Friday, July 18, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 223



দর্পহরন পর্ব-১৩+১৪+১৫

0

#দর্পহরন
#পর্ব-১৩

নদী থেকে বালু উত্তোলনের কাজ নিয়ে বিশাল একটা ক্যাওয়াজ বেঁধে গেছে। এতোদিন এই কাজ এককভাবে ইব্রাহিম পরিবার দখল করে রেখেছিল। ভেতর ভেতর রুষ্ঠ থাকলেও নিজের জীবনের মায়া করে কেউ মুখ খোলেনি। এবার দলেরই আরেকপক্ষ এসে বাঁধা দিলো। প্রথমে কথা কাটাকাটি তারপর হাতাহাতি। খবর পেয়ে সোহেল ছুটে গেলো। মাথাগরম সোহেলের পিস্তলের গুলিতে একজনার লা/শ পড়ে গেলো। এবং একজন দূর থেকে পুরো ঘটনা অবলোকন রেকর্ড করে নিল। থানায় খবর গেছিল আগেই। যা আগে হয়নি তা হলো ইব্রাহিম পরিবারের কাউকে গ্রেফতার করা। সেটাও হয়ে গেলো থানায় আসা নতুন ওসির কল্যানে।

খবরটা ইব্রাহিম সালিম সাহেবের কানে যেতেই তিনি নড়েচড়ে বসলেন। ইদানীং তিনি বাড়ি থেকে কম বের হন। ক্ষমতা পরিবর্তন হওয়ার পর চারপাশে পুরো পরিস্থিতি অবলোকন করে সেই অনুযায়ী নিজেকে প্রস্ততু করছেন। হুট করে খবরটা পেয়ে তাই থমকে গেছে। মোর্শেদ ছুটে এলো-“সালিম, চল থানায় যাই। সোহেলরে গ্রেপতার করছে, আমাগো সোহেলরে। ওরা জানে না কার পোলা সোহেল? এইরকম ঘটনা তো আমগোর লগে আগে ঘটে নাই। কি হইলো এইসব? বারবার এইরকম হইতে শুরু করলে তো সমস্যা। আমাগো কামকাজ নিয়া ঝামেলায় পড়ুম।”
থম ধরে বসে থাকা সালিম সাহেব মুখ তুললেন-“থানায় নতুন ওসি আইছে। সে আমাদের চিনে না এইজন্যই মনেহয় ভুল কইরা সোহেলরে তুলছে।”
“আচ্ছা, যাইহোক তুই চল।”
“চলেন ভাইজান। আপনি নামেন আমি পাঞ্জাবি পইড়া আসতেছি।”
তুহিন নিঃশব্দে পাশে এসে দাঁড়ায়। সালিম সাহেব পাঞ্জাবি পরে চিন্তিত মুখে নিচে নামে। গাড়িতে বসেও চুপচাপ থাকে। মোর্শেদ ভাইকে ডাকলো-“কি ভাবতেছোস সালিম? বালু উত্তোলনের জায়গা পুলিশ সিল করছে। কাম বন্ধ কইরা দিছে। কি করুম এখন?”
“কথা কই আগে তারপর না পরিস্থিতি বুঝুম।”

ওসি সাহেব মিটিং করছিস। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে বলেছিল সালিম সাহেবকে। তাতেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে সরাসরি ওসির কেবিনে ঢুকে গেলো সালিম। ওসি সাহেব অবাক হয়ে তাকালেন-“কি চাই?”
সালিম থতমত খেল, এই ওসি কি তাকে চেনে নাই নাকি ইচ্ছা করে এমন না চেনার ভাব করতেছে?
সে দরাজ গলায় বলে উঠলো-“আমি ইব্রাহিম সালিম। প্রাক্তন সাংসদ ও স্হানীয় সরকার মন্ত্রী। আমার ছেলেকে নাকি গ্রেফতার করেছেন?”
ওসি বাকীদের ইশারা করতেই তারা রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ওসির জামায় ঝুলে থাকা স্টিকারে নাম দেখে নিলেন সালিম, দিলশাদ। ওসি দিলশাদ চেয়ারে হেলান দিলো-“আপনার ছেলে একজনকে গুলি করে মে/রে ফেলেছে।”
কিছু বলতে যাচ্ছিল সালিম তাকে থামিয়ে দিলো ওসি-“চাক্ষুষ প্রমান আছে কাজেই তাকে ছেড়ে দেওয়া সম্ভব হবে না। হ/ত্যা মামলা হয়েছে। নি/হ/তে/র স্ত্রী মামলা করেছে। এই মামলা কোর্টে উঠবে, কোর্ট ডিসিশন নিবে।”
সালিমের চোয়াল শক্ত হলো। এই ওসিটা বেশ ঘোড়েল বলে মনেহচ্ছে। মোর্শেদ সালিমের হাত ধরে চাপ দিলো। শান্ত থাকার ইশারা করে বললো-“ওসি সাহেব, আপনার বুঝতে ভুল হইছে। সোহেলের এমন কিছু করার কথা না।”
ওসি তখনও ওভাবেই বসে আছে। মুচকি হেঁসে জবাব দিলো-“কোন ভুল হয়নি। রেকর্ড আছে আমাদের কাছে। এই আপনারা আসার কিছুক্ষণ আগেই নি/হ/তে/র স্ত্রী মামলা দায়ের করেছে।”
“কে মা/রা গেছে?”
সালিমের কন্ঠ নরম। দিলশাদ কলম নাড়াচাড়া করছিল। থেমে বললো-“সে আপনি একটু কষ্ট করে খুঁজে নিন।”
সালিম উঠে দাঁড়ায়-“আমার ছেলের সাথে দেখা করবো।”
“সম্ভব হবে না। যেদিন কোর্টে তুলবো দেখা করবেন। আজ না।”
এবার আর সহ্য করতে পারলেন না সালিম, হুঙ্কার দিলেন-“ওই তুই জানোস আমি কে? দুইদিন হইলো আইছোস এই এলাকায় তাই এতো ভাব? ভাব ছুটায়া দিমু।”
দিলশাদের মুচকি হাসি চওড়া হলো-“ওসব আমি জানি। কিন্তু আপনি হয়তো জানেন না আমি এসবে ভয় পাই না। আপনার যা করার করতে পারেন।”
“দেখতেছি তোর এই তেজ কয়দিন থাকে।”
মোর্শেদ ভাইকে থামাতে চায়, দিলশাদের দিকে তাকিয়ে বললো-“ওসি সাহেব, কিছু মনে করিয়েন না। ছেলের চিন্তায় পাগল হয়ে গেছে।”
দিলশাদ জবাব দিলো না। মোর্শেদ ভাইকে টেনে নিয়ে বেড়িয়ে এলেন। মৃদুস্বরে ধমকে বললেন,-“সালিম, কি করতেছোস কি? এইরকম পাগলামির মানে হয়?”
“আপনি দেখছেন ভাইজান, দুইদিনের আসা ওসি কেমনে কথা কইতেছিল? মেজাজ ঠিক থাকবো?”
মোর্শেদ ঠান্ডা গলায় বললো-“সব ঠিক আছে কিন্তু নিজে প্যাচে পইড়া থাকলে মাথাগরম করা যাইবো না। ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে হইবো। এইগুলা কি তোরে বইলা দেওয়া লাগবে?”
সালিম জবাব দিলো না। তার গা কাঁপছে এখনো। কি করবে কি করবে না ভেবে পেলো না। গাড়িতে উঠে তুহিনকে ডাকে-“তুহিন, নাহিদ কই আছে দেখতো। ওর কাছ থিকা সব খবর বাইর কর। কে মা/রা গেছে আমাকে জানা।”
“আচ্ছা।”
তুহিন নেমে গেল মাঝপথে।

সোহেলের খবরে বাড়িতে আরেকবার শোকের ছায়া নেমে এলেও তুলতুল কেন যেন ভীষণ খুশি হলো। ওই লোকটাকে ক’দিন এ বাড়িতে দেখতে পাবে না এই ভেবে শান্তি পাচ্ছে। তাছাড়া ওর সাথে যা করেছে তাতে জেলে যাওয়াটা কম সাজা। ওর জেলেই পঁচে ম/রা উচিত। ভাবতে ভাবতে তুলতুল কেঁদে দিলো। মা, ভাইয়া, চাচা চাচিকে দেখেনা হিমিটাকে কোলে তুলে আদর করে না কতদিন। ওর খুব ইচ্ছে করে মায়ের কোলে যেতে। কতদিন মায়ের আদর পায় না মেয়েটা। এমনকি কথা বলার ব্যাপারেও কত মানা। অনেক কাকুতি মিনতি করে কথা বলতে হয়। আর মাতো ভয়ে ফোনই দেয় না। তুলতুলের নিঃশব্দ কান্নায় ঘরের বাতাস ভারী হয়ে যায়।

★★★

রণ ঠিক করেছে যত ব্যস্ততাই থাক প্রতি সপ্তাহে একদিন এলাকায় থাকবে। যেখানকার মানুষের ভালোবাসা পেয়ে সে আজ মন্ত্রী হয়েছে তাদের সুবিধার দিকে নজর রাখবে। নিজেকে দেওয়া কথা রাখতেই প্রতিসপ্তাহে রণর পিতৃভুমে আগমন। আজও এসেছে। কয়েকজন নেতাকর্মীর সাথে মিটিং করতে করতেই দিলশাদের ফোন এলো-“ভাই, খারাপ একটা খবর আছে।”
“কি হয়েছে দিলশাদ? বলো তাড়াতাড়ি।”
“ভাই একটা মা/র্ডা/র হয়ে গেছে। ইব্রাহিম সালিমের ছেলে সোহেলের হাতে। কি করবো ভাই?”
রণর চোয়াল শক্ত হলো। এরা বাবা ছেলে আবারও শুরু করে দিয়েছে। দৃঢ় স্বরে জানতে চাইলো-“পুরো ঘটনা বলো আমাকে।”
দিলশাদ পুরো ঘটনার বিস্তারিত জানালো। রণ বললো-“সোহেলকে গ্রেফতার করে যা করার করো। নি/হ/তের স্ত্রীকে বলো মামলা করতে। ওর প্রটেকশন দেওয়ার ব্যবস্থা আমি করছি। সোহেলকে কিছুতেই ছাড়বে না। আমি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হয়ে নিজের এলাকার মানুষের নিরাপত্তা না দিতে পারলে তো ব্যর্থ।”
দিলশাদ নরম কন্ঠে বললো-“ভাই, সালিম সাহেব থানায় এসে খুব ঝামেলা করেছে। আমাকে হুমকি দিয়ে গেছে।”
রণ হাসলো-“তুমি কি ভয় পেয়েছ?”
দিলশাদ পাল্টা হাসলো-“একদমই না ভাই।”
“গুড। আপাতত সে নখদন্তহীন বাঘ, তোমার কিছু করতে পারবে না। আমি আছি দেখবো তোমাকে। তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করো।”
“ঠিক আছে ভাই।”
ফোন রাখতেই মিহির তাকালো-“নিচে ওরা এসেছে বিচার চাইতে।”
রণ অবাক হলো-“কারা?”
“যাদের সাথে সালিমের ঝামেলা হইছে। ওদের দাবী সালিমের একছত্র অধিপত্যে কমাতে হবে। গত কয়েকবছর তারা বঞ্চিত ছিল এখন হক চায়।”
রণ চিন্তিত হয়ে গেলো-“সে তো ঠিক আছে কিন্তু এতো তাড়াহুড়ো কেন? এতোদিন পারেনি আর কিছুদিন ধৈর্য্য ধরুক। ধীরে ধীরে সব ঠিক করবো।”
“গত কয়েকদিনে আপনার কমপ্লেন বক্সে একশোর উপরে কমপ্লেন জমা হয়েছে। কারো জমি দখল, কারো বাড়ি দখল, কারো ব্যবসা বন্ধ এরকম অভিযোগ। আমি অভিযোগের সংখ্যা দেখে অবাক ভাই। এরা কি মানুষ না হায়েনা। কত টাকা লাগে এদের?”
রণর চেহারা গম্ভীর-“ওদেরই তো টাকা লাগবে। ছেলেমেয়ে সবার প্রায় থাকে বিদেশে। খোঁজ নিয়ে দেখ বেশিরভাগই দেশ থেকে পাঠানো টাকা দিয়ে ফুর্তি করে। পড়ালেখা, আলিশান ভাবে থাকা খরচ আছে না? এইগুলা করে টাকা কামায়।”
“তাই বলে এতো মানুষের ক্ষতি করে?”
“এই কয়টা দেখেই এমন লাগছে তোর? আরও আসবে দেখিস। অদ্ভুত অদ্ভুত অভিযোগ পাবি।”
চুপ করে কিছু একটা ভাবলো রণ-“চল দেখি ওরা কি বলে শুনি। আর ওই যে কে মা/রা গেছে তার বউ আর ছোট বাচ্চা আছে একটা। ওদের অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা কর। সালিম সাহেব যেন ওদের খবর না পায়।”
মিহির মাথা দুলালো। সালিম সাহেবকে বোঝাতে হবে তার দিন ফুরিয়ে গেছে।

মিটিং শেষ করে মাত্রই ফ্রি হয়ে এককাপ কফি নিয়ে বসেছে রণ খবর এলো সালিম সাহেব স্বয়ং তার বাসার নিচে। দেখা করতে চায়। রণ এবার সত্যিই অবাক। লোকটা তার দ্বারে এতো তাড়াতাড়ি চলে আসবে এটা সে ভাবেনি কখনোই। রণ ধীরে সুস্থে ড্রয়িংরুমে এলো-“আসসালামু আলাইকুম চাচা। হঠাৎ আপনি এলেন?”
সালিম সাহেবকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে তবুও গলায় তেজ নিয়ে বললো-“রণ, কাজটা ভালো করতেছ না। তুমি ভুলে যাইতেছ বাঘ কখনো বিড়াল হয় না। আর বিড়াল কখনো বাঘ।”
রণ নিরীহ মানুষের মতো মুখ করলো-“এসব কি বলছেন চাচা? আমি কি করেছি তাই তো জানলাম না?”
“আমার সোহেলকে পুলিশ গ্রেফতার করছে। আমি জানি এর পেছনে তোমার হাত আছে। তুমি থানার অফিসারকে সাহস দিতেছ।”
রণ দারুণ এক হাসি দিলো-“চাচা, খুব অন্যায় কথা বললেন। কেউ অপরাধ না করলে পুলিশ কেন তাকে গ্রেফতার করবে? আপনার ছেলে খু/নি, তার মতো অপরাধীকে ছাড়া যায়? আমি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, আমার এলাকায় এমন ঘটনা ঘটলে আমার কি করা উচিত আপনি বলেন।”
“আমি এতো কিছু জানি না রণ। তুমি আমার ছেলেকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করো। আমি চাই না আমি স্বরুপে আসি তাহলে এলাকায় র/ক্তে/র বন্যা বয়ে যাবে।”
রণর চেহারা গম্ভীর হলো-“এসব হুমকি ধমকি দিয়ে কাজ হবে না চাচা। এতোদিন যা হয়েছে তা আর হবে না। আমি কোন অন্যায়কারীর পক্ষ নিতে পারবোনা। এমন অনুরোধ আমাকে করবেন না।”
সালিম সাহেব মেজাজ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছেন-“তাহলে তো তুমিও অপরাধী রণ।”
“আমি! আমি কি করেছি?”
সালিম সাহেব হাসলো-“কি করেছ তা তুমি ভালোই জানো। তুমি একজন অপহরণ কারী। আমার মেয়েকে গুম করেছিলে। তুমি কি ভেবেছ আমি কিছু টের পাবো না?”
বলতে বলতে চোয়াল শক্ত হলো ইব্রাহিম সালিমের। রণর চেহারায় চোরা হাসি-“আপনার কাছে কোন প্রমান আছে চাচা?”
জবাব দিলো না সালিম। ধারালো দৃষ্টি হেনে রণকে কুপোকাত করার চেষ্টা করছে। রণ সেই দৃষ্টিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে উঠে দাঁড়ায়-“প্রমান ছাড়া কাউকে অপরাধী বলা ঠিক না চাচা। এটা আপনার চেয়ে ভালো কে জানে। এতোদিন এভাবেই প্রমান ছাড়া অপরাধ করেই তো টিকে আছেন। যাইহোক, আপনি মুরব্বি মানুষ আপনাকে অসম্মান করবো না। আমাকে মাফ করবেন আপনার অন্যায় কাজে সাহায্য করতে পারছি না।”
রণ করজোড়ে ক্ষমা চাইতেই সালিম উঠে দাঁড়ায়, দাঁতে দাঁত চেপে বললো-“এক মাঘে শীত যায় না রণ। একদিন আমার পায়ে আসতে হবে তোমাকে। সালিমকে হারায় এমন কেউ দুনিয়ায় পয়দা হয়নি এখনো। মনে রেখ কথাটা।”

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-১৪

সবাই ড্রয়িংরুমে বসে ছিলো। ছিলো তুলতুল আর শুভ্রাও। সালিম সাহেবকে ঢুকতে দেখে সবাই নড়েচড়ে বসলো। রিমা ছুটে এলো স্বামীর দিকে-“কি হইলো? কি কইলো প্রতিমন্ত্রী? সোহেলরে ছাড়ান দিব?”
সালিম সাহেব জবাব না দিয়ে ক্লান্ত শরীর নিয়ে সোফায় বসলো দপ করে। চোখের উপর হাত রেখে হেলান দিয়ে সোফায় গড়িয়ে গেল। রিমা কি বুঝে চুপ করে গেলো। মোর্শেদ, শরীফ, তাহের দৃষ্টি বিনিময় করলো নিজেদের মধ্যে। গলা খাকরানি দিয়ে মোর্শেদ বললো-“সালিম, চুপ থাকলে কি সমাধান আইবো? কি কইলো ক আমাদের।”
“ভাইজান, কি বললো বলেন না কেন?”
তাহেরের কথায় রেগে গেল সালিম-“কি কইতে পারে বুঝস নাই? সোহেল খু/নি ওরে ছাড়ন যাইব না-এইটা কইলো। মানা কইরা দিলো আমারে। দুইদিনের পোলা এই সালিমরে মানা করলো। চিন্তা করছোস কিছু? ভাবছে আমার ক্ষমতা নাই কোন। হাহাহা।”
শরীফ এগিয়ে এলো-“আব্বা, এতো উত্তেজিত হয়েন না। আপনার শরীর খারাপ করবে।”
“কি কস তুই? আমার পোলা জেলের মধ্যে রইসে আর আমি শান্ত থাকমু? আমি বাপ হয়ে আরামে বসে থাকমু?”
শুভ্রা এগিয়ে এলো-“আব্বা, আপনে শান্ত হন। সোহেল ভাইয়ার কিছু হবে না। আমরা এতোগুলো মানুষ আছি কোন না কোন ব্যবস্থা হবেই আব্বা।”
সালিম জবাব দিলো না। চেচিয়ে তুহিনকে ডাকলো। তুহিন এসে দাঁড়াতেই জানতে চাইলো-“মাইয়াডার খবর বাইর করতে পারছোস?”
তুহিন আড়চোখে তুলতুলকে দেখে নিলো। তুলতুল কাঠের তৈরি পুতুলের মতো বসে আছে।
“খোঁজ পাই নাই। কোথাও নাই, মামলা দিয়া গায়েব হইয়া গেছে।”
সালিম ঘুষি মারলো সোফায়-“ওই রণই ওরে লুকাইয়া রাখছে যাতে আমরা খোঁজ না পাই। তুহিন, আমি কিছু জানি না। তুই ওই মাইয়ারে খুঁইজা বাইর কর। এই কামে কে কে আছে দেখ। একজন একজন কইরা সাইজ করুম।”
তুহিন শুনে মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেলো। শরীফ বললো-“আব্বা, মাথা গরম কইরেন না। এইসময় মা/রা/মা/রি কা/টা/কা/টির চিন্তা বাদ দেন। যুগ বদলায়ে গেছে। এখন মানুষের হাতে হাতে মোবাইল। আপনি কিছু করবেন কেউ না কেউ ছবি তুলে নিবে। এরচেয়ে আমরা বরং এইটা ভাবি সোহেলকে কেমনে ছাড়ানো যায়। আপনে উকিলকে খবর দেন।”
সালিম রক্তলাল চোখে ছেলের দিকে তাকালেন-“আমার চেয়ে বেশি জানোস তুই? উকিল ধইরা কোন বা/লডাও হইবো না যদি প্রমান না মুছি। যারা সাক্ষ্য দিব তাগোর গায়েব করা লাগবো।”
শরীফ রেগে গেলো হঠাৎ-“এইজন্যই ভালো লাগে দেশে। খালি খু /ন/খা/রা/বির আলাপ। ভদ্র কোন আলাপ জানেই না এরা। বারবার বলতেছি এইসব কইরেন না, শুনবে না। যা খুশি করেন আপনি।”
শরীফ রেগে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। তাহের ছুটলো ওর পিছনে। মোর্শেদ শুকনো কন্ঠে বললো-“শরীফ একদম খারাপ কথা কয় নাই রে সালিম। তুই যদি ক্ষমতায় থাকতি তাইলে এক কথা আছিল। এখন নতুন নতুন পোলাপান রাজনীতি করে ওদের ভাবসাব আলাদা। একটু বুইঝা চলতে হইবো। তারপরও দেখ তুই যা ভালো বোঝছ কর আর কি।”
সালিম সাহেবের মেজাজ আরও খারাপ হলো। তার বাড়ির মানুষ তাকে বিশ্বাস করতেছে না। তাহলে বাইরের মানুষ কি বলবে? সেকি তার ছেলের জন্য খারাপ চাইবে? ছেলের ভালোর জন্য সব করবে সে।

তুলতুল চুপচাপ বসে ছিলো শুভ্রার বিছানায়। ওকে দেখে শুভ্রার খুব খারাপ লাগছে। গত দুই মাস ধরে মেয়েটা ওর সাথে ছায়ার মতো লেগে থেকেছে, গল্প করেছে। ওকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর চেষ্টা করেছে। এখন ওর নিজেরই বিপদ। অল্পবয়সী মেয়ে, স্বামীর এরকম ঘটনা শুনে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে হয়তো। কষ্ট তো শুভ্রারও হচ্ছে। সোহেল একটু বদরাগী হলেও তাকে ভীষণ ভালোবাসতো। বোনের ইচ্ছেপূরনে সদা তৎপর থাকতো। এখন এসব শুনে কেমন যেন অবিশ্বাস্য লাগে। শুভ্রা তুলতুলের পাশে বসলো, নরম কন্ঠে জানতে চাইলো-“ভাইয়া চলে আসবে ভাবী। তুমি কিছু চিন্তা করো না। বাবা নিশ্চয়ই কোন ব্যবস্থা করবে।”
তুলতুল মাথা নাড়ে-“আমি চিন্তা করছি না তো।”
শুভ্রা অবাক হলো-“তাহলে? মন খারাপ করছো কেন?”
“এমনিতেই। আপনাদের মন খারাপ দেখে আমারও মন খারাপ হচ্ছে।”
শুভ্রা হেসে দিলো-“তুমি ভাইয়াকে পছন্দ করো না তাই না? তোমাদের কখনো সেভাবে কথা বলতে দেখিনি।”
তুলতুল জবাব দিলো না। শুভ্রা তুলতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ও বোঝার চেষ্টা করছে তুলতুলের মনে কি চলছে।

★★★

সোহেল হাজতে থেকে ভীষণ হইচই করছিল। এর আগে তাকে কখনোই হাজতে বন্দী থাকতে হয়নি। এবার হুট করে যখন হাতে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে এলো সোহেল বোকা বনে গেলো। ভেবে পাচ্ছিল না কি বলবে কি করবে। তবুও আশায় ছিলো বাবা হয়তো তাকে কোনভাবে ছাড়িয়ে নেবে। কিন্তু রাত হয়ে যাওয়ার পরেও কেউ এলোনা দেখে সে হম্বিতম্বি শুরু করে দিলো। থানার এসআই এলে তাকে গালিগালাজ করলো, দেখে নেওয়ার হুমকি দিলো। ফলাফল হিসেবে তাকে জেলের মধ্যে উত্তম মধ্যম দেওয়া হলো।

একদিন পরে তাকে কোর্টে তোলা হলো। বাবাকে দেখে সোহেল চিৎকার করে-“আব্বা, আমাকে এইখান থিকা বাইর করেন।”
সালিম ছেলেকে আস্বস্ত করলো-“তুই চিন্তা করিস না। আমি ব্যবস্থা করতেছি।”
কিন্তু সালিম সাহেবকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সোহেলের জামিনের আবেদন নাকচ করে তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হলে তার মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থা হয়ে গেলো। কারো কাছ থেকে সহযোগিতা না পেয়ে সালিম সাহেব কিছুই করতে পারলেন না। তুহিন দু’জনকে ধরে এনেছিল বটে, তাদেরকে প্রচুর মারাও হলো কিন্তু তারা কিছুই বলতে পারলোনা। অক্ষম আক্রোশে নিজের মাথার চুল নিজে ছিড়ে ফেলার অবস্থা সালিমের। অতি উত্তেজনায় প্রেসার বাড়িয়ে বমি করে ঘর ভাসিয়ে ফেললে তাকে ঘুমের ওষুধ দেওয়া হলো।

পরদিন ঘুম ভাঙার পরেও নিশ্চুপ শুয়ে থাকে সালিম সাহেব। ছেলের জন্য তার বুকের ভিতর ভাঙচুর হয়। সেই দুঃখে তার চোখ থেকে অবিরাম জল বর্ষন হয়। এতোটা অসহায় এর আগে নিজেকে মনে হয়নি তার। কোনদিন দিয়েই কোন সাহায্য পাচ্ছেন না। কেউ সাহায্য করতে চাইছে না। রাতারাতি পরিস্থিতি এতোটা বদলে যাবে ভাবেননি একদমই।

শুভ্রা বাবার কাছে বসবে বলে এসেছিল। কিন্তু বাবা কাঁদছে এটা টের পেয়ে পর্দার ওপাশে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল পাঁচ মিনিট। বাবার অসহায় অবস্থা দেখে তারও কান্না পাচ্ছে। তার জীবনে কোনদিন বাবাকে এরকম অসহায় দেখেনি সে। পরক্ষণেই চোখ মুছে নেয় শুভ্রা। বাবাকে এরকম ভেঙে পড়তে দেবে না সে কিছুতেই। সাহস দেবে বাবাকে, কিছু একটা করবেই বাবা আর ভাইয়ের জন্য, করতেই হবে।
“বাবা, ঘুম ভেঙেছে?”
সালিম সাহেব নিজের চোখের জল মুছে নিলে হাসার চেষ্টা করলো-“আম্মা, আসেন আমার কাছে আসেন।”
সালিম সাহেব মেয়েকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকেন। শুভ্রা বাবার মাথার কাছে বসলো। বাবার চুলগুলো হাল্কা টেনে দেয়-“মন কি বেশি খারাপ আব্বা?”
সালিম সাহেব চোখ বুঁজে রইলো, জবাব দিলো না। শুভ্রা ডাকলো-“আব্বা, একটা কাজ করতে তোমার অনুমতি চাই।”
এবার চোখ মেলে তাকিয়ে মেয়েকে দেখলেন। শুভ্রা উশখুশ করে চোখ লুকায়। সালিম সাহেব সন্দেহ নিয়ে বললো-“আম্মা, কি করতে চাইতেছেন বলেন তো?”
“আমাদের সব সমস্যার সমাধান চাইতেছি। যে আমাদের জন্য এতো এতো সমস্যা তৈরি করতেছে তাকে শায়েস্তা করতে চাইতেছি। তুমি শুধু আমাকে একজনার সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করে দাও।”
শুভ্রা সংকোচের সাথে মিনমিন করলো। সালিম সাহেব জানতে চাইলো-“কার সাথে দেখা করবেন আম্মা?”
শুভ্রা ফিসফিস করে একটা নাম বললে সালিম সাহেব চোখ বড় বড় করে তাকায়, তার চোখে অবিশ্বাস-“তার সাথে দেখা কইরা কি করবেন?”
শুভ্রা হাসলো-“প্রানভোমরার জীবন চাবি তারই কাছে আব্বা। তাকে হাত করতে পারলেই আমাদের কাজ হবে।”

★★★

সোহেলের ঘটনা ম্যানেজ করতে রণকে দুটো দিন বেশি থাকতে হলো এলাকায়। সোহেলের রিমান্ড মঞ্জুর হওয়ায় খানিকটা সস্তি আসলেও সে জানে সালিম সাহেব চুপ করে থাকার মানুষ না। কিছু না কিছু সে করবেই। আর কি করবে সেটা জানে না বলেই চিন্তা হচ্ছে। সে চায় না তার কারণে কোন নিরীহ মানুষ ভুগুক। এইজন্য সারাক্ষণ ভাবনার মাঝে ডুবে থাকতে হচ্ছে তাকে।

প্রধানমন্ত্রীর সাথে জরুরি মিটিং শেষ করে ফোন হাতে নিতে দিলশাদের ফোন-“ভাই, সোহেল তো কোন কথাই বলে না। চুপ করে থাকে।”
“যেভাবেই হোক ওর কাছ থেকে সীকারোক্তি নিতে হবে দিলশাদ। না হলে সব চেষ্টা ভন্ডুল হয়ে যাবে। কি করবে এখন দেখো।”
“ও কঠিন ছেলে ভাই। মারধোর করে লাভ হবে বলে মনেহয় না।”
“তাহলে অন্য কোন পন্থা অবলম্বন করো। যেটাতে কাজ হবে সেটা।”
চাপা স্বরে আদেশ করলো রণ। দিলশাদ দ্বিধা নিয়ে বললো-“আচ্ছা দেখি। জানাব আপনাকে।”

বাসায় ফিরে সব সুনসান দেখে অবাক হলো রণ। সাধারণত সে বাসায় আসবে জানলে মা আর বোনেরা তার অপেক্ষায় থাকে। আজ মাকে না দেখতে পেয়ে বিস্মিত হলো। হাসিখুশি গম্ভীর মুখে বসে আছে তাদের কামরায়। রণ ওদের মাথায় গাট্টা মারে-“কি খবর হাসিখুশি? আজ তোদের মুখে ঘোর আমাবস্যা কেন? আর মায়ের কি হয়েছে? তাকে দেখছি না যে?”
“মা তার রুমে আছে ভাইয়া। জানি না কি হয়েছে, সন্ধ্যা থেকে দরজা দিয়ে শুয়ে আছে। দুপুরে খাবার খায়নি।”
খুশি জবাব দিলো। রণ চিন্তিত হলো কিন্তু বোনদের বুঝতে দিলো না-“আচ্ছা, তোরা ভাবিস না আমি দেখছি মায়ের কি হয়েছে।”

মায়ের রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডাকলো রণ-“মা, আসবো?”
“তুই ফ্রেশ হয়ে টেবিলে আয় রণ। আমি আসছি।”
জলি ঘরের ভেতর থেকে জবাব দিলো। সে এসেছে আর মা দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছে মানেই বিরাট ঘাপলা। ভ্রু কুঁচকে গেল রণর। মায়ের গলা অনেক ভারী লাগছে। মা কি কোন কারণে কান্না করছে? রণর চিন্তা বাড়ে। সে তড়িঘড়ি করে শাওয়ার নিয়ে টেবিলে আসতেই মাকে দেখলো। মুখটা ভীষণ গম্ভীর। রণর বুক কাঁপতে লাগলো। কিছু কি হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে নাকি সে কোন ভুল করেছে? কোনভাবে মাকে কষ্ট দিয়েছে? এতে গম্ভীর এর আগে মাকে দেখেনি সে। জলি চুপচাপ ভাত বেড়ে দিলো রণর প্লেটে। রণর খেতে ইচ্ছে না করলেও ভাত মাখিয়ে মুখে তুললো। মায়ের মুখ দেখার চেষ্টা করছে কিন্তু জলি সরাসরি তাকাচ্ছে না। রণ হঠাৎ নরম স্বরে মাকে ডাকলো-“মা, কি হয়েছে বলবে? তোমার এমন মুখ দেখে আমার গলা দিয়ে খাবার নামছে না।”
রণর ডাকে জলি যে দৃষ্টি মেলে রণকে দেখলো তাতে রণ একটা ধাক্কা মতো খেল। মায়ের দৃষ্টিতে অবিশ্বাস নাকি ঘৃনা বুঝে পেলো না। তবে এটুকু পরিস্কার বুঝতে পারছে সেই দৃষ্টিতে তার জন্য ভালোবাসাটা আর নেই।

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-১৫

“মা, আমি কি করেছি? এভাবে দেখছো কেন আমাকে?”
রণর অসহায় কন্ঠ শোনা গেলো। জলি ছেলের মুখের উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিলো তীব্র বিতৃষ্ণায়-“তোমাকে এই শিক্ষা দিয়েছি রণ? আজ তোমার বাবা থাকলে ভীষণ লজ্জা পেতেন যেমন আমি পাচ্ছি। তোমাকে নিয়ে গর্ব ছিলো আমার, সেই গর্ব চূর্ন করে দিলে। মাথা উঁচু করে ছেলেকে নিয়ে গর্ব করার অধিকার কেঁড়ে নিলে আমার কাছ থেকে।”
রণ খাবার প্লেট দূরে ঠেলে হাত ধুয়ে এলো। জলির সামনে দাঁড়িয়ে বললো-“এবার বলে কি বলছিলে? আমি কি এমন করেছি যে এতবড় কথা বলে ফেললে?”
“এখনো বুঝতে পারছো না কি করেছ?”
জলির কথায় এবার ভীষণ বিরক্ত রণ-“মা প্লিজ, এতো ভনিতা না করে বলো না কি করেছি? আমি সত্যি বুঝতে পারছি না।”
জলি তীব্র চোখে ছেলের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন-“এ কথা কি সত্য যে তুমি নির্বাচনে জেতার জন্য ইব্রাহিম সালিমের মেয়েকে অপহরণ করেছিলে? মেয়েটাকে দুই মাস আঁটকে রেখেছিলে কোথাও?”
রণর মাথাটা ঘুরে উঠলো তীব্র বেগে। শ্বাস আঁটকে এলো। মা এসব কিভাবে জানলো! কে জানালো মাকে? কেউ কি এসেছিল? রণর মাথাটা হুট করে শুন্য মনে হলো। সে চেয়ারে বসে পড়লো ধপ করে।
“কি কথা নেই কেন মুখে? আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না তুমি এই কাজ করেছ। সত্যি তুমি এমন করেছ রণ? শুধু নির্বাচন করার জন্য একটা মেয়ের সম্ভ্রম নিয়ে খেলেছ এ কথাও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে? তুমি কি আমার সেই ছেলে রণ?”
রণ ফাঁকা দৃষ্টি নিয়ে মায়ের দিকে তাকালো। কিছু বলবে সেই সাহসই করতে পারছেনা। জলি ধমকে উঠলো-“কথা বলছো না কেন? আমি সত্যি জানতে চাই। সত্যটা বলো আমাকে রণ।”
রণর পুরো শরীর কেঁপে উঠলো। জলি হাত বাড়িয়ে দিলো-“আমাকে ছুঁয়ে বলো রণ। মাকে ছুঁয়ে বল সত্যি তুই এমন কিছু করেছিস।”
রণ জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটলো। তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। গ্লাস থেকে পানি শেষ করলো। জলি একদৃষ্টিতে তাকে দেখছে। রণ শান্ত গলায় ডাকলো-“মা, এখানে বসো আমার সামনে।”
জলি তবুও ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। তার গা জ্বলছে। ছেলের এই অধপতন মেনে নিতে পারছে না কিছুতেই। রণ অনুরোধ করলো-“মা প্লিজ বসো। না বসলে তোমাকে সব গুছিয়ে বলতে পারবোনা।”
জলি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বসলো চেয়ারে। রণ বারবার ঢোক গিললো। লম্বা শ্বাস নিয়ে বললো-“এসব কে বলেছে তোমাকে?”
“কে বলেছে সেটা কি জরুরি? তুমি আমাকে সত্যিটা বলো।”
“তুমি যা শুনেছে সেটা সত্যি মা। তবে আমি মেয়েটাকে কোন ধরনের অসম্মান করিনি। শুধু আঁটকে রেখেছিলাম।”
“মিথ্যে, মিথ্যে, মিথ্যে। তুমি তোমার মায়ের সাথে মিথ্যে বলছো। তুমি কি ভেবেছ আমি কখনো জানবোনা তোমার কাজ? তুমি মেয়েটাকে আঁটকে রেখে নানা ধরনের মানসিক অত্যাচার করনি? ওকে অন্ধকার ঘরে আঁটকে রেখে খাবার খেতে দাওনি। বলো সত্যি কিনা?”
রণ নিশ্চুপ হয়ে মাথা নিচু করলো। জলির মুখ ছিটকে বেরিয়ে এলো-“ছিহ! ছিহ! তুমি আমার ছেলে? তোমাকে পেটে ধরেছি আমি? নিজেকেই এখন ঘেন্না ধরছে। যাদেরকে আমি অপরাধী ভাবতাম, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাদের মাফ করবোনা ভাবতাম, তুমি আমার সন্তান হয়ে নিজেকে তাদের পর্যায়ে নিয়ে গেলে? কেন? একটা পদ পাওয়ার জন্য!”
মায়ের ছিহ শব্দ রণর বুকে তোলপাড় তুলে দিয়েছে। প্রতিটা বাক্য ওর বুক থেকে রক্ত শোষণ করে নিচ্ছে। মাথা তুলে মায়ের চোখে চোখ রাখার সাহস আজ হারিয়ে ফেললো বুঝি। জলি একটু থেমে আবারও মুখ খুললো-“তুমি ভাবো তোমার বোনদের সাথে কেউ এমন করছে। তাদের কি মাফ করতে পারবে?”
রণ আঁতকে উঠে মুখ তুললো-“মা প্লিজ!”
জলি ফুঁসে উঠলো-“আমাকে মা বলে ডেকোনা তুমি। তোমার মত ছেলের মা হতে চাই না আমি। যে ছেলেকে মেয়েদের সন্মান করা শেখাতে পারিনি আমি তার মা না।”
“মা আমি যদি ইব্রাহিম সালিমের মেয়েকে অপহরণ না করতাম তাহলে আজকে আমি হয়তো কবরে থাকতাম। তোমাকে কি নতুন করে বলতে হবে উনি কি? কতটা নৃশংস?”
রণ নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করলো। জলি মাথা নাড়ে-“আমি চাইনি তুমি রাজনীতিতে আসো। কারণটা এখন বুঝতে পারছো? শুরুতেই তুমি নিজেকে নোংরামিতে জড়িয়ে ফেললে বাকী পথ কি হবে। কেন তুমি রাজনীতিতে এলে রণ?”
জলির কন্ঠে হাহাকার ফুটে উঠলো। রণ দৃঢ় স্বরে বললো-“যা বাবা করতে পারেনি তা করতে। তুমি চেয়েছ আমি শিক্ষাদিক্ষা নেই, নিয়েছি। বাবা চেয়েছে দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে, তার ইচ্ছে পূরণ করাও আমার কর্তব্য।”
জলি পুনরায় রেগে গেল-“তা বলে অন্যায় পথে? তাহলে ইব্রাহিম সালিম আর তোমার মধ্যে পার্থ্যক্য কোথায়?”
“পার্থক্য কোথায়? ওদের সাথে তুমি আমাকে তুলনা করছো?”
জলি হাসলো-“করা উচিত না? ওরাও মেয়ে তোলে তুমিও তোল৷ তো তোমরা দু’জনই এক। যে মেয়েটা দেশেই থাকে না, বাবার কাজের কিছুই জানে না সেই মেয়েটাকে আঁটকে রেখে তুমি কি প্রমান করেছ আমি জানি না। আমি শুধু জানি তুমি একজন নির্দোষকে সাজা দিয়েছ। আর ওই মেয়েটার এই ঘটনা লোকে জানলে কে বিয়ে করবে ওকে? আমার দু’টো মেয়ে আছে কাজেই আমি খুব ভালো বুঝতে পারছি এরকম ঘটনায় মা বাবার কেমন লাগে।”
“কেউ জানবে না মা। কেউ জানেনি। তুমি বেশি বেশি ভাবছো।”
রণ দূর্বল গলায় বলে। জলি অবাক হয়ে ছেলেকে দেখলো-“তোমাকে দেখছি আর অবাক হচ্ছি রণ। এতটুকু অনুশোচনা নেই তোমার মধ্যে। শেম অন মি, আমি ব্যর্থ মা।”
“মা! কেন ছোট বিষয়কে বাড়িয়ে বড় করছো?”
রণর কন্ঠে আঁকুতি।
“এটা ছোট বিষয়ে লাগছে তোমার কাছে?”
জলি ভীষণ জোরে চেচিয়ে উঠলো। হাসিখুশি হাসিখুশি ভয় পেয়ে ছুটে এলো-“কি হয়েছে? তোমরা চেচাচ্ছ কেন?”
জলি রাগমিশ্রিত নজরে মেয়েদের ধমক দিলো-“নিজেদের কাজে যা।”
দু’জনেই ভয়ে পালিয়ে এলো। রণ মাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করলো-“মা প্লিজ ঠান্ডা হও।”
জলি ছিটকে সরে গেলো-“কাল ইব্রাহিম সালিমের বাড়ি যাব আমরা।”
রণর এবার অবাক হওয়ার পালা-“কেন?”
“কথা পাকা করতে। ওর মেয়েকে বিয়ে করবে তুমি।”
রণ আর্তনাদ করে উঠলো-“মা! এসব কি ধরনের পাগলামি?”
জলি অনড়ভাবে বললো-“আমি একজন শিক্ষিকা। তোমার অন্যায় জেনেও যদি প্রতিকার না করি তাহলে বেঁচে থাকা কষ্টকর হবে আমার জন্য। যা নিজের মেয়ের বেলায় সহ্য হবে না তা অন্যের বেলায় হতে দেই কি করে?”
“আমি বারবার বলছি মা, ওর ঘটনা কেউ জানেনা জানবে না। ওই মেয়ের বিয়ে দিতে কোন সমস্যা হবে না। ওর বাপের টাকা কম নেই ছেলের অভাব হবে না।”
রণর কন্ঠে অসন্তোষ। জলি পাত্তা দিলো না-“আর বিয়ের পর পাত্র জেনে গেলে? মেয়ে দুই মাস গায়েব ছিল এটা জানার পর কোন পুরুষ মেনে নেবে? তখন কিছু হলে সে দায় কে নেবে?”
“তোমার এই অন্যায় আবদার আমি মানতে পারছি না মা। ওদের সাথে আত্মীয়তা কখনো সম্ভব হবে না। ওরা বাবার সাথে কি করেছে তা কি তুমি জানো না?”
“এতো কিছু জানি না আমি। যা বলেছি তুমি তা করবে।”
রণ হতবাক হয়ে মাকে দেখছে। যেন চিনতে পারছে না এই মাকে-“আমি পারবো না মা, কিছুতেই পারবোনা।”
জলি অটল গলায় বললো-“পারতে হবে। তোমার বাবাকে আজও খুঁজে পেলাম না। আমি চাই না তুমিও তার মতো নিরুদ্দেশ হয়ে যাও। তুমি যা করেছ এরপর তোমাকে এভাবে ছেড়ে রাখতে ভরসা নেই আমার। আমি জানি সালিম সুযোগ পেলেই তোমার ক্ষতি করবে। তাছাড়া কোন বাপ মেয়ের এরকম অসম্মান মেনে নেবে?”
রণ কি বলবে ভেবে পেল না। কোন মাকে দেখছে সে? এরকম ভীতু তার মা কবে ছিল?
“তুমি কাল আমার সাথে যাবে। যত খারাপই হোক নিজের মেয়ে জামাইকে নিশ্চয়ই মে/রে ফেলবে না?”
রণ মাথা নাড়লো-“আমি কাল কোথাও যাব না। তোমার এসব পাগলামির সাথে আমি নেই। আমি কিছুতেই ইব্রাহিম সালিমের কাছে ছোট হবো না।”
“যেতে হবে তোমাকে। আমি কথা দিয়েছি ওদের। আমি স্বামী হারিয়েছি সন্তান হারানোর শক্তি নেই আমার।”
“তাই বলে অন্যায়কারীর সাথে এতবড় কম্প্রোমাইজ করবে?”
রণ সবকিছু এলোমেলো লাগছে। জলি ছলছল চোখে তাকালো-“সন্তানের জীবনের জন্য এর চাইতে বড় কম্প্রোমাইজ করা যায়। এটাতো কিছুই না।”
“সরি মা, আমি মানতে পারছি না তোমার সিদ্ধান্ত। আমাকে মাফ করো।”
রণ নিজের ঘরে চলে এলো। জলি ওর দিকে তাকিয়ে রইলো একপলকে। বিরবির করে বললো-“তোমাকে মানতে হবে। আমি ব্যবস্থা করবো।”

চলবে—
©Farhana_Yesmin

দর্পহরন পর্ব-১০+১১+১২

0

#দর্পহরন
#পর্ব-১০

“কেমন আছো সালিম?”
“ভালো আপা। আপনার শরীর কেমন?”
নেত্রী মৃদু হেসে মাঝের চেয়ারে বসলেন। ও পাশের চেয়ারে রণ বসে আছে মুখে স্মিথ হাসি নিয়ে।
“আমার ভালো থাকাটা সম্পূর্ণ তোমাদের উপর নির্ভর করে। বয়স হয়েছে, যে কয়দিন বেচে আছি দেশের মানুষের জন্য কিছু করে যেতে চাই। আর সবচেয়ে বড় যে ইচ্ছা তা হলো সন্মান নিয়ে পৃথিবী ছাড়তে চাই।”
সালিম সাহেব চুপ করে গেলেন। এসব কথার বিপরীতে কথা চলে না আর। নেত্রী ডাকলেন-“সালিম রণর সাথে তোমার আলাপ হয়েছে তো? আজ তোমাদের দু’জনের সাথে খোলাখোলি আলাপ করবো বলেই ডেকেছি। তোমাদের দু’জনার যদি দু’জনার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকে তাও শুনবো।”
রণ কথা বলে উঠলো-“ফুফু, আমার কোন অভিযোগ নেই। চাচা যথেষ্ট হেল্পফুল।”
নেত্রী সালিম সাহেবকে দেখলেন-“তোমার কথা বলো সালিম। ওকে নিয়ে কোন সমস্যা আছে?”
সালিম সাহেব চুপ করে থাকলেন। নেত্রী কি বুঝে বলে উঠলেন-“সালিম, দেখো তুমি হয়তো ভাবতে পারো তোমার জায়গায় ওকে কেন নমিনেশন দিলাম। তুমি দলের অনেক পুরনো সদস্য সেই বাবার সময়কার। আর তোমাকে খুব বিশ্বাস করি। তুমি এই দলের জন্য অনেক করেছ। তোমার ত্যাগ অনস্বীকার্য তবে এটাও অস্বীকার করা যাবে না সালিম, তোমার খুব বদনাম হয়েছে। আর এই বদনামের দূর্গন্ধ আমাদের দলের মধ্যে চলে এসেছে। যা আমাদের জন্য ভাবনার বিষয়। তোমাকে ছাড়া চলার কথা আমি ভাবতেও পারি না কিন্তু তোমার বদনামও আমার সহ্য হচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে এই ব্যবস্থা আমাকে নিতে হয়েছে। রণ তোমার জায়গায় দাঁড়াবে আর তুমি কিছুদিন পরে হওয়া মেয়র নির্বাচনে। আমার মনেহয় এবার তোমার মেয়র পদে ইলেকশন করাটা ভালো হবে।”
সালিম সাহেব আকাশ থেকে মাটিতে পড়েন-“আপা আমি!”
নেত্রী হাসলেন-“দুইবছর পর মেয়র নির্বাচন হবে। ততদিনে রণ এলাকায় আমাদের দলের ভালো রেপুটেশন তৈরি করে ফেলবে। লোকে তোমার কাজ ভুলে যাবে। আশাকরি নির্বাচনে জিততে তোমার কোন সমস্যা হবে না। তুমি আর রণ মিলে একসাথে কাজ করলে আমিও চিন্তা মুক্ত থাকি। বুঝতে পারছো তো?”
সালিম কি বলবে ভেবে পেলো না। নেত্রী পুনরায় বললেন-“শোন সালিম, সামনে প্রচুর বিনিয়োগ আসবে তোমার এলাকায়। জাপানিজরা ওখানে ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করতে চায়। রাস্তাঘাটের নকশা পরিবর্তন হবে। ঢাকা থেকে সরাসরি যাওয়ার জন্য ফ্লাইওভার হবে। নদী বন্দরটা নতুন করে ব্যবহারের উপযোগী করা হবে। বুঝতে পারছো কত বড় ধরনের সুযোগ আসছে সামনে? আর এসব কাজের শর্ত হলো কোন ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকা চলবে না এলাকায়। শান্তি বজায় থাকতে হবে। আর শান্তি বজার রাখতে নিজেদের মধ্যে একতা থাকা খুব জরুরি। ক্ষমতায় টিকে থাকা জরুরি। বুঝতে পেরেছ?”
সালিম মাথা দুলালেন। রণ অবশ্য কোন কথা বলছে না চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছে।
“রণ আর তুমি মিলেমিশে কাজ করবে। ছেলেটা নতুন এসেছে অনেক কিছু বুঝবে না তুমি ওকে সব বুঝিয়ে দেবে। আর রণ, যে কোন বড় কাজে তুমি তোমার সালিম চাচার মতামত নেবে তাকে সন্মান করবে। ঠিক আছে?”
“ঠিক আছে ফুপু।”
“সালিম তোমার কিছু বলার আছে?”
“না আপা, আপনি যেমন বলবেন তেমনই হবে সব।”
নেত্রী সন্তুষ্ট চিত্তে জবাব দিলেন-“নির্বাচনের আগমুহূর্তে তোমাদের ডাকার কারন এটাই যে নির্বাচনের পর যেন কোন ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটে। আমি ওই এলাকাকে সবচেয়ে শান্তিপূর্ন এলাকা হিসেবে দেখতে চাই। তোমরা দু’জন বিবেচক তাই ভরসা করছি তোমাদের উপর। জানি আমার আশা পূরণ করবে তোমরা।”
রণ উঠে এসে মাথা নিচু করে সালাম করলো ফুপুকে-“দোয়া করবেন ফুপু আপনার ভরসার মান যেন রাখতে পারি।”
নেত্রী রণর মাথায় হাত রাখলেন। পুরো দৃশ্য সালিম সাহেবের হৃদয়ে জ্বালা ধরাল। উনি উসখুস করে উঠলেন। রণ দাঁড়িয়ে বললো-“আমি তাহলে যাই ফুপু। শেষ মুহূর্তের প্রচারনাটা শেষ করি।”
নেত্রী মাথা নাড়লেন। রণ দু’জনকে সালাম দিয়ে বেরিয়ে যায়। ওর ঠোঁটের কোনের চোরা হাসি সালিম সাহেবের নজর এড়ায় না। নেত্রী আরও কিছুক্ষণ আলাপ করেছিলেন সালিম সাহেবের সাথে কিছু কোন কথাই মাথায় ঢুকছিল না তার। কোন আলাপে মন ছিল না।

এরপরও আজ পর্যন্ত কয়েকবার দেখা হয়েছে রণর সাথে। রণ প্রতিবার বেশ নমনীয় হয়ে কথা বলেছে তার সাথে। তবুও কোথায় সুক্ষ জ্বলুনি টের পেয়েছে৷ এই নির্বাচনী এলাকা দীর্ঘ দিন ধরে তাদের পরিবারের ছিল। হুট করে সেটা নতুন একজন হস্তগত করবে এটা মেনে নেওয়া তার জন্য ভীষণ কষ্টকর। তার ও তার পরিবারের জন্য সন্মান হানিকর। সামনে এতো এতো কাজ হবে সবটাই ওই পুঁচকে ছেলেটা নিয়ন্ত্রণ করবে এটা ভাবতেই মাথাটা ভীষণ গরম হয়ে যাচ্ছে। সে জানে নেত্রী তাকে শান্ত রাখতে, হাতে রাখতে মেয়র নির্বাচনের মুলো ঝুলিয়েছে। আর জানে বলেই মেজাজ আরও বেশি বিগড়ে যাচ্ছে। এই বয়সে এসে এরকম হাড় মেনে নেওয়া যায় না। অপমানবোধটা বড্ড খোঁচাচ্ছে তাকে। কিন্তু তার হাত পা বাঁধা। কিছু করতে পারছেন না কেবল নিজের মাথার চুল নিজে ছিঁড়ছেন। তা না হলে ওই রণকে রাস্তা দেখিয়ে দিতেন ঠিক যেমনটা ওর বাপকে দেখিয়েছিলেন বারো বছর আগে।

নিজের কামড়ায় বসে ভাবনায় ডুবে থাকা সালিম সাহেব হঠাৎ চোখ খুললেন। বাইরের ঘর থেকে হইচই এর আওয়াজ আসছে। বেশ একটা হুলুস্থুল পড়ে গেছে মনেহচ্ছে। সালিম সাহেব বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন।

★★★

দীর্ঘ দুই মাস অপহৃত থাকার পর শুভ্রা বাড়ি ফিরে এলো। মাকে দেখে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো-“মা, শরীর কুটকুট করছে। গোসল করবো। আমার বাথরুমের গিজারটা ঠিক আছে তো?”
শুভ্রার মা রিমা মেয়েকে দেখে হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শুভ্রার কথা শুনে বিহ্বলতা বাড়লো। আর্তনাদ বেড়িয়ে এলো মুখ থেকে। সে ছুটে মেয়ের কাছে যেতে গিয়ে আচমকা পিছলে পড়ে মাথা ফা/টি/য়ে ফেললো। ডাইনিংএ সকালের প্রাতরাশ করতে বসা বাড়ির বাকি সকলে রিমার আর্তনাদ শুনে টেবিল ছেড়ে উঠে এসে শুভ্রাকে দেখে হতবাক। হতবাক অবস্থা কাটর আগেই রিমাকে দেখে আঁতকে ওঠে সোহেল আর শরীফ। তুলতুল শাশুড়ীকে জাপ্টে ধরে চিৎকার দিল। সোহেল আর শরীফ বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে।

সালিম সাহেব বাইরে বেড়িয়ে শুভ্রাকে দেখে চমকে উঠলেন। শুভ্রা কখন এলো? পুরো পরিস্থিতি বুঝতে তিরিশ সেকেন্ড লাগলো তার। তিনি অবাক হয়ে একবার বউ আরেকবার মেয়েকে দেখলেন। শুভ্রা তার দিকে তাকালো-“বাবা, তুমি ভালো আছো?”
মানুষটা জবাব দিলো না। শুভ্রা বললো-“আমি শাওয়ার নিয়ে আসছি। পেট চোচো করছে, খেতে হবে আমার।”
রিমাকে ফিরেও দেখলো না শুভ্রা। বাবার জবাবের অপেক্ষা করলোনা। খুব স্বাভাবিক ভাবে হেঁটে নিজের রুমে গেলো। পুরোটা সময় ইব্রাহিম সালিম মেয়েকে দেখলেন তাকিয়ে তাকিয়ে। তার ভ্রু কুঁচকে আছে। তিনি মেয়ের ঘরের দিকে একবার তাকিয়ে এগিয়ে এলেন রিমার কাছে। রিমাকে ধরাধরি করে নিচে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তুলতুল আছে সাথে। শরীফ আর সোহেলকে হতভম্ব দেখাচ্ছে। সালিম সাহেব ধমক দিলেন-“আহাম্মকের মতন চাইয়া আছোস কেন? তোর মার লগে যা। এইদিকে আমি দেখতাছি।”
ছেলে দু’টো মাকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটলো। সালিম সাহেব মেয়ের বন্ধ কামড়ার দিকে তাকালেন। শুভ্রা কোথা থেকে কিভাবে এলো এই সকালে? গতকাল নির্বাচন হয়ে গভীর রাতে এই এলাকার ফলাফল ঘোষণা হয়েছে। ভোররাত পর্যন্ত এলাকায় আনন্দ মিছিল, আতশবাজি আর খাওয়া দাওয়া হয়েছে। আজ সকালে তাই চারিদিক নিরব। এরমধ্যেই শুভ্রার আগমন। প্রতিপক্ষ ভীষণ চতুর এতে কোন সন্দেহ নেই। তারা জানে আজ চারিদিক নিরব থাকবে, কেউ টের পাবে না কিছু। কোন প্রত্যক্ষদর্শী থাকবে না। সালিম সাহেব তুহিনকে ডাকলেন। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা তুহিন এগিয়ে এলো-“আপামনি গাড়িতে আইসা নামছে স্যার। সিসিটিভি ক্যামেরায় দেইখা মজিদ আমাকে ডাকছিল। উবারের গাড়ি। আমারে কইলো এয়ারপোর্ট থিকা উঠছে আপামনি।”
“তার মানে কোন ক্লু নাই?”
“নাহ। একমাত্র আপামনিই যদি কিছু বলে।”
সালিম সাহেব ভ্রু কুঁচকে তাকালেন-“যদি কিছু বলে মানে কি তুহিন? লুকাছাপা না কইরা ক কি কইতে চাস?”
তুহিন কেঁপে উঠলো। সত্যি বলতে ভয় পাচ্ছে সে।
“চুপ কইরা আছোস কেন?”
তুহিন কিছু বলতে চাইলো তখনই শুভ্রা বের হলো রুম থেকে। তার চুল ভেজা, চেহারায় স্নিগ্ধতা ছাপিয়ে ক্লান্তির ছাপ। শুকিয়ে গেছে অনেক, চেহারায় কমনীয়তার জায়গায় রুক্ষতা। তুহিনকে দেখে হাসলো-“তুহিন ভাই, আপনার হাতের ভুনা খিচুড়ি খেতে মন চাইছে সাথে কষা গরুর মাংস।”
তুহিন থতমত খেল। সালিম সাহেবকে দেখে নিল একবার। মৃদুস্বরে বললো-“কখন খাবেন আপামনি?”
“সন্ধ্যায়। এখন নাস্তা করে একটা ঘুম দেব। অনেকদিন ধরে ঘুমাই না। আজকে নিজের রুমে শান্তির ঘুম দেব। ঘুম থেকে উঠে আপনার হাতের খিচুড়ি খাবো।”
“আচ্ছা, আপামনি।”
শুভ্রা টেবিলে বসে প্লেটে খাবার নিয়ে খেতে শুরু করেছে। টেবিলে থাকা সব খাবার নিয়ে প্লেট ভর্তি তার। সালিম সাহেব তুহিনকে ইশারায় চলে যেতে বলে নিজে গিয়ে মেয়ের কাছে বসলেন-“আম্মু, কোথা থেকে আসলা এতো সকালে?”
শুভ্রা রুটি চিবাতে চিবাতে ঘড়ি দেখলো-“সকাল কোথায় আব্বু? সাড়ে এগারোটা বাজে।”
“আম্মা, কোথায় ছিলা এতদিন?”
শুভ্রার খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। হাতের গ্রাস প্লেটে নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ায়-“আমি যাই আব্বা। খুব ঘুম পাচ্ছে।”
শুভ্রা উঠে এলোমেলো পা ফেলে রুমে চলে গেলো। সালিম সাহেব তাকিয়ে দেখলেন, কি বলবেন ভেবে পেলেন না। মেয়েটাকে খানিকটা অস্বাভাবিক লাগছে তার কাছে। ওর সাথে কি খারাপ… না না কিছুতেই হতে পারে না। ওরা বলেছিল নির্বাচনে কোন ঝামেলা না করতে উনি মেনে নিয়েছেন। তাহলে? ওরা কেন কথা রাখবে না?

সালিম সাহেব দাঁতে দাঁত চেপে মেজাজ ঠিক রাখার চেষ্টা করেন। নতুন ছেলেটার বিরুদ্ধে কোন প্রমান পাওয়া যায়নি। গত দেড়টা মাস ধরে তুহিন তার পেছনে লোক লাগিয়ে রেখেছে কিন্তু কোন লাভ হয়নি। হয় ছেলেটা সত্যিই ইনোসেন্ট না হয় অতিরিক্ত চালাক। সালিম সাহেব খুব অসহায় বোধ করছেন। একটা মাত্র মেয়ে দুই মাসের অধিক সময় কারো কাছে বন্দী ছিল এটা মাথায় আসলেই মেজাজ চটে যাচ্ছে তার। সবচেয়ে কষ্ট দিচ্ছে যে ব্যাপারটা সেটা হলো তিনি এতোদিনেও কিছু করতে পারেননি। না মেয়ের অ/প/হ/র/ণকারীদের ধরতে পেরেছেন না মেয়েকে উদ্ধার করতে পেরেছেন। না জানি তার মেয়েটা এই দুইমাসে কত কি সয়েছে। চোয়াল শক্ত হয় তার। যদি কোনভাবে জানতে পারতেন এই অতি জঘন্য কাজটা কে করেছে তাহলে তাকে বুঝিয়ে দিতেন তিনি কি জিনিস। সালিম সাহেব অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন নিস্ফল আক্রোশ নিয়ে।

চলবে—
© Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-১১

শুভ্রা শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে। তার ঘুম আসছে না। না ঘুমাতে ঘুমাতে তার অভ্যাস পরিবর্তন হয়ে গেছে। সামান্য শব্দ পেলে চমকে উঠছে, ভয় পেয়ে উঠে বসে থাকছে। সবচেয়ে আজব ব্যাপার খাটে শুয়ে ভালো লাগছে না তার। সে কিছুক্ষণ মেঝেতে শুয়ে রইলো। কিছুক্ষণ চেয়ারে বসে রইলো। তারপর আবার বিছানায় এলো। ঘুম নেই তবুও শুভ্রা চুপচাপ শুয়ে রইলো। তার দরজার বাইরে অস্থির পায়চারীর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। শুভ্রা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে পাশ ফিরলো। সে জানে তার সাথে কথা বলার জন্য সবাই ব্যাকুল হয়ে আছে। কিন্তু সে কারো সাথেই কথা বলতে চায় না। পরিবারের মানুষের হাজারো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ইচ্ছে তার নেই। এইজন্য দরজার সিটকিনি আঁটকে আছে। তা না হলে দেখা যেত তার ঘরে একের পর এক লোক আসছে তো আসছে, প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছে। নিজেকে বাঁচাতে তাই শুভ্রা রুমের দরজা আঁটকে আছে।

শুভ্রা আসলে কথা বলার মতো অবস্থায় নেই৷ একা থাকতে থাকতে এখন এতো মানুষ দেখে কেমন যেন অসস্তি হচ্ছে। তারউপর সবার অতি উৎসাহী চোখ শুভ্রাকে আরও বেশি মিইয়ে দিচ্ছে। শুভ্রা চোখ বুঁজে তার বন্দী জীবনের কথা ভাবলো। বন্দী জীবনে পালানোর চেষ্টা করাটা কি বিশাল ভুল ছিলো তা ধীরে ধীরে টের পেয়েছে শুভ্রা। এই চেষ্টা করার ফলে তার বন্দী জীবনটা ট্রমার মতো কেটেছে। রণ নামের মানুষটা সেইদিনের পর আর একদিনও যায়নি ওর কাছে। না খাবার দিয়েছে না ঘুমাতে দিয়েছে। ঘুমালেই পুরো বাড়ি অন্ধকার করে দিত। ফলে শুভ্রা ভয়ে জেগে উঠতো। একা একা অন্ধকারে বসে থেকে মনে হতো আশেপাশে কেউ আছে। চিৎকার করে কাঁদতো দিনের পর দিন। আর খাবারের কথা মনে এলেই গা শিউরে ওঠে শুভ্রার৷ উফফ! কী নিদারুণ কষ্ট। শুভ্রা গুঙিয়ে উঠলো। বালিশ চেপে ধরলো পেটের উপর। ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। অনেকক্ষণ পরে বিরবির করে বললো-“আপনাকে মাফ করবো না কিছুতেই। নিজ হাতে কঠিন সাজা দেব আপনাকে।”

★★★

সকালে ঘুমিয়েছিল রণ। কিন্তু এতো এতো মানুষের ফোন পাচ্ছে যে ঘুমিয়ে থাকার উপায় নেই। বারবার ঘুমের ব্যাঘাত হওয়াতে বিরক্ত হয়ে দু’তিন ঘন্টা পরেই উঠে পড়লো। চোখ দুটো এখন ব্যাথা করছে রণর। উঠে ডাইনিং এ এলো রণ। ওকে দেখে জলি এগিয়ে এলো-“কিরে উঠে পড়লি যে?”
রণ হাই আঁটকালো-“ঘনঘন ফোন আসছে মা ঘুমাব কি করে?”
“তা তো আসবেই। নিজে পছন্দ করে এই পথ বেছে নিয়েছিস এখন বোঝ।”
রণ মায়ের দিকে তাকালো। জলির চেহারায় চাপা একটা খুশির আভা আছে। চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে আছে। রণ মুচকি হেসে বললো-“তোমার কি হয়েছে মা? তুমি তো সারারাত আমার সাথে জেগে ছিলে এখনও দেখছি জেগেই আছো। তারপরও চেহারায় কোন ক্লান্তি নেই। কি ঘটনা বলোতো মা?”
জলি মুখটা গম্ভীর করার চেষ্টা করলো-“কি আবার ঘটনা হবে? তোর দুনিয়ার গেস্ট আসছে তাদের আপ্যায়ন দেখতে হচ্ছে। কাজের মেয়ে দু’টো কি এসব বোঝে? ওদের পেছনে লেগে থাকতে হচ্ছে, সব দেখিয়ে দিতে হচ্ছে। একটু আগেই মিহির এসে বললো এলাকার গন্যমান্য কেউ এসেছে। ভালো আপ্যায়নের ব্যাবস্থা করতে।”
রণ এগিয়ে এসে জলিকে জড়িয়ে ধরে-“আমার এই এচিভমেন্টে তুমি খুব খুশি তাই না মা?”
জলির চোখের কোনে খুশির বারিধারা চিকচিক করছে। সে আপ্লূত হয়ে মাথা নাড়লো-“এবার কিন্তু বিয়ে করতে হবে রণ। তুই ব্যস্ত হয়ে যাবি আমার সঙ্গী লাগবে। এতোদিন নানা টালবাহানা করেছিস তবে এখন আর শুনবো না।”
রণ হেসে দিয়ে পিছিয়ে গেল-“তুমি পারোও বটে মা। কেবল নতুন করে সব শুরু করছি। তুমি আমাকে পিছুটান দিয়ে বাঁধতে চাইছো এখনই? সব আগে একটু গুছিয়ে নেই। সবচেয়ে বড় কথা ওই বাঁদর দুটো বিদায় না করে আমার কি বিয়ে করা ঠিক হবে মা? দুটো মিলে তো শুধু আমার বউকে হেনস্তা করবে। ভেবেই হবু বউয়ের জন্য চিন্তা হচ্ছে আমার।”
শেষের দিকে কথা বলতে বলতে খানিকটা গম্ভীর হলো রণ। জলি রেগেমেগে এগিয়ে এসে রণর কান মলে দিলেন-“খবরদার আমার মেয়েদের কথা বলবি না। ওরা অনেক লক্ষী। তুই বিয়ে করার আগেই বউকে নিয়ে ভাবছিস? বোনদের শত্রুর আসনে বসিয়ে দিচ্ছিস?”
“উফফ মা! দেখলে অবস্থা? শুধু বউয়ের কথা একটু ভেবেছি তাতেই তুমি কেমন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলে। তাহলে ভাবো বিয়ের পর কি করবে। এইজন্যই বিয়ে করতে চাই না মা। এই ভালো আছি।”
জলি অবাক হলো-“আরেহ! আমি কখন তেলেবেগুনে জ্বললাম? বুঝিনা ভেবেছিস? বিয়ে না করার ফন্দি সব। শোন এসব বলে লাভ হবে না এবার। তোর কোন..”
মিহির প্রবেশ করলো-“ভাই, উঠেছেন?”
রণ মিহিরকে দেখলো-“হ্যা, কেবলই উঠলাম। কি হয়েছে?”
“নিচে মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা আসছে। আপনি ঘুমিয়ে আছেন বলার পরও যায় না। ওরা আনন্দমিছিল করতে চায আপনাকে নিয়ে।”
“আনন্দমিছিল তো সম্পূর্ণ ফলাফল প্রকাশের পর করার কথা। আচ্ছা ঠিক আছে চল আমি কথা বলছি। মা আমার জন্য কড়া করে একমগ কফি দেবে?”
জলি মুখ গোজ করলো-“পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
রণ মিহিরের সাথে চলে গেল। সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে ফিসফিস করলো-“কোন আপডেট পেয়েছিস?”
মিহির চাপা গলায় জবাব দিলো-“সব চুপচাপ। কোন আওয়াজ নাই।”
“পৌছেছে ঠিকমতো?”
“হ্যা। আমি নিজে দেখেছি।”
“আচ্ছা।”
রণর মুখেচোখে সস্তি ফুটে উঠলো। মিহির মিনমিন করলো-“কিন্তু ভাই, ওই মেয়ে আপনাকে দেখেছে। ওর বাপকে যদি বলে দেয় তাহলে কি হবে?”
“বলার কথা না। এমনকি ওর বাপেরও কোন উচ্চবাচ্য করার কথা না। করলে কি করবি তাতো জানিস।”
“ভয় করে ভাই। ওর বাপটা কিন্তু সাংঘাতিক।”
রণর চেহারায় অমনিশা নামে। সে ফিসফিস করলো-“মেয়েটাও কম সাংঘাতিক না।”

★★★

“তুমি তো ভারি মিষ্টি দেখতে। কে তুমি? মা, এই মেয়েটা কে?”
শুভ্রা তুলতুলের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললো। রিমার মাথায় চারটে সেলাই পড়েছে। তবুও তৃষিত নয়নে মেয়েকে দেখছেন। মাঝে মাঝে চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। শুভ্রা শুয়ে আছে মায়ের কোলে। তুলতুল জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সামনে। রিমা তুলতুলকে দেখে শুভ্রার দিকে তাকায়-“ও সোহেলের বউ তুলতুল।”
শুভ্রা মায়ের কোল থেকে উঠে বসলো। তার চোখে মুখে বিস্ময়-“ভাইয়া বিয়ে করেছে? কবে? আমাকে ছাড়া তোমরা ভাইয়ার বিয়ে দিয়ে দিলে? আমাকে তোমরা জানানোর প্রয়োজন বোধ করোনি?”
রিমাকে খানিকটা ব্যাকুল দেখায়। সোহেলের কীর্তি শুভ্রাকে বলা যাবে না। বাপ ভাইরা মেয়ের কাছে আলাভোলা মানুষ সেজে থাকে। তাছাড়া শুভ্রা এখন এসব ঘটনা শোনার মতো মানসিক স্থিতিতে নেই। তাই কি জবাব দেবেন বুঝে পেলেন না। দ্বিধা জড়িত কন্ঠে বললো-“কাউকেই জানাই নাই। ভাবছি তুই আসলে অনুষ্ঠান করবো।”
শুভ্রা সন্দেহ নিয়ে মাকে দেখলো-“কেন? কাউকে জানাও নাই কেন?”
রিমা কঠিন কন্ঠে বললো-“জানাবো কেমনে? তোর চাচী তো দেশে নাই জানোস। তুই মালিহা, তন্ময়, মুমু কেউ নাই। ওদের খবর দিতে হবে, দেশে আসবো তারপর না অনুষ্ঠান। আমি একা একা সব কাম পারিনা দেইখা তাড়াতাড়ি বিয়ে করাই দিছি।”
শুভ্রা তুলতুলকে দেখলো। মেয়েটা সুন্দরী, তবে চেহারা কেমন যেন ফ্যাকাশে। সবসময় তটস্থ হয়ে থাকছে। ও তুলতুলকে ডাকলো-“ভাবি, তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন? এখানে এসে বসো আমার পাশে।”
তুলতুল রিমার দিকে তাকালো একবার-“না আপা, আপনারা গল্প করেন। আমি বরং একটু রান্নাঘর হয়ে আসি। দেখি আপনার খিচুড়ির কি হাল।”
শুভ্রা আবারও মায়ের কোলে শুয়ে গেলো-“আচ্ছা, দেখো। হলে খানিকটা বাটিতে নিয়ে এসো।গরম গরম খাব।”
তুলতুল মাথা নেড়ে চলে গেলো। শুভ্রা চোখ বুঁজলো। রিমা মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। গালে হাত বুলিয়ে দিলো৷ শুভ্রার ত্বক রুক্ষ হয়ে গেছে, গায়ের রং ময়লা হয়েছে। অথচ শুভ্রার গায়ের রং মিলিয়েই নাম রাখা হয়েছিল। গলার বিউটি বোন একটু বেশিই দৃশ্যমান, শরীর শুকিয়ে কমনীয়তা হারিয়েছে। রিমা ফিসফিস করে ডাকলো-“ও শারমিন, ঘুমাইছোস?”
শুভ্রা ক্লান্ত গলায় জবাব দিলো-“ঘুম আসে না মা। অনেকদিন হলো ঘুমাই না তো।”
রিমা ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করলো-“ঘুমাস না কেন? কই আছিলি তুই? ঘুমাইতে দেয় নাই তোরে?”
“ভয়ে ঘুম আসতো না মা। একা থাকতাম তো।”
বলতে বলতে শুভ্রা কাত হলো। ওর কথাগুলো জড়ানো। ওর জীর্নশীর্ন চুলগুলো একপাশে দিলো রিমা। তখনই ঘায়ের নিচে কালসিটে দাগটা নজরে এলো। রিমা আলতো হাতে সেখানে হাত বুলায়-“এইখানে কি হইছে শারমিন? কেমনে ব্যাথা পাইছোস?”
জবাব এলো না কোন। মৃদু নাক ডাকার শব্দ পাওয়া গেলো। রিমা বিস্মিত হয়ে আবিস্কার করলো শুভ্রা ঘুমিয়ে গেছে তার কোলের মধ্যে। দু’হাতে রিমাক আগলে নিয়ে আছে। অনেকটা ভয় পাওয়া বাচ্চাদের মতো। রিমার কান্না পেয়ে গেল। তার মেয়েটা গত দুই মাস অনেক কষ্টে ছিল বোঝা যাচ্ছে। অথচ মা হয়ে কিছু করতে পারছে না।

“ঘুমাইছে?”
ফিসফিস করলো সালিম সাহেব। এতোক্ষণ দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে মা মেয়েকে দেখছিলেন। রিমাকে চোখ মুছতে দেখে এগিয়ে এলেন। রিমা মাথা দুলায়-“ভয় পায় একা থাকতে। দেখেন কেমনে ঘুমাইতেছে।”
নিচু স্বরে জবাব দিলো রিমা। সালিম সাহেব একদৃষ্টিতে মেয়েকে দেখে চলেছেন। রিমা ছলছল চোখে স্বামীর দিকে তাকালেন-“ওরে মনেহয় মা/র/তো ওরা।”
সালিম সাহেব ভ্রু কুচকে তাকিয়ে স্ত্রীকে দেখলেন-“কেমনে বুঝলা?”
শুভ্রার ঘাড়ের দিকে ইশারা করলো-“এই যে দেখেন কেমন কালা হইয়া আছে। খাইতে দিত না। গায়ের রং কেমুন ময়লা হইছে দেখছেন? শুকায়া গেছে দেখেন না।”
সালিম সাহেবের চোয়াল শক্ত হলো। তার কলিজায় হাত দেওয়া মানুষটাকে কিছুতেই ছাড়বেন তিনি। শুধু জানতে দেরি তাকে সাজা দিতে দেরি করবেন না মোটেও। মনেহয় তাকে জায়গা থেকে সরানোর জন্য বেশ বড়সড় পরিকল্পনা হয়েছিল। এটা কারো একার কাজ হতেই পারে না। তাকে সরিয়ে নতুন কাউকে তার জায়গায় বসানো, তার ক্ষমতা কমানো। এসব কিসের ইঙ্গিত দেয়? তাকে কি এভাবে দমানো যাবে? প্রতিপক্ষ জানেনা কার বিরুদ্ধে নেমেছে তারা। সে দা ইব্রাহিম সালিম, এতো সহজ নয় তাকে সরানো। আর তার সন্মানে আঘাত দেওয়ার চেষ্টা করলে কি হবে তা দেখিয়ে দেবেন শিগগিরই। এতোদিন চুপচাপ বসে ছিলেন কারন মেয়ে কাছে ছিলো না। এখন মেয়ে পেয়ে গেছেন, র/ক্তে/র ব/ন্যা বইয়ে দেবেন দরকার হলে। তবুও মেয়ের অ/প/হ/র/ণ কারীদের চাই তার। অপরাধী স্বয়ং নেত্রী হলেও তার ছাড় হবে না। কারণ, ইব্রাহিম সালিম এই দেশে একজনই। আর তাকে ঘাটালে, তার সন্মান নিয়ে টানাটানি করলে তার ফল যে ভালো হয় না এটা আবার নতুন করে বুঝিয়ে দেওয়ার সময় হয়েছে।

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-১২

রণর প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহনের দিন আজ। সাংসদ হিসেবে শপথ নিয়েছেন নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পঞ্চমদিনেই। সংখ্যাগরিষ্ট দল হিসেবে জনতা পার্টি বাংলাদেশ ক্ষমতায় এসেছে দুই সপ্তাহের অধিক হবে। এরমধ্যে রাস্ট্রপতির আমন্ত্রণে নেত্রী নতুন মন্ত্রীসভা গঠন করেছে। এবার তরুনদের অগ্রাধিকার দিয়ে গঠিত মন্ত্রীসভায় রণকে স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে যেটার পূর্ণ ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর অধীনে থাকবে। রণকে তার কাজের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে জবাবদিহিতা করতে হবে। এইরকম অচেনা কাউকে প্রথমবারেই এতো বড় মন্ত্রনালয়ের দাঁয়িত্ব দেওয়াটা আশ্চর্যজনক বইকি। পুরনো নেতাকর্মীদের মধ্যে এ নিয়ে জোর আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। নেত্রী অবশ্য কোন কথাই আমলে নেননি। উনি ওনার সিদ্ধান্তে অটল আছেন।

রণ আনন্দিত হবে নাকি হবে না বুঝতে পারছে না। শুরুতেই এতোবড় দায়িত্ব সে চায়নি কিছুতেই। রাজনীতির র বোঝেনা এখনো। যেখানে অপজিশন পদে স্বয়ং নিজের দলের বর্ষীয়ান নেতা সেখানে এই দায়িত্ব অনেকটা বোঝার মতো লাগছে তার কাছে। নির্বাচনের পর এলাকায় একটা মিটিং হয়েছিল যেখানে সব শ্রেনীর দলীয় কর্মী উপস্থিত ছিল। মিটিং এ রণ কথাই বলতে পারেনি। মিটিংটা মুলত দলীয় নেতাকর্মীদের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা শোনার জন্য আয়োজন করা হয়েছিল। মাঠপর্যায়ের নেতানেত্রীদের নানা দাবিদাওয়া ছিল যার মধ্যে এক নম্বর হলো তাদের জন্য কিছু করা। সরকারের সব কাজ একজনকে করার সু্যোগ না দিয়ে যেন সবার মধ্যে সমানভাবে বন্টন করা হয় যাতে দলের জন্য খেটে যাওয়া মানুষটাও কিছু টাকা উপার্জন করতে পারে। অতীতে এমন দাবী বারবার করা হলেও কেউ কানে নেয়নি। তাই এবার যেন বিশেষ নজর দেওয়া হয় এদিকটায়। এমন দাবী শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিল ইব্রাহিম সালিম। তার দাবী মিটিং এ ডেকে এনে তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে অপদস্ত করা হচ্ছে। তার মতো এমন বর্ষীয়ান নেতা, দলের জন্য যার অনেক অবদান তাকে অপমান করা এটা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। তিনি মিটিং বয়কট করে চলে গেলেন। দেখা গেলো সমগ্র এলাকার সত্তুরভাগ দলীয় নেতা তার পিছু নিয়ে মিটিং বয়কট করলো। বোকা বনে গেছিল রণ। বুঝতে পারলো, তার প্রতিপক্ষ তার ভাবনার চাইতে কয়েকধাপ এগিয়ে। তার ভাবনার সাথে তাল মিলাতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে তাকে। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায় রণ।

গায়ে নীল পাঞ্জাবির উপর অফ হোয়াইট কোটি চাপিয়েছে আজ রণ। চুরিদার পায়জামার সাথে কেতাদুরস্ত জুতো খুব মানিয়ে গেছে। চুলগুলোতে জেল লাগিয়ে সেট করে নিলো। জলি হাতে বাটি নিয়ে ঘরে ঢুকলো-“বাবাই, পায়েস রেঁধেছি তোর জন্য। একটু মুখে দে।”
রণ মুখের বিরক্তি কাটিয়ে হাসি আনার চেষ্টা করলো। মাকে সে এসব বুঝতে দিতে চায় না। না হলে মা ভয় পেয়ে যাবে।
“মিষ্টি খেতে ইচ্ছে করছে না মা।”
জলি এক চামচ পায়েস তুলে ছেলের মুখের সামনে ধরলো-“শুভ কাজে যাচ্ছিস মানা করিস না।”
রণ চুপচাপ খেয়ে নিলো। মায়ের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো-“আসছি মা।”
জলি ছেলের মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন।

★★★

বর্তমানে তুলতুলের প্রধান কাজ শুভ্রার সাথে থাকা। তুলতুল ব্যাপারটায় বেশ আনন্দ পাচ্ছে। এতোদিন তার জীবনটা ছিল আলো আঁধারির গোলকধাঁধা। এখন শুভ্রা আসার পর যেন একটা দিশা খুঁজে পেয়েছে। সোহেলের সাথে তার সম্পর্ক নামকোবাস্তে। বিয়ের পর থেকে সোহেল কেন যেন তাকে সহ্যই করতে পারে না। যেই মেয়েটাকে তুলে এনে রেপ করলো তাকে বিয়ের পর একদিনও কাছে টানেনি। তুলতুল অবাক হয়েছে। সোহেলের প্রতি ঘৃনা ছাড়া আর কিছু ফিল করে না সে। দেখলে কেন যেন প্রথমদিনের স্মৃতি মনে পড়ে যায়। ঘৃনায় তুলতুলের গা কাঁপে, বুক ধরফর করে।

সোহেলের অবশ্য এতোসব দেখার সময় নেই। প্রায় রাতে সে মদ খেয়ে মাতাল অবস্থায় ফিরে আসে। তুলতুল বুঝেছে অন্য মেয়ে মানুষের কাছে যায় সে। এসব বোঝার কিছু ক্ষমতা আল্লাহ মেয়েদের দিয়েছেন। তুলতুলের তাতে কিছু যায় আসে না। সে অবাক হয়ে এ বাড়ির মানুষগুলোকে দেখে। অন্যের মেয়েকে তুলে এনে রে/প করলেও এদের কিছু মনেহয় না। অথচ নিজের কন্যার বেলায় এরা কতটা মানবিক। ভেবেই হাসি পেল তুলতুলের।

এ বাড়িতে রিমাকেই খানিকটা নরম মনের মানুষ মনেহয়। কিন্তু এই মানুষটা কি কিছু জানে না? তার ছেলেটা এমন জঘন্য কাজ করে সে মেনে নেয়? সে নিজেও তো একজন মেয়ে। কি করে মেনে নেয় আরেকটা মেয়ের অসন্মান? তুলতুল অনেকবার ভেবেছে এই বিষয় নিয়ে জিজ্ঞেস করবে রিমাকে। কিন্তু এখনো সাহস করে উঠতে পারেনি। তুলতুল যখন থেকে বুঝেছে এ বাড়িতে সে অনাহুত। অনেকটা বাধ্য হয়ে তাকে বউ বানানো হয়েছে তখন থেকেই তার মধ্যে ভয়টা জাঁকিয়ে বসেছে৷ পারতপক্ষে সোহেলের সামনে যায়না সে। রিমার সাথে মানিয়ে চলছে, চাবি দেওয়া পুতুলের মতো চলছে যাতে আবার পরিবারের কাছে ফিরতে পারে। মা ছোটভাই, চাচা চাচী আর অনেক মিস করে সে। মিস করে পড়ালেখার জীবনটাকে। এভাবে জীবনের মোড় ঘুরবে তা স্বপ্নেও ভাবেনি।

তবে একটা ব্যাপার সে ভেবে রেখেছে, চলে যাওয়ার আগে এ বাড়ির ভিত নড়িয়ে দিয়ে যাবে। কিভাবে কি করবে তা জানে না কিন্তু করবে। বাবার বিভৎস মৃত্যু দৃশ্য এখনো ভোলেনি সে। শীতলক্ষ্যায় ডুবে থাকা দুইদিনের ফুলে যাওয়া মৃ/ত/দে/হ দেখে মায়ের অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ভোলেনি। আর নিজের স/ম্ভ্র/ম/হা/নির অপমানই বা কি করে ভুলবে? সব মনে রাখছে। একদম সময় মতো সব হিসাব চুকিয়ে ফেলবে।

★★★

শুভ্রা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে। যদিও এখনও রাতে ঘুমায় না শুভ্রা। অন্ধকার সহ্য করতে পারে না। কোথাও অন্ধকার দেখলেই চেচিয়ে বাড়ি মাথায় করে। তার জন্য বাধ্য হয়ে রাতে বাতি জ্বালিয়ে রাখতে হয়। রাতে তুলতুল শুভ্রার সাথে থাকে। দিনে রিমা আঠার মতো মেয়ের পেছনে লেগে থাকে। সে প্রায়ই হরেকরকম মজাদার খাবার বানিয়ে আনছে, কাছে বসে মেয়েকে খাওয়াচ্ছে। তার জোরজবরদস্তিতেই শুভ্রা ধীরে ধীরে খেতে শুরু করেছে। ভগ্ন স্বাস্থ্য একটু একটু করে ঠিক হতে শুরু করেছে। চেহারার রুক্ষতাও কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। রিমা নিয়মিত অয়েল ম্যাসাজ দিয়ে যাচ্ছে মেয়ের চুলে। চেহারায় নানা রকম প্রাকৃতিক উপাদান মাখিয়ে রাখছে। শুভ্রার বিরক্ত লাগলেও রিমাকে দমানো যাচ্ছে না। সে শুভ্রাকে এক সেকেন্ড চোখের আড়াল করে না।

রিমা আসলে মনে মনে ভীষণ ভয়ে থাকে। মেয়েটা এতোদিন কোথায় ছিল, কেমন ছিল, তার সাথে কিছু হয়েছে কিনা সেসব জানার কোন উপায় নেই। এ নিয়ে কোন প্রশ্ন করলেই শুভ্রা নিজেকে ঘরবন্দী করে ফেলে। তাই সে চেষ্টা বাদ দিয়েছে। কিন্তু মনের কু চিন্তা কিছুতেই দূর করতে পারে না। আচ্ছা, শুভ্রাকে কি… নিজের ভাবনা আগাতে দেয় না রিমা। দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুম হয় না। অবশেষে সেদিন যখন মেয়ের পিরিয়ড হলো মনের পাথর সরে গেলো রিমার। নিজের ভাবনায় নিজেই লজ্জা পেলো। নিজের মেয়েকে নিয়ে এরকম ভাবনা ভাবতে কোন মায়েরই ভালো লাগবে না। রিমারও লাগে না কিন্তু সে নিরুপায়। শুভ্রার নিরবতা তাকে এরকম ভাবতে বাধ্য করেছে।

সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো শুভ্রা এখন একদমই কথা বলে না। সারাদিন চুপচাপ বসে থাকে। আবার যখন নিজ থেকে বলতে শুরু করে তাকে থামানো যায় না। বেশি লোকজন দেখলে ভয় পাচ্ছে। সারাদিন নিজের রুমে বই পড়ছে। তুলতুলও চুপচাপ ওর পাশে বসে থাকে। রিমা অবশ্য বলেছে ও যেন শুভ্রার সাথে এটাসেটা গল্প করে। তুলতুল মাঝে মাঝে চেষ্টা করে গল্প করার। কিন্তু ওর নিজের মনই তো ভালো থাকে না। জোর করে কি গল্প করবে?

আজ সালিম সাহেব বাড়িতে বলে পুরো বাড়ি একটু বেশি নিরব। সালিম সাহেবের মনমেজাজ খুব খারাপ থাকে ইদানীং। অকারণে চিৎকার চেচামেচি করে ফেলে মাঝে মাঝে। বাড়ির কাজের লোকেরা খুব তটস্থ থাকে। সালিম সাহেব বাসায় বলে রিমা আজ মেয়ের কাছে বসেনি বেশিক্ষণ। শুভ্রা হঠাৎ বই থেকে মুখ তুলে তুলতুলকে দেখলো-“আজ কি হয়েছে? কারো কোন সারা নেই।”
তুলতুল উদাস হয়ে জানালার ধারে বসে ছিল-“আপনার আব্বা বাসায়। তার খুব মেজাজ খারাপ আজকে। কারন কি জানি না। এখন টিভিতে কি যেন দেখতেছে।”
শুভ্রা উৎসুক হয়ে জানতে চাইলো-“কি দেখছে?”
“আমি দেখি নাই। তবে হলরুমে আপনার চাচারাও আছে।”
শুভ্রা উঠে দাঁড়ায় দেখে তুলতুল অবাক হয়ে তাকায়-“কই যান আপা?”
“মাকে দেখে আসি।”
তুলতুল অনিচ্ছায় দাঁড়াতেই শুভ্রা তাকে থামায়-“তোমার আসতে হবে না। আমি এখনই চলে আসবো।”
তুলতুল হাফ ছেড়ে বাঁচলো। হলরুমে সোহেলকে বসে থাকতে দেখেছে।

শুভ্রা পায়ে পায়ে হলরুমে এলো। সবাই গম্ভীর হয়ে বসে আছে। রিমা শুভাকে দেখে ডাকলো-“কি হইছে? কিছু খাবি? খিদা লাগছে?”
শুভ্রা মাথা নাড়ে। সালিম স্নেহময় দৃষ্টিতে মেয়েকে দেখলেন-“আম্মা, আমার কাছে এসে একটু বসেন। আমার ভালো লাগবে।”
শুভ্রা সংকোচ নিয়ে বাবার পাশে বসলো-“তোমরা সবাই মিলে কি দেখছো টিভিতে?”
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন সালিম সাহেব-
“তেমন কিছু না আম্মা। আজকে আপার শপথ অনুষ্ঠান হইতেছে তাই দেখতেছি।”
শুভ্রা টিভির দিকে তাকালো-“কিসের শপথ?”
সালিম মেয়ের দিকে তাকায়। শুভ্রাকে কথা বলতে দেখে ভালো লাগছে তার। স্নেহার্দ কন্ঠে বললো-“নির্বাচন হইছে। দল জিতছে এখন প্রধানমন্ত্রী আর মন্ত্রীরা শপথ নিবে।”
“তুমি যাও নাই আব্বা? তোমাকে ছাড়া শপথ অনুষ্ঠান?”
সালিম সাহেবের বুকে লাগলো কথাটা। মেয়ে তার ক্ষমতা দেখে অভ্যস্ত। বুকে রক্তক্ষরন টের পেলেন। গম্ভীর হয়ে জবাব দিলেব-“আমার শরীর ভালো না আম্মা তাই যাই নাই।”
শুভ্রা কথাটা শুনলো কিনা বোঝা গেলো না। সে একদৃষ্টিতে টিভি দেখছে। হঠাৎ টিভির দিকে আঙুল তুললো-“এই ছেলেটা কে? ফুপুর পাশে দাঁড়িয়ে আছে?”
সালিমের চেহারায় বিস্ময়। মেয়ের নজর হঠাৎ রণর উপর কেন গেলো? তাহলে কি রণ সেই ব্যক্তি যে তার মেয়েকে….। সালিমের চোয়াল শক্ত হলো। সে মেয়ের মুখের দিকে তাকায়। শুভ্রার জুলজুলে চাহুনি কি কিছু বলতে চাইছে?

চলবে—
©Farhana_Yesmin

দর্পহরন পর্ব-৮+৯

0

#দর্পহরন
#পর্ব-৮

পুরো ইব্রাহিম নিবাস জুড়ে পিনপতন নীরবতা গত দু’দিন ধরে। মনেই হয় না বাসায় এতোগুলো মানুষ আছে। খাওয়া বন্ধ প্রায় সবার। সবাই ভীষণ রকম চিন্তিত। এরমধ্যে আজ সালিম সাহেবকে ঢাকায় যেতে হবে। পার্টির হাইকমান্ডের জরুরি মিটিং। কয়েকটি আসনের চুড়ান্ত ফয়সালা হবে। সালিম সাহেব শারীরিক দিক দিয়ে ভীষণ দূর্বল বোধ করছেন। মন চাইছে না কোথাও যেতে। সারাজীবন দাপটের সাথে চলাফেরা করা সালিম সাহেব ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারেননি তার নিজের সাথে এমন কিছু ঘটবে। কারো এতোখানি সাহস থাকতে পারে সেটাই তার মাথায় আসেনি। এখনো ভেবে পাচ্ছেন এতোটা দুঃসাহস কে দেখাতে পারে। তার মেয়েকে কে তুলে নেবে? সে কি জানেনা তার মেয়েকে তুলে নেওয়ার পরিনাম কি হবে?

সবচেয়ে বড় কথা এ নিয়ে কোন ধরনের উচ্চ বাচ্য করতে পারছেন না। তার মেয়ে অপহৃত হয়েছে এটা লোক জানাজানি হলে সমাজ আর রাজনীতির মাঠে এর কি প্রভাব পড়বে তা ভাবতেই হৃদয় ক্রোধে গর্জন করে উঠছে। তিনি ভেবেই পাচ্ছেন এরকম দুঃসাহসিক কাজ কার হতে পারে।

আরেক দিকে রিমা মেয়ের চিন্তায় শয্যাশায়ী। দিনরাত এক করে কাঁদছে। তার আদরের মেয়ে কোথায় আছে কেমন আছে কেউ জানে না। মেয়ে খেয়েছে কিনা কিংবা আদৌও বেঁচে আছে কিনা সেটাও জানা নেই। নাওয়া খাওয়া বন্ধ, জ্ঞান হারাচ্ছে দিনে কয়েকবার করে। এখন বাধ্য হয়ে স্যালাইন দিতে হচ্ছে তাকে। সালিম সাহেব নিজেও মেয়ের চিন্তায় পাগলপারা। মেয়েটাকে বড়ই ভালোবাসেন তিনি। ভাবছেন, এই ভয়েই তো সারাজীবন আদরের মেয়েকে দূরে রাখলেন। মনের কোথাও চোরা অনুভূতি ছিলো, মেয়েটাকে সবকিছু থেকে দূরে রাখতে হবে। ওর কোন বিপদ হতে দেওয়া যাবে না। অথচ পারলেন না। মেয়ে তাদের সারপ্রাইজ দিতে চাইছিল। সত্যি সত্যি এমন সারপ্রাইজ তারা পেলেন যে বাক্যহারা হয়ে গেলেন। এইসব ভাবনায় তিনি সারাদিন থম ধরে বসে আছেন হলরুমের সোফায়। কয়েকবার করে সবাই ডেকে গেলেও তিনি শোনেন না। চুপচাপ বসে থাকছেন। ব্যবসা রাজনীতি কোন কাজের কোন খোঁজ নিচ্ছেন না। আজ বাধ্য হয়ে সোহেল বাবার কাছে এসে দাঁড়ালো-“আব্বা, এইভাবে বসে থাকলে কি শারমিনরে পামু? আপনে কিছুই বলতেছেন না কেন?”
সালিম সাহেব দূর্বল গলায় প্রতিবাদ জানালেন-“কি কমু? বেশি লোক জানলে কি হইবো বুঝতেছোস? আমার মাইয়ার মান সম্মান নিয়া টানাটানি হইবো। ওর বিয়া দিমু কেমনে? তারউপর আমার মাইয়া অপহরণ হইছে শুইনা মানুষ আমারে সস্তা মনে করতে শুরু করবো। আমার ক্ষমতা নিয়া সন্দেহ করবো। কি করুম কিছুই বুঝতাছি না।”
সোহেল ফুঁসে ওঠে-“তাই বইলা এমনে বইসা থাকুম? বইসা থাকলে শারমিনরে ফেরত পামু?”
“কি করবি জানি না। আইজকা আবার আপার লগে মিটিং আছে। দুপুরে ঢাকায় যামু।”
“আমি কই কি আমি আমার মতো কইরা খোঁজ নিমু?”
সালিম সাহেব সোহেলকে দেখলেন। কিছু একটা ভেবে মাথা নাড়লেন-“নাহ, চুপচাপ থাক। যে এইকাজ করছে তারে এতো বোকা ভাবা ঠিক হইবো না। অনেক ভাইবা এই কাজ করছে আমি শিওর। সে জানে আমরা কি ক্ষমতা রাখি। সব যাইনা বুইঝা এই কাজ করছে মানে শারমিনের খোঁজ পাওন এতো সোজা হইবো না। তারচেয়ে চুপচাপ দেখি তারা কি চায়।”
সোহেলের মুখ দেখে বোঝা গেলো এই জবাব তার পছন্দ হয় নাই। সে প্রতিবাদ করলো-“এয়ারপোর্টে আমাগো লোক আছে। তার থিকা যদি সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া যায়। কে এই কাম করছে যদি জানা যাইতো।”
সালিম সাহেব ভ্রু কুঁচকে উঠে দাঁড়ায়-“শরীফ কইলো সে তার মতো কইরা খোঁজ নিছে। তোরে আমার ইদানীং ভরসা কম লাগে সোহেল। গত কয়েকদিন যেসব কাজ করলি সব মনোযোগ তোরে দেওয়া লাগছে। তোর আকাম সামলাইতে না হইলে হয়তো শারমিনের এই কাজ হইতোই না। নাইলে আগেই টের পাইতাম। তোর মা কবে থিকা কইতেছিল শারমিনের খোঁজ নাই। তোর আকাম সামলাইতে সামলাইতে আমার হুশ গেছিলোগা। বাদ দে বাপ। আমার মাইয়ার ব্যাপার আমি দেখুমনে। কি করতে কি করবি সব ঝামেলা পাকাই ফেলবি। তারচেয়ে তুই তোর মতো থাক কিছু করার কাম নাই।”

বাপের কথায় প্রচন্ড মর্মাহত হলো সোহেল। অপমানও কম হলো না। সে তো জানতোই না শারমিন সেদিন দেশে আসবে। তাহলে সে কিভাবে দোষী হয়? যেখানে তার কোন দোষই নেই সেখানে সম্পূর্ণ দোষ তার ঘাড়ে এলো। আবার এখন শরীফ নাকি খোঁজ নিয়েছে তাই তার খোঁজ নেওয়া যাবে না। সে নাকি সব ওলট পালট করে ফেলবে। সোহেল মেজাজ খারাপ নিজের রুমে ফিরে এলো।

তুলতুল হাঁটুতে মুখ ডুবিয়ে উদাস হয়ে বসে ছিল খাটে। সারাদিন সে ঘরে বসে হয় শুয়ে থাকে নয়তো কাঁদে। তাকে ওরকম বসে থাকতে দেখে সোহেলের গরম মেজাজ আরও খানিকটা গরম হলো। মনে হলো তার জীবনের সব ঝামেলার জন্য এই মেয়েটা দায়ী। এই মেয়েটাকে তুলে আনার পর থেকে যত ঝামেলা শুরু হয়েছে। সোহেল ঠাস করে দরজা আঁটকায়। আওয়াজে তুলতুল চমকে ওঠে। সামনে সোহেলকে দেখে আঁতকে উঠে পিছিয়ে গেলো। সোহেল তুলতুলের চুল মু/ঠো করে ধরলো-“তুই যত নষ্টের গোড়া। যেইদিন থিকা তোর সাথে দেখা হইছে সেইদিন থিকা ঝামেলা শুরু হইছে জীবনে।”
তুলতুল ব্যাথায় চিৎকার করে-“আহ! ছাড়েন আমাকে। আমি কি করছি? আমার জীবন নষ্ট করছেন আপনি। সব আপনি করছেন।”
“আমি তোর জীবন নষ্ট করছি না তুই আমার জীবন নষ্ট করছিস? কতো মাইয়া তুইলা আনছি কাউকে বিয়ে করা লাগে নাই আমার। তোকে কেন বিয়া করা লাগলো। বল?”
তুলতুল কাঁদছে-“আমি কি জানি? আমি তো আপনাকে বিয়ে করতে চাই নাই। কেন বিয়ে করছেন আমাকে?”
তুলতুলের জবাব শুনে সোহেল সজোরে চ/ড় কসালো। তুলতুল ছি/ট/কে পড়লো বিছানায়।
“হা/রা/ম/জা/দি, মুখে মুখে জবাব দেস। এতো সাহস তোর? খালি নির্বাচনটা যাইতে দে তোর কি হাল করি দেখিস। তুই কি ভাবছোস আমার বউ হইয়া বাঁইচা যাবি?”
সোহেল ওকে টেনেহিঁচড়ে মেঝেতে নামিয়ে আনে-“তুই আমার বিছানায় থাকোস কেন? আমার বউ হওয়ার কোন যোগ্যতা নাই তোর। নাম, যা এইখান থিকা। যা…”
হঠাৎ শরীফকে দরজায় দেখে থমকে গেলো সোহেল। শরীফ তুলতুলকে একনজর দেখে নজর ফিরিয়ে নিলো-“কি করছিস এসব সোহেল? বাসায় এই পরিস্থিতি আর তুই এখনও এইসব করে যাচ্ছিস? ছাড় ওকে।”
শরীফকে দেখে বুকের রক্ত ছলকে ওঠে সোহেলের। বাবার কথাগুলো কানে বাজে। মেজাজ খারাপ করে তুলতুলের হাত টেনে ধরে হিসহিসিয়ে বলে-“আমার বউ আমি যা খুশি করবো তোর কি?”
শরীফ রেগে গেল-“যা খুশি কর কিন্তু এখন না। মা অসুস্থ আর তুই যা খুশি করবি? তুই কি অমানুষ হয়ে গেছিস? ছেড়ে দে ওকে।”
মায়ের কথা বলাতে খানিকটা নরম হলো সোহেল। তুলতুলের হাতের বাঁধন আলগা করলো। তুলতুল নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। শরীফকে কৃতজ্ঞিত নয়নে একবার দেখলো। শরীফ সুধায়-“তুমি মায়ের ঘরে যাও। মা একা আছে দেখ কিছু লাগবে কিনা।”
তুলতুল যেন পালিয়ে বাঁচলো। শরীফ সোহেলের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো-“পরের মেয়ের সাথে এমন করিস বলেই আজ নিজের বোনের কোন খবর নেই। একবার ভেবে দেখ তুই যা করছিস ঠিক একই কাজ যদি আমাদের শুভ্রার সাথে কেউ করে তাহলে কি হবে। তোদের এইসব কাজের ফল না শুভ্রার উপর দিয়ে যায়।”
শরীফ দাঁড়ায় না। ও চলে যেতেই সোহেল প্রবল আক্রেশে কাঠের দরজায় বাড়ি দেয়।

★★★

রণ শুভ্র সাদা শার্ট গায়ে চড়িয়ে বোতাম লাগাচ্ছে। অফ হোয়াইট রঙা গেভারডিন প্যান্টের সাথে ধবধবে সাদা শার্টে বেশ সুপুরুষ দেখাচ্ছে তাকে। জলি ছেলের দিকে তাকিয়ে মনে মনে দোয়া করে দিলেন। ছেলের যেন নজর না লাগে। জলির মনে বড্ড ভয় ছেলেকে নিয়ে। এতদিন চোখের আড়ালে ছিল। মনে কষ্ট থাকলেও ভয় ছিল না। এখন চোখের সামনে থাকলেও মনে সর্বদা ভয়। রণ পর্দার আড়ালে মায়ের উপস্থিতি টের পেয়ে হাসলো-“মা, ওখানে কি করছো?”
জলি লাজুক হাসি দিয়ে ঘরে ঢুকলো-“আজকে কি যেতেই হবে?”
রণ মাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমো দিল-“উফফ মা, এতো ভয় পাও কেন তুমি?”
জলির চোখ ছলছল হলো-“কেন ভয় পাই তা কি জানিস না?”
রণ মাকে বিছানায় বসিয়ে নিজেও পাশে বসলো-“জন্ম হলে মরতে তো হবেই মা। ভালো কাজ করে মরলে বরং সান্ত্বনা থাকবে। তুমি তো আমার সাহসী মা। এতো দূর্বল হলে চলবে?”
জলি জবাব না দিয়ে ছেলের মাথায় হাত বুলালেন। রণ ডাকলো-“মা, আমি যাচ্ছি। দোয়া করে দাও যেন সব ভালো ভাবে শেষ হয়।”
জলি ছেলের কপালে চুমো আঁকলেন-“সব ভালো হবে বাবাই। তুই সফলকাম হবি।”

আজ নেত্রীর কার্যালয় নেতাকর্মীদের ভীড়ে উৎসবমুখর হয়ে আছে। মনোনয়ন ঘোষণা করা হবে আজ। সালিম সাহেব শুকনো মুখে বোর্ডমিটিং এ এলেন। স্বাভাবিক কুশল বিনিময় করলেন সবার সাথে। মিটিং এ একজন নতুন মুখ দেখে বেশ অবাক হলেন সালিম সাহেব। একদম তরুন একজন ছেলে যার স্থান হয়েছে আপার পাশে। মাঝে মাঝেই আপার সাথে নিচু হয়ে কথা বলছে।
নেত্রী উপস্থিত থাকলে কানাঘুষার সু্যোগ থাকে না। ফলে সালিম সাহেব জানতে পারলেন না ছেলেটা কে। সালিম সাহেবের সবকিছু কেমন যেন অসহ্য লাগে। দুইদিন ধরে দুশ্চিন্তা, অনিয়ম সব মিলিয়ে অস্থির বোধ হয়। এমন অবস্থায় নেত্রী ডাকলো-“সালিম, তোমার কি শরীর খারাপ নাকি? এতোক্ষণে একটা কথাও বললে না?”
সালিম সাহেব হাসার চেষ্টা করলেন-“না আপা, ঠিক আছি।”
“আচ্ছা বেশ। তোমার এলাকার আলাপটা সেরে নেই। তার আগে সবার উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলতে চাই আমি।”
রুমের সবাই নড়েচড়ে বসলো। রুমে উপস্থিত সকলেই নেত্রীর কাছের লোক, দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসিন বয়োজ্যেষ্ঠ। নেত্রী সবার দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করে-“আপনাদের সাথে আগেই আলোচনা করেছিলাম এবছর আমি একদম তরুণ কিছু ছেলেপেলেকে রাস্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কিছু দায়িত্বে দেব। আমি আসলে দেখতে চাইছি আধুনিক ধ্যানধারনা, জ্ঞান নিয়ে তরুনরা কি করে দেশ পরিচালনা করে। এইজন্য অবশ্য আপনাদের কাউকে কাউকে নিজেদের পদ কনসিডার করতে হবে।

সেই ইচ্ছার ফলশ্রুতিতে আমি সর্বপ্রথম সালিমের এলাকার মনোনয়ন ঘোষণা করছি। ওর এলাকায় নতুন প্রার্থী হিসেবে রাগীব শাহরিয়ার রণকে মনোনয়ন দিচ্ছি। সালিমের সাথে এ বিষয়ে আমি আগে আলোচনা করেছিলাম। আমার সিদ্ধান্তের উপর সালিমের ভরসা আছে। সালিম, আমি চাই তুমি এবার রাগীবকে পুরোপুরি সহায়তা করবে আমাদের দল থেকে যেন সে নির্বাচিত হতে পারে। আর নির্বাচন পরবর্তী সময়ে তার দায়িত্ব পালনে তাকে পুরোপুরি সহযোগিতা করবে। ঠিক আছে?”

সালিম সাহেবকে দেখে মনে হলো তিনি কিছু বুঝতে পারছেন না। চোখ দুটো বোধশক্তিহীন। বারবার রণকে দেখছিলেন। তার জায়গায় এই অল্প বয়সী ছোকরা? তাহলে সোহেলকে দিলেই হতো? চেনা জানা নেই এমন কেউ কেন? সালিম সাহেবের মনে হলো তার মাথাটা বনবন করে ঘুরছে। হিসেব না মেলায় একসময় সিটেই চোখ বুজে পড়ে গেলেন সালিম সাহেব।

★★★

কয়েকদিন ধরে শুভ্রা একদম একা। রণ আসেনি একবারও। সারাদিন করার কিছু নেই খাওয়া আর ঘুম বাদে। সেটা কাহাতক ভালো লাগে। শুভ্রার পাগল পাগল লাগে। প্রথমদিন ঘুমালেও দ্বিতীয় দিন থেকে ঘুম নেই চোখে। সারাদিন অকারণে সারা ঘরময় চরকি কাটে। কিছুক্ষণ সোফায় থাকে, কিছুক্ষণ বিছানায়। রান্না করে খেতে ইচ্ছে করে না বিধায় খাওয়া হয় না। তৃতীয় দিন খিদেয় পেট চো চো করায় একবার বাধ্য হয়ে রান্নাঘরে গেছিল। ঢ্যালঢ্যালা খিচুড়ি আর ডিম ভেজে নিয়ে ডাইনিং বসেছিল। সেই বিস্বাদ জিনিস খেতে বসে আর ভালো লাগে না। কিছুটা খেয়ে কিছুটা টেবিলে ছড়িয়ে রাখে।

সময় কাটাতে শুভ্রা পাশের ঘরটাতে গেলো আজ। প্রতিটা জিনিস তন্নতন্ন করে খুঁজলো। কিছু যদি পাওয়া যায়। কোন কাগজ বা বই বা ডায়েরি। কে ছেলেটা কি তার পরিচয়? সেদিন একটা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু শুভ্রারই তো শরীর খারাপ করলো তাই উত্তরটা শোনা হয়নি। আজ মনেহচ্ছে এই অজানা অন্ধকার থেকে গতদিন কষ্ট করে একটা সত্যি জেনে নেওয়া উচিত ছিল।

শুন্য হাতে আবার ডাইনিং এ বসলো শুভ্রা। ভেবে বের করার চেষ্টা করছে, ক’দিন হলো এসেছে এখানে? সাতদিন না দশদিন? এতোদিনেও কি তার বাবা বা ভাই বা চাচা কেউ তার খোঁজ বের করার চেষ্টা করেনি? আর আমেরিকায় তার কথিত প্রেমিকটিই বা কি করছে? শুভ্রা অবাক হলো নিজের আচরণে। জোসেফের কথা কেবলই মনে এলো তার। এই কয়দিনে একবারও জোসেফকে মনে আসেনি। অবশ্য এটাকে প্রেম বলা যায় কিনা সে জানে না। এ পর্যন্ত প্রেমিকের লিষ্টটা লম্বা শুভ্রার। কাউকে ভালো না লাগলে তার সাথে সম্পর্ক ছেদ করতে এক সেকেন্ড দেরি করে না সে যেমনটা সম্পর্ক গড়তে দেরি করে না। আমেরিকার পাঁচ বছরের জীবনে জোসেফ সপ্তম বা অষ্টম বয়ফ্রেন্ড হবে হয়তো কিংবা তারও বেশি। সঠিক সংখ্যা নির্নয়ে সময় ব্যায় করার মতো সময় তার ছিলো না। অথচ আজ সেই পুরনো কাসুন্দি ঘাটতে বসেছে।

শুভ্রা ভেবে বের করার চেষ্টা করলো, কাউকে কি এমন আঘাত দিয়েছে যাতে তারা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে তাকে কিডন্যাপ করতে পারে? অনেক ভেবেও সেরকম কাউকে খুঁজে পেলো না সে। এক সময় সবকিছু অসহ্য লাগতে শুরু করলে চিৎকার করে কান্না শুরু করে শুভ্রা। তারপর ডাইনিং এর ছোট টেবিলে মাথা এলিয়ে দেয়। ওখানেই ঘুমিয়ে যায়। নাওয়া নেই, খাওয়া নেই, এলোমেলো চুল, বাসি পোশাক গায়ে। শুভ্রার চেহারা জুড়ে ক্লান্তির ছাপ।

কতোক্ষণ ঘুমিয়েছে জানে না শুভ্রা। চোখ মেলতেই রণকে দেখলো সোফায় শুয়ে আছে চোখ বুঁজে। শুভ্রা অবাক হয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলো রণর পানে। শুভ্র সাদা রঙের শার্টে রণকে দেখে ধন্দ লাগে শুভ্রার চোখে। অজানা অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিলো। টেবিলে ছড়ানো ছিটানো ভাতের থালা থেকে গন্ধ আসছে। শুভ্রা উঠে দাঁড়ায়। এঁটো বাসন তুলে রান্নাঘরে নিতে চায়। কিন্তু সদ্য ঘুম ভাঙা শুভ্রার হাত কেঁপে বাসন মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে ঝনঝন আওয়াজে। রণ লাফিয়ে উঠে বসলো। আওয়াজের উৎস খুঁজে পেতে শুভ্রার দিকে তাকায়-“উঠে গেছেন?”
শুভ্রা জবাব না দিয়ে পুনরায় বাসন তুলে রান্নাঘরে গেল। রণ এলো ওর পিছুপিছু-“এখন ওসব রেখে আসবেন একটু? কথা বলতাম।”
শুভ্রা তবুও জবাব দিলো না দেখে রণ আশাহত হলো-“কয়েকদিন ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম তাই আসতে পারিনি। আসুন না প্লিজ। কাজগুলো পরেও করতে পারবেন।”
শুভ্রা শুনলো কিন্তু তাকালো না। নিজের মতো এঁটো বাসন ধুতে লাগলো। রণ হাল ছেড়ে দিয়ে ফিরে এলো। মনোনয়ন ঘোষণা হওয়ার পর সে বাসায় যায়নি। এখানে এসে বসে আছে। আর এই মেয়ে কিনা তাকে ভাব দেখাচ্ছে। রণ চুপচাপ সোফায় এসে বসলো। আধাঘন্টা পরে শুভ্রা এসে ওর সামনে বসলো-“বলুন কি বলবেন।”
রণ মিষ্টির প্যাকেট বের করলো-“আজ আমার জীবনের একটা বিশেষ দিন, ভীষণ খুশি দিন। সেই উপলক্ষে মিষ্টি এনেছি। আর এই যে আপনার ডিমান্ড অনুযায়ী কিছু বই আছে এতে।”
দুটো বক্স টেবিলে উঠিয়ে রাখলো রণ। শুভ্রা সেসবে ফিরেও দৃষ্টি দিলো না। ও মুখভার করে বললো-“একটা প্রশ্নের উত্তর পাওয়া আছে আমার। দয়া করে উত্তরটা দিন।”
রণ হাসলো-“আচ্ছা, এইজন্য মন খারাপ? বলুন কি জানতে চান।”
“আমি কি আপনাকে চিনি?”
রণ মাথা নাড়ে-“নাহ, চেনেন না।”
“তাহলে আমাকে এভাবে আঁটকে রেখেছেন কেন?”
রণর হাসি চওড়া হলো-“এই প্রশ্নের উত্তর পেতে আপনাকে দ্বিতীয় যে কাজটা করতে হবে সেটা হলো রুটিন মাফিক জীবন যাপন করা। এই যে কয়েকদিন আসিনি বলে আপনার জীবন অচল হয়ে আছে এমনটা করা যাবে না। আমি প্রায়ই আসবো না এখন। আপনার এই একা জীবনে অভ্যস্ত হতে হবে। নিজেকে সারভাইব করা শিখতে হবে।”
শুভ্রার ভ্রু কুঁচকে গেল রণ বললো-“এই যে খাবার নষ্ট করেছেন তা করা যাবে না। প্রতি সপ্তাহে আপনাকে নির্দিস্ট এমাউন্ট খাবার দেওয়া হবে সেটা দিয়ে সপ্তাহ চালিয়ে নিতে হবে। তারপর ধরুন এই যে সারাক্ষণ সবঘরে লাইট জ্বালিয়ে রাখছেন বিদ্যুৎ বিল আসছে অনেক। এমন হলে হুট করে কানেকশন কেটে জেতে পারে। তখন অন্ধকারে কি করে থাকবেন সেটা ভাবুন। আগে থেকে প্রপ্রার ব্যবস্থা নিন আঁধারে কি করবেন। বুঝতে পেরেছেন? এক কাজ করা যাক। আগামীকাল থেকে তিনদিন আপনার ফ্ল্যাট আঁধার থাকবে। আপনার নেক্সট এক্সাম আঁধারে বেঁচে থাকা। এইজন্য আজকের মধ্যে যা যা প্রয়োজনীয় সব জোগাড় করে ফেলুন। যেমন ধরুন মোমবাতি কিংবা টর্চ এসব আর কি।”
“আর এসব আমি পাবো কোথায়?”
শুভ্রার প্রশ্নের রণ রহস্যময় হাসলো-“ফ্লাটে সব আছে শুধু খুঁজে নিতে হবে আপনাকে। আজকের মতো যাচ্ছি। আপনি সারভাইব করলে দেখা হবে তিনদিন পর।”
শুভ্রার হাতপা ঠান্ডা হয়ে আসছে। বলছে কি ছেলেটা? এই ছেলেটা আসলে তাকে মে/রে ফেলতেই চায়। এভাবে না মে/রে বুকে গুলি চালিয়ে দিলেই হয়। অন্ধকারে থাকার চাইতে গু/লি খাওয়া উত্তম শুভ্রার জন্য।

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-৯

দীর্ঘ দিন পরে নিজের পিতৃভূমিতে ফিরে আপ্লূত হয় রণ। মাকে সাথে নিয়ে পিতার আদি নিবাসে আগমনটা বেশ জাঁকজমকপূর্ণই হলো। ভাবেনি এতো লোকের সমাগম হবে তার আসা উপলক্ষে। সাধারণ লোকের আকন্ঠ সমর্থন দেখে সে আর জলি দু’জনেই বিস্মিত। তাদের নতুন বাড়ির নামকরণ হয়েছে। ‘দর্পন’ নামের বাড়িটা সাধারণ জনগণ, মাঠপর্যায়ের কর্মীদের ভীড়ে সমাগম। আসলে নেত্রীর কড়া আদেশ, প্রার্থী যেই হোক তাকে দলের সবাই মিলে সাপোর্ট দিতে হবে। কোন ধরনের কোন্দল বরদাস্ত করা হবে না।

তারউপর রণ ফ্রেশ মুখ। তার বাবা এলাকার গন্যমান্য মানুষ ছিলেন। সমাজসেবক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সুনাম ছিলো। মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ানোর অভ্যাস ছিলো। তার ছেলে হিসেবে রণ এলাকার মানুষের অন্ধ সমর্থন পেয়ে গেছে। আর বাকী রইলো রাজনৈতিক পরিপক্বতা, সময়ের সাথে সাথে সেটাও অর্জন করে ফেলবে। এটা লোকের বিশ্বাস।

লোকজনের আন্তরিকতায় জলি সিক্ত। আজ মনেহচ্ছে, ভালো মানুষের মুল্যায়ন হয় না এ কথাটা ভুল। দেরিতে হলেও ভালো কাজ আর ভালো মানুষ দুটোরই মুল্যায়ন হয়। একসময় ছেলের রাজনীতিতে যোগদানে ভীষণ ভয় ছিলো জলির। আজ সব দেখে কেন যেন ভালো লাগে। তার ছেলে এতো এতো মানুষের ভালোবাসা পাবে সে তার ভাবনায় ছিলো না। ভীষণ ভালোলাগা নিয়ে জলি রণকে দেখে। ছেলে স্মিত মুখে সবার সাথে আলাপ করছে। দূর থেকে সে দৃশ্য দেখতে বড়ই ভালো লাগছে তার। গত কয়েকদিন ধরেই দূর থেকে লুকিয়ে দেখছে তবুও স্বাধ মিটছে না জলির। অবাক হয়ে ভাবছে, তার ছোট্ট ছেলেটা কবে এতো বড় হলো? এতো সেদিও বাবা বাবা করে কেঁদে জলির কোলে মুখ লুকাতো। সেই রণ আজ বাবার জায়গায়। জলি দেখে আর কাঁদে।

“মা, চলো আজ ঢাকায় ফিরবো।”
“এখানে তোর কাজ শেষ?”
জলি উৎকন্ঠিত হয়ে জানতে চায়। রণ মাকে দেখে হাসলো-“না মা, এখানে কাজ কেবল শুরু। আমার তো এখন এখানেই থাকতে হবে। কিন্তু তুমি এখানে এভাবে থাকলে হাসি খুশি তো পাগল হয়ে যাবে।”
জলি রাগ হলেন-“ওরা কেন পাগল হবে? ছোট আছে নাকি ওরা? ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে, নিজেদের দেখে রাখতে পারে।”
রণ হেসে দিলো-“আমি তো তাহলে বুড়ো হয়ে গেছি মা।”
জলি স্নেহার্দ হয়ে জবাব দিলো-“তোর কথা আলাদা। তুই তো এতোদিন দূরেই ছিলি। এখন চোখের আঁড়াল করতে মন চায় না। আমি তোর সাথে এখানেই থাকবো। উহু কোন কথাই শুনবো না।”
রণ মাকে জড়িয়ে ধরে-“আমার সাথে মিহির আছে, জাফর আছে। তাছাড়া হাসি খুশিকে দেখে রাখতে হয় মা। ওরা বড় হয়েও ছোটদের মতো আচরণ করে। তুমি ওদের সাথে থাকো মা।”
জলি মাথা নাড়ে-“তাহলে ওদেরকেও এখানে আনি।সবাই মিলে এখানেই থাকি। এতো বড় বাড়ি সমস্যা নেই তো কিছু।”
রণ আঁতকে উঠলো-“কখনোই না মা। আমি চাই না সবাই এখানে থাকি। অন্তত নির্বাচনের আগে তো নয়ই। আমি নতুন মানুষ মা। কে আমাকে বন্ধু ভাবছে কে শত্রু তা এখনো জানি না। তাই তোমাদের নিয়ে কোন রিস্ক নেব না আমি।”
“বেশ। তাহলে আর কোন কথা নেই। আমি তোর সাথেই থাকবো।”
রণ হতায় হয়ে মাথা নাড়ে-“আচ্ছা বেশ থেকো। আমাকে তাহলে দিন ঠিক করে নিতে হবে। চারদিন এখানে থাকবো তিনদিন ঢাকায় ফিরবো। ঠিক আছে?”
জলি জবাব দিলো না। গোছগাছে মন দিলো।

★★★

“তুহিন, একটা কাজ করতে পারবি?”
তুহিন বিস্মিত হয়ে ইব্রাহিম সালিমকে দেখলো। কতদিন পরে তুহিনকে ডাকছেন সালিম সাহেব। ছেলে সোহেলের চক্করে তুহিনকে ডাকতে ভুলে গেছিলেন ইব্রাহিম সালিম। আজ এতোদিন পরে তুহিনকে কাজের জন্য ডাকছে। আবেগপ্রবণ হয়ে গেলো তুহিন। দৃঢ় স্বরে বলে-“কি কাজ স্যার?”
“কি যেন নাম ছেলেটার? এই এলাকার প্রার্থী হইছে।”
“রণ?”
“হুমম। ওর হিস্ট্রি বের করে আমাকে জানা। ওই ছেলে হুট করে উড়ে এসে জুড়ে বসলো কেমনে? এতো শর্ট টাইমে আপা এর আগে কাউরে মনোনয়ন দেয় নাই। ওর কেসটা কি?”
তুহিন হাসলো। ও জানতো এই প্রশ্মটা আসবে তাই আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে ছিলো সে।
“স্যার, ওর হিস্ট্রি জানি আমি। হাসনাত হামিদের পোলা এই রণ। এতোদিন বিদেশ আছিলো। পড়ালেখার ধার ভালো। কি পুরস্কার পাইছে জানি। ছয়মাস মতো দেশে আইছে। এলাকার ছেলে, বাপের নামধাম ভালো, সবাই এখনো একনামে চিনে ওর বাপকে। এইজন্য আপা তারে মনোনয়ন দিছে। হয়তো ভাবছে নতুন মানুষ আপনিও নিজের মতো চালাইতে পারবেন।”
ইব্রাহিম সালিম বিস্ময়ের চুড়ান্ত হলেন-“কস কি? ওরা থাকে কই এখন?”
“ঢাকায় থাকে, শান্তিনগরে ওর নানার দেওয়া জমিতে বাড়ি করছে।”
“আচ্ছা, তাইতো বলি এলাকায় দেখি নাই কেন এতোদিন। হাসনাতের বাড়ি আছে না? ওইটায় কে থাকে?”
“ওই পুরান বাড়ি ভাইঙা দশতলা বিল্ডিং হইছে। তার তিনতলায় আইসা থাকবে রন। পার্টির কাজ করব এইখানে থাইকা।”
সালিম বিস্ময় নিয়ে তুহিনকে দেখলেন-“তুই এতো কিছু জানোস কেমনে? তুই কি জানতিস ওর ব্যাপারে?”
তুহিন মাথা নাড়ে-“জানতাম না। ওই এলাকায় সবচেয়ে সুন্দর বাড়িটা এখন হাসনাত হামিদের। ওই বাড়ি দেইখা একদিন খোঁজ নিছিলাম। পরে কালকে মনোনয়নের ঘোষণার পর আবার একটু খোঁজ নিলাম।”
সালিম সাহেব চিন্তিত হয়ে পান চাবালেন কিছুক্ষণ। তুহিন তাকিয়ে আছে তার দিকে। হয়তো কিছু শোনার প্রত্যাশায়। সালিম সাহেব আনমনা হয়ে বললেন-“আপাকে এতো কাঁচা কাজের মানুষ মনেহয় না। ওকে মনোনয়ন দেওয়ার পিছনে কারণ নিশ্চয়ই আছে। আচ্ছা, এক কাজ কর তুহিন।”
তুহিন উৎসুক হলো-“কি কাজ?”
“ওর উপর নজর রাখ। সারাদিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা। কোথায় যায় কি করে সব নজরে রাখ।”
তুহিন সন্দিহান গলায় জানতে চাইলো-“আপামনির ব্যাপারে কি আপনার সন্দেহ হয়?”
সালিম সাহেব সন্তুষ্ট চিত্তে তুহিনকে দেখলেন-“তোর মতো আর কেউ বোঝে না আমাকে। কিছু বলার আগেই বুইঝা যাস কি কইতে চাই।”
তুহিন হাসলো-“সত্যি বলতে আমি কালকে ওর পিছনে লোক লাগাইছি। দেখি সে কি কয়।”
সালিম সাহেব কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে দেখলেন সালিমকে-“এইজন্যই তোরে ভালা পাই তুহিন। তুই একদম আমার মনের মতো।”
তুহিন স্মিত হেসে চুপ করে গেলো। সালিম সাহেব আবারও শুয়ে গেলেন। গতদিন মিটিং শেষ হওয়ার আগেই ফিরতে হয়েছে তাকে। মিটিং এর মধ্যে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায় আপা ডাক্তার ডেকে দেখান। ব্লাড প্রেশার বেড়ে বিচ্ছিরি অবস্থা। সাথে সাথে বাড়ি ফিরতে হয়েছে তাকে। কড়া সিডেটিভ দিয়ে ঘুমানোর ব্যবস্থা করা হয়। দিনদুয়েক আধো ঘুম আধো জাগরনে কাটানোর পর আজ শরীর কিছুটা ভালো বোধ করার তুহিনকে নিজের কামড়ায় ডেকে নেয়।

রণ ছেলেটার সব শোনার পরও মনটা খচখচ করছে। ছেলেটা মিটিং এর মাঝে দুই একবার তাকিয়েছিল তার দিকে। সেই দৃষ্টিতে কি হেলা ছিল? কেন যেন রণ ছেলেটা মাথা থেকে যাচ্ছে না।

★★★

পুরো বাড়ির বাতি জ্বলে উঠতেই শুভ্রা চোখের উপর হাত দিলো।
“আরেহ, আপনি তো দেখি বেশ সাহসী মেয়ে। একদম ফিট আছেন।”
রণর গলা শুনেও শুভ্রা হাত সরায় না। রণ কয়েকটা প্যাকেট এনে টেবিলের উপর রাখলো। শুভ্রা ক্লান্ত গলায় বললো-“এখানে এসেছি কতদিন হলো?”
দু’সপ্তাহ হয়নি এখনো।”
“আর কতদিন থাকতে হবে?”
“এখনো বলতে পারছি না।”
শুভ্রা ধীরে ধীরে হাত সরায়। আলোতে চোখ মেলতে কষ্ট হচ্ছে তার। ক্ষীন কন্ঠস্বরে জানতে চাইলো-“আমাকে কি জীবিত মায়ের কাছে যেতে দেবেন নাকি মে/রে ফেলবেন?”
রণ মৃদু হাসি মুখে নিয়ে তাকিয়ে আছে। শুভ্রার মুখের বিস্বাদ তাকে স্পর্শ করলোনা। সে উৎফুল্ল কন্ঠে বললো-“আরেহ, কি বলছেন এসব? আমাকে বুঝি আপনার খু/নি মনেহচ্ছে? আমার কাজ হয়ে যাওয়ার পর আমি নিজে আপনাকে মুক্তি দেব। একদম ভাববেন না।”
শুভ্রা রণর দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে থেকে বললো-“একজন মেয়েকে একদম অন্ধকারে আঁটকে রেখে আপনি কি প্রমান করতে চাইছেন আমি জানি না। তবে যা করছেন খুব খারাপ করছেন।”
রণ ভাবলেশহীন তাকিয়ে থেকে উচ্চস্বরে হেঁসে দিলো। শুভ্রার চেহারায় বিরক্তি। নিস্তব্ধ ফ্লাটে রণর হাসি বড্ড কানে লাগে বলে সে কানে হাত দিলো-“প্লিজ আস্তে হাসুন কানে লাগছে।”
রণ হাসি বন্ধ করে-“আমেরিকার কি করতেন আপনি? পড়ালেখার সময় বাদে? জব করতেন কোন? টাকা তো আপনার বাবা পাঠাতো। কাজেই জব করতেন না। কি করতেন তবে? পাবে যেয়ে নতুন বয়ফ্রেন্ড বানানো, নাচানাচি, ঢলাঢলি। খুব জম্পেশ লাইফ কাটিয়েছেন তাই না?”
শুভ্রা কড়া গলায় জবাব দিলো-“দ্যাটস নান অফ ইয়োর বিজনেস। আপনার কোন ক্ষতি তো করিনি। আপনি কেন আমাকে নিয়ে এতো বদার হচ্ছেন?”
“আমি আপনাকে নিয়ে মোটেও বদার না। প্লিজ নিজেকে এতো ইমপর্টেন্ট ভাববেন না।”
“তাহলে কি অন্য কারো রোশ আমার উপর ঝাড়ছেন?”
রণ এবার বিরক্ত-“আজ এতো ওলটপালট বকছেন কেন? তিনদিন অন্ধকারে থেকে পাগল হয়ে গেলেন নাকি?”
শুভ্রা ভাঙবে তবু মচকাবে না-“পাগল হইনি তা বলবো না। আমি আসলে আর পারছি না। কোন দোষে দোষী হয়ে এই সাজা পাচ্ছি সেটাতো বলবেন?”
রণ শুভ্রাকে দেখলো খানিকক্ষণ। মেয়েটার চোখের নিচে কালি পড়েছে। মুখটা শুকনো হয়ে আছে। চুলে চিরুনি পড়েনি ক’দিন বোঝাই যাচ্ছে। মুখটা ফ্যাকাসে লাগছে দেখতে। প্রচন্ড ভয় পেয়েছে বোঝা যাচ্ছে। মুহুর্তের জন্য মনটা নরম হলো রণর। তারপরেই আবার ওর বাবার কথা মনে হয়ে কঠোর হলো।
“খাবার এনেছি আপনার জন্য। দ্বিতীয় চ্যালেন্জ পাস করেছেন সেই উপলক্ষে। আপনার পছন্দের খাবার।”
শুভ্রা খাবারের প্যাকেট খুলেও দেখলো না। রণর দিকে তাকিয়ে বললো-“তাহলে দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দিন। আমাকে কেন তুলে এনেছেন?”
“কারনটা আগেও বলেছি এখন আবার বলছি। বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে আপনাকে অপহরণ করেছি। উদ্দেশ্য সফল হলে আপনাকে ফিরিয়ে দেব।”
“উদ্দেশ্যটা কি সেটাই জানতে চাইছি।”
রণ আবার পুরনো রুপে ফিরে এলো-“জানানোর হলে আগেই জানাতাম। শুধু শুধু এনার্জি ক্ষয় করবেন না। যতটা প্রয়োজন ততটা জানুন। আপনার জন্য সেটাই মঙ্গল হবে। আসছি আজ।”
শুভ্রা এবার আঁতকে উঠলো-“প্লিজ যাবেন না। গত তিনদিন হলো ঘুমাই না। গোসল হয় না। আপনি কিছুক্ষণ থাকুন প্লিজ। গোসল সেড়ে ঘন্টাখানিক ঘুমিয়ে নেই। তখন না আপনি চলে যাবেন।”
রণ কেন যেন শুভ্রার নিরীহ আবদার ফেলতে পারে না। মাথা ঝাঁকিয়ে বললো-“আচ্ছা, আমি বসছি কিছুক্ষণ।”
শুভ্রা ধীর পায়ে উঠে গেল। রণ একপলক দেখে সোফার গা এলিয়ে দিলো। আজ রাতে মিটিং আছে ওর নির্বাচনী প্রচারনা টিমের সাথে। কিছু বর্ষীয়ান নেতা উপস্থিত থাকবে সেখানে। কাল আবার ফিরতে হবে নির্বাচনী এলাকায়। নানা ভাবনা ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত রণ ঘুমিয়ে পড়লো।

খট করে আওয়াজ হতেই রণ চমকে উঠে বসলো। বুঝতে চাইলো কোথায় আছে সে। বোঝার সাথে সাথে দৌড়ে রুমে গেল। যা ভেবেছিল তাই। রুমে শুভ্রা নেই। পাশের রুমে ঢু মেরে দেখেই বাইরের দিকে ছুটলো। বাসার চাবিটা শার্টের বুকপকেটে ছিল। সেটা জায়গায় নেই। রান্না ঘরের দরজার দিকে ছুটলো রণ। দরজাটা হাঁট করে খোলা। রণর বুক ধক করে উঠলো। মেয়েটা পালিয়ে গেল শেষ পর্যন্ত? কি হবে এখন? কেন সে ঘুমিয়ে গেল? তার বোঝা উচিত ছিল ওর বাবা কে?

চলবে—
©Farhana_Yesmin

দর্পহরন পর্ব-৬+৭

0

#দর্পহরন
#পর্ব-৬

“রণ হোয়াট?”
শুভ্রা ধমকে উঠলো-“আগে পরে কিছু নেই? আমি কি আপনাকে চিনি? আমাকে তুলে এনেছেন কেন? আমার সাথে কি শত্রুতা? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন আপনি জানলেন কি করে আমি সেদিন দেশে এসেছি?”
একের পর এক প্রশ্ন শুনে রণ হেসে দিলো। তার সেই প্রানখোলা হাসি দেখে শুভ্রা থমকালো। মুগ্ধ দৃষ্টিতে রণর দিকে চাইলো। আজ খেয়াল করলো হাসলে ছেলেটার বা গালে টোল পড়ে, চোখ দুটো তারার মতো জ্বলজ্বল করে। কত উচ্চতা হবে ছেলেটার? পাঁচ এগারোর কম না। একটু নড়াচড়া করলেই শার্টের উপর দিয়ে সুগঠিত দেহের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। হাতের ঘড়ি আর পায়ের জুতোজোড়ায় সৌখিনতা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। রণ অবশ্য শুভ্রার মুগ্ধতা আমলে নিলো না। সে হাসতে হাসতেই বলে-“কিডন্যাপ আপনি হয়েছেন না আমি? আচ্ছা বেশ, আপনার প্রশ্নের উত্তরগুলো ধীরে ধীরে দেব আমি। তবে তারজন্য শর্ত আছে আমার। শর্ত যাইহোক যদি রাজি থাকেন তাহলে উত্তর পাবেন।”
শুভ্রা আগের মতোই তেজদীপ্ত ভঙ্গিতে জানতে চাইলো-“কিসের শর্ত? কোন শর্ত টর্ত মানতে পারবোনা।”
রণ গম্ভীর হলো-“ভেবে বলুন। চারদিনের বেশি হলো পেটে দানা পড়েনি। আর কয়দিন না খেয়ে থাকতে পারবেন?”
শুভ্রা ঢোক গিললো। সত্যিই তার খিদে পেয়েছে। পেট এতোটাই ফাঁকা যে ‘খেতে দে’ বলে রীতিমতো হুমকি দিচ্ছে। শুভ্রার অবস্থা দেখে রণ মুচকি হাসে-“তাছাড়া এই যে ওষুধ খেয়ে গলার ব্যাথা টের পাচ্ছেন না কথা না শুনলে সে সুবিধাও কেড়ে নেব। আমার সুন্দর কথায় পটে যাবেন না। কাজের বেলায় আমি কতোটা নিষ্ঠুর সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে বাকী নেই?”
কথাটা যেন মরিচের ঝাল গেলার মতো কষ্ট দিলো শুভ্রাকে। তার গালের রং পরিবর্তন হলো দ্রুত। রণ আজ প্রথমবারের মতো মাথা নিচু করে থাকা মেয়েটাকে ভালোমতো দেখলো। ফর্সা গায়ের রং এ নিটোল মুখ। খাঁড়া নাক আর পাতলা ঠোঁট নিখুঁত হলেও চোখদুটো খানিকটা চাকমাদের মতো বলে অন্যদের চাইতে আলাদা লাগে। মাথা জুড়ে এলোমেলো একহারা চুল। আঁটোসাটো পোশাকে মেয়েলি শরীরের খাঁজগুলো একেবারে স্পষ্ট হয়ে ফুটে আছে। ও মেয়েটাকে দেখছে বুঝতে পেরে নিজের নজর সরিয়ে নিলো দ্রুত। শুভ্রার মন খারাপ বুঝেই কোমল কন্ঠে বললো-“শুনুন, আপনাকে আবারও বলছি আপনার সাথে কোনরকম খারাপ ব্যবহারের কোন ইচ্ছে আমার নেই। যে কারনে আপনাকে তুলে এনেছি সেই প্রয়োজন মিটে গেলে আপনাকে স্বসম্মানে ফিরিয়ে দেব। প্লিজ কোঅপারেট করুন।”
শুভ্রাও নিজেকে সামলে নিয়েছে ততক্ষণে। মুখরা মেয়ের মতো বলে উঠলো-“কতটা ভালো ব্যবহার করবেন সে দেখা হয়ে গেছে আমার।”
রণ কৌফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বললো-“কালকের ঘটনায় আপনি একশোভাগ দোষী। ইচ্ছে করে প্ররোচিত করেছেন আমাকে। খারাপ ব্যবহারে বাধ্য করেছেন।”
রণর কথায় দাঁতে ঠোঁট কামড়ে ধরে শুভ্রা। শরীরে হাজার সুই ফুটলো। ছোট বেলা থেকেই ঝাল খেতে পারে না সে। এইজন্য কত মজার মজার বাঙালি খাবার সে খায় না। ভাইবোনগুলো এ নিয়ে তাকে কত খেপায়। কিন্তু আসলেই সে পারে না ঝাল খেতে। আর এই লোক কিনা তাকে আস্ত এক বাটি মরিচ খাইয়েছে। অপমানে কানটা গরম হয়ে উঠলো তার। পরক্ষণেই দ্রুত নিজেকে সামলে নিলো। এই ছেলেকে কিছু বুঝতে দেবে না সে। সব মনে রাখবে শুভ্রা, কিছুই ভুলবে না। হিসেব তোলা থাকলো। সময়মতো জবাব দেবে শুধু। গম্ভীর মুখে রণর দিকে তাকিয়ে বললো-“কি করতে হবে আমাকে?”
শুভ্রার মুখ দেখে মনোভাব পড়তে ব্যর্থ হলো রণ। তবে মুখের কথায় সন্তুষ্ট হলো। চেহারার স্বাভাবিক হাসি ফিরে এলো-“এইতো গুড গার্লের মতো কথা বললেন। তাহলে কাজে নেমে পড়ুন। দেখি শর্ত কতটুকু পূরণ করতে পারেন।”
শুভ্রা গম্ভীর হলো-“শুনুন, আমি হোষ্টেলে থেকে বড় হওয়া মেয়ে। প্রয়োজনে সব কাজ করতে পারি।”
“রিয়েলি! আচ্ছা তাহলে প্রথম চ্যালেন্জ দিয়ে দেই আপনাকে। দেখি ফিলআপ করতে পারেন কিনা।”
শুভ্রা সন্দিহান দৃষ্টি নিয়ে চাইলো। রণ মুখটা হাসি হাসি করে বললো-“তিনঘণ্টা সময় আপনার হাতে। পুরো বাড়ি পরিস্কার করতে হবে।”
শুভ্রা একইরকম ভাবে তাকিয়ে থেকে বললো-“বিনিময়ে আমি কি পাবো?”
“একটা প্রশ্নের উত্তর।”
শুভ্রা মাথা নাচালো-“উহু, পোষাবে না। আরও কিছু চাই আমার।”
রণ ভ্রুকুটি হেনে জানতে চাইলো-“আর কি চাই?”
“পেট পুরে খেতে চাই। ভাত খাওয়াতে হবে নিজের হাতে রান্না করে।”
শুভ্রার আবদার শুনে মানা করে না রণ-“ঠিক আছে। আপনাকে ভাত খাওয়াবো। কাজ শুরু করুন।”
শুভ্রা সাবধানে পা ফেলে উঠে দাঁড়ায়। এগিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এলো রণর কাছে-“এখন রাত না দিন? বাসায় ঘড়ি নেই সময় বোঝার উপায় নেই।”
রণ গম্ভীর হলো-“সময় জানার দরকার কি আপনার?”
শুভ্রা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে চলে গেলো। এই ছেলেটা আচ্ছা ত্যাদর। যেটা বলবে না সেটা নিয়ে প্রশ্ন করাই বৃথা।

★★★

গতকাল মা আর চাচা চলে যাওয়ার পর তুলতুলের আশ্রয় হয়েছে ভেতর বাড়িতে সোহেলের কামরায়। অবাক ব্যাপার হলো সোহেলকে সারারাতে একবারও দেখা যায়নি এ রুমে। তুলতুল অবশ্য অপেক্ষাও করেনি তার জন্য। আসলে অপেক্ষা করার মতো পরিস্থিতি ছিল না ওর। সোহেলের উপর্যুক্ত অত্যাচারে তুলতুলের শরীরের অবস্থা নাজুক। জ্বর আর ব্যাথায় প্রান ওষ্ঠাগত। তাই রাতে সে ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে গেছিল। সকাল দশটা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে। ঘুম ভেঙেছে কাজের মেয়ের ডাকে।
“আম্মা আপনাকে ডাকে।”
সদ্য ঘুম ভাঙা তুলতুল না বুঝে জানতে চাইলো-“কে আম্মা? কে ডাকে?”
কাজের মেয়েটা কিঞ্চিত বিরক্ত হলো-“আপনার শাশুড়ী ডাকে। তাড়াতাড়ি আসেন। আর বলছে ভালোমতো তৈরি হয়ে আসতে। মেকাপ কইরা আপনের মুখের দাগ ঢাকতে কইছে। বাইরে মেহমান আছে হেরা জানি কিছু না বোঝে। এই যে কাপড় রাইখা গেলাম।”
তুলতুল দেখলো একটা দামী শাড়ী সাথে গহনার বক্স রাখা। তুলতুলের ইচ্ছে হলো সব ছুড়ে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে কানতে। দু’দিন আগেও তার জীবনটা কতটা আনন্দে পূর্ণ ছিলো আর আজ মনে হচ্ছে অভিশপ্ত জীবন তার। কি থেকে কি হয়ে গেলো। সমাজের চোখে তার পরিচয় শুরুতে ধর্ষিতা তারপর এখন একজন ধ/র্ষ/ক আর খুনীর স্ত্রী। ঘৃনায় শরীর রি রি করে ওঠে। নিজের শরীরটাকে ভীষণ অচ্ছুৎ লাগে। কোনভাবে যদি সোহেলের স্পর্শ মুছে দেওয়া যেত। তুলতুলের বুকটা হুহু করে ওঠে। কান্নার দমকে হিঁচকি ওঠে।

পরক্ষনেই কালকে ইব্রাহিম সালিমের বলা কথাগুলো কানে বাজলো। লোকটা সোজাসাপ্টা হুমকি দিয়েছে কালকে-“ভালোয় ভালোয় বিয়ে করে এই বাড়ির ভদ্র বউ হয়ে থাকো। বাপকে আগেই হারাইছো এখন তোমার কারনে তোমার মা ভাই আর চাচার জীবন সংকট হবে। তোমার ভাগ্য ভালো যে তোমার সাথে আমার পোলার বিয়া দিতাছি নাইলে এতোক্ষণে গাঙে ভাসতা।”
ভয়ে তুলতুলের শরীর কাঁপে। দ্রুত বিছানা থেকে নামে। বাথরুম থেকে পরিস্কার হয়ে এসে কাপড় পরে নিলো। গায়ে গহনা চরিয়ে চুলগুলো হাতখোপা করে মাথায় শাড়ির আঁচল তুলে দিল। বাইরে পা বাড়াবে এমন সময় সোহেল ঘরে ঢুকলো। চোখ দুটো টকটকে লাল। মাথার চুল উসকোখুসকো। ভয়ে তুলতুলের হাত পা কাঁপে, মাথা থেকে কাপড় খসে পড়ে। তুলতুল কয়েক কদম পিছিয়ে গেল। সোহেল তুলতুলকে এক পলক দেখলো। মাথায় আগুন ধরে গেল তার তুলতুলকে দেখে। এই ফকিন্নিকে কিনা বিয়ে করা লাগলো শেষমেষ। যাকে একবার ঘেটে ফেলছে তাকে প্রতিদিন দেখবে চোখের সামনে এটা ভাবলেই তার মুখ বিস্বাদ হয়ে ওঠে। তুলতুলকে তাই মুখ খিচিয়ে গালি দিলো-“ওই মা/গী শোন, বাইরে যাইয়া যদি কিছু উল্টা পাল্টা কিছু কইছোস তাইলে আইজকাই তোর জীবনের শেষ দিন। বুঝছোস?”
তুলতুল কাঁপছে ঠকঠক করে। এরমধ্যেই সে কিছু না বুঝে মাথা দুলালো। সোহেল রণমুর্তি হয়ে এগিয়ে এলো ওর দিক-“কেউ কিছু জিগাইলে কবি তুই খুব ভালা আছোস এইখানে। ঠিক আছে?”
তুলতুল আবারও মাথা দুলালো। ওর মাথা দুলানো দেখেই মনেহয় সোহেলের মেজাজ আরও খারাপ হলো-“মাথা নাড়োছ কেন হুদাই? বা/ড়ি দিয়া মাথা ফা/টা/য় দিমু কইলাম।”
তুলতুল ভয়ে মুর্তি বনে গেল। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে দেখে সোহেলের মেজাজ আরও খারাপ হলো-“আবার খাম্বার মতো খারায় রইছে। যা বাইরে যা।”
তুলতুল কাঁপা হাতে মাথায় ঘোমটা টানে। এগুতে গিয়ে বাঁধা পেল-“এই শোন, মুখে হাসি আন। এমন ম/রা মানুষের মতন মুখ কইরা রাখছোস কেন? হাস, হাসি মুখে যা।”
তুলতুল হাসার চেষ্টা করলে মুখের আদল কান্নার চাইতেও খারাপ দেখালো। সোহেল বিরক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো।

বড় ড্রয়িংরুমে নিয়ে আসা হলো তুলতুলকে। রিমা ওকে নিয়ে এলো। কয়েকজন লোক বসে আছে ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন হাতে। ইব্রাহিম সালিমও বসে আছেন ওখানে। তুলতুলকে রিমা নিচু স্বরে কিছু বলতেই তুলতুল সালিম সাহেবকে সালাম দিলো।
“বসো বউমা। এনারা বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিক। যা যা জানতে চায় বলো এনাদের।”
তুলতুল আগা মাথা কিছু না বুঝে মাথা দুলায়। ও বসা মাত্রই একজন প্রশ্ন করলো-“মিসেস তুলি, বিয়েটা কি আপনার ইচ্ছায় হয়েছে নাকি জোর করে তুলে এনে বিয়ে করেছে? আপনারা কি পূর্ব পরিচিত? যে ভিডিও ফুটেজ লিক হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে আপনাকে জোর করে তুলে নেওয়া হচ্ছে। কোনটা সত্যি?”
তুলির হাত পা ঘামতে শুরু করেছে। সে হতবিহ্বল হয়ে একবার রিমা আর একবার সালিম সাহেবের দিকে তাকাচ্ছে। কি বলবে কি বলবে না সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে তার। গরম লাগছে ভীষণ। তুলতুলের মনেহলো তার মাথা দিয়ে আগুন বের হচ্ছে। ঠিক সেই সময় সোহেলকে দেখা গেলো। ধবধবে সাদা রঙের পাঞ্জাবি পরে মুখে হাসি নিয়ে সে তুলতুলের পাশে বসলো। ওকে একহাতে জড়িয়ে নিয়ে গদগদ কন্ঠে বললো-“আরে, তুমি চুপ করে আছো কেন বউ? সাংবাদিক ভাইয়েরা যা জানতে চায় তা বলো। বলো কেন আমি তোমাকে তুলে আনলাম। বলো সত্যিটা। তোমার সাথে যে আমার সম্পর্ক আছে আর সেটা তোমার পরিবার মানবে না তা বলে দাও। তোমার আম্মা অন্য জায়গায় তোমার বিয়া দিয়ে দিবে। আমি গুন্ডা মাস্তান তাই আমার সাথে বিয়া দিবে না। তুমিও মায়ের কথা মেনে নিয়ে আরেক জায়গায় বিয়ে করতে রাজি হইছো। এইটা কি প্রেমিক হয়ে আমি মেনে নিতে পারি না নেওয়া উচিত? তাই বাধ্য হয়ে আমাকে এই কাজ করতে হইছে। বলো ঠিক কিনা? বলো বলো।”
তুলি সোহেলের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। একটা মানুষ এতো সুন্দর করে মিথ্যা গল্প সাজাতে পারে সেটা সোহেলকে না দেখলে বিশ্বাস করতো না কিছুতেই। আর এতো নিখুঁত অভিনয় কিভাবে পারে? এরকম নিখুঁত অভিনয় আর মিথ্যে গল্প সাজিয়েই কি এই গুন্ডা আর ওর বাবাটা দিনকে রাত আর রাতকে দিন প্রমান করে? এভাবেই কি সত্যকে অন্ধকার প্রকোস্ঠে পাঠিয়ে মিথ্যেকে প্রজ্জলিত করে?

চলবে—
© Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-৭

ইব্রাহিম পরিবার এখনো যৌথ পরিবারের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। যৌথ পরিবার বলতে সালিম সাহেবরা তিন ভাই একত্রে থাকা আর কি। বাবা গত হওয়ার পর মা বিছানাগত। এতোদিন ইব্রাহিম মোর্শেদের স্ত্রী এ বাড়ির বড় বউ মিনু পরিচালনা করতো সংসার। রিমা তার সাথে সাথে থাকতো। গত মাসখানেক সে কানাডায় তার বড় মেয়ের কাছে গেছেন। মেয়ের বাচ্চা হবে সেই উপলক্ষে। তারপর থেকে রিমার উপর সংসারের দায়িত্ব চেপেছে।

এ বাড়ির বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে দেশের বাইরে। মোর্শেদের এক মেয়ে যার বিয়ে হয়েছে বাড়ির কাছেই আর সালিমের ছেলে সোহেল বাদে দুই ভাইয়ের বাকী চার ছেলেমেয়ে দেশের বাইরে থাকে। কেউ পড়াশোনা করছে কেউ পড়া শেষে চাকরি করছে। তাদের কারো মধ্যেই দেশে ফেরার টান নেই কিংবা বলা যায় দেশে ফিরতে চায় না।

ইব্রাহিম সালিমের ছোট ভাই ইব্রাহিম তাহের এখনো ব্যাচেলর। বিয়ে করেনি, দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ায়, টুকটাক লেখালেখি করেন শখের বসে। কিছুটা আলাভোলা স্বভাবের মানুষটা বেশিরভাগ সময় ঢাকাতে নিজের ফ্লাটে নির্জনে থাকে। কালেভদ্রে বাবার তৈরি করা বাড়িতে আসেন। আসলে তিনি এই বাড়িতে এসে থাকতে পারেন না। দমবন্ধ হয়ে আসে তার। মনেহয় এ বাড়ির প্রতিটা ইট অভিশপ্ত। যে অন্যায় তার দুই ভাই করে তা স্বচক্ষে দেখা তার পক্ষে সম্ভব না। আবার ঠেকানোও সম্ভব না সম্পর্ক নষ্ট হবে এই ভয়ে তিনি এসব থেকে দূরে থাকেন। তার বৈরাগী জীবনে বেঁচে থাকার রসদ বলতে তার ভাইয়ের বাচ্চারা। এরা সবাই তাদের ছোট চাচাকে অত্যন্ত পছন্দ করে। তাদের জীবনের যাবতীয় সিক্রেট তাদের ছোট চাচা জানে।

সে জানা থেকেই তাদের মেঝ ভাইয়ের একমাত্র মেয়ে শারমিন শুভ্রা তাকে ফোন করেছিল সপ্তাহ খানেক আগে। দেশে ফিরবে সে বাবা মাকে না জানিয়ে। তার পঁচিশতম জন্মদিন সে বাবা মায়ের সাথে স্পেশাল ভাবে কাটাতে চায়। সেই হিসেবে তার ফ্লাইট ছিল দিন পাঁচেক আগে। তাহের ভাতিজীকে বরন করার সব প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু আসল সময়ে ভুলে বসে থাকলেন। যখন মনে পড়লো তখন শারমিনের ফ্লাইট ল্যান্ডের সময় পেরিয়ে গেছে বহু আগেই। তবুও ভাতিজীকে বারবার ফোন দিলেন। এয়ারপোর্টে এসে খোঁজ নিলেন কিন্তু কোন ভাবেই শারমিনের কোন হদিস পেলেন না। ভীষণ চিন্তিত হয়ে গেলেন তিনি। নানা জায়গায় ফোন করেও যখন কোন কুল কিনারা পেলো না তখন সত্যি সত্যি ভীত হলেন। গেল কোথায় মেয়েটা? বাড়িতে যায়নি তো? এটা ভেবেই
বাড়িতে ফোন দিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে ভাবির সাথে আলাপ করে বুঝলেন শারমিন বাড়িতেও যায়নি। এবার হাত পা ঘামতে শুরু করলো। ভাইকে ফোন দিয়ে জানাবেন সেই সাহস করে উঠতে পারলেন না সোহেলের ঝামেলা শুনে। কেন যেন মনে হলো সামনে বিরাট এক ঝড় আসতে চলেছে তাদের জীবনে। সেই ঝরে তার পরিবার লন্ডভন্ড হবে।

দুইদিন অপেক্ষা করলেন। হাজার বার শারমিনের নাম্বার ডায়াল করলেন। কিন্তু বন্ধ শুনতে শুনতে কান বন্ধ হওয়ায় উপক্রম। অবশেষে মনস্থির করে লন্ডনে থাকা শরীফকে ফোন দিলেন। সব ঘটনার বিস্তারিত জানালেন। শরীফ জানালো সে খবর নিয়ে জানাচ্ছে। পরেরদিন শরীফ যখন জানালো
শারমিনের ইউনিভার্সিটিতে উইন্টারের ছুটি শুরু হয়েছে। সে তেরো তারিখ রাতে ফ্লাইটে উঠেছিল। দুবাইতে ট্রানজিট ছিলো সাতঘন্টা। সেই হিসেবে পনের তারিখ সকালে তার বাংলাদেশে ল্যান্ড করার কথা। আজ আঠারো তারিখ। শারমিনের ফোন বন্ধ। শারমিন বাসায় যায়নি তাহলে গেছে কোথায়? কোথাও না গেলে শারমিনের সাথে কি হয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার আঁচ করে চাচা ভাতিজা দু’জনেই ঘামতে শুরু করেছে। দু’জনেই জানে, এই ঘটনা সালিম সাহেবের কানে গেলে কেয়ামত ঘটে যাবে। শরীফ চাচাকে অভয় দিল, সে রাতেই ফ্লাইটে উঠবে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে। বাবাকে এখনই কিছু জানাতে মানা করে। সে এসে বাবার সাথে কথা বলবে।

মাঝে আরও একদিন কেটে গেছে। শরীফ এলো বিশ তারিখ বিকেলে। তাহের শরীফকে নিয়ে ইব্রাহিম ভিলায় পা রখলো রাত এগারোটার কিছু পরে। ড্রয়িংরুমে বসে আছে সালিম, মোর্শেদ, সোহেল আর রিমা। সে ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে আঁচলে চোখ মুছছে। সালিমের ব্যক্তিগত সহচর তুহিন দাঁড়িয়ে আছে পাশে। সকলের চেহারা অন্ধকার, পুরো বাড়ি থমথমে। চাচা ভাতিজা দু’জনেই দু’জনকে দেখলো। ওদের ভেতরে ঢুকতে দেখে সকলেই অবাক হলো। বিশেষ করে শরীফকে দেখে। সালিম সাহেব বলেই ফেললেন-“তুমি হঠাৎ দেশে এলে? তোমাকে কে খবর দিলো?”
শরীফ সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে-“কিসের খবরের কথা বলতেছেন? আপনাদের সবার কি হয়েছে? মা কাঁদছে কেন?”
রিমা শরীফকে দেখে দৌড়ে এলো। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে এবার ডুকরে কেঁদে উঠলো-“ও শরীফ, শারমিনরে কে জানি অপহরণ করছে। তুইল্লা নিছে আমার শারমিনরে। ও আল্লাহ কি হইলো এইসব?”
শরীফ আর তাহের দু’জনেই চমকে উঠে একে অপরকে দেখলো।

★★★

একটু তন্দ্রা মতন এসেছিল রণর। মেয়েলি ডাকে চমকে উঠলো। সামনে সদ্য গোসল করে আসা শুভ্রা দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনে হাফ হাতা গেন্জি আর ঢিলেঢালা প্যান্ট। চুল থেকে এখনো পানি গড়িয়ে পড়ছে, মুখটা টলটলে হয়ে আছে। চোখ দুটো ম্রিয়মান। ফর্সা উন্মুক্ত বাহু নেশা ধরায়। রণ নজর সরিয়ে বললো-“আপনাকে এসব পোশাক পরতে নিষেধ করেছিলাম।”
শুভ্রা চেয়ার টেনে সামনে বসলো-“শুনুন, পোশাকটা একদম নিজস্ব পছন্দ আর আরামের ব্যাপার। কাজেই এ ব্যাপারে কারো কোন কথা বলা উচিত না। আপনি যেমন সুন্দর শার্ট প্যান্ট পরে আছেন এখন কেউ যদি আপনাকে শর্টস আর স্যান্ডোগেন্জি পরে থাকতে বলে তাহলে ভালো লাগবে বলেন?”
রণ জবাব দিলো না দেখে শুভ্রা পুনরায় বললো-“আপনার শর্ত অনুযায়ী কাজ শেষ করেছি। চেক করে নিন।”
“পরে করবো। এখন খেয়ে নিন।”
রণ খাবার প্লেটে বেড়ে শুভ্রার সামনে দিলো। আয়োজন খুব সামান্য। সাদাভাত, ডাল, ডিম ভাজি আর আলুভর্তা। শুভ্রা প্রায় হামলে পড়লো খাওয়ার উপরে। কিন্তু কয়েকগ্রাস খাওয়ার পরেই ওর রুচি নেমে গেলো। পেট মুচড়ে উঠলো। গলার ব্যাথাট বেশ ভোগাচ্ছে তাঁকে, শরীরও শীতে কাঁটা দিচ্ছে। মনেহচ্ছে আবারও জ্বর আসছে। সে হাত ধুয়ে উঠে পড়লো। রণ কিছুটা অবাক হয়ে জানতে চাইলো-“খাবেন না?”
“নাহ। গলাটা খুব ব্যাথা করে আর জ্বর আসছে আবার।”
রণ জবাব না দিয়ে খাবার গুছিয়ে রাখলো। শুভ্রা ওষুধ মুখে দিয়ে রণকে ডাকলো-“আমি তো আপনার শর্তে রাজি আছি। চেয়ারে বাঁধার প্রয়োজন আছে?
“আপনি চাইলে বিছানায় থাকতে পারেন।”
“ধন্যবাদ।”
রণ ফিরে আসতেই শুভ্রা ডাকলো-“শুনুন, আমার সময় কাটানোর কোন বন্দোবস্ত করুন। এভাবে থাকতে কষ্ট হয়। কখনো এমন বন্দী থাকিনি বুঝতেই তো পারছেন।”
রণর ভ্রু কুঁচকে গেলো-“টিভি তো নিজেই ভাঙলেন। অবশ্য থাকলেও যে দেখতে পেতেন এমন না।”
শুভ্রা বিরক্ত হলো-“আমাকে বরং কিছু বই এনে দিন।”
রণ জবাব দিলো না। শুভ্রা গায়ে কম্বল চেপে চোখ বুঝলো। আর চোখ খুলে রাখা সম্ভব হচ্ছে না তার পক্ষে।

মিহির খানিকটা গম্ভীর হয়ে আছে। রণ জানতে চাইলো-“কি হয়েছে?”
“ক্যালকুলেশন উলট পালট হয়ে গেলো না? ওই সাংবাদিকের মেয়েটাকে বিয়ে করবে এইটা তো বুঝি নাই।”
“আমি ভেবেছিলাম। ওনার পক্ষে সবই সম্ভব। তবে এই কাজ সে নিজের ইচ্ছায় করে নাই। দলের চাপে করেছে। না করলে খুব খারাপ ইমেজ হতো দলের। ওনার একার জন্য সার্বিকভাবে দল ক্ষতিগ্রস্থ হবে এটা কেউ মানবে না।”
রণর কথায় মিহির সন্তুষ্ট হলো। একটু গম্ভীর হয়ে বললো-“ভাই, এই কয়েকদিনে ওরা অন্য সব ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত ছিলো বলে এইদিকে নজর পড়ে নাই। এখন যখন জেনে গেলো সাবধান থাকা লাগবে। আর আপনের পরিচয় প্রকাশ হলে আরও বেশি ঝামেলা। আপনার উপর রিস্ক বাড়বে।”
“সমস্যা কি? তুই আছিস, রাজিব আছে, দিলশাদ আসবে। আরও কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী পেয়ে যাবো আশাকরি। সবচেয়ে বড় কথা স্বয়ং ফুপি আছে সাথে।”
মিহিরের গাম্ভীর্য কমলো না-“ভাই, মাঠে আপনার ফুপু কিছু করতে পারবে না এটা আপনিও ভালো জানেন। উনি অনেক বেশি খারাপ। এখন যা কিছু করতেছে তার জের তুলবে ভবিষ্যৎ এ নিশ্চিত থাকেন।”
“এইজন্যই তো ওনার সবচেয়ে দূর্বল জায়গাটা হাতে এনেছি। নির্বাচন পর্যন্ত নিশ্চিত আছি। তারপর কি হবে তখন দেখা যাবে। এতো ভাবিস না। আচ্ছা, এখন এসব বাদ দিয়ে বল আজকের আপডেট কি? চিঠি পাঠাইছিস?”
মিহির মাথা দুলায়-“হ্যা। সবাই চুপচাপ খুব বেশি চুপচাপ। যদি কেউ কোনভাবে টের পায়?”
মিহির চুপ করে গেল। রণ হাসলো-“টের পাওয়ার কোন উপায় আছে? পাঁচটা বছর ধরে প্রস্তুতি নিছি তাও যদি ঠিক মতো কাজ না করতে পারি তাহলে জীবন বৃথা। বাদ দে। এতো ভাবিস না। কাল আবার দলের মিটিং। দেখা যাক কি হয়। শুনতেছি পরশু নমিনেশনের ঘোষণা আসবে। শোন, তুই ওইদিকে একটু নজর রাখ। কি করে দেখ।”
“নজর আছে। এখনো কোন আপডেট নাই। ওরা হয়তো এমন কিছু কল্পনাও করে নাই। সারাজীবন যাকে ইচ্ছা তাকে তুলে নেওয়া মানুষকে যদি কেউ তুলে নেয় তাহলে সে কি করবে? আমার মনেহয় ওরা বুঝেই পারতেছে না কি করবে। শরীফ দেশে আসছে আজকেই।”
“ও জানলো কিভাবে?” রণ অবাক হলো।
“তা জানি না। না জানলে তো আসার কথা না। বাপকে দেখতে পারে না তবে বোনকে ভালোবাসে।”
রণ উঠে দাঁড়ায়-“আমি গেলাম। দেরি হইলে মা রাগ করবে।”
মিহির মাথা দুলায়। মিহির টের পেলো রণর চেহারায় দুশ্চিন্তার ছায়া।

চলবে—
©Farhana_Yesmin

দর্পহরন পর্ব-৪+৫

0

#দর্পহরন
#পর্ব-৪

তুলতুল ঘুমের মধ্যে বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে। ঠোঁটের কোন ক্ষতবিক্ষত, মুখের কয়েক জায়গা কালচে হয়ে আছে। দুই হাতের কবজিতে পাঁচ আঙুলের ছাপ স্পষ্ট। ওর জামাকাপড়ের র/ক্তের দাগ শুকিয়ে গেছে। রিমার খুব মায়া হলো মেয়েটাকে দেখে। গায়ের রং ফর্সার দিকে, চেহারাটা পুরাই পুতুলের মতো। এই মেয়েটার কি হাল করেছে তার ছেলে? বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠলো। কোন মায়ের বুকের ধন তুলে এনেছে কে জানে।

মেয়েটাকে দেখে কেন যেন নিজের মেয়ে শারমিনের কথা মনে এলো। সকাল থেকে হাজার বার ফোন দিয়েছেন মেয়ের নাম্বারে কোন খবর নেই। এর আগে কোনদিন এমন হয়নি। শারমিন সবসময় ফোন ধরে, ধরতে না পারলে পরে ব্যাক করে। এবারের মতো কয়েকদিন কথা না বলে থাকেনি আগে। রুমার ভীষণ চিন্তা হচ্ছে মেয়ের জন্য। তার চিন্তার কথা কার সাথে শেয়ার করবেন সেটাই বুঝতে পারছেন না। মেয়ের বাবা এখন নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার আর ছেলে নিয়ে চিন্তিত। রুমা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মেয়েটার গায়ে হাত রাখলেন। সাথে সাথে মেয়েটা ধরমরিয়ে উঠে বসে দু’হাতে মুখ ঢেকে চিৎকার শুরু করলো-“না না না, প্লিজ কাছে আসবেন না। আমাকে মাফ করে দিন। আর কখনো এমন করবো না।”
রিমার বুকটা ধক করে উঠলো। সে বিচলিত হয়ে বললো-“মাগো, ভয় পাইয়ো না। আমি তোমাকে কিছু করুম না।”
তুলতুল মুখের উপর থেকে হাত সরিয়ে রিমাকে দেখলো। ভীত চাহুনি দিয়ে জানতে চাইলো-“আপনে কে? কি চান?”
রিনরিনে বাচ্চা বাচ্চা কন্ঠের কথাগুলো শুনে হাসলো রিমা-“কিছু চাই না। তোমারে তৈরী করতে আসছি। তোমার মা আসবে তোমাকে দেখতে।”
“মা! সত্যি মা আসবে? আমাকে নিয়ে যাবে? এখান থেকে নিয়ে যাবে আমাকে?”
বলতে বলতে কেঁদে দেয় তুলতুল। রিমার ইচ্ছে হলো মেয়েটাকে বুকে নিয়ে আদর করতে কিন্তু ইচ্ছেটা দমন করলো। বলতে চাইলো, এখানে কেউ একবার ঢুকলে খুব সৌভাগ্যবতী না হলে আর বেরুতে পারে না। কিন্তু বলতে পারলোনা। রিমা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে কোমল স্বরে বললেন-“এই যে এখানে কাপড় রাখা থাকলো। তুমি গোসল করে এগুলা পইরা তৈরি হও। আমি কিছুক্ষণ পর একজনকে পাঠাচ্ছি তোমাকে বাইর বাড়িতে নিয়ে যাবে। ঠিক আছে?”
তুলতুল জবাব দিলো না। রিমা দরজার দিকে যেতে গিয়ে আবার ফিরে এলো-“শোন মা, তুমি কিন্তু উল্টা পাল্টা কিছু কইরো না। এরা বাপ পোলা অনেক খারাপ। রাগ উঠলে কি থেকে কি করবে নিজেরাই জানে না। তুমি তৈরি হয়ে আসো। তোমার মায়ের আসার কথা আছে। দেখ কি করে।”
তুলতুল কঠিন মুখ করে বসে আছে। সে একবার কাপড়গুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করে। এই কাপড় পাঠানোর মানে কি? গতকালকে তুলে এনে রে/প করলো এখন কি করতে চায়? আর মা কেন আসছে এখানে? কি চায় ওরা? বাবার মতো তাকেও কি…। মায়ের সাথে শেষ দেখা করাতে চায় নাকি? তুলতুল হু হু করে কেঁদে দেয়।

★★★

দেবরের মুখেপানে উৎকন্ঠিত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে তুলতুলের মা তহুরা। গোলাম রাব্বানী ফোনটা কান থেকে নামাতেই তহুরা জানতে চাইলো-“রাব্বি, কি বললো ইব্রাহিম সালিম? আমার মেয়ে কোথায়?”
“ইব্রাহিম সালিম আমাদের তার বাড়িতে ডাকে ভাবি।”
পাশ থেকে রাব্বাীর বউ মিতা আঁতকে উঠলো-“না না ওর বাড়িতে যাওয়া যাবে না। আমার খুব ভয় করছে।”
রাব্বি বিরক্ত হলো-“আহ মিতা, শুধু শুধু ভয় পেয় নাতো। সামনে নির্বাচন আসছে। মনেহয় না এই মুহূর্তে ইব্রাহিম সালিম উল্টো পাল্টা কিছু করবে।”
“না না রাব্বি মিতা ঠিকই বলেছে। ওদের উপর কোন ভরসা নেই। তোমার ভাইকে কিভাবে দিনদুপুরে শেষ করে দিল দেখনি? মেয়েটাকে এতো করে বোঝালাম তবুও আমার কথা কানে তোলেনি। না জানি মেয়েটা এখন কি অবস্থায় আছে।”
বলতে বলতে ঝরঝর করে কাঁদে তহুরা। মিতা জায়ের পিঠে হাত রেখে স্বান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করে। রাব্বি গুম হয়ে থাকলো কিছুক্ষণ তারপর বললো-“আমি বলি কি ডেকেছে যখন যেয়ে দেখি কি বলে। যদি তুলতুলের কোন খবর পাই।”
“না প্লিজ তুমি যেয় না। আমার ভয় করে। ওদের ওপর ভরসা করা যায় কিছুতেই।”
রাব্বি মাথা নাড়ে-“উহু, এই মুহূর্তে আমাদের কিছু বলবে না ইব্রাহিম সালিম। তুলতুলের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, সাংবাদিকরা সরব। শুনেছি এবার নমিনেশন পাচ্ছে না ব্যাটা। মনেহয় না কোন ভুল করবে এখন। ভাবি, তুলতুলের খবর পেতে ওর আস্তানায় যেতেই হবে। এভাবে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলে কিছুই হবে না।”
তহুরা বললো-“ঠিক আছে তাহলে আমিও যাব তোমার সাথে।”
“মা, চাচ্চুর সাথে আমি যাবো। তোমার যেতে হবে না।”
তুলতুলের ভাই ফাহিম রুমে ঢুকলো। তহুরা আতঁকে উঠে বললো-“মাথা নস্ট হয়েছে তোর? ওই পাষন্ডদের কাছে তোকে কোনদিন যেতে দেব না। তোর বোন কথা না শুনে যা করেছে তাকি যথেষ্ট না? এখন তুইও ওর মতো বিপদ ডাকতে চাইছিস?”
ফাহিম বললো-“তুমি আর চাচ্চু যেতে চাচ্ছ, তোমাদের বিপদ হবে না?”
“হলে হবে। আমাদের বিপদ হলে তুই থাকবি সামাল দিতে। সবাই মিলে একসাথে বিপদে পড়ার কোন মানে নেই।”
“কিন্তু মা…”
তহুরা ফাহিমকে থামিয়ে দিলো-“আর কোন কিন্তু নয়। তুই যাবি না মানে যাবি না। কথা শেষ।”
রাব্বি মাথা দুলায়-“হ্যা ফাহিম মা যা বলছে শোন। তোর চাচী আর হিমি একা থাকবে, তুই ওদের সাথে থাক। আমি বরং হাফিজ ভাইকে ডেকে নেব আমাদের সাথে।”
মিতার কিছুতেই ইচ্ছে হচ্ছে না রাব্বিকে বাঘের গুহায় যেতে দেওয়ার কিন্তু মানা করবে সে উপায়ও নেই। তুলতুলে এ বাড়ির মেয়ে। তার বিপদে পাশে না থাকলে কি হবে? এমন বিপদ যদি হিমির হয় তাহলে? নিজের মেয়ের কথা ভেবে আরেকবার বুকটা ধ্বক করে উঠলো। তুলতুল বড্ড ভালোবাসে হিমিকে, হিমিও তুলতুলকে। কাল থেকে তুলতুলের কথা জানতে চেয়ে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছে হিমি। তুলতুলটা ভালো আছে তো? প্রশ্নটা মাথায় আসতেই মিতার ভয়ে কম্পমান বুক থেকে দীর্ঘ শ্বাস বেরুলো কেবল।

★★★

জ্ঞান ফিরে গতদিনের মত হাত পা খোলা পেল শুভ্রা। তবে আজ নিজেকে মেঝেতে আবিষ্কার করে অবাক হলো। তাহলে কি গতকাল ওকে বেঁধে রেখে যায়নি? মেঝে থেকে উঠতে যেয়ে টের পেলো হাত পা প্রচন্ড ব্যাথা। কোনরকমে উঠে ওয়াশরুম গেল। বেরিয়ে আসতেই দেয়ালে সাঁটানো চিরকুটে নজর গেলো। কৌতুহলে এগিয়ে এসে চিরকুটটা মন দিয়ে পড়লো শুভ্রা। সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা আছে-“নিজেকে মুক্ত পেয়ে খুশিতে আটখানা হয়ে আবার পালানোর পথ খুঁজবেন না। আপনার জন্য কিছু কাজ আছে আজ সেইজন্যই নিজেকে মুক্ত পেয়েছেন। ধরে নিন এটা আপনার দ্বিতীয় পরীক্ষা। কালতো ফেল করলেন আজ যেন ফেল না হয়। আজ আপনার টাস্ক হলো বাড়ি পরিস্কার করা। পুরো বাড়ি ভীষণ ময়লা হয়ে আছে খুব সুন্দর করে পরিস্কার করবেন। রান্নাঘরে চালডাল সবজি ডিম রাখা আছে। দু’জনার আন্দাজে রান্না করবেন। নিজে খাবেন আমার জন্য রাখবেন। আমি এসে কাজ দেখে আপনাকে নাম্বার দেব। কাজ না করলে বা ভালো না হলে কি সাজা হবে সেটা না হয় তখনই দেখবেন।”
শুভ্রার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। একে তো তাকে কিডন্যাপ করেছে তারউপর আবার ঢং দেখো তাদের। শুভ্রাকে দিয়ে কাজ করাবে? এই শুভ্রাকে দিয়ে? এতোবছর ধরে বাইরে কখনোই এসব করতে হয়নি তার। আর সে কিনা ঘর মুছবে? অনেক হয়েছে ভদ্রতা দেখানো। এবার সে দেখাবে কার মেয়ে সে। তারা মনেহয় চেনে না কাকে তুলে এনেছে। আজ হাড়ে মজ্জায় বুঝিয়ে দেবে কি তার পরিচয়।

শুভ্রা মেজাজ খারাপ করে রুম থেকে বেরুল। টেবিলের উপর পাউরুটির প্যাকেট দেখলো। জেলির বয়ামও আছে। দেখে খিদে পেয়ে গেলো। গোগ্রাসে দুতিন পিস পাউরুটি খেয়ে নিলো শুভ্রা। তারপর পুরো বাড়ি ঘুরে দেখলো। অদ্ভুত ব্যাপার হলো এ বাড়িতে জানালা নেই কোন। পুরো বাড়িতে বাইরের কোন আলো আসে না। দু’টো শোবার ঘর আছে একটা বড় হলরুম যেখানে একপাশে সোফা আর আরেক পাশে ছোট্ট টেবিল রাখা যেখানে সে বসে ছিল কিছুক্ষণ আগে। রান্নাঘরের দরজাটা লোহার, সম্ভবত ওপাশ থেকে তালা দেওয়া। শুভ্রা অনেক চেষ্টা করেও কিছু করতে পারলোনা। হাল ছেড়ে দিয়ে হলরুমে ফেরত এলো শুভ্রা। টিভি ছাড়লো তবে সেখানে নিজেকে দেখে চমকে উঠলো। দাঁতে নখ কেটে ভাবছে কেসটা কি। পরক্ষনেই বুঝতে পেরে বোকার মতো হাসলো সে। আচ্ছা, এই ব্যাপার? বাড়িতে সিসিটিভি লাগানো আছে? শুভ্রার বেশি কষ্ট করতে হলো না। হলরুমের একেবারে সামনে মাথার উপরে ক্যামেরাটা জ্বলজ্বল করছে। শুভ্রার মুখের উপর স্থির হয়ে আছে ক্যামেরাটা। শুভ্রার মনে হঠাৎ দুষ্ট বুদ্ধি উদয় হলো। সে বার কয়েক ভেংটি কাটলো ক্যামেরা বরাবর তাকিয়ে। সোফায় শুয়ে বসে রইলো কিছুক্ষণ। নাহ, জমছে না। শয়তানী করার জন্য মনটা আকুপাকু করছে। বদমাশ লোকটা তাকে আঁটকে রেখে মজা নেবে এটা কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না। কি মনে করে শুভ্রা বেডরুমে গেল।

প্রত্যেকটা ঘরে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো আছে। শুভ্রা নিজের লাগেজটা খুঁজে বের করলো। ওখান থেকে বেছে বেছে সবচেয়ে আঁটোসাটো গেন্জি আর প্যান্ট বের করে ওয়াশরুমে ঢুকলো। পরে বেরিয়ে এসে ক্যামেরার তাকিয়ে মুচকি হাসলো।

ক্যামেরার মুখোমুখি সোফায় শুয়ে পড়লো। টল ফিঙ্গার দেখিয়ে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করলো ক্যামেরার দিয়ে তাকিয়ে। মুখ ভাঙচি কাটলো কিছুক্ষণ, একসময় ক্লান্ত হয়ে সোফায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো শুভ্রা। কতোক্ষণ ঘুমিয়েছে জানে না, হঠাৎ গায়ে ঠান্ডা বরফের শীতল স্পর্শ পেতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। হতচকিত হয়ে দেখলো সামনে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা। শুভ্রা তাকানো মাত্র ওর গায়ে বরফ কুচি ছিটিয়ে দিলো। সে গা থেকে বরফ ঝেড়ে ফেলতে চাইলো-“এসবের মানে কি?”
ছেলেটা নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইলো। শীতল দৃষ্টি হেনে বললো-“আপনার সাথে ভদ্র আচরণ করছি বলে মনেহয় পুরো ব্যাপারটাকে ফান হিসেবে নিয়েছেন। আপনি হয়তো ভাবছেন আমরা আপনাকে ভিআইপি ট্রিটমেন্ট দেব। তাইতো আমার কথাগুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। ভাবছেন, আমাকে এরা আর কি করবে। তাই না?”
শুভ্রা কিছু বললো না। ছেলেটা হাসলো-“আপনার সব ভাবনার ট্রিটমেন্ট সাথে নিয়ে এসেছি আজ।”
“মমমমমানে?”
ছেলেটা হাসি গিলে নিলো-“মনে একটু পরেই বুঝবেন। আসেন টেবিলে বসুন।”
শুভ্রা ভয়ে পিছিয়ে গেল-“কেন টেবিলে বসবো কেন? আমি কিছু খাবো না।”
“আরেহ, ভয় পাচ্ছেন কেন? খাবার খেতেই বলছি।”
বলেই যে হাসিটা দিলো তাতে শুভ্রার পা দুটো দুলে উঠলো তুমুলভাবে। মন তীব্র ভাবে পালাতে চাইছে কিন্তু পা দু’টো মাটিতে আঁটকে আছে।
“বললাম তো খাব না। খিদে নেই আমার।”
রণ কঠিন চোখে তাকালো-“আমাকে কোন অশোভন কাজ করতে বাধ্য করবেন না মিস শুভ্রা। যদি বাধ্য করেন তাহলে খুব খারাপ হবে। নিজেকে কোথাও মুখ দেখানোর অবস্থায় খুঁজে পাবেন না।”
শুভ্রা চুপসে গেলো। এই ছেলেটাকে দেখলে মনেহয় সে সব পারবে। কথা না বাড়িয়ে রণর পিছু পিছু টেবিলে বসলো। রণ এক বাটি কাঁচামরিচ এগিয়ে দিলো-“এগুলো খেয়ে শেষ করুন।”
শুভ্রার গোল গোল চোখ দুটো যেন কোটর থেকে বেড়িয়ে আসবে-“কিহ! এতো মরিচ খাবো? পাগল পেয়েছেন আমাকে?”
“নাহ, সুস্থ মানুষ পেয়েছি তাই সুস্থ আবদার করেছি। কিন্তু আপনি তো সুস্থ না তাই আমার সব কথাকে পাগলামি মনেহয়। এখন ভদ্র মেয়ের মতো খেতে শুরু করুন।”
“খাব না আমি। আমার ঝাল সহ্য হয় না। আমি খেতে পারবোনা।”
রণ চুপচাপ নিজের মোবাইলটা বের করে শুভ্রার ভিডিও দেখালো-“ভাবছি আপনার বাবাকে ভিডিওটা পাঠাব। ইব্রাহিম সালিমের আদরের কন্যা কি করছে সে দেখুক।”
জবাব দিলো না শুভ্রা। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখলো, ওর পোশাক পরিবর্তনের ভিডিও আছে সেখানে। জিভ দাঁতে কাটে সে। ওই রুমে যে সিসিটিভি আছে ভুলে গেছিস তখন। উচিত ছিল ওয়াশরুমে যেয়ে কাপড় চেঞ্জ করা। কিন্তু তাই বলে ছেলেটা সেটার ভিডিও নেবে? লজ্জা করলো না একটা মেয়েকে এভাবে দেখতে? শুভ্রা রেগে গেলো-“লজ্জা নেই আপনার? একটা মেয়ের অজান্তে এভাবে ভিডিও করতে? দেখে তো ভদ্রলোক ভেবেছিলাম।”
রণ শান্ত দৃষ্টি হেনে মুচকি হেসে বললো-“আপনাকে কে বললো আমি আপনাকে দেখেছি? নিজেকে এতো বেশি ভাববার প্রয়োজন নেই। আর আমি ভদ্রলোকই কিন্তু আপনি ভদ্রমহিলা না। তা না হলে আমার কথা শুনতেন। আমাকে চ্যালেন্জ করতেন না।”
একটু থেমে রণ তাড়া দিলো-“তাড়াতাড়ি শুরু করুন। আমার দেরি হচ্ছে কিন্তু।”
শুভ্রা মাথা নাড়তেই রণ মোবাইল তুললো-“পাঠালাম তাহলে। ইউটিউবেও আপলোড করে দেই।”
শুভ্রাকে অসহায় দেখালো-“কেন এমন জরছেন বলুন তো? কি করেছি আমি?”
“কি করেছেন! আপনি জানেন না কি করেছেন? বারবার উল্টো পাল্টা আচরণ করে আমাকে রাগিয়ে দিচ্ছেন। আমি আপনাকে বলেছি, ভদ্র ভাবে থাকলে আপনাকে সুবিধা দেব, আপনি শুনছেন?”
রণ রেগে কথাগুলো বলে মরিচের বাটির দিকে ইঙ্গিত করলো-“এবার বুঝুন। আজ কোন মাফ হবে না। আশাকরি আজকের পর আর কখনো এমন কিছু করার চেষ্টা করবেন না।”
শুভ্রা এবার নরম হলো-“আমি ঝাল খেতে পারি না। এতগুলো মরিচ খেলে আমি মরে যাব। প্লিজ এমন করবেন না।”
রণ মোবাইল তুলে ভিডিও সেন্ড করতে গেলেই শুভ্রা মরিচ হাতে নিয়ে খেতে শুরু করলো। একটার পর একটা মরিচ খেয়ে যাচ্ছে। ঝালে মুখ পুড়ে যাচ্ছে তার কিন্তু থামলো না। রণ চেয়ারে হেলান দিয়ে আয়েস করে দেখছে তাকে। কিছুক্ষণ পর শুভ্রার চোখ দুটো থেকে জল গড়াতে শুরু করলো আপনাতেই। ক্রমান্বয়ে টকটকে লাল হয়ে যাচ্ছে চোখ দুটো। শুভ্রা পানি খেতে গেলো কিন্তু রণ ফট করে বোতল টেনে নিলো তার হাত থেকে। শুভ্রা হাসফাস করে উঠলো-“প্লিজ একটু পানি দিন।”
“তাড়াতাড়ি শেষ করুন।”
আদেশ করলো রণ। শুভ্রা হা করে নিশ্বাস নিচ্ছে। রনর নিষ্ঠুরতায় কান্না পাচ্ছে তার। তার নাক দিয়ে জল গড়াতে শুরু করেছে। অসহায় চাহুনি দিয়ে রণর দিকে তাকালো। রণ নির্বিকার। শুভ্রার কেন যেন জিদ চেপে গেল। সে আবারও মরিচ খেতে শুরু করেছে৷ তার মুখ, গলা, বুক, পেট সব জ্বলতে শুরু করেছে তবুও একের পর এক মরিচ খেয়ে যাচ্ছে। একসময় রণর মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সে বোতল এগিয়ে দিলো-“এরপর বাঁদরামো করতে মন চাইলে আজকের কথা ভাববেন।”
শুভ্রা ভেবেছিল পানিই খাবে না কিন্তু বোতল পাওয়া মাত্রই টেনে নিয়ে ঢকঢক করে পানি পান করতে লাগলো। এরপর শুরু হলো বমি। শুভ্রার সমগ্র শরীর যেন জ্বলে যাচ্ছে। বমি করতে করতে কান চেপে ধরলো সে। তাকে এই অবস্থায় রেখে বেড়িয়ে এলো রণ।

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-৫

সকালে বেরিয়ে বিকেলের দিকে বাড়ি ফিরেছেন ইব্রাহিম সালিম। সেই থেকে নিজের রুমে বসে আছেন। রিমা খাবার খাওয়ার জন্য কয়েকবার ডেকে গেছে কিন্তু তাকে নড়তে দেখা গেলোনা। মেজাজটা বেখাপ্পা রকমের খারাপ হয়ে আছে। চারিদিকের পরিস্থিতি তার বিপরীতে চলে গেছে। ইন্টারনেটে আজকের ভাইরাল ভিডিও সোহেলের মেয়ে তুলে নেওয়া। কয়েকটা পত্রিকায় তার নানা দুর্নীতি আর অনিয়মের রিপোর্ট এসেছে আজই। এইসবই কি কোইন্সিডেন্স নাকি সোহেলের কালকের কাজের রেশ বুঝতে পারছেন না। হুট করে চারিদিকে তাকে নিয়ে এমন শোরগোল শুরু হলো কেন? হতবিহ্বল লাগে তার। এদিকে পার্টির হাইকমান্ড থেকে ফোন এসেছিল। সব ঝামেলা অতিদ্রুত মিটিয়ে ফেলার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। সামনে ইলেকশন তাই দলের বদবাম হোক এমনটা তারা চায় না কিছুতেই। সব শুনে সাবেক এমপি বড়ভাই ইব্রাহিম মোর্শেদ তাকে মাথা ঠান্ডা রাখতে বলেছেন। ভাইয়ের পরামর্শে মনের বিরুদ্ধে গিয়ে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে তাকে। ভাবনার মাঝে সোহেল ঘরে ঢুকলো-“আব্বা, আপনের এই সিদ্ধান্ত মানতে পারুম না। বিয়ার সিদ্ধান্ত মানি না আব্বা। ওই ফকিরনি পুত্রীরে আমি বিয়া করুম না কোনমতেই।”
লাল টকটকে আঁখিদ্বয় খুলে ছেলেকে দেখলেন-“কি কইলি?”
সোহেল ঘাবড়ে গেল বাপের এমন রুপ দেখে। মিনমিনে গলায় বললো-“ওই মাইয়া, চিনি না জানি না ওরে বিয়া করুম না আব্বা।”
সালিম সাহেব চেয়ার ছেড়ে তেড়ে এলেন ছেলের দিকে-“তোরে আমি…”
মারতে যেয়েও শেষ মুহূর্তে হাত গুটিয়ে নিলেন। সোহেল ভয়ে চোখ বুজে আছে। সালিম সাহেব লম্বা একটা নিশ্বাস নিলেন-“তোর চাইতে তো শরিফ ভালো রে সোহেল। অন্তত ও আমার কোন ক্ষতি করে না। নিজের মতো জীবন বাইছা নিছে। তরে এতো আদর ভালোবাসা দিছি, ভাবছি তুই আমাদের বংশ উজ্জ্বল করবি। আমার যোগ্য উত্তরসুরি হবি। এখন দেখতেছি তুই আমাকে ডুবানোর তাল করছোস। আর তোর নিজের ভবিষ্যত অন্ধকার।”
শরীরে বিচুটি পাতা ডলে দিলে যেমন অনুভূতি হয় বাবার কথাগুলো তেমনই লাগলো সোহেলের কাছে। বাপের জন্য সে বিনাবাক্যে বহু অন্যায় করেছে ভবিষ্যতেও করবে। তাই বাপের মুখে অন্য কারো প্রশংসা ভালো লাগে না তার। সে নিশ্চুপ হয়ে রইলো। সালিম সাহেব ক্ষনকাল চুপ থেকে স্থিমিত কন্ঠে বললেন-“আপাতত বিয়া কইরা পরিস্থিতি ঠান্ডা কর। নির্বাচনের পরে বউরে রাখবি কিনা ঠিক করিস। আর ঝামেলা করিস না সোহেল। আমার কথা বুঝছোস?”
অনিচ্ছায় মাথা দুলায় সোহেল। ভীষণ রাগ হচ্ছে মেয়েটার উপর। ওই হা/রা/ম/জা/দি যে একটা কু/ফা সেইটা আগে বুঝলে কোনদিন এই ভুল করতো না সে। মনেহচ্ছে এখনই যেয়ে চুলের মুঠি ধরে পানিতে চুবিয়ে মা/র/তে। সোহেলের হাত নিশপিশ করে। সালিম সাহেব এগিয়ে এসে সোহেলের কাঁধে হাত রাখলেন-“মাঝে মাঝে জিতার জন্য হারতে হয় সোহেল। হারতে শিখ তাইলে জিততে পারবি। আর মেজাজটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে শেখ। যখন তখন মেজাজ হারাইলে তার পরিনতি এমনই হবে, বুজছোস?”
সোহেল একটু নরম হলো। বাবার দিকে তাকালো। সালিম সাহেব নরম গলায় বললেন-“তৈরি হয়ে যা। ওই মাইয়ার চাচা আর মা আসলে বিয়া হইবো তোদের। আপাতত কোনরকম মাথা গরম করবি না। ঠিক আছে?”
সোহেল ঘাড় হেলায়। সালিম সাহেব পিঠ চাপড়ে দিলো-“সাব্বাশ। যা এখন।”

★★★

তুলতুলের মা তহুরা, চাচা রাব্বানী আর ওর বাবার বন্ধু নতুন সূর্য পত্রিকার সাংবাদিক হাফিজ উদ্দিন সন্ধ্যার মুখে ইব্রাহিম নিবাসে পা রাখলো। নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে বন্দর থানার ওসিকেও ডেকেছিল তারা কিন্তু আনঅফিশিয়াল এই মিটিংয়ে উনি কিছুতেই থাকতে রাজি নন। আর কিছুদিন আছেন এই এলাকায়, কোন বিতর্কে যেতে চায় না বলে আসেননি। সালিম সাহেব কোন রাখঢাক না করেই তহুরাকে প্রস্তাব দিলো-“দেখেন আপা, আমার ছেলে একটা ভুল করে ফেলছে। আমি চাই এটা নিয়ে আর কোন উচ্চবাচ্য না হোক। আপনার মেয়েকে আমার বাড়ির বউ করতে চাই। তাহলে আপনার মেয়ে আর আমার পরিবার দুজনেরই সন্মান রক্ষা হবে।”
এমন প্রস্তাবে উপস্থিত তিনজনই ভরকে গেলো। এইরকম কিছু ইব্রাহিম সালিম বলতে পারে তা ওদের ধারণাতেও ছিল না। তহুরা আঁতকে উঠে আকুতি জানালো-“ভাই, আপনার কাছে করজোড়ে মিনতি করছি, আমার মেয়েটাকে ফিরায় দেন। বিয়ের কোন প্রয়োজন নাই। আমরা এলাকা ছেড়ে যাব মেয়ে নিয়ে।”
ইব্রাহিম সালিমের চোয়াল শক্ত হলো। মেজাজ এমনিতেই খারাপ তারউপর তহুরার কথা। মহিলা মনেহয় ভুলে গেছে কোথায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে। যে মেয়ে ভয় না পেয়ে প্রতিবাদ করে তাকে আর যাইহোক খোলা ছেড়ে দেওয়া যাবে না। ওই মেয়ে মোটেও চুপ থাকার মেয়ে না। ওর বাবাও এমন ঘাউড়া ছিল। বাবার রক্ত মেয়ের মধ্যেও জাগনা।
“আমি আপনার মেয়ের সন্মান রক্ষার চেষ্টা করতেছি আর আপনি উল্টা ভাবতেছেন। ভাবনার মিল না হইলে সমস্যা আপা। আপনার মেয়েকে এখন নিয়ে গেলে কি হবে বুজতেছেন? তারে জীবনে বিয়া দিতে পারবেন না। তাছাড়া আপনার মেয়ে আমার ছেলের কোন ক্ষতি করবে না তার গ্যরান্টি কি? শোনেন আপা, অতীত ভুলে যান নাই আশাকরি। মেয়ে বাঁইচা আছে তার বিয়া হইবো এরচেয়ে আনন্দ আর কি? আর কথা বাড়ায়েন না।”
ইব্রাহিম সালিমের কথার গভীরতা বুঝতে খানিকটা সময় লাগলো তহুরা। তার বুকটা হুহু করে উঠলো। মেয়েটার সাথে খুব খারাপ কিছু হয়েছে এটা বুঝতে আর বাকী নেই। তিনি অসহায় চাহুনি নিয়ে দেবরের দিকে তাকালেন। রাব্বানীর সাথে চোখাচোখি হলো। তাকেও বিভ্রান্ত দেখালো। এরকম বাঘের অরন্যে কে থাকতে চাইবে? কিন্তু এইমুহূর্তে তাদের প্রস্তাবে না করারও কোন উপায় নেই। ইব্রাহিম সালিম সময় নষ্ট করলেন না-“কিছুক্ষণের মধ্যে কাজি আসবে। আপনি আপনার মেয়ের সাথে কথা বলেন আপা। তাকে বিয়ের কথা বলেন। আমি কোন ঝামেলা চাই না আর। এমনিতেই নানা টেনশনে আছি। আশাকরি আমার পরিস্থিতি বুঝবেন।”
ইব্রাহিম সালিম উঠে দাঁড়ালেন। ঠিক ওই সময় তুলতুল ঘরে এসে ঢুকলো। তুলতুলকে দেখেই গা শিউরে উঠলো তহুরার। হৃদয়ে আর্তনাদ করে উঠলো। তার আদরের মেয়েটার কি হাল করেছে হায়েনাটা? তুলতুল ‘মা’ বলে চিৎকার দিয়ে দৌড়ে এসে মায়ের কোলে ঝাপিয়ে পড়লো। মা মেয়ের কান্নায় ইব্রাহিম নিবাসের ইটের দেয়ালেও যেন কাঁপন উঠলো। ইব্রাহিম সালিম রিমাকে ইশারা করেন সব সামলে নিতে।

ঠিক আধাঘন্টা পরে তুলতুলের তুমুল আপত্তি আমলে না নিয়ে সোহেলের সাথে তার বিয়ের কাজ শেষ হলো। নির্বাক তহুরা, প্রথমে স্বামী হারিয়ে আর আজ মেয়ে হারিয়ে। সে জানে তার মেয়ে আর বেশিদিন নেই এই পৃথিবীতে। হয়তো আজ থেকেই তার মৃত্যুদিন গোনা শুরু হলো।

★★★

খাবার টেবিলে অন্যমনস্ক হয়ে খাবার নাড়াচাড়া করছিল রণ। জলি সেটা লক্ষ্য করে বললেন-“কি হয়েছে রণ খাচ্ছিস না কেন বাবাই? খেতে ভালো লাগছে না?”
“তোমার বাবাই তো বাবু নিজ হাতে খেতে পারে না মা। তুমি খাইয়ে দিলে ঠিকই খাবে। তাই নারে খুশি?”
পাশের চেয়ারে বসে থাকা খুশিকে চিমটি দিয়ে হাসি মুচকি হাসলো। খুশি ফিকফিক করে হাসে-“তা আর বলতে? বুড়ো খোকা একেই বলে।”
জলি মেয়েদের দিকে তেড়ে গেলেন-“এই তোরা চুপ করবি? ছেলেটা সবসময় দূরে দূরে থেকেছে, ওকে খাইয়ে দেওয়ার সুযোগ পেলাম কোথায়? খুব হিংসুটে হয়েছিস তো?”
এতোকিছুর মধ্যেও রণকে কথা বলতে দেখা গেলো না। অন্য সময় হলে সে বোনদের সাথে সমান তালে খুনসুটি করতো। জলি ছেলের কাছে এগিয়ে এলো। রণ মাথা নাড়লো-“না মা, শরীরটা হঠাৎ খারাপ লাগছে।”
জলি উৎকন্ঠিত হয়ে এগিয়ে এসে ছেলের কপালে হাত রাখলেন-“জ্বর তো নেই বাবাই। তাহলে কি হয়েছে? কোন কারনে কি তোর মন খারাপ?”
মায়ের কথা শুনে রণ খানিকটা চমকে উঠলো-“এখন খেতে ইচ্ছে করছে না মা। আমি বরং শুয়ে একটু আরাম করি। পরে খিদে লাগলে তোমাকে বলবো।”
রণ হুট করে উঠে যাওয়াতে বোনেরাও একটু অবাক হলো। তাদের ভাইয়ের সত্যিই হয়তো খারাপ লাগছে না হলে ওদের সাথে কথা না বলে থাকে না রণ। রণ চলে যাওয়ায় জলি মেয়েদের সাথে গজগজ করছে-“সবসময় ভাইয়ের পেছনে লেগে থাকা। বলি তোদের কি কোন কাজ নেই? সারাদিন কত জায়গায় দৌড়ে আসে। বাসায় এসে তোদের জ্বালা।”
হাসি আর খুশি দুই বোন মুখচোখ কাচুমাচু করে খাওয়ায় মন দিলো।

রণ চোখের উপর হাত রেখে শুয়ে আছে। ঘুমানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। অশান্ত মনটা খচখচ করছে। জীবনে প্রথমবারের মতো বাবা মায়ের শিক্ষার বিপরীত কাজ করলো সে। সে জানে খুব খারাপ কাজ করেছে কিন্তু না করলেও চলছিল না। মেয়েটার অমন অসভ্যের মতো আচরণ মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল ওর। সন্দেহ নেই মেয়েটা ওর বাবা আর ভাইয়ের মতোই ডাকাবুকো। রণ শুধু এপাশ ওপাশ করে। ওইসময় ফোনটা এলো। রণ দেখলো স্ক্রীনে মিহিরের নাম ভেসে উঠেছে। দ্রুত বিছানায় উঠে বসলে সে-“বল মিহির।”
মিহিরের কথা চুপচাপ শুনলো রণ। খবরটা চিত্ত চন্চল করার মতোই কিন্তু সে শান্ত রইলো। ধীর কন্ঠে জানতে চাইলো-“দিলশান কবে আসবে এদিকে?”
ওপাশে মিহির কি বললো শোনা গেলো না। রণ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে-“আচ্ছা, ঠিক আছে। সময় তো বেশিদিন নাই। চিরকুটটা কালকে পৌঁছানোর ব্যবস্থা কর।”
ফোন নামিয়ে বিছানা থেকে নামলো রণ। ধীরে ধীরে শক্ত খোলসে আবৃত করে নিজেকে লৌহ মানব বানালেও মনের কোথায় যেন এই পথে চলতে সায় দেয় না। অথচ প্রতিদ্বন্দী খুব চালাক এবং হিংস্র। নিজের স্বার্থে হেন কাজ নেই করে না। এমন মানুষের সাথে লড়তে নিজেকে তার চাইতে খারাপ বানাতে হচ্ছে। প্রতিদ্বন্দীকে বশে আনতে তারই দেখানো পথে এগুতে হচ্ছে। মন অটল করলো রণ। যত যাইহোক এবার তাকে পারতেই হবে। বাবা যা পারেনি সে করে দেখাবে। দেখাতেই হবে। এই ভাবনায় মন কিছুটা শান্ত হলো। বুকের ভার কমলো খানিকটা। কালকে অনেক কাজ করতে হবে। তাই বিছানায় যেতে দেরি করলোনা আর।

★★★

শুভার রাতে জ্বর এসেছিল। হলরুমের টেবিলের উপর প্রয়োজনীয় ওষুধ পেয়ে গেলেও অবাক হওয়ার অনুভূতি কাজ করছিল না ওর। কোনরকমে জ্বরের ওষুধ খেয়ে সোফায় গড়িয়ে গেছে। সর্বাঙ্গ জ্বলে শেষ। গলা ছিলে গেছে, চোখ ফুলে একাকার। পুরো হলরুম জুড়ে বমির ঘ্রান কিন্তু শুভ্রা পরিস্কার করার পরিস্থিতিতে নেই। শরীরের তীব্র জ্বালা ধীরে ধীরে কমে এলে ঘুম নামতে চায় চোখে। কিন্তু ক্ষণে ক্ষণে ভয় পেয়ে উঠে বসেছে আবার শুয়েছে। রাতে একা একা এই ভুতুড়ে বাসায় থাকতে ভয় লাগছিল ওর। সেসব কথা শোনার কেউ নেই বলে চুপচাপ আবারও ঘুমানোর চেষ্টা করে। ভাবছে গত কয়েকদিন তাহলে ঘুমালো কি করে? ওকে কি ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছিল? নিজের ভাবনায় বিরক্ত শুভ্রা উঠে ঘরময় পায়চারি করে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দরজা জানালাগুলো চেক করে। কোথাও কোন ফাঁক দেখা যায় কিনা। পরে হাল ছেড়ে দিয়ে আবারও হলরুমে ফেরত আসে। কিছু না পেয়ে অলীক কল্পনার রাজ্যে পারি দেয়। এলোমেলো ভাবনায় ক্লান্ত হয়ে একসময় ঘুমের কোলে নুইয়ে পড়ে।

ঘুম কয়টার দিকে ভেঙেছে জানে না শুভ্রা। এ বাড়িতে কোন ঘড়ি রাখা হয়নি। গলার তীব্র জ্বলুনির সাথে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর। পেট খিদেয় চো চো করছে। শুভ্রা পাত্তা দিলো না। সে ফাঁকা পেটেই জ্বর আর ব্যাথার ওষুধ খেল। কেন যেন ভীষণ আক্রোশ তৈরি হয়েছে তার মধ্যে। বিদ্রোহের ইচ্ছে জাগছে। সে জবাব চায়। কেন তাকে এভাবে আঁটকে রাখা হয়েছে। কি চাই ওদের? গুমোট মাথা নিয়ে শুভ্রা তাকে বেঁধে রাখা ঘরে ফিরে গিয়ে আলমারির পুরো কাপড় এলোমেলো করে নিচে ফেলে দিলো। কাঁচের জিনিসপত্র ভাঙচুর করলো অকারণে। সবঘরের বিছানা তছনছ করলো। সবার শেষে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে টিভিটায় দিকে গ্লাস ছুঁড়ে মারলো। ঝনঝনিয়ে টিভি ভেঙে পড়লো। তবুও আক্রোশ কমলো না। তিনদিনের না খাওয়া শরীরে এতো শক্তি কোথা থেকে পেলো জানে না। অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে চিৎকার করলো। যদিও তার গলার স্বর শোনা গেল না খুব একটা। ফ্যাসফ্যসে কন্ঠে চিৎকার করতে কষ্ট হচ্ছিল তার। যখন শরীরের সমস্ত শক্তি শেষ হয়ে গেলো তখন যেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো।

ঘুম ভাঙতেই ছেলেটাকে তার সামনে দেখলো। ওর নড়াচড়া দেখেই বলে উঠলো-“মেঝেতে সাবধানে পা রাখবেন। কাঁচ ছড়িয়ে আছে পা কেঁটে যাবে।”
শুভ্রা সাবধানে উঠে বসলো। মাথাটা দুলে উঠলো ভীষণভাবে কিন্তু তা এই ছেলেকে বুঝতে দেবে না। সে ছেলেটার পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো জুতো পড়ে বসে আছে। শুভ্রার পুরনো মেজাজ ফিরে এলো। ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে বললো-“গরু মেরে জুতো দানের দরকার নেই আমার। এতো চিন্তা থাকলে ঘর পরিস্কার করে রাখতেন।”
ছেলেটা শুভ্রাকে দেখলো মন দিয়ে তারপর উচ্চ স্বরে হাসলো-“গুড জোকস। আমার জিনিসপত্র সব ভাঙবেন আপনি আর আমি সেগুলো পরিস্কার করবো যাতে আপনার পা না কাটে?”
শুভ্রা ঠোঁট টিপে বললো-“দরকার হলে তাই করবেন বৈকি।”
ছেলেটা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে ভ্রু নাচালো-“দরকার! তা দরকারটা কেন হবে?”
শুভ্রা তেরছা হাসলো-“আমাকে তুলে এনেছেন মানেই তো আমাকে দরকার আপনার। তাই না?”
ছেলেটার ভ্রু কুঞ্চিত হলো-“আপনি আবারও ভুল করছেন। আমার ভালো ব্যবহারকে দূর্বলতা ভেবে নিচ্ছেন। দেখুন আমি চাইলে আপনাকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পারিয়ে রাখতে পারি। কোন কষ্ট করতে হবে না আমার। কিন্তু আপনার কোন ক্ষতি করার আমার সত্যিই কোন ইনটেনশন নেই। আমার প্রয়োজন ফুরালেই আপনাকে মুক্ত করে দেব। ততদিন পর্যন্ত কষ্ট করে থাকতে হবে আপনাকে।”
শুভ্রা অটল গলায় বললো-“থাকবো কিন্তু নিজের পরিচয় দিন আপনি। কেন আমাকে তুলে এনেছেন কারণ বলুন। যুক্তিসংগত মনে হলে আমি চুপচাপ মেনে নেব।”
“সরি। কারন বলতে পারবোনা।”
“তাহলে আমিও ভালোমতো থাকতে পারবোনা। চাইলে আপনি আমাকে আরও মা/র/তে পারেন। মা/র/তে মা/র/তে মেরেও ফেলতে পারেন তাতেও লাভ হবে না।”
ছেলেটা অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইলো শুভ্রার দিকে। শুভ্রা সে দৃষ্টির মানে বুঝলোনা। কেমন যেন নিস্পৃহ ভাব। তবে শুভ্রাও হারবে না আজ। সেও তাকিয়ে রইলো ছেলেটার দিকে। অনেকটা সময় পার হওয়ার পর ছেলেটা মুখ খুললো-“আমি রণ।”

চলবে—
©Farhana_Yesmin

দর্পহরন পর্ব-০২+৩

0

#দর্পহরন
#পর্ব-২

শুভ্রার ঠিক বিপরীতে বসে আছে সে। গম্ভীর মুখ নিবন্ধিত আছে মোবাইলে। টমক্রজের স্টাইলে কাটা চুলগুলো মাঝে মাঝে হাত দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে শুভ্রাকে দেখে নিচ্ছিল। এরইমধ্যে ওকে নড়তে দেখে হাতের মোবাইলটা প্যান্টের পকেটে চালান করে সোজা হয়ে বসলো।

আধো আধো বোজা চোখ মেলতেই সুদর্শন যুবা পুরুষটিকে দেখে হচকে গেলো শুভ্রা। ঘোর ভেঙে গেল সহসাই। চোখ দুটো বিস্ফোরিত। ছেলেটার সাপের মতো শীতল দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে থাকতে দেখে ভয়ের শীতল একটা অনুভূতি শুভ্রার পিঠ বেয়ে নেমে যাচ্ছে। কোথায় আছে সেই প্রশ্ন মাথায় উঁকি দেওয়ার আগেই তলপেটে তীব্র চাপ টের পেয়ে ছটফটিয়ে উঠলো শুভ্রা। আওয়াজ করতে যেয়ে বুঝলো তার মুখ স্কচটেপ দিয়ে আঁটকানো। নড়তে যেয়ে তীব্র ব্যাথা টের পেলো কাঁধ আর হাতে। মাথা ঘুরিয়ে দেখলো হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধা। পায়ের থাই এর অংশটা দড়ি দিয়ে চেয়ারের সাথে কষে পেঁচানো বিধায় শুভ্রার নড়বারও কোনো উপায় নেই। বৃথা জেনেও নিজের সমস্ত শক্তি ব্যায় করে শরীরটা নাড়াবার চেষ্টা করলো একবার। না পেরে পা দুটো মেঝেতে দাপালো কয়েকবার। তাতেও সামনের মানুষটার কোন ভ্রুক্ষেপ হলো না। অসহায় বোধ হচ্ছে শুভ্রার। অনুভূতি কাজ করছে না ঠিকঠাক। তার কি রাগ হওয়া উচিত? কি হচ্ছে তার সাথে ধারণা নেই কোন। তাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে কিন্তু কেন? তার অপরাধ কি? জানতে চাওয়ার উপায় নেই।

শুভ্রা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো সামনে বসে থাকা ছেলেটা ওর পুরো কর্মকান্ড বেশ আয়েশ করে উপভোগ করছে। মুখটা হাসি হাসি করে তাকিয়ে আছে শুভ্রার দিকে। তলপেটের চাপ বাড়ছে বলে থাকতে না পেরে আবারও মেঝেতে পা দাপালো শুভ্রা। ছেলেটা এবার দন্ত বিকশিত হাসি দিলো যা দেখে তীব্র জলীয় নিষ্কাশনের চাপ নিয়েও শুভ্রা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো ছেলেটার দিকে। মনে হচ্ছে বাইশ বছরের এক দীপ্তমান তরুন। শুভ্রার চাহুনি টের পেয়েই মনেহয় নিজেকে সামলে নিলো ছেলেটা। গম্ভীর স্বরে জানতে চাইলো-“ওয়াশরুম যেতে চান?”
স্বজোরে মাথা দুলায় শুভ্রা। তবুও জায়গা থেকে উঠতে দেখা গেল না তাকে। স্থির চোখে চেয়ে থেকে বললো-“আমি আপনার হাত পায়ের বাঁধন খুলে দেব যদি আপনি লক্ষী মেয়ের মতো আমার সব কথা শোনের।”
উপায় না পেয়ে তড়িৎগতিতে মাথা দুলায় শুভ্রা। ছেলেটা এগিয়ে এসে ওর হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিলো-“দাঁড়াবেন না। আপনার বামে ওয়াশরুম।”
দীর্ঘ সময় বাঁধা থাকার কারনে হাত পা অসার হয়ে আছে। চাইলেও নড়তে পারছে না শুভ্রা। ওকে হতচকিত করে ছেলেটা প্রায় চ্যাংদোলা করে ওকে ওয়াশরুমের ভেতর পৌঁছে দিয়ে বললো-“কাজ শেষ করে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসুন। দেরি হলে আমি ভেতরে ঢুকে যাব কিন্তু। আর হ্যা মুখের স্কচটেপ খোলার চেষ্টা করবেন না নিজেই আহত হবেন।”
প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়েই বেরিয়ে গেলো ছেলেটা। তলপেটের চাপে বেশি কিছু ভাববার সুযোগ পেল না শুভ্রা। দ্রুত নিজের কাজ শেষ করে খুড়িয়ে খুড়িয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো। ও বেরুনো মাত্রই ছেলেটা ওর হাত দুটো পিছমোড়া করে বেঁধে ফেললো। ওকে ঠেলে চেয়ারে বসিয়ে পা বেঁধে দিয়ে ওর সামনে চেয়ার টেনে বসলো-“আপনি নিশ্চয়ই এতোক্ষণে বুঝতে পারছেন আপনাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে?”
শুভ্রা মাথা দুলায়।
“আপনার সুবিধার জন্য কিছু কথা বলে দিতে চাই আপনাকে। যতই চেষ্টা করেন না কেন এখান থেকে আপাতত মুক্তি পাচ্ছেন না আপনি। বিশেষ উদ্দ্যেশে আপনাকে অপহরণ করেছি। কাজ শেষ হলে স্বসম্মানে ছেড়ে দেওয়া হবে আপনাকে। আপনার অন্য কোন ক্ষতি করার ইচ্ছে নেই আমাদের যদি না আপনি বাধ্য করেন। শুধু কিছুদিন অতিথি হয়ে বন্দী থাকতে হবে এখানে। সেই থাকাটা কতটা ভালো হবে সেটা আপনার আচরণের উপর নির্ভর করছে। আপনি যেমন আচরণ করবেন তেমন অতিথি আপ্যায়ন হবে। আর হ্যা, রুমটা সাউন্ড প্রুফ কাজেই চিৎকার চেচামেচি করে লাভ হবে না। এখন আপনি ঠিক করুন কি করবেন।”
শুভ্র মুখে কিছু বলার চেষ্টা করলো কিন্তু সেটা গো গো শব্দ ছাড়া আর কিছু মনে হলোনা।
“কিডন্যাপের কারন জানতে চান?”
শুভা মাথা নাড়তেই হাসলো ছেলেটা-“কারণটা আপনার না জানলেও চলবে। এখানে আপনি যত কম জানবেন তত মঙ্গল আপনার জন্য। সেটা অবশ্য এখন বুঝবেন না। ভবিষ্যতে ভালো টের পাবেন।”
কথার মাঝে ছেলেটার ফোন বেজে উঠলো। প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল বের করে কেটে দিয়ে শুভ্রাকে দেখলো-“আজকের মতো যাচ্ছি। কষ্ট করে আজ রাতটা না খেয়ে থাকতে হবে আপনাকে। কাল যদি সম্ভব হয় খেতে দেব আপনাকে।”
শুভ্রা তীব্র বেগে মাথা নাড়ে, মেঝেতে পা দাপায়। খিদের তার পেটে ছুঁচো দৌড়াচ্ছে। সর্বশেষ দুইদিন আগে ভরপেট খেয়ে প্লেনে চড়েছিল। কাল পুরোটা দিন জার্নিতে কেটেছে বলে ঠিকমতো খাওয়া হয়নি। যতদূর মনে পড়ে সকাল দশটায় বেড়িয়েছিল এয়ারপোর্ট থেকে। ছেলেটা আবারও মুচকি হাসলো-“একদিন দুইদিন না খেয়ে থাকাটা এমন কঠিন কোন ব্যাপার না মিস শুভ্রা। প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হবে তবে ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে যাবে। আসছি কেমন? ঘুমিয়ে পড়ুন। আরে আরে অবাক হচ্ছেন কেন? হ্যা হ্যা এভাবেই ঘুমাতে হবে আপনাকে। দেখবেন এটাও অভ্যাস হয়ে যাবে একসময়।”
বলতে বলতে চোয়াল শক্ত হলো ছেলেটার-“নরম বিছানায় ঘুম আর যা ইচ্ছা তা খাওয়া তো হলো অনেক। অনেকদিন তো আকাশে উড়লেন এবার একটু মাটিতে থেকে দেখুন কেমন লাগে। চলি কেমন? গুড নাইট।”
লোকটা বেরিয়ে যাওয়া মাত্রই রুমের বাতি নিভে গেল। অন্ধকারে ডুবে গেল শুভ্রা। অসহ্য খিদেয় ছটফট করতে করতে শুভ্রা ভেবেই পেল না এই ছেলেটার কি ক্ষতি করেছে সে। কখনো দেখেছে বলেও মনেহয় না। তাহলে? কেন তাকে এখানে আটকে রেখেছে? কি অপরাধে? আর ছোট চাচা তো জানতো তার আসার খবর। তাকে না পেয়ে কি বাবাকে জানায়নি ছোট চাচা? আর বাবা জেনে চুপচাপ বসে থাকবে এও কি সম্ভব? ভাবনারা ডালপালা ছড়ায় কিন্তু কুল না পেয়ে আবারও একই জায়গায় ফেরত আসে। খিদেয় কাতর শুভ্রা একসময় ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে।

★★★

গাড়ি এলাকায় ঢুকতেই সিটে সোজা হয়ে বসলেন ইব্রাহিম সালিম। গাড়িতে ঘুমিয়ে গেছিলেন। এখন ঘুম থেকে উঠে বেশ আরাম বোধ হচ্ছে। ঝিমঝিম ভাব কেটে গিয়ে মাথাটা একটু একটু করে কাজ করতে শুরু করেছে। একবার ঘড়ি দেখার চেষ্টা করলেন। অন্ধকার বলে পারলেন না। গাড়ির বাতি জ্বালানোর ইচ্ছে করছে না। তিনি গলা খাকরানি দিলেন-“তুহিন, কয়টা বাজে রে?”
“সাড়ে বারোটা বাজে স্যার।”

ইব্রাহিম সালিম পাল্টা জবাব না দিয়ে বাইরে তাকালেন। রাত হয়েছে বলেই রাস্তা অন্ধকার। দু’পাশের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে, জনমানব শুন্য রাস্তা। মাঝে মাঝে দুই একটা গাড়ি চলছে অবশ্য। সালিম সাহেব ফোঁস করে শ্বাস ফেললেন। তার এলাকায় লোকেরা রাত তো দূরে থাক সন্ধ্যা থেকে ঘর থেকে বের হয় না। কারনটা কি ইব্রাহিম পরিবার নয়?

চিন্তাধারা পরিবর্তন হতে দেখে নিজের উপর বিরক্ত হলেন সালিম সাহেব। ভ্রু কুঁচকে ভাবলেন তিনি কি বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন? এরকম দূর্বল চিন্তা আসছে কেন তার মাথায়? নেত্রী একবার পিছিয়ে যেতে বললেই কি হাত পা গুটিয়ে নেবেন? একবার নির্বাচন করতে না পারলেই কি জীবন শেষ হয়ে যাবে? তাছাড়া সবচেয়ে বড় কথা হলো সব শেষ হয়ে গেছে এমন ভাবনা ভাবছেন কেন তিনি? হতে পারে এটা অপজিশনের ষড়যন্ত্র। কে এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছে তা জানতে হবে তো? আজকাল প্রচুর শত্রু বেড়েছে তার। নেত্রীর সাথে তার আন্তরিক সম্পর্কটাও অনেকে সহ্য করছে না। কেউ হয়তো নেত্রীর কানে বিষ ঢেলেছে তার নামে।
তা না হলে নেত্রী কেন তাকে সরে দাঁড়াতে বলবে? আর বললেই সরে যেতে হবে নাকি? শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করবেন পদ পাওয়ার।
“স্যার, চলে আসছি।”
তুহিনের ডাকে বাস্তবে ফেরে ইব্রাহিম সালিম। তাকিয়ে দেখলেন তুহিন দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে। ক্লান্ত পায়ে নেমে বাড়ির ভেতর ঢুকলেন সালিম সাহেব। ড্রয়িংরুমে এসে বসতেই স্ত্রী রিমা একগ্লাস জল নিয়ে এলো। তিনি নিঃশব্দে জল পান করলেন। রিমা মৃদুস্বরে বললো-“আপার শরীর ভালো আছে?”
সালিম সাহেব চোখ বুঁজে মাথা দুলালেন। রিমা তবুও দাঁড়িয়ে রইলো। দু’টো জরুরি খবর দিতে হবে মানুষটাকে। সে মানুষটার মেজাজ বুঝতে চাইছেন। সালিম সাহেব রিমার অস্তিত্ব টের পেয়ে চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলেন-“কিছু বলবা?”
রিমা মাথা নাড়লো। সালিম সাহেব গর্জে উঠলেন-“তো খাম্বার মতো খাড়াই আছে কেন? কয়া ফালাও।”
তুমুল গর্জনে রিমার শরীর কেঁপে উঠলো। এই ভয়টাই পাচ্ছিলেন তিনি। রিমার মুখে যেন তালা লেগে লেগো। বলার সাহস করে উঠতে পারছেন না। সালিম সাহেব রক্তচক্ষু নিয়ে চাইলেন-“কি হইলো? কথা কও ন কেন?”
“শারমিন দুইদিন ধইরা ফোন করে না। আইজ আমি ফোন দিছিলাম ওয় ধরে নাই।”
মেয়ের কথা শুনে কিছুটা নরম হলেন ইব্রাহিম সালিম। মাছি তাড়ানোর মতো করে হাত নাড়েন-“পড়ালেখা নিয়া ব্যস্ত মনেহয়। আর ও না ধরলে মালিহাকে ফোন দাও।”
রিমা ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলো-“দিছিলাম। ও কইলো কিছু জানে না। ওয় জামাই নিয়া বেড়াইতে গেছে অন্য শহরে।”
রিমার জবাবে অসন্তুষ্ট হলেন সালিম সাহেব-“তুহিনকে কইছিলা? সারাদিন পরে এই খবর দিলা? আচ্ছা সকাল দেখতেছি কি করা যায়।”
“আরেক খান কথা।”
রিমার বুক কাঁপছে দুরুদুরু। এই খবর পেয়ে কি করবেন সালিম সাহেব সে জানে না তবে এটা খুব জরুরি।
“আর কি কইবা? এই মাঝরাইতে বাড়িত আইসাও শান্তি নাই দেখতেছি।”
“সোহেল মাইয়্যা তুইলা আনছে আইজকা।”
রিমার কথা না বুঝে সালিম সাহেব পুনরায় জানতে চাইলো-“কি কইলা?”
রিমাকে আতঙ্কিত দেখায়-“সোহেল বিকালে এক মাইয়া তুইলা আনছে। আঁটকায়া রাখছে টং বাড়িতে। কয় ওই মাইয়াকে বিয়া করবো।”

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-৩

সোহেলের চোখ মুখ কেটে একাকার। কাল রাতে সালিম সাহেব মেজাজ হারিয়ে বেদম প্রহার করেছে তাকে। প্রথমবারের মতো বাবার হাতে মার খাওয়ায় হতবাক সোহেল। নিজেকে বাঁচানোর কথা একবারও মনে আসেনি তার। নিশ্চুপ হয়ে পিটুনি হজম করেছে। সোহেল বুঝেছে তার বাবার মেজাজ কোন কারনে ভীষণ খারাপ ছিলো। তা না হলে সোহেল তার বাবার আদরের সন্তান। হাজার অন্যায় করলেও বাবা কখনো তাকে বকা দেয় না। বরং তার সব অন্যায় কাজ ধামাচাপা দেয় নিজের গরজে। এই সকালে আয়নায় নিজেকে দেখে তার একটু কষ্ট হচ্ছে বইকি।
“সোহেল, উঠছোস ঘুম থিকা?”
দরজায় বাবার গলা শুনে মুচকি হাসলো সোহেল। নিশ্চয়ই তার বাবা সারারাত ঘুমায়নি। সোহেল হাসি লুকিয়ে সারা দিলো-“উঠছি আব্বা।”
সালিম সাহেব ঘরে ঢুকে সোহেলকে দেখলেন। চেহারা দেখে তার অনুতপ্ততা বাড়লো। হাত দিয়ে সোহেলের মুখটা আলতো হাতে আদর করে দিলো-“কোন মাইয়া তুইলা আনছোস? বিয়া করবি কেন ওরে?”
সোহেল হেসে দিলো-“মা অনেক জ্বালাইতেছিল কালকে তাই মারে মিছা কথা কইছি আব্বা। বিয়া টিয়া করুম না ওরে। মাইয়াটা বহুত তাফালিং করতাছিল তাই বাধ্য হইয়া ওরে তুইলা আনছিলাম।”
সালিম সাহেব বিরক্ত হলেও ছেলেকে বুঝতে দিলেন না-“ছোট খাটো ব্যাপারে মাইয়া তোলা লাগে? তোরে কি লোকে ডরায় না নাকি?”
সোহেল মাথা চুলকায়-“আব্বা, কালকে ইব্রাহিম মার্কেটে ঝামেলা হইছিল। এক দোকানী চান্দা দিব না বইলা ঝামেলা করতেছিল। মোমিন আমারে ডাকছিল তখন। ওই দোকানদারকে তুইলা আনতে গেছিলাম তখন এই মাইয়া সামনে আইসা পড়ছে। কিছুতেই দোকানদারকে আনতে দিব না। পড়ে দোকানদারকে ফালায়া এই মাইয়ারে তুইলা আনছি। দুই একদিন রাইখ্যা নদীতে ফালায় দিমু নাইলে অন্য কোন ব্যবস্থা করমু।”
“তোর এই মাথা গরম স্বভাব আর গেলো না সোহেল। এখন যদু মধু কদুরে তুইলা আনা শুরু করছোস। তোর এইসব কারবার আপার কান পর্যন্ত চইলা গেছে। এইজন্য সে এইবার আর আমারে নমিনেশন দিব না ঠিক করছে। তোরে নিয়া কি করমু ক?”
সোহেলকে বোকা বোকা দেখালো। কাল রাতে বাবার অগ্নিশর্মা হওয়ার কারনটা পরিস্কার হলো এবার। অপরাধবোধ ফুটে উঠলো তার চেহারায়। কেন যে এতো শর্টটেমপার সে? অল্পতেই দুনিয়া ধ্বংস করা রাগ উঠে যায় তার। সালিম সাহেব আরও কিছু বলবেন তার আগেই ফোন বেজে উঠলো তার। সোহেল আড়চোখে দেখলো ফোনটা। বন্দর থানার ওসির। কেন যেন সোহেলের মনে কু ডাকলো। এই সাতসকালে ফোন আসা ভালো লক্ষন না। সে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।

ওপাশের জনের কথা শুনতে শুনতে তার বাবার চেহারার নকশা যে বদলে যাচ্ছে সেটা বুঝতে বেগ পেতে হলো না সোহেলের। ফোনটা কান থেকে নামাতেই সোহেলের দিকে তাকিয়ে খেঁকিয়ে উঠলেন-“না যাইনা কার মাইয়া তুইলা আনছোস হারামজাদা?”
সোহেল তুতলে বললো-“কেন? কি হইছে?”
“গোলাম রসুলের মাইয়ারে তুইলা আনছোস যারে তিনবছর আগে শীতলক্ষ্যায় ভাসায় দিছিলি। ওর চাচা গোলাম রাব্বানী, হাইকোর্টের উকিল। থানায় মামলা করছে কালকা। মামলা নিতে চায়নাই থানা কিন্তু কে যেন ফোন দিছিলো মামলা নেওয়ার জন্য। মামলা না নিলে আপাকে জানাইবো হুমকি দিছে। তার উপর তোর মাইয়া তুইলা নেওয়ার পুরা ভিডিও ফেসবুকে ছাইরা দিছে।”
সোহেলের মনে মনে প্রমোদ গুনলো। কি হচ্ছে এসব? ঢোক গিলে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো-“আমি তো জানতাম না আব্বা যে ওই ছেড়ি…”
“তুই তো কিছুই জানোস না সোহেল। আমারে না ডুবায়া তুই থামবি না দেখতেছি। একদিকে সামনে নির্বাচন আরেকদিকে তোর এইসব আকাম। কই যামু ক? নির্বাচনের প্রস্তুতি নিমু নাকি তোর এইসব সামলাবো? কয়দিন আগেও তোর এই ঝামেলা সামলাইছি আইজকা আবার।”
সালিম সাহেব মাথায় হাত দিয়া বসে পড়লেন। সোহেল হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সবকিছু কেমন যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। একটা মেয়েকে তুলে আনলে যে এতকিছু হবে তা সে জানতো না। এর আগে অনেকবার এমন করেছে কিন্তু কেস হওয়া দূর কারো টু শব্দ করার সাহস হয় নাই। এইবার কি হইতেছে এইসব?

সালিম সাহেবও বিস্মিত। যত যাইহোক থানায় মামলা দেওয়ার সাহস আজ পর্যন্ত হয় নাই কারো। এই গোলাম পরিবারের হঠাৎ এতো ক্ষমতা হইলো কেমনে? এদের পিছনে কে আছে? আর ভিডিও ছাড়ছে কে? যদি আপার নজরে আসে কোনভাবে তাইলে আর এইবার নির্বাচনের কোন আশা নাই। সালিম সাহেব মাথার তালুতে হাত বুলিয়ে চলছে ক্রমাগত। সোহেল ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলো-“এখন কি করুম আব্বা?”
“ওই মাইয়া কই? তুই ওরে কিছু করস নাই তো?”
সোহেল ঢোক গিগলো। কালকে তুলে আনার পর পরই মেয়েটাকে রেপ করেছে সে। সারাদিনে দুই তিন দফা পাশবিক অত্যাচার করেছে। কিছুই করার ছিলো না তার। মেয়েটা খুব চেচামেচি করছিল, হুমকি ধমকি দিয়ে কাজ হচ্ছিল না। সালিম সাহেব ছেলেকে মৌনতা ধারন করতে দেখে যা বোঝার বুঝে গেলেন। ইচ্ছে হচ্ছে চাবকে ছেলের গায়ের চামড়া তুলে নিতে। এইরকম গাধা তার ছেলে সেটা ভাবতেই মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তিনি ভস্মীভূত করে দেওয়া দৃষ্টি হেনে ছেলেকে একবার দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

★★★

“দেখ রাগীব আমি কিন্তু সালিমকে বলে দিয়েছি যে এবার ওকে নমিনেশন দেব না। ও কিছু না বললেও আমি জানি ও সহজে সব মেনে নেবে না। কিছু না কিছু ঝামেলা করবেই।”
রণকে খানিকটা বিচলিত দেখায়-“আমার নাম কি বলে দিয়েছেন ফুপি?”
“নাহ বলিনি। তুমি নিষেধ করেছিলে না। তবে আজ অথবা কাল বলতে তো হবেই। নির্বাচনের তপসিল ঘোষণা হয়ে গেছে মনোনয়ন জমা দেওয়ার আর বেশি দিন তো নেই।”
“পরে জানাতে কোন সমস্যা নেই ফুপু। আশাকরি উনি কোনপ্রকার ঝামেলা ছাড়াই পদ থেকে সরে দাঁড়াবে।”
নেত্রীকে বিরক্ত দেখালো-“এতো শিওর হচ্ছ কি করে? ও অতো সহজ নয় তা তুমি ভালোই জানো। আমিও কম চেষ্টা করিনি ওর ক্ষমতা কমাতে কিন্তু পারলাম কোথায়? তোমার বাবাকে দিয়ে একবার চেষ্টা করেছিলাম। তার কি পরিনতি ছিল তুমি ভালোই জানো। ক্ষেত্রবিশেষে ও আমাকেও ভয় পায় না এটাই সমস্যা। তুমি এমন মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। আশাকরি পরে পিছিয়ে যেয়ে আমার মানসম্মান নষ্ট করবে না।”
রণ মৃদুস্বরে হাসলো-“পিছিয়ে যাওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না ফুপু। আপনি আমার দিক থেকে নিশ্চিত থাকুন। তবে আপনাকে একটাই অনুরোধ থাকবে উনি যেন সহজে আমার পরিচয় না জানেন। একদম শেষ মুহূর্তে জানাব।”
“যেমন তুমি বলবে। যেটাই করো না কেন পিছু হটা যাবে না। এটা আমার কথা।”
রণ আত্মবিশ্বাসী হাসি দিয়ে হাতের ফোনটা বাড়িয়ে দিলো-“এটা ওনার ছেলের গতকালের ইন্সিডেন্ট। সাংবাদিক গোলাম রসুলের মেয়েকে দিনদুপুরে তুলে নিয়েছে। ওনার আর ওনার ছেলের অত্যাচারে পুরো এলাকার মানুষের জীবন দূর্বিষহ হয়ে গেছে।”
মোবাইলে ভিডিওটা মন দিয়ে দেখলেন নেত্রী। তার চেহারা গম্ভীর হলো। মোবাইল ফেরত দিয়ে বললেন-“কি করতে চাও?”
রণ রহস্যময় হাসি দিলো-“যেটাই হবে তাতে আপনি সায় দেবেন ফুপু। নির্বাচনের মুহূর্তে জনগণ এসব খুব মনে রাখবে। সামান্য একটা স্টেপ কিন্তু কাজ হবে স্ফুলিঙ্গের মতো। ভোটের জোয়ার বইবে। আপনি বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই কি বলতে চাইছি?”
নেত্রী তৃপ্ত হয়েওঠে মাথা দুলালেন-“বুঝেছি। তুমি এবার এসো তাহলে।”
রণ উঠলো। দলীয় প্রধানের বাসভবন থেকে বেড়িয়ে নিজের গাড়িতে চড়ে বসলো। ওর ব্যক্তিগত সহচর মিহির বসেছে ড্রাইভারের পাশে-“ভাই, উত্তরে না পূর্বে?
“পূর্বে চল। মিহির দিলশাদকে খবর পাঠা, ওইদিকে সব ঠিক আছে নাকি জানতে চা।”
মিহির পেছনে তাকিয়ে রণকে দেখলো-“ভাই, সব ঠিক আছে।”
রণ শান্ত হয়ে কালো কাঁচের বাইরে তাকাল। অনেক কাজ বাকী। কেবল পথচলা শুরু বলা যায়। ভাবনা কেবল একটাই, সব কাজ ঠিক মতো করতে পারবে তো?

★★★

ঘুম ভাঙতেই হাত পা ঘুরিয়ে শরীরের আড়মোড়া ভাঙলো শুভ্রা। পরক্ষণেই চমকে চোখ মেললো। বিস্ময়াভিভূত হয়ে লক্ষ্য করলো তার হাত পা খোলা। সবচেয়ে আনন্দের কথা তার মুখের স্কচটেপটাও লাগানো নেই। আনন্দে চিৎকার করতে যেয়ে মুখ হাত দিলো শুভ্রা। দরজাটা হাট করে খোলা। ওপাশ থেকে আলোর ছটা ওর ঘরটা আলোকিত করছে। ও ধীর পায়ে দরজা সামনে এসে উঁকি দিলো। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। শুভ্রা আরেকটু এগুলো। বিশাল বড় একটা হলরুমে টিভি চলছে বিনাশব্দে। সেই আলোয় আলোকিত পুরো ঘর। বাইরে বের হওয়ার দরজা খুঁজলো শোভা। স্লাইডিং ডোর নজরে এলো। দ্রুত হাতে সেটা খুলতেই চমকে গেলো শুভ্রা। ওপাশে একটা রান্নাঘর যেখানে কালকের ছেলেটা কাজ করছে। ওকে দেখে বললো-“কাল আপনাকে বলেছিলাম, আপনার বন্দী জীবনে কতটা সুযোগ সুবিধা পাবেন সেটা আপনার আচরণের উপর নির্ভর করছে। এটাও বলেছিলাম, পালানোর চেষ্টা করবেন না। আজ প্রথম পরীক্ষায় আপনি ফেল করলেন। ভেবেছিলাম আজ খেতে দেব আপনাকে কিন্তু আপনি সে সুযোগ হেলায় হারালেন।”
শুভ্রা গোল চোখে তাকিয়ে দেখছে সামনের মানুষটাকে। ও পালাচ্ছে কিনা সেটা এই লোক দেখলো কি করে? লোকটা পিছমোড়া হয়ে কাজ করছে বলে মুখ দেখা যাচ্ছে না। লোকটার কথা শুনতে শুনতেই কিনা ওর পেটের খিদেটা জানান দিলো। শুভার হঠাৎ কান্না পেয়ে গেলো। কি হচ্ছে এসব ওর সাথে? কোথায় বাড়ি যেয়ে সবাই মিলে আনন্দ করার কথা ছিল। সেখানে ও কিনা বন্দী হয়ে আছে কোনো অচেনা জায়গায় অচেনা লোকের কাছে।
“ওরকম নাকি কান্না করে লাভ হবে না মিস শুভ্রা। ভদ্র মেয়ের মতো রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন। পরে আর সুযোগ পাবেন না।”
শুভ্রা রুমে ফিরে এলো। রুমটায় চোখ বুলিয়ে নিলো ভালোমতো। নিজের লাগেজ খুঁজলো কিন্তু পেল না। গা কুটকুট করছে গোসলটা দেওয়া দরকার। কিন্তু কাপড় কোথায় পাবে? শুভ্রা পুনরায় ফিরে এলো রান্নাঘরে। ও প্রশ্ন করার আগেই লোকটা ওর দিকে ফিরলো-“আপনার লাগেজে যেসব পোশাক আছে ওগুলো পরবেন না দয়া করে। ও ঘরে আলমারিতে কাপড় রাখা আছে আপনার জন্য সেখান থেকে কিছু পরুন।”
“আমার ফোনটা?”
শুভ্রার কথায় লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে হাসলো-“বন্দী জীবনে কে কবে ফোন ব্যবহার করার সুযোগ পেয়েছে?”
“আমাকে কতদিন থাকতে হবে এভাবে?”
‘ইনফাইনাইট ডে হতে পারে। বলেছি তো কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত। কাজ তাড়াতাড়ি শেষ হলে তাড়াতাড়ি ছুটি হবে আপনার। আর কথা বাড়াবেন না। যান তাড়াতাড়ি নিজের কাজ সারুন। আমার আবার ফিরে যেতে হবে।”
শুভ্রা রুমে ফিরে আলমারি খুলে থরে থরে সালোয়ার কামিজ সাজানো দেখলো। ওর পরনের পোশাকটাও দেখলো একবার। কেন যেন হাসি পেয়ে গেল তার। বোর্ডিং স্কুলে পড়া শুরু হয়েছিল সেই ক্লাস এইট থেকে। এ লেভেল পর্যন্ত দার্জিলিং এ ছিল তারপর ফ্লোরিডা। কোন এক অদ্ভুত কারনে ওকে দেশে রাখতে রাজি না বাবা। কিছুদিনের জন্য বেড়াতে গেলেও থাকার সুযোগ নেই। অথচ ওর ভীষণ ইচ্ছে করে মায়ের কাছে থাকতে। এমন না যে বাবা ভালোবাসে না তাকে। তার দুই ভাইয়ের চাইতে বরং বেশি ভালোবাসে কিন্তু কাছে রাখবে না। এই যে শুভ্রা অপহরণ হয়েছে বাবা কি জানে? মনেহয় না। শুভ্রা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে একসেট সালোয়ার কামিজ নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো।

“ওয়াশরুমের দরজায় কোন লক নেই কেন?”
“ইচ্ছে করেই রাখা হয়নি। আপনার প্রটেকশনের জন্য।”
ছেলেটা খেতে বসেছে টেবিলে। শুভ্রাকে দেখে নিয়ে পুনরায় খাবারে মন দিলো ছেলেটা। শুভ্রা হাসবে না কাঁদবে বুঝে পেল না। একজন এডাল্ট মেয়ে বাথরুম যাবে দরজা খোলা রেখে। হাউ রেডিকুলাস। প্রতিউত্তর করতে যেয়ে চারকোনা টেবিলও নজর গেল। শুভ্রা ঢোক গিললো। ছেলেটা সম্ভবত রামেন খাচ্ছে। লাল ঝোলের মাঝে অর্ধেক করে কেটে রাখা ডিম দেখে শুভ্রার মুখে লালা চলে এলো। ছেলেটা মধ্যে অবশ্য কোন বিকার দেখা গেল না।
“আর কিছু বলার আছে? এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে খাবারে নজর দেবেন না।”
শুভ্রা বেশ অপমানিত বোধ করলো। এরকম কিছু সে তার জীবনে প্রথম শুনলো। কিন্তু তবুও সরে যেতে পারলোনা। তীব্র পানির পিপাসা অনুভূত হচ্ছে। ছেলেটার কাছে কিছু চাইতে মন না চাইলেও চেয়ে ফেললো-“একটু পানি পাওয়া যাবে?”
ছেলেটা খাওয়া থামিয়ে পানির গ্লাস ঠেলে দিলো শুভ্রার দিকে। পুরো দুইদিন পরে পেটে পানি পড়ার সাথে সাথে পেট উল্টে বমি এলো শুভ্রার। বহু চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা হলো না। শুভ্রা ঘর ভাসিয়ে বমি করলো। ছেলেটা এবার সোজা হয়ে বসলো। ওর বমি করার পুরো দৃশ্যটা দেখলো। সে তার জায়গা থেকে নড়লো না।

শুভ্রা সোজা হয়ে দাঁড়াতেই ছেলেটা বললো-“এখন ভালো বোধ করছেন?”
শুভ্রা জবাব দিলো না।
“রান্নাঘরের পাশে আরেকটা ওয়াশরুম আছে ওখান থেকে বালতি আর মব নিয়ে এসে ঘরটা পরিস্কার করে ফেলুন।”
শুভ্রা বিস্ফোরিত দৃষ্টি নিয়ে দূর্বল কন্ঠে বললো-“আমি!”
“তো কে? এখানে আপনার জন্য কাজের লোক নেই কোন। তাড়াতাড়ি করুন প্লিজ। দেরি করিয়ে দিচ্ছেন। খাওয়াটাও ঠিক মতো খেতে দিলেন না।”
শুভ্রা দূর্বল শরীর নিয়ে অনেক সময় ব্যয় করে ঘরটা পরিস্কার করলো।
“এরপর বমি আসলে বেসিনে চলে যাবেন তাহলে আর কষ্ট করতে হবে না।”
শুভ্রা জবাব দিলো না। ছেলেটাকে অত্যন্ত নিষ্ঠুর মনেহচ্ছে এখন। ওর দিকে দু’টো ওষুধ বাড়িয়ে দিলো ছেলেটা-“খেয়ে নিন। শরীর ভালো লাগবে।”
শুভ্রা কথা না বাড়িয়ে ওষুধ দু’টো গিলে নিল।
“রুমে চলুন। আমার যাওয়ার সময় হয়ে গেছে।”
শুভ্রা টলতে টলতে রুমে এসে চেয়ারে বসলো। ছেলেটা ওকে বেঁধে ফেলার আগেই জ্ঞান হারিয়ে টলে পড়লো।

চলবে—
©Farhana_Yesmin

দর্পহরন পর্ব-০১

0

#দর্পহরন
#পর্ব-১

বর্ষীয়ান নেতা ইব্রাহিম সালিমের একমাত্র কন্যা শুভ্রাকে এয়ারপোর্ট থেকে অপহরণ করা হলো। মেয়েটা চেয়েছিল নিজের পরিবারকে সারপ্রাইজ দিতে। তাই কাউকে না জানিয়ে দীর্ঘ দিন পর চুপি চুপি দেশে ফিরেছিল নিজের পঁচিশতম জন্মদিন পালনের উদ্দেশ্য নিয়ে। একদম চুপি চুপিও নয়। একজনকে জানিয়েছিল। কিন্তু বুঝলো একজনকে জানানো খুব ভুল হয়েছে। বুঝলে কি হবে তখন আর কিছু করার নেই শুভ্রার।

জ্ঞান হারানোর ঠিক আগ মুহূর্তে শুভ্রা বুঝলো সে অপহৃত হয়েছে। বুঝতে কিছু সময়ের দেরীর কারনে অপহৃত শুভ্রা জ্ঞানহীন পড়ে রইলো একটা টয়োটা করোলার ব্যাকসিটে। অথচ এই কিছুক্ষণ আগেও শুভ্রা ভীষণ উচ্ছ্বসিত ছিলো। ওকে দেখে বাবা কি বলবে সেটা ভেবে নিজের মধ্যে উত্তেজনা টের পাচ্ছিল। সেই মেয়েটাকেই এখন কিনা মৃতের ন্যায় পড়ে থাকতে হচ্ছে! জ্ঞান থাকলে বোকামীর জন্য নিজেকে কষে ধমক দিত শুভ্রা।

আধাঘন্টা আগেও নিজেকে বেশ বুদ্ধিমতী ভাবছিল সে। একা একা সব কাজ করতে পারে ভেবে তার আত্মবিশ্বাসের পারদ আকাশ ছুঁয়েছিল। আধাঘন্টা আগে সব ফর্মালিটি পূরণ করে যখন লাগেজ নিয়ে
বেড়িয়ে এলো তখনই লোকটাকে চোখে পড়েছিল শুভ্রার। ওর নামের প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে ছিলো। মুখে মাস্ক পরে থাকা লোকটাকে চিনতে পারেনি শুভ্রা। ও দেশে আসছে এই খবরটা ছোট চাচ্চু বাদে আর কাউকে জানায়নি। তাই চাচ্চু পাঠিয়েছে ভেবে খুশিতে আটখানা হয়ে শুভ্রা লোকটার দিকে এগিয়ে যায়।

লোকটা লাগেজ গাড়িতে তুলে রেখে গাড়ির দরজা খুলে দিল শুভ্রাকে। ঠিক তখনই কথাটা মনে পড়লো। চাচ্চু বলেছিল, নিজে আসতে না পারলে বিশ্বস্ত কাউকে পাঠাবে। মাস্ক পরে নিজেকে আড়াল করবে এমন কাউকে কি পাঠাবে চাচ্চু? প্রশ্নটা মনে এলেও যাচাই করার সুযোগ পেল না শুভ্রা। দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে। কেউ একজন তার পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিলো হয়তো৷ কিছু একটা ঠিক নেই ভেবে শুভ্রা চিৎকার করবে ঠিক এমন সময় সেই কেউ একজন তার মুখে আলতো করে রুমাল চেপে ধরলো। ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে শুভ্রা ঢলে পড়লো রুমাল চাপা দেওয়া মানুষটার কাঁধে। লোকটা আশপাশ দেখে নিয়ে তড়িঘড়ি শুভ্রাকে গাড়ির ভেতর ঠেলে দিলো। ভেতরে বসে থাকা একজন ওকে ধরে সিটে শুইয়ে দিলো। জ্ঞান হারিয়ে চোখ বন্ধ করার আগে কেবল শুনতে পেলো-“প্যাকেট পিকআপ ডান।”

★★★

এই মুহূর্তে ইব্রাহিম সালিম বসে আছেন দলীয়প্রধানের কার্যালয়ে। ভীষণ ব্যস্ত কার্যালয়ে উৎসব মুখর পরিবেশ বলা চলে। কারণ সামনে নির্বাচন আসছে। কাকে কোন এলাকা থেকে নমিনেশন দেবে সেটা নিয়ে জোর আলোচনা, সমালোচনা, তদবির চলছে। ঘনঘন দলীয় মিটিং হচ্ছে। নমিনেশন পেতে ইচ্ছুক প্রার্থীদের নিজেদের এলাকায় জনপ্রিয়তা কেমন সেসব নিয়ে যাচাই বাছাই চলছে গোপনে।

তবে ইব্রাহিম সালিমের এসব নিয়ে ভাবনা নেই। তার নির্বাচনী এলাকায় সে দীর্ঘদিন ধরে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে। আধিপত্য বিস্তার শুরু হয়েছিল তার বাবা ইব্রাহিম খলিলের হাত ধরে। তিন দশক আগে তিনি এলাকার সাংসদ ছিলেন, এরপর বড়ভাই ইব্রাহিম মোর্শেদ। তারপর তিনি বিগত একদশকের বেশি সময় ধরে তার এলাকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত সাংসদ। রীতিমতো পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রসিদ্ধ ইব্রাহিম সালিম তাই নমিনেশন পাওয়া নিয়ে ভাবে না মোটেও। সে জানে তার এলাকায় তার থেকে যোগ্য প্রাথী আর কেউ নেই। আগামী এক দশকেও হবে না।

তুখোড় রাজনৈতিক হিসেবে আলাদা খ্যাতি আছে ইব্রাহিম সালিমের। বাবার রাজনৈতিক ক্ষমতা আর পারিবারিক প্রতিপত্তিকে ব্যবহার করে নিজের আলাদা জায়গা তৈরী করেছে ইব্রাহিম সালিম। সে চাইলে তার এলাকা অচল করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। যে এলাকা ঢাকার অদূরে এবং শিল্পাঞ্চল হিসেবে পরিচিত। তাই দলে তার আলাদা সন্মান আছে। সিনিয়র জুনিয়র সকলে তাকে যতনা সমীহ করে তার চেয়ে বেশি করে ভয়। স্বয়ং দলীয় প্রধান তাকে সমঝে চলে।

সেসব ভেবে মনে মনে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে ইব্রাহিম সালিম। আত্মবিশ্বাস ঠিকরে পড়ে তার চেহারা আর আচরণে। আজ দলীয় প্রধান ডেকেছে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করতে। সে জানে তার মতামত বিশেষ গুরুত্ব রাখে দলীয়প্রধানের কাছে। ইব্রাহিম সালিম বীরদর্পে বসে আছেন অতিথি কক্ষে। দলীয় প্রধানের পিএ খোকন কবির উঁকি দিলো-“স্যার, ম্যাডাম অপেক্ষা করতেছে আপনার জন্য।”
“ঘটনা কি কবির? আজকে হঠাৎ ম্যাডাম ডাকলো কেন? জানো কিছু?”
কবির হাত কচলায়-“আমি ছোট মানুষ স্যার, ম্যাডামের মনের খবর কিভাবে জানবো?”
ইব্রাহিম সালিম মাথা দুলালেন। আজ ম্যাডামের ব্যক্তিগত কক্ষে ডাক পড়েছে দেখে খানিকটা অবাক হলেন। তাহলে কি ম্যাডাম কোন ব্যক্তিগত সমস্যায় পড়ে তাকে ডেকেছে? অতীত অভিজ্ঞতা তাই বলে। ইব্রাহিম সালিম রুমে ঢুকে সালাম ঠুকলেন। ম্যাডামের হাতে একটা বই। সেটা থেকে নজর সরিয়ে একবার দেখলেন তাকে-“কি খবর সালিম? শরীর কেমন আছে তোমার?”
বইয়ের নামটা দেখে নিলো ইব্রাহিম সালিম। ড্রেমোক্রেসি এন্ড হিউম্যান রাইটস। মুচকি হেসে সামনের চেয়ারে বসলো-“ভালো আছি আপা। আপনার শরীর কেমন?”
ম্যাডাম মাথা নাড়লেন। কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপ করে রইলো। ম্যাডাম নিমগ্ন হয়ে বই পড়ছে। সালিম তাকে বিরক্ত করতে পারলোনা। মোবাইল ব্যবহারের উপায় নাই, ম্যাডামের সামনে এমন আচরণ শোভন দেখায় না। অনেকটা সময় এভাবেই পার হলো। ইব্রাহিম সালিম অধৈর্য্য হয়ে উসখুস করেন। তখনই ম্যাডাম বই বন্ধ করে চোখ থেকে চশমাটা খুললেন ধীরে। চোখ বুঁজে বসে রইলেন। কিছুক্ষণ পর বললেন-“সালিম, তোমার এলাকার খবর কি? সব ভালো? রেপ কেসটার কোন সুরাহা হলো? আসামি ধরা পড়েছে? আর ওই যে স্কুল ছাত্র ছেলেটা মারা গেলো সেই মামলার অগ্রগতি কি?”
ইব্রাহিম সালিম ঢোক গিললেন কয়েকবার। ম্যাডাম আসলে আজকে কি কারণে ডেকেছে তাকে? এসব খবর তার কানে দিলোই বা কে? জবাব না পেয়ে ম্যাডাম চোখ খুললেন-“কথা বলছো না কেন সালিম?”
“আপা, এগুলো তো পুরনো খবর। এলাকায় সব এখন ঠান্ডা। ভালোভাবে চলছে সব। নির্বাচন নিয়ে কিছু ভাববেন না।”
ম্যাডাম খুব ধরে লম্বা শ্বাস নিলেন। ঘোলা চোখে সালিমকে জড়িপ করলেন। সে দৃষ্টির মানে বুঝে পেলো না সালিম।
“খবর পেয়েছি তোমার এলাকায় জনঅসোন্তোষ চরমে উঠেছে। সামনে ভয়ে হয়তো কেউ কিছু বলতে পারে না কিন্তু ভোট হলে তোমার ভরাডুবি হবে। পরপর কয়েকটা ইন্সিডেন্ট হয়েছে তোমার ছত্রছায়ায় এবং একটারও বিচার হয়নি। এমনকি ভুক্তভোগীদের মামলা নিতে চায়নি থানা। এরকম চললে কি ক্ষমতায় থাকতে পারবো বলো তো?”
ষোলতে চলা এসির কোল্ড টেম্পারেচারেও দরদর করে ঘামে সালিম। ম্যাডাম কি সত্যিই এসব বলছে তাকে? নিজের কানটা আঙুল দিয়ে ঘুচড়ে দিলেন। নাহ কান ঠিকই আছে। ম্যাডাম তার দিকে তাকিয়ে আছেন। সালিম নজর ফিরিয়ে নিলো।
“ভাবছি এই অবস্থায় তোমাকে নমিনেশন দেওয়া ঠিক হবে না। তোমার এলাকা আমার জন্য খুব জরুরি এটা জানো তো? আমি কিছুতেই ওই আসন হাতছাড়া করতে চাই না। পরবর্তী মেয়াদে তোমার এলাকা নিয়ে অনেকগুলো পরিকল্পনা আছে মাথায়। প্রচুর বিদেশি বিনিয়োগ আসবে। এখন তুমি বলো এই অবস্থায় কি উচিত হবে হার নিশ্চিত জেনেও তোমাকে নমিনেশন দেওয়া?”
ইব্রাহিম সালিম নিশ্চুপ। সে জানতোনা আজ এ ধরনের কোন আলাপ হবে। তাই যুৎসই কোন জবাব না পেয়ে চুপ করে রইলো। ম্যাডাম পুনরায় মুখ খুললেন-“তুমি আমার ভাইয়ের মতো বলেই তোমার সাথে খোলাখুলি আলাপ করলাম। আমি চাইনা তোমার সাথে এসব নিয়ে বিন্দুমাত্র মনকষাকষি হোক।”
“আপনি যেমন বলবেন তেমনই হবে আপা।”
বিরবির করলো ইব্রাহিম সালিম। ম্যাডাম সে কথা শুনে খুশি হলেন কিনা বোঝা গেলোনা। সালিম টলতে টলতে ম্যাডামের রুম থেকে বেড়িয়ে এলো। ভুতগ্রস্থের মতো গাড়িতে উঠলেন। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না ম্যাডাম আপা তাকে এই কথা বলেছে। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর ইব্রাহিম সালিমকে এই মুহূর্তে ভাঙাচোরা এক মানুষ মনেহচ্ছে।

★★★

মোবাইলে রিং হওয়ার সাথে সাথে রিসিভ হলো। তাড়াহুড়োয় ফোনটা হাত থেকে মেঝেতে পড়তেই মেজাজ খারাপ হলো রণর। এবার খুব সাবধানে ফোনটা তুলে কানে ঠেকালো। ওপাশ থেকে কানে যেন মধু বর্ষন হচ্ছে। অন্তত রণকে দেখে তাই মনেহচ্ছিলো। কথা শুনতে শুনতেই তার ঠোঁটের হাসি বিস্তৃত হচ্ছিল।
“আচ্ছা, ঠিকাছে। বাকীটা আমি সামলে নিতে পারবো। তোমরা এখন যাও।”
ফোন কেটে দিয়ে উঠে দাড়ালো রণ। নিজের পচ্ছন্দের গানের কলি ভাজতে ভাজতে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো। আঙুল দিয়ে খানিকক্ষণ চুল ঠিক করলো, মুখ দেখলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। কিছু কি বোঝা যায়? নিজেকে প্রশ্ন করে উত্তর খুঁজলো কিছুক্ষণ। উত্তরেটা না বোধক হতেই রণ আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বকে আঙুল তুলে বন্দুকের ন্যায় তাক করে গুলি ছুড়লো-“নিজেকে সামলে রাখিস রণ, চারিদিকে অনেক শত্রু তোর। শত্রুদের মধ্যেই নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। বুঝলি?”
আয়নার রণ জবাব দিলো-“বুঝলাম। তুইও বুঝে নে রণ বদলে গেছে। এই রণ ভীড়ে বাঁচতে শিখে গেছে। যত অন্ধকারই থাক আলো জ্বালতে ভুল হবেনা তার।”
বলেই মুচকি হাসলো সে। মন দিয়ে আরো কিছুক্ষন নিজেকে দেখলো। গায়ের আঁটোসাটো গেঞ্জিটা খুলে ফেললো। আয়নায় নিজের মাসলঅলা শরীরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। পাঁচ ফিট এগারো উচ্চতার পেটানো শরীরটা বেশ আকর্ষনীয় দেখাচ্ছে। রণর কাছের মানুষগুলো ওর এই ট্রান্সফর্মে ভীষণ অবাক হয়। বছর পাঁচেক আগেও এতোটা ফিগার কনসাস ছিলোনা রণ। হঠাৎ করে জিম করতে শুরু করলে ওর মা হোসনে আরা বেগম জলি ভীষণ অবাক হয়ে ওকে বলেছিলেন-“তুই তো এমনিতেই অনেক ফিট বাবাই, তোর জীম করার কি দরকার?”
রণ মিষ্টি হেসে মাকে জবাব দিয়েছিলো-“মা জিমটা আমি শরীর না মনের ফিটনেসের জন্য করছি। মনের দিক দিয়ে আমি এখনো শিশুর মতো সরল আছি, ঝামেলা দেখলে ঘাবড়ে যাই। জিম করে দেখি সেটা কাটানো যায় কিনা। ওই যে বলে না, শরীর আর মন একে অপরের পরিপূরক। শরীর ফিট হলে মনটাও আস্তে আস্তে ফিট হতে শুরু করবে।”
জলি ছেলের কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিলো-“পাগল ছেলে! তোর মন তো বরাবরই ফিট। আজকাল এমন মনের দেখা পাওয়া যায় না। সকলের ময়লা জমা মন বলেই তাদের কাছে তোরটাকে আনফিট মনেহয়। কিন্তু মনে রাখিস তোর পরিস্কার মনটাই তোর বড় শক্তি। ওটাই তোকে সকলের চেয়ে আলাদা করবে। তোর বাবাও কিন্তু এরকমই ছিলো। মনটা পাল্টে ফেলিস না বাবাই, সবাই এরকম হতে পারে না চাইলেও।”
ভাবতে ভাবতে হাসলো রণ। তার মা বাবার শিক্ষা এ যুগে একেবারে অচল। এখন মানুষ বেশি সন্মান পেলে ভ্রু কুঁচকে তাকায়, ভদ্র ব্যবহারকে দূর্বলতা ভেবে সুযোগ নিতে চায়। তাই বলে রণ অভদ্র হতে চায় না। ও কেবল মানুষ ভেদে সঠিক আচরণ করতে চায়। যে যেমন তার সাথে তেমন আচরণ। যদিও এটা বেশ কঠিন কাজ। বিশেষ করে তার মতো মানুষের জন্য তো আরো কঠিন। ব্যবসায়ী এবং মুক্তিযোদ্ধা বাবা আর স্কুল শিক্ষিকা মায়ের সন্তান হিসেবে সারাজীবন ভদ্র নম্র ব্যবহারের শিক্ষাই পেয়েছে। সেই নম্রতাই যে তাদের জীবনে কাল হয়ে দাঁড়াবে তা কে জানতো? কতকিছু হারাতে হলো জীবনে। মাথার উপর থেকে বাবার ছায়া, তাদের সাজানো গোছানো সংসার, তার তারুণ্যের দিনগুলো।

রণ অন্যমনস্ক হয়ে সাদা শার্ট গায়ে চাপালো। অনেকদিন ধরে মনের ক্ষততে প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছিল না। এবার কি পারবে? লোকে যেখানে পৌছানোর স্বপ্ন দেখে নিজেকে সেই অবস্থানে পৌঁছানো কতটা কঠিন তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সে। কিন্তু দৃঢ় কল্প সে সেই অবস্থানে পৌছানোর ব্যাপারে। পরিচিত মহলে মোস্ট এলিজেবল ব্যাচেলর সে, বয়স ত্রিশ চলছে। মা বিয়ের কথা বলে বলে হয়রান, সে নিজেও বোঝে বিয়েটা করা উচিত কিন্তু অংক মেলে না বলে বিয়ে করা হচ্ছে না। সরল অংকের হিসেবে কোনো একটা গড়মিল হয়েছে সেটা না মেলা পর্যন্ত বিয়ের ভাবনা করা যাবে না। আপাতত সে গড়মিলটা ঠিক করে অংক মিলানোর চেষ্টা করছে সে। রনর আশা খুব দ্রুত অংক মিলিয়ে ফেলতে পারবে সে।

তৈরি হয়ে নিজেকে দেখলো রণ। এতোগুলো বছর ধরে নিজেকে ইস্পাতের ন্যায় কঠিন বানিয়েছে। কতটা পেরেছে তা বোঝার সময় আসন্ন ভেবে চোয়াল শক্ত হলো। রণর রণাঙ্গনে আবিভার্বের সময় হয়ে গেছে অবশেষে।

চলবে—
©Farhana_Yesmin

অসম্ভবে অসঙ্গতে পর্ব-০৪ এবং শেষ পর্ব

0

#অসম্ভবে_অসঙ্গতে
লেখক: নবনীতা শেখ
|পর্ব ৪|

পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতিটি হচ্ছে একাকিত্বকে উপভোগ করতে পারার অনুভূতি। আমি একা নই। আমার জন্য কুহু আছে। অনেক অনেক মাস পর যখন দু’জন একাকিত্বে অভ্যস্ত হয়ে উঠলাম, একরাতে চুপিসারে কুহুকে শুধালাম,
-“আম্মাজান, আপনি বাবাইকে মিস করেন?”

কুহু ঘুম জড়ানো আওয়াজে উত্তর না দিয়ে উলটো জিজ্ঞেস করেছিল,
-“আপনি করেন?”

যারা প্রতিটি পদক্ষেপে উপলব্ধি হয়ে থাকে, তারা অনুপস্থিতির অনুভবে কী করে থাকবে? থাকে না তো। নিয়মানুসারে আমিও মুহিবকে মিস করি না। মৃদু হেসে বললাম,
-“করি না।”

কুহু ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে বলল,
-“আমিও করি না।”

আমরা দু’জনেই ঘুমিয়ে গেলাম। পরদিন কুহুকে একটা স্কুলে ভর্তি করে দিলাম। আবির প্রায়ই রাতে কল দিয়ে কুহুর খোঁজ নেয়, কুহুর সাথে কথা বলে। দু’জনের বেশ চমৎকার একটা বন্ডিং হয়েছে। আমার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরোতে চায়। যদি সেবার আবিরকে আমার কিশোরী উপলব্ধিটা জানাতাম, তবে গল্পটা আজ সম্পূর্ণ ভিন্ন হতো। একটা ছোট্ট সংসার হতো, একটা সুখী পরিবার আমারও হতো!

পরপর আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলা থেকে নিজেকে আটকে ফেলি। আমি কি প্রকৃতির নিয়মের বাইরে যেতে চাইছি? আমি কি ভাগ্যের বিপরীতে গিয়ে, সাঁইসাঁই বাতাসে দমবন্ধ হয়ে মরতে চাইছি? মুহিব তো আমাকে তা করতে নিষেধ করে গেছে। মুহিব আমাকে কঠিন গলায় বলেছিল,
-“অনিন্দিতা! আফসোসের সুরে বিষ থাকে। তুমি কি আত্মহত্যা করতে চাও?”

আমার স্রষ্টার আমাকে নিয়ে যা পরিকল্পনা আছে, আমি তা সহাস্য চোখে দেখে যেতে চাই। সেভাবেই এগোতে লাগলাম। আমার জায়েরা আমাকে আর কিছু বলে না এখন। আগে মাঝে মাঝে খোঁটা দিত, এখন যা দেয় সব অগোচরে; সামনাসামনি কখনও না। আমার জব পার্মানেন্ট হয়ে গেল। প্রমোশনও পেয়ে গেলাম। এখন আর কুহুকে মায়ের বাড়ি রেখে যাই না। এখানেই থাকে। দিন কেটে যায় টিভিতে কার্টুন দেখে, বাচ্চাদের বই পড়ে, একাডেমিক পড়ে, একা একা খেলে। মাঝে মাঝে আঁকি-বুঁকিও করে। স্কুলে সকালে দিয়ে আসি, আসার সময় আরিফা ভাবি নিজের মেয়ের সাথে ওকেও নিয়ে আসে। তারপর একা একাই খাওয়া-গোসল করে। বাচ্চা আমার, কী গুছিয়ে চলে! এবার ছয় পড়ল। অথচ এখনই কী শান্ত!

মুহিবকে ছাড়া আমাদের প্রায় দের বছর পেরিয়েছে। ঠিক এরম এক সন্ধ্যায় অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দেখতে পাই বড়ো আপা আর ছোট আপা বসার ঘরে আমার মেয়েকে নিয়ে বসে আছে, বিভিন্ন কথা বলছে। টুকটাক কিছু কথা কানে এলো, আপা বলছে,
-“কুহু শোন, তোর মামনি তোরে ছেড়ে চলে যাবে।”

কুহু অবাক হয়,
-“কেন যাবে?”
-“কেন যাবে মানে? তোর ওই আঙ্কেল আছে না? ওই লোকের সাথে চলে যাবে।”

ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইল কুহু। অনেকক্ষণ পর জিজ্ঞেস করল,
-“মামনিরা চলে যায়?”
-“আর কারোর মামনি যায় না। তোর মামনি যাবে।”
-“কেন?”
-“ভালো থাকতে।”
-“এখন ভালো নেই?”
-“না।”
-“কেন ভালো নেই?”
-“কারণ তুই সবসময় তোর মামনিকে জ্বালাস, শান্তিতে থাকতে দেস না। এজন্য ছেড়ে চলে যাবে।”

কুহু দু’দিকে মাথা নেড়ে বলল,
-“আমি আর জ্বালাব না।”
-“তাইলে শোন, আমি তোর জন্য নতুন বাবা খুঁজি। তোর মামনিকে বলিস, বাবা লাগবে। তখন তোর মামনির সাথে তোর একটা নতুন বাবার বিয়ে দিয়ে দেবো। তোরা একসাথে ভালো থাকবি।”

কুহু কী বুঝল জানি না, অবুঝ বাচ্চাদের মতো ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
-“কিন্তু আমার তো বাবাইয়ের দরকার নেই।”

বুকের ভেতরটায় যেন কেউ পাথর চাপা দিয়ে রেখেছিল, তা তুলো হয়ে উড়ে গেল ক্ষণিকেই। আমি তাদের সম্মুখে চলে এলাম। কুহু আমাকে দেখে বরাবরের মতো দৌড়ে কোলে চলে এলো। আমি ওকে কোলে নিয়ে দু’গালে চুমু খেয়ে বললাম,
-“দিন কেমন কাটল, প্রিন্সেস?”
-“খুউব ভালো।”

আমি হাসলাম। পরপর আপার দিকে তাকালাম। তীক্ষ্ণ চাহনি ও ধারালো আওয়াজে তাদের জানালাম,
-“ভিটে ভাগ হোক।”

আপারা স্তব্ধ হয়ে গেল। আমি বুঝতে পেরেছি, আমার বিয়ে অন্যত্র দিয়ে এ বাড়ি থেকে সরানোর ছকটাই তারা কষেছে। সে গুড়ে যেন বালি পড়ল। বোঝাতে চাইল নানান কিছু। আমি বুঝলাম না। রুমে গিয়ে আবিরকে কল লাগালাম। তিনি কল রিসিভ করেই বললেন,
-“অনিন্দা, কোনো সমস্যা? বাড়ি পৌঁছেছ? সব ঠিকঠাক?”

তার উত্তেজিত আওয়াজ। আমি স্থিরতায় বললাম,
-“ইমিডিয়েট একটা ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করে দিন অফিসের আশে-পাশে।”
-“সব ঠিক আছে তো?”
-“জি ঠিক আছে, আবির ভাই।”

আবির আর কিছু বললেন না আমাকে। পরদিনই মালিগঞ্জে একটা ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করে দেন। আমি সপ্তাহ সময় নিয়ে সে ফ্ল্যাটে উঠলাম। জুনের মাঝামাঝি সময়, অর্থবছরের শেষের একটা বড়ো অ্যামাউন্টের বোনাস পেলাম, সেই সাথে স্যালারিও বাড়ল। পুরোটাসহ জমানো টাকার আংশিক নিয়ে কিছু প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কিনে ফ্ল্যাটটা গুছিয়ে ফেললাম। বাড়িতে আবির একজন হেল্পিং হ্যান্ড এনে দেন কুহুকে দেখার জন্য। তিনি সবেতেই অনেক সহায়তা করেছেন। ফ্ল্যাটে ওঠার পরপরই তাণ্ডব শুরু করলাম।

শীঘ্রই বৈঠকে এলাম, আমার ভাগের অংশটুকুর বদলে আমি সমপরিমাণে টাকা নিলাম। এই টাকা দেওয়াতেও আপাদের ছিল নানান ছুকছুকানো কৌশল। কিন্তু লাভ হলো না ও বাড়িতে আমার না থাকায়।

ধীরে ধীরে সব কিছু থেকে বেরিয়ে এসে নিজের লাইফটা গুছিয়ে নিই। আর জমি-জমা থেকে নেওয়া টাকাগুলো দিয়ে মালিগঞ্জেই গৃহহীন নারীদের জন্য একটা বাড়ি তৈরি করি। বেশ বড়ো সড়ো একটা বাড়ি, বাড়ির নাম দিই “আশিয়ানা”। ধীরে ধীরে অসংখ্য মানুষ আমার আশিয়ানাতে থাকা শুরু করে। তাদের প্রত্যেকের গল্পগুলো আরও কুৎসিত। রুহ কেঁপে ওঠার মতো কুৎসিত।

আমি তাদের দায়িত্ব নিই, তাদের প্রত্যেকের ভালো থাকার দায়িত্ব নেই। আমার একার উপার্জনে তাদের চালানোর সামর্থ্যটা হয় না। এক্ষেত্রে আমি মুহিবের রেখে যাওয়া অর্থগুলো ব্যবহার করে নারীদের জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করি। আমি তাদের দক্ষ বানানোর জন্য উঠে-পড়ে লাগি। তাদেরকে বিভিন্ন হাতের কাজে প্রশিক্ষিত করি। এরপর তাদের জন্য কাজের ব্যবস্থা করি।

তারপর একসময় দেখলাম, আশিয়ানার নারীদের জন্য আমার নিজ থেকে খরচ করতে হচ্ছে না আর, তারা নিজেরাই নিজেদের চালিয়ে নেওয়ার সামর্থ্য রাখছে। বাড়তি যা আয় হচ্ছে, তাতে বাচ্চাদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করলাম। আরও মানুষ বাড়তে লাগল। আশিয়ানার পাশের খালি জমিটুকুও কিনে নিলাম, বাড়িটাকে বড়ো করলাম। অসংখ্য নারীদেরকে বিদায়ও জানালাম, যখন তাঁরা সম্পূর্ণভাবে আত্মপ্রত্যয়ী হয়েছেন।

আমার জীবনের আরও নয়টা বছর এখানেই কেটে গেল। কুহু এবার দশম শ্রেণিতে পড়ছে। রোজ স্কুল, কোচিং শেষে বিকেল বেলায় এখানে চলে আসে। তারপর হেসে-খেলে পুরো বাড়ির সবার খোঁজ নিয়ে বেড়ায়। সবার সাথে তার কী দারুণ সখ্য! আশিয়ানাতে এখন পথশিশুদেরও থাকার ব্যবস্থা করেছি। কুহু তাদের সবার প্রিয় আপা। কুহু এলেই বাচ্চাদের হৈ-হুল্লোড় বেড়ে যায়। আশিয়ানাতে কী আনন্দ কী আনন্দ!

আমি জব ছেড়ে দিয়েছি বছর চার আগেই, আপাতত আশিয়ানাই আমার ধ্যান-জ্ঞান সব। সমাজের নারীদের জন্য আমি নিজেকে উৎসর্গ করলাম আমি। মুহিব আমাকে যে সকল আদর্শ দিয়ে গেছে, আমি সে সকল আদর্শে তৈরি করলাম হাজারো নারী।

জীবনটা কোনো যাচ্ছেতাই কিছু নয়, জীবন মানে একটি ঘর; কিছু মানুষ নিয়ে সাজানো গোছানো ঘর। মানুষ সব পারলেও, ঘর থেকে দূরে সরতে পারে না। ঘরটা অপছন্দ? সমস্যা কী? সাজিয়ে-গুছিয়ে নিলেই হয়। বলতে যতটা সহজ, করতে তারও অধিক সরল। কেবল প্রয়োজন দৃঢ় মনোবল, প্রবল ইচ্ছেশক্তি, পর্বত সমান আত্মবিশ্বাস ও ইস্পাত কঠিন ব্যক্তিত্ব।

সময়টা শীতের। গায়ে চাদর জড়িয়ে আশিয়ানার ছাদে দাঁড়িয়ে রাত উপভোগ করছিলাম। হুট করেই কে যেন আমার সামনে এক মগ ধোঁয়া ওঠানো কফি এগিয়ে দিলো। আমি তাকালাম, আবির দাঁড়িয়ে আছেন। মগটা হাতে নিয়ে বললাম,
-“কখন এলেন?”
-“কিছুক্ষণ আগেই।”
-“আচ্ছা।”

আবির মগে চুমুক দিলেন। তারপর চাঁদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-“দ্য মুন ইজ বিউটিফুল, ইজন’ট ইট?”

আমি হেসে ফেললাম। চাঁদের দিকে তাকালাম তারপর। আবির নিজেও হাসলেন। কফির মগ রেলিংয়ে রেখে তার গায়ের শাল ঠিক করলেন। সাদা পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে গোটাতে বললেন,
-“অনিন্দা, তোমার কাছে জীবন মানে কী?”

কোনোরূপ ভাবনা ছাড়াই বললাম,
-“আমার কাছে জীবন মানে অ্যাডভেঞ্চার। পদে পদে চমক। কখনও সুখে বুক কাঁপে, কখনও ভয়ে আত্মা ছলকে ওঠে। জীবন মানেই অকস্মাৎ থমকানোর এক গল্প।”

আবির হেসে হেসে রেলিং ঠেসে দাঁড়ালেন,
-“জীবন বিশ্রী। সবচেয়ে বেশি যেই জিনিসটা নিয়ে ভাবি, সেটাই হারিয়ে যায়। যতবার সুখ খুঁজতে হাত বাড়াই, এক মুঠো দুঃখ পাই।”

আমি প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললাম,
-“আপনার বয়স কত?”

বড়ো ভাব নিয়ে আবির বললেন,
-“ফেব্রুয়ারিতে ৪১ হবে।”
-“এখনও বিয়ের বয়স হয়নি?”
-“কী যে বলো না! বিয়ের বয়স শেষ, অনিন্দা। এখন আর মেয়েরা আমাকে চয়েজ করে না। সো ওসব বিয়ে-টিয়ে হোয়াট এভার, বাদ!”
-“ঢং করছেন কেন? খুলে বলবেন কেন বিয়ে করতে এত অনিচ্ছুক?”

আবির ভাই চাঁদের দিকে তাকালেন। আজ পূর্ণচাঁদের রাত। চাঁদের আলোয় চারপাশটা কী মোহময় লাগছে! আবির সেসব দেখতে দেখতে বললেন,
-“নারীরা নিজেদের স্বামীর কাছেও সেফ নয়। তাই নিজেকে এই ‘স্বামী’ ক্যাটাগরিতে ফেলতে ইচ্ছে করে না। আর কোনো প্রশ্ন কোরো না, অনিন্দা। তোমাকে মিথ্যে বলতে আমার কষ্ট হবে।”
-“ঠিক আছে।”

তারপর প্রায় ঘন্টাখানেক দুইজন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। রাত বারোটার পর শীত বাড়তে লাগল। আমি তখন আবিরকে বললাম,
-“নিচে আসুন।”

আবির আমার দিকে তাকালেন না,
-“এখানে ভালো লাগছে, তুমি যাও।”

আমি চলে এলাম। আবির সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলেন। মানুষ যা চায়, সব কি সে পায়? যা পায়, আদতে কি তাই-ই চায়? কিছুটা ভাগ্য, বাকিটা কর্ম। চাওয়া দিয়ে পাওয়া হয় না, লাগে পরিশ্রম। আবির কি পরিশ্রম করেছিলেন? নির্বোধ পুরুষজাতি!

_____
রাতে ঘুমানোর সময় কুহু আমার রুমে চলে এলো। রাত তখন দেড়টার কাছাকাছি, জিজ্ঞেস করলাম ওকে,
-“কী ব্যাপার? ঘুমাননি?”

কুহু এগিয়ে এসে আমার কোল থেকে ল্যাপটপ সরিয়ে মাথা রাখল নিজের। মিষ্টি করে হেসে বলল,
-“আপনার সাথে ঘুমোতে ইচ্ছে করছে, মামনি। ঘুম পারিয়ে দিন।”

আমি কুহুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বললাম,
-“কুহেলি?”
-“জি, মামনি?”
-“আপনার কখনও আফসোস হয় না?”
-“কীসের আফসোস?”
-“আর বাকি দশটা মানুষের মতো স্বাভাবিক ও সুন্দর একটি জীবন না পাওয়ার আফসোস।”
-“হতে চায়, হতে দিই না।”
-“কীভাবে দেন না?”
-“আমরা ভালো আছি, মামনি। আরও ভালো থাকতে চাইছি, কেউ কেউ তো সামান্য এটুকু ভালো থাকার জন্য স্রষ্টার কাছে প্রতি ওয়াক্তে কান্না করছে। আমার মা আছে, কারো কারো বাবা-মা, কেউই নেই। আমাদের শারীরিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সব ঠিক আছে, কেউ বিকলাঙ্গ হয়েও তো বেঁচে থাকে। আমরা দুনিয়ার কুৎসিত রূপ দেখে হাহাকার করছি, কেউ দুনিয়াই দেখতে পাচ্ছে না। আমার স্রষ্টা আমাকে সেই কষ্ট দেননি, যা ওদের দিয়েছেন। আমি কেন আফসোস করব? কেন শুকরিয়া আদায় করব না?”

ঝুঁকে কুহুর কপালে চুমু খেলাম আমি। কুহু চোখ বন্ধ করে বলল,
-“মামনি, আবির আঙ্কেল বোধহয় আপনাকে ভালোবাসেন।”

কুহু আচমকা এ কথা বললেও, আমি চমকাইনি। সংক্ষিপ্ত উত্তরে বললাম,
-“জানি আমি।”

কুহুও অবাক হলো না। নড়েচড়ে ঠিক হয়ে শুয়ে বলল,
-“এ বিষয়ে আঙ্কেলের সাথে সরাসরি কথা বলেছেন, মামনি?”
-“না। সম্পর্ক জটিল হয়ে যাবে।”

কুহু হেসে বলল,
-“মানে তিনি জানাতে চান না, আর আপনিও অবুঝ সেজে থাকবেন? ইন্ট্রেস্টিং।”
-“ইয়েস, প্রিন্সেস! লাইফ ইজ মোর ইন্ট্রেস্টিং দ্যান উই ক্যান ইম্যাজিন।”

কুহু উঠে বসে বলল,
-“মামনি, আপনি চাইলে কিন্তু পারতেনই আবির আঙ্কেলকে একটা সুযোগ দিতে।”
-“অবশ্যই পারতাম। তবে এতে আপনার বাবাইয়ের কথাগুলোয় ভাটা পড়ত, আমাদের আশিয়ানাও তৈরি হতো না।”

কুহু আবারও শুয়ে পড়ল, অনুত্তেজিত গলায় বলল,
-“আপনি এত সঠিক কেন সকল ক্ষেত্রে? পার্ফেকশন ইজ নট অ্যা ওয়েল থিং। মাঝে মাঝে কিছু ভুল করা দরকার!”
-“আমিও মানুষ, ভুলের ঊর্ধ্বে নই। কিছু সাংঘাতিক ভুল আমার দ্বারাও হয়েছে?”
-“কী?”
-“ঘুমান।”

কুহু আর প্রশ্ন করল না, আমিও জবাব দিলাম না। আমার ভুলগুলোর শৃঙ্গে স্থান নিয়েছে স্বার্থপরতা। স্বকীয় স্বার্থে দমে গিয়ে অন্যের ভালোবাসাকে সম্মান জানাতে আমার সে কী আলস্য!

|সমাপ্তি|
[এখন অনেকেই বলবেন, এটা কেমন সমাপ্তি? অনেক কথাই পরিষ্কারভাবে বলা হয়নি, অনেক জায়গা জানানো হয়নি, আবির কেন বিয়ে করল না, অনিন্দিতা কেন আবিরকে সুযোগ দিলো না, অনিন্দিতা কী ভুল করেছে, অনিন্দিতা কী স্বার্থপরতা করেছে! এরম অসংখ্য প্রশ্ন আসবে এখন।
তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, একটা ছোট গল্পে কখনও পরিপূর্ণভাবে সবকিছুর ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়। ছোট ছোট অনেক অংশেই, অনেক ক্লু দেওয়া থাকে। এক্ষেত্রে পাঠকদের মনোযোগ সহকারে পড়তে হবে, বুঝে নিতে হবে, ভেবে নিতে হবে। প্রতিটি ছোট গল্প, এক একটি পাজল। এই পাজলটি তৈরি করা লেখকদের কাজ এবং পাঠকদের কাজ হলো তাদের গভীর চিন্তা-চেতনার মাধ্যমে এর সমাধান করা। লেখা আমার কাজ, উত্তর মেলানো আপনাদের। ভালোবাসা সকলের জন্য! 🖤]

অসম্ভবে অসঙ্গতে পর্ব-০৩

0

#অসম্ভবে_অসঙ্গতে
লেখক: নবনীতা শেখ
|পর্ব ৩|

হুট করেই বড়ো আপা আমাকে ডেকে নিয়ে বাড়িভর্তি মানুষের সামনে জিজ্ঞেস করেন,
-“তা ছোট, বিয়ে-শাদির ব্যাপারে চিন্তা কী?”

অবাক হলাম,
-“কীসের বিয়ে?”

ছোট আপা হেসে বলল,
-“আরে অনু, তোর বিয়ের।”

আমি ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে বললাম,
-“এখনও ভাবছি না।”

উঠে চলে যেতে লাগলাম, ওমনিই ও-বাড়ির বড়োবৌ জহুরা আমাকে বলে উঠল,
-“লুকিয়ে কাজ নেই, ভাই। এখনও যৌবনেই আছ, একা যে থাকবে না তা আমরা বুঝি। এখন অন্যত্র জড়ালেও তো ক্ষতি নেই। তোমার বিয়ে-শাদি দিলে আমরাও একটু নিশ্চিন্ত হই। চিন্তা তো কম হয় না তোমার জন্য।”

আমি হেসে ফেললাম, সামনের সোফায় বসে জিজ্ঞেস করলাম,
-“তা আমার বিয়ে-শাদির সাথে আপনাদের নিশ্চিন্ত হওয়ার সংযোগ কোন জায়গায়?”

আমার হাসিতে সবার মুখ গুমোট হয়ে উঠল। কেউ যেন কথা এগোনোর সুযোগ পাচ্ছে না। কোনো একটা বিষয় নিয়ে ভাবছে, কথাটা কীভাবে ওঠানো লাগবে তাই যেন ভাবনার আদ্যোপান্ত। এ-সময়ের মধ্যেই আরেকজন বলে উঠল,
-“তুমি আমাদের আপনজন। তাই চাই-না নাম খারাপ হোক। বয়স কম, স্বামী নেই। পরিণতি কী, জানা আছে আমাদের। তাই চাই, বিয়ে করলে করে নাও।”

আমার ভেতর থেকে রাগগুলো আগ্নেয়গিরির ভয়ানক লাভার মতো উথলে উঠতে চাইছে। চোখ বন্ধ করে ফেললাম, মুষ্টিবদ্ধ হলো হাত। মুহিব বলত, রাগ ভালো কিছু না। রাগ মন্দকে ভালো ও ভালোকে পৃথিবীর সবচেয়ে মন্দ কিছুর রূপে প্রদর্শন করায়। রাগ জাগতিক সকল শুদ্ধকে অশুদ্ধ বানিয়ে দেয় ও অশুদ্ধকে আঁকড়ে ধরতে শেখায়। রাগ বিবেক-বুদ্ধির সংহার ঘটায়। যেই ব্যক্তি নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে জানে, গন্তব্য স্বয়ং তার সামনে রাস্তা বানিয়ে দেয় এগোনোর তাগিদে। রাগ নিয়ন্ত্রণ করার বেশ কিছু পদ্ধতি আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হচ্ছে চোখ বন্ধ করে দু-তিনবার প্রলম্বিত শ্বাস ফেলা এবং বন্ধরত চোখে এই কিঞ্চিৎ সময়ের মাঝে নিজের সবচেয়ে দূর্বলতম দিকটা ভেবে নেওয়া।
আমি আমার দূর্বলতাকে চিন্তা করলাম, কুহুকে ভাবলাম। এটা তো আমার যুদ্ধ, এখানে লড়াই শারীরিক না, মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়ে করতে হবে। আশ্চর্যজনকভাবে আমার রাগ নেমে এলো।

অপ্রশস্ত হেসে বললাম,
-“বিয়ে করব না, আপা। আমি আমার আর কুহুর জন্য যথেষ্ট।”
-“এ কথা এখন বলছ, দু-দিন পর ঠিকই বাচ্চাটাকে ছেড়ে চলে যাবে। তখন তো সব এসে আমাদের ঘাড়েই পড়বে।”

এ-পর্যায়ে আমার শক্ত হতে সময় লাগল না,
-“আপনাদের চিন্তা-ভাবনা অত্যন্ত সংকীর্ণ।”

জহুরা আপা বললেন,
-“তোমাকে প্রায়ই একজন ব্যাটালোকের সাথে দেখা যায়, অনু। তুমি অস্বীকার করতে পারবে?”

মূল ঘটনা বুঝতে পারলাম আমি। এরপর আর কিছুতে সম্ভবত কোনো লাভ হতো না। ধরা পড়লে লোকে বহুত কাহিনি বানায়, তাদের ধারণা আমিও বানাব। অথচ আমার ইচ্ছে করছে না নিজের ব্যাখ্যার্থে কিছু বলতে। হতাশাজনক শ্বাস ফেললাম ছোট্ট করে। পরপর তাদেরকে দেখে নিলাম। উঠে চলে যাওয়ার আগে বললাম,
-“আমার সাথে একজন ছেলেমানুষকে দেখে যারা ভেবেই নিয়েছে সম্পর্কটা কোন ধাঁচের, তাদের কাছে এর এক্সপ্লেনেশন দিতে আমার বড়ো আলস্য। তারা নির্বোধ। তারা আগামীকাল আমাকে আমার আপন ভাইয়ের সাথে দেখলেও কথা শোনাতে ছাড়বে না। এমন কথাকে গায়ে বাঁধাচ্ছি না। ধন্যবাদ। আজ অফ ডে, একটু কুহুকে নিয়ে ঘুরতে বেরোব। আপনারা বসুন, আপনাদের বিশেষত্ব নিয়ে সকল অবিশেষ গল্প করুন।”

উঠে রুমে চলে এলাম। মেয়েটা রুমে নেই, সম্ভবত খেলতে বেরিয়েছে। আমি শাড়ির আঁচল ঠিক করে বাড়ি থেকে বেরোলাম। বাড়ির পাশেই একটা ছোট্ট মাঠ আছে, ওখানে ওর বয়সী বাচ্চারা এই সময়ে খেলাধুলো করে। বাচ্চাদের এই বয়সে অন্য বাচ্চাদের সাথে মেশা প্রয়োজন। এতে তারা অল্প বয়সেই একাধিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানুষদের সংস্পর্শে এসে দুনিয়াদারির অনেকটাই বুঝে যাবে। বাচ্চাদের বিকাশের বয়সে এই মারামারি, ঝগড়াঝাঁটির খুব প্রয়োজন আছে। তারা মুখ থুবড়ে পড়বে, তবেই না একা একা উঠতে শিখবে। একাকি বেড়ে ওঠা মেয়েরা খুব নাজুক হয়, তারা অল্পতেই ভেঙে পড়ে, তারা নিজেকে সামলাতে জানে না। আমি কুহুকে পৃথিবীর সকল সুন্দর-কুৎসিত বিষয়াদির সাথে এই ছোট থেকেই পরিচয় করাতে চাই। মুহিব আমাকে এটা করতে বলেছিল।

সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় দেখি কুহু সিঁড়ির নিচে মুখে হাত রেখে বসে আছে। আমি এগিয়ে গিয়ে ওর পাশে বসে পড়লাম। কুহু খেয়াল করে রেলিং ঘেঁসে সরে গেল। আমিও ওর দিকে চেপে বসলাম। ও ঠোঁট উলটে বসে আছে। চোখ-মুখ ভেজা। আমি আস্তে করে বললাম,
-“মিস কুহেলি, আপনার কি কোনো সমস্যা হচ্ছে?”

বড়ো বুঝদার বাচ্চার মতো কুহু দু’দিকে মাথা নেড়ে নেতিবাচকতা প্রকাশ করল। পর পর ফুঁপিয়ে উঠল। আমি হাত বাড়িয়ে টেনে কোলে বসিয়ে নেওয়ায় কুহু ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার বুকে। শব্দ করে কান্না করতে লাগল। আমি ওর মাথায় হাত বোলাতে লাগলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর ওর কান্না থেমে এলে আমি জিজ্ঞেস করলাম,
-“কী হয়েছে, মা?’

কুহু আমার বুকে মুখ লুকিয়ে আছে। কান্নায় শাড়ির বুকের দিকের অংশ ভিজে গেছে। কী সাংঘাতিক কান্না করতে পারে মেয়েটা! মুহিব তো এমন না। নিশ্চয়ই আমিই ছোটবেলায় আমি ছিলাম। মেয়েটা মায়ের স্বভাব পেয়েছে। কুহু অনেকক্ষণ পর বললাম,
-“মামনি, ওরা আমাকে মেরেছে।”
-“ওরা? দেখি কই মেরেছে?”

কুহু দুইহাতের খামচানো অংশগুলো দেখাল, কিছু জায়গায় ছুলে গেছে। এরপর হাঁটু অবধি আকাশি রঙের ফ্রকটা উঁচিয়ে দেখিয়ে বলল,
-“আমি খেলতে গেছিলাম, ওরা আমাকে খেলায় নিচ্ছিল না। বলছিল, আমি পচা মেয়ে, আমার মামনি পচা। ওদের মামনি আমার সাথে মিশতে বারণ করেছে। আমার খুব খারাপ লেগেছে। আমি কখনও ওদের সাথে খারাপ কিছু করিনি, কখনও বকিনি, মারিনি। আমি কীভাবে পচা মেয়ে হই? আমি ওদেরকে জিজ্ঞেস করায় আমাকে খামচ্চি মেরে ধাক্কা দিয়েছে। মামনি, হাঁটুতে জ্বলছে খুব। ওরা আমাকে আর খেলায় নেবে না।”

এই বলে আবারও মেয়েটা আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল। আমি আঁচলের অংশ দিয়ে ওকে আগলে নিয়ে দু-হাতে আঁকড়ে ধরলাম, ওর মাথায় থুতনি রেখে বললাম,
-“ভালো মেয়েরা কান্না করে না। ভালো মেয়েরা সবসময়, সব পরিস্থিতিতে হাসে। আমার কুহেলি ভালো, তাই-তো?”

কুহু নাক টেনে বলল,
-“হু।”
-“মামনি আপনাকে ভালোবাসে, কুহেলি। আপনি কান্না থামান।”

কুহু বুঝদার বাচ্চাদের মতো কান্না থামাল। আমি ওকে কোলে নিয়েই বাড়ির ভেতর চলে গেলাম। লিভিং রুমে ভাবিদের আড্ডার আসরকে একবার আঁড়চোখে দেখে সরাসরি নিজের রুমে চলে এলাম। কুহুকে বিছানায় বসিয়ে আমি কাবার্ড থেকে ফার্স্ট এইড নিয়ে এলাম। তুলোতে এন্টিসেপ্টিক মিশিয়ে হাঁটুমুড়ে ওর সামনে বসে পড়লাম। ও লক্ষ্মী বাচ্চার মতো হাত এগিয়ে দিলো। আমি স্মিত হেসে বললাম,
-“সামান্য জ্বলবে কিন্তু।”

কুহু দু’দিকে মাথা নাড়ল। আমি আস্তে-ধীরে তুলো চেপে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করলাম। কুহু চোখ খিঁচে ধরল, কিন্তু কান্না করল না। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
-“আম্মাজান, ব্যথা পাচ্ছেন?”
-“একটু, মামনি।”
-“আর একটু, হয়ে গেছে প্রায়।”

আমি হাঁটুর দিকটায় পরিষ্কার করে দিলাম। তারপর স্টিকি ব্যান্ডেজ করে দিলাম। কুহুর মুখটা কী শুকিয়ে আছে! আমি জিজ্ঞেস করলাম,
-“আপনি কি মামনির সাথে ঘুরতে বেরোতে চান, কুহেলি?”

কুহু তৎক্ষনাৎ বলে উঠল,
-“ইয়েস! কোথায় নিয়ে যাবেন, মামনি?”
-“চলুন, পার্কে যাই। খুব মজা করব দু’জন। আইস্ক্রিম খাব, চকলেটস খাব। হু?”

কুহু দাঁত কেলিয়ে হাসল। আমি একটা সাদা ফ্রক পরিয়ে দিলাম কুহুকে। চুলগুলোয় দু’টো ঝুঁটিও করে দিলাম। এরপর নিজেও শাড়িটা পরিবর্তন করে ওর মতো সাদা আসমানি মিশেলের একটা শাড়ি পরে নিলাম।

তারপর একটা রিকশায় করে নিকটস্থ পার্কে চলে গেলাম। এখানে একটা নদীর শাখা আছে। সেখানটায় ফেলে রাখা এক বেঞ্চে ওকে নিয়ে বসলাম। আশে-পাশে অনেক মানুষ আছে। কুহু চুপটি করে বসে এদিক-ওদিক দেখছে। তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করল,
-“আচ্ছা মামনি, বাবাই আবার কবে আসবেন?”
-“বাবাই আসবে না, কুহেলি।”

কুহু বড়ো অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। চোখ-মুখ কুঁচকে, ঠোঁট ফুলিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“তা কেন?”
-“কারণ বাবাই মারা গেছে।”
-“মারা গেছে?”
-“হ্যাঁ।”
-“কেউ মারা গেলে আর ফেরে না?”
-“না, ফেরে না।”
-“কেন ফেরে না, মামনি?”

আমি ওর হাত দুটোকে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললাম,
-“কারণ এটা নিয়ম। আমরা দুনিয়াতে এসেছি একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। প্রতিটি মানুষেরই এখানে আসার পেছনে কিছু উদ্দেশ্য থাকে, সেই উদ্দেশ্য পূরণ হলেই মৃত্যু আসে। এরপর আবার ফিরে যেতে হয়। উদ্দেশ্য পূরণ হয়ে গেলে আবার আসবে কেন?”
-“বাবাইয়ের কী উদ্দেশ্য ছিল, মামনি?”
-“সম্ভবত আমাদের দুইজনকে গড়ে তোলা।”
-“বাবাইয়ের উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে?”
-“হয়েছে সম্ভবত।”
-“তাহলে আর ফিরবে না?”
-“না।”
-“আচ্ছা।”

কুহু হাত-পা নাড়াতে নাড়াতে আবারও আশে-পাশে দেখতে লাগল। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
-“আপনার খারাপ লাগছে না?”

কুহু পুনরায় আমার দিকে তাকাল, ফ্যালফ্যাল চোখে। কীজন্য খারাপ লাগবে, তা হয়তো বুঝতে পারছে না। আমি বোঝানোর তাগিদে বললাম,
-“আপনার বাবা আর ফিরবে না, খারাপ লাগছে না?”

কুহু দু-দিকে মাথা নেড়ে বোঝাল,
-“না, লাগছে না।”

আমি হেসে বললাম,
-“আমারও লাগছে না।”

কারণ মুহিবের শারিরীক মৃত্যু হয়েছে, তার কথা ও তার সকল আদর্শ এখনও বেঁচে আছে। মানুষটা আমাকে এক জীবনে ভালো থাকার সকল সূত্র ভালোভাবে বুঝিয়ে গেছে। আমার খারাপ লাগবে কেন? লাগছে না তো। হয়তো চলতি পথে কয়েকবার কদম নড়বড়ে হবে, হয়তো ক্লান্ত হব, হয়তো গুটিয়ে পড়ব! কিন্তু পরক্ষণেই ভালো থাকার জন্য সর্বোপরি খারাপ মানুষটা আমি হব। আর এটাই হচ্ছে লাইফের সাথে গেইমিং।

কিছুক্ষণ পর হুট করেই খেয়াল করলাম কেউ একজন এগিয়ে এসে ঠিক কুহুর সামনে দাঁড়ালেন। আমি তাকাতেই তিনি কুহুকে বললেন,
-“আপনি? মিস কুহেলি আরশাত?”

কুহু বিজ্ঞদের মতো উপর-নিচ মাথা নেড়ে বলল,
-“ইয়েস!”

আবির অবাক হয়ে বলল,
-“আরে বাপ রে! আপনি সত্যিই কুহেলি আরশাত?”

কুহু আমার দিকে একবার তাকাল, এরপর আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“মামনি বলেছেন, আননৌন কারোর সাথে কথা বলতে নেই।”

আবির হেসে আমাকে বললেন,
-“কুহেলির মামনি, কুহেলিকাকে আমার সাথে কথা বলার জন্য অনুমতি দিয়ে বাধিত করুন।”

আমি কুহুকে বললাম,
-“আচ্ছা।”

আবির উৎসুকভাবে কুহুর ওপাশে বেঞ্চে বসে বলল,
-“সি! পার্মিশন গ্র‍্যান্টেড।”

কুহু সব-ক’টা দাঁত বের করে হাসল। আবির এবার আমাকে বললেন,
-“আমি কি কুহুকে নিয়ে একটু ঘুরে আসতে পারি? যদি ম্যাডামের অনুমতি থাকে তো!”
-“কই যাবেন?”
-“আপনাকে বলব কেন, অনিন্দা?”

আমি হেসে ফেললাম,
-“ঠিক আছে, যান।”

কুহুকে কোলে তুলে নিলেন আবির। তার পরনে সাদা শার্ট, স্লিভস গোটানো, চোখে গ্লাস। তিনি বললেন,
-“সব ম্যাচিং ম্যাচিং! কী ব্যাপার, কুহেলি? মতলব কী?”

কুহু এতেও হাসল কেবল। আবির ওকে নিয়ে দূরের ওই আইস্ক্রিম পার্লারটিতে গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এলেন। প্রথমের সেই হাস্যোজ্জ্বল মুখটা তাঁর কেমন মিইয়ে রয়েছে। হাসছেন না একদমই। আইস্ক্রিম আমার দিকে এগিয়ে দিলে আমি তা হাতে নিয়ে বললাম,
-“কী হয়েছে, আবির ভাই?”

আবির কিছু বললেন না আমাকে আর। পুরোটা সময় কুহুর সাথে কথা বলল কেবল। আমিও আর কিছু বললাম না তাঁকে। সন্ধ্যের দিকে ফেরার সময় কুহুকে অনেকগুলো চকোলেটস নিয়ে দিলেন। এতে আমি বললাম,
-“প্রয়োজন নেই এসবের।”

আবির কঠোরভাবে তখন বললেন,
-“তোমার কোনো কিছুরই প্রয়োজন পড়ে না, অনিন্দা। কিন্তু বাচ্চা মেয়েটার পড়ে। একরোখা মেয়ে মানুষ তুমি। সেসবের আর কী বুঝবে?”

আমি সরু চোখে তাকিয়ে বললাম,
-“কীসের প্রয়োজন?”
-“একজন মা নিজেকে তার বাচ্চার জন্য যথেষ্ট মনে করলেও, একজন বাচ্চার জন্য কখনও তা যথেষ্ট নয়। আ সিঙ্গেল মাদার ক্যান নট এফোর্ড দ্যা হোল হ্যাপিনেস অভ আ চাইল্ডস নিড। কুহুর গায়ের প্রতিটি ক্ষত তার প্রমাণ হিসেবে জ্বলজ্বল করছে।”

আমি চুপ রইলাম। কুহু সম্ভবত আবিরকে সব বলে দিয়েছে! আমার আর আজগুবি লজিক দিয়ে তর্ক এগোতে ইচ্ছে করল না। আবির মিথ্যে বলেননি। আমি কুহুকে গোটা পৃথিবী দিতে পারলেও, কখনও একজন বাবা দিতে পারব না। এদিক দিয়ে আমি ব্যর্থ। শেষমেষ বললাম,
-“পৃথিবীতে সবার বাবা থাকা লাগবে এর কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে?”

আবির আরও গম্ভীর হলেন,
-“নিজের আর কুহেলির খেয়াল রেখো, অনিন্দা। তোমাদের লড়াই অনেকদূরের…”

|চলবে|

অসম্ভবে অসঙ্গতে পর্ব-০২

0

#অসম্ভবে_অসঙ্গতে
লেখক: নবনীতা শেখ
|পর্ব ২|

-“অনিন্দা!”

আবিরের আওয়াজ শুনে বুকটা কেমন কেঁপে উঠল আমার। মনে পড়ে গেল ঠিক আট বছর আগের সংঘর্ষগুলো। তখন আমি উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়েছি। বয়স উনিশ পেরোবে পেরোবে ভাব, চাল-চলনে ছিল চাঞ্চল্য। বয়সের চেয়ে অত্যাধিক উড়নচণ্ডী ছিলাম আমি। আবির ছিলেন আমার সেজো মামির ভাগ্নে। তাদের বাড়িও আমাদের মামা বাড়ি থেকে খুব একটা দূরে ছিল না। যতবার ছুটি পেয়ে মামাবাড়ি যেতাম, ততবারই আবিরের সাথে দেখা হতো, একটা আড্ডা জমত। তিনি আমার চেয়ে চার বছরের বড়ো। তবুও কীভাবে কীভাবে যেন বেশ সুন্দর একটা বন্ধুত্ব হয়ে যায় ছোট থাকতেই। মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত চমৎকার আর আমি কিঞ্চিৎ দুষ্ট প্রকৃতির। বর্তমানে আমি পালটেছি সম্পূর্ণভাবে, তারটা বলতে পারলাম না। তবে বিপরীত আকর্ষণবলের ক্রিয়া আমার মধ্যে সামান্য দেখা গিয়েছিল।

সেবার যখন আমার বিয়ে ঠিক হলো, আমি মামাবাড়ি গিয়ে সবার আগে বিষয়টা আবিরকে জানিয়েছিলাম। তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন,
-“তুই রাজি, অনিন্দা?”

আমি রাজি ছিলাম না। তাকে পছন্দ করতাম। কিন্তু মনের পছন্দটা সেই পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি, যেই পর্যায়ে গেলে তা মুখে আনা যায়। আবিরও আমাকে অন্য কোনো নজরে দেখতেন না। আমি তাকে জানাই,
-“হ্যাঁ, আবির ভাই। তুমি কিন্তু আসবে।”

আবির হেসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন,
-“ঠিক আছে, যাব।”

কিন্তু তিনি আসেননি। তারপর আর দেখা হয়নি তাঁর সাথে। বিয়ে হলো, বিয়ের পর কতবারই তো গেলাম মামাবাড়ি। অথচ তাঁর দেখা পাইনি। সেজোমামির কাছে জিজ্ঞেস করলে, তিনি বলেছিলেন উচ্চশিক্ষার জন্য দেশ ছেড়েছেন। তারপর একসময় মুহিব আমার সেই কিশোর হৃদয়ের ভালোলাগা পুরোপুরি মিটিয়ে দিলো। মুহিব!

শুরুটা যেখানেই হোক না কেন, শেষটা মুহিবের মাঝে গিয়েই আটকে রইল। আমার উত্তেজনা সব নেমে গেল। মিহি হেসে বললাম,
-“ভালো আছেন?”

আবির আমার দিকে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছেন। আমি ডেস্কে বসেছিলাম। তিনি দু-বার শ্বাস ফেলে হাতের তর্জনী ও বৃদ্ধার সাহায্যে কপাল ঘোষলেন, এরপর বললেন,
-“আমার কেবিনে আসুন।”

সেকেন্ডের ব্যবধানে উলটোদিকে ঘুরে কেবিনে চলে গেলেন। আমি হাতের কাজটা শেষ করে উঠে সরাসরি তার কেবিনের দিকে গেলাম। দরজা নক করে বললাম,
-“আসব?”

আবির আমাকে এক পলক দেখে সেদিকেই তাকিয়ে রইল। আমি সেই চাহনির মানে বুঝে ভেতরে প্রবেশ করে মুখোমুখি দাঁড়ালাম। তারপর স্মিত হাসলাম। হাসির চেয়ে ধারালো কোনো অস্ত্র নেই। কেবলমাত্র ছোট্ট একটা হাসির দ্বারা প্রবল শক্তিসম্পন্ন প্রতিপক্ষকেও দ্বিধায় ফেলা সম্ভব।
আবির আমার শত্রু নয়, তবে এমন একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে তা যেন আমার জন্য ছিল এক ভীষণ দুঃস্বপ্ন। সেই দুঃস্বপ্ন বাস্তবতায় মিশে গেল।

আবির কাঠকাঠ গলায় আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
-“তুমি এখানে কেন?”

আমি মুখ থেকে হাসি সরালাম না, সেভাবেই ভ্রু কুঁচকে বললাম,
-“কাজ করি এখানে।”
-“কেন?”
-“কেন আবার? জব করতে পারি না আমি?”
-“হঠাৎ?”

হাসি মলিন হলো আমার। অনমনীয় চোখে তাকিয়ে বললাম,
-“কী শুনতে চাইছেন?”
-“এ-ই, কর্মজীবী মেয়েদের দেখে সবসময় যেই মেয়েটা বলত, ‘বিয়ের পর আমি মোটেও চাকরি-বাকরি করব না। সম্পূর্ণ সময়টা সংসারে দেবো।’ সেই মেয়েটা এখানে কেন?”

চোখে চোখ রাখলাম আবিরের,
-“জানেন না কিছু?”

আবিরের চোখের পাতা সামান্য কেঁপে উঠল দেখলাম, সে বলল,
-“জানি না, জানতে চাইছি।”

আমি প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে বললাম,
-“তেমন কিছু না।”
-“বলার মতো না?”
-“আসলে মুহিব.. মানে আমার স্বামী! গত মাসের ৬ তারিখে মারা গেছে। তাই.. এখন অনেক ইচ্ছে-অনিচ্ছেই নিজেদের রাস্তা পালটেছে।”

আবির অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন, যেন মেনে নিতে পারছেন না। ধরা গলায় বললেন,
-“এত সাবলীলভাবে এত বিশ্রী সত্য বলতে পারছ?”
-“পারছি।”
-“কী করে?”
-“সত্য বলতে দ্বিধা থাকা উচিত নয়।”

আবির আমাকে সান্ত্বনা দিতে বললেন,
-“তুমি ঠিক আছ, অনিন্দা? ফ্যামিলিতে প্রবলেম হচ্ছে? কোনো সমস্যা? আমাকে বলো।”

বরাবরের মতোই উপহাসসূচক সেই হাসিটা ঠোঁটের ভাঁজে রাখলাম,
-“সহানুভূতি দেখাবেন না, আমার ভালো লাগে না।”

থেমে আবার বললাম,
-“মুহিব তার সকল অ্যাকাউন্টের নমিনি আমাকে করে রেখে গেছে। যা টাকা-পয়সা আছে, মনে হয় না গোটাজীবন বসে বসে খেলেও ফুরোবে।”
-“তবে চাকরি করছ কেন?”

আমি স্মিত হেসে বললাম,
-“আয়ের উৎস নিশ্চিত না করে কেবল ব্যয় করতে থাকলে, নিঃস্ব হতে সময় লাগে না।”

আবির কিছু বললেন না, টেবিলের ওপর থেকে গ্লাস তুলে পানি পান করলেন। এরপর নিজের চেয়ারে বসে কিছুক্ষণ মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলেন, কিছু ভাবলেন সম্ভবত। আমি তাকিয়ে আছি শুধু। বহুদিন পর মানুষটাকে দেখলাম। মনের ভেতর সেই ভালোলাগার অনুভূতিটা আছে, তবে তা কেবল সম্মানের। অন্য কোনোভাবে কল্পনা করার সুযোগ পাইনি আগে, আর এখন সম্ভব না। আমি এগিয়ে গিয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-“আপনি ভালো আছেন?”

আবির সঙ্গে সঙ্গে উত্তর নিলেন না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
-“হু, ভালো।”
-“আচ্ছা, আমি আসি তবে?”
-“হ্যাঁ, যাও।”

আমি উঠে দাঁড়ালাম। বেরিয়ে আসার আগ মুহূর্তে আবির পূনরায় ডাকলেন,
-“অনিন্দা!”

পিছে তাকিয়ে বললাম,
-“হু?”
-“অফিস আওয়ার শেষে নিচে ওয়েট কোরো। একসাথে বেরোব।”
-“কেন?”
-“কথা আছে সামান্য।”
-“আচ্ছা, ঠিক আছে।”

______
পাঁচটায় বেরোনোর সময় আবির গাড়ি নিয়ে এগিয়ে এলেন। আমি বিনাবাক্যে উঠে পড়লাম পাশে। আবিরকে বললাম,
-“ছয়টার মধ্যে আমাকে রোকেয়া সরণিতে নামিয়ে আসবেন।”
-“তাড়া আছে?”
-“হ্যাঁ, মেয়ে অপেক্ষায় আছে।”

আবির গাড়ি স্টার্ট করল, এরপর বলল,
-“মেয়ের নাম কী রেখেছ?”
-“কুহেলি আরশাত। ডাকনাম কুহু।”
-“সুন্দর নাম। বয়স কত?”
-“এ বছর পাঁচ পেরোবে।”
-“বাপের বাড়িতেই থাকছ?”
-“না, আমার বাড়ি ছেড়ে কই যাব?”

কিঞ্চিৎ অবাক হলো আবির,
-“তোমার বাড়ি? আলাদা থাকো?”
-“নাহ। মুহিবের বাড়িই তো আমার বাড়ি।”
-“ও বাড়ির সবাই ভালো?”
-“ভালো।”
-“সমস্যা হয় না তো কোনো?”
-“সমস্যাকে সমাধান করতে জানি।”

আবির হেসে ফেলল সামান্য,
-“তুমি অনেক পালটে গিয়েছ, অনিন্দা!”

আমিও হাসলাম,
-“ঠিক যেভাবে আমাদের মধ্যে তুই-তুমি থেকে, তুমি-আপনি চলে এসেছে।”
-“আগের মতো কিছুই নেই যে!”
-“তা বিয়ে করেননি কেন?”

হুট করেই অন্য প্রসঙ্গে ঢুকে পড়লাম আমি। আবির যেন প্রস্তুত ছিলেন এমন প্রশ্নে,
-“বিয়ের বয়স হয়নি আমার।”

এহেন কথায় হো হো করে হাসলাম আমি। হাসতে হাসতে বললাম,
-“রসিকতা করছেন?”
-“রসিকতা করব কেন? বয়সই বা কত আমার? সবে ৩২। ছেলেদের বিয়ের বয়স এরপর থেকে শুরু হয়।”
-“আচ্ছা, বুঝলাম।”

তারপর গাড়ি যখন বেশ নিস্তব্ধ সড়ক দিয়ে চলতে লাগল, আমি জানালার বাইরে তাকিয়ে আবিরকে বললাম,
-“আবির ভাই, জীবনটা কাফনের রঙের মতো সাদা। শুধু শুধু কালি ছেঁটানো কি উচিত?”

আবির কিছু বললেন না। আমি হেসে বললাম,
-“আবির ভাই, আমি ভালো আছি। মুহিব আমাকে একা চলতে শিখিয়েছিল ওর উপস্থিতিতেই, ও আমাকে ভালো থাকতে শিখিয়েছিল। ও আমাকে বলেছিল, কারো অনুপস্থিতি কারো জীবনে খুব বেশি সময় প্রভাব ফেলতে পারে না। তাই ওই যেটুকু সময় প্রভাব ফেলে, সেটুকু সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত, প্রভাবিত যাতে না হই সেজন্য সর্বস্ব দেওয়া উচিত। আমি তা-ই করেছি। নিজেকে ব্যস্ত রাখছি। নিজে সাবলম্বী হতে চাইছি। ওর রেখে যাওয়া টাকায় আমি কুহুকে নিয়ে ভালোই থাকতে পারতাম। কিন্তু লোকেরা সুযোগ নিতে চাইত। অবলা নারী ভেবে হাত বাড়াতে কেউ ইতস্তত করত না। ইতোমধ্যে চারপাশের কুৎসিত নজরগুলোর শিকার আমি হয়েছি। কিন্তু যখনই দেখে আমি নিজেকে চালানোর সামর্থ্য রাখি, অধিকাংশের নজর আমার থেকে ঝুঁকে যায়। আর বাকি যারা এখনও ছুকছুকানো নজরে তাকিয়ে থাকি, আমি অনিন্দিতা তাদের দৃষ্টিকে পায়ে মাড়াই না।”

আমি থেমে গেলাম, আবির পুনরায় বললেন,
-“একা চলা.. একা নারীর পক্ষে এতই সহজ?”
-“উঁহু, সহজ নয়। তবে আমি চাইলেই সহজ বানাতে পারি।”
-“কীভাবে?”
-“দেশে সিঙ্গেল মাদারদের অভাব নেই।”

আবির থেমে থেমে বললেন,
-“তোমার হাজব্যান্ডকে খুব ভালোবাসতে?”
-“হ্যাঁ, বাসি।”

তারপর পুরো রাস্তায় আবির আর কিছু বললেন না। আমিও বললাম না। গন্তব্যে পৌঁছে নামার সময় তাকে বললাম,
-“আবির ভাই, শুনুন?”
-“বলো।”
-“আমার প্রতি কখনও সহানুভূতি দেখাবেন না, অনুরোধ।”

আবির মলিন হেসে বললেন,
-“সহানুভূতির সাথে অনিন্দিতা নামটা যায় না ঠিক।”
-“আসি।”
-“এসো।”

তারপর থেকে গোটা মাস অফিসে বাড়তি কোনো কথা-বার্তা কেউই বললাম না। আবির ভীষণ বুঝদার মানুষ। উনি ভালো করেই জানেন, একজন বিধবা অথবা ডিভোর্সি নারীর সাথে অন্য কোনো পুরুষের মেশাটা সমাজ বেশ কটুচোখে দেখে। সমাজকে আমি কিংবা আবির কেউ-ই তোয়াক্কা করি না। তবে দু’জনেই শান্তিপূর্ণ মানুষ। শুধু শুধু অশান্তি ডেকে আনতে চাইনি। তাই খুব প্রয়োজন ব্যতীত একে-অপরের থেকে দূরে দূরে থাকলাম। অফিসে এ-ই, অফিসের বাইরে দেখা হলে এড়িয়ে যাইনি, বরঞ্চ মুচকি হেসে ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করেছি। তিনিও কো-অপারেট করে গেছেন আমাকে।

জীবনটা খুব স্মুদলি যাচ্ছে। অথচ এটা জীবনের নিয়ম না। জীবন অকস্মাৎ চমকে দিতে ভালোবাসে…

|চলবে|