#গোধূলি_রাঙা_দিগন্ত
#পর্বঃ৪
#লেখিকাঃফারিহা_খান_নোরা
‘আমার সাথে রাত কাটানোর আগে মনে ছিলো না, সম্পর্কে আমি তোমার শা’লী? এতো দিন আনন্দ উল্লাস করে মনে হচ্ছে আমি তোমার শা’লী? বিয়ে করতে চাইছো না কেন? যখনই শুনেছ আমার গর্ভে তোমার সন্তান তখনি পাল্টি খাচ্ছো।পাল্টিবাজ কোথাকার লজ্জা থাকা উচিত।’
নাবিলের শার্টের ক’লা’র ধরে এক নাগারে কথা গুলো বলল রূপা। নাবিল রূপার থেকে ক’লা’র ছাড়িয়ে নিয়ে রূপার দুই বাহু ধরে জো’র করে সামনের চেয়ারে বসিয়ে দেয়।কারণ এত চিৎ’কা’রে’র ফলে রেস্টুরেন্টে এর মানুষজন এই দিকেই তাকিয়ে রয়েছে।নাবিল অফিসে ছিলো,অফিস থেকে রূপা জরুরি তলবে তাকে ডেকে নিয়ে এসেছে।নাবিল রূপার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলে রূপা ঢকঢক করে এক নিঃশ্বাসে খেয়ে নেয় । নাবিল হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে হাতে সময় বেশি নেই জাস্ট দুই ঘন্টার ছুটি নিয়ে এসেছে সে।নাবিল শান্ত ভঙ্গিতে রূপাকে বলল,
‘রা’ত শুধু আমি একাই কাটিয়েছি ? আর আনন্দ উল্লাসে কি শুধু আমি একাই মজে ছিলাম ? তোমার বোনের মৃ’ত্যু’র পর যখন আমি ভে’ঙে পড়েছিলাম একা ফ্লাট পেয়ে তুমি সহানুভূতি দেখার নাম করে যখন তখন রাত বিরাতে আসতে তাও বাড়িতে বলে আসতে খালার বাড়ি যাচ্ছো।আমি যদি বলি তুমি আমাকে তোমার দিকে আকৃষ্ট করছো? আমি একজন বিবাহিত পুরুষ যতোই আমি বউকে ভালোবাসি না কেন সবার একটা চাহিদা আছে তুমি যুবতী মেয়ে হয়ে একা একজন পুরুষ মানুষের কাছে কেন আসবে? আর বিয়ের কথায় যদি বলি ইসলামে প্রেগন্যান্ট অবস্থায় বিয়ে যায়েজ নেই। আমি ছয় মাসের জন্য অফিস থেকে বাহিরের দেশে যাবো আশা করি ছয় মাস পরে দেখা হবে।প্রতি মাসে তোমার একাউন্টে পর্যাপ্ত পরিমাণে টাকা পাঠাবো নিজের এবং বেবীর খেয়াল রেখো। ছয় মাস পর আমি এসে যা করার করব।আর যে বাচ্চাটার কথা বলছো? আদেও কী সেই বাচ্চাটা আমার নাকি শাকিলের?
শাকিলের কথা শুনে রূপা চ’ম’কে গেল।তার কপাল বেয়ে ঘাম দর দর করে ঝড়ছে ।নাবিল তা দেখে টিস্যু এগিয়ে দেয়।রূপাকে অনিশ্চিত জীবণে রেখে সে স্বপ্নের পথে উড়াল দেয়।
_____________________________
আরিবা নাস্তা করে একা রুমে বসেছিল এই বাড়িতে চেনা পরিচিত তেমন কেউ নেই।প্রণয় বিয়ের পরের দিনই বাবার কথা না শুনে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। আচ্ছা রূপা হলে কি এমন করতে পারতো ? দরজা খোলা ছিলো প্রেমা এসে আরিবার পাশে বসে অনুনয়ের সুরে বলল,
‘ভাবি একা বসে থেকে নিশ্চই বোর ফিল করছো।আসলে আমিও তোমাকে টাইম দিতে পারছি না।এমনি বিয়ের এতো ঝামেলা তারমধ্যে পনেরো দিন পর থেকে আমার পরীক্ষা ইয়ার চেঞ্জ সব মিলিয়ে ব্যাস্ত।’
‘না না ঠিক আছে সমস্যা নাই । তুমি কোনো ইয়ারে পড়?’
‘অর্নাস থার্ড ইয়ার।’
আরিবা বুঝতে পারে প্রেমা তার থেকে বড় দেখতে হলেও কলেজে পড়ে। আসলে প্রণয়ের মত প্রেমা লম্বা নয়, সে একটু খাটো তার মায়ের মত।প্রেমা মনে হয় আরিবার মনের কথা বুঝতে পারল।সে নিজ থেকে বলল,
‘তুমি বয়সে আমার থেকে ছোট কিন্তু সম্পর্কে বড় আমার প্রিয় বড় ভাইয়ের বউ।তোমাকে আমি ভাবিই ডাকবো।তুমি কিন্তু আমার নাম ধরে বলবে। আমি মায়ের মতো হয়েছি আমাকে দেখে অনেকে বুঝতে পারে না, আমি অর্নাস থার্ড ইয়ারে উঠেছি।অনেকে মনে করে আমি ইন্টারে পড়ি,যাইহোক তোমার কিন্তু আরেকটা দেবর আছে।সে এখন ট্যুরে গেছে আসলে অবশ্যই দেখবে।’
বলেই প্রেমা তাঁর ঝকঝকে দাঁত নিয়ে হাসতে শুরু করলো।আরিবা মেয়েটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে,প্রণয় এর মতো ফর্সা না হলেও শ্যামলা মুখশ্রীতে অদ্ভুত মায়া কাজ করছে মেয়েটির। ছিমছাম শরীরে লম্বাটে মুখশ্রী সব মিলিয়ে প্রেমাকে দেখতে বেশ লাগছে।এর মধ্যে নাসিমা শেখ ভিতরে এসে ঠেস দিয়ে দন্ত পিষিয়ে বললেন,
‘প্রেমা তোর ভাবিকে বলে দে শুয়ে বসে থেকে এই বাড়িতে ভাত খাওয়া যাবে না,নিজে রেঁধে খেতে হবে।শেখ বাড়ির নিয়ম অনুযায়ী বিয়ের পরেরদিন ছেলের বউ সবার জন্য রান্না করে।ঘরে শুয়ে না থেকে নিচে আসতে বল তাকে।’
বলেই চলে গেলেন।এই কথাটা ভালো করেও উনি বলতে পারতেন এভাবে বালার কি ছিল?এমন ভাব করছে আরিবা জেনো চিলের মত উড়ে এসে জুড়ে বসেছে তার ছেলের ঘাড়ে। প্রেমা দ্বিধাময় হাসি দিয়ে নরম সুরে বলল,
‘নিচে চলো ভাবি।’
আরিবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পা বাড়ায় গন্তব্য এখন শেখ বাড়ির রান্নাঘর।
রান্নাঘরে এসে দেখেন তাঁর শাশুড়ি দাঁড়িয়ে আছে সব কিছু আশেপাশে ছড়ানো।সব রান্না তাকেই নিজ হাতে করতে হবে কোনো সাহায্য ছাড়াই যার জন্য ময়নাকে পর্যন্ত কিচেনে রাখে নি।আরমান শেখ বারণ করলে, তখন নাসিমা শেখ হিসহিসিয়ে বলে দেয়,
‘তুমি পুরুষ মানুষ মেয়ে লোকের মধ্যে কথা বলবা না।’
আরমান শেখ অসহায় চোখে আরিবার দিকে তাকিয়ে উপর উঠে যায়।যেতে যেতে আক্ষেপের সুরে বলে,
‘বারণ করতে নাকি আবার মেয়ে লোক হতে হয় আজব!’
আরিবা বুঝতে পারে,শাশুড়ি সবাইকে তার কথায় উঠায় আবার তার কথায় বসায়।মহিলার বুদ্ধি আছে ভাবা যায়।বেশ জাঁদরেল মহিলা!
আরিবা রান্নার আয়োজন শুরু করে দেয়। কমছে কম দশ জনের রান্না করতে হবে তাঁকে।বাড়িতে তেমন রান্না করে নি তবে একে বারেই যে পারে না তা কিন্তু নায়।সাহস করে কাজে লেগে পড়ে। তিনঘন্টা লাগিয়ে রান্না শেষ করে উপরে উঠে আসে ফ্রেশ হতে। শাওয়ার নিয়ে সবুজ রঙের একটি জামদানি শাড়ি পড়ে বেরিয়ে এসে দেখে প্রণয় এসে পড়েছে।তবে তার দিকে খেয়াল করে নি।আরিবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেজা চুল আঁচড়ে মাথায় কাপড় দিয়ে নিচে নেমে যায়।কারণ সবকিছু টেবিলে রেখে খাবার পরিবেশন করতে হবে।
_______________________________
খাবারের মৌ মৌ গন্ধ ডাইনিং এ ছড়িয়ে পড়েছে। আরমান শেখ নিচে নেমে এসে তার চেয়ার টেনে বসে পড়ে।খাবারের সুগন্ধে তার মন ভরিয়ে যায়।তিনি উৎসাহ নিয়ে বললেন,
‘সাব্বাস! মা তুমি তো ফাটিয়ে দিয়েছ গন্ধ শুঁকেই আমার অর্ধেক পেট ভরে গেছে বাকি অর্ধেক খেলে ভরবে।’
শশুড়ের বলার ভঙ্গিমা দেখে আরিবা ফিক করে হেঁসে দেয়।এই হাসিটাই জেনো নাসিমার সহ্য হলো না।সে ড্রয়িংরুমে বসেছিলো ছো’ট’লো’কের মেয়ে সম্পর্কে স্বামীর প্রশংসা শুনে তিনি এগিয়ে যেয়ে ঠা’স করে বলে দেন,
‘গন্ধ তো ভালো বের হচ্ছে এখন খেলেই বুঝা যাবে কেমন রান্না? পেট ভরবে নাকি সব বেড়িয়ে আসবে। গন্ধ শুঁকে যেমন খাবারে টেস্ট বুঝা যায় না ঠিক তেমনি চেহারা দেখে মানুষ চেনা যায় না।’
শেষের কথাটা কটমট চোখে আরিবাকে উদ্দেশ্য করে বলল নাসিমা বেগম।সেই কথার তালেই আরমান শেখ হাসির ছলেই জবাব দিলেন,
‘ঠিক যেমন,রূপা।’
আরিবার হাসি পাচ্ছে তাকে নিয়ে শশুড় শাশুড়ির এমন করায়। একজন কথার ছলে খোচা দিতে ছাড়ে না।আপরজন তার হয়ে প্রতিবাদ করতে ছাড় দেয় না। নাসিমা শেখ স্বামীর দেওয়া খোঁচা ঠিক বুঝলেন কিছু বলতে যাবে তার আগে লক্ষ করে প্রণয়ের উপস্থিতি।সদ্য শাওয়ার নিয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে সে নামছে।
আস্তে ধীরে টেবিলে সবাই বসে পড়ে।আরিবা চুপচাপ খাবার পরিবেশন করতে লেগে পড়ে। প্রণয় খাবার টেবিলে ম্যানু হিসাবে দেখতে পেল,
সাদা ভাত, ঘন ডাল, আলু ভর্তা,গরুর কষা মাংস, চিংড়ি মাছের মালাইকারি, ইলিশ মাছ ভাজা,টমেটোর চাটনি ও শেষ পাতে ঘন দুধের পায়েশ যা প্রণয়ের ভীষণ পছন্দের। সবাই খাবারে প্রশংসা করে।নাসিমা শেখ এখনো কাউকে বলে নি আজকে খাবার আরিবা রান্না করেছে শধু আরমান শেখ জানেন।।প্রণয় খাবারের প্রশংসা করলে নাসিমা হাসি মুখে চুপ থাকে।পায়েশ মুখে দিয়ে প্রণয় চোখ বন্ধ করে বলে,
‘আহ্ মা! পায়েশ নয় জেনো অমৃত এমন পায়েশই আমি খেতে চাইতাম।কি রান্না করছো তুমি আজকে? সব খাবার ই সুস্বাধু।’
আরমান শেখ নিরব থেকে তাচ্ছিল্য করে বললেন,
‘আজকের খাবার তোর মা রান্না করে নি।’
প্রণয় খেতে খেতে প্রফুল্ল সুরে বলল,
‘ওহ্ সমস্যা নেই। যে রান্না করেছে তার হাতে চুমু দেওয়া উচিত।’
কথাটি শুনেই আরিবার শুকনো কাশি উঠে যায়।সে কাশতে থাকে,আরমান শেখ ও আমেনা মুখ টিপে হাসে।আর নাসিমা রা’গে গুজরে উঠে এতো কাল ধরে সে হাত পু’ড়ি’য়ে রান্না করে এতো বড় করল আর দুই দিনের বউয়ের রান্না একবার খেয়ে হাতে চুমু দিতে চায়? তার হাত পু’ড়’লেও তো কেউ দেখতে আসতো না। না! ছেলে তার বদলে যাচ্ছে। কিছু তো করতেই হবে।
প্রেমা হাসতে হাসতে মজা করে বলল,
‘ভাইয়া চুমু খাবি? ভাবির হাতে খা কারণ আজকের রান্না সব ভাবিই করেছে।’
প্রেমার কথা শুনার সাথে সাথেই প্রণয়ের বিষম উঠে গেল।আরিবা তড়িঘড়ি করে পানির গ্লাস এগিয়ে দেয় প্রণয়ের দিকে। লজ্জায় আরিবা চোখ তুলে তাকাতে পারছে না।
#গোধূলী_রাঙা_দিগন্ত
#পর্বঃ৩
#ফারিহা_খান_নোরা
রহস্যময় পৃথিবীতে মানুষের জীবনটা বৈচিত্র্যময়! তা না হলে আরিবা প্রণয়ের লাইফে অপশনাল হয়ে আসতো না।রুমে প্রবেশ করা মাত্রই আরিবা বিভিন্ন ধরণের ফুল দিয়ে রুম ও বেড সাজানো দেখতে পায়। তবে সাদা বেডশীটের উপরে লাল গোলাপের পাপড়ি দিয়ে প্রণয় প্লাস রূপা দেওয়া আর রুমের দেওয়ালে প্রণয়ের বাহু জড়িয়ে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে অন্য একটি মেয়ের ছবি দেখে অবাক হয় আরিবা। প্রণয়ের মায়ের বলা একটা কথায় বার বার আরিবার কানে বাজতে থাকে,
‘এই মেয়েটা প্রণয়ের বউ হলে আমার রূপা কোথায়?’
কে এই রূপা যার নাম তার সদ্য বিবাহিত স্বামীর বাসরঘরের বেডশীটে পর্যন্ত আছে।আর দেওয়ালে টাঙানো ছবিটার মেয়েটিই বা কে?আরিবার চোখে অবাক ও আগ্রহ বিরাজমান।প্রণয় নিমিষেই বুজতে পারে সেজন্য বিয়ে ভাঙা থেকে শুরু করে তার কারণ অবধি, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আরিবাকে বলে প্রণয়।আরিবা সব কিছু শুনে একটা বড়সড় শকে চলে যায়।শেষ পর্যন্ত বাবাও কি না তাকে এভাবে ঠকালেন।আরিবাকে বিচলিত হতে দেখে প্রণয় অত্যন্ত শান্ত কন্ঠে বলল,
‘তুমি আমার অনেক ছোট সেজন্য তুমি করেই বললাম রূপাকে আমি পছন্দ করতাম যা বিয়ে অবধি গড়ায়নি তবে এখন তুমি আমার বিবাহিতা স্ত্রী বিয়েটা যেভাবেই হোক না কেন আমি অস্বীকার করতে পারবো না।তবে আমার সময় লাগবে সব কিছু স্বাভাবিক করতে আশা করি তুমি সেই সময়টুকু আমায় দিবে।’
আরিবা মনে মনে বলে,
‘এ পছন্দ করে একজনকে বিয়ে করলো আরেকজনকে!এই ব্যাটা দেবদাস হয়েও কি সুন্দর ডায়ালগ দিয়ে গেল।ব্যাটা তুই কি একাই দেবদাস?তোদের বাপ ছেলে শশুড়ের গেরাকলে পড়ে মাঝখান থেকে আমার জারিফটা আজ থেকে দেবদাসের খাতায় নাম দিবে।যদিও সে এখনো জানে না তবে জানতে কতোক্ষণ?’
এসব ভাবনার মাঝে উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের মায়াবী মুখশ্রীর একটি মেয়ে হন্তদন্ত হয়ে লাগেজ নিয়ে রুমে প্রবেশ করে আরিবার হাত ধরে উচ্ছসিত হয়ে বলে,
‘তুমিই আমার ভাবি?আমি তোমার একমাত্র ননদিনী প্রেমা।এই নাও লাগেজে তোমার ড্রেস রাখা আছে তুমি যেকোনো একটা ড্রেস নিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো আমি গেলাম আজ তুমি বেশ টার্য়াড ইনশাআল্লাহ! কাল জমিয়ে আড্ডা দিবো।আর হ্যা ময়না রুমে তোমাদের রাতের খাবার দিয়ে যাবে খেয়ে নিও গুড নাইট ভাবি।’
বলেই প্রেমা নামের মেয়েটা যেমন ঝড়ের গতিতে এসেছে তেমনি ঝড়ের গতিতে চলে গেল।আরিবা কিছু বলার সুযোগ অবধি পেলো না ।হাতে দেওয়া লাগেজ টা ওপেন করে দেখতে পায়,ভিতরে তিনটি সুতি শাড়ি ও ছয়টির মত জামদানী ও কাতান শাড়ি রয়েছে সাথে বেশ কিছু খ্রীপিচ ও রয়েছে যা এখনো বানানো হয় নি।বেশ কিছু কসমেটিক আয়টেম আছে।আর একটা বক্সে দেখতে পেলে সিম্পেল এক লহরের শীতাহার, একজোড়া ইয়ার রিং ও বেশ বড় সাইজের একটি আংটি। আরিবার তখনি মনে হলো এগুলো রূপার জন্য কেনা শাড়ি।নিজেকে ভীষণ তুচ্ছ মনে হচ্ছে। তার করার কিছুই নাই সে রাগের বশে বাড়ি থেকে একটা কিছুও নিয়ে আসে নি। দীর্ঘশ্বাস দিয়ে গোলাপী রঙের কারুকাজ করা সুতির একটি শাড়ি নিয়ে ওয়াসরুমে চলে যায়।
প্রণয় এতোক্ষণ বারান্দায় ছিলো ময়না খাবার দিতে আসলে ময়নাকে দিয়ে প্রণয় রুম ও বেডের ফুল গুলো পরিষ্কার করে আর রুমের ছবিটাও স্টোর রুমে পাঠিয়ে দেয়। এর মাঝে আরিবা শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে আসলে দুজনই ডিনার করে নেয়।আরিবা ভীষণ ক্ষুধার্ত ছিলো চুপচাপ খেয়ে নিয়েছে।ঘড়িতে এখন রাত একটা বেজে চল্লিশ মিনিট।প্রণয় বেডে এসে শুয়ে পড়ে।আরিবা আমতা আমতা করে দাঁড়িয়ে আছে।
‘এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে না থেকে লাইট অফ করে শুয়ে পড় অনেক রাত হয়েছে।’
প্রণয়ের কথায় আরিবা আমতা আমতা করে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে,
‘আমি কোথায় শোব?’
প্রণয় বালিশ থেকে মাথা তুলে আরিবার দিকে ঘাড় কাত করে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। ধমক স্বরে বলে,
‘জীবণটা কি সিনেমা মনে হচ্ছে তোমার? এখন সিনেমার নায়কের মত আমি বলব, আমি খাটে আর তুমি মেঝেতে শুবে। সেই আশায় এক বালতি পানি ঢেলে দেও। ন্যাকামি না করে খাটে শুতে পারলে শুয়ে পড় নয়তো রুমের দরজা খোলা আছে বেরিয়ে যাও।’
আরিবা প্রণয়ের এমন ধমক খেয়ে সুরসুর করে লাইট অফ করে দিয়ে প্রণয়ের পাশে দুরত্ব বজায় রেখে শুয়ে পড়ে আর মনে মনে বলতে থাকে,
‘এই ব্যাটা তো দেখছি দেবদাস নামের কলঙ্ক।কোথায় ভাবলাম দেবদাসদের মত বলবে তুমি আমার সঙে এক খাটে থাকতে পারবে না! ধাৎ ভেজাল খাদ্যদ্রব্য এর এই দুনিয়ায় আজকাল দেখছি এই ব্যাটা দেবদাসটাও ভেজাল হয়ে গেছে।’
____________________________
আরিবা মনে মনে গজগজ করে ভাবতে ভাবতে রাতে কখন ঘুমিয়েছে ঠিক মনে নেই।চোখ খুলে নিজেকে এক নতুন পরিবেশে আবিষ্কার করল।কাল রাতে প্রণয়ের সাথে রূপার নাম দেখে ও তার সাথে ঘনিষ্ট ভাবে অচেনা মেয়েকে দেখে রা’গে’র মাথায় রুমটা ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করাই হয় নি আরিবার। আজ কেন জানি দেখতে ইচ্ছে করে সেজন্য আরিবা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো, বেডটা রুমের ঠিক মাঝখানে, ডান পাশে বড় সড় চার পার্টের একটি আলমারি, কিছু দূর দূরত্বে অপরপাশে ড্রেসিং টেবিল রাখা।সামনে সোফা ও সেন্টার টেবিল।বাম পাশে টেবিল ও দুটো চেয়ার রাখা যেখানে প্রয়ণের বই ও লেপটপ সহ যাবতীয় জিনিস রাখা আছে তাছাড়াও কর্ণারে বিভিন্ন ধরণের শো পিস রাখা।রুমের সাথে এ্যাটাচড ওয়াশরুম ও বারান্দাও রয়েছে।সব মিলিয়ে রুমটা বেশ বড় সড়।প্রণয় পেশায় বিজনেস ম্যান, বাবার ব্যাবসা সে নিজ হাতে হ্যান্ডেল করে।সব মিলিয়ে বলা চলে প্রণয় গুছানো মানুষ শুধু তার জীবণটাই অগোছালো হয়ে গেল।
এত আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রণয় আরিবার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকে।আরিবা নিজেকে স্বাভাবিক রেখে ধীরে সুস্থে বলল,
‘গুড মর্নিং ‘
প্রণয় মৃদু হেসে জবাব দেয়। ঠিক তখনি ঘড়িতে দশাটার ঘন্টা বেজে উঠে।এতো বেলা হয়ে গেছে আর সে এখনো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে সময় দেখেই তো আরিবার মাথা গরম হয়ে গেল।বিয়েটা যেমন ভাবেই হোক না কেন আরিবা তো এই বাড়ির নতুন বউ। নতুন বউ এতো বেলা অবধি ঘুমিয়ে আছে বাড়ির লোক কে কি ভাববে বা কিভাবে নিবে?
তড়িঘড়ি করে লাগেজ থেকে লাল রঙের গোল্ডেন জরির পাড়ের একটা সুতি শাড়ি নিয়ে আরিবা ফ্রেশ হতে চলে যায়।
____________________________
রুম থেকে বেরিয়ে আবারও একটি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হলো।রূপার জায়গায় সবাই তাকে দেখে কি মনে করছে আরিবা নিজেও জানে না।তবে সবার উৎসুক দৃষ্টি বেশ বুজতে পারলো।
সোফায় বসে থাকা মধ্যবয়স্ক একজন মহিলা চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠলেন,
‘কি ব্যাপার ভাবি এই যদি আপনার ছেলের বউ হয় তাহলে রূপা কোথায়? আপনি যে বলেছিলেন রূপারই এই বাড়ির বউ হবে যার জন্য আমার ভাইয়ের এমন সুন্দরী শিক্ষিতা মেয়েকেও বাতিল করলেন।যাইহোক আপনার ছেলের বউ দেখি সুন্দরীই আছে।তা কি কি দিলো মেয়ের বাড়ি থেকে?’
নাসিমা শেখ চুপচাপ শুনছিলেন প্রথমে রা’গ হলেও এতোক্ষণ জেনো বলার কিছু খুঁজে পেলেন।ঝনঝন করে বলে উঠলেন,
‘কি আর দিবে!খালি হাত পায়ে এসেছে।দেখতে হবে প্রণয়ের বাবার কর্মচারীর মেয়ে বলে কথা।আমাদর রূপা হলে খালি হাত পায়ে আসতে পারতো ভাবি? ফ্ল্যাট দিতে চেয়েছিলো তাও আবার উত্তরায়।সবই কপাল প্রণয়ের বাবা কই থেকে যে ধরে নিয়ে আসলেন।’
বলেই মুখ ঝা’ম’টা দিলেন তিনি।নাসিমা শেখের কথায় আরিবার মাথা নিচু হয়ে গেছে এমন লজ্জায় সে কোনো কালে পড়ে নি।নাসিমা শেখ যে তাকে দু’চোখ সহ্য করতে পারছে না এটা বেশ বুঝতে পারছে তার সাথে এটাও বুঝতে পারছে তাঁর ভবিষ্যত আশঙ্কায় রয়েছে।
প্রণয়ের ফুফু আমেনা বেগম রয়েসয়ে বললেন,
‘ভাবি বুঝলাম আরিবা না হয় খালি হাতে এসেছে। তোমার রূপা ফ্লাট সহ অনেক কিছু নিয়ে আসতো বললে,তার সাথে এটাও জানা উচিত উনাদের, এতো কিছুর সাথে দুই মাসের বাচ্চাও পেটে করে নিয়ে আসত যা কিনা মৃ’ত বোনের স্বামীর সাথে অগাত মেলামেশার ফল।এবার বুজতে পারছেন আপনারা? আমার ভাই কেন রূপার বদলে আরিবাকে শেখ বাড়ির বউ করে নিয়ে এসেছে।’
শেষের কথাটা সবার উদ্দেশ্যে বলল।আমেনার কোনো কালেই তার ভাবিকে পছন্দ না।কারণ নাসিমা শেখ অহংকারী মহিলা কথায় কথায় অপমান করে।নাসিমা শেখের মুখ চুপসে গেলো।সবাই তাকে নানান ধরণের প্রশ্ন করছে। আরিবাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রেমা এসে হাসিমুখে বলল,
‘একি ভাবি দাঁড়িয়ে আছো কেনো এখানে এসে বসে পড়।’
আপমানে আরিবা চোখ তুলে তাকাতে পারছে না।এভাবে সে কোনো কালেই অপমানিত হয় নি।প্রেমা আরিবাকে সোফায় বসিয়ে দেওয়ার পরেই প্রণয়ের মামি কটাক্ষ করে বললেন,
‘তা যাইহোক যা হওয়ার হয়ে গেছে তবে কোন জমিদারের মেয়ে এনেছো আপা যে কিনা এগারোটায় ঘুম থেকে উঠে?’
ঠিক তখনি আরিবা শুনতে পায়,
‘সে জমিদারের মেয়ে না হলেও জমিদারের বউ।আমার কি কম আছে নাকি মামি ? আমি আমার বউকে জমিদারের মত পালতে পারবো সমস্যা নাই। আপনাদের এতো কিছু না জানলেও চলবে।’
প্রণয় নামতে নামতে কথাটি বলল।প্রণয়ের কথা শুনে সকলের দৃষ্টি তার দিকে গেল।প্রণয়ের মুখে এমন কথা শুনে আরিবাও অবাক হয়ে যায়।
নাসিমা শেখ ও অবাক হয়ে যায়।যে ছেলে নিজের মায়ের মুখের উপর একটা কথা বলার সাহস পায় না সেই ছেলে বউয়ের হয়ে সকলের সামনে কথা বলছে।এক রাতেই এই ফলাফল বাকি জীবণ তো পড়েই আছে।না ভাবতে হবে ছেলেকে আঁচল ছাড়া করা যাবে না।কতো সাধের ছেলে তাঁর!
#গোধূলী_রাঙা_দিগন্ত
#পর্বঃ২
#লেখিকাঃফারিহা_খান_নোরা
আরিবার জীবণে কয়েক ঘন্টার ব্যাবধানে সবচেয়ে বড় অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে গেল।সেই বোধহয় প্রথম মেয়ে যে কিনা আগে থেকে কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই বিয়ে করে ফেলল।বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে সম্মান বাঁচাতে বিয়েটা করতেই হলো তাকে।প্রথমে ভেবেছিল তার বর্তমান বর কি জেনো তার নাম!ও হ্যা প্রণয় শেখ সে বুঝি, না করবে কারণ চেনা নাই জানা নাই এভাবে কোনো ছেলে না দেখেই কোনো মেয়েকে বিয়ে করবে নাকি। কিন্তু না প্রণয়ও সুরসুর করে তিন কবুল বলে দিয়েছে। সাদামাটা ভাবেই বিয়ে সম্পূর্ণ হলো। আরমান শেখ আরিবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তার ডানহাতে থাকা একটা কারুকার্য খচিত বক্স থেকে নেকলেস বের করে পড়িয়ে দিলেন।বক্সে একজোড়া ঝুমকা ও চুড় ছিলো যা পড়তে আরশি আপু তাকে সাহায্য করে। সবশেষে আরমান শেখ অত্যন্ত আদুরে গলায় বললেন,
‘মা!তুমি ভেবো না এসব অন্যের জন্য নিয়ে আসা।বরং এটা ভাবো এ সবকিছু তোমার নিয়তি’তে ছিলো। যা তুমি পেয়ে গেছো তবে অপ্রত্যাশিত ভাবে।’
আরমান শেখের এমন কথায় আরিবা কিছুই বুঝলো না।সব কথাই যেনো তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।বাবার দিকে সন্দেহের চোখে তাকায় আরিবা।সে ভালো করেই জানে আরমান শেখ তার বাবার অফিসের বস। হঠাৎ করে না বলেই এই রাত্রি বেলা ছেলা নিয়ে কোথায় থেকে উদয় হলো সে বুঝতে পারছে না তাও আবার এতো বড়লোক হয়েও মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে আরিবাকে ঘরে পুত্রবধূ করে কেনই বা তুলবেন।তবে একটা কথা বুজতে পারছে পুরো ঘটনায় অবশ্যই ঘাপলা আছে নয়তো বাবা হঠাৎ করে তাকে এভাবে বিয়ে দিতেন না।
অবশেষে আসলো বিদায়ের পালা।আরিবা সবার উপরে অভিমান করেছে।সে কিছুতেই কাঁদবে না।কেন কাঁদবে আর কাদের জন্য কাঁদবে যে মানুষ গুলো তাকে এক রাত্রির মধ্যে পর করে দিয়েছে তাদের জন্য কাঁদবে?উহু কিছুতেই না।রেবা খাতুন কাঁদছেন পাশে আরশিও।দুই বোনের মধ্যে কতো ঝগড়া খুনসুটি ছিলো তবুও আজ একজন আরেক জনকে ছেড়ে যাবে বলে কাঁদছে।আরিবা মুখ শক্ত করে প্রণয়ের পিছু পিছু গাড়িতে গিয়ে বসলেন ।হাসান সাহেব মেয়ের আচারণে ক’ষ্ট পেলেও অনেক ক’ষ্টে নিজেকে স্বাভাবিক করে রেখেছেন কারণ সে মেয়ের মতামত না নিয়েই এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছে।আরমান শেখ হাসান ও রেবাকে আস্বস্ত করলেন,সময় দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে।যদিও মনে মনে তিনিও ভয় পান কারণ দুই প্রান্তের ভিন্ন ধর্মীর দুই মানুষকে এক সুতায় বেঁধে দিয়েছে তাদের মতের বিরুদ্ধে যেয়ে। ভবিষ্যতে এখন কি হয় দেখার বিষয়।
গাড়ির পেছনের সিটে বসে আছে প্রণয়, মাঝখানে পর্যাপ্ত পরিমাণে দুরত্ব বজায় রেখে বসেছে তার’ই বিয়ে করা নতুন বউ।একদম জানালার গ্লাস ঘেসে বসে আছে মাথা ঠেকিয়ে।পেছনের গাড়িতে আরমান শেখ ও তার ভাই আসছে।
________________________
তখন জেদের বসে আসলেও বাড়ির সবার জন্য আরিবার খুব খারাপ লাগছে বিশেষ করে আরশির জন্য বেশি খারাপ লাগছে।আরশি আরিবার থেকে চার বছরের বড়। ছোট থেকে একসঙে সব সুখ দুঃখ হাসি কান্না ভাগাভাগি করে বড় হয়েছে তাঁরা।অনেক সময় মনে হতো দুজন দুজনের চোখের বি’ষ আবার কখনো মনে হতো তারা একজন আরেক জনকে ছাড়া থাকতেই পারে না।এই এখন যেমন মনে হচ্ছে।আরশির কথা মনে হতেই আরেকটা ব্যাপারে মনে পড়ে ঠিক তখনি আরিবার বুকের ভিতরে ধক করে উঠলো। আরশির দেবর জারিফের সাথে আরিবার প্রণয়ের সম্পর্ক রয়েছে।তারা দুজন দুজনকে ভালোবাসে,ছয় মাস হলো তাদের সম্পর্কের এখন কি করবে সে?বাবা কেন তাকে এমন অনিশ্চিত সম্পর্কে জড়িয়ে ফেলল ? তার আর জারিফের সম্পর্ক ভাঙার পরে যদি আরশি আপুর বিয়ে না টিকে?হাজার হলেও জারিফ তারিফ ভাইয়ার ছোট ভাই যার সাথে আরিবার প্রণয়ের সম্পর্ক থাকলেও পরিণয় পর্যন্ত তার বাবা গড়াতে দিলেন না।
এ সব কিছু ভাবনার মাঝেই আরিবা জোরে একটা ঝাঁকুনি খেল।সামনে তাকিয়ে দেখতে পায় বড় একটা ডুপ্লেক্স বাড়ি সামনে ও পিছনে রঙ বেরঙের লাইটিং করা।দেখেই বুঝা যায় বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান।এখন কথা হলে প্রণয়ের পরিবার আগে থেকেই জানে বিধায় এমন সাজিয়েছে কারণ দুই ঘন্টায় কেউ এভাবে সাজাতে পারবে না।তাহলে আরিবা জানতো না কেন তার বিয়ের ব্যাপারে?
প্রণয় কোনো কিছু তোয়াক্কা না করে আগেই গাড়ি থেকে নেমে যায়।আরিবা নামলে আরমান সাহেব এসে আরিবার হাত ধরে ভিতরে নিয়ে যায়।গাড়ি থেকে নাকি বর বউকে নামিয়ে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যায় আর আরিবাকে নিয়ে যাচ্ছে তার শশুর! এই ছিলো তার কপালে হাস্যকর!
___________________________
নাসিমা শেখ ড্রয়িং রুমে বসেছিলেন।আজ তার মনের বড় ইচ্ছে পূরণ হতে চলেছে।তার বড় ছেলে প্রণয়ের সঙে একমাত্র ছোট বোনের রেখে যাওয়া স্মৃতি রূপার বিয়ে।রূপাকে এবাড়ির বড় বউ হিসাবে দেখতে চাওয়া এটা তার কত বছরের লালন করা ইচ্ছা সেজন্যই তো নাসিমা শেখ খুশি মনে লাল পাড় সাদা শাড়ি, গা ভর্তি স্বর্ণের গহণা পড়ে বরণ ডালা নিয়ে অপেক্ষা করছেন।ঘড়িতে এখন রাত দশটা বেজে পনের মিনিট। এর মধেই প্রণয় হন্তদন্ত হয়ে দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে।নাসিমা শেখ কিছু বলতে যাবে তার আগেই প্রণয় সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়। কিছুক্ষণ পর আরমান শেখকে দেখা যায়,লাল জামদানি শাড়ি গায়ে জড়িয়ে হালকা সাজে মাথায় ঘোমটারত অবস্থায় বধূ বেশে অচেনা একটি মেয়েকে নিয়ে আসছেন।মেয়েটি আরমান শেখের পাশে এসে আস্তে ধীরে ভীরু পায়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।নাসিমা শেখ ভালো করে মেয়েটিকে লক্ষ করেন।দুধে আলতা গায়ের রঙে হালকা সাজেও পরীর থেকে কোনো অংশে কম লাগছে না মেয়েটিকে।এখন প্রশ্ন হলো এই মেয়েটা এখানে কেনো? এখানে তো রূপার থাকার কথা।রূপা কোথায় আর এই মেয়েটি আরমান শেখের পাশেই বা কেন। কিছুক্ষণ আগে প্রণয়ের এমন ব্যবহারে নাসিমা বেগমের মাথায় তখন একটা কথায় আসল।যার ফলে তিনি আরমান শেখের উপর গ’র্জে উঠলেন।
আরমান শেখ কিছু বলার জন্য মুখ খুলবেন তার আগেই নাসিমা শেখ গ’র্জে ওঠে চি’ল্লি’য়ে বলেন,
‘কই কে কোথায় আছো গো?দেখে যাও বু’ড়ো বয়সে এসে আমার কপাল পু’ড়’লো।তারপর আরমান শেখের উদ্দেশ্যে ঝরঝরে কন্ঠে বললেন,
‘এই বয়সে এসে এসব করতে তোমার লজ্জা করলো না? গিয়েছিলে তো ছেলেকে বিয়ে করাতে।ছেলেকে বিয়ে না করিয়ে শেষ পর্যন্ত নিজে বিয়ে করলে তাও আবার হাঁটুর বয়সী একটা মেয়েকে।তাই তো বলি ছেলে আমার কোনো কথা না বলে এভাবে উপরে গেল কেন?রূপাও তো তার সাথে নেই।সাথে থাকবেই বা কি করে?যেখানে বাপের’ই বিয়ের শখ মিটে নি সেখান ছেলের বিয়ে কি করে হবে?’
নাসিমা শেখের কথায় বাড়িতে যে সকল আত্মীয় ছিল সবাই চলে এসেছে।আরমান শেখের ছোট বোন আমেনাও পাশে আসলেন।এসব দেখে আরমান শেখের লজ্জায় মাথা কা’টা যাচ্ছে।আজকে জেনো আরমান শেখের মাথা কা’টা’রই দিন।মা ছেলে মিলে সকাল থেকে যে যেমন করে পারছে তার মাথা কা’ট’ছে।আরে আগে বললেই তো হতো আমার মাথাটা যখন তোদের মা ছেলের এতোই পছন্দ আমি নিজেই কেটে তোদের হাতে ধরিয়ে দিতাম।আরমান শেখ কঠোর চোখে নাসিমা শেখের দিকে তাকালেন এতো বছরের সংসারে নাসিমা তাকে একটুও বিশ্বাস করল না।ছিঃ শেষ পর্যন্ত মেয়ে সমতুল্য পূত্রবধূকে তার সাথে জড়িয়ে সন্দেহের তালিকায় ফেললেন।
প্রণয় শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে আসে।নিচ থেকে মায়ের চিৎ’কা’রে’র আওয়াজে এক মুহূর্ত দেরি করে নি নিচে নামতে।যদিও সে জানতো এমন কিছুই হবে তবে মায়ের চিৎ’কা’র তুলনামূলক ভাবে বেশিই মনে হচ্ছে।মাকে সে ভীষণ ভালোবাসে।নিচে যেয়ে দেখে কাহিনী ভিন্নি দিকে মোর নিয়েছে।প্রণয় কিছু বলতে যাবে তার আগেই আরমান শেখ আরিবার হাতটি প্রণয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে করুন কন্ঠে বললেন,
‘নে বাবা তোর বউ তুই সামলা আর আমার বউকে আমাকএ সামলাতে দে।এই বয়সে এসে তোর জন্য আমার বউ সন্দেহ করছে।শেষ বয়সে এসে বউ ছাড়া হতে পারব না আমি।যা তুই চোখের সামনে থেকে। যেদিন থেকে দুনিয়াতে এন্ট্রি নিয়েছিস আমায় জ্বালিয়েই খাচ্ছিস।’
প্রণয় কিছু না বলে আরিবার হাত ধরে উপরে উঠতে লাগল।শেষের কথা কানে আসে তার মা বলছে ,
‘এই মেয়েটা প্রণয়ের বউ হলে আমার রূপা কোথায়?’
____________________
বালিসে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কান্না করছেন নাসিমা শেখ।পাশেই নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন আরমান শেখ।এমনিতে সারাদিন এতো সব ধকল গেছে তার উপর সম্মান নিয়ে টানাটানি এতো টেনশনে তার বেহাল অবস্থা। কোথায় একটু স্ত্রী সেবা যত্ন করবে তা না। মধ্যরাতে ম’রা কা’ন্না জুড়ে দিয়েছে।আরমান শেখ বিরক্ত হয়ে বললে,
‘আহ কি হয়েছে এভাবে কাঁদছো কেন?’
নাসিমা শেখ চোখের পানি মুছে বললেন,
‘তুমি কখনো আমার কথা শুনেছ যে,আজ শুনবে?’
‘তোমার কোন কথা শুনি নি সেটা বলো আগে।’
নাসিমা রে’গে গিয়ে তরতরিয়ে বললেন,
‘আমার ছেলেটার কি থেকে কি হয়ে গেল?শেষে কিনা কর্মচারীর মেয়ে এই বাড়ির বউ হয়ে আসল। কোথায় আমার রূপা আর কোথায় এই মেয়ে।’
এমন কথায় আরমান শেখ জেনো দ্বিগুণ রে’গে যায়।তেলে বেগুনে জ্ব’লে উঠলো।বললেন,
‘শোনো নাসিমা জন্ম মৃ’ত্যু বিয়ে আল্লাহ এর হাতে তিনি যার সঙে যাকে লিখে রেখেছেন সঠিক সময়ে তার সঙ্গেই জুড়ে দিবেন।আর হ্যা কি জেনো বলছিলে?রূপার সাথে এই মেয়ে যায় না?আমিও বলছি সত্যিই রূপার সাথে আরিবা যায় না। এখন যদি তোমার অন্যের বাচ্চা কাচ্চার মুখে ফ্রি’তে দাদি ডাক শুনতে ইচ্ছে হয় তাহলে রূপাকে নিয়ে আসতে পারো। আমার বলার কিছুই নাই।’
শেষের কথাটা ঠাট্টার ছলেই বললেন।আরমান শেখের কথায় নাসিমা চুপসে গেলেন বলার মত মুখ রাখেনি এই রূপাটা।
_____________________
ড্রয়িংরুমের এমন বি’শ্রি ঘটনায় আরিবা চোখ ছলছল করছে।শেষে কিনা এ বাড়িতে প্রথম পা রাখতেই এমন জঘন্য ঘটনার সম্মুখীন হতে হলো তাকে?বুকের ভিতরটা দুরুদুরু করে কাঁপছে।প্রণয় তাকে একটা রুমে নিয়ে আসে। কিন্তু রুমে ঢুকেই আরিবার মাথায় জেনো বা’জ পড়ল।
বিয়ের ভরা আসরে হবু বউয়ের ব্যাগ থেকে এনগেজমেন্টের রিং এর সঙ্গে প্রেগন্যান্সি কিট বেরিয়ে আসায় অনুষ্ঠানের উপস্থিত সবাই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায় রূপার দিকে।রূপা সবার দিকে এক পলক তাকিয়ে পড়ে যাওয়া জিনিস গুলো তুলে নিয়ে ব্যাগ থেকে রির্পোট বের করে তার বড় বোনের স্বামীর হাতে তুলে দেয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাই যেন হতবাক।একের পর এক চমক পেলে এমন হতবাক সবারই হবার কথা।
আজ খালাতো ভাই প্রণয় শেখের সাথে রূপার বিয়ে ছিলো।রূপা কিনা বিয়ের আসরে সবার সামনে তার দুলাভাইয়ের দিকে প্রেগন্যান্সি কিট এগিয়ে দেয়।রূপার দুলাভাই নাবিল মাথা নিচু করে ফেলে। রূপার বাবা রাশেদ সাহেব নাবিলের থেকে রির্পোট নিয়ে খুলে স্তব্ধ হয়ে বসে পড়ে। নাবিলের দিকে তাকিয়ে আক্রোশের সহিত বলে,
‘আমার বড় মেয়ে রুনা মা’রা গেছে তিন মাসও হয় নি। আমার ছোট মেয়ে রূপা দুই মাসের প্রেগন্যান্ট! এই রিপোর্ট এ অভিভাবক এর জায়গায় তোমার নাম দেওয়া তাও স্বামী হিসাবে।এসবের মানে কি?তোমাকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম সেজন্য বড় মেয়ে মা’রা যাবার পরেও তোমার অগাধ যাতায়াত ছিলো আমার বাড়িতে।সেই তুমি আমার বিশ্বাসের এই মূল্য দিলে?’
রাশেদ সাহেব রূপার দিকে এগিয়ে যেয়ে গায়ের জোরে দুইটা থা’প্প’ড় লাগিয়ে দেয়।তার ভাবতেও ঘৃ’ণা হচ্ছে যে,তার মেয়ে কিনা এতো গুলো মানুষের সামনে তার’ই সম্মান নিয়ে এভাবে খেলবে। ইতিমধ্যে অনুষ্ঠানের সবাই কা’না’ঘু’ষা শুরু করে দিয়েছে।রূপার হবু বর প্রণয় শেখ এক নজরে সামনে তাকিয়ে আছে কি হচ্ছে সব যেনো তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।এদিকে প্রণয়ের বাবা আরমান শেখ এমন পরিস্থিতিতে কি করবে বুঝতে পারছে না।স্ত্রী নাসিমার ছোট বোন নাসরিন এর দুই মেয়ে রুনা ও রূপা। পাঁচ বছর আগে নাসরিন গত হয়েছে।সন্তান জন্ম দিতে যেয়ে তিন মাস আগে বড় মেয়ে রুনা ও তার অনাগত সন্তান পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে।ফলে রূপা ও তার বাবা একা হয়ে যায় ।সেজন্য আদরের মৃ’ত বোনের একমাত্র ছোট মেয়েকে কাছে রাখতে নাসিমা তার বড় ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেন।রূপার সাথে প্রণয়ের বেশ ভালো সখ্যতা ছিলো।ছেলেকে বিয়ে করিয়ে বউ নিয়ে যাবার কথা ছিলো।স্ত্রীর জোরাজুরিতে এই সম্পর্ক নয়তো এই মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ের কথা তিনি ভুলেও ভাবতেন না।রূপাকে তার আগে থেকেই পছন্দ না।তার মতে রূপা একটি অ’হং’কা’রী ও ওভার স্মার্ট মেয়ে।এতো গুলো মানুষের সামনে এখন মাথা কাটা যাওয়ার মতো অবস্থা তার।এক এক করে বিয়ে আসর থেকে সবাই চলে যেতে শুরু করেছে।আরমান সাহেব যে করেই হোক আজ ছেলের বউ ঘরে নিয়ে যাবেন মানে যাবেন’ই।বউ নিতে এসে এভাবে খালি হাতে ফিরবে না।এই মেয়ে না হোক অন্য মেয়ে খুঁজবে তবুও এই আসরেই ছেলের বিয়ে দিবেই।এমন ন’ষ্ট মেয়ে তার ছেলের ঘাড় থেকে নেমেছে আল্লাহ এর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া।বিয়ের পর এসব ঘটলে কি হতো।না আর ভাবতে পারছে না।
রূপার বাবা এগিয়ে আসেন।আপরাধীর ন্যায় মাথা নিচু করেন।আরমান শেখের দিকে দুই হাত জোড় করে অপরাধীর সুরে বলে,
‘ভাই সাহেব আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি সন্তানকে ঠিক ভাবে মানুষ করতে পারি নি ,মা ম’রা দুই মেয়ে।বেশি আদর দিয়ে মাথায় তুলেছি। বুঝতে পারি নি এই দিন দেখতে হবে। আমার জন্য আপনার মাথা নিছু হলো।পারলে ক্ষমা করবেন।’
আরমান শেখ মাথা তুলে তাকলেন।রাশের সাহেবের হাতের উপর হাত দিয়ে আস্বস্ত করলেন।এর থেকে বেশি কিই বা করতে পারতেন।রাশেদ সাহেব সত্যিই অত্যান্ত ভদ্র মানুষ। স্ত্রীর মৃ’ত্যু’র পর বেচারা একা হাতে সব কিছু সামলিয়েছেন।এমনকি নতুন করে বিয়ে অবধি করেন নি।পিছে সন্তান গুলোকে যদি নতুন বউ দেখতে না পারে সেই ভয়ে।
প্রণয় যখন আসল ঘনটা বুঝতে পারলো তখন থেকে রা’গে ফুঁ’স’তে ফুঁ’স’তে বাবার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকে।কখনো তাকে কারো কাছে এতোটা অপমানিত হতে হয় নি যতটা আজ হতে হয়েছে।রূপা তার সাথে ভালোবাসার নামে ছলনা করে তার’ই দুলাভাইয়ের সঙ্গে অ’বৈ’ধ সম্পর্কে জড়িয়েছে।এভাবে তাকে ঠকালো?বিয়ের নাম করে বাড়িসহ আত্মীয় স্বজদের সামনে বিয়ে করতে নিয়ে এসে এভাবে ধোঁ’কা দিলো? নাবিলের সাথে তার যখন এতোই গভীর সম্পর্ক আগেই বলতো।এভাবে তার সাথে ছলনা না করলেও পারত!
___________________________
আরমান শেখের মাথা নিচু হয়ে গেছে সবার সামনে।তার স্ত্রীকে এতো বার নিষেধ করা শর্তেও তিনি তার কথা শুনেন নি।তার স্ত্রীর সাথে অবশ্য প্রণয়ের ও মত ছিলো।তারজন্য মা ছেলের সাথে গত সাতদিনে তার মনমালিন্য চলছে।আজ ছেলের জীবণে অত্যন্ত খুশির দিন বলে নিজের ইচ্ছাকে বির্সজন দিয়ে এসেছে। এসব ভাবতেই আরমান সাহেবের বুকের বাম পাশে চিনচিন ব্যাথা করে উঠে।তিনি তার বাম হাতটি বুকে চেপে ধরলে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরমান সাহেবের ম্যানেজার তাকে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দেন।প্রণয় সহ বাকি সব কাছের আত্মীয় গুলো ছুটে আসেন।আরমান শেখ’কে তড়িঘড়ি করে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলে তিনি খেয়ে কিছুটা স্বাভাবিক বোধ করে।
কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে আরমান শেখ তার ম্যানেজার হাসান এর উদ্দেশ্যে বলেন,
‘হাসান সাহেব কি ভাবে যে কথাটা বলি,আপনি আমাদের পরিবার, আমায় ও আমার ছেলে সম্পর্কে সব কিছুই জানেন ।আজ আমি আপনার কাছে একটা আবদার নিয়ে এসেছি প্লীজ না করবেন না।’
অফিসের বস এমন হাত ধরায় হাসান সাহেব একটু অবাক হয়ে যায়।কারণ তার মত সামান্য কর্মচারীর কাছে কিসের আবদার করবে আরমান শেখ তাও আবার হাত জোড় করে।তিনি ধীরে ধীরে হাতটি ছাড়িয়ে নেন।মাথা নিচু করে কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
‘স্যার এভাবে বলতে হবে না। আমার সাধ্যের মধ্যে হলে আমি অবশ্যই আপনার আবদার রাখবো।আপনি বিনা সংকোচে বলুন।’
‘হাসান সাহেব,আমার ছেলে প্রণয়ের জন্য আমি আপনার ছোট মেয়ে আরিবার হাত চাইছি প্লীজ না করবেন না।এমনিতেও আজ সবার সামনে আমার সম্মান ধূলায় মিশে গেছে।এখন সেই সম্মান আপনার হাতে।’
আরমান শেখের কথায় হাসান সাহেবের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়।প্রণয়কে তিনি ব্যাক্তিগত ভাবে পছন্দ করেন তবে রূপা নামের মেয়েটার সাথে প্রণয়ের আগে থেকে ঘ’নি’ষ্ঠ’তা ছিলো তা জানা শর্তেও কি করে তার আদরের ছোট মেয়েকে এমন একটা ছেলের হাতে তুলে দিবেন।তিনি ফ্যাকাসে মুখ নিয়ে কম্পনরত কন্ঠে বলেন,
‘স্যার প্রণয় বাবাকে আমার পছন্দ কিন্তু আমার মেয়েটা এখনো ছোট সবে মাত্র অর্নাস ফার্স্ট ইয়ারে পড়াশোনা করছে আর বড় মেয়েকে এখনো শশুড়বাড়ি তুলে দেই নি,তার আগেই কিভাবে ছোট মেয়েকে বিয়ে দেই বলেন?’
আরমান শেখ এবার আত্মবিশ্বাসীর সুরে বলে,
‘তোমার মেয়ে মানে আমার মেয়ে।আমি তোমার কাছে আমার ছেলের বউ না,মেয়ে চাইছি। তোমার আরিবাকে আমায় দেও আরশির দিকটা আমি দেখছি।বাকিটা এখন তোমার উপর নির্ভর করছে।’
প্রণয় জেনো এতোক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে সবকিছু দেখছিলো।আরমান শেখ আর কোনো কথা বলতে না দিয়ে প্রণয় ও তার চাচা মিলে কাজিসহ হাসান সাহেবের বাড়িতে যান।
_______________________
মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে আরিবা।দেখতে সুন্দর গায়ের রঙ ফর্সা,হাসলে জেনো তার হাঁসির মায়ায় সবাই পড়ে।এখন রাত আটটা বাজে আরিবা বসে গান শুনছিলো হঠাৎ করে তার মা রেবা খাতুন ও বড় বোন আরশি হন্তদন্ত হয়ে রুমে এসে বলে,
‘আরিবা এখন সময় নেই উঠে পড়।আর আরশি তুই আরিবাকে রেডি করে দে।হাতে থাকা লাল জামদানি শাড়িটা আরশিকে দিয়েই বেরিয়ে গেলেন উনি।’
আরিবা অবাক হয়ে আরশিকে বলল,
‘কি হয়েছে আপু, রাত বিরাতে এসবের মানে কি? আমি শাড়ি পড়বো কেন?’
আরশি কিছুটা থতমত খেয়ে গেলো।বলল,
‘বোন তুই চলে গেলে কিভাবে থাকবো আমি?’
বলেই আরশি কেঁদে দিলো।আর আরিবাকে শাড়ি পাড়াতে শুরু করলো।শাড়িট সুন্দর করে পড়িয়ে দিয়ে আরিবার কোমড় ছড়ানো চুল গুলো খোঁপা করে তাতে আর্টিফেসিয়াল জুঁই ফুলের গাজরা দিয়ে দেয়।চোখে গাড় কাজল ও ঠোঁটে কড়া লাল লিপস্টিক।সাজানোর মধ্যে আরিবা আরশিকে হাজারটা প্রশ্ন করে।আরশি তখনও চুপ করে ছিলো।
এরমধ্যে তার বাবা হাসান সাহেব আসলেন রুমে।ছল ছল চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন।আরিবার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘মা আমার,বাবা যা করি তোমার ভালোর জন্য। তুমি আমায় ভুল বুঝো না। দোয়া করি তুমি সব সময় ভালো থাকবে।’
আরিবা এবার অবাক হয়ে যায়।তার মে’জা’জ খা’রা’প হতে শুরু করে।বাবাকে বলে,
‘তোমরা কি শুরু করলে বলো তো? একবার মা এসে এসব করছে।একবার আরশি আপু কান্না করছে এখন আবার তুমি এসে এসব বলছো।তোমরা কি করছো আমি বুঝতে পারছি না।দয়াকরে আমায় সবকিছু খুলে বলো।’
এবার বাবার মুখ থেকে আরিবা অপ্রত্যাশিত একটি বাক্য টি শুনতে পেলো।
আমাদের জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা প্রায় সময়ই ঘটে থাকে। তাই বলে সবসময় সেটা নিয়ে পড়ে থাকলে তো আর চলবে না। আমি যখন জানতে পারলাম যে মি. আহমেদ নয় এই ব্যাপারটা নিয়ে কেবল তার মা-ই ভেবেছেন তখন আমার একটু খারাপ লেগেছিল। আমি ভেবেছিলাম হয়তো ওনার সম্মতিতেই এমন একটা প্রস্তাব নিয়ে আন্টি হাজির হয়েছিলেন। আমার তখন মিশ্র অনুভূতি হওয়ার কারণ এটা ছিল কেউ আমাকে স্ত্রী হিসেবে চাইছে। আমার ধারণা ভুল ছিল। অনুভূতি আছে কি নেই সেটা বলতে পারছি না। তবে আমি একটু নড়বড়ে হয়ে পড়েছিলাম এই ঘটনার পর। কাজ কর্মে আমার মনোযোগ কমই বসতো এরপর থেকে। আন্টি আমাকে কয়েকবার কল করেছিলেন। আমি কেবল দুই বারই রিসিভ করেছি। আসলে তার কথা যখন শুনি তখন আমি আসলে দুর্বল হয়ে পড়ি। আমি তাই এড়িয়ে যাচ্ছি টিনটিনকেও। ব্যাপারটা সে সইতে পারছে না। আমারও খারাপ যে লাগছে না তা নয়। তবে এটাই আমার কাছে আপাতত সঠিক মনে হচ্ছে। বাস্তবিক চিন্তা করলে এমন একটা প্রস্তাব আমার গ্রহণ করা অনুচিত। আমাকে কারো মা হতে হলে আগে অবশ্যই কারো স্ত্রী হতে হবে। এবং স্ত্রী এর যথাযথ মর্যাদা আমি আশা করি। যা মি. আহমেদ আমায় দিতে পারবেন না আমি জানি। যে মানুষটা স্ত্রীর মৃ’ত্যুর এত বছর পরও বিয়ে করেনি সে হঠাৎ করে আমাকে বিয়ে করতে যাবেই বা কেন? অবশ্যই নিজের স্ত্রীকে তিনি অসম্ভব ভালোবাসেন। নয়তো আরো আগেই কেউ আসতো তাঁর জীবনে। আমি যদি এখন তাঁর স্ত্রী হয়ে যাইও আমাকে যে তিনি ভালোবাসবেন তার কি গ্যারান্টি আছে?
আমার পরিবার সাদামাটা পরিবার। ভাই আর ভাবির ব্যাপারটা একটু আলাদা। তবে আমার বাবা-মা সাধারণ জীবনটাই প্রেফার করেন। মা কিংবা বাবা কেউই চান না আমি এমন কোনো পরিবারে যাই। মায়ের কথা আমাকে একজন ন্যানি হিসেবেই থাকতে হবে। বাচ্চাটার দেখভালের জন্যেই আমাকে তাঁরা নিতে চান। নইলে এত বড় বাড়ির ছেলের জন্য আমাকেই কেন নিবে? আরো কত মেয়েই তো আছে। আমি জানি মি. আহমেদ এর পরিবার ওই চিন্তা ভাবনা করেনি তবে পরের কথাটাও তো সত্যি।
স্কুল থেকে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। আজ বেলা তিনটায় সবাইকে উপস্থিত থাকতে হবে। সাড়ে তিনটা থেকে প্রতিযোগিতা শুরু হবে। প্রতি বছর এটা কয়েকবারই হয়। মূলত এক পার্ট থেকে অন্য পার্টে কে কে যাওয়ার যোগ্য সেটাই পরীক্ষা করা হয়। ছোট বাচ্চাদের জন্য আমরা সেটা প্রতিযোগিতা বলেই চালিয়ে দেই। পরীক্ষায় তাদের একটু ভী’তি কাজ করে তো তাই।
আমি স্কুলে পৌঁছে দেখলাম টিনটিনের সাথে তার বাবাও এসেছে। টিনটিন আমার কাছে ছুঁটে এসেছিল। পেছনে ওর বাবাও এলো। আমি তাকে এড়িয়ে যেতে পারলাম না ভদ্রতার খাতিরে।
-‘কেমন আছেন?’
-‘আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো। আপনি?’
-‘এই তো বেশ আছি। আপনাদের আয়োজনটা চমৎকার হয়েছে।’
-‘ধন্যবাদ।’
মাইকিং হতেই আমি বিদায় নিয়ে এলাম তাদের থেকে। প্রতিযোগিতা শুরু হলো কিছুক্ষণ পরেই। আমি সিঁড়িতে গিয়ে বসলাম। পাশেই হল রুমে ছাত্র ছাত্রীরা সব ছবি আঁকছে। হঠাৎ আমার পাশে একজন এসে বসল। আমি চমকে উঠলাম। মি. আহমেদ হাসলেন। বললেন,
-‘ভ’য় পেলেন?’
-‘না না, ভ’য় পাইনি।’
-‘মিস লিয়া! আমি আপনার কাছে একটা বিষয়ে কথা বলতে এসেছি।’
আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম। বললাম,
-‘জ্বি বলুন!’
উনি আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন কিছু সময়। এরপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
-‘আমি আমার স্ত্রীকে ভালোবাসি।’
-‘জানি।’
উনি একটু অবাক হলেন বোধহয়। পরক্ষণেই হাসলেন। বললেন,
-‘আপনি বুদ্ধিমতী।’
-‘এটা বোঝার কথা।’
-‘তা অবশ্য ঠিক। তবে অনেকের ধারণা আমার ক্যারেক্টার ভালো না। তাই বিয়ে করছি না। কিন্তু … বুঝতেই পারছেন।’
-‘জ্বি।’
-‘চয়নিকা আমার ক্লাসমেট ছিল। আমরা টেনথ্ ক্লাসেই রিলেশনে জড়াই। অনার্স কমপ্লিট হতেই বিয়ে। তার দু বছর পর এসে যায় আমার টিনটিন আর চলে যায় চয়নিকা। আমি চাইলেই বিয়ে করতে পারি। ভালো লাইফ লিড করতে পারি। কিন্তু আমার সেই ইচ্ছেটাই ম’রে গেছে। আমার টিনটিনকে নিয়েই আমার দুনিয়া। আমি সবসময় চাই আমার টিনটিন ভালো থাকুক। তবে সেটা অবশ্যই কাউকে দুঃখ দিয়ে না।’
আমি তার কথা গুলো মন দিয়ে শুনলাম। আমি ঠিক এমন কিছুই আশা করেছিলাম। আমার ধারণা মিলে গেছে। উনি বললেন,
-‘আপনি প্লিজ এই ব্যাপারটা নিয়ে ভেবে হতাশ হবেন না। আসলে পুরোটাই আমার মায়ের ইচ্ছেতেই হয়েছে। মায়ের মন তো! বোঝেনই! মায়েরা চায় আমরা ভালো থাকি। তবে এখানে আরেকটা ব্যাপারও আছে, মা চান টিনটিন ভালো থাকুক। অন্য কেউ এসে টিনটিনকে ভালোবাসবে না মা এটাই মানেন। তাই আপনার কাছে একটা আবদার নিয়ে চলে গেছেন। তবে এটা তিনি খেয়াল করেননি যে তার চাওয়াটা অপরজনের প্রতি অ’ন্যায় হয়ে যায়। আমি বলছি না আপনি ব্যাপারটা ভুলে যান। আমি শুধু চাই আপনি প্লিজ, এই ব্যাপারটা নিয়ে টিনটিনের থেকে দূরত্ব রাখবেন না। আপনি তার সাথে ততটুকুই থাকুন যতটুকু একজন টিচার হিসেবে থাকার কথা। আপনার এড়িয়ে চলাটা আমার টিনটিনের উপর প্রভাব ফেলছে। ও মাঝে প্রাণোচ্ছল হলেও এখন আবার আগের মতো হয়ে যাচ্ছে। আমি আপনাকে কিন্তু ইউজ করছি না মিস। আপনিই বলেছিলেন আপনি দেখবেন যতটা সম্ভব হয় আপনাদের পক্ষে। আপনারা চেষ্টা করবেন ওর মুখে হাসি ফোঁটাতে।’
আমি ভেবে দেখলাম। ইশ! আমি কি বোকার মতো কাজ করেছি? টিনটিনের এসব নিয়ে কোনো লেনাদেনা নেই। আমি অথচ ওকেই বড় পুঁজি করে ফেলেছিলাম এই এড়িয়ে চলার যু’দ্ধে। ও তো আমার ছাত্রী, আমার কাছে বাকিদের মতোই। আমি কেন ওকে অন্য চোখে দেখতে গেলাম? দো’ষটা তো এখানে আমারই বেশি!
-‘আমি মন থেকে ক্ষমা চাইছি মি. আহমেদ। এমনটা করা আমার আসলেই উচিত হয়নি।’
-‘ইটস্ ওকে। আপনি নিশ্চয়ই এমনি এমনি তো এমনটা করেননি। এই তো আর বেশি দিন নেই, আর কয়টা দিন একটু সহ্য করুন দয়া করে।’
-‘মানে?’
-‘টিনটিনের ফুপির কাছে টিনটিনকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমার বড় বোন সারা। অনেক আগে থেকেই টিনটিনকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছে। আমি দেইনি। সন্তানকে চোখের আড়াল করতে ভালো লাগে না যে তাই।’
-‘আশ্চর্য! আপনি এটা করবেন কেন?’
-‘এটা করতেই হবে। টিনটিন এই বয়সটা যখন মা ছাড়া বড় হয়েছে পরের বয়সটুকুও পারবে আমি আশা রাখি। এই পরিবেশে ওর মা নেই। ওই পরিবেশে ওর সেই সমস্যা হবে না। আমার বোনের মা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ওর একটা বাচ্চার খুব শখ। নিজের ভাইয়ের মেয়েকে ও নিজের সন্তানের মতোই লালন করবে আমি আশা করি।’
-‘এখন এতো উঠে পড়ে লাগছেন কেন টিনটিনকে ওদের কাছে দিতে?’
উনি এই প্রশ্নে কিছুক্ষণ চুপ ছিলেন। এক সময় মাঠের ঘাস গুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন,
-‘টিনটিন আজকাল একটা অ’ন্যা’য় আবদার করছে। তাই।’
-‘যেমন?’
-‘সেদিন যখন আপনি ওকে বলেছিলেন আপনি সবসময় ওর সাথে থাকবেন না তারপর থেকেই প্রতিনিয়ত ও আবদার করে যাচ্ছে যে কেন আপনি ওর সাথে সারাদিন থাকতে পারেন না? ওর আপনাকে সবসময় চাই। সবসময়ের জন্য আপনাকে ওর কাছে এনে দিতে হবে। আর যেটা আমার পক্ষে সম্ভব না।’
আমি হল রুমের দিকে তাকালাম। জানালার পাশেই টিনটিন বসেছে। খুব মনোযোগ দিয়ে আর্ট করছে সে। আমার এক রাশ ভালোবাসা তাকে গিয়ে ছুঁলো। সেই সাথে বেশ কিছু সহানুভূতি। আমরা সবসময় যা চাই তা হয় না। আমাদের বাস্তব সম্মত চিন্তা করতে হয়। আমি যে সমাজে আছি সেই সমাজ এমন বিয়ে সহজভাবে গ্রহণ করে না। আমার পরিবারই গ্রহণ করবে না। আর পরিবারের বাইরে গিয়ে কিছু করার আমার নেই। যদি এখানে অন্য কিছু থাকত তবে হয়তো আমি যেতাম। সেই অন্য কিছুটাই নেই।
আমার ফোন রিং করছে। হাতে নিয়ে দেখলাম মায়ের কল। আমার মন যাতে অন্য দিকে না ঘুরে যায় তাই আমার মা বাবা আমাকে যত দ্রুত সম্ভব বিয়ে দিয়ে দিতে চান। তাদের ধারণা আমি টিনটিনের দাদুর কথায় গলে গিয়ে হয়তো ভুল স্টেপ নিয়ে ফেলব। তাই আমাকে এই মাসেই বিয়ে দিয়ে চিন্তার বোঝাটা মাথা থেকে নামাতে চাইছেন। আজ সন্ধ্যায় পাত্রপক্ষ আসবে। আমার বড় খালামণির পরিচিত। শুনেছি পছন্দ আমাকে আগেই করেছে। আজ আংটি পরিয়েই যাবে। মি. আহমেদ আমার পাশ থেকে উঠে চলে গেলেন। আমি তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। না! কোনো অনুভূতি কাজ করছে না আমার তার জন্য। দিন শেষে নতুন দিন আসে, আসবেই। তবে হারিয়ে যাওয়া মানুষ গুলো আর আসবে না। এক্ষেত্রে উনার এবং টিনটিনের জন্য আমি কেবলই সমবেদনা বোধ করছি। এছাড়া আর কিছুই নয়। কেননা এখানে কখনোই কিছু ছিল না। টিনটিন একদিন বড় হবে, খুব বড় হবে। এই কঠিন দিন গুলো একদিন শেষ হবে, সে একা চলতে শিখবে। সে বুঝতে পারবে সবাই আমাদের সাথে সবসময় থাকে না এটা জগতের নিয়ম। তখন আর সে কাঁদবে না, বায়না ধরবে না। আমার দোয়া রইল তার জন্য। মা হারা মেয়েটা হয়তো মায়ের আদর পায়নি তবে তার যদি কখনো গর্ব করার মতো কিছু থেকে থাকে তবে সেটা তার বাবা। কেননা সে একজন চমৎকার বাবা পেয়েছে। একদিন তাই টিনটিনের মা হারানোর দুঃখের থেকেও এমন বাবা পাওয়ার আনন্দ বেশি হবে।
আমার আর্ট স্কুলের নতুন ছাত্রী টিনটিন। ভালো নাম হুমাইরা নাজ, বয়স পাঁচ হবে। তাকে সবাই টিনটিনই ডাকে। কেউ কেউ আদর করে ডাকে তো কেউ আবার একটু মজা করার জন্য এই নামে ডাকে। টিনটিন রাগ করে না তাতে। মেয়েটা ভীষণ চুপচাপ থাকে সবসময়। কথা বলে খুব মেপে মেপে। এই বয়সের বাচ্চারা সাধারণত এমন হয় না। এই বয়সের চঞ্চলতা, নতুন কিছু জানার আগ্রহ, কৌতূহলী মনোভাব কিছুই টিনটিনের মধ্যে দেখা যায় না। ছোট একটা বাচ্চা অথচ সে যেন এখনই সব কিছুতে আগ্রহ হারিয়ে বসে আছে। আমি বেশ কিছুদিন নোটিস করেছিলাম। মেয়েটার হাব ভাব অন্য বাচ্চাদের মতো নয়। আমি একদিন তাকে ডেকে কথাও বলেছি। যা যা প্রশ্ন করেছি সবকিছুরই মিনমিন করে জবাব দিয়েছে। একবার মনে হচ্ছিল সে ভয় পাচ্ছে আবার মনে হলো ভয় না! মন খুলে কথা বলতে পারে না সে। আমার কাছে একটু অদ্ভুত লাগল ব্যাপারটা। তাই আমি তার প্যারেন্টস্ কল করলাম পরদিন। একজন বয়স্ক মহিলা কল রিসিভ করেছিল। পরিচয় জানতে চাইলে জানান তিনি টিনটিনের দাদু। তিনি জানালেন টিনটিনের বাবা বাসায় নেই। তবে আমার কল করার কথা তিনি তাঁর ছেলেকে জানিয়ে দেবেন।
সেই সপ্তাহে আর কোনো ক্লাস ছিল না। তাই টিনটিন আর আসেনি। আমার মাথা থেকেও এক মুহূর্তের জন্য ওর কথা বেরিয়ে পড়ে। এত কাজের চাপে মনেই ছিল না আসলে। এরপর এলো শনিবার। টিনটিনের ক্লাস ছিল সেদিন। আমার খেয়াল ছিল না। আমি রোজকার মতোই অফিস রুমে বসে তখন কাগজ পত্র ঘাটাঘাটি করছি। দরজায় নক হলো। আমি ভেতরে আসার অনুমতি দিলাম। অনুমতি পেয়ে দরজা খুলে এক সৌম্যদর্শন পুরুষ ভেতরে ঢুকল। সত্যি বলতে আমি একটু ভড়কে গিয়েছিলাম এক মুহূর্তের জন্য। লোকটা নিজের পরিচয় দিলো।
-‘হ্যালো মিস! আমি ওয়াসিফ আহমেদ। হুমাইরার বাবা।’
একটু চমকে উঠেই যেন বললাম,
-‘টিনটিনের বাবা?’
লোকটা আমার কথা শুনে চমৎকার করে হাসলেন। মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে বললেন,
-‘জ্বি, টিনটিনের বাবা।’
আমি খেয়াল করলাম আমি তখনও তাকে বসতে বলিনি। তাই হন্তদন্ত হয়ে বললাম,
-‘প্লিজ হ্যাভ আ সিট মি. আহমেদ।’
ভদ্রলোক বসলেন চেয়ার টেনে। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম চা, কফি কি নিতে চান? তিনি জানালেন কিছুই নিবেন না এখন। তার খুব দরকারি কাজ আছে। টিনটিনের ব্যাপারে আমি কি বলতে চেয়েছিলাম সেটাই জানতে চাইলেন তিনি। আমি তাকে জানালাম তার সন্তানের আচার আচরণ সম্পর্কে। এবং জিজ্ঞেস করলাম,
-‘ছোট বাচ্চাটা কি এমন কারণে এত উদাস থাকে? আপনি কিংবা আপনার স্ত্রী কেউই এটা লক্ষ্য করেননি?’
সব শুনে কিছু সময় নিরব ছিলেন তিনি। একটু পরই বেশ ঠান্ডা গলায় বললেন,
-‘টিনটিনের মা নেই। ওর জন্মের সময় কিছু প্রতিকূলতার কারণে আমার স্ত্রী মারা গেছেন।’
এমন জবাব আমি আশা করিনি। এত ছোট্ট একটা বাচ্চা মা ছাড়া বড় হচ্ছে? সব হিসেব যেন মুহূর্তেই মিলে গেল। তবুও চুপ থেকে শুনছিলাম লোকটার সব কথা।
-‘আমার যে পেশা তার কারণে আমাকে বছরে এদিক সেদিক যেতেই হয়। মেয়েকে সত্যি বলতে খুব কম সময়ই দেই আমি। তারপরেও যতটুকু পারি চেষ্টা করি। টিনটিন আমার মায়ের সাথেই থাকে সবসময়। মা ওর খেয়াল রাখেন। তারপরেও ও সবসময় নিজের মায়ের অভাব বোধ করে। আমি সেটা বুঝি। প্রথম প্রথম ও বায়না ধরতো যে মায়ের সাথে স্কুলে যাবে। কেননা সব বাচ্চারাই মায়ের সাথে আসে। অফ পিরিওডে মায়েরা বাচ্চাদের খাইয়ে দেয়। টিনটিন ন্যানির কাছেই থাকে। আগে ও এত জেদ করত না, স্কুলে যাওয়ার পর থেকেই মা নিয়ে ওর একটু মন খারাপ ভাব, জেদ এসব এসেছে। কিছুদিন আগে তার এসব জেদের জন্য আমি..
কথাটা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন তিনি। আমি অপলক তাকিয়ে রইলাম। কি করেছিলেন তিনি? মেয়েটাকে মেরেছেন? একটু সময় নিয়ে তিনি বললেন,
-‘আই স্কোলডেড হার। এরপর থেকে সে আর আবদার করেনি এমন কিছুর। কথা বলাও কমিয়ে দিয়েছে। আমি বুঝিয়েও বলেছি অনেক। লাভ হচ্ছে না।’
আমি মাথা নেড়ে বললাম,
-‘আমি বুঝতে পেরেছি মি. আহমেদ। তবে ভালো হতো আপনি ওকে না বকে ধীরে সুস্থে বুঝিয়ে বললে।’
-‘আই থিঙ্ক সো।’
-‘ওর বন্ধু বান্ধব নেই কোনো?’
-‘না। ও মিশতে চায় না কারো সাথে।’
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। মেয়েটার জন্য আমার মায়া হলো ভীষণ। আমি টিনটিনের বাবাকে আশ্বস্ত করলাম আমাদের আর্ট স্কুল থেকে আমরা সবাই যথাসাধ্য চেষ্টা করব টিনটিনের এই মন খারাপ দূর করে ওকে হাসি খুশি রাখার। উনি শুনে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিলেন বোধ হয়। আমাকে তার ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বললেন,
-‘কোনো সমস্যা হলে আমার নাম্বারে কল করবেন মিস।’
এরপর থেকে আমি সবসময় টিনটিনের খেয়াল রাখতাম। সবসময় চেষ্টা করতাম ও যেন একটু ফ্রী হতে পারে সবার সাথে। ক্লাসের সবার সাথে ওর পরিচয় করিয়ে দিলাম। একটা সময় ওর সাথে আমারই সখ্যতা বেড়ে গেল। টিনটিন বন্ধুদের থেকেও আমার সাথেই থাকতে পছন্দ করত খুব। যেদিন ক্লাস থাকত সেদিন সে সবার আগে চলে আসত। এসেই গল্পের ঝুড়ি খুলে বসত। আমি তখন অবাক হয়ে ভাবতাম, আশ্চর্য! এটা সেই মেয়েটা? যে চুপ করে ক্লাসের এক কোণে বসে জানালার দিকে মুখ করে তাকিয়ে থেকে আকাশ দেখত?
একদিন ক্লাস শেষে টিনটিন আবদার করল ওর সাথে আমাকে বরফ পানি খেলতে হবে। আমি বললাম দুজনে খেললে তো মজা নেই। ও চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল ও ছুটবে আর আমাকে ওর পিছু নিতে হবে, ওকে পাকড়াও করতে হবে। আমি প্রথমে রাজি হইনি। ও খুব অনুরোধ করতে লাগল যে আমি রাজি না হয়ে পারলাম না। আসলে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে না বলা সম্ভব নয়। আমি ওই নিষ্পাপ, ছোট্ট মা হারা বাচ্চাটাকে না বলিই বা কী করে? ওর কথা মতো ছুঁইছুঁই খেলা শুরু হলো। ওকে ছুঁতে পারলেই আমি জিতে যাবো। এটা আহামরি কঠিন ছিল না আমার জন্য। এক নিমিষেই ওকে ধরে ফেলা আমার বা হাতের কাজ। কিন্তু তাতে বাচ্চাটার আনন্দটা অল্পতেই শেষ হয়ে যাবে। তাই মিছেমিছি ছুটছিলাম আর বারবার বলছিলাম,
-‘টিনটিন দাঁড়াও, আমাকে ধরতে দাও।’
ও হাসছিল আর দৌঁড়াচ্ছিল। আমি যখন শেষবার ডাকলাম তখন সে পেছন ফিরে বলল,
-‘আমাকে ধরতে পারবে না।’
সাথে সাথেই হোঁচট খেয়ে ও পড়ে গেল। আমি দৌঁড়ে গিয়ে ওকে তুললাম। গায়ের মাটি ঝেড়ে দিয়ে ব্যাকুল হয়ে জানতে চাইলাম কোথায় আঘাত পেয়েছে? সে নিজের হাঁটু দেখাতেই আমি দেখলাম কিছুটা ছিলে গেছে জায়গাটা। ওকে কোলে তুলে নিয়ে যখন আমি যখন অফিস রুমের দিকে রওনা দিব তখনই খেয়াল করলাম একজন আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছেন। ডার্ক ব্লু শার্ট আর ব্ল্যাক প্যান্ট পরিহিত এক যুবা পুরুষ, যার এক হাতে পরনের ব্ল্যাক কোর্টটা ঝুলছে। একটু ক্লান্ত আর অগোছালোও লাগছে বটে মানুষটাকে। অবাক করা বিষয় এতেও তার সেই চার্মিং ভাবটা কাটেনি বরং আরো কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। লোকটা তখন আমাদের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। টিনটিন তাকে দেখেই ‘বাবা’ বলে চেঁচিয়ে উঠল। মি. আহমেদ একটু এগিয়ে এসে আমার কোল থেকে টিনটিনকে নিয়ে নিলেন। আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। কি না কি ভাবছেন লোকটা? আমি থাকতেও তার মেয়েটা পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে। নিশ্চয়ই খুব রেগে গেছেন উনি। আমি তাই দ্রুত বলে উঠলাম,
-‘ইটস্ ওকে মিস। এটা খুব স্বাভাবিক। বাচ্চারা খেলতে গিয়ে একটু আধটু আঘাত পাবেই। বড় কেউ বাচ্চাদের সাথে খেলতে গিয়ে আঘাত পেল কিনা সেটাই দেখার বিষয়।’
টিটকিরি করল কিনা বুঝলাম না। তবে আমি ভীষণ লজ্জা পেলাম। উনি বললেন,
-‘ওর খেয়াল রাখার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ মিস। আজ তবে আসছি। পরে কখনো দেখা হবে আবার।’
আমি ইতস্তত করে বললাম,
-‘ওর পায়ে একটু স্যাভলন লাগিয়ে দেই? ইনফেকশন হতে পারে! আমার কাছে আছে ফার্স্ট এইড বক্স।’
-‘শিওর!’
আমরা দুজন পাশাপাশি হাঁটতে লাগলাম। টিনটিন তার বাবার কানে ফিসফিস করে কি যেন বলছিল বারবার। আমার জানার আগ্রহ জাগলেও জানতে চাইলাম না। বাবা মেয়ের ব্যাপারে আমার না ঢোকাই উত্তম। রুমে এসে আমি যখন স্যাভলন হাতে নিলাম টিনটিন চেঁচিয়ে উঠল। আমি অবাক হয়ে গেলাম। ওর বাবা বললেন,
-‘ও স্যাভলন লাগাতে ভয় পায়। একটু জ্বা’লা করে তো, সহ্য করতে পারে না।’
আমি টিনটিনকে বুঝিয়ে বললাম এখন একটু জ্ব’ললেও পরে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এখন না দিলে পরে দেখা গেল ইনফেকশন হবে। তখন ইনজেকশন দেওয়া লাগে যদি? টিনটিন ইনজেকশনের কথা শুনে আরো ঘাবড়ে গেল। ওর বাবার দিকে তাকালো আতঙ্কিত হয়ে। ওর বাবাও মাথা নেড়ে সায় জানালো আমার কথার। টিনটিন রাজি হলো। আমি খুব সাবধানে কাঁ’টা স্থান স্যাভলন দিয়ে ওয়াশ করে ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিলাম। ওরা যাওয়ার আগে আমি আদর করে ওর কপালে চুমু খেয়ে বললাম,
-‘ভালো থেকো। নিজের খেয়াল রেখো।’
ও চমকে উঠে বলল,
-‘কেন? তুমি থাকবে না আমার খেয়াল রাখার জন্য?’
মি. আহমেদের সামনে ওর করা এমন প্রশ্নে আমি একটু বিব্রতবোধ করলাম। বললাম,
-‘আমার সাথে তো তোমার আবার নেক্সট উইক দেখা হবে। আমি তো সবসময় তোমার সাথে থাকব না। এই কয়দিন নিজের যত্ন নিও।’
-‘উফ! সেটা তো অনেক দিন।’
আমি হেসে ফেললাম ওর কথা শুনে। ওদেরকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। মি. আহমেদ যাওয়ার আগে আরেকবার ধন্যবাদ জানাতে ভুললেন না।
পরের সপ্তাহের শনিবারে আমার জরুরী কাজ থাকায় আমি সেদিন স্কুলে আর যেতে পারিনি। পরদিন রবিবারেও যাওয়া হয়নি। সেই দুই দিনই আবার টিনটিনের ক্লাস ছিল। রবিবার মাঝ রাতে একটা অচেনা নাম্বার থেকে আমার ফোনে কল আসে। আমি রিসিভ করলে ওপাশে ব্যক্তি পরিচয় দিলেন তিনি টিনটিনের বাবা। আমি ভীষণ চমকে গেলাম। পরমুহূর্তেই মনে হলো টিনটিনের কিছু হলো নাকি? তিনি জানালেন তেমন কিছুই না। টিনটিন দুই দিন আমার দেখা পায়নি। মিস করছিল আমায়। কথা বলতে চায়। আমি টিনটিনের সাথে কথা বললাম বেশ কিছুক্ষণ। ও রাগ করেছে খুব। আমি স্যরি বলে মাফ চাইলাম। ও বলল পরদিন ওর জন্মদিন। আমি যেন যাই। তাহলেই ও আর রাগ করে থাকবে না। ওর কথা শেষ হলে মি. আহমেদ ও আমায় অনুরোধ করলেন আমি যেন টিনটিনের জন্মদিনে যাই। সরাসরি না বলতে পারলাম না। বললাম সময় বের করতে পারলে যাব।
পরদিন সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই এমন সময়ে আমি তাদের বনানীর বাসায় গিয়ে উপস্থিত হলাম। গিয়ে তো আমি রীতিমত তব্দা খেয়ে গেলাম। এত বড় বাড়িতে, দুই তিনটে কাজের লোক আর একজন বৃদ্ধা আর টিনটিন ছাড়া কেউই নেই। টিনটিন আমাকে দেখে ছুটে এলো। আমি কোলে তুলে নিলাম ওকে। হাতের টেডি বিয়ারটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,
-‘হ্যাপি বার্থডে লিটেল পাম্পকিন।’
টিনটিন টেডি বিয়ার দেখে খুশি হয়ে গেল। আমার কোল থেকে নেমে টেডি নিয়ে সোফায় গিয়ে বসল। বয়স্ক ভদ্র মহিলা এগিয়ে এলেন আমার দিকে। আমি বুঝতে পারলাম উনি টিনটিনের দাদু। সালাম দিতেই তিনি আমাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরলেন। তার ভীষণ অমায়িক ব্যবহারে আমি মুগ্ধ হলাম। কথায় কথায় জানতে পারলাম টিনটিনের জন্মদিন হলেও দিনটা টিনটিনের মায়ের মৃত্যুবার্ষিকীও তাই কখনোই অনুষ্ঠান করে কিছু করা হয় না। এতিম খানায় বাচ্চাদের খাওয়ানো হয়, গরীব দুঃখীদের দান খয়রাত করা হয় ব্যাস এটুকুই। আর বাসায় টিনটিন একটা কেক কাটে ওর বাবা আর দাদুর সাথে। আমার মনেই ছিল না কথাটা। আমি টিনটিনের দিকে তাকালেম। সে আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল। আমার ওর জন্য সহমর্মিতা জাগল। ছোট আয়োজন যদিও মুখেই ছিল আদৌতে তেমনটা ছিল না। খাওয়া দাওয়ার এলাহি কান্ড দেখে আমার মাথায় হাত। সব নাকি আমায় খেতে হবে। টিনটিনের দাদু নিজ হাতে রান্না করেছেন সব। এত এত আইটেম দেখে আমার ক্ষুধা মিটে গেল। আমি এত খেতে পারলাম না। উনি জোর করলেন খুব তবুও আর খেতে পারিনি। আমি আসলে রাতে এত খাই না। দুইটা রুটি আর সবজি বা ডিম ভাজা দিয়েই আমি ডিনার করি। আর আটটার মধ্যেই খেয়ে নেওয়ার অভ্যাস আমার। তারপর দশটায় বেডে গিয়ে এগারোটায় ঘুম। ওই এক ঘন্টা আমি মুভি দেখি অথবা বই পড়ি।
নয়টার দিকে টিনটিনের বাবা ফিরলেন। আমি তখন চলে আসার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। সবাই আমাকে কেক কাটার সময় পর্যন্ত থাকার জন্য অপেক্ষা করতে বললেন। টিনটিন বলল আমি চলে গেলে সে কেক কাটবে না। অতঃপর আরো কিছুক্ষণ থাকলাম। কেক কাটার পর আমি যখন ফিরব তখন আন্টি তথা মি. আহমেদের মা বললেন,
-‘লিয়া? তুমি কি বলো! ওয়াসিফের এখন একটা বিয়ে করা উচিত না?’
আমি কি বলব? আমার এখানে বলারই বা আছে কী? তবে গুরুজনের প্রশ্ন এড়িয়ে যেতেও পারলাম না। আর তাছাড়া ওনার ছেলের এখনও সামনের একটা বড় অধ্যায় পড়ে আছে। মা হিসেবে উনি নিশ্চয়ই চান তাঁর ছেলে নতুন করে শুরু করুক সবটা। আমি তাই বললাম,
-‘জ্বি। উচিত নিশ্চয়ই।’
মি. আহমেদ আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন তখনই। আমি বুঝতে পারলাম না এভাবে কেন তাকালেন? রেগে গেছেন নাকি? ধুর! কারো পারিবারিক মা’মলায় আমার যাওয়ার কাজ নেই। আমি দ্রুত বিদায় নিয়ে নিজের বাড়ি ফিরলাম।
তিন দিনই পরই সেই আশ্চর্যজনক ঘটনাটা ঘটল। বাবা আমাকে জানালেন পাত্র পক্ষ দেখতে আসবেন। আমি প্রস্তুত ছিলাম না এমন কিছু শোনার জন্য। বাসায় এক দফা রাগারাগি হলো। বাবা বললেন বিয়ে তো বললেই হয়ে যাচ্ছে না। একটু দেখা সাক্ষাৎ হোক। ভাবিও বোঝালেন। বয়স বেড়ে যাচ্ছে আমার। আমি বুঝলাম, আমার বয়স বেড়ে যাওয়াতে ভাবির সমস্যাও বেড়ে যাচ্ছে। কি ভেবে রাজি হলাম। বিকেলে পাত্র পক্ষ এলো। আমি তখন আমার রুমেই শাড়ি পরে তৈরি হয়ে বসেছিলাম। হঠাৎ করেই টিনটিন দৌঁড়ে এলো। তাকে দেখে আমি চমকে উঠলাম। জিজ্ঞেস করলাম,
-‘কার সাথে এসেছ টিনটিন?’
-‘দাদুর সাথে।’
একটু পরেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো। আমার মা সব শুনে রাজি হলেন না। বাবাও হ্যাঁ বলতে পারলেন না তখনই। একটু সময় নিলেন। যাওয়ার আগে আন্টি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
-‘একটু ভেবে দেখো মা। আমার নাতনিটা মা ছাড়া বড় হয়েছে। তুমি ফিরিয়ে দিলে বাকি জীবনটাও মা ছাড়া থাকবে। আমি হয়তো ছেলের জন্য অন্য কাউকে বউ করে আনতে পারব, কিন্তু নাতিনের জন্য মা আনতে পারব না।’
আমার যে কি হলো! এই একটা কথা আমাকে গভীরে গিয়ে স্পর্শ করল। আমি ভাবুক হয়ে পড়ে রইলাম। রাতে ভাইয়া আর ভাবি, মা বাবাকে বোঝাতে লাগলেন প্রস্তাবটা ফেলে দেওয়ার মতো না। বিরাট বড় ধনকুবের ওয়াসিফ আহমেদ। খানদানি এবং অভিজাত বংশ তাদের। তাদের দশ বার বাজারে বেঁচতে পারবেন। ভাইয়ার কথা শুনতে আমার ভালো লাগছিল না। ভাইয়া কি নিজের মা বাবা কিংবা বোনকে এই চিনেকে? কারো নাম, যশ, খ্যাতি, সম্পদ এসবে কি আমাদের কোনো লো’ভ আছে? কোনো দিন ছিল কী?
মায়ের এক কথা একটা বিপত্নীক এবং এক বাচ্চার বাবা এমন ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিবেন না। তাদের মেয়ের তো কোনো ত্রুটি নেই। তবে কেন দিবেন এমন ঘরে বিয়ে? যদি বাচ্চা না থাকত তবুও হতো। একটা বাচ্চা আছে। এটা সম্ভব না। ভাইয়া রাগারাগি করে বাসা থেকে বের হয়ে গেলেন। তার এক কথা দিলে এই ঘরেই বোনকে বিয়ে দিবেন। ভাইয়ার উদ্দেশ্য কি জানি না। তবে আমার মিশ্র অনুভূতি কাজ করছিল।
সেই রাতে বারোটায় ও আমার ঘুম এলো না। আমি ঘরময় পায়চারি করছিলাম। বারোটার পর আমার ফোন বেজে উঠল। মি. আহমেদ কল করেছেন। আমি নার্ভাস হয়ে পড়লাম। এত রাতে কল করেছেন কেন তিনি? কি বলতে চান? আমি রিসিভ করলাম।
-‘মিস! আই আম এক্সট্রিমলি স্যরি। আমার পরিবারের কাজের জন্য আমি সত্যিই লজ্জিত। আমি জানতাম না মা এমন কিছু করবেন। ট্রাস্ট মি।’
ওয়াহিদ ফিরেছে গতকাল সন্ধ্যেয়। দু’সপ্তাহের টানা ঘুরাঘুরিতে ও যে কতটা ক্লান্ত সেটা বুঝেছে বাসায় পা দিয়ে। ফ্রেশ হয়ে বিছানায় যেতেই ঘুমে কখন তলিয়ে গিয়েছিলো বলতে পারবে না।
ফ্লাইট থেকে নেমে একবার, বাসায় ঢুকে আরেকবার ফোন দিয়ে ঠিকঠাক পৌঁছানোর কথা জানিয়েছিলো অপরাজিতাকে। এরপর ঘুমেই রাত পার করেছে। ফোন, মেসেজ দেওয়ার সুযোগ হয়নি। এখন বাজে সকাল দশটার মতো। শুক্রবার যেহেতু, অপরাজিতার ক্লাস নেই আজকে। বাসায়ই থাকবে। চাইলেই দেখা করতে চলে যাওয়া যায়। কিন্তু দুপুরে জুম্মায় মসজিদে যেতে হবে। ওইটুকু সময়ে অপরাজিতা কোথায় আবার অপেক্ষা করবে! তারচেয়ে দুইটার দিকে দেখা হলে সব থেকে ভালো হয়। ভেবেচিন্তে অপরাজিতাকে ফোন দেয় ও। ঘুম ঘুম কন্ঠে ভেসে আসে অপরাজিতার প্রশ্নভরা কথা, “হ্যালো! ওয়াহিদ। এতো সকালে উঠেছেন! আমি তো ভাবলাম অনেকক্ষণ ঘুমাবেন আজকে।”
ওয়াহিদ সহসা জবাব দিতে পারলো না। ঘুম ঘুম কন্ঠে যে এমন মাদকতা থাকতে পারে সেটা অপরাজিতার সঙ্গে প্রতিদিন সকালে কথা বলতে গেলে টের পায় ও। সকালে হেঁটে এসে অপরাজিতাকে ফোন দিয়ে ঘুম থেকে জাগানো রীতিমতো অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। সন্তপর্ণে শ্বাস ছেড়ে নিজেকে সামলায় ও। হাসিমুখে বলে, “গুড মর্নিং, অপরা। অনেকক্ষণই ঘুমিয়েছি। প্রায় এগারো ঘন্টার মতো।” হাই চেপে ছোট্ট করে অপরাজিতার বলা ‘ওহ’ শুনে ওয়াহিদের হাসি দীর্ঘ হয়। ও এবারে জিজ্ঞেস করে, “দেখা করবে আজকে? দুপুরে?” অপরাজিতা ভেবে উত্তর দেয়, “সেটা করতে পারি। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারবো না। সাড়ে চারটায় পড়াতে যেতে হবে। এন্ড বিফোর ইউ সে এনিথিং, নো! টিউশন ক্যানসেল করা যাবে না।” অপরাজিতার বলার ধরনে ওয়াহিদ শব্দ করে হাসে। অনুরোধের সহিত প্রশ্ন করে, “টিউশনটা কি তিনটায় নেওয়া যায়? তাহলে ছয়টায় দেখা করতে পারতাম।” অপরাজিতা স্টুডেন্টকে ফোন দিয়ে, ওকে শিওরলি জানাবে বলে ফোন রাখে। ওর কন্ঠে ঘুমের রেশ এখনও রয়ে গেছে। আরও খানিকক্ষণ বোধহয় ঘুমাবে। ততক্ষণ অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই।
ওয়াহিদ রুম ছেড়ে বেরোয়। ঘিয়ে ভাজা পরোটা খেতে ইচ্ছে করছে হঠাৎ করেই। ছুটির দিনে সকালের নাস্তা ওদের বাসায় সবাই একসাথে করার চেষ্টা করে। আজকেও আম্মু ডেকেছিলো ওকে নয়টার পর পর। কিন্তু আলসেমিতে উঠতে ইচ্ছে করেনি। এখন ঘিয়ে ভাজা পরোটার কথা বললে পরোটার সাথে দুই-একটা বকাও ফ্রিতে পাওয়া যাবে! অবশ্য আম্মুর বকা খাওয়া-ই যায়। ও চটজলদি মা’কে গিয়ে বললো পরোটার কথা।
জোহরা সুলতানা শুনলেন ছেলের কথা। কোনো উচ্চবাচ্য না করে ছেলেকে টেবিলে বসতে বলে ডিপ ফ্রিজ থেকে ফ্রোজেন পরোটা বের করলেন। চা বসিয়ে, ঘি দিয়ে পরোটা ভাজলেন সময় নিয়ে। নিজের মনে চলতে থাকা কথাগুলো গুছিয়ে নিলেন ছেলেকে বলবেন বলে। চা-পরোটা, গরুর মাংস নিয়ে ছেলের সামনে রেখে নিজেও বসলেন ওর মুখোমুখি চেয়ারে। ওয়াহিদ মায়ের থমথমে চেহারা তখনও খেয়াল করেনি। পরোটার সঙ্গে চা দেখেই মন খুশি হয়ে গেছে ওর। খেতে শুরু করে গরুর মাংস কতটা মজা হয়েছে সেটা বলতে গিয়েই টের পেলো মায়ের মন মেজাজ ঠিক নেই। সহসাই খাওয়া থেমে গেলো ওর। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কিছু হয়েছে আম্মু? তোমার মুড অফ কেনো?” জোহরা সুলতানা গম্ভীরস্বরে জবাব দিলেন, “মুড অফ হওয়াটা কী স্বাভাবিক না? তুই, তোর আব্বু আমাকে কিছুই বলছিস না। আকদের প্রায় তিন মাস হয়ে গেলো অথচ বউ এখনও বাসায় আসলো না। ক্লিয়ার করে বল সমস্যাটা কোথায়?”
ওয়াহিদ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। আম্মু এতো ক্ষেপে আছে জানতো না। কিছু বলার আগেই জোহরা সুলতানা আবার বলেন, “কোন নতুন বউয়ের সঙ্গে তার শাশুড়ীর একবারও কথা হয় না? বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা যখনই হোক, এতোদিনে একবার কথা বা দেখা হওয়া কী উচিত ছিলো না?” ওয়াহিদ মায়ের আক্ষেপ বুঝলো। মা’কে শান্ত করতে চাইলো। ওর চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে তিনি ফের বলে উঠেন, “তোর আব্বু কে কিছু জিজ্ঞেস করলেও লাভ নেই। ভাঙা রেডিওর মতো এক কথা! সময় হলেই নাকি প্রোগ্রাম হবে। সেই সময়টা হচ্ছে না কেনো? তুই আর তোর আব্বু মিলে কি লুকাচ্ছিস?” পরিস্থিতি আরও বিগড়ে যাচ্ছে। সেটা সামলাতেই ওয়াহিদ দ্রুত বলে উঠে , “কিছুই লুকাচ্ছি না আম্মু। বিয়ে টা হঠাৎ হয়েছিলো। তাই বলে প্রোগ্রাম তো হঠাৎ করা যায় না। আব্বুর, অপরাজিতার বাবার কত চেনা-জানা মানুষ! সবাইকে একসঙ্গে করতেও তো সময় লাগে।” ছেলের দেওয়া যুক্তি ভুল না। জোহরা সুলতানা কিছুটা নিভলেন। আগের চেয়ে শান্ত হয়ে বললেন, “সেটা মানলাম। কিন্তু তাই বলে এতো সময়ও লাগে না।” ওয়াহিদ রয়েসয়ে মা’কে বুঝায়, “এতো সময় কোথায়! এখনের বিয়েতে তিন-চার মাস ধরে শুধু প্ল্যানিংই হয় আম্মু। ওয়েডিং প্ল্যানার ঠিক করা, পছন্দের কনভেনশন হলে বুকিং দেওয়া, গেস্ট লিস্ট, শপিং, খাবার মেন্যু এসবে সময় লাগে না?”
জোহরা সুলতানা ভেবে দেখলেন কথা ভুল না। তার ছোট মেয়ের বিয়ের সময়ে যে কনভেনশন হলে প্রোগ্রাম আয়োজন করতে চাইলেন সেটায় বুকিংই দিতে হয় দু’মাস সময় হাতে নিয়ে। দেরি হয়, হোক। তবু মেয়ে আর জামাইয়ের ইচ্ছে ছিলো ওখানেই বিয়ে হবে। সবাই মেনে নিয়েছিলো। দুইমাস অপেক্ষা করেই শেষে বিয়ে হয়েছিলো। অপরাজিতারও এমন ইচ্ছে হতেই পারে। সেটায় কোনো অসুবিধে নেই। তার প্রশ্ন অন্যখানে। তিনি মন খারাপ করে ছেলেকে বলেন, “সব বুঝলাম। তবুও আমার মনে হয় কিছু একটা ঠিক নেই।”
মায়ের দুশ্চিন্তা বোঝে ওয়াহিদ। কিন্তু সিচুয়েশনটা এতোই গোলমেলে, চাইলেই সত্যিটা বলা যায় না। ও অসহায় বোধ করে। মন খারাপটা আটকে রেখে প্লেটের পরোটার দিকে মনোযোগ দিতে চেষ্টা করে। অথচ একটু আগের প্রচন্ড খিদে কোথায় মিলিয়ে গেছে।
জোহরা সুলতানা গভীর চোখে ছেলেকে লক্ষ্য করেন। নিজকে প্রশ্ন করেন, সব যদি বেঠিকই হতো ওয়াহিদ কী শ্বশুরের সঙ্গে ইন্ডিয়া যেতো? তার খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে অপরাজিতার সঙ্গে ওয়াহিদের কথা হয় কি না। তবে ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখেন। ছেলে বড় হয়ে গেছে। বিয়ে করে ফেলেছে। নিজেরটা ভালোই বোঝে। চাইলেই হাজারটা প্রশ্ন তিনি করতে পারেন না। কিছুদিন পর বউ এলে এমনিতেও নিজের ফ্ল্যাটে চলে যাবে।
ওনাদের পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের প্রথম দু’তলা ডুপ্লেক্সের আদলে করা হলেও পরের তিন তলায় স্বাভাবিক নিয়মেই এক ইউনিটের ফ্ল্যাট। ওয়াহিদের আব্বু তিন ছেলেকে যথাক্রমে তিন, চার, পাঁচ তলার ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিয়েছেন। বিয়ের পর ছেলেরা বউ নিয়ে যার যার ফ্ল্যাটে উঠে যাবে এমনটাই ঠিক হয়ে আছে। বড় ছেলে ওয়ালিদের পর এবার মেজ ছেলে ওয়াহিদের পালা।
একসময় ভরা সংসার ছিলো জোহরা সুলতানার। চার মেয়ে-তিন ছেলে কখনও মিলেমিশে, কখনও ঝগড়া-মারামারি করে বাড়ি মাথায় করে রাখতো। তাদের এই বিশাল বাড়ি তখন যতোটা মুখরিত থাকতো এখন ততোটাই শব্দহীন হয়ে থাকে। মেয়েদের নিজের সংসার হয়েছে। তারা আসা-যাওয়ার মাঝে থাকলেও, ব্যস্ততায় সেটাও বেশি সম্ভব হয় না। এখন প্রতি শুক্রবার ছেলেদের নিয়ে একসঙ্গে খাওয়ার চেষ্টা করেন কেবল। সেটাও সবসময় হয়ে উঠে না। একেকজনের কাজকর্ম, অফিস পার্টি লেগেই থাকে। ছোট ছেলে ওয়াসিফও যখন চলে যাবে নিজের ফ্ল্যাটে তখন এতো বড় বাড়িতে তিনি আর মাজহার সাহেব একা থাকবেন, ভাবতেই বুকের ভেতরে হাহাকার টের পান। কিন্তু কিছু করার নেই। এটাই জগতের নিয়ম। ছেলেমেয়েরা কেনো জলদি বড় হয়ে যায়? কেনো অতটা বড় হয় যতটা বড় হলে সম্পর্ক ঠিক রাখতে দূরে চলে যেতে হয়?
দীর্ঘশ্বাস গোপন করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। সেই সঙ্গে যেনো ঝেড়ে ফেলেন সকল মন খারাপ, অস্থিরতা, দুশ্চিন্তাদের। আজীবন ধরে দূরে চলে আসার নিয়ম তিনি যেমন মেনেছেন তার ছেলেমেয়েরাও একইভাবে মানবে। দেখে যাওয়া ছাড়া এখানে তার আর কোনো ভূমিকা নেই।
***
ওয়াহিদ তৈরি হচ্ছিলো নামাজে যাবার জন্য। ঘড়ির কাঁটায় একটা বাজে তখন। ওর মন খারাপের অবসান ঘটিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে অপরাজিতার মেসেজে আসে সেইসময়, “গুড মর্নিং ওয়াহিদ। যদিও দুপুর হয়ে গেছে। তা-ও। স্যরি, তখন ভয়াবহ ঘুম পাচ্ছিলো। আবোলতাবোল কিছু বললেও ওটা কিন্তু আমি নই! সাড়ে পাঁচটায় দেখা করতে পারবো। খিলগাঁওয়ের দিকে যেতে ইচ্ছে করছে। রিকশায় করে। যাবেন?”
না যাওয়ার কোনো কারণ ওয়াহিদের নেই। বরং এইটুকু কথায় ওর মনের কোনে জমে থাকা সকল বিষাদ ছুটি নিলো। রিপ্লাইয়ে কোনো অসুবিধে নেই জানিয়ে দিয়ে, নিজ মনেই হাসলো।
নামাজ শেষে বাসায় ফিরে, সবার সঙ্গে লাঞ্চ করতে বসলেও আশ্চর্যজনক ভাবে খেয়াল করলো ওর অস্থির লাগছে। খাচ্ছে, কথা বলছে ঠিকই কিন্তু মন চলে যাচ্ছে অপরাজিতার কাছে। এতদিন পর দেখা হবে বলেই কী এই অস্থিরতা? খাওয়ার পাট চুকিয়ে ও দ্রুত তৈরি হয়। টি-শার্ট পরবে ভেবেও মত বদলে জিন্সের সাথে সাদা শার্ট পরে ফেলে। সাদা শার্ট পরলে বউ যে একটু বেশি বেশি তাকায় সেটা ও দেখেছে। বউয়ের চোখের মুগ্ধতার কারণ হতে পারা চাট্টিখানি কথা না!
ওয়াহিদ যখন বাসা থেকে বের হয় তখন সাড়ে তিনটের বেশি বাজে। জ্যামে পরলেও সময়মতো পৌঁছে যেতে পারবে। সিএনজি চলতে শুরু করতেই ওর অস্থিরতাও কমতে শুরু করে। মন-মস্তিস্ক থেকে যেনো সকল ইন্দ্রিয়ে অপরাজিতার দেখা পাওয়ার বার্তা পৌঁছে গেছে!
***
অপরাজিতা টিউশনটা এগিয়ে তিনটায় নিয়ে এসেছিলো। পড়ানো শেষ করে সাড়ে চারটায় বের হতে পারলেও বাসায় আসতে সময় লেগেছে ওর। ঘড়ির কাঁটায় পাঁচটা বিশ বাজতেই ওয়াহিদ ফোন কলে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়েছে।
নিজেকে তাড়া দেয় অপরাজিতা। চোখেমুখে পানি দিয়ে, দ্রুত তৈরী হওয়ার চেষ্টা করে। ডেনিম ওয়াইড লেগ জিন্সের সাথে বটল গ্রীন ফ্লেয়ারড টপসে নিজেকে সাজায়। ফ্লোরাল ওরনা গলায় পেঁচিয়ে, এলো চুলে লুজ পনিটেইল করে। ডাইনিংরুমে বেসিনের সামনে থাকা আয়নায় একবার উঁকি দেয়। কিছু একটা মিসিং মনে হতেই বারগান্ডি রেড লিপস্টিক ঠোঁটে ছোঁয়ায়। এবার ঠিক লাগছে কি না সেই ভাবনা বাদ দিয়ে ফোন, ব্যাগ, চাবি নিয়ে দরজা লক করে বের হয়।
ওয়াহিদ দাঁড়িয়েছিলো বাসার সামনের রোডে গলির মুখে। অপরাজিতাকে দেখে নিঃসংকোচে স্বীকার করে, “ইউ আর সিস্পলি বিউটিফুল!” ওয়াহিদের সরল স্বীকারোক্তি, চোখের উন্মাদনায় অপরাজিতা লাজুক হাসে। সমস্ত তনু-মনে অদ্ভুত ভালোলাগা হুটোপুটি খায়। নিজের মধ্যে এক ঝাঁক প্রজাপতির অস্তিত্ব খুঁজে পায়। মনে হয় ইংরেজিতে বলা ‘বাটারফ্লাইস ইন স্টোমাক’ কথাটা একবিন্দুও মিথ্যে নয়!
ওরা যাচ্ছে খিলগাঁও তালতলায়। ধানমন্ডি থেকে রিকশায় ওখান পর্যন্ত যাওয়াটা বেশ সময়ের ব্যাপার। তবে রিকশায় ঘুরে বেড়ানো মূল উদ্দেশ্য হলে এই সময়টা বেশ উপভোগ্য। রিকশায় বসে ওরা পুরোটা সময় গল্প করলো। ইন্ডিয়ায় দু’সপ্তাহ কেমন ছিলো সেটা ওয়াহিদ চমৎকার গুছিয়ে বললো। অপরাজিতা কে সঙ্গে করে আবার যেতে চায় সেটাও অকপটে বলে ফেললো। অপরাজিতা বললো দু-তিন দিন আগে মাঝরাতে ঝুম বৃষ্টির কথা। ও আর মুনিরা মিলে তখনই কেমন খিচুড়ি রান্না করে খেয়েছে সেই গল্প করলো হাসিমুখে। ওয়াহিদ তখন জানালো ওর মনের ভেতরের সুপ্ত ইচ্ছে। সে অপরাজিতা কে সঙ্গে নিয়ে হুড খোলা রিকশায় বৃষ্টিতে ভিজতে চায় কোনো এক সন্ধ্যেয়। সেটা শুনে অপরাজিতা খুব হাসলো। হাসির তোরে ভেসেই প্রশ্ন করলো কেনো সন্ধ্যেয়? কেনো বিকেলে বা দুপুরে না? ওয়াহিদ তখন খুব সিরিয়াস হয়ে বললো, “এজ অ্যা পারসন আই অ্যাম ভেরি পজেসিভ! আর তোমাকে নিয়ে ঠিক কতটা পজেসিভ সেটা তুমি আন্দাজও করতে পারবে না।” অপরাজিতা এই কথাতেও হাসলো। মজা করে জানতে চাইলো, “শুধু পজেসিভ? একটুও জেলাস না?” ওয়াহিদ খুব ভাব নিয়ে বললো, “উহু। জেলাসি আমার কখনোই হয়না কোনো ব্যাপারে।” অপরাজিতা তখন ওকে শিহাব ভাইকে কেন্দ্র করে ঘটা কাহিনী শোনালো। সবটা শুনে ওয়াহিদ চোখমুখ কুঁচকে বললো, “প্রেমে পড়ে ছেলেরা মোটামুটি গাধা টাইপ কাজকর্ম করে ফেলে। রিপা পাগল-ছাগল ডেকে ভুল করেনি।” অপরাজিতা অবাক হয়ে গেলো ওর রিয়াকশনে। ও ভেবেছিলো ওয়াহিদ জেলাস হবে! এমন উদ্ভট একজনকে বাবা কোথায় পেলো!
তালতলায় এসে ওরা আগে তালতলার বিখ্যাত কফিশপের হট ক্যাপোচিনো কফি খেলো। এরপর তালতলা মার্কেটের মাঝখানে বসা ফুটপাথের ছোট ছোট দোকান ঘুরে অপরাজিতা নোজপিন, কাঁচের চুরি কিনলো। মার্কেটের পেছনে থাকা ভেলপুরির স্টল থেকে দুজনে ভাগাভাগি করে ভেলপুরি খেলো। আরেকটু সামনে এগিয়ে ঘুরে ঘুরে বাসায় পরার জন্য আরাম আরাম টাইপ টি-শার্ট কিনতে চাইলে ওয়াহিদ পছন্দ করে দিলো। মার্কেট থেকে বেরিয়ে ওখানেই এক স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে ফুচকা খেলো। ওয়াহিদের ফুচকা অতটা পছন্দ না। ও এক পিস টেস্ট করলো কেবল।
এরপর হেঁটে হেঁটে তালতলার মেইন রেস্টুরেন্টের এরিয়াতে এসে, এতো এতো রেস্টুরেন্ট দেখে কোথায় বসবে সেটা নিয়ে কনফিউশানে পরে গেলো। সি থ্রু রেস্টুরেন্ট গুলোর জানলায় দেখলো কোনোটাই তেমন খালি না। সবখানেই মানুষের এতো আনাগোনা দেখে ওরা কিছুক্ষণ হাঁটলো। শেষে পাস্তা খাবে ঠিক করে একটা রেস্টুরেন্টে যেয়ে বসলো। অপরাজিতার স্পাইসি নাগা পাস্তার বিপরীতে ওয়াহিদের সুইট পাস্তা বাস্তার কম্বিনেশনে ওয়েটার কী অবাক হলো একটুখানি? কী জানি!
খাওয়া শেষে ধানমন্ডি ফিরতে এবার ওয়াহিদ সিএনজি ঠিক করলো। একটা গাড়ি থাকলে এখন কতো ভালো হতো সেটা ভেবে একটু মন খারাপ হলো ওর। সেটা লক্ষ্য করে অপরাজিতা অবাক হলো। জানতে চাইলো কি হয়েছে। ওয়াহিদ বলবে কি না বুঝতে পারছিলো না। তারপর মনে হলো অপরাজিতার নিজের যুদ্ধটা এখনও বাকি। সেখানে ওর কেনো গাড়ি নেই, বা ওর গাড়ি কেনার প্ল্যানিং নিতান্তই তুচ্ছ ব্যাপার। ও কথা ঘুরিয়ে বললো, “তোমাকে ড্রপ করার সময় হয়ে যাচ্ছে। মন খারাপ হওয়াটাই তো স্বাভাবিক।” অপরাজিতার বিশ্বাস হলো না সেটা। তবে সিএনজিতে বসে আর কথা বাড়ালো না। পুরো রাস্তা দু’জনেরই কাটলো নিঃশব্দে।
ধানমন্ডি এসে পৌঁছাতে দশটা চল্লিশের মতো বাজলো। অপরাজিতার মনে অলরেডি প্রশ্ন জমে ছিলো। একটু আগে আরো প্রশ্ন যোগ হয়েছে সেখানে। এতোসব প্রশ্ন নিয়ে ও কোনোভাবেই বাসায় যেয়ে শান্তি পাবে না। কিন্তু এই মুহূর্তটাও কথা বলার জন্য পারফেক্ট না। তার উপর গেইট বন্ধ করার সময় হয়ে গেছে। নিজেকে সামলে নেয়। কয়েক মুহূর্ত ভেবে আগামীকাল দেখা করতে পারবে কি না জিজ্ঞেস করে ওয়াহিদকে। ওয়াহিদ রাজি হয় সানন্দে। অপরাজিতার সঙ্গে দেখা করতে ওর কোনো না নেই।
***
অনেক ভেবেচিন্তে অপরাজিতা ঠিক করেছে ওয়াহিদকে বাসায় আসতে বলবে। রেস্টুরেন্টে বসে এতো সব কঠিন প্রশ্ন করা যায় না। একচুয়েলি হয়ে উঠে না। গতকাল দেখা করতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত ও ভেবেছিলো সুযোগ করে কথাগুলো জিজ্ঞেস করতে পারবে। কিন্তু এতো মানুষ, হৈচৈয়ের ভীড়ে সম্ভব হয়নি। আজকেও সেরকম কিছু যেনো না হয় তাই ওর এই ডিসিশন। মুনিরা সকালে বেরিয়ে গেছে। সন্ধ্যের আগে ফিরবে না। তারপরও অপরাজিতা ওকে বিষয়টা জানিয়েছে। মুনিরা খুশি মনে বলেছে তার কোনো প্রবলেম নেই। বরং ওরা যেনো আরাম করে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করে! হাহ! যদি মুনিরা জানতো কি সব জটিল সমীকরণ নিয়ে অপরাজিতা দিন পার করছে তবে এই উইশ নিশ্চয়ই করতো না। অপরাজিতা আরেকটা কাজ করেছে। বাড়িওয়ালাকেও ব্যাপারটা জানিয়েছে। এই বাসাটায় ফ্যামিলি থাকে দুই/একটা ফ্ল্যাটে। বাকি সবটাতেই স্টুডেন্ট অথবা কর্মজীবী মেয়েরা থকে। সেখানে হুট করে ওয়াহিদকে নিয়ে আসাটা দৃষ্টিকটু। কোনোরকম কনফিউশান চায় না অপরাজিতা। তাই আগেই সতর্ক হয়েছে।
সকাল থেকে ভেবেচিন্তে করা এতোকিছুর মধ্যে ওয়াহিদকে জানাতেই সবচয়ে দেরি হয়েছে। এগোরাটার দিকে যখন ফোনে জানালো ও বেশ অবাক হয়েছিলো। কীভাবে, কেনো, কী হচ্ছে বুঝতে না পেরে হাজারটা প্রশ্ন করছিলো। অপরাজিতা তখন বলেছে সব প্রশ্নের উত্তর বাসায় এলেই পাবে। ওয়াহিদ মেনে নিয়েছে। স্বভাবসুলভ হাসিতে জিজ্ঞেস করেছে, “আমার জন্য স্পেশাল কী রান্না করবেন, ম্যাডাম?” এরপরে অপরাজিতার খেয়াল হয়েছে দুপুরে শুধু গুরুগম্ভীর আলোচনা করলেই হবে না লাঞ্চও করতে হবে! সেই থেকে এখন অব্দি ও রান্নাঘরেই। রান্নাটা মোটামুটি কাজ চালানোর মতো ভালোই জানে ও। কিন্তু প্রথমবার ওয়াহিদকে রান্না করে খাওয়ানোটা এক্সট্রা টেনশন দিচ্ছে ওকে। যদিও ভাত, ডাল, মুরগী ভুনা, মাছ ভাজার মতো সহজ রান্নাই করেছে। তারপরও চিন্তা হচ্ছে। কখনো মনে হচ্ছে ঝাল বেশি হয়ে গেলো! আবার কখনো মনে হচ্ছে আইটেম কম হয়ে গেলো! এদিকে দেড়টা বাজে, ওয়াহিদের আসতেও দেরি নেই। জলদি শাওয়ার নিয়ে ফেলা দরকার। নিজেকে প্রেজেন্টেবলও তো লাগতে হবে। সকাল থেকে করা এতোসব কাজে অপরাজিতার মনে প্রশ্ন জেগেছে সংসার কী এভাবেই শুরু হয়? এক’পা-দু’পা করে?
ওয়াহিদ এলো একটু দেরি করে। মিষ্টি, চকলেটস, আইসক্রিমসহ আরো দু’টো ব্যাগে রাজ্যের জিনিসপত্র সঙ্গে নিয়ে। অপরাজিতাকে হেসে বললো, “তুমি দাওয়াত দিয়েছো। খালি হাতে আসি কী করে!” ওর কথায় অপরাজিতা কেবল মাথা নাড়লো। এমন আধপাগলা মানুষ বাবা কোথায় পেলো!
খেতে বসে ওয়াহিদ খেলো আরাম করে। সময় নিয়ে। অপরাজিতা যতটা ভয় পাচ্ছিলো তেমন কিছুই হলো না। ওয়াহিদের চেহারায় পরিতৃপ্ত ভাবটা ক্লিয়ারলি বুঝিয়ে দিলো এই মানুষটাকে তুষ্ট করা সহজ। খাওয়া শেষে ওয়াহিদ বারান্দায় গিয়ে বসলো। অপরাজিতা টেবিল গোছগাছে ব্যস্ত তখন।
বারান্দায় বসে ওয়াহিদ দূরের আকাশে নিজের মন খারাপটা উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করে। অপরাজিতা হঠাৎ কেনো বাসায় আসতে বললো সেটা সঠিক না জানলেও আন্দাজ করা যায়। ওয়াহিদের কাছে অপরাজিতার প্রশ্নের জবাব আছে। কিন্তু ও নিজে যে ভুলটা করেছে সেটার কোনো উত্তর নেই। আজকে এই বাসায় না এলে ও কখনোই হয়তো বুঝতো না ওর ভুলগুলো কত বিশাল। দু’টো বেডরুমের এই বাসায় দরজা খুলতেই মাঝখানের ডাইনিং স্পেস চোখে পরে। বেডরুমের সাইজ ছোট হলেও অপরাজিতা নিজের মতো সাজিয়েছে। রান্নাঘরটা একজন মানুষের একা কাজ করার জন্য ঠিকঠাক। বড়সড় এই বারান্দায় বসে সহজেই মন খারাপগুলোকে ছুটি দেয়া যায়। কিন্তু সারাজীবন আরাম-আয়েশে, বাবার অতি ভালোবাসায়, আম্মুর আদরে-আহ্লাদে বড় হওয়া অপরাজিতার জন্য এগুলো কোনোকিছুই ঠিক নয়। ওয়াহিদের এর আগে পর্যন্ত মনে হতো ও ভুল করেছে। হঠাৎ বিয়ের সিদ্ধান্তে রাজি হয়ে অপরাজিতাকে কষ্ট দেওয়ার মতো ভুল করেছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে অন্যায় করেছে। যে মেয়েটার প্রেমে পড়েছে, যাকে পাওয়ার জন্য অস্থির হয়েছে সেই মেয়েটা কী চায় ও ভাবেনি। একবারও জানার চেষ্টা করেনি। সেদিন বিয়ের গল্পটা ওর জন্য যতটাই আনন্দের ছিলো, অপরাজিতার জন্য ততটাই কষ্টের-হতাশার ছিলো। এই সত্যটা ও আগে টের পায়নি। ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ অপরাজিতার পাওনা ছিলো। ও যদি অপরাজিতায় মুগ্ধ হয়ে বিয়ে করতে পাগল হতে পারে অপরাজিতারও ওয়াহিদে মুগ্ধ হয়ে হ্যাঁ বলার অধিকার আছে। অথচ ও এটা কী করলো?
অপরাজিতা বাড়ি ছেড়েছে জানার পর ও বিস্মিত হয়েছে। বিয়ের আসরে বুঝেছিলো, প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলা মেয়েটা, এই বিয়েতে হ্যাপী না। কিন্তু তাই বলে বাড়ি ছাড়বে ওটা ভাবেনি। তারপরও অপরাজিতার বাবা যখন বললো ওর সাথে দেখা করতে তখন ও ভীষণ খুশি হয়েছে। অভিমানীনির অভিমান ভেঙে ফেলতে পারবে সেই বিশ্বাসে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সময় লাগলেও, দেয়াল তুলে দিয়ে নিজের অনুভুতি লুকিয়ে রাখলেও, অপরাজিতা ওর ভালোবাসায় সাড়া দিয়েছে। কিন্তু অপরাজিতার মনে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে ওর কারণে সেটার সামনে ও কীভাবে দাঁড়াবে?
আইসক্রিম খাওয়ার জন্য ডাকতে এসে টুলে বসে থাকা অন্যমনস্ক ওয়াহিদ কে দেখে অপরাজিতা থমকে গেলো। গতরাতের মতো অস্থির অনুভব করলো। আলতো স্পর্শে ওয়াহিদের কাঁধে হাত রাখলে ও ফিরে তাকিয়ে মলিন হাসলো। সে হাসিতে ওয়াহিদকে এতো অসহায় দেখালো, অপরাজিতার মনে হলো কিছুই ঠিক নেই। কি করবে বোঝার আগেই ওয়াহিদ ওকে চট করে জড়িয়ে ধরলো। প্রথমবারের জড়িয়ে ধরার অনুভতি অনেক ম্যাজিকাল হতে পারতো। কিন্তু অপরাজিতার ঠেকলো বিষাদময়। এতো কিসের বিষাদ ওয়াহিদের? নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে, ওয়াহিদকে টেনে ওর রুমে নিয়ে আসে অপরাজিতা। ফ্লোরিং করা বিছানায় বসতে ইঙ্গিত করে নিজেও ওর পাশেই বসে। ওয়াহিদকে সময় দেয় খানিকক্ষণ। এতো অসহায়, ক্লান্ত কেনো লাগবে সদা প্রাণবন্ত এই মানুষটাকে?
“অপরা, তোমার সাথে আমি খুবই অন্যায় করেছি। কিন্তু একটু আগে পর্যন্ত সেটা বুঝিনি।”, নিজ থেকে বলতে শুরু করা ওয়াহিদের কথায় অপরাজিতা খেই হারায়। কথার অর্থ উদ্ধার করতে না পেরে প্রশ্ন করে, “কিসের অন্যায়? কি হয়েছে ওয়াহিদ? আপনি এতো ডিস্টার্বড কি নিয়ে? গত রাতেও খেয়াল করেছি।”
অপরাজিতার হাত আঁকড়ে ধরে ওয়াহিদ নিচু স্বরে বলে, “গত রাতে তোমাকে ড্রপ করার সময় আমার খুব আফসোস হচ্ছিলো। কেনো আমার একটা গাড়ি নেই? গাড়ি কেনার জন্য আমি টাকা সেইভ করছি। সামনের বছর হয়তো কিনে ফেলবো। গতরাতে এটা নিয়ে একটু আপসেট ছিলাম। কিন্তু এটা আমার মন খারাপের কারণ না। ব্যাপারটা খুব গোলমেলে। বুঝিয়ে বলতে পারছি না।”
অপরাজিতা আদতেই কিছু বুঝতে পারছে না। ওর দু’চোখের বিস্ময় জানান দিলো সেটা। ওয়াহিদ স্মিত হাসে। প্রশ্ন করে, “আগামী দু’বছরেও বিয়ের প্ল্যানিং নেই, বলেছিলাম তোমাকে। মনে আছে?” মাথা নেড়ে অপরাজিতা সায় দিতেই নিচুস্বরে বলতে শুরু করে ওয়াহিদ, “আমি আরো গুছিয়ে নিতে চেয়েছিলাম। গাড়ি কেনাটা সেই গুছিয়ে নেয়ার মধ্যেই পরে। নিজের ইনকামে গাড়ি কিনবো, পুরো ফ্ল্যাট সাজাবো তারপর বিয়ে, এটাই আমার প্ল্যান ছিলো। এই কারণেই বিয়ে নিয়ে আব্বুর কথায় গুরুত্ব দিতাম না। কিন্তু অপরা, তোমাকে দেখার পর সমস্ত প্ল্যানিং যেনো আমি ভুলে গেছি। বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলাম। বিয়ে করে ফেললাম। হুটহাট ডিসিশন আমি ইউজুয়ালি নিই না। অথচ তোমার ক্ষেত্রে এটাই করেছি। তোমাকে আমার পছন্দ। কিন্তু তুমি আমাকে পছন্দ করবে কি না সেটা চিন্তাই করিনি। তোমাকে সেদিন হুট করে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ফেললাম। তুমি রাজি হলে। কিন্তু কেনো হলে? মন থেকে কি আদোও রাজি হলে? সেটাও চিন্তা করিনি। তোমাকে ভালোবাসি, বিয়ে করলে তোমাকে পাবো এর বাইরে কিছুই ভাবিনি। তুমি আমার হুটহাট করা কাজের জন্য বাড়ি ছাড়লে, আমি তোমার অভিমান ভাঙাতে চলে এলাম। অথচ বুঝলামই না এই সকল ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু আমি। তোমার বাবার কাছে আমি বেস্ট চয়েজ হতে পারি। কিন্তু সেই বেস্ট চয়েজকে তুমি গ্রহণ করবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত তোমার। আমি, আমরা তোমাকে সেই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলাম। তোমার হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। আজকে এইখানে না আসলে আমি কখনোই ব্যাপারগুলো বুঝতাম না। শুধু বাবার সাথে অভিমান বলেই একটা মেয়ে সম্পূর্ন নতুন একটা জীবন বেছে নিবে? নাহ তো। তোমার অস্তিত্বের সাথে যুদ্ধ বলেই তুমি আজকে এখানে। তুমি আমাকে পছন্দ করেছো। কিন্তু দেয়াল ভাঙছো না। আমি ভাবলাম বাবার প্রতি অভিমান না মিটলে এই দেয়াল ভাঙবে না। অথচ বুঝলামই না অভিমানের দেয়াল বাবার সঙ্গে হলেও তোমার অস্তিত্বের লড়াইটা আমার সঙ্গে!”
এতোদিন ধরে লুকিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস সশব্দে ছাড়ে অপরাজিতা। নিচু কিন্তু দৃঢ়কণ্ঠে বলে উঠে, “ঠিক তাই ওয়াহিদ। আপনার বোঝায় কোনো ভুল নেই। গত তিন মাস ধরে আমি আপনাকে একটু একটু করে জেনেছি, দেখেছি, প্রেমে পড়েছি, ভালোবেসেছি। কিন্তু আপনার ভলোবাসায় সাড়া দেয়া নিজের সাথে অন্যায় করা। আবার না দেওয়াও অন্যায় করা। এই নিদারুন মানসিক সংঘাতে আমি ক্লান্ত। আপনি আমাকে ভালোবাসলেন, আমাকে চাইলেন অথচ তাড়াহুড়ো করলেন। আপনার ব্যক্তিত্বে আমি মুগ্ধ হয়েছি। বিয়ের আগেও যদি সামনে এসে দাঁড়াতেন, কথা বলতেন তবে কী মুগ্ধ হতাম না? বাবার চোখেমুখের প্রবল আকুতি আমাকে বিয়েতে হ্যাঁ বলিয়েছে। আপনার ব্যক্তিত্ব, সর্বোপরি আপনিতে মুগ্ধ হয়ে, আপনাকে ভালোবেসেছি, ভবিষ্যৎে সংসারও করবো। কিন্তু ওয়াহিদ, আমার ব্যক্তি স্বাধীনতা আছে। সিদ্ধান্ত নিতে পারার অধিকার আছে। এটা আপনারা ভুলে গেলেন কেনো? আপনি বাবার কাছে বেস্ট চয়েজ। আমার কাছেও বেস্ট চয়েজ কি না সেটা ভাবার সুযোগটাই আমি পাইনি। বিয়ের পরে জানলাম, ইয়েস মানুষটা আমার জন্য পারফেক্ট। বিয়ের আগে কী জানতে পারতাম না? আপনার প্রতি প্রগাঢ় যে অনুভূতি আমার হয় সেটা যতটা আনন্দের ততটাই আবার নিজের অস্তিত্ব সংকটে হেরে যাওয়ার মতো কষ্টের। হুট করে বিয়ের প্রস্তাব আপনারা দিলেও আমার বাবা সেটায় রাজি হয়েছে। এখানে আপনার দোষ নেই। এটা বাবার সাথে আমার বোঝাপড়া। বাবার জন্য মন পুড়লেও একারণেই ফিরে যেতে পারিনি। মেনে নিয়ে, মানিয়ে নিয়ে জীবন কাটানো আম্মু আমাকে শেখায় নি। তাই আপনাকে ভালোবাসলেও এই দেয়াল ভাঙুক চাইনি। ভালোবাসার থেকেও ভালোথাকা জরুরি।”
অপরাজিতা থেমে যোগ করে, “মনের মধ্যে এত জটিলতা নিয়ে সংসার করা যায় না ওয়াহিদ। আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলতে চাইনি। বিয়ের দিনের দমবন্ধকরা অনুভূতিটা আপনার জন্য এতো অন্যরকম মায়াময় সেটা ভেবে হাজারবার কষ্ট পেতে চাইনি। আপনাকে ভালোবাসলেও কষ্ট হচ্ছে। ভালো না বাসলেও যন্ত্রণা হচ্ছে। মানুষ হিসেবে আপনি যদি আরেকটু খারাপ হতেন তবে বোধহয় এই দ্বিধা-দ্বন্দে আমি জড়িয়ে পড়তাম না। আপনি ভালো বলেই বাবার প্রতি অভিমানটা হালকা হয়ে আসছে। বুঝতে পারছি বাবা আমার জন্য বেস্ট মানুষ টাকে পেয়েছে বলেই হুটহাট বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি বুঝেছি আপনাকে ভালোবাসি সেটা স্বীকার করলেই মানিয়ে নিয়ে জীবন পার করা হবে না। বরং আপনি যে ভীষণ ভালোবাসতে জানেন, সেটা নিয়ে আপনার সঙ্গে জীবন কাটানো হবে। ভালোবেসে ভালো থাকাটাও জরুরি, ওয়াহিদ। আমি আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি।”
ওয়াহিদের চোখেমুখে খেলা করা বিভিন্ন অনুভুতির ছটায় অপরাজিতা মিষ্টি করে হাসে। বলে, “বাবাকে জানাবেন, আমার আর সময় লাগবে না। তিনি যেনো জলদি আসেন।”
———————————————————————————–
চলবে
#বিয়েকথন
শেখ জারা তাহমিদ
শেষ পর্ব (সমাপ্তাংশ)
অনেক কাঙ্খিত মানুষটাকে পেয়ে যাওয়ার আনন্দ কতটা তীব্র হতে পারে সেটা ওয়াহিদ ভাষায় বর্ণনা করতে পারবে না কখনও। তবে আজ দু’দিন ধরে সব কিছুতে ভীষণ সুখ সুখ অনুভব হয় তার। অপরাজিতাও ভালোবাসে ওকে, এই ব্যাপারটাই যেনো ম্যাজিকাল। সেদিন অপরাজিতার কথায় কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গিয়েছিলো ও। মন বলছিলো অপরাজিতা হারিয়ে যাবে এবং সেটা ওর-ই দোষে। কিন্তু অপরাজিতা নিজের মনের দ্বন্দ্বে যেমন জিতে গেছে তেমনি জিতিয়ে দিয়েছে ওয়াহিদকেও। মনের জটিলতা মিলিয়ে দিয়ে চমৎকার করে আগলে নিয়েছে ওকে।
ওয়াহিদ, অপরাজিতার মেসেজ পৌঁছে দিয়েছে ওর বাবার কাছে। আনাম সাহেব মেয়ের কথা জেনে কোনো রিয়াকশন দেননি। শান্ত থেকেছেন। তবুও ওয়াহিদ জানে কী প্রচন্ড আকুলতায় তিনি এই ডাকের অপেক্ষায় ছিলেন। মেয়েকে সময় দিতে হবে, এই উপলব্ধি তার ছিলো বলেই শত অস্থিরতায়ও নিজেকে শক্ত খোলসে আটকে রেখেছিলেন। আনাম হাসনাত! অপরাজিতার বাবা! কি প্রবল আত্মবিশ্বাসে মেয়ের ফিরে আসার অপেক্ষা করেছেন!
***
টিউশন শেষে অপরাজিতা বাসায় ফিরছিলো। সারাদিনের ক্লান্তিটাকে সরিয়ে দিয়ে হেঁটে হেঁটে মাত্রই সন্ধ্যে নেমে আসা শহরটাকে ভীষণ আদুরে ঠেকছিলো ওর। মনের মধ্যে থাকা অনেকদিনের অস্থিরতা বিদায় নিয়ে আশ্চর্য এক শীতলতা তার অস্তিত্ব জানান দিয়েছে। অভিমানের প্রগাঢ় অনুভূতি ম্লান হয়ে, ঘরে ফেরার প্রখর অনুভতি হয়ে ধরা দিয়েছে। বাবার অপেক্ষায় তৃষ্ণার্ত দুচোখ মেলে প্রতিটা মুহূর্ত পার করছে।
কিন্তু অপরাজিতা জানে না বাবা চলে এসেছেন। ক্রিসেন্ট রোডের বাসায় ওর প্রিয় হাওয়াই মিঠাই নিয়ে অপেক্ষা করছেন সেই কোন বিকেল থেকে।
***
আনাম সাহেব বসে আছেন অপরাজিতাদের বারান্দায়। তিনি যখন এলেন মুনিরা নামের মেয়েটা দরজা খুলেছিলো। অপরাজিতার বাবা শুনে ভেতরে এনে অপরাজিতার রুমে বসিয়েছে। ব্যস্ত হয়ে অপরাজিতাকে ফোন করতে গেলে তিনি নিষেধ করেছেন। বলেছেন অপেক্ষা করবেন। অপরাজিতা তার সময় মতোই আসুক। মুনিরা তাকে চা বানিয়ে দিয়েছে। চা খাওয়ার ফাঁকে মুনিরার সঙ্গে কথায় কথায় জানলেন নতুন এক অপরাজিতাকে।
যখন শুনলেন অপরাজিতা প্রায়ই নিশ্চুপ হয়ে বারান্দায় বসে থাকে, উঠে গিয়ে ওখানে বসলেন তখন। গোধূলির আলোমাখা আকাশে তাকিয়ে মেয়ের লুকানো হাজারো দীর্ঘশ্বাস যেনো অনুভব করতে পারলেন। মেয়েকে ঠিক কতটা কষ্ট দিয়েছেন মনে হতেই অপরাধবোধে, অনুশোচনায় আবারও জর্জরিত হলেন।
অপরাধবোধ, অনুশোচনায় দিশেহারা বাবাকে মুক্তি দিতে, অপরাজিতা বাসায় আসলো সন্ধ্যে পার করে। দরজার বাইরে রাখা বাবার জুতো চিনতে তার ভুল হয়নি একটুও। মনের আনন্দ চোখেমুখে খেলা করলো ওর। অভিমানটাও যেনো মুচকি হাসলো। ঝাপসা চোখে বেল বাজিয়ে অপেক্ষার অবসান ঘটালো। মুনিরা দরজা খুলে, বাবার আসা থেকে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করার সবটাই বললো। মুখ ফুটে কিছুই বলতে না পেরে শান্ত ভঙ্গিতে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলো অপরাজিতা, যেখানে মন ভালো করার পসরা সাজিয়ে বসে আছে ওর জীবনের জাদুর মানুষটি।
মেয়ে এসেছে, তার ঠিক পেছনেই বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে আছে টের পেয়েছেন আনাম হাসনাত। কিন্তু ঘুরে তাকাতে পারছেন না। চোখ ভিজে আসছে। মেয়ের দিকে ঘুরে তাকানো এতো কঠিন কবে হলো? কেনোই বা হলো?
অপরাজিতা বাবাকে বুঝে ফেললো চট করে। মৃদু হেসে শুধালো, “কফি খাবে, বাবা?” আনাম সাহেব জবাব দিলেন না, বলা ভালো দিতে পারলেন না। অশ্রুজলে তার কন্ঠ বুজে এসেছে। অপরাজিতা অবশ্য বাবার হ্যাঁ-না বলার অপেক্ষা করলো না। নিজের মতো কফি বানাতে চলে গেলো। তার নিজেরও কান্না পাচ্ছে। বাবা মানুষটার সঙ্গে তার কোনোকালেই লুকোছাপা ছিলো না। দাদী চলে যাওয়ার পরেও বাবাকে সে মন খরাপ করতে দেখেছে, গুমরে কাঁদতে দেখেছে। সেসব দিনে অপটু অপরাজিতা বাবাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু আজকের কান্নায় ও শামিল হবে না। আজকের কান্নায় বাবার নিজের ভেতরে থাকা অপরাধবোধ মুছে যাক। ওর জাদুর মানুষটা আবারও মাথা উঁচিয়ে ওর সামনে দাঁড়াক।
***
মুনিরা, অপরাজিতার ব্যাপারে অতো ডিটেইলস জানে না। তবে আজকে ওর বাবার আগমনে এতোটুকু বুঝেছে এই মুহুর্তে বাসায় না থাকাটাই ভালো হবে। অপরাজিতা যখন কফি করতে গেলো তখনই মুনিরা, একটু আসছি বলে বেরিয়ে গেছে। কফিও এতক্ষণে হয়ে গেছে। বড় একটা দম নিয়ে অপরাজিতা বাবাকে ডাকে। এবারে উঠে, ডাইনিংয়ে আসেন আনাম সাহেব। বদলে যাওয়া অপরাজিতাকে দেখেন। মেয়েটা এতো শুকিয়ে গেলো কিভাবে! মেয়েকে নিয়ে বাসায় যাওয়ার পর ইরা যে তার সাথে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘোষণা করবে সেটায় কোনো সন্দেহ নেই।
অপরাজিতা চেয়ার টেনে বাবাকে বসতে দিয়ে নিজেও বসে। কফি খেতে খেতে বাবাকে ভালো করে দেখে। সেদিন ওয়াহিদের ফেইসবুক স্টোরিতে দেখা আর সামনে থেকে দেখার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। রেগ্যুুলার মেহেদী দেওয়া বাবার চুলে বোধহয় মেহেদী দেওয়া হয়নি অনেকদিন। সাদা চুল দেখা যাচ্ছে। আম্মু নিজে সবসময় মেহেদী দিয়ে দিয়েছে। বাবা-আম্মুর আসলেই কী কিছু হলো? ওর চলে আসাটা আম্মু-বাবার সম্পর্কেও কী এফেক্ট করলো? শিট! দেরি না করে অপরাজিতা প্রশ্ন করে, “আম্মু কেমন আছে, বাবা?” আনাম সাহেব মুখ খুলেন এবার। জবাব দেন, “নিশ্চয়ই ভালো আছে! দেখলে তেমনই লাগে।” বাবার গলায় ঝরে পরা অনুযোগ টের পায় অপরাজিতা। ও চলে আসায় আম্মু কি কথা না বলে বাবাকে পানিশমেন্ট দিচ্ছে? এই ভাবনায় হাসি পায় ওর। সঙ্গে সঙ্গে আনন্দও হয়। দারুণ এক উপলব্ধিতে মন জুড়ে প্রশান্তি বয়ে যায়। জগতের সবার কাছে পরিচিত কঠিন ব্যক্তিত্বের আনাম হাসনাত, স্ত্রী-মেয়ের কাছে নিতান্তই সাধারণ একজন মানুষ। যার সাথে চাইলেই স্ত্রী রাগ করে কথা বলা বন্ধ রাখতে পারে। মেয়ে অভিমান করে বাড়ি ছাড়তে পারে।
অপরাজিতাকে চুপ দেখে আনাম সাহেবের অস্বস্তি হয় খুব। শান্ত অপরাজিতাকে কখনোই দেখেননি তিনি। সারাক্ষণ চঞ্চলতায় মাতিয়ে রাখা মেয়েটার সাথে কোনো মিলই যেনো নেই। মেয়েটা কী সত্যিই বড় হয়ে গেলো? এতো তাড়াতাড়ি বড় না হলেই কী চলতো না? তিনি গলায় কুন্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করেন, “আমার নেয়া ভুল ডিসিশনে তুই কি খুব বড় হয়ে গেলি, অপরা?” বাবার প্রশ্নে অপরাজিতা সময় নিয়ে উত্তর দিলো, “বড় আগেই হয়েছিলাম বাবা। কিন্তু তোমরা ছিলে বলে ‘বড় হয়েছি’ এই বোধটুকুর প্রয়োজন ছিলো না। তোমাদের ছেড়ে এসে, একা বাঁচার চেষ্টায় অস্তিত্ব সংকটে যখন উঠেপড়ে লেগেছি তখন বুঝলাম আমি বড় হয়ে গেছি। বারান্দায় যে মানি প্ল্যান্ট গাছটা দেখেছো ওটার সাথে আমার খুব একটা পার্থক্য নেই বাবা। যখন অবলম্বন হিসেবে গ্রিল ছিলো, গাছটা গ্রিল বেয়েই শাখা-প্রশাখা ছড়িয়েছে। গ্রিল থেকে নামিয়ে দিয়ে যখন এমনি ফেলে রাখলাম, গাছটা বাতাসে দুলতে দুলতে নিচের দিকে নেমে গেছে। নতুন করে শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়েছে। এতটুকু বড় হওয়াতে, কষ্ট হলেও আমি আনন্দ খুঁজে পেয়েছি।” আনাম সাহেব মেয়ের উত্তরে মুগ্ধ হলেন। অপরাজিতা বুঝলো সেটাও। নিজ থেকেই আবার বলে উঠলো, “তোমার নেয়া ডিসিশনের মধ্যে কোনটাকে ভুল বলছো? আমার জন্য ওয়াহিদকে পছন্দ করেছো, সেটা? আমাকে না জানিয়ে সেদিন ওনাদের আসতে বলেছো, ওটা? নাকি হঠাৎ আকদের প্রস্তাবে রাজি হওয়ার সিদ্ধান্তটা? কোনটা ভুল, বাবা?”
মেয়ের ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নে আনাম সাহেব মুচকি হাসলেন। চকিতে একবার অপরাজিতাকে দেখলেন। ওর চোখেমুখের অঘোষিত কৌতূহল যেনো জানান দিলো বাবার কথা শুনতে সে ঠিক কতটা উদগ্রীব। কৌতূহল, প্রশ্ন ফুরিয়ে দিয়ে আনাম সাহেবও এক্সপ্লেইন করলেন তার নেয়া একেকটা সিদ্ধান্তের পেছনের গল্প!
শুরুটা করলেন ওয়াহিদকে প্রথম দেখা থেকে। একে একে বলে গেলেন, কেনো ছেলেটাকে তার ভালো লাগলো। ছেলেটার কোন কোন কোয়ালিটি তাকে মুগ্ধ করলো। মেয়ে বিয়ে দিয়ে মেয়েকে পর করে দেওয়া নয়, বরং ছেলে পাওয়ার যে ইচ্ছে সেটা ঠিক কীভাবে ওয়াহিদ পূরণ করতে পারলো। দারুন আলাপচারিতায় ওয়াহিদ কীভাবে অপরাজিতায় মুগ্ধ হয়ে ওকে চাইলো, সবটাই মেয়েকে বললেন। অপরাজিতা শুনলো বিভোর হয়ে। যে ওয়াহিদে ওর বাবা মুগ্ধ হয়েছে, সেই ওয়াহিদে ও নিজেও মুগ্ধ হয়েছে। একজন সেইম মানুষকে ঘিরে বাবা-মেয়ের মুগ্ধতার গল্প যদি একই হয় তবে বলা যায় সেই মানুষটা সত্যিই স্পেশাল। আনাম সাহেব কেনো ওয়াহিদকে পছন্দ করেছিলেন সেটা বিগত দিন গুলোতেই অপরাজিতা বুঝতে পেরেছিলো। তবুও বাবার মুখে শুনে ও নতুন করে রিয়েলাইজ করলো বাবা ঠিক কতটা যাচাই-বাছাইয়ের পর ভেবেচিন্তে ওয়াহিদকে ওর জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে দিলেন। তবুও প্রশ্ন থেকেই যায়। সেই প্রশ্নটা অপরাজিতা করলো বাবাকে, “ওয়াহিদকে তুমি আমার জন্য পছন্দ করেছো। কিন্তু কেনো করলে, সেটা আমিও এখন জানি, বুঝি। উনি আমার জন্য বেস্ট চয়েজ, তা-ও মানি। কিন্তু বাবা, আমাকে জানালে না কেনো? সিদ্ধান্ত নিতে আমাকে তুমি, আম্মুই শিখিয়েছো। অথচ এই এতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে মাত্র কয়েক মিনিট সময় দিলে কেনো? তোমার পছন্দের ওপর কি তোমার বিশ্বাস ছিলো না? নাকি তোমার পছন্দকে আমি অপছন্দ করতে পারি সেটা ভেবেছিলে? কোনটা?”
আনাম সাহেব মৌন রইলেন। চোখের কোনে আবারও জলেরা ভীড় জমালে অপরাজিতা পরম মমতায় সেটা মুছে দিলো। বাবার হাত শক্ত করে চেপে ধরলো। আনাম সাহেব যেনো এই মমত্ববোধে শক্তি পেলেন। অস্ফুটস্বরে বলতে শুরু করেন, “আমি ভয় পেয়েছিলাম, অপরা। তোকে অবিশ্বাস করিনি। নিজের পছন্দেও বিশ্বাস ছিলো। তুই এই দুনিয়াতে আসার আগে পর্যন্ত আমি বুঝিনি বাবা হওয়াটা কতটা ম্যাজিকাল হতে পারে। তুই এনআইসিও থেকে যেদিন তোর আম্মুর কাছে আসলি সেদিন থেকে কী ভীষণ মায়ায় তুই আমাদের জড়িয়ে ফেললি। সেই তোকে ছেড়ে একদিন এই দুনিয়া থেকে আমাকে চলে যেতে হবে। তোর দাদী-দাদা চলে গিয়েও আমি তোকে নিয়ে, তোর আম্মুকে নিয়ে বাঁচতে পারছি। তোকেও আমাদের ছাড়া বাঁচতে হবে। এমন নয় যে আমরা না থাকলে তোর জীবন থেমে থাকবে। তুইও কাউকে সঙ্গী হিসেবে পাবি, জীবন ঠিক কেটে যাবে। কিন্তু তোর জীবনসঙ্গী যদি অতোটা ভালো না হয়? তোকে যদি আগলে না রাখে? আমি চিন্তায় অস্থির হলাম। তোর আম্মু আমার অস্থিরতায় হাসলো। বললো কিছুদিন গেলে এইসব পাগলামি চিন্তাভাবনা আমার কেটে যাবে। কিন্তু দিন যতো গেলো, যতো তোর বিয়ের প্রস্তাব আসলো আমি ততোটা দিশেহারা হলাম। অনেক অপেক্ষার পর ওয়াহিদ এলো। আমার স্বস্তি পাওয়ার কথা। কিন্তু আমার অস্থিরতা আরো বেড়ে গেলো। বিয়ে দিয়ে দিলেই তো তুই চলে যাবি। আমার মেয়ে আমার বাড়ি ছেড়ে নতুন ঠিকানায় চলে যাবে। বাড়ির লনে আর শিউলি কুড়াবে না। ভ্যানিলা আইসক্রিম কেনো আনতে ভুলে গেলাম সেই রাগে গাল ফুলাবে না। হাওয়াই মিঠাইয়ের বায়না করবে না। মেয়েকে কিভাবে বিয়ে দিবো আমি? যে মেয়েকে ঘিরে আমি, ইরা -আমরা জীবন সাজালাম সেই মেয়েকে ছাড়া আমাদের দিনগুলো কিভাবে পার হবে? তুই ছাড়া আমাদের আছেই বা কে? এই হারানোর ভয়ে আমি স্থির হতে পারছিলাম না। ওয়াহিদদের আসতে বলতে মন চাইলো না। তবুও একদিন ডাকলাম। শর্ত রাখলাম তুই জানবি না। তোকে রয়েসয়ে বলার ছুতোয়, আরো ক’টা দিন আমাদের কাছেই রেখে দিতে চাইলাম। ওরা এলো। তোকে ওদের পছন্দ হলো। ওরা প্রস্তাব দিতেই নিদারুণ অস্থিরতায়, হারানোর ভয় আমাকে জেঁকে ধরলো। আমি না-ই বলতে যাচ্ছিলাম। তোর বড় ফুপি আমার মন পড়ে ফেললো। শক্ত কন্ঠে বললো আমার মনের এই অমূলক ভয় ঝেরে না ফেললে কোনোদিনই তোকে বিয়ে দিতে পারবো না। যত ভালো ছেলেই হোক আমি এগোতে পারবো না। মনের অমূলক ভয় ঝেরে ফেলার চেষ্টায় আমি সাহস করে রাজি হয়ে গেলাম। মেয়ের জন্য পছন্দ করা বেস্ট চয়েজটা মেয়েও পছন্দ করবে সেই বিশ্বাসে, আমি সাহস দেখিয়ে রাজি হয়ে গেলাম। বারবার মনে হলো আজকে যদি ওরা চলে যায়, যেই সাহসটা আমি করতে পারছি সেটা আর পারবো না। মেয়ে অন্যের ঘরে যাবে, এই কঠিন সিদ্ধান্ত বারবার নেয়ার মতো মানসিক শক্তি আমার ছিলো না। চিরকাল ধরে চলে আসা নিয়মের বেড়াজালে বন্দী হয়ে আমি সেদিন রাজি হয়ে গেলাম।”
বাবার কথার এ পর্যায়ে হাপুসনয়নে কেঁদে চলা অপরাজিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তিনি বলে চললেন, “তোর সিদ্ধান্ত তুই-ই নিবি সবসময়। সেটাই তোকে শিখিয়েছি অথচ সেদিন নিজের কথাই কেবল ভেবেছি। তুই ভেবেচিন্তে জানাবি এই সময়টা তোকে দেয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছি। তোর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে তোর হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে তোকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। স্যরি, মা।”
হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন, পৃথিবীতে অনেক খারাপ মানুষ আছে, কিন্তু খারাপ বাবা একটাও নেই। অপরাজিতার বাবা সেই বাবাদেরই একজন। জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজ ‘কোটা ফ্যাক্টরির’ একটা সংলাপের বাংলা করলে দাঁড়ায়, মা-বাবার সিদ্ধান্ত হয়তো ভুল হতে পারে, কিন্তু উদ্দেশ্য কখনো ভুল হতে পারে না। আনাম সাহেবের সিদ্ধান্ত ভুল ছিলো, তবে অমন হঠাৎ নেয়া সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য খুব কি ভুল ছিলো?
অপরাজিতা বাড়ি ফিরেছিলো সেদিনই। আম্মু ওকে দেখে শুরুতে খুব রাগ দেখিয়েছে। এতো ফোনকল, মেসেজ কিছুতেই মেয়ের মন গলেনি অথচ বাবা যেতেই চলে এসেছে -এই নিয়ে খানিকক্ষণ কপট অভিযোগও করেছে। অপরাজিতা হাসিমুখে সব বকা শুনেছে। এরপর মাকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী মেয়ে হয়ে বাবার সঙ্গে ঝগড়া মিটিয়ে ফেলে ভাব করতে বলেছে। মায়ের শরীরের ঘ্রাণে মিশে গিয়ে অনেকগুলো দিন পরে আরাম করে ঘুমিয়েছে।
***
আজকে অপরাজিতা-ওয়াহিদের রিসেপশন। দুমাস ধরে চলা আয়োজনের আজকে শেষদিন।
আকদ হয়ে যাওয়ার পরে আবার নতুন করে এনগেজমেন্ট, বিয়ে পড়ানোতে রাজি ছিলো না অপরাজিতা। কিন্তু ওয়াহিদের ‘বিয়ে জীবনে একবারই করছি!’ যুক্তির সামনে তার আপত্তি ধোপে টেকেনি। বহু আলোচনার পরে সিদ্ধান্ত হয়েছে, গায়ে হলুদের দু’টো প্রোগ্রাম আর ওয়েডিং রিসেপশন, এই তিনে, অপরাজিতা-ওয়াহিদের নতুন পথ চলার শুরু হবে। বিয়ে নিয়ে কারো উৎসাহ-ই কম না। একমাত্র মেয়ের বিয়েতে ইরা, মেঝ ছেলের বিয়েতে জোহরা -কারোই আনন্দের শেষ নেই। রোজ তারা দুজনে ফোনে কথা বলছেন, এটা-সেটা ঠিক করছেন। ছেলে-মেয়েকে একসাথে কি দারুন মানাবে সেই সুখস্বপ্নে বিভোর হচ্ছেন। তাদের এতোসব প্ল্যানিংয়ে সবচেয়ে বেশি ঝামেলায় বোধহয় ছিলো ওয়েডিং প্ল্যানার টিম। তবুও কোনো কিছু থেমে থাকে নি। বিয়ের শপিং থেকে শুরু করে ওয়াহিদ-অপরাজিতার নতুন ফ্ল্যাট সাজানো সবটাতেই তারা দারুন কাজ দেখিয়েছে। অপরাজিতার মনে হয় এই টিম ছিলো বলেই রিসেপশন পর্যন্ত ও আসতে পেরেছে। বিয়ে ওর। কিন্তু সবার এতো আগ্রহ, এতো এতো মতামত। এরটা শুনলে ও মন খারাপ করে। ওরটা বাদ দিলে এ নতুন আরেকটা বলে। এতোসব আইডিয়ায় অতিষ্ঠ হয়ে, অপরাজিতা তখন মা-শাশুড়ি আর ওয়েডিং প্ল্যানার শম্পাকে সঙ্গে নিয়ে বসেছে। ক্লিয়ারলি জানিয়েছে, দু’টো হলুদের একটায় হলুদ হলে অন্যটায় সবুজ রং থাকতে হবে। শাড়ি-লেহেঙ্গা যাই হোক তার কোনো সমস্যা নেই। আর রিসেপশনে তার পড়নে গাঢ় লাল রঙ থাকতেই হবে। শাড়ি হতে পারে তবে লেহেঙ্গা বেটার অপশন। ডিজাইন নিয়ে তার কিছু বলার নেই। মায়েরা সবাইকে নিয়ে যেয়ে কিনুক। যেখান থেকে ইচ্ছে কিনুক। জুয়েলারি নিয়েও সেইম। সাজসজ্জায়ও মেকআপ আর্টিস্টের ইচ্ছেই ফাইনাল, শুধু অতিরিক্ত না হলেই হয়। এরপরে ওকে আর কেউ তেমন বিরক্ত করেনি।
ওয়াহিদ যখন শুনলো রিসেপশনে অপরাজিতা গাঢ় লাল পরবে, তখন ওর মনে হলো ইন্ডিয়া থেকে আনা লাল রঙা সিল্কের কাঞ্জিভরম শাড়িটাই তো অপরাজিতা পরতে পারে। কিন্তু রিসেপশনের শপিং নিয়ে মা-শাশুড়িসহ সকলের এতো এক্সাইটমেন্ট দেখে সেই কথা শেষ পর্যন্ত আর বলেনি। আবার ওর পজেসিভ সত্ত্বাও অপরাজিতা এই শাড়ি কেবল ওর জন্য পরুক সেই চিন্তায় সায় দিয়েছে! শেষে ওর কেনা শাড়িগুলো অপরাজিতাকে পাঠিয়ে দিয়েছে ওয়েডিং গিফট হিসেবে। প্রত্যেকটা শাড়ির সঙ্গে আলাদা করে চিরকুট এঁটে দিয়েছে। অপরাজিতা শাড়ি দেখে যতটা খুশি হয়েছে চিরকুট পড়ে ততটাই লজ্জায় রাঙা হয়েছে। কী ভেবে, কোন শাড়ি কেনা হয়েছে সেটা লিখে পাঠালে অনুভূতিরা অমন লাল রঙ ধারণ করে ছোটাছুটি তো করবেই!
সিলভার-পিংক কম্বিনেশনের কাঞ্জিভরম শাড়িটায় শুধু অপরাজিতাকেই মানাবে, ওয়াহিদের জোর দিয়ে লেখা এটুকু কথায় কী ছিলো কে জানে! অনেকবছর আগে, ছোট্ট অপরাজিতার মনে গেড়ে বসা ‘গোলাপি বেগম’ এইবার বোধহয় ধুয়েমুছে যাবেই। ওই ঘটনার পরপর আম্মু-বাবা চেষ্টা করেছিলো ওকে বুঝাতে। কিন্তু ছোট্ট অপরাজিতার কান্নাকাটিতে হাল ছেড়ে দিয়েছিলো। বড় হওয়ার পরও জোর করেনি। নিজেরাও এভোয়েড করেছে। ওয়াহিদ এই ঘটনা জানে না। তাই কিনে ফেলতে পেরেছে। অপরাজিতা একসময়ের অতি প্রিয় রঙটাকে আবার ধারণ করলে বাবা-আম্মুও নিশ্চয়ই আনন্দিত হবে।
বিয়ের শপিংয়ে যখন সবাই ব্যস্ত অপরাজিতা আর ওয়াহিদ নিজেরা মিলে ফ্ল্যাট সাজানোর এটা-সেটা কিনেছে। ওখানেই এক দোকানের কুশন কভার দেখে ওর বেশ পছন্দ হলো। কিনে ফেলতে গিয়ে মনের খেয়ালে বলে ফেললো, আমাদের রুমের সোফার কুশনে এটা খুব মানাবে। বলতেই খেয়াল হলো ওয়াহিদের রুমটা কখনো ওর নিজের হবে কি না সেই শংকা কাটিয়ে দিয়ে, ওয়াহিদ ওকে আস্ত একটা সংসার উপহার দিয়েছে।
গায়ে হলুদের দু’টো প্রোগ্রামেই একটা ঘরোয়া আমেজ ছিলো। আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুদের বাইরে কাউকেই দাওয়াত করা হয়নি। দু’হাত জুড়ে মেহেদী রাঙানো, হাসিতে মুখরিত অপরাজিতাকে দেখে ওয়াহিদের রবীন্দ্রনাথের হৈমন্তী গল্পের মতো বলতে ইচ্ছে করেছে, “আমি পাইলাম,’আমি ইহাকে পাইলাম।’ কাহাকে পাইলাম। এ যে দুর্লভ, এ যে মানবী, ইহার রহস্যের কি অন্ত আছে।”
সকলের মিলিত হাসি-আনন্দ-উচ্ছ্বাসে, বিদায়ের সুরটাও কোথাও একটায় অপরাজিতাকে বারবার কাঁদিয়েছে। মায়া-মমতার চিরচেনা মানুষগুলোকে ছেড়ে, নতুন মানুষের সঙ্গে নতুন স্বপ্ন চোখে নিয়ে চলে যাওয়াটা যতটা মন খারাপের ততটাই আবার আনন্দের। পাওয়ার আনন্দ-হারানোর বেদনা, সমানতালে মনের মধ্যে অদ্ভুত এক দৃশ্যপট তৈরি হয়েছে। আদুরে মেয়ে থেকে নবপরিণীতা হওয়ার এই উপাখ্যান, সকল অপরাজিতাদেরই তো এক!
সন্ধ্যের রিসেপশনে, হাজারো অতিথিদের শুভকামনায় অপরাজিতা-ওয়াহিদের বিবাহিত জীবনের শুরুটা হলো মহাসমারোহে। আত্মজার বিদায়ে সিক্ত হলেন অপরাজিতার আম্মু। জীবনের কঠিন নিস্তব্ধ সময়টায় অপরাজিতার মা হয়েছিলেন তিনি। অনিবার্য এই বিচ্ছেদে অপরাজিতা খুব ভালো থাকুক, এই কামনায় মেয়েকে জড়িয়ে রাখলেন শেষ পর্যন্ত।
বাবা নামের জাদুর মানুষটা চোখে কান্না, মুখে চমৎকার হাসি নিয়ে অপরাজিতাকে তুলে দিলেন, ওর জীবনে ভালোবাসা হয়ে আসা জাদুর মানুষটার কাছে। নতুন স্বপ্ন, গোছালো-অগোছালো ইচ্ছে, হুটহাট রাগ-অভিমান নিয়ে শুরু হলো ওদের নতুন অধ্যায়।
***
ওয়াহিদদের বাসায় টুকটাক বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে, অপরাজিতাকে নতুন সাজানো ফ্ল্যাটের বেডরুমে কিছুখন আগে রেখে গিয়েছে ওয়াহিদের বোন-ভাবী-কাজিনরা। সকলে চলে যেতেই- সারাদিনের ক্লান্তি, সাজগোজ ধুয়েমুছে অপরাজিতা সময় নিয়ে গোসল সারলো। ওয়াহিদ বাসায় আসেনি তখনও। সেই সুযোগে অপরাজিতা লাল রঙা সিল্কের কাঞ্জিভরম শাড়ীটা পরে ফেললো। খোলা চুলে, গাঢ় লাল লিপস্টিকে নিজেকে ওয়াহিদের মনমতো সাজিয়ে তুললো। বিয়ের উপহার হিসেবে ওয়াহিদের প্রিয় ব্র্যান্ডের ঘড়ি নিয়ে অপেক্ষায় থাকলো।
ওয়াহিদ এলো রেড ভেলভেট কেক নিয়ে। নতুন জীবনের শুরুটা মিষ্টিমুখে হোক! পারফেক্ট এন্ড ডীপ লাভের প্রতিনিধিত্ব করা টিউলিপ ফুল উপহার দিলো, ওর একান্তই ব্যক্তিগত মেয়েটাকে। পূর্ণতার নোনাজলে ভাসিয়ে অপরাজিতার অনামিকায় সবশেষে পরিয়ে দিলো রেডিয়েন্ট কাট ডায়মন্ড রিং। ওর গভীর চাহনিতে মাদকতার ছড়াছড়ি। লুকিয়ে, আঁড়চোখে তাকানোর দিনের সমাপ্তি টেনে, ওয়াহিদ স্পষ্ট মুগ্ধতা নিয়ে নবপরিণীতাকে দেখে। আকুলতায় ডুবে প্রশ্ন করে, “আমি যদি অনেক করে তোমার হই, তবে কি অনেক করে তোমাকে পাবো, অপরা?” ভালোলাগার আবেশে, ঘোরের মধ্যে হারিয়ে অপরাজিতা মাথা দোলালো কেবল।
ঠিক এইভাবে অপরাজিতার একটা ভালোবাসার গল্প হলো। সবখানে এতো মানুষের ভীড়ে, একটা নিজের মানুষ হলো। পায়ে পায়ে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গী হলো। রাতজাগার সঙ্গী হলো। অনেকখানি মায়ায় জড়ানোর প্রিয় মানুষ হলো।
ওয়াহিদের সঙ্গে যেদিন প্রথম দেখা হয়েছিলো আনাম সাহেবের সেদিন শনিবার। সারা সপ্তাহ ক্লাসের পর ওয়াহিদের ইউনিভার্সিটিতে শুক্র-শনি দু’দিন ছুটি। বুঝেশুনেই সেদিন তিনি সময় দিলেন দুপুর দেড়টায়। উত্তরায় একটা রেস্টুরেন্টে আসতে বললেন। ওয়াহিদের বাসার একদম কাছে। দেখতে চাইলেন এতো কাছে ওয়াহিদ সময়মতো আসে কি না। ফর্মাল পোশাকে জড়তাহীন, হাসোজ্জল ওয়াহিদ এসেছিলো সময়মতোই।
রেস্টুরেন্টে বসে সাধারণ কুশল বিনিময়ের পর, যখন অর্ডার দেওয়ার সময় হলো ওয়াহিদ ভদ্রভাবে জানতে চেয়েছিলো তার ডায়াবেটিস আছে কি না। ব্যাপারটায় তিনি অবাক হয়েছিলেন। মৃদু হেসে নিশ্চিত করেছিলেন এরকম কোনো ব্যাপার নেই।
খাওয়ার ফাঁকে সেবারে ওয়াহিদের পড়াশোনা, পরিবার, চাকরি নিয়ে টুকটাক কথা বলেছিলেন। সামনে বসা ছেলেটার সাবলীলতায়, বুদ্ধিদীপ্ত কথায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। পড়ায় বলেই বোধহয় ছেলেটা জমিয়ে কথা বলতে জানে। খাওয়া শেষে বিল দেওয়ার সময় বিনীতভাবেই ওয়াহিদ বলেছিলো, “আজকের বিল আমি দিতে চাই আংকেল। আপনি বাবার বন্ধু, সেই সম্মান থেকেই চাচ্ছি।” আনাম সাহেব ওয়াহিদের কথায় রাজি হননি। ছেলের বয়সী ওয়াহিদের এতটুকু কথা-ই তার ভালো লেগেছিলো। তিনি বিশাল ব্যবসায়ী, তার সাথে যে বা যারা দেখা করতে আসে হয় গদগদ ভাব নয়তো কাচুমাচু ভঙ্গিতে নিজেকে প্রকাশ করে। এর আগেও অনেককেই তিনি মেয়ের জন্য দেখতে এসেছেন। কেউ-ই এতটা দৃঢ়তা নিয়ে বলে নি। হয়তো বোঝেই নি বলা যায়! অথচ মেয়ে বিয়ে দিয়ে তিনি শুধুমাত্র মেয়ের জীবনসঙ্গী চান নি! ছেলেও চেয়েছেন! মেয়েকে আগলে রেখে যে কি না তারও ছেলে হয়ে উঠবে।
ওয়াহিদের মাঝের এই স্বতস্ফুর্ত আচরণেই ওকে আরো জানার আগ্রহ হয়েছিলো তার। বলেছিলেন, “তোমার অবসর সময়ে আরেকদিন লাঞ্চ করো আমার সাথে।” ওয়াহিদ কথা রেখেছিলো। নিজেই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলো। তবে ডিনারে। পরের শুক্রবারে। মিরপুরে। প্রথমবার তিনি গিয়েছিলেন ওয়াহিদের এলাকায়, সেই ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয়বারে যেনো ওয়াহিদ এসেছিলো তার এলাকায়! রাজনীতি, ব্যবসা নিয়ে কথায় কথায় উঠে এসেছিলো ওয়াহিদের মাছ ব্যবসার কথা। নিজের দিক থেকে কিছু সাজেশন দিয়েছিলেন তিনি। ওয়াহিদের প্রশ্নে সেই সাজেশন দীর্ঘ হয়েছিলো স্বাভাবিক আলোচনায়। রেস্টুরেন্টে আসা যে কারো মনে হতেই পারে, দারুন আলাপচারিতায় মেতে উঠেছে বাবা-ছেলে!
এরপর আরও দু-তিনবার লাঞ্চ-ডিনারে বসলেন ওয়াহিদের সঙ্গে। একবার সঙ্গে এসেছিলো ওয়াহিদের বাবা মাজহার উদ্দিন। আনাম সাহেব অবাক হয়ে দেখলেন কোনো ইতস্ততা ছাড়াই বাবার সাথে হাসি-আড্ডায় প্রাণবন্ত এক ছেলেকে। সেদিনেই তার মনে হলো ব্যাপারটা সামনে এগোতে পারে। পরের বার ওয়াহিদকে নিয়ে গেলেন তার পছন্দের এক ছাদ খোলা রেস্তোরায়। কর্ণস্যুপ খেতে খেতে অবশেষে জানতে চেয়েছিলেন ওয়াহিদ কেনো ফিনল্যান্ড থেকে চলে এলো!
ওয়াহিদ বেশ গুছিয়ে উত্তর টা দিয়েছিলো। সময় নিয়ে সুন্দর করে বলেছিলো, “ফিনল্যান্ডে আমি তিন বছর ছিলাম। মাস্টার্সে প্লেসমেন্টসহ কোর্স শেষ করতে দুইবছর। আর একবছর একটা রিসার্চ ইনস্টিটিউটে জব করেছি। পড়াশোনার দু’টো বছরে প্রচুর অড জব করেছি। দেশ থেকে আব্বু টিউশন ফি অর্ধেকটা দিয়েই পাঠিয়েছিলেন, বাকীটাও দিতে চাইলেন। কিন্তু আমার মনে হলো নিজেরটা এবার নিজেরই দেওয়া উচিত। ক্লাসের ফাঁকে নিয়ম করে ৩০ ঘন্টা সপ্তায় কাজ করেছি। প্রেজেন্টেশন, কেইস স্টাডি, গ্রুপ ডিসকাশন সব করেছি। ২/৩ মাস যাওয়ার পর নিজের রান্না নিজেই করেছি। কিন্তু এতো সবের মাঝেও আমি একা ফিল করেছি। দিনশেষে মনে হতো লুক ফরোয়ার্ড করার কিছু নাই। বাঙালি কমিউনিটির আশেপাশেই থাকতাম। কিন্তু তাদের সাথে আড্ডার সময় আমার যেমন নাই তাদেরও নাই। সবাই ছুটছে। সবাই ব্যস্ত। ভাবলাম সলিড জবে ঢুকে যেতে পারলে সব ঠিক হয়ে যাবে। ভাগ্য ভালো ছিলো। মাস্টার্স প্লেসমেন্টে আমি যে ফ্যাক্টরিতে ইন্টার্ন করেছি ওদেরই সিস্টার কনসার্ন রিসার্চ ইনস্টিটিউটে জব হয়ে গেলো। স্যালারি বেশ ভালো। দুই বেডরুমের বাসা নিয়ে আমি আরামসে থাকতে পারছি। সেভিংসও হচ্ছে। আর একটাবছর পার হলে ইন্সটলমেন্টে খুব ভালো একটা গাড়িও কিনে ফেলতে পারতাম। স্যালারিও তখন আরো বাড়বে। কিন্তু অবস্থার উন্নতি হলো না। একাকিত্ব বোধ আরো গাঢ় হলো! সারাদিন এতো কাজ করতাম ল্যাবে, তারপরও ঘুম আসতো না। বাসায় ফোন দিয়ে কথা বলেও শান্তি পাচ্ছিলাম না। অনেক চিন্তাভাবনা করলাম। বিদেশে যারা পড়তে আসে তারা মোটামুটি তাদের সবটা নিয়ে চলে আসে। সেই টাকা ইনকাম করে দেশে ফেরত পাঠিয়ে আরো ইনকাম করতে পারাটাই সকলের মূল টার্গেট। আমার ক্ষেত্রে এমন কিছুই ছিলো না। আমি কোনো অড জব না করলেও সমস্যা ছিলো না। আব্বু সবসময় ছিলেন সাপোর্ট হিসেবে। তারপরও আব্বু যে টাকা দিয়েছে সেটা আব্বুকে রিটার্ন করে দিয়েছিলাম ফিনল্যান্ডে আসার বছর পার হতেই। না দিলেও আব্বু কখনো বলতো না কেনো দিলাম না! সেসব দেওয়ার পরও আমার কাছে মোটামুটি বড় একটা অ্যামাউন্ট আছে। দেশে ফিরে গিয়ে যদি কোনো জব সঙ্গে সঙ্গে না-ও হয় চলবে। সিজনাল ব্যবসাটা বন্ধুরা মিলে করছি। ওটাতেও হবে। তারপরও কিছু করতে না পারলে আব্বুর ব্যবসায় গিয়ে বসবো। মাথার উপর আব্বুর এই সাপোর্টটা আছে বলেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম আমি দেশে ফিরবো। সবার সাথে থাকবো। দিনশেষে কী করলাম, কী খেলাম, দিন কেমন কাটলো এই কথাগুলো জিজ্ঞেস করার মানুষ আমার আছে। তাহলে কেনো দূরে থাকা? জব ছেড়ে দিয়ে দেশে চলে আসলাম। কারণটা আপনার খুব অযৌক্তিক মনে হতে পারে আংকেল। কিন্তু আমার খুব ঠিক মনে হয়েছে। হ্যাঁ, যদি এমন হতো আমার ফ্যামিলি আমার উপর ডিপেন্ড করে আছে তাহলে কোনোভাবেই ফিরতাম না। যতই একা ফিল হোক। কেউ ডিপেন্ড করে নেই বলেই চলে আসার মতো লাক্সারিয়াস ডিসিশন আমি নিতে পেরেছিলাম।”
মনোযোগ দিয়ে সবটা শুনে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, “তোমার কখনো মনে হয়নি ফিরে আসার সিদ্ধান্তটা ভুল হয়েছে? তুৃমি তিন-সাড়ে তিন বছর আগে ফিরে এসেছো। না ফিরলে এতোদিনে অনেক কিছুই করে ফেলতে পারতে।” ওয়াহিদ মুচকি হেসে জবাব দিয়েছিলো, “আসলেই হয়তো করে ফেলতে পারতাম। স্যালারি বর্তমানে ইউনিভার্সিটিতে চাকরি করে যা পাই তার চারগুন শুরুতেই পেতাম ফিনল্যান্ডে। এতোদিনে আমার ডাবল প্রমোশন হয়ে যেতো! আমি যখন দেশে ফিরে এলাম আমার বয়স তখন সাতাশ। বন্ধুদের বেশিরভাগেরই ততদিনে জব সেক্টরে এক-দুই বছরের ক্যারিয়ার হয়ে গেছে। সেখানে আমি রীতিমতো বেকার! চার-পাঁচ মাস সত্যি বলতে বসেই ছিলাম। জব ইন্টারভিউতে ডাক পেলেও আমার যে এক্সপেরিয়েন্স সেটার সাথে ওনাদের চাহিদা মিলতো না। হতাশ হওয়ারই কথা ছিলো। কিন্তু একবারও হইনি। বরং জব হচ্ছে না দেখে আম্মু যখন চিন্তা করতে না করতো, ফিনল্যান্ডের জব ছেড়ে ফিরলাম বলে আপুরা যখন গাধা বলে মজা করতো, আব্বু যখন গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করে, তার ব্যবসায় জয়েন করতে বলতো -আমার ভালো লাগতো। না ফিরলে আমাকে নিয়ে চিন্তা করার, মজা করার জন্য এই মানুষগুলোকে কোথায় পেতাম?”
ওয়াহিদের কথায় আনাম সাহেব দু’টো ব্যাপার বুঝেছিলেন। সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো বিশেষ গুণটা এই ছেলের আছে। সেটা ঠিক-ভুল যেমনই হোক। সে মনের দোটানা কাটিয়ে উঠতে জানে। এটা কোনো সহজ কাজ নয়। এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার এই কাজটাই ওয়াহিদ করে প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে। তার সামনে বসে থাকা ছেলেটার এই আত্মবিশ্বাসী সত্তা অবশ্যই প্রশংসনীয়।
খাওয়া যখন শেষের দিকে তখন তিনি করেছিলেন সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটা, “তোমার আব্বু বলেছে তুমি এখনই বিয়ে করতে রাজি ছিলে না। মত বদলালে কেনো?”
ওয়াহিদ মাথা চুলকে হেসে ফেলেছিলো। বিনয়ের সঙ্গে বলেছিলো, “আংকেল, আমি জানি অপরাজিতাকে বিয়ে করতে চাওয়ার লোকের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। আমার মতো আরো অনেকের সাথেই আপনি এভাবে বসেছেন, কথা বলেছেন। তাদেরও সেইম প্রশ্ন করেছেন। তারা অনেকেই হয়তো দারুন সব উত্তর দিয়ে ফেলেছে। আমার উত্তরে খুব যে নতুনত্ব আসবে না সেটা আমি জানি। তাছাড়া আমার কাছে আসলে বলার মতো অনেকগুলো কারণও নেই। তারপরও অপরাজিতাকে কেনো বিয়ে করতে চাই? এককথায় বলতে গেলে, অপরায় মুগ্ধ হয়েছি।”
মত বদলে ফেলার কারণ হিসেবে ওয়াহিদের এই সহজ স্বীকারোক্তিই ছিলো যথেষ্ট। ওয়াহিদের মতো এইভাবে আগে কেউ বলেনি। এতোটা গভীরতা নিয়ে কখনই মনের অনুভূতি প্রকাশ করেনি। একটা মাত্র বাক্যে এতো জোর থাকতে পারে সেটা ওয়াহিদ বুঝিয়ে দিয়েছিলো।
***
যতই ভাবেন, আনাম সাহেবের মনে হয় তিনি কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেন নি। ওয়াহিদকে মেয়ের জন্য পছন্দ করা মোটেও ভুল সিদ্ধান্ত নয়। তবে, ভুল কোনটা? মেয়ে কে না জানিয়ে ওদের বাড়ি ডাকা টা? বিয়ের প্রস্তাবে হুট করে রাজি হওয়াটা? নাকি মেয়ের অভিমান বুঝতে না পারা টা?
উত্তর টা তিনি জানেন। এই প্রত্যেকটা কাজ যে ভুল সেটায় কোনো সন্দেহ নেই। তবে মাঝে মাঝে তার মনে প্রশ্ন জাগে, শুধু ভুল? অন্যায় নয়?
অন্যায় যদি না-ই হবে, তবে ইরা কেনো তার সঙ্গে কথা বলে না? বিগত এক মাসে রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে না পারার এটাও একটা কারণ। নিশ্চুপ ইরাকে তিনি কখনোই দেখেন নি। সবার সঙ্গে শান্ত ইরা তার কাছে সবসময়ই ছিলো দুরন্ত। মিসক্যারেজের পরেও ইরা তার সাথে হাজার কথা বলেছে। কান্নায় ভেঙে পরেছে। অপরাজিতা এসে সেই ইরাকে বদলে দিয়েছিলো। সেই ইরা কী তবে অপরাজিতার সঙ্গেই আবার হারিয়ে গেলো? ওরা মা-মেয়ে কী তার মনের অস্থিরতা কখনো বুঝবে?
ভাবনার সুঁতো কেটে অবশেষে তিনি বাস্তবে ফিরলেন, গাড়ি থামার শব্দে। নেমে দাঁড়িয়ে, এয়ারপোর্ট ১নং টার্মিনালের আশেপাশে ওয়াহিদ কে খুঁজলেন। ভারত যাচ্ছেন তিনি। ব্যবসার কাজে। সপ্তাহ দুয়েকের জন্য। এবারের জার্নিতে তার সঙ্গী ওয়াহিদ। অপরাজিতা হল ছেড়ে বাসায় উঠেছে এই খবর ওয়াহিদ জানিয়েছে তাকে মাসখানেক আগে। তিনি অবশ্য আগেই জানতেন। সেটা বুঝতে না দিয়ে ওয়াহিদের কথা শুনেছেন। ওয়াহিদের নালিশ শুনে বহু কষ্টে হাসি আটকেছেন। মেয়েকে আহ্লাদ দিয়ে তিনি আসলেই মাথায় উঠিয়েছেন। তাই বলে মেয়ের ভয়-ডর বলে কিছু থাকবে না? তার মেয়ে এতো সাহসী কবে হলো! ইরা কে-ও বলেছেন একা একা বাসায় উঠার এই কথা। চোখমুখ লাল করে তাকে ভস্ম করে দেওয়াটাই বোধহয় বাকী ছিলো ইরার!
খানিক আগেই মা-মেয়ের কথা ভেবে আত্মগ্লানিতে ভুগছিলেন! আবার এখন তাদের কান্ডেই আনন্দ খুঁজে পাচ্ছেন! নাহ, জীবন সুন্দর। পাওয়া-না পাওয়া, অভিমানের ভীড়ে জীবন সুন্দর।
অপরাজিতার সঙ্গে আকদের তিন মাস প্রায় হয়ে এসেছে। বাবা-মেয়ের অভিমানের ভীড়ে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা এখনও থমকে আছে। তবে ওর মনে হচ্ছে অভিমানের গল্প শেষের পথে। বাবা নাকি মেয়ে কে আগে মুভ করবে সেটাই দেখার বিষয়!
অপরাজিতার সঙ্গে সম্পর্কটা আদতে খুব স্বাভাবিক। কিন্তু ও টের পায়। অপরার অস্থিরতা টের পায়। একজন মানুষ কে ভালোবেসে, তাকে শুধুমাত্র ভালালাগার ভান করা সহজ নয়। অপরাজিতা সেই ভান করে চলেছে। অনুভূতি, অভিব্যক্তি লুকানো কী এতোই সোজা? তার ওপর সেটা যদি হয় বিশুদ্ধ প্রেমের, তীব্র ভালোবাসার? তবুও অপরাজিতা পারছে। সেটাতেই অবাক লাগে ওর।
গতকাল যখন বিদায় নিতে গেলো, কী ভীষণ মন খারাপ নিয়ে পুরোটা সময় বসেছিলো। অথচ আচরণে তার ছিটেফোঁটাও নেই। চোখমুখ কুঁচকে প্রায় ধমকের স্বরেই বলেছিলো, “কোন ইউনিভার্সিটি এতোদিন ছুটি দেয়? তা-ও ঘুরতে যাওয়ার জন্য? আপনিও কেমন ফ্যাকাল্টি, স্টুডেন্টদের ক্লাস ক্যানসেল করে ট্যুর দিচ্ছেন!” অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে রেখেছিলো ওয়াহিদ। গম্ভীর মুখে বলেছিলো, “এতো বছরের চাকরিতে একবারও ছুটি নেইনি। এই ছুটি আমার পাওনা ছিলো বলতে গেলে। ক্লাস ক্যানসেল করেছি, এতে স্টুডেন্টরা বেশ খুশিই বলা চলে। কয়েকজন তো বৃহস্পতিবারে আমার ক্লাস নেই বলে কক্সবাজার ট্যুরেরও প্ল্যান করে ফেলেছে। আমিও ওদের প্ল্যানে টুকটাক আইডিয়া দিলাম। সবাই খুশি। শুধু তোমাকে অখুশি লাগছে। আমার যাওয়াতে তুমি কি মন খারাপ করছো অপরাজিতা?”
সঙ্গে সঙ্গে পাত্তা না দেওয়ার মুখোশ আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো অপরাজিতা। চোখমুখ কঠিন করে স্বাভাবিকভাবে জবাব দিলো, “আপনি এতো খুশি মনে, আনন্দ নিয়ে ঘুরতে যাচ্ছেন, আমি মন খারাপ করবো কেনো?” ওয়াহিদ আকুলস্বরে বলেছিলো, “আই উইশ তোমার মন খারাপ হতো, অপরা।” এ কথায় অপরাজিতা কী কেঁপে উঠেছিলো একটুখানি? নাকি ও ভুল দেখেছিলো?
অপরাজিতাকে জিজ্ঞেস করেছিলো কি আনবে ওর জন্য? অনেক ভেবেচিন্তে অপরা ওর জন্য শান মসলাগুঁড়া নিতে বলেছে! তার রান্নায় খুব নাকি হেল্প হবে! জুতো, ব্যাগ, শাড়ি সব বাদ দিয়ে এমন কিছুও কেউ চাইতে পারে?
***
ইন্ডিয়ায় আসার ছয়দিন হয়েছে। প্রথমদিনের পর থেকেই আনাম সাহেব ব্যস্ত। রোজই মিটিংয়ে যাচ্ছেন।
দিল্লীর এখানে-ওখানে ওয়াহিদ ঘুরে বেড়াচ্ছে একা একাই। ঘুরছে কম। শপিং করছে বেশি। নিজের জন্য নয় অবশ্যই। অপরাজিতার জন্য। বেনারশী শাড়িতে অপরাজিতাকে কী স্নিগ্ধ, সুন্দর লাগবে সেটায় কোনো সন্দেহ নেই। ঘুরে ঘুরে তাই বেনারশী কিনেছে ও। সেখানেই এক শাড়ির দোকানের বিক্রেতা বললো পিওর কাঞ্জিভরম শাড়ির কথা। স্যাম্পলও দেখালো। লাল রঙা সিল্কের একটা কাঞ্জিভরম শাড়ি ওর বেশ পছন্দ হলো। খোলা চুলে, গাঢ় লাল লিপস্টিকে এই শাড়িতে অপরাজিতাকে কেমন ভয়ংকর সুন্দর লাগবে সেটা ভাবতেই পানি তেষ্টা পেলো ওর। শাড়িটা কিনে ফেলতে দু’বার ভাবলো না। সিলভার-পিংকের কম্বিনেশনে আরেকটা কাঞ্জিভরম শাড়িতে ওর চোখ আটকে গেলো। অপরাজিতাকে পিংকে দেখেনি ও। তারপরও কিনে ফেললো। মনে হলো এই শাড়িটায় শুধু অপরাকেই মানাবে। কোটা দরিয়া সিল্ক শাড়িও নিলো তিন-চারটে। এমনিতে শপিংয়ে গেলে সহজে ওর কিছুই পছন্দ হয় না। তার ওপর শাড়ি সম্পর্কে ওর তেমন কোনো আইডিয়া নেই বললেই চলে। অথচ মানুষটা অপরা বলেই হুটহাট কিনে ফেলতে পেরেছে।
আচ্ছা অপরাজিতা কী জানে ও শাড়ি পরলে ওয়াহিদ কতটা আকর্ষিত হয়? এই তো কদিন আগে দেখা হলো বিকেলে। অপরাজিতার একটা প্রেজেন্টেশন ছিলো। গুছিয়ে সুন্দর করে শাড়ি পরেছিলো। বেগুনি রঙা সুতি শাড়িটায় অনিন্দ্যসুন্দর লাগছিলো ওকে। ওয়াহিদের হাঁ করে তাকিয়ে থাকা দেখে লজ্জা পেয়েছিলো। শাড়ির প্রতিটা কুঁচির ভাঁজে অপরাজিতার লুকিয়ে রাখা যত্নে ওয়াহিদ অভিভূত হয়েছিলো। এই মেয়েটা কবে ওর ঘরে আসবে? শাড়ি পরে নতুন বউয়ের মতো সংসার সাজাবে? সংকোচ-দ্বিধার অবসান হতে আরও কত দেরি?
আরও দু’তিন দিন পর ঘুরেফিরে ওয়াহিদ চলে গেলো নামকরা ঘড়ির ব্র্যান্ডের একটা শো-রুমে। দুজনের জন্য মিলিয়ে ঘড়ি কিনে ফেললো। কী মনে হতে শ্বশুর-শাশুড়ির জন্যও মিলিয়ে ঘড়ি কিনলো। গল্পে গল্পে অপরাজিতা বলেছিলো ওর বাবা-আম্মু এখনও মিলিয়ে ঘড়ি পড়েন। সেখান থেকে বেরিয়ে গেলো ব্যাগের শো-রুমে। আম্মুর জন্য শোল্ডার ব্যাগ নিলো দু’টো। আব্বুর জন্য ওয়ালেট। বোনদের জন্য শাড়ি কিনতে চাইলেও সহজে পছন্দ করতে পারবে না জানে ও। তাই আর চেষ্টাও করলো না। চকলেট নিয়ে শপিং শেষ করলো। তারপর মনে পরলো অপরাজিতার বলে দেওয়া মসলার কথা! খুশিমনে একটা ডেইলি শপে গিয়ে নিয়ে নিলো সেগুলোও।
আগামীকাল কলকাতা যাচ্ছে ওরা। আনাম সাহেবের দ্বিতীয় দফার মিটিংগুলো ওখানে। সেখান থেকে অবশ্য তেমন কিছু কেনার নেই। ঘুরে ফিরে বেড়িয়ে সময়টা কাটিয়ে দিবে। অপরাজিতাকে ছাড়া এটাই ওর শেষবারের মতো কোথাও ঘুরতে যাওয়া। বিবাহিত কিন্তু ব্যাচেলার হিসেবে শেষ ট্যুরও বলা যায়।
কলকাতায় গিয়ে ওয়াহিদ প্রচুর ঘুরে বেড়ালো। কলকাতার শহরতলীতে প্রচুর দেখার জিনিস আছে। প্রথমদিন নিউমার্কেট গিয়ে ঘুরে ঘুরে হাবিজাবি এটা-সেটা কিনলো। রাতের হাওড়া ব্রিজ দেখতে গিয়ে, লঞ্চ ঘাট থেকে নৌকায় করে রাতের কলকাতা দেখলো। পরদিন সায়েন্স সিটিতে গেলো কৌতুহল বশত। নাইট-লাইফ ঘুরে দেখতে সন্ধ্যেয় পার্ক স্ট্রিটে গিয়ে মনে হলো অন্য এক কলকাতায় চলে এসেছে ও। এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে শুরু হয়ে ভিতরের রাস্তা ধরে পায়ে পায়ে হেঁটে গিয়ে একের পর এক গয়নার দোকান, বিখ্যাত রেস্তোরাঁ, ছবির দোকান সব ঘুরে বেড়ালো। বইয়ের দোকান চোখে পরতেই অপরাজিতার জন্য দুষ্প্রাপ্য কিছু বই কিনে ফেললো।
এর পরদিন বিকেলে প্রিন্সেপ ঘাট দেখতে গিয়ে সন্ধ্যে পর্যন্ত ওখানেই কাটালো। ব্যস্ত শহরের এদিকটায় আশ্চর্য এক নীরবতা ছিলো। সেই নীরবতায় বসে ও অপরাজিতাকে খুব মিস করলো। ক্যামেরা হাতে প্রচুর লোকজনকে ঘুরে বেড়াতে দেখেও ওর ছবি তুলতে ইচ্ছে করলো না। বারবার মনে হলো নরম রোদমাখা আরামের কোনো এক দুপুরে অপরাজিতাকে সঙ্গে নিয়ে ও ফিরে আসবে৷
আনাম সাহেবের অফিশিয়াল কাজকর্ম শেষ হতেই দুদিন সময় নিয়ে ওরা গেলো বিধাননগড়। সল্টলেক সিটি তে গিয়ে নিউ টাউন ইকো পার্কে ঘুরলো। সেখান থেকে সবার জন্য স্যুভেনিয়র কিনলো। ওখানের বিখ্যাত মাল্টিকোর্স রেস্তোরায় ডিনার করলো দু’জনে। মেমোরি ধরে রাখতে ওয়াহিদ বেশ কিছু ছবি তুললো। সেই ছবি ফেইসবুকে স্টোরি দিলো! অপরাজিতা স্টোরি দেখার দশ মিনিটের মাথায় ফোন দিলো। শান্তস্বরে জানতে চাইলো, “আপনি বাবার সঙ্গে ইন্ডিয়া গিয়েছেন! সেটা আমাকে বলেন নি কেনো?” টোপ জায়গা মতো পরেছে বুঝতে পেরে ওয়াহিদ মুচকি হাসলো। তবে সেটা লুকিয়ে রেখে বললো, “বাবার বিজনেসের কাজে আসতেই হবে। কিন্তু আম্মু সঙ্গে আসবেন না। তাই ভাবলাম বাবা-ছেলে মিলেই ঘুরে আসি। তোমাকে আলাদা করে জানাতে হবে বুঝিনি।” অপরাজিতা কি বুঝলো কে জানে! চট করে ফোন কেটে দিলো। ওয়াহিদ সঙ্গে সঙ্গে কল দিলো আবার। বেজে বেজে সেটা কেটে গেলো একসময়। ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসি ধরে রেখে সগতোক্তি করে ওয়াহিদ, “অভিমানের দিন ফুরালো বলে, অপরা!”
কলকাতায় থাকার শেষ দিন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি দেখতে গিয়ে আনাম সাহেব পুরোনো গল্প করলেন। অপরাজিতার আম্মু কে নিয়ে বিয়ের পরে আসার গল্প শুনে ওয়াহিদের কেবল মনে হলো শ্বশুর ওর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিচ্ছে!
***
অপরাজিতার ভীষণ মন খারাপ। ওয়াহিদের ফেইসবুক স্টোরিতে বাবার সঙ্গে ছবি দেখার পর থেকেই অস্থির লাগছে ওর। কতগুলো দিন পরে বাবাকে দেখলো। মনের ভেতর হাজারটা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। আম্মু কেনো বাবার সঙ্গে নেই? বাবা ইন্ডিয়া গেছে আর আম্মু যায়নি এমনটা কখনোই হয়নি। আম্মু-বাবার মাঝে সব কী ঠিক নেই? ওয়াহিদ ওকে কেনো জানালো না? বাবা কী অসুস্থ? এজন্যই কী ওয়াহিদ কিছু বলেনি? কিন্তু ওয়াহিদের কথায় মনে হয়নি এরকম কিছু। কী অবলীলায় ওয়াহিদ বললো বাবা-ছেলে মিলে ঘুরতে গেছে! বাবা, ওয়াহিদের বাবা হলো কবে থেকে?
ক’দিন ধরেই অপরাজিতার মন খারাপ ছিলো। ওয়াহিদ ইন্ডিয়া যাওয়ার পর থেকে সেভাবে সময় নিয়ে কথা হয়নি। ঘুরে-ফিরে ও ক্লান্ত থাকে। ফোন দিলেও বেশিক্ষণ কথা হয় না তাই। মাঝে চার-পাঁচদিন আগে অবশ্য খুব পাগলামি করেছিলো। বারবার বলেছে, “তোমাকে ছাড়া ভালো লাগছে না অপরা। মন কেমন করছে। দেশে ফিরে তোমাকে শক্ত করে জড়িয়ে না ধরলে কিচ্ছু ঠিক হবে না। তুমি প্লিজ পারমিশন দিও।” অপরাজিতা অন্য সব সময়ের মতো লজ্জা পায়নি। বরং ওয়াহিদের ব্যাকুলতা অনুভব করেছে। ফোনের এপাশে নিঃশব্দে কেঁদেছে। ভীষণ দোটানায় মন পুড়েছে। ওয়াহিদের অনুপস্থিতিতে ওকে দেখার বাসনায় মনের অস্থিরতা তীব্র হয়েছে। এই অস্থিরতার কারণটা অপরাজিতা জানে। ওয়াহিদ কে ভালোবাসে ও। ভালোবাসার সহজ অনুভূতিটাই কী ভীষণ কঠিন ওর জন্য। দুজনের মধ্যে যে আবছা প্রাচীর ও তুলে রেখেছিলো স্বেচ্ছায়, সেটাই বেদনাদায়ক হয়ে ওকে আঘাত করছে।
নিজের এই অনুভূতি নিয়ে ও যখন টালমাটাল, ঠিক তখনই নতুন সমস্যাটা হলো। দুদিন আগে, সকালের ক্লাসে গিয়ে বসতেই ক্লাশমেট বিজয় এসে বললো, “তোকে শিহাব ভাই ডেকেছে। বকুলতলায়। ক্লাস শেষে মাস্ট যেতে বলেছে।” শিহাব ভাই ওদের দুই সেমিস্টার সিনিয়র। চমৎকার আবৃত্তি করেন। ওনার মোটামুটি ভালো ফ্যান-ফলোয়ার আছে। ডিবেট করার কারণে ওনার সাথে অপরাজিতার মাঝেমধ্যে কথা হয়েছে। এটাকে সখ্যতা বলা যায় না। ওকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে কথা বলার মতো সখ্যতা তো আরো না। বিস্ময় চেপে রেখেই ও গিয়েছে বকুলতলায়।
কোনো ভনিতা ছাড়াই শিহাব ভাই জানিয়েছে সে রিপা কে পছন্দ করে! আচমকা কনফেশনে অপরাজিতা কী বলবে বুঝে উঠতে পারেনি। রিপা ওদের ডিপার্টমেন্টে সবচেয়ে কঠিন মেয়ে হিসেবে পরিচিত। কম কথা বলা, কারো সাতেপাঁচে না থাকা রিপাকে, অতি ব্যস্ত শিহাব ভাই কখন পছন্দ করলো! কী বলবে ভেবে না পেয়ে অপরাজিতা চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলো কিছু সময়। শিহাব ভাই তখন আবার বললো, “রিপাকে না বলে তোমাকে বলছি ভেবে অবাক হয়ো না। রিপাকে আগেই বলেছি। সে আমাকে প্লে-বয় বলে ধমক-ধামক মেরে চলে গেছে।” অপরাজিতার প্রচন্ড হাসি পেয়ে গেলো। হাসি আটকে রাখতে ব্যর্থ হয়ে হাসতে হাসতেই বললো, “রিপা আমার কথা শুনবে বলে মনে হয় না, শিহাব ভাই। ওর মতো কঠিন মেয়ে আমি আর একটাও দেখি নাই।” কাতর স্বরে শিহাব ভাই তখন অনুরোধ করলো ও যেনো তা-ও রিপাকে বলে। ডিপার্টমেন্টের সবাই জানে অপরাজিতা-রিপা বেস্ট ফ্রেন্ড। রিপা নিশ্চয়ই বেস্ট ফ্রেন্ডের কথায় ওকে একটা সুযোগ দিবে!
অপরাজিতা অবাক হয়েছিলো। শিহাব ভাইয়ের চোখের উন্মাদনা চিনতে ভুল হয়নি ওর। ওয়াহিদের চোখের ভাষায় হরহামেশাই এই আকুলতা, উন্মাদনা খেলা করে। তাই শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছে। রিপাকে বলবে ও। একবার চেষ্টা করে দেখতে তো দোষ নেই। কিন্তু ততক্ষণে ঝামেলা লেগে গেছে। শেষ বর্ষের শিহাবের সাথে তৃতীয় বর্ষের অপরাজিতাকে আলাদা করে কথা বলতে দেখেছে কয়েকজন। অতি কৌতুহলী হয়ে একে-ওকে জিজ্ঞেস করেছে ঘটনা কী। ঘটনা না জানলেও সবাই ধরে নিয়েছে ব্যাপারটা প্রেমঘটিত! এরপর থেকেই সারা দিনভর ব্যাচমেট, ক্লাসমেটদের অসংখ্য প্রশ্ন। ও যতই বলে এমন কিছু না, ওরা ততই বাঁকা হেসে মজা করে! এতো কিছুর মধ্যে রিপাকে আসল কাহিনি বলার সুযোগ হয়নি। তাই ক্লাস শেষে ওকে সঙ্গে করে ক্রিসেন্ট রোডের বাসায় নিয়ে এসেছে। পুরোটা বুঝিয়ে বলতেই বরাবরের শান্ত রিপা ক্ষেপে গেছে। শিহাব ভাইকে পাগল-ছাগল ডেকে তার গুষ্টি উদ্ধার করেছে।
তবে সমস্যা সমাধান হয়নি। সকলের কৌতুহলী দৃষ্টি এড়িয়ে দুদিন যাবত ও ক্লাস করছে ঠিকই। কিন্তু মন বসছে না কিছুতেই। সব ছেড়েছুড়ে বাসায় ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে। নিজের ঘরে গিয়ে সমস্ত মন খারাপ, দায়িত্ব, অভিমান, বোঝাপড়া, ঝামেলাকে ছুটি দিয়ে আরাম করতে ইচ্ছে করছে। আম্মুর গায়ের ঘ্রানকে এতোটা মিস করবে কখনও কী ভেবেছিলো ও?
এই এতোসব ইচ্ছের ভীড়ে ওয়াহিদের স্টোরি দেখে মন খারাপের ষোলোকলা পূর্ণ হয়েছে।
আনাম হাসনাতকে যদি প্রশ্ন করা হয় নিজের কোন পরিচয়টা সবচেয়ে পছন্দ, নির্দ্বিধায় তার উত্তর হবে ‘অপরার বাবা’।
ছাত্র হিসেবে তিনি মোটামুটি ছিলেন। উচ্চমাধ্যমিকের পর পড়াশোনা করার কোনো রকম উৎসাহ তার ছিলো না। তবুও স্নাতক শেষ করেছিলেন মায়ের জোরাজুরিতে। এক্ষেত্রে তার মায়ের যুক্তি ছিলো, ইন্টার পাশ ছেলের কাছে কেউ মেয়ে বিয়ে দিতে রাজি হবে না! এমন উদ্ভট যুক্তি কে কবে শুনেছে! লোক হাসানোর আগেই তাই চুপচাপ মায়ের কথা মেনে নিয়েছেন। চার ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয় হলেও, মায়ের বড় ছেলে তিনি। তাই হয়তো মায়ের অন্ধ স্নেহের পুরোটাই তার জন্য বরাদ্দ ছিলো। সেই স্নেহে তিনি বিগড়ে যান নি। বরং বাকি ভাই-বোনেরা ভাগে আদর যেটুকু কম পাচ্ছে সেটা নিজে তাদের পুষিয়ে দিয়েছেন।
উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হওয়া আনাম হাসনাতের জীবনে প্রয়োজনীয় সকল প্রাচুর্য ছিলো। নটা-পাঁচটার চাকরি সেই প্রাচুর্যের স্ট্যাবেলিটি ধরে রাখতে পারতো। কিন্তু সেসবে তার মন বসে নি। দাদাজানের কাপড়ের ব্যবসায় বরং তার আকর্ষন ছিলো বেশি। নারায়নগঞ্জে মাঝারি আকারের কারখানায় দাদাজানের অনেকদিনের ব্যবসা। তার বাবা-চাচা সেই ব্যবসায় যোগ দেন নি কখনোই। চাকুরে জীবন বেছে নিয়ে নিজেদের আলাদা সত্তা গড়ে তুলেছেন। দাদাজানের মৃত্যুর পর ব্যবসা যখন প্রায় হাতবদল হয়ে যাচ্ছিলো তখনই সেটাকে তিনি আঁকড়ে ধরেন। স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের আনাম হাসনাত নড়বড়ে, ঝিমিয়ে আসা ব্যবসাটাকে শেষ থেকে শুরু করেন। পথটা সহজ ছিলো না। প্রথম দু-তিন বছর সীমিত লাভে ক্রেতাকে পণ্য দিয়েছেন, মার্কেট এনালাইসিস করেছেন, সমপর্যায়ের প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠান থেকে ভালো মানের আলাদা নকশার পোশাক তৈরি করেছেন, ব্যবসার সম্পূর্ণ মালিকানা এককভাবে নিজের করেছেন। স্নাতক শেষ ততোদিনে। স্নাতকোত্তরে পড়া থেকে শুধু ব্যবসায় মনোযোগ দেওয়া বেশি লাভজনক মনে করেছেন। মায়ের কথা মানেন নি। সেই সুযোগে মা শর্ত জুড়ে দিলেন। হয় বিয়ে নয় স্নাতকোত্তর! বয়স সবে তখন চব্বিশ। এতো জলদি কে বিয়ে করে! বড় বোন আসমা হাসনাতের বছর আগে বিয়ে হয়েছে, তিনিও মায়ের কথায় সায় দিলেন। বললেন, “আমি শ্বশুরবাড়ি চলে আসায় বাড়ি ফাঁকা। তুই বিয়ে করে সেটা পূরন করে ফেল।”
মা-বড়বোনের অকাট্য যুক্তিতে হেরে তিনি বিয়ে করতে রাজি হলেন। মা, বোনদের সাথে নিয়ে বেশ কয়েকজনকে দেখলেন। শেষ পর্যন্ত বাবার কলিগের মেয়েকে সবার পছন্দ হলো। উনিশ বছরের কলেজ পড়ুয়া ইরাকে তার নিজেরও খুব পছন্দ হলো। চেনা-জানার সুযোগ তেমন পেলেন না। তবে ইরার তাকে অপছন্দ নয় সেটা নিশ্চিত হয়েছিলেন। ধুমধাম করে ইরাকে বিয়ে করলেন প্রচন্ড শীতের এক বিকালে। বাপ-দাদার মগবাজারের পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে সংসার সাজালেন নারায়ণগঞ্জ শহরে।
বিয়ের পরে ইরাকে চিনলেন নতুন করে। কথা কম বলা মেয়েটা চমৎকার সব কথা জানে। সেসব কথার একমাত্র শ্রোতা তিনি। রাঁধতে না জানা ইরার নিত্যদিন রান্না শেখার চেষ্টা৷ শুধুমাত্র তার জন্য। লাল-কালোর আচ্ছাদনে সংসার সাজানোয় মত্ত ইরা। কারন লাল-কালো তাদের পছন্দ। তার প্রিয় লেখক শরৎচন্দ্র বড়দিদি’তে লিখেছিলেন ‘যাহার হৃদয়ে ভালোবাসা আছে, যে ভালেবাসিতে জানে-সে ভালোবাসিবেই’। শান্তশিষ্ট ইরার সান্নিধ্যে এসে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন কথাটা কত সত্যি। নীরবে, নিভৃতে তার জীবনের সঙ্গে জুড়ে যাওয়া ইরা তাকে যত্ন করে ভালোবেসেছিল। সেই ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে তিনি ইরার মায়ায় পড়েছিলেন৷ সেই মায়া তার কাটেনি কোনোদিন। বরং মায়ার সঙ্গে ভালেবাসা মিলেমিশে ইরা তার আজীবনের অভ্যেসে পরিণত হয়েছে।
কলেজের পাঠ চুকিয়ে স্নাতকে ভর্তির অপেক্ষায় থাকা ইরার বয়স তখন বিশ। ক’দিনের জ্বরে ক্লান্ত, দূর্বল শরীর নিয়ে যখন মাথা ঘুরে বারান্দায় পরে গেলো, সঙ্গে থাকা ছোট ননদ আরজু হাসনাত সামলে নিলো তখনকার মতো। তবে বিপদ ঘটলো দু’দিন পরের সন্ধ্যেয়। প্রচন্ড পেটে ব্যাথায় অস্থির ইরার রক্তপাত শুরু হলো। হসপিটালে যতক্ষণে নেয়া হয়েছে, ইরার জ্ঞান নেই। কর্তব্যরত ডাক্তার গাইনী বিভাগে পাঠালেন। সেখানে গিয়ে জানা গেলো ইরার মিসক্যারেজ হয়েছে। ইরা প্রেগন্যান্ট ছিলো সেটা যেমন তারা বোঝেনি তেমনি মিসক্যারেজ কি করে হলো সেটাও কেউ বোঝেনি। ডাক্তার কারণ হিসেবে জানালেন, প্লাসেন্টা বা গর্ভফুল নামের যে অঙ্গের মাধ্যমে মায়ের শরীর থেকে বাচ্চার শরীরে রক্ত সরবরাহ হয়, সেটার গঠনে ত্রুটি ছিলো।
এই দুর্ঘটনার রেশ ধরে ইরা চুপ হয়ে গেলো। কম কথা বলা ইরার সব কথারা যেনো এবার একেবারেই ফুরিয়ে গেলো। তার বয়স কম কিন্তু সে তো অবুঝ নয়। কেনো কিছু টের পেলো না? অপরাধবোধ তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো। সেসময়টায় পঁচিশের আনাম শক্তহাতে সামলালেন অসুস্থ ইরাকে। সর্বপ্রথম বাসা ছেড়ে দিলেন। নারায়নগঞ্জ শহরের আট মাসের সংসার ছেড়ে ঢাকায় ফিরে এলেন। মগবাজারের বাসায় সবার মাঝে থেকে ইরা নিশ্চয়ই হাবিজাবি ভাবার সময় পাবে না। ব্যবসা তখন সামনে এগোচ্ছে, সেটাকেও তিনি শক্তহাতে ধরলেন। ঢাকা থেকে রোজ নারায়ণগঞ্জ এসে-যেয়ে ব্যবসার দেখভাল তার জন্য কঠিন ছিলো। কিন্তু ভেঙে গুড়িয়ে যাওয়া ইরাকে দেখা আরো কঠিন ছিলো। যে অতিথি তাদের জীবনে হঠাৎ এসে হঠাৎই চলে গেলো তার জন্য এক অদ্ভুত শূন্যতা তিনি বোধ করতেন। তবে প্রকাশ্যে সেটা কখনোই নিয়ে আসেন নি।
ইরার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে বছর পার হলো। বলা যায় আনাম সাহেবের মায়ের সাপোর্টেই সে আবারও পড়াশোনায় ফিরলো। ছেলেকে দিয়ে যে আশা পূরণ হলো না ইরাকে দিয়েই সেটা সম্ভব করলেন আনাম সাহেবের মা। স্নাতক শেষে স্নাতকোত্তর, পুরো সময়টায় প্রিয় ছেলের বউকে আগলে রাখলেন তিনি। এই সময়টায় ইরা প্রতিক্ষণ নতুন কারো আসার অপেক্ষা করেছে। প্রত্যেকবার আশাহত হয়েছে। বারবার মনে হয়েছে তার জন্য আনাম সাহেব বাবা হতে পারছেন না। কিন্তু তার এসকল কথা-বার্তা, চিন্তা-ভাবনা যে নিতান্তই অবান্তর সেটার প্রমাণ প্রতিবার পেয়েছেন। তাকে নিয়েই জীবন চমৎকার কেটে যাচ্ছে প্রতি মূহুর্তে সেটাই তাকে অনুভব করিয়েছেন আনাম হাসনাত। নতুন অতিথির এই চমৎকার জীবনে আসাটা হবে বোনাস। না এলেও সই। আনাম সাহেবের মা ইরাকে কঠিন হতে শেখালেন। সন্তান না-ই হতে পারে। এটা তার দোষ নয়। এই বাক্যটাই বারংবার তাকে বুঝিয়েছেন। একপর্যায়ে গিয়ে আফসোস করা বাদ দিয়ে জীবনের চক্রকে মেনে নিতে শুরু করা ইরা চাকরিতে যোগ দেন। জীবনে সব পেতে হবে, না পেলে নষ্ট জীবন, সেই চিত্র মন থেকে সরিয়ে দিয়ে নতুন শুরু করলেন।
আনাম সাহেবের ব্যবসা ততদিনে শক্তপোক্ত অবস্থানে এসে পৌঁছেছে। দেশীয় মার্কেটে তার পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। জীবনের প্রথম গাড়িটা কিনলেন তখন। মা-কে সেই গাড়িতে চড়িয়ে শহর ঘুরে বেড়ালেন। মায়ের চোখেমুখে খেলে বেড়ানো আনন্দেরা তাকে জানালো অপূর্ণতায় ও তিনি পূর্ণ। মায়ের প্রতি ভালোবাসায়, শ্রদ্ধায় অনুভব করলেন কী ভীষন ভাগ্যবান তিনি। তবে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরে যাওয়াটা সবেই শুরু হয়েছিলো তখন। চাকরিতে ব্যস্ত ইরাকে নিয়ে সময় করে নেপাল ঘুরতে গেলেন। সেখানে পোশাকের চাহিদায় নতুন বিজনেস প্ল্যান মাথায় নিয়ে, ছুটি কাটিয়ে দেশে ফিরলেন। দেশে ফেরার মাসখানেক পরে একদিন ইরা জানালো তাদের জীবনের কাঙ্খিত অতিথির আগমন বার্তা। বিস্ময়ে তিনি হতবিহ্বল হলেন। মায়ের আনন্দাশ্রু, ভাই-বোনদের উচ্ছাস, ইরার কান্না, সবকিছুর ভীড়ে তিনি এক সম্পূর্ণ নতুন অনুভতির সাথে পরিচিত হলেন। বাবা হওয়া। বাবা হবেন তিনি।
ইরার প্রেগন্যান্সিতে কমপ্লিকেশনস আছে অনেক। স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দিলো সে। মাসে দু’বার করে নিয়মিত ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। হাসব্যান্ড, মায়ের মতো শাশুড়ির যত্নে শুয়ে-বসে দিন কাটে তার। কথা কম বলা ইরা আশ্চর্যজনক ভাবে প্রচুর কথায় মুখরিত তখন। অতি সতর্কতায় প্রতিটাক্ষণ অপেক্ষায় দিন গুনে চলে। তবুও শেষ রক্ষা হলো না।
সাতমাসের নিয়মমাফিক চেক-আপে ডাক্তার আল্ট্রাসাউন্ড রিপোর্ট দেখে জানায় গর্ভফুল বা প্লাসেন্টা জরায়ুর নিচে অবস্থান করছে। গর্ভফুলের অবস্থান সাধারণত জরায়ুর ভেতরে ওপরের দিকে থাকে। কোনো কারণে যদি এই গর্ভফুল জরায়ুর নিচের দিকে নেমে যায়, তখন তাকে মেডিকেলের ভাষায় বলে ‘প্লাসেন্টা প্রিভিয়া’। গর্ভফুল জরায়ুর নিচে অবস্থান করলে সন্তান প্রসবের আগেই জরায়ু স্ফীত হয়ে উঠে এবং গর্ভফুল আলাদা হতে শুরু করে। ফলাফল অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে রক্তশূন্যতা হয়ে মা শকে চলে গিয়ে মারা যায়।
ইরার প্লাসেন্টা বা গর্ভফুল পর্দার মতো পাতলা। যার ফলে প্রথমবার সঠিক গঠন হয়নি। দ্বিতীয়বারেও সমস্যাটা ছিলো। তবে ডাক্তার আশায় ছিলেন ব্যাপারটা এতো খারাপের দিকে যাবে না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বাচ্চা যতো বড় হচ্ছিলো তত গর্ভফুলের উপর চাপ পরছিলো। গর্ভফুল জরায়ুর লোয়ার ইউটেরাইন সেগমেন্ট অর্থাৎ নিচের দিকে থাকে, চাইলেই গর্ভফুলটা আকারে বড় হতে পারে না। ইরার ক্ষেত্রে গর্ভফুল টোটাল সেন্ট্রাল অবস্থায় আছে অর্থাৎ গর্ভফুল, জরায়ুর সম্পূর্ণ মুখই ঢেকে ফেলেছে। যেকোনো সময় রক্তপাত শুরু হতে পারে। অপারেশন ছাড়া অন্য বিকল্প নেই। জরায়ুও হয়তো অপসারণ করা লাগতে পারে। বাচ্চাও মায়ের থেকে কোনো পুষ্টি সেরকমভাবে আর পাচ্ছে না। ওজনও কম। এক কথায় অপরিপক্ক। জন্মের পরপর তাকে এনআইসিও তে পাঠাতে হবে। যতদিন না নিজে থেকে নিশ্বাস নিতে পারবে, সেখানেই বাচ্চাটাকে রাখতে হবে। ডাক্তার দুদিন সময় নিলেন। ইরাকে হসপিটালে ভর্তি করানো হলো। দু’দিনে তার শরীরে স্যালাইনের মাধ্যমে নিউট্রিয়েন্টস চললো বিরতিহীন ভাবে। চার ব্যাগ রক্ত লাগবে, ডোনার খুঁজে বের করা হলো। পুরো সময়টায় ইরা শক্ত রইল। নতুন অতিথির জন্য সকল যুদ্ধে সে যেনো প্রস্তুত। আনাম হাসনাত অবাক হয়ে নতুন এক ইরাকে দেখলেন। বিমুগ্ধ হলেন। সাহস পেলেন। বিশ্বস্ত সেনাপতির মতো সঙ্গে রইলেন।
অতঃপর হালকা শীতের আমেজে, ২০০১ সালের নভেম্বরের শেষ দিকে, সাত মাসের প্রি-ম্যাচিওর বাচ্চাটা এই দুনিয়ায় এলো। তিন ব্যাগ রক্ত লাগলেও জরায়ু অপসারণ করতে হলো না সেবারের মতো। ইরার জীবনের অপূর্ণতা মিলিয়ে দিয়ে, ২.৩ কেজি ওজনের ছোট্ট বাচ্চাটা চারদিন পরে এনআইসিও থেকে মায়ের কোলে আশ্রয় খুঁজে নিলো। বাবা হওয়ার ঘটনা দ্বিতীয়বারের মতো তার জীবনে এলেও তিনি প্রথমবারের মতো বাবা হওয়ার চমৎকার অনুভূতির তীব্রতা অনুভব করলেন। তেত্রিশের আনাম হাসনাত অনুভব করলেন কী ভীষণ সুখী তিনি। হার না মেনে, বাবা-মা হিসেবে তাদের জিতিয়ে দেয়া বাচ্চাটার নাম রাখলেন অপরাজিতা।
***
অপরাজিতা কে নিয়ে তারা যখন বাড়ি ফিরলো তখন ডিসেম্বর মাস। শীত জাঁকিয়ে বসেছে। ছোট্ট অপরাজিতার অবশ্য সেসবে যায় এলো না। মায়ের কোল থেকে দাদী-ফুপিদের কোলে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তার জীবনের প্রথম শীত কেটে গেলো। বাবা তাকে কোলে নেয়ার সাহস করেন না। হাতের ফাঁকফোকর গলে পরে যায় যদি!
সকলের আহ্লাদের অপরাজিতা নিউমোনিয়া বাঁধালো চার মাসের বেলায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ার কারণে খুব সহজেই রোগ তাকে কাবু করে ফেলে। টানা বারো দিন আবারও হসপিটালে কাটিয়ে অবশেষে অপরাজিতা বাড়ি এলো। এই বারো দিনে মায়ের সঙ্গে সঙ্গে বাবার কোলেও চড়লো সে। হাতে লাগানো ক্যানোলা অপরাজিতার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটালো ভালোভাবেই। কোলে যতখন থাকে ততক্ষণই সে আরাম করে ঘুমায়। হসপিটালের বেডে শোয়ানোর অল্পক্ষণের মধ্যেই জেগে গিয়ে কান্নাকাটি করা যেনো তার প্রিয় কাজ হয়ে গেলো! দিনটা যেমন-তেমন এর-ওর কোলে করে কাটিয়ে দেয়া যায়। বিপত্তি বাঁধে রাতে। ইরা মেয়েকে নিয়ে বেশিক্ষণ হাঁটতে পারে না। অপারেশনের ধকল তখনও কাটিয়ে উঠছে সে। সেলাইয়ের স্থানে হালকা ব্যাথা অনুভব করে। উপায় না পেয়ে আনাম হাসনাত মেয়েকে কোলে নিয়ে পুরো রাত কেবিন জুড়ে হাঁটতে শুরু করেন। ক্লান্তি অনুভব করার কথা থাকলেও তিনি অনুভব করতেন অপার শান্তি। ক্যানোলা লাগানো হাতটা পরম যত্নে আগলে রাখতেন। ইরা অবাক হয়ে দেখতো এক বাবাকে। যার মধ্যে কোনো বিরক্তি নেই। শুদ্ধতম ভালোবাসা ছাড়া অন্যসব অনুভূতি অনুপস্থিত মানুষটার চোখেমুখে।
এইযে বাবার কোলে চড়ে অভ্যেস হলো, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পরও এই অভ্যেস রয়ে গেলো অপরাজিতার। বাবা কোলে নিয়ে হাঁটবে, তবেই সে ঘুমাবে। সারাদিনের কাজকর্মের পরে মেয়েকে কোলে নিয়ে হাঁটা সোজা কথা না, তবুও খুশি মনে সেটাই করতেন আনাম হাসনাত। ঘুম গভীর হলে একসময় বিছানায় শুইয়ে দিতেন মেয়েকে। তারপরও ভয়ে ভয়ে থাকতেন, যদি জেগে যায়! অপরাজিতার দাদী এসব দেখে ছেলেকে বলতেন, “নিজে বাপ হইসো, এখন বুঝবা মা’র টান।”
বাবা-মেয়ের বন্ধুত্বটা হলো এইভাবে। বাবাকে দেখলেই দুর্বোধ্য ভাষায় কথার তুবড়ি ছোটায় মেয়ে। বাবা কী বোঝেন কে জানে। তিনিও ফিরতি মেয়েকে শোনান সারাদিনের ব্যস্ততার গল্প। বাচ্চারা সাধারণত ছয় মাস বয়স থেকেই কথা বলা শুরু করে। তবে অপরাজিতার সময় লাগলো। আটমাসের দিকে সে প্রথমবার বাবলিং শব্দের বাইরে কথা বললো। পরিষ্কারভাবে ‘বাবা’ ডাকলো। মা হিসেবে ইরা অভিমান করতেই পারতো। এতো কষ্ট সহ্য করেছে সে, আর অপরাজিতা কি না প্রথম ডাকলো তার বাবাকে! তবে ইরা খুশি হলো। চোখের সামনে মেয়েকে নিয়ে হেঁটে বেড়ানো আনাম হাসনাতের চোখের উজ্জ্বল দ্যুতি সে আনন্দ শতগুণে বাড়িয়ে দিলো।
***
আনাম হাসনাতের ব্যবসা তখন দেশের সীমা অতিক্রম করেছে। প্রায়ই বিদেশে যান-আসেন। চার বছরের অপরাজিতা মাকে নিয়ে বাবার সঙ্গী হয় প্রত্যেকবার। কলকল করে কথা বলা অপরাজিতার প্লেনে চড়তে ভালো লাগে। ভুলভাল উচ্চারণে সে মেঘেদের সঙ্গে কথা বলে। সে-ই কথায় ইরা যোগ দেয় চোখেমুখে হাসির ঝিলিক নিয়ে। আনাম সাহেবের মনে হয় উনিশ বছরের ইরা ফিরে এসেছে। ইরা এখন সবার সঙ্গে কথা বলতে জানে৷ তবে ওর সকল কথারা আনন্দের সাথে যেনো ঠিকরে পড়ে শুধু অপরাজিতার বেলায়।
অপরাজিতাকে স্কুলে ভর্তি করানো হলো। মা-দাদী তাকে আনা-নেওয়া করেন। তবুও সে যেনো মুখিয়ে থাকতো বাবার সঙ্গে মাঝেসাঝে স্কুলে যাওয়ার সময়টার জন্য। বাবার হাত ধরে হেলেদুলে স্কুলে যেতে সে বড় আনন্দ পায়। বাবা সঙ্গে গেলেই স্কুলের পাশের লাইব্রেরি থেকে ছবি আঁকার অনেক বই কেনা যায়। ইচ্ছেমতো বেলুন-স্টিকার কেনা যায়। সিনড্রেলা-স্লিপিং বিউটি-স্নো হোয়াইট এই তিন ডিজনি প্রিসেন্সদের ছবি আঁকা পেন্সিল ব্যাগ কেনা যায়। চিপস দু’টোর বেলায় চারটে কেনা যায়। মেয়েকে কোনো কিছুতেই না করতে না পারার এক অদ্ভুত সমস্যায় আনাম সাহেব ভুগছিলেন ইচ্ছে করেই।
অপরাজিতা আরেকটু বড় হতেই আনাম-ইরা দম্পতির সংসারে পিংকের আনাগোনা শুরু হলো। ছোট্ট অপরাজিতার প্রিয় কার্টুন মীনা। মীনার গায়ের জামার রঙ তার অতি পছন্দ। আবার বিদেশ থেকে বাবার এনে দেওয়া বার্বি ডলের রঙও পিংক। যেকোনো খেলনা তার এই রঙেরই হতে হবে। যেকোনো জামা এই রঙের হলে সে মহাখুশি। বিছানার চাদর থেকে ঘরের এটা-সেটায় এই এক রঙের সমাহার। আনাম সাহেবকে কেউ যদি জিজ্ঞেস করতো তার পণ্যের বেশিরভাগ রং গোলাপি বা গোলাপির ধারেকাছে কেনো সেটার উত্তরে তিনি আনন্দের সাথেই বলতেন, “পিংক আমার প্রিয় রং।” আনাম-ইরা দম্পতির লাল-কালোর সংসার অপরাজিতায় হয়ে উঠেছিলো গোলাপিময়।
অপরাজিতার গোলাপির ঘোর কেটে গেলো রাতারাতি। দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় স্কুলের ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ প্রতিযোগিতায় মা তাকে গোলাপি শাড়িতে সাজিয়ে দিয়েছিলো। মিষ্টি দেখতে অপরাজিতাকে নিয়ে ক্লাসের দুষ্ট ছেলেরা হেসে লুটিয়ে পড়ছিলো। নাম দিয়েছিলো ‘গোলাপি বেগম’। কেঁদেকেটে বাড়ি ফিরে সেই যে পিংকের সঙ্গে আড়ি পাতলো অপরাজিতা আর কখনোই ভাব করেনি।
মিরপুরের ডুপ্লেক্স বাসায় যখন ওরা শিফট করলো অপরাজিতা তখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। নতুন বাড়ি নিয়ে তার উৎসাহের শেষ নেই। দাদা-দাদীকে সঙ্গে নিয়ে পুরো বাড়ি সে ছুটে বেড়ায়। বাড়ির সামনের লনে লাগানো সাদা বাগানবিলাশ তার খুব পছন্দ হলো। বাবার কাছে আহ্লাদীস্বরে বললো একটা শিউলিফুলের গাছ লাগবে। বাবা পরের মাসেই শিউলি ফুলের চারা লাগালেন। সেই ফুলের সঙ্গে সঙ্গে বড় হলো অপরাজিতাও।
অতি প্রিয় একমাত্র মেয়ের জন্য আনাম সাহেব করতে চাইতেন অনেককিছুই। কিন্তু ইরার চোখ রাঙানো দেখে থেমে গেছেন অনেকবার। মেয়েকে অপ্রয়োজনীয় কিছুই দেয়া যাবে না। অতি প্রাচুর্যে বিগড়ে গেলে? তবুও তাদের বাবা-মেয়ের গোপন চুক্তি ছিলো। মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে পছন্দের গল্পের বই পড়া, প্রিয় আইসক্রিম খাওয়া, স্কুল ফাঁকি দিয়ে বাবার গাড়ি চালানো শেখা সবটাই অপরাজিতা করতো বাবার আশকারায়।
অপরাজিতার দাদী দুনিয়া ত্যাগ করলেন এক ভোরবেলায়। অপরাজিতা তখন কলেজে পড়ে। দাদীর চলে যাওয়ায় বাবা যে থমকে গেছে সে বুঝলো সেটা। তার মনে হলো বাবাও যদি এমন করে একদিন চলে যায়, সে কীভাবে থাকবে? বাবার কষ্টে সে যেনো হুট করেই বড় হয়ে গেলো। বাবার আহ্লাদী মেয়েটা বাবাকে আগলে রাখতে শিখে গেলো। খাওয়ায় অনিয়ম করা বাবাকে তার সামনে বসে থেকেই খেতে হবে জেদ করলো। সেই প্রথম আনাম সাহেব বুঝলেন তার মা চলে গিয়েও রয়ে গেছেন কোথাও না কোথাও। মেয়েরা তো মা’ই হয়।
তবে দুঃখ পিছু ছাড়লো না। দাদী চলে যাওয়ার মাস দুয়েকের মধ্যে দাদাও চলে গেলো। অপরাজিতার বাবা-ফুপি-চাচারা এতিম হলো। সেই শোক সামলে উঠতে সকলের সময় লাগলো। শোক সামলে উঠলেও ক্ষত কী কখনও সেরে উঠেছিলো? আনাম সাহেবের সঙ্গে তার বাবার মাখোমাখো সম্পর্ক ছিলো না। তবে তিনি জানতেন বাবার ছায়াটা আছে। সেই ছায়া হারিয়ে তিনি অনুভব করলেন বিশাল পৃথিবীতে তিনি না থাকলে তার মেয়েও একা। মেয়েকে আগলে রাখার মতো কাউকে কী কখনো পাবেন?
মেয়ে যখন ভার্সিটিতে ভর্তি হলো তখন থেকেই তার বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করলো। চেনাজানা ব্যবসায়ী বন্ধু, কাছের দূরের আত্মীয়, এলাকার ঘটক সবাই যেনো লাইন ধরে দাঁড়ালো। কে কত ভালো পাত্র নিয়ে আসতে পারেন সেই প্রতিযোগিতায় মেতে উঠলো। তিনি যতই বলেন এখনই মেয়ে বিয়ে দেবেন না, কেউ সেটা যেনো বুঝতেই চাইলো না। মেয়ে তার অথচ মাথা ব্যাথা হয়ে গেলো সবার। তিনি আরো গুটিয়ে গেলেন। মনের মধ্যে ভয় ঢুকে গেলো, মেয়ের জন্য যোগ্য কাউকে তিনি যদি বাছাই করতে না পারেন?
সময় যত গড়ালো, মনের চিন্তাও তত ডালপালা মেললো। কাউকেই পছন্দ না করার ভীড়ে ওয়াহিদকে ভালো লাগলো। এতো বছরের ব্যবসায় কম মানুষ দেখেন নি। ওয়াহিদের মনের ভাব তিনি ওর চোখেই পড়ে ফেললেন। ছেলেটার ব্যক্তিত্ব মুগ্ধ করার মতন। তিনি মুগ্ধ হলেন। প্রথমবারের মতো তার মনে হলো অপরা ভালো থাকবে। তিনি না থাকলেও অপরাকে ওয়াহিদ আগলে রাখবে। এতোসব বোঝাপড়ার খেলায় মেয়ে কে না জানিয়ে ওদের বাড়ি ডেকে ফেললেন। এবং ভুল করে ফেললেন। মেয়ের নিজেরও যে কিছু বলার থাকতে পারে সেটা বেমালুম ভুলে বসলেন। মেয়ের মত পাবেন সেই বিশ্বাস তার ছিলো। কিন্তু অপরার অভিমান হতে পারে সেটা কখনোই ভাবেন নি। অপরা যখন তার বিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন উঠালো তক্ষুনি বুঝলেন মেয়ে কষ্ট পেয়েছে। ভীষণ কষ্টে বাড়ি ছাড়তে চাইছে। তিনি আটকালেন না। ইরার এতো অনুরোধ কান্নাকাটিতেও কিছুই বললেন না। মেয়েকে যেতে দিলেন। বলা ভালো মেয়েকে সময় দিলেন। ওয়াহিদকে জানালেন অপরার চলে যাওয়ার খবর। সরাসরিই বললেন, “তোমাকে কেনো পছন্দ করেছি সেটা অপরাকে বোঝাও। কী দেখে তোমাকে আমার পারফেক্ট লাগলো সেটা অপরাকে বুঝতে দাও। দেখতে দাও।”
নিজেকেও মেয়ের সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য তৈরী করতে লাগলেন। কিন্তু পারছেন কোথায়? কিসের এক জড়তায় থমকে যাচ্ছেন। মেয়ের এই অভিমান কাটবে কী না সেই চিন্তায় বড্ড দিশেহারা বোধ করেন। মায়ের অভাবটা গত একমাসে নতুন করে অনুভব করেছেন। অপরাজিতার শূন্যতায় মায়ের শূন্যতা এতটা প্রকট হয়ে উঠবে সেটা তো তিনি জানতেন না। আচ্ছা অপরাজিতা যখন শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে তখন কী করে থাকবেন তিনি?
ওয়াহিদের কথায় অপরাজিতা চমকালো। থমকে গেলো। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ওয়াহিদ মৃদু হেসে বলে, “অর্ণবের মতো বলছি, তোমায় ঘিরে আমার ভালোলাগা। সেই ভালোলাগা একটুও লুকিয়ে রাখতে চাই না। তুমি করে বলি, প্লিজ?” এতো কাতর শোনালো ওয়াহিদের গলা, অপরাজিতা শুধু কোনোরকমে মাথা দোলাতে পারলো। অথচ ওয়াহিদের চোখেমুখে তখন পাওয়ার আনন্দ। মেইবি এনাদার ম্যাচ পয়েন্ট!
কফিতে চুমুক দিয়ে অপরাজিতাকে প্রশ্ন করে ও, “স্রোতস্বীনী শুনেছো অপরা? ইনকোরের গানটা?” অবাক হয়ে অপরাজিতা মাথা দোলায় আবারও। ওয়াহিদ ফের বলে, “গানটায় একটা লাইন আছে। ‘আমি ভেবে নিলাম তুমি সেই লাল গোলাপ, যারে নিরন্তর পাহারা দেয় এক কাঁটার বাগান’। অপরা, তুমি ছিলে সেই লাল গোলাপের প্রতিবিম্ব। তোমার বাবা হলেন সেই কাঁটার বাগান। নেগেটিভ ভাবে বলছি না কিন্তু। মেটাফোর হিসেবে বলছি। তোমাকে তোমার বাবা এতোটাই আগলে রেখেছেন যে ওই কাঁটার বাগান পার করে কেউ পৌঁছাতে পারেনি। ভাগ্যিস পারেনি। তাই সুযোগটা আমি পর্যন্ত এসেছে। সুযোগ পেয়েই আমি লুফে নিয়েছি। এন্ড প্রাউডলি বলছি, তোমাকে জিতে নিয়েছি। তবে এর জন্য ঠিক কতবার কতভাবে আমাকে টেস্ট দিতে হয়েছে সেটা আরেক গল্প। আনাম আংকেল অনেক ভেবেচিন্তে তার কাঁটার বাগান পার করে আমাকে সেই লাল গোলাপ পর্যন্ত যেতে দিয়েছেন। সেই লাল গোলাপ বাড়ি ছেড়ে হলে উঠলো, আমি কি জানবো না?” অপরাজিতা যেনো কথা বলতে ভুলে গেছে! বড় বড় চোখে তাকিয়েই রইলো শুধু। ওকে আরো চমকে দিয়ে ওয়াহিদ বললো, “আংকেল নিজেই ডেকে জানিয়েছেন। এক্সাক্টলি কি বলেছেন সেটা বলা যাবে না। সিক্রেট।” অপরাজিতার চোখেমুখে রীতিমতো অবিশ্বাস। ওয়াহিদ হাসলো সেটা দেখে। কফি মগ এগিয়ে দিয়ে বললো, “খিদে পেয়েছে অপরা। লাঞ্চ করিনি। আরও কিছু অর্ডার দিই?” অপরাজিতার চট করে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো এটা শুনে। কন্ঠে রাগ নিয়ে প্রশ্ন করলো, “লাঞ্চ করেননি, সেটা আগে বলেননি কেনো? রেস্টুরেন্ট ছেড়ে তো আসতাম না তাহলে। এখানে বার্গার-স্যান্ডউইচ ছাড়া আপনি আর কী পাবেন?” এবার ওয়াহিদের অবাক হবার পালা। একটু আগে চুপ করে থাকা, ইমোশনাল হয়ে পরা মেয়েটা কোথায় গেলো! ইন্সট্যান্ট মুড চেইঞ্জ! বউয়ের বকাবকি কী তবে শুরু হয়ে গেলো?
ওয়াহিদ দু’টো বার্গার অর্ডার দিলো। অপরাজিতা সেটা দেখে বললো ও খাবে না। দু’টো অর্ডার দেয়ার দরকার নেই। ওয়াহিদের চোখেমুখে দুষ্টমি খেলে গেলো সেটা শুনে। সঙ্গে সঙ্গে বললো, “ফিনল্যান্ডে গিয়ে শুরুর দিকে আমি ঠিকঠাক রান্না করতে পারতাম না। তখন বার্গার খেয়ে দিন কাটতো আমার। এতো এতো বার্গার খেয়েছি অথচ একটুখানিও রুচি নষ্ট হয়ে যায়নি। কখনই মনে হয়নি জীবনেও আর বার্গার খেতে পারবো না। বরং প্রত্যেকবার মনে হয়েছে নতুন করে খাচ্ছি। তোমার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই, অপরা। যতই ভালোবাসি সেটা ফুরিয়ে যাবে না। তোমার প্রতি যে তীব্র ভালোলাগা সেটা মিলিয়ে যাবে না।” এই কথায় অপরাজিতা কঠিন লজ্জা পেলো! সেটা দেখে ওয়াহিদ অত্যন্ত ইনোসেন্ট ভঙ্গিতে বললো, “মেটাফোর হিসেবে বলেছি। ডাবল মিনিং করে বলিনি!” ব্যস। অপরাজিতা হেসে গড়াগড়ি খেলো। ওয়াহিদও ওর সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাসলো। বার্গার এলে, খেতে খেতে দুজনে গল্প করলো। অপরাজিতা একটা বার্গারের হাফ খেলো। তারপর যখন বিল দেওয়ার সময় হলো ওয়াহিদ ওয়ালেট বের করতেই অপরাজিতা বলে উঠলো, “আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে, ওয়াহিদ। সেটা যেভাবেই হোক। ইউ আর মাই হাসব্যান্ড। এন্ড আমার হাসব্যান্ডের দায়িত্বও আমার। বিল আমি দেবো, ওয়ালেট বের করছেন কেনো?” সেদিন ওয়াহিদের কথায় অপরাজিতা, আর আজকে অপরাজিতার কথায় ওয়াহিদ বিমূঢ় হয়ে বসে রইলো!
***
ক্যাফে থেকে ওরা যখন বেরোলো তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। সাড়ে ছ’টার মতো বাজে। ওয়াহিদের ফিরে যাওয়ার তাড়া নেই। অপরাজিতাও ফেরার কথা বলেনি। সুযোগ বুঝে ওয়াহিদ তাই একসঙ্গে ডিনার করার আব্দার করলো। অপরাজিতার মনে তখনও অনেক প্রশ্ন। ও তাই চট করে রাজি হয়ে গেলো। কিন্তু ডিনারের সময় হতে দেরি আছে। কোথাও না বসে ততক্ষণ ওরা ঘুরে বেড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলো।
অপরাজিতার বাড়ি থেকে নিয়ে আসা জামা, কামিজে আর চলছে না। কাল-পরশু ও শপিংয়ে যেতো। এখন যেহেতু শো-রুম গুলোয় ঘুরছেই, ওর মনে হলো শপিং করে ফেলা যাক। ওয়াহিদের ধৈর্যের একটা ছোট্ট পরীক্ষাও নিয়ে ফেলা যাবে! নিজের ভাবনায় নিজেই মিটিমিটি হাসলো ও। কিন্তু অপরাজিতা যদি জানতো ধৈর্যের পরীক্ষা ওকে দিতে হবে তবে কেনোভাবেই ওয়াহিদকে নিয়ে শপিংয়ে যেতো না!
একটা নামকরা দেশী ব্র্যান্ডের শো-রুমে গেলো ওরা প্রথমেই। অপরাজিতা কিছুক্ষণ দেখেশুনে একটা কামিজ পছন্দ করলো। ওয়াহিদকে কেমন জিজ্ঞেস করতেই ওয়াহিদ বললো, “ভালো। কিন্তু এটা ফুল স্লিভ হলে বেশি ভাল্লাগতো।” সেই থেকে শুরু। কোনোটাই ওয়াহিদের পারফেক্ট লাগে না। কোনোটার ডিজাইন ভালো লাগে না! কোনোটার রং ওর চোখে বেশি লাগে! অপরাজিতা বিরক্ত হয়ে শেষে শো-রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। একজন মানুষ জামাকাপড় পছন্দ করতে এতো খুঁতখুঁতে হয় কীভাবে! যার জামাকাপড় পছন্দে এতো সময় লাগে সে মানুষ পছন্দ করতে কতদিন সময় নেয় কে জানে! ওয়াহিদকে সে কথা বলতেই ও হেসে বললো, “ইনডাইরেক্টলি জিজ্ঞেস করছো তোমাকে পছন্দ করতে কতসময় লাগলো? ট্রাস্ট মি অপরা, তুমি আর জামাকাপড় এক না।” অপরাজিতা খুব চেষ্টা করলো বিরক্তি ভাবটা চেহারায় ধরে রাখতে। কিন্তু ওয়াহিদের আকুতিভরা সহজ, সরল স্বীকারোক্তিতে বরাবরের মতোই এবারও পারলো না। একরাশ মায়া নিয়ে প্রশ্ন করলো, “আপনি আমাকে ভালোবাসলেন কখন? যেদিন ছবি দেখলেন, সেদিনই?” ওয়াহিদ সময় নিলো উত্তরটা দেয়ার আগে। ব্যস্ত মেইনরোড ছেড়ে গলির নিরিবিলি রাস্তায় পা চালালো। মাঝে মাঝে রিকশার আনাগোনায়, স্ট্রিট লাইটের আলোয় আর দূরের কোনো এক বিল্ডিং থেকে ভেসে আসা অচেনা গানের মৃদু শব্দে মুহূর্তটা বিশেষ হয়ে উঠলো। সেই বিশেষ মুহূর্তে ওয়াহিদ শোনালো ওর মুগ্ধতার গল্প।
সাবলীল কন্ঠে শুরু করলো, “আব্বু তোমার ছবি আমাকে দেখালো প্রায় মাস দু’য়েক আগে। আগামী দু’বছরেও আমার যে বিয়ের কোনো প্ল্যান নেই, সেটা আব্বু জানে। কিন্তু পাত্তা দেয়না। নিয়ম করে মেয়ের ছবি, বায়োডাটা পাঠায় ভাবীকে দিয়ে। অথচ! সেদিন নিজে এলো! খুব আগ্রহ নিয়ে ফেইসবুকে তোমার ছবিটা দেখালো। দেখলাম। বিশেষ কিছু অনুভব হলো না। তুমি সুন্দরী। একবার দেখলে আবারও যে কেউ ঘুরে তাকাবে। আমিও দ্বিতীয়বার দেখলাম। এইবার মনে হলো সুন্দর হলেও তুমি সিম্পল। ব্যাপারটা এখানেই থেমে যেতে পারতো। কিন্তু আব্বুর আগ্রহে আমি অবাক হলাম। প্রিয় বন্ধুর মেয়ে বলেই এতো আগ্রহ হবে কেনো? কৌতুহল হলো। ফেইসবুকে আংকেলকে খুঁজে বের করলাম। তোমাকে নিয়ে লেখা আংকেলের জন্মদিনের বার্তায় আরো অবাক হলাম। মেয়েকে তিনি ভালোবাসেন সেটা বোঝা গেলো ৪/৫ লাইনের ওই বার্তায়। তবে আমাকে আকর্ষন করলো তোমার নাম। অপরা কারো নাম হতে পারে সেটা প্রথমবার দেখলাম! তখনও পুরো নাম জানি না। আংকেল লেখেনি। তোমাকে তার পোস্টেও ট্যাগ করেনি। কমেন্ট সেকশনও অফ করা। কোনোভাবেই খুঁজে পেলাম না। দুদিন বাদে ভাবীকে গিয়ে বললাম অপরার ফেইসবুক আইডি লাগবে। ভাবী কী বুঝলো কে জানে! সে আরেকধাপ উপরে। টিজ করলো কতক্ষণ। তারপর বললো, আজমীরা হাসনাতকে খুঁজে না পাওয়ার কী আছে!”
তখনের ফাস্ট্রেশন ওয়াহিদের কন্ঠে এখনও যেনো ঝরে পরছে! অপরাজিতা সশব্দে হেসে উঠলো। ওয়াহিদ সেদিকে তাকিয়ে বললো, “হেসো না। তুমি যে অপরাজিতা সেটাই জানতাম না আমি! আজমীরা হাসনাত তো সিলেবাসের বাইরে!” অপরাজিতার হাসি থামলো না। অনেকদিন পর প্রাণখুলে যেনো হেসে উঠলো ও। ওয়াহিদের এতো ভালো লাগলো। ও অপরাজিতার হাসি থামার অপেক্ষা করলো। অতঃপর আবার শুরু করলো, “তোমাকে খুঁজে পেলাম। ইংরেজিতে অনার্স করা মেয়েটার টাইমলাইন ভর্তি শেক্সপিয়ার-ওয়ার্ডসওয়ার্থ। বাবার সাথে হাসোজ্জল ছবি। আম্মুর সাথে মিলিয়ে সেইম শাড়ি পরা ছবি। কাজিনের বাচ্চাদের নিয়ে আহ্লাদী ছবি। বন্ধুদের সাথে ট্যুরের ছবি। ছবিগুলো আমি কতবার যে দেখেছি, হিসেব নেই। সব ছবিতে কমন হলো হাসিমুখের অপরা। আমার খুব ভালো লেগে গেলো। এই হাসিমুখের অপরাকে এতোটাই ভালো লেগে গেলো যে আব্বুকে জানালাম বিয়ে করবো! আব্বু কীভাবে আংকেলকে রাজি করালেন জানি না। একদিন বললেন আংকেল দেখতে চাইছেন আমাকে। আংকেলের সঙ্গে কয়েকবার দেখা হলো। কঠিন যাচাই-বাছাই হলো আমার। পাশ করার পর তোমাদের বাসায় ফাইনালি ডাক পরলো! যদিও আন-অফিশিয়ালি। গেলাম। তোমাকে প্রথমবার সামনে থেকে দেখলাম। নীল শাড়িতে, স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরে বেড়ানো তোমাকে দেখে গলা শুকিয়ে আসছিলো আমার। পুরোটা সময় মনে মনে বলছিলাম, এই মেয়েটা আমার হয়ে যাক!”
নিয়ন আলোয় একধ্যানে বলে চলা, পাশে হাঁটতে থাকা ওয়াহিদকে দেখে অপরাজিতা। মানুষটা এতো গুছিয়ে কী করে বলে? ওয়াহিদের অবশ্য এতসবে খেয়াল নেই। ও বিভোর সেদিনের অপরাজিতায়, যেদিন প্রথমবার ভালোবাসা এসেছিলো, “লাঞ্চে যখন বসলাম, তুমি এলে ড্রইয়ংরুমে। বাচ্চাদের খাবারে মনিটর করলে। ওদের সাথে ওইটুকু সময়ের মাঝে গল্প জমিয়ে ফেললে। ওরা সব আমার বোনেদের বাচ্চাকাচ্চা। আমি খেলাম কম তোমাকে দেখলাম বেশি। খাওয়া শেষে আম্মু আমাকে জিজ্ঞেস করলো তোমাকে কেমন লেগেছে। ভালো লাগলে, আংকেলকে প্রস্তাব দেয়া হবে। আংকেল রাজি হবেনই এমন না৷ তবুও একটা চান্স নেয়া আর কি। আমি চান্সটা নিলাম। আংকেল প্রস্তাব শুনলেন। ভাবলেন। আমাকে আলাদা করে ডেকে কথা বললেন। এরপর তোমাকে জানাতে গেলেন। সাড়ে চারটের দিকে যে গেলো, পাঁচটা পার করেও যখন কোনো খবর এলো না, তোমার ফুপি উঠে গেলেন। ততক্ষণে, তুমি ‘না’ বলেছো সেটায় আমি শতভাগ নিশ্চিত। কিন্ত অপরা, তুমি আমার ভাগ্যে ছিলে। ফুপি যাওয়ার দশ মিনিটের মাথায় সবাই বেরিয়ে এলো। আংকেল ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে আব্বুকে জড়িয়ে ধরলেন। মাগরিবের আগেই বিয়ে! কাজী আনতে গেলো কয়েকজন। সবাই দারুন আনন্দে এটা-সেটা করছে। শুধু আমি স্ট্যাচু হয়ে বসে রইলাম। তুমি আমার সঙ্গে কথা না বলেই রাজি হয়ে গেলে। এটাকে আমি পজিটিভলি নিবো কিনা বুঝতে পারছিলাম না। কাজী এলো। তোমাকে নিয়ে আসা হলো। অলওয়েজ হাসতে থাকা তোমার মুখে কোনো হাসি নেই। রিয়েলাইজ করলাম ভুল হয়ে গেছে। তক্ষুনি বিয়েটায় তুমি হ্যাপী না।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ওয়াহিদ। অপরাজিতা চুপ করে থাকে। সেদিনের সন্ধ্যে আরেকবার ভেসে উঠে ওর মানসপটে। ওয়াহিদ আবার বলতে শুরু করেছে, “কবুল পড়ে তুমি আমার বউ হয়ে গেলে। নতুন বউয়ের চোখেমুখে খেলা করা লজ্জারা, চাপা আনন্দরা তোমার মধ্যে অনুপস্থিত। বিয়ের নীল শাড়ি যেনো তোমার মনের বিষাদেরই ছাপ। একহাত দূরত্বে বসে থাকা সেই বিষণ্ণ, সুন্দর তোমাকে আমি ভালোবেসে ফেললাম।”
অপরাজিতা এপর্যায়ে দাঁড়িয়ে পরে। ওয়াহিদের অনুভূতির তীব্রতা ওকে ছুঁয়ে যায়। কী চমৎকার করে বিয়ের দিনে বউকে ভালাবেসে ফেলার একটা গল্প আছে মানুষটার!
বিয়ে নিয়ে ওদের দু’জনের অনুভূতি এতো অন্যরকম কেনো? ওয়াহিদের টা যেখানে স্নিগ্ধতায়, মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ, অপরাজিতার টা সেখানে দম বন্ধ করা কেনো?
***
ডিনারে ওরা গেলো শংকর রোডের একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে। খাবার অর্ডার দিয়ে রিল্যাক্স হয়ে বসলো। ওয়াহিদ এরমাঝে গেলো ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে যখন হেঁটে আসছিলো, অপরাজিতার আবারও মনে হলো একটা তালগাছের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়েছে! ওয়াহিদ বসতেই ও জিজ্ঞেস করলো, “আপনার হাইট কতো?” তারপর ওয়াহিদের বলা “বেশি না। মাত্র পাঁচ ফিট এগারো!” শুনে হাঁ হয়ে রইল। যেটা ও পাঁচ ফিট আট ভাবছিলো সেটা পাঁচ ফিট এগারো! এতো লম্বা হওয়া লাগবে কেনো? এই লোকের দিকে ও সরাসরি তাকাবে কী করে! ঘাড় বাঁকিয়ে? তবে মনে মনে স্বীকার করলো ওদের দুজনের হাইট ডিফরেন্স পারফেক্ট। আজকে যখন শো-রুমের আয়নায় দু’জন পাশাপাশি দাঁড়ালো তখনই মনে হয়েছে সেটা।
খেতে বসে অপরাজিতা ওয়াহিদের নতুন একটা দিক আবিষ্কার করলো। ওয়াহিদ ঝাল খেতে পারে না। অপরাজিতা চিলি চিকেন খায় বলে অর্ডার দিলেও সেটা ওয়াহিদ মুখে তুলে নি। ভেজিটেবলে থাকা ক্যাপসিকামও বেছে খেলো। ব্যাপারটা ওর ইন্টারেস্টিং লাগলো। বিয়ের পর অচেনা মানুষটাকে একটুখানি করে জানতে-বুঝতে ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে এক্সপ্লোর করার অনেক কিছু আছে। এই তো সেদিন ইএলটি পরীক্ষা দিয়ে এসে কফি খেতে খেতে ওয়াহিদের সাথে কথা বলছিলো। তখন জানলো ওয়াহিদের চা ছাড়া দিন চলে না। দুধ চা, রঙ চা, মাল্টা চা সব ফ্লেবার পছন্দ ওর। অথচ অপরাজিতা চা খায় না। একদমই না। এই ছোট্ট মিল-অমিলগুলো ওদের মায়ায় জড়িয়ে দিচ্ছে। যেই মায়ার টানে অনেক বছর সংসার করে ফেলা যায়।
খাওয়ার মাঝপথে ওয়াহিদের ফোনে কল এলো। মায়ের ফোন দেখে, অপরাজিতাকে আর্জেন্ট বলে কল রিসিভ করলো। তবে এবারে উঠে গেলো না। ওর সামনেই কথা বললো। কথা শেষে অপরাজিতা প্রশ্ন করলো, “আজকে উঠে গেলেন না কেনো?” ওয়াহিদ প্রথমে বুঝলো না। পরে বুঝতেই এক্সপ্লেইন করলো, “সেদিনের ওটা অফিশিয়াল কল ছিলো। তোমার সামনে কথা বললে তুমি বিরক্ত হতে। আর আজকে তো আম্মু ফোন দিলো। আমার আম্মু তোমারও তো আম্মু। কোনো সিক্রেট তো নেই। তোমার সামনে কেনো কথা বলবো না?” অপরাজিতার উত্তর পছন্দ হলেও মেজাজ খারাপ হলো। গোমড়া মুখে বললো, “আপনার আম্মু আমার আম্মু। কিন্তু আমার বাবা আপনার আংকেল! সেটা কেনো?” ওয়াহিদ গালভরে হাসলো বউয়ের অভিযোগে। জবাব দিলো, “পারমিশন দাওনি তো, অপরা।” অপরাজিতার আরো মেজাজ খারাপ হলো। পারমিশন দেয়নি মানে কী! পারমিশন লাগবেই কেনো! বিয়ে করার সময় খুব যেনো ওর পারমিশনের অপেক্ষা করেছে! এরা জামাই-শ্বশুর এমন কেনো?
ওরা রেস্টুরেন্ট থেকে বের হলো, দশটা পার করে। ওয়াহিদ বললো অপরাজিতাকে পৌঁছে দিয়েই ও উত্তরা ফিরবে। অপরাজিতার বাসায় গেইট বন্ধ হয় এগারোটায়। রিকশায় করে সময়মতোই পৌঁছে যাওয়া যাবে। কিন্তু ওর মাথায় ঘুরছে অন্য চিন্তা। ওয়াহিদ জানতো ও হলে থাকে। এখন, যখন দেখবে হল ছেড়ে দিয়েছে, এটায় কী সায় দিবে? অবশ্য সায় না দিলেও কিছু করার নেই।
অপরাজিতা রিকশা ঠিক করে উঠে বসলো। ক্রিসেন্ট রোডের নাম শুনে অবাক হলেও ওয়াহিদ কোনো প্রশ্ন করলো না। রিকশা চলতে শুরু করলে, অন্ধকারে ঝলমল করা শহরের দিকে তাকিয়ে অপরাজিতা স্পষ্ট গলায় হল ছেড়ে দিয়ে বাসায় উঠার কথা জানালো।
ওয়াহিদ বুঝেছিলো এমন কিছু হতে পারে। ব্যাপারটা ওর পছন্দ না হলেও কিছু বললো না। কেনো একা একা বাসা ঠিক করলো সেটা নিয়ে রাগ করলে করা যায়। কিন্তু কার সাথে রাগ করবে? এই অভিমানী মেয়ের সঙ্গে রাগ করলে ওকেও দেখা যাবে বয়কট করেছে! কিছু জিনিস ঠিক হতে সময় লাগে, জানে ওয়াহিদ। এই দ্বন্দ্ব কাটতেও লাগবে। ততদিন ও অপরাজিতাকে আগলে রাখতে পারে কেবল। ফিরে যাও অথবা ফিরে যাওয়া উচিত এই টাইপ কথা বলেও কোনো লাভ হবে না। ওর বাবা যতদিন না নিজে আসবেন মেয়ে কোনোভাবেই যাবে না। অপরাজিতা না বললেও, ও বুঝতে পারে সেটা।
চিন্তাভাবনা সরিয়ে রেখে ওয়াহিদ অপরাজিতাকে দেখে। আজকের বিকেল থেকে এখন পর্যন্ত পুরোটা সময় ওর কাছে অপ্রত্যাশিত। সকালেও কী ও জানতো আজকের দিনটা অপরাজিতা এতোটা সুন্দর করে তুলবে? প্রশ্নটা করা ঠিক না বেঠিক সে ভাবনায় না গিয়ে প্রশ্নটা করেই ফেলে ওয়াহিদ, “অপরা, তোমার প্রেমে পরেছি কখন জানো?”
অপরাজিতা অপেক্ষা করছিলো ওর হল ছাড়া নিয়ে ওয়াহিদ কিছু বলবে। তার বদলে সম্পূর্ণ অন্যরকম একটা প্রশ্নে ও অসহায় বোধ করে। কথা জড়িয়ে আসে। ওয়াহিদ সাড়া না পেয়ে নিজ থেকেই বলে, “তোমার প্রেমে আমি প্রতিবার অল্প অল্প করে পরেছি। অপরাকে খুঁজতে খুঁজতে প্রথমবার প্রেমে পরেছি। খুঁজে পেয়ে হাসিতে মুখরিত তোমার প্রেমে আরেকটু পরেছি। আকদের দিন যখন একহাত দূরত্বে বসা তোমাকে দেখলাম তখন প্রেমে পরেছি। আজকে যখন রিকশায় বসে আড়চোখে আমাকে দেখলে তখনও প্রেমে পরেছি। সন্ধ্যেয় যখন শহর ঘুরলে আমার সঙ্গে তখনও একবার প্রেমে পরেছি।” অপরাজিতার খানিক আগের চিন্তা, মন খারাপ অন্ধকারেই মিলিয়ে যায়। মনে হয়, অ্যা ডে ক্যান নট বি মোর পারফেক্ট দ্যান টুডে!
***
রাত জেগে কথা বলা, কাজের ফাঁকে-ক্লাসের গ্যাপে ছোট্ট মেসেজ করা, হুটহাট রিকশায় ঘোরাঘুরি, অপ্রিয় চায়ের আড্ডায় হাসাহাসি- সেদিনের পর ওদের গল্পেরা ডালপালা মেলে ঠিক এইভাবে।
ওয়াহিদকে ভালো লাগে অপরাজিতার। ওর প্রতি ভালোবাসাটাও দরজায় কড়া দিয়ে যায়। ও দমিয়ে রাখে সেটাকে। আবছা একটা প্রাচীর তুলে রাখে।
আকদের মাস পেরিয়েছে। মাস পেরিয়েছে বাড়ি ছাড়ারও। দিন দিন বাড়ি ফেরার তীব্র ইচ্ছে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে অপরাজিতার। বাবা এ মাসেও ওর অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়েছে। অথচ একবারও ফোন দেয়নি। কিসের জড়তায় বাবা আটকে যায় ও বুঝতে পারে। সেই একই জড়তায় ও নিজেও আটকে যায়। কিন্তু আম্মুর কোনো জড়তা নেই। আম্মুদের বুঝি জড়তা থাকতে নেই। তিনি রোজ ফোন দেন। হোয়াটসঅ্যাপে টেক্সট পাঠান। অপরাজিতা পড়ে ঠিকই। বারবার পড়ে। কেঁদে চোখ ভেজায়। তবুও ফিরে যেতে পারে না। ফিরে গেলে এতোদিনের সব যদি ঠুনকো হয়ে যায়?
***
আনাম সাহেবের রাতে ঘুম হয়নি। হচ্ছে না অনেকদিন ধরেই। ঘুম যখন হয়নি, শুয়ে থেকে সময় নষ্ট করলেন না তিনি। ব্যলকনিতে গিয়ে বসলেন। সামনের লনে ফুটে থাকা শিউলিফুলের দিকে তাকালেন। ভোর হতেই ঝরে যাওয়া এই শিউলি ফুল অপরাজিতার অতি প্রিয়। প্রিয় সবকিছু ছেড়ে মেয়ে যেদিন চলে গেলো সেদিন থেকেই ঘুমাতে পারেন না তিনি।
মেয়ের সব খবরই রোজ পেয়ে যান। ক্রিসেন্ট রোডের বাসায় হাত পুড়িয়ে রান্না থেকে শুরু করে মিডে নাম্বার মন-মতো না হওয়া পর্যন্ত সবটাই তিনি জানেন। তবুও মেয়েকে ফিরিয়ে আনতে যান নি। মেয়ের প্রতি অভিমানে দ্বগ্ধ হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। কিসের অভিমান? তারও কী অভিমানের গল্প আছে? আছে বৈকি। আদরে-আহ্লাদে বড় হওয়া অপরার বাবারও একটা গল্প আছে।