Friday, July 18, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 225



নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-৪৪+৪৫

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪৪

“শেফালী, কেঁদো না। মানুষের জীবন নদীর মতো। তারা নিজের মতো বইতে পারেনা। উপত্যকা হিসেবেই তাদের চলতে হয়।” কথাটা বলে আংটি দুটো কুড়িয়ে বিছানায় বসে কালাচাঁন। শেফালী হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “কাঁদব না? আমি তিয়াস ভাইকে কতটা ভালোবাসি জানেন আপনি?”

শেফালী তেড়ে গিয়ে কালাচাঁনের কলার টেনে ধরল। আলতো মাথা নিচু করে নেয় কালাচাঁন। মনে মনে হাসে, ভালোবাসার পরীক্ষা দিতে গিয়ে জোতার মালা গলায় পরেছে। গ্ৰামবাসীরা একশো একটা আঘাত করেছে। সৌজন্য হেসে বলে, “তিয়াস ভাই আমাকে সব জানিয়েছে। তোমাকে ভালো রাখার দায়িত্ব আমার হাতে ন্যস্ত করেছে। গোলাপিকে হারিয়ে বিয়ের কথা আমি ভুলে গিয়েছিলাম। সেদিন তুমি যখন আমার হয়ে সবাইকে বলেছিলে, আমাকে গ্ৰাম থেকে বের না করতে। সেদিন মায়ের মনে তুমি জায়গা করে নিয়েছিলে। আমার এই রঙহীন জীবন আলোকিত করতে, মাকে তোমাকে পছন্দ করেছে।
শেফালী অতীত ভোলা যায় না, তাই বলে অতীত আঁকড়ে ধরে থাকা উচিত নয়। তোমাকে আমি গোপালির মতো ভালোবাসতে পারব না। তবে তোমাকে ভালো রাখতে পারব।”

আঁকড়ে ধরা হাতটাতে আংটি পরিয়ে ছাড়িয়ে নিল কালাচাঁন। বিছানার একপাশে সেঁটে শুয়ে পড়ল। শেফালী অপলক দৃষ্টিতে কালাচাঁনের দিকে তাকিয়ে আছে। কালাচাঁনের ভালোবাসা ছিল খাঁটি। হঠাৎ কানে এলো পোকাদের শব্দ। অচেনা জায়গায় এমনিতেই ভীতু শেফালী। ভয়েটা তড়তড় করে বেড়ে যাচ্ছে। ভয় কাটাতে দূরত্ব রেখে শুয়ে পড়ল শেফালী। শুনতে পেল ফোঁপানোর শব্দ। পুরুষেরা সহজে ভেঙে পড়েনা, তার উদাহরণ কালাচাঁন।
__
সাত জন যুবক যুবতি হেঁটে যাচ্ছে মাটির রাস্তা দিয়ে। প্রথমত আরু গোসল করেছে সন্ধ্যায়, দ্বিতীয়ত চাদর নিয়ে আসেনি। তাই ঠকঠক করে কাঁপছে আর হাঁটছে। হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে সুমি ও তিয়াস সম্মুখে এগিয়ে গেছে। তার আগে এগিয়ে গেছে তিস্তা ও সুজন। অপূর্ব দু-হাতে বউ ও বোনকে ধরে হাঁটছে। আচমকা অপূর্বর হাত ছেড়ে রাস্তার কিনারে নদীর দিকে মুখ করে বসে পড়ল আরু। গড়গড় করে বমি করল। অসময়ে আরুর এই অবস্থা দেখে অপূর্ব আরুর নিকট যায়। ঝুঁকে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়‌। আরুর চোখে-মুখে এক ক্লান্তি বিরাজমান। যত্ন করে বলে, “কী হয়েছে আরুপাখি, শরীর খারাপ?”
“পঁচা মাছের বিশ্রী গন্ধ আসছে। আমার বমি পাচ্ছে।”
অপূর্ব তার শরীর থেকে চাদর খুলে আরুর গায়ে জড়িয়ে দিল। উন্মুক্ত হলো পানের লাল পিক। আরু চাদর দিয়ে নাক ঢেকে অপূর্বর কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে পুনরায় হাঁটা শুরু করল। সুমি ও তিয়াস অনেক সামনে এগিয়ে গেল। এক পর্যায়ে দাঁড়িয়ে যায় তিয়াস। পিছিয়ে ওদের জন্য দাঁড়ায়। দূর থেকে বলে, “ভাই, দাঁড়িয়ে পড়লেন কেন?”
“স্কুল থেকে ফিরে রান্না করেছে, না খেয়েই এখানে চলে এসেছে। খালি পেটে পচা মাছের গন্ধে বমি করেছে।”
“পচা মাছ পেলেন কোথায়?”
“মনেহয় জাল থেকে মাছ ছাড়ানোর সময় দু-একটা ঝোপঝাড়ে পড়ে ছিল। সেটাই পচে দুর্গন্ধ ছাড়াচ্ছে।

অপূর্বরা এগিয়ে আসতেই কিঞ্চিৎ আলোতে অপূর্বর সাদা‌ শার্টে লাল দাগ দেখে বলে, “আপনার শার্টের এই অবস্থা হয়েছে কীভাবে ভাই?”

অপূর্বর মনে পড়ল তখনকার কথা। আরু কাঁচুমাচু করে হাত ছাড়িয়ে নেয়। পুনরায় আরুর হাত ধরে অপূর্ব বলে, “এই গোরুটা পানের পিক ফেলেছে। গোরুর মতো পান চিবানো শিখেছে। সাদা শার্টে এই দাগ উঠবে? ঘষে ঘষে যদি এই দাগ আরু উঠাতে না পারে, তাহলে ওর শরীরে দাগ করার দায়িত্ব আমায়।”

আরু চোখ রাঙিয়ে তুরকে ইশারা করে। তুর মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। হাত ছাড়িয়ে সুমির হাত ধরে হাঁটা দিয়ে বলে, “তোমরা সবাই আস্তে হাঁটছ কেন? আমার পা ব্যথা করছে।”

“তুর। তুই আমার একমাত্র আদরের বোন। যখন তুই হাঁটতে শিখেছিস, তখন মা-বাবা দেশে ফিরে এসেছে। আমাকে জোর করে ভিনদেশে রেখে এসেছে। এক প্রকার চাপা রাগে আমি এতদিন দেশে ফিরিনি। মা তখন আরুকে আমায় বধ করার অ/স্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কেবল আরুর টানেই আমি দেশে এসেছি। ছোটবেলায় তোকে তেমন কোলে নিতে পারিনি, চাইলে এখন বড়ো ভাইয়ের কোলে উঠতে পারিস।”

বলেই হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে অপূর্ব। তুর এই সুযোগটাকে মিস করতে চায়না, তাই অপূর্বর গলা ধরে ঝুলে পড়ল। ভাই বোনের এই মিষ্টি সম্পর্কগুলো আজীবন অক্ষত থাকুক।
__
শীতকালের আগমনের আগেই কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে। বিভিন্ন প্রজাতির পাখিরা এসে জানালার পাশে বসেছে। পাখিদের ডাকে ঘুম ভেঙে যায় কালাচাঁনের। কালাচাঁনদের বাড়ি নদীর কিনারায় একটু ভেতরে থাকাতে শীত বেশি পড়ে। তবে অন্যদিনের তুলনায় আজ শীত অনেকটা কম। কালাচাঁন অনুভব করে কেউ তাকে পেছন থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে। কালাচাঁন আলতো ঘাড় কাত করে শেফালীর তৈলাক্ত ও ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখতে পায়। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে ছেলেটি। গতরাতে যে বিয়ে করে কেঁদে চোখ ফুলিয়েছে, আজ সে কালাচাঁনকে অবলম্বন করে রেখেছে। কালাচাঁন শেফালীর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে মায়াতে আবদ্ধ হওয়ার পূর্বেই দরজার করাঘাত পড়ল। অনবরত করাঘাত বাড়তে শুরু করল। দরজার বিপরীত পাশ থেকে তুর বলে, “দুলাভাই, আর কত ঘুমাবেন। উঠুন। বিয়ের পর দিনে এত ঘুমায় না!”

শেফালীর তন্দ্রা হালকা হয়ে এলো। চোখ মেলে সর্বপ্রথম নজরে এলো কালাচাঁনের লাল রঙের পাঞ্জাবি। চকিতে ঠ্যালে পিছনে যেতেই বিছানা থেকে মাটিতে পড়ল শেফালী। ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠে। কালাচাঁন বিছানা থেকে উঠে নিজেই কম্বল ভাঁজ করে পাশে রাখে। এটা তার নিত্যদিনের কাজ। অতঃপর কমলা রঙের একটা পাজামা-পাঞ্জাবি কাঁধে নিয়ে দরজা খুলে দিল। তুরের পেছনে সুমি দাঁড়িয়ে ছিল। হাত দিয়ে কালাচাঁনের পথ আটকে বলে, “নন্দাই সাহেব, রাত কেমন কেটেছে।”
“আপনার ননদকে জিজ্ঞেস করুন।” লজ্জা পাওয়ার ভান ধরে দিঘির দিকে গেল কালাচাঁন। আড়াল থেকে বেরিয়ে সুমিদের সাথে যোগ দিল আরু ও তিস্তা। কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করে শেফালীকে বিছানায় দেখতে পেল। ততক্ষণে মাটিতে থেকে শাড়ি ঝেড়ে বিছানায় বসেছে শেফালী। গতরাতের শাড়িতে ভাঁজ না দেখে অকপটে সুমি বলে, “শেফালী এভাবে কোমরে হাত দিয়ে কেন বসে আছো?”
“ব্যথা পেয়েছি।”
“অ্যাহ!”
“সত্যি বলছি। ধাক্কা দিলে ব্যথা পাবোনা?”
“বোন, তুই বাইরে গিয়ে এই কথা বলিস না। তাহলে আমাদের মানসম্মান শেষ।” আরু হেসে বলে।
“শেফালী কি তোর মতো? ও সব বুঝে। তোকে যখন প্রশ্ন করেছিলাম, তখন অপূর্ব ভাইকে ধরিয়ে দিয়েছিস। আমাদের সাথে যদি শেয়ার না করে, কার সাথে করবে? ওর কি ননদ আছে?” আরুকে খানিক রঙ্গ করে বলে তিস্তা। রঙ্গ বুঝতে পারল না আরু। বিপরীতে তেজ দেখিয়ে বলে, “আমি খা/রা/প এটা বলতে চাইছো? তোমরা থাকো তোমাদের মতো। আমি আর তোমাদের বিরক্ত করব না।”

বলেই রাগান্বিত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল আরু। চার জন যুবতি বুঝতে পারল না, আরুর ব্যবহারের মানে। আরু সহসা রাগে না, আজ সামান্য কারণে রেগে গেল। আরু পেছনের দরজা দিয়ে রসুইঘরে এসে দাঁড়াল। অনিতা ও জাহানারা নাস্তা তৈরি করছে। আরু পিঁড়ি পেতে বসতেই অপূর্ব ডাক্তার নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকল। সুন্দরী যার কাছে পরীক্ষা করেছিল, সে অপূর্বর পরিচিত বলে বাড়িতে নিয়ে এসেছে। অপূর্ব ডাক্তারকে ঘরে রেখে রসুইঘরে এসে বলে, “মা, ডাক্তার এসেছে। এক চাপ চা দাও।”

জাহানারা কাপে ছাঁকনি দিয়ে চা ঢালতে ঢালতে আরুকে উদ্দেশ্য করে বলে, “আরু চা আর বিস্কুটগুলো নিয়ে যা।”
“পারব না। আমি কি এই বাড়ির বউ? যে বউ তাকে বলো। সে-তো এত বেলাতেও ঘুমাচ্ছে আর আমরা সাতসকালে হাজির।”

অজানা কারণে আরুর মাথায় আগুন জ্বলে উঠেছে। জাহানারা আড়চোখে অনিতার দিকে তাকিয়ে বলে, “ইদানীং ওর কী হয়েছে ভাবী? কথায় কথায় ছ্যান ছ্যান করে ওঠে।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪৫

“আমিও বুঝতে পারছি না। খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করেনা। সকালের খাবার দুপুরে, দুপুরের খাবার রাতে খায় যদি আমি মনে করে দেই। খাবারের কথা বললে কেমন করে তাকায়। খাবার নিজের হাতে সাজিয়ে হাতে দিলাম, কিছুক্ষণ পর দেখি দিঘিতে ফেলে দিচ্ছে। কাজের কথা বললে, আলসেমি করে।” মল্লিকা সায় দিল জাহানারার সাথে। আরু যেন চণ্ডাবতী হয়ে উঠল। তেড়ে বলে, “কী বলতে চাইছ, ‘আমি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরি। কোনো কাজ করি না।’ এখন তো আমাকে ভালো লাগবেই না। সুমি ভাবীই ভালো।”

“তুই ভুল ভাবছিস আরু।” অনিতা আরুকে সামলানোর চেষ্টা করে।

“আমার এইটুকু বোঝার বয়স হয়েছে।” আরু উত্তেজিত হয়ে বলে। অপূর্ব পাশেই দাঁড়ানো ছিল। মায়ের প্রতি স্ত্রীর এমন কথা শুনে হতভগ্ন হয়ে গেল। সিঁড়ি থেকে নিচে নামতে নামতে ধমকায় অপূর্ব, “এক চড়ে তোর সব দাঁত ফেলে দিবো আরু। মায়ের সাথে এভাবে কথা বলার সাহস কে দিয়েছে তোকে? শাসন করছি না বলে বে/য়া/দ/ব হয়ে যাচ্ছিস দিনদিন।”

প্রিয়তমর মুখে এমন ধমক শুনে অশ্রু এসে ভিড় করল আরুর চোখে। অপূর্বও আরুকে বুঝতে পারেনা? আরুকে বজ্রকণ্ঠে ধমকেছিল, তাই ঘরের সবাই বাইরে এলো। মোতাহার আহসান সংশয় নিয়ে বলেন, “কী হয়েছে এখানে? এত চিৎকার চ্যাঁচামেচি কেন?”
“আপনার ভাগনিকে জিজ্ঞেস করুন। সাত ভাইয়ের এক বোন, এক ভাগনি। কার সাথে কীভাবে কথা বলতে হয়, এখনো জানে না।” অপূর্ব অন্যদিকে ফিরে বলে। আরুর সমস্ত ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলে শুরু করল। চোখ মুছে শুরু করল তার অভিযোগ, “বোন, ভাগনি। দাম দিয়েছেন তাদের? ভাইঝির বিয়ে, অথচ বোন দুলাভাই হিসেবে আমার মা-বাবা জানে না। বংশের সবাই উপস্থিত কিন্তু আমার মা-বাবা নেই। তিস্তা আপু দূর থেকে চলে এসেছে, অথচ আমার মা কাছে থেকেও নেই। তারপরেও আপনারা কীভাবে আশা করেন, আপনাদের সাথে আমি ভালো ব্যবহার করব?”

উপস্থিত সবাই যেন বিস্মিত, হতবাক, বাকরুদ্ধ। অনিতা রান্না রেখে আরুর কাঁধে হাত রেখে বলেন, “তুই তো জানিস, আমরা কতটা ব্যস্ত আছি। তোর কি উচিত ছিলনা, পারুলকে খবর দেওয়ার? অন্তত একবার আমাদের জানাতি।”
“আপনার ছেলে কী করে? তিয়াস ভাই তার বোনকে খবর দিয়ে নিয়ে এসেছে। ওনিও আমার মাকে নিয়ে আসত। সে আমাকে মা/রা/র জন্য ব্যস্ত থাকে। কালরাতে ভুলে পানের পিক ফেলেছিলাম, ওনার শার্টে। এতে ওনি আমাকে হুমকি দিয়েছে, পানের দাগ না উঠলে আমাকে মে/রে হাসপাতালে ভর্তি করবে। তাই ভোরে ঘুম থেকে উঠে ওনার শার্ট ধুয়ে এই বাড়িতে এসেছি।
আসলে ওনার কোনো দোষ নেই, বিদেশে ছিল তো। বিদেশিনী দেখে চোখ জুড়িয়েছে, এখন আমার মতো গ্ৰামের মেয়েকে ওনার ভালো লাগছে না।” বলতে বলতে আরু কেঁদে ফেলল। মধ্যবয়স্করা হতভগ্ন হলেও যুবক-যুবতিরা আশ্চর্যান্বিত। অপূর্ব অন্য ইঙ্গিতে বলছিল, আরু তার অন্য মানে বের করছে। এই লজ্জাজনক কথার জন্য অপূর্বর পক্ষ নিয়ে কেউ কথা বলল না। মোতাহার আহসান থমথমে গলায় বললেন, “এজন্য তুই আজানের পর দিঘিতে গিয়েছিলিস?”
“হুঁ।”
“অপূর্ব, আহসান বাড়ির ছেলেরা কখনো কাপুরুষের মতো স্ত্রীর গায়ে হাত তোলে না। তোমার কাছ থেকে এমন ব্যবহার আশা করিনি।” বলেই মোতাহার আহসান ঘরে চলে গেলেন ভাইদের নিয়ে। অপরাধ না করেও বাবার চোখে নত হলো অপূর্ব। রাগে হাত টিনের সাথে আঘাত করল অপূর্ব। জং ধরা টিন ভেঙে হাত ভেতরে চলে গেল। কা/ট/ল অনেকটা। প্রাণনাথের এমন অবস্থা দেখে আরু এগিয়ে এলো। অপূর্ব কা/টা হাতের দিতে তাকিয়ে বলে, “আরু, আমার মাথা গরম আছে। সামনে এসে আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিস না।”
“শুনুন।”
“আমি এই বাড়ি থেকে যেতে বলেছি তোকে।”
“আপনার হাত থেকে রক্ত পড়ছে।”
“আরু… এখান থেকে যা।” অপূর্বর ধমকে আরু খানিক কেঁপে উঠল। হুট করে আরু ফের রেগে গেল। রাগান্বিত হয়ে বলে, “আপনি আমাকে বাড়িতে চলে যেতে বলছেন? ঠিক আছে।”
আরু আরু‌ পেছনে তাকাল না। ছুটে গেল বাড়ির দিকে। তুর, সুমি, তিস্তা থামানোর প্রচেষ্টা করল। কিন্তু আরু আজকাল কারোর কথায় গুরুত্ব দেয় না। চম্পা তখন উনুনের কাছে বসে কৌতূহল নিয়ে বলেন, “আমার কেন জানি মনে হয়, আরু পোয়াতি। মোতাহার যখন আমার গর্ভে এসেছিল, তখন আমি হুটহাট রেগে যেতাম। এখন মোতাহারের রাগ সবার উর্ধ্বে।”

“আম্মা। আরু কখনো বলেনি ওর মাথা ঘুরে, বমি পায়, অস্থির লাগে। আমার মনে হয় পারুল বুবুকে খবর দেইনি বলেই রেগে ছিল।” মল্লিক বাক্য করে।

“কে বলেছে আরু বমি করেনি? কালকে রাতে রাস্তায় করেছিল, আবার স্কুলে গিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসেছিল। ওর শরীর নাকি ভালো লাগছে না।” তুরের কথায় ছোটোখাটো ভূমিকম্প হলো এখানে। সবাই একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে। মল্লিকা উৎফুল্লিত হয়ে বলেন, “আমাদের অপু সবার পরে বিয়ে করে ছক্কা হাঁকাবে, আমরা কেউ ভাবতেই পারিনি। ভাবী, তুমি দাদি হচ্ছো, মিষ্টি দাও।”

“আমি কি একা দাদি হচ্ছি, তোমরা হচ্ছো না? মিষ্টি খাওয়াবে আম্মা, সে প্রথমবার পুতির মুখ দেখতে চলেছে।” অনিতা বললেন। জবাবে একগাল হেসে চম্পা বলেন, “তা আর বলতে? কিন্তু অপূর্বর মনোচিকিৎসার ওপরে আমার সন্দেহ হচ্ছে। আরু যে পোয়াতি, এটা কেন স্বামী হয়ে ও বুঝল না?”

অপূর্ব এখনো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। তাকিয়ে আছে আরুর গমনপথের দিকে। আরুকে দেখা যাচ্ছেনা, অথচ মস্তিষ্ক আরুর মুখ থেকে শুনতে চাইছে সত্যটা। চম্পার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে অপূর্ব হাঁটা দিল বাড়ির দিকে। আহসান বাড়ি থেকে কালাচাঁনদের‌ বাড়ি পাঁচ মিনিটের রাস্তা। আজকে সেখানে পাঁচ মিনিট পাঁচ যুগের মতো লাগল অপূর্বর কাছে। কাঠের দরজায় মস্ত এক তালা দেখে সন্দিহান হলো। কোথায় গেল আরু? হাতের ইশারায় কাছে ডাকে এক প্রহরীকে। নিকটে আসতেই বলে, “আরুকে দেখেছেন ভাই?”

“ভাবী তো আপনাদের সাথেই বের হয়েছে আর ফেরেনি।”

“চাবিটা দিন তবে।”
প্রহরী চাবি এগিয়ে দিতেই অপূর্ব তালা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে। আরু কোথায় গেছে, অপূর্ব অনুমান করেছে। সিঁড়ি পেরিয়ে সোজা দোতলা ঘরে গেল। মাথায় হাত রেখে বিছানায় বসতেই ময়নাপাখি ডেকে উঠল, “আরুপাখি, আরুপাখি, আরুপাখি।”

ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়ে কালাচাঁনদের বাড়িতে গিয়েছিল পরিবার। তখন ঘুমন্ত ছিল পাখিরা। আরুও খাবার দেয়নি। অপূর্ব টিনের কৌটা থেকে খাবার বের করে খাঁচার ভেতরে দিল। পুনরায় কৌটা টেবিলে রাখতে নিলেই হাতের ধাক্কায় কাঠের ফুলদানিটা মাটিতে পড়ল ঠক করল। বিরক্ত নিয়ে ঝুঁকে ফুলদানিটা তুলতে গেলে অবাধ্য দৃষ্টি আটকালো খাটের নিচে। অপ্রত্যাশিত ও পরিচিত প্যাকট দেখে অপূর্ব খাটের তলা থেকে বের করে আনল। আগের মতো দেখে রাগল ভীষণ। মেয়েটা অবাধ্য হয়েছে, কিশোরী জীবন নিয়ে খেলছে। এই বয়সে গর্ভধারণ মানে জানে ও?
অপূর্ব ছুটল মৃধা বাড়ির দিকে।
_
দিঘির পাড়ে বসে আছে মাছওয়ালা। তার পাত্র থেকে মাছ গুনে গুনে অয়নের হাতে দিচ্ছে। অয়ন তা গুনে দিঘিতে ফেলছে। বেশ কিছুদিন আগে দিঘির পানি পালটে আবার নতুন পানিতে ভরতি করেছে। মাছের পোনা ফেলছে আজ। পাঁচশো পোনা মাছ ফেলার পর পারুল আঁচলে হাত মুছে অয়নকে আদেশ দেয়, “বালিশের ভেতরে আমার ছোটো ব্যাগ আছে। ওটা নিয়ে আয়।”

অয়ন ছুটে ঘরে গিয়ে বালিশের তলা থেকে ব্যাগ বের করে ফের রওনা হলো দিঘির দিকে। আচমকা ডানে নজর যেতেই মাটিতে পড়ে থাকতে দেখল আরুকে। অয়ন ছুটে গিয়ে আরুকে ঠ্যালা দিয়ে বলে, “বুবু, এই বুবু ওঠ। মা দেখো, বুবু এখানে পড়ে আছে।”

অয়নের চিৎকারে ছুটে এলো পারুল। মেয়েকে এই অবস্থায় দেখে চমকে গেছে।

চলবে.. ইন শা আল্লাহ

নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-৪১+৪২+৪৩

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪১

ভিজে জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরু। পাশে অপূর্ব দাঁড়িয়ে আছে। এখানকার রিচ্যুয়াল শেষ হতেই অপূর্ব অগ্রসর করল কলতলার দিকে। মল্লিকা বাধা দেয়, “এই অপু, একা যাচ্ছিস তোর বউকে কে নিয়ে যাবে। কোলে করে কলতলায় নিয়ে যা।”

অপূর্ব ফিরে আরুর দিকে তাকাল‌। প্রতিবেশীদের উপস্থিতির কারণে আরুকে তুলতে লজ্জা অনুভূত হলো তার। মণি রঙ্গ করে বলে, “অপু তুই লজ্জা পাচ্ছিস কেন? শুধু আমাদের সাথে ঠোঁট কাটা হলে চলবে, গ্ৰামবাসীর সামনেও তো হতে হবে না-কি?”

“গ্ৰামবাসী আর তুমি কি এক চাচি? তুমি আমার বয়সী। তোমার সাথে আমি যা করতে পারি, অন্যের সাথে তা করা সম্ভব নয়।” মৃদু কণ্ঠে বলে আরুকে পাঁজাকোলা করে নিল অপূর্ব। আরু তার কাঁধে হাত রাখতেই কলতলায় চলে গেল অপূর্ব। ভেতরে ঢুকে আরুকে নামিয়ে দরজার ছিটকিনি তুলে দিল। ভেজা সেন্ট গেঞ্জি খুলে টিউবওয়েলের হাতলে রেখে বলে, “ফটাফট কল চেপে পানি তোল, গোসল করে বের হতে হবে।”

“পারব না।” কঠোর ভাবে বলে টিউবওয়েলের হাতল উপরে তুলে‌। প্রথমবার আরুর এমন ভঙ্গিমা দেখে অপূর্ব হতভাগ না হয়ে পারল না। অথচ কখনো অপূর্বর মুখে মুখে তর্ক করে না আরু‌। অপূর্ব চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, “কী বললি তুই? আমার মুখের উপর কথা বলার সাহস কোথায় পেলি? এদিকে আয়।”

“আসব না। পারব না। আজ আপনি পানি তুলে আমাকে দিবেন, গোসল করতে। না-হলে এখন আমি মাথার কাপড় ফেলে এই ভেজা অবস্থায় চলে যাবো। এবার আপনার মত?” বুকে হাত গুজে বলে আরু। অপূর্ব বুঝতে পারে, তাকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। বাধ্য হয়ে প্রথমবার নিজে টিউবওয়েল চেপে পানি তুলে আরুর গোসলের জন্য। অপূর্বর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বলছে, ‘তোর খবর আছে আরু।’
__
সূর্য আজকাল সময়ের আগে মেঘের আড়ালে তলিয়ে যায়। বর্ষাকালে সূর্য সর্বোচ্চ তাপমাত্রা দিলেও বর্ষার কারণে গরম অনুভূত হয় না। আরু একা বারান্দায় গিয়ে বসে বৃষ্টি উপভোগ করছে। তাদের উঠান জুড়ে একাধারে নৃত্য পরিবেশন করছে বৃষ্টি। হঠাৎ কল এলো অপূর্বর ফোনে। অপূর্ব ফোন রেখে হাঁটতে গেছে। ফোনটা রিসিভ করে সালাম বিনিময় করতেই ওপাশ থেকে ইমদাদ হোসেন বলে, “আরু, অপূর্ব কোথায়? তোরা কখন আসবি? আমি কি গাড়ি নিয়ে আসব?”

“না বাবা, আসতে হবে না। উনি বাড়িতে নেই, ফিরলে আমি তাকে নিয়ে চলে আসব।”

“আচ্ছা। তুই আর অপূর্ব একা আসিস না। সবাইকে নিয়ে আসিস।”

“আচ্ছা। রাখি।” তারপরে কল রেখে আরু নিচে গেল। বৃষ্টির মাঝে সবাই ক্যাসেট দিয়ে ভূতের সিনেমা দেখছে। অপূর্ব ফিরে নিজেও যোগ দিয়েছে সবার সাথে। তুর ও শেফালী ওড়না মাথায় দিয়ে রেখেছে ভয়ে, কখনোবা আংশিক মাথা বের করছে। সুমি তৎক্ষণাৎ চা নিয়ে হাজির হলো। আরু এগিয়ে সুমির হাত থেকে ট্রে নিয়ে সবাইকে চা পরিবেশন করতে থাকে। সবাইকে দিয়ে এক পর্যায়ে অপূর্বর হাতে চা দিয়ে বলে, “বাবা ফোন দিয়েছিল, আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছে। কখন যাবেন?”

“আমি গেলেও থাকতে পারব না। কাল থেকে আমার চেম্বার খোলা। তুমি যেতে চাইলে দিয়ে আসব।” চা নিয়ে চুমুক বসায় অপূর্ব। অনিতা লক্ষ্য করে এগিয়ে এসে বলে, “কী হয়েছে আরু, মুখ কালো করে আছিস কেন?”

“মামি, ও বাড়িতে যাওয়ার জন্য বাবা ফোন করেছিল। কিন্তু উনি বলছে, তার সময় নেই। আমাকে একা থাকতে।”

“ও কী কথা! এখন সময় না-থাকলে কবে সময় হবে? নতুন বিয়ে করেছিস শ্বশুর বাড়িতে যাবি, হানিমুনে যাবি। ছুটি নেই মানে কী?” তীক্ষ্ণ গলায় অনিতা বলে‌। অপূর্ব বৈঠকখানা ত্যাগ করে দোতলায় চলে গেল। তার মাথায় এখন প্রচণ্ড উত্তেজনা। দু-দিন পরপর ছুটি নেওয়ার কারণে কথা শুনতে হয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। আরু মন খারাপ নিয়ে সোফায় বসতেই ইমদাদ ছাতা মাথায় নিয়ে হাজির হয় আহসান বাড়িতে। তক্তার সাথে ঝুলিয়ে আরুকে রাগ দেখিয়ে বলে, “তোদের জন্য কত অপেক্ষা করব, কখন যাবি? তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে চল‌, তোর মা অপেক্ষা করছে।”

অনিতা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলে, “আরু বেয়াইকে চা দাও।”
বেয়াই সম্বোধন শুনে প্রসন্ন হলেন ইমদাদ। খোশগল্পে মেতে উঠলেন বেয়াইয়ের সাথে। আরু বাবাকে চা দিয়ে উপরে গেল। অপূর্ব মনযোগী হয়ে কাগজে কিছু লিখছে। আরু আঁচলটা কোমরে গুঁজে বারান্দায় থাকা ময়না পাখিদের খাবার দিল। অতঃপর শব্দ করে ট্রাভেলিং ব্যাগ বিছানায় রাখে। গোছানো জামাকাপড়গুলো ছুড়ে ফেললে এলোমেলো হয়ে গেল তা। শব্দে বিরক্ত হয়ে অপূর্ব এক নজর তাকাল আরুর দিকে। চণ্ডাবতী রূপ দেখে অপূর্ব খাতা কলম পাশে রেখে পেছন থেকে আরুকে জড়িয়ে ধরে। অপূর্বকে ছাড়াতে ছাড়াতে আরু উড়ণচণ্ডী হয়ে বলে, “আদিখ্যেতা করছেন কেন? আমাকে একদম ধরবেন না।”

“চণ্ডী রূপে পুড়ে ছাই হওয়ার আগে তাকে থামানো উত্তম। (পরপর বলে) এত রেগে আছে কেন ময়না পাখিটা?” জড়িয়ে ধরেই বলে।

“একদম ময়না পাখি বলবেন না, বাবা নিতে এসেছে। আপনার খোঁজ করছে, তাকে গিয়ে বোঝান আপনি যাবেন না। বিয়ের আগে বউকে চোখে হারায়, বিয়ের পর কর্পূরের মতো উড়ে গেছে প্রেম।” অভিমানী শোনাল আরুর গলা। অপূর্ব তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে ললাটে এঁকে দিল ভালোবাসার পরশ। চরম আদুরে গলায় বলে, “তুমি কি চাও তোমার স্বামীকে হাসপাতাল থেকে বের করে দিক। প্রতিদিন মানুষ ফি দিয়ে অ্যাপয়েন্টম্যান্ট করে রাখে। কিন্তু আমার সাথে দেখা করতে পারে না। চিকিৎসক হিসেবে আমার উচিত ওদের রোগ সম্পর্কে জেনে বিস্তারিত পরামর্শ দেওয়া। আজকে তুমি যাও, আগামী বৃহস্পতিবার আমি যাবো। শুক্রবার থেকে শনিবার তোমাকে নিয়ে চলে আসব। আমার জন্য তুমি বাবা মাকে দেখতে পাবে না, এটা আমার ভালো লাগবে না। তাই প্রথম ও শেষবারের মতো আমি তোমাকে একা ঐ বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি দিলাম।”

আরুর রাগ নেমে এলো শূণ্যতায়। পরক্ষণে অপূর্বর কাছে তা হুরহুর করে বেড়ে গেল। একটা প্যাকেট আরুর হাতে দিয়ে বলে, “এটা রাখো!”

“কী এটা?”

“সামনে তোমার পরীক্ষা। আমি চাই না এখন নতুন কেউ আসুক।” অপূর্বর ইঙ্গিত বুঝতে সমস্যা হলো না আরুর। মুখ ফুটে বলার আগে নিচ থেকে অপূর্বর ডাক পড়ল। ইমদাদ হোসেনের ডাকে সাড়া দিতে অপূর্ব নিচে চলে গেল। রাগে হাতের প্যাকেটটা মুঠো করে ফেলে দিল খাটের নিচে। অতঃপর আবার জামা কাপড় গোছাতে ব্যস্ত হলো। গোছানো শেষে আরু ব্যাগ সমেত নিচে নামল। অপূর্ব ইতোমধ্যে বুঝিয়েছে ইমদাদ হোসেনকে। তাই জামাতা ছাড়াই মেয়েকে নিয়ে যাত্রা শুরু করল মৃধা বাড়ির দিকে।
বাড়িতে একা আরুকে দেখে অপূর্বর খোঁজ করল পারুল। প্রথমবার জোড়া নায়র শ্বশুর বাড়িতে না এসে একা মেয়েকে দেখে প্রশ্ন করল কেউ। আরু রাগ দেখিয়ে বলে, “আমাকে কেন এত কথা জিজ্ঞেস করছ, তোমার ভাইপো কোথায়? ওকে জিজ্ঞেস করো। আমার থেকেও তোমার ভাইপোকে বেশি বিশ্বাস করো।”
তারপরে নিজের ঘরে চলে গেল আরু। পাঁচ বান্ধুবীকে এভাবে ফুল দিয়ে ঘর সাজাতে দেখে বুঝতে বাকি রইল না, তারাও অপূর্বর জন অপেক্ষারত। আরুকে দেখে উত্তেজিত হয়ে মিতু বলে, “দুলাভাই কোথায়, তোদের জন্য কেমন ঘর সাজিয়েছি বল।”

প্রসন্ন না হয়ে অপ্রসন্ন হলো আরু। রেগে ফুলগুলো টেনে ছিঁড়ে ফেলল। আঙুল তুলে বলে, “আমি তোদের ঘর সাজাতে বলেছি? সাজিয়েছিস কেন? আর কখনো আমাকে জিজ্ঞেস না করে আমার ঘরে আসবি না। বের হ।”

ওরা আরুর রাগ দেখে বিলম্বে জিনিসপত্র নিয়ে ত্যাগ করল ঘর। আনমনে অপূর্বকে নিন্দা করে খাবার না-খেয়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল আরু।

চলবে.. ইন শা আল্লাহ

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪২

চালের উপর বৃষ্টির ধারা নৃত্য পরিবেশন করছে। রাস্তার দুই ধারে থাকা কদম গাছে কদম ফুল ফুটেছে। সেই গাছে আশ্রয় নিয়েছে নাম না-জানা বহু প্রজাতির পাখি। ঠান্ডা আবহাওয়ায় কোল বালিশ জড়িয়ে আরু নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। আর পাঁচটা দিনের মতো আজকে রাতটা কাঁটছে তার। মৃধার বাড়ির লোকেরা শত ডেকেও আরুকে বিছানা থেকে উঠাতে পারেনি। বিনিময়ে শুনতে হয়েছে আরুর বাজখাঁই গলা।
মধ্যরাতে পেছনের ঘরে প্রবেশ‌ করে কেউ। কদম ফুলের গুচ্ছ টেবিলের উপর রেখে কাঁপতে কাঁপতে বিছানায় উঠে। কোল বালিশ থেকে আরুকে ছাড়িয়ে টেনে নেয় হৃদমাঝারে। রাতের অন্ধকার পেরিয়ে আলোর সূচনা হলেও বৃষ্টির বিরতি দেওয়ার নাম নেই। তারা নিজের কাজে ব্যস্ত। মোরগ ডেকে সবাইকে সকালের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। বৃষ্টির দিনে মোরগ নিজে ঠাওর করতে পারেনি ভোরকে। লম্বা চুলগুলো হাত খোঁপা করে উঠে বসল আরু। অনুভব করল পাশ থেকে জড়িয়ে রাখা একটা হাত তার শাড়ি ভেদ করে নগ্ন পেট স্পর্শ করছে। চকিতে পাশে ফিরতেই মিলল অপূর্বর মুখশ্রী। গতকাল রাতে এই বিছানায় একা ঘুমিয়েছিল, অপূর্ব এলো কীভাবে? রাতে প্রখর বাদল ছিল। সেই সময়ে অপূর্বর আসা অসম্ভব। চাপা অভিমান নিয়ে অপূর্বকে ছাড়িয়ে বিছানা থেকে নামল আরু। নজরে এলো একগুচ্ছ কদম। দৃষ্টিতে সরিয়ে এগিয়ে গেল সামনে। পেছনের দরজা খুলে মাটির সিঁড়িতে দাঁড়াতেই দেখল, রসুইঘর থেকে ধোঁয়া উড়ছে‌। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে রসুইঘরে ঢুকে। নয়না পারুলকে দেখে হেসে বলে, “তুই উঠেছিস, ভালো করেছিস। জামাইকে তুলে মুখ ধুতে বল। নিজেও মুখ ধুয়ে পিঠাগুলো দিয়ে আয়।”

“জামাইকে যদি এত খাওয়ানোর শখ তাহলে নিজে গিয়ে দিয়ে আসুন। আমি পিঠা দিয়ে আসতে পারব না। কালকে তো বড় মুখ করে বলেছিল, ‘কাজ আছে, বৃহস্পতিবার ছাড়া যেতে পারব না।’ রাতে চোরের মতো কেন এসেছে‌? বের করে দিতে পারলে না?” বলতে বলতে নিমগাছের ডাল ফেলে দাঁত মাজতে থাকে আরু। পারুল চোখ রাঙিয়ে বলে, “বিয়ে হয়ে গেছে, এবার গলার স্বর ছোটো কর। জামাই ঘরে, তোর কথা শুনলে কী ভাববে!”

“আরু তুই মুখ ধুয়ে অপূর্বকে জাগা।” নয়না বলে। তখনই বাড়ির ভেতরে ঢুকে আসে‌ পাঁচ যুবতি। বৃষ্টি খরা দিয়েছে। সাথী বলে, “ভাইয়া কখন এসেছে চাচি?”

“মাঝরাতে বৃষ্টিতে ভিজে মিষ্টি, পান, বিস্কুট নিয়ে এসেছে। রাতের বৃষ্টি, জ্বর না আসলেই হয়। এতরাতে আসার কী দরকার ছিল, সকালে আসতে পারত।” হাত নাড়িয়ে বলে অনিতা। অতঃপর তন্বী বলে, “আরুকে কষ্ট করে যেতে হবে না, আমরা যাচ্ছি। গতকাল রাতে ভাই আসেনি বলে, কী রেগে ছিল! কত কষ্ট করে বিছানা সাজালাম, সবকিছু নষ্ট করে ফেলল।”

তৎক্ষণাৎ অপূর্ব চলে এলো বাইরে। পরনে তার ঢিলেঢালা একটা পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি। এই পোশাকটা আরু চেনে, ইমদাদ হোসেন মৃধার। আরু প্রায়ই ধুয়েছে। মুখ ফিরিয়ে নিল অপূর্বকে দেখে। অপূর্ব কাশতে কাশতে আরুর কাছে গেল। গাছ থেকে ডাল ভেঙে বলে, “আমাকে আর কষ্ট করে ডাকতে যেতে হবে না, আমি চলে এসেছি। তবে তোমাদের একটু কষ্ট করতে হবে। টিউবওয়েল চেপে পানি তুলে দিতে হবে মুখ ধোয়ার জন্য।”

“অবশ্যই দুলাভাই। প্রয়োজনে আপনার গোসলের পানিও তুলে দিবো।” মিতুর কথায় আরু ফিক করে হেসে ফেলল। নিমের ডাল ফেলে দিয়ে দিঘির দিকে যেতে যেতে অকপটে বলে, “নিমগাছের ডালে হবে না, বাকল লাগবে। শুধু মুখ না ধুইয়ে পাঁচজনে মিলে গা ধুইয়ে দে। পারলে মুখের ভেতরে হাত দিয়ে অন্তরটাও ঘষে দিস। তোদের দুলাভাইয়ের মুখে এক, অন্তরে আরেক। অন্তরটা পরিষ্কার থাকলে এক কথা বিরাজ করবে।”

“আরু, জামাইকে কী বলছিস এগুলো! নিজের কাজে যা।” পারুল থমথমে গলায় বলে। আরু চলে গেল দিঘির পাড়ে। দিঘির দিকে ইঙ্গিত করে অপূর্ব বলে, “সুন্দরী মেয়ে কিংবা আত্মীয়র ভেতরে বিয়ে করো না, বউয়ের থেকে সম্মান পাবে না।”
__
মাটিতে হোগলা বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। অপূর্ব জোতা খুলে বস। বিভিন্ন ধরনের পিঠা ইতোমধ্যে অপূর্বর সামনে সাজিয়ে রেখেছে পারুল। আরু হাতপাখা নিয়ে বসে আছে। ঠান্ডা বলে হাওয়া করতে হচ্ছে না অপূর্বকে। অপূর্ব জামাই পিঠা ভেঙে মুখে দিয়ে বলে, “মা, এত আমি খেতে পারব না। আপনারা সবাই বসুন। একসাথে খাবার খাই।”

“না, তুই আমাদের জামাই। প্রথমবার শ্বশুর বাড়িতে এসেছিস। তোর খাওয়া শেষ হলে আমরা খাবো।” পারুল গ্লাসে পানি ঢেলে বলে। বিপরীতে অপূর্ব বলে, “আমি তো অহরহ এসেছি। আজ প্রথম নয়।”

“এতদিন এসেছিস ফুফুর বাড়ি হিসেবে, আজ এসেছিস জামাই হিসেবে। তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ কর।” পারুল থামতেই অপূর্ব খাওয়া শুরু করে। আরু মনে মনে ছক করে বলে, “প্রথমবার শাশুড়ির হাতের তৈরি পিঠা খাচ্ছে জামাই। স্মরণীয় করে রাখতে হবে। উনি আবার লজ্জা পায়, তোরা একটু খাওয়া।”

আরু উঠে যেতেই পাঁচ যুবতি বসল হোগলায়। অপূর্বকে কোণঠাসা করে সমস্ত খাওয়া মুখে তুলে দিল। অপূর্ব ফেলতেও পারছে না। ঠেসে ঠেসে সব খাবার শেষ করে ঢেকুর তুলে ঘরে চলে গেল। ঠিকভাবে হাঁটাচলাও করতে পারছে না। পেটে হাত দিয়ে রেখেছে। পারুল জামাইয়ের পক্ষ নিয়ে বলে, “তোর সবকিছুতে বাড়াবাড়ি, জামাইকে জোর করে খাওয়ালি। যদি বদহজম হয়। আমি জিরা দিয়ে স্পেশাল একটা টোটকা বানিয়ে দিচ্ছে। অপুকে খাওয়া।”

তারপরে রসুইঘরে গিয়ে পারুল অপূর্বর জন্য এক গ্লাস ঔষধ তৈরি করে নিয়ে এলো। পারুল দিতেই আরু ছুটে গেল ঘরে। অপূর্ব উবুড় হয়ে শুয়ে আছে। অপূর্বকে দেখে মায়া লাগল আরুর‌। এভাবে শাস্তি না দিলেও পারত‌। প্রথমবার জামাই শ্বশুর বাড়িতে এসে ঘরে-বাইরে যাচ্ছে। ব্যাপারটা যদি ঘটে এবং জানাজানি হয়। খুব খারাপ হবে‌। অপূর্বর মাথার কাছে বসে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, “মা, এটা পাঠিয়েছে। ধীরে ধীরে খেয়ে চোখ বন্ধ করে রাখুন।”

“তোর তো খুব ভালো লাগছে আমাকে এই অবস্থায় দেখে। নাচতে ইচ্ছে করছে। খাবো না আমি।” অপূর্ব শুয়ে থেকেই বলে। আরুর কষ্ট হয়। একটু চাপা অভিমান নিয়ে বলে, “আমি কখনো আপনার ক্ষতি চাইনা। একটু রেগে ছিলাম জাস্ট। এটা খান।”

অপূর্ব উঠে বসে ঠিকই, তবে গ্লাসটা কেড়ে টেবিলের উপর রেখে দিল। আরুর আঙুলের ভাঁজে আঙুল ঢুকিয়ে বলে, “মা বোধহয় আমাকে মিষ্টি দিতে ভুলে গেছে। কালরাতে এত মিষ্টি নিয়ে এলাম, একটিও পেলাম না।”

“আপনি এই ভরা পেট নিয়ে আবার মিষ্টি খেতে চাইছেন? এবার পেট ফেটে যাবে নির্ঘাত।”

“তবুও মায়ের মিষ্টি দেওয়া উচিত ছিল।”

“আপনি মিষ্টি খাবেন? আমি নিয়ে আসছি।”

“না, এখন আর খাবো না। মা ভুল করে মিষ্টি দেয়নি, তার মেয়ে হিসেবে তোর উচিত তার ভুল শুধরানোর। কাছে আয় আরু, আমাকে মিষ্টি মুখ করা।” বলে অপূর্ব মাথা এগোলে আরুর দিকে। আরুর অধরে অপূর্বর স্পর্শ পৌঁছাতেই ছটফট করে উঠে আরু। অপূর্বকে ফেলে ত্যাগ করে কক্ষ‌। অপূর্বর মনে পড়ে গতরাতের কথা। দোতলায় বসে কাজ করছিল অপূর্ব। রাত করে বাড়িতে ফেরে মোতাহার আহসান। দোতলায় আলো জ্বলতে দেখে সংশয় নিয়ে স্ত্রীকে প্রশ্ন করে, “দোতলায় আলো জ্বালিয়ে রেখেছ কেন? এই গ্ৰামে বিদ্যুৎ কেবল আমার একার ঘরেই আছে। এত অপচয় কেন করছ?”

“অপূর্ব আছে দোতলায়।” অনিতা বাক্য তোলে।

“কেন? আরুর সাথে জোড়া নায়র যায়নি?”

“ওর কীসব কাজ আছে, তাই আরু একা গেছে।”

“অপূর্ব নিজেকে কী মনে করেছে? ওর যদি এতই ব্যস্ততা তাহলে এখন কেন বিয়ে করল? কালকে বিয়ে করেছে আর আজকেই ও এত ব্যস্ত হয়েছে যে, জোড়া নায়র যেতে পারেনি। ফুফু বাড়ির আবদার? অপূর্বর জন্য ঐ বাড়ির লোকদের কথা শোনাতে ছাড়বে পাড়া প্রতিবেশীরা? ফুফু বাড়ি তো শ্বশুর বাড়ি, তাই গুরুত্ব দিচ্ছে না। ওকে ঘুমাতে বারণ করে দাও, আমি খেয়ে ওর সাথে কথা বলল।” কথাটা বলে মোতাহার আহসান খাবার ঘরে গেলেন। অনিতা দ্রুত কাঠের সিঁড়ি পেরিয়ে উপরে উঠে গেলেন। অপূর্বকে স্বামীর কথাটা জানাতেই তড়িগড়ি করে তৈরি হয়ে নিল। অনিতা ঘরে থাকা মিষ্টি, পান, বিস্কুট অপূর্বর হাতে ধরিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে বের করে দিলেন। বৃষ্টি তখন ঝুম দিয়ে পড়ছে‌। অনিতা ঘরে গিয়ে অপূর্বর জন্য ছাতা নিয়ে এলেন। কিন্তু অপূর্ব দম না দিয়ে ভিজে চলে গেল। সেখানে গিয়ে নিজের পোশাক ছেড়ে ইমদাদ হোসেনের পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি পরিধান করে নিয়েছে।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪৩

অতিবাহিত হয়েছে কয়েকমাস। চোখের পলকে পেরিয়ে এসেছে সময়। সামনে আরু, শেফালী ও তুরের টেস্ট পরীক্ষা। আজ স্কুল থেকে রুটিন দিয়েছে। তন্বীসহ চার বান্ধুবী পরীক্ষা নিয়ে কথা বলতে বলতে ফিরছিল বাড়ির পথে। হঠাৎ তাদের সামনে একটা সাইকেল থামে। প্রয়াস মুচকি হেসে তুরের দিকে তাকায়‌। কাশি দিয়ে বলে, “আমার তুরের সাথে কথা ছিল। আপনারা একটু ওকে আমার সাথে ছাড়বেন?”
তিন বান্ধবী একত্রে সালাম দিল, “আসসালামু আলাইকুম ভাই।”
সালাম না দিয়ে প্রেমিকাকে চাওয়াতে খানিক লজ্জা পেল প্রয়াস। মাথানত করে বলে, “ওয়া আলাইকুম সালাম।” পরপর আরুকে বলে, “আরু, অপূর্ব ভাইয়ের সাথে কেমন চলছে তোমার দিনকাল?”

“নাম ধরে নয়, ভাবী বলুন। সম্পর্কে অপূর্ব ভাই আপনার বউ, তার স্ত্রী আপনার বড়ো হবে।”

“জি।”

“শেফালীর বিয়ে ঠিক হয়েছে। তুরকে কবে বিয়ে করবেন? তৃতীয় ব্যক্তি যাতে আপনাদের সম্পর্কে না ঢুকে। চল আমরা আগে আগে যাই।” শেফালী ও তন্বীর হাত ধরে সামনে সামনে পথ ধরে আরু। মাঝপথে তন্বীকে বিদায় দিয়ে কিছুটা পথ এগিয়ে যেতেই দেখা মিলল কালাচাঁনের। আড়চোখে শেফালীর দিকে তাকিয়ে বইখাতা গুলো শক্ত করে ধরে আগে আগে পেরিয়ে যায় পথ‌। বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছে দেখতে পেল অন্য দরজা দিয়ে অপূর্ব ভেতরে প্রবেশ করছে। হাতে বাজারের থলে থাকার সত্ত্বেও, সেই থলে থেকে চুইসে চুইসে রক্ত ঝরে পড়ছে। অপূর্ব থলেটা অনিতার দিকে দিয়ে বলে, “আমার এক কলিগের পুত্র সন্তানের জন্ম হয়েছে। দুটো খাসি দিয়ে আকিকা দিয়েছে। পরিচিত সবার জন্য খাসির মাংস এনেছে। ভালোবেসে নিয়ে এসেছে, তাই নিয়ে এলাম। রান্না করে আরুর জন্য দুই টুকরো রেখে সবাইকে দিও‌।”

“আরুর জন্য আমি কেন আলাদা করে রাখব? ও খাসি মাংস খেতে ভালোভাবে। যতটা খেতে পারে খাবে, প্রয়োজনে আমি রাখাল ভাইকে আবার বাজারে পাঠিয়ে দিবো কাল সকালে।” বলে অপূর্বর থেকে মাংস নিয়ে হাঁটা দিল। আরু বইখাতার সোফার উপরে রেখে ফিরে এলো। অনিতার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে বলে, “আমি এক্ষুনি ধুয়ে বসিয়ে দেই। টাটকা খেতে বেশি ভালো লাগে।”

“তোর সামনে পরীক্ষা, তোকে রান্না করতে হবে না।”

“আমি তো এই বাড়ির বউ। ভাবীও এই বাড়ির বউ। আমার উচিত তার থেকে বেশি কাজ করা। কারণ আমি বড়ো বউ।” তারপরে মাংসগুলো নিজের মনের মতো টুকরো করে নিল। ভালোভাবে ধুয়ে বসিয়ে দিল উনুনে। মশলা দিয়ে মাংসগুলো উনুনে রেখে বই নিয়ে বসল ইশরা। উনুনে লাকড়ি দিতে দিতে বই পড়ছে। অন্যদিকে অপূর্ব গোসল সেরে আরুর কাছে এলো। আরুকে এভাবে রান্নার পাশাপাশি পড়তে দেখে প্রসন্ন হলো। আরুর কাজ সহজ করতে অপূর্ব নিজেও বসল উনুনের কাছে‌। আগুনে কাঠ পুড়ে ছাই হলে দুই একটা কাঠ ভেতরে দিচ্ছে। অপূর্ব বলে, “আজ এত আগ্রহ নিয়ে পড়ছিস। কবে পরীক্ষা, কিছু জানিয়েছে?”
“রুটিন দিয়েছে।” বলে আরু তার বইয়ের ভেতরে থেকে অপূর্বকে রুটিন বের করে দিল। রুটিন পর্যবেক্ষণ করে অপূর্ব বলে, “এখনো এক সপ্তাহ।”

সময়টা অগ্রহায়ণের প্রথম দিকে। মৃদু শীতের আবহাওয়া। সবাই এসে উনুনের কাছে বসে। আরু লক্ষ্য করে শেফালী নেই। উঁকিঝুঁকি দিয়ে খোঁজার চেষ্টা করে, “মা, শেফালী ঘরে এক একা কী করছে?”

মণি আঁতকে বলে, “ওকে তো দেখলাম না। আসলে আমার সাথে আগে দেখা করে।”

“তাই তো! আমিও দেখিনি।” অনিতা তাল মেলায়। অনিতার হতে সবাই সহমত হয় কেউ দেখেনি। সবাই তো সন্দেহজনক দৃষ্টিতে আরু ও তুরের দিকে তাকায়। আরু নতজানু হয়ে আমতা-আমতা করে বলে, “কালাচাঁন এসেছিস সেখানে। শেফালীর সাথে কথা বলবে, তাই আমি ওকে রেখে এগিয়ে এসেছি। পেছনে তুর ছিল।”

“আমি ফেরার পথে শেফুকে দেখিনি। আমি জানি, তোরা দুজনে একসাথে‌।”

অপূর্ব বিরক্ত হয়ে বলে, “আজব ব্যাপার! তোরা তিনজনে সামনে পেছনে হেঁটেছিস কেন? তোরা না সবসময় হাত ধরে হাঁটিস?”

কেউ কোনো জবাব দিতে পারল না। অপূর্ব বিরক্ত নিয়ে মোতাহার আহসানকে কল দিল। কালাচাঁনের ফোন নাম্বার অপূর্বর কাছে নেই। রিসিভ হতেই অপূর্ব বিরাগী হয়ে বলে, “বাবা, শেফালী বাড়ি ফেরেনি। কালাচাঁন ওদের স্কুলের সামনে গিয়েছিল।”

“শেফালী কালাচাঁনদের বাড়িতে গেছে। বাসন ধুতে গিয়ে ঘাটলা ভেঙে বেয়ান দিঘিতে পড়ে গেছে। হাত ভেঙে গেছে বোধহয়। তুমি ডাক্তার, তোমাকে আর বোঝাতে হবেনা আশা করি।” ওপাশ থেকে মোতাহার আহসান।

“কিন্তু বাবা, ওদের এখনো বিয়ে হয়নি।”

“বেয়ানের‌ সাথে আমার কথা হয়েছে। তিনি বলেছে, কাজি নিয়ে যেতে। তোমরা সবাই তৈরি হয়ে নাও। তারপরে কালাচাঁনদের বাড়ির দিকে এগোও। আমি তিয়াসকে ফোন করে কাজি নিয়ে আসতে বলেছি।” তারপরে ফোন রেখে দিল মোতাহার আহসান। পরক্ষণে মহিলাদের আদেশ দিল অপূর্ব, “কালাচাঁনের মায়ের হাত ভেঙেছে, তাই কালাচাঁন শেফালীকে নিয়ে গেছে ওদের বাড়িতে। বাবা সবাইকে তৈরি হয়ে ওদিকে যেতে বলেছে। কাজি ডেকে আজ শেফালীকে কালাচাঁনের হাতে তুলে দিবে। এই অবস্থায় সংসার সামলাতে শেফালীকে সেখানে প্রয়োজন।”

অপূর্বর কথা শুনে উদ্বিগ্ন হয়ে গেল সবাই। তৈরি হতে চলে গেল। অপূর্ব ফ্রেশ হয়ে বসে ছিল বিদায় আর তৈরি হতে গেল না। আরুর পরনে এখনো স্কুলের পোশাক। একদিকে উনুন জ্বালানো অন্যদিকে শেফালীর কাছে যাওয়া প্রয়োজন। কী করবে ভাবছে আরু! অপূর্ব বাটি থেকে পানি ফেলে উনুনের কাছে বসে কষানো মাংস নেওয়া চেষ্টা করছে। আরু বাটিটা নিয়ে কয়েক টুকরো মাংস দিয়ে বলে, “আমি কি যাবো না-কি থাকব?”

“বাবা সবাইকে যেতে বলেছে। বাড়ি পাহারা দেওয়ার মানুষ আছে। তোর যদি যেতে ইচ্ছে না করে তাহলে থাকতে পারিস।” বলে অপূর্ব মাংস টেনে ছেঁড়া চেষ্টা করে। ভালোভাবে সিদ্ধ না হওয়াতে কোষ আলাদা হচ্ছে না। অপূর্ব থমথমে গলায় বলে, “এটা খাসির মাংস না-কি গন্ডারের? ওরা ভুলে খাসির বদলে গন্ডার দিয়ে ফেলে না-তো? চিবুতেই পারছি না।”

“সিদ্ধ হতে দিয়েছেন? জিভ থেকে জল পড়ছে।” ভেংচি দিয়ে আরু বলে। তারপরে ছুটে গেল ভেতরে। টাঙ্গাইলের শাড়ি পরে মাথায় কাপড় টেনে ঘর থেকে নামে আরু। তুর ব্যতীত সবার পরনে শাড়ি। সবার শেষে ঘরে থেকে নামে অনিতা। দরজায় বড়ো তালা ঝুলিয়ে একটা খিল্লি পান এনে চম্পার হাতে দেয়। চম্পা আঁচলে গিট দিয়ে নেয়। আরু অতি সাবধানে চম্পার পাশে হাঁটতে হাঁটতে আঁচল থেকে পান খুলে মুখে দেয়।
হেঁটে হেঁটে তাঁরা পৌঁছে যায় কালাচাঁনদের বাড়িতে। বাবা ও পাঁচ ছেলে চেয়ারে বসে খোঁজ নিচ্ছে সুন্দরীর। সুন্দরীর হাত প্রাকৃতিক জরিবুটি দিয়ে বাঁধা। অনেকটা ফুলে উঠেছে। নিঃসন্দেহে ভেঙে গেছে। মণি বেয়ানের পাশে বসে বলে, “বেয়ান হাত ভাঙল কীভাবে?”

“ঘাটলা থেকে পড়ে। এইদিকে তেমন বাড়ি ঘর নেই। সন্ধ্যা হলে আমি ঘরে ঢুকি আর বের হই না। শরীর খারাপ থাকায় দুপুরে খেয়ে ঘুমিয়েছি। ঘুম থেকে উঠে দেখি মাগরিবের আজান দিচ্ছে। আছরের নামাজ শেষ। অন্যদিকে দূরের বাড়ি থেকে পানি আনতে হবে, পুকুর খেতে পানি এনে বালতি ভরতে হবে, মাগরিবের নামাজ পড়তে হবে। তাড়াতাড়ি ওজু করে কলস নিয়ে ঘরে যাওয়ার সময় পা পিছলে ঘাটলা নিয়ে পড়ে যাই। রাতে মনে করেছি, সামান্য ব্যথা। ঘুম থেকে উঠে দেখি ফুলে উঠেছে। কালাচাঁন আমাকে নিয়ে হাসপাতালে গেল বিকালে। কিছু টেস্ট করেছে। আগামীকাল বলবে, হাত ভেঙেছে কি-না। রিপোর্ট ভাঙা আসলে গ্ৰামের বাইরে গিয়ে ভালো ডাক্তার দেখাতে হবে।”

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পান চিবাচ্ছে আর কথা শুনছে আরু। মুখ ফিরিয়ে পানের পিক ফেলতে গিয়ে অপূর্বর শার্টে ফেলল। অন্ধকারে অপূর্ব ঠাওর করতে না পেরে মুখ খোলে, “কী ফেলেছিস? যেখানে-সেখানে এগুলো কী ফেলছিস?”

আরুর পরবর্তী দৃশ্য দেখার আগেই ভয়ে পেছনের দিকে গেল। সেখানে শেফালী রান্না করছে আর সুমি তাকে সাহায্য করছে।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪৩ [বর্ধিতাংশ]

মাটির উনুনে রান্নার কারণে হাতে ও মুখে কালি লেগেছে শেফালীর। একদিকে লাকড়ি দেওয়া অন্যদিকে তরকারি দেখার জন্য শেফালী পেয়ে উঠছে না। আরু হাসতে হাসতে পিঁড়ি টেনে বসল। রঙ্গ করে বলে, “সারাবছর মা চাচিদের রান্না খেয়ে এসেছিস। এবার একটু তোর শাশুড়িকে রান্না করে খাওয়া।”

“আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য তোরা আর ছেলে পেলি না? একটা জঙ্গল এটা‌। আশেপাশে কেউ থাকেনা। আমি এখানে কীভাবে থাকব? একবার বাড়িতে যাই, আর আসব না।”

“হাস্যকর শেফু। কিছুক্ষণ পর তোকে পাকাপোক্ত এখানে রাখতে কাজি সাহেব নিয়ে আসছে তিয়াস ভাই। মার্কেট বন্ধ তাই ছোট চাচির বিয়ের শাড়ি এনেছে তোকে সাজাতে।” হাসতে হাসতে বলে আরু। মা ও চাচিরা ঘরের পেছনের দরজা দিয়ে রসুইঘরে এসে পৌঁছেছে। সুমিকে রান্নার দায়িত্ব দিয়ে শেফালী মণিকে জড়িয়ে ধরে বলে, “মা, আমি এখানে থাকব না। তুমি আমাকে নিয়ে যাও। এখানে আমার ভয় করে।”

“স্বামী থাকলে সেখানে তোর কীসের ভয়? কোনো ভয় নেই। বিয়ের পর কালাচাঁনকে আঁচলে বেঁধে রাখবি। সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে যাতে ও ঘরে থাকে।” শেফালীর মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনা দেয় মণি। তখনই শুনতে পেল অপরিচিত একটা কণ্ঠস্বর। অতঃপর শোনা গেল তিয়াসের গলা। অর্থাৎ কাজি সাহেব এসেছে। শেফালীর মন ভার হলো। মা ও চাচিরা শেফালীকে বোঝাতে শুরু করল। দীর্ঘক্ষণ পর তাঁরা শেফালীকে নিয়ে বারান্দায় গেল। রান্না ইতোমধ্যে শেষ।
শেফালীকে বধূবেশে তৈরি করে নিয়ে গেল ঘরে। মোতাহার আহসানের নেতৃত্বে নিকাহনামা লিখেছে কাজি। কালাচাঁনের নিকাহ পড়ানো শেষ। কোনে উপস্থিত হতেই কাজি সাহেব শুরু করলেন, “একশো এক টাকা ধার্য করিয়া ও নগদ টাকা বুঝিয়ে পাইয়া মরহুম আব্দুল লতিফ সিদ্দিকের একমাত্র পুত্র কালাচাঁন সিদ্দিক আপনার নিকাহ করিতে চায়। আপনি কি বিয়ে রাজি আছেন মা? তাহলে বলুন কবুল।”

শেফালীর চোখ থেকে পানি ঝরল মাটিতে। তাকিয়ে দেখল তার প্রিয়জনের মুখ। কবুল উচ্চারণ করার পর এই একা বাড়িতে ফেলে রেখে যাবে আহসান পরিবার। কাছের মানুষদের ছেড়ে শেফালী কীভাবে এখানে থাকবে? মুখে হাত দিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল শেফালী। কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আমি বিয়ে করব না, আমি বাবা মাকে ছেড়ে কোথাও থাকতে চাই না। আমি বাবা মায়ের এক মাত্র সন্তান। তাদের ছেড়ে কীভাবে এখানে থাকব।”

পেছনের বারান্দা থেকে মেয়ের কান্না শুনে কেঁদে ফেললেন মণি। আবেগপ্রবণ হলো শাহিনুজ্জামান। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলে, “এটাই নিয়তি। বিয়ের পর প্রতিটি মেয়েকে বাবার বাড়ি ছেড়ে স্বামীর বাড়িকে আপন করে নিতে হয়।”

“এতই আপন করে নিতে হয় যে, বোনের বিয়েতেও খবর দেয় না।” বলতে বলতে ভেতরে প্রবেশ করে তিস্তা‌। তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে সুজন। উপস্থিত সবাই বিস্মিত তিস্তাদের দেখে। এতকিছুর মাঝে তিস্তার কথা মাথা থেকে বের হয়ে গেছে। জাহানারা উৎফুল্লিত হয়ে তিস্তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “এতরাতে কীভাবে এলি, খবর পেয়েছিস কীভাবে?”

“তোমাদের কাছে পর হয়ে গেলেও তিয়াসের কাছে এখনো বোন। ও আমাকে জানিয়েছে।” কথাটা বলে শেফালীর পাশে বসে তিস্তা। মোতাহার আহসান খোশমেজাজে বলেন, “তোকে দেখে আমার ভালো লাগল। আমাদের চলে যাওয়ার পর ভাইবোনের সম্পর্ক এভাবে থাকুক।”

পরিবারের বড়ো মেয়ে হওয়ার কারণে তিস্তা সবার আদরের। মোতাহার আহসান চোখের ইশারায় শেফালীকে ঈঙ্গিত করল। দুঃখী মুখ করে তিস্তা বলে, “মন খারাপ করিস না শেফু বেবি। তুরের বিয়েটা হতে দে, তারপরে আমরা তিনজনে ঘর জামাই থাকব। বাড়ির মেয়ে তিনজনের সাথে দুইজন বউ পারবে না।”

কবুল বলার লক্ষণ পাওয়া গেল শেফালীর মাঝে। আড়চোখে তিস্তার পানে চেয়ে বলে, “তুমি ঠিক বলছ তো?”

“হ্যাঁ।”

“আলহামদুলিল্লাহ কবুল। আলহামদুলিল্লাহ কবুল। আলহামদুলিল্লাহ কবুল।” এক নাগাড়ে বলে ফেলে শেফালী। এতক্ষণ হেঁয়ালি করা মেয়েটাকে হঠাৎ এভাবে কবুল উচ্চারণ করাতে সবাই হাসল। শাহিনুজ্জামান ও মণি তাদের একমাত্র মেয়ে শেফালীকে কালাচাঁনের হাতে তুলে দিয়ে বলে, “আমার একমাত্র মেয়ে শেফালী। তোমার সম্পর্কে আমার ধারণা মন্দ। কেবল আমার ভাইয়ের কথাতে শেফালীর সাথে তোমার বিয়েতে রাজি হয়েছি। আমাদের কাছে মেয়ের সুখই আমার সুখ। মেয়ে অসুখী হলে এই বিয়ে ভাঙতেও আমাদের সময় লাগবে না।
আমাদের বাড়ির ভাগনিকে তোমার হাতে তুলে দিতে না-পারলেও, মেয়েকে তুলে দিয়েছি। আশা করি, আমাদের মান রাখবে।”
সুন্দরী শেফালীর হাত ধরে বলে, “কালাচাঁন নয়, শেফালীর দায়িত্ব আমি নিলাম। ওকে সুখে রাখার দায়িত্ব আমার। কালাচাঁনকে যখন জুতার মালা গলায় পরিয়ে গ্ৰাম থেকে বের করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, তখন কেবল এই শেফালী আমার কোল খালি হতে দেয়নি। তাই শেফালীকে কালাচাঁনের বউ করে এনেছি। আমি বিশ্বাস করি এই শেফালী আমার কালাচাঁনকে বুঝতে পারবে।”

অতঃপর সুন্দরী চোখের ইশারা করলেন শেফালী ও কালাচাঁনকে। ঈঙ্গিত বুঝতে পেরে পা ছুঁয়ে সালাম করে আশির্বাদ চায় ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য। মোতাহার আহসান বলেন, “দুজন দুজনকে বুঝে সবার দায়িত্ব নেওয়াই সংসার। দোয়া করি কালাচাঁন ও শেফালী সুখী হোক। কালাচাঁন তোমাকে আমি ভরসা করে ভাই ও ভাবীকে বুঝিয়ে শেফালীকে দিয়েছি। ওদের কাছে আমার মাথা হেঁট করবে না।”

“জি চাচা।”

“আমরা এগোই। মা আপনি শেফালীর সাথে থাকবেন?” মোতাহার আহসান চম্পাকে উদ্দেশ্য করে বলে। চম্পা সায় দিল, “কাছের কেউ থাকলে শেফালী ভরসা পাবে। আমি আজ থাকি।”

মধ্যবয়স্ক পুরুষেরা চলে গেলেন। থেকে গেল জাহানারা, মল্লিকা ও ছোটোরা। হাসতে হাসতে বারান্দায় গেল তিস্তা। সুমি, তুর ও আরু পেছনের বারান্দা গোছাচ্ছে। তিস্তা ব্যাগ থেকে কিছু গাঁদা ফুল বের করে বিছানার উপরে রাখল। সুমি ভ্রু কুঁচকে বলে, “তিস্তা আপু ফুল পেলেন কোথায়? চাচা তাড়াতাড়ি আসতে বলাতে আমরা ফুল সংগ্রহ করতে পারিনি।”

“দিঘির পাড়ে কয়েকটা গাঁদা ফুল গাছ লাগিয়েছি। আসার সময় হঠাৎ চোখ পড়ল ফুলের দিকে। তাই পরিস্থিতি আন্দাজ করে নিয়ে এলাম।”

অতঃপর চারজনে মিলে হাতে হাতে ফুল দিয়ে ঘর গুছিয়ে ফেলল। খাওয়া-দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে কালাচাঁন ও শেফালীকে বাসর ঘরে নিয়ে এলো। তিয়াস একজোড়া স্বর্ণের আংটি বের করে শেফালীর হাতে দিয়ে বলে, “আজ থেকে তোর জীবন শুরু হয়েছে। অতীত ভুলে গিয়ে কালাচাঁনকে নিয়ে সুখী হ। আমাদের ভাগ্যে যা লেখা আছে, তাকে নিয়েই জীবন সাজাতে হবে।”

শেফালী তাকাল তিয়াসের দিকে। কালাচাঁনের বিচারের দিন তিয়াস শেফালীকে স্বার্থপর বলেছে। এরপর আর কখনো কথা হয়নি। আজ আবার কথা বলেছে। অথচ এই মানুষটাকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে ভালোবেসেছে। অন্যদিকে কালাচাঁন আরুর দিকে তাকিয়ে আছে। মুক্তার মতো দাঁত পানে লাল হয়েছে। ঠোঁটের মাঝ থেকে চুইষে পড়ছে লাল রঙের তরল পদার্থ। এতে আরুকে মোহনীয় লাগছে কালাচাঁনের। এই বাসর সাজানোর কথা ছিল আরুর নামে, অথচ সেখানে শেফালী। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে কালাচাঁন বলে, “আপনারা যেতে পারবেন না-কি আমি দিয়ে আসব?”

“আজ তোমাদের বাসর। নিজেদের সময় দাও। আমরা যেতে পারব।” বিরতি দিয়ে অপূর্ব বলে, “যদি হাত ভেঙে থাকে, তাহলে আমি নিজ দায়িত্বে আমার পরিচিত এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। আর আমরা ভাইবোনেরা তাকে সঙ্গ দেওয়ার পাশাপাশি সেখানে ঘুরেও আসব কয়েকদিন।”

“আচ্ছা ভাইয়া।” কালাচাঁন বলে। অতঃপর সবাই দলবেঁধে বেরিয়ে গেল আহসান বাড়ির উদ্দেশ্যে। দরজার খিল তুলে দিল কালাচাঁন। পরক্ষণে লক্ষ্য করল, তিয়াসের দিয়ে যাওয়া জুয়েলারি বক্সটা মাটিতে পড়ে আংটি দুটো পায়ের কাছে এসেছে গড়িয়ে। মাটিতে বসে অঝোর ধারায় কাঁদছে শেফালী। কালাচাঁন কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার অন্তঃকরণ ক্ষয় হচ্ছে আরুর নামে। পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে কামনা করেছে।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-৪০

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪০

“তোমাদের ঘরে কোনো সন্তান নেই। মায়ের কাছে শুনেছি তোমরা অনেক চেষ্টা করেছিলে। আমি মনোচিকিৎসক হলেও এক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারব। চাচার সাথে কথা বলে পরামর্শ নিতে আমার কাছে দুজনে এসো।” অপূর্বর কথাতে থমথমে পরিবেশ সৃষ্টি হলো। চম্পাকে ধাক্কা দিয়ে মণি বলে, “দেখেছেন মা, আপনার নাতি আমাকে কী বলল? আমি ওর চাচি হই। বয়সে আমি ওর সমবয়সী হলেও সম্পর্কে চাচি। ও কীভাবে এমন কথা আমাকে বলছে?”

“গতকাল আমি তোমাকে বারণ করলাম। আজকেও তুমি এমন কোনো কথা বলেছ নিশ্চয়ই, যাতে অপূর্ব লজ্জাজনক কথা বলেছে। আমার ছেলে ইদানীং ঠোঁট কাটা হয়ে যাচ্ছে। কথা বললে লজ্জা তুমিই পাবে।” এঁটো বাসন একত্রিত হয়ে মল্লিকার হাতে তুলে দিল অনিতা। তখনই সেখানে মিষ্টি নিয়ে উপস্থিত হলো কালাচাঁন। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বড়ো করে সালাম দিল। সালাম বিনিময়ের পর কালাচাঁন ভেতরে এলে মল্লিকা হাত থেকে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে বলে, “এত মিষ্টি আনার কোনো দরকার আছে কালাচাঁন? গতকাল কতগুলো মিষ্টি নিয়ে আসলে।”

“মা পাঠিয়েছে। আমি আজকে আসতে চাইনি, মা জোর করে পাঠিয়েছে।” বলতে বলতে চেয়ার টেনে কালাচাঁন বসতেই আরু উঠে দাঁড়াল। অবাধ্য দৃষ্টি আরুর দিকে পরতেই কালাচাঁন অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আরুর রূপ ক্রমশ প্রকট হওয়াতে সবাই ঘায়েল হচ্ছে, বাদ নেই কালাচাঁন। ঠোঁট চেপে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে টেবিলে তাকাল। শেফালীর সাথে বিয়েতে মত দেয়নি কালাচাঁন, সুন্দরীর কথায় সায় দিয়েছে। ‘আরুর দিকে তাকাবে না’ – এই পণ করে কালাচাঁন এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে পান করে। মল্লিকা জামাতার জন্য খাবার সাজাতে সাজাতে বলে, “বেয়ানকেও আসতে বলতে। কুটুম বলে কথা, তার থাকা প্রয়োজন।”

“আসলে বাড়ি ফাঁকা রেখে মা বের হয় না।”

“এই শেফু, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? জামাইকে নিজের হাতে খেতে দে।” থালা এগিয়ে শেফালীর দিকে দিয়ে বলে মণি। রোষে থালাটা কেড়ে নিয়ে শব্দ তুলে টেবিলের উপরে রাখে শেফালী। আরুর চুলের খোঁপাও খুলে গেল সেই কম্পনে। মল্লিকার হাত ধরে টেনে শেফালী নিয়ে গেল তার ঘরে। দরজাটা বন্দ করে অবাধ্য গলায় বলে, “তোমরা কী চাইছ মা? তোমাকে একটা কথা বলে দিচ্ছি, আমি এই বিয়ে করব না।”

মল্লিকা বলে, “কালাচাঁন আগের থেকে ভালো হয়ে গেছে।”

“তুমি দেখেছ, ও আরুকে এখনো ভালোবাসে। গত পাঁচ বছর ধরে আরুকে ভালোবাসে কালাচাঁন। এক নিমেষে আমার সাথে বিয়ে হয়ে গেলে, তারপরে আমি কি আদৌ ওর সাথে সংসার করতে পারব? ওর মনে আরু চলাচল করবে।” বুকে হাত গুজে বলে শেফালী। নিজের ভালোবাসাকে ভুলে অন্য কাউকে আপন করে নেওয়া সম্ভব নয় শেফালীর। বাম হাত ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে শেফালীকে ধমকায়, “এক চড়ে তোর সব দাঁত আমি খুলে ফেলব। কালাচাঁনের মনে আরু থাকবে, নাকি তোর মনে তিয়াস থাকবে। কী ভেবেছিস, আমি কিছু জানি না! আমি সব জানি।
তোর সাথে আমি অনেকদিন কথা বলিনি এরজন্য। তুই থাকলে তুই, তিয়াস ও সুমি কেউ সুখী হতে পারবি না। তাই কালাচাঁনকে বিয়ে করতেই হবে তোকে, নাহলে আমাকে মা বলে ডাকবি না।”

“মা!” বাক্য স্ফুট করার পূর্বেই শেফালী চোখ রাঙায়, “চুপ! একদম চুপ! ভাইজান আমার থেকে সুযোগ চেয়েছে, আমার বিশ্বাস সে ভুল করবে না। সে এলাকা মেরামত করে দেয়, আমার মেয়ের জীবন মেরামত করতে পারবে না? (থেমে) শোন মা, যাকে চেয়েছিস তাকে পাবি না বলে জীবনটা শেষ করে দেওয়া মহৎ কাজ নয়। তুই আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল। আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে কালাচাঁনকে একটা সুযোগ দে। কালাচাঁন তোর মন ভালো বুঝবে, তুই বুঝবি কালাচাঁনের মন।”
অতঃপর মল্লিকা চলে গেল উঠানে। ইতোমধ্যে আরুকে দেখতে এসেছে গ্ৰামবাসীরা।
__
সকাল পেরিয়ে দুপুর গড়িয়ে এলো। মৃধা বাড়ি থেকে আরুর সাথে দেখা করতে এসেছে আরুর অভিভাবক। অবিলম্বে আরু ছুটে গিয়ে ইমদাদ হোসেনকে জড়িয়ে ধরে। মিষ্টির প্যাকেট ডানহাতে, বামহাতে আরুকে ধরে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “কাঁদছিস কেন? আমরা তো চলে এসেছি। পাগল মেয়ে আমার।”

“বাবার কাছেই যাবি, আবার কাছে আসবি না।” বলেই পারুল কাছে টেনে নিল আরুকে। অয়ন মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপভোগ করছে পরিবেশ। একরাতে বোনকে হারানোর যাতনা অনুভব করেছে বলেই পেছন থেকে আরুকে জড়িয়ে ধরে বলে, “বুবু, আমার খোঁজ করলি না?”

মাকে ছেড়ে আরু হাত বুলিয়ে দিল অয়নের মাথায়। সন্দিহান গলায় বলে “তুই কি আর আমাদের সাথে থাকবি না বুবু?”

“না। যাবো, দুই একদিন থেকে চলে আসব। আমি যাবো না বলে, তুই তো অনেক খুশি হয়েছিস! এখন আর কেউ বাবার নিয়ে আসা খাবারে ভাগ বসাবে না, কেউ তোর যত্ন নেবে না, তোর জন্য দিঘি থেকে পানি তুলে তোকে গোসল করিয়ে দেবে না। এখন পুরো বাড়ি তোর।” আরুর কথায় অয়নের মন ভার হয়ে এসেছে‌। যে মেয়েটার উপস্থিতিতে ঈর্ষা প্রকাশ করত, আজ তার অনুপস্থিতিতে উৎফুল্ল প্রকাশ করার কথা। অথচ অয়নের চোখে পানি। অপূর্বকে হলুদ পাঞ্জাবি পরে উপস্থিত হতে দেখা গেল শ্বশুর শাশুড়িদের সামনে। সালাম বিনিময়ের পর অয়নকে কোলে নিয়ে বলে, “সালা বাবুর কী খবর? আজ বোনের সাথে এত ভাব কেন?”

“ভাইয়া বুবুকে আমি নিয়ে যাই? ও আমাদের সাথে থাকুক।”

“তাহলে আমি থাকব কীভাবে? বিয়ের পর স্বামীর বাড়িই স্ত্রীর বাড়ি। ও গিয়ে দুই একদিন থেকে আসতে পারবে, কিন্তু আজীবন আমার কাছেই ওকে থাকবে হবে।” অপূর্ব বলে থামতেই একদল যুবতি ভেতরে প্রবেশ করে বলে, “তাই বুঝি দুলাভাই? এখনই বউকে ছাড়া থাকতে পারছেন না।”

অপূর্ব মুচকি হেসে বলে, “কেমন আছো তোমরা?”

“ভালো। আপনি কেমন আছেন? আমাদের দেওয়া শর্তের কথা ভুলে গেছেন?”

“শ্যালিকা হচ্ছে আধা ঘরওয়ালী। পাঁচজন শালির আড়াই ঘর আর আরুর একাই এক ঘর। কোনটা বড়?” বলে অপূর্ব মুঠো করে বাকি টাকা দিয়ে দিল। তন্বীরা আরুকে টেনে নিয়ে এলো দোতলায়। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে শেফালী না এলেও বাদ গেল না তুর। আরুকে গোল করে বসে মিতু বলে, “কাল রাতে কী কী হলো?”

তন্বী আগ্রহ প্রকাশ করে, “দেনমোহর পরিশোধ করেছে?”

আড়ষ্ট হয়ে আরু চুপ করে আছে‌। তুর বেজায় বিরক্ত হয়ে বলে, “আমি চেয়েছিলাম, ওদের ঘরে একটা ক্যামেরা ফিট করে রাখতে। কিন্তু একবার ধরা পড়লে জামিন নেই। তাই দুঃসাহসিকার কাজ করিনি।”

আরু চোখ রাঙায়, ‘যার অর্থ অপূর্ব ভাইকে বলে দিবে।’ আঁখি রঙ্গ করে বলে, “আমাদের বোঝার বাকি নেই, তোর ভেজা চুল বলে দিচ্ছে সব। (থেমে) কী কী হয়েছে, না বললে বুঝব কীভাবে?”

আরু উঠে বারান্দার দরজা খুলে দিল। ছয় জনে বারান্দার নীলপদ্ম দেখে ত্বরা হয়ে ছিঁড়তে গেলেই বাদ সাধল আরু। এই পদ্মে কেবল তার অধিকার। বলতে শুরু করল লজ্জায় রাঙানো সেই মুহুর্ত। সব শুনে বিস্মিত যুবতির দল। অপূর্বর প্রেমমূলক বার্তা শুনে অবাক। থমকানো মুখে আঁখি বলে, “তোর জামাই এত রোমান্টিক? আমার ভাগ্যে যেন এমন অপূর্ব জোটে।”

“অপূর্ব আহসান একটাই, সে শুধু আমার। তারমতো কেউ হতে পারবে না।” গর্বে আরুর বুক ফুলে উঠে‌। আরুর কথা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অনিতা শুনে ফেলে। না শোনার ভান ধরে বলে, “তোমরা সবাই এখানে বসে আছো, কষ্ট করে আরুকে হলুদের শাড়িটা পরিয়ে দাও। আমরা হলুদ বাটছি।”

“দিন।” তারপরে সবাই মিলে আরুকে শাড়ি পরাতে ব্যস্ত হলো। আরু খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনে ভাবে সেদিনের কথা। যেদিন ‘অপূর্বর বউয়ের’ ভাগ্য নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেছিল।

চলবে.. ইন শা আল্লাহ

নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-৩৭+৩৮+৩৯

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩৭

“আরুপাখি, আজ নিজের ইচ্ছায় তুই আমার কাছে এসেছিস। আমার গলা জড়িয়ে ধরেছিস। তুই কি সত্যি আমার আরুপাখি?” দুহাত আরুর পিঠে রেখে অপলক দৃষ্টি নিবদ্ধ করে প্রেমময় কণ্ঠে বলে অপূর্ব। আরু আজ লজ্জা পায় না, নিজের দৃষ্টি অপূর্বর চোখে নিবদ্ধ করে বলে, “এই যে আংটি পরিয়ে আপনি আমাকে জীবন সঙ্গিনী হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তাই তীব্র অধিকার বোধ থেকে আপনার সান্নিধ্যে এসেছি।”

“এই কথাটা যাতে আগামী শুক্রবার পর্যন্ত তোর মুখ শুনতে পারি। তখন যাতে তোর মাথা নতজানু হয়ে না যায়।”

“শুক্রবার কী?”

“আনুষ্ঠানিকভাবে তুই চিরতরে অপূর্ব আহসানের হয়ে যাবি।” অপূর্ব ও আরুর এই মধুমাখা মুহুর্তে খলনায়িকা হয়ে প্রবেশ ঘটে তুর ও শেফালীর। দুই মানবের আগমনে তুই তৃষ্ণার্ত কপোত কপোতী বিচ্ছিন্ন হলো। অপূর্ব উঠে পোশাক ঠিক করতে করতে নিজেকে স্বাভাবিক করার প্রয়াস করে বলে, “তোরা এখানে কেন এলি? ডাকলেই তো পারতি।”

“আমাদের আরুর সাথে কথা আছে। বাবা আপনাকে ডাকছে, কিছুক্ষণের ভেতরে আমরা বাড়ির দিকে যাত্রা করব।” নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কথাটা বলে তুর হেলে পড়ে শেফালীর কাঁধে। অপূর্ব দুকদম এগিয়ে বোনদের আড়ালে আরুর হাতে বাটন ফোনটা গুঁজে দেয়। আরু খানিক প্রশ্ন করে, “কী এটা?”

“প্রেম বার্তা পাঠানোর মাধ্যম। সবসময় সাথে সাথে রাখবি, কল করলে যাতে সাথে সাথে পাই। কলে কথা বলতে না পারলে মেসেজ পাঠাবি।” অপূর্ব চঞ্চল পায়ে বেরিয়ে গেল আরুর ঘর থেকে। অপূর্বর অনুপস্থিতে আরুকে ঝোঁকে ধরল দুই বোন।
__
আহসান বাড়িতে লেগেছে বিয়ের আমেজ। নারীরা অপূর্বর জন্য হলুদ মেহেদী বাটছে পাটায়। অপূর্বর পরনে লুঙ্গি ও সেন্টো গেঞ্জি, গলাতে লাল গামছা ঝুলানো। অপূর্ব ঘরের ভেতরে লজ্জানত হয়ে আছে, তাকে পচাচ্ছে তিয়াস। তিস্তা ও সুজন গতকাল রাতে ফিরেছে। বৈঠকখানায় বোনদের আনন্দের ঢেউ উচ্ছে পড়ছে। তখনই পান, সুপারি ও মিষ্টি নিয়ে কালাচাঁন ও তার মা সুন্দরী উপস্থিত হয় আহসান বাড়িতে। আনন্দপূর্ণ লগ্নে কালাচাঁনের আগমনে দফায় দফায় বিরক্ত হয় সদস্যরা। তিস্তা সবাইকে টপকে বলে, “আপনারা আমাদের বাড়িতে কী করছেন? এখানে আমার ভাইয়ের সাথে আরুর বিয়ে হচ্ছে, এই মুহুর্তে আপনারা কোনো ঝামেলা করবেন না।”

“আমরা বিয়েতে ঝামেলা করতে আসিনি, চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে দেখা করতে এসেছি। যদি ওনাকে একটু ডেকে দিতেন।” সুন্দরীর কথায় নিরুপায় হয়ে তিস্তা তার বাবা চাচা ও দাদাকে ডেকে নিয়ে আসে। আনন্দের মাঝে কালাচাঁনদের আপ্যায়নে ত্রুটি রাখা হয় না। সুন্দরী নিজ থেকে ছেলের বিয়ের প্রস্তাব রাখে, “আমার কালাচাঁন আগের থেকে ভালো হয়ে গেছে। এখন তো চাকরি করে কোম্পানিতে। আপনার বাড়ির মেয়ে শেফালীকে সেদিন আমার ভালো লেগেছে। তাই কালাচাঁনের সাথে শেফালীর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছি।”

“অসম্ভব। এমন একটা ছেলের সাথে আমি আমার মেয়েকে বিয়ে দিয়ে ওর জীবনটা ন/ষ্ট করতে পারব না। আমি শেফালীর জন্য রাজপুত্র খুঁজে দিয়ে আসবো।” কথাটা বলে শাহিনুজ্জামান বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। শেফালীর বিয়ের ব্যাপারে উপস্থিত সবাই আপত্তি জানায়। অপূর্ব আগ বাড়িয়ে বলে, “বাবা, চাচা, দাদু। আপনাদের সাথে আমার জরুরি কথা আছে। যদি সময় করে আমার কথাটা শুনতেন।”

“আমিও যেতে চাই।” তিয়াস বলে। বড় ছেলের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে সাতজন মানুষ চলে গেল আলাদা এক কক্ষে। কিছুক্ষণে তাদের আলোচনা সেরে বের হয়ে অনিতাকে উদ্দেশ্য করে বলে, “ওনাদের মিষ্টি দেওয়ার ব্যবস্থা করো। আমি কালাচাঁনের সাথে শেফালীর বিয়েটা মেনে নিয়েছি।”

একমাত্র মেয়ের জীবনের এমন একটি সিদ্ধান্ত শুনে ছুটে এলো মণি। করুন গলায় বলে, “ভাইজান, আমি সবসময় আপনার মতামতকে গুরুত্ব দিয়েছি। আমার বিশ্বাস আপনি কখনো ভুল করতে পারেননা। কিন্তু তাই বলে, আপনি আজ আমার মেয়ের সাথে এই লম্পট ছেলেটার বিয়ে ঠিক করছেন।”

“আমি ভেবেচিন্তে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাকে তোমরা কম বিশ্বাস করোনা, আরেকবার বিশ্বাস করে দেখো। শেফালীর জন্য আমরা কালাচাঁনকে উত্তম বলে মনে করছি।” মোতাহার আহসান মণিকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বললে মণি রাগান্বিত হয়ে বৈঠকখানা ত্যাগ করে। শাহিনুজ্জামান স্ত্রীকে বুঝাতে ছুটে গেল। সময় গড়িয়ে গেলেও, পরিবেশটা ছিমছাম থেকে যায়। খানিকক্ষণ পর মণি ফিরে এসে মেয়ের মাথায় হাত রেখে জানায়, “এই বিয়েতে আমি মত দিলাম। তবে আমার মেয়ের ওপর কোনো নির্যাতন হলে সাথে সাথে শেফালীকে নিয়ে আসবো।”

“ঠিক আছে।”

সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। এখন আকাশ স্বচ্ছ, বর্ষকাল বলে লহমায় লহমায় বৃষ্টিরা নৃত্য পরিবেশন করে উঠানে। আকাশ মেঘের ভেলা সাজিয়ে ফেলেছে দেখে সুজন ছুটে এলো বাইরে থেকে। বাইকে তাড়া দিয়ে বলে, “চাচি বৃষ্টি আসবে, তার আগে অপূর্ব ভাইয়ের হলুদ শেষ করতে হবে। একবার বৃষ্টি শুরু হলে কখন থামবে তার ঠিক নেই।”

সুজনের কথা শুনে মনে পড়ল, অপূর্বর হলুদের কাজ এখনো শেষ হয়নি। বাড়ির প্রতিটি সদস্যকে নিয়ে চলে গেল সাজানো স্টেজে। প্রথম হলুদ ছোঁয়াল মোতাহার আহসান ও অনিতা। তারপরে এক এক করে সবাই ছোঁয়াল। প্রতিটি দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করতে স্টুডিও থেকে লোক ভাড়ায় আনা হয়েছে। গ্ৰাম্য গানের মাধ্যমে অপূর্বর গোসলের কাজ শেষ হলে সুজন তাকে কাঁধে তুলে কলতলায় নিয়ে গেল। বিয়ের হলুদের ছোঁয়ায় অপূর্বর সুশ্রী দ্বিগুণ হয়ে উঠছে ক্রমশ। আরু প্রথম সাক্ষাতে অপূর্বকে গহীন চোখে দেখেছিল, আজ অপলক চেয়ে থাকত।
_
সিঁথি, সাথি, সাবিত ও মেঘলা চাচাতো ভাই বোন ছাড়াও বিয়েতে অংশ নিয়েছে আরুর বিবাহিত বান্ধুবী মিতু ও তন্বী। উপস্থিত সবাই আরুর গায়ে হলুদ ছুঁয়েছে। সবাই একসাথে পানি দিয়ে গোসলের নিয়ম সমাপ্ত করে। হলুদের পর ঘরে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত কাউকে না কাউকে কোলে নিতে হয়। কিন্তু তেমন কাউকে চোখে পড়ছে না পারুলের। ইমদাদ হোসেন মেয়েকে হলুদ দিয়ে রান্নার দিকে গেছেন। পারুলের তখন মনে পড়ল মিহিরের কথা। ভাসুরের ঘরের দিকে পা ফেলতেই নজরে এলো ট্রাভেলিং ব্যাগ নিয়ে বের হয়েছে শিরীনেরা। পারুল তাকে পরিপাটি বেশে দেখে প্রশ্ন করে, “আপা ব্যাগ পত্র নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?”

“আমরা শহরে ফিরে যাচ্ছি। কল এসেছে, জরুরি আমাদের ঢাকাতে যেতে হবে।” শিরীনের একরোখা জবাব।

“আরুর বিয়ের দাওয়াত খেয়ে যাবেন না?”

“না। আমরা আরুর বিয়ে খেতে আসিনি। আমরা যেই কাজে এসেছিলাম, তা যেহুতু হচ্ছে না। তাই ফিরে যাচ্ছি।” বলে রওনা হলেন শিরীন। পারুল তার পথ আটকে দিয়ে অয়নকে পাঠাল ইমদাদ হোসেনকে ডেকে আনতে। বোনের ফেরার কথা শুনে উল্কার বেগে হাজির ইমদাদ। বোনের হাত থেকে ট্রাভেলিং ব্যাগ নিয়ে বলে, “মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোদের? কাল আরুর বিয়ে আর তোরা আজ চলে যাবি?”

“মাথা আমার ঠিকই আছে, আপনার খারাপ হয়েছে। আরুকে আমি মিহিরের জন্য পছন্দ করে রেখেছি আর আপনি অপূর্বর সাথে বিয়ে দিচ্ছেন। এরপরেও আমার এখানে থাকা শোভা পায়?” বলতে বলতে শিরীনের চোখে ধরা দিল পানি। উপস্থিত সবাই থমকে গেছে। ইমদাদ নিজেকে সামলে বলে, “তুই কখনো আমাকে বলিস নি, আরুকে মিহিরের জন্য পছন্দ করেছিস।”

“কাল সকালে আমি আপনাকে আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছি, এরপরেও বোঝানো বাকি থাকে?”

আরু পিঁড়ির উপর থেকে নেমে ছুটে গেল ঘটনাস্থলে। সে মিহিরকে কেবল নিজের ভাইয়ের নজরেই দেখেছে। অপূর্বকে ভেবেছে নিজের অর্ধাঙ্গ। শিরীন পুনরায় বলে, “মিহির আরুকে ভালোবাসে, এজন্য কাজের ফাঁকে ফাঁকে গ্ৰামে আসত আরুকে দেখতে। ছেলেটা আমার ভেঙে পড়েছে। কীভাবে সামলাবো আমি?”

আরু একপা একপা করে এগিয়ে গেল মিহিরের দিকে। অস্ফুট স্বরে বলে, “তুমি আমাকে পছন্দ করতে মিহির ভাই?”

মিহির তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। দুহাতে আরুর দুই বাহু খামচে ধরে হিংস্র হয়ে বলে,

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩৮

“একটা মেয়ে ‘কোন ছেলে দূর থেকে, তাকে কেমন নজরে দেখে’ সব বুঝতে পারে। আমি সবকিছু ফেলে তোর কাছে আসতাম ভালোবাসার টানে। এখন তুই বলছিস তুই আমাকে ভাইয়ের নজরে দেখিস নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করছিস?” আরুর বাহু খামচে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে কথা ব্যক্ত করে মিহির। টুস করে অবাধ্য অশ্রু কণা আরুর চোখ থেকে ঝরে পড়ে‌। আরুর চোখের পানি সহ্য করতে ব্যর্থ হয়ে ছেড়ে দিল মিহির। পারুল আরুকে পিছিয়ে বলে, “এখানে আমাদের কোনো দোষ দেখছি না, সেদিন এসেই আরুর জন্য প্রস্তার দেওয়া উচিত ছিল। আমরা কেউ আরুর বিয়ে অপূর্বর সাথে ঠিক করে রাখিনি। তখন বললে, আরুকে মিহিরের হাতে তুলে দিতাম।”

“না! বিয়ের আসরেও যদি ভাইজান আরুর সাথে অপূর্বর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হতেন। তবে আমি সেই বিয়ে ভেঙে অপূর্বর সাথেই আরুর বিয়ে দিতাম। মোতাহার আহসানের কারণে আমার মেয়ে এখনো শ্বাস নিচ্ছে। তাই তাকে খুশি করা আমার দায়িত্ব।” দৃঢ় গলায় নিজের মতামত জানায় ইমদাদ। অতঃপর ব্যাগটা ফিরিয়ে দিল শিরীনের কাছে। ছেলের মুখে এমন কথা শুনে বলে, “আমি ওকে পেটে ধরেছি নাকি ঐ চম্পা তোকে পেটে ধরেছে? সবসময় তুই আহসান বাড়ির টান টানিস। তোর মেয়ের বিয়েতে আমি থাকব না, ঢাকাতে চলে গেলাম।”

“মা, আরু তোমার নাতনি।”

“যেখানে আমার মতামতের গুরুত্ব নেই, সেই বিয়েতে আমি থাকব না।” বলে মেয়ের সাথে ঢাকাতে যাওয়ার জন্য রওনা হলেন। বিয়ের দিন এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার কারণে মেয়ের উপর ত্রুব্ধ হলেন পারুল। আরুর গাল চেপে ধরে রোষ নিয়ে বলে, “এত সুন্দর কে হতে বলেছে তোকে? তোর জন্য আমাকে যতটা অন্যের কাছে হেয় হতে হয়, অন্যের মেয়ে থাকার পরেও তাদের হতে হয় না।”

ব্যথায় আরুর চোখে পানি চলে এসেছে। ইমদাদ মেয়েকে ছাড়িয়ে উঁচু গলায় বলে, “বিয়ের দিনেও তুমি মেয়েটার গালে হাত দিলে? মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে কী পাও তুমি?”

“ওর জন্য শিরীন আপার সাথে তোমার সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে গেল।”

“আমার বোনের সাথে আমার সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে, তাতে আমার কোনো আফসোস হচ্ছে না। তোমার কেন হচ্ছে?” আঙুল তুলে বলে ইমদাদ। আরু হেঁচকি তুলে কেঁদে চোখমুখে ছাপ ফেলেছে। ভেজা শাড়িটা অঙ্গেঈ শুকিয়ে গেছে। মায়ের প্রতি চরম অভিমান নিয়ে চলে গেল রান্নাঘরে। মাটির উনুন থেকে দুই হাতে কালি তুলে নিজের শরীরে মাখতে থাকে। উপস্থিত সবাই হতভগ্ন হয়ে আরুকে থামাতে ভুলে গেছে। আরু অনবরত বলে যাচ্ছে, “এই বাড়িতে যতক্ষণ থাকব, আমি কালি মেখেই থাকব। সুন্দর হলে সমস্যা, অসুন্দর হলেও সমস্যা।”

তখন সেখানে উপস্থিত হয় আহসান বাড়ির ছোটরা। আরুকে এই অবস্থা দেখে ছুটে আসে তিস্তা। কান্নায় আরেক দফা ভেঙে পড়ে আরু। নয়নাও ধমকালো পারুলকে, “তুই এটা ঠিক করলি পারুল। বিয়ের দিন মেয়ের রূপ সবাই দেখবে, সেখানে তোর জন্য মেয়েটা কালি মেখে বসে আছে‌। কিছুক্ষণ পর মেয়েকে দেখতে আসবে গ্ৰামের লোক, মেয়ের এই অবস্থা দেখলে মন্দ বলবে। বুঝিয়ে শুনিয়ে কলতলায় নিয়ে যা।”

নয়নার কথা মেনে আরুকে ধরে পারুল বলে, “চল গোসল করবি।”

“বলেছি না, এই বাড়িতে এমনই থাকব। হাত ছাড়ো আমার।” আরু প্রবল তেজ নিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিল‌। তিস্তা, তুর ও শেফালী জোরপূর্বক আরুকে ধরে টেনে নিয়ে গেল কলতলায়। ছিটকিনি তুলে দিয়ে তিস্তা বলে, “বিয়ের দিন কেউ এমন কাজ করে?”

“আমি করতে চাইনি, মা করেছে। আমি যখন বিদায় নিয়ে চলে যাবো, একটুকুও কাঁদবো না। কালাচাঁন আমাকে ভালোবাসে তাতে কি আমার দোষ? মিহির ভাই আমাকে ভালোবাসে, তাতে কি আমার দোষ? সবকিছুতে মা আমার দোষ খুঁজে বেড়ায়। তাই রাগে কালি লাগিয়েছি।
__
সকল জল্পনা কল্পনার ইতি টেনে বরবেশে মৃধা বাড়িতে উপস্থিত হলো অপূর্ব। অপূর্বর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে আহসান বাড়ির একদল পুরুষ ও মেয়েরা। সাথী, সিঁথি, আঁখি, তন্বী, মিতু সাবিত ও অয়ন দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। বরযাত্রীদের উপরে কঠোর নিয়ম জারি করে, “চেয়ারম্যান বাড়ির চাঁদের হাট মৃধা বাড়িতে পড়েছে। তবে এক হাজার টাকার কমে কাউকে ভেতরে যেতে দেওয়া হবে না।”

“ভাগ্যিস আমার এমন আয়োজন করে বিয়ে হয়নি, এত আয়োজন করে বিয়ে করলে শালিকা ও শ্যালক বাহিনী সব টাকা হাতিয়ে নিতো।” তিয়াস বলে। উপস্থিত সবাই একটু হাসে। শেফালী ব্যতিব্যস্ত হয়ে তুরের কানে ফিসফিস করে বলে, “আমরা যদি ওদের দলে থাকতাম, তাহলে ভাগ পেতাম।”

“চুপ। ওরা আমার ভাইয়ের টাকা নিয়ে যাচ্ছে আর তুই ভাগ নিয়ে পড়েছিস? কীভাবে টাকা বাঁচাতে পারব, সেটা ভাব।” চোখ পাকিয়ে শেফালীকে উদ্দেশ্য করে বলে তুর। ভাইয়ের টাকা বাঁচাতে পণ করে সবাইকেই ঠেলে সামনে চলে গেল তুর। আচমকা ধাক্কায় শেফালী গিয়ে ধাক্কা খেল কালাচাঁনের সাথে। কালাচাঁন শেফালীকে আঁকড়ে ধরে নিজের সামনে নিয়ে এলো। আরও অনেক পুরুষ এসেছে বরযাত্রী হিসেবে, তাদের স্পর্শ থেকে বাঁচিয়ে সামনে নিয়ে বলে, “এত ছোটাছুটি কেন করো? বিয়ে বাড়ির এই ভিড়ের পড়ে গেলে তোমার হাড়গোড় সব ভেঙে যাবে।”

এই প্রথম কোনো পুরুষ তাকে রক্ষা করল। ঘড়ির কাঁটার মতো টিকটিক করতে করতে শেফালীর মনে শূন্য থেকে একে পৌঁছে যায় ভালোবাসার কাটা। শেফালী সামনে গিয়ে দাঁড়ালে তুর একটু জোর নিয়ে বলে, “এত টাকা দেওয়া যাবে না। তোমরা সাতজন আছিস, আমি পঞ্চাশ করে সাতজনকে তিনশো পঞ্চাশ টাকার সাথে পঞ্চাশ টাকা বেশি দিয়ে তিনশো টাকা দিবো। যদি নিতে চাও, তাহলে এটাই পাবে।”

চাপা অভিমান নিয়ে করুন গলায় আঁখি বলে, “অপূর্ব ভাই, আপনি তো একবারই বিয়ে করবেন। শ্যালক শালিকাদের একবারই খুশি করতেন পারবেন। এক হাজার টাকা দিন না? আরুকে আমরা এত কষ্ট করে সাজিয়েছি, দরজার জন্য না হোক, আরু সাজের জন্য দিন।” এতক্ষণ অপূর্ব রুমাল মুখে নিয়ে একপাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিল। অপূর্বর দূর্বলতা আরুকে নিয়ে আসতেই অপূর্ব বুকের ছাতি ছাপ্পান্ন ইঞ্চি হয়ে উঠল। শেরয়ানির পকেট থেকে পাঁচশো টাকার দশটা নোট বের করে টেবিলের উপরে রেখে বলে, “আমি চেয়ারম্যান বাড়ির বড়ো সন্তান অপূর্ব আহসান। বাবার পরে আমিই ভবিষ্যৎ চেয়ারম্যান। চেয়ারম্যানরা সবসময় মাথা উঁচু করে ঢুকে, তাই ভবিষ্যৎ চেয়ারম্যান অপূর্ব আহসান মাথা উঁচু করে ঢুকবে। (বিরতি টেনে) ভোটটা যাতে আমার নামে যায়।”

অপূর্বর কথায় উৎফুল্ল হয়ে সবাই করতালি দিল। অতঃপর লাল ফিতা কেটে ভেতরে প্রবেশ করে অপূর্ব। তাকে খাওয়ানো হলো শরবত ও মিষ্টি। অতঃপর নিয়ে আসনে বসানো হলো। অপূর্ব যাওয়ার‌ সময় ফিসফিস করে বলে, “আরুর সাজ যদি আমার পছন্দমতো হয়, তাহলে আরও পাবে।”

তুর ছুটে তন্বীর হাত ধরে বলে, “আমাকে ভাগ দিস বান্ধুবী।”

“একদম না, তোকে এক টাকাও দেওয়া হবে না। তুই আমাদের বিপক্ষ দল।” বলে টাকা ভাগ না করে মেয়েরা ছুটে গেল আরুর কাছে। হালকা সাজে মাথায় দোপাট্টা টেনে বসে আছে আরু। পাঁচ কুমারী প্রবেশ করে আরুর মাথা থেকে খুলে ফেলল দোপাট্টা। হালকা সাজটা মুছে ফেলতেই পারুল বাক্য তোলে, “কী করছিস, অনেক কষ্টে ভাবী সাজিয়ে দিয়েছে। মুছে ফেলছিস কেন?”

“কারণ সাজটা সুন্দর না, আমরা পাঁচজনে সাজাচ্ছি।” আঁখি বলে। তারপরে আরুর সাজ ফুটিয়ে তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তারা। ‘তুর ও শেফালী’ আরুর সাথে সাক্ষাৎ করতে এসে, আরুকে সাজাতে দেখে ব্যঙ্গ করে বলে, “দরজা নিয়ে এত মেতেছিলিস যে, আরুকে সাজাতেই পারিস নি?”

“সাজিয়েছিল মা। কিন্তু অপূর্ব ভাই বলেছে আরুকে যদি সুন্দর করে সাজাতে পারি, তাহলে আরও টাকা দিবে। তাই সুন্দর করে সাজাচ্ছি।” সাথীর কথা শুনে সেখান থেকে মন খারাপ করে শেফালীকে নিয়ে চলে গেল তুর। দুই বোনকে খুঁজতে এসে মনমরা হয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এলো তিস্তা। চিন্তিত হয়ে বলে, “তোরা এখানে বসে কী করছিস?”

“কপাল চাপড়াচ্ছি। কনেপক্ষের মেয়েরা আরুকে সাজিয়ে টাকা নিচ্ছে, দরজা ধরে টাকা পাচ্ছে। আমরা যদি সকালে ওদের দলে যেতাম, তাহলে আমরাও পেতাম।” মন খারাপ করে তুর বলে। তুরকে বুকে টেনে তিস্তা বলে, “পাগল বোনরা, এখনো মূল আকর্ষণ বাকি। আমরা বাসর সাজিয়ে অপূর্ব ভাইয়ের থেকে ডাবল আদায় করে নিবো।”

“সত্যি?”

“হম।” তিস্তা শব্দটা উচ্চারণ করার পূর্বেই শেফালীর হাত ধরে তুর ছুটে গেল বাড়ির দিকে। বিভিন্ন ধরনের ফুলের ব্যবস্থা করতে হবে তাদের।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩৮ [বর্ধিতাংশ]

“নীলপদ্ম দেনমোহর হিসেবে ধার্য করিয়া ও নগদ বুঝিয়ে পাইয়া, সুন্দরনগর গ্ৰামের চেয়ারম্যান মোতাহার আহসানের বড়ো ছেলে অপূর্ব আহসান আপনাকে
নিকাহ করিতে আসিয়াছে, বিয়েতে রাজি থাকলে, বলেন মা আলহামদুলিল্লাহ কবুল।” উপস্থিত সবাই আরুর মুখের দিকে তাকালো কবুল শোনার জন্য। আরুর অন্তরে ‘নীলপদ্ম’ শব্দর পুনরাবৃত্তি চলছে। আরু কবুল উচ্চারণ না করাতে পুনরায় হুজুর বলে, “রাজি থাকলে বলুন আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”

নয়না পেছন থেকে আরুকে ঠ্যালা দিয়ে অব্যক্ত স্বরে বলে, “আরু সবাই অপেক্ষা করছে, কবুল বল।”

“আলহামদুলিল্লাহ কবুল!”

“আবার বলুন কবুল।”

“আলহামদুলিল্লাহ কবুল!”

আরও একবার কবুল বলুন।”

“আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”

“আলহামদুলিল্লাহ, আমরা সবাই শুনেছি। আপনারা এখন স্বামী স্ত্রী।” হুজুর বলতেই সেখান থেকে বেরিয়ে গেল বাইরে। অতঃপর ভবিষ্যৎ জীবনের সুখের আশায় নবদম্পতির জন্য দুহাত তুলে দোয়া চাইলো। পারুল আঁচলে মুখ আড়াল করে কেঁদে উঠলে সেই রোল পৌঁছে গেল আরুর কানে। কঠোর আরু উঠল ফুঁপিয়ে। নয়না একটু চাপা গলায় বলে, “পারুল কাঁদছিল কেন? আরু তোর বাপের বাড়িতে গেছে। আরুর যত্নে কোনো ত্রুটি থাকবে না। তুই এক থালা খাবার এনে আরুকে খাইয়ে দে। সকাল থেকে না খাওয়া মেয়েটা, চেয়ারম্যান বাড়ির পুত্রবধূ বলে কথা, আদৌ খেতে পারে কি-না কে জানে।”

নয়না এক থালা খাবার এনে আরুকে দুই লোকমা খাওয়াতে পারে কেবল। খাওয়া দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে অপূর্ব ঘরে প্রবেশ করে। মেয়ে জামাতাকে দোয়া ও দুধ খাইয়ে হাতে তুলে দিল পারুল। চোখের জলে বলে, “আমার একটাই মেয়ে অপু, ওকে ভালো রাখার দায়িত্ব আমি তোকে দিলাম।”

ঝাপসা চোখে সম্মুখে দাঁড়ানো ছেলেটাকে দুই সেকেন্ড দেখে অপূর্বর হাতটা খামচে ধরল আরু। অপূর্বর দিকে একটু সেঁটে যেতেই অপূর্ব লক্ষ্য করে ফিসফিসিয়ে বলে, “কালাচাঁনকে‌ দেখে ভয় পাওয়া কিছু হয়নি, ও আহসান বাড়ির হবু জামাতা।”

“মানে?”

“মানে শেফালীর সাথে কালাচাঁনের বিয়ে ঠিক হয়েছে। বাড়িতে গিয়ে সময় করে সব বলব।” রুমালে অধর আড়াল করে বলে অপূর্ব। নাছোড়বান্দা আরু তবুও প্রশ্ন করে, “তাহলে আমি কিছু জানি না কেন?”

“ফুফুও জানে না। আজ সকালে হয়েছে। এই পরিস্থিতির ভেতরে কাউকে বলেনি বাবা। আমাদের বিয়ের পর্ব শেষ করে সবাইকে বলবে।” অপূর্ব নতজানু হয়ে বাক্য তোলে। বর্ষাকাল বিধায় মেঘে ঢেকে এলো স্বচ্ছ অন্তরিক্ষ। বাড়ি যাওয়া নিয়ে মোতাহার আহসান তাড়া দিতেই কেঁদে উঠল পারুল, ইমদাদ। আজকে বোনকে হারানোর কষ্ট অনুভব করে বাদ গেল না অয়ন। অপূর্ব আরুকে পাঁজাকোলা করে ঘরে থেকে নামাতেই বড়ো বড়ো কয়েকটা বৃষ্টি পতিত হওয়ার পাশাপাশি ধরা দিল সূর্যের তেজহীন ছবি। অপূর্ব তার গন্তব্যে আরুকে নামাতে আরু লক্ষ্য করল টাইসনকে। সোনালী রঙের ঘোড়াটা নতজানু হতে, অপূর্ব উঠে বসল তাতে। আরু কান্নায় ইতি ঘটিয়ে বলে, “অপূর্ব ভাই, আপনি ঘোড়ায় চড়ে এখানে এসেছেন?”

উপস্থিত সবাই হাসল, অপূর্ব পেল খানিক লজ্জা। তিস্তা নিকটে এসে বলে, “অপূর্ব ভাই এখন তোর স্বামী। স্বামীকে কেউ ভাই বলে সম্বোধন করে? নিজেকে হাসির পাত্র বানাচ্ছিস কেন?”

আরু আড়ষ্ট হয়ে যেতেই অপূর্ব হাত বাড়িয়ে দিল। সেই হাতে নিজের হাত স্পর্শ করতেই চকিতে অপূর্ব তাকে সামনে উঠিয়ে নিল। ঘোড়ার ঘাড় ছুঁয়ে আদর করতেই তার পোষ্য ময়নাপাখির কথা মনে পড়ল। তিন ছানাকে নিয়ে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে এসে বলে, “আরুপাখি আর আসবে না, আর আসবে না, আর আসবে না।”

“মা, ওমা। আমি ময়নাপাখিদের নিয়ে যাই?” বাবার বিটা ত্যাগ করার আগে আরু বলে। মেয়ের কথা রাখতে খাঁচা এনে, তিন ময়নাপাখি ধরে ভেতরে ঢুকালো। তারপরে তুলে দিল তিস্তার হাতে। আরুর মুখে হাসি ফুটতে অপূর্ব টাইসনকে আদেশ দেয়, “চল টাইসন। বাড়ির পথে ফিরে চল।”

টাইসন দুপায়ে ভর দিয়ে ডেকে টগবগ টগবগ করে ছুটে চলল। আশেপাশের জনগণ অবাক নয়নে দেখছে ওদের। আরু তার মাথা অপূর্বর বুকে হেলে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বলে, “আমার রাজকুমার সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে এসেছে, আমাকে পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়িয়ে রানী করে নিয়ে যাচ্ছে তার রাজ্যে।”
_
অনিতা বরন করা শেষ করে আরু ও অপূর্বকে ঘরে তোলার অনুমতি দিয়েছে। দুপা ফেলতেই আরুর নজরে এলো ফুল। অপূর্ব ফুলগুলো কুড়িয়ে আরুর শাড়িতে দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। আরুকে বসানো হলো বৈঠকখানায়, আহসান বাড়ির উত্তরসূরী বলে আরুকে দেখতে ভিড় করেছে গ্ৰামবাসীরা। অপূর্ব ততক্ষণে শেরয়ানি ছেড়ে পরিধান করেছে সাধারণ টিশার্ট ও লুঙ্গি। অপূর্বকে এমন রূপে দেখে অনিতা রাগান্বিত হয়ে বলেন, “বরবধূকে একসাথে দেখতে এসেছে গ্ৰামবাসীরা, আর তুই শেরয়ানি খুলে ফেলেছিস?”

“শরীর চুলকাচ্ছে, এই ভিড়ের ভেতরে আমি থাকতে পারব না। মনে হয় গায়ের ভেতরে লেপটে যাচ্ছে মানুষ।” বলতে বলতে লম্বা টিশার্টের হাতা গুটিয়েছে অপূর্ব‌। মল্লিকার বয়স অপরিপক্ক, রঙ্গ করে বলেই ফেলে, “কিছুক্ষণ পর বউকে তো ঠিকই লেপটে রাখতে পারবে। তখন শরীর চুলকাবে না, মনে হবে আরু চুলকানির ওষুধ।”

“এত ঘটা করে বিয়ে করেছি, বউকে বুকের সাথে লেপটে রাখতে। সহ্য নাহলেও আজকে লেপটে রাখতেই হবে‌, ওয়েডিং ফাস্ট নাইট বলে কথা। তাছাড়া বয়স তেত্রিশ, এখন না লেপটালে কবে লেপটাবো?” বলে কারো মুখের দিকে না তাকিয়ে ধপাধপ পা ফেলে অপূর্ব বাইরে চলে গেল। ছেলের মুখে প্রথমবার লাগামহীন কথা শুনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল সবাই। অনিতা কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলে, “ও বিদেশে বড় হয়েছে, এগুলো সেখানকার কমন কথা। তাই বলে মায়ের সামনে..!”

আঁচলে মুখ আড়াল করে সেখান থেকে চলে গেল অনিতা।
_
গতমাসে অপূর্বর জন্য দোতলা ঠিক করেছে। ঘরের সামনে খোলা এক বারান্দা। বিভিন্ন প্রজাতির ফুলে সাজানো হচ্ছে পালঙ্ক। অনিতা বিয়ের ভারী বেনারসি পালটে সুতি শাড়ি পরতে আরুকে পাঠিয়ে দিয়েছে অপূর্বর ঘরে। ট্রাভেলিং ব্যাগ খুলে তিস্তা আরুর জন্য লাল শাড়ি বের করতেই আরু বলে, “অপূর্ব ভাইয়ের আলমারিতে একটা বেনারসি আছে। ওটা বের করে দাও, আমি পরব।”

তুর আলমারি থেকে বেনারসিটা বের করে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে তিস্তা ও সুমিকে দেখালো। তিস্তা চট করে বলে ফেলে, “এই বেনারসিটা তো বিয়েতে কেনা হয়নি। এটা এখানে এলো কীভাবে?”

“ভাবীর জন্য বিয়ের সরঞ্জাম কেনার সময় এটা ভালো লেগেছে, এজন্য অপূর্ব ভাই আলাদা করে কিনে রেখেছেন।”

“এখনও তুই অপূর্ব ভাইকে ভাইয়া বলে ডাকবি। তখন না তোকে বারণ করলাম। ওগো বলবি।” চোখ পাকিয়ে বলে তিস্তা। অপূর্বর থেকে ভাই শব্দটা কীভাবে সরাবে? অপূর্বকে আদৌ ওগো বলা যায়? আড়ষ্ট হয়ে বলে, “আমার লজ্জা করে।”

“সমস্যা নেই, আজকে রাতের পর সব লজ্জা চলে যাবে। অপূর্ব ভাই তোমাকে সাহায্য করবে। এবার এসো তোমাকে শাড়ি পরিয়ে দেই।” কথাটা বলে সুমি আরুকে শাড়ি পরাতে ব্যস্ত হলো। দীর্ঘক্ষণ পর আরুকে বেনারসি পরিয়ে ফুলের রানী সাজাতে উঠে পড়ে লাগল সকলে। ঘড়ির কাঁটা এগারোটা দশে পৌঁছাতেই অপূর্ব দরজার কাছে এসে কড়া নেড়ে উঠে। গলা খাঁকারি দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানাতেই মেয়ের দলেরা আটকে দাঁড়াল অপূর্বর পথ। তিয়াস তিস্তাদের দলে থাকলেও সুজন নিজের মত বদলে অপূর্বর পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। তিস্তা রেগে বলে, “তুমি স্ত্রী রেখে শ্যালকের কাছে কেন গেলে?”

“কারণ শ্যালক দুলাভাই ভাই ভাই। এক টাকাও দেব না।” দৃঢ় ভঙ্গিতে বলে।

চোখ রাঙায় সুজনকে, “তোমাকে পরে দেখছি। (থেমে) দশ হাজার টাকা দিতেই হবে। নাহলে আজকে রাতে বউয়ের কাছে থাকার কথা ভুলে যান এবং আমরা এখান থেকে সরব না।”

অপূর্বর সুদর্শন দেহে প্রবল তেজ। এক ধাক্কায় সবাইকে ফেলে আরুর কাছে গিয়ে বসল। আরুর ঘোমটায় হাত রাখতে রাখতে বলে, “ভাইয়ের বাসরে থাকার ইচ্ছে থাকলে থাকতে পারিস।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩৯

“ভাইয়ের বাসরে থাকার ইচ্ছে থাকলে থাকতে পারিস।” চোখ টিপে খানিক রঙ্গ করে ভাইবোনদের উদ্দেশ্যে কথাটা বলে অপূর্ব। আরু আড়ষ্ট হয়ে আঁচলটা খামচে ধরতেই সুজন উচ্চ স্বরে হেসে উঠে। তিস্তা ললাটে ঈষৎ রাগ ঝুলিয়ে বলে, “এটা আপনি ঠিক করলেন না ভাই। আমরা এত কষ্টে আপনার বাসর সাজালাম, বউ সাজালাম‌। আপনি আমাদের সাথে অন্যায় করলেন।”

ভাইবোনদের দল অভিমানে ঘর ত্যাগ করার প্রয়াস করতেই অপূর্ব দূরত্ব রাখল আরুর থেকে। টেবিলের ছোটো ড্রয়ার থেকে শ্বেত খাম বের করে। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, “তোরা সবাই আমার ছোটো ভাই-বোন। তোরা যদি আমার বাসর নাও সাজাতিস, তবুও এটা পেতিস।”

ভাইবোন মহলে আনন্দের আমেজ তৈরি হলো। দ্রুত খাম ছিঁড়ে টাকাগুলো বের করে গুনলে হদিস পেল, বারো হাজার টাকার। অবিলম্বে সবার মুখে হাসি ফুটল। অপূর্ব বুকে হাত গুজে খুঁটির সাথে হেলান দিয়ে বলে, “খুশি হলেই চলবে না, আগামীকাল আরেকদফা লোকজন আসবে আরুকে দেখতে। তখন ওদের হাত থেকে আরুকে বাঁচাতে হবে।”

“আগ্গে মহারাজ।” বলেই সবাই হৈচৈ করতে করতে বিদায় নিল সেখান থেকে। অপূর্ব দরজার ছিটকিনি তুলে ঘোমটা টানা আরুর পানে দৃষ্টি মেলাতেই আরু নামল বিছানা থেকে। অপূর্বর মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে ঝুঁকল পায়ের কাছে‌। পা ছুঁয়ে সালাম করতেই অপূর্ব আরুর মাথায় হাত রেখে বলে, “স্বামী সোহাগী হও বধূ। আদরে আদরে ভরে উঠুক তোমার আমার সংসার।”

মৃদু ঝুঁলে আরুকে পাঁজাকোলা করে নিল অপূর্ব। অমনি ঘোমটা খুলে পড়ল মাথা থেকে, ছড়িয়ে পড়ল রজনীগন্ধার সুবাস। স্বচ্ছ আকশে হুট করে বাজ পড়ল অদূরে। অপ্রত্যশিত সময়ে আরুর ত্রাস হুরহুর করে বেড়ে আবদ্ধ করে নিল অপূর্বকে। অপূর্ব এক নাগাড়ে আরুর মুখপানে চেয়ে আছে। আরুর মাত্রারিক্ত ফর্সা মুখটা আঁধারেও অপূর্ব দেখতে পাচ্ছে। অপূর্ব এগিয়ে গেল খোলা বারান্দায়। এক দমটা হাওয়া লোমকূপ পর্যন্ত কাঁপিয়ে তুলল দুজনের। আকাশ ক্ষণে ক্ষণে গর্জে উঠছে। অপূর্ব হেঁটে টুলের উপর বসে আরুকে নিয়ে, তখনই শুরু হলো ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ধারা। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি করতলে লাগাতেই অপূর্ব তার হাত আরুর হাতের নিচ দিয়ে রাখল। আরু মিষ্টি হেসে অপূর্বর বুকে মাথা হেলিয়ে দিয়ে বলে, “আপনাকে আমি প্রথম ঐ দিঘির পাড়ে রোদ পোহানো অবস্থায় দেখেছি। আপনি জানেন, আমি আপনার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাঁটতে গিয়ে রাজহাঁসের বাচ্চাকে আঘাত করেছিলাম। আপনার গায়ের রঙটা কম ফর্সা নয়, এমন সুদর্শন পুরুষ আমি দেখিনি।”

অপূর্ব হিম হাতটা এনে আরুর নগ্ন পেটে রাখলে আরুও ধরল অপূর্বর হাত। সরে আসার প্রচেষ্ট করতেই অপূর্ব ফিসফিস করে বলে, “তুমি সেই নারী, যাতে প্রথম দেখে আমার হৃদস্পন্দন থেমে গিয়েছিল। মা তোমার ছবি পাঠিয়েছিল, সেই ছবি দেখেই আমি তোমার প্রতি মুগ্ধ হয়েছিলাম। দেশে এসে তোমাকে দেখে আমি হতাশ হয়েছিল, বয়সটা কম। কিন্তু বয়স কোনো বিষয় নয়। আমার বয়স বেশি হলেও আমৃত্যু পর্যন্ত তোমাকে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখব।”

আরুর চোখ আঁটকে গেল বারান্দার এক কোণে।‌ বড়ো একটা পাত্রে ফুটে আছে নীলপদ্ম। আরু নীলপদ্ম ছুড়ে বলে, “আমি কখনো নীলপদ্ম দেখেনি অপূর্ব ভাই। আপনি এই পদ্ম কীভাবে পেলেন, তাও আবার বারান্দায়?”

“বিদেশ থেকে বীচ নিয়ে এসেছিলাম। বর্ষার সূচনা হতেই বপন করেছিলাম। এখন বারান্দায় এনে রেখেছি। এটাই আমাদের বিয়ের মোহরানা।”

“কবে বপন করেছেন? এতদিন দেখেনি তো।” আরুর সন্দিহান গলা। অপূর্ব উঠে ঘরে চলে গেল। নীলপদ্মের মালাটা এনে আরুর গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে বলে, “আমি ছাড়া কেউ দেখেনি এতদিন, আজ তুই দেখলি।”

নীলপদ্মের সাথে অপূর্বর পছন্দ করা বেনারসিতে আরুর রূপ উতলে উঠছে। বৃষ্টির আঁচ ক্রমশ বেড়ে চলেছে, অপূর্ব সময় নষ্ট না করে আরুকে পুনরায় কোলে তুলে ঘরে ফিরে এলো। বিছানায় রেখে বাতির সুইচ বন্ধ করে পরনের টি শার্ট খুলে আলমারির উপরে রেখে দিল। প্রকট হলো আরুর প্রিয় ভাঁজ কাটা দেহ। অপূর্ব এগিয়ে আসলে হাতটা আবেগ নিয়ে বুকে রেখে তাকিয়ে রইল আরু। বিরতিহীন দৃষ্টিকে অবরোধ করতে চুলের ভাঁজে হাত রেখে আরুর অধরে অধর মিলিত করল। সূচনা হলো মধুর মুহূর্তের। মাথাটা হেলে ঝুলন্ত গাঁদাফুলের মালাটা ধরতেই ছিঁড়ে গেল তা। অপূর্বর থেকে ছাড়া পেতেই আরু ফ্যাকাসে মুখে বলে, “আহ্! ছিঁড়ে গেছে।”

“কিছুক্ষণ পর সবগুলোই ছিঁড়ে যাবে।” গভীর দৃষ্টিতে তাকাতেই লজ্জানত আরু বলে, “কেন ছিঁড়ে যাবে?”

“সেদিন তুই যেই ক্যাসেটটা দেখতে চেয়েছিলি, এখন সেটা দেখলে বুঝতে পারবি।” বলতে বলতে অপূর্ব গাঁদা ফুলের পাপড়িগুলো আরুর উপরে ফেলতে থাকল।
__
গতরাতের বৃষ্টির পর আকাশ আজ স্বচ্ছ। বহু প্রতিক্ষার পর অপূর্বর বুকের সাথে লেপটে বিড়াল ছানার ন্যায় ঘুমিয়ে আছে আরু। প্রথম সুখ নিয়ে অপূর্ব চোখ মেলে তাকিয়ে আরুকে থেকে একটু চমকে উঠে। পরক্ষণে গতরাতের দৃশ্য মস্তিস্ক গোচর হতেই অপূর্ব হাসে। আরুকে দৃঢ় করে জড়িয়ে ধরে কপালে এঁকে দেয় ভালোবাসার পরশ। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আরুকে সরিয়ে উঠে যায়। ভালোভাবে কাঁথাটা প্যাঁচিয়ে শুভ্র টিশার্ট ও ট্রাইজার নিয়ে বের হলো কলতলার উদ্দেশ্যে। গোসল সেরে আরুকে তেমনই ঘুমাতে দেখে মুচকি হেসে বারান্দায় মেলে দিল পোশাক। সমস্ত ঘরের ফুলগুলো একপাশে জড় করে গুছিয়ে নিল ঘর। আলমারি থেকে জুয়েলারি বক্স বের করে আরুর ব্যবহৃত রূপার অলংকার খুলে স্বর্ণের অলংকার পরিয়ে দিল। রূপারটা রইল বাবার বাড়ির সম্পদ হিসেবে। অপূর্বর স্পর্শে চোখ মেলে তাকায় আরু। অপূর্বকে দেখে তড়িগড়ি করে উঠে বলে, “আপনি?”

পরক্ষণে দমে গিয়ে বলে, “আমাদের তো বিয়ে হয়ে গেছে।”

“তাড়াতাড়ি ওঠ। গোসল করে নাস্তা করতে হবে।”

“হুঁ।” আড়মোড়া ভেঙে আরু উঠে বসে। হালকা গোলাপি রঙের শাড়িটা নিয়ে চলে গেল কলতলায়। অপূর্ব তৈরি হয়ে ডাইনিংয়ে বসেছে। পুরুষরা খেয়ে উঠতেই অপূর্ব তার বোনদের নিয়ে বসে। আরু ফিরে আসে তখন। গোসলের সময় শাড়ির অনেকটা ভিজিয়ে ফেলেছে। চেয়ার টেনে বসতেই অপূর্ব খাওয়া রেখে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। থমথমে গলায় বলে, “পরে খা, রান্নাঘরে কী লাগবে দেখ। কাজে সাহায্য কর।”

“আজকে কাজ করতে হবে না। আজকে তোর সাথে খাবার খাক।” অনিতা গরুর গোশতের বাটিটা টেবিলে রেখে বলে। অপূর্ব তবুও নাকচ করে, “ও তোমার পুত্রবধূ মা। ওকে গড়ে নেওয়ার দায়িত্ব তোমার। তোমাদের পর ও এই বাড়ির বড় বউ। ওকে প্রথম থেকে তোমার মতো তৈরি করতে হবে।”

অপূর্ব লক্ষ্য করে আরুর মাথার ঘোমটা পড়ে গেছে। অপূর্ব আঁচলটা মাথায় তুলে দিয়ে বলে, “আমার মায়ের একটাই ছেলে। মায়ের কথার অবাধ্য হবি না। কেমন?”

“হুঁ।”মাথা নিচু করে অপূর্বর কথার সায় দিল। আরু বুঝে গেছে এই আঁচল কখনো মাথা থেকে ফেলতে পারবে না। অনিতা আরুকে টেনে চেয়ারে বসিয়ে বলে, “আজকে আরুর শাশুড়ি আরুকে ছুটি দিল। আরু খেতে বস।”

অনিতা গেল রান্নাঘরে। তখনই হাসতে হাসতে সেখানে এসে উপস্থিত হয় চম্পা। মজার ছলে বলে, “অপূর্ব, তুই কিন্তু বড়ো নাতি। তিয়াসের আগে আমাকে তুই পুঁতি উপহার দিবি।”

মল্লিকা বলে, “আমাদের অপূর্ব সবসময় ফাস্ট হয়। আমাদের বিশ্বাস আছে, ও ফাস্ট হবে। দেখছেন না, প্রথম দিনেই আরুকে স্বর্ণে মুড়িয়ে ফেলেছে। ওর থেকে চোখ ফেরানো যায় না।”

সুমি তাল মেলায়, “তা আর বলতে? অসম্ভব সুন্দর লাগছে কিন্তু আরুকে।”

আরু হাতের ও গলায় তাকিয়ে স্বর্ণের হদিস পায়। তবে কান ও নাক দেখতে পারে না। খাওয়া শেষে ঘরে গিয়ে নতুন আরুকে দেখবে।
অপূর্ব হাসতে হাসতে নাস্তা করে‌। মল্লিকা সেজো বউ, অনেকবার সন্তান নেওয়ার চেষ্টা করেও তার ঘর আলো করে কোনো সন্তান আসেনি। তাই বাকি ছেলেমেয়েদের নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসে। অপূর্ব খাওয়া শেষ করে রঙ্গ করে বলে, “তোমাদের ঘরে কোনো সন্তান নেই। মায়ের কাজে শুনেছি তোমরা অনেক চেষ্টা করেছিলে। আমি মনোচিকিৎসক হলেও এক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারব। চাচার সাথে কথা বলে পরামর্শ নিতে আমার কাছে দুজনে এসো।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-৩৪+৩৫+৩৬

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩৪

“আপনার উচিত ছিল, ছেলেকে পেয়ে উপস্থিত সবার মাঝে ঠাস ঠাস করে চ/ড় বসিয়ে দেওয়া। আপনি উলটো ছেলের নামে সাফাই গাইছেন। আমাদের বাড়ির মেয়েকে আপনার ছেলের বউ করতে উঠে পড়ে লেগেছেন।” চোখ রাঙিয়ে কথাটা বলে অনিতা। সুন্দরী চেয়ারম্যান সাহেবের স্ত্রী বলে দ্বিরুক্তি করার সাহস সে খুঁজে পেল না। তবুও ছেলেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে বাক্য করে, “আমার স্বামী আজ নয় বছর হয়েছে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। কালাচাঁন ব্যতিত আমার কোনো সন্তান নেই। একমাত্র ছেলেকে হারালে আমি নিঃস্ব হয়ে যাবো। তাই লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে ছেলের নামে সাফাই গাইছি। (বিরতি দিয়ে) আমার ছেলে আরুকে অনেক ভালোবাসে। আপনাদের আরুকে আমার ছেলের বউ হিসেবে স্বীকৃতি দিবো।”

সুন্দরীর কথায় আরুর মনে ভয়ের সৃষ্টি হলো। বসা থেকে উঠে ঘরের ভেতরে পা ফেলার চেষ্টা করতে থাকল। তবে তার প্রয়াসকে হাতে ঠেলে অপূর্ব ধরে ফেলল আরুর উষ্ণ হাত। চোখে চোখ স্থায়ী করে সৌজন্য হাসির রেখা ফুটিয়ে আরুর অস্থির দূর করল। মুখে প্রকাশ করে, “একপা এখান থেকে যাবি না আরু। কালাচাঁন তোকে ডিজার্ভ করেনা। বিয়ে তো দূরের ব্যাপার। ওর মুখের দিকে তাকালে তুই ভয় পাস? ও কে? কেন ওকে তোর ভয় পেতে হবে?”

“শুনলেন না, তিনি কী বলল? আমাকে তার ছেলের বউ করে নিয়ে যাবে‌।” আরু জড়তা নিয়ে বলে। পারুল আগ বাড়িয়ে বলে, “ভাইজান, আপনি কিছুতেই এই কালাচাঁনের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে ঠিক করবেন না। যে ছেলের মায়ের কোল খালি করে সন্তানকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মা/র)তে চায়। সে ছেলের হাতে আমি আমার মেয়েকে তুলে দিবো না। (থেমে) ও একটা উন্মাদ। বিয়ে পর আমার মেয়ের সাথে ঝগড়া বাঁধলে যদি আরু কথা বলা বন্ধ করে দেয়, তাহলে আরুর গলা কা/ট/তেও ওর সেকেন্ড খানেক সময় লাগবে না।”

বলেই আঁচলে মুখ আড়াল করে কেঁদে উঠে। মোতাহার আহসান দিশেহারা হয়ে উঠল বোনের কান্নায়। বিরাগী হয়ে বলে, “আমি কি একবারও বলেছি ওর সাথে আরুর বিয়ে দিবো? বিয়েতে দুটো মনের পাশাপাশি দুটো পরিবারের মিলের প্রয়োজন। কালাচাঁনের সাথে আরুর মনের কোনো মিল নেই। তাছাড়া একপক্ষিক ভালোবাসা মেনে বখাটে কালাচাঁনের সাথে বিয়ে দেওয়া হলে, বখাটেরা এখন থেকে এই বুদ্ধি অবলম্বন করে গ্ৰামের রূপবতী মেয়েদের বিয়ে করবে।”

সন্তুষ্ট প্রকাশ করে সবাই। মোতাহার আহসানের কথায় সায় দিয়ে তার প্রহরীরা এগিয়ে গেল কালাচাঁনের কাছে। পাঁচটা বেত একত্রিত করে বাধা রাবার দিয়ে। তারপরে প্রহরীরা শুরু করে নির্যাতন। তিনজন প্রহরী একশো একটা আঘাতের পর থামল। কালাচাঁন যাতনায় শব্দ করে কেঁদে চলেছে। ক্রন্দনরত অবস্থায় বলে, “গোলাপী, আমি তোমাকে ভালোবাসি। ভালোবাসা কোনো অন্যায় নয় যে, এভাবে আমাকে শাস্তি পেতে হবে। আমি সবার সামনে বাজি ধরে বলতে পারি, আমার চেয়ে তোমাকে এত ভালো কেউ বাসতে পারবে না।”

“ভালোবাসা মানে ভালো থাকার একটা সন্ধান। যার সাথে আজীবন সুখে থাকা যায়। কিন্তু আপনি যেটা করেছেন, সেটা আজীবন ওকে দুঃখে রাখার ব্যবস্থা। অকালে ওর জীবনটা হারিয়ে ফেলা।” ভাঙা গলায় অপূর্ব বলে। ডাহুক পাখিরা তখন এসে উঠানে ডেকে চলেছে ঝাঁক বেঁধে। প্রাহরীরা তার কাজে ব্যস্ত। ছেঁড়া জুতা একত্রিত করে মালা তৈরি করছে। তাদের কাজ সমাপ্ত হতেই কালাচাঁনের গলায় পরিয়ে দিল। গাছ থেকে দড়ি খুলে যখন সেখান থেকে কালাচাঁনকে গ্ৰাম থেকে বের করে দেওয়ার প্রয়াস করে তখন সেখানে হন্তদন্ত হয়ে উপস্থিত হয় শেফালী। অসুস্থ ও ক্লান্ত শরীর নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, “আপনারা কেন ওনাকে গ্ৰাম থেকে বের করে দিচ্ছেন? ভালোবাসার জন্য মানুষ কত কিছু করেছে, কালাচাঁন শুধু তার ভালোবাসা প্রমাণ করতে চেয়েছে।”

শেফালীর কথাকে উটকো ঝামেলা বলে উড়িয়ে দিল অনেকে। মণি মেয়ের হাত ধরে নত অথচ ঝাঁজালো গলায় বলে, “এক চড়ে তোর সব দাঁত ফেলে দিবো। যে মেয়েটার জন্য তুই আজ আমাদের মাঝে বেঁচে আছিস। সেই মেয়েটা তোর জন্য বিপদে পড়েছে। একটা ছেলে ওকে মারতে চেয়েছিল আর তুই তার হয়ে সাফাই গাইছিস? ঘরে যা।”

“ওকে অনেক শাস্তি দেওয়া হয়েছে মা। ওকে দয়া করে গ্ৰাম ছাড়া করতে বারণ করো।”

“কালাচাঁন আরুকে গলায় কলস বেঁধে মারতে চেয়েছিল। বড়মিয়া যে কালাচাঁনকে চুবিয়ে মারার নির্দেশ দেয়নি, এটা কম নয়?” মণির জোরাজুরিতে শেফালী বাধা দেয়। মণির হাত ছাড়িয়ে আরুর কাছে ছুটে যায়। আরুর দুহাত ধরে মিনতি করে বলে, “আরু, তুই অন্তত ওর মনের কষ্টটা বোঝার চেষ্টা কর। তুই তো একজনকে ভালোবাসিস। তাকে না পেলে তোর মনের অবস্থা কেমন হবে? (উদাসীন হয়ে) আমাকে দেখ, তুই জানিস আমি কেন বি/ষ খেয়েছিলাম। ভালোবাসার উর্ধ্বে কিছু নয়।”

আরুর চোখের তারায় ভেসে উঠল কালাচাঁনের সাথে কাটানো সময়গুলো। কোনো এক অদৃশ্য টানে সে সায় দিল শেফালীর সাথে। দৃঢ় এক মনোবল নিয়ে মোতাহার আহসানের কাছে মিনতি করে, “মামা, ওনার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। আপনি ওনাকে ছেড়ে দিন।”

আরু কালাচাঁনের দিকে তাকালে তার গভীর দৃষ্টিকে উপেক্ষা করতে পারেনা। জ্বরের মাত্রা হু হু করে বেড়ে আরু ঢলে পড়ে ঘটনাস্থলে। আরুকে আগলে নিয়ে অপূর্ব বলে, “বাবা, আপনি যা ভালো বুঝেন, তাই করুন।”

অতঃপর আরুকে পাঁজাকোলা করে অপূর্ব ঘরে চলে গেল। আরুর মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে মোতাহার আহসান বিচার কার্য সমাপ্ত করে উঠে দাঁড়ালেন।
__
ভিড় ধীরে ধীরে ছেড়ে যাচ্ছে চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে। পারুল ভিড় ঠেলে ঘরে যেতে পারছে না। হঠাৎ সে শুনতে পেল এক মধ্যবয়স্ক লোক বলছে, “মেয়েটাকে ছেলেটা নিয়ে একদিন বন্দিনি করেছে। একদিন কম সময় নয়। মেয়ে আর কুমারী নেই। এই বয়সে এই জোর সহ্য করতে পারেনি। তাই ব্যথায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে ঘনঘন।”

“আমার কিন্তু অন্য কিছু মনে হচ্ছে ভাইজান। আমার মনে হচ্ছে, মেয়েটা পোয়াতি হয়েছে। চেয়ারম্যান সাহেব এখন কার কাছে বিয়ে দিবে মেয়েটাকে?” আরেকজন বলে। তার‌ প্রশ্নের জবাবে পূর্বের লোক বলে, “অনেকে আছে। চেয়ারম্যান সাহেব লুকিয়ে অনেক জমিজমা দিয়ে ভাগ্নিকে বিয়ে দিবে। লোভে সবাই মেয়েকে বিয়ে করবে। তবে যা হলো খারাপ হলো।”

“এজন্য বেশি সুন্দর হতে নেই। ছেলেদের নজর লাগে। আগে তো তানাদের নজর লেগেছিল। ভালো কথা ভাইজান, মেয়েটা না-কি অসুস্থ শরীর নিয়ে অনেকক্ষণ পানিতে ছিল। বেঁচে আছে কীভাবে?”

“তানাদের জন্য। তারা পানির অনেক গভীরে যেয়ে ফিরে আসতে পারে। তবে আরও দেরি হলে বাঁচানো যেত না। চলো সবাই। ক্ষেতে যেতে হবে।” বলেই সবাই চলে গেল। গ্ৰামবাসীদের কথায় পারুল নিজেও সন্দিহান হলো। দৌড়ে চলে গেল ঘরে। চেতনাহীন আরুকে তখন বৈঠকখানার চৌকিতে রেখেছে। মেয়ের রুগ্‌ণ মুখের পানে চেয়ে অনিতাকে জড়িয়ে ধরে ক্রন্দনরত অবস্থায় বলে, “ভাবী, আমার মেয়েটার সাথে কালাচাঁন কী করেছে? আমার মেয়েটার আর বিয়ে হবেনা।”

“থাম! আরুর এই বিপদে কী বলছিস তুই? মেয়েটা বেঁচে আছে, এটা কী কম? এইসব চিন্তা তোর মাথায় কে ঢুকিয়েছে?” সান্ত্বনা দিয়ে বলে অনিতা। পারুল দ্বিরুক্তি করে বলে, “আমি যেটা বলছি, সেটা সত্যি ভাবী? গ্ৰামবাসীরা বলাবলি করছিল। আমার মেয়ের বিয়ে হবেনা।”

“তোর মেয়ের বিয়ে না-হলে আমাকে দিস। আমি আরুকে আমার ছেলের জন্য নিয়ে আসব। একটু সুস্থ হতেই আরুকে আমি নিয়ে আসব।” অনিতা বলে আরু ও অপূর্বর দিকে তাকাল। অপূর্ব আরুর মাথায় জ্বর পট্টি দিচ্ছে। দুজনকে দেখে তার কাছে রাজযোটক ঠেকছে।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩৪ [বর্ধিতাংশ]

আরু‌ চৌকির উপরে পা দুলিয়ে বসে আছে বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ। খাবার গ্রহণের জন্য জবরদস্তি করলেও আরু তাতে অসম্মত প্রকাশ করে। জ্বরে আক্রান্ত দেহ নিয়ে মামার কাছে খিচুড়ির সাথে ভাজা ইলিশ মাছ খাবে বলে আবদার করে। একমাত্র ভাগ্নি হওয়ার সুবাদে সাথে সাথে বাজারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়ে লোক। আরু এখন অপেক্ষারত ইলিশ ফেরার। হঠাৎ করে ওর মস্তিষ্কে হানা দিল প্রত্যাশিত কিছু, হওয়ার হলেও আরুর জন্য ব্যাঘাত ঘটেছে তাতে। চট করে আরু বিছানা ছেড়ে হাঁটা দিল বাড়ির বিপরীত পথে। অনিতা আরুকে লক্ষ করে ডাক দেয়, “আরু, অসুস্থ শরীর নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস মা?”

“মাত্র পাঁচ মিনিট দাও, আমি আসছি।” আরু পশ্চাৎ না ফিরে বলেই এগিয়ে গেল। কাঙ্ক্ষিত বাড়িতে গিয়ে সে গলা ছেড়ে ডাকে, “বাড়িতে কেউ আছে?”

ঘর থেকে বেরিয়ে এলো মধ্যবয়স্ক এক নারী। সিঁথি ভর্তি সিঁদুর ও হাতে শাঁখা পলা। পান‌ চিবুতে চিবুতে আরুর কাছে এসে আশ্চর্যান্বিত হয়ে শুধাল, “তুই আরু না, চেয়ারম্যান বাড়ির ভাগ্নি? গতকাল তোকে পানি থেকে তোলা হলো, আজ আবার বিচার হলো?”

আরুর নাকে আসছে ধুপ ও ধোঁয়ার গন্ধ। আরুর রুগণ দেহ সেই অস্থির করা গন্ধ মেনে নিতে নারাজ। হাসফাঁস করতে করতে বলে, “জি আমি আরু। আমার কয়েকটা কাঁচা হলুদ লাগবে। আজ আহসান বাড়ির দুই জোড়া নবদম্পতির গোসল। আমার চিন্তায় সবার মাথা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল, আপনি তাড়াতাড়ি আমাকে কিছু হলুদ তুলে দিন।”

“আচ্ছা, দাঁড়া।” মহিলা বলেই হাতের অবশিষ্ট চুনগুলো গাছের সাথে মুছে দিল। আরু আশেপাশে দৃষ্টি মিলিয়ে দেখতে পেল সব গাছের সাথেই কমবেশি চুন লাগানো। আরু পান খেতে পছন্দ করলেও এই স্বভাবের প্রতি সে বিরক্ত। কিছুক্ষণের মধ্যে মহিলা আরুকে অনেকগুলো হলুদ দিল। আরু ওড়নায় প্যাঁচিয়ে নিয়ে পানের থালা থেকে পান বানিয়ে হাঁটা দিল। মুখে ঢুকিয়ে ফেরার পথে পাঁচ বাড়িতে গোসলের খবর পৌঁছে দিল। আরু সরাসরি বাড়িতে গেল না, দক্ষিণ পাড়ার মেহেদী গাছ থেকে অনেকগুলো মেহেদী পাতা ছিঁড়ে নিয়ে গেল বাড়িতে। অনিতা আরুর পেছনে এতজন মহিলাকে দেখে বিস্মিত হয়ে বাক্য করে, “আপনার এখন এখানে?”

“মামি আমি তাঁদের নিয়ে এসেছি। আমার জন্য তিয়াস ভাই আর তিস্তা আপুদের গোসল বাদ গেছে। এজন্য আমিই ব্যবস্থা করে দিলাম।”

“কিন্তু আরু, এই পরিস্থিতিতে..

“গোসলের পাট চুকিয়ে আমি বাড়িতে ফিরে যাবো। নিজের প্রতি আমাকে যত্নবান হতে হবে। তুমি যদি গোসল না করাও, তাহলে আজকে থেকে কী করব?” আরুর একরোখা জবাবে অনিতা দ্বিরুক্তি না করে আঁচল পেতে আরুর থেকে মেহেদী ও হলুদগুলো নিয়ে নিল। তিন ঝাঁ-কে ডেকে নিল কাছে। গানের তালে তাঁরা হলুদ ও মেহেদী বাটতে বসে‌।
আরু অগ্রসর হয় বাড়ির দিকে। ঠান্ডায় নাক থেকে পানি ঝরছে। মেহেদী তোলার ঐ একই হাত দিয়ে সে নাক পরিষ্কার করতে গেলে আরুর নাকে ডগা লাল হলো খানিক। যাত্রাপথে অপূর্বর টিশার্ট নাগালে পেলে রুমাল হিসেবে ব্যবহার করতে ভুল করে না আরু। আরু খাবার ঘরে গিয়ে দেখল চম্পা সবাইকে খাবার পরিবেশন করে দিচ্ছে। আরু যেতেই আগলে নিল চম্পা। ললাটে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে বলে, “অন্যের কথা ভাবলে হবে? নিজের কথাও মাঝে মাঝে ভাবতে হবে। নাহলে অসুস্থ হলে অন্যের কথা কিভাবে ভাববি?”

“ক্ষুধা লেগেছে নানি জান। ইলিশ মাছের বড়ো ডিমগুলো আমাকে দাও‌। এখন নিজের কথা ভাবি।”

“পাজি পেয়ে।” চম্পা নিজের হাতে খাবার তুলে দিতেই আরু টেবিলের উপরে বসে খেতে থাকে। গরম হওয়াতে নাক থেকে পানি ঝরতে থাকে। আরু বেজায় বিরক্ত হয়ে বলে, “ইচ্ছে করছে নাকটা কেটে ফেলে দেই। অসুস্থতা আমাকে কাবু করতে না পারলেও, একমাত্র এই ঠান্ডা লাগাটা আমার বিরক্ত লাগে। হা করে শ্বাস নিতে হয়।”

মল্লিকা তখন অপূর্বর জন্য তেল গরম করে ফিরে এসেছে। গতকাল রাতে অপূর্বর পা মচকে গিয়েছিল বিধায় ঠিকভাবে হাঁটতে পারছে না সে। অপূর্ব তেলের বাটিট নিয়ে ঘরের দিকে যেতে যেতে আরুকে ইঙ্গিত দেয় তার ঘরে যাবার, “জ্ঞান ফিরে সবার কথা ভেবেছিস, অথচ তোর বিরহে অপূর্বর পা মচকে হাঁটতে পারছেন না – সেটা তোর চোখে পড়ছে না। খেয়ে আমার সেবা করবি।” অপূর্ব প্রস্থান করলে সবাই খাওয়াতে ব্যস্ত হলো। শেফালীর আজ ঈর্ষা জাগল, এ সাধারণ ঈর্ষা নয়। শেফালী যাকে ভালোবাসে সে তাকে ভালোবাসে না, অথচ আরুকে একসাথে দুজন মানুষ প্রচণ্ড ভালোবাসে। মৃত্যুকেও হার মানায়। আচ্ছা, শেফালী যদি আরুর মতো রূপবতী নারী হতো, তাহলে অপূর্ব ভাই তো তাকে ভালোবাসতো। দেখা যেত তিয়াসও তার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকেই চাইত। ও ভাবনার মাঝে অনুভব করল, এক গ্লাস পানি টেবিলে ফেলে দিয়েছে আরু। খানিকটা ছিটে ওর দেহে পতিত হতেই উঠে ঝাঁজালো গলায় বলে, “এই বয়সে চোখের মাথা খেয়েছিস? সবাই তোকে ভালোবাসে বলে নিজেকে মহারানী ভাবছিস?”

তিস্তা বিরক্ত হয়ে বলে, “একটু পানিই তো ফেলেছে, এভাবে রিয়েক্ট করার কী আছে?”

“আছে। আমার সামান্য জ্বর আসলে কারো কিছু যায় আসবে না, তাই রিয়েক্ট করার অনেক কিছু আছে। আরুর তো অনেকে আছে।” শেফালীর ত্যাড়া প্রতুক্তিতে অসুস্থতার পর তিয়াস এই প্রথম শেফালীর সাথে তর্ক ধরল, “বে/য়া/দ/ব একটা, কারো প্রতি কৃতজ্ঞতা নেই। তোর জন্য এই মেয়েটা মরতে বসেছিল। আরেকটু দেরি হলে..! অথচ এখন তার সাথে রিষ করছে, কৃতজ্ঞতার ছিটেফোঁটাও নেই ওর। তোর কাজের পর নিজেকে ছোট মনে হয়েছিল, এখন মনে হচ্ছে বেশ করেছি।”

তীব্র লাঞ্ছনায় বিলম্ব করল না মুহুর্ত। ছুটে গেল নিজের ঘরে। ‘যত দ্রুত সম্ভব এই বাড়ি ত্যাগ করাই শ্রেয়’- আনমনে ভেবে লোকমা মুখে তুলে হাঁচি দিতে দিতে অপূর্বর ঘরে চলে গেল। অপূর্ব নিজেও ঠান্ডায় কুপোকাত। তেল মালিশ করতে ব্যস্ত ছিল দীর্ঘক্ষণ, আরুকে দেখে সেই কাজটা থামিয়ে দিল। আরু অপূর্বর পায়ের নিকটে বসে মচকে যাওয়া পা নিজের কোলে তুলে নেয়। উষ্ণ তেলে হাত ডুবিয়ে অপূর্বর চুলের মাঝবরাবর সিঁথি করে তালু ম্যাসাজ করে দেয়। সরিষার তেলে রসুনের মিশ্রণ থাকার ফলে ঝাঁঝ লাগে নাকে। পরনের শার্টটা টানতে টানতে বলে, “এটা খুলুন, বুকে একটু লাগিয়ে দেই, ঠান্ডা চলে যাবে।”

অপূর্ব হেলান ছেড়ে শার্টের বোতাম খুলে নগ্ন হতেই আরু সেদিক চেয়ে রইল অপলক। তার প্রিয় ভাঁজকাটা দেহ। পুনরায় তেলে হাত ডুবিয়ে ম্যাসাজ করে দিতে লাগল বুকে। অপূর্ব এক দৃষ্টিতে চাওয়া মুখপানে। আরু সেই চোখে চেয়ে চেয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছে। অতঃপর পায়ের আঙুল দৃঢ় করে ধরে তেল লাগিয়ে ম্যাসাজ করতে থাকল। প্রথম দিকে ব্যথায় টনটন করলেও বেশ খানিকক্ষণ আরাম অনুভূত হলো। অপূর্ব আরুর রুগ্‌ণ মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, “পদ্মবতীর মন ভার কেন? আমি ডেকেছি বলে?”

“না!”

“তবে?”

আরুর নিজের কাজে ব্যস্ত হওয়ার ভান ধরে অপূর্বর প্রশ্নের জবাব সে দিল না। আরুর হাতটা ধরে পুনরায় একই প্রশ্ন করলে আরু হাতটা ছাড়িয়ে নেয়। টেবিলের উপরে উঠে বসে পা দোলাতে দোলাতে জবাবে জানায়, “স্বজ্ঞানে কালাচাঁন আমার কোনো ক্ষতি করেনি, করেনি আমার যত্নে কোনো কমতি। তবুও অনেকে বলছে, কালাচাঁন আমাকে কুমারী রাখে নি।”

বুকটা ছ্যাত করে উঠলো। বিষয়টাকে কর্পূরের ন্যায় উড়িয়ে দিতে ভ্রু কুঁচকে অপূর্ব বলে, “তো? কী হয়েছে তাতে?”

“কেউ আমাকে বিয়ে করবে না। আর আমিও মোটা যৌতুক দিয়ে বিয়ে করব না। আমাদের ঘরের পেছনের খুঁটিটা পোকে নষ্ট করে‌ ফেলেছে। বাবাকে বলব, প্রয়োজনে ঐ খুঁটিতে আমাকে গেঁথে রাখতে। তবুও যাতে মোটা যৌতুকে আমাকে বিয়ে না দেয়।”

“এই ঘরটা ভালোভাবে দেখ আরু, টিনের চাল থেকে মাঝে মাঝে পানি পড়ে ভেসে যায়। ভাবছি এখানে পদ্ম আনব। পানিতে বেশ সতেজ থাকবে। তুই কি হবি, সেই পদ্ম! পদ্মবতী?”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩৫

“কাছে আয় আরু, কীসের এত অভিমান তোর? তুই একরাত দূরে কেন, তুই যদি এক যুগ দূরে থাকতি তাহলে এই অপূর্ব তোকে কেবল দেখায় আপন করে নিত। কোনো অভিযোগ ছাড়াই। কাছে আয় আরুপাখি।” অপূর্ব হাত বাড়িয়ে আরুকে ডাকল হৃদমাঝারে। অপূর্বর ডাক উপেক্ষা করতে না পেরে ব্যর্থ আরু এলো অপূর্বর কাছে। তবে দুইয়ের মাঝে দূরত্ব রাখল অনেকটা। অপূর্ব দূরত্ব সহ্য করতে না পেরে বলে, “বিয়ে করবি না আমাকে?”

“না, আমি কাউকে বিয়ে করব না। আপনাকেও না।” বুকে হাত গুজে লুকিয়ে ফেলে দৃষ্টি। অপূর্ব পরমুহূর্তে আরুর লুকিয়ে ফেলা হাতটা টেনে ফেলল বুক পিঞ্জিরায়। খোঁপা করা চুলের গোছা খুলে ছড়িয়ে গেল অপূর্বর দেহ জুড়ে। যত্নসহকারে চুলগুলো সরিয়ে আরুর মুখ প্রকট করতে করতে বলে, “তবে আমাকে আমার প্রাপ্য বুঝিয়ে দে আরু। এমনি এমনি কেউ কারো পেছনে ঘুরে না। (বিরতি দিয়ে) আমি প্রথমবার তোর ঠোঁটে ঠোঁট রেখে শ্বাস দিয়েছিলাম। আমার কামনা ফিরিয়ে দে।”

চকিতে আরুর হাত ঠেকল ওষ্ঠের উপর। চোখেমুখে তার বিস্মিত ভাব। তখনই অনিতার গলার স্বর প্রকট হওয়ার পাশাপাশি শক্ত মাটির শব্দটা স্পষ্ট হলো। আরুর মাথা চেপে বুকের সাথে ঠেকিয়ে অপূর্ব ভাঁজ বিহীন কাঁথা দ্বারা ঢেকে নিল দুইজনকে। বিলম্বে অনিতা প্রবেশ করে অপূর্ব কক্ষে নজরবন্দি করে শুধায়, “আরুকে দেখেছিস অপু? মেয়েটাকে কোথাও দেখছি না।”

“আমি খাওয়ার সময় দেখেছিলাম। এখন কোথায় গেছে জানি না।”

“সবাই বলেছে, চুনহলুদ নিয়ে এই ঘরে এসেছিল। তাই এলাম। তুই রেস্ট কর। আমি দেখি আরুকে কোথায় পাই।” বাক্য শেষ করার পূর্বেই অনিতা অগ্রসর হলেন। দরজার বাইরে একপা ফেল খুঁটি ধরে ঝুলে বলে, “অপু, তোর পায়ের নূপুরটা অনেক সুন্দর। আজকাল নূপুর পরা শুরু করে দিয়েছিস? আবার পায়ের রঙটা বেশ উজ্জ্বল ও লোম নেই। এই পা নিয়ে বাইরে নামিস না।”

অনিতার প্রস্থানের পরপর আরু বের হলো কাঁথার ভেতর থেকে। অপূর্ব মাথা চুলকে জানালার দিকে ফিরে ফোঁস করে ফেলল নিঃশ্বাস। অধর কা/ম/ড়ে চেয়ে দেখল আরু পগারপার।
_
তারপর পেরিয়ে গেল বহু মুহূর্তে। সম্পর্কের সমীকরণ বদলাতে শুরু করেছে তখন।
নিত্যদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠা আরুর যেন এক অভ্যাস। গ্ৰামের মানুষের কত কাজ, তারা তো সকালেই উঠবে। নিমগাছের ডাল ভেঙে দাঁত ঘষতে ঘষতে দিঘির দিকে গেল আরু। শানে পা রেখে মুখ ধোঁয়ার উদ্দেশ্য হাত বাড়াতেই হাওয়াতে একটা স্রোত ভেসে এলো। তাতে একটা সিলভার কার্প মাছ। আরু দৃষ্টি উঁচু করতেই নজরে এলো দিঘি ভর্তি মাছ ভেসে আছে। মাছ সচরাচর যেভাবে সাঁতার কাটে, সেভাবে নয়। নিমের ডালটা হাত থেকে খসে পড়ল পুকুরে। মাথায় হাত দিয়ে চিৎকার দিল আরু, “মাআআ।”

আরুর চিৎকার শুনে নিবৃত্ত নেই কেউ। হাজির হয় দিঘির পাড়ে। পারুল অস্থির হয়ে বলে, “কী হয়েছে আরু, চিৎকার দিলি কেন?”

আরু ক্রন্দনরত অবস্থায় আঙুল তুলে দিঘির দিকে ইঙ্গিত করে বলে, “মা-মাছ। দেখো মাছগুলো মরে গেছে।”

স্তম্ভিত সবাই। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে ইমদাদ হোসেন মৃধা। তার দিঘিতে এত মাছ আছে, তা জানা হয়ে গেছে। কেউ কারো ভালো দেখতে পারে না। আরু ঝাঁপ দিল পানিতে। দিঘির মধ্যিখানে একটা গ্লাস কার্প মাছ ভাসছে। দুহাতে আগলে সেই মাছটি আগলে কেঁদে উঠল আরু। এই দিঘির সবচেয়ে বড়ো মাছ এটি। পুকুরে জাল ফেললে অন্যমাছের সাথে এই মাছটি উঠলে আদর করে ছেড়ে দেওয়া হয়। মাছের দীর্ঘতা অয়নের মতো। একসাথে দাঁড় করিয়ে দীর্ঘতা মাপা হয়েছে। অয়ন ঘাটে নামতেই আরু সাঁতার কেটে মাছটি নিয়ে এলো। অয়ন মাছটিকে ছুঁয়ে কেঁদে দিল, “মা, কে আমাদের দিঘিতে ওষুধ দিয়েছে?”
গ্ৰামের মানুষ একটু সাদাসিধে দেখতে হলেও তারা অন্যের উন্নতি সহ্য করতে পারেনা। কারো পুকুরে মাছ বড় হলে/হাঁসমুরগিতে খোঁপর ভর্তি হলে ওষুধ দিয়ে মে/রে ফেলে। কখনোবা দেখা যায়, সদ্য ঘরে তোলা ধানের গোলা মধ্যরাতে আ/গু/নে দাউ দাউ করে জ্বলছে।

আরু ও অয়নের হাউমাউ করে কান্না সহ্য করতে না পারলেও ইমদাদ হোসেন ও পারুল সহ্য করতে বাধ্য। যত দ্রুত সম্ভব মরা মাছগুলো তুলে ওষুধের পানিগুলো ফেলে আবার নতুন পানি দিয়ে মাছের চাষ শুরু করবে। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে ইমদাদ রাস্তার দিকে তাকাতেই দেখল বাড়ির দরজা দিয়ে পরিচিত কতগুলো মুখ ভেতরে ঢুকছে। ইমদাদ হোসেন অসন্তুষ্ট হয়ে এগিয়ে যেতেই মিহি ও মিহির ‘মামা’ বলে জড়িয়ে ধরে তাকে। অতঃপর তারা সরে যেতেই ইমদাদের একমাত্র বোন ঝাঁপিয়ে পড়ে তার হৃদমাঝারে। ভেঙে পরে কান্নায়। ক্রন্দন ধ্বনির সাথে নির্গত করে, “ভাইজান, কেমন আছেন? কতদিন পর আপনাকে দেখলাম।”

“আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি শিরীন। তুই কেমন আছিস?” বোনের পিঠে হাত রেখে সান্ত্বনা দিয়ে শুধালেন। প্রত্যুত্তরে খানিক অভিমান দিয়ে বলে, “বোন ভালো না থাকলে আপনার কী? ঢাকাতে থাকেন, একবার বোনকে দেখে আসলে কী হয়? আমিও তো প্রিয়জনদের আশায় থাকি।”

“তোর বাড়িতে যাওয়ার কথা শুনলে মা কাঁদবে, তাই যাই না।”

“এবার আমি এমন অবস্থা করব যে, আপনারা মাসের আগামাথায় আমার বাড়িতে থাকবেন।” বলেই পারুলের সাথে কুশল বিনিময় করে শিরীন। তারপরে নিজেই আগ বাড়িয়ে ভাইয়ের কাছে আবদার করে, “আমার একটা আবদার আছে, আমার আবদার পূরণ করতেই হবে কিন্তু।”

শিরীনের কথায় কোনোরূপ সায় দেওয়ার পূর্বেই আরুর দাদিজান লাঠিতে ভর দিয়ে হাজির হলো পুকুর পাড়ে। মেয়ের প্রতি চাপা অভিমান নিয়ে বলে, “মা তোর এত পর হয়ে গেছে, সবার প্রথমে তুই মায়ের সাথে দেখা করলি না।”

“কীযে বলো তুমি! ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছে, তাকে সরিয়ে তোমার সাথে কথা বলতে যাবো?” কথাটা বলে ব্যাগপত্র নিয়ে চলে গেল আরুর বড় চাচার ঘরে। মিহির আরুর অশ্রুভেজা চোখের পানে চেয়ে আছে। মাছের তাড়নায় তার চোখে সৃষ্টি হয়েছে জলপ্রপাত। মন প্রফুল্ল থাকলে পূর্বের মতো ছুটে এসে চকলেট চাইতো। মিহির ব্যাগ নিয়ে আরুর সামনে দাঁড়িয়ে আগ বাড়িয়ে খোঁজ নেয়, “কেমন আছিস আরু?”

“ভালো, তুমি কেমন আছো?”

“ভালোই। এভাবে বেশিক্ষণ বসে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবো তোর। পোশাক পালটে একবার বড়ো মামার ঘরে আসিস, তোর জন্য অনেক চকলেট এনেছি।” বলে ট্রাভেলিং ব্যাগ টেনে চলে গেল ঘরের দিকে। নয়না দাঁড়িয়ে ছিল তাদের অপেক্ষায়।
__
সূর্য ডূবে আকাশে লেগে আগে তার ফেলে যাওয়া রক্তিম আভা। গাছে গাছে ফুটে আছে কদমফুল। বৃষ্টিতে মাটিতে পানি জমে আছে। রাস্তার অবস্থা তখন বেসামাল। অপূর্ব ছাতা মাথায় নিয়ে হাঁটু সমান কাঁদা নিয়ে বাড়ির দরজায় পা ফেলে। কান উঁচু করেও শ্রবণ হলোনা আরুর খিলখিল করা মনোমুগ্ধকর হাসির রোল। বেসামাল অপূর্ব দিঘিতে গিয়ে পা ধুয়ে জোতা মাথায় ঘরের ভেতরে ঢুখে। ছাতাটা বন্ধ করে বাইরে ঝুলন্ত অবস্থায় রেখে তুরকে উদ্দেশ্য করে বলে, “আরু আজকে পড়তে আসেনি?”

“না। আরুদের দিঘিতে ওষুধ দিয়েছে বলে ওদের দিঘির সব মাছ মরে গেছে। তাই আরু আজ স্কুলেও যায়নি, আমাদের বাড়িতেও আসেনি।” বিটিভিতে সন্ধ্যার অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে কথাটা বলে তুর। অপূর্বর বুক ছ্যাত করে উঠল। ফোন বের করে ইমদাদ হোসেনকে কল করতে যাবে তখন সুমি চা এনে টেবিলে রেখে বলে, “আজ আরুকে পাবেন কি-না সন্দেহ। শুনেছি আরুর ফুফুরা এসেছে।”

“তারমানে তো মিহিরও এসেছে?” অপূর্ব প্রশ্নটা করে নিজেও লজ্জায় আড়ষ্ট হলো। প্রত্যাশিত কিছু চাইতে অনিতার কোলে মাথা রাখল অপূর্ব। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে আঁচল থেকে চাবিটা খুলে সুমির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, “বউমা, বিকালে তোমার চাচা শ্বশুর যে বক্সটা আমাকে দিয়েছিল। সেটা আমি আলমারিতে রেখেছি। তুমি ওটা নিয়ে এসো।”

সুমি অনিতাদের ঘরের দিকে পা ফেললে তিয়াসকে আদেশ দেয় অনিতা, “চার ভাইকে জরুরিভিত্তিতে বাড়িতে আসতে বলো। আমি চেয়েছিলাম, আগামীকাল ঐবাড়িতে যাবো। কিন্তু এখন আর থাকা সম্ভব নয়।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩৬

পারুল মাটির উনুনে চা তৈরি করছে। রান্নাঘরের দিকটাতে বাতির ব্যবস্থা নেই বিধায় একটা হ্যারিকেল জ্বালিয়ে কাজ করছে পারুল। আরু তাকে সঙ্গ দিতে কাঁচের চায়ের কাপগুলো নামিয়ে ধোয়ার জন্য দিঘির দিকে যেতেই পারুল থামায় তাকে। চা’পাতা দিয়ে রঙ পরীক্ষা করতে করতে বলে, “দিঘিতে ওষুধ দিয়েছে, ভুলে গেছিল? দিঘিতে নতুন পানি না ফেলা পর্যন্ত কোনো কাজ করা যাবে না। নাহলে রোগব্যাধি হবে।”

অমনি আরুর মন বিষণ্ন হলো। সন্ধ্যার আগে টেনে আনা পানিতে কাপগুলো ধুতে থাকে। পারুল চায়ের ডেক্সি উনুন থেকে নামিয়ে কাপে চা ঢালতে ঢালতে বলে, “আজকে স্কুলেও গেলি না, পড়তেও গেলি না। পড়াশোনার করার ইচ্ছে নেই তোর?”

“কাল থেকে যাবো। বকো না প্লীজ।”

“আমার সাথে ইংরেজিতে ফুটানি করবি না। প্রতিবার পরীক্ষায় সবার সেরা হয়ে প্লেট নিয়ে আসিস। এবার যদি লাড্ডু নিয়ে আসিস তাহলে তোর খবর আছে।” কড়া গলায় শাসায় পারুল। আরু চাপা রাগ দেখিয়ে হারিকেন নিয়ে ঘরে চলে গেল। ততক্ষণে পারুলের চা ঢালা শেষ। অন্ধকার হয়ে যেতেই চ্যাঁচিয়ে বলে, “আরু। হারিকেন নিয়ে গেলি কেন? আমি এই অন্ধকারে চা নিয়ে যাবো কীভাবে? অপূর্ব আমাকে এই চায়ের কাপের সেট বিদেশ থেকে এনে দিয়েছে। অন্ধকারে কিছু সাথে বেঁধে যদি পড়ে কাপ ভেঙে যায়। তোর খবর আছে।”

অতঃপর আরু খালি হাতেই এলো রান্নাঘরে। লাকড়ি না দিলেও আগের লাকড়িতে মৃদু আলো জ্বলছে। ধপাধপ পায়ে এসে পারুলের হাত থেকে কাপের ট্রেটা কেড়ে একই গতিতে চলে গেল। বৈঠকখানায় আরুর দুই চাচি ও চাচাতো ভাইবোন বসে আছে। অতিথিরাও বাদ নেই। আরু সবার হাতে চায়ের কাপ তুলে দিয়ে দোতলায় উঠে গেল। টিনের ঝাড় থেকে খই বের করে দুই থালাতে ঢেলে সবাইকে দিল। তারপরে আবার চলে গেল নিজের ঘরে। বইটা খুলে পৃষ্ঠা উলটে মনযোগী হওয়ার প্রচেষ্টা করছে। কিন্তু বোনদের জ্বালায় বারবার বিঘ্ন ঘটছে পড়াতে। ওর ছটফটে মন নিবদ্ধ বৈঠকখানায়। তখন সন্তর্পনে সেখানে প্রবেশ ঘটে মিহিরের। আরুর জন্য আনা চকলেট বক্সটা টেবিলের উপরে রেখে বলে, “এটা তোর।”

“ধন্যবাদ।”

“কোনো কারণে তোর মন খারাপ আরু? আমার সাথে কথা বলছিস না। আগে আমি আসলে তুই অনেক খুশি হতি।” বলতে বলতে খানিক ঝুঁকল আরুর উপর। আরু দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। ‘তোমাকে একটা চুমু খেয়েছিলাম, এজন্য অপূর্ব ভাই ছলেবলে কৌশলে একশোর বেশি চুমু আদর করে নিয়েছে। চার ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে বলেছে। আর কোনো ভুল করতে চাইনা।’ মনে মনে পুনরাবৃত্তি করে বাক্য। তৎক্ষণাৎ কানে এলো একদল লোকের কথা। মনে হলো আহসান বাড়ির চাঁদের হাট মৃধা বাড়িতে বসেছে। চকিতে আরু সেদিকে যেতে চাইলেও দমিয়ে নিল। তাদের সামনে নিজেকে পড়াকু প্রমাণ করতে হবে।

পারুল স্বামীর ভিটাতে আপনজনদের দেখে অসন্তুষ্ট হলো ব্যাপক। উত্তেজিত হয়ে বলে, “এই বৃষ্টিবাদলের দিনে এলে, পা ধুতে দেওয়ার মতো পানিও নেই।”

“শুনেছি তোদের দিঘিতে ওষুধ দিয়েছে। চেয়ারম্যানের জামাইর বাড়ির দিঘিতে কে ওষুধ দিয়েছে, অনেক খোঁজ করেছি। এখনো ধরা পড়েনি। চেষ্টা করছি যাতে ধরা পড়ে যায়।” আরুর নানাজান বলে‌। যার জন্য এত ঘটা করে এসেছে আহসান পরিবার তার দেখা নেই তাই চম্পা আরুর সন্ধান করে, “আরুকে দেখছি না, কোথায় ও?”

“চা দিয়ে ঘরে গেছে। পারুলের সাথে মনে হয় ঝগড়া হয়েছে, মুখ ফুলিয়ে রেখেছে।” নয়না থামলে ইমদাদ বলে, “মেয়েটাকে তোমার সবসময় ব/কতেই হবে?

“স্কুলেও যায়নি, পড়াশোনাও করেনি আজ। বলেছি তাই পড়তে গেছে.. পারুলের বাক্যে দাড়ি টেনে নিজ ঘর থেকে আরু চ্যাঁচিয়ে বলে, “শুধু এটা বলো নি, ‘প্লেটের বদলে লাড্ডু নিয়ে আসলে খবর আছে’ – বলো নি?”

পারুল পড়েছে মহা ফ্যাসাদে। তাকে সেই ফ্যাসাদ থেকে রক্ষা করতে মোতাহার আহসান ইমদাদ হোসেন মৃধাকে নিয়ে বাইরের ছোট রোয়াকে কথা বলতে গেলেন। তুর শেফালী ও সুমিও থেমে নেই, অনিতার ইশারায় চলল আরুর ঘরে। তিনজনের প্রবেশে বেরিয়ে গেল মিহির। আরু দাঁড়িয়ে কুশল বিনিময় করতেই তুর আরুর আকর্ষণীয় শাড়িটা বের করল। আরু ব্যতিব্যস্ত হয়ে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলে, “শাড়ি নামাচ্ছিস কেন?”

“তুই পরবি তাই।”

“আমি বর্ষাকালে শাড়ি পরি না। ঠান্ডায় শাড়ি শুকাতে চায় না।” আরুর সিদ্ধান্তকে ঠেলে দিয়ে ওড়না কেড়ে নিল শেফালী। শহরের কায়দা শাড়ি পরাতে শুরু করল।
_
মিহিরকে আরুর ঘর থেকে বের হতে দেখে মেজাজ হলো ক্রুব্ধ। ঠোঁট চেপে সামলানোর প্রয়াস করল অপূর্ব। এই ঘরে এখন মিহিররা ছাড়া কেউ নেই, সবাই পারুলকে সাহায্য করতে ব্যস্ত। আধঘন্টা সময়ের মধ্যে বাহারি খাবারে টেবিলে সাজিয়ে ফেলল পারুল‌। শরবতের গ্লাস নিয়ে ধীর চুমুকে পান করছে দেখে পারুল রঙ্গ করে বলে, “অপু তুই আজ লজ্জা পাচ্ছিস কেন? লজ্জা পাওয়ার কথা নতুন বউয়ের। সুমি এই প্রথম এসেছে। ও চারপাশে ঘুড়েও দেখছে।”

“নতুন জামাইরা তো লজ্জা পাবেই।” অপূর্বর চোখ রাঙানো দেখে থেমে গেল তিয়াস। আরুকে ধরে ধরে নিয়ে এলো ওরা। সুমির ইঙ্গিত পাওয়া মাত্র উঠে দাঁড়ায় তিয়াস। অপূর্বর পাশের জায়গা আরু গ্ৰহণ করতেই আহসান বাড়ির বড় কর্তা পারুলকে উদ্দেশ্য করে বলে, “আমার মেয়েকে আমি ইমদাদের হাতে তুলে দিয়েছে অনেক আগে, এখন আমার নাতিকে ফিরিয়ে নিতে চাইছি। ইমদাদের এক্ষেত্রে আপত্তি নেই। তোর কী মতামত?”

“ও গেলে পুরো বাড়ি ফাঁকা লাগবে। মাঝে মাঝে কাজেও আমাকে সাহায্য করে।”

“তারমানে মেয়েকে বিয়ে দিবি না?” মোতাহার আহসানের প্রশ্নে এতক্ষণে সবকিছু মস্তিষ্কে গোচর হলো। পারুলের চোখে পানি এলেও আরুর মুখে ফুটে উঠে হাসি। মাথার ঘোমটা টেনে লজ্জানত হয়‌। দ্বিধান্বিত হয়ে বলে, “আরুল সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। পরীক্ষার পর বিয়ে..

“বিয়েতে আরুর উপরে কোনো প্রভাব পড়বে না। সে ভাগ্নি হিসেবে থাকবে। অপূর্বর কাছে পড়ে আবার ফিরতে হয়। বিয়ে হলে অপূর্ব সবসময় পড়াতে পারবে। তাছাড়া অপূর্বর বয়সটাও তো বেড়ে যাচ্ছে।” উপস্থিত সবাই তখন পারুলের মতামত শোনার জন্য আগ্রহী। পারুল ‘হ্যাঁ’ জানাতেই একদল লোক ঘর ছেড়ে চলে গেল। পারুল থামানোর চেষ্টা করলেও শিরীনেরা থামল না।
__
জড়তায় আড়ষ্ট হওয়া আরুর পানে করতল মেলে দিলেই আরু ঘোমটার আড়াল থেকে একঝলক দেখে হাত বাড়িয়ে দিল। আরুর সেই হাতে বাম হাত রাখলে অনিতা জুয়েলারি বক্স খুলে অপূর্ব দিকে এগিয়ে দিল চকচকে আংটি। চকচক করা স্বর্ণের মাঝে এক পাথরের আংটি তুলে আরুর অনামিকা আঙুলে পরিয়ে দিল। অতঃপর হাতটা নিকটে এনে আরু নিবৃত্ত দৃষ্টিতে দেখতে থাকল। এটা যেন তার জন্য সৃষ্টি। তদানীং আরুর লাজুক ভাব বাড়িয়ে দিতে অপূর্ব বলে, “পদ্মবতী, পরে দেখো। আংটিটা আগে আমাকে পরিয়ে দিয়ে নাও পাখি।”

আরু দেখল অপূর্ব হাত বাড়িয়ে রেখেছে। অনিতার থেকে আংটি নিয়ে অপূর্বকে স্পর্শ না করেই পরিয়ে দিল অনামিকায়। সাথে পড়ল একফোঁটা অশ্রু, তা আনন্দের না-কি বিষাদের? গুরুজনদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আরু দ্বি মুহূর্তে ছুটে গেল ঘরে। কাঠের দরজা ভিড়িয়ে পিঠে ঠেকিয়ে ঘনঘন শ্বাস ফেলতে থাকে। এরপরে বিছানায় গিয়ে কোলবালিশ জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে হেসে উঠে।

‘খুশি করল অপূর্ব, জড়িয়ে ধরে কোলবালিশ। দিস ইজ নট ফেয়ার আরু।’ বলে বুকে হাত গুজে অপূর্ব। আরু শোয়া থেকে উঠে নিজেকে সামলাতে সামলাতে বলে, “আপনি গতকালকেও বললেন না, আজকে আংটি বদল করে ফেলবেন।”

“আমি নিজেই জানতাম না। হঠাৎ মা তাড়া দিল বিয়ের জন্য। (বিরতি টেনে) শুনেছি, এই শুক্রবার আমাদের বিয়ে সেড়ে ফেলবে। কিছুদিন আগে তিস্তার বিয়ে গেল। এই মুহূর্তে এত খরচ করে বড়ো করে বিয়ের ব্যবস্থা করা ঠিক হবেনা।” বলতে বলতে আরুর পাশে বসে অপূর্ব। অপূর্বর গলা জড়িয়ে কোলে বসে আরু। আজ আলাদা এক অধিকার বোধ খুঁজে পাচ্ছে।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-৩২+৩৩

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩২

“তোমরা এই পূর্ণিমাতে নদীতে কী করছ? পূর্ণিমার আলোয় সবকিছু উজ্জ্বল দেখা গেলেও খরস্রোতা ঢেউ তোমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। পানির ধারা বৃদ্ধি পাওয়ার আগে এখান থেকে চলে যাও তোমরা।” নৌকা নিয়ে অগ্রসর হওয়ার সময় এক মাঝি সাবধান করে দেয় অপূর্বদের। বৈঠা নিয়ে ঠেলে সামনে যাওয়ার প্রয়াস করতেই অপূর্ব একটা জ্বলন্ত আলোর পথের সন্ধান পেল। দাঁড়িয়ে অপূর্ব বলে, আমি অপূর্ব। আপনাদের চেয়ারম্যান সাহেবের ছেলে। আপনারা আমাকে একটু সাহায্য করুন।”

“আপনি চেয়ারম্যান ভাইয়ের ছেলে? আগে বলবেন তো বাবা। তা আমাদের কাছে আপনাদের কী সাহায্য লাগবে? আমরা সব করব।”

“আপনারা একটু নদীতে নেমে আরুকে এনে দিবেন। কিছুক্ষণ আগে ঐ পাড়ার ব/খা/টে ছেলে কালাচাঁন আমাদের বাড়ির মেয়ে নিয়ে জোর করে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে। আপনারা একটু দেখুন না?” অপূর্বর ভাঙা গলায় এক মাঝি ও দুই জেলে বিচলিত হয়ে উঠল। একজন জেলে অন্য জেলেকে উদ্দেশ্য করে বলে, “এখনো বসে আছিস কেন? চেয়ারম্যান বাড়ির মেয়ে। যেভাবে হোক আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে।”

জেলেদের কাছে এক ধরনের টর্চ লাইট থাকে। যা বিদেশ থেকে শুভাকাঙ্ক্ষিদের মাধ্যমে দেশে আনা হয়। যা দিয়ে নদীর অনেক গভীরে যাওয়া যায়। দুটো জেলে লাইট দুটো নিয়ে ঝাঁপ দিল জ্বলে। নিভু নিভু আলোয় তখন জ্বলছে হারিকেন। তুর ছুটে গিয়ে খবর পৌঁছে দিয়েছে ‘সাত ভাই চম্পা’ নিবাসে। সবাই ছুটে এসেছে নদীর পাড়ে। জেলেরা কিছুক্ষণ তল্লাশি করে ভেসে উঠে পানিতে, পায় না আরুর সন্ধান। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, “মনে হয় ভেসে গেছে স্রোতে। পানির নিচে কেউ নেই।”

পারুল হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। নদীতে নামার জন্য ব্যস্ত হয়ে গেল। মোতাহার আহসান পারুলকে একহাতে আগলে নিয়ে জেলেকে বলে, “তোমাদের পরিচিত কেউ নেই? খবর দিয়ে সবাই একসাথে খুঁজতে থাকো।”

“চেয়ারম্যান সাহেব, এত সময় নেই। আমরা নিজেদের মতো চেষ্টা করছি।” বলেই অনেকটা এগিয়ে আবার ডুব দিল জেলে। এক মুহুর্তের আগেই ভেসে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে, “পেয়েছি। এইখানে আছে‌। তবে মেয়েটার গলায় একটা কলস বাঁধা। আবার একটা ছেলে হাত ধরে আছে শক্ত করে। কতটা পানি খেয়েছ, জানা নেই। আপনারা একটা কাঁচা ডালের ব্যবস্থা করে দিল। কলস ভেঙে উদ্ধার করে নিয়ে আসি।”

নৌকাতে জীবন বাঁচাতে বড় বড় দা রাখা হয়। দা বের করে এগিয়ে দিতেই অপূর্ব একটা ছোটো গাছের ডাল একবারে কেটে নিয়ে এলো। মাঝিসহ মোট তিনজনে পানির নিচে চলে গেল। আরু চেতনাহীন। ওর বুকের উপরে কলসখানা। আরুর একহাত কালাচাঁন শক্ত করে ধরে আছে। আরু অন্যহাত দিয়ে কালাচাঁনের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করেছে, দেখে বোঝা যাচ্ছে। ডাল দিয়ে কলস চূর্ণ বিচূর্ণ করে তিনজনে দুজনকে আলাদা করে উপরে তুলে দিয়ে এলো। আরুর শাড়িটা বোধহয় জলের বেগে এলোমেলো হয়ে গেছে। গলার সাথে এখনো বাধা কলসের অংশ ও দড়ি। আরুকে উপরে তুলতে বিলম্ব হলেও আরুর উপর ঝাপিয়ে পড়তে কারো বিলম্ব হলো না। আরুকে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে পারুল বলে, “আরু, কথা বল মা। আমি আর কখনো তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করব না। তুই একবার চোখ মেলে তাকা।”

অপূর্ব তার ভেজা পোশাকটা জড়িয়ে দিল আরুর দেহে। আরুর কোনো শ্বাস পড়ছে না। অপূর্ব পেটের উপর প্রেষ করতে করতে বলে, “তোমরা দাঁড়িয়ে না থেকে আরুর হাত পায়ের তালু ম্যাসাজ করে দাও।”

অপূর্বর অদম্য কাজে আরুর মুখ থেকে গরগর করে পানি পড়তে থাকে। অন্যদিকে জেলেরা তখন কালাচাঁনকে বাঁচাতে ব্যস্ত। মুখের উপর মৃদু চপল দিতে থাকে, কিন্তু এতেও আরুর শ্বাস পড়ে না। অপূর্ব বুঝে গেছে, একটাই উপায় আছে। কেবল সেভাবেই জ্ঞান ফেরানো সম্ভব। অপূর্ব শার্ট নিয়ে নিজেকে যথেষ্ট আড়াল করে নিয়ে ঝুঁকে গেল আরুর মুখের উপর। আশেপাশের সবাই তখন অন্যদিকে তাকাল। কিছুক্ষণ পর অপূর্ব সরে শার্টটা জড়িয়ে দিল আরুর গায়ে। তিন সেকেন্ড পর আরু ফোঁস করে দীর্ঘ শ্বাস গ্ৰহণ করে। মাটি থেকে পিঠটা একটু উপরে উঠে গেল। সবাই তখন আরুকে ঘিরে ধরল। অপূর্ব বারণ করে, “একটু ফাঁক করে দাঁড়াও। অক্সিজেন নিতে দাও।”

আরু শ্বাস নিলেও জ্ঞান ফিরল না। ওর শরীরে যে ধুম জ্বর ও মাথা ভার ছিল। এভাবে দীর্ঘক্ষন ফেলে রাখলে আরুর অবস্থা অস্বাভাবিক হয়ে উঠবে। অপূর্ব অতি যত্নে আরুর গলা থেকে ভাঙা কলসের অংশসহ দড়ি খুলে ফেলল। অতঃপর অপূর্ব আরুকে কোলে তুলে হাঁটার প্রয়াস করে, কিন্তু তার মচকে যাওয়া পা ও অসাড় শরীর নিয়ে হাঁটতে পারছে না। তখন ইমদাদ হোসেন ছুটে আসে। মেয়েকে কোলে নিয়ে নৌকার মাঝিকে উদ্দেশ্য করে বলে, “আমাদের একটু ওপার ছেড়ে দাও ভাই। এতটা পথ হেঁটে যাওয়া ঠিক হবে না।”

“তা কি বলতে হয়? কে কে যাবেন, আসুন।” মাঝি বলতেই পারুল এগিয়ে যায়। মোতাহার আহসান দুইহাত পেছনে রেখে বলে, “কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস ওকে? আরু আমার বাড়ি থেকে হারিয়ে গেছে। আমি ওকে ফিরিয়ে দিতে পারলেও, ও একটুও সুস্থ নয়।‌ ওকে সুস্থ করে তবেই তোরা বাড়িতে যাবি। তাছাড়া কাল সবাই দেখবে চেয়ারম্যান মোতাহার আহসানের ভাগ্নেকে মা/রার জন্য একে কেমন শা/স্তি দেই? দেখবে‌ নি/ষ্ঠু/র আমিকে। বাড়ির দিকে চল।”

মোতাহার আহসান মুখের উপর কেউ কোনো বাক্য করতে পারে না। এগিয়ে যায় বাড়ির দিকে। অপূর্ব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যায় পেছনে পেছনে। মোতাহার আহসান নৌকার তিনজনকে উদ্দেশ্য করে বলে, “আপনাদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। যেভাবে আমার ভাগ্নিকে আমাদের হাতে তুলে দিলেন। বলুন, আপনাদের কী চাই? আমার বোনের কলিজাকে ওর হাতে তুলে দেওয়ার জন্য, প্রয়োজনে আমি আমার কলিজা আপনাদের হাতে তুলে দিবো।”

“আমার মতো দরদি চেয়ারম্যান এই সুন্দরনগরে পেয়ে আমরা ধন্য। আপনার কলিজা আমাদের চাই না। আপনি এভাবেই আমাদের পাশে থাকুন। বিদায় দিন, আজ আমরা আসি।”

“আসুন। (প্রহরীদের উদ্দেশ্য করে) এখনো এখানে দাঁড়িয়ে কী দেখছেন আপনারা? ঐ শু/য়ো/রটাকে নিয়ে গোয়াল ঘরে ফেলে রাখুন। আগামীকাল সকালে পুরো গ্ৰামকে আমার বাড়িতে হাজির থাকতে বলবেন। কালকে ওর শা/স্তি হবে।” বলেই মোতাহার আহসান বাড়ির দিকে গেল। পেছনে পেছনে গেল তার তিন ভাই ও বাবা।
_
আরুর চেতনা ফিরেনি। আরুর অসুস্থ শরীর নিয়ে কয়েক মুহূর্ত পানির ভেতরে ছিল বলে হাত পা সাদা হয়ে গেছে। দড়ি থাকার কারণে গলায় একটা কালচে দাগ দেখা যাচ্ছে। অপূর্ব ডাক্তারি সরজ্ঞাম নিয়ে আরুর চিকিৎসা করল প্রাথমিকভাবে। ইনজেকশন পুশ করে হাতটা ধরে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ ফেলল। অনুভব করে পালস রেট। এই হাতটা দিয়ে রক্ত চলাচল করছে। অপূর্বর এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছিল, এই হাতটা জীবিত অবস্থায় সে দেখতে পারবে না। আরুর জীবিত থাকলেও ততক্ষণ অপূর্বর স্বপ্ন মনে হবে, যতক্ষণ আরু ডাকবে না অপূর্ব ভাই বলে।

অপূর্বর বড্ড ইচ্ছে করল, আরুকে বুকে নিয়ে তার হৃৎপিণ্ডের রক্ত চলাচলের শব্দ শুনতে। কিন্তু আশেপাশের মানুষগুলোর কারণে সেটা অসম্ভব। বিয়ের আগেই আরুকে অক্সিজেন দেওয়ার ব্যাপারটা তাকে বেশ ভাবাচ্ছে। আজ রাতে আরুর পাশে তার বাবা মা থাকবে। নিজের কাঙ্ক্ষিত স্পৃহাকে বুকে চাপা দিয়ে উঠে দাঁড়ায় অপূর্ব। আরুর ফ্যাকাসে মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, “রাতে আরুর জ্ঞান ফিরতে পারে। দুধ ছাড়া গরম কিছু খাওয়ালে ভালো হতো। এমনিতেই গায়ে ধুম জ্বর। দুধ খাওয়ালে টাইফয়েড হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর রাতে যতই জ্বর বাড়ুক আমাকে বলবেন। অনেকক্ষণ পানির ভেতরে ছিল। তাই পানি দিলে ঠান্ডায় জ্বর বেড়ে যেতেই পারে। উঠি!”

আচ্ছা ঘরের ভেতরে কি, কোনো অদৃশ্য গাছের শিকড় প্রবেশ করেছে? তাহলে অপূর্বর পা কেন আটকে যাচ্ছে। কেন আরুর বিপরীত দিকে পা চলছে না?

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩৩

রাতে হঠাৎ করেই তাপমাত্রা নেমে গেল। আর্দ্র হয়ে গেল গ্রামের পরিবেশ। কুয়াশায় দূরের কিছু সুব্যক্ত নেই। মশারা বৈরী আবহাওয়ায় আশ্রয় গ্রহণ করল গোয়াল ঘরে। মশার তাণ্ডবে গরুরা মাঝরাতে হাম্বা হাম্বা ডেকে উঠে। সেই গোয়ালে ফেলে রাখা হয়েছে কালাচাঁনকে। পাঁচ গরুর ছোটাছুটিতে একের পর এক পাদাঘাত পড়ল কালাচাঁনের দেহে। বেদনাক্রান্ত দেহ নিয়ে পল্লব উন্মুক্ত করতেই কালাচাঁন উঠে বসে। মৃত্যু থেকে করব পর্যন্ত দেহ থাকে ব্যথাহীন। কিন্তু কালাচাঁন তেমন কিছু অনুভব না করে হাত দিয়ে স্পর্শ করে দেহ। গোয়ালঘরের দরজা দিয়ে ফকফকা পূর্ণিমার আলো দেখে তার উপলব্ধি হলো কিছুটা। সে যে চেয়ারম্যান বাড়িতে তালাবদ্ধ আছে। দরজা ধরে ধাক্কা দিয়ে চ্যাঁচিয়ে বলে, “কে কোথা আছো? দরজা খুলে দাও। শুনতে পারছ, দরজা খোলো। গোলাপী, কোথায় তুমি?”

আহসান বাড়ির সদস্যরা নির্ঘুম রাত্রিযাপন করছে। কালাচাঁনের শব্দটা কানে পৌঁছালেও প্রতিক্রিয়া দেখায় না। সেই তীক্ষ্ণ কণ্ঠটা আরুর কানে লাগে। ইমদাদ হোসেন মৃধার ঘুমে চোখ লেগে আসলেও মেয়ের দিকে চেয়ে আছে পারুল। আচমকা আরু তন্দ্রার মাঝে কেঁপে ওঠে। শুণ্য গলা থেকে অযথা কলসের দড়ি খোলার চেষ্টা করতে করতে ব্যক্ত করে বাক্য, “আমি ম/র/ব না। আমি বাঁচতে চাই কালাচাঁন। পৃথিবীতে সাতজন মানুষ দেখতে একরকমের। তোমার ভালোবাসার জোরে তাদের একজনকে তুমি খুঁজে নাও। তোমার ভালোবাসার তুলনা হয় না। কিন্তু তোমার ভালোবাসার ছলে আমার এই জীবনটা কেড়ে নিও না। আমাকে বাঁচতে দাও।”

পারুল গভীর আলিঙ্গনে জড়িয়ে রাখলেন আরুকে। আরুর বন্ধ চোখ থেকে পানি ঝরছে। তাপমাত্রা বোধহয় ১০৪° এ পৌঁছেছে।‌ মেয়ের গোঙানির শব্দ শুনে ইমদাদ হোসেন উঠে আলো জ্বালিয়ে দিলেন। আরুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে থাকে, “আরু মা, চোখ মেলে তাকা। তোকে কেউ মারবে না।”

আরু ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল বাবা মায়ের দিকে। তবে মনের ভেতরে দানা বাঁধা ভয় থেকে মুক্তি মিলে না। উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, “ঐ দেখো কালাচাঁন। আমাকে নিয়ে ঝাঁপ দিল জলে। আমাকে বাঁচাও।”

আরুর এই কণ্ঠ যথেষ্ট ছিল সবাইকে ঘর থেকে নিয়ে আসতে। অপূর্ব ছুটে এসেছে সবার প্রথমে। আরুকে উত্তেজিত হতে দেখে ছুড়ে দেয় প্রশ্ন, ” ফুফু-ফুফা, আরুর কী হয়েছ? এমন করছে কেন?”

“জানি না, হঠাৎ করে কেমন ভয় পেয়ে চলেছে।”

“এখনো ও সেই মুহুর্তটা থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না। তাই এমন করছে।” বলেই অপূর্ব আরুর মাথায় হাত রাখে। আরু উন্মাদের মতো ইমদাদ হোসেনকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। অনিতা অপূর্বর শুষ্ক মুখমণ্ডলের পানে চেয়ে অনুভব করল, ছেলের কষ্ট। দ্বিধা নিয়ে পারুলকে উদ্দেশ্য করে বলে, “অপূর্ব ডাক্তার মানুষ, ও আরুকে পারবে ঐ অবস্থা থেকে বের করে আনতে।”

অপূর্ব মুগ্ধ হয়ে মায়ের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই তিনি আশ্বস্ত করলেন অপূর্বকে। অপূর্ব বিছানায় বসে আরুর মাথায় হাত রাখতেই পদ্মবতী খুঁজে নিল তার জলকে। দুহাত অপূর্বর চিবুকে‌ রেখে বলে, “অপূর্ব ভাই, আপনি এসেছেন? কালাচাঁন আমাকে নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে তার ভালোবাসাকে ইতিহাস করে রাখতে চেয়েছে। কিন্তু আমি তো ওকে ভালোবাসি না। আপনি আমাকে বাঁচান।”

“পারুল, আরু দুদিন কিছু খেয়েছে কিনা জানি না। এসো, ওরজন্য হালকা কিছু তৈরি করে নিয়ে আসি।” পারুলকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলে অনিতা রান্নাঘরে গেল। পারুলসহ বাকি তিন বউও গেল রান্নাঘরে। ইমদাদ হোসেন লজ্জায় উঠে গেলেন মোতাহার হোসেনের সাথে কথা বলতে‌। শেফালী কড়া ডোজের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছে। তিস্তা সুজনের দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙিয়ে বলে, “সবাই ওদের স্পেস দিতে চলে গেছে, তুমি হা করে তাকিয়ে কী দেখছ? বউকে আদর করে দু খানা কথা বিয়ের পর তোমার মুখ থেকে আমি শুনিছি। বিয়ের আগে ভালোবাসা উতলে পড়ছিল। বড় ভাইকে দেখে শেখো। (বিরতি দিয়ে) দাঁড়িয়ে আছো কেন? ঘরে চলো।”

“তুমিই তো বললে, দেখতে।”

“তুর তুই ঘরে যায়। তোর ভাইয়ের নাকে দড়ি বেঁধে আমিও ঘরে যাচ্ছি।” তিস্তা থামার পূর্বেই সুজন ছুটে গেল ঘরে। তুরও ফিরল শেফালীর কাছে। দরজাটা ভিড়িয়ে নবদম্পতি তাদের নতুন ঘরে ফিরে গেল। দৃষ্টির অগোচরে চেনা মানুষগুলো চলে যেতেই অপূর্ব আরুকে টেনে নিল হৃদমাঝারে। আরু বিড়ালছানার মতো লেপ্টে করে গেল কালাচাঁনের নামে তার অভিযোগ। অপূর্ব আদুরে গলায় আরুকে বলে, “পদ্মবতী, তুমি অপূর্বর হৃদমাঝারে আছো! এই দেহে যতক্ষণ প্রাণ নামক অদৃশ্য বস্তুটা অর্পিত থাকবে, ততক্ষণে তুমি এরচেয়ে বেশি নিরাপদ কোথাও থাকবে না। আমার চোখে নিজের চোখ রেখে একবার দেখো, এই চোখের গভীরতা। তুমি নদীর জলে নয়, তোমাকে হারানোর ভরে জমিয়ে রাখা চোখের জলে তুমি ডুবে যাবে। এই ডোবা মানে, আমার প্রেমে নিজেকে হারিয়ে ভুলে যাবে সব উন্মাদনা। তাকাবে কি আরুপাখি?”

আরু তাকালো সেই চোখে। হারালো সেই মায়াডোরে। ভয়ের মাত্রা হুরহুর করে নামল শুণ্যে। চোখ বন্ধ করলেই গড়াল জমিয়ে রাখা পদ্মবতীর অশ্রু। অপূর্ব অতি আদরে নিজের ললাট ঠেকিয়ে দিল আরুর ললাটে। জমিয়ে রাখা দুঃখের সময়টাকে গাঢ় নিঃশ্বাসের সাথে ফেলে দিল। অপূর্ব খুব শীঘ্রই আরুকে ঘরণী করে তুলবে! খুব শ্রীঘ্রই!
আরুর খবর পৌঁছে গেছে ময়নার কাছে। ছানাদের ঘুম পাড়িয়ে রেখে উড়ে এসে থেমেছে আরুর ঘরের জানালায়। পুনরাবৃত্তি করল একটি বর্ণ, “আরুপাখি! আরুপাখি! আরুপাখি!”
__
আহসান বাড়িতে মানুষ ধরে না, তবুও এসেছে বিচার দেখতে। সচরাচর বাড়িতে বিচার কাজ সম্পন্ন না করলেও এই প্রথম সেই কাজটি করতে রাজি মোতাহার আহসান। আরুকে একটা চাদর প্যাঁচিয়ে নিয়ে এসেছে বিচারে। এলোমেলো চুলগুলো হাত‌খোঁপা করে আঁচল তুলে দিয়েছে মাথায়‌। ফ্যাকাসে মুখ জানান দিচ্ছে জ্বরের তীব্রতা। মোতাহার আহসান আরুর অবস্থা দেখে বলেন, “বোন, একটা চেয়ার এনে বসা মেয়েকে।”

“না ভাইজান, বিচারের সময় সবাই দাঁড়িয়ে থাকে। আমি চাইনা আরুর তা অমান্য করুক।” আরুকে ধরে বলে পারুল। তবুও অনিতা ছোটো একটু টুল এনে দেয় বসতে। মোতাহার আহসানের আদেশে এবার তা খেয়ানত করার স্পর্ধা খুঁজে পায় না পারুল। বিচারকার্য পরিচালনার সিংহাসনে বলে বলেন, “ঐ শু/য়ো/রের বাচ্চাটাকে এখানে নিয়ে আসুন। ওর মাকে এনেছেন?”

“জি, চাচা।” প্রহরীরা বলেই চলে গেল গোয়ালঘরের উদ্দেশ্য। গোয়ালঘর থেকে বিষ্ঠাতে‌ লেপা কালাচাঁনকে নিয়ে হাজির হয় বিচারসভায়। নিমগাছের সাথে বেঁধে ফেলে তারপরে। কালাচাঁনকে দেখে ভয়ে জড়সড়ো হয়ে যায় আরু। মোতাহার আহসান উপস্থিত গ্ৰামের সামনে নিজের মতামতের রাখে, “আমার ভাগ্নির বিচার এখানে হচ্ছে না, এখানে বিচার হচ্ছে একটি মেয়ের। যাকে এই কালাচাঁন অ/পহ/র/ণ করে নিয়ে গেছে। তারপরের দিন গলায় দড়ি বেঁ/ধে মেয়েটিকে নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেয়। তাই আমি গতকাল রাতে ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এই কালাচাঁনকে একশো একটা বে/তের বাড়ি দিয়ে জুতার মালা গলায় পরিয়ে আপনারা গ্ৰাম থেকে বের করে‌ দিবেন। এই সুন্দরনগর গ্ৰামে এই ছেলের ছায়াও যাতে না পড়ে।”

তখনই সেখানে হাজির হয় সুন্দরী। একমাত্র ছেলে তার। ছেলের হয়ে হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে মিনতি করে, “আমার ছেলে ভুল করেছে সাহেব। ও অনেক বড় অন্যায় করেছে। ওকে এই শাস্তি দিবেন না। ক্ষমা করে দিন।(বিরতি টেনে) আমি আরুকে আমার বাড়ির বউ করে নিয়ে যাবো প্রয়োজনে।”

অনিতা এবার স্বামীর পক্ষ নিয়ে সুন্দরীকে বলে, “ছেলেকে আপনি মানুষ করতে পারেননি। একজনকে ভালো লাগতেই পারে। ঘটকের মাধ্যমে বিয়ে প্রস্তাব পাঠাবেন, পছন্দ হলে বিয়ে নয়তো সেখানেই শেষ। রাজি নয় বলে জোর করে নদীতে ঝাঁপ দেওয়া কেমন রীতি? একটু হলে..

বলতে গিয়ে কেঁপে উঠলেন অনিতা। কেঁপে উঠে উপস্থিত সবাই।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-৩০+৩১

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩০

সুজলা, সুফলা, শস্যশ্যামল সুন্দরনগরে এসেছে ইমদাদ হোসেন মৃধা। তিস্তার বিয়ের সময় তাকে ডিপার্টমেন্ট থেকে ছুটি দেওয়া হয়নি। তাছাড়া কাজের অনেক চাপ ছিল। এখন চাপ কম থাকার কারণে তিস্তার জন্য উপহার নিয়ে এসেছে। ট্রেশন থেকে সোজা ব্রিজের সামনে এসে রিকশা থামে। ইমদাদ হোসেন রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে ব্যাগ নিয়ে বাড়ির পথ ধরে। আহসান বাড়িটা নদীর এপার বলে ব্রিজ পর্যন্ত যেতে হয় না। তবে ব্রিজের কাছে না গেলে রিকশা পাওয়া যায় না। এজন্য ব্রিজের কাছে যেতে হয়। তবে মৃধা বাড়ি ওপাড় বলে ব্রিজ দিয়ে নদী পাড় হতে হয়। ইমদাদ হোসেন প্রথমে নিজের বাড়িতে যেতে চায়। ব্রিজের দুইপাশেই সারিবদ্ধ দোকান। ইমদাদ হোসেনকে দেখে দোকানদার চা বানানো রেখে বলে, “মৃধা সাহেব, মেয়ে নিখোঁজ কাল থেকে আর তুমি আজকে আসলে?”

“মেয়ে নিখোঁজ মানে?”

“তোমার মেয়ে আরুর কথা বলছি গো। কেন তুমি জানো না? তোমার মেয়েটার ভাগ্যে কী লেখা আছে, কে জানে। গতবার তানারা তোমার মেয়েকে নিয়ে গেল। এবার একদল ছেলে তোমার মেয়েকে নিয়ে গেল। পুলিশ সকালে এসে খোঁজ করেছিল, তখনই জেনেছি।”

ইমদাদ হোসেন বাক্যরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। আরুদের বাড়িতে কোনো ফোন নেই। আরুর বড় চাচার ঘরে একটা ল্যান্ডফোন আছে, সেটা দিয়ে কথা বলে ইমদাদুল। কিন্তু গতকাল কেউ তাকে ফোন করে আরু নিখোঁজের ব্যাপারটা জানায়নি। ইমদাদ হোসেন ছুটে বাড়ির দিকে চলে গেলেন। যেতে যেতে হোঁচট খেয়ে এক জোড়া স্যান্ডেজ ছিঁড়ে ফেললেন। জুতা জোড়া হাতে নিয়ে ছুটে বাড়িতে পৌঁছে গেলেন। দেখতে পেলেন, অয়ন তার চাচাতো ভাইয়ের সাথে খেলাধুলা করছে। ‘বোনের দুর্দশায় ভাই হোক ছোট বা বড়ো’ – সে থাকবে টঠস্ত। কিন্তু অয়নের এমন ভাব দেখে ইমদাদ হোসেন ভাবলেন, মশকরা করেছে লোকজন। রোয়াকে জিনিসপত্র রেখে বলে, “তোর বুবু আর মা কোথায় অয়ন?”

“মা পশ্চিম পাড়ায় বুবুর জন্য কাঁদছে। পরশুদিন তিয়াস ভাই সুমি ভাবীকে বাড়িতে নিয়ে এসেছে। কালকে শেফালী বুবু বি/ষ খেয়েছিল। সবাই শেফালী বুবুকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় বুবু পিছনে পিছনে গিয়েছিল। তখন থেকে বুবু নিখোঁজ। সবাই বলছে ওকে কেউ অ/পহ/র/ণ করেছে।” খেলতে খেলতে বলে অয়ন। পরপর তিনটি ঘটনায় ইমদাদ হোসেনের মাথায় স্বচ্ছ পরিবেশের মধ্যেও বাজ পড়ে। প্রতিবার তার আগমনে ছেলে ও মেয়ের মাঝে আনন্দের আমেজ পড়ে। ছেলের এমন গুরুত্বহীন কাণ্ডে ইমদাদ হোসেন ধরে নেয়, আরুকে হিং/সার কারণ। ইমদাদ হোসেন পশ্চিম দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রয়াস করলে একটা পেয়ারা তার মাথায় পড়ে। ইমদাদ হোসেন গতি রোধ করে উপরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই একটা তাবিজ ঝুলন্ত অবস্থায় দেখল গাছের মগডালে। হাত বাড়িয়ে নাগালে পেল না তাবিজখানা। গাছে উঠে তাবিজখানা নামানো জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করতেই ভেসে এলো চিৎকার। ইমদাদ হোসেন স্থির না থেকে ছুটে গেলেন পাড়ায়। পারুল আরুর শোকে কাঁদছে আর বড়ো বউ তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে।

“আমার মেয়েটা কোথা গেল ভাবী? কালরাত থেকে খুঁজে পাচ্ছি না। কালরাতে অয়নকে দুধ দেয় নি, এজন্য মেয়েটাকে আমি চ/ড় মেরেছি। অনেক কথা শুনেছি। মেয়েটা মনে হয় রাগ করে কোথাও চলে গেছে।” প্রলাপ ব/কে চলেছে পারুল। বড়ো বউ সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “তাহলে মেয়েটা যখন কাছে থাকে, তাহলে কেন ওকে মারো?”

“গুনধর পুত্রকে দুধ দেয়নি, এজন্য মে/রেছে। আমার মেয়েটাকে একদম সহ্য করতে পারে না।” বিরক্ত নিয়ে বলে ইমদাদ। পারুল স্বামী দিকে তাকিয়ে কান্নায় প্রবল ভেঙে পড়ে। স্বামী স্ত্রীর মাঝে তৃতীয় ব্যক্তিকে নিষিদ্ধ করে বড়ো বউ চলে গেল। পারুল তখন কাঁদতে কাঁদতে ইমদাদকে জড়িয়ে ধরে বলে, “তুমি এসেছ, যেভাবে হোক আমার মেয়েটাকে ফিরিয়ে এনে দাও। আমি আর কখনো ওর গায়ে হাত দিবো না।”

“কেঁদো না। আমি আছি। সব ঠিক করে দিবো। আর নিখোঁজের ব্যাপারটা তুমি আমাকে কেন জানলে না, পারুল?”

“তুমি ঢাকাতে থাকো। তুমি চিন্তা করবে, এজন্য আমি কিছু জানাইনি।”

“সন্ধ্যা হয়ে গেছে। হাঁস মুরগি খোপরে ঢুকিয়ে আহসান বাড়িতে চলো। তোমাকে এখানে একা রাখতে আমার ভয় করছে এমন। ভাইজানের সাথে কথা বলতে হবে।”

“ছাগলদের গোয়ালে দিয়েছে, হাঁসমুরগির খোপরে দিয়েছি। এখন আর কোনো চিন্তা নেই। আর ভাইয়া বলেছে, যেভাবে হোক আরুকে খুঁজে নিয়ে আসবে।”

অতঃপর বাড়িতে লম্বা একটা তালা ঝুলিয়ে ইমদাদ ও পারুল আহসান বাড়ির দিকে গেল। অয়নের ভাব দেখে তার দাদির কাছে রেখে আসল।
__

চিনের তৈরি চৌচালা ঘর কালাচাঁনদের। সেই বড়ো ঘরে কালাচাঁন ও তার বৃদ্ধ মা থাকে। কালাচাঁনের আম্মা সুন্দরী ভর সন্ধ্যায় উঠান ঝাড়ু দিতে ব্যস্ত। তখন সেখানে প্রবেশ ঘটে অপূর্বদের। আশেপাশে তাকিয়ে তিস্তা বলে, “এটাই কালাচাঁন বাড়ি আর উনি কালাচাঁনের মা‌। আগেরবার ওনার কাছেই কালাচাঁনের নামে বিচার দিয়েছিলাম।”

“তোরা থাক, আমি ছলেবলে কথা শুনে আসছি।” বলেই অপূর্ব এগিয়ে যায়। কালাচাঁন মা সুন্দরী অপূর্বকে দেখে ঝাড়ু দেওয়া বন্ধ করে বলে, “তুমি কে বাবা, আমার বাড়িতে কী করো?”

“আমি কালাচাঁনের বন্ধু। কালাচাঁন বাড়িতে আছে‌ চাচি?”

“না বাজান, কালাচাঁনরে বাড়িতে পাওয়া যায় না। ও সারাদিন রাস্তায় টইটই করে। শুধু ওয়াক্ত মতো একে গিলে যায়।” বলতে বলতে আবার সুন্দরী ঘর ঝাড়ু দিতে থাকে। কালাচাঁনের এই বাড়িটি একদম ভেতরের দিকে এবং এদিকে কোনো ঘর নেই। এরমধ্য লম্বা দৈত্যের মতো ছায়া বাড়ির উঠানে পড়ে। অপূর্ব কান পেতে শুনতে পারল পাতার উপরে হাঁটার শব্দ। তাই তিস্তাদের কাছে গিয়ে আড়াল হয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে প্রকট হয় কালাচাঁন। বাড়ির পেছন দিক দিয়ে উঠানে এসে সুন্দরীকে বলে, “কী রান্না করেছ আম্মা?”

“ছিপ ফেলে শোল মাছ ধরেছিলাম বাড়ির পেছন থেকে। সেটাই রান্না করেছি। তুই আজ এত তাড়াতাড়ি বাড়িতে এলি যে, তোকে তো রাত দশটার আগে বাড়ির আশেপাশে দেখা যায় না।”

“বিলের মাঝখানে আমাদের সে আম বাগান আছে না? লোকেরা না-কি আম পেরে বিক্রি করছে, খবর পেয়েছি। তাই একজন বন্ধুকে নিয়ে সেখানে থাকব। সেখানে তো ঘর করা আছে, আমাদের অসুবিধা হবেনা। এখন রাতের জন্য খাবার নিতে এসেছি। নিয়েই ফিরে যাবো। যা রেঁধেছ, নিয়ে এসো। হাতে একদম সময় নেই।” কালাচাঁনকে প্রচণ্ড ভয় পায় সুন্দরী। ছেলের মুখের উপর কোনো কথা না বলে ঝাড়ু রেখে ঘরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর গামছা মুড়িয়ে খাবার নিয়ে এসে কালাচাঁনের হাতে দেয়। কালাচাঁন খাবার নিয়ে পূর্বের পথ ধরে চলে যায়। পরক্ষণে ছেলের গমন পথের দিকে তাকিয়ে ঘরে ঢুকে খিল তুলে দিলেন সুন্দরী‌। আড়াল থেকে অপূর্বরা বেরিয়ে আসে। তুর সন্দেহ নিয়ে বলে, “আমার মনে হয়, ঐ বিলের মাঝেই আরুকে ব/ন্দি করে রাখা হয়েছে।”

তিস্তা বলে, “হতে পারে, নাহলে যে কালাচাঁন বাড়ির কোনো খবর নেয় না, কাজ করে না। সে হঠাৎ রাস্তায় আড্ডা দেওয়া রেখে কেন বিলের মাঝে থাকবে? আমাদের গিয়ে দেখতে হবে।”

কালাচাঁনদের বাড়ির পাশ গিয়ে বয়ে গেছে নদী। নদীর পানি জোয়ারের জন্য ক্ষেতে উঠে আবার ভাটায় নেমে যায়‌। বারো মাস ভিজে থাকে। এখন জোয়ার বইছে তাই ভিটার চারপাশের ছোটো নালাতে পানি জমে আছে। কালাচাঁন লাফ দিয়ে সেই নালা পেরিয়ে পানির মাঝে ছোপ ছোপ করে হেঁটে চলেছে। আলো বিম্ব জানাচ্ছে কালাচাঁনের গতিপথ। অপূর্বর নালা সম্পর্ক কোনো ধারণা নেই। তাই কদম ফেলে কালাচাঁনের পথ ধরতেই নালার ভেতরে পড়ে গেল। বেকায়দায় পড়ে পা মচকে ফেলেছে। অপূর্ব সেখানে পড়ে চাপা আর্তনাদ করতেই তিস্তা ও তুর ধরে তুলে অপূর্বকে। অপূর্ব পায়ের দিকে না তাকিয়ে ক্ষেতের দিকে তাকাচ্ছে। ততক্ষণে কালাচাঁন মিলিয়ে গেছে অন্ধকারে। অপূর্ব পা ফেলতে পারছে না ব্যথায়।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩১

আরু কুঁড়েঘরের একপাশে শুয়ে আছে। বিরতিহীন ধারায় কেশে চলেছে। শত হোক, ভালোবাসার মানুষ , তাকে যাতনা দেওয়া সাজে না। আরু ভার মাথা নিয়ে হেলান দেয় কুঁড়ের তৈরি দেয়ালে। ঘরে কিছু খড়কুটো ছাড়া কিছু নেই। জমানো খড়কুটোর পাশে পরে আছে অবশিষ্ট কিছু বিড়ির টুকরো। আরু হাত দিয়ে শরীরের তীব্রতা পরখ করে নেয়। সেদিন জোরজবরদস্তি করে আরুকে ডিঙিতে তোলার সময় ভিজে জবুথবু হয়েছিল। ভেজা অবস্থা থেকে ঠান্ডা তাকে আপন করে নিয়েছে। দীর্ঘক্ষণ তৃষ্ণার্ত থাকার কারণে খালি ঢোক গলা বেয়ে নেমে যেতে বাঁধা পায়। আরু ফোঁস করে উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেলে মাটির কলসের কাছে হামাগুড়ি দিয়ে ছুটে যায়। কলস থেকে নারিকেলের খোলসে পানি ঢেলে নিজের তৃষ্ণা নিবারণ করে।

তখনই শুনতে পেল কালাচাঁনের মুগ্ধ করা গানের সুর। পরেনা চোখের পলক, কী তোমার রূপের ঝলক। আমি জ্ঞান হারাবো, মরে যাবো।
বাঁচাতে পারবে না কেউ।

কালাচাঁন চাবি দিয়ে তালা খুলবে এমন সময়ে দেখতে পেল আম গাছের ডালের সাথে বিঁধে রাখা একটা পাটের থলে। আরুর জন্য কবিরাজের থেকে জরিবুটি আনতে বলেছিল, তা এনে বাইরে রেখে দিয়েছে। কালাচাঁন থলে নিয়ে তালা খুলে প্রবেশ করে ভেতরে। আরুকে দেখে তার ঠোঁটের কোণে স্ফুটিত হয় জোড়াল হাসি। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে খাবার বের করে কালাচাঁন। দেড় দিন না খেয়ে থাকাতে পেটে মোচড় দিয়ে উঠে আরুর। ক্লান্ত আরু নিজ থেকে খাবার কোলে তুলে নেয় খাওয়ার উদ্দেশ্যে। আরুর জীর্ণদশা দেখে কালাচাঁন খাবার নিয়ে নেয়। নিজের হাতে মেখে খাইয়ে দেয় আরুকে। আরুর চোখে পানি চলে এসেছে। সে লক্ষ্য করে কালাচাঁনের চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে। তাকে এই জীর্ণদশা সহ্য হচ্ছে না বোধহয় কালাচাঁনের। সত্যিকারের সেই ভালোবাসা। কালাচাঁনকে খাওয়ানো শেষ করে পাটের থলে থেকে একটা নতুন শাড়ি আরুর সামনে রেখে বলে, “এটা পরে নিও গোলাপী। তোমাকে এই অবস্থায় দেখলে আমার অন্তঃকরণ চূর্ণ বিচূর্ণ হয়।”

“আমার বাইরের অবস্থা দেখে আপনার এই অবস্থা, ভেতরের অবস্থা দেখলে কী করবেন?”

“গোলাপী, আমার দোষটা আসলে কোথায়? সেই সাড়ে চার বছর ধরে একটু একটু করে তোমাকে ভালোবেসে চলেছি। আমার গায়ের রঙ কালো। বিধাতা করেছে কালো, আমি করব কী?” কালাচাঁনের অনুভূতি পূর্ণ কণ্ঠটা শুনলে মৃ/ত্যুদ/ন্ড প্রাপ্ত আ/সামী/র আদেশেও জল্লাদ পিছিয়ে যাবে। এক গাছের ছাল অন্য গাছে লাগে না। যার বাম পাঁজর দিয়ে নারী সৃষ্টি, সে ভালো না বাসলেও মিলন তার সাথেই লেখা। হোক সে কাঁলাচানের মতো পা/গ/লা প্রেমিক। সেখানে আরু একটা মানুষ। আরু জ্বর যখন হুরহুর করে বেড়ে যাচ্ছিল, তখন অপারক হয়ে কালাচাঁন আরুর মাথায় পানি ঢেলেছিল। জীবনে এক গ্লাস পানিও সে ঢেলে খায়নি। সে রাত জেগে প্রিয়তমার সেবায় নিয়োজিত ছিল। আরুর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। বেড়ার পাশে পড়ে থাকা *দা* তুলে নিয়ে কালাচাঁনের দিকে এগিয়ে ক্রন্দনরত অবস্থায় বলে, “নিন, এটা দিয়ে আমাকে দ্বি খণ্ডিত করে ফেলুন। দুইজন মানুষ আমাকে এত করে চায়, অথচ আরু মাত্র একটি। কারো গোলাপী, কালো পদ্মবতী। আমাকে দুই টুকরো করলে অপূর্ব ভাইও পাবেন, আপনিও পাবেন।”

“অপূর্বকে তুমি ভালোবাসো। তাহলে কেন সেদিন তুমি আমাকে বলেছিলে ‘বিয়ের কথা?’ আমি সেদিন ভেবেছিলাম, তুমিও আমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছ। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা আরো গাঢ় হতে শুরু করেছিল। শোনো গোলাপী, তুমি যদি আমার নাহয় তুমি কারো নয়। তুমি যদি আমার হও। তবে তুমি আমার।” আরুর হাত থেকে কালাচাঁন *দা* নিয়ে ফেলে দিল মাটিতে। কালাচাঁনের দৃঢ় গলায় আরু বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। আরুর কাঁধ শক্ত করে ধরে জবাব চাইছে কালাচাঁন। আরু হাত দুটো সরিয়ে দিয়ে মাটিতে বসে পড়ে। গতকাল মাথায় পানি দেওয়ার কারণে পানি অনেকটা নরম। আরু সেই মাটি মুঠো করে ধরে অঝোর ধারায় অশ্রুপাত ঘটাতে থাকে। কালাচাঁনের সহ্য হয় না আরুর কান্না। ঘরের পানি ভর্তি কলসটা তুলে সম্পূর্ণ পানি ফেলে দেয় মেঝেতে। চুষে নেয় শুষ্ক মাটি। কলসের ভেতরে ঢুকলো দড়ি। একহাতে আরুর হাত ধরে, অন্যহাতে কলসখানা তুলে এগিয়ে যায় সামনের দিকে। আরুর রুগ্‌ণ দেহ অনেকটা গিয়ে হার স্বীকার করে। কিন্তু ক্ষান্ত হয় না কালাচাঁন। আরুকে নদীর ধারে এনে বজ্রকণ্ঠে বলে, “আজ এই নদী সাক্ষী হয়ে থাকবে আমাদের ভালোবাসার। কারো মৃ/ত্যুতে কারো জীবন থমকায় না, তাই তোমাকে সাথে নিয়ে আমি দুজনের জীবন থমকাবো।”

বলেই কলস ভর্তি করে নিল নদীর পানিতে। আরুর দেহে কাঁপন সৃষ্টি হলো। জোরপূর্বক বেঁধে দিল তা আরুর গলায়। আরুর পীড়িত দেহ পেরে উঠল না কালাচাঁনের সাথে। কাতর স্বরে বলে, “দেখ কালাচাঁন, আমি চেয়ারম্যান বাড়ির ভাগ্নে। একবার যদি জানতে পারে কেউ, তুই আমাকে মে/রেছিস। তোকে কেউ আস্ত রাখবে না।”

“হা! হা! হা! হাস্যকর। আমি তো তোর সাথেই ইতি টানতে চলেছি জীবনের। আমাকে পাবে কোথায়?” অপূর্বর কণ্ঠে আরু ভীত হয়ে উঠে। জীবনের মায়া। ছুটে যায় গলায় ভারী কলস নিয়ে। বেশিদূর যাওয়ার আগেই কালাচাঁন তাকে থামায়। আরু কাতর হয়ে বলে চলেছে, “আমি ম/র/ব না, দয়া করে আমাকে ছাড়ুন।”
__
অপূর্ব তার পা নিয়ে বোনদের কাঁধে ভর করে পেরিয়ে এসেছে এতটা পথ। নদীর ধার দিয়ে সরু রাস্তা পার হওয়ার সময় কানে এলো ফিসফিস শব্দ। আলোর বিন্দুমাত্র রেখা নেই। অপূর্বর মন ছটফট করছে। অপূর্ব বিচলিত হয়ে বলে, “যেভাবে হোক আজ রাতের ভেতরে আরুকে উদ্ধার করতে হবে। আরু যে আমার অর্ধ অঙ্গ। আমি ওর কষ্ট অনুভব করতে পারছি।”

“শান্ত হন ভাই, কালাচাঁন আরুর জন্য খাবার নিয়ে গেছে। আমার মনে হয়, কালাচাঁন ওর অযত্ন করবে না। আমরা চাচাকে জানাই, কালাচাঁনদের আম বাগান সম্পর্কে আমাদের ধারণা নেই। চাচাকে জানালে, লোক লাগিয়ে আরুকে বের করে আনতে এক মুহুর্তও লাগবে না।” তিস্তা বলে সান্ত্বনা দেয় অপূর্বকে। আরও কিছুটা পথ অতিক্রম করতেই অন্তঃকরণ সিগন্যাল পাঠায়, আরু সন্নিকটে। অপূর্ব তখন উদাসীন হয়ে উঠল। পাশেই ফিসফিস কথোপকথন ও পানির শব্দ শুনতে পেল। ছুটে গেল সেখানে। টর্চের আলোটা দুজনের মুখে পড়ে। অপূর্ব দেখতে পায় অচেনা আরুকে। বাক্য হারিয়ে ফেলে। তখনই কালাচাঁন আরুর হাত ধরে ঝাঁপ দিল পানিতে। তিনজন মানুষ বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকে। ধ্যান ভাঙতেই অপূর্ব দুই বোনের হাত ছাড়িয়ে নিজেও ঝাঁপ দিল নদীতে। অথচ সে সাঁতার জানে না। তুর ও তিস্তা অপূর্বকে ধরতে গিয়েও ধরতে পারেনা। পূর্ণিমা তিথি বলে তখন নদীর পানি তটের অনেক উর্ধ্বে। দুইজন মানুষ ছিটে গেলেও আরু বোধহয় কলসের ভারে তলিয়ে গেছে নদীর তলদেশে। কিছুক্ষণ পর অপূর্ব ভেসে উঠল। সাঁতার দেওয়ার চেষ্টা করছে। একবার তার মাথা দেখা যাচ্ছে, আরেকবার দেখা যাচ্ছেনা। অপূর্ব যে তুরের আপন ভাই। তুর ঝাঁপ দিয়ে নদীতে। পূর্ণিমা হওয়ার কারণে পানির পাশাপাশি অনেক স্রোত। তুর বহু কষ্টে অপূর্বকে তুলে আনে পাড়ে। অপূর্ব হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, “ওটা আরুই ছিল। ওরা কেন ভেসে উঠছে না?”

“তুই সিউর ওটা আরু ছিল?”

“শুধু আরু নয়, কালাচাঁনও ছিল। আরুর গলায় আমি একটা কলস দেখছি। সেই কলস থেকে পানি পড়ছিল। কীভাবে ওকে বাঁচাবো আমি।” বলেই অপূর্ব কান্নায় ভেঙে পড়ে। পুনরায় আরুর জন্য নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার প্রয়াস করলে তিস্তা বাধা দেয়। টর্চ দিয়ে নদী পর্যবেক্ষণ করে বলে, “নদীতে যা স্রোত, না-জানি ওদের ভাসিয়ে কতদূর নিয়ে গেছে।”

‘তার পদ্মবতীর উচিত পদ্মের মতো ভেসে থাকা এই জলে?’ অপূর্বকে চিন্তা মুক্ত করতে সেখানে এসে উপস্থিত হলো একদল জেলে। নৌকায় করে নদীতে মাছ ধরা তাদের পেশা!

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-২৮+২৯

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২৮

“তুই না-কি অয়নকে দুধ খেতে দিবি না বলে দুধের গ্লাস ভেঙে ফেলেছিস?” বলতে বলতেই হাঁটু গেড়ে আরুর পাশে বসে অপূর্ব। একতরফা অপূর্বর প্রতি তীব্র অভিমানের ভেলা ঘিরে ধরল চারপাশ থেকে। আরু মুখ ফিরিয়ে নিল পূর্ব দিকে। সেদিকে শেয়াল ডেকে চলেছে। ততক্ষণে গা ঘেঁষে অপূর্ব বসে নিজের মাথা আরুর কাঁধে ঠেকিয়ে দিয়েছে। চাপা অভিমান নিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে, “অপূর্ব ভাই, আপনিও আমাকে বুঝলেন না? আপনিও ভেবে নিলেন, আমি অয়নের জন্য গ্লাস ভেঙেছি?”

“নীরবতা সম্মতির লক্ষণ। তুই যদি মুখ ফুটে সত্যিটা না বলিস, আমি সত্যিটা জানতে পারব না। আবার অন্যের কথার পরিপ্রেক্ষিতে তোকেও অবিশ্বাস করতে পারব না। আরুপাখি, বল কী হয়েছে?”

দিঘিতে মাছে বুটবুট করে তার সাথে আরুও নিজের বাক্য তোলে, “শেফালী কীটনাশক জাতীয় কিছু একটা দুধে মিশিয়ে সুমি ভাবীকে খাওয়াতে চেয়েছিল। আমি বাধা দিয়েছি বলে নিজে খেতে চাইল। সেই মুহুর্তে আমি দুধের গ্লাস নিয়ে বাইরে আসতেই অয়ন উঠে পড়ে লাগে দুধ খাবে। বোন হয়ে ভাইয়ের মুখে জেনে শুনে কীভাবে বি/ষ তুলে দেই। জোর করাতে ইচ্ছে করেই আমি গ্লাসটা ভেঙে ফেলেছি।”‌

আরুর এমন প্রত্যুক্তিতে অপূর্বর খোয়া গেছে বুলি। চোখজোড়া রসগোল্লার মতো হয়েছে। ঠোঁটের পল্লব জোড়া বিচ্ছিন্ন হয়েছে ঈষৎ। রাগে কাঁপছে অঙ্গ। ত্রস্তব্যস্ত হয়ে অপূর্ব বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। এর ফলাফল অনুমান করে পথ আটকে দাঁড়াল আরু। বিহ্বল হয়ে বলে, “বাড়ির দিকে আপনি যাবেন না।”

রোষের গোঙানি তুলে আরুকে সরাতে সরাতে বলে, “আমার সামনে থেকে সরে যা আরু, ‘এই কাজটা করার আগে ওর কলিজা একবারও কাঁপেনি কেন?’ – আমি ওকে সেটা জিজ্ঞেস করব। সামলে থেকে সর।”

“আজকে তিয়াস ভাই সুমি ভাবী সবাই অনেক খুশি। এমন সময় যদি শেফালীর কথা জানাজানি হয় সবাই অনেক কষ্ট পাবে। দয়া করে, আপনি আজকে কিছু বলেন না। ছোটো মামা শুনলে কষ্ট পাবে।” অপূর্ব হাত ধরে আশা নিয়ে বলে আরু। আরুকে আশাহত না করে দৃঢ় করে ধরে হাতটা। অসময়ে ঝুম ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়। অতঃপর বৃষ্টি হতে ত্রাণ পেতে আশ্রয় নেয় নারিকেল গাছের নিচে। জড়সড়ো হয়ে বসে পাঞ্জাবির পকেট থেকে ছোটো একটা পলিথিন বের করে। প্রেমের বান ভেঙে বলে, “শুনেছি বিয়ের মিষ্টি খেলে মেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়। এই মিষ্টিটা তুই খেয়ে ফেল। দেখি কবে আমাদের বিয়ে হয়।”

বলে অপূর্ব মিষ্টিটা মুখে নিয়ে এগিয়ে ধরল আরুর দিকে। আরু ভেঙে নেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই অপূর্ব থামলো হাতের গতি। আরু বুঝে গেল তার করণীয় কাজ কী! দূরত্ব ঘুচিয়ে অপূর্ব থেকে আংশিক মুখে নিয়ে নতজানু হলো লজ্জায়। প্রিয় মানুষের দেওয়া লজ্জায় প্রিয় মানুষের বুকে মুখে গুজে দিল।
__
আরু দ্রুতহাতে ফুলের মালা গাঁথছে। বাসর ঘর সুন্দর করে সাজিয়ে বিছানার উপর সুমিকে রাখল। তাজা দুধ গরম করে নিজের হাতে এনে টেবিলের উপর রেখেছে আরু। ততক্ষণে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে তিয়াস। ঘরে পা রাখার আগে অবরোধ জারি করে আরু বলে, “ঘর সাজাতে আমাদের অনেক খাটতে হয়েছে। এক হাজার টাকা দিলে বউ আর ঘর দুটোই আপনার। নাহলে আমরা আজ বাসর করব ভাবীর সাথে।”

“কী?” এক হাজার! তোরা কী ডাকাত? এত টাকা চাইছিস কেন? কম নে বোন।” তিয়াসের করুন অনুরোধ। পেছন থেকে অপূর্ব হেলান দিয়ে বলে, “এগারো শো।”

“মাত্র তো বলল, এক হাজার।”

“যত কথা বলবি, তত বাড়বে। তাড়াতাড়ি দে, নাহলে আরও বাড়বে। বারোশো।” অপূর্ব থামার আগেই তিয়াস ঘরের ভেতরে ঢুকল। টেবিল ক্লথের নিচ থেকে বারোশো টাকা বের করে আরুর দিকে এগিয়ে দিল। তুর তা ছিনিয়ে নিল। অপূর্ব আশেপাশে চেয়ে দেখে শেফালী নেই উপস্থিত। তুর টাকা গুনতে গুনতে বলে, “ভাইয়া, আপনি নতুন বউ পেয়েছেন। আমরাও ভাবী পেয়েছি। আমাদেরও তো একটা হক আছে ভাবীর সাথে বাসর করার।”

“তবে রে.. বলে এগোতেই তুর ছুটে গেল বাইরে। অপূর্বর সাথে বেরিয়ে যেতে যেতে আরু বলে, “টেবিলের উপর গ্লাস আছে। বড়ো মামি দিয়েছে।”

তিয়াস ছিটকিনি তুলে ধীর পায়ে এগিয়ে সুমির পাশে বসে। ঘোমটার কারণে মুখের কোনো অংশ দেখা যাচ্ছে না। তিয়াস ঘোমটা তুলে সুমিকে দেখে নিজের তৃষ্ণা মেটায়। দুহাত মেলে দিয়ে দেয় বুকে আসায় ইঙ্গিত। শরীরের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে হুরহুর করে। সুমিকে এক হাতে জড়িয়ে জানালা খুলে দিল তিয়াস। বাইরে থেকে আসা বৃষ্টির ঝাপটায় উপশম হলো সেই রোগ। সুমির ওষ্ঠদ্বয় ঢাকা পড়ল প্রেমিকের ওষ্ঠের ভাঁজে। আকাশের ফালি চাঁদটা বহু আগে লজ্জায় লুকিয়ে গেছে মেঘের আড়ালে।
__
অপূর্বর বিছানা ঝেরে বালিশ‌ ঠিক করে দিল আরু। অপূর্ব হাত দুটো বুকে গুজে হেলান দিয়েছে দেয়ালে। আরুর কাজ শেষ করে পা গতিশীল করার পূর্বে টেনে ধরল অপূর্ব। আলমারিতে গুছিয়ে রাখা বিয়ের বেনারসিটা হাতে তুলে দেয়, দিল আরও একটি প্যাকেট। যা ভর্তি চুড়ি দিয়ে। আরু চমকে উঠে বাক্য সাজায়, “এগুলো আপনি আমাকে দিচ্ছেন কেন?”

“সেম ডিজাইনের চুড়ি খুঁজে পাইনি। তাই এগুলো সব নিয়ে এসেছি। আর বেনারসিটা আমার আরুপাখি পছন্দ করেছে। তাই আগাম নিয়ে এলাম।”

“বিয়ের সময় এমন সাদামাটা বেনারসি পরলে চেয়ারম্যান বাড়ির মান থাকবে?”

“রাতে এটা পরবি। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখব কেবল।”

“এটা আপনার কাছে রেখে দিন। মা শাড়ি দেখলে প্রশ্ন করে আমার পাগল করে ফেলবে।” আরুর কথায় সায় দিয়ে অপূর্ব শাড়িখানা তুলে রাখে আলমারিতে। তবে এখন মুঠো চুড়ি আরুর হাতে পরিয়ে দিতে ভুলে না। আরু চুড়ির জোড়া ছুঁয়ে বলে, “শুভ রাত্রি।”

অতঃপর আরু তুরদের ঘরে গেল। তুর বসে বসে টাকা থুতু দিয়ে গুনতে ব্যস্ত। আরু দেখল সেখানে নেই শেফালী। মেয়েটা রাগে আজও আসেনি ঘুমাতে। আরু সেই ফাঁকা ঘরটাতে গেল। দরজাটা ফাঁক করতেই স্তম্ভিত হলো সে। দুধের গ্লাসে শেষ চুমুক দিয়ে টেবিলের উপর রেখেছে শেফালী। ছিটকিনির শব্দে শেফালী জানে আরু এসেছে। একটা ব্যঙ্গাতক হাসি দিয়ে বলে, “আরু তুই এবার আর আমাকে বাঁচাতে পারলি না। পারলি না, পারলি না। আমি ঠিক দুধ খেয়ে ফেললাম। জানিস আরু, আমার ভেতরটা পুড়ে ছাই হয়ে যায় ওদের একসাথে দেখলে। তিয়াস ভাইয়ের পাশে আমার থাকার কথা ছিল, কিন্তু আজ ঐ সুমি। আমি তিয়াস ভাইকে আপন করতে না পারি মৃত্যুকে ঠিকই আপন করতে পারব।”

শেফালী গলা চেপে ধরে ছটফট করেছে মাটিতে। ওর শরীরে মাটি লাগছে। আরুর শরীর কম্পনের জন্য অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। আরু ছুটে গেল তুরের কাছে। কিন্তু তুর ওকে পাত্তা দিল না। ছোটো মামার ঘরের দরজায় ধাক্কা দিতেই মণি বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। হাই তুলে বলে, “কী হয়েছে আরু মা? এতরাতে দরজা ধাক্কা দিলি কেন?

“শেফালী ঐ ঘরে একা শুয়েছে। ও কেমন করছে..

“ও গতকালও ঐ ঘরে ঘুমিয়েছে। দুইদিন থাকতে দে, নিজেই তোদের ঘরে চলে যাবে।” আরুকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে খিল দিল মণি। আরু অসহায় হয়ে পড়ে শেফালীর চিন্তায়। শেষ ভরসা হিসেবে ছুটে যায় অপূর্বর কাছে। দুহাতে একের পর এক ধাক্কা দেয় দরজায়। ঘুম ভেঙে যায় অপূর্বর। বিরক্ত হয়ে দরজা খুললে অপূর্বকে কথা বলার কোনো সুযোগ দিল না আরু। নিজে থেকে সাহস নিয়ে বলে, “অপূর্ব ভাই, আমাদের শেফালী বি/ষ খেয়েছে। মাটিতে পড়ে কেমন‌ কাতরাচ্ছে। কেউ আমার কথা শুনছে না।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
#পর্ব: ২৮ (বর্ধিতাংশ)

“অপূর্ব ভাই, আমাদের শেফালী বি/ষ খেয়েছে। মাটিতে পড়ে কেমন‌ কাঁতরাচ্ছে। কেউ আমার কথা শুনছে না।”
আরুর ব্যাকুল কণ্ঠে অপূর্বর ঘুম ঘুম ভাবটা অনায়াসেই দূর হয়ে গেল। তিন সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে ছুটে গেল শেফালীর ঘরে। শেফালীর কাতরানোর দৃশ্যটা সহ্য করতে পারে না অপূর্ব। পার্লস রেট চেক করতে করতে আদেশ দেয়, “রান্নাঘরে ডিম দেখেছি। তাড়াতাড়ি সেখান থেকে ডিম নিয়ে আয়।”

পরক্ষণেই উল্কার বেগে রান্নাঘরের দিকে ধাবিত হলো আরু। খাঁচি আর বাটি দুটোই তুলে নিয়ে এলো। তারপরে বাটিতে ভেঙে খাওয়ানোর সময় লক্ষ্য করল চামচ নেই। অপূর্ব রাগান্বিত কণ্ঠে বলে, “চামচটা কি আমি গিয়ে নিয়ে আসব?”

আরু ছুটে চামচ নিয়ে ফেরত এলো। এই সাধারণ দূরত্ব এতো জলদি আসা-যাওয়া করল যে, ওর পা যাতনায় টনটন করে উঠে। অপূর্ব শেফালীর মুখে কাঁচা ডিম তুলে দেয়। কাঁচা ডিমের গন্ধে শেফালীর পেট মোচড় এলো বমি। ভাসিয়ে দিল ঘর। অপূর্ব অনেকটা নিশ্চিন্ত হলো, অতঃপর বাজখাঁই গলায় বলে, “কে কোথায় আছো? তাড়াতাড়ি এখানে এসো। আমাদের শহরে যেতে হবে। শেফালী বি/ষ খেয়েছে।”

অপূর্বর চিৎকারে কিলোমিটার দূরে থাকা কাকটাও ডাল ছেড়ে উড়ে গেল। কিছুক্ষণের ভেতরে সবাই হাজির হলো ঘরে। ততক্ষণে অপূর্ব পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়েছে শেফালীকে। শেফালীর জ্ঞান নেই। মেয়ের এমন অবস্থা দেখে মণি অস্থির হয়ে বলে, “আমার মেয়ের কী হয়েছে আরু? ওকে অপু কোথায় নিয়ে গেছে?”

“শেফালী কীটনাশক খেয়েছে মামি। অপূর্ব ভাই অনেকটা বের করে এনেছে, বাকিটা বের করার জন্য হাসপাতালে ছুটছে।” বলেই আরু ছুটে গেল। সবাই বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, এখন করণীয় কাজটি করতে তারা ভুলে গেছে। ততক্ষণে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে তিয়াস ও সুমি। ড্রয়িং রুমে মা চাচির হাহাকার শুনে ধারণা হলো অনেকটা। বাবা চাচারা ইতোমধ্যে ছুটেছে। পুরুষ মানুষদের মধ্যে তিয়াস একা গেল না। প্রাণহীন জড় পদার্থের ন্যায় ঘরে ফিরত এলো। পতির এমন অবনতি দেখে সুমি এলো ঘরে। ঈষৎ রাগান্বিত কণ্ঠে বলে, “সেদিন নাহয় শেফালী আমাকে নিয়ে একটা খা/রা/প কথা বলেছে। এতে খা/রা/প লাগলেও সত্যি। তাই বলে মেয়েটার এমন বিপদে ভাই হয়ে কা/পুরুষের মতো দরজায় খিল দিয়ে বসে থাকবে? আমার হাতের চুড়িগুলো নাও, হাতে দিয়ে বসে থাকো।”

বলতে বলতে আংশিক খুলে ফেলে সুমি। সুমিকে বাধা দিয়ে নিজের দুঃখ ভাগাভাগি করে তিয়াস, “তুমি তোমার স্বামীর ভাগ কাউকে দিতে পারবে সুমি?”

বিস্ময়ে আঁতকে উঠে তিয়াসের দিকে তাকায় সুমি। পরবর্তী বাক্য তুলতে বাধা দিতে হাত ঠেকিয়ে দিল তিয়াসের ওষ্ঠদ্বয়ে। ব্যথিত গলায় বলে, “কোনো নারী তার স্বামীর ভাগ কাউকে দিতে পারে না। আমিও একজন নারী। তোমাকে ভাগ করে নেওয়ার আগে আমি নিজেকে ভাগ করে ফেলবো।”

“শেফালী সেই ভাগটা চায়। শেফালী আমাকে নিজের স্বামী হিসেবে চায়। ও আমাকে ছোটো থেকে ভালোবাসে।” হাতটা সরিয়ে উৎকন্ঠিত হয়ে বলে তিয়াস। সুমি কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এতক্ষণে সে ঠাওর করতে পারছে, শেফালীর এমন আচরণের মানে। বিয়ের এক সেকেন্ড আগেও যদি ব্যাপারটা আঁচ করতে পারব, ফিরে যেতে বাড়ি। সুমি আচমকা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। তিয়াস নিজেই হতভম্ব। অল্পতেই হেঁচকি তুলে বলে, “তুমি আমাকে দোষী করে দিলে। ঐ বাচ্চা মেয়েটার কাছে আমাকে ঋণী করে দিলে‌। ওর যদি কিছু হয়ে যায়, আমাকে সারাজীবন চাচির একমাত্র সন্তান হারানোর অভিশাপ নিয়ে বাঁচতে হবে।”

“শান্ত হও, ওর কিছু হবেনা। আমি সব ঠিক করে দিবো।”

“তুমি আমার জীবন গুছিয়ে ওর জীবন কেড়ে নিবে?” দুহাতে পাঞ্জাবিটা মুষ্টিবদ্ধ করে কুঞ্চিত করে ফেলেছে অনেকটা। তিয়াস সুমির মাথায় হাত বুলিয়ে কেবল ওকে সান্ত্বনা দিয়ে চলেছে। বুক ছিঁড়ে প্রকাশ পেল একটা বিষাক্ত নিঃশ্বাস।
__
গা ছমছমে পরিবেশ। শেফালীকে কোলে তুলে ছুটে চলেছে অপূর্ব। তার পেছনে পেছনে লম্বা কদম ফেলে বাবা-চাচারা আসছে। তার পেছনে আসছে আরু। আরুর অনেকটা পেছনে আসছে অপূর্বর তিন চাচি ও মা।
ব্রিজ পর্যন্ত আসতেই বিপরীত দিক থেকে দুইটা বেবিট্যাক্সি এসে থামল সামনে। মোতাহার আহসান ফোন করে আসতে বলেছে বাড়ির কাছে। অপূর্ব শেফালীকে যত্ন করে বেবিট্যাক্সিতে তুলে দেয়। সেই বেবিট্যাক্সিটা শাঁ শাঁ করে গন্তব্যের জন্য রওনা হতেই অপূর্ব এলো অন্য বেবিট্যাক্সির দিকে। দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো ছুটে আসা পদ্মাবতীর দিকে। আরুর দিকে কয়েকপা এগিয়ে কাঁধে হাত রেখে বলে, “স্যরি, তখন রাগের কারণে ওভাবে বলে ফেলেছি। আশা করি, তুমি আমাকে বুঝতে পারছ। এদিকে আর এসো না। বাড়িতে ফিরে যাও। চাচিকে সামলাও।”

“আমি রাগ করিনি। দেরি হয়ে যাচ্ছে, আপনি যান।”

“আসি।” বলেই অপূর্ব বেবিট্যাক্সিতে পা রাখতেই চালক দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলে। অপূর্বর সেজো চাচা প্রশ্ন করে, “কার সাথে কথা বললি?”

“আরু। দৌড়াতে দৌড়াতে চলে এসেছে। আশেপাশে কাউকে দেখতে পারছি না। তাই বাড়িতে যেতে বলেছি। (বিরতি টেনে) আরু যদি সঠিক সময়ে আমাকে খবর না দিতো। তবে যে.. বাক্য শেষ করার আগেই বেবিট্যাক্সিতে থাকা তিনজন পুরুষের দেহে অতি মাত্রায় কেঁপে উঠে। অনেকটা পথ পেরিয়ে যেতেই দুশ্চিন্তা নিয়ে মুখ খোলে মেজো চাচা, “তুই নিজেই তো একজন ডাক্তার। তাহলে শেফালীকে হাসপাতালে না নিয়ে তুই নিজেই ওর চিকিৎসা করতে পারতি।”

“আমি মনোচিকিৎসক চাচা। এইসব ধরণে আমার মোটামুটি অভিজ্ঞতা থাকলেও, যন্ত্রপাতি নেই।”
__

গমন পথের দিকে তাকিয়ে দুফোঁটা পানি ফেলে ফিরতি পথে পা বাড়ায় আরু। আনমনে সে অঢেল কামনা করে শেফালীকে ফেরত পাওয়ার। ব্রিজের দিক থেকে কয়েকটা ছেলে এগিয়ে আসছে আরুর পেছনে পেছনে। পেছনের শব্দ কোনো দুষ্টু তাদের ভেবে আরু পায়ে ঘর্ষণ করে হেঁটে চলে। কিন্তু তাদের পায়ের শব্দে আরু পেছনে ফিরলে ছেলেদের দল দেখে ব্যাকুল হয়ে উঠে। কীভাবে পরিত্রাণ পাবে? আরু দ্রুত কদম ফেলতেই যুবকের দলও গতি বাড়িয়ে দেয়। এর মাঝে আরুর দেহ ঘেঁষে হাঁটে কালাচাঁন। কিঞ্চিৎ ভরকে পাশে তাকিয়ে বিরাগী পোষণ করে বলে, “সরে হাঁটুন। রাস্তা যথেষ্ট বড়ো।”

সরে হাঁটতে হাঁটতে প্রতুক্তি করে, “এতরাতে এদিকে কোথায় গিয়েছিল গোলাপী?”

“শেফালী বি/ষ খেয়েছে। এজন্য বাড়ির সমস্ত পুরুষেরা ওকে হাসপাতালে গেছে।” বলতে বলতে আরু হাঁটে। বাড়ির কাছাকাছি এসে ডান দিকে বাঁক নেওয়ার পূর্বে আরুর হাত ধরে ফেলে কালাচাঁন। আরু ব্যতিব্যস্ত হয়ে হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বলে, “কালাচাঁনের বাচ্চা হাত ধরেছিস কেন তুই? আমার হাত ছাড়।”

“তোর সাথে আমার একটু কথা আছে। ওদিকে আয়।” দৃঢ় গলায়।

“আমার কোনো কথা নেই। তোর কোনো কথা থাকলে কালকে দিনে বলিস।” রাগান্বিত কণ্ঠে বলে আরু হাত ছাড়াতে থাকে। কিন্তু তার চেষ্টাকে বৃথা করে পেছন থেকে আঁকড়ে ধরে আরুকে। নদীর ধারে জঙ্গলের ভেতরে নিয়ে যেতে থাকে। পুরুষালি শক্তির কাছে আরুর শক্তি তুচ্ছ। এর ফলাফল জেনে আরুর শরীর কেঁপে উঠছে। কাঁতরাতে কাঁতরাতে অশ্রুপাত করে বলে, “আমাকে ছেড়ে দিন। আমার কোনো ক্ষতি করবেন না।”

“তোমার কোনো ক্ষতি করব না, তবে তোমাকে আমার করব।” পেছন থেকে অন্য একজন আরুর মাথায় আ/ঘা/ত করে। আরুর শক্তি লোপ পেয়ে চেতনা হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে কালাচাঁনের বুকে। কালাচাঁন আরুকে আপন করে নিয়ে বলে, “ওকে কেন মারলি? ওকে একটা ফুলের টোকাও দিবি না।”

“আরে আ/ঘা/ত না করলে সহজে আসত না ভাই।” বন্ধুর কথায় তবুও দ্বিমত করে আরুকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে এগিয়ে যায় সামনের দিকে। ততক্ষণে কালাচাঁনের বন্ধুরা নৌকা এনে ভিড়িয়েছে পাড়ে।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২৯

ভোরের আলো অস্ফুট থেকে স্ফুট হতে আরম্ভ করেছে। একটি রাত নির্ঘুম অতিবাহিত হয়েছে আহসান বাড়ির প্রতিটি সদস্যদের। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা শেফালীর চেতনা এখনো আসেনি, তবে বি/ষ সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করা হয়েছে। অপূর্ব এই হাসপাতালের ডাক্তার বলে নিজেই শেফালীর চিকিৎসা করেছে। এখন সে বিপদ সীমার বাইরে অবস্থান করছে।

কিছুক্ষণ পর সূর্য উঁকি দিতেই মহিলারা হাজির হলো হাসপাতালে। পুরুষরা তখন বারান্দায় অপেক্ষারত। মণি হন্তদন্ত হয়ে সবার আগে এসে শাহিনুজ্জামানের জামা ধরে‌ টেনে বিচলিত কণ্ঠে বলে, “আমার মেয়ে কোথায়? কেমন আছে ও? সত্যিই কী ও বিষ খেয়েছে? বেঁচে আছে তো?”

একের পর এক প্রশ্ন অস্বাভাবিক নয় মায়ের। শাহিনুজ্জামান পিঠে হাত রেখে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “শান্ত হও, আমাদের শেফালী ভালো আছে এখন।”

মণি কাঁচ দিয়ে অচেতন শেফালীকে দেখল ভেতরে। ছ্যাত করে দরজা খুলে ধাবিত হলো শেফালীর কাছে। অচেতন শেফালীকে সপাং করে লাগাল চড়। সবাই তখন মণিকে ক্ষান্ত করতে নিযুক্ত হয়। ঘুমের কড়া ওষুধের ডোজ থেকে পরিত্রাণ পেয়ে চোখ মেলে তাকায় শেফালী। মণিকে এমন রূপ ধারণ করতে দেখে নত হয়। ক্রোধের গোঙানি তুলে মণি বলে, “যখন তুই বি/ষ খেয়েছিলি, তখন একেবারের জন্যও আমাদের কথা তোর মনে পড়ে নি? তুই আমাদের একমাত্র সন্তান। আদর ভালোবাসায় কখনো কমতি রাখিনি। মেয়ে হয়ে কিভাবে পারতি আমাদের নিঃসন্তান করার কথা ভাবতে।”

“মা..

শেফালী শব্দ স্ফুটিত করার প্রয়াস করলে মণি হুংকার দেয়, “আমি তোর মা না, তুই আমার মেয়ে না। একদম আমাকে মা বলে ডাকবি না।” বলে কাঁদতে থাকে মণি। তখন অপূর্ব সেখানে উপস্থিত হয়। আশেপাশে আরু নামক যুবতিকে না পেয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে না। অপূর্ব দৃষ্টির অর্থ আন্দাজ করে অনিতা বলে, “আরু কোথায়, ওকে দেখছি না যে?”

“আরু আমাদের সাথে আসেনি। ওকে আমি বাড়িতে ফিরে যেতে বলেছি।”

“কী বলিস? ও বাড়িতে ফিরে যায়নি। আমরা সবাই জানি, ও তোদের সাথে আছে।” অনিতার প্রতুক্তিরে অপূর্বর অন্তঃকরণে হানা দিল আতঙ্ক। নদীর অন্যপাশ দিয়ে যখন তারা হাসপাতালের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিল, তখন শুনেছে এক উগ্র কণ্ঠ। পারুল পাশ থেকে বলে, “ও মেয়ের অনেক জেদ। তুই নিয়ে আসিস নি এজন্য বোধহয় সোজা বাড়িতে চলে গেছে। আমরা সবাই ব্রিজ পর্যন্ত গিয়েছিলাম। সেখানে ও ছিল না।”

“ফুফু আরু এটুকুতে এমন জেদ ধরবে না।” তুরের বিরক্তিকর গলা। অপূর্ব সেকেন্ড খানেক সময় নষ্ট না করে ছুটে গেল বাড়ির দিকে। তুরকে নিয়ে ফিরল বাড়িতে। সমস্ত বাড়িতে আরুর কোনো সন্ধান পেল না। উদাসীন হয়ে আরুদের বাড়ির দিকে পা ফেলল। রাস্তায় দেখতে পেল কয়েকটা চুড়ি ভাঙা। অপূর্ব পাত্তা না দিয়ে মৃধা বাড়িতে গেল। সেখানেও আরুর সন্ধান নেই। অপূর্ব দেখল ময়নাপাখি বাচ্চাদের নিয়ে খেলা করছে। তুর ছুটে গিয়ে ময়না পাখিকে উদ্দেশ্য করে বলে, “এই ময়না, আরু এসেছিল?”

“আরু! আরু! নেই! আরুপাখি নেই! আরুপাখি নেই!” ময়নার বাক্য শুনে অপূর্ব ছুটে গেল রাস্তায়। এতটা পথ সে হেঁটে ব্রিজ দিয়ে যেতে পারবে না বিধায় নদী পার হয়ে গেল। তখন নদীতে ভাটার টান পড়েছে। তাই টাকনু সমান পানি। ভেজা মাটির উপর কাউকে টেনে নিয়ে যাওয়ার একটা চিহ্ন নজরে এলো অপূর্বর। সেখানেও আরুর ভাঙা চুড়ি। অপূর্ব চুড়ি জোড়া গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে বুঝে, গতকাল রাতে এই চুড়ি জোড়া অপূর্ব নিজের হাতে আরুকে পরিয়ে দিয়েছিল। অপূর্ব নিশ্চিত হয়ে বলে, “আমার মনে হয় আরুকে কেউ তুলে নিয়ে গেছে।”

“আমারও তাই মনে হয় ভাইয়া, কিন্তু কে আরুকে তুলে নিয়ে যাবো? শেফালীর ঘটনাটা‌ হঠাৎ ঘটেছিল। কেউ জানত না, আরু এখানে আসবে। আপনি আরুকে ফিরিয়ে এনে দিন ভাই।”

বোনের কান্নায় অপূর্ব ধৈর্যধারণ করতে পারে না। তুরকে আগলে নিয়ে জানায়, সে খুঁজে আনবে আরুকে।
__
শেফালীকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে আনা হয়েছে। এক মেয়ের দুঃশ্চিন্তার পর অন্য মেয়ের জন্য চিন্তিত আহসান পরিবার। পুলিশ তদন্ত করতে নেমে পড়েছে। কিন্তু আরুর সঠিক তথ্য জোগাড় করতে পারেনি। বাড়ির এই পরিবেশের মধ্যে তিস্তাকে নায়র আনার কথা মনেও নেই কারো। আহসান বাড়ির প্রাঙ্গণে বসে আরুর খোঁজ নিয়ে গবেষণা হচ্ছিল, তখন একটা রিকশা এসে থামে বাড়ির রাস্তায়। উপস্থিত সবাই তিস্তাকে দেখে হতবাক হয়। কীভাবে ভুলে গেল মেয়ের কথা?
তিস্তা রোষের সাথে ভাড়া মিটিয়ে বাড়ির ভেতরে ট্রাভেলিং ব্যাগসহ প্রবেশ করে। সবার দিকে রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভেতরে চলে গেল। তবে বউয়ের পথ অনুসরণ না করে সবাইকে সালাম দিয়ে খোঁজখবর নেয় সুজন। পর মুহুর্তে বাজখাঁই গলা শুনতে পায় তিস্তার, “ও, এজন্য আমার কথা সবাই ভুলে গেছে। বাড়িতে নতুন বউ এসেছে, মেয়ে তো পর হয়ে যাবেই।
তিস্তার ভুবন কাঁপানো চিৎকারে সকলে ছুটে যায় ঘরে। কেউ তাকে ক্ষান্ত চাইলে বিনিময়ে সে রেগে কেঁদে ফেলে। অশ্রু মিশ্রিত কণ্ঠে বলে, ”কীভাবে পারলে একদিনেই আমাকে ভুলে যেতে। সারাদিন তোমাদের জন্য ছটফট করেছি, এই বুঝি এসে পড়বে। কিন্তু কেউ আসোনি। দুইটা দিন ভিন্ন একটা পরিবেশে কেমন ছিলাম, আমিই জানি।”

তিয়াস সান্ত্বনা দিতে পারে না। আপন ভাই তিয়াসের প্রতিও তার অঢেল রাগ। সবাই যখন হার মেনে নিল তখন এগিয়ে গেল অপূর্ব। তিস্তার চোখের পানি দেখে আলতো হাতে মুছে দিয়ে বলে, “তোকে যে চিঠিটা দিয়েছিলাম বোনু, সেটা দেখেছিস?”

“না। কোথায় রেখেছি, আর খুঁজে পাইনি। মনে হয় বাচ্চারা নিয়ে গেছে।” একটু নতজানু হয়ে জবাব দেয় তিস্তা। অপূর্ব এটাই সন্দেহ করেছিল এতক্ষণ। অতঃপর আবার বাক্য তোলে, “সেই কাগজে সুমির কথা লিখে দিয়েছিল তিয়াস। আমি তোকে বলেছিলাম, একা পড়বি। বলেছিলাম তো?”

“হ্যাঁ! সেটা নাহয় বুঝলাম, কিন্তু আমাকে কেউ কেন নিয়ে আসতে যায়নি?” ততক্ষণে রোষ নিয়ন্ত্রণে এসেছে। সম্পূর্ণ রোষ দমাতে তিস্তাকে পানি এগিয়ে দেয় অপূর্ব। তিস্তা পাত্র গ্ৰহণ করে পানি পান করা শেষ হলে অপূর্ব বলে, “শেফালী গতকাল বি/ষ খেয়েছে। রাতে ওকে নিয়ে ছুটেছি। সকালে বাড়িতে এসে দেখি আরু নেই। রাস্তায় ওর চুড়ি ভাঙা আর নদী দিয়ে টেনে নৌকায় করে কেউ নিয়ে গেছে ওকে। এত চিন্তার মাঝে তোর কথা মনে থাকে?”

তিস্তা চমকালো ভীষণ, প্রথম বাক্যের শেষে শেফালীর কথা ভেবে শান্ত হয়, পরবর্তী বাক্য আরুর জন্য অস্থির হয়ে বলে, “ভাইয়া কী বলছেন আপনি? শেফালী বি/ষ খেয়েছে মানে কী? আমি তোমাদের পর হয়ে গেছি যে, এই গুরুত্বপূর্ণ একটা সংবাদ আমাকে জানানো হয়নি?
আরু নিখোঁজ। আর তোমরা হাত-পা গুটিয়ে বসে আছো কেন?”

“শেফালী এখন বিপদ মুক্ত, দুদিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে যাবে আর পুলিশ আরুকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে।” অপূর্ব থামতেই তিস্তা ছুটে গেল ঘরে। শেফালীর সাথে দেখা করে ব/কে দিল কয়েক দফা। ফিরে এসে অপূর্বকে বলে, “কালাচাঁন নামের একটা ছেলে আছে যে, আরুকে প্রচুর ডিস্টার্ব করে। আমার মনে হয় ও কিছু করেছে‌।”

“আমার মনে হয় না, কালাচাঁন। কারণ ওকে আমি শিক্ষা দিয়েছি।” অপূর্ব ভেবে বলে।

তবুও তিস্তার মন সায় দেয় না। “সাবধানের মা/র নেই। চলুন আমরা একবার কালাচাঁনের বাড়িতে খুঁজে আসি। হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার চেষ্টা নিশ্চিত হয় ভালো।”

অতঃপর কয়েকজন যুবক যুবতি মিলে সংঘবদ্ধ হয়ে ছুটে যায় কালাচাঁনের বাড়ির দিকে। সাথে নিয়ে যায় আরুকে পাওয়ার এক আশা।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-২৬+২৭

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২৬

আরু ও তুর অপেক্ষা করছে শেফালী ও অপূর্বর জন্য। শেফালী দৃঢ় গলায় জানিয়েছে, সে তিস্তার সাথে সাক্ষাত করতে যাবে না। কিন্তু অপূর্ব কেন বিলম্ব করছে তা ঠাউর করতে পারে না ওরা। মিনিট তিন পর অপূর্ব এলো। তবে বেশ রাগান্বিত হয়ে, হাতে নতুন একটা জিন্স। আরুর সামনে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় বলে, “এটা কী করেছিস তুই? সেলাই করেছিস কেন? আমাকে বলেছিলি আলমারিতে তুলে রাখবি, তোলার নাম করে কী করেছিস এটা? আমার আরও একটা স্টাইলিশ জিন্স দিয়ে তুই ঘর মুছেছিস।”

অবিলম্বে আরু অপূর্বর হাত থেকে কেড়ে নিল জিন্সটা। ভালোবাসে পর্যবেক্ষণ করে উপলব্ধি করে, সেই ছেঁড়া জিন্সটা। চড়া গলায় বলে, “এজন্য কারো ভালো করতে নেই। আপনাকে ব/ল/দ পেয়ে ছেঁড়া জিন্সটা গছিয়ে দিয়েছিল। ফেলে দেওয়ার চেয়ে সেলাই করে পরা ভালো। তাই নিজের হাতে সেলাই করেছি।”

“এটা ছেঁড়া?”

“উঁহু। ছেঁড়া নয়। মনে হয় এই জিন্সটা কেনার জন্য দুজনে টানাটানি করেছিল। তখন ফেসে গেছে।”

“এটা স্টাইল!”

“এটা স্টাইল?”

“জি। থাকিস তো গ্ৰামে। জানবি কীভাবে? ড্রেস সম্পর্কে তোর কোনো আইডিয়া আছে? এমনিতেই খাঁটো, আবার একটা শাড়ি পরে ঘুরঘুর করিস। একদম ফুটবলের মতো লাগে তোকে। যা, শাড়ি পালটে একটা থ্রী পিস পরে আয়।” অপূর্ব থমথমে ভঙ্গিতে কথাটা বলে। আরু চাপা রাগ নিয়ে ঘরে চলে গেল। অতঃপর পথের দিকে চেয়ে লাজুক হাসি দিল। তুর অপূর্ব-র কাঁধে হাত রেখে বলে, “ভাই, আরুকে একদমই ফুটবলের মতো লাগে না। চোখ ঝলসানো পরীর মতো লাগে। আর তুমি তালগাছের মতো লম্বা, আরু মোটেও বেঁটে নয়।”

“তা তো জানিই। কোনো ছেলেই চাস না, তার প্রিয়তমার সৌন্দর্য অন্য কোনো পুরুষের চোখে পড়ুক।” অপূর্বর কথায় প্রয়াসের কথা স্মরণে এলো তুরের। তিয়াস তো পেয়ে গেল নিজের ভালোবাসার মানুষকে। কিন্তু তুর? সে কখনোই বাবা মায়ের মুখে চুনকালি লেপে প্রয়াসের হাত ধরে পালিয়ে যাবে না। ‘এতে যদি তাকে শেফালীর মতো আগুন বুকে চেপে স্বাভাবিক থাকার ভান করতে হয়’ – এতেও অসম্মতি নেই তুরের। তুর কল্পনা থেকে বেরিয়ে অপূর্বকে রঙ্গ করে বলে, “সামথিং! সামথিং!”

“নাথিং!” বলে হাতের দিকে ইঙ্গিত দিল অপূর্ব। অবিলম্বে হাত নামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় তুর। আশেপাশে গভীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে শেফালীর সন্ধানে নামে অপূর্ব। ব্যস্ত থাকলে সবকিছু থেকে দূরে থাকবে শেফালী। অপূর্ব বলে, “শেফুকে দেখছি না যে, কোথায় ও?”

“কত করে বললাম আমাদের সাথে চল। ও যাবে না বলল।” তুর জানায়। তিয়াস তৈরি হয়ে এদিকেই এসেছে। রক্তের সম্পর্ক তিস্তার সাথে, তিয়াস না গেলে ভালো দেখায় না। তিয়াসের আপাদমস্তক নজরবন্দি করে অপূর্ব মুখ খুলে, “তোকে যেতে হবে না। কিছুক্ষণ পর সুমির বাবা ও চাচা আসবে। তুই তাদের জামাই। তোর এখানে থাকা জরুরি।”

“তিস্তা তো আমাদের অপেক্ষায় আছে!”

“আমিও তো ওর ভাই? তোর মতো আপন নয়। তবে ভাই তো। চিন্তা করিস না, আমি এই বিষয়ে কিছু বলব না। মেয়েটা তাহলে ওযথা চিন্তা করবে।”

“বাঁচালেন আমায়। আচ্ছা তাহলে আমি যাই, ওনারা ব্রীজ পর্যন্ত চলে এসেছে।” তিয়াস বিদায় নিয়ে চলে গেল ব্রীজের দিকে। আরুও শাড়ি পালটে উজ্জ্বল লাল রঙের থ্রিপিস পরে এসেছে। সাজগোজ টাও আগের তুলনায় বাড়িয়ে দিয়েছে। চোখের উপরে ও নিচে মোটা কাজল লাগিয়েছে, লাল টুকটুকে লিপস্টিক, দুহাত ভর্তি চুড়ির মাঝামাঝি একটা রুপার বালা। পায়ে নূপুরের পাশাপাশি এখন আলতায় রাঙা, কপালের মাঝবরাবর একটা টিপ, হাঁটু সমান চুলগুলো খোলা। হাওয়াতে উড়ছে। ঠোঁটে ঝুলে আছে রহস্যময় হাসি। মেয়েটা কি কথাগুলো শুনে ফেলেছে? অপূর্বর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। এই যে চৈত্র আসার আগেই চৈত্রের কাঠ ফাটা রোদ্দুরের তান্ডব শুরু করে দিয়েছে। কাছাকাছি আসতেই অপূর্ব দিল রাম ধমক, “চুলগুলো খোঁপা কর জলদি। মাথায় কাপড়ও দিবি। আমি শেফুকে নিয়ে আসছি।”

অপূর্ব দ্রুতগতিতে ঘরের ভেতরে চলে গেল। দুই গ্লাস পানি খেয়ে গলা ভিজিয়ে নিল। আরেকটু হলেই পানির পিয়াসে প্রাণ পাখিটা উড়ে যেত।
_
প্রথম রিকশা এসে থামল তালুকদার বাড়িতে। তুর ও আরু রিকশা থেকে নেমে অপেক্ষা করছে অপূর্বদের জন্য। অপূর্ব ও শেফালী আলাদা রিকশায় আসছে। আরুর মন বেজায় ভার‌। তার প্রবল স্পৃহা রিকশায় অপূর্ব হাত জড়িয়ে এত পথ পাড়ি দিয়ে তিস্তাদের বাড়িতে আসবে। পৃথিবীতে সকল প্রেমিক প্রেমিকারা চায়, প্রিয় মানুষের সাথে একান্ত সময় পার করতে। আরুও তার ব্যতিক্রম নয়! আচ্ছা আমি কি অপূর্ব ভাইয়ের পাশে দাঁড়ানোর যোগ্য নই? আমাকে তার সাথে মানায় না বলেই কি তিনি অন্য রিকশায় এসেছেন? অপূর্বর জন্য সাজগোজটা বিষের মতো লাগল আরু কাছে। সময় নিয়ে সাজটা বৃথা। সৌজন্য হেসে ওড়না দিয়ে লেপটে দিল চোখের কাজল, লিপস্টিক, ফেলে দিল টিপ। চুলগুলো খোঁপা করে ওড়না টেনে দিল মাথায়। চুড়িগুলো চেপে কয়েকটা ভেঙে ফেলল।
তখন অপূর্ব এলো। দুই রিকশার ভাড়া মিটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। আড়চোখে একবার আরুকে দেখে মলিন লাগল মুখশ্রী। কিছুক্ষণ পূর্বেও প্রাণবন্ত ঠেকছিল সেই মুখ। হাতেও নেই সব চুড়ি। অপূর্ব সন্দিহান গলায় বলে, “কিরে সাজগোজ নষ্ট করেছিস কেন?”

“একটু আগেও না সব ঠিক ছিল?” তুর বলে।

“তিস্তা আপু আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। চলো।” বিষয়টা সাবধানে ধামাচাপা দিয়ে আরু আগেই হেঁটে চলে গেল। অপূর্ব তাকালো মাটির দিকে। সেখানে চুড়ির টুকরো পড়ে আছে। টিপ ও সাথে কয়েক ফোঁটা রক্ত। ভাঙল প্রেমের বান। মনে মনে আওড়াল, “এত অভিমান কেন তোমার? কেন বুঝতে পারো না আমায়? আজকাল তোমার দিকে তাকালেও নিজেকে বেসামাল লাগে। আজ তো নিজেকে সেজেছ গোলাপ রানী। নিজেকে সামলাতে কতটা কষ্ট করতে হয়েছে, তা কি তুমি জানো?”

“তোরা ভেতরে যা। আমি আসছি‌।” মিষ্টির হাঁড়ি ও যাবতীয় বাজার দিয়ে দিল তুরের হাতে। ওরা দুজন চলে যেতেই অপূর্ব হাঁটু গেড়ে বসে। ভাঙা চুড়ির টুকরো জোড়া দিয়ে বুঝে চারটা চুড়ি ভেঙেছে। অপূর্ব দুর্বল হেসে বাড়ির ভেতরে যেতে যেতে বলে, “চারটা চুড়ি ভেঙেছ তুমি গোলাপ রানী। তোমাকে চার ডজন চুড়ি কিনে দেওয়া আমার দায়িত্ব।”
_
প্রিয় মানুষদের পেয়ে আরেকদফা কেঁদে ভাসিয়েছে তিস্তা। আরুও কম যায় না, সেও কাঁদল। অভিমানে একবারও তাকাল না অপূর্ব দিকে। তিস্তাদের টিনের বাড়ি। বাড়িতে অসংখ্য মানুষ গিজগিজ করলেও বাড়ির মূল সদস্য বর্তমানে তিনজন। সুজনের মা, ভাই, সুজন ও তিস্তা। বাকিরা বিয়ে উপলক্ষ্যে আসা অতিথি।

সুজন ও সেই ছেলেটা এলো সেখানে। গতকাল যে আরুর রুপের প্রশংসা করছিল। ওর নাম দর্পণ। ইতস্তত নিয়ে বলে,‌ “স্যরি‌। আসলে আমি বুঝতে পারিনি, বেয়াইদের সাথে‌ আপনারা তেমন মিশেন না। তাহলে আমরা কখনোই এমন করতাম না।”

“সমস্যা নেই। আসলে আমাদের বংশে তিস্তা আপুর বিয়েই ছিল প্রথম। বেয়াই বেয়ানদের সাথে কেমন সম্পর্ক হয় আমরা জানি না।” তুর বলে। ছেলেটা আবার আরুর রূপের মুগ্ধতা প্রকাশ করে, “আপনাকে দেখতে কিন্তু খুব সুন্দর লাগছে। সাজগোজ নষ্ট হওয়ার পরেও অপূর্ব লাগছে। না জানি যখন সেজেছেন, তখন কেমন লাগছিল।”

তিস্তাদের এই বাড়ির এই ঘরটার একটা জানালা পূর্ব দিকে। তাই সূর্যের রশ্মিটা ঘরের ভেতরে পড়ছে। আরু তার বিপরীত পাশে বসেছে বলে সূর্যের রশ্মিতে তার মুখমণ্ডল সৌন্দর্যে দ্বিগুণ হয়েছে। অপূর্ব দর্পণের সব কথা সহ্য করে নেয়। আরু তা লক্ষ্য করে অপূর্বকে আরেকটু ঈর্ষান্বিত করে বলে, “আমাকে না-কি দেখতে ভালো লাগে না?”

“কে বলেছে? আমি বলব তার চোখ খারাপ। আপনার মতো সুন্দর মেয়ে আমি আর দেখিনি। তাহলে সেদিন বললাম, আমি হলে ভাবীকে রেখে আপনাকে বিয়ে করতাম?” বলেই দর্পণ ছেলেটা হাসল। আরুর ওর সাথে তাল মেলালো। অপূর্ব সবকিছু সহ্য করে উঠে দাঁড়ায়। ইতোমধ্যে বেতের টেবিলটাতে খাবারে ভর্তি করে ফেলেছে। একপাশে অপূর্বর নিয়ে আসা বাজার। অপূর্ব বাজারগুলো তিস্তার হাতে দিয়ে বলে, “এগুলো ভেতরে নিয়ে যা। বাড়িতে জরুরি কাজ আছে। আমাকে যেতে হবে। চিন্তা করিস না, আগামীকাল আমি গাড়ি নিয়ে এসে তোদের নিয়ে যাবো।”

তিস্তার মনে বর্ষণ শুরু হয়ে গেল। প্রিয় মানুষগুলো চলে যাবে ভাবতেই মলিন হয়ে এলো তার মুখমণ্ডল। বাজারগুলো নিয়ে ধীর পায়ে ভেতরে দিকে পা বাড়াল। অপূর্ব গেল তার পিছু পিছু। সবার অগোচরে একটা চিঠি তিস্তার হাতে গুজে দিয়ে বলে, “যখন একা থাকবি, তখন এটা পড়বি। বাকিটা বাড়িতে এসে জানবি। (কিছুক্ষণ থেমে আবার বলে) মহারানী রেগে ঢোল হয়ে আছে। যখন তখন তোর ভাইয়ের গর্দানের আদেশ দিতে পারে। ভাইকে বাঁচাতে চাইলে, ওকে একটু সাজিয়ে দে।”

তিস্তা শুধু আরুকে নয়, তিনজনকেই সাজিয়ে দিল। তবে আশ্চর্যের বিষয়, এবার অপূর্ব নিজেই আগ বাড়িয়ে আরুর রিকশায় উঠে। শেফালী ও তুরকে আদেশ দেয়, “তোরা আগে আগে যা। বলা তো যায় না নতুন কোনো জ্বীন, পরীর রূপে মুগ্ধ হয়ে আবার ভর করে।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২৭

মোতাহার হোসেন ফোন করে কাজি সমেত বাড়িতে যেতে বলেছে অপূর্বকে। অপূর্ব বাবার আদেশ মেনে কাজি বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ফেরেনি বাড়িতে। আরও একটা গুরু দায়িত্ব পড়েছে। সুমির বিয়ের জন্য আপাতত লাল বেনারসি ও হালকা জুয়েলারি নিয়ে যেতে বলেছে।
তুর ও শেফালীর রিকশাটা মার্কেটের বাইরে রেখে আরুকে নিয়ে ভেতরে গেল অপূর্ব।
একেক পর এক শাড়ি দেখাচ্ছে। শাড়ি সম্পর্কে তেমন কোনো অভিজ্ঞতা নেই আরু ও অপূর্বর। তাই দোকানদারের দেওয়া শাড়িটাই পছন্দ করে নিল অপূর্ব। বিল মিটিয়ে যাওয়ার সময় খেয়াল করল আরু একটা লাল বিয়ের বেনারসির দিকে তাকিয়ে আছে অপলক। আরুর কাঁধে হাত রেখে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে অপূর্ব, “দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী দেখছ? পছন্দ হয়েছে?”

“শাড়িটা সুন্দর না? একদম সিম্পল, কিন্তু মনকাড়া।” আরু শাড়ির মিহিন দেহে স্পর্শ করতে করতে অপূর্বকে প্রশ্ন করে। অপূর্বও ভালো লাগল। অপূর্ব ও‌ আরুর বিয়ে হতে বহু প্রহর অপেক্ষা করতে হবে, ততদিনে কোনো নারী এই বেনারসি অঙ্গে জড়িয়ে কোনো পুরুষের অর্ধাঙিনীর স্বীকৃতি নিবে। অপূর্ব শাড়িটাকে দেখিয়ে জড়ানো গলায় বলে, “এটাও প্যাকেট করে দিন।”

আরও কিছু শাড়ি কেনার পাট চুকিয়ে নিয়ে গেল জুয়েলারি দোকানে। আরুকে দায়িত্ব দিল গহনা পছন্দ করার। আরু পছন্দ করার ফাঁকে প্রশ্ন করে, “আপাতত আজকে পরার জন্য এই বক্সটা নিন। সাথে নরমাল জুয়েলারিগুলো। বক্সটার গহনাগুলো আজকের জন্য, আর এগুলো রোজকারের জন্য। তারপরে নাহয় সুমি ভাবী আর তিয়াস ভাইয়া পছন্দমতো কিনে নিবে।”

অপূর্ব আরুর কথা মেনে শাড়ি ও অলংকার
কিনে নিল। আরুকে সবকিছু বুঝিয়ে অপূর্ব মিষ্টি কিনতে গেল। শেফালীর হাতে একটা ছোটো কাঁচের কৌটা দেখতে পেল আরু। উচ্চ স্বরে বলে, “তুর ওর হাতে কী? যাওয়ার সময় তো দেখলাম না।”

“মাত্র কিনে নিয়ে এসেছে। ওর সাদা গোলাপ ফুলের গাছে না-কি পোকামাকড় বাসা বেঁধেছে। এজন্য এনেছে।” তুর বলে। ততক্ষণে মিষ্টি কিনে ফিরে এসেছে অপূর্ব। শেফালীও লুকিয়ে নিয়েছে সেই ওষুধটা। আরুর বুক কেঁপে উঠছে। শেফালী উলটাপালটা কিছু বলে বসবে না-তো?
__
সন্ধ্যা হতে না হতেই চাঁদের মৃদু প্রতিবিম্ব দেখা গেল জলে আর আয়নাতে দেখা গেল সুমির লজ্জায় মাখা বধূবেশের প্রতিবিম্ব। আরু লাল ওড়নাটা সুমির মাথায় তুলে দিয়ে বলে, “ভাবী, তোমরা কতদিন ধরে প্রেম করছিলে? প্রেম হলো কীভাবে?”

“একদম ছোট থাকতে। আমি তো তোমাদের ভাইকে পাত্তা দিতাম না। সে নিজেই আমার স্কুলের সামনে গিয়ে ঘুরঘুর করতো। সবার দেখাদেখি ভাবলাম আমিও নাহয় প্রেম করি। তবে এতটা কাবু হয়ে যাবো ভাবিনি।” বলেই লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে উঠল সুমি। শেফালী তখন এলো দুধের গ্লাস নিয়ে। সুমির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, “খেয়ে নাও ভাবী।”

আরুর সন্দেহ লাগল ব্যাপারটা। যে মেয়েটা সহ্য করতে পারেনা সুমিকে, তার থেকে এমন মিষ্টি ব্যবহার প্রত্যাশার বাইরে। সুমি খাওয়ার জন্য হেসে গ্লাস তুলতেই আরু বাধা দেয়। গ্লাসটা ফিরিয়ে দিয়ে বলে, “এখন খেলে বাসর ঘরে স্বাদ পাবে না। পরে খেও। চল ভাবী। কাজি ডাকছে।”

তুর ধরে ধরে সুমিকে নিয়ে গেল ড্রয়িং রুমে। তবে আরুকে যেতে দিল না। বাহু ধরে টেনে ঘরের দ্বার বন্ধ করে দিল। হুংকার দিয়ে বলে, “তুই কেন সুমিকে দুধ খেতে দিলি না আরু? তুই কি আমার ভালো চাস না?”

“তারমানে আমার ধারণা সত্যি। তুই ওটা দুধে মিশিয়ে ছিলিস?”

“হ্যাঁ, মিশিয়েছি। ওকে মে/রে ফেলতাম আমি। আমার সামনে ও নেচে নেচে বিয়ে করে নিবে আর সেটা আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখব। এতটা মহান আমি নই।”

“দেখ শেফু, সুমি ভাবী ও তিয়াস ভাই দুজন দুজনকে ভালোবাসে। ওদের সুখী হতে দে।” আরুর কথার প্রেক্ষিতে শেফালী বাক্য তোলে না। শেফালী গ্লাসটা নিয়ে পান করার প্রয়াস করল। চকিতে গ্লাসটা নিজের আয়ত্বে নিয়ে সরে গেল আরু। শেফালী ক্রমশ আরুর দিকে‌ এগিয়ে আসার পাশাপাশি গ্লাস ফেরত চাইছে। চট করে দরজার ছিটকিনি খুলে আরু বেরিয়ে গেল দুধের গ্লাস সমেত। ভীত শেফালী সেদিক যাওয়ার স্পর্ধা দেখায় না।
পারুল বাড়ির কাজ শেষ করে অয়নকে নিয়ে এসেছেন। পারুল উঠানে জাহানারা অনিতার সাথে কথা বলছেন। ছেলেদের বিয়ে মায়ের দেখতে হয় না বিধায় চাচিরা উঠানে বসে আছে। অয়ন ছুটে ভেতরে এসে লক্ষ্য করে আরুর হাতে দুধের গ্লাস। অয়ন আরুর থেকে গ্লাসটা নিতে নিতে বলে, “বুবু, তুই একা এই গ্লাস ভর্তি দুধ খাবি? আমাকেও একটু দে।

“না! একদম না।” হতভম্ব হয়ে আরু দ্রুত হাতটা উপরে তোলে। পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উচ্চতা বৃদ্ধি করে আরুর হাত থেকে নেওয়ার প্রয়াস করে। অনবরত বারণ করে চলেছে আরু। তবুও নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে অয়ন। আরু অধৈর্য হয়ে দেয় ধমক, “এক চড়ে সবগুলো দাঁত ফেলে দিবে অয়নের বাচ্চা। বলেছি না, এটা দেওয়া যাবেনা। সামনে থেকে সর।”

অয়ন ছুটে গেল পারুলের কাছে। ক্রন্দনরত অবস্থায় বলে, “মা, বুবু আমাকে দুধ খেতে দিচ্ছে না। এক গ্লাস দুধ। আমি বলেছি একটু দিতে। দিবে না, আরও আমাকে মারতে চায় বাবু।”

“আরু ওকে দুধের গ্লাস দে। আমার বাপের বাড়িতে দুধ কম পড়েনি যে, তোর ভাগ্যে জুটবে না। ওকে গ্লাসটা দিয়ে তুই আরও এক গ্লাস নিয়ে আয়।” বলতে বলতে গ্লাস নিতে অনেকটা এগিয়ে এলো পারুল। আরুর হাত থরথরিয়ে কাঁপছে। শেফালীর ব্যাপারটা বলা শোভা পায় না, অন্যদিকে গ্লাস দিলে অয়ন খেয়ে ফেলবে। পারুল গ্লাস ধরার পূর্ব মুহুর্তে আরু হাত ছেড়ে দিল। অবিলম্বে তা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়। কাঁচের টুকরোগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে। ক্ষোভের গোঙানি তুলে আরুর দিকে তাকায় পারুল। তিন সেকেন্ড পর তার হাতটা আপনাআপনি গিয়ে ঠেকে আরুর গালে। আরু বুঝতে পারিনি এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। আরও একটা চড় মারার জন্য হাত নাড়াতেই এগিয়ে এলেন অনিতা। আরুকে যথাসম্ভব আড়াল করে বলে, “মেয়েটাকে মারছ কেন পারুল? তোমার জোরাজুরিতে গ্লাসটা হাত ফসকে পড়ে গেছে। ভালোভাবে বললে আরু নিশ্চয়ই দিয়ে দিতো।”

“আমি গ্লাসটা ধরার আগেই ও ইচ্ছে করে ফেলে দিয়েছে। অয়নকে দুচোখে সহ্য করতে পারেনা মেয়েটা। ভাই হয় ওর, একটুখানি দিলে কী হতো?” তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আরুর পানে নিক্ষেপ করে প্রত্যুত্তর করে পারুল। পারুলের প্রশ্নের ফিরতি জবাব দেয় জাহানারা, “অয়ন যখন দেখছে, আরু ঐ গ্লাসে দুধ খাচ্ছে। তাহলে ওর কেন ওটাতেই খেতে হবে। ডেক্সিতে আরও দুধ ছিল। আমাকে বললে আমিই দিতাম। তোমার মেয়ে নয়, তোমার ছেলে আরুকে সহ্য করতে পারে না। (অয়নকে উদ্দেশ্য করে) আয়, তোকে দুধের ভেতরে চুবিয়ে জীবনের মতো দুধ খাওয়া শেখাচ্ছি।”

সবাই ঘরের দিকে চলে গেল। আরু একা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে দিঘির দিকে গেল। নারিকেল গাছের নিচে বসে নিঃশব্দে অশ্রু ফেলতে লাগল।

সুমি ও তিয়াসের বিয়ের কাজ শেষ। মাগরিবের নামাজ আদায় করতে দিঘির পাড়ে এসেছে অজু করতে। অজু করে উঠে উপরের দিকে দুই পা ফেলতেই নারিকেল গাছের দিকে তার চোখ পড়ল। আবছা অন্ধকারে মানুষের মতো ঠাওর করতে পারে অপূর্ব। তাই গলা ছেড়ে ডাকে, “কে ওখানে?”

আরু একটু নড়েচড়ে উঠে অপূর্বর ডাকে। ভাঙা গলায় সাড়া দিতে চেয়ে অনুভব করে তার গলায় কোনো স্বর নেই। অপূর্ব ততক্ষণে টর্চ নিয়ে এগিয়ে গেছে। আরুর মুখের দিকে তাকাতেই খণ্ডিত হলো নিজের বুক। উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, “এখানে বসে কাঁদছিস কেন মেয়ে? কেউ কিছু বলেছে?”

আরুর প্রত্যুত্তর হীন মুখ আভাস দেয় সম্মতির।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-২৪+২৫

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২৪

আরু আনমনা ভেঙে নিচে ভিড় ভাট্টার সম্মুখীন হয়। আরু নিত্যদিনের মতো নিমগাছের ডাল দিয়ে দাঁত মেজে দিঘিতে যায় মুখ ধুতে। ইতোমধ্যে সবাই খেয়ে তিস্তাকে গোসলের জন্য নামিয়েছে। দক্ষিণ দিক থেকে ধোঁয়া আসছে। বিয়ের বাড়ি উপলক্ষ্যে সকালে খিচুড়ি রান্না করা হয়েছে। দুপুরে বরযাত্রী এলো বলে। আরু শাড়িতে মুখ মুছতে মুছতে গেল সেদিকে। বড়ো বড়ো ডেক্সি থেকে দুই চামচ খিচুড়ি তুলে কলা পাতায় নিয়ে খেতে বসে কাঠের চেয়ারে।
অপূর্ব রান্নার দিকে ছিল বলে ঘেমে জবুথবু হয়ে হাজির হলো আরুর কাছে। হাতের মুঠোয় দুই টুকরো লেবু। উভয় টুকরো খিচুরিতে চিপকে দিল। আরু ডাগর ডাগর চোখে অপূর্ব-র দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। আরুর মাথায় চাট্টি দিয়ে বলে, “ঘেমে কালো হয়ে গেছি। তোর আঁচলখানা দিয়ে দ্রুত আমার নোনা জলটুকু মুছে দে। তারপরে কয়েক লোকমা মুখে তুলে দে। কাজের চাপে আজ একটুকুও খেতে পারিনি।”

আরু নিজেও খেল না, অপূর্বর মুখেও তুলে দিল না। নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কেবল। অপূর্ব তুরি বাজিয়ে বলে, “হা করে না থেকে খাবারটা মুখে তুলে দে জলদি। কাজ আছে আমার। দুপুর করে ঘুমানোর সময় আমার নেই।”

আরু নিজে না খেয়ে অনবরত লোকমা তুলে দিল অপূর্বর মুখে। আরু আজ হলুদ শাড়ির সাথে মিলিয়ে কাঁচের হলুদ চুড়ি পরেছে। মাঝেমধ্যে রিনিঝিনি শব্দ তুলছে সেই চুড়ি। অপূর্ব তা মুগ্ধ নয়নে দেখছে। পেট ভরে খেয়ে অপূর্ব আবার রান্নার দিকে চলে গেল। আরু এবার নিজে খেতে লাগল। খাওয়া শেষে আরু গিয়ে দাঁড়াল উঠানে। তিস্তার মাথায় পানি ঢেলেছে। তিয়াস নিজের বোনকে কোলে নিয়ে কলতলায় চলে গেল। উঠান ভিজে তাই আরু ভালোভাবে হাঁটছে যাতে পিছলে না যায়। আরুকে দীর্ঘক্ষণ অক্ষত থাকতে দিল না তুর। পেছন থেকে ছুটে এসে আরুকে ল্যাং মেরে ফেলে দিল কাঁদায়। শেফালী ছুটে এসে পা ধরে টানতে থাকে কাঁদায়। আরু বারবার বলছে, “প্লীজ আমাকে তোরা ছেড়ে দে, আমি মাত্র খেয়ে এসেছি। দৌড়ঝাঁপ করলে পেটে ব্যথা করবে।”

তুর বা শেফালী কেউ ছাড়ল না আরুকে। কিছুক্ষণের ভেতরে চিনচিন ব্যথা অনুভব করল আরু। ততক্ষণে নিজেদের কাজ শেষ করে আরুকে ছেড়ে দিয়েছে ওরা। এবার বড়োরা কাঁদায় টানাটানি করছে। আরুর কিছু একটা স্মরণে আসতেই আরু ছুটে তাদের ঘরে চলে গেল। গতকাল সে পুঁইশাকের বিচির লাল রং গুলো সংগ্রহ করে রেখেছিল। সেটা নিয়ে ছুঁড়ে দিল দুজনের শরীরে। আরু ক্ষান্ত হলো না, ওদের পেছনে দৌড়ে দৌড়ে রং ছুড়তে চাইল। পেটের ব্যথাটা অনেকটা চাড়া দিয়ে উঠতেই আরু দূর থেকে রঙ ছুড়ে দিল। সেখানে এসে উপস্থিত হলো অপূর্ব। মেহেদির পাশাপাশি লাল রঙে পুরোপুরি খরচার খাতায় চলে গেল হলুদ পাঞ্জাবিটা। দিল রাম ধমক, “দৌড়ে দৌড়ে তামাশা করা হচ্ছে এখানে? আমার কাজের বারোটা করে দিলি তিনজনে। ইচ্ছে করছে তিনটা নিয়ে..। যা গোসল করে তৈরি হয়ে নে।”

শেফালী ও তুর নিরুদ্দেশ হয়েছে আগেই। আরু পেটে‌ হাত দিয়ে অতি সাবধানে কদম ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। অপূর্ব ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বলে, “কী হয়েছে? এভাবে হাঁটছিস কেন?”

“আপনি সবসময় আমাকে বকেন। একদম সবসময়। আমি কি ইচ্ছে করে ওদের রং মাখিয়েছি না-কি? মাত্র খেয়ে উঠলাম। কতবার বারণ করলাম তবুও কাঁদায় টেনে পেটে ব্যথা শুরু করে দিল।” আরুর অভিমানী গলা। অপূর্ব লক্ষ্য করল আরুর দুই হাতে মাত্র তিনটা চুরি। বাকিগুলো যে ওদের কারণে ভেঙে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। অপূর্ব পেছন থেকে একটা আবদার করে বলে, “আমার ঘরের আলমারিতে সেদিনের নীল শাড়িটা আছে, চুড়ি, আলতা। কমতি নেই কিছুতে। আজকে পারলে একবার পরিস।”

_
দোল দোল দোলনি,
রাঙা মাথায় চিরুনি
বর আসবে এখুনি,
নিয়ে যাবে তখনি।
বর এসেছে বর এসেছে বলে বাচ্চাদের চিৎকার শোনা গেল। শেফালী ও তুর ফুলের সজ্জিত প্রবেশদ্বারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আরও কয়েকজন মেয়ে রয়েছে সেখানে। আরু নিজের নীল রঙের শাড়ির আঁচল তুলতে তুলতে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। নীল রঙের চুড়িগুলোর মাঝে সাদা রুপার চুড়িটা চকচক করছে। খোঁপায় গুজেছে নীলপদ্ম। সম্পূর্ণ শাড়িতে রয়েছে পদ্মের ছাপ। আরুর দুধে আলতা রঙে সর্বোচ্চ মানিয়েছে আরুকে। সুজনের সাথে তা সমবয়সী ভাই বা বন্ধু হয়েছে কয়েকজন। তাঁরাও মুগ্ধ আরুর রূপে। অপলক চেয়ে রয়েছে।
আরু গিয়ে কোমরে হাত গুজে বলে, “সুজন ভাই, শালি মানে আধি ঘরওয়ালী। শালিদের আবদার পূরণ করে তবেই আপনি পূর্ণ ঘরওয়ালী কাছে যেতে পারবেন।”

সুন্দর করে ছেলেটা রঙ্গ করে বলে, “আমি সুজনের জায়গায় থাকলে টাকা না দিয়ে আধি ঘরওয়ালীকে পুরো ঘর ওয়ালী বানিয়ে ফেলতাম।”

“যেহুতু আপনি সুজন ভাই নয়, তাই চুপ করে থাকুন। আর সুজন ভাইয়ের মতো নজর একদিকেই রাখুন।” শেফালীর উগ্র কণ্ঠ। চলে যাওয়ার প্রয়াস করে বাঁধা পায় তুরের। সামান্য একটা কথাতে রাগ করে চলে গেলে টাকা হাত ছাড়া হয়ে যাবে। ফিসফিস করে বলে, “এমন একটু আধটু বলে। এতকিছুর ব্যবস্থা করে কি পানিতে ভাসিয়ে দিবো? দাঁড়া। যাস না।”

বরপক্ষের ছেলেরা টাকা দিতে অস্বীকার করে। মেয়েরা নামে টাকা আদায় করতে। অপূর্ব দূর থেকে স্পষ্ট দেখে সবকিছু। অন্যদিকে বেলা পড়ে যাচ্ছে, তাই অপূর্ব এগিয়ে এসে বলে, “ছেড়ে দে, ওনারা হয়তো জানে না কোনে পক্ষের দরজায় টাকা দিতে হবে। তাই বোধহয় আনেনি। তোরা আমার কাছ থেকে নিয়ে নিস। দরজা ছেড়ে ভেতরে যা।”

বরপক্ষের ছেলেরা একটু অসন্তোষ প্রকাশ করে বলে, “এই নিন টাকাটা।”

“এতক্ষণ যখন টাকা ফেলতে পারেননি, এবার আর দরকার নেই। একটা কাজ করুন, টাকা পকেটে নিয়ে ভেতরে আসুন।” বলেই অপূর্ব ডাকে তিয়াসকে। তিয়াস এগিয়ে আসলে দুজনে ধরে টেবিল সরিয়ে রাখে পাশে। কাঁ/চিটা সুজনের হাতে দিয়ে বলে, “ফিতা কেটে ভেতরে আসো।”
__
সবে ঘোড়ার গাড়িটা শাঁ শাঁ করে বেরিয়ে গেল। বিদায়ের সময় কেঁদে ভাসিয়ে ফেলেছে আরু। মল্লিকা এখনো কাঁদছে। চারজন বাড়ির বউ কেঁদে ভাসিয়ে ফেলেছে। সেক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই পারুল। বংশের প্রথম ভাইজিকে গাড়িতে তুলে দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছে সেও। অন্যের কান্নার চেয়ে আরু একটু বেশিই কেঁদে কেঁদে ভাসিয়ে ফেলেছে। যথারীতি শরীরে তার অজস্র কাঁদা লেগে আছে।

পারুল আঁচল থেকে চাবি খুলে আরুর হাতে দিয়ে বলে, “কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে গিয়ে হাঁস মুরগি খোপরে ঢুকিয়ে আয়। শুধু শুধু কাঁদার চেয়ে কাজ করতে করতে কাঁদ।”

আরু চাবিটা হাতে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির রাস্তা ধরে। উপস্থিত সবাই মেয়েকে বিদায় দেওয়ার কান্না ভুলে আরুর কাণ্ডে হাসছে। তিয়াস নিজেকে একটু শক্ত করে বলে, “মেয়েটা একটু কাঁদবে, তোমার জ্বালায় কাঁদতেও পারল না। তা একা একা বাড়ির দিকে পাঠিয়ে দিলে, সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। বটতলাটা ভালো না।”

অপূর্ব আরুর পেছনে পেছনে হাঁটা দিল। আরু তখন বটতলা পর্যন্ত এসেছে। পেছন থেকে অপূর্বর ডাক তার কাছে মনে হলো কোনো দিবা। হাঁটার সময় পেছন থেকে বারবার ডাকে, কখনোবা পেছনে পেছনে হাঁটে। আরু বামপা দিয়ে কয়েকবার ঘর্ষণ করে এগিয়ে গেল। হাঁটার তালে তালে আরুর মাথার খোঁপাটা খুলে গলার কাছে জমে রইল। সম্পূর্ণ পড়ে যাওয়ার আগেই অপূর্ব ধরে ফেলে। ভীত আরু আরেকটু কাবু হয়ে পেছনে তাকাতেই অপূর্বকে দেখতে পেল। অপূর্ব সন্তর্পনে আরুর খোপা ঠিক করে দিল।‌ পাশের লজ্জাবতী গাছটাও এতটা লজ্জা পেল না। আরুকে সন্নিকটে টেনে হাত দুটো নিজের কাঁধে তুলে দিল অপূর্ব। অতঃপর নিজের হাত দুটো কোমরে রেখে অপলক চেয়ে রইল।

“ওভাবে কী দেখছেন?”

“আমার পদ্মাবতীকে দেখছি। আজকাল তাকে দেখতে অসম্ভব সুন্দর লাগে। আজকে তুই একটু বেশিই লজ্জা পাচ্ছিলিস, কিন্তু কেন? বিয়ে তো তিস্তার। তুই কেন লজ্জা পাবি? একবার মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হতে দে, তোর লজ্জা ভাঙানোর দায়িত্বটা তখন আমি নিবো।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২৫

আহসান বাড়ির চার ভাই একত্রে বসে আছে। তাদের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়ানো তিয়াস ও সুমি। বাড়ির মেজো ছেলে অর্থাৎ তিয়াসের বাবা উঁচু গলায় বললেন, “তুমি একটা মেয়েকে ভালোবাসো। আমাদের বললেই আমরা মেনে নিতাম। সেই মেয়েকে নিয়ে চলে এলে। আজ আহসান বাড়ির মান সম্মান ধুলোয় মিশে যাবে তোমার জন্য।”

“আমি যেটা করেছি, সেটা ভুল। কিন্তু এছাড়া আমার কোনো উপায় ছিল না।” কথাটা বলে তিয়াস সুমির দিকে ইশারা করে। অবিলম্বে ঝাঁপিয়ে পড়ে সুমি। দাদিজানের পা ধরে ক্রন্দনরত অবস্থায় বলে, “আমার মা নেই, ছোটবেলায় মা মারা গেছে। বাবা আবার‌ বিয়ে করছে। আমাকে বাড়ি থেকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। চকিদারের মাতাল ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করছে। আমারে বাঁচান।”

চার ছেলের সাথে আলোচনা করলেন পিতা। কিছুক্ষণ আগে তিস্তাকে বিদায় দেওয়া হয়েছে। ‘এরমধ্যে তিয়াস সুমিকে বাড়িতে নিয়ে আসবে’- এটা কারো প্রত্যাশায় ছিল না। হট্টগোল না করে তাই নিজেদের ভেতরে আলোচনা করছে আহসান পরিবার। পরিস্থিতি তখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। মোতাহার আহসান বলেন, “আমাদের একটা মানসম্মান আছে। চাইলে আমরা সব করতে পারিনা। তোমার বাবাকে খবর দেয়। কাল সকালে আসতে বলি। কথা বলে সব মিটমাট করে বলব।”

এত সময় পর সমস্যা সমাধান হতে দেখে অন্তঃকরণ ভেঙে চূর্ণ বিচূর্ণ হলো শেফালীর। সবাই প্রায় সুমিকে বাড়ির বউ হিসাবে মেনে নিয়েছে। নিজের ভালোবাসার মানুষটি চিরতরে অন্যের হওয়া মেনে নেওয়া কতটা কষ্টের সেই জানে। শেফালী বাজখাঁই গলায় বলে, “না চাচা, না বাবা, না দাদা। এমন একটা চরিত্রহীন মেয়ে তিয়াস ভাইয়ের সাথে মানায় না। যে মেয়ে বংশের মুখে চুনকালি লেপে অন্য ছেলের সাথে আসতে পারে, তার চরিত্র কখনোই ভালো হতে পারে না। আপনারা ওকে বাড়ি থেকে বের করে দিন।”

ভালোবাসার মানুষটির নিন্দা কি কোনো প্রেমিক সহ্য করতে পারে? তিয়াসও পারে না। শেফালীকে নিজের দিকে ফিরিয়ে ঠাটিয়ে লাগল এক চ/ড়। রাগে শরীর ফেটে যাওয়ার উপক্রম। তিয়াসের রাগান্বিত মুখমণ্ডল দেখে অপূর্ব তাকে সরিয়ে নিল। তবুও তিয়াস বলে, “আর একটা কথা বললে তোর মুখ আমি ভেঙে দিবো শেফু। আমাকে শাসন করার জন্য আমার বাবা চাচারা আছে। তুই মাতব্বরি করতে আসলে ভালো হবে, বলে দিলাম।”

“এবারে কারো ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা বলবে না। যাতে তার চরিত্রের দিকে আঙুল উঠে।” শাহিনুজ্জামান তার মেয়েকে বলে। শেফালীর চোখমুখে রাগের আভাসে দেখা গেল। সুমির জন্য সবাই একাধারে শেফালীকে বকে চলেছে ‌। বেশিক্ষণ নিজেকে সংযত করতে পারে না শেফালী। ধুম করে ঘরে গিয়ে খিল তুলে দিল‌। তুর ও আরু এর ফলাফল জেনে ছুটে গেল ঘরের দিকে। শেফালী ততক্ষণে ভাঙচুর শুরু করে দিয়েছে। চুলগুলো টেনে ধরে ছিঁড়ে ফেলার জন্য টানতে। আরু দরজা ধাক্কা দিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, “মিষ্টি কুমড়ার ফালি, দ্রুত দরজা খোল।”

“শেফু, দরজা খুলতে বলেছি তোকে। নাহলে কিন্তু বাবাকে গিয়ে বিচার দিবো।” তুর শাসায়। শেফালী দরজা খুলে আবার বিছানায় গিয়ে বসে। আরু ও তুর ভেতরে প্রবেশ করে খিল তুলে দিল দরজার। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আরু বলে, “মনের উপর কারো জোর চলে না শেফালী। তিয়াস ভাই সুমিকে ভালোবাসে।”

“তো! তাই বলে সবার সামনে আমাকে মারবে? আমার ভেতরটা কেউ বুঝতে পারছে না। তিয়াস ভাইকে আমি নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসি। তার পাশে ঐ শাতচুন্নিটাকে কীভাবে সহ্য করব, বল তোরা?”

শেফালী নিজের চুল ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। বিপরীত সুরে তুর বলে, “এখানে অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পারছি না আমি। ভালোবাসার মানুষের নামে কিছু বললে, কেউ সহ্য করতে পারে না।”

“তোরা এখন‌ সুমির দলে চলে গেছিস? বাহ্! গুড। যা বোঝার‌ আমি বুঝে গেছি। এবার তোরা আসতে পারিস।” শেফালী নিজের ক্ষোভ ধরে বসে থাকে। তুর ও আরু অধৈর্য হয়ে উঠে। তখনই দরজায় করাঘাত পড়ে। আরু দরজা খুলে দেখতে পেল জাহানারা এসেছে সুমিকে নিয়ে। মুচকি হেসে বলে, “তিস্তা তো চলে গেছে, এখন তোদের ঘরে সুমিকে রেখে দে। সুমি আলাদা থাকলে অস্বস্তি হতে পারে।”

“আচ্ছা।” তুর বলে সুমিকে নিয়ে ঘরে ঢুকে। ঘরের ভাঙাচোরা অবস্থা দেখে সংশয় প্রকাশ করে জাহানারা। শেফালীর মুখের দিকে তাকিয়ে আভাস পায় অন্য কিছুর। এগিয়ে গিয়ে শেফালীর মাথায় হাত দিয়ে বলে, “রাগ করিস না মা, তিয়াস হঠাৎ করে এমন করে ফেলবে কে বুঝতে পেরেছে। আমি তিয়াসকে বলব তোর কথা ক্ষমা চাইতে।”

শেফালী হাতটা সরিয়ে ফেলে বিলম্বে। জাহানারা আশ্চর্যান্বিত হলো শেফালীর ব্যবহারে। চকিতে নিজের বালিশ আর কাঁথা নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে, “আমি বাইরের কারো সাথে আমার ঘর শেয়ার করতে পারব না। যতদিন সে এই ঘরে থাকব, আমি ততদিন অন্য ঘরে থাকব‌।”

“এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে শেফু?”

“আমার বাবা মা আমার গায়ে হাত দেয় না, আর তিয়াস ভাই আমার গালে চড় মেরেছে এই মেয়েটার জন্য। তারপরেও আমি ওর সাথে বিছানা শেয়ার করব? কখনোই না।” বলেই শেফালী বেরিয়ে গেল। সবাই শেফালীকে আটকানোর চেষ্টা করে কিন্তু পারে না।
অপূর্ব ক্লান্তি কাটিয়ে লম্বা একটা গোসল নিয়ে ঘরের ভেতরে যাচ্ছিল। পাশের ঘর থেকে অতিরিক্ত কথোপকথন শুনে থেমে গেল সে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আরুকে আদেশ করে, “আরুপাখি, শুনে যা বাবু।”

“কী হয়েছে?” আরু ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে বলে।

“শেফালীর সম্পর্কে কেমন একটা কথা‌ শুনলাম। একটু খুলে বল।”

“আমি কিছু জানি না।” বলে আরু উলটা পথে পা রাখে। ঘরে প্রবেশের আগেই অপূর্ব তার বলিষ্ঠ হাতে বাধা দিল তাকে। মুঠো করে ধরে নিয়ে এলো বাইরে। দরজার বাইরে সিমেন্টে বাঁধানো চেয়ারে বসে বলে, “বাড়িতে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেছে। আমি চাইনা, এতরাতে তোকে আর আমাকে‌ একসাথে দেখে আবার কিছু ঘটুক। তার আগে বলে বিদায় হ।”

আরুর কী হলো জানে না। অপূর্বর বুকে মুখ গুজে দিল। আবদ্ধ করে নিল কোনো বন্ধনে। আগ বাড়িতে এভাবে সে কখনো অপূর্বকে ছোঁয় না। অপূর্ব আরুর পিঠে হাত রেখে আদুরে গলায় বলে, “কী হয়েছে আমার পদ্মাবতীর? মন খারাপ?”

চকিতে শুনতে পেল আরুর কান্নায় মাখা গলা। কাঁদতে কাঁদতে অপূর্বর শার্ট ভিজে গেছে। আরু ভাঙা গলায় বলে, “তিয়াস ভাইয়াকে শেফালী অনেক ভালোবাসে। শেফালী অনেকবার তাকে বুঝিয়েছে। কিন্তু তিয়াস ভাই সুমি ভাবীকে ভালোবাসে। আজ এমন ঘটনায় শেফালী অনেক ভেঙে পড়েছে।”

অপূর্ব হতভম্ব হলো। নিজেকে সামলানোর আগে আরুকে সামলানো দরকার। শেফালীর কষ্টতে ভেঙে পড়েছে আরু। পদ্মবতী যে অপূর্বকে ভালোবাস, তা জেনে অপূর্বর ঠোঁট প্রসারিত হয়। আরুর পিঠে হাত রেখে সান্ত্বনা দেয়, “ওদের ভালোবাসা ছিল এক তরফা। কিন্তু আমাদের ভালোবাসা দুজনের দিক থেকে। তোকে ঠেকানোর কোনো চান্স নেই। ঘরে গিয়ে একটা ঘুম দিবি। এইসব নিয়ে আর ভাববি না।”

আরু উঠে ঘরের ভেতরে চলে গেল। অপূর্ব বস রইল সেখানে। শেফালীর জন্য অদৃশ্য সহানুভূতি কাজ করে অপূর্ব-র। ভালোবাসার মানুষকে চোখের সামনে অন্যকারো হতে দেখা, কতটা পিড়াদায়ক। অপূর্ব তা অনুভব করে।

চলবে.. ইন শা আল্লাহ

error: ©<b>গল্পপোকা ডট কম</b>