নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-৪৪+৪৫

0
168

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪৪

“শেফালী, কেঁদো না। মানুষের জীবন নদীর মতো। তারা নিজের মতো বইতে পারেনা। উপত্যকা হিসেবেই তাদের চলতে হয়।” কথাটা বলে আংটি দুটো কুড়িয়ে বিছানায় বসে কালাচাঁন। শেফালী হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “কাঁদব না? আমি তিয়াস ভাইকে কতটা ভালোবাসি জানেন আপনি?”

শেফালী তেড়ে গিয়ে কালাচাঁনের কলার টেনে ধরল। আলতো মাথা নিচু করে নেয় কালাচাঁন। মনে মনে হাসে, ভালোবাসার পরীক্ষা দিতে গিয়ে জোতার মালা গলায় পরেছে। গ্ৰামবাসীরা একশো একটা আঘাত করেছে। সৌজন্য হেসে বলে, “তিয়াস ভাই আমাকে সব জানিয়েছে। তোমাকে ভালো রাখার দায়িত্ব আমার হাতে ন্যস্ত করেছে। গোলাপিকে হারিয়ে বিয়ের কথা আমি ভুলে গিয়েছিলাম। সেদিন তুমি যখন আমার হয়ে সবাইকে বলেছিলে, আমাকে গ্ৰাম থেকে বের না করতে। সেদিন মায়ের মনে তুমি জায়গা করে নিয়েছিলে। আমার এই রঙহীন জীবন আলোকিত করতে, মাকে তোমাকে পছন্দ করেছে।
শেফালী অতীত ভোলা যায় না, তাই বলে অতীত আঁকড়ে ধরে থাকা উচিত নয়। তোমাকে আমি গোপালির মতো ভালোবাসতে পারব না। তবে তোমাকে ভালো রাখতে পারব।”

আঁকড়ে ধরা হাতটাতে আংটি পরিয়ে ছাড়িয়ে নিল কালাচাঁন। বিছানার একপাশে সেঁটে শুয়ে পড়ল। শেফালী অপলক দৃষ্টিতে কালাচাঁনের দিকে তাকিয়ে আছে। কালাচাঁনের ভালোবাসা ছিল খাঁটি। হঠাৎ কানে এলো পোকাদের শব্দ। অচেনা জায়গায় এমনিতেই ভীতু শেফালী। ভয়েটা তড়তড় করে বেড়ে যাচ্ছে। ভয় কাটাতে দূরত্ব রেখে শুয়ে পড়ল শেফালী। শুনতে পেল ফোঁপানোর শব্দ। পুরুষেরা সহজে ভেঙে পড়েনা, তার উদাহরণ কালাচাঁন।
__
সাত জন যুবক যুবতি হেঁটে যাচ্ছে মাটির রাস্তা দিয়ে। প্রথমত আরু গোসল করেছে সন্ধ্যায়, দ্বিতীয়ত চাদর নিয়ে আসেনি। তাই ঠকঠক করে কাঁপছে আর হাঁটছে। হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে সুমি ও তিয়াস সম্মুখে এগিয়ে গেছে। তার আগে এগিয়ে গেছে তিস্তা ও সুজন। অপূর্ব দু-হাতে বউ ও বোনকে ধরে হাঁটছে। আচমকা অপূর্বর হাত ছেড়ে রাস্তার কিনারে নদীর দিকে মুখ করে বসে পড়ল আরু। গড়গড় করে বমি করল। অসময়ে আরুর এই অবস্থা দেখে অপূর্ব আরুর নিকট যায়। ঝুঁকে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়‌। আরুর চোখে-মুখে এক ক্লান্তি বিরাজমান। যত্ন করে বলে, “কী হয়েছে আরুপাখি, শরীর খারাপ?”
“পঁচা মাছের বিশ্রী গন্ধ আসছে। আমার বমি পাচ্ছে।”
অপূর্ব তার শরীর থেকে চাদর খুলে আরুর গায়ে জড়িয়ে দিল। উন্মুক্ত হলো পানের লাল পিক। আরু চাদর দিয়ে নাক ঢেকে অপূর্বর কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে পুনরায় হাঁটা শুরু করল। সুমি ও তিয়াস অনেক সামনে এগিয়ে গেল। এক পর্যায়ে দাঁড়িয়ে যায় তিয়াস। পিছিয়ে ওদের জন্য দাঁড়ায়। দূর থেকে বলে, “ভাই, দাঁড়িয়ে পড়লেন কেন?”
“স্কুল থেকে ফিরে রান্না করেছে, না খেয়েই এখানে চলে এসেছে। খালি পেটে পচা মাছের গন্ধে বমি করেছে।”
“পচা মাছ পেলেন কোথায়?”
“মনেহয় জাল থেকে মাছ ছাড়ানোর সময় দু-একটা ঝোপঝাড়ে পড়ে ছিল। সেটাই পচে দুর্গন্ধ ছাড়াচ্ছে।

অপূর্বরা এগিয়ে আসতেই কিঞ্চিৎ আলোতে অপূর্বর সাদা‌ শার্টে লাল দাগ দেখে বলে, “আপনার শার্টের এই অবস্থা হয়েছে কীভাবে ভাই?”

অপূর্বর মনে পড়ল তখনকার কথা। আরু কাঁচুমাচু করে হাত ছাড়িয়ে নেয়। পুনরায় আরুর হাত ধরে অপূর্ব বলে, “এই গোরুটা পানের পিক ফেলেছে। গোরুর মতো পান চিবানো শিখেছে। সাদা শার্টে এই দাগ উঠবে? ঘষে ঘষে যদি এই দাগ আরু উঠাতে না পারে, তাহলে ওর শরীরে দাগ করার দায়িত্ব আমায়।”

আরু চোখ রাঙিয়ে তুরকে ইশারা করে। তুর মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। হাত ছাড়িয়ে সুমির হাত ধরে হাঁটা দিয়ে বলে, “তোমরা সবাই আস্তে হাঁটছ কেন? আমার পা ব্যথা করছে।”

“তুর। তুই আমার একমাত্র আদরের বোন। যখন তুই হাঁটতে শিখেছিস, তখন মা-বাবা দেশে ফিরে এসেছে। আমাকে জোর করে ভিনদেশে রেখে এসেছে। এক প্রকার চাপা রাগে আমি এতদিন দেশে ফিরিনি। মা তখন আরুকে আমায় বধ করার অ/স্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কেবল আরুর টানেই আমি দেশে এসেছি। ছোটবেলায় তোকে তেমন কোলে নিতে পারিনি, চাইলে এখন বড়ো ভাইয়ের কোলে উঠতে পারিস।”

বলেই হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে অপূর্ব। তুর এই সুযোগটাকে মিস করতে চায়না, তাই অপূর্বর গলা ধরে ঝুলে পড়ল। ভাই বোনের এই মিষ্টি সম্পর্কগুলো আজীবন অক্ষত থাকুক।
__
শীতকালের আগমনের আগেই কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে। বিভিন্ন প্রজাতির পাখিরা এসে জানালার পাশে বসেছে। পাখিদের ডাকে ঘুম ভেঙে যায় কালাচাঁনের। কালাচাঁনদের বাড়ি নদীর কিনারায় একটু ভেতরে থাকাতে শীত বেশি পড়ে। তবে অন্যদিনের তুলনায় আজ শীত অনেকটা কম। কালাচাঁন অনুভব করে কেউ তাকে পেছন থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে। কালাচাঁন আলতো ঘাড় কাত করে শেফালীর তৈলাক্ত ও ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখতে পায়। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে ছেলেটি। গতরাতে যে বিয়ে করে কেঁদে চোখ ফুলিয়েছে, আজ সে কালাচাঁনকে অবলম্বন করে রেখেছে। কালাচাঁন শেফালীর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে মায়াতে আবদ্ধ হওয়ার পূর্বেই দরজার করাঘাত পড়ল। অনবরত করাঘাত বাড়তে শুরু করল। দরজার বিপরীত পাশ থেকে তুর বলে, “দুলাভাই, আর কত ঘুমাবেন। উঠুন। বিয়ের পর দিনে এত ঘুমায় না!”

শেফালীর তন্দ্রা হালকা হয়ে এলো। চোখ মেলে সর্বপ্রথম নজরে এলো কালাচাঁনের লাল রঙের পাঞ্জাবি। চকিতে ঠ্যালে পিছনে যেতেই বিছানা থেকে মাটিতে পড়ল শেফালী। ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠে। কালাচাঁন বিছানা থেকে উঠে নিজেই কম্বল ভাঁজ করে পাশে রাখে। এটা তার নিত্যদিনের কাজ। অতঃপর কমলা রঙের একটা পাজামা-পাঞ্জাবি কাঁধে নিয়ে দরজা খুলে দিল। তুরের পেছনে সুমি দাঁড়িয়ে ছিল। হাত দিয়ে কালাচাঁনের পথ আটকে বলে, “নন্দাই সাহেব, রাত কেমন কেটেছে।”
“আপনার ননদকে জিজ্ঞেস করুন।” লজ্জা পাওয়ার ভান ধরে দিঘির দিকে গেল কালাচাঁন। আড়াল থেকে বেরিয়ে সুমিদের সাথে যোগ দিল আরু ও তিস্তা। কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করে শেফালীকে বিছানায় দেখতে পেল। ততক্ষণে মাটিতে থেকে শাড়ি ঝেড়ে বিছানায় বসেছে শেফালী। গতরাতের শাড়িতে ভাঁজ না দেখে অকপটে সুমি বলে, “শেফালী এভাবে কোমরে হাত দিয়ে কেন বসে আছো?”
“ব্যথা পেয়েছি।”
“অ্যাহ!”
“সত্যি বলছি। ধাক্কা দিলে ব্যথা পাবোনা?”
“বোন, তুই বাইরে গিয়ে এই কথা বলিস না। তাহলে আমাদের মানসম্মান শেষ।” আরু হেসে বলে।
“শেফালী কি তোর মতো? ও সব বুঝে। তোকে যখন প্রশ্ন করেছিলাম, তখন অপূর্ব ভাইকে ধরিয়ে দিয়েছিস। আমাদের সাথে যদি শেয়ার না করে, কার সাথে করবে? ওর কি ননদ আছে?” আরুকে খানিক রঙ্গ করে বলে তিস্তা। রঙ্গ বুঝতে পারল না আরু। বিপরীতে তেজ দেখিয়ে বলে, “আমি খা/রা/প এটা বলতে চাইছো? তোমরা থাকো তোমাদের মতো। আমি আর তোমাদের বিরক্ত করব না।”

বলেই রাগান্বিত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল আরু। চার জন যুবতি বুঝতে পারল না, আরুর ব্যবহারের মানে। আরু সহসা রাগে না, আজ সামান্য কারণে রেগে গেল। আরু পেছনের দরজা দিয়ে রসুইঘরে এসে দাঁড়াল। অনিতা ও জাহানারা নাস্তা তৈরি করছে। আরু পিঁড়ি পেতে বসতেই অপূর্ব ডাক্তার নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকল। সুন্দরী যার কাছে পরীক্ষা করেছিল, সে অপূর্বর পরিচিত বলে বাড়িতে নিয়ে এসেছে। অপূর্ব ডাক্তারকে ঘরে রেখে রসুইঘরে এসে বলে, “মা, ডাক্তার এসেছে। এক চাপ চা দাও।”

জাহানারা কাপে ছাঁকনি দিয়ে চা ঢালতে ঢালতে আরুকে উদ্দেশ্য করে বলে, “আরু চা আর বিস্কুটগুলো নিয়ে যা।”
“পারব না। আমি কি এই বাড়ির বউ? যে বউ তাকে বলো। সে-তো এত বেলাতেও ঘুমাচ্ছে আর আমরা সাতসকালে হাজির।”

অজানা কারণে আরুর মাথায় আগুন জ্বলে উঠেছে। জাহানারা আড়চোখে অনিতার দিকে তাকিয়ে বলে, “ইদানীং ওর কী হয়েছে ভাবী? কথায় কথায় ছ্যান ছ্যান করে ওঠে।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৪৫

“আমিও বুঝতে পারছি না। খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করেনা। সকালের খাবার দুপুরে, দুপুরের খাবার রাতে খায় যদি আমি মনে করে দেই। খাবারের কথা বললে কেমন করে তাকায়। খাবার নিজের হাতে সাজিয়ে হাতে দিলাম, কিছুক্ষণ পর দেখি দিঘিতে ফেলে দিচ্ছে। কাজের কথা বললে, আলসেমি করে।” মল্লিকা সায় দিল জাহানারার সাথে। আরু যেন চণ্ডাবতী হয়ে উঠল। তেড়ে বলে, “কী বলতে চাইছ, ‘আমি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরি। কোনো কাজ করি না।’ এখন তো আমাকে ভালো লাগবেই না। সুমি ভাবীই ভালো।”

“তুই ভুল ভাবছিস আরু।” অনিতা আরুকে সামলানোর চেষ্টা করে।

“আমার এইটুকু বোঝার বয়স হয়েছে।” আরু উত্তেজিত হয়ে বলে। অপূর্ব পাশেই দাঁড়ানো ছিল। মায়ের প্রতি স্ত্রীর এমন কথা শুনে হতভগ্ন হয়ে গেল। সিঁড়ি থেকে নিচে নামতে নামতে ধমকায় অপূর্ব, “এক চড়ে তোর সব দাঁত ফেলে দিবো আরু। মায়ের সাথে এভাবে কথা বলার সাহস কে দিয়েছে তোকে? শাসন করছি না বলে বে/য়া/দ/ব হয়ে যাচ্ছিস দিনদিন।”

প্রিয়তমর মুখে এমন ধমক শুনে অশ্রু এসে ভিড় করল আরুর চোখে। অপূর্বও আরুকে বুঝতে পারেনা? আরুকে বজ্রকণ্ঠে ধমকেছিল, তাই ঘরের সবাই বাইরে এলো। মোতাহার আহসান সংশয় নিয়ে বলেন, “কী হয়েছে এখানে? এত চিৎকার চ্যাঁচামেচি কেন?”
“আপনার ভাগনিকে জিজ্ঞেস করুন। সাত ভাইয়ের এক বোন, এক ভাগনি। কার সাথে কীভাবে কথা বলতে হয়, এখনো জানে না।” অপূর্ব অন্যদিকে ফিরে বলে। আরুর সমস্ত ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলে শুরু করল। চোখ মুছে শুরু করল তার অভিযোগ, “বোন, ভাগনি। দাম দিয়েছেন তাদের? ভাইঝির বিয়ে, অথচ বোন দুলাভাই হিসেবে আমার মা-বাবা জানে না। বংশের সবাই উপস্থিত কিন্তু আমার মা-বাবা নেই। তিস্তা আপু দূর থেকে চলে এসেছে, অথচ আমার মা কাছে থেকেও নেই। তারপরেও আপনারা কীভাবে আশা করেন, আপনাদের সাথে আমি ভালো ব্যবহার করব?”

উপস্থিত সবাই যেন বিস্মিত, হতবাক, বাকরুদ্ধ। অনিতা রান্না রেখে আরুর কাঁধে হাত রেখে বলেন, “তুই তো জানিস, আমরা কতটা ব্যস্ত আছি। তোর কি উচিত ছিলনা, পারুলকে খবর দেওয়ার? অন্তত একবার আমাদের জানাতি।”
“আপনার ছেলে কী করে? তিয়াস ভাই তার বোনকে খবর দিয়ে নিয়ে এসেছে। ওনিও আমার মাকে নিয়ে আসত। সে আমাকে মা/রা/র জন্য ব্যস্ত থাকে। কালরাতে ভুলে পানের পিক ফেলেছিলাম, ওনার শার্টে। এতে ওনি আমাকে হুমকি দিয়েছে, পানের দাগ না উঠলে আমাকে মে/রে হাসপাতালে ভর্তি করবে। তাই ভোরে ঘুম থেকে উঠে ওনার শার্ট ধুয়ে এই বাড়িতে এসেছি।
আসলে ওনার কোনো দোষ নেই, বিদেশে ছিল তো। বিদেশিনী দেখে চোখ জুড়িয়েছে, এখন আমার মতো গ্ৰামের মেয়েকে ওনার ভালো লাগছে না।” বলতে বলতে আরু কেঁদে ফেলল। মধ্যবয়স্করা হতভগ্ন হলেও যুবক-যুবতিরা আশ্চর্যান্বিত। অপূর্ব অন্য ইঙ্গিতে বলছিল, আরু তার অন্য মানে বের করছে। এই লজ্জাজনক কথার জন্য অপূর্বর পক্ষ নিয়ে কেউ কথা বলল না। মোতাহার আহসান থমথমে গলায় বললেন, “এজন্য তুই আজানের পর দিঘিতে গিয়েছিলিস?”
“হুঁ।”
“অপূর্ব, আহসান বাড়ির ছেলেরা কখনো কাপুরুষের মতো স্ত্রীর গায়ে হাত তোলে না। তোমার কাছ থেকে এমন ব্যবহার আশা করিনি।” বলেই মোতাহার আহসান ঘরে চলে গেলেন ভাইদের নিয়ে। অপরাধ না করেও বাবার চোখে নত হলো অপূর্ব। রাগে হাত টিনের সাথে আঘাত করল অপূর্ব। জং ধরা টিন ভেঙে হাত ভেতরে চলে গেল। কা/ট/ল অনেকটা। প্রাণনাথের এমন অবস্থা দেখে আরু এগিয়ে এলো। অপূর্ব কা/টা হাতের দিতে তাকিয়ে বলে, “আরু, আমার মাথা গরম আছে। সামনে এসে আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিস না।”
“শুনুন।”
“আমি এই বাড়ি থেকে যেতে বলেছি তোকে।”
“আপনার হাত থেকে রক্ত পড়ছে।”
“আরু… এখান থেকে যা।” অপূর্বর ধমকে আরু খানিক কেঁপে উঠল। হুট করে আরু ফের রেগে গেল। রাগান্বিত হয়ে বলে, “আপনি আমাকে বাড়িতে চলে যেতে বলছেন? ঠিক আছে।”
আরু আরু‌ পেছনে তাকাল না। ছুটে গেল বাড়ির দিকে। তুর, সুমি, তিস্তা থামানোর প্রচেষ্টা করল। কিন্তু আরু আজকাল কারোর কথায় গুরুত্ব দেয় না। চম্পা তখন উনুনের কাছে বসে কৌতূহল নিয়ে বলেন, “আমার কেন জানি মনে হয়, আরু পোয়াতি। মোতাহার যখন আমার গর্ভে এসেছিল, তখন আমি হুটহাট রেগে যেতাম। এখন মোতাহারের রাগ সবার উর্ধ্বে।”

“আম্মা। আরু কখনো বলেনি ওর মাথা ঘুরে, বমি পায়, অস্থির লাগে। আমার মনে হয় পারুল বুবুকে খবর দেইনি বলেই রেগে ছিল।” মল্লিক বাক্য করে।

“কে বলেছে আরু বমি করেনি? কালকে রাতে রাস্তায় করেছিল, আবার স্কুলে গিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসেছিল। ওর শরীর নাকি ভালো লাগছে না।” তুরের কথায় ছোটোখাটো ভূমিকম্প হলো এখানে। সবাই একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে। মল্লিকা উৎফুল্লিত হয়ে বলেন, “আমাদের অপু সবার পরে বিয়ে করে ছক্কা হাঁকাবে, আমরা কেউ ভাবতেই পারিনি। ভাবী, তুমি দাদি হচ্ছো, মিষ্টি দাও।”

“আমি কি একা দাদি হচ্ছি, তোমরা হচ্ছো না? মিষ্টি খাওয়াবে আম্মা, সে প্রথমবার পুতির মুখ দেখতে চলেছে।” অনিতা বললেন। জবাবে একগাল হেসে চম্পা বলেন, “তা আর বলতে? কিন্তু অপূর্বর মনোচিকিৎসার ওপরে আমার সন্দেহ হচ্ছে। আরু যে পোয়াতি, এটা কেন স্বামী হয়ে ও বুঝল না?”

অপূর্ব এখনো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। তাকিয়ে আছে আরুর গমনপথের দিকে। আরুকে দেখা যাচ্ছেনা, অথচ মস্তিষ্ক আরুর মুখ থেকে শুনতে চাইছে সত্যটা। চম্পার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে অপূর্ব হাঁটা দিল বাড়ির দিকে। আহসান বাড়ি থেকে কালাচাঁনদের‌ বাড়ি পাঁচ মিনিটের রাস্তা। আজকে সেখানে পাঁচ মিনিট পাঁচ যুগের মতো লাগল অপূর্বর কাছে। কাঠের দরজায় মস্ত এক তালা দেখে সন্দিহান হলো। কোথায় গেল আরু? হাতের ইশারায় কাছে ডাকে এক প্রহরীকে। নিকটে আসতেই বলে, “আরুকে দেখেছেন ভাই?”

“ভাবী তো আপনাদের সাথেই বের হয়েছে আর ফেরেনি।”

“চাবিটা দিন তবে।”
প্রহরী চাবি এগিয়ে দিতেই অপূর্ব তালা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে। আরু কোথায় গেছে, অপূর্ব অনুমান করেছে। সিঁড়ি পেরিয়ে সোজা দোতলা ঘরে গেল। মাথায় হাত রেখে বিছানায় বসতেই ময়নাপাখি ডেকে উঠল, “আরুপাখি, আরুপাখি, আরুপাখি।”

ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়ে কালাচাঁনদের বাড়িতে গিয়েছিল পরিবার। তখন ঘুমন্ত ছিল পাখিরা। আরুও খাবার দেয়নি। অপূর্ব টিনের কৌটা থেকে খাবার বের করে খাঁচার ভেতরে দিল। পুনরায় কৌটা টেবিলে রাখতে নিলেই হাতের ধাক্কায় কাঠের ফুলদানিটা মাটিতে পড়ল ঠক করল। বিরক্ত নিয়ে ঝুঁকে ফুলদানিটা তুলতে গেলে অবাধ্য দৃষ্টি আটকালো খাটের নিচে। অপ্রত্যাশিত ও পরিচিত প্যাকট দেখে অপূর্ব খাটের তলা থেকে বের করে আনল। আগের মতো দেখে রাগল ভীষণ। মেয়েটা অবাধ্য হয়েছে, কিশোরী জীবন নিয়ে খেলছে। এই বয়সে গর্ভধারণ মানে জানে ও?
অপূর্ব ছুটল মৃধা বাড়ির দিকে।
_
দিঘির পাড়ে বসে আছে মাছওয়ালা। তার পাত্র থেকে মাছ গুনে গুনে অয়নের হাতে দিচ্ছে। অয়ন তা গুনে দিঘিতে ফেলছে। বেশ কিছুদিন আগে দিঘির পানি পালটে আবার নতুন পানিতে ভরতি করেছে। মাছের পোনা ফেলছে আজ। পাঁচশো পোনা মাছ ফেলার পর পারুল আঁচলে হাত মুছে অয়নকে আদেশ দেয়, “বালিশের ভেতরে আমার ছোটো ব্যাগ আছে। ওটা নিয়ে আয়।”

অয়ন ছুটে ঘরে গিয়ে বালিশের তলা থেকে ব্যাগ বের করে ফের রওনা হলো দিঘির দিকে। আচমকা ডানে নজর যেতেই মাটিতে পড়ে থাকতে দেখল আরুকে। অয়ন ছুটে গিয়ে আরুকে ঠ্যালা দিয়ে বলে, “বুবু, এই বুবু ওঠ। মা দেখো, বুবু এখানে পড়ে আছে।”

অয়নের চিৎকারে ছুটে এলো পারুল। মেয়েকে এই অবস্থায় দেখে চমকে গেছে।

চলবে.. ইন শা আল্লাহ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে