Thursday, August 14, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 227



নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-১৮+১৯

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৮

করই গাছের মগডালে আরুকে হাঁটতে দেখা গেল। অথচ একজন মানুষ সেই ডালে পা রাখা মানেই ভেঙে পড়া ডালটা। অপূর্ব সহ বাকিরা আরুকে দেখে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কীভাবে ফিরিয়ে আনবে তাকে? তথাপি অপূর্ব প্রয়াস করল, “আরু, এদিকে তাকা। শুনছিস?”

আরু ব্যস্ত কোনো অদৃশ্য ব্যক্তির সাথে কথোপকথনে, তাই শুনল না অপূর্ব ডাক। দিশেহারা হয়ে অপূর্ব গাছে উঠার জন্য পা এগোতেই মোতাহার আহসান বলেন, “উপরে বৈদ্যুতিক তার দেখছ-না? আরু কোনো মানুষের সংস্পর্শে গেলে তার শরীরে ওজন চলে আসবে। তখন ঐ মগডাল ভেঙে নিচে পড়বে এবং তারের সাথে বাঁধবে।”

মাথায় হাত রেখে আরুর ফেরার অপেক্ষায় রাস্তার কিনারায় বসে রইল অপূর্ব। দীর্ঘক্ষণ সেই ধৈর্য ধারণ করতে না পেরে গাছের উঠার প্রস্তুতি নিল। করই গাছের মগডালে মেহগনি গাছের ডালপালা এসে ভিড় করেছে। মেহগনি গাছের ডালপাতা যথেষ্ট শক্তপোক্ত। তাছাড়া বিদ্যুতিক তার আরুর সামনে অপূর্ব পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রাখলে শখ খাওয়ার কোনো সম্ভবনা নেই। বিদ্যুৎ অফিসে ফোন করে বিদ্যুৎ প্রবাহ অবরোধ করার মতো সময় অপূর্ব নেই।

সকলের বাধা উপেক্ষা করে অপূর্ব ধাপে ধাপে উঠে আরুর কাছাকাছি গেল। চোখ তুলে আরুর দিকে এক নজর তাকাতেই তার দেহটা কাঁপুনি দিয়ে উঠল। মুখশ্রীর সেই প্রাণোচ্ছল ভাবটা নেই, চুলগুলো এলোমেলো হয়ে হয়তো জট পাকিয়ে গেছে, শাড়িটা নোংরা হয়ে আছে। তবুও অপূর্ব-র প্রাণ জুড়িয়ে গেল। মগডালে এক হাঁটু তুলে কথা বলছিল আরু। অপূর্ব সন্তর্পনে তার বামহাতটা গলিয়ে দিল আরুর ফর্সা উদরে। দৃঢ় করে জড়িয়ে ধরতেই আরুর ওষ্ঠদ্বয়ে অবরোধ ঘটল। পল্লব বন্ধ হয়ে হেলে পড়তেই অপূর্ব আরুকে আগলে নিল হৃদমাঝারে। চকিতে ডালটা ভেঙে নিচে পড়ল। আরুর সম্পূর্ণ ভর তখন বহন করছে অপূর্ব। ডালটা চেপে ধীরে ধীরে কয়েকটা ফেলতেই অপূর্ব হেলে পড়ল। ঝুলন্ত দুইজন মানুষ রইল গাছের ডালে। মোতাহার আহসান অধৈর্য হয়ে উঠলেন। অবশ্য ঐদিকটায় বৈদ্যুতিক তার নেই। তিনি প্রহরীদের আদেশ করলেন, “তোরা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কী করছিস, ওদের নামানোর ব্যবস্থা কর।”

প্রহরী দড়ি নিয়ে গাছে উঠল। অপূর্ব-র অবস্থানের ঠিক আগে দড়িটা বেঁধে শক্তপোক্ত গিট দিয়ে নেমে গেল। অপূর্ব হাত ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম তবুও আরুর জন্য সে সর্বোচ্চ যাতনা সহ্য করতে প্রস্তুত। আরু তার কাঁধে মুখ গুঁজে রয়েছে। দড়িটা ধরে ধীরে ধীরে নামল অপূর্ব। আরুকে মাটিতে শুইয়ে রেখে পাশে শুয়ে পড়ল সে। ঘনঘন শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ে কাত হয়ে আরুর দিকে তাকিয়ে রইল। কাঁপা কাঁপা হাতে আরুর মুখমণ্ডল স্পর্শ করে অনুভূতি পূর্ণ হয় অপূর্ব। তার চোখের পানিটা টুপ করে আরুর চোখের তারায় পড়ে। দুহাত চোয়ালে রেখে গভীরভাবে ওষ্ঠদ্বয় ছুঁয়ে দিল আরুর ললাটে। অতঃপর আরুর মাথাটা জড়িয়ে নিল বুকে। উপস্থিত সবাই ব্রীড়ানত হয়, অপূর্ব চেয়ারম্যান বাড়ির ছেলে আর চেয়ারম্যান উপস্থিত না থাকলে কানাঘুষো শোনা যেত। এক্ষেত্রে শোনা গেল না।
মোতাহার আহসান ভ্যানগাড়ি ভাড়া করলেন। বাড়ির প্রতিটি সদস্য ভ্যানে চেপে বসতেই ভ্যান চলতে শুরু করল। অপূর্ব কোলে চেতনাহীন আরুকে নিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে। তার প্রাণ যে জুড়িয়ে গেল।
পদ্মাপাড়ের পদ্মাবতী কী সুন্দর মুখখান, তোমার কী সুন্দর মুখখান।
দেখলে তোমায় জুড়াইয়া যায় আমার মনোপ্রাণ।

__
পল্লব যুগল মেলে উপরের দিকে চেয়ে রইল অপলক। গলা ও শরীর ব্যথায় আক্রান্ত। ক্ষতবিক্ষত পায়ের করতল। রিক্ত পায়ে হেঁটে গেছে বহুদূর। শরীরও যেন চলছে না। ধূপের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন ঘরের অন্তরভাগ। মেয়েকে হাত দিয়ে ধরে অনুভব করছেন পারুল।
মেয়েকে দেখে উত্তেজিত হয়ে চেতনা হারিয়ে ফেলেছিলেন পারুল।‌ সামলাতেও প্রয়োজন হয়েছিল মানুষ। আরুর চেতনা ফেরাতে প্রয়োজনীয় সবকিছু করেছে কবিরাজ। গোলাপজল পড়ে দিয়ে গেছেন গোসলের জন্য। স্বজ্ঞানে ফিরলে তাকে গোসল করানোর নির্দেশ দিয়েছেন।

ইতোমধ্যে সবকিছুর তোরজোর করে ফেলেছেন অনিতা। উষ্ণ পানিতে হিম পানি ও গোলাপজলের মিশ্রণ করে রেখেছেন। পারুলকেকে তাড়া দিলেন, “আপা সবকিছুর ব্যবস্থা করা হয়েছে, মেয়েটাকে নিয়ে এসো।”

চরম আদুরে গলায় মেয়েকে উঠানোর প্রয়াস করতে করতে বলেন, “আয় মা, গোসল করে আবার শুয়ে থাকবি।”

লোকসমাগম আরু-কে দেখতে। জাগ্রত হওয়ার পর অবশ্য কানাঘুষো শুনে সবটা অনুমান করতে পেরেছে আরু, তবে সবটাই তার কাছে কল্পনা কিংবা জাল্পনা। নিশ্চল শরীর নিয়ে উঠার বিন্দুমাত্র বল নেই দেহে। অব্যক্ত স্বরে বলে, “থাক না।”

কণ্ঠনালীতে এসে দলা পাকিয়ে রইল বুলি। অনুভব করল সে কথা বলতে পারছে না। অপূর্ব আরুর অব্যক্ত ভাষার রিপিট করে, “ও গোসল করতে চাইছে না।”

“না মা, এমন বলেনা। আমি ধরে নিয়ে যাচ্ছি। একটু কষ্ট কর।” বলতে বলতে পারুল আরুকে শোয়া থেকে বসালেন। সেদিন কাঁকড়ার আঘাতে হাতের জখম শুকিয়ে এসেছে। পা মাটিতে রেখে মৃদু ভর প্রয়োগ করতেই টনক নড়ে উঠে ব্যথায়। পা সরিয়ে করুন চোখে চেয়ে থাকে মায়ের দিকে।
অপূর্ব সহ্য করতে পারল না। পায়ের পাতাটা গভীর দৃষ্টিতে পরখ করে নিল। রক্তও জমাট বেঁধে শুকিয়ে আছে, অথচ এই ক্ষত পা নিয়ে কিছুক্ষণ পূর্বে দিব্যি গাছের ডালে হাঁটছিল। ফুফুর দিকে তাকিয়ে বিনীত অনুরোধ জানায়, “আমি ওকে কোলে নিয়ে কলতলায় যাবো ফুফু?”

“তাহলে তো ভালোই হয় বাবা।” পারুলের প্রত্যুত্তর পেয়ে দ্বি মুহুর্ত ব্যয় না করে ঝুঁকে পাঁজাকোলা করে নিল আরুকে। আরু তার তেজহীন হাতটা অপূর্ব-র কাঁধে রাখে না, শুধু চেয়ে থাকে অপলক। অপূর্ব অতি সন্তর্পণে পা ফেলে এগোয়।

কলতলা আরুদের বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে। তিন ভাইয়ের মাঝামাঝি স্থানে স্থাপন করা হয়েছে। মোতাহার আহসান কলের ব্যবস্থা করে দিলেও নারাজ জানিয়েছিল ইমদাদ। সে নিজের মতো বাঁচতে চায়। এতে মোতাহার আহসান বেশ সন্তুষ্ট হয়েছিল।
কলতলার ভেতরে ছোটো একটা টুল পেতে রেখেছেন অনিতা। অপূর্ব আরুকে সেই টুলে রেখে মায়ের দিকে তাকায় এক পলক। প্রসন্ন গলায় বলে, “আমি বাইরে আছি মা। গোসল শেষ হলে আমাকে ডেকো, ওকে নিয়ে যাবো। অন্য কোনো প্রয়োজন হলেও ডেকো আর হালকা পোশাক পরিও।”

অতঃপর অপূর্ব বেরিয়ে যায়। পারুল ভেতরে প্রবেশ করে দরজার খিল টেনে ব্যস্ত হলো তার কাছে। কবিরাজের বলা কথা অনুসরণ করে আরু-কে গোসল করাতে লাগল। ঘণ্টা খানেক বোধহয় লাগল সময়। দরজা ফাঁক করে অনিতা অপূর্ব-কে উদ্দেশ্য করে বলে, “আছিস অপু?”

“হম। আসব?”

“আয়।”

অপূর্ব ভেতরে পা রাখল। আরুকে যেভাবে বসিয়ে রেখেছিল ঠিক সেভাবে বসে আছে। চুলে বড়ো একটা গামছা জড়ানো, পরনে একটা ফ্রক। গায়ের উজ্জ্বল রঙটা জ্বলজ্বল করে উঠেছে আরুর। গাল দুটো অসম্ভব লাল। ময়লা আবরণ থেকে বেরিয়ে এসেছে যেন। অপূর্ব ধ্যান ভাঙতেই আরুকে পুনরায় পাঁজাকোলা করে নিল। গোসলের পর মেয়েটার ওজন সত্তর ভাগ কমে গেছে। আরু এবার হাত রাখল কাঁধে। ঠান্ডা হাতের স্পর্শে কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠে অপূর্ব। হৃৎপিণ্ড অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। মাছ যেমন পানির সংস্পর্শে এসে সতেজ হয়ে উঠে তেমনি অপূর্ব-র পদ্মাফুল পানির সংস্পর্শে এসে খোলস ছেড়ে নিজের আসল রূপে ফিরে এসেছে। অপূর্ব ফিরে চাইল না আরুর পানে। বিন্দু বিন্দু পানি তাকে প্রণয়ের আভাস দিচ্ছে যে। নিজের পথে অগ্রসর হয় অপূর্ব। নুপূরের ঝুনঝুন শব্দটা অপূর্ব বেশ আগ্রহ নিয়ে শ্রবণ করছে।

অনিতা আরুর ফেলে রাখা পোশাকটাকে উদ্দেশ্য করে বলে, “এগুলো কী করবি পারুল?”

“কবিরাজ সাহেব তো বলল পশ্চিম দিকে পুঁতে রেখে আসতে। আমার বেশ ভয় করছে ওদিকে যেতে। তুমি আমার সাথে যাবে ভাবী?”

“চল।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ] 💚

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৯

অনিতাকে সঙ্গে নিয়ে পারুল ছুটেছিল কবিরাজের কাছে। কিছু তাবিজ দিয়েছেন, তা নিয়ে এসেছে। বাড়ির কাজের কথা ভেবে অনিতা ফিরেছে বাড়িতে। ঘরের খিল বাইরে থেকে তুলে উঠানে পায়চারি করছে অপূর্ব। আরু ঘুমাচ্ছে বিধায় সম্পূর্ণ বাড়িতে সে একা। দীর্ঘক্ষণ বসে থাকায় পায়ে ব্যথা করছে। এছাড়া একা একা ব্যাকুল হয়ে উঠছে বলে, ব্যাকুল ভাবটাকে দমাতে উঠানে পায়চারি করছে অপূর্ব। পারুল ততক্ষণে নিকটে এসে পৌঁছে একটা সাদা কাগজে প্যাঁচানো প্যাকেট অপূর্ব হাতে দিয়ে বলেন, “তুই তবে যাসনি অপু, তবে আরেকটু বস। আমি ছাগলটা খোয়ারে তুলে হাঁস মুরগি খোপরে ঢুকাই।”

“তা যান ফুফু। কী বলেছে কবিরাজ, আরুর সাথের সে চলে গেছে?” অপূর্ব সংশয় নিয়ে প্রশ্ন করে। পারুলকে বেশ উদাসীন লক্ষ্য করা গেল। এদের নজর একবার কারো পানে নিবদ্ধ হলে সহজে তার ব্যাঘাত ঘটানো সম্ভব নয়। কালো মুখে বলে, “তাবিজটা দিতে বলেছে সাথে। তাহলে আসবে না। সেদিন রাতে জ্বীন পরী ঘুরছে এসেছিল এদিকে। আরুর রূপে মুগ্ধ হয়ে ওর উপর আঁচড় করেছে। তাবিজ দিয়ে আপাতত নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, পুরোপুরি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। তবে তারা আরুর কোনো ক্ষতি করবে না, জোড়া না হলে করত।”

“তাবিজটা আপনি লাগাবেন, না-কি আমি চেষ্টা করে দেখব।”

“পারলে ঝুলিয়ে দাও। যত তাড়াতাড়ি লাগাব ততই মঙ্গল। আমি গেলাম।” বলেই শাড়ি উঁচু করে এগিয়ে গেল পারুল। অপূর্ব প্যাকেটটা মুঠো করে দরজার খিল নামিয়ে ঘরে ঢুকল। বিছানা ফাঁকা। আশেপাশে গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেও আরুর সন্ধান পেল না। চারদিকে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে চেয়ে হতাশ হলো অপূর্ব। সবে সে বাইরে পা রাখল এবং আরু নিখোঁজ হলো‌। বিন্দু বিন্দু ঘাম কপালে জমে উঠল। উচ্চ স্বরে চ্যাঁচিয়ে অপূর্ব, “আরু, এই আরু। কোথায় গেলি আরু?”

কণ্ঠটা ততটা প্রকট হলো না অথচ অপূর্ব-র গলা ছিঁড়ে যাচ্ছে। শব্দ হারিয়ে গেছে অজানায়। চিন্তিত অপূর্ব পেছনে ফিরতেই এক টুকরো কাঠ এসে পড়ল তার পিঠে। অপূর্ব তা লক্ষ্য করে উপরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই আরুর পরনের জামাটা দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মাথা বের করে রেখেছে সে। অপূর্ব ঠান্ডা অথচ বিধ্বস্ত কণ্ঠে বলে, “ওখানে কী করছিস তুই, মাত্র না তোকে শুয়ে থাকতে দেখলাম?”

“শরীরটা অস্থির লাগছে অপূর্ব ভাই। মনে হচ্ছে ভেতরে কেউ আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। দরজা তো বন্ধ তাই উপরে উঠে হাওয়া নিয়ে শরীর ঠান্ডা করার চেষ্টা করবি।” আরু মাথা ঝুঁকিয়ে বলে। অপূর্ব হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, “হয়েছে এবার নাম।”

আরু সন্তর্পণে খুঁটিতে পা রেখে নামতেই অপূর্ব তাকে আঁকড়ে নামিয়ে নিল নিচে। বন্ধন আলগা না করেই ওভাবে দৃঢ় করে বসে অগোছাল বিছানায়। আরু কেঁপে উঠে তার স্পর্শ। বিলম্ব হলো তার ভেতর হিম হয়ে আসতে। অপূর্ব অনেক যত্নে তার হাতে তাবিজ বেঁধে দিল। আরু এক ধ্যানে অপূর্ব-র মুখশ্রীর পানে চেয়ে আনমনা হয়, আপনার সংস্পর্শে আমার দেহ ক্ষান্ত হবে জানলে আপনাকে আবদ্ধ করে নিতাম হৃদমাঝারে। মুখে বলে, “তাবিজ লাগালে নিজেকে রোগী রোগী লাগে অপূর্ব ভাই। আমি কখনো এই তাবিজ বাঁধি না।”

আরুর নাকটা আলতো করে ছুঁয়ে বলে, “তুই তো রোগী নয়, মহারোগী। রোগ হলে ওষুধ খেলে তা সেরে যাবে, কিন্তু তোর ক্ষেত্রে তাকে নিয়ে যাবে। পদ্মাবতী ব্যতিত অপূর্ব-র কোনো মূল্য নেই আরু।”

প্রেমময় দৃষ্টিতে চেয়ে নিজের কষ্টি পাথরের আংটিটা খুলে আরুর তর্জনীতে পরিয়ে দিল। অতঃপর চিবুকে দুই হাত বন্দি করে বলে, “অন্তত আমার জন্য একটু কর।”

“আপনি কি আমাকে প্রপোজ করছেন অপূর্ব ভাই?” আঙুলের পানে অপলক দৃষ্টি আরুর। অচেনা আবেশে জর্জরিত হয়েছে আজ, পরিচয় হয়েছে নতুন অনুভূতির। ঈষৎ উঁচু করে চোখদুটো নিজের চোখে স্থির করে অপূর্ব বাক্য তোলে, “না, তোমাকে আমার হতে হবে তার ক্ষুদ্র চেষ্টা করলাম মাত্র।”

_
সময়টা এগিয়ে বসন্তের মাঝামাঝি। চারিদিকে ফুলে সুবাস বইছে। গাছে গাছে গজিয়েছে নতুন পাতা। তিনজন কিশোরী মৃদু গতিতে ছুটতে ছুটতে কুউ কুউ কুউ করে চলেছে। তার সাথে মিলিত হয়েছে কোকিল। সাড়া দিচ্ছে ডাকে। আরু অনেকটাই পিছিয়ে। ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে একটা হাত বের হয়ে আরুর কোমল হাত টেনে নিয়ে গেল ঝোপে। আচমকা ঘটা ঘটনায় হতভম্ব সে। অতঃপর কালাচাঁনকে দেখে স্তম্ভিত আরু। নক ডেবে গেছে। আরু চিৎকার করে বলে, “কালাচাঁন তুই আমাকে এখানে কেন এনেছিস?”

“আমি তোকে শেষবারের মতো কইতাছি, আমার ভালোবাসা গ্ৰহণ করে নে গোলাপী। আমি তোকে সত্যি অনেক ভালোবাসি।” কঠিন তার গলা। আরু নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত করে প্রত্যুত্তর করে, “দেখ কালাচাঁন। আমিও তোকে শেষবারের মতো বলছি, আমি তোকে ভালোবাসি না।”

বাক্য শেষ হওয়া পরই আরুর উপর নেমে এলো নির্যাতন। দৃঢ় করে চেপে ধরে আরুর চোয়াল। যেন ভেঙে আসার জোয়ার। হুংকার দিয়ে বলে, “আর একবার আমার সাথে দেখা হলে, আমি তোর থেকে উত্তর নিবো। আমাকে ভালোবাসলে তো ভালো, নাহলে এই নদীতে তোরে নিয়ে আমি ঝাঁপ দিবো।”

আরুকে না পেয়ে তুর ও শেফালী সন্ধান করতে করতে এসে পৌঁছেছে সেখানে। ততক্ষণে বিদায় নিয়েছে কালাচাঁন ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। আরুর কাঁধে হাত রেখে সংশয় নিয়ে বলে, “এখানে কী করছিস? আমরা ওদিকে তোকে খুঁজছি।”

আরুর গালে হাত রেখে বলে শেফালী, “এগুলো কীসের রাগ? রক্ত বের হচ্ছে তো।”

সন্তর্পনে আড়াল করে সবটা আরু, “পা পিছলে কখন এখানে পড়ে গেছি বুঝতেই পারিনি। ঘোর থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে তোরা চলে এলি। তখনই হয়তো লেগেছে। মা হয়তো বাড়িতে চিন্তা করছে, আমি আজ যাই।”
শেফালী ও তুর পালটা প্রশ্ন গুছিয়েছে, ততক্ষণে আরু এগিয়ে গেছে অনেকটা পথ। ফিরে চায়নি পিছু।

কিছুটা পথ পেরিয়ে যেতেই আরুর চোখে পরল একটা ডোবা। সেখানে ফুটে আছে অজস্র শাপলা ফুল। একমাত্র বর্ষার সময় আরুদের বাড়ির সামনের ধানক্ষেতে শাপলা হয়, তখন বেশ তৃপ্তি করে ভাজি করে খায়। আরু বইখাতাগুলো মাটিতে রেখে অতি সাবধানে ঝুঁকে ঝুঁকে শাপলা সংগ্রহ করে‌। অনেকগুলো শাপলা সংগ্রহ করে প্যাঁচিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয় আরু।
পারুল উঠানে কাঁথা সেলাই করছে তিস্তার জন্য। বিয়ের সময় এই নকশিকাঁথা তিস্তার শ্বশুর বাড়িতে পাঠাবে। আরু বইখাতাগুলো রোয়াকে রেখে পারুলকে উদ্দেশ্য করে বলে, “রান্না শেষ মা?”

“এখন বাজে দুইটা বিশ, তোর আশায় কি রান্না ফেলে রাখব?” বলতে বলতে দৃষ্টি মেলালেন আরুর দিকে। কপালে ভাঁজ ফেলে বলেন, “তুই আবার ঝোপঝাড়ে গিয়েছিলি? বারণ করিনি যেখানে সেখানে যাবি না।”

“যেখানে সেখানে যাইনি। ফেরার সময় দেখলাম আর তুলে নিয়ে এলাম।” উঠানে রোদে মেলে দেওয়া ফ্রকটা নিয়ে দিঘির দিকে অগ্রসর হলো আরু। পারুল অতিষ্ঠ হলেন। দ্রুতহাতে শাপলার আঁশ ছাড়াতে লাগলেন। হাতে গলায় তাবিছ লাগিয়েছে বলে কি দূর থেকে তারা আকর্ষণ করতে পারবে না? মেয়েটাকে শত বুঝিয়েও লাভ হয়না তার।

আরুর গোসল সেরে খেতে বসতে অনেকটা সময় লাগল। তদানীং পারুলের শাপলা ভাজির করা শেষ। কিছুটা মুখে তুলতে গিয়ে থামল আরু। অপূর্ব-র কথা তার মস্তিষ্কে হানা দিল। অপূর্ব-র সাথে দেখা হয় না বহুদিন, রাতে ফিরে সকালে যায় হাসপাতালে। আগামীকাল শুক্রবার শাপলা দেওয়ার অজুহাতে গেলে আজ রাত পার করে আগামীকাল ফিরবে। কালাচাঁনের ব্যাপারে নালিশ জানাবে। অপূর্ব-র দেওয়া শর্তে রাজি হয়ে উচিত শিক্ষা দিবে কালাচাঁনকে।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৯ [বর্ধিতাংশ]

‘অপূর্ব ভাই নিশ্চয়ই শাপলা ভাজি খায়নি।’
“মা, আরও কি শাপলা আছে? অপূর্ব ভাইয়ের জন্য নিয়ে যেতাম। তোমার হাতে শাপলা খেলে শুধু খেতেই চাইবে।” বলতে বলতে লোকমা তুলে মুখে।

পারুল আগেই বাটিতে সরিয়ে রেখেছেন আলাদা করে। কলা পাতায় ঢাকা দিয়ে আরুকে বলে, “খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে অয়নকে সাথে নিয়ে যাস।”

খাওয়ার ইতি টেনে অপূর্ব-র দেওয়া একটা ফ্রক পরে নিল, মৃদু ভেজা চুলগুলো দুই বেনুনি করে রাখল, কপালে লাগায় মাঝারি সাইজের লাল টিপ, চোখে কাজল ও ঠোঁটে লিপস্টিক, পায়ে ছোঁয়াল আলতা। অতঃপর বাটি নিয়ে নাচতে নাচতে একাই অগ্রসর হলো আহসান বাড়ির দিকে।

আলতা রাঙা পা, আবার নূপুর পরেছে
আরু তোমায় পা/গল করেছে।
.
মাসটা পেরিয়ে গেছে অতিদ্রুত। অপূর্ব এখন নিজের কাজে মগ্ন থাকে। বাবা মায়ের কাছে বিয়ের জন্য ধার চেয়েছে আরও কয়েকমাস। ‘আরুর মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হলেই আয়োজন করে ঘরে বধূ রুপে তুলবে সে’ – আহসান বাড়ির সবাই জানলেও পারুল এ বিষয়ে অবগত নয়।
নিজ কক্ষে প্রবেশ করে ঘুমন্ত আরুকে দেখে একটু বিস্মিত হলো অপূর্ব, তবে নিজেকে বেশ সামলে নিল। ইদানীং তার স্বপ্নে আরুর প্রবেশ ঘটছে। আগ বাড়িয়ে স্পর্শ করার প্রয়াস করলে অদৃশ্য হয়ে যায়। অপূর্ব তাই আরুর কাছাকাছি যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থেকে বলে, “আমার অঙ্গনে তোমার প্রবেশ ঘটুক, কিন্তু তোমার অঙ্গনে আমার প্রবেশ কেন নিষিদ্ধ করে রেখেছ প্রেমবতী?”

অপূর্ব ব্যাগগুলো বিছানায় রেখে তোয়ালেটা কাঁধে নেয়। দেহ থেকে তীব্র ঘামের গন্ধ নিঃসৃত হচ্ছে, প্রেমবতী যদি সেই দুর্গন্ধে পালিয়ে যায় অন্যথ? অনিচ্ছার সত্ত্বেও পা ফেলে কলতলার উদ্দেশ্যে। গোসল সম্পন্ন করে ফিরে এসে আরুকে অন্য ভঙ্গিতে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখে। আজ এতক্ষণ আছে ভেবেই অপূর্ব মুগ্ধকর হাসে, “আজকাল আমার কাছে তোমার থাকতে ভালো লাগে পদ্মাবতী, তাই না?”

আরুর ঘুমের রেশ তখন কাটিয়ে উঠে বসেছে। অপূর্বকে দেখে আঁচলটা ঠিক করে অপলক চেয়ে থাকে তার ভাঁজকাটা দেহে। অপূর্ব জড়ানো তোয়ালেটা খোলার প্রয়াস করতেই আরু চঞ্চল গলায় বলে, “কী করছেন? আমি যেয়ে নেই আগে, তারপরে আপনি পোশাক পালটান।”

“সেদিন তো বিছানায় বসে দিব্যি সবকিছু দেখছিল, আজ হঠাৎ লজ্জা পাচ্ছিস কেন? আগে কথাও বলতি না। বোবার মতো চেয়ে থাকতি। আজ দেখছি বুলিও ফুটেছে।” বলতে বলতে অপূর্ব তোয়ালে-তে হাত রাখতেই আরু দিল চিৎকার। অবিলম্বে ছুটে গেল। অপূর্ব এখনো ধ্যানে রয়েছে, পর্দা এখনও নড়ছে। কানে চিৎকারের শব্দগুলো স্পষ্ট বাজছে। এতদিন আরুর গায়েব হতে দরজা লাগত না, আজ কেন লাগল? অপূর্ব মাথায় হাত রেখে অব্যক্ত স্বরে বলে, “ও শেট। দাঁড়া আরু।”

টিশার্ট আর লুঙ্গিটা পরে শপিং ব্যাগগুলো সমেত বৈঠকখানায় পা রাখল অপূর্ব।‌ আরু ডাগর ডাগর চোখ করে বোবার মতো বসে আছে আর তাকে ঘিরে রয়েছে বাকিরা। গলায় হাতে তাবিজ বাধা আরুর। সন্ধ্যা নেমে আসায় আরুকে বাড়ির দিকে এগোতে দেয়নি পারুল। অপূর্ব-র ঘরেই ঘুমিয়েছে।

অনিতা উদ্বিগ্ন হয়ে আরুকে শান্ত করতে বলে, “কতবার বললাম ও ঘরে যাস না। পেলি তো ভয়।”

“কিচ্ছু হবেনা, শান্ত হ। তোর সাথে তাবিজ আছে। আর ঘরের ভেতরে ভুত থাকে না।” চম্পার কথায় আরু টু শব্দটি না করে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে, কীভাবে বলবে অপূর্ব ভাই এমন কাজ করেছিল। অপূর্ব এবার আগ বাড়িয়ে বলে, “ঘুম থেকে উঠে আমাকে দেখে ভয় পেয়েছে। নাও মা দেশে ফিরে প্রথমবার স্যালারী পেয়েছি। তাই সবার সবার জন্য শপিং করে এনেছি, শুধু তিস্তা বাদে। (তিস্তাকে উদ্দেশ্য করে) কাল আমার খোলা আছে। বিকালে তোকে নিয়ে বের হবো। তৈরি হয়ে থাকিস।”

তিস্তার বিয়ে ঠিক হয়েছে সুজনের সাথে। পরিবারের বড় মেয়ের ভালোবাসা সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছে সবাই। সুজনদের টিনের শোরুম রয়েছে। অর্ডার করা টিন গাড়ির মাধ্যমে গন্তব্যে পাঠানোই তার কাজ। পড়াশোনা শেষ করে সেখানে যোগদান করেছে। মা, চাচি ও দাদির জন্য অপূর্ব আজ পোশাক নিয়ে এসেছে। আগামীকাল বোনদের নিয়ে যাবে। আহসান বাড়ির মেয়ের বিয়ে বলে কথা, সবকিছুর তুলে নিয়ে আসবে অপূর্ব।

উপস্থিত সবাই অপূর্ব কথা মেনে নিয়ে মৃদু হাসছে। ব্যাগগুলো খুলে একে একে সবাইকে দিতে ব্যস্ত হলো অপূর্ব। অনিতার হাতে দিতেই সে বলে, “আমার জন্য আনার কী দরকার ছিল অপু?”

“তোমার জন্য আনিনি, মায়ের জন্য এনেছি।”
তুর শেফালী তো খুশিতে উৎফুল্ল। ভাইকে জড়িয়ে ধরে সেই আনন্দ ভাগাভাগি করে নিল। আরুর দিকে না চেয়ে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলে, “এটা তোর নীল শাড়ি। সুন্দর করে পরবি তিস্তার বিয়েতে।”

“নিজের জন্য আনেননি?” প্যাকেকটা না ধরেই আরু পালটা প্রশ্ন করে। মেয়েটা তার দিকে নজর রাখে ভেবে অপূর্ব হাসে, “হু এনেছি।”
অপূর্ব নিজের পোশাকটা বের করে এগিয়ে দেয়। আরু লক্ষ্য করে জিন্স বেশ কিছুটা ছেঁড়া। সবার জন্য উত্তম জিনিসটা এনে নিজের জন্য ছেঁড়া জিনিসটা এনেছে ভেবেই আরুর চোখমুখ শুকিয়ে গেল। সুঁই সুতা দিয়ে সেলাই করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে আরু বলে, “আপনার পোশাকটা আমাকে দিন, আমি যথা স্থানে গুছিয়ে রাখব।”

নিঃসন্দেহে ভরসা করে আরুর হাতে তুলে দিল তার পোশাক। আরু সেই পোশাক নিয়ে তুরের ঘরের দিকে অগ্রসর হলো। অপূর্ব সুন্দর নকশিকাঁথা সেলাই করতে পারে আরু। সুঁই দিয়ে ছেঁড়া অংশটুকু স্বযত্নে সেলাই করে ডিজাইন তৈরি করল‌। অতঃপর শুভ্র হৃদয়ে মনমতো সাজায় শব্দ গুচ্ছ।

অপূর্ব-র আলমারিতে পোশাক রাখতে গিয়ে একটা জিন্সে নজরবন্দি হলো আরুর। সেই জিন্স ও নতুন কিনে আনা জিন্সের একই স্থানে ছেঁড়া। মাথা হাত রেখে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আরু অব্যক্ত স্বরে বলে, “ছেঁড়া জিন্স পরে না, অথচ সবাইকে শান্তনা দিতে সেই ছেঁড়া জিন্স কিনে এনেছে। পুরনো জিন্সটা বের করে আলমারির ছিটকিনি তুলে দেয়। পানিতে ভিজিয়ে অপূর্ব-র আসবাবপত্র মুজতে ব্যস্ত হলো।
আরু কি জানে, এটাই যে বিদেশি ফ্যাশন?

অপূর্ব ঘরটা নিজের মতো সাজিয়ে অপূর্ব-র অপেক্ষায় রইল আরু। খাওয়া শেষে অপূর্ব ঘরে প্রবেশ করে ক্ষান্ত রইল। আগ বাড়িয়ে দু চারটে কথা উচ্চারণ সে করল না বরং এগিয়ে যেয়ে তর্জনী দিয়ে আরুর বাহুতে দিল মৃদু চাপ। আরু মৃদু ঘসতে ঘসতে বলে, “উফ অপূর্ব ভাই, ব্যথা দিলেন কেন?”

অপূর্ব-র ঠোঁট প্রসারিত হলো আরু অদৃশ্য না হওয়াতে। আয়েশ করে বসে বলে, “বিছানায় যেভাবে বসে ছিলি ভেবেছি বোবা ভূতে ধরেছে তোকে। অন্যের স্পর্শ ব্যতিত বোবা ভূত যায় না, তাই ছুঁয়ে দিলাম। মাত্র এক আঙুল দিয়ে ছুঁয়েছি কিন্তু। ব্যথা লেগেছে?”

“না।” ইতস্তত করে আরু। মূল কথাটা না বলেই উঠে ধীর পা ফেলে। অপূর্ব ডাকে পেছন থেকে, “তুই কি খুব বেশি ব্যস্ত আরু?”

“না।” পিছু ফিরে আরু।

“গরমে থাকতে থাকতে পিঠটা ঘামাচিতে ভরে গেছে। চিরুনি দিয়ে পিঠটা আঁচড়ে একটু পাউডার দিয়ে দিতে তোর কোনো সমস্যা আছে আরু?”

আরু প্রফুল্ল হলো। ইতস্তত কাটিয়ে উঠতে অনেকটা সময় তার লাগবে, লজ্জাদায়ক কাজটা হুটহাট করা কি সম্ভব? অপূর্ব-র সান্নিধ্য পেতে হবে যে। অপূর্ব চিরুনি ও মিল্লাদ ঘামাচি পাউডার দিয়ে বসল।

অপূর্ব শার্ট খুলে নগ্ন পিঠে উবুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। আরু স্তম্ভিত হয়ে বলে, “পিঠ তো যা ইচ্ছে তাই হয়ে গেছে। কাউকে বললে আঁচড়ে ঠিক পাউডার লাগিয়ে দিত। তাহলে এতটা হতো না।”

আরুর তার হাতটা অপূর্ব-র পিঠে রেখেছে। হাতের রুপার বালার সেই শব্দে মন জুড়িয়ে গেল অপূর্ব-র। আবেশে পল্লব ঢেকে ফেলে। আরু বলে, “ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি যখন পড়বে-না? তখন আপনি খালি গায়ে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকবেন। এতে ঘামাচি চলে যায়।”
“বৃষ্টিতে ভিজলে আমার জ্বর আসে আরু, তবে পদ্মাবতীর ব্যক্তিগত বৃষ্টিতে ভিজলে অপূর্ব-র জ্বর আসবে না, ব্যধি আসবে। যার নাম প্রেম ব্যধি।” অপূর্ব চোখ মেলে তাকাল। আরু এক দৃষ্টিতে অপূর্ব-র দিকে চেয়ে আছে। চোখ মা/রতেই আরু লজ্জানত হলো।

“পড়াশোনা কেমন চলছে তোর?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। একটা কথা বলব, শুনবেন?”

“বল।” অপূর্ব-র অনুমতি পেয়েও আরু বাক্য তোলে না। নিজের কাজ শেষ করতে ঝুঁকে গেল। দু-কাঁধে হাত রেখে দুগালে পাঁচবার ওষ্ঠদ্বয় স্পর্শ করে সরে এলো। অপূর্ব উদাসীন হয়ে ফিরল পিছু। আরুর মুখমণ্ডল জুড়ে তখন রাজ্যের ব্রীড়া। অপূর্ব উঠে দ্রুতি কণ্ঠে বলে, “কী হলো এটা?”

“আমি অগ্রিম পাঁচটার বেশি দিতে পারব না। কাজ শেষ হলে বাকিগুলো দিবো?”

“অগ্রিম? কীসের পাঁচটা?” সংকোচ নিয়ে প্রশ্ন অপূর্ব-র। ততক্ষণে বিস্মৃতি হয়েছে বুলি, ভুলেছে তার দেওয়া শর্ত। আরু বাক্য তোলে, “সেদিন আপনি বলেছিলেন-না, একশো একটা চুমু আপনাকে জড়িয়ে ধরে‌ খেলে আপনি কালাচাঁনকে পি/টু/নি দিবেন। তারজন্য।”

“কিছু করেছে কালাচাঁন?”

“আমি যদি ওকে ভালোবাসার কথা না বলি, তাহলে ও আমাকে নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিবে। জানেন আমাকে সে ব্যথা দিয়েছে।” বলতে বলতে‌ আরু তার চিবুক উঁচু করল ঈষৎ। গোসলের ফলে দেখা গেল না স্পষ্ট। দীর্ঘক্ষণ চেয়ে গর্ত খুঁজে পেল অপূর্ব। আলতো স্পর্শ করে বলে, “খুলে বল সবটা।”

অতঃপর আরু খুলে বলে সবটা। অপূর্ব উঠে আলমারি থেকে মলম বের করে আঙুলের ডগায় নেয়। অতঃপর তা আরুর চিবুকে লম্বা একটা টান দিয়ে বলে, “আগামীকালের পর সে আর কখনো তোর সামনে আসবে না। এলেও তোর দিকে চোখ তুলে তাকাবে না। নত দৃষ্টিতে এড়িয়ে যাবে। তবে কাজ শেষ হওয়ার পর আমার পাওনা যাতে আমি বুঝে পাই।”

“একদম অপু সোনা।” বলেই অপূর্ব-র গাল টেনে ছুটে যাওয়ার প্রয়াস করতেই অপূর্ব বলে, “শাপলা ভাজিটা খুব স্বাদের লেগেছে। প্রথমবার খেলাম। এতটা পথ পেরিয়ে আমার জন্য শাপলা নিয়ে আসার জন্য তোকে নীলপদ্মটা জীবনের তরে দিয়ে দিবো ভাবছি।।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-১৬+১৭

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৬

আরুর শরীরের তাপমাত্রা যেন সাধারণ তাপমাত্রাকে অতিক্রম করতে পারে অনায়াসেই। সম্পূর্ণ রাতে একটিবারের জন্যও চেতনা ফিরল না আরুর। জ্বরের মাঝে সে কেবল কাঁপছিল। পারুল লোহা গরম করে পানি পান‌ করাল আরুকে। তা গলা পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এলো, অতঃপর গাল বেয়ে নেমে গেল। সকাল হতে না-হতেই কবিরাজ ডেকে আনা হলো। আহসান বাড়ির সবাই ছুটে এসেছে ভাগ্নেকে দেখতে। একটা হোগলা বিছিয়ে উঠানে নামানো হলো আরুকে। কবিরাজ আরুর হাতে তেল দিয়ে মালিশ করে দিতে বললে পারুল, অনিতা, জাহানারা ও মনি গেল ব্যস্ত হয়ে উঠল। তখনও ফিরল না আরুর গেল। অবশেষে অবসন্ন হয়ে কবিরাজ বলে, “খুঁজে দেখুন তো, কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় কি-না?”

হাত-পা খুঁজে চুলের নিচে ঘাড় পর্যন্ত যেতেই সন্ধান পেল তিনটি নখের দাগের। কবিরাজ ক্ষত তিনটি দাগ গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে বলে, “ওকে ধরে কেউ ঘরের ভেতরে নিয়ে যাও দ্রুত।”

“কেন?” চম্পা বলে।

“তা বলছি, দ্রুত করো। বেশিক্ষণ বাইরে থাকা ক্ষতিকর।” কবিরাজ উদ্বিগ্ন হয়ে বলে। অপূর্ব কষ্টেসৃষ্টে পাঁজাকোলা করে আরুকে নিয়ে ঘরে গেল। আরুর চেয়ে দ্বিগুণ একটা মেয়েকে চকিতে বহন করার ক্ষমতা রাখে অপূর্ব, সেখানে আজ আরুকে বহন করতেই তার ঘাম ঝরছে।
কবিরাজ চারটা লোহা পারুলের হাতে দিয়ে বলে, “এই লোহা চারটা ঘরের চার কোনায় রাখবি। তিনদিন আরুকে ঘর থেকে বের হতে দিবি না। চোখে চোখে রাখবি। এক চল্লিশ দিন সতর্ক রাখবি। সন্ধ্যার আর দুপুরে পশ্চিম দিকে যেতে দিবি না, ঘরে রাখবি। আমাকে একটু তপস্যা করতে হবে। তিনদিন পরে এসে যা করার করব। খবরদার ঘর থেকে বের হতে দিবি না। ওঁরা ওকে নিয়ে যাবে।”

উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে গেল। কবিরাজ পানি পড়া ও ধূপ দিলেন সকাল সন্ধ্যা ব্যবহার করতে। ইমদাদ কবিরাজকে বললেন, “কী হবে আমার মেয়েটার?”

“তোর মেয়ের মতো রূপবতী গুণবতী মেয়ে এই তল্লাটে তো দূর আট গ্ৰামেও পাওয়া যাবে না। মেয়েটাকে হারাস না, অন্তত তিনদিন ওর পাশাপাশি থাক। ঘর থেকে বের হলে কোথায় নিয়ে যাবে, ঠিক নেই। অতিরিক্ত ভয় পেয়েছে বলেই জ্ঞান ফিরতে দেরি হচ্ছে।” বলে কবিরাজ ঘরমুখো হতেই মোতাহার আহসান থামালেন। কিছু টাকা মুঠোবন্দী করে এগিয়ে দিয়ে বলে, “তোর হাদিয়া।”

“না চেয়ারম্যান সাহেব। আপনার থেকে কিছু নিবো না। আপনি আমাদের গ্ৰামের জন্য যা করেছেন, এটা নিয়ে নিজেকে ছোট করতে পারব না। তবে একটা অনুরোধ, এইবার টিউবল এলে আমাদের পাড়ায় একটা দিয়েন। বিশুদ্ধ পানির জন্য অনেক দূরে যেতে হয় গিন্নিকে। আমি তো আবার সব জায়গা যেতে পারি না।” কবিরাজের কথায় মোতাহার আহসান টাকাটা নিজের পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকিয়ে রাখলেন। কাঁধে হাত রেখে আশ্বাস দিয়ে বললেন, “তোদের ঐ পাড়ার দুইটা কলের জন্য আপিল করেছি উপর মহলের কাছে। আসলে কল বসানোর যাবতীয় খরচ আমি দিয়ে আমার ভাগ্নের ঋণ শোধ করব।”

কবিরাজ প্রস্থান করার পরপরই পারুল সম্পূর্ণ ঘরে পানি ছিটালেন। মেয়েটাকেও পান করালেন কিছু। অপূর্ব স্থির দৃষ্টি আরুর ঈষৎ কৃষ্ণাভ মুখশ্রীর দিকে। শীর্ণ হয়ে আছে যে। বামহাতের কনিষ্ঠা আঙুল নড়তে দেখে এগিয়ে যেতে আরুর গালে হাত রাখল অপূর্ব, “আরুপাখি উঠ।”

আরু অবলোকন করল তার ঘন পাপড়িযুক্ত ডাগর ডাগর চোখ দিয়ে। কিছু বলল না। পারুলকে আদেশ করে মোতাহার আহসান, “আরুকে কিছু খাওয়া। কাল দুপুরে দুমুঠো খেয়ে এসেছে।”

“তোমরাও তো কালরাতে খবর পেয়েই ছুটে এসেছ, কিচ্ছু দাঁতে কা/টো নি। সবাই খেতে এসো।” বলেই পারুল রান্নাঘরে গেল। কালরাতে রান্না করা ভাত তেমনই পড়ে আছে। ইলিশ মাছটা পড়ে আছে হাঁড়িতে। অনিতা গেল সাহায্য করতে। মাছ টুকরোগুলো উনুনে দিয়ে একটু সেকে নিল।

ইলিশ মাছে ডিম হয়েছে বড়োবড়ো দুই খণ্ড। পারুল একটা ডিম সাত টুকরো করেছে ও অন্যটা আস্তো অপূর্ব-র জন্য রেখেছে। সবাইকে খেতে দিয়ে আরুর জন্য আলাদা বাটিতে পান্তা ভাত, একটু পেঁয়াজ, এক টুকরো ডিম, শুকনো পোড়া মরিচ নিয়ে এসেছে পারুল‌। আরু নাকোচ করে, “মা, আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।”

“না মা, খেয়ে নে। খেয়ে শুয়ে থাক। একা খেতে পারবি? নাহলে একটু অপেক্ষা কর মা, এখান তো সবাইকে খেতে দিয়েছি।” রেখেই খাওয়ার ঘরে চলে গেল পারুল। পানি ঢেলে হাত ধুয়ে ভাতের বাটিটা নিয়ে বসল আরু। জ্বর ততক্ষণে বিদায় নিয়েছে শরীর ছেড়ে। উষ্ণ শরীরে পান্তা ভাত বেশ লাগল আরুর। অপূর্ব খাওয়া শেষে আরুর পাশে গিয়ে বসল। অতঃপর অনিতা উঠে গেল। সবসময় একজন নয় একজন আরুর পাশে থাকা উচিত।
পাতে তুলে দেওয়া বড়ো খণ্ডের ডিমটা দাঁতে কাটেনি অপূর্ব। অগোচরে নিয়ে এসেছে। আরুর আড়ালে পাতে দিয়ে হাত মুখে ফেলল রুমালে।
আচমকা ডিমটা দেখে বাকরুদ্ধ হলো আরু। খাওয়ায় অনশন করে বলে, “আমার স্পষ্ট মনে আছে, মা আমাকে এক টুকরো দিয়েছিল তাও ছোট। এখন দেখছি দুই টুকরো।”

“আমিও তো দেখলাম দুই টুকরো। হয়তো ভাতের ভেতরে ছিল, তুই দেখিস নি। বিশ্বাস না হলে মাকে জিজ্ঞেস কর।”

“তাই হবে বোধহয়।” বলেই ডিম ভেঙে টুকরো করে মুখে তুলে স্বাদ গ্ৰহণ করে ডিমের। আরু জানতেও পারল না, কেউ একজনকে তার প্রিয় মাছের প্রিয় ডিমখানা না-খেয়ে তারজন্য লুকিয়ে এনেছে।
__
অপরাহ্ন পেরিয়েছে। গভীর নিদ্রায় মগ্ন আরু। বাইরে প্রবেশ নিষেধ বিধায় পোশাক ছেড়ে হাতমুখ ধুয়ে নিয়েছিল আরু। অপূর্বরা রয়েছে মধ্যবয়স্করা সবাই চলে গেছে। উঠানে বসে চা বিস্কুট খাচ্ছে। উত্তর পাশ দিয়ে একটা কালো কুচকুচে বিড়াল এসে বসল সবার মাঝে। পারুল কয়েকটা মুড়ি মাটিতে রাখতেই বিড়াল ছানাটা মুখে নিল। খাওয়া শেষে আহসান বাড়ির দিকে মুখ করে পা চাটে। তুর মজার ছলে‌ বলে, “গতকাল পা চাটলে বুঝতাম, আমরা আসব বলে আগমন বার্তা দিচ্ছিস। কিন্তু এখন কেন চাটছিস?”

ভেজা মুড়িগুলো চামচ দিয়ে মুখে তুলতে তুলতে বলে অয়ন, “কালকেও এসেছিস ও‌। আমি তাড়িয়ে দিয়েছি। কালকে চাটতে পারেনি তাই আজকে এসেছে।”

অপূর্ব প্রশ্ন করে, “বিড়াল পা চাটলে অতিথি আসে?”

“হম। সবাই বলে।” পারুল বলে। বিড়াল ছানাটা ঘরের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে তিনবার ম্যাও আওড়াল। অতঃপর ছুটে চলে গেল। পারুল দৃষ্টি অনুসরণ করে অয়নকে আদেশ দেয়, “দেখতো আরু ঘরে আছে কি-না?”

অপ্রসন্ন হলো অয়ন। রোষে গজগজ করতে করতে ঘরে যেয়ে ফিরে এসে স্পষ্ট স্বরে বলে, “বুবু ঘরে নেই মা।”

কেউ কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই অপূর্ব কাপ ফেলে ছুটে গেল ঘরে। উপস্থিত সবাই গেল পেছন পেছন। আরু-কে ডানপাশ ফিরে শুয়ে থাকতে দেখে অপূর্ব হৃৎপিণ্ডে শীতল স্রোত খেয়ে গেল। পারুল চ/ড় বসালেন অয়নের গালে। রাগান্বিত কণ্ঠে বলেন, “ইচ্ছে করছে এক চ/ড়ে সব দাঁতগুলো ফেলে দেই। মিথ্যা বলা শিখে গেছে। গুরুতর একটা বিষয় নিয়ে মজা করছে।”

চোখে পানির আগমন হতে না হতে হেঁচকি উঠে গেল অয়নের। এতে কড়া গলায় শাসায় পারুল, “আরুর ঘুম ভাঙলে ঐ কলা বাগানে বেঁধে রাখব তোকে। যা এখান থেকে।” অয়ন ছুটে গেল বাইরে। আরুদের ঘরে দুইটা দরজা। পেছনের দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়ে উঠানে গিয়ে বসল পারুল। পুনরায় খোশগল্পে মেতে উঠল।

পেরিয়ে গেল কিছুক্ষণ। অয়ন ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলে, “মা বুবু কোথায় জানি যাচ্ছে।”

“মা/র না খেতে চাইলে সামনে থেকে সর।” অয়নের কথাকে ফাঁকা আওয়াজে উড়িয়ে দিলেন পারুল। অপূর্ব অস্থির হৃদয় নিয়ে তিন মিনিট ক্ষান্ত থাকতে পারেনা। ‘দেখে আসি’ ভেবে অগ্রসর হলো ঘরের দিকে। বিছানার চাদরটা কুঁচকে আছে, আরু নেই। বিছানা ফাঁকা এই ভর সন্ধ্যায় কোথায় গেল মেয়েটা? ‘পেছন দিকের দরজাটা দমকা হাওয়াতে একবার বন্ধ হচ্ছে আরেকবার খুলছে’ -কে খুলল?

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৭

কবিরাজ সকাল সকাল খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন। রাতে তিনি আসতে পারতেন, তবে কবিরাজরা চাইলেই সবসময় সব স্থানে যেতে পারেন না। তাদের অনেক বিধি নিষেধ মেনে চলতে হয়। কান্নায় ভেঙে পড়েন পারুল, “কবিরাজ সাহেব আমার আরুকে ওরা নিয়ে গেছে, আপনি আমার আরুকে ফিরিয়ে এনে দিন।”

“গতকাল বারবার বারণ করেছি মেয়েকে হাত ছাড়া করবি না। আমার কথা তোরা কেউ শুনলি না।” কবিরাজ অধৈর্য হয়ে বলে। পারুল অনুশোচনা বোধ করলেন। ভুল স্বীকার করে, “এমন হয়ে যাবে আমি বুঝিনি। আরু ঘুমাচ্ছিল, আমরা উঠানে বসে চা খাচ্ছিলাম। আপনি বলেছিলেন বাড়ি থেকে বের হলে তবেই আরু-কে নিয়ে যাবে, কিন্তু ওরা যে ঘর থেকে ঘুমন্ত আরুকে নিয়ে গেছে।”

কবিরাজ রাগান্বিত দৃষ্টিতে চেয়ে পানি ছিটালেন বাড়িতে, যা তিনি কিছুক্ষণ পূর্বে পড়ে নিয়ে এসেছেন। অতঃপর তেজস্রী গলায় বলে, “দরজা বাইরে থেকে খোলার সাধ্য ওদের নেই, তোরাই কেউ খুলেছিস। ওরা দূর থেকে শুধু আকর্ষণ করেছে।”

পারুলের স্মৃতিশক্তি যতদূর ভেসে উঠে সে দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেওয়ার পূর্বে তেজস্রী অয়ন রাগ দেখিয়ে বের হয়ে গিয়েছিল। আরুর চলে যাওয়ার সংবাদ অয়ন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দিয়েছিল, অথচ অয়নকে সমুখের দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখেনি কেউ। এক্ষেত্রে সে পেছনের দরজা ব্যবহার করেছে। পারুল রোষে গজগজ করতে করতে অয়নকে খোঁজার প্রচেষ্টা করল। দৃষ্টিগোচর হলে আজ বোধহয় তার সেদিন দিন থাকত।
_
আরুর নীল রঙের শাড়িটা উঠানে দড়ির সাথে দুলছে। কাল দুপুরে মেলে দেওয়া হয়েছে, এখন বোধহয় আরুর অপেক্ষায় অপেক্ষারত সে। তাকে ঘরে নিয়ে ভাঁজ কথার তীব্র বাসনা।

মৃধা বাড়িতে ক্রন্দনরোলে মুখরিত। উঠানে হোগলা বিছিয়ে এলোপাতাড়ি বসে আছে সকলে। নির্ঘুম পেরিয়েছে গোটা এক কালরাত্রি। পারুলকে শান্তনা দিচ্ছে অনিতা, জাহানারা, মণি ও মল্লিকা। মোতাহার আহসান তার চেয়ারম্যান-ই ক্ষমতা প্রয়োগ করে আশপাশ গ্ৰামে আরুর খবর ছড়িয়েছে, অথচ এখনো আরুর সন্ধান নেই। চার ভাই, স্বামী ও বাবা বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই পারুল অশান্ত হয়ে ছুটে গেল সেদিকে। গ্ৰামীণ শাড়ির এক প্যাঁচ খুলে মাটিতে গড়াগড়ি করে মাখিয়েছে আর্দ্র ও শুষ্ক উভয় মাটি। বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “বাজান, তুমি আমার আরুকে এনে দাও। কাল থেকে আমার মেয়েটার কোনো খোঁজ নেই।”

বংশের একমাত্র মেয়ে/বোন। সাত ভাইয়ের এক বোন বলেই তো ভালোবেসে তার নাম রেখেছিল পারুল। আজ বোনের কান্নায় বুকে ফেটে যাচ্ছেন তাদের। মোতাহার আহসান বলেন, “কাঁদিস না, কিছুক্ষণের ভেতরেই আমরা আরুকে পেয়ে যাবো। একজন মানুষ উধাও তো হয়ে যেতে পারে না।”

“কীসের চেয়ারম্যান আপনারা? নিজের বোনের সমস্যাই সমাধান করতে পারছেন না, গ্ৰামের সমস্যা কী সমাধান করবেন?” পারুল কাঁদতে থাকে অনবরত। চেপে রাখা হাতটা আলগা হয়ে ঝুলে গেল নিচে। হেলে পড়ার পূর্বেই ধরে ফেলল ভাইয়েরা। এতগুলো মুখ যখন হাহাকারে জর্জরিত তখন একটি মুখে ভেসে আছে প্রফুল্ল হাসি। বেশ হয়েছে আরু চলে গেছে, এবার তাকে সবাই ভালোবাসবে। উপস্থিত সবার মাঝখান থেকে বেরিয়ে গেল খেলতে। আরুর জন্য কান্না সহ্য হচ্ছে না তার। বহু কষ্টে ধরে হোগলা পর্যন্ত নিয়ে যেতেই সবাই দাঁড়িয়ে জায়গা করে দিল পারুলকে রাখার। অনিতা চাপা গলায় অন্য ঝা-দের বলে, “জাগানো দরকার নেই, বিশ্রাম করুক একটু।
সত্যি কি মেয়েটার কোনো খবর‌ আপনারা পাননি?”

“না, বউমা। কোথায় কীভাবে নিয়ে গেছে, কে জানে? এক সেকেন্ডে তাঁরা অনেক পথ পাড়ি দিতে পারে।” দাদাজানের দিকে চেয়ে ফোঁস করে‌ নিঃশ্বাস ছাড়ল অপূর্ব। উড়তে থাকা আরুর নীল রঙের শাড়িটা দড়ি থেকে নামিয়ে বুকে চেয়ে রাখল। পায়ের নুপূরের শব্দটা এখনো যেন বাজছে। চোখের তারা ভিজে আনমনে বলে উঠে, পদ্মাবতী, ক্ষমা করে দিও তোমার ব্যর্থ প্রেমিক-কে। অপূর্ব-র বুকে ফুটে উঠা পদ্মফুলটা কেউ কেড়ে নিয়ে গেল অজানায়। ফিরে এসে আগলে রাখার শেষ একটা সুযোগ দাও আমায়।”
__

অপূর্ব দিঘির জলে পা ভিজিয়ে শাড়িটাকে আঁকড়ে ধরে নিজের ব্যথায় কাতর হয়ে আছে। তখন সেই ব্যথার উপশম হিসেবে আগমন ঘটল আরুর। অপূর্ব-র কাঁধে হাত রাখতে হৃৎপিণ্ড অস্বাভাবিক হয়ে উঠল। চকিতে পাশ ফিরতেই আরুর আবেদনময়ী মুখশ্রী নজরে এলো তার। হাত-পা কাঁপতে কাঁপতে স্থির থাকতে না পেরে অবিলম্বে আবদ্ধ করে নিল আরুকে। দুরন্ত কণ্ঠে বলে, “কোথায় ছিলে পদ্মাবতী?”

“এই তো কাছে। কে আমাকে কতটা ভালোবাসে পরখ করতে।” আরুর শান্ত কণ্ঠ। অপূর্ব দূরত্ব বজায় রাখল না। বড্ড উন্মাদ হয়ে উঠল। আরু নিজেকে যথা সম্ভব দূরে‌ নিল। দিঘির পাড়ে বেড়ে উঠা কচু পাতা নিয়ে রঙ্গ করে বলে, “আপনার মন খারাপ না? আমি আপনার মন ভালো করে দিবো দাঁড়ান।”

অপূর্ব-র বাহু আঁকড়ে ঢালবিশিষ্ট দিঘিতে পানি ছোঁয়ার চেষ্টা করে। অপূর্ব অন্যহাতে কোমর জড়িয়ে আরুকে আগলে রাখে। বেশ খানেকক্ষণ পানিতে চুবিয়ে তুলে একই রঙ্গ করে বলে, “দেখেছেন ভিজে নি। এটা আরুর ম্যাজিক।”

“খুব সুন্দর ম্যাজিক, এজন্য তোমার একটা পুরস্কার প্রাপ্য।” দুগালে হাত রেখে দূরত্ব শূন্যতায় এনে আরুর কপালে ছুঁয়ে দিল ওষ্ঠ। নিরবচ্ছিন্ন দৃষ্টি চেয়ে রইল আরু। অতঃপর পুনরায় বুকে জড়িয়ে নিয়ে নিবৃত্ত কণ্ঠে বলে, “আমি জেনে গেছি আমার মনে কথা। যেই বয়সের দোহায় দিয়ে তোমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছিলাম, সেই বয়স তোমাকে অধিক কামনা করছে।”

ফোনের রিংটোনে অপূর্ব-র ভাবনার সমাপ্তি ঘটে। হাসপাতাল থেকে ফোন করেছে। নতুন যোগদান করে একদিন গিয়েছিল, আরুর চিন্তা আর যায়নি। তিনটা দিন পেরিয়ে গেছে আরু নিখোঁজের। সূর্যটাও আগের মতো উঠে না অপূর্ব-র আকাশে, মেঘলা থাকে সর্বক্ষণ।
বিষণ্নতায় মাখা মন নিয়ে রিসিভ করে কল। ওপাশ থেকে কী বলল শোনা গেল না। অপূর্ব শান্ত গলায় বলে, “আমি কয়েকটা দিন যেতে পারব না। একটু অশান্তিতে আছি।”

অপূর্ব লাইন বিচ্ছিন্ন করে পুনরায় চোখের পাতা বুঝে আরুকে আহ্বান করল। মায়ের ডাকে চোখ মেলে তাকাল অপূর্ব। তিনদিন পর তার চোখের পাতা লেগে এসেছিল। একটু ঘুম পেয়েছিল। সে স্বপ্নেও আবির্ভাব ঘটেছিল আরুর। অনিতা বসতেই অপূর্ব মায়ের কোলে মাথা রাখে। জড়িয়ে ধরে বলে, “মা আমার পদ্মাবতীকে কি আমি ফিরে পাবো না?”

“তুই তো বললি, ‘ওকে তুই বিয়ে করবি না।’ তাহলে ওর জন্য উতলা হচ্ছিস কেন?” ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জরানো গলায় বলে অনিতা।

“তুমিই তো আরুর ভালোবাসার বীজ আমার বুকে বপন করেছিলে। বীজ থেকে চারা হয়ে উঠেছে। সেই চারা অন্য কারো বুকে রোপন করতে দিবো না। এখানে বড় হবে।” প্রেমপূর্ণ কণ্ঠে বলে অপূর্ব।

অনিতা নিরবে অপূর্ব-র চুলগুলো টেনে দিচ্ছে। অপূর্ব-র বন্ধ করা চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু অনিতার শাড়িতে পড়ে। স্বযত্নে ছেলের চোখ মুছে দিয়ে বলে, “পশ্চিম দিকের লোকজন তোর বাবাকে ফোন দিয়েছিল। সেদিকে একটা মেয়েকে কড়ই গাছের মগডালে হাঁটতে দেখা গেছে। সকাল থেকে দেখা যাচ্ছে। বর্ণনা অনেকটা আরুর সাথে মিলে গেছে। তোর বাবা সেদিকে গেছে।”

চকিতে অপূর্ব উঠে বসে। প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠে অপূর্ব। ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে ধীরে ধীরে ব্যক্ত করে বর্ণ, “আমি জানি ওটা আরু মা। ঐটাই আমার পদ্মাবতী। কীভাবে যেতে হবে, আমায় একটু বলো। আমি যাই।”

অনিতা প্রহরী ডেকে তাদের হাতে অপূর্ব-কে তুলে দিয়ে আরুর কাছে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি স্ব-শরীরে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দিলেন। অপূর্ব সে-তো আগে আগেই ছুটে গেল।

তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো,
আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে..!

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-১৪+১৫

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৪

অপূর্ব ভাই উবুড় হয়ে গাঢ় নিদ্রায় ব্যস্ত। দিঘি কিনারা থেকে একটা কাঁকড়া ধরে এনেছে আরু। পানি ছাড়া কাঁকড়া ছয় ঘণ্টা বেঁচে থাকতে পারে বলে আরুর কষ্ট কম হলো। দুহাত দিয়ে কাঁটাযুক্ত হাত ধরা ছিল। ধীরে ধীরে বিছানার কর্ণারে রেখে নিঃশব্দে পা বাড়ল আরু। রহস্যপূর্ণ হাসি দিয়ে আনমনে বলে, “বিয়ে না করে লিভ-ইন সম্পর্কে জড়ানোর খুব শখ না আপনার। আজ এই কাঁকড়া আপনার মন থেকে চিরতরে লিভ-ইন সম্পর্কে জড়ানোর শখ ঘুচিয়ে দিবে।”

সকাল বেলা ঘুম থেকে জেগে নিমপাতা দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে দিঘির পাড়ে গিয়েছিল আরু। তখনই কাঁকড়াটাকে দেখতে‌ পায়। অবশ্য রাতে ঘুমানোর সময় পরিকল্পনা করেই রেখেছিল।
__
আরু মামিদের সাথে রান্নাঘরে বসে আছে। আজ শুক্রবার। স্কুল বন্ধ। তাই চারবোন একসাথে বসে আছে। স্কুল থেকে দেওয়া সরকারি বিস্কুট দিয়ে রং চা খাচ্ছে সকলে। ভোরে রাখাল চাচা বাড়িতে ফিরে গেছে। তাই দুধ ধোয়ানো হয়নি। ফলস্বরূপ আজ দুধ নেই বাড়িতে। কিয়ৎক্ষণ পর তিয়াস ও অপূর্ব এসে যোগদান করে। অপূর্ব-র পরনে লুঙ্গি ছাড়া। নগ্ন পিঠে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। সৃষ্টি হয়েছে ক্ষতের। উপর তৈলাক্ত মলম লাগানো। উপস্থিত সবাই স্তম্ভিত হয়ে যায়। অনিতা উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, “অপু তোর বুকেপিঠে এগুলো কীসের ক্ষত?”

“কাঁকড়ার। ঘুমের মাঝে মনে হচ্ছে, পিঠ কেটে নিয়ে যাচ্ছে কিছুতে। প্রথমে ভেবেছি তোমরা কেউ। তখন তিয়াস দেখাল কাঁকড়া। অনেক কষ্টে ছাড়িয়েছি।”

“শোবার ঘরে কাঁকড়া, কী বলিস?”

“হ্যাঁ চাচি। তিয়াস তো বলল ওটা কাঁকড়া।”

আরু নতজানু হয়ে চায়ে চুমুক দেয়। উক্ত কাজটি আরুর দ্বারা সম্পন্ন হয়েছে, সে সম্পর্কে অবগত অপূর্ব। ক্ষতগুলোতে হাত বুলিয়ে বেদনাক্রান্ত কণ্ঠে বলে, “পিঠের সাথে চেপে ছিল। অনেক কষ্টেও ছাড়াতে পারিনি। তখন মনে হচ্ছিল প্রাণপাখিটা উড়ে যাচ্ছে।”

চায়ের কাপটা তৎক্ষণাৎ ঠেলে রাখে আরু। সামনে রাখা বড় পাত্রটা নিয়ে অবনত কণ্ঠে বলে, “মামি তখন তো বললে, অপূর্ব ভাইয়ের জন্য মেয়ে দেখতে যাবে। চাচা না-কি ছুটি নিয়ে গেছে। মিষ্টিও তো বানাতে হবে। আমি একটা কাজ করি, দুধ দোহন করে নিয়ে আসি।”

উপস্থিত প্রত্যেকে স্বাভাবিক ভাবে ব্যাপার নিলেও অপূর্ব-র ক্ষেতে ব্যতিক্রম, পরিচিত হলো আরুও অসাধারণ একটি গুণের সাথে। তদানীং পাত্র নিয়ে গোয়ালের উদ্দেশ্যে অগ্ৰসর হয়েছে আরু।

আজ কুদ্দুস রাখাল আসেনি। সকালে গোয়াল আবর্জনাশূন্য করে নিজ সংসারে প্রত্যাগমন করেছেন। অপরাহ্ণের পূর্বেই পুনরায় যাত্রা শুরু করবেন।

আহসান নিবাসে ছয়টা গোরু। তার মধ্যে পাঁচটা দুধ দেয়, বাছুর রয়েছে বারোটা। আরু বাছুর সরিয়ে দিয়ে সংগ্রহ করতে ব্যস্ত হয়ে উঠল। একে একে চারটা গোরুর দুধ সংগ্রহ করে পঞ্চম গোরুর কাছে পৌঁছাতেই হাজির হলো বাহিনী। অপূর্ব পাত্রে অবলোকন করে ভ্রু কচকালো। পাঁচ সেকেন্ড আরুর কাজের গভীর দৃষ্টি মস্তিস্কে বন্দি করে বলে, “আরু সর, আমি সংগ্রহ করছি।”

“না আমি পারব। এমনিতেই আপনার দেহে পীড়া। গোরুতে পদাঘাত করলে হিতে বিপরীত হবে।” নেতিবাচক জবাব দিয়ে আরুর নিজের কাজে ব্যস্ত হলো। অপূর্ব স্থির রইল না। টেনেহিঁচড়ে আরুকে সরিয়ে নিয়ে কাজটি করতে বসল। আরুর মুখের কথা মুখে সীমাবদ্ধ রইল না, তিন সেকেন্ড পর পদাঘাত পড়তে বিলম্ব হলো না। চিত হয়ে গোয়ালে পড়ে। উপস্থিত সবাই হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। কিঞ্চিৎ হাসল আরু। অপূর্ব-কে টেনে তুলে লক্ষ্য করল বক্কে। গোরুর পায়ের বিষ্ঠার ছাপ অপূর্ব-র বুকেই শুধু নয়, সারাদেহে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিশ্রী গন্ধ। আরু কলতলার দিকে অগ্রসর হতে হতে তুরকে উদ্দেশ্য করে বলে, “দুধগুলো নিয়ে মামিকে দে। আর বলিস ভিখারি এসেছে। দুমুঠো চাল দিতে।”

প্রথমদিনের অপূর্ব-র উক্তিটিকে কটাক্ষ করে বলেছে, তাতে সন্দেহ নেই। আরু হাত ধুয়েছে, অপূর্ব গোসল সেরে নিয়েছে। অনিতা চুল হলুদ নিয়ে আরুকে পাঠাল অপূর্ব-র ঘরে।
অপূর্ব জানালার শিক ধরে রাজহাঁস দেখছে। সিল্ক চুলগুলো ভেজা, টুস টুস করে ঝরছে পানি। লুঙ্গি পরে রোদে বসেছে।

মৃদু স্বরে বলে, “আসব।”
অপূর্ব না তাকিয়ে জবাব দেয়, “আয়।”

আরু ঘরে প্রবেশ করে চুল-হলুদের মিশ্রণের পাত্রটা বিছানায় রাখে। অনিতা বাটিটা অপূর্ব-র কাছে পৌঁছে দেওয়ার আদেশ করেছে, কিন্তু আরু সেখানে ক্ষান্ত থাকতে চায় না। নিজের দেওয়া ক্ষতটা স্পর্শ করার স্পৃহা। নিশ্চল আরুকে দেখে মুখ খুলে অপূর্ব, “রেখে যা, আমি লাগিয়ে নিবো।”

একপা, দুইপা, তিনপা, চারটা.. গুনে গুনে দরজা পর্যন্ত গিয়ে পিছু ফিরে তাকায়। ফাঁকা ঢোক নেমে যায় গলা বেয়ে। ইতস্তত করে‌ বলে, “আমি লাগিয়ে দেই?”

“খুব ব্যথা করছে আরু। মনোচিকিৎসক না হয়ে ম্যাজিশিয়ান হলে ভালো হতো। এক নিমেষে নিজের ক্ষতটা সারিয়ে ফেলতাম।”‌ করুণ শোনাল অপূর্ব গলা। আরু থেমে নেই, বাটিটা নিয়ে অপূর্ব মুখোমুখি বসে। ডানহাতের চারটা আঙুলের তলে মেখে লেপ্টে দিল অপূর্ব-র ক্ষতে। জ্বলে উঠল স্থানটা।‌ মৃদু আর্তনাদ করে‌ আরুর হাতটা চেপে ধরে অপূর্ব। ছলছল চোখের তারা। আরু আশ্বাস দেয়, “একটু সহ্য করুন প্লীজ। এটা লাগালে কিছুক্ষণের ভেতরে জ্বালা কমে যাবে।”

আরু যত্নসহকারে ক্ষতগুলোতে চুল-হলুদের মিশ্রণ লাগিয়ে দেয়। অপূর্ব ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠেছিল আর আরু ঠিক ততবার গুনেছিল; এক, দুই, তিন, চার.. উনিশ। আরুর চোখ অশ্রুতে পূর্ণ হয়ে এলো। কাজটি শেষ হতে এক মুহুর্ত না থেমে সর্বশক্তি দিয়ে ছুটে গেল। অপূর্ব হেসে বলে, “আমি জানি, আমার বিছানায় তুই কাঁকড়া ছেড়েছিলি। কিন্তু কেন? আবার আমার আঘাতে কষ্টই বা কেন পাচ্ছিস?”

নদীতে পা ঝুলিয়ে বসেছে আরু। নদীটা পাড় হলেই তাদের বাড়ি। এখানে থেকে কাউকে কষ্ট দেওয়ার মানেই হয়না। চকিতে নামল নদীতে, অতঃপর থামল। এগোল না। নদীর তীরে দীর্ঘক্ষণ পা ডুবিয়ে বসে থাকল। নদীর তীরে তিনটা কাঁকড়া নজরে আসতেই ডান হাত বাড়িয়ে বাধা দিল তার গমনপথে। অতঃপর তিনটা কাঁকড়া ক্ষতবিক্ষত করল আরুর হাত। টলমলে চোখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁতে চেপে সহ্য করে ঊনিশটা আঘাত। অতঃপর হাত ঝেড়ে কাঁকড়া ফেলে দিল। রক্তগুলো চুইসে চুইসে পড়ছে নদীতে। লাল রঙটা নিঃশেষ হয়ে উঠছে। প্রেমপূর্ণ কণ্ঠে বলে, “আপনাকে দেওয়া কষ্টগুলো আমি নিজে অনুভব করার চেষ্টা করলাম অপূর্ব ভাই।
_
ইমদাদ হোসেন মৃধা ঢাকা থেকে ফিরেছেন। ছেলে-মেয়েদের জন্য এত এত খাবার নিয়ে এসেছেন। এনেছেন আরুর পছন্দের পদ্মার ইলিশ। শ্বশুর বাড়ির জন্য এনেছেন মিষ্টি, পানসুপারি ও ফলমূল। তাকে দেখে আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন অনিতা। এক গ্লাস লেবুর শরবত দিয়ে আরও কিছুর তোরজোর করার চেষ্টা করতেই ইমদাদ হোসেন মৃধা বলেন, “ভাবী দুপুরের সময় এসেছি, পারলে দুমুঠো ভাত দাও। খেয়ে আরুকে নিয়ে রওনা দেই।”

“আরুকে নিয়ে যাবি?” মোতাহার আহসানের প্রশ্ন। মাথা নেড়ে ইমদাদ তার উত্তর জানাতেই অনিতা টঠস্ত হয়ে টেবিল সাজাতে লাগলেন, বংশের একমাত্র জামাতা বলে কথা।
শেফালী ও তুর ডাকতে গেল আরুকে। আরু ওদের ঘরে শুয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে আছে, যদিও একটু বসন্তের ছোঁয়া লেগেছে।
“তুই কি গোসল করবি না আরু?” তুরের প্রশ্নে আরু জবাব দেয়, “না-রে। ভালো লাগছে না।”

পীড়াপীড়ি করেও আরুকে সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারেনি তুর বা শেফালী। অগত্যা যেতে হয় তাদের। ইমদাদ বিদেশেও গেছেন বেশ কয়েকবার। তার মাধ্যমেই অপূর্ব-র জন্য পিঠা প্রেরণ করতেন পারুল। সম্পর্ক তাদের মিষ্টি মধুর। অনিতাও এলেন ফিরে। চিন্তিত ধারায় বলেন, “আরুর কী হলো, কেন জানে? কতবার ডাকলাম আসল না।”

অপূর্ব-র খাওয়া শেষের পথে তখন। অবশিষ্ট খাবার এক লোকমায় মুখে তুলে কোনোরকম হাত ধুয়ে পা বাড়াল বোনদের কক্ষের দিকে। আরু পিঠ দেখিয়ে শুয়ে আছে। অপূর্ব বাজখাঁই গলায় বলে,

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৫

“তোর সাহস দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে আরু। ডাকলে কারো কথা শুনিস না। এক চ/ড়ে তোর সব দাঁত আমি খুলে ফেলব।” অপূর্ব-র বাজখাঁই গলা। আরু তবুও নিজ সিদ্ধান্তে অনড় থেকে প্রতিক্রিয়া দেখল না।

অতঃপর অপূর্ব নিজেই যেতে বাহু টেনে বসাল আরুকে। আরুর আঙুলের ভাঁজে আঙুল রাখলেই মৃদু আর্তনাদ করে আরু। অপূর্ব ভ্রু কুঁচকে নিজের হাতে দৃষ্টি মেলাল। নিজের হাতে ছাপছাপ রক্তের দাগ দেখে বিচলিত হয়ে আরুর হাত পরখ করে। ক্ষতগুলো তার চেনা ঠেকল। অনন্তর তেজস্রী গলায় বলে, “আমাকে চুল-হলুদ লাগানোর সময় তোর হাতে এমন ক্ষত ছিলনা আরু। এই অবস্থা হলো কখন?”

প্রশ্নের জবাব না পেয়ে নির্ভীক হয়ে উঠে অপূর্ব। পুনরায় তেজপূর্ণ গলায় বলে, “কিছু জিজ্ঞেস করছি আমি।”

“আমি.. আমি আপনার বিছানায় কাঁকড়া রেখেছিলাম। গতকাল আপনি বলেছিলেন না, আপনি ‘লিভ-ইন’এ ছিলেন। তাই রোষের বসে।” ক্রন্দনরত অবস্থায় আরুর ভাঙা গলা বলে। অপূর্ব প্রশান্তির হাসি দেয়। ‘আরুও যে প্রেমে জড়িয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে’ – সে কি তা জানে?
দরজার বাইরে থেকে সেই মুহূর্তটি দেখে আনন্দে আটখানা হয়ে গেলেন অনিতা। ছেলেকে তিনি আরও কিছুটা সময় দিবেন, জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। কারণ একটি ভুল সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে।
_
ইলিশ মাছ দুটো নিয়ে বাবাইয়ের পাশাপাশি হেঁটে বাড়িতে এলো আরু। মেয়েকে পেয়ে ইমদাদ হোসেন মৃধার আনন্দের অন্ত নেই। বাড়িতে আরুর পদচারণ পড়তেই ময়না উড়ে এসে বসল আরুর কাছে। তিনবার আওড়াল, “আরুপাখি! আরুপাখি! আরুপাখি! এসেছিস! এসেছিস! এসেছিস!”

“হ্যাঁ, এসেছি ময়না। দেখ, বাবাই কতবড় ইলিশ মাছ নিয়ে এসেছে।”

পারুল দিঘির পাড়ে বোলের ভেতরে পানি নিয়ে বসেছে। অয়ন সাবান ঘসছে। ময়না পাখির ডাক শুনে উঠানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই আনন্দে ভরে উঠলেন তিনি। কতদিন পর নিজের স্বামীকে দেখেছেন। ছেলেকে রেখেই ছুটে গেলেন ইমদাদ হোসেন মৃধার কাছে। বক্ষে ঝাঁপিয়ে মায়াবী কণ্ঠে বললেন, “কেমন আছো তুমি? আসবে যে, একবারও তো বললে না।”

“বলে দিলে সারপ্রাইজ থাকতো? আমাকে দেখে কেউ চামকাতো?” মাথায় হাত রাখলেন পারুলের। আনন্দের অশ্রু আবির্ভাব। আরু পাশে দাঁড়িয়ে আছে, তা লক্ষ্য করে ইমদাদ আদুরে গলায় বলেন, “ছেলেমেয়েরা পাশে দাঁড়ান। কখন কে আসে বলা তো যায়না। ঘরে গেলে জড়িয়ে রেখো।”

পারুল ছেড়ে দাঁড়াল। মেয়েকে দেখে তার মস্তিষ্কে অগ্নি প্রজ্বলিত হলো, কিন্তু মনে জেগে উঠল মাতৃত্ব। আপন করে নিল আরু-কে। মেয়ের মাথা হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, “মাকে মনে পড়ল তোর? কোমরে ব্যথা পেয়েছি। কালকে সবাই দেখতে এসেছিল তুই বাদে।”

স্তম্ভিত হলো আরু। গতকাল সবাই আরুকে মিথ্যা বলে তার মাকে দেখতে এসেছিল? চকিতে আরুর হাত ধরে পারুল বললেন, “হাতে ব্যান্ডেজ কেন? কী হয়েছে মা?”

“একটু ব্যথা পেয়েছি।” মেয়ের হাতে চুমু খেলেন পারুল। ইমদাদের কাছ থেকে বাজার নামাতে নামাতে বললেন, “আরুর সাথে দেখা হলো কখন, না-কি ঐ বাড়িতে গিয়েছিলে?”

“গিয়েছিলাম। আরু ইলিশ মাছ খেতে পছন্দ করে, তাই নিয়ে এসেছি।”

“অপূর্ব বিদেশ থেকে এসেছে। ওর সামনে দিয়ে কীভাবে তুমি ইলিশ মাছ নিয়ে এলে?”

“ভাবীকে বলেছিলাম রেখে দিতে। রান্না করে কয়েক টুকরো পাঠিয়ে দিতে। আমাকে ধমক দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। একটা কাজ করো, ইলিশ মাছটা রান্না করে ওদের আসতে বলে দাও। ছেলেটা এখন পর্যন্ত ফুফু বাড়িতে বেড়াতে আসেনি। এসে দুদিন থেকে যাবে।” ইমদাদের কথা পছন্দ সই হলো পারুলের। আরু সুন্দর করে ইলিশ মাছ কা/টতে পারে তাই আরুকে বলতে চেয়েছিলেন ইলিশটা কে/টে নিতে, আরুর হাতের দিকে চেয়ে তা পারলেন না। অন্য আদেশ দিলেন, “একটা কাজ কর মা, অয়নকে গোসল করিয়ে দে। আমি কাজগুলো করে নিচ্ছি।”

এতক্ষণে ছেলের কথা স্মরণে এলো ইমদাদের। আশেপাশে চেয়ে ছেলের সন্ধান করতে করতে বলে, “অয়নকে দেখছি না কোথায় ও?”

“দিঘির পাড়ে। গোসল করছে। তুমি গিয়ে বিশ্রাম করো।” বলেই বাজার নিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল পারুল। ইমদাদ ঘরে চলে গেলেন। আরু গেল দিঘির দিকে।
দাঁত চেপে বসে আছে অয়ন। বাবা এসে একবারও তার নাম করেনি, অথচ ফেরার সময় মেয়েকে নিয়ে এসেছে। ইটের বড়ো টুকরোটা পানিতে ছুড়ে দিয়ে বলে, “বাবাই আমাকে একটুও ভালোবাসে না। কেউ ভালোবাসে না। সবাই শুধু আরু আরু করে।”
_
পারুল মাছ ভাজছে আর দুই ছেলেমেয়ে বাটি সমেত উনুনের কাছে বসে অপেক্ষারত ইলিশ মাছ ভাজা খাওয়ার জন্য। হলদেটে আলোয় মাছের দিকে তাকিয়ে বলে অয়ন, “মা আর কতক্ষণ লাগবে?”

“বাপুরে বাপু, এই নিয়ে সতেরবার জিজ্ঞেস করেছিস। একটু অপেক্ষা কর। এগুলো তো তোরাই খাবি।” বিরাগী হয়ে বলতে বলতে পাতা দিল উনুনে। ইমদাদ ছেলে-মেয়েদের দিকে চেয়ে আছে অনুভূতি পূর্ণ দৃষ্টিতে। কতগুলো দিন সে পরিবারের এই মুহুর্তটা মিস করেছে। এরমধ্যে পারুল ইমদাদকে আহসান বাড়িতে ফোন দিতে বললেন। কিয়ৎক্ষণ পূর্বে ফোন করে আসতে বলেছেন অপূর্বদের। অনিতা বারণ করে দিয়েছে, ‘ছেলে মেয়েদের জন্য মাছ কিনে এনেছে, ওরাই তৃপ্তি করে খাক।’

ফোন করার আগেই হাজির হলো অপূর্বরা। খালি হাতে আসেনি। অনেককিছু বহন করে এনেছে। তাঁরাও গোল করে উনুনের কাছে বসে। ততক্ষণে ইলিশের এক তাবা হয়ে গেছে। পারুল ভাজা মাছ তুলে রেখে বলে, “আরু পশ্চিম পাড়ায় কাঠালি কলা ‘গাছেই’ পেকেছে। তুই নেই বলে আমিও সাহস করে যাইনি। দা* খানা নিয়ে কলা ছড়া পেরে নিয়ে আয় মা। ভাবী দুধ পাঠিয়ে দিয়েছে। তোর বাবাই দুধকলা ভাত খেতে পছন্দ করে অনেক।”

“আচ্ছা, আগে মাছটা খেয়ে নেই।”

পারুল দিতে চাইলেন না। তালবাড়িয়ার শিমুলের মেয়েকে ভুতে ধরেছে ইলিশ মাছের জন্য। ভর সন্ধ্যা বেলা ইলিশ মাছ ধুতে গিয়েছিল নদীর পাড়ে। ঐ গায়ে দিঘি নেই, শুধু বড়ো একটা নদী। সবাই সেই নদীকে নিজের ভেবে শাসন করে।
ভুতের কথা বললে আরু ভয়ে যেতে চাইবে না, তাই খোলসা না করে ইঙিয়ে বলে, “তুই যদি কলা এনে খাস, তবে তোকে দুইটা মাছ খেতে দিবো।”

‘প্রয়োজনের সময় পান্তাও যেমন অমৃত’ー⁠ আরু সেই যুক্তি মেনে নিজহাতে মাছ পাতে তুলে খেতে লাগল। উপস্থিত সবাইকে মাছ খেতে দিলেন পারুল। বিদেশে অবস্থানরত সময়ে পারুল পদ্মার ইলিশ ভেজে অপূর্ব-র জন্য পাঠিয়েছেন। অপূর্ব-রও খুব প্রিয় এ মাছ। মৃদু হলদেটে আলোতে দ্রুত খেতে গিয়ে অঘটন ঘটিয়ে ফেলল। কাঁটা বাঁধল গলায়। দুবার কাশি দিয়ে গলা ধরে অপূর্ব। পারুল বিচলিত হয়ে বলে, “কী হয়েছে অপু? কাঁ/টা বেঁধেছে?”

“হ্যাঁ ফুফু।”

“দেখে খাবি না। আমাকে বললে আমি কাঁ/টা বেছে দিতাম। (অতঃপর আরুকে আদেশ করে) যা কয়টা শুকনো ভাত নিয়ে আয়।”

আরু ছুটে যেয়ে ঘর থেকে শুকনো ভাত নিয়ে এসে ক্ষান্ত রইল না। দলা পাকিয়ে অপূর্ব-র মুখে তুলে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “না চিবিয়ে গিলে ফেলুন। নেমে যাবে কাঁ/টা।”

প্রথমবার ও দ্বিতীয়বার ব্যর্থ হলো আরু। তৃতীয়বার সফল হলো। আরুর কথা মেনে গলা বেয়ে নেমে গেল কাঁ/টাটা। অপূর্ব-র চোখ রক্তিম হয়ে আছে। তবুও মাছ খাবে অপূর্ব। পারুল কাটা ছাড়াতে ছাড়াতে অপূর্ব-র মুখে তুলে দিল। ফুফুর ভালোবাসা গ্ৰহণ করতে পেরে পূর্ণ হলো অপূর্ব। কত ভালোবাসে অথচ আরুর জন্য ফুফুর সাথে কেমন ব্যবহার করল সে। সকলের অগোচরে আরু দা* নিয়ে ছুটেছে উত্তর পাড়ায়। আলাদা কলা বাগান। হাতে একটা টর্চ, যার তুখোড় আলো। আজকের হাওয়াটা অন্যরকম, কেমন গাঁ ছমছমে পরিবেশ। আকাশে একটা তাঁরাও নেই, চাঁদ তো অনুপস্থিত।
আজ অমাবস্যা তিথি। মুরুব্বিরা বলে, এরাতে একটা দড়ি উঠানে পড়ে থাকলে তা-ও না-কি সাপ হয়ে শব্দ করে। আরও শরীরে ইলিশ মাছের গন্ধ। কলা বৃক্ষের কাছে ফল চেয়ে অনুরোধ করে দা বসাল বৃক্ষে। কলা কেটে বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়াতে পেছন থেকে আরু আরু বলে ডেকে উঠল কেউ অথচ সেই দিকটা জনশূন্য, মানবশূন্য, থাকেনা কেউ। আরুর মতো একটা মেয়ে কেঁপে উঠল ভয়ে। পায়ের নূপুরের ঝুনঝুন শব্দে আরু হয়ে উঠল উদাসীন। তার পা কাঁপছে। মনে হচ্ছে বৃক্ষের শিকড় সর্প হয়ে তার চরণ জোড়া আবদ্ধ করে রেখেছে। যেন গলা চেপে ধরেছে কোনো অজ্ঞান বস্তু। তার হৃৎপিণ্ড স্বাভাবিক নেই। ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে। আকাশমণি গাছটা মুঠো করে ধরে চিৎকার করে উঠে আরু, “মাআআআ!”

লোহা, রসুন, আগুন সঙ্গে থাকলে তারা কাছাকাছি আসতে পারেনা। আরুর হাতে লোহার দা*। আরুর ভীত ভাবটা কিঞ্চিৎ দূর হলো। একহাতে কলা ছড়া অন্যহাতে দা* নিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে ছুট লাগাল বাড়ির দিকে। তালগাছ পর্যন্ত আসতেই আরুর বড়ো খোঁপাটা খুলে চুলগুলো উড়তে লাগল শীতল হাওয়াতে। ষষ্ঠইন্দ্রিয় সতেজ হয়ে উঠল। লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল।

তদানীং মেয়ের চিৎকার শুনে উপস্থিত সবাই ছুটে এসেছে। ল্যাম্প নিয়ে একই রাস্তা দিয়ে আরুকে ছুটতে দেখে তারাও ছুটল। পারুল গিয়ে ধরল আরুকে। পরক্ষণে হাত থেকে খসে পড়ল বস্তু দুটি। চেতনা হারিয়ে লুটিয়ে পড়ার পূর্বেই অপূর্ব তার শক্তহাতে আরুকে আষ্টেপৃষ্ঠে আবৃত করে‌ নিল। পারুল দ্রুতহাতে চুলগুলো খোঁপা করে ল্যাম্পের অগ্নিশিখার তাপ আরুর দেহে স্পর্শ করাল। পারুলের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এসেছে।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-১২+১৩

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১২

আরু আজ দুপাশে বেনুনি গেঁথেছে। তাতে লাগিয়েছে গাঁদা ফুল। খয়েরি গাঁদা। সকালের নাস্তা খেয়ে চম্পার পানের ডালা থেকে পান নেওয়ার জন্য পা বাড়াল আরু। মুখে তুলে যাওয়ার সময় চম্পা পেছন থেকে ডেকে উঠল আরুকে। আরু দু বেনুনি ঘুরাতে ঘুরাতে বলে, “কী হয়েছে নানি জান, পেছন ডাকলে কেন? তুমি জানো না পেছন ডাকতে নেই।”

“তোকে আমার প্রয়োজন। পেছন না ডাকলে কি তুই আসতিস?”

“কেন?” দাঁতের আগায় চুল লেপ্টে বলে।

“দেখ না, আমার মাথার চুলগুলো পেকে গেছে। তুই বেছে বেছে পাকাগুলো তুলে দে।” আরুর হাত ধরে বাসনা নিয়ে বললেন চম্পা। খানিক বিরক্ত হলো আরু। প্রতিবার এই বাড়িতে আসলে পাকা চুল তুলে দেওয়া আরুর ধরাবাঁধা কাজ। অথচ চম্পার মাথায় হাতে‌ গোনা এক গোছা চুলও নেই কাঁচা। কোমরে হাত দিয়ে ললাট কুঁচকে বলে, “নানি জান, তোমার মাথায় পাকা চুল তুলতে গেলে নেড়ো হয়ে যাবে।”

“নেড়ো হলে আমি হবো। তুই এদিকে আয়।” আরুকে জোরজবরদস্তি করে ঘরে নিয়ে গেলেন চম্পা। ফিরি পেতে বসলেন। বিরক্তির সাথে কয়েকটা পাকা চুল তোলার পর আরুর মুখে হাসিটা গাঢ় হয়ে উঠল। পাকা চুল রেখে নানির মাথার কাঁচা চুল তুলতে আরম্ভ করল আরু।
পাকা চুল উত্তোলনের সময় আয়াশ পাওয়া যায়, কাঁচা চুলের ক্ষেতে বিপরীত। চম্পা মাথা চেপে বলে, “এখন ব্যথা পাচ্ছি কেন আরু?”

“তাড়াতাড়ি তুলছি তো তাই। ভালো না লাগলে বলো, আমি রেখে দেই।” বলতে বলতে হেসে উঠল আরু।

“না না, তুই তুলতে থাক। একটু ধীরে ধীরে তুলিস, ব্যথা যাতে না পাই।” চম্পার আদরে বলা কথায় আরুর মন গলে না। দীর্ঘ এক ঘণ্টার অধিক সময় অতিবাহিত হয়‌। নিজের কাজ সম্পন্ন করে উঠে দাঁড়ায় আরু। প্রতিবার চুল তুলতে দিলে অস্থির হয়ে উঠতো, আজ তেমন না হওয়াতে প্রসন্ন হলেন চম্পা। আরুর চিবুক স্পর্শ করে আঙুলে চুমু খেয়ে বলে, “আজকে যা, আবার কালকে তুলে দিস।”

ভাব নিয়ে বলে, “আজ তোমার সব চুলগুলো তুলে দিয়েছি।”

“কী বলিস, একটুকু সময়ে সব তুলে ফেলেছিস?” উদ্বিগ্ন হয়ে বলে।

যথাসম্ভব অনুদ্ধত রইল আরু। পাকা চুল থেকে বাছাই করে ফেলে দেওয়া কাঁচা চুলগুলো তুলে নানি জানকে দেখায়। বিদ্রুপ করে বলে, “হাঁ! হাঁ! হাঁ! তোমার মাথার সব কাঁচা চুল তুলে ফেলেছি নানি জান। এবার তুমি আবার চুল তোলার কথা বললে ট্রিমার দিয়ে পাকা চুল তুলে ফেলব সব।”

চম্পা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যায়। কিয়ৎক্ষণ নিজের চুলে তল্লাশি করেও যখন সন্ধান পেল না কালো চুলের তখনই ক্ষিপ্র হয়ে উঠল। লাঠি দিয়ে মারতে চাইল আরুকে। আরু ছুটল। বৈঠকখানায় আড্ডা দেওয়া মামার পেছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল। চম্পা লাঠি নিয়ে উপস্থিত হতে দেখে উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে উঠল। মোতাহার আহসান বললেন, “মা তুমি লাঠি নিয়ে আরুকে তাড়া করছ কেন?”

“তুই ওকে ছাড়, আজ ওকে আমি ইচ্ছামতো পেটাবো।”‌ বলতে বলতে আরুর দিকে অগ্রসর হলেন চম্পা। আরু ছুটে অপূর্ব-র কাছে গেল। অনিতা এসে ক্ষান্ত করল চম্পাকে, “এভাবে বাচ্চা মেয়েটাকে লড়াচ্ছেন কেন মা, কী করেছে ও।”

“কী করেনি, তাই কও। ওরে আমি বললাম ‘আমার মাথার পাকাচুল তুলে দিতে।’ ও কাঁচা চুলগুলো তুলে দিল। একটা কাঁচাচুলও নেই।” সবাই নিঃশব্দে হাসল। মা-কে শান্ত করতে আরু-কে কিছু বলা উচিত, “আরু তুই মায়ের কাঁচা চুল কেন তুলেছিস?”

“বাহ্-রে! প্রতিদিন আমার কাছে এসে বলে পাকাচুল তুলে দিতে। ওনার মাথায় সব পাকাচুল। মাঝে মাঝে দু-চারটা কাঁচা চুল। তাই বুদ্ধি করে কাঁচা চুলগুলো তুলে দিলাম। এরপর যদি আবার পাকাচুল তুলতে হলে, তাহলে ট্রিমার দিয়ে সব চুল তুলে ফেলব। হি! হি! হি!” অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সবাই। আরুকে বাহবা দিয়ে বলে, “মা, তোমারই দোষ। এত পাকা চুল তুলতে গেলে তোমার মাথা টাক হয়ে যাবে।”

চম্পা লাঠি দিয়ে মাটিতে আঘাত করে ঘরের দিকে অগ্রসর হতে হতে বলেন, “যেমন মামা, তেমন ভাগ্নে।”

আরু বাইরের দিকে অগ্রসর হলো। সূর্য মাথা তখন মাথায় উপর উঠেছে। অপূর্ব কলতলায় পা রেখেছে গোসলের উদ্দেশ্যে। কল চেপে বালতি পূর্ণ করল। অতঃপর দরজার দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে এলো বিরক্তিতে। গ্ৰামে এসে এখন অবধি সে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করেনি, মায়ের করে দেওয়া উষ্ণ পানিতে গোসল সেরেছে। নূপুরের সেই মাতাল হওয়া ধ্বনি শুনেই মুখ তুলে অপূর্ব, “আরু, এদিকে শোন।”

আরু এসে স্থির হওয়ার পূর্বেই অপূর্ব বলে, “রান্নাঘরে গিয়ে দেখত, পানি গরম হয়েছে কি-না? গরম হলে মা-কে নিয়ে আসতে বল।”

আরু না থেমে রান্নাঘরে গেল। অপূর্ব-র সাথে সে অভিমান করে আছে। একটুকুও কথা বলবে না।
পানি ফুটতে শুরু করেছে। তবুও পাতা পুড়িয়ে তাপ দিচ্ছে অনিতা। ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে, “মামি অপূর্ব ভাই কলতলায় বসে আছে। পানি গরম হলে আমাকে দাও। আমি দিয়ে আসছি।”

অনিতা শুকনো পাতা দেওয়া বন্ধ করে চলা কাঠটা ভুলবশত আরুর দিকে তাক করে বলে, “তোর শরীরে জ্বর। মাথা ঘুড়ে পড়ে গেলে হিতে বিপরীত হবে। আমি দিয়ে আসছি।”

আরুর কর্ণপথে পৌঁছাল না সেই কণ্ঠ। এক দৃষ্টিতে জ্বলন্ত চলা কাঠটার পাশে চেয়ে আছে। অতঃপর চিৎকার দিয়ে বলে, “নাহহ। মা মেরো না।”

উপস্থিত সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বাক্‌শূন্য সকলে। আরু ক্রমশ পিছু হটছে। অপূর্ব এসেছে তখন। দ্রুতি কণ্ঠে‌ বলে, “মা পানি কতদূর?” আর কিছু উচ্চারণ হলো না। তার হৃৎপিণ্ডে ধাক্কা লাগল কোনো রমনীর। অতঃপর সেই রমনী দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করে নিল অপূর্ব-কে। আরুর কম্পিত শরীরটা অপূর্ব-র সংস্পর্শ এসেছে, সেই কম্পন অনুভব করছে অপূর্ব। হৃৎপিণ্ড স্বাভাবিক নেই, ধুকপুকানি গুনতে পারছে। অনিতার দিকে চেয়ে ইঙ্গিত করল অপূর্ব। অনিতা চলা কাঠটার দিকে চেয়ে অসহায় কণ্ঠে বলে, “মনে হয়, কাঠটা ওর হাতে লেগেছে।”

“তাই হবে বোধহয়।” জাহানারা সায় দিলেন। আরুর পিঠে হাত রাখল অপূর্ব। আর্দ্র পল্লব মেলে অপূর্ব দিকে তাকালো। ছ্যাত করে উঠল অপূর্ব-র অন্তঃকরণ। ডানহাতটা গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে যখন ক্ষত-র সন্ধান পেল না তখন দৃষ্টি মেলালো অন্যহাতে। ক্ষত-র সন্ধান না পেয়ে আশ্চর্যান্বিত হলো অপূর্ব। মোলায়েম গলায় বলে, “কী হয়েছে আরু? কোথায় লেগেছে দেখি।”

“লাগেনি।” সুললিত কণ্ঠে বলে আরু দূরত্ব বজায় রাখল। অতঃপর ঘরের দিকে ছুটে পালাল। ঔৎসুক্য নিয়ে অপূর্ব বলে, “কী হলো বলোতো? হাতে তো কোনো ক্ষত পেলাম না।”

“আরু চারটা শব্দ উচ্চারণ করেছে। নাহহ, মা মেরো না।” ঝোঁক নিয়ে বলেন জাহানারা।

“আমার মেয়ে কিছু করেনি তো। ওকে নিয়ে কোথায় যাবো আমি। এই বাচ্চা মেয়েটাকে চলা কাঠ দিয়েও বোধহয় মে/রেছে।” বলেই হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলেন চম্পা।

জাহানারা কাঠের টুকরো টা সরিয়ে রেখে বলেন, “এই সব ঐ অয়নের বুদ্ধি। পেটে পেটে শুধু শ/য়/তা/নি বুদ্ধি। আসুক একবার এই বাড়িতে। এটা দিয়ে যদি না মে/রেছি।”

“ততক্ষণে নিভে যাবে।” অপূর্ব বলে।

“আবার আগুন দিয়ে জ্বলন্ত করে নিবো।” জাহানারা বলে।”

অপূর্ব উষ্ণ পানি বহন করে অগ্রসর হলো কলতলার উদ্দেশ্যে।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৩

অপূর্ব লুসমি দিয়ে গরম পাতিল কলতলায় নিয়ে এলো। হিম পানির সাথে উষ্ণ পানির মিশ্রণ করে তাকাতেই দেখল তার ব্যবহারিত স্যাবলন সাবান নিখোঁজ। গম্ভীর হয়ে ভাবার সময় শ্রবণ হলো পানি ঝাপটানোর শব্দ। অগ্রসর হলো দিঘির দিকে। শীতকালে বৃষ্টিপাত হয়না বললেই চলে, যাতে পানি শুকিয়ে গেছে অনেকটাই।অন্যদিকে দিঘি পুনরায় খনন করতে হবে। চারপাশের মাটিতে পূর্ণ হয়ে এসেছে দিঘি। হাতে গোনা কিছু মাছ রয়েছে। তিনবোন গোসল করছে। একে অপরের দিকে পানির ছিটা দিচ্ছে। সাবানটা শানের উপর রাখা। বিরক্ত হয়ে বলে, “সাবানটা নিয়ে এসেছিস, বলবি না?”

সবাই অপূর্ব-র দিকে দৃষ্টি মেলাল। অতঃপর শেফালী বলে, “ভুলে গিয়েছিলাম, নিয়ে যান এখন।”

অপূর্ব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সাবান নিয়ে পুনরায় কলতলার দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রচেষ্টা করতেই আরু বলে, “অপূর্ব ভাই, এখন শীত নেই। এদিকে আসুন একসাথে গোসল করি।”

“আমি সাঁতার জানি না।” অপূর্ব থেমে বলে।

“দিঘির জলে সবাই গোসল করতে পারেনা পূর্ব ভাই। আপনি তো কখনোই পারবেন না। একমাত্র ভালো মনের মানুষেরাই দিঘিতে এভাবে ভেসে থাকতে পারে, আপনার মনে তো কাঁদা।” আরু পানি ছুড়ে ব্যঙ্গ করে বলে। অপূর্ব থেমে গেল। ধীর পায়ে হেঁটে দিঘিতে নামল। খেজুর গাছের উপর‌ হাঁটু সমান পানিতে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। অতঃপর আরও কিছুটা নামতেই সে অনুভব করল, এই দিঘি তাকে ডোবাতে পারবে না।

আরুর মস্তিস্কে হানা দিল দুষ্টু বুদ্ধি। ডুব দিয়ে অপূর্ব-র খুব নিকটে ভাসমান হলো, পশ্চাৎ। নিজের পিঠে পাওয়া আঁচড়ের বদলা নিতে অপূর্ব-র পিঠে চেপে বসল। মাথাটা চেপে দিঘির জলে দিল চুব। বিশ সেকেন্ড পার হওয়ার পর একুশ সেকেন্ডের মাথায় আরু অনেক দূরে। অপূর্ব ঘনঘন শ্বাস ফেলে। নি/র্দয় পরিস্থিতি অনুভব করে শেফালীর হাতটা চেপে তুর বলে, “এখানে দাঁড়িয়ে নিজের পিন্ডি চটকানোর চেয়ে চল ভাগি। এখানে আমাদের রাজত্ব চললেও স্থলে ভাইয়ের রাজত্ব। তাছাড়া শুনলেও মা মা/রবে।”

শেফালী টু শব্দ উচ্চারণ না করে গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হলো। দুই বোন যখন স্থলে উঠে গেছে তখন ধ্যান ভাঙল আরুর। তার হাতে অপূর্ব-র লুঙ্গি। চাইলেও ওঠা অসম্ভব। স্থলের দিকে যাত্রা শুরু করে স্তব্ধ হলো অপূর্ব। আশেপাশে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আরুর দিকে নজরবন্দি করে তার লুঙ্গির হদিস পেল। চ্যাঁচিয়ে বলে, “আরু আমার লুঙ্গি দে বলছি। এটা কোন ধরনের অসভ্যতামি?”

“এটা আরুর শাস্তি। আপনার সাহস হয় কীভাবে ‘পূর্ব-পশ্চিম’ ভাই, আমার পিঠে আঁচড় কাটার? আপনাকে জাস্ট একটু ট্রেইলর দেখালাম।” আরুর দৃঢ় কণ্ঠ। অপূর্ব কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। কুলকিনারা না পেয়ে অন্য বুদ্ধি প্রয়োগ করে, “তুই আমার লুঙ্গি কেড়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস। কারণ তুই আমাকে এই অবস্থায় দেখতে চাস, তাই তো? শুধু শুধু পানির ভেতরে না দাঁড় করিয়ে বলতি, সরাসরি দেখাতাম। নিজের প্রতিটি অঙ্গ তো শতবার দেখি, একবার না-হয় তুই দেখলি।”

বলতে বলতে বুক সমান পানি দেয়া কোমর সমান পানি এলো। অতি প্রিয় ভাঁজ কা/টা ও জিম করা দেহের দিকে এক নজর অপলক চেয়ে রইল। গতিরোধ করল না অপূর্ব। এগিয়ে চলেছে ক্রমশ। পরিস্থিতি অনুভব করে পল্লব বন্ধ করে পশ্চাৎ ঘুড়ে আরু। দেয় ভুবন ভোলানো চিৎকার, “নাহহ! আমি দেখব না। আর একটুও এগোবেন না আপনি।”

অপূর্ব স্মিত হাসে। বলে, “আমি থামব না, শুধু এগিয়ে যাবো। যতক্ষণ আমার লুঙ্গি আমার হাতে না-আসে, ততক্ষণ এভাবে থাকব।”

পশ্চাৎ দিকে মুখ করে থাকে আরু আর সমুখে তাকায় না। লুঙ্গি ছুড়ে দেয় অপূর্ব-র দিকে। পরিধান করে লুঙ্গি। অতঃপর অপূর্ব এগোয় ক্রমশ। জলধারা অপসারিত হয়ে দুইজন মানব অদূরে এলো। সম্পূর্ণ জলাধারাকে অপসারিত করতে পেছন থেকে কোমর জড়িয়ে অঙ্গে অঙ্গে মিলিত করল দুটি দেহ। আরু থরথর করে কাঁপছে। এত জলের মাঝেও সে পিয়াসু। ওষ্ঠদ্বয় কানের লতিতে মিশিয়ে বলে, “দিলি কেন লুঙ্গি, চেয়েছি আমি? তুই তো দেখতে চেয়েছিস।”

স্পর্শগুলো আরও গাঢ় হয়ে এলো, বিচরণ করল নগ্ন কোমরে। অথচ আজ তার দেহে তুরের ব্লাউজ রয়েছে। কম্পিত আরু না-বোধক জবাব দেয়, “না, আমি দেখব না।”

অপূর্ব-র সেখানে বুক পর্যন্ত পানি, আরুর সেখানে গলা পর্যন্ত পানি। অপূর্ব পানিতে ডুব দিয়ে পাঁজাকোলা করে নিল আরুকে। আরু সাঁতার জানে বিধেয় অপূর্ব গলায় আড়কে ধরল না। ডাগর ডাগর চোখে শুধু চেয়ে রইল। নাকের সাথে নাকের ডগায় সুড়সুড়ি দিয়ে আলতো করে চুমু খেল ললাটে। আরু কেঁপে উঠল। নেত্রপল্লব গ্ৰথন করে রাখল। অপূর্ব ফিসফিস করে বলে, “এটা দিঘি নয়, নদী। প্রেমনদী। প্রেমতরঙ্গ। প্রেমতরঙ্গে বহমান প্রেমের জোয়ারে ভাসাতে অপূর্ব প্রস্তুত।”

অতঃপর অপূর্ব ঠেলে ভাসিয়ে দিল আরু-কে। আরু উলটা সাঁতারের দিল। কাতল মাছ আরুর পায়ের করতল স্পর্শ করে। সাঁতারের ফলে ঢেউয়ের সৃষ্টি হলো।

প্রেমেরও জোয়ারে, ভাসাবে দোঁহারে
বাঁধন খুলে দাও, দাও! দাও! দাও!
ভুলিব ভাবনা, পেছনে চাবো না
পাল তুলে দাও, দাও! দাও! দাও!
_
আরুর জ্বর নেমে এসেছে স্বাভাবিক মাত্রায়। মামাবাড়িতে থেকে পড়াশোনা দিব্যি চলছে আরুর। শীতকালে দিনের তুলনাত্মক রাত দীর্ঘ হয়। স্কুল ছুটির পর থাকে অপরাহ্ণ। আরু ও শেফালী নদীর ধানে অপেক্ষারত তুরের জন্য। ঝোপঝাড়ের মাঝে প্রয়াসের সে কিছু বলছে, তাও দীর্ঘক্ষণ। মাগরিবের আযান ঘনিয়ে আসছে। ব্যাকুল হয়ে আরু শুধাল, “কতক্ষণ লাগবে তুর? তাড়াতাড়ি আয়-না। চিন্তা করছে সবাই।”

“কেউ চিন্তা করছে না। আমি রোজ দেরি করে যাই।” ঝোপঝাড় থেকে তুর বলে উঠে। রাস্তার মাঝে পদচারণ করছে উৎসুক হয়ে উঠল আরু। শেফালী ললাটে উগ্র ভাঁজ ফেলে বলে, “ওর জন্য রোজ রোজ বাড়িতে যেতে দেরি হয়। মনে চায় আমিও একটা প্রেম করি।”

“করবি?” আগ্রহ নিয়ে মাটির রাস্তায় বসেছে আরু। সঙ্গ দিতে শেফালীও বসেছে। কিঞ্চিৎ পর তন্বীকে দেখা গেল এই অভিমুখো হতে। সংশয় নিয়ে বলে, “তোরা দুটোয় এখানে বসে কী করছিস? তুর কোথায়?”

“জানে কে? গিয়ে দেখ, নদীর পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছে দুটোতে। কতবার লুকিয়ে লুকিয়ে গেলাম দেখতে।” বিরক্ত প্রকাশ পেল শেফালীর গলায়। আরুর অগোচরে শেফালী, তুর ও তন্বী ফন্দি এঁটেছে কিছুর। অতঃপর অস্ফুট স্বরে বলে, “পরানের দোকানে ঐ ক্যাসেট টা এনেছে শুনলাম। তুর যতক্ষণে ফিরে আসবে ততক্ষণে আমরা দুজনে নিয়ে আসি।”

“কী ক্যাসেট?” আরুর সাদামাটা প্রশ্ন। কেউ উত্তর দিল না। আরুকে প্রহরীর দায়িত্ব দিয়ে ছুটে গেল দুজনে, একা দোটানা নিয়ে বসে রইল সেখানে। পেরিয়ে গেল ক্ষণ। লাল রঙের জ্ঞাত স্লিপার দৃষ্টিগোচর হতেই ঊর্ধ্বভাগে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল আরু। অপূর্ব-কে সমুখে দেখে নোনা জল সঞ্চয় হলো ললাটে। আশেপাশে তাকিয়ে দুইবোনের সন্ধান করতে করতে হুংকার দিল অপূর্ব, “ভর সন্ধ্যায় এখানে বসে বসে কী করছিস? সঙ্গি দুটোয় কোথায়?”

অপূর্ব-র হুংকারে কেঁপে উঠে আরু। দুই বোনকে গালমন্দ করছে নিরবে আরু। অপূর্ব আজ সকালে শহরে গেছে। অফার করা চাকরিটা কনফার্ম করতে। বাড়ি ফিরে তিনবোনকে না দেখে এদিকে এসেছে।
ততক্ষণে শেফালী ও তন্বী ফিরত এসেছে। আরুর তার হাত দুটো ঢেউখেলানোর ন্যায় উপর থেকে নিচে নামিয়ে ইশারা করছে দুজনকে। পুনরাবৃত্তি করছে হিস, হিস। অপূর্ব হতভম্ব হয়ে বলে, “এমন করছিস কেন?”

রাস্তার ধানে ইঁদুর গর্ত করে রেখেছে। দুইপাশে বিভিন্ন আকৃতির মাটি জমানো। আরু ইতস্তত করে বলে, “অপূর্ব ভাই, আপনি তো‌ ইঁদুর ভয় পান। তাই ইঁদুর লড়াচ্ছি।”

“তাহলে পেছনের দিকে তাকিয়ে কেন.. বলতে বলতে পশ্চাৎ ফেরার প্রয়াস করে অপূর্ব। সেই বাক্যকে মাঝপথে দাঁড়ি টেনে হুট করে অপূর্ব-র হৃদমাঝারে ঝাঁপিয়ে পড়ে আরু। হিতাহিত ঘটনায় অপূর্ব নির্বাক। হুট করে সাজানো মিথ্যা কথাগুলো অপূর্ব-র হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানির কাছে হেরে গেল। দ্বি মুহূর্ত এভাবে অতিবাহিত হলো। অপূর্ব ছাড়িয়ে নিল নিজেকে। ধমক দেয়, “মাঝরাস্তায় কী হচ্ছে এইসব আরু? তুই তো এমন বেপরোয়া ছিলি না।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১৩ (বর্ধিতাংশ)

“অপূর্ব ভাই, আসলে আমি একটা কথা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভুলে গেছি।” চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে আরু।

“কী সেটা? বলার আগেই ভুলে গেলি?” অপূর্ব-র ফিরতি প্রশ্ন। আরুর তার হাতটা রাখল অপূর্ব-র বুকের পাপাশে। রুপার বালা শব্দ করল মৃদু। হাতটা মৃদু ভর প্রয়োগ করতেই অপূর্ব-র হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক শব্দটা ঘোড়ার মতো টগটগ করতে ব্যস্ত হলো। ছ্যাকা লাগল বুকে। প্রেমতরঙ্গে নিজেকে ভাসিয়ে আরু কণ্ঠে হয়ে উঠে আসক্ত, “ধুকপুক ধুকপুক ধুকপুক। এই শব্দটা আমায় অগোছালো করে দেয়। মনে হয় আমার স্থান এখানে। ঠিক এখানে। যেই হাড়টা আপনার নেই, সেই হাড়টা আমি। মনে হয়, আমি আপনার বাম পাজরের অধিকারিণী।”

“কীসব বলছিস?”
অপূর্ব পিছিয়ে গেল কদম। আরুর হাতে হাওয়া প্রবেশ করল। অপূর্ব-র ডানহাতটা নিজের বুকে রেখে বলে, “বিশ্বাস না হলে দেখুন। আপনার স্পর্শ আমার স্পন্দন অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।”

আরুর সেই স্পন্দন অপূর্ব অনুভব করতে পারছে। তার সিক্সসেন্স বলছে, এটা অস্বাভাবিক। সে যে মনের ডাক্তার, মনোচিকিৎসক। মনের ভাষা বোঝাই তার পেশা।
মুহুর্তে হাতটা পরিণত হলো কোনো ইট, পাথর বা শক্ত কোনো ধাতুতে। নিজের হাতটা সরানোর ভরটুকু অপূর্ব-র নেই। অব্যক্ত স্বরে বলে, “হাত ছাড় আরু।”

“কেন? আপনি অন্য পুরুষদের থেকে চার ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে বলেছেন। আপনার থেকে নয়।”

বিদেশে অবস্থানরত সময়ে বহু নারীর সংস্পর্শে গিয়েছিল। ‘হাত ধরেছে, জড়িয়ে ধরেছে’ তখন তো এমন অগোছালো অনুভূতির সম্মুখীন হতে হয়নি।

ঝোপঝাড় থেকে বেরিয়ে এসেছে তুর। অপূর্ব-র ভয়ে নদীর তীরেই বসে আছে। শেফালী ও তন্বী অতি নিকটে। তিন সই একত্রিত হয়ে বলে, “অপূর্ব ভাই, আপনি এখানে?”

হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ল অপূর্ব। চেতনা ফিরত এলেই হাত নিজের কাছে টেনে যথাসম্ভব গম্ভীর গলায় হলে, “কয়টা বাজে এখন? চারটা বাজে স্কুল ছুটি হলে বাড়িতে যেতে লাগে পনেরো মিনিট। এখন সময় সাড়ে পাঁচটা। এতক্ষণ এখানে কী করছিস?”

“ভাইয়া, আমরা প্রতিদিন দেরি করেই বাড়িতে ফিরি। আজ একটু বেশি দেরি হয়ে গেছে। নদীর পাড়ের হাওয়া খেতে ভালো লাগে।” তুর সাহস সঞ্চয় করে বলে। পুনরায় প্রশ্ন করে, “নদীর পাড়ে হাঁটতে ভালো লাগে। তাহলে আরু এখানে কী করছে?”

“আমার পা ব্যথা করছিল। তাই যাইনি। এসে দেখলেন না, বসে ছিলাম?” আরু বলে। অপূর্ব-র মন হতে সন্দেহে দূর হয়নি। সামনের দিকে অগ্রসর হতে হতে বলে, “হম, চল। (আরু-কে একান্ত ভাবে বলে) জড়িয়ে ধরে কী জানো বলতে চেয়েছিলি। ঘুমানোর আগ পর্যন্ত সময়। উল্লেখযোগ্য কোনো কারণ না পেলে, ঢেউ খেলা দেখিয়ে যে ইঁদুর তাড়াচ্ছিলি। সেই ইঁদুরের গর্তে আমি তোকে রেখে মাটি চাপা দিয়ে দিবো।”

আঁতকে উঠল আরু। কী করবে ভেবে পেল না। বাংলা সিনেমায় দেখেছে নায়িকা আঘাত পেয়ে স্মৃতিশক্তি লোপ পেলে পরবর্তী আ/ঘা/তে ফিরে আসে। কিন্তু আরু তো ভুলে যায়নি। আচ্ছা অপূর্ব হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানির শব্দে বিস্মৃত হয়েছে কথা, আবার ঐ ঝড় তোলা বুকে মাথা রাখলে মনে পড়বে সেই কথা?

“এনেছিস ক্যাসেট?” ফিসফিসিয়ে বলে আরু। তুর নক টাকতে টিকতে বলে, “কীসের ক্যাসেট?”

আরু উত্তর দিতে পারেনা, কারণ সে জানে না। শেফালী বলে, “এনেছি, আরুর বইয়ের ভেতরে রেখে দিয়েছি।”

আরু ও অপূর্ব মধুর সময়ে অগোচরে লুকিয়ে রেখেছে ঘাসের উপর রাখা আরুর বইয়ের ভাঁজে। কৌতূহল নিয়ে বইয়ের পাতা উলটায় আরু। ক্যাসেটের উপরে লাগানো পোস্টারে নজর যেতেই গলা শুকিয়ে গেল। অপূর্ব-কে খেয়াল না করে আচমকা বলে ফেলে, “ছিঃ, এগুলো কী এনেছিস তোরা?”

অপূর্ব-র কদম থেমে গেল। ঘাড় কাত করে তাকাল চারজনের দিকে। আরুর মুখ চেপে ধরেছে তিনজনে। ডাগর ডাগর চোখ করে কেবল চেয়ে আছে। বলে নিজেও নির্বোধ হলো আরু। থমথমে গলায় বলে, “তোরা ওর মুখ চেপে আছিস কেন?”

পরক্ষণে হাত ছেড়ে নতজানু হয়ে গেল দুই জোড়া কিশোরী। অতঃপর অপূর্ব বলে, “মাত্র কী বললি? কী এনেছিস তোরা?”

তন্বী দাঁড়াল না। অপূর্ব-কে অতিক্রম করে সর্বশক্তি দিয়ে ছুটে গেল। অপূর্ব চাইলে ধরতে পারত হাত, কিন্তু অচেনা অজানা মেয়েকে স্পর্শ করা বেঠিক। প্রয়াসের এনে দেওয়া চানামুঠ দেখিয়ে বলে, “এগুলোর কথা বলেছে। আসলে আরু খায়না তো তাই।”

আপাদমস্তক চেয়ে থেকে বলে, “তোদের তিনটাকে আমার বিশ্বাস হয়না। সামনে সামনে এগো।”

মাটির রাস্তা সরু হওয়াতে তিনজনে এক লাইনে হাঁটতে পারছে না। ধাক্কা লাগছে। দুপাশের ঝোপঝাড়ের মাঝে সাপ থাকা‌ অবাস্তব বিষয় নয়। হাঁটার সময় সামনে পেছনে যাওয়া আরুর বামহাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে নিল অপূর্ব। কিয়ৎক্ষণ পূর্বের অনুভূতি সম্মুখীন হলো সে। মাগরিবের আযানে মুখরিত হচ্ছে। গলায় প্যাঁচিয়ে রাখা ওড়নার শেষ কোণাটা আরুর মাথা তুলে দিয়ে বলে, “আযান দিচ্ছে অথচ দেঙ্গি মেয়েরা মাথায় কাপড় না দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।

সুন্দরনগরে সূর্য ডুবে মৃদু অন্ধকারে আবৃত গ্ৰাম। আরু দিঘি থেকে ডুব দিয়ে কলতলায় গেছে পোশাক পালটাতে। শেফালী ও তুর রাত নেমে আসার কারণে হাতমুখ ধুয়ে পোশাক পালটে নিয়েছে আরও আগে। সাঁতার না জানার দরুণ কলতলার উদ্দেশ্য এগোল অপূর্ব। টিনের দরজাটা ফাঁক করে একপা বাড়াতেই থমকে‌ গেল অপূর্ব। আরুকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে তার গলা শুকিয়ে এলো। আরু উলটো হয়ে দাঁড়ানো। দ্বি মুহুর্ত একধ্যানে তাকিয়ে থাকার পর যখন চেতনা ফিরে এলো সময় অপচয় না করে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। দরজা তখনও অপূর্ব-র হাতে‌ বন্দি। ছেড়ে দিতেই খ্যাক খ্যাক শব্দে ভিড়ে গেল। আরু সেই শব্দ শুনে বলে উঠে, “কে এখানে?”

অপূর্ব জবাব দিল না। উলটো পথে অগ্রসর হলো। আজ সে আর কলতলায় আসবে না। প্রয়োজনে মায়ের টেনে রাখা পানি দিয়ে হাত মুখ ধুবে।

অপূর্ব ঘরে যেয়ে দেখল, বাড়ির গৃহিনীরা তৈরি হয়ে নামছে ঘর থেকে। বৈঠকখানায় বসে টিভি দেখছে শেফালী ও তুর। অপূর্ব সন্দিহান গলায় বলে, “তোমরা সবাই কোথায় যাচ্ছ?”

অনিতা চাপা গলায় বলে, “পানি আনতে গিয়ে পড়ে পারুল কোমরে ব্যথা পেয়েছে। ওকে দেখতে যাচ্ছি সবাই।”

“আরু যাবে না?” অপূর্ব-র ফিরতি প্রশ্ন। অনিতা সাজিয়ে রাখা উত্তরটা দিলেন, “না, ওকে নিয়ে গেলে সব কাজ ওকে করতে হবে। গিয়ে দেখি, প্রয়োজনে একটা কাজের লোক ঠিক করে দিবো। কিন্তু আরুকে দেওয়া যাবে না। তুইও আরুকে বলিস না।”

অপূর্ব সায় দিল। আরু নিজের জামাটা নিগড়াতে নিগড়াতে এলো। অপূর্ব-র মতো সেই প্রশ্ন করে, “কোথায় যাচ্ছো তোমরা?”

“একটু হাঁটতে যাচ্ছি।” অনিতার হাস্যোজ্জ্বল জবার। আরুও বায়না ধরে তাদের সাথে হাঁটতে যাওয়ার। তুর ও শেফালীর জন্য অসফল হয় আরু। তিস্তা শরীরের অসুস্থতার বাহানা দিয়ে রয়ে গেল সুজনের জন্য। সুজনকে চাচার কথাটা বলতে হবে।

সুন্দরনগর গ্ৰামে একমাত্র সাত ভাই চম্পা নিবাসে বিদ্যুৎ রয়েছে। চেয়ারম্যান বাড়ি বলে কথা, অস্বাভাবিক কিছু নয়। শেফালী ল্যান্ডফোনে ডায়াল করে বাড়ির পরিবেশ জানায় তন্বীকে। কিছুক্ষণ পর তন্বী এলো। তিস্তা তখন সুজনের ঘরে কথায় সাম্পান ওয়ালার সাথে ব্যস্ত কথায়। আরুর বইয়ের ভাঁজ থেকে ক্যাসেট এনে চালু করতেই আরু উঠে দাঁড়ালো। করুণ গলায় বলে, “আমাকে ছেড়ে দে-না, আমি এইসব দেখতে পারব না।”

“চুপ থাক, বিয়ের পর বর যখন জোর করে দেখাবে তখন দেখতে পারবি ঠিকই। এখন তোর বাহানা।” তুর বলে।

“তোকে কে বলেছে, বর বিয়ের পর এগুলো দেখায়?” কৌতূহলী কণ্ঠ আরুর।

“নাইনে ফেল করা মিতু বলেছে। ফেল করার পর চাচা তো ওকে জোর করে বিয়ের পিরিতে তুলে দিয়েছে। বিয়ের পর না-কি রোজ এগুলো দেখাতো। শুনে আর থাকতে পারলাম না। কবে না কবে বিয়ে করব। চুপচাপ দেখ।” বলেই দেখতে মন দিল তন্বী। সবাইকে অনুসরণ করে আরুও টিভির পর্দায় চোখ বুলিয়ে নিল। পরক্ষণে অস্বস্তিতে কুঁচকে এলো পল্লব।

আরুকে এই অবস্থা থেকে রক্ষা করতে আগমন ঘটল অপূর্ব-র। পায়ের শব্দ শুনে ব্যাকুল হয়ে উঠল তুর। চ্যাঁচিয়ে বলে শেফালীকে “তোকে আমি দরজা বন্ধ করতে বলেছিলাম। করেছিস?”

নক কাটতে কাটতে শেফালী বলে, “এই যা ভুলে গেছি। কে আসছে বল-তো।”

“বারণ করেছিলাম, শুনলি না। এবার কি হবে?” আরু বলে।

“থাকবি তোরা, মনে হয় তিস্তা আপু এসেছে। তিনি ছাড়া বাড়িতে আর কেউ নেই। আমি দেখছি।” বলতে বলতে দরজার দিকে অগ্রসর হলো তুর। পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকিতেই তার ধারণা ভুল প্রমানিত হলো। তিস্তা নয়, তিয়াস ও অপূর্ব এসেছে। তিয়াস শহরে গিয়েছিল চাকুরিতে, কিন্তু অপূর্ব যে মৃধা বাড়িতে গিয়েছিল। তুর নিচু অথচ উদ্বিগ্ন গলায় বলে, “টিভি বন্ধ কর তাড়াতাড়ি। অপূর্ব ভাই ও তিয়াস ভাই এসেছে।”

বলা মাত্র সবাই টিভি বন্ধ করতে ব্যস্ত হয়ে গেল। রিমোট খুঁজে পাচ্ছে না। রিমোট খুঁজবে না-কি ক্যাসেট খুলবে বুঝতে পারছে না। চট করে তুর বুদ্ধিমান হয়ে উঠল। প্ল্যাকের সকেট খুলে ফেলল। অতঃপর সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। ততক্ষণে তিয়াস ও অপূর্ব ঘরে প্রবেশ করেছে। হাতে নতুন ফোনের প্যাকেট। সদ্য কিনে আনা নিজের বাটন ফোনটা বের করে চার্জে দিতে দিতে বলে, “তোর ফোনের মতো স্মার্টফোন কিনতে চেয়েছিলাম। রাজধানী ছাড়া পাওয়া যাবে না।”

“এটা ফেরার সময় নিয়ে এসেছি। তুই যদি তখন বলতিস, তোর জন্যও নিয়ে আসতাম। ফেলেও যা দাম চাইবে।” অপূর্ব বলে। প্লাকে চার্জার দেওয়া পরেও সংযোগ আসছে না দেখে বিভ্রান্ত হলো তিয়াস। লাল রঙের তীক্ষ্ণ আলোটা প্ল্যাকে জ্বলছে না দেখে সন্দিহান হয়ে সকেটের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। অতঃপর বলে, “এই সকেটটা কেন খুলেছিস?”
তিয়াস বাড়িতে ফেরার আগে তার সদ্য কেনা নতুন ফোন দিয়ে অপূর্ব-র ফোনে কল করে সিস্টেম পরীক্ষা করছিল। তখনই জানতে পারে, আহসান পরিবার পারুলকে দেখতে যাচ্ছে। মহিলামহলকে মৃধা বাড়িতে পৌঁছে অপূর্ব-কে ফিরে আসতে বলে, কারণ তিয়াস নিজেও মৃধা বাড়িতে যাবে। পোশাক পালটাতে বাড়িতে এসেছে। সকেটটা বোর্ডে দিতেই তন্বী এক দৌড়ে বেরিয়ে গেল। তিনবোন একসাথে মাথায় হাত দিল।
অনাকাঙ্ক্ষিত গোঙানির শব্দ শ্রবণ হতে তিয়াস চার্জের পিন লাগিয়ে বলে, “কীসের শব্দ হচ্ছে রে?”

অপূর্ব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে টিভির সেই দৃশ্য মস্তিষ্কে ধারণ করছে। নেত্রপল্লব একবারের জন্যও ফেলছে না। দাঁতে দাঁত চেপে আছে। রোষের সাথে খুঁটিটা চেপে ধরে। তুর সৌজন্য হেসে ছুটে গেল। তিয়াস টিভির স্ক্রিনে তাকিয়ে নির্বাক হয়ে গেল। চক্ষু তার চড়কগাছ। অতঃপর বলে, “ছিঃ, এইসব কী ছেড়েছিস?”

আরু বেতের সোফার নিচে উবুড় হয়ে আছে। শেফালী একাই নড়তে পারে না। অবিলম্বে চ/ড় বসিয়ে দিল তিয়াস, “শেফু, এইসব টিভিতে এলো কীভাবে? ক্যাসেট পেয়েছিস কোথায়?”

শেফালী নতজানু হয়ে রইল। তিয়াস আরও কয়েকটা চড় বসাতেই ক্রন্দনরত অবস্থায় বলে, “আমি কি একা কিছু করেছি না-কি? তুর তো সায় দিয়েছে।”

অপূর্ব নিবৃত্ত কণ্ঠে বলে, “তুই কেন সায় দিলি? পাই একবার তুরকে। তোদের তিনজনের খবর আছে। (তিয়াসকে উদ্দেশ্য করে) তাড়াতাড়ি পোশাক ছেড়ে আয়। ওনাদের আনতে যেতে হবে তো।”

তিয়াস মাথা নেড়ে চলে গেল ঘরের দিকে। শেফালী তার পেছনে পেছনে ছুটল। তিয়াসের হাত ধরে বলে, “আমি ভুল করে ফেলেছি। আমি আর জীবনেও ঐসব দেখব না। প্লীজ রাগ করো না।”

“হম। যা এখন।”

“শোনো না?” শেফালীর আবদারে দাঁড়িয়ে যায় তিয়াস। উত্তরের আশায় চেয়ে থাকে। পায়ের টাকনুতে ভর দিয়ে তিয়াসের সমান হওয়ার প্রচেষ্টা করে শেফালী। কিঞ্চিৎ সম্ভব হয়। নাকে সংস্পর্শে নাক এনে প্রেমপূর্ণ কণ্ঠে বলে, “আমি আপনাকে প্রচণ্ড ভালোবাসি তিন হাঁস ভাই। আপনি যদি আমার উপর রাগ করে থাকেন। আমি সহ্য করতে পারিনা।”
আলতো ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে দূরত্ব বাড়াল। ঠাটিয়ে চ/ড় বসিয়ে দিল। অতঃপর তেজস্রী গলায় বলে, “কতদিন তোকে বলেছি, আমার সাথে এইসব কথা বলবি না। তুই শুধুই আমার বোন। আমি শুধু সুমিকে ভালোবাসি। বের হ আমার ঘর থেকে।”

“আপনি আমাকে শুধু শুধু মা/র/লেন। আমি আপনাকে অ/ভি/শা/প দিচ্ছি, সুমিকে নিয়ে আপনি একদিনও সংসার করতে পারবেন না।” ক্রন্দনরত অবস্থায়।
কিয়ৎক্ষণ পূর্বের চ/ড়ে আঘাত থাকলেও অভিমান হলো এখন। ছুটে চলে গেল ঘরে। দরজাটা ভিড়িয়ে কেঁদে উঠল শেফালী।
_
শেফালী ও তিয়াস দৃষ্টি আড়াল হতেই অপূর্ব বেতের সোফার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। গলা খাঁকারি দিয়ে বলে, “তুই কি বের হবি আরু, না-কি আমি বের করব? আমি জানি তুই এখানে লুকিয়ে আছিস।”

আরু কচ্ছপের গতিতে বের হলো। তখনও টিভির পর্দায় চলছে সেই দৃশ্যগুলো। দুহাতে গাল ধরে করুণ গলায় বলে, “বিশ্বাস করুন, আমি দেখিনি। আমি শুধুই বসে ছিলাম।”

“অপরাধ করা আর সহ্য করা, সমান” হাত ঘুড়িয়ে বেতের সোফার উপর বসে আরুকে নিয়ে। চঞ্চল আরু ইদানীং অপূর্ব-র স্পর্শে আজকাল বোকা হয়ে যায়। দিশেহারা হয়ে উঠে। লজ্জায় তার চোখে জল উপস্থিত হয়। তবুও অপূর্ব-র ধমকানিতে চেয়ে থাকে অপলক। অপূর্ব হাসে। আরুর চোখ মুখের লালচে ভাবটা নজরে আসতেই ছ্যাত করে উঠে অপূর্ব-র অন্তঃকরণ। রিমোট দিয়ে টিভি বন্ধ করে আরুর মাথাটা বুকে চেপে ধরে বলে, “তোর এই মুখের ভঙ্গিমা আমাকে জানিয়ে দেয়, তুই কেমন‌। ক্ষমা করে দিলাম।”

লজ্জা, অস্বস্তি ও অভিমানে মুখ তুলে চাইল না আরু। আরুর চিবুকে হাত রেখে ঈষৎ উঁচু করে আদুরে অপূর্ব শুধাল, “রাগ করে ছিলিস কেন?”

“আপনি আমার পিঠে আঁচড় দিয়ে রক্ত জমাট করে ফেলেছিলেন তাই।” উদাসীন আরুর অভিমানী কণ্ঠ। অপূর্ব অপ্রসন্ন হয়। আদরে মাখা গলা আরও আদুরে করে বলে, “তাই? আমি যে তখন হামি দিলাম তার বেলায়? আঘাত করলেই কথা বলা বন্ধ, আদর করলে উলটা কেন?”

“আপনি তো কপালের মধ্যিখানে হামি দিয়েছিলেন, বুঝব কীভাবে?” আরুর অস্বস্তির মাত্রা বাড়িয়ে অপূর্ব একটু নির্লজ্জ হলো, “তাহলে যেখানে আঘাত করেছি, সেখানে দেই। পেছনে ফের।”

আঁতকে উঠল আরু। এই অজপাড়া গাঁয়ে হয়তো স্বামীও তার স্ত্রীকে এরুপ মন্তব্য করেনা, লজ্জায় জড়সড়ো হয়ে বলে, “ছিঃ!”

“ছিঃ কীসের? তোর এই গ্ৰামে কেউ না বললেও, বিদেশে এসব সাধারণ বিষয়। মেয়েরা বিয়ে না করে লিভিং করতে চায়। আমার বান্ধবী সামিরা। আমাকে বলেছিল, তার সাথে লিভিং-এ যেতে। দেশে আসার আগে লিভিং শেষ করে অন্য একজনের সাথে পুনরায় লিভিং-এ যাবে।”

“লিভিং কী?”

“বিয়ে না করে বিবাহিতদের মতো থাকা।” অপূর্ব-র উত্তরে আরু বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। চোখমুখ কুঁচকে ঘরের দিকে যাওয়ার প্রয়াস করতে অপূর্ব বলে, “বালিশের নিচে তোর জন্য একটা প্যাকেট আছে।”

অপূর্ব সিডির ভেতর থেকে ক্যাসেট বের করে চূর্ণ বিচূর্ণ করে ফেলল। মৃদু কেঁপে উঠে আরু। উঠে ছুটে ঘরে দিকে গেল আরু। বালিশের নিচ থেকে ব্যাগটা নিয়ে বুকে আবদ্ধ করে নিল, “অপূর্ব ভাই, আপনার মতো করে কেউ আমাকে বোঝে না।
আপনি লিভিং-এ ছিলেন? এর শা/স্তি আপনাকে পেতে হবে। আগামীকাল সকালে যদি এর শাস্তি আমি না দিতে পারি, তবে আমার নাম আরু নয়, গরু।”

আরুর অবুঝ মন আ/সা/মি বানিয়ে দেয় অপূর্ব-কে।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-১০+১১

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১০

“মেয়েটার শরীরে জ্বর। ছেলেটাকে বলতে পারো না?” বিরাগী হয়ে বলে মিহির। অপূর্ব এক ধ্যানে চেয়ে আছে আরুর দিকে। শেষ দেখা আর বর্তমানের মধ্যে কত ফারাক। লালচে আভা জমেছে মুখমণ্ডলে। মলিন মুখমণ্ডল। অপূর্ব আরুর ললাট স্পর্শ করে জ্বরের মাত্রা পরীক্ষা করে বলে, “গাঁ পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। কখন জ্বর এসেছে, ওষুধ খেয়েছিস?”

অপূর্ব-র প্রশ্নের প্রত্যুত্তর না করে ফিরতি প্রশ্ন করে, “একটু অপেক্ষা করবেন? আমি চেয়ার নিয়ে আসছি।”

অপূর্ব আরুকে যেতে দিল না। নিজে গেল দাদা জানের জন্য চেয়ার আনতে। ইতোমধ্যে ব্যাপারটা খোলসা করেছে মিহির। অপূর্ব-র দাদা জান বা আরুর নানা জান বললেন, “পারুল, আমি আরুকে নিতে এসেছি। ঐ বাড়ির সবাই চাইছে আরু ঐবাড়িতে থাকুক।”

আরু-কে একদণ্ড সহ্য করতে পারেনা পারুল, মেয়ে তার কাছে থাকবে না ভাবলেই উদাসীন হয়ে উঠেন তিনি। এক কাজ কীভাবে সামলে উঠবেন আরু ব্যতিত। দৃঢ় গলায় বলেন, “না, আমার মেয়ে কেন অন্যের বাড়িতে থাকবে? তাছাড়া ওর বাবা ওকে যেতে দিবে না।”

অপূর্ব চেয়ার এনে দিতে দাদা জান আয়েশ করে গ্ৰহণ করলেন। থমথমে গলায় বলেন, “মা যদি মায়ের মতো না-হয়। মায়ের চেয়ে যদি মাসি আপন হয়। তাহলে নিজ গৃহের চেয়ে অন্যের গৃহ নিরাপদ। আমি ইমদাদের সাথে কথা বলেছি। আমার উপরে ওর কোনো কথা থাকতে পারেনা নিশ্চয়ই। (জ্বরে‌ আড়ষ্ট থাকা আরুর পানে চেয়ে স্নেহ করে বলেন) আরু যা, তোর যা যা লাগবে নিয়ে তৈরি হ। আমি ভ্যান নিয়ে এসেছি। তোকে আর খাল সাঁতরে যেতে হবেনা।”

পারুলের চোখমুখে বিরক্তির ছাপ। শরীর রোষে কাঁপছে অনবরত। রুষ্টের সাথে বলে, “যা, দেখি মায়ের চেয়ে মামির দরদ কতদিন থাকে।”

মা-কে ছেড়ে থাকার কথা আরু দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনা। অব্যক্ত স্বরে বলে, “আমি যাবো না। কোথাও যাবো না।”

অপূর্ব নাকের ডগায় রাগ জমে উঠল। তেজ নিয়ে বলে, “তোর ঢং দেখার জন্য আমরা আসিনি। বাড়িতে গিয়ে যত পারিস ঢং করিস। (বিরতি দিয়ে পুনরায় বলে) তোকে যেতে হবে না। আমি আনছি।”

হনহন করে ঘরে ঢুকল। নিজের পছন্দমাফিক জিনিসপত্র নিয়ে এক শাড়ির উপরে রেখে‌ গিট দিয়ে জোলা বানালো। বইখাতাও নিয়েছে কতেক। অতঃপর ফিরে এলো। উঠানে সেকেন্ড খানেক সময় থামল না। বাড়ির পথে হাঁটা দিল। ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে যে। ময়না পাখিটা আরুর দিকে তাকিয়ে তিনবার ডাকল, “আরুপাখি! আরুপাখি! আরুপাখি।”

আরু ফিরে চাইলো। বুকে ছ্যাঁকা লেগেছে। অপূর্ব সংশয় নিয়ে বলে, “তোর ময়না বুঝি?”

“হম।” সংক্ষিপ্ত জবাব।

“নিবি?”

“না, ও ডিম দিয়েছে। ডিমে তা দিচ্ছে। বাচ্চা ফুটবে কয়েকদিন পর। আমার সাথে গেলে ডিমগুলো নষ্ট হয়ে যাবে।”

আরুদের রওনা হওয়ার পর মুহুর্তে আরুর বড়ো চাচি নয়না এলো। চ্যাঁচামেচি শুনে ক্ষান্ত থাকতে পারেনি। উত্তেজিত হয়ে বলেন, “কী হয়েছে পারুল? এখানে এত চ্যাঁচামেচি কীসের?”

ক্রুদ্ধ হয়ে বলে, “আমি না-কি আরু-কে শুধু মা/রি। এমনে মা/রলে না-কি ও ম/রে যাবে। তাই নিতে এসেছে। মেয়েটাকে এত ভালোবাসি তবুও তার অভিযোগের শেষ নেই। ইচ্ছে করে মেয়েটাকে গলা চে/পে মে/রে ফেলি।”

“পারুল মুখ সামলে কথা বল। ও তোর মেয়ে। তুই উ/ন্মা/দ হয়ে যাচ্ছিস। আরুকে তাদের কাছে নিয়ে রাখার ভাবনাটা খা/রা/প না। ইদানীং তুই বদলে গেছিস। মেয়েটাকে মেয়ে মানিস না। গরুর মতো মা/রি/স। সেদিন সাধারণ একটা বিষয় নিয়ে উঠানে বেঁধে মারলি, জ্বরের ভেতরে মেয়েটাকে আবার মা/র/লি।” নয়নার বলা প্রতিটা শব্দ পারুল তার মস্তিষ্কে আওড়াল। কিছু ভুল বলছে না। ইদানীং আরুকে সহ্য হয়না পারুলের। দেখলেই শরীর জ্বলে। মন চায় শুধু মা/রি। কোঁকড়ানো চুলগুলো টেনে মাটিতে বসে পড়ে পারুল। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে, “বিশ্বাস করো ভাবী, আমি ইচ্ছে করে আরুকে মা/রি না। আরু-কে দেখলেই আমার রক্ত মাথায় উঠে যায়। শরীর জ্বলে যায়। মনে হয় ওকে শেষ করে ফেলি।”

অদূরে দাঁড়িয়ে মায়ের সব কথা শুনে ক্ষোভে ফেটে পড়ে অয়ন। পরিবারের বড় মেয়ে বলে আদর ভালোবাসা সব তার জন্য বরাদ্দ। নয়নাকে উদ্দেশ্য করে বলে, “চাচি, সাবিত কোথায়?”

“ও ঘরে আছে। সকালের নাস্তা খাচ্ছে।” নয়না আরও কিছু বলেছে, তা শ্রবণ না করে অয়ন ছুটে গেল বড়ো চাচার ঘরে। আরুর দাদা নেই, দাদি বড়ো ছেলের সংসারে থাকে। রোয়াকে বসে পান বানাচ্ছেন তিনি। অয়নকে দেখে প্রসন্ন হলেন বটে। বলেন, “কী হয়েছে দাদুভাই, মুখ এমন করে আছো কেন?”

“তুমি ঠিকই বলেছ দাদি জান, বাবা-মা কেউ আমাকে ভালোবাসে না। সবাই আরুকে ভালোবাসা শুধু।” ক্রোধে ফোঁস করে বলে অয়ন। দাদি পান রেখে অয়নকে কোলে বসালেন। পাশে টেবিলের উপর দুটো পেয়ারা রাখা। নাতির অভিমান ভাঙাতে একটা অয়নের হাতে দিয়ে আদুরে গলায় বলেন, “কী হয়েছে আমার নাতিটার?”

অয়ন পেয়ারায় কামড় বসিয়ে আধো গলায় তার অভিযোগ জানায়, “নানা জান এসেছে, সাথে এসেছে অপূর্ব ভাই। ওরা বুবুকে নিয়ে গেছে। এবার মা আমাকে ভালো না বেসে বুবুর জন্য শুধু কাঁদছে। বুবুকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার জন্য এতকিছু করলাম।”

“আরে পা/গ/ল। আরুকে বাড়ি থেকে বের করে দিলে তোর কষ্ট হবে। কে তোকে পানি টেনে দিবে গোসলের? কে খাবার পরিবেশন করে দিবে?‌ আর সবচেয়ে বড় কথা কী জানিস?” পেয়ারা খেতে খেতে অয়ন দাদির কথাগুলো নিভৃতে আওড়াল। ভুল কিছু বলে বলেনি। অতঃপর বলে, “আর কী?”

“তোর নানা বাড়ির এত সম্পত্তি। এগুলো যদি সব আরুকে দিয়ে দেয় তখন?” অয়নের মুখমণ্ডলে ভয় হানা দিল। ছুটে যাওয়ার প্রয়াস করতে টেনে ধরলেন দাদি। আরও একটা পেয়ারা দিয়ে বলেন, “এটাও নিয়ে যা। আরুর জন্য রেখেছিলাম, এখন তোর মাকে দিস।”
__
বৈঠকখানায় বেতের সোফার পাশাপাশি একটা ছোটো চৌকি রাখা। আরু সেই চৌকিতে আধশোয়া। দীর্ঘ রাস্তাটুকু অপূর্ব-র বুকে ঠেস দিয়ে এসেছে মামা বাড়িতে। জ্বরের তীব্রতা বেড়েছে। অনিতা দুধের গ্লাস নিয়ে এসেছে। আরু-কে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। সে খেতে নারাজ। বিষণ্ন গলায় বলে, “মামি, জ্বরের সময় দুধ খেলে টাইফয়েড জ্বর হয়।”

জাহানারা আজ সকালে আরুর জন্য যত্ন করে তাল বড়া বানিয়েছেন। আরুর বরাবরই তার খুব প্রিয়। গুড় মিশিয়েছেন ঈষৎ। থালাটা চৌকিতে রেখে বলে, “তাল বড়া গুলো চেয়ে নে আরু।”

তালবড়াগুলো তিক্তস্বাদযুক্ত জ্বরাক্রান্ত রসনায়। মণি একগ্লাস ঝরিবুটি নিয়ে এসেছেন। অপূর্ব এনেছে তার ওষুধ। সবকিছু দেখে ব্যাকুল হয়ে উঠল আরু। আনন্দের অশ্রু চোখে ধরা দিল। কাতরচিত্তে বলে, “এত ব্যস্ত হইও না। এই সামান্য জ্বরে বাঘিনীর কিচ্ছু হবেনা।”

‘বাঘিনী’ নিঃশব্দে বেশ কয়েকবার উচ্চারণ করল অপূর্ব। মন্দ নয়, বাঘিনীই তো। অপূর্ব বলে, “তোমার এই বাঘিনী কী করেছ, জানো নানি জান? অয়নকে না-কি বালতিতে চুবিয়ে ধরেছে।”

চম্পা দৃঢ় গলায় বলেন, “বেশ করেছে। মেয়েটাকে একটু শান্তি দেয় না। মায়ের কানে সারাক্ষণ বোনের নামে কু-মন্ত্রনা ঢালতেই থাকে।”
__
দুপুর দুইটা। রোজকার নিয়ম মেনে খেতে বসেছে মধ্যবয়স্ত পুরুষেরা। তাদের খাওয়া প্রায় শেষের দিকে। ছেলেমেয়ে খেতে এসেছে। জাহানারা আরুকে ধরে নিয়ে এসেছে। কাতারে এসে আরু দাঁড়াতেই মোতাহার আহসান বলেন, “আরু তুই বসে যা। এতক্ষণ তোকে বসে থাকতে হবে না।”

“এক সাথেই খাই।” আরু বলে চেয়ারে বসে। মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না। কাঠের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। এখন শুধু মোতাহার আহসান ও তার বাবা বসে আছেন। বাকি তিন ভাই খাওয়া শেষ করে উঠে পড়েছেন। আরুর পছন্দের খাসির মাংস রান্না হয়েছে। অনিতা আরুর জন্য বরাদ্দকৃত বাটিটা এগিয়ে দিয়ে বলে, “আরু, বসে বসে একটুকু খা মা। আমি খাবার দিচ্ছি। (অতঃপর স্বামীর দিকে চেয়ে ইতস্তত করে বলে) আসলে মেয়েটা খাসির মাংস খেতে ভালোবাসে তাই।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১১

“তাহলে আরেকটু দাও।” মোতাহার আহসান আরুর দিকে তাকিয়ে বললেন। অনিতা জড়তা নিয়ে বলেন, “কেজি দুই এনেছিলাম। আর একটু আছে। বাকি ছেলে-মেয়েদেরও তো দিতে হবে।”

“তাহলে আমাদের কেন দিলে? নামেই মেয়েটাকে খাওয়ালে। কুদ্দুসকে (রাখাল) বলে দিচ্ছি, শহর থেকে কেজি পাঁচ আনতে। আনলে রাতে রান্না করো।” এঁটো প্লেটে হাত ধুয়ে টেবিল ত্যাগ করলেন না মোতাহার আহসান। ইদানীং বুকে ব্যথা অনুভব করেন তিনি। ছেলেমেয়েরা খেতে বসল। অনিতা খাবার পরিবেশন করছেন। আরু খেতে খেতে বলে, “তোমার হাতে সেই স্বাদ পাচ্ছিনা মামি। সব তেতো লাগছে।”

“মা বেছে বেছে তেতোগুলো তোকে দিয়েছে। আমার গুলো খেয়ে দেখ।” অপূর্ব যেন সুযোগ পেল। তার পাতের মাংসগুলো সন্তর্পনে আরুর পাতে তুলে দিল। আরু খাওয়া থামিয়ে অপূর্ব-র পানে দৃষ্টি মেলাল। অপূর্ব নিবৃত্ত কণ্ঠে বলে, “আমার দিকে না তাকিয়ে চুপচাপ খেয়ে উঠ।”

উপস্থিত সবাই মৃদু হাসছে।
ভদ্রতা বজায় রেখে আরু নিজের খাবার খেয়ে হাত ধোয়ার পূর্ব মুহূর্তে পুনরায় অপূর্ব-র পাতে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ছ্যাত করে বলে, “আমি কারো দেওয়া খাবার খাই না। আমার তেতোই ভালো।”

অপূর্ব পানি পান করতে করতে আরুর গমন পথের দিকে চেয়ে রইল অপলক। মেয়েটা কি তার উপর রেগে আছে? বোধহয় আছে। নাহলে যে মেয়েটা অপূর্ব ভাই বলতে উন্মাদ, সে আলগোছে তাকে উপেক্ষা করবে কেন?”
মোতাহার আহসান অপূর্ব-কে উদ্দেশ্য করে বললেন, “তুই তো মেয়ে দেখতে গেলি না। বিয়ে টিয়ে কি করবি না? সব যোগাড় করে পাত্রীপক্ষ কত রে/গে গেছিল, ধারণা আছে?”

অপূর্ব খাওয়া থামিয়ে বাবার দিকে এক নজর তাকায়। আরুর দিকে তাকালে অন্য মেয়েদের যে বিষাক্ত লাগে, মোতাহার আহসান কি তা জানে? অতঃপর বলে, “হ্যাঁ যাবো। সেদিন ফুফুর জন্য যাইনি।”

“ঠিক আছে। আরেকটা কথা, তিস্তার জন্য একটা সমন্ধ এসেছে। মেয়ের বয়স বাড়ছে। অপূর্ব-র জন্য তো ফেলে রাখতে পারি না। দুদিনের ভেতরে ওরা মেয়ে দেখতে আসবে। সব যোগাড় করে রেখো।” বলেই মোতাহার আহসান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তিস্তা খাবার মুখে তুলতে পারলে না। আলগোছে খাওয়া ছেড়ে প্রস্থান করল। তার মনে উথালপাথাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে। সুজন একটা ভালো চাকুরি না পাওয়া অবধি কাউকে এই সম্পর্কের কথা জানাবে না। ভয় হয় যদি মেনে না নেয়। প্রয়াসের কথা ভেবেই তুরের গলায় খাবার আটকে গেল। মস্তকে উঠল।
_
মেহেরজান সিনেমা চলছে সাদাকালো টিভির পর্দায়। সবাই মনোযোগ সহকারে উপভোগ করলেও অপূর্ব তার ব্যতিক্রম। সে দেখার পাশাপাশি ব্যায়াম করেছ। শরীরের ঘাম ঝরিয়ে ঠান্ডা দূর করে প্রচেষ্টায় মগ্ন। হ্যান্ড গ্রিপারের সাহায্য হাতের ব্যায়াম করার সময় লক্ষ্য করে অপূর্ব, তিনটা ইঁদুর মুখ ভর্তি করে ধান নিয়ে ছুটছে। যাত্রাপথে ব্যাপক ধান পড়ে আছে। কালো রঙে বিশাল ইঁদুর দেখে অপূর্ব ভীত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক চেষ্টা করেও মাকে ডাকার শক্তি তার গলায় অবশিষ্ট নেই।

গর্তে ধান সঞ্চয় করে ফিরত এলো ইঁদুর ছানা। বক্ষে ভয় সঞ্চিত হলেও বাইরে নির্ভীক থাকার নামই পুরুষ জাতি। হ্যান্ড গ্রিপার দিয়ে ইঁদুরের গতিপথ পরিবর্তন করে দিতেই তিনটি ইঁদুর দিশেহারা হলো। মাটি ছেড়ে বাঁশের খুঁটি দিয়ে পালানোর প্রচেষ্টা আরম্ভ করল। তা বেশিক্ষণ স্থির হলো না। হ্যান্ড গ্রিপার দ্বারা একবার ধাক্কা দিতেই ভারসাম্যহীন হয়ে অপূর্ব-র শরীরে পড়ল, অবিলম্বে মুখরিত হলো অপূর্ব চিৎকারে। ইঁদুর তখন অপূর্বর টি-শার্টের ভেতরে তাণ্ডব আরম্ভ করেছে।

বাড়িতে অবস্থানরত সবাই ছুটে এসেছে অপূর্ব-র চিৎকারে। লম্ফঝম্প করা অপূর্বকে অনবরত শুধিয়ে চলেছে, “কী হয়েছে অপূর্ব, এভাবে লাফালাফি করছিস কেন?”

বিরতিহীনভাবে ছটফটানি করতে করতে অপূর্ব বলে, “মা তোমার এই ছেলেটাকে বাঁচাও। ইঁদুরের কামড়ে তোমার ছেলে আর বাঁচবে না। একমাত্র ছেলে তোমার। এখনো বিয়ে করেনি।”
চার ভাই ও বাবা মিলে আলোচনা করছিলেন, তারাও ইতোমধ্যে উপস্থিত। আরুর ছোটমামা উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, “ইঁদুর? ইঁদুর কোথায়? তোকে কামড় দিয়েছে?”

“না চাচা, এখনো দেয়নি। দিতে ফেলল বলে।”

অপূর্বকে নিবৃত্ত করে আরু বলে, “নিচ থেকে টি-শার্ট ফাঁক করে দিন। বের হয়ে যাবে।”

লম্ফঝম্প করার মাঝেও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আরুর পানে চাইলো অপূর্ব। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, “আমাকে দেখে বেশ মজা নিচ্ছিস, তাই না? টি-শার্ট ফাঁক করে দেই আর সে শর্ট-এর ভেতরে প্রবেশ করুক।”

অনেকেই চেষ্টা করল আরুর কথা মেনে টি-শার্ট ফাঁক করে দেওয়ার। কিন্তু সে অবাধ্য! দুর্বার! অনিবার্য! উপায়শূন্য হয়ে আরু এগিয়ে গেল। উপর থেকে টি-শার্ট ফাঁক করে হাত ঢুকিয়ে দিল। নারীর স্পর্শে সুড়সুড়ি লাগল অপূর্ব-র। আরুকে সরানোর চেষ্টা করেও সরাতে পারল না, আরু মাথা চেপে বের করে আনল ইঁদুর। ছুড়ে ফেলতেই খুঁটির সাথে বেঁধে মাথা ফেটে রক্ত গড়ালো। অপূর্ব ক্ষান্ত হয়েছে ততক্ষণে। আরুর হাত থেকে রক্ত গড়াচ্ছে। অনিতা তা লক্ষ্য করে বলে, “ইঁদুর মা/রা/র আগেই তোর হাতে রক্ত। খুব জোরে চেপে ধরেছিলি, তাই না? চাপেই রক্ত বেরিয়েছে। তোর হাতে আর মনে জোর আছে বলতে হবে।”

তৎপরতার সাথে আরু জবাব দিলো দেয়, “কামড় দিয়েছে।”

কামড় দিয়েছে! রক্ত গড়াচ্ছে! অথচ আরুকে দেখে মনে হচ্ছে, মশার কামড়ে রক্ত ঝরছে। নানাজান গর্জে উঠলেন, “দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী দেখছ তোমরা? হাতটা চেপে বিষ রক্তটুকু বের করে ফেলো। মনি, উঠান থেকে কয়েকটা বন্যলতা তুলে নিয়ে আসো। মল্লিকা, পানি নিয়ে আসো।
মেয়েটাকে ইঁদুরে কামড়েছে, অথচ সবাই হাত-পা গুটিয়ে বসে আছে। কী তাই তো?”

অনিতা আরুর হাতের আঙুল ধরে প্রেষ করতেই গড়গড়িয়ে রক্ত বের হওয়ার পাশাপাশি আরুর চোখের বাঁধ ভাঙল। ডান চোখ থেকে একফোঁটা পানিও ঝরল। নিজের শাড়িটা আঁকড়ে ধরে সংযত করে রেখেছে। অপূর্ব যে মনোচিকিৎসক! আরুর মুখশ্রী দেখেই আরুর মনের কথা পড়ে ফেলল। পড়ে ফেলল তার যাতনার কথা। মাত্র একফোঁটা পানিও ক্ষতবিক্ষত করল অপূর্ব-র অন্তঃকরণ। অনিতা বলেন, “টি-শার্ট একটু ফাঁক করলে ইঁদুর পড়ে যেতো, কামড়াতো কীভাবে? ডাক্তাররাই যদি ইঁদুর ভয় পায়, তাহলে সাধারণ মানুষ কার কাছে যাবে?”

অপূর্ব ঘরে ছুটে গেল। বিদেশ থেকে বহন করে আনা বক্সটা নিয়ে এলো। তুলোতে মেডিসিন লাগিয়ে অন্তর্পনে আরুর হাত ড্রেসিং করে দিল। নক দিয়ে চেপে ধরে অপূর্ব-র কাঁধ। আরু মৃদু আর্তনাদ করতেই অপূর্ব চাপা গলায় বলে, “এই সামান্য ব্যথায় বাঘিনী ক্ষান্ত হয়ে গেছে?”

আরু ভ্রু কুঁচকালো। অপূর্ব-কে সেই ব্যথা অনুভব করাতে অপূর্ব-র হাতে নিজের দাঁত বসালো। অপূর্ব আর্তনাদ করল না। আরু সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাত পর্যবেক্ষণ করল। দাগ বসে রক্ত জমাট বেঁধেছে।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-০৯

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৯

“আরু আর তোর বাড়িতে যাবে না। ইমদাদুল আসলে এখানে পাঠিয়ে দিবি। ও যদি মেয়ের যত্ন নিতে পারে, তবেই আরু-কে ঐ বাড়িতে পাঠাবো। আরু ঘরে যা।” চম্পার স্পষ্ট বাক্য।

শত হোক মা! অয়ন আরুকে সহ্য করতে পারে না। ‘বাবা যে তার চেয়ে মেয়েকে বেশি ভালোবাসে’-এটাই তার অ/পরা/ধ। আরু ঘরে গেল না, উলটো পথে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরল। অপূর্ব মুষ্ঠিবদ্ধ করে গাছের সাথে আঘাত করে হাত। পেরিয়ে গেল কিছু মুহূর্ত। পিনপতন নীরবতা। নীরবতার ইতি টেনে অনিতা বলেন, “অপূর্ব যাবি না? সবাই এগো, আমি দরজায় তালা লাগিয়ে আসছি।”

“আমার বোন চলে গেছে, আর আমি ঐ বাড়িতে পাত্রী দেখতে যাবো? অসম্ভব। তোমার ননদ গেলে নিয়ে যাও।” বলেই অপূর্ব টিনের বেড়ায় লা/থি দিল। বেঁকে গেল তা। ধপাধপ পা ফেলে রাস্তার দিকে গেল অপূর্ব। আশেপাশে আরুর দেখা নেই। নদীর ওপারে ভেজা নীলপদ্ম-কে দেখা যাচ্ছে। সাঁতরে ওপাড়ে গেছে। অপূর্ব-র সাঁতার জানা নেই। নাহলে এই নদী সাঁতরে আরু-কে নিয়ে আসতো। নিজের উপর ঈষৎ রাগ জন্মালো। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। শহরের মতো আলো নেই কোথাও। অপূর্ব-র মনে ভয় উঠল। তাই আর চলতিপথে এগোল না, ফিরতি পথ ধরল।

আকাশ কালো করে এসেছে। এই শীতে বৃষ্টির আগমন ঘটার সম্ভাবনা নেই, তবুও অন্তঃকরণ জানান দেয় বৃষ্টির অপ্রত্যাশিত আগমনের কথা। আরু ক্ষেতে নামতেই মিঠু ছুটে এলো নিকটে। ভেজা শাড়িতে ঘেঁষল ছাগল খানা‌। আরু আজ মিঠুকে কোলে তুলল না, হাত বুলিয়ে দিল না তার শরীরে। বড়ো ছাগলটা-কে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলো। গোয়ালে রাখতেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পতিত হলো। হাঁস-মুরগিগুলো খোপরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আরু আর জামা কাপড় পালটালো না। খোপরের দরজা খুলে দিল। গুনে গুনে হাঁস মুরগি ভেতরে ঢুকালো। নির্দিষ্ট সংখ্যায় আসতেই তালাবদ্ধ করে দিল দরজা। তখন বৃষ্টি ক্রমশ বাড়ছে। ধানগুলো ভালোভাবে পলিথিন দিয়ে ঢেকে কলস নিয়ে চলল দিঘির পাড়ে। প্রথম কলস পানি নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারলেও দ্বিতীয় কলসের সময় ব্যতিক্রম হলো। বৃষ্টিতে ভিজে উঠান কর্দমময় হয়ে উঠেছে। পা পিছলে মাটির কলসখানা নিয়ে পড়ল। ভাঙল কলস। ভীত হলো আরু। পারুল আবার তার উপর..। মাটির কলসখানা স্পর্শ করে কান্নায় ভেঙে পড়ল আরু। স্থান পরিবর্তন করল না। বসে রইল। ময়নাপাখি বৃষ্টি উপেক্ষা করে ছুটে এলো।
“আরুপাখি, আরুপাখি, আরুপাখি। বৃষ্টি, বৃষ্টি, বৃষ্টি। চল, চল, চল।”

ময়না আরুর কাঁধ দখল করে দিল। ময়নার শরীরে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আরু বলে, “আমি ইচ্ছে করে ভাঙিনি, মা দেখলে খুব মা/র/বে ময়না। আমার খুব ভয় করছে।”

“কিছু হবেনা, কিছু হবেনা, কিছু হবেনা।” ময়না তিনবার আওড়ালো। অয়ন ও পারুল বৃষ্টি মাথায় নিয়ে এসেছে। একটু আগে মায়ের কাছ থেকে শুনে আসা কটুক্তি, এখন নিজের কলস ভাঙা। রোষে শরীর ‘র-র’ করছে। শাড়িটা ঈষৎ উঁচু করে এগিয়ে গেলেন। আরুর মাথা ধরে একটা ধাক্কা দিতে রোষ মেজাজে বলে, “ইচ্ছে করছে, কলসের মতো তোকেও চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেই। একটা কাজও সাবধানে করতে পারিস না, না-কি আমার উপর রাগ দেখিয়ে আমার কলসখানা ভাঙলি?”

আরু হাঁচি দিল দু-বার। পারুল শাড়ির দিকে লক্ষ্য করল, ভেজা শাড়ি এখনো পালটায় নি। সব কাজ পরিপাটি করে শেষ করেছে। তুলনামূলক একটু শান্ত হয়ে বলে, “যা উদ্ধার করেছ, করেছ। বৃষ্টিতে না ভিজে জামা কাপড় পালটে নে। বাবাই ফোন করলে বলিস, ‘কলস ভেঙেছি। নতুন কলস নিয়ে এসো।’ যত্তসব।”

অতঃপর চলে গেল। আরুও উঠে চলে গেল। শাড়ি পালটে বিছানায় গাঁ হেলিয়ে দিল। ঠান্ডায় মাথা ভার হয়ে আসছে, জ্বর আসবে বোধহয়।
__

শীতকালে সূর্য মামার মাটি স্পর্শ করতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়। কুয়াশা ভেদ করা চাট্টিখানি কথা নয়। তবে এখন শীত শেষের দিকে। কুয়াশা ফিকে হয়ে উঠেছে। হাড় কাঁপানো শীতে আরুর গরম নিয়ন্ত্রণ পোশাকের প্রয়োজন হয়নি, কিন্তু জ্বরের কারণে আজ চাদর জড়িয়ে বসে আছে দিঘির পাড়ে। উঠানের শেষ প্রান্তে দিঘি। মিহির বসেছে পাশে।

অয়ন ছাই দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে আরুর কাছে এলো। মাধুর্যর্পূর্ণ কণ্ঠে বলে, “বুবু, পানি তুলে দে।”

জ্বরে মাথা ধরে যাওয়ার দরুন আরু চাম্পল গাছে ঠেস দিয়ে গ্ৰথন পল্লবে ছিল। অয়নের ডাকে বালতি হাতে নিয়ে দিঘিতে নামল। অয়ন সাঁতার জানে না, দিঘির কাছে যেতে ভয় পায়। অয়নের গোসলের যাবতীয় পানি আরু বহন করে দেয়।

বালতি ভর্তি পানি স্লাভের উপর রাখতেই পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে অয়ন। উষ্ণ শরীরে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে সর্ব বল প্রয়োগ করে চ/ড় লাগালো গালে। অয়ন তেজ দেখিয়ে বলে, “তুই আমকে মা/র/লি বুবু। আরেক‌ বালতি পানি এনে না দিলে মাকে বলব, তুই পানি ফেলে আমাকে মেরেছিস।”

আরু ফোঁস করে নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। একপেশে কাত হয়ে থাকা পানি শূন্য বালতিটা নিয়ে নেমে গেল দিঘিতে। পূর্ণ করে পূর্বের স্থানে রেখে বলে, “পানি এনে না দিলে কী করতি?”

“মায়ের কাছে বিচার দিয়ে তোকে মার খাওয়াতাম। পানি এনে দিয়েছিস, এখনও মার খাওয়াবো। দাঁড়া তুই।” নিজ সিদ্ধান্তে অনড় থেকে বলে অয়ন। আরু সময় নষ্ট করল না, অয়নের মাথা চেপে ধরল পানি ভর্তি বালতিতে। পারুল বের হয়েছে ঘর থেকে। ছেলেমেয়ের এই কাণ্ড দেখে অবিলম্বে ছুটে‌ এলো। অয়নকে আরুর থেকে ছাড়িয়ে চ/ড় লাগালো আরুর গালে। অতঃপর সে নিজেও হতভম্ব হলো। এক সেকেন্ডের মতো আরুর সংস্পর্শ লেগেছিল, এতেই জ্বরের প্রভাব হাতে লেগেছে। চোখ মুখটাও অতি শুষ্ক। আরুর ললাট স্পর্শ করে জ্বরের তীব্রতা পরীক্ষা করল পারুল। পারুল অনুভব করল, মেয়েটা জ্বরের ঘোরে এরূপ করেছে। কারণ ভাইকে সে প্রাণের চেয়ে বেশি স্নেহ করে। তবুও থমথমে গলায় প্রশ্ন করে, “কী হয়েছে এখানে?”

ক্রন্দনরত অবস্থায় অয়ন বলে, “পানি তুলে দিতে বলেছিলাম। বুবু পানি তুলে তা ফেলে দেয়। আমি পানি তুলে দিতে বলেছি বলে আমাকে চ/ড় মে/রে/ছে। নতুন পানি এনে চুবিয়ে..
অয়নের বাক্যের ইতি ঘটার পূর্বেই হুংকার দিল আরু, “খবরদার অয়ন, একটা মিথ্যা মুখ থেকে বের হলে খবর আছে। আগে বালতিতে চুবিয়ে রেখেছি এখন পুকুরে চুবিয়ে রাখব।”

ময়না পাখিটা তাল মিলিয়ে বলে, “খবরদার অয়ন। খবরদার অয়ন। খবরদার অয়ন।”

আরুর মুখের কথা অবিকল নকল করেছে ময়না। এতে ভীত হলো অয়ন। কিছু বলে না। মিহির আরুকে সঙ্গ দিয়ে বলে, “মামি, তোমার ছেলেকে সহবত শিখাও। সবটা তো নিজেকে চোখেই দেখলাম। আরুর জ্বর এসেছে। ও দৌড়ে কলতলায় যেতে পারত। আরুকে কেন হুকুম দিবে?”

তদানীং উপস্থিত হলো আরুর নানা ও অপূর্ব। আরুকে নিতে এসেছে। পারুল সালাম দিল। অতঃপর আরুকে বলে, “বাজানের জন্য চেয়ে নিয়ে আয়।”

“মেয়েটার শরীরে জ্বর। ছেলেটাকে বলতে পারো না?” বিরাগী হয়ে বলে মিহির। অপূর্ব এক ধ্যানে চেয়ে আছে আরুর দিকে। শেষ দেখা আর বর্তমানের মধ্যে কত ফারাক। লালচে আভা জমেছে মুখমণ্ডলে। অপূর্ব আরুর ললাট স্পর্শ করে জ্বরের মাত্রা পরীক্ষা করে বলে, “গাঁ পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। কখন জ্বর এসেছে, ওষুধ খেয়েছিস?”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-০৮

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৮

“এখন ওখানে নেই। স্কুলে আসা-যাওয়ার সময় থাকে শুধু।” নম্র ভাষা।
অপূর্ব ফোঁস করে নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। তুরের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে ইশারায় যাওয়ার ইঙ্গিত করে। তুর নিঃশব্দে প্রস্থান করে।

“তবে আমার একটা শর্ত আছে। তুই যদি আমার একটা শর্ত মানিস তবে আমি কালাচাঁনকে আচ্ছা করে পি/টা/বো।” শর্তের প্রসঙ্গ তুলে আরুর মুখমণ্ডলের ভঙ্গিমা দেখল অপূর্ব। শর্তের কথা শুনে জড়সড়ো হয়ে আছে আরু। কিছুক্ষণ প্যাঁচা মুখ করে থেকে বলে, “ঠিক আছে, তবে শর্তটা কী?”

জয়ের হাসি ফুটে উঠল অপূর্ব-র ঠোঁটের কোণে। গলা খাঁকারি দিয়ে বলে, “আমার প্রথম শর্ত, তুই কখনো কোনো পুরুষের কাছাকাছি যাবি না। অন্তত চার ফুট দূরত্ব বজায় রাখবি।”

বলা বাহুল্য আরুর দূরত্ব বজায় রাখতে মিলি সেকেন্ডই যথেষ্ট। চার বেশিও বজায় রাখল। অপূর্ব বিরাগী হয়ে হাত টেনে দূরত্ব ঘোচাল। অতঃপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, “আমি আমার সাথে দূরত্ব দেখাতে বলিনি। আমি ব্যতিত অন্যরা। বিশেষ করে মিহির।”

“আপনার সবাই তো আমার ভাই। আমি দুচোখামী করতে পারব না।”

“তাহলে এক চোখামী করবি। মামা বাড়ির সাথে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে না, শুধু দাদা বাড়ির সাথে রাখলেই যথেষ্ট। আমার দ্বিতীয় শর্ত, আমাকে জড়িয়ে ধরে একশো একটা চুমু খেতে হবে।”

আরু নাক কুঁচকালো। চোখে তার অপ্রত্যাশিত চাওনি। জ্ঞান হারিয়ে ফেলল এই বুঝি। সম্পর্কে ভাই না হলে অপূর্ব-কে সে চাচা হিসেবে সম্বোধন করতো। জড়িয়ে ধরা অবধি ঠিক ছিল, তাই বলে দুদিনের চেনা ছেলেকে চুমু? তাও একশো একটা। আরু ইতস্তত করে বলে, “এই শর্ত না মেনে অন্য শর্ত মানলে হবে?”

“তাহলে কালাচাঁন আর ওর সাঙ্গপাঙ্গদের না মে/রে অন্য কাউকে মা/র/লে হবে?”

আরুর মুখশ্রী আঁধারে ঢেকে গেল। অপূর্ব-র রাগ জাগল। তবুও বলে, “তোকে বিশ্বাস নেই, কাজ করার পর যদি বেঁকে বসিস। তাই আগে কিছু অগ্ৰিম দিতে হবে।”

আরুর ওড়নায় গিট দেওয়া অংশ খুলে টাকা বের করল। ত্রিশ টাকা আছে। টাকাগুলো এগিয়ে দিয়ে বলে, “আমার কাছে ত্রিশ টাকাই আছে বিশ্বাস করুন। ওরা পাঁচজন। পাঁচ টাকা করে নিয়ে বাকি পাঁচ টাকা ফিরত দিন।” অপূর্ব ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল অপলক। আরু পুনরায় বলে, “ফিরত দিতে হবেনা। প্রয়োজনে আপনি আমার সব টাকা নিয়ে যান। টাকার বিনিময়ে মা/রু/ন। তবুও..”

“অন্য কাউকে দেখ, আমার যা লাগবে আমি বলে দিয়েছি।” বলেই অপূর্ব অগ্রসর হলো। আরুর দীর্ঘক্ষণ ভেবে অপূর্ব হাত ধরে বলে, “এমন করছেন কেন?”

অপূর্ব ফিচেল হেসে হাত ছাড়িয়ে বেরিয়ে গেল। আরুও নামল পিছুপিছু।‌বাড়ির সব মহিলারা ও ছোটরা তৈরি হয়ে নেমেছে তখন। আরুকে দেখে একদফা চমকে উঠল সকলে। জাহানারা আরুকে কাঁদতে দেখে বলে, “কি-রে আরু, কাঁদছিস কেন মা?”

অপূর্ব আগ বাড়িয়ে জবাব দেয়, “আমার বউ না-কি সে পছন্দ করে আনবে। আমাদের সাথে যেতে চাইছে, তাই কাঁদছে।”

“এজন্য কাঁদা লাগে। পাগল মেয়ে, আয় তৈরি করে দেই।” জাহানারা আরুকে টেনে গেল কক্ষে।

নীল রঙে চওড়া সাদা পাড় বিশিষ্ট শাড়ি আরুর জন্য আলমারি থেকে নামিয়েছে জাহানারা। আরু সেটা গ্ৰামে মতো করে পরিধান করে নিল অঙ্গে। দীর্ঘ চুলগুলো দুপাশে বেনুনি করে নীল রঙের ফিতা দিয়ে বাঁধল। খয়েরি গাঁদা ফুল গুঁজে দিল ফাঁকে-ফাঁকে। চোখে চওড়া কাজল, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক ও হালকা পাউডার মুখে, কপালে বিন্দুর মতো টিপ। আরুর জন্য অপেক্ষারত ছিল সবাই। আরু এই সাদামাটা রূপে নেত্রপল্লব স্থির রইল সকলের। অনিতা এগিয়ে এসে আরুর চোখ থেকে কাজল কনিষ্ঠ আঙুল নিয়ে লেপ্টে দিলেন কানের পশ্চাৎ-এ। ‘রূপবতী, গুনবতী মেয়ের সন্ধানে যাচ্ছি অথচ সেই মেয়ে আমার ঘরে’ বলেই অনিতার হাত নিশ্চল হয়ে গেল।

অনিতা তাড়া দিয়ে বললেন, “চল, চল বেরিয়ে পড় সকলে। আমি দরজায় তালা ঝুলিয়ে প্রহরীদের বলে আসছি।”

অনিতা কক্ষে প্রবেশ করতেই এক এক করে বাইরে বেরিয়ে গেল সকলে। নূপুরের শব্দ তুলে অগ্ৰসর হয়ে অপূর্ব-কে অতিক্রম করার সময় আশাতীত কাজ করে ফেলল অপূর্ব। অশান্ত কণ্ঠে বলে, “আরু, এটা পরিপাটি সাজ নয়। আমরা মেয়ে দেখতে যাচ্ছি। এই সাজ একদমই বেমানান। শাড়ির সাথে ব্লাউজ বা থ্রী পিস পরে নে।”

“আমার কাছে শাড়িই স্বস্তিদায়ক। তাছাড়া ব্লাউজ এই বাড়িতে নেই।”

“তুর বা শেফালী কারো তো নিশ্চয়ই আছে, এনে দেই।”

“না, আমি এতেই ঠিক আছে।” হাত ছাড়িয়ে পুনরায় অগ্রসর হলো আরু। অপূর্ব বাঁধা দিল না, দমিয়ে রাখল শুধু। নখ দিয়ে আঁচড় কেটে ফেলল আরুর ব্লাউজ বিহীন নগ্ন পিঠে। অচল হলো আরু, বিলম্ব হলো রক্ত ঝরতে। পিঠে হাত দিয়ে দেখল, রক্ত। ফিচেল হেসে অপূর্ব যেতে যেতে বলে, “বড়দের কথা না শুনলে এমন হবেই। বেশি করে হবে। তুরকে পাঠাচ্ছি। আমার আদেশ মেনেই আসবি। নতুবা..

আষাঢ়ে ভেসে আসা পদ্ম তুমি। নীলপদ্ম। উন্মুক্ত করার অধিকার শুধুই আমার।

পারুল ও‌ অয়ন এসেছে। তাঁরাও আজ যাবে অপূর্ব-র মেয়ে দেখতে। আহসান বাড়িতে পা রেখে আরুকে দেখা মাত্র তাঁর মস্তিস্ক অগ্নিতে প্রজ্বলিত হলো। সেই অনলে ঘি ঢেলে পারুলের আঁচল টেনে বলে অয়ন, “দেখো মা, বুবু কাজের ভয়ে এখানে এসেছে। বুবু দিনদিন অকর্মণ্য হয়ে যাচ্ছে। বিয়ে দিলে জামাই এক দরজা দিয়ে নেবে অন্য দরজা দিয়ে ফেরত দিয়ে যাবে।”

পারুল ক্রোধে ফুঁস করে উঠে। আরুর গাঁথা দুই বেনুনি ধরে টেনে পরপর তিন খানা চড় বসালো। আরুর শুভ্র ও উজ্জ্বল গাল অবিলম্বে রক্ত জমে রক্তিম হয়ে উঠল। তাতেও ক্ষান্ত হলো না পারুল, বরং বেনুনি টেনে লাঠি খুঁজতে মরিয়া হয়ে উঠল চারপাশে। ছোটো একটা মগডাল হাতের নাগালে পেতেই, সেটা দিয়ে কয়েক ঘা লাগালো। আরু ব্যথায় কুঁকড়ে উঠার পাশাপাশি প্রস্থান করার চেষ্টা করল, কিন্তু বেনুনির কারণে সম্ভব হলো না। বাজখাঁই গলায় বলেন, “সারাদিন এপাড়া-ওপাড়া করিস। বাড়ির কাজ কে করবে? কে ছাগল গোয়ালে ঢুকাবে? তোর ময়নাকে কে খাওয়াবে? হাঁস মুরগি কে খোপরে ঢুকাবে? গৃহস্থালির কাজ কে করবে?”

মা-কে খুঁজতে অপূর্ব এলো। আরুকে এভাবে আ/ঘা/ত করতে দেখে ছুটে এলো। ফুফুর হাত থেকে বেনুনি ছাড়িয়ে নিল। অতঃপর চ্যাঁচিয়ে বলে, “হয়েছে কী এখানে? ওকে মা/রছ কেন?”

আরু মাটিতে নুয়ে হাউমাউ করছে। অশ্রু চোখের কাজল লেপ্টে গেছে। বেনুনিতে গাঁথা গাঁদা ফুলের পাপড়ি মাটিতে ছড়ানো ছিটানো।

লাঠি নিয়ে তেড়ে আসতে আসতে বলে, “ওর এপাড়া ওপাড়া বেড়ানো বন্ধ করছি। মেয়ে মানুষ স্কুল থেকে বাড়িতে যাবে, খাবে কাজ করবে আর ঘুমাবে। কেন টইটই করবে?”

অপূর্ব লাঠি আয়ত্ত করে চূর্ণ করে ফেলল। চ্যাঁচামেচির শব্দ শুনে সবাই এলো। চম্পা মেয়ের গালে কষে চড় বসালেন এবং বললেন, “আরু আর তোর বাড়িতে যাবে না। ইমদাদুল আসলে এখানে পাঠিয়ে দিবি। ও যদি মেয়ের যত্ন নিতে পারে, তবেই আরু-কে ঐ বাড়িতে পাঠাবো। আরু ঘরে যা।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-০৭

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
#পর্ব: ০৭

“আরু আমি তোমার জন্য পাক্কা একঘণ্টা দশ মিনিট দাঁড়িয়ে আছি। এত দেরিতে কেন এলে? ঐ ছেলেটার কাছ থেকে চিঠি নিলে কেন?” গর্হিত কণ্ঠে বলে কালাচাঁন।

নিজের হাতের দিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে চেয়ে রইল আরু। এই অজপাড়া গাঁয়ে মেয়েরা শৌখিন না-হোক ফেলনা নয়।

কালাচাঁদকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার জন্য অগ্ৰসর হলো। আরু পারল না, কালাচাঁন আটকে দিল পথ। আরুর সাথি তন্বি অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে, “তোরে না কয়দিন কইছি কালাচাঁন। একদম আরুর পিছে লাগবি না। আরু ওর মামারে বললে তোর মতো কালাচাঁন মাটির নিচে যেয়ে মাইট্টা চাঁন হয়ে যাবে।”

“তন্বি তুই আমার আর গোলাপী সুন্দরীর মাঝে আসবি না। (অতঃপর মোলায়েম কণ্ঠে বলে) আরু বিশ্বাস করো, আমি তোমারে মেলা ভালোবাসি। তুমি আমারে গ্ৰহণ কইরা লও।”

“আমি বিয়ে করব, সিনেমার নায়ক। সবাই বলে আমি অনেক সুন্দর। আমি সুন্দর হয়ে তোকে কেন বিয়ে করব? আমি বিয়ে করব সুদর্শন পুরুষকে।” বিদ্রুপ করে বলে আরু। ক্ষান্ত করার প্রচেষ্টা করে কালাচাঁন বলে, “দেখো গোলাপী, সাদা কালো বিপরীত। সাদা আছে বলেই কালোকে সবাই তাচ্ছিল্য করে। কালো আছে বলেই সাদার এত কদর। তুমি আমারে বিয়ে করলে সবাই বলবে, কালার ঘরে চাঁন আইছে। আমার কালাচাঁন নাম সার্থক হবে।”

“রাখ তোর কালাচাঁন, রাতে আকাশ থাকে অন্ধকার। এই অন্ধকার আকাশে কালাচাঁনকে দেখাই যাবে না। আমি সাদাচাঁন-ও বিয়ে করব না। আমি বিয়ে করব সূর্যকে। সূর্য আট মিনিট উনিশ সেকেন্ডে পৃথিবীতে আলোকিত করে দেয়। যখন সে আমার ব্যক্তিগত সূর্য হবে তখন আলো আসতে কোনো সময় লাগবে না।” আরুর এরুপ কথাতে ক্ষেপে গেল কালাচাঁন। আরুর হাতটা আরেকটু চেপে ধরল। শহরের মেয়েদের স্পর্শ করা যতটা সহজ ভাবে নেওয়া সম্ভব, গ্ৰামের মেয়েদের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত। আরুর চোখ জলে পূর্ণ হয়ে এলো। ক্রোধে ফোঁস করে বলে, “কালাচাঁনের বাচ্চা, তোর সাহস হয় কীভাবে আমাকে স্পর্শ করার? তুই আমার অপূর্ব ভাইকে চিনিস না। সিনেমার হিরোদের মতো ভাঁজ কা/টা তার দেহ। এক ঘু/সিতে তোকে কালাচাঁন থেকে চ্যাপাচাঁন করে দিবে।”

আরুর চ্যাঁচানো শুনে ভীত কালাচাঁন হাত ছেড়ে দৌড়ে পালাল। কালাচাঁনের স্পর্শ করা হাত ঘষতে ঘষতে রক্তিম করে ফেলল আরু। লোকে জানলে বলবে, পরপুরুষ আরুকে ছুঁয়েছে।
উ/ন্মা/দ হয়ে হেঁটে চলেছে আরু। তন্বি আরুকে থামানোর চেষ্টা করে। চার রাস্তার মোড়ে এসে আলাদা পথ ধরে তন্বি, বইখাতা আঁকড়ে ধরে মামাবাড়ির পথ ধরে আরু। অপূর্ব-কে সে টাকা দিয়ে ভাড়া করে কালাচাঁনকে পি/টু/নি খাওয়াবে।

‘টগবগ! টগবগ! টগবগ!’ করে ঘোড়ার পিঠে চড়ে অপূর্ব ছুটে আসে। আরুকে উদাসীন হয়ে হেঁটে যেতে দেখে বিস্মিত হলো অপূর্ব। পায়ের নূপুরের ভিন্ন ‘বিষাদের’ সুর শুনে ঘোড়ার গতিরোধ করল অপূর্ব। বলে, “উ/ন্মা/দের মতো হাঁটছিস কেন?”
ঘোড়া দেখে আরু ভুলে গেল উ/ন্মাদনা। বাদামী সম্পূর্ণ দেহের রঙ। চুলগুলো ১৬ ইঞ্চি দীর্ঘ ও ফিকে বাদামী। লেজ ২৪ ইঞ্চি লম্বা ও সম্পূর্ণ লেজ চুল দ্বারা আবৃত। অপূর্ব-র সামনে শেফালী বসে আছে‌। আরুকে দেখে শেফালী উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, “জানিস আরু, অপূর্ব ভাই আমাদের সবাইকে ঘোড়ায় চড়িয়েছে। টগবগ টগবগ করে চলছে ঘোড়া। কী মজা।”

‘মজা’ শব্দটা শোনার পর স্পৃহা জাগল ঘোড়ার পিঠে চড়ার। আরু যদি আহসান বাড়ির মেয়ে হতো, তবে অনায়াসে সেই অবদান করতে‌ পারত। কিন্তু তার চাচাতো ভাই সাবিত ছোট। একমাত্র মিহির ভাই আছে। যদিও সে আরুকে‌ যথেষ্ট ভালোবাসে, তবুও। আরুর মন পড়ে অপূর্ব বলে, “শেফালী তুই নাম, আরু উঠুক।”

“আমি তো মাত্রই চড়লাম। আরেকটু থাকি।” আবদার তার।

“ধাক্কা দেওয়ার আগে নাম। নাহলে হাত-পা ভাঙবে।”

অগত্যা অপূর্ব-র সাহায্যে শেফালী নামল ঘোড়া থেকে। নিজের বইখাতা শেফালীর হাতে দিয়ে ঘোড়ার দিকে এগোল আরু। অপূর্ব মাটিতে নেমে আরুর কোমর আঁকড়ে ঘোড়ার উপর তুলে দিল। অতঃপর নিজেও আরোহণ করে পেছনে। আদেশ করে টাইসনকে, “ছুটে চল টাইসন।”

পুনরায় টগবগ করে ছুটল সে। গতিশীল হওয়ার পর মুহুর্তেই আরুর হাস্যোজ্জ্বল মুখ ভয়ে নিমজ্জিত হয়ে গেল। অপূর্ব হাতে আঁচড় কে/টে বলে, “নামব, আমার ভয় করছে।”

“এটুতেই ভয়! তোর না-কি সারাজীবনের ইচ্ছে ছিল রাজকুমার বিয়ে করার?” ঘোড়ার বেল্ট ধরে আস্ফালন করতে করতে বলে অপূর্ব।

“হম। আমি রাজকুমার বিয়ে করব। তার পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে নিজেকে রানীর পরিচয় দিবো।” অপূর্ব-র বক্ষে হেলান দিয়ে নিজের কল্পনায় প্রবেশ করল আরু। ঘোড়ার বেল্ট থেকে হাত আরুর ডান কাঁধে রেখে বলে, “রাজকুমার থাকে দূরে, বহুদূরে। একদম সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারে। সে আসে পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে। পক্ষীরাজ ঘোড়ার ডানা হয়, আমার ঘোড়ার নাইবা হলো। আমিও আমার রাজকুমারীকে রানীর রুপ দিতে সাত সমুদ্র তের নদীর ওপার থেকে ঘোড়া নিয়ে এসেছি।”
আরু মাথা তুলে অপূর্ব-র দিকে তাকালো। তারমানে অপূর্বও কোনো রাজপুত্র। কোনো রাজকুমারীর জন্য এসেছে। ঈষৎ ঈর্ষা অনুভূত হলো আরুর। এই গ্ৰামে হাজার থেকে লক্ষাধিক মেয়ের বিয়ে হয়েছে অথচ কোনো রাজকুমার ঘোড়া নিয়ে আসছি। এই প্রথম কোনো নারীর জন্য ঘোড়া নিয়ে এসেছে। আরুর স্পৃহা জন্মালো সেই সৌভাগ্যবতী নারীর ললাটে ললাট ঠেকাতে। বামহাত দিয়ে নিজের কপাল মেপে নিল। একমাত্র চার আঙুল কপালের মানুষের ভাগ্যে জোটে ভালো কিছু। কিন্তু সেই সৌভাগ্যবতীর ললাট নিশ্চয়ই পাঁচ আঙুল হবে, লাখে এক বলে কথা। কিন্তু আরুর কপাল তিন আঙুলের।
ততক্ষণে বাড়ির প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রবেশ করেছে ঘোড়। আরু ও অপূর্ব উভয়ে নেমেছে। রাখাল চাচা ঘোড়া নিয়ে গেছে গোয়ালে। আরুর মন খারাপ অপূর্ব চট করে পড়ে ফেলল, অতঃপর ফোঁস করে নিঃশ্বাস ত্যাগ করে, ‘স্যরি আরু, তুই যথেষ্ট ছোট ও বাচ্চা। তোর ভাগ্যে আমি নেই। প্রার্থনা করি, তোর জন্যও কোনো রাজকুমারের আগমন ঘটুক।’

অপূর্ব ভাবল, আরু একটু ক্ষেপে যাবে। একটু অভিমান পুষবে। অপূর্ব আবার সেই অভিমান মুছে দিবে। অপূর্ব-র ভাবনাকে মিথ্যা প্রমাণ করে আরু বলে উঠে, “অপূর্ব ভাই ঘোড়া কেন দাঁড়িয়ে ঘুমায়? কেন? সারারাত দাঁড়িয়ে ঘুমাতে ওদের পা ব্যথা করে না বুঝি?”
__
তুরকে প্রয়াসের চিঠি দিয়ে অশ্রুপাতে ভেঙে পড়ল আরু।
অপূর্ব বোনেদের ঘর অতিক্রম করার সময় কান্নার শব্দ শুনতে পেল। কৌতুহল বশত ভেড়ানো দ্বার উন্মুক্ত করল। আরু-কে ক্রন্দনরত অবস্থায় দেখে হৃৎপিণ্ড তার কাজ ভুলে গেল। তুর একাধিকবার প্রশ্ন করছে কী হয়েছে? আরু প্রত্যুত্তর বিহীন কেঁদে চলেছে। অপ্রসন্ন হয়ে বলে, “বলবি তো কাঁদছিস কেন?”

আরু তার বামহাতটা বাড়িয়ে দিল। হাতের কবজির কাছে লালচে বর্ণ হয়ে আছে। ছিলে গেছে বোধহয়। হেঁচকি তুলে বলে, “কালাচাঁন আমার হাত ধরেছে তুর। আমার মন চাচ্ছে, হাতের চামড়া তুলে ফেলি।” অতঃপর ক্রন্দনরত অবস্থায় সবকিছু খুলে বলে আরু।

আরুর নিকট পৌঁছে অস্থিরচিত্তে জেরা করল অপূর্ব, “কখন ঘটেছে এইসব?”

অপূর্ব-র আগমনে আশ্চর্যান্বিত হয়ে উঠল আরু। নিজের করা প্রশ্নে জবাব না পেয়ে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠে অপূর্ব। রক্তিম হাতে বল প্রয়োগ করে পুনরায় অভিন্ন প্রশ্ন করে।

হাত ছাড়াতে ছাড়াতে ব্যথাহত কণ্ঠে বলে, “স্কুল থেকে আসার সময়। যখন আপনার সাথে দেখা হলো।”

‘এজন্য উন্মাদের মতো লাগছিল?’ অপূর্ব নির্লিপ্তভাবে বলে, “তখন কেন বললি না। এখন চল।”

ভীত হয়ে গেল আরু। কোনোভাবে মায়ের কাছে খবর গেলে আস্তো রাখবে ওকে। কম্পিত গলায় বলে,

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]
রেসপন্স করার অনুরোধ রইল 💚

নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-০৬

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৬

“অপূর্ব ভাই, মেয়েদের ছবি দেখাতে ঘটক এসেছে। মামি ডাকছে আপনাকে।” বলতে বলতে অপূর্ব-র কক্ষে প্রবেশ করল আরু। একই গতিতে বিরতি না দিয়ে আরু ফিরতি পা বাড়ালে অপূর্ব থামিয়ে দিল, “দাঁড়া, একসাথে যাই।”

মধু খেয়ে ঠান্ডা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে অপূর্ব-র। এজন্য হলেও আরু-কে ছোট করে ধন্যবাদ দেওয়া দরকার। চাদর জড়িয়ে একসাথে বৈঠকখানায় গেল আরু ও অপূর্ব। অনিতা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। ঘটক তার আনা পাত্রীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সাজিয়ে দেওয়ার খাবার মুখে তুলতে তুলতে বলে, “আমার কাছে খাসা পাত্রী আছে, চেয়ারম্যান বাড়ির ছেলের বিয়ে বলে কথা। নিরানব্বই খান ছবি আছে।”

“নিরানব্বই-এর পর একশো নাম্বার পাত্রী আমাদের আরু।” অন্যমনস্ক হয়ে বলে ফেলেন অনিতা। আচমকা সবাই তাকাল। পরিস্থিতি সামলাতে বলেন, “আপনি ছবিগুলো দিন।”

ঘটক ছবি দেখানো শুরু করল। প্রতিটা ছবির মেয়েকে একনজর দেখে আরুকে দেখে অপূর্ব। তার প্রণয়ী হৃদয় আরুর প্রতিচ্ছবির সন্ধান চাইছে। নিরানব্বই খানার মাঝে এক খানা ছবি পছন্দ করা হলো। সেই খানা রেখে দিল। ঘটক আহ্লাদিত হয়ে বলে, “তারাও চেয়ারম্যান। আমি কথা বলে রাখব। পরশুদিনই আপনারা মেয়ে দেখতে যেতে পারবেন।”

“পরশুদিন কেন? কালকেই যাবো। ছেলের বয়স বাড়ছে। আর দেরি করা যাবে না।” অনিতা বলেন। ঘটক সায় দেয়, “ঠিক আছে। তবে বিয়ের সময় আমাকে টাকা পয়সা যা দেন দিয়েন। সাথে একটা ছাতা দিয়েন।”
ঘটকের এই অবদান নতুন নয়। নতুন ঘটকালি করতে গেলে ছাতা নিয়ে শুরু করে আহ্লাদ। ঘটক পান খেয়ে বিদায় হলেন। আরু পান বানাতে বসল। সবাইকে দিয়ে অপূর্বকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“অপূর্ব ভাই, পান খাবেন?” সংশয়ের বশবর্তী হয়ে বলতে বলতে নানি জানের পানের ডালা থেকে মস্ত বড়ো একটা পান নিয়ে নিল আরু। প্রয়োজনের তুলনায় অধিক জর্দা দিয়ে পান বানিয়ে মুখে দিল আরু। চম্পা তেড়ে এসে ছিনিয়ে নিলেন পানের ডানা। রাগান্বিত হয়ে বলেন, “তুই কি গরু হয়ে চাস আরু? পান খেলে পড়াশোনা হয়না।”

অপূর্ব আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে নিল আরুর। পান চিবুকে আরুকে বেশ উচ্ছ্বাসিত দেখাচ্ছে। বিদেশে অবস্থানরত সময়ে সিগারেট টেনে যতটা প্রফুল্লচিত্তে দীপ্ত থাকত অপূর্ব, ততটা। গ্ৰামে এসে হুক্কা ছাড়া কিছু ছোটে না তার। জর্দা নেশার মতো কাজ করে বলেই নারীরা একটি পানে সারাদিন অভুক্ত থাকতে প্রস্তুত। উদ্ভাসিত হয়ে শুধাল, “আরু বেশি জর্দা দিয়ে মনমাতানাে একটা পান বানিয়ে দে।”

ব্যাস, নির্বাক্যে চম্পা পানের ডালা দিয়ে দিল। আরু ঢেড় জর্দা দিয়ে পান বানাল, অপূর্ব তা গ্ৰহণ করতে নারাজ। আধ কৌটা জর্দা পানে ঢেলে মুখে দিল। উপস্থিত সবাই কিৎকর্তব্যবিমঢ়। বিলম্বে ঝালে হাঁসফাঁস করে কিঞ্চিৎ ব্যবধান করে ওষ্ঠদ্বয়। পৃথক অংশ ছেড়ে লাল রস যেন প্লাবিত হয়ে নিচে গড়িয়ে পড়ছে। অতঃপর চিৎকার করে উঠে অপূর্ব, “ঝাললললল।”

জিভ দিয়ে ঠেলে বাইরে ফেলে দিয়েছে পানের চর্বণ করা অংশ। সামান্য আগে খেজুরের রস পান করেছে, এখন যুক্ত হয়েছে পান। হঠাৎ করে অপূর্ব-র মনে হলো, পৃথিবী সূর্যকে ছেড়ে অপূর্বকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। ভ্রু স্ফুরিত করে বলে, “কী পান খাওয়াইলি মোরে? একদম নেশা ধরাইলি।”

অপূর্ব নিজেকে সামলে রাখতে ব্যর্থ হয়ে বমি করে দিল। আরু বরাবর নিচে থাকার দরুন সরাসরি আরুর দেহে পতিত হলো। আরু নাক চেপে বাজখাঁই গলায় বলে, “দিলেন তো, আমার থ্রি-পিছ নষ্ট করে। গাও ছুইয়া যায় সেই মার্কেট থেকে বাবাই আমাকে এই জামাটা এনে দিয়েছে।”

“দেবো টেনে এক চড়, তুই তো অপুকে পান সেদেছিলি। বেশ করেছে। যেই শাড়িটা এনেছিলি, ওটাই পালটে নে।” মায়ের ধমকে আরু তুবড়ে গেছে। মামির শাড়িটা নিয়ে দিঘির দিকে অগ্রসর হলো। কিয়ৎক্ষণ পর দিঘির পানিতে শব্দ হলো। আরু এই ঠান্ডাতে আবার দিঘিতে নেমেছে?

দশ মিনিটের মাথায় ফিরে এলো আরু। মাথা ঘোরার মাঝে আরুকে বেসামাল অবস্থায় দেখে অপূর্ব এবার কিছু দেখতে পারল না। সেদিনের সেই শাড়ি, সেই ভেজা কেশ। টপটপ করে ঝরছে পানি। শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে। চুপসে যাওয়া মুখটা বড্ড আকর্ষণ করছে তাকে। নিত্যদিনের খোঁপা করা ঘন কেশ খোলা। হাঁটু ছাড়িয়েছে।

আরুর ঘরে প্রবেশের পরবর্তী মুহুর্তে সিঁথি প্রবেশ করে। উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, “মিহির ভাই এসেছে আরু।”

তুবড়ে যাওয়া মুখমণ্ডল পরবর্তী মুহুর্তে প্রাণবন্ত হয়ে উঠল। কুঞ্চিত বিশিষ্ট ঠোঁট প্রশস্ত হয়ে উঠে। বলে, “সত্যি? কোথায় মিহির ভাই?”

বাক্য থামতেই মিহির প্রবেশ করল। একগাল হেসে বলে, “এখানে।”

আরু পা গতিরোধ করতে পারল না, ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল মিহিরকে। মিহিরের হাত তখন অপ্রত্যাশিত অংশে। আরুর একমাত্র ফুফুর ছেলে মিহির। বয়সটা চব্বিশ অতিক্রম করে সবে পঁচিশে পা রেখেছে। মিহির বলে, “বাড়িতে তোকে খুঁজে না পেয়ে সোজা এখানে চলে এসেছি। কেমন আছিস তুই?”

“একদম ভালো না। চকলেট এনেছ?”

মিহির একটা রেপিং করা প্যাকেট দিয়ে বলে, “ভুলে যাওয়া যায় বুঝি?” অতঃপর ডান গালে হাত রেখে ইশারায় বোঝাল কিছু। মাথা নাড়িয়ে আরু বলে, “না, আমি এখন বড় হয়ে গেছি।”

মিহিরের অভিমানী চোখে আরু দীর্ঘক্ষণ আত্মবিশ্বাসী হয়ে থাকতে‌ পারল না। পায়ের আঙুলে ভয় দিয়ে কিঞ্চিৎ উঁচু হয়ে মিহিরের ডান গালে নিঃশব্দে দুবার ওষ্ঠ স্পর্শ করে।‌ মিহির হেসে বলে, “কাঁধে উঠ, বাড়িতে নিয়ে যাই। (পারুলকে লক্ষ্য করে বলে) মামি আরুকে নিয়ে গেলাম। তোমরা গেলে তারাতাড়ি এসো। নতুবা আমি চললাম।”

কাঁধে উঠল না আরু, কোমরে উঠে কাঁধ ধরে রাখল। সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলল তারা। ঝাঁপসা নয়নে ক্রুব্ধ সংযত করে সবটা দেখে গেল অপূর্ব। অনুভব করল, তার প্রিয় কিছুতে ভাগ বসাচ্ছে অন্য কেউ। কিয়ৎক্ষণ পূর্বে বাছাই করা রাখা ফটোখানা এক লহমায় খণ্ড বিখণ্ড করে ফেলে অপূর্ব। এর শাস্তি অতিদ্রুত পাবে তুমি।
__
দুহাতে বইগুলো আঁকড়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার জন্য পা চালাচ্ছে আরু। পেছন থেকে দ্রুত গতিতে সাইকেল এসে আরুর সমুখে স্থির হয়ে গেছে। পকেট থেকে একটা সাদা চিঠি বের করে অগোচরে আরুর দিকে এগিয়ে দিল। তরুণকে দেখে লাজুক হেসে চিঠি গ্ৰহণ করল আরু। বইয়ের ভাঁজে যতন করে রেখে বলে, “আমি তো ভেবেছি, আপনি আসবেন না প্রয়াস ভাই।”

“না এসে উপায় আছে? আসতে হলো তোমার জন্য। আমার জন্য ফুফি শাশুড়ির অনেক মা/র খেয়েছ শুনলাম। নাও তোমার জন্য ঝুড়িভাজা আর কিছু জরিবুটি নিয়ে এসেছি। খেয়ে নিও। আর ধন্যবাদ।” একটা প্যাকেট বিশেষ করে আরুর জন্য এনেছে। গ্ৰহণ করতে না চাইলেও আরু গ্ৰহণ করে। পরক্ষণে সাইকেলের গতি বাড়িয়ে আরু-কে অতিক্রম করে চলে গেল প্রয়াস।

সময় চারটা বেজে দশ মিনিট। গতকাল আরু বাড়িতে ফেরে নি। মামা বাড়িতে রাত্রিযাপন করেছে। স্কুল ফ্রোকটা রেখে যাওয়ার দরুন বিশৃঙ্খলার সম্মুখীন হতে হয়নি তাকে। আজ অপূর্ব-র জন্য মেয়ে দেখতে যাবে, তাই তুর শেফালী স্কুলে আসেনি।
তালগাছ তলায় কালাচাঁন সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। যাতায়াতের সময় প্রায় আরুকে উত্যক্ত করে। আরুকে দেখে এগিয়ে এলো কয়েকপা। শ্রীহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে খপ করে আরুর হাত ধরে। গর্হিত কণ্ঠে বলে, “আরু আমি তোমার জন্য পাক্কা একঘণ্টা দশ মিনিট দাঁড়িয়ে আছি। এত দেরিতে কেন এলে? ঐ ছেলেটার কাছে থেকে চিঠি নিলে কেন?”

নিজের হাতের দিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে চেয়ে রইল আরু। এই অজপাড়া গাঁয়ে মেয়েরা শৌখিন না-হোক ফেলনা নয়।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-০৫

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০৫

অপূর্ব উঠানে এসে দাড়িয়ে যায়। জাহানারা, মনি ও মল্লিকা বাড়ির উঠানে প্রখর রোদে মেলে দেওয়া ধানে বিচরণ করছে। অনিতাই শুধু রান্নার দিকটা দেখছেন। চেয়ারম্যান বাড়ির বলে কথা, উঠান আর ধান দুটোই পর্যাপ্ত রয়েছে। ছেলেমেয়ে মৃধা বাড়ি থেকে ফিরে গৃহে প্রবেশ করেছে অপূর্ব ব্যতিত। চাচিদের উঠানে দেখে সেও অগ্ৰসর গেল সেদিক। জুতা খুলে শূন্য পায়ে ধানের ভেতরে হাঁটতে লাগল। বিদেশে বসবাসরত অবস্থা ধান বইয়ের পাতায় বা ভিডিয়ো-তেই অবরুদ্ধ ছিল, এই প্রথম স্পর্শের মাধ্যমে অনুভূত হয়েছে। আহ্লাদিত হয়ে সমস্ত ধানে বিচরণ করল। জাহানারা উৎকণ্ঠার সাথে বললেন, “অপু তোকে ধান মেলতে হবে না। তুই ঘরে গিয়ে বস। ধানের আলে তোর পা চুলকাবে বাবা।”

“কিচ্ছু হবে না চাচি। তোমরা ঘরে যাও, আমি একাই সব ধান মেলবো।” উলটা তালে বলে অপূর্ব।

মল্লিকা অনেকবার প্রচেষ্টা করেও অপূর্ব-কে তার সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারল না। দিগ্‌ভ্রান্ত হয়ে অনিতাকে জানাতে গেলেন মল্লিকা। রান্না অসমাপ্ত রেখেই ছুটে‌ এলেন অনিতা। ধানের মধ্য থেকে অপূর্ব-কে টেনে এনে রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন, “চাচিরা বারণ করছে না, ধানের ভেতরে না যেতে? তাদের কথা কেন শুনছিস না তুই? সিদ্ধ ধানের আল এখনো আলগা। পা চুলকাবে।”

“চুলকাবে না।” অপূর্ব অনুরাগশূন্য হয়ে বলে। “চুলকাবে না।” কথাটা যতটা জোরের দৃঢ়তার সাথে অপূর্ব বলেছে, কাজের বেলায় ততটা দৃঢ় থাকল না। বিকেলেই পা মৃদু ফুলে উঠল। চুলকানি কমছে না, বৈ বাড়ছে। অপূর্ব-র চিৎকারে আহসান বাড়ি মাথায় তুলে ফেলেছে। মোতাহার আহসান নিরুপায় হয়ে ডাক্তার, বৈদ্য, কবিরাজ ডাক পাঠালেন। বৈদ্য জরিবুটি দিয়ে গেছে, অপূর্ব তা পায়ে লাগাতে নারাজ। বালতি ভর্তি পানিতে পা ভিজিয়ে বসে আছে সে, অথচ গ্ৰামের এই তীব্র ঠান্ডা থেকে বাঁচতে পরিধান করেছে উষ্ণ করার পোশাক।

অন্যদিকে ছাগলের জন্য ঘাস কে/টে স্তূপ করেছে আরু। খোপরে হাঁস মুরগি, গোয়ালে ছাগল রেখেছে। গাছ থেকে টাটকা খেজুরের রস নামিয়ে মায়ের জোরাজুরিতে আহসান বাড়িতে এসেছে আরু ও অয়ন। ভাইবোনেরা টিভিতে ‘হাতিম’ দেখছে। আজ শুক্রবার বলেই হাতিম চলছে বিটিভিতে। সপ্তাহে মাত্র একদিন। আরু এসে তুরের পাশে বসে হাতিম দেখায় মন দিয়েছে। পারুল অপূর্ব অবস্থা জিজ্ঞেস করলে অনিতা ঠাট্টা করে বললেন সব। আরু অট্টহাসি দিয়ে বলে, “এই সামান্য কারণে এই অবস্থা। মায়ের মা/রে/র ভয়ে আমি কত শিম ক্ষেতে লুকিয়ে ছিলাম। রাতে মা খুঁজে যখন বলত, ‘আয় আরু মা/র/ব না।’ তখনই বের হতাম। উষ্ণ পানিতে গোসল করে সরিষার তেল দিতেই সব জ্বালা খতম।”

“ফুফি তোকে যা মা/রে তুই শিম ক্ষেতেই তো লুকাবি। তাছাড়া তোর হচ্ছে গন্ডারের চামড়া। শুধু শিম পাতার সাথে শরীর ঘেঁষা কেন, শিম পাতা যদি ঘঁষে ঘঁষে তোর শরীরে লাগাই। তবেও কিছু হবেনা।”

“আপনার মতো বিড়ালের চামড়া তো নয়। সবাই বলে মাঘের শীত বাঘের গায়ে। এখন দেখি তার ছোট ভাই বিড়ালের গায়ে। আমার শরীর যদি আপনার মতো হতো, তাহলে খেজুর গাছ থেকে রস নামাতে পারতাম না। স্কুল থেকে ফিরে মাঠে সারাদিন কাজ করতে পারতাম না। আপনি যাই বলুন, সবাই বলে নারীরা ননীর পুতুল। এখন দেখছি পুরুষেরাও ননীর পুতুল।”

“গাছে ধান না হয়ে, চাল হলে ভালো হতো। তাহলে অন্তত আমার এই অবস্থা হতো না।” অপূর্ব-র কণ্ঠে স্পষ্ট অভিযোগ ছিল।

“ঘোড়া এনে নিজেকে তো বহুত রাজকুমার পৃথ্বীরাজ মনে করেন। কোনো এক রাজার কারণেই চাল থেকে ধান হয়েছে।” আরুর ফিরতি তিসস্কারে অপূর্ব-র আসর জমে উঠল। উদ্দীপিত হয়ে বলে, “কীভাবে?”

“আমার দাদিজান বলেছে, এক রাজা অন্য রাজ্যে থেকে পেট পুড়ে ভোজন খেয়ে বাড়ি ফেরার পথে ধান গাছ দেখেন। ঘোড়া থেকে নেমে ধান গাছ থেকে কয়েকটা ধান ছিঁড়ে মুখে দেয়। সেই দুঃখে ধান আল্লাহর কাছে আবেদন করে, তার উপরে সাত প্রলেপ দেওয়া হোক। যাতে কেউ অপ্রয়োজনে খেতে না পারে। অবশ্য আমি ধানের তুস/চিড়ে খুলে কত খাই। হি! হি! হি!” বলে মনমাতানো হাসি উপহার দেয় আরু

ভেংচি দিয়ে বলেই আরু রান্নাঘরের দিকে অগ্রসর হলো। ভরা কলসির পানি পাতিলে নিয়ে আগুন ধরালো উনুনে। পানি ফুটন্ত গরমে টগবগ করে উঠতেই পাতা দেওয়ার সমাপ্তি ঘটালো আরু। অতঃপর লুচমি দিয়ে উত্তপ্ত পাতিল নিয়ে অপূর্ব ভিজিয়ে রাখা ঠান্ডা পানির বালতি ঢেলে দিল। অপূর্ব চমকিত হয়ে পা সরানো প্রয়াস করতেই
দ্বিধান্বিত হয়ে উঠল আরু। পাতিল ফেলে অপূর্ব-র পা-জোড়া উষ্ণ পানিতে চেপে ধরে রাখল। অধৈর্য হয়ে অপূর্ব চড়া গলায় বলে, “আরু পা ছাড় বলছি। দ্রুত পা ছাড়।”

“আপনার কী মনে হয় অপূর্ব ভাই, আমি পা ছাড়ব? আপনি পুরুষ মানুষ, আপনার শরীরে নিশ্চয়ই আমার থেকে বেশি শক্তি। পারলে আরুর থেকে ছাড়িয়ে নিন।” বলতে বলতে আরু লুফা দিয়ে অপূর্ব পা ঘষে ঘষে পরিষ্কার করতে পারল। অপূর্ব হাজার চেয়েও আরুর হাত থেকে নিজের ব্যথায় আক্রান্ত পা সরাতে পারল না। দাঁত খিঁচে আরুর নি/র্যা/ত/ন সহ্য করছে। উপস্থিত সবাই মিটমিট করে হেসে চলেছে। অনিতা জরিবুটি নিয়ে এসে বলে, “আরু এটাও একটু দিয়ে দে।”

অপূর্ব-র প্রথমে ভালো না লাগলেও পরে লাগে। ঠান্ডা হ্রাস পাচ্ছে যে। হাতের কাজ শেষ করে খেজুরের রস গ্লাসে ঢেলে নিয়ে এলো আরু। অপূর্ব-র দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, “এটা খেলে ঠান্ডা কমে যাবে। খেয়ে নিন।”

“বাঁশ-বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই,
মাগো আমার শোলক্-বলা তিস্তা দিদি কই?”

পূর্ণিমার থালার মতো চাঁদের আড়াল থেকে বাঁচতে তিস্তা ও সুজন বাঁশঝাড়ের সাহায্য নিয়েছে। বাঁশের সাথে হেলান দিয়ে বুকে হাত গুজে মাটির দিকে চেয়ে আছে তিস্তা। সুজন অনবরত তিস্তার অভিমান ভাঙানোর চেষ্টা করছে। কানে হাত দিয়ে বলে, “তিস্তা আপনি কিন্তু অহেতুক রাগ করে আছেন। আপনি ভালোভাবেই জানেন, আমার বাবা নেই। আমি ছাড়া মায়ের কেউ নেই। আমাকে যেতেই হতো।”

তিস্তার নয়ন অশ্রুতে পরিপূর্ণ হলো। কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, “আপনি সবসময় এমন করেন। আমি কি একবারও বলেছি, আপনার মায়ের কাছে যাবেন না‌? আপনি কেন‌ আমাকে বলে গেলেন না। জানেন, আপনার জন্য কত অপেক্ষা করেছি। সারাদিন পর রাতে জানি, আপনি বাড়িতে গেছেন।”

“এটা নতুন কী, প্রতি বৃহস্পতিবার আমি বাড়িতে যাই শুক্রবার সন্ধ্যায় ফিরে আসি। গতকাল যাওয়ার সময় আপনাকে দেখিনি, তাই বলে যেতে পারিনি। স্যরি।” বলেই তিস্তায় হাত ধরল সুজন। অভিমানে হাত ছাড়িয়ে নিল তিস্তা। সুজন স্থির থাকল না, এলোমেলো চুলগুলো কানের পেছনে গুজে দিয়ে ফিসফিস করে বলে, “আমার ব্যক্তিগত নদী তিস্তা। তুমি সেই তিস্তা নদী, এই সুজন মাঝি যেখানে রোজ-রোজ নৌকা ভাসায়।”

তিস্তা মৃদু হাসল। হাতের ভাঁজে লুকিয়ে রাখা চিঠিটা অতি সাবধানে সুজনের হাতে গুঁজে দিয়ে ছুটল।
আরু বালতির পানি ফেলে দিতে এসেছে। ভরা বালতি সমেত দাঁড়িয়ে লজিং মাস্টার সুজন ও তিস্তার কথা শুনেছে। তিস্তা কাছাকাছি আসতেই পানিগুলো ফেলে দিল। খানিক চমকিত হয়ে তিস্তা তাকিয়ে বলে, “ওদিকে ফেলতে পারলি না, একটু‌ হলেই তো ভিজে যেতাম।”

“তুমি তো বাঁশ বাগানে ছিলে। এমনভাবে দৌড়ে চলে আসলে ভাবলাম, সাম্পান ওয়ালা তোমাকে লড়ানি দিয়েছে।” আরু দুষ্টুমি করে বলে। ব্রীড়ানত হয়ে তিস্তা বলে, “আরু তুই কিন্তু কাউকে কিছু বলবি না।”

“তা বলব না, কিন্তু এত সহজে তোমার মেনে নেওয়া উচিত হয়নি। ছেলেদের একটু নাকে দড়ি দিয়ে ঘুড়াতে হয়, জানো না বুঝি? নাহলে আবার সুযোগ পেয়ে মাথায় উঠে বাঁদরের মতো নাচবে।” ভাব নিয়ে বলে আরু। তিস্তা গাল টেনে চলে যেতে যেতে বলে, “পাকা বুড়ি একটা।”

তিস্তাকে একটু খেপাতে আরু বলে,
“ওরে সাম্পান ওয়ালা তুই আমারে করলি দিওয়ানা।
তুই আমারে, তুই আমারে
করলি দিওয়ানা-রে, সাম্পানওয়ালা।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]