারাপ হবে এতটুকু বোঝার জ্ঞান তার আছে। শুভ্রা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ভাবলো, আর কিছু খারাপ না হোক। এতে খারাপ সহ্য হচ্ছে না।

*****

পুরো এলাকা জুড়ে সাজ সাজ রব। প্রধানমন্ত্রী আসবে বলে পুরো শহর সাজানো হয়েছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। রণ দফায় দফায় মিটিং করছে দলের লোকজনদের সাথে। কাল থেকে না ঘুমিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। আপাতত তৈরি হওয়ার জন্য রুমে ফিরেছে। মিহির জানালো দিলশাদ এসেছে। জরুরি কথা বলবে। রণ মিহিরকে বললো দিলশাদকে ভেতরে নিয়ে আসতে।
“দিলশাদ, কি হয়েছে? হঠাৎ জরুরি ভাবে চলে এলি?”
“ভাই, সালিম সাহেব অনেক লিয়াজো করার চেষ্টা করতেছে। আমার আশঙ্কা আপনাকে খারাপ বানানোর জন্য সে হয়তো প্রধানমন্ত্রীর উপর হামলা চালানোর চেষ্টা করতে পারে।”
রণ প্রথমে অবাক হলো তারপর হেসে দিলো-“এতোটা নিচে নামবে না মনেহয়। আফটারঅল হাজার হলেও আমি তার মেয়ের জামাই।”
দিলশাদ মোটেও হাসলোনা-“ভাই, আমি সিরিয়াসলি বলতেছি। উনার প্রতিপক্ষ হিসেবে যেই থাক কাউকে গোনায় ধরে না সে। তাছাড়া সোহেলের চলনবলন খুব সন্দেহজনক। সে নিজের গ্যাং নিয়ে আপনার সমর্থক কয়েকজনকে হুমকি দিয়েছে অলরেডি।”
রণ একটু ভাবলো। চেহারায় কয়েকটা রেখা উঠে মিলিয়ে গেলো। মিহিরের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো-“খাদেমের বউ কই?”
“নিজের বাসায়। কেন ভাই?”
মিহির বিস্ময় নিয়ে জানতে চাইলে রণ বললো-“ওকে দূরে কোথাও সরায় নেওয়া যায় না? খাদেমের মামলাটা আবার ওপেন করতাম।”
দিলশাদ থামালো রণকে-“ভাই, একটা কথা বলি?”
রণ দিলশাদের দিকে তাকালো। দিলশাদ একবার মিহিরকে দেখে নিল-“খাদেমের বউকে দিয়ে হবে না। সত্যি বলতে কাউকে দিয়েই হবে না। ওরা কোন না কোনভাবে খুঁজে বের করে ফেলবে। তারপর মামলা ডিসমিস।”
রণ ভাবনায় ডুবে থেকে বললো-“তাহলে কি করবো বলে দে।”
দিলশাদ মাথা চুলকায়। যা মনে আছে তা বলে ফেলা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছে না। শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিলো। রণকে বললো-“ভাই, আজকের পর্ব শেষ হোক তারপর একটা সিদ্ধান্ত নেন কি করবেন৷ দেখেন সালিম সাহেব আজকে কি করে। আর একটু চোখ কান খোলা রাইখেন ভাই। মিহির আর রাজীব যেন সবসময় আপনের সাথে থাকে।”
রণ মাথা দোলায়-“ঠিক আছে।”
ফোন বেজে উঠতেই রণ ছুট লাগালো। প্রধানমন্ত্রী কাছাকাছি এসে গেছে।

রণ পৌঁছে দেখলো সালিম সাহেব উপস্থিত তার দলবল নিয়ে। রণকে দেখে হাসলো-“তুমি আমাকে না বললেও আমি উপস্থিত আছি জামাই। আপার সাথে আমার সম্পর্কটা তোমার বয়সের চাইতেও অনেক বেশি পুরনো। এইজন্যই সব জায়গায় পাঙ্গা লাগা ঠিক না।”
রণ হাসলো-“কে বললো আমি পাঙ্গা লেগেছি? আপনি দলের পুরনো মানুষ। যে কোন জায়গায় আপনার অটো দাওয়াত ইস্যু হয়ে যায়। তো অনুষ্ঠান করে দাওয়াত দিতে হবে কেন? সব জায়গায় তো বিনা দাওয়াতে হাজির হয়ে যান।”
সোহেল তেড়ে এলো মারতে। সালিম সাহেব ঠেকালো-“তোর বোন জামাই হয়। খবরদার অসন্মান করবি না। আর আপার সামনে কোন কাহিনি না।”
সোহেল পিছু হটে গেলো। রণ কিছু বলার আগেই নেত্রী এসে নামলো।

*****

জলি নামাজে বসেছে। কাল রণর সাথে যেতে চাইলেও রণ তাকে সাথে নেয়নি। বউকে বলেছে সেও নাকি যাবে না। রণ একা একা এলাকায় গেলেই জলির বুক ধকধক করে। অজানা আশঙ্কায় বুক কাঁপে। শুভ্রাকে সে কথা বলা যায় না। তাই নামাজে বসে আছে কাল থেকে। জায়নামাজে বসে থেকেই কলিংবেলের আওয়াজ শুনলো সে।

বিকেলের দিকে হাসিখুশির সাথে বসে গল্প করছিল শুভ্রা। সেই সময় কলিংবেল বাজলো। হাসিখুশি প্রস্তাব করেছে লুডু খেলার। শুভ্রা কলিংবেল শুনে উঠে দাঁড়ায়-“তোমরা লুডু বের করো আমি দেখে আসছি কে এসেছে?”
“আচ্ছা ভাবি।”
হাসি ঘাড় হেলায়। শুভ্রা ছুটে এসে দরজা খুলতেই চমকে উঠলো। তন্ময় দাঁড়িয়ে আছে মুখে হাসি নিয়ে। শুভ্রা ভয় পাওয়া গলায় বললো-“তুমি?”
“হ্যা আমি। আজ তো তোর বর নেই তাই এলাম।”
শুভ্রা মাথা নাড়ে-“তুমি চলে যাও ভাইয়া। প্লিজ চলে যাও। ও কোনভাবে জানলে খুব অশান্তি হবে।”
তন্ময় শুভ্রাকে ঠেলে ঘরের ভেতরে ঢুকলো-“কোনভাবেই জানবে না। তোর জামাই ভীষণ বিজি।”
এমন সময় খুশি উঁকি দিলো-“ভাবি, আসছো না কেন? লুডু সাজিয়েছি।”
তন্ময় চোখ নাচায়-“আরে বাহ! লুডু খেলা হবে নাকি? চল আমি খেলবো তোদের সাথে। টিম বানিয়ে খেলা যাবে।”
শুভ্রা খুশিকে ধমকে দিলো-“তুমি ভেতরে যাও খুশি আমি আসছি।”
খুশি ভয় পেয়ে ভেতর ঘরে দৌড়ে চলে গেলো। শুভ্রা তন্ময়কে দেখলো-“ভাইয়া প্লিজ। আমি কোন সিন করতে চাই না। তুমি চলে যাও প্লিজ। বারবার বলছি এখানে এসো না।”
তন্ময় কঠিন দৃষ্টিতে শুভ্রাকে দেখলো-“দেখ শুভ্রা, তোর চিন্তা দুলাভাইকে নিয়ে তো?”
শুভ্রা জবাব দিলো না। তন্ময় হাসলো-“এতো ভাবিস না শুভ্রা। আচ্ছা, ধর যদি তোর বর না থাকে, তাহলে?”
শুভ্রার ভ্রু কুঁচকে গেলো-“মানে? কি বলতে চাইছো?”
“তোর বর গেছে আমাদের এলাকায়। ও ছোট বাবার প্রতিপক্ষ। ছোট বাবা নিজের প্রতি পক্ষকে কোন ছাড় দেয় না এটা তুই ভালোমতোই জানিস। যদি তোর বর আজ বাসায় না ফেরে তাহলে কেমন হয়? কি করবি তুই?”
শুভ্রা বোকার মতো তাকিয়ে থাকে তন্ময়ের দিকে-“তুমি কি বলতে চাইছো আমি বুঝতে পারছি না ভাইয়া।”
“ছোট বাবা খুব রেগে আছে তোর বরের উপর। বড় কিছু করে ফেলতে পারে তাকে।”
শুভ্রার মাথার উপর দিয়ে গেলো তন্ময়ের কথা। তার বাবা তার স্বামীকে কিছু করবে এমনটা সে কল্পনাও করে না। হাজার হোক মেয়ে জামাই সে। হঠাৎ পেছনে জলির কন্ঠ-“আমার রণর কি হইছে? ও বউ কি হইছে? তোমার ভাই কি বলে এইসব? আমার বাবুন। ওহহহ।”
বুক খামচে ধরে সেকেন্ডের মধ্যে জলি মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। শুভ্রা চেচিয়ে উঠে দৌড়ে এসে জলিকে ধরে-“মা!”

আমার নতুন বই অন্ধকারে জলের কোলাহল প্রি অর্ডার করেছেন তো?

চলবে—
©Farhana_Yesmin

দর্পহরন পর্ব-২৯+৩০

0

#দর্পহরন
#পর্ব-২৯

রণর হাতে একটা লিষ্ট। কয়েকদিন আগে দিলশাদ পাঠিয়েছে লিষ্টটা। ওর এলাকায় কারা কারা সরাসরি সালিম সাহেবের বিপক্ষে, কারা নিউট্রাল আর কারা পক্ষে পুরো তথ্য আছে এখানে। পক্ষে বিপক্ষে ছাড়া এলাকার কিছু ব্যবসায়ী আছে যারা কোনদিকেই থাকে না। যার যখন পাওয়ার তখন তার হয়ে কাজ করে। রণ অনেকক্ষণ লিষ্ট হাতে নিয়ে বসে থাকলো। এদের মধ্যে কেবল সবুর আর ইমাদের সাথে কথা বলতে পেরেছে রণ। ওরা দলের জন্য কাজ করলেও সালিম সাহেবের কারণে কখনো পাত্তা পায়নি। আপাতত আসন্ন দলীর নির্বাচনে রণকে সাপোর্ট দেবে কথা দিয়েছে। সেই সাথে বাকী সকল সুবিধা বঞ্চিতদের সাথে কথা বলবে আস্বাস দিয়েছে রণকে। রণও তার কাজ শুরু করেছে ভেতরে ভেতরে। কয়েকটা সরকারি কাজের টেন্ডার হয়েছে যেগুলোর কাজ ইমাদ সবুর আর দুই তিনজনের মাঝে ভাগ করে দিয়ে দিয়েছে। সালিম সাহেব পর্যন্ত খবর যেতে দেয়নি। আশা করছে এই কাজের পর অনেককেই তার পাশে পাবে। রণ মুচকি হেঁসে হাতের কলম দিয়ে কয়েকটা নাম কেটে দিলো লিষ্ট থেকে। কাগজটা ভাজ করে নিজের পার্সোনাল ড্রয়ারে রেখে দিলো। আজ পাশের দেশে যাবে প্রধানমন্ত্রীর সাথে তিনদিনের রাস্ট্রিয় সফরে। এসে বাকী কাজ নিয়ে বসবে। তারপর হুট করে একদিন এলাকায় দলীয় প্রধান নির্বাচনের ভোট করবে। আপাতত এমনটাই ভেবে রেখেছে রণ। কতটা সফল হবে সেটা ভবিষ্যত বলে দেবে। মিহির ফোন দিয়েছে-“ভাই, এই দিকে খুব হাঙামা হচ্ছে।”
“কি নিয়ে?”
“সবুর ভাই আর ইমাদের উপর চরাও হইছে সালিম সাহেবের লোক। মোর্শেদ আর সোহেল আবার মাঠ গরম করতেছে।”
“করুক। মিহির সবাইকে শান্ত থাকতে বল। আপাতত কেউ কিছু করবি না। আমি তিনদিন থাকবো না তোরা কেউ ঝামেলা করবি না। খুব বেশি সমস্যা হলে দিলশাদকে জানাবি।”
“ভাই, এইরকম চললে কিভাবে শান্ত থাকবে সবাই? দুই দফা মারামারি হউছে। কার্যালয়ে কাউকে ঢুকতে দিতেছে না। সোহেল কব্জা করে রাখছে।”
“রাখুক। সবাইকে বল আমি না আসা পর্যন্ত কেউ কার্যালয়ে না যাক। আমি এসে দেখবো।”
“আচ্ছা ভাই।”
মিহির যেন অনিচ্ছায় ফোন কাটলো। রণ কি ভেবে দিলশাদকে ফোন দিলো-“দিলশাদ, খবর শুনেছিস?”
“শুনেছি ভাই। আপনি ভাববেন না আমি খেয়াল রাখবো।”
“শুধু খেয়াল রাখিস বড় কোন ঘটনা না ঘটে।”
“আচ্ছা।”
তবুও মনটা শান্ত হলো না রণর। মনটা খচখচ করছে। কিন্তু এতো কিছু ভাবার সময় নেই এখন। ঘড়ি দেখলো এখনই বেরুতে হবে। আর দুই ঘন্টা পরে তার ফ্লাইট।

*****

“আরে ভাবি, বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ভেতরে এসো।”
হাসি দরজায় তাকিয়ে শুভ্রাকে দেখলো। শুভ্রা দ্বিধা নিয়ে জানতে চাইলো-“তোমরা কি পড়ালেখা করছো? তাহলে আসবো না।”
খুশি উঠে শুভ্রাকে ধরে রুমের ভেতর আনলো-“পড়ালেখা করছি না। ভাইয়ার ছবি দেখছিলাম। তুমিও দেখো না। ভাইয়া অনেক ভালো ভালো কাজ করছে তারই নিউজ।”
শুভ্রার দিকে মোবাইল বাড়িয়ে দিলো। রণর হাস্যোজ্জল ছবি আছে সেখানে। প্রায় প্রতি ছবিতে সেদিনের মেয়েটাকে ওর সাথে দেখা যাচ্ছে।
“এই মেয়েটাকে চেন তোমরা?”
হাসি দেখলো-“ভাইয়া বলেছিল প্রধানমন্ত্রীর বোনের মেয়ে। কানাডা থেকে পড়ালেখা করে এসেছে। একটা প্রজেক্টের লিড হিসেবে কাজ করবে। মেয়েটার নামটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। ভারী আনকমন নাম, চন্দ্রানী। সুন্দর না নামটা?”
শুভ্রা কিছু না বলে মেয়েটাকে মন দিয়ে দেখলো। সে কি মেয়েটার থেকে কম সুন্দর? সেদিন দেখেছিল মেয়েটাকে। গায়ের রং বরং তার থেকে একটু চাপাই। চেহারা বেশ আকর্ষনীয়। সবসময় শাড়ী পরে ঘুরছে। নিজের দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে দেখে নিলো। ইদানীং সে সালোয়ার কামিজ পরতে শুরু করেছে। জলির কড়া আদেশ ঘরের বউ গেঞ্জি পড়ে ঘোরা মানা। বাসায় সবসময় মেহমান আসে যায়। এরকম থাকলে লোকে বদনাম দেবে। শুভ্রা উচ্চ বাচ্য না করে মেনে নিয়েছে।
“এই ভাবী, তুমিও কিন্তু বাসায় বসে না থেকে কোন কাজে জয়েন করতে পারো?”
শুভ্রা না বুঝে খুশির দিকে তাকায়-“না মানে তোমার আমেরিকার ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি আছে চাইলেই ভালো কোন জবে জয়েন করতে পারো।”
শুভ্রা খানিকক্ষন চুপ করে রইলো। আসলেই তো? অনেক কিছুই হতে পারতো কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো গত কয়েক মাসে তার জীবন উল্টে পাল্টে গেছে। কোন কিছু ভাবার অবকাষই পায়নি। ভাবছেই না কিছু। অথচ ক্যারিয়ার নিয়ে কত কিছু ভেবে রেখেছিল। সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে হয়তো সে এতোদিনে আমেরিকাতেই কোন চাকরিতে ঢুকে যেত। এখন কেন যেন সব ভাবনা তালাবন্ধ হয়ে গেছে। কিছুই ভাবতে ভালো লাগে না আর। হঠাৎ গায়ে হাত। শুভ্রা তাকিয়ে দেখলো হাসি। শুভ্রা হাসলো-“ভালো কথা মনে করিয়ে দিয়েছ তোমরা। এ ব্যাপারে ভেবে দেখবো। আসলেই বাসায় থেকে বোর হচ্ছি। কিছু একটা করলে আমারও সময়টা ভালো কাটবে।”
খুশি মাথা দুলায়-“যাই করো ভাইয়াকে বলে করো। নিজের লোকদের ব্যাপারে ভাইয়া খুব পজেসিভ।”
“পজেসিভ মানে? কাজ করতে দেবে না?”
“না সেটা না। সে আসলে ভয় পায় কেউ আমাদের কোন ক্ষতি না করে। এটাই কারণ।”
“আচ্ছা।”
মুখে আচ্ছা বললেও মনে মনে বললো ‘কিন্তু আমি কি তার আপনজন যে আমার জন্য পজেসিভ হবে?”

*****

“আব্বা, কিছু একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। সবকিছু হাত থিকা বাইর হইয়া যাইতেছে। কাজ অন্য মানুষকে দিয়ে দিতেছে শুভ্রার জামাই। সবাই আপনার বিরুদ্ধে চইলা যাইতেছে।”
সালিম সাহেবের চেহারা জুড়ে চিন্তার আভাস। বড় ভাই মোর্শেদ যেন সেই চিন্তায় ঘি ঢাললো-“হহহ সালিম, সোহেল কিন্তু ঠিক কইতেছে। এতোগুলা কাজ গেলো একটারও খবর পাইলাম না। এইদিকে বালু উত্তোলনের কাজ তো বন্ধই বলা যায়। সেইদিন হিরা চুপেচাপে বালু তোলার কাজ করতে গেছিলো কে জানি পুলিশে খবর দিছে। সবার সাহস বাইরা যাইতেছে। কি করবি সালিম? মাইয়া বিয়া দিয়া কি ফাইসা গেলি? জামাই এখন যা মন চায় তাই করবো?”
“আব্বা, সবচেয়ে বড় কথা কি জানেন, আমাগো মানুষ ভয় পাইতো ভয়ডা কাইটা যাইতেছে। আর ভয় কাটলে কি হইবো জানেন তো? কিছু না করলে সামনে বিপদে পড়ুম।”
সালিম সাহেব সোহেল আর মোর্শেদকে পালাক্রমে দেখলো। গম্ভীর হয়েই জবাব দিলো-“মাইয়া বিয়া দিছি শুক্কুরে শুক্কুরে দেড় দুই মাস। ওখনই জামাই এর লগে বিটলামি করুম? আর জামাই ও আমাগো আপন ভাববো? এট্টু ধৈর্য্য ধরতে পারেন না আপনেরা। কিছু কাম হাত থিকা গেলে যাক না। এতো আফসোস করেন কিয়ের কিগা? অল্প কিছুর বদলে বড় কিছু যদি পান তাইলে কি সমস্যা আছে? এতোদিন তো মেলা খাইছি এখন এট্টু না হয় কয়দিন কম খাইলাম। চিন্তা কইরেন না। সময়মতো জামাই আর কামাই দুইটাই আমাগো হাতে আইবো।”
সোহেল উৎসুক দৃষ্টি মেলে তাকায়-“কেমনে আব্বা?”
“সময় আইলে দেখবি সোহেল। সবুর কর, সবুরে মেওয়া ফলে। জামাই বাবাজিরে ওর অস্ত্র দিয়াই ঘায়েল করুম। কিন্তু তার আগে তোরে একটাই অনুরোধ উল্টা পুল্টা কিছু করবি না। পুলিশ জানি তোর নাগাল না পায়। তোরা চুপচাপ থাক বাকী সব সামলাই নিমু আমি।”

*****

দুপুরে দেশে ফিরে সোজা অফিসে গেছিল রণ। সামনেই একটি আর্ন্তজাতিক সংস্থার সম্মেলন হবে দেশে সেই নিয়ে তুমুল তোরজোর। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাস্ট্রপ্রধানরা আসবে। সেই নিয়ে দফায় দফায় আলোচনা পর্যালোচনা চলছে। কয়েকটা মিটিং এটেন্ড করে আর পারলোনা রণ। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাসায় ফিরলো সন্ধ্যার পরপরই। কিন্তু ড্রয়িংরুমে ঢুকেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো তন্ময়কে দেখে। তার দুই বোন তন্ময়ের সাথে গল্প করছে। ওকে দেখেই হাসিখুশির চেহারা ম্লান হয়ে গেলো। তন্ময়ও উঠে দাঁড়িয়েছে। শুভ্রা বিস্মিত, এইসময় রণ আসবে ভাবেনি। রণর বাসায় ফেরার সময় প্রায় দিনই গভীর রাত। আর আজ তো দেশের বাইরে থেকে ফেরার কথা। রণ মনে মনে ভীষন রেগে গেলো। সৌজন্যতার বশে দুটো কথা বলেই সে ঘরে ঢুকে গেলো। মেজাজ তার আকাশচুম্বী। নিজেকে শান্ত করতেই লম্বা সময় বাথটাবের উষ্ণ জ্বলে বসে রইলো চোখ বুঁজে।

ঘুমিয়ে গেছিল রণ, দরজায় করাঘাত শুনে তার ঘুম ভাঙলো-“কে?”
ঘুম জড়ানো কন্ঠে জানতে চাইলো রণ।
“আমি। আপনার কি শরীর খারাপ করছে? বের হচ্ছেন না কেন? আন্টি খুব চিন্তা করছে।”
রণ জবাব দিলো না। পাঁচ মিনিট পরে টাওয়েল পড়ে বেরিয়ে এলো। রণ শুভ্রাকে দেখেও দেখলো না। শুভ্রা বেশ অপ্রস্তুত। রণ কখনো এরকম অবস্থায় তার সামনে আসেনি। আসলে আসার মতো পরিস্থিতি হয়নি। আজ কি হলো? রণ চুপচাপ আলমারির সামনে যেয়ে দাঁড়িয়ে গেঞ্জি বের করে গায়ে জড়িয়ে নিলো। ট্রাউজার পরার সময় লজ্জা পেলো শুভ্রা। সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।

রণ সরাসরি বোনদের রুমে। দীর্ঘ সময় পানিতে থাকার কারণে ওর চোখ দুটো অসম্ভব লাল। হাসিখুশি ভীষণ ভয় পেলো। তারা বেশ বুঝতে পারছে ভাই আজ রেগে গেছে খুব।
“এই ছেলে আগে এসেছে বাসায়?”
দুইবোনের একজন হ্যা আরেকজন না সূচক মাথা নাড়ে। রণ গম্ভীর হলো-“সত্যি বল।”
হাসি ভয় পেলো-“আগে একদিন এসেছিল।”
“আমাকে বলিসনি কেন?”
খুশি জবাব দিলো-“ভাবির ভাই ভাবির কাছে আসে আমরা কি বলবো?”
“তো তোরা গল্প করতে গেছিলি কেন?”
রণ দু’হাত আড়াআড়ি ভাজ করে দাঁড়ায়। হাসিখুশি ঢোক গিললো-“ভাবি ডাকলে কি মানা করবো?”
“আর যাবিনা। ভাবির বাড়ি থেকে কেউ আসলে আর সামনে যাবি না। মনে থাকবে?”
দুই বোন স্ব জোরে মাথা দুলায়। রণ দাঁড়ায় না। জলি খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছিল। মায়ের সাথে কুশল বিনিময় শেষে চুপচাপ খেয়ে নিলো।

রণ খেতে বসতেই ঘরে ফিরেছিল শুভ্রা। তন্ময়কে দেখে লোকটা এতো গম্ভীর হয়ে গেলো কেন তা বোধগম্য হলো না শুভ্রার।
“আপনার ভাইরা কেউ এ বাড়িতে আসুক আমি চাই না।”
চমকে উঠলো শুভ্রা। রণ কখন সোফায় এসে বসেছ। শুভ্রা না বুঝে আবার জানতে চাইলে রণ কথার পুনরাবৃত্তি করলো। শুভ্রা বিস্ময় নিয়ে জানতে চাইলো-“কেন? ভাই বোনকে দেখতে আসবে না? এটা কেমন কথা?”
“না আসবে না। আমি চাই না আপনার চরিত্রহীন ভাইদের ছায়া আমাদের বাড়িতে পড়ুক।”
রণ গম্ভীর। ওর সুদর্শন চেহারা জুড়ে রাগের লালিমা।
শুভ্রা রেগে আগুন। সে রণর সামনে এসে দাঁড়ায়-“হাউ ডেয়ার ইউ? আমার সাহস হয় কি করে আমার ভাইদের চরিত্রহীন বলতে?”
রণর ভাব পরিবর্তন হলো না-“চরিত্রহীনকে চরিত্রহীন বলবো নাতো কি বলবো?”
“কিসের ভিত্তিতে এমন অভিযোগ তুলছেন আপনি? কি করেছে তন্ময়?”
“এতো ব্যাখ্যা দিতে পারবোনা। আমি বলেছি এ বাড়িতে ওরা কেউ আসবে ব্যস কথা শেষ।”
শুভ্রার গায়ে লাগলো কথাটা-“কেন আসবে না। ওরা আমার ভাই হয়। আমাকে দেখতে আসবে না? এ বাড়িতে আমার কি অধিকার তবে? আমি কি আপনার নামমাত্র বউ?”
রণ ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলো-“অধিকার! অধিকার অর্জন করে নিতে হয় স্বামীর বাড়ির সকলকে আপন করে নিয়ে, নিজের আন্তরিকতা দিয়ে। আপনি বলুনতো কি করেছেন আজ পর্যন্ত। না আমার মায়ের জন্য কিছু করেছেন না আমার বোনেদের জন্য আর না আমার জন্য। বলুন কিছু করেছেন?”
শুভ্রা স্তম্ভিত। রণ এভাবে তাকে বলবে সে ভাবেনি কখনো। রণ ঠান্ডা গলায় বললো-“আপনি পণ করে এসেছেন আমাকে ধ্বংস করবেন। বেশ ভালো কথা। কিন্তু আমি আগেই আপনাকে বলেছিলাম, আমার পরিবার থেকে দূরে থাকবেন। যা কিছু করতে চান আমার সাথে করবেন। আমাকে কষ্ট দেবেন দিন বাট নট মাই সিস্টার্স নট মাই মাদার। ওদের ক্ষতি করার কথা ভাবলেও সেটার পরিনাম ভালো হবে না।”
হুট করে এতোগুলা কড়া কথা শুনে কেন যেন কান্না পেয়ে গেলো শুভ্রার। সে ঝরঝর করে কেঁদে দিলো-“আমি কি করেছি? ক’দিন পরে বাড়ি ফিরে এরকম করছেন কেন আমার সাথে? দোষটা কি আমার?”
রণ শুভ্রার দিকে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়-“ক’দিন পরে বাড়ি ফিরেছি আপনি কি খুশি? কই দেখলাম নাতো? বেশ তো ভাইয়ের সাথে গল্প করছিলেন। বাদ দিন এসব নাকি কান্না। আমি ভীষণ টায়ার্ড, ঘুমাতে হবে আমাকে।”
রণ বিছানার দিকে এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে শুভ্রা তাকে জড়িয়ে ধরলো। পিঠে মুখ ঠেকিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে বললো-“কেন এমন নিষ্ঠুরতা দেখাচ্ছেন আমার সাথে? প্রথমে কিডন্যাপ করলেন, বিনা কারণে দুইমাস আঁটকে রেখে অত্যাচার করলেন। এখন বিয়ের পর সবসময় দুরছাই করছেন। কেন করছেন এমন? কেন কষ্ট দিচ্ছেন আমাকে? কেন? কেন?”

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-৩০

“হাসিখুশিকে নিজের বোন মনে করি। আর আন্টিকে মা। ওদের ক্ষতি করার কথা আমি স্বপ্নেও ভাবি না। অথচ আপনি আমাকে কতবড় অভিযোগ দিয়ে দিলেন। একবারও ভাবলেন না আমি কষ্ট পাবো কিনা।”
শুভ্রার কান্না জড়ানো গলায় বলা কথাগুলো শুনে কিছুটা সময় স্থির হয়ে রইলো রণ। তারপর শুভ্রাকে ধরে নিজের সামনে নিয়ে এলো। শুভ্রার কান্না ভেজা মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো বেশ কিছুক্ষণ। ফর্সা মুখটা কান্নার দমকে কেমন রক্তলাল হয়ে আছে। রণর বুকের কোথাও যেন রক্ত ক্ষরন হয়। শুভ্রা মুখ নিচু করে কেঁদে যাচ্ছে। রণ ওর চিবুক তুলে ডাকলো-“শুনুন, আপনি কি সত্যিই এতো ইনোসেন্ট? মানে কিছুই জানেন না বোঝেন না?”
শুভ্রার ফোঁপানি কমলো কিছুটা। চোখের গড়িয়ে পড়া জল মুছে অবাক হয়ে বললো-“কি জানবো? আমার কি কিছু জানা উচিত?”
রণর এবার দুঃখে হাসি পেলো। সে মাথার চুল হাতালো কয়েকবার তারপর দ্বিধা নিয়ে বললো-“আপনার পরিবারের লোকগুলো কেমন সেসব কিছুই কি আপনি জানেন না? আপনার ভাই, আপনার বাবা, চাচা, তন্ময় ওদের সম্পর্কে কিছু জানেন না কিভাবে সেটা ভেবেই অবাক হচ্ছি। আপনি এ যুগের মেয়ে। ইন্টারনেট ব্যবহারে দক্ষ। তবুও এরকম অন্ধকারে আছেন কি করে সেটাই আমার বুঝে আসছে না।”
শুভ্রা এবার ভালো করে চোখের জল মুছে নিলো। বিরক্ত স্বরে বললো-“আপনি এতো হেয়ালি করছেন কেন? যেটা বলবার বলে ফেললেই তো হয়? আমার পরিবারের লোকজন কেমন বলুন দেখি? পত্রিকায় কিংবা ওয়েবে অনেক কিছুই দেখি তাই বলে সব কি সত্যি? আমরা কয়েক পুরুষ ধরে বনেদী। দাদা সাংসদ ও মন্ত্রী ছিলেন, চাচাও তাই তারপর বাবা। দীর্ঘদিন ধরে পারিবারিক ভাবে ক্ষমতায় থাকা খুব সহজ কাজ নয়। বন্ধুর চেয়ে শত্রু হবে বেশি, শুভাকাঙ্ক্ষী জমে যাবে, প্রশংসার চাইতে বদনাম বেশি হবে। আমাদের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। আমি কিছু কিছু ব্যাপার দেখেছি নিউজে কিন্তু এটাও ভালোমতো জানি এসব সত্যি না। আমার পরিবার কখনো এতোটা খারাপ হবে না হতে পারে না।”
রণ হাল ছেড়ে দিয়ে কাঁধ ঝাঁকাল-“তাহলে তো আপনাকে কিছু বলা বৃথা। সব জেনেশুনে যখন অন্ধ সেজে বসে আছেন তখন আপনাকে জ্ঞান দিয়ে আলো ফোটানোর চেষ্টা করা অনর্থক।”
শুভ্রা রণর চোখে চোখ রাখে-“দেখুন, বাবা যখন থেকে আমাকে বুঝিয়েছে আমি এসব নিউজ, পোর্টাল এসব দেখা একদমই বন্ধ করে দিয়েছি। তাছাড়া আমি থেকেছি বাইরে বাইরে। জীবন কেটেছে ব্যস্ততায়। আপনি হয়ত জানেন না আমি নিজের খরচ নিজে চালানোর চেষ্টা করেছি সর্বদা। আমার অতো সময় কোথায় পরিবারে কোথায় কি হচ্ছে সেসব নিয়ে খোঁজ রাখবো।”
“এখন তো অঢেল সময় এখন খোঁজ রাখছেন না কেন?”
রণর কন্ঠে কৌতুক। শুভ্রা ভ্রুকুটি করলো-“টোন কাটছেন? আপনার অন্ন ধ্বংস করছি বলে?”
রণ জিভ কামড়ে বলে-“ছি ছি, এতো মিন মাইন্ড মনেহচ্ছে আমাকে?”
শুভ্রা ঠোঁট ওল্টায়-“বুঝিনা বাপু, আপনি কি বলতে চান তাই বুঝতে পারলাম না আজ অবধি।”
“চেষ্টা করলে ঠিকই পারতেন।” বিরবির করে রণ।
“কিভাবে পারতাম? সুযোগ না দিলে কিভাবে পারতাম?”
রণ রহস্য করে হাসলো। কৌতূহলে জানতে চাইলো-“তা কেমন সুযোগ চাচ্ছেন বলুন তো? আমিও আসলে বুঝতে পারছি না।”
“আপনাকে বুঝতে কি কি করতে হবে সেটা আগে বলুন। ভোর সকালে বেরিয়ে গভীর রাতে বাসায় ঢুকলে বউ কি বুঝবে আপনাকে?”
শুভ্রা ফিরে যাচ্ছিল রণ তার হাত ধরে কাছে টানলো। মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন করলো-“তো আপনি কি চাইছেন দেশের জরুরি কাজ বাদ দিয়ে আপনার কাছে বসে থাকি? আপনাকে দেখি সারাদিন?”
শুভ্রা থতমত খেলো-“আমি কখন একথা বললাম?”
রণ ঠোঁটের কোনের হাসিটা গিলে নিলো-“মুখে না বললেও মনে মনে বলছেন নিশ্চয়ই। তা নয়তো আমি শুনতে পেলাম কি করে?”
শুভ্রা মুখ হা করে তাকিয়ে আছে। ওর বোকা কান্ড দেখে রণ হো হো করে হেসে দিলো-“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? ভুল কিছু বলেছি?”
“আমার মন কি বলছে তা আপনি শুনতে পেলেন কি করে? খুব মন বিশারদ হয়েছেন দেখা যাচ্ছে। এইজন্যই বুঝি চন্দ্রানীর সাথে ঘুরে বেড়ানো হচ্ছে আজকাল? ওর মনের কথা খুব বুঝছেন তাই না?”
রণ বেশ মজা পেলো শুভ্রার কথায়। শুভ্রাকে আরেকটু রাগিয়ে দিতেই বললো-“তা একটু একটু পারছি বলতে পারেন। মেয়েটা বেশ ভালো। দেখেছেন দেশের বাইরে থাকার পরও কতো সুন্দর করে শাড়ী পরে থাকে।”
শরীরটা জ্বলে উঠলো শুভ্রার। সে হুট করে রণর খুব কাছে চলে এলো। ওর গেঞ্জির কলার মুচরে ধরে বললো-“চন্দ্রানী খুব সুন্দর শাড়ী পরে তাই না? তাতে তার শরীরের বাঁকগুলো স্পষ্ট বোঝা যায়। আপনার দেখতে সুবিধা হয়?”
রণ মোটেও ঘাবড়ে গেলোনা। তার চেহারা জুড়ে অস্পষ্ট হাসির রেখা ধরে রেখে বললো-“তা একটু সুবিধা হয় বইকি। কি আর করা নিজের বউয়েরটা যখন দেখার সুযোগ নেই তখন না হয় অন্যেরটাই দেখি।”
শুভ্রার সর্বাঙ্গ জ্বলে যাচ্ছে রণর কথা শুনে। ইচ্ছে করছে রণর টুটি চেপে ধরতে। দাঁতে দাঁত চেপে বললো-“এতো শখ বউয়ের টা দেখার তো দেখুন না। কে মানা করেছে আপনাকে? দেখুন চাইলে ছুঁয়ে দিন। ঢং করে ভদ্রলোক সেজে থাকা হচ্ছে তাই না?”
রণ মুগ্ধ চোখে শুভ্রাকে দেখছে। মেয়েটা রেগে টং হয়ে আছে। নাকের ডগা বেদানার মতো রং ধারণ করেছে। রাগের বশে কতটা কাছাকাছি এসেছে মেয়েটা টেরই পাচ্ছে না। রণ হুট করে শুভ্রাকে দু’হাতে জড়িয়ে নিলো-“আমি মোটেও ভদ্রলোক সেজে থাকছি না। আমি আসলেও ভদ্রলোক। বউয়ের অনুমতি ব্যাতীত তাকে দেখা তো দূর ছুঁয়ে দেওয়ারও কোন ইচ্ছে আমার নেই। বুঝলেন অবুঝ মেয়ে?”
বলেই ওর নাকে নিজের নাকটা ঘষে দিয়ে টুপ করে চুমো একে দিলো মেয়েটার নাকে। শুভ্রা হতচকিত রণর কান্ডে। এই লোক হুটহাট এমম এমন কাজ করে যে অবাক না হয়ে পারে না। লোকটার হাতের বাঁধনে বাঁধা পড়ে কেমন যেন লাগছে তার। বুকটা অকারণে ধুকপুক করছে। শুভ্রা কম্পিত কন্ঠে প্রশ্ন করলো-“কি করছেন?”
রণ মদিরাসাক্ত গলায় বললো-“আমি কি করলাম? আপনিই তো বললেন আপনাকে কাছে টানতে।”
শুভ্রা মাথা নাড়ে-“দেখতে বলেছি জড়িয়ে ধরতে বলিনি।”
রণ সাথে সাথে ছেড়ে দিলো শুভ্রাকে-“সরি, ভুল শুনেছি।”
শুভ্রার মনেহলো কি যেন হারিয়ে যাচ্ছে ওর কাছ থেকে। মন চাইলো রণকে জাপ্টে ধরতে। কিন্তু নিজের আত্মসম্মান বাঁধা দিলো। এর চেয়ে বেশি আগানো তার পক্ষে সম্ভব না। এতোটা নিচে নিজেকে নামাতে পারবে না। তাই অনেকটা মনখুন্ন হয়েই বিছানায় নিজের জায়গায় যেয়ে চুপটি করে শুয়ে পড়লো। রণ চুপচাপ ওকে দেখলো তারপর নিজেও শুয়ে পড়লো। ঘুমানোর আগ মুহুর্তে বললো-“আগামী কয়েকটা সপ্তাহ ভীষন ব্যস্ত থাকবো আমি। মা আর হাসিখুশির খেয়াল রাখার দায়িত্ব তাই আপনার উপর দিলাম। বাসায় যেন অযাচিত কেউ না আসে সেটা দেখভালের দায়িত্ব আপনার উপর। আশাকরছি আপনি আপনার দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করবেন।”
শুভ্রা চুপ করে রইলো। ঝগড়া করার মুড নেই তার।

*****

“ভাইয়া, তুমি আর এসো না এখানে। ও পছন্দ করছে না।”
শুভ্রার মুখে কথাটা শুনে অবাক তন্ময়-“আমি তোর ভাই শুভ্রা। আমি আসলে কি সমস্যা হবে?”
“আমি জানি না। ও বললো বাসায় পুরুষ আসা ঠিক না। আমরা মেয়েরা থাকি এইজন্য আর কি।”
তন্ময় মুখ নিচু করে বসে আছে। কিছু একটা ভাবলো তারপর বললো-“তাহলে তোকে সরাসরি বলি, তোর ননদটাকে পছন্দ হয়েছে শুভ্রা।”
শুভ্রা বিস্ময় নিয়ে ভাইকে দেখলো। ভাইয়ের চেহারা দেখে ওর শরীর কাঁপতে লাগলো। এ কি সর্বনাশা বিপদ আসতে চলেছে তার কাঁধে। সে নিচু স্বরে চেচিয়ে উঠলো-“ননদটাকে? কাকে?”
তন্ময় হাসলো-“খুশিকে। সি ইজ আ নাইস গার্ল।”
শুভ্রা ঢোক গিললো-“এসব ভুলে যাও ভাইয়া। ও শুনলে জানে মেরে ফেলবে আমাকে।”
তন্ময় তাকিয়ে রইলো-“এ কেমন কথা শুভ্রা। তোর ননদকে পছন্দ করেছি চাইলে বিয়ে করবো। এখানে মেরে ফেলার মতো কি হয়েছে?”
শুভ্রা আঁতকে উঠে বললো-“তোমার মাথা নষ্ট হয়েছে ভাইয়া। এটা কখনো সম্ভব হবে না। প্লিজ তুমি আর এসো না। এমনিতেই ঝামেলার শেষ নেই জীবনে। নতুন করে কোন ঝামেলা চাই না আর।”
তন্ময় অনড়ভাবে বসে রইলো-“তুই আমার বোন শুভ্রা। আমাকে জানিস আমি কেমন। তোর বরকে বরং বলিস আমার প্রস্তাব ভেবে দেখতে।”
শুভ্রা এবার হাতজোড় করলো-“প্লিজ ভাইয়া, এমন কিছু করো না। ও ওর বোনদের খুব ভালোবাসে। ওরা এখনো ছোট বিয়ের কথা মাথায় আনাও পাপ ওদের জন্য। আমি কিছুতেই এ কথা বলতে পারবোনা ওকে। প্লিজ ভুলে যাও এসব।”
তন্ময় উঠে দাঁড়ায়। ক্ষনকাল শুভ্রার দিকে তাকিয়ে রইলো তারপর স্মিত কন্ঠে বললো-“আজ আসছি।
প্রয়োজন হলে আবার আসবো। তোর ভাই নিজের মর্জির বাইরে একপাও নড়ে না। জানিস তো? ভালো থাকিস।”
শুভ্রা উদভ্রান্ত দৃষ্টি মেলে তন্ময়ের চলে যাওয়া দেখলো। এইজন্যই বুঝি লোকটা মানা করেছিল। ভেবে ভয়ে বুক হিম হয়ে গেলো শুভ্রার। তার বুকের ভেতর তোলপাড় হচ্ছে। মনেহচ্ছে কিছু একটা ঠিক নেই। বড় কোন অঘটন না ঘটে যায়। খুব ঘামতে লাগলো শুভ্রা।

চলবে—
©Farhana_Yesmin

দর্পহরন পর্ব-২৫+২৬+২৭

0

#দর্পহরন
#পর্ব-২৫

সকাল সকাল শুভ্রাকে বাড়িতে উপস্থিত হতে দেখে রিমা অবাক হয়ে জানতে চাইলো-“এতো সকালে তুই একা একা কোথা থিকা আসলি শারমিন?”
শুভ্রার মেজাজ খারাপ ছিলো সেটা মায়ের কথায় আরও বাড়লো-“এতো প্রশ্ন করো কেন আম্মা?আমার যখন ইচ্ছা তখন আসবো। নিজের বাড়িতে আসতে আবার সময় দেখা লাগবে? নাকি আমার আসা পছন্দ না তোমার? বিয়া হইছে মেয়ে পর হয়ে গেছে, তাই তো?”
রিমা হা করে মেয়েকে দেখছে। সে বুঝে পাচ্ছে না মেয়ে হঠাৎ করে এতো রেগে গেলো কেন? সে তো খুব সাধারণ একটা প্রশ্ন করেছে। মিনু কি বুঝলো কে জানে পরিস্থিতি শান্ত করতে বললো-“রিমা, বাদ দেতো। মেয়েটা সাতসকালে আসছে ওরে খাইতে টাইতে দে। প্রশ্ন পরেও করা যাবে।”
ইশারায় রিমাকে শান্ত থাকতে বললো। শুভ্রা অবশ্য তাতে শান্ত হলো না। সে গজগজ করলো আরও কিছুক্ষন তারপর বললো-“চাচী, আমি এখন খাবো না। রাতে ঘুম হয় নাই তাই ঘুমাবো। ঘুম থেকে উঠে খেতে মন চাইলে খাবো। দয়া করে তোমরা কেউ আমাকে ডাকবে না।”

শুভ্রা চলে যেতেই রিমা জায়ের দিকে তাকিয়ে বললো-“ওর হঠাৎ কি হইছে বুবু? জামাই ছাড়া সকাল সকাল চইলা আসলো কেন? কালকে এতো জোর করলাম আসলো না আর আজই সকালে চলে আসছে। দেখছেন কারবার?”
“আমার মনেহয় ঝগড়া হইছে জামাই এর সাথে।”
“কিন্তু জামাইরে তো ভালোই লাগছে আমার। ওর মা আর বোন দুইটাও ভালো। ঝগড়া কেন লাগবে? মানলাম ওরা আমাদের মতো না তাই বইলা ফেলনাও না। ঝগড়া কেন করবে?”
মিনু হাসলো-“তোর মাইয়া যে জেদি। এক্কেরে বংশের ধারা পাইছে। তয় জামাইরেও কিন্তু সোজা মনেহয় নাই। মন পরিস্কার হইতে পারে কিন্তু তেড়া আছে। নিশ্চয়ই কিছু কইছে শারমিনরে। তুই চিন্তা করিস না, আমি ওর লগে কথা কমু।”
চিন্তা করিস না বললেও রিমার মনে চিন্তা লেগে রইলো। একা একা বড় হওয়া মেয়েটা একটু বেশি জেদি সেটা তার চেয়ে ভালো কে জানে। কে জানে কি করে আসছে ওই বাড়িতে।

অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করেও ঘুম আসছে না শুভ্রার। কাল থেকে তার মনটা অসম্ভব খারাপ হয়ে আছে। রণর বলাটা প্রতিটা কথা তার গায়ে কাঁটার মতো বিঁধেছে। একজন মেয়ে হয়ে এই অপমান সে মেনে নিতে পারছেনা। দু’টো মাস রণ তার সাথে যা করেছিল সে শুধু তার মতো করেই সেই কাজের শোধ তুলতে চেয়েছে। এতে কি ভুল হয়েছে তার? রণ কেন এভাবে বলবে তাকে? মানুষটা কি নিজের কাজে একটুও অনুতপ্ত হবে না?

হ্যা, এটা ঠিক বন্দী থাকা সময়ে রণ তাকে কোনভাবে অপমান করেনি। কখনো বাজে দৃষ্টিতে তাকায়নি তার দিকে কিন্তু নানাভাবে কষ্ট তো দিয়েছে। সেই সব কি সে ভুলে যাবে সহজে? রণ হলে কি ভুলে যেত? বিয়েটা করে কি ভুল করেছে সে? এরচেয়ে আমেরিকায় ফিরে গেলেই হতো। পড়া শেষ এখন একটা চাকরি নিয়ে দিব্যি দিন কেটে যেত। কি এক প্রতিশোধের চক্করে বিয়ে ফিয়ে করে জীবনটা আরও জটিল করে ফেললো। এখন কি করবে সে? এই অপমানের পর কি ওর রণর কাছে ফেরা উচিত হবে? ভাবতে ভাবতে শুভ্রা কেঁদে দিলো হঠাৎ করে।

*****

রেডি হয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো রণ। জলি ওর অপেক্ষায় ছিলো। ছেলেকে দেখে এগিয়ে এলো-“তোর তো শরীর ঠিক নেই তুই কোথায় যাচ্ছিস রণ? বউমাই বা কোথায় গেলো সাতসকালে?”
“ও ওর বাবার বাসায় গেছে মা। এতো চিন্তার কিছু নেই। আর আমার একটা মিটিং আছে এলাকার কর্মীদের সাথে। তুমি প্লিজ হাসিখুশি নিয়ে ঢাকায় চলে যাও। আমি মিটিং করে সরাসরি ঢাকায় যাবো।”
জলি অবাক হয়ে বললো-“বউমা যাবে না?”
রণ ঈষৎ বিরক্তি নিয়ে জবাব দিলো-“ও গেলে যাবে না গেলে যাবে না। ওকে নিয়ে এতো ভেবনা মা। বাবার বাড়ি গেছে থাকনা কিছুদিন।”
“বউ ছাড়া ঢাকায় ফিরে যাব? এটা কেমন ব্যাপার হলো রণ?”
জলির মনটা ভারাক্রান্ত হলো। রণ মাকে জড়িয়ে ধরে-“মা প্লিজ, বারবার বউ বউ করো না। ও নিজ ইচ্ছায় গেছে নিজ ইচ্ছায় ফিরবে। আর আমার পক্ষে বউ নিয়ে ব্যস্ত থাকা সম্ভব না। এমনিতেই কয়েকদিনের ব্যস্ততায় কাজ জমে পাহাড় হয়েছে। কিভাবে কি করবো ভেবে পাচ্ছি না আর তুমি পড়ে আছো বউ নিয়ে। আমার আজ ঢাকায় ফিরতেই হবে যে কোনভাবে। তুমি প্লিজ হাসিখুশিকে রওনা দাও। দেরি করবে না মা। তুমি জানো তো তোমাদের এখানে থাকা আমি পছন্দ করছি না।”
জলিকে রুষ্ট দেখালো-“আচ্ছা ঠিক আছে চলে যাব। তুমি ঠিকঠাক মতো বের হ। ঢাকায় পৌঁছে তোকে জানিয়ে দেব ভাবিস না।”
“গুড গার্ল। আসছি তাহলে।”
রণ মায়ের কপালে চুমু একে দিয়ে বেরিয়ে এলো। জলি পেছন থেকে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার মনটা খচখচ করছে। মেয়েটা কি রাগ করেছে কাল? কড়া কথা শুনিয়েছিল মেয়েটাকে। সেইজন্য আবার রাগ হলো নাতো রণর সাথে? কিন্তু সে তো খারাপ কিছু বলেনি। বিয়ে হয়েছে এখন স্বামীর প্রতি টান হবে না? না হয় রণ ওকে কিডন্যাপ করেছিল, অন্যায় করেছিল কিন্তু এখন মেয়েটা যা করছে সেটাই বা কতটুকু যৌক্তিক? শুভ্রার প্রতি রুষ্টতা আরেকটু বাড়লো জলির।

রণর গাড়ি ছুটছে দলীয় কার্যালয়ের দিকে। মিহিরকে ডাকলো রণ-“মিহির, সব ঠিক আছে? সবাই কি এসেছে?”
“এসেছে ভাই। আপনার কথা মতো আজ সালিম সাহেবকে আমন্ত্রণ করি নাই।”
“ভালো করেছিস। চল দেখি শুনি ওরা কি বলে। আর কাগজগুলো এনেছিস তো?”
মিহির কোলের উপরে থাকা ব্রিফকেসটা দেখালো-“সব আছে এখানে।”
রণর মুখে হাসি ফুলটো-“গুড জব মিহির।”

*****

ডাইনিং এ খেতে বসে মেয়ের বাড়ি আসার কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে গেলো সালিম সাহেবের। রিমার দিকে তাকিয়ে বললো-“ওরে ডাইকা আনো। শুইনা দেখি একা আইছে কেন? ওর না জামাই নিয়া আসার কথা আছিল? কালই কইলো জামাই অসুস্থ। আইজ আবার অসুস্থ জামাই ফালায়া এইখানে আইছে কেন?”
রিমা মিনমিন করলো-“আমিও এইকথা জিগাইছিলাম। আমারে মেলা কথা শুনাইলো।”
“ওয় ডাকতে মানা করছিল। ঘুমাইতেছে মনেহয়। ঘুমাক সালিম তুই ভাবিস না। ও উঠুক আমি কথা কমু ওর সাথে।”
পাশ থেকে বড় ভাবি মিনুর কথা শুনে খাওয়ায় মন দিলো সালিম। শরীফ নিঃশব্দে খেয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ সালিম সাহেব তাকে ডাকলো-“তুই কি আবার ফিরা যাবি? না গেলে আমার একটা বিজনেস সামলা। তাও তো আমি একটু হালকা হইতে পারি।”
শরীফ খাওয়া থামিয়ে জবাব দিলো-“হুট করে আসছিলাম তাই চাকরি ছাড়তে হইছিল। আবার কোন চাকরি হইলেই চলে যাব আব্বা। আপনাদের এইসব বিজনেস পোষাবে না আমার।”
সালিম সাহেব বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলো-“বাইরে একা একা থাইকা এতো কষ্ট কেন করোস আমি বুঝি না। এইখানে সব আছে তবুও তোরা কেউ থাকতে চাস না। তাহেরটা তো বিয়েই করতে চায় না।”
শরীফ জবাব দিলো না। জবাব দিলেও লাভ নেই। উত্তর তার বাবার পছন্দ হবে না। শুধু শুধু অশান্তি চায় না সে। সালিম ছেলের দিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে বড়ভাইকে দেখলো-“ভাইজান, তন্ময় আইছে এইবার ওরে বিয়া করায় দেন। পোলা দেশে থাকুক। সবাই অস্ট্রেলিয়া আমেরিকা থাকলে আমাদের এই এতোবড় ব্যবসা দেখবে কে বলেন দেখি? ইদানীং খুব চিন্তা হয় ভাইজান।”
মোর্শেদ পত্রিকা ভাজ করে রাখলো-“আমিও তাই ভাবছি সালিম। তন্ময়কে বিয়ে করাবো। দেখি তন্ময় কি বলে।”
মিনু কিছু বলতে যেয়ে থেমে গেলো। এদের ভাইদের মধ্যকার আলোচনায় কথা বলা বৃথা। বউদের কথা এরা শোনে না। এরচেয়ে চুপ থেকে সন্মান বজায় রাখা বুদ্ধিমানের কাজ।

“আব্বা!”
হুট করে সোহেল চলে এলো। তার চেহারা জুড়ে উত্তেজনা। সে সালিম সাহেবের কানে কানে কিছু বলতেই সালিম সাহেব নিজেও উত্তেজিত হয়ে উঠলো-“কি কস এইসব? খবর পাক্কা তো?”
“একশোভাগ পাক্কা আব্বা। ওরা এখন ওইখানে আছে।”
“আচ্ছা, চল দেখি যাই।”
সালিম সাহেব টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লেন। মোর্শেদ ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলো-“কি হইছে সালিম? কই যাস এখন?”
“খুব জরুরি কাজ ভাইজান। আমি পরে আইসা বলতেছি।”
“আরে খাওন খাইয়া যান না।”
“আরে রাখো তোমার খাওন। এইদিকে জীবন চইলা যাইতেছে সে পইড়া আছে খাওন নিয়া।”
সালিম সাহেব ধমক দিলো। কোনরকমে হাত ধুয়ে নিচে নেমে গেলো। সোহেল তার পিছু পিছু।

*****

“আপনারা যারা আজকে আমার ডাকে সারা দিয়ে এসেছেন তাদের সবাইকে ধন্যবাদ। আশাকরি আজকের আলোচনায় উপস্থিত সকলেই আজ এখানে আলোচিত বিষয়ের ব্যাপারে গোপনীয়তা পালনে সচেষ্ট হবেন। আমি এই এলাকার নতুন নির্বাচিত সাংসদ হওয়ার পাশাপাশি একজন মন্ত্রীও বটে। আমার দায়িত্ব দেশের প্রতিটা নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এই দায়িত্ব সুচারুরুপে পালন করতে আমি বন্ধ পরিকর। তাই সারা দেশের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি আমার নিজ এলাকার প্রতি একটা বাড়তি দায়িত্ব এসে যায়। এই এলাকার জনপ্রতিনিধি হিসেবে এখনকার প্রতিটা মানুষের সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার ও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতে চাই বলেই আজকের এই মিটিং এর আয়োজন করেছি।

আপনারা হয়তো ভাবতে পারেন আমি সালিম সাহেবের জামাতা। আমি হয়তো সব কাজে তাকে ফেভার করবো। আজ আমি নিজ মুখে বলছি যে, তার আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক কেবল বাড়ির ভেতর। বাড়ির বাইরে এই সম্পর্কের দাবিতে আমি কোন অন্যায়কে প্রশয় দেব না। এলাকার মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী কাউকে সে যেই হোক না কেন, কাউকেই আমি প্রশ্রয় দেব না। এটা মাথায় রাখবেন সবাই।

এতোদিন এই এলাকায় দলীয় কর্মকান্ড যেভাবে চলেছে এখন থেকে সেভাবে চলবে না। গেল কয়েকবছরে দলের কয়েকজন অনেক বেশি সম্পদশালী হয়েছে আর কয়েকজন বঞ্চিত হতে হতে দলের প্রতি বিতশ্রদ্ধ হয়েছে। কেউ কেউ দলীয় লোকের হাতেই লাঞ্ছিত হয়ে নীরবে দল থেকে সরে গেছে। কে কি করেছেন এই সব তথ্য
আমার হাতের এই কাগজগুলোতে আছে। তবে ভয় পাবেন না কাউকে শাস্তি দেব না আমি। আমি শুধু চাই সব কিছু নতুন করে শুরু করতে। কারো প্রতি অবিচার না করতে। আর আপনাদের কার কি অভিযোগ আছে সব আমলে নিয়ে কাজ করতে।

সামনে দু’টো নির্বাচন হবে। আমি চাই আপনারা যোগ্য কাউকে নির্বাচিত করুন। সেই জন্য এখন থেকেই বিচার বিবেচনা করে কাজ শুরু করতে হবে। যারা কাজ করেছেন কিন্তু পদ বঞ্চিত থেকেছেন দীর্ঘদিন তাদের নিয়ে আমি বিশেষ কিছু করতে চাই। আপনারা কি রাজি আছেন?”
মিটিং এ উপস্থিত সকলে সমস্বরে চিত্কার করে উঠলো-“হ্যা, রাজি রাজি।”
রণর মুখে বিজয়ীর হাসি ফুটে উঠলো-“বেশ, তাহলে প্রথম কয়েকটা কাজের জন্য তৈরি হয়ে যান আপনারা। সবুর চাচা, ইমাদ ভাই আপনাদের জন্য নির্বাচিত কাজ হলো…”
“আরে থামো থামো জামাই বাবা থামো। আমাকে ছাড়া কি করতেছ তোমরা এইখানে?”
পুরো মিটিংস্থল থমকে গেলো। সুনসান নিরবতা নেমে এলো। চারিদিকে ফিসফিস আওয়াজ। রণ অবাক হয়ে মিহিরকে দেখলে সে মাথা নাড়লো নিরবে। তারপর চুপচাপ হাতের কাগজগুলো ব্রিফকেসে ঢুকিয়ে নিলো। সালিম সাহেব এগিয়ে এসে রণর সামনে দাঁড়িয়ে থেকে হাসলো-“মানলাম তুমি মন্ত্রী হইছো কিন্তু আমি এখনো এই এলাকার দলীয় প্রধান। আর তুমি আমাকে না জানায়া মিটিং করতেছ? কামটা কি ঠিক করলা?”

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-২৬

“মিহির, প্রতিবার এই লোক কিভাবে খবর পায়? একটাবার সফল হতে পারতেছি না কেন?”
মিহিরের মুখ কাচুমাচু-“আমি জানি না ভাই। কিভাবে জেনে যায় সত্যিই জানি না।”
“এই মিটিং এ উপস্থিত প্রত্যেকের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক কর মিহির। কে এই খবর পাস করেছ তাকে খুঁজে বের কর। তুই আবার একটা মিটিং এ্যারেন্জ কর। এবার যেন কেউ টের না পায়। কেউ না মানে কেউ না।”
রণর রণমুর্তি দেখে মিহির চুপসে গেলো। ফোনের এপাশ থেকে কিছু বলার সাহস হলো না। রণ ফোন কেটে দিয়েছে ততক্ষণে। তার মেজাজ আসলেই বেশ খারাপ। গুছিয়ে আনা কাজ শেষ করতে না পারলে ভীষণ মেজাজ খারাপ হয় বইকি। সে আরামকেদারায় হেলান দিলো।

আজ নেত্রীর সাথে মিটিং ছিলো। সামনে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে নদীবন্দরকে ঘিরে। রণকে নিজের এলাকার উন্নয়নে নজরে দিতে বলেছে নেত্রী। সেই সাথে এলাকায় দলীয় শৃঙ্খলা বজায় যেন বজায় থাকে সে ব্যাপারে কড়া দৃষ্টি দিতে বলেছে। কিন্তু রণ যেন বারবার হোঁচট খেয়ে যাচ্ছে। নিজ থেকে যাই করতে যাচ্ছে বারবার ভেস্তে যাচ্ছে তার চেষ্টা। অনেক ভেবে দিলশাদকে ফোন দিলো-“দিলশাদ, একটা সাহায্য করবি?”
“কে কে সালিম সাহেবের পক্ষে কাজ করে এর একটা লিস্ট আমি আপনাকে দেব ভাই। কয়েকটা দিন সময় দেন।”
রণ হেসে দিলো-“তুই কিভাবে জানলি আমি এটাই বলতাম তোকে?”
দিলশাদ হাসলো-“আপনার মিটিং এর ব্যাপারটা আমার কানে এসেছে। আপনি নতুন মানুষ, রাজনীতি এখনো বুঝে উঠতে পারেননি। আর সালিম তো অনেক পুরনো লোক আর সে লোকও ভালো না তাই কেউ কেউ তাকে পছন্দ না করলেও ভয়েই খবর জানায়। আপনার কাজে দূর্বল চিত্তের কাউকে রাখবেন না ভাই। তাতে আপনি কিছু করতে চাইলেও সফল হবেন না। আর এরপর মিটিং করলে আমাকে জানায়েন। আশাকরি এসব সমস্যা হবে না।”
“থ্যাংক ইউ দিলশাদ। মনে থাকবে।”
দিলশাদের ফোন কেটে পুনরায় মিহিরকে ফেন দিলো রণ। ওপাশ থেকে মিহির হ্যালো বলতেই রণ বললো-“সবুর চাচা আর ইমাদ ভাইয়ের সাথে কালকে ঢাকায় একটা মিটিং ফিক্সড কর। ওদের বলবি কেউ যেন না জানে। শুধু ওরা দুইজন। কারণ যতটুকু জানি ওদের দুইজনের সাথেই সালিম সাহেবের গন্ডগোল আছে। ওরা কেউ সালিম সাহেবকে পছন্দ করে না। বুঝেছিস?”
“আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনি কোন চিন্তা করবেন না ভাই। মিটিং ঠিক করে আমি আপনাকে সময় জানিয়ে দেব ভাই।”
“আচ্ছা।”

*****

“ভাবি, তোমাদের বিয়ে হলো কি করে? তোমার পরিবারের কেউ আসে ন কেন বাসায়? তুমিও তো তোমার বাবার বাড়ি যাওনা কোনদিন। ভাইয়ার সাথে কোথাও বেড়াতেও যাওনা কেন? তুমি সবসময় এমন মনমরা হয়ে থাকো কেন?”
শুভ্রা তুলতুলকে সকাল বিকাল প্রশ্ন করে যাচ্ছে। তুলতুল প্রতিবার নিরব থাকছে। শেষমেষ না পেরে তুলতুল সেদিন বলে ফেললো-“আপা, এইসব প্রশ্ন আমাকে আর কইরেন না। আমি উত্তর দিবো না। আপনার যদি কিছু জানার থাকে আপনার পরিবারের লোকদের জিজ্ঞেস করেন।”
শুভ্রা ভীষণ অবাক হয়ে বললো-“তুমি কিছু বলবে না কেন? কি সমস্যা বলো তো?”
তুলতুল জবাব দিলো না। শুভ্রা কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে উঠে গেলো। সে বুঝতে পেরেছে কোন একটা ঘোলাটে ব্যাপার আছে এখানে। ব্যাপারটা কি হতে পারে সেটা জানার জন্য মনটা উশখুশ করছে তার। মায়ের খোঁজে বের হলো সে।

রিমা আর মিনু ভিডিও কলে কথা বলছিল কারো সাথে। শুভ্রা মাকে ইশারা দিচ্ছিলো কিন্তু রিমা গা করলোনা। শুভ্রা অপেক্ষা করলো ওদের কথা শেষ হওয়ার। কথা শেষ হওয়া মাত্র রিমা মেজাজ দেখিয়ে জানতে চাইলো-“কি হইছে? দেখতেছিস যে কথা বলতেছি তাও এমন করতেছিলি কেন?”
শুভ্রা ব্যস্ত গলায় বললো-“ভাবি তার মায়ের বাড়ি যায় না কেন মা? ওর মাও আসে না? শুনছি যে ওর মা আর ভাই আছে একটা। ওরা আসে না কেন?”
রিমা সন্দিহান নজরে মেয়েকে দেখলো-“তুই শশুরবাড়ি কবে যাবি শুভ্রা? জামাই ফালাইয়া আর কয়দিন বাপের বাড়ি থাকবি? বিয়া তো নিজ থিকা করছোস এখন যাস না কেন? বাপের বাড়ি আইসা নানা ব্যাপারে মাথা ঘামানি তোরে মানায়?”
শুভ্রা হতবাক হয়ে গেলো। সে দুঃখী চেহারায় মাকে বললো-“এসেছি সাতদিনও হয়নি তুমি এভাবে বলতে পারলে মা? আমি তোমাদের সব খেয়ে ফেলছি?”
রিমা রেগে গেলো-“তোরে খাওয়ার কথা কইছি আমি? এতো বেশি বোঝোস কেন তুই? বিয়া হইলে এতোদিন স্বামী ফালায়া বাপের বাড়ি থাকতে নাই। এই সহজ কথা তুই কবে বুঝবি শুভ্রা?”
শুভ্রা জবাব দিলো না। সে তীব্র অভিমানে মাকে দেখলো কয়েকপলক তারপর দৌড়ে নিজের রুমের দরজা বন্ধ করলো। মিনু পুরো দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে বললো-“এমনে না কইলেও পারতি রিমা। মাইয়া কষ্ট পাইছে।”
“পাইলে পাক বুবু। আমি কোনদিকে যাব? ও কি জানতে চাইছে শুনছেন? ওরে এইসব কইলে ওর বাপ আমাকে আস্ত রাখবে বলেন? মেয়েরে কিছু জানাইব না বইলাইনা মেয়েরে সারাজীবন বাইরে বাইরে রাখলো। আমার হইছে যত জ্বালা। আর ভালো লাগে না এইসব।”
মিনু তীব্র চোখে রিমাকে দেখছে। এই মেয়ে সবসময় নরম। কিছু একটা হলেই ওলটপালট বকতে শুরু করে। সালিমের বউ হিসেবে এই মেয়েকে সবসময় অযোগ্য মনেহয়েছে তার কাছে। কিন্তু সালিমের একেই বিয়ের যোগ্য মনেহয়েছে। মিনু বিরক্ত হয়ে উঠে গেলো।

রাতে সালিম সাহেব বাড়ি ফিরে শুনলো শুভ্রা সারাদিন কিছু খায়নি। দোর আঁটকে শুয়ে আছে। সালিম সাহেব মেয়ের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালেন-“আম্মা, খাবেন না আপনি? আব্বাও কিন্তু খায় নাই এখনো।”
শুভ্রা কান্না জড়িত গলায় জবাব দিলো-“খাবো না আমি। মা আমাকে খাওয়া নিয়ে কথা শুনিয়েছে।”
সালিম সাহেব কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বললো-“আচ্ছা ঠিক আছে। না খাইলেন দরজাটা অন্তত খুলেন আম্মা। সারাদিন আপনাকে দেখি নাই।”
শুভ্রা কিছুক্ষন পর দরজা খুলে দিলো। সালিম সাহেব মেয়ের ঘরে ঢুকলো। শুভ্রা মন খারাপ করে বিছানায় বসে আছে। পাশে বসে মেয়ের মাথায় হাত রাখে সালিম সাহেব-“মায়ের কথায় মন খারাপ করতে আছে? মা তো একটু এমনই।”
“তাই বলে বাপের বাড়ি আসার খোঁটা দিবে? এইটা কেমন কথা আব্বা? বিয়ে হয়েছে বলে কি আর এই বাড়ি আসতে পারবোনা আমি?”
“তা কেন পারবেন না। এই বাড়ি সবসময় আপনের ছিল আপনারই থাকবে। আপনি যখন খুশি আসবেন যাবেন। কিন্তু একটা কথা সত্যি আম্মা। আপনের তো নতুন বিয়া হইছে এইভাবে আইসা থাকলে লোকে নানা কথা বলবে। মা এইটা মিথ্যা বলে নাই।”
“আব্বা আপনিও?”
শুভ্রার চেহারায় বিষাদ নামে। সালিম সাহেব নরম গলায় শুধালো-“ভুল বুইঝেন না আম্মা। একটা প্রশ্নের উত্তর দেন তো। আপনি কি আব্বাকে ভালেবাসেন?”
শুভ্রা চমকে বাবার মুখ পানে চায়-“এটা কেমন কথা আব্বা? আপনাকে আমি ভালোবাসি এটা প্রমানের দরকার আছে আপনের?”
সালিম সাহেব মৃদু হাসলো-“আচ্ছা বেশ। আমার জন্যই না হয় আপনি ফিরে যান। এখন আপনার এই বাবার জন্যই আপনার ওই বাসায় থাকা বেশি জরুরি। জামাই বাবা কি করতে চাইতেছে তার কিছুই বুুঝতে পারতেছি না। আপনি থাকলে আমি অন্তত কিছু খবর সবর পাবো। বুঝছেন তো কি বলতে চাইতেছি?”
শুভ্রা ঠোঁট দু’টো দাঁতে চেপে আছে-“আপনার জামাই আমাকে না নিতে আসলে আমি ওই বাসায় ফেরত যাব না আব্বা। মানসম্মান না পেলে কোথাও থাকা কষ্টকর।”
“আপনি বুঝতেছেন না আম্মা। আপনি না থাকাতে অনেক সমস্যা হইতেছে আমার। খবর পাইছি জামাই বাবা মিটিং করতেছে আমার এন্টি মানুষের লগে। কিসের মিটিং করে তা জানি নাই। আপনি কি আপনার বাপের অসম্মান দেখতে পারবেন আম্মা? আপনার জামাই আপনার বাপকে অসম্মান করতে চাইতেছে। আমি কি করবো কিছুই বুঝতেছি না। আপনি ওই বাড়ি ফিরে যান আম্মা। খবর সংগ্রহ করে আমাকে জানান।”
শুভ্রা বাবার কথায় নিরবে মাথা নাড়ে-“সব বুঝতেছি আব্বা তবুও সে না নিতে আসলে আমার যাওয়া সম্ভব না।”
“মাঝে মাঝে জেতার জন্য হারা লাগে আম্মা। জিদ না করে ফিরা যান।”
শুভ্রা তবুও অটল গলায় বললো-“এই কাজটা পারবোনা আব্বা। আমাকে মাফ করেন। সে না নিতে আসলে আমি কিছুতেই যাব না।”
সালিম সাহেব মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুসময়। মেয়ের অটল মনোভাবের কারন অনুসন্ধান করছে হয়তো। ভেবে নিয়ে মুখ খুললো-“আচ্ছা বেশ, সে নিতে আসলে যাবেন তো?”
শুভ্রা মাথা নাড়ে। সালিম সাহেব হাসলো-“ঠিক আছে। সে নিতে আসলেই যাইয়েন। কিন্তু এইবারের মতো হুটহাট আর আসবেন এই বাড়িতে। আব্বা না বলা পর্যন্ত তার সাথে ভাব জমায় থাকার চেষ্টা করবেন। কি পারবেননা?”
শুভ্রা চকিতে বাবার দিকে তাকায়। কি বলতে চাইছে বাবা সেটা জানতে বাবার চোখে চোখ রাখে। সালিম সাহেব মেয়ের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করলো-“আপনে এইটুক না করতে পারলে আপনের জামাই আপনের আব্বাকে দুনিয়ার সামনে ছোট করবে আম্মা। আমার রাজনৈতিক জীবন নিঃশেষ করে দিবে নিজের স্বার্থে। আপনি কি তা সইতে পারবেন?”
শুভ্রা মাথ নাড়লো। সালিম সাহেব কন্ঠে আদ্রতা ঢেলে বললো-“আমি জানতাম পারবেন না। তাই যতদিন আমি না বলবো ততদিন আর এ বাড়ি মুখ হবেন না। কেমন? আর সব খবরাখবর আমাকে দিতে থাকবেন। ঠিক আছে?”
শুভ্রা ঘাড় হেলায়। সালিম সাহেব মুচকি হাসলো-“তাইলে চলেন এখন খেয়ে নেই। আমার খুব খিদা লাগছে আম্মা।”

রণ শুভ্রাকে নিতে এলো তারও কয়েকদিন পরে। জলি রণকে বলে বলে ক্লান্ত হয়ে গেছে তবুও বউ আনার কথাটা কানে তোলেনি রণ। কিন্তু শেষমেষ বাধ্য হয়ে আসতেই হলো। একটা রাস্ট্রিয় অনুষ্ঠানে স্বস্ত্রীক আমন্ত্রণ পাওয়ায় কারণে। শশুর বাড়ি আসার পথেই বুদ্ধিটা মাথায় এলো রণর। সে মিহিরকে বললো-“ফাহিমকে একটু খবর দেতো মিহির। ওর সাথে জরুরি কথা আছে আমার।”
“ও হয়তো অফিসেই আছে। ডাকলেই পাওয়া যাবে।”
বলেই মাথা চুলকায় মিহির। রণ খানিকটা অবাক হলো-“ও কি আসে নাকি অফিসে?”
মিহির ঘাড় নাড়ে-“আসে। প্রায়ই এসে বসে থাকে। বোনের খবর পাওয়ার আশায়।”
রণ হাসলো। তার ভাবনা তাহলে ঠিক দিকেই আছে। মিহিরের দিকে তাকালো সে-“ওকে কিছু কাজ দিয়ে দে। ওর ক্যাপাবিলিটি কেমন যাচাই করি। আমি ওকে কাজে লাগাতে চাই।”
“কিন্তু সালিম সাহেব জানলে?” মিহিরের কন্ঠে দ্বিধা।
“যাতে না জানে সেইরকম কাজ দে।”
রণ মিহিরের দিকে তাকায়। মিহির বুঝে গেলো রণ কি চায়। সে মৃদু হেসে মাথা দুলায়।

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-২৭

বিয়ের পর প্রথমবারের মতো মেয়ে জামাই আসছে বলে এলাহি আয়োজন করেছে সালিম সাহেব। রণ বেশ ভদ্রভাবেই মানা করলো-“এক মগ কফি ছাড়া আমি কিছু খাবো না। সারাদিন সময় পাই না তাই রাতে মায়ের হাতের খাবার ছাড়া কিছু খাই না। আশাকরি কিছু মনে করবেন না। শুভ্রা কি তৈরী? তাহলে রাত করবোনা।”
সালিম সাহেব হইহই করে উঠলো-“এইটা কেমন কথা? জামাই প্রথমবার আসছে না খাইলে হবে?”
রণ অবিচল গলায় জবাব দিলো-“হবে। খাওয়ার অনেক সময় পাওয়া যাবে। আপনার মেয়েকে বলেন রেডি হতে। কালকে সকালে জরুরি মিটিং আছে তাই যত তাড়াতাড়ি ঢাকায় ফিরবো তত ভালো। এমনিতেও অনেক রাত হয়েছে।”
সালিম সাহেব জোর করলো না-“আচ্ছা ঠিক আছে। রিমা দেখোতো শুভ্রা তৈরী কিনা?”
রিমা চলে গেলো। সালিম সাহেব রণর পাশে এসে বসলো-“আমার মেয়েটা একটু বোকা সোকা। তুমি আমার রাগ ওর উপর দেখাইও না জামাই।”
রণর মেজাজ খারাপ হলেও নিজেকে শান্ত রেখে বললো-“আপনার মেয়ে কি এমন কিছু বলেছে?”
সালিম সাহেব একটু ঘাবড়ে গেল-“না না, তা বলে নাই। সেইদিন হুট করে চলে আসছিস তাই ভাবলাম কিছু হইলো কিনা।”
“কিছু হলে তাকে নিতে আসতাম না কখনোই। আর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আপনার রাগ তার উপর দেখাবো এমন অবিবেচক আমি না। যাইহোক, আপনি আপনার মেয়েকে ভালোমতো বুঝায় দেন সে যেন ভদ্র মেয়ে হয়ে থাকে। বিয়ে করে ফেলেছি বলে আঁটকে গেছি, তার সব অন্যায় মেনে নেব এমনটাও কিন্তু ভাববেন না।”
সালিম সাহেব দাঁতে দাঁত চেপে অপমান সহ্য করলো। নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো-“তুমি বসো আমি দেখি মেয়ের কি অবস্থা।”
রণ জবাব দিলো না। মোবাইলটা হাতে নিয়েছে এমন সময় তুলতুল এলো কফির মগ নিয়ে। কোন কথা না বলে মগটা রণর হাতে দিয়ে চলে গেলো। কাপটা তুলতে যেয়ে তাড়াতাড়ি নামিয়ে রাখলো রণ। তার বুক টিপটিপ করছে। কাপের নিচে কিছু একটা দেখেছে সে। কিন্তু কিভাবে শিওর হবে? চারপাশ দেখে নিয়ে মগটা মুখের কাছে এনে সামান্য তুলে চুমুক দিলো। দ্রুত হাতে ছোট্ট কাগজটা পকেটে পুরো স্বাভাবিক ভাবে বসলো।

শুভ্রাকে বাবা মায়ের সাথে আসতে দেখা গেলো। শুভ্রার মুখটা শুকনো দেখাচ্ছে। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক আর চুলগুলো পরিপাটি করা শুভ্রার পরনে সালোয়ার কামিজ। ওড়নাটা আলতো করে মাথায় দেওয়া। রিমা মেয়ের পাশে হেঁটে আসতে আাতে বারবার চোখ মুছছে। শুভ্রার মধ্যে কোন বিকার দেখা গেলো না। রণর মনে হলো শুভ্রার মেজাজ খারাপ। সে হয়তো তার সাথে যেতে চায়নি। রণর হাসি পেলো ওকে দেখে। মনেহচ্ছে ধরে বেঁধে জেলে নেওয়া হচ্ছে ওকে। রিমা এগিয়ে এসে রণর হাত ধরলো-“বাবা, আমার মেয়েটা অবুঝ তুমি তাকো বুঝে চইলো। ভুল করলে মাফ করে দিয় বাবা। ওকে ভালোবেসে আগলায়া রাইখো।”
রণর খুকখুক করে কাশে। শুভ্রা রাগি চোখে মাকে দেখে-“মা! আর কথা নাই তোমার? আমি ছোট মানুষ না যে আমাকে অন্য কারো দেখা লাগবে। নিজেকে নিজে দেখতে পারি আমি।”
রিমা গর্জে উঠলো-“চুপ থাক বেয়াদব মেয়ে। মা তোর সাথে কথা বলতেছে? তুই কেন মাঝখানে কথা বলিস?”
শুভ্রা হতচকিত। কয়েক পলক মাকে দেখে রেগেমেগে নিচে নেমে গেলো-“আমি গেলাম যার আসা দরকার সে আসুক।”
রণর ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসি। আচ্ছা সবক মিলেছে মেয়ের। খুব ফটর ফটর করে। সে রিমাকে স্বান্তনা দিলো-“আপনি ভাববেন না। আমাদের বাড়িতে ওর কোন সমস্যা হবে না আশাকরি। আসছি এখন।”

*****

পুরোটা পথ দু’জনার কেউই কারো সাথে কথা বলেনি। গভীর রাত হওয়ার কারনে ওরা একঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলো বাড়িতে। জলি শুভ্রাকে দেখে অবাক হলো-“তুমি এলে শেষ পর্যন্ত? আমি তো ভেবেছি আসবে না।”
শুভ্রা চুপ করে রইলো। জলি ফোঁস করে শ্বাস ফেলে-“এসেছ ভালো হয়েছে। যাও রুমে গিয়ে রেস্ট নাও।”
পাশ থেকে রণ বলে উঠলো-“আমার খিদে পেয়েছে মা। তুমি খাবার রেডি করো আমি হাতমুখ ধুয়ে আসছি।”
জলি মাথা দুলায়। রণ চলে গেলো। শুভ্রা তবুও দাঁড়িয়ে ছিল। জলি ফিসফিস করলো-“দু’জনই রাগ করে থাকলে সম্পর্ক আগাবে না। এই যে এতোদিন গিয়ে থাকলে একবারও কথা হয়েছে রণর সাথে? যেভাবে জেদ ধরে বিয়ে করেছ সেভাবেই সম্পর্কটা ঠিক করে নাও।”
শুভ্রা বোকা বোকা চাহুনিতে জলিকে দেখলো। জলি মৃদু হাসলো-“রণ এগুবে এমন আশা করো না। ও ওর বাবার মতো। খুব জেদি। তবে যদি তুমি একবার ওর মনে জায়গা করতে পারো তাহলে তোমার জন্য সব করবে। বুঝতে পেরেছ?”
এবারে খানিকটা হাসি ফুটলো শুভ্রার মুখে। সে ভেবে পেলো না এসব কথা আন্টি তাকে বলছে কেন? যেভাবে বিয়ে হয়েছে তাতে এই মানুষটার তাকে অপছন্দ করার কথা।
“মা খাবার রেডি?”
রণ বেরিয়ে এলো। জলি ছেলের দিকে তাকায়-“তুই টেবিলে বোস আমি খাবার আনছি।”
শুভ্রা একপলক দেখলো রণকে তারপর ঘরে চলে গেলো। বাবা বলেছে রণর সাথে মিলেমিশে থাকতে যাতে ওর কাজের খবর পাওয়া যায়। রণর কাজের খবর বের করতে রণর কতটা কাছাকাছি যেতে হবে সেটা খানিকটা আন্দাজ করেছে সে। আর ভেবেই অসস্তি হচ্ছে। এই লোকের সাথে দু’টো ভালো কথাই তো বলা যায় না আর তার সাথে কিনা রংঢয়ের আলাপ করতে হবে, খাতির করতে হবে? ভেবেই অসস্তি আকড়ে ধরলো শুভ্রাকে।

“সরি।”
“হ্যাহ!”
শুভ্রা চোখ গোলগাল করে তাকায়। অবিশ্বাস তার চোখের তারায়। রণ সোফায় বসলো-“এতো অবাক হওয়ার কি আছে? আমি আপনার মতো সেলফিশ নই। নিজের ভুল মনে হলে সরি বলতে পারি। সেদিন আপনার সাথে বেশি রুড হয়েছিলাম তাই সরি বলছি। এমনটা বলা উচিত হয়নি আমার।”
শুভ্রার চোখ খুলে আসার উপক্রম হলো। মুখ হা করে আছে। এই লোক হুট করে এমন বদলে গেলো কেন? নিশ্চয়ই কোন মতলব আছে। শুভ্রা নিজেকে সামলে নিলো-“ইটস ওকে। কিন্তু আমার কাছে আবার সরি আশা করবেন না। আপনাকে আমি কখনো মাফ করতে পারবোনা। যদি কখনো আপনার দুই মাসের কাজের জন্য সরি বলেনও তবুও পারবোনা।”
রণ গম্ভীর হলো, শুভ্রাকে দেখলো সময় নিয়ে তারপর বললো-“আমি সরি ফিল করছি না আপাতত। কখনো ফিল করলে বলবো। মাফ করা না করা আপনার উপর।”
শুভ্রা বিছানায় রণর মুখোমুখি বসলো-“আমার মতো মেয়েকে বউ হিসেবে কখনো ভাববেন অথচ তাকে বন্দী করে রেখে কাজ উদ্ধার করতে পারবেন। পুরো ব্যাপারটা কেমন কন্ট্রাডিকটরি মনেহয় না আপনার কাছে?”
রণ জবাব দিলো না। শুভ্রা হাসলো-“আচ্ছা বাদ দিন। জানি আপনার কাছে কোন জবাব হবে না। আমার কিন্তু এখনো দুটো পুরস্কার পাওনা আপনার কাছে। মনে আছে?”
“আছে। বলুন আর কি চাই?”
“আপাতত কিছু প্রশ্নের উত্তর দিন তাতেই চলবে।”
“কি জানতে চান?”
“ভাবির মা আর ভাইয়ের সাথে সেদিন লুকিয়ে দেখা করিয়েছিলেন। আসল ঘটনা কি বলবেন? এতো লুকোচুরির কি আছে?”
রণ নিঃশব্দে হাসলো-“বাবা মায়ের কাছে জানতে চাননি? তারা কিছু বলেনি আপনাকে?”
শুভ্রা এবার বিরক্ত হলো-“তারা বলেনি বলেই জানতে চাইছি।”
“তাহলে আমার বলা উচিত হবে না। আমি জানি আপনি যতটা না আমার বউ তার চাইতে সালিম সাহেবের কন্যা, সোহেলের বোন। যদি পুরোপুরি আমার বউ হতেন তাহলে নিশ্চয়ই আপনাকে সব ঘটনা খুলে বলতাম।”
“আমি বুঝে পাচ্ছি না কি এমন ঘটনা যে এতো লুকোচুরি করতে হবে?”
“সেটা তো আপনার বাড়ির লোক ভালো বলতে পারবে।”
রণ সোফায় হেলান দিয়ে বসলো। তার চোখেমুখে কৌতুক। এমন ভাব যেন খুব মজা পাচ্ছে শুভ্রার প্রশ্নে। শুভ্রার কন্ঠে অভিমান জমলো-“আপনি কথা দিয়েছিলেন যা চাইবো তাই দেবেন। এখন কথা রাখছেন না।”
“অন্য কিছু বলুন অবশ্যই দেব।”
“আর কিছু চাই না আমার।”
“বেশ। এবার তাহলে আমার একটা চাওয়া পূরণ করুন। কাল একজন মন্ত্রী কন্যার বিয়ের দাওয়াত আছে সেখানে যাবেন আমার সাথে।”
শুভ্রা অপলক নয়নে তাকিয়ে থেকে বললো-“এইজন্যই স্বপ্রনোদিত হয়ে আমাকে নিয়ে এলেন?”
“না, ঠিক সেজন্যও না। আসলে আপনাকে মিস করছিলাম। ঝগড়া করতে না পেরে জীবনটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছিলো।”
রণ হাসছে মুচকি মুচকি। শুভ্রার হার্টবিট মিস হলো একটা। সে কন্ঠে অবিশ্বাস ঢেলে বললো-“মিথ্যে বলছেন!”
রণ উঠে দাঁড়ায়, হেঁটে এসে বিছানায় শুভ্রার উল্টো প্রান্তে শুয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললো-“জানেন যেহেতু প্রশ্ন করা বোকামি। শুয়ে পড়ছি, কাল আমার অনেক কাজ। বাতিটা নিভিয়ে দেবেন।”
শুভ্রা অনেকটা সময় রণর পিঠের দিকে তাকিয়ে রইলো। মানুষটা আজ একের পর এক ঝাটকা দিলো তাকে। কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যে বোঝা মুশকিল। শুভ্রা উঠে রুমের বাতি নিভিয়ে দিয়ে রণর পাশে শুলো। আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত নিজের জীবন নিয়ে ভীষণ হতাশ লাগছিল। এখন মনেহচ্ছে, জীবনটা খুব একটা খারাপও না।

চলবে—
©Farhana_Yesmin

দর্পহরন পর্ব-২২+২৩+২৪

0

#দর্পহরন
#পর্ব-২২

ঢাকার অনুষ্ঠানে সত্যি সত্যি শুভ্রা ভদ্র বউ হয়ে রইলো। পুরো অনুষ্ঠানে হাসি মুখে সবার সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করলো, ছবি তুললো। প্রচুর প্রচুর ছবি তোলা হলো ওদের। বেশিরভাগই গন্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে গ্রুপ ছবি। অনেকের অনুরোধে কাপল ছবিও তোলা হলো কয়েকটা যাতে রণ আর শুভ্রা দুজনাই ভীষণ আনইজি ফইল করলো। ভালোয় ভালোয় অনুষ্ঠান শেষ হয়ে পরদিন নির্বাচনী এলাকায় চলে গেলো ওরা। এবারই প্রথম পুরো পরিবার নিয়ে এলাকায় এলো রণ। হাসিখুশি মা সবাই এসেছে। এলাকার সবাই দাওয়াত পেয়েছে। রাতে অনুষ্ঠানের আয়োজন দেখতে নেমেছিলো রণ এমন সময় মিহির এলো একজনকে নিয়ে-“ভাই, ও ফাহিম। আপনার সাথে কথা বলতে আসছে।”
ফাহিম সালাম দিলো। রণ উত্তর দিয়ে আন্তরিক হেসে জানতে চাইলো-“ফাহিম, কি বিষয়ে কথা বলবে?”
“ভাইয়া, একটু আলাদা কথা বলা যাবে? বিষয়টা ব্যক্তিগত।”
রণ মিহিরের দিকে তাকালে সে আশ্বস্ত করলো। রণ ফাহিমকে নিয়ে উপরে উঠে এলো। নিজের জন্য বরাদ্দ ঘরে ঘুরে গেট আঁটকে বসলো। ফাহিমের দিকে তাকিয়ে বললো-“এবার বলো কি বলবে? তার আগে বলো তুমি কে?”
ফাহিমের চেহারা গম্ভীর হলো-“আমি তুলতুলের ভাই। সালিম সাহেব মানে আপনার শশুরের বড় ছেলে সোহেল আমার বড় বোনকে তুলে এনে শ্লীলতাহানি করেছিল। পরে বাধ্য হয়ে বিয়ের নাটক করেছে।”
শুনতে শুনতে রণর চেহারায় অসন্তোষ ফুটে উঠলো-“তুমি আমার কাছে কেন এসেছ ফাহিম?”
ফাহিম কেমন যেন বাঁকা হাসলো-“আপনি এই এলাকার নতুন এমপি, মন্ত্রীও হয়েছেন। সালিম সাহেবকে সরিয়ে যখন আপনি এলেন ভেবেছিলাম এবার বুঝি আমরা এই দানবের হাত থেকে রক্ষা পাবো। এটাও ভেবেছি আপনার কাছে এসে আমার বোনের ব্যাপারে সাহায্য চাইবো। কিন্তু তারপরে শুনলাম আপনি নিজেই এখন সালিম সাহেবের একমাত্র মেয়ের জামাই।”
রণ হেসে দিলো-“সব জানার পরও এলে কেন তবে?”
ফাহিমের চোখ ছলছল হলো-“আপুকে শেষ দেখেছি তিনমাস আগে। নামের বিয়ে হয়েছে ওই বদমাশটার সাথে কিন্তু ওই জেলখানা থেকে ছাড়া পায়নি আমার বোন। ফোন নেই ওর কাছে, মাঝে মাঝে ও নিজ থেকে অন্য কারো ফোন থেকে কথা বলে। এছাড়া কারো সাথে কোন যোগাযোগ করতে দেয় না। আমার মা তার মেয়েকে দেখতে না পেয়ে অসুস্থ হয়ে গেছে। আপনার কাছে একটা অনুরোধ করি, প্লিজ আমার বোনটাকে একবার দেখার ব্যবস্থা করে দিন। কোনভাবে একবার বোনটাকে এই অনুষ্ঠানে আনতে পারলে আমরা একটু কাছ থেকে বোনটাকে দেখতাম। ও কেমন আছে জানতে পারতাম। প্লিজ স্যার, একটু দয়া করেন আমার মায়ের উপর। আপনার তো নিকট আত্মীয় হয় ওরা আসতে বললে নিশ্চয়ই মানা করবে না?”
ফাহিম হাত জোর করে দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখ দুটো ভেঁজা-“বোনটা কেমন করে বেঁচে আছে সেটা একটু নিজ চোখে দেখতাম স্যার। অনেক আদরের বোন আমার। কত ভালো ছাত্রী ছিলো। অনার্সে ফার্ ক্লাস পেয়েছে। সেই মেয়ের পড়ালেখা বন্ধ। কি থেকে কি হয়ে গেলো স্যার। একটু দেখা করিয়ে দিন না স্যার। আমার মা অনেক অসুস্থ, হয়তো বাঁচবে না বেশিদিন।”
রণ হতভম্ব হয়ে গেলো। পুরো ঘটনা বুঝো উঠতে যা সময় লাগলো। সে ফাহিমের হাত ধরে বসিয়ে দিলো। ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে ধরতেই হু হু করে কাঁদলো-“ভাইয়া, বেশি কিছু না একটাবার শুধু বোনটাকে দেখতে চাই।”
রণর চোয়াল শক্ত হয়, হাত মুঠো করে ধরে। সালিমের নিষ্ঠুরতার আর কতো গল্প শুনবে? একটা মানুষ কি করে এতটা জঘন্য হয়? রণ ফাহিমকে ভরসা দিলো-“তুমি কাল তোমার মাকে নিয়ে এসো ফাহিম। আমি কথা দিচ্ছি কাল তোমরা তোমার বোনের সাথে দেখা এবং কথা দু’টোই বলতে পারবে।”
ফাহিমের চোখ চকচক করে উঠলো-“সত্যি ভাইয়া?”
রণ মাথা নাড়লো-“সত্যি। আমি এখনো মিথ্যে বলতে শিখিনি ফাহিম। ভরসা করতে পারো আমাকে। এখন যাও, কাল সময়মতো চলে এসো।”

ফাহিমকে বিদায় দিয়ে চিন্তিত মুখায়বর নিয়ে বসে ছিলো রণ। মিহির এগিয়ে এলো-“ভাই, ফাহিম কি বললো?”
রণ হাসলো-“তুই তো জেনেশুনেই ওকে আমার কাছে পাঠিয়েছিস মিহির। আমি কিছু জানি না ভেবেছিস?”
মিহির আলতো হাসলো-“ছেলেটা অনেক কান্দে ভাই। মায়া লাগে দেখে।”
“ভালো কাজ করেছিস মিহির। এতোদিনে মনেহচ্ছে সালিম সাহেবের মেয়ে বিয়ে করে একটা কাজের কাজ করেছি।”
রণকে মুচকি হাসতে দেখে মিহির অবাক হলো-“আপনে কি করতে চান ভাই?”
“কি করবো তা তো জানি না। তবে কালকের অনুষ্ঠানে মেয়েটা থাকবে এটা জানি।”
বলেই উঠে গেলো রণ।

শুভ্রা হাসিখুশির সাথে বসে গল্প করছিল। রণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছিলো ভেতরে যাবে কিনা। অনেকক্ষণ পরে হাসিখুশির নজর পড়লো ওর উপর-“আরে ভাইয়া, বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? এসো ভেতরে এসো। আমরা শাহরুখ খানের মুভি দেখছি। দিলওয়ালে দুলহানিয়া।”
ঘরে ঢুকে হাসি মাথায় গাট্টা মারে রণ-“আর কতোবার দেখবি? তিরিশ বারের বেশি দেখে ফেলেছিস।”
“রাজের মতো একজনকে না পাওয়া পর্যন্ত দেখতে থাকবো ভাইয়া।”
খুশি নিচু স্বরে কথাটা বলেই দাঁতে জিভ কাটে। রণ হো হো করে হাসলো-“ইউনিভার্সিটিতে টপার না হলে তোদের দুটোকেই রিকশাওয়ালা ধরে বিয়ে দেব। বুঝতে পেরেছিস? কাজেই বিয়ের ভুত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে পড়ালেখায় মন দে। আর আপনি একটু আসুন তো। কথা আছে।”
শুভ্রা হা করে তাকিয়ে আছে রণর মুখপানে-“জ্বি! আমি?”
রণ গম্ভীর হলো-“তো আর কে? জরুরি কথা আছে তাড়াতাড়ি আসুন।”
বলেই রুম থেকে বেরিয়ে এলো। হাসিখুশি মুখ টিপে হাসছে। শুভ্রা তবুও বোকার মতো তাকিয়ে থাকে। এই লোকের হুট করে কি হলো? তাকে কেন ডাকছে? শুভ্রাকে বসে থাকতে দেখে হাসিখুশি ওকে তাড়া দিলো-“ভাবি, বসে আছো কেন? ভাইয়া ডাকলোনা তোমাকে? যাও যাও তাড়াতাড়ি যাও।”
শুভ্রা গুটিগুটি পায়ে তার জন্য বরাদ্দকৃত কামরায় এলো। রণ তখনও দাঁড়িয়ে। তার মনে নানারকম ভাবনা। কিভাবে কি বলবে শুভ্রাকে তাই ভাবছে।
শুভ্রা ডাকলো-“বলুন কি জন্য ডেকেছেন আমাকে?”
রণ শুভ্রাকে দেখলো এক নজর। ঢোলাঢালা গেঞ্জি আর প্যান্ট পরে আছে। গলায় একটা ওড়না ঝুলছে। রণ ধীরস্থির কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো-“যে ভাইকে ছাড়াতে এতো হম্বিতম্বি করলেন সে তো গতকালের অনুষ্ঠানে এলো না। না সে এলো না তার বউ এলো। কেমন ধারা ভাই ভাবি আপনার, একটুও কৃতজ্ঞতা নেই বোন কিংবা বোনজামাই এর প্রতি?”
শুভ্রার ভ্রু কুঁচকে গেলো। রণর কোন পরিকল্পনা আছে কিনা আন্দাজ করতে চাইছে সে। রণকে স্বাভাবিক দেখালো। শুভ্রা ঠান্ডা গলায় জবাব দিলো-“আপনি তো চাইছিলেন ওরা না আসুক। এখন হঠাৎ করে ওদের নিয়ে এতো ইন্টারেস্ট কেন?”
“ইন্টারেস্ট এর কি আছে? একটা ভাই বিবাহিত তার মানে তার বউ আছে। কিন্তু সেই বউকে কোথাও দেখতে পেলাম না। না বিয়ের দিন আপনাদের বাসায় না গতদিনের অনুষ্ঠানে। আজব একটা পরিবার।”
রণর কথাগুলো সত্যি বলেই শুভ্রা চুপ করে রইলো। এই প্রশ্নগুলো শুভ্রাও করেছিল ওর মাকে। মা বলেছে অনুষ্ঠান হয়নি তাই বউকে কারো সামনে নেই না। তোর অনুষ্ঠান হলো এরকম দেখি সোহেলের বিয়ে উপলক্ষে একটা অনুষ্ঠান করবো। বউকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। তারপর বউকে সব জায়গায় নেওয়া যাবে শুভ্রাকে চুপ থাকতে দেখে রণ খোঁচায়-“কি এখন কথা নেই কেন মুখে?”
শুভ্রা ভ্রু কুঁচকে বললো-“ভাবছি হুট করে আমার ভাইয়ের জন্য এতো দরদী হয়ে উঠলেন কেন? কি প্ল্যান আপনার বলুন তো?”
রণ হেসে দিলো-“কি প্ল্যান থাকতে পারে বলে মনেহয় আপনার? আমার সম্বন্ধী আছে সে বলে আবার বিবাহিত। তো তাদের কারো সাথেই তো পরিচয় হলো না আমার। তাই বলছিলাম আর কি। আচ্ছা বাদ দিন। না আসলে নেই।”
শুভ্রা তখনো সন্দিহান-“আপনি চাইছেন ওরা আসুক?”
রণ অবাক হওয়ার ভান করলো-“আমি কেন চাইবো? লোকে কানাকানি করে সেটাই বলেছি।”
“লোকের কানাকানি আপনি পাত্তা দেন! আমার কেন যেন মনেহচ্ছে আপনি চান ভাইয়া আর ভাবি আসুক। ভাইয়াকে নিয়ে নিশ্চয়ই কোন প্ল্যান আছে আপনার।”
রণ বিমোহিত হাসি দিলো-“কোন প্ল্যান নেই। শুনুন, আমি ভুলে আপনার ভাইয়ের কথা বলে ফেলেছি। তার এখানে আসার দরকার নেই। একজন অপরাধী আমার কোন অনুষ্ঠানে না আসাই ভালো।”
শুভ্রা রেগে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো-“খবরদার ভাইয়াকে অপরাধী বলবেন না। তার বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমান হয়েছে কি? তাহলে সে কিভাবে অপরাধী হয়? কালকে আসতে বলবো ভাইয়াকে। সে অবশ্যই আসবে।”
“আপনি বললেন আর আপনার ভাই নাচতে নাচতে চলে আসবে এটা বিশ্বাস করতে বলছেন আমাকে? এতোই যদি ভালোবাসতো আপনাকে তাহলে কাল ঠিকই আসতো। আপনি তো তাকে ছাড়াতেই আমাকে বিয়ে করেছিলেন। আর সে কিনা আপনার বিয়ের অনুষ্ঠানে এলো না। ওসব দেখা আছে আমার।”
শুভ্রা নিচু স্বরে গর্জন করে উঠলো-“সে অবশ্যই আসবে। তার বউকে নিয়েই আসবে। দেখবেন কাল।”
রণ অটল কন্ঠে বলে উঠলো-“কোনদিন আসবে না। আপনিও দেখে নেবেন।”
“ভাইয়া যদি ভাবীকে নিয়ে আসে তাহলে কি করবেন আপনি?”
রণ মুচকি হাসলো-“আসবেই না। তবুও যদি এসে যায় তাহলে আপনি যা বলবেন তাই করবো।”
শুভ্রার চেহারায় ক্রুর হাসি খেলে গেলো-“আর ইউ শিওর?”
“আমি কথা দিয়ে কথা রাখি এটা নিশ্চয়ই নতুন করে প্রমান করতে হবে না?”
রণর কথায় শুভ্রা দাঁত বের দিলখোলা হাসি দিলো-“ঠিক আছে। তাহলে ওই কথাই রইলো। ভাইয়া যদি ভাবিকে নিয়ে আসে তাহলে আমি যা বলবো তাই করতে হবে আপনাকে। ডান?”
“ডান।” শুভ্রার চোখে চোখ রেখে জবাব দিলো রণ।

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-২৩

“তন্ময় ভাইয়া! তুমি! কবে এসেছো? কেউ বলেনি তো আমাকে?”
শুভ্রা বাচ্চাদের মতো আহলাদ করছে। দেখে গা জ্বলে গেলো রণর। সে ভদ্রতা করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো শুভ্রার পাশে। তন্ময় নামের ছেলেটা এগিয়ে এসে শুভ্রাকে জড়িয়ে ধরে-“শুধু আমি না মাও এসেছে শুভ্রা। তোকে সারপ্রাইজ দেব বলে বলিনি।”
“সত্যি! চাচীও এসেছে?”
“হুমম, সত্যি। ওই যে দেখ।”
তন্ময় পেছনে ইশারা করতেই দেখা গেলো ওদের। পুরো ইব্রাহিম পরিবারকে। সবাইকে দেখে হাত নাড়িয়ে শুভ্রা রণর কানে ফিসফিস করলো-“ভাইয়া এসেছে ভাবীকে নিয়ে। আপনি আপনার চ্যালেন্জ হেরে গেলেন এবার শাস্তির জন্য প্রস্তুত হয়ে যান।”
রণও পাল্টা হাসি দিলো-“সব শাস্তি মাথা পেতে নেব। তার আগে আরও একটা কাজ করতে হবে আপনাকে।”
শুভ্রা অবাক হলো-“আবারও? শাস্তি কিন্তু ডবল হবে বলে দিচ্ছি।”
রণ মৃদু হেসে মাথা দুলায়-“হোক। এখন দয়া করে মহিলাদের নিয়ে নিজের কামরায় গিয়ে বসুন। ওখানেই খাবার দিন। এখানে সব রাজনৈতিক নেতাকর্মী আছে। কাজেই এখানে আপনার না থাকলেও চলবে।”
শুভ্রা ভয় পাওয়া গলায় বললো-“আপনি কি করবেন ওদের? আব্বাকে আবার কিছু বলবেন নাতো?”
রণ হেসে দিলো-“আমি কি করবো? আমাকে দেখে কি মারপিট করা গু*ন্ডা কিংবা মানুষ খু*ন করা খু*নী মনেহয়?”
শুভ্রা শীতল কন্ঠে বললো-“আপনাকে বিশ্বাস নেই। সব করতে পারেন আপনি।”
রণ আশ্বাস দিলো-“ভয় নেই আজ কিছু করবো না।”
শুভ্রা ভরসা পেলো কিনা বোঝা গেলো না। তবে মহিলাদের সাথে নিয়ে সে বাড়ির ভেতর চলে গেলো। যাওয়ার আগে তন্ময়ের সাথে রণর পরিচয় করিয়ে দিতে ভুললো না। রণ তন্ময়কে সাথে নিয়ে সালিম সাহেবের দিকে এগিয়ে গেলো। মুখে হাসি ঝুলিয়ে সোহেলের সাথে হ্যান্ডসেক করলো। শরীফ আর তাহের আগে থেকে আন্তরিক রণের প্রতি এটা ওদের আচরণে বোঝা হয়ে গেছে। সবাইকে নিয়ে দক্ষিণ দিকের প্যান্ডেলে দিকে গেলো রণ। ওখানেই এলাকার গন্যমান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দদের বসানো হয়েছে। এলাকার অনুষ্ঠান বলেই আয়োজনটা বাড়ির সামনের ফাঁকা মাঠে করা হয়েছে। এলাকার লোকজন আর তৃনমুল পর্যায়ের নেতা কর্মীদের সাথে যোগাযোগ বাড়ানোর জন্য এই অনুষ্ঠান করা। রণ চায় সকলের সাথে তার সম্পর্কটা সহজ হোক। কতটুকু সফল হবে সেটা সময় বলবে।

মিনু আর রিমা জলির সাথে গল্প করছে তার কামরায়। তুলতুল এ ঘরে একা বসে আছে। শুভ্রা খাবারের প্লেট তুলতুলের দিকে এগিয়ে দিলো-“এমন চুপচাপ বসে আছো কেন ভাবি? কি হয়েছে?”
তুলতুল চমকে গেলো ভীষণভাবে। সে মিনমিন করলো-“কিছু না আপা। এমনিতেই।”
শুভ্রা খানিকটা অবাক হলো। তুলতুল মাথা তুলেও তাকাচ্ছে না পাছে শুভ্রা সব বুঝে যায় এই ভয়ে। শুভ্রা কাছে এসে বসলো। তুলতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো-“ভাবি, তোমার মুখে কি হয়েছে? কেমন যেন লাগছে দেখতে? আর বোরকা পরেছ কেন? ভাইয়া মানা করেনি?”
তুলতুলের হাত কেঁপে উঠলো। সে ব্যস্ততার ভান করে জোর করে পোলাও মেখে মুখে তুললো-“কি হবে আপা কিছু হয়নি।”
শুভ্রা তুলতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো-“কিছু একটা তো অবশ্যই হয়েছে। কি হয়েছে সেটাই ধরতে পারছি না।”
তুলতুল এবার হাসার চেষ্টা করলো-“আরে আপা কিছু হয়নি বললাম তো। এখন কি শান্তিমতো খেতে দেবে? নয়তো খাবার রেখে দিচ্ছি।”
শুভ্রা তুলতুলকে আঁটকায়-“না না তুমি খাও ভাবি। আমি পানি নিয়ে আসছি দাঁড়াও।”
শুভ্রা ঘর থেকে বের হবে এমন সময় রণ এসে দাঁড়াল-“আসবো?”
শুভ্রা তাকায়-“হ্যা আসুন।”
রণ রুমে ঢুকে কোন ভনিতা না করে তুলতুলকে ডাকলো-“তুলতুল তুমি প্লিজ আমার সাথে এসো। তোমার মা আর ভাই অপেক্ষা করছে। তারা তোমার সাথে দেখা করতে চায়।”
তুলতুল হতবাক হয়ে রণর দিকে তাকায়। অবিশ্বাসী গলায় বললো-“কি বলছেন এসব? আমার মা আর ভাই কেন এখানে আসবে?”
রণ আবারও মৃদুস্বরে বলে উঠলো-“দেরি করো না তুলতুল। তোমার হাতে সময় খুব কম। কেউ টের পাওয়ার আগেই ফিরে আসতে হবে এখানে।”
তুলতুল হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। তার শরীর কাঁপছে ভীষণ ভাবে। সে কি করবো বুঝতে পারছে না। রণ তাড়া দিলো-“হাতটা ধুয়ে এসো তাড়াতাড়ি।”
তুলতুল যন্ত্রচালিত মানুষের মতো এগিয়ে গেলো। শুভ্রা কিছু বুঝতে পারছে না। সে পালাক্রমে তুলতুল আর রণকে দেখছে। এতোটা অবাক সে তার জীবনে হয়নি। বোকার মতো দু’জনার দিকে তাকিয়ে থেকে জানতে চাইলো-“আপনি কি করছেন আমি বুঝতে পারছি না। ভাবিকে চেনেন আপনি?”
রণ শুভ্রার চোখে চোখ রেখে হাসার চেষ্টা করলো-“না চিনি না। আজই প্রথম দেখলাম। আর প্লিজ বোঝার চেষ্টাও করবেন না আমি কি করছি। শুধু একটা অনুরোধ আপনার চাচী আর মাকে ব্যস্ত রাখবেন দশ পনেরো মিনিট আপনার ভাবীর ফিরে আসা পর্যন্ত। পারবেন তো?”
শুভ্রা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো-“আর এমনটা আমি কেন করবো? আমার কি ঠেকা আপনাকে হেল্প করতে?”
রণ হাসি থামিয়ে বললো-“আমার জন্য করার দরকার নেই আপনার ভাবির জন্য করবেন। প্লিজ এখন প্রশ্ন করে সময় নষ্ট করবেন না। ফ্রি টাইমে এসব নিয়ে ঝগড়া করার প্রচুর সময় পাবেন।”
“কিন্তু কি করতে চাইছেন সেটাই তো বুঝতে পারছি না। এতো লুকোচুরির কি আছে এখানে? মা জানলে কি হবে?”
রণ ঠোঁটে হাত দিলো ইশারা করলো-“শশশ, আস্তে কথা বলুন। জানলে কি হবে সেটা এই মুহুর্তে না জানলেও হবে। প্লিজ দয়া করে পনেরোটা মিনিট নিজের মগজ চালানো বন্ধ করুন। আই রিকোয়েস্ট।”
শুভ্রা রাগ করে দু’ঠোঁট চেপে ধরে রাখলো। পরক্ষণেই জবাব দিলো-“তিনটে কাজ হয়ে যাচ্ছে। সবই বকেয়া রয়ে যাচ্ছে কিন্তু?”
শুভ্রার বোকা বোকা কথায় রণ হেসে দিলো-“যা খুশি চেয়ে নেবেন। আপাতত হেল্প করুন। প্লিজ!”
রণর কড়োজোরে মিনতি দেখে শুভ্রা চুপ করে গেলো। তুলতুল বেরিয়ে আসতেই রণ আশেপাশে তাকিয়ে তুলতুলকে তার পিছু আসার ইঙ্গিত দিলো।

“মা! ভাইয়া! তোমরা এখানে?”
তুলতুল এক ছুটে যেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো।তহুরা মেয়েকে বুকের মধ্যে নিয়ে হুহু করে কেঁদে দিলেন। ফাহিমও বাচ্চাদের মতো কাঁদছে। সে মা বোনকে জড়িয়ে ধরে আছে। এরকম একটা দৃশ্য দেখে রণর চোখেও জল এলো। সে হাত দিয়ে চোখের কোলটা মুছে নিলো আলতো হাতে। তহুরা তুলতুলের মুখে হাজারটা চুমু খেলো-“তুলতুল, কেমন আছিস মা? ওরা তোকে মারে? অনেক অত্যাচার করে তাই না? কত শুকিয়ে গেছে আমার মেয়েটা।”
তুলতুল মাথা নাড়লো-“না মা মারে না। কিছুই বলে না।”
ফাহিম কান্না থামিয়ে বোনের দিকে স্নেহময় দৃষ্টিতে তাকায়-“সত্যি আপা? তোমাকে বোরখা পড়াইছে কেন?”
তুলতুল মিথ্যে বললো-“আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান হয় নাই এইজন্য। অনুষ্ঠানের আগে মুখ দেখানো মানা। তোমরা ভাইবো না আমি ভালো আছি মা।”
বলতে বলতে কাঁদে তুলতুল-“কতদিন পর তোমাদের দেখলাম মা। আমার কি যে ভালো লাগতেছে। এখন আমি মরে গেলেও আফসোস থাকবে না।”
তহুরা অস্থির হয়ে গেলো তুলতুলের কথা শুনে। পাগলের মতো বারবার বলতে লাগলো-“ও তুলতুল, তুই মরার কথা কেন বললি? মরবি কেন তুই? ওরা তোকে কি বলছে? তুলতুলরে বল তাড়াতাড়ি। থাক তুই আর যাইস না ওইখানে। চল আমাদের সাথে। তোকে নিয়ে ঢাকায় চলে যাব।”
তুলতুল মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। মায়ের গালের সাথে গাল ঠেকিয়ে রেখে বলে-“কোথায় যাব মা? বাংলাদেশের কোন কোনায় পালিয়ে বাঁচবো না। আমি তো এখন বেঁচে আছি, ভালো আছি। তোমরা আমাকে নিয়ে ভেবোনা। ভাইয়া, মায়ের খেয়াল রাখবা। কত্ত শুকায় গেছে আমার মা।”
তিনজনেরই চোখ ভেজা। রণ ঘড়ি দেখলো-“তুলতুল যেতে হবে।”
তহুরা যাওয়ার কথা শুনেই তুলতুলকে বুকের সাথে জাপ্টে ধরলো-“ও বাবা, তুমি তো এখন মন্ত্রী হইছো। আমার মেয়েটাকে আমার বুকে ফিরায় দিতে পারবা না? আমি স্বামীহারা মহিলা অনেক কষ্ট করে এই ছেলেমেয়ে দুইটাকে মানুষ করছি। আমার বুকের ধনকে আমার বুকে ফিরায় দাও না বাবা। আর কিছু চাই না বাবা, আমাদের আর কিছু চাওয়ার নাই।”
রণ মনকে কঠোর করে এগিয়ে এসে তহুরার সামনে বসলো-“খালা, বাবা ডেকেছেন তো? আপনার মেয়ে আপনার বুকে ফিরবে। তবে আজকে না খালা। আমি কথা দিচ্ছি খুব তাড়াতাড়ি আপনার মেয়েকে আপনার কাছে ফিরিয়ে দেব। ভরসা রাখেন আমার উপর।”
তারপর তুলতুলের দিকে তাকালো-“তুলতুল বোন আমার চলে তাড়াতাড়ি। ওরা সন্দেহ করুক এমনটা চাই না।”
তুলতুল অনেক কষ্টে নিজেকে তহুরার থেকে ছাড়িয়ে নেয়। রণ ফাহিমের দিকে তাকায়-“তোমরা এখানেই থাকো আমি না বলা পর্যন্ত বেরুবে না।”
ফাহিম মাথা দুলায়। রণ তুলতুলকে দোতলায় যাওয়ার ইশারা করে নিচে নেমে গেলো।

অনুষ্ঠান চুকে যাওয়ার পর রাতে ক্লান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে ছিল রণ। তখনই মোবাইলে ম্যাসেজ এলো। ঘুমঘুম চোখে ম্যাসেজ খুলে দেখলো লেখা আছে-“আপনি কেথায়? রুমে আসুন এখনি।”
অবাক রণ ভাবছে সালিম সাহেবের মেয়ের আবার হলোটা কি? সে নিজ থেকে রণকে ম্যাসেজ করেছে? ক্লান্ত শরীর নড়তে চাইছে না বুঝতে পেরে রণ পাল্টা ম্যাসেজ পাঠালো-“তিনতলায় আছি। শরীর ভীষণ ক্লান্ত। পরে আসলে হয় না?”
শুভ্রা এবার ফোনই দিয়ে বসলো-“না হয় না। আপনার সাথে কি শর্ত ছিলো মনে নেই? এখনি আসুন। আমি ওয়েট করছি।”
অগত্যা বাধ্য হয়ে রণ উঠলো। স্যান্ডেল পায়ে গলিয়ে ধীর পায়ে দোতলায় নেমে এলো। শুভ্রার রুমের দরজায় টোকা দিলো-“আসবো।”
“হ্যা, আসুন।”
রণ দরজা ঠেলে ঢুকলো। শুভ্রা বিছানায় বসে আছে। তার সামনে একটা কাঁচের বল ভর্তি কাঁচামরিচ। রণকে দেখে মিষ্টি করে হাসলো শুভ্রা-“তিন তিনটে কাজের পুরস্কার বাকি দেখে আমার ধৈর্য্য হচ্ছে না। জানেন তো, বাকীর কাজ ফাঁকি। তাই ভাবলাম একটা কাজের পেমেন্ট অন্তত নিয়ে রাখা দরকার। তাই না?”
রণ জবাব দিলো না। সে ভাবছে শুভ্রা কি করতে চাইছে আসলে? রণর ভাবনা বুঝেই মেয়েটা মুচকি হাসলো। গলায় মধু ঢেলে শুধালো-“আরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আসুন এখানে আমার সামনে বসুন। আপনার প্রথম কাজের পেমেন্ট হিসেবে এই কাঁচামরিচ গুলো খেয়ে আমাকে উদ্ধার করুন প্লিজ।”
রণ সাথে সাথে বুঝে গেলো শুভ্রার প্রতিশোন পরায়ন মনের ভাবনা। সে বেশ জোরেই হেসে উঠলো-“প্রতিশোধ নিতে চাইছেন?”
শুভ্রার মুখের হাসি গায়েব। সে গম্ভীর মুখ করে বললো-“নেওয়া উচিত না? আমার আর আপনার মধ্যে হিসেবের সমতা আসেনি এখনো। যতদিন সমতা না আসবে ততদিন আমরা প্রতিদ্বন্দি হয়ে থাকবো, স্বামী স্ত্রী হয়ে উঠতে পারবোনা।”
রণ বিরবির করলো-“স্বামী স্ত্রী হতে চাইছে কে?”
শুভ্রা না বুঝে তাকালো-“কিছু বলছেন?”
“না মানে বলছিলাম যে আমাকে সাজা দেওয়ার জন্যই আপনি ও বাড়ি গেলেন না?”
শুভ্রা রণর দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা কি কথার খেলা খেলে তার খেলা পন্ড করতে চাইছে?
“না কাজের পুরস্কার নেব তাই যাইনি। সব পুরস্কার বাকী রেখে দেওয়া রিস্ক। দেখা যাবে পরে বললেন কিসের পুরস্কার। আমি বাপু কোন রিস্ক নিতে চাই না।”
“তা আর কি কি করতে হবে এরপর? বুঝতে পারছি দুইমাসের শোধ নেবেন। একেবারে বলে দিলেই ভালো হয়।”
শুভ্রার চোখ জুড়ে ক্রুর হাসি-“আগে বললে মজা আছে? শুনুন আর কথা বলবেন না। খেতে শুরু করুন তো।”
“ইয়ে মানে এতগুলো মরিচ খেতে হবে সত্যিই? কাল কিন্তু বাইরে বাইরে থাকতে হবে আমাকে। পেট খারাপ হলে ভীষণ বিপদে পড়বো।”
রণ মুখেচোখ কাচুমাচু করলো। শুভ্রা অবশ্য তাতে একটুও গললো না-“জ্বি হা। পুরো বাটি শেষ করবেন আমার সামনে বসে।”
রণ ঢোক গিললো। শুভ্রা মনে মনে খুব করে হাসলো। অন্যকে সাজা দিতে গেলে মজা লাগে। আর সেই সাজা যখন নিজের উপর এসে পড়ে তখন কেমন কঠিন লাগে এবার বোঝো মিস্টার রণ। তাছাড়া এটা তো কেবল শুরু। সামনে আরও কত কিছু করা হবে তোমার সাথে তখন কি করবে বাছাধন?

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-২৪

“তোর ভাই আর মায়ের সাথে দেখা হইছে?”
সোহেলের কথায় তুলতুল আমুলে কেঁপে উঠলো। সোহেল জানলো কিভাবে? সে চকিতে ভয়ে ভীত নয়নে সোহেলের দিকে তাকায়। সোহেলের মুখ জুড়ে হাসি, চোখে ক্রুরতা-“কি ভাবছিলি জানুম না? মা ভাইকে সাথে নিয়া আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবি আর আমি জানুম না?”
তুলতুল আঁতকে উঠে পিছিয়ে গেলো-“কি বলতেছেন এইসব?”
সোহেল খাট থেকে উঠে এলো-“মিছা কতা কইছি? ভাই আর মায়ের লগে দেখা করছ নাই? ক?”
তুলতুল বুঝলো মানা করে লাভ নেই কোন। সে মাথা দুলালো-“আমি তো জানতাম না ওইখানে মা আর ভাই আসবে। দুলাভাই দাওয়াত দিছে তাই আসছে। এইখানে আমার কি দোষ? আর সত্যি বলতেছি কোন ষড়যন্ত্র করি নাই। আপনি তো আমার স্বামী, স্বামীকে নিয়ে কি ষড়যন্ত্র করবো?”
সোহেল মুচকি হেসে তুলতুলের দিকে এগিয়ে যেতেই তুলতুল পিছাতে শুরু করে। শেষ মেষ দেওয়ালে পিঠ ঠেকে বুঝলো আর পেছানোর সুযোগ নেই। সোহেল ওর দুপাশে হাত রেখে মুখোমুখি দাঁড়ায়-“তুই তো আমাকে স্বামী মানোস না।”
“আপনিও তো আমাকে বউ মানেন না।”
তুলতুলের উত্তর শুনে সোহেল হাসলো-“খুব চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বাইর হইতেছে তোর মুখ দিয়া। একদিন দেখা কইরাই এতো সাহস? তোর ভাইটা তোরে এই বন্দীদশা থেকে মুক্ত করতে চায় তাই না?”
তুলতুল দ্রুত মাথা নাড়লো-“কেউ কিছু চায় না।”
সোহেলের মুখ থেকে হাসি গায়েব হলো-“যেইদিন বুঝমু একটু উল্টা পাল্টা করার চেষ্টা করতেছোস সেইদিন তোর ভাইরে শেষ করুম আগে তারপর তোরে। আমাকে তো চিনছোস এতোদিনে, নাকি? যা কই তার নড়চড় হয় না বুঝছোস তো?”
তুলতুলের শরীর কাঁপছে, গলা শুকনো। সে ঢোক গিলে নিল-“আপনে ভুল বুঝতেছেন। আমাদের মধ্যে আমার ভাইকে টাইতেছেন কেন? ওর কোন দোষ নাই। ও কিছু জানে না। সত্যি বলতেছি।”
“আমি ঠিক বুঝতেছি। এতো বোকা ভাইবো না আমারে চান্দু।”
তুলতুলের হঠাৎ কি হলো জানেনা সে সোহেলকে জড়িয়ে ধরলো-“আমার সাথে সবসময় এইরকম কু*ত্তার মতো ব্যবহার করেন কেন? কিসের এতো রাগ আমার উপর?”
সোহেল থতমত খেয়ে গেলো। বোকার মতো তুলতুলকে দেখছে। তার চোখ দুটোতে বিস্ময়। তুলতুলের এমন আচমকা পরিবর্তন সে গিলতে পারছে না। তুলতুলকে নিজের থেকে ছাড়াতে চাইলো কিন্তু পারলো না। তুলতুল সোহেলের বুকে মাথা রেখে ফিসফিস করলো-“কি চান আপনি? আমি নিজ থেকে আপনার কাছে আসি? মেয়ে মানুষকে এইরকম ছে ছে করলে তারা নিজ থেকে কাছে আসে না জানেন না। মেয়েদের কাছে চাইলে তাদের আদর সোহাগের সাথে নরম গলায় ডাকবেন, দেখবেন আপনার জন্য জা*ন দিব।”
সোহেল হতবিহ্বল, কি হচ্ছে সব মাথার উপর দিয়ে গেলো। সে দু’হাতে তুলতুলকে দূরে ঠেলে দেয়-“এই যা সর এইখান থিকা। নতুন নাটক লাগাইছে। এইগুলা কইরা সত্য লুকানো যাইবো না বুঝছোস?”
তুলতুল অভিমানী কন্ঠে মৃদুস্বরে অভিযোগ জানায়-“ভালো করলেও দোষ খারাপ করলেও দোষ। কি যে চায় মানুষ।”
সোহেল সন্দিহান নজরে তাকিয়ে দেখলো তুলতুলকে তারপর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। তুলতুলের আচরণ সন্দেহজনক, নিশ্চয়ই কোন মতলব আছে তার। এদিকে সোহেল বেরিয়ে যাওয়ার পরই তুলতুল মুখ গম্ভীর করলো। মনে মনে বিশ্রী করেকটা গালি দিলো সোহেলকে। গা ঝাড়া দিলো কয়েকবার। সোহেলের কাছাকাছি আসলেই গা ঘিনঘিন করে তুলতুলের। কিন্তু সোহেল কি করে জানলো ওর মা ভাইয়ের কথা? দুলাভাইকে জানাতে হবে কথাটা।

★★★

সারারাত মুখ আর বুকের জ্বলুনিতে তরপেছে রণ। চোখ থেকে ঘুম গায়েব হয়েছে। প্রচন্ড কষ্টে পায়চারি চলছে অবিরত। ভোর থেকে শুরু হলো পেটের গন্ডগোল আর বমি। আজ বিশেষ মিটিং আছে এলাকার জনগণের সাথে কিন্তু মনেহয় না মিটিং এ যেতে পারবে। বাথরুমে দৌড়াতে দৌড়াতে গায়ে জ্বর চলে এলো রণর। বমি আর বাথরুমের চাপে সকাল দশটা নাগাত নিস্তেজ হয়ে বিছানায় গড়িয়ে পড়লো রণ। মিহির রণকে ডাকতে এসে ওর অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে বাধ্য হয়ে দোতলা থেকে জলিকে ডেকে নিয়ে গেলো, ডাক্তারকে খবর দিলো। রণকে দেখে হাউমাউ করে উঠলো জলি। একবেলার মধ্যে মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে। জ্বর আর পেটের ব্যাথায় কিছুক্ষণ পর পর আর্তনাদ করে উঠছে। রণ বড়ই শক্ত ছেলে। সে কোকাচ্ছে মানে শরীর বেশিই খারাপ। জলি মিহিরকে আদেশ করলেন রণকে ধরে দোতলায় নিয়ে যেতে। তার চোখের সামনে থাকবে ছেলে পরিচর্যা হবে।

শুভ্রা হাসিখুশির সাথে গল্পে মশগুল। হাসি বললো-“ভাবি তোমাদের বাড়ি যাবে না?”
শুভ্রা অবাক গলায় বললো-“যাবো না কেন? আব্বা কালকে যেতে বলছে তোমার ভাইকে নিয়ে। আজকে কিবা কাজ আছে তোমার ভাইয়ের।”
হাসি অবাক গলায় জানতে চাইলো-“ভাইয়া যাবে বলেছে?”
“হ্যা। বাবাকে তো বলেছে যাবে। কেন?”
শুভ্রা সন্দিহান গলায় জানতে চাইলো। হাসি হাসলো-“কিছুনা। এমনিতেই জানতে চাইলাম।”
খুশি প্রসঙ্গ পাল্টে বললো-“ভাবি, তোমার ভাবীটা কিন্তু দেখতে সুন্দর। আমার খুব ভালো লেগেছে। ওনার নাম তুলতুল দেখতেও তুলতুলা। তাই না হাসি?”
“হ্যা, ভাবি। কিন্তু ওনার বাড়ির কেউ এলো না কেন? কেউ নেই ওনার? বাবা মা ভাই বোন?”
হাসির কথায় মনটা খচখচ করে ওঠে শুভ্রার। আরে তাইতো! কথাটা ভুলে গেলো কি করে? ভাবি তার মা আর ভাইয়ের সাথে দেখা করতে গেছিল না? তাদের সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দিলো না কেন? রণ বলেছিল পরে সব বলবে কিন্তু সে কেন রণর কাছে জানতে চাইলো না ঘটনাটা? জিজ্ঞেস করতে হবে রণকে। সে কি বাইরে বেরিয়ে গেছে নাকি বাসায়?
“আমি একটু আসছি।”
বলে বেরুতে যেয়ে জলির মুখোমুখি পড়ে গেলো শুভ্রা। জলি ভ্রুকুটি করে শুভ্রাকে দেখলো-“যাচ্ছ কোথায়?”
শুভ্রা থমকে গেলো। জলিকে গম্ভীর দেখাচ্ছে-“কাল কি খেয়েছে রণ?”
জলির প্রশ্ন শুনে শুভ্রা মনে মনে চমকে গেলো-“কেন? কি হয়েছে?”
“ছেলেটা অসুস্থ হয়ে পরেছে। জ্বর, বমি, পেট ব্যাথা আর ঘনঘন বাথরুম যাচ্ছে। জানো তুমি?”
শুভ্রা ঢোক গিলে নিলো-“না, জানি না তো।”
“তা জানবে কি করে? তোমরা জেদি মেয়ে যা চাও তা পেতে হবে। পেয়ে গেলে আর সেই জিনিসের কদর নেই। বলি বিয়েটা তো জোর করে করেছ এখন সম্পর্কটা জোর করে এগিয়ে নিচ্ছ না কেন? দু’জন দুই রুমে থেকে কি প্রমান করতে চাইছো সেটাই বুঝতে পারছি না। জামাই অসুস্থ হয়ে তিনতলায় পড়ে আছে বউ জানেই না। কেমন ধারা মেয়ে তুমি?”
শুভ্রা বোকার মতো মুখ করে তাকিয়ে আছে জলির দিকে। হাসিখুশি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। জলি পাত্তা দিলো না মেয়েদের। শুভ্রার দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বললো-“যাও যেয়ে রণর কাছে বসো। দেখো ওর কি লাগবে।”
শুভ্রা মাথা দুলালেও জলি দেখলো না। হনহন করে চলে গেলো। শুভ্রার লজ্জা লাগছিল ভীষণ হাসিখুশির সামনে। সে ওদের দিকে না তাকিয়েই চলে এলো।

শুভ্রা ঘরে ঢুকে দেখলো রণ চোখ বুজে শুয়ে আছে। রণর মুখটা ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। ফর্সা চেহারা হলদেটে হয়ে গেছে। শুভ্রা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উচ্চস্বরে হেসে দিলো। রণ চমকে উঠে বসলো-“কি হয়েছে?”
শুভ্রা মুখে হাত চাপা দিয়ে বললো-“কিছু না। সরি, আপনার ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম।”
রণ কিছু না বললেও চোখে মুখে বিরক্তি ফুটে উঠলো। আবার শুয়ে পড়লো সে। শুভ্রা ওর সামনে এসে দাঁড়ায়-“শুনুন, আপনি নিজে যেটা সহ্য করতে পারছেন না সেটা করতে আমাকে বাধ্য করেছিলেন। এখন কি ভাবতে পারছেন কি অবস্থা হয়েছিল আমার? কতোটা কষ্ট পেয়েছিলাম? তারউপর দেখুন আপনার মতো এতো সেবা পাইনি আমি। একা একাই পড়ে ছিলাম কয়েকদিন। অথচ আপনি ভিআইপি ট্রিটমেন্ট পাচ্ছেন। মানুষ কতটা হিপোক্রেট হতে পারে সেটা ভেবেই হাসি পেয়ে যাচ্ছে।”
শুভ্রার কথায় চোখ মেলে তাকিয়ে ওকে দেখলো রণ। চাপা অসন্তোষ ফুটে উঠলো ওর চোখে মুখে। উঠে বসে বললো-“এখন কি করতে হবে আমাকে? আমাকেও তাহলে আঁটকে রাখুন। খাবার পানি কিছু দেবেন না। ঘরের আলো বন্ধ করে সাতদিন আঁটকে রাখুন। আপনার মন শান্তি হবে তাতে?”
শুভ্রা দাঁতে দাঁত চেপে বললো-“দুই মাসের শাস্তি আপনি চালাকি করে সাতদিনে শেষ করতে চাইছেন?”
“তারমানে আপনি দুইমাস আঁটকে রাখতে চাইছেন আমাকে? আমার থাকতে কোন আপত্তি নেই। সত্যি বলছি। আমার অভ্যাস আছে। কিন্তু আমার পক্ষে তো সম্ভব হবে না বন্দী থাকা। রাস্ট্রের গুরুত্বপূর্ন দায়িত্ব পালন করার জন্য। বিনিময়ে কি করা যাবে বলুন। যতটুকু বুঝতে পারছি আপনি আমাকে সেম টু সেম শাস্তি না দিলে শান্তি পাবেন না।”
শুভ্রা জবাব না দিয়ে তাকিয়ে থাকলো। প্রচন্ত পেটব্যাথায় রণর মুখেচোখ কুঁচকে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। সে হাত বাড়িয়ে স্যালাইন পানির গ্লাসটা নিয়ে দুটো চুমুক দিলো। সেই পানি পেটে যাওয়া মাত্রই পেটের মধ্যে উথালপাতাল শুরু হলো। গা গুলিয়ে বমি উঠে এলো। নিজেকে আঁটকাতে না পেরে ঘর ভাসিয়ে বমি করলো রণ। গলা জ্বলে যাচ্ছে রণর। সে চেচিয়ে উঠলো সইতে না পেরে-“আহহহ।”
জলি দৌড়ে এলো-“কি হয়েছে?”
শুভ্রা ভালোমানুষের মতো মুখ করে বললো-“কিছু না আন্টি। বমি করেছে আমি পরিস্কার করে দিচ্ছি। আপনি যান।”
রণ অবাক হওয়ার মতো অবস্থায় নেই তবুও অবাক হলো শুভ্রার কথায়। জলি চলে গেলে শুভ্রা ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। রণ মেজাজ খারাপ করে বললো-“কি?”
“কিছু না।”
“এখন আমার বমি পরিস্কার করতে হবে। তাই তো?”
শুভ্রার ঠোঁটের হাসি ছড়িয়ে পড়লো সারা মুখে-“বাহ! মন্ত্রী মশাইয়ের বুদ্ধি আছে দেখা যাচ্ছে।”
রণ দূর্বল শরীর নিয়ে বিছানা ছাড়লো-“আপনার মনস্তত্ত্ব বুঝতে আইনস্টাইন হতে হবে না। আমেরিকায় পড়ালেখা করলে কি হবে আপনার ঘটে সেই চিরাচরিত বাঙালি ব্রেন। এর বেশি কিছু ভাবতে পারবেন না।”
শুভ্রা চিড়বিড়িয়ে উঠলো। আঙুল উঁচিয়ে শাসালো-“আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন।”
রণ পাত্তা দিলো না, বাথরুম থেকে বালতি নিয়ে এলো টলতে টলতে-“আপনি প্লিজ ভাবুন দুই মাসের বন্দীত্বের বদলে কি শাস্তি দেওয়া যায়। ভেবে বলুন আমাকে। আমি যত দ্রুত সম্ভব শাস্তির কোটা শেষ করতে চাই। এটাই আমাদের দু’জনার জন্য মঙ্গলজনক হবে।”
“কেন? আমাকে বউয়ের রোলে দেখতে চাইছেন?”
শুভ্রার কন্ঠে কৌতুক। রণ মব ধরে দাঁড়িয়ে গেলো। দৃষ্টি ক্ষীন করে শুভ্রাকে দেখলো-“আপনার তাই মনেহচ্ছে? আপনার কি মনেহয় আপনি আমার বউ হওয়ার যোগ্য?”
শুভ্রার ভ্রু কুঁচকে গেলো, কর্কশ কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো-“কি বলতে চাইছেন আপনি?”
রণর গভীর দৃষ্টি শুভ্রাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিলো। রণ শান্ত গলায় বললো-“আমার মাকে ব্লাকমেল করে খুব সহজে আমার বউ হতে পেরেছেন। অন্যথায় আপনি কখনোই আমার বউ হওয়ার যোগ্য ছিলেন না। আপনার মতো মেয়েকে এই রণ তাকিয়েও দেখতো না। বুঝতে পেরেছেন?”
শুভ্রা জবাব দিলো না। অপমানে ওর গা ফুটন্ত উনুন। চোখ দুটো আগ্নেয়গিরির লাভা। রণ তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলো-“আপনার ভাগ্য আমি আপনাকে অপহরণ করেছিলাম। আমার সেই ভুলের কথা বলে আমাকে আর আমার মাকে ব্লাকমেল করেছেন। তা না হলে আপনার মতো মাসে মাসে বয়ফ্রেন্ড বদল করা কোন মেয়ে এই রণর বউ হতো না কখনোই।”

চলবে—
©Farhana_Yesmin

দর্পহরন পর্ব-১৯+২০+২১

0

#দর্পহরন
#পর্ব-১৯

শুভ্রার ঘুম ভেঙেছে এগারোটায়। ঘুমঘুম চোখে সে ঘড়ি দেখে ধরমরিয়ে উঠে বসলো। রিমা তাকে পইপই করে বলে দিয়েছে বিয়েটা যেভাবেই হোক সে যেন বউ হওয়ার দায়িত্ব পালন করে ষোলআনা। সকালে যেন ঘুম থেকে ওঠে। মায়ের বাড়ি ভেবে সারাদিন শুয়ে না থাকে যেন। শুভ্রা নিজের উপর বিরক্ত হলো ভীষণ। এতো বেলা অব্দি কি করে ঘুমালো সে? তাও আবার অপরিচিত জায়গায়? পুরো ঘরে চোখ বুলিয়ে দেখলো। নাহ সে নেই। স্বস্তি হলো না অসস্তি বুঝলোনা শুভ্রা। সে লোকটাকে যতটা সহজে কাবু করতে পারবে ভেবেছে এখন দেখছে ততটা সহজ হবে না ব্যাপারটা। মুখে হাত দিয়ে হামি ঠেকালো সে৷ দরজায় ঠকঠক আওয়াজ। শুভ্রা অলসতা ঝেড়ে উঠে দরজা খুললো। হাসিখুশিকে দেখা গেলো। ওকে দেখেই দুইবোন হাসলো। দু’জনই একসাথে বলে উঠলো-“তোমার ঘুম ভেঙেছে ভাবি? বাসায় অনেক মেহমান এসেছে। মা বললো তোমাকে তৈরী করে নিয়ে নিচে নামতে।”
শুভ্রাও পাল্টা হাসলো-“ভেতরে এসো তোমরা। আমি হাতমুখ ধুয়ে আসছি।”
দু’জনই হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলো। শুভ্রা বাথরুম থেকে বেড়িয়ে দেখলো ঘর পরিপাটি হয়ে গেছে। বিছানার চাদর টানটান। এলোমেলো কাপড় সম্ভবত রণর সেগুলো ধোঁয়ার জন্য ঝুরিতে দিয়ে দিয়েছে। ওকে দেখে দুই বোন হাসলো-“নানু এসেছে তো। যদি তোমার ঘরে এসে যায় তাই গুছিয়ে দিলাম তাড়াতাড়ি। নানুর আবার ওসিডি আছে। এলোমেলো আর নোংরা দেখলে তার মেজাজ খারাপ হয়। বকাঝকা করে। মানুষ আর পরিস্থিতি বোঝে না।”
শুভ্রা জবাব না দিয়ে লাগেজ খুললো। কি পরবে ভাবছে। খুশি এগিয়ে এসে বললো-“ভাবি, দেখ শাড়ি আছে তোমার লাগেজে। লাল রঙের শাড়ী ওটা পরো। তুমি নতুন বউ না শাড়ীতে ভালো লাগবে।”
শুভ্র সালোয়ার স্যুট তুলে নিলেও হাসি এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে-“প্লিজ ভাবি, খুশি যা বললো সেটাই করো। মা বলেছে শাড়ী পরতে। আমার মামীরা এসেছে। তোমার উল্টো পাল্টা দেখলে ওনারা আবার মাকে কথা শোনানোর সুযোগ খুঁজবে। প্লিজ একটু কষ্ট হলেও এডজাস্ট করে নাও।”
“কিন্তু আমি শাড়ী তো পরতে পারি না।” শুভ্রার চেহারা অসহায় দেখায়।
“আরে তাতে কি? আমরা আছি না? আমরা পরিয়ে দেব।”
শুভ্রা শাড়ী বের করে রাখলো-‘তোমাদের এতো আত্মীয় তো কাল কেউ যায়নি কেন?”
খুশি হাসলো-“সে তো ভাইয়া কাউকে নেয়নি তাই। সকলেই চটে আছে ভাইয়ার উপর। ভাইয়া অবশ্য বলেছে রিসিপশন করে পুষিয়ে দেবে সব রাগ।”
শুভ্রা জবাব দিলো না। দুই বোন গল্প করতে করতে শুভ্রাকে তৈরি করে দিলো। গলায় কানে হালকা গহনা হাতে সোনার চুড় পরিয়ে দিয়ে হাসি শুভ্রাকে বললো-“ভাবি, নানু একটু উল্টো পাল্টা বকে। তুমি প্লিজ চুপচাপ থেকো। জবাব দিলে মা কষ্ট পাবে।”
শুভ্রা মাথা দুলায়। মনে মনে ভাবছে কত প্যাচরে বাবা। কোথায় ভেবেছিল লোকটাকে সারাক্ষণ কোন না কোন প্যাচে ফেলে অশান্তি দেবে এখন দেখা যাচ্ছে তার দেখা পাওয়াই দুস্কর।

“বউ তো সুন্দর কিন্তু আমার নাতি কই জলি? বিয়া করতে না করতে অফিস কিসের?”
“মা, ওর জরুরি ফোন আসছিল। ভোরে বের হইছে।”
জলি মোলায়েম কন্ঠে জবাব দিলো। সেলিনা কাটকাট কন্ঠে সুর তুললো-“তুই আজীবনের জেদি জলি। পোলা বড় হইছে তাও তার সব ব্যাপারে তোর মাথা ঢুকাইতে হবে। বিয়া শাদীতে জোর চলে? এতো সুন্দরী মেয়ে তবুও তো পোলার মন নাই। বিয়ার ক্ষেত্রে সৌন্দর্য না মন দেখা লাগে জলি।”
“আম্মা থামেন। নতুন বউয়ের সামনে কি বলেন এইসব? ওরে দোয়া করে দেন।”
সেলিনা মনোক্ষুণ্ণ হয়ে তার বড় বউমা রোকেয়াকে ডাকলো-“ও বড় বউ, গহনার বক্সটা দাও দেখি।”
পাশ থেকে ছোট বউ মোহনা টিপ্পনী কাটে-“আম্মা, সব রণর বউকে দিয়ে দিয়েন না। আপনার ছেলের ছেলেদের জন্যও কিন্তু রাইখেন।”
“কেন? তোমাদের কি কম আছে? তাছাড়া আমার রণ তো একশোর মধ্যে একজন। তার মতো যোগ্য কে আছে।”
শুভ্রার বিরক্ত লাগছে রণর প্রশংসা শুনতে। একবার শাশুড়ী মায়ের দিকে তাকালো। তার চেহারা ভাবলেশহীন। সেলিনা নাতবউের গলায় জড়োয়া হারটা পরিয়ে দিলো। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলো-“মাশাল্লাহ, সুন্দর লাগতেছে। শোন মেয়ে, এইসব গহনা যত দামীই হোক বিয়ের পর স্বামীই মেয়েদের আসল গয়না। এইটা যত তাড়াতাড়ি বুঝবা ততই মঙ্গল হবে। বুঝলা?”
শুভ্রা মাথা দুলায় আর মনে মনে মুখ ভেংচি কাটে, আমার বয়েই গেছে স্বামীকে গয়না বানাতে।

★★★

রণ বেরিয়ে পড়েছে ভোর সকালে ইমার্জেন্সি ফোন পেয়ে। কাল রাতে মায়ানমার সীমান্তে প্রচুর গোলাগুলি হয়ে দু’জন সেনা মারা গেছে এবং প্রচুর বহিরাগত অনুপ্রবেশ করেছে। খবরটা শোনামাত্রই অফিসে ছুটেছে রণ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধান ও সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধান আগেই তার অপেক্ষায় ছিল। নিজের কর্মক্ষেত্রে এসেই তাদের সাথে মিটিংয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। দফায় দফায় মিটিং আলোচনা পর্যালেচনা শেষে করনীয় কাজ সম্পর্কে ব্রিফিং দিয়ে রণ অফিস থেকে বের হলো। এরইমধ্যে মিটিং এর ফাঁকে ফাঁকে সকলের শুভকামনা শুনতে শুনতে রণর প্রান ওষ্ঠাগত হওয়ার জোগাড়। সন্ধ্যায় ছুটলো প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের কর্যালয়ের দিকে। সেখানে দলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে মিটিংএ গিয়ে সবার মিশ্র প্রতিক্রিয়া রণর কানে এসেছে। স্বয়ং সালিম সাহেবও উপস্থিত ছিলেন। অনেককে আড়ালে বলতে শুনেছে, ‘মেয়ের সাথে বিয়ে দেবে বলেই রণর জন্য নিজের দীর্ঘদিনের নির্বাচনি সিট ছেড়ে দিয়েছে সালিম। সালিম বুদ্ধিমান, বুঝেছে ওর দূর্নাম অনেক বেড়েছে তাই সময় থাকতে সরে দাঁড়িয়েছে। এখন জামাইয়ের কাঁধে বন্দুক রেখে সব কাজ করবে। দূর্নাম হলে মেয়ে জামাইয়ের আর কাজ হবে সালিমের। একেই বলে অন্যের কাঁধে বন্দুক রেখে গুলি চালানো।’ সালিম সাহেবকে তার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি হাসতে দেখেছে রণ। সব শুনে বুঝে রাগে গা কাঁপে রণর। হাতের মুঠো মুষ্টিবদ্ধ হয়। হেরে যাচ্ছে সে হেরে যাচ্ছে। নিজের সব পরিশ্রমের ফল আরেকজন নিয়ে যাচ্ছে বিনা শ্রমে। এটা কিভাবে হতে দেবে? কিভাবে?

বাড়ি ফিরতে ফিরতে গাড়িতে গুম হয়ে বসে থাকে সে। ক্লান্ত লাগছে আজ। কাল আবার সারাদিন ব্যস্ত থাকবে। যেতে হবে খুলনা, মংলা বন্দরে নতুন জেটির উদ্বোধন করতে। এদিকে বিয়ে পরবর্তী একটা অনুষ্ঠান করাও জরুরি। যেহেতু বিয়ের ব্যাপার সবাই জেনে গেছে অনুষ্ঠান সেরে ফেলাই ভালো। অবশ্য অনুষ্ঠান একটা না দু’টো করতে হবে। একটা ঢাকায় আরেকটা নিজের এলাকায়। মায়ের সাথে আলোচনা করে ডেট ফাইনাল করতে হবে। এলোমেলো ভাবনায় রণর মনটা আছন্ন হয়ে রইলো।

রাজিব চুপচাপ দেখছে রণকে। অনেক কথা তার কানেও এসেছে। সে বুঝতে পারছে রণ কেন গুম হয়ে আছে। তাই আরেকটা খারাপ খবর দিয়ে তার মন খারাপ করতে চাইলো না। বাসার নিচে এসে নরম কন্ঠে ডাকলো রণকে-“ভাই, বাসায় আসছি।”
রণ চোখ বুঁজে ছিলো। রাজিবের ডাকে চোখ মেলে তাকিয়ে একবার দেখলো তারপর চুপচাপ গাড়ি থেকে নেমে গেলো।

জলি বসেছিল ছেলের অপেক্ষায়। রণ মাকে দেখে হাসলো-“এতো রাত অব্দি বসে আছো কেন?”
জলি হাসলো-“সকালে তাড়াহুড়ায় বেরিয়ে গেলি। সারাদিন কি খেয়েছিস তাতো জানি না। এখন হাতমুখ ধুয়ে আয় আমার সাথে বোস। তোর পছন্দের চিংড়ি মালাইকারি করেছি।”
রণ তখনই হাত ধুয়ে বসে গেলো-“তাহলে দাও খেয়ে নেই। খিদে পেয়েছে ভীষণ।”
জলি মানা করলোনা। প্লেটে ভাত আর চিংড়ি বেড়ে এগিয়ে দিলো। রণ গোগ্রাসে খেলো কয়েক লোকমা। মায়ের দিকে তাকালো-“তুমি খেয়েছ?”
“হুম। তোর নানি এসেছিল আজ। সারাদিন ছিলো এই কিছুক্ষণ আগেই গেলো। তোর সাথে দেখা করতে চাইছিল।”
“ওহহহ। আচ্ছা আমি সময় করে যাব একসময় দেখা করে আসবো। মা, অনুষ্ঠান তো করতে হবে একটা। কবে করা যায় বলো তো?”
“তোর সুবিধামতো একটা দিন ঠিক কর। কবে কাজ কম তোর?”
রণ একটু ভেবে জবাব দিলো-“আগামী শুক্রবার একটা করি আর তারপরের দিন এলাকায় আরেকটা। ঠিক আছে?”
“পরপর দুইদিন কেন? মেয়েটার জন্য অনেক ঝক্কি হয়ে যাবে। একদিন গ্যাপ দিয়ে কর।”
রণ একটু থমকায়। মেয়েটা বলতে মা কাকে বোঝালো সেটা বুঝতে খানিকটা সময় নিলো তারপর মৃদুস্বরে বললো-“আচ্ছা, তাহলে শুক্রবার আর রবিবার করি।”
“ঠিক আছে। দেখিস তোর দাদুর বাড়ি কেউ যেন বাদ না পরে।”
জলির কথায় রণ অবাক হয়ে বললো-“হঠাৎ ওদের কথা কেন বললে মা?”
জলি নাক টানে-“তোর চাচা ফোন দিয়েছিল আজ।”
“কি বললো?”
“তোকে ওদের থেকে দূরে রেখে ভালো করছি না এটাই বললো। এতোকিছু হয়ে গেলো তাদের কেন জানাইনি?”
“আশ্চর্য! এতোদিন পরে হুট করে কি চাইছে ওরা? তাছাড়া নিজেরা আমাদেরকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে এখন নিশ্চয়ই তাদের দরকারে কাছে আসার চেষ্টা করছে?”
জলি মন খারাপ করে বললো-“কারণ যাইহোক ওদের বলিস। এতো বছর পরেও নিজেকে কাঠগড়ায় দেখতে ভালো লাগে না।”
রণ থমকে গেলো। মায়ের কষ্টটা কোথায় সেটা বুঝে কথা না বাড়িয়ে মাথা দুলিয়ে নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করলো।

★★★

“এতোক্ষণে বাড়ি ফেরার সময় হলো? নতুন বউয়ের কথা একবারও মনে হয়নি?”
রণ জানতো রুমে ঢুকে এরকম কিছু শুনবে তাই না শোনার ভান করে নিজের কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলো। গোসল সেরে বেরিয়ে দেখলো শুভ্রা তখনও বসে আছে বিছানায়। রণর বিরক্ত লাগছে। ইচ্ছে করছে না এই মেয়ের সাথে ঝগড়া করতে। সে ক্লান্ত গলায় বললো-“আমার সাথে ঝগড়া করার জন্য বসে আছেন? আপনার ধৈর্য্য আছে বটে।”
শুভ্রা হাসলো-“ঝগড়া করার জন্য বসে আছি এ কথা কে বললো? আমি আমার গিফট নেওয়ার জন্য বসে আছি।”
“গিফট! আচ্ছা ঠিক আছে। কি চাই আপনার?”
শুভ্রা হা করে তাকালো। ওর বিশ্বাস হচ্ছে না রণর কথা। লোকটা এতো সহজে মেনে নিলো?
“আরে তাড়াতাড়ি বলুন কি চাই?”
“ভাইয়ার মুক্তি।”
রণ শান্ত দীঘির জলের মতো গভীর দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইলো শুভ্রার দিকে-“এটা তো সম্ভব না। অন্য কিছু বলুন।”
“আপাতত এটাই আমার চাই।”
“সরি তাহলে আবার মত বদলে ফেলতে হচ্ছে। গিফট নেই আপনার কপালে।”
শুভ্রা দাঁতে দাঁত চেপে বললো-“বউ ছাড়া রিসিপশন করবেন?”
“মানে?”
শুভ্রা হাসলো-“মানে তো খুব সহজ। আমি চাই রিসিপশনের অনুষ্ঠানে আমার পুরো পরিবার উপস্থিত থাকুক। তো সেজন্য ভাইয়াকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করতে হবে তো। ভাইয়া ছাড়া পরিবার অসম্পূর্ণ না?”
রণ কিছু না বলে তাকিয়ে রইলো চুপচাপ। শুভ্রা পুনরায় মুখ খুললো-“যদি তা না হয় তাহলে কিন্তু বউ ছাড়া রিসিপশন করতে হবে। আমি কিছুতেই আপনার কোন অনুষ্ঠানে পার্টিসিপেট করবো না। আপনার বউ হওয়াটা যেমন আমার চয়েজ ছিলো তেমনি বাকী সবটা আমার চয়েজে হবে। তা না হলে সবাই জানবে, মন্ত্রী মশাই একজন নারী অপহরণকারী। তিনি একজন মন্ত্রী হয়েও নারীর প্রতি নুন্যতম সন্মান রাখে না মনে। জনগণ এসব জানলে নিশ্চয়ই ভালো কিছু হবে না?”
রণ হাসলো-“সত্যিই তাই করবেন বুঝি? এতে আপনার সন্মান বাড়বে?”
“আমার সন্মান তো যেদিন আপনি আমাকে তুলে নিয়েছেন সেদিনই কমে গেছে। কাজেই ওতে আর ভয় করি না।”
রণ দাঁতে দাঁত চেপে অপমান হজম করলো। সে চুপচাপ আলমারি থেকে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো গুছিয়ে নিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে এলো। এই মেয়ের সাথে একইরুমে থাকার কোন মানেই হয় না। এই নামমাত্র বিয়ের জন্য নিজেকে কষ্ট দেওয়া কেন?

চলবে—
©Farhana_Yesmin

#দর্পহরন
#পর্ব-২০

সারাদিন ছোটাছুটির উপর আছে রণ। এরমধ্যেই মিহিরের ফোন-“ভাই, একটা খারাপ খবর আছে।”
রণ দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। এই মেয়েটাকে বিয়ে করার পর থেকে সব খারাপ খবরই পাচ্ছে। সে ম্রিয়মান কন্ঠে বললো-“কি হয়েছে বল।”
“খাদেমের বউ আর বাচ্চাকে সালিম সাহেব খুঁজে পেয়ে নিজের ডোরায় তুলে নিছিলো। ওর বাচ্চাকে আঁটকায়া রাখছে। বউকে বলছে মামলা তুলে নিতে। তাইলে বাচ্চাকে দিবে।”
খবরটা শুনেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো তার। চেচিয়ে উঠে বললো-“ওদের কিভাবে খুঁজে পেলো মিহির? কোথায় রেখেছিলি ওদের?”
মিহির মিনমিন করলো-“ভাই, কিভাবে খুঁজে পেলো জানি না। আমি নিজেও আশ্চর্য হয়ে গেছি। কেউ হয়তো ফাঁস করছে নাহলে তো খোঁজ পাওয়ার কথা না। এইদিকে নান্টুকেও পাওয়া যাইতেছে না।”
রণ গর্জন করে উঠলো-“কেমন লোক দিয়ে কাজ করাচ্ছিস মিহির? কে এমন কাজ করেছে খুঁজে বের কর। বিশ্বাসঘাতককে চিনে রাখতে হবে।”
“আচ্ছা ভাই। আমি দেখতেছি।”
রণ বিরবির করলো-“ইব্রাহিম সালিম, এই লোক কোনদিন ভালো হবে না। আর আমি ঘরের মধ্যে এই লোকের ছাও পুষতেছি। আচ্ছা রাখলাম। ব্যস্ত আছি এখন পরে কথা বলবো।”
মিহির চুপ করে রইলো। নিজেকে অপরাধী লাগছে তার। রণ ভাই কত ভরসা করে কাজ করতে দিয়েছিল।

দিলশাদের মেজাজ চরম খারাপ হয়ে আছে। রিমান্ডের পাঁচদিন পেরিয়ে গেছে অথচ সোহেলের কাছ থেকে একটা কথা বের করা যায়নি। কথা আদায়ের নানারকম পদ্ধতি ব্যবহার করা যায় কিন্তু দিলশাদ দ্বিধান্বিত। চাইলে সোহেলকে শেষ করে দিতে পারে অন্তত ওর মনেপ্রাণে এমনই ইচ্ছা কিন্তু এখনও সময় হয়নি। কেবলই এখানে এসেছে, একটু পাকাপোক্ত ভাবে বসতে হবে। জাল ফেলে সুতো ছাড়ার সময় এখন। বড় বড় মাছ জালে এলেই কেবল সুতো গোটানো শুরু করবে। এখন ধৈর্য্য ধরে থাকতে হবে, কোন উপায় নেই। ফোন বাজছে। দিলশাদ বিরক্ত হয়ে মোবাইল স্ক্রিনে চোখ রাখে। রণর ফোন দেখে তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়ায়-“ভাই, আপনি হঠাৎ?”
“দিলশাদ, একটা বিপদ হয়ে গেছে রে।”
“কি হয়েছে ভাই?”
“খাদেমের বউয়ের খবর পেয়ে গেছে সালিম সাহেব। বউটা হয়তো যে কোন সময় তোর কাছে যাবে মামলা তুলে নিতে। সোহেল নিশ্চয়ই কিছু বলেনি এখনো?”
দিলশাদ অবাক হলো না। সে জানতো এমন কিছুই হবে। স্বাভাবিক গলায় জানতে চাইলো-“কিছু বলেনি ভাই। কি করবো তাহলে?”
রণ হাসলো-“আমাকে বিশ্বাস করিস তো দিলশাদ?”
“একশোভাগ। হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন ভাই?”
“এমনিতেই। শত্রুর সাথে আত্মীয়তা করেছি সবাই ভুল বুঝতে পারে সেজন্যই জানতে চাইছি। আচ্ছা শোন, আপাতত সোহেলকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা কর।”
দিলশাদ হাসলো-“খাদেমের বউ চলে আসছে ভাই। মামলা ডিশমিশ হলে তো ছেড়ে দিতেই হবে। আপনি চিন্তা করবেন না।”
রণ গম্ভীর হলো-“আপাতত বলেছি দিলশাদ। আপাতত ও খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিক। পরে দেখবো কি করা যায় ওকে নিয়ে।”
“ঠিক আছে ভাই। দেখছি আমি।”
রণ ফোন নামিয়ে রেখে চেয়ারে হেলান দিলো। আরেকটা হারের মালা গলায় চড়লো। সামনের পরিস্থিতি আরো কঠিন হবে বুঝতে পারছে। কিভাবে সব গোছাবে বুঝতে পারছে না। চোখ বুঁজে রকিং চেয়ারে দোল খেতে লাগলো চোখ বুঁজে।

★★★

“আব্বা! আইছোস তুই?”
সালিম সোহেলকে বুকে জড়িয়ে নিলো। সোহেল বাবার বুকে মাথা গুঁজে অভিমানী কন্ঠে বললো-“দশদিন আব্বা। দশদিন জেলে থাকা লাগলো। কত কষ্ট হইছে বুঝতে পারছেন?”
সালিম অতি কষ্টে নিজের আবেগ দমন করলো। ছেলের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললো-“যে অবস্থা ছিলো আব্বা। আমি ভাবছি তোকে আর দেখতে পাবো না। আল্লাহর শোকর, আমার শুভ্রা এইবার আমার দায়িত্ব তার কাঁধে তুলে নিছে।”
সোহেল বাবার বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে বিস্ময় নিয়ে বললো-“শুভ্রা! ও কেমনে কি করলো?”
সালিম গর্বিত হাসি দিলো-“দেখতে হইবো না কার মাইয়া? আমার মাইয়া আমার মতোই সাহসী। প্রতিমন্ত্রীরে তোর দুলাই বানাইছে। বুঝছোস কিছু?”
সোহেল হতবাক-“বিয়া হইছে শুভ্রার? আমারে ছাড়া?”
“তোর লাইগা আব্বা। শুভ্রা তোর লাইগা তোরে ছাড়া বিয়া করছে। তোরে মুক্ত করার লাইগা। পরশু দিন জামাইবাবা পার্টি রাখছে। শুভ্রা চাইছে আমরা পুরা পরিবার সেই পার্টিতে উপস্থিত থাকি। তাই তো তোরে মুক্ত করতে পারছি।”
“সত্যি আব্বা! আমার ছোট বোন এতো বড় হইলো কবে?”
সোহেল আপ্লুত হয়, কেঁদে দিলো আবেগে। রিমা নরম কন্ঠে ধমক দিলো-“কি শুরু করছেন আপনেরা বাপ পোলা? ওয় কত্তদিন পর আইছে ওরে গোসল করতে দেন, খাইতে দেন।”
সালিম চোখ মুছলেন-“হহহ আব্বা, তুই যা। গোসল কইরা আয় আমরা একলগে খামু।”
সোহেল মাথা নাড়ে। জেলের মধ্যে এইবার খাতিরদারি হয় নাই। খুব কষ্ট গেছে। সেসব মনে করে মনটা তেতো হলো। আনমনা হয়ে নিজের রুমে ঢুকতেই তুলতুলের উপর নজর গেলো। মেয়েটা হঠাৎ ওকে ঢুকতে দেখে ভীষণ চমকে গেছে। এরপর ওর চোখে দেখা গেলো ভয়। ভয়ে ভীত হয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে মেয়েটা। সোহেল কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই সোহেলের চেহারা থেকে বিরক্তি মিলিয়ে গেলো। ক্রুর একটা হাসি দিয়ে বললো-“আমাকে ছাড়া কয়দিন খুব ভালো আছিলা মনেহয়? চেহারা তো খুব খোলতাই হইছে দেখাযায়?”
তুলতুল ঢোক গিললো। আসলেই কয়দিন সে খুব আনন্দে ছিলো। একদম নিশ্চিত নির্ভাবনায়। হুট করে সোহেলকে দেখে মনে মনে ভীষণ ঘাবড়ে গেছে। সোহেলকে দেখে তুলতুলের গা গুলিয়ে বমি পেলো। ওর গা থেকে ভুরভুর করে গন্ধ আসছে। সোহেল ওর নিশ্চুপতা দেখে কয়েকপা এগিয়ে এলো। তুলতুল পিছিয়ে গেলো দেখে সোহেল হাসলো-“পালাইয়া যাইবা কই? বউ লাগো না তুমি আমার? ভাবছিলাম তোমারে আর ধরুম না। সোহেল একবার ফেলা জিনিস ধরে না। কিন্তু আজই মনে হইতেছে ভুল কইছিলাম।”
সোহেল ঠোঁট চাটলো। তুলতুলের বুক ধুকপুক করছে। পালাতে মন চাইছে। কিন্তু কিভাবে পালাবে? সোহেল কি ভেবে বললো-“দাঁড়াও গোসল দিয়া আসি। ঘুপচি জেলের মধ্যে থাইকা খুব খারাপ অবশ্য হইছে। গায়ে গন্ধ করে।”
নিজের গায়ের গন্ধ শুকে নাকমুখ কুঁচকে গেলো সোহেলের। সে বাথরুম ঢুকে যেতেই তুলতুল ছুটে রুম থেকে বেরুলো।

★★★

জলি প্রতিদিন রাতে ছেলের অপেক্ষায় বসে থাকে। রণ খেতে খেতে মায়ের সাথে সারাদিনের গল্প করে। তারপর মা ঘুমিয়ে গেলে নিচে নেমে আসে। আজও জলি অপেক্ষা করছিল। শুভ্রা পানি খেতে এসে জলিকে দেখে দাঁড়ালো-“আন্টি, আপনার না শরীর খারাপ ছিলো?”
“রণর সাথে একটু জরুরি কথা আছে তাই জেগে আছি।”
“আপনি চাইলে শুয়ে পড়তে পারেন। উনি এলে আমি ডেকে দেব আপনাকে।”
জলি অবাক হয়ে তাকিয়ে শুভ্রাকে দেখলো। মেয়েটাকে ছেলের বউ বানিয়ে এনেছেন ঠিকই কিন্তু মন থেকে মেনে নিতে পারছেন না। মেয়ের মুখের দিকে তাকালেই বিশ্রী অতীত চোখের সামনে চলে আসে। সহ্য না হলেও দাঁতে দাঁত চেপে থাকে। শুভ্রাকে কোনক্রমেই বুঝতে দেয় না কিছু। তবে বিশেষ কথাও বলে না। ছেলের জন্য কষ্ট হয় তার।
তিনি বুঝতে পারেন রণ কতটা কষ্টে এই তেতো করলাকে সহ্য করছে। মনে মনে হয়তো মাকে বকাও দেয়। কিন্তু তিনি বড়ই অসহায় মা। সন্তানের জীবনের মায়া বড় মায়া একজন মায়ের কাছে। রণ যদি কখনো বোঝে তাহলে হয়তো তাকে মাফ করতে পারবে।
“তুমি সত্যিই জেগে থাকবে তো?”
শুভ্রা হাসলো-“আমি তো অনেক রাত অবধি জেগে থাকি। অভ্যাস আছে আমার।”
“কিন্তু কাল তো অনুষ্ঠান আজ এতো রাত পর্যন্ত জেগে থাকলে কাল সমস্যা হবে তো। থাকগে, তুমি যাও ঘুমিয়ে পড়ো।”
শুভ্রা খানিকটা জোর খাটালো-“কোন সমস্যা হবে না। আপনি যেয়ে শুয়ে পড়ুন প্লিজ।”
অগত্যা জলি উঠলো। নিজের কামরায় গিয়েও ফিরে এলো। শুভ্রা তাকালো তার দিকে-“কিছু বলবেন?”
জলিকে দ্বিধান্বিত দেখায়-“আমি জানি বিয়েটা তুমি জেদ করেই করেছ। ওকেও বাধ্য করেছ আমায় দিয়ে। তোমার দিক থেকে তুমি হয়তো ঠিক আছো। কিন্তু একটা কথা মনে রেখ, বিয়ে যেভাবেই হোক স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র সম্পর্ক। বাবার পরে মেয়েদের একমাত্র আশ্রয়, ভরসার জায়গা হচ্ছে স্বামী। তাই বলছি সম্পর্কটা ঠিক করার চেষ্টা করো।”
জলি দাঁড়ায় না। ধীর পায়ে ঘরে ফিরে গেলো। শুভ্রা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলো। জলি হুট করে তাকে এতো কথা বললো কেন? সে নিজেও তো খুব একটা পছন্দ করে না শুভ্রাকে। তবে?

রণ দোতলায় এসে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে তারপর খেতে আসে। তাও শুধুমাত্র মা খাবার নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করে সেজন্য। ইদানীং ব্যস্ততা বেড়েছে তাছাড়া রাতে দোতলায় থাকছে বলে বোনদের সাথে দেখা হচ্ছে না। কাল শুক্রবার তার উপর আবার অনুষ্ঠান। সেজন্য দুইদিনের ছুটি নিয়েছে রণ। কাজ গুছিয়ে দিতে যেয়ে আজ তাই ফিরতে রাত হলো। খুব ধীরে ধীরে দরজায় আওয়াজ করলো। খোলা দরজার ওপাশে শুভ্রার মুখ দেখে চমকে উঠলো সে। সেদিনের পর থেকে শুভ্রার সাথে না দেখা হয়েছে না কথা। আজ হঠাৎ কি মনে করে এই মেয়ে তার সামনে এলো। নিজেকে সামলে নিয়ে গম্ভীর মুখে ডাইনিং এ বসলো-“মা, ওমা তুমি কোথায়?”
“আন্টির শরীর খারাপ ছিলো একটু তাই আমি শুয়ে পড়তে বলেছি।”
শুভ্রাকে মোলায়েম কন্ঠে কথা বলতে দেখে রণ অবাক হলো। প্লেট টেনে ভাত বেড়ে নিতে নিতে বললো-“তা আপনি জেগে আছেন কেন?”
শুভ্রা মুচকি হাসলো-“আপনাকে ধন্যবাদ দিতে। আমার মুখ দেখার গিফটটা দিয়েছেন সেজন্য ধন্যবাদ।”
রণর ভ্রু কুঁচকে গেলো। কথার সারমর্ম বুঝতে খানিকটা সময় লাগলো। জবাব না দিয়ে পাতে তরকারি নেওয়ায় মনোযোগ দিলো।
“কাল দয়া করে ভরা মজলিসে আমার বাবাকে অপমান করবেন না। তাকে শশুরের মর্যাদা দেবেন। আপনার তো বাবা নেই, আমার বাবাকে বাবা মনে করুন তাহলেই হবে।”
রণর খাওয়া বন্ধ হলো। রক্তচক্ষু নিয়ে শুভ্রার পানে চাইলো। তার তাকানোর ভঙ্গি শুভ্রাকে বিবশ করে দিলো। সত্যি বলতে এবারই প্রথম রণর এমন রুপ দেখলো শুভ্রা। সে ভয় পেয়ে আঁতকে উঠলো। রণ কিছু না বলে খাবার থেকে হাত ঝেড়ে উঠে গেলো। এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে দোতলায় নেমে গেলো। কিছুই না বুঝতে পেরে শুভ্রা বোকাবোকা মুখ করে বসে রইলো।

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-২১

“আব্বা, আমি যাবো না আজকে। আপনারা যান।”
সোহেলের এমন কথায় সালিম সাহেব বিস্মিত-“যাবি না কেন খামাখা? শুভ্রা তো আমাগো সবাইরে একসাথে যাইতে কইছে। তুই না গেলে ওর মন খারাপ হইবো না।”
“হইবো না। কইবেন পরশুদিনের অনুষ্ঠানে আমি যামু। এখন ঢাকায় যাইতে মন চাইতেছে না। কালকেই আসলাম শরীর ক্লান্ত একটু বিশ্রাম নেই।”
সালিম সাহেব কি ভেবে রাজি হয়ে গেলেন-“আচ্ছা ঠিক আছে। তুই থাক তাইলে আমরা ঘুইরা আসি।”
“আচ্ছা আব্বা।”

সালিম সাহেবরা সকলে বেরিয়ে যেতেই সোহেল গুনগুন করতে করতে নিজের ঘরে ঢুকলো। তুলতুলকে না দেখে ওর ভ্রু কুঁচকে গেলো। মেয়েটা গেলো কই? কিছুক্ষণ আগেই তো ঘরে দেখে গেলো? বাথরুম, বারান্দা কোথাও না পেয়ে সত্যি সত্যি চিন্তায় পড়লো সোহেল। আজব তো! কই গেলো অল্প সময়ে? ছাঁদ, বাবা মায়ের ঘর কোনটাই বাদ দিলো না খোঁজ করতে। হঠাৎ মনে পড়লো ওখানে নেই তো? ভাবনা মাথায় আসতেই শুভ্রার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায় সোহেল। ভেতর থেকে বন্ধ পেয়ে ঠোঁটের কোনে হাসিটা চওড়া হলো তার। তার ধারণা ঠিক, তার বোনের ঘরটাকে নিরাপদ আশ্রয় মনে করে লুকিয়ে আছে তুলতুল। সে আদুরে গলায় ডাকলো-“তুলতুলি, ও তুলতুলি, তুমি নিজের ঘর বাদ দিয়ে এই ঘরে আসছো কেন? তাড়াতাড়ি গেট খুলো। দেখো আব্বা আম্মা সবাই গেছে গা। একা একা ভালো লাগতেছে না আমার।”
কোন সারা পাওয়া গেলো না। ভেতরে তুলতুলি বসে আছে, ঠকঠক করে কাঁপছে তার শরীর। সোহেল আবারও মোলায়েম কন্ঠে ডাকলো-“তুলতুলি পাখি, কালকে থেকে পালাই বেড়াইতেছ তুমি। আর কতো? স্বামীকে কষ্ট দিতেছ তোমার কিন্তু পাপ হবে। দরজাটা খুলে সোনা।”
তুলতুল তবুও সারা দিলো না। সোহেলের মেজাজ খারাপ হচ্ছে তবুও সে মাথা ঠান্ডা রেখে আবারও ডাকলো-“বউ এইবার দরজা না খুললে কিন্তু দরজা ভাইঙা ফেলবো। তারপর কি করবো তা তুমি জানো। আমি মেজাজ খারাপ করতে চাইতেছি না। লক্ষী মেয়ের মতো দরজাটা খুলে দাও। সত্যি বলতেছি কিছু করবোনা।”
বলার মিনিট খানেকের মাথায় দরজা খুলে গেলো। সোহেল দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। তুলতুলি ভয়ে জড়সড় হয়ে বিছানার এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে। সোহেল ওর দিকে এগিয়ে যেতেই তুলতুল পেছালো। সোহেল ওর হাত ধরে কাছে টানলো-“আরে আরে, ভয় পাও কেন? আমি কি বাঘ? স্বামী হই তোমার। হক আছে তোমার উপর। এমন করলে কেমনে চলবে?”
তুলতুল ভয়ে চেচিয়ে উঠলো-“না না ধরবেন না আমাকে। প্লিজ।”
সোহেল উচ্চস্বরে হাসলো-“আরে, এ কি কথা? আমি তোমাকে ধরবো না তো কে ধরবে?”
“আপনি তো বলছেন একবার ছুঁয়ে ফেলা মেয়েকে আপনি বউ মানেন না। প্লিজ ছেড়ে দেন আমাকে। আপনি চাইলেই অনেক মেয়ে পাবেন তাদের কাছে যান। তবুও আমার কাছে আইসেন না।”
তুলতুল অনুনয় করলো। সোহেল মেজাজ চরছে ধীরে ধীরে। সে ঠান্ডা গলায় বললো-“এতো সুন্দরী বউ থাকতে অন্য মেয়ের কাছে যাবো কেন? আজকে আমার তোমাকে লাগবে বউ।”
বলেই তুলতুলকে কাছে টানলো। গালে গলায় চুমো দিতে শুরু করলো। তুলতুলের আর সহ্য হলো না। সোহেলকে ধাক্কা দিলো-“আমার সহ্য হয় না আপনাকে। মাফ করেন আমাকে প্লিজ দয়া করে মাফ দেন।”
সোহেল হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তুলতুল তাকে রিজেক্ট করেছে এটা বুঝতে পেরেই মেজাজের দফারফা হলো। তুলতুলের দিকে তাকিয়ে কর্কশ কন্ঠে বললো-“কি কইলি তুই?”
তুলতুল পালানোর পথ খুঁজছে। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। সোহেল লাল আঁখি নিয়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে-“আমারে ঘেন্না লাগে তোর? ফকিন্নি, একটু ভালোমতো কথা কইছি ভাবছোস আমারে নাচাবি? তুই ভুইলা গেছোস তুই কি? এতোকিছুর পরেও তোর তেজ কমে নাই? আইজ তোরে…”
তুলতুল দরজা দিয়ে বেরুতে যেতেই সোহেল ওর শাড়ীর আঁচল ধরলো খপ করে। একটানে শাড়ির অনেকটা খুলে নিতেই তুলতুল ঘুরে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো। সোহেল এগুতে এগুতে পুরো শাড়ী ওর হাতের মুঠোয় নিলো। তুলতুল দু’হাত আড়াআড়ি ভাবে বুকের উপর রাখে। ফোপাঁতে শুরু করেছে সে। ওই অবস্থায় উঠে রুমের দরজার দিকে এগুলো। সোহেল ওকে কাঁধে তুলে নিয়ে নিজের কামরার দিকে হাঁটতে শুরু করলো-“ভাবছিলাম জোর করুম না তোকে কিন্তু তুই বাধ্য করলি। এর শাস্তি তুই পাবি। এমন শাস্তি দিব যাতে তুই নিজে থিকা আমার কাছে আসবি।”
বলেই নিজ ঘরের বিছানায় আছড়ে ফেললো তুলতুলকে। দরজা আঁটকে গায়ের কাপড় খুলতে খুলতে তুলতুলের দিকে এগুলো-“আইজকাই শেষ দিন। এরপর তুই আসবি আমার কাছে। নিজের থিকা আদর দিবি আমাকে। না দিলে কি করুম তুই ভাবতেও পারবি না। এই সোহেলকে এখনও চিনোস নাই তুই।”
তুলতুলে ভয়ে গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদছে। কিছু বলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। সোহেল ততক্ষণে ওর মুখ বন্ধ করেছে নিষ্ঠুর দানবের মতো।

★★★

শুভ্রার পরনে আজ মেরুন রঙের বেনারসি শাড়ি। আলাদা করে ওড়না না নিয়ে মাথায় শাড়ীর আঁচলই তুলে দিয়েছে। আজ গায়ে রণর মায়ের দেওয়া গয়না শোভা পাচ্ছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে শোভা। সত্যি বলতে একদম অন্যরকম লাগছে ওকে। গায়ের পোশাক গহনা সবই শাশুড়ীর পছন্দের হলেও আজ নিজের রুপ নিজের কাছেই অচেনা লাগে। বাঙালি বউ যেমন হয় ঠিক তেমন লাগছে তাকে। দরজায় আওয়াজ হলো-“আসবো?”
রণর গলা শুনে শুভ্রা অবাক হলো-“হ্যা আসুন।”
রণ ভেতরে ঢুকে বউ সাজে সজ্জিত শুভ্রাকে দেখলো একপলক। চোখ আঁটকে গেলো ওর। মেয়েটাকে বউয়ের সাজে মোহনীয় লাগছে। যদি এটা স্বাভাবিক বিয়ে হতো তাহলে এই দেখাটা নিশ্চয়ই অন্যরকম আনন্দদায়ক হতো? হয়তো মধুর কোন স্মৃতি রচিত হতো এই মুহূর্তে। শুভ্রারও কি নজর আঁটকেনি রণতে? ব্লু কালারের কোর্ট প্যান্টে রণকে ড্যাশিং হিরোর মতোই লাগছে আজ। কয়েক সেকেন্ডের জন্য দু’জনার নজর আঁটকে রইলো দু’জনাতে। রণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে নজর ফিরিয়ে সোফায় বসলো। শুভ্রাকে ইশারায় বসতে বললো-“বসুন প্লিজ। আপনার সাথে কিছু জরুরি কথা আছে।”
শুভ্রা কিছু না বলে বসলো। সে মনে মনে ভাবছে কি এতো জরুরি কথা বলবে বদ মন্ত্রী। রণ একটু ভেবে নিলো তারপর মুখ খুললো-“আজকের দিনেই কেন কথা বলতে এলাম? এমন প্রশ্ন আপনার মনে এলে তার উত্তরে বলি আজকের জন্য জরুরি বলেই কথা বলতে আশা। আজ অনেক গন্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকবে। উপস্থিত থাকবে আপনার পরিবারও। আমার ওয়াইফ হিসেবে অনুষ্ঠানের মধ্যমনি থাকবেন আপনি। প্লিজ খেয়াল রাখবেন আমার পরিবারের কোন সদস্য যেন আপনার বা আপনার পরিবারের কারণে অপমান বা অপদস্ত না হয়। ইচ্ছে বা অনিচ্ছা যেটাই হোক না কেন আপনি এখন এ পরিবারের বউ। এই পরিবারের সন্মান রক্ষা করা আপনার দায়িত্ব। আমি আমার মা বোন আত্মীয়দের ব্যাপারে ভীষণ সেনসেটিভ। ওদের জন্য কারো সাথে আপোষ করতে পারি না। আশাকরি এটুকু মাথায় রেখে চলবেন। আর রইলো ও বাড়ি যাওয়ার কথা। আপনি চাইলে আজও যেতে পারবেন আবার আগামী পরশু এলাকায় আরেকটা অনুষ্ঠান হবে তারপরও আপনার বাড়িতে যেতে পারেন। এতে আমার বলার কিছু নেই।”
খানিকক্ষণ থেমে দম নিলো রণ। আবার বলতে শুরু করে-“এই বিয়েটা নিয়ে আপাতত কিছু ভাবছি না আমি। আমি জানি আপনিও কিছু ভাবছেন না। আপনার আমাকে বিয়ে করার উদ্দেশ্য কি জানি না। বিয়ের ভবিষ্যত কি হবে সেটা হয়তো ভাগ্যই বলে দেবে। তাই আপনার জীবনের কোন ব্যাপার নিয়েই আমার কিছু বলার নেই৷ ইটস আপ টু ইউ। ঠিক তেমনি আমার কোন ব্যাপারে আপনিও অযাচিতভাবে কিছু বলবেন না। শুধু একটা বিষয়ের অনুরোধ এমন কিছু করবেন না যাতে আমার পরিবার আহত হয়। বাকী আমার তরফ থেকে আপনি স্বাধীন। কোন কিছুতে কোন বাঁধা নেই। আপনি আপনার মতো স্বাধীন ভাবে চলতে পারেন। আপনি আমার বাধ্য নন আমিও আপনার বাধ্য নই। বুঝতে পেরেছেন?”
শুভ্রা না বুঝেই মাথা নাড়ে। রণ এত এত কথা বললো কোনটা মনে রাখবে সে? রণ উঠে দাঁড়ায়-“গুড। আমি এখন ভেন্যুতে চলে যাব গেষ্ট এটেন্ড করতে। আপনি মা আর হাসিখুশিকে নিয়ে একসাথে আসবেন। ঠিক আছে?”
এবারও শুভ্রা কেবল মাথা দুলিয়ে সায় জানায়। শুভ্রাকে ভদ্র বাচ্চার মতো মাথা দুলাতে দেখে রণ প্রসন্নচিত্তে উঠে যেতেই শুভ্রা হাসলো, বিরবির করলো-“এতো সহজ মন্ত্রী মশাই? সব ভুলে যাব এতো সহজে? আমার দুইমাসের কষ্ট একটু একটু করে শোধ তুলবো। খাবার না খেতে দেওয়া, দিনের পর দিন অন্ধকারে রাখা। কি ভেবেছেন, ভুলে যাব সব? আপনি সুখ ভিক্ষা চাইবেন আমার কাছে। কাঁদবেন পায়ে পড়বেন তারপর মাফ করবো কিনা ভেবে দেখবো। এই শুভ্রা নিজের উপর হওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নেবেই নেবে।

চলবে—
©Farhana_Yesmin

দর্পহরন পর্ব-১৬+১৭+১৮

0

#দর্পহরন
#পর্ব-১৬

পরের দিন অফিসে যাওয়ার সময় জলি রণর সামনে এলো না। জীবনে প্রথমবারের মতো এমন হলো যে রণ বাইরে যাচ্ছে আর জলি তাকে বিদায় দিতে আসেনি। রণ সারাটাদিন অফিসে অন্যমনস্ক হয়ে রইলো। গুরুত্বপূর্ণ কাজের ফাঁকে ফাঁকে কেবল মায়ের কথাগুলো কানে বাজছে। রণর মনটা ভীষণ ভার হয়ে রইলো। মা কেন এরকম অন্যায় জেদ করছে সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। মা কি জানে না ওরা কেমন? কতটা নির্দয় হতে পারে। ভেবে ভেবে মনটা অশান্ত হয়ে গেলো রণর। ওর সহকারী রাজিবকে ডেকে পাঠালো।
“ভাই, ডেকেছেন?”
রাজিব এসে দাঁড়ায়। রণকে ভীষণ গম্ভীর দেখা গেলো-“গতকাল মায়ের সাথে দেখা করতে বাসায় কেউ এসেছিল?”
রাজিব অবাক হলো-“হ্যা এসেছিল একজন মহিলা বোরকা পরে।”
“চেহারা দেখেছিস?”
“নাহ ভাই। মুখে নেকাব ছিল। আম্মা বলে রাখছিল, কোন মহিলা আসলে যেন তাকে বাসায় পাঠায় দেই।”
রণ চিন্তিত হয়ে জানতে চাইলো-“কখন এসেছিল?”
রাজীব ভীত গলায় জানতে চাইলো-“দুপুরের দিকে। কেন ভাই কোন সমস্যা হইছে?”
রণ বিরবির করলো-“সমস্যা মানে বিরাট সমস্যা হইছে।”
“ভাই কিছু বলতেছেন?”
রণ চমকে উঠলো-“নাহ কিছু না। শোন, আমি এখন উঠবো। সন্ধ্যার পর কোথায় যেন যাওয়ার কথা ছিল ওটা মানা করে দে। বলবি আমি অসুস্থ।”
রাজীব বিস্মিত হয়ে বললো-“আচ্ছা। কিন্তু হইছে কি?”
“পরে বলবো। এখন চল আগে বাসায় যাই।”
রাজীব ঘাড় হেলিয়ে বেরিয়ে গেলো।

বাসায় ফিরে সেই সুনসান নিরবতা। রণ মায়ের ঘরের সামনে এসে কয়েকবার মাকে ডাকলো কিন্তু কোন সাড়া পেলো না। বাধ্য হয়ে বোনদের রুমে এলো। হইচই করে পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখা হাসিখুশিও আজ নিরব। রণ মনখারাপ করে এসে ওদের বিছানায় বসলো। দুইবোন চুপচাপ পড়ার টেবিলের সামনে বসে ছিলো। ভাইকে দেখে বললো-“ভাইয়া, মা আজ সারাদিন খায়নি। রুম থেকেও বেরোয়নি। এরকম করলে তো মা অসুস্থ হয়ে যাবে।”
রণ চমকে গেলো-“সারাদিন খায়নি?”
“উহু। অনেকবার ডেকেছি বলেছে খাবে না।”
রণ কি বলবে ভেবে পেলো না। তার নিজেকে বড্ড অপরাধী মনেহচ্ছে। কিন্তু মায়ের অন্যায় আবদার মেনে নেওয়াও অসম্ভব তার পক্ষে। সে চুপ করে বসে রইলো। হাসিখুশি উসখুস করছে ভাইকে কিছু বলবে বলে। রণ সেটা বুঝে তাকায় ওদের দিকে-“কিছু বলবি তোরা?”
দু’জনই মাথা দুলায়-“কাল একটা মেয়ে এসেছিল বাসায়। মায়ের সাথে চুপিচুপি কি সব আলাপ করলো। মেয়েটা যাওয়ার পর থেকেই মা গম্ভীর।”
রণ কি মনে করে হুট করে নিজের মোবাইল থেকে একটা ছবি বের করে দেখালো-“এই মেয়েটা নাকি দেখতো?”
দুই বোন মন দিয়ে ছবিটা দেখলো। তারপর চেচিয়ে উঠে বললো-“হ্যা ভাইয়া, উনিই এসেছিল। কে বলো তো?”
“তোরা চিনবি না।” রণ ভীষণ চিন্তিত হলো।
“ভাইয়া, মেয়েটা কিন্তু বেশ সুন্দরী। তাই না হাসি?”
রণ অন্যমনস্ত হয়ে বোনদের দেখলো। তার মাথায় তখন শুভ্রার চিন্তা। এই মেয়ে কি উদ্দেশ্য নিয়ে মায়ের কাছে এসেছিল? মাকে পটিয়ে কোনভাবে তার বউ হতে? তারপর তাকে ব্যবহার করে ভাইকে জেল থেকে মুক্ত করা? পুরো চাল নিশ্চয়ই ইব্রাহিম সালিমের মাথা থেকে এসেছে? এই লোক এতেটাই নিচু মনের যে নিজের স্বার্থে মেয়েকে ব্যবহার করতে কুন্ঠিত হবে না। রণর চোয়াল শক্ত হলো, হাত মুষ্টিবদ্ধ। শুভ্রা কতোটা ঘাড়ত্যাড়া সেটা তার মা জানে না। দু’টো মাস রণকে জ্বালানোর হেন চেষ্টা নাই করেনি। শুধু মেয়েটার জেদের কারণে রণকে তার সাথে অভদ্রতা করতে হয়েছে। জেনেবুঝে এই মেয়েকে বিয়ে করা মানে নিজের মৃত্যুসনদে সাক্ষ্য দেওয়া। মা কেন বুঝতে পারছে না এসব ওদের চাল? রণ ছটফটিয়ে উঠলো। যে কোন ভাবে মায়ের সাথে কথা বলতে হবে। মাকে বোঝাতে হবে এসব কথা। রণ পুনরায় মায়ের ঘরের সামনে এলো। নরম গলায় মাকে ডাকলো-“মা, বিয়ের ব্যাপারে কথা বলবো তোমার সাথে। দরজাটা খুলবে? মা প্লিজ দরজাটা খোল।”
পাঁচ মিনিট পরে খট করে দরজা খোলার আওয়াজ এলো।
“ভেতরে এসো রণ।”
রণর বুকটা হুহু করে উঠলো। মা কাল থেকে তাকে তুমি সম্বোধন করেই যাচ্ছে। একটা মেয়ের জন্য মা তাকে কত দূরের মানুষ বানিয়ে দিয়েছে। নিজেকে সামলে নিয়ে মায়ের বিছানায় এসে বসলো রণ। জলি একটু দূরত্বে বসেছে। সে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। মায়ের মুখ ঘুরিয়ে রাখা টের পেয়ে খারাপ লাগা বাড়লো রণর। সে বলেই ফেললো-“মা, আমি কি এতই খারাপ যে আমার মুখ দেখতে চাও না এখন?”
জলি জবাব দিলো না। রণ অপেক্ষা করলো এবার হয়তো মা তাকাবে তার দিকে।
“মা, তুমি সারাদিন খাওনি কেন? শরীর খারাপ করবে তো?”
জলি এবার মেজাজ দেখিয়ে বললো-“সে চিন্তা কি তোমার আছে? মাকে নিয়ে কতটা ভাবো তা দেখা হয়েছে আমার।”
“মা! এভাবে বলতে পারলে? আমি কবে তোমার চাওয়ার বিপরীতে কাজ করেছি মা?” রণ আর্তনাদ করে উঠলো।
“চাওয়া!” জলি তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলো-“তুমি আমার ভাবনার অনেক বাইরে কাজ করেছ। যদি একটাবার মায়ের কথা ভাবতে তাহলে কোনদিন এমন কিছু করতে না যাতে তোমার মায়ের মাথা হেট হয়। কেউ তার দিকে আঙুল তুলতে পারে। কেউ এটা বলার সাহস পেতো না যে আমার ছেলের কারণে তার জীবন নষ্ট হয়েছে। ”
রণর হাসফাস লাগে। মাকে আর কতবার বুঝিয়ে বললে মা বুঝবে? সে অসহায় চাহুনি দিয়ে বললো-“তুমি কি একটুও বুঝতে পারছ না আমি কেন এমন করেছি?”
জলি এবার ছেলের দিকে তাকালো-“তুমি কি বুঝতে পারছ না আমি কেন এমন বলছি?তুমি ভাবছো আমি খুব শখ করে তোমাকে এই কাজ করতে বলছি? আমি শুধু ওই মেয়েটার জায়গায় নিজের সন্তানকে দেখছি। আর তোমাকে কিছুতেই মাফ করতে পারছি না। আমি জীবনে কোনদিন ভাবিনি আমার রণর দিকে কেউ আঙুল তুলবে। কেউ বলবে, এই ছেলেটা মেয়েদের সন্মান করে না।”
“তুমি অন্যায় জেদ করছো মা। ওই মেয়েটাকে এই বাড়িতে আনলে আমাদের সবার জীবন নরক হয়ে যাবে। ও যেনতেন কোন মেয়ে নয় মা। প্লিজ তুমি তোমার জেদ থেকে সরে এসো। চলো খেতে যাই।”
রণ উঠে জলির হাত ধরতে গেলে সে ঝাঁটকা দিয়ে হাত সরিয়ে দিলো-“আমাকে বুঝ দিতে হবে না রণ। আমি কোন বাচ্চা মেয়ে নই। সব বুঝে ভেবে ডিসিশন নিয়েছি। তুমি হয় আমার সিদ্ধান্ত মানো নয়তো আমাকে আমার হালে ছেড়ে দাও। যা হওয়ার হোক।”
রণ এবার মেজাজ হারালো-“মা তুমি কেন বুঝতে পারছো না এটা ইব্রাহিম সালিমের চাল। ওর ছেলেকে হত্যা মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে। সেইজন্য আমার পেছনে লেগেছে। এখন ওনার সাথে আত্মীয়তা করা মানে নিজের ক্যারিয়ারে কুড়াল মারা। দলের প্রান্তিক শ্রেনী, এলাকার লোকজন সবাই আমাকে বিশ্বাস করে মা। ওদের বিশ্বাসের খেলাপ করা হবে। ওরা আর ভরসা করবে না আমাকে। তাছাড়া ফুপি কি বলবে?”
জলির ভ্রু কুঁচকে এলো-“ফুপি! ফুপি কি বলবে? তার বলা না বলায় কি এসে যায়। তোমার বাবা এতো গুলো বছর হয় নিখোঁজ সে কি কোন খবর বের করতে পেরেছে? নাকি আমাদের দু’বেলা ভাত খাইয়েছে? আর রইলো এলাকার লোকের কথা। আমি তোমাকে ইব্রাহিম সালিমের পা চাটা গোলাম হতে বলিনি। মেয়ে জামাই হওয়ার পর ওরাই বরং তোমার কাছে ঠেকে থাকবে মেয়ের সুখের কথা ভেবে।”
রণ হাসলো-“এরকম কিছুই হবে না। না তুমি ইব্রাহিম সালিমকে চিনেছ না ওর মেয়েকে। ওরা বরং আমাকে গোলাম হতে বাধ্য করবে।”
“আমার আর চেনার দরকার নেই। শোন রণ, আমার চুলগুলো এমনি এমনি পাকেনি। অবশ্যই তোমার চাইতে বেশি বুঝি আমি। আমার দুটো মেয়ে আছে, ওদের বিয়ে দিতে হবে। তুমি আছো। আমি চাই না আমার এই ছোট পরিবারে কারো নজর লাগুক। আর তুমি রাজনীতির মাঠে নেমেছ এতো ভয় পেলে চলবে কেন? ওরা যদি তোমাকে বশ করতে চায় তাহলে তুমি থেমে থাকবে কেন? তুমি ওদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারলেই না বোঝা যাবে কিছু শিখেছ। এরপরও যদি তুমি না মানো তাহলে আর কিছু করার নেই আমার। তোমাদের নিজেদের হালে ছেড়ে আমি নিজেকে মৃত্যুর হাতে সপে দেব।”
“মা! আমাদের এতিম করে দেওয়ার কথা তোমার মাথায় এলো কি করে?” রণর হুঙ্কার শুনে কেঁপে উঠলো জলি। কথাগুলো বলতে তারও যে বুক কেঁপেছে ভীষণ। জলির চোখদুটো জ্বলছে।
“তুমি বুঝলে না দূরের শত্রুর সাথে যুদ্ধ করা আর শত্রুকে ঘরে টেনে আনার মধ্যে পার্থক্য কতটা। বেশ, মেনে নিলাম তোমার জেদ। তবে তোমারও একটা কথা মেনে নিতে হবে। এরপর আমি বউয়ের সাথে কিভাবে জীবন কাটাবো সে বিষয়ে কিছু বলতে পারবেনা তুমি। কোন ধরনের নাক গলাবে না আমার বিবাহিত জীবনে। যদি কথা দিতে পারো তাহলে যেদিন বলবে বিয়ে করবো।”
জলি কিছু বলতে যেয়েও নিজেকে সামলে নিলো-“আমি কথা বলে নিচ্ছি ওদের সাথে। পরশু যাবো ওদের বাড়িতে। ছোটখাটো আয়োজনে বিয়ে সারবো। পরে বড় করে রিসিপশন করা যাবে।”
রণর মুখেচোখে ঘোর আমাবস্যা। সে হেরে যাওয়া মানুষের মতো ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললো-“ওসব নিয়ে যা খুশি করো। আপাতত খেতে এসো। তোমার কারণে কাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি আমার। দয়া করে খেতে দাও আমাকে।”
“তুই শাওয়ার নিয়ে আয় আমি খাবার রেডি করছি।”
রণ অবসন্ন ভাবে উঠে দাঁড়ায়। পায়ে কোন জোর পাচ্ছে না সে। টলতে টলতে মায়ের ঘর ছাড়ে। কোনরকমে নিজের ঘরে ফিরে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে। এতকিছু করে শেষ পর্যন্ত সে কিনা নিজের ঘরেই হেরে গেলো? এই অনুভূতি তাকে হেরে যাওয়ার চাইতেও বাজে অনুভূতি দিচ্ছে যা তার কাছে ভীষণ পীড়াদায়ক লাগলো। শুভ্রা তার মাকে দখল করে নিলো? এরপর মেয়েটা কিকি করবে ভাবতেই মাথা দুলে উঠছে তার। যতটা স্বপ্ন নিয়ে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু করেছিল তার সবটাই যেন ধুলোয় মিলিয়ে গেলো। ঘরের মধ্যে শত্রু বসে থাকলে সে কিভাবে শত্রুর বিনাশ করবে?

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-১৬

পরের দিন অফিসে যাওয়ার সময় জলি রণর সামনে এলো না। জীবনে প্রথমবারের মতো এমন হলো যে রণ বাইরে যাচ্ছে আর জলি তাকে বিদায় দিতে আসেনি। রণ সারাটাদিন অফিসে অন্যমনস্ক হয়ে রইলো। গুরুত্বপূর্ণ কাজের ফাঁকে ফাঁকে কেবল মায়ের কথাগুলো কানে বাজছে। রণর মনটা ভীষণ ভার হয়ে রইলো। মা কেন এরকম অন্যায় জেদ করছে সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। মা কি জানে না ওরা কেমন? কতটা নির্দয় হতে পারে। ভেবে ভেবে মনটা অশান্ত হয়ে গেলো রণর। ওর সহকারী রাজিবকে ডেকে পাঠালো।
“ভাই, ডেকেছেন?”
রাজিব এসে দাঁড়ায়। রণকে ভীষণ গম্ভীর দেখা গেলো-“গতকাল মায়ের সাথে দেখা করতে বাসায় কেউ এসেছিল?”
রাজিব অবাক হলো-“হ্যা এসেছিল একজন মহিলা বোরকা পরে।”
“চেহারা দেখেছিস?”
“নাহ ভাই। মুখে নেকাব ছিল। আম্মা বলে রাখছিল, কোন মহিলা আসলে যেন তাকে বাসায় পাঠায় দেই।”
রণ চিন্তিত হয়ে জানতে চাইলো-“কখন এসেছিল?”
রাজীব ভীত গলায় জানতে চাইলো-“দুপুরের দিকে। কেন ভাই কোন সমস্যা হইছে?”
রণ বিরবির করলো-“সমস্যা মানে বিরাট সমস্যা হইছে।”
“ভাই কিছু বলতেছেন?”
রণ চমকে উঠলো-“নাহ কিছু না। শোন, আমি এখন উঠবো। সন্ধ্যার পর কোথায় যেন যাওয়ার কথা ছিল ওটা মানা করে দে। বলবি আমি অসুস্থ।”
রাজীব বিস্মিত হয়ে বললো-“আচ্ছা। কিন্তু হইছে কি?”
“পরে বলবো। এখন চল আগে বাসায় যাই।”
রাজীব ঘাড় হেলিয়ে বেরিয়ে গেলো।

বাসায় ফিরে সেই সুনসান নিরবতা। রণ মায়ের ঘরের সামনে এসে কয়েকবার মাকে ডাকলো কিন্তু কোন সাড়া পেলো না। বাধ্য হয়ে বোনদের রুমে এলো। হইচই করে পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখা হাসিখুশিও আজ নিরব। রণ মনখারাপ করে এসে ওদের বিছানায় বসলো। দুইবোন চুপচাপ পড়ার টেবিলের সামনে বসে ছিলো। ভাইকে দেখে বললো-“ভাইয়া, মা আজ সারাদিন খায়নি। রুম থেকেও বেরোয়নি। এরকম করলে তো মা অসুস্থ হয়ে যাবে।”
রণ চমকে গেলো-“সারাদিন খায়নি?”
“উহু। অনেকবার ডেকেছি বলেছে খাবে না।”
রণ কি বলবে ভেবে পেলো না। তার নিজেকে বড্ড অপরাধী মনেহচ্ছে। কিন্তু মায়ের অন্যায় আবদার মেনে নেওয়াও অসম্ভব তার পক্ষে। সে চুপ করে বসে রইলো। হাসিখুশি উসখুস করছে ভাইকে কিছু বলবে বলে। রণ সেটা বুঝে তাকায় ওদের দিকে-“কিছু বলবি তোরা?”
দু’জনই মাথা দুলায়-“কাল একটা মেয়ে এসেছিল বাসায়। মায়ের সাথে চুপিচুপি কি সব আলাপ করলো। মেয়েটা যাওয়ার পর থেকেই মা গম্ভীর।”
রণ কি মনে করে হুট করে নিজের মোবাইল থেকে একটা ছবি বের করে দেখালো-“এই মেয়েটা নাকি দেখতো?”
দুই বোন মন দিয়ে ছবিটা দেখলো। তারপর চেচিয়ে উঠে বললো-“হ্যা ভাইয়া, উনিই এসেছিল। কে বলো তো?”
“তোরা চিনবি না।” রণ ভীষণ চিন্তিত হলো।
“ভাইয়া, মেয়েটা কিন্তু বেশ সুন্দরী। তাই না হাসি?”
রণ অন্যমনস্ত হয়ে বোনদের দেখলো। তার মাথায় তখন শুভ্রার চিন্তা। এই মেয়ে কি উদ্দেশ্য নিয়ে মায়ের কাছে এসেছিল? মাকে পটিয়ে কোনভাবে তার বউ হতে? তারপর তাকে ব্যবহার করে ভাইকে জেল থেকে মুক্ত করা? পুরো চাল নিশ্চয়ই ইব্রাহিম সালিমের মাথা থেকে এসেছে? এই লোক এতেটাই নিচু মনের যে নিজের স্বার্থে মেয়েকে ব্যবহার করতে কুন্ঠিত হবে না। রণর চোয়াল শক্ত হলো, হাত মুষ্টিবদ্ধ। শুভ্রা কতোটা ঘাড়ত্যাড়া সেটা তার মা জানে না। দু’টো মাস রণকে জ্বালানোর হেন চেষ্টা নাই করেনি। শুধু মেয়েটার জেদের কারণে রণকে তার সাথে অভদ্রতা করতে হয়েছে। জেনেবুঝে এই মেয়েকে বিয়ে করা মানে নিজের মৃত্যুসনদে সাক্ষ্য দেওয়া। মা কেন বুঝতে পারছে না এসব ওদের চাল? রণ ছটফটিয়ে উঠলো। যে কোন ভাবে মায়ের সাথে কথা বলতে হবে। মাকে বোঝাতে হবে এসব কথা। রণ পুনরায় মায়ের ঘরের সামনে এলো। নরম গলায় মাকে ডাকলো-“মা, বিয়ের ব্যাপারে কথা বলবো তোমার সাথে। দরজাটা খুলবে? মা প্লিজ দরজাটা খোল।”
পাঁচ মিনিট পরে খট করে দরজা খোলার আওয়াজ এলো।
“ভেতরে এসো রণ।”
রণর বুকটা হুহু করে উঠলো। মা কাল থেকে তাকে তুমি সম্বোধন করেই যাচ্ছে। একটা মেয়ের জন্য মা তাকে কত দূরের মানুষ বানিয়ে দিয়েছে। নিজেকে সামলে নিয়ে মায়ের বিছানায় এসে বসলো রণ। জলি একটু দূরত্বে বসেছে। সে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। মায়ের মুখ ঘুরিয়ে রাখা টের পেয়ে খারাপ লাগা বাড়লো রণর। সে বলেই ফেললো-“মা, আমি কি এতই খারাপ যে আমার মুখ দেখতে চাও না এখন?”
জলি জবাব দিলো না। রণ অপেক্ষা করলো এবার হয়তো মা তাকাবে তার দিকে।
“মা, তুমি সারাদিন খাওনি কেন? শরীর খারাপ করবে তো?”
জলি এবার মেজাজ দেখিয়ে বললো-“সে চিন্তা কি তোমার আছে? মাকে নিয়ে কতটা ভাবো তা দেখা হয়েছে আমার।”
“মা! এভাবে বলতে পারলে? আমি কবে তোমার চাওয়ার বিপরীতে কাজ করেছি মা?” রণ আর্তনাদ করে উঠলো।
“চাওয়া!” জলি তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলো-“তুমি আমার ভাবনার অনেক বাইরে কাজ করেছ। যদি একটাবার মায়ের কথা ভাবতে তাহলে কোনদিন এমন কিছু করতে না যাতে তোমার মায়ের মাথা হেট হয়। কেউ তার দিকে আঙুল তুলতে পারে। কেউ এটা বলার সাহস পেতো না যে আমার ছেলের কারণে তার জীবন নষ্ট হয়েছে। ”
রণর হাসফাস লাগে। মাকে আর কতবার বুঝিয়ে বললে মা বুঝবে? সে অসহায় চাহুনি দিয়ে বললো-“তুমি কি একটুও বুঝতে পারছ না আমি কেন এমন করেছি?”
জলি এবার ছেলের দিকে তাকালো-“তুমি কি বুঝতে পারছ না আমি কেন এমন বলছি?তুমি ভাবছো আমি খুব শখ করে তোমাকে এই কাজ করতে বলছি? আমি শুধু ওই মেয়েটার জায়গায় নিজের সন্তানকে দেখছি। আর তোমাকে কিছুতেই মাফ করতে পারছি না। আমি জীবনে কোনদিন ভাবিনি আমার রণর দিকে কেউ আঙুল তুলবে। কেউ বলবে, এই ছেলেটা মেয়েদের সন্মান করে না।”
“তুমি অন্যায় জেদ করছো মা। ওই মেয়েটাকে এই বাড়িতে আনলে আমাদের সবার জীবন নরক হয়ে যাবে। ও যেনতেন কোন মেয়ে নয় মা। প্লিজ তুমি তোমার জেদ থেকে সরে এসো। চলো খেতে যাই।”
রণ উঠে জলির হাত ধরতে গেলে সে ঝাঁটকা দিয়ে হাত সরিয়ে দিলো-“আমাকে বুঝ দিতে হবে না রণ। আমি কোন বাচ্চা মেয়ে নই। সব বুঝে ভেবে ডিসিশন নিয়েছি। তুমি হয় আমার সিদ্ধান্ত মানো নয়তো আমাকে আমার হালে ছেড়ে দাও। যা হওয়ার হোক।”
রণ এবার মেজাজ হারালো-“মা তুমি কেন বুঝতে পারছো না এটা ইব্রাহিম সালিমের চাল। ওর ছেলেকে হত্যা মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে। সেইজন্য আমার পেছনে লেগেছে। এখন ওনার সাথে আত্মীয়তা করা মানে নিজের ক্যারিয়ারে কুড়াল মারা। দলের প্রান্তিক শ্রেনী, এলাকার লোকজন সবাই আমাকে বিশ্বাস করে মা। ওদের বিশ্বাসের খেলাপ করা হবে। ওরা আর ভরসা করবে না আমাকে। তাছাড়া ফুপি কি বলবে?”
জলির ভ্রু কুঁচকে এলো-“ফুপি! ফুপি কি বলবে? তার বলা না বলায় কি এসে যায়। তোমার বাবা এতো গুলো বছর হয় নিখোঁজ সে কি কোন খবর বের করতে পেরেছে? নাকি আমাদের দু’বেলা ভাত খাইয়েছে? আর রইলো এলাকার লোকের কথা। আমি তোমাকে ইব্রাহিম সালিমের পা চাটা গোলাম হতে বলিনি। মেয়ে জামাই হওয়ার পর ওরাই বরং তোমার কাছে ঠেকে থাকবে মেয়ের সুখের কথা ভেবে।”
রণ হাসলো-“এরকম কিছুই হবে না। না তুমি ইব্রাহিম সালিমকে চিনেছ না ওর মেয়েকে। ওরা বরং আমাকে গোলাম হতে বাধ্য করবে।”
“আমার আর চেনার দরকার নেই। শোন রণ, আমার চুলগুলো এমনি এমনি পাকেনি। অবশ্যই তোমার চাইতে বেশি বুঝি আমি। আমার দুটো মেয়ে আছে, ওদের বিয়ে দিতে হবে। তুমি আছো। আমি চাই না আমার এই ছোট পরিবারে কারো নজর লাগুক। আর তুমি রাজনীতির মাঠে নেমেছ এতো ভয় পেলে চলবে কেন? ওরা যদি তোমাকে বশ করতে চায় তাহলে তুমি থেমে থাকবে কেন? তুমি ওদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারলেই না বোঝা যাবে কিছু শিখেছ। এরপরও যদি তুমি না মানো তাহলে আর কিছু করার নেই আমার। তোমাদের নিজেদের হালে ছেড়ে আমি নিজেকে মৃত্যুর হাতে সপে দেব।”
“মা! আমাদের এতিম করে দেওয়ার কথা তোমার মাথায় এলো কি করে?” রণর হুঙ্কার শুনে কেঁপে উঠলো জলি। কথাগুলো বলতে তারও যে বুক কেঁপেছে ভীষণ। জলির চোখদুটো জ্বলছে।
“তুমি বুঝলে না দূরের শত্রুর সাথে যুদ্ধ করা আর শত্রুকে ঘরে টেনে আনার মধ্যে পার্থক্য কতটা। বেশ, মেনে নিলাম তোমার জেদ। তবে তোমারও একটা কথা মেনে নিতে হবে। এরপর আমি বউয়ের সাথে কিভাবে জীবন কাটাবো সে বিষয়ে কিছু বলতে পারবেনা তুমি। কোন ধরনের নাক গলাবে না আমার বিবাহিত জীবনে। যদি কথা দিতে পারো তাহলে যেদিন বলবে বিয়ে করবো।”
জলি কিছু বলতে যেয়েও নিজেকে সামলে নিলো-“আমি কথা বলে নিচ্ছি ওদের সাথে। পরশু যাবো ওদের বাড়িতে। ছোটখাটো আয়োজনে বিয়ে সারবো। পরে বড় করে রিসিপশন করা যাবে।”
রণর মুখেচোখে ঘোর আমাবস্যা। সে হেরে যাওয়া মানুষের মতো ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললো-“ওসব নিয়ে যা খুশি করো। আপাতত খেতে এসো। তোমার কারণে কাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি আমার। দয়া করে খেতে দাও আমাকে।”
“তুই শাওয়ার নিয়ে আয় আমি খাবার রেডি করছি।”
রণ অবসন্ন ভাবে উঠে দাঁড়ায়। পায়ে কোন জোর পাচ্ছে না সে। টলতে টলতে মায়ের ঘর ছাড়ে। কোনরকমে নিজের ঘরে ফিরে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে। এতকিছু করে শেষ পর্যন্ত সে কিনা নিজের ঘরেই হেরে গেলো? এই অনুভূতি তাকে হেরে যাওয়ার চাইতেও বাজে অনুভূতি দিচ্ছে যা তার কাছে ভীষণ পীড়াদায়ক লাগলো। শুভ্রা তার মাকে দখল করে নিলো? এরপর মেয়েটা কিকি করবে ভাবতেই মাথা দুলে উঠছে তার। যতটা স্বপ্ন নিয়ে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু করেছিল তার সবটাই যেন ধুলোয় মিলিয়ে গেলো। ঘরের মধ্যে শত্রু বসে থাকলে সে কিভাবে শত্রুর বিনাশ করবে?

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-১৮

রাত নয়টা পয়তাল্লিশ মিনিটে তিনবার কবুল বলে রণ আর শুভ্রা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলো। মুরুব্বিদের সালাম করার নিয়মে যেয়েই বিপাক বাঁধলো। শুভ্রা তার শশুরবাড়ির লোকদের সালাম করলেও রণ দাঁড়িয়ে রইলো। সে মুখে সালাম জানালো হাতের ইশারায়। ইব্রাহিম সালিম হাসলো-“বেয়াইন, আপনার ছেলেরে দেখি আদব শেখান নাই? মানলাম সে প্রতিমন্ত্রী কিন্তু আমি তো তার শশুর লাগি এখন। আর বিয়ের পর মুরুব্বিদের দোয়া নিতে হয় এটা কি তাকে বলে দিতে হবে?”
রণ কিছু বলতে চাইছিল জলি তাকে চোখের ইশারায় শান্ত থাকতে বলে মৃদুস্বরে জবাব দিলো-“ভাইসাহেব, পায়ে হাত দিয়ে সালাম করার ব্যাপারে ধর্মে নিষেধ আছে। আমার ছেলেকে এভাবেই শিখিয়েছি। আর শুধু সালামে কি আদব বোঝা যায়? দেখতে হবে আচরণ কেমন? আমার ছেলে আলহামদুলিল্লাহ আদবের দিক দিয়ে সেরা। মানুষ হিসেবে অসাধারণ আর ছেলে হিসেবে লাখে একটা। এতটুকু বলতে পারি অন্যায় ব্যাতীত সে আপনাদের কখনো অসম্মান করবে না।”
সালিম সাহেব আরও কিছু হয়তো বলতেন কিন্তু মোর্শেদ থামালো। জলি হাসলো-“আরেকটা কথা ভাইসাহেব। বলেছিলাম স্বল্প পরিসরে আয়োজন করতে। আপনি এলাহি কান্ড করেছেন। এমনটা না করলেও পারতেন। আমরা চেয়েছিলাম ক’দিন পরে সবাইকে জানাবো। এতো তাড়াহুড়োর কিছু ছিলো না। যাইহোক যা করেছেন ভালো করেছেন।”
সালিম চতুর হাসি দিলো-“কি বলেন বেয়াইন! একমাত্র মেয়ের বিয়ে আর আমি আয়োজন করবোনা? আপনি কি জানেন না মেয়ের বিয়ে লুকিয়ে দিতে হয় না।”
জলি কথা না বাড়িয়ে মাথা নাড়ে-“আমরা তাহলে বিদায় নেই। ওখানে যেয়ে অনেক আনুষ্ঠানিকতা করতে হবে।”
এ কথা শোনা মাত্র রিমা এগিয়ে এসে জলির হাত ধরলো-“আপা, আমার বড় আদরের মেয়ে শারমিন। একটু জেদি হইলেও মনটা পরিস্কার। আপনি ওকে দেখে রাইখেন আপা।”
জলি স্বান্তনা দিলো-“আপনি ভাববেন না আপা। আমার দুই মেয়ের সাথে ও আরেকটা মেয়ে হয়ে থাকবে। আমরা অন্তত মেয়ে আর বউয়ের মধ্যে তফাৎ করি না।”
সালিম হাত মুঠি করলো। জলির প্রতিটা কথা তার কানে সীসা ঢালছে যেন। এই মহিলা এতো কথা জানে আগে কোনদিন বোঝেনি। এখন বুঝতে পারছে ছেলেটা এতো বুদ্ধি কোত্থেকে পায়।

বিদায় বেলায় শুভ্রা কাঁদলো না খুব একটা। মায়ের হাউমাউ কান্না শুনে কেবল তার চোখের কোল ভিজেছিল। এই পুরো দৃশ্য দূর থেকে দেখেছে তুলতুল। রিমার কান্না দেখে তার খুব নিজের মায়ের কথা মনে পড়ছে। ভালো মতো বিয়ে হলে তার মাও নিশ্চয়ই এভাবে কেঁদে কেটে বিদায় দিতো তাকে? তুলতুলের ভীষণ মনখারাপ হলো। শুভ্রার বিয়েতে তাকে কোথাও দেখা যায়নি। না তার বাড়ির লোকেরা নিমন্ত্রিত ছিলো। সালিম সাহেবের নিষেধ ছিলো তুলতুল যেন কারো সামনে না আসে। শুভ্রার জন্য খারাপ লাগে তুলতুলের। একসাথে থাকতে থাকতে মেয়েটার উপর মায়া পড়ে গেছিল। সাদা মনের মেয়ে, কোন প্যাচ নেই। বাপ ভাইয়ের মতো কুটিল নয় একদমই। মেয়েটা মনেহয় জানেইনা ওর বাপভাই কতটা খারাপ। এই যে তুলতুলকে তুলে এনে বিয়ে করা হয়েছে এটা কি শুভ্রা জানে?

★★★

হাসিখুশি দুই বোন তাদের একমাত্র ভাইয়ের বিয়েতে যায়নি। এটাও রণর ইচ্ছে। বোনদের ওই লোকের সংস্পর্শে নিতে দেবে না কিছুতেই। বলা যায় তাদের মনে কি আছে। বোনদের নিয়ে রিস্ক নেবে না। হাসিখুশির মন খারাপ হয়েছে কিন্তু ভাইয়ের জেদের কারণে হাড় মেনেছে। ওরা বাড়িতে তৈরি হয়ে বসে ছিলো ভাবিকে বরন করে নিতে। গাড়ি এসে থামা মাত্রই দুই বোন আর বাকী কাজিনরা হুড়মুড় করে নিচে নেমে এলো। রণ এমনিতেই বিরক্ত হয়ে ছিলো। পুরোটা রাস্তা সে একটা কথাও বলেনি। চুপ করে বসে ছিলো। মেজাজ দেখানোর উপায় নেই বলে শরীর জুড়ে রক্তকনিকাগুলোর অবাধ্য ছোটাছুটি চলছে। রণ নিশ্চুপ নেমে গেলো গাড়ি থেকে।

এ বাড়ির দোতলাটা নিজের কাজের জন্য ব্যবহার করছে রণ। ও সোজা দোতলায় এলো। গায়ের শেরওয়ানি খুলে নরমাল পোশাক পরে নিলো। আজ এখানে মিহির আর রাজীব দু’জনই আছে। এই মুহূর্তে রণর দু’জনকেই দরকার বলে মিহিরকে ফিরতে দেয়নি এলাকায়। রণকে দেখে মিহির আর রাজীব দু’জনই একে অপরের দিকে তাকিয়ে মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। বুঝতে পারছে রণর মেজাজ ভীষণ খারাপ। মিহির রণর কানে ফিসফিস করলো-“ভাই, নিচে অনেক সাংবাদিক আছে। বিয়ের খবর কভার করতে চায়। কি করবো?”
রণ ভ্রু কুঁচকে ছিলো। খবর শুনে দু’জনকে দেখলো পালা করে-“একটা কাগজে সংক্ষিপ্ত আকারে বিবৃতি লিখে ওদের হাতে দিয়ে দে। আর চা মিষ্টি খাইয়ে বিদায় কর। বিয়ে নিয়ে কোন হইচই যেন না হয় এটা কড়া ভাবে মানা করে দিবি। পরে সবাইকে বলা হবে এটাও জানিয়ে দিস।”
দু’জন মাথা দুলায়। রাজিব বেরিয়ে গেলো।
“দিলশাদ ফোন দিয়েছে? ওদিকে কি খবর?”
মিহিরকে দ্বিধান্বিত দেখায়-“ওরা আজকে জামিনের কোন চেষ্টাই করে নাই। দিলশাদ বললো এবার পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদন মঞ্জুর করেছে।”
রণ হাসলো-“বুঝিসনি কেন চুপ করে বসে আছে? ভেবেছে আমাকে দিয়ে কাজ সারবে। ওদের কি প্ল্যান হতে পারে বলতো? আমার তো মাথা জট পাকিয়ে যাচ্ছে।”
মিহির মাথা চুলকালো। এরকম পরিস্থিতিতে সে কখনো পড়েনি কাজেই কোন আইডিয়া নেই আসলে। সে মিনমিন করলো-“ভাই, কি করবেন জানি না। তবে এইবার পরিস্থিতি পাল্টে যাবে। সোহেলের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। এরইমধ্যে নান্টু গায়েব হয়ে গেছে। সবাই ভাববে আপনি সালিমের দলে ভিরে গেছেন।”
রণ গম্ভীর হয়ে রইলো। কিছুক্ষণ ভেবে বললো-“একটা কাজ করতে পারবি? আচ্ছা থাক। দেখি দিলশাদের সাথে কথা বলি। আর শোন, একটা কাজ দেই তোকে। আমার শশুরের সব বৈধ অবৈধ কাজের তথ্য একত্রে করে আমাকে দিবি। আর ওই যে অভিযোগ বক্সে অভিযোগ জমা হইছিল ওইগুলার বর্তমানে স্ট্যাটাস আমাকে আপডেট দে। আগামী সপ্তাহে আমি এলাকায় যাব। এর একটা আউটপুট দেখাতে চাই এলাকার লোকজনকে। বুঝতে পেরেছিস?”
বলেই মুচকি হাসলো রণ। মিহির অদ্ভুত দৃষ্টিতে রণকে দেখছে। আসলে বুঝতে চাইছে রণ কি করতে চাইছে। মিহির কিছু বলবে তার আগেই রাজিব এসে খবর দিলো, রণকে জলি ডেকে পাঠিয়েছে।

★★★

“বিয়ে করে বউ এনেছ। এতো রাতে দোতলায় কি কাজ রণ? এই শিক্ষা দিয়েছি তোমাকে?”
জলির কথায় রণ ভীষণ বিরক্ত-“মা, তোমাকে আগেই বলেছিলাম বিয়ের পর আমার জীবন নিয়ে মাথা ঘামাবে না তুমি।”
রণর খালা মলি গম্ভীর হলো-“দেখ রণ, যা হয়েছে তা হয়েছে। এসব নিয়ে সিনক্রিয়েট না করাই ভালো। তুই চাসনি বলে যেনতেন ভাবে বিয়েটা হলো। ছেলেমেয়েরা সবাই খুব মন খারাপ করেছে। এখন তোকে মনে রাখতে হবে তুই কোন হেলাফেলার মানুষ না। এমন কোন কাজ করা উচিত হবে না যাতে লোকের হাসির পাত্র হতে হয়।
লোকে এসব জানলে নিউজ হবে। জবরদস্তির বিয়ে কিংবা বউয়ের সাথে তোর ঝামেলা চলছে এসব ঘরের মধ্যে থাকুক। লোকে জানলে তোর ইমেজে ইফেক্ট হবে বাবা।”
রণর মামা ব্যরিস্টার খোকন ভাগ্নের কাঁধে হাত রাখলো-“মায়ের উপর রেগে থাকিস না রণ। মা তোর ভালো চেয়েছে বলেই এমন একটা কাজ করেছে। আর বিয়ে যেহেতু হয়ে গেছে সেহেতু মানিয়ে চলার চেষ্টা কর। তুই আমাদের পরিবারের সন্তানদের কাছে আদর্শ মানুষ। তুই এমন কিছু করিস না যাতে ছোট ভাই বোনদের নজরে ছোট হতে হয়। বাকী তুই বুঝদার বাচ্চা, কি বলবো তোকে?”
রণ চুপচাপ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। সবার এক্সপেকটেশন পূরণ করতে করতে তার নিজের চাওয়া পাওয়া ভুলে গেছে সে। ভালো হওয়াটা কি দোষের? মা কেন তার উপর সব চাপিয়ে দিচ্ছে?
রণ ভীষন মন খারাপ করে ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। ভেতর থেকে হাসাহাসির আওয়াজ আসছে। রণর ভ্রু কুঁচকে গেলো। এই মেয়ের সাথে সবার এতো কিসের হাসাহাসি সে ভেবে পেলো না। এতো অল্প সময়ে সবার সাথে ভাব জমিয়ে ফেলেছে কি করে? ভাবনা আঁটকে রেখে রণ দরজার আওয়াজ দেওয়া মাত্রই সবার হাসি থেমে গেলো। হাসি এসে দরজা খুললো। ওকে দেখে ঢোক গিললো। ভেতরে তাকিয়ে বললো-“ভাইয়া এসেছে। চল আমরা এখন যাই।”
সেকেন্ডের মধ্যে রুম খালি হয়ে গেলো। খালাতো মামাতো বোনেরা কেউ কেউ একবার তাকিয়ে রণকে দেখে মুখ টিপে হাসলো। রণ সেই হাসির কারণ খুঁজে না পেয়ে বিরক্ত হলো। ঘরে ঢুকেই দেখলো শুভ্রা ভদ্র মেয়েটি সেজে লম্বা ঘোমটা টেনে মাথা নিচু করে বসে আছে। তার কি করনীয় সেটা ভেবে পেলো না রণ। এই মেয়ের সাথে কথা বলার মতো কিছু খুঁজে পেলো না। অনেকটা সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো বোকার মতো। তারপর সোফায় যেয়ে বসলো।

শুভ্রা ঘোমটার আড়ালে চুপচাপ বসে থেকে রণর কীর্তি দেখছে। তার চোখেমুখে দুষ্ট হাসির রেখা। সে ইচ্ছে করে একটু কাশলো-“উহুম উহুম।”
রণ চমকে উঠলো। শুভ্রা নাকি কন্ঠে বললো-“নতুন বউকে দেখবেন না মন্ত্রীমশাই?”
রণর কুঞ্চিত ভ্রু যুগল আরও খানিকটা কুঁচকে গেলো। কি করতে চাইছে মেয়েটা? নিশ্চয়ই কোন মতলব আছে। রণ সন্দিহান নজরে তাকিয়ে রইলো। শুভ্রা আবারও কথা বলে উঠলো-“আরেহ! ওভাবে বসে আছেন কেন? নতুন বউয়ের মুখ দেখার রীতি পূরন করে আমাকে মুক্তি দিন। আর কতোক্ষণ বসে থাকবো?”
রণ কড়া গলায় বললো-“কে বসে থাকতে বলেছে আপনাকে? ফাজলামো হচ্ছে আমার সাথে? কোন মুখ দেখাদেখি হবে না। আপনার যা ইচ্ছে হয় করুন।”
শুভ্রা ভারী লেহেঙ্গা নিয়ে অনেক কষ্টে নেমে এসে রণর মুখোমুখি দাঁড়াল। ওর চেহারার উপর এখনো ওড়না ঝুলছে। সে গলায় আহলাদ ঢেলে বললো-
“প্লিজ ঘোমটাটা তুলুন। বাসর রাতে বউয়ের মুখ না দেখলে স্বামীর অমঙ্গল হয়। আমি কি করে আপনার অমঙ্গল চাইবো বলুনতো? শত্রু হলেও আপনিই আমার স্বামী, আমার প্রাননাথ।”
রণ হতভম্ব হয়ে উঠে দাঁড়ায়। এই মেয়েটা তাকে বোকা বানাতে বন্ধ পরিকর বোঝা যাচ্ছে। ওড়নায় উপর দিয়ে শুভ্রার বঁধু সাজে সজ্জিত চাঁদ মুখখানা ঘরের উজ্জ্বল আলোয় চকচক করছে। রণ সেদিকে তাকিয়ে হেসে দেয়-“খুব স্বামীর চিন্তা আপনার, তাই না?”
শুভ্রা মাথা দুলায়। রণ হাসতে হাসতে বললো-“এককাজ করুন। আপনি সোফায় বসে থাকুন আমি একটু ঘুমাব। ঘুম থেকে উঠে না হয় আপনার মুখ দেখবো কিনা সিদ্ধান্ত নেব।”
শুভ্রার চেহারা থেকে হাসি মিলিয়ে গেল। মন খারাপ করে দরজার দিকে এগুলো। রণ জিজ্ঞেস করলো-“কোথায় যাচ্ছেন?”
“আপনার মায়ের কাছে।”
“কেন?”
“তাকে যেয়ে বলি যে তার ছেলে বাসর রাতে বউয়ের মুখ দেখতে চাইছে না।”
রণ রেগে গেলো-“মিস শুভ্রা, যথেষ্ট নাচিয়েছেন আমার মাকে। আগে কিছু বলিনি বলে ভাববেন না এখনও সব মেনে নেব। আমাদের মধ্যকার ব্যাপারে তাকে দূরে রাখবেন এটাই মঙ্গল হবে আপনার জন্য।”
শুভ্রা ঘুরে দাঁড়িয়ে রণর দিকে তাকিয়ে বললো-“প্রথমত আমি এখন মিস না মিসেস। দ্বিতীয়ত, আপনার মা আপনার মতো খারাপ মানুষ না। ভালো মন্দ জ্ঞান আছে তার। তাই তাকে কোন ব্যাপারেই দূরে রাখবো না।”
রণ রাগী দৃষ্টি নিয়ে শুভ্রার দিকে তাকিয়ে রইলো। শান্ত গলায় বললো-“আপনার সমস্যা কি বলবেন? আপনার মতো সুন্দরীকে পাত্তা দেইনা এটা গায়ে জ্বালা ধরায় তাই না?”
শুভ্রা অনড়ভাবে বললো-“এতো কথা শুনতে চাই না। আপনি আমার মুখ দেখবেন নাকি শাশুড়ী মায়ের কাছে যাব?”
রণর মনটা বিদ্রোহ করতে চাইছে। মা এ কিসের মধ্যে ফাঁসালো তাকে? সে ক্লান্ত গলায় বললো-“আপনি দয়া করে নিজ হাতে ঘোমটা তুলুন আমি আপনার মুখ দর্শন করি। প্লিজ আর আর্গু করবেন না। যদি এতেও রাজি না থাকেন তাহলে আপনি মায়ের কাছে যেতে পারেন।”
শুভ্রা কিছু সময় চুপচাপ রইলো। তারপর দু’হাতে ওড়না তুলে মাথায় রাখলো। রণ দিকে তাকিয়ে আছে সে। তার চেহারায় নতুন বউয়ের মতো স্বাভাবিক লজ্জার লেশমাত্র নেই। তীক্ষ্ণ নজরে রণকে বিদ্ধ করতে চাইছে। রণ তাকিয়ে থেকে বললো-“দেখলাম। এবার খুশি? প্লিজ এবার আমাকে ঘুমাতে দিন। কাল একটা জরুরি মিটিং আছে সকালে।”
শুভ্রা মাথা দুলিয়ে মিষ্টি হাসলো-“ঘুমান তবে তার আগে আমার গিফটটা দিন।”
“গিফট!” রণ চেচিয়ে উঠলো। শুভ্রা দুষ্ট হাসি দিলো-“নতুন বউয়ের মুখ দেখে গিফট দিতে হয়।”
“এনাফ! যথেষ্ট ফান করেছেন। এবার দয়া করে থামুন। তাছাড়া আপনার মুখ আমি দেখতে চাইনি আপনি জোর করে দেখিয়েছেন। এখন আবার জোর করে গিফটও দাবী করছেন। আপনি তো দেখছি আজব ধরনের বেহায়া মেয়ে? শুনুন কোন গিফট টিফট দিতে পারবোনা। মানুষ বউ দেখে গিফট তখনই দেয় যখন তার মন প্রশান্ত হয়। আপনাকে দেখে তো আমার মনের শান্তি বিনষ্ট হয়ে গেছে। কিসের গিফট দেব আপনাকে?”
বলতে বলতে রণ বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। শুভ্রা ওকে দেখতে দেখতে দাঁত কিড়মিড় করে বিরবির করলো-“গিফট তো আপনাকে দিতেই হবে মিস্টার রণ। দেখি কিভাবে গিফট না দিয়ে থাকেন আপনি।”

চলবে—
©Farhana_Yesmin