Friday, July 18, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 224



অসম্ভবে অসঙ্গতে পর্ব-০১

0

#অসম্ভবে_অসঙ্গতে
লেখক: নবনীতা শেখ
|পর্ব ১|

বিদেশ থেকে আজ আমার স্বামীর লাশ এলো। স্তব্ধ আমিটা যখন প্রাণপ্রিয় স্বামীর চিরকালের জন্য নিশ্চুপ হয়ে যাওয়া মুখটা দেখে চিৎকার করে কাঁদতে চাইলাম, ওমনিই আমারই স্বজনদের কথাগুলো আমার কানে এসে সুচারু তীরের মতো বিঁধতে লাগল। আমি অবাক হয়ে গেলাম। কান্নারা আর এলো না।

আমার ভাসুর আর জায়েরা মিলে তখন জমি-জমার হিসেব কষতে ব্যস্ত। খালা আমাকে চুপিসারে জানিয়ে গেল,
-“বার বার বলছিলাম, জামাইয়ের থেকে তার পাওনা সব লিখ্যা নিতে। নিছোস? নেস নাই। এখন কী করবি? শ্বশুরবাড়ি থেকে এক আনাও পাবি না। জন্ম দিছোস মাইয়া, সব তো তোর দেবর-ভাসুরদের নামে হইয়া যাইবে।”

এখন কী হিসেব কষার সময়? আমি এক হাতে আমার পাশ থেকে কুহুকে আগলে নিই। মেয়েটা ভয় পাচ্ছে। এসব কী হচ্ছে, ও বুঝতে পারছে না। বয়সই বা কত? সবে পাঁচ। ও শুধু বুঝতে পারছে, কিছু একটা ঘটেছে। যা ঘটেছে, তা ভালো কিছু নয়, তা মারাত্মক খারাপ।

আমার শ্বশুর-শাশুড়ি বেঁচে নেই। যৌথ পরিবারের প্রায় অনেকটা খরচ আমার স্বামী বহন করত। তার মৃত্যুতে কেউ কষ্ট পাক বা না-পাক, টাকা-পয়সার চিন্তা করতে ভোলেনি। আমি আজ নতুন করে মানুষ চিনলাম। এরাই না বিদেশি পয়সার জন্য সব সময় আমায় মাথায় করে রাখত?

সারাটাদিন আমি আর কাঁদলাম না। চুপ হয়ে মেয়েকে নিয়ে মুহিবের নিথর শরীরটার পাশে বসে রইলাম। বিকেলে জানাজা হলো। বাড়িটা আস্তে-আস্তে খালি হচ্ছিল। আমি চুপ হয়ে বসার ঘরের এক কোণায় বসে বসে পাওয়া না-পাওয়ার হিসেব কষছিলাম যখন, প্রতিবেশীদের টুকিটাকি কথা ফের কানে এলো। একজন বলছে,
-“অল্পবয়সে বিধবা হইলো, এখন তো ঠিকই বেশ্যাপনা করে বেড়াবে।”

আরেকজন বলল,
-“মেয়েটার কথা ভাবছো? ওইটুকুন বাচ্চা! মা ভেগে যাবে আরেকটার সাথে, সব কষ্ট এসে পড়বে বাচ্চা মেয়েটার ওপর।”

আমি তাদের কথা শুনে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। কোত্থেকে যেন মা হুট করে এসে তাড়া দিতে লাগল আমাকে,
-“ওঠ, অনু। ব্যাগ গোছা। বাসায় যাবি আমার সাথে।”

একবাক্যে বলে দিলাম মাকে,
-“বাড়ির পরিস্থিতি তো দেখছই। সবটা ঠিক হোক? কুহুকে নিয়ে দু-চারদিনের জন্য বেড়াতে যাবনি, হুঁ? তুমি কি আজ যাবে না-কি থাকতে চাইছো?”

মা কিছু বলার আগে আমি আবার বলে উঠলাম,
-“মা, আজ বরং চলে যাও। কাল এসো। বাড়িতে অনেক মানুষ। জায়গা হবে না থাকার।”

মা আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরে অন্যপাশে নিয়ে গিয়ে বলল,
-“এরা তোকে শান্তি দেবে না। বাঁচতে পারবি না।”

শক্ত চোখে তাকিয়ে সামান্য হাসলাম ভাগ্যকে পরিহাস করে,
-“ভাইয়ের সংসারে বোঝা হয়ে কীভাবে থাকি, বলো? মুহিব বেঁচে থাকতে আমাকে বেশিদিন বাপের বাড়ি থাকতে দিতে চাইত না। ও বার বার বলত, আমি যে ও-বাড়ি যাই, আমার ভাবি মনে মনে বিরক্ত হতে পারেন; হয়তো ভদ্রতার খাতিরে বলতে পারেন না। আচ্ছা মা? অন্যের বিরক্তির কারণ কেন হব?”

মা হয়তো আমাকে বুঝল। কিন্তু সেসব আরও কঠিন হয়ে বলল,
-“তোর বাপের বাড়ি আছে। তোর বাপের যতটুকু টাকা আছে, তুই আর কুহু তিনবেলা খেতে-পড়তে পারবি।”

অনড়ভাবে বললাম,
-“ওই টাকায় ভাইয়ার অধিকার। আমার সংসার আমি ছাড়ব না। মরলেও এখানেই মরব।”

মা দ্বিতীয়বার আর কিছু বলার সাহস পেল না। আস্তে-আস্তে আমার সংসারটা কেমন যেন হয়ে উঠতে লাগল। বড়ো জিদ করে তো বলেছিলাম, আমার সংসার আমি ছাড়ব না। কিন্তু..

পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন চারটি দিন কাটল আমার। আমি ভেঙে পড়িনি। বিয়েটা পারিবারিকভাবে হলেও, ভালোবাসায় আমাদের কোনো অংশেই কমতি ছিল না। তাই তো প্রতিবার দেশ ছাড়ার আগের রাতে আমি তার বুকে নির্ঘুম পড়ে থেকে ফোঁপাতাম। অসম্ভব ধৈর্যসম্পন্ন মুহিব আমাকে শান্ত করতে কত কী-ই না করত! ছেলেভোলানো সব কথা বলত। এক পর্যায়ে আমি বুঝদার বাচ্চাদের মতো কান্না থামিয়ে তার কথা শুনতে লাগলে, সে রসিকতা ছেড়ে আমাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরত নিজের বুকে। তারপর বলত,

-“অনিন্দিতা, আগামীকাল এই সময়টায় আমি তোমার থেকে কয়েকশত কিলো দূরে থাকব। তখন চাইলেও তুমি আর রাগ দেখাতে পারবে না, চাইলেও গাল ফুলিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকতে পারবে না। কেননা তখন আমি এভাবে বুকে জড়িয়ে তোমার মান ভাঙাব না। এভাবে টুকটাক আদরে তোমায় নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়ে ভাবাব না। আগামীকাল মাঝরাতে যখন তোমার ঘুম ভাঙবে, তুমি অর্ধ অচেতনতায় বিছানা হাতড়ে আমায় খুঁজবে। বিনিময়ে এক বুক হাহাকার পাবে। আর কয়েক ঘন্টা আছি আমি। আমাকে নিয়ে তোমার পৃথিবীতে যত কথা আছে, আমাকে বলো। আমি শুনব। মৃত্যুর কাটা সেকেন্ডের চেয়েও দ্রুত এগোয়। আমি কাল যাব, এটা সত্য। দূরত্ব বাড়বে, সেটাও সত্য। অথচ দীর্ঘসময়ের এই দূরত্বটা ঘুচিয়ে আমি আবারও তোমার কাছে ফিরব—এই কথাটা অসত্য প্রমাণ হতে সময়ের প্রয়োজন পড়বে না। প্রতিবছর অসংখ্য প্রবাসী লাশ হয়ে স্বজনদের কাছে ফিরছে। আমি তোমায় গ্যারান্টি দিতে পারব না যে, নেক্সট লাশটা তোমার স্বামীর হবে না। ওদের স্ত্রী/সন্তানরা শেষ বিদায় জানাতে পারে না। অসংখ্য না বলা কথা থেকে যায় ওদের। অসংখ্য পরিকল্পিত ভবিষ্যৎকে অতীত বানিয়ে রেখে যায় ওরা। আমি তোমায় পরিকল্পনা করতে বারণ করি। আমি তোমায় শেষ বিদায় জানানোর সুযোগ দিই। তাই প্রতিবার তুমি আমাকে বিদায় জানাবে, ঠিক যেমন ধরো আর এই বুকে আসতে পারবে না। অনিন্দিতা! আর কয়েক ঘন্টা আছে। আমাকে বিদায় জানাও।”

আমি তার কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতাম। তারপর আস্তে-আস্তে মানিয়ে নিতে লাগলাম। প্রতি বিদায়ে তাকে আমি শেষবারের মতো বিদায় জানাতাম। তাকে নিয়ে যত ভাবনা-চিন্তা ছিল, যত রাগ-অভিমান ছিল, সব বলতাম। এই তো, পাঁচ মাস আগে যখন নিয়মমাফিক আবারও বিদায় জানানোর দিন, মুহিব আমার চুল আঁচড়ে বিনুনি গাঁথতে গাঁথতে বলেছিল,
-“আমি না থাকলেও, তুমি নিজের খেয়াল রাখতে কার্পণ্য করবে না। নিজের যত্নে খামতি রাখবে না। খাওয়া-দাওয়ায় হেলা করবে না। কুহুকে অযথা বকাবকি করবে না। রাগ উঠলে কাগজে লিখবে, এরপর পানিতে ভিজিয়ে ফেলবে কাগজটা। দেখবে, ঠিক শান্তি লাগছে। জীবন আমাদের প্রতিপদে জীবিকার শিক্ষা দেয়। তুমি হতাশ হবে না, শিক্ষা নেবে, এগিয়ে যাবে। জীবনের প্রতিকূলে যেতে চেয়ো না, স্রোতের টানে ভেসে যাবে। অনুকূলে তাল মেলাতে থেকো। বিশ্বাস করো, জীবনকে একবার নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে শিখে গেলে, এর চেয়ে সুন্দর কিছু আর খুঁজে পাবে না। অনিন্দিতা, তুমি অত্যন্ত বুঝদার একজন মেয়ে। আমার কথাগুলোকে মনে রেখো সর্বদা।”

আমি মনে রেখেছি সেসব। ভুলিনি কিছুই। ভুলতে পারিনি। সেজন্যই এতখানি স্বাভাবিক সম্ভবত!

_____
সকাল থেকে আমার মেয়েটা বেশ হেসেখেলে বেড়াচ্ছে। আমার ননদের ছেলে-মেয়েরা ওর সমবয়সী, ওদেরকে পেয়ে আনন্দ ধরছে না। কুহুর দিনগুলো এভাবেই আর রাতগুলো আমার বুকে শক্ত করে মিশে থেকে কাটছে। ছোট থেকেই বাবার সান্নিধ্য সেভাবে সে পায়নি বলে কোনো ধরনের শক্ত অনুভূতি মেয়েটা পাচ্ছে না। এখানে ওর দোষ নেই। ওর সাথে ওর বাবার তেমন কোনো স্মৃতি নেই। কিঞ্চিৎ যা-ও ছিল, বড়ো হতে হতে সে-সব আর মনে থাকবে না, এটা ধ্রুব সত্য।

মুহিবের মৃত্যুর চতুর্থ দিন আজ। আয়েশা ভাবি আর রিমা ভাবি মিলে দুদিন ধরে কথা শোনাচ্ছে। ওরা চেয়েছিল আত্মীয়-স্বজনদের ডেকে খাওয়াতে। কিন্তু মৃত্যু উপলক্ষে লোক খাওয়ানোটা মুহিব ঠিক পছন্দ করত না, তাই কঠিনভাবে জানিয়েছি তাদের,
-“এসব কিছুর প্রয়োজন নেই।”

মুহিবের বড়ো ভাই আমাকে ভীষণ স্নেহ করেন, এজন্য কেউ আর আমার ওপর উচ্চবাচ্য করতে পারেনি, মেনে নিয়েছে আমার কথা। মুহিবের রেখে যাওয়া কথাগুলোকে আদর্শ মেনে দিন চলতে শুরু করলাম। চাকরির চিন্তাটা যখন মাথায় এলো, তখন খুব মনে পড়ল মুহিবের জোর করে আমার পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার দিনগুলো। বিয়ের পর পড়াশোনা করার ইচ্ছেটা ছিল না, তবুও মুহিবের রোজ এক কথা, “বিয়ে মানে সংযুক্তি, নির্ভরশীলতা নয়। আগামীদিনটিতে আমি কর্মক্ষম হয়ে গেলে তুমি যেন সার্টিফিকেটের দোহায় দিয়ে আফসোস না করো, তার খেয়াল রাখাটাও আমার দায়িত্ব।”

আমি অকম্পিতভাবে সার্টিফিকেটগুলো ছুঁয়ে গেলাম। ছুঁয়ে গেলাম আমার নামটা, অনিন্দিতা অনু, অভিভাবক মুহিব আহসান। একাধারে ছোটখাটো যত জব সার্কুলার পেলাম, সবেতেই অ্যাপ্লাই করতে লাগলাম। বাছ-বিচার তেমন একটা করলাম না। সিভি দেখে তন্মধ্যে বেশ ভালো একটা কোম্পানি থেকে ডাকা হলো আমাকে। অল্পতেই ঘাবড়ে যাওয়া আমি প্রবল আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ় মনোবলের দ্বারা ভাইবাতেও উত্তীর্ণ হলাম। জয়েনিং সোমবার।

এ নিয়ে বাড়িতে কম ঝামেলা হয়নি। বড়ো ভাই একবার বলেছেন,
-“অনু, তোমার এসব কাজ করা লাগবে না। আমরা মরে যাইনি।”

নিজের জায়গায় শক্ত থেকে আমি বলেছি,
-“মুহিব চাইতো না আমি কখনও কারোর ওপর নির্ভরশীল হই। আমি ওর চাওয়াকে সম্মান করি।”

বড়ো ভাই আর কিছু বলেননি। সেই সাথে জায়েদের আমার মুখের ওপর বলা “চাকরি করে দুনিয়া কিনে নেবে নাকি” কথাটা থেমে গেল সামনা-সামনি। গোপনে শুরু হলো এর ওর কাছে আমার নিন্দে। ব্যাপারটা ধরতে পারি আমি, তারপরও চুপ থাকি। তর্ক সুশিক্ষিতার শিক্ষা ধ্বংস করে অশিক্ষিতার পর্যায়ে নামিয়ে আনে। মুহিব না আমাকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে উঠে-পড়ে লাগত?

বাড়িটায় আগের মতোই থাকার চেষ্টা করি। ওদের কারো কথাকে তোয়াক্কা করি না। সরাসরি কেউ অবশ্য কিছু বলার সাহসও পায় না। গতকাল বড়ো আপা বলেছিল, একটু হিসেব করে চলতে এখন।

আমি অবাক হয়ে তখন শুধিয়েছি,
-“কেন? সহানুভূতি দেখাচ্ছেন? না-কি আমার স্বামীর রেখে যাওয়া টাকার অভাব?”

মুখের ওপর এভাবে বলে ফেলাতে বড়ো আপা ঘাবড়ে গিয়েছেন, ইতস্তত করতে করতে বলেছেন,
-“তোর আর কুহুর ভালোর জন্যই বলেছিলাম, ছোট।”
-“আপা, এত ভালোর দরকার নেই। আল্লাহ যতদিন হাত-পায়ের জোর রেখেছেন, ইনশাআল্লাহ অভাব আসবে না আমার আর কুহুর লাইফে। জীবন চলার জন্য যতটুকু প্রয়োজন, আমি করব। স্বামী বেঁচে আছে মানে নারী রানি। স্বামী নেই মানেই দুঃখিনী? এ কোন নিয়ম?”

কোত্থেকে যেন ছোট আপা এসে বললেন,
-“এই তোর দুঃখ লাগছে না, অনু? বর মরেছে মাস গেল মাত্র, বিন্দুমাত্র শোক নেই?”

আমি শক্ত চোখে তাকিয়ে বললাম,
-“শোক নেই, আপা। মৃতদের জন্য মনে শোক রাখা উচিত না, দুঃখ পাওয়া উচিত না। মৃত্যু কখনও অনাকাঙ্ক্ষিত হয় না। প্রতিটি মানুষের হায়াত সৃষ্টিকর্তা তার জন্মের সময়ই লিখে রেখেছেন। এর কিঞ্চিৎ বেশি বাঁচার সামর্থ্য কারোর নেই। তবে মৃত্যুর মতো এত সত্য বিষয়ের সাথে আমরা অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দটা যোগ করে কেন শোক পালন করব?”ggg

ওরা আর কিছু বলেনি এরপর আমাকে। সম্ভবত ভেবে নিয়েছে স্বামী শোকে পাথর বনে গিয়েছি। ব্যাপারটা তা নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন বিষয় হচ্ছে মৃত্যু, আর মুহিব আমাকে এই বিষয়টা সহজভাবে গ্রহণ করতে শিখিয়েছিল। যে মৃত্যুকে মেনে নিতে পারে, সে দুনিয়া জয় করতে পারে। সেদিন মুহিবের লাশের সামনে দাঁড়িয়ে আমি সামান্য নড়বড়ে হয়েছিলাম অবশ্য, তারপর নিজেকে শক্ত করতে আমার খুব একটা সময় লাগেনি।

দিনগুলো এভাবে কাটল। আস্তে-ধীরে সোমবার চলে এলো। একটা হালকা রঙের সুতির শাড়ি পরে নিলাম। চুলগুলোয় খোঁপা, হাতে ব্রেসলেট, গলায় একটা সরু চোকার্স। সাজসজ্জা এমনিতে পছন্দ না আমার, তবে সাজলে নাকি মেয়েদের আত্মবিশ্বাসের বাড়ে। এই কথাটাও আমাকে আমার সেই বিখ্যাত দার্শনিক মুহিব আহসান জানিয়েছিলেন। লোকটার কথায় জাদু ছিল! মনে পড়লেই ঠোঁটের ভাঁজে আপনা থেকেই কী মিষ্টি একটা হাসি চলে আসে..

অফিস যাওয়ার পথে কুহুকে বাড়িতে রেখে যেতে ইচ্ছে করছিল না। তাই ওকে নিয়েই বেরোলাম। পথিমধ্যে মায়ের বাড়ি, ওকে সেখানে রেখে আমি ফের রওয়ানা হলাম। ঘন্টাখানেকের রাস্তা৷ বাসে গেলে আধ ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাওয়া যাবে। কিন্তু প্রথম দিন পাবলিক ট্রান্সপোর্টে যেতে ইচ্ছে করল না। একটা ক্যাব বুক করে নিলাম। এরপর পৌঁছালাম আমার গন্তব্যে।

অফিসে প্রথমদিন আমিসহ আরও দু’জনের জয়েনিং হলো। সবাই ফুল দিয়ে আমাদের অভিবাদন জানাল। নতুন ছেলে-মেয়ে দু’জন অন্য টিমের। আমাদের টিমের লিডার আজ ছুটিতে আছেন। তাই তার অ্যাসিসটেন্ট আমাকে আমার কাজগুলো বুঝিয়ে দিলো। প্রথম দুটো দিন সাধারণভাবেই কাটল। সকালে কুহুকে মায়ের বাড়ি রেখে বের হওয়া, এরপর ৯-৫টা অফিস। তারপর মায়ের কাছ থেকে কুহুকে নিয়ে বাড়ি ফেরা। এই তো, এভাবেই যাচ্ছে।

অথচ বিপত্তি ঘটল যেন ঠিক ক’দিন পর! আমাদের টিম লিডারকে দেখে আমি ভড়কে গেলাম, পায়ের মাটি নড়বড়ে হয়ে উঠল। এতটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ব জানলে সম্ভবত এই শহরেই থাকতাম না। আমাকে দেখে তিনিও অবাক হয়েছেন। অবিশ্বাস্য গলায় ডেকেছেন,
-“অনিন্দা!”

চলবে…

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব–৬০ এবং শেষ পর্ব

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
অন্তিম প্রহর

মোতাহার আহসান নাতনিকে পেয়ে সন্তুষ্ট হয়েছেন। অসুস্থতা যেন কর্পূরের মতো উবে গেছে। পারুল দূর থেকে নাতনিকে দুর্বল চোখে দেখে নিষ্প্রভ হয়ে যান। নিজের রক্ত মেয়েটির দেহে প্রবাহিত হলেও স্পর্শ করা অন্যায়, অপরাধ, ছুঁলে পাবেন কঠোর সাজা। তীব্র অভিলাষ হৃদমাঝারে ধামাচাপা দিয়ে আঁচলে অশ্রু মুছল। কাতর গলায় বলল, “চলো। আমাদের সংসারে ফিরে যাই।”
বিপরীত মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখার অপেক্ষা না করেই ত্যাগ করে আহসান বাড়ি।‌ বাড়ির রাস্তায় উঠতে বিদ্যুৎ গতিতে ইমদাদ হোসেন যোগ দিলেন। শক্ত আঙুলের ভাঁজে পারুলের কোমল আঙুল ডুবিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “পারুল, আমাদের ভাগ্যের ওপরে মানুষের হাত নেই। মানুষ কখনো মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারেনা।”
“আর সময় কখনো মানুষের জন্য অপেক্ষা করে না। আর মানুষ? নিজের স্বার্থে আঘাত লাগলে সাপের মতো ফোঁস করে উঠে।” প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে চোখের পানি বিসর্জন দিচ্ছে পারুল। এই কয়দিনে তার চোখের পানি সংগ্রহ করলে পুকুর ভরে যেত। কদমের পর কদম ফেলে মৃধা বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছাতে সময় বেশি লাগল না। জনশূন্য বাড়িটা এই চার দিনে ভীতিকর হয়ে উঠেছে।
ইমদাদ হোসেন শার্টের পকেট থেকে দুটো তাবিজ বের করে পেয়ারা গাছের ভিন্ন বাদে ঝুলালেন। পারুল ঝোপঝাড়ের দিকে তাকিয়ে শীতল করছে মায়ের মন। চট করে ইমদাদের পাশে দৃষ্টি যেতেই ভ্রু কুঁচকে এলো তার। দ্রুত পায়ে সেদিকে গিয়ে সন্দিহান গলায় বলল, “কী করছ এখানে? এটা পেয়ারা গাছের সাথে বাঁধছ কেন?”

দুটো তাবিজ ঝুলিয়েছে গাছে, তারমধ্যে একটি আগের অন্যটি ফকির বাবা দিয়েছে। বলেছে দুটো একই ডালে ঝুলিয়ে রাখতে। স্বামীর আশাতীত কাজটির জবাব না পেয়ে ফের বলল, “আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি তোমাকে!”

“ফকির বাবার কাছে গিয়েছিলাম। কেউ আমাদের সংসার ভাঙনের জন্য এই তাবিজ এখানে ঝুলিয়েছ। গণনা করে বলেছে, তোমাকেও খাবারের মাধ্যমে কিছু খাইয়েছে। তাকে তো এত সহজে ছেড়ে দিতে পারিনা। তাই আমার এই ছোট্ট আয়োজন।” কথাটা বলে রোয়াকে উঠে ঘরের তালা খুলে ইমদাদ হোসেন। শোকাহত মাথায় ইমদাদের কথাটি পৌঁছাল না পারুলের। ফের প্রশ্ন করলেও উত্তর পেল না ইমদাদের কাছ থেকে। পেছনের বারান্দা থেকে কোদাল এলে দক্ষিণ দিকে পা বাড়িয়ে আবার ফেরত হলো। পারুলের হাত দুটো ধরে বললেন, “আমি আর শহরে ফিরে যাব না পারুল। গ্ৰামে ছোটোখাটো কাজ করে যা উপার্জন করব, তাতে আমাদের চলে যাবে।”

দুহাতে স্বামীর কলার মুঠো করে ধরে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকাল পারুল। বিনিময়ে শার্টের ওপরের অংশ পারুলের অন্তরের মতো দুমড়ে মুচড়ে গেল। মাথাটা ইমদাদের বাঁপাশে রেখে বাঁধ ভাঙল পারুলের। টর্নেডোর মতো ইমদাদ হোসেনেও বুকে ভাঙন ধরল। স্ত্রীকে ঠিক সামলে নিবেন তিনি। বুঝতে দিবে না আঘাত।
__
পরপর দুটো রিকশা থামল দরজায়। অপূর্বকে দেখেই সম্মান জানাল প্রহরী। অপূর্ব মাথা দুলিয়ে ডাক্তার নিয়ে ভেতরে ঢুকল। তীব্র অসুস্থতার লোকটাকে মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব করতে দেখে ভারী চমকাল। মগবুল আলম ভুঁইয়া চিন্তিত হওয়ার ভান করে খানিক রঙ্গ করলেন, “অপূর্ব, রোগী কে?”

“আমিও তো তাই ভাবছি, রোগী কে? আমাকে কি মিথ্যা বলল?”

অনিতা ছেলে ও বৌমাকে দেখে প্রসন্ন হলেন। খুশি সকলে। অপূর্ব মাকে প্রশ্ন করল, “মা, বাবা কী অসুস্থ ছিল?”

অনিতা ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করলেন। বাড়িতে ইমারজেন্সি রোগী দেখতে গিয়ে বোধ হয় এটাই প্রথম, রোগী খেলছে নাতনির সাথে।

“হ্যাঁ। একদম কথাই বলতে পারছিল না। নাতনিকে দেখে সে সুস্থ। তুই যখন ডাক্তার নিয়ে এসেছিস, একবার চেক করে রাখ।”

“হ্যাঁ স্যার একটু দেখুন।” অপূর্বর অনুরোধে মোতাহার আহসানকে চেক করে হতাশ হয়েই ফিরে গেলেন মগবুল সাহেব। কেবল প্রেসার বেড়েছিল। প্রেসারের ওষুধ নিয়মিত খেতে ও চিন্তামুক্ত থাকতে বলেই বিদায় নিয়েছেন। অপূর্ব ও আরু অতিথিদের মতো ইতস্তত করছে বসতে। ক্ষণে ক্ষণে দুজনের মাঝে দৃষ্টি আদানপ্রদান করে ইঙ্গিতে আলোচনা করছে। এক পর্যায়ে অপূর্ব সহসা বলেই ফেলল, “মা, বাবা যখন এখন সুস্থ আছে। আমরা তবে আসি।”

হৃদয় ভাঙল সকলের, কেবল মোতাহার আহসান আগের ন্যায় হাসিখুশি। নাতনির সাথে খেলতে খেলতে বললেন, “দেখেশুনে যাস। আর কোনো প্রয়োজন হলে বলিস।” একটুকু বলে দম ফেলল। অপূর্ব পাখির কাছেপিঠে যেতেই মোতাহার আহসান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে গমগম করে বললেন, “পাখির কাছে তোর কী? পাখি আমাদের সাথেই থাকবে। তোদের যেতে হলে যা। ও তোদের সাথে‌ আসেনি, তোদের সাথে যাবেও না।”

হোক বেপরোয়া, হোক ঠোঁটকাটা, কিন্তু বাবার আদেশের কাছে ভেজা বিড়াল অপূর্ব আহসান। এটা সম্মান! মল্লিকা একটা পান বানিয়ে এনে চম্পার হাতে দিল। তর্জনীর ডগায় চুন লাগিয়ে চম্পা বলল, “মেয়েকে ছেড়ে কত যেতে পারিস দেখি।”
“আমি এখানে থাকব না দাদি জান। এই বাড়িতে আমার, আমার স্ত্রী, আমার সন্তানের কোনো মূল্য নেই।”
মোতাহার আহসান পাখিকে শেফালীর কোলে রেখে বিছানা ছাড়লেন। অনিতাকে বিছানার ময়লা পরিষ্কার করে বলে অপূর্বকে বললেন, “কে বলেছে তোকে? আমি তো বলিনি! তুই তো সব বুঝিস অপু। এটাও একটু বোঝ। ধর একদিকে তোর বোন তুর, অন্যদিকে পাখি। কোনদিকে পা বাড়াবি তুই? দশ মাস দশ দিন গর্ভে রেখে মা হয়। তারপরে বড়ো হয়। এক মুহুর্তের মাঝে যদি সে চলে যায়, কেমন লাগে মায়ের? আমার বুঝদার ছেলেটাও অবুঝ।”

বাবাকে অপূর্ব অসম্মান করবে না। সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব অপূর্বর কাঁধে তুলে দিয়ে মোতাহার আহসান বললেন, “আজ থেকে তুই এই বাড়ির কর্তা, তুই চেয়ারম্যান হবি, তুই বাবাও হবি। দেখি আমার ছেলে কতটা দক্ষ।
চেয়ারম্যানকে হতে হবে শক্ত, হতে হবে নরম। সবার মনের কথা বুঝতে হবে। তুই তো মনোচিকিৎসক, আশা করি এটা তুই খুব ভালো পারবি।”

অপূর্ব এগিয়ে গেল। জড়িয়ে ধরল। দুই ফোঁটা অশ্রু চোখ থেকে ঝরার পাশাপাশি ঝরে পড়ল আবেগ। যেই পিতা মাতা দূরদেশে রেখে শিক্ষিত করেছে, তাদের ছেড়া যাওয়া উচিত হয়নি। মোতাহার আহসান অপূর্বকে বুকে জড়িয়ে কানে কানে বললেন, “তুই ঠিক, আমরা ভুল। পাশে থেকে ভুলগুলো শুধরে দিস বাবা। দূরে গিয়ে বাবাকে অপরাধী করিস না। যেই গ্ৰামে আমি চোখের মণি, যেখানে আজ আমি কয়লার খনি। আরেকটু হলে বোধ হয় বাবাকে আর এসে পেতিস না। পাখিকে পাঠিয়ে এ যাত্রায় বাঁচিয়ে দিলি।”

অপূর্ব চমৎকার হাসল। বাবাকে এবার পদ থেকে মুক্তি দিবে। পরিবার পরিজন ও গ্ৰাম নিপুণভাবে সামলে বাবার আধিপত্য বজায় রাখবে। বাবার থেকে সে কোনো অংশে কম নয়।

পরিশিষ্ট
সালটা এগিয়ে গেছে। গ্ৰামের রাস্তাটা পাকা হয়েছে এবার। আজ তার উদ্বোধন হবে। আহসান বাড়ির বাইরে তীব্র শোরগোল শোনা যাচ্ছে। গ্ৰামবাসীরা অপেক্ষা করছে অপূর্বকে নিয়ে যাওয়ার। অপূর্ব আলমারি খুঁজেও সঠিক পাঞ্জাবি পাচ্ছেনা। নিরুপায় হয়ে নিচতলায় নেমে আরুকে খুঁজতে লাগল। অসাবধানতায় ধাক্কা লাগল তিস্তার সাথে। সরি বলে মুখের দিকে তাকিয়ে চট করে বলল, “তোরা কখন এলি?”
“ওমা! এই প্রথম আমাদের গ্ৰামে পাকা রাস্তার উদ্বোধন হবে, আর আমরা দেখতে আসব না? শেফালীরাও আসছে। নে তৌফিককে ধর।”

তিস্তা তার ছেলেকে তুলে দিল অপূর্বর কোলে। মামা বলে আদরে মাখিয়ে দিল ভাগনেকে। অতঃপর হাঁক দিল আরুকে, “আরু দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার। তাড়াতাড়ি পাঞ্জাবি বের করে দে।”

আরু রান্নাঘর থেকে বিরক্তি নিয়ে বের হলেও তিস্তাদের দেখে মন ভালো হয়ে গেল। হাতের পায়েসের বাটিটা অপূর্বকে দিয়ে তিস্তায় সাথে ভালোবাসায় মেতে উঠল। অপূর্ব হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে ফের বলে, “লেট হয়ে যাচ্ছে আরুপাখি!”

“আপনার মনোমতো একটা পরলেই তো পারেন। তিস্তা আপুর সাথে একটু কথাও বলতে পারছি না। ধ্যাত!” বলতে বলতে আরু দোতলার দিকে পা রাখল। পিছু ফিরে রান্নাঘরে থাকা সুমিকে উদ্দেশ্য করে বলল, “ভাবি, তিস্তা আপুদের পায়েস দিও। আমি চেয়ারম্যানের চেয়ারটা ভেঙে আসছি।”

আরুর কথা শুনে অট্টোহাসিতে ফেটে পড়ল পরিবেশ। দ্রুত পায়ে উপরে এসে আলমারি থেকে সাদা রঙের একটা পাঞ্জাবি বের করে বলল, “শুভ কাজে সাদাই ভালো। এটা পরুন।”

“এদিকে আমি তো কালো পরতে চেয়েছিলাম। আমার জীবনে তুই আসার পর সব এলোমেলো হয়ে গেছে। ভালো মন্দের জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি।”

“ঢং!” আরু পা ফেলল। অপূর্ব আটকে দিল পথ। এক কদম এক কদম করে এগোতে শুরু করল। রসগোল্লার মতো চোখ করে আরু বলল, “সামনে থেকে সরুন। নিতে যাব।”

“চেয়ারম্যানের চেয়ার ভাঙবি না?” দুজনের দূরত্ব তখন শূন্যতায় পৌঁছেছে। অপূর্ব প্রেমপূর্ণ হয়ে উঠল। দুহাতে আরুর টকটকে গাল ধরে নাকে নাক ছুঁয়ে বলল, “চেয়ার তো ভাঙলি না। আমার তো উচিত, তোর রাগ ভাঙা। তা রাগ ভেঙেছে।”

মনের আকাশে তখন রাগ নামক বস্তুটা সরে ভালোবাসার রোদ উঠেছে। লজ্জায় মুখটা অপূর্বর বুকে গুঁজল। অপূর্ব ঝাঁঝে বলল, “ছিলাম এক মুডে। নামিয়ে দিল আরেক মুডে। আমি তো রোমান্স করতে চাইলাম, আর তুই বুকে লুকিয়ে পড়লি?”

“আমি মহান। মাত্র গোসল করেছেন। আপনাকে আর গোসল করাতে চাই না।” অপূর্বর গলা জড়িয়ে আরু বলল। অপূর্ব মুগ্ধতা মিশিয়ে এক গাল হাসল। অপূর্বর গালে টোল পড়ল। পুনরায় আরু বলল, “এই হাসিটা আমার দুর্বলতা, এই টোল আমার দুর্বলতা। গোটা আপনিই আমার দুর্বলতা।”

“জানি। একটা কথা বলব?”

“হুঁ!”

“ওরা সবাই রাস্তার উদ্বোধন দেখতে যাবে, তুমি যেও না প্লীজ?”

“কেন?”

“প্রয়াস আসবে সন্ধ্যায়। বাবা-মাকে ছাড়া কাউকে জানায়নি। আজ পাকা কথা হবে। অনেক আয়োজন করতে হবে। সবাই যদি যাই, তাহলে আয়োজন কে করবে?” অপূর্বর কথায় আরুর মুখের হাসিটা চওড়া হলো। মেয়েটা লুকিয়ে লুকিয়ে প্রয়াসের সাথে যোগাযোগ করে। সেদিনের পর আরুর সাথেও তেমন কথা বলে না। আজকের পর আর অভিমান করে থাকতে পারবে না। তুরের বিয়ে হয়ে যাবে! অপূর্ব দুহাতে আরুকে আরেকটু জড়িয়ে ধরে বলল, “এত সুন্দর একটা সুখবর দেওয়া জন্য দুইটা পাপ্পি লাগবে। তাড়াতাড়ি দাও।”

বলেই চোখ বন্ধ রাখল অপূর্ব। পরপর দুগালে ওষ্ঠদ্বয় স্পর্শ করে ছুটে পালাল আরু। অপূর্ব গালে হাত দিয়ে প্রেমময় গলায় বলল, “আমার চণ্ডাবতী, লজ্জাবতী, রূপবতী, গুণবতী আর পদ্মাবতী।”

অপূর্ব তৈরি হয়ে সবাইকে নিয়ে বেরুল। পাখি ও তিহান দাদা অন্তঃপ্রাণ। বের হওয়ার আগে পাখিকে নিয়েই বের হয়ে তিনি। মেজো ভাই তৌফিককে কোলে নিয়েছে। শাহিনুজ্জামান শেফালীর দুই সন্তানকে কোলে নিয়েছে। তিহানকে কোলে নিয়েছে নিঃসন্তান ছোটো ভাই। স্ত্রীর মা হওয়ার ক্ষমতা না থাকলেও ভাতিজি, ভাতিজা, ভাগনি দিয়েই শখ আহ্লাদ পূরণ করেছে। এবার নানি নাতনিও শখ ওদের সন্তান দিয়েই পূরণ করবেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রচণ্ড ভিড়। এই প্রথম গ্ৰামের রাস্তার উদ্বোধন। তাঁবুর ভেতরে আহসান পরিবার বসে আছে। অপূর্ব উদ্বোধন শেষ করে তাঁবুর ভেতরে আসতে পাখি চেয়ার থেকে উঠে অপূর্বর কাছে ছুটে গেল। অপূর্ব খোশমেজাজে মেয়েকে কোলে নিয়ে বলল, “পাখি মায়ের কী হয়েছে?”
“আমি একটু ওদিকে যাব? যাব আর আসব। এক জন আমাকে ডাকছে।”

মেয়ের কথায় অপূর্বর কপার চিন্তার ছাপ পড়ল। আগন্তুককে দেখার জন্য আগ্রহ ধামাচাপা দিতে অপারগ হলো অপূর্ব। পাখিকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে বলল, “যাও পাখি! উড়ে যাও।”

পাখি দিল ভোঁ দৌড়। অপূর্ব ধীরে ধীরে এগোল সেদিক। বেগুনী রঙের শাড়ি পরে পারুল দাঁড়িয়ে ছিল পাখির অপেক্ষায়। পাখি ছুটে এসে বলল, “এসেছি। বলো কী বলবে?”

পারুল কোলে নিল পাখিকে। বয়স তার পাঁচ বছর এগারো মাস আট দিন। বাবা মায়ের পর যদি কেউ বেশি আপন হয়, সেটা নানি। পারুল পরম আদরে পাখিকে আদর করে‌ চলেছে। অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিয়ে বলল, “মাঝে মাঝে আমার কাছে এসো, এই নিঃসন্তান মায়ের কোলে তুমি একটু সুখ হয়ে এসো।”

পারুল কাঁদছে। পাখি সেই কান্না সহ্য করতে পারছে না। আলতো হাতে মুছে দিয়ে বলল, “কেঁদো না, আমার বাবা চেয়ারম্যান। বাবাকে তোমার কষ্টের কথা বলো। দেখবে, বাবা তোমার সব কষ্ট দূর করে দিবে।”

“তোমার বাবা আমার কষ্ট সহ্য করতে পারবে পাখি। তবে আমাকে সহ্য করতে পারবে না।” বলেই পাখিকে কোল থেকে নামাল। এতক্ষণে পাখির খোঁজ নিশ্চয়ই পড়েছে। যদি এক সাথে দেখে ফেলে, আর অপূর্ব যদি কড়া কথা বলেই ফেলে তখন? পারুলের এই ভয়টাই সত্যি হলো। অপূর্ব দেখে নিল দুজনকে। তবে আজ কোনো রাগ নেই, চোখে বিরাজমান রাজ্যের বিস্ময়। এ কি হাল হয়েছে পারুলের? চোখমুখের দিকে তাকানো যায় না! পাখি হারিয়ে গেলে আরু ও অপূর্বও কি এমন হাল হবে? না! পাখি কোথাও যাবে না! অপূর্ব তাকে যেতে দিবে না। অপূর্ব কোমল গলায় বলল, “পাখি এসো।”

পাখি এসে অপূর্বর আঙুলে আঙুল ঢুকিয়ে হাসল। অপূর্ব এগিয়ে যেতে যেতে কয়েকবার তাকাল সেদিক।
সন্ধ্যার দিকে প্রয়াস তার বাবা মাকে সাথে নিয়ে সম্বন্ধ নিয়ে এলো। তুর বিস্ময় কাটাতেই না। লজ্জায় সে আটখানা। তিস্তা, শেফালী সাজাচ্ছে তুরকে। মহিলারা কথা বলছে পাত্রপক্ষের সাথে। আরু ও সুমি রান্নাঘরে। খাবারের পর্ব শেষ হতেই তুরকে নেওয়ার ডাক পড়ল। শেষ পাতে পানের সাথে তুরকে নিতে এসে আরু বলল, “তুরকে আর সাজিও না তিস্তা আপু। নাহলে এখন দেখবে এক রকম, বিয়ের সময় দেখবে আরেক রকম। ভাববে বউ পালটে দিয়েছি।”

সুমি প্রতিবাদ করল, “একদম না! আমাদের তুর সবসময় সুন্দর।”

শেফালী রঙ্গ করে বলে, “তোর বাসর ঘরে যা হবে, আমাদের বলবি কিন্তু। নাহলে বাসর ঘরে ঢুকতেই দিব না।”

“তোর বাসরে কী হয়েছিল বলেছিস? আমার বাসরের কথা কেন বলব?”

“শোন, আমার বাসর ঘরে তেমন কিছুই হয়নি। আমি তিয়াস ভাইয়ের জন্য কেঁদেছি আর কালাচাঁন আরুর জন্য।”

“পরে তো রোমান্স ঠিকই হয়েছে। তখন বলতি। আবার বলিস না কখনোই অমন কিছু হয়নি। কিছু না হলে তোদের দুটো পোনা আসত না।” তুর অকপটে বলে ফেলল। শেফালী দুই সন্তানের জননী। দুটোই মেয়ে, মিষ্টি ও বৃষ্টি। অপূর্ব, তিয়াস, সুজন ও কালাচাঁন তখনই ভেতরে এলো। সবাইকে গল্প করতে দেখে বলল, “তাঁদের যাওয়ার সময় হয়ে গেছে, আর তোরা বাসরের কথা ভাবছিস। পরে এইসব আলাপ করবি। তাড়াতাড়ি চল তুর।”

তুর আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ল। হুট করে তার অপূর্ব ভাইকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। অপূর্ব মাথায় হাত বুলিয়ে ব্যঙ্গ করল, “এখন এত কাঁদলে বিয়ের সময় কী করবি তুই? কান্না জমিয়ে রাখ, এক সাথে কাঁদিস।”

“মজা করছেন? আমি কিন্তু বড়ো হয়ে গেছি।”

“জানি! বিয়ে দিব এখন।”

“ক্ষমা করবেন ভাই।‌ প্রয়াসের জন্য আপনাদের সাথে দূরত্ব বজায় রেখেছি। ভুল বুঝেছি।”

“পা/গ/লি মেয়ে! আরুর সাথে বেশি খারাপ আচরণ করেছিস। ওর কাছে ক্ষমা চেয়ে সব মিটমাট করে নে।” অপূর্ব আদেশ দিল তুরকে। অপূর্বর আদেশ মেনে তুর হাতজোড় করে ক্ষমা চাইল, “আরু সেদিনের ব্যবহারের জন্য আমি অনুতপ্ত। ক্ষমা করিস বোনটাকে। তোদের জন্যই আজ এত বড়ো একটা সারপ্রাইজ পেলাম।”

তুরের প্রতি আরুর কোনো অভিযোগ নেই। তবুও অভিনয় করে কঠোর গলায় বলল, “আমি তোর বড়ো ভাবি। পা ধরে ক্ষমা চাইতে হবে।”

তুর পা ছোঁয়ার আগেই আরু ধরে ফেলল। তুরকে জড়িয়ে নিয়ে বলল, “সুখে থাক তোরা!”

এরমধ্যে চিৎকার শুনতে পেল সকলে। পাখির কান্না শুনে সবকিছু ফেলে রেখে বৈঠকখানায় ছুটে গেল আরু। পাখির পা থেকে রক্ত ঝরছে। কান্নায় চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। আরু দ্রুত মেয়েকে কোলে নিয়ে সান্ত্বনা দিল, “এই তো এসেছি মা, কিচ্ছু হয়নি। কীভাবে ব্যথা পেয়েছিস?”

মোতাহার আহসান ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল, “কেউ একটু পানি নিয়ে আয় জলদি।”

অপূর্ব পানি এনে পাখির পা ভিজিয়ে রাখল। চম্পা পান চিবিয়ে পাখির ক্ষতস্থানে লাগিয়ে কাপড় দিয়ে বেঁধে দিল। শাহিনুজ্জামান বললেন, “পাঁচটায় খেলতে খেলতে দরজার চিপায় পা ঢুকিয়ে দিয়েছে। বের করতেই রক্ত ঝরতে শুরু করল।”

পাখি হেঁচকি তুলে কাঁদছে। আরু মেয়ের পিঠে চাপড় মে/রে দোলাতে দোলাতে বলল, “আপনারা কথা বলুন। আমি ওকে নিয়ে ঘরে যাই।”

“তুই ওকে আমার কাছে দে। বাইরে হেঁটে আসি।” মোতাহার আহসান হাত বাড়াতেই পাখি যেতে চাইল। আরু যেতে দিল না। দ্রুত পা ফেলে ওপরে যেতে যেতে বলল, “অতিথি এসেছে। আপনি পাত্রীর বাবা। আপনার থাকা জরুরি। আপনি এখানেই থাকুন।”

অপূর্বও আরুর পেছনে পেছনে গেল। কাঠের সিঁড়ি ভেঙে মেয়েকে নিয়ে ঘরের ভেতরে হেঁটে শান্ত করার চেষ্টা করছে আরু। কিন্তু মেয়ে কি শান্ত হওয়ার? কাঁদতে কাঁদতে বলে, “এখানটা না খুব ব্যথা করছে!”

আরু ফুঁ দিয়ে ব্যথা কমানোর চেষ্টা করে। মেয়ের কান্নায় ভেতরটা বেরিয়ে আসার উপক্রম। অপূর্বর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, “শান্তি পেয়েছেন আপনি? মেয়েটার দিকে একটু খেয়াল রাখতে পারতেন না? সারাদিন তো মহান কাজ করেন, বাড়ি থাকার সময়টুকু একটু মেয়ের দিকে নজর দিলে কী এমন ক্ষতি হয়!”

অপূর্বর পদ্মাবতী চণ্ডাবতী হয়ে আছে। তার কাছে টু শব্দটি করার স্পর্ধা অপূর্বর নেই। মাথাটা নত করে বলল, “অপু সরি। অনেক সরি। ভুল তো সংশোধন করা উচিত? চলো সংশোধন করে আসি।”
অপূর্ব আলমারি থেকে জামাকাপড় নামাতে মরিয়া হয়ে উঠল। ট্রাভেলিং ব্যাগ ভরতি করল তিন জনের জামাকাপড়ে। মেয়েকে শান্ত করতে করতে আরু বলল, “ওগুলো নামাচ্ছেন কেন? মাথা খারাপ করবেন না কিন্তু। এগুলো কিন্তু আর গোছাতে পারব না।”

অপূর্ব আরুর কথা শুনল না। নিজের মতো কাজ করে নিল। ব্যাগ ও পাখিকে নিয়ে নিচে নামতেই দেখল পাত্রপক্ষ বিদায় নিয়েছে। অপূর্ব কৌতূহল নিয়ে বলল, “কী পরিয়ে গেছে?”

তুর হাত দেখিয়ে অনামিকা আঙুলের দিকে ইশারা করল। সেখানে চকচক করছে স্বর্ণের আংটি। বাড়ির সবাই অপূর্বর ব্যাগ দেখে না চমকে পারল না। অনিতা প্রশ্ন করল, “কোথায় যাচ্ছিস তোরা?”

“আমি জানি না মামুনি। তোমার ছেলেকে জিজ্ঞেস করো। ব্যাগপত্র গুছিয়ে কোথায় যাচ্ছে কে জানে?” খানিক বিরক্ত প্রকাশ করল আরু। অপূর্ব কিঞ্চিৎ হেসে বলল, “শ্বশুর বাড়িতে যাচ্ছি মা, কতদিন হয়েছে যাই না। চেয়ারম্যান হিসেবে একটা দায়িত্ব আছে না?”

আরু থমকে গেল। চকচক করছে চোখের পাতা। অপূর্বর এই সিদ্ধান্ত সবাই কেবল সন্তুষ্ট নয়, আনন্দিত। চম্পা বললেন, “তুই সত্যি ওই বাড়িতে যাবি অপু?”

“এই তো যাচ্ছি।”

“তাহলে আমরা এখানে থেকে কী করব? চলো, আমরাও ফুফুর বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।” তিস্তা সবাইকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলল। সবাই এতে মত দিল। মোতাহার আহসান বললেন, “মা মেয়ের এই মুহুর্তটার সাক্ষী হতে আমরাও যাব। কে কে যাবি?”

“আমি!” সবাই একসাথে। আরু হাসে। অপূর্বর হাতটা শক্ত করে ধরে বলল, “আমরা আগে যাই?”

“যা!” মোতাহার আহসান অনুমতি দিল। আরু আগে আগে গেল। পাখি ঘুমিয়ে পড়েছে আরুর কোলে। রাত করে টাইসনকে বের করল অপূর্ব। ঘোড়ার পিঠে চড়ে আরুর হাত ধরে টেনে তুলল। পাখিকে ঘুরিয়ে নিজের কোলে নিয়ে বলল, “পাখি আমরা ঘোড়ায় চড়েছি।”

“সত্যি বাবাই! টগটগ করে ছুটবে এবার।” অপূর্বর আদেশ পেয়ে টাইসন ছুটতে লাগল নিজের পথে। এই সামান্য মুহুর্ত আরুর কাছে যুগ যুগকেও হার মানাবে। মৃধা বাড়ির সামনে এসে ঘোড়া থামল। সবকিছু আগের মতো রয়েছে। ঘোড়া আওয়াজ শুনে কান খাঁড়া হয়েছে ইমদাদ ও পারুলের। আরু চট করে ঘোড়া থেকে নেমে ছুটে ভেতরে যেতে যেতে বলল, “ময়না, ময়না, ময়না।”

প্রত্যুত্তরে ময়না আরুপাখি আরুপাখি আরুপাখি বলে উড়ে এলো। কাঁধে বসে নিজের সুরে ডাকল। পারুল ও ইমদাদ ঘর থেকে নেমে এলো। আরুকে বাড়িতে দেখে দৃষ্টিভ্রম মনে করল। অপূর্ব ততক্ষণে ঘোড়া বেঁধে ভেতরে চলে এসেছে। বিনীত সুরে সালাম দিল। দুজনেই সেই সালাম নিল। পারুল আবেগে ভেসে বলল, “তোরা সত্যি এসেছিস? এটা আমার স্বপ্ন নয়তো?”

“না! স্বপ্ন নয়! বাস্তব।” বলেই আরু ঝাঁপিয়ে পড়ল মায়ের কোলে। পারুলের নিঃসন্তান তকমা ঘুচে গেল। অপূর্বও ইমদাদ হোসেনের সাথে আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলো। পারুল অনুতপ্ত হয়ে বলল, “এক সন্তানকে হারিয়ে আমি উন্মাদ হয়েছিলাম। সব কষ্ট আমি তোর ওপর ঝেড়েছি। ক্ষমা করিস আরু।”

“মায়েরা হাজারো ভুল করতে পারে। তাদের ক্ষমা চাইতে হয়না। তখন তোমার ওপর আমার অনেক অভিমান ছিল তাই দূরে সরে গেছি। এখন আবার ফিরে এসেছি।” পারুলের মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে। অপূর্ব পাখিকে পারুলের কোলে তুলে দিয়ে বলল, “পাখিকে আর লুকিয়ে কোলে নিতে হবেনা।”

পারুলের কোলে উঠে পাখি প্রশ্ন করল, “এরা কারা বাবাই?”

“এরা তোমার মায়ের বাবা মা। মানে তোমার নানাজান আর নানিজান।” অপূর্ব উত্তর দেয়। দুজনের আদরে পাখি আজ অনেক খুশি। আরুর দৃষ্টি পড়ে ঝোপের দিকে। যেখানে শায়িত আছে অয়ন। আরু এক কদম এক কদম করে এগিয়ে যায় সেদিক। অপূর্ব ইমদাদের থেকে পাখিকে চেয়ে ঝোপঝাড়ের দিকে পা ফেলে বলে, “সাত ভাই চম্পা নিবাস ফাঁকা হয়ে গেছে। সবাই এখানে আসছে। প্রস্তুতি নিন।”

পারুলের আনন্দ ধরে না। কতদিন পর আবার পরিচিত মুখগুলোর দেখা পাবে। কী করে আপ্যায়ন করবে ভেবে পায় না।

আরু সবার প্রথমে সালাম দিয়ে ভাইয়ের খবর নিল, দোয়া দরুদ পড়ল। তারপরে মোনাজাত ধরে ভাইয়ের রুহের মাগফিরাত কামনা করল। আরুর দৃষ্টি গেল কিছুটা দূরে। সেখানে নতুন একটা কবর। যেটা তার দাদিজানের। মারা গেছে পাঁচ বছর আগে। ইমদাদ হোসেন গাছে তাবিজ বাঁধার পর থেকে তার অবস্থা দিনদিন খারাপ হতে লাগল। এক সময় রক্ত বমি করতে লাগল‌, তার কিছুদিন পর বিছানা থেকে উঠতেই পারল না। মায়ের এই অবস্থা দেখে ইমদাদ হোসেন সব বুঝে গেলেন যে, তার সংসার ভাঙনের পেছনে তার মা জড়িত। গাছ থেকে তাবিজ খুলে দিলেন। এরপর? এরপর সেই অসুস্থ শরীর নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মা/রা গেলেন।
আরু পাখিকে বলল, “এই হচ্ছে তোমার মামার করব। যেদিন তুমি চোখ খুলে এই পৃথিবী দেখছ, সেদিন সে চোখ বুজেছে।”

“আর চোখ মেলেনি?”

“না! সে ওখানে শুনে আছে।

“আমার সাথে দেখা করবে না?”

“না।”

পাখির মন খারাপ হলো। তখনই বাড়ির ভেতর থেকে শোরগোল শোনা গেল। সবাই চলে এসেছে যে! আরু সেদিকে পা বাড়াল। তখনও আরুর কাঁধ জুড়ে আছে ময়না পাখি। দখিনা হাওয়াতে উড়ে গেল ঘোমটা। অপূর্ব পেছন থেকে তার পদ্মাবতীকে দেখতে দেখতে ছন্দ মিলাল,

দিঘির মাঝে ফুটেছে পদ্ম,
নীল তার রং।
ঘন কালো কেশ কেড়েছে আমার চোখের ত্রাস, তন্দ্রা, গ্লানি!
নূপুরের ঝুনঝুনিতে পুলকিত হলো, হৃদয়খানি।
সে যে আমার নীলপদ্ম!
জানতাম তুই আসবি।
তুই আসবি বলেই, নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে।

[সমাপ্ত]
পাখি ও তার দাদার বন্ডিং + তুর ও প্রয়াসের বিয়ে নিয়ে একটা সারপ্রাইজ পর্ব লিখব সময় করে।

নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-৫৮+৫৯

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৫৮

আকাশে চলছে মেঘের গর্জন। বিদ্যুৎ চমকানিতে বিরতি নেই। অদূরে বিদ্যুতের খুঁটির ওপর বাজ পড়তেই আলো শূন্য হলো ঘর। চৌকির ওপর অপূর্বর রানি ও রাজকন্যা শুয়ে আছে। অপূর্ব টিউবওয়েল চেপে গোসল করেছে। পরিধান করেছে ইরফানের ব্যবহৃত লুঙ্গি ও ফতুয়া। কলতলাল ভেতরে থাকাকালীন বিদ্যুৎ যাওয়াতে অপূর্ব দরজা খুঁজে পেল না। টিনের ওপর ধাক্কা দিয়ে ডাকে ইরফানকে, “ইরফান, আলো নিয়ে এদিকে আসো। আলোতেই আমি খুঁজে ঘরে যেতে পারব না, এখন তো অন্ধকার।”

কলতলা থেকে ঘরের দ্রুত অনেকটা। কিঞ্চিৎ সময়ের ব্যবধানে ইরফান কুপি ও ছাতা মাথা নিয়ে এলো কলতলায়। দরজার উপরে খানিক ফোকট ছিল বিধায়, আগমনের সাথে সাথে হলদে আলো পৌঁছে গেল ভেতরে। টিনের দরজায় ধাক্কা দিয়ে ইরফান বলল, “তাড়াতাড়ি বের হন স্যার, ঘরে দুইটা কুপি। একটা ভাবির কাছে রেখে অন্যটা নিয়ে এসেছি। আমার স্ত্রী অন্ধকারে রুটি বানাচ্ছে।”

লহমায় দরজা খুলে বের হলো অপূর্ব। এক হাতে ভেজা জামাকাপড়, অন্য হাতে সাবানের বক্স নিয়ে পা ফেলতেই ইরফান দ্রুতি কণ্ঠে বলল, “স্যার, এগুলো আপনি আমাকে দিন। আমি দড়িতে মেলে দিব। আপনি ছাতা আর কুপি ধরুন।”

হাত অদলবদল করে পালটে নিল জিনিসপত্র। অতঃপর এগিয়ে গেল ঘরের ভেতরে। অপূর্বকে ঘরে ভেতরে দিয়ে ইরফান চলে গেল রসুইঘরে। অপূর্ব গামছায় নিজের মাথা মুছে চৌকির সাথে মেলে দিয়ে আরুর পাশে বসল। পাখির ঘুমন্ত মুখের পানে চেয়ে বলল, “কখন ঘুমিয়েছে?”

“মাত্রই ঘুমিয়েছে।”

“মশা কামরাচ্ছে?”

“হাতপাখা দিয়ে গেছে। হাওয়া করছি। বৃষ্টির সময় সব মশা ঘরে চলে এসেছে। এমনিতেই শীতল আবহাওয়া। হাওয়া করলে পাখির ঠান্ডা লাগবে।”

“দেখি ইরফানকে বলে মশারির ব্যবস্থা করতে পারি কি-না। তুই পাখিকে দেখ।” বলেই অপূর্ব অগ্রসর হলো। আরুর মনে পড়ল তার ময়না পাখির কথা। অয়নের চিন্তায় পাখিদের খাবার দেওয়া হয়নি। উদ্বিগ্ন হয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই অপূর্ব এলো মশারি হাতে। সাথে এলো মিতা। পেরেকের সাথে মশারির কোনা লাগাতে লাগাতে বলল, “তোমার কিছু প্রয়োজন হয়ে আমাকে বলো আরু। বয়সে তুমি আমার ছোটো। নির্দ্বিধ আমাকে বলবে। লজ্জা পেয়ে আমার থেকে এড়িয়ে গেলে মেয়ে অসুস্থ হবে।”

“দুঃখিত বুবু। কিছু প্রয়োজন হলেই বলল আপনাকে।”

“মনে থাকে যেন। লজ্জা পেয়ো না। এখন তোমরা আমাদের কাছে আছো। তোমাদের বিপদ দেখার দায়িত্ব আমাদের।”
ততক্ষণে হাতের কাজ শেষ মিতার। মশারি চৌকির চারদিকে গুটিয়ে দিয়ে বলল, “রুটি বানিয়েছি। আরেকটু অপেক্ষা করো, নিয়ে আসছি।”

আরু লজ্জাবনত হয়ে বলল, “এই বৃষ্টির ভেতরে ঝামেলা কেন করতে গেলে বুবু?”

“বুবু বলে ডাকছ, আর তোমার জন্য এইটুকু করতে পারব না? এই সময়ে তোমার ভারি খাবার খাওয়া উচিত। বৃষ্টি না থাকলে তোমার ভাইকে দোকানে পাঠাতাম। যেহুতু বৃষ্টি তাই আটা দিয়ে রুটি করেছি। তোমরা কথা বলো, আমি আসছি।” বলেই ছুটে গেল মিতা। আরু বিছানা থেকে একটু উত্তরে সেঁটে গেল। ঠান্ডা হাওয়া দেহে মেখে বলল, “একটু বাবাকে কল দিবেন? ময়নাদের আজ খাবার দেওয়া হয়নি। বাইরে খাঁচায় রেখেছে ওদের। কেন যে আপনি গতকাল ওদের বাড়িতে আনতে গেলেন!”

“কিন্তু ফোন আমি বন্ধ করে রেখেছি।”

“খুলে কল দিন। বৃষ্টিতে ভিজে ওদের ঠান্ডা লেগে যাবে। এখন আমিও নেই ওদের পাশে। কে যত্ন নিবে?” মিষ্টি সুরেলা কণ্ঠে আবদার করল আরু। সেই আবদার ফেলার সাধ্য অপূর্বর নেই। অপূর্বকে এত বড়ো গিফট ‘পাখি’ দিল! তার বিনিময়ে হলেও আরুর কথা রাখা উচিত অপূর্বর। টেবিলে ওপর থেকে নিজের মুঠোফোন হাতে নিয়ে চালু করল। অতঃপর ডায়াল করল ইমদাদ হোসেন মৃধার নাম্বারে। এই কলটির জন্যই বোধ হয় ইমদাদ হোসেন অপেক্ষায় ছিলেন। চকিতে কল রিসিভ হলো। বিরতিহীন বলে গেল, “অপূর্ব কোথায় তুই? আরু কোথায়? পাখি কেমন আছে? ওদের নিয়ে কোথায় চলে গেছিস তুই?”

“আমরা শহরে আছি এখন ফুফা। আরু ও পাখি দুজনেই সুস্থ আছে। বাড়ির পরিবেশ এখন কেমন?” অপূর্ব এপাশ থেকে বলল।

“রোয়াকে বসে আছি আমি। পারুলকে নিয়ে গেছে ভাইজান। তোরা কোথায় আছিস বল, আমি গিয়ে নিয়ে আসব।”

“আমাদের নিয়ে চিন্তা করবেন না। যার জন্য ফোন করেছি, ময়নারা বাইরে আছে‌। ওদের ভেতরে নিয়ে খাবার দিন।”
আরুর কথা শুনতেই ইমদাদ হোসেন পাখির খাঁচা নিয়ে ঘরে চলে গেলেন। ভাঙা চাল দিলেন খাবার হিসেবে। সারাদিন পর খাবার পেতেই ক্ষুধার্ত পাখিরা দিশেহারা হয়ে খেতে লাগল। অতঃপর আশ্বস্ত করল অপূর্বকে, “ওদের খাবার দিয়েছি।” ফের কিছু বলার আগেই অপূর্ব লাইন বিচ্ছিন্ন করল। বন্ধ করে রাখল ফোন। ইমদাদ হোসেনের কল আর সংযোগ দিল না।
__
রুটি ও সবজি ভাজি রেঁধেছে মিতা। বিদ্যুৎ এখনো আসেনি। ঘরের মাঝামাঝি একটা হারিকেন জ্বালিয়ে রাখা। আরুর জন্য হাতে করে খাবার এনে মিতা বলল, “ভাই কি এখানে খাবেন? ড্রাইনিংয়ে আসুন।”

“না। এমনিতেই আমার খাওয়ার ইচ্ছে নেই। আপনি আরুর জন্য দুটো রুটি নিয়ে আসুন।” অপূর্বর জবাব শুনে আরু বলল, “আমিও খাব না। খেতে ইচ্ছে করছে না।”

“আপনি আরুর কথা শুনবেন না। নিয়ে আসুন!” দৃঢ় গলায় অপূর্ব বলতেই মিতা চলে গেল। পরপর আরুকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আজ তোর শরীরের উপর দিয়ে ধকল গেছে। খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো না করলে অসুস্থ হয়ে পড়বি। আগে খাওয়া তারপর সবকিছু।”

আরুর মুখে টু শব্দ নেই। মিতা খাবার বিছানার পাশের টেবিলের ওপর ঢাকা দিয়ে রেখে গেল। আরু বিছানা মধ্যে থেকে কিনারায় কোনোরকম বসল। অপূর্ব কাঠের চেয়ার টেনে বসে টেবিল ও আরুর কাছাকাছি। রুটি ছিঁ/ড়ে ভাজি মিশিয়ে আরুর মুখে তুলে দিয়ে বলল, “আমাদের পাখির জন্য একটু শক্ত হ আরু। একটু।”

আরুর চোখের বাঁধ ভাঙল। উপচে পড়ছে জল। ভাঙা গলায় বলল, “এমনটা কেন হলো? এই কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই যে।”

আরুকে হৃদমাঝারে নিয়ে অপূর্ব বলল, “তুই একজন মা, আরু। মায়েদের হতে হবে তুলার চেয়ে কোমল, আবার লোহার চেয়ে শক্ত। কাঁদিস না।”
__
শেষ রাতে আরুর চোখের পাতা একত্রিত হয়নি। বৃষ্টির ধারাও নেমে এসেছে শূন্যতায়। নেই মেঘ, নেই বজ্রপাত, নেই বিদ্যুৎ। এখনো জ্বলছে হলদে কৃত্রিম আলো। অপূর্ব ঘুমালেও ক্ষণে ক্ষণে তার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটছে।‌ আগামীকালের কাজের কথা মাথায় রেখে ঘুমাচ্ছে আবার আরুর কথা ভেবে উঠে যাচ্ছে। ভোরের আলোতে আংশিক অন্তরিক্ষ স্বচ্ছ হতেই কেঁদে উঠল পাখি। অপূর্ব ধরফরিয়ে উঠে বসে পাখির দিকে তাকায়। ক্লান্ত মুখমণ্ডল আরুর, ঘুমে কাঁদা সে। ডাক দেওয়ার স্পৃহা নেই তার। পাখিকে কোলে দিতেই লক্ষ করল, পটি করে দিয়েছে। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে পরিষ্কার করল। অতঃপর কোল নিয়ে একা একা কথা বলতে বলতে পার করে দিল বহু ক্ষণ।
অফিসে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসতেই দরজার কড়া নেড়ে উঠল ইরফান। ফিসফিস করে বলল, “স্যার উঠেছেন? আজকে চেম্বারে যাবেন?”

“হ্যাঁ যাব।” প্রতুক্তি দেওয়ার সেই মুহুর্তে আরুর ঘুম ভাঙল। হাতিয়ে মেয়েকে না পেয়ে উঠে বসল। সন্ধান পেল বাবার কোলে মেয়েকে। হাত বাড়িয়ে কাছে চাইল মেয়েকে, “আমাকে ডাকতেন, কতক্ষণ পাখিকে কোলে নিয়ে ঘুরেছেন?”

“সারা রাত না, তবে অনেকক্ষণ।”
দরজা খুলে ইরফানকে যেতে বলল অপূর্ব।মুখ ধুতে যাওয়ার আগে আরুকে পর্যবেক্ষণ করল। বাড়ি থেকে এক কাপড়ে নেমে এসেছে। ভালো কিছু পোশাক কেনার পাশাপাশি আসবাবপত্র কিনতে হবে। আজ না পারলেও আগামীকাল নতুন ভাড়া বাড়িতে উঠবে। এবার থেকে পরিবারের বোঝা বইতে হবে তাকে।

চলবে ইন শা আল্লাহ

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৫৯

ইরফানদের টিনের বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে পাকা বাড়ির সন্ধান পেয়েছে অপূর্ব। পাকা বাড়ির চারদিক ইটের তৈরি হলেও ওপরে টিনের চাল। নিচটাও পাকা। অপূর্ব আরুকে নিয়ে সেই ভিলায় বসবাসের আগে টুকিটাকি জিনিস কিনে নিয়েছে। খাট কেনার ইচ্ছে থাকলেও অর্থের কারণে সম্ভব হয়নি। তবে তোশক, বালিশ ও কম্বল কিনেছে।
তিনটা দিন পেরিয়ে গেছে ইতোমধ্যে। আরুও আগের থেকে অনেকটা সুস্থ। চেম্বারে যাওয়ার আগে সবকিছু গুছিয়ে গিয়েছিল অপূর্ব। তাই বাড়িতে ফিরে কষ্ট করতে হলো না তাকে। জামাকাপড়ের ব্যাগটা আরুকে দিয়ে নিজে নিল পাখিকে। তাদের জন্য অপেক্ষারত রিকশা। ইরফানের কাঁধে হাত রেখে অপূর্ব বলল, “বিপদের দিনে যেভাবে আমাদের উপকার করলে। তা আমি কখনো ভুলতে পারব না ইরফান।”

“সেভাবে কিছুই করলাম না।”

“আর কয়েকটা দিন থেকে নাহয় ঘর ভাড়া নিতেন।” মিতা বলল।

“যেহুতু আলাদা থাকতে হবে, তাই দেরি না করাই ভালো। আমি সব সামলে নিতে পারব।” কথাটা বলে মিতার সাথে গভীর আলিঙ্গনে ব্যস্ত হলো আরু। এই সাড়ে তিন দিনে মায়া জন্মে গেছে মিতার প্রতি। অতঃপর এগিয়ে গেল রিকশার দিকে। আরু হাত দিয়ে টা টা দিতেই অপূর্ব বলল, “আসি, তোমরা সুযোগ পেলেই চলে এসো।” পরপর রিকশাওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “মামা আস্তে আস্তে চলেন।”

অপূর্ব, আরু ও পাখি চলল তাদের গন্তব্যে। ভবিষ্যত বাসস্থানে, পরিবার ছেড়ে চলার লড়াই শুরু করতে। ভারি গলায় শ্বাস টেনে মিতা বলল, “আমার ঘরটা ফাঁকা হয়ে গেল। হঠাৎ করে এসে মায়া লাগিয়ে দিয়ে গেল।”

“কোনো কাজ না থাকলে তুমি ওদের কাছে চলে যেও। কাছেই! পাঁচ মিনিটের মতো লাগবে। বাবু আর ব্যাগের জন্যই রিকশায় গেছে।” স্মিত হেসে মিতার হাত ধরে ঘরের দিকে পা বাড়াল ইরফান। বাড়িতে ফিরলে পাখির কান্না বড্ড মিস করবে ইরফান।
__
খোলামেলা বাড়িটা, বাইরে রং না থাকলেও ভেতরের রং খসে বিশ্রী অবস্থা। বাড়িটার ভেতরে তিনটা ঘর। একটা ঘরে আরও একজন ভাড়াটে থাকলেও বাড়ি দুটো খালি ছিল এতদিন। অপূর্বের চলাফেরা শৌখিন। একটি ঘরে কি তাকে মানায়?
আরু দরজার ছিটকিনি খুলে দেখল, অপূর্ব ইতোমধ্যে জিনিসপত্র সাজিয়ে রেখেছে। দেয়ালের সাথে ব্যাগটা ঠেস দিয়ে রেখে ভেতরে ঢুকে ঘূর্ণন দিল আরু। আবেগপ্রবণ হয়ে বলল, “অপূর্ব ভাই আপনি কি জানেন, এটা আমার সংসার?”

“এটা আমাদের সংসার।”

“তা বুঝলাম, খুব ক্ষুধা লেগেছে। খাবার রান্না করতে হবে?”

“বিরিয়ানি নিয়ে এসেছি। রাতে এগুলো খেয়ে পার করব। কাল শুক্রবার, কালকে বাজার করে নিয়ে আসব। তুই বস, আমি পানি নিয়ে আসি।” কথাটা বলে স্টিলের কলসটা নিয়ে বের হয়ে গেল অপূর্ব। ছোট পরিসরে কলতলা কিছুটা দূরে‌ অবস্থিত। টিন দিয়ে বেড়া দেওয়া। দরজা খুলে পা রাখতেই পিছলে গেল পা। স্টিলের কলসটা মাটিতে পড়ে শব্দ তুলে চলে গেল বহুদূরে। দ্রুত টিন ধরে নিজেকে স্থির করল‌ অপূর্ব। জং ধরা টিনে খানিকটা কেটে গেল হাতের করতল। লক্ষ করল শেওলা জমে পিচ্চিল হয়ে আছে জায়গাটা। আরুর পড়ে যেতে সময় লাগবে না। কলতলা থেকে বের হয়ে একটা ইটের টুকরো কুড়িয়ে নিয়ে এলো অপূর্ব। এক পাশে থাকা ব্লিচিং পাউডার দিয়ে ঘষে ঘষে শেওলা তোলার চেষ্টা করতে লাগল। তার এই কাজ শেষ হতে আধ ঘণ্টার বেশি লাগল। ততক্ষণে ভিজে জবুথবু সে। কলসটা ধুয়ে পানি নিয়ে ঘরে গেল। সামনে রেখে বলল, “ব্যাগ থেকে আমার জামাকাপড়গুলো বের করে দে।”

“হ্যাঁ! দিচ্ছি। কিন্তু কথা হচ্ছে আপনার গায়ে শেওলা আসল কীভাবে?”

“শেওলা জমে ছিল কলতলায়। পা পিছলে পড়ে গেছি। যদি পড়ে তোর দাঁত ভেঙে যায়, তাই পরিষ্কার করে এলাম। বেশিক্ষণ ভেজা থাকলে ঠান্ডা লাগবে, তাড়াতাড়ি জামাকাপড় দে।”

আরু জামাকাপড়ের ব্যাগ থেকে অপূর্বকে একটা ফতুয়া ও লুঙ্গি বের করে দিল। অপূর্ব ফের সেই পথেই পা বাড়াল। যেহুতু আর ফিরে যাচ্ছে না আহসান বাড়িতে, তাই নিজেদের ব্যবহারের উপযোগী পোশাক কিনে নিয়েছে। আরু বিরিয়ানিগুলো থালায় পরিবেশ করে অপেক্ষা করে অপূর্বর জন্য। মিনিট পাঁচ পর কাঁপতে কাঁপতে অপূর্ব এলো ঘরে। দরজা খোলার সাথে সাথে দমকা হাওয়া ছুঁয়ে দিল আরুর দেহ। গর্জন করল আকাশ। কৌতূহল নিয়ে আরু বলল, “বাইরের অবস্থা ভালো না। ইদানীং থেমে থেমে প্রচুর বৃষ্টি হয়।”

“সাগরে ঘুর্নিঝড় উঠেছে। সেই কারণেই বৃষ্টি হচ্ছে। আরও দুদিন এমন আবহাওয়া থাকতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।”

“আচ্ছা, আমার যদি ডানা থাকতো। কতই না ভালো হতো। আমরা ডানায় ভর দিয়ে মধ্যাকর্ষণ শক্তির বাইরে চলে যেতাম। শীতের সময় চলে যেতাম সূর্যের কাছাকাছি। কী মজা হতো তাই না!”

“পাখি? তুই হচ্ছিস রূপবতী নারী। তোর মতো নারী আমি দেখিনি। যদি তুই পাখি হতিস, তাহলে তোর রূপে মুগ্ধ হয়ে শিকারিরা তোকে ধরে নিয়ে যেত। আমৃত্যু বন্দি থাকতি লোহার খাঁচায়।”

বৃষ্টিহীন প্রকৃতি। গাছের পাতায় দু এক ফোঁটা পানি জমে আছে। ভেজহীন রোদ উঁকি দিয়েছে আকাশে। পাখিকে কোলে নিয়ে পিঁড়িতে বসে ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ রোদ শুষে নিচ্ছে মা মেয়ে। অপূর্ব বাজার করতে বের হয়েছে।
আরুদের পাশের ঘরেও আছে এক দম্পতি। বিয়ের ছয় বছর চলছে তাদের। দুজনেই কর্মজীবী। একটা মেয়ে আছে, তবে সে থাকে দাদির সাথে অজপাড়া গাঁয়ে। মেয়েটির নামও শেফালী। আরুকে রোদ পোহাতে দেখে এগিয়ে এসে বসল তাদের পাশে। পাখির চোয়াল ধরে আদুরে গলায় বলল, “মিষ্টি একটা মেয়ে। দেখতে অবিকল তোমার মতো হয়েছে।”
তোমার কোনো কাজ থাকলে ওকে আমার কাছে দিয়ে, করতে পারো।”

মেয়েটির কথায় আরু সন্তুষ্ট হলেও দ্বিরুক্তি করল। অপরিচিত একটা মেয়ের কাছে নিজের মেয়েকে রেখে যাওয়া ঠিক হবেনা। আরুর না বলা বাক্য বুঝে নিল শেফালী নামের মেয়েটা। জোর করে পাখিকে আরুর কোল থেকে নিজের কোলে নিয়ে বলল, “তুমি কাজ করো, আমি ওকে নিয়ে তোমার পাশে পাশে ঘুরব। ও হ্যাঁ! বলাই তো হয়নি। আমার নাম শেফালী।”

শেফালী নামটা শুনেই মেয়েটির প্রতি আরুর মনে সৃষ্টি হলো বিশ্বাস। এই নামটা যে তার অতি প্রিয়। পাখির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “আপনি ওকে কোলে নিয়ে পাঁচ মিনিট কষ্ট করে বসুন। আমি ঘরটা গুছিয়ে আসছি।”

বলেই চঞ্চল পায়ে ঘরে এলো আরু। ঘরের কাজ সেরে উঠতেই অপূর্ব বাজার নিয়ে ফিরল। বাজারের থলে বাইরে রেখে ঘরে এলো। আচমকা কেউ পেছনে থেকে জড়িয়ে ধরল মেয়েটাকে। খানিক ভরকে গিয়ে পিছু ফিরে অপূর্বর হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখে হ্রাস পেল ভীতি। ভেংচি দিয়ে বলল, “এত এত খুশি কেন?”

“বলছি, পাখিকে দেখলাম পাশের বাড়ির আপুর কোলে। এই সুযোগে হবে নাকি?” অপূর্বর ইঙ্গিত বুঝতে বেগ পেতে হলো না আরুর। নাক কুঁচকে বলল, “ছি! কী কথা! পরিবারের কারো সাথে যোগাযোগ নেই বলে আমার মনে ভালো নেই। এদিকে তিনি এক্কা দোক্কা খেলতে এসেছেন।”

“আমার মন ভালো। ফুফার সাথে দেখা হয়েছে বাজারে।”

“কখন?”

“অবশ্যই বাজারে গিয়েছিলাম তখন। অয়নের মিলাদের জন্য জিলাপি কিনতে এসেছিস। কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়ে গেছে।”

“আমার ভাইটা নেই, ভাবতেই পারিনা।”

আরুকে নিজের দিকে ফিরাল অপূর্ব। জড়িয়ে ধরে বলল,
“এত ভাবিস না। চল, রান্না করবি। আমি পাখিকে নিয়ে তোর পাশাপাশি ঘুরব।”

_
সময় দুইটা ছুঁইছুঁই। রোদ্দুর খাঁ খাঁ করছে গ্রামে। মোতাহার আহসান সহ বাকিরা নামাজ শেষে বাড়িতে ফিরে যাচ্ছে। একদল মুসলিমও নামাজ শেষে জিলাপি হাতে নিয়ে বাড়িতে ফিরছে। অনেকটা দূরে যেতেই পেছন থেকে এক মুসলিম ডাকল, “চেয়ারম্যান সাহেব, দাঁড়ান।”

সবাই দাঁড়াল। নামাজ আদায় থেকে শুরু করে কিছুক্ষণ মোতাহার আহসানকে কিছু বলার চেষ্টা করছিল। তবে সুযোগ হয়ে উঠেনি। কাছাকাছি এসে বলল, “ভাই, একটা কথা ছিল। আমার ছেলে বিয়ের পর বউয়ের কথা শুনে। আমার সাথে ও আমার স্ত্রীর সাথে দুর্ব্যবহার করে। তাই আমরা চাই আলাদা থাকতে। আমার ছেলে যাতে মাসে মাসে কিছু টাকা দেয়। এই ব্যবস্থাটা করে দিতে পারবেন?”

“ছেলের থেকে আলাদা হবে কেন? আমি একবার তোমার ছেলের সাথে কথা বলে দেখি। ফের যদি ও দুর্ব্যবহার করে তাহলে তুমি আলাদা হয়ে যেও। ছেলের কাছে হাত পাততে হবে না। আমি তোমার নামে বয়স্ক ভাতার কার্ড বানিয়ে দিব। যে ছেলে তোমাদের সাথে ভালো ব্যবহার করবে না, তার জিনিস না খাওয়াই ভালো।”

“আচ্ছা।”

আরেকজন মুসলিম যাচ্ছিল সেখান দিকে। ফিসফিস ও ব্যঙ্গ করে বলল, “চাচা, তুমি কার কাছে বিচার চাইছ? যে নিজেই তার ছেলে ও বৌমাকে তাচ্ছিল্য করেছে? তার ছেলেই তো আলাদা থাকে।”

অস্ফুট স্বরে বললেও শোনা গেল কণ্ঠস্বর। মোতাহার আহসান দ্বিরুক্তি না করে সবাইকে নিয়ে বাড়ির পথ ধরলেন। অস্থিরতা কাজ করছে ভেতরে ভেতরে। হাত দিয়ে হাওয়া করতে করতে বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছে গেল। রোয়াকে বসে বললেন, “কাল পর্যন্ত কেউ আমার সাথে এভাবে‌ কথা বলেনি। আজ সামনাসামনি বলছে। আমি বোধ হয় সত্যি বিচার করতে অক্ষম হয়ে গেছি।”

“ভাইজান, বাদ দাও তার কথা। একটু খুঁত পেল অমনি তার সারাজীবনের কাজ নিয়ে খোঁটা দিল।”

“আমি আর চেয়ারম্যান পদে দাঁড়াব না। বয়সের কারণে সঠিক বিচার করতে ভুলে গেছি আমি। অপূর্বকে তার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে লম্বা একটা বিরতি নিল।” মোতাহার আহসান বললেন। পরপর বললেন, “অনি, আমার জন্য এক গ্লাস তেঁতুল নিংড়ানো পানি নিয়ে এসো। প্রেসার বাড়ছে।”

মুহূর্তের মাঝে উদাসীন হলেন তিনি। তেঁতুল পানি আনার সময়টুকুও দিলেন না অনিতাকে। ঢলে পড়লেন বাবার বুকে। ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে গেল তাকে। বিছানায় রেখে হাত পা ম্যাসাজ করতে লাগল। তেঁতুলের পানিটা খাইয়ে অনিতা বলল, “কী হলো হঠাৎ? ভালো মানুষটা নামাজ আদায় করতে গেলেন। কেউ একটু ডাক্তারকে খবর দাও।”

“একজন মানুষ ভাইজানকে বিচার নিয়ে খোঁটা দিয়েছে, সেটা‌ নিয়ে ভাবতে ভাবতে প্রেসার বাড়িয়ে ফেলেছেন।” ছোটো ভাই বলে।‌

মেজো ভাই ডাক্তারকে কল করতে গেলেন। ফ্যান ছাড়া থাকার পরেও ঘামছেন চেয়ারম্যান। পারুল বালতিতে করে পানি নিয়ে আসতেই অনিতা কেড়ে নিল তা। রাগান্বিত গলায় চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “শান্তি হয়েছিস তুই? তাহলে ঘরে গিয়ে বসে থাক। আমার স্বামীর মাথায় তোকে পানি দিতে হবেনা।”

“এভাবে কেন বলছ ভাবি?”

“কীভাবে বলব তাহলে? নিজের সংসার তো শেষ, এবার আমার সংসারের দিকে তোর নজর পড়েছে। আমার নাতির বয়স পাঁচ দিন। অথচ আমি ওকে দেখতে পারিনি। তোরজন্য আমার ছেলে, বউ, নাতনি দূরে চলে গেছে। এই অবধি আমি ঠিক ছিলাম। তবে আজ? আজ যদি আমার স্বামীর কিছু হয়, তাহলে আমার থেকে খা/রা/প কেউ হবেনা।” আঙুল তুলে কথাটা বলে স্বামীর মাথায় যত্নে পানি দিতে লাগল অনিতা। পারুল ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেদিক। এই সবকিছুর জন্য আসলেই সে দায়ী। আজ যদি মোতাহার আহসানের কিছু হয়ে যায় বাবা মাকে মুখ দেখাতে পারবে না। এই সংসারটা তাকেই ঠিক করে দিতে হবে। তারপরে নিজের ভাঙা সংসারে ফিরে যাবে। টোনাটুনির সংসার হবে শুধু!

চলবে.. ইন শা আল্লাহ

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৫৯ (বর্ধিতাংশ)

রান্নার কথা আরুর থাকলেও রান্না করছে অপূর্ব। বিদেশে থাকাকালীন রান্না করে খাইয়েছে নিজের নানা নানিকে। স্ত্রী সন্তানকে রান্না করে খাওয়ানো দায়িত্বের মধ্যে পরে। সলা চিংড়ি মাছে হলুদ মরিচ মিশিয়ে গরম তেলে দিয়ে অপূর্ব বলল, “আজ এমন রান্না করব একদম হাত চেটেপুটে খাবি।”

“আগে রান্না করুন, পরে দেখা যাবে।” পাখির বুকে চাপড় মেরে বলে আরু।

“এতটা তাচ্ছিল্য করিস না। অপূর্ব সবদিক থেকে পারফেক্ট। আগে সাঁতার জানতাম না, এখন সেটাও জানি।” আঁচ নামিয়ে লাউ কা/ট/তে বসল অপূর্ব। মনোযোগী হয়ে এক সমান কাটছে সবগুলো। দেখে মনে হয়, প্রতিটা মেপে মেপে সমান করছে। আরু মাথা ঝাঁকিয়ে মনে মনে বাহবা দিল প্রাণনাথকে। মুখে বলল, “কুঁচো চিংড়ি দিয়ে লাউ রান্না করলে মুখে লেগে থাকবে।”

“ডিম নিয়ে এসেছি। ডিম ভেঙে রান্না করব, দেখিস কত মজা লাগে। বনে জঙ্গলে বন্ধুদের নিয়ে আমি অনেকবার ঘুরতে গিয়েছি। এক জায়গায় তিন-চারবার গিয়েছি। ঘুরতে যাওয়ার সময় ব্যাগে করে বিভিন্ন সবজির বীচ নিয়ে যেতাম। জঙ্গলের মাঝে পুঁতে দিতাম। পরেরবার সেখানে গেলে আমাদের আর খাওয়ার জন্য চিন্তা করতে হতো না। ডিম দিয়ে লাউ খাওয়া শিখেছি মূলত সেখান থেকেই। গাছে ধরা লাউ আর ঘুঘু পাখির ডিম।”

“ঘুঘুর পাখির ডিম কোথায় পেলেন?”

“যে গাছে পাখি ছিল তার পাশেই তাবু টানিয়েছি। তাই পাখিরা উড়ে যাওয়ার পর সেখান থেকে দুটো ডিম নিয়ে লাউ দিয়ে খেয়েছি।”

“না বলে আপনি ওদের ডিম নিয়েছেন?”

“হ্যাঁ!”

“এখন যদি আপনার থেকে ওরা পাখিকে নিয়ে নেয়। তাহলে আপনার কেমন লাগবে?”

“তাহলে আমার ভারি অন্যায় হয়ে গেল। কী করে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারি?”

“আর কখনো ওদের ডিম নিবেন না। ঠিক আছে?”

“মহারানির হুকুম বলে কথা। রাখতেই হয়।” মাথা দুলিয়ে অপূর্ব বলে। বিদ্রুপ মনে করে ভেংচি দিল আরু। তখনই তাদের দিকে এগিয়ে এলো তিন জন মানুষ। এক জন কাঙ্ক্ষিত হলেও দুই জন অনাকাঙ্ক্ষিত। আরু ও অপূর্ব নিজেদের মধ্যে দৃষ্টিতে আদানপ্রদান করে উঠে দাঁড়াল। ততক্ষণে এগিয়ে এসেছে তিন জনে। ইরফান হাসিমুখে বলল, “স্যার, এরা আপনাদের খোঁজ করছিল। তাই নিয়ে এলাম। তাদের চিনেন?”

ইমদাদ হোসেন ও পারুল চেনা হয়েও অপূর্বর কাছে বড্ড অচেনা। দৃষ্টি সরিয়ে বলল, “না। চিনি না। এদেরকে এখানে কেন এনেছ?”

পারুলের মুখ মলিন হয়ে গেল। অপূর্বর এই প্রতুক্তি অপ্রত্যাশিত ছিল। তবে প্রত্যাশা করা দোষের ছিল না। অপূর্ব তো সেদিন সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। পাখির হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখে পারুল এগিয়ে যেতেই আরুর কোল থেকে মেয়েকে নিয়ে নিল অপূর্ব। পারুল চুপসে গেল বেলুনের মতো। অবিকল ছোটো আরু। সৌজন্য হেসে বলল, “সন্তান হারা এক মায়ের আর্তনাদ তোরা বুঝিসনি। তবে এবার বুঝবি! কারণ তোদেরও সন্তান এসেছে।”

“আপনারা কেন এসেছেন?” অপূর্বর প্রশ্নে ইমদাদ হোসেন বলল, “তোরা বাড়ি ছেড়ে চলে এলি না শুধু, তোর বাবার সম্মান নষ্ট করে এলি। এখন কেউ তোর বাবাকে সম্মান করেনা। আজ নামাজ আদায় করে বাড়িতে ফেরার সময় এক বৃদ্ধ, তার ছেলের নামে নালিশ করেছে ভাইজানের কাছে। আরেকজন ব্যঙ্গ করে বলেছে যে নিজেদের বিচার করতে পারেনা, সে কীভাবে অন্যের বিচার করবে? আর সেটা শুনেই তোর বাবার‌ প্রেপার বেড়ে গেছে। বুকেও ব্যথা বেড়েছে। ভাবি তো পারুলের সাথে হিংস্র আচরণও করছে।”

“তাই আমি তোদের ওই বাড়িতে ফিরিয়ে নিতে এসেছি। তোদের ওই বাড়িতে রেখে আমি নিজের ঠিকানায় চলে যাবে। নিজের সংসার তো শেষ হতে বসেছে। অন্যের সংসার কীভাবে ভাঙি।” পারুল বলে।

“বাবার এই অবস্থার জন্য একটু হলেও আমি দায়ী। তাই আহসান বাড়িতে আমি যাব। কিন্তু থাকব না। বাবা ঠিক হলেই চলে আসব।” কথাটা বলে উনুনের আগুন নিভিয়ে দিল অপূর্ব। রান্নার সরঞ্জামগুলো বয়ে ঘরে রেখে এলো। কড়ায় দুইটা তালা ঝুলিয়ে ফিরে এলো। আরুর থেকে পাখিকে কোলে নিয়ে বলল, “তোদের দুজনকে এখানে রেখে যাওয়ার সাহস পাচ্ছি না। তোরা আমার সাথে যাবি, আবার আমার সাথেই আসবি।”

অপূর্ব ও আরুর পেছনে পেছনে ইমদাদ ও পারুল হাঁটা দিল। ইরফান বিদায় নিয়ে ঘরমুখো হলো। ভরদুপুর ও বন্ধের দিনের কারণে নির্জন পরিবেশ। তবে রাস্তায় উঠতেই দেখা মিলল কয়েকটা রিকশার। অপূর্ব হাতের ইশারায় রিকশাওয়ালাকে বার্তা পাঠাল। দৃষ্টিগোচরে বার্তা পৌঁছাতে হর্ন বাজাতে বাজাতে রিকশা এলো নিকটে। অপূর্ব স্বাভাবিক থেকে বলল, “চেয়ারম্যান বাড়ি যাব।” পরপর শ্বশুর শাশুড়িকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আপনারা এই রিকশায় যান, আমরা আসছি।”

দ্বিরুক্তি না করে দুজনে রিকশায় চড়ল। খচখচে মন নিয়ে রিকশা গতিশীল হওয়ার পূর্ব মুহুর্তে ইমদাদ হোসেন বলল, “আরু, ওকে একটু আমাদের সাথে নেই?”

চট করে উত্তরের আশায় আরু তাকাল অপূর্বর দিকে। অনুসরণ করে রিকশাওয়ালা সহ তিন জনেই তাকাল সেদিকে। অপূর্ব ইতস্তত নিয়ে বলল, “তোর বাবাকে চাইলে দিতেই পারিস। তার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। তবে সে যাতে অন্য কারো কোলে আমার সন্তানকে না দেয়।”

হাসল আরু। বাবার কোলে কাঁথা সহ মেয়েকে তুলে দিয়ে শান্তি পেল। রিকশাওয়ালা এগিয়ে গেল সামনের দিকে। অপূর্ব আরুকে সাথে নিয়ে অন্য রিকশার হদিস করার ফাঁকে ডায়াল করল হার্ট বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মগবুল আলম ভূঁইয়াকে। অপূর্ব মনের ডাক্তার, বাবার পরীক্ষা করতে পারলেও চিকিৎসা দিতে পারবেনা। তাই ডাক্তার সাথে নিল।

আহসান বাড়িটা শান্ত হয়ে গেছে। এখানে বাচ্চারা আগের মতো ছেলেমানুষি করেনা। সবাই সংসার সামলাতে ব্যস্ত। বাড়ির দোরগোড়ায় রিকশা থামল। ইমদাদ হোসেন পাখিকে কোলে নিয়ে নামল রাস্তায়। পারুল তাকিয়ে আছে ঘুমন্ত পাখির মুখে। এক হাতে নাতনিকে ধরে অন্য হাতে পকেট থেকে টাকা বের করতে বেগ পেতে হচ্ছে তাকে। নাতনিকে স্পর্শ করার লোভ সামলাতে না পেরে পারুল বলল, “আমার কাছে দিয়ে টাকা বের করো।”

“মাথা খা/রা/প আমার! ওরা পেছনে আসছে। তোমার কোলে পাখিকে দেখলে রেগে যাবে। যদি পারো, পকেট থেকে টাকা বের করে ওনাকে দাও।” ইমদাদ হোসেনের কথা পারুল মানল। ভাড়া মিটিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই হোঁচট খেল কাঠের সাথে।
পরিষ্কার রাস্তায় শুকনো একটা কাঠ দেখাই যাচ্ছিল না। পাখির ঘুম ভাঙল। নিজেকে আগন্তুকের কোলে দেখে কান্না শুরু করল। ইমদাদ হোসেন দোলাতে দোলাতে বলেন, “পাখি, আমি তোমার নানাভাই। কাঁদে না সোনা।”

পাখি কেবল কাঁদছে। উদাসীন হলেন ইমদাদ। দোলাতে দোলাতে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলেন। ভিড় তখনও ছিল মোতাহার আহসানের ঘরে। পাখির কান্নার শব্দে তাকাল সেদিক। অনিতা স্বামীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “বাচ্চাকে কার থেকে ধরে আনলে? কাঁদছে কেন?”

“আরুর থেকে ধরে এনেছি।”

“পাখি?” চট করে বলেই অনিতা এগিয়ে গেল। প্রথমবার দর্শন করল নাতনিকে। চোখ থেকে পানি না পরলেও কাঁদতে কাঁদতে রক্তিম নাকের ডগা। কাঁথা সহ পাখিকে কোলে নিয়ে বলল, “সোনা পাখির কী হয়েছে? এভাবে কাঁদছে কেন?”

‘তুর থেকে বুড়া বাবা’ – কেউ বাদ নেই পাখির কান্না থামাতে। তবুও মেয়েটা কাঁদছে। তিস্তা বলল, “আরু তো ছোটোবেলায় শান্তশিষ্ট ছিল। ওর মেয়ে এমন কাঁদুনে কীভাবে হলো? ফুফা আপনি ভুল করে অন্য কারো বাচ্চা নিয়ে আসেননি তো?”

শেফালী বলে, “দেখতে কিন্তু মা-শা-আল্লাহ।”

সুমি শেফালীর পেটে হালকা স্পর্শ করে বলল, “নয় মাস পর তোমারও হবে।”

মোতাহার আহসান আধশোয়া হয়ে বসে বললেন, “মেয়ে তার বাবার মতো হয়েছে। মা না কাঁদলেও বাবার কান্নায় কেউ ঘুমাতে পারেনি। ওকে আমার কোলে দাও। আমার শ্বশুরের মতো বুদ্ধি প্রয়োগ করে কান্না থামানো যায় কিনা দেখি!”

“ওমা! তুমি না অসুস্থ। উঠলে কেন?”

“নাতনি এসেছে। অসুস্থ থাকি কীভাবে। ওকে এদিকে দাও।” হাত বাড়ালেন মোতাহার আহসান। অনিতা কোলে দিলেও বিরতি দিল না কান্নার। অবশেষে শ্বশুরের বুদ্ধি প্রয়োগ করলেন, “অপূর্বর আরুপাখি কোথায়?”

কান্না থামিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকাল পাখি। উপস্থিত সবাই হতবাক, বিস্মিত, চিন্তিত। এই ডাকেই কীভাবে থামল কান্না? পরক্ষণে পটি করে দিল কোলে। অবশেষে কান্না থামার কারণ খুঁজে পাওয়া গেল।

চলবে.. ইন শা আল্লাহ

নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-৫৬+৫৭

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৫৬

অয়নের দাফন সম্পন্ন করে চার ভাই ও ইমদাদুল হোসেন উঠানে এসে দাঁড়াল। মাথা থেকে টুপি খুলে পাঞ্জাবির পকেটে রেখে পারুলের দিকে তাকাল সকলে। অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছে জননী। ইমদাদুল হোসেন নিজেকে ধাতস্থ করে বললেন, “এখানে আরুর কোনো দোষ নেই ভাইজান। পারুলের সাথে আপনিও পা/গ/ল হয়ে গেলেন। কেন মেয়েটাকে পুলিশে দিলেন ভাই? মেয়েটা এমনিতেই অসুস্থ। প্রচণ্ড ভেঙে পড়েছিল। একা ওখানে কেমন আছে, কে জানে?”

“চিন্তা করিস না। ওকে পুলিশে দেইনি, ওকে ভালো রাখার ব্যবস্থা করেছি। পারুল ছেলেকে হারিয়ে উন্মাদ হয়ে গেছে। এই সময়ে আরুকে ওর সামনে রাখা ঠিক হবেনা।” মোতাহার আহসান বললেন।

শাহিনুজ্জামান বললেন, “পারুলকে বাড়িতে নিয়ে চলেন ভাই, এখানে রাখা ঠিক হবেনা।”

তদানীং অপূর্ব টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে সন্দিহান ভাবে পা ফেলছে বাড়ির ভেতরে। বুকটা খাঁখাঁ করছে। আরুকে নিয়ে ভীষণ চিন্তায় পার হয়েছে গোটা এক দিন। রোয়াকে টিফিন ক্যারিয়ার রেখে মোতাহার আহসানের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। কপালে জমে আছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ভ্রুতে ভাঁজ ফেলে বলল, “বাবা, তোমরা এখানে? বাড়িতে এত ভিড় কীসের?”

“অয়ন পানিতে পড়ে মা/রা গেছে। দাফন সম্পন্ন করে এলাম।” বলতে গিয়ে গলা ধরে এলো শাহিনুজ্জামানের। অপূর্ব দিশেহারা হয়ে উঠল। সমুদ্রের চেয়েও বিশাল এক জলরাশিতে তলিয়ে গেল। যার কোনো কূলকিনারা নেই। ভ্রম ভাঙতেই আরুর কথা মস্তিষ্ক গোচর হলো। সবকিছুর জন্য আরুকে দায়ী করবে পারুল। দৃঢ় গলায় বলল, “আরু কোথায় এখন?”

“আছে। তোর সাথে আমার একটু কথা আছে।” অপূর্বর কথার পরিপ্রেক্ষিতে কথাটা বললেন মোতাহার আহসান। লহমায় অপূর্বর মস্তিষ্ক আগুনের ফুলকি ছাড়ল। কঠোর গলায় বলল, “আরু কোথায়, আমি জানতে চাই।”

সবাই নীরব, প্রতুক্তি দেওয়ার ভাষা নেই। অপূর্ব এতে আরও রুষ্ট হলো। উচ্চৈঃস্বরে আবার জানতে চাইল আরুর খবর। অপূর্বর বাজখাঁই গলায় এক মিলি সেকেন্ডের জন্য বাড়ি নীরব হয়ে গেল। তুর উঠানে বসে কাঁদছে অয়নের জন্য। অপূর্ব তা লক্ষ করে ডাকল তুরকে। আংশিক কথা শুনতেই আরুর দাদিজান তেড়ে এসে বলল, “তোর বউকে পুলিশে কোমরে দড়ি পরিয়ে নিয়ে গেছে। তোর বউয়ের জন্য আমার নাতি পানিতে পড়ে ম/র/ছে। ইচ্ছে করে ওকে পানিতে ফেলে দিয়ে ঘরে গিয়ে ঘুমিয়েছিল। অলক্ষ্মী একটা। ওর জন্য আমাদের মৃধা বাড়ি সার্কাসে পরিণত হয়েছে।”

“মুখ সামলে কথা বলবেন। আমি আপনার ছেলে না যে আপনার কটূক্তি শোনার পরেও চুপ করে থাকব। এত নাতি নাতি করেন, আগে কোথায় ছিল আপনার নাতি? এদিকে তো ঘুরেও আসতেন না। এখন নাচতে নাচতে কাঁদছেন।” দাদি শাশুড়ির মুখের ওপর লাগাম না টেনে বলল অপূর্ব। অপূর্বর উগ্র আচরণে হতবাক হলো সকলে। পারুল দ্বিরুক্তি করে, “অয়নকে গোসল করাতে বলে আমি রান্না করতে গিয়েছিলাম। আরু গোসল না করিয়ে ঘরে এসেছিল জামাকাপড় বদলাতে। ও তো জানত, অয়ন সাঁতার জানেনা। তবুও কেন ওকে দিঘির পাড়ে রেখে এলো।”

“ঘাটলার ওপর গোসল করছিল অয়ন?”

“না! আমি পানি তুলে দিয়েছিলাম উঠানে। এইখানটায় বসে আমার অয়ন গোসল করছিল কিছু ঘণ্টা আগে। এখন আমার ছেলে ঐখানে শুয়ে আছে।” কাঁদতে কাঁদতে বললেন পারুল। প্রবল রাগে অপূর্ব দাঁতে দাঁত চেপে চোখ গ্রথন করে নিজেকে দমানোর প্রচেষ্টা করল। প্রিঞ্চ করে দাদি শাশুড়ি কিছু বলার প্রচেষ্টা করতেই অপূর্বর কথায় লাভা ছড়াল, “আপনাকে না আমি চুপ করতে বললাম? যথেষ্ট সম্মান দিয়েছি আপনাকে, আর দিতে পারছি না। আমার স্ত্রীকে এই অবস্থায় আপনার বাড়িতে কেন এনেছিলেন, অয়নের বডিগার্ড বানাতে? আমার স্ত্রী আমার বাড়িতে রানি হয়ে থাকে। মেয়েকে আপনি কোনো কালেই সহ্য করতে পারতেন না। নিঃসন্তান হয়ে চেয়েছিলেন না? মৃধা বাড়িতে দাঁড়িয়ে অপূর্ব আহসান বলে যাচ্ছে, আরুর কোনো মা নেই। আপনি নিঃসন্তান।”

অনিতা সবকিছু ফেলে উঠানে ছুটে এলেন। রাগান্বিত গলায় বললেন, “তুই দিনদিন বে/য়া/দ/ব হয়ে যাচ্ছিস অপু। বড়োদের সাথে এ কেমন আচরণ তোর! আমার বাবা মা তোকে এই শিক্ষা দিয়েছে?”

“তোমার ননদ যদি মেয়ের প্রতি অ/মা/নবিক হয়, তবে আমি বে/য়া/দ/ব হলে কীসের সমস্যা?” পরপর দম নিয়ে বলল, “আমার বাবা বোনের প্রতি ভালোবাসায় এতটা অন্ধ যে, বিচারকার্য তিনি ভুলে গেছেন। চেয়ারম্যান হয়ে গ্ৰামের বিচার করতে পারলেও নিজের পরিবারের বিচার করতে পারেনা। যেখানে বোনের জন্য ভাগনে/পুত্রবধূর সাথে অ/বিচার হয়, সেখানে তাদের না থাকাই ভালো। আরুকে নিয়ে আমি বহুদূরে চলে যাব।”

“তুই ভুল ভাবছিস অপু, পারুলকে সান্ত্বনা দিতে আরুকে পুলিশে দেওয়ার অভিনয় করা হয়েছে। কাল সকালে ওকে নিয়ে তুই আমার ভাইকের কাছে চলে যাইস।” আশ্বাস দিলেন পারুল। তবুও অপূর্ব বেপরোয়া, “ফুফু বাচ্চা? তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার কী আছে? অথচ যে বাচ্চা, তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার কেউ নেই।”

অপূর্ব উঠানের জাম গাছটার সাথে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিজের রাগ সংযত করছে। কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে গ্ৰামবাসীদের। তখনই ধীরপায়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল হাবিলদার। ব্যতিব্যস্ত হয়ে ইমদাদুল হোসেনকে বললেন, “আপনার মেয়ের পেইন উঠেছিল। ধাত্রী ঠিক করে এতক্ষণে বোধ হয় ডেলিভারি হয়ে গেছে। সকাল থেকেই নাকি ব্যথা ছিল, সারাদিন ব্যথা পাত্তা না দিলেও ভ্যানগাড়ির ঝাঁকুনিতে অস্থির হয়ে উঠেছে। আপনারা কেউ যেতে চাইলে আসুন।”

অপূর্ব দুহাতে চুল টেনে ধরল। রাগে দুঃখে একফোঁটা জল পড়ল চোখ বেয়ে। গলা ধরে এলো আনন্দে। বহু কষ্টে বলল, “ওকে কোথায় দেখে এসেছেন?”

“থানায়।”

জিম করা দেহের শক্তির প্রমাণ এতদিনে না মিললেও, আজ মিলল। একটা শক্তপোক্ত ডাল ধরে ভেঙে ফেলল উঠানের মাঝে। সৌজন্য হেসে উন্মাদের মতো বলল, “চেয়ারম্যান বাড়ির সন্তানের জন্ম হয়েছে থানায়। বাহ্! তোমাদের প্রতি আমার আর কোনো অভিযোগের বাকি নেই। সব পূর্ণ করে দিয়েছ তোমরা। আমার সন্তান চোখ মেলে দেখল তার মা অপরাধ করে থানায় তার জন্ম দিয়েছে। আরেকজন মা, তার মেয়ের কষ্টটাই বুঝতে পারল না।”

চম্পা অপূর্বর হাত ধরে বললেন, “আমি ওর কাছে যাব অপু।”

“এতক্ষণ যখন কেউ যেতে পারেনি, এখন আর যেতে হবেনা। এখন আমার স্ত্রীর জন্য আমি একাই একশো।” এই বাক্যটিই বোধ হয় সবচেয়ে কোমল ছিল। অতঃপর অপূর্ব অগ্রসর হলো থানার দিকে। একবারও পেছনে চেয়ে দেখল না কারো মুখ।
__
গ্ৰাম জনশূন্য। গ্ৰামবাসীরা ভিড় করেছে মৃধা বাড়িতে। হাবিলদারের সাথে সাথে এগিয়ে যাচ্ছে অপূর্ব‌। মনে অভিমান ও অভিযোগ ছাড়া কিছু নেই। দীর্ঘক্ষণ পর তারা পৌঁছাল সুন্দরনগর থানায়। চকিতে কর্ণপথে পৌঁছাল নবজাতকের কান্নার শব্দ। একজন ধাত্রী শুভ্র রঙের কাপড়ে জড়িয়ে রেখেছে নবজাতককে। অপূর্ব শিশুটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। আরুর থেকেও রূপবতী সেই শিশুটি। শিশুটির গালে হাত দিয়ে বলল, “আমি ওর বাবা। ওকে কোলে নিব একটু?”

“অবশ্যই। এতক্ষণে আসার সময় হলো? মেয়ের কান্না থামছে না। বাবার কোলে গেলে থামে কি-না দেখি।” বলে ধাত্রী অপূর্বর কোলে তুলে দিল ছোট্ট পাখিকে। অপূর্ব তার মুখমণ্ডলে হাত বুলিয়ে জড়িয়ে নিল বুকে। ললাটে প্রথম আঁকল ভালোবাসার চিহ্ন। অবিলম্বে কান্না থেমে গেল তার। অপূর্বর গচ্ছিত অশ্রু ঝরে পড়ল পাখির চোয়ালে। মৃদু স্বরে বলল, “আমার পাখি। সরি মামুনি, তোর বাবা তোকে রাজকন্যার মতো সিংহাসনে তুলে দিতে পারল না। আমাকে ক্ষমা করিস মামুনি।
আরু কোথায়?”

“ও অসুস্থ। আপনি নিশ্চয়ই বুঝবেন ওর কষ্টের কথা। ভেতরে গিয়ে দেখা করে ওর পাশে থাকুন।
পুশ করতে গিয়ে চিৎকার করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। কিছুক্ষণ আগে জ্ঞান ফিরেছে।”
অপূর্ব পাখিকে আগলে ভেতরে প্রবেশ করে আরুর ক্লান্ত মুখ দেখল। পাশে বসে আরুর হাতটা মুঠো করে ধরল। চোখ মেলে তাকাতেই অপূর্ব বলল, “আরুপাখি, আমাদের পাখি এসেছে। অপূর্ব দেখতে তার মুখ।”

চলবে.. ইন শা আল্লাহ

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৫৭

“তবে আমার ভাইটা যে চলে গেল। আমি যদি আরেকটু সময় ওখানে দাঁড়াতাম তবে অয়নকে হারাতে হতো না।”
বলতে গিয়ে আরুর চোখে বর্ষণের সূচনা হলো। পাখিকে আগলে নিয়ে আরুর সেই বর্ষণ মুছে দিল অপূর্ব। জড়ানো গলায় বলল, “কাঁদিস না আরুপাখি। এটাই নিয়তি। তবে আমার তীব্র আফসোস, সে সময়ে তোর পাশে থাকতে পারলাম না। বৃক্ষের মতো তোকে ছায়া দিতে পারলাম না।”

“অয়নকে দাফন দিয়েছে? মায়ের অবস্থা এখন কেমন?” আরুর পালটা প্রশ্নে প্রথমে অপূর্বর প্রতুক্তি দেওয়ার স্পৃহা জন্মালেও পরবর্তীতে রুষ্ট হলো। দৃষ্টি সরিয়ে খোলা জানালার বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকারে স্থির করে বলল, “তোর মা নেই। আমারও পরিবার নেই।”

অপূর্বর থমথমে কণ্ঠ আচমকা আবির্ভাব হয়েছিল বিধায় আরু খানিক ভড়কালো। ভীত অথচ কৌতূহলী গলায় বলল, “মানে? কী বলছেন আপনি?”

“যেটা শুনেছিস সেটাই। আমাদের সন্তান এখানে জন্ম নিয়েছে কেবল তোর মায়ের জন্য। এক সন্তান মা/রা গেলে বলে, সে নিঃসন্তান হতে চেয়েছিল। তাই আমি তাকে নিঃসন্তান করে এসেছি‌। আমার পরিবার তোর মাকে প্রশ্রয় দিয়েছে। তাই পরিবার ছেড়ে চলে এসেছি। আমি আর ওই বাড়িতে ফিরব না তোদের নিয়ে।”
থমথমে গলায় কথাটা বলে ফের আরুর দিকে তাকাল অপূর্ব। নজরবন্দি হলো দেহের বিভিন্ন জায়গায় রক্তের ছিটা লেগে আছে। চকিতে অপূর্ব স্পর্শ করল সেই ক্ষতগুলো। রক্ত উঠে গেলেও সেখানে রয়ে গেলে দাগ, কিঞ্চিৎ ফুলে উঠেছে জায়গাটা। ভ্রুতে ভাঁজ ফেলে অপূর্ব বলল, “এগুলো কীভাবে হয়েছে?”

সত্যিটা বলা মানে অপূর্বর রাগে ঘি ঢালা। সত্য আড়ালের প্রচেষ্টা করতে হাত বাড়িয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল,
“পাখিকে আমার কাছে দিন। খালা সেই মধু খাওয়াতে নিয়ে গেল, আর কোলে দিল না। পরিবার পরিকল্পনার কর্মীরা বলেছিল, জন্মের এক ঘণ্টার ভেতরে তার শাল দুধ খাওয়াতে হয়। কোলে দিন।”

“স্টপ আরু। আমি একজন ডাক্তার, আমাকে শেখাতে আসিস না, কখন কী করতে হবে! উত্তর না পেলে পাখিকে কোলে পাবিনা। তাড়াতাড়ি মুখ খোল।”

“অয়নকে আমিই দিঘি থেকে তুলে এনেছি। ডুব দিয়ে দিঘির মাঝে যখন খুঁজেছি, তখন বাঁশের কঞ্চির সাথে লেগে শরীর এভাবে আঁচড়ে গেছে।” নত গলায় বলে অপূর্বর থেকে পাখিকে কোলে নিয়ে নিল আরু। চট করে উঠে সেখান থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো অপূর্ব। পেছন থেকে আরু ডেকে থামাতে পারল না অপূর্বকে।
মিনিট ত্রিশ পর অপূর্ব ফিরত এলো জুনিয়র গাইনী বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ইরফানকে নিয়ে। আরুকে পরীক্ষা করে ওকে জানাতেই অপূর্ব ব্যাকুল হলো আরুকে নিয়ে যেতে। পাখিকে ইরফানের কোলে দিয়ে আরুকে পাঁজাকোলা করে নিল। বিতৃষ্ণা ও ব্যথায় আরুর দেহ অবশ হয়ে আছে। অপূর্বর গলা জড়িয়ে ধরে আরু বলে, “কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে? এই অবস্থায় আমি যেতে পারব না।”

“ইরফানের সাথে এই বিষয়ে আমার কথা হয়েছে। সঠিক যত্নের সাথে নিলে সমস্যা হবেনা। আমি ভ্যানগাড়ির ব্যবস্থা করেছি। তুই শুধু ধৈর্যের বাঁধটা আরেকটু উঁচু কর।”

আরু রাজি হলো। ভ্যানগাড়িতে আরুকে তুলে, পাখিকে ঠান্ডা থেকে আঁকড়ে রাখল হৃদমাঝারে। ইরফানকে সাথে নিয়ে আহসান বাড়ির রাস্তা পেরিয়ে শহরের রাস্তা ধরতেই আরু থতমত খেয়ে বলল, “একি, গাড়ি এদিকে কোথায় যাচ্ছে? এটা তো বাড়ির রাস্তা নয়।”

“আমরা বাড়িতে যাব না আরু। আমরা ইরফানের বাড়িতে যাচ্ছি। আজ রাতটা ওর বাড়িতে থেকে আগামীকাল নতুন বাড়ি খুঁজে শিফট হব।” অপূর্ব নিজ সিন্ধান্তে অনড় থেকে বলল। আরু দুঃখের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে মরিয়া হয়ে উঠল। মেনে নিতে পারছে না পরিবার ছাড়া বসবাস। ইরফান তার স্ত্রী মিতাকে নিয়ে হাসপাতালের পাশের এক গলিতে বসবাস করে। অপূর্ব ও আরুর থাকার কথাটা মিতাকে জানাতে সে সব ব্যবস্থা করেই রেখেছে। ভ্যানসহ সেখানে পৌঁছাতে নজর এলো মিতাকে। দাঁড়িয়ে ছিল অপূর্বদের ফেরার অপেক্ষায়।
_
আহসান পরিবার ও মৃধা পরিবার দাঁড়িয়ে আছে সেই পরিস্থিতিতে। পারুল চাতালে বসে ভাবছে অপূর্বর কথাগুলো। ইমদাদুল হোসেন গামছা গলায় ঝুলিয়ে মোতাহার আহসানকে বলল, “পারুলকে আপনাদের বাড়িতে নিয়ে যান ভাইজান। যদি পারেন, ওকে পা/গ/লা গা/র/দে ভর্তি করে দিয়েন। পুরোপুরি সুস্থ হলে আমি নিয়ে আসব। এখন আমি আরুকে নিয়ে আসতে যাচ্ছি। এক সন্তান হারিয়ে আমি শেষ হয়ে গেছি। আরেক সন্তানকে হারাতে পারব না। আমি আরুকে ফিরিয়ে আনতে গেলাম।”

বলে ইমদাদুর হোসেন থানার দিকে অগ্রসর হলে পারুল হিংস্র হয়ে এগিয়ে গেল ইমদাদুলের দিকে। শার্টের কলার টেনে উচ্ছৈঃস্বরে বলল, “আমাকে কী মনে করেন আপনি, আমি পা/গ/ল?”

“তুমি পাগল কি-না আমি জানি না। তবে তুমি এখন বিকৃত মস্তিষ্কের একজন মানুষ।” বলতে বলতে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো পেয়ারা গাছের ডালের দিকে। দুইশো ভোল্টের হলদেটে আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ঝুলন্ত তাবিজ খানা। ইমদাদুল হোসেন আগেও একবার দেখেছিল সেই ঝুলন্ত তাবিজ। এগিয়ে গিয়ে পেয়ারা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে পায়ের আঙ্গুলিতে
ভর দিয়ে উচ্চতা বৃদ্ধি করল। তাবিজ ধরে টান দিতেই শুষ্ক গাছের ডালটা ভেঙে পড়ল মাটিতে। এপিঠ-ওপিঠ করে দেখে বলল, “তাবিজটা তুমি এখানে ঝুলিয়েছ পারুল?”

“না।” পারুলের একরোখা জবাব।

“আমার সংসার ভাঙার পেছনে যে দায়ী তাকে এত সহজে আমি ছেড়ে দিব না।” তাবিজটা লুঙ্গিতে গুঁজে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল ইমদাদুল হোসেন। শাহিনুজ্জামান মোতাহার আহসানের গা ঘেঁষে বলল, “ভাইজান, এভাবে কতদিন চলবে? আহসান বাড়ির বড় নাতনি জেলে থাকবে কতদিন? আপনি পারুলকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে থানায় চলুন। আমাদের অপূর্ব, আরুর পাশে থাকা দরকার। ওদের বোঝানো উচিত।”

“হুঁ।” বলেই দাদাজান ডানলেন চম্পাকে। চম্পার পেছনে পেছনে এসে দাঁড়ালেন অনিতা। সাথে এলেন জাহানারা, মণি ও মল্লিকা। শাহিনুজ্জামান আকারে ইঙ্গিতে স্ত্রীর মাধ্যমে রাগ দেখালেন সবাইকে, “দলবেঁধে চলে এসেছে। তোমাকে কেউ এখানে ডাকেনি, কাজে যাও। পারুলকে নিয়ে বাড়িতে যাও।”

গায়ে লাগতেই সবাই পা বাড়াল ফিরতি পথে‌। শাহিনুজ্জামান অনিতাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “তুমি থাকো ভাবি, বাকিরা যাক।”

জায়গাটা নির্জন হলো। সন্তান হারা মাকে তৈরি হতে ঘরে নিয়ে গেল। অনিতা পরিষ্কার তার মত জানাল, “ওটা আমার ছেলের বাপের বাড়ি আবার পারুলেরও বাপের বাড়ি। দুজনের সমান অধিকার। ননদ হিসাবে আমার মতো যত্ন কেউ করে না। ‘ওর জন্য যদি আমার ছেলে বাড়ি ছাড়ে’ তাহলে দেখবে, ভাবির অত্যাচার কেমন হয়। পারুল তার সন্তানকে জলে ফেলে দিতে পারলেও আমি পারব না।”

অনিতা দ্বিতীয় মুহুর্তের আগমনের অপেক্ষায় রইল না। ধপাধপ পা ফেলে এগিয়ে গেল আহসান বাড়ির দিকে। পুরুষেরাও অগ্রসর হলো থানার দিকে। মহিলাদের জন্য প্রহরীর ব্যবস্থা করেছে। আসার সময় পায়ে হেঁটে এলেও, যাওয়ার সময় ভ্যানে বসে চলে গেল থানার দিকে।
__
গাছ গাছালির জন্য থানার সেই জমিটা ঘন হয়ে আছে সবুজ রঙে। শুকনো পাতা গাছ থেকে খসে পড়ছে টিনের ওপর। অনেক পাতায় রাস্তাঘাট দেখাই যাচ্ছেনা টর্চের আলোতে। মোতাহার আহসান থানার দোরগোড়ায় পৌঁছানোর পূর্বেই দারোগা সহ কনস্টেবল চলে গেছে, রয়েছে দুইজন হাবিলদার। কিছুটা এগিয়ে দেখতে পেল, ইমদাদুল হোসেন মাথায় হাত দিয়ে সরু বেঞ্চিতে বসে আছে। মোতাহার আহসান তার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, “এখানে বসে আছো কেন? ভেতরে চলো।”

“ভেতরে গিয়ে কী করব? অপূর্ব আরু কেউ নেই। অপূর্ব এসে আরুকে জোর করে কোথায় নিয়ে গেছে। ঠিকানা দিয়ে যায়নি।” ইমদাদুল হোসেন হতাশ হয়ে বললেন। বিনিময়ে মোতাহার আহসান দাড়োয়ানকে জিজ্ঞেস করলে একই কথা বলল। অপূর্বর নাম্বারে ডায়াল করল, বন্ধ বলছে একটি মেয়ে। কখনো বাংলায়, কখনো ইংলিশে। দাদাজান বিরক্তির সাথে বললেন, “সংযোগ কেন দিবে না? দিতেই হবে। আমাদের ফোনে টাকা আছে। আমরা সুন্দরনগরের চেয়ারম্যান।”

“শাহিন, তুই একটা ফোন কিনে দিস বাবাকে। তাহলে ফোন সম্পর্কে তার ধারণা জন্মাবে। কেউ যদি ফোন বন্ধ করে রাখে, তাহলে কীভাবে সংযোগ দিবে?” মোতাহার আহসান ইঙ্গিতে তার পিতাকে বলেন।পরপর নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “ইমদাদ বাড়িতে চলো, সেখানে গিয়ে কথা হবে।”

“আমি আমার বাড়িতে যাব, ভাইজান। পারুলকে দেখে রাখবেন। অপূর্ব ও আরুর কোনো খবর পেলে আমাকে জানাবেন।” দেহের ধুলাবালি ঝেড়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ির দিকে চলে গেলেন ইমদাদুল হোসেন। অতঃপর সেই ভ্যানে করেই বাড়ির দিকে চলে গেল আহসান পরিবার।

স্বামী, দেবর ও শ্বশুরকে দেখে আশা আলো জ্বলে উঠেছে অনিতার মনে। কাছাকাছি যেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, “পাখিকে দেখেছ? কেমন হয়েছে দেখতে, আমাদের মতো নাকি পারুলদের মতো দেখতে?”

“আমরা যাওয়ার আগেই অপূর্ব আরুকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে গেছে।” শাহিনুজ্জামান বলতেই মোতাহার আহসান নিজের ঘরে চলে গেলেন। আশার প্রদীপ দমকা হাওয়ায় নিভে গেল। অনিতা নিজের ঘরে গিয়ে দেখল, তার প্রাণনাথ জানালা খুলে অন্ধকার দেখছে। অনিতা কোমরে হাত দিয়ে কঠোর গলায় বলল, “তোমার কাছে আমার কথা কোনো মূল্য নেই, তাই তো? নিজের ছেলের প্রতি তোমার একটুও ভালোবাসা নেই?”

“আমাকে কি করব, বলো তুমি? আমি হাঁপিয়ে উঠেছি! আর এই বোঝা বইতে পারছিনা।” অশ্রুসিক্ত নয়নে নরম গলায় বলল, “ছেলের মুখের দিকে তাকালে নিজেকে সেরা অপরাধী মনে হয়না। পারুলের দিকে তাকালে নিজেকে স্বার্থপর মনে হয়। এই যাতনা সহ্য করতে না পেরে কবে জানি আমি বাড়ি থেকে চলে যাই। মিলিয়ে যাই ঘোর অন্ধকারে।”

চলবে.. ইন শা আল্লাহ

নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-৫৪+৫৫

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৫৪

অপূর্বর হাতে টিফিন ক্যারিয়ার তুলে দিল আরু। অপূর্ব হাত ঘড়ির পানে এক ঝলক চেয়ে চঞ্চল পায়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, “আরু, আমি আসি। ভারি কাজ করবি না। কোনো কিছুর প্রয়োজন হয়ে ফুফুকে বলবি। কেমন?”

“সাবধানে যাবেন।” হাতের ইশারায় বিদায় দিতেই অপূর্ব এগোল। সিঁড়ি খেয়াল না করে পা রাখতেই হুমড়ি খেয়ে পড়ল। চকিতে সামলেও নিল নিজেকে। আরু ছুটে গিয়ে অপূর্বকে ধরে বলল, “দেখে হাঁটবেন না, ব্যথা পেয়েছেন?”

“না। আমি ঠিক আছি। তাড়াহুড়ো করে যাচ্ছিলাম তো তাই খেয়াল করিনি।”

“বাধা পড়েছে। একটু বসে যান।” আরুর মনে কু ডাকছে। অপূর্বর নিমিত্তে ছটফট করছে অন্তঃকরণ। অপূর্ব হাত ঘড়িতে ফের তাকাল। আরুর আবদার রাখা অসম্ভব। আলতো জড়িয়ে কপালে এঁকে দিল প্রেমের পরশ। মৃদু হেসে বলল, “আমাকে যেতেই হবে। এমনিতেই আজ দেরি হয়েছে, আর বসা সম্ভব নয়। পাখির খেয়াল রাখিস, আমার জন্য দোয়া করিস।”

অপূর্ব হাসি মুখে এগিয়ে গেল। আরু চেয়ে রইল গমনপথের দিকে। প্রাণেশ্বরের জন্য একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে তিনবার আয়াতুল কুরসি পাঠ করল আরু। অতঃপর আকাশের দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ফেলতেই পেটের ভেতর চিনচিনে ব্যথা অনুভব করল। সহনশীল ব্যথা বলে আরু উঠানে গিয়ে বসল। কিছুক্ষণ আবার হাঁটাহাঁটি শুরু করল। পাখি পেটের ভেতরে ফুটবল খেলছে। হাঁটতে হাঁটতে মধ্যহ্ন চলে এলো। ইমদাদুল হোসেন বাজার করতে শহরে গেছেন। অয়ন বালুমাটি লাগিয়ে বাড়ি ফিরল। পারুল দেখেই ঝাঁজালো গলায় বলল, “আবার ভিজে এসেছিস? আজ তোর বাবা আসলে আমি বিচার দিবই।”

“দিও না মা।”

“এই নিয়ে তিন দিন তুই ভিজে এসেছিস। এতদিন না বলতেও আজ বললই।”
পারুল তার সিদ্ধান্তে অটল। আরু না বোঝার স্বরে বলল, “অয়ন কি নদীতে গোসল করে মা? অয়ন সাঁতার জানেনা, নদীতে গেলে ডুবে ম/র/বে।”

“নদীতে যায় না। পাপড়িরা শহর থেকে গ্ৰামে চলে এসেছে। ওদের বাড়ি নদী থেকে বালু তুলে উঁচু করেছে। ওরা সেই ভেজা বালুতে গিয়ে খেলে। বালুতে ঘা হয়ে গেলে কে দেখবে?”
পারুলের কথায় অয়ন ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। রাগ ভাঙল পারুলের। তবুও চাপা রাগ দেখিয়ে বলে, “আরু, আমি পানি তুলে দিয়ে যাচ্ছি। কষ্ট করে ওরে একটু গোসল করিয়ে দিতে পারবি? আমি রান্না করছি মা।”

“আচ্ছা। তুমি পানি তুলে দিয়ে যাও। আমি এই অবস্থায় তুলতে পারব না।”
পারুল বালতি হাতে তুলে নামল দিঘিতে। কেউ যাতে দিঘি থেকে মাছ তুলতে না পারে, তাই দিঘিতে বাঁশ ফেলে রাখা হয়েছে। মাছগুলো তার আশেপাশে ঘুরছে। পারুল বালতি ভরতি পানি উঠানে রেখে চলে গেল। অতঃপর গাছের প্রকাণ্ডের ওপর দাঁড়িয়ে গায়ে ঢালতে লাগল অয়ন। আরু খানিক দূরে দাঁড়িয়ে বলল, “অয়ন, সাবান দিয়ে গা ঘষে নে। বালুতে শরীর ক্ষয় হয়।” পরপর বলল, “পানির কাছে খেলতে যাবিনা। কখন কী হয়, বলা যায়না।”

“জানিস বুবু, বালুতে খেলতে অনেক মজা লাগে। তাই বারণ করার পরেও খেলতে যাই। তুই আজকের মতো মাকে একটু বুঝিয়ে নিস, আমি আর কখনো খেলতে যাব না বালুতে।” বলতে বলতে আরুর ওড়না টেনে ধরল অয়ন। আরু আজ অন্য দৃষ্টিতে তাকাল। আগে যে ছেলেটা তাকে সহ্য করতে পারত না, আজ সে ছেলেটা তাকে এত ভালোবাসে। কৌতূহল নিয়ে আরু বলল, “হঠাৎ এত ভালো বাসছিস কেন অয়ন? আগে তো মায়ের হাতে মা/র খাওয়াতিস।”

“বুবু, তোকে ছাড়া আমার কিছুই ভালো লাগেনা। মা সারাদিন আমাকে মা/রে। আগে তোর পেছনে গিয়ে লুকাতাম, এখন কারো কাছে লুকাতে পারিনা। দাদিজান আগে আমাকে কত ভালোবাসতো, এখন গেলে গাল টিপে ব্যথা দেয়। তুই আমার কাছে ফিরে আয় বুবু। আর তোকে মার খাওয়াব না। আসবি?”
অয়ন কাঁদছে। আরুর চোখের পানি করছে টলটল। এজন্য বোধ হয় বলে, থাকতে মর্ম বুঝে হয়। অয়নের শরীরের পানিতে ভিজে গেছে আরু। চোখ মুছে বলে, “তুই তো আমাকে ভিজিয়ে দিলি। তাড়াতাড়ি গোসল শেষ কর। জামাকাপড় না পালটালে বাবুর ঠান্ডা লেগে যাবে।”

“তবে তুই যা। আমার গোসল শেষ। পা ধুয়ে জামা কাপড় পালটে নিব।”
বলেই জোতা জোড়া তুলে নিল অয়ন‌। আরু ঘরের দিকে যেতেই সে এগোল দিঘির দিকে। অতঃপর শব্দ হলো দিঘির পানিতে।
_
আরু জামাকাপড় পালটে রসুইঘরে গেল। পারুল রুই মাছ ভাজছে। জামাকাপড় নিয়ে দিঘির দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রয়াস করতেই পারুল থামাল, “আরু মাছ ভাজা খাবি?”
আরুর প্রতুক্তির পূর্বেই একটা মাছ থালায় তুলে আরুর দিকে বাড়িয়ে দিল। আরু জামাকাপড়গুলো নিমগাছের ডালের সাথে বাঁধিয়ে বলল, “মা জামাকাপড়গুলো ধুয়ে দড়িতে দিয়ে এসে খাই?”

“ঠান্ডা হয়ে যাবে। তুই খেয়ে নে, আমি পরে ধুয়ে দিব।”
মায়ের আদেশ পেয়ে ভাজা মাছ খেতে লাগল আরু। চোখেমুখে মলিন ভাব ফোটে উঠেছে। অপূর্বর জন্য চিন্তিত সে। মাছটা ধীরে ধীরে কাঁটা বেছে বেছে খেয়ে উঠল। অতঃপর হাই তুলে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। শরীরটা ভালো লাগছেনা। চোখের পাতা গ্রথন করে ঘুমের রাজ্যে ডুব দিল। তার ঘুম স্থায়ী হলো না বেশিক্ষণ। ঘুমের মাঝে মনে উঁকি দিল অয়নের কথা। মাছ খাওয়ার সময়ও তো দেখা পেলনা ছেলেটার। এক প্রকার যুদ্ধ করে ঘুম থেকে মুক্তি পেল। বড়ো বড়ো চোখের পাতা করে বিছানা ছাড়ল। সময় গড়িয়ে গেছে, উঠানে দাঁড়িয়ে অয়ন অয়ন বলে চিৎকার করছে পারুল। আরু নিকটে গিয়ে বলল, “অয়নকে খুঁজছ মা?”

“হ্যাঁ। ওর বাবার কাছে বিচার দিব বলেছিলাম, এজন্য ভয়ে কোথায় গেল কে জানে। তোকে কিছু বলে গেছে?”

“না, মা। আমি জামাকাপড় পালটাতে গেলাম। ও বলল, পা ধুয়ে..
আরু থেমে গেল। বাম হাতটা ভারি পেটের ওপর রেগে উদাসীন হয়ে ছুটল দিঘির দিকে। চোখে পড়ল অয়নের হলুদ দুটো জোতা ভাসছে। ভাসতে ভাসতে দু-তীরে চলে গেছে। গলাটা ধরে এলো তার। প্রবল শক্তি নিয়ে চিৎকার করে ডাকল, “অয়নননন! অয়ননননন! অয়ননননন!”
সাড়া দিল না কেউ। অথচ পাখিরা সেই চিৎকারে ভয় পেয়ে উড়ে গেছে দূরান্তে। ভারি পেট নিয়ে ঝাঁপ দিল দিঘিতে। মনে তার একটাই চাওয়া, অয়নের যাতে কিছু না হয়। কিন্তু…
দিঘিতে থাকা বাঁশের সাথে লেগে দেহ ছিন্ন ছিন্ন হলো। কিন্তু আরু থামছেনা। এক পর্যায়ে থামল, যখন দেহটা অন্য একটা দেহের সংস্পর্শে এলো তখন। চোখ মেলেই ডুব দিয়ে দেহটা দেখেই পাথর হয়ে গেল। অয়ন যেন তার দিকেই তাকিয়ে আছে। মুঠো করে ধরে আছে একটা পাতা। অন্তিম মুহুর্তে সেই পাতাটিকে ধরে বাঁচতে চেয়েছিল। শ্বাস ফুড়িয়ে যেতে আরু মাথা তুলল। পারুল সেই পাড়ে এসে বলল, “কী খুঁজছিস ওখানে?”

আরু জবাব দিতে পারল না। ফের দম নিয়ে ডুব দিল। ভারি পেটকে তুচ্ছ করে অয়নকে পাঁজাকোলা করে অনেক কষ্টে ভেসে উঠল। পানি খেয়ে পেট ফুলে আছে বিধায় আরু ভালো ভাবে তুলতেও পারছে না। অয়নকে এক ঝলক দেখে পারুলের গলা শুকিয়ে গেল। ঝাঁপ দিয়ে পানিতে নেমে গাল ধরে ডাকল বেশ কয়েকবার। দীর্ঘক্ষণ পানিতে থাকার কারণে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মুখমণ্ডল। পারুল উন্মাদের মতো ডেকে চলেছে, “অয়ন, অয়ন, এই অয়ন। কথা বল বাবা। আমি তোর বাবার কাছে কোনো বিচার দিব না।”

অয়ন সাড়া দিল না। তড়িঘড়ি করে ওপরে তুলে পেট চেপে পানি বের করার চেষ্টা করতে থাকল পারুল। বড্ড বেশি দেরি হয়ে গেছে। আরু মলিন চোখে চেয়ে রইল ভাইয়ের দিকে। অয়নের খোলা চোখ দুটো যেন বলছে, “আসবি বুবু?”

চলবে.. ইন শা আল্লাহ

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৫৫

বাড়ি ভরতি মানুষ। অয়নকে চাদরে মুড়িয়ে হোগলার ওপর রাখা হয়েছে। শিউরে বসে হাউমাউ করে কাঁদছে তার জননী। আরু তার ভারি পেট নিয়ে বসা মাটিতে। জামা দেহেই শুকিয়েছে। পাথর হয়েছে মন। পেটের ব্যথাটা আরও বেড়েছে। কিন্তু মুখ ফুটে বলার ধ্যান নেই। ইমদাদুল হোসেন থলে রাস্তায় ফেলেই ছুটতে ছুটতে এলেন বাড়িতে। শুভাকাঙ্ক্ষীর কথা শুনে রাস্তায় ফেলে রেখে এসেছে থলে। উল্কার বেগে ভেতরে এসে মৃত ছেলের মুখটা দেখে বললেন, “পারুল, কীভাবে হলো এসব? কখন হলো?”

বাঁধ ভাঙল, জলপ্রপাত সংঘঠিত হলো। সব ছেড়েছুড়ে স্বামীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, “ওগো, আমার কী সর্বনাশ হলো! আমার কোল খালি হয়ে গেল। আমার অয়ন মা বলে ডাকছে না কেন? ওর আগে আমাকে কেন নিয়ে গেল না?”

ইমদাদুল হোসেন নিজেকে ধাতস্থ করলেন। দাঁত চেপে পুরুষ মানুষ বলে নিজেকে কঠোর করলেন। তদানীং শাড়ি উঁচু করে ছুটতে ছুটতে এলেন নয়না। আরুর কাঁধে হাত রেখে উত্তেজিত হয়ে বললেন, “কীভাবে হয়েছে আরু?”

আরু আপন কাউকে পেল। জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে পুনরাবৃত্তি করল, “চাচি, আমার জন্য সব হয়েছে। কেন অয়নকে একা রেখে আমি ঘরে গেলাম? তুই তো বলেছিলিস, পা ধুয়ে ঘরে আসবি। কেন এলি না? জানো অয়ন আমাকে বলেছিল, যাতে আমি আবার এই বাড়িতে থাকি। আসবি?
অয়ন ভাই আমার, একবার তুই ফিরে আয়। আমি আর কখনো তোকে ছেড়ে ওই বাড়িতে ফিরে যাব না।”
কাঁদছে আরু। নয়না লক্ষ করল আরুর দেহ ক্ষতবিক্ষত। ভেজা শাড়ি শুকিয়ে গেলেও ভাজ তেমনই রয়েছে। আরুকে ধরে টেনে ঘরে নিয়ে যেতে যেতে বলল, “এই অবস্থায় কে ভেজা থাকে মা? ঘরে আয়! জামা পালটে নে।”

পারুলের হুঁশ ফিরল নয়নার কথায়। উশকোখুশকো চুল, রুগ্‌ণ মুখমণ্ডল, চোখ উত্তাপ, জ্বলছে আগুন। হিংস্র পশুর মতো এগিয়ে এসে বাধা দিয়ে বলল, “ওরে নিবা না ভাবি। ওর জন্য আমার ছেলের এই অবস্থা। আমার ছেলেটাকে একটুও সহ্য করতে পারেনা। শুধু এক সন্তান কেন? ওরে দিঘির পানিতে চুবিয়ে মে/রে একসাথে আমি নিঃসন্তান হব।”

“পা/গ/ল হয়েছিস তুই? ও কী চুবিয়ে মা/র/ছে? ওর হায়াত এই পর্যন্ত ছিল। ওভাবে মেয়েটাকে দোষী করছিস কেন?” আরুকে আগলে নিয়ে কথাটা বলে নয়না। ব্যথায় ঠিকমতো দাড়াতেও পারছেনা আরু। অথচ তাকে নিয়ে চলছে টানাহেঁচড়া। আরুর দাদি অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বললেন, “তুমি চুপ করো বড়ো বউ। এই মেয়ে অপয়া, অলক্ষ্মী। আমার নাতিটাকে খেয়ে ফেলল। এজন্য এই অপয়াকে আমি সহ্য করতে পারতাম না। ওকে পুলিশে দিয়ে যদি আমি কোমরে দড়ি পরিয়ে জেলে পাঠাতে না পারি, তবে আমি শিকদার বাড়ির মেয়ে না।”

নয়না তাচ্ছিল্য করল শাশুড়িকে। আরুর বিয়ের পর থেকে অয়নকে সহ্য করতে পারত না, অথচ এখন ভালোবাসা উপচে পড়ছে। আরুকে ঘরে নিয়ে জামাকাপড় পালটে বললেন, “ওখানে যাবিনা তুই, গেলেও কারও কথা মাথায় নিবিনা। অয়নের শোকে মাথা ঠিক নেই, কী বলতে কি বলে ফেলছে।”

“মিথ্যা বলছে না।”

“মুখে মুখে কথা। চুপ করে বসে থাক।” রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে নয়না। আরু মাথা নিচু করে বলে, “চাচি, আমার পেটে ব্যথা করছে। উনি যাওয়ার সময় থেকে ব্যথা করছে। একটু একটু করে কেবল বাড়ছে।”

“টেনশনে বাড়ছে। চুপ করে একটু শুয়ে থাক।” বলেই বিছানা ঠিক করে নিজের হাতেই আরুকে শোয়ালেন নয়না। আরু শুয়ে জানালা দিকে লেবু গাছের দিকে তাকিয়ে রইল। নয়ন ভরা জল। অপূর্ব কখন আসবে? কখন? এই দম বন্ধ পরিবেশ থেকে অপূর্ব ছাড়া কেউ আরুকে বের করে আনতে পারবেনা।
.
হিংস্র বাঘের মতো গর্জন করতে করতে নয়না আরুর কাছে এলেন। হাত ধরে হেঁচকা টেনে বাইরে নিয়ে যেতে লাগলেন। আরু টু শব্দটি করল না। উঠানের একপাশে তার পরিচিত মুখগুলো দাঁড়িয়ে আছে। কেউ সাহস করে আরুকে বাঁচাতে পারছে না। অবশেষে মোতাহার আহসান পারুলকে ধরে বললেন, “শান্ত হ। ওর দোষ কী এখানে?”

“ওরই সব দোষ। পুলিশ এসেছে, ওকে পুলিশের হাতে তুলে দিব।” পারুল বলে‌। অনিতা এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই জাহানারা বলল, “ভাবি, পারুলকে সামলাতে হবে আগে।”

অনিতা বলল, “আরুর উপর দিয়ে কী যাচ্ছে, সেটা তুই দেখছিস না?”

জাহানারা বলল, “তাই বলে আরুর দোষ অস্বীকার কেন করছ ভাবী? ওর দায়িত্বজ্ঞানহীনতার জন্যই অয়নের এই অবস্থা। আমরাও ওর সময়টা পার করে এসেছি। ওর মতো এত ন্যাকামি করিনি। ও তোমার পুত্রবধূ, পেটে বংশধর। তাই তুমি অন্ধ। কিন্তু আমি অন্ধ নই। আমার সুমি যদি এমন কাজ করত, তাহলে ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দিতাম।”

“হয়েছে তোর জ্ঞান দেওয়া? এতই যখন জ্ঞানী তাহলে শেফালীর সময় জ্ঞান কোথায় ছিল তোর? তখনবাড়ির মেয়ের জন্য যেমন নিজের পুত্রবধূকে বের করে দিসনি। তেমন আমিও ভাগনের জন্য পুত্রবধূকে বের করে দিতে পারব না।
বড়ো বড়ো জ্ঞান আমাকে না দিয়ে, পারুলকে জ্ঞান দে যা। উসকানি দিস না।” বিদ্রুপ করে কথাটা বলে মোতাহার আহসানের কাছে গেল অনিতা। স্বামীর হাত ধরে টেনে এনে ফিসফিস করে বলল, “পারুল কী বলছে! আরুকে পুলিশে দিবে মানে? এই অবস্থায় এত প্রেসার কীভাবে নেবে মেয়েটা?”

“এছাড়া কোনো উপায় নেই। পুলিশের সাথে আমার কথা হয়েছে। ওখানে আরুর অযত্ন হবেনা। এখানে থাকলে মেয়েটাকে শান্তি দিবেনা পারুল আর পারুলও শান্ত হবেনা। তাই এটা করতেই হবে। কালকে আরুকে বের করে অপূর্বর সাথে তোমার বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দিব। ওখানে আরুর অযত্ন হবেনা।” মোতাহার আহসান মনে মনে ছক করেছে। স্বামীর কথাটা সন্তুষ্ট সে। অনিতা স্বামীকে ছেড়ে পারুলের কাছে এলো। আরুর হাত ধরে পারুলের থেকে ছাড়িয়ে নিল। কড়া গলায় বলল, “কেন এমন করলি তুই? তোর জন্য অয়ন আজ আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। পুলিশ, আরুকে নিয়ে চলে যান। ওকে আমি আর এখানে সহ্য করতে পারছি না।”

“মামি…

“চুপ। একদম আমাকে মামি বলে ডাকবি না। স্যার, আপনাকে আমি কী বললাম শুনতে পাননি?” অনিতার কথায় আরু হতাশ দৃষ্টিতে তাকাল। জীবনের প্রতি আর কোনো অভিযোগ নেই তার। যারা এই অসময়ে পাশে থাকবে, তারাই দূরে ঠেলে দিচ্ছে। মহিলা পুলিশ এসে আরুর কোমরে দড়ি পরিয়ে দিলো। অতঃপর টানতে টানতে ভ্যানগাড়ির দিকে নিয়ে গেল। আরু কাতর দৃষ্টি ও ঝাপসা চোখ নিয়ে এগিয়ে গেল। ভ্যানগাড়িতে তুলে চলল তার গন্তব্যে। ভ্যানগাড়ি যখন তার গন্তব্যের কাছাকাছি তখন আরুর পেটের ব্যথা ক্রমশ বাড়তে লাগল। শুয়ে পড়ল ভ্যানের উপর। হাত দিয়ে চুলগুলো টেনে গলা কা/টা মুরগির মতো ছটফট করতে থাকে। আরুর অবস্থা দেখে মহিলা কর্মীরা উত্তেজিত হয়ে বলল, “কী হয়েছে,এমন করছিস কেন?”

“পেটে ব্যথা করছে। মনে হচ্ছে ম/রে যাচ্ছি।”

“কখন থেকে?”

“সকাল থেকে। ধীরে ধীরে বাড়ছে। এখন আর সহ্য করতে পারছি না। আপনারা কিছু করুন।” কাতরাতে কাতরাতে কথাটা বলে আরু। দুজন কর্মীরা উভয়ের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে বলে, “পেট তো বড়ো। মনে হয়, লেভার পেইন উঠেছে। ওকে দ্রুত ভেলিভারি করাতে হবে।”

“স্যার, চেয়ারম্যান সাহেবকে জানাবেন?” মহিলার কর্মীর জবাবে দারোগা বলে, “না, চেয়ারম্যান ব্যস্ত আছেন। আপনাদেরই কিছু একটা কথা হবে। আপনাদের পরিচিত কোনো ধাত্রী থাকলে খবর দিন।”

“আপা, তাহলে আপনি পোয়াতির সাথেই থাকুন। আমি ধাত্রী, প্রয়োজনীয় কাপড়, যা যা লাগবে সব নিয়ে আসি।”
বলেই কর্মী নেমে গেল ভ্যানগাড়ি থেকে। আরু যাতনা সহ্য করে চলেছে। সম্পূর্ণ সময় জুড়ে আপনজনেরা থাকলেও, গুরুত্বপূর্ণ এই সময়ে তারা নেই। কেউ নেই। অপূর্বও নেই।

চলবে.. ইন শা আল্লাহ

নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-৫২+৫৩

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৫২

আনন্দ নগরের বড়ো বটগাছের নিচে শেষ দিনের বাইজি নাচ বসেছে‌। প্রধান বাইজি ছাড়াও সেখানে রয়েছে আরও চার জন। গ্ৰামবাসীদের সাথে যোগ দিয়েছে ওরাও। আরু উদাসীন হয়ে নিভৃতে ভেবে চলেছে তুরের কথা। দুই সখীর কেউ মনোযোগী নয় এই নাচে। তুর বাধ্য হয়ে এসেছে, আরু একা ঘরে ভয় পাবে বিধায় এসেছে। শেফালী দুই সখীর মাঝে এসে বলল, “আরু মুখ ভার করে রেখেছিস কেন? তুরের সাথে ঝামেলা হয়েছে? সেও মুখ ভার করে রেখেছে। কতবার জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? জবাব পেলাম না।”

“শেফু, আমি একটা অন্যায় করে ফেলেছি। তুর ও প্রয়াস ভাইয়ের কথা আমি ওনাকে জানিয়ে দিয়েছি। এজন্য তিনি তুরের ওপর ক্ষ্যাপে আছেন। তুরও আমার ওপর রেগে আছে। আমি ভালোর জন্য বলেছিলাম, এতে বিপরীত হয়ে যাবে বুঝতে পারিনি।”

“আমি প্রয়াস ভাইকে দেখেই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। অপূর্ব ভাইয়ের এমন ব্যবহার অস্বাভাবিক নয়। একটা পরপুরুষকে এভাবে নাটকের মতো সাজিয়ে রাখা ন্যায় নয়, অন্যায়। আবার তুরের কষ্ট আমি অনুভব করতে পারছি।”
বলতে গিয়ে শেফালীর চোখ হলো টলমল। না! আর তিয়াসের কথা সে ভাববে না। তার জন্য চারটা জীবন অনিশ্চয় হয়ে পড়তে পারে। এবার সে এক পা এগোবে কাঁলাচানের দিকে। বিনিময়ে কাঁলাচান যদি এক পা এগোয়। তবে শেফালী আবার দুই পা এগোবে। তাদের সম্পর্কটা অনিশ্চিত করবে না। আরুকে আশ্বাস দিয়ে বলল, “এইসব নিয়ে তুই প্যানিক করিস না। সম্পর্কের মাঝে একটু বাধা না আসলে ভালোবাসার গভীরতা অনুভব করা যায় না।”

অপূর্ব ভ্রু কুঁচকে তাকাল উভয়ের দিকে। সময় ক্রমাগত পেরিয়ে যাচ্ছে। শীত গ্রাস করছে রাতকে। অপূর্ব সবাইকে পেরিয়ে পেছনে যেতেই শেফালী সামনে ফিরে এলো। আরুর পাশে বসে বাকিদের উদ্দেশ্য করে বলল, “তোদের দেখা হলে বলিস। ফিরে যাব।”

কাঁধে হাত রেখে আরুকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিল। আরু কেবল ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে কাতর গলায় বলল, “ভালোবাসার সংজ্ঞা জেনেও আপনি বারবার কেন এমন করেন? কেন ওর কাছে আমাকে অপরাধী করে দিলেন? প্রথমবার প্রাণের প্রিয় বোনের গায়ে হাত তুলতে আপনার বাঁধল না? নাকি ওর ভালোবাসার মূল্য আপনার কাছে নেই?”

“তোকে এই প্রশ্নের উত্তর আমি দেব না। বোনকে মাথায় তুলে নেচে বাঁদর তৈরি করার চেয়ে শাসন করে মানুষ তৈরি করা আমার ভালো। তুই ঘুমা।” অপূর্বর ত্যাড়া কথায় আরু মাথা তুলল। চোখমুখে কঠোর ভাব এনে উঠে দাঁড়াল। মির্জা বাড়ির অতিথি হওয়ার কারণে ওদের আসন সবার সম্মুখে। আরু প্রথম সারিতে গিয়ে তিস্তাকে বলল, “তোমার সাথে বসব।”

চেয়ারের কাছে রোগাপটকা দেহ তিস্তার। এক পাশে সেঁটে আরুকে বসার জায়গা করে দিয়ে মনোযোগী হলো নাচ দেখায়। আরু কেবল রাগের কারণে এখানে এসেছে, ঘুমে পল্লব ঢাকতে মিনিট তিন লাগল না। তিস্তার কাঁধে মাথা রেখে পা তুলে বসে ঘুমিয়ে গেল। নাচ সমাপ্ত হওয়ার শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত সবাই উপভোগ করল সেই নাচ। দর্শকেরা টাকা উড়িয়ে দিয়েছে বাইজিদের দেহে। অপূর্ব তা করল না। ইস্কান্দার মির্জার পুতি হওয়ার দৌলতে বাইজিদের সম্মানি দিল হাতে তুলে। রেশমী নামের মহিলা অপূর্বর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাল। বয়সের কারণে তেজ কমে গেলেও সাজসজ্জার ত্রুটি নেই। কৌতূহল নিয়ে বলল, “কে তুই? আগে তো কখনো তোকে এখানে দেখিনি।”

“আমি অপূর্ব আহসান। ইস্কান্দার মির্জার একমাত্র মেয়ে চম্পাকে চেনেন? আমি তার বড়ো ছেলে মোতাহার আহসানের ছেলে অপূর্ব আহসান।”

“তুই চম্পার নাতি? চম্পা কেমন আছে? চম্পাকে বলিস, রেশমী সালাম পাঠিয়েছে। আগে আমার মা নাচ করত। মায়ের সাথে এখানে আসতাম। চম্পা আমাকে কত ভালোবাসত।” রেশমীর চোখে ফোটল অতীতের আসরের দৃশ্য। নিজেকে ধাতস্থ করে টাকাগুলো নিয়ে অপূর্বর মাথায় হাত রাখল। তখন এগিয়ে এলো আরু ছাড়া সকলে। মেতে উঠল রেশমীর সাথে। রেশমাকে ‌বিদায় দিয়ে অপূর্ব লক্ষ করল, একটি ফাঁকা চেয়ারে জড়সড়ো হয়ে শুয়ে আছে আরু। পরিচিত বলতে ইলিয়াস আলী ছাড়া কেউ নেই আশেপাশে। অভিমানী আরুকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে বাড়ির দিকে এগোল অপূর্ব। বাকিরা হাঁটছে তার পিছুপিছু।
__
মির্জা বাড়ি ঘুমে বিভোর। তবে এক নবদম্পতি শুতেই পারেনি বিছানায়। শেফালী হাঁসফাঁস করছে চাপা কথা স্ফুট করতে। কালাচাঁন তার শার্ট খুলে কেবল সেন্ডো গেঞ্জি পরে লেপের তলায় ঢুকল। নোকিয়া মোবাইলে সাপ গেমস খেলতে খেলতে আড়চোখে শেফালীর দিকে এক পলক ফেলে। যার দরুন সাপের লেজে মুখ লেগে গেমস ওভার। চার্জে লাগানোর সুবিধা নেই এখানে। কালাচাঁন ফোনটা বালিশের কিনারে রেখে বলল, “ওখানে দাঁড়িয়ে কী করছ? কাল সকাল সকাল বের হব গ্ৰামের উদ্দেশ্য।”

শেফালী চট করে বিছানায় উঠে বলল, “আপনার সাথে আমার একটা কথা আছে। জরুরি কথা। শুনবেন?”

“কেন শুনব না? সব কথার চেয়ে তোমার কথাখানা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বলো।” কালাচাঁন আগ্রহ নিয়ে বলে। তবে শেফালী স্বাভাবিক হয়ে বলতে পারছেনা। শেফালীর কাজে বিরাগী হয়ে কালাচাঁন চোখ বন্ধ করল। ফের শেফালী বলব, “শুনবেন না, আমার কথা?”

“তুমি মুখে অনশন পালন করছ। অনশন পালন করলে খেতে পারেনা। কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তুমি কথাও বলতে পারোনা। অনশন ভাঙা অবধি আমার পক্ষে অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। অনশন ভেঙে আমাকে ডেকো।” কালাচাঁন চোখ বন্ধ রেখেই বলল। ভাবাবেগ দেখা গেল না কালাচাঁনের মাঝে। তবে কালাচাঁনের চোখ বন্ধ থাকার কারণে শেফালীর জড়তা কা/ট/তে শুরু হয়েছে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, “আমরা কি আর পাঁচটা স্বামী-স্ত্রীর মতো বৈবাহিক সম্পর্কে জড়াতে পারিনা?”

চট করে চোখ মেলল কালাচাঁন, দৃষ্টি নামিয়ে ফেলেছে শেফালী। কানে সমস্যা হয়েছে ভেবে কনিষ্ঠা আঙুল দিয়ে পরিষ্কার করে নিল এক দফা। শেফালীর মুখ বলে দিচ্ছে সে মিথ্যা শোনে নি। চাঁদশূন্য আকাশ। ঘুটঘুটে অন্ধকার বিরাজ করছে সেই কামরাতেও। শেফালীর থুতনি তুলে চোখে চোখ রেখে কালাচাঁন বলে, “আমি কি ভুল শুনলাম? আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলবে আর একবার?”

“অতীত ভোলা যায়না, আবার অতীত আঁকড়ে বাঁচা যায়না। তবে আমি বর্তমান নিয়ে বাঁচতে চাই। আমার মনের দহনের কথা আপনি জানেন, আপনার দহন আমি অনুভব করতে পারি।” এর জবাবে কিছু বলল না কালাচাঁন। মাথাটা আলতোভাবে ঠেকাল শেফালীর ললাটে। ঘনঘন শ্বাস নিল শেফালী। পৌঁছেছে প্রেম বার্তা, বেড়ে গেল উষ্ণতা। পৌষের শীতও হার মানে তাতে। কালাচাঁন যদি গড়ে নিতে পারে, নিক-না গড়ে। সমস্যা নেই। শুধু একটু আদরে সাজিয়ে নিক।

সময় ও স্রোত কখনো কি কারো জন্য অপেক্ষা করেছে? তাঁরা তো বহমান। নিজের মতো ধাবিত হওয়াই এদের কাজ। আরুর ছোটো পেট অনেকটা প্রশস্ত। এক মাস, দুই মাস, তিন মাস… পেরিয়ে গেছে নয়টি মাস। পেট না ধরে চলাফেরা করতে পারেনা আরু। কোনো কাজ আজকাল তাকে করতে হয়না। বংশে প্রথম সন্তান আসছে বলে কথা।
আরু রোয়াকে বসে আমের আচার খাচ্ছিল। বেশ স্বাদের সেই আচার? প্রথমদিকে বমি দূর করতে খেলেও আজকাল অভ্যাসের কারণে খায়। আরুর জন্য গাছের ছাল নামক মশলা থাকে না। খেয়ে শেষ করে ফেলে। মল্লিকা কলতলা থেকে পানি এনে উঠানে রেখে বলল, “তুই এখনো বসে আছিস কেন? দুলাভাই না একটু পর তোকে নিতে আসবে? জামাকাপড় গুছিয়েছিস?

“বাবাইয়ের তো কোনো খবর নেই। কখন আসবে কে জানে। তাছাড়া আমার যা জামাকাপড় আছে, ওগুলো টাইট হয়ে গেছে অনেক। তাই নেব না। মায়ের শাড়ি পরব।” আচার খেতে খেতে বলে আরু। তখনই বাড়িতে মিষ্টি, পান, সুপারি হাতে প্রবেশ করল ইমদাদ হোসেন ও অয়ন। আরুকে দেখেই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল। উত্তেজিত হয়ে বলল, “বুবু কেমন আছিস তুই? পুঁচকে কেমন আছে?”

চলবে.. ইন শা আল্লাহ

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৫৩

“বুবু তুই কেমন আছিস, পুঁচকে কেমন আছে?” অয়নের কথায় এক গাল হাসে আরু। নয় মাসের পেটের কারণে আরুকে আয়ত্ব করতে পারেনি অয়ন। তাই চোখমুখ বেশ মলিন। অয়নকে সরিয়ে ইমদাদুলের হাত থেকে প্যাকেটটা নিয়ে বলল, “বাবা, কালকে আসবে বলেও কেন এলে না?”

“রাগ করিস না মা। ট্রেন মিস করে ফেলেছিলাম। আসতে আসতে দেরি হয়ে গেছে। তাই রাত করে এলাম না। এমনিতেই আমাদের গ্ৰাম ভালো নয়।” ইমদাদুল হোসেন বাইরেই শানের ওপর বসল। ‘বাড়ির একমাত্র দুলাভাই ও বেয়াইয়ের কণ্ঠ শুনে ফিরে এলেন অনিতা। প্রসন্ন হয়ে বললেন, “এখানে বসলে কেন ইমদাদুল? ভেতরে এসো।” পরপর বিরতি দিয়ে বললেন, “তুমি সবসময় দুই হাত ভরে খাবার নিয়ে আসো। তোমাকে কতদিন বলেছি, খালি হাতে আসতে?”

“নিজের শ্বশুর বাড়ি আবার মেয়ের শ্বশুরবাড়ি। খালি হাতে আসা শোভা পায়না। আমি এমনই আসব। যদি এগুলো আনতে বারণ করো, তবে আর আসব না ভাবী।” ইমদাদুলের কথায় অনিতা কান টেনে ধরল‌। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তাদের মাঝে বিরাজমান।

“হয়েছে আর ভাষণ দিতে হবেনা। চুপ করে ভেতরে এসে বসো। সুমি, ইমদাদুল ভাই আর অয়নকে শরবত দাও।”

“আমাকে নিয়ে এত ব্যস্ত হতে হবেনা। আমি আরু আর অপু নিয়ে এখনই চলে যাব। ভেলিভারির সময় মেয়ে তার মায়ের কাছে থাকলে জোর পায়। তাই পারুল আমাকে পাঠিয়েছে। কড়া হুকুম, ওকে নিয়েই যেতে হবে।”
বলতে বলতে সবাই বৈঠকখানায় গিয়ে বসল। সুমি ততক্ষণে নাস্তা এনে টেবিল সাজিয়ে ফেলেছে। আরু আর আগের মতো কাঠের সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠেনা। এই অবস্থায় অপূর্ব তাদের মালামাল নিচে নামিয়েছে। আরু ঘর থেকে জামাকাপড়ের ব্যাগ নিয়ে বৈঠকখানায় আসতে অনিতা বলল, “বিকালে গেলে হবেনা? অপু তো এখনো এলো না। দুপুরের খাবার খেয়ে বিশ্রাম নিতে নিতে অপু চলে আসবে।”

“পারুল আরুর জন্য অপেক্ষা করছে। আমি আরুকে নিয়ে যাই, অপূর্ব বিকালে এসে চলে যাবে।” ইমদাদুলের কথায় বাধ্য হয়েই সায় দিল অনিতা। নাস্তা খেয়ে রওনা হলো বাড়ির দিকে। আসার সময় রিকশা নিয়ে এসেছিল বলে তেমন সমস্যা হলো না। অনেকদিন পর আরু এলো মৃধা বাড়িতে, সাথে এলো ময়না পাখিরা। পারুল আরুকে দেখে প্রসন্ন হয়ে জড়িয়ে ধরলেন রিকশায় থাকতেই। অতঃপর হাত ধরে ধীরে ধীরে নামালেন। জড়িয়ে ধরে অয়নকে আদেশ দিল, “তাড়াতাড়ি তোর চাচিকে ডেকে নিয়ে আয়। আরু আসলেই তাকে খবর দিতে বলেছে।”

অয়ন ছুটে গেল। চোখমুখে প্রকাশ পেয়েছে উত্তেজনা। নয়না দিঘিতে কালির পাতিল ধুচ্ছিল। অয়ন দিঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে বলে, “চাচি বুবু এসেছে, মা আপনাকে ডাকছে।”

“তুই যা, আমি হাতের কাজ শেষ করে আসছি।” মাজতে মাজতে বলে নয়না। অয়ন শুনল না বোধ হয়, কিংবা ইচ্ছা করেই নয়নার আঁচল ধরে টানতে টানতে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। নয়না আঁচল ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, “ছাড়, অয়ন। আঁচল ছাড়। কেউ চলে আসবে। আমার হাতের মা/র খাবি কিন্তু। অয়ন! তোর মাকে বি/চার দিব। ছাড়।”

“আপনাকে বুবুর কাছে নিয়েই তবে ছাড়ব।” বলতে বলতে উঠানে নিয়ে গেল নয়নাকে। আঁচল ছাড়তেই নয়না পারুলকে উদ্দেশ্য করে বলল, “অয়ন দিনদিন বেয়াদব হয়ে যাচ্ছে। আমার আঁচল ধরে টেনে নিয়ে এসেছে।”

ইমদাদুল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে অয়ন কাঁচুমাচু মুখে করে ফেলে। ভীত অয়ন ছুটে যায় সাবিতের কাছে। অতঃপর আরুকে নিয়ে পিঁড়ি পেতে বসায় রোয়াকে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “কেমন আছিস আরু?”

“ভালো আছি চাচি। তোমরা কেমন আছো?”

“ভালো আছি। অপু আসেনি?”

“উনি রাতে আসবে। সাথী, সিঁথি ওরা কোথায়? কতদিন হয়েছে ওদের সাথে কথা হয়না। ডাক দাও, কথা বলি।” পেটে হাত দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে আরু বলে। রিকশায় ঝাঁকানিতে বেসামাল তার অবস্থা। আরুর তখনকার ছাগল ছানা মিঠু এই নিয়ে চারবার ছানা দিয়েছে। উঠানের একপাশে মিঠুকে বেঁধে রাখা হয়েছে ছানা নিয়ে। ছানা দুটো খেলা করছে। আরু দুহাত বাড়িয়ে আয় বলতেই ছানা দুটো ছুটে এলেও মিঠু এলো না। চোয়ালের নিচে হাত রাখতেই ছানা যুগল পল্লব বুজে অনুভব করতে থাকল সোহাগ। আরু কৌতূহল নিয়ে বলল, “মা, মিঠু ওভাবে বসে আছে কেন? কী হয়েছে ওর?”

“মিঠুকে বোধ হয় সাপে ছোবল দিয়েছে। সারা শরীর ঘাঁ হয়ে গেছে। কালকে পশু হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম, ডাক্তার ইনজেকশন দিয়েছে। সারা শরীরে মাখার জন্য একটা মলম দিয়েছে। বলেছে, ছানা দুটো যাতে মায়ের থেকে দূরে রাখি। দুধ ছাড়া কী খাবে ছাগল দুটো?” প্রিয় ছাগলের এমন কথা শুনে আরু উঠে এগিয়ে গেল। মাটিতে বসে কোলে তুলে আদর করতে থাকে। ছাগলের দেহের বিভিন্ন অংশ পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। বোধ হয় বেশিদিন বাঁচবে না। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে দিঘিতে নজর রাখতেই মাছের বুটবুট দেখতে পেল। প্রসন্ন হয়ে বলল, “মা, মাছগুলো অনেক বড়ো হয়েছে তো। একটা মাছ ধরো না? আজ মাছ দিয়ে ভাত খাব।”

“আচ্ছা। তুই এখন ঘরে চল।” পরপর আশেপাশে তাকিয়ে মিলাতে পারল না অয়নের হদিস। অপারক হয়ে ইমদাদুল হোসেনকে বলল, “আপনি এখানে থাকুন।‌ ছানা দুটো যাতে মায়ের দুগ্ধ খেতে না পারে। আমি আরুকে ঘরে দিয়ে আসি।”

বলেই আরুকে ধরে ধরে ঘরে নিয়ে গেল। আরুর ঘরটিতে রেখে ফ্যান চালু করল। আরু মায়ের হাতটি ধরে বলল, “মা, তুমি একটু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে? রাত হলেই পাখি পেটের ভেতরে নড়াচড়া করে। পায়ের দাগ স্পষ্ট দেখা যায়। ব্যথায় চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। উনাকেও ঠিকমতো ঘুমাতে দেইনা, আমিও ঘুমাই না। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। আমাকে একটু ঘুম পাড়িয়ে দেবে মা?”

“তুই থাক, আমি এক মিনিটের ভেতরে আসছি।” পারুল বিছানা ঝেড়ে আরুকে রেখে দিঘির দিকে গেলেন। দখিনের জানালা খুলতেই দমকা হাওয়া আরুকে ছুঁয়ে দিল। অনুভব করল পুরনো দিনের কথা। এই ঘরে কাটাল দৃশ্য ভেসে উঠল চোখের পাতায়। পেছনে তাকিয়ে দেখল, পারুল ওজু করে এসেছে। আরুকে নিজের কোলে‌ নিয়ে মধুর কণ্ঠে দোয়া পড়তে শুরু করল, করল জিকির। আরুর ছটফটে প্রাণ সেই কণ্ঠে শীতল হয়ে এলো। ওষ্ঠদ্বয় নাড়িয়ে নিজেও ব্যক্ত করল হরফ। নেত্রপল্লব ঝিমিয়ে নেমে এলো তন্দ্রার রাজত্ব।
__
ফোনের রিংটোর এক নাগাড়ে বেজে চলেছে। সময় ৫.১৫ টা। অপূর্ব ফোন রিসিভ না করে পা থেকে মোজা টেনে খুলছে। বাড়িতে প্রবেশ করে আরুর আসার কথা শুনেই চলে এসেছে এখানে। অপূর্ব ফোন রিসিভ করে কানের কাছে নিয়ে বলে, “হ্যালো মাহাদ, আমি আজ সাড়ে চারটার বের হয়েছি। তাই তোমার সাথে দেখা হয়নি। আশেপাশে খুঁজেও তোমাকে পাইনি।”

চিরচেনা কণ্ঠ শুনে আরু তাকাল। মুচকি হেসে মাথাটা অপূর্বর কোলে রেখে জড়িয়ে ধরল কোমর। অপূর্ব ওপাশের কথা আর শুনল না, কল বিচ্ছিন্ন করে আরুর মাথায় হাত চালিয়ে বলল, “লম্বা একটা ঘুম দিলি শুনলাম। তা ঘুমানোর আগে কিছু খেয়েছিস?”

“না। তবে অনেকদিন পর নিজেকে ফ্রেশ ফ্রেশ লাগছে। এতদিন ঘুমের কারণে মাথা ঝিম দিয়ে থাকত। আজ তেমন লাগছেনা। তবে খুব ভালো লাগছে। তা আপনি কখন এসেছেন?”

“এই এলাম। ফ্রেশ হয়ে একসাথে খাব।” বলতে বলতে অপূর্ব ব্যাগ থেকে নিজের সাধারণ পোশাক বের করে দিঘির দিকে রওনা হলো, মুখ ধুতে আরুও চলল পিছুপিছু। যাওয়ার সময় নিমের ডাল ভাঙতে ভুলে না। দিঘির পাড়ে বসে দাঁত মাজছে, অন্যদিকে অপূর্ব তখন সাবান দিয়ে দেহ পরিষ্কার করছে। গাছের সাথে হেলান দিয়ে পাখিকে উদ্দেশ্য করে আরু বলে, “এই পাখি, কবে তুই আমার কোলে আসবি। কবে মা বলে ডাকবি। না! না! তুই বিদেশিদের মতো মম ও ড্যাড বলে ডাকবি, ঠিক আছে?”

চলবে.. ইন শা আল্লাহ

নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-৫০+৫১

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৫০

দুপুরের খাবারের পর সবাই ধানখেতে বসে রোদ পোহাচ্ছে। কাকতাড়ুয়া সেজে দাঁড়িয়ে থাকার এক ঘণ্টা পার হয়েছে বলে তিয়াস খেতে বসেছে। স্বামীর একাকিত্বের সঙ্গী হতে সুমি খায় নি। নিজের হাতে খাবার সাজিয়ে দিল তিয়াসকে। কাঁচামরিচের ভর্তা দিয়ে ভাত মেখে তিয়াস বলে, “যার বউ নেই, তার কেউ নেই। খাওয়ার সময় অনশন দিয়ে দিল। আপনি জানেন না, খাওয়ার সময় সালাম দিতেও নেই।”

“কিন্তু তুই তো কথা বলছিস। দুর্ভাগ্যবশত তুই তখন খেতে বসিস নি।” পা দোলাতে দোলাতে বলে অপূর্ব।

“খেতে বসিনি। কিন্তু খাওয়ার জন্য উত্তেজিত ছিলাম।”

“বেশি পকপক না-করে তাড়াতাড়ি খা। তোর ভাগ্য ভালো আমি মাঝরাতে ধানখেতে একা কাকতাড়ুয়া সেজে থাকতে বলিনি। গতরাতে নির্ঘুম কাটিয়েছিস। এই রাতে তোকে খুঁজেই পাওয়া যেত না।” অপূর্বর এমন জবাবে বাক্য হারাল তিয়াস। সৌজন্য হেসে সুমির হাতে খাবার খেতে লাগল। অন্যদিকে নির্ঘুম রাতের কথা শুনে ঘুমে জেঁকে ধরল আরুকে। এই সময়ে তার পর্যাপ্ত ঘুমের প্রয়োজন। মাথা থেকে তোয়ালে খুলে ঘাসের ওপর মেলে দিয়ে হাই তুলে বলে, “ঘুম পেয়েছে। বাড়িতে চলুন। ঘুমাব।”

অপূর্ব সরে পর্যাপ্ত জায়গা করে দিলে আরুকে। কোলে ইঙ্গিত করে বলে, “আমার কোলে মাথা দিয়ে শো। রোদে ঘুম ভালো হবে।”

আরু শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করতে করতে তাকাল অপূর্বর দিকে। অপূর্বর হাতটা কপালের কাছে এনে জড়ানো গলায় বলে, “ঘুমের কারণে মাথা ব্যথা করছে। একটু চুলগুলো টেনে দিন না।”

অপূর্ব কি আরুর কথা ফেলতে পারে? যত্নের সাথে স্পর্শগুলো আদুরে হয়ে উঠল। আরু বিড়াল ছানার মতো লেপটে রইল অপূর্বর সাথে। রাতে ঘুম না হওয়াতে সবাই মাথা হোগলায় রেখে পা ঘাসের ওপর রেখে সটান হয়ে ঘুমিয়েছে। অপূর্ব একাই শুতে পারল না। এতে কোনো আফসোস নেই তার। ঘুমের ঘোরে পাশ ফিরতে গিয়ে নখ লাগল অপূর্বর হাতে। আরুর চোখাল নখে ছিলে গেল একটু। আরুর হাতটা এপিঠ-ওপিঠ করে দেখে ইলিয়াস আলীকে বলে, “নখ কাটার কিছু আছে চাচা?”

“ব্লে/ড আছে। চলবে?”

“দিন।” অপূর্বর মত পেতেই ইলিয়াস আলী ব্লে/ড নিয়ে এলো। আঙুলের মাথা ধরে ম/রা নখগুলো ফেলে দিচ্ছে। ঘুমের মাঝে বিরক্ত করার কারণে ঘুম ভাঙল আরুর। পরক্ষণে প্রিয় নখগুলোর এই অবস্থা দেখে হাত টেনে নিতে নিতে বলে, “কী করছেন? নখ কা/ট/ছেন কেন? আপনি জানেন এগুলো আমার কত পছন্দের? স্কুলের ম্যাডামের নখ দেখে বড় রাখার চেষ্টা করছি।”

“কিন্তু তোর নখগুলো ভেঙে গেছে। আমার হাতের সাথে সামান্য লেগে কী অবস্থা হয়েছে দেখ।” হাতটা দেখিয়ে অপূর্ব বলে। চকিতে ভেংচি দিয়ে আরু উঠে বসে বলে, “আপনার মোটা মোটা প্যান্ট ধুতে গিয়েই ভেঙেছে। আমার জন্য এইটুকু সেক্রিফাইস করতে পারলেন না?”

অপূর্বর চোখের পলক পড়ল না। মেয়েটার জন্য না ঘুমিয়ে বসে ছিল যাতে আরুর ঘুমের কমতি না-হয়। আর সেই মেয়েটা বলছে সেক্রিফাইসের কথা। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে অপূর্ব অন্য দিকে তাকাল। চোখ পড়ল ধানখেতের দিকে। ইঁদুরে মাটি তুলেছে। অপূর্বর মনে পড়ল পুরনো দিনের কথা। আরুর সাহসিকতার কথা। খানিক ব্যঙ্গ করে বলে, “আমি তোর মতো এত সাহসী নই। মনে আছে, আমার জামার ভেতর থেকে কীভাবে ইঁদুরটাকে বের করে নিয়ে এসেছিলিস? বলতে গেলে তুই বাঘিনী আর আমি বিড়াল।”

নিজেকে এভাবে ভীতু করাতে অপূর্বর প্রেসটিস পাংচার হলেও আরু সন্তুষ্ট হলো। অতঃপর বলে, “আমার কোলে মাথা রাখুন। আপনিও তো আমাদের কারণে ঘুমাতে পারেননি।”

“আমি ঘুমাব না, তুই ঘুমা। রাতে ঘুমালে হুঁশ থাকবে না।”

“শুনলেন না চাচা কী বলল? রাতে নাচ দেখতে যাবো। আমি কখনো এমন নাচ দেখিনি।” আরুর আবদার ফেলল না অপূর্ব। আরুর কোলে মাথা রেখে ওড়নার সাহায্যে নিজেকে আবৃত করল। উদর আঁকড়ে ধরে শোনার প্রয়াস করল ছোট্ট পাখিকে। আরু অপূর্বর স্পর্শ হাসল কেবল।

গাছের পাতা হলদে হয়ে গাছ থেকে ঝরে পড়েছে। কিছু গাছে পাতা নেই বললেই চলে। বসন্তের ছোঁয়া পেতেই তাঁরা নতুন পাতা নিয়ে আসবে। আসবে মুকুল, হবে ফল। বিকেল গড়িয়ে আসতেই ঘুম ভাঙল তিস্তার। হাই তুলে নিভু নিভু দৃষ্টি আরুর পানে নিবদ্ধ করলে চোখ পড়ল শিউলি ফুলের তৈরি বিনি সুতার মালায়। অপলক চেয়ে বলে, “এটা কোথায় পেলি? আমরা ঘুমানোর পর তোরা ঘুরতে গিয়েছিলিস নাকি?”

“তুমি বোধ হয় খেয়াল করোনি। এটা তো নানি জানের সখীর বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিলাম।”

“দাদি জানের সখীকে কোথায় ফেলি তোরা?”

“আফিয়া তার নাম। এখানে আসার সময় পরিচয় হয়েছে। অপূর্ব ভাইয়ের ফোন দিয়ে দুজন সখীর কথা হয়েছে।”

“তোরা কতকিছু দেখলি। অথচ আমরা কিছু দেখতে পারলাম না।” শুকিয়ে যাওয়া চুলগুলো হাত খোঁপা করতে করতে বলে। আরু অপূর্বর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “তিনি বলেছেন, ‘বিকালে চন্দন বাড়িয়ার ব্রিজ দেখতে যাবে।’ আজ বোধ হয় যাওয়া হবেনা।”

“কী? ব্রিজ দেখতে নিয়ে যাবে?” উত্তেজিত হয়ে সবাইকে ঠ্যালে ঘুম থেকে তুলতে ব্যস্ত হলো তিস্তা। সুজন পাশ ফিরে শুতে তিস্তা জগ ভরতি পানি ফেলল দেহে। ভিজে জবুথবু হয়ে লাফিয়ে দাঁড়াল সুজন। বিচলিত হয়ে বলে, “কী হয়েছে? কী হয়েছে?”

সুজনের চিৎকারে উঠে বসল অপূর্ব। লহমায় তন্দ্রায় ব্যাঘাত ঘটার কারণে রক্তিম নয়ন জোড়া। চোখ ঢলতে ঢলতে বলে, “কী হয়েছে?”

তিস্তার হাতে পানির জগ দেখে পরিস্থিতি আন্দাজ করতে অসুবিধা হলো না সুজনের। কাজের জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করে সুজন বলে, “ঘুমের মাঝে তিস্তা পানি ঢেলে দিয়েছে।”

“এখনো বুদ্ধি হলো না তোদের। মাথার ভেতরে টাসটাস করছে। মনে হচ্ছে, রগ ছিলে যাচ্ছে।”

তিস্তা নতজানু হয়ে আরুর দিকে চাইল। সবকিছুর সমাধান আজকাল আরুর ভেতরে লুকিয়ে থাকে। ও যেন জাদুর কাঠি। অপূর্বর মাথার চুলগুলো টেনে দিতেই আরুর কাঁধে মাথা ঠেকাল অপূর্ব। আরুর মনে হলো, মস্তিষ্কও যেন হৃৎপিণ্ডের ন্যায় স্পন্দন করছে। আরু জড়তা নিয়ে বলে, “চন্দন বাড়িয়ায় যাবেন না? ওঁরা সবাই ব্রীজ দেখতে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছে।”

ইলিয়াস আলী নারিকেল তেলের বোতল আগুনে গলিয়ে নিয়ে এসেছে। আরু করতলে নিয়ে অপূর্বর তালুতে ছোঁয়াল। অপূর্ব চোখ বন্ধ করে ইলিয়াস আলীকে উদ্দেশ্য করে বলে, “চাচা ওঁদের নিয়ে চন্দন বাড়িয়ার দিকে এগোন। আমার শরীর কাঁপছে। স্বাভাবিক হলে আসছি।”

“জি বাবা।” ইলিয়াস আলী বলার পূর্বেই যুবক-যুবতিরা ধুলো উড়িয়ে ছুটে গেল রাস্তার দিকে। অপূর্বর যে চোখ দেখেছে, তাতে লহমায় ওদের ছাই করে দিতে প্রস্তুত। ইলিয়াস আলী এগিয়ে যেতেই অপূর্ব বলে, “তুই কেন গেলি না আরু? আমার স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে। হাত-পায়ে জোর পাচ্ছি না।”

“আপনাকে রেখে যাবো কীভাবে? যদি যেতে পারেন তাহলে যাবো। নাহলে ইলিয়াস চাচার তো আছেই, তিনি সবাইকে ঘুরিয়ে দেখাবে।”

“বড়ো ভাই হিসাবে ওঁদের সাথে থাকা আমার কর্তব্য। ভ্যান পেলে ভ্যানে যাবো।”

“এই বাড়িতে ইলিয়াস চাচার একটা সাইকেল আছে। আমি সাইকেল চালাতে পারি। প্রয়োজনে আমি সাইকেল চালিয়ে আপনাকে নিয়ে যাব।”

“চল তবে।”
উঠে দাঁড়ায় অপূর্ব। তাকায় আরুর দিকে। মেয়েটা এই অবস্থায় তাকে বয়ে নিয়ে যাবে চন্দন বাড়িয়ায়। এক্ষেত্রে আরুর ব্যায়াম হবে বলেই অপূর্ব রাজি হয়েছে, নতুবা এই অবস্থায় রাজি হতো না।
সাইকেলে করে অপূর্বকে বয়ে গন্তব্যে চলছে আরু। কুড়াচ্ছে সুখ। অপূর্ব পেছন থেকে আঁকড়ে ধরে প্রেমময় কণ্ঠে বলে, “পদ্মাবতী গুণে গুণান্বিত, রূপে রূপসী। দেশ-দেশান্তরে কম ভ্রমণ করিনি। কিন্তু আমার পদ্মবতীর মতো রূপবতী ও গুণবতী নারীর সন্ধান আমি পাইনি।”

চলবে.. ইন শা আল্লাহ

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৫১

আরু কাঠের ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে খরস্রোতা নদী উপভোগ করছে। নদী হলেও উপত্যকা গভীর নয়। বাহারি রঙের পাথরে চন্দন বাড়িয়ার ব্রিজ আকর্ষণীয় করে তুলেছে। ঝুলন্ত কাঠের ব্রিজে আরুর পাশে দাঁড়িয়ে প্রকৃতি উপভোগ করছে অপূর্ব। নিচে পাথরের ওপর বসে ক্যামেরায় মুহুর্ত বন্দি করতে ব্যস্ত সকলে। কুয়াশার আস্তরণ জমেছে বিধায় কাছের বস্তু ঘোলাটে দেখায়। ঠান্ডায় দু-বার কাশি দিয়ে নাকে হাত রাখতেই মৃদু ব্যথা অনুভব করল আরু। শুষ্ক হয়েছে গোলাপি ওষ্ঠদ্বয়। মেরিলের কৌটা বের করে কিঞ্চিৎ আঙুলের ডগায় নিয়ে ছোঁয়াল আরুর ঠোঁটে। আরু এক পলক অপূর্বর দিকে দৃষ্টি রেখে ঝুঁকল ব্রিজ থেকে। প্রয়াসের বিষয়টা অপূর্বর থেকে লুকানো উচিত হয়নি আরুর। অপূর্বর দুহাত ধরে প্রেমপ্রবণ হলো আরু। জড়িয়ে আসা গলায় বলে, “আমি আপনাকে যতটা ভালোবাসি কিঞ্চিৎ পরিমাণ বেশি হলেও আপনি আমাকে ভালোবাসেন। আপনি বুঝবেন, বিচ্ছেদ কতটা যাতনার।”

“হঠাৎ এত আবেগময় হয়ে যাচ্ছিস কেন? তুই তো একটা রোমান্টিক নয়। ব্যাপার কী? সত্যিটা বল।”

“বলুন স্বাভাবিকভাবে মেনে নিবেন। তবেই বলব।”

আরুর কথার জবাব না দিয়ে আদেশ দিল বলাল, “বল।”

“প্রয়াস ভাই ও তুর দুজন দুজনকে ভালোবাসে।” কথাটা বলে আরু দৃষ্টি সরিয়ে ফেলল। চোখ ছোটো ছোটো করে অপেক্ষায় রইল অপূর্বর উঁচু গলার। অপূর্ব নিশ্চল দৃষ্টিতে আরুর লজ্জা তড়তড় করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঠান্ডার ভেতরেও কপালে জমল লবণাক্ত জল। বাকিদের সাথে যোগ দিতে স্থির পা গতিশীল করলে আরুর হাতে কারণে থামল। কৌতূহল টেনে অপূর্ব বলে, “এত তাড়াতাড়ি ভালোবাসার সৃষ্টি হয়ে গেল? এটা ভালোবাসা নয়, ভালো লাগা। আমি এই বিষয় নিয়ে ওদের সাথে কথা বলব।”

“খালি চোখে যেটাকে ভালো লাগা বলছেন। সেটা ভালোবাসা। ওঁরা তিন বছর ধরে প্রেম করছে। আসলে প্রয়াস ভাই আমাদের গ্ৰামের ছেলে। মনে আছে আপনার, একটা ছেলের চিঠির জন্য মা আমাকে উঠানে বেঁধে চলা কাঠ দিয়ে মে/রে/ছিল। সেই চিঠিটা ছিল প্রয়াস ভাইয়ের তরফ থেকে তুরকে দেওয়ার জন্য।” নতজানু হয়ে কথাগুলো বলে তাকাল অপূর্বর পানে। অপূর্ব বিস্মিত, নির্বাক, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। লহমায় চেপে রাখা হাতটা আলগা হয়ে খসে পড়ল। দ্বি মুহূর্তে নিজেকে সং‌যত করে প্রতুক্তি চাইল, “তারমানে প্রয়াসের এখানে আসা সাজানো নাটক? শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত? ও আসলে আমাকে চিনেও না চেনার ভান ধরেছিল? প্রথমবার ও আমাকে এভাবে ঠকাল।”

“আপনি ভুল ভাবছেন। প্রয়াস ভাই সবার মন জয় করার জন্য অপরিচিত সেজেছে। সময় ও সুযোগ বুঝে সবটা জানাত।”

“এখানেই ওদের সম্পর্ক আমি দাঁড়ি টানলাম। তুর প্রয়াসকে এখানে আনার আশকারা দিয়েছে। ওকেও আমি দেখে নিব। বাবা মায়ের অবর্তমানে আমিই তুরের অভিভাবক।” বলেই অপূর্ব এগোল। চেতনা ফিরতে অপূর্বর উদ্দেশ্যে বিঘ্ন ঘটাতে আরু ছুটল পেছনে পেছনে। অপূর্ব অবিচল হয়ে ওদের মুখোমুখি দাঁড়াল, আরু তখন নামল ব্রিজ থেকে। অসংখ্য পাথরের মাঝে পা স্থির রাখতে পারল না। পানির কারণে পিছলে গেল। ধপাস করে চিত হয়ে মাটিতে পড়ল সে। সেই শব্দে উপস্থিত সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হলো আরু। অপূর্ব তেজ শুন্যতায় নেমে গেছে। চঞ্চল পায়ে এগিয়ে এসে আরুকে টেনে তুলতে তুলতে বলে, “পড়লি কীভাবে? কোথায় লেগেছে দেখি।”

“দরদ দেখাতে হবে‌না। আপনার জন্যই পড়েছি। মনে হচ্ছে কোমরটা ভেঙে গেছে।” কপালে ভাঁজ ফেলে রাগ দেখাল আরু। চোখ বন্ধ করে ব্যথা সহ্য করার প্রচেষ্টা করল। আদৌ লাভ হলো কি-না, কেবল সে জানে। অপূর্ব নরম হলো। কর্পূরের মতো রাগগুলো উড়িয়ে আরুকে কোলে তুলে নিল। বিশাল আকারের একটা পাথরের ওপর বসিয়ে বলল, “কোথায় কোথায় লেগেছে দেখি আরু, এই সময়ে একটু ধীরে ধীরে হাঁটতে হবে।”

“ধীরে ধীরে হাঁটতে দিয়েছেন আমাকে? আপনার জন্য পড়েছি। আমার যদি কিছু হয়ে যেত, খবর ছিল আপনার। এখন শুধু কোমরে ব্যথা পেয়েছি। বাড়িতে গিয়ে মালিশ করে দিবেন।”

অপূর্ব স্বাভাবিক থাকার ভান ধরে প্রয়াসের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি সাইকেল চালাতে জানো? সাইকেল সম্পর্কে আমার তেমন অভিজ্ঞতা নেই। আরুই আমাকে এখানে এনেছে। এই ব্যথা নিয়ে এখন আর সাইকেল চালাতে পারবে না। সম্ভব হলে তুমি একটা..

অপূর্ব বাক্য শেষ না করে পূর্বের কথার পরিপ্রেক্ষিতে জানিয়ে দিল বার্তা। প্রয়াস মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “হুঁ। আমি পারি। আমি ভাবিকে সাইকেলে করে মির্জা বাড়িতে নিয়ে যাবো।”

তুর দুজনের দিকে চেয়ে ঝটপট বলল, “আমিও যাবো, ভাইয়া।”

অপূর্বর তেজ আগ্নেয়গিরির লাভার ন্যায় ফুটতে শুরু করল। প্রিয়সীর যাতনার কারণ তুরকে মনে করল। অবাধ্য হাত প্রথমবার তার আদুরে বোনের গালে গিয়ে থামল। লহমায় গাল জ্বলে উঠলেও বি/স্ফো/রি/ত হলো পরিবেশ। সেই শব্দ প্রকৃতিতে লেগে আবার ফিরে এলো। আচমকা তুরের হাতটা ধরে সরিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “সমস্যা কী তোর? চোখে দেখতে পাস না, সাইকেলে মাত্র দুটো সিট? তুই বসলে ওরা বসবে কোথায়?”

তুচ্ছ বিষয়ে চড় হজম হলো না কারো। ক্রন্দনরোল তুলে উঠতেই তিস্তা এগিয়ে এলো। অপূর্বর হিংস্র থাবা থেকে তুরকে সরিয়ে বলল, “অপূর্ব ভাই, আপনি তুরের সাথে এমন করছেন কেন? বাচ্চা মেয়ে সাইকেল দেখে উঠতে চেয়েছে। বুঝিয়ে বললেই হতো। আপনি অহেতুক মাথা গরম করছেন।”

“সেটা কি তোর থেকে আমি শিখব? সবাই সামনের দিকে এগোও, তুরের সাথে আমার কথা আছে। পিতা মাতার অবর্তমানে তুরের অভিভাবক আমি। তাই কেউ আমাকে উপদেশ দিতে এসো না।” অপূর্বর কথায় সবাই আরুর দিকে তাকিয়ে থাকল। গিরিগিটির মতো রং বদলায় অপূর্ব। এই ভালো, তো এই খারাপ। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে অপূর্ব ও তুরকে রেখে এগিয়ে গেল। আরু জানে অপূর্ব কেন তুরকে আলাদা করেছে, কিন্তু মুখ ফোটে বলতে পারল না।

সকলের থেকে দশ মিটার পিছিয়ে অপূর্ব ও তুর। ঝাপসা দেখা গেলেও কথা শোনার জো নেই। অপূর্ব কঠোর গলায় শাসাল তুরকে, “প্রয়াসের আশেপাশে যাতে তোকে না দেখি, নাহলে তোকে এখান থেকে সুন্দরনগর নিয়ে ফিরব না।”
পরপর টেনে বলে, “প্রেমিকের পরিচয় গোপন রেখে, অপরিচিত সাজিয়ে এখানে এনে অ/ন্যা/য় করেছিস তুই। তার শা/স্তি গ্ৰামে গিয়েই তোকে দেব।”

“মানে?” কাঁপাকাঁপা গলায় উচ্চারণ করল তুর।

“এই নদীতে তোকে পুঁ/তে রেখে যাব। আমার সাথে নাটক করছিস? কী ভেবেছিস, আমি জানিনা কিছু? চল বাড়িতে।” অপূর্বর ধমকে তুর সামনে এগিয়ে গেল। তুর বিচক্ষণতার পরিচয় দিল, এটা নিঃসন্দেহে আরুর কাজ। সেই অপূর্বকে জানিয়েছে। বিশ্বাসের এমন প্রতিদান দিল আরু?
__

হলদে আলোয় মির্জা বাড়ি আলোকিত। সবাই সেখানে থাকলেও, নেই তুর। একা ঘরে হারিকেন জ্বালিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। প্রচণ্ড তেজে ভয়ের লক্ষণ দেখা যাচ্ছেনা তুরের মাঝে। চোখ থেকে আপনাআপনি পানি ঝরল।
কুপির ওপরে সরিষার তেল ও রসুন গরম করছে তিস্তা। অতঃপর আরুর ব্যথার স্থানে লাগিয়ে দিতে দিতে বলল, “ব্যথা কমেছে?”

আরুর মন উদাস, ননদ রূপী সখীকে না দেখে পরিস্থিতি অনুমান করতে পেরেছে। তুরের সাথে একটু খোলাসা করে কথা বলার প্রয়োজন। উঁকিঝুঁকি দিল দোতলার সেই ঘরটিতে। সকলের আড়ালে কুপিটা নিয়ে অগ্রসর হলো তুরের কক্ষে। মেয়েটাকে উবুড় হয়ে শুয়ে কাঁদতে দেখে মলিন হলো মুখমণ্ডল। অপরাধীর মতো নরম গলায় বলল, “তুর, এখানে একা শুয়ে আছিস কেন? শরীর খারাপ লাগছে? ওখানে সবাই একসাথে আড্ডা দিচ্ছে। চল! ওখানে যাবি?”

“আরু আমার মন ভালো নেই। এখান থেকে যা!”

“আরে শোন না… বলে তুরের হাত ধরতেই ঝটকায় ছাড়িয়ে নিল তুর। শোয়া থেকে উঠে উচ্ছৈঃস্বরে বলে, “তোর মনে আনন্দ আছে, তাই তুই ওখানে বসে আড্ডা দিচ্ছিস। কিন্তু আমার মনে কোনো আনন্দ নেই। তুই সখী হওয়ার যোগ্য নয়। কীভাবে পারলি আমার সাথে এমন কাজ করতে? ভাইয়াকে প্রয়াসের কথা জানানোর পেছনে কীসের স্বার্থ আছে তোর? ভালোবেসে তোরা তো নিজেদের ভালোবাসার মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছিস। অন্যকে নিয়ে এত ভাবনা কীসের তোর? একটা কথা কান খুলে শুনে রাখ, প্রয়াসকে যদি আমি না পাই। তাহলে তোদেরও আমি সুখে থাকতে দেব না। যে অনলে কালাচাঁন, শেফালী, মিহির পুড়ছে। একই অনলে আমরা দুজন তো পুড়বই, তোদেরও পুড়িয়ে ছাই করে দিব। যার নাম প্রেমানল।”

চলবে.. ইন শা আল্লাহ

নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-৪৯

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪৯

অপূর্ব সবাইকে সামলাতে নাজেহাল হয়ে উঠল। দশ জনের ভেতরে সে বড়ো। দরজার ছিটকিনি তুলে বিছানার দিকে এগুতেই লক্ষ করল সুন্দরী নেই, তবে তুর আছে। অপূর্বর হাত ছেড়ে আরু বিছানায় উঠে আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে। অপূর্ব কিঞ্চিৎ সন্দেহ নিয়ে বলেন, “শেফালী তোর শাশুড়ি কোথায়?”

“জীবন বাঁচানো ফরজ। তাই নূপুরের আওয়াজ কানে আসতেই চিৎকার করে কালাচাঁনকে নিয়ে বাইরে বের হয়েছি। বের হয়ে দেখি সবাই বাইরে।” শেফালীকে করা অপূর্বর প্রশ্নের জবাব দেয় তুর। কারণ সন্ধ্যা রাতে সুন্দরীর সাথে সে ছিল।

“কতবার ঠ্যালা দিলাম। উঠল না। নূপুরের শব্দ শুনে বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে, জানি না।”

তিস্তা পালটা প্রশ্ন করে, “শ্বাস পড়ছিল কি-না পরীক্ষা করেছিস? তাঁর কিছু হয়ে গেলে কালাচাঁন কিন্তু আমাদের ধরবে।”

কালাচাঁনের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। গ্ৰামে থাকতে রাতবিরেতে রাস্তা দিয়ে বাড়িতে যেত। সুন্দরী থাকত একা বাড়িতে। মনে কিঞ্চিৎ ভয়ও নেই। শেফালীর জন্য বাধ্য হয়ে এখানে এসেছে। অপূর্ব বিরক্ত হয়ে বলে, “থামবি তোরা? উনি রাতে বোধ হয় ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছেন তাই নূপুরের শব্দ শুনতে পায়নি।” সবাই নির্বাক হতেই অপূর্বর ফের বলে, “হারিকেন কোথায় তোদের? মায়ের কাছে শুনেছি আগুন থাকলে তাঁরা আশেপাশে আসে না।”

“ঘরে। সময় পাইনি নিয়ে আসার।”

“অপূর্ব ভাই, আপনি একবার ইলিয়াস চাচাকে ফোন করুন। দেখুন কী বলে?” তিয়াসের কথায় অপূর্ব কল করল। তবে লাভ হলো না। কারণ ঘন কুয়াশায় নেটওয়ার্ক সমস্যা। বিছানায় উঠে সবাই গুটিয়ে বসে থাকল।
_
কুয়াশা ভেদ করে সূর্যের রশ্মি পতিত হতেই ব্যাগপত্র নিয়ে নিচে নামল অপূর্ব। আরুর হাত ধরে অপেক্ষা করতে থাকল বাকিরা আসার। ঘুমের ওভার ডোজের কারণে গতরাতে সুন্দরীর ঘুম না ভাঙলে এবার ভাঙল। সবাই এসে ভিড় করল বড়ো বৈঠকখানায়। প্রয়াস পীড়া দিয়ে বলে, “দাঁড়িয়ে পড়লেন কেন? তাড়াতাড়ি চলুন।”

“চাচা আসুক। আমাদের যাওয়ার কথা তাকে জানানো উচিত। তিনি এসে আমাদের খোঁজ করবেন।” অপূর্বর কথায় সম্মতি দিয়ে সবাই অপেক্ষা করছে ইলিয়াস আলীর আসার। কিছুক্ষণ পর ইলিয়াস আলী টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে মির্জা বাড়িতে ঢুকল। সবাই তৈরি দেখে আগ বাড়িয়ে বলে, “আপনারা এত তাড়াতাড়ি উঠলেন কেন? শীতের ভেতরে একটু দেরি করে উঠতেন।”

“এই বাড়িতে যে ভূত আছে। আগে কেন বলেননি চাচা? আমরা আর এই বাড়িতে থাকছি না। গতরাতের কথা মনে পড়লে গায়ে কাঁটা দেয়।”

“ভূত? ভূত এলো কোথা থেকে?”

“মাঝরাতে আমরা সবাই নূপুরের শব্দ পেয়েছি।” তুর বলে। ইলিয়াস আলী মৌনাবলম্বন করে বলে, “কালকে তো রাস পূর্ণিমা ছিল। আমার একদম খেয়াল ছিল না। আগে এই মির্জা বাড়িতে বাইজি আসর হতো। এখন এখানে না হলেও কিছু দূরে বটতলায় বাইজি আসর বসে। আর এই আসর বসে রাস পূর্ণিমায়। বোধ হয় আপনারা সেই ঘুঙুরের শব্দ শুনেছেন।”

সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সামান্য এই কারণে তাঁরা ভয়ে জবুথবু। অপূর্ব ফের প্রশ্ন করে, “কতদিন হয় এই নাচ?”

“তিন দিন। পূর্ণিমা, পূর্ণিমার আগেরদিন ও পরেরদিন। এখনও কি আপনারা চলে যাবেন?” ইলিয়াসের প্রশ্নে সবাই না-বোধক মাথা নাড়ে। ব্যাগপত্র রেখে তৈরি হতে যায়, যার যার কক্ষে। ইলিয়াস আলী হাতের ইশারায় অপূর্বকে দোতলার ঘরটিকে দেখিয়ে বলে, “ঐ কোনায় যে ঘরটা দেখতে পারছেন, ওটা ছিল ইস্কান্দার মির্জার। মানে আপনার বুড়ো বাবার। তিনি ঐ গোপন ঘরে স্ত্রী মমতাজকে নিয়ে থাকতেন।”

অপূর্ব অবাক না হয়ে পারল না। কারণ আরুকে নিয়ে সে গতরাতে ঐ ঘরে ছিল। অপূর্বকে নিয়ে ইলিয়াস আলী বাড়ি ঘুরে দেখাতে লাগলেন। সবাই এসে যোগ দিল বাড়ি দেখতে। এক এক করে তালাবদ্ধ ও গুপ্ত ঘরগুলো দেখাতে লাগলেন। বললেন, “আগে এই বাড়ি ছিল জমজমাট। ছয় ভাই এই বাড়িতে জমিয়ে দিন কা/টাতো। কিন্তু আফসোস এই বাড়ি আলো করে আর কোনো পুত্র সন্তান এলো না। মেয়েদের বিয়ের পর থেকে ক্রমশ ফাঁকা হতে থাকল বাড়ি। এখন মাঝে মাঝে নাতিপুতি নিয়ে ঘুরতে আসে তারা।”

বেশিক্ষণ এই বাড়ি দেখল না তারা‌। সুন্দরীকে নিয়ে নিয়ে অপূর্ব, কালাচাঁন ও ইলিয়াস আলী গেলেন ডাক্তারের কাছে। বাড়ি বসে রইল বাকিরা। যাওয়ার আগে অবশ্য সকালের খাবার সবাইকে খেয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিল। তবে আরুরা রোদ প্রখর না হওয়া পর্যন্ত, অনশন করেছে। এক পর্যায়ে হাঁটতে বের হলো সকলে। নতুন পরিবেশে হাঁটতে বেশ লাগছে সকলের। ‘ছিক, ছিক’ শব্দ করে তুরকে ইঙ্গিতে পেছনে যাওয়ার নির্দেশ দিল। তুর ধীরে ধীরে পিছিয়ে গেল। প্রখর রাগ দেখিয়ে ব্যঙ্গ করে বলে, “আমি পরিত্যক্ত বাড়ি ভ্রমণ করতে চেয়েছিলাম, ভূতের বাড়ি না। ভূত দেখে ওমনি আমার প্রতি ভালোবাসা কর্পূরের মত উড়ে গেল? সব আপনার নাটক।”

প্রয়াস মাথা চুলকায়। ইতস্তত নিয়ে বলে, “ভূতের বাড়ি জানলে কি তোমাকে আসতে দিতাম? দাঁড়াও ছবি তুলে দেই।”

তুর চাদর আঁকড়ে ধরে গাছের সাথে হেলান দিল। প্রয়াস অবিরাম ছবি তুলতে থাকল তুরের। দূর থেকে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে দুজনকে দেখছে তিয়াস। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে, “এই প্রয়াস নামের ছেলেটা অদ্ভুত টাইপের। এখন পর্যন্ত আমার সাথে কথা বলল না, অথচ তুরের সাথে সখিত্ব গড়ে তুলেছে। মনে হচ্ছে, আগে থেকেই একে অপরকে চেনে।”

আরু ও শেফালী দৃষ্টি বিনিময় করে হাঁক দেয়, “তুর, এদিকে আয়‌। গ্ৰাম ভালো না, একা ছেলেমেয়েকে একসাথে দেখলে খারাপ ভাববে‌। তাছাড়া রাস্তাঘাট কেউ চিনি না। হারিয়ে গেলে?”

“ছেলেটা ভালো ছবি তোলে। আমার ছবি এখন পর্যন্ত তোলে নি। তাই ভাবলাম তুলে নেই।” বলতে বলতে এগিয়ে এসে সবার সাথে পা মেলাল তুর। কিছুটা পথ এগিয়ে যেতেই দেখা মিলল একটা খালের। রাস্তা থেকে খালের দূরত্ব একটা মাঝারি সাইজের দূর্বা ভরতি মাঠ। রোদ্দুর জেঁকে বসেছে সেই মাঠে। তাই আগ্রহ নিয়ে সবাই মাঠে নামে। মাঠের এক কিনারে রয়েছে কলাগাছ। জায়গাটা সরকারি হলেও জনগণ মনোমতো ক্ষণস্থায়ী গাছ লাগাতে পারে। দাঁত দিয়ে কলাপাতা কে/টে আসন পেতে বসেছে অনেকে। আরুর মনে পড়ে পুরনো এক অতীত। খাল দেখলে এখন এড়িয়ে যায়, আগে কত মাছ ধরত। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আরু বলে, “এই শীতের সময় খালে কুঁচো চিংড়ি পাওয়া যায়। আমি আর অয়ন ওড়না দিয়ে ধরেছি। রাতে মা সেই চিংড়ি ও ডাল দিয়ে বড়া বানিয়ে দিত। এখনো জিভে লেগে আছে।”

তিস্তা প্রিঞ্চ করে বলে, “খালি বড়া খেয়েছিস? ফুফুর মা/র খাসনি? মাছ ধরে ঠান্ডা লাগাতি আর ফুফু তোকে মা/রত। মা/র থেকে বাঁচতে আমাদের বাড়িতে এসে লুকাতি। মা/র খেয়েও তুই বড়া খাওয়া ছাড়তে পারতি না।”

অপূর্ব নদীর ওপার দিয়ে ফিরছিল। পরিচিত পোশাকের মানুষগুলো দেখে রাস্তা থেকে নদীর পাড়ে নেমে বলে, “তোরা এখানে কী করছিস?”

“রোদ পোহাচ্ছি। আপনিও আসুন।”

“বেলা এগারোটা ছাড়িয়ে গেছে। কুয়াশা ছাড়ছে না তাই সময় বোঝা যাচ্ছেনা। সবগুলো এই নদীতে নেমে গোসল সেড়ে নে। আমরা সবাই ইলিয়াস চাচার বাড়িতে দুপুরের খাবার খাবো।” ওপার থেকে অপূর্ব বলে।

তিয়াস ব্যতিক্রম স্বরে বলে, “এই শীতে গোসল করলে বাঁচব না। আর এই নদীতে তো অসম্ভব। যদি কেউ এই নদীতে নেমে এক ডুব দিতে পারে, তাহলে ধান ছাড়া খেতে কাকতাড়ুয়া সেজে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকব।”

“পারবি তো?”

“পারব?”

“১০০% সিউর?”

“১০০০% সিউর।”
তিয়াস থামার পূর্বেই পানির শব্দ কানে এলো। চেয়ে দেখল অপূর্ব নেই। সবাই স্বাভাবিক চোখে তাকালেও আরু অস্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখল। এখনো কেন উঠছে না। অপূর্ব তো সাঁতার জানে না। হৃৎপিণ্ড রক্ত সঞ্চালন অস্বাভাবিক হয়ে উঠছে।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪৯ (বর্ধিতাংশ)

অপূর্বকে দেখা যাচ্ছে না নদীতে। অপূর্বর চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠেছে আরু। গতকাল ছিল পূর্ণিমা। পূর্ণিমার লগ্ন এখনো যায়নি। জোয়ারের পানি তট ছুঁইছুঁই। ভাবাবেগ নেই বাকি কারো। আরুও ঝাঁপ দিল নদীতে। চমকাল উপস্থিত সবাই। হাত দুটো ঝাপটাতে ঝাপটাতে পৌঁছে গেল অপূর্বর কাছে। অপূর্ব পানি থেকে মাথা তুলে। আরুকে নিকটে দেখে ভীষণ চমকায়। ললাটে ভাঁজ ফেলে বলে, “তুই এখানে কী করছিস? এই ঠান্ডা পানিতে নেমেছিস কেন? তোর টিউবওয়েলে গোসল করা উচিত ছিল।”

আরুর কাছে পৌঁছাল না শব্দ। উভয়ের মাঝের দূরত্ব শূন্যতায় নামিয়ে দুহাতে গলা ঝাপটে ধরল অপূর্বর। ভর সম্পূর্ণ অপূর্বর দেহে পতিত হওয়ার কারণে তলিয়ে গেল পানিতে। পায়ে ঠেকল কাদামাটি। পানিতে ওষ্ঠদ্বয় নাড়িয়েও শব্দ করতে পারল না অপূর্ব। আরুর মাথায় হাত রেখে ভরসা দিয়ে পিছিয়ে গেল। তটে আসতেই দৃশ্যমান হলো বুক। আদুরে গলায় বলে, “এই বাবুর মা, পানিতে নেমেছিস কেন?”

“আপনি তো সাঁতার জানেন না, পানিতে কেন নামলেন?” আরুর প্রশ্নে প্রশস্ত হলো ললাটে। বোধগম্য হলো এমন আচরণের কারণ। দিঘিতে গোসল করেনা অনেকদিন। টিউবওয়েল চেপেই গোসল করে নিত্যদিন। তাই দৃষ্টিনন্দন হয়নি বিষয়টি। জবাব দেয় প্রশ্নের, “সে-তো আরও আগে শিখেছি। আরও আগে বলতে, আরও আগে। তোকে নদী থেকে উদ্ধার করার পর। সেদিন যদি আমি সাঁতার জানতাম তবে, আমিই তোকে উদ্ধার করতে পারতাম। এখন যেহুতু গ্ৰামে থাকি, তাই সাঁতার জানা জরুরি।”

আরু এক গাল হাসল। ছেলেটা তার জন্য সাঁতার শিখেছে। কালাচাঁন ও সুন্দরী দাঁড়িয়ে ছিল তীরে। ঘুরে আসতে পা ফেলে বলে, “এই ঠান্ডা নদীর পানিতে গোসল করার ইচ্ছে নেই। আমরা বরং ঘুরে আসি।”

আরু ও অপূর্ব সাঁতরে পৌঁছাল পাড়ে। এগিয়ে গেলে ওপরে উঠতে সাহায্য করল তিস্তা। পানি ঝাড়তে ঝাড়তে বলে, “ওকে কেন পানিতে নামতে দিলি?”

“আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আরু ঝাঁপ দিয়েছে। কীভাবে আটকাতাম। এই আরু তুই পানিতে কেন ঝাঁপ দিলি?”

“আমি কি জানি অপূর্ব ভাই সাঁতার জানে? তাই ভয়ে ঝাঁপ দিয়েছি।” শীতে কাঁপতে কাঁপতে আরু বলে। বেশিক্ষণ ভেজা অবস্থায় থাকা ঠিক নয়। তাই বাড়ির দিকে যাত্রা শুরু করেছে। পুল পেরিয়ে যোগ দিয়েছে কালাচাঁন ও সুন্দরী। অপূর্ব আরুকে আড়াল করে হাঁটতে হাঁটতে তিয়াসকে বলে, “কাকতাড়ুয়া হয়ে এক ঘণ্টা তোকে থাকতে হবে। সময় আমি জানিয়ে দিবো।”

_
লাল রঙের লেপ জড়িয়ে রাজকীয় হয়ে বসে আছে আরু। ঠকঠক করে কাঁপছে শীতে। অপূর্ব দিনদুপুরে হারিকেন জ্বালিয়ে বিছানার ওপরে রেখে বলে, “ছ্যাক দে। ঠান্ডা কমে যাবে।”

লক্ষ করল আরুর মাথার খোঁপা পূর্বের মতোই খোঁপা করা। ভেজার কারণে দলা পাকিয়ে আছে চুল। অপূর্ব খোঁপা খুলে তোয়ালে প্যাঁচিয়ে দিতে দিতে বলে, “ভেজা চুলগুলো মুছিস নি কেন? ঠান্ডা লেগে যেতে পারত।”

“আমার চুল কি অন্যদের মতো ছোট যে শুকিয়ে যাবে। আজ সারাদিনেও শুকাবে না।”

“এখানে বসে থাকলে শীত কমবে না। চল একটু হেঁটে আসি।”

লেপ ভাঁজ করে গুছিয়ে আরুর হাত ধরে বের হলো অপূর্ব ও আরু। ঠান্ডায় রোদের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে তারা। একজন বৃদ্ধা উঠান ঝাড়ু দিতে দিতে লক্ষ করে ভিনদেশী যুবক-যুবতিকে। মাথায় কাপড় টেনে মৃদু গলায় বলে, “কারা তোমরা? আগে তো এই গ্ৰামে দেখিনি। কোন বাড়িতে এসেছ?”

উঠান বেশ বড়। একপাশে মাটির উনুন। রান্না করছে মধ্যবয়স্ক এক নারী। তরকারি কাটছে এক যুবতি। আরু ও অপূর্ব রোদ পোহাতে সেই বাড়ির ভেতরে ঢুকল। বৃদ্ধার প্রশ্নের উত্তর দেয়, “আমরা মির্জা বাড়ির অতিথি।”

“কোন মির্জা বাড়ি? ইস্কান্দার মির্জার পরিত্যক্ত বাড়ি?”

“হ্যাঁ! আমি ইস্কান্দার মির্জার মেয়ে চম্পার নাতি।”
বৃদ্ধ খুশি হলেন ব্যাপক। চোখে ফোটল অশ্রু। ঝাড়ু ফেলে দুটো পিঁড়ি এনে উঠানে দিয়ে বলে, “তোমরা চম্পার নাতি? বসো তোমরা। কেমন আছে চম্পা?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে।”

অপূর্বর মনে হলো, এই বৃদ্ধা নিবিড়ভাবে চেনা চম্পাকে। তবুও সৌজন্যস্বরুপ বলে, “আপনি আমার দাদিজানকে চিনেন?”

“তোমার দাদিজান হওয়ার আগে আমি চম্পাকে চিনি। এই পথঘাট সাক্ষী আমাদের সখিত্বের। এই শীতকালে আমরা কয়েকজন সখী মিলে ধানের অবশিষ্ট ছড়া তুলতে যেতাম। ছড়া থেকে চাল বানাতাম। সেই চাল ও হাঁসের ডিম দিয়ে আমরা চড়ুইভাতি খেলতাম।” বৃদ্ধার চোখে দেখতে পেল অতীতের স্মৃতি। বৃদ্ধার নাতনি গেল আমাবলি পিঠা নিয়ে আসতে। থালা ভরতি পিঠা দিয়ে আপ্যায়ন করল। আরু পিঠা খেতে খেতে বলে, “আপনার নাম কী দাদি? দাদিজানকে আপনার কথা জানাতে হবে।”

“আমার নাম আফিয়া। চম্পা আমাকে ব্যঙ্গ করে আতি বলে ডাকে। পারলে চম্পাকে একবার গ্ৰামে আসতে বলো, কতদিন দুই সখী গল্প করিনা।”

“আপনি দাদিজানের সাথে কথা বলবেন?”

“হুঁ।”

অপূর্ব বাড়ির ল্যাণ্ডফোনে ডায়াল করল। রিসিভ করল অনিতা। মায়ের খোঁজখবর নিয়ে দাদিজানকে চাইল। চম্পা তখন পান চিবুচ্ছিল। অপূর্বর জরুরি তলবে পান চিবুতে বলে, “কচি বউকে নিয়ে ঘুরতে গেছ, বুড়ো বউয়ের কথা তোর মনেও ছিলনা। এখন কেন কল দিয়েছ? দুই নৌকায় পা দিয়ে চললে হবেনা।”

“ও তো বাচ্চা বউ। আমার যত্ন নিবে কীভাবে? তাই বুড়ো বউকে খুঁজছি।”

“যা পা/গ/ল! কী করছিস তোরা?” পান চিবুতে চিবুতে বলে চম্পা।

“আফিয়া নামের নতুন একটা বউ পেয়েছি। জামাই করতে আদরযত্ন করছে। তুমি কি বলো, বউ কি বানিয়ে ফেলব?”

“আতির কাছে তোরা? কোথায় ও। তোদের সাথে কীভাবে দেখা হলো? ওকে একটু ফোনটা দে। কতদিন হয়েছে ওর সাথে কথা হয়না।” চম্পার উত্তেজিত গলা শুনে অপূর্বর ফোন হাতে দিল আফিয়ার। জোতা খুলে আরু উঠে হাঁটতে থাকল। উঠানের কোনে শিউলি ফুলের গাছ। ঝরা শিউলি ফুল মাটিতে পড়ে সুবাস ছড়াচ্ছে। ঝুঁকে ফুল কুঁড়াতে থাকে আরু। আরুর পিঠ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে শিউলি ফুলের গাছ ধরে ঝাঁকাল অপূর্ব। আলগা ফুলগুলো অমনি আরুর চারদিকে পড়তে থাকল। তড়িঘড়ি করে ওড়না টেনে ফুলগুলো সংগ্রহ করতে লাগল। নীল স্বচ্ছ আকাশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছেনা কুয়াশায়। মোহনীয় লাগছে আরুকে। অপূর্বর চোখ আটকাল জিগার গাছে। এক ধরনের আঠা বের হচ্ছে সেই গাছ থেকে। অপূর্ব আরুর ওড়না থেকে শিউলি ফুল নিয়ে দুই পাশ জিগার আঠায় ডুবাল। অতঃপর শিউলি ফুল লাগাল। একের পর এক শিউলি ফুল লাগানোর কারণে তৈরি হলো মালা। আরুর গলায় পরিয়ে দিল। আরু মাথা নিচু করে বলে, “আমার এখানে কিছুই ভালো লাগছে না। সবাইকে মনে পড়ছে। কবে বাড়িতে যাবো?”

“কালকে আরেকবার ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। উন্নতি হলে ওষুধপত্র নিয়ে গ্রামে ফিরে যাবো। খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে চন্দন বাড়িয়ার ব্রিজ দেখতে যাবে। সেখানে গেলে তোমার মন ভালো হয়ে যাবে”
কথা বলে দুজনে এগোল বাড়ির দিকে। ততক্ষণে দুই সখীর কথোপকথনের ইতি ঘটেছে। আফিয়ার থেকে বিদায় নিয়ে অগ্রসর হলো ইলিয়াস আলীর বাড়ির দিকে।

ধানখেতে হোগলা বিছিয়ে খাবার সাজিয়েছে রোদে। গরম ভাতের সাথে উনিশ রকমের ভর্তা। আরুদের সেখানে পৌঁছানোর পূর্বেই সেখানে হাজির বাকিরা। শিউলি ফুলের গন্ধ পৌঁছে গেছে নাকে। কাছাকাছি আসতেই প্রয়াস বলে, “আপনারা কোথায় গিয়েছিলেন ভাই?”

“শুধু আপনাদের জন্য ক্ষুধা সহ্য করছি। এত রকমের ভর্তার গন্ধে ক্ষুধা দ্বিগুণ হয়ে গেছে।” তিয়াসের কথায় অপূর্ব ভ্রু কুঁচকাল। আসন পেতে হোগলায় বসে বলে, “এই ধানখেতে কাকতাড়ুয়া হয়ে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাক তিয়াস।”

চমকাল তিয়াস, থমকে গেল। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল। সবাই ইতোমধ্যে থালা ধুয়ে ভাত খাচ্ছে। তিয়াস করুণ দৃষ্টিতে কাকতাড়ুয়ার বেশে ধানখেতে দাঁড়িয়ে আছে।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-৪৭+৪৮

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪৭

দোতলা ছোটো লঞ্চ। ওপর থেকে নিচে তাকালে পানি দেখা যায়। এই প্রথম লঞ্চে উঠেছে আরু। আনন্দে রেলিং ধরে নিচে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। তুর পাশে দাঁড়িয়ে ইশারা করছে ঘাটের দিকে। আরু কৌতূহল নিয়ে পাশে তাকাতেই বিস্মিত হচ্ছে। প্রয়াস ট্রাভেলিং ব্যাগ নিয়ে ঘাটের দিক থেকে এদিকে এগিয়ে আসছে। শঙ্কায় আরু জমে পেছনে তাকাল, অপূর্ব হেসে হেসে কথা বলছে। ঘনঘন পলক ফেলে তুরকে ঠ্যালা দিয়ে বলে, “প্রয়াস ভাই এদিকে আসছে কেন? ওনি দেখলে কিন্তু ভয়ংকর কিছু ঘটবে।”

“আমি তাকে আসতে বলেছি।”

“মাথা খা/রা/প তোর? আমি সিউর আজ কোনো ঝামেলা হবে। তুই তাড়াতাড়ি প্রয়াস ভাইকে যেতে বল।”

“সব প্ল্যান করা আছে। নো টেনশন ডু ফুর্তি।”

আরুর চিন্তার অন্ত নেই। করতে পারছে না ফুর্তি। প্রয়াস জ্যাকেটের পকেটে এক হাত রেখে অন্য হাতে ট্রাভেলিং ব্যাগ ঠেলতে ঠেলতে উপস্থিত হলো। মুচকি হেসে আরুকে অভিনন্দন জানায়, “ভাবী, কেমন আছেন? আমি যে ফুফা হচ্ছি, জানালেন না কেন?”

“আপনি কীভাবে জানলেন?” আরুর বোকা প্রশ্ন। জবাবে এক‌ গাল হেসে প্রয়াস বলে, “তুর জানিয়েছে।”

মাথায় হাত দিল আরু। মেয়েটা ঠোঁট কাটা। প্রকাশ হওয়ার আগেই প্রয়াসকে জানিয়ে দিয়েছে। আরু এই প্রসঙ্গ পালটে অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে বলে, “আমার বাবুর না হওয়া ফুফাকে এখানে দেখলে আমার বাবুর বাবা তাকে পানিতে ফেলে দিবে। ফুফা হতে চাইলে এখান থেকে যেতে হবে।”

“দূরে দূরে থাকলে ফুফা হব কীভাবে? দেখা যাবে, বিয়েটাই হবে না।”
তিন জনের কথপোকথনের মাঝে এলো অপূর্ব। সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে বলে, “আপনি কে?”

চেনার সত্ত্বেও অজানার ভান ধরে প্রয়াস বলে, “আপনি কে?”

“আমার বোন আর আমার বউ।”

“ওহ্। আসলে ঘাট থেকে দেখলাম, দুজনে নিচের দিকে ঝুঁকে নদী দেখছে। মাথা ঘুরে যদি পড়ে যায়, তাই বারণ করলাম ভাই।”
প্রয়াসের কথায় অপূর্বর মনে পড়ল, আরু ইদানীং মাথা ঘুরে। আরুকে টেনে কিনার থেকে মধ্যে আনল। সৌজন্য হেসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, “ধন্যবাদ।”

হাত মিলিয়ে প্রয়াস বলে, “এটা আমার কর্তব্য। তা আপনারা কোথায় যাচ্ছেন ভাই?”

অপূর্ব বলে, “আমরা আনন্দনগর যাচ্ছি। ভালো ডাক্তারের খোঁজে। আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”

“আমি সাধারণত ট্যুরিস্ট। সময় পেলেই দেশ ঘুরি। কোথায় যাচ্ছি ঠিক জানি না। যেখানে যাই মিনিমাম চার দিন থাকব।” শুরু হলো হবু শ্যালক ও দুলাভাইয়ের কথপোকথন। অপূর্ব বিদেশে থাকতে সময় পেলেই বনভোজনে যেত। সেই অভিজ্ঞতা ভাগাভাগির করছে প্রয়াসের সাথে‌। আওয়াজ তুলে লঞ্চ অগ্রসর হলো যাত্রাপথে। আরু চেয়ারে বসে প্রকৃতি দেখছে। ঠান্ডা লাগলেও এই দৃশ্য এড়িয়ে যাওয়া যায় না। সুন্দরীর দুই পাশে শেফালী ও কালাচাঁন বসে আছে। সম্পর্কে বিরাজমান কিন্তু। সুন্দরী চায়, এই দম্প্রতি সুখী হোক। চেয়ার থেকে উঠে আরুকে উদ্দেশ্য করে বলে, “আমার সাথে একটু ওয়াশরুমে যাবে?”

“চলুন।” আরু ও তুর দুজনে চলল সুন্দরীর সাথে। সুজন ভালো ছবি তুলতে পারে। ক্যামেরা ব্যাগে করে নিয়ে এসেছে প্রয়াস। শেফালীদের থেকে কিঞ্চিৎ দূরে তিস্তার ছবি তুলে দিচ্ছে সুজন। শেফালী কাতর দৃষ্টিতে তিয়াস ও সুমিকে দেখছে। কালাচাঁন জানে শেফালীর ভাঙা হৃদয়ের কথা। ফাঁকা চেয়ারে শেফালীর পাশে বসে বলে, “শেফু, চলো একটু হেঁটে আসি।”

“ইচ্ছে করছে না।”

কালাচাঁন উঠে এগোল। না বলার পরেও শেফালী কালাচাঁনের পেছনে পেছনে গেল। তিস্তা ওদের লক্ষ করে বলে, “একসাথে দাঁড়া, ছবি তুলে দেই। তোদের তো কাপল পিক নেই।”

তারপরে ক্যামেরাবন্দি করল দুজনের ছবি। অপূর্ব প্রয়াসের সাথে কথা বলতে বলতে বলে, “আমার বউ কোথায়? আমিও কাপল পিক তুলব।”

“অপূর্ব ভাই, সব জায়গায় জোড়া জোড়া। কিন্তু আপনারা তিন জন। এজন্য আরু জোড়া নিয়ে আছে, আপনাকে পাত্তা দিচ্ছেনা।”

“এই শীতে বউ ছাড়া থাকা যায় না। তাই বউ রাগ করে শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার সাথে সাথে রাগ ভাঙিয়ে নিয়ে এসেছি।” অপূর্বর কথায় মাঝেই সেখানে এলো আরু। শুরু হলো তাদের ছবি তোলার মুহূর্ত। দুপুর গড়িয়ে আসতেই টিফিন ক্যারিয়ার খুলে খেতে বসল সকলে। প্রয়াস সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই অপূর্ব তাকে থামায়‌। খিচুড়ি রান্না করে দিয়েছি। অপূর্ব নিচের টিফিন ক্যারিয়ান নিয়ে আরুকে নিজের হাতে খাওয়ায়। চাদর খামচে ধরে ঠকঠক করে শীতে কাঁপছে ও খাচ্ছে আরু। অপূর্ব নিজের জ্যাকেট খুলে আরুর কোলের ওপর রেখে বলে, “একটু আগেও তুই এতটা কাঁপিসনি।”

“ওয়াশরুমে গেলাম না? ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে তুরের জন্য দাঁড়িয়েছি। পেছনে অনেক বাতাস। সেই বাতাসে কাঁপা শুরু হয়েছে, থামার নাম নেই।” খেতে খেতে কথা ও কম্পন চালিয়ে যাচ্ছে আরু। উঠল মস্তকে। ছিপি খুলে বোতল তুলে পান করল পানি। মাথায় চাপড় দিয়ে বলে, “আস্তে আস্তে খা।”

“আর খাবো না।”

“ঠিক আছে।” অতঃপর অপূর্ব নিজে খেতে থাকল। দীর্ঘক্ষণ পূর্বে রান্নার ফলে খাবার ঠান্ডা হয়ে গেছে। খেয়ে সবাই কাঁপছে। প্রয়াস খেয়ে সবাইকে প্রস্তাব দিল, “চলুন সবাই মিলে চা খাই। ঠান্ডা খিচুড়ি আর পানি খেয়ে ভেতরটা বরফ হয়ে গেছে।”

প্রয়াসের দেওয়া প্রস্তাব পছন্দ হলো সকলের। ধাপে ধাপে পা ফেলে সবাই নিচতলায় চায়ের দোকানে গেল। এগারো কাপ চায়ের অর্ডার দিল। অর্ডার দেওয়া চা মনোমতো না হলেও ঠান্ডা কমানোর ওষুধ হিসেবে কাজ করছে। তিয়াস খানিক কৌতূহল নিয়ে বলে, “অপূর্ব ভাই, আমরা কোথায় যাচ্ছি? মানে আনন্দনগরে গিয়ে আমরা কোথায় থাকব?”

আরুর চায়ে ফুঁ দিয়ে সহনশীল পর্যায়ে নিয়ে এলো অপূর্ব। চা আরুর হাতে দিয়ে নিজে এক কাপ নিয়ে প্রতুক্তি করে,
“তোমার-আমার দাদির বাবার বাড়িতে। দাদি হচ্ছে তার মা-বাবার একমাত্র সন্তান। ছেলে না থাকার কারণে তাঁদের মৃত্যুর পর বাড়িটা পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে। সেকেলের এক কর্মচারী বাড়িটার দেখাশোনা করে। বাবা প্রতি মাসে ডাকপিওনের মাধ্যমে চিঠি ও টাকা পাঠায়। আমাদের যাওয়ার কথা ফোনে জানিয়ে দিয়েছে। ইতোমধ্যে সেখানে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে ফেলেছেন তিনি।” বলতে বলতে অপূর্ব চা-টুকু খেয়ে ফেলেছে। প্রয়াস ছক কষে বলে, “যদি কিছু মনে না করেন, তবে আমি কি আপনাদের সাথে যেতে পারি? আসলে পরিত্যক্ত বাড়ি ভ্রমণ করার ইচ্ছে অদম্য।” বিরতি দিয়ে বলেন, “প্রয়োজনে আমার খাবারের খরচ আমি বহন করব।”

“আমার বাবা হচ্ছে, সুন্দরনগর গ্ৰামের চেয়ারম্যান। আপনি তার শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে টাকার বিনিময়ে খাবেন? এতে বাবা অপমানিত হবে। আপনার সমস্ত খরচ আমাদের।” আরুর হাত ধরে উঠে দাঁড়ায় অপূর্ব। চায়ের বিল পরিশোধ করার পূর্বেই প্রয়াস মিটিয়ে দিল। কেবল মুচকি হাসল সকলে। ইতঃপর আরুকে নিয়ে গেল নিচতলার ইঞ্জিনের কাছে। ইঞ্জিন ঘরের বাইরে বেশ গরম লাগছে। অপূর্ব আরুর হাত চাদরের নিচ থেকে বের করে লোহার সাথে লাগাল। কিঞ্চিৎ সময়ে উষ্ণ হয়ে এলো হাত। অপূর্ব হাসি দিয়ে আরুর অপূর্ব ভাই বলে, “ঠান্ডা কমেছে?”

“হুঁ। এখানে ঠান্ডাই লাগছে না। সবাইকে এখানে ডেকে নিয়ে আসি।”

“উঁহু। জাহাজে আমাদের একটু প্রাইভেট সময় কাটানোর দরকার। বাবু আসলে তখন তোমার সাথে গোপন সময় কাটাতে পারব কি-না, জানা নেই। আসো।” দুহাত বাড়িয়ে আরুকে কাছে ডাকল অপূর্ব। চাদর ফাঁক করে অপূর্বর ডাকে সাড়া দিয়ে জড়িয়ে ধরল আরু। ঢেকে দিল অপূর্বকেও। আরুর তুলতুলে শরীরের তাপ অপূর্বকেও উষ্ণ করে দিয়েছে। বুকে মাথা রেখে পরম শান্তি অনুভব করে আরু বলে, “আমাকে এত কেন ভালোবাসেন?”

“তোমাকে ভালোবাসি না। আরুপাখিকে ভালোবাসি, নিজের বাম পাঁজরের একটি হাড়কে ভালোবাসি। যাকে ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ।”

অদূরে এক ঝাঁক গাঙচিল উড়ে আসছে লঞ্চের পেছনে পেছনে। মাছ খোঁজা রেখে তার সাক্ষী হচ্ছে অপূর্ব আরুর প্রেমময় লগ্নের।

চলবে.. ইন শা আল্লাহ

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪৮

এক দিকে নদী অন্য দিকে সারিবদ্ধ গাছ। গাছের পর বিশাল বিশাল ধানখেত। তার অধিকাংশ ধান কে/টে ঘরে তোলা হয়েছে। অবশিষ্ট কুটো কে/টে ফেলা রাখা হয়েছে খেতে। সবকিছু অতিক্রম করে এগিয়ে চলেছে ছাদ খোলা গাড়ি। ইতোমধ্যে মাগরিবের আজানে মুখরিত চারপাশ। আরু উঁকি দিয়ে আনন্দনগর দেখার চেষ্টা করছে। অপূর্ব আরুর মাথাটা ভেতরে টেনে থমথমে গলায় বলে, “সমস্যা কী? বাইরে মাথা বের করছিস কেন? অতিরিক্ত ঠান্ডায় কুয়াশা হিমাঙ্কের নিচে নেমে তুষারের মতো পড়ছে। এমনিতেই আমরা লঞ্চে করে এসেছি। এখন তুই এমন পা/গ/লা/মি করলে ঠান্ডার লাগবে।”

“লাগবে না ঠান্ডা। দেখুন, কী সুন্দর! হালকা হালকা তুষার পড়ছে। মনে হচ্ছে আমি অ্যান্টার্টিকা মহাদেশে আছি।”

“অ্যান্টার্টিকা মহাদেশে থাকে পেঙ্গুইন, সেখানে মানুষ থাকতে পারে না। তুই কি মানুষ না? পেঙ্গুইন? তোর পেটে মানুষ পাখি না-কি পেঙ্গুইন পাখি।” অপূর্ব বিস্মিত হয়ে বলে। উপস্থিত সবাই হাসল। জানা সত্ত্বেও অজানার ভান ধনে প্রয়াস বলে, “ভাই, আপনি বুঝি বাবা হবেন?”

“হুঁ। আমিও তাই জানি। আমার মতে, এই সময়ে মেয়েদের সতর্ক থাকতে হয়। কিন্তু তোমার ভাবি আমার কথা শোনে না।”

“কচুর ডাক্তার আপনি। ডাক্তার হয়েও আপনি আমার অসুখ বুঝতে পারেননি। আমি যতটা মেধাবী ছাত্রী ,আপনি ততটা মেধাবী ছিলেন না। নির্ঘাত টুকে পাস করেছেন।” ভেংচি কা/ট/ল আরু। অপূর্ব তো মনের ডাক্তার। তার বোঝা উচিত ছিল আরুর মন খা/রা/পের কারণ। এক নিমেষে অন্যের রোগ সারিয়ে দিতে পারলেও বউয়ের কাছে টুকে পাস করা ডাক্তার। ততক্ষণে গাড়ি এসে থেমেছে তার গন্তব্যে। এগারো জন গাড়ি থেকে নেমে ভাড়া পরিশোধ করে দাঁড়ায় প্রবেশদ্বারের কাছে। ফোন বের করে কর্মচারীর নাম্বারে ডায়াল করল। ঘন কুয়াশায় নেটওয়ার্কের সমস্যার কারণে কল ঢুকল না। তবে কিছুক্ষণের ভেতরে হারিকেন হাতে নিয়ে এগিয়ে এলো একজন চাদর ঢাকা লোক। পাকা দাড়ি, শ্যাম বর্ণ গায়ের রং, গায়ের চামড়া কুঁচকে গেছে। অন্যহাতে লাঠি। ঠুকঠুক করে লাঠিতে ভর দিয়ে বলে, “তোমরা কি আহসান বাড়ির লোক, মির্জা বাড়িতে এসেছ?”

“জি। আপনি ইলিয়াস আলী?”

“জি। ভেতরে আসুন। পরিত্যক্ত মির্জা বাড়িতে আপনাদের স্বাগতম। অনেকদিন পর এই বাড়ি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠল। ভেতরে আসুন সকলে।” হারিকেনের আলো ধরে সবাইকে ভেতরে নিলেন ইলিয়াস আলী। গা ছমছমে পরিবেশ। ক্ষমতার কারণে মোতাহার আহসান বাড়িতে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে পারলেও এখানে বিদ্যুৎ নেই। প্রতিটা মেয়ে তার প্রিয়তমর হাত জড়িয়ে ধরে আছে। অপূর্ব খানিক কৌতূহল নিয়ে বলে, “এখানে আলোর ব্যবস্থা নেই? বড় বাড়িতে আমরা এই কয়জন। ভয় করবে রাতে।”

“আলো নেই। হারিকেনের ব্যবস্থা করেছি সবার জন্য। নিচতলা তালাবদ্ধ, আপনাদের থাকার ব্যবস্থা দোতলায় করেছি। আপনারা সবাই ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে বিশ্রাম নিন। কাল সকালে আপনাদের গ্ৰাম ঘুরিয়ে দেখাব।”

“আচ্ছা।”

ইলিয়াস আলী বালতি ভরতি করে রেখেছিলেন পানি। সেই পানি দিয়ে সবাই হাতমুখ ধুয়ে পরিপাটি হয়ে নিল। খাবার টেবিলে বসতেই দেখতে পেল গোরুর গোশত ও রুটি। তরকারির রং যেমন, স্বাদও তেমন। তিয়াস খেয়ে বলে, “চাচা, কে রান্না করেছে এই খাবার?”

“আপনাদের ভালো লাগেনি?”

“অসাধারণ হয়েছে। আপনাকে দেখে মনে হয়না, আপনি রেঁধেছেন।”

“আমার স্ত্রী। আপনাদের আসার খবর শুনেই হাট থেকে গোরুর গোশত ও আটা কিনে এনেছি। স্ত্রী রান্না করে দিয়েছে।”

“আপনিও বসুন। আমরা সবাই একসাথে খাই।” সুজনের কথায় তাল মেলাল সবাই। কিন্তু ফলাফল শূন্য। প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দেয় ইলিয়াস, “আপনাদের চাচি আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমাকে না খাইয়ে সে খায় না। তাই বাড়িতে ফিরে একসাথে খাবো।”

বিয়ের এত বছরেও জীবন্ত ভালোবাসা। সবাই হাসে। তাকায় তার সহধর্মিণীর দিকে। অপূর্ব বলে, “তবে আপনি চলে যান‌। আমরা খেয়ে শুতে যাব।”

“এঁটো থালা-বাসন আমাকে ধুয়ে রেখে যেতে হবে। নাহলে দুর্গন্ধ আসবে।”

“আপনি যান, আমরা এইটুকু করে রাখতে পারব।” অপূর্ব লোকটাকে যাওয়ার অনুরোধ করলেও তিনি নাকচ করে। কিন্তু অপূর্ব যে একরোখা। তাই বেশিক্ষণ জেদ ধরে রাখতে পারে না ইলিয়াস।‌ সবকিছুর দায়িত্ব সবাইকে বুঝিয়ে দিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। খাওয়াদাওয়া শেষ করে তিস্তা ও সুমি মিলে থালা-বাসন ধুয়ে পরিষ্কার করে ফেলে।
__
ঘড়ির কাঁটা তখন দুইটার ঘরে। দোতলায় ছয়টা ঘরে এগারো জন মানুষ শুয়েছে। সবাই গভীর তন্দ্রায় ব্যস্ত। সবার কিনারের গোপন ঘরটিতে শুয়েছে অপূর্ব, আরু। তার সাথের ঘরটিতে সুজন, তিস্তা। তার পাশের ঘরে তিয়াস ও সুমি। বিপরীত দিকের ঘরে প্রয়াস। দ্বিতীয় ঘরে তুর ও সুন্দরী, শেষের ঘরে কালাচাঁন ও শেফালী। একদম পাশে হওয়ার কারণে ঠান্ডা একটু বেশিই। ভারী ভারী কাঁথায় শীত ঠেকাতে পারছেনা। দুজনের মাঝে তখন পাহাড় সমান দূরত্ব। যার নিচে হাওয়া প্রবেশের ব্যবস্থা করা। কালাচাঁন কাত হয়ে শেফালীর দিকে ফিরে বলে, “এদিকে আসো‌। ফাঁক দিয়ে হাওয়া ঢুকছে। এমন হাওয়া ঢুকতে থাকলে কাঁথা গরম হবেনা, ঘুমও হবে না।”

“নাহলে নেই।”

“লাস্ট ওয়ার্নিং দিচ্ছি, এদিকে এসো। নাহলে আমি কাঁথা টেনে নিয়ে যাবো।” কথাটা বলে শেফালীকে কিছু সময় দিল কালাচাঁন। সময়কে সঠিক ব্যবহার করতে পারল না শেফালী। বিনিময়ে এক টানে সবটুকু কাঁথা টেনে নিল কালাচাঁন। খামচে ধরলেও শেষ রক্ষা হলো না। চাপা রোষে শেফালী ওড়না দিয়ে দেহ ঢেকে নিল। ঠকঠক করতে কাঁপতে থাকে অনবরত। সময় যত এগিয়ে যাচ্ছে শীতের তাণ্ডব তত বেড়ে চলেছে। নিরুপায় হয়ে শেফালী উভয়ের দূরত্ব ঘোচাল। কাঁথা ও কথা, উভয় টানতে টানতে বলে, “ছাড়ুন। শীত করছে।”

কালাচাঁন ছাড়ল। শেফালী কেবল কাঁথার ভেতরে ঢুকল না, ঢুকল কালাচাঁনের বাম পাঁজরে। যেন ভেঙে অন্য পাশ দিয়ে চলেও যাবে। কালাচাঁন তার উষ্ণ শরীর দিকে শেফালীর ঠান্ডা শরীর স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। এক পর্যায়ে হেসে বলে, “তুমি এক লাইন কম বুঝলে হয় না? এই শীতে কাঁথা ছাড়া টিকে থাকা অসম্ভব। সেখানে তুমি অযথা আমাকে রাগ দেখিয়েছ।”

ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল কালাচাঁন, শেফালী। শোনা গেল নূপুরের শব্দ। ধীরে ধীরে প্রকট হচ্ছে শব্দ। আরুর কানে যেতেই নিভুনিভু দৃষ্টিতে তাকাল। ফাঁকা ঢোক গলা বেয়ে নেমে গেল ভয়ে। অপূর্বকে জড়িয়ে রাখা হাতটা বুকের কাছে এনে ধাক্কা দিয়ে বলে, “শুনছেন, কে জানো নূপুর পরে নাচছে। আমার ভয় করছে।”

“কোথায়? আমি তো শুনতে পাচ্ছি না। বোধ হয় তুমি তোমার পায়ের নূপুরের শব্দ শুনতে পারছ, আরুপাখি। আমার বুকে শুয়ে থাকো। কেউ তোমার ক্ষতি করতে পারবে না।”

“ভূত, পেতনি। অপূর্ব ভাই, আপনি শুনতে পারছেন না নূপুরের শব্দ?” আরু ভয়ে অপূর্বকে শক্ত করে ধরে কাঁপছে। অপূর্ব চোখ পরিষ্কার করে তাকাল। চোখে হলদে আলো পড়ার আগে কানে এলো নূপুরের শব্দ। অপূর্ব লক্ষ করল আরু নিশ্চল, অথচ বেজে চলেছে নূপুরের ধ্বনি। এবার অপূর্বর মনে ভয় হানা দিল। দুজনে কাঁথা মুড়ি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে থাকল। কানে এলো দরজা ধাক্কা দেওয়ার মতো শব্দ। দরজায় করাঘাত করতে করতে কেউ যেন তিস্তার‌ গলায় বলে, “অপূর্ব ভাই, দরজা খুলুন।”

অপূর্ব সাড়া দিল না। মাঝে মাঝে অন্যের কণ্ঠে কথা বলে তারা। শুনতে পেল তুরের গলা, “ভাইয়া দরজা খুলুন!”

“দরজা খুলুন।” তিয়াসের গলা।

“ম/রে গেলাম গো। দরজা খুলুন।” শেফালী বলে। চারটার বেশি গলা শুনলে অপূর্ব আরুকে নিয়ে উঠে বসে। এক হাতে আরুকে ধরে অন্য হাতে হারিকেন নিল। দরজার ছিটকিনি খুলতেই যুবক-যুবতিরা ঘরের ভেতরে ঢুকে হাঙ্গামা শুরু করে দিল, “চলুন আমরা এখন বাড়িতে ফিরে যাই।”

প্রয়াস বলে, “ভাই আমি পরিত্যক্ত বাড়ি ভ্রমণ করতে চেয়েছিলেন, ভূতের বাড়ি না।”

চলবে.. ইন শা আল্লাহ

নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-৪৬

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪৬

“আরু, এই আরু! ঠিক আছিস মা?” বলতে বলতে বেশ কয়েকবার আরুকে ঠ্যালা দিল পারুল। অয়ন ছুটে ঘর থেকে হোগলা নিয়ে উঠানে বিছাল। পারুল আরুর ডাকার এক সুযোগে বলেন, “নয়না ভাবিকে তাড়াতাড়ি ডেকে আন অয়ন।”

“আচ্ছা।” পরমুহূর্তেই অয়ন ছুটে বড়ো চাচার ঘরে চলে গেল। নয়নাদের ধান ইতোমধ্যে ঘরে তোলা হয়েছে। শাশুড়িকে নিয়ে ধান সিদ্ধ করছিল নয়না। অয়ন সেখানে উপস্থিত হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে জানায়, “চাচি একটু আমাদের ঘরে যাবেন? বুবু উঠানের পাশে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে।”

“কী বলছিস, আরু কখন এসেছে?”

“জানি না, হঠাৎ দেখলাম উঠানের এক কোনে ঝোপঝাড়ের মাঝে পড়ে আছে।” অয়নের কথায় চিন্তিত দেখাল নয়নাকে। আড়চোখে শাশুড়ির দিকে তাকাতেই দেখল, তিনি নির্বিকার। নাতনি অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে, শোনার পর দাদির ছুটে যাওয়ার উচিত ছিল। তবে এটা নতুন নয়। আরুর বিয়ের পর যখন গ্ৰামে ফিরল তখন থেকে মেজো ছেলের সংসারে ঢোকে না, ইমদাদ হোসেন আসলেও না। নয়না ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন। দেবরের ঘরের দিকে অগ্রসর হতে হতে শাশুড়িকে অনুরোধ করলেন, “আম্মা আমি ফেরার আগ পর্যন্ত আপনি এখানে থাকেন।”

নয়না চলার পরে তিনি এক এক করে শুকনো পাতা দিতে লাগলেন। চোখমুখে হিংস্র একটা ভাব।
নয়না ও পারুল আরুকে ধরে হোগলায় রাখলেন। পানির ঝাপটা দিতেই আরু নিভুনিভু দৃষ্টিতে তাকাল। পারুল মাথায় নারিকেল তেল দিতে দিতে বলেন, “কেমন লাগছে মা?”

“ভালো।”

“কখন এসেছিস? কিছু দেখে ভয় পেয়ে জ্ঞান হারিয়েছিস?” নয়নার প্রশ্নে আরু অতীত মনে করতে ব্যস্ত হয়। অতঃপর সৌজন্য হাসি দিয়ে সত্য আড়াল করে বলে, “ভালো লাগছিল না, তাই এদিকে এসেছি। কীভাবে জ্ঞান হারালাম জানি না। মাথা ঘুরছে। ইদানীং মাথা ঘুরে প্রচুর।”

“অপূর্বকে বলেছিস?”

“তুমি এত অপূর্ব অপূর্ব কেন করো মা? তোমার অপূর্ব কি সুপারম্যান যে, আমার সব সমস্যা সমাধানে করে দিবে?” বিরক্তিকর গলায় বলে আরু। পারুল যে মা, ধরে ফেললেন আরুর মিথ্যা। মেয়েকে চটালেন না। মাছ বিক্রেতা এখনো দাঁড়িয়ে আছেন। পারুল অয়নের থেকে ব্যাগ নিয়ে পোনার মূল্য পরিশোধ করল। তিনি চলে যেতেই আরু বাক্য তোলে, “কীসের টাকা দিলে তাকে?”

“দিঘিতে পাঁচশো পোনা ফেলেছি। রুই, কাতলা, মৃগেল, গ্রাস কার্প, সিলভার কার্প, বিগহেড কার্প। তার টাকা দিয়েছি।”

“ফেলেছ না-কি এখনো আছে।”

“তিনি আমাকে গুনে পাঁচশো দিয়েছে। আমি তিনশো বিশটা গুনে ফেলেছি। এখন বাকিগুলো বালতিতে।” আরুর মাথা টিপে দিয়ে বলে পারুল। আরু চট করে উঠে দিঘির দিকে অগ্রসর হলো। তার পেছনে পেছনে গেল সবাই। হাত ডুবিয়ে দিল বালতিতে। মাছেরা হাত ঘেঁষে সাঁতার কাটতেই সুরসুরি লাগল। খিলখিল করে হেসে উঠল আরু। বালতি থেকে কয়েকটা মাছ আলাদা করে মগে রেখে মাছগুলো ফেলে দিল দিঘিতে। পারুল সংশয় প্রকাশ করে, “মাছগুলো ছেড়ে দে, নতুবা মরে যাবে।”

“এখানে পাঁচটা আছে। ভেজে দাও, আমি ভাত দিয়ে খাবো।”

আরুর কথায় ভ্যাবাচাকা খেল সকলে। পারুলের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করে নয়না বলে, “অ্যাহ! এই পোনা খাবি?”
আরু জবাব দেয় না। মাছগুলো ধরছে এক ধ্যানে। ফের পারুল বলে, “এগুলো বড় হলে খাবি, ছেড়ে দে এখন। আমি তোর জন্য বড়ো মাছের ব্যবস্থা করছি।”

“লাগবে না।” তেজ দেখিয়ে মগটা দিঘিতে ফেলে দিয়ে ঘরে ফিরে গেল আরু। মাছগুলো মারা যাওয়াতে দিঘিতে ভেসে আছে। ভেসে মাঝে যাওয়ার আগে নয়না মাছগুলো তুলে পারুলের হাতে দিয়ে বলে, “মাছগুলো ভেজে দে, খেতে পারলে খাক। ধান সিদ্ধ প্রায় শেষ। আম্মাকে বসিয়ে রেখে এসেছি। বেশিক্ষণ থাকলে বললে, আমরা তার নামে নি/ন্দা করি। পানি ঝাড়িয়ে রোদে দিয়ে কিছুক্ষণ পর আসছি। তোর সাথে আরুর ব্যাপারে আমার কথা আছে।”

পান্তা ভাতের সাথে মাছ ভাজা। শীতের দিনে কনকনে ঠান্ডায় আরু পান্তা খাচ্ছে। মাঝেমধ্যে কামড় বসাচ্ছে কাঁচা মরিচে। একটা মাছ খেয়ে চারটা মাছ তুলে রাখল থালায়। পারুল গ্লাসে পানি ঢেলে বলে, “তুলে রেখেছিস কেন?”

“স্বাদ লাগে না।”

“এগুলো‌ কি পুঁটি মাছ যে, স্বাদ লাগবে। মাছগুলো ছেড়ে দিতিস, বড়ো হলে খেতে পারতিস। অয়ন তুই খাবি?”

“না মা।” পরপর আরুকে উদ্দেশ্য করে বলে, “আমি তোর ঘর গুছিয়ে দিচ্ছি।” অয়ন ছুটে গেল আরুর ঘর গোছাতে। সেখানে এসে উপস্থিত হলো কালো কুচকুচে একটা বিড়াল। মিউ মিউ করছে মাছের গন্ধে। আরু পাত থেকে তুলে রাখা তিনটা মাছ মাটিতে রাখতেই তৃপ্তিতে ভক্ষণ করল। অতঃপর ছুটে গেল। পারুল অবাক না হয়ে পারল না, আরুর বিদায়ের পর এই কালো বিড়াল কখনো এই বাড়িতে আসেনি। আজ আরুর আগমনের সাথেই চলে এলো। ইতোমধ্যে খাবার খেয়ে থালাতেই হাত ধোয় আরু। বিড়ালের কথা ভাবতে ভাবতে পারুল থালা নিয়ে ধুতে গেল। তদানীং হন্তদন্ত হয়ে মৃধা বাড়িতে এলো অপূর্ব। তিনটা ঘর খুঁজে খাবার ঘরে পৌঁছালে আরুর সন্ধান পেল। বুকের ভেতরে উদাসীন হওয়া প্রাণপাখি এবার ক্ষান্ত হলো। আরুর গাঁ ঘেঁষে আসন পেতে বলে, “মা, ক্ষুধা পেয়েছে খেতে দিন।”

অপূর্বর কণ্ঠ কানে যেতেই পারুল ও অয়ন এলো ছুটে। অপূর্বর দিকে চেয়ে পরমুহূর্তে দৃষ্টি সরাল আরু। প্রফুল্ল হয়ে পারুল বলে, “তুই এসেছিস অপু, কেমন আছিস?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি‌। আপনি ভালো আছেন?”

“তা আছি। আরুকে এই সময়ে একা ছেড়েছিস কেন? মেয়েটা ঠিকমতো বাড়িতে আসতেও পারেনি, রাস্তায় পড়ে ছিল।” চোখ পাকিয়ে অপূর্বকে বলে পারুল। আঁতকে আরুর ফ্যাকাসে মুখের দিকে তাকাল অপূর্ব। ডাক্তার হিসেবে এই অবস্থায় নারীর যত্নের কথা তার অজানা নয়। নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হলো। বিনয়ী হয়ে বলে, “আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি এখনো এই বাড়ির জামাই হয়ে উঠতে পারিনি। কাল শেফালীর..

“আপনি এখানে কেন এসেছেন?” অপূর্বর বাক্য ইতি টেনে আরু বলে। শেফালীর বিয়ের কথা মায়ের থেকে লুকাতে চাইছে আরু। আরুর ভাবনাকে সমর্থন করে শেফালীর বিয়ের কথা চাপা রাখল। বিষণ্ণ গলায় বলে, “আমি তোকে একবারও এখানে আসতে বলিনি। আমি তোকে আমার সামনে থেকে সরতে বলেছি।”

এতক্ষণে পারুল বুঝতে পারল দম্পতির মাঝে মান-অভিমানের খেলা চলছে। দুজনকে ফাঁকা স্থান দিতে এক গাল হেসে বলেন, “তোরা কথা বল, আমি দুপুরের রান্নার ব্যবস্থা করি।”
অয়নকে নিয়ে উঠানের শেষ প্রান্তে চলে গেল। শীতকালীন সবজি লাগিয়েছেন পারুল। পালংশাক, মুলাশাক, ফুলকপি, বাঁধাকপি, শালগম ইত্যাদি।
আরু উঠে দাঁড়িয়ে হোগলা ধরে টান দিতেই অপূর্ব চিত হয়ে পড়ার উপক্রম হলো। রক্ষা পেয়ে হোগলা থেকে নামতেই আরু প্যারেকের সাথে ঝুলিয়ে রাখল। অতঃপর ঘরের দিকে অগ্রসর হতেই অপূর্ব তাকে অনুসরণ করল। হাঁটতে হাঁটতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আরু বলে, “সমস্যা কী? আমার পেছনে আসছেন কেন?”

“তোর থেকে কিছু প্রশ্নের উত্তর নিতে এসেছি। বিয়ের পরের দিন তোকে আমি একটা প্যাকেট দিয়েছিলাম। সেটা কোথায় রেখেছিস?”
অপূর্বর এই একটি প্রশ্নে আরুর তেজ কর্পূরের মতো উড়ে গেল‌। আমতা-আমতা করে মিথ্যা বলার চেষ্টা করতেই ধমকাল অপূর্বর, “মিথ্যা বললে দাঁত খুলে হাতে ধরিয়ে দেবো। তোকে একটা কথাও বলে বোঝাতে পারিনা। কেন আমার কথা শুনতে চাস না?”

“আপনার ওপরে তখন রাগ করে ছিলাম। তাই রাগে প্যাকেটটা কোথায় রেখেছি ভুলে গেছি। বাড়ি ফিরে খুঁজেও পাইনি। ভয়ে আপনাকে বলতে পারিনি।”

অতি আদুরে গলায় কাছে ডাকল অপূর্ব, “এদিকে আয়।” গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এলো আরু। পালস, চোখ ও জিভ পরীক্ষা করে বলল, “এই অপরাধের একটা শাস্তি তোকে দিলাম। আমার ভালোবাসা এতদিন তোর নামে থাকলেও আজ আমি আমার ভালোবাসার একাংশ অন্যকে দিয়ে দিলাম। এতদিন তুই আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমালেও কয়েকমাস পর অন্য একজনকে আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমানোর অধিকার দিলাম।”

অপূর্বর কথায় অশ্রু এসে ভিড় করল আরুর চোখে। অপূর্বর রাগ ভাঙাতে নরম হলো। নিজের মাথাটা অপূর্ব বুকে ঠেসে প্রেমময় কণ্ঠে বলে, “কেন? আমাকে এতবড় শাস্তি দেবেন না। আপনার বিরহে আমি বিলীন হয়ে যাব। আপনাকে অন্য নারীর সাথে ভাগ করে নেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব।”

চলবে.. ইন শা আল্লাহ

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪৬ [বর্ধিতাংশ]

“ধুর পা/গ/লি, অন্য নারীকে কেন আমার বুকে জায়গা দেব? আমার বুকে জায়গা হবে শিশুর। যে তোর আমার অংশ দিয়ে তৈরি।” আরুর মাথায় হাত বুলিয়ে আশ্বাস দিল অপূর্ব। মুখ তুলে চাইল অপূর্বর পানে। বিস্মিত আরুর নেত্রপল্লব। অপূর্ব উচ্চতা শুন্যতায় নামাতে হাঁটু গেড়ে মাটির ওপর বসল। কাপড় সরিয়ে মাথা রাখল আরুর ফরসা উদরে। দফায় দফায় কেঁপে উঠল। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে পিছিয়ে গেল। তবে রক্ষা হলো না। শক্তপোক্ত কাঠের খুঁটির সাথে বেধে গেল। বামহাতটা অপূর্বর চুলের মাঝে রেখে থেমে থেমে বলে, “কী করছেন? ছাড়ুন। কেউ চলে আসবে।”

অপূর্ব থামল না, না ছাড়ল। বিনিময়ে বন্ধন দৃঢ় করে ধরে ওষ্ঠদ্বয় ছোঁয়াল আরুর উদরে। চকিতে হাতটা নিচে নামিয়ে তুলে নিল উঁচুতে। মাটি থেকে আরুর পায়ের দূরত্ব তখন অনেকটা। ভারসাম্য বজায় রাখতে আঁকড়ে ধরল অপূর্বর কাঁধ। অপূর্ব ললাটে ললাট ঠেকাতে ভরাট গলায় আরু বলে, “কী করছেন? আজ এমন কেন করছেন? একটু আগে বললেন আরেকজনকে বুকে নিয়ে ঘুমাবেন, এখন আদর করছেন!”

অপূর্ব জবাব না দিয়ে হাসে। তার চঞ্চল বউ আজ বোকা হলো কীভাবে? ঘুরতে ঘুরতে বলে, “আমি বাবা হচ্ছি, বউ আমাকে উপহার দিচ্ছে। সেই হিসেবে এইটুকু আদর তার প্রাপ্য।”

বাক হারিয়ে ফেলল। বাঘ থেকে বিড়াল ছানার মতো চুপসে গেল। বিড়াল ছাড়া মিউ বলতে পারলেও আরু বলতে পারছে না। শত প্রচেষ্টার পর বলে, “তবে তো আমি মা হব। কিন্তু আপনাকে কে বলেছে? যাকে বুকে নিয়ে ঘুমাতে চেয়েছেন, সে কি অন্তঃসত্ত্বা?”

“আমার বউ কি পাঁচটা? একটা‌। অবশ্যই সেই বউ অন্তঃসত্ত্বা। এতদিন তোর উগ্র আচরণে হতবাক হয়েছি, ডাক্তার হয়েও অনুভব করতে পারিনি আমি বাবা হব। একটু আগে বাবার কথায় রেগে আমি তোর সাথে ওমন ব্যবহার করেছি। ঘুণাক্ষরেও যদি অনুভব করতাম তুই নতুন অতিথি আনার বাহক। তবে এমন কাজ করতাম না।”

অপূর্ব এখনো উৎফুল্লিত হয়ে আরুকে ঘুরাচ্ছে। আরুর মাথা ঘুরছে। ঝাপসা দৃষ্টিতে অপূর্বকে দৃশ্যমান হচ্ছে না। ঘনঘন পলক ফেলে বলে, “মাথা ঘুরছে, নামান আমাকে। বমি পাচ্ছে।”

অপূর্ব হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে নামাল আরুকে। পৃথিবীর গতির সাথে টক্কর দিতে না পেরে আরু হেলেদুলে বাইরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। পেছন দরজার কাছে যেতেই মুখ ভরে এলো বমিতে। মাথাটা একটু বাঁকিয়ে গড়গড় করে শূন্য করল পেট। অতঃপর দরজার সাথে ঠেসে বসে পড়ল মাটিতে। অপূর্ব ধ্যান থেকে বের হয়ে আরুকে ধরল। বাইরে থেকে মেয়ের এরূপ অবস্থা থেকে পারুল সবজি ফেলে ছুটে এলেন ঘরে। সরিষার তেল মাথার তালুতে দিয়ে ম্যাসাজ করতে করতে বলেন, “এই মাত্র তোকে সুস্থ দেখে গেলাম। এরমধ্যে আবার…। একটু আমের আচার দেই? খেলে ভালো লাগবে।”

“না। চালতার আচার দাও।” অপূর্বর গায়ে মাথা ঠেকিয়ে আরু বলে। অনিতা পানি দিয়ে আরুকে কুলি করিয়ে মুখ ধোয়ালেন। চালতার আচার বাটিতে দিয়ে অপূর্বকে বলেন, “তুই তো ডাক্তার, আরু হঠাৎ এমন করা তোর ডিকশনারিতে কী বলে।”

“আপনার ঘরে নতুন অতিথি আসার লক্ষণ। অয়ন মামা হতে চলেছে। বুবু আর তোমাকে ভালোবাসবে না।”

পারুল হাসলেন। সবজি তোলার সময় নয়না এসে এই আভাস দিয়েছিলেন।অয়নের মন ভার হলো। বিষাদের সুর তুলে বলে, “তাতে কী? আমি তো মামা হব। সবাইকে বলে আসি।”

বলেই অয়ন ছুটল সবাইকে জানাতে। অপূর্ব আরুকে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে শোয়াল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, “আরু বাবুর আগমনের কথা শুনে বাবুর বাবাও বাবু হয়ে গিয়েছিল। তাই তোকে ঘুরিয়েছে। আমার জন্য তোর ক্লান্ত লাগছে।”

আরু চালতার আচার খেতে খেতে বলে, “এটা তো রোজকার অভ্যাস। আপনার কোনো দোষ নেই। আচার খাবেন?”

“না! তুই খা! খেয়ে ঘুমা।”
অপূর্বর আদেশ মেনে আরু চালতা খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করল। ক্লান্ত শরীর ব্যস্ত হলো তন্দ্রায়। তন্দ্রা ব্যাঘাত ঘটল হট্টগোলে। আহসান বাড়ির চাঁদের হাট তখন বসেছে মৃধা বাড়িতে। বিভিন্ন ধরনের কণ্ঠ আরুর কর্ণপথে যেতেই ছুটি নিল তন্দ্রা। ঘুমের কারণে দেহটা বেশ লাগছে আরুর। মাথায় ঘোমটা টেনে উপস্থিত হলো বৈঠকখানায়। ততক্ষণে আরুর গোপন তথ্য ফাঁস করেছে অপূর্ব। আরুকে দেখে চার জা গোল করে ধরল। অনিতা জড়িয়ে নিয়ে বলে, “তোর অসুস্থতার কথা আমাদের কেন বললি না মেয়ে? আমরা বুঝতে না পেরে তোর সাথে কেমন ব্যবহার করলাম।”

“আমি কিছু মনে করিনি।”

উত্তরে জাহানারা বলেন, “রাগ করে বাপের বাড়িতে চলে এসেছে। আবার বলে কিছু মনে করেনি।”

মোতাহার আহসান এগিয়ে এসে আরুর মাথায় হাত রেখে বলেন, “তোর মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়েছি কিন্তু। এবার বাড়িতে ফিরে তৈরি হয়ে নে।”

“কোথায় যাবো?”

“অপূর্ব আমাকে বলেছে তোর কথা‌। আমি দাদু হতে চলেছি। এই বয়সে সবাই নাতি নাতনি কাঁধে নিয়ে ঘুরে। অবশেষে আমার সময় আসছে। কী যে ভালো লাগছে।” মোতাহার আহসানের কথায় আরু লজ্জানত হলো। চোখমুখে ফুটে উঠল লাজুক ভাব। তবুও তিনি বলেন, “তোর শরীরের কথা চিন্তা করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সব ভাই-বোন মিলে বেয়ানকে নিয়ে ঘুরতে যাবি। বেয়ানের চিকিৎসার জন্য এই গ্ৰামে ভালো কোনো চিকিৎসক নেই। তাই ডাক্তার দেখানোর পাশাপাশি তোর মাইন্ড ফ্রেশ হবে। ইতোমধ্যে ব্যাগপত্র গোছাতে সুজন ও তিস্তা চলে গেছে।”

“অয়নকে নিয়ে যাই?” আরুর প্রশ্নের জবাবে পারুল বলেন, “দরকার নেই। আমাদের নায়র নিতে এসেছেন। তোরা ফেরার আগ পর্যন্ত আমরা সেখানে থাকব।”

আরু ও অপূর্ব অগ্রসর হলো আহসান বাড়ির দিকে। পেছনে আসছে তাঁরা।
__
ট্রাভেলিং ব্যাগগুলো সারিবদ্ধভাবে রাখা‌। সোয়েটার জড়িয়ে আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে আরু। ব্যাগপত্র অপূর্ব গুছিয়েছে। সবাই অপেক্ষারত দুপুরের খাবারের। লঞ্চে নিয়ে যাত্রা শুরু করবে। গাড়ি এসে থেমেছে আহসান বাড়ির দোরগোড়ায়। চালক বাইরে থেকে হাঁক দিতেই তিয়াস বিরক্ত হয়ে বলে, “কতক্ষণ লাগবে মা?”

“হয়ে গেছে।” টিফিন ক্যারিয়ার এনে বিছানার ওপর রাখল জাহানারা। সুমি ক্যারিয়ানটা চালকের হাতে দিয়ে বলে, “এগুলো নেওয়ার কোনো দরকার আছে মা? ঘুরতে যাচ্ছি। নদী দেখতে দেখতে ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে গরম গরম ভাত খেতাম। ওখানেই পাওয়া যায়।”

“খবরদার কেউ বাইরের খাবার খাবি না। তোরা খেলে আরুও খেতে চাইবে। আরুর জন্য এখন বাইরের খাবার ঠিক না।” কড়া গলায় বলেন মণি। বিনিময়ে রঙ্গ করে সুমি বলে, “জা, কে তোমাকে এখন এই পকেট নিতে বলেছে। এই পকেটের জন্য বাইরের খাবার খেতে পারব না।”

পেটের ওপর হাত রেখে ভাব নিয়ে আরু বলে, “এই পকেটের জন্য যেতে পারছ ভাবী, এটা কম কিসে? চলো, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
আরু সবাইকে তাড়া দিয়ে অনিতার কাছে গেল। পা ছোঁয়ার চেষ্টা করতেই অনিতা বাধা দিল, “এই সময়ে ঝুঁকতে নেই। সাবধানে যাক। নিজের যত্ন নিস।”

“আচ্ছা।”

সবার থেকে বিদায় নিয়ে আরু উঠল গাড়িতে। একে একে উঠল বাকিরা। তিস্তা সুজন পূর্বেই বসা ছিল। আরুকে দেখে বেশ রঙ্গ করে সুজন বলে, “ভাবী, সুখবরের সাথে মিষ্টি পেলাম না। মিষ্টি পাবো কবে?”

“বিয়েটা আগে আপনারা করেছেন, অথচ সবাইকে সুখবর আগে আমি শুনিয়েছি। মিষ্টি তাহলে কার বিলানো উচিত? সুজন মাঝি, তৈরি হন।” বলতে বলতে অপূর্বর কাঁধে মাথা রাখল আরু। গতিশীল গাড়ি থামল ব্রিজের কাছে। সেখান থেকে গাড়িতে উঠল তিনজন। আরেকদফা অপূর্ব আরুর কাছে মিষ্টি চাইল। এক ফাঁকে তুরকে ঠ্যালে আরু বলে, “মিতুর সাথে ওখানে দাঁড়িয়ে কী করছিলি?”

“প্রয়াসকে চিঠি পাঠিয়েছি। সে ইতোমধ্যে ঘাটে পৌঁছে গেছে। আমরা কোন লঞ্চে যাবো তা-তো জানে না, সেটা লিখে পাঠিয়েছে।”

আরু মাথায় হাত দিল। এমনিতেই মাথা ঘুরছে তার।

চলবে.. ইন শা আল্লাহ