গোধূলি রাঙা দিগন্ত পর্ব-১১

0
179

#গোধূলি_রাঙা_দিগন্ত
#পর্বঃ১১
#লেখিকাঃফারিহা_খান_নোরা
এই পৃথিবীতে যত রকম দান আছে তার মধ্যে সবথেকে সেরা আর পবিত্র দান হচ্ছে র’ক্ত’দান। কেননা একজনের র’ক্ত’দানের মাধ্যমে একটা জীবন বেঁচে যেতে পারে। পৃথিবীতে মানুষ খুব অল্প সময়ের জন্যই আসে।জীবনে বেঁচে থাকার সময় খুব কমই ভালো কাজ করার সুযোগ আসে।তেমনি র’ক্ত দান একটি ভালো কাজ।যখন র’ক্ত’দান করা যায় তখন সবাই র’ক্ত’দান করুন কেননা র’ক্ত’দান করলে আপনার কোনো ক্ষতি হবে না বরং আপনার দ্বারা র’ক্ত’দানের মাধ্যমে একটা জীবন বাঁচবে।
র’ক্তের কোন ধর্ম নেই একজন খ্রিস্টান র’ক্ত দিতে পারে একজন মুসলিম র’ক্ত দিতে পারে তেমনি একজন হিন্দু র’ক্ত দিতে পারে একে অপরের র’ক্ত কোনো ধর্মের পার্থক্য বোঝায় না।

জারিফ হাতের র’গ কে’টে’ছে প্রচুর ব্লা’ড লস হয়েছে যার জন্য র’ক্তে’র প্রয়োজন। জারিফ ব্লা’ড গ্রুপের সাথে প্রণয়ের ব্লা’ড ম্যাচ করে যার জন্য প্রীতম প্রণয়ের কাছে এসেছিলো।তার প্রাণপ্রিয় বন্ধুর এই অবস্থা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। ঘন্টা খানেক আগেও জারিফের সাথে কথা বলেছে অন্য দিনের মতো স্বাভাবিক ছিলো জারিফ তাহলে হঠাৎ করে কেন এই কাজ করে বসলো?

প্রণয়ের শরীর থেকে র’ক্ত নেওয়া হচ্ছে।প্রণয় প্রথমে জারিফকে না চিনলেও পরবর্তীতে যখন প্রীতম বলল জাহিনের কথা তখন আর এক মুহূর্তও দেরি করেনি।ছেলেটাকে সে অনেক আগে থেকেই চেনে হাস্যচ্ছল একটা ছেলে কোনো ব্যাপারে সিরিয়াস না,সেই ছেলে কি না এমন সিরিয়াস একটা কান্ড করে বসলো ভাবা যায়?

প্রণয় একা আসে নি তার সাথে আরিবাও এসেছে।মেয়েটাকে সে এতো রাতে নিয়ে আসতে চায় নি কিন্তু আরিবা জোর করেই এসেছে।আরিবাকে তার ঠিক লাগছে না। হতে পারে জাহিন তার পরিচিত বলে খা’রা’প লাগছে।প্রণয় হয়তো বিষয়টা নিয়ে বেশি ভাবছে।

_________________________

হসপিটালের করিডরে বসে আছে আরিবা। তাঁর মনটা আজ ক্ষ’ত’বি’ক্ষ’ত হয়ে আছে সে কিছুতেই মনকে বুঝাতে পারছে না,জারিফ এই কাজটি করেছে।দুই দিন আগেও জারিফ অন্য একটি নাম্বার দিয়ে আরিবাকে ফোন করেছে আকুতি মিনতি করছে আরিবা তাকে কাটকাট করে বলে দিয়েছিলো তাঁর ও আরিবার রাস্তা এখন সম্পূর্ণ আলাদা।সে জেনো আরিবার পিছু আর না নেয়।আরিবা এখন বিবাহিত তাঁর সাথে জড়িয়ে আছে বাবার বাড়ির সম্মান। শশুড় বাড়ির সম্মান‌ও তার সাথে জড়িয়ে আছে যা নতুন করে জড়িয়ে পড়ছে। বিবাহিত মেয়ে ঘরে স্বামী রেখে প্রেমিকের সাথে যোগাযোগ সমাজ মেনে নিবে? কখনোই না।যার জন্য আরিবা জারিফকে ভালো করে বুঝিয়ে বলছে কিন্তু জারিফ যে এমন একটা কাজ করে বসবে সে কাস্মিনকালেও ভাবে নি।ভাববেই বা কি করে তাঁরা তো আর কিশোর কিশোরী না,যে হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো। পঁচিশ বছরের একটা যুবকের কাছে আরিবা এমনটা আশা করে নি। কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেতেই আরিবা পিছনে ফিরে দেখে আরশি দাঁড়িয়ে আছে।আরশি আরিবার পাশে বসে পড়ে আরিবা সময় না নিয়ে আরশিকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে দেয়। ক্রোন্দনরত কন্ঠে বলে উঠে,

‘এটা কি হয়ে গেলো আপু? আমি তো এমনটা চাই নি ও এমন কি করে করতে পারলো! ভালোবাসা মানে কি শুধু কাছেই থাকা? নাকি ভালোবাসা মানে একজনের জন্য বাকি সব মানুষদের কষ্ট দেওয়া।আজ আমার আর ওর লাইফ অন্য দিকে মোড় নিয়েছে তার জন্য কি এতো সব কাছের মানুষদের কষ্ট দিয়ে ও সু’ই’সা’ই’ড এ’টে’ম করবে?’

আরশি আরিবাকে কি বলে সান্তনা দিবে বুজতে পারছে না।জারিফ ঠিক কাজ করে নি, ভালোবাসা ঠিক তবে ভালোবাসার জন্য নিজের জীবনকে শেষ করে দেওয়া এটা মেনে নেওয়া যাচ্ছে না কোনো ভাবেই যা জারিফ করেছে।

‘তুই চিন্তা করিস না,সব ঠিক হয়ে যাবে। জারিফ একদম সুস্থ ভাবে আমাদের মাঝে আবার ফিরে আসবে। দরকার হয় আমি ওকে বুঝাবো তুই এতো টেনশন করিস না।’

‘টেনশন যে হচ্ছে আপু।’

আরিবা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।আরশি আরিবার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে। আশেপাশে তাকিয়ে সতর্ক হয়ে বলে,

‘শুনলাম প্রণয় ভাইয়া এসেছে। তুই এভাবে ভেঙে পড়লে যে কেউ সন্দেহ করবে সেখানে প্রণয় ভাইয়া তো অবশ্যই করবে। তোর চোখ মুখের কি অবস্থা হয়েছে দেখছিস? এমন থাকলে তোদের মধ্যে ঝামেলা হবে।প্লীজ এমন করিস না লক্ষ্মী বোন আমার।’

‘আমি আর পারছি না আপু। আমার ভিতরটা জ্ব’ল’ছে তা শুধু আমিই বুঝতে পারছি।’

আরশি কিছু বলতে নিবে তার আগেই প্রণয় এসে পড়ে। আরিবা ঢুক গিলে প্রণয়ের চোখের আড়ালে মুখ মুছে নেয়।প্রণয় আরশির সাথে হেঁসে হেঁসে কুশল বিনিময় করে। কিছুক্ষণ পর আরিবার দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে বলে,

‘এবার যাওয়া যাক।’

আরিবা কেঁপে উঠে আরশির দিকে অসহায় চোখে তাকায়।বাড়িতে গিয়ে সে শান্তি পাবে না যতক্ষণ না সে জারিফের বিপদমুক্ত হবার নিউজ পাচ্ছে। আরশি বোনের মনে অবস্থা বুঝতে পারছে তবুও পরিস্থিতি সামলিয়ে বলল,

‘ভাইয়ার শরীর এখন বেশ দূর্বল তার রেস্ট দরকার আমরা এখানে আছি তোর ভাইয়া আমার শশুর ভিতরে আছে। তুই বরং ভাইয়ার দিকে খেয়াল রাখ।বাসায় গিয়ে রেস্ট কর।’

তারপর একটু চিন্তিত হয়ে প্রণয়কে উদ্দেশ্য করে আবার বলল,

‘আসলে কি হয়ছে জারিফ আমাদের নিজেদের মানুষ যার জন্য সবার একটু চিন্তা হচ্ছে ভাইয়া। আপনি কিছু মনে করেন না।’

প্রণয় মুচকি হেঁসে বলল,

‘সমস্যা নেই এমনটা হ‌ওয়াই স্বাভাবিক।’

আরিবাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘চলো।’

আরশি আরিবাকে যাওয়ার জন্য চোখের ইশারা করে। আরিবা নির্বিকার ভঙ্গিতে প্রণয়ের পিছু পিছু চলে যায়।

________________________

মাঝখানে কেটে গেছে দু্ই দিন জারিফ এখন বিপদমুক্ত শারীরিক ভাবে সুস্থ তবে মানসিক ভাবে অনেকটাই ভেঙে পড়েছে।ডাক্তার জারিফকে সব সময় চোখে চোখে রাখতে বলেছে এ ধরনের পেশেন্ট কোন সময় কি করে বসে তাঁরা নিজেরাই ঠিক ভুল বুঝে না। হসপিটাল থেকে এসে সেই রাতে প্রণয় আরিবাকে কোনো প্রশ্ন করে নি তবে সেই রাতে প্রণয় আরিবার অনেকটা কাছে এসেছিলো। প্রণয়কে কেনো জেনো বেসামাল লাগছিলো আরিবার।আরিবাও প্রণয়কে বাঁধা দেয় নি,এই ভাঙাচোরা মন নিয়ে সে পুরোটাই প্রণয়ের দখলে গেছে।তাঁরা তো স্বামী স্ত্রী আর কতো? এক ছাদের নিচে স্বামী স্ত্রী একসঙ্গে থাকবে আর তাঁদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা হবে না? তা কি করে হয়! নাটক সিনেমা গল্পে এসব মানায় তবে বাস্তবতা ভিন্ন।নারী পুরুষ সবার‌ই জৈবিক চাহিদা আছে আর সেখানে প্রণয় আর সে তো স্বামী স্ত্রী।

চুলায় চা বসিয়েছে। মাথা বেশ ধরছে আরিবার সেজন্য নিচে এসে চা বসিয়ে দেয় গ্যাসে।প্রীতম আরিবাকে চা করতে দেখে হেঁসে বলে,

‘ভাবি আমায় জন্য এক কাপ দেন।’

আরিবা প্রতিত্তোরে আচ্ছা বলে কাজে মনোযোগ দেয়।প্রীতম লিভিং রুমে বসে টিভিতে খেলা দেখছে।আজ বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষ নেই প্রীতম ছাড়া নয়তো সবাই একসাথে বসে খেলা দেখতো। আরিবার প্রীতমের সাথে তেমন সখ্যতা গড়ে উঠে নি। প্রীতম বেশ লাজুক প্রকৃতির ছেলে। আরিবা তার কতো ছোট তবু ভাবি বলে তো ডাকেই আবার আপনি সম্মধন করে।মানতেই হবে শাশুড়ি তার যেমন হোক না কেন! তিনটা ছেলে মেয়ে‌ই তাঁর ভীষণ ভালো। হবেই না কেন? তার শশুড়ের মতো মানুষ‌ই হয় না।আরিবা এক কাপ চা নিয়ে প্রীতমকে দেয়।প্রীতম হাতে বাড়িয়ে চায়ের কাপটি নেয় ।চুমুক দিয়ে বলে,

‘ধন্যবাদ ভাবি এমন অসাধারণ চা খাওয়ানোর জন্য।’

আরিবা একটু হেঁসে চলে যেতে নেয় সেসময় প্রীতমের ফোনে জারিফের কল আসে।আরিবা একটু পাশে যেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।

‘হ্যালো! জারিফ বল কেমন আছিস তুই?’

জারিফ ওপাস থেকে কি বলল তা শুনা গেলো না তবে প্রীতমকে বেশ চিন্তিত দেখা গেলো।এবার প্রীতম বেশ উত্তেজিত কন্ঠে বলল,

‘মাথা খা’রা’প হয়ছে তোর? রাখ তুই আমি রাতে হসপিটালে যাবো। পা’গ’ল কোথাকার আন্টি আঙ্কেলের সাথে আমি কথা বলবো।’

‘কি বলবো মানে? তাঁরা সঠিক ডিসিশন নিয়েছে। ছেলে বড় হয়েছে তাকে তো বিয়ে করাতেই হবে। আমি নিজ দায়িত্বে তোর জন্য মেয়ে দেখবো তোর এসব ই’ত’রা’মি শেষ হবে ব‌উ আগে আসুক।’

প্রীতম ঠাট্টার সুরে বলল,

‘বিয়ে করবি না কেন? এটাই বিয়ে করার সঠিক সময় ভাই।দেখ আমি বিয়ে করতে চায় কিন্তু বাবা মা আমার কথায় শুনছেই না। তাঁদের কাছে আমি নাকি বাচ্চা অথচো দেখ আজ বিয়ে দিলে কালকেই এক বাচ্চার বাপ হবো তা আর আমি বাবা মাকে বুঝাতে পারছি না।আর তুই না চাইতেই ব‌উ পাচ্ছিস শুকরিয়া কর বেটা। এখন রাখছি রাতে দেখা হবে উল্টো পাল্টা সিধান্ত নিবি না।তোর জন্য তিন দিন আমরা সবাই বেশ ভুগেছি।’

জারিফ বিয়ে করবে? সব শুনে আরিবার হাতে থাকা চায়ের কাপটি কাঁপতে থাকে। প্রীতম কথা বলে তাঁর রুমে চলে যায়। লিভিং রুমে আরিবা একা একটু পর প্রেমা নেমে আসে তাঁর পরনে বাহিরের পোষাক। আরিবা নিজেকে সামলিয়ে প্রেমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। প্রশ্ন ছুঁড়ে,

‘কোথায় যাচ্ছো?’

প্রেমা আমতা আমতা করতে করতে বলে,

‘আসলে ভাবি বাহিরে একটা কাজ ছিলো এই যাবো আর আসবো।’

আরিবার কেন জানি আজকাল প্রেমাকে সন্দেহ হয় মনে হয় কিছু লুকাচ্ছে তাঁর থেকে ঠিক এমনটা প্রণয় ও তাঁর সাথে করছে।এরা দুই ভাই বোন মিলে এমনটা করছে কেন সেটাই বুঝতে পারছে না আরিবা।

‘আমার লেট হচ্ছে আমি আসছি।’

বলেই প্রেমা চলে যায়,জেনো হাফ ছেড়ে বাঁচে।

_______________________

‘তুমি এখানে?’

জারিফ হসপিটালের বেডে শুয়ে জানালার ফাঁক গলিয়ে আকাশ দেখছিলো। হঠাৎ করে তাঁর রুমে উপস্থিত চেনা পরিচিত মুখ দেখে প্রশ্ন ছুঁড়ে।

মেয়েটি হেঁসে বলে,

‘কেন আশা করেন নি বুঝি?’

জারিফ ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,

‘আশা ঠিক করছিলাম তবে দুই দিন পরে নয়,আছ থেকে দুইদিন আগেই ।’

জারিফের রহস্যময় কথা শুনে প্রেমা চমকে যায়। জারিফ প্রেমাকে আর‌ও চমক দিতে অবিশ্বাস্য একটা কথা বলে ফেলে,

‘ভালোবাসো আমায়?’

প্রেমা শকে চলে যায়।দুই বছর হলো সে জারিফকে ভালোবাসে তবে গোপনে। কোনো দিন‌ও প্রকাশ করে নি। জারিফ কিভাবে জানলো প্রেমার লুকিয়ে রাখা অনূভুতির কথা।প্রেমা তোতলাতে তোতলাতে বললো,

‘আপনি এসব কি বলছেন?’

জারিফ বক্র হেঁসে বলে,

‘আমি মিথ্যা পছন্দ করি না।’

জারিফ আজ জেনো প্রেমাকে চমকের উপর চমক দিচ্ছে।প্রেমা চমক না দিলে কি করে হয়? সেজন্য শেষ মেষ প্রেমাও জারিফকে একটা অভাবনীয় চমক দিয়েই দিলো।

‘আপনি আরিবাকে ভালোসেন!’

।চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে