Monday, June 23, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 227



নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-০২

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০২

“অপূর্ব ভাই, আপনি জামা কাপড় খুলে ফেললেন কেন? আমি কিন্তু চিৎকার করব বলে দিলাম।” কল চাপা রেখে স্তম্ভিত হয়ে বলে উঠে আরু। অপূর্ব সবে সাদা শার্ট খুলে রেখেছে বালতিতে। আরুর করে উঠা চিৎকার শ্রবণ হওয়া মাত্র ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকাল। আঙুল তুলে কৌতুহলী কণ্ঠে বলে, “শার্ট খুলব জাস্ট, লুঙ্গি নয়। চ্যাঁচামেচি বন্ধ কর। নাহলে সেই কাজটাও করে ফেলব। লজ্জায় কিন্তু তুই পড়বি।”

আরু নতজানু হয়ে তার হাতের সাহায্যে একের পর এক কলের হাতল ধরে চেপে পানি উত্তোলন করার প্রচেষ্টা করছে। ক্ষণে ক্ষণে অপূর্ব-র জিম করা শরীরের দিকে তাকাচ্ছে। গ্ৰামের পুরুষের শরীরে এমন ভাঁজ কখনো দেখেনি। ভর্তি হওয়া বালতি থেকে মগ দিয়ে অনবরত পানি ঢালতে থাকে অপূর্ব। প্রবল যাতনায় ক্ষান্ত হয়ে ব্যথাহত কণ্ঠে আরু বলে উঠে, “এত কষ্ট করে পানি না তুলে দিঘিতে একটা ডুব দিলেই তো হয়।”

“দিঘির পানিতে কী কী কাজ করে – তোর ধারণা আছে? এই গোবর দিঘির জল দূষিত করবে।” ‘Sevlon’ নামের সাবানটা ঘষতে ঘষতে বলেন অপূর্ব।

“তাতে কী হয়েছে। গোবরে পানি পরিষ্কার হয়, আপনি জানেন না? আপনি তো বিদেশি মানুষ। জানাবেন কীভাবে?”

“যদি গোবরে পানি পরিষ্কার হতো, তবে আমাদের গরুগুলো কেন রাখাল চাচা নদীতে গোসল করতে নিয়ে যায়?” আরু পরীক্ষায় যথেষ্ট ভালো ফলাফল করলেও অপূর্ব-র এই প্রশ্নের উত্তর তার অজ্ঞাত। প্রত্যুত্তরের আশায় দীর্ঘক্ষণ চেয়ে থেকে অপূর্ব পূর্বের ভঙ্গিতে বলে উঠে, “টিউবল থেকে পানি তুলে গোসল করবি, ভুলেও দিঘিতে ঝাঁপ দিবি না।”

অপূর্ব ভেজা পোশাক পালটে চলে গেল ঘরে। আরু ভেজা পোশাক কাচতে ব্যস্ত হলো। তুর অনিতার শাড়িটা দিয়ে গেলেই ভেজা পোশাক ছাড়বে আরু। সে যে আর পাঁচটা মেয়েদের মতো থ্রি-পিছ পরে থাকতে‌ পারে না। শাড়িই তার ভূষণ।

__
“আরুকে তো দেখলি, কেমন লাগল তোর?” ছেলে দেশে ফেরা উপলক্ষ্যে গতকাল থেকে অনিতার ‘আনন্দ’ যেন বিদায় হতে অনিচ্ছুক। প্রতি বেলাতে বিভিন্ন ধরনের খাবারে সজ্জিত করেন টেবিল। দিঘি থেকে তোলা সলা চিংড়ি মাছের ভুনা অপূর্ব-র পাতে দিতে দিতে উপর্যুক্ত প্রশ্নটি করেন অনিতা।

‘প্রতি বেলায় মধ্যবয়স্ক থেকে উর্ধবয়স্ক পুরুষেরা প্রথমে খাবার খাওয়ার পর বাড়ির ছেলেমেয়েরা এবং তার পরে গৃহবধূরা খাবার খাবেন’ – এটাই সাত ভাই চম্পা নিবাসের অতীতের নিয়ম। জাহানারা তার ছেলে তিয়াসের পাতে ভাত দিতে দিতে অপূর্বকে উদ্দেশ্য করে বলে, “তিস্তার বিয়ে খেতে এসে এবার নিজের বিয়েটা সেড়ে ফেল অপু। বয়স তো কম হলো না।”

“হ্যাঁ, এবার ভালো একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করে নিবো। দেশে ফেরার কথা জানাজানি হওয়ার পর ঢাকা থেকে অফার এসেছে। জীবনের অর্ধেকের বেশি বয়স পরিবার ছেড়ে থেকেছি। বাকিটা তোমাদের সাথে পার করব। সুন্দরনগর শহরে একটা হাসপাতালে চাকরি নিয়েছি। বলার সাথে সাথে তারা রাজি হয়েছে।”

“আরু-কে.. অনিতা সম্পূর্ণ বাক্য শেষ করার পূর্বে অপূর্ব তাকে দমিয়ে দিয়ে একরোখা কণ্ঠে বলে, “স্যরি মা। আরুর মতো একটা‌ বাচ্চা মেয়েকে আমার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব নয়।”

“ও বাচ্চা নয়।” আরুর নানি চম্পা বলেন।

“কিন্তু আমার বয়সের কাছে সে নিতান্তই বাচ্চা। আরু যথেষ্ট সুন্দর আমি মানি, অন্য কোনো মেয়ে যদি হয়। তবেই.. অপূর্ব থেমে গেল। ব্রাউজ বিহীন শাড়ি পরে তারই আঁচল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ঘরে এসেছে আরু। খোঁপা বাঁধা চুলগুলো থেকে অবিরাম পানি গড়াচ্ছে আরুর নগ্ন গলা ও পিঠে। অপূর্ব পলকরহিত চেয়ে রইল সেদিক। অপরাহ্ণের সময় প্রখরতা হীন সূর্যের ফিকে রোদ আরুর দেহে সোনালী আভা সৃষ্টি করেছে। তার ধ্যান ভাঙল চম্পার কথায়, “নানুভাই এতক্ষণে এসেছ, বেলা গড়িয়ে গেছে। খাবে এসো।”

“না নানুভাই, আমার মিঠু আর ময়নাকে খেতে দিতে হবে। আমি যাই।” আরু হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলে আরু।

অনিতা শুনলেন না। আরুর হাত ধরে বসালেন টেবিলে। থালাতে খাবার পরিবেশন করার পাশাপাশি সংগোপনে ফেললেন দীর্ঘ নিঃশ্বাস। ষোলটা বছর ধরে তিলে তিলে ‘আরু’ নামক মেয়েটাকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি, আচমকা সেই স্বপ্নটা তাসের ঘরের মতো ভেঙে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেছে।

“মামুনি, ও মামুনি। তুমি আজ এমন করে আছো কেন?”

“কোথায় কেমন? ছেলে এসেছে তো, তাই তোর প্রতি অযত্ন করে ফেলছি মা।
তুই না বললি অপূর্ব-র জন্য পিঠা এনেছিস। সেগুলো কোথায়?” অনিতার এমন কথাতে আরু ভাষা খুঁজে পেল না। তবুও কাঁচুমাচু মুখে করে বলে, “তোমাদের রাজহাঁসের লড়ানিতে সব গোবরের ভেতরে ফেলে দিয়েছি। মা জানতে পারলে আমার খুব মা/র/বে।”

“আমরা না বললে জানবে কীভাবে হ্যাঁ? আমি ফোন করে বলল, ‘পিঠাতে চিনি হয়নি। আরেকবার করে দাও ননদিনী।’ অপুর পিঠা খাওয়াও হবে। তোর দোষও হবে না।” জাহানারা বললেন। দীর্ঘক্ষণ জমিয়ে রাখা ভয়ের ছাপ উধাও হয়ে যায় এক নিমিষে। আরু হেসে উঠে। অপূর্ব ভ্রু কুঁচকে বলে, “ফুফুকে আমি মিথ্যা বলতে পারব না। আমি সোজাসুজি বলব, ফুফি তুমি আরুকে জোর করে পাঠিয়েছ বলে সে পিঠাপুলি গোবরে ফেলে দিয়েছে।”

“মামুনি।” মিহি কণ্ঠে বলে অনিতার কোমর জড়িয়ে ধরে আরু। আরুর মাথায় হাত বুলিয়ে অভয় দিয়ে বলেন, “অপু মেয়েটাকে আর বিরক্ত করিস না। আর শোন, তোরা খেয়ে সবকিছু গুছিয়ে রাখিস। আমি উঠলাম। ভালো লাগছে না।” অতি সাবধানে পরিস্থিতি সামলে শোবার ঘরে চলে যায় অনিতা।

বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে অপূর্ব। কখনোবা বাতির সুইচ ‘অফ অন’ করছে। তার নেত্রপল্লবে ঘুমেরা স্থগিত রেখেছে। পল্লব বন্ধ করলেই ভেসে উঠে আরুর সেই পিঠ ও গলার ছবি। ছটফট করতে করতে উঠে বসে অপূর্ব। অস্বাভাবিক কিছু নয় এটা, বরং স্বাভাবিক। মায়ের কথাতে বিগত বছরগুলোতে সে আরুকে ঘরনি করার স্বপ্নে মেতে ছিল। প্রথমবার তাকে দেখে এমন অনুভূতি অস্বাভাবিক কিছু নয়।

অপূর্ব বিছানা ছেড়ে উঠে ট্রাভেলিং ব্যাগটা নিয়ে তুর-শেফালীর ঘরের যায়। দরজায় সামনে যেয়ে আরেকদফা ‌থমকে যায়। চৌকিতে মাঝবরাবর উবুড় হয়ে শুয়ে আছে আরু। নগ্ন পিঠের তিনটা তিল প্রবেশে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। নিচের ঠোঁট ভেতরে ঢুকে আছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায় অপূর্ব-র। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ধীরকদমে এগিয়ে গেল অপূর্ব। ঠান্ডা হাত নিজের অজান্তেই স্পর্শ করল আরুর পিঠ। ঘুমন্ত আরু কেঁপে উঠল। তৎক্ষণাৎ প্রবেশ ঘটল তুরের। খোঁপা খুলে ছড়িয়ে যাওয়া চুল দিয়ে পিঠ ও পরিস্থিতি একসাথে সামলে নিল অপূর্ব।

“ভাইয়া, আপনি এখানে।”‌ তুর বলে।

“হ্যাঁ, ঐ আরকি। তোদের গিফটগুলো দেওয়া হয়নি। ওগুলো দিতে এসেছি। আরুও আছে। দ্রুত যা সবাইকে ডেকে নিয়ে‌ আয়।”

তুরের আগেই শেফালী ছুটে গেল ডাকতে। অপূর্ব গলা খাঁকারি দিয়ে বলে, “ওকে তোল।”

তুর ডেকে ঘুম থেকে তুলল আরুকে। আরু চোখ পরিষ্কার করতে করতে উঠে বসে। আরুর ঘন চুল বিছানায় পড়েছে। ঠাওর করা গেল না এই কোঁকড়ানো চুলগুলের দীর্ঘতা। মিনিট দুয়ের মধ্যে মহিলারা উপস্থিত হলো কক্ষে। অপূর্ব চেইন খুলে গিফট দেওয়া শুরু করেছে। সবাইকে দেওয়া শেষ করে আরুর কাছে আসতেই নিশ্চুপ হয়ে গেল সে। ঘরনির জন্য সে নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছিল। সেই নীলপদ্ম আরুকে দিতে অনিচ্ছুক তাই নিজের আরেক অতিপ্রিয় বালু ঘড়িটা আরুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, “এটা তোর জন্য এনেছি।”

ডাগর ডাগর চোখে বালু ঘড়িটাকে পর্যবেক্ষণ করে আড়ষ্ট কণ্ঠে বলে, “অপূর্ব ভাই, বিদেশে এতকিছু থাকতে শুধু এই বালু ঘড়িটা কেন এনেছেন। আমার হাতঘড়ি আছে, এটা লাগবে না।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব-০১

0

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ০১

“অপূর্ব ভাই দেশে ফিরেছে, তাতে আমার কী মা? তোমার ভাই-পো, তুমি শীতের পিঠা নিয়ে যাও। গতবার রাজহাঁসের লড়ানি খেয়ে হাঁটু ছিলে এসেছি। আমি আর হাঁটু ছিলতে ঐ বাড়িতে যাবো না, ব্যাস।”

ছাগল ছানা মিঠুকে আঁকড়ে ধরে নিজ সিদ্ধান্তে অনড় থেকে বলে আরু। মেয়ের কথাতে অপ্রসন্ন হলেন পারুল। ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে পারুল ধমকে বললেন, “অ/ভ/দ্র মেয়ে, মায়ের কথা শুনছে না।”

“আমি অ/ভদ্র, তাই না? তাহলে আরও অ/ভদ্র হবো, যাবো না।” ক্রোধের গোঙানির শব্দ তুলে আরু অগ্ৰসর হলো দিঘির দিকে। ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে উড়ে এসে আরুর কাঁধ দখল করে নিল ময়না পাখি। অতঃপর পারুলের সাথে তাল মিলিয়ে দুবার বলে, “অ/ভদ্র মেয়ে, অ/ভদ্র মেয়ে।”

তৃতীয় বার বলার পূর্বেই ধমকে আরু বলে, “চুপ, একদম চুপ। আর একবার যদি বলিস, দুইদিন খেতে দিবো না।” আরুর ধমকানিতে ‘অভ/দ্র মেয়ে’ দুই শব্দের বাক্যটি ভুলে গেল ময়না। আরুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে পারুল বলে,

“অপূর্ব আমার হাতের পাটিসাপটা পিঠা খেতে পছন্দ করে, আরুসোনা। গতকাল ছেলেটা দেশে ফিরেছে। ধান সিদ্ধ দিয়েছি, এখন যেতেও পারব না। তাই পিঠা করে দিয়েছি। তুই একটু কষ্ট করে যা-না, মা।”

মায়ের মিষ্টি কথাতে নিজ সিদ্ধান্তে দীর্ঘক্ষণ অনড় থাকতে পারে না আরু। তৎক্ষণাৎ পিঠার বাটিটা কেড়ে নিয়ে ইতস্তত করে আরু বলে, “গোসল করে খেয়ে যাই।”

“ওখানে গেলে তোকে না-খাইয়ে রাখবে না আমার ভাবী। যাওয়ার পথে নদীতে গোসল করে যাস। ভাবীর শাড়ি পরবি। আবার ফেরার সময় নিজের জামাকাপড় পরে আসবি।”

“ময়নাকে নিয়ে যাই?”

“অপূর্ব ঘোড়া নিয়ে এসেছে। বিদেশি ঘোড়া। ঘোড়া দেখে তোর ময়না ভয় পাবে। ওকে রেখে যা।” বলেই হাত মেলে ময়নাকে কাছে আসার জন্য ইঙ্গিত করল পারুল। অবিলম্বে পারুলের হাত গিয়ে দখল করল ময়না। ঘোড়া! বিদেশি ঘোড়া। গ্ৰামের এই অজপাড়া গাঁয়ে কখনো ঘোড়া আসেনি, যার দরুন দেখাও হয়নি আরুর। আনমনে ভেবে আরু শুধাল, “মা, প্লেনে করে ঘোড়া আনা যায়?”

“জানি না, অপুকে জিজ্ঞেস করিস। আমার অপুকে তো জীবনেও দেখিস নি। দেখবি একদম রাজপুত্র। তাড়াতাড়ি যা।” বলেই পারুল ঘরে চলে গেলেন। মামা বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছে না থাকলেও ঘোড়া দেখার ইচ্ছে আরুর। সেই আকাঙ্ক্ষাকে পূরণ করতে অগ্রসর হলো ‘সাত ভাই চম্পা’ নিবাসের উদ্দেশ্য।

আরশি মৃধা আরু। পড়াশোনায় বড্ড পাকা আমাদের প্রিয় আরু। আরুদের বাড়ি থেকে মামার বাড়ির দূরত্ব একটা খাল। সচরাচর মামা বাড়িতে দেখা যায় না তাকে। অপূর্ব ভাই! অবশ্য তাকে কখনো আরু দেখেনি। বড়ো মামা মোতাহার আহসান বিদেশে পড়াশোনার জন্য গিয়েছিল, তখন তার সাথে পরিচয় হয়েছিল অনিতার। সেখানে বিয়ের এক যুগ সমাপ্ত করে দেশে ফিরেছেন। এলেন না, তার একমাত্র ছেলে অপূর্ব। তিনি নানাদের কাছেই বড়ো হলেন‌। আরুর বাবা ইমদাদুল হোসেন মৃধা ব্যবসার কাজে প্রায়ই বিদেশে যান, তখন মনের মতো পিঠা তৈরি করে দেন পারুল।

আহসান বাড়িতে রাজহাঁস পোষণ। আহসান বাড়ির পূর্ব প্রজন্ম এই রাজহাঁস পুষতেন। বংশের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে এখন রাজহাঁস পোষেণ তাঁরাও। এখন তাদের দশটা বাচ্চা। গতবার রাজহাঁসের দৌড়ানি খেয়ে ‘গাউছিয়া মার্কেট’ থেকে বাবার কিনে দেওয়া থ্রী পিসের সালোয়ারটা ছিঁ/ড়ে গেছে। এজন্য ডাল গুটুনি-টা ভেঙেছেন আরুর পিঠে।

খালের ভাটার টান পড়েছে। খাল সাঁতরে পিঠা নিয়ে উপস্থিত হলো আহসান বাড়ির দোরগোড়ায়। ভেজা থাকায় দিঘির দক্ষিণের প্রবেশদ্বার দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করল আরু। ঢাকনা খুলে একবার পরখ করে নিল পিঠাগুলো। ঢাকনা যুক্ত বিধায় বাটি ভিজলেও পিঠাগুলো ভিজল না। পুনরায় ঢাকনা বন্ধ করতে ভুলে গেল।
‘এক দুই তিন চার এমনি করে, বছরগুলো পেরিয়ে’ গান ধরতে ধরতে ভেজা আরু পৌঁছে গেল মামার বাড়িতে। দিঘির পাড়ে ঘাসের উপর চেয়ারে লুঙ্গি পরিহিতা এক পুরুষ রোদ পোহাচ্ছে। তাঁকে দেখামাত্র আরুর হৃৎপিণ্ডের গতি বৃদ্ধি পেল। সিল্ক চুলগুলো রোদ্দুরে লালচে দেখাচ্ছে। বিদেশি বলে? চাপ দাড়ির মাঝে টোল পড়া গালের হাসিটা তীরের মতো বিঁধল বুকে। প্রথমবার দেখা সেই পুরুষটি আরুর হৃদয়ে জায়গা করে নিল। ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে গিয়েও যথাসম্ভব সামলে নিল নিজেকে। আচমকা শ্রবণ হলো রাজহাঁসের ‘কড়কড়’ কণ্ঠস্বর। রাজহাঁসের বাচ্চার উপর পা দিয়েছে সে। অতিদ্রুত সরে এলো। বাচ্চারা মায়ের কাছে ছুটে গেল। ‘কড়-কড়’ করে আরুর নামে বিচার দিল। অতঃপর মা রাজহাঁসটা ছুটে এলো দ্রুত গতিতে। দু-হাতে বাটিটা আঁকড়ে ধরে দিল দৌড়।

‘ঝুনঝুন! ঝুনঝুন! ঝুনঝুন!’ নূপুরের ঝুনঝুন করা শব্দে অপূর্ব ফিরে তাকায় পেছনে। আকাশী রঙের ভেজা ফ্রক পরা একটি মেয়ে রাজহাঁসের থেকে বাঁচতে ছুটে চলেছে। ফর্সা পায়ে বেশ লাগছে নূপুরটি। ইউকে বসবাসরত অবস্থা নূপুর পরিহিত কোনো নারীকে দেখেনি অপূর্ব! তবে গ্ৰামে সব মেয়েরা এই নূপুর পরে। হালকা রঙের ভেজা পোশাক আঁটসাঁট হয়ে দেহের ভাঁজ প্রকট করছে। মেয়েটির ফিগার দেখে অপূর্ব-র তাকে কিশোরী মনে হলেও তার পোশাক আশাক নিতান্তই বাচ্চা। হাতেও রুপার বালা, তাতেও ঝুনঝুন করছে, গলাতে রুপার চেন, নাক-কান এমনকি মধ্য-নাকেও রয়েছে রুপার নথ। হাতে বাটি। ভিখারিরা রুপা ব্যবহার করে? অপূর্ব-র অশান্ত মন, আরুকে ভিখারি ভেবে নিল। অপূর্ব-র ভাবনার মাঝে ঈষৎ দূরে জমানো গোবরের স্তূপে গিয়ে পড়ল আরু। হাতে পিঠা পুলি গুলো পড়ল গোবরে। হাত, পা, মুখ ও ভেজা পোশাকে গোবরে যেন পদ্মফুল আরু। আরুর গোবর রূপ দেখে সয়ং রাজহাঁস ভয়ে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে ছুটে গেল। পরক্ষণে ছিঁচকাদুনে আরু কেঁদে উঠল। শরীরে গোবরে গন্ধে গাঁ গুলিয়ে উঠছে তার।

বাটি নিয়ে এগিয়ে গেল। চেয়ারম্যান বাড়ির ছেলে দেশে ফিরেছে বলে, মোতাহার আহসান চাল ডাল বিলিয়েছে। অপূর্ব উচ্চস্বরে বলে, “মা, ভিখারি এসেছে। সকালের মতো এনাকেও দু মুঠো চাল দাও।”

হাত থেকে গোবরে ভর্তি বাটিটা নিচে পড়ল আরুর। ভুবন কাঁপানো চিৎকার দিয়ে বলে, “বড়ো মামি!”
অনিতা চালের বাটি সমেত হাজির হলেন বটে। তবে, বাকিরা সবাই আরুর চিৎকারে উপস্থিত হলো। লাঠিতে ‘ঠুক-ঠুক’ শব্দ করে নানি জান এলো। অনিতা বলেন, “আরু, তুই। (আশেপাশে তাকিয়ে) অপু ভিখারি কোথায়?”

আরু বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালো। ‘নানা বাড়ির সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও সুদর্শন পুরুষটি আমার এই অপূর্ব ভাই।’ অপূর্ব হাই তুলে বলে, “সামনে গোবর ভর্তি বাটি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভিখারিকে দেখতে পারছ না, মা। খাবার আর টাকার অভাবে গোবর বাটিতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।”

নানি জান হেসে ফেললেন। বললেন, “পাগলী মেয়ে। তা তোকে তো স্বপ্নেও আমাদের বাড়িতে পাওয়া যায় না। হঠাৎ এলি যে।”

“আমি নিজের কাছে নিজে প্রতিজ্ঞা করেছি, এই বাড়িতে যতদিন রাজহাঁস থাকবে ততদিন আমি এই বাড়িতে পা রাখব না। কিন্তু তোমার মেয়ে জোর করে এই বাড়িতে পাঠিয়েছে, আমি মন থেকে মোটেও আসিনি।
আর এই ছেলেটা বলছে, আমি না-কি ভিখারি।” ক্রন্দনরত অবস্থায় বলে না-ঝরা চোখের পানি মুছে নিল আরু।

অপূর্ব নাকে হাত দিয়ে দুর্গন্ধ দূর করার প্রচেষ্টা করছে। অনিতা বলে, “ও আরু। তোর ফুফুর একমাত্র মেয়ে।”

“ফুফির সেই ফা/জিল/ মেয়েটি?” নির্বিকার ভঙ্গিতে কথাটা বলে সম্মুখে আসা চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিল অপূর্ব। আরু পরপর দুই একবার ডানে-বামে মাথা নামিয়ে নাকোচ করতে চাইলেও নাকোচ করতে সে পারল না। সতিটা সত্যি রয়ে গেল‌। স্তম্ভিত হয়ে ডাগর ডাগর চোখে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু আরু করে উঠতে পারল না। বিব্রত পরিস্থিতি তুর, শেফালী ও তিস্তা হাজির হলো। তুর আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে, “এই আরু, তবে তুই এলি? অপূর্ব ভাই ঘোড়া এনেছে। দেখলে আয়।”

কয়েক মুহুর্তের জন্য ‘ঘোড়া’ নামক প্রাণীটার নাম আরুর মস্তিষ্ক থেকে কাট হয়ে গিয়েছিল। পুনরায় মস্তিষ্কে যুক্ত হতেই লাফিয়ে উঠল আরু, “চল, দেখে আসি। মা-তো আমাকে ঘোড়ার লোভ দেখিয়ে পিঠা পাঠিয়েছেন।”

আরু দুকদম এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে বাহু টেনে ধরল অপূর্ব। ৪৫° ঘুরিয়ে ঈষৎ নিকটে এনে রুদ্র গলায় বলে, “এই নোংরা অবস্থায় আমার ঘোড়ার কাছে যাবি না।”

প্রথমবার অজানা পুরুষের স্পর্শ পেতে হৃৎপিণ্ডের রক্ত চলাচল থেমে গেল আরুর। অপূর্ব-র বলার সময় নির্গত হওয়া প্রতিটি শ্বাস আরুর কপালে সংঘর্ষ করছে। গ্ৰামের সেই বোকা অথচ চঞ্চল মেয়েটি আজ বাক্যহীন কোনো পুরুষের সংস্পর্শে এসে।
হুট করে কাছে টেনে নেওয়ার সময় আরুর শরীরের সেই গোবরের কিছু অংশ ছিটকে গেল অপূর্ব-র শরীরে। ডানহাত দিয়ে শক্ত করে চেপে রাখা আরুর হাতটা সে ছাড়ল না বরং, বিশ্রী গন্ধ থেকে পুনরায় নাক-কে বাঁচাতে চেপে ধরল নাক। ক্রুব্ধ কণ্ঠে বলে, “দিলি তো আমাকে নোংরা করে। ইচ্ছে করছে গোবরের ভেতরে নিয়ে ঢুবিয়ে রাখি।”

“আপনি টান দিলেন বলেই তো..। তাছাড়া সব দোষ আপনাদের হাঁসের। হাঁস-কে নিয়ে ঢুবিয়ে রাখুন গোবরে।”

“বললেই হলো। নাম তো আরু। আরু আর গরু সমানই। তোকে গরু মনে করে হাঁসে দৌড়ানি দিয়েছে। তোর জন্য আমাকে আবার গোসল করতে হবে। আমার গোসলের সব পানি তুই কল চেপে তুলে দিবি।”

“বললেই হলো? যাবো না।” দৃঢ় গলায় আরু।

“দেখা যাবে।” বলতে বলতে অগ্ৰসর হলো কলতলার দিকে। হাতে টান পড়ার দরুন আরুও এগিয়ে চলেছে সঙ্গে।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

গোধূলি রাঙা দিগন্ত পর্ব-১২ এবং শেষ পর্ব

0

#গোধূলি_রাঙা_দিগন্ত
#পর্বঃ১২ অন্তিম পর্ব
#লেখিকাঃফারিহা_খান_নোরা
প্রকৃতিকে এখন ঋতুর রাজা বসন্ত চলছে। বসন্ত মানেই যে সবার জীবনে রঙ বেরঙের সমাহার এমন‌ কিন্তু না। এমন যদি হতোই তাহলে কি প্রেমার জীবণটা এমন হতে পারতো?

প্রেমা পাতলা একটা শাল গায়ে জড়িয়ে রাতের আঁধারে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।ঠিক এক বছর আগের স্মৃতি মনে মনে স্মরণ করছে। এক বছর আগে যখন প্রেমা জারিফের সাথে আরিবার ভালোবাসার কথা বলেছিলো জারিফ বেশ চ’ম’কে যায়। প্রেমা একটু হেঁসে বলেছিলো সেদিন প্রেমাদের বাড়িতে রুমের ভিতরে সে তাদেরকে দেখে নেয়।প্রেমা জারিফকে তাঁর সাথে নতুন করে শুরু করার কথা জানায়।জানায় জারিফের জন্য প্রেমার হৃদয়ে এক আকাশ সমান ভালোবাসার কথা কিন্তু জারিফ প্রেমাকে ফিরিয়ে দেয়।এতে প্রেমা ভীষণ কষ্ট পায়‌ ক্ষ’ত বি’ক্ষ’ত হৃদয় নিয়ে চলে আসে।তার ঠিক এক মাস পরেই জারিফের বাবা মা জারিফকে নিয়ে প্রেমাদের বাড়িতে উপস্থিত হয় সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দেয়। জারিফ যেহেতু প্রীতমের বন্ধু যার জন্য দুই পরিবারের সম্পর্ক আগে থেকেই ভালো। প্রেমার বাবা মা প্রেমার সিধান্ত জানাতে বললে প্রেমা কম্পনরত কন্ঠে বলে,

‘আমি রাজি।’

প্রীতমের এই বিয়েতে মত নেই কিন্তু প্রেমা যেহেতু রাজী সে আর কি বলবে? জারিফ তার বন্ধু কিন্তু প্রীতম জানে জারিফ অন্য একটা মেয়েকে ভালোবাসে তবে মেয়েটি কে সে জানে না।সেই মেয়েটির জন্য জারিফ সু’ই’সা’ই’ড এ’টে’ম করেছে।সব জেনে শুনে আদরের বোনকে সে কিভাবে জারিবের তুলে দেওয়ার কথা চিন্তা করে? প্রীতম প্রেমাকে বুঝাতে গিয়েছিল তবে প্রেমা কোনো কথা না শুনেই খুশি হয়ে বলে,

‘ছোট ভাইয়া আমি এই বিয়েতে রাজী। আমি জারিফ ভাইয়াকে আগেই থেকেই পছন্দ করতাম।’

প্রেমার কাছে তখন বিষয়টা মেঘ না চাইতে জলের মতো। জারিফ রাজি হয়েছে তার মানে জারিফ নতুন করে সব শুরু করতে ইচ্ছুক তবে প্রেমার ধারণা সব ভুল প্রামাণ করে বাসর রাতে জারিফ নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। আজ জারিফ ও প্রেমার বিয়ের একবছর পূর্ণ হলো কিন্তু জারিফ নেই।প্রেমা জারিফদের বাড়িতেই আছে তার বাড়ির মানুষ গুলো যে কতো বার নিতে এসেছে প্রেমা বার বার তাঁদের ফিরিয়ে দিয়েছে।জারিফকে সবাই অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও পায় নি।পরে জানতে পারে পরিবার থেকে চাপ দেয় যার ফলে জারিফ এই বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায়। বিয়েটা করার পর জারিফ জে’দে’র বসে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। প্রেমার উদ্দেশ্য একটা চিঠি রেখে যায়।ঠিক চিঠি বলা যায় না,কারণ জাস্ট দুই লাইন কথা ছিলো,

‘আমার #গোধূলি_রাঙা_দিগন্ত অন্যকে ঘিরে সেখানে তোমার প্রবেশ নিষিদ্ধ। তুমি সব জেনে শুনে প্রবেশ করেছ।’

_______________________

মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে আরিবা। সামনে রক্তচক্ষু নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে প্রণয়।

‘আর কতো জ্বালাবে আমায়! মানুষ মনে হয় না? কতো চিন্তায় থাকি তুমি জানো? আর একটুর জন্য কি হতো।এতোটা কেয়ারলেস হলে চলে?’

নয় মাসের ভরা পেট নিয়ে প্রণয়ের কথা শুনছে আরিবা।একটু আগেই সে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে সামনে পা রাখতেই পা স্লীপ করে। প’ড়া’র আগেই প্রণয় এসে ধরে যার জন্য আল্লাহ রক্ষা করেছে।আরিবা ভীষণ ভয় পায় আর একটুর জন্য কি হতো? এক হাত পেটের উপর রেখে বেশ লম্বা একটা শ্বাস টেনে মিনমিন করে বলল,

‘আসলে আমি বুঝতে পারি নি। হঠাৎ করে এমনটা হলো।’

প্রণয় ধ’ম’কে’র সুরে বলল,

‘তোমায় কতোবার বলেছি এই অবস্থায় একা চলাফেরা করবে না।আমায় ডাকবে নয়তো মা কিংবা ময়নাকে ডাকবে।’

‘আর এমনটা হবে না।’

নাসিমা শেখ ফল দিয়ে পরিপূর্ণ একটা প্লেট হাতে নিয়ে রুমে এসে প্রণয়কে বলে,

‘তুই আবার ব‌উমাকে ধ’ম’ক দিয়েছিস?’

‘কেন দিয়েছি তোমার ব‌উমাকেই বলো।’

নাসিমা শেখ আরিবার মায়া ভরা মুখের দিকে তাকালেন।এই মেয়েটাকে সে কিছুতেই সহ্য করতে পারতো নি।কতো অপমান করেছে কিন্তু দিন শেষে তার ভুলটা ঠিক বুঝতে পেরেছে আরিবার কাছে সে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে।এখন আরিবা তার আরেক মেয়ে।রূপার জন্য আরিবাকে সে দেখতে পারতো না।সেই রূপা এখন জে’লে।সে অতিরিক্ত ড্রা’গ নিতো যার জন্য বাচ্চাটাও নষ্ট হয়ে গেছে। তাঁর কিছু উশৃঙ্খল সঙ্গী ছিলো তাঁরা কয়জন মিলে ড্রাগ নেওয়া অবস্থায় একজন পথচারীর উপর গাড়ি চালিয়ে দেয়।সেখানেই পথচারী নি’হ’ত হয় পুলিশ এসে সব কটাকে নিয়ে যায়।
নাসিমা শেখ আরিবাকে বসিয়ে দিয়ে পরম মমতায় মাথায় হাত রাখে।এক পিস আপেল নিয়ে আরিবার মুখে তুলে দেয়।

‘এ অবস্থায় সাবধানে চলতে হবে মা।এমন অসাবধানতাবশত চললে অনেক দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে আজ না হয় প্রণয় সামলিয়ে নিয়েছে কিন্তু সব সময় তো আর ও থাকে না।তুমি আর একা চলাফেরা করবে না।আমরা আছি কি করতে? তুমি আমাদের এতো কষ্ট করে বংশধর উপহার দিবে আর আমরা তোমার এইটুকু যত্ন আত্মী করতে পারবো না?

আরিবা মুগ্ধ হয়ে শাশুড়ি কথা শুনছে এই সেই নারী যার চোখে আরিবা বি’ষে’র ন্যায় ছিলো আর এখন সময়ের সাথে সাথে মধুর ন্যায় হয়ে উঠেছে।ইশ আজকাল এসব ভাবতেও আরিবার ভালো লাগে।

__________________

কনসিভ করার পর থেকে আরিবাকে নিচে নামতে দেওয়া হয় নি।প্রণয় আরিবাকে কঠোর ভাবে নিষেধ করে দিয়েছে আর এখন তো আরিবা চলাফেরা তেমন করতে পারে না।মাঝে মাঝে ময়না তার শাশুড়ি এসে গল্প করে যায়।তার ভীষণ সুখ সুখ লাগে কিন্তু প্রেমার কথা মাথায় আসলেই ঠোঁটের কোনে থেকে সুখের হাঁসিটুকু আপনা আপনি গায়েব হয়ে যায়। শুধু মনে হয় তার জন্য প্রেমা সুখী হচ্ছে না।এই অবস্থার জন্য সে নিজেই দায়ী।মাঝে মাঝে তো প্রণয়কে বলেও ফেলে।প্রণয় তাঁকে শান্তনা দেয় এই বলে,

‘দেখো আরিবা প্রেমা জেনে শুনেই এই পথে পা বাড়িয়েছে তোমার সাথে জারিফের সম্পর্ক ছিলো যা আমি বিয়ের পর জেনেছি তুমি বলার আগেই।বিয়ের পর প্রথম যখন তোমাদের বাড়িতে গেলাম সেই দিন জেনেছি কিন্তু এই জাহিন যে জারিফ তা জেনেছি হাসপাতালে।যেদিন আমি জারিফকে র’ক্ত দিলাম।বিয়ের আগে জানলে আমি তোমাকে কিছুতেই বিয়ে করতাম না ,সেখানে প্রেমা বিয়ের আগেই সব জেনেছে।হ্যা ভাই হিসাবে আমার বোনের জন্য খা’রা’প লাগে কিন্তু ও জেনে শুনে আ’গু’নে ঝাঁপ দিয়েছে। তুমি নিজেকে দোষী করছো কেন? সেক্ষেত্রে আসল দোষী তো আমি। আমার জন্য তুমি তোমার ভালোবাসা হারিয়েছো।

আরিবা অসহায় চোখে প্রণয়ের দিকে তাকায়।প্রণয় বরাবরের মতো নির্বিকার। আরিবা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,

‘সব জেনেও আমায় মেনে নিয়েছেন?’

প্রণয় হেঁসে বলে,

‘তুমিও তো সব জেনেও আমার সাথে থাকছো। আমার জীবণে অন্য কেউ ছিলো তুমি এটা জেনেও চলে যেতে পারো নি,তাহলে আমি কেন মেনে নিবো না বলো?’

আরিবা প্রণয়ের বুকে মাথা রাখে।এই বুকে মাথা রাখার কথা আগে কল্পনাতেও ভাবে নি কিন্তু এখন মাথা রাখলে আরিবার চোখ জুড়ে হাজার রঙিন স্বপ্ন ভেসে ওঠে।

‘আমি যদি না থাকতাম?’

‘তাহলে মুক্ত করে দিতাম।’

প্রণয়ের সরল কন্ঠ, আরিবা একটু মন খারাপ করে। এতে করে প্রণয় হেঁসে উঠে শাড়ির আঁচলটা পেটের উপর থেকে সরিয়ে আরিবার উঁচু পেট উন্মুক্ত করে। উন্মুক্ত পেটে অজস্র বার উষ্ণ পরশ দেয়।আরিবা কেঁপে উঠে চোখ পিটপিট করে।আরিবার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রণয় ফিসফিস করে বলে,

‘তুমি আমার জীবনে থেকে গেলে বলেই আমি যত্ন করে তোমায় রেখে দিলাম।’

আরিবা আবেগে আপ্লুত হয়। প্রণয়ের মতো এমন জীবণ সঙী পেয়ে সে সত্যি সুখি সে সাথে তার বাবা ও শশুড়ের প্রতি কৃতজ্ঞ।তারপর কিছু একটা মনে হয়ে বলে উঠে,

‘আপনার মনের কোথায় কি রূপা আছে?’

প্রণয় আরিবার কপালে ভালোবাসার স্পর্শ আঁকে মুচকি হেঁসে বলে,

‘রূপা আমার কাছে বিষন্নতায় ঘেরা দিনের মতো যেখানে একটু শান্তি নেই,নেই কোনো স্বস্থি। আর তুমি আমার জীবণটা রঙিন করে তুলেছো তোমার মধ্যে আমার অস্তিত্ব বিরাজমান করছে। তুমি আমার কাছে #গোধূলি_রাঙা_দিগন্ত ।

__________________সমাপ্ত_________________

গোধূলি রাঙা দিগন্ত পর্ব-১১

0

#গোধূলি_রাঙা_দিগন্ত
#পর্বঃ১১
#লেখিকাঃফারিহা_খান_নোরা
এই পৃথিবীতে যত রকম দান আছে তার মধ্যে সবথেকে সেরা আর পবিত্র দান হচ্ছে র’ক্ত’দান। কেননা একজনের র’ক্ত’দানের মাধ্যমে একটা জীবন বেঁচে যেতে পারে। পৃথিবীতে মানুষ খুব অল্প সময়ের জন্যই আসে।জীবনে বেঁচে থাকার সময় খুব কমই ভালো কাজ করার সুযোগ আসে।তেমনি র’ক্ত দান একটি ভালো কাজ।যখন র’ক্ত’দান করা যায় তখন সবাই র’ক্ত’দান করুন কেননা র’ক্ত’দান করলে আপনার কোনো ক্ষতি হবে না বরং আপনার দ্বারা র’ক্ত’দানের মাধ্যমে একটা জীবন বাঁচবে।
র’ক্তের কোন ধর্ম নেই একজন খ্রিস্টান র’ক্ত দিতে পারে একজন মুসলিম র’ক্ত দিতে পারে তেমনি একজন হিন্দু র’ক্ত দিতে পারে একে অপরের র’ক্ত কোনো ধর্মের পার্থক্য বোঝায় না।

জারিফ হাতের র’গ কে’টে’ছে প্রচুর ব্লা’ড লস হয়েছে যার জন্য র’ক্তে’র প্রয়োজন। জারিফ ব্লা’ড গ্রুপের সাথে প্রণয়ের ব্লা’ড ম্যাচ করে যার জন্য প্রীতম প্রণয়ের কাছে এসেছিলো।তার প্রাণপ্রিয় বন্ধুর এই অবস্থা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। ঘন্টা খানেক আগেও জারিফের সাথে কথা বলেছে অন্য দিনের মতো স্বাভাবিক ছিলো জারিফ তাহলে হঠাৎ করে কেন এই কাজ করে বসলো?

প্রণয়ের শরীর থেকে র’ক্ত নেওয়া হচ্ছে।প্রণয় প্রথমে জারিফকে না চিনলেও পরবর্তীতে যখন প্রীতম বলল জাহিনের কথা তখন আর এক মুহূর্তও দেরি করেনি।ছেলেটাকে সে অনেক আগে থেকেই চেনে হাস্যচ্ছল একটা ছেলে কোনো ব্যাপারে সিরিয়াস না,সেই ছেলে কি না এমন সিরিয়াস একটা কান্ড করে বসলো ভাবা যায়?

প্রণয় একা আসে নি তার সাথে আরিবাও এসেছে।মেয়েটাকে সে এতো রাতে নিয়ে আসতে চায় নি কিন্তু আরিবা জোর করেই এসেছে।আরিবাকে তার ঠিক লাগছে না। হতে পারে জাহিন তার পরিচিত বলে খা’রা’প লাগছে।প্রণয় হয়তো বিষয়টা নিয়ে বেশি ভাবছে।

_________________________

হসপিটালের করিডরে বসে আছে আরিবা। তাঁর মনটা আজ ক্ষ’ত’বি’ক্ষ’ত হয়ে আছে সে কিছুতেই মনকে বুঝাতে পারছে না,জারিফ এই কাজটি করেছে।দুই দিন আগেও জারিফ অন্য একটি নাম্বার দিয়ে আরিবাকে ফোন করেছে আকুতি মিনতি করছে আরিবা তাকে কাটকাট করে বলে দিয়েছিলো তাঁর ও আরিবার রাস্তা এখন সম্পূর্ণ আলাদা।সে জেনো আরিবার পিছু আর না নেয়।আরিবা এখন বিবাহিত তাঁর সাথে জড়িয়ে আছে বাবার বাড়ির সম্মান। শশুড় বাড়ির সম্মান‌ও তার সাথে জড়িয়ে আছে যা নতুন করে জড়িয়ে পড়ছে। বিবাহিত মেয়ে ঘরে স্বামী রেখে প্রেমিকের সাথে যোগাযোগ সমাজ মেনে নিবে? কখনোই না।যার জন্য আরিবা জারিফকে ভালো করে বুঝিয়ে বলছে কিন্তু জারিফ যে এমন একটা কাজ করে বসবে সে কাস্মিনকালেও ভাবে নি।ভাববেই বা কি করে তাঁরা তো আর কিশোর কিশোরী না,যে হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো। পঁচিশ বছরের একটা যুবকের কাছে আরিবা এমনটা আশা করে নি। কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেতেই আরিবা পিছনে ফিরে দেখে আরশি দাঁড়িয়ে আছে।আরশি আরিবার পাশে বসে পড়ে আরিবা সময় না নিয়ে আরশিকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে দেয়। ক্রোন্দনরত কন্ঠে বলে উঠে,

‘এটা কি হয়ে গেলো আপু? আমি তো এমনটা চাই নি ও এমন কি করে করতে পারলো! ভালোবাসা মানে কি শুধু কাছেই থাকা? নাকি ভালোবাসা মানে একজনের জন্য বাকি সব মানুষদের কষ্ট দেওয়া।আজ আমার আর ওর লাইফ অন্য দিকে মোড় নিয়েছে তার জন্য কি এতো সব কাছের মানুষদের কষ্ট দিয়ে ও সু’ই’সা’ই’ড এ’টে’ম করবে?’

আরশি আরিবাকে কি বলে সান্তনা দিবে বুজতে পারছে না।জারিফ ঠিক কাজ করে নি, ভালোবাসা ঠিক তবে ভালোবাসার জন্য নিজের জীবনকে শেষ করে দেওয়া এটা মেনে নেওয়া যাচ্ছে না কোনো ভাবেই যা জারিফ করেছে।

‘তুই চিন্তা করিস না,সব ঠিক হয়ে যাবে। জারিফ একদম সুস্থ ভাবে আমাদের মাঝে আবার ফিরে আসবে। দরকার হয় আমি ওকে বুঝাবো তুই এতো টেনশন করিস না।’

‘টেনশন যে হচ্ছে আপু।’

আরিবা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।আরশি আরিবার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে। আশেপাশে তাকিয়ে সতর্ক হয়ে বলে,

‘শুনলাম প্রণয় ভাইয়া এসেছে। তুই এভাবে ভেঙে পড়লে যে কেউ সন্দেহ করবে সেখানে প্রণয় ভাইয়া তো অবশ্যই করবে। তোর চোখ মুখের কি অবস্থা হয়েছে দেখছিস? এমন থাকলে তোদের মধ্যে ঝামেলা হবে।প্লীজ এমন করিস না লক্ষ্মী বোন আমার।’

‘আমি আর পারছি না আপু। আমার ভিতরটা জ্ব’ল’ছে তা শুধু আমিই বুঝতে পারছি।’

আরশি কিছু বলতে নিবে তার আগেই প্রণয় এসে পড়ে। আরিবা ঢুক গিলে প্রণয়ের চোখের আড়ালে মুখ মুছে নেয়।প্রণয় আরশির সাথে হেঁসে হেঁসে কুশল বিনিময় করে। কিছুক্ষণ পর আরিবার দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে বলে,

‘এবার যাওয়া যাক।’

আরিবা কেঁপে উঠে আরশির দিকে অসহায় চোখে তাকায়।বাড়িতে গিয়ে সে শান্তি পাবে না যতক্ষণ না সে জারিফের বিপদমুক্ত হবার নিউজ পাচ্ছে। আরশি বোনের মনে অবস্থা বুঝতে পারছে তবুও পরিস্থিতি সামলিয়ে বলল,

‘ভাইয়ার শরীর এখন বেশ দূর্বল তার রেস্ট দরকার আমরা এখানে আছি তোর ভাইয়া আমার শশুর ভিতরে আছে। তুই বরং ভাইয়ার দিকে খেয়াল রাখ।বাসায় গিয়ে রেস্ট কর।’

তারপর একটু চিন্তিত হয়ে প্রণয়কে উদ্দেশ্য করে আবার বলল,

‘আসলে কি হয়ছে জারিফ আমাদের নিজেদের মানুষ যার জন্য সবার একটু চিন্তা হচ্ছে ভাইয়া। আপনি কিছু মনে করেন না।’

প্রণয় মুচকি হেঁসে বলল,

‘সমস্যা নেই এমনটা হ‌ওয়াই স্বাভাবিক।’

আরিবাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘চলো।’

আরশি আরিবাকে যাওয়ার জন্য চোখের ইশারা করে। আরিবা নির্বিকার ভঙ্গিতে প্রণয়ের পিছু পিছু চলে যায়।

________________________

মাঝখানে কেটে গেছে দু্ই দিন জারিফ এখন বিপদমুক্ত শারীরিক ভাবে সুস্থ তবে মানসিক ভাবে অনেকটাই ভেঙে পড়েছে।ডাক্তার জারিফকে সব সময় চোখে চোখে রাখতে বলেছে এ ধরনের পেশেন্ট কোন সময় কি করে বসে তাঁরা নিজেরাই ঠিক ভুল বুঝে না। হসপিটাল থেকে এসে সেই রাতে প্রণয় আরিবাকে কোনো প্রশ্ন করে নি তবে সেই রাতে প্রণয় আরিবার অনেকটা কাছে এসেছিলো। প্রণয়কে কেনো জেনো বেসামাল লাগছিলো আরিবার।আরিবাও প্রণয়কে বাঁধা দেয় নি,এই ভাঙাচোরা মন নিয়ে সে পুরোটাই প্রণয়ের দখলে গেছে।তাঁরা তো স্বামী স্ত্রী আর কতো? এক ছাদের নিচে স্বামী স্ত্রী একসঙ্গে থাকবে আর তাঁদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা হবে না? তা কি করে হয়! নাটক সিনেমা গল্পে এসব মানায় তবে বাস্তবতা ভিন্ন।নারী পুরুষ সবার‌ই জৈবিক চাহিদা আছে আর সেখানে প্রণয় আর সে তো স্বামী স্ত্রী।

চুলায় চা বসিয়েছে। মাথা বেশ ধরছে আরিবার সেজন্য নিচে এসে চা বসিয়ে দেয় গ্যাসে।প্রীতম আরিবাকে চা করতে দেখে হেঁসে বলে,

‘ভাবি আমায় জন্য এক কাপ দেন।’

আরিবা প্রতিত্তোরে আচ্ছা বলে কাজে মনোযোগ দেয়।প্রীতম লিভিং রুমে বসে টিভিতে খেলা দেখছে।আজ বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষ নেই প্রীতম ছাড়া নয়তো সবাই একসাথে বসে খেলা দেখতো। আরিবার প্রীতমের সাথে তেমন সখ্যতা গড়ে উঠে নি। প্রীতম বেশ লাজুক প্রকৃতির ছেলে। আরিবা তার কতো ছোট তবু ভাবি বলে তো ডাকেই আবার আপনি সম্মধন করে।মানতেই হবে শাশুড়ি তার যেমন হোক না কেন! তিনটা ছেলে মেয়ে‌ই তাঁর ভীষণ ভালো। হবেই না কেন? তার শশুড়ের মতো মানুষ‌ই হয় না।আরিবা এক কাপ চা নিয়ে প্রীতমকে দেয়।প্রীতম হাতে বাড়িয়ে চায়ের কাপটি নেয় ।চুমুক দিয়ে বলে,

‘ধন্যবাদ ভাবি এমন অসাধারণ চা খাওয়ানোর জন্য।’

আরিবা একটু হেঁসে চলে যেতে নেয় সেসময় প্রীতমের ফোনে জারিফের কল আসে।আরিবা একটু পাশে যেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।

‘হ্যালো! জারিফ বল কেমন আছিস তুই?’

জারিফ ওপাস থেকে কি বলল তা শুনা গেলো না তবে প্রীতমকে বেশ চিন্তিত দেখা গেলো।এবার প্রীতম বেশ উত্তেজিত কন্ঠে বলল,

‘মাথা খা’রা’প হয়ছে তোর? রাখ তুই আমি রাতে হসপিটালে যাবো। পা’গ’ল কোথাকার আন্টি আঙ্কেলের সাথে আমি কথা বলবো।’

‘কি বলবো মানে? তাঁরা সঠিক ডিসিশন নিয়েছে। ছেলে বড় হয়েছে তাকে তো বিয়ে করাতেই হবে। আমি নিজ দায়িত্বে তোর জন্য মেয়ে দেখবো তোর এসব ই’ত’রা’মি শেষ হবে ব‌উ আগে আসুক।’

প্রীতম ঠাট্টার সুরে বলল,

‘বিয়ে করবি না কেন? এটাই বিয়ে করার সঠিক সময় ভাই।দেখ আমি বিয়ে করতে চায় কিন্তু বাবা মা আমার কথায় শুনছেই না। তাঁদের কাছে আমি নাকি বাচ্চা অথচো দেখ আজ বিয়ে দিলে কালকেই এক বাচ্চার বাপ হবো তা আর আমি বাবা মাকে বুঝাতে পারছি না।আর তুই না চাইতেই ব‌উ পাচ্ছিস শুকরিয়া কর বেটা। এখন রাখছি রাতে দেখা হবে উল্টো পাল্টা সিধান্ত নিবি না।তোর জন্য তিন দিন আমরা সবাই বেশ ভুগেছি।’

জারিফ বিয়ে করবে? সব শুনে আরিবার হাতে থাকা চায়ের কাপটি কাঁপতে থাকে। প্রীতম কথা বলে তাঁর রুমে চলে যায়। লিভিং রুমে আরিবা একা একটু পর প্রেমা নেমে আসে তাঁর পরনে বাহিরের পোষাক। আরিবা নিজেকে সামলিয়ে প্রেমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। প্রশ্ন ছুঁড়ে,

‘কোথায় যাচ্ছো?’

প্রেমা আমতা আমতা করতে করতে বলে,

‘আসলে ভাবি বাহিরে একটা কাজ ছিলো এই যাবো আর আসবো।’

আরিবার কেন জানি আজকাল প্রেমাকে সন্দেহ হয় মনে হয় কিছু লুকাচ্ছে তাঁর থেকে ঠিক এমনটা প্রণয় ও তাঁর সাথে করছে।এরা দুই ভাই বোন মিলে এমনটা করছে কেন সেটাই বুঝতে পারছে না আরিবা।

‘আমার লেট হচ্ছে আমি আসছি।’

বলেই প্রেমা চলে যায়,জেনো হাফ ছেড়ে বাঁচে।

_______________________

‘তুমি এখানে?’

জারিফ হসপিটালের বেডে শুয়ে জানালার ফাঁক গলিয়ে আকাশ দেখছিলো। হঠাৎ করে তাঁর রুমে উপস্থিত চেনা পরিচিত মুখ দেখে প্রশ্ন ছুঁড়ে।

মেয়েটি হেঁসে বলে,

‘কেন আশা করেন নি বুঝি?’

জারিফ ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,

‘আশা ঠিক করছিলাম তবে দুই দিন পরে নয়,আছ থেকে দুইদিন আগেই ।’

জারিফের রহস্যময় কথা শুনে প্রেমা চমকে যায়। জারিফ প্রেমাকে আর‌ও চমক দিতে অবিশ্বাস্য একটা কথা বলে ফেলে,

‘ভালোবাসো আমায়?’

প্রেমা শকে চলে যায়।দুই বছর হলো সে জারিফকে ভালোবাসে তবে গোপনে। কোনো দিন‌ও প্রকাশ করে নি। জারিফ কিভাবে জানলো প্রেমার লুকিয়ে রাখা অনূভুতির কথা।প্রেমা তোতলাতে তোতলাতে বললো,

‘আপনি এসব কি বলছেন?’

জারিফ বক্র হেঁসে বলে,

‘আমি মিথ্যা পছন্দ করি না।’

জারিফ আজ জেনো প্রেমাকে চমকের উপর চমক দিচ্ছে।প্রেমা চমক না দিলে কি করে হয়? সেজন্য শেষ মেষ প্রেমাও জারিফকে একটা অভাবনীয় চমক দিয়েই দিলো।

‘আপনি আরিবাকে ভালোসেন!’

।চলবে।

গোধূলি রাঙা দিগন্ত পর্ব-১০

0

#গোধূলি_রাঙা_দিগন্ত
#পর্বঃ১০
#লেখিকাঃফারিহা_খান_নোরা

অপেক্ষা! অপেক্ষা সত্য‌ই বিরক্তিকর একটা অনুভুতি।সকাল বেলা আধঘন্টা হলো জামা কাপড় হাতে নিয়ে ওয়াশরুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আরিবা। অপেক্ষা করছে প্রণয়ের বেড়িয়ে আসার।কাল রাত থেকে প্রণয় কেমন জেনো অদ্ভুত কর্মকাণ্ড করছে।এই যেমন আজ সকালে আরিবা ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হতে জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ করেই ঝড়ের গতিতে প্রণয় ওয়াশরুমে ঢুকে চোখের পলকেই আরিবার মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দেয়।আরিবা সেই তখন থেকে আহাম্মকের মতো অপেক্ষা করছে কিন্তু প্রণয়ের বের হ‌ওয়ার কোনো নাম‌ই নেই। শেষ পর্যন্ত আরিবা অধৈর্য্য হয়ে প্রণয়কে মনে মনে কিছু ভদ্র ভাষায় গা’লি দিতে দিতে প্রেমার রুমের দিকে এগোয় । পথিমধ্যে নাসিমা শেখের সঙে দেখা হয় উনিও এই দিকেই আসছেন।আরিবাকে দেখে চোখ মুখ কুঁচকে রুক্ষ সুরে বলেন,

‘কোথায় যাচ্ছো?’

আরিবা চোখ পিটপিট করে বলে,

‘প্রেমার রুমে।’

আরিবার হাতের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘জামা কাপড় নিয়ে যাচ্ছো যে?’

আরিবা বেশ অস্বস্তি বোধ করে তবুও আমতা আমতা করে বলে,

‘ফ ফ ফ্রেশ হতে।’

সাথেই সাথেই নাসিমা বেগম নাক সিঁটকায়। ধ’ম’কে’র স্বরে বলে,

‘এতো বড় মেয়ে তোমার কোনো কান্ড জ্ঞান নেই।এই অবস্থায় ঘর থেকে বের হয়ে ধেই ধেই করে ঘুরছো।ছিঃ এই নোং’রা শরীর নিয়ে গোসল না করেই আমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছো?’

নাসিমা শেখের কথা প্রথমে আরিবা না বুঝলেও পরবর্তীতে উনার বলা শেষের কথায় বুঝতে পারে আসলে উনি কি মিন করছে। আরিবা এখন এই মহিলাকে কিভাবে বুঝাবে তার ছেলের সাথে এমন কোনো সম্পর্ক এখনো তৈরি হয় নি যাতে করে আরিবার শাওয়ার নিতে হবে সে তো জাস্ট ফ্রেশ হতে প্রেমার ওয়াসরুমে ইউজ করার উদ্দেশ্য বেরিয়েছিলো এই বজ্জাত প্রণয়ের জন্য এই সকাল বেলা এই মহিলার এতো কথা ফেস করতে হচ্ছে আরিবাকে। আরিবা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসে অত্যন্ত শান্ত কন্ঠে বলে,

‘শাশুড়ি আন্টি আমি ইচ্ছে করে আপনার সামনে এসে দাঁড়ায় নি আপনি নিজেই চলে এসেছেন।আপনাকে আগে থেকে আসতে দেখলে এই অবস্থায় আমি আপনার সামনে নয় পিছনে গিয়ে দাঁড়াতাম।’

একটু চুপ করে দাঁত কেলিয়ে বলে,

‘এখন কি করবেন শাশুড়ি আন্টি সামনে যখন এসে পড়েইছি নোং’রা হয়ে গেলেন, যান আপনিও বরং ফ্রেশ হয়ে নিন।’

নাসিমা বেগম রা’গে ক্ষো’ভে ফুঁ’সে উঠে। উচ্চস্বরে বলে,

‘ফাজিল মেয়ে।’

গজগজ করতে করতে আর‌ও কয়টা কথা বলে।আরিবা সেসব পাত্তা না দিয়ে উল্টো ঘুরে তাদের রুমেই আসে।প্রেমার রুমে আর যায় না।

___________________________

সকালের পর থেকে আরিবা প্রণয়ের সাথে আর কোনো কথা বলছে না।কথা বলবে কেন? এই লোকটার জন্য‌ই তো সকালে এমন কান্ড ঘটলো।আরিবাকে জ্বালাতেই প্রণয় ওয়াশরুম থেকে একঘন্টা সময় লাগিয়ে বের হয়েছে আরিবা বেশ বুজতে পারছে।প্রণয় অবশ্যই আরিবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য অনেক চেষ্টা করছে তবে আরিবা প্রণয়কে পাত্তা দেয় নি।আজ বাদে কাল আরিবার কলেজে পরিক্ষা।ইনকোর্স পরিক্ষা তিন সাবজেক্ট একসাথে সেজন্য সে মনোযোগ সহকারে পড়ছে।এ বাড়িতে আসার সময় এবার আরিবা তার প্রয়োজনীয় সকল জিনিস এনেছে।ব‌ই খাতা থেকে শুরু করে জামাকাপড় সব কারণ সে চায় না রূপার জন্য নিয়ে আসে কোনো কিছু ব্যাবহার করতে।তারপর থেকে আরিবা নিজের ড্রেস ইউজ করছে। আজ আরিবা নিচে তেমন নামে নি কিন্তু নাসিমা শেখের সাথে আরিবার যতো বার‌ দেখা হয়েছে নাসিমা শেখ ততোবার ই বিরবির করে আরিবাকে অসংখ্য গা’লি দিয়েছে।আরিবা সেসব গায়ে মাখে নি কারণ আরিবা জানে মৌচাকে ঢিল ছুঁড়লে মৌমাছি পিছু নিবেই সেখানে তো আরিবা সকাল বেলা নিজ দায়িত্বে নাসিমা বেগমকে বেশ চটিয়ে দিয়েছে।

রাতের বেলা প্রণয় রুমে এসে দেখে দুই ননদ ভাবী গল্প করছে।আরিবার কোলের উপর একটা ব‌ই আর বিছানায় ছড়িয়ে আছে বেশ কিছু ব‌ই সেসবে কারো গুরুত্ব নেই।দুই বাঁচাল গল্পে মশগুল প্রণয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফ্রেশ হতে যায়। বেরিয়ে আসার পর ননদ ভাবী দুই জনের দিকে দুইটা চকলেট বক্স এগিয়ে দেয়।প্রেমা তো খুব খুশি।

‘থ্যাংক ইউ ভাইয়া।’

আরিবা হাতে বক্স নিয়ে দুই ভাইবোনের কথা শুনে।প্রণয় দেখে আরিবা বেশ চুপচাপ।সে হালকা হেঁসে বলে,

‘ওকে বাট এক বারে সব খেয়ে ফেলিস না।তোর কিন্তু চকলেট খেলে এসিডিটির সমস্যা হয়।তোরা দুটোতে একবারেই সব খেয়ে ফেলে গতবার অসুস্থ হয়ে পড়ছিলি সো বি কেয়ার ফুল।’

আরিবার ভ্রু এবার কুঁচকে আসে দু’টোতে মানে? সে তো তেমন চকলেট পছন্দ‌ই করে না তার উপর আবার একবক্স খাবে? আর সবচেয়ে বড় কথা প্রণয় এর আগে কখনো আরিবাকে চকলেট এনে দেয় নি।তাহলে প্রণয় কার কথা বলছে একজন তো প্রেমা অন্যজন কে?

আরিবাকে আর প্রশ্ন করতে হলো না তাঁর আগেই প্রণয় উচ্ছ্বাস এর সাথে বলতে শুরু করে,

‘জানো আরিবা এই প্রেমা ও রূপা দুজন ভীষণ দুষ্টু।আমি যা নিষেধ করবো এরা সেটাই করবে।দুইজন বাঁদরের মতো লাফায় আর সারাদিন ভাবতে থাকে কি কি অকাজ করা যায়।এদের মাথা থেকে এতো শয়তানি বুদ্ধি কি করে বের হয় আমি সেটায় ভাবি। দু’টোতে মিলে বাড়িটা মাতিয়ে রাখে।’

আরিবা নির্বিকার।প্রেমা অবাক হয়ে যায় ভাইয়ের আচারণে। তাঁর ভাই রূপা আপুর কথা ভাবির সামনে এভাবে বলছে? মেয়েটা স্বামীর মুখে প্রাত্তনের কথা শুনে কষ্ট পাবে না! আসলেই তার ভাই ব’ল’দ কি ভাবে হাঁসি দিচ্ছে আবার। পরিবেশ গুমোটে প্রণয় খেয়াল করে রূপার কথা এভাবে বলা ঠিক হয় নি।

প্রেমাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘গল্প হয়ে গেলে পড়তে যা। সারাদিন শুধু গল্প আর গল্প।’

প্রেমা পরিবেশ স্বাভাবিক করতে ভেংচি কেটে ভাইকে বলে,

‘আমার গল্প তোকে কোনো সমস্যা করছে না।ভাইয়া আসলে তুই এখন আমাকে এই রুম থেকে যেতে বলছিস।ভাবির সাথে প্রেম করবি আমি জানি তো ।আমি এমনি‌ও চলে যেতাম কাবাব মে হাড্ডি হতে চাই না আমি।’

বলেই প্রেমা দৌড় দেয়। প্রণয় প্রেমার পিছু নেয়। চেঁ’চি’য়ে বলে,

‘তবে রে দাঁড়া!’

প্রেমাকে আর পায় কে? প্রণয় রুমের দরজা লক করে আরিবার পাশে এসে বসে।শান্ত স্বরে বলে,

‘আজ এতো চুপচাপ যে?’

আরিবা ঠেশ দিয়ে বলে,

‘আমি তো আর আপনার রূপার মতো চঞ্চল না যে হৈ চৈ করে বাড়ি মাতিয়ে রাখবো।আমি আরিবা আমি চুপচাপ‌ই থাকি।’

প্রণয় আরিবার কাছে ঘেষে বসে আরিবা সড়ে যেতে নিলে প্রণয় আরিবার কমোড়ে হাত রাখে জড়িয়ে নেয় নিজের সাথে।এতে করে আরিবা কেঁপে উঠে অদ্ভুত চোখে প্রণয়ের দিকে তাকায়।প্রণয় আগে থেকেই আরিবার দিকে তাকিয়ে ছিলো ফলে দুইজোড়া চোখ একত্রিত হয়।প্রণয় ফিসফিস করে বলে,

‘রূপা আমার অতীত তুমি আমার বর্তমান। অতীত টেনে এনে আমি আমার বর্তমান নষ্ট করতে চাই না।রূপা ছোট থেকে আমাদের বাড়িতে বেশি সময় থাকতো যার জন্য অনেক সময় ওর কথা বলে ফেলি যা আমার উচিত হয় নি। আমি ওকে পছন্দ করতাম অস্বীকার করি না,তবে ও পছন্দ পর্যন্ত‌ই সীমাবদ্ধ থাকুক।আমি চাই পছন্দের গভীরে যে সকল সম্পর্ক সবকিছু তোমার সঙে গড়ে উঠুক।সব কিছু ঠিক করতে একটু তো সময় লাগবে কারণ আমরা মানুষ হঠাৎ করে সব কিছু ন’ষ্ট করতে পারলেও হঠাৎ করে কিন্তু কোনো কিছু জুড়তে পারি না।

আরিবা মনোযোগ দিয়ে প্রণয়ের কথা শুনে প্রণয় চুপ হয়ে যায় আরিবা গোলাপী ঠোঁট জোড়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।এই ঠোঁট জোড়া তাকে বড্ড টানছে। প্রণয় তার একটা হাতে আরিবার মাথার চুল গলিয়ে দেয় আর অপর হাত আরিবার কোমড়ে রেখে তার সাথে জড়িয়ে নেয় , ঠোঁট দুটো বাড়িয়ে ধীরে ধীরে আরিবার ঠোঁটের দিকে এগিয়ে যায় আরিবা বুজতে পেরে কাঁপতে থাকে চোখ বন্ধ করে নেয়।তারা একে অপরের নিঃশ্বাসের আওয়াজ শুনতে পারছে,যেই মাত্র ঘনিষ্ঠ হবে ঠিক তখনি দরজায় কেউ ধুমধাম বা’ড়ি দিতে শুরু করে।প্রণয় বিরক্ত হয়ে উঠে পড়ে এই মুহূর্তে এমন না হলেও পারতো।আরিবা বন্ধ করে রাখা নিঃশ্বাস ছাড়ে নিজেকে গুছিয়ে নেয়।প্রণয় দরজা খুলতেই প্রীতম হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,

‘ভাইয়া সর্বনাশ হয়ে গেছে জারিফ সুইসাইড এটেম করছে। তার অবস্থা খুব‌ই খারাপ!’

।চলবে।

গোধূলি রাঙা দিগন্ত পর্ব-০৯

0

#গোধূলি_রাঙা_দিগন্ত
#লেখিকাঃফারিহা_খান_নোরা
#পর্বঃ০৯
ভালোবাসা! সুন্দর একটি অনুভূতি। এই সুন্দর অনুভূতির সাথে সে সকল মানুষ পরিচিত যাদের জীবণে ভালোবাসা এসেছে। যে সকল মানুষ ভালোবাসা নিজের করে পায় তাদের থেকে সেই সকল মানুষ ভালোবাসার মর্ম একটু হলেও বেশি বুঝে যারা ভালোবাসা হারায়। সেই ঘটনার পর আরিবার দুই মাস পেরিয়ে গেছে এই বাড়িতে। সেইদিন জারিফ ও আরিবাকে অই অবস্থায় কে দেখে নিয়েছে তা জানতে পারে নি কারণ পিছন ফিরে দেখতে পারে দ্রুত গতিতে একটা ছায়া সড়ে যায়।আরিবা ও জারিফ উভয়‌ই রুমের বাহিরে এসে দেখে মানুষের কোনো চিহ্ন নেই শুধু নিচে পড়ে আছে বড় ফুলদানিটি।আরিবা জারিফের উপর রেগে যেয়ে বলে দেয় তার সাথে জেনো কোনো রকম যোগাযোগ সে আর না রাখে। এখন আরিবা বিবাহিত তার একটা সম্মান আছে।জারিফ তার প্রেমিক ছিলো ঠিক তবে বিয়ের পর একটা মেয়েকে পরিচিত ছেলের সাথে দেখলেও সবাই সন্দেহের চোখে দেখে এটাই নিয়ম।মাঝে মাঝে জারিফ বিভিন্ন নাম্বার থেকে আরিবার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে কিন্তু আরবি পুরোপুরি ইগনোর করে।

এই দুইমাসে প্রেমার সাথে আরিবার ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তবে মাঝেমধ্যে প্রেমার মুখে রহস্য জনক কথা শুনা যায় যা আরিবাকে পরবর্তীতে বেশ ভাবিয়ে তোলে অন্যদিকে নাসিমা বেগম সেই রিনা খানের চরিত্রে আটকিয়ে আছে। আরমান শেখ আরিবাকে বরাবরই সার্পোট করে একদম নিজের মেয়ের মতো দেখে।প্রণয়ের সাথে আরিবার সম্পর্ক আগের থেকে সহজ হয়ে উঠেছে তবে আর পাঁচটা স্বামী স্ত্রীর মতো স্বাভাবিক সম্পর্ক এখনো গড়ে উঠে নি।এই কয়দিনে আরিবা বেশ ভালো ভাবেই বুঝতে পেরেছে প্রণয় হলো মা ভক্ত ছেলে।মা যা বলবে প্রণয় সেটাই শুনবে।প্রণয় মাকে যেমন ভক্তি করে তেমন অন্ধের মতো বিশ্বাস করবে এই পয়েন্ট কাজে লাগিয়ে নাসিমা শেখ তাদের মধ্যে ঝামেলা তৈরি করার চেষ্টা করছে বার বার।

আকাশটা আজ মেঘলা। আকাশে রোদ মেঘের কানামাছি চলছে।আরিবা প্রেমার জন্য কলেজের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দুইজন এক‌ই ভার্সিটির স্টুডেন্ট হবার সুবাদে এক সাথে আসা যাওয়া করে। হঠাৎ করেই অচেনা একটা ছেলে আরিবার সামনে এসে মুখে হাঁসি নিয়ে বলে,

‘হাই মিস।’

আরিবা বিরক্ত হয় তবুও সৌজন্যমূলক আচরণ করে,

‘হ্যালো।’

ছেলেটি সাড়া পেয়ে দিন দুনিয়া ভুলে যায়। আরেকটু এগিয়ে এসে বলে,

‘হেই সুন্দরী আমারা কি বন্ধু হতে পারি। আপনার মতো সুন্দরী মেয়েকে বন্ধু হিসাবে পেলে আর কি লাগে বলুন এমনিতেও আপনাকে দেখে সিঙ্গেল‌ই মনে হয় তেমনাটা হলে আমাকে বয়ফ্রেন্ড বানিয়ে নিতে পারেন আমার কোনো সমস্যা নেই।’

অচেনা ছেলের এতো বড় স্পর্ধা দেখে রা’গে আরিবার শরীর রি রি করে।ফর্সা মুখ লালচে বর্ণ ধারণ করে এমন গায়ে পড়া ছেলে আরিবা আর একটাও দেখেনি। কিছু বলতে যাবে তার আগেই ছেলেটির ক’লা’র চেপে ধরে প্রণয় ধ’ম’কে’র সুরে বলে,

‘তোর এতো বড় সাহস ভরা রাস্তায় মেয়েদের সাথে ফ্লাট করিস?’

ছেলেটি প্রণয়ের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।এতে করে প্রণয় ক’লা’র আর‌ও শক্ত করে ধরে। ছেলেটি আর্তনাদ করে হাঁসফাঁস করে বলে,

‘আপনার সমস্যা কি ভাই? ফ্লাট করলে আমি এই মেয়েটির সাথে করছি আপনি আপনার রাস্তা মাপেন।’

আরিবা ভ’য়ে জড়সড় হয়ে আছে প্রণয়ের এমন রা’গ সে এর আগে দেখে নি তার মধ্যে ছেলেটির এমন কথায় প্রণয় যে কি করবে তা ভাবাচ্ছে।এতো ভাবাভাবির আগেই প্রণয় ছেলেটির নাক বরাবর গায়ের জো’রে দুটো ঘু’ষি মে’রে দেয়।ছেলেটি নিচে পড়ে কাতরাতে থাকে নাক দিয়ে র’ক্ত বের হচ্ছে। আরিবা মুখ চেপে পিছনে সড়ে আসে।প্রণয় গজরাতে গজরাতে ছেলেটিকে তুলে আরেক ঘা লাগিয়ে দেয়। দাঁত কিড়মিড় করে বলে উঠে কন্ঠে তার কঠোরতা,

‘হা’রা’মি’র বাচ্চা আমি আমার রাস্তায় মাপছি। তুই যে মেয়েটির সাথে ফ্লাট করছিস সে আমার ব‌উ। আমার ব‌উয়ের দিকে আর একবার যদি চোখ তুলে তাকাস তোর চোখ উপড়ে ফেলবো।’

বলেই ছেলেটির প্রাইভেট জায়গায় লাত্থি মা’রে। প্রণয়ের মুখে ব‌উ কথাটি শুনে আরিবার শরীরে অদ্ভুত শিহরণ জাগে।পুরো শরীর জুড়ে অদৃশ্য ভালো লাগায় ছেয়ে যায়।এর মধ্যে প্রেমা এসে পড়ে বড় ভাইকে এমন রে’গে যেতে দেখে আরিবাকে জিজ্ঞেস করে।আরিবা শুরু থেকে বলে প্রেমা যেয়ে প্রণয়কে থামিয়ে দেয় প্রণয় রা’গে বিরবির করতে করতে গাড়িতে গিয়ে বসে।আরিবা ভয়ে জড়সড় হয়ে প্রণয়ের পাশে যেয়ে বসে পড়ে। প্রণয় আরিবার দিকে তাকিয়ে আওড়ায়,

‘এসেছিলাম বোনকে কেউ ডিস্টার্ব করে কিনা সেই টা দেখতে এখন এসে দেখি উল্টো কাহিনী।বোনকে নয় আমার ব‌উকেই ডিস্টার্ব করছে ছেলেরা।’

আরিবা আর‌ও চুপসে যায়। ভাইয়ের কথা শুনে প্রেম হাঁসবে না কাঁদবে ঠিক বুজতে পারছে না। সুন্দরী ব‌উ হলে যা হয় আর কি!

____________________________

গাড়ি থেকে নামতেই প্রণয় আরিবাকে সবার সামনে দিয়ে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করে নাসিমা শেখ দেখে বেজায় খুশি হয়।সাইট থেকে গজগজ করতে করতে উস্কে দিয়ে বলে,

‘নিশ্চয়‌ই কোনো আকাম করছে।যা রুমে যেয়ে আচ্ছা মতো দুই চারটা লাগিয়ে দে। আমি আগেই বলেছিলাম এই মেয়েকে আর পড়াতে হবে না।কেউ শুনে নি আমার কথা।দেখবি একদিন এই মেয়েই মির্জা বাড়ির সম্মান ধূলোয় মিশে দিবে ছো’ট’লো’কের মেয়ে কি না?’

প্রণয় চুপ করে শুনে গেলো মাকে কিছুই বলল না। কলেজে সবার সামনে আরিবাকে ব‌উ বলায় প্রণয়ের প্রতি আরিবার যতোটা না ভালো লাগা তৈরি হয়েছিলো এখনকার এই ঘটনায় প্রণয়ের প্রতি সেই ভালো লাগা মিশে যায়।প্রণয় তো পারতো তাঁর মাকে ভালো করে বুঝাতে।

প্রেমা তাঁর মাকে চুপ করিয়ে দিতে বিরক্তের সহিত বলল,

‘আহ্ মা চুপ করো।যা জানো না তা নিয়ে কথা বলতে যাও কেন?’

নাসিমা শেখ ফুঁ’সে উঠে বলেন,

‘এখন তুই অই ছো’ট’লো’কের মেয়ের পক্ষ নিয়ে আমায় কথা শুনাবি।এটাই তো বাকি ছিলো হবেই না কেন বাপ তো মির জাফর।মিরজাফরের বাচ্চা কি আর আমার পক্ষ নিয়ে কথা বলবে।শুন যতোই বাপ বাপ করিস না কেন দশ মাস কিন্তু আমিই পেটে জায়গা দিয়েছি তোর বাপ কিন্তু জায়গা দেয় নি।’

ল্যাও ঠ্যালা! মাকে ভালো বুঝাতে এসে মা কিনা তার জন্মের কথা অবধি চলে গেছে।এমন ভাবে কথা বলছে মনে হচ্ছে বাবা প্রেমাকে জন্মের আগেই জায়গা থেকে বিতারিত করেছে তার মা দয়া করে প্রেমাকে দশমাস জায়গা দিয়েছে! এখন কথা হলো মায়েরা তো জন্ম দেয়, বাবারা তো জন্ম দেয় না।

____________________________

রুমে এসে দরজা লক করে দেয় প্রণয়।আরিবা প্রণয়ের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য হাত মুচড়া মুচড়ি করে তবুও পারে না।প্রণয় এক ঝটকায় আরিবাকে নিজের সাথে মিশিয়ে চাপা স্বরে চেঁ’চি’য়ে বলে,

‘কলেজে পড়তে যাও নাকি নিজের রূপ দেখতে যাও?’

আরিবা ব্যা’থা পাচ্ছে। টলমল চোখ জোড়া নিয়ে প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘কলেজে মানুষ রূপ দেখাতে যায়?’

প্রণয় হিসহিসিয়ে বলে,

‘তুমিই তো যাও অই ছেলের তো তোমার রূপের প্রতি এতো ইন্টারেস্ট।’

‘আমি ছেলেটাকে চিনি না। হঠাৎ করেই উনি আমার সামনে চলে এসে এসব বলছে।’

প্রণয় ব্যাঙ্গ স্বরে বলে,

‘তুমি বলো নি তুমি বিবাহিত! আমার কথায় চলবে তুমি আর কোনো ছেলের সাথে জেনো তোমায় না দেখি।’

আরিবা এবার জেনো রা’গে ফুঁসে উঠে এরা মা ছেলে পেয়েছেটা কি! তাকে যেভাবে খুশি সেভাবে ট্রিট করবে?

দন্তপিষে আরিবা বলল,

‘আপনি আমাকে ব‌উ বলে মানেন অদ্ভুত পুরুষ মানুষ।ব‌উ বলে মানেন না আবার জোর দেখায়।মায়ের উপর তো একটা কথাও বলেন না।আমি কি করি না করি আপনাকে বলতে যাবো কেন? যেদিন ব‌উ বলে মানবেন সেদিন স্বামী বলে আমিও আপনার সব কথা শুনবো।’

প্রণয় আকস্মিক একটা কাজ করে বসে।আরিবার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট বসিয়ে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

‘ব‌উ না মানলে এতো গুলো মানুষের সামনে তোমায় ব‌উ বলে স্বীকার করি? এখন থেকে কলেজে যেতে হলে সবাইকে বলবে ‘তুমি বিবাহিত’

।চলবে।

গোধূলি রাঙা দিগন্ত পর্ব-০৮

0

#গোধূলি_রাঙা_দিগন্ত
#পর্বঃ৮
#ফারিহা_খান_নোরা
আকস্মিক পেছন থেকে হঠাৎ করে কেউ জড়িয়ে ধরতে চমকে গেল আরিবা। না দেখলেও বুঝতে পারছে হাত দুটোর অধিকারী কোনো পুরুষ মানুষ। প্রণয় তার সাথে এমন কাজ করবে না। এ কয়দিনে যতটুকু চিনেছে আর যাইহোক প্রণয় একটা মেয়েকে সম্মান দিতে জানে।এই বাড়িতে পুরুষ মানুষ বলতে প্রণয় তার শশুর ও দেবর প্রীতম আছে।প্রথম দু’জন তার নিকট অত্যন্ত সম্মানের ব্যাক্তি আর প্রীতম তার সাথে আরিবা তেমন পরিচিতি নয় যার জন্য বলতে পারছে না।আরিবা প্রচন্ড বেগে পেছনে ফিরে, না দেখেই সামনের ব্যাক্তিকে জো’রে ধা’ক্কা দিয়ে বসে। লোকটি কিছুটা দূরে সরে যায়,মুখ তুলে তাকাতেই আরিবা সামনের ব্যাক্তিটিকে দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। তাঁর হাত পা ক্রমাগত কাঁপতে থাকে সাথে ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে।এ কি করে হতে পারে ও কি সত্যি দেখছে নাকি স্বপ্ন!

‘এভাবে কেউ ধাক্কা দেয়? আরেকটু হলেই তো পড়ে যেতাম। বাহ্ এই কয়দিনে দেখছি তুমি ভালোই শক্তি সঞ্চয় করেছো জানেমান।’

আরিবা অবাক হয়ে যায়। অনবরত তিরতির করা কাঁপা ঠোঁট দিয়ে অতি কষ্টে একটা শব্দ‌ই বেরিয়ে আসে।

‘জারিফ!’

জারিফ হেঁসে দেয়।আরিবার কাছে এসে প্রফুল্ল চিত্তে বলে,

‘হ্যা জারিফ! তোমার জারিফ জানেমান। প্রথমে তোমায় এখানে দেখে আমি অবাক হয়ে যাই পরবর্তীতে তোমাকেও একটু অবাক করবো বলে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরি কিন্তু তুমি যে এতোটা ভয় পাবে তা আমি বুঝতে পারি নি।’

আরিবা নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারছে না। সে এতোদিন ভেবে এসেছে কি করে জারিফের সম্মুখীন হবে। একদিন না একদিন তো তাকে জারিফের সামনে দাঁড়াতেই হবে কিন্তু সেই দিন যে এতো তাড়াতাড়ি আসবে সে কল্পনায়ও ভাবতে পারে নি।মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগে জারিফ এখানে কেন?

আরিবা লক্ষ করে তারা ঠিক প্রণয়ের রুমের দরজার সামনে অবস্থানরত। যে কোনো মুহূর্তে প্রণয় আসতে পারে।আরিবা জারিফের থেকে নিজের দূরত্ব বাড়িয়ে ফেলে এতে করে জারিফের ভ্রু কুঁচকে যায়।আজ আরিবার ব্যাবহার তার কাছে অদ্ভুত ঠেকছে। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে আরিবা তার থেকে কিছু একটা লুকাতে চাইছে।এই আরিবাকে তাঁর কেমন জানি অচেনা লাগছে।ঠিক তখনি প্রণয় বেরিয়ে এসে আরিবাকে দেখে অবাক হয়ে যায়। এতো রাতে আরিবাকে সে এখানে আশা করে নি।

‘আরে প্রণয় ভাই! আপনি দেখছি বিয়ে করে আগের থেকেও বেশি হ্যান্ডসাম হয়ে গেছেন। এসবের ক্রেডিট কি আমাদের নতুন ভাবির নাকি?’

প্রণয় এতোক্ষণে সামনের ব্যাক্তিটিকে লক্ষ্য করে।ছেলেটি আর কেউ নয় প্রীতমের ছোট বেলার বন্ধু। ছেলেটির শেষের কথায় অস্বস্তিতে পড়ে আড়চোখে আরিবাকে একবার দেখে নেয় মেয়েটি কেমন জড়সড় হয়ে চুপসে আছে।প্রণয়ের কপালে ভাঁজ পড়ে। নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে,

‘জাহিন তুমি এখানে! প্রীতমের রুমে গিয়েছিলে?’

জারিফ একটু হেসে আরিবার দিকে তাকিয়ে বলে,

‘প্রীতমের রুমেই যেতে নেয় মাঝপথে এই ম্যাডামের সাথে দেখা সেজন্য দাঁড়িয়ে পড়লাম। প্রণয় ভাই নতুন বিয়ে করেছেন ভাবিকে সময় না দিয়ে আপনি এখানে আমাদের সাথে সময় নষ্ট করছেন এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। আপনি বরং রুমের ভিতরে যেয়ে আমাদের সুন্দরী ভাবিকে সময় দেন।’

জারিফের এমন কথায় আরিবার চুপসানো মুখ ফুঁস হয়ে যায় অপরদিকে প্রণয়ের চোখে বিস্ময়। প্রণয় প্রশ্ন ছুঁড়ে,

‘তুমি আরিবাকে আগে থেকে চিনো?

জারিফ একটু লজ্জা পায় বন্ধুর বড় ভাইয়ের সামনে তো আর বলা যায় না,আরিবা তার গার্লফ্রেন্ড।জারিফ কিছু একটা ভেবে বলে,

‘আমাদের ভার্সিটির জুনিয়র আরিবা। কিন্তু আরিবা এখানে কেন? প্রণয় ভাই এমন না তো আরিবা আপনার শালী? ভাবির সাথে এসেছে বুঝি!’

আরিবার হাঁসফাঁস হচ্ছে কি একটা পরিস্থিতিতে পড়ল সে। নিজেকে ফাঁ’সি’র আসামির মতো লাগছে।এই জারিফটার ও মাথায় কি বুদ্ধিসুদ্ধি নেই কি সব বলে যাচ্ছে ননস্টপ।ব‌উ কে বানাচ্ছে শালী ভাবা যায়!

প্রণয় কটমট করে একবার আরিবার দিকে তাকায় ও একবার জারিফের দিকে তাকায়। আরিবার দিকে আঙুল উঁচিয়ে ধরে কন্ঠে কঠোরতা আরোপ করে বলে,

‘ও আমার শালী নয়, ও আমার ব‌উ।তোমাদের ভাবি বুঝলে জাহিন?’

কথা শেষ করে আরিবাকে আদেশ করে,

‘রুমে এসো।’

______________________

নিস্তব্ধ রাত! এই রাতে কেউ হাজার স্বপ্ন বুনে, কারো স্বপ্ন আবার ভঙ্গ হয়। জারিফ প্রতীমের ছোট বেলার বন্ধু।স্কুল কলেজে তার নাম জাহিন ইসলাম।সবাই জাহিন নামেই চেনে তাকে একমাত্র বাড়িতে জারিফ নামে পরিচিত।ছেলেটা সব সময় মজার ছলে থাকে সেজন্য‌ই তো আরিবাকে এ বাড়িতে দেখে ব্যাপারটা মজার ছলেই নিয়েছে কিন্তু সে কি জানতো তার জন্য কি অপেক্ষা করছে? আরিবা তার সাথে এসব করতে পারলো কি করে! সে বন্ধুদের সাথে ট্যুরে গিয়েছিলো,ফিরে এসে যে,সে এতো বড় সারপ্রাইজ পাবে কোনো কালেই ভাবে নি।জারিফের বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।এতো বড় প্রতারণা!

আরিবা গুটিগুটি পায়ে রুমে ঢুকতেই প্রণয় প্রশ্নবিদ্ধ করে,

‘তুমি এখানে?’

‘কেন আশা করেন নি বুঝি?’

আরিবার কন্ঠে তাচ্ছিল্য।প্রণয় নিজেকে সামলিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বলে,

‘বলতে পারো।এতো রাতে তোমাকে আশা করি নি।’

‘বাবা এনেছে।’

প্রণয় আর কোনো কথা বলেননি।আরিবা স্বস্থি খুঁজে পেল কারণ প্রণয় জারিফকে নিয়ে আর একটা প্রশ্ন‌ও করে নি।প্রণয় জানে জাহিন ফানি টাইপ,মজা করতে পছন্দ করে যার জন্য ওর প্রসঙ্গ টেনে এনে সময় নষ্ট করতে চায় নি।প্রণয় কি আর জানতো এই জাহিন তার লাইফের সবচেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গের সাথে জড়িয়ে আছে?

____________________

সকালবেলা আরিবাকে দেখে রা’গে ফেটে পড়ে নাসিমা শেখ।মনে মনে গা’লি দিতে থাকে। রা’গে গজগজ করতে করতে আরিবাকে বেশ কয়েটা কথা শুনিয়ে দেয়।

‘তোমার কি লা’জ লজ্জা বলতে কিছু‌ই নেই? বিয়ের এক সপ্তাহ পেরোতো না পেরোতেই নিজের লজ্জাও খেয়ে ফেলেছো। যেখানে আমার ছেলে তোমাকে চায় না, রেখে এসেছে বাপের বাড়িতে সেখানে নিজেই ধেই ধেই করে একা একা চলে এসেছো। লজ্জা শরম হীন মেয়ে মানুষ কোথাকার।’

আরিবার মনটা এমনিই বিক্ষিপ্ত ছিলো তার মধ্যে নাসিমা শেখের এমন কথায় ভেতরটা ভে’ঙে চুড়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেই আরমান শেখ এসে উচ্চস্বরে বলে,

‘নাসিমা তুমি কিন্তু বড্ড বেড়েছ। যা জানো না তা নিয়ে কথা বলো কেন? নাকি আরিবাকে অপমান করার একটা কারণ ও ছাড়ো না। আরিবা একা একা আসে নি আমি নিজে যেয়ে ওকে নিয়ে এসেছি। আমার মনে হয় কি জানো আত্মসম্মান আরিবার ঠিক আছে কিন্তু তোমার নেই তা না হলে নিজেকে কেউ অন্যের চোখে এতো নিচে নামায়?’

আরমান শেখ আরিবার মাথায় হাত রেখে বলে,

‘যাও মা রুমে যাও। এবাড়িতে কোনো কাজ তোমায় করতে হবে না। তুমি আমার মেয়ে, তুমি তোমার মতো করে চলবে।আর এই মহিলার থেকে সাবধানে থেকো।’

শেষের কথাটা নাসিমা শেখ কে দেখিয়ে দিয়ে বললেন। নাসিমা শেষ রা’গে ফেটে পড়েন স্বামীর কাজে।স্বামী তো নয় যেনো মির’জাফর!

আরিবা নিঃশব্দে যেতে নেয়। পিছন থেকে আরমান শেখ বলে উঠে,

‘নরম মনের হলে চলবে না মা।মনে রাখবে তুমি রিনা খানের মতো শাশুড়ি পেয়েছ।যেখানে রিনা খানের মতো শাশুড়ি আছে সেখানে নিজেকে বাংলার ব‌উ ভাবতে হবে।’

শেষের কথাটা মজার ছলেই বলল আরমান শেখ। আরিবা বুঝতে পারছে তাকে হাঁসাতে কথা গুলো বলা তবুও তার মুখে হাঁসি নেই।জীবণটা তার কেমন যেনো হয়ে গেলো। রুমে আসতে নেয় তার আগেই কেউ হেঁচকা টান দিয়ে ফাঁকা রুমে নিয়ে যায়। তাকিয়ে দেখে জারিফ করুন চোখে তার দিকে আগে থেকেই চেয়ে আছে।আরিবা নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করে।এতে করে জারিফ আর‌ও শক্ত করে ধরে করুন কন্ঠে বলে,

‘তুমি এখানে ভালো নেই আরিবা। আমি সব বুঝতে পারছি তুমি ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই বিয়ে করেছো তাই না? তুমি ডিভোর্স দিয়ে আমার কাছে চলে আসো। আমি তোমাকে অনেক সুখে রাখবো।আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি আরবি।’

দরজার সামনে ফুলদানি পড়ার শব্দে আরিবা ও জারিফ উভয়‌ই চমকে যায়। পেছনে তাকিয়ে দেখতে পারে……

।চলবে।

গোধূলী রাঙা দিগন্ত পর্ব-০৭

0

#গোধূলী_রাঙা_দিগন্ত
#পর্বঃ৭
#লেখিকাঃফারিহা_খান_নোরা

সময় বহমান!এ বাড়িতে আসার দুই দিন হয়ে গেলো অথচ ও বাড়ি থেকে এখন পর্যন্ত কেউ আরিবাকে নিতে আসেনি। প্রণয় আরিবাকে নিয়ে এসেছিলো কথা ছিলো তাঁরা দুইজন তিন দিন থেকে একসাথে চলে যাবে কিন্তু কপাল! কথায় আছে না জোর করে কোনো সম্পর্ক জোড়া লাগে না। প্রণয় সেই রাতেই চলে যায় রাত বারোটায় খবর আসে নাজমা শেখ নাকি প্রণয় প্রণয় করে কেঁদে কুটে সারাবাড়ি মাথায় তুলছে।প্রণয় না যাওয়া অবধি পানি পর্যন্ত স্পর্শ করবেন না। এসব শুনে মা ভক্ত প্রণয় সাত দিনের বিয়ে করা ব‌উকে ফেলে সেই রাতে চলে যায় মায়ের কাছে তারপর থেকে ও বাড়ির সাথে আরিবার কোনো যোগাযোগ নেই।

ও বাড়ি থেকে আসার তৃতীয় দিন সকাল দশটায় আরিবার ঘুম ভাঙে। এ বাড়িতে এসে একের পর এক অবাক হচ্ছে আরিবা আগে যে মা কথায় কথায় বকতো সেই তিনি কিনা আরিবাকে কিছুই বলে না। এতো বেলা করে ঘুম থেকে উঠেছে অথচ তার মা কিছুই বলল না ,আগে হলে এতোক্ষণ কতো বকা খেতে হতো। অথচ এখন সামনে চা নাস্তা দিয়ে রেখেছে। খেতে খেতে ফোনে কল আসে।ফোন তুলে দেখে প্রেমা কল করেছে।

‘হ্যালো’

‘কি ব্যাপার ভাবি ও বাড়িতে যেয়ে আমাদের ভুলেই গেছো।’

‘না সেরকম কিছু না। তা তোমরা কেমন আছো?’

‘আলহামদুলিল্লাহ্। কিন্তু তুমি চলে যাওয়ার পর থেকে আর ভালো লাগছে না।এই এক সপ্তাহ‌ই কি মায়ায় ফেলেছ তুমি আমাকে।না জানি ভাইয়াকে কি করেছ?’

ওমনি ওপাশ থেকে পুরুষালী কাশির শব্দ পাওয়া যায়।আরিবা সচেতন কন্ঠে বলে,

‘পাশে তোমার ভাইয়া আছে নাকি?’

প্রেমা দাঁত বের করে প্রণয়ের দিকে তাকায়। প্রণয় রক্তচুক্ষ বের করে।প্রেমা বলে,

‘হ্যা শুরু থেকেই।’

আরোও কিছু বলতে যাবে তার আগেই প্রণয় ফোনটা প্রেমার থেকে নিয়ে কল কেটে দেয়।প্রেমা বুজতে পেরে দৌড় দেয়।

_____________________________

স্বন্ধ্যায় চায়ের আড্ডায় হাসান সাহেব ও রেবা বসে আছেন।আজ একটু তাড়াতাড়িই এসেছে।রেবা বেগম স্বামীকে চা দেয়।মেয়ে এসেছে বলে হাসান সাহেব বেজায় খুশি।

‘তোমাকে আজ খুশি খুশি লাগছে আরশির বাবা?’

‘মেয়েটা আমার কাছে থাকলে খুশি লাগে।এই যেমন এখন, কথা না হয় নাই বলল কাছে তো আছে। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়।’

‘মেয়ে বিয়ে দিয়েছ কাছে রাখার জন্য? প্রণয় সেদিন রাতেই আরিবাকে রেখে গেছে।তিন দিন হলো কোনো খোঁজ খবর নাই।প্রণয়ের সাথে আরিবার সম্পর্ক স্বাভাবিক না। ভুলে যেও না আরশির বাবা মেয়ে যখন বিয়ে দিয়েছ তখন পরের বাড়িতেই থাকতে হবে ওটাই তার আসল বাড়ি।’

রেবা বেগমের চিন্তিত কন্ঠস্বরে বলা কথায় হাসান সাহেবের হাসিখুশি মুখটা মলিন হয়ে গেল।রেবার কথা শুনে খারাপ লাগলেও রেবা কিন্তু ভুল কিছু বলে নি।

আরিবা দরজার আড়াল থেকে সব শুনে ফেলে।তার মনটা আরও খারাপ হয়ে যায়।বিয়ের পর মেয়েদের নিজের বলতে বুঝি কিছু থাকে না।চেনা পরিচিত পরিবার এক সময় যা নিজের বলে দাবি করতো সেই বাবার বাড়িও পর হয়ে গেলো? এই যেমন তার কাছে লাগছে।

__________________________

প্রণয় ড্রয়িং রুমে বসে আছে।সামনে তার মা ভাত নিয়ে ছোট বাচ্চাদের মত ঘ্যান ঘ্যান করছে।প্রণয় পড়ছে মহা ফ্যাসাদে,এই মাকে সে চিনে না।তার মা তিন দিন যাবৎ এমন বাচ্চামো করছে সে বিশ্বাস‌ই করতে পারছে না।এই তিন দিন হলো প্রণয়কে তিনি ওয়াসরুম ব্যাতিত কোথাও যেতে দেন নি।এমনকি রাতে শোবার সময় ও বার বার এসে দেখে যায়।কি যন্ত্রনা! এদিকে আরিবাকে এই বাড়িতে নিয়ে আসার কথা উঠতেই ঘ্যান ঘ্যান শুরু হয়ে যায়।

আরমান শেখ স্ত্রীর এমন অভিনয় দেখে অতিষ্ঠ।সারাটা জীবন এমন অভিনয়ে সে অভ্যস্ত কিন্তু প্রেমের বিয়ে তাই তেমন কিছু করতেও পারেন। আরিবাকে ও বাড়ি থেকে নিয়ে আসতে হবে।না জানি ওনারা কি ভাবছে ।মান সম্মানের প্রশ্ন। না পেরে সিদ্ধান্ত নেয় তিনি নিজেই আরিবাকে নিয়ে আসবেন। নাসিমা যে,প্রণয়কে যেতে দিবে না সে নিশ্চিত।

__________________________

বিকাল বেলায় আরমান শেখ এ বাড়িতে আসলেন। হাসান সাহেবের সাথে ফোনেই কথা হয়েছিল তার।সে অনুযায়ী রেবা বেগম দুপুর থেকে বড় মেয়েকে নিয়ে রান্নার আয়োজন করেছেন।তার মন‌ও খুব একটা ভালো নেই মাথার ভিতর একটাই প্রশ্ন প্রণয় কেন এলো না। নতুন জামাই এভাবে মেয়েকে জামাই ছাড়া যেতে হবে এটা মানতে পারছে না।

সবুজ রঙের জামদানি শাড়ি পড়ছে আরিবা।লম্বা চুল গুলো ছেড়ে দেওয়া। মুখে হালকা মেকাপ,চোখে গাড় কাজল আর ঠোঁটে ডার্ক রেড লিপস্টিক।হাতে কানে গলায় ছোট ব্যাবহারের অলংকার যা শশুড়বাড়ি থেকে পাওয়া। বসে থেকে জীবণের ছক কষছে সে।সব মেয়েদের‌ই নিতে আসে বর আর তাকে নিয়ে যেতে এসেছে তাঁর শশুড় অদ্ভুত না?

‘স্যার প্রণয় বাবা এলো না কেন?’

হাসানের প্রশ্নের উত্তর সাথে করেই নিয়ে এসেছে আরমান শেখ।তিনি হাসি মুখে বললেন,

‘ও কাজে আটকে পড়েছে।আর কি স্যার স্যার বলছো তখন থেকে শুনি? এখন আমাদের একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আমারা এখন বেয়াই তাই স্যার স্যার বলা বন্ধ করো।’

হাসান সাহেব মুগ্ধ হলেন এমন ব্যাবহারে।আরিবা আসতে আসতে কথা গুলো শুনতে পায় সে জানে তার শশুড় মোটেও সত্য কথা বলছে না।কারণ প্রেমা তাকে ও বাড়ির কাহিনী বলেছে। প্রণয় কাছে আটকে পড়েনি বরং মায়ের পিছু পিছু মুরগীর বাচ্চার মত চ্যাও চ্যাও করছে।আরিবাকে দেখে আরমান শেখ হেঁসে বললেন,

‘এইতো আমার মা এসেছে।বাবার কাছে এসে বসো মা।’

আরিবা সালাম দিয়ে বসে পড়ে।মুখের সামনে তাঁর বাবার হাসি মুখের দিকে চোখ যায়। আরিবার ভিতর থেকে অস্থির হয়ে পড়ে।আসার পর থেকে বাবার সাথে সে কোনো কথাই বলেনি।মায়ের সাথে টুকটাক বলেছে।তবে বাবাকে পুরোপুরি ইগনোর করেছে।আজ সে শশুড়বাড়ি যাবে এ বাড়ির সবাইকে সে খুব মিস করবে।বাবা মাকে দেখে মনে হচ্ছে এখনি তাদের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে মনের তার অশান্তি দূর করুক কিন্তু না,এ অশান্তিতে তার বাবাই তাকে ফেলেছে।

রেবা বেগম ও আরশি রাতের খাবার পরিবেশন করছে। আরমান শেখ ও হাসান সাহবের মাঝের চেয়ারে বসেছে আরিবা মূলত আরমান শেখ নিজেই বসিয়েছে।রাতে খাবার পর্ব শেষে এখন ও বাড়িতে ফেরার পালা। হাসান সাহেব অসহায় ভাবে আরিবার দিকে তাকায়,আরিবা আর সহ্য করতে না পেরে বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কান্না শুরু করে দেয়।হাসান সাহেব আরিবার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

‘বাবা তোমার জন্য ভুল সিদ্ধান্ত নেয় নি মা আজ না বুঝলেও একদিন ঠিক বুজবে।’

আরিবা বাবার বুক থেকে মাথা তুলে বলে,

‘সে একদিন জেনো আমার জীবণে কখনো না আসে আর দোয়া করো এ বাড়িতে জেনো আর না আসতে হয়।’

মেয়ের এমন কথায় হাসান সাহেবের বুক হাহাকার করে উঠে।রেবা ও আরশি কান্না শুরু করে দেয়। আরমান শেখ আরিবাকে সময় দেওয়ার জন্য আগেই বিদায় নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসেছে।আরিবা এতো গুলো অসহায় চোখে দৃষ্টি পিছনে ফেলে চলে যায় নতুন গন্তব্যে।

__________________________

শেখ বাড়িতে কেউ জানে না আরমান শেখ আরিবাকে নিতে গেছে।আগে থেকে জানলে হয়তো নাসিমা শেখ নতুন ফন্দি আটতো সেজন্য কাউকে না বলেই চলে গেছে।
তখন রাত বাজে এগারোটা, ডিনার শেষে যে যার মতো রুমে অবস্থান করছে। প্রথম বারের মতো দ্বিতীয় বারও আরিবা শশুড়ের হাত ধরে শেখ বাড়িতে উপস্থিত হয়।বাড়ির পরিবেশ নিস্তব্ধ দেখে আরমান শেখ বললেন,

‘যাও মা ঘরে যাও!প্রণয় রুমেই আছে। প্রণয়কে নিয়ে তোমার মনে কি ধারণা জন্মাছে আমি বলতে পারবো না।তবে প্রণয় সত্য‌ই ভালো মনের ছেলে তবে অতিরিক্ত মা ভক্ত।এই অতিরিক্ত ভক্তিটাই তোমার শাশুড়ি অন্যায় কাজে লাগায়।এখন তুমি এসেছ,আমার ছেলের চোখে ঠিক ভুল ধরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব তোমার।শশুড় হয়ে বলছি না,বলছি তোমার বাবা হয়ে।’

আরিবা এতো কিছুর পরেও মনে মনে খুশি হয়।কথায় আছে না?

‘ জামাই আমার যেমন তেমন শাশুড়ি আমার মনের মত’

আরিবার ক্ষেত্রে হলো ঠিক উল্টো টা,

‘জামাই আমার যেমন তেমন শশুড় আমার মনের মতো ‘

কিন্তু কথা হলো তার বেলার সূত্র মিললো না কেন!

‘কেন কেন কেন?’

এতো গুলো কেনোর উত্তর এখন তাকে কে দিবে!

।চলবে।

গোধূলি রাঙা দিগন্ত পর্ব-০৬

0

#গোধূলি_রাঙা_দিগন্ত
#পর্বঃ৬
#লেখিকাঃফারিহা_খান_নোরা
ভীড়ের মাঝে অপ্রত্যাশিত ভাবে শরীরে পুরুষালী হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠে আরিবা। দু চোখের কোঠর দিয়ে পানি উপচে পড়ার মত অবস্থা।ঘৃ’ণা ও রা’গে তার শরীর রি রি করছে। প্রণয়ের গুরুত্বপূর্ণ কল আসায় সে রিসিভ করতে একটু ফাঁকা জায়গা যায়।প্রেমাকে বলে আরিবাকে নিয়ে তাঁর পরিচিতি শপে যেতে। হঠাৎ করে প্রেমা কিছু না বলেই ভীড়ের মধ্যে উধাও হয়ে যায়। ততক্ষণে আরিবা ভীড়ের মাঝে অপ্রিতিকর পরিস্থিতিতে পড়ে। আরিবা জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। তার এই বাজে পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করে স্বয়ং প্রণয় শেখ নিজেই।কিছু না বলেই হঠাৎ করে আরিবার বাহু ধরে হেঁচকা টান দিয়ে নিজের বুকের একপাশে চেপে ধরে ভীড় ঠেলে চলতে থাকে।

আরিবা প্রণয়ের এতো কাছে এসে কেঁপে উঠে।কখনো কোনো পুরুষের এতো কাছে সে কোনো দিন আসে নি।প্রণয়ের বুক পর্যন্ত তার মাথা ঠেকেছে।প্রণয়ের বুকের বাম পাশের ধুকপুক শব্দ তার কানে এসে বাড়ি খায়।মনের ভিতর অদ্ভুত ভালো লাগা দোল খায় সাথে নিজের বুকের বা পাশের হৃৎপিণ্ড নামক যন্ত্রটি ক্রমান্বয়ে ধুকপুক ধুকপুক তরঙ্গ সৃষ্টি করতে থাকে।গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠে প্রণয় বলে উঠে,

‘বড় বড় কবিরা বলে গেছেন সুন্দরী মেয়েরা বোকা হয়।আজ নিজের চোখে দেখলাম।’

______________________________

প্রণয় ও আরিবা শপে এসে দেখে প্রেমা নেই।প্রেমার ফোনে কল করে অসংখ্য বার তবুও পায় না।আরিবা ভেতরে রাখা সোফায় বসে প্রণয়ের করা সব অদ্ভুত আচরণ সম্পর্কে ভাবছে।প্রণয় পায়চারি করছে প্রেমার উপর খুব রা’গ লাগছে তার, এভাবে না বলে কোথায় চলে গেলো মেয়েটা? তার উপর টেনশন ও হচ্ছে প্রচুর কারণ এখন সময়টা খুব খারাপ।আধ ঘণ্টা হয়ে গেলো অধৈর্য হয়ে প্রণয় যখন প্রেমাকে খুঁজতে বের হবার ডিসিশন নিলো ঠিক তখনি হন্তদন্ত হয়ে প্রেমা ঢুকে পড়ে।প্রণয়কে দেখে চমকে উঠে।এতোটা লেট হবে সে বুঝতেই পারে নি।

প্রণয় প্রেমাকে এভাবে ঢুকতে দেখে রে’গে যায়। দাঁতে দাঁত পিষে প্রেমার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে,

‘কোথায় গিয়েছিলি?’

আমতা আমতা করে প্রেমা উত্তর দেয়,

‘কেন এখানেই তো ছিলাম।’

‘এখানেই ছিলাম মানেটা কি? তোকে আমি এই শপটাতে আসতে বলেছি।আমরা আধঘন্টা হলো এখানে এসেছি তুই তো এখানে ছিলি না।’

ধরা পড়ে প্রেমার মুখ চুপসে যায় সে ভয়ে ঢোক গিলে।কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে বড় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ভড়কে যায়।নিজেকে সামলিয়ে অপরাধীর সুরে বলে,

‘আসলে ভাইয়া আমি ভুলে এই শপে না এসে কসমেটিক সাইটে যাই।ভেবেছি তুমি ওখানেই যেতে বলেছ।সরি ভাইয়া আমার জন্য তোমাদের এতো অপেক্ষা করতে হলো।’

প্রণয় কিছুটা দমে গেল। তাচ্ছিল্য পূর্ণ কন্ঠে বলল,

‘থাক আর সরি বলতে হবে না।এক বলদ ভুলে উপরে যায় আরেক বলদ ভুলে নিচে থেকে যায়।’

শেষের কথাটা প্রণয় আস্তে ধীরে বলল।আরিবা কিছু না বুঝে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।প্রণয়ের মাইন্ড চেঞ্জ দেখে আরিবা জেনো হাফ ছেড়ে বাঁচে।

প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে তাঁরা লেহেঙ্গা দেখেই যাচ্ছে কিন্তু নেওয়ার নাম নেই।কখনো বলে এটা ভালো কখনো বলে ওটা ভালো নিজেরাই নিজেদের মনকে স্থির করতে পারছে না যে,এটাই ভালো এটা নিবো।হায়রে মেয়ে জাতি!

প্রণয় বিরক্ত! তার এখন মনে হচ্ছে এই কাপড় গুলোর মত পুরুষরাও যদি রঙ চঙ মানে লাল নীল বেগুনী হতো তাহলে মেয়েরা সঠিক বয়সে পাত্র‌ই নির্ধারণ করতে পারত না।কখনো বলতো আমার লাল চাই কখনো বলতো না লাল নয় বেগুনী।এই যেমন তার বোন আর ব‌উ ড্রেসের বেলায় করছে। যাক আল্লাহ্ বাচাইছে এটা হয় নি যে,শুকরিয়া!

অবশেষে প্রণয় ড্রেস দেখতে বসলেন। হালকা গোলাপি রঙের গোল্ডেন স্টোন ও সুতার কারুকাজ খচিত লেহেঙ্গা নিলো। সাথে লাল রঙের বেনারসি শাড়ি কারণ আরিবা বিয়েতে বেনারসী পড়তে পারে নি,তিনটা জামদানি শাড়ি নিয়ে দেয়।কিছু ড্রেস ও নিয়ে দেওয়া হয়। আধঘন্টার মধ্যে সব কিছু সম্পূর্ণ করে বেরিয়ে পড়ে রেস্টুরেন্টে এর উদ্দেশ্যে ।

________________________________

দেখতে দেখতে আরিবার এই বাড়িতে আসার ছয়দিন চলে গেছে আজ সাত দিন পড়ল।বিয়েটা যেহেতু অনাকাঙ্ক্ষিত আত্মীয় স্বজনরা কেউ বাড়িতে ছিলো না।তবে আজ সবাই বাড়িতে এসেছে।আসবে নাই বা কেন?আজ আরমান শেখের বড় পুত্রের রিসেপশন বলে কথা।বিয়েটা যেমনি সাদামাটা ভাবে হয়েছে রিসেপশন পার্টি ঠিক তেমনি জাঁকজমকপূর্ণ।প্রণয়ের সব বন্ধু বান্ধব ও তাদের বিজনেস পার্টনার আমন্ত্রিত এই অনুষ্ঠানে তবে আরিবা তার বন্ধু মহলকে জানায় নি। এই কয়দিনে নাসিমা শেখ তাকে ছোট বড় ব্যাপারে খোঁচা দিতে ভুলে নি। প্রথম প্রথম আরিবার খারাপ লাগলেও এখন আর এসব কানে তুলে না।কারণ সে জানে এখন এসব তার ভবিষ্যৎ,যা তার বাবা নিজের হাতে সূচনা করেছে।বাবার কথা মনে পড়তেই আরিবার মুখটা মলিন হয়ে গেলো।এতোদিনে বাড়ির কারো সাথে যোগাযোগ করে নি সে?কেন করবে তাঁরা আরিবার প্রতি অন্যায় করছে।এতো সব কিছু জেনোও তারা কিভাবে পারলো আরিবাকে প্রণয়ের সাথে বিয়ে দিতে।

‘ভাবি এদিকে তাকাও আর ভাইয়া তুমি ভাবির দিকে এগিয়ে এসো।কি দুজন দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছো।এমন ভাব করছো জেনো তোমরা স্বামী স্ত্রী না, বরং পাড়া প্রতিবেশী।’

প্রেমার কথায় আরিবার ধ্যান ভাঙ্গল।প্রণয়ের দিকে তাকালে দেখতে পায় প্রণয় শক্ত চোখে প্রেমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।বেচারি প্রেমা বুঝতে পেরে হেসে দেয়। ফটোগ্রাফার তাদের অসংখ্য ছবি ক্লিক করে।দেখতে দেখতে ও বাড়িতে যাওয়ার সময় হয়।যদিও আরিবা যেতে চায় না তবুও আরমান শেখের কথা ফেলতে পারে না। এতোক্ষণে আরিবা তার বাবা মা ও বোনের সাথে কোনো কথায় বলে নি।তারা চেষ্টা করছে তবুও ব্যার্থ। অবশেষে হাল ছেড়ে দেয় মেয়েটা তো বাড়িতে যাচ্ছে তখন না হয় সব ঠিক হবে।

_______________________________

রাস্তায় পুরোটা সময় আরিবা চুপচাপ বসে ছিলো।প্রণয় ড্রাইভিং সিটে তার পাশে আরিবা।পেছনের সিটে বাবা মা ও আরিবার বোন বসেছে।কেউ কারো সাথে কোনো কথা বলছে না।তবে মাঝে মাঝে প্রণয় ও হাসান সাহেব টুকটাক কথা বলছে। অবশেষে সাতদিন পর আরিবা নিজের বাড়িতে প্রবেশ করলো।নিজের বাড়ি বললে ভুল হবে এখন আর এটা নিজের বাড়ি নেই।আরিবা নিজের রুমে ঢুকেই বিছানায় শুয়ে পড়ে। চারিদিকে চোখ দিয়ে দেখে। আহ্ কতো আরাম কতোই না শান্তির জায়গা।এই সাত দিনে অই বাড়িতে এমন শান্তি পায় নি।তার অনুপস্থিতিতে ঘরটা ভালোভাবেই গুছিয়ে রেখেছে হয়তো মা নয়তো আপু।

আরশি রুমে ঢুকে আরিবার পাশে বসে মাথায় হাত দেয়। একমাত্র ছোট বোন তার। সে বাড়িতে থাকছে অথচ আরিবা এতো ছোট বয়সে শশুড়বাড়ি চলে গেল এটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে তার।

আরিবা শান্ত চোখে বড় বোনের দিকে তাকায়।আরিবার চোখে আজ তীব্র অভিমান দেখতে পারছে আরশি।সে দৃষ্টিতে আরশি কিছুক্ষণ ভড়কালো।তারপর কথা গুছিয়ে আরিবার উদ্দেশ্যে বলল,

‘কেমন আছিস? সব ঠিকঠাক আছে তো!’

আরিবা ধীর কন্ঠে আক্ষেপের সুরে বলল,

‘কেন সব ঠিকঠাক থাকার জন্য‌ই তো তোমরা বিয়ে দিয়েছো।’

আরশি আবারও ভড়কালো অসহায় ভাবে বলল,

‘এভাবে বলছিস কেন?’

‘কিভাবে বলব আশা করছো? প্রণয়ের জীবণে অন্যকেউ ছিলো সব জেনে বুঝে তোমরা আমার সাথে কিভাবে এমনটা করতে পারলে?’

আরশি আরিবাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

‘আমি সত্যই জানতাম না পাখি আব্বু যে এমন একটা স্টেপ নিবে।যখন জানলাম তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।আমি আর তোর দুলাভাই আব্বুর সাথে কথা বলেছি।আব্বুর সাথে তোর দুলাভাইয়ের কথা কাটাকাটি হয়েছে এমনকি আমারও।’

আরিবা তাচ্ছিল্য পূর্ণ কন্ঠে বলে ওঠে,

‘ওহ্ তাই নাকি? আমি জারিফ দুইজন দুইজনকে পছন্দ করতাম এটাও কি জানতে না তুমি?’

আরশি চুপ হয়ে গেল তার মুখ চুপসে যায়। কন্ঠনালী থেকে কোনো কথা বের হচ্ছে না।সে শুরু থেকেই জানতো আরিবা ও জারিফ দুজন দুজনকে পছন্দ করে।এতে আরশি ভীষণ খুশিও ছিলো।কারণ তার ছোট আর সে সারাজীবন তাহলে এক বাড়িতে থাকতে পারবে জা হয়ে অথচ কি থেকে কি হয়ে গেলো।

প্রণয় গাড়ি থেকে নেমে ও বাড়ি থেকে নিয়ে আসা গিফট গুলো শশুড় শাশুড়িকে বুঝিয়ে দেয়।হাসান ও রেবা ইতস্তত বোধ করে প্রণয়কে জানায়,

‘এসবের কি দরকার ছিল বাবা? এসব না নিয়ে আসলেই পারতে।’

প্রণয় একটু হেসে শান্ত কন্ঠে বলে,

‘তা কি করে হয় এসব আমার পক্ষ থেকে আপনাদের জন্য ছোট একটু ভালোবাসা।’

এই কথা শুনে হাসান ও রেবা মুগ্ধ হয়ে যায়।প্রণয়কে বিভিন্ন নাস্তা পানি দিলে সে শুধু লেবুর শরবত টুকু খেয়ে উঠে পড়ে।রেবা বেগম রেস্ট নেওয়ার জন্য আরিবার ঘর দেখিয়ে দেয়। প্রণয় আরিবার ঘরের সামনে এসে দুই বোনের কথপোকথন এর কিছু অংশ শুনতে পারে ভেতরে যাবে কিনা বুঝতে পারে না।তবে আরিবার বলা শেষের কথাটা শুনে প্রণয় স্তব্ধ হয়ে যায়।তার মনে একটা কথায় আসছে আরিবা জারিফকে পছন্দ করে।

‘কে এই জারিফ?’

।চলবে।

গোধূলি রাঙা দিগন্ত পর্ব-০৫

0

#গোধূলি_রাঙা_দিগন্ত
#পর্বঃ৫
#লেখিকাঃফারিহা_খান_নোরা
‘রাত্রি গভীর হলে বিরহে অন্তর কাঁদে!’

রাতের আকাশে ঝলমল করছে তারার মেলা। শুধু আরিবার জীবনটাই অন্ধকারে ঢেকে গেছে। না পারতে সব কিছু সহ্য করতে হচ্ছে।এই যেমন এখন ঘড়িতে বাজে রাত বারোটা এতোক্ষণেও প্রণয় বাড়িতে আসে নি যার জন্য প্রণয়ের মা কিছুক্ষণ আগেই তাকে বেশ কিছু কথা শুনিয়ে গেলেন।আরিবার জন্য‌ই নাকি তার ছেলে বাড়ি ছাড়া হচ্ছে।আরিবার ভেতর থেকে শুধু দীর্ঘশ্বাস‌ই বেরিয়ে আসে।যেখানে নিজের বাবার কাছেই তার গুরুত্ব নেই সেখানে অনাকাঙ্ক্ষিত শশুড়বাড়ি। বিয়ের পর এই বাড়িতে আসার সময় ফোনটাও নিয়ে আসে নি । সবার প্রতি তার বড্ড অভিমান জমিয়ে আছে। তবে জারিফকে বার বার মনে পড়ছে তার । ছেলেটা না জানি তাকে দেখতে না পেরে কতো বার কল করেছে আল্লাহ্ ভালো জানেন। ফোনটা না নিয়েই বড্ড বড় ভুল করেছে। সে তো চায় নি জারিফকে ব্যাতিত অন্য কোনো ছেলের সাথে জীবন বাঁধতে ।

ভাবনার মাঝেই আরিবা রুমে প্রণয়ের উপস্থিতি টের পায়। টাইয়ের নট ঢিল করতে করতে রুমে ঢুকে প্রণয়। তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে কতোটা ক্লান্ত সে।প্রণয়ের আজ অফিসে একটু ঝামেলা হয়ছে যার জন্য আসতে লেট হলো। টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে।আরিবা নিচে যেয়ে প্রণয়ের জন্য প্রথমে ঠান্ডা পানি দিয়ে লেবুর সরবত করে তারপর খাবার গুলো গরম করে উপরে নিয়ে এসে সেন্ট্রার টেবিলে সাজিয়ে রেখে আবার বারান্দায় আসে।

প্রণয় ফ্রেশ হয়ে এসে তার প্রতি আরিবার কেয়ার দেখে মনে মনে খুশি হয়। যাক ব‌উ তার একটু হলেও যত্ন তো করছে। প্রফুল্ল চিত্তে সে সোফায় বসে পড়ে অতঃপর ডিনার শেষ করে ম্যাডমকে খুঁজতে বারান্দায় যায়।

_________________________

‘আকাশের দিকে তাকিয়ে কি খোঁজ ?’

প্রণয়ের কথায় আরিবা পিছন ফিরে তাকায়। প্রণয়ের দিকে এক পলক চেয়ে চোখ নামিয়ে নিয়ে আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলে,

‘খুঁজি না! সুখ বির্সজন দেই।’

প্রণয় ঠাট্টার সুরে বলল,

‘আকাশের দিকে তাকিয়ে আবার সুখ বির্সজন দেওয়া যায়?’

আরিবার মেজাজ এমনি খারাপ ছিলো প্রণয়ের হাসি ঠাট্টায় যেনো মেজাজটা আর‌ও খা’রা’প হয়ে গেল। রাগান্বিত কন্ঠে বলল,

‘কেন দেওয়া যায় না?আপনিও দেন আসেন।আপনাকে বিয়ের করে আমি যেমন সুখ বিসর্জন দিচ্ছি ঠিক তেমনি আপনি ও দেন তবে আমার জন্য না আপনার অই সো কলড রূপার জন্য। তার সাথে বিয়ে না হ‌ওয়ার জন্য।যার সাথে প্রতি নিয়ত আমায় তুলনা করা হচ্ছে।তবে একটা কথা মাথায় রাখবেন মিস্টার শেখ রূপা কিন্তু রূপাই হয় আর সোনা সোনাই হয় যতোই ভেঙে যাক না কেন রূপা কখনো স্বর্ণের জায়গা দখল করতে পারবে না।’

প্রণয় হতভম্ব হয়ে যায়।রূপার কথা উঠতেই রে’গে যায়।রাগে গজগজ করে বলে,

‘অনেক রাত হয়েছে এসব আজেবাজে চিন্তা না করে যাও ঘুমিয়ে পড় আর আমাকেও ঘুমাতে দাও।লাইট অফ না করলে ঘুম হয় না আমার।

উচিত কথা বললেই ঘুমিয়ে পড়ে। আজব পুরুষ মানুষ নিজের মনে কথা গুলো বির বির করে বলে আরিবা প্রস্থান করল।

_______________________________

দেখতে দেখতে মাঝের দুটো দিন কেটে গেল। ও বাড়ি থেকে কেউ আরিবার খোঁজ নেয় নি এমন কিন্তু না। হাসান সাহেব ও রেবা বেগম প্রায় সময়ই আরমান শেখকে কল দিয়ে মেয়ের খোঁজ নিতেন।আরমান শেখ তাদের সাথে কথা বলার জন্য আরিবার কাছে ফোন এনে দিলে কোনো না কোনো ভাবে আরিবা ব্যাস্ততা দেখিয়ে এড়িয়ে যেত।আর বরাবরেই মতো বলত,

‘আমি রুমে যেয়ে ব্যাক করে নিবো।’

আরমান শেখ সবটা বুঝতেন তবুও চুপ থাকতেন।আরিবাকেও সময় দেওয়া উচিত তার।মেয়েটা হঠাৎ করে ইচ্ছার বিরুদ্ধে এসে নতুন পরিবেশের সাথে যুক্ত হয়েছে। মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগবেই।আর এসবের জন্য‌ই আরিবার বাবা মার প্রতি অভিমান হয়েছে যা স্বাভাবিক।

আর চার দিন পর বাড়িতে রিসেপশনের পার্টি রাখা হলো।সব মিলিয়ে বিয়ের সাত দিন পর রাখা হয়েছে।কারণ এই বাড়ির আরেকটা ছেলে প্রণয়ের ছোট ভাই প্রিতম বাড়িতে নেই। বাড়ির ছেলেকে ছাড়া এত বড় অনুষ্ঠান তো আর করা যায় না । আয়োজন বেশ বড় পরিসরেই। আরমান শেখের ছেলের বিয়ের রিসেপশন পার্টি বলে কথা বড় না হলে হয়?

_____________________________

শেখ বাড়ির মেহমান বলতে তেমন কেউ নেই। প্রণয়ের ফুফুর বাড়ি ঢাকার বাহিরে বলে তিনি থেকে গেছেন।বিকাল বেলা অবসর সময় আরিবা ও প্রেমা ড্রয়িং রুমে বসে চা খাচ্ছে ও টিভি দেখছে ।বাড়ির সবাইকে ছাড়া আরিবার শেখ বাড়িতে আজ তৃতীয় দিন।মুখে স্বীকার না করলেও বাড়ির সবার জন্য মন পু’ড়’ছে তবে অভিমান মনকে ঠিক সামলিয়ে নিয়ে তর স্থান শক্ত পোক্ত করেছে। নাসিমা বেগম কিচেনে । কিছুক্ষণ পর আরমান শেখ ও যোগ দিলেন। আরমান শেখ চা পান শেষ করে কাপটা টেবিলের উপরে রেখে পরম স্নেহের সহিত আরিবার দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘আরিবা মা! মাঝখানে আর মাত্র দুই দিন বাকি। কেনা কাটার ও একটা ব্যাপার রয়েছে। স্বন্ধ্যার পর তুমি ও প্রেমা তৈরি থেকো আমি প্রণয়কে বলে রাখছি তোমাদের নিয়ে যাবে। নিজের পছন্দ মত শপিং করবে কারণ তোমাদের লাইফের একটি বিশেষ দিন আমি চাই আমার পুত্র ও পুত্রবধূ সেভাবেই নিজেদের উপস্থাপন করুক।’

কথার মাঝে হঠাৎ করে নাসিমা শেখ চলে এসে কাঠকাঠ কন্ঠে বললেন,

‘যতোই ভাল ভাবে উপস্থাপন করুক না কেন সেই তো কর্মচারীর মেয়েই থাকবে এর থেকে বেশি কিছু তো হবে না।’

আরমান শেখের প্রতিবাদী কন্ঠস্বর।বলল,

‘যেমন তুমি! এতো বছর ধরে পেলে পুষে সেই রুনা খানের মতোই থেকে গেলে কবরী আর হতে পারলে না। আর ভুলে যেও না তুমি কোথায় থেকে উঠে এসেছে। অন্যকে কথা বলার আগে নিজের অবস্থান কোথায় ছিলো সেটা ভেবে দেখবে।’

‘সুযোগ পেলেই খোঁচা দেয় যত্তোসব।’

কথাটি বলেই নাসিমা শেখ গজগজ করতে করতে প্রস্থান করলেন। এই মহিলার কথায় আরিবার শুরুতে ভীষণ ক’ষ্ট পেত এখন রা’গ লাগে।তার মন বলছে সংসার জীবন প্রণয়ের মা’ই হবে তাঁদের একমাত্র বাঁধা। তবে আরমান শেখের কথা তার বেশ ভালোই লাগে। ভীষণ ভালো মানুষ তার হয়ে নিজের স্ত্রীকেও কথা বলতে ছাড় দেয় না। আরমান শেখকে বলে আরিবা রুমে চলে আসে।

প্রেমা এতোক্ষণ চুপ ছিলো তবে ভাবির সাথে মায়ের ব্যাবহার তার মোটেও ভালো লাগে না।মেয়েটা বয়সে তার থেকেও ছোট।মা কিন্তু চাইলেই পারে ভাবিকে নিজের মেয়ের মত ট্রিট করতে।

________________________________

এখন স্বন্ধ্যা সাতটা বেঝে পনের মিনিট! আরিবা কালো রঙের একটা জামা পড়েছে।ফর্সা শরীরে কালো রঙটা জেনো একটু বেশিই ফুটে উঠেছে। কোমড়ে ছড়ানো চুল গুলো আঁচড়ে ছেড়ে দেওয়া।চোখে আইলাইনার ও ঠোটে নুড লিপস্টিক দিয়ে তৈরি হয়ে নিলো।এর মধ্যে প্রেমা রুমে ঢুকে পড়ে।পেছন থেকে আরিবাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

‘বাহ্ ভাবি! এতো সুন্দর লাগছে তোমাকে।যদিও তুমি সুন্দরী।আজ একটু বেশিই সুন্দর লাগছে। এ অবস্থায় আমার ভাই তোমাকে দেখলে ফিদা হয়ে যাবে দেখে নিও।’

বলেই প্রেমা হাসতে নিলো।আরিবার মুখটা চুপসে যায়।আরিবার ফ্যাকাসে মুখ দেখে প্রেমা আরিবার হাত ধরে বুঝানো সুরে বলে,

‘ভাবি আমি জানি ভাইয়া ও তোমার মধ্যে এখনো স্বাভাবিক আর পাঁচ দশটা স্বামী স্ত্রীর মত সম্পর্ক তৈরি হয় নি।নিজের ভাই বলে বলছি না, আমার ভাই অনেক ভালো তুমি স্বাভাবিক ভাবে তার সাথে মিশো কেয়ার নাও দেখবে সে তোমায় ছাড়া কিছু চোখে দেখছে না।এমনিতেও তুমি যা সুন্দর ওই শাকচুন্নীর ঘোর থেকে আমার ভাই অলরেডি বের হতে চেষ্টা করছে।’

‘বুদ্ধি তো ভালোই দিলে ননদিনী কিন্তু তোমার ভাই যদি সারাদিন তার চোখে দিয়ে শুধু আমায়’ই দেখে তোমার মা’র তাহলে কি অবস্থা হবে ভেবে দেখেছো?’

বলেই আরিবা বাঁকা চোখে তাকায় তাঁর কন্ঠে হাস্যরসাত্মক বিরাজ করছে।আরিবার এমন তাকানো দেখে প্রেমা হেসে দেয় সাথে আরিবাও।নিচে থেকে প্রণয়ের কথা শুনে তারা গার্ডেনে গাড়ির কাছে যায়।প্রেমা গাড়ির পেছনে উঠে বসে। আরিবা বসতে নিলে প্রণয় একটু জোরেই বলে,

‘আমায় দেখে কি তোদের ড্রাইভার মনে হয়ে । তোরা দুইজন‌ই পেছনে বসছিস! শপিং এ যেতে হলে একজনকে সামনে বসতে হবে নয়তো নেমে পড়।প্রেমা অসহায় চোখে আরিবার দিকে তাকায় কারণ প্রেমা আগেই উঠে বসেছে।আরিবা প্রেমার চোখের ভাষা বুজতে পেরে সামনে যেয়ে প্রণয়ের পাশে বসে সিট বেল্ট বেঁধে নেয়।একপলক প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে দেখে ফর্মাল ড্রেস পড়া অবস্থায় আছে কারণ সে অফিস থেকে এসে বাড়ির ভিতরে না প্রবেশ করেই তাদের নিয়ে যাচ্ছে।প্রণয়ের উজ্জ্বল শ্যামলা মুখটা গরমে লাল বর্ণ ধারণ করেছে এই এসির মধ্যেও।

গাড়ি চলতে শুরু করল। প্রণয় মিররে আরিবাকে পর্যবেক্ষণ করল। মনে হচ্ছে তার পাশে কোনো অপ্সরা বসে আছে।মেয়েটা এতো সুন্দর কেন?আগে সে ভালো করে খেয়াল করে নি। গাড়ি চালানোর মাঝেই আড় চোখে বার বার আরিবার দিকে তাকায়।মেয়েটা এতো সুন্দর যে,তার দিক থেকে চোখ ফিরাতে ইচ্ছে করছে না। দুধে আলতা শরীরের সাথে কালো রঙের ড্রেসটায় মেয়েটিকে স্নিগ্ধ ফুলের মতো লাগছে ঠিক জেনো কালো গোলাপ। সুন্দরী মুখশ্রীতে তাকালেই মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে।হালকা মেকআপ করেছে যার জন্য আরো সুন্দর লাগছে।আর কাজলে আবৃত টানা চোখ গুলো মাশাআল্লাহ! প্রণয় শেখ এক পলক আরিবার কাজল টানা চোখের দিকে তাকিয়ে বির বির করে একটু জোরেই বলল,

‘চোখ তো নয় মনে হচ্ছে আমার জন্য পাতা সর্বনাশের ফাঁদ। ‘

আরিবা ও প্রেমা দুইজন‌ই একসাথে বলে উঠে,

‘কি বললেন,কি বললি!!!’

।চলবে।