Monday, June 23, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 229



বিয়েকথন পর্ব-০৫

0

#বিয়েকথন
শেখ জারা তাহমিদ

পঞ্চম পর্ব

মিড শেষ হয়েছে গতকাল। বরাবরই ভালো পরীক্ষা দেয়া অপরাজিতার এবারের পরীক্ষাগুলো আপ টু দ্যা মার্ক হয়নি। লিখেছে সবই। তবুও মনে হচ্ছে আরও ভালো লেখা যেতো। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে চাইলেও সেটাকে থামিয়ে রাখে অপরাজিতা। নষ্ট করার মতো সময় নেই। হল থেকে চলে যাচ্ছে ও। আজকেই। অনেক খুঁজে মনের মতো বাসা পেয়েছে। বাসাটা গ্রীন লাইফ হসপিটালের পেছনে। ক্রিসেন্ট রোডে। পাঁচতলা বিল্ডিয়ের চারতলায় দুই রুমের ছোট্ট বাসা। এক রুমে মেডিকেলে পড়া এক মেয়ে থাকে। আরেকটা রুম খালি হয়েছে চার-পাঁচদিন আগে। ফেইসবুকে টু-লেট গ্রুপ থেকে বাসাটার খোঁজ পেয়েছে অপরাজিতা। ভার্সিটি থেকে কাছে হবে বলেই উৎসাহ দেখিয়েছে। পরীক্ষার মাঝেই সময় করে দেখতে গিয়েছে। পছন্দ হয়েছে ভীষণ। একমাসের এডভান্স দিয়ে এসেছে সেদিনই। এন্ড টুডে ইজ মুভ ইন ডে!

অপরাজিতা ভেবেছিলো নেওয়ার কিছু নেই ওর। কিন্তু পরে দেখা গেলো ওর রুমে ফ্যান নেই। ফ্যান কিনতে হবে। লাইট আছে। কোনো খাট নেই। ফ্লোরিং করতে হলেও তোশক লাগবে! ম্যাট্রেস লাগবে! চাদর লাগবে! বালিশ লাগবে! খাওয়ার জন্য প্লেট-গ্লাস লাগবে! রান্নাও নিজেরটা নিজের করতে হবে! সো, হাঁড়ি-পাতিলও লাগবে! আল্টিমেটলি একটা সংসার শুরু করতে যা যা লাগে তার সিকিভাগ হলেও লাগছে অপরাজিতার। সেইসব কিনতেই বেরিয়েছে ও রিপাকে নিয়ে। একাই যাচ্ছিলো। রিপা সঙ্গে এসেছে জোর করে। বলেছে, “তোর পছন্দ করতে সুবিধে হবে। টু ইজ বেটার দ্যান ওয়ান, রিমেম্বার?” রিপার কাছে অপরাজিতার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। বাসা ছেড়ে আসা, বিয়ে, ওয়াহিদ সবটাই রিপাকে বলেছে ও। রিপা রিয়েকশন হিসেবে শুধু বলেছে, “তোর জামাইয়ের ছোট ভাই নিশ্চয়ই আমাদের সিনিয়র হবে। খোঁজ নিস তো সিঙ্গেল কি না!” ব্যাস। এটুকুই। ওদের বাবা-মেয়ের দ্বন্দ্ব, ওয়াহিদ-অপরাজিতার সম্পর্কের সমীকরণ নিয়ে কিছু বলেনি। প্রশ্ন করেনি। কোনো সাজেশন দেয়নি। শুধু আগের চেয়ে বেশি খেয়াল রেখেছে অপরাজিতার। এই এতো এতো মায়া কোথায় পেলো মেয়েটা?

কেনাকাটা করে ক্লান্ত অপরাজিতা, রিপাকে নিয়েই ওর নতুন বাসায় গেলো দুপুরের দিকে। তোশকের দোকানের এক ছেলে ওদের সঙ্গে এলো তোশক নিয়ে। চারতলা অব্দি দিয়ে গেলো। তারপর বাকিটা সেট করলো ওরা দুজনে মিলে। নতুন রুমমেট মুনিরাও হাত লাগালো। ফুডপান্ডায় অর্ডার দিয়ে খাবার আনিয়ে নিলো। খেতে খেতে আড্ডায় নিজেরা ভালোমতো পরিচিত হলো। সন্ধ্যের পরে ফ্যান লাগানোর লোক এলো। সেট করে দিয়ে যাওয়ার পর, রিপা বেরিয়ে গেলো। হলে ফিরবে। বেরিয়ে গেলো মুনিরাও। ওর টিউশন আছে। বাসায় একা রয়ে গেলো অপরাজিতা। বাসার একমাত্র বারান্দায় গিয়ে টুলে বসলো। গ্রিল বেয়ে উঠা মানি-প্ল্যান্টের দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেললো একসময়। মানি-প্ল্যান্টটা যেমন গ্রিল অবলম্বন করে শাখা-প্রশাখা ছড়িয়েছে, তেমনি অপরাজিতাও বড় হয়েছে বাবা-আম্মুর অবলম্বনে। অথচ সেই বাবা-আম্মুকে ছাড়া ওর কতকিছু করতে হচ্ছে। অভিমান এত তীব্র হয় কেনো?

***

পরদিন খুব ভোরে ঘুম ভাঙে অপরাজিতার। চারপাশে এতো হসপিটাল বলেই বোধহয় ভোর হতেই মানুষের আনাগোনা শুরু হয়। সিএনজি, রিকশার টুংটাং শব্দ শুনতে খারাপ লাগে না। টের পায় খিদে পেয়েছে। গতরাতে বারান্দা থেকে রুমে ফিরে দরজা আটকে শুয়ে পরেছিলো ও। খেতে ইচ্ছে করেনি। ওয়াহিদ ফোন করেছিলো সেটাও ধরেনি। মুনিরা যখন লক খুলে বাসায় ঢুকলো তখনও উঠেনি। একসময় চোখে ঘুম নেমে এসেছিলো। সেই ঘুম এতখনে ভাঙলো। বাইরে থেকে আসা হালকা আলোয় রুমটাকে দেখে ও। বাসায় ফেলে আসা নিজের রুমের কথা মনে পরে। আচ্ছা কখনো কি ওই রুমে আগের মতো ফেরা হবে? বিয়ে যখন হয়ে গেছে, একসময় ওয়াহিদের কাছে চলে যেতেই হবে। ওয়াহিদের রুমটা কি ওর নিজের হবে? সেটায় ওর একার দখলদারিত্ব কী কখনও হবে? নাহ! মুড অফ হয়ে যাচ্ছে। হাবিজাবি ভেবে সকালটা বিগড়ে দেয়ার কোনো মানে নেই। তারচেয়ে বরং ওয়াহিদকে একটা ফোন দেয়া যাক। এই ভোর ছয়টায় ফোন পেয়ে লোকটা নিশ্চয়ই খুব অবাক হবে। তাও আবার অপরাজিতার দেয়া প্রথম ফোন!

দু’বার ফোন দিলো অপরাজিতা। ওয়াহিদ রিসিভ না করায় মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গেলো। লোকটা তো খুব বলেছিলো সে ভোরে উঠে! হাঁটতে বেড়োয়! আজকেই কী হাঁটতে না বেরিয়ে আরাম করে ঘুমাচ্ছে? নাকি ফোন রেখে বের হলো? কোনটা? এলোমেলো ভাবনা বেশিদূর যাবার আগেই ওয়াহিদ ফোন দিয়ে ফেললো। একটা ছোট্ট মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে পরলো অপরাজিতার ঠোঁট জুড়ে। আজকাল ওয়াহিদ ফোন দিলেই এই হাসিটা খেলে বেড়ায় ওর চোখেমুখে। সেটা কী মেয়েটা বুঝতে পারে? পারে। পারে বলেই অবাক হয়। মাত্র সতেরো দিনের পরিচয়ে কাউকে ভালো লাগাটা কী যুক্তিসঙ্গত?

অপরাজিতা সময় নিয়ে রিসিভ করলো। সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেলো ওয়াহিদের উদ্বিগ্ন গলা, “অপরাজিতা, সব ঠিক আছে? আপনি ঠিক আছেন? রাতে ফোন ধরেননি। এখন এতো ভোরে ফোন দিলেন। আর ইউ অলরাইট?” এইযে এতো অস্থিরতা ওয়াহিদের কন্ঠে, সেটা শুধুমাত্র ওর জন্য। জানে অপরাজিতা। জানে বলেই চোখ ভিজে আসে ওর। হুট করে প্রশ্ন করে ফেলে, “আপনি কি আমাকে ভালোবাসেন ওয়াহিদ?” ওপাশের নীরবতা ভেঙে কয়েক সেকেন্ডের মাঝে উত্তর দেয় ওয়াহিদ, “খুব ভালোবাসি অপরাজিতা।”

***
অপরাজিতা ফোন কেটে দিয়েছে। মেয়েটা কি কাদঁছে? শিট! রাগ লাগে ওয়াহিদের। এক্ষুণি ভালোবাসি বলার কী দরকার ছিলো! সময় তো চলে যাচ্ছিলো না। রয়েসয়ে জানাবে ভেবেছিলো। কিন্তু অপরাজিতা এতটা আবেগ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, অন্যকিছু বলতে ইচ্ছে করেনি। ইনফ্যাক্ট, ও অন্যকিছু বলতে চায়নি!

আচ্ছা, অপরাজিতাকে এতটা ভালো কখন বাসলো ও? যখন আব্বু অপরাজিতার ছবি দেখালো, তখন? নাকি যখন অপরাজিতাদের বাসায় গেলো তখন? নাকি যখন তিন কবুল পড়ে মেয়েটা চিরতরে ওর হয়ে গেলো তখন? নাকি সেদিন, যখন বটতলার ওপাশে বসে এদিক-সেদিক তাকিয়ে অপরাজিতা ওকে খুজঁছিলো তখন? সেদিনের কথা মনে হতেই মুচকি হাসে ওয়াহিদ। অপরাজিতা ওকে চেনে না সেটায় কোনো সন্দেহ ছিলো না। তাও শিওর হতে আগে বটতলায় গিয়েছিলো ও। ম্যাডাম তখন ব্যস্তভঙ্গিতে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিলো! অথচ ও পাশেই ছিলো! অপরাজিতার দুশ্চিন্তা কাটাতেই, পরে ঘুরে অপরাজেয় বাংলার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। টেক্সট পাঠিয়েছে। এই কাহিনি অবশ্যই অপরাজিতাকে কখনো বলা যাবে না। দেখা গেলো লজ্জায় বাড়িঘর ছেড়ে চলে গেলো! সেদিন একের পর এক যে শক ম্যাডাম ওকে দিয়েছে তাতে এটা খুব কঠিন হবে না! শুধুমাত্র এক রিকশায় উঠতে হতে পারে ভেবে ধানমন্ডি যেতে না করে দিলো! ভাগ্যিস উবার ড্রাইভারকে একটু অপেক্ষা করতে বলেছিলো! নাহয় শুরুর আগেই ডেট শেষ হয়ে যেতো! বউয়ের মতিগতি বোঝা কত কঠিন সেটা ওইদিনই টের পেয়েছে ওয়াহিদ! রেস্টুরেন্টে গিয়ে ও যখন ফোনে কথায় ব্যস্ত ছিলো, ম্যাডাম তখন ওকে দেখছিলো গভীর মনোযোগে! অথচ জিজ্ঞেস করতেই, কী চমৎকার বললো, “সে তো আপনিও করেছেন, স্যার।” যেনো ওয়াহিদ তাকালো বলেই উনি তাকালেন! ভাঙবে তবু মচকাবে না! এইযে খাবার অর্ডারের আগে ইচ্ছে করে মেন্যুকার্ড রেখে দিলো, সেটাও তো ওয়াহিদকে পরীক্ষা করতেই। খেতে গিয়ে অনেকেই সাথের পার্টনারের পছন্দকে ইগনোর করে নিজেই অর্ডার দিয়ে বসে থাকে, ডিসকাস করে অর্ডার দেয়া দূরে থাক। এক্ষেত্রে ওয়াহিদ কী করে সেটাই দেখতে চেয়েছে অপরাজিতা। এই এতোসবের মাঝে ওয়াহিদকে যে ফোন দেয়ার পারমিশন দিলো সেটাই হচ্ছে ম্যাচ পয়েন্ট! এই ভাবনাগুলো ওয়াহিদ আজকে প্রথমবার ভাবছে, সেটা কিন্তু নয়। সেদিনের পর থেকে বারবার ভেবেছে। তবুও নতুন করে ভাবতে ভালো লাগে। অপরাজিতা রিলেটেড সবকিছু ওর দারুণ লাগে।

গতরাতে অপরাজিতাকে ফোনে না পেয়ে চিন্তা হচ্ছিলো। প্রথমবারের মতো ভাবছিলো ওর বউ কেনো ওর সাথে নেই! তারপরই মনে পরেছে বউকে এখনও ‘তুমি’ বলার পারমিশনই ওর হয়নি! আবার একসাথে থাকা! সে যা-ই হোক, মন এতো সমীকরণ বোঝে না। ফলাফল, গতকাল ওয়াহিদ জেগে ছিলো অনেক রাত অব্দি। যদি অপরাজিতা ফোন দেয়। অপেক্ষা করে করে একসময় ঘুমিয়েছে। তবুও ভোরেই ঘুম ভেঙেছে রোজকার নিয়মে। সকালে হাঁটতে যাওয়ার অভ্যেসটা ও রপ্ত করেছে ফিনল্যান্ড থাকতে। দেশে ফেরার তিনবছর হয়ে হলেও অভ্যেস ত্যাগ করেনি। আজও বেরোনোর জন্য তৈরি হচ্ছিলো। ওয়াশরুমে ছিলো যখন অপরাজিতা কল করেছে। বেরিয়ে এসে ‘টু মিসড কল’ দেখে মাথা খারাপ হয়ে গেছে। অপরাজিতা আগে কখনই ফোন দেয়নি। আজকে দিলো, পরপর দুবার! সেটাও এই ভোরে! রীতিমতো প্যানিকড হয়ে গেছিলো ওয়াহিদ। আর এতেই সত্যিটা বলে ফেলেছে।

আরেকবার কী ফোন দিবে? নাকি অপেক্ষা করবে? অপরাজিতার ফোনের অপেক্ষা?

ওয়াহিদের অপেক্ষা ফুরালো দশটার দিকে। ও তখন ইউনিভার্সিটিতে। ক্লাসে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মেসেজে প্রশ্ন ছুড়ে পাঠিয়েছে অপরাজিতা, “দেখা করতে পারবেন? দুপুরে? ২টায়? সেদিনের রেস্টুরেন্টে?” মেসেজের নোটিফিকেশন দেখে ওয়াহিদ যতটা খুশি হয়েছিলো, মেসেজ পড়ে ততটাই চিন্তায় পরে গেলো। ওর শেষ ক্লাসটা দুপুর সাড়ে বারোটা থেকে দুইটা পর্যন্ত। এরপর পুরোটাই অফিস টাইম। ছুটি চাইলে পাওয়া যাবে। খুব তাড়াহুরো করলেও আড়াইটায় যে ও পৌঁছাতে পারবে সেটার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তিনটা হচ্ছে ওর জন্য সেইফ টাইম। কিন্তু ততক্ষণ অপরাজিতা লাঞ্চ না করে বসে থাকবে, সেটা ওর ভাল্লাগছে না। কিছুক্ষণ ভেবে শেষে টেক্সট পাঠালো, “বিকেলে দেখা করি? চারটায়? তখন হলে আমি টাইমলি আসতে পারবো।” খানিকবাদে রিপ্লাই আসে অপরাজিতার, “ওকে। সমস্যা নেই। টেইক ইউর টাইম।”

***

অপরাজিতা সুন্দর করে রেডি হলো। লাল-সবুজের মিশেলে সুতির কামিজ পরলো। খোলা চুলে, পিচ রেড ম্যাট লিপস্টিকে ওকে চমৎকার দেখালো। ব্লাশঅন দেওয়া ছাড়াও ওর গাল লাল হয়ে রইল। ভোরবেলায় ওয়াহিদের করা সহজ স্বীকারোক্তিই ক্ষণে ক্ষণে রাঙিয়ে তুলছে ওকে। ও বোধহয় প্রেমে পরে যাচ্ছে। এই যে প্রেমে পরে যাচ্ছে এই নিয়ে ওর মনে সারাক্ষণ একের পর এক হিসেবে বয়ে চলছে। অথচ যাকে ঘিরে এতো হিসেব-নিকেশ সে কিচ্ছু জানতে পারছে না। তাই ওয়াহিদকে ডেকেছে অপরাজিতা। সে-ও জানুক অপরাজিতার অভিমানের গল্প! অপরাজিতার মন খারাপের সঙ্গী হবে কি না সেটাও ভাবুক!

ওয়াহিদ এলো চারটের একটু পরে। অপরাজিতা অপেক্ষা করছিলো রেস্টুরেন্টের বাইরে। আজকে রেস্টুরেন্টে ভীড় বেশি। কথা বলার জন্য ঠিক পারফেক্ট মনে হয়নি ওর। তাই বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো। ওয়াহিদ আসতেই জানালো সে কথা। চটজলদি দুজনে মিলে ঠিক করলো সাতমসজিদ রোডের একটা ক্যাফে তে বসবে। কীভাবে যাবে ভেবে ওয়াহিদ প্রশ্ন করলো সিএনজি ডাকবে কি না। অপরাজিতা হাসলো। তারপর নিজেই রিকশা ডেকে একপাশে উঠে বসলো। এমন গ্রীন সিগন্যাল পাবার পর ওয়াহিদ দেরি করলো না। পাছে ম্যাডাম মন বদলে ফেলে! রিকশায় পুরোটা সময় ওরা মৌন রইল। ওয়াহিদ বারকয়েক অপরাজিতার দিকে তাকালো সরাসরি। বিকেলের কমলা রঙের আলোয় অপরাজিতাকে দেখে ওর মুগ্ধতা সীমা ছাড়ালো। অপরাজিতা কী পিছিয়ে রইল? না। সে-ও তাকালো। আড়চোখে। ফেডেড পার্পল শার্টে ওয়াহিদকে কতোটা চমৎকার লাগছে তাই দেখলো মুগ্ধ হয়ে।

ক্যাফে তে এসে, ওরা বসলো জানালা লাগোয়া এক টেবিলে। চকলেট কোল্ড কফি অর্ডার দিলো দুজনেই। ওয়েটার চলে যেতেই ওয়াহিদ সোজাসাপ্টা বললো, “আপনাকে সুন্দর লাগছে, অপরাজিতা।” স্মিত হাসে অপরাজিতা। ওয়াহিদকে দেখতে ভীষণ ভালো লাগছে, এই কথাটা বলতে জড়তায় ঠোঁট চেপে ধরে। ওয়াহিদ হয়তো বুঝলো সেটা। মুচকি হেসে বলে, “কমপ্লিমেন্টস দেয়ার জন্য সারাজীবন পরেই আছে। লজ্জা পেতে হবে না।”

ওয়াহিদের এই এক কথায় যেনো অপরাজিতা বাস্তবে ফিরে আসে। সারাজীবন? ওদের কী সারাজীবন একসাথে থাকা হবে? অপরাজিতার লাইফটা এখন কতোটা এলোমেলো হয়ে আছে সেটা তো ওয়াহিদ জানে না। এই এলেমেলো লাইফে ওয়াহিদ কী জড়াতে চাইবে? যতই ওয়াহিদ ওর বাড়ি ছাড়ার সাথে রিলেটেড হোক। ওয়াহিদের ফ্যামিলি তারাও কী এটা ভালোভাবে নেবে? ওরাও তো নতুন বউকে ঘরে তোলার অপেক্ষায় আছে। সেই বউ বাড়ি ছেড়েছে অভিমান করে এটায় তাদের খুশি হবার তো কোনো কারণ নেই। কফির কাপ রেখে ওয়েটারের বলা ‘প্লিজ, এনজয়’ এই শব্দে ওর চিন্তারা ছুটে পালায়। জহুরি চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকা ওয়াহিদকে দেখে। এতো মায়া কেনো ওই মানুষটার সবকিছুতে? অস্ফুটস্বরে বলে উঠে, “ওয়াহিদ, আমি বাসা ছেড়ে চলে এসেছি। বিয়ে যেদিন হলো সেদিনই।” কয়েক মুহূর্ত শান্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকে ওয়াহিদ। অতঃপর ওর কপালে পরে থাকা চুলগুলো আলগোছে সরিয়ে দিয়ে বলে, “জানি, অপরা!”

চলবে।

বিয়েকথন পর্ব-০৪

0

#বিয়েকথন
শেখ জারা তাহমিদ

চতুর্থ পর্ব

অপরাজিতা এদিক-সেদিক তাকালো বারকয়েক। কাউকে যদি চেনা মনে হয়! একদিনেই আরেকবার লজ্জায় পরতে চায় না ও। তবে ভাগ্য সহায় হলো এবার। দশ মিনিটের মাথায় মেসেজ এলো ওয়াহিদের, “অপরাজেয় বাংলা’র সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আপনার ঠিক পেছনেই।”

টেক্সট দেখে অপরাজিতা উঠে পরলো। ঘুরে বটতলার এপাশটায় আসতেই, অপরাজেয় বাংলা’র সামনে দাঁড়ানো, কালো শার্ট পরিহিত একজনকে হাত নাড়তে দেখলো। ওয়াহিদ। ওয়াহিদকে দেখে অপরাজিতার প্রথমেই মনে হলো, লোকটার কী গরম লাগছে না? যেখানে গরমে ও ব্ল্যাক এভোয়েড করে, সেখানে ব্ল্যাক পরে লোকটা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে! মনের চিন্তাকে মনে রেখে ও ওয়াহিদের সামনে যেয়ে দাঁড়ালো। অস্বস্তি কাটিয়ে সালাম দিলো। মুচকি হেসে ওয়াহিদ সালামের উত্তর দিয়ে বললো, “আগে কোথাও বসি, অপরাজিতা? আপনাকে টায়ার্ড লাগছে।” অপরাজিতা সম্মতি জানাতেই ওয়াহিদ পুনরায় জানতে চাইলো, “কোথায় যাওয়া যায়? ধানমন্ডি?” ধানমন্ডি ইজ অ্যা গুড অপশন। কিন্তু দুজনকে এক রিকশায় উঠতে হবে ভেবে অপরাজিতা নিষেধ করে দিলো। ওয়াহিদ বোধহয় বুঝলো সেটা। হেসে জানালো, “আমার সাথে উবার আছে, অপরাজিতা। ধানমন্ডি চাইলেই যেতে পারেন।” অগত্যা অপরাজিতা রাজি হলো। লোকটা সবদিক ভেবেই এসেছে! ক্লেভার!

গাড়িতে ওরা দুজনেই চুপ রইলো। অপরাজিতা অস্বস্তিতে। ওয়াহিদ ওর অস্বস্তি কাটানোর চেষ্টাতে। মাঝে কেবল একবার কোন রেস্টুরেন্টে যেতে চায় জানতে চাইলে, অপরাজিতা কোনো একটা লাইভ মিউজিক ক্যাফেতে যেতে বললো।

***

ধানমন্ডি ল্যাবএইডের উল্টোপাশের একটা রেস্টুরেন্টে গেলো ওরা। অপরাজিতা এখানে আগে আসেনি। লাঞ্চ টাইম হলেও ভীড় কম। গাছপালার মাঝে রেস্টুরেন্টের ইন্টেরিয়র, সিটিং অ্যারেঞ্জমেন্ট ওর বেশ পছন্দ হলো। ঘুরে ঘুরে চারদিকটা দেখলো। একফাঁকে গিয়ে চোখেমুখে পানি দিয়ে এলো। রেস্টুরেন্টের প্লে-লিস্টে বাজতে থাকা অর্ণবের গান শুনে মনটা ভালো হয়ে গেলো। এতোক্ষণে যেটা করেনি, বলা ভালো করতে পারেনি সেটা করলো। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, একটু দূরে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলা ওয়াহিদকে দেখলো।

অপরাজিতার পাঁচ ফিট চার হাইটের বিপরীতে ওয়াহিদ কম করে হলেও পাঁচ ফিট আট হবে। একটু বেশিই লম্বা! তালগাছ! শ্যামবর্ণের বলিষ্ঠ গড়ন। রেগ্যুলার নিশ্চয়ই জীমে যায়! হাতে বাদামি বেল্টের ব্র্যান্ডেড ঘড়ি। ব্র্যান্ড খুব মেইনটেইন করে বোধহয়! ফ্যাশন সেন্সটা ভালো। স্টাইলিশও বটে! গাল জুড়ে ট্রীম করে রাখা খোচাখোচা দাঁড়িতে চমৎকার মানিয়েছে। তবে ওয়াহিদের বেস্ট ট্রেইট হলো ওর হাসি। ফোনে যখন শব্দ করে হাসলো, শুনতে ভালো লেগেছে। এখনও ফোনে কথা বলছে মুখে স্মিত হাসি ধরে রেখে। দেখতে ভালো লাগছে। কন্ঠস্বরে একটা ডীপ, রাফনেস আছে। এন্ড ইট’স অ্যাট্রাক্টিভ ইন অ্যা গুড ওয়ে। বয়সটা কেমন হতে পারে? আটাশ? তিরিশ? অবশ্য বত্রিশ হলেও ক্ষতি নেই। এইজ ইজ জাস্ট অ্যা নাম্বার আফটারঅল! কয়েকবার দেখার পর অপরাজিতা নিজেকে প্রশ্ন করলো, “তিনদিন আগে আচমকা বিয়ে হওয়া হাজব্যান্ডের উপর ছোট্ট একটা ক্রাশ কী খাওয়া যাবে?” নিজের মনে করা প্রশ্নে নিজেই হেসে ফেলে ও।

রেস্টুরেন্টের ওপেন এরিয়াতে, একটা টেবিলের চেয়ার টেনে বসে অপরাজিতা। ওয়াহিদের আসার অপেক্ষা করতে করতে মেন্যুকার্ড উল্টায়। কী একটা ভেবে মেন্যুটা রেখে দিয়ে চুপ করে বসে থাকে। ওয়াহিদ আসে ৪/৫ মিনিট পর। বসতে বসতে জানায়, একটু দেরি হয়ে গেলো। অপরাজিতা বুঝদারের মতো মাথা দোলায়। মুচকি হেসে ওয়াহিদ মেন্যুকার্ডটা ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, “প্লিজ, অর্ডার। আই’ল গো বাই ইওর চয়েজ।” অপরাজিতা মনে মনে আওড়ায়, “ওয়েল ম্যানারড। জেন্টেলম্যান? বলা যায়।” তারপর ভদ্রতার সহিত জানায়, “আমার চয়েজ আপনার ভালো নাই লাগতে পারে। তারচেয়ে দুজন মিলে ডিসাইড করি।” ওয়াহিদ সঙ্গে সঙ্গে বলে, “গোটা আপনাকেই পছন্দ, অপরাজিতা। সো, আপনার চয়েজ ভালো না লাগার চান্সই নেই।” অপরাজিতা বিষম খেলো। ফ্লার্টি! ভেরি ফ্লার্টি! নিজের এক্সপ্রেশন লুকাতে ওয়াহিদের কথা না শোনার ভান করে জলদি অর্ডার করলো।

খাবার আসা পর্যন্ত ওরা কথা বললো। বিয়ের আগের চেনা-জানাটা বলতে গেলে এই সময়টায় হলো। ওয়াহিদের বিশাল ফ্যামিলি। বাবা-মা, ওরা তিন ভাই-চার বোন। চার বোনের সবাই বিবাহিত। ঢাকাতেই থাকে বিভিন্ন জায়গায়। ওয়াহিদরা থাকে উত্তরা। কেমিস্ট্রিতে অনার্স, মাস্টার্স করা ওয়াহিদ একটা প্রাইভেট ভার্সিটির লেকচারার। সিজনাল মাছ ব্যবসায় ও মূলত মধ্যপ্রাচে মাছ রপ্তানি করে। ছোট্ট করে শুরু করা ব্যবসাটা এখন অনেকটাই গ্রো করেছে। মাছ ব্যবসায়ী ওয়াহিদ বললেও খুব একটা ভুল হবে না সেক্ষেত্রে!

অপরাজিতা শুনলো সবটাই। ওয়াহিদ ওর সম্পর্কে সবটাই হয়তো জানে। তবুও নিজের সম্পর্কে টুকটাক বেসিক বললো। খাবার এসে পরলো তখন। খেতে খেতে ওয়াহিদ আরও নানান কথা বললো। কীভাবে ব্যবসাটা শুরু করেছিলো। ফিনল্যান্ড থেকে মাস্টার্স করে কেনো দেশে ফিরে এলো। কখনই ভাবেনি ওর দ্বারা পড়ানো সম্ভব। তাও কী করে যে ফ্যাকাল্টি হয়ে গেলো সেই গল্পও করলো।

এতসব গল্পের মাঝে খুব সূক্ষ্মভাবে কেয়ারিং ওয়াহিদকে নোটিস করলো অপরাজিতা। ওর প্লেটে খাবার তুলে দিলো এমনভাবে যেনো একাজটা ও সবসময়ই করে আসছে। অপরাজিতা স্লো খাচ্ছে বুঝতে পেরে নিজেও সময় নিয়ে খেলো। সবচেয়ে যেটা ডিফারেন্ট লাগলো অপরাজিতার, এই পুরো সময়টায় ওয়াহিদ একবারও ফোন হাতে নেয়নি। সম্পূর্ণ অ্যাটেনশান অপরাজিতা কে দিয়েছে। অথচ ঘুরতে গিয়ে, ফ্যামিলির সাথে সময় কাটাতে গিয়ে আন-ন্যাসেসারিলি ফোনেই ব্যস্ত হয়ে পরাটা আমাদের এই জেনারেশনের কমন প্র্যাকটিস। অপরাজিতা নিজেও করে। ওর বন্ধুরাও করে। কিন্তু ওয়াহিদ করে নি। ও যে অপরাজিতাকে ইম্প্রেস করতে এমনটা করেনি তাও বোঝা যাচ্ছে। ইম্প্রেস করার হলে শুরুর ফোনটাও ধরতো না। বরং তখন সুন্দর করে বলেছে, “স্যরি, অপরাজিতা। বেশ আর্জেন্ট কল। রিসিভ করতে হচ্ছে। গিভ মি টেন মিনিটস, প্লিজ।” তখন অপরাজিতা ভেবেছে ফোন আসতেই পারে, রিসিভ করলে করবে! ওকে এত স্যরি-ট্যরি কেনো বলতে হবে! কিন্তু এখন ব্যাপারটা ক্লিয়ার। সামনে থাকা মানুষকে প্রায়োরিটি দিতে জানে ওয়াহিদ। সেটা যেই হোক। প্রথমদিনের দেখায় ওয়াহিদের এই সাবলীলতা ভালো লাগলো অপরাজিতার। বাবা কী ঠিক এই বিষয়গুলো দেখেই পছন্দ করেছিলো ওয়াহিদকে?

খাওয়া শেষে, বিল পে করার সময় অপরাজিতা বিল স্প্লিট করতে চাইলো। তৎক্ষনাৎ হাসি মিলিয়ে গেলো ওয়াহিদের। অপরাজিতার দিকে তাকিয়ে প্রগাঢ়স্বরে বললো, “আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে, অপরাজিতা। সেটা যেভাবেই হোক। ইউ আর মাই ওয়াইফ। এন্ড আমার ওয়াইফের দায়িত্বও আমার। বিল স্প্লিট করার কথা আসছে কেনো?” ওয়াহিদের কন্ঠে, কথায় এতোটা সিরিয়াসনেস ছিলো যে অপরাজিতা দ্বিতীয় কিছু বলতে পারলো না। বিমূঢ় হয়ে বসে রইল।

রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে ওয়াহিদ যখন বাসায় ড্রপ করতে চাইলো, অপরাজিতা জানালো নীলক্ষেতে কাজ আছে ওর। কাজ শেষে ক্যাম্পাসে ফিরবে। ওয়াহিদ কী বুঝলো কে জানে। মুচকি হেসে ওকে রিকশায় তুলে দিলো। এবং অতি অবশ্যই রিকশা ভাড়া দিতে ভুল করলো না। বিদায় বেলায় বললো, “আপনার তো মিড সামনে। আমি কী দিনে এক-দুবার ফোন দিতে পারবো? পারমিশন চাচ্ছি, ম্যাডাম।” ব্যাপারটা অপরাজিতার ভালো লাগলো। হেসে বললো, “পারমিশন দেয়া হলো।”

***

হলে ফিরে অপরাজিতা আগে ফ্রেশ হলো। তারপর ওয়াটার হিটারে পানি গরম করে, এককাপ কফি বানালো। ওয়াহিদের কথা না চাইতেও ভাবনায় এলো। বিল স্প্লিট করা নিয়ে যে অধিকারবোধ মানুষটা দেখালো, সেটা ওকে সারপ্রাইজড করেছে। বিয়েটা নিয়ে ওয়াহিদ কত সিরিয়াস সেটায় কোনো সন্দেহ রইল না আর। কিন্তু অপরাজিতা কী সিরিয়াসলি বিয়েটা নিয়ে একবারও ভেবেছে? না! ভাবেনি! আজকে ওয়াহিদের ফোন আসার আগে পর্যন্ত ভাবেনি। এখন কী ভাবা উচিত? অবশ্যই উচিত। কিন্তু কেনো যেনো ইচ্ছে করছে না। সব ভাবনাচিন্তা ওয়াহিদের উপর ছেড়ে দিলে কেমন হয়?

ওয়াহিদ ফোন দিলো রাতে। রুম থেকে বেরিয়ে অপরাজিতা ফোন ধরলো। অতি সাধারণ কিছু কথাবার্তার পর ওয়াহিদ জিজ্ঞেস করলো, “আমাকে কেমন দেখলেন, ম্যাডাম?” ওর গলায় দুষ্টুমির রেশ টের পেলো অপরাজিতা। গলার স্বর যথাসম্ভব গম্ভীর করে বলার চেষ্টা করলো, “দেখলাম। ঠিকঠাক। মানুষের মতোই।” ওয়াহিদ তরল গলায় প্রশ্ন ছুড়লো, “শুধু দেখলেন? আমার তো মনে হলো কেউ আমাকে চেক আউট করছে!” অপরাজিতা দ্রুত সামলে নিয়ে বললো, “সে তো আপনিও করেছেন, স্যার।” ওয়াহিদ হেসে ফেললো। হাসলো অপরাজিতাও। ঠিক তখন থেকে শুরু হলো ওদের গল্পটা।

***

অপরাজিতার দিনগুলো কাটছে লাইব্রেরিতে। হলে এতোজনের মধ্যে কোনোভাবেই পড়তে পারে না ও। হলের গেইট বন্ধের আগ পর্যন্ত লাইব্রেরিতে বসে থাকে। হরেক রকম চিন্তারা এসে জাপটে ধরে ওকে। বাবার প্রতি অভিমানটা এতই গভীর যে বাসায় ফেরার কথা ভাবতে পারে না। কিন্তু হলে এইভাবে আর কতদিন? কেউ কিছু না বলুক। অপরাজিতার নিজেরই খারাপ লাগে। ওরা আর কতদিন অ্যাডজাস্ট করবে ওর জন্য? সপ্তাহ পার হলো ওর এখানে থাকার। চারদিন বাদেই মিড শুরু। মিড শেষ হতে আরো লাগবে সপ্তাহখানেক। দশ/বারোদিন আছে হাতে। এরপর কোথায় যাবে ও? রিপা খোঁজ নিয়েছিলো কোন রুমে ফাঁকা আছে কিনা। নেই। তোরাপুও খোঁজ নিচ্ছে। অন্য হলেও দেখছে। পায়নি কিছু। তবে আশা ছাড়েনি। বলেছে, “মিড পর্যন্ত ওয়েট কর, অপরা। আমি একটা ব্যবস্থা করে দেবো।” সেই আশাতেই দিন পার হচ্ছে অপরাজিতার তা নয়। ও হোস্টেলে উঠার কথাও ভেবেছে। খোঁজ নিয়েছে। কিন্তু মাসের মাঝে কোথাও কিচ্ছু পাচ্ছে না। ক্লাসমেট যারা হোস্টেলে থাকছে তাদেরও সিট পেলে জানাতে বলেছে। টাকা নিয়ে ভাবনা নেই। টিউশন থেকে ও যা পায় সেটা মোর দ্যান এনাফ। তাও লাগলে অ্যাকাউন্টে টাকার অভাব নেই। জীবনে প্রথমবারের মতো অপরাজিতা একা একা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। মন্দ লাগছে না। কিন্তু অভাব বোধ করছে। মা-বাবার গাইডেন্সের অভাব।

আরও যেটা ফিল করছে সেটা হলো টেনশন। এক্সাম টেনশন। প্রত্যেক এক্সামের আগে ওর লাইফটা আম্মু কতটা ইজি করে দিতো সেটা টের পাচ্ছে এখন। টাইমলি খাওয়া-গোসল কিছুই হয় না এখন। টাইমলি ঘুমানো তো দূরের কথা। এক্সামের আগে প্রতিরাতে আম্মু চুলে তেল দিয়ে শক্ত করে বেণী করে দিতো। আম্মুর মতে এটায় ঘুম ভালো হয়। তখন হাসলেও এখন অপরাজিতা রিয়েলাইজ করে বেণী করায় ঘুম ভালো হোক না হোক, আম্মু যে সূক্ষ্ম পজেটিভনেস ওর মাঝে দিয়ে দেয় সেটায় খুব ভালো ঘুম হয়। আম্মু রোজ ফোন করে। অপরাজিতা রিসিভ করতে পারে না। অভিমানের দেয়াল ভাঙতে পারে না।

ফোন ওয়াহিদও দেয়। প্রতিদিন দুবার করে। তিন-চার মিনিটমতো কথা হয়। কখনোবা পাঁচমিনিট। না চাইতেও বাঁধা পরা সম্পর্কটা অপরাজিতাকে ভাবায়। ওয়াহিদ ওকে পছন্দ করে সেটায় কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ওয়াহিদ কী জানে অপরাজিতার জীবনের সকল জটিলতার কেন্দ্রবিন্দু ও? পুরোটা না ঠিক কিন্তু কিছুটা তো অবশ্যই। ওয়াহিদের ব্যক্তিত্ব মুগ্ধ হবার মতো। ওয়াহিদ দেখতেও মুগ্ধ হবার মতো। অপরাজিতা কী মুগ্ধ হয়েছে? হ্যাঁ। হয়েছে। অবলীলায় সেটা স্বীকার করে ও। কিন্তু এই মুগ্ধতাকে প্রশয় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। এখন ওর যে সিচুয়েশন সেখানে এই মুগ্ধতায় সায় দেয়া মানে নিজেকে বিট্রে করা। কিন্তু সায় না দেয়াও কী নিজেকে বিট্রে করা হবে না? অপরাজিতা কী জানে ওকে নিয়ে অধীর হবার মানুষটা ওয়াহিদ? যার সাথে দারুন মিষ্টি একটা গল্প হবে ওর!

চলবে।

বিয়েকথন পর্ব-০৩

0

#বিয়েকথন
শেখ জারা তাহমিদ

তৃতীয় পর্ব

“কী হয়েছে, অপরা? তোমার হাতে ব্যাগ কেনো?”, অবাক কন্ঠে করা তামিম ভাইয়ার প্রশ্ন শুনে অপরাজিতা মৃদু হাসলো। গলা চড়িয়ে আম্মুকে ডাকলো। তিনি কিচেনে ছিলেন। সকলের জন্য চায়ের নির্দেশ দিচ্ছিলেন। মেয়ের জোরগলায় ডাক শুনে ছুটে এলেন। অপরাজিতার হাতে ব্যাগ দেখে, তামিমের করা সেইম প্রশ্নটাই আবার করলেন। ড্রয়ইংরুমে ততক্ষণে সবাই হাজির হয়ে গেছে। সকলকে দেখে অপরাজিতার চোখমুখ শক্ত হয়ে গেলো।

কাঠ কাঠ গলায় বলে উঠলো, “আমি কী তোমাদের অবাধ্য মেয়ে, আম্মু? নাকি আমার অনেক বেশি চাহিদা? এই নাটকীয়তার পিছনে রিজন কী? সবাই মিলে কিচ্ছু না জানার অভিনয় কী দারুনভাবে করলে! আজকের গেস্ট আমাকে দেখতে আসছে, সেটা বললে আমি কী বাড়িঘর ছেড়ে চলে যেতাম? নাকি ওদের আসতে নিষেধ করতাম? তোমাদের থেকে আমি এটা এক্সপ্যাক্ট করি নাই।” মামী এগিয়ে এলেন। বোঝানোর চেষ্টা করে বললেন, “তুই ভুল ভাবছিস, অপরা। ব্যাপারটা অফিশিয়াল না বলে তোকে জানানো হয়নি। শুধু শুধু তোকে কেউ প্রেশার দিতে চাচ্ছিলো না।” অপরাজিতা মামীর দিকে প্রচন্ড বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকলো। এরা এখনো বলছে অফিশিয়াল ছিলো না! প্রেশার দিতে চায়নি! অথচ বুঝতেই পারছে না কতটুকু প্রেশার ওকে দিয়ে ফেলেছে! ওর কান্না পেয়ে গেলো। এরা ওর ফ্যামিলি? আসলেই?

কান্নাজড়ানো গলায় ও থেমে থেমে বললো, “বাবা, তুমি আমার হিরো। তুমি যেটা যখন বলো সেটা আমার জন্য মাস্ট করতে হবে টাইপ। তুমি যদি বলতে ওরা আসবে, আমাকে পটের বিবি হয়ে ওদের সামনে গিয়ে বসতে হবে, আমি তাও করতাম। কিন্তু তুমি সবকিছু লুকিয়ে করেছো। আমি রাজি কি না, জিজ্ঞেস করেছো। কিন্তু সবকিছু রেডি করে আমাকে জিজ্ঞেস করার মানেটা কী? ছেলেটার সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছো। তোমার ঠিক মনে হয়েছে, তারমানে ঠিকই হবে। কিন্তু আমি কী তার সাথে একবার কথা বলতে পারতাম না? এতোবড় একটা ডিসিশন নেয়ার জন্য পাঁচ-দশ মিনিট কী এনাফ, বাবা?” এ পর্যায়ে অপরাজিতা হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো। “আমি বিয়েতে হ্যাঁ বললাম। তুমি জানতে চাইলে রাগ করে বলছি কি না। রাগ কবে করেছি আমি তোমার সাথে? আমার মত জানতে চেয়ে তুমি ভয়ে ভয়ে অপেক্ষা করলে। যদি আমি না করে বসি! তুমি আসলে আমাকে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করো না, বাবা।” অপরাজিতার বাবা কিছু বলতে চাইলেন। কিন্তু মেয়ের অভিযোগের পিঠে পেরে উঠলেন না। দাঁড়িয়ে থেকে কেবল দেখে গেলেন। বড়ফুপি ওকে শান্ত করতে চাইলেন। হলো হিতে বিপরীত। অপরাজিতা আরো ক্ষেপে গেলো। ফোপাঁতে ফোঁপাতে বলে উঠলো, “ধরবে না ফুপি। তোমাদের সবার মনে এক, মুখে আরেক। পুরোটা সময় আমি ভেবেছি, সুযোগ থাকলে তোমরা বোধহয় আমাকে ওদের সঙ্গে পাঠিয়েই ছাড়তে! তোমাদের সাথে আমি থাকবো না! এত কাহিনী করেও, তোমরা একটুও স্যরি না। উল্টো নিজেদের পয়েন্ট অ্যাট এনি কস্ট জাস্টিফাই করতে উঠেপরে লেগেছো।”

এরপর আম্মুর কান্নাকাটি উপেক্ষা করেই ও একপ্রকার বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো৷ আশ্চর্যের বিষয় হলো বাবা একবারও ওকে আটকায়নি। এতেই ওর অভিমান আরো গভীর হয়েছে। অভিমান না হলে আর কী? রাগ? নেভার। বাবার সাথে কখনই ও রাগ করতে পারে না।

আদরে-আহ্লাদে বড় হওয়া অপরাজিতার এই ছিলো বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসার গল্প। ডিড শী মেইক অ্যা মিসটেক? ওয়াজ শী অ্যান ইমোশনাল ফুল? মেইবি। কিন্তু কাছের মানুষগুলোর ভালোবাসার ছলে করা ভুলগুলো ভুলই। এক্সকিউজ দিয়ে জাস্টিফাই করতে চাইলেই হবে না।

***

আম্মু অনেকবার ফোন দিলেও, অপরাজিতা রিসিভ করে নি। ভালো আছে বলে টেক্সট পাঠিয়েছে। অবশ্য ও না জানালেও বাবা-আম্মু ঠিকই ওর খবর জানে৷ বাসা ছেড়ে বেরোনোর পর থেকেই যে ওর আপডেট বাবার কাছে কোনো না কোনোভাবে ঠিক পৌঁছে যাচ্ছে, সেটায় কোনো সন্দেহ নেই।

হলে আসার তিনদিন পার হয়েছে। সহজেই মানিয়ে নিয়েছে ও। এতোজন একসাথে থাকা ব্যাপারটা ওর জন্য নতুন হলেও এনজয় করছে। রাতজেগে ওদের সঙ্গে মুভিও দেখেছে গতকাল। নয়জন মিলে এক ল্যাপটপে মুভি দেখাটাও ওর কাছে চমকপ্রদ এক্সপেরিয়েন্স। হলের খাবারে মন ভরেনি। হাকিম চত্বরের খিচুড়ি-চিকেন চাপ, কলাভবন ক্যাফেটেরিয়ায় ভাত-আলুভর্তা-মুরগী! এই দিয়ে চলছে। ক্লাসেও গিয়েছে সেদিনের পর। টিউশনও বাদ দেয়নি।

আজকেও ক্লাস শেষে, বারোটা নাগাদ লাইব্রেরিতে চলে গেলো অপরাজিতা। মিডটার্মের পড়া সব বাকী কি না। ম্যাথিউ আর্নল্ডের “দ্যা স্কলার জিপসি” পড়ে, কেনো একজন স্কলার একাডেমিক লাইফ ছেড়ে জিপসিদের জয়েন করলো, সেটারই সামারাইজেশন করছিলো ও। সোশ্যাল চেইঞ্জ, ক্লাস কনফ্লিক্ট নিয়ে ভেবে ভেবে যখন ওর মাথা খারাপ দশা, আননোন নাম্বার থেকে কলটা এলো তখনই। কল ধরার জন্য সিট ছেড়ে উঠতে হবে। ফিরে এসে এই সিট কোনোভাবেই আর পাওয়া যাবে না। মিডটার্ম বলেই এতো ভীড়। নাহ। থাক। পরে কলব্যাক করা যাবে। পড়ায় মন দেয়া যাক এখন।

কিন্তু কলদাতা সেটা বুঝলে তো। মিনিট পনেরো পরে আবার ওর কল বেজে উঠলো। মেজাজ খারাপ করে সব গুছিয়ে অপরাজিতা দ্রুত বেরিয়ে এলো৷ বটতলার দিকে যেতে যেতে কল রিসিভ করলো। ওর মৃদুস্বরে বলা হ্যালোর বিপরীতে বলিষ্ঠ গলার হ্যালো শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পরলো। জানতে চাইলো, “কে বলছেন? স্যরি, চিনতে পারছি না।” পুরুষ কন্ঠের আওয়াজ ভেসে এলো, “অপরাজিতা! ওয়াহিদ বলছি। কেমন আছেন?”

অপরাজিতা ভ্রূ কুঁচকায়। গলার স্বর তীক্ষ্ণ হয়, “ওয়াহিদ? কোন ওয়াহিদ? এই নামে কাউকে চিনি বলে মনে পরছে না।” ওপাশ থেকে বিস্মিত গলা শোনা গেলো ওয়াহিদের, “কোন ওয়াহিদ! ওয়াহিদ জামান। আট তারিখে বিয়ে করলেন যাকে, সেই ওয়াহিদ।”

অপরাজিতা রীতিমতো জমে গেলো এবার। লোকটা, মানে ছেলেটা তার হাসব্যান্ড। আমতা আমতা করে বললো, “স্যরি। নাম্বার সেইভ ছিলো না। বুঝতে পারিনি।” ওয়াহিদ কৌতুকপূর্ণ কন্ঠে বললো, “না, না। ইট’স ওকে। নাম্বার সেইভ থাক না থাক, হাসব্যান্ডের নাম ভুলে যেতেই পারেন! এটা আপনার বউগত অধিকার, ম্যাডাম!” শেষ কথায় অপরাজিতার হাসি পেয়ে গেলো। ঠোঁট কামড়ে ও হাসি আটকালো। সেটা বুঝতে পেরে ওয়াহিদ বললো, “শব্দ করে হাসতে কিন্তু মানা নেই, অপরাজিতা। বরং এতে আপনাকে আরো চমৎকার দেখায়।”

চমৎকার দেখায়! কী অবলীলায় বলে দিলো! লোকটা এতকিছু কখন নোটিস করলো! কথা ঘোরাতে অপরাজিতা জিজ্ঞেস করলো, “আপনি ভালো আছেন? বাসার সবাই?” হেসে জবাব দিলো ওয়াহিদ, “ভালো আছি অপরাজিতা। বাসার সবাইও ভালো আছে। আমরা অধীর আগ্রহে আপনার অপেক্ষা করছি।”

অপরাজিতার একটু সময় লাগলো কথার পিঠে ডাবল মিনিং বুঝতে। যখন বুঝলো, না চাইতেও লজ্জা পেয়ে গেলো। লোকটা ভীষণ ঠোঁটকাটা। নিজের কথা বাসার নামে চালিয়ে দিচ্ছে! ও ধরা না দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আপনার মাছ ব্যবসা কেমন চলছে?” ওয়াহিদ আবারও অবাক হওয়া কন্ঠে বললো, “আমার সিজনাল ব্যবসার কথা আপনি জানেন!?” অপরাজিতা দ্বিধান্বিত হলো, “সিজনাল ব্যবসা! আমি যে শুনলাম আপনি মাছ ব্যবসায়ী।” ওয়াহিদ এবার শব্দ করে হাসতে থাকলো। মন খুলে হাসি যাকে বলে। খানিক পরে হাসতে হাসতেই বললো, “মাছের ব্যবসা করি বলেই কী নামটা ভুলে গিয়েছিলেন? আমি তো তাও বেঁচে গেলাম, ম্যাডাম। জগতে এতো মাছ ব্যবসায়ীদের কী হবে? তারা কী বউ পাবে না?” লোকটা মাছ ব্যবসায়ী না! তবে ও যে মাছ মাছ স্মেল পেলো! সেটা কী ছিলো? ওর অবচেতন মনের ভ্রম? অপরাজিতার লজ্জায় হাসফাস অবস্থা হলো। “বাই” বলে কোনোরকমে ফোন রেখে দিলো। এই ঠোঁটকাটা লোকের মুখে কোনো ফিল্টার নেই! কিচ্ছু আটকায়না!

বটতলায় গিয়ে বসতেই অপরাজিতার ফোন আবার ভাইব্রেট করলো। ওয়াহিদের টেক্সট। দু’লাইনের ছোট্ট মেসেজ। “আপনার ক্যাম্পাসের কাছেই আছি। ইফ ইউ ওয়ান্ট, মেইবি উই ক্যান মিট ফর লাঞ্চ।” অপরাজিতা দোনোমোনো করে রাজি হয়ে গেলো। ফিরতি টেক্সট পাঠালো, “বটতলায় আছি আমি। কোথায় আসবো?” কয়েক সেকেন্ডের মাঝে রিপ্লাই এলো ওয়াহিদের, “বাংলা একাডেমি থেকে বটতলায় আসতে ৭/৮ মিনিট লাগবে। ততক্ষণ একটু অপেক্ষা করুন। আমি আসছি।”

সশব্দে চেপে রেখা শ্বাস ছাড়ে অপরাজিতা। দেখা করতে রাজি হওয়াটা ঠিক হলো কি না বুঝতে পারলো না। হঠাৎ খেয়াল হয় ওয়াহিদ দেখতে কেমন ও জানে না! সেদিন দেখেছিলো ঠিক। কিন্তু এতোজনের মাঝে প্রোপারলি খেয়াল করেনি! শিট! ফ্লেয়ারড জিনস, গলায় পেচানো নীল স্কার্ফ, সাদা নী লেংথ কুর্তিতে নিজেকে ভীষন আন্ডারড্রেসড মনে হলো। হুট করে বিয়ে করা বরের সাথে প্রথম দেখায় এই ড্রেস-আপ অবশ্যই ঠিক নেই। ডাবল শিট!

চলবে।

বিয়েকথন পর্ব-০২

0

#বিয়েকথন
শেখ জারা তাহমিদ

২য় পর্ব

গেস্টরা খেয়ে উঠার পর অপরাজিতারা খেতে বসেছিলো। কিন্তু ততক্ষণে চনমনে খিদেটা মিলিয়ে গেছিলো ওর। দু’পিস কাবাব খেলো কোনোরকমে। আম্মু কত সাধলো, তবুও ইচ্ছে করেনি। শর্মীপুর মেয়েকে নিয়ে চলে গেছিলো উপরে, ওর রুমে৷ খাওয়া শেষে আয়নাভাবী, শীলাপু-শর্মীপু জয়েন করেছিলো ওকে। নিজেদের মাঝে এটা-সেটার গল্প করলো। ছবি তুললো। তারপর এলো সেইক্ষণ।

আসরের আজান পরে যাওয়ার কিছুখনের মধ্যে বাবা-আম্মু ওর ঘরে এলো। পেছনে মামা। ওদের দেখে ভাবী-আপুরা ব্যালকনিতে চলে গিয়ে স্লাইডিং ডোর টেনে দিলো। ঘড়িতে তখন বোধহয় সাড়ে চারটে।

অপরাজিতা অবাক হয়েছিলো ওদের দেখে। ওকে খাটে, নিজের পাশে বসিয়ে যখন বাবা কথা শুরু করলো তখন অবাকের চূড়ান্ত হলো। আজকের গেস্ট মাজহার আংকেল ওর বাবার বন্ধু, ঠিক। কিন্তু ব্যবসার বন্ধু না। অনেক বছর আগে তারা একসঙ্গে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েছেন। মাজহার উদ্দিনের বাবা সরকারি চাকুরির সুবাদে বদলি হয়ে গেলে, যোগাযোগটা আর হয়ে উঠে নি। অনেকসময় পর গতবছর দেখা হয়েছে, বলা যায় ব্যবসার খাতিরেই। তারপর থেকেই যোগাযোগ হয়েছে প্রতিনিয়ত। মাসখানেক ধরেই মাজহার সাহেব, তার মেঝ ছেলের জন্য বউ খুঁজছেন। অপরাজিতার জন্মদিনে ওকে নিয়ে ফেইসবুক একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন ওর বাবা আনাম হাসনাত৷ সেখানেই অপরাজিতার ছবি দেখেন মাজহার সাহেব। মিষ্টিমুখের মেয়েটাকে পছন্দ হতেই, ছেলের জন্য চেয়ে বসলেন। শুরুতে রাজি ছিলেন না অপরাজিতার বাবা। মেয়েকে এখনই বিয়ে দিতে চাইছিলেন না। কিন্তু মাজহার সাহেবের বারবার আকুতি তাকে দ্বিতীয়বার ভাবতে বাধ্য করেছে। অপরাজিতার মাকে বলার পর, তিনি একবার দেখতে আসার ক্ষেত্রে সায় দিয়েছেন৷ তখনই অপরাজিতার খালা, মামা, ফুপু, চাচাদের জানিয়েছেন। ছেলের বাবা সম্পর্কে শুনেই সকলে পজিটিভ ফিডব্যাক দিয়েছেন৷ ছেলের সম্পর্কেও খোঁজ নিয়েছেন। সবদিক বিবেচনা করেই আনাম সাহেব আজকে ওদের আসতে দাওয়াত করেছেন। কিন্তু সেটা আন-অফিশিয়ালি। ওনারা এসে অপরাজিতাকে দেখে যাক। ছেলেও জানুক বাবার পছন্দ করা মেয়েটা কেমন। অপরাজিতাও সবাইকে কম্ফোর্টেবলি দেখুক। ওনারা চলে যাবার পরই ওকে জানানো হবে এই আন-অফিশিয়ালি দেখার কথা। তারপর সিদ্ধান্ত ওর। ভেবেচিন্তে জানাবে। ছেলের ক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু! একটু বদল এসেছে প্ল্যানিয়ে। মাজহার সাহেবের পরিবারের সবার অপরাজিতাকে খুব পছন্দ হয়েছে। আনঅফিশিয়াল দেখা-সাক্ষাৎকে ওনারা অফিশিয়াল করতে চাইছেন! সোজা বাংলায় বিয়ে পড়িয়ে ফেলতে চাইছেন! আজকেই! এখনই!

বাবার কথা শেষেই অপরাজিতার মামা বললেন, “অপরা, ওনারা এতো রিকুয়েষ্ট করলো তাই অনেক ভেবেচিন্তে আমরা তোকে জানালাম। তারমানে কিন্তু এটা না যে তোকে বিয়ে করতেই হবে। এখনই করতে হবে সেটা তো আরো না৷ তোর বাবার এতে খুব একটা সায়ও নেই। ওদেরটা ওরা বলেছে। আমরা করবো সেটাই যেটা তুই চাইবি। তোর ওপর কোনো জোর নেই, মা।” মামার কথা শুনেই অপরাজিতা ফিক করে হেসে ফেললো। তারপরই গম্ভীর হয়ে গেলো। কয়েকমিনিট পর সরাসরি বাবার দিকে তাকিয়ে নরমস্বরে বললো, “তোমার কথায় এটা বেশ বোঝা যাচ্ছে বাবা, আমি ছাড়া আজকে উপস্থিত সকলেই সবটা জানতো। অথচ, বিয়ের কথা, আন-অফিশিয়ালি দেখতে আসা, পুরোটাই আমিকেন্দ্রিক। আমাকে কেনো বললে না বাবা? এমন তো নয় আমার কোনো পছন্দ আছে। তাহলে আমার কাছে লুকাতে কেনো হলো?”

ওর কথায় কেউ কোনো জবাব দিতে পারলো না। জবাব না পেয়ে, ও আবার বললো, “বাবা, তুমি বললে তুমি রাজি ছিলে না। সবাই পজিটিভ ফিডব্যাক দেওয়াতে তুমি এগিয়েছো। ওদের আসতে বলেছো। কিন্তু বাবা, তুৃমি একজন বিজনেসম্যন। দ্যাট মিনস ভেরি ক্যালকুলেটিভ। তুমি ছেলের সম্পর্কে সব খোঁজ নিয়েছো। তোমার পছন্দ হয়েছে। না হয় তোমার বন্ধু যত যা বলুক তুমি আম্মুকে জানাতে না, বাকী ফ্যামিলিকে জানাতে না। সবাই যতই বলুক তুমি যদি না চাইতে ওরা আজকে কোনোভাবেই এখানে আসতে পারতো না। তারমানে তুমি চেয়েছো, বাবা। ইনফ্যাক্ট, এইযে ওনারা আজকে বিয়ে করাতে চাইছে, এটায় তোমার সম্মতি আছে। মামা যে বললো তোমার সায় নেই, সেটা খুবই ভুল। তোমার সম্মতি আছে বলেই, উই আর হ্যাভিং দিজ কনর্ভাসেশন রাইট নাও! তুমি না চাইলে, ওনারা কি চাইলো সেটা আমি পর্যন্ত এখন কোনোভাবেই আসতো না বাবা।” বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে ফের বললো ও, “বাবা। বিব্রত হয়ো না প্লিজ। তুমি যেহেতু চাইছো এই বিয়েটা আমি করি, তারমানে এটাই আমার জন্য বেস্ট। আমার কোনো আপত্তি নেই বাবা। বিয়েটা আমি করবো।”

অপরাজিতার কথায় রুমজুড়ে যে পিনপতন নীরবতা এসেছিলো সেটা ভাঙলো বড়ফুপির আগমনে। অপরাজিতা মত দিলো কি না সেটা দেখতেই তিনি এসেছিলেন। সবার থমকানো চেহারা দেখে ধরে নিলেন অপরাজিতা না করে দিয়েছে। তবুও তাড়া দিলেন। গেস্টরা অপেক্ষা করছে। তাদের কিছু একটা তো বলতে হবে। মৌনতা ভেঙে অপরাজিতার আম্মু বললেন, “তুই শিওর, অপরা? সবকিছু খুব ফার্স্ট হচ্ছে। আমার ভালো লাগছে না। তুই আরো সময় নে। বিয়ে-ফিয়ে করা লাগবে না।” অপরাজিতা মায়ের কথায় গা করলো না। আগের মতোই বসে রইল। বাবার কথার অপেক্ষা করলো।

অবশেষে আনাম হাসনাত মেয়েকে বললেন, “বিয়ে একটা কমিটমেন্ট, অপরা। আমার মনে হয়েছে এখানে বিয়ের পর তুই আজীবনের একটা সাপোর্ট সিস্টেম পাবি। খুব ভালো থাকবি। রাগ থেকে নয়, ভেবে বল তুই রাজি কি না। যেটাই বলবি আমি মেনে নেব।” বাবার কথার পর অপরাজিতা সময় নিলো না। সঙ্গে সঙ্গে বললো, “আমি রাজি, বাবা। ভেবেই বলছি।”

ওর মত পেয়েই মামা, বড়ফুপি স্বমস্বরে উচ্চারণ করলেন, “আলহামদুলিল্লাহ।” বাবার চোখেমুখে দেখা গেলো তৃপ্তির হাসি। আম্মুর চোখে শংকা। অপরাজিতা সব দেখেও যেনো কিচ্ছু দেখলো না। কেমন ভোঁতা এক অনুভূতি নিয়ে ঠায় বসে রইল।

নতুন আয়োজন করতে হবে। একে একে সবাই বেরিয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে ব্যালকনি থেকে হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকলো আড়ি পেতে সমস্তটা শুনতে থাকা তিন রমণী! শীলাপু জড়িয়ে ধরলো ওকে। অপরাজিতার বিয়েতে সে কত্ত খুশি সেটাই বারবার করে বললো। শর্মীপু বললো, “মাছ ব্যবসায়ীর বউ তবে হয়েই গেলি, অপরা।” কথাটা খট করে বিধলো অপরাজিতার কানে। মাছ ব্যবসায়ী! শুনেই কেমন জানি গা গুলিয়ে আসতে চাইলো ওর! অথচ বাকীদের কোনো হেলদোল নেই। আয়না ভাবী মিটমিটিয়ে হাসছে কেবল।

***

ছোট ফুপি এলো বিয়ে পরানোর মিনিট দশ আগে। অপরাজিতা তাকে দেখেই হেসে বললো, “আর একটু হলেই আমার বিয়েটা মিস করে ফেলতে!” সকলেই যেনো কিছুটা চমকালো। বিয়েতে রাজি হবার আগে না হোক, পরে অন্তত ছেলের সাথে ও কথা বলতে চাইবে সেটাই সবাই ভেবেছিলো। কিন্তু অপরাজিতা বড়ই নির্লিপ্ত। ওর মায়ের মনে হচ্ছে কিছু একটা ঠিক নেই। তবে তিনি সেটা ধরতে পারছেন না। তার হাজব্যান্ডকে যেমন বুঝতে পারছেন না, তেমনি মেয়ের মনও পড়তে পারছেন না।

সকলের জল্পনা-কল্পনা, আশংকাকে একপাশে রেখে, পড়ন্ত বিকেলে মাগরিবের আগে আগে অপরাজিতার আকদ হয়ে গেলো। বারো লক্ষ টাকা কাবিনে। কাজীসাহেব যখন কবুল বলতে বললো, একটা ঘোরের মধ্যে থেকেই ও তিনবার কবুল বলে ফেললো। ছেলের নামটা কী যেনো শুনলো। শাহেদ? খালেদ? একহাত দূরত্বে বসে থাকা ছেলেটার চেহারাও ঠিকমতো খেয়াল করতে পারলো না। সারাটাক্ষণ একটা মাছ মাছ আঁশটে গন্ধে ও কাবু হয়ে রইল!

বিয়ের পর ওদের একসাথে বসিয়ে চটজলদি কিছু ফটোসেশন করা হলো। একফাঁকে শ্বশুরবাড়ির কেউ একজন খেজুর সামনে ধরলো। এত তাড়াতাড়ি খেজুরও ম্যানেজ করে ফেলেছে। নিশ্চয়ই বাবার কাজ। চমৎকার! কেউ কেউ ওর হাতে সালামি গুঁজে দিলো। ওদের একসাথে কী দারুন লাগছে সেটাও বললো। এতসবের ভীড়ে স্ট্যাচুর মতো ও কেবল বসে থাকলো।

মাগরিব আজান পরতেই অপরাজিতাকে অবশেষে রুমে পাঠিয়ে দেয়া হলো। নামাজের পরই গেস্টরা বেরিয়ে পরবেন। এর মাঝে এক কান্ড হলো। ছেলের বড় ভাবী মেহের সুযোগ বুঝে ছোট ফুপিকে বললেন, “ছেলে-মেয়ে দুজন তো বিয়ের আগে কথা বলার সুযোগ পেলো না। চট করেই বিয়েটা হয়ে গেলো। ওদের তো জানাশোনা দরকার। আজকে আমার দেবর নাহয় থাকুক।” ছোটফুপি প্রায় রাজিই হয়ে যাচ্ছিলেন। ভাগ্যিস সেখানে আয়না ভাবী ছিলো। সে দ্রুত অপরাজিতার মাকে ডেকে আনলো। অপরাজিতার মা আব্দার শুনে কঠিন হলেন। এত তাড়াহুড়ো তার পছন্দ হচ্ছে না। বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে সবকিছু। রাজি না হয়ে বললেন, “বিয়ে যেহেতু হয়েছে ওরা একসাথেই থাকবে। তবে আজকেই সেটার প্রয়োজন নেই। খুব জলদিই হয়তো বিয়ের প্রোগামের দিন-তারিখ ফিক্সড করা হবে। ততদিন ওরা দূর থেকেই চিনুক-জানুক। কিছু মনে কোরো না। তোমার কথা রাখতে পারছি না।” মেহের লজ্জা পেয়ে ফেরত গেলো। হুট করেই বিয়েটা হয়েছে। মেয়েটার নিশ্চয়ই সময় লাগবে। তার দেবর সেটা বুঝলে তো!

গেস্টরা চলে যাবার খবর পেতেই অপরাজিতা যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। পরিধান করা শাড়িটা জগদ্দল পাথর ঠেকলো। ভাবতেই আশ্চর্য লাগলো এটা ওর বিয়ের শাড়ি। এভাবেও বিয়ে হতে পারে? নিজের সাথে না ঘটলে ও বুঝতোই না। দেখতে এসে হুট করে বিয়ে হয়ে যাওয়াটাই অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ?

কী ভেবে ও উঠে পরলো। শাড়ি পালটে একটা সুতির সালোয়ার কামিজ পরলো। প্রয়োজনীয় দু-তিনটে জিনিস, কদিন চলার মতো জামা-প্যান্ট, কামিজ একটা ট্র্যাভেল ব্যাগে নিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে পরলো। বাবাকে খুঁজতে খুঁজতে ড্রয়ইংরুমে গিয়ে হাজির হলো। ভাই, বোনেদের মাঝে বসে নিচুস্বরে আলোচনায় ব্যস্ত ছিলেন আনাম সাহেব। অপরাজিতাকে দেখে মাথা উঁচিয়ে তাকালেন। মেয়ের হাতে ব্যাগ দেখেই তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিলো, কিচ্ছু ঠিক নেই।

চলবে।

বিয়েকথন পর্ব-০১

0

#বিয়েকথন
শেখ জারা তাহমিদ

১ম পর্ব

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কবি সুফিয়া কামাল হল। ২০৬ নাম্বার রুমের কোণার বেডটায় গতদিন উঠেছে অপরাজিতা। ইংরেজিতে অনার্স করা অপরাজিতার হলে থাকার আদতে কোনো প্রয়োজন নেই। মিরপুরে ওর বাবার বিশাল বাড়িটি দেখে যে কেউ নির্দ্বিধায় সেকথা বলবে। তবুও অপরাজিতা যখন সন্ধ্যেনাগাদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে রিপা কে ফোন করেছিলো, রিপা তখন কী ভেবে ওকে হলে ওর রুমে উঠতে বলেছে।

হলে এসে অপরাজিতার আরো মন খারাপ হয়েছে। রুমে আটজনের সিট। আটজনই তাদের বই-খাতা নিয়ে রীতিমতো সংসার পেতেছে বলা যায়। সেখানে ও অনাহূত অতিথির মতো। যদিও ওরা ওকে সাদরেই গ্রহণ করেছে, তারপরও অপরাজিতার অস্বস্তি কাটেনি। সিনিয়র তোরাপু বললো, “হুটহাট কতো মেয়ে এমন এসে উঠে। শুধু হল লাইফটা কেমন দেখতেও বন্ধুরা আসে। আবার চলেও যায়৷ তুই কিচ্ছু ভাবিস না অপরা। যতদিন ইচ্ছে থাক। আমরা কত আনন্দ করি, স্ট্রাগল করি- দেখে যা।” তোরাপু বাংলা সাহিত্যে পড়ে বলেই বুঝি সুন্দর করে কথা বলতে জানে। কী চমৎকার করে ওর অস্বস্তিটা কাটিয়ে দিলো। অপরাজিতার আরও একটা ব্যাপার ভালো লাগছে। কেউ জানতে চায়নি ও কেনো হলে এসে উঠেছে। রিপাও জানতে চায়নি। নিজের মতো বানিয়ে বলেছে, “অপরাজিতা ক’টা দিন থাকবে। সামনেই আমাদের মিডটার্ম এক্সাম। একসাথে পড়ালেখা করবো।”

গতরাতে অপরাজিতাকে বেড ছেড়ে দিয়ে রিপা ফ্লোরে শুয়েছে। বলেছে, “আজকে বেড তোর। পরদিন আমার। শাফল করে থাকি, ওকে?” অপরাজিতা কিচ্ছু বলতে পারেনি। শুধু শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে রিপাকে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাজিতা চেনা মুখ। ডিবেট করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা মেয়েটাকে সিনিয়র-জুনিয়র সকলের পছন্দ। সুন্দরি, মিষ্টভাষী অপরাজিতার বন্ধু সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। এতো এতো বন্ধু থাকতেও কে আসল শুভাকাঙ্ক্ষী সেটা বেশ বোঝে ও। তাই অমন ঝামেলার মাঝে সবার আগে মফস্বল থেকে আসা রিপাকেই ফোন দিয়েছে ও। সবটা দিয়ে আগলে রাখতে জানার বিশেষ গুন আছে এই মেয়েটার। একবার ফোন করতেই কিচ্ছু না ভেবে বললো চলে আয়। এমন করে আর কেউ কী বলতো!

***

অনেকক্ষণ ধরে এটা-সেটা ভাবনায় নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চাইলেও আর পারছে না অপরাজিতা। রুমে এই মুহুর্তে কেউ নেই। সকলেই ক্লাসে নয়তো লাইব্রেরিতে গিয়েছে। ওর ইচ্ছে করছে না বলে, রিপা কিছু বলেনি। একাই চলে গেছে ক্লাসে। তারপরেই দরজা আটকে রিপার বেডে এসে শোয় অপরাজিতা। খোলা জানলায় দূরের আকাশ দেখে। আনমনে ভেসে উঠে একটা চেহারা। যার সাথে গতদিন বিকেলে বিয়ে হয়েছে অপরাজিতার!

বাবা-আম্মুর একমাত্র মেয়ে অপরাজিতা। আদরে- আহ্লাদে বড় হয়েছে ও। যখন যা চেয়েছে তখনই সেটা পেয়েছে। তবে ওর চাওয়া-পাওয়া সবসময়ই ছিলো সীমিত। আম্মুর থেকে শিখেছে প্রয়োজনের কোনো কিছুই ভালো নয়। তাই বাবার টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির বড় ব্যবসা থাকা সত্ত্বেও, অপরাজিতা জীবন কাটিয়েছে সাধারণ মেয়ের মতোই। সরকারি স্কুল-কলেজে পড়েছে। নিজের মেধায় চান্স পেয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। টিউশন করিয়েছে। বাবা শুরুতে একটু গাঁইগুই করলেও পরে খুশি হয়েছে। তবে প্রতিমাসে ওর অ্যাকাউন্টে ঠিকই টাকা দিয়েছে। বলেছে, “তুই টিউশন করা, মা। আমি তো বাঁধা দিচ্ছি না। তেমনি তোর হাতখরচ দেওয়াটা আমার দায়িত্ব। আমাকেও বাঁধা দিস না।” হাসিমুখেই মেনে নিয়েছে অপরাজিতা। টিউশনের টাকায় বাবা কে তার প্রিয় ব্র্যান্ডের শার্ট কিনে দিয়েছে কখনো। কখনোবা আম্মুকে কিনে দিয়েছে তার প্রিয় জামদানি। বন্ধুদের সাথে ট্যুরেও গিয়েছে কখনোসখনো। সবে মিলে ওর জীবনটা সুন্দর কাটছিলো। দীর্ঘশ্বাসের কোনো গল্প ওর নেই।

আসলেই কী নেই? মাঝেমধ্যেই অপরাজিতার মনে হয়েছে, আমার কেনো একটা ভালোবাসার গল্প নেই? কেনো পায়ে পায়ে এগিয়ে যাওয়ার কেউ নেই? কেনো রাতজাগার একটা সঙ্গী নেই? কেনো একটুখানি মায়ায় জড়ানোর কেউ নেই? ওর জীবনে ভালোবাসা আসেনি। মুগ্ধচোখে তাকিয়েছে অনেকে কিন্তু হাত বাড়িয়ে দেয়নি। যারা দিয়েছে তাদের চোখে অপরাজিতা ভালোবাসা খুঁজে পায়নি। তবু অপেক্ষা করেছে। প্রিয় কারো ওর জীবনে আগমনের অপেক্ষা করেছে। কিন্তু গতকাল সব অপেক্ষা ফুরিয়েছে। অচেনা-অজানা একজনের সাথে ওর বিয়ে হয়ে গেছে। অ্যারেঞ্জ ম্যারেজে ওর আপত্তি কোনোকালেই ছিলো না। কিন্তু তাই বলে হুট করে কাউকে বিয়ে করে ফেলতে যে আপত্তি হবে না, তা নয়।

ঘটনার সূত্রপাত গতকাল সকালে। এগারোটা নাগাদ। আর্লি মর্নিং ক্লাসের পরপর ওর একটা টিউশন ছিলো। সেটা শেষে ওর নীলক্ষেত যাবার কথা। কিছু নোট ফটোকপি করতে দিয়ে এসেছিল মামুন মামার কাছে। তার আগেই আম্মু ফোনে বাসায় ফিরতে বললো। গেস্ট আসবে। ওর নাকি থাকতে হবে। অতশত না ভেবে ও টিউশন ক্যানসেল করে বাসায় ফিরলো। গিয়ে দেখে বিশাল আয়োজন হচ্ছে। বড়ফুপি এসেছে, ছেলের বউ আয়না ভাবীকে নিয়ে। ছোটফুপি বিকেলের মাঝে এসে পরবে তার ছানা-পোনাদের নিয়ে। ওর একমাত্র মামা এসেছে মামীকে নিয়ে। মামাতো বোন শীলাপু আসছে হাসব্যান্ড নিয়ে। বড়খালা আসবে কি না শিওর বলেনি। তবে খালাতো বোন, শর্মীপু আসবেই। বড়জোর দুপুর হতে পারে। ছোট চাচ্চু তো আরেক কাঠি এগিয়ে। এসেই কিচেনে ঢুকে খোঁজ নেয়া শুরু। নামী রেস্তোরাঁর দামী শেফ কি না! ছোট চাচী হাসি হাসি মুখে এর-ওর সাথে গল্প করছে। তাদের জমজ ছেলেরা বাসাজুড়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। সবাইকে দেখে চমকে যাবার কথা থাকলেও অপরাজিতা একটুও চমকায়নি। ওদের বাসায় মাসে এক-দুবার এমন হুটহাট গেট টুগেদার কমন চিত্র। ও বরং সবাইকে দেখে হাজারটা কথা বলেছে। শর্মীপুকে ফোন দিয়ে জলদি আসতে বলেছে। সেগুনবাগিচা থেকে আসতে এতখন লাগে নাকি! আম্মু যখন একসময় গোসল করে ফ্রেশ হতে তাড়া দিলো, ও তখন নিতান্তই অনিচ্ছায় শাওয়ারে গেলো। আয়নাভাবী শাড়ি পরেছে দেখে ও নিজে থেকেই একটা নীল জামদানী পরলো শাওয়ার শেষে। তখনও কী জানতো এটাই ওর বিয়ের শাড়ি হবে?

অপরাজিতা শাড়ি পরে বেরিয়ে দেখলো শীলাপু, তার হাজব্যান্ড তামিম ভাইয়াকে নিয়ে এসে পরেছে। ওদের সাতমাসের বাচ্চাকে নিয়ে সবার আহ্লাদী আড্ডায় যোগ দিলো ও। এক ফাঁকে পায়ে পায়ে উঠে মায়ের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো, “দু’টা সিংগাড়া ছাড়া আর কিচ্ছু খাই নাই আম্মু। ইঁদুর রীতিমতো ম্যারাথন দৌড়াচ্ছে আমার পেটে!” আম্মু হেসে জবাব দিলো, “আসল গেস্ট এখনও আসেনি। ওদের রেখেই খেয়ে নিবি?” অপরাজিতা এবারে অবাক হলো। চোখ বড় বড় করে প্রশ্ন করলো, “আসল গেস্ট কারা? আমি ভাবলাম আমাদের এজ অ্যাজুয়াল গেট টুগেদার।” এবারও হাসিমুখে আম্মু জানালো, “তোর বাবার বন্ধুরা আসবে কয়েকজন। তাদের জন্যই আজকের গেট টুগেদার।” থেমে যোগ করলেন, “তোর বাবাকে বল একটা ফোন দিয়ে খোঁজ নিতে ওরা কতদূর এলো।” আম্মুর কথা ঠিকমতো প্রসেস করার আগেই মামা এসে জানালো গেস্টদের গাড়ি নিচে এসে পরেছে। মনের প্রশ্ন মনে আর পেটের খিদে পেটে রেখেই অপরাজিতাও চললো গেস্ট দেখতে।

বিশ-বাইশজন মানুষ একে একে ওদের বাসায় ঢুকে ড্রয়ইংরুমটা পূর্ণ করে ফেললো। অপরাজিতা বিস্মিত হওয়ার সুযোগ পেলো না। তার আগেই পরিচয় পর্ব শুরু হয়ে গেলো। এর সাথে ওর হাই-হ্যালো চললো কতক্ষণ। বাবা অপরাজিতাকে পরিচয় করানোর সময় বললেন, “এই হলো আমার অপরাজিতা মা। ঢাবি তে ইংরেজিতে অনার্স করছে। দ্বিতীয় বর্ষ।” সঙ্গে সঙ্গে অপরাজিতা শুধরে দিয়ে বলেছিল, “দ্বিতীয় না। তৃতীয় বর্ষ, বাবা। সবসময় ভুলে যাও তুমি!” ওর কথায় হাসির রোল পরেছিলো ড্রয়ইংরুম জুড়ে। খানিকটা লজ্জা পেয়ে অপরাজিতা সরে এসেছিলো ওখান থেকে।

***

আড়াইটা নাগাদ টেবিলে সব খাবার সাজিয়ে ফেলা হলো। অপরাজিতা মা, ফুপি, মামীর হাতে হাতে এগিয়ে দিলো। শর্মীপু এলো সেইসময়, ওর তিন বছরের মেয়েকে নিয়ে। অপরাজিতাকে দেখেই চোখ নাচালো। ইশারায় কী কিছু বোঝাতে চাইছিলো শর্মীপু?

খাবার টেবিলে একসঙ্গে সবার জায়গা হলো না। বারোজন টেবিলে আর বারোজন বসলো ড্রয়ইংরুমে। বাবাকে ছাড়া তার বন্ধু কোনোভাবেই বসবে না। অগত্যা বাবা বসলেন। মামাকেও টানলেন সাথে। খাওয়া শুরু হলো। আম্মু, ফুপি, মামী, চাচ্চু অ্যাপায়ন করলেন। কিন্তু এতো গেস্ট, তামিম ভাইয়াও দাঁড়িয়ে রইলেন না। একফাঁকে আম্মু অপরাজিতাকে ডেকে বললেন, “বাচ্চাগুলোর খাবারে একটু মনিটরিং কর, অপরা। তোর মামী আছে ওখানে, তারপরও। ডাইনিং ছেড়ে নড়তে পারছি না আমি। তোকে দেখে কম্ফোর্টেবলি বলতে পারবে কিছু লাগবে কি না।” মায়ের কথা শুনে অপরাজিতা ড্রয়ইংরুমে চলে গেলো। বাচ্চাগুলোর প্লেটে তুলে তুলে দিলো। গল্প করলো। ওদের এটা-সেটা জিজ্ঞেস করলো। ওখানে থাকা বড়দের সাথেও টুকটাক কথা বললো। তাদের মধ্যে কাউকে তো পাত্র বলে মনে হয়নি। কারো মুগ্ধ চোখের চাহনি অনুভব করেনি। অথচ ছেলেটা নাকি ওখানেই ছিলো!

চলবে।

মন পবনের নাও পর্ব-০৫ এবং শেষ পর্ব

0

#মন_পবনের_নাও
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৫ (অন্তিম পর্ব)

আনাবিয়া ফ্লোরে বসে হাঁটুতে মুখ গুঁজে ঘন্টা খানিক কান্না করে উঠে দাঁড়ালো। একটা মূহুর্তের জন্য তার মনে হয়েছিল তানিম হয়তো নির্দোষ নিজের বোঝার মধ্যে হয়েতো কোন ভুল আছে। হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছে রুমটার চারদিকে বার কয়েক চোখ বুলিয়ে নিলো, কতশত স্মৃতি জমে আছে এও ঘরের কোনায়, কোনায় এক নিমেষেই সেসব মরিচিকা হয়ে গেলো। চোখ বোলাতে চেয়ে হঠাৎ চোখ পরলো বেড সাইট টেবিলের উপর গ্লাস চাপা দেয়া একটা কাগজের উপর। দ্রুত সেটি হাতে তুলে নিলো বিশাল একখানা চিঠি, বেডে বসে চিঠিটা খুললো…… আমি প্রেম করিনি কখনো তবে বিয়ের পর তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। আমি চাপা স্বভাবের আর তুমি চঞ্চল হরিণীর মত তোমার চাঞ্চল্যের প্রেমে পরেছি বারংবার।শুনেছি স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের মূল হচ্ছে বিশ্বাস, আর ভরসা এই দুটোর উপর ভর করেই একসাথে পুরোটা জীবন কাটিয়ে দিতে হয় একে অপরের বাহুডোরে।সুখে, দুঁখে ভালো খারাপে একে অপরের পাশে থাকতে হয়, অথচ তুমি আমাকে ভরসা করতে পারলে না তিন বছর একি বিছানায় একি ছাদের তলায় থেকেও আমার চরিত্র সম্ভব বুঝলে না! মানছি আমার কিছু ভুল আছে তবে সেই ভুল শুধুমাত্র তুমিই ঠিক করে দিতে পারতে আমকন উপর বিশ্বাস রেখে। আমি তোমাকে ভালোবেসেছি আর বাসবো তবে আর এই লঞ্চনার সংসারে ফিরবো না। আমার নিজের মা আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তুমি তো চলেই গেছো ছেড়ে, আচ্ছা সম্পর্ক বুঝি খুব ঠুনকো তাইতো সামান্য বাতাসে নড়বড়ে হয়ে গেলো। চোখের৷ দেখার মাঝেও ভুল থাকে, সত্যির আড়ালেও সত্যি থাকে। একটু সময় দিলে কি খুব অন্যায় হতো আনা? যাইহোক তুমি ভালো থেকো। তোমার জীবনের তিন বছর নষ্ট করার জন্য পারলে ক্ষমা করে দিও।
ইতি…….
যার অস্তিত্বের পারদ নষ্ট হয়ে গেছে তার নাম আর কোথাও লেখা না হোক।

আনা চিঠি বন্ধ করে বলে,কেন বারবার আমাকে সংশয়ে ফেলে দিচ্ছো! কিছু একটা তো স্পষ্ট করে বলতে পারো কেন বলছো না। আমিও তো তোমার প্রেমে পরেছিলাম, ভালোবেসে মায়ায় বেঁধে রেখেছিলাম। তাহলে ছেড়ে গেলে কেন? কোন করলে এমন। কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যে আমি কিভাবে বুঝবো! আনা চিঠিটা বালিশের তলায় রেখে উঠে আসলো। সোজা রাইমার রুমে।

‘রাই আনাকে দেখে বলে,আনা অবশেষে আমি আমার প্রফেসারকে পেতে চলেছি ভাবতেই প্রশান্তি ছেয়ে যাচ্ছে।
‘রাই আমার তোর সাথে কথা আছে।
‘বল তোর সব কথা শুনছি।
‘আমার মনে হচ্ছে স্বর্ণা কোন ভাবে তোর ভাইকে ফাঁসিয়েছে এই পুরো ঘটনার পিছনে একটা চক্রান্ত আছে, যেভাবে হোক সেটা আমাদের জানতে হবে।
‘আচ্ছা তাহলে এরজন্য সব সময় স্বর্ণার উপর নজর রাখতে হবে।

দিন কাটছিলো কিন্তু সময় ফুরচ্ছিলো না, সব জেনো কেমন থমকে গিয়েছে। রাইয়ের বিয়ের ডেটও কাছাকাছি চলে আসছে। কিন্তু তানিমের কোন খোঁজ নেই! মোবাইলটাও রেখে গেছে।
রহিমা বেগম বলেন,মা’তুমি আর কতদিন আছো এ বাসায়?রাইমার বিয়ের পর কি চলে যাবে?
‘মা আমার বাসা থেকে আমি কেন যাবো! যে যাওয়ার সে যাবে। এতোদিন অপেক্ষা করছিলাম আপনার ছেলে ফিরে আসবে তার সামনেই সবটা প্রকাশ করবো কিভাবে স্বর্ণা ওকে বোকা বানিয়েছে।
‘স্বর্ণা চোখ বড় বড় করে বলে,বোকা বানিয়েছি মানে? আমার গর্ভের সন্তান কি তবে উড়ে আসলে? সেদিন তোমার তানিম আমার সাথেই রাত কাটিয়েছে।
‘তা অবশ্য কাটিয়েছে, তারপর তোমার আমাকে দেখিয়ে তানিমের আগে পিছে ঘোরা সব কিছুই তো এই ঝামেলা তৈরি করার জন্য। তবে তুমি হয়তো জনো না সত্যি কখনো চাপা থাকে না,সত্য বের হবেই আজ না হয় কাল। সেদিন আমি নিজের হাতে তানিমকে ঘুমের ঔষধ দিয়েছিলাম ওর ঘুম কম তাই। আমি, আম্মু,রাই আন্টির বাসা থেকে ফিরতে পারিনি বৃষ্টির কারণে। আর তুমি সেই রাতটা কাজে লাগালে৷ তানিমের ঘুমের সুযোগ নিয়ে ওর সাথে বাজে, বাজে পিক ক্যাপচার করলে। কিন্তু তানিম তোমাকে স্পর্শও করেনি।

‘আষাঢ়ে গল্প বললেই কেউ বিশ্বাস করবে না৷
‘প্রমাণ আছে তো তোমার গর্ভের সন্তানের ডিএনএ টেস্ট। আর তোমার মোবাইল রেকর্ড।

‘হ্যা এসব আমি করেছি, আমি কি করতাম নাইমের সাথে পালিয়ে গেলাম ও আমাকে বিয়ে না করে শুধু ভোগ করে ছেড়ে দিলো। তাই ভাবলাম তানিম সহজ সরল আছে ওকে কাজে লাগাই এরজন্য এসব করেছি। নিজেন সন্তানের পরিচয়ের জন্য।
‘তোমার পাপের প্রতিফল তুমি ভোগ করবে সেটা আরেকজন কেন ভোগ করবে? এবার এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাও আর কখনো এখানে আসবে না।

🌿আজরার বর সেজে রেডি,সবাই বের হয়েছে বউ আনার উদ্দেশ্যে।

‘রাইমা বউ বেশে বসে আছে এমন আনন্দের দিনে সবার চোখে পানি। এখনো তানিমের কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি। বাহিরে আওয়াজ আসলো বর এসেছে এসেছে। ঘরোয়া ভাবে এই বাড়িতে বিয়ে সেরে কাল ওই বাড়িতে বড় করে অনুষ্ঠান হবে।
কাজি সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করবে ঠিক তার আগে তানিম বলে,আমাকে ছাড়া আমার বোনকে বিয়ে করে কে নিয়ে যায় দেখি!
‘রাই একছুটে তানিমকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। সুন্দর ভাবে বিয়ে সম্পন্ন হলো। রাইকে বিদায় দিয়ে তানিম ঘরে আসলো।

‘আনা জানালা ধরে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে।
তানিম বলে,বৌ আমার সাথে কথা বলবে না?
‘আনা মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো।
‘কই রাগ করবো আমি, উল্টো তুমি রাগ দেখাচ্ছো!
‘আনা সামনের দিকে ঘুরেই তানিমকে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে, আনার চোখের জলে তানিমের বুকের কাছের শার্ট ভিজে যাচ্ছে।
‘আরেহহ পাগলি বৌ কাঁদাছো কেন? আমি তো আছিই।
‘কেন গেলো কিছু না বলে, আমার কত কষ্ট হয়েছে এ ক’দিন।
‘কি করবো বলো, তোমাকে বললে তো বুঝতে না। তুমি আমাকে ভরসাটুকু করতে পারোনি সুযোগ ও দাওনি সোজা বাপের বাড়ি চলে গেছো।
‘আর কখনো যাবো না। আর আপনিও কোন কাজিনকে এতো হেল্প করবেন না। হেল্প করতে হলে আমার মাধ্যমে করাবেন, মনে থাকবে তো?
‘হ্যা খু্ব মনে থাকবে।
‘ভালোবাসি আপনাকে, আপনি আমার #মন_পবনের_নাও
‘তুমি আমার মন পবনের প্রদীপ আর আলোতে আমার জীবন আলোকিত।

🌿 আজরান ধীর পায়ে রাইয়ের পাশে এসে বসলো,আলতে হাতে রাইয়ের ঘোমটা সরিয়ে দিলো তারপর রাইয়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,হৃদয়হরনী তোমাকে আমি চিনেছি তুমিই সেই মেয়ে যাকে আমার মন পবনে জায়গা দিয়েছি। আজরান রাইয়ের কপালে আলতো চুমু দিলো৷
রাই আজরানের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,আমান ডিয়ার ক্রাশ প্রফেসার বান্ধবীর ভার্সিটিতে আপনাকে দু’বার দেখেই প্রেমে পরেছি,আপনার পকেটে নিজের ঝুমকো দিয়ে আমার মন পাঠিয়েছি তাহলে কিভাবে আমার না হয়ে থাকবেন!
আজরান রাইকে জড়িয়ে ধরে বলে,দুষ্ট বৌ আমার। তোমার কাছে একটাই চাওয়া, আমার বাবা,মা আর বোনকে নিজের মনে করবে। কখনো কোন সমস্যা হলে আমাকে বলবে,আমার মায়ের অনেক শখের তুমি তাই তার সাথে কখনো,খারাপ ব্যবহার করবে না।
‘আজ থেকে আপনার প্রিয়রা আমার প্রিয়। কখনো অভিযোগ করার সুযোগ দিবো,না।
‘তোমরার প্রিয়রা আমার প্রিয়। আর তুমি আমার প্রিয়তমা।

“”সবাই চায় শ্বাশুড়ি যেনো মায়ের মত হয়, অথচ কেউ শ্বাশুড়িকে মায়ের চোখে দেখে না,’মা সারাদিন বকাঝকা করলেও আমরা সেটা সহ্য করি কিন্তু শ্বাশুড়ির সামান্য কথা সহ্য হয় না!!

সমাপ্তি।

মন পবনের নাও পর্ব-০৪

0

#মন_পবনের_নাও
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৪

‘ রাই তুই কার জন্য অপেক্ষা করছিস?যে লোকের ম্যনারস নাই তার জন্য! একটা ছেলে যার কমন সেন্স নাই, যে জানেনা মেয়েদের অপেক্ষা করাতে নেই তার জন্য আমরা আধঘন্টা ধরে বসে আছি!
‘ আনা তুই এতো অস্থির কেন বলতো! জানিস তো তোর শ্বাশুড়ি আম্মাকে যদি দেখা না করে যাই তবে প্যারা দিবে।
‘ তুই বলে দিবে ছেলে আসেনি।
‘ এসব কিছু হচ্ছে তোর জন্য, চল বাসায় ফিরে চল কয়েকদিন বিয়ের প্যারা থেকে মুক্ত থাকবো৷
‘ শাঁকচুন্নি আছে নাকি গেছে?
‘ শোন শাঁকচুন্নিরা নিজে থেকে যায় না, তাদের ঝাঁটিয়ে বিদায় করতে হয়।
‘তোর কি মনে হয় তোর ভাইয়ের কোন সম্পর্ক নেই ওই পেত্নীর সাথে?
‘আমার মনে হয় কোন একটা ঘাপলা আছে যেটা আমরা ধরতে পারছি না। আমার সাথে বাসায় চল দু’জন মিলে গোয়েন্দা গিন্নি হয়ে সব বের করবো।
‘তুই শিউর কোন কিছু উদঘাটন করতে পারবো? যদি আরো ভয়ংকর কিছু বেরিয়ে আসে তো!
‘তো তুই চলে আসবি তোকে কে আটকাবে? আমার ভাই তা বলে কি অন্যায় প্রশয় দেবো!
‘ আনা রাইয়ের গালে হালকা কিস করে বলে,’লাভ ইউ।

পেছন থেকে একজন কর্কশ কন্ঠে বলে,আপনারা কি পাবলিক প্লেসের প্রাইভেসি বোঝেন না?
‘আনা বলে, আপনি কি মিন করতে চাইছেন?বলেই সামনে তাকিয়ে বলে,মিস্টার প্লাস্টিক আপনি?
‘ মুখ সামলে কথা বলুন আমি আপনার বেয়াই না যে যেখানে সেখানে উদ্ভট বিহেভিয়ার করবেন।
‘ রাই এক পলক তাকিয়ে বলে,প্লিজ কিছু মনে করবেন না বসুন। ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড তবে আপনারা কি পূর্বপরিচিত?
‘এ আপনার বেস্ট ফ্রেন্ড হলে কথা এগোনের দরকার নেই।
‘এটাই ছেলে হলে বিয়ের তো প্রশ্নই উঠেনা।
‘উপরোক্ত কথাটা বললো আজরান আর দ্বিতীয় কথাটা আনার। রাই মনে,মনে বলে কোন জায়গায় ফেঁসে গেলাম।
‘রাইমা নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে,আসসালামু আলাইকুম আমি রাইমা।
‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম, আমি আজরান।
‘আনা হেসে দিয়ে বলে আজরাইল।
‘রাই আনার হাতে চিমটি কেটে চুপ করতে বলে।
‘আজরান বলে,স্যরি আমার পক্ষে অসুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের সাথে বসা সম্ভব না। আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করার জন্য দুঃখিত।
‘আমি আপনার সাথে পরিচিত হতে ইন্টারেস্টটেট। আর আমার ফ্রেন্ড সুস্থ তবে কাউকে ছাড় দেয় না, হয়ত আপনাদের মাঝে কোন ভুলবোঝাবুঝি হয়েছে। মিটিয়ে নিন প্লিজ।
‘আনা হেসে বলে,আরেহহহ তেমন কিছু না সব বাদ এখন বিয়ের আলাপ।( মনে, মনে বলে রাই একে পছন্দ করে না তো কোন ভাবে? দেখা যাক কি হয় এখন মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে।) আচ্ছা ভাইয়া ওইদিনের জন্য স্যরি।
‘ইট’স ওকে। তো মিস রাইমা আপনি বর্তমানে করছেন কি? স্টাডি নাকি জব?
‘স্টাডি আর পাশাপাশি একটা কোচিং সেন্টারে ক্লাস নেই ।
‘ভেরী গুড। আমি প্রফেসর। তো ভবিষ্যতে আপনার কি হওয়ার ইচ্ছে?
‘প্রফেসারের বৌ। হুট করে মুখ ফসকে কথাটা বের হয়ে গেলো রাইয়ের। জিহ্বে কামড় দিয়ে বলে, স্যরি এখনো ভাবিনি৷
‘আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে আজরান চলে গেলো।
আজরান রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতেই আনা বলে,কিরে রাই কি চলছে বল তো? এটাই তোর ওই ব্রাশ বয় না তো?
‘না মানে হ্যা আসলে।
‘ওহহহ এই খবর। তবে ছেলেটা দেখতে ঠিকঠাক কিন্তু বেয়াদাব।
‘শোন এই স্যার অনেক ভালো আমি জানি ওইদিন লিজার ভার্সিটিতে তার সাথে দ্বিতীয়বার দেখা হয়েছে আমি তার পকেটে চুপিচুপি আমার ইয়ার রিং রেখে আসছি।
‘কি প্রেম!
‘তোরে তো,প্রেম করতে দিলাম না তার আগেই আমার ভাইয়ারের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলাম।
‘বহুত উপকার করেছেন এবার বাসায় চলেন বিয়ের তোড়জোড় শুরু করতে হবে।
‘বিয়ে মানে?
‘দেখিস এই প্লাস্টিক তোকেই বিয়ে করবে চল বাসায়।
‘এটা সত্যি হলে তোরে আমি ট্রিট দেবো জানু।
আনা এবাড়িতে আসলো নিজের বাড়ি নিজের সংসারের প্রতি অন্য রকম টান থাকে। এসেই রহিমা বেগমকে জড়িয়ে ধরে বলে,আম্মু কেমন আছেন।
‘রহিমা বেগম বলে, তুই চলে এসেছিস এবার আমি সবার চেয়ে ভালো থাকবো।
‘স্বার্ণা বলে,তা মুখ উঠিয়ে আবার চলে আসলে যে?
‘আমরার বাড়ি আমি তো আসবোই আমি না আসলে তোমাকে ঝেটিয়ে বিদায় করবে কে?
‘মুখ সামলে কথা বলো আনা।
‘আমার মুখ আর হাত কখনো উচিৎ জায়গা পেলে সামলাতে পারি না। তাই এখান থেকে বিদায় হও।

স্বর্ণা কিছু না বলে সোজা ছাদে চলে গেলো।

রাহিমা বেগম বলে, তোর রুমের চাবি আমার রুমের বালিশের তলায় যা নিয়ে আয়।
‘ আম্মু রুমে তালা দেয়া কেন?
‘কারন তোর স্বামী বলে গেছে তোকে ছাড়া আর কাউকে রুমে ঢুকতে দিতে না।
‘তা তোমার ছেলে কই আম্মু?
‘জানিনা কিছুই তো ঠিকমত বললো না।
আচ্ছা আমি দেখছি। বলেই আনা নিজের রুমে আসলো, মনে মনে বলে আমি ফিরে আসিনি শুধু রাইয়ের জন্য এসেছি। এতোই যদি আমাকে ভালোবাসেন তবে সত্যিটা কেন বলছেন না! আমি সহজ তবে পানির মত। “তৃষ্ণা মেটাতেও জানি আবার ডুবিয়ে মারতেও জানি।

🌿আজরান বাসায় এসে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বলে, ‘জারা আমাকে এক গ্লাস ঠান্ডা ঠান্ডা লেবুর শরবত দে তো।
‘আমি কেন দেবো? বিয়ে করে এনে নিজের বৌকে হুকুম দাও আমার পড়া আছে পারবো না৷
‘আম্মু তোমার মেয়েকে কিছু বলবা? দিনদিন মুখে মুখে তর্ক করা শিখছে।
‘উচিৎ কথা কারোই সহ্য হয় না বাবজান। আমার এখন বয়স হয়েছে তোর খেতমদ করবো নাকি নিজের নাকি তোর বাবা, বোনের। তুই বিয়ে করলে করবি না করলে আমরা করাবো তুই শুধু কবুল বলবি।
‘আচ্ছা তাহলে আজকের মেয়েটাকে দিলাম তোমাদের করে, তবে মনে রেখে বিয়ে করবো আমি তবে সে হবে তোমার বৌ মা আর আমার বোনের ভাবিজান। আমার কিছুই না৷
‘সত্যি বলছিস তুই বিয়ে করবি! নাহার বেগমের কন্ঠে উৎফুল্ল সে জারা কে ডেকে বলে তাড়াতাড়ি রেডি হ আজই আংন্টি পরিয়ে আসবো মেয়েকে।

🌿আনাবিয়া অনেকক্ষণ রুমের মধ্যে পায়চারি করে নিজের ফোন নিয়ে তানিম কে কল করলো৷ কিন্তু ওপাশ থেকে বলছে সুইচড অফ।
আনা ভাবলো না আর কল দেবো না। আমাকে সত্যিটা বের করার কাজে লেগে পরতে হবে।
আনা খুঁজে ও কোথাও কিছু পেলো না।আনা বেডে এসে বসলো, কিছুক্ষণ বসে থেকে বালিশে মাথা রাখলো কোন ফাঁকে ঘুমিয়ে পরেছে নিজেও জানেনা৷
ঘুম থেকে উঠে চোখ মেলে দেখে রাত প্রায় ন’টা ছাড়িয়েছে। আড়মোড়া ভেঙে ওয়াশরুমে ঢুকে পরে আনা। ফ্রেশ হয়ে বেে হবে তখন চোখে পরলো একটা প্রেগন্যান্সি কিটের। আনা ঘামতে লাগল, তার ওয়াশরুমে এটা কে রাখলো? নাকি আনা যা ভাবছে তাই সতি। আনা দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস নিচ্ছে। বন্ধ চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পরছো নোনা জল। এই মূহুর্তে ইচ্ছে করছে হাউমাউ করে চিৎকার করে কান্না করতে৷ চোখের সামনে ভেসে উঠলো অতীতেের কিছু স্মৃতি…….
তানিম আনার কপালে চুমু খেয়ে আনার চেহারার উপরে লেপ্টে থাকা চুলগুলো আলতো হাতে কানের পিছে গুঁজে দিয়ে বলে, কখন বাবা হলে আমার। মেয়ে চাই তোমার মত সুইট কিউট মেয়ে, আর তার না। থাকবে আতিফা আনজুম।
‘আনা তানিমের বুকে মুখ লুকিয়ে বলে, যখন হবে কখন দেখা যাবে।
‘তানিম পরম যত্নে আনাবিয়াকে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,চাইলে কি আতিফাকে আনার ট্রাই করতে পারি।
‘আনা তানিমের বুকে আদুরে কিল মেরে বলে সব সময় মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি। এসব ছাড়া আর কিছু আসে না মাথায়?
‘বুঝলা বৌ তোমারে দেখলেই আমার প্রেম, প্রেম পায়, তুমিই আমাকে বিগড়ে দিয়েছি এবার দ্রুত আমাকে ঠিক করো।

#চলবে

মন পবনের নাও পর্ব-০৩

0

#মন_পবনের_নাও
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৩

‘দেখো তুমি যত যাই বলো কাজ হবে না, কারণ ‘শুকনো কথায় চিড়ে ভিজবে না!! আমাকে সত্যিটা বলতে হবে তবেই আমি ফিরবো। কথা শেষ করে আনাবিয়া নিজের ফোন বের করে তানিমের একটা পিক তুললো, তারপর নিজের বাসায় ঢুকলো।
‘তানিম অসহায় দৃষ্টিতে আনার যাওয়ার পথে চেয়ে রইলো। আনা গেটের ভেতর ঢুকে গেট লক করে দিয়েছে৷ তানিম আকশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলে,কবে আমি এসব থেকে মুক্তি পাবো?
🌿
‘নীলা বেগম ভেবেছিলেন তার মেয়ে জেদি তাই তাকে বুঝিয়ে ওই বাড়িতে পাঠালে হয়ত তানিম মানঅভিমান মিটিয়ে নেবে।কিন্তু এমন কি হলো আনা আবার চলে আসলো? জেদি ঠিক কিন্তু ওতো খুব সফট হৃদয়ের গুরুতর কিছু না হলে নিশ্চয়ই আবার ফিরে আসতো না। নীলা বেগমের ভাবনার মাঝেই আনা নিজের ফোন বের করে তার মামনে রেখে বলে, দেখো আমি কার সাথে এসেছি। তবে মনে রেখো এরপর আমাকে ওই বাড়িতে পাঠাতে চাইলে ‘আমি তোমারদেরকেও ছেড়ে যাবো। কথা শেষ করে হনহন করে নিজের রুমে চলে গেলো আনা।

‘আফজাল সাহেব বলেন, ‘নীলা নিজের সন্তানকে বুঝতে হয়, নিজের সন্তানের কঠিন সময় পাশে দাঁড়াতে হয়, নিজের সন্তানের সুখ, দুঃখ ভাগ করে নিতে হয়,আশাকরি আমি কি বলতে চাইছি বুঝতে পেরেছে?
‘জ্বি বাবা আমার ভুল হয়েছে সবটা না জানতে চেয়ে আনাকে আবার ওইখানে পাঠানো। আমি ওর সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করবো, জানতে চাইবো এমনটা করার কারন কি?

🌿 মা’আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি! কি এমন হয়েছে যে ভাবি বাসা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে!
‘আমাকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করবি না, আমি এখন কে? তোদের যার যেটা ইচ্ছে কর।
‘মা এভাবে কেন বলছো?
‘তাহলে আর কিভাবে বলবো! তোর ভাইকে আগে থেকে সাবধান করেছি ওই মেয়ের ব্যাপারে, এখন কি হলো যেটার ভয় ছিলো সেটাই হলো তো। তোকে সেই এক বছর ধরে বলছি বিয়েটা করে নে তুই আমার কথা শুনেছিস!তোর পড়ালেখা শেষ করে মন্ত্রী হতে হবে, তোর ভাইয়ারের ঘরে বউ থাকতে পরকীয়া করতে হবে তাহলে আমি কে? যে তোরা আমার কথার মূল্য দিবি!
তোদের যেটা করার তোরা সেটাই কর, আমার যে তিকে দু’ চোখ যায় আমি সেদিকে চলে যাবো।

‘কি শুরু করলে মা? সোজা কথার সোজা উত্তর দাও না।
‘নেই আমার কাছে সোজা উত্তর, তুই হয়তো আমার কথা শুনবি নয়তো তোকে রেখে আমি যেদিক দু’চোখ যায় চলে যাবো।
‘মা বলবা তো,হুট করে কি,হলো? কিছু তো বলবা না হলে বুঝবো কি করে?
‘তুই বিয়েটা করেনে আমার ছোট বেলার ফ্রেন্ড শিউলি তোর জন্য একটা পাত্র দেখেছে যদি মায়ের প্রতি একটুও ভালোবাসা থাকে তাহলে আমার কথাটা রাখ।
‘আশ্চর্য তোমার বউ রাগ করে বাড়ি ছেড়ে গেছে তবুও তুমি আমার বিয়ে নিয়ে পরে আছো!
‘আনা তো ঠিক কাজ করছে। ‘আমি আনার জায়গায় থাকলে আমিও এমন করতাম। আমার কথাটা শোন এসব জানাজানি হওয়ার আগেই কিছু একটা কর।
‘স্বর্ণা রাইমাকে বলে, রাই আমি তোর ভাইয়কে ভালোবাসি এক কাজ কর আমাদের বিয়েটা দিয়ে দে।
‘স্বর্ণা নিজের লিমিটের মধ্যে থাক লিমিট ক্রস করিস না। মনে রাখিস ‘ বেশি উড়লে পিপীলিকার পাখা ভেঙে যায়।
‘আমি পাহাড়ের মত, একবার গড়ে উঠলে ধ্বংস করা কঠিন।
‘ভূমিধস হলে পাহাড়ও নিমিষেই গুড়িয়ে যায়, তখন কোথাও তার অস্তিত্ব ও থাকেনা।

রাইমা বারান্দায় এসে আনাকে কল দিলো৷, রিং হচ্ছে কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না। বার কয়েক কল করে বারান্দায়র রেলিং ধরে তাকিয়ে রইলো রাস্তায়।

‘তানিম বাসায় এসে ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিলো। তারপর নিজের মায়ের রুমের সামনে এসে বলে,আসবো আম্মু?
‘নাহহহ আমার রুমে তোর আসতে হবে না।
‘মা আমাকে একটু সময় দাও আমার দিকটা আমি তুলে ধরবোই। একবার আমার কথাটা শুনো।

‘তানিম ‘রাহিমা বেগমের কাছে এসে তার পায়ের কাছে বসলো,নিজের পকেটে থেকে কিছু কাগজ পত্র বের করে,মায়ের হাতে দিয়ে বলে,মা আমি বের হচ্ছি আল্লাহ তায়ালার রাস্তায় যদি ভুল করি তবে ক্ষমা করে দিও। আমার বোন আর স্ত্রীকে দেখে রাখবে আশাকরি।

‘বাহহহহ চুরি করে ধরা পরার ভয়ে পালাচ্ছিস আর তার নাম দিচ্ছিস আল্লাহ তায়ালার রাস্তায় বের হচ্ছিস!
‘মা ‘যেদিন সবটা জানতে পারবে সেদিনের অপেক্ষায় রইলাম আসি এখন।

‘আনাবিয়া ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে নিজের মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে রাইমার অনেকগুলো মিসড কল। দ্রুত রাইমাকে কল ব্যাক করলো।
‘রাইমা রিসিভ করে বলে তুই আমাকে একদিনেই পর করে দিলি!
‘কি বলছিস তোকে পর করে দিয়েছি!
‘তুই কেন চলে গেলি কত শখ করে তোকে নিজের ভাইয়ের বউ করে এনেছিলাম।
‘মনে কর আমারা সেই আগের আনাবিয়া আর রাইমা। বেস্ট ফ্রেন্ড আছি ছিলাম থাকবো। মাঝখানে যা ছিলো দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যা।
‘তুই চলে গেছিস মা আমার জন্য ছেলে সিলেক্ট করে ফেলেছে, এখন দেখা করতে বলছে ওই ছেলের সাথে।
‘তো বিয়ে করবি না? আমি তো সেই তিন বছর আগেই করলাম এবার করে নে আর মানা করিস না।
‘তাহলে তুইও আয় একসাথে দেখা করতে যাবো৷
‘আচ্ছা আসবো,তুই লোকেশন সেন্ট করে রাখিস আর টাইম বলে রাখিস। আর হ্যা আম্মু কেমন আছে?
‘তোকে ছাড়া কেমন থাকবে? জানিস তো আম্মু তোকে কত ভালোবাসে। তুই নেই আম্মু মনে হয় নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে।
‘আম্মুর খেয়াল রাখিস রাই, আম্মুে যত্ন নিবি।
‘পারবো না এসব করার দ্বায়িত্ব ছেলের বৌয়ের তুই এসে কর।
‘আনা কথা না বাড়িয়ে বলে,আচ্ছা দেখা হচ্ছে বিকেলে। বলেই কল কেটে দিলো।

🌿আজরান ভার্সিটিতে এসে মনে মনে খুঁজতেছে ঝুমকাটা কার?এটা তার কাছে কিভাবে আসলো?
তার সাথের একজন কলিগ বলে,আজরান সাহেব মন আজ কোথায় রেখে এসেছেন?

‘মন আর কই হারাতে পারলাম বলুন! আমার মন তো হারাচ্ছেই না।
‘একবার হারালে সারাজীবনেও খুঁজে পাবেন না।
‘তবুও হারাক। বলেই ক্লাস রুমে ঢুকলো। আজ একটু আগেই বের হয়ে এসেছে ভার্সিটিতে থেকে। বাসায় এসে নিজের রুমে ঢুকবে দেখে রুম লক করা। আজরান জোড়ে জোড়ে ডাকতে লাগলো, আম্মু, আম্মু।

‘নাহার বেগম বলেন, তুই বিয়ের জন্য রাজি না হওয়া পর্যন্ত এই দরজা খুলবে না।
‘আমি কখন বললাম বিয়ে করবো না!আমি বলেছি মেয়ে দেখো পছন্দ হলে বিয়ে করবো।
‘নাহহ তোর পছন্দ করতে হবে না, আমরা পছন্দ করবো তুই শুধু কবুল বলবি।
‘কি আশ্চর্য কথা আম্মু! আমার বিয়ে আর মেয়ে পছন্দ করবা তোমরা!
‘হু আমরাই করবো। এবার গেস্ট রুমে যা তোর ড্রেস রাখা আছে চেঞ্জ কর। তারপর বিকেলে আমার দেয়া ঠিকানায় পৌঁছে যাবি।

‘দরজা খুলো আম্মু পরে দেখছি কি করা যায়।
‘দরজা খুলবে না, মেয়ে দেখে এসে ফিডব্যাক দিবি তারপর দরজা খুলবে।
‘মা’ একবার ভাবো আমার বৌ খুব ঝগড়ুটে হলো বা তাবিজ,টাবিজ করে আমাকে তার বশে করে নিল তখন?
‘করুক আমি চাই তোর বৌ তোকে বশ করুক, এসব লজিকলেস কথা আমাকে বলে লাভ নেই। আমার বৌ’মা যাই সে ঝগরুটে হোক বা যেমন হোক।
‘ঠিক আছে যাবো দরজা খুলে দাও।
‘আগে যাবে পরে পাবে।
আজরান গেস্ট রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পরলো। সে যাবেনা মানে যাবেনা।

#চলবে

মন পবনের নাও পর্ব-০২

0

#মন_পবনের_নাও
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -২

আনাবিয়া ফ্রেশ হয়ে নিজের রুমে এসে মোবাইল হাতে নিলো, নাহহ তানিমের কোন মেসেজ আসেনি!
আনাবিয়া মনে মানে ভাবলো, আমাকে এখন আর কি দরকার এখন তো আছেই সাকচুন্নি স্বর্ণা। কতক্ষণ আউলা, ঝাউলা চিন্তা ভাবনা করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,তুমি আমাকে কিভাবে ভুলে যেতো পারো তানিম! তুমি না বলেছিলে, জীবনে প্রেম করোনি আর আমিই তোমার প্রথম ও শেষ ভালোবাসা, তাহলে কেন এসব করলে?
নীলা বেগম উঁচু স্বরে ডাকতে লাগলেন, আনা, আনা…
‘এভাবে ডাকছো কেন?
‘তুমি কার পারমিশন নিয়ে এবাড়িতে এসেছো?
‘আমার বাড়িতে আসতে আবার আমার পারমিশন লাগবে?
‘অবশ্যই লাগবে। স্বামীর আদেশ ছাড়া স্ত্রী বাহিরে বের হলে ফেরেশতারা সেই মহিলাকে লানত দিতে থাকে। আমি কতবার তোমাকে বলেছি,ধর্ম সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান রাখো, আমার কথা কে শুনে!
‘এটা কেমন কথা হলো? আমি কি মূর্খ নাকি! ঠিক ভুল আমি বুঝি।
‘তুমি এই মূহুর্তে ও বাড়িতে ফিরে যাবে আর আসতে হলে তানিমকে বলে তবেই আসবে।
‘মা’আমি এই সংসার আর করবো না।তোমাদের জামাইকে ডিভোর্স দিয়ে দেবো।
‘বিয়ে কি পুতুল খেলা?তিন বছর খেলেছো এখন খেলবে না! সংসারে মানঅভিমান, ঝামেলা হবেই তাই বলে তো সংসার ছেড়ে দেয়া যাবে না। তাহলে তো কোন সংসার টিকতো না।
‘মা ‘আজ যা হয়েছে এরপর আর আমার পক্ষে সম্ভব না ওই লোকটার সাথে একি ছাদের তলায় থাকা।
‘কারন বলো।
‘আনাবিয়া সবটা খুলে বললো।
নীলা বেগম সবটা শুনে বলে, তুমি জানো কারো উপর মিথ্যে অপবাদ দেয়া কত বড় গুন্নাহ! তুমি যা দেখেছো,সত্যটা তার ভিন্ন হতে পারে!
‘আমার চোখ ভুল দেখেনি নিজের চোখে দেখেছি।
‘চোখের দেখাও ভুল হয়। আর তানিম পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পরে অত্যান্ত নম্র,ভদ্র সে কখনো এমন জঘন্য কাজ করতে পারে না।
‘মা ‘নামাজ পরলেই কেউ ফেরেশতা হয়ে যায় না।
‘তুমি কি বোরখা ছাড়া এসেছো এ বাসায়?
‘হ্যা এসেছি তো!
‘তোমার হ্যাসবেন্ড বিয়ের পর থেকে তোমাকে আগলে রেখেছে সবার নজর থেকে আর একদিনেই তুমি তা শেষ করে দিলে?
‘উফফ মা’ আর ভালো,লাগছে না সেই কখন থেকে জ্ঞান দিচ্ছো!
‘আমার একটা বোরখা নাও আর সোজা নিজের বাড়িতে চলে যাও,আগে সত্যিটা জানো তারপর আমরা ফয়সালা নিবো।

‘স্বর্ণা মনের আনন্দে রান্না করছে,এতোদিনে তার মনের বাসনা পূর্ণ হলো।কত আশা ছিলো তানিমের বউ হওয়ার কিন্তু সবাই তাকে রেখে আরেকজন মেয়েকে বউ করে আনলো!

রহিমা বেগম কিচেনে এসে বলে, আমার রান্নাঘরে তোর ছায়াও জেনো না পরে। বের হও এখান থেকে।
‘মামি এতো রেগে যাচ্ছে কেন! বুঝতে তো তোমরাই ভুল করেছেন, নিজের ছেলের পছন্দের মেয়েকে রেখে বাহিরের মেয়েকে বউ করে এনে।
‘তুমি তো চলে গিয়েছিলে আবার কেন এসেছো? আমার শান্তির সংসারে অশান্তি করতে?
‘আপনার ছেলেকে আমার ভিষণ পছন্দ। আনা তো চলেই গেছে আমাকে মেনে নিন।
‘দরকার পরলে এবাসা ছেড়ে বস্তিতে যেয়ে থাকবো তবুও তোমাকে নিজের ছেলের বউ হিসেবে মানবো না।
‘আজ না মানলে কাল মানবেন, কাল না মানলে পরশু,মেনে তো নিতেই হবে।

‘তানিম রুমে ঢুকে নিশ্চুপ বসে রইলো,হঠাৎ তার মায়ের সাথে বাজে বিহেভিয়ারের কথা মনে পরলো মনে, মানে বলে আমি কি করবো মা’আমি যে নিরুপায় সামান্য একটা ভুল আমাকে আজ এতো বাজে পরিস্থিতিতে এনে ফেলেছে। আল্লাহ আপনি আমাকে ক্ষমা করুন আর এর থেকে মুক্তির পথ সহজ করে দিন।
অনেকটা সময় পর মোবাইলটা হাতে নিলো কল করার জন্য। আনাবিয়ার নাম্বার ডায়েল করেছে এমন সময় দরজায় কেউ আঘাত করতে লাগলো৷
‘তানিম দরজার সামনে যেয়ে বলে,স্বর্না সব কিছুর লিমিট থাকে, লিমিট ক্রস করার পর মানুষ আর কোন কিছুকেই ভয় পায় না আর একবারও তুই আমার সামনে আসবি না।
‘আপনার মনে কি সব সময় স্বর্ণা থাকে? মানে ওকে ছাড়া কাউকে কল্পনা করতে পারেন না!
‘তানিম দ্রুত উঠে দরজা খুলে দিয়ে আনাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আমি জানতাম আমাকে ছেড়ে তুমি থাকতে পারবে না ঠিক চলে আসবেই।
‘ছাড়ুন আমাকে একদম ইমোশনাল কথা বলে আমাকে গলানোর চেষ্টা করবেন না। সকালে যা দেখেছি তার বিহিত হবে তারপর আপনার সাথে কথা। এখন চলুন আমাকে বাসায় দিয়ে আসবেন।
‘তানিম বিছনার উপর পা দুলিয়ে বসে বলে, আমাকে তো পা’গ’লা কুকুর কামড়েছে নিজের বউকে আরেক বাসায় রেখে আসবো!
‘অতো কথা তো আমি জানিনা আপনি নিজে আমাকে নিয়ে যাবেন৷
‘বউ ছাড়া থাকতে আমার ভিষণ কষ্ট হবে, আমি আবার বউ পাগল ছেলে।
‘ তা বউ পাগল হতে ক’টা বউ লাগে? একটা বউ থাকলে বুঝি বউ পাগল হওয়া যায় না?
‘আনা একদিন এসব কথার জন্য আফসোস করবে।
‘আমি চাই আফসোস করতে, আমাকে সত্যিটা বলুন। ওই লিপস্টিক আপনার ঠোঁটে কি করে এলো? বলুন আপনি আর স্বর্ণা এতো কাছাকাছি কি করে এলেন? আমাকে ভুল প্রমান করুণ বিশ্বাস করেন এসব ভুল প্রমাণিত হলে আমি সবচেয়ে খুশি হবো।
‘তানিম চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো,না পারছে সত্যিটা বলতে না পারছে আনার এমন আচরণ সহ্য করতে।

🌿
আজরান বাসায় ঢুকতেই জারা বলে, ভাইয়া তুমি কোন সুইমিং পুলে গোসল করে নিজের চেহারা বদলে এসেছো? বলে স্ব শব্দে হেসে দিলো।
‘আজরান জারা কে ধমক দিয়ে নিজের রুমে ঢুকে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকলো, শাওয়ার নিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করার সময় দেখে তার পকেটে একটা ইয়ার রিং। রিংটার দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবছে এটা আবার কোথা থেকে আসলো? আজরান ড্রেস চেঞ্জ করে কিচেনে চেয়ে নিজের জন্য কড়া করে এক কাপ কফু বানালো। কফি নিয়ে সোফায় আয়েশ করে বসে কফিতে চুমুক দিলো৷
‘নাহার বেগম কফি কাপটা হাত থেকে নিয়ে বলে, আর কত নিজের কফি নিজে বানিয়ে খাবি? একটা বউ থাকলে তোর জন্য কফি বানিয়ে এনে দিতো, আমার সাথে হাতে,হাতে সাহায্য করতো, কত ভালো লাগতো ভাবতো?
‘মা আমি কি বলেছি বিয়ে করবো না! মেয়ে দেখো পছন্দ হলেই বিয়ে পাকা। তব হ্যা মেয়ের বয়স অবশ্যই আঠারো বছরের বেশি হতে হবে।বলেি কফি মগটা নিয়ে নিজের রুমে চলে আসলো।

🌿আনা বোঝাতে ব্যার্থ তানিম দু’জনেই বের হবে ঠিক তখন রাইমা এসে বলে, ভাবি তোমরা কোথায় যাচ্ছো?
‘আনা বলে,আজকে দেখে তোমার আমার মাঝে শুধু বন্ধুত্ব কোন ভাবি, ননদের সম্পর্ক নেই মনে থাকবে?
‘হঠাৎ কি হলো তোমার? মাথা ঠিক আছে?
‘নিজের কথা থেকে নড়বে না কিন্তু, বলেছিলেনা তোমার ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক না থাকলেও আমাদের বন্ধুত্ব সময় সময় থাকবে।
‘হ্যা তা তো থাকবেই কিন্তু হলো টা কি?
‘আনা কিছু না বলে বের হয়ে গেলো।

‘তানিম রুমেই বসে আছে, কিন্তু সে যানে আনার কত জেদ সত্যি যদি গাড়ির সাথে ইচ্ছে করে এক্সিডেন্ট করে! দ্রুত একটা টিশার্ট পরে বের হয়ে গেলো।

‘আনা হাঁটে আবার একটু পিছু তাকায়, আবার হাঁটে আবার একটু পিছু তাকায়।
‘তানিম পেছন থেকে বলে,ভালোবাসি বউ প্লিজ এবারের সত ক্ষমা করে আমার সাথে চলো, ভবিষ্যতে কখনো এমন ভুল হবে না৷ এই কানে ধরেছি।

#চলবে

মন পবনের নাও পর্ব-০১

0

#মন_পবনের_নাও
#নুসাইবা_ইভানা
সূচনা পর্ব

“আমার হ্যাসবেন্ড আর তার বোনকে এতোটা কাছাকাছি দেখে,রেগে গেলাম আমি। স্বর্ণা আমাকে দেখেই সরে গেলো। ‘বাপ্পি বললো আনা তুমি ভুল ভাবছ!
‘একদম আমাকে ঠিক ভুল শেখাতে আসবে না। আমি এতোটা অবুঝ না। নিজের চোখে যেটা দেখেছি সেটা অবিশ্বাস করবো!
‘চোখের দেখাও ভুল হয় আনা।
‘তুমি তো কথাই বলো না৷ লজ্জা করলো না তোমার! নিজের ওয়াইফ নেই সেই সুযোগে বোনের কাছাকাছি আসতে! ছিহহহ আমার ত ভেবেই গা গুলিয়ে বমি আসছে।
‘কি বলছো এসব আনা!
আনা বাপ্পির হাত ধরে আয়নার সামনে নিয়ে আসলো৷ আমি তো ভুল বলছি, কিন্তু আয়না নিশ্চই ভুল বলবে না! দেখো আর বলো তোমার ঠোটে এই লিপস্টিক কোথা থেকে আসলো! এবার এটা বলো না আমি নেই তাই আমার লিপস্টিক তুমি ব্যবহার করেছিলে।
‘আমি আর স্বর্ণা যাস্ট কথা বলছিলাম। আমি বসেছিলাম হুট করে দাঁড়িয়ে যাওয়াতে এই দূর্ঘটনা।
‘তা তোমার বউ নেই সেটা জানার পরেও নিজের বেড রুমে তোমার বোনকে আসতে দিলে কেনো?
‘ও আমার কাজিন ছোট থেকে এখানে বড় হয়েছে৷ ও নিজেদের মানুষের মতই৷ রাইমা যেমন আসতে পারে স্বর্ণাও পারে!
‘রাইমা আর স্বর্ণা এক না, রাইমার সাথে তোমার বিয়ও বৈধ না আর এরকম দূর্ঘটনা ও ঘটতো না।
‘আনা তুমি নিজের লিমিট ক্রস করছো!
‘যাস্ট সেট আপ মিস্টার বাপ্পি হাসান। আপনার আওয়াজ নিচে। আপনি যে ঘৃণ্য কাজ করেছেন তারপর এসব কথা মানায় না। ভুলে যাবেননা আমি আপনার সাথে একা একা আসিনি৷ আপনার বাবা মা আমাকে নিয়ে এসেছে৷ তো যা বলার তাদের সামনে বলবেন।
‘তুমি এতোদিনে আমাকে এই চিনলে!
‘পুরো জীবন কাটিয়ে দিলেও মানুষ চেনা যায় না৷ আর আপনার সাথে মাত্র তিন বছরের সম্পর্ক আমার! এতো কথা আমাকে না আপনার বাবা মাকে বলবেন!

‘আনা এই সমান্য বিষয় তুমি বাবা মাকে বলবে!
‘এটা আপনার মত চরিত্রে লোকদের জন্য সামান্য হতে পারে! কিন্তু আমার মত মেয়ের জন্য অসামান্য।
‘আচ্ছা কথা দিচ্ছি আর কখনো এরকম করবো না। আজকে থেকে স্বার্ণার সাথে কথা বলা বন্ধ।
‘আজকেই ওকে এ বাসা থেকে বের করে দেবেন। আমি এ বিষয়ে দ্বিতীয় কোন কথা শুনতে চাইনা।
‘আচ্ছা আমি বাবা মায়ের সাথে এ বিষয়ে কথা বলবো।

‘দেখো আমি তোমাকে যেটা বলছি সেটা না হলে, আমি যা করবো ভাবছি তাই করবো!
‘বাপ্পি চলে গেলো রুম থেকে। রাস্তায় বেড় হয়ে সিগারেট ধরালো। একে একে পুরো প্যাকেট শেষ করলো। কিন্তু কি করবে বুঝতে পারছে না।

✨প্রফেসার আজরান চৌধুরী। নিজের ফ্যামেলি নিয়ে এসেছে মেয়ে দেখতে, এ পর্যন্ত শ’খানেক মেয়ে দেখেছে। তবে কাউকে তার মনে ধরছে না।

আজরান বসে আছে তার পাশেই জারা আর নাহার বেগম। সাথে জসিম আবসার চৌধুরী। তিনজনে ফিসফিস করছে, আজ যদি মেয়ে পছন্দ না হয় তবে আমরা আর মেয়ে দেখতে আসবো না।

এরমধ্যেই ট্রে নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে এক ষোড়শী কন্য আসলো। আজরান মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলো, তুমিই কি পাত্রী?
‘মেয়েটি লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নিলো।
‘কানে শুনতে পাওনি কি জিজ্ঞেস করছি?
‘পাশ থেকে মেয়ের ভাবি বলে, এতো হাইপার হচ্ছেন কেন! এটাই পাত্রী। ওর নাম নীরু।
‘বাকি কথা না শুনেই হনহন করে বেরিয়ে গেলো আজরান। রাগে নিজেই ড্রাইভার রেখে একা বেরিয়ে পরলো। চৈত্রমাসের প্রখর গরমে অতিষ্ঠ জন জীবন। তারচেয়ে বেশি অতিষ্ঠ আজরান । কি হচ্ছে তার সাথে!শেষে কিনা একজন টিনেজার মেয়েকে দেখতে আসলো আজরান! গাড়ি নিজেই ড্রাইভ করছে, আসতে আসতে কোথা থেকে কোথায় চলে এসেছে?হুট করেই গাড়ী হার্ট ব্রেক করলো। আরো বিরক্তি নিয়ে কাঁচ নামিয়ে বললো চোখে দেখতে পাননা নাকি!

‘এই যে মিস্টার” একটা প্লাস্টিকের গাড়ীর ড্রাইভার হয়ে এতো তেজ! দেখছেননা রাস্তায় পানি আপনার প্লাস্টিক ধীরে চালাতে পারলেননা।
‘,আজরান গাড়ি থেকে বের হয়ে বলে,সমস্যা কি!
‘আমার তো কেন সমস্যা নেই সব সমস্যা আপনার মিস্টার প্লাস্টিক।
‘প্রচন্ড লেভেলের বেয়াদব আপনি। মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটা ছেলের সাথে তর্ক করছেন!
‘তো ভয় পাই নাকি, এই রাস্তা আমার।

‘এটা সরকারি রাস্তা তাই এখানে কারো মালিকানা নেই।
‘বললেই হলো নেই! এই যে দেখছেন বাউন্ডারি এটাকে বলে, তানিন কুঞ্জ।তার পাশে যে বিল দেখতে পাচ্ছেন সেখানে আমাদের জমি আছে। আর আমাদের জমির সোজা রাস্তাটুকু আমাদের! সরকার রাস্তা করেছে তাতে কি!
‘এসব ভুলভাল থিওরি আপনাকে কে শিখিয়েছে!
‘মোটেও ভুলভাল থিওরি না।আমার দাদাজান বলেছেন।
‘থাকেন তো এই নোংরা পরিবেশে। কেমন পানি জমে আছে রাস্তায়।
‘থাকি তাতে আপনার কি! আর এই নোংরা পরিবেশে আপনাকে নিশ্চয়ই কেউ নিমন্ত্রণ করে আনেনি। এবার এসেই যখন পরেছেন দেখুন কেমন মজা।

আনাবিয়া হাত দিয়ে পানি ছিটিয়ে আজরানকে ভিজিয়ে দিয়ে চলে গেলো।

‘বাসায় চেয়ে চেঁচামেচি করে ডাকতে লাগলো দাদা।
আফজাল সাহেব বললেন, কি গো প্রেমিকা জামাই রাইখা এই বুইড়া প্রেমিকরে কেন মনে পড়লো?
‘আমি আর ওই বাড়িতে যাবো না।তোমাদের কথায় বিয়ে করেছি এখন যদি জোড় করে ওই বাসায় পাঠাও তাহলে সোজা ঝুলে পরবো সিলিংয়ে।
‘ওরেহহ বাপরেহহহ মেয়ের ত দেখি ভারি অভিমান হয়েছে! আয় ঘরে আয় তোর বাড়ি তোর যতদিন ইচ্ছে থাকবি কেউ তোকে জোড় করবে না।
‘তোমার ছেলে যদি কিছু বলে তাহলে?
‘ছেলের ঘাড়ে ক’টা মাথা? যে আমার প্রেমিকারে কিছু কইবো! কিন্তু এই পানিতে গড়াগড়ি খেয়ে কেন আসছেন বিবিজান?
‘আমার ইচ্ছে এবার সরো আমি ফ্রেশ হবো।

বাপ্পি বাসায় ফিরে দেখে স্বর্না লাল শাড়ী পরে সোফায় বসে আচার খাচ্ছে। বাপ্পি আসেপাশে তাকিয়ে বলে,আনা কই?
‘তোমার আনা তুমিই খুঁজে দেখো। খুচরো পয়সা ত হয়তো এদিক সেদিক পরে আছে।
‘রহিমা বেগম এসে বলে, হইছে তোর মনের খায়েশ পূরণ? আনাবিয়া বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। চরিত্রহীন পুরুষের সাথে কোন মেয়ে থাকবে?
‘মা’ ‘তুমি কিন্তু বেশি কথা বলছো ভুলে যেওনা আমার টাকায় সংসার চলে।
‘আমার কথা কম আর বেশি!একদিন এই মেয়ে কাল নাগিনীর মত তোর সব চুষে খাবে দেখে নিস। ঘরে সুন্দরী বউ থাকতে যে পুরুষ পর নারীর দিকে নজর দেয় এমন পুরুষের দিকে কেউ থুথুও ফেলে না। আর যে মেয়ে জেনে শুনে বিবাহিত পুরুষের মাথা খায় সে তো পতিতালয়ের ব্য’শ্যার চেয়ে নিকৃষ্ট। এটা এখন সংসার না বিষ মনে হচ্ছে। ‘কথাটা জানাজানি হলে পাড়া প্রতিবেশীর কাছে মুখ দেখানোর জো থাকবে না। ছিহহহ ছিহহহহ শেষে কিনা এইদিন ও দেখতো হলো! ‘ এসব দেখার আগে মরন আসলো না কেন?

বাপ্পি স্বর্নার দিকে রক্ত চক্ষু নিক্ষেপ করে তাকালো। কিছু বলবে তার আগেই বাপ্পির ফোনে টুং করে মেসেজ টোন বেজে উঠলো মোবাইল হাতে নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দেখল স্পষ্ট অক্ষরে লেখা…….. তোমাকে বলেছিলাম, যতদিন তোমার স্পর্শ শুধু আমার থাকবে, ততদিন যা হয়ে যাক আমি তোমার থাকবো।তবে কথায় আছে না পুরুষ মানুষ এক নারীতে আসক্ত থাকতে পারে না।ঘরে বিরিয়ানি থাকলেও পরের ঘরের পান্তা ভাতের দিকে নজর দেবেই।
বিচ্ছেদ আমি কখনো চাইনি তবে ভাগের স্বামী আর ভালোবাসাও চাইনি। ডিভোর্স লেটার খুব তাড়াতাড়ি পেয়ে যাবেন। বাপ্পি হাসান।
কয়েক মূহুর্ত টেক্সটের দিকে তাকিয়ে থেকে লম্বা পা ফেলে নিজের রুমে প্রবেশ করে। স্বর্ণাও বাপ্পির পিছু পিছু আসে কিন্তু বাপ্পি স্বর্নাকে রুমে ঢুকতে না দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।

স্বর্ণা বাহির থেকে বলে,’ সত্যিটা সবাইকে জানিয়ে দাও। মনে রাইখো সত্যি বেশিদিন চাপা থাকে না। আজ না হয় কাল জানাজানি হবেই। ‘ তখন দেখা যাবে কেঁচো খুড়তে কেউটে বেড়িয়ে আসবে”!!

চলবে?
ভুলত্রুটি মার্জিত ভাষায় ধরিয়ে দিবেন, ইনশা আল্লাহ শুধরে নেয়ার চেষ্টা করবো।