Monday, June 23, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 226



নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-১৪+১৫

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৪

অপূর্ব ভাই উবুড় হয়ে গাঢ় নিদ্রায় ব্যস্ত। দিঘি কিনারা থেকে একটা কাঁকড়া ধরে এনেছে আরু। পানি ছাড়া কাঁকড়া ছয় ঘণ্টা বেঁচে থাকতে পারে বলে আরুর কষ্ট কম হলো। দুহাত দিয়ে কাঁটাযুক্ত হাত ধরা ছিল। ধীরে ধীরে বিছানার কর্ণারে রেখে নিঃশব্দে পা বাড়ল আরু। রহস্যপূর্ণ হাসি দিয়ে আনমনে বলে, “বিয়ে না করে লিভ-ইন সম্পর্কে জড়ানোর খুব শখ না আপনার। আজ এই কাঁকড়া আপনার মন থেকে চিরতরে লিভ-ইন সম্পর্কে জড়ানোর শখ ঘুচিয়ে দিবে।”

সকাল বেলা ঘুম থেকে জেগে নিমপাতা দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে দিঘির পাড়ে গিয়েছিল আরু। তখনই কাঁকড়াটাকে দেখতে‌ পায়। অবশ্য রাতে ঘুমানোর সময় পরিকল্পনা করেই রেখেছিল।
__
আরু মামিদের সাথে রান্নাঘরে বসে আছে। আজ শুক্রবার। স্কুল বন্ধ। তাই চারবোন একসাথে বসে আছে। স্কুল থেকে দেওয়া সরকারি বিস্কুট দিয়ে রং চা খাচ্ছে সকলে। ভোরে রাখাল চাচা বাড়িতে ফিরে গেছে। তাই দুধ ধোয়ানো হয়নি। ফলস্বরূপ আজ দুধ নেই বাড়িতে। কিয়ৎক্ষণ পর তিয়াস ও অপূর্ব এসে যোগদান করে। অপূর্ব-র পরনে লুঙ্গি ছাড়া। নগ্ন পিঠে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। সৃষ্টি হয়েছে ক্ষতের। উপর তৈলাক্ত মলম লাগানো। উপস্থিত সবাই স্তম্ভিত হয়ে যায়। অনিতা উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, “অপু তোর বুকেপিঠে এগুলো কীসের ক্ষত?”

“কাঁকড়ার। ঘুমের মাঝে মনে হচ্ছে, পিঠ কেটে নিয়ে যাচ্ছে কিছুতে। প্রথমে ভেবেছি তোমরা কেউ। তখন তিয়াস দেখাল কাঁকড়া। অনেক কষ্টে ছাড়িয়েছি।”

“শোবার ঘরে কাঁকড়া, কী বলিস?”

“হ্যাঁ চাচি। তিয়াস তো বলল ওটা কাঁকড়া।”

আরু নতজানু হয়ে চায়ে চুমুক দেয়। উক্ত কাজটি আরুর দ্বারা সম্পন্ন হয়েছে, সে সম্পর্কে অবগত অপূর্ব। ক্ষতগুলোতে হাত বুলিয়ে বেদনাক্রান্ত কণ্ঠে বলে, “পিঠের সাথে চেপে ছিল। অনেক কষ্টেও ছাড়াতে পারিনি। তখন মনে হচ্ছিল প্রাণপাখিটা উড়ে যাচ্ছে।”

চায়ের কাপটা তৎক্ষণাৎ ঠেলে রাখে আরু। সামনে রাখা বড় পাত্রটা নিয়ে অবনত কণ্ঠে বলে, “মামি তখন তো বললে, অপূর্ব ভাইয়ের জন্য মেয়ে দেখতে যাবে। চাচা না-কি ছুটি নিয়ে গেছে। মিষ্টিও তো বানাতে হবে। আমি একটা কাজ করি, দুধ দোহন করে নিয়ে আসি।”

উপস্থিত প্রত্যেকে স্বাভাবিক ভাবে ব্যাপার নিলেও অপূর্ব-র ক্ষেতে ব্যতিক্রম, পরিচিত হলো আরুও অসাধারণ একটি গুণের সাথে। তদানীং পাত্র নিয়ে গোয়ালের উদ্দেশ্যে অগ্ৰসর হয়েছে আরু।

আজ কুদ্দুস রাখাল আসেনি। সকালে গোয়াল আবর্জনাশূন্য করে নিজ সংসারে প্রত্যাগমন করেছেন। অপরাহ্ণের পূর্বেই পুনরায় যাত্রা শুরু করবেন।

আহসান নিবাসে ছয়টা গোরু। তার মধ্যে পাঁচটা দুধ দেয়, বাছুর রয়েছে বারোটা। আরু বাছুর সরিয়ে দিয়ে সংগ্রহ করতে ব্যস্ত হয়ে উঠল। একে একে চারটা গোরুর দুধ সংগ্রহ করে পঞ্চম গোরুর কাছে পৌঁছাতেই হাজির হলো বাহিনী। অপূর্ব পাত্রে অবলোকন করে ভ্রু কচকালো। পাঁচ সেকেন্ড আরুর কাজের গভীর দৃষ্টি মস্তিস্কে বন্দি করে বলে, “আরু সর, আমি সংগ্রহ করছি।”

“না আমি পারব। এমনিতেই আপনার দেহে পীড়া। গোরুতে পদাঘাত করলে হিতে বিপরীত হবে।” নেতিবাচক জবাব দিয়ে আরুর নিজের কাজে ব্যস্ত হলো। অপূর্ব স্থির রইল না। টেনেহিঁচড়ে আরুকে সরিয়ে নিয়ে কাজটি করতে বসল। আরুর মুখের কথা মুখে সীমাবদ্ধ রইল না, তিন সেকেন্ড পর পদাঘাত পড়তে বিলম্ব হলো না। চিত হয়ে গোয়ালে পড়ে। উপস্থিত সবাই হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। কিঞ্চিৎ হাসল আরু। অপূর্ব-কে টেনে তুলে লক্ষ্য করল বক্কে। গোরুর পায়ের বিষ্ঠার ছাপ অপূর্ব-র বুকেই শুধু নয়, সারাদেহে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিশ্রী গন্ধ। আরু কলতলার দিকে অগ্রসর হতে হতে তুরকে উদ্দেশ্য করে বলে, “দুধগুলো নিয়ে মামিকে দে। আর বলিস ভিখারি এসেছে। দুমুঠো চাল দিতে।”

প্রথমদিনের অপূর্ব-র উক্তিটিকে কটাক্ষ করে বলেছে, তাতে সন্দেহ নেই। আরু হাত ধুয়েছে, অপূর্ব গোসল সেরে নিয়েছে। অনিতা চুল হলুদ নিয়ে আরুকে পাঠাল অপূর্ব-র ঘরে।
অপূর্ব জানালার শিক ধরে রাজহাঁস দেখছে। সিল্ক চুলগুলো ভেজা, টুস টুস করে ঝরছে পানি। লুঙ্গি পরে রোদে বসেছে।

মৃদু স্বরে বলে, “আসব।”
অপূর্ব না তাকিয়ে জবাব দেয়, “আয়।”

আরু ঘরে প্রবেশ করে চুল-হলুদের মিশ্রণের পাত্রটা বিছানায় রাখে। অনিতা বাটিটা অপূর্ব-র কাছে পৌঁছে দেওয়ার আদেশ করেছে, কিন্তু আরু সেখানে ক্ষান্ত থাকতে চায় না। নিজের দেওয়া ক্ষতটা স্পর্শ করার স্পৃহা। নিশ্চল আরুকে দেখে মুখ খুলে অপূর্ব, “রেখে যা, আমি লাগিয়ে নিবো।”

একপা, দুইপা, তিনপা, চারটা.. গুনে গুনে দরজা পর্যন্ত গিয়ে পিছু ফিরে তাকায়। ফাঁকা ঢোক নেমে যায় গলা বেয়ে। ইতস্তত করে‌ বলে, “আমি লাগিয়ে দেই?”

“খুব ব্যথা করছে আরু। মনোচিকিৎসক না হয়ে ম্যাজিশিয়ান হলে ভালো হতো। এক নিমেষে নিজের ক্ষতটা সারিয়ে ফেলতাম।”‌ করুণ শোনাল অপূর্ব গলা। আরু থেমে নেই, বাটিটা নিয়ে অপূর্ব মুখোমুখি বসে। ডানহাতের চারটা আঙুলের তলে মেখে লেপ্টে দিল অপূর্ব-র ক্ষতে। জ্বলে উঠল স্থানটা।‌ মৃদু আর্তনাদ করে‌ আরুর হাতটা চেপে ধরে অপূর্ব। ছলছল চোখের তারা। আরু আশ্বাস দেয়, “একটু সহ্য করুন প্লীজ। এটা লাগালে কিছুক্ষণের ভেতরে জ্বালা কমে যাবে।”

আরু যত্নসহকারে ক্ষতগুলোতে চুল-হলুদের মিশ্রণ লাগিয়ে দেয়। অপূর্ব ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠেছিল আর আরু ঠিক ততবার গুনেছিল; এক, দুই, তিন, চার.. উনিশ। আরুর চোখ অশ্রুতে পূর্ণ হয়ে এলো। কাজটি শেষ হতে এক মুহুর্ত না থেমে সর্বশক্তি দিয়ে ছুটে গেল। অপূর্ব হেসে বলে, “আমি জানি, আমার বিছানায় তুই কাঁকড়া ছেড়েছিলি। কিন্তু কেন? আবার আমার আঘাতে কষ্টই বা কেন পাচ্ছিস?”

নদীতে পা ঝুলিয়ে বসেছে আরু। নদীটা পাড় হলেই তাদের বাড়ি। এখানে থেকে কাউকে কষ্ট দেওয়ার মানেই হয়না। চকিতে নামল নদীতে, অতঃপর থামল। এগোল না। নদীর তীরে দীর্ঘক্ষণ পা ডুবিয়ে বসে থাকল। নদীর তীরে তিনটা কাঁকড়া নজরে আসতেই ডান হাত বাড়িয়ে বাধা দিল তার গমনপথে। অতঃপর তিনটা কাঁকড়া ক্ষতবিক্ষত করল আরুর হাত। টলমলে চোখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁতে চেপে সহ্য করে ঊনিশটা আঘাত। অতঃপর হাত ঝেড়ে কাঁকড়া ফেলে দিল। রক্তগুলো চুইসে চুইসে পড়ছে নদীতে। লাল রঙটা নিঃশেষ হয়ে উঠছে। প্রেমপূর্ণ কণ্ঠে বলে, “আপনাকে দেওয়া কষ্টগুলো আমি নিজে অনুভব করার চেষ্টা করলাম অপূর্ব ভাই।
_
ইমদাদ হোসেন মৃধা ঢাকা থেকে ফিরেছেন। ছেলে-মেয়েদের জন্য এত এত খাবার নিয়ে এসেছেন। এনেছেন আরুর পছন্দের পদ্মার ইলিশ। শ্বশুর বাড়ির জন্য এনেছেন মিষ্টি, পানসুপারি ও ফলমূল। তাকে দেখে আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন অনিতা। এক গ্লাস লেবুর শরবত দিয়ে আরও কিছুর তোরজোর করার চেষ্টা করতেই ইমদাদ হোসেন মৃধা বলেন, “ভাবী দুপুরের সময় এসেছি, পারলে দুমুঠো ভাত দাও। খেয়ে আরুকে নিয়ে রওনা দেই।”

“আরুকে নিয়ে যাবি?” মোতাহার আহসানের প্রশ্ন। মাথা নেড়ে ইমদাদ তার উত্তর জানাতেই অনিতা টঠস্ত হয়ে টেবিল সাজাতে লাগলেন, বংশের একমাত্র জামাতা বলে কথা।
শেফালী ও তুর ডাকতে গেল আরুকে। আরু ওদের ঘরে শুয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে আছে, যদিও একটু বসন্তের ছোঁয়া লেগেছে।
“তুই কি গোসল করবি না আরু?” তুরের প্রশ্নে আরু জবাব দেয়, “না-রে। ভালো লাগছে না।”

পীড়াপীড়ি করেও আরুকে সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারেনি তুর বা শেফালী। অগত্যা যেতে হয় তাদের। ইমদাদ বিদেশেও গেছেন বেশ কয়েকবার। তার মাধ্যমেই অপূর্ব-র জন্য পিঠা প্রেরণ করতেন পারুল। সম্পর্ক তাদের মিষ্টি মধুর। অনিতাও এলেন ফিরে। চিন্তিত ধারায় বলেন, “আরুর কী হলো, কেন জানে? কতবার ডাকলাম আসল না।”

অপূর্ব-র খাওয়া শেষের পথে তখন। অবশিষ্ট খাবার এক লোকমায় মুখে তুলে কোনোরকম হাত ধুয়ে পা বাড়াল বোনদের কক্ষের দিকে। আরু পিঠ দেখিয়ে শুয়ে আছে। অপূর্ব বাজখাঁই গলায় বলে,

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৫

“তোর সাহস দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে আরু। ডাকলে কারো কথা শুনিস না। এক চ/ড়ে তোর সব দাঁত আমি খুলে ফেলব।” অপূর্ব-র বাজখাঁই গলা। আরু তবুও নিজ সিদ্ধান্তে অনড় থেকে প্রতিক্রিয়া দেখল না।

অতঃপর অপূর্ব নিজেই যেতে বাহু টেনে বসাল আরুকে। আরুর আঙুলের ভাঁজে আঙুল রাখলেই মৃদু আর্তনাদ করে আরু। অপূর্ব ভ্রু কুঁচকে নিজের হাতে দৃষ্টি মেলাল। নিজের হাতে ছাপছাপ রক্তের দাগ দেখে বিচলিত হয়ে আরুর হাত পরখ করে। ক্ষতগুলো তার চেনা ঠেকল। অনন্তর তেজস্রী গলায় বলে, “আমাকে চুল-হলুদ লাগানোর সময় তোর হাতে এমন ক্ষত ছিলনা আরু। এই অবস্থা হলো কখন?”

প্রশ্নের জবাব না পেয়ে নির্ভীক হয়ে উঠে অপূর্ব। পুনরায় তেজপূর্ণ গলায় বলে, “কিছু জিজ্ঞেস করছি আমি।”

“আমি.. আমি আপনার বিছানায় কাঁকড়া রেখেছিলাম। গতকাল আপনি বলেছিলেন না, আপনি ‘লিভ-ইন’এ ছিলেন। তাই রোষের বসে।” ক্রন্দনরত অবস্থায় আরুর ভাঙা গলা বলে। অপূর্ব প্রশান্তির হাসি দেয়। ‘আরুও যে প্রেমে জড়িয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে’ – সে কি তা জানে?
দরজার বাইরে থেকে সেই মুহূর্তটি দেখে আনন্দে আটখানা হয়ে গেলেন অনিতা। ছেলেকে তিনি আরও কিছুটা সময় দিবেন, জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। কারণ একটি ভুল সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে।
_
ইলিশ মাছ দুটো নিয়ে বাবাইয়ের পাশাপাশি হেঁটে বাড়িতে এলো আরু। মেয়েকে পেয়ে ইমদাদ হোসেন মৃধার আনন্দের অন্ত নেই। বাড়িতে আরুর পদচারণ পড়তেই ময়না উড়ে এসে বসল আরুর কাছে। তিনবার আওড়াল, “আরুপাখি! আরুপাখি! আরুপাখি! এসেছিস! এসেছিস! এসেছিস!”

“হ্যাঁ, এসেছি ময়না। দেখ, বাবাই কতবড় ইলিশ মাছ নিয়ে এসেছে।”

পারুল দিঘির পাড়ে বোলের ভেতরে পানি নিয়ে বসেছে। অয়ন সাবান ঘসছে। ময়না পাখির ডাক শুনে উঠানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই আনন্দে ভরে উঠলেন তিনি। কতদিন পর নিজের স্বামীকে দেখেছেন। ছেলেকে রেখেই ছুটে গেলেন ইমদাদ হোসেন মৃধার কাছে। বক্ষে ঝাঁপিয়ে মায়াবী কণ্ঠে বললেন, “কেমন আছো তুমি? আসবে যে, একবারও তো বললে না।”

“বলে দিলে সারপ্রাইজ থাকতো? আমাকে দেখে কেউ চামকাতো?” মাথায় হাত রাখলেন পারুলের। আনন্দের অশ্রু আবির্ভাব। আরু পাশে দাঁড়িয়ে আছে, তা লক্ষ্য করে ইমদাদ আদুরে গলায় বলেন, “ছেলেমেয়েরা পাশে দাঁড়ান। কখন কে আসে বলা তো যায়না। ঘরে গেলে জড়িয়ে রেখো।”

পারুল ছেড়ে দাঁড়াল। মেয়েকে দেখে তার মস্তিষ্কে অগ্নি প্রজ্বলিত হলো, কিন্তু মনে জেগে উঠল মাতৃত্ব। আপন করে নিল আরু-কে। মেয়ের মাথা হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, “মাকে মনে পড়ল তোর? কোমরে ব্যথা পেয়েছি। কালকে সবাই দেখতে এসেছিল তুই বাদে।”

স্তম্ভিত হলো আরু। গতকাল সবাই আরুকে মিথ্যা বলে তার মাকে দেখতে এসেছিল? চকিতে আরুর হাত ধরে পারুল বললেন, “হাতে ব্যান্ডেজ কেন? কী হয়েছে মা?”

“একটু ব্যথা পেয়েছি।” মেয়ের হাতে চুমু খেলেন পারুল। ইমদাদের কাছ থেকে বাজার নামাতে নামাতে বললেন, “আরুর সাথে দেখা হলো কখন, না-কি ঐ বাড়িতে গিয়েছিলে?”

“গিয়েছিলাম। আরু ইলিশ মাছ খেতে পছন্দ করে, তাই নিয়ে এসেছি।”

“অপূর্ব বিদেশ থেকে এসেছে। ওর সামনে দিয়ে কীভাবে তুমি ইলিশ মাছ নিয়ে এলে?”

“ভাবীকে বলেছিলাম রেখে দিতে। রান্না করে কয়েক টুকরো পাঠিয়ে দিতে। আমাকে ধমক দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। একটা কাজ করো, ইলিশ মাছটা রান্না করে ওদের আসতে বলে দাও। ছেলেটা এখন পর্যন্ত ফুফু বাড়িতে বেড়াতে আসেনি। এসে দুদিন থেকে যাবে।” ইমদাদের কথা পছন্দ সই হলো পারুলের। আরু সুন্দর করে ইলিশ মাছ কা/টতে পারে তাই আরুকে বলতে চেয়েছিলেন ইলিশটা কে/টে নিতে, আরুর হাতের দিকে চেয়ে তা পারলেন না। অন্য আদেশ দিলেন, “একটা কাজ কর মা, অয়নকে গোসল করিয়ে দে। আমি কাজগুলো করে নিচ্ছি।”

এতক্ষণে ছেলের কথা স্মরণে এলো ইমদাদের। আশেপাশে চেয়ে ছেলের সন্ধান করতে করতে বলে, “অয়নকে দেখছি না কোথায় ও?”

“দিঘির পাড়ে। গোসল করছে। তুমি গিয়ে বিশ্রাম করো।” বলেই বাজার নিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল পারুল। ইমদাদ ঘরে চলে গেলেন। আরু গেল দিঘির দিকে।
দাঁত চেপে বসে আছে অয়ন। বাবা এসে একবারও তার নাম করেনি, অথচ ফেরার সময় মেয়েকে নিয়ে এসেছে। ইটের বড়ো টুকরোটা পানিতে ছুড়ে দিয়ে বলে, “বাবাই আমাকে একটুও ভালোবাসে না। কেউ ভালোবাসে না। সবাই শুধু আরু আরু করে।”
_
পারুল মাছ ভাজছে আর দুই ছেলেমেয়ে বাটি সমেত উনুনের কাছে বসে অপেক্ষারত ইলিশ মাছ ভাজা খাওয়ার জন্য। হলদেটে আলোয় মাছের দিকে তাকিয়ে বলে অয়ন, “মা আর কতক্ষণ লাগবে?”

“বাপুরে বাপু, এই নিয়ে সতেরবার জিজ্ঞেস করেছিস। একটু অপেক্ষা কর। এগুলো তো তোরাই খাবি।” বিরাগী হয়ে বলতে বলতে পাতা দিল উনুনে। ইমদাদ ছেলে-মেয়েদের দিকে চেয়ে আছে অনুভূতি পূর্ণ দৃষ্টিতে। কতগুলো দিন সে পরিবারের এই মুহুর্তটা মিস করেছে। এরমধ্যে পারুল ইমদাদকে আহসান বাড়িতে ফোন দিতে বললেন। কিয়ৎক্ষণ পূর্বে ফোন করে আসতে বলেছেন অপূর্বদের। অনিতা বারণ করে দিয়েছে, ‘ছেলে মেয়েদের জন্য মাছ কিনে এনেছে, ওরাই তৃপ্তি করে খাক।’

ফোন করার আগেই হাজির হলো অপূর্বরা। খালি হাতে আসেনি। অনেককিছু বহন করে এনেছে। তাঁরাও গোল করে উনুনের কাছে বসে। ততক্ষণে ইলিশের এক তাবা হয়ে গেছে। পারুল ভাজা মাছ তুলে রেখে বলে, “আরু পশ্চিম পাড়ায় কাঠালি কলা ‘গাছেই’ পেকেছে। তুই নেই বলে আমিও সাহস করে যাইনি। দা* খানা নিয়ে কলা ছড়া পেরে নিয়ে আয় মা। ভাবী দুধ পাঠিয়ে দিয়েছে। তোর বাবাই দুধকলা ভাত খেতে পছন্দ করে অনেক।”

“আচ্ছা, আগে মাছটা খেয়ে নেই।”

পারুল দিতে চাইলেন না। তালবাড়িয়ার শিমুলের মেয়েকে ভুতে ধরেছে ইলিশ মাছের জন্য। ভর সন্ধ্যা বেলা ইলিশ মাছ ধুতে গিয়েছিল নদীর পাড়ে। ঐ গায়ে দিঘি নেই, শুধু বড়ো একটা নদী। সবাই সেই নদীকে নিজের ভেবে শাসন করে।
ভুতের কথা বললে আরু ভয়ে যেতে চাইবে না, তাই খোলসা না করে ইঙিয়ে বলে, “তুই যদি কলা এনে খাস, তবে তোকে দুইটা মাছ খেতে দিবো।”

‘প্রয়োজনের সময় পান্তাও যেমন অমৃত’ー⁠ আরু সেই যুক্তি মেনে নিজহাতে মাছ পাতে তুলে খেতে লাগল। উপস্থিত সবাইকে মাছ খেতে দিলেন পারুল। বিদেশে অবস্থানরত সময়ে পারুল পদ্মার ইলিশ ভেজে অপূর্ব-র জন্য পাঠিয়েছেন। অপূর্ব-রও খুব প্রিয় এ মাছ। মৃদু হলদেটে আলোতে দ্রুত খেতে গিয়ে অঘটন ঘটিয়ে ফেলল। কাঁটা বাঁধল গলায়। দুবার কাশি দিয়ে গলা ধরে অপূর্ব। পারুল বিচলিত হয়ে বলে, “কী হয়েছে অপু? কাঁ/টা বেঁধেছে?”

“হ্যাঁ ফুফু।”

“দেখে খাবি না। আমাকে বললে আমি কাঁ/টা বেছে দিতাম। (অতঃপর আরুকে আদেশ করে) যা কয়টা শুকনো ভাত নিয়ে আয়।”

আরু ছুটে যেয়ে ঘর থেকে শুকনো ভাত নিয়ে এসে ক্ষান্ত রইল না। দলা পাকিয়ে অপূর্ব-র মুখে তুলে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “না চিবিয়ে গিলে ফেলুন। নেমে যাবে কাঁ/টা।”

প্রথমবার ও দ্বিতীয়বার ব্যর্থ হলো আরু। তৃতীয়বার সফল হলো। আরুর কথা মেনে গলা বেয়ে নেমে গেল কাঁ/টাটা। অপূর্ব-র চোখ রক্তিম হয়ে আছে। তবুও মাছ খাবে অপূর্ব। পারুল কাটা ছাড়াতে ছাড়াতে অপূর্ব-র মুখে তুলে দিল। ফুফুর ভালোবাসা গ্ৰহণ করতে পেরে পূর্ণ হলো অপূর্ব। কত ভালোবাসে অথচ আরুর জন্য ফুফুর সাথে কেমন ব্যবহার করল সে। সকলের অগোচরে আরু দা* নিয়ে ছুটেছে উত্তর পাড়ায়। আলাদা কলা বাগান। হাতে একটা টর্চ, যার তুখোড় আলো। আজকের হাওয়াটা অন্যরকম, কেমন গাঁ ছমছমে পরিবেশ। আকাশে একটা তাঁরাও নেই, চাঁদ তো অনুপস্থিত।
আজ অমাবস্যা তিথি। মুরুব্বিরা বলে, এরাতে একটা দড়ি উঠানে পড়ে থাকলে তা-ও না-কি সাপ হয়ে শব্দ করে। আরও শরীরে ইলিশ মাছের গন্ধ। কলা বৃক্ষের কাছে ফল চেয়ে অনুরোধ করে দা বসাল বৃক্ষে। কলা কেটে বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়াতে পেছন থেকে আরু আরু বলে ডেকে উঠল কেউ অথচ সেই দিকটা জনশূন্য, মানবশূন্য, থাকেনা কেউ। আরুর মতো একটা মেয়ে কেঁপে উঠল ভয়ে। পায়ের নূপুরের ঝুনঝুন শব্দে আরু হয়ে উঠল উদাসীন। তার পা কাঁপছে। মনে হচ্ছে বৃক্ষের শিকড় সর্প হয়ে তার চরণ জোড়া আবদ্ধ করে রেখেছে। যেন গলা চেপে ধরেছে কোনো অজ্ঞান বস্তু। তার হৃৎপিণ্ড স্বাভাবিক নেই। ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে। আকাশমণি গাছটা মুঠো করে ধরে চিৎকার করে উঠে আরু, “মাআআআ!”

লোহা, রসুন, আগুন সঙ্গে থাকলে তারা কাছাকাছি আসতে পারেনা। আরুর হাতে লোহার দা*। আরুর ভীত ভাবটা কিঞ্চিৎ দূর হলো। একহাতে কলা ছড়া অন্যহাতে দা* নিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে ছুট লাগাল বাড়ির দিকে। তালগাছ পর্যন্ত আসতেই আরুর বড়ো খোঁপাটা খুলে চুলগুলো উড়তে লাগল শীতল হাওয়াতে। ষষ্ঠইন্দ্রিয় সতেজ হয়ে উঠল। লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল।

তদানীং মেয়ের চিৎকার শুনে উপস্থিত সবাই ছুটে এসেছে। ল্যাম্প নিয়ে একই রাস্তা দিয়ে আরুকে ছুটতে দেখে তারাও ছুটল। পারুল গিয়ে ধরল আরুকে। পরক্ষণে হাত থেকে খসে পড়ল বস্তু দুটি। চেতনা হারিয়ে লুটিয়ে পড়ার পূর্বেই অপূর্ব তার শক্তহাতে আরুকে আষ্টেপৃষ্ঠে আবৃত করে‌ নিল। পারুল দ্রুতহাতে চুলগুলো খোঁপা করে ল্যাম্পের অগ্নিশিখার তাপ আরুর দেহে স্পর্শ করাল। পারুলের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এসেছে।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-১২+১৩

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১২

আরু আজ দুপাশে বেনুনি গেঁথেছে। তাতে লাগিয়েছে গাঁদা ফুল। খয়েরি গাঁদা। সকালের নাস্তা খেয়ে চম্পার পানের ডালা থেকে পান নেওয়ার জন্য পা বাড়াল আরু। মুখে তুলে যাওয়ার সময় চম্পা পেছন থেকে ডেকে উঠল আরুকে। আরু দু বেনুনি ঘুরাতে ঘুরাতে বলে, “কী হয়েছে নানি জান, পেছন ডাকলে কেন? তুমি জানো না পেছন ডাকতে নেই।”

“তোকে আমার প্রয়োজন। পেছন না ডাকলে কি তুই আসতিস?”

“কেন?” দাঁতের আগায় চুল লেপ্টে বলে।

“দেখ না, আমার মাথার চুলগুলো পেকে গেছে। তুই বেছে বেছে পাকাগুলো তুলে দে।” আরুর হাত ধরে বাসনা নিয়ে বললেন চম্পা। খানিক বিরক্ত হলো আরু। প্রতিবার এই বাড়িতে আসলে পাকা চুল তুলে দেওয়া আরুর ধরাবাঁধা কাজ। অথচ চম্পার মাথায় হাতে‌ গোনা এক গোছা চুলও নেই কাঁচা। কোমরে হাত দিয়ে ললাট কুঁচকে বলে, “নানি জান, তোমার মাথায় পাকা চুল তুলতে গেলে নেড়ো হয়ে যাবে।”

“নেড়ো হলে আমি হবো। তুই এদিকে আয়।” আরুকে জোরজবরদস্তি করে ঘরে নিয়ে গেলেন চম্পা। ফিরি পেতে বসলেন। বিরক্তির সাথে কয়েকটা পাকা চুল তোলার পর আরুর মুখে হাসিটা গাঢ় হয়ে উঠল। পাকা চুল রেখে নানির মাথার কাঁচা চুল তুলতে আরম্ভ করল আরু।
পাকা চুল উত্তোলনের সময় আয়াশ পাওয়া যায়, কাঁচা চুলের ক্ষেতে বিপরীত। চম্পা মাথা চেপে বলে, “এখন ব্যথা পাচ্ছি কেন আরু?”

“তাড়াতাড়ি তুলছি তো তাই। ভালো না লাগলে বলো, আমি রেখে দেই।” বলতে বলতে হেসে উঠল আরু।

“না না, তুই তুলতে থাক। একটু ধীরে ধীরে তুলিস, ব্যথা যাতে না পাই।” চম্পার আদরে বলা কথায় আরুর মন গলে না। দীর্ঘ এক ঘণ্টার অধিক সময় অতিবাহিত হয়‌। নিজের কাজ সম্পন্ন করে উঠে দাঁড়ায় আরু। প্রতিবার চুল তুলতে দিলে অস্থির হয়ে উঠতো, আজ তেমন না হওয়াতে প্রসন্ন হলেন চম্পা। আরুর চিবুক স্পর্শ করে আঙুলে চুমু খেয়ে বলে, “আজকে যা, আবার কালকে তুলে দিস।”

ভাব নিয়ে বলে, “আজ তোমার সব চুলগুলো তুলে দিয়েছি।”

“কী বলিস, একটুকু সময়ে সব তুলে ফেলেছিস?” উদ্বিগ্ন হয়ে বলে।

যথাসম্ভব অনুদ্ধত রইল আরু। পাকা চুল থেকে বাছাই করে ফেলে দেওয়া কাঁচা চুলগুলো তুলে নানি জানকে দেখায়। বিদ্রুপ করে বলে, “হাঁ! হাঁ! হাঁ! তোমার মাথার সব কাঁচা চুল তুলে ফেলেছি নানি জান। এবার তুমি আবার চুল তোলার কথা বললে ট্রিমার দিয়ে পাকা চুল তুলে ফেলব সব।”

চম্পা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যায়। কিয়ৎক্ষণ নিজের চুলে তল্লাশি করেও যখন সন্ধান পেল না কালো চুলের তখনই ক্ষিপ্র হয়ে উঠল। লাঠি দিয়ে মারতে চাইল আরুকে। আরু ছুটল। বৈঠকখানায় আড্ডা দেওয়া মামার পেছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল। চম্পা লাঠি নিয়ে উপস্থিত হতে দেখে উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে উঠল। মোতাহার আহসান বললেন, “মা তুমি লাঠি নিয়ে আরুকে তাড়া করছ কেন?”

“তুই ওকে ছাড়, আজ ওকে আমি ইচ্ছামতো পেটাবো।”‌ বলতে বলতে আরুর দিকে অগ্রসর হলেন চম্পা। আরু ছুটে অপূর্ব-র কাছে গেল। অনিতা এসে ক্ষান্ত করল চম্পাকে, “এভাবে বাচ্চা মেয়েটাকে লড়াচ্ছেন কেন মা, কী করেছে ও।”

“কী করেনি, তাই কও। ওরে আমি বললাম ‘আমার মাথার পাকাচুল তুলে দিতে।’ ও কাঁচা চুলগুলো তুলে দিল। একটা কাঁচাচুলও নেই।” সবাই নিঃশব্দে হাসল। মা-কে শান্ত করতে আরু-কে কিছু বলা উচিত, “আরু তুই মায়ের কাঁচা চুল কেন তুলেছিস?”

“বাহ্-রে! প্রতিদিন আমার কাছে এসে বলে পাকাচুল তুলে দিতে। ওনার মাথায় সব পাকাচুল। মাঝে মাঝে দু-চারটা কাঁচা চুল। তাই বুদ্ধি করে কাঁচা চুলগুলো তুলে দিলাম। এরপর যদি আবার পাকাচুল তুলতে হলে, তাহলে ট্রিমার দিয়ে সব চুল তুলে ফেলব। হি! হি! হি!” অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সবাই। আরুকে বাহবা দিয়ে বলে, “মা, তোমারই দোষ। এত পাকা চুল তুলতে গেলে তোমার মাথা টাক হয়ে যাবে।”

চম্পা লাঠি দিয়ে মাটিতে আঘাত করে ঘরের দিকে অগ্রসর হতে হতে বলেন, “যেমন মামা, তেমন ভাগ্নে।”

আরু বাইরের দিকে অগ্রসর হলো। সূর্য মাথা তখন মাথায় উপর উঠেছে। অপূর্ব কলতলায় পা রেখেছে গোসলের উদ্দেশ্যে। কল চেপে বালতি পূর্ণ করল। অতঃপর দরজার দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে এলো বিরক্তিতে। গ্ৰামে এসে এখন অবধি সে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করেনি, মায়ের করে দেওয়া উষ্ণ পানিতে গোসল সেরেছে। নূপুরের সেই মাতাল হওয়া ধ্বনি শুনেই মুখ তুলে অপূর্ব, “আরু, এদিকে শোন।”

আরু এসে স্থির হওয়ার পূর্বেই অপূর্ব বলে, “রান্নাঘরে গিয়ে দেখত, পানি গরম হয়েছে কি-না? গরম হলে মা-কে নিয়ে আসতে বল।”

আরু না থেমে রান্নাঘরে গেল। অপূর্ব-র সাথে সে অভিমান করে আছে। একটুকুও কথা বলবে না।
পানি ফুটতে শুরু করেছে। তবুও পাতা পুড়িয়ে তাপ দিচ্ছে অনিতা। ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে, “মামি অপূর্ব ভাই কলতলায় বসে আছে। পানি গরম হলে আমাকে দাও। আমি দিয়ে আসছি।”

অনিতা শুকনো পাতা দেওয়া বন্ধ করে চলা কাঠটা ভুলবশত আরুর দিকে তাক করে বলে, “তোর শরীরে জ্বর। মাথা ঘুড়ে পড়ে গেলে হিতে বিপরীত হবে। আমি দিয়ে আসছি।”

আরুর কর্ণপথে পৌঁছাল না সেই কণ্ঠ। এক দৃষ্টিতে জ্বলন্ত চলা কাঠটার পাশে চেয়ে আছে। অতঃপর চিৎকার দিয়ে বলে, “নাহহ। মা মেরো না।”

উপস্থিত সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বাক্‌শূন্য সকলে। আরু ক্রমশ পিছু হটছে। অপূর্ব এসেছে তখন। দ্রুতি কণ্ঠে‌ বলে, “মা পানি কতদূর?” আর কিছু উচ্চারণ হলো না। তার হৃৎপিণ্ডে ধাক্কা লাগল কোনো রমনীর। অতঃপর সেই রমনী দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করে নিল অপূর্ব-কে। আরুর কম্পিত শরীরটা অপূর্ব-র সংস্পর্শ এসেছে, সেই কম্পন অনুভব করছে অপূর্ব। হৃৎপিণ্ড স্বাভাবিক নেই, ধুকপুকানি গুনতে পারছে। অনিতার দিকে চেয়ে ইঙ্গিত করল অপূর্ব। অনিতা চলা কাঠটার দিকে চেয়ে অসহায় কণ্ঠে বলে, “মনে হয়, কাঠটা ওর হাতে লেগেছে।”

“তাই হবে বোধহয়।” জাহানারা সায় দিলেন। আরুর পিঠে হাত রাখল অপূর্ব। আর্দ্র পল্লব মেলে অপূর্ব দিকে তাকালো। ছ্যাত করে উঠল অপূর্ব-র অন্তঃকরণ। ডানহাতটা গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে যখন ক্ষত-র সন্ধান পেল না তখন দৃষ্টি মেলালো অন্যহাতে। ক্ষত-র সন্ধান না পেয়ে আশ্চর্যান্বিত হলো অপূর্ব। মোলায়েম গলায় বলে, “কী হয়েছে আরু? কোথায় লেগেছে দেখি।”

“লাগেনি।” সুললিত কণ্ঠে বলে আরু দূরত্ব বজায় রাখল। অতঃপর ঘরের দিকে ছুটে পালাল। ঔৎসুক্য নিয়ে অপূর্ব বলে, “কী হলো বলোতো? হাতে তো কোনো ক্ষত পেলাম না।”

“আরু চারটা শব্দ উচ্চারণ করেছে। নাহহ, মা মেরো না।” ঝোঁক নিয়ে বলেন জাহানারা।

“আমার মেয়ে কিছু করেনি তো। ওকে নিয়ে কোথায় যাবো আমি। এই বাচ্চা মেয়েটাকে চলা কাঠ দিয়েও বোধহয় মে/রেছে।” বলেই হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলেন চম্পা।

জাহানারা কাঠের টুকরো টা সরিয়ে রেখে বলেন, “এই সব ঐ অয়নের বুদ্ধি। পেটে পেটে শুধু শ/য়/তা/নি বুদ্ধি। আসুক একবার এই বাড়িতে। এটা দিয়ে যদি না মে/রেছি।”

“ততক্ষণে নিভে যাবে।” অপূর্ব বলে।

“আবার আগুন দিয়ে জ্বলন্ত করে নিবো।” জাহানারা বলে।”

অপূর্ব উষ্ণ পানি বহন করে অগ্রসর হলো কলতলার উদ্দেশ্যে।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৩

অপূর্ব লুসমি দিয়ে গরম পাতিল কলতলায় নিয়ে এলো। হিম পানির সাথে উষ্ণ পানির মিশ্রণ করে তাকাতেই দেখল তার ব্যবহারিত স্যাবলন সাবান নিখোঁজ। গম্ভীর হয়ে ভাবার সময় শ্রবণ হলো পানি ঝাপটানোর শব্দ। অগ্রসর হলো দিঘির দিকে। শীতকালে বৃষ্টিপাত হয়না বললেই চলে, যাতে পানি শুকিয়ে গেছে অনেকটাই।অন্যদিকে দিঘি পুনরায় খনন করতে হবে। চারপাশের মাটিতে পূর্ণ হয়ে এসেছে দিঘি। হাতে গোনা কিছু মাছ রয়েছে। তিনবোন গোসল করছে। একে অপরের দিকে পানির ছিটা দিচ্ছে। সাবানটা শানের উপর রাখা। বিরক্ত হয়ে বলে, “সাবানটা নিয়ে এসেছিস, বলবি না?”

সবাই অপূর্ব-র দিকে দৃষ্টি মেলাল। অতঃপর শেফালী বলে, “ভুলে গিয়েছিলাম, নিয়ে যান এখন।”

অপূর্ব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সাবান নিয়ে পুনরায় কলতলার দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রচেষ্টা করতেই আরু বলে, “অপূর্ব ভাই, এখন শীত নেই। এদিকে আসুন একসাথে গোসল করি।”

“আমি সাঁতার জানি না।” অপূর্ব থেমে বলে।

“দিঘির জলে সবাই গোসল করতে পারেনা পূর্ব ভাই। আপনি তো কখনোই পারবেন না। একমাত্র ভালো মনের মানুষেরাই দিঘিতে এভাবে ভেসে থাকতে পারে, আপনার মনে তো কাঁদা।” আরু পানি ছুড়ে ব্যঙ্গ করে বলে। অপূর্ব থেমে গেল। ধীর পায়ে হেঁটে দিঘিতে নামল। খেজুর গাছের উপর‌ হাঁটু সমান পানিতে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। অতঃপর আরও কিছুটা নামতেই সে অনুভব করল, এই দিঘি তাকে ডোবাতে পারবে না।

আরুর মস্তিস্কে হানা দিল দুষ্টু বুদ্ধি। ডুব দিয়ে অপূর্ব-র খুব নিকটে ভাসমান হলো, পশ্চাৎ। নিজের পিঠে পাওয়া আঁচড়ের বদলা নিতে অপূর্ব-র পিঠে চেপে বসল। মাথাটা চেপে দিঘির জলে দিল চুব। বিশ সেকেন্ড পার হওয়ার পর একুশ সেকেন্ডের মাথায় আরু অনেক দূরে। অপূর্ব ঘনঘন শ্বাস ফেলে। নি/র্দয় পরিস্থিতি অনুভব করে শেফালীর হাতটা চেপে তুর বলে, “এখানে দাঁড়িয়ে নিজের পিন্ডি চটকানোর চেয়ে চল ভাগি। এখানে আমাদের রাজত্ব চললেও স্থলে ভাইয়ের রাজত্ব। তাছাড়া শুনলেও মা মা/রবে।”

শেফালী টু শব্দ উচ্চারণ না করে গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হলো। দুই বোন যখন স্থলে উঠে গেছে তখন ধ্যান ভাঙল আরুর। তার হাতে অপূর্ব-র লুঙ্গি। চাইলেও ওঠা অসম্ভব। স্থলের দিকে যাত্রা শুরু করে স্তব্ধ হলো অপূর্ব। আশেপাশে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আরুর দিকে নজরবন্দি করে তার লুঙ্গির হদিস পেল। চ্যাঁচিয়ে বলে, “আরু আমার লুঙ্গি দে বলছি। এটা কোন ধরনের অসভ্যতামি?”

“এটা আরুর শাস্তি। আপনার সাহস হয় কীভাবে ‘পূর্ব-পশ্চিম’ ভাই, আমার পিঠে আঁচড় কাটার? আপনাকে জাস্ট একটু ট্রেইলর দেখালাম।” আরুর দৃঢ় কণ্ঠ। অপূর্ব কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। কুলকিনারা না পেয়ে অন্য বুদ্ধি প্রয়োগ করে, “তুই আমার লুঙ্গি কেড়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস। কারণ তুই আমাকে এই অবস্থায় দেখতে চাস, তাই তো? শুধু শুধু পানির ভেতরে না দাঁড় করিয়ে বলতি, সরাসরি দেখাতাম। নিজের প্রতিটি অঙ্গ তো শতবার দেখি, একবার না-হয় তুই দেখলি।”

বলতে বলতে বুক সমান পানি দেয়া কোমর সমান পানি এলো। অতি প্রিয় ভাঁজ কা/টা ও জিম করা দেহের দিকে এক নজর অপলক চেয়ে রইল। গতিরোধ করল না অপূর্ব। এগিয়ে চলেছে ক্রমশ। পরিস্থিতি অনুভব করে পল্লব বন্ধ করে পশ্চাৎ ঘুড়ে আরু। দেয় ভুবন ভোলানো চিৎকার, “নাহহ! আমি দেখব না। আর একটুও এগোবেন না আপনি।”

অপূর্ব স্মিত হাসে। বলে, “আমি থামব না, শুধু এগিয়ে যাবো। যতক্ষণ আমার লুঙ্গি আমার হাতে না-আসে, ততক্ষণ এভাবে থাকব।”

পশ্চাৎ দিকে মুখ করে থাকে আরু আর সমুখে তাকায় না। লুঙ্গি ছুড়ে দেয় অপূর্ব-র দিকে। পরিধান করে লুঙ্গি। অতঃপর অপূর্ব এগোয় ক্রমশ। জলধারা অপসারিত হয়ে দুইজন মানব অদূরে এলো। সম্পূর্ণ জলাধারাকে অপসারিত করতে পেছন থেকে কোমর জড়িয়ে অঙ্গে অঙ্গে মিলিত করল দুটি দেহ। আরু থরথর করে কাঁপছে। এত জলের মাঝেও সে পিয়াসু। ওষ্ঠদ্বয় কানের লতিতে মিশিয়ে বলে, “দিলি কেন লুঙ্গি, চেয়েছি আমি? তুই তো দেখতে চেয়েছিস।”

স্পর্শগুলো আরও গাঢ় হয়ে এলো, বিচরণ করল নগ্ন কোমরে। অথচ আজ তার দেহে তুরের ব্লাউজ রয়েছে। কম্পিত আরু না-বোধক জবাব দেয়, “না, আমি দেখব না।”

অপূর্ব-র সেখানে বুক পর্যন্ত পানি, আরুর সেখানে গলা পর্যন্ত পানি। অপূর্ব পানিতে ডুব দিয়ে পাঁজাকোলা করে নিল আরুকে। আরু সাঁতার জানে বিধেয় অপূর্ব গলায় আড়কে ধরল না। ডাগর ডাগর চোখে শুধু চেয়ে রইল। নাকের সাথে নাকের ডগায় সুড়সুড়ি দিয়ে আলতো করে চুমু খেল ললাটে। আরু কেঁপে উঠল। নেত্রপল্লব গ্ৰথন করে রাখল। অপূর্ব ফিসফিস করে বলে, “এটা দিঘি নয়, নদী। প্রেমনদী। প্রেমতরঙ্গ। প্রেমতরঙ্গে বহমান প্রেমের জোয়ারে ভাসাতে অপূর্ব প্রস্তুত।”

অতঃপর অপূর্ব ঠেলে ভাসিয়ে দিল আরু-কে। আরু উলটা সাঁতারের দিল। কাতল মাছ আরুর পায়ের করতল স্পর্শ করে। সাঁতারের ফলে ঢেউয়ের সৃষ্টি হলো।

প্রেমেরও জোয়ারে, ভাসাবে দোঁহারে
বাঁধন খুলে দাও, দাও! দাও! দাও!
ভুলিব ভাবনা, পেছনে চাবো না
পাল তুলে দাও, দাও! দাও! দাও!
_
আরুর জ্বর নেমে এসেছে স্বাভাবিক মাত্রায়। মামাবাড়িতে থেকে পড়াশোনা দিব্যি চলছে আরুর। শীতকালে দিনের তুলনাত্মক রাত দীর্ঘ হয়। স্কুল ছুটির পর থাকে অপরাহ্ণ। আরু ও শেফালী নদীর ধানে অপেক্ষারত তুরের জন্য। ঝোপঝাড়ের মাঝে প্রয়াসের সে কিছু বলছে, তাও দীর্ঘক্ষণ। মাগরিবের আযান ঘনিয়ে আসছে। ব্যাকুল হয়ে আরু শুধাল, “কতক্ষণ লাগবে তুর? তাড়াতাড়ি আয়-না। চিন্তা করছে সবাই।”

“কেউ চিন্তা করছে না। আমি রোজ দেরি করে যাই।” ঝোপঝাড় থেকে তুর বলে উঠে। রাস্তার মাঝে পদচারণ করছে উৎসুক হয়ে উঠল আরু। শেফালী ললাটে উগ্র ভাঁজ ফেলে বলে, “ওর জন্য রোজ রোজ বাড়িতে যেতে দেরি হয়। মনে চায় আমিও একটা প্রেম করি।”

“করবি?” আগ্রহ নিয়ে মাটির রাস্তায় বসেছে আরু। সঙ্গ দিতে শেফালীও বসেছে। কিঞ্চিৎ পর তন্বীকে দেখা গেল এই অভিমুখো হতে। সংশয় নিয়ে বলে, “তোরা দুটোয় এখানে বসে কী করছিস? তুর কোথায়?”

“জানে কে? গিয়ে দেখ, নদীর পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছে দুটোতে। কতবার লুকিয়ে লুকিয়ে গেলাম দেখতে।” বিরক্ত প্রকাশ পেল শেফালীর গলায়। আরুর অগোচরে শেফালী, তুর ও তন্বী ফন্দি এঁটেছে কিছুর। অতঃপর অস্ফুট স্বরে বলে, “পরানের দোকানে ঐ ক্যাসেট টা এনেছে শুনলাম। তুর যতক্ষণে ফিরে আসবে ততক্ষণে আমরা দুজনে নিয়ে আসি।”

“কী ক্যাসেট?” আরুর সাদামাটা প্রশ্ন। কেউ উত্তর দিল না। আরুকে প্রহরীর দায়িত্ব দিয়ে ছুটে গেল দুজনে, একা দোটানা নিয়ে বসে রইল সেখানে। পেরিয়ে গেল ক্ষণ। লাল রঙের জ্ঞাত স্লিপার দৃষ্টিগোচর হতেই ঊর্ধ্বভাগে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল আরু। অপূর্ব-কে সমুখে দেখে নোনা জল সঞ্চয় হলো ললাটে। আশেপাশে তাকিয়ে দুইবোনের সন্ধান করতে করতে হুংকার দিল অপূর্ব, “ভর সন্ধ্যায় এখানে বসে বসে কী করছিস? সঙ্গি দুটোয় কোথায়?”

অপূর্ব-র হুংকারে কেঁপে উঠে আরু। দুই বোনকে গালমন্দ করছে নিরবে আরু। অপূর্ব আজ সকালে শহরে গেছে। অফার করা চাকরিটা কনফার্ম করতে। বাড়ি ফিরে তিনবোনকে না দেখে এদিকে এসেছে।
ততক্ষণে শেফালী ও তন্বী ফিরত এসেছে। আরুর তার হাত দুটো ঢেউখেলানোর ন্যায় উপর থেকে নিচে নামিয়ে ইশারা করছে দুজনকে। পুনরাবৃত্তি করছে হিস, হিস। অপূর্ব হতভম্ব হয়ে বলে, “এমন করছিস কেন?”

রাস্তার ধানে ইঁদুর গর্ত করে রেখেছে। দুইপাশে বিভিন্ন আকৃতির মাটি জমানো। আরু ইতস্তত করে বলে, “অপূর্ব ভাই, আপনি তো‌ ইঁদুর ভয় পান। তাই ইঁদুর লড়াচ্ছি।”

“তাহলে পেছনের দিকে তাকিয়ে কেন.. বলতে বলতে পশ্চাৎ ফেরার প্রয়াস করে অপূর্ব। সেই বাক্যকে মাঝপথে দাঁড়ি টেনে হুট করে অপূর্ব-র হৃদমাঝারে ঝাঁপিয়ে পড়ে আরু। হিতাহিত ঘটনায় অপূর্ব নির্বাক। হুট করে সাজানো মিথ্যা কথাগুলো অপূর্ব-র হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানির কাছে হেরে গেল। দ্বি মুহূর্ত এভাবে অতিবাহিত হলো। অপূর্ব ছাড়িয়ে নিল নিজেকে। ধমক দেয়, “মাঝরাস্তায় কী হচ্ছে এইসব আরু? তুই তো এমন বেপরোয়া ছিলি না।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৩ (বর্ধিতাংশ)

“অপূর্ব ভাই, আসলে আমি একটা কথা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভুলে গেছি।” চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে আরু।

“কী সেটা? বলার আগেই ভুলে গেলি?” অপূর্ব-র ফিরতি প্রশ্ন। আরুর তার হাতটা রাখল অপূর্ব-র বুকের পাপাশে। রুপার বালা শব্দ করল মৃদু। হাতটা মৃদু ভর প্রয়োগ করতেই অপূর্ব-র হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক শব্দটা ঘোড়ার মতো টগটগ করতে ব্যস্ত হলো। ছ্যাকা লাগল বুকে। প্রেমতরঙ্গে নিজেকে ভাসিয়ে আরু কণ্ঠে হয়ে উঠে আসক্ত, “ধুকপুক ধুকপুক ধুকপুক। এই শব্দটা আমায় অগোছালো করে দেয়। মনে হয় আমার স্থান এখানে। ঠিক এখানে। যেই হাড়টা আপনার নেই, সেই হাড়টা আমি। মনে হয়, আমি আপনার বাম পাজরের অধিকারিণী।”

“কীসব বলছিস?”
অপূর্ব পিছিয়ে গেল কদম। আরুর হাতে হাওয়া প্রবেশ করল। অপূর্ব-র ডানহাতটা নিজের বুকে রেখে বলে, “বিশ্বাস না হলে দেখুন। আপনার স্পর্শ আমার স্পন্দন অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।”

আরুর সেই স্পন্দন অপূর্ব অনুভব করতে পারছে। তার সিক্সসেন্স বলছে, এটা অস্বাভাবিক। সে যে মনের ডাক্তার, মনোচিকিৎসক। মনের ভাষা বোঝাই তার পেশা।
মুহুর্তে হাতটা পরিণত হলো কোনো ইট, পাথর বা শক্ত কোনো ধাতুতে। নিজের হাতটা সরানোর ভরটুকু অপূর্ব-র নেই। অব্যক্ত স্বরে বলে, “হাত ছাড় আরু।”

“কেন? আপনি অন্য পুরুষদের থেকে চার ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে বলেছেন। আপনার থেকে নয়।”

বিদেশে অবস্থানরত সময়ে বহু নারীর সংস্পর্শে গিয়েছিল। ‘হাত ধরেছে, জড়িয়ে ধরেছে’ তখন তো এমন অগোছালো অনুভূতির সম্মুখীন হতে হয়নি।

ঝোপঝাড় থেকে বেরিয়ে এসেছে তুর। অপূর্ব-র ভয়ে নদীর তীরেই বসে আছে। শেফালী ও তন্বী অতি নিকটে। তিন সই একত্রিত হয়ে বলে, “অপূর্ব ভাই, আপনি এখানে?”

হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ল অপূর্ব। চেতনা ফিরত এলেই হাত নিজের কাছে টেনে যথাসম্ভব গম্ভীর গলায় হলে, “কয়টা বাজে এখন? চারটা বাজে স্কুল ছুটি হলে বাড়িতে যেতে লাগে পনেরো মিনিট। এখন সময় সাড়ে পাঁচটা। এতক্ষণ এখানে কী করছিস?”

“ভাইয়া, আমরা প্রতিদিন দেরি করেই বাড়িতে ফিরি। আজ একটু বেশি দেরি হয়ে গেছে। নদীর পাড়ের হাওয়া খেতে ভালো লাগে।” তুর সাহস সঞ্চয় করে বলে। পুনরায় প্রশ্ন করে, “নদীর পাড়ে হাঁটতে ভালো লাগে। তাহলে আরু এখানে কী করছে?”

“আমার পা ব্যথা করছিল। তাই যাইনি। এসে দেখলেন না, বসে ছিলাম?” আরু বলে। অপূর্ব-র মন হতে সন্দেহে দূর হয়নি। সামনের দিকে অগ্রসর হতে হতে বলে, “হম, চল। (আরু-কে একান্ত ভাবে বলে) জড়িয়ে ধরে কী জানো বলতে চেয়েছিলি। ঘুমানোর আগ পর্যন্ত সময়। উল্লেখযোগ্য কোনো কারণ না পেলে, ঢেউ খেলা দেখিয়ে যে ইঁদুর তাড়াচ্ছিলি। সেই ইঁদুরের গর্তে আমি তোকে রেখে মাটি চাপা দিয়ে দিবো।”

আঁতকে উঠল আরু। কী করবে ভেবে পেল না। বাংলা সিনেমায় দেখেছে নায়িকা আঘাত পেয়ে স্মৃতিশক্তি লোপ পেলে পরবর্তী আ/ঘা/তে ফিরে আসে। কিন্তু আরু তো ভুলে যায়নি। আচ্ছা অপূর্ব হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানির শব্দে বিস্মৃত হয়েছে কথা, আবার ঐ ঝড় তোলা বুকে মাথা রাখলে মনে পড়বে সেই কথা?

“এনেছিস ক্যাসেট?” ফিসফিসিয়ে বলে আরু। তুর নক টাকতে টিকতে বলে, “কীসের ক্যাসেট?”

আরু উত্তর দিতে পারেনা, কারণ সে জানে না। শেফালী বলে, “এনেছি, আরুর বইয়ের ভেতরে রেখে দিয়েছি।”

আরু ও অপূর্ব মধুর সময়ে অগোচরে লুকিয়ে রেখেছে ঘাসের উপর রাখা আরুর বইয়ের ভাঁজে। কৌতূহল নিয়ে বইয়ের পাতা উলটায় আরু। ক্যাসেটের উপরে লাগানো পোস্টারে নজর যেতেই গলা শুকিয়ে গেল। অপূর্ব-কে খেয়াল না করে আচমকা বলে ফেলে, “ছিঃ, এগুলো কী এনেছিস তোরা?”

অপূর্ব-র কদম থেমে গেল। ঘাড় কাত করে তাকাল চারজনের দিকে। আরুর মুখ চেপে ধরেছে তিনজনে। ডাগর ডাগর চোখ করে কেবল চেয়ে আছে। বলে নিজেও নির্বোধ হলো আরু। থমথমে গলায় বলে, “তোরা ওর মুখ চেপে আছিস কেন?”

পরক্ষণে হাত ছেড়ে নতজানু হয়ে গেল দুই জোড়া কিশোরী। অতঃপর অপূর্ব বলে, “মাত্র কী বললি? কী এনেছিস তোরা?”

তন্বী দাঁড়াল না। অপূর্ব-কে অতিক্রম করে সর্বশক্তি দিয়ে ছুটে গেল। অপূর্ব চাইলে ধরতে পারত হাত, কিন্তু অচেনা অজানা মেয়েকে স্পর্শ করা বেঠিক। প্রয়াসের এনে দেওয়া চানামুঠ দেখিয়ে বলে, “এগুলোর কথা বলেছে। আসলে আরু খায়না তো তাই।”

আপাদমস্তক চেয়ে থেকে বলে, “তোদের তিনটাকে আমার বিশ্বাস হয়না। সামনে সামনে এগো।”

মাটির রাস্তা সরু হওয়াতে তিনজনে এক লাইনে হাঁটতে পারছে না। ধাক্কা লাগছে। দুপাশের ঝোপঝাড়ের মাঝে সাপ থাকা‌ অবাস্তব বিষয় নয়। হাঁটার সময় সামনে পেছনে যাওয়া আরুর বামহাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে নিল অপূর্ব। কিয়ৎক্ষণ পূর্বের অনুভূতি সম্মুখীন হলো সে। মাগরিবের আযানে মুখরিত হচ্ছে। গলায় প্যাঁচিয়ে রাখা ওড়নার শেষ কোণাটা আরুর মাথা তুলে দিয়ে বলে, “আযান দিচ্ছে অথচ দেঙ্গি মেয়েরা মাথায় কাপড় না দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।

সুন্দরনগরে সূর্য ডুবে মৃদু অন্ধকারে আবৃত গ্ৰাম। আরু দিঘি থেকে ডুব দিয়ে কলতলায় গেছে পোশাক পালটাতে। শেফালী ও তুর রাত নেমে আসার কারণে হাতমুখ ধুয়ে পোশাক পালটে নিয়েছে আরও আগে। সাঁতার না জানার দরুণ কলতলার উদ্দেশ্য এগোল অপূর্ব। টিনের দরজাটা ফাঁক করে একপা বাড়াতেই থমকে‌ গেল অপূর্ব। আরুকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে তার গলা শুকিয়ে এলো। আরু উলটো হয়ে দাঁড়ানো। দ্বি মুহুর্ত একধ্যানে তাকিয়ে থাকার পর যখন চেতনা ফিরে এলো সময় অপচয় না করে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। দরজা তখনও অপূর্ব-র হাতে‌ বন্দি। ছেড়ে দিতেই খ্যাক খ্যাক শব্দে ভিড়ে গেল। আরু সেই শব্দ শুনে বলে উঠে, “কে এখানে?”

অপূর্ব জবাব দিল না। উলটো পথে অগ্রসর হলো। আজ সে আর কলতলায় আসবে না। প্রয়োজনে মায়ের টেনে রাখা পানি দিয়ে হাত মুখ ধুবে।

অপূর্ব ঘরে যেয়ে দেখল, বাড়ির গৃহিনীরা তৈরি হয়ে নামছে ঘর থেকে। বৈঠকখানায় বসে টিভি দেখছে শেফালী ও তুর। অপূর্ব সন্দিহান গলায় বলে, “তোমরা সবাই কোথায় যাচ্ছ?”

অনিতা চাপা গলায় বলে, “পানি আনতে গিয়ে পড়ে পারুল কোমরে ব্যথা পেয়েছে। ওকে দেখতে যাচ্ছি সবাই।”

“আরু যাবে না?” অপূর্ব-র ফিরতি প্রশ্ন। অনিতা সাজিয়ে রাখা উত্তরটা দিলেন, “না, ওকে নিয়ে গেলে সব কাজ ওকে করতে হবে। গিয়ে দেখি, প্রয়োজনে একটা কাজের লোক ঠিক করে দিবো। কিন্তু আরুকে দেওয়া যাবে না। তুইও আরুকে বলিস না।”

অপূর্ব সায় দিল। আরু নিজের জামাটা নিগড়াতে নিগড়াতে এলো। অপূর্ব-র মতো সেই প্রশ্ন করে, “কোথায় যাচ্ছো তোমরা?”

“একটু হাঁটতে যাচ্ছি।” অনিতার হাস্যোজ্জ্বল জবার। আরুও বায়না ধরে তাদের সাথে হাঁটতে যাওয়ার। তুর ও শেফালীর জন্য অসফল হয় আরু। তিস্তা শরীরের অসুস্থতার বাহানা দিয়ে রয়ে গেল সুজনের জন্য। সুজনকে চাচার কথাটা বলতে হবে।

সুন্দরনগর গ্ৰামে একমাত্র সাত ভাই চম্পা নিবাসে বিদ্যুৎ রয়েছে। চেয়ারম্যান বাড়ি বলে কথা, অস্বাভাবিক কিছু নয়। শেফালী ল্যান্ডফোনে ডায়াল করে বাড়ির পরিবেশ জানায় তন্বীকে। কিছুক্ষণ পর তন্বী এলো। তিস্তা তখন সুজনের ঘরে কথায় সাম্পান ওয়ালার সাথে ব্যস্ত কথায়। আরুর বইয়ের ভাঁজ থেকে ক্যাসেট এনে চালু করতেই আরু উঠে দাঁড়ালো। করুণ গলায় বলে, “আমাকে ছেড়ে দে-না, আমি এইসব দেখতে পারব না।”

“চুপ থাক, বিয়ের পর বর যখন জোর করে দেখাবে তখন দেখতে পারবি ঠিকই। এখন তোর বাহানা।” তুর বলে।

“তোকে কে বলেছে, বর বিয়ের পর এগুলো দেখায়?” কৌতূহলী কণ্ঠ আরুর।

“নাইনে ফেল করা মিতু বলেছে। ফেল করার পর চাচা তো ওকে জোর করে বিয়ের পিরিতে তুলে দিয়েছে। বিয়ের পর না-কি রোজ এগুলো দেখাতো। শুনে আর থাকতে পারলাম না। কবে না কবে বিয়ে করব। চুপচাপ দেখ।” বলেই দেখতে মন দিল তন্বী। সবাইকে অনুসরণ করে আরুও টিভির পর্দায় চোখ বুলিয়ে নিল। পরক্ষণে অস্বস্তিতে কুঁচকে এলো পল্লব।

আরুকে এই অবস্থা থেকে রক্ষা করতে আগমন ঘটল অপূর্ব-র। পায়ের শব্দ শুনে ব্যাকুল হয়ে উঠল তুর। চ্যাঁচিয়ে বলে শেফালীকে “তোকে আমি দরজা বন্ধ করতে বলেছিলাম। করেছিস?”

নক কাটতে কাটতে শেফালী বলে, “এই যা ভুলে গেছি। কে আসছে বল-তো।”

“বারণ করেছিলাম, শুনলি না। এবার কি হবে?” আরু বলে।

“থাকবি তোরা, মনে হয় তিস্তা আপু এসেছে। তিনি ছাড়া বাড়িতে আর কেউ নেই। আমি দেখছি।” বলতে বলতে দরজার দিকে অগ্রসর হলো তুর। পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকিতেই তার ধারণা ভুল প্রমানিত হলো। তিস্তা নয়, তিয়াস ও অপূর্ব এসেছে। তিয়াস শহরে গিয়েছিল চাকুরিতে, কিন্তু অপূর্ব যে মৃধা বাড়িতে গিয়েছিল। তুর নিচু অথচ উদ্বিগ্ন গলায় বলে, “টিভি বন্ধ কর তাড়াতাড়ি। অপূর্ব ভাই ও তিয়াস ভাই এসেছে।”

বলা মাত্র সবাই টিভি বন্ধ করতে ব্যস্ত হয়ে গেল। রিমোট খুঁজে পাচ্ছে না। রিমোট খুঁজবে না-কি ক্যাসেট খুলবে বুঝতে পারছে না। চট করে তুর বুদ্ধিমান হয়ে উঠল। প্ল্যাকের সকেট খুলে ফেলল। অতঃপর সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। ততক্ষণে তিয়াস ও অপূর্ব ঘরে প্রবেশ করেছে। হাতে নতুন ফোনের প্যাকেট। সদ্য কিনে আনা নিজের বাটন ফোনটা বের করে চার্জে দিতে দিতে বলে, “তোর ফোনের মতো স্মার্টফোন কিনতে চেয়েছিলাম। রাজধানী ছাড়া পাওয়া যাবে না।”

“এটা ফেরার সময় নিয়ে এসেছি। তুই যদি তখন বলতিস, তোর জন্যও নিয়ে আসতাম। ফেলেও যা দাম চাইবে।” অপূর্ব বলে। প্লাকে চার্জার দেওয়া পরেও সংযোগ আসছে না দেখে বিভ্রান্ত হলো তিয়াস। লাল রঙের তীক্ষ্ণ আলোটা প্ল্যাকে জ্বলছে না দেখে সন্দিহান হয়ে সকেটের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। অতঃপর বলে, “এই সকেটটা কেন খুলেছিস?”
তিয়াস বাড়িতে ফেরার আগে তার সদ্য কেনা নতুন ফোন দিয়ে অপূর্ব-র ফোনে কল করে সিস্টেম পরীক্ষা করছিল। তখনই জানতে পারে, আহসান পরিবার পারুলকে দেখতে যাচ্ছে। মহিলামহলকে মৃধা বাড়িতে পৌঁছে অপূর্ব-কে ফিরে আসতে বলে, কারণ তিয়াস নিজেও মৃধা বাড়িতে যাবে। পোশাক পালটাতে বাড়িতে এসেছে। সকেটটা বোর্ডে দিতেই তন্বী এক দৌড়ে বেরিয়ে গেল। তিনবোন একসাথে মাথায় হাত দিল।
অনাকাঙ্ক্ষিত গোঙানির শব্দ শ্রবণ হতে তিয়াস চার্জের পিন লাগিয়ে বলে, “কীসের শব্দ হচ্ছে রে?”

অপূর্ব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে টিভির সেই দৃশ্য মস্তিষ্কে ধারণ করছে। নেত্রপল্লব একবারের জন্যও ফেলছে না। দাঁতে দাঁত চেপে আছে। রোষের সাথে খুঁটিটা চেপে ধরে। তুর সৌজন্য হেসে ছুটে গেল। তিয়াস টিভির স্ক্রিনে তাকিয়ে নির্বাক হয়ে গেল। চক্ষু তার চড়কগাছ। অতঃপর বলে, “ছিঃ, এইসব কী ছেড়েছিস?”

আরু বেতের সোফার নিচে উবুড় হয়ে আছে। শেফালী একাই নড়তে পারে না। অবিলম্বে চ/ড় বসিয়ে দিল তিয়াস, “শেফু, এইসব টিভিতে এলো কীভাবে? ক্যাসেট পেয়েছিস কোথায়?”

শেফালী নতজানু হয়ে রইল। তিয়াস আরও কয়েকটা চড় বসাতেই ক্রন্দনরত অবস্থায় বলে, “আমি কি একা কিছু করেছি না-কি? তুর তো সায় দিয়েছে।”

অপূর্ব নিবৃত্ত কণ্ঠে বলে, “তুই কেন সায় দিলি? পাই একবার তুরকে। তোদের তিনজনের খবর আছে। (তিয়াসকে উদ্দেশ্য করে) তাড়াতাড়ি পোশাক ছেড়ে আয়। ওনাদের আনতে যেতে হবে তো।”

তিয়াস মাথা নেড়ে চলে গেল ঘরের দিকে। শেফালী তার পেছনে পেছনে ছুটল। তিয়াসের হাত ধরে বলে, “আমি ভুল করে ফেলেছি। আমি আর জীবনেও ঐসব দেখব না। প্লীজ রাগ করো না।”

“হম। যা এখন।”

“শোনো না?” শেফালীর আবদারে দাঁড়িয়ে যায় তিয়াস। উত্তরের আশায় চেয়ে থাকে। পায়ের টাকনুতে ভর দিয়ে তিয়াসের সমান হওয়ার প্রচেষ্টা করে শেফালী। কিঞ্চিৎ সম্ভব হয়। নাকে সংস্পর্শে নাক এনে প্রেমপূর্ণ কণ্ঠে বলে, “আমি আপনাকে প্রচণ্ড ভালোবাসি তিন হাঁস ভাই। আপনি যদি আমার উপর রাগ করে থাকেন। আমি সহ্য করতে পারিনা।”
আলতো ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে দূরত্ব বাড়াল। ঠাটিয়ে চ/ড় বসিয়ে দিল। অতঃপর তেজস্রী গলায় বলে, “কতদিন তোকে বলেছি, আমার সাথে এইসব কথা বলবি না। তুই শুধুই আমার বোন। আমি শুধু সুমিকে ভালোবাসি। বের হ আমার ঘর থেকে।”

“আপনি আমাকে শুধু শুধু মা/র/লেন। আমি আপনাকে অ/ভি/শা/প দিচ্ছি, সুমিকে নিয়ে আপনি একদিনও সংসার করতে পারবেন না।” ক্রন্দনরত অবস্থায়।
কিয়ৎক্ষণ পূর্বের চ/ড়ে আঘাত থাকলেও অভিমান হলো এখন। ছুটে চলে গেল ঘরে। দরজাটা ভিড়িয়ে কেঁদে উঠল শেফালী।
_
শেফালী ও তিয়াস দৃষ্টি আড়াল হতেই অপূর্ব বেতের সোফার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। গলা খাঁকারি দিয়ে বলে, “তুই কি বের হবি আরু, না-কি আমি বের করব? আমি জানি তুই এখানে লুকিয়ে আছিস।”

আরু কচ্ছপের গতিতে বের হলো। তখনও টিভির পর্দায় চলছে সেই দৃশ্যগুলো। দুহাতে গাল ধরে করুণ গলায় বলে, “বিশ্বাস করুন, আমি দেখিনি। আমি শুধুই বসে ছিলাম।”

“অপরাধ করা আর সহ্য করা, সমান” হাত ঘুড়িয়ে বেতের সোফার উপর বসে আরুকে নিয়ে। চঞ্চল আরু ইদানীং অপূর্ব-র স্পর্শে আজকাল বোকা হয়ে যায়। দিশেহারা হয়ে উঠে। লজ্জায় তার চোখে জল উপস্থিত হয়। তবুও অপূর্ব-র ধমকানিতে চেয়ে থাকে অপলক। অপূর্ব হাসে। আরুর চোখ মুখের লালচে ভাবটা নজরে আসতেই ছ্যাত করে উঠে অপূর্ব-র অন্তঃকরণ। রিমোট দিয়ে টিভি বন্ধ করে আরুর মাথাটা বুকে চেপে ধরে বলে, “তোর এই মুখের ভঙ্গিমা আমাকে জানিয়ে দেয়, তুই কেমন‌। ক্ষমা করে দিলাম।”

লজ্জা, অস্বস্তি ও অভিমানে মুখ তুলে চাইল না আরু। আরুর চিবুকে হাত রেখে ঈষৎ উঁচু করে আদুরে অপূর্ব শুধাল, “রাগ করে ছিলিস কেন?”

“আপনি আমার পিঠে আঁচড় দিয়ে রক্ত জমাট করে ফেলেছিলেন তাই।” উদাসীন আরুর অভিমানী কণ্ঠ। অপূর্ব অপ্রসন্ন হয়। আদরে মাখা গলা আরও আদুরে করে বলে, “তাই? আমি যে তখন হামি দিলাম তার বেলায়? আঘাত করলেই কথা বলা বন্ধ, আদর করলে উলটা কেন?”

“আপনি তো কপালের মধ্যিখানে হামি দিয়েছিলেন, বুঝব কীভাবে?” আরুর অস্বস্তির মাত্রা বাড়িয়ে অপূর্ব একটু নির্লজ্জ হলো, “তাহলে যেখানে আঘাত করেছি, সেখানে দেই। পেছনে ফের।”

আঁতকে উঠল আরু। এই অজপাড়া গাঁয়ে হয়তো স্বামীও তার স্ত্রীকে এরুপ মন্তব্য করেনা, লজ্জায় জড়সড়ো হয়ে বলে, “ছিঃ!”

“ছিঃ কীসের? তোর এই গ্ৰামে কেউ না বললেও, বিদেশে এসব সাধারণ বিষয়। মেয়েরা বিয়ে না করে লিভিং করতে চায়। আমার বান্ধবী সামিরা। আমাকে বলেছিল, তার সাথে লিভিং-এ যেতে। দেশে আসার আগে লিভিং শেষ করে অন্য একজনের সাথে পুনরায় লিভিং-এ যাবে।”

“লিভিং কী?”

“বিয়ে না করে বিবাহিতদের মতো থাকা।” অপূর্ব-র উত্তরে আরু বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। চোখমুখ কুঁচকে ঘরের দিকে যাওয়ার প্রয়াস করতে অপূর্ব বলে, “বালিশের নিচে তোর জন্য একটা প্যাকেট আছে।”

অপূর্ব সিডির ভেতর থেকে ক্যাসেট বের করে চূর্ণ বিচূর্ণ করে ফেলল। মৃদু কেঁপে উঠে আরু। উঠে ছুটে ঘরে দিকে গেল আরু। বালিশের নিচ থেকে ব্যাগটা নিয়ে বুকে আবদ্ধ করে নিল, “অপূর্ব ভাই, আপনার মতো করে কেউ আমাকে বোঝে না।
আপনি লিভিং-এ ছিলেন? এর শা/স্তি আপনাকে পেতে হবে। আগামীকাল সকালে যদি এর শাস্তি আমি না দিতে পারি, তবে আমার নাম আরু নয়, গরু।”

আরুর অবুঝ মন আ/সা/মি বানিয়ে দেয় অপূর্ব-কে।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-১০+১১

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১০

“মেয়েটার শরীরে জ্বর। ছেলেটাকে বলতে পারো না?” বিরাগী হয়ে বলে মিহির। অপূর্ব এক ধ্যানে চেয়ে আছে আরুর দিকে। শেষ দেখা আর বর্তমানের মধ্যে কত ফারাক। লালচে আভা জমেছে মুখমণ্ডলে। মলিন মুখমণ্ডল। অপূর্ব আরুর ললাট স্পর্শ করে জ্বরের মাত্রা পরীক্ষা করে বলে, “গাঁ পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। কখন জ্বর এসেছে, ওষুধ খেয়েছিস?”

অপূর্ব-র প্রশ্নের প্রত্যুত্তর না করে ফিরতি প্রশ্ন করে, “একটু অপেক্ষা করবেন? আমি চেয়ার নিয়ে আসছি।”

অপূর্ব আরুকে যেতে দিল না। নিজে গেল দাদা জানের জন্য চেয়ার আনতে। ইতোমধ্যে ব্যাপারটা খোলসা করেছে মিহির। অপূর্ব-র দাদা জান বা আরুর নানা জান বললেন, “পারুল, আমি আরুকে নিতে এসেছি। ঐ বাড়ির সবাই চাইছে আরু ঐবাড়িতে থাকুক।”

আরু-কে একদণ্ড সহ্য করতে পারেনা পারুল, মেয়ে তার কাছে থাকবে না ভাবলেই উদাসীন হয়ে উঠেন তিনি। এক কাজ কীভাবে সামলে উঠবেন আরু ব্যতিত। দৃঢ় গলায় বলেন, “না, আমার মেয়ে কেন অন্যের বাড়িতে থাকবে? তাছাড়া ওর বাবা ওকে যেতে দিবে না।”

অপূর্ব চেয়ার এনে দিতে দাদা জান আয়েশ করে গ্ৰহণ করলেন। থমথমে গলায় বলেন, “মা যদি মায়ের মতো না-হয়। মায়ের চেয়ে যদি মাসি আপন হয়। তাহলে নিজ গৃহের চেয়ে অন্যের গৃহ নিরাপদ। আমি ইমদাদের সাথে কথা বলেছি। আমার উপরে ওর কোনো কথা থাকতে পারেনা নিশ্চয়ই। (জ্বরে‌ আড়ষ্ট থাকা আরুর পানে চেয়ে স্নেহ করে বলেন) আরু যা, তোর যা যা লাগবে নিয়ে তৈরি হ। আমি ভ্যান নিয়ে এসেছি। তোকে আর খাল সাঁতরে যেতে হবেনা।”

পারুলের চোখমুখে বিরক্তির ছাপ। শরীর রোষে কাঁপছে অনবরত। রুষ্টের সাথে বলে, “যা, দেখি মায়ের চেয়ে মামির দরদ কতদিন থাকে।”

মা-কে ছেড়ে থাকার কথা আরু দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনা। অব্যক্ত স্বরে বলে, “আমি যাবো না। কোথাও যাবো না।”

অপূর্ব নাকের ডগায় রাগ জমে উঠল। তেজ নিয়ে বলে, “তোর ঢং দেখার জন্য আমরা আসিনি। বাড়িতে গিয়ে যত পারিস ঢং করিস। (বিরতি দিয়ে পুনরায় বলে) তোকে যেতে হবে না। আমি আনছি।”

হনহন করে ঘরে ঢুকল। নিজের পছন্দমাফিক জিনিসপত্র নিয়ে এক শাড়ির উপরে রেখে‌ গিট দিয়ে জোলা বানালো। বইখাতাও নিয়েছে কতেক। অতঃপর ফিরে এলো। উঠানে সেকেন্ড খানেক সময় থামল না। বাড়ির পথে হাঁটা দিল। ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে যে। ময়না পাখিটা আরুর দিকে তাকিয়ে তিনবার ডাকল, “আরুপাখি! আরুপাখি! আরুপাখি।”

আরু ফিরে চাইলো। বুকে ছ্যাঁকা লেগেছে। অপূর্ব সংশয় নিয়ে বলে, “তোর ময়না বুঝি?”

“হম।” সংক্ষিপ্ত জবাব।

“নিবি?”

“না, ও ডিম দিয়েছে। ডিমে তা দিচ্ছে। বাচ্চা ফুটবে কয়েকদিন পর। আমার সাথে গেলে ডিমগুলো নষ্ট হয়ে যাবে।”

আরুদের রওনা হওয়ার পর মুহুর্তে আরুর বড়ো চাচি নয়না এলো। চ্যাঁচামেচি শুনে ক্ষান্ত থাকতে পারেনি। উত্তেজিত হয়ে বলেন, “কী হয়েছে পারুল? এখানে এত চ্যাঁচামেচি কীসের?”

ক্রুদ্ধ হয়ে বলে, “আমি না-কি আরু-কে শুধু মা/রি। এমনে মা/রলে না-কি ও ম/রে যাবে। তাই নিতে এসেছে। মেয়েটাকে এত ভালোবাসি তবুও তার অভিযোগের শেষ নেই। ইচ্ছে করে মেয়েটাকে গলা চে/পে মে/রে ফেলি।”

“পারুল মুখ সামলে কথা বল। ও তোর মেয়ে। তুই উ/ন্মা/দ হয়ে যাচ্ছিস। আরুকে তাদের কাছে নিয়ে রাখার ভাবনাটা খা/রা/প না। ইদানীং তুই বদলে গেছিস। মেয়েটাকে মেয়ে মানিস না। গরুর মতো মা/রি/স। সেদিন সাধারণ একটা বিষয় নিয়ে উঠানে বেঁধে মারলি, জ্বরের ভেতরে মেয়েটাকে আবার মা/র/লি।” নয়নার বলা প্রতিটা শব্দ পারুল তার মস্তিষ্কে আওড়াল। কিছু ভুল বলছে না। ইদানীং আরুকে সহ্য হয়না পারুলের। দেখলেই শরীর জ্বলে। মন চায় শুধু মা/রি। কোঁকড়ানো চুলগুলো টেনে মাটিতে বসে পড়ে পারুল। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে, “বিশ্বাস করো ভাবী, আমি ইচ্ছে করে আরুকে মা/রি না। আরু-কে দেখলেই আমার রক্ত মাথায় উঠে যায়। শরীর জ্বলে যায়। মনে হয় ওকে শেষ করে ফেলি।”

অদূরে দাঁড়িয়ে মায়ের সব কথা শুনে ক্ষোভে ফেটে পড়ে অয়ন। পরিবারের বড় মেয়ে বলে আদর ভালোবাসা সব তার জন্য বরাদ্দ। নয়নাকে উদ্দেশ্য করে বলে, “চাচি, সাবিত কোথায়?”

“ও ঘরে আছে। সকালের নাস্তা খাচ্ছে।” নয়না আরও কিছু বলেছে, তা শ্রবণ না করে অয়ন ছুটে গেল বড়ো চাচার ঘরে। আরুর দাদা নেই, দাদি বড়ো ছেলের সংসারে থাকে। রোয়াকে বসে পান বানাচ্ছেন তিনি। অয়নকে দেখে প্রসন্ন হলেন বটে। বলেন, “কী হয়েছে দাদুভাই, মুখ এমন করে আছো কেন?”

“তুমি ঠিকই বলেছ দাদি জান, বাবা-মা কেউ আমাকে ভালোবাসে না। সবাই আরুকে ভালোবাসা শুধু।” ক্রোধে ফোঁস করে বলে অয়ন। দাদি পান রেখে অয়নকে কোলে বসালেন। পাশে টেবিলের উপর দুটো পেয়ারা রাখা। নাতির অভিমান ভাঙাতে একটা অয়নের হাতে দিয়ে আদুরে গলায় বলেন, “কী হয়েছে আমার নাতিটার?”

অয়ন পেয়ারায় কামড় বসিয়ে আধো গলায় তার অভিযোগ জানায়, “নানা জান এসেছে, সাথে এসেছে অপূর্ব ভাই। ওরা বুবুকে নিয়ে গেছে। এবার মা আমাকে ভালো না বেসে বুবুর জন্য শুধু কাঁদছে। বুবুকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার জন্য এতকিছু করলাম।”

“আরে পা/গ/ল। আরুকে বাড়ি থেকে বের করে দিলে তোর কষ্ট হবে। কে তোকে পানি টেনে দিবে গোসলের? কে খাবার পরিবেশন করে দিবে?‌ আর সবচেয়ে বড় কথা কী জানিস?” পেয়ারা খেতে খেতে অয়ন দাদির কথাগুলো নিভৃতে আওড়াল। ভুল কিছু বলে বলেনি। অতঃপর বলে, “আর কী?”

“তোর নানা বাড়ির এত সম্পত্তি। এগুলো যদি সব আরুকে দিয়ে দেয় তখন?” অয়নের মুখমণ্ডলে ভয় হানা দিল। ছুটে যাওয়ার প্রয়াস করতে টেনে ধরলেন দাদি। আরও একটা পেয়ারা দিয়ে বলেন, “এটাও নিয়ে যা। আরুর জন্য রেখেছিলাম, এখন তোর মাকে দিস।”
__
বৈঠকখানায় বেতের সোফার পাশাপাশি একটা ছোটো চৌকি রাখা। আরু সেই চৌকিতে আধশোয়া। দীর্ঘ রাস্তাটুকু অপূর্ব-র বুকে ঠেস দিয়ে এসেছে মামা বাড়িতে। জ্বরের তীব্রতা বেড়েছে। অনিতা দুধের গ্লাস নিয়ে এসেছে। আরু-কে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। সে খেতে নারাজ। বিষণ্ন গলায় বলে, “মামি, জ্বরের সময় দুধ খেলে টাইফয়েড জ্বর হয়।”

জাহানারা আজ সকালে আরুর জন্য যত্ন করে তাল বড়া বানিয়েছেন। আরুর বরাবরই তার খুব প্রিয়। গুড় মিশিয়েছেন ঈষৎ। থালাটা চৌকিতে রেখে বলে, “তাল বড়া গুলো চেয়ে নে আরু।”

তালবড়াগুলো তিক্তস্বাদযুক্ত জ্বরাক্রান্ত রসনায়। মণি একগ্লাস ঝরিবুটি নিয়ে এসেছেন। অপূর্ব এনেছে তার ওষুধ। সবকিছু দেখে ব্যাকুল হয়ে উঠল আরু। আনন্দের অশ্রু চোখে ধরা দিল। কাতরচিত্তে বলে, “এত ব্যস্ত হইও না। এই সামান্য জ্বরে বাঘিনীর কিচ্ছু হবেনা।”

‘বাঘিনী’ নিঃশব্দে বেশ কয়েকবার উচ্চারণ করল অপূর্ব। মন্দ নয়, বাঘিনীই তো। অপূর্ব বলে, “তোমার এই বাঘিনী কী করেছ, জানো নানি জান? অয়নকে না-কি বালতিতে চুবিয়ে ধরেছে।”

চম্পা দৃঢ় গলায় বলেন, “বেশ করেছে। মেয়েটাকে একটু শান্তি দেয় না। মায়ের কানে সারাক্ষণ বোনের নামে কু-মন্ত্রনা ঢালতেই থাকে।”
__
দুপুর দুইটা। রোজকার নিয়ম মেনে খেতে বসেছে মধ্যবয়স্ত পুরুষেরা। তাদের খাওয়া প্রায় শেষের দিকে। ছেলেমেয়ে খেতে এসেছে। জাহানারা আরুকে ধরে নিয়ে এসেছে। কাতারে এসে আরু দাঁড়াতেই মোতাহার আহসান বলেন, “আরু তুই বসে যা। এতক্ষণ তোকে বসে থাকতে হবে না।”

“এক সাথেই খাই।” আরু বলে চেয়ারে বসে। মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না। কাঠের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। এখন শুধু মোতাহার আহসান ও তার বাবা বসে আছেন। বাকি তিন ভাই খাওয়া শেষ করে উঠে পড়েছেন। আরুর পছন্দের খাসির মাংস রান্না হয়েছে। অনিতা আরুর জন্য বরাদ্দকৃত বাটিটা এগিয়ে দিয়ে বলে, “আরু, বসে বসে একটুকু খা মা। আমি খাবার দিচ্ছি। (অতঃপর স্বামীর দিকে চেয়ে ইতস্তত করে বলে) আসলে মেয়েটা খাসির মাংস খেতে ভালোবাসে তাই।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১১

“তাহলে আরেকটু দাও।” মোতাহার আহসান আরুর দিকে তাকিয়ে বললেন। অনিতা জড়তা নিয়ে বলেন, “কেজি দুই এনেছিলাম। আর একটু আছে। বাকি ছেলে-মেয়েদেরও তো দিতে হবে।”

“তাহলে আমাদের কেন দিলে? নামেই মেয়েটাকে খাওয়ালে। কুদ্দুসকে (রাখাল) বলে দিচ্ছি, শহর থেকে কেজি পাঁচ আনতে। আনলে রাতে রান্না করো।” এঁটো প্লেটে হাত ধুয়ে টেবিল ত্যাগ করলেন না মোতাহার আহসান। ইদানীং বুকে ব্যথা অনুভব করেন তিনি। ছেলেমেয়েরা খেতে বসল। অনিতা খাবার পরিবেশন করছেন। আরু খেতে খেতে বলে, “তোমার হাতে সেই স্বাদ পাচ্ছিনা মামি। সব তেতো লাগছে।”

“মা বেছে বেছে তেতোগুলো তোকে দিয়েছে। আমার গুলো খেয়ে দেখ।” অপূর্ব যেন সুযোগ পেল। তার পাতের মাংসগুলো সন্তর্পনে আরুর পাতে তুলে দিল। আরু খাওয়া থামিয়ে অপূর্ব-র পানে দৃষ্টি মেলাল। অপূর্ব নিবৃত্ত কণ্ঠে বলে, “আমার দিকে না তাকিয়ে চুপচাপ খেয়ে উঠ।”

উপস্থিত সবাই মৃদু হাসছে।
ভদ্রতা বজায় রেখে আরু নিজের খাবার খেয়ে হাত ধোয়ার পূর্ব মুহূর্তে পুনরায় অপূর্ব-র পাতে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ছ্যাত করে বলে, “আমি কারো দেওয়া খাবার খাই না। আমার তেতোই ভালো।”

অপূর্ব পানি পান করতে করতে আরুর গমন পথের দিকে চেয়ে রইল অপলক। মেয়েটা কি তার উপর রেগে আছে? বোধহয় আছে। নাহলে যে মেয়েটা অপূর্ব ভাই বলতে উন্মাদ, সে আলগোছে তাকে উপেক্ষা করবে কেন?”
মোতাহার আহসান অপূর্ব-কে উদ্দেশ্য করে বললেন, “তুই তো মেয়ে দেখতে গেলি না। বিয়ে টিয়ে কি করবি না? সব যোগাড় করে পাত্রীপক্ষ কত রে/গে গেছিল, ধারণা আছে?”

অপূর্ব খাওয়া থামিয়ে বাবার দিকে এক নজর তাকায়। আরুর দিকে তাকালে অন্য মেয়েদের যে বিষাক্ত লাগে, মোতাহার আহসান কি তা জানে? অতঃপর বলে, “হ্যাঁ যাবো। সেদিন ফুফুর জন্য যাইনি।”

“ঠিক আছে। আরেকটা কথা, তিস্তার জন্য একটা সমন্ধ এসেছে। মেয়ের বয়স বাড়ছে। অপূর্ব-র জন্য তো ফেলে রাখতে পারি না। দুদিনের ভেতরে ওরা মেয়ে দেখতে আসবে। সব যোগাড় করে রেখো।” বলেই মোতাহার আহসান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তিস্তা খাবার মুখে তুলতে পারলে না। আলগোছে খাওয়া ছেড়ে প্রস্থান করল। তার মনে উথালপাথাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে। সুজন একটা ভালো চাকুরি না পাওয়া অবধি কাউকে এই সম্পর্কের কথা জানাবে না। ভয় হয় যদি মেনে না নেয়। প্রয়াসের কথা ভেবেই তুরের গলায় খাবার আটকে গেল। মস্তকে উঠল।
_
মেহেরজান সিনেমা চলছে সাদাকালো টিভির পর্দায়। সবাই মনোযোগ সহকারে উপভোগ করলেও অপূর্ব তার ব্যতিক্রম। সে দেখার পাশাপাশি ব্যায়াম করেছ। শরীরের ঘাম ঝরিয়ে ঠান্ডা দূর করে প্রচেষ্টায় মগ্ন। হ্যান্ড গ্রিপারের সাহায্য হাতের ব্যায়াম করার সময় লক্ষ্য করে অপূর্ব, তিনটা ইঁদুর মুখ ভর্তি করে ধান নিয়ে ছুটছে। যাত্রাপথে ব্যাপক ধান পড়ে আছে। কালো রঙে বিশাল ইঁদুর দেখে অপূর্ব ভীত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক চেষ্টা করেও মাকে ডাকার শক্তি তার গলায় অবশিষ্ট নেই।

গর্তে ধান সঞ্চয় করে ফিরত এলো ইঁদুর ছানা। বক্ষে ভয় সঞ্চিত হলেও বাইরে নির্ভীক থাকার নামই পুরুষ জাতি। হ্যান্ড গ্রিপার দিয়ে ইঁদুরের গতিপথ পরিবর্তন করে দিতেই তিনটি ইঁদুর দিশেহারা হলো। মাটি ছেড়ে বাঁশের খুঁটি দিয়ে পালানোর প্রচেষ্টা আরম্ভ করল। তা বেশিক্ষণ স্থির হলো না। হ্যান্ড গ্রিপার দ্বারা একবার ধাক্কা দিতেই ভারসাম্যহীন হয়ে অপূর্ব-র শরীরে পড়ল, অবিলম্বে মুখরিত হলো অপূর্ব চিৎকারে। ইঁদুর তখন অপূর্বর টি-শার্টের ভেতরে তাণ্ডব আরম্ভ করেছে।

বাড়িতে অবস্থানরত সবাই ছুটে এসেছে অপূর্ব-র চিৎকারে। লম্ফঝম্প করা অপূর্বকে অনবরত শুধিয়ে চলেছে, “কী হয়েছে অপূর্ব, এভাবে লাফালাফি করছিস কেন?”

বিরতিহীনভাবে ছটফটানি করতে করতে অপূর্ব বলে, “মা তোমার এই ছেলেটাকে বাঁচাও। ইঁদুরের কামড়ে তোমার ছেলে আর বাঁচবে না। একমাত্র ছেলে তোমার। এখনো বিয়ে করেনি।”
চার ভাই ও বাবা মিলে আলোচনা করছিলেন, তারাও ইতোমধ্যে উপস্থিত। আরুর ছোটমামা উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, “ইঁদুর? ইঁদুর কোথায়? তোকে কামড় দিয়েছে?”

“না চাচা, এখনো দেয়নি। দিতে ফেলল বলে।”

অপূর্বকে নিবৃত্ত করে আরু বলে, “নিচ থেকে টি-শার্ট ফাঁক করে দিন। বের হয়ে যাবে।”

লম্ফঝম্প করার মাঝেও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আরুর পানে চাইলো অপূর্ব। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, “আমাকে দেখে বেশ মজা নিচ্ছিস, তাই না? টি-শার্ট ফাঁক করে দেই আর সে শর্ট-এর ভেতরে প্রবেশ করুক।”

অনেকেই চেষ্টা করল আরুর কথা মেনে টি-শার্ট ফাঁক করে দেওয়ার। কিন্তু সে অবাধ্য! দুর্বার! অনিবার্য! উপায়শূন্য হয়ে আরু এগিয়ে গেল। উপর থেকে টি-শার্ট ফাঁক করে হাত ঢুকিয়ে দিল। নারীর স্পর্শে সুড়সুড়ি লাগল অপূর্ব-র। আরুকে সরানোর চেষ্টা করেও সরাতে পারল না, আরু মাথা চেপে বের করে আনল ইঁদুর। ছুড়ে ফেলতেই খুঁটির সাথে বেঁধে মাথা ফেটে রক্ত গড়ালো। অপূর্ব ক্ষান্ত হয়েছে ততক্ষণে। আরুর হাত থেকে রক্ত গড়াচ্ছে। অনিতা তা লক্ষ্য করে বলে, “ইঁদুর মা/রা/র আগেই তোর হাতে রক্ত। খুব জোরে চেপে ধরেছিলি, তাই না? চাপেই রক্ত বেরিয়েছে। তোর হাতে আর মনে জোর আছে বলতে হবে।”

তৎপরতার সাথে আরু জবাব দিলো দেয়, “কামড় দিয়েছে।”

কামড় দিয়েছে! রক্ত গড়াচ্ছে! অথচ আরুকে দেখে মনে হচ্ছে, মশার কামড়ে রক্ত ঝরছে। নানাজান গর্জে উঠলেন, “দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী দেখছ তোমরা? হাতটা চেপে বিষ রক্তটুকু বের করে ফেলো। মনি, উঠান থেকে কয়েকটা বন্যলতা তুলে নিয়ে আসো। মল্লিকা, পানি নিয়ে আসো।
মেয়েটাকে ইঁদুরে কামড়েছে, অথচ সবাই হাত-পা গুটিয়ে বসে আছে। কী তাই তো?”

অনিতা আরুর হাতের আঙুল ধরে প্রেষ করতেই গড়গড়িয়ে রক্ত বের হওয়ার পাশাপাশি আরুর চোখের বাঁধ ভাঙল। ডান চোখ থেকে একফোঁটা পানিও ঝরল। নিজের শাড়িটা আঁকড়ে ধরে সংযত করে রেখেছে। অপূর্ব যে মনোচিকিৎসক! আরুর মুখশ্রী দেখেই আরুর মনের কথা পড়ে ফেলল। পড়ে ফেলল তার যাতনার কথা। মাত্র একফোঁটা পানিও ক্ষতবিক্ষত করল অপূর্ব-র অন্তঃকরণ। অনিতা বলেন, “টি-শার্ট একটু ফাঁক করলে ইঁদুর পড়ে যেতো, কামড়াতো কীভাবে? ডাক্তাররাই যদি ইঁদুর ভয় পায়, তাহলে সাধারণ মানুষ কার কাছে যাবে?”

অপূর্ব ঘরে ছুটে গেল। বিদেশ থেকে বহন করে আনা বক্সটা নিয়ে এলো। তুলোতে মেডিসিন লাগিয়ে অন্তর্পনে আরুর হাত ড্রেসিং করে দিল। নক দিয়ে চেপে ধরে অপূর্ব-র কাঁধ। আরু মৃদু আর্তনাদ করতেই অপূর্ব চাপা গলায় বলে, “এই সামান্য ব্যথায় বাঘিনী ক্ষান্ত হয়ে গেছে?”

আরু ভ্রু কুঁচকালো। অপূর্ব-কে সেই ব্যথা অনুভব করাতে অপূর্ব-র হাতে নিজের দাঁত বসালো। অপূর্ব আর্তনাদ করল না। আরু সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাত পর্যবেক্ষণ করল। দাগ বসে রক্ত জমাট বেঁধেছে।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-০৯

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৯

“আরু আর তোর বাড়িতে যাবে না। ইমদাদুল আসলে এখানে পাঠিয়ে দিবি। ও যদি মেয়ের যত্ন নিতে পারে, তবেই আরু-কে ঐ বাড়িতে পাঠাবো। আরু ঘরে যা।” চম্পার স্পষ্ট বাক্য।

শত হোক মা! অয়ন আরুকে সহ্য করতে পারে না। ‘বাবা যে তার চেয়ে মেয়েকে বেশি ভালোবাসে’-এটাই তার অ/পরা/ধ। আরু ঘরে গেল না, উলটো পথে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরল। অপূর্ব মুষ্ঠিবদ্ধ করে গাছের সাথে আঘাত করে হাত। পেরিয়ে গেল কিছু মুহূর্ত। পিনপতন নীরবতা। নীরবতার ইতি টেনে অনিতা বলেন, “অপূর্ব যাবি না? সবাই এগো, আমি দরজায় তালা লাগিয়ে আসছি।”

“আমার বোন চলে গেছে, আর আমি ঐ বাড়িতে পাত্রী দেখতে যাবো? অসম্ভব। তোমার ননদ গেলে নিয়ে যাও।” বলেই অপূর্ব টিনের বেড়ায় লা/থি দিল। বেঁকে গেল তা। ধপাধপ পা ফেলে রাস্তার দিকে গেল অপূর্ব। আশেপাশে আরুর দেখা নেই। নদীর ওপারে ভেজা নীলপদ্ম-কে দেখা যাচ্ছে। সাঁতরে ওপাড়ে গেছে। অপূর্ব-র সাঁতার জানা নেই। নাহলে এই নদী সাঁতরে আরু-কে নিয়ে আসতো। নিজের উপর ঈষৎ রাগ জন্মালো। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। শহরের মতো আলো নেই কোথাও। অপূর্ব-র মনে ভয় উঠল। তাই আর চলতিপথে এগোল না, ফিরতি পথ ধরল।

আকাশ কালো করে এসেছে। এই শীতে বৃষ্টির আগমন ঘটার সম্ভাবনা নেই, তবুও অন্তঃকরণ জানান দেয় বৃষ্টির অপ্রত্যাশিত আগমনের কথা। আরু ক্ষেতে নামতেই মিঠু ছুটে এলো নিকটে। ভেজা শাড়িতে ঘেঁষল ছাগল খানা‌। আরু আজ মিঠুকে কোলে তুলল না, হাত বুলিয়ে দিল না তার শরীরে। বড়ো ছাগলটা-কে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলো। গোয়ালে রাখতেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পতিত হলো। হাঁস-মুরগিগুলো খোপরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আরু আর জামা কাপড় পালটালো না। খোপরের দরজা খুলে দিল। গুনে গুনে হাঁস মুরগি ভেতরে ঢুকালো। নির্দিষ্ট সংখ্যায় আসতেই তালাবদ্ধ করে দিল দরজা। তখন বৃষ্টি ক্রমশ বাড়ছে। ধানগুলো ভালোভাবে পলিথিন দিয়ে ঢেকে কলস নিয়ে চলল দিঘির পাড়ে। প্রথম কলস পানি নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারলেও দ্বিতীয় কলসের সময় ব্যতিক্রম হলো। বৃষ্টিতে ভিজে উঠান কর্দমময় হয়ে উঠেছে। পা পিছলে মাটির কলসখানা নিয়ে পড়ল। ভাঙল কলস। ভীত হলো আরু। পারুল আবার তার উপর..। মাটির কলসখানা স্পর্শ করে কান্নায় ভেঙে পড়ল আরু। স্থান পরিবর্তন করল না। বসে রইল। ময়নাপাখি বৃষ্টি উপেক্ষা করে ছুটে এলো।
“আরুপাখি, আরুপাখি, আরুপাখি। বৃষ্টি, বৃষ্টি, বৃষ্টি। চল, চল, চল।”

ময়না আরুর কাঁধ দখল করে দিল। ময়নার শরীরে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আরু বলে, “আমি ইচ্ছে করে ভাঙিনি, মা দেখলে খুব মা/র/বে ময়না। আমার খুব ভয় করছে।”

“কিছু হবেনা, কিছু হবেনা, কিছু হবেনা।” ময়না তিনবার আওড়ালো। অয়ন ও পারুল বৃষ্টি মাথায় নিয়ে এসেছে। একটু আগে মায়ের কাছ থেকে শুনে আসা কটুক্তি, এখন নিজের কলস ভাঙা। রোষে শরীর ‘র-র’ করছে। শাড়িটা ঈষৎ উঁচু করে এগিয়ে গেলেন। আরুর মাথা ধরে একটা ধাক্কা দিতে রোষ মেজাজে বলে, “ইচ্ছে করছে, কলসের মতো তোকেও চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেই। একটা কাজও সাবধানে করতে পারিস না, না-কি আমার উপর রাগ দেখিয়ে আমার কলসখানা ভাঙলি?”

আরু হাঁচি দিল দু-বার। পারুল শাড়ির দিকে লক্ষ্য করল, ভেজা শাড়ি এখনো পালটায় নি। সব কাজ পরিপাটি করে শেষ করেছে। তুলনামূলক একটু শান্ত হয়ে বলে, “যা উদ্ধার করেছ, করেছ। বৃষ্টিতে না ভিজে জামা কাপড় পালটে নে। বাবাই ফোন করলে বলিস, ‘কলস ভেঙেছি। নতুন কলস নিয়ে এসো।’ যত্তসব।”

অতঃপর চলে গেল। আরুও উঠে চলে গেল। শাড়ি পালটে বিছানায় গাঁ হেলিয়ে দিল। ঠান্ডায় মাথা ভার হয়ে আসছে, জ্বর আসবে বোধহয়।
__

শীতকালে সূর্য মামার মাটি স্পর্শ করতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়। কুয়াশা ভেদ করা চাট্টিখানি কথা নয়। তবে এখন শীত শেষের দিকে। কুয়াশা ফিকে হয়ে উঠেছে। হাড় কাঁপানো শীতে আরুর গরম নিয়ন্ত্রণ পোশাকের প্রয়োজন হয়নি, কিন্তু জ্বরের কারণে আজ চাদর জড়িয়ে বসে আছে দিঘির পাড়ে। উঠানের শেষ প্রান্তে দিঘি। মিহির বসেছে পাশে।

অয়ন ছাই দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে আরুর কাছে এলো। মাধুর্যর্পূর্ণ কণ্ঠে বলে, “বুবু, পানি তুলে দে।”

জ্বরে মাথা ধরে যাওয়ার দরুন আরু চাম্পল গাছে ঠেস দিয়ে গ্ৰথন পল্লবে ছিল। অয়নের ডাকে বালতি হাতে নিয়ে দিঘিতে নামল। অয়ন সাঁতার জানে না, দিঘির কাছে যেতে ভয় পায়। অয়নের গোসলের যাবতীয় পানি আরু বহন করে দেয়।

বালতি ভর্তি পানি স্লাভের উপর রাখতেই পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে অয়ন। উষ্ণ শরীরে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে সর্ব বল প্রয়োগ করে চ/ড় লাগালো গালে। অয়ন তেজ দেখিয়ে বলে, “তুই আমকে মা/র/লি বুবু। আরেক‌ বালতি পানি এনে না দিলে মাকে বলব, তুই পানি ফেলে আমাকে মেরেছিস।”

আরু ফোঁস করে নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। একপেশে কাত হয়ে থাকা পানি শূন্য বালতিটা নিয়ে নেমে গেল দিঘিতে। পূর্ণ করে পূর্বের স্থানে রেখে বলে, “পানি এনে না দিলে কী করতি?”

“মায়ের কাছে বিচার দিয়ে তোকে মার খাওয়াতাম। পানি এনে দিয়েছিস, এখনও মার খাওয়াবো। দাঁড়া তুই।” নিজ সিদ্ধান্তে অনড় থেকে বলে অয়ন। আরু সময় নষ্ট করল না, অয়নের মাথা চেপে ধরল পানি ভর্তি বালতিতে। পারুল বের হয়েছে ঘর থেকে। ছেলেমেয়ের এই কাণ্ড দেখে অবিলম্বে ছুটে‌ এলো। অয়নকে আরুর থেকে ছাড়িয়ে চ/ড় লাগালো আরুর গালে। অতঃপর সে নিজেও হতভম্ব হলো। এক সেকেন্ডের মতো আরুর সংস্পর্শ লেগেছিল, এতেই জ্বরের প্রভাব হাতে লেগেছে। চোখ মুখটাও অতি শুষ্ক। আরুর ললাট স্পর্শ করে জ্বরের তীব্রতা পরীক্ষা করল পারুল। পারুল অনুভব করল, মেয়েটা জ্বরের ঘোরে এরূপ করেছে। কারণ ভাইকে সে প্রাণের চেয়ে বেশি স্নেহ করে। তবুও থমথমে গলায় প্রশ্ন করে, “কী হয়েছে এখানে?”

ক্রন্দনরত অবস্থায় অয়ন বলে, “পানি তুলে দিতে বলেছিলাম। বুবু পানি তুলে তা ফেলে দেয়। আমি পানি তুলে দিতে বলেছি বলে আমাকে চ/ড় মে/রে/ছে। নতুন পানি এনে চুবিয়ে..
অয়নের বাক্যের ইতি ঘটার পূর্বেই হুংকার দিল আরু, “খবরদার অয়ন, একটা মিথ্যা মুখ থেকে বের হলে খবর আছে। আগে বালতিতে চুবিয়ে রেখেছি এখন পুকুরে চুবিয়ে রাখব।”

ময়না পাখিটা তাল মিলিয়ে বলে, “খবরদার অয়ন। খবরদার অয়ন। খবরদার অয়ন।”

আরুর মুখের কথা অবিকল নকল করেছে ময়না। এতে ভীত হলো অয়ন। কিছু বলে না। মিহির আরুকে সঙ্গ দিয়ে বলে, “মামি, তোমার ছেলেকে সহবত শিখাও। সবটা তো নিজেকে চোখেই দেখলাম। আরুর জ্বর এসেছে। ও দৌড়ে কলতলায় যেতে পারত। আরুকে কেন হুকুম দিবে?”

তদানীং উপস্থিত হলো আরুর নানা ও অপূর্ব। আরুকে নিতে এসেছে। পারুল সালাম দিল। অতঃপর আরুকে বলে, “বাজানের জন্য চেয়ে নিয়ে আয়।”

“মেয়েটার শরীরে জ্বর। ছেলেটাকে বলতে পারো না?” বিরাগী হয়ে বলে মিহির। অপূর্ব এক ধ্যানে চেয়ে আছে আরুর দিকে। শেষ দেখা আর বর্তমানের মধ্যে কত ফারাক। লালচে আভা জমেছে মুখমণ্ডলে। অপূর্ব আরুর ললাট স্পর্শ করে জ্বরের মাত্রা পরীক্ষা করে বলে, “গাঁ পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। কখন জ্বর এসেছে, ওষুধ খেয়েছিস?”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-০৮

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৮

“এখন ওখানে নেই। স্কুলে আসা-যাওয়ার সময় থাকে শুধু।” নম্র ভাষা।
অপূর্ব ফোঁস করে নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। তুরের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে ইশারায় যাওয়ার ইঙ্গিত করে। তুর নিঃশব্দে প্রস্থান করে।

“তবে আমার একটা শর্ত আছে। তুই যদি আমার একটা শর্ত মানিস তবে আমি কালাচাঁনকে আচ্ছা করে পি/টা/বো।” শর্তের প্রসঙ্গ তুলে আরুর মুখমণ্ডলের ভঙ্গিমা দেখল অপূর্ব। শর্তের কথা শুনে জড়সড়ো হয়ে আছে আরু। কিছুক্ষণ প্যাঁচা মুখ করে থেকে বলে, “ঠিক আছে, তবে শর্তটা কী?”

জয়ের হাসি ফুটে উঠল অপূর্ব-র ঠোঁটের কোণে। গলা খাঁকারি দিয়ে বলে, “আমার প্রথম শর্ত, তুই কখনো কোনো পুরুষের কাছাকাছি যাবি না। অন্তত চার ফুট দূরত্ব বজায় রাখবি।”

বলা বাহুল্য আরুর দূরত্ব বজায় রাখতে মিলি সেকেন্ডই যথেষ্ট। চার বেশিও বজায় রাখল। অপূর্ব বিরাগী হয়ে হাত টেনে দূরত্ব ঘোচাল। অতঃপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, “আমি আমার সাথে দূরত্ব দেখাতে বলিনি। আমি ব্যতিত অন্যরা। বিশেষ করে মিহির।”

“আপনার সবাই তো আমার ভাই। আমি দুচোখামী করতে পারব না।”

“তাহলে এক চোখামী করবি। মামা বাড়ির সাথে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে না, শুধু দাদা বাড়ির সাথে রাখলেই যথেষ্ট। আমার দ্বিতীয় শর্ত, আমাকে জড়িয়ে ধরে একশো একটা চুমু খেতে হবে।”

আরু নাক কুঁচকালো। চোখে তার অপ্রত্যাশিত চাওনি। জ্ঞান হারিয়ে ফেলল এই বুঝি। সম্পর্কে ভাই না হলে অপূর্ব-কে সে চাচা হিসেবে সম্বোধন করতো। জড়িয়ে ধরা অবধি ঠিক ছিল, তাই বলে দুদিনের চেনা ছেলেকে চুমু? তাও একশো একটা। আরু ইতস্তত করে বলে, “এই শর্ত না মেনে অন্য শর্ত মানলে হবে?”

“তাহলে কালাচাঁন আর ওর সাঙ্গপাঙ্গদের না মে/রে অন্য কাউকে মা/র/লে হবে?”

আরুর মুখশ্রী আঁধারে ঢেকে গেল। অপূর্ব-র রাগ জাগল। তবুও বলে, “তোকে বিশ্বাস নেই, কাজ করার পর যদি বেঁকে বসিস। তাই আগে কিছু অগ্ৰিম দিতে হবে।”

আরুর ওড়নায় গিট দেওয়া অংশ খুলে টাকা বের করল। ত্রিশ টাকা আছে। টাকাগুলো এগিয়ে দিয়ে বলে, “আমার কাছে ত্রিশ টাকাই আছে বিশ্বাস করুন। ওরা পাঁচজন। পাঁচ টাকা করে নিয়ে বাকি পাঁচ টাকা ফিরত দিন।” অপূর্ব ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল অপলক। আরু পুনরায় বলে, “ফিরত দিতে হবেনা। প্রয়োজনে আপনি আমার সব টাকা নিয়ে যান। টাকার বিনিময়ে মা/রু/ন। তবুও..”

“অন্য কাউকে দেখ, আমার যা লাগবে আমি বলে দিয়েছি।” বলেই অপূর্ব অগ্রসর হলো। আরুর দীর্ঘক্ষণ ভেবে অপূর্ব হাত ধরে বলে, “এমন করছেন কেন?”

অপূর্ব ফিচেল হেসে হাত ছাড়িয়ে বেরিয়ে গেল। আরুও নামল পিছুপিছু।‌বাড়ির সব মহিলারা ও ছোটরা তৈরি হয়ে নেমেছে তখন। আরুকে দেখে একদফা চমকে উঠল সকলে। জাহানারা আরুকে কাঁদতে দেখে বলে, “কি-রে আরু, কাঁদছিস কেন মা?”

অপূর্ব আগ বাড়িয়ে জবাব দেয়, “আমার বউ না-কি সে পছন্দ করে আনবে। আমাদের সাথে যেতে চাইছে, তাই কাঁদছে।”

“এজন্য কাঁদা লাগে। পাগল মেয়ে, আয় তৈরি করে দেই।” জাহানারা আরুকে টেনে গেল কক্ষে।

নীল রঙে চওড়া সাদা পাড় বিশিষ্ট শাড়ি আরুর জন্য আলমারি থেকে নামিয়েছে জাহানারা। আরু সেটা গ্ৰামে মতো করে পরিধান করে নিল অঙ্গে। দীর্ঘ চুলগুলো দুপাশে বেনুনি করে নীল রঙের ফিতা দিয়ে বাঁধল। খয়েরি গাঁদা ফুল গুঁজে দিল ফাঁকে-ফাঁকে। চোখে চওড়া কাজল, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক ও হালকা পাউডার মুখে, কপালে বিন্দুর মতো টিপ। আরুর জন্য অপেক্ষারত ছিল সবাই। আরু এই সাদামাটা রূপে নেত্রপল্লব স্থির রইল সকলের। অনিতা এগিয়ে এসে আরুর চোখ থেকে কাজল কনিষ্ঠ আঙুল নিয়ে লেপ্টে দিলেন কানের পশ্চাৎ-এ। ‘রূপবতী, গুনবতী মেয়ের সন্ধানে যাচ্ছি অথচ সেই মেয়ে আমার ঘরে’ বলেই অনিতার হাত নিশ্চল হয়ে গেল।

অনিতা তাড়া দিয়ে বললেন, “চল, চল বেরিয়ে পড় সকলে। আমি দরজায় তালা ঝুলিয়ে প্রহরীদের বলে আসছি।”

অনিতা কক্ষে প্রবেশ করতেই এক এক করে বাইরে বেরিয়ে গেল সকলে। নূপুরের শব্দ তুলে অগ্ৰসর হয়ে অপূর্ব-কে অতিক্রম করার সময় আশাতীত কাজ করে ফেলল অপূর্ব। অশান্ত কণ্ঠে বলে, “আরু, এটা পরিপাটি সাজ নয়। আমরা মেয়ে দেখতে যাচ্ছি। এই সাজ একদমই বেমানান। শাড়ির সাথে ব্লাউজ বা থ্রী পিস পরে নে।”

“আমার কাছে শাড়িই স্বস্তিদায়ক। তাছাড়া ব্লাউজ এই বাড়িতে নেই।”

“তুর বা শেফালী কারো তো নিশ্চয়ই আছে, এনে দেই।”

“না, আমি এতেই ঠিক আছে।” হাত ছাড়িয়ে পুনরায় অগ্রসর হলো আরু। অপূর্ব বাঁধা দিল না, দমিয়ে রাখল শুধু। নখ দিয়ে আঁচড় কেটে ফেলল আরুর ব্লাউজ বিহীন নগ্ন পিঠে। অচল হলো আরু, বিলম্ব হলো রক্ত ঝরতে। পিঠে হাত দিয়ে দেখল, রক্ত। ফিচেল হেসে অপূর্ব যেতে যেতে বলে, “বড়দের কথা না শুনলে এমন হবেই। বেশি করে হবে। তুরকে পাঠাচ্ছি। আমার আদেশ মেনেই আসবি। নতুবা..

আষাঢ়ে ভেসে আসা পদ্ম তুমি। নীলপদ্ম। উন্মুক্ত করার অধিকার শুধুই আমার।

পারুল ও‌ অয়ন এসেছে। তাঁরাও আজ যাবে অপূর্ব-র মেয়ে দেখতে। আহসান বাড়িতে পা রেখে আরুকে দেখা মাত্র তাঁর মস্তিস্ক অগ্নিতে প্রজ্বলিত হলো। সেই অনলে ঘি ঢেলে পারুলের আঁচল টেনে বলে অয়ন, “দেখো মা, বুবু কাজের ভয়ে এখানে এসেছে। বুবু দিনদিন অকর্মণ্য হয়ে যাচ্ছে। বিয়ে দিলে জামাই এক দরজা দিয়ে নেবে অন্য দরজা দিয়ে ফেরত দিয়ে যাবে।”

পারুল ক্রোধে ফুঁস করে উঠে। আরুর গাঁথা দুই বেনুনি ধরে টেনে পরপর তিন খানা চড় বসালো। আরুর শুভ্র ও উজ্জ্বল গাল অবিলম্বে রক্ত জমে রক্তিম হয়ে উঠল। তাতেও ক্ষান্ত হলো না পারুল, বরং বেনুনি টেনে লাঠি খুঁজতে মরিয়া হয়ে উঠল চারপাশে। ছোটো একটা মগডাল হাতের নাগালে পেতেই, সেটা দিয়ে কয়েক ঘা লাগালো। আরু ব্যথায় কুঁকড়ে উঠার পাশাপাশি প্রস্থান করার চেষ্টা করল, কিন্তু বেনুনির কারণে সম্ভব হলো না। বাজখাঁই গলায় বলেন, “সারাদিন এপাড়া-ওপাড়া করিস। বাড়ির কাজ কে করবে? কে ছাগল গোয়ালে ঢুকাবে? তোর ময়নাকে কে খাওয়াবে? হাঁস মুরগি কে খোপরে ঢুকাবে? গৃহস্থালির কাজ কে করবে?”

মা-কে খুঁজতে অপূর্ব এলো। আরুকে এভাবে আ/ঘা/ত করতে দেখে ছুটে এলো। ফুফুর হাত থেকে বেনুনি ছাড়িয়ে নিল। অতঃপর চ্যাঁচিয়ে বলে, “হয়েছে কী এখানে? ওকে মা/রছ কেন?”

আরু মাটিতে নুয়ে হাউমাউ করছে। অশ্রু চোখের কাজল লেপ্টে গেছে। বেনুনিতে গাঁথা গাঁদা ফুলের পাপড়ি মাটিতে ছড়ানো ছিটানো।

লাঠি নিয়ে তেড়ে আসতে আসতে বলে, “ওর এপাড়া ওপাড়া বেড়ানো বন্ধ করছি। মেয়ে মানুষ স্কুল থেকে বাড়িতে যাবে, খাবে কাজ করবে আর ঘুমাবে। কেন টইটই করবে?”

অপূর্ব লাঠি আয়ত্ত করে চূর্ণ করে ফেলল। চ্যাঁচামেচির শব্দ শুনে সবাই এলো। চম্পা মেয়ের গালে কষে চড় বসালেন এবং বললেন, “আরু আর তোর বাড়িতে যাবে না। ইমদাদুল আসলে এখানে পাঠিয়ে দিবি। ও যদি মেয়ের যত্ন নিতে পারে, তবেই আরু-কে ঐ বাড়িতে পাঠাবো। আরু ঘরে যা।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-০৭

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
#পর্ব: ০৭

“আরু আমি তোমার জন্য পাক্কা একঘণ্টা দশ মিনিট দাঁড়িয়ে আছি। এত দেরিতে কেন এলে? ঐ ছেলেটার কাছ থেকে চিঠি নিলে কেন?” গর্হিত কণ্ঠে বলে কালাচাঁন।

নিজের হাতের দিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে চেয়ে রইল আরু। এই অজপাড়া গাঁয়ে মেয়েরা শৌখিন না-হোক ফেলনা নয়।

কালাচাঁদকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার জন্য অগ্ৰসর হলো। আরু পারল না, কালাচাঁন আটকে দিল পথ। আরুর সাথি তন্বি অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে, “তোরে না কয়দিন কইছি কালাচাঁন। একদম আরুর পিছে লাগবি না। আরু ওর মামারে বললে তোর মতো কালাচাঁন মাটির নিচে যেয়ে মাইট্টা চাঁন হয়ে যাবে।”

“তন্বি তুই আমার আর গোলাপী সুন্দরীর মাঝে আসবি না। (অতঃপর মোলায়েম কণ্ঠে বলে) আরু বিশ্বাস করো, আমি তোমারে মেলা ভালোবাসি। তুমি আমারে গ্ৰহণ কইরা লও।”

“আমি বিয়ে করব, সিনেমার নায়ক। সবাই বলে আমি অনেক সুন্দর। আমি সুন্দর হয়ে তোকে কেন বিয়ে করব? আমি বিয়ে করব সুদর্শন পুরুষকে।” বিদ্রুপ করে বলে আরু। ক্ষান্ত করার প্রচেষ্টা করে কালাচাঁন বলে, “দেখো গোলাপী, সাদা কালো বিপরীত। সাদা আছে বলেই কালোকে সবাই তাচ্ছিল্য করে। কালো আছে বলেই সাদার এত কদর। তুমি আমারে বিয়ে করলে সবাই বলবে, কালার ঘরে চাঁন আইছে। আমার কালাচাঁন নাম সার্থক হবে।”

“রাখ তোর কালাচাঁন, রাতে আকাশ থাকে অন্ধকার। এই অন্ধকার আকাশে কালাচাঁনকে দেখাই যাবে না। আমি সাদাচাঁন-ও বিয়ে করব না। আমি বিয়ে করব সূর্যকে। সূর্য আট মিনিট উনিশ সেকেন্ডে পৃথিবীতে আলোকিত করে দেয়। যখন সে আমার ব্যক্তিগত সূর্য হবে তখন আলো আসতে কোনো সময় লাগবে না।” আরুর এরুপ কথাতে ক্ষেপে গেল কালাচাঁন। আরুর হাতটা আরেকটু চেপে ধরল। শহরের মেয়েদের স্পর্শ করা যতটা সহজ ভাবে নেওয়া সম্ভব, গ্ৰামের মেয়েদের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত। আরুর চোখ জলে পূর্ণ হয়ে এলো। ক্রোধে ফোঁস করে বলে, “কালাচাঁনের বাচ্চা, তোর সাহস হয় কীভাবে আমাকে স্পর্শ করার? তুই আমার অপূর্ব ভাইকে চিনিস না। সিনেমার হিরোদের মতো ভাঁজ কা/টা তার দেহ। এক ঘু/সিতে তোকে কালাচাঁন থেকে চ্যাপাচাঁন করে দিবে।”

আরুর চ্যাঁচানো শুনে ভীত কালাচাঁন হাত ছেড়ে দৌড়ে পালাল। কালাচাঁনের স্পর্শ করা হাত ঘষতে ঘষতে রক্তিম করে ফেলল আরু। লোকে জানলে বলবে, পরপুরুষ আরুকে ছুঁয়েছে।
উ/ন্মা/দ হয়ে হেঁটে চলেছে আরু। তন্বি আরুকে থামানোর চেষ্টা করে। চার রাস্তার মোড়ে এসে আলাদা পথ ধরে তন্বি, বইখাতা আঁকড়ে ধরে মামাবাড়ির পথ ধরে আরু। অপূর্ব-কে সে টাকা দিয়ে ভাড়া করে কালাচাঁনকে পি/টু/নি খাওয়াবে।

‘টগবগ! টগবগ! টগবগ!’ করে ঘোড়ার পিঠে চড়ে অপূর্ব ছুটে আসে। আরুকে উদাসীন হয়ে হেঁটে যেতে দেখে বিস্মিত হলো অপূর্ব। পায়ের নূপুরের ভিন্ন ‘বিষাদের’ সুর শুনে ঘোড়ার গতিরোধ করল অপূর্ব। বলে, “উ/ন্মা/দের মতো হাঁটছিস কেন?”
ঘোড়া দেখে আরু ভুলে গেল উ/ন্মাদনা। বাদামী সম্পূর্ণ দেহের রঙ। চুলগুলো ১৬ ইঞ্চি দীর্ঘ ও ফিকে বাদামী। লেজ ২৪ ইঞ্চি লম্বা ও সম্পূর্ণ লেজ চুল দ্বারা আবৃত। অপূর্ব-র সামনে শেফালী বসে আছে‌। আরুকে দেখে শেফালী উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, “জানিস আরু, অপূর্ব ভাই আমাদের সবাইকে ঘোড়ায় চড়িয়েছে। টগবগ টগবগ করে চলছে ঘোড়া। কী মজা।”

‘মজা’ শব্দটা শোনার পর স্পৃহা জাগল ঘোড়ার পিঠে চড়ার। আরু যদি আহসান বাড়ির মেয়ে হতো, তবে অনায়াসে সেই অবদান করতে‌ পারত। কিন্তু তার চাচাতো ভাই সাবিত ছোট। একমাত্র মিহির ভাই আছে। যদিও সে আরুকে‌ যথেষ্ট ভালোবাসে, তবুও। আরুর মন পড়ে অপূর্ব বলে, “শেফালী তুই নাম, আরু উঠুক।”

“আমি তো মাত্রই চড়লাম। আরেকটু থাকি।” আবদার তার।

“ধাক্কা দেওয়ার আগে নাম। নাহলে হাত-পা ভাঙবে।”

অগত্যা অপূর্ব-র সাহায্যে শেফালী নামল ঘোড়া থেকে। নিজের বইখাতা শেফালীর হাতে দিয়ে ঘোড়ার দিকে এগোল আরু। অপূর্ব মাটিতে নেমে আরুর কোমর আঁকড়ে ঘোড়ার উপর তুলে দিল। অতঃপর নিজেও আরোহণ করে পেছনে। আদেশ করে টাইসনকে, “ছুটে চল টাইসন।”

পুনরায় টগবগ করে ছুটল সে। গতিশীল হওয়ার পর মুহুর্তেই আরুর হাস্যোজ্জ্বল মুখ ভয়ে নিমজ্জিত হয়ে গেল। অপূর্ব হাতে আঁচড় কে/টে বলে, “নামব, আমার ভয় করছে।”

“এটুতেই ভয়! তোর না-কি সারাজীবনের ইচ্ছে ছিল রাজকুমার বিয়ে করার?” ঘোড়ার বেল্ট ধরে আস্ফালন করতে করতে বলে অপূর্ব।

“হম। আমি রাজকুমার বিয়ে করব। তার পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে নিজেকে রানীর পরিচয় দিবো।” অপূর্ব-র বক্ষে হেলান দিয়ে নিজের কল্পনায় প্রবেশ করল আরু। ঘোড়ার বেল্ট থেকে হাত আরুর ডান কাঁধে রেখে বলে, “রাজকুমার থাকে দূরে, বহুদূরে। একদম সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারে। সে আসে পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে। পক্ষীরাজ ঘোড়ার ডানা হয়, আমার ঘোড়ার নাইবা হলো। আমিও আমার রাজকুমারীকে রানীর রুপ দিতে সাত সমুদ্র তের নদীর ওপার থেকে ঘোড়া নিয়ে এসেছি।”
আরু মাথা তুলে অপূর্ব-র দিকে তাকালো। তারমানে অপূর্বও কোনো রাজপুত্র। কোনো রাজকুমারীর জন্য এসেছে। ঈষৎ ঈর্ষা অনুভূত হলো আরুর। এই গ্ৰামে হাজার থেকে লক্ষাধিক মেয়ের বিয়ে হয়েছে অথচ কোনো রাজকুমার ঘোড়া নিয়ে আসছি। এই প্রথম কোনো নারীর জন্য ঘোড়া নিয়ে এসেছে। আরুর স্পৃহা জন্মালো সেই সৌভাগ্যবতী নারীর ললাটে ললাট ঠেকাতে। বামহাত দিয়ে নিজের কপাল মেপে নিল। একমাত্র চার আঙুল কপালের মানুষের ভাগ্যে জোটে ভালো কিছু। কিন্তু সেই সৌভাগ্যবতীর ললাট নিশ্চয়ই পাঁচ আঙুল হবে, লাখে এক বলে কথা। কিন্তু আরুর কপাল তিন আঙুলের।
ততক্ষণে বাড়ির প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রবেশ করেছে ঘোড়। আরু ও অপূর্ব উভয়ে নেমেছে। রাখাল চাচা ঘোড়া নিয়ে গেছে গোয়ালে। আরুর মন খারাপ অপূর্ব চট করে পড়ে ফেলল, অতঃপর ফোঁস করে নিঃশ্বাস ত্যাগ করে, ‘স্যরি আরু, তুই যথেষ্ট ছোট ও বাচ্চা। তোর ভাগ্যে আমি নেই। প্রার্থনা করি, তোর জন্যও কোনো রাজকুমারের আগমন ঘটুক।’

অপূর্ব ভাবল, আরু একটু ক্ষেপে যাবে। একটু অভিমান পুষবে। অপূর্ব আবার সেই অভিমান মুছে দিবে। অপূর্ব-র ভাবনাকে মিথ্যা প্রমাণ করে আরু বলে উঠে, “অপূর্ব ভাই ঘোড়া কেন দাঁড়িয়ে ঘুমায়? কেন? সারারাত দাঁড়িয়ে ঘুমাতে ওদের পা ব্যথা করে না বুঝি?”
__
তুরকে প্রয়াসের চিঠি দিয়ে অশ্রুপাতে ভেঙে পড়ল আরু।
অপূর্ব বোনেদের ঘর অতিক্রম করার সময় কান্নার শব্দ শুনতে পেল। কৌতুহল বশত ভেড়ানো দ্বার উন্মুক্ত করল। আরু-কে ক্রন্দনরত অবস্থায় দেখে হৃৎপিণ্ড তার কাজ ভুলে গেল। তুর একাধিকবার প্রশ্ন করছে কী হয়েছে? আরু প্রত্যুত্তর বিহীন কেঁদে চলেছে। অপ্রসন্ন হয়ে বলে, “বলবি তো কাঁদছিস কেন?”

আরু তার বামহাতটা বাড়িয়ে দিল। হাতের কবজির কাছে লালচে বর্ণ হয়ে আছে। ছিলে গেছে বোধহয়। হেঁচকি তুলে বলে, “কালাচাঁন আমার হাত ধরেছে তুর। আমার মন চাচ্ছে, হাতের চামড়া তুলে ফেলি।” অতঃপর ক্রন্দনরত অবস্থায় সবকিছু খুলে বলে আরু।

আরুর নিকট পৌঁছে অস্থিরচিত্তে জেরা করল অপূর্ব, “কখন ঘটেছে এইসব?”

অপূর্ব-র আগমনে আশ্চর্যান্বিত হয়ে উঠল আরু। নিজের করা প্রশ্নে জবাব না পেয়ে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠে অপূর্ব। রক্তিম হাতে বল প্রয়োগ করে পুনরায় অভিন্ন প্রশ্ন করে।

হাত ছাড়াতে ছাড়াতে ব্যথাহত কণ্ঠে বলে, “স্কুল থেকে আসার সময়। যখন আপনার সাথে দেখা হলো।”

‘এজন্য উন্মাদের মতো লাগছিল?’ অপূর্ব নির্লিপ্তভাবে বলে, “তখন কেন বললি না। এখন চল।”

ভীত হয়ে গেল আরু। কোনোভাবে মায়ের কাছে খবর গেলে আস্তো রাখবে ওকে। কম্পিত গলায় বলে,

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]
রেসপন্স করার অনুরোধ রইল 💚

নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-০৬

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৬

“অপূর্ব ভাই, মেয়েদের ছবি দেখাতে ঘটক এসেছে। মামি ডাকছে আপনাকে।” বলতে বলতে অপূর্ব-র কক্ষে প্রবেশ করল আরু। একই গতিতে বিরতি না দিয়ে আরু ফিরতি পা বাড়ালে অপূর্ব থামিয়ে দিল, “দাঁড়া, একসাথে যাই।”

মধু খেয়ে ঠান্ডা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে অপূর্ব-র। এজন্য হলেও আরু-কে ছোট করে ধন্যবাদ দেওয়া দরকার। চাদর জড়িয়ে একসাথে বৈঠকখানায় গেল আরু ও অপূর্ব। অনিতা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। ঘটক তার আনা পাত্রীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সাজিয়ে দেওয়ার খাবার মুখে তুলতে তুলতে বলে, “আমার কাছে খাসা পাত্রী আছে, চেয়ারম্যান বাড়ির ছেলের বিয়ে বলে কথা। নিরানব্বই খান ছবি আছে।”

“নিরানব্বই-এর পর একশো নাম্বার পাত্রী আমাদের আরু।” অন্যমনস্ক হয়ে বলে ফেলেন অনিতা। আচমকা সবাই তাকাল। পরিস্থিতি সামলাতে বলেন, “আপনি ছবিগুলো দিন।”

ঘটক ছবি দেখানো শুরু করল। প্রতিটা ছবির মেয়েকে একনজর দেখে আরুকে দেখে অপূর্ব। তার প্রণয়ী হৃদয় আরুর প্রতিচ্ছবির সন্ধান চাইছে। নিরানব্বই খানার মাঝে এক খানা ছবি পছন্দ করা হলো। সেই খানা রেখে দিল। ঘটক আহ্লাদিত হয়ে বলে, “তারাও চেয়ারম্যান। আমি কথা বলে রাখব। পরশুদিনই আপনারা মেয়ে দেখতে যেতে পারবেন।”

“পরশুদিন কেন? কালকেই যাবো। ছেলের বয়স বাড়ছে। আর দেরি করা যাবে না।” অনিতা বলেন। ঘটক সায় দেয়, “ঠিক আছে। তবে বিয়ের সময় আমাকে টাকা পয়সা যা দেন দিয়েন। সাথে একটা ছাতা দিয়েন।”
ঘটকের এই অবদান নতুন নয়। নতুন ঘটকালি করতে গেলে ছাতা নিয়ে শুরু করে আহ্লাদ। ঘটক পান খেয়ে বিদায় হলেন। আরু পান বানাতে বসল। সবাইকে দিয়ে অপূর্বকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“অপূর্ব ভাই, পান খাবেন?” সংশয়ের বশবর্তী হয়ে বলতে বলতে নানি জানের পানের ডালা থেকে মস্ত বড়ো একটা পান নিয়ে নিল আরু। প্রয়োজনের তুলনায় অধিক জর্দা দিয়ে পান বানিয়ে মুখে দিল আরু। চম্পা তেড়ে এসে ছিনিয়ে নিলেন পানের ডানা। রাগান্বিত হয়ে বলেন, “তুই কি গরু হয়ে চাস আরু? পান খেলে পড়াশোনা হয়না।”

অপূর্ব আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে নিল আরুর। পান চিবুকে আরুকে বেশ উচ্ছ্বাসিত দেখাচ্ছে। বিদেশে অবস্থানরত সময়ে সিগারেট টেনে যতটা প্রফুল্লচিত্তে দীপ্ত থাকত অপূর্ব, ততটা। গ্ৰামে এসে হুক্কা ছাড়া কিছু ছোটে না তার। জর্দা নেশার মতো কাজ করে বলেই নারীরা একটি পানে সারাদিন অভুক্ত থাকতে প্রস্তুত। উদ্ভাসিত হয়ে শুধাল, “আরু বেশি জর্দা দিয়ে মনমাতানাে একটা পান বানিয়ে দে।”

ব্যাস, নির্বাক্যে চম্পা পানের ডালা দিয়ে দিল। আরু ঢেড় জর্দা দিয়ে পান বানাল, অপূর্ব তা গ্ৰহণ করতে নারাজ। আধ কৌটা জর্দা পানে ঢেলে মুখে দিল। উপস্থিত সবাই কিৎকর্তব্যবিমঢ়। বিলম্বে ঝালে হাঁসফাঁস করে কিঞ্চিৎ ব্যবধান করে ওষ্ঠদ্বয়। পৃথক অংশ ছেড়ে লাল রস যেন প্লাবিত হয়ে নিচে গড়িয়ে পড়ছে। অতঃপর চিৎকার করে উঠে অপূর্ব, “ঝাললললল।”

জিভ দিয়ে ঠেলে বাইরে ফেলে দিয়েছে পানের চর্বণ করা অংশ। সামান্য আগে খেজুরের রস পান করেছে, এখন যুক্ত হয়েছে পান। হঠাৎ করে অপূর্ব-র মনে হলো, পৃথিবী সূর্যকে ছেড়ে অপূর্বকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। ভ্রু স্ফুরিত করে বলে, “কী পান খাওয়াইলি মোরে? একদম নেশা ধরাইলি।”

অপূর্ব নিজেকে সামলে রাখতে ব্যর্থ হয়ে বমি করে দিল। আরু বরাবর নিচে থাকার দরুন সরাসরি আরুর দেহে পতিত হলো। আরু নাক চেপে বাজখাঁই গলায় বলে, “দিলেন তো, আমার থ্রি-পিছ নষ্ট করে। গাও ছুইয়া যায় সেই মার্কেট থেকে বাবাই আমাকে এই জামাটা এনে দিয়েছে।”

“দেবো টেনে এক চড়, তুই তো অপুকে পান সেদেছিলি। বেশ করেছে। যেই শাড়িটা এনেছিলি, ওটাই পালটে নে।” মায়ের ধমকে আরু তুবড়ে গেছে। মামির শাড়িটা নিয়ে দিঘির দিকে অগ্রসর হলো। কিয়ৎক্ষণ পর দিঘির পানিতে শব্দ হলো। আরু এই ঠান্ডাতে আবার দিঘিতে নেমেছে?

দশ মিনিটের মাথায় ফিরে এলো আরু। মাথা ঘোরার মাঝে আরুকে বেসামাল অবস্থায় দেখে অপূর্ব এবার কিছু দেখতে পারল না। সেদিনের সেই শাড়ি, সেই ভেজা কেশ। টপটপ করে ঝরছে পানি। শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে। চুপসে যাওয়া মুখটা বড্ড আকর্ষণ করছে তাকে। নিত্যদিনের খোঁপা করা ঘন কেশ খোলা। হাঁটু ছাড়িয়েছে।

আরুর ঘরে প্রবেশের পরবর্তী মুহুর্তে সিঁথি প্রবেশ করে। উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, “মিহির ভাই এসেছে আরু।”

তুবড়ে যাওয়া মুখমণ্ডল পরবর্তী মুহুর্তে প্রাণবন্ত হয়ে উঠল। কুঞ্চিত বিশিষ্ট ঠোঁট প্রশস্ত হয়ে উঠে। বলে, “সত্যি? কোথায় মিহির ভাই?”

বাক্য থামতেই মিহির প্রবেশ করল। একগাল হেসে বলে, “এখানে।”

আরু পা গতিরোধ করতে পারল না, ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল মিহিরকে। মিহিরের হাত তখন অপ্রত্যাশিত অংশে। আরুর একমাত্র ফুফুর ছেলে মিহির। বয়সটা চব্বিশ অতিক্রম করে সবে পঁচিশে পা রেখেছে। মিহির বলে, “বাড়িতে তোকে খুঁজে না পেয়ে সোজা এখানে চলে এসেছি। কেমন আছিস তুই?”

“একদম ভালো না। চকলেট এনেছ?”

মিহির একটা রেপিং করা প্যাকেট দিয়ে বলে, “ভুলে যাওয়া যায় বুঝি?” অতঃপর ডান গালে হাত রেখে ইশারায় বোঝাল কিছু। মাথা নাড়িয়ে আরু বলে, “না, আমি এখন বড় হয়ে গেছি।”

মিহিরের অভিমানী চোখে আরু দীর্ঘক্ষণ আত্মবিশ্বাসী হয়ে থাকতে‌ পারল না। পায়ের আঙুলে ভয় দিয়ে কিঞ্চিৎ উঁচু হয়ে মিহিরের ডান গালে নিঃশব্দে দুবার ওষ্ঠ স্পর্শ করে।‌ মিহির হেসে বলে, “কাঁধে উঠ, বাড়িতে নিয়ে যাই। (পারুলকে লক্ষ্য করে বলে) মামি আরুকে নিয়ে গেলাম। তোমরা গেলে তারাতাড়ি এসো। নতুবা আমি চললাম।”

কাঁধে উঠল না আরু, কোমরে উঠে কাঁধ ধরে রাখল। সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলল তারা। ঝাঁপসা নয়নে ক্রুব্ধ সংযত করে সবটা দেখে গেল অপূর্ব। অনুভব করল, তার প্রিয় কিছুতে ভাগ বসাচ্ছে অন্য কেউ। কিয়ৎক্ষণ পূর্বে বাছাই করা রাখা ফটোখানা এক লহমায় খণ্ড বিখণ্ড করে ফেলে অপূর্ব। এর শাস্তি অতিদ্রুত পাবে তুমি।
__
দুহাতে বইগুলো আঁকড়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার জন্য পা চালাচ্ছে আরু। পেছন থেকে দ্রুত গতিতে সাইকেল এসে আরুর সমুখে স্থির হয়ে গেছে। পকেট থেকে একটা সাদা চিঠি বের করে অগোচরে আরুর দিকে এগিয়ে দিল। তরুণকে দেখে লাজুক হেসে চিঠি গ্ৰহণ করল আরু। বইয়ের ভাঁজে যতন করে রেখে বলে, “আমি তো ভেবেছি, আপনি আসবেন না প্রয়াস ভাই।”

“না এসে উপায় আছে? আসতে হলো তোমার জন্য। আমার জন্য ফুফি শাশুড়ির অনেক মা/র খেয়েছ শুনলাম। নাও তোমার জন্য ঝুড়িভাজা আর কিছু জরিবুটি নিয়ে এসেছি। খেয়ে নিও। আর ধন্যবাদ।” একটা প্যাকেট বিশেষ করে আরুর জন্য এনেছে। গ্ৰহণ করতে না চাইলেও আরু গ্ৰহণ করে। পরক্ষণে সাইকেলের গতি বাড়িয়ে আরু-কে অতিক্রম করে চলে গেল প্রয়াস।

সময় চারটা বেজে দশ মিনিট। গতকাল আরু বাড়িতে ফেরে নি। মামা বাড়িতে রাত্রিযাপন করেছে। স্কুল ফ্রোকটা রেখে যাওয়ার দরুন বিশৃঙ্খলার সম্মুখীন হতে হয়নি তাকে। আজ অপূর্ব-র জন্য মেয়ে দেখতে যাবে, তাই তুর শেফালী স্কুলে আসেনি।
তালগাছ তলায় কালাচাঁন সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। যাতায়াতের সময় প্রায় আরুকে উত্যক্ত করে। আরুকে দেখে এগিয়ে এলো কয়েকপা। শ্রীহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে খপ করে আরুর হাত ধরে। গর্হিত কণ্ঠে বলে, “আরু আমি তোমার জন্য পাক্কা একঘণ্টা দশ মিনিট দাঁড়িয়ে আছি। এত দেরিতে কেন এলে? ঐ ছেলেটার কাছে থেকে চিঠি নিলে কেন?”

নিজের হাতের দিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে চেয়ে রইল আরু। এই অজপাড়া গাঁয়ে মেয়েরা শৌখিন না-হোক ফেলনা নয়।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-০৫

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৫

অপূর্ব উঠানে এসে দাড়িয়ে যায়। জাহানারা, মনি ও মল্লিকা বাড়ির উঠানে প্রখর রোদে মেলে দেওয়া ধানে বিচরণ করছে। অনিতাই শুধু রান্নার দিকটা দেখছেন। চেয়ারম্যান বাড়ির বলে কথা, উঠান আর ধান দুটোই পর্যাপ্ত রয়েছে। ছেলেমেয়ে মৃধা বাড়ি থেকে ফিরে গৃহে প্রবেশ করেছে অপূর্ব ব্যতিত। চাচিদের উঠানে দেখে সেও অগ্ৰসর গেল সেদিক। জুতা খুলে শূন্য পায়ে ধানের ভেতরে হাঁটতে লাগল। বিদেশে বসবাসরত অবস্থা ধান বইয়ের পাতায় বা ভিডিয়ো-তেই অবরুদ্ধ ছিল, এই প্রথম স্পর্শের মাধ্যমে অনুভূত হয়েছে। আহ্লাদিত হয়ে সমস্ত ধানে বিচরণ করল। জাহানারা উৎকণ্ঠার সাথে বললেন, “অপু তোকে ধান মেলতে হবে না। তুই ঘরে গিয়ে বস। ধানের আলে তোর পা চুলকাবে বাবা।”

“কিচ্ছু হবে না চাচি। তোমরা ঘরে যাও, আমি একাই সব ধান মেলবো।” উলটা তালে বলে অপূর্ব।

মল্লিকা অনেকবার প্রচেষ্টা করেও অপূর্ব-কে তার সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারল না। দিগ্‌ভ্রান্ত হয়ে অনিতাকে জানাতে গেলেন মল্লিকা। রান্না অসমাপ্ত রেখেই ছুটে‌ এলেন অনিতা। ধানের মধ্য থেকে অপূর্ব-কে টেনে এনে রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন, “চাচিরা বারণ করছে না, ধানের ভেতরে না যেতে? তাদের কথা কেন শুনছিস না তুই? সিদ্ধ ধানের আল এখনো আলগা। পা চুলকাবে।”

“চুলকাবে না।” অপূর্ব অনুরাগশূন্য হয়ে বলে। “চুলকাবে না।” কথাটা যতটা জোরের দৃঢ়তার সাথে অপূর্ব বলেছে, কাজের বেলায় ততটা দৃঢ় থাকল না। বিকেলেই পা মৃদু ফুলে উঠল। চুলকানি কমছে না, বৈ বাড়ছে। অপূর্ব-র চিৎকারে আহসান বাড়ি মাথায় তুলে ফেলেছে। মোতাহার আহসান নিরুপায় হয়ে ডাক্তার, বৈদ্য, কবিরাজ ডাক পাঠালেন। বৈদ্য জরিবুটি দিয়ে গেছে, অপূর্ব তা পায়ে লাগাতে নারাজ। বালতি ভর্তি পানিতে পা ভিজিয়ে বসে আছে সে, অথচ গ্ৰামের এই তীব্র ঠান্ডা থেকে বাঁচতে পরিধান করেছে উষ্ণ করার পোশাক।

অন্যদিকে ছাগলের জন্য ঘাস কে/টে স্তূপ করেছে আরু। খোপরে হাঁস মুরগি, গোয়ালে ছাগল রেখেছে। গাছ থেকে টাটকা খেজুরের রস নামিয়ে মায়ের জোরাজুরিতে আহসান বাড়িতে এসেছে আরু ও অয়ন। ভাইবোনেরা টিভিতে ‘হাতিম’ দেখছে। আজ শুক্রবার বলেই হাতিম চলছে বিটিভিতে। সপ্তাহে মাত্র একদিন। আরু এসে তুরের পাশে বসে হাতিম দেখায় মন দিয়েছে। পারুল অপূর্ব অবস্থা জিজ্ঞেস করলে অনিতা ঠাট্টা করে বললেন সব। আরু অট্টহাসি দিয়ে বলে, “এই সামান্য কারণে এই অবস্থা। মায়ের মা/রে/র ভয়ে আমি কত শিম ক্ষেতে লুকিয়ে ছিলাম। রাতে মা খুঁজে যখন বলত, ‘আয় আরু মা/র/ব না।’ তখনই বের হতাম। উষ্ণ পানিতে গোসল করে সরিষার তেল দিতেই সব জ্বালা খতম।”

“ফুফি তোকে যা মা/রে তুই শিম ক্ষেতেই তো লুকাবি। তাছাড়া তোর হচ্ছে গন্ডারের চামড়া। শুধু শিম পাতার সাথে শরীর ঘেঁষা কেন, শিম পাতা যদি ঘঁষে ঘঁষে তোর শরীরে লাগাই। তবেও কিছু হবেনা।”

“আপনার মতো বিড়ালের চামড়া তো নয়। সবাই বলে মাঘের শীত বাঘের গায়ে। এখন দেখি তার ছোট ভাই বিড়ালের গায়ে। আমার শরীর যদি আপনার মতো হতো, তাহলে খেজুর গাছ থেকে রস নামাতে পারতাম না। স্কুল থেকে ফিরে মাঠে সারাদিন কাজ করতে পারতাম না। আপনি যাই বলুন, সবাই বলে নারীরা ননীর পুতুল। এখন দেখছি পুরুষেরাও ননীর পুতুল।”

“গাছে ধান না হয়ে, চাল হলে ভালো হতো। তাহলে অন্তত আমার এই অবস্থা হতো না।” অপূর্ব-র কণ্ঠে স্পষ্ট অভিযোগ ছিল।

“ঘোড়া এনে নিজেকে তো বহুত রাজকুমার পৃথ্বীরাজ মনে করেন। কোনো এক রাজার কারণেই চাল থেকে ধান হয়েছে।” আরুর ফিরতি তিসস্কারে অপূর্ব-র আসর জমে উঠল। উদ্দীপিত হয়ে বলে, “কীভাবে?”

“আমার দাদিজান বলেছে, এক রাজা অন্য রাজ্যে থেকে পেট পুড়ে ভোজন খেয়ে বাড়ি ফেরার পথে ধান গাছ দেখেন। ঘোড়া থেকে নেমে ধান গাছ থেকে কয়েকটা ধান ছিঁড়ে মুখে দেয়। সেই দুঃখে ধান আল্লাহর কাছে আবেদন করে, তার উপরে সাত প্রলেপ দেওয়া হোক। যাতে কেউ অপ্রয়োজনে খেতে না পারে। অবশ্য আমি ধানের তুস/চিড়ে খুলে কত খাই। হি! হি! হি!” বলে মনমাতানো হাসি উপহার দেয় আরু

ভেংচি দিয়ে বলেই আরু রান্নাঘরের দিকে অগ্রসর হলো। ভরা কলসির পানি পাতিলে নিয়ে আগুন ধরালো উনুনে। পানি ফুটন্ত গরমে টগবগ করে উঠতেই পাতা দেওয়ার সমাপ্তি ঘটালো আরু। অতঃপর লুচমি দিয়ে উত্তপ্ত পাতিল নিয়ে অপূর্ব ভিজিয়ে রাখা ঠান্ডা পানির বালতি ঢেলে দিল। অপূর্ব চমকিত হয়ে পা সরানো প্রয়াস করতেই
দ্বিধান্বিত হয়ে উঠল আরু। পাতিল ফেলে অপূর্ব-র পা-জোড়া উষ্ণ পানিতে চেপে ধরে রাখল। অধৈর্য হয়ে অপূর্ব চড়া গলায় বলে, “আরু পা ছাড় বলছি। দ্রুত পা ছাড়।”

“আপনার কী মনে হয় অপূর্ব ভাই, আমি পা ছাড়ব? আপনি পুরুষ মানুষ, আপনার শরীরে নিশ্চয়ই আমার থেকে বেশি শক্তি। পারলে আরুর থেকে ছাড়িয়ে নিন।” বলতে বলতে আরু লুফা দিয়ে অপূর্ব পা ঘষে ঘষে পরিষ্কার করতে পারল। অপূর্ব হাজার চেয়েও আরুর হাত থেকে নিজের ব্যথায় আক্রান্ত পা সরাতে পারল না। দাঁত খিঁচে আরুর নি/র্যা/ত/ন সহ্য করছে। উপস্থিত সবাই মিটমিট করে হেসে চলেছে। অনিতা জরিবুটি নিয়ে এসে বলে, “আরু এটাও একটু দিয়ে দে।”

অপূর্ব-র প্রথমে ভালো না লাগলেও পরে লাগে। ঠান্ডা হ্রাস পাচ্ছে যে। হাতের কাজ শেষ করে খেজুরের রস গ্লাসে ঢেলে নিয়ে এলো আরু। অপূর্ব-র দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, “এটা খেলে ঠান্ডা কমে যাবে। খেয়ে নিন।”

“বাঁশ-বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই,
মাগো আমার শোলক্-বলা তিস্তা দিদি কই?”

পূর্ণিমার থালার মতো চাঁদের আড়াল থেকে বাঁচতে তিস্তা ও সুজন বাঁশঝাড়ের সাহায্য নিয়েছে। বাঁশের সাথে হেলান দিয়ে বুকে হাত গুজে মাটির দিকে চেয়ে আছে তিস্তা। সুজন অনবরত তিস্তার অভিমান ভাঙানোর চেষ্টা করছে। কানে হাত দিয়ে বলে, “তিস্তা আপনি কিন্তু অহেতুক রাগ করে আছেন। আপনি ভালোভাবেই জানেন, আমার বাবা নেই। আমি ছাড়া মায়ের কেউ নেই। আমাকে যেতেই হতো।”

তিস্তার নয়ন অশ্রুতে পরিপূর্ণ হলো। কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, “আপনি সবসময় এমন করেন। আমি কি একবারও বলেছি, আপনার মায়ের কাছে যাবেন না‌? আপনি কেন‌ আমাকে বলে গেলেন না। জানেন, আপনার জন্য কত অপেক্ষা করেছি। সারাদিন পর রাতে জানি, আপনি বাড়িতে গেছেন।”

“এটা নতুন কী, প্রতি বৃহস্পতিবার আমি বাড়িতে যাই শুক্রবার সন্ধ্যায় ফিরে আসি। গতকাল যাওয়ার সময় আপনাকে দেখিনি, তাই বলে যেতে পারিনি। স্যরি।” বলেই তিস্তায় হাত ধরল সুজন। অভিমানে হাত ছাড়িয়ে নিল তিস্তা। সুজন স্থির থাকল না, এলোমেলো চুলগুলো কানের পেছনে গুজে দিয়ে ফিসফিস করে বলে, “আমার ব্যক্তিগত নদী তিস্তা। তুমি সেই তিস্তা নদী, এই সুজন মাঝি যেখানে রোজ-রোজ নৌকা ভাসায়।”

তিস্তা মৃদু হাসল। হাতের ভাঁজে লুকিয়ে রাখা চিঠিটা অতি সাবধানে সুজনের হাতে গুঁজে দিয়ে ছুটল।
আরু বালতির পানি ফেলে দিতে এসেছে। ভরা বালতি সমেত দাঁড়িয়ে লজিং মাস্টার সুজন ও তিস্তার কথা শুনেছে। তিস্তা কাছাকাছি আসতেই পানিগুলো ফেলে দিল। খানিক চমকিত হয়ে তিস্তা তাকিয়ে বলে, “ওদিকে ফেলতে পারলি না, একটু‌ হলেই তো ভিজে যেতাম।”

“তুমি তো বাঁশ বাগানে ছিলে। এমনভাবে দৌড়ে চলে আসলে ভাবলাম, সাম্পান ওয়ালা তোমাকে লড়ানি দিয়েছে।” আরু দুষ্টুমি করে বলে। ব্রীড়ানত হয়ে তিস্তা বলে, “আরু তুই কিন্তু কাউকে কিছু বলবি না।”

“তা বলব না, কিন্তু এত সহজে তোমার মেনে নেওয়া উচিত হয়নি। ছেলেদের একটু নাকে দড়ি দিয়ে ঘুড়াতে হয়, জানো না বুঝি? নাহলে আবার সুযোগ পেয়ে মাথায় উঠে বাঁদরের মতো নাচবে।” ভাব নিয়ে বলে আরু। তিস্তা গাল টেনে চলে যেতে যেতে বলে, “পাকা বুড়ি একটা।”

তিস্তাকে একটু খেপাতে আরু বলে,
“ওরে সাম্পান ওয়ালা তুই আমারে করলি দিওয়ানা।
তুই আমারে, তুই আমারে
করলি দিওয়ানা-রে, সাম্পানওয়ালা।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-০৪

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৪

বাসনা মিটিয়ে আরুকে মা/র/তে ব্যস্ত পারুল। দু-হাত দু-পা মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধা। ক্রন্দনরত অবস্থায় হাতজোড় করছে আরু। পারুল সেদিকে ভ্রুকুঞ্চন করে তাকাচ্ছে অবধি না। ঈষৎ উষ্ণ অথচ নেভানো চলা কাঠ দিয়ে পে/টা/চ্ছে। সাদা বেনামের চিঠিটা ছুড়ে দিয়ে রূঢ় কণ্ঠে বলে, “সত্যি করে বল ছেলেটা কে? কে তোকে এই চিঠি দিয়েছে? কার সাথে প্রেম চলছে তোর? তোকে স্কুলে পাঠাই এইসব করতে? আজ থেকে তোর স্কুলে যাওয়া বন্ধ। তোর বাবা ফিরুক। ওকে জানাতে হবে, তার মেয়ে এখন প্রেম পিরিতি শিখে গেছে। বিয়ে দিতে হবে।”

“বিশ্বাস করো মা, আমি কোনো ছেলের সাথে কথা বলিনা। তুমি বাবাইকে কিচ্ছু বলো না।” ক্রন্দনধ্বনি শোনা যাচ্ছে কথা বলার সময়।

আরুর ছোট ও একমাত্র ভাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আনন্দোচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে। বোনকে বিন্দুমাত্র সহ্য করতে পারে না ও। আরুকে হেয় করে বলে, “বুবু আমি নিজে তোর বই থেকে এই কাগজটা পেয়েছি। আমি পড়তে না পারলেও পা ঠিকই পড়তে পারে। তুই মাকে সত্যিটা বলে দে।”

আরু চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই অয়ন কেঁদে ফেলে, “দেখো মা, বুবু আবার আমাকে চোখ গরম দেখাচ্ছে।”

“অন্যায় করেছি আবার আমার ছেলেকে চোখ রাঙাচ্ছিস। তোকে তো..!” বাক্য শেষ করে আরো কয়েক ঘা দিলেন। অতঃপর ছুড়ে ফেলে দিয়ে ঘরে চলে গেলেন। শীতের দুপুরের প্রখর রোদে আরু হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে রইল।
ফুফুর সাথে দেখা করতে অপূর্ব এসেছে মৃধা বাড়িতে।

উঠোন পেরিয়ে গৃহ প্রবেশ করার পূর্বে শ্রবণ হলো হৃদয়ঙ্গম করা নূপুরের ঝুনঝুন শব্দ। অপূর্ব অভিমুখে তাকাতেই মায়ের লাল শাড়ি পরা একটি মেয়েকে দেখতে পেল। চট করে চিনে ফেলল অপূর্ব। দ্রুতগতির ছুটে গেল আরুর আছে। মাটি থেকে তুলে উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে আরু, এভাবে মাটিতে শুয়ে আছিস কেন?”

গলায় কথা দলা পাকিয়ে রয়েছে। হেঁচকি তুলতে তুলতে অপূর্ব-র বুকে মাথা রেখে নিঃশব্দে কেঁদে চলেছে আরু। অপূর্ব মাথায় হাত বুলিয়ে আশ্বাস দিয়ে বলে, “কি হয়েছে আরুপাখি, কাঁদছিস কেন?”

ততক্ষণে উপস্থিত তিয়াস, শেফালী, তুর ও তিস্তা। তিস্তা এগিয়ে গিয়ে বলে, “কী হয়েছে আরু, তোকে হাত পা বেঁধে রেখেছে কে?”

বলতে বলতে বাঁধন খুলে দিল তিস্তা। প্রখর রোদে ফর্সা ধবধবে আরুর শরীর লালচে হয়ে গেছে। আচ্ছা আরুর কি এনিমিয়া আছে? এনিমিয়া ছাড়া এতটা ফর্সা গ্ৰামের মেয়ে, আদৌ সম্ভব! আরুকে জিজ্ঞেস করার স্পৃহা জন্মালো অপূর্ব-র। প্রশ্ন করাটা কি ঠিক হবে? কিছুটা ‘কাই মিল-গায়া’ সিনেমার পরিচালক-কে সাংবাদিকের করা প্রশ্নের মতো মনে হবে। সিনেমা সংক্রান্ত প্রশ্ন না-করে তিনি বোধহয় করেছিল, ‘আপনার ছেলে আপনার মতো টাক হলে কী করবেন।’ তেমন!

পারুল ঘরে থেকে বেরিয়ে এলো। দূর থেকে চিৎকার করে বলে উঠে, “খবরদার ওকে ধরবি না, ওর বাবা এসে ধরবে।”
আরু তখনও অপূর্বর বুকে মাথা রেখে আছে। দ্রুত সে আরুকে কোলে নিয়ে ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে, “নিজের মেয়েকে কেউ এভাবে মা/রে ফুফি। তোমার সাথে দেখা করতে এসে, যা দেখলাম।”

মেয়ের যাতনায় এতক্ষণ বোধহীন ছিলেন পারুল। অপূর্বকে দেখে কিছুটা প্রশান্তি পেলেন। বিলম্বে তার নিষ্ঠুর ভাব গুছিয়ে অনুদ্ধত ভাব প্রকাশ পেল। হাসি মুখে বলে, “অপু তুই, কেমন আছিস বাবা?”

পারুলকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করে অপূর্ব। বেতের সোফায় আরু-কে বসিয়ে তিস্তাকে আদেশ দিল, “দ্রুত যা, এক গ্লাস পানি নিয়ে আয়। (তুরকে বলে) তাড়াতাড়ি ফ্যানটা চালু কর।”

সৌরবিদ্যুচ্চালিত পাখা ঘূর্ণ্যমান হতে যতটুকু সময় লাগে অপূর্ব সেই সামান্য সময় টুকুও অপেক্ষা করল না, টিনের বেড়ার ফাঁকে গেঁথে রাখা হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করতে শুরু করল। অতঃপর কিছুটা তাচ্ছিল্য করে বলে, “নানিকে কখনো তোমার শরীরে হাত তুলতে দেয়নি বাবা। আর তুমি কি-না তার বোন হয়ে নিজের মেয়েকে উঠানে বেঁধে রেখে এভাবে মা/র/০ছ ফুফি। তোমার কাছ থেকে এটা আশা করিনি।”

পারুল বিপরীত সুরে বলে, “তুই জানিস না কী হয়েছে, আরুর বইয়ের মাঝে আমি চিঠি পেয়েছি। এই যেই-সেই চিঠি না, প্রেম পত্র।”

“তো? তাই বলে মেয়েকে মা/র/বে। এমনও তো হতে পারে, ছেলেটা আরুকে পছন্দ করে। কিন্তু আরু করে না। তাই লুকিয়ে বইয়ের ভাঁজে দিয়েছে। তাছাড়াও এটা বয়ঃসন্ধি কাল ফুফু। এই সময়ে মেয়েরা একটু বেপরোয়া হয়ে ওঠে। আরু যদি প্রেম করত তুমি ওকে বুঝিয়ে বলতে। ও যদি এখন আরেকটু বেপরোয়া হয়ে সেই ছেলেটার সাথে পালিয়ে যায়। তখন কি হবে? সবাই বলবে, মৃধা বাড়ির মেয়ে বা চেয়ারম্যানের ভাগ্নি পালিয়েছে গেছে। তখন শুনতে ভালো লাগবে।”

“ও এমন করবে না।” নতজানু হয়ে বলে পারুল।

“এত বিশ্বাস যখন, তখন আরেকটু বিশ্বাস রাখলে কম পড়তো না। তোমার মা বিশ্বাস বাড়ির মেয়ে কিন্তু, অথচ তার মেয়ের বিশ্বাস নেই।” শেষ বাক্যটা বলতে গিয়ে অপূর্ব একটু হাসল। পারুলের হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে অদেখায় নিজের জিন্স পকেটে রেখে দিল।

“আমার ভুল হয়েছে, আর এমন করব না। বস তোরা। প্রথমবার এলি। দেখি কী আছে?” বলেই পারুল তাকের উপর থেকে টিনের জাড় উবুড় করে খই বের করলেন। অতঃপর রান্নাঘরে গেলেন। ধানের ভেতরে সিদ্ধ দিয়ে আমাবলি পিঠা বানিয়েছেন। ট্রে-তে এনে পরিবেশন করলেন তা। আরু তখনও মায়ের ভয়ে জড়সড়ো হয়ে বসে আছে। অপূর্ব একটা পিঠা আরুর হাতে দিয়ে ভাইবোনদের সাথে তৃপ্তি সহকারে খাচ্ছে। আশেপাশে তাকিয়ে বলে, “অয়ন কোথায় ফুফি।”

“খেলতে গেছে।”

মৃধা বাড়ি ফাঁকা। পারুল ব্যতিত সবাই দাওয়াত খেতে গেছে। রাতে ফিরে আসবে, তখন নিজের বাড়িতে যাবে পারুল।
গতকালের সিদ্ধ করা ধান আজ রোদ্দুরে মেলে দিয়েছে পারুল। কাক এসে বসতেই পারুল বলে, “আরু দাঁড়িয়ে না থেকে, ধানে নাড়া দে।”

জড়সড়ো আরু যেন মুক্ত পাখির ন্যায় ছুটে‌ গেল, বিচরণ করল ধানের মাঝে। ছুটে চলার সময় নির্গত হওয়া নূপুরের ঝুনঝুন শব্দে অপূর্ব অস্থির হয়ে উঠে। সৌজন্য হেসে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “আমরা আসি। তোমরা তাড়াতাড়ি এসো।”

“আচ্ছা। বিকেলে খেজুরের রস পাড়িয়ে, নিয়ে যাবো।” পারুল বলে। অপূর্ব তিয়াস, তুর, শেফালী ও তিস্তা চলল বাড়ির পথে। ধান মেলার কাজের ইতি করে ,চাল ধুয়ে পুকুর পাড়ে উঠে আরু। অন্তঃকরণে কিছু একটা হানা দিতেই পাতিলটা মাটির উনুনের উপর রেখে দৌড় লাগালো ওদের গমন পথের দিকে।

পায়ে শব্দ শুনে দাঁড়াল সবাই। আরু অতি গোপনে তুরের হাত ধরে কানে-কানে ফিসফিসিয়ে বলে, “প্রয়াস ভাইয়ের চিঠিটা অপূর্ব ভাইয়ের পকেটে। আর হ্যাঁ তোর জন্য মায়ের চলা কাঠের মা/র খেয়েছি। প্রয়াস ভাইকে বলে চানামুঠ খাওয়াস।”

“হু।” বিনা স্বরে।

“অপূর্ব ‘মেহেরজান’ সিনেমার ক্যাসেড আনতে দিয়েছে। সবাই একসাথে দেখব, চল।” তিস্তা উৎফুল্লতার সাথে বলে।

“না, আমি সিনেমা হলে চার চারবার দেখেছি। তোমরা দেখো। মিঠু ও ‘ওর’ মাকে খড় থেকে ছাড়িয়ে এনেছি ঠিকই কিন্তু ঘাস খেতে দেওয়া হয়নি। ওদের জন্য ঘাস কা/ট/তে যেতে হবে। আমি গেলাম।” আরু আর ফিরে চাইল না। একই গতিতে নূপুরের ছন্দ তুলে এগিয়ে গেছে। অপূর্ব ব্যতিত সবাই গতিশীল হয়েছে। তার কানে এখনো আরুর নূপুরের‌ সেই ঝুনঝুন শব্দ বেজে চলেছে।
চলবে.. ইন শা আল্লাহ

নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-০৩

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৩

“অপূর্ব ভাই, বিদেশে এতকিছু থাকতে শুধু এই বালু ঘড়িটা কেন এনেছেন। আমার হাতঘড়ি আছে, এটা লাগবে না।” বলে আরু থামতে না থামতেই ধরাম করে চড় বসিয়ে দিল আরুর গালে। সেকেন্ড খানেকের জন্য স্থির হয়ে গেল সময়। ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠে অপূর্ব, “বালু ঘড়ি দেখে নেবে না, কী সাদ। এটা বিজ্ঞানের আবিষ্কার। এর মূল্য জানিস তুই? উপরের ফ্যানেলে যে মিহি বালুগুলো দেখতে পাচ্ছিস, এগুলো নিচের ফ্যানেলে ভর্তি হবে। তারপরে এই দাগগুলো দিয়ে সময় পরিমাণ করা হবে। আমাকে এটা আমার স্যার দিয়েছিলেন।”

অপূর্ব-র কথা আরুর এক কান দিয়ে প্রবেশ করে‌ অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। গালে হাত দিয়ে ক্রন্দনোন্মুখ দৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে আরু। চঞ্চল হলেও প্রায় অয়নের কারণে চ/ড় থা/প্প/ড় জোটে আরুর গালে। ‘আর এক মুহূর্তও আরু এখানে থাকবে না, এই মাঝরাতে সে নদী সাঁতরে বাড়িতে চলে যাবে’ – এটা ভালোভাবে জানে সবাই। অনিতা আরুর হাত ধরে বলে, “তাল না তোর খুব প্রিয়? সকালে গাছ থেকে দুটো তাল পড়েছে। কাল সকাল সকাল তালরুটি করে দিবো।”

“অপূর্ব-র টাইসনকে তো দেখলি না। চল, তোকে টাইসনকে দেখাচ্ছি।” জাহানারা আরুকে ক্ষান্ত করতে বলে।

“টাইসন কে?” প্রশ্নসূচক দৃষ্টি।

“অপূর্ব-র ঘোড়া।” অনুদ্ধত কণ্ঠে বলে আরুর অন্যহাত ধরে নানি জান চম্পা।

হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়াল আরু। এক মুহুর্ত না নিয়ে গম্ভীর গলায় বলে, “আমি এই বাড়িতে আর থাকব না। কখনো আসব না। মা যখন আসবে, তখন শাড়িটা নিয়ে আসবে।”

“রাগ করে না মা। ‘অবদার’ ওখানে ভুত থাকে, তুই গেলেই ঘাড় মটকে দিবে আরু।” অনিতা অনেকবার প্রচেষ্টা করেও আরুর মনে ভয় ঢুকাতে পারলেন না ঠিকই কিন্তু অপূর্ব ভয়ে কাঁপছে। অনিতা বিতৃষ্ণা নিয়ে বলেন, “দিলি তো মেয়েটাকে ভয় দেখিয়ে। এই রাতে আরু খাল সাঁতরে গেলে আপা কী মনে করবে?”

“তুমি আমাকে যে ভয় দেখিয়েছ, বাইরে তাকাতেই আমার ভয় করছে। আবার আরু খাল সাঁতরে যাবে। অসম্ভব।” অপূর্ব বলে।

তিয়াস অপূর্ব-র কাঁধে হাত রেখে হেলান দিয়ে বলে, “আরু কিন্তু আপনার মতো ভিতু নয়। ওকে দেখতে যতটা ভোলাভালা, ও ততটাই চঞ্চল। আপনাকে এক হাঁটে বিক্রি করে অন্য হাঁটে কিনে নিয়ে আসবে।”

অপূর্ব বাইরের দিকে পা ফেলতে চেয়েও ক্ষণে ক্ষণে পিছপা হটছে। আরু ফিরত এলো। চঞ্চল পায়ে শুকাতে দেওয়া ফ্রোকটা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার প্রয়াস করতেই অপূর্ব টেনে ধরল আরুর বাহু। ব্যবহৃত মুঠোফোনের বাটন চেপে কল করে ফুফির ফোনে। অতঃপর বিনীত সুরে সালাম বিনিময় করে শুধাল, “ফুফি, আমার জন্য এত পিঠা পাঠালে যে, ভাগেই পেলাম না।”

বহমান তেজটুকু অবিলম্বে নিস্তেজ হয়ে করুন চোখে অপূর্ব-র দিকে তাকাল আরু। ‘ঝুন-ঝুন-ঝুন’ শব্দ তুলে অপূর্ব-র মুখ চেপে কথা বলার স্বর বন্ধ করে দিল। ফোন সরিয়ে হাতটা নামিয়ে অপূর্ব বলে, “চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়, কাল সকালে সবাই একসাথে যাবো। আমার কথার অন্যথা হলে ফুফিকে বলে দিব, তুই পিঠা ইচ্ছাকৃত ভাবে ফেলে দিয়েছিস।”

আরু জবাব না দিয়ে শিথিলভাবে ডায়ে-বায়ে মাথা নেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। মাকে সে প্রচণ্ড ভয় পায়।

_
চারপাশে ঘন কুয়াশাতে দূরের বস্তু ঝাপসাও দেখা বিরল। মোরগ ‘সকাল’ চিনতে ভুল করল না। ডেকে উঠল। আরু বিছানা ছেড়ে উঠল। প্রতিদিন সকালে ময়না আরুর ঘুম ভাঙায়, অতঃপর মিঠুকে নিয়ে যায় ক্ষেতে ঘাস খাওয়াতে। আজ ভিন্ন!

আহসান বাড়ির সামনে বড় একটা নিমগাছ। আরু বের হয়ে সর্বপ্রথম গাছের ডাল ভেঙে দাঁত মাজতে মাজতে দিঘির দিকে অগ্ৰসর হলো। সারিবদ্ধ নারিকেল গাছের গোড়ায় আসনের ভঙ্গিতে কিন্তু পায়ের টাকনু উপরে তুলে অপূর্ব চোখ বন্ধ করে আছে। বৃদ্ধা ও মধ্যমা আঙুল হাঁটুর উপরে। ধ্যানে মগ্ন সে। এই সকালে অপূর্বকে দিঘির পাড়ে দেখে আরু ছুটে গেল কাছে। ‘নূপুরের ঝুনঝুন শব্দ’ অপূর্ব-র ধ্যানে বিঘ্ন ঘটিয়েছে বহু আগে। ‘অপূর্ব ভাই, অপূর্ব ভাই’ বলেও যখন পল্লব মেলাতে পারল না, তখন ধাক্কা দিল কাঁধে। অবিলম্বে তাকালো অপূর্ব। রক্তিম চোখজোড়া উদাসীন হয়ে আছে। কিছুক্ষণ লাগল নিজেকে শান্ত করতে, অতঃপর বাজখাঁই গলায় চ্যাঁচিয়ে বলে, “একটা চড়ে সবগুলো দাঁত খুলে ফেলব, ধ্যান ভাঙালি কেন?”

আরু ভীত হলো। কাঁপতে কাঁপতে বলে, “আপনি ধ্যান করছিলেন? এভাবে ধ্যান করে বুঝি?”

“কেন নাম শুনিস নি, না-কি দেখিস নি। আমি মনোচিকিৎসক আর একজন মনোচিকিৎসকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে, মনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া। তাই আমি প্রতিদিন ১৫ মিনিট ধ্যান মগ্ন থেকে মনকে প্রশিক্ষণ দেই। তাছাড়া আমাদের নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি প্রায়ই হেরা গুহায় ধ্যান মগ্ন থাকতেন।” অপূর্ব-র কথা আরু বুঝেছে। তাকে যতই জোর করা হোক না কেন সে ধ্যান করবে না। অবশ্য এতক্ষণ আরুকে নিশ্চুপ হয়ে একস্থানে বসে থাকতে দেখা যাবে না।

অপূর্ব টাওয়াল নিয়ে অগ্ৰসর হলো বাড়ির দিকে। আরু কি তবে একা দাঁড়িয়ে থাকবে? সে অগ্রসর হলো দিঘির দিকে। গ্ৰামের শীতকাল শহরের মতো নয়। সেখানে বাংলার মতো এত গাছ নেই, হাঁটতে বাঁধা দিতে রাতে কুয়াশা ঘাসের উপর পড়েনা।

ঘাসের উপর পা রাখতেই পিছলে গেল অপূর্ব-র পা। তড়িগড়ি করে নিজেকে সামলে উঠতে চলমান আরুর বাহু ধরল। আরু নিজেও স্থির থাকল না। অপূর্ব-র কাঁধ আঁকড়ে ধরল। চোখাচোখি হলো দু’জনার। চঞ্চল আরু এক নিমিষে স্থির হয়ে মিরে গেল।

দুজনে গিয়ে বসল মাটির চুলার কাছে। অনিতা মাটির এক চুলায় চিতই পিঠা বানাচ্ছে অন্য চুলায় চা বসিয়েছে। অপূর্ব আসতেই ছোট মামি মল্লিকা কাপ নিয়ে এলেন। ঝাঁকুনি দিয়ে পাতা আলাদা করে সবাইকে রঙ চা পরিবেশন করলেন। অপূর্বকে দিতে গিয়ে সংশয় নিয়ে বললেন, “অপূর্ব তুই কি চা খাবি, না-কি কালকের মতো কফি খাবি?”

“চা খাবো। এখন থেকে যখন গ্ৰামেই থাকব, তাহলে তোমাদের মতোই অভ্যাস করতে হবে।”

রাখাল চাচা দুধ নিয়ে হাজির হলেন। জাহানারা দুধ উনুনে রেখে তাকেও এক কাপ চা দিলেন। অতঃপর দুধ গরম করে আরুকে এক গ্লাস গরম দুধ খেতে দিল। উপস্থিত সবার হাতে চা, একমাত্র আরু ব্যতিত। সংশয় নিয়ে অপূর্ব বলে, “ওকে কেন দুধ খেতে দিলে মা?”

“আরু চা খায় না। আসলে পারুল খেতে দেয় না। আমি চা খেতে দিয়েছি শুনলে ও রাগ করবে।”

“কেন রাগ করবে?”

“কারণ পারুল মনে করে আরু চা খেলে ও কালো হয়ে যাবে। তাই খেতে দেয় না। ফর্সা রাখতে প্রতিদিন ওকে আর অয়নকে দুধ খেতে দেয়।”

অপূর্ব কাপে চুমুক দিয়েও খেল না। ওষ্ঠের সাথে ঠেস দিয়ে কাপ রেখে আরুর দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা শুধু ফর্সাই নয়, ঢের ফর্সা। গ্ৰামের মেয়েদের এত ফর্সা মানায় না, তারা থাকবে কালো বা শ্যামবর্ণের। প্রকৃতি উপভোগ করতে করতে সূর্যের তাপে তাদের গায়ের রঙ ফর্সা থাকবে না-মানে থাকবে না।

আরুর চুমুক দেওয়া দুধের গ্লাসটা টেনে নিল অপূর্ব। ছিটকে পড়ল দেহে। ফাঁকা হাতে নিজের চায়ের কাপটা দিয়ে ক্ষান্ত কণ্ঠে বলে, “নে, চা খা।”

“না, আমি চা খাবো না। মা বকবে।” ভীত কণ্ঠে বলে।

“আমি খেতে বলেছি।” দৃঢ় কণ্ঠে বলে অপূর্ব।

“কী করছিস অপু। জোর করিস না। তাহলে মেয়েটা আর আসবে না।”

“হ্যাঁ ভাইয়া, এমনিতেই রাজহাঁসের ভয়ে মেয়েটা আসেনা।” তিয়াস বলে।

“তিনটা হাঁস যে একসাথে পোষে, তার বেলায়? তিয়াস সমান তিন হাঁস।” আরু স্বশব্দে বলতে পারল না, কারণ সেই ছেলেটা তার জন্য অপূর্বকে বোঝাচ্ছে। অপূর্ব যখন আরুকে আরেকটু জোর করার প্রয়াস করল তখনই ছুটে এলো আরুর বড়ো চাচার মেয়ে সিঁথি, “আরু তোর মিঠুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে জেনেছি মিন্টু চাচার কলাবাগানে ঢুকেছিল বলে সে খড়ে পাঠিয়ে দিয়েছে।”

আরু থেমে রইল না। চায়ের কাপটা ফেলে রেখে ছুটল অজানায়।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]