গোধূলি রাঙা দিগন্ত পর্ব-০৪

0
176

#গোধূলি_রাঙা_দিগন্ত
#পর্বঃ৪
#লেখিকাঃফারিহা_খান_নোরা
‘আমার সাথে রাত কাটানোর আগে মনে ছিলো না, সম্পর্কে আমি তোমার শা’লী? এতো দিন আনন্দ উল্লাস করে মনে হচ্ছে আমি তোমার শা’লী? বিয়ে করতে চাইছো না কেন? যখন‌ই শুনেছ আমার গর্ভে তোমার সন্তান তখনি পাল্টি খাচ্ছো।পাল্টিবাজ কোথাকার লজ্জা থাকা উচিত।’

নাবিলের শার্টের ক’লা’র ধরে এক নাগারে কথা গুলো বলল রূপা। নাবিল রূপার থেকে ক’লা’র ছাড়িয়ে নিয়ে রূপার দুই বাহু ধরে জো’র করে সামনের চেয়ারে বসিয়ে দেয়।কারণ এত চিৎ’কা’রে’র ফলে রেস্টুরেন্টে এর মানুষজন এই দিকেই তাকিয়ে রয়েছে।নাবিল অফিসে ছিলো,অফিস থেকে রূপা জরুরি তলবে তাকে ডেকে নিয়ে এসেছে।নাবিল রূপার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলে রূপা ঢকঢক করে এক নিঃশ্বাসে খেয়ে নেয় । নাবিল হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে হাতে সময় বেশি নেই জাস্ট দুই ঘন্টার ছুটি নিয়ে এসেছে সে।নাবিল শান্ত ভঙ্গিতে রূপাকে বলল,

‘রা’ত শুধু আমি একাই কাটিয়েছি ? আর আনন্দ উল্লাসে কি শুধু আমি একাই মজে ছিলাম ? তোমার বোনের মৃ’ত্যু’র পর যখন আমি ভে’ঙে পড়েছিলাম একা ফ্লাট পেয়ে তুমি সহানুভূতি দেখার নাম করে যখন তখন রাত বিরাতে আসতে তাও বাড়িতে বলে আসতে খালার বাড়ি যাচ্ছো।আমি যদি বলি তুমি আমাকে তোমার দিকে আকৃষ্ট করছো? আমি একজন বিবাহিত পুরুষ যতোই আমি ব‌উকে ভালোবাসি না কেন সবার একটা চাহিদা আছে তুমি যুবতী মেয়ে হয়ে একা একজন পুরুষ মানুষের কাছে কেন আসবে? আর বিয়ের কথায় যদি বলি ইসলামে প্রেগন্যান্ট অবস্থায় বিয়ে যায়েজ নেই। আমি ছয় মাসের জন্য অফিস থেকে বাহিরের দেশে যাবো আশা করি ছয় মাস পরে দেখা হবে।প্রতি মাসে তোমার একাউন্টে পর্যাপ্ত পরিমাণে টাকা পাঠাবো নিজের এবং বেবীর খেয়াল রেখো। ছয় মাস পর আমি এসে যা করার করব।আর যে বাচ্চাটার কথা বলছো? আদেও কী সেই বাচ্চাটা আমার নাকি শাকিলের?

শাকিলের কথা শুনে রূপা চ’ম’কে গেল।তার কপাল বেয়ে ঘাম দর দর করে ঝড়ছে ।নাবিল তা দেখে টিস্যু এগিয়ে দেয়।রূপাকে অনিশ্চিত জীবণে রেখে সে স্বপ্নের পথে উড়াল দেয়।

_____________________________

আরিবা নাস্তা করে একা রুমে বসেছিল এই বাড়িতে চেনা পরিচিত তেমন কেউ নেই।প্রণয় বিয়ের পরের দিনই বাবার কথা না শুনে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। আচ্ছা রূপা হলে কি এমন করতে পারতো ? দরজা খোলা ছিলো প্রেমা এসে আরিবার পাশে বসে অনুনয়ের সুরে বলল,

‘ভাবি একা বসে থেকে নিশ্চ‌ই বোর ফিল করছো।আসলে আমিও তোমাকে টাইম দিতে পারছি না।এমনি বিয়ের এতো ঝামেলা তারমধ্যে পনেরো দিন পর থেকে আমার পরীক্ষা ইয়ার চেঞ্জ সব মিলিয়ে ব্যাস্ত।’

‘না না ঠিক আছে সমস্যা নাই । তুমি কোনো ইয়ারে পড়?’

‘অর্নাস থার্ড ইয়ার।’

আরিবা বুঝতে পারে প্রেমা তার থেকে বড় দেখতে হলেও কলেজে পড়ে। আসলে প্রণয়ের মত প্রেমা লম্বা নয়, সে একটু খাটো তার মায়ের মত।প্রেমা মনে হয় আরিবার মনের কথা বুঝতে পারল।সে নিজ থেকে বলল,

‘তুমি বয়সে আমার থেকে ছোট কিন্তু সম্পর্কে বড় আমার প্রিয় বড় ভাইয়ের ব‌উ।তোমাকে আমি ভাবিই ডাকবো।তুমি কিন্তু আমার নাম ধরে বলবে। আমি মায়ের মতো হয়েছি আমাকে দেখে অনেকে বুঝতে পারে না, আমি অর্নাস থার্ড ইয়ারে উঠেছি।অনেকে মনে করে আমি ইন্টারে পড়ি,যাইহোক তোমার কিন্তু আরেকটা দেবর আছে।সে এখন ট্যুরে গেছে আসলে অবশ্যই দেখবে।’

বলেই প্রেমা তাঁর ঝকঝকে দাঁত নিয়ে হাসতে শুরু করলো।আরিবা মেয়েটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে,প্রণয় এর মতো ফর্সা না হলেও শ্যামলা মুখশ্রীতে অদ্ভুত মায়া কাজ করছে মেয়েটির। ছিমছাম শরীরে লম্বাটে মুখশ্রী সব মিলিয়ে প্রেমাকে দেখতে বেশ লাগছে।এর মধ্যে নাসিমা শেখ ভিতরে এসে ঠেস দিয়ে দন্ত পিষিয়ে বললেন,

‘প্রেমা তোর ভাবিকে বলে দে শুয়ে বসে থেকে এই বাড়িতে ভাত খাওয়া যাবে না,নিজে রেঁধে খেতে হবে।শেখ বাড়ির নিয়ম অনুযায়ী বিয়ের পরেরদিন ছেলের ব‌উ সবার জন্য রান্না করে।ঘরে শুয়ে না থেকে নিচে আসতে বল তাকে।’

বলেই চলে গেলেন।এই কথাটা ভালো করেও উনি বলতে পারতেন এভাবে বালার কি ছিল?এমন ভাব করছে আরিবা জেনো চিলের মত উড়ে এসে জুড়ে বসেছে তার ছেলের ঘাড়ে। প্রেমা দ্বিধাময় হাসি দিয়ে নরম সুরে বলল,

‘নিচে চলো ভাবি।’

আরিবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পা বাড়ায় গন্তব্য এখন শেখ বাড়ির রান্নাঘর।

রান্নাঘরে এসে দেখেন তাঁর শাশুড়ি দাঁড়িয়ে আছে সব কিছু আশেপাশে ছড়ানো।সব রান্না তাকেই নিজ হাতে করতে হবে কোনো সাহায্য ছাড়াই যার জন্য ময়নাকে পর্যন্ত কিচেনে রাখে নি।আরমান শেখ বারণ করলে, তখন নাসিমা শেখ হিসহিসিয়ে বলে দেয়,

‘তুমি পুরুষ মানুষ মেয়ে লোকের মধ্যে কথা বলবা না।’

আরমান শেখ অসহায় চোখে আরিবার দিকে তাকিয়ে উপর উঠে যায়।যেতে যেতে আক্ষেপের সুরে বলে,

‘বারণ করতে নাকি আবার মেয়ে লোক হতে হয় আজব!’

আরিবা বুঝতে পারে,শাশুড়ি সবাইকে তার কথায় উঠায় আবার তার কথায় বসায়।মহিলার বুদ্ধি আছে ভাবা যায়।বেশ জাঁদরেল মহিলা!

আরিবা রান্নার আয়োজন শুরু করে দেয়। কমছে কম দশ জনের রান্না করতে হবে তাঁকে।বাড়িতে তেমন রান্না করে নি তবে একে বারেই যে পারে না তা কিন্তু নায়।সাহস করে কাজে লেগে পড়ে। তিনঘন্টা লাগিয়ে রান্না শেষ করে উপরে উঠে আসে ফ্রেশ হতে। শাওয়ার নিয়ে সবুজ রঙের একটি জামদানি শাড়ি পড়ে বেরিয়ে এসে দেখে প্রণয় এসে পড়েছে।তবে তার দিকে খেয়াল করে নি।আরিবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেজা চুল আঁচড়ে মাথায় কাপড় দিয়ে নিচে নেমে যায়।কারণ সবকিছু টেবিলে রেখে খাবার পরিবেশন করতে হবে।

_______________________________

খাবারের মৌ মৌ গন্ধ ডাইনিং এ ছড়িয়ে পড়েছে। আরমান শেখ নিচে নেমে এসে তার চেয়ার টেনে বসে পড়ে।খাবারের সুগন্ধে তার মন ভরিয়ে যায়।তিনি উৎসাহ নিয়ে বললেন,

‘সাব্বাস! মা তুমি তো ফাটিয়ে দিয়েছ গন্ধ শুঁকেই আমার অর্ধেক পেট ভরে গেছে বাকি অর্ধেক খেলে ভরবে।’

শশুড়ের বলার ভঙ্গিমা দেখে আরিবা ফিক করে হেঁসে দেয়।এই হাসিটাই জেনো নাসিমার সহ্য হলো না।সে ড্রয়িংরুমে বসেছিলো ছো’ট’লো’কের মেয়ে সম্পর্কে স্বামীর প্রশংসা শুনে তিনি এগিয়ে যেয়ে ঠা’স করে বলে দেন,

‘গন্ধ তো ভালো বের হচ্ছে এখন খেলেই বুঝা যাবে কেমন রান্না? পেট ভরবে নাকি সব বেড়িয়ে আসবে। গন্ধ শুঁকে যেমন খাবারে টেস্ট বুঝা যায় না ঠিক তেমনি চেহারা দেখে মানুষ চেনা যায় না।’

শেষের কথাটা কটমট চোখে আরিবাকে উদ্দেশ্য করে বলল নাসিমা বেগম।সেই কথার তালেই আরমান শেখ হাসির ছলেই জবাব দিলেন,

‘ঠিক যেমন,রূপা।’

আরিবার হাসি পাচ্ছে তাকে নিয়ে শশুড় শাশুড়ির এমন করায়। একজন কথার ছলে খোচা দিতে ছাড়ে না।আপরজন তার হয়ে প্রতিবাদ করতে ছাড় দেয় না। নাসিমা শেখ স্বামীর দেওয়া খোঁচা ঠিক বুঝলেন কিছু বলতে যাবে তার আগে লক্ষ করে প্রণয়ের উপস্থিতি।সদ্য শাওয়ার নিয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে সে নামছে।

আস্তে ধীরে টেবিলে সবাই বসে পড়ে।আরিবা চুপচাপ খাবার পরিবেশন করতে লেগে পড়ে। প্রণয় খাবার টেবিলে ম্যানু হিসাবে দেখতে পেল,

সাদা ভাত, ঘন ডাল, আলু ভর্তা,গরুর কষা মাংস, চিংড়ি মাছের মালাইকারি, ইলিশ মাছ ভাজা,টমেটোর চাটনি ও শেষ পাতে ঘন দুধের পায়েশ যা প্রণয়ের ভীষণ পছন্দের। সবাই খাবারে প্রশংসা করে।নাসিমা শেখ এখনো কাউকে বলে নি আজকে খাবার আরিবা রান্না করেছে শধু আরমান শেখ জানেন।।প্রণয় খাবারের প্রশংসা করলে নাসিমা হাসি মুখে চুপ থাকে।পায়েশ মুখে দিয়ে প্রণয় চোখ বন্ধ করে বলে,

‘আহ্ মা! পায়েশ নয় জেনো অমৃত এমন পায়েশই আমি খেতে চাইতাম।কি রান্না করছো তুমি আজকে? সব খাবার ই সুস্বাধু।’

আরমান শেখ নিরব থেকে তাচ্ছিল্য করে বললেন,

‘আজকের খাবার তোর মা রান্না করে নি।’

প্রণয় খেতে খেতে প্রফুল্ল সুরে বলল,

‘ওহ্ সমস্যা নেই। যে রান্না করেছে তার হাতে চুমু দেওয়া উচিত।’

কথাটি শুনেই আরিবার শুকনো কাশি উঠে যায়।সে কাশতে থাকে,আরমান শেখ ও আমেনা মুখ টিপে হাসে।আর নাসিমা রা’গে গুজরে উঠে এতো কাল ধরে সে হাত পু’ড়ি’য়ে রান্না করে এতো বড় করল আর দুই দিনের ব‌উয়ের রান্না একবার খেয়ে হাতে চুমু দিতে চায়? তার হাত পু’ড়’লেও তো কেউ দেখতে আসতো না। না! ছেলে তার বদলে যাচ্ছে। কিছু তো করতেই হবে।

প্রেমা হাসতে হাসতে মজা করে বলল,

‘ভাইয়া চুমু খাবি? ভাবির হাতে খা কারণ আজকের রান্না সব ভাবিই করেছে।’

প্রেমার কথা শুনার সাথে সাথেই প্রণয়ের বিষম উঠে গেল।আরিবা তড়িঘড়ি করে পানির গ্লাস এগিয়ে দেয় প্রণয়ের দিকে। লজ্জায় আরিবা চোখ তুলে তাকাতে পারছে না।

‘ইশ, কি লজ্জা!!!’

।চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে